ভ্রমণ সমগ্র
ছবিঃ সনোজ চক্রবর্তী
শর্মিষ্টা ভট্টাচার্য্য
চৈতালি পুরকায়স্থ
ভিতরকণিকা –
জলে, জঙ্গলে
প্রদীপ কুমার বসাক
ভিতরকণিকা ন্যাশেনাল পার্ক
শহর কলকাতার কংক্রিট জঙ্গল আর ধুলো ধোঁয়ার বাইরে মন বহু দূর যেতে চায়। প্রকৃতির রাজ্যে যেখানে নেই কোন কোলাহল, কোন কৃত্তিমতা। প্রকৃতির অপার সজীবতা অনুভব করা যায় জল, জঙ্গল, নদী, পাহাড় বা সমুদ্রের স্পন্দনের মাঝে। অল্প কয়েকদিনের জন্য মুক্ত বাতাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রাণের স্ফুর্ততা ও সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য আমাদের আসেপাশেই অল্প দূরত্বে এমন বহু জায়গা রয়েছে সেখানে যাতায়াত ও অবসর যেমন কাটানো যায় তেমন কিছু শিক্ষালাভও হয়। এই উদ্দেশ্যেই মাত্র কয়েকদিনের পরিকল্পনা শেষে আমরা কয়েকজন মিলে হঠাৎই বেরিয়ে পড়লাম পাশের রাজ্য ওড়িশার জল জঙ্গলময় এলাকা ভিতরকণিকার উদ্দেশ্যে।
জঙ্গলের নির্জনতা, দূর্ভেদ্যতা ও নদী প্রবাহের ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমরা ঘন বর্ষাকালে বেড়িয়ে পড়লাম রাত্রি এগারোটা চল্লিশের তিরুপতি এক্সপ্রেসে। আমাদের যথারীতি বার্থ রিজার্ভ করাই ছিল। তাতে চেপে সারারাত আধ জাগা অবস্থায় মাঝে মধ্যে গল্প করতে করতে পরদিন ভোর ছ-টা তিরিশ মিনিটে ট্রেন ভদ্রক স্টেশনে থামল। আমরা সকলে বেশ তাড়াহুড়ো করে এখানে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। কারণ এখানথেকেই ভিতরকণিকার খাঁড়িময় জঙ্গল পরিদর্শনের জন্য যেখানে থাকতে হয় সেই স্থান (চাঁদবালি) খুব কাছাকাছি, দূরত্ব মাত্র ষাট কিমি। ট্রেকার ধরে চাঁদবালি পৌঁছনোর জন্য আমরা স্টেশনের বাইরে বেড়তেই দু-তিনটে ট্রেকার চালক আমাদের কাছে ছুটে এল। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমরা পাঁচশো টাকায় আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হল।
মাঝ রাস্তায় পথ নির্দেশ দেখতে দেখতে আমাদের মনে ট্রেকার চালক অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে আমাদের ‘আরাডি’ নামে একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। ওখান থেকে চাঁদবালি পরে যাওয়া হবে। বুঝলাম গন্ডগোল কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ ড্রাইভার আমাদের কথা কিছু একটা ভুল বুঝেছে। আমাদের গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় তাকে বলেছিলাম চাঁদবালি যাওয়ার পথে যদি কোন দ্রষ্টব্য স্থান থাকে তাহলে তা দেখিয়ে দিত। আর সে করল কি আসল গন্তব্য চাঁদবালির দিকে না গিয়ে অন্য অন্য একদিকে চলে এসেছে। বাধল আমাদের সাথে তার বচসা। জুটল ওখাঙ্কার কিছু স্থানীয় অধিবাসী। তার সবকিছু শুনে ড্রাইভার বেশ বকাবকি করল। অগত্যা তারাই বলে দিল যে আমরা যেখানে এসে গেছি সেখান থেকে পিছনে না ফিরে বরং কিছু কম টাকায় রফা করে দিল ট্রেকারকে ওই আরডিতেই নামিয়ে দেওয়ায় জন্য। আমরা আরাডিতে নেমে সেখানকার প্রাচীন শিবমন্দির দেখলাম। ওড়িশা হিন্দুধর্ম তথা মন্দিরের পীঠস্থান সমৃদ্ধ। তারই একটি অন্যতম মন্দির ঘুরে দেখে আমরা আরাডি নৌকাঘাটে পৌঁছলাম। সকাল নয়টা, সামনে বৈতরণী নদী বয়ে চলছে বঙ্গোপসাগরে দিকে। রাস্তা শেষ। চাঁদবালি পৌঁছতে হলে এখান থেকে যন্ত্রচালিত নৌকাই ভরসা।
নৌকাচালক আড়াইশ টাকায় আমাদের চাঁদবালি পৌঁছে দিতে রাজি হল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আরো কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে নৌকা চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে নৌকা চলতে লাগল। পেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে নদী তীরের একের পর এক গ্রাম, ধানক্ষেত। বেশ কিছু বিভিন্ন ধরনের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে, দেখে ভালই লাগল। প্রায় পৌনে বারোটার সময় আমাদের নৌকা চাঁদবালি পৌঁছল। সামনেই আমাদের থাকার জন্য উৎকল ভবন থেকে বুক kara chilo ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের ‘অরণ্য নিবাস’। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে বৈতরণী নদী।সবাই স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজ করতে বসে মনে হল চাঁদবালির সব বালিই বোধহয় খাবারের সাথে আছে। কোনক্রমে খাওয়া শেষ করে আমরা ম্যানেজারের কাছে সব জানিয়ে রাত্রের রান্না যাতে নিজেরাই করে নেওয়া যায় তার কথা বলা হল। তিনি তাতে কোন আপত্তি করলেন না। বিকেলের দিকে বেড়িয়ে ছোট্ট জনপদ অথা ভিতরকণিকার জঙ্গলে প্রবেশের আবাস্থল চাঁদবালি ঘুরে দেখা হল।‘ভিতরকণিকা’ জাতীয় উদ্যান ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রভ অরণ্য। এর আয়তন ছ’শো বর্গ কিমির থেকেও বেশী। সমগ্র অঞ্চলটি সমুদ্র উপকূলস্থ খাঁড়িময় জলাকীর্ণ।এখানে প্রধানত বৈতরণী নদীর মোহনায় অবস্থিত একাধিক শাখানদী যা একে অপরকে ছেদ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। অজস্র উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকুলের আবাস্থল এই জঙ্গলে সুন্দরী ও গরান গাছের ঘন অবস্থান, জঙ্গলের অকৃত্তিমতা সুন্দরবনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এখানে অজস্র কুমীর, সাপ, বাঁদর, সম্বর ও ছোপ ছোপ হরিণ জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ডাংমালে কুমীর প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। আর এখানেই রাখা আছে একটি সাদা কুমীর যা পৃথিবীতে প্রায় অবলুপ্ত। জোয়ারের জল যখন খাঁড়িগুলোতে প্রবেশ করে তখন গাছের অনেকটা অংশ জলে ডুবে গিয়ে পাতার সঙ্গে জল ঠেকে যায়। আর যখন ভাঁটা হয় তখন জলাভূমির দ্বীপগুলোর মাটির বিভিন্ন রকম স্তর খাঁড়ির উভয় দিকে চোখে পড়ে। এসব ঘুরে দেখার জন্য পরদিন ওড়িশা
ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের মোটর লঞ্চ কলকাতা থেকেই বুক করে রেখেছি আমরা। সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা আর চা খেতে খেতে গান, জোকস, এক একজনের পূর্বের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আলোচনার মাধ্যমে আড্ডা বেশ জমে উঠল। এর সাথে চলতে লাগল রাতের রান্না। সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়া শুরু হল কষা মাংস, রুটি আর স্যালাড। রাত্রি একটা পর্যন্ত গল্প করে সব শুতে যাওয়া হল।
পরদিন সকাল – সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে সারাদিনের খাবারের সরঞ্জাম গুছিয়ে নেওয়া হল। সময় মত নদীর ঘাটে আমাদের জন্য মোটর লঞ্চ এসে হাজির। সারাদিন ধরে জঙ্গলের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য এর মোট ভাড়া ষোলশো টাকা। আমার খাবার ও জল নিয়ে উঠলাম লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়ল নয়টা নাগাদ। প্রায় এক ঘন্টা বাদে আমরা ভিতরকণিকার খাঁড়িময় জঙ্গলের দোড়গোরায় থামলাম। গাইড প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহ করে নিল। একটা ছোট্ট গ্রাম রয়েছে এখানে। ধান চাষও বেশ ভালই। বর্ষাকাল তাই ধান ক্ষেত জলে ভর্তি। নদীর জলও কিনারায় প্রায় উপছে পড়ছে। লঞ্চ আমার চলতে লাগল। শুরু হল গভীর জঙ্গল। জোয়ারের সময় গাছগুলো প্রায় ডুবন্ত। যেন আমাদের কাছে চলে এসেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে একে একে দেখা গেল বকের ঝাঁক ও বিভিন্ন রকমের পাখি। গাইড জানালেন সামনেই বার্ড স্যাংকচুয়ারি, যেখানে লক্ষ লক্ষ পাখি পাখি এসময় বাস করে। নির্দিষ্ট স্থানে লঞ্চ থামল। সুন্দরী ও গরান গাছের ডাল দিয়ে তৈরী সাঁকো দিয়ে আমরা জঙ্গলের ভিতর প্রায় আধ কিমি রাস্তা পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওয়াচ টাওয়ারের গোড়ায়। চারিদিকে অজস্র ছোট ছোট শ্বাসমূল জলাভূমির ওপর মাথা তুলে রয়েছে। প্রচন্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা যেন ঝর্ণার শব্দ কানে আসছে। গাইড জানালো একটা ঝর্ণা নয় এ হল লক্ষাধিক পাখির সম্মিলিত কলতান। তিনতলা সমান ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা জীবনে ভোলার নয়। অজস্র বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্নদেশের পাখিরা জঙ্গলে গাছের ডালে বসে রয়েছে। কিং ফিসার, সি ঈগল, স্যান্ড পাইপার প্রভৃতি পাখিরা আছে বলে গাইড জানালো। এক একটা সাদা, সাদা-কালো, সাদা-খয়েরী সংমিশ্রণে রঙের পালক সমৃদ্ধ পাখি এদিক ওদিক উড়ছে। মনে শিহরণ জেগে উঠল। ফটো তুলব ভাবতেই বর্ষার মেঘ ঘন আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ছাতা বা বর্ষাতি নিয়ে কোন লাভ হল না। সম্পূর্ণ ভিজে গেলাম। ধীরে ধীরে ভেজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে লঞ্চে এসে তোয়ালে আর গামছা দিয়ে একসঙ্গে গা মোছার তাড়াহুড়ো বেধে গেল। সময় বেলা বারোটা তিরিশ। লঞ্চ এবার আমাদের নিয়ে চলল ডাংমালের উদ্দেশ্যে যেখানে কুমীরের দেখা পাওয়া যায় অজস্র। কিন্তু বাঘ এই জঙ্গলে একটাও নেই। মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সাথে তীব্র গতিতে ঝোড়ো হাওয়া। লঞ্চ টলমল করতে শুরু করল। চারিদিক ঘন জঙ্গল আর জলাভূমি। আমরা কয়েকজন ছাড়া বহুদূর পর্যন্ত কোন মানুষই নেই। লঞ্চ ডুবলে বাঁচা তো পরের কথা মরলেও খবর পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বেলা দেড়টা নাগাদ লঞ্চ ডাংমালের কাছাকাছি পৌঁছল। কিন্তু বৃষ্টি আর ঝড়ে লঞ্চের অবস্থা বেহাল। সাথে আমাদেরও। চালক বলল এইভাবেই দুপুরের খাওয়া লঞ্চের মধেই সেরে ফেলতে হবে। বৃষ্টি থামলে ডাংমালে পৌঁছলে সেখানে নেমে ঘোরা যাবে। খাওয়া শেষ হল। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। লঞ্চ এল ডাংমালে। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা নেমে পড়লাম। এখানে ট্যুরিষ্ট কটেজের ব্যবস্থা থাকলেও বর্ষাকালে রাত্রি যাপনের কোন অনুমতি মেলে না। এখানে বিভিন্ন জায়গায় কুমীরের বিভিন্ন প্রজাতি রাখা আছে। দেখা মিলল লুপ্ত প্রজাতির সাদা কুমীরের। বনকর্মীর সহায়তায় আমার কুমীরকে কাঁকড়া খাওয়ালাম আর সাদা কুমীরের খাবার গ্রহণের লম্ফঝম্প দেখা হল। বনবাংলোর পাশে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু হরিণ। অনেক চেষ্টা করেও কোন হরিণের গায়ে হাত দেওয়া গেল না।
বিকেলের দিকে ফেরার সময় গাইড বলল শীতকালে এখানে গাহিরামাঠা নামে এক স্থানে প্রশান্ত মহাসাগরের কচ্ছপ ডিম পাড়ার জন্য আসে। কিন্তু এখন সেখানে কিছুই নেই। তাই জঙ্গলের আরেকটা জায়গায় লঞ্চ আমাদের নিয়ে গিয়ে নামাল। গভীর জঙ্গল। গাইড আমাদের জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরের দিকে সরু রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে রাস্তা প্রায় শেষ। আগাছা রাস্তা ও আশপাশ ঢেকে দিয়েছে। তারই এক একটা গায়ে মুখে লেগে ছড়ে গেল। দেখা গেল বেশ কিছু বাঁদর, পোকামাকড়, সাপ ও বনমুরগী। বহু শ্বাসমূল এদিক ওদিক দেখা গেল।
বিকেল পাঁচটার সময় লঞ্চ চাঁদবালি ফিরিয়ে আনতে শুরু করল। ভাঁটার সময় খাঁড়ির পাশে দেখা মিলল বেশ কিছু কুমীরের। আর দেখা গেল মাটির বিভিন্ন স্তর। রাত্রি আটটা নাগাদ লঞ্চ থামল চাঁদবালিতে। সবাই সারাদিন ঘুরে আর জলে ভিজে ক্লান্ত। তারই মধ্যে রান্না ও খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়া হল।
সকাল হতেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয় দেখে নিজেরা কতকগুলো ছবি তুললাম। খেয়েদেয়ে ট্রেকারে চেপে দুপুর নাগাদ ভদ্রক স্টেশনে পৌঁছলাম। বিকালের ধৌলি এক্সপ্রেসে করে রাত নয়টা পঁচিশে হাওড়া স্টেশন।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। প্রকৃতির হাতছানি মনের কোনে কোথাও যেন লুকিয়ে পড়ল। শুরু হল দৈনন্দিন জীবন। মাঝে মাঝে এই দৈনন্দিন জীবন যাপন আমাদের একঘেয়েমি এনে দেয়। সকল প্রাপ্ত বয়ষ্ক ও শিশুদের মানসিক ক্লান্তি ঘিরে ধরে।শিশু মনের বিকাশ, শিক্ষার পরিপূর্ণতা ও মনের সজীবতা বজায় রাখার জন্য সকলেই এভাবে সময় ও সুযোগ বুঝে বেড়িয়ে পড়তে পারেন প্রকৃতির কোলে।
Comments
পাবলো নারুদার
দেশ চিলে
চৈতালি পুরকায়স্থ
ডালাস, টেক্সাস
বাচ্চারা ইলামার পিঠে
দক্ষিণ আমেরিকার চিলেতে এসে মনকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দিল ভালপারাইযো শহর। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে এই পুরাতন বন্দর সুবিখ্যাত ছিল একসময়। তখন ছিল না পানামা ক্যানাল। তাই কোন জাহাজকে ইউরোপ থেকে আসতে হলে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণপ্রান্ত পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে এসে প্রথম নোঙর ফেলতে হত ভালপারাইযো বন্দরে। তারপর আবার হয়তো যাত্রা শুরু হত উওরের দিকে। তাই এ শহর দেখলাম উন্নত মানের।
আমাদের অবাক করল বাড়ীগুলোর আকার। সমুদ্রের পাশে পাহাড় তাই বাড়ীগুলোর কোনদিকে দোতলা বা তিনতলা দেখতে পাচ্ছি, আবার রাস্তা ঘুরে যখন পেছনদিকে যাব তখন দেখব পাঁচতলা। অর্থাৎ পেছনের দিকে পাহাড়ের নীচু অংশ তাই আসল বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের আর্কিটেকচার খুব কম দেশে দেখা যায়। বাইরে কোন কোন জায়গায় ট্রোলার কার এর ব্যবস্থা রয়েছে, যদি উঁচু থেকে নীচুতে যেতে হয় তাই। ঠিক যেন একটা ছোট ট্রামগাড়ী।
তবে সবচেয়ে আকৃষ্ট হলাম পোয়েটস পার্কে গিয়ে। একটি ছোট পার্ক, তাতে রয়েছে চিলের বিখ্যাত তিন কবির মূর্তি। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত সাম্যবাদী কবি পাবলো নেরুদা, যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। পার্কের কাছেই রয়েছে পাবলো নেরুদার বাড়ী। এত দেশে গেলাম কিন্তু কোথাও দেখিনি কবিদের জন্যে পার্ক, যেখানে রয়েছে তাদের মূর্তি এবং সংক্ষিপ্ত জীবনকথা।
ভালপারাইযোর পথে আমরা অনেক যাত্রী একসঙ্গে রওনা হয়েছিলাম চিলের রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে। যাত্রীরা বেশীরভাগ এসেছিল ব্রেজিল এবং মেহিকো অর্থাৎ মেক্সিকো থেকে। তাদের ভাষা ছিল স্প্যানিশ। আর আমরা তিনজন বাঙালী ও একটি অস্ট্রেলিয়ান মহিলা শুধুই ইংরিজি ভাষা বুঝি। আমাদের বাসের ড্রাইভারটি যেমন দক্ষ তেমনি চমৎকার তার ব্যবহার। আমাদের গাইড পর্তুগীজ ছেলে সিবাসটিয়ান। সে অত্যন্ত সহজ ও সুন্দর করে দুটি ভাষাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছিল দ্রষ্টব্য স্থানগুলো। সে প্রথম থেকেই জানিয়েছিল পর্তুগীজ হলে কি হবে সে পর্তুগীজ ভাষা ভাল জানে না, সবচেয়ে ভালো জানে স্প্যানিশ। আমি লক্ষ্য করলাম সে ইংরিজিও কিছু কম ভালো জানে না।
এবার সে আমাদের নিয়ে এল শহরের কেন্দ্রস্থলে, ট্রলি কারের সাহায্য নিয়ে। আর ড্রাইভারটি রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল আমাদের বাসকে। সেখানে দেখলাম পার্লামেন্ট ভবন ও আরো অনেক ঐতিহাসিক বিল্ডিং। ঠিক যেন ইউরোপীইয়ান পুরনো শহর। সেখান থেকে গেলাম সমুদ্রতীরে একটি রেস্টুরেন্টে, মধ্যান্নভোজের জন্যে। চমৎকার দৃশ্য। আমি, সুবীর ও বন্দনা খেলাম একটি ব্রাজিলের দম্পতির সঙ্গে বসে একই টেবিলে। মেয়েটি বেশ সুন্দরী, দেখতে ঠিক ভারতীয় মহিলার মত। সেখান থেকে বাস চলল ঠিক পাশেই ভিনা ডেল মার শহরে। এ শহর অর্থশালী লোকেদের। সুন্দর সুন্দর দুর্গর মত দেখতে বাড়ী রয়েছে সমুদ্রতীরে আর পাহাড়ের চূড়ায়। আর রয়েছে অনেক উচ্চতল যুক্ত বাড়ী, প্রায় কাঁচ দিয়েই তৈরি। তা হল বড়োলোকদের ছুটি কাটাবার ফ্ল্যাট, চারিদিক থেকে অপূর্ব দৃশ্য সমুদ্রের। এই শহরে রয়েছে চিলের সবচেয়ে বড় ক্যসিনো, সমুদ্রের মধ্যে একটি দ্বীপের মত অংশে। এই সুন্দর শহর ছেড়ে এবার আমরা রওনা হলাম সান্তিয়াগোর পথে। আসবার সময় এসেছিলাম আমরা অনেক টানেলের মধ্যে দিয়ে অনেক পাহাড় পেরিয়ে। শুনেছিলাম যে চিলের ৪৯% টাকা আসে মাইনিং ইন্ডাস্ট্রি
থেকে। কিছু আগে সাংকোসে খনিতে যে দুর্ঘটনা হয়েছিল তা চিলের উওরাংশে। নিশ্চয়ই আপনাদের সকলের মনে আছে সে ঘটনা। টেলিভিশনে আমরা সবাই দেখেছিলাম উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অবস্থায় অপেক্ষা করছেন চিলের প্রেসিডেন্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ মানুষটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোথাও যাননি। এমন প্রেসিডেন্টের দেখা সহজে মেলে না, তাই এ ঘটনা আমি এখনও ভুলিনি।
চিলের মধ্য অংশ বিখ্যাত নানা রকমের ফলের জন্যে। তাই তৈরী হয় নানারকম মদ। এই অঞ্চলে হয় অলিভ গাছ, যাপাটা টানেল দিয়ে যাবার পথে আমাদের গাইড তা দেখিয়ে দিতে ভোলে নি। দক্ষিণ চিলেতে আছে শুধু কাঠ তৈরীর শিল্প, অনেক গাছপালা ভর্তি সেই অংশ। মানচিত্র দেখলে বোঝা যায় চিলে উওর দক্ষিণে বিস্তৃত কিন্তু পশ্চিম থেকে পূর্ব অংশ মাত্র ১১০ মাইলের বেশী নয়। পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর এবং সমুদ্র তীরবর্তি পর্বতমালা চিলেকে দিয়েছে অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।
এবার বলি চিলের রাজধানী সান্তিয়াগোর কথা। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য, চারিদিক ঘিরে উঁচু পাহাড় মধ্যে উপত্যকায় শহর। শুনলাম শীতকালে পর্বতমালা যখন তুষারাবৃত হয় তখন যে কি মনোরম হয় চতুর্দিক, তা যারা দেখেছে তারাই বলতে পারে । শুনলাম ঠিক নাকি সুইজারল্যান্ডের মত। আমরা এসেছি এপ্রিল মাসে, চিলের গরমকাল শেষ হয়ে হেমন্ত আসছে, তাই আমাদের তা দেখার সৌভাগ্য হল না। তবে শহর দারুণ পরিচ্ছন্ন, লোকেদের চেহারা ইউরোপীয়ানদের মত। বেশীরভাগ লোক ভালো ইংরিজি জানে।
পরদিন একটা দোতলা বাস নিয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমরা গেলাম শহরের কেন্দ্রে বেলাভিস্তা অঞ্চলে। সেখানে অনেক দোকান পাট। পাহাড়ী ট্রেন নিয়ে আমরা উঠলাম এক পাহাড়ের চূড়ায়। সে পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে মা মেরীর বিশাল মূর্তি, পাথরে তৈরী। আমরা চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ, শুনলাম ভক্তদের গান।
পাহাড়ের নীচে যখন নেমে এলাম তখন দেখলাম ইলামাদের (স্থানীয় জন্তু) সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু স্থানীয় লোক। বাচ্চারা যদি ইলামার পীঠে চড়তে চায় তাদের রাইড দিচ্ছে। চারিদিকে অনেক ছোট ছোট দোকান আমাদের মত বিদেশী আগন্তুকদের জন্যে। সেখান থেকে একটু পায়ে হেঁটে গেলাম এক দর্শনীয় স্থানে, তা হল পাবলো নেরুদার শহরের বাসস্থান। মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে এখন। ১৯৭৩ সালে মৃত্যু হয়েছিল পাবলো নেরুদার।
চিলেতে বিখ্যাত হল দুটি জিনিষ - লাপিস লাজোলি পাথর এবং রুপো। এই বিশেষ পাথরটি পাওয়া যায় শুধু চিলে আর আফগানিস্থানে। জানা মুস্কিল কেন শুধু এই দুই দেশ। নিশ্চই এই দুই দেশের কোন বিশেষত্ব আছে। শুনলাম পাথরের রং যত গাঢ় নীল হবে তত ভাল জাতের।
চলে আসার দিন সকালে আমাদের যাবার সুযোগ হল শিল্পীদের মেলায়। নানারকম ধাতুর তৈরী অনেক জিনিষ রয়েছে সেখানে। নানারকমের গয়নার দোকান, বিশেষত লাপিস লাজোলি এবং রুপোর। মহিলাদের মনোহরণের জায়গা, সন্দেহ নেই।
চিলে খুবই সুন্দর দেশ, তবে মানুষ সবই ইউরোপীয়ান। একটি আমেরিকান ইন্ডিয়ানকেও দেখলাম না এই দুই শহরে। নিরাশ হলাম আমি। এমনটি ঠিক আশা করি নি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে এসে।
Comments
জয়রামবাটির মা,
কামারপুকুরের মাটি,
বিশ্বে বাংলার মানুষ
জাহির রায়হান
সার্কাস ময়দান, বেলডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদ
তখনও বুঝিনি বিয়ে বাড়ি গিয়ে দেবভূমি দর্শন হতে পারে। যদিও নিজের আখাম্বা জীবনদর্শনই সেই সুযোগ দিল ঘটিয়ে। পিনাকী’র বিয়ে। পিনাকী আমার সহকর্মী, আমার ছোটভাই এবং আমাদের চিটফান্ডের নিরলস সদস্য।চিটফান্ডের বাকি শয়তান মেম্বারগুলো সহজে যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনায় পিনাকী’র শ্বশুরঘর অর্থ্যাৎ কল্যানী যাওয়া ঠিক করল। আমি বললাম, তা হবে না, আমি বৌভাতেই যাবো, প্রয়োজনে একা একাই। কারণ পিনাকী’র বাড়ির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাটাই উচিৎ কর্তব্য। আমার দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে জুটে গেল দুই মন্ডল, মিলন ও পরিতোষ, সঙ্গে আরও এক ভাইসাহেব, ফজলে নূর। দুই হিন্দু আর দুই মুসলিম মোট চার বাঙালি বেড়িয়ে পড়লাম বৌভোজের সকাল বেলায় হুগলির গোঘাটের উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে কামারপুকুর ও জয়রামবাটি স্রেফ এপাড়া ওপাড়া।
ভূগোল বরাবরই কেমন গোল গোল ব্যাপার, তাই পিনাকী যখন জানালো খুব নিকটেই সেই পবিত্র মাটির অবস্থান, একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম নিজের অজান্তেই। টবিন রোড ছাত্রাবাস থেকে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন তো ছিল পায়ে হাঁটা দূরত্বে, বাগবাজারের ‘মায়েরবাটী’ আর একটু দূরে, আর দক্ষিণেশ্বর তো আমার বহু ভালোলাগার সাক্ষী। বান্ধবীর সান্নিধ্য আর হিং-এর কচুড়ি। আজ তবে উৎসমুখের নিকটে, যে আকর্ষণ শুরু হয়েছিল সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনে, তা আজ বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর বা বরানগর পেরিয়ে অজান্তেই টেনে এনেছে সেই যুগপুরুষের জন্মভিটেয়। গাড়ি এগোলো, মিলনদা বলল, জাহির কি ভাবছ? উত্তর দিলাম ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’।
বেশ কিছু ব্যাপারে দেখবেন আপনার সঙ্গে আমারও বেশ মিল আছে, যেমন গাড়ির ড্রাইভার। যে যে ড্রাইভারকে আপনি চেনেন তারা সকলেই আমার চেনা ড্রাইভারের মতোই জোরে জোরে গান বাজায় এবং প্রায় সব ড্রাইভারই একই ধরণের চটুল গান বাজায় গাড়িতে। তবে আজকের কেসটা আলাদা বোধ হচ্ছে প্রথম থেকেই। আজ সহ্য লয়ে মিষ্ট গান। দেবভূমির মাহাত্ম্য না পিনাকী’র চিমটি বুঝলাম না। আমাদের পরিতোষ, সারগাছির ছাত্র। রামকৃষ্ণ মিশনের নানা গল্প তার কাছে পাওয়া গেল। শুধু সন্ন্যাসীদের নাম ভবানন্দ, বিদ্যুতানন্দ বা তড়িতানন্দ ঠিক কেন বা কি পদ্ধতিতে হয়, আমার সে কৌতুহলের নিরসন সে করতে পারল না। এম এম কিছু বলতে শুরু করতেই, গাড়ি পার্ক হয়ে গেল, ড্রাইভার জানালো-জয়রামবাটী।
খুব ছোটতেই নরেনের গল্প পড়েছিলাম, ব্রহ্মদত্যির গল্পে বন্ধুদের উপদেশ দিয়েছিল নরেন, ‘নিজে চোখে না দেখে কখনও কোন কথা বিশ্বাস করবি না’। দূরন্ত, ডানপিটে নরেন পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ পরমংহসদেবের সান্নিধ্যে এসে আমূল বদলে গিয়েছিলেন। পথে হুগলি
জেলা ছাড়িয়ে যেই বাঁকুড়ার মাটিতে প্রবেশ করেছিলাম, রাস্তার অদ্ভূত একটা বাঁক আর রাস্তায় নেমে আসা পার্শ্ববর্তী বৃহৎ একটি বৃক্ষের অনিয়ন্ত্রিত ডালপালার কোলাজ, মনটাতে উদাস ভাবের বীজ রোপন করেছিল। শ্রীশ্রী সারদা মায়ের কুটির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করার পর অতি দ্রুত মনের সেই উদাসীভাব শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করল।পরিপাটি, নিকানো, সুস্থির সেই কুটির প্রাঙ্গনে প্রবেশ যেন আমাদের নিজগৃহেই প্রবেশ, যেখানে অপেক্ষায় রয়েছে মা, পায়ের শব্দ পেয়ে দাওয়াতে বেরিয়ে হাসি হাসি মুখে বলবে, খোকা ফিরেছিস। অজান্তে, অসংলগ্ননে মনটাও যেন সেই রকমই একটি মাতৃডাকের আশায় ছুঁ ছুঁ করছে।এত যত্নে, এত নিপুনতায় যে ভিটে রয়েছে, সেখানে মা নেই? হতেই পারে না! মাটি লেপাকুটিরে হাত ছোঁয়ালেই শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে যেন, নিরন্তর ঘুরপাক খেতে খেতে, পুরো চত্বর, পুরো অঙ্গন, যেখানে যেখানে শ্রীশ্রীমার পদচারণা ঘটেছে, হেঁটে এলাম দম দেওয়া পুতুলের মতো অনিয়ন্ত্রিত আবেগে। তখনও প্রার্থনা শুরু হয়নি, প্রস্তুতি চলছে, ভক্ত অথবা সন্তান সমাগম শুরু হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। আমরা বেরিয়ে এলাম শ্রান্ত মন নিয়ে। প্রবেশ পথের দু’ধারে হরেক মালের পসরা। বাবা হওয়ার পর থেকে ‘যা হবে দেখা যাবে’ বোধ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে চলেছে। ফলে সে বৈকালিক হরেকরকম্বায় অংশগ্রহন করতেই হলো মেয়ের কথা ভেবে, বেলতলায় হাঁড়ি কাঠে গলা দেওয়ার পূর্ব প্রজন্মে আমার কাছে যা ছিল নিছকই বদাভ্যাসের নমুনা। আমার দেখাদেখি বাকিরাও মগ্ন হল কেনাকাটায়। এর আগে বীরভূমের কিছু গ্রাম্য মহল্লা দেখার অভিজ্ঞতা আছে আমার। জয়রামবাটীর এই পুণ্যভূমি ও সংলগ্ন আধা গ্রাম আধা মফস্বলে সে অভিজ্ঞতার সাযুজ্য রয়েছে।
কামারপুকুরে আমার যাবতীয় আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হলো ঠাকুর রামকৃষ্ণের নিজহস্তে রোপিত আম গাছটিতে। গাছ ভর্তি আম তখন, অপরাধ নেবেন না পাঠকগণ, বাকিদের নজর এড়িয়ে একটা আম পেড়ে নেওয়ার বদখেয়াল মনের মধ্যে উদয়ও হলো একবার। বহু কষ্টে লোভসংবরণ করে, গাছের নীচে ইতি উতি খুঁজতে থাকলাম যদি সে অমৃত একখান পড়ে থাকে কোনওখানে! কিন্তূ এমন পাপী আমি, সেটারও দেখা মিলল না। তবে দেখলাম যা তাতে ইহজীবনের কিছু পাপ যে আমার ক্ষয় হবে সেটা হলপ করে বলা যায়। দেখলাম নির্দিষ্ট সেই স্থানটি যেখানে ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। নমস্কার করব না গড় হয়ে করব প্রণাম, ভারী দো’টানায় পড়ে গেলাম। বাকিদের দিকে তাকিয়ে দেখি সবারই একই অবস্থা। কিন্তূ সবার চোখ চিকচিক করছে অদ্ভূত এক আভায়। কথিত আছে এক জ্যোতিষ্ক সদৃশ আলো মাতৃগর্ভে প্রবেশের পরই জন্ম হয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের। এখনও কি সেই আলোকছটা রয়েছে ওখানে? পাপী তাপী, হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সে আলো ধরা পড়ে আগত দর্শনার্থীদের চোখেমুখে!
বাঙালি ভাগ্যবান, ঠাকুর জন্মেছিলেন এই বাংলায়।বাঙালি ভাগ্যবান কারণ বাঙালি দর্শন করেছিল দেবতাসদৃশ এক যুগপুরুষকে, যাঁর কোন পুঁথিগত বিদ্যা হয়ত ছিল না সে অর্থে, কিন্তূ যে বিদ্যা দীপ্তির তিনি অধিকারী ছিলেন, তা তথাকথিত শিক্ষিত পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের কাছে আজও অধরা। নিতান্তই ছাপোষা, অতি সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ঠাকুর যে জ্ঞান দান করেছেন বিশ্ববাসীকে তা কাল পেরিয়ে যুগোত্তীর্ণ। যাঁর মতবাদ, যাঁর ভাবধারা বহন করে স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন আমার আপনার দেশ ভারতবর্ষকে। জয়রামবাটি, কামারপুকুর দর্শন করে তাই মনে হলো নিতান্তই তুচ্ছ অহঙ্কারে অহঙ্কারী আমরা। ধর্মবিভেদে, জাতি বিদ্বেষে আমরাও নানা ধর্মের ধ্বজাধারী পতাকা বাহক বোধহয়। আমরাও কোনদিন হয়ে যেতে পারি কোন সাম্প্রদায়িক সংগঠনের অংশ। তাই মনেহয় চিৎকার করে বলি, ঠাকুর আর একবার তুমি ফিরে এসো, আর একটিবার তুমি বলো আমাদের - “যত মত তত পথ, কালী, খ্রিষ্ট, আল্লা সবই এক”।
Comments
হাওয়াইতে
আট দিন
মণিদীপ সেনগুপ্ত
পালো অল্টো, ক্যালিফোর্নিয়া
হনলুলু বিচ, হাওয়াই
পার্ল হারবার মেমোরিয়াল, হাওয়াই
চলুন বেড়িয়ে পড়ি কিছুদিনের জন্য প্রকৃতির রূপ দেখতে, ডালাস থেকে মাত্র আট ঘন্টার যাত্রা। সকাল আটটায় প্লেন ছাড়ে ডি এফ ডবলু এয়ারপোর্ট থেকে বিকেল চারটে নাগাদ হাওয়াই এর রাজধানী হনুলুলু। বছর কয়েক আগে এই পথে আমরা একবার হেঁটেছিলাম। তারই স্মৃতি রোমন্থন করে এই বিবরণ লিখছি পরের বারের জন্য। কি করা যায় না করা যায় তার কিছুটা আন্দাজ আমাদের আগে থেকেই ছিল। কিছু রিজার্ভেশন করা, গাড়ি আর হোটেলের ব্যবস্থা, লুয়া খাওয়ার জায়গা ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক কিছুর খোঁজ পাওয়া যায়।
প্লেন থেকে নেমে একটা কনর্ভাটেবল গাড়ি ভাড়া করে প্রথমেই আমরা যাব লুয়া খেতে। বাঙালির ভোজন রসিকতার সুনামটা রাখতে হবে তো। অবশ্য আসল আকর্ষণ হল ওখানকার হুলা নাচ। ঘাসে ঢাকা সুন্দরীদের কোমর দুলিয়ে মনোরঞ্জন। একদিকে দামামা বাজছে, পিছনে সমুদ্রের গর্জন। খাবারটা তেমন কিছু নয়, শুয়োর মেরে বালিতে পুঁতে রেখে কিছু একটা ওরা রান্না করে। খেতে ভাল না লাগলে কোন অসুবিধা নেই, টেবিলে সাজানো থাকে থরে থরে বুফে। নাচের সাথে সাথে জলন্ত লাঠি নিয়ে নানা ভোজবাজি আর জাগলারির খেলা। অনেক সময় মনে হয় সার্কাস দেখছি। যাইহোক সন্ধ্যেবেলা মানচিত্র দেখে হোটেল খুঁজে ঘুমোনোর পালা, সেই হুলা নাচের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। ঐ নাচ দেখেই হাওয়াই আসা সার্থক মনে হয়। ওরা সব দর্শকদের নাচতেও শিখিয়ে দেয়। নাচের জন্য পার্টনারের দরকার হতে পারে। আপনি নিজের সঙ্গিনী নিয়ে নাচতে পারেন, অনেকে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়েও নাচের প্র্যাকটিস করেন। আবার অনেকে ওখানকার কোন ঘাসের পাতায় মোড়া স্থানীয় শিল্পীকেও পেয়ে যান। আপনি কাকে নিয়ে নাচবেন আর নাচাবেন?
ঘুম থেকে উঠে বাসে করে আমরা যাব পার্ল হার্বর দেখতে। বাসের ব্যবস্থা হোটেল থেকেই করা যায়। প্রথমে সেই বাস নিয়ে যায় পার্ল হার্বর মেমোরিয়াল। বেশ জনপ্রিয় জায়গা, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হয়। ইউ-এস-এস অ্যারিজনা কিভাবে জলের নিচে ডুবে রয়েছে তা ঐ মেমোরিয়াল থেকে দেখা যায়, ফোঁটা ফোঁটা করে তেল বেরিয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ১৬০০ নাবিক সমেত এই যুদ্ধ জাহাজটি জাপানী বোমার ঘায়ে ডুবে গিয়েছিল। ঘন্টা দুয়েক লাগে সেখানে। তারপর ঐ বাস আমাদের নিয়ে যাবে হনলুলু শহর দেখাতে। কন্ডাক্টর ভারী মজার লোক, নানা রকমের চুটকি বলতে বলতে হাওয়াই এর ইতিহাস বুঝিয়ে দেয়। হনলুলু শহরে রয়েছে হাওয়াই এর রাণীর প্রাসাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র রাজসিক স্থাপত্য।বাস খালি বাইরের থেকে দেখিয়ে দেবে। আমরা সময় করে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারি।
হনলুলু শহরটা ওয়াহ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। দুটো হাইওয়ে দু-দিক থেকে দ্বীপটাকে ঘিরে রেখেছে। আমরা সেবার রওনা দিয়েছিলাম পূর্বদিকে মাকাপু পয়েন্ট নামের একটা জায়গা দেখতে। পাহাড়ে নিচে ছোট ছোট বিচ ওপর থেকে দেখা যায়। কাছেই সমুদ্রের মধ্যে থেকে উঠেছে কিছু ছোট ছোট দ্বীপ। নৌকা করে যাওয়া যায় তবে জনবসতি নেই। ছবি তোলার অনবদ্য জায়গা। হাইওয়ে ধরে ঘুরতে ঘুরতে এবার আমরা যাব ‘পালী স্টেট পার্কে’ ওয়াহ দ্বীপের মাঝামাঝা জায়গায়। মেইল মাইল খানেক একটা হাইক আছে পালী লুক আউটে যাবার জন্য। সেখান থেকে পুরো দ্বীপটার ভূগোল চোখের সামনে দেখা যায়।
ওয়াইকিকি বিচ, হাওয়াই
দুপুরের দিকে হাইকিং করার একটা ভাল জায়গা হল ডায়মন্ড হেড। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়কার মার্কিন কামান কোথায় কিভাবে তাক করা থাকতো তা একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখা যায়। প্রায় তিন ঘন্টা লাগে পার্কিং লট থেকে উপরে উঠতে। ভাল জুতো থাকাটা বেশ জরুরী। এই হাইকিং এর পরে বিকেল বেলায় যাব আমরা বিখ্যাত ওয়াইকিকি বীচে হাঁটতে। সন্ধ্যায় হনলুলু ইন্টারন্যাশেনাল মার্কেট। কিছু স্যুভেনিয়ার তো কিনতে হবে।চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল আমাদের এই বেড়ানো এর পরেও শরীর দিলে গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে দেখবো আলো ঝলমলে হনলুলু শহর। ফিরে এসে কোন নাইট ক্লাবেও যেতে পারি – ওখানকার নৈশ জীবন দেখতে। একটা সতর্কতা – হনলুলু শহরের অনেক রাস্তা ওয়ান ওয়ে আর রাস্তাগুলো সমান্তরাল নয়। আমাদের সাথে জি পি এস ছিল না তাই রাস্তা খুঁজতে অনেক জায়গায় বেগ পেতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় দিন – ভোরবেলা ওয়াইকিকি বীচে প্রার্তভ্রমণ। সে এক দর্শনীয় বেলাভূমি। কাতারে কাতারে লোক, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ হাঁটছে, আবার অনেকে জলে নেমে পড়ছে। জলের তাপমাত্রা ৮২ ডিগ্রী – যেন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সুইমিং পুল। গতকাল ঐ জলে না নেমে থাকলে আজ নামতে হবে। আকণ্ঠ জলে দাঁড়িয়ে সূর্্যপ্রমাণ করার আদর্শ জায়গা।
ও জবা কুসুম সংকাশন...। তাড়াতাড়ি করতে হবে। তারপরই স্নান সেরে হোটেল ছেড়ে দিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। গাড়ি জমা দিয়ে প্লেন করে বিগ আইল্যান্ড। নতুন গাড়ি নিয়ে জায়গাটা ঘুড়ে বেড়াবো, ওখানকার স্থানীয় খাবার চেখে দেখবো। বেশী সময় হাতে থাকবে না ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে হেলিকপ্টার ট্যুর আগ্নেয়গিরি দেখবো। মাটির নিয়ে গনগনে লাভা জ্বলছে। সেই লাভা কি ভাবে গড়িয়ে চলছে সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রে পৌঁছে তা কতটা বাষ্প তৈরী করতে পারে। ভাল পাইলট পেলে হাওয়াই-এর দেবদেবীর গল্প শোনাবে। জানিয়ে দেবে যে হাওয়াইতে কোন সাপ নেই, লাভা কি ভাবে পাহাড়ের কোলে একটা মাত্র বাড়ি বাঁচিয়ে রেখেছে ইত্যাদি... ইত্যাদি...। হেলি-ট্যুর সেরে আরেকটা প্লেনে করে হনলুলু, সেখানে থেকে মাউই দ্বীপ। এয়ারপোর্টে আমাদের তৃতীয় গাড়ি। চালিয়ে যাব দ্বীপের অন্য প্রান্তে সান সেট ক্রুইজ নিতে। নীল সমুদ্রের মধ্য সেই ক্রুইজ নিয়ে যায়। অনেক রকম রীফ দেখায়, সঙ্গে নানা ধরনের গান আর খানা পিনার আয়োজন।
নীল সাগরের মধ্যে থেকে থেকে উঠছে সবুজ রঙের হাওয়াই এর বিভিন্ন দ্বীপ, সূর্যাস্থের সাথে সাথে তা কালচে হয়ে আসে। ডেকের পাশে ডলফিন লাফিয়ে বেড়ায়, ডেকের ওপর সান্ধ্য নাচ। ঘন্টা তিনেকের ক্রুজ সেরে আবার হোটেল খোঁজার পালা। বেশী রাত হয়ে গেলে রাস্তা কি রকম থমথমে হয়ে যায়। রাস্তায় বেশী আলো নেই। মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন নাইটক্লাবে গান বাজনার আওয়াজ আর পিছনে সমুদ্রের গর্জন। এই দ্বিতীয় দিনের শেষে আবার মনে হবে হাওয়াইতে আসা কতটা সার্থক। মাউই দ্বীপটা অত্যন্ত সুন্দর। এখানে অন্তত আরো কয়েকটা দিন থাকলে ভাল হত। এদিন সকালে আমার যাব স্নরকেলিং করতে। এর জন্য খুব ভাল সাঁতার জানারও দরকার নেই। স্নরকেলিং এর সমস্ত সামগ্রী বোটের লোকেরাই জোগাড় করে রাখে। বিভিন্ন জায়গায় জলে বোট দাঁড় করিয়ে সবাইকে জলে নামায়। কত রকম রং বেরঙের মাছ, কচ্ছপ, ডলফিন, কোরাল রিফ – সব দেখায়। এখানে কেউ গেলে ভাল ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া উচিত। বোটের ওপর থাকে নানা ধরনের
খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। ঘন্টা পাঁচেকের প্রোগ্রাম এটা। আর একদিন যাব হালিয়াকালা ন্যাশেনাল পার্কের পাহাড় চুড়ায়। ক্রেটারের কাছেই রয়েছে ওখানকার অবজার্ভেটরি। গাড়ি চালিয়ে একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছান যায়। ওখানকার ঘাস পাতা আর নতুন ধরনের মাটি দেখার জন্য। সমুদ্র থেকে ১০,০০০ ফুট, ত্রিশ মাইলের মধ্যে। কোথাও ফুল গাছের বাহার কোথাও রুক্ষ জমি। পথে পড়ে দু-একটা ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। সেখানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কফি খাবো। স্থানীয় দোকানে ফুলের বাহার। কোনটা পছন্দ হলে সেই ফুলের বাহার ওরা আপনাকে ডালাসে পাঠিয়ে দেবে। সাইকেল ভাড়া করারও ব্যবস্থা আছে ওখানে। আপনাকে আর আপনার সাইকেলকে বাসে করে হালিয়াকালা ক্রেটারের মাথায় ছেড়ে দেবে। আপনি সাইকেল চালিয়ে গড়গড়িয়ে নেমে আসবেন ১০,০০০ ফুট।মাউই সম্ভবত হাওয়াই এর সবচেয়ে জনপ্রিয় দ্বীপ। এয়ারপোর্টটা উত্তর প্রান্তে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে যায় হানা হাইওয়ে। রাস্তায় ৭২টা জলপ্রপাত আর শ-দেড়েক হেয়ার পিন বেল্ড। প্রত্যেক জলপ্রপাতেই মনে হয় দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুলি। তাই ২৫ মাইল রাস্তা ঘুড়ে আসতে ছয় থেকে দশ ঘন্টা সময় লাগে।
রাস্তায় মাঝে মাঝেই অসাধারণ বীচ। কেউ সার্ফিং করছে, কেউ সূর্যস্নান। অনেকে ছোট ছোট নৌকায় পাল তুলে দিয়ে সমুদ্রে সাইলিং করছে। অনেকেই শিক্ষানবীশ, পাল উলটে পড়ে যায়,আবার তা সোজা করে নেয়। এয়ারপোর্ট থেকেও পশ্চিমের দিকেও আমরা একবার রওনা দিয়েছিলাম। তবে সে রাস্তাটা খুব একটা ভাল নয়। তাছাড়া সন্ধ্যা নেমে আসছিল। তবে সে রাস্তাটাও খুব একটা ভাল নয়। কিছু দূর গিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম। দক্ষিণ প্রান্তে সুন্দর সুন্দর বেলাভূমি, পার্ক আর ঝর্ণায় ভরা। কোথায় দাঁড়াবে আর কোনটা গাড়ি চালিয়ে ঘুরে নেবো বোঝা মুশকিল। সময় হাতে থাকলে আমরা দিন দুয়েক আরো এখানেই থাকতাম।আরেকদিন কয়েক ঘন্টা সময় করে আমরা যাবো ইয়াও নিডলস দেখতে। দু-পাশে ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক চূড়া। হাজার দুয়েক ফুট হবে তাও ঘন গাছপালায় ঢাকা। ভারতবর্ষ হলে লোক শিবলিঙ্গ মনে করে পূজা শুরু করত। ওখানেও পূজা হত তবে আজকাল বোধহয় হয় না। নিডলসের চারিদিকে হাইকিং করার ট্রেল হয়েছে একটা ছোট নদীর ধার ধরে। দু-ঘন্টার ট্রেল সেটাও আমি হাইক করে নিতে পারি।
অবসর বলে মাউইতে কিছুই নেই, যে কদিনের জন্যই যাই প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় কিছু না কিছু করার রয়েছে। ওখানে আমরা প্যারাগ্লাইডিং, সার্ফিং, ক্রুজ… আগে থেকে একটু জেনে গেলে ভাল হয়। আর একটা কথা, মাউই থেকে সরাসরি হেলকপ্টার ট্যুরের ব্যবস্থা আছে বিগ আইল্যান্ডের আগ্নেয়গিরি দেখতে যাওয়ার। কেবল লাভা দেখতে হলে আলাদা প্লেনের টিকিট কেটে ওখানে গেলে সময় আর পয়সা দুইই নষ্ট হয়। ক’দিন কাটালাম আমরা মাউই-তে? তিনদিন পর প্লেনে করে হনলুলু, সেখান থেকে আর একটা প্লেনে করে কাউই দ্বীপ। এই দ্বীপটা প্রাকৃতিক দিক থেকে সবচেয়ে সুন্দর। লোকজন খুব বেশী নেই, পাহাড়ি ঝর্ণা চতূর্দিকে। আমাদের হোটেল ঠিক করে দক্ষিণ প্রান্তের হাইওয়ে ধরে যাবো দ্বীপের শেষ কোনায়। ওখানে এক নতুন ধরনের গ্রান্ড ক্যানিয়ন দেখবো – অ্যারিজোনার মতই গভীর কিন্তু সবুজ। ছোট্ট দ্বীপ কিন্তু প্রচুর বৃষ্টি পড়ে। দ্বীপের সমস্ত নদী নালা সারা বছর জলে টইটুম্বুর হয়ে থাকে। ক্যানিয়নের পরে আমরা একটা পার্কে দাঁড়াতে পারি – সমুদ্রে ওপর জলের ফোয়ারা। পাথরের ফাটলে সমুদ্রের ঢেউ ঢুকে এই ফোয়ারা তৈরী করে। সেই পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা গিয়েছিলাম গোলাপের বাহার দেখতে। ওখানকার অনেক বাড়ির বেড়া তৈরী করা হয়েছে গাছের ফুল দিয়ে। অসাধারণ ফুল। কানের ওপর গুঁজে আমার স্ত্রীকেও এক অনন্যা সুন্দরী মনে হচ্ছিল। এই সব দেখতে দেখতে আমার ষষ্ঠ দিনটাও চলে গেল।
সপ্তম দিন সকালে হোটেল থেকে বেড়িয়ে গাড়ি চালিয়ে উত্তর দিকে। কিলাই –এর সোনা বেলা।শেষ মাথায় একটা লাইট হাউস আছে। ওয়াইকিয়া ফলস মাঝারি সাইজের জলপ্রপাত। ওখান থেকে আর নীচের থেকে দেখার জন্য ভিস্তা পয়েন্ট রয়েছে। জলের কাছে আমরা সেবার যেতে পারিনি, এবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। হোটেলের দিকে ফেরার পথে আরেকটা বড় আকর্ষণ একটা বোট রাইড। ওখানকার ছোট্ট নদীতে। আমাদের নিয়ে যাবে একটা গুহা দেখতে। ওখানে অনেক স্বনামধন্য লোকজন নাকি বিয়ে করতে যায়। এই বোট রাইডের আরেকটা আকর্ষণ হল হুলা নাচের প্রদর্শন। ওরা যে কত রকমের মুদ্রা ব্যবহার করে, আর তার মানি কি তা প্রাঞ্জল করে শিখিয়ে দেয়।
হাওয়াই-এর অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কার, গান বাজনার একটা সুন্দর বিবরণও পাওয়া যায়। দুপুরবেলায় খাওয়া সেরে – আমাদের এক সফরের দ্বিতীয় হেলিকপ্টার রাইড – সারা দ্বীপটা ঘুরিয়ে দেখাবে। আগের দিনের ক্যানিয়নটা আবার দেখবো আকাশ থেকে। ঘুরতে ঘুরতে যাব দ্বীপের উত্তরপূর্ব কোনায়। এমন সব বেলাভূমি আছে যে সেখানে আজও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাহাড়ের কোলে, আর ওপর থেকে নামছে ঝর্ণা। পাইলট হেডফোনে বিবৃতি দিতে দিতে চলেছে। সারি সারি পাহাড়ের মাঝে আমাদের হেলিকপ্টার উড়ছে, যে দিকে তাকাই ঝর্ণা। একটা নয়, দুটো নয় ডজনে ডজনে। জুরাসিক পার্কের শুটিং হয়েছিল এখানে। যেমনি ঘন সবুজ বন।, তেমনি পাহাড়, নদী আর ঝর্ণা। পৃথিবীর এই চেহারাটা একবার দেখলে আর ভোলা যায় না। অদ্যই শেষ রজনী মনে মরে আমরা ঘুমোতে গিয়েছিলাম।
আবার হয়ত বা কোনদিন এখানে বেড়াতে আসবে। সাত দিন ধরে চারখানা দ্বীপ ঘুরে আমরা তখন ক্লান্ত । ঘুম ভাঙল মোরগের ডাকে। ক’বছর আগে নাকি ঝড়ে এখানে অনেক খামার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে যত মোরগ আর মুরগী নিজেদের থেকেই ঘুরে বেড়ায়। আর হ্যালোজেন লাইট থেকে সূর্্য মনের করে চেঁচায়। যাই হোক ভোর রাতে উঠে আমরা একটা স্থানীয় পার্কে গেলাম। সে এক অনবদ্য সূর্যদয়। অনেক ছবিই তুলে রেখেছি কিন্তু চোখে না দেখলে সেই সৌন্দর্্য্য অনুভব করা যায় না। সেদিন আমাদের ভ্যাকশন শেষ হবার মুখে। এয়ারপোর্টে গাড়ি ফেরত দিয়ে প্লেনে চেপে হনলুলু। কয়েক ঘন্টা হাতে সময়
ছিল হাতে, ওখানকার লাউঞ্জে ঘুরে ঘুরে আরো কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। প্লেনের সময় হয়ে গেল, আট ঘন্টা পরে ডালাস।
তাহলে পরের বার কি রকম প্ল্যানিং হবে? আমাদের এই আট দিনের সফরটা বেশ একটা ঝটিকা সফর হয়ে গিয়েছিল। এই দ্বীপগুলোর কোনটিতে তিন বা চার দিন না থাকলে ঠিক সুবিচার হয় না। হোটেল, প্লেন, আর গাড়ি ভাড়া ডালাস থেকেই করবো। আর বাকি সব কিছুই ওখানে পৌঁছে। খরচা পাতি কি রকম। হোটেল, গাড়িভাড়া, পেট্রল আর খাওয়াদাওয়ার খরচ এখানকার মতোই, হয়তো বা সামান্যই বেশী। প্রধান খরচা হচ্ছে প্লেনের টিকিট। দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে যেতে হলে হাওয়াইতে প্লেন ছাড়া গতি নেই। তাছাড়া রয়েছে ওখানে যা যা করবেন তার খরচা। হেলি-ট্যুরগুলো শ-দুয়েক ডলার। আর লুয়া ভোজন, স্নরকেলিং বা ক্রুজ নিলে এক একটা প্রায় পঞ্চাশ ডলার। আমার মতে দশ বারো দিনের জন্য গেলে পয়সা উশুল হয়ে আসে। যাওয়ার সব থেকে ভাল সময় হল শীতকাল। সমস্ত বুকিং আগে থেকে করা ঠিক নয়, ওখানকার স্থানীয় কাগজে অনেক কুপন পাওয়া যায়।
হাওয়াই থেকে ফিরে আসার আগে একটা মুদ্রা আপনাদের শিখিয়ে দিই। ডান হাতটা মুঠো করুন। এবার বুড়ো আঙুল দুটো যত সম্ভব ফাঁক করুন। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর মতো। এবার এই মুঠোটা কাউকে দেখান – ভাঁজ করা আঙুলগুলো যাকে দেখাচ্ছেন তার দিকে। এটা হল এক হাওয়াইয়ান মুদ্রা মানে হল হ্যাং লুস।
Comments
পায়ের তলায়,
কেদারতাল ট্রেক
দেবাশীষ চৌধুরী
সার্কাস ময়দান, বেলডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদ
(প্রথম পর্ব)
ট্রেকিংয়ের স্বর্গরাজ্য গাড়োয়াল। এমন কোন ট্রেকার পাবেন না, যিনি গাড়োয়ালে ট্রেক করেননি। বিদেশী ট্রেকারদের ভাষায় গাড়োয়ালের রূপের তুলনায় আল্পস্’ও নাকি পিছনে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই পাহাড়ে যাই না, পাহাড় তার নিজের কাছে আমাদের টেনে নিয়ে আসে, নিশির ডাকের মত! পাহাড়ীরা একটা কথা খুব বলে…… “পাহাড় বুলাতা হ্যায়”
সালটা ২০০৫, মাসটা মার্চের শেষ কিংবা এপ্রিলের প্রথম। অফিসে অমলদার ফোন এল। অমলদার ফোন মানেই……… “পাহাড় বুলায়া হ্যায়”। ২০০৫’এর ফেব্রুয়ারীতে সান্দাকফু ট্রেকের প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু কপাল মন্দ, ঘি-সিং সাহেব পাহাড়েবন্ধ ডেকে বসলেন। ওঃ ভগবান, সেকি মনের অবস্থা। দু-তিন মাসের প্রস্তুতি জলে। যাদের বেড়ানর, বিশেষত ট্রেকিংয়ের নেশা তাঁরাই বুঝবেন কি ভীষণ চাপ পড়ে মনের উপর এই সময়ে।
“কেদারতাল যাবি”? “কবে বেরুতে চাইছ”? “এই ধর জুনের শেষে”। “সঙ্গে আর কে কে যাচ্ছে”? “তুই আমি আর পঞ্চানন”। “তিনজনের টিমে গাড়োয়াল-ট্রেক! খরচাটা ভাব”। “দূর ছাড়ত, কত আর খরচা হবে”! “তুমি আর পঞ্চ’দা তো ব্যাঙ্ক-অফিসার, ফাটবে ত আমার”! হ্যা হ্যা করে হেসে অমলদা বলল, “টিকিট কেটে তোকে ফোন করব”।
২৫শে জুন দুন এক্সপ্রেসে তিনজনে রওনা হলাম, গন্তব্য হরিদ্বার। দুর্ভোগের দু’রাত্রি কাটিয়ে ২৭শে জুন সকালে হরিদ্বার পৌঁছে তখনই রওনা দিলাম হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে। ছবির মতন দেখতে ঋষিকেশ রেল স্টেশন। রেল স্টেশনের কাছই জিপ-আড্ডা। একটা ধাবায় টিফিন সেরে সওয়ার হলাম শেয়ার জিপে, আজকের গন্তব্য উত্তরকাশী।
নরেন্দ্রনগর, শ্রীনগর আর ছবির মত সুন্দর টেহেরি ড্যাম পার হয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ জিপ পৌঁছল উত্তরকাশী। উত্তরকাশীর জিপ-স্ট্যান্ডের সামনের হোটেলটাই ‘ভান্ডারী-হোটেল’। আজকের রাতের আস্তানা ওখানেই। কাল সকালে শুরু হবে গঙ্গোত্রীর পথে যাত্রা।
২৮শে জুন সকাল আটটায় জিপ-যাত্রা শুরু হল। মা গঙ্গাকে বাঁদিকে রেখে ক্রমশই উঁচু থেকে আরও উঁচুতে ওঠা। পড়ন্ত দুপুরে হরশিল। মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে আপেলহীন আপেল বাগানের পথ পেরিয়ে হরশিল জিপ-আড্ডা। কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি। ঠান্ডা সেই উত্তরকাশী থেকেই পাচ্ছি। এখানে ঠান্ডার আধিক্যটা বেশ ভালই।
শেষ বিকালে ভৈরোঁঘাঁটি পেরিয়ে গঙ্গোত্রী। ১০,৭০০ফুট উচ্চতায় ঠান্ডা তার উপস্থিতি প্রবলভাবেই জানান দিচ্ছে। আগামীকাল বিশ্রাম। ঠিক করতে হবে পোর্টার গাইড, কিছু কেনাকাটাও করতে হবে, বিশেষত ‘মিট্টি-তেল’ মানে কেরোসিন!
(দ্বিতীয় পর্ব)
৩০শে জুন সকাল সাতটায় শুরু হল কেদারতাল ট্রেক। আজকের গন্তব্য ভূজ খড়ক, উচ্চতা ১২,৫০০ফুট। পুর পথটাই খাড়া চড়াই। আমাদের দলে নতুন দু’জন যোগ দিয়েছে, গাইড পন্ডিতজী আর পোর্টার তোম্বা। পন্ডিতজী গাড়োয়ালী আর তোম্বা নেপালী। সারাটা ট্রেকরুটে গাড়োয়ালী আর নেপালী’দের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ ক্লাইম্বার, তার ফয়সালা এই দু’জনে করতে পারেনি!
“গঙ্গা মাইকী, জয়য়য়য়”………….পিঠে রুকস্যাক, বুকে ন্যাপস্যাক নিয়ে যাত্রা হল শুরু। ঘন পাইনের জঙ্গল ভেদ করে ট্রেল ধরে ক্রমাগত আকাশকে ধরতে চাওয়ার এক অসম লড়াই। সমতলের মানুষ আমরা, দু’পা উঠতেই শরীর বিদ্রোহ শুরু করে দিল। অমলদা কড়া লিডার, নো ধানাই-পানাই!
“ও দেখ সাব, গ্লেসিয়ার।” সম্বিত ফেরে গাইড পন্ডিতজীর কথায়। হ্যাঁ, সত্যিই তো। সামনের ট্রেল’টা সাদা চাদরে মোড়া! গ্লেসিয়ারে উঠতেই বিপত্তির শুরু! বাটার চারশো টাকা দামের পাওয়ার আর যাইহোক গ্লেসিয়ারে চড়ার উপযুক্ত নয়……যা হবার তাই হল, পা স্লিপ্ করে চিতপটাং! “বড়া সাব, ছোটা সাব গির গিয়া!” গাইড পন্ডিতজীর ডাকে খানিকটা এগিয়ে থাকা অমলদা আর পন্চাদা পিছন ফিরে আমার দুরাবস্তা দেখে একটি আদিরসাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে আবার চলতে শুরু করল। আমিও গাইডের হাত ধরে খাড়া হলাম।
“এটাই এই ট্রেকরুটের অন্যতম বড় বাধা। অনেক দলই এখান থেকে ফিরে যায়। যদি ‘ভার্গো’ অর্থাৎ খাদের দিকে তাকালে মাথা ঘোরার ব্যামো থাকে, তবে আর না এগোনই ভাল!” অমলদার কথায় সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ট্রেল’টা খুব বেশী হলে ফুট তিরিশের মত হবে। কিন্তু চওড়া নয়-দশ ইঞ্চির বেশী হবেনা। পুরো ট্রেলটাই পাহাড়ের গা ধরে ধরে আড়াআড়ি ভাবে যেতে হবে, কোন ভাবে পা যদি একবার ফস্কায় সোজা কেদারগঙ্গার বুকে!!!
“শালা ওটা টিকটিকি নাকি!” বিশাল এক বোঝা নিয়ে শিস দিতে দিতে পোর্টার তোম্বা সিং অবলীলাক্রমে পেরিয়ে যেতেই ‘মেজ-সাব’ পন্চাদার সরস মন্তব্য। এবার আমাদের পালা, প্রথমে অমলদা তারপর পন্চাদা। পন্চাদার পিছনে গাইড আর তার পিছনে আমি। পাহাড়ের গা ধরে একপা একপা করে এগুচ্ছি(পড়ুন-ঘষটাচ্ছি)আর ইষ্টনাম জপছি! কেলো’টি পাকল ফুট দশেক যাবার পর। ডান হাত দিয়ে যে পাথরটা ধরলাম, সেটা খুলে হাতে চলে এল! ভাগ্যিস বাঁ হাত দিয়ে যে পাথরটা ধরেছিলাম সেটা খুলে যায়নি, খুলে গেলে আর দেখতে হতনা সোজা কেদারগঙ্গায় ল্যান্ড করতাম।
এখন সাড়ে বারটা বাজে, পৌঁছে গেছি ১২,৫০০ফুট উচ্চতার ভূজ খড়কে। ট্রেল থেকে সামান্য নিচুতে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। ফাটাফট দুটো টেন্ট ডিচ্ করা হয়ে গেল। ওদিকে ভাঙাচোরা একটা টিনের শেডের তলায় পন্ডিতজী আর তোম্বা রান্না চাপিয়েছে। সারাটা রাস্তা বৃষ্টি জ্বালিয়েছে, যদিও ঝিরঝিরে এই আছে তো এই নেই! এতক্ষণ পথশ্রমে গলদঘর্ম হচ্ছিলাম, এখানে বসতে না বসতেই ঠান্ডা তার প্রাবল্য টের পাইয়ে দিল। একদিকে খাদ আর বাকি তিনদিক জুড়ে বড় বড় গাছের জঙ্গল। ভূর্জপত্রের অনেক গাছ রয়েছে বলেই বোধহয় এই স্থানের নাম ‘ভূজ খড়ক’।
(তৃতীয় পর্ব)
১লা জুলাই, এখন সাড়েদশটা বাজে। শুরু হল আজকের গন্তব্য কেদার খড়কের উদ্দেশ্যে যাত্রা। গতকাল বিকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কপাল ভাল বরফ পড়েনি। সকালে আবার এক কেলো! বৃষ্টির মধ্যেই পলিথিন মুড়ি দিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জঙ্গলে ঢুকেছি। খেয়াল পড়ল ‘বিশেষ- কর্ম’ সারা হতে! টিসু-পেপার তো টেন্টে রুকস্যাকের মধ্যে রেখে এসেছি!!! জঙ্গলে একধরনের ছোট গাছ হয়, দেখতে অনেকটা পালংয়ের মত। পাতাগুলোও বেশ বড় আর গোল গোল, আপাতত তাই দিয়েই টিসু-পেপারের কাজ সারলাম!
টানা ঘন্টা তিনেক হাঁটার পর একটা জায়গায় এসে বিশ্রামের হুকুম মিলল। সকালে পন্ডিতজীর বানানো টিফিন মেস্টিন থেকে বার করে খাচ্ছি আর খেতে খেতে পন্ডিতজীর কথা শুনছি, “সাব, ঔর আধা ঘন্টা বাদ মিলেঙ্গে এহি রুট’কা সবসে বড়া মুসিবত……ধসা পাহাড়”। এই ধসা পাহাড়ের কথা আগেই শুনেছিলাম।
দেড়শো মিটার ট্রেল’টা গেছে একটা ঝুর পাথরের ঢালের উপর দিয়ে। একপা এগোলে দু’পা খাদের দিকে হড়কাতে হবেই আর তার সঙ্গে ওপর থেকে সারাক্ষণইছোট বড় বিভিন্ন আকারের নুড়ি গড়িয়ে পড়ে। সত্যিই খুবই কঠিন এই জায়গাটা পার হওয়া।
“ওঃ এটাই সেই ‘ধসা পাহাড়’!!! পার হব কিকরে”? “শুধুমাত্র মনের জোরে”, জবাব এল অমলদার থেকে। সত্যি, মনের জোর ছাড়া একে পেরনো অসম্ভব। প্রথমে তোম্বা গেল বোঝা সমেত। ও হড়কাল বটে, মোটে দু-চার পা! এরপর অমলদা আর পন্চাদাও পেরিয়ে গেল, আট-দশ ফুট হড়কাল মাত্র। এবার আমার পালা। একপা করে এগুচ্ছি আর পিছন থেকে পন্ডিতজী ‘সাবস বেটা’ বলে চলেছে।
ভালই চলছিলাম, হঠাৎ যেন ভূমিকম্প হল! পন্ডিতজীর ‘সাবস বেটা’ মোটে বিশ ফুট হড়কেছে। একরকম আরও বার তিনেক হড়কে ওদিকে পৌঁছলাম।
এই জায়গাটার সিনিক বিউটি অসাধারণ। অতলস্পর্শী খাদের শেষে কেদারগঙ্গা আপনমনে বয়ে চলেছে গঙ্গোত্রী অভিমুখে। অপরপাড়ে মন্দার পর্বতশ্রেণী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কোথাও সবুজের লেশ মাত্র নেই। এপারে ট্রেলের পাশে সামান্য সবুজ ঘাসের আভা, আমরা ট্রি-জোন ছাড়াতে চলেছি যে!
ঘন্টা খানেক আরও হাঁটার পর ফুট দশেক চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতেই অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। অচেনা এক জগত তার রূপের ডালি সাজিয়ে যেন আমারই প্রতীক্ষায়। অসম্ভব একটা ভাল লাগার আবেশ যেন গ্রাস করে নিল সমস্ত সত্ত্বা’কে। পথশ্রমের ক্লান্তি অনুভব করার বোধশক্তিটাই তো তখন বিলীন হয়ে গেছে।
এটা যে গাড়োয়াল……গাড়োয়াল হিমালয়! এর টানেই যে বারবার ছুটে আসি। না ভুল বললাম, ঘাড় ধরে সমতল থেকে নিজের কোলে টেনে আনে! সামনে সবুজ মখমলের এক সুবিশাল বুগিয়াল। সামনে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি মেঘের আড়াল থেকে ‘টুকি’ করছে, পূর্বদিক জুড়ে কেদারগঙ্গার ওপারে মন্দার পর্বতশ্রেণী আর পশ্চিমে পাহাড়ের গা বেয়ে বুগিয়াল ওপরে উঠে যেন হাতছানি দিয়ে
ডাকছে। কোথায় বড় গাছের চিহ্ন মাত্র নেই। থাকবে কিকরে, আমরা ট্রি-জোনের ওপরে যে! পৌঁছে গেছি ১৪,৫০০ফুট উচ্চতার কেদার খড়ক।
প্রথমে অভ্যর্থনা জানাল একটি পাহাড়ি ডগী। ইনি মেষপালকের পোষ্য। এনার ডিউটি হচ্ছে সারারাত জেগে থেকে ভেড়ারপালকে বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা আর দিনের বেলায় তাদের উপর খবরদারী করা। এনারা দলে তিনজন, বাকি দু’জন পালের সঙ্গে আছেন। সামনেই মেষপালকের তাঁবু। আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলেন। কথায় কথায় জমে গেল আলাপ। “দিনের পর দিন একা থাকেন কি করে”? আমার প্রশ্ন শুনে হেসে উত্তর দিলেন, “আদত হো গিয়া সাব”।
অদ্ভুত জীবন এই মেষপালকদের। শীতের বরফ গলতেই মালিকের মেষের পাল চরাতে বেরিয়ে পড়েন গাঁও ছেড়ে। ফিরবেন সেই শীতের শুরুতে। সারাটাদিন কাটে জড়িবুটি সংগ্রহে আর বিকাল থেকে তাঁবুতে, দৈনন্দিন রুটিনের কোন পরিবর্তন নেই। ভাবতে পারেন, TV, FM, ফেসবুক, হোটাসএ্যাপ ছাড়া দিনের পর যদি আপনাকে এইরকম সঙ্গীহীনজীবন কাটতে হত! D.A., Pay Commission, G.T., M.T. নিয়ে কতই না অসন্তোষ আমাদের! এঁদের জীবন দেখলে সভ্যতার সব অভিযোগই কিরকম যেন যুক্তিহীন লাগে।
তাঁবু খাটানর কাজ শেষ। পন্ডিতজী আর তোম্বা’র তদারকিতে রান্না চেপেছে। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা চা খাচ্ছি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। গাঢ় কুয়াশা, সাদা চাদর বিছিয়ে চারদিক ক্রমশ ওয়াশআউট করে দিচ্ছে। দশহাত দূরের তাঁবুটাও আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। না, ঠান্ডায় আর বাইরে থাকা যাচ্ছেনা। ঢুকে
পড়লাম তাঁবুর মধ্যে স্লিপিংব্যাগের নিরাপদ আশ্রয়ে। কাল যে পৌঁছতে হবে প্রায় ১৬,৫০০ ফুট উচ্চতার কেদারতালের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে, দি লাস্ট ডেস্টিনেশন!
(চতুর্থ পর্ব)
২রা জুলাই, সকাল হয়েছে কেদার খড়কে। বাইরে ঝলমলে রোদের মাঝে ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল’ থালাইসাগর, ভৃগুপন্থ, আরও নাম না’জানা কত তুষারাবৃত-শৃঙ্গ। সবুজ মখমলের বুগিয়ালে তখনও অচেনা শিশির বিন্দু ঘাসের ডগায় বসে হাসছে। ভেড়ারপাল বুগিয়ালের ঢাল বেয়ে চরতে চলেছে। আর আমরাও মিঠে রোদ গায়ে মেখে পথে নামলাম।
বুগিয়াল পেরতেই ‘বোল্ডার-জোন’ শুরু হয়ে গেল। কোথাও সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই। প্রকৃতির এই রুক্ষ রূপ আত্মস্থ করা কঠিন।
‘ভয়ঙ্কর-সুন্দর’ শব্দটা বইয়ের পাতাতেই এতদিন পড়েছি, এবার চাক্ষুষ করলাম। উপলব্ধি হল মহাদেবের রুদ্র-রূপের মহিমা, ‘সত্যম-শিবম-সুন্দরম’ এর যে কোন পুঁথিগত ব্যখ্যাই যেন এর কাছে অপূর্ণ। দেবভূমি হিমালয়, তপঃভূমি হিমালয় তাঁর স্বীয়-মহিমা নিজ-গুনে প্রকাশ না করলে সাধারণ মানবের সাধ্য কি তাকে অনুভব করে!! তাই তো প্রকৃত সাধকেরা সাধারণত ১৬০০০ ফুট উচ্চার নিচে নামেন না!!!
পাহাড়ের এক একটা বাঁকে প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে। গাড়োয়ালের এই রূপ ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি। শুধুই একটা আবেশ, একটা ঘোর, একটা অনাস্বাদিত আনন্দের হিল্লোল সারা দেহ-মন জুড়ে বয়ে চলেছে। দূরে চোখ গেলে শুধুই তুষারাবৃত পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে সূর্য-বিকিরণের ঝলসানিতে গাঢ় কালো রোদ-চশমাও হারমেনে যাচ্ছে, বেশীক্ষণ তাকান যাচ্ছেনা সেদিকে। ভাগ্যিস ট্রেলে এখন বরফ নেই তাই যেতে পারছি, অন্যথায় নেমে আসতে হত!
“সাব, ইয়ে জায়গা’নে অক্সিজেন বহুত কম হ্যায়। যিতনা জলদি হো’সকে ইস্ জায়গা পার হোনা হ্যায়”। সম্বিত ফেরে পন্ডিতজীর কথায়। সামনে তাকিয়ে দেখি হাফ্-কিলোমিটার ট্রেল’টা গেছে একটা বেসিনের মত জায়গার মধ্য দিয়ে। আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আর ওপারটার উচ্চতা এক। ট্রেলটা প্রথমে ডাউনওয়াড হয়েছে, পরে আপওয়াড হয়ে ও’মাথায় উঠেছে। এমনিতেই ট্রি-জোনের পর অক্সিজেনের লেয়ার ক্রমশ কমতে থাকে আর এই রকম বেসিনের মত পকেটে কার্বনডাই অক্সাইডের লেয়ারটা বেড়ে থাকে। গাছ নেই যে, কেবানাবে কার্বনডাই অক্সাইড থেকে অক্সিজেন!
পুকুরে বা নদীতে ডুব দিয়ে একটু বেশীক্ষণ থাকলে যেমন একটা কষ্ট হয়, সেইরকম একটা কষ্ট সয়ে আমরা সবাই ওমাথায় পৌঁছলাম। ক্ষণিকের বিশ্রামের পর আবার চরৈবেতী। যত অল্টিচিউট গেন করছি তত’ই রোদের তেজ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। হাতের গ্লাভস্ অমলদার
নিষেধ সত্ত্বেও আগেই খুলে রেখেছিলাম, এখন বুঝছি কি ভুল করেছি! ফুলহাতা জামার হাতা অবধি মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু তারপর! হাতের তালু-চেটো সান-বার্ণ হয়ে গাঢ় কালচে-লাল রঙের হয়ে গেছে!(এই স্মৃতিচিহ্ন’টি মাসখানেক ছিল)
কিছুক্ষণ ধরেই কামান দাগার মত একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি, জিজ্ঞাসা করলাম পন্ডিতজীকে। উত্তর এল, “ও’তো এ্যাভেল্যান্জ’কা আওয়াজ হ্যায়। ধূপ যিতনা বাড়েগা, এ্যাভেল্যান্জ উতনাই য্যাদা হোগা”! পাহাড়ের তুষারাবৃত অংশে রোদের তেজে বরফ কিছুটা নরম হয়ে পড়লে বরফের একটা অংশ নুড়ি-পাথর সমেত নিচের দিকে গড়িয়ে আসে, এই ঘটনাটাকে এক কথায় ‘এ্যাভেল্যান্জ’ বলে! বড় এ্যাভেল্যান্জ হলে, দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে যেন ধোঁয়া উড়ছে! যারা ক্লাইম্বার, তাঁদের এ্যাভেল্যান্জের কবলে পড়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা সখের ট্রেকার, আমাদের এর কবলে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
ট্রেল থেকে অনেকটা দূরে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বরফের মাঝে চ্যাটালো জায়গায় পান্না-সবুজ জলের ছোট ছোট জলাশয় দেখতে পাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করাতে অমলদা উত্তর দিল, “দেবা, প্রকৃতির লীলা বোঝা ভার! মা জগদম্বা তাঁর অবোধ-সন্তানদের তৃষ্ণার কথা ভেবেই হয়ত এই দুর্গমস্থানে জলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন! রোদের তাপে আশেপাশের বরফ-গলা জলে ওই জলাশয়গুলি সবসময়ই পূর্ণ থাকে আর ওতেই WILD-LIFE তৃষ্ণা মেটায়”।
“ঔর কিতনা দূর পন্ডিতজী”? প্রশ্নের জবাব পেলাম, “ব্যাস্, আগিয়া”। “ব্যাস্, আগিয়া” কথাটা বার দশেক শোনার পর, ডানহাতি এক পাহাড়ি-চড়াইয়ের বাঁকের ধারে দেখা মিলল হাল্কা-নীল জলের একটি লেকের ছোট ভগ্নাংশের। হ্যাঁ, এটাই কেদারতাল!! চলার পথে প্রথম দর্শন এখান থেকেই হয়। একটা লক্ষ্যে পৌঁছনোর আনন্দ, একটা মন ভরে ওঠার তৃপ্তি, একটা সব পেয়েছির দেশে প্রথম পা রাখার অনুভূতি। সব মিলিয়ে একটা কেমন যেন থম মেরে গেলাম। “চলিয়ে সাব, ঔর তো স্রিফ্ পনরো-বিশ মিনিট কা বাত হ্যায়”। সম্বিত ফেরে পন্ডিতজীর কথায়। সবাই এগিয়ে গেছে, আমিই শুধু দাঁড়িয়ে আছি। পা চালালাম ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের দিকে।
দেবাত্মা হিমালয়, শিবভূমি হিমালয়, আত্মজ্ঞান লাভের পীঠস্থান হিমালয়। তোতাপাখির মতন বইয়ে পড়া মন্ত্রসম শব্দগুলি কোনদিন যে জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে উঠে আসবে, তা ছিল কল্পনাতীত। দাঁড়িয়ে আছি ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ডে। সামনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থালাইসাগর, ভৃগুপন্থ ইত্যাদি শৃঙ্গগুলি যেন মহাদেবের এক একটি রূপ! পশ্চিমে কেদারগঙ্গার উৎস প্রাকৃতিক-হ্রদ কেদারতাল স্ব-মহিমায় বিরাজমান! এ্যাভেল্যান্জের শব্দে যেন সৃষ্টি হচ্ছে দেবাদিদেবের ডমরু-বাদ্য। সমুদ্র মানুষকে Extrovert করে দেয় আর পাহাড় আমাদের Introvert করে নেয়! কোন কথা বলতে ভাল লাগছেনা, একটা আবেশ সারা দেহ-মনে জড়িয়ে আছে। মৃত্যুর পর স্বর্গে যাওয়া যায় কিনা জানিনা, তবে জীবদ্দশায় নিশ্চিত স্বর্গারোহণ হয়ে গেল!
(পঞ্চম পর্ব)
ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ড থেকে প্রায় হাজার দেড়েক ফুট নিচে কেদারতাল। নামার রাস্তা দু’টি, একটি শর্টকাটে টিকটিকির মত পাথর বেয়ে নামতে হবে আর অপরটি অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গা দিয়ে অনেকটা ঘুরে আসতে হবে। অমলদা উত্তরকাশীর নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং’এর বেসিক-কোর্স পাস করা। উনি প্রথম পথটা বাছলেও আমি চললাম দ্বিতীয় পথটা দিয়ে। অনেকটা ঘুরে আসতে গিয়ে একটা বাড়তি লাভ হল। এক জায়গায় দেখি পাথুরে জমিতে, কেদারগঙ্গা যেখান থেকে সবে মাত্র কেদারতাল থেকে বেরিয়ে নদীরূপ পাচ্ছে, সেখানে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে গুল্ম আর ঘাস জাতীয় কিছু উদ্ভিদের, রুক্ষ পাথুরে প্রকৃতির মাঝে অনেকটা জায়গা নিয়ে সবুজের আভাস যেন বিশ্ব-প্রাণের প্রতীক। মনে পড়ে গেল স্বামীজীর সেই বিখ্যাত উক্তি, “Life is the unfoldment and development of a being under circumstances tending to press it down”.
“এ্যাই লে, ছোটাবাবু উলাট গিয়া”! ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ড থেকে ‘মেজবাবু’র রসালো মন্তব্য। ভুলটা আমারই ছিল। শর্টকাটের বাসনায় একটা লাফ দিয়েছিলাম কেদারগঙ্গার এপার থেকে ওপারে যাবার বাসনায়। কিন্তু লাফ দেওয়ার মুহূর্তে যে পায়ে ভর দিয়েছিলাম, সে যে মাটিতে আটকে থাকবে তা কিকরে জানব!
ফলে হল কি লক্ষ্যের বদলে যেখানে এসে পড়লাম, পুরো থকথকে কাদা। হাঁটু অবধি কাদায় ঢুকে গেল। কোনরকমে খাড়া হয়ে ওই অবস্থায় চলতে শুরু করলাম।
কেদারতালের পাড়ে এখন যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি, এটাই হচ্ছে বেস্ট ভিউ পয়েন্ট। প্রচন্ড হাওয়ার বেগে জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠেছে, ফলে জলে থালাইসগরের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছেনা। শুনেছিলাম অপূর্ব লাগে সেই দৃশ্য, কপাল খারাপ আমাদের। ফিরে এলাম ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ডে আর এখান থেকেই উপভোগ করতে লাগলাম কেদারতালের মাধুর্য্য। সূর্য্যের অবস্থানের তারতম্যে জলের রঙের পটপরিবর্তন হচ্ছে। কখনও হাল্কা সি-গ্রীন, কখনওবা গাঢ়-সবুজ। আবার কখন যেন নীল থেকে গাঢ় নীল।
এখান থেকে দক্ষিণদিকে আরও কিছুটা গেলে এ্যাডভান্স বেস-ক্যাম্প। সে জায়গার রূপ’ও আলাদা। উন্মুক্ত পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে শুধুই স্নো-পিক। যোগিন ১,২,৩ ছাড়াও খর্চাকুন্ডকে স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। কিন্তু কেদারতালের ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ডের পর থেকে ‘স্নো-জোন এরিয়া’ শুরু হচ্ছে। রুক্ষ পাথরের রাজত্ব শেষ হয়ে তুষার রাজত্বের শুরু। উপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম ছাড়া ওপথে যাওয়া অনুচিত। আমাদের দৌড়’ও এই অবধি, আগামীকাল ফিরে যাব গঙ্গোত্রীতে, ২১কিমি উতরাইয়ের পথে।
এখন বিকাল পাঁচটা, বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! বৃষ্টির জল মাটিতে পড়ে কচুপাতার উপরে থাকা জলের মত আকার নিচ্ছিল। না জল, না বরফ। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই ভেঙে জল হয়ে যাচ্ছিল। প্রচন্ড ঠান্ডা কিন্তু পরিষ্কার আকাশ। সূর্য্য পশ্চিমপাটে যাবার আগে পেঁজা তুলোরমত মেঘের গায়ে রঙের খেলা দেখাল বটে! সূর্য্যাস্ত হচ্ছে কেদারতালে, চারিদিকে আলো ক্রমশ কমে আসছে। সূর্য্য-রশ্মির ফোকাস-বিন্দু এখন থালাইসাগরের মাথায়, ওঃ সে এক অপার্থিব দৃশ্য। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি সেদিকে।
চাঁদ উঠেছে। থালাইসাগরের গায়ে তার রিফ্লেক্সান এক অপার্থিব জগতের সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীটা এখন শুধুমাত্র দু-রঙা, সাদা আর কালো। বরফের গায়ে রূপালী চাঁদের জ্যোৎস্না আর তার বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার, এছাড়া অন্য কোন রঙের চিহ্নমাত্র নেই। মুখের কথায় এই Black & White ছবির যেকোন বর্ণনাই অসম্পূর্ণ। বিজ্ঞানের চোখে নিঃপ্রাণ হিমালয় মানুষের অনুভবে কেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, এখানে না এলে বোঝা যাবেনা।
কথায় বলে’না, “নর্মদা মে কঙ্কর সবই হ্যায় শঙ্কর, মান তো শঙ্কর না মান তো পাথ্থর”। প্রবাদ আছে এই কেদারতালে নাকি নগাধিরাজ প্রত্যহ অবগাহন করেন। যদি শুধুমাত্র ‘ট্রেকার’ হিসাবে আপনি হিমালয়ে আসেন, হিমালয়ের বাহ্যিক রূপ দেখেই আপনাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর যদি ‘খোঁজ’ পেতে আসেন, কথা দিলাম খালি হাতে ফিরতে হবেনা! ইচ্ছে করছে? চলে আসুন, কেদারতাল আপনার প্রতীক্ষায় আজও অপেক্ষা করে আছে যে…………
Comments
যাত্রা পথে
চিরঞ্জীব সর্দার
ডালাস, টেক্সাস
টড রক, মাউন্ট আবু, রাজস্থান
সানসেট পয়েন্ট, মাউন্ট আবু, রাজস্থান
সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে, তবু রোদের তেজ আছে ভালই। ঘড়িতে বিকেল ৪টে। মাউন্ট আবু বাস স্ট্যান্ডে দুই বন্ধু নামলো বাস থেকে। পিঠে দুটো রুকস্যাক, আর কোনও মাল পত্র নেই। এরা দুজন প্রায় এক মাস ধরে রাজস্থান ঘুরছে। চোখে মুখে বেশ ক্লান্তির ছাপ, তবু নতুন জায়গা দেখার আনন্দে, নতুন লোক চেনার আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুজনেই স্টুডেন্ট, কলেজে পুজর ছুটি চলছে, তাই ওরা বেরিয়ে পড়েছে। পকেটে টাকা পয়সাও শেষের দিকে, আর কিছু দিনের মধ্যেই ঘরে ফিরতে হবে। মাউন্ট আবু রাজস্থানের একমাত্র হিল স্টেশন, অন্য জায়গা গুলোর চেয়ে খরচা বেশি, তাই আসবে কি আসবে না দোনামোনা করছিল। কিন্তু উদয়পুরে একজন বলল অবশ্যই যেন দেখে যায় বাড়ি ফেরার আগে। সস্তার জৈন ধর্মশালার খোঁজ ও দিয়েছিল। সেখানে ফ্রি খাবারও দেয়। এসব শুনে চেপে পড়েছিল বাসে। কিন্তু এখানে পৌঁছে তাদের মাথায় হাত। রাজস্থান ট্যুরিজ্ম এর অফিস থেকে ওদের বলল যে এখন জৈনদের একটা বিরাট অনুষ্ঠান চলছে এক সপ্তাহ ধরে। সমস্ত ধর্মশালা ভর্তি, হোটেলগুলো সুযোগ বুঝে ১০০ টাকার ঘর ৩০০/৪০০ যা পারছে চাইছে (এটা ২০০৪ সালের ঘটনা, তাই ঘর ভাড়া ২০১৫ এর হিসাব অনুযায়ী কম মনে হলেও তখন অনেক টাকা)। টাকা ফেললেও ঘর পাওয়া যাচ্ছে না। এখন উপায়? যা অবস্থা বাস স্ট্যান্ড-এই রাত কাটাতে হবে মনে হয়। কিন্তু এটা হিল স্টেশন, রাতের বেলা জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়ে । গরমের দেশে আসছে বলে তেমন জুতসই ঠাণ্ডার জামা কাপড়ও নেই। ওদের অবস্থা দেখে মনে হয় ট্যুরিজ্ম অফিসের লোকটার মায়া হল, জিগ্যেস করল কত টাকা আছে? দুজনের কাছে কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা আছে তার থেকে খাওয়া দাওয়া, এখানে ঘোরাঘুরি আর যোধপুর অবধি বাস ভাড়া রেখে ১০০ টাকাও হচ্ছে না। যোধপুরে একজনের পিসির বাড়ি, ওখানে পৌঁছাতে পারলে আবার হাতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। হিসাব নিকাশ করে ওরা ৮০ টাকা বার করতে পারল। তাই দেখে লোকটা খুব একটা ভরসা দিতে না পারলেও কয়েকটা জায়গায় ফোন করল। কোন হোটেলই রাজি হচ্ছে না। শেষমেশ কেউ একজন সদয় হল, ওরা সেই হোটেল এর ঠিকানা আর ডিরেকশন নিয়ে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বেরল।
বাস স্ট্যান্ড থেকে ১৫ মিনিট মত হাঁটাপথ - নাম শান্তিভিলা। ঠিকানা মিলিয়ে যেখানে এল সেটা সাদা রং এর ছোট একটা দোতলা বাড়ি, ঠিক হোটেলের মত নয়। তবে একটা রিসেপশন কাউন্টার আছে, সেখানে একজন পেপার পড়ছিল, ওদের দুজনকে দেখে পেপার রেখে উঠে দাঁড়াল। ঘরের কথা বলতে হাঁক দিয়ে একটা ছেলেকে ডাকল, সে গিয়ে দোতলার একটা ঘর দেখাল ওদের। ছিমছাম সুন্দর ঘর, সাদা মার্বেল দেওয়া মেঝে, লাগোয়া বাথরুম। গরমজল লাগলে এনে দেবে বালতি করে। ঘর দেখে তো ভীষণ পছন্দ হল, আর বাস স্ট্যান্ডে রাত কটানোর তুলনায় এই হোটেল তো রাজপ্রাসাদ। কিন্তু ৮০ টাকায় এরকম ঘর কি করে দিচ্ছে,যখন এতো চাহিদা। রিসেপশনে ফিরে গিয়ে ঘর পছন্দ হয়েছে বলতে বলল ৩০০ টাকা ভাড়া আর ১০০ টাকা ডিপোজিট। বলে কি? ওরা নিজেদের অবস্থা জানিয়ে বলল ওদেরকে তো এখানে পাঠাল সব জেনেশুনে। কোথা থেকে দেবে এতো টাকা? তখন সে বলে আমি তো কিছু জানি না কে পাঠিয়েছে তোমাদের। রীতিমতো তর্কাতর্কি বেঁধে যায়, তখন ভেতর থেকে কেউ একজন বলল 'ঘর দে দো'। আরও একজন বয়স্ক লোক ছিল ঘরে ওরা খেয়াল করে নি আগে। ওনার কথা শুনে রিসেপশনের লোকটা আর কথা বাড়াল না, ঘরের চাবি দিয়ে দিল। ওরা দুজন তো মহা খুশি। ঘরে গিয়ে ব্যাগ পত্র ছুঁড়ে দিয়ে খাটে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। ৪ ঘণ্টার উপর বাস জার্নি করে এসেছে। তারপর এসে এতো ঝামেলা। কিছুক্ষন পর দরজায় টোকা, খুলতেই দেখল যে ছেলেটা ঘর দেখিয়েছিল সে পটে করে চা এনেছে সেই সাথে গরম জল। ওরা তো অবাক, বলে নি তো এসব দিতে। হোটেলের চা-এর চেয়ে রাস্তার ধারের দোকানে অনেক কমে হত। কিন্তু তখন শরীরের যা অবস্থা একটু চা আর স্নানের গরম জল পেয়ে ওরা বর্তে গেল। হিসাব করে দেখল এগুলোর টাকা ওরা দিতে পারবে। তাই আর দেরি না করে চা'টা শেষ করে গরম জলে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ল আশপাশটা ঘুরে দেখতে।
শহরটা সুন্দর, তবে রাজস্থানের অন্য শহরগুলোর থেকে একটু আলাদা। ওরা ঘুরে ঘুরে লোকজনদের সাথে কথা বলে পরদিন কোথায় কোথায় যেতে পারে তার একটা লিস্ট বানিয়ে নিল। দেখার অনেক জায়গা আছে কিন্তু ওরা পায়ে হেঁটে ঘুরবে আর যেখানে ঢুকতে টাকা লাগবে না সেখানে সেখানে যাবে। রাতের খাওয়া ঘি মাখানো রুটি আর আচার। খেতে খেতে একজনের সাথে আলাপ হল, সে লোকাল
গাইড। ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে চাইল, কিন্তু ওদের গাইডের দরকার নেই। তখন সে বলল ওর একটা ছোট ছেলে আছে, সে সারাদিন এমনি ঘুরে বেরায় নানা জায়গায়, সে ওদের সাথে যেতে পারে, দুপুরের খাওয়া আর যা পারবে দিলেই হবে। ওদের পকেট গড়ের মাঠ, কিন্তু এই গাইডের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ, তাই ওরা নিমরাজি হয়ে গেল।পরদিন সকাল সকাল আবার ঘরে চা, গরম জল তার সাথে ব্রেকফাস্টও। ওরা অবাক হওয়ার জায়গায় এবার রেগে গেল। না চাইতেই এসব দিয়ে পকেট কাটার তাল। তাড়াতাড়ি স্নান টান সেরে ওরা তৈরি হয়ে নিল। ব্যাগ দুটো রিসেপশনে রেখে ওরা ঘুরে আসবে। সন্ধেবেলা যখন এখান থেকে ফেরার বাস ধরবে তখন আবার নিয়ে যাবে। টাকা পয়সা মেটাতে গিয়ে আবার অবাক। ঘর ভাড়ার ৮০ টাকা ছাড়া আর কোনও বিল নেই। চা, জলখাবার, গরম জল সব ফ্রি। ওরা রিসেপশনের লোকটাকে জিগ্যেস করল ব্যাপারটা কি। যা শুনল তাতে ওদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আগেরদিন যে বয়স্ক ভদ্রলোক ওদের ঘর দিয়ে দিতে বলেছিল, সেই এই হোটেলের মালিক শেঠজী। ওনার ছোট ছেলে খুব ঘুরতে ভালবাসত, হুটহাট বেরিয়ে যেত কাউকে কিছু না বলে। বেশ কিছুদিন পর ফিরে আসত আর নিজের ঘোরার অদ্ভুত সব গল্প শোনাত বাবাকে।
একবার নাকি এরকম বেড়াতে গিয়ে একটা অ্যাকসিডেন্টে সে মারা যায়। তারপর থেকে শেঠজী যখন দেখে ওদের মত অল্পবয়স্ক কেউ ঘুরতে এসেছে, টাকাপয়সার টানাটানি, তাদের কম ভাড়ায় ঘর দিয়েছে। চা জলখাবারের পয়সা নেয় নি। ওদের দেখেও হয়ত নিজের ছেলের কথাই মনে পড়েছিল ওনার। পৃথিবীতে কত এরকম মানুষ নিজের কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে, চুপ করে - বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। ওদের গাইড বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়াবে কথা হয়েছে। পৌঁছে দেখল একজন না দুজন গাইড। দশ বছরের ছেলেটা তার পাঁচ বছরের বোনকেও নিয়ে এসেছে। সেও নাকি যাবে ওদের সাথে। ওরা জিগ্যেস করল সারাদিন ওদের সাথে ঘুরতে কষ্ট হবে না? বলল ওরা তো নানা জায়গায় ঘুরে বেরায়, ঘর থেকে মাইলের পর মাইল চলে যায়। স্কুল যাওয়ার টাকা নেই। সারাদিন ঘুরে ঘুরে যদি কিছু কাজ জোটে তাহলে খেতে পায়, নইলে কিছু ঠিক নেই। বাবা তো রোজগার করে। ওরা বলল মায়ের নাকি খুব অসুখ, তাই সব টাকা ওষুধ কিনতে বেরিয়ে যায়। পরপর মন খারাপ করা কথা। আর দেরি না করে ওরা বেরিয়ে পড়ল আধার দেবী মন্দির যাবে বলে। আধার দেবীর মন্দির পৌঁছাতে হলে ৩৬০ টা সিঁড়ি ভাঙ্গতে হবে। ওরা তো একটু ওঠে একটু বসে একটু জিরোয় আবার সিঁড়ি ভাঙ্গে। বাচ্চাদুটো তরতর করে উঠে যাচ্ছে আর ওদের বলছে এইটুকু করে উঠেই বসে পড়লে সারাদিন লেগে যাবে উপরে পৌঁছাতে। অবশেষে উপরে পৌঁছে দুজনেই ধপ করে বসে পড়ল একটা পাথরের উপর । ওখান থেকে সুন্দর ভিউ, চুপ করে বসে থাকতেও ভাল লাগে। মন্দিরে দর্শনার্থী আসছে সমানে
কিন্তু তেমন চিৎকার চেঁচামেচি নেই। আর এতো উঁচুতে শহরের আওয়াজও পৌঁছায় না। চারপাশে একটা শান্তি আছে। মন্দিরের ভেতরটা আহামরি কিছু না, যেমন আর পাঁচটা মন্দির হয়। কিন্তু লোকেশনটার জন্যই বারবার আসা যায়। বেশ কিছুক্ষন দুজনে বসে থাকল, তারপর নামতে যাবে ওদের গাইড জিগ্যেস করল ওরা পুজ দেবে না। ওরা মাথা নেড়ে নামতে শুরু করল। কি হবে পূজা দিয়ে, পূজা উপচার আর দক্ষিণার টাকায় বরং ওই বাচ্চাদুটোর আর একবেলা খাওয়া হয়ে যাবে।
ওখান থেকে ওরা গেল নাক্কি লেক। শহরের মাঝে বেশ ভালই সাজানো গোছান লেকটা, চারপাশে পাহাড় ঘেরা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কে নাকি নখ দিয়ে এই লেক খুঁড়ে বানিয়েছিল, তাই নাম নাক্কি। লেক এর জলটা বেশ নোংরা, তবে প্রচুর মাছ খেলা করছে। নাক্কি লেক থেকে একটা টিলার উপর একটা বিশাল পাথর দেখিয়ে বাচ্চা দুটো বলল ওই পাথরটা দূর থেকে দেখলে একটা ব্যাং এর মত লাগে তাই ওর নাম টোড রক। ওখানে যাবে কিনা জিগ্যেস করতে দুজনেই একসাথে বলল আবার পাহাড়ে চড়তে হলেই হয়েছে। গাইড ওদের ভরসা দিল সে নাকি শর্টকাট রাস্তা চেনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। ওরা রাজি হল যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেল রাজি হয়ে ভুল করেছে। জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ, কোথাও কোথাও সেটাও নেই। কখনও পাথর বেয়ে উপরে ওঠা, তো কখনও পাথরের গা বেয়ে স্লিপ খেয়ে নামা। জিভ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারটাও ভাল লাগছে। আর যতটা চলে এসেছে এখন তো ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। পথে একটা গুহা দেখিয়ে বাচ্চাটা বলল ওটায় নাকি ভালুক থাকে ওরা দেখেছে। জঙ্গলে নাকি চিতাও আছে, তারা রাতের দিকে লোকালয়ে চলে আসে। আবার কিছুক্ষন পরে আরেকটা গুহার মুখে দাঁড়িয়ে বলল তার মধ্যে নাকি একটা মন্দির আছে আর এক সাধুবাবা থাকে। আর আছে এক আশ্চর্য কুয়ো ।এরকম শুনলে তো কৌতূহল তো হবেই। ওরাও গুটি গুটি পায়ে ঢুকল গুহার মধ্যে, অবশ্য প্রায় হামাগুড়ি দিয়েই ঢুকতে হল, গুহার মুখটা এতো নিচু। ভেতরে গিয়ে একটা হলের মত, তার একপ্রান্তে ছোট্ট মন্দির। সেখানে গুহার ছাদ বেশ উঁচু। ওরা চারজন ঢোকার পর জায়গাটা প্রায় ভরে গেল এতটাই ছোট জায়গা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে এক সাধু বাবা হাজির হল। বয়েসের গাছ পাথর নেই, মাথায় একরাশ জটা।
সাধুবাবা ওদের কোনও পূজা আচ্চা দিতে বলল না, সাধারণ পূজারিরা যেমন ব্যাবসায়িক কথা বলে সেরকম কিছুই বলল না। বরং ইতিহাস, পুরাণ, রামায়ান, মহাভারতের অনেক গল্প শোনাল। বাচ্চা দুটোকে অনেক দিন চেনে বোঝা গেল। ওদের বাড়ির খবর, মার শরীরের খবর নিল। ওদের সবাইকে একটা লাড্ডু থেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে প্রসাদ দিল। ওরা কুয়োর কথা জিগ্যেস করতে একটা লন্ঠন নিয়ে ওদের বলল পেছন পেছন আসতে। একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে কিছুটা গিয়ে আরেকটা অন্ধকার ঘরে পৌঁছালো। লন্ঠনের হালকা আলোয় একটা কুয়ো দেখতে পেল ওরা। সাধুবাবা বলল পুরাণ মতে যে সাপের নামে মাউন্ট আবুর নাম সেই অর্বুদা নাকি এই গুহায় থাকত। সেই প্রায়ান্ধকার গুহায়, লন্ঠনের টিমটিমে আলোয় এই কাহিনির সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে যাওয়া বৃথা। ওই কুয়োর জল নাকি এখনও খাওয়া যায় । গুহার ছাদে দুটো বড় গর্ত আছে, সেখান থেকে সকাল আর বিকেলের কয়েক ঘণ্টা নাকি সূর্যের আলো এসে সোজা কুয়োর মধ্যে পড়ে, তাতেই নাকি কুয়োর জল খারাপ হয় না। ওদের বিশ্বাস হচ্ছিল না ওই কুয়োর জল সত্যি খাওয়া যায়, সাধুবাবা বালতি করে তুলে ওদের দিল। ভীষণ ঠাণ্ডা জল, খাওয়ার পর ওদের মনে হল সকাল থেকে এতো দৌড়ঝাঁপ করে শরীরে যত ক্লান্তি জমেছিল সব নিমেষে উবে গেল।
সাধুবাবাকে বিদায় জানিয়ে ওরা আবার এগিয়ে চলল। সাধুবাবার দিন চলে কি করে জিগ্যেস করার ইচ্ছা ছিল, কারণ ওই গুহায় কোনও ভ্রমণকারী সহজে পৌঁছাতে পারবে না, আর তারা না পৌঁছালে দক্ষিনাও তেমন জুটবে না। কিন্তু সবকিছু দেখে শুনে ওদের মনে হল যে এই সাধুবাবা দক্ষিনার খুব একটা ধার ধারে না। টোড রকে পৌঁছে দেখল সেখানে বেশ কিছু লোকজন। তারাও ট্রেক করে এসেছে। তবে অন্য পথে। সেখানে বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিল ওরা। জায়গাটা এমনিতে ভালই, তবে বারটা বাজিয়ে রেখেছে উঠতি যুবক যুবতীর প্রেম অমর করে রাখার দুর্নিবার বাসনা। চারিদিকে পাথরে X + Y এর ছড়াছড়ি। এতো প্রেমিক প্রেমিকা এখানে এতো সহজে পৌঁছে যায় যখন তাহলে নিশ্চয়ই সহজ পথ আছে, বাচ্চা দুটো ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এনেছে। কিন্তু ওদের উপর রাগ হল না, ওদের জন্যই তো এমন সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে ওদের । দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক্ষণ, সবার পেটেই ছুঁচো ডন দিচ্ছে। চারজন একসাথে খাওয়া দাওয়া করল। ওদের পুঁচকে গাইডদের পেট ভরে যা ইচ্ছা করছে খাওয়াল, আবার কোনদিন ওদের সাথে দেখা হবে কিনা জানা নেই, না হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। ওদের সাথে ছবি তুলল। ওদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে বলল ছবি পাঠিয়ে দেবে। তারপর ওদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ছেড়ে দিল ওদের। খুশি মনে হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল ওরা। শহরটা ওরা নিজেরাই ঘুরে নেবে, বিকালে যাবে সানসেট পয়েন্ট।ঘুরতে ঘুরতে ঘড়ির দিকে খেয়াল ছিল না ওদের, সূর্য ডোবার বেশি দেরি নেই। ওরা তখন যেখানে সেখান থেকে সান সেট পয়েন্ট পৌঁছাতে হেঁটে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট। বাস যায় না, ট্রেকার এ গেলে ১০ মিনিট মত। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে দেওয়ার পর আর ট্রেকার ভাড়া নেই। শহরে ঘোরার সামায় শুনেছে দিলওয়াড়ার অসাধারন কারুকার্য করা মন্দিরের কথা। সেখানে যেতেই হবে যোধপুর ফেরার আগে। পাথেয় যথেষ্ট নেই, তাই যতটা সম্ভব খরচ বাঁচাতে হবে। ওরা প্রায় দৌড়াতে শুরু করল। তখন একটা ট্রেকার ওদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করল সানসেট পয়েন্ট যেতে হলে উঠে পড়তে নইলে মিস করবে। ওরা যখন বলল ভাড়া নেই, তখন ড্রাইভার বলল ছাদে বসে যেতে পারলে ভাড়া দিতে হবে না। আর কি চাই, লাফ দিয়ে দুজন উঠে পড়ল ট্রেকারের ছাদে। তখন ওই ট্রেকার ড্রাইভারকেই ওদের ভগবান বলে মনে হচ্ছিল। চারপাশের অসাধারণ সব দৃশ্য দেখতে দেখতে আর হাওয়া খেতে খেতে ওরা পৌঁছে গেল গন্তব্যে।
সানসেট পয়েন্ট এ তখন গিজগিজ করছে ভিড়। এটাই টুরিস্টদের কাছে মাউন্ট আবুর সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের হট্টমেলা সেখানে। সবার হাতে ক্যামেরা, খচাখচ ছবি উঠছে। ওরাও একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল। সূর্য পাটে বসেছে, পশ্চিম আকাশে কে আবির ঢেলে দিয়েছে। লাল হলুদ কমলার সাথে আকাশের নীল মিলে মিশে একাকার। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। বহুদূর দিগন্ত রেখায় অল্প অল্প মেঘ। সব মিলিয়ে এক মায়াবী পরিবেশ। চুপ করে শুধু বসে থাকতে হয়। পার্থিব জগতের সুখ দুঃখ হাসি কান্না অভাব প্রাচুর্য সব কিছু থেকে দূরে, অনেক দূরে এই সময়টা। দুহাত ভরে তাকে শুধু গ্রহন করতে হয় আর সে এসে পূর্ণ করে জীবনকে। ধীরে ধীরে সূর্য নেমে গেল দিগন্তরেখার নীচে, অন্য কোনও এক দেশে ভোরের আলো ফোটাতে। অন্ধকার গ্রাস করতে শুরু করল ওরা যেখানে ছিল সেই জায়গাটাকে। বেড়াতে এসেছিল যারা তারা এক এক করে ফিরতে শুরু করল। ওরা দুজন বসে রইল স্থবিরের মত। সামনেই অমাবস্যা, তাই চাঁদ উঠবে না এখনি। তবে অসংখ্য তারা আকাশটাকে দখল করে নিল, এক অপার্থিব মায়াজালের চাঁদোয়া বিছিয়ে দিল যেন জঙ্গলের উপর। সেই মায়াজাল একটু একটু করে ওদেরকেও ঘিরে ফেলল, ওরাও ডুবে গেল মায়াবী সেই নীল আলোয়।
নিক্কি লেক, মাউন্ট আবু, রাজস্থান
Comments
পেরেম্বানান
স্তুতি বিশ্বাস
ছোটবেলায় ইতিহাসের পাতায় পরে একটু বড় হলে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুমাত্রা, যবদ্বীপ, বালি ও বোরনিওর উল্লেখ পেয়েছি। অন্য দ্বীপগুলির নাম এক থাকলেও যবদ্বীপ এখন জাভা। জাভার বরোবুদুর পৃথিবী বিখ্যাত। কিছুদিন আগে নেট ঘাটতে ঘাটতে খোঁজ পেলাম পেরাম্বানেনের। নবম শতাব্দীর হিন্দু মন্দির। স্বল্প খ্যাত। ছবি দেখে ও বিবরণ পড়ে চাক্ষুষ দেখার প্রবল ইচ্ছা জাগল। তাই এবার বালি বেড়ানোর কথা উঠতেই পেরাম্বানান যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। মঞ্জুর হয়ে গেল। প্রোগ্রাম হল দুইদিন যোজিয়াকারতা তারপর বালি। ছোট্ট শহর যোজিয়াকরতা। ওখান থেকে বরোবুদুর, পেরেম্বানেন দুই জায়গায় যাওয়া যায়।
সিংগাপুর থেকে দুই ঘন্টার ফ্লাইট যোজিয়াকারতা। ছোট্ট এয়ারপোর্ট। রানওয়ের ওপাশে ঘন সবুজের সমারহ। সকালের মিষ্টি রোদ মুচকি হেসে আমাদের অভ্যর্থনা করল । প্লেন থেকে লোহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট বিল্ডিংএ। বড় হল ঘরের একপাশে কাঠের পার্টিশন করা ইমিগ্রেশন। ইন্দোনেশিয়া ভারতের বন্ধু দেশ তাই ভিসা লাগে না। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে এখন অ্যারাইভেল ভিসা ফি ও মকুব করে দেওয়া হয়েছে। মালপত্র নিয়ে বাইরে বেড়তেই দেখি আমাদের গাইড বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাথমিক আলাপচারিতায় জানলাম গাইডের নাম তোউফান। ইন্দোনেশিয়ার ভাষার নাম বাহাসা। আমাদের সংস্কৃত থেকে অনেক শব্দ নেওয়া হয়েছে। তাই বাঙলার সাথে কিছু কিছু শব্দ কমন পাওয়া যায়। গাইড জানাল তোউফান আসলে আমাদের তুফান। ওর জন্মের সময় নাকি ইন্দোনেশিয়ায় প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল তাই নাম রাখা হয়েছে তুফান। ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে রামায়ণ, মহাভারতের প্রভাব প্রচুর। তুফান জানাল যোজিয়াকারতা নামটি এসেছে রামায়ণের অযোধ্যা থেকে। ওখানকার রাজা রামের মত রাজা হতে চেয়েছিলেন তাই রাজ্যের নাম রেখেছিলেন অযোধ্যাকারতা। পরে লোকের মুখে মুখে সেটা যোজিয়াকারতা হয়ে গেছে।
ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগ স্থলে সতেরো হাজার দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ দেশ ইন্দোনেশিয়া। জনগণনায় পৃথিবীতে চতুর্থ স্থান অধিকারী। জনসংখ্যার আশি শতাংশ মুসলিম বাকী অন্য। তবে কট্টরবাদীতা সেরকম নজরে এল না। বেশভূষায় বেশ খোলামেলা। প্রকৃতি ও মানুষের আন্তরিকতায় মনে হয় গ্রাম বাংলার কোথাও ঘুরছি। সকলেই দুইহাত জোর করে নমস্কারের মাধ্যমে অভিবাদন করে। যোজিয়াকারতা খুব একটা বড় শহর নয়। প্রতি পদক্ষেপে কলকাতাকে মনে করিয়ে দেয়। রাস্তায় বাস ট্যাক্সির সাথে পাল্লা দিয়ে রিক্সা ও ঘোড়ার গাড়ী চলছে। ফুটপাথ দখল করে খাবার স্টল। শহরের প্রধান শপিং স্থল মালিবু রোড। মালিবু রোডের ফুটপাথ মার্কেট সারারাত ধরে চলে। ফুটপাথের ভিড় ঠেলতে ঠেলতে বার বারই গড়িয়াহাটের কথা মনে পরে যাচ্ছিল।
হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেস হয়ে আমরা তুফানের সাথে বেড়িয়ে পড়লাম পেরেম্বানেনের উদ্দেশ্যে। ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভা প্রদেশে অবস্থিত পেরাম্বানান। নবম শতাব্দীতে একাধিক হিন্দু মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল এখানে। যোজিয়াকারতা থেকে দূরত্ব ১৭ কিমি।একটু ইতিহাস দেখেনি। সপ্তম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত মধ্য জাভা অঞ্চলে ছিল মাতারাম রাজ্য। এই রাজ্যে রাজত্ব করতেন প্রথমে শৈলেন্দ্র বংশ পরে সঞ্জয় বংশ। শৈলেন্দ্র ছিলেন বৌদ্ধ। সঞ্জয় ছিলেন হিন্দু। সেই সময় জাভা সহ সমস্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার
সামাজিক, বাণিজ্যিক ও সংস্কৃতিতে এই দুই ধর্মের বিস্তর প্রভাব পড়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার হিন্দুরা ত্রিমূর্তির (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব) উপাসক। আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে সঞ্জয় বংশের এক রাজা এখানে প্রথম শিবগৃহ স্থাপনা করেন। পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজারা পাশে পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও অন্যান্য মন্দির তৈরী করেন। পেরেম্বানান মাতারাম রাজ্যের রাজ মন্দির ছিল। পুরো মন্দির চত্বরটি প্রায় ১০০ বছর ধরে তৈরি করা হয়েছিল। চত্বরে প্রধান ছয়টি মন্দির ছাড়াও আরো ২৩৫টী ছোট ছোট মন্দির ছিল। নবম শতাব্দীর শেষের দিকে মধ্য জাভা থেকে রাজ্য সরে যায় পূর্ব দিকে। স্থানান্তরের আসল কারণ জানা যায় না। অনেকে মনে করেন কাছেই মাউন্ট মেরাপী জীবন্ত আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণে ঐ অঞ্চল লাভা ও ছাইয়ে ঢেকে যায়। তাই রাজ্য স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়েছিল। তারপর থেকেই পেরেম্বানান পরিত্যক্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে এক ভয়ংকর ভূমিকম্পে মন্দির কমপ্লেক্সটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
স্থানীয় গ্রামের লোকজন লুপ্তপ্রায় মন্দিরগুলির কথা জানলেও ইতিহাস জানত না। তাই তারা মন্দিরগুলি নিয়ে নিজেদের মত করে দৈত্য ও রাজকুমারীর গল্প বানিয়ে ছিল। পরম্পরা ধরে তাই চলে আসছিল।
উনবিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বের নজরে আসে পেরেম্বানান। ১৯১৮ সালে ডাচরা প্রথম কম্পাউন্ড পুনরুদ্ধার শুরু করে। ঠিকঠাক ভাবে ১৯৩০ সালে কাজ শুরু হয়। ১৯৫৩ সালে প্রাচীন শিব মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। পরে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু মন্দিরের সংস্কার হয়। তুফানের মুখে ইতিহাস শুনতে শুনতে কখন পৌঁছে গেছি পেরেম্বানানের গেটে খেয়াল নেই। গাড়ী পারকিং করে টিকিট ঘরের কাছে যেতেই দেখি লম্বা লাইন।
মনটা দমে গেল। তুফান জানাল আমরা এসেছি রামাদান (ঈদ)ছুটির মরসুমে। এখন এখানে সাত দিন ধরে ছুটি চলছে তাই এত ভীড়। যাইহোক বিদেশীদের জন্য আলাদা গেট। ফাঁকা। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। চোখ জুড়িয়ে গেল। আগ্নেয়গিরির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তারই পদতলে সবুজের ভাসাভাসি। নিকটেই মাউন্ট মেরাপি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। শেষ ২০১০এ জ্বলন্ত লাভা ও ছাই উগড়ে দিয়েছিল। সবুজের বাগানে নীল আকাশের নীচে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর মন্দির। ভাবতে অবাক লাগে সেই প্রাচীনকালে ঝড়ঝঞ্জা জয় করে সাতসমুদ্র তেরো নদী অতিক্রম করে হিন্দুধর্ম পৌছে গেছিল ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ পুঞ্জে। আর আজ আমরা হিন্দুধর্মের উৎসতেই তাকে বজায় রাখার জন্য নানা ছলছুতো করতে থাকি। ইন্দোনেশিয়ার হিসাব মহা ঝকমারি। মুদ্রার নাম রুপয়া। শুরু ১০০০ নোট থেকে। হোটেল থেকে মালিবু রোড রিক্সা ভাড়া চাইল ৩৫০০০ রুপয়া। আকাশ থেকে পড়লাম। এ কিরে ভাই … কোন দেশে এলাম রিক্সাওয়ালা হাজার ছাড়া কথা বলে না। ডাব খেলাম। এত জল, এত জল যে পেট ফুলে জয়ঢাক হবার জোগাড়। দাম চাইল ১৫০০০ রুপয়া।কোন কিছু হিসাব করতে গেলেই শূন্যরা মাথার মধ্যে সব লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিচ্ছিল। শূন্যের আধিক্যে মাঝে মাঝে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছিলাম। আচ্ছা এই লক্ষ, কোটিপতি রিক্সাওলা, ডাবওলা এরপর কি পতি হবে !!!!!!!!!!!! এই দেশের জন্যই মনে হয় ক্যাল্কুলেটর বেঁচে আছে। কমপ্লেক্সে ঢুকতেই আমাদের স্বাগত জানাল বল্লমধারী সান্ত্রীরা। এগোতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম দেখি রাক্ষস খোক্কস ঘোরাফেরা করছে। ক্যামেরা হাতে নিতেই তারা পাশে এসে দাঁড়াল। চললো নানা ভঙ্গিমায় ফটো সেশন।পেরেম্বানানে ছয়টি মূল মন্দির ছাড়াও আরো ছোট ছোট ২৩৫টি মন্দির ছিল। বেশীরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয় লোকেরা পরিত্যক্ত পাথর নিয়ে কাজে লাগিয়েছে। এখন অবশ্য সবই সংরক্ষিত। মন্দিরগুলি ধূসর কালচে রঙের আগ্নেয়গিরির পাথর দিয়ে তৈরি। সংস্কারের পর কয়েকটি মন্দির পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় শিবগৃহ। তার দুইপাশে অপেক্ষাকৃত ছোট ব্রহ্মা ও বিষ্ণু মন্দির। এই তিন মন্দিরের সামনে বাহন নন্দী, গারুদা ও হংস মন্দির। এ ছাড়া দুর্গা ও গণেশের আলাদা মন্দির। ব্রহ্মা ও শিব মন্দিরের গায়ে পাথরের ব্লকে খোদাই করা রামায়ণ গাথা। বিষ্ণু মন্দিরের গায়ে খচিত শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনী। অন্যান্য মন্দিরের গায়ে ভগবৎ পুরাণের কাহিনী বর্ণনা করা আছে।প্রত্যেক মন্দিরে উঠতে হল পাথরের উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভেঙে। মন্দিরের কারুকার্য সত্যি দেখার মত। সংরক্ষণের এত বন্দোবস্ত করলেও আশ্চর্য লাগল দেখে যে মন্দিরের ভিতরে কোন আলোর বন্দোবস্ত নেই। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভিড়ে দম বন্ধ হবার যোগার। আলো না থাকায় পাথরের মূর্তির ভাল করে ফটো তোলা গেল না। পাথরের গায়ে খোদাই করা কারুকার্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেছিলাম সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে। খেয়াল করি নি কখন সূর্য পশ্চিম গগনে হেলে গেছে। কমপ্লেক্সটি বিরাট বড়। ভাল করে দেখতে হলে পুরোদিন হাতে করে যেতে হবে। ছুটির মরসুম হওয়ায় বেশ ভীড় ছিল। তবে প্রায় সবই লোকাল লোকজন। বিদেশী খুব একটা নজরে এল না। ফিরতে মন চায় না। দেখার তৃষ্ণা মেটে না। কিন্তু ফিরতে হবেই। ফেরার পথে কমপ্লেক্স সংলগ্ন মার্কেট থেকে কিছু কাঠের জিনিষ কেনা হল। ভালই দরাদরি চলে। যখন গাড়ীতে চড়লাম তখন চারিদিকে গোধূলির কমলা আলোর মায়াময়তা। পাখিরা ডানায় ক্লান্তি মেখে ফিরছে। কমপ্লেক্স পেরিয়ে গ্রামের পথ ধরলাম। ম্লান আলোয় দূরের গ্রামগুলি ছায়াছায়া হয়ে জেগে উঠছে। পেরেম্বানান রহস্যের সীমা নেই। খননের ফলে এখনো বেড়িয়ে আসছে অনেক মন্দিরের নিদর্শন। সম্প্রতি ১৩ মিটার আগ্নেয়গিরির ছাইর নীচে চাপা পরা মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রচুর মূল্যবান নিদর্শন লুকিয়ে আছে এখানে। বিদায় পেরেম্বানান। আর কোনদিন হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। এই ভাবেই শতাব্দী ধরে ইতিহাসের পাতায় তুমি বেঁচে থাকবে।
Comments
মেঘের মুলুকে
সুখের পরশ
শ্রীতমা বিশ্বাস
মনের গভীরে ‘শেষের কবিতা’র গল্পলিপি। মেঘবালিকার আপন ঘরে প্রেম এতটাই গাঢ়।
ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা একনাগাড়ে হয়েই চলেছে। রাস্তার দু’পাশে সবুজে ধোওয়া পাইনের সমারোহ। মাঝেমধ্যেই কোথা থেকে একরাশ কুয়াশার জাল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে গাড়ির কাঁচ। আর দৃশ্যমান জগত নিমেষেই নিরুদ্দেশ! পাইন গাছগুলোর গা বেয়ে ঝরছে সেই কুয়াশা মাখা বারিধারা। বর্ষাস্নাত পাহাড়ে জলনুপূরের রিনিঝিনি। আবছা জানলার ওপাশে পাহাড়ী অর্কিড, ফার্ন আর রঙ বেরঙের বুনো ফুল। একদল কিশোরীর প্রাণখোলা হাসির মতই যেন তাদের রূপের স্নিগ্ধতা।
মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলেছি। গন্তব্য শিলং পিক। চলা শুরু হলে আর উদ্দেশ্যের কথা মনেই থাকে না। পু্রো পথটা প্রকৃতির নিরাভরণ সৌন্দর্যের মায়াজালে মোড়া। বাঙালি ড্রাইভারের গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে হঠাৎই বেজে উঠলো - “এই পথ যদি না শেষ হয়...।” দূরে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে ঝর্ণার চপল, চঞ্চল স্রোত। চলন্ত গাড়ি থেকেই সেই দৃশ্য একের পর এক ক্যামেরা বন্দী করছি। মেঘালয়ের উচ্চতম চূড়া শিলং পিকে পা রাখলাম। পাইন-বারচ-দেওদারে ছাওয়া ভিউ-পয়েন্ট থেকে ছবির মত দেখায় পাহাড়ের কোলে গোটা শিলং শহরটাকে। ততক্ষণে মেঘ সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছে। ঝকঝকে রোদ্দুরে আকাশের নীল শামিয়ানার আঙিনায় যেদিকেই দুচোখ পড়ে, শুধুই বাকশূন্যতা ঘিরে ধরে। খোলা আকাশের নীচে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ গালিচায় মোড়া শহরের মাঝে ছোট ছোট বাড়ীঘর- যেন কোনও দক্ষ শিল্পীর তুলির টানে আঁকা নানা রঙের জলছবি। নয়ন সম্মুখে উদ্ভাসিত রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য আদন্ত্য রোমান্টিকতায় জড়ানো শৈলশহরটি। অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে চিরনূতন ‘শেষের কবিতা’- অমিত লাবণ্যের একান্ত প্রাণের কথা।
সূর্যের পড়ন্ত যৌবনে গোধূলির শেষ লগ্নে যখন আঁধার ঘনায়, দূরে আলোর চুমকিতে শিলং তখন সেজে ওঠে রাতপরীর বেশে। কলকাতার রিয়ালিজমের থেকে অনেক যোজন পেরিয়ে এ এক ফ্যান্টাসির জগত; যেখানে মেঘবালিকার মেখলার আলতো স্পর্শ, কুহেলিকার ধূসর পালকি মনকে শুধু মুগ্ধই করে না, ধীরে ধীরে গ্রাস করে; যেখানে আড়ামোড়া ভাঙা ভোর আসে নাম না জানা অচিন পাখির ডাকে; কুয়াশা মাখা নির্জন পাইন বনের আলো আঁধারিতে প্রজাপতিরা পাখা মেলে একে একে; রোদ আর ছায়া স্বপ্নে হাত ধরাধরি করে অমিত আর লাবন্যরা ডুবে যায় জীবনের সুর খোঁজার সাধনাতে।
Comments
লালচে মাটির
রুক্ষতায়
কৃষ্ণতরু বর্মণ
ডালাস, টেক্সাস
ক্যানিয়ন ভিউ, পালো ডুরো
ক্যানিয়ন ভিউ, পালো ডুরো
‘ঐ দ্যাখ, লাইট হাউস, আরে ওদিকটা দেখ’ – চোখ থেকে ক্যামেরার লেন্স সরিয়ে সনুকে হাত তুলে লোকেশনটা ইশারা করলাম। খুবই এক্সাইটেড হয়ে সনুও রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ল। আকাশ পরিষ্কার থাকলে পার্কের ভিজিটর সেন্টার থেকেই দিব্বি দেখতে পাওয়া যায়। 'লাইটহাউস' নামে একটা মাইল ছয়েকের হাঁটা পথ। ভিজিটরদের অনেকেই ফ্যামিলি নিয়ে দিব্বি ঘুরে আসেন।সনু একটু অবাক চোখে ঘাড় নেড়ে বলে উঠল – ‘বাট, ইট ডাজ নট লুক লাইক এ লাইটহাউস, স্পেশালি ইনসাইড দি ক্যানিয়ন।' হেসে ফেললাম, খুব খারাপ বলে নি, বিশেষ করে ক্যানিয়নের মধ্যে একটা লাইটহাউস ভাবতেই একটু অবাক লাগে।
ঝলমলে রোদ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। গরম নেই বললেই চলে, আর বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাপ গুগুল করতে হবে। ভিজিটর সেন্টারের সামনে একটা ভিউতে দাঁড়িয়ে স্বাতীর সঙ্গে টুকটাক ক্যানিয়ন সংক্রান্ত কথা হচ্ছিল। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের চোখ মুখ ছুঁয়ে উত্তরগামী। হঠাৎই ‘দিস ইজ দি পারফেক্ট টাইম টু ভিজিট পালো ডুরো, ইন সামার ইটস টু হট’ – পাশ থেকে একটা গলা ভেসে এল। মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক। পরণে সবুজ রঙের ইউনিফর্ম। তাতে লেখা পালো ডুরো, নানান ছবি আর হাজার ব্যাচ আটকানো। পার্কেরই হয়ত কোন কর্মী হবেন। ক্ষণিকের আলাপ। নাম ডেভিড। ডেভিডবাবু থাকেন ক্যানিয়ন শহরে। খুবই ছোট্ট, এক মুঠো লোকের বসবাস। টুকটাক কথাবার্তায় উঠে এল পালো ডুরোর টুকরো টুকরো ইতিহাস, ভিউ পয়েন্টের মাহাত্ম্য, পরিবেশের খামখেয়ালিপনা, তাপমাত্রা বিষয়ক নানান তথ্য, স্থানীয় মানুষ ও তাদের কথা। বলে বসলেন – ‘এই মনোরম পরিবেশ, আর দেরী না করে ট্র্যাকিং এ বেড়িয়ে পড়ুন।' হায় রে, বেচারা... আর কাউকে পেল না, শেষে কিনা এই বঙ্গ তনয়কে। আমার একটা হাই তোলা ম্যাড়ম্যাড়ে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেই হেসে ফেললেন। বউকে ইশারায় বললাম – ‘যাবে নাকি?’ ওদিক থেকেও তেমন কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। ডেভিডবাবুকে থ্যাংকস জানিয়ে কেটে পড়লাম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে ঠিকই, তবে নজরে পড়ার মত কিছু না।
'– জান তো, পালো ডুরো একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ হল হার্ড উড,’ - গরম কফিতে আয়েস করে একটা চুমুক মেরে অরিজিৎ-কে একটু লো ভলিউমে দিয়ে বলে উঠলাম। ধীর গতিতে গাড়ি চলছে। দু-পাশে নানান অজানা গাছপালা, পাথরের উপর অজস্র বুনো ঝোপ আর ফাঁকে ফাঁকে লালচে ঝুরো পাথর। ডালপালা বিহীন রকি মাউন্টেনের জুনিপার গাছ খুব একটা নজরে পড়ছে না। এই গাছের কাঠ একটু সাদাটে ধরনের বেশ শক্ত। বলা বাহুল্য পার্কের নামকরণের উৎসটা এখন আমাদের কাছে জলের মত পরিষ্কার। এর পাশাপাশি রেড বেরি জুনিপার, ওয়ান সিড, ইউলো, কটনউডের হাল্কা জংগল পেরিয়ে চলতে লাগল আমাদের গাড়ি।
আঁকাবাঁকা রাস্তা ক্যানিয়নের মাঝে হারিয়ে গেছে। মাঝে মধ্যেই দু-একটা ভিউ পয়েন্ট। ‘বাহঃ দারুণ তো’ বলে খচাখচ কয়েকটা ছবি তুলে নেওয়ার মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে আবার পরের ভিউ পয়েন্ট। মাঝখানে গরম কফিতে আলতো চুমুকের সাথে অরিজিতের ইনকমপ্লিট সোলোর দুর্দান্ত কম্বিনেশন। মোটামুটি আমাদের মতো সুখী ভিজিটরদের ঐ একটাই ফরমুলা। ব্যাতিক্রমী উৎসাহীরা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে নিচে পাথরের খাঁজে বিলীন। তবে ট্র্যাকিং এর এক অদ্ভুত নেশা আছে, যারা করেন তারাই বোঝেন। আমার মত ভাতঘুমে অভ্যস্থ এই বাঙালি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ ওদের পাগল বললেও বাস্তবটা অনেকটাই রোমাঞ্চকর। যা আমাদের কাছে কিছুটা হলেও আঙ্গুর ফল টকের মত, যাহা অনস্বীকার্য।
কিছুটা এগোতেই ক্যাম্প গ্রাউন্ড। সোজা কথায় খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে ক্যানিয়নের কোলে রাত্রিবাস। পাশেই রয়েছে আর-ভি রাখার কিছু নির্ধারিত স্লট। অদূরেই রিম কেবিন। এক কি দুই বেডের ছোট্ট কেবিন। চওড়া শক্ত পাথরের দেওয়াল, কয়েকটা কাঠের জানলা। ভিতরে বিছানা, টেবিল, চেয়ার সবই আছে। বাথরুম, শাওয়ারেরও ব্যবস্থা চমৎকার। আপনার পছন্দের কেবিনটি অনায়াসেই অনলাইনে বুকিং করে ফেলতে পারেন। এলাকাটি অত্যন্ত নির্জন হলেও বেশ নিরাপদ। দু-পাশে লাল পাথরের রুক্ষতায় নিস্তব্ধ বাতাবরণ। হাল্কা মৃদু মন্দ বাতাস। জয়ের সুরে ‘অ্যাবি সেনের’ গানে রূপঙ্কর, শ্রেয়াকেও দারুণ মানিয়ে গেছে এই পরিবেশে। তাছাড়া পার্কে ঠিক ঢোকার আগেই আমাদের পেট পুজো সাঙ্গ... কাজেই সব কিছু প্ল্যান মাফিক।
ডালাস থেকে পালো ডুরোর দূরত্ব প্রায় চারশ মাইল, ঘন্টা ছয়েকের পথ। কাজেই দু-দিনের একটা ঝটিকা সফর যখন তখন নামিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। সেই ভেবেই কয়েকদিন ধরেই বুদ্ধির গোঁড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে একটা উইক এন্ডে রাস্তায়।
খুব ছোট্ট একটা নির্জন শহর চাইল্ডরেস। মাত্র হাজার ছয়েক লোকের বাস। হাইওয়ে ২৮৭তে ডালাস থেকে ঘন্টা চারেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় বেড়িয়ে এই নির্জন চাইল্ড্রেসে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালেই পালো ডুরোর রুক্ষতায় হারিয়ে যাবার প্ল্যান আগে থেকেই ভেঁজে রেখেছিলাম। রিম কেবিন ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথে চলছি ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অফ টেক্সাসের’ মধ্যে দিয়ে। সাধারণতঃ পালো ডুরোকে এই নামেই ডাকা হয়। প্রায় ২৭ হাজার একর জুড়ে লালচে পাথুরে রুক্ষ জমি, ছোট ছোট গাছের সারি আর অসংখ্য বুনো ঝোপ। ১৯৩৩ সালে ‘দি সিভিলিয়ন কঞ্জারভেশন কর্প’ নামে একটি সরকারী সংস্থা সাতটি গ্রুপ বা কোম্পানি তৈরি করে। তারপর এই প্রতিটি কোম্পানিতেই বেশ কিছু সংখ্যক মিলিটারি ভ্যাটারন আর অল্প বয়সী যুবকদের রিক্রুট করে দলবল-শুদ্ধু ‘পালো ডুরোতে’ পাঠিয়ে দেয়। বেশ কয়েকটি ভিজিটর সেন্টার, কেবিন, সেলটার, ভিউ পয়েন্ট, ব্রিজ, রাস্তা আর ট্রেইল বানানোর কাজ খুব দ্রুত গতিতেই শেষ হয়। কাজ চলতে থাকে আরও কয়েক বছর। যদিও এই পার্কের দরজা অফিসিয়ালি খুলে দেওয়া হয় জুলাই ৪র্থ, ১৯৩৪ সালে। গাড়ি চালাতে চালাতে এমনই কিছু তথ্য স্বাতীদের সামনে ঝেড়ে দিলাম।
- ‘কি রে খিদে পাচ্ছে... ও মা, এই তো খেলি’ – কানে এল মা-ছেলের ফুসর ফুসর। পায়োনিয়র অ্যাম্পিথেয়েটরে সামনে একটু দাঁড়িয়েছি। বিশাল পার্কিং লট প্রায় খাঁ খাঁ করছে। পিছনের উঁচু পাহাড় বেয়ে কয়েকজন উঠছেন। এরা ঐ উৎসাহীদের দলে।ওদের মত উঠা তো দূরের কথা, দেখেই আমার হাওয়া বেড়িয়ে গেল। চারপাশ বেশ মনোরম। মিষ্টি একটা রোদ পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নেমে আসছে। এই ফ্যান্সি চনমনে হাওয়ায় আর এই খাই-খাই পরিবেশে বারবার খিদে পেতেই পারে। বললাম – ‘একটু দাঁড়া, একটা আইসক্রিম সপ দেখেছি, এটা দিয়ে একটু ম্যানেজ কর তারপর দেখছি। আর তাছাড়া গাড়িতে তো এটা সেটা তো রয়েছে ঐগুলোই খা না।' বলা মাত্রই হঠাৎই মা-ছেলের চোখে মুখে পাহাড় বেয়ে নেমে এল এক সুন্দরী রোদের ঝিলিক। অ্যাম্পিথেয়েটারের ভিতরে ঢুকলাম। সামনেই প্রচুর দশর্ক আসন। আর ঠিক মধ্যিখানে একেবারে খোলা আকাশের নিচে একটি বিশাল মঞ্চ। পিছনে উঁচু লালচে পাহাড়ের ন্যাচেরাল ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু একেবারে জনশূন্য। আমাদের মত গুটিকয়েক লোকজন ঘুরপাক খাচ্ছেন। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে যে শো-এর দিন সন্ধ্যাবেলা ঠিক এখানেই কত মানুষের সমাগম। মানুষের ভীড়, কথাবার্তায় গমগম করতে থাকে এই থিয়েটার। প্রায় ৩০ জন অভিনেতা, শিল্পী, মিউশিয়ান নিয়ে এই চমৎকার মিউজিক্যাল ড্রামার সাক্ষী থাকেন অসংখ্য মানুষ। নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় পাহাড়ের কোলে পড়ে থাকা একাকী এই মঞ্চটি, কত ঘটনার নীরব সাক্ষীও বটে। এই মিউজিক্যাল শো দেখতে হলে আগে থেকে দিন-ক্ষণ দেখে অনলাইনে টিকিট কেটে নিতে পারেন, তাতে রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হতে পারে একই যাত্রায়।
পার্ক রোড ৫ ধরে একটু এগোতেই ডান দিকে ‘ওল্ড ওয়েস্ট স্টেবেলস’ নামে একটা জনশূন্য অফিস কেবিনের সামনে দাঁড়ালাম। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেলাম না। পার্ক অপারেটেড গাইডেড ট্যুর এখান থেকেই নিতে হয়। ঘোড়ার পিঠে চেপে নির্জন সরু জঙ্গলের পথে বেড়িয়ে আসার মজা পেতে হলে হাতে কিছুটা সময় রেখে অনলাইন বুকিং সেরে ফেলুন। কাছেই ট্রেডিং পোস্ট বলে একটা ছোট্ট দোকান। ক্যানিয়নের ভিতরে আমাদের মত ভবঘুরেদের সাময়িক বিশ্রামের আদর্শ জায়গা। সুভেনিয়র থেকে আরম্ভ করে গরম কফি, স্যান্ডুইচ, বার্গার, ড্রিঙ্কস সবই মিলল। আরও সব টুকিটাকি দ্রব্যসামগ্রী। কাউন্টারে অল্প বয়েসী মেয়েরা। প্রায় সকলেরই পড়াশোনার সাথে সাথে পার্টটাইম জব। সামনেই টেবিল জুড়ে একটা টিন-এজারদের গ্রুপ।গপাগপ স্যান্ডুইচ গিলছে আর তার সঙ্গে লম্বা কোকের স্ট্র-তে সুখটান। টেবিল জুড়ে বেপরোয়া হাসিঠাট্টা। বেরোনোর একটু আগে সনুকে বললাম – ‘অন্য কোন কাজকর্ম থাকলে এখানেই সেরে নে’। অর্থটা বুঝেই ‘ড্যাডি...’ বলে একগাল হাসি ওর।
পথে একে একে পড়ল চায়নাবেরী, ফোর্টট্রেস, জুনিপার, ক্যাকটাস, কাউ, মেস্কুইট, ঊলফবেরী ক্যাম্প গ্রাউন্ড। দৃশ্যপট মোটামুটি সব একই রকম। এই নির্জন, নিস্তব্ধ পরিবেশে ছুটি কাটাতে ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থাও একেবারে নিখুঁত। কাছেই একটা ছোট্ট নদী। দূরের পাহাড় আর হাওয়ার ফিসফিসানির মাঝে নদীর জলের মৃদু কল কল ধ্বনি। সাথে তাল রেখে মাথা নাড়ায় নাম না জানা গাছের সারি, কিছু পাখীর খোঁজ মিলল এ ডাল থেকে ও ডালে।
‘ওয়াইড ভ্যারাইটি অফ ওয়াল্ডলাইফ এর আদর্শ জায়গা হল এই পালো ডুরো, জানতিস এটা?’ - একটা বাদামের টুকরো গোঁফের তলায় ছুঁড়ে দিয়ে বিজ্ঞের সুরে বলে উঠি। ‘রিয়েলি!’ – সনুর চোখে বিস্ময়। ‘হু...হু...তবে আর বলছি কি, শোন মন দিয়ে।' ‘পালো ডুরো মাউসের নাম শুনেছিস?’ সটাং প্রশ্নটা ওকেই ছুঁড়ে দিলাম। চটপট জবাবও এল – ‘না’। রাস্তার বাঁক আর সাইনগুলোর দিকে নজর রাখতে রাখতে বলে উঠলাম - 'প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের মধ্যে পড়ে এই ‘পালো ডুরো মাউস। চেহারাতে একেবারে আমাদের দেশের নেংটি ইঁদুর। ভেবে দেখ, এদেশে নেংটি ইঁদুরও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের লিস্টে জায়গা পেতে চলেছে।' পিছন থেকে হাসির রোল উঠল।
'তা তোর এই নেংটি ইঁদুর প্রজাতিকে টেক্সাস প্যান-হ্যান্ডেলের মধ্যে এই পালো ডুরো আর আশেপাশের দু-একটা কাউন্টি ছাড়া দেখতে পাওয়া যায় না। জংগলের আর একটু গভীরে মিউল ডিয়ার, রোডরানার, বন্য টার্কি কিংবা কটনটেইলস এর সঙ্গে দেখা করে আসতে পারিস। আশা করা যায় ওদের আতিথেয়তায় কোন ত্রুটি থাকবে না। তবে আর বেশী না এগোনোই ভাল। তার কারণ হিসাবে ধরে নে, তোর সঙ্গী হতে চাইবে কয়েকটা হোয়াইট টেইল্ড ডিয়ার, দু একটা হিংস্র কায়েটিস কিম্বা ধর কিছু বারবেরী শিপ আর ববক্যাটের দল। অতি উৎসাহী রেকুনের দলের তোকে যদি একবার পছন্দ হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। তোর ঘাড়ে চেপেই জঙ্গল পরিক্রমা সেরে ফেলবে।' এবার থামলাম, কফিও শেষ। আমার অযাচতি ভাষণের ঠেলা সামলাতে ওরা দু-জনেই ব্যস্ত। সনুর কল্পনায় তখন ওর কাঁধে রেকুনের দল। ব্রেকে পা। সামনে একটা দারুণ ভিউ। পিছন থেকে সনু বলে উঠল - ‘লেটস গো, ড্যাডি, লেটস সী সাম আনিম্যালস’। হাতে অনেকটা সময়। তাড়া নেই। ধীরে সুস্থে ঘুরে ঘুরে দেখা যেতেই পারে। এদিকটাতে গাছের ডালে দুএকটা পাখীও নজরে পড়ল। বিভিন্ন প্রজাতির পাখীদেরও আড্ডা এই ক্যানিইয়নের জঙ্গলে। গোল্ডেন ফ্রন্টেড উডপিকারস, ক্যানিয়ন টোহইস আর রেড টেইল্ড হকস চোখে পড়লে তো আর কথাই নেই। ক্যামেরার খচখচানি বেড়ে যাবে। আড়াল থেকে রোড রানারের নজরদারী চলছে আমাদের ওপর। ফেরার পথে আমাকে শুনিয়ে সনুর ফাজলামি - ‘ইউ নো মামি, দিস ইজ আওয়ার সোশাল স্টাডি ক্লাস'... কন্ডাক্টেড বাই...।'
এই পালো ডুরোতে পাহাড় আর জঙ্গলের একটা সুন্দর সমন্বয় মানে একটা অ্যাট্মস্ফেয়ার রয়েছে।সাধারণতঃ হয় কি, অনেক পার্কেই ভ্রমনার্থীদের সুবিধার্থে এই নেচার্যাল ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।কালচারাল রিসোর্সটা বাঁচিয়ে রাখার অতটা তাগিদও থাকে না। তাছাড়া আরকিওলজিক্যাল-ই বলুন কিংবা প্যালিওন্টোলজিক্যাল - এই সাইটগুলো বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা এক কথায় অনস্বীকার্য।
ঘুরতে ঘুরতে সময় যেন কোথায় চলে যায়, পিছনের সারিতে তখন সারাদিনের ফেলে আসা অসংখ্য মুহূর্ত সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে। গাছের সারি, পিছনের পাহাড়, অজানা জঙ্গলের বাঁক, হাওয়ার ফিসফিসানি যেন বলতে থাকে আবার দেখা হবে। ফেরার পথে একটা সহজ ট্র্যাকিংও সেরে নিলাম। একটু হেঁটেই পাহাড়ের ফাটলে একটা অকৃত্তিম গুহা, উৎসাহী কয়েকজনের সঙ্গে পা মেলালাম। সনু সবার আগে। ওপর থেকে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগল নীচের সবুজ উপত্যকা। রুক্ষতা তখন উধাও। ছোট ছোট সবুজ গাছের সারি, দূরের লালচে পাহাড়, ছোট্ট নদীর জলে তার লালচে প্রতিচ্ছবি, ব্যস্ত রোডরানার ... আরও কত কি।
ম্যাক ডিক গ্রুপ প্যাভিলিয়ন এ ফেরার পথে ঢু মারলাম। কাদের একটা বিয়ে-থা হচ্ছে। অতিথি সমাগমে জমজমাট প্যাভিলিয়ন। সবাই সেজেগুজে হাজির। ইচ্ছে ছিল একবার ভিতরে উঁকি মারার। পার্কিং লটেই সিকিউরিটি। ট্রেস্পাসার্স আর নট অ্যালাউডেড। কাজেই আর দেরী না করে ওখান থেকে পাততাড়ি গোটালাম।
- ‘কি রে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অফ টেক্সাস কেমন লাগল।‘ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সনু পিছনের সিটে কাত মেরে।
- 'ইটস, নাইস ড্যাডি... অসাম... বাট উই ডিড নট সি এনি এনিম্যালস’ বলে নাকের ওপর নেমে আসা চশমাটা একবার উপর দিকে ঠেলে আবার গেমসে ঢুকে পড়ল সনু। 'অনেক হয়েছে বাবা, আর অ্যানিম্যাল দেখে না...' স্বাতীর মুচকি হাসি। সন্ধ্যা নামছে ক্যানিয়ন শহরের অলিতে গলিতে। যেখানে এখন শুধুই নিস্তব্ধতা। আমাদের গাড়িও এই অন্ধকার, নিস্তব্ধতা চিরে ফেয়ারভিউ এর পথে, আজ ওখানেই রাত্রিবাস।
পরদিন সকাল। তাড়া নেই, ঘুম ভাঙল একটু দেরীতে। সাধারণতঃ ঝটিকা সফরে চাপ থাকে, আমাদের তার ঠিক উলটো। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরতে বেরতে প্রায় এগারোটা। আজই ডালাস ফিরবো। ফেরার পথে ক্যাপ-রক ক্যানিয়নে একটু ঢুঁ মারব। রাস্তা ঘাট বড়ই নির্জন। একটা দুটো গাড়িও চোখে পড়ছে না। মাইলের পর মাইল ফাঁকা জমি, কিছুটাতে চাষবাস, কয়েকটাতে আবার ক্যাটেল ফার্ম। একটা বাঁকের মুখে সুন্দর একটা দোতালা বাড়ি নজরে এল, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল যে তার আশেপাশে অন্তত আর মাইল খানেকের মধ্যে কোন প্রতিবেশী নেই। স্বাতীকে ইশারায় বললাম – ‘ধর তোমাকে ওই বাড়িতে থাকতে বলা হল, কি করবে...?’। ও হেসে চোখ কপালে তুলে বলল – ‘পাগল!’।
পার্কে ঢুকে একটা নির্জন জায়গা দেখে দাঁড়ালাম।অভ্যর্থনায় এগিয়ে এল একটা স্লিম চেহারার রোডরানার। জিম ছাড়াই দিব্বি ছিপছিপে চেহারা। একটু দূর থেকেই আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। কাছেই বোর্ডে সাবধানবানী ‘বাইসন হইতে সাবধান’। দু-দিকে বিস্তীর্ণ ফাঁকা ঘাসের জমি। বাইসনদের মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্র। একটু এগিয়েই বাঁ দিকে ছোট্ট লেক ‘থিও’। শান্ত জলে দূর পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। পাশে ছোট্ট একটা ফিশিং ডেক। চেয়ারে বসে বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা, একটা হাতে ছিপ, আর অন্যটাতে বড় সাইজের একটা চকলেট কুকি। আমাদের দেখে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিল।
আমারিলো থেকে প্রায় একশ মাইল দঃ পূর্বে ব্রিস্কো কাউন্টির বুক চিরে এই ক্যাপ-রক ক্যানিয়ন। সাইজে পালো ডুরোর থেকে ছোট। প্রায় হাজার ১৫ একর জুড়ে রুক্ষ জমি, বাইসনের তৃণ-ভূমি আর পাহাড়-নদী। লেক পেরিয়ে রাস্তা ঘুরল ডান দিকে। - ‘ড্যাডি, সি প্রেইরি ডগস’ সনু খুব এক্সাইটেড। গাড়ি গেল থেমে। হনি ফ্ল্যাট ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের ঠিক পাশেই রাস্তার গা ঘেঁষে অসংখ্য কাঠবিড়ালি প্রজাতির প্রেইরি ডগস। রাস্তার গাঁ ঘেঁসে সমানে নাচন কোঁদন করছে। একটু হাওয়া খারাপ বুজলেই আবার গর্তের মধ্যে ধাঁ। ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। পথে পড়ল ওয়াইল্ড হর্স, লিটিল রেড টেন্ট, সাউথ প্রং টেন্ট ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। একই রকম, তফাৎ কিছুই নেই। অদূরেই বোর্ডে আপার ক্যানিয়ন ট্রেইল ম্যাপ। এই ট্রেইল ধরে তিন হাজার একশো ফুট উঁচুতে একটা ভিউ পয়েন্টে চলে যাওয়া যায়। তবে এখানে এক্সপেরিয়েন্স ম্যাটারস। প্রচণ্ড কষ্টকর ও অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল এই পথ। বিপদ ডাকে সংকীর্ণ খাড়াই, আর পায়ের তলায় ঝুড়ো লালচে পাথর। সনুকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম কিছুটা। পড়ল একটা শুকনো নদী, টুকরো টুকরো পাথর নদীর বুক জুড়ে। নাম সাউথ প্রং রিভার। পাহাড়ে হঠাৎ বৃষ্টি এলে এই পথে না হাঁটাই ভাল, আচমকা হড়কা বানের প্রবল সম্ভাবনা থাকে। নির্জন এই ট্রেইল-এ লোকজনের দেখা মেলা ভার। তবে এক ভদ্রলোকের দেখা মিলল। স্থুল চেহারা, ম্যাপ হাতে হন-হন করে হেঁটে চলেছেন। একাই এসেছেন অস্টিন থেকে। মিনিট দুয়েক দাঁড়ালেন, টুপি খুলে টাক মাথার ঘাম মুছে দু-একটা কথা সেরে আবার হারিয়ে গেলেন লালচে পথে। সামনেই উঁচু পাহাড়, আর তাকে আলিঙ্গন করতে একটুকরো কালো মেঘের অহেতুক দস্যিপনা। পড়ন্ত বিকেলের হাতছানি। তা ঐ অস্টিনবাবুটি মেঘের সাজসজ্জাকে পাত্তা না দিলেও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম – ‘সুবিধের ঠেকছে না রে, ঝড় বৃষ্টি আসার আগেই চল কেটে পড়ি, নইলে আবার ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। ’
- ‘নে এবার শুয়ে পড়।' ল্যাপটপটা সাটডাউন করে সনুকে বলে উঠলাম। ও প্রায় আমার ঘাড়ের ওপরই বসে, গত দু-দিনের গাদা-গুচ্ছের ছবি দেখে চলেছি দু-জনে। ছবিগুলোর মধ্যেই বেঁচে থাক আমাদের এই ঝটিকা সফরের কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতি। একটু আগেই বাড়ি ফেরেছি। ক্লান্তি জড়ানো চোখে ‘শুভ রাত্রি' জানিয়ে সবার আগে আমি চললাম আবার একটা ভোরের অপেক্ষায়। আবার যদি কাল কোথায় বেড়িয়ে পড়তে পারতাম, কি ভালই না হত!
ক্যানিয়ন ভিউ, পালো ডুরো
ক্যাম্প গ্রাউন্ড, পালো ডুরো
পালো ডুরো ক্যানিয়ন
ক্যাপরক ক্যানিয়ন
Comments
ইগুয়াসু ফলসের
কাহিনী
চৈতালি পুরকায়স্থ
ডালাস, টেক্সাস
ইগুয়াসু ফলসের দৃশ্য
ইগুয়াসু ফলসের দৃশ্য
আপনারা সকলেই গেছেন উত্তর আমেরিকার নায়েগ্রা ফল্স দেখতে। কেউ কি শুনেছেন দক্ষিণ আমেরিকার ইগুয়াসু ফল্স-এর কথা? যদি দেখতে যান আশ্চর্য হবেন, ভাববেন কেন নায়েগ্রা ফল্সকে বলে সবচেয়ে বড় ফল্স? ইগুয়েসু ফল্স এর সঙ্গে কোন তুলনাই হয় না নায়েগ্রার। জলপ্রপাত চলছে তো চলছেই প্রায় দুমাইল ধরে, শেষ খুঁজে পাওয়াই যায় না কোন। এবার বলি কেমন করে দেখার সুযোগ পেলাম।আমরা তিনজন - আমি, সুবীর এবং অনিল লাড (যিনি এসেছিলেন ভারত থেকে) রওনা হয়েছিলাম ব্রেজিল ও আর্জেন্টিনা অভিমুখে। সুবীর ও মিস্টার লাডের ছিল অফিসের কাজ ও বেড়ানো আর আমার ছিল শুধুই নতুন দেশ দেখার সখ।
আমাদের যাত্রা শুরু হল রিও ডিজেনেরো শহর থেকে। অপূর্ব সুন্দর শহর, মানুষকে মুগ্ধ করার মত। সেখানে দুদিন থেকে রওনা হলাম ইগুয়াসুফল্স এর পথে। আমাদের প্লেন যখন নামলো চারিদিকে ঝম্ঝম্ করে নেমেছে বৃষ্টি। ভাবলাম ছোট্ট এয়ারপোর্ট, প্লেন থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে, নিশ্চই ভিজে একসা হব। আমাদের অবাক করে দিয়ে চলে এল একটা ছোট ট্রাকের মত গাড়ী, গাড়ীর চালক নেমে পড়ে যাত্রীদের সকলকে দিতে লাগলেন একটা করে লাল রং এর ছাতা, এমন কি খুলে প্রত্যেকের হাতে এগিয়ে দিতেও ভুল হল না। আমি চমৎকৃত, এমন ব্যবহার কোন এয়ারপোর্টে কোনদিনও পাইনি!এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকে দেখলাম আমাদের গাইড মার্কো দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্যে। সে জানালো দুপুর হয়ে গেছে, সময় বেশী নেই, এক্ষুনি চল ফল্স দেখতে। আমরা চললাম ফল্স অভিমুখে। চারিদিক সবুজ, ফল্সকে ঘিরে রয়েছে ন্যাশানাল পার্ক।ফল্সের সৃষ্টি হয়েছে ইগুয়াসু নদী থেকে ব্রেজিল ও আর্জেন্টিনার সীমারেখায়।ব্রেজিলের দিক থেকে দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর, তাই আমাদের সেই দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মার্কো জানালো গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি চলছে তাই জল অনেক বেশী রয়েছে এখন।
যখন ফল্সের সামনে এসে পৌঁছোলাম বৃষ্টি তখনও থামেনি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখতে পেলাম ইগুয়াসু নদী কি আশ্চর্য ভাবে নেমেছে উঁচু থেকে নীচুতে। কি অপূর্ব দৃশ্য! প্রায় দু-মাইল ধরে জল নেমেছে বাঁ পাশে শ্বখুরাকৃতি হয়ে, তারপর নেমেছে উঁচু থেকে নীচুতে নানান স্তরে। এক স্তর নেমে কিছু দূর নদীর মত বয়ে আবার নেমেছে আর একটা স্তরে। পর পর কত যে ছোট -বড় জলপ্রপাত, মধ্যে মধ্যে রয়েছে গাছপালা। যেখানে নদীর মত অংশ সেখানে রয়েছে Cat walk অর্থাৎ কাঠের তৈরী সরু হাঁটার রাস্তা। Cat walk দিয়ে হেঁটে এসে পৌঁছোলাম জলের খুব কাছে। মনে হল এমন দৃশ্য তো নায়েগ্রাতে দেখিনি। সেখানে তো নৌকো বা জাহাজ নিয়ে জলের কাছে যেতে হয়! ইগুয়াসু সত্যিই অন্যরকমের জলপ্রপাত। যত দিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল, শেষ দেখতে পেলাম না কোন।
অশ্বক্ষুরাকৃতি অংশ
জলপ্রপাত ছাড়িয়ে কিছু দূরে ইগুয়াসু নদীর জল এসে মিশেছে পারানা নদীর সঙ্গে। পারানা নদীর ওপারে অন্য দেশ - প্যারাগুয়ে এই মিলনস্থলের খুব কাছে যেখানে একদিকে ব্রেজিল আর অন্যদিকে প্যারাগুয়ে, সেখানে তৈরী হয়েছে ইতাইপু ড্যাম। এইড্যাম তৈরী করেছিলেন ব্রেজিল ও ইটালীর ইঞ্জিনীয়াররা, কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তৈরী হয়েছিল বিশাল Hydroelectric power plant। ব্রেজিল ও প্যারাগুয়ে দুই দেশকে ভাগ করে নিতে হয়েছে electricityর অংশ। যদি আপনারা কখনও যান ইগুয়াসু দেখতে আরও দুই শহরের কথা মনে রাখবেন।ব্রেজিলের রিও ডিজেনেরো আরআর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসরিও ডি জেনেরোর প্রাকৃতিকসৌন্দর্য অবর্ণনীয়। আরবুয়েনস আইরেস, যাকেবলাহয় আমেরিকার প্যারিস, তার কাহিনীর শেষ নেই।আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম কবরস্থান দেখে। কিন্তু আমার মনকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দিয়েছিল ট্যাংগোনাচের জন্ম কাহিনী। সে কাহিনীর শুরু দূর দেশ থেকে আসা immigrant-দের জীবন এবং নিজেদের দেশকে ফেলে আসার দুঃখের ইতিহাস থেকে। যদি আপনারা জানতে চান পরে লিখতে পারি সে সব কথা।
Comments
ঐতিহ্যের শহর কিয়োতো
অরুন্ধতী ঘোষ
পিট্সবার্গ, ইউ এস এ
প্রাসাদ চত্ত্বরে
নাঞ্জেনজি জেন বৌদ্ধমন্দির
জাপানের দোশিশা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুমাসের জন্য পড়তে আমাদের মেয়ে গেছে জাপানে। একান্ত ইচ্ছা, তার পড়ার শেষে আমরা ঘুরে আসি। কিন্তু যাওয়া মানে তো হাজার ঝক্কি। হলই বা, মেয়ের ইচ্ছাপূরণ করতে এটুকু তো করতেই হয়।
অনেক পরিকল্পনা করে, পোষা কুকুর আর বেড়ালের ভরণপোষণের যথাযথ ব্যবস্থা করে আমরা স্বামী-স্ত্রী এয়ার কানাডার জাপানগামী প্লেনে চড়ে বসলাম। এই যাত্রায় আমার মাতৃদেবীও আমাদের সহযাত্রী। গন্তব্যস্থল – কিয়োতো শহর। অনেক লম্বা পথ (প্রায় ১১০০০কিমি)। ওসাকার কেনসাই এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম,- তখন রাত আটটা। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে চড়ে রাত নটায় কিয়োতোর হোটেলের লবিতে পৌঁছে গেলাম। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল মেয়ে - দেখে দৌড়ে এল। আশ্চর্য লাগলো হোটেলের রোবট দারোয়ানকে দেখে- জাপানী ভাষায় সে যে কত কি বলে গেল! একবর্ণ বুঝলাম না, শুনতে কিন্তু ভালই লাগল।
হোটেলে মালপত্র রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম খেতে। আশেপাশেই অনেক খাবার জায়গা- রামন নুডল (জাপানে ফাস্ট ফুড), টেম্পুরা, ইত্যাদি। আমরা একটা রামনের জায়গায় ঢুকলাম। কাউন্টারের সামনে খাবার ব্যবস্থা। মেয়ে জাপানীতে খাবারের অর্ডার দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এসে গেল ধূমায়িত পাত্রে মাছের ব্রথে রামন নুডল, অল্প সবজি, তাতে একটা আধসিদ্ধ ডিম ভাসছে (এটাই প্রথা)। খিদের মুখে খেতে ভালই লাগল। আমাদের হোটেল সিজো স্ট্রিটের (একটি অন্যতম প্রধান রাস্তা) পাশেই। এখানে বলে রাখি কিয়োতোর সবথেকে আকর্ষণীয় রাস্তা কাওরামাচি, সিজো, তেরামাচি আর সিন-কিওগোকু (দোকানপাট, ক্লাব ইত্যাদি)।
পরের দিন সকালে দ্রষ্টব্য কামো-গায়া নদীর পাশে রাজপ্রাসাদে (কিয়োতো গিয়োয়েন)। ১৩৩১-১৮৬৪ অবধি এই প্রাসাদটি ছিল সম্রাটের বাসস্থান- এরপরে অবশ্য টোকিও তে স্থানান্তরিত হয়। বহু সংস্করনের পর বর্তমান প্রাসাদটি তৈরী হয় ১৮৫৫ সালে। একঘণ্টার গাইডেড ট্যুর থাকা সত্ত্বেও আমরা নিজেরা প্রাসাদটিকে ঘুরে দেখবো বলে মনস্থির করলাম। গেট পেরিয়ে প্রাসাদ চত্বরে ঢুকে পড়লাম- সংলগ্ন বাগানটি দেখবার মতো- একদিকে পাইনগাছ ও হিগাসিয়ামা পাহাড়, অন্যদিকে রাজপ্রাসাদ এখনো শান্তিপূর্ণ হেইয়ান সাম্রাজ্যর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আমার মা খানিকক্ষণ ঘুরে ক্লান্তি বোধ করলে, তাঁকে বাগানে গাছের ছায়ায় বসিয়ে আমরা তিনজনে বাকিটা ঘুরে দেখলাম। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে মেট্রো চড়ে আমরা এলাম নিশিকি বাজারে। সিজো স্ট্রিটের উত্তরে একটি গলিতে অবস্থিত বাজারটিতে সবচেয়ে উন্নতমানের রান্নার উপকরণ পাওয়া যায়। আমাদের সবথেকে ভালো লাগলো নানারকমের খাদ্যদ্রব্য যেভাবে সাজিয়ে দোকানিরা বিক্রি করছে তা দেখে। সব ই সুন্দর প্যাক করা-নানারকমের মাছ, সবজি, স্যালাড উপকরণ, পিকলস্ ইত্যাদি। দোকানিরা সামনে দাঁড়িয়ে সুর করে ডেকে ডেকে বিক্রি করছে। এখানে কায়সেকি (কিয়োতো অঞ্চলের রান্নার স্টাইল) সেফরা বাজার করতে আসেন। এছাড়াও আশেপাশের গলিতে অনেক স্থানীয় শিল্পকলার দোকান-হাতপাখা, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ- ছোট-বড়, বৌদ্ধ জপমালা, পোশাকের মধ্যে য়ুকাতা (সুতির কিমোনো) ইত্যাদি। আমরা তিন-প্রজন্ম ভালোই টুকটাক বাজার করে নিলাম। মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছি অল্পবয়সী মেয়েরা দলবেঁধে য়ুকাতা পরে মাথায় ফুল গুঁজে গল্প করতে করতে চলেছে। বেশির ভাগ লোক জনের ওয়েস্টার্ন পোশাক (পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে)। মেয়ের কাছে জানলাম যে এখন জুলাই মাস- এখানে গিয়ন উৎসব - তাই লোকে য়ুকাতা পরেছে।
গিয়ন উৎসব কিয়োতোর সবচেয়ে বড় ও পুরোনো উৎসব। আগেকার দিনে রোগের প্রকোপ, খরা, বন্যা ইত্যাদি থেকে উদ্ধারের জন্য স্থানীয় লোকেরা তাদের অঞ্চলের দেবদেবীর (বৌদ্ধ বা সিন্তো বা দুইই) কাছে সাহায্য চাইত এই উৎসবের মাধ্যমে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বংশানুক্রমে তাদের এলাকার দেবতাকে সুসজ্জিত কাঠের উঁচু ঠেলাগাড়িতে বসিয়ে দড়ি দিয়ে টানতে টানতে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যায়। এর জন্য অনেক উদ্যম, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম লাগে। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন হোটেলে ফেরার পথে সিজো স্ট্রিটে দশটি বিভিন্ন অঞ্চলের শোভাযাত্রা দেখার। পুরুষরাই বেশি-সবাই য়ুকাতা পরেছেন, বাচ্চারাও আছে। শোভাযাত্রা খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে এগিয়ে চলল।
পরের দিন “দার্শনিকের পথ” দেখতে গেলাম। অদ্ভুত নাম না? কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রী নিশিদা কিতারো এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতেন রোজ -তাই রাস্তার এই নাম। এই রাস্তাটি একটি নয়নাভিরাম চেরীগাছ পরিবেষ্টিত ক্যানালের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে পূর্বদিকে হিগাসিয়ামা পাহাড় থেকে গিংকাকুজি হয়ে দক্ষিণদিকে নিয়াকিওজি জিঞ্জা অবধি চলে গেছে- মাঝে নাঞ্জেনজি সংলগ্ন রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমরা নাঞ্জেনজি থেকে গিংকাকুজি পর্যন্ত গেছিলাম। রাস্তার ধারে ধারে সুন্দর ছোটো ছোটো বাড়ি, কাফে, খাবারের ও বিভিন্ন শিল্পকলার দোকান। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে গাছের নিচে বেঞ্চি পাতা- দুদণ্ড বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য। কিয়োতোর প্রধান পাঁচটি জেন মন্দিরের একটি নাঞ্জেনজি জেন বৌদ্ধমন্দির। মন্দিরের বিশাল দুতলা গেটটি তৈরী হয়েছিল ওসাকা প্রসাদের অবরোধে নিহত সৈন্যদের স্মরণে। গেট পেরিয়ে ভিতরে তিনটি উপ-মন্দির- কন্চি ইন, তেন্জু ইন (সুন্দর শুষ্ক বাগান ও সবুজ বাগান) এবং নাঞ্জেন ইন। এখানে বলে রাখি- ‘শুষ্ক বাগান’ হল জেন বৌদ্ধধর্মের এক বৈশিষ্ট্য। বাগান মূলত বালি, পাথর দিয়ে সাজানো। বালির ওপরে লাইন টানা -কোথাও লম্বা, সমান্তরাল কোথাও বৃত্তাকার। খুব ভোরে উঠে জেন সন্ন্যাসীরা নিজে হাতে এটি করেন। বালির মধ্যেমধ্যে বিভিন্ন আকার ও আয়তনের পাথর বসানো। জেন বৌদ্ধদের বিশ্বাস বাগান শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার জন্য নয়, এটি আত্মনিমগ্ন হবার স্থান। তাই এরা সীমিত জায়গার মধ্যে অতি সামান্য উপকরণ দিয়েই বিশালতা আনার প্রচেষ্টা করেন যা হয়ে ওঠে অসামান্য। এই ‘সীমার মাঝে অসীমের’ সুর বাজানোর প্রচেষ্টা সত্যিই অনবদ্য। প্রতি বছর দেশ, দেশান্তর থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন এই বাগান দেখতে।
নাঞ্জেনজি দেখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে আমরা পৌঁছলাম গিংকাকুজি বা সিলভার প্যাভিলিয়নে। তাঁর পাহাড়ের ওপর ধর্মচিন্তার আবাসস্থল হিসেবে এটি নির্মাণ করেছিলেন আশিকাগা দলপতি ইয়োশিমাসা (১৩৫৪-১৪০৪)। নিজের পিতামহের (কিংকাকুজির প্রতিষ্ঠাতা) প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মনস্থির করেন গিংকাকুজি রুপোর পাতে মুড়ে দেবেন। কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাওয়ায় কাজ বন্ধ রাখতে হয়। ইয়োশিমাসার মৃত্যুর পর বাসস্থানটি মন্দিরে পরিণত হয় কিন্তু রুপোর পাত আর লাগানো হয় নি। প্যাভিলিয়নের প্রথমতলা বাসস্থান, দ্বিতীয়তলা প্রাথর্নাকক্ষ। সংলগ্ন শুষ্ক বাগানটি বিশেষ দ্রষ্টব্য। কিছুক্ষণ বসে থাকলে মন শান্ত হয়ে যায়। এছাড়াও আছে সবুজ বাগান- ঘুরে বেরানোর জন্য। বাগানে সাদা পাথর বসানো হয়েছিল রাতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হবার জন্য। এটি প্রকৃতি নির্জনে ধর্মচিন্তার আদর্শ জায়গা।
এরপর গন্তব্যস্থল কিংকাকুজি বা গোল্ডেন প্যাভিলিয়ন। আমাদের মতো পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ইয়োশিমাসার পিতামহ ইয়োসিমাত্সু তৈরী করেন তাঁর অবসর বাসস্থান হিসেবে। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তাঁর উত্তরসূরিকে সাম্রাজ্য দিয়ে এবং কিংকাকুজি সমাপ্ত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর গুরু সোসেকি এর প্রধানপদে নিযুক্ত হন। গাছের ছায়ায় ঢাকা পথ দিয়ে মন্দিরের প্রবেশপথ পেরিয়ে একটি সুন্দর বাগানের পাশেই সোনার পাতে ঢাকা মন্দিরটি বিশেষ নজর কাড়ে। বাগানে পুষ্করিণীর জলে সোনার মন্দিরের ছায়া বিশেষ দ্রষ্টব্য। এখানে একটি বাড়িতে আমরা জাপানি প্রথায় চা পান করলাম। ভিতরে ঢুকে জুতো ছেড়ে, একটি ঘরে তাতামি ম্যাটের ওপর বসলাম। একজন মহিলা কিমোনো পরে চা পরিবেশন করলেন। সবুজ মাচা চা, সংগে মিষ্টি।
৭৯৪ সালে কিয়োতোতে রাজধানী স্থানান্তরিত হবার পর শহরের দক্ষিণে এর প্রধান প্রবেশপথের দুপাশে দুটি বিশাল মন্দির স্থাপিত হয়- পূর্বদিকের মন্দিরটি হল অধুনা তোজি মন্দির, আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য। পশ্চিমদিকের মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কালের নিয়মে। কুকাই ছিলেন শিনগন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী। ৮২৩ সালে
সম্রাট সাগা তাঁকে এই মন্দিরের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। তোজি মন্দির এখনো শিনগন বৌদ্ধদের হেড-কোয়ার্টার। শিনগন বৌদ্ধরা তান্ত্রিক বৌদ্ধ। এরা বিশ্বাস করে নির্বাণলাভ সম্ভব জীবনে প্রকৃত শিক্ষা এবং দেহ, মন ও বাক-সংযমের সাহায্যে।
তোজি মন্দিরে ঢুকলেই প্রথমে কন্ডো বা প্রধান কক্ষ। কাঠের একটি বিশাল বাড়ি। ভিতরে বুদ্ধ (ইকুশি নোরাই), এঁর হাতে পথ্য- যা দয়া ও ক্ষমা দিয়ে মানুষের শরীর, মন কে সারিয়ে তোলে। কোডো- ভাষণ কক্ষ, এটিও কাঠের। ভিতরে গিয়ে মন শান্তিতে ভরে গেল। একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষ- তার ভিতরে বিশাল বড় বাতি জ্বলছে -তাতেই বেশ দেখা যাচ্ছে। স্টেজের উপর বুদ্ধ এবং তাঁর সহচররা রয়েছেন মন্ডলার আকারে।
২১টি মূর্তি দিয়ে মন্ডলা তৈরী হয়- মাঝখানে বুদ্ধ, দুইপাশে দুই বোধিসত্ত্ব (যাঁরা নির্বাণলাভ না করে মানুষের সেবার জন্য নিযুক্ত), আটজন মিয়ো বা বিচক্ষন রাজা- যাঁরা জনগণকে কঠোর সংযমের সাহায্যে পরিচালিত করেন, দশজন তেন্বু বা রক্ষক- যাঁরা বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও মিয়োদের রক্ষা করেন। স্টেজের সামনে বেঞ্চি পাতা- বসে প্রার্থনা করার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। স্বল্প আলোয় প্রায় ফাঁকা ঘরে মন্ডলা এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মূর্তিগুলিও অসামান্য। কন্ডো থেকে বেরিয়ে গেলাম প্রাচীন পাঁচতলা প্যাগোডা দেখতে। কাঠের তৈরী এই সুবিশাল (১৮৭ ফিট উঁচু) প্যাগোডার সামনে কিছুক্ষণ মাথা নত করে সেই অজানা স্থপতিদের মনে মনে প্রণাম জানালাম যাঁরা এই বিশাল কীর্তি রেখে গেছেন।
তোজি মন্দিরের উত্তরে কিয়োতো স্টেশনের কাছে আছে আরো দুটি বৌদ্ধমন্দির- নিশি (পূর্ব) হোংগান্জি এবং হিগাসি (পশ্চিম) হোংগান্জি। নিশি হোংগান্জি আগে তৈরী করেছিলেন সম্রাট তয়োতমি হিদেহসি বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত জোডো-সিন্সু উপসম্প্রদায়ের জন্য। ভিতরে আছেন আমিডা বুদ্ধ- যাঁকে আমরা বলি “তথাগত বুদ্ধ”। অন্যদিকে হিগাসি হোংগান্জি তৈরী হয়েছিল পরে তোকুগাওয়া দলপতি লেয়েসুর নেতৃত্বে। এখানকার বৈশিষ্ট্য হল ভক্তদের দান করা মাথার চুল দিয়ে দড়ি বানিয়ে মন্দির তৈরীর কাজে ব্যবহার হয়। এখনও এই দড়ি মন্দির মেরামতের কাজে ব্যবহার হয়। দুটি মন্দির ই বেশ ভাল লাগলো আমাদের।
এতক্ষণ বৌদ্ধমন্দিরের গল্প বলছিলাম। এবার বলব শিন্তো মন্দিরের কথা। ফুশিমি ইনারি শিন্তো মন্দির। কিয়োতো স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেন ধরে দু স্টেশন পরে জে আর ইনারি স্টেশন-এর খুব কাছেই এই মন্দির। জাপানের অন্যতম প্রধান শিন্তো মন্দিরের মধ্যে একটি। ৭১১ সালে তৈরী এই মন্দিরটি ধানের দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গিত হয়। আগেকার দিনে ধান বা চাল দিয়ে কর দিতে হত। সেইজন্য ব্যবসায়ীরা এখানে আসত উন্নতি এবং অর্থাগমের জন্য পুজো দিতে। এখনও মানুষ আসে – উদ্দেশ্য - ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা। আমরা হাত ধুয়ে মন্দিরে ঢুকলাম। বিভিন্ন রকমের পুজো দেবার
গিয়ন উৎসব - বিভিন্ন অঞ্চলের শোভাযাত্রা
হোটেলের সম্মুখভাগ
ব্যবস্থা, দামও আলাদা। ভগবানের সামনে তিনবার হাতে তালি দিয়ে প্রণাম করার নিয়ম। চোখে পড়ল আশেপাশে শিয়ালের মূর্তি-গলায় লাল বিব্ বাঁধা। শিয়াল এই দেবীর অনুচর-এদেশের মানুষ মনে করে যে বিব্-এর মধ্যে শস্যভাণ্ডারের চাবি আছে। মন্দিরের পিছনে প্রায় আড়াই কিলোমিটার রাস্তা পাহাড়ের উপর উঠে গেছে। ১০,০০০ লাল তোড়ন দিয়ে রাস্তা ঢাকা। অভূতপূর্ব অনুভূতি হল- কারণ এই রকম তোড়ন ঢাকা রাস্তা আমরা কখনো আগে দেখিনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর দানে নির্মিত তোড়ন ঢাকা পথে পাহাড়ের উপরে উঠে আমরা আবার কিয়োতো শহরকে নতুন করে দেখলাম। পথে জাপানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের দেখলাম।
জাপানীরা জন্মসূত্রে সবাই শিন্তো কিন্তু এদের জীবনে বৌদ্ধধর্ম ঢুকে গেছে কারণ দীর্ঘদিন ধরে জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য রয়েছে। আবার বর্তমান প্রজন্ম খৃষ্টধর্মের রীতিনীতিকে মেনে চলছে। তাই এরা জন্মায় শিন্তো হয়ে, বিয়ে করে খৃষ্টমতে আর মৃত্যুকালে সৎকার হয় বৌদ্ধমতে। বেশিরভাগ লোক জাপানেই থাকতে পছন্দ করে। সবাই চুপচাপ, জোরে কথা বলে না, ঝগড়া-ঝাঁটি তো দূরের কথা। এদেশে জাপানী ভাষাই চলে, কিন্তু ট্যাক্সিচালক, ট্রাফিক পুলিস, কনভেনিয়েন্ট স্টোরের কর্মী -সবাই ইংরেজি বলতে পারে। তবে বিদেশী যদি জাপানী ভাষায় কথা বলে তবে আন্তরিক ব্যবহার পাওয়া যায়। কনভেনিয়েন্ট স্টোরে দু-তিন টি করে এ টি এম মেশিন থাকে- যা আমাদের মতো পর্যটকদের পক্ষে খুব সুবিধাজনক।
যাদের কাছে জাপান-মানে বহুতল বাড়ি, সাঁ সাঁ করে ছুটে চলা গাড়ী, বুলেট ট্রেন, ঝাঁ চকচকে এক দেশ, কিয়োতো তাদের জন্য নয়। কিয়োতো শহর আধুনিক শহর, কিন্তু এখনও প্রাচীন রাজধানীর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। তার চিহ্ন সর্বত্র বর্তমান,- এদের পুরোনো কাঠের বাড়ি, প্রাসাদ, প্রাচীন শিল্পকলার দোকান, রাস্তায় য়ুকাতা পরা মহিলা-পুরুষ এবং অসংখ্য বৌদ্ধ ও শিন্তো মন্দিরে। বহুতল বাড়ি এখানে তুলনামূলক ভাবে কম। কিয়োতো শহরে কাঠের বাড়ির প্রচলন বেশী, রাজপ্রাসাদ, মন্দির সবই কাঠের তৈরী। কিন্তু এর জন্য তাদের মূল্য দিতে হয়েছে, অনেক বিপদ এসেছে। বারংবার গোটা শহর পুড়ে গেছে, আবার সব নতুন করে তৈরী হয়েছে- প্রাসাদ, মন্দির সব- অবিকল আগের মতো। এর থেকেই বোঝা যায় এই শহরের মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে কতটা দৃঢ়সঙ্কল্প। তাই তো কোনো প্রাসাদ, মন্দির দেখলে মনে হয় পুরোনো দিনের জাপানে ফিরে গেছি। ঐতিহ্যের সৌন্দর্যের প্রতি এদের নিষ্ঠা সত্যিই বিস্ময়কর। মনে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের জাপান যাত্রী -র একটি অংশ-
“জাপান আপনার ঘরে বাইরে সর্বত্র সুন্দরের কাছে আপন অর্ঘ নিবেদন করে দিচ্ছে। এ দেশে আসবা-মাত্র সকলের চেয়ে বড়ো বাণী যা কানে এসে পৌঁছয় সে হচ্ছে, “আমার ভালো লাগল, আমি ভালোবাসলুম।” এই কথাটি দেশসুদ্ধ সকলের মনে উদয় হওয়া সহজ নয়, এবং সকলের বাণীতে প্রকাশ হওয়া আরো শক্ত। এখানে কিন্তু প্রকাশ হয়েছে। প্রত্যেক ছোটো জিনিসে, ছোটো ব্যবহারে সেই আনন্দের পরিচয় পাই। সেই আনন্দ ভোগের আনন্দ নয়, পূজার আনন্দ। সুন্দরের প্রতি এমন আন্তরিক সম্ভ্রম অন্য কোথাও দেখি নি। এমন সাবধানে, যত্নে, এমন শুচিতা রক্ষা করে সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে অন্য কোনো জাতি শেখে নি। যা এদের ভালো লাগে তার সামনে এরা শব্দ করে না। সংযমই প্রচুরতার পরিচয় এবং স্তব্ধতাই গভীরতাকে প্রকাশ করে, এরা সেটা অন্তরের ভিতর থেকে বুঝেছে। এবং এরা বলে, সেই আন্তরিক বোধশক্তি বৌদ্ধধর্মের সাধনা থেকে পেয়েছে।”
অনেক কিছু লিখলাম, আবার অনেক কিছু না লেখা রয়ে গেল। সবচেয়ে যা বেশী শিখলাম,-‘ সুন্দরের প্রতি এমন আন্তরিক সম্ভ্রম’। ফিরে এলাম মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে যা দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেয়।
রাস্তায় খাবার দোকানের সম্মুখে
তোজি মন্দির - শিনগন বৌদ্ধদের
হেড-কোয়ার্টার।
Comments
ইংকাদের দেশ
পেরু
চৈতালি পুরকায়স্থ
ডালাস, টেক্সাস
বর্তমানের মাচু পিচু শহর
পেরু ইঞ্জিনিয়ারিং
এবার আপনাদের বলি দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর পশ্চিমে পেরু দেশের কথা। ইংকা সম্রাট পাচাকুতির কাহিনী। দক্ষিণ আমেরিকার ইংকা সাম্রাজ্যের কথা আপনারা সকলেই শুনেছেন। পেরু দেশের কুস্কো শহরে ছিল ইংকাদের রাজধানী। যদিও তাদের রাজত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদিকে। ১১ হাজার ফুট উঁচু আন্দিজ পর্বতমালার উপত্যকায় কুস্কো শহর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে পুরাতন শহর।
বর্তমানের মাচু পিচু শহর
দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের বসবাস অনেক হাজার বছর ধরেই। ইংকাদের পূর্বে দু-হাজার বছর ধরে অন্যান্য সভ্যতার কথাও শোনা যায়। ইংকাদের সভ্যতা ৭০০ বছরের পুরনো। তাদের রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন পাচাকুতি। আমরা তাঁর মূর্তি দেখতে পেলাম শহরের কেন্দ্রস্থলে। ইংকারা ছিল খুবই উন্নত, তবে তাদের পূর্বসূরিদের অনেক অবদান ছিল, সন্দেহ নেই। জানা গেছে যে এদের পূর্বপুরুষরা এসেছিল চীন দেশ থেকে।
ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা যখন এদেশে এসে পৌঁছোয় তখন ইনকা সম্রাট পাচাকুতির মৃত্যু হয়েছিল। সম্রাটের দুই রাণীর দুই পুত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল রাজত্ব নিয়ে। তাদের মধ্যে এক রাজপুত্র স্প্যানিশদের ডেকে নিয়ে এল ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধে সাহায্য পাবার জন্যে। ফলে খুব সহজে কুস্কো শহর অধিকার করে নিল স্প্যানিশদের দলনেতা ফ্রান্সিস্কো পিজারো, অতি অল্প সৈন্য নিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত রাজত্বটাই চলে গেল তাদের দখলে! প্রথম দিকে স্পেনের রাজার শাসনে চলত এদেশ। তারপর স্বাধীনতা আসে ১৮৩১ সালে। পেরু পরিণত হয় স্বাধীন রাষ্ট্রে।
পেরুতে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ২০১১ সালে, এপ্রিল মাসে। আমার স্বামী সুবীর ও আমাদের বন্ধু বন্দনা চ্যাটার্জীর সঙ্গে যাত্রা শুরু হল আটলান্টা এয়ারপোর্ট থেকে, পেরুর রাজধানী লিমা অভিমুখে। এসে পৌঁছলাম প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে লিমা শহরে। এলাম ম্যারিয়ট হোটেল এ যেখানে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করা ছিল। ১৫ তলার ওপর আমাদের ঘর, সামনে অপূর্ব দৃশ্য, সমুদ্র এবং সমুদ্রতীরের। সামনে যে বাগানটি দেখা যাচ্ছিল তার তলা দিয়ে নীচের level এ রাস্তা নেমে গেছে, যেন তলার রাস্তাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে বাগান দিয়ে। অর্ধ গোলাকৃতি সমুদ্র, নানারকম গাছ, ক্যাকটাস ধরনের ফুল এবং সমুদ্রতীর পাহাড়ি। চারিদিকের দৃশ্য এত সুন্দর যে মনে হল এখানে যদি কটা দিন থাকা যেত! কোথাও কোথাও উঁচু চূড়া তুষারাবৃত। কুস্কোতে বেশীরভাগ লোকের চেহারা দেখলাম অন্যরকম। লিমা শহরে লোকেদের দেখে মনে হয়েছিল
এরা ইউরোপিয়ান। কিন্তু এখানকার লোকেদের চেহারার সঙ্গে ভারতবর্ষের পাহাড়ি অঞ্চলের লোকেদের চেহারার খুব মিল দেখলাম। তাদের হাঁটা চলা, কথাবার্তা সবই যেন অন্যরকম। শুনলাম এখানকার ৬০% লোকেদের মধ্যে স্প্যানিশ ও ইংকাদের মিশ্রণ রয়েছে। সত্যিকারের ইংকা যারা এখনও, তারা মাত্র ৫%। কুস্কো শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি হোটেলে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল ট্যাক্সিচালকটি। দেখে মনে হল এ যেন একটা বাড়ী, তাকে করা হয়েছে হোটেল। নীচে একটা উঠোন, ছোট্ট একটা ফোয়ারা সেখানে, আর বারান্দার মধ্যে করা হয়েছে অফিস। দেখে বেশ ভালই লাগলো।
ঘরে গিয়ে বিশ্রামের পর আমরা হেঁটে শহর দেখতে বেরলাম। কেন্দ্রস্থলে একটা বড় গির্জা, ঠিক যেন ইউরোপের একটি ছোট পুরাতন শহর, খুব খোলামেলা। রাস্তা ঘাট পাথরের তৈরি। এ অংশ তৈরি করেছিল স্প্যানিশরা। শুনলাম খুব কাছেই রয়েছে ছোট একটি গির্জা, তার নীচে আবিষ্কার হয়েছে ইংকাদের তৈরি একটি মন্দির। অর্থাৎ স্প্যানিশরা এসে মন্দিরের ওপর দিয়ে গির্জা তৈরি করেছিল। আমরা দেখতে গিয়ে জানলাম গির্জাটি বন্ধ, দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য হল না দেখা। পরে জানলাম বড় গির্জাটিও তৈরি হয়েছিল ইংকাদের রাজপ্রাসাদ ভেঙ্গে, তার ওপর। এই শহরের আশে পাশে রয়েছে ইংকা রাজত্বের অনেক ধ্বংসাবশেষ। এক জায়গায় মৃতদেহ রাখা হত, ঠিক যেমন মিশরে প্রচলিত ছিল। রাত্তিরে আমরা পায়ে হেঁটে হোটেলের কাছেই একটা রেষ্টুরেন্টে গেলাম খেতে। সেখানে দেখি তিনজন পেরুভিয়ান ছেলে বাজনা বাজিয়ে গান গাইছে। আমরা আসলে ভারতবর্ষের লোক জেনে তারা খুব খুশী হল। বলল আমরা
তোমাদের শাহরুখ খানের খুব ভক্ত, তার সব সিনেমা দেখি। আমরা হিন্দী গানও জানি। বলে সত্যিই বাজনা বাজিয়ে একটা হিন্দী গান গেয়ে শুনিয়ে দিল। আমরা তো অবাক, জানতাম না দূর বিদেশে হিন্দী গান আর সিনেমার এত জনপ্রিয়তা! দেখলাম waitress-দের ব্যবহার চমৎকার, আমাদের কত যত্ন করে খাওয়ালো! এমনটা সত্যিই আশা করিনি! কিন্তু আমাদের টিকিট কাটা ছিল। তাই পরের দিন রওনা হতে হল পুরনো রাজধানী কুস্কো অভিমুখে। ১১ হাজার ফুট উঁচুতে এই শহরকে ঘিরে রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালা। পরদিন সকালে ইংকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর মাচুপিচু দেখার জন্যে রওনা হলাম গাড়ী নিয়ে।মাচুপিচু শব্দের ইংরাজি অনুবাদ হল ‘The Great Peak’। এ শহর তৈরী হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে সম্রাট পাচাকুতির রাজত্বকালে। পাহাড়ের ওপর এক দুর্গম অঞ্চলে। ছোট্ট শহর, বাড়ীগুলো তৈরি হয়েছিল পাথরের টুকরো দিয়ে। পাথরের টুকরো বয়ে আনত ইলামারা। ইলামা হল এ অঞ্চলের এক জন্তু, যাদের গা লোমে ভরা। পাহাড়ি অঞ্চলের শীতের উপযুক্ত তারা। শহরের বাসিন্দা ছিল শিক্ষিত ও বিত্তশালী লোকেরা। আর থাকত তাদের বাড়ী যারা দেখাশুনো করত তারা। পাহাড়ের অংশ কেটে ক্ষেত করা হত। পাহাড়ের ওপর যে রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়ে ছিল তা ছিল উন্নত মানের। আশ্চর্য হতে হয় দেখে যে পাথরগুলোকে দেওয়ালের গায় এমন করে বসানো হত যে ভূমিকম্প হলেও কোন বাড়ী ভেঙ্গে পড়তো না! এ যুগের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের মানাতো ইংকারা। এমনকি নদীর ওপর দিয়ে সেতুবানাতেও জানত তারা, মোটা দড়ির সাহায্য নিয়ে।
এরপর হল স্পেনের লোকেদের আগমন। কুস্কো শহর অধিকার করে নিল তারা। ইংকারা বুঝতে পারছিল তাদের এমন সাধের শহর চলে যাবে শত্রুদের হাতে। তাই তারা এ শহরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল অন্যান্য শহর থেকে। এখানকার অধিবাসীরা যে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না! বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত শহরের ওপর নতুন নতুন গাছপালার আগমন শহরটাকে লুপ্ত করে দিল সভ্যতার থেকে!
অনেক বছর পরে ১৯১১ সালে হিরাম বিংহাম নামে এক আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক এই শহরকে আবিষ্কার করলেন একটি ছোট ছেলের সাহায্য নিয়ে। তারপর শুরু হয় খননকার্য। অনেক চেষ্টায় ফিরিয়ে আনা হয় ভগ্ন শহরটিকে।
আমাদের গাড়ী এসে পৌঁছোল একটা ট্রেন স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেন নিয়ে রওনা হলাম মাচু পিচুর পথে। ট্রেন চললো উরুবাম্বা নদীর ধার দিয়ে। অনেক পাহাড়, উপত্যকা এবং গ্রাম পেরিয়ে কুস্কোর চেয়ে দু হাজার ফুট নীচুতে বর্তমানের মাচু পিচুতে এসে পৌঁছলাম।
অবাক হবার মত শহর! উঁচু খাড়া পাহাড়ের গায়ে এমন শহর যে কেমন করে তৈরি করেছিল ইংকারা, কে জানে! এখনও ঠিক আগের মতই রয়েছে সূর্য মন্দির, যেখানে দিনের বিশেষ সময়ে এক উঁচু পাথরের চূড়ার ছায়া দেখে বৈজ্ঞানিকরা বুঝতে পারত সূর্য এখন পৃথিবীর কোন গোলার্ধে আছে। আমাদের ছেলেমানুষ গাইডের খুব উৎসাহ তাদের শহরটাকে ভাল করে দেখাবার জন্যে। আমি ভাঙ্গা চোরা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে চাচ্ছি না দেখে সে নিয়ে গেল নীচু দিয়ে একটি অংশে, সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে শহরটি। দেখলাম বসে আছেন কয়েকজন আমেরিকান বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। বুঝলাম এরা আমারই মত ভয় পেয়েছেন ওপরে যেতে! মুগ্ধ হয়ে দেখলাম এ শহর। ইংকাদের বুদ্ধি আর সাহসের সত্যিই তুলনা নেই! ছশো- সাতশো বছর আগে তারা যে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এত উন্নত ছিল তা দেখে বিস্ময় জাগে আমাদের মতো এ যুগের লোকের। তাও তো এ শহর ধংসস্তুপ, কত কিছু হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্যে! ইউরোপিয়ানরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে ইংকারা তাদের চেয়েও অনেক উন্নত ছিল এ ব্যাপারে।
এবার বলি আর একটি শহরের কথা। তার নাম ছিল 'এল ডোরাডো'। শোনা যায় এ শহরে সোনা দানা লুকিয়ে রেখেছিল ইংকারা। এ শহর সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আন্তর্জাতিক পর্যটকরা কয়েকশো বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছেন এল ডোরাডো-কে খুঁজে বার করতে। কিন্তু সফল হন নি তারা। ২০০২ সালে একদল পর্যটকের ধারণা হয় শহরটি আমাজন নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইংকাদের রাজত্ব অনেকদূর বিস্তৃত ছিল। বর্তমানের কলম্বিয়া যেখানে সোনা ছিল বিখ্যাত, ছিল ইনকাদের দখলে। এ শহর সত্যি থাকলেও কোথায় যে ছিল, তা এখনও অজানা। কে জানে হয়তো বা শুধুই কল্পনা!
ইলারার সঙ্গে পেরুর মহিলারা
Comments
কলম্বিয়া
চৈতালি পুরকায়স্থ
ডালাস, টেক্সাস
বলিভার স্কোয়ার
মুইস্কাস চীফের সাজ পোষাক
মন্সেরাটে পাহাড়ের ওপর থেকে
আমাদের যাত্রা শুরু হল কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা অভিমুখে ডালাস থেকে মায়ামি শহর হয়ে। মায়ামি এয়ারপোর্টে আন্দ্রেসের সঙ্গে দেখা হল, আমাদের তিনজনের একই ফ্লাইটে রওনা হবার কথা ছিল। টার্মিনাল ডি থেকে এ-তে যেতে হবে, হাঁটছি তো হাঁটছিই, ঠিকমত সাইন দেওয়া নেই, ভাগ্যিস আন্দ্রেসের রাস্তা চেনা ছিল তা না হলে কতক্ষণে পৌঁছোতাম কে জানে! কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটাতে এসে পৌঁছোলাম অনেক রাতে। যে হোটেলে এলাম তার নাম হোটেল লা ফন্তানা এসটেলার, শহরের উওরে বর্দ্ধিষ্ণু এলাকাতে।হোটেল তৈরী হয়েছিল স্প্যানিশ ডিজাইনে। ভেতরে পথ চলার রাস্তা পাথরেরও ইঁটের। চারিদিকে ফুল, বাইরে এবং ভেতরে। শুনলাম এখানে ঋতু পরিবর্ত্তণ বলে কিছু নেই। শুধু বর্ষাকালেরই পরিচয় পাওয়া যায়, বলা যায় প্রায় চির বসন্তের দেশ।
পরদিন সকালে হোটেলের ব্রেকফাষ্ট লাউঞ্জে যাবার পথে দেখি এক বিশাল কোর্ট ইয়ার্ড, তার মধ্যে কি সুন্দর একটা চার্চ। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন ইউরোপে এসেছি।আন্দ্রেস জানালো এখানকার লোকেরা খুব ধার্ম্মিক, ৯৫% রোমান ক্যাথলিক। সুবীর আর আন্দ্রেস এখানে এসেছে কাজ করতে, আর আমার কোন কাজ নেই, অঢেল সময় বেড়াবার। ঠিক হল আমি ইংরিজি জানা একজন গাইড নিয়ে শহর দেখতে বেরোব। পাওয়া গেল একজনকে, দুপুর দুটোর সময়। বোগোটা শহরের পুরোনো নাম ‘স্যান্টা ফে‘। এই শহরের পওন করেছিল স্প্যানিসরা ১৫৩৮ সালে, মন্সারেট আর গুয়াডালুপ পাহাড়ের পাদদেশে। এখানে ছিল তখন মুইস্কাস উপজাতিদের বাস। তাদের ভাষা ছিল 'চিবচা'।তাদের উন্নতমানের সোনার কাজ, পটারি এবং বস্ত্রশিল্প এখনও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে কলম্বিয়াতে। কলম্বিয়া বহুদিন স্পেনের রাজার অধীনে ছিল, পুরোনো নাম ছিল ‘নিউ গ্র্যানাডা‘। স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটে ১৮১৯ সালে, বহু যুদ্ধের পর। প্রথম প্রেসিডেন্টের নাম হল 'সাইমন বলিভার'।সাইমন বলিভার এক বিখ্যাত নাম দক্ষিণ আমেরিকাতে। এই বীর দেশপ্রেমিক স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিউ গ্র্যানাডাকে পরিণত করেন স্বাধীন দেশ কলম্বিয়াতে।
তারপর ধীরে ধীরে স্যান্টা ফে নামের পরিবর্তন হয়, সৃষ্টি হয় বোগোটা নামের।আমার গাইড গাড়ী চালিয়ে আমাকে নিয়ে গেল কেবল কার স্টেশনে, মন্সেরাটে পাহাড়ের নীচে। পথে যেতে যেতে পরিচয় পেলাম পাহাড় ও উপত্যকায় ছড়ানো এই শহরের।উদ্দেশ্য কেবল কার নিয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে শহর এবং প্রাকৃতিক শোভা দেখা। পাহাড়ের চূড়ায় একটা পুরোনো স্প্যানিস গির্জা, পাথর দিয়ে বাঁধানো চত্বর ও সিঁড়ি। চূড়া থেকে দেখা যায় এক বিশালউপত্যকায় ছড়িয়ে রয়েছে বোগোটা শহর গত পাঁচশো বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার নিদর্শন নিয়ে। অন্যদিকে শুধুই পর্বতমালা,
জনবসতি আপাততঃ নেই। দেখতে পেলাম একটু দূরে গুয়াদালুপে পাহাড়ের চূড়ায় এক বিশাল মূর্তি যীশুখৃষ্টের, ধব্ধবে সাদা রং এর পাহাড় থেকে নেমে অনেক উঁচু নীচু রাস্তা পেরিয়ে গেলাম শহরের মধ্যস্থলে। আমার গাইড মহিলা হলে কি হবে গাড়ী চালানোতে দক্ষতা এতটুকু কম নয়! আমাকে প্রথমে দেখাতে নিয়ে এল ওখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাণবন্ত সব ছাত্রছাত্রীর দল, তাদের হৈ হল্লা দেখে নিজের কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ল অনেকদিন পরে।সেখান থেকে অল্প হেঁটে গেলাম বলিভার স্কোয়ারে, যেখানে রয়েছে এখানকার পার্লামেন্ট ভবন, বিখ্যাত গির্জা এবং সুপ্রিম কোর্ট ইত্যাদি। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রয়েছে সাইমন বলভারের মূর্তি। মধ্যিখানে পাথরে বাঁধানো বিরাট চত্বর যা অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।তবে এখন পায়রাদের রাজত্ব হাজার হাজার পায়রা বসে আছে চত্বরে, বোধহয় খাবার আশায়। এখনকার প্রেসিডেন্টের নাম আল্ভারো উড়িবে, তাঁর অফিস পার্লামেন্ট ভবনের পেছনে প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ, এমন ভালো প্রেসিডেন্ট নাকি কলম্বিয়াতে বহু বছর দেখেনি কেউ। প্রেসিডেন্ট উরিবে নাকি এদেশে এনেছেন যুগান্তকারী পরিবর্তন, কলম্বিয়া দিনে দিনে এগিয়ে চলেছে উন্নতির পথে কলম্বিয়ার কুখ্যাত ড্রাগ কার্টেলের প্রভাব অনেক কমেছে, মানুষ নির্ভয়ে হাঁটা চলা করতে পারে রাস্তা দিয়ে। পুলিশকে আর পাহারা দিতে হয় না প্রতি রাস্তায়। কলম্বিয়াতে এসে যে আমার এত ভাল লাগবে আগে ভাবতে পারি নি। সবচেয়ে ভালো লাগলো যখন দেখলাম এরা তিন হাজার বছরের পুরোনো আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সভ্যতাকেবাঁচিয়ে রেখেছে শ্রদ্ধার সঙ্গে। এদেশের মানুষদের মধ্যে বহু মিশ্রণ দেখা যায় অর্থাৎ স্প্যানিস বা ইউরোপীয়ানদের সঙ্গে স্থানীয় লোকেদের।লোকেদের চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায় কিন্তু সবাই মনে করে কলম্বিয়া তাদের নিজেদের দেশ। রাতে বোগোটার লোকেদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে একথা বুঝতে পারলাম।
পরদিন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে একজন ইংরিজি জানা বয়স্ক গাইড এসে আমাকে নিয়ে গেলেন এখানকার গোল্ড মিউজিয়াম দেখাতে। স্প্যানিসদের এখানে এসে উপনিবেশ স্থাপনকরার আগে আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের তৈরী সোনার নানারকম জিনিষ রয়েছে এখানে। কলম্বিয়ার সোনা এবং পান্না খুব বিখ্যাত। বোগোটার আদিম অধিবাসী মুইসকাসরা শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিল। জ্ঞানে এবং বিদ্যায় তারা খুবই উন্নত ছিল।তাই তাদের অস্ত্রসস্ত্র বা সৈন্য সামন্তের প্রয়োজন হয় নি।তাদের সমাজে পুলিশ বলে কিছু ছিল না। এদের প্রধান বা চীফরা খুব জ্ঞানী লোক হত। চীফদের কানে, নাকে ও বুকের ওপর সোনার গহনা পরার প্রথা ছিল। ভগবানের কাছে অর্ঘ্য হিসেবে এরা দিত সোনা বা পান্নার তৈরী ছোট ছোট মূর্তি। প্রায় সমস্ত অর্ঘ্য দান করা হত লেকের বা পুকুরের জলে। কারণ লেককে এরা মনে করতো পৃথিবীর জরায়ু, যেখানে সন্তানের জন্ম হয়। চীফদের অভিষেক হত লেকের জলের মধ্যস্থলে গিয়ে। মানুষের আত্মিক উন্নতিই ছিল এদের প্রধান লক্ষ্য।
কলম্বিয়া স্পেনের রাজার অধীনে থাকাকালীন বহু আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের মৃত্যু ঘটে।আমার গাইডের মতে সব মিলিয়ে ৫ মিলিয়ান লোককে মেরে ফেলা হয় ঐ সময়।স্পেনের লোকেদের ছিল উন্নত ধরনের অস্ত্রসস্ত্র, এদের তা একেবারেই ছিল না। আমার গাইড একজন জার্মান ভদ্রলোক, অনেকদিন ধরে কলম্বিয়াতে বসবাস।বললেন উনি আর খ্রীস্টান নন, ওঁর গুরু হলেন একজন আমেরিকান ইন্ডিয়ান সাধু, যিনি উওর কলম্বিয়ার এক পাহাড়ী অঞ্চলে থাকেন। গুরুর ছবি দেখলাম এই মিউজিয়ামে।তাঁবুর সামনে বসে থাকা গুরুর ছবি দেখে মনে হল খুব সরল এঁর জীবন।প্রত্যেক বছর গুরুকে দর্শন করতে এই ভদ্রলোক যান উওরের পাহাড়ী অঞ্চলে। কয়েক দিন গুরুর সঙ্গে কাটান। সব শুনে আমি অবাকই হলাম। একজন ইউরোপীয়ানের কাছে এমন কথা শুনবো এদেশে এসে, ভাবিনি কোনদিন। মনে হল,পৃথিবীতে কত কিছু জানার আছে, আর আমি কত কম জানি!
Comments
Comments
অপরূপা
সুইজারল্যান্ড
শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য
নেদারল্যান্ড
কোলকাতায় জন্ম আর বড়ো হওয়া। যাদবপুর থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরী জীবন শুরু। তারপর বিয়ে আর কিছুদিন বাঙ্গালরে বাস। ওখান থেকেই নতুন চাকরী নিয়ে সপরিবারে বিদেশের মাটিতে পাড়ি। প্রায় দু’দশক ছুঁতে গেল হল্যান্ডে বাস। পরদেশে এসে নতুন ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষজন, উচ্চশিক্ষা, চাকরী, সংসার সবকিছু মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেকটা সময় চলে গেল। তবে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ হয়েছে। সেইসঙ্গে ঘোরা হয়েছে অনেক দেশ। তাই ভ্রমণের গল্প লেখার ভাবনাটা হঠাৎই মাথায় এলো। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ, নিজের ভাবনাগুলো লেখার আর অন্য মানুষের কাছে সহজে পৌঁছিয়ে দেবার একটা খুব ভালো জায়গা আছে। তাই চাকরীর ফাঁকে ফাঁকে অনেকদিনের এই সুপ্ত বাসনাটাকে একটু জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা যাতে মন আর মস্তিষ্ক দু’ই নবীন আর প্রফুল্ল থাকে।
দীর্ঘদিন হোল আমি হল্যান্ডে থাকি, চাকরির সুবাদে। এখান থেকে পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ ঘোরাই বেশ সুবিধের। এখানের বেশিরভাগ মানুষেরই ছুটির পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায় ইংরাজি নতুন বছর শুরু হতে না হতেই। সুইজারল্যান্ড বোধকরি সব মানুষেরই অন্যতম পছন্দের ভ্রমণের গন্তব্যস্থল। রূপসী আল্পস পর্বতমালাকে কাছে থেকে উপভোগ করতে চাইলে গ্রিন্দেলওয়াল্ড নামের এই সুইস পাহাড়ি অঞ্চলের জুড়ি মেলা ভার।
গ্রিন্দেলওয়াল্ডের স্কিন্দি নামের একটি ছোট্ট গ্রামে আমরা এবার ঘর ভাড়া নিলাম। মধুচন্দ্রিমার জন্য সুইজারল্যান্ড যে সদ্য বিবাহিতদের প্রথম পছন্দ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উঁচুনিচু পাহাড়, গভীর উপত্যকা, ছোট ছোট রোমান্টিক গ্রাম, চারিদিকে সবুজের সমারহ, গরুর বাছুরের গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুংটাং মিষ্টি আওয়াজ, মাঝে মধ্যে পাহাড়ি ঝর্ণার কুলুকুলু শব্দ- সবমিলিয়ে এখানে প্রকৃতিতেই ভালবাসা ছড়িয়ে আছে আনাচে কানাচে। পরন্তবেলার সূর্যের আলোতে এইগার (উচ্চতা ৩,৯৭০ মিটার) শিখরের চোখ জোড়ানো অপূর্ব রূপের মাধুরী মনে মেখে প্রথম দিনের যবনিকা নামলো।
পরদিন সকালে গ্রিন্দেলওয়াল্ড থেকে ট্রেন নিয়ে চললাম জুংফ্রউ-জহ দেখতে। সুইস সরকার পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে খুবই সতর্ক। অনর্থক পরিবেশ দূষণ যাতে না হয় তাই বেশিরভাগ প্রসিদ্ধ পাহাড়ের চূড়াগুলোতে পৌঁছাতে পারবেন ট্রেন ধরে, অথবা পায়ে হেঁটে ট্র্যেকিং করে। ট্রেনে করে প্রথমে ক্লেইনে স্কাইদিগে পৌঁছিয়ে সেখান থেকে কগ ট্রেন নিতে হবে যা আপনাকে পৌঁছিয়ে দেবে জুংফ্রউ এর পর্বত শিখরে।
এই যাত্রায় বেশিরভাগ পথই পাহাড়ের সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে। গ্রিন্দেলওয়াল্ড থেকে জুংফ্রউ যাবার পুরো ট্রেন যাত্রাটি মোটামুটি আড়াই ঘণ্টার মতো। জুংফ্রউ-জহ তে পৌঁছয়েই হাতের কাছে পেয়ে যাবেন মুঠো মুঠো বরফরাশি আর মনোরম বরফের স্থাপত্য শিল্প। এই পর্বত শিখর ইউরোপের সব চেয়ে উঁচু স্থান যেখানে ট্রেন ধরে পৌঁছানো যায়। আল্পসের এই পর্বতচূড়ার উচ্চতা ৪,১৫৮ মিটার। এখানে বানানো রয়েছে পায়ে চলার উপযোগী বরফে ঢাকা রাস্তা, আছে নানারকম বরফের উপরে খেলার আয়োজন - যেমন স্কি, স্নো-বোর্ড, কেবেল-কার ভ্রমন, প্যারা গ্লাইডিঙ, আর পর্বতারোহীদের জন্য রোমাঞ্চকর আকর্ষণীয় সব অভিযানের আয়োজন। জুংফ্রউ স্টেশন থেকে লিফট নিয়ে আরও কিছুটা উপরে উঠলে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো যাবে। রোদ উজ্জ্বল ঝকঝকে দিনে এখান থেকে আল্পস পর্বতমালার উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ব্লাঙ্ক (৪,৮১০ মিটার) দেখা যেতে পারে, যেটি ফরাসী আল্পেসের অংশ। সাদা পাহাড়ের এই অলৌকিক রূপে মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে পারা যাবে না, সৃষ্টিকর্তাতে মনে মনে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হবে তাঁর এই দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টির জন্য। জুংফ্রউ স্টেশনে আপনার রসনা তৃপ্ত করতে পাবেন বলিউডি রেস্টুরেন্ট এবং অনেক দেশের খাবার। এখানে পাবেন বিখ্যাত সুইস চকলেট “লিন্দ” এর দোকান যেখানে রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের চকলেটের বিপুল সম্ভার। এক কথায় পুরো দিন কেটে যাবে প্রকৃতির বুকে, তার শোভাকে আলিঙ্গন করে।
দ্বিতীয় দিনে ইন্তেরলাকেন শহর ঘুরে দেখতে সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা সুইজারল্যান্ডর অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর বিশেষত এখানকার মনোরম প্রকাণ্ড দুটি ঝিলের শোভার জন্য। পূর্বদিক জুড়ে রয়েছে ঝিল ব্রিঞ্জ আর পশ্চিমে ঝিল থুন – একসাথে এসে মিলিত হয়েছে এই শহরের বুকে। এখানে নৌকা ভ্রমণ ছাড়াও নানারকম জলক্রিয়া খুবই জনপ্রিয়। কিছু উৎসাহী মানুষজন ঝিলের ঠাণ্ডা জলেও ঘণ্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটতে অথবা আধ খোলা গায়ে সূর্য-স্নান করতেও দ্বিধা বোধ করে না। এছাড়া ইন্তারলাকেন ট্রেন স্টেশন এর কাছ থেকে কেবেল কার চড়ে পৌঁছিয়ে যাওয়া যেতে পারে হারডার কুলাম নামের জায়গায় যেটা ইন্তেরলাকেন শহরের উচ্চতম স্থান। এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক শোভা দেখতে পাবেন ব্রিঞ্জ আর থুন ঝিলদ্বয়ের। ফেরার পথে লাউটারবানেন ঘুরে আসা যেতে পারে। এখানে আছে অনেকগুলো সুন্দর পাহাড়ি ঝর্ণা যেইগুলোর একবারে উৎস স্থল পর্যন্ত পৌঁছিয়ে যাওয়া যেতে পারে পাহাড়ি রাস্তার বাঁক ধরে। পরেরদিন আমাদের গন্তব্য হোল সাইনিগে প্লাতে, যেটা জুংফ্র অঞ্ছলের মধ্যেই অবস্থিত। এখানে যেতে পারেন শুধুমাত্র “কগ” ট্রেনে অথবা পায়ে হেঁটে ট্র্যাকিং করে। পুরো যাত্রায় দুই চোখ ভরে দেখে নিন অগুন্তি প্রজাতির পাহাড়ি বনানী, অপূর্ব সুন্দর বরফে ঢাকা পর্বতমালা, আর জঙ্গলি ঝর্ণার অবিশ্রান্ত ধারা। মুঠো মুঠো প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে এখানকার আকাশে বাতাসে। এখানে পৌঁছিয়ে পাহাড়ের পথ ধরে আধঘণ্টার আরোহণে পৌঁছিয়ে যাওয়া যাবে আল্পস এর আরও একটি পর্বতশিখর চূড়ে, পথে শোনা যাবে অবিরাম গো-বাছুরের গলায় বাঁধা ঘণ্টার রুনুঝুনু শব্দ। লক্ষণীয় হোল এখানে সব গোবাদির গলাতেই নানামাপের ঘণ্টা বাঁধা থাকে তাদের নিজস্ব পরিচিতির জন্য। এই ঘণ্টাই আবার বিক্রি হয় সুইস ‘সুভিনিওর’ হিসেবে। গ্রীষ্মের রোদ্দুজ্জল দিনে এই স্থানটি থেকে আল্পস এর অনেকগুলো চূড়া যেমন
মঞ্ছ, জুংফ্রউ, এইগার, ইত্যাদির দৃশ্য অতীব মনোরম। এই স্থানটিতে রাখা আছে এই দেশের কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্র আল্প-হর্ন, যেটি পাহাড়ের বাসিন্দারা আগেকারদিনে পস্পরকে বার্তা পাঠানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতো। আধুনিক যুগে এটি অবশ্য কেবলমাত্র মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত হয়। চারিদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের রস আস্বাদন করার ফাঁকে বিরতির জন্য রসনা তৃপ্ত করতে পাবেন লোভনীয় নানারকম সুইস বেকারির তৈরি কেক, বা অন্য প্রদেশের মুখরোচক খাবার।
চতুর্থ দিনে আমরা আল্পসের বিখ্যাত পাহাড়ের বুকের সুদৃশ্য “মাউণ্টেন পাস” দেখতে বেড়িয়ে পরলাম। এটি মোটামুটি একটি বৃত্তাকার যাত্রাপথ যেটি চারটি পর্বত বক্ষ
জুড়ে বিস্তৃত। গ্রিন্দেলওয়াল্ড থেকে বেরিয়ে প্রথমে এলাম গ্রিমসেল পাস। এখানে পৌঁছাতেই প্রথমে চোখে পড়লো স্নিগ্ধ একটি প্রাকৃতিক ঝিল যেটি হিমবাহের জলে তৈরি। চারিদিকের স্নিগ্ধতা মনে প্রশান্তির স্বাদ এনে দেবে এক নিমেষে। এখান থেকে বেরিয়ে চললাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য স্থল নিউফেন পাস। একটি ‘পাস’ থেকে পরেরটিকে যেতে আপনাকে একবারে পর্বত শিখর থেকে উপত্যকায় চলে আসতে হবে, তারপর আবার উত্তরনের পালা। এইভাবে নিউফেন পাস হয়ে আমরা পৌঁছলাম ফুরকা পাসে। প্রতিটি ‘পাসেরই’ একটা নিজেস্বতা আছে, আছে একবারে স্বকীয় সৌন্দর্যতা। কিছু কিছু পাহাড়ি পথ বেশ সঙ্কীর্ণ, বিপদের হাতছানি আছে প্রতি মুহূর্তে - তাই অসতর্কতা চলবে না। আমাদের অন্তিম গন্তব্য ছিল গত্থারদ পাস। এটিতে যাবার পথটিও বেশ বিপদসঙ্কুল। রাস্তায় ছিল অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণার ধারা। এই অপূর্ব যাত্রার অভিজ্ঞতা সারাজীবন স্মৃতির মণিকোঠায় সযত্নে সাজানো থাকবে।
শেষদিনে আমরা গ্রিন্দেলওয়াল্ড এর আশপাশের আকর্ষণীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখলাম। এখানে আছে অনেক পুরনো এইগার পর্বতের গুহা গহ্বর, যার উৎস স্থলে আছে ক্যানন হিমবাহ। এই হিমবাহর বরফ গলা জলে সৃষ্টি হয়েছে খরস্রোতা নদী লুটসাইন। বৈজ্ঞানিকদের মতে আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রার বৃদ্ধি এই হিমবাহের স্বাভাবিক কার্যপদ্ধতি অনেক পরিবর্তন করে দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে শীতের সময় বরফ গলা জল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কম আর গরমের সময় বেশি হবার কথা। কিন্তু এখন শীতের সময় তাপমাত্রা বেশি হওয়ায়ে অনেক বেশি পরিমানে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। এইরকম চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর মধ্যে এই হিমবাহের অস্তিত্ব মুছে যাবে। ভাবতে খুবই কষ্ট বোধ হয় যে এই সুন্দর প্রাচীন হিমবাহ তিলেতিলে ক্ষয় হয়ে চলেছে পৃথিবীর ক্রমশ বর্ধমান তাপমাত্রা জন্য। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুখ থেকে বঞ্চিত হবে।
দুপুরের খাওয়া সেরে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল “ফার্স্ট ক্লিফ ওয়াক”। এই অভিযান করতে হলে প্রথমে আকাশ পথে গণ্ডলা চড়ে যেতে হবে বেশ কিছুটা পথ। রাস্তাতে দেখতে পাওয়া যাবে চোখ জুড়ানো আল্পস এর ঘন সবুজ উপত্যকা, দিগন্ত বিস্তৃত আল্পস পর্বতমালার সারি, অগুন্তি পাহাড়ি ঝর্ণা, টুকরো টুকরো সুইস ভিলেজ। গণ্ডলা আপনাকে পৌঁছিয়ে দেবে ফার্স্ট স্টেশনে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়া যেতে পারে ৩ কিলোমিটার দূরত্বের ‘বাখাল্প সি’তে, এটি ছোট একটি প্রাকৃতিক ঝিল। এখানে পৌঁছলে এইগার পর্বতশিখরকে মনে হবে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।
বাখাল্প সি দেখে আবার ফার্স্ট স্টেশন ফিরে আসলে ওখান থেকেই শুরু হবে ক্লিফ ওয়াক এর রাস্তা । প্রায় ৮০০ মিটার লম্বা এই ভাসমান সেতু তৈরির পিছনে প্রসিদ্ধ সুইস ঘড়ির সংস্থা ‘টিসট’ এবং সুইস সরকারের আর্থিক অবদান আছে। এই ক্লিফ ওয়াক করতে অবশ্যই দৃঢ় মনের প্রয়োজন, তা না হলে এটি করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। তবে মনে জোর নিয়ে যদি অন্তিম বিন্দু পর্যন্ত পৌঁছতে পারা যায়, তবে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিজের চোখে দেখার সাক্ষী হতে পারবেন।
এই অসাধারন ভ্রমণ শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা। গত পাঁচ দিনের অভিজ্ঞতা মনের খাতায় চিরকালের জন্য স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলো। প্রকৃতি এখানে তার অগাধ উজার করা সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে আছে। মনের সব গ্লানি, দৈনন্দিন জীবনের মানসিক চাপ, সাংসারিক জীবনের ক্লান্তি আর একঘেরেমি দূর করে আবার নতুন উদ্যমে জীবনী শক্তি খুঁজে পেতে হলে এই গ্রিন্দেলওয়াল্ড ভ্রমণ অবশ্যই দরকার। তাই আর দেরি না করে আপনার পরবর্তী বিদেশের মাটিতে ভ্রমণে গন্তব্যের ঠিকানা হতে পারে সুইজারল্যান্ডের এই স্বপ্ন-সুন্দর গ্রিন্দেলওয়াল্ড অঞ্ছল। আর যাদের সেই উপায় নেই তারা অন্তত এই ভ্রমণ কাহিনী পড়তে পড়তে একটু হলেও কল্পনায় আমার সাথে বেড়িয়ে এলেন এই আশা রাখি।
আলোকচিত্র - শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য
ছবির উপর ক্লিক করুন
Comments
বতর্মানের
মিশর
চৈতালি পুরকায়স্থ
ডালাস, টেক্সাস
স্ফিংস- রাজার মুখ, সিংহের দেহ
পিরামিড ও উঠ
কায়রোতে আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ
২০১৪ সালের শেষের দিকে যখন আমাদের মিশর যাবার কথা হচ্ছিল - যে শুনছিল সেই বলছিল কেন যাচ্ছ এমন দেশে, এই সময়ে? প্রাণ হারাতে চাও নাকি? কিন্তু আমার স্বামী সুবীর বদ্ধপরিকর - সে যাবেই যাবে। তার ধারণা এবার না গেলে, আর কোনদিনই যাওয়া হয়ে উঠবে না আমাদের!
সুতরাং সাহস করে যাত্রা শুরু হল আমাদের ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। মিশরের রাজধানী কায়রো এসে পৌঁছোলাম ৬ তারিখে। এয়ারপোর্টে খুবই বিশৃঙ্খলা দেখলাম, অনেক আগে ভারতবর্ষে যা হত তাই। কোন নিয়ম কানুনের বালাই নেই। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াতে স্থানীয় লোকেরা জানালো আমাকে মহিলাদের লাইনে যেতে হবে। গিয়ে দেখি আমাকে আবার আলাদা করে ফর্ম ভরতে হবে - বেশ, করলাম যা বললো তাই।তারপর দেখলাম স্বামী স্ত্রী ছেলে মেয়ে সবাইকে একসঙ্গে নিয়েও যেতে দেয়। কেউ জানে না কোনটা নিয়ম! তারপর মালপত্র খুঁজে বের করা। ভাগ্যিস পোর্টার পাওয়া গেল, আস্তে আস্তে মালপত্র যোগাড় হল।
বাইরে এসে দেখলাম মেরিওট হোটেল থেকে পাঠানো গাড়ীর ড্রাইভার আমাদের নাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বাঁচলাম! তার গাড়ীতে এসে পৌঁছোলাম নীল নদের তীরে মেরিওট হোটেলে। হোটেলের মধ্য অংশে পুরোণো রাজপ্রাসাদ, যা পরিণত হয়েছে হোটেলের লবি ও রেস্টুরেন্টে। এছাড়া দুপাশে নতুন দুটি উঁচু বিলডিং, সেখানে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা।
আমরা ঘর পেলাম নয় তলায়। ঘরের বারান্দা থেকে নীল নদ এবং শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার দৃশ্য। লোকেদের চেহারা বেশ হৃষ্টপুষ্ট। মহিলাদের অনেকের মাথা ঢাকা, তবে অল্পবয়িসীদের নয়। শুনলাম আমার মত বিদেশিনীদের কাছে ওরা আশা করে না মাথায় ঢাকা দেওয়া! তবে আমি তো বিদেশিনী নই ওদের কাছে। কুয়েত থেকে প্লেনে কায়রো আসার পথে এয়ার হোসটেস জানতে চেয়েছিল আমি মিশরীয় কিনা। শুনে অবাক হয়েছিলাম আমি!
বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাড়ীর মত দেখতে একটি বড় জাহাজ, তার নাম ম্যাকসিম। শুনলাম ঐ জাহাজ যাত্রীদের নিয়ে সন্ধ্যাবেলা নৌকাবিহারে যায়। হোটেলের রেস্টুরেন্ট খুবই রাজকীয় ভাবে সাজানো - সেখানেই রাতের আহার হল আমাদের।
পরের দিন সকালে আমরা প্রথমেই এলাম শহরের কেন্দ্রস্থলে মিউজিয়াম দেখতে। গিয়ে দেখি সামনে অনেক মিলিটারি এবং মিলিটারি ট্যাঙ্ক। ভেতরেও অনেক মিলিটারি। শুনলাম মিলিটারিই এদেশে রাজত্ব চালাচ্ছে এখন। হয়তো দ্রষ্টব্য বস্তুর যাতে ক্ষতি না হয় তাই এই ব্যবস্থা।
কায়রোর এই বিখ্যাত মিউজিয়াম তৈরী করা সহজ হয়নি। মিশরের ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের পুরোণো।মিশরের শিল্পকলার নিদর্শন প্রাচীন কালের ফারাওরা মুক্ত হস্তে দান করে দিতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে প্রথম মিউজিয়াম করার চেষ্টা হয়। তৎকালীন মিশরের রাজা অস্ট্রিয়ার রাজাকে দান করে দিয়েছিলেন যেটুকু শিল্পকলার নিদর্শন প্রথম দিকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত মিউজিয়ামটি তৈরী হয় ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে এক ফরাসী শিল্পীর সহায়তায়। তারপর আজকের অবস্থানে আসে ১৯০২ সালে।
এই যাদুঘরে অর্থাৎ মিউজিয়ামে বেশীর ভাগ জিনিষই চার পাঁচ হাজার বছরের পুরোণো। রাজা টুটেন খামেনের সোনার মূর্তি এবং মিশরের মমিই সবচেয়ে বিখ্যাত। রয়েছে পাথরে তৈরী নানান দেবদেবীর মূর্তি। মন্দিরের ভেতর থেকে আনা লাইম স্টোনে তৈরী রাজা, রাণী এবং তিন রাজকন্যার মূর্তি। দেখলাম অনেক সাধারণ কর্মীদের মূর্তি। শিল্প খুবই উন্নত মানের। চার পাঁচ হাজার বছর আগে এত উন্নত ছিল মূর্তি তৈরীর শিল্প, যা আশ্চর্য হবার মত। জানা গেল শিল্পীদের অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হত, যত ইচ্ছে সময় তারা নিতে পারতো।রাজারা অনেক গহনা পরতেন। রাজা টুটেন খামেনের গলার হার এবং কানের দুল রয়েছে সেখানে। ছেলেমানুষ রাজা, আয়ু মাত্র ১৯ বছর, তার মমি রাখা হয়েছিল চারটি সোনার জল দিয়ে তৈরী করা বাক্সে। প্রথমে সবচেয়ে ছোট বাক্স - তারপর আর একটু বড় - শেষে সবচেয়ে বড়টি প্রায় ঘরের মত সাইজের। রাণী নামে একটি স্থানীয় গাইড আমাদের সব বুঝিয়ে দিল। অজস্র মূর্তি রয়েছে, কোন কোন দেবদেবী পশুর চেহারার বা মুখ পশুর কিন্তু দেহ মানুষের।
দেবতাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন সূর্যদেবতারা এবং পাতালের দেবতা ওসিরিস। চীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল যে মৃত্যুর পর ওসিরিস তাদের দেখাশুনো করেন।
সন্ধ্যাবেলা গেলাম নৌকাবিহারে, ম্যাক্সিম নিয়ে, হোটেলের খুব কাছ থেকেই। জাহাজে নীচ তলায় রেসটুরেন্ট, সেখানেই আমাদের বসানো হল। বসে বসে নদীর তীরবর্তি দৃশ্য দেখতে লাগলাম রাতের অন্ধকারে। কত ছোট ছোট নৌকো দেখলাম, আলো দিয়ে সাজানো। তারপর গান শুরু হল, মন্থর গতিতে জাহাজ চলছে। এবার শুরু হল পুরুষদের আরবীয় নাচ - বাজনা চমৎকার - পোষাক ও নাচ অন্যরকম। এরপর শুরু হল বেলি ডান্স, নাচতে এল কয়েকটি অল্পবয়িসী মেয়ে। ভেবেছিলাম নতুন মিলিটারী গভর্ণমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েদের নাচ, কিন্তু তা নয়। নর্তকীরা খুবই উৎসাহী, চমৎকার হল নাচ। খাবার অনেক - স্যালাড, মাছ, মিষ্টি কিছু বাদ নেই।ভালোই লাগলো আমাদের। মনে পড়ল এই সেই নীল নদ, ছোটবেলায় টেন কমান্ডমেন্টস সিনেমায় দেখা নীল নদ, যার মধ্যে দেখেছিলাম সেই অলৌকিক দৃশ্য - নদীর জল দুদিকে সরে যাচ্ছে এবং ইহুদীদের ধর্মগুরু মোসেস ইহুদী ক্রীতদাসদের দলকে নিয়ে নদী পার হয়ে চলে যাচ্ছেন! আজকালকার অনেক ইতিহাস তত্ত্ববিদরা বিশ্বাস করেন না যে খৃষ্টপূর্ব ঐ সময় মোসেস নামে কোন ঐতিহাসিক চরিত্র ছিল।
পরদিন সকালে আমরা হোটেলের ড্রাইভার হাসানের গাড়ীতে রওনা হলাম গিজার পথে। সে প্রথমেই আমাদের কায়রোর বিখ্যাত মসজিদ আল আজাহার দেখিয়ে নিতে চাইলো।সেখানে এসে দেখলাম একেবারেই কোন লোকজন নেই। মসজিদের ভেতরের অংশ দেখে ফিরে আসার পর দ্বাররক্ষী দুঃখ করে জানালো - আজকাল বিদেশ থেকে লোকজন একেবারেই আসে না।সবাই বর্জন করেছে আমাদের দেশ, পিকচার পোস্টকার্ড কেনারও কোন লোক পাই না। শুনে দুঃখ হল আমাদের, আমরা কিছু পিকচার পোস্টকার্ড কিনলাম।
এবার এসে পৌঁছোলাম কায়রোর উওর দিকে গিজা অঞ্চলে যেখানে রয়েছে পিরামিড ও স্ফিংস। পিরামিডের কাছে এসে বোঝা গেল মিশর সত্যিই মরুভূমির দেশ। চারিদিকে শুধু বালি আর বালি। বালির ঝড়ে ঢাকা পড়েছিল এখানকার এই তিন পিরামিড, হাজার হাজার বছর ধরে। আবিষ্কার করা হয়েছে অনেক পরে। প্রথম পিরামিড রাজা খুফার। দ্বিতীয়টি রাজা খাফ্রের আর তৃতীয়টি রাজা মেনটুরার। রাজারা নিজেরাই নিজেদের পিরামিড তৈরী করে রাখতেন বেঁচে থাকাকালীন, যাতে মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ রাখা হয় ত্রিকোণাকৃতি এই বিরাট স্তম্ভের মধ্যে। পিরামিড তৈরী হত বড় বড় পাথরের টুকরো দিয়ে। কেমন করে দুটো পাথরকে জোড়া দিয়ে একসঙ্গে রাখা হত তা দেখিয়ে, বুঝিয়ে দিলেন আমাদের ইংরিজি জানা গাইড আলি। প্রথম পিরামিডটি তৈরী হয়েছিল বছরে ১ হাজার কর্মীর সাহায্য নিয়ে, মোট ৩০ বছর ধরে।
আমার শুধু মনে হল কী স্বার্থপর এই রাজারা! এত বড় পিরামিড কিনা একটি মাত্র মৃতদেহের জন্যে! পরিবারের অন্যদেরও তো স্থান দিতে পারা যেত সেখানে? আর সেই যুগে এত বড় পিরামিড তৈরী করতে গিয়ে, এত পাথর তুলতে গিয়ে, না জানি কত লোক প্রাণ হারিয়েছে! রাজারা কি নিষ্ঠূর! পিরামিড দেখার আনন্দটা অনেক কমে গেল আমার।
আর স্ফিংস এর যে মূর্তি দেখলাম - রাজা খাফ্রের মুখ এবং দেহ সিংহের। তার অর্থ হল - রাজা মানুষ হতে পারেন কিন্তু তার বিক্রম সিংহ সমান। যত লোক পিরামিড দেখতে এসেছিল সেদিন তারা সবাই ছিল স্থানীয় লোক। স্কুলের ছেলের দল নয়তো কলেজে পড়া বড় ছেলে মেয়ে। সমস্ত চত্বরে আমরা ছাড়া আর কোন বিদেশীদের দেখা পাওয়া গেল না সেদিন। বেশ কয়েকটি উট দেখলাম, কিন্তু চড়বার কোন লোক ছিল না।
এবার গাইড আলি আমাদের নিয়ে গেল নিকটস্থ একটি ছবির দোকানে। সেখানে আমাদের দেখানো হল পপাইরাস গাছের ডাল জলে ভিজিয়ে রেখে কিভাবে কাগজ তৈরী করা হয়। তার ওপর ছবি আঁকা হত প্রাচীনকালে। এখনো হয় দেখলাম।
পাঁচ হাজার বছর আগে সত্যিই মিশর সভ্যতার শিখরে উঠেছিল। শিল্পকলার সবচেয়ে বেশী উন্নতি তখনই হয়েছিল। মিশরীয়রা লিখতে শিখে গিয়েছিল তখন থেকে। মন্দিরের পুরোহিতরা পর পর প্রতিটি রাজার নাম লিখে রেখেছিলেন। এই সভ্যতা চলেছিল ৫০০ বছর। এই সভ্যতার পতনের পর যে উন্নত সভ্যতা আসে, সেই সময় মিশরে চাষবাস এবং বানিজ্যের খুব উন্নতি হয়। নদীপথে জাহাজে করে মালপত্র নিয়ে গিয়ে ব্যবসা শুরু হয়। আর শেষে যে সভ্যতা আসে তাদের ছিল যুদ্ধবিদ্যায় নিপুনতা। মিশরের উওরে ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিমে ও পূর্বে দুদিকেই মরুভূমি। তাই বহিঃশত্রুর আক্রমণ এদেশে অনেক কম হয়েছিল। তাছাড়া আবহাওয়া ছিল বেশ সুন্দর। দিনে গরম এবং রাতে বেশ ঠান্ডা। তাই চার পাঁচ হাজার বছর আগে তৈরী শিল্পকলা নষ্ট হতে পারে নি।
প্রাচীন মিশরীয়দের জীবনের প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা। তারা মনে করতো দৈহিক মৃত্যুর পরও অন্য কোনো জীবন আছে। তাই তারা মৃতদেহকে মমি তৈরী করে রেখে দেবার চেষ্টা করতো।
শেষের দিনে আমরা গেলাম পুরোণো কায়রোতে। সেখানে আছে একটি বিখ্যাত মসজিদ, শুনলাম এ মসজিদ আফ্রিকার সবচেয়ে পুরোণো মসজিদ। তার খুব কাছেই রয়েছে খৃস্টানদের পুরোণো চার্চ এবং ঠিক পাশেই ইহুদীদের মন্দির। দেখে মনে হল এই তিন ধর্মের মানুষ এদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতো। তবে কেন এমন হয়ে গেল মিশর? মারামারি হানাহানি কেন কেড়ে নিল সব শান্তি? বোধহয় রাজনীতি আর ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষনা করেন তারাই এই প্রশ্নের উওর দিতে পারবেন।
Comments
ট্রয় ট্রেনে
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং
আবু আফজাল মোহাঃ সালেহ
জীবননগর, চুয়াডাঙ্গা,বাংলাদেশ
সুকনা ষ্টেশন ও মিউজিয়াম
মূলতঃ ইংরেজদের অবকাশকালীন স্থান হিসাবে দার্জিলিং বা হিমালয় পাহাড়ের এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়।নিউজলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ৮৮ কিমি ন্যারো গেজের রেললাইন DARJEELING HIMALAYAN RAILWAY সংক্ষেপে DHR। আর এ রুটের টয় ট্রেন আজ পর্যন্ত সুন্দরতম পাহাড়িয়া ট্রেন যাত্রা বলে আধুনিক এ যুগেও স্বীকৃত। বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ১৮৯৬ সালে।
DHR ‘টয় ট্রেনে' একদিন ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেদিনটাকে তাঁর জীবনে কাটানো অন্যতম উপভোগ্য দিন বলে মন্তব্য করেন। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে টয় ট্রেন’কে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
নিউজলপাইগুড়ি বা এনজেপি ষ্টেশন সংলগ্নে টয় ট্রেনের রেপ্লিকা আছে। বলে রাখা ভাল, পূর্বে বাষ্পচালিত বা কয়লা চালিত ইঞ্জিনদ্বারা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পৌঁছাতে ৯-১০ ঘণ্টা সময় লাগলেও বর্তমানে ডিজেল চালিত ইঞ্জিন দ্বারা টয় ট্রেনে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগে। আর ট্যাক্সিতে গেলে (HILL CART ROAD ধরে) সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। বড় বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে - HILL CART ROAD এর পাশাপাশি টয় ট্রেন রুট ও ছোট ছোট ষ্টেশনগুলো অবস্থিত। সুকনা, ঘুম বা দার্জিলিং ষ্টেশন সংলগ্ন মিউজিয়ামে ডি-এইচ-আর’ এর ঐতিহ্য বা ইতিহাস, তথ্যাদি সংরক্ষিত আছে।
সুকনা ষ্টেশন থেকে বুঝা যায় ক্রমান্বয়ে উচ্চতায় উঠছে ট্রেন। বড় রকমের বাঁক শুরু এ ষ্টেশন থেকে। রান্টং ষ্টেশন বা নিকটবর্তী এলাকা থেকে কুর্শিয়াং পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এ রুটে ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় ‘ঘুম’ ষ্টেশন অবস্থিত। যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় এবং সমগ্র পৃথিবী’র মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত রেল ষ্টেশন। অন্যদিকে এনজিপি মাত্র ৩১৪ ফুট উপরে (সমতল ভূমি থেকে) অবস্থিত। ১৮৮০/১৮৮১ সালের দিকে এ রুটের বেশিরভাগ ষ্টেশনগুলো প্রতিষ্ঠিত। এর মাঝে আছে কুর্শিয়াং ষ্টেশন। যেখান থেকে চা বাগানের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ‘ঘুম’ ষ্টেশন’র আগে ‘জোড় বাংলা’তে সড়কপথ ও রেলপথ ক্রস করেছে। এখানকার বাতাসিয়া’র বাগান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও দার্জিলিং এর অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। সর্বশেষ ষ্টেশন হচ্ছে দার্জিলিং। এটি ৬৮১২ ফুট উচ্চতায়। ১৯৩৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত দার্জিলিং ষ্টেশন ধংসপ্রাপ্ত হয় যা ১৯৪৪ সালে পুননির্মিত হয় যা আজ দাড়িয়ে আছে।
সুকনা ষ্টেশন থেকে বুঝা যায় ক্রমান্বয়ে উচ্চতায় উঠছে ট্রেন। বড় রকমের বাঁক শুরু এ ষ্টেশন থেকে। রান্টং ষ্টেশন বা নিকটবর্তী এলাকা থেকে কুর্শিয়াং পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এ রুটে ৭৪০৭ ফুট উচ্চতায় ‘ঘুম’ ষ্টেশন অবস্থিত। যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় এবং সমগ্র পৃথিবী’র মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত রেল ষ্টেশন। অন্যদিকে এনজিপি মাত্র ৩১৪ ফুট উপরে (সমতল ভূমি থেকে) অবস্থিত। ১৮৮০/১৮৮১ সালের দিকে এ রুটের বেশিরভাগ ষ্টেশনগুলো প্রতিষ্ঠিত। এর মাঝে আছে কুর্শিয়াং ষ্টেশন। যেখান থেকে চা বাগানের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ‘ঘুম’ ষ্টেশন’র আগে ‘জোড় বাংলা’তে সড়কপথ ও রেলপথ ক্রস করেছে। এখানকার বাতাসিয়া’র বাগান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও দার্জিলিং এর অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। সর্বশেষ ষ্টেশন হচ্ছে দার্জিলিং। এটি ৬৮১২ ফুট উচ্চতায়। ১৯৩৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত দার্জিলিং ষ্টেশন ধংসপ্রাপ্ত হয় যা ১৯৪৪ সালে পুননির্মিত হয় যা আজ দাড়িয়ে আছে।
ঘুম ষ্টেশনের মিউজিয়াম
বর্তমান কালের টয় ট্রেন
Comments
অ্যামট্র্যাক
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
কলকাতা, পশ্চিমবাংলা
৩১শে মে যখন কলেজ স্টেশনের বাড়ি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস তথা হলিউড দেখার জন্য রওনা দিচ্ছি তখন ঘড়িতে দুপুর পৌনে একটা। হন্ডা সিআরভি গাড়িটি একটি ছিমছাম বাহুল্য বর্জিত এস ইউ ভি। রাজীবের বিশ্বস্ত হাতে মাইলের পর মাইল চলেছে এই গাড়ি। দেবলীনাও লম্বা ড্রাইভ করে, তবে রাজীবের আত্মবিশ্বাস বেশি। আমরা একশো দশ মাইল দূরে Austin - Bergstrom International Airport এ পৌঁছে গেলাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। পথে পড়লো ক্যাল্ডোয়েল, ব্যাস্ট্রপ ইত্যাদি ছোট শহর। যেতে হল স্টেট হাইওয়ে দিয়ে- ইন্টার স্টেট নয়। এয়ারপোর্টের লাগোয়া লংটার্ম পার্কিং লটে গাড়ি রেখে লট থেকে এয়ারপোর্টের শাটল বাস চেপে এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে অস্টিন রেলস্টেশনে পৌঁছে গেলাম বেলা চারটের একটু পরেই। বলা বাহুল্য, কলেজ স্টেশন আর অস্টিন একই রাজ্যের দুটি শহর। রাজ্যটির নাম টেক্সাস। অস্টিন টেক্সাসের রাজধানী। আমরা অ্যামট্র্যাকের ট্রেনে দুরাত্তির কাটিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছব। আমার দীর্ঘদিনের সখ অ্যামেরিকার রাতের গাড়ি চাপার। ট্রেন আমার প্রিয় বাহন। মেয়ে জামাই- দেবলীনা রাজীব আমার সখ পূরণ করল। আমার আর কিছু চাইবার নেই- মার্কিন মুলুকের অনেকটাই ঘুরেছি। ক্যালিফোর্নিয়া আর ফ্লোরিডা যাওয়া হয়নি কেবল। আলাস্কা আর হাওয়াই তো বটেই। তবে আমার চাইবার কিছু নেই, কপালে থাকলে হবে।
আমি, গিন্নি, রাজীব আর নাতি ত্রিজ্ঞ- এই চারজন অস্টিন থেকে ট্রেনে উঠবো। দেবলীনার হঠাৎ কাজ পড়ে গেল। মাঝে মাঝে ওয়াশিংটন ডিসিতে যেতে হয়, অ্যামেরিকার রাজধানী। ৩১শে মে ও যখন ফিরবে তখন অস্টিন থেকে ট্রেনটা রওনা হয়ে যাবে। তবে পরের বড় স্টেশন স্যান অ্যান্টনিওতে আমাদের বগিটা থাকবে রাত দশটা থেকে পরের দিন ভোর পৌনে তিনটে পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে দেবলীনা স্যান অ্যান্টনিও পৌঁছলে ট্রেন ধরতে পারবে।
টিলার মত উচ্চতায় ২৫০ নর্থ ল্যামার ব্যুলেভার্ডে অস্টিন স্টেশন। একেবারে আমাদের আমোদপুর লাভপুর লাইনের গ্রামের স্টেশন। ফাঁকা। হবে না কেন? সারাদিনে একটি দুটি গাড়ি চলে। যে গাড়িতে চড়বো আমরা তা আসছে শিকাগো থেকে। নাম টেক্সাস ঈগল। স্যান অ্যান্টনিওতে অন্য গাড়ির সঙ্গে জুড়ে যাবে আমাদের কামরা। সে গাড়ি আসবে নিউ অর্লিয়ান্স থেকে, যাবে লস অ্যাঞ্জেলেস। গাড়িটির নাম সানসেট লিমিটেড।
ফাঁকা ষ্টেশন অবশ্য কিছুটা জমজমাট হলো সময় গড়ানোর সাথে সাথে। সবমিলিয়ে কত প্যাসেঞ্জার হবে? জনা তিরিশেক। ওয়েটিং হলেরই এক কোনে স্টেশন মাস্টার কাম বুকিং ক্লার্ক কাম ট্রেন অ্যানাউন্সার কাম আরও কত কিছু কে জানে। সাকুল্যে দুতিনজনের বেশী কর্মচারী দেখলাম না। ওয়েটিং হল আরামদায়ক। গোটা অ্যামেরিকাটাই বাতানুকূল, খোলা আকাশের নিচের অংশ এবং কার পার্ক ছাড়া, গাড়ি বাড়ি সব এসি। সেন্ট্রালি এসি। সুন্দর টেরাকোটার টালি লাগানো ছাদ ষ্টেশন বিল্ডিঙের। অবশ্যই একতলা। উলটো দিকে একটাই লাইন গাড়ি যাওয়া আসার। ষ্টেশনে ঢোকার আগে লাইনটা দুভাগ হয়েছে। প্রয়োজনে ক্রসিং করানো হতে পারে।
লাইনের ওপারেই একটু ঢালু পরিখা। শুকনো। ওপারে লোকালয়। লোকের যাতায়াত আছে হাঁটা পথে। পাশেই বিশাল এক পরিত্যক্ত বাড়ি। তার দরজা জানালা নেই। দেয়ালে অদ্ভুত আর্ট। গ্র্যাফিটি। শহরের হাইরাইজ গুলো দেখা যাচ্ছে ডানদিকে। প্ল্যাটফর্ম বলে কিছু নেই। ছটা বাইশে যে ট্রেন ঢোকার কথা সে ট্রেন এলো প্রায় সন্ধে সাতটায়। ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিল দোতলা ট্রেন। গায়ে নীল রঙের ছাপা অ্যামট্র্যাক। প্ল্যাটফর্মের ওপর টুল দিয়ে ট্রেনে উঠতে হয়। পাদানি অনেক নিচুতেই। আমাদের অবশ্য র্যা ম্প করে দেওয়া হল কারণ এক হইলচেয়ার ভদ্রলোক আমাদের সহযাত্রী। বলতে ভুলে যাব, অ্যামেরিকার প্রায় সর্বত্রই সিঁড়ির পাশাপাশি র্যানম্প আর লিফটের এমন ব্যবস্থা আছে যাতে প্রতিবন্ধীদের কোন অসুবিধেই না হয়। ট্রেনে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেল। ঠিক প্লেনের কায়দাতেই অ্যাটেনড্যান্ট স্বাগত জানালেন। সুন্দর হাতল দেওয়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। একতলা দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলো বাথরুম। একতলায় একটি স্নানের ঘরও আছে। শাওয়ার- ঠাণ্ডা গরম জল। দোতলায় আমরা তিনটি ছোট কামরা ভাড়া করেছিলাম। একেক কামরায় দুজন করে থাকা যায়। নাম রুমেট।
শিকাগো থেকে আসা টেক্সাস ঈগল সাড়ে ছটার বদলে রাত সাড়ে আটটার সময়ে অস্টিন ষ্টেশন ছাড়ল। ট্রেনে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খাবার ঘরে যাবার ডাক পড়লো। লাগোয়া কম্পার্টমেন্টটাই খাবার রেস্তোরাঁ। দেবলীনার খাবারটা পাওয়া গেল না। ও অবশ্য ততক্ষণে ডালাস চলে এসেছে। আর একটা প্লেন ধরে স্যান অ্যান্টোনিও আসবে। আমরা বলে দিলাম, ট্রেনের ডিনার জুটবে না। কেননা ডাইনিং কার তখন বন্ধ হয়ে যাবে। দেবলীনা ডালাসেই এয়ারপোর্টে খেয়ে নেবে।
ডাইনিং কারে আসতেই মেনু ধরিয়ে দিলেন ওয়েটার। রীতিমত মেনু কার্ড- স্টার্টার, ডিনারের যে কোন আইটেম আর ডেসার্ট ফ্রি, মানে টিকিটের মধ্যেই দাম ধরা আছে। মদ্যপান করতে গেলে পয়সা দিতে হবে কেবল।
ট্রেন অস্টিন শহরের মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করল। রাস্তা, উড়ালপুল, দোকান, গাড়িবাড়ি ছাড়িয়ে, ক্রমশ গ্রামাঞ্চলে ঢুকে যাচ্ছে, বাইরে অন্ধকার নেমে আসছে। অন্ধকার হতে দেরি হয়, রাত আটটাতেও আলো থাকে। তবে গ্রামাঞ্চল হলেও সর্বত্রই চওড়া রাস্তা অ্যামেরিকার বৈশিষ্ট্য। প্রচুর গাছ আর জনহীন পথে কয়েকটি গাড়ি চলে। মাঝে মাঝে লোকালয়। দোতলা ট্রেন টেক্সাস ঈগল ছুটে চলে। দোতলাতেই কড়িডোর দিয়ে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়া যায়।
রাত সাড়ে দশটায় স্যান অ্যান্টোনিও শহরে ঢুকছে গাড়ি। দেবলীনা দাঁড়িয়েছে কামরার সামনে। ওঁর পরিচিতি নিশ্চিত করে কামরায় ঢোকার অনুমতি দেওয়া হল। ত্রিজ্ঞ মাকে পেয়ে খুশী হবার অবকাশ পায় নি। ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। দেবলীনা কিছু খেয়ে এসেছিল। আমাদের উদ্বৃত্ত খাবার ডাইনিং কার থেকে প্লেট র্যা পার বন্দী করে নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলোও খেল সে। কিছু গল্প গুজবের পর তিনটে ঘরে আমরা পাঁচজন শুয়ে পড়লাম। একটিতে আমি রাজীব। একটিতে ত্রিজ্ঞ দেবলীনা। অন্যটিতে অজন্তা। সারারাত ঘুমের বারটা। আধমাইল জুড়ে আমাদের বগির শান্টিং। জুড়ে দেওয়া হল নিউ অর্লিয়ান্স থেকে আসা সানসেট লিমিটেড গাড়ির সঙ্গে। বাইরে দেখছি স্যান অ্যান্টোনিও শহরের রেল ইয়ার্ড আর আলোর কারুকাজ। এ শহরে বেড়িয়ে গেছি আগে, বিখ্যাত অ্যালামো দুর্গ দেখেছি। এখন দূরে ওই আলো অন্ধকারে কোথাও আছে। হোটেল আর সুরম্য অট্টালিকার গায়ে ঝলমলে আলো। শহরের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে স্যান অ্যান্টনিও নদী। তার ওপর দিয়ে অজস্র ছোট ছোট পুল। দুধারে রিভার ওয়াক রেস্তোরাঁ। নৌকো করে ঘুরে গেছি সেই পথে কিছু দিন আগে। সে সব হোটেলগুলোর চুড়ো আর আলো দেখা যাচ্ছে ট্রেনের জানালা দিয়ে।
আধোঘুমে ছেড়ে দিল ট্রেন। টেক্সাস বিশাল রাজ্য, যাত্রাপথের অধিকাংশটাই এই রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রসারিত। ভোরবেলায় ডেল রিও ষ্টেশন। ছটা বাজেনি তখনও। একটু পাশ ফিরে আবার কম্বল মুড়ি দিলাম। ঘুম ভাঙল বেশ দেরীতে। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে মৃদু ঘোষণা ব্রেকফাস্ট শুরু হয়ে গেছে। রেস্তোরাঁ কামরাটা পাশেই ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। রাত্তিরে শান্টিংয়ের সময় ট্রেনের মানচিত্রটাই বদলে গেছে। চেপেছিলাম টেক্সাস ঈগলে, এখন সে গাড়ি সানসেট লিমিটেড। গাড়িটা চলছেও উলটো দিকে। বিশাখাপত্তনম বা হাওড়াতে থ্রু ট্রেনগুলোর যা হয় আর কি। রাতের অ্যাটেনড্যান্ট পালটে গেছেন।
আরে ছোট ছোট- ব্রেকফাস্টের সময় পেরিয়ে যায়। পাঁচ ছটা বসা যাত্রীদের কোচ- ২X২ মাঝখানে প্যাসেজ। সেসব পেরিয়ে দেখা মিলল রেস্তোরাঁর। চলন্ত রেস্তোরাঁর মজা আলাদা। রেস্তোরাঁর লাগোয়া অবজারভেশন কোচ। গদি আঁটা চেয়ার সোফা পাতা আছে। বিশাল বিশাল জানালা। ছাদের অনেকটা কাচ ঢাকা। ব্রেকফাস্ট সেরে কফি নিয়ে বসে গেলাম সেখানে। রুক্ষভূমি- ছোট ছোট পাহাড় দূরে। সারাদিনে কত ষ্টেশন এলো। স্যানডারসন, অ্যালপাইন, এল পাসো, (টেক্সাস) ডেমিং, লর্ডসবার্গ, (নিউ মেক্সিকো), বেনসন, টাসকন, ম্যারিকোপা (অ্যারিজোনা)। রাত বারটা নাগাদ এল ইউমা (অ্যারিজোনা)। পেরিয়ে গেল পয়লা জুন। দোসরা জুন ভোর রাতে পেরিয়ে গেল পাম স্প্রিং, অন্টারিও, পামোনা ষ্টেশন (ক্যালিফোর্নিয়া)। ভোর পাঁচটার আগেই পৌঁছে গেলাম লস অ্যাঞ্জেলেস (ক্যালিফোর্নিয়া) ষ্টেশন। নির্দিষ্ট সময়ের আধ ঘণ্টারও আগে।
বলা বাহুল্য, বন্ধনীর মধ্যে রাজ্যগুলোর নাম রেখেছি। মোট যাত্রাপথের দীর্ঘতম এলাকা টেক্সাস রাজ্যে অবস্থিত, আগেই বলেছি। ষ্টেশনের নামগুলোর মধ্যে স্প্যানিশ প্রভাব। রুক্ষভূমি। কোথায় যেন সেই ফিল্ম প্রসিদ্ধ ওয়াইল্ড ওয়েস্ট। চোখের সামনে চলচ্চিত্র দেখি কল্পনায়। ঘোড়ায় চেপে ছুটে আসছে ডেস্প্যারেডো। কোমরে ঝুলছে রিভলভার- ঘোড়ার গাড়ির ওয়াগনে ড্যামসেল ইন ডিসট্রেস। ছুটে আসছে নায়ক। ক্ষিপ্র পদক্ষেপ- শরীর, নায়িকাকে বাঁচাবেই। স্প্যানিশ প্রভাব সমস্ত ল্যাটিন অ্যামেরিকা জুড়ে। ইংরেজি থেমে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। দক্ষিণে আর নামতে পারেনি। এল পাসো শহরের লাগোয়া দেখতে পেলাম মেক্সিকো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা – কাঁটাতার। মেক্সিকো দেশটিও একটি ফেডারেল দেশ। অনেক প্রদেশ সেখানেও। তবে ভারতের সঙ্গে মার্কিন মুলুক বা মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের তফাৎ এই যে সে দেশগুলো মোটামুটি মনোলিথিক। ভাষা এবং ধর্ম দুটোতেই। অবাক লাগে এতো বিবিধতা নিয়েও ভারত আজও একটা দেশ হিসেবেই রয়েছে। জনবিস্ফোরণ সত্ত্বেও ভারতের অগ্রগতি অভাবনীয়।
ভাবছিলাম ভারতের অগ্রগতি নিয়ে। পাকিস্তান দেশটি এখনও বস্তাপচা কাশ্মীর সমস্যা জিইয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। গঙ্গা পদ্মা ঝিলম বিয়াস দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে। ওই দেশটার হিংসুটেপনা আর গেল না। শ্রীহরিকোটা থেকে ভারতে রকেটে সার্কের দেশগুলো তো বটেই- সারা পৃথিবী স্যাটেলাইট পাঠালো আকাশে। পাকিস্তান পাঠালো না। ভারতের ডাক্তারেরা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত পাকিস্তানি আবালবৃদ্ধ বনিতাকে সার্জারি করে, নানা চিকিৎসা করে সুস্থ করে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। সেদেশের মায়েরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে ইন্ডিয়াতে এসে বলে মনেই হচ্ছে না বিদেশ- এতো ভালোবাসা পেয়েছি এখান থেকে। আর পাকিস্তান কেবল বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কতগুলো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ের মাথা চিবোচ্ছে, হাতে অস্ত্র দিচ্ছে- ইন্ডিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে পাথর ছোঁড়ার জন্য পয়সা দিচ্ছে। আরে কাশ্মীর জিতলেও তো পাকিস্তানের লাভ হবে না কিছু। কাশ্মীরীরা স্বাধীনতা চায়- পাকিস্তানের অংশ হয়ে তারা থাকতে চাইবে না। উপমহাদেশ চার টুকরো হবে তাহলে। ইসলামের হেফাজত? পাকিস্তানকে তার জিম্মাদারি দিয়েছে কে? বাংলাদেশ আলাদা হয়েছে। ইসলামের নামে বঞ্চনা সহ্য করেনি। বালুচিস্থান জ্বলছে। সেসব না ভেবে যেন তেন প্রকারেণ ভারতের ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করা ছাড়া এই দেশটার আর কোন কাজ নেই। অথচ সহযোগিতা হলে কত ভালো হত। ভারতের বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাকিস্তানি ছাত্র ছাত্রীরা পড়ার সুযোগ পেত, মেডিক্যাল ট্যুরিজম বাড়ত, পাকিস্তানের খাইবার অঞ্চল পাহাড়ি অঞ্চলে, মন্দির মসজিদ গুরুদ্বার মহেঞ্জোদারো হরাপ্পায় ভারতীয়রা বেড়াতে যেতে পারত। লাহোরের ফুড স্ট্রিট উপচে পড়ত ভারতীয় খাদ্যপ্রেমীদের ভিড়ে। বিজ্ঞান আর কারিগরি সহযোগিতা ব্যবসা বাণিজ্যে সহযোগিতা পৃথিবীর এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক মানচিত্রই বদলে দিতে পারত। কবে যে সুবুদ্ধির উদয় হবে, পাকিস্তানের বিদেশ নীতি কবে পাল্টাবে। দেশে বিদেশে উগ্রপন্থার চাষ আর রপ্তানির বাইরে বেরিয়ে পাকিস্তানকে অন্য কিছু ভাবতে হবে, যদি সত্যিই সে নিজের অধিবাসীদের মঙ্গল চায়। ভারত ভালো থাকলে পাকিস্তানও ভালো থাকবে। এক আবেগের বশে দেশভাগ হয়েছে, দ্বিজাতি তত্ত্ব যার নাম। কিন্তু তার পরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। বার্লিন প্রাচীর ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। রাশিয়া ভেঙেছে। বিশ্বায়ন হয়েছে। বিশ্ব বাজার তৈরি হয়েছে। ইয়োরোপের দেশগুলো কাছাকাছি এসেছে। এক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ব্রেক্সিট ঘটেছে বটে তবে সেটাই শেষ কথা নয়।
লস অ্যাঞ্জেলেস ইউনিয়ন ষ্টেশনে অ্যামট্র্যাক থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হলো ওয়েটিং হলে পৌঁছতে। অবশ্য সামান্য অপেক্ষা করলেই ব্যাটারির গাড়িতে চাপা যেত। ট্রেন ষ্টেশনে ঢোকার আধঘণ্টা আগেই অ্যাটেনড্যান্ট বলে দিয়েছেন টেবিলে কফি, কাগজের ব্যাগে কুকিস, এবং জলের বোতল রাখা আছে। প্রয়োজন মত সেসব নিয়ে আমরা নামতে পারি। বলা বাহুল্য এই ট্রেনটির প্রতিটি কামরায় একজন করে অ্যাটেনড্যান্ট আছেন। তাঁদের কাজ হলো যাত্রীস্বাচ্ছন্দ্য দেখা, বার্থ পেতে দেওয়া, বিছানা ঠিক করে দেওয়া, যে কোন রকম জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনারের সময়ে ডেকে দেওয়া, প্রয়োজনে ডাইনিং হল থেকে খাবারে এনে দেওয়া। দুপুর আর রাতের খাবারের সময় ঠিক করা যাত্রীর ওপর নির্ভর করে। ঘণ্টা দুয়েক সময়ের পরিসর দেওয়া হয়। যাত্রী তার পছন্দের সময় জানিয়ে দেন। আধঘণ্টা বাদে বাদে সেই সময়ে যাত্রীকে ডেকে নেওয়া হয়।
একটি বড় সুটকেস আমরা গাড়িতে ওঠার আগেই অস্টিনের ষ্টেশন মাস্টারের কাছে জিম্মা করেছিলাম। সেটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে লটবহর সমেত যৎসামান্য বিশ্রাম নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম পাতালরেল ধরতে। এখানেও তার নাম মেট্রো। সাবওয়েও বলা হয়। ১৫ মিনিটের পাতালরেল যাত্রার পরে পৌঁছে গেলাম হলিউড হাইল্যান্ড ষ্টেশনে। পরপর ষ্টেশনগুলোর নাম Civic Center/Grand Park, Pershing Square, 7th St/Metro Center, Westlake/MacArthur Park, Wilshire/Vermont, Vermont/Beverly, Vermont/Santa Monica, Vermont/Sunset, Hollywood/Western, Hollywood/Vine, Hollywood/Highland।
হলিউড হাইল্যান্ড ষ্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা শপিং মল।তার মধ্য দিয়ে কিছুটা গেলেই আমাদের হোটেল। ছিমছাম বাহুল্যহীন – কোন বড় লাউঞ্জ নেই। নাম হলিউড অর্কিড স্যুইটস। আমাদের বুকিং ছিল বেলা তিনটে থেকে। কিন্তু সঙ্গে ত্রিজ্ঞ আর মালপত্তর। তখনই ঘর দিয়ে দেওয়া হল অতিরিক্ত কোন খরচ ছাড়াই। সাড়ে সাতটা থেকে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্নও জুটে গেল। বিশাল ঘর, ডাইনিং স্পেস, রান্নাঘর, টয়লেট সমেত স্যুইট।
খরচের খুঁটিনাটিতে ঢুকি না। যেটুকু শুনি অনেকটাই ভুলে যাই। যতটুকু মনে আছে বলি। আমাদের পাঁচজনের ট্রেনভাড়া ১৭০০ ডলারের কাছাকাছি। আমরা যে হোটেলে উঠেছি তার ঘরভাড়া পাঁচজনের যথেচ্ছ ব্রেকফাস্ট সমেত দৈনিক দুশো ডলার। অস্টিনে গাড়ি রেখে ট্রেনে উঠেছিলাম আমরা। ফিরতেও হয়েছে সেই অস্টিনে। প্লেনভাড়া একেকজনের দেড়শো ডলারের মত।
অ্যামট্র্যাক ট্রেনে – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
আমার মুগ্ধবোধ, চৈতন্যের সহজ হাতছানি;
সে আমাকেই ফেলে রেখে ছায়া ছুটে যাচ্ছে
বনানীতে বিপরীতে, আমার থেকেও বেশি জানে?
দ্রুতগতি ট্রাকের হেডলাইট ছুঁড়ে দেয় মায়া-
প্রিয়তমা এমন দিনে আমাকে রেলরোডে রেখে
তুমি কি চলে যাচ্ছ অতল গহ্বরে?
লক্ষ্যবস্তু ভেদ করে চলে যাচ্ছে অগোছালো তির,
পৃথিবীর পরিচিত গুঞ্জন যেন দূরাগত ফুলবাস
ভেসে আসে নিশীথ উদ্যান থেকে।
দ্রুত সরে যায় যাবতীয় গ্রামীণ প্রহর
রাত্রির মধ্যযামে; অ্যামট্র্যাক মার্কিন ট্রেনে
তরঙ্গ আসে কানে,
যেন নদীর ঢেউ ডেকেছে ছলাৎ আহ্বানে।
Comments
Top
ঝান্ডি-কথা
নিলাদ্রী দেব
কোচবিহার, পশ্চিমবাংলা
শহরের ব্যস্ততার ঘাম পাহাড়ের কাছাকাছি এসে শুকিয়ে গেল। তেমনটাই চেয়েছিলাম যদিও লাভা, লোলেগাও এর রাস্তাকে ডান হাতে রেখে খাড়াই সাপ-রাস্তা বেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে গন্তব্যে পৌছনোর কিছুটা আগে দাড়িয়ে গেলাম হঠাৎ বৌদ্ধ গুম্ফাটির ঠিক পাশে। গুম্ফাটি ছোট হলেও অদ্ভুত সুন্দর। এর বাঁয়ে পাথুরে সমতল, একেবারে পাহাড়ের পায়ে এসে মিলিয়ে গেছে। সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে গবাদির দল। মাঠে সবুজ ঘাস-কার্পেটের মাঝে বেশ বড় বড় কালো পাথর মাথা তুলে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
কিছুটা এগিয়ে এলাম। আবার বাধ্য হলাম দাড়াতে। প্রকৃতির চুম্বকটি যেন বারবার টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনছে প্রকৃতিরই কোলে। এখানে বাঁয়ে খাদ। ডানে পাহাড় প্রাচীর। রাস্তার দুপাশে বসবার মত ছোট দুটো জায়গা। ওরই একটাতে বসে খাদের ওপারের পাহাড় দেখছিলাম। এ পাহাড়ে সূর্যালোকের বাহারি আস্তরণ। রাস্তার কালো পিচের ওপর নেমে আসা সূর্য রেখা কাটাকুটি খেলছে আসেপাশের ডালপালা কিংবা পাতাদের সাথে।
এগুলো পেরিয়েই এলাম ছোট্ট একটা গ্রামে। সে গ্রাম আধুনিকতার প্রলেপে অপূর্ব সাজে সেজে উঠেছে। গড়ে উঠেছে ইকো হাটস্। এখানে পৌছেই নিজের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলাম পুরোপুরি। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি। তা বেয়ে নেমে এলে পাহাড়-বাড়ির প্রবেশ পথ। আশ্রয় জুটিয়ে দৌড়ে পৌছলাম এ বাড়ির মাথায়, ছাদে। জড়িয়ে ধরল মেঘের দল। এরপর অনেকক্ষণ চুপ। ছাদের ঠিক মাঝে একদম চুপ করে বসে দেখছি মেঘ রাজ্যের কার্যকলাপ। এ রাজ্যে সীমান্ত বলে কিছু নেই। মেঘের দল এখানে আপন মনে ভেসে যায় দেশ, কালের গন্ডী ভুলে। এখানে সূর্য কখনো মুখ ঢাকে, কখনো মুখ তুলে চায়। মেঘ পর্দার মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো, অনেকটা ঈশ্বরের আলোর মত চোখে এসে লাগল। এক ঐশ্বরিক আবহ যেন ঘিরে আছে পুরো পরিবেশকে। ধোঁয়ার মত উঠে আসা মেঘ-ঢেউয়ে দূরের পাহাড়গুলো নিজেদের লুকিয়ে নিচ্ছে ক্রমশ। আবার জেগে উঠছে. এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে বোঝা যায়, আকাশ আর পাহাড় মিলে একটা বিরাট ক্যানভাস গড়ে তুলেছে। তার মাঝে কিছু অপরিচিত মুখের মত. প্রথমবারের জন্য চিনে নিতে চেষ্টা করি। এ চেষ্টাতেই দুপুর গড়িয়ে যায় নিজের খেয়ালে।
মোবাইলে কোনো নেটওয়ার্ক নেই। নেই কোনো ফোন কল। যোগাযোগহীন ভাবে বেঁচে থাকা যে কত শান্তির, তা হয়তো বলে বোঝানোর নয়। অনুভব-ই বুঝে ওঠার একমাত্র পথ। এমন অজস্র সব অনুভূতি, মেঘেদের গল্পগাঁথা আর অনেক অনেক দৃশ্য-ভিড়ের মাঝে আমি যেন ডানাহীন ভাবেও ভাসছি। নস্টালজিয়ায় বেসামাল হয়ে পড়ছি।
ছোটবেলার ভাবনাগুলো যেন ঘুরে ফিরে আসছে।
"আচ্ছা, মেঘেদের কি ডানা থাকে?
তাহলে ওরা উড়ে বেড়ায় কীভাবে?"
এতসব প্রশ্ন-ভিড়ই স্বপ্নপথ তৈরী করছে। যে পথ ধরে সেকেন্ডে সেকেন্ডে সৃষ্টি হচ্ছে - গল্প নয়, এক একটি উপন্যাস যার প্রতিটি পাতায় স্বপ্নের আনাগোনা। যে স্বপ্ন খানিকটা স্বপ্ন বটে। বাকিটা বাস্তব।
দুপুরে ছুঁয়ে দেখা স্বপ্নকে ঘিরেই বিকেল এল। খুব তাড়াতাড়ি নেমে এল সন্ধ্যেও। চারপাশে মেঘেদের কুয়াশাচ্ছন্ন মুখ। পাহাড়ের ঢালে বাড়িগুলোর ছাদ, ঘরের টিন বেয়ে মেঘেরা ওপরে উঠে আসছে। সাথে হিমেল হাওয়া। এবার ঠান্ডা লাগছে। আর রোমাঞ্চ চেপে আছে সোয়েটারের মত। মাথার ওপরে তিব্বতি পতাকাগুলো উড়ে চলছে। উড়েই চলছে। ওতে অজানা সব মন্ত্রের স্ক্রিপ্ট। অজানা হলেও মূল বোধটা খুবই পরিচিত। আসলে এমন সবটাই যে জীবনের কথা বলে। বলে সম্প্রীতির কথা, ভালবাসার কথা। যে ভালবাসাকে কেন্দ্র করে বৃত্ত আঁকে অনেক সম্পর্ক, যাকে ঘিরেই আমাদের প্রতিদিনের এই বেঁচে থাকা।
এতসব চিন্তা ভাবনার মাঝেই কখন যে দূর পাহাড়ের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলেছে, ঠিক চোখে পড়েনি। হঠাৎ দেখে সেগুলোকে তারা বলে মনে হল। মনে হল আকাশের তারাদের থেকে পাহাড়ের তারারা যেন অনেক কাছে এসে দাড়িয়েছে। কোজাগরীর প্রায়-পূর্ণচাঁদ এদিকে আলোর জোয়ার এনেছে। সে জোয়ারে ডুব দিলাম। ডুবে গেলাম আনন্দে, উচ্ছলতায় আর স্বপ্নময়তায়।
ভেসে উঠলাম ভোরে। আধঘুমে বিছানায় এলিয়ে ছিলাম। পর্দা তুলতেই 'গুড মর্নিং' বলে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘা।এরপর আবার ঘুম-লেপের ভেতরে।
হাতঘড়ি জানান দিল ফিরে আসার সময়।
গতরাতের স্বপ্ন, গল্প, কবিতা, গান, আড্ডা, রাত-ঘরের বিছানা, বালিশ, সাত সকালের চা, স্থানীয় মোরগের ডাক, পাথরের ওপর পাথরে সাজানো রান্না ঘরের দেয়াল, খানিক লালচে মাটি দিয়ে লেপে রাখা দুয়ার আর হঠাৎ পরিচিত হয়ে ওঠা সেই মুখগুলোকে মনের অ্যালবামে তুলে রেখে, পাহাড়ি ফুল আর ঝর্ণায় নেমে আসা নুড়িদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে চেনা রাস্তা ধরে চেনা ঠিকানার দিকে রওনা হলাম।
বাম হাতে বিশাল ভ্যালি। সমতলের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলছে গাড়ি। পেছনে আমার একদিনের জীবন।
ঝান্ডি। দার্জিলিং। 06,07/10/2017
(শহরে এসে জ্বর জ্বর ভাব। জ্বরের উষ্ণতার সাথে মিলে যাচ্ছে ঝান্ডি উপাখ্যানের বন্ধুত্বের উষ্ণতা. ভীষণরকম মনে পড়ছে দাদাকে, প্রবীর দা'কে, তন্ময় আর পান্না পাহাড়কে।)
Comments
Top
রূপকথার শহর
প্যারিস ডিজনিল্যান্ড শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য
নেদারল্যান্ড
ভারসেইলেস রাজপ্রাসাদের বাইরের দৃশ্য)
ভারসেইলেস রাজপ্রাসাদের ভিতরের দৃশ্য
বিগত কয়েক দশক ধরে সারা পৃথিবীতে ভ্রমণ রসিকদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছুটির গন্তব্যের তালিকায় শীর্ষস্থানে ছিল প্যারিস শহর। এই শহর টুরিস্টদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রধানত তার প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, মনোরম চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্প,এবং আকাশচুম্বী আইফেল টাওয়ারের শোভার জন্য।আর ছোটদের পছন্দের তালিকায় প্রথম নাম হল প্যারিস ডিজনিল্যান্ডের। এই জনপ্রিয়তার প্রধান আকর্ষণ হোল কার্টুন ছবির চরিত্র ‘মিকি মাউস’, ‘ডোনাল্ন্ডডাক’, ইত্যাদির উপস্থিতি, আর আধুনিক যন্ত্রচালিত নানারকম রোমাঞ্চকর “রাইডস”। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে শেষ তিন চার বছরে এই জনপ্রিয়তায় কিঞ্চিত ভাঁটা লেগেছে ফ্রান্সের বুকে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী ঘটনায়।
গত বছরের শীতের ছুটিতে ক্রিসমাসের সময়ে প্যারিস আর ডিজনিল্যান্ড বেড়িয়ে এলাম। এই সময়ে সবাই খুশির মেজাজে থাকে কারণ ক্রিসমাস ইউরোপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আনন্দের উৎসব। সারা ইউরোপের সব বড় শহরগুলোতে বসে ক্রিসমাসের বাজার, বিক্রি হয় রকমারি ঘর সাজানের জিনিস, জমকালো পোশাক, সুস্বাদু খাবার, বিভিন্ন ধরণের অ্যালকোহলের পানীয়, ইত্যাদি। থাকে অনেকরকম মনোরঞ্জনীয় খেলার সরঞ্জামও। বড় শহরগুলোকে সাজানো হয় রংবেরঙের আলো দিয়ে, থাকে সুসজ্জিত ঝকমকে ক্রিসমাস ট্রি। এই সময়ে প্যারিসের মতো শহরে ঘুরে বেড়ানো দারুনই মজার। বড়দিনের ঠিক দুদিন আগে পৌঁছলাম প্যারিস শহরে। ঘর নিলাম একদম শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে যাতে শহর জীবনের স্বাদটা বেশী করে উপভোগ করতে পারি। প্রথমদিন আমরা পায়ে হেঁটে শহরের কিছুটা অংশ দেখলাম। প্যারিস শহরের বুক জুড়ে বয়ে চলেছে অপূর্ব সুন্দর সিন নদী। আর নদীর দুই প্রান্তকে যুক্ত করেছে কিছু দূরে দূরে বানানো সেতু। প্রতিটি সেতুই তার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে সুদৃঢ় ভাবে দৃপ্তমান। আর সিন নদীর দুইপ্রান্ত জুড়ে রয়েছে সুদৃশ্য ঐতিহাসিক ভবন, রাজকীয় প্রাসাদগৃহ, স্মৃতিস্তম্ভ। এইসব দৃশ্যাবলীর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সিন নদীবক্ষ জুড়ে চলে সারা দিনব্যাপী নৌকাভ্রমণ। অবশ্য নদীর পাস ধরে শহরের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে হেঁটে বেড়াতেও বেশ লাগে।
প্যারিস শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে সুবিখ্যাত বিশালাকার ভারসেইলেস রাজপ্রাসাদ। এই মহাকায় প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ১১শ শতাব্দীতে মূলত রাজ বাসস্থান হিসেবে। রাজা লুইস ১৪ এবং তার পরবর্তী কয়েক পুরুষ বংশধরেরা এই প্রাসাদে বাস করেছেন ফরাসী বিপ্লবের আগে পর্যন্ত। বিংশ শতাব্দী থেকে এই প্রাসাদটি মূলত জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে সংগৃহীত আছে ফরাসী সম্রাটদের বংশপরম্পরায় সঞ্চিত শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, গৃহসজ্জা, রাজকীয় দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সরঞ্জাম। এই বিপুলাকার প্রাসাদভবনটি ঘুরে দেখতে পুরো দিন কেটে যাবে। তবে এই রাজপ্রাসাদ পর্যবেক্ষণ থেকে নিঃসন্দেহে আঘ্রাণ করা যাবে ফরাসী রাজাদের জীবনশৈলী। ভারসেইলেস প্রাসাদের চারিদিক জুড়ে রয়েছে অতি মনোরম সুসজ্জিত বাগিচা, পুষ্করিণী আর পায়ে হেঁটে বেড়ানোর পথ।
ডিজনি পার্কের রূপকথার দুনিয়া-দিনের এবং রাতের আলোয়
ডিজনি পার্কে ঢুকতেই চোখে পরবে অপূর্ব সুন্দর ক্যাসেল, যেটি ওয়ার্ল্ড ডিজনির সিনেমার প্রতীকী। সন্ধ্যের সময় এখানে আলো আর সঙ্গীতের সমন্বয়ে খুব সুন্দর ফোয়ারার খেলা প্রদর্শিত হয়। তাছাড়া প্রতি সন্ধ্যাবেলা এই পার্কে প্যারেড শো হয় যেটিতে ডিজনি সিনেমার সব চরিত্র এবং মডেল গুলোকে একই সঙ্গে দেখা যায়। এই প্যারেড শোটি অসম্ভব জনপ্রিয়। এইটি চলাকালীন হাজারে হাজারে গুণমুগ্ধ দর্শক আর উৎফুল্ল ছোট-বড় বাচ্চারা অধীর আগ্রহে রাস্তার দুইধারে দাড়িয়ে হর্ষধনি করতে থাকে।
ডিজনি পার্কের সন্ধ্যাবেলার প্যারেড শো
ক্রিসমাসের সময়ে ডিজনি পার্কে আরও একটি বিশেষ প্যারেড শো দুপুরবেলায় আয়োজিত হয়। এই বিশেষ সময়ের কথা মনে রেখে ক্রিসমাসের মূলভাবে সজ্জিত হয় এই প্রদর্শনীটি। সান্তাক্লজ আর তার সঙ্গী সাথীরা ক্রিসমাসের গানের ছন্দে তাল মিলিয়ে রঙিনযানে চরে আনন্দের ঢেউ নিয়ে আসে আকাশে বাতাসে, মনে হয় যেন কোন এক স্বপ্নের রাজ্যে পৌঁছিয়ে গেছি আমরা সবাই যেখানে দুঃখের লেশ মাত্র নেই। ছোটোদের খুশীর সীমা থাকে না এই আনন্দের ছন্দে তাল মিলিয়ে নিজেদের ভাসিয়ে দিতে।
ক্রিসমাসের রাতের আলোয় রঙিন নোত্রদাম গির্জার দৃশ্য
সিন নদীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত“নোত্রদাম”গির্জা যেটি পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় তার গগনচুম্বী উচ্চতা আর নান্দনিক গোথিক স্থাপত্যশৈলীর কারণে। এই গির্জাটি প্রায় ৮৫০ বছরের পুরনো। প্রতি বছর লক্ষ কোটি মানুষজন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসে এইটি দেখতে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দেখতে গেলে এইটি সমগ্র ইউরোপের পর্যটকদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ক্যাথেড্রাল। নোত্রদাম ছাড়াও প্যারিসের আরও একটি অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং ফ্রান্সের সর্বাধিক পরিচিত প্রতীক হোল “আইফেল টাওয়ার”। গুস্তাভো আইফেল নির্মিত (১৮৮৯) জগৎবিখ্যাত এই টাওয়ারটি উচ্চতায় ৩২০ মিটার।বিভিন্ন আকৃতির ছোট-বড় লোহনির্মিত কাঠামো জোড়া দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। টাওয়ারের পাদদেশ থেকে লিফট নিয়ে দুইটি বিভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছানো যায়। এখান থেকে দেখা যেতে পারে পুরো প্যারিস শহর এবং সিন নদীর অতি মনোরম দৃশ্য। সন্ধ্যাবেলায় প্রতি ঘণ্টায় আইফেল টাওয়ার ঝিকিমিকি আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয় শুধুমাত্র ৫ মিনিটের জন্য। টাওয়ারের উপর থেকে রাতের প্যারিস শহরের দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব।
রাতের আলোয়
আইফেল টাওয়ার
ল্যুভরে মিউজিয়ামের ভিতরের স্থাপত্যের নিদর্শন
প্যারিসের আরও একটি দৃষ্টব্য বস্তু হোল“আর্ক দ্য ট্রায়ম্ফ” (উচ্চতা ৫১ মিটার)।এই স্মৃতিস্তম্ভটি ফ্রান্সের সৈনিক বাহিনী যারা ফরাসি বিপ্লবের সময় দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। এটি নেপোলিয়নের বিজয় স্তম্ভ হিসাবেও পরিচিত।এই স্তম্ভের পাথরের বুকে খোঁদাই করা রয়েছে সমস্ত ফরাসি সৈনিকদের জয়লাভের ইতিহাস এবং সেনাপতিদের নাম। এই বিখ্যাত স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে ১৮৩৬ সালে এবং অবস্থিত অভিজাত শঁম-জে-লিজে মহারাস্তার পশ্চিম প্রান্তে এবং প্লাস দ্য লেতোয়াল এর কেন্দ্রে। এর একদিকে রয়েছে বিখ্যাত ল্যুভরে মিউজিয়াম, অন্যপাশে ফ্রান্সের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই স্মৃতিস্তম্ভটি পুরাতন প্যারিস এবং নতুন প্যারিসের সংযোগস্থল। আর প্রসিদ্ধ শঁম-জে-লিজে রাস্তার দুই ধার জুড়ে রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত “ব্রান্ডেড”জমকালো দোকানের মহাসমাবেশ। স্বনামধন্য ডিজাইনারদের তৈরি বিলাসবহুল জামাকাপড়ের দোকান, জুতো, সুগন্ধি, ঘড়ি, ব্যাগ, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম- কি নেই এখানে। পৃথিবীর ধনী ক্রেতাদের স্বপ্নরাজ্য এই জায়গা। আর ক্রিসমাসের সময়ে এই পুরো অঞ্চলটি সুসজ্জিত হয় চোখ জুড়ানো রংবেরঙের আলো দিয়ে। তাই এক কথায় সন্ধ্যেবেলার প্যারিস শহর অনবদ্য এবং দৃষ্টি মধুর।
আর্ক দ্য
ট্রায়ম্ফ
ল্যুভরে মিউজিয়ামের ভিতরের স্থাপত্যের
নিদর্শন
প্যারিসের ল্যুভরে জাদুঘরের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এইটি হল পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ, পুরাতন এবং সুবিখ্যাত শিল্প প্রদর্শনশালা। এই ঐতিহাসিক কলাভবনটি সিন নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। ল্যুভরে মিউজিয়াম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প সংগ্রহালয়, যেটিতে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ দর্শক আসেন এই অসাধারণ ভবনটি পরিদর্শন করতে। বহু প্রাচীন ব্যবিলিওন, মিশরীয়, চীন দেশের প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, ইসলামি শিল্পকলা, গ্রিক রোমান স্থাপত্য,ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও এশিয়ার চিত্রকলা, ফরাসী সভ্যতার ইতিহাস – এক কথায় পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাস, কলা আর স্থাপত্য শিল্পের অপরিসীম গুপ্ত ভাণ্ডার এই ল্যুভরে মিউজিয়াম। আর এই জাদুঘরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা।
টাওয়ারের উপর থেকে প্যারিস শহরের শোভা
এই মনোরম প্যারিস শহরের আরও একটি প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্য স্থান হল শ্বেতশুভ্র ক্যাথলিক গির্জা “সেক্রে কেউর”, যেটি রোমান এবং বাইজেনতাইন স্থাপত্যের নিদর্শন। এটি প্যারিসের সেক্রেড হার্টের বেসিলিকাতথা যীশু খ্রীষ্টের পবিত্র হৃদয়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।এই গির্জাটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মূলত যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলার জন্য এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি ঐশ্বরিক ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে।এই গির্জাটি একটি পাহাড়ের উপরে নির্মিত এবং এখান থেকেও প্যারিস শহরের অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে। প্যারিস শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে সুবিখ্যাত বিশালাকার ভারসেইলেস রাজপ্রাসাদ । এই মহাকায় প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ১১শ শতাব্দীতে মূলত রাজ বাসস্থান হিসেবে। রাজা লুইস ১৪ এবং তার পরবর্তী কয়েক পুরুষ বংশধরেরা এই প্রাসাদে বাস করেছেন ফরাসী বিপ্লবের আগে পর্যন্ত। বিংশ শতাব্দী থেকে এই প্রাসাদটি মূলত জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে সংগৃহীত আছে ফরাসী সম্রাটদের বংশপরম্পরায় সঞ্চিত শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, গৃহসজ্জা, রাজকীয় দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সরঞ্জাম। এই বিপুলাকার প্রাসাদভবনটি ঘুরে দেখতে পুরো দিন কেটে যাবে। তবে এই রাজপ্রাসাদ পর্যবেক্ষণ থেকে নিঃসন্দেহে আঘ্রাণ করা যাবে ফরাসী রাজাদের জীবনশৈলী। ভারসেইলেস প্রাসাদের চারিদিক জুড়ে রয়েছে অতি মনোরম সুসজ্জিত বাগিচা, পুষ্করিণী আর পায়ে হেঁটে বেড়ানোর পথ।
ডিজনি পার্কের ক্রিসমাসের বিশেষ প্যারেড শো
লক্ষণীয় যে বিশেষত ছোটো ছোটো মেয়েরা অনেকেই আসে রূপকথার রাজকন্যার সাজে, আর শরীক হয় এক অবর্ণনীয় অনাবিল আনন্দের।
ডিজনিল্যান্ডের দ্বিতীয় পার্কটি হোল ডিজনি স্টুডিও। এখানেও অনেকগুলো রোমহর্ষক রাইডস আছে। মিকি মাউসের সাথে নিজের ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলে সেটিও মিটতে পারে এই স্টুডিও চত্বরে, তবে তার জন্য ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করতে হতে পারে। এই ডিজনি স্টুডিওর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল এখানে সিনেমা বানানোর গুপ্ত রহস্য সহজ ভাবে প্রদর্শন করা আছে। কিভাবে অ্যানিমেশেন ছবি বানানো হয়, সিনেমায় কি ভাবে বিভিন্ন স্টান্ট অথবা অ্যাকশন দৃশ্য দেখানো হয়, কিভাবে তৈরি করা হয় ভূমিকম্প, আগুণ বা বন্যার দৃশ্য, স্টুডিয়োতে বসেই কি ভাবে বিভিন্ন দেশকে ক্যামেরা বন্দি করা হয়, তৈরি করা হয় সিনেমার সব বিন্যাসক্রম- এই সবকিছু কারুকলা সুন্দরভাবে বর্ণিত এবং প্রদর্শিত করা আছে। তাছাড়াও আছে কিছু লাইভ পারফরমেন্স শো যেগুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ডিজনি সিনেমার সংকলন দিয়ে। তাই এক কথায় পুরো সিনেমা জগতের গোপন তথ্য জানা যাবে, আর জনপ্রিয় ডিজনি নির্মিত ছবিগুলোর টুকরো টুকরো ঝলক দেখা যাবে এই পার্কের অভিযানে।
ডিজনি স্টুডিও চত্বর
ডিজনিল্যান্ডের দুটো পার্ক ঘোরার পরে এখানকার দোকান থেকে কিছু প্রতীকী কেনা যেতে পারে স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ। পার্কের বাইরে রয়েছে বিশালাকার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর রঙ্গশালা। এখানে একসাথে দশটির বেশি সিনেমার প্রদর্শনী চলতে থাকে।
প্যারিস আর ডিজনিল্যান্ডের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার পরে এবার বাড়ি ফেরার পালা। এই যাত্রায় অনেক দৃষ্টিনন্দনীয় স্থাপত্য, অপূর্ব শিল্পকলা, রোমাঞ্চকর রাইডস, রূপকথার দুনিয়া দেখা হল। কিন্তু তার ফাঁকে আরও কিছু দেখলাম যার কথা না উল্লেখ করলে এই ভ্রমণ কথা সম্পূর্ণ হবে না। রাতের প্যারিসের রাস্তায় দেখেছি অনেক গৃহহীন মানুষ জনকে যারা তাদের ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে দোকানের বাইরের ছাদের নীচে নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছে। এই মানুষজনেরা অনেকই এসেছে সিরিয়া, ইয়মেন বা আফ্রিকার যুদ্ধ বিদ্ধস্থ দেশগুলো থেকে।
একফালি ছাদ আর এক টুকরো রুটির জন্য তারা টুরিস্টদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে। হিমশীতল রাতে তারা কতটা অসহায় সেটা চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা যায় না।ফরাসী সরকার এবং ইউরোপের অন্য দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ঠিকই, তবে সব সাহায্যপ্রার্থীর কাছে সঠিকভাবে পৌঁছনো বোধহয় অসম্ভব। আরও একটি ব্যাপার এবার বেশ নজর কেড়েছে সেটা হল বন্দুকধারী পুলিশের টহলদারি। সাম্প্রতিক কালে নোত্রদামগির্জা, আইফেল টাওয়ার বা ল্যুভরে মিউজিয়াম প্রবেশপথে চলছে সব দর্শনার্থীর শরীরের চিরুনি তল্লাশি। প্যারিসের মহারাস্তায়, স্টেশন চত্বরে এবং শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে সারা দিনরাত্রি জুড়ে সশস্ত্র পুলিশের তটস্থ পাহারা। তাই প্যারিস শহর বেড়ানোর মজায় কিছুটা ঘাটতি অবশ্যই পড়েছে। আশারাখি আগামী দিনগুলোতে আমাদের পৃথিবী থেকে সন্ত্রাসের অবসান ঘটবে এবং ভ্রমণপ্রিয় মানুষজন দেশে বিদেশের সব জায়গায় নিঃসঙ্কোচে যেতে পারবে এবং এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ পুরোমাত্রায় পুনরায় উপভোগ করতে পারবে।
সেক্রে কেউর গির্জারদৃশ্য
মোনালিসা
Comments
Top
ঐতিহ্যময় কিয়োতোর
আশে পাশে
অরুন্ধতী ঘোষ, পিটসবার্গ
পিটসবার্গ, ইউ এস এ
তোডাইজি মন্দিরের ভৈরচেন বুদ্ধ
বাঁশবাগানের মধ্যে (আরাসিয়ামা)
আগের লেখাতেই জানিয়েছি, আমাদের একমাত্র মেয়ে কিয়োতোর দোশিশা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল। তার একান্ত ইচ্ছায় আমরা স্বামী-স্ত্রী ও আমার মা-তিনজনে কিয়োতো বেড়াতে গেছিলাম ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। যদিও সময়টা ছিল গরমকাল- প্রচন্ড গরমেও কিন্তু আমাদের বেড়ানোর আনন্দ বিন্দুমাত্র কমেনি। সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা কিছুটা লিখেছি আগের লেখায়।
আগের লেখাটিতে ছিল কিয়োতো বেড়ানোর বিস্তারিত অভিজ্ঞতা। কিয়োতো সত্যিকারের ঐতিহ্যময় শহর, কিন্তু তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জায়গাগুলির মাধুর্য কম নয়। এই লেখাতে থাকছে সেকথা।
আরাসিয়ামা
বাঁশবাগান ও হোজু-গাওয়া নদী ঘেরা আরাসিয়ামা জেলা,অনেকটা আমাদের মফস্বল শহরের মত। এটির অবস্থান কিয়োতো শহরের একটু পশ্চিমে। ভোর ভোর জে আর (J R) স্টেশন থেকে ট্রেনে করে আরাসিয়ামা এলাম। স্টেশন সংলগ্ন কাফেতে চা-জলখাবার খেয়ে যখন আরাসিয়ামার প্রধান আকর্ষণ তেনরিউজি বৌদ্ধমন্দিরের দিকে যাচ্ছিলাম, ছবির মত পথের দুদিকে চোখে পড়ছিল সুন্দর,ছোট ছো্ট বাড়ি দোকান। দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম তোগেৎসু-কিও ব্রিজের দিকে।হোজি-গাওয়া নদীর ওপরের এই ব্রিজটি শহরের একপ্রান্তকে আরেকপ্রান্তের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
তেনরিউজি মন্দিরের বালি-পাথরের বাগান
বোঝাই যায়, বসন্ত বা শরতকালে এই ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটলে অন্য অনুভূতি, কারণ ব্রিজের দুপাশেচেরী গাছের সারি। আমরা গেছিলাম জুলাই-এর শেষে, তাও আমাদের বেশ ভালোই লাগল। ব্রিজ পেরিয়ে দোকানপাট-শিল্পকলা, খাবার ইত্যাদি। অনতিদূরেই তেনরিউজি মন্দির।সম্রাট কামেয়ামার (১৩শ শতাব্দী)পল্লীনিবাশ এই বাড়িটি ১৪শ শতাব্দীতে মন্দিরে রূপান্তরিত হয়।মন্দিরের প্রধান বাগান (শুষ্কবাগান)- জল, বালি ও পাথর দিয়ে সাজানো পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে- এক অপূর্ব দৃশ্য।বিভিন্ন দিক থেকে বাগানটিকে দেখার জন্য বাগানের সামনে ও পাশে দুটি বাড়ির মধ্যে বসার জায়গার ব্যবস্থা আছে। এক অভূতপূর্ব অনুভূতি হল মনে- ওপরে আকাশ, নিচে পাহাড়, পাহাড়ের সামনে ছোট্ট পুষ্করিণী, তার মধ্যে বিভিন্ন আকার ও আয়তনের পাথর বসানো। পুষ্করিণীর ধারে গাছ ও সামনে তটে বালি ছড়ানো। বালির ওপরে সমান্তরাল লাইন টানা। আবার সেই সীমার মধ্যে অসীম আনার প্রচেষ্টা- যার কথা আমি আগের লেখায় উল্লেখ করেছি।
ওপরে নীল আকাশ আর নিচে পুষ্করিণীর জলে সেই আকাশ,পাহাড়,গাছ ও পাথরের ছায়া পড়েছে।দেখেই কবিগুরুর সেই গান মনে পড়ে গেল “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে”।কিছুক্ষণ বসে সেই দারুণ দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম আমরা। সবাই নির্বাক, নিস্তব্ধ। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন অনেক পর্যটক ও তীর্থযাত্রী- সবারি এক অবস্থা। সেই মুহূর্তে আমরা বিভিন্ন দেশের মানুষ সবাই একাগ্রচিত্তে এই অপূর্ব বাগানের এবং তৎসংলগ্ন প্রকৃতির মেলবন্ধন দেখতে দেখতে আত্মমগ্ন হলাম। তেনরিউজি মন্দির থেকে বেরিয়েই একটি বাঁশবাগান-দুপাশে সারি সারি বাঁশগাছ- তার মাঝখান দিয়ে পায়ে হাঁটা মাটির পথ। মন্দির থেকে বেরিয়েই এই ছায়ায় ঢাকা সেই ঠান্ডা মনোরম বাঁশবাগান আমাদের মনে গভীর প্রশান্তি এনে দিল। ফেরার পথে আমরা আরো দুটি বৌদ্ধমন্দির দেখলাম- হোরিনজি ও তেনবুজি। দুটিই আমাদের বেশ ভালো লাগল।
নারা
৭১০-৭৮৪ খৃষ্টাব্দ অবধি, কিয়োতো রাজধানী হবারও আগে, জাপানের রাজধানী ছিল নারা। শহরটি কিয়োতো থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে।কিয়োতোতে রাজধানী স্থানান্তরিত হবার পর নারা রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঐতিহাসিক সম্পদ সংরক্ষিত ছিল দীর্ঘদিন ধরে।তাইতো আমাদের মতো পর্যটকরা উপভোগ করি এদের মন্দিরের ও মিউসিয়ামের সংরক্ষিত সম্পদ।
নারাতে আমরা দেখতে পাই ভারতবর্ষ থেকে আগত বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন চিহ্ন, চীনের তাং সাম্রাজ্যের ও কোরিয়ার স্থাপত্য, গ্রীস, টার্কি ও পারস্য থেকে আসা শিল্পকলার সম্ভার।তৎকালীন চীন ও কোরিয়া থেকে জাপানে এসেছিলবৌদ্ধধর্ম।এখানে বৌদ্ধধর্মের প্রতীক বা চিহ্নের ব্যাবহার দেখতে পাই মন্ডলার মধ্যে। মন্ডলার উল্লেখ করেছি আগের লেখায়-কিয়োতোর তোজি মন্দিরে।মণ্ডলা হল ২১টি মূর্তির সমষ্টি। মাঝখানে বুদ্ধ, দুইপাশে দুই বোধিসত্ত্ব (যাঁরা নির্বাণলাভ না করে মানুষের সেবার জন্য নিযুক্ত), আটজন মিয়ো বা বিচক্ষণ রাজা- যাঁরা জনগণকে কঠোর সংযমের সাহায্যে পরিচালিত করেন, দশজন তেন্বু বা রক্ষক- যাঁরা বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও মিয়োদের রক্ষা করেন।
এখানেও আমরা দেখতে পাই সেই প্রতীকী মন্ডলা। মন্দিরের মধ্যে মূর্তিসমুহের সাজানো অথবা মন্দিরপ্রাংগনে সাজানো বাড়ীগুলির মধ্যে।পুরোনো নারা শহর তৈরী হয়েছিল প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজ্যের শহরের অনুকরণে। যেমন শহরের মধ্যস্থলে স্যাকরেড স্কোয়ার বা পবিত্র স্থান, প্রধানতঃ রাজপ্রাসাদের অবস্থান - যেখান থেকে রাস্তাগুলি বেরিয়ে গেছে তারের জালির মতো।শহরের এই প্ল্যান আমরা আগেও দেখেছি কিয়োতো শহরে। কালের প্রভাবে এবং অযত্নে আস্তে আস্তে প্রাসাদগুলি হারিয়ে গেছে নারায়। শহরের উত্তর পূর্বদিকের বৌদ্ধ ও শিন্তো মন্দিরগুলি রয়ে গেছে। শহরের এক কোনে নারা পার্ক। এখানে অসংখ্য হরিণ দেখতে পাওয়া যায়।
নারাপার্কের হরিণ
শেনতো-কুন, নারা শহরের ম্যাসকট
এরা নারা পার্কের বিশিষ্ট দ্রষ্টব্য - পরিচয়ে জাপানী হরিণ- লালের ওপর সাদা ছোপ। প্রায় ১২০০ হরিণ আছে এই পার্ক ও সংলগ্ন এলাকায়। হরিণ এই শহরের পবিত্র প্রাণী-কোনো ক্ষতি করা চলবে না। এদের খাওয়ানোর জন্য বিস্কুট কিনতে পাওয়া যায়। দেখলাম সবাই সেইগুলি হরিণদের খাওয়াচ্ছে। হরিণদের কোনো ভয় নেই- তারা দিব্যি কাছে এসে সেইগুলি খাচ্ছে আর আরও পাবার প্রত্যাশায় কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে।আমাদের পেনসিলভানিয়ার হরিণরা রাস্তা পেরোবার সময় গাড়ী দেখলে থমকে যায় এবং তড়িঘড়ি করে পালিয়ে যায়। নারার হরিণগুলি অন্যরকম, ভয় তো পায়ই না- বরং গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়ে এরা রাস্তা পেরোলে! অবশ্য শহর থেকে সতর্কীকরণ করা হয়েছে- এরা পোষ্য হলেও প্রধানত: বন্য প্রানী-এদের বেশী কাছে না যেতে বা গায়ে হাত না দিতে। হরিণদের নিয়ে একটি গল্প আছে। কথিত আছে এক শিন্তো দেবী “তাকেমিকাজুচি-নো-মিকোতো” (বিখ্যাত নারাস্থিত “কাসুগা তাইসা” মন্দিরের চার দেবীর একজন)এক সাদা হরিণে চড়ে অনেক দূরের হিতাচি অঞ্চল থেকে নারাতে এসেছিলেন। তখন থেকেই যত হরিণ কাসুগা পাহাড়ে (অধুনা নারা পার্কের অন্তর্গত) ঘুরে বেড়ায় তারা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে।হরিণরা আপাততঃ “জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ”- অনিষ্টকারীদের ঘোরতর শাস্তি হবে। নারাবাসীদের হরিণপ্রীতির নিদর্শন হল এই শহরের ম্যাস্কট্ “শেনতো-কুন”-ছোট্ট বুদ্ধ মাথায় হরিণের শিং। ভারী মিষ্টি দেখতে।
স্টেশনের পাশেই বৌদ্ধমন্দির- কোফুকুজি। প্রায় ৫০০ বছর ফুজিয়ারা গোষ্ঠীর অভিভাবকত্বে এই মন্দিরে দুটি প্যাগোডা তৈরী হয়েছিল। তিনতলা ও পাঁচতলা প্যাগোডা। কোফুকুজি মন্দিরের পাশেই “নারা জাতীয় মিউজিয়াম”। এর ইষ্ট গ্যালারী বিশেষ দ্রষ্টব্য। তোডাইজি মন্দিরের অনেক মূর্তি ও শিল্পকলা যা মন্দিরে জনসাধারণের চোখের আড়ালে থাকে, সেগুলি এই গ্যালারীতে প্রদর্শিত হয় আক্টোবর-নভেম্বর মাসে। স্বচক্ষে না দেখলেও অনুভব করতে পারি,- কি অসাধারণ হয় সেই প্রদর্শনী।
নারাপার্কের সেন্ট্রাল আভেনিউ ধরে উত্তরদিকে গেলেই তোদাইজি মন্দির। ৭৪৩ শতাব্দীতে তৈরী এই মন্দির নারার প্রধান আকর্ষণ। মন্দিরের দিকে হাঁটতে শুরু করলে প্রথমেই পরবে নান্দাই-মন গেট। ১৮টি স্তম্ভ দিয়ে তৈরী এই গেটটি তৈরী হয়েছিল কামাকুরা সাম্রাজ্যের সময়। গেটের ভিতরে কাঠের তৈরী মিয়ো (মন্ডলার অংশ) মূর্তিগুলি তৈরী হয়েছিল ১৩শ শতাব্দীতে। নান্দাই-মন গেটের পশ্চিমে ইসুই-এন বাগান তৈরী হয়েছিল মেইজি যুগে। গেট দিয়ে ঢুকে একটু হাঁটলেই পড়বে দাইবুত্সু ডেন- এখানে রয়েছেন বিশাল ব্রোঞ্জের ভৈরচেন বুদ্ধ (সিদ্ধার্থ গৌতম)। ৫০০ টনের এই মূর্তিটি উচ্চতায় ৫৫ ফিট। অসংখ্যবার মেরামত হওয়া এই মূর্তিটি পদ্মের পাপড়ির ওপরে উপবিষ্ট। এই পদ্মের পাপড়ির খোদাই করা কাজ দেখে ঐতিহাসিকরা বলেছেন পূর্বতন বুদ্ধমূর্তিটি ছিল শাক্যমুনি বুদ্ধ। মূর্তির মতো বুদ্ধহলটিও অসংখ্যবার ধংস হয়েছে, আবার পুনর্গঠিত হয়েছে। বর্তমান হলটি আগের হল থেকে আয়তনে কম, তবুও এখনো পুরোনো দিনের নারার প্রতিভূ হিসেবে রয়ে গেছে। দাইবুত্সু হল থেকে বেড়িয়ে পূর্বদিকে একটি রাস্তা দিয়ে গেলে পাহাড়ের ওপর দুটি মন্দির পড়বে। রাস্তার দুইধারে পাথরের লন্ঠন দিয়ে সাজানো। একটি মন্দিরে দেখলাম ফুকুকেনজাকু ক্যানন (ক্ষমার দেবী)আলো দিচ্ছেন সবদিকে। চারপাশে সহচরীরা ও রক্ষকরা মন্ডলার আকারে সাজানো।এখানে বলে রাখি তোডাইজি মন্দিরে একটি মূর্তি দেখেছি (বোধিসত্য) যে মুর্তির হাতে আঁকা গুহাচিত্র দেখেছি ভারতে অজন্তায়। এর থেকে প্রমাণিত হয় জলপথে এবং স্থলপথে ভারতের সংগে জাপানের যোগাযোগ ছিল।
তোডাইজি মন্দিরের বুদ্ধমূর্তি
আরাসিয়ামার পথে
এবার নারাতে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার গল্প বলবো। মেয়ের সংগে পরামর্শ করে আমার স্বামী জাপানী অতিথিশালায় আমাদের রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করেছেন। এইরকম বিশেষ অতিথিশালার নাম “রিওকান”। ঘরে ঢুকেই দেখি মেঝেতে তাতামি ম্যাট পাতা সর্বত্র। ঘরের মাঝখানে নিচু টেবিল পাতা, তার চারধারে মাটিতে তাতামি ম্যাটের ওপর বসে চাপান ও খাবার খাওয়া। কিমোনো পরা দুজন পরিচারিকা এসে আমাদের সামনে মিষ্টি ও সবুজ মাচা চা রেখে গেলেন। আমার মার জন্য গরম হোজি চা। তাদের অন্তরঙ্গ ব্যবহারে আমাদের পরিশ্রান্ত প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
রিওকান
ওসাকা দুর্গ
জুতো পরে তাতামি ম্যাটে ওঠা নিষেধ। জুতো খুলে খালি পায়ে বা মোজা পরে হাঁটাচলা করা যেতে পারে। ম্যাটের বাইরে মেঝেতে পরার চপ্পল আছে। বাথরুমের মধ্যে পরার আলাদা চপ্পল। সেই চপ্পল বাথরুমের বাইরে বার করা চলবে না। ঘরের চপ্পল বাথরুমে ঢুকবে না। আমরা হোটেলের দেওয়া য়ুকাতা পরে ডিনারে বসলাম। খাবার পরিবেশন করলেন আমাদের ঘরের জন্য নিযুক্ত পরিচারিকা দুজন। প্রথমে এল সুপ, তারপর একে একে প্রায় চারপ্রস্থ খাবার। প্রত্যেকবার আগের পাত্র তুলে নিয়ে গিয়ে নতুন পাত্রে খাবার আসছে। বেশিরভাগই কাঁচের বাসন, বিভিন্ন আকার ও আয়তনের। আর খাবার? প্রথমে টেম্পুরা, তারপর সুসি, সাসামি, ভাত, টোফু, নানারকমের সবজী।সযত্ন পরিবেশন। কোনো খাবার একটু উপেক্ষা করলেই নম্র স্বরে প্রশ্ন “খাবার কি ভালো হয়নি?” ভরপেট খেয়ে তবেই আমাদের ছুটি মিলল।
চান করে লোকে খায়। এখানে খাওয়ার পরই আমরা গেলাম “অনসেন” বা উস্নপ্রস্রবনে চান করতে। আমাদের অনুরোধে একটি প্রাইভেট অনসেন বুক করা হয়েছে। একটি বড় কাঠের চৌবাচ্চা, তাতে রয়েছে গরমজল। বেশ গরম!নামার আগে ভালো করে চান করে পরিস্কার হয়ে এই জলে নামতে হয়।ধীরে ধীরে গায়ে সইয়ে গরমজলে গা ডোবালাম- আস্তে আস্তে গরমজল অভ্যেস হয়ে গেল- বেশ আরাম লাগছিল। একটু বাদে উঠে পড়লাম। ঘরে ফিরে দেখি মেঝেতে ফুটন পেতে বিছানা করে দিয়ে গেছেন পরিচারিকা। বিছানায় শুতেই ঘুম। এক্কেবারে সকাল ঘুম ভাঙলো। তড়িঘড়ি করে প্রস্তুত হয়ে জাপানী প্রথায় তৈরী জলখাবার খেতে গেলাম নীচে। খাবার ঘরে অনেক টেবিল চেয়ার পাতা। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম। জাপানী জলখাবার হল মিশো সুপ, গ্রিল করা মাছ, ভাত, টোফু ইত্যাদি। আবার সেই তিন-চার প্রস্থ খাবার। রান্নার স্বাদ আর পরিবেশনা দেখলে বোঝা যায় কতটা ভাবনা চিন্তা করে খাদ্যদ্রব্যগুলি প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সকালে এত খাওয়ার অভ্যেস নেই- তাই সব খেতে পারলাম না। আবার সেই নম্র কন্ঠে ভীতিপ্রদ প্রশ্ন “রান্না কি ভালো হয় নি?” সে এক রীতিমতো লজ্জার বিষয়! একসময় উঠে পড়তে হল। এই অদ্ভুতসুন্দর যত্নময় পরিবেশ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম ওসাকার উদ্দেশে।
ওসাকা
ষষ্ঠ শতাব্দীতে সম্রাট কোতোকু ওসাকাতে সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে। তখন নাম ছিল নানিও।নয় নয় করে প্রায় নয় বছর রাজধানী ছিল এখানে। তারপরই, পরবর্তী সম্রাটের সময়, রাজধানী স্থানান্তরিত হয় অন্য শহরে। কিন্তু ততদিনে ওসাকার উন্নতির শুরু হয়ে গেছে। সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় ওসাকা বাণিজ্যের এক অন্যতম নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমুদ্রপথের নিকটবর্তী হওয়ায় শুধুমাত্র বাণিজ্য নয়, বৌদ্ধধর্ম সহ সামগ্রিক চৈনিক প্রভাব জলপথে এসে পড়ল জাপানী সভ্যতায়। সেখান থেকে রাজধানী নারা- ক্রমে ক্রমে সমগ্র জাপানে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কিয়োতো ও নারার পর ওসাকাতে এলে মনে হয় পুরোনো জাপান থেকে বর্তমান জাপানে এসে পড়লাম।অত্যাধুনিক জাপানের সবকিছু আকর্ষণ সেখানে উপস্থিত।ওসাকা “কানসাই অঞ্চলের” প্রধান কেন্দ্র মূলত: বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার এবং উন্নত প্রযুক্তি শিল্পের কেন্দ্রস্থল ওসাকা জাপানের তৃতীয় জনবহুল শহর। এখানকার খাবার, মাটির নীচের শপিং সেন্টার, দুর্গ, বন্দর, বানরাকু পুতুলনাচের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও একোয়ারিয়াম এবং ইউনিভার্সাল স্টুডিও জনপ্রিয়।
নারা থেকে ট্রেনে যখন ওসাকা পৌঁছলাম, তখন রোদের তাপ তীব্র। কিন্তু মেয়ের স্থির সিদ্ধান্ত, ওসাকা দুর্গ দেখব।অগত্যা!হোটেলে একটু বিশ্রাম সেরেই সেই প্রচন্ড গরমের মধ্যেই যাত্রা শুরু- ওসাকা দুর্গের উদ্দেশে।
চেরী গাছ দিয়ে সাজানো একটি পার্ক, তার মধ্যেই দুর্গ।দুর্গের চারপাশে পাথরের দেওয়াল দেওয়া পরিখা। ফেরো কংক্রিট দিয়ে তৈরী বর্তমান দুর্গটির মেরামত হয় ১৯৯৭ সালে।কপারের ছাদ, কালো ও সোনালী অলংকরণ এবং বিশাল পাথরের দেওয়াল নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।আগের থেকে আকারে অনেক ছোটো-তবুও অধুনা দুর্গটি দেখতে ভারী সুন্দর।এখন দুর্গ প্রধানত: একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মিউজিয়াম।দুর্গের ইতিহাস যা জানা যায়,- এই দুর্গ তৈরী করান যোদ্ধা রাজা তয়োতমি হিদেহসি ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে। সম্রাট তয়োতমিই প্রথম ওসাকাকে বাণিজ্য নগরী হিসেবে চিহ্নিত করেন।তখন নিকটবর্তী কিয়োতোতে অনেক ক্ষমতালোভী যোদ্ধাগোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।এদের সঙ্গে তয়োতমির ঝামেলা লেগেই থাকত। এদের মধ্যেই এক গোষ্ঠীর নেতা তোকুগাওয়া লেয়েসু তয়োতমির মৃত্যুর পর তার সৈন্যদের এবং অন্যান্য গোষ্ঠীদের পরাজিত করে তয়োতমির সাম্রাজ্য ধ্বংস করেন ১৬০০ খৃষ্টাব্দে বিখ্যাত সেকিগাহারা যুদ্ধে। ধীরে ধীরে রাজধানী হিসেবে ওসাকার ক্ষমতালুপ্ত হল কারণ লেয়েসু রাজধানী স্থানান্তরিত করেন ইডোতে (বর্তমানে টোকিও) ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে। এসত্তেও ওসাকা কিন্তু বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে থেকে যায়।দুর্গ-মিউজিয়ামে দেখলাম একটি ফোল্ডিং স্ক্রিনের ওপর বিখ্যাত সেকিগাহারা যুদ্ধের আঁকা ছবি,তাতে অপূর্ব ডিটেলের কাজ। এছাড়াও আছে সম্রাট তয়োতমির সোনালী চা-পান কক্ষ, সামুরাই যোদ্ধাদের যুদ্ধের বর্ম, অস্ত্র ইত্যাদি।তয়োতমি ও তোকুগাওয়ার মধ্যে আদানপ্রদান হওয়া হাতে লেখা অনেক বার্তা সুন্দর করে সংরক্ষিত আছে। তখনকার দিনে হাতে লেখা চিঠি সম্রাটের সীল দিয়ে প্রেরিত হত বার্তাবাহকের মাধ্যমে। চিঠিপত্রের পরিমাণ দেখে মনে হল সম্রাট ও অন্যান্য গোষ্ঠীপতিরা দিনের বেশীরভাগ সময় ব্যয় করতেন রাজনৈতিক চাল দিতে এবং পত্র আদানপ্রদান করতে।এগুলি সবই তয়োতমি হিদেহসির সময়কার রাজকীয় জীবনযাত্রা, রাজনীতি এবং সেই সময়কার জাপানের পরিচয় বহন করছে।দুর্গের একদম ওপরতলার একটি ঘর - তার চারদিকে কাঁচের জানলা দিয়ে গোটা ওসাকা শহরকে দেখতে পাওয়া যায়। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, ইতিহাসকে পাশে রেখে দূর থেকে বর্তমানকে দেখা।
ওসাকা দুর্গ থেকে বেরিয়ে আমরা পার্কের মধ্যে দিয়ে বরফঠান্ডা মাচা চায়ের স্বাদ নিতে নিতে হোটেলে ফিরে এলাম।আপাতত: জাপান ভ্রমণ সমাপ্ত। পরেরদিন সকালেই আমাদের প্লেন,- কানসাই এয়ারপোর্ট থেকে ভ্যানকুভারের পথে। টরোন্টো হয়ে পিটস্বার্গে নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম। একটি অদ্ভুত সুন্দর দেশ, তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার অদম্য প্রচেষ্টা, সুন্দর ও নিয়ামানুবর্তিতার প্রতি দুর্দান্ত ভালোবাসা, তাকে লালন-পালন করার সুদৃঢ় প্রচেষ্টা – এই সবই রয়ে গেল স্মৃতিতে। আশা রইল আবার কখনো যেতে পারবো – অনেক কিছুই যে রয়ে গেল বাকি। কৃতজ্ঞতা স্বীকার- পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় লেখক শ্রী ভাস্কর বসু- এই লেখাটি ডিটেলে পড়ে মতামত জানানোর জন্য যাতে আরো উন্নতমানের করা যায়।
Comments
Top
ব্রিটিশদের দেশে
কয়েকদিন
শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য
নেদারল্যান্ড
বাকিংহাম প্যালেসের দৃশ্য
সালিসবেরি চার্চ
সালিসবেরি ক্যাথিড্রালের অভ্যন্তর
ইংল্যান্ডের নাম শুনলেই সবার আগে মনে আসে লন্ডন শহরের ছবি। তবে এই জনপ্রিয় লন্ডন শহর ছাড়াও আরো অনেক আকর্ষণীয় এবং প্রসিদ্ধ জায়গা আছে ইংল্যান্ডে – যেমন উত্তরের দিকে বারমিংহাম, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, কেমব্রিজ শহর; মধ্যভাগে অক্সফোর্ড, ব্রিস্টল, বাথ; আর দক্ষিণের দিকে সালিসবেরি, ব্রাইটন ইত্যাদি শহর। প্রায় প্রতিটি শহরেই আছে ঐতিহ্যশালী যাদুঘর আর প্রাচীন অভিজাত অট্টালিকা সমূহ যেইগুলো ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধশালী সভ্যতার এবং রাজকীয় গরিমার স্মারক। আবার এইসব বেশীরভাগ শহরে রয়েছে জগৎবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে নানা দেশ বিদেশের শিক্ষার্থী, গবেষক আর অধ্যাপকদের সমাবেশ। ইংল্যান্ডের আরও একটি অতি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট গন্তবস্থল হোল “স্টোন হেঞ্জ” যেইটি প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো, কিন্তু এখনো সদর্পে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন বহন করে স্বকীয় মহিমায় দণ্ডায়মান। গ্রেট ব্রিটেন মূলত বৃষ্টি প্রধান শীতল দেশ। তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই সবুজ বনানীর প্রাচুর্য এই দেশে। জনবহুল শহর ছাড়িয়ে নির্জন গ্রামের দিকে “লং ড্রাইভ” নিয়ে বেড়াতে গেলে এই দেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের রস উপভোগ করা যাবে- আর মনে পরবে বিখ্যাত ইংরেজ কবিদের লিখে যাওয়া সব কবিতার লাইন। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অতুল সম্ভার নিয়ে স্কটল্যান্ড এর সীমানা ছুঁয়ে সুসজ্জিত আছে দৃষ্টিনন্দন উইনডারম্যার অঞ্চল।
গত দু’বছর আগে আমরা গরমের ছুটিতে ৭ দিনের জন্যে বেড়াতে গেলাম ইংল্যান্ডের এইরকম কয়েকটি জায়গায়। হল্যান্ড থেকে জাহাজে করে নর্থ সি এর কোলে ভেসে এক রাত্রির সমুদ্র ভ্রমণে পৌঁছিয়ে গেলাম গ্রেট ব্রিটেনের হারউয়িচ বন্দরে। নর্থ সি হোল অ্যাটলান্টিক মহাসমুদ্রের অংশ এবং অপেক্ষাকৃত কম উত্তাল। সেই কারণে এই সমুদ্র ভ্রমণ বেশ আরামদায়ক, রোম্যান্টিক এবং অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতা। বিলাসের সব বন্দোব্যবস্থাই আছে এই সমুদ্রযাত্রায়। মজার ব্যাপার হোল জাহাজে করে নিজেদের গাড়িও সাথে করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা আছে এই সমুদ্র যাত্রায়। পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই নিজেদের সঙ্গে গাড়ি থাকলে অথবা গাড়ি ভাড়া করে নিজেরা ড্রাইভ করলে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানো অনেক বেশি সুবিধের। খুব সকালে পৌঁছিয়ে গেলাম ইংল্যান্ডের হারউয়িচ শহরের সমুদ্র বন্দরে। জাহাজ থেকে নেমে প্রথমেই রাস্তাতে প্রাতরাশ সেরে আমরা চললাম সালিসবেরি শহর দেখতে।
ম্যাগনা কার্টা চুক্তি
লন্ডন শহরের প্রতীক বিগ বেন
সেদিন সকাল থেকেই অঝরে বৃষ্টি, তাই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা কিছুটা কম হলেও আনন্দের ঘাটতি তেমন হল না। সালিসবেরি পৌঁছিয়ে প্রথমেই গেলাম বিখ্যাত গথিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি ক্যাথিড্রাল চার্চ আর ম্যাগনা কারটা দেখতে। এই চার্চটি প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো এবং আদি ব্রিটিশ স্থাপত্যের সেরা শিল্পকর্ম হিসাবে বিশেষ সমাদৃত। গির্জাটির চূড়াতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম অতি পুরাতন যন্ত্রচালিত বিপুলাকার ঘড়ি যেইটি এখনো কার্যরত। এই ক্যাথিড্রালে সংগৃহীত রয়েছে “ম্যাগনা কার্টা” চুক্তি যা ১২১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়। ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসে ম্যাগনা কার্টা চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই চুক্তি অনুযায়ী দেশের রাজা প্রতিনিধি স্থানীয় লোকদের অনুমোদন ছাড়া দেশের নাগরিকদের কারোর স্বাধীনতায় বা সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এই চুক্তির সুপ্রভাব শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। বিচার বিভাগ অনেকটা নিরপেক্ষ হয়ে উঠেছিলো এই ম্যাগনা কার্টা চুক্তিটির কারনে। বর্তমান যুগেও এইটি ইংল্যান্ডের অন্যতম সাংবিধানিক দলিল হিসাবে ব্যবহিত হয়ে থাকে।
সালিসবেরি শহর থেকে আমরা চললাম স্টোন হেঞ্জ দেখতে। এই প্রাগৌতিহাসিক স্তম্ভগুলো নির্মিত হয়েছে নিওলিথিক এবং ব্রোঞ্জ যুগে। এই স্তম্ভগুল সেই যুগে মানমন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং আধ্যাত্মিক চর্চা ও আনুষ্ঠানিক কার্য উপলক্ষে ব্যবহিত হতো বলে ধারণা করা হয়। অন্য তথ্য অনুযায়ী এই স্থানটি এক সময় কবরস্থান হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। এই স্তম্ভগুলো ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারের অ্যামাসবারির নিকটে অবস্থিত, যার দূরত্ব লন্ডন শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার। স্টোনহেঞ্জ নির্মিত হয়েছে বৃত্তাকারে দণ্ডায়মান বিশালাকার প্রস্থরখণ্ড দিয়ে এবং এইটির গঠনও বেশ জটিল। প্রতিটি দাঁড়ানো পাথর প্রায় ৪ মিটার উচ্চতায়; ২,১ মিটার প্রস্থে এবং ২৫ টন ওজনের। কথিত আছে যে এই পাথরগুলো সেই যুগে ওয়েলসের প্রেসেলি পাহাড় থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরত্ব বহন করে আনা হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন এই স্তম্ভগুলো নির্মিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বিসি থেকে ২০০০ বিসি সময়ের মধ্যে। আধুনিক যুগে স্টোনহেঞ্জ অতীতের প্রাচীন কৃতিত্বের একটি শক্তিশালী স্মারক। বর্তমান সময়ে এই অঞ্চলটির অপূর্ব স্থাপত্য শিল্পগুলি বিভিন্ন গ্রন্থে, সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রে অনেক ব্যবহৃত হয়। ১৯৮৬ সালে ইউনিস্কো এই জায়গাটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর সেই সময় থেকেই ব্রিটিশ সরকার টুরিস্টদের অডিও গাইড সমেত এই স্থানটি পরিদর্শন করার জন্য বিশেষ অনুমতি দিয়েছে।
ছাদ খোলা দোতালা বাস
স্টোন হেঞ্জ দেখে আমরা চললাম অক্সফোর্ড শহরের উদ্দেশ্যে। শেষ বেলার আলোতে প্রথম দেখলাম অক্সফোর্ড শহরকে। অভিজাত স্থাপত্যের ঐতিহ্য আর রাজকীয় মহিমার গরিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই অতি প্রাচীন শহরটি। অক্সফোর্ড শহরটি মূলত প্রসিদ্ধ এখানকার মহাবিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জগত জোড়া খ্যাতির জন্য। পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত নানা কলেজ, নানা বইয়ের দোকান আর প্রচুর ছোটো বড় কফিশপ। এই কফিশপগুলোতে খুব জনপ্রিয় “হাই টি” এর জন্য – যার অর্থ হোল চা অথবা কফির সাথে কেক বা প্যাসট্রি খাওয়া। কিছু কফিশপ দেখলে আমাদের কলেজস্ট্রীটের কফিহাউস এর ছবি মনে আসবে- যেখানে চলে কফির সাথে নানারকম আধুনিক ভাবনার চর্চা আর নতুন আবিষ্কারের অঙ্কুর। অক্সফোর্ড শহরে ছাদখোলা দোতালা বাস করে ঘোরা অথবা পায়ে হেঁটে কলেজ ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো বেশ জনপ্রিয়।অক্সফোর্ড শহরের অন্যতম আরও একটি আকর্ষণ হল বিখ্যাত সিনেমা হ্যারি-পটার এর শুটিং স্থল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির যেই কলেজগুলো এই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে সেইগুলোই বিশেষত জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট। কিছু কলেজ প্রায় ৮০০-৯০০ বছরের ঐতিহ্য কাঁধে বহন করে এখনও স্বকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া আছে বিখ্যাত আসমেলিয়ান মিউজিয়াম যেইটি ব্রিটেনের সবচেয়ে পুরনো যাদুঘর। এই মিউজিয়ামটি বিশেষত জনসাধারণের জন্যই বানানো হয়েছিলো ১৬৮৩ শতাব্দীতে। এখানে সংরক্ষিত আছে অনেক মিশরীয় মমি, শাস্ত্রীয় ভাস্কর্য, প্রত্নতত্ত্ব এবং বিশ্বের প্রসিদ্ধ কলাকারদের চিত্রকলা ও শিল্পকর্ম। এই যাদুঘরটি জিজ্ঞাসা পিপাসু গবেষকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত এখানকার অতুলনীয় দুর্লভ সংগ্রহগুলির কারণে।
ন্যাশানাল মিউজিয়াম
আর্ট গ্যালারি
ওয়েস্ট টাওয়ার
একরাত্রি এই শহরে কাটিয়ে আমরা চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। অক্সফোর্ড শহর থেকে লেক ডিস্ট্রিক্ট এর উইনডারম্যার অঞ্চলটি বেশ অনেকটাই পথ। প্রায় ঘণ্টা পাঁচ গাড়ির যাত্রায় পৌঁছানো যাবে এই অপূর্ব সুন্দর লেক ডিস্ট্রিক্ট এর শহরতলিতে। উইনডারম্যার লেকের কোল ঘেঁষে স্কটল্যান্ড এর সীমানা ছুঁয়ে ছড়িয়ে আছে এই দৃষ্টিনন্দনীয় লেক ডিস্ট্রিক্ট জায়গাটি। আর এই উইনডারম্যার লেকটি হোল ইংল্যান্ডের বৃহত্তম প্রাকৃতিক হ্রদ, যেইটি ১০,৫ মাইল দীর্ঘ এবং এক মাইল চওড়া। বাওনেস-অন-উইনডারম্যার হোল লেক ডিস্ট্রিক্ট এর সবচেয়ে জনপ্রিয় টুরিস্ট গন্তব্য যেখানে বিশেষত গরমের ছুটির মরশুমে বিভিন্ন রকমের নৌকায় জলভ্রমণের অফুরন্ত সুযোগ আছে। শোনা যায় যে এখানে অন্তত ১০,০০০ নৌকো সরকারী তালিকাভুক্ত আছে যেইগুলো প্রতি বছর এই দীঘির উপর ভাসমান হয়। পুরো অঞ্চলটির স্নিগ্ধতা, ছোটো-বড় উঁচু-নিচু পাহাড়ি উপত্যকা আর সবুজ বনানীর সৌন্দর্য, বিহঙ্গের কাকলি ধ্বনি মনে এনে দেবে অপার শান্তির আস্বাদ।
বিগত উনিবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের ধনী ব্যবসায়ীদের অনেকেরই লক্ষ্য ছিল এই লেক ডিস্ট্রিক্ট অঞ্চলটিতে প্রাসাদোপম বাড়ি অথবা ক্যাসেল বানানোর। পরবর্তীকালে অবশ্য এইরকম বাড়িগুলোর অধিকাংশই হোটেলে পরিবর্তিত হয়েছে। আর ক্যাসেলগুলো টুরিস্টদের পরিদর্শনের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এইরকমই একটি ক্যাসেল হল ওয়ারী ক্যাসেল, যেইটি বর্তমানে ন্যাশানাল ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত। এই ক্যাসেলটি গথিক শিল্পের নিদর্শন এবং নির্মিত হয়েছে একেবারে আসল ক্যাসেলের আদলে – যেমন এই ক্যাসেলটিতেও আছে চূড়া, গম্বুজ, দুর্গ, সাধারন এলাকা, এবং গুপ্ত জায়গা ইত্যাদি। গ্রেট ব্রিটেনের বহু প্রখ্যাত লেখক লেখিকা এই উইনডারম্যার অঞ্চলটির স্বর্গীয় প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বিশেষত উনিবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক লেখক-কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, থমাস ডি কুইন্সি এবং জন রাস্কিন এই লেক ডিস্ট্রিক্টের রূপে গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁদের সৃষ্টিশীল রচনাতে উইনডারম্যার অঞ্চলটির সৌন্দর্যের ছবি বারংবার ফুটে উঠেছে। উইনডারম্যারের প্রাকৃতিক রূপে মন ভরিয়ে আমরা চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লিভারপুল শহরে। এই শহরটি অ্যাটলান্টিক এর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। সমুদ্রের তটে বেড়ে উঠা এই বন্দর-শহর ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রধান ব্যবসাহিক কেন্দ্র হলেও, এই শহরের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বও যথেষ্ট বেশী।
আসমেলিয়ান মিউজিয়াম
খ্রিষ্ট-চার্চ কলেজ
হ্যারি-পটার ছবির শুটিং স্পট
খ্রিষ্ট-চার্চ কলেজের প্রবেশদ্বার
বিখ্যাত শিপ স্ট্রিটের জেসাস কলেজ
লিভারপুল শহরে রয়েছে অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধশালী স্থাপত্যের নিদর্শন, যেইগুলি ইউনিস্কো বিশ্বের ঐতিহ্য স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ন্যাশানাল মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারি, আর্কিটেকচারের উদাহরণ স্বরূপ রয়েছে লিভারপুল ক্যাথেড্রাল, সেন্ট জর্জ'স হল, রয়েল লিভার বিল্ডিং, ওরিয়েল চেম্বার্স, বিশ্বের প্রথম মেটাল ফ্রেমযুক্ত গ্লাস পর্দার দেওয়াল বিল্ডিং এবং ওয়েস্ট টাওয়ার। গত ২০০৪ সালে লিভারপুল ইউরোপের “সংস্কৃতির রাজধানী” শহরের শিরোপায় ভূষিত হয়।
ইংল্যান্ডের আরও একটি বড় শহর হোল বারমিংহাম যেইটি বোধকরি প্রবাসী ভারতীয়দের প্রথম পছন্দের বাসস্থানের জায়গা। এই শহরটি লন্ডন থেকে গাড়িতে প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। এই শহরে ঢোকার মুখেই স্থানীয় রেডিওতে বেজে উঠলো হিন্দি গানের সুর। শহরের কিছু অঞ্চলের জনপথে দেখা যাবে সারি সারি ভারতীয় দোকানের স্টল, রাস্তায় মিলবে ভারতের জনপ্রিয় মিষ্টি এবং মজাদার মুখরোচক স্ন্যাক্সের সম্ভার। এই শহরের বুকে রয়েছে অসংখ্য প্রবাসী ভারতীয় এবং পাকিস্তানী মানুষের বাস, তাই অলিতে গলিতে পাওয়া যাবে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট এবং দেশী জিনিসের সামগ্রীর দোকান। বারমিংহাম শহরের কিছু রাস্তায় চলতে চলতে মনে হবে ভারতেরই কোনও শহরতলীতে হেঁটে বেড়াচ্ছি। তবে এই শহরের কেন্দ্রস্থলও ইংল্যান্ডের অন্য শহরের মতোই সাজানো গোছানো, দেখা যাবে লাল রঙের দোতালা বাস, লাল রঙের টেলিফোন বুথ, অসংখ্য ফিশ-চিপ্সের দোকান, আর ঐতিহ্যশালী বাড়িঘর। বারমিংহাম শহরের আরও একটি ব্যাপার যা মন ছুঁয়ে যাবে সেটি হোল একই শহরে পাশাপাশি অবস্থান করছে হিন্দুদের উপাসনার মন্দির, মুসলমানদের মসজিদ, শিখদের গুরুদ্বারা আর খ্রীষ্টানদের গির্জা। ইউরোপের একমাত্র শ্রী ভেঙ্কটেসশ্বরা মন্দিরও রয়েছে এই শহরে যেটি তিরুপতি মন্দিরের আদলে তৈরি। তাই প্রবাসী ভারতীয়রা দেশের সব স্বাদই পাবে এই বারমিংহাম শহরে।
ওয়েস্ট মিনিস্টার আবে
উইনডারম্যার লেকের
কয়েকটি ছবি
ওয়ারী ক্যাসেল
লন্ডন শহরের সবচেয়ে রোমান্টিক দৃশ্য উপভোগ করতে হলে থেমস নদীর উপরের নৌকা ভ্রমণ অবশ্যই করতে হবে। অবশ্য যন্ত্রচালিত নাগরদোলা “লন্ডন আই” থেকেও দেখা যেতে পারে পুরো লন্ডন শহরের শোভা। আবার থেমস নদীর সীমানা ধরে হাঁটতে অথবা “হপ অন - হপ অফ” ছাদ খোলা দোতালা বাসে করে লন্ডন শহর ঘুরে বেড়াতেও বেশ মজা লাগবে। সারাদিন ঘোরার ফাঁকে খোলা আকাশের নিচে আরাম করে বসার জন্য আছে ট্রাফেলগার স্কোয়ারের ময়দান। এইটি জনসাধারণের জন্য বানানো জায়গা যেখানে সব মানুষজন বসে গল্প করে, নানারকম নামি-অনামি শিল্পীদের চিত্রকলা প্রদর্শন চলতে থাকে, কিছু শিল্পী সামান্য কিছু অর্থ উপার্জনের প্রয়াসে সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, নৃত্যকলা পরিবেশনও করতে থাকে। এই স্কোয়ারটি সাধারণ মানুষজন নানারকম প্রতিবাদ, মিছিল এবং সন্মিলনের জন্যও ব্যবহার করে থাকে। এ অনুভূতির জন্ম দেয়। দেখে মনে হয় সারা পৃথিবী জুড়ে জনসাধারণের দিনলিপি আর রোজনামচা প্রায় একই রকম, তা সেই দেশ ইংল্যান্ডই হোক অথবা ইন্ডিয়া।
ছোটবেলা থেকেই ইংল্যান্ড সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনে বড় হওয়া। ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থাকার এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের গল্প বারবার মনে ভেসে আসছিল এই ইংল্যান্ড সফরে। লন্ডনের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখা কোহিনুর মণি স্মরণ করিয়ে দেয় ভারতবাসীদের উপর ব্রিটিশদের আধিপত্যের কথা। তাছাড়া সবচেয়ে যেটা লক্ষণীয় তা হোল ইউরোপের অন্য শহরগুলোর থেকে ইংল্যান্ড বেশ অনেক দিক দিয়েই আলাদা। যেমন এই দেশে যানবাহন চলে রাস্তার বাম দিক দিয়ে যেটি ইউরোপের অন্য শহরের তুলনায় একেবারেই বিপরীত দিক, আর আমাদের ভারতের জন্যে তা সঠিক দিক। আর ব্রিটিশরা চা পান করে দুধ আর চিনি মিশিয়ে, যা আমাদের অধিকাংশ ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস কিন্তু ইউরোপের বাসিন্দাদের কাছে একেবারেই অনাকাঙ্খিত। আমাদের ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মধ্যে ব্রিটিশ সভ্যতার যে সুদৃঢ় প্রভাব রয়েছে সেই কথাই বারবার মনে হচ্ছিল এই যাত্রার প্রতিটি মুহূর্তে।
বারমিংহাম শহরের ছবি
হাইডে পার্ক থেকে বাকিংহাম
প্যালেসের দৃশ্য
বারমিংহামের
শ্রী ভেঙ্কটেসশ্বরা মন্দির
Comments
Top
একটি
ভ্রম(ন) কাহিনী
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
বুরহানের যুদ্ধ প্রান্তরে বসে খুরম মিঞা তোলার এক দিকে বুরহান জয় ও গৌহর বেগম ভূমিষ্ঠ হওয়ার আনন্দ আর অন্য দিকে দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগমের অকাল প্রয়াণ লাগিয়ে বুঝলেন দ্বিতীয় দিকটার ভার অনেক বেশী। বিচ্ছেদ-বিষাদ ছাপিয়ে যাচ্ছে সকল আনন্দকে।
খুরম মিঞা আরজুমান্দ বেগমকে প্রথম দেখেছিলেন আগ্রার বাজারে ১৬১২ তে। প্রথম দর্শনেই কুপোকাত। তখন দুজনের বয়স ১৫ বছর ও ১৪ বছর। জ্যোতিষী বাদ সাধলেন সাদীতে, সময় ভাল নয়। হয়ে রইল বাকদান। কিছুকাল পরে জাকজমকে বিয়ে।
আরজুমান্দ হলের মিঞায় দ্বিতীয় স্ত্রী (কেউ বলেন ৩য়, কেউ ৪র্থ- আসলে রাজা বা সম্রাটদের স্ত্রীর সংখ্যা ধরতে নেই)। ১৬৩১ সালে আরজুমান্দ ১৪ তম সন্তান গৌহর বেগমের জন্মদিতে গিয়ে মারা গেলেন। মাত্র ১৮ বছরের মধ্যে নিভে গেল দাম্পত্য জীবনের আলো। জয়নাবাদ বাগানে সাময়িক সমাহিত করা হল আরজুমান্দকে। কিন্তু এ তো আর যে সে প্রেম কাহিনী নয় যে ফুস করে শেষ হয়ে যাবে। খুরম মিঞা তাঁর প্রেমকে অমর করে রাখতে শুরু করলেন এক অনন্ত যুূদ্ধ। সে যুদ্ধে সামিল হল ২০০০০ মানুষ,১০০০ হাতি। খরচ হল আনুমানিক ৬৪৩৮ কোটি টাকা। পারস্য থেকে তলব হল ঈশা আফেন্দীর।
তৈরী করলেন নকসা্। মুল স্থপতির দায়িত্ব নিলেন উস্তাদ আহমেদ লাহোরী। কাজিম খান, চিরঞ্জীলাল, আমানত খানেরা ভাগ করে নিলেন দায়িত্ব। যমুনা নদী দূর্গের নিচ থেকে পশ্চিমদিকে যেখানে বড় বাঁক নিয়েছে স্থির হল সেখানেই তৈরি হবে সৌধ।
রাজস্থান থেকে এল সাদা পাথর, লাল-বাদামী-হলুদ পাথর এল পাঞ্জাব থেকে, চীন থেকে সবুজ,তিব্বত থেকে নীল আর নীলমনি রত্ন এল শ্রীলঙ্কা থেকে। নির্মাণ শুরু হল ১৬৩২ এ, মূল নির্মাণ শেষ হল ১৬৪৮ এ। তবে সৌধের চারপাশ, প্রবেশপথ এসব ধরলে নির্মাণ শেষ হয় ১৬৫৩ তে, অর্থাৎ ২১ বছর ধরে চলে সেই নির্মাণ-সংগ্রাম। খুরম অর্থাৎ সম্রাট সাহাবুূদ্দিন মহম্মদ শাহজাহান নির্মাণ করলেন এক অমর কীর্তি "তাজমহল"।
পরবর্তীকালে ওখানেই আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মমতাজ মহলের সমাধীর পাশেই সহাহিত হন সম্রাট শাহজাহানও। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ রাজার রাজদূত ও পর্যটক এডওয়ার্ড লিয়ার তাজমহল দেখে বলেলেন--
"আজ থেকে বিশ্ববাসীকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হলো, প্রথম শ্রেণী যারা তাজমহল দেখেছে আর দ্বিতীয় যারা তা দেখে নি।" ১৯৯৯ এ, আমি প্রথম শ্রেণীতে ঢুকে পড়ি। সেবার আমরা বি.এড. কলেজ থেকে গিয়েছিলাম তাজমহল। এবার আমরা একজন দর্শক বাড়িয়েছি। তাজমহলের প্রবেশ পথ ১০০ ফিট উচুঁ। যেমন প্রাণী তার মলও তেমন। হাতির মলের সঙ্গে আরশোলার পটির তুলনা চলে না।
পুরো তাজমহল ১৮০ ফিট উচুঁ। তাজমহলের গম্বুজের উচ্চতা ২১৩ ফিট। পুরো চৌহুদ্দী ১৯০২x ১০০২ বঃ ফিট। চারপাশে রয়েছে চারটি মিনার। মিনার এর উচ্চতা ১৬২.৫ ফিট।
তাজমহলে বিভিন্ন ধর্মের নিদর্শন মেলে। গম্বুজের উপর চুঁড়াটি শিবের ত্রিশুল(অনেকে মনে করেন তাজমহল আসলে রাজা জয় সিংহের শিব মন্দির) মিনার ও গম্বুজ ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। সারা সৌধ জুড়ে অপরূপ সব স্থাপত্য, ভাস্কর্য যা বর্ণনা করা যায় না। পারস্য,তুরস্ক,ভারতীয় ও ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের সম্মিলন তাজমহল। সূর্যোদয়,সূযাস্ত এমন কি পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় রং পাল্টে পাল্টে যায় তাজমহলের। তাজমহলের দার্শনী জন প্রতি ৫০ টাকা পনেরো বছরের নিচে শিশুদের ফ্রি। প্রবেশ পথে নানা জিনিসের উপর নিষেধ আছে। মুড়ি-বিড়ি-গুটখা এসবে আটকে যেতে পারেন।
সরকারি পরিচয় পত্র দাখিল করে ভেতরে যেতে হয়। বাইরে অটো চালক, ফেরিওয়ালা আপনার পকেট কাটতে তৈরি ফলে সাবধানে এগানো ভালো।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সৈন্য-রা তাজমহলের শরীর থেকে মূল্যবান রত্ন খুলে নেয়। এখন তাজমহলকে চোখ রাঙাছে দূষণ। তার শরীরে থাবা বসাচ্ছে অ্যাসিড বৃষ্টি। যমুনায় আর কেউ জল আনতে যায় না। যমুনায় জল নেই। যমুনা বয়ে চলেছে বিষ।
যমুনায় আর তাজের ছায়া পড়ে না। অপরূপ তাজমহল দেখতে দেখতে আপনার চোখ বারবার আটকে যাবে আমার মতো কাঁচা ফটোগ্রাফারদের দিকে। যারা বৌ-বাচ্চার হাতে তাজমহল ঝুলিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই উদয়শংকর হয়ে উঠেছে। ফটো তোলার ভঙ্গীর নানা বিভঙ্গ। তাছাড়া নিজস্বী তোলার বিচিত্রতা আপনাকে বিনোদন দেবেই। সরাসরি তাজমহল তো দেখবেনই তার সঙ্গে আগ্রা ফোর্ট থেকে তাজমহল'কে সত্যি অন্য রকম লাগে। শাহজাহান বন্দী অবস্থায় ফোর্টের ঐ অংশ দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকতেন তাজের দিকে। তাজমহল দেখছি। গাইড নাগাড়ে বলে যাচ্ছে তাজমহলের ইতিবৃত্ত। মোবাইলে রেকর্ড করে নিচ্ছি সেসব। এক পর্যটক তার ক্যামেরা নিয়ে নিবিষ্ট আমার বিকচ শিরদেশে। খচাখচ শব্দে ছবি হয়ে গেলাম তাজমহলের সঙ্গে। অনেক চেষ্টা করেও জানা গেল না ব্যাটা কি নিলো ক্যামেরায়--
আমার টাকে তাজের প্রতিবিম্ব না তাজমহলের পাশাপাশি ধরা রইল আর একটি চকচকে গম্বুজ।
Comments
Top
ফতেপুর সিক্রির
আনাচে-কানাচে
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
দুপুরের রোদে তেমন তেজ নেই। গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস আসছিল হু হু করে আর তাতেই চোখ বুজে আসছিল আলতো ভাবে। গাড়ি ফতেপুর সিক্রি পৌঁছানোর আগে আমাদের ড্রাইভার ফতেপুর সিক্রি কি আর কি তার ইতিহাস তা সংক্ষেপে জানিয়ে দিল আমাদের। এবং এও জানলাম এখানে গাইড না নিলে কিছুই বোঝা যাবে না। সরকার স্বীকৃত গাইড নিতে হবে। ওরা চাইবে সাড়ে ছয়'শ টাকা, তবে দর-দস্তুর করে এগানো উচিত কাজ হবে।
ফতেপুর সিক্রিতে পাইভেট গাড়ি যায় না। বাসস্ট্যান্ড থেকে আগ্রা ডেভলাপম্যান্টের গাড়ি ধরতে হয়। ভাড়া জন প্রতি দশ টাকা। তবে অটোও যাচ্ছে কিছুটু আগে পর্যন্ত। একজন গাইডের সঙ্গে কথা হল, চার'শ তে রাজি হল লোকটি। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে জয় লাভ করে বাবার আল্লাহকে সুক্রিয়া জানিয়ে নির্মান করেন সিক্রি নগর। পরবর্তীকালে মুঘলই - আজম- জাল্লাউদ্দিন - মহম্মদ আকবর গুজরাট জয়ের স্মারক হিসাবে লাল বেলে পাথরে নির্মান করেন ফতেপুর সিক্রি। ফতে অর্থাৎ বিজয়। আসলে আকবর ছিলেন নিঃসন্তান। পুত্র সন্তানের আশায় দরবেশ শেখ সেলিম চিস্তির কাছে প্রার্থণা করেন।
দরবেশের আশীর্বাদে আকবরের পাদসা বেগম যোদ্ধাবাঈ এর সন্তান হয়। যোধাবাঈ ছিলেন আমের(জয়পুরের) রাজকন্যা। রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করার জন্য সম্রাট রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু ভারত সম্রাট সন্তানহীন হওয়ায় উত্তরাধীকারীর ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। দরবেশ সেলিম চিস্তির ভবিষ্যত বানী মিলে যায়। আকবরের তিন বেগম সন্তান সম্ভবা হন। একদিকে গুজরাট জয় অন্য দিকে সেলিম চিস্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা হেতু চিস্তির গ্রামে শৈলশিরায় ১৫৬৯ -এ নির্মান করেন রাজধানী। হিন্দু আর মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য মেলবন্ধন যার নাম ফতেপুর সিক্রি। এই ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের রাজধানী ছিল দীর্ঘ ষোল বছর। পরবর্তী কালে জলের অভাবে তিনি আবার ফিরে যান আগ্রায়। অবশ্য ফতেপুর সিক্রির পতনের অন্য এক গাঁথা শুনলাম গাইডের কাছে।
জেরিনা নামে এক নর্তকী স্থান পায় সম্রাটের হারেমে। জেরিনা ছিল সিক্রি গ্রামের অখ্যাত নর্তকী। তার ইচ্ছা ছিল সম্রাটের নর্তকী হওয়ার। তার সেই ইচ্ছা পূরণের সুযোগ তৈরি হয়ে যায় কাকতালীয় ভাবে। একবার সম্রাটের ইচ্ছে হয় তানসেনের সঙ্গীতের সঙ্গে একজন নর্তকী নাচুক। সে সময় নর্তকী মিলল না। এক দাসী মারফৎ সুযোগ পেয়ে যায় জেরিনা।জেরিনার নৃত্যে মুগ্ধ হন সম্রাট।ক্রমে জেরিনা আকবরের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠেন। আর তাতেই ঈর্শান্বিত হয়ে পড়েন যোধাবাঈ তথা মরিয়ম-উজ-জামানীর( প্রতি যুগের আনন্দ ) দাসী মাধবী।
চক্রান্ত করে মাধবী চোর সাবস্ত্য করে জেরিনাকে। সম্রাট বিশ্বাস ভঙ্গে আঘাত পান।জেরিনা বারবার করে সম্রাটকে জানায় যে সে চুরি করে নি। কিন্তু রাজধর্ম পালনে আকবর বাধ্য হন শাস্তি প্রদানে।পরদিন বিচার সভা বসার আগেই ভোর থেকে আর জেরিনার দেখা মেলে না। বিচারের আগেই অাত্মহত্যা করে জেরিনা। ভেঙে পড়েন সম্রাট। জেরিনার বাবা অভিশাপ দেয় তার মেয়ের আকাল মৃত্যুতে শেষ হয়ে যাবে সম্রাটের স্বপ্নের নগর ফতেপুর সিক্রি। কিছু কাল পরে পুর নগরে জল কষ্ট দেখা দেয়। মৃতের নগরী হয়ে যায় ফতেপুর। সম্রাট ফিরে যান আগ্রায়।
ফতেপুরের দুটি ভাগ রাজবাড়ি আর গুরুবাড়ি। পূর্ব দিকের রয়েল গেট থেকে রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। ঢুকেই সবুজ মখমল বিছানো 'দেওয়ানী আম' প্রতি দিন সকালে সম্রাট দেখা দিতেন প্রজাদের।
একটু উচুঁতে সম্রাটের বসবার জায়গা। 'দেওয়ানী আম' পেরিয়ে 'তোলা-দান' এখানে সম্রাট আকবর তার সন্তান সেলিম তথা জাহাঙ্গীরকে তোলার একদিকে রেখে অন্য দিকে সোনা দিয়ে ওজন করেছিলেন। ঐ সোনা দান করেছিলেন গরীব প্রজাদের মধ্যে। তোলাদানের পাশে জ্যোতিষ পরুষোত্তম দাসের কার্যালয়। পাশেই 'ইবাদতখানা'। এখানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা হত। সম্রাট আকবর সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন। আকবরের 'দীন ইলাহির' প্রচার হয় এই 'ইবাদতখানা' থেকে।
সংলগ্ন 'পাঁচ-মহল'। পাঁচতলা বিশিষ্ট 'হাওয়া মহল'।কোন দেওয়াল ছাড়া পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই 'হাওয়া মহল'। আকবর জয়পুরের হাওয়া মহলের আদলে নির্মান করেন এই 'হাওয়া-মহল'। মোট পিলার সংখ্যা ১৭৬টি । সব চেয়ে নিচে ৮৪টি, তারপর ৫৬, ২০, ১২ ও সবচেয়ে উপরে ৪টি। ওখানে হাওয়া খেত সম্রাট আকবর ও তার পাটরানী যোধাবাঈ।
সবথেচে নিচের তালায় আর্বি ও পার্সী শিক্ষা দেওয়া হত। সে কাজে যুক্ত ছিলেন আবুল ফজল ও আবুল ফৌজী। সম্রাট আকবরের লাইব্রেরী ছিল ওখানে।
সম্রাট লেখাপড়া না জানলেও সভাসদরা পাঠ করে শোনাতেন। সম্রাট আকবরের খাস সভা বসত 'দেওয়ানী খাসে'। বড় পিলারের আসনটিতে বসতেন সম্রাট, চারদিকে তার নয় সভাসদ। 'দেওয়ানী খাস' এর স্থাপত্য আজও অম্লান। দেওয়ানী খাস সংলগ্ন চাতালে সম্রাট দাসীদের ঘুঁটি করে দাবা খেলতেন। চাতালের পাশে 'অনুপ তালাও'। 'অনুপ তালাও'-এ বসে গান গাইতেন তানসেন।
'অনুপ তালাও'-এর চারপাশে গোলাপ জলের জলকেলি। সঙ্গীতের সঙ্গে মুজরাও বসত সেকালে। সম্রাট আকবরের প্রধান তিন মহিষী ছিলেন হিন্দু (যোধাবাঈ জয়পুর থেকে), মুসলিম (রুকাইয়া তুর্কীর সুলতানা), খ্রিস্টান (মারিয়াম গোয়া থেকে)। তিন পত্নীর পৃথক পৃথক মহল ছিল। রুকাইয়া বেগম মুসলমান হলেও তার মহলের স্থাপত্যে তুলসীগাছ, মঙ্গল ঘট, স্বস্তিক চিহ্ন নজরে পড়ে। মহামতি আকবরের আরামখানা ঢোকার মুখে প্রকান্ড এক জলপাত্র। যা আজ ভগ্নাবশেষ মাত্র। ঐ পাত্রে নাকি পানের জল থাকত সম্রাটের।
'অনুপ তালাও'-এর চারপাশে গোলাপ জলের জলকেলি। সঙ্গীতের সঙ্গে মুজরাও বসত সেকালে। সম্রাট আকবরের প্রধান তিন মহিষী ছিলেন হিন্দু (যোধাবাঈ জয়পুর থেকে), মুসলিম (রুকাইয়া তুর্কীর সুলতানা), খ্রিস্টান (মারিয়াম গোয়া থেকে)। তিন পত্নীর পৃথক পৃথক মহল ছিল। রুকাইয়া বেগম মুসলমান হলেও তার মহলের স্থাপত্যে তুলসীগাছ, মঙ্গল ঘট, স্বস্তিক চিহ্ন নজরে পড়ে। মহামতি আকবরের আরামখানা ঢোকার মুখে প্রকান্ড এক জলপাত্র। যা আজ ভগ্নাবশেষ মাত্র। ঐ পাত্রে নাকি পানের জল থাকত সম্রাটের। জল আসত ঘটা করে হরিদ্বার থেকে। সম্রাটের শয়ন কক্ষটিও রাজকীয়। আকবরের উচ্চতা ছিল ৫ফুট-৪ইঞ্চি কিন্তু পাথর নির্মিত খাটটির বহর ছিল- ১৮x১৫ বঃ ফুট। দেখে নিলাম রাজকীয় ভোজনালয়। পাথরের কোটরে কোটরে থাকত মোগলাই খানা। আরামখানার প্রবেশ পথটি উচ্চতায় বেশ ছোট। ছোট কেন তা জানা গেল গাইডের থেকে। সম্রাটের এক মন্ত্রী মহেশ দাসের পরামর্শ ক্রমে নির্মান হয় প্রবেশ পথের। মহেশ দাস বলেন প্রবেশ পথ এমন হোক যাতে যে কেউ মাথা নিচু করে প্রবেশ করবেন সম্রাটের কাছে। গাইড ফেললেন ঝামেলায়।
প্রশ্ন করে বসলেন -- কে এই মহেশ দাস? আপনি তো বাঙালী বলুন? মাথা চুলকে, ঠোঁট কাঁমড়ে সে এক যা তা অবস্থা। পরে জানা গেল এই মহেশ দাস হলেন-- "বীরবল"।
সম্রাটের পাটরানীর রন্ধনশালায় ১৫৬টি ঝুমকোর নকসা্। যোধাবাঈয়ের পচ্ছন্দ মাফিক সম্রাট নকসা্ -র আদলে সোনার ঝুমকো গড়ে দিতেন। গাইড বেশ মজার মানুষ। হঠাৎ ভাঙা ভাঙা বাংলায় জানতে চাইলেন-
-- যোধাবাঈ কি আছেন?
আমি বললাম-- সে কত যুগ আগের কথা, কি করে থাকবে?
আমার গিন্নীর দিকে ইশারা করে বলল
-- বলেন কি! এই তো যোধাবাঈ।
আমি বললাম--
-- না এটি আমার যা তাইই যোধাবাঈ হতে যাবে কেন! যোধাবাঈ হতে গেলে রুকাইয়া, মারিয়াম দরকার হয়ে পড়ে যে। পুরো চত্তরে ভেঙে পড়ল হাসি। যোধাবাঈ-এর মহলটি 'যোধাবাঈ প্যালেস' নামে পরিচিত। নির্মান রীতি রাজস্থানী হাভেলীর মতো। ভেতরে কৃষ্ণ মন্দির ছিল উপাসনার জন্য। এখন তুলসীমঞ্চে জবা গাছ দেখলাম। ঝরোখার কাজ চোখে পড়ার মতো। রাজবাড়ি ছেড়ে চললাম গুরুবাড়ি। এর প্রবেশ পথে এশিয়ার বৃহত্তম দরজা 'বুলন্দ দরওয়াজা' এ দরজা নির্মিত হয় গুজরাট জয়ের স্মারক হিসাবে। উচ্চতায় ৪১ মিটার।ভিতরে মক্কার আদলে হিন্দু ও পারসীক শৈলীতে 'জামি মসজিদ'। মসজিদে এক সঙ্গে ১০০০০ নামাজী নামাজ আদায় করতে পারে। গুরুবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ 'সেলিম চিস্তির দরগা' তথা 'মকবারা'। অনন্য তার স্থাপত্য। পাথরের জালি বা জাফরির কাজে চোখ আটকে যায়। তবে এ দরগা ধর্মীয় মাহাত্ম্য আজও অম্লান। আজও নিঃসন্তান দম্পতি দরগায় সন্তান কামনায় দাগা বাঁধেন অনন্ত বিশ্বাসে। ইতিহাসের আনাচ-কানাচে ঘুরতে ঘুরতে বেলা ফুরিয়ে এসেছে। সূর্যাস্তের লাল আভায় ধুয়ে যাচ্ছে ফতেপুরের প্রান্তর। আরো মোহময়ী হয়ে উঠেছে নির্মাণ। অন্ধকার নামার আগেই ফিরে যেতে হবে গন্তব্যে। শেষবারের মতো চোখ আটকে গেল 'বুলন্দ দরওয়াজায়' যেন একটা ছায়া মতো সরে গেল আচমকা চোখের সামন থেকে। গাইড বলে ছিল আজও গভীর রাতে দরওয়াজায় কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো মাধবী দাঁড়িয়ে থাকে জেরিনার অপেক্ষায়। জেরিনার কাছে তার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু হয় নি যে।
Comments
Top
বারাণসীর
ঘাটে ঘাটে....
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সব মানুষের মধ্যে একটা করে নদী থাকে। সে নদী কুলকুল করে বইতে থাকে অবিরত। ঐ যে স্পন্দন, ঐ বহমানতা ওটাই তো জীবন। যদি স্রোত রুদ্ধ হয়,যদি গতি বাধা পড়ে তবে জীবন থেমে যায়। হয়তো তাই মানুষ বারে বারে ফিরে গেছে নদীর কাছে, স্রোতের সান্নিধ্যে। তার সঙ্গে মেলাতে চেয়েছে জীবনকে। রাস্তায় এসে দেখি নদীর কাছে যাওয়ার কোন ব্যবস্থাই নেই। থাকবে কি করে! মোবাইলে এলার্ম দেওয়া ছিল ভোর চারটায়। তৈরি হতে মিনিট দশ। রাস্তায় নেমে মোবাইলে সময় দেখলাম--
চারটে কুড়ি। পথ-ঘাট সব শুনশান। না আছে রিকসা্ না অটো। শীত শীত করছে.... এদিকে নদী ডাকছে.... নদীর কুলকুল শব্দ টানছে.... অগত্যা হাঁটা। সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছতে হবে ঘাটে। শিথিল সে প্রত্যুষে গলিতে গলিতে যে লোকজনের দেখা মিলল তারা সবাই চলেছে নদীর জন্য। সবাই চলেছে বারাণসীর পুণ্যতোয়া গঙ্গার উদ্দেশ্যে।
খ্রিস্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে সুহোত্র পুত্র কাশ্য একটি নগরী নির্মাণ করেন। কাশ্যর নাম অনুসারে নগরীটির নাম হয় কাশী। পরবর্তীকালে কাশীরাজ বরণা বারাণসী নামে এক দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন। কাশীর নাম পাল্টে হয়ে যায় বারাণসী। আবার বামনপুরাণে বলা হচ্ছে-- বিষ্ণুর অংশসম্ভূত অব্যয় পুরুষের দক্ষিণ পা থেকে সর্বপাপহরা মঙ্গলদায়িনী বরুণা ও বাম পা থেকে অসি নদীর উদগম।
ঐ দুই নদী যেহেতু ঐ স্থলে মিলিত হয়েছে তাই নগরটির নাম বারাণসী। ঘাটের পাট ভেঙে পায়ে পায়ে নেমে এলাম নদীর কাছে। ভোরের আবছা আলোয় জেগে উঠছে দশাশ্বমেধ ঘাট। বৈদিক ঐতিহ্য আর নানান স্তোত্রপাঠে সে এক স্বর্গীয় পরিবেশ। গঙ্গা এখানে পবিত্রতার, পরিত্রাতার প্রতীক। এখানে স্নান করলে নাকি সর্বরোগ দূর হয়, সর্বপাপ ক্ষয় হয়। এক গন্ডূষ গঙ্গাজল পানে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল মেলে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মত্ত অবগাহনে।
মন্দিরের চারপাশের বাড়ি ভাঙা হচ্ছে যাতে মন্দির দূর থেকে প্রতীয়মান হয়। চারপাশে ধুলো আর তার সঙ্গে ষন্ড ও পান্ডাদের উৎপাত। বিশ্বনাথ দর্শন সেরে রাস্তায় পৌচ্ছে দেখি ভোরের সে পথ এখন অন্য এক চেহারা নিয়েছে। অগনিত মানুষ, অটো, রিকসা্, হেলেদুলে ষাড়েদের যাতায়াত, ফুটপাথ উপচে দোকানপাট -- বেসামাল ট্রাফিক ব্যবস্থা।
বিকেলে বেরালাম নৌকায় চেপে গঙ্গা ঘুরতে। সে এক আনন্দময় পরিভ্রমন। অসি ঘাট থেকে শুরু হল নৌ-বিহার। তারপর একে একে জানকী ঘাট, তুলসী ঘাট, হনুমান ঘাট পেরিয়ে হরিশ্চন্দ্র ঘাট। রাজা হরিশ্চন্দ্র-শৈবা-রুহিতাস্য স্মৃতিমন্ডিত হরিশ্চন্দ্র ঘাটে শব দাহ হচ্ছে দেখলাম। নৌ-চালক জানালো, লোকালয় থেকে এ ঘাট দূরে বলে দাহ হয় কম।
তারপর কেদার ঘাট, নারদ ঘাট, ধোবী ঘাট, অহল্যাবাঈ ঘাট, প্রয়াগ ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট মান ঘাট, মীরা ঘাট ও সব শেষে মনিকর্নিকা ঘাট। এ ঘাটে নাকি শিব-জায়া পার্বতীর কুন্ডল পড়ে। তাই বেনারস একান্ন সতী পীঠের একটি। মনিকর্নিকা ঘাট হল মহাশ্মশান, এখানে শবদহ চলে অবিরত। নৌ-বিহারের শেষ দিকে সন্ধ্যা নামল। সূর্যাস্থের লাল আলো মিশে যাচ্ছে গঙ্গার স্রোতে। সে এক অপরূপ দৃশ্য।
বারাণসীর আরো এক আকর্ষণ হল সন্ধ্যাকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গারতি। সাতজন পুরোহিত এক সঙ্গে আরতি করেন। স্তোত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে চলে সে আরতি। নদীর জলে আলোর আলপনা। আরতি শেষে পুরোহিতের সুললিত কন্ঠে বেজে ওঠে ঈশোপনিষদের শান্তি পাঠ--
"ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাং পূর্ণমুদচ্যতে;
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ "
গঙ্গারতি শেষে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলেছি। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে বহমান গঙ্গা। কানে বাজছে শান্তি পাঠ--
"উহা পূর্ণ(অদৃশ্য ব্রহ্ম), ইহা পূর্ণ(এ দৃশ্য জগৎ)
পূর্ণ(ব্রহ্ম) থেকেই পূর্ণের( দৃশ্য জগতের) উৎপত্তি।
পূর্ণ(দৃশ্য জগৎ) -এর পূর্ণত্ব সরিয়ে নিলে পূর্ণ(ব্রহ্ম)-ই মাত্র অবশিষ্ট থাকেন।
মনে মনে ভাবলাম এই যে গঙ্গারতি এ তো জীবনের বন্দনা, এতো স্রোতের উপাসনা।
এ ভ্রমন তো নিছক ভ্রমন নয়- এ যে জীবনবোধের পাঠ। এ যে জীবনের মূলমন্ত্রটির উচ্চারণ।
অস্ফুটে কে যেন বলে উঠল--
" শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ।"
তোমরা অমৃতের সন্তান--
জীবনকে... জীবনের গতিকে....
জীবনের প্রবাহকে.....
অশিব থেকে শিবে, অকল্যান থেকে কল্যানে প্রবাহিত কর।
দক্ষিণায়ণ
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
Comments
Top
লক্ষ্মীপুজোর রাতে চেপে বসলাম ১২৮৬৩ হাওড়া-যশবন্তপুর ট্রেনে। গন্তব্য যশবন্তপুর।শরীর আজকাল আর মহাশয় নয়। তেলমশলা অনেক কাল ধরে বুক-পেট জ্বালাচ্ছিল গ্যাস-অম্বল-চোঁয়া ঢেঁকুর এমন সব নানান উপসর্গে। বেদনার বিরাম নেই। বপুর ক্রমবর্ধমান ভারে হাঁটুর হাঁসফাঁস দশা। বুক-পেট তো ছিলই, ব্যথা এখন বাসা বেঁধেছে হাঁটুতেও। পুজোর লম্বা ছুটিতে দক্ষিণে ডাক্তার দেখাতে বেরিয়ে পড়লাম। এখানে! এখানে পুজোর থিমে ডাক্তার ডাকাত হলে ভরসা তেরচাভাবে চায়।
শুধু যে ডাক্তার দেখানোর জন্যই দক্ষিণযাত্রা তা নয়। এরই ফাঁকে খানিক দখিনা বাতাস মেখে নেওয়া যাবে। নাকি দক্ষিণ ভ্রমণের অবসরে কিঞ্চিৎ ডাক্তার দেখানো! সে তর্ক সাপেক্ষ। আমাদের ভ্রমণপথ বড় দীর্ঘ। ব্যাঙ্গালোর-মহীশূর-উটি-কুন্নুর-কোদাই-কন্যাকুমারী-রামেশ্বরম-মাদুরাই- ব্যাঙ্গালোর। প্রায় দুহাজার পাঁচশ কিমি যাত্রাপথের সারথিটি বড় ভালো মানুষ। আটই অক্টোবর সকাল সকাল আমরা তৈরি। সকালের নরম ও উজ্জ্বল আলোকে হার মানিয়ে তার চেয়ে বেশি কোমল ও চকচকে হাসি মিশিয়ে গুডমর্নিং বলল মূর্তি রাও। মূর্তি রাও আমাদের দক্ষিণ যাত্রার সারথী। মূর্ত্তিজি আদতে মারাঠি হলেও এখন আদ্যন্ত কর্ণাটকী। প্রশ্ন করলাম - "কত পুরুষ হল আপনারা চলে এসেছেন কর্ণাটকে?" কপালে ভাজের সংখ্যা বাড়ে কিন্তু তার হিসাব পায় না মূর্ত্তিজি।
গাড়ি ছুটল মহীশূর রোড ধরে। ব্যাঙ্গালোর অনেকটা পাহাড়ি শহর। সমতল থেকে সাতশ আটশ মিটার উঁচু। সারা শহর জুড়ে বাড়িগুলো নানান উচ্চতায় ছড়ানো যেন ঢেউ খেলানো। বাড়িগুলোর এধরণের অবস্থানের জন্য একটু উঁচু থেকে দেখলে শহরটাকে বড় সুন্দর লাগে। যেন অট্টালিকার স্থাপত্য। রাস্তার দুপাশে নানা ধরনের ফুল পথকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। আমাদের কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল ফুল এখানে ওখানে আগুন ছড়িয়ে জেগে আছে। নাম জানতে চেষ্টা করেছিলাম, জানা যায় নি। হয়তো নাম না জানাটাই ওকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। একটা রেস্টুরেন্টে গাড়ি দাঁড় করাল মূর্ত্তিজি। রেস্টুরেন্টে থকথকে ভিড়। এখানকার ইডলি ধোসা দারুণ। কাউন্টারের সামনে নোটিস লটকানো-কন্নড় ও ইংরাজী ভাষায়-
"আজ বরিবার তাই টেবিলে খাওয়ার সার্ভ করার লোক নেই, নিজেকেই খাওয়ার কাউন্টার থেকে নিয়ে নিতে হবে "
সকালের টিফিন সেরে গরম চা নিয়ে গাড়ির সিটে ফিরে গেলাম। আবার ছুটল গাড়ি। একটু এগিয়ে সারি সারি পাহাড়, ঠিক পাহাড় নয় টিলার মতো। জায়গাটা সম্ভবত রামনগর। মূর্ত্তিজি বলল এখানেই নাকি শোলে সিনেমার শুটিং হয়েছিল। কথাটা শুনে আমাদের উঁকি ঝুঁকি গেল বেড়ে। যে টিলাগুলোকে অবহেলা করছিলাম খানিক আগে, গাড়ি থামিয়ে সেগুলোই হল ক্যামেরা বন্দী। হঠাৎ চোখ চলে গেল গাড়ির জানালায়, দেখি বাবদা(আমার বছর ছয়ের ছেলে) দু'হাতের মুদ্রায় বন্ধুক তৈরি করে তাক করেছে আমাকে। উঁচু টিলা থেকে যেন ভেসে এল গব্বরের কন্ঠ- "আব গুলি খা।" ঘড়ির কাঁটা সকাল দশটা ছুঁইছুঁই পৌঁছলাম শ্রীরঙ্গপত্তনে। আমাদের ভ্রমণ শুরু হল মন্দির দর্শন করে।
শ্রীরঙ্গপত্তনে রয়েছে শ্রীরঙ্গনাথস্বামী মন্দির। এ মন্দির নির্মাণ করেন গঙ্গারাজাদের গভর্নর থিরুমালায়। দক্ষিণী শৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরের ভাস্কর্যে ধরা পড়েছে বিষ্ণুর নানা অবতার। মূল বিগ্রহটি শ্রীরঙ্গনাথের। শ্রীরঙ্গনাথ আসলে দেবতা বিষ্ণু। বিষ্ণু এখানে কুনুইএর উপর ভর দিয়ে নিদ্রাভিভূত। শিরদেশে পঞ্চমুখী নাগের ছত্রছায়া। কালো পাথরে তৈরি মূর্তির সামনে দাঁড়ালে ভরসা ও ভয় দুই কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিশাল মন্দির ও তার অভ্যন্তরের ভাস্কর্য আপনার পায়ে শিকল পরিয়ে দেবে। পুজো দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। পুরোহিতরা খুব ভাল মানুষ তাদের কোন উৎপাত চোখে পড়ল না। মন্দিরে কোনো প্রবেশ দক্ষিণা নেই তবে গর্ভগৃহে ছবি তোলা বারণ।
দেবতার নামেই এই জায়গার নাম এমনটি হয়ে থাকতে পারে। মন্দিরের লাগোয়া অনেক দোকানপাট নজরে এল। কাঠের কাজ,হাতির দাঁতের কাজ করা পণ্যগুলি বেশ আকর্ষক। তবে দামদস্তুর করে এগানো ভালো। মন্দিরের বাইরে কারুকার্যময় রথ দাঁড়িয়ে। মাঘ মাসে রথযাত্রা হয় এখানে। যখন জানলাম রথটি আসলে হায়দার আলির উপহার তখন অবাক না হয়ে পারলাম না। সত্যি "শক হুনদল পাঠান মোঘল একদেহে হল লীন"।
হায়দার পু্ত্র টিপুও বড় ভক্ত ছিল এই দেবতার। শ্রীরঙ্গপত্তন আসলে কাবেরীর দু'শাখায় একটা দ্বীপ আর এই নামটির সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাস,বীরত্বের ইতিহাস, এক সতেরো বছর বয়সী তরুণের বীর গাঁথা। শ্রীরঙ্গপত্তন মানেই "সোর্ড অব টিপু সুলতান"। মন্দির থেকে বেরিয়ে বাবদা বায়না জুড়ল সে হর্স রাইডিং করবে। অনেক ঘোড়া দাঁড়িয়ে। বড় চকচকে আর নধর তাদের চেহারা। থেকে থেকে লম্বা লেজ ছুঁড়ে মারছে পিঠে, ছু্ঁড়ছে পিছনের পা দু'টি। সহিস চিৎকার করে দর হাঁকছে একশ একশ একশ... ভয়ে ভয়ে তার বায়না মেটালাম। টাকাটাই গচ্চা গেল। বাবদা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল অতি দ্রুত। আমারও জ্বর ছাড়ল ঘাম দিয়ে।
তবে বড়দের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। কয়েক মিনিটের জন্য ইচ্ছে করলে ঘোড়ায় চড়ে রাজা সেজে নিতে পারেন। আসলে "মেজাজটাই তো আসল রাজা" তাই শ্রীরঙ্গপত্তনে একবার মেজাজটাকে মর্যাদা দিয়ে নকল টিপু হয়ে উঠতে পারেন মাত্র পঞ্চাশ টাকায় বিনিময়ে।
মূর্ত্তিজি কি ধর্মভীরু? নাকি সে সত্যিকার সারথি! যে পথে মন্দির গিয়েছিলাম ফেরার সময় সে পথেই একটু এগিয়ে পথের বাঁ দিক ঘেঁষে দাঁড়াল গাড়িটা। গাড়ির জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি পথের বাঁ দিকে সাদা পাথর বাঁধানো একটা চত্বর তার ঠিক মাঝ বরাবর একটা বেদী। বেদীতে একটা ফলক। ফলকে লেখা The body of tippu sultan was found here.
অর্থাৎ যাওয়ার পথে সচেতন ভাবে এই জায়গাটা এড়িয়ে গেছে মূর্ত্তিজি যাতে মন্দির থেকেই শুরু করা যায়। একসঙ্গে এতোগুলো মানুষ এতোগুলো দিনের জন্য বেরিয়েছি এতদূর পথ পার হব বলে। তাঁর সাহচর্য, তাঁর আশীষ ব্যতীত এ পারাপার কি সম্ভব!
অলৌকিক ভাবে সেই সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদই তো পাথেয় হয়ে সুগম করে তোলে যাত্রাপথ। মূর্ত্তিজি তো আমাদের ক্ষণিকের সঙ্গী তবু তার উপলব্ধি তার অনুভব ছুঁয়ে গেল পরমাত্মীয়তায়। এই বোধ থেকেই, এই অনুভব থেকেই বোধহয় একজন চালক উত্তীর্ণ হন সারথিতে।
১৭৯৯ এর ৪ঠা মে এই চত্বরেই দেখা যায় টিপুর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ। টিপুরই এক সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজের গুলিতে হত্যা করা হয় টিপুকে। কন্নড় ভাষায় টিপু কথার অর্থ হল বাঘ। গাড়ি থেকে নেমে শ্রদ্ধা জানালাম "শের ই মহীশূর"- কে। আজও যেন ঐ চাতাল সংলগ্ন বাতাস বিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়াচ্ছে।
এরপর দরিয়া দৌলত বাগ ও টিপুর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ দেখে সোজা পৌঁছে গেলাম 'জামিয়া ই টিপু মসজিদ' অর্থাৎ টিপুর সমাধিস্থলে। এটি কালো পাথরের ছত্রিশটি পিলারের উপর একটি ক্রিম রঙের গম্বুজ। প্রবেশে পথে মস্ত তোরণ। তোরণ পেরিয়ে পাথর বাঁধানো পথ সোজা চলে গেছে গম্বুজে। পথের দু'পাশে সবুজ ঘাসের মখমল আর ছোট বড় নানান গাছগাছালির বনসাই পরিবেশে এনেছে অন্য এক মাধুর্য। এখানে পর্যটক সমাগম তুলনামূলক কম।
গ্যালারী - ১
পিতা হায়দার আলির সমাধিক্ষেত্র হিসাবে এই গম্বুজ নির্মাণ করেন স্বয়ং টিপু।কালের কি নির্মম পরিহাস তাঁর নিজের তৈরি গোরস্থানে মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে সমাধিস্থ করা হয় তাকেও। পাশেই রয়েছে মা মদিনা বেগমের সমাধি। ঊনপঞ্চাশের যুবক টিপু এখানে পিতা মাতার সঙ্গে রয়েছেন শান্তির শয়ানে। গম্বুজের দেওয়ালে বাঘছাল নক্সা। টিপুর সমাধির উপর রয়েছে বাঘছাল ম্যাট্রেস। তার উপর রজনীগন্ধা ও গোলাপ সহ নানান ফুল। এ গম্বুজের দরজা ছিল সোনা নির্মিত। ব্রিটিশরা সে দরজা খুলে নিয়ে যায়। এখন পাথরের জাফ্রি দিয়ে আটকানো আছে সে পথ। গম্বুজের বাইরের অংশে রয়েছে টিপুর আত্মীয়দের সমাধি। ভেতরে গিয়ে ছবি নেওয়া যায় না।
গম্বুজ থেকে বেরিয়ে তোরণের বাইরে এক খঞ্জকে বসে থাকতে দেখলাম। পাথরের চাতালে শরীরটাকে ঘঁষটাতে ঘঁষটাতে সে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। বাঁ পকেটে হাত ভরলাম খুচরোর সন্ধানে। এতো প্রাসাদ, এতো মন্দির, এতো মসজিদ, এতো রাজা-রাজড়া, ইতিহাসের পাতায় পাতায় শুকিয়ে যাওয়া কালচে-লাল রক্ত- এগুলোই কি 'Incredible india'! আসলে এগুলো হল অর্ধেক ভারত বাকি অর্ধেকটা হল এই খঞ্জ-অন্ধ দুঃখী মানুষগুলোর জীবন সংগ্রামের বহমান ইতিহাস।
দুপুরের আহারাদি সেরে আমরা চললুম মহীশূর জু তে। কেতাবি নাম চামরাজেন্দ্র জুলজিক্যাল গার্ডেন। ১৮৩২ গড়া এই জু-তে এখন প্রায় পনের'শ প্রাণী রয়েছে। এলাকা চল্লিশ হেক্টরের মতো। প্রাণীগুলো আলিপুরের মতো রুগ্ন নয়। জানলাম বেশ কিছু ধনীলোক দত্তক নিয়েছে কিছুকিছু প্রাণীকে। ঐ প্রাণীর সব খরচ ঐ ব্যক্তির। এখানকার প্রধান আকর্ষণ গৌর-ভারতীয় বাইসন। জু-এর মধ্যে পরিবেশ বান্ধব গাড়ি আছে দক্ষিণা দিয়ে সেটাতেও সওয়ারি হওয়া যায়। জু-র মধ্যে জলের বোতল, পলিথিন এসব নিয়ে ঢোকা যায় না। ক্যামেরার জন্য আলাদা দক্ষিণা দিতে হয়। একটা বিষয় বেশ আশ্চর্যজনক মোবাইলে ছবি তোলা যায় কিন্তু ক্যামেরায় মানা! যাই হোক জু-তেই একটা বড় রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে সব রকম খাওয়ার পাওয়া যায়। এক অবেলায় খাওয়া তার উপর দঃ ভারতীয় খাদ্য। পেট ভর্তি অস্বস্তি। চারপাশে এতো গাছগাছালি তবুও ক্রমশ গরম বাড়ছে। এই সময়ের সবচেয়ে সুখাদ্য আইসক্রিম, তাই নেওয়া হল। তাপ এতোটাই বেশি আইসক্রিম নরম হয়ে নেমে আসছে কুনই বেয়ে।
ইতিহাসের কাছে যেতে হয় নিঃশব্দে। পায়ে পায়ে তার আনাচ-কানাচ ছুঁয়ে দেখতে হয়। একটিবার তার সাথে নিবিড় হতে পারলে সে আপন খেয়ালে কথা বলা শুরু করে। কোলাহল সরিয়ে ইতিহাসের অঙ্কলগ্ন হতে পারলেই আপনা হতেই তার হলদেটে পাতাগুলো ফরফর খুলে যায়। ইতিহাস তো দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে আলোক স্তম্ভের মতো। দাঁড়িয়ে থাকে রোদ জল মেখে আর সময় হলেই তার আশ্চর্য - ঝাঁপিটাকে উজাড় করে দেয়। শুধু তার কাছে যেতে হয় নিঃসঙ্গ, নিঃশর্ত। সমর্পণ করে দিতে হয় অপার বিস্ময়ে। একটা গেটের কাছে গাড়িটাকে দাঁড় করাল ড্রাইভার। কথার মধ্যে দক্ষিণ ভারতীয় একটা টান লাগিয়ে হিন্দি-ইংরাজি মিশিয়ে বলল-
"দ্যা রাইট সাইডো মেএন গেএট। এ গেএট কা নাআম জঅয় মার্তান্ডা। রয়েল ফ্যামেলি এন্ট্রান্স গেএট। দ্যা অনলি রাজ-রানী এন্ট্রান্স গেএট।"
প্রকান্ড প্রবেশপথ তদুপরি বিশাল প্যালেস দেখে কবিগুরুর কথা মনে হল-
"যে লোক ধনী ঘরের চেয়ে তার বাগান বড়ো হইয়া থাকে। ঘর অত্যাবশ্যক; বাগান অতিরিক্ত, না হইলেও চলে। সম্পদের উদারতা অনাবশ্যকেই আপনাকে সপ্রমাণ করে। ছাগলের যতটুকু শিং আছে তাহাতে তাহার কাজ চলিয়া যায়, কিন্তু হরিণের শিঙের পনেরো-আনা অনাবশ্যকতা দেখিয়া আমরা মুগ্ধ হইয়া থাকি।" চিড়িয়াখানায় প্রায় সাত-আট কিলোমিটার ঘুরে পা আর চলতে চাইছিল না। তিন ক্ষুদে সঙ্গী আর আমার শ্বাশুড়িমাতা তো কাহিল।প্রায় চারহাজার বর্গমিটার জুড়ে প্যালেস, প্যালেসের চারপাশটা ঘুরতে কমবেশি কিলোমিটার দুই-তিন হাঁটতে হতো। সে ধকল নেওয়ার মতো মানসিক জোর কিঞ্চিত অবশিষ্ট থাকলেও শারীরিক ক্ষমতা তখন তলানিতে। শেষপর্যন্ত জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সেল(ব্যাটারি) চালিত শকটে সওয়ারি হলাম আমরা। ব্যাটারি চালিত গাড়িটাতে প্যালেসের বাইরের চারদিকটা ঘোরার সময় দেখে নিলাম গায়ত্রী, ভুবনেশ্বরী ও নবগ্রহ মন্দির। মিনিট দশ-পনেরোতে প্যালেসের চৌহদ্দি ঘুরিয়ে গাড়ি নামিয়ে দিল বামাবর্ত্তে, ওটাই প্যালেসের ভেতরে যাওয়ার পথ। পাশেই বাগিচা। রংবেরং-এর ফুল ফুটেছে বাগিচা জুড়ে। প্যালেসের চূড়াটি ১৮ ক্যারেট সোনায় গিলটি করা। প্রকান্ড সে চূড়া সূর্যের আলোয় আরো বেশি করে দীপ্যমান। ড্রাইভারের থেকে জেনেছিলাম এখানকার রাজারা হিন্দু হলেও সব ধর্মকে সমাদর করতেন। তাই প্যালেসের মাথায় মন্দিরের চুড়ার সঙ্গে মসজিদের আদলে বেশ কয়েকটি গম্বুজের সহাবস্থান। মহীশূর প্যালেসের দর্শনী জনপ্রতি ষাট টাকা। এরা ছোটোদের হাইট মেপে টাকা নেয় তাই ঝামেলা এড়াতে বাবদাদেরও টিকিট নেওয়া হল।
প্রবেশ পথ বেশ সংকীর্ণ। নিজেদের কষ্ট করে প্যালেসের মধ্যে ঢুকতে হল না। দর্শনার্থীদের ভিড়টাই বয়ে নিয়ে গেল ভেতরে। বৈভব মানুষের বাসস্থানকে কত বিচিত্র করে তোলে। এ প্যালেসে প্রতিটি পদক্ষেপে বিপুল বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে আপনার জন্য। যে কোনো রবিবার বা দশেরা উৎসবের দিনগুলি হল এই প্যালেস দেখার সবচেয়ে ভাল সময়। ঐ দিনগুলিতে প্যালেসের সব দ্বার উন্মুক্ত। ঢোকার মুখেই একতলায় ডলস মিউজিয়াম শ্বেতপাথরের মূর্তি,মহারাজার হাওদা,পুরানো প্রাসাদের মডেল। পুরানো প্রাসাদটি ছিল দারু নির্মিত। ১৮৯৭ এর ভয়াবহ আগুনে তা পুড়ে যায়। বর্তমান প্রাসাদটি হেনরি আরউইনের নকসায় নির্মাণ করেন ২৪ তম ওডিয়ার। এ প্রাসাদ ইন্দো-সেরাসেনিক শৈলীতে তৈরি।
আটকোন বিশিষ্ট কল্যাণ মন্ডপে রয়েছে রবি ভার্মার আঁকা দশেরা উৎসবের ছবি। ১৬১০ সাল থেকে ওডিয়াররা দশেরা উৎসবের প্রচলন করেন। যে উৎসব ঘিরে আজও দেশ বিদেশের পর্যটক সমাগম ঘটে আজকের মাইসোরে। কল্যাণ মন্ডপে রয়েছে দু'টি রুপোর চেয়ার একটি মহারাজের অন্যটি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের- যা অলঙ্করণ ও আভিজাত্যে উপমাহীন। শ্বেতপাথরের সিঁড়ি আমাদের নিয়ে এল দরবার হলে। এই দরবার হল আজও বিত্ত বৈভবে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এখানেই রয়েছে ২৮০ কেজি ওজনের রত্ন সিংহাসন- এ সিংহাসন নাকি বিজয়নগর জয়ের স্মারক। এছাড়াও রয়েছে সোনার হাতি। পিতলের স্তম্ভ,ঝাড়লন্ঠন,অলঙ্কৃত কাঠের দরজা,রুপোর দরজা, চন্দন ও মেহগনির আসবাব, মূল্যবান পাথরের চাকচিক্যময় অলঙ্করণ, মোজাইক মেঝে, সিলিং- এ প্রাসাদকে ইন্দ্রপুরী করে তুলেছে। সেকালে প্যালেসের মধ্যেই বসত মল্লযুদ্ধ। স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে রাজা নেমে আসতেন সেই দেহসৌষ্ঠব আর মল্লের প্যাঁচপয়জার দর্শনে। এখনও একটা বৃত্তাকার জায়গা বালি দিয়ে চিহ্নিত রয়েছে মল্ল যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসাবে। প্যালেসের আর্ট গ্যালারিটি তৈলচিত্রে অনবদ্য। ছবি আঁকিয়েদের কাছে সে যেন মৃগয়াভূমি। বইয়ের পাতায় পড়া টিপুর তরবারি,শিবাজীর বাঘনখ নিজের চোখে দেখার পর দু'হাতে চোখ কচলে নিলাম। সত্যি দেখছি তো! প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে চললাম বৃন্দাবন গার্ডেনে। এম বিশ্বেসরাইয়ার পরিকল্পনায় কাবেরী নদীর উপর সিমেন্ট ছাড়াই পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে তিন কিমি দীর্ঘ ও চল্লিশ মিটার উঁচু কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধ। তারই নিচে বৃন্দাবন গার্ডেন। আমারা যখন পৌঁছলাম তখন কাবেরীর জল অস্ত রবির আভায় টলটলে লাল। ফেরার পথে দেখি মহীশূর প্রাসাদ আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে। তখনই মনে পড়ল ড্রাইভারটা বলেছিল ছিয়ানব্বই হাজার বিজলি বাতি দিয়ে সাজানো প্রাসাদ রাতে অন্য রূপ পায়। হোটেলে ফিরেও চোখ বন্ধ করলে বারেবারে ফিরে আসছে মহীশূরের অহংকার, মহীশূরের বিস্ময় ওডিয়ারদের প্রাসাদ। বুঝতে পারছি এই ঘোর থেকে এই ইন্দ্রজাল থেকে না বেরাতে পারলে সমূহ বিপদ।
রাত বাড়ছে। বাড়ছে পেটের দায়। আদিম মানুষ যেমন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত ফল-মুল, পশু-পাখির খোঁজে। দক্ষিণায়নে আমাদের অবস্থাও তাই। বাঙালী খাওয়ারের খোঁজে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়াতে হবে পথে-বিপথে। আর যদি খাওয়ার না মেলে! ভাবতেই কেঁপে উঠলাম! পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।
কথিত আছে মহিষাসুর থেকে মহীশূর নামের উৎপত্তি। এখানেই নাকি মহিষাসুর বসবাস করত, নাম ছিল মাহিষ্মতি। দেবী চামুন্ডেশ্বরী বধ করেন অসুরকে। সেই থেকে কালক্রমে মহীশূর নামের উৎপত্তি বলে শোনা যায়। দেবী চামুন্ডেশ্বরী পূজিত হন চামুন্ডি পাহাড়ে। চামুন্ডেশ্বরী আসলে দেবী দুর্গা। মহীশূর ছেড়ে আমরা চলেছি চামুন্ডি পাহাড়ের পথে। মহীশূর শহর জুড়ে তখনও দশেরার মেরাপ খোলা হয় নি। মহীশূর শহর থেকে খানিক দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ১০৯৫ মিটার উঁচু চামুন্ডি পাহাড়।
মহীশূর পুলিশ কোয়াটার থেকে পাহাড়ি পথের শুরু। পায়ে হাঁটা পথে সিঁড়িতে একহাজার ধাপ উপরে উঠে মন্দিরে যাওয়া যায়। ত্যাগ আর কৃচ্ছ্র সাধন ছাড়া তো ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায় না। তাই সিঁড়ি ভেঙে পাহাড় চূড়ায় মন্দিরে পৌঁছাতে পারলে নিবেদন পূর্ণতা পায়। তবে তার জন্য বুকের খাঁচায় দম থাকা প্রয়োজন। আমার কার্বন পূর্ণ কলিজা নিয়ে সিঁড়ি ভাঙা যে হাঁফ ও চাপ দুদিক থেকে বেশ বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে তা আগাম অনুমান করেই গাড়িতে চেপে প্রায় দশ কিমি ঘুর পথে মন্দির চললাম। একটু উপরে উঠলে বায়ুস্তর হালকা হয়ে আসে পাহাড়ে চড়ার মেজাজ পাওয়া যায়। পাকদন্ডি বেয়ে মন্দির পৌঁছতে মন্দ লাগে না। পথ বেশ প্রশস্ত। গাড়ির জানালায় ধরা উপত্যকা ছবির মতো লাগে। চামুন্ডেশ্বরী ওদিয়ারদের কুলদেবী। পাহাড় চূড়ায় এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণরাজা তৃতীয় ওদিয়ার। প্রায় দু'হাজার বছরের পুরানো মন্দিরে রয়েছে দেবীর কনকমূর্তি।মন্দিরের প্রবেশ পথে মহিষাসুরের প্রকান্ড মূর্তি। মন্দিরের স্থাপত্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মন্দিরে সাত তলা গোপুরম রয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির গুলিতে সুউচ্চ ও অলংকৃত যে প্রবেশদ্বার দেখা যায় সে গুলোকে গোপুরম বলে। এটি দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যের একটি অন্যতম দিক। দেখলাম মন্দিরের পুরোহিতরা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে দর্শনার্থীদের সঙ্গ দেন। মন্দির চত্বরে বাঁদরের উপদ্রব রয়েছে সে বিষয়ে সাবধান থাকা ভাল। পাহাড় থেকে নামার পথে এক বিশাল নন্দীমূর্তি। একটা মস্ত বড় পাথর কেটে তৈরি হয়েছে তা।
পাকদন্ডি বেয়ে নামার সময় পথের পাশে পলিথিনের এক চিলতে ছায়ায় এক দেহাতি মানুষ পাথর কুঁদে তৈরি করছে দেবমূর্তি। সে নিবিষ্ট তার নির্মাণে। বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুলে চেপে ধরেছে পাথর, পাথরের উপর ছেনি-হাতুড়িতে রূপ পাচ্ছে গনপতি। অবাক করছিল তার নির্মাণ কৌশল। পায়ে আটকে থাকা গনপতি তখন তার কাছে দেবতা নয় একখন্ড পাথর,তার সৃষ্টির উপকরণ। এটিই তার অন্নের সংস্থান,এটি তার কাছে পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার যিনি এই গনপতি সংগ্রহ করেন, তার কাছে এটি ঈশ্বর। তবে উভয়ের মধ্যে মিল একটি ক্ষেত্রেই, তা হল দু'জনেই নিষ্ঠাবান। পাশেই মস্ত টেলিস্কোপওয়ালা ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে গোটা মহীশূর শহরটাকে পাখির চোখে দেখা যায়। চামুন্ডেশ্বরী যেহেতু ওদিয়ারদের কুলদেবী তাই প্রাসাদ দেবীমুখী। এখান থেকে মহীশূর প্রাসাদের দৃশ্য অনবদ্য। চামুন্ডি পাহাড় ছেড়ে চললাম উটির পথে।
গ্যালারী - ২
মহীশূর-উটি রোডে মধুমালাই জাতীয় উদ্যান। শাল, সেগুন, চন্দন, দেবদারু, আবলুস, ইউক্যালিপটাস ঘেরা অরণ্যভূমি। শুনেছি বাঘ, চিতা, ভালুক, হাতি, গৌর, হরিণ, বুনো কুকুর, বুনো শুয়োর কি নেই এ বনে। আমরা কয়েক দল হরিণ ও একটি চিতা ছাড়া আর কারো দেখা পেলাম না। তবে বনের ভিতর ময়ার নদীর জলপ্রপাতটি বেশ লাগল। বেলা দুটো নাগাদ হোটেলে উঠলাম। পেটের মধ্যে ছুঁচোর দাপাদাপি, সামনে ভাতের থালা তবুও ডান হাতে অতৃপ্তির অলসতা। চামুন্ডি পাহাড় থেকে নামার সময় মহীশূর- আর.এম.সি-তে যে পাহাড়ি পথ শেষ করেছিলাম মধুমালাই ফেরত উটি-মহীশূর রোডে বেশ খানিক এগিয়ে গুডালুরের খানিক আগে ফিরে এল সেই পাহাড়ি পথ। মধুমালাই কার্যত আমাদের হতাশ করেছে ফলত একটা দীর্ঘশ্বাস যাত্রাপথকে বড় একঘেয়ে করে ফেলেছিল।
কিন্তু গুডালুরের অনেকটা আগে থেকে পথশোভা অস্থির করে তুলেছিল চোখ দুটোকে। রাস্তার দু'পাশে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস, ঝাউ, মেহগনির সবুজে বারবার আটকে যাচ্ছিল চোখ। দিগন্ত প্রসারিত অনুচ্চ পাহাড়ের শিরদেশ আর তার শরীর জুড়ে সাদা মেঘের আলপনা রোমাঞ্চ জাগাচ্ছিল থেকে থেকে। প্রবেশ পথে এই অভ্যর্থনাই বলে দিচ্ছে উটিকে দক্ষিণের রানী বলাটা কোনো মতেই বাড়াবাড়ি নয়। গুডালুরের নিডিল রক ভিউ পয়েন্টে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ রোদ ঝলমলে পরিবেশ। এখান থেকে পুরো নীলগিরিটাকে দেখা যায়। গাছগাছালি ঘেরা নিডিল রক প্রাণ ভরিয়ে দিল। ওখান থেকে আমাদের গাড়ি ছুটল পাইকারার দিকে। পাইকারাতে বাঁদরের উৎপাত আছে।আমরা ছাড়া আরো গুটিকয় টুরিস্ট বাঁদর সামলে চললাম পাইকারা শুটিং স্পটের দিকে। একটু একটু করে ঠান্ডা বাড়ছে,হাওয়া দিচ্ছে। জায়গাটার নাম সম্ভবত নাইন মাইলস। পিচ রাস্তা থেকে সবুজ ঘাসের গালিচা ক্রমশ উঠে গেছে আকাশের দিকে। ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে সওয়ারির অপেক্ষায়। আমরা উঠে এলাম একেবারে ঢালু গালিচার মাথায়। এখান থেকে দূরে দূরে উপত্যকা গুলোকে বড় মায়াবী মনে হয়। আজকের মতো সূর্যের আলো ফুরিয়ে আসছে।
এখান থেকে পাইকারা জলপ্রপাত প্রায় দশ-বারো কিমি পথ। সময়ের টানাটানিতে আমাদের আর সে পথে এগানো সম্ভব হল না। উটি শহরে ঢোকার আগে সবুজে মোড়া পাহাড়, পাহাড়ের ঢালে চা-বাগান, ঘন সবুজ গাছপালা দেখে মন বড় উচাটন হল। ইচ্ছে করছিল মূর্ত্তিজিকে বলি- "গাড়ি রুকিয়ে"। কিন্তু উপায় ছিল না। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। দিন শেষে দূরে বাগিচা থেকে বাড়ি ফিরছে লোকজন। অন্ধকার নামার আগেই গন্তব্যে পৌঁছানো চাই। তার উপর আমাদের হোটেল বুক করা নেই। দরদস্তুর করে হোটেল খু্ঁজে পেতে সময় লাগবে এমন সব অজানা আশঙ্কায় গাড়ি থেকে নেমে প্রকৃতির এমন রূপে দু'দন্ড চুপটি করে থাকার অভিলাষে শিকল দিলাম। পথে পুলিশ আটকে দিল আমাদের গাড়ি। গাড়ি পার্ক করে মূর্ত্তিজি ছুটল কাগজ পত্তর নিয়ে বড় কত্তার কাছে।
আর এই সুযোগে আমরাও নেমে এলাম গাড়ি থেকে- এতক্ষণ ধরে যে অভিলাষটা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তা পূরণের এতো বড় সুযোগ হাতছাড়া করা যায় কি? গাড়ি থেকে নামতেই শীত শীত করছে। তাতে কি যায় আসে শরীরের শিরায় শিরায় তখন উত্তেজনা ছড়াচ্ছে উটি-সুন্দরী। মূর্ত্তিজি ফিরল জরিমানা দিয়ে। যদিও সব কাগজ পত্তর ঠিকঠাক ছিল কিন্তু বেচারা কেন জুতোতে মোজা নেয় নি তার জন্যই জরিমানার আয়োজন। জায়গায় জায়গায় প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষজন, তাদের পোশাক, পছন্দ, রুচি এসব কিছু বদলে বদলে গেলেও পুলিশ বদলায় না। উলবেড়িয়া চেকপোষ্টের পুলিশ আর উটির পুলিশ এক। শোলে সিনেমায় আসরানির সেই সংলাপটা মনে পড়ে গেল - "লেকিন হামারা ইতনি বদলিওকি বাদমে, হাম নেহি বদলে।"
নীলগিরি পাহাড়ে ২২৮৫ মিটার উঁচুতে চিরবসন্তের দেশ উটি। পোশাকি নাম উটি এসেছে উটকামন্ড বা উধাগামন্ডলম থেকে। উধাগামন্ডলম হল একটা টোডা শব্দ যার অর্থ হল কুটিরের গাঁও। উটি সকলের সঙ্গে সখ্যতা করে না। আমাদের সঙ্গে উটির তেমন একটা সখ্য গড়ে ওঠে নি। সকালবেলা আমরা যখন বের হলাম উটির সৌন্দর্যে অবগাহন করব বলে তখন সে মুখ ফিরিয়ে নিল আমাদের থেকে। থেকে থেকে মেঘের চাদরে আত্মগোপন করল সে। কুন্নুরের পথ নেওয়ার আগে পর্যন্ত জারি রইল এই লুকোচুরি। সকাল সাড়ে আটটায় আমরা পৌঁছে গেলাম দোদাবেতার প্রবেশদ্বারে। তখন সবে মাত্র টিকিট কাউন্টার খোলা হয়েছে। দোদাবেতা নীলগিরির সবচেয়ে উঁচুশৃঙ্গ। মেঘ সরে যেতেই দোদাবেতা থেকে ক্যাথি উপত্যকার শরীরী বিভঙ্গ বিমোহিত করল আমাদের। আলো-ছায়ায় সম্পাত চলছে উপত্যকার আনাচে কানাচে। আর তাতেই ক্যাথি ধরা দিচ্ছে নব নব রূপে। উটির অন্যতম আকর্ষণ বোটানিক্যাল গার্ডেন। গার্ডেন নয় এ যেন গাছ-গাছালির ভাস্কর্য। বৈচিত্র্য আর বৈভবে এ হল উটির অলংকার। মুগ্ধ করল পাহাড়ের ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা রোজ গার্ডেন।উটি লেকে বোটিং সেরে আমরা চললাম কুন্নুরের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে ক্যাথি ভ্যালি চোখ জুড়াল। উটি থেকে কুন্নুর প্রায় কুড়ি কিমি। যাত্রীরা সাধারণত ট্রয় ট্রেনে লোয়ার কুন্নুর পৌঁছায় তারপর সেখান থেকে গাড়িতে আপার কুন্নুর। কুন্নুরের আসল সৌন্দর্য আপারে।
লোয়ার কুন্নুর গাড়ি, ধুলো, ধোঁয়ায় বিরক্তিকর। আমরা ট্রয়-ট্রেন পেলাম না। তাই গাড়িতেই পৌঁছলাম কুন্নুরে।
লোয়ার কুন্নুর থেকে একটু এগিয়ে সীমস পার্ক। প্রথমে ভেবে ছিলাম ওটাতো একটা পার্ক, না গেলেও চলে। মূর্ত্তিজি পিড়াপিড়ি করল। তাই চললাম সীমস পার্ক। সীমস পার্কের কাছে ছোট্ট একটা বাজার নানা ফল বিক্রি হচ্ছে। মুলসিতা নামে একটা ফল দেখলাম। ওটা নাকি ক্যানসারে বড় উপকারী। পাহাড়ের ঢালে সীমস পার্কে নানা ফুলের বাহার, গাছে গাছে পাখির কাকলি - এ কেবল দুটো কথা নয়, এক অনির্বচনীয় দর্শন। যতই আপারের দিকে এগোচ্ছি ততই কুন্নুর যেন স্বর্গের কিন্নরদল হয়ে উঠছে। পথের দুপাশে নাম না জানা রং-বেরংএর ফুল, চা ও কফির বাগিচা, দীর্ঘল ঝাউে বাতাসের শনশন আপনাকে একা করে দিতে চাইবে। ইউক্যালিপটাস, সিলভার ওকগুলোকে যেন কেউ মাপা হাতে রোপণ করেছে এখানে।
গ্যালারী - ৩
আপার কুন্নুরে পায়ে পায়ে বেশ খানিক চড়াই পেরলে ল্যাম্বস রক। হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে আসায় ওখানে গিয়ে কেবল কষ্টই হল। দ্রুত নেমে, চললাম ডলফিন নোজ। অসাধারণ এখান থেকে উপত্যকা আর সমতলের সৌন্দর্য। দূরে ক্যাথেরিন ফলস যেন পাহাড়ের গায়ে সাদা উপবীত।
বেলা দু'টা নাগাদ পেট ভরে ভাত খেলাম শ্রীবাবা রেস্টুরেন্টে। ধীরাজ ভরদ্বাজ শিলিগুড়ির লোক হোটেল করেছে ওখানে। নিজের হাতে পাকানো ভাত, মুগডাল, আলুপোস্ত খাওয়ালো আমাদের। অনেক দিন পর বাংলায় বলতে পারলুম... আর একটু ভাত দিন...
পথে নামার ইচ্ছেটাই শেষ কথা। একটিবার পথে নেমে পড়তে পারলেই সামনের পথ আপনা হতেই পায়ের তলায় চলে আসে। পথ চলাতে উৎকন্ঠা থাকলেও তা কখন যে রোমাঞ্চে বদলে যায় তার টের পাওয়া যায় না। অজানা অচেনা পথের সুলুক-সন্ধানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আবিষ্কারের আনন্দ। পথ চলাতে সম্মোহন আছে। একটা নেশা নেশা ঘোর আছে। তা যদি না হতো তবে দুপুর দু'টার পর একজন সত্তরোর্দ্ধ মহিলা আর তিনটি বছর ছয়-সাতেকের বাচ্চা নিয়ে দু'শ কুড়ি-ত্রিশ কিমি পথ-যাত্রা শুরু করা যায়! যেখানে এক'শ-র বেশি পাহাড়ি পথ!
দুপুর আড়াইটা নাগাদ কুন্নুর থেকে চললাম কোদাইকানালের দিকে। আজ আমাদের রাত্রি বাস কোদাইকানালে। কাল সকাল থেকে কোদাই দেখে নেওয়া। যেহেতু পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যেতে পারে তাই আলগা সময় পেয়ে বাবারেস্টুরেন্ট থেকে মূর্ত্তিজী ফোন করেছিল ওর পরিচিত এক হোটেল মালিককে। থাকার ব্যাপারে একটা আগাম কথা হয়ে যাওয়ায় বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে। পাকদন্ডী বেয়ে নামছে গাড়ি। সারি সারি পাহাড়, গাছ-গাছালি পিছলে যাচ্ছে পিছনের দিকে। রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো রঙ-বেরঙের ফুলের ডালি সাজিয়ে যেন বিদায় জানাচ্ছে আমাদের। উপর্যুপরি পাহাড়ি বাঁকে শক্ত হাতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করছে মূর্ত্তিজী।
একটা পাহাড়ি বাঁকে চা ও চকলেট কেনা হল। উটির হোম-মেড চকলেট ভারি সুস্বাদু। ঠান্ডা বেশি বলেই এখানে চকলেট তৈরি হয়। নিচের দিকে এই চকলেট পাওয়া যায় না। কুন্নুর থেকে কোদাই আসার পথে মেট্রুপালিয়ামে আমরা সমতলে এসে পড়লাম। ঠিক সমতল নয় প্রায়-সমতল। এই সমতলে যত কম সময়ে যত বেশী পথ চলে নেওয়া যায় ততই ভাল। তাই গাড়ির বেগ ক্রমশ বাড়াতে থাকল মূর্ত্তিজী। আঙুলে গাঁট গুনে যা হিসাব পেলাম তাতে যদি সব ঠিকঠাক চলে তবে রাত্রি দশটার আগে কোনো ভাবেই কোদাই পৌঁছতে পারব না আমরা। মেট্রুপালিয়াম থেকে পালনি এক'শ আশি কিমি সমতল পথে গাড়ি ছুটল তীব্র গতিতে। পালনি হল কোদাই-এর প্রবেশদ্বার।আমাদের যাত্রাপথ কোয়েম্বাটুর, অবিনাশি, দারাপুরম হয়ে ছুটে চলল পালনির দিকে। কোয়েম্বাটুরে আকাশ কালো হয়ে এলো। ওখান থেকে অবিনাশি চুয়াল্লিশ কিমি পথ পেরতে না পেরতেই শুরু হল ঘন বর্ষা। ছয় লেনের সড়ক বর্ষার জলে সাদা ধবধব করছে। ওয়াইপার দ্রুত হাতে কাঁচ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে জল। অবিনাশি হয়ে দারাপুরম যাওয়া যায়। আবার অবিবাশির থেকে দশ-বারো কিমি আগে আন্নুর থেকে অন্য একটা পথ চলে গেছে দারাপুরম হয়ে পালনি। আমরা দ্বিতীয় পথটা নিলাম। অবিনাশি গেলাম না। যদিও জানতাম অবিনাশিতে একটা শিব মন্দির আছে,তবুও টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে গিয়ে ওখানে গেলাম না। এর মধ্যে বর্ষা থেমেছে। ঠান্ডা বাতাসে আয়েশি ফরমান। পিছন ঘুরে দেখি বাকিরা প্রায় সকলেই সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। আমার না জেগে উপায় নেই। মূর্ত্তিজীকে তো জাগতে(লক্ষ্য রাখতে) হবে। ওর দু'চোখের পাতা এক হলে সমূহ বিপদ। মাঝে মধ্যে মূর্ত্তিজীর হাত স্থির হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ চোখ জুড়ে আসছে ওর। স্বাভাবিক কদিনের টানা পরিশ্রম তার উপর ভাত খাওয়ার পর বর্ষা আবহাওয়াকে বিশ্রামের উপযুক্ত করে তুলেছে। পরিস্থিতিকে একটু হলেও আড়াল করার চেষ্টা করছে সে। যেন আমার নজরে না আসে। আমি এলোমেলো দু-চার কথা জুড়ে দিলাম ওর সঙ্গে যাতে ওর ঘুম না আসে। খানিক বাদে মূর্ত্তিজী গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমটা অন করল... কর্ণ-প্রদাহের যন্ত্রণা নিয়ে বাজছে যন্ত্রটা....
গ্যালারী - ৪
"উইকিপিডিয়া তু চেক করলে, গুগল তু সার্চ করলে.... ইক নম্বর ইক নম্বর..." মূর্ত্তিজীকে বললাম-
-- মূর্ত্তিজী পাঁচ বাজনে চলা, চা পিনেকি লিয়ে আপকি মন নেহি কর রাহা।
-- ও তো কর রাহা, লেকিন আপনে নেহি বাতায়্যা..
-- আপ হামারা সারথি হ্যাঁয়। বাতানে কা ক্যায়া কুছ জরুরতি হ্যাঁয়?এক আচ্ছাসা রেস্টুরেন্ট দেখকে গাড়ি রুক দিজিয়ে।
চায়ের কাপে চমুক দিয়ে মূর্ত্তিজী শুরু করল অবিনাশির গল্প। অবিনাশি কথার অর্থ যার বিনাশ নেই। অবিনাশিতে একটা শিব মন্দির আছে যার বিনাশ কখনই সম্ভব নয়। কোন প্রাকৃতিক- অপ্রকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষয় নেই মন্দিরের। এই মন্দির হল এমন এক শিব মন্দির কেবল মাত্র এখানে দুর্গা রয়েছেন শিবের ডানদিকে। অন্য সব মন্দিরে দুর্গা রয়েছেন শিবের বামে। মন্দিরের আর এক আশ্চর্য কাহিনী শোনাল মূর্ত্তিজী। একবার সুন্দরমূর্ত্তি নায়নার নামে এক সাধু মন্দিরের সামনের থেকে যাচ্ছিল। সে সময় ঐ সাধু দু'টো শব্দ শুনতে পায় বিপরীত মুখী দু'টি বাড়ি থেকে। একটা আনন্দের অন্যটা কান্নার। সাধু খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ঐ দুই বাড়ির দু'টি ছেলে পরস্পর বন্ধু ছিল। একবার ওরা এক সঙ্গে স্নান করতে যায়। কিন্তু একজনকে কুমির খেয়ে নেয়। যে বেঁচে গেল তার বাড়িতে আনন্দ কারণ তার পৈতা হচ্ছিল। অন্য বাড়িতে কান্নার কারণ, ঐ বাড়ির ছেলে বেঁচে থাকলে তারও পৈতা হত। ঘটনা শুনে সাধু শিবের তপস্যা শুরু করলেন যাতে তিনি ঐ মৃত ছেলেটির পুনঃ জন্মের ব্যবস্থা করে দেন। সাধুর গভীর তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হন। শুকনো পুকুর জলে ভরে যায়। আর কুমির ছেলেটাকে উগরে দেয়। গল্প শুনে মনে হল অবিনাশিটা দেখে নিলেই ভাল হতো। পালনি তে যখন পৌঁছলাম তখন গভীর অন্ধকার নেমেছে পাহাড়ে। আসলে পালনি হল নীলগিরির অংশ। পালনিতে কোদাইকানাল একটা জনপদ। পালনি থেকে প্রায় সত্তর কিমি পাকদন্ডি বেয়ে তবেই কোদাই। গাড়ির আলোয় পাহাড়, গাছপালার অবয়বের একটা আন্দাজ ছাড়া বাকি সব ঘন অন্ধকার। সে অন্ধকার গভীরভাবে নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেক নিচে। নিচের দিকে আলোগুলো একটা জোনাকির মতো জেগে আছে। এমন ঝুঁকির জার্নি সত্যি সত্যি ভাবনাতেও ছিল না। বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছল হয়ে বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। ভয় পেয়ে বসেছে কিন্তু তবুও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। আমি ভয় পেলে বাকিদের ধরে রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে উঠবে।
মূর্ত্তিজীকে বলেছি রাত বাড়ে বাড়ুক গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখুন। গাড়িও চলছে ধীর গতিতে। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে আসা অন্য একটা গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো ঝলকে দিলো চোখ। বিপদ অনুমান করে কষে ব্রেক লাগাল মূর্তি। গাড়িটা একটু এগিয়ে রাস্তা কামড়ে দাঁড়িয়ে গেল। চেয়ে দেখি চাকার হাত দুই সামনেই গভীর খাত, অন্ধকারে সে বিপদের মাত্রা বোঝা যায় না। যখন কোদাইকানাল পৌঁছলাম তখন সারা কোদাই শুনশান। পথের ধারে দোকান পাট সব বন্ধ। হোটেলগুলোতে রাত বাতি জ্বলছে। মোবাইলের আলোয় সময় তখন রাত পৌনে দশ। আমাদের গাড়িটা একটা হোটেলের সামনে দাঁড়াল। একজন বয়স্ক লোক হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে এলো আমাদের জন্য। সুন্দর হোটেল, বেশ গোছানে ব্যাপার কিন্তু অনেক দিন লোকজন না থাকায় কেমন যেন গন্ধ। গন্ধ হোক এতো রাতে মাথা গোঁজার এই বন্দোবস্তটাই না হয়ে থাকলে খুব মুশকিল হতো। সঙ্গে রুম রিফ্রেশনার ছিল তাড়াতাড়ি বের করে ছড়িয়ে দিলাম সুবাস। হোটেল থেকেই রাতের খাওয়ার দিল রুটি, সবজি আর ডাল। সবজি আর ডাল এতো বিরক্তিকর যে মুখেই নেওয়া গেল না। ভোর রাতে টের পেলাম ঠান্ডা বেশ বেড়েছে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি কেদাই-এ বৃষ্টি নেমেছে।
সকাল সকাল ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। এখানে হোটেলে ভাড়ার সঙ্গে সকালের টিফিন খরচ ধরা থাকে। একটু বেলার দিকে সকালের খাওয়ার দেয় এরা। আমাদের হাতে অপেক্ষা করার মতো সময় নেই তাছাড়া রাতের খাওয়ারের স্বাদ অপেক্ষা করার সাহস আর ইচ্ছার পূর্ণছেদ দিয়ে রেখেছে। কোদাই শহর তখনও মেঘ আর কুয়াশার বিছানা ছেড়ে জেগে ওঠে নি। তার সারা শরীরে অদ্ভুত এক আলস্য। কিন্তু আমাদের তো আর আলসেমির অবকাশ নেই। বাইরের দোকান থেকে সকালের খাওয়ার নিয়ে নেওয়া হল। সঙ্গের পলি প্যাকে ভরে নেওয়া হল সে রসদ। দোকানে বসে খাওয়ার সময় নেই । আজ কোদাই দেখে রওনা দিতে হবে কন্যাকুমারীর দিকে। পাইন, ঝাউ,ইউক্যালিপটাস মোড়া রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল গাড়ি। চারদিকে ঘন অরণ্য। রাতের বৃষ্টিতে ভিজেছে মাটি আর তারই একটা অন্য রকম গন্ধে মত্ত হয়ে আছে বাতাস। শীতের কামড় ধারালো হচ্ছে ক্রমশ। এতো গভীর অরণ্য যে গাছের শির বেয়ে সূর্যের আলো নেমে আসতে পারছে না। দূরে সারি দিয়ে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। মূর্ত্তিজী বলল--
-- স্যারজি ও হ্যাঁ কৌশন চেকপোষ্ট। ইস ইলাকামে প্লাস্টিক, দারু, বিড়ি, সিগরেট মানা হ্যাঁ। গাড়িকা অন্দর যো প্লাস্টিক হ্যাঁ ছুপা দি জিয়ে। ও লোগ দেখেগা তো তকলিফ বড় যায়েগা।
দু'জন আধা-মিলিটারি পিচরাস্তায় ভারি বুটের আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে আমাদের গাড়ির দিকে। গাড়ির মধ্যে প্লাস্টিকে ভরা খাওয়ার, পাঁচ লিটারের জলের বোতল,চিপসের প্যাকেট কি নেই। নানা আশঙ্কা ভিড় করে আসছে... যদি খাওয়ারটাই কেড়ে নেয়! খাওয়ার কেড়ে নিলেও তবু রক্ষে, যদি ফিরিয়ে দেয় এখান থেকে! মুখে একটা ছদ্ম স্মার্টনেস লাগিয়ে, দু'হাত জোড়ো করে নমস্কার জানালাম আগন্তুকদের। হাতের ইশারায় সঙ্গে বললাম--
-- প্লিজ আইয়ে স্যার আইয়ে... সাহস দেখানোটা বেশ কাজে দিল।
যদিও টেনশনে কোদাইয়ের আট-নয় ডিগ্রি টেম্পারেচারে ভেতরের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে যাচ্ছিল। যারা চেক করতে এসেছিল তারা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ফিরে গেল। হয়তো আমাদের দলে মহিলা আর শিশুদের আধিক্য তাদের নিশ্চিন্ত করেছিল। অবশ্য তার আগেই জলের বোতল সহ পলিথিনের ব্যাগগুলোকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল ঢাউস লাগেজের আড়ালে। ভারি বুটের আওয়াজ একটু একটু করে ক্ষীণ হতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ঘন অরণ্য পথ ধরে গাড়ি ছুটল। একটু উপরের দিকে গাছ-গাছালি বেশ পাতলা। তার ফলে সূর্যের আলোয় পথে-প্রান্তরে ধরা পড়েছে গাছের ছায়ার আলপনা। লম্বা পাইন, ইউক্যালিপটাস বা সিলভার ওকের শির চুঁইয়ে সূর্যের আলো নেমে আসছে কোদাই-এ। আলো-ছায়ার সে এক মায়াবী মোহ। নাম না জানা পাখিরা মুখর করে তুলেছে যাত্রাপথ। হয়তো এদিকটায় তেমন কোন বন্যজন্তুর উপদ্রব নেই, তাই বনের ভেতর সরু পথ ধরে একদল মহিলা চলেছে কাঠ সংগ্রহে। অরণ্য কত ভাবে কতশত মানুষের রুজি- রোজগারের উপায় হয়ে যায়। আসলে এদের প্রয়োজনটাই এতো কম তাই প্রকৃতি এদের সয়ে নিতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে এদের একটা নিবিড় ভালোবাসার আশ্রয় নির্মাণ হয়ে যায় অজান্তে। আমাদের মতো ভদ্র সভ্য মানুষেরা কত সহজেই টলিয়ে দেই প্রকৃতির ভারসাম্য। প্রকৃতির মাঝে আনন্দ নিতে এসে অবলীলায় বিরক্ত করে তুলি তাকে। সেই কারণেই চেকপোষ্টের ঘেরাটোপ। আবার চালাকি করে ঘেরাটোপ টোপকে যাওয়ার উল্লাস।
গাড়ি গিয়ে যখন ময়ার পয়েন্টে পৌঁছল তখন সকাল দশটা বাজে। ময়ার পয়েন্টকে টেন মাইলসও বলে। এখান থেকে পুরো কোদাই-এর ভিউটা দেখা যায়। ময়ার পয়েন্ট থেকেই কোদাই বেড়ানো শুরু হয়। সরকারি গাড়িতে পূর্ণবয়স্কদের ভাড়া আড়াই'শ টাকা আর ছোটদের দেড়'শ। নিজেদের গাড়ি নিয়েও চলা যায় সেক্ষেত্রে গাড়ির সিট অনুযায়ী ভাড়া দিতে হয়। আমাদের তিন'শ টাকা ভাড়া দিতে হল। এ পথে অনেকগুলো ভিউ পয়েন্ট আছে। একটা ভিউ পয়েন্ট এ্যাটেন্ড করার পর যদি পরেরটায় না যান তবে সেটা হবে মস্ত ভুল। সমস্ত ভিউ পয়েন্ট থেকে কোদাই দর্শন পাল্টে পাল্টে যায়। ময়ার পয়েন্ট থেকে আমরা চললাম পশ্চিমে, বেরিজাম রোড ধরে বেরিজাম লেকের দিকে। এ পথেই রয়েছে কেদারের দর্শনীয় স্থানগুলো। ময়ার পয়েন্ট থেকে পাঁচ কিমি পথ এগিয়ে পিচ রাস্তার বাঁ'দিকে গাড়িটা পার্ক করাল মূর্ত্তিজী। আমরা নুড়ি-পাথর মেশানো ঢালু পথে পায়ে হেঁটে চললাম 'সাইল্যান্ট ভ্যালি' দেখতে। ঢালু পথ তাই কোনো ধকল ছাড়াই খুব দ্রুত নেমে এলাম আমরা। প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থাকা পাইন, মেহগনি আর ফার্নে বাতাসের দোলায় কট, কট করে শব্দ হচ্ছে। ঝিঁ, ঝিঁ মতো চেনা কোনো একটা ডাক শোনা যাচ্ছে গাছগুলোর ডালে ডালে। পাহাড়টা যেখানে শেষ হয়েছে তার একটু আগে একটা ওয়াচ টাওয়ার। পাহাড়টার শেষ প্রান্ত উঁচু তারের জাল দিয়ে ঘেরা আর তারপর গভীর খাদ। তারের জাল ধরে নিচের দিকে তাকতেই বুকের ভিতর সাহসের ঘাটতি বোধ করলাম। ভয়ে সরিয়ে নিলাম নিজেকে। টাওয়ারের উপর থেকে মেঘের লুকোচুরিতে ভ্যালির যে চোখ জুড়ানো রূপ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
সাইল্যান্ট ভ্যালি থেকে একটু এগিয়ে রাস্তার ডান দিকে বেরিজাম লেক ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে বেরিজাম লেক দেখা যায় পথে পড়ল ক্রপস ফ্লাই ভ্যালি। সবুজ গাছে মোড়া ম্যাথিকেত্তান সোলা। এই ম্যাথিকেত্তানে বন্যজন্তুরা উপত্যকার নিচ থেকে উপর আর উপর থেকে নিচ হয়। ম্যাথিকেত্তান সোলা মুগ্ধ করল আমাদের। ম্যাথিকেত্তান সোলা থেকে নিচের দিকে দু কিমি নেমে বেরিজাম লেক।
লেকের চারপাশে জেগে আছে সবুজ। পাহাড় ভেদ করে সূর্যের আলো পড়েছে লেকের জলে। চিকমিক করছে লেকের জল। তবে উপর থেকেই লেকটাকে আসাধারণ দেখাচ্ছিল। যে পথে গিয়েছিলাম ফিরে এলাম সে পথে। ময়ার পয়েন্ট থেকে আগে গিয়েছিলাম পশ্চিমে এবার চললাম পূর্বে। সামনেই পাইন ফরেস্ট। অবাক করে এ অরণ্য। পাইন ছাড়া আর কোনো গাছ নেই এখানে। পাইন তার ডালপালা ছড়িয়ে সোজা উঠে গেছে আকাশের দিকে। ১৯০৬ সালে এ অরণ্য রোপিত হয় মিস্টার ব্রায়ান্ট-এর উদ্যোগে। এখন এটি দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার অন্যতম শুটিং স্পট। পাইন ফরেস্ট বেশ কিছু খাওয়ার দোকান নজরে এল। খাওয়ারগুলোও বেশ বিচিত্র। পাইন ফরেস্ট দেখে আমরা এলাম গুনা কেভ-এ। গুনা কেভ নাকি শয়তানের রান্নাঘর।
মেঘ জড়িয়ে গেছে গাছে গাছে। গাছের ছড়ানো শিকড়গুলো কেমন যেন ফাঁদের আদল নিয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটা বেশ গা ছমছম করার মতোই। জানলাম এখানেই নাকি কমাল হাসানের বিখ্যাত সিনেমা "গুনা"- এর শুটিং হয়েছিল। পিলার রক কোদাই এর অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু মেঘের কারণে আমরা পিলার রক এর সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত রইলাম। বাঁধানো পথের দু'দিকে সারি সারি দোকান। চকলেট, আইসক্রিম, উপহার সামগ্রী কি নেই এ গলিতে। তবে অদ্ভুত কান্ড এমন একটা গলি পথ শেষ হয়েছে সুইসাইড পয়েন্টে। প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উঁচু এ জায়গাটা লোহার রড দিয়ে ঘেরা। নিচে উপত্যকা যেন স্বর্গের মতো অপরূপ। খুব ইচ্ছে হল আইসক্রিম খাই কিন্তু চারপাশে অসংখ্য বাঁদর। বিষয়টা বুঝিয়ে বলতেই দোকানদার রাজি হল আমাদের গাড়িতেই সে আইসক্রিম পৌঁছে দেবে।
সত্যি পাহাড়ে আইসক্রিম কেমন যেন পাল্টে যায়। কোদাই-এ গল্ফ ক্লাব আছে, ইচ্ছে হলে খেলে নিতে পারেন। হাতের আইসক্রিম হাতেই গলছে। চোখ বিস্ময়ে গোলগোল। গলগল করে নেমে আসছে রুপোর ধারা। সূর্যের আলোতে ঠিকরে পড়ছে তার বিচ্ছুরণ। সশব্দে দু'শ ফুটের বেশি উচ্চতা থেকে নেমে আসছে সিলভার ক্যাসকেড। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম রূপসী সেই জলপ্রপাতের দিকে। রবিঠাকুর বলেছিলেন-
"যদি ভারতকে জানতে চাও, তবে বিবেকানন্দের রচনাবলী পড়ো। তাঁর মধ্যে যা কিছু আছে সবই ইতিবাচক; নেতিবাচক কিছুই নেই।"
দেশ গড়ার জন্য বিবেকানন্দ মানুষের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর গুরুবাক্যই তো ছিল-“যত্র জীব তত্র শিব”। বিবেকানন্দের এই ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছিল সারা ভারতবর্ষকে খুব নিবিড় ভাবে দর্শনের মধ্যে দিয়ে। তিনি ভারতের গ্রাম,শহর, ধর্মস্থান, পাহাড়,পর্বত,নদী- আসমুদ্রহিমাচল পায়ে হেঁটে জেনেছেন। সে ছিল তার পরিব্রাজন। হিমালয়ে তিনি যেমন বারবার ছুটে গিয়েছেন তেমনি ভারতের দক্ষিণতম শেষ স্থানটিতে ধ্যানস্থ থেকেছেন টানা তিন দিন। কোদাইকানাল থেকে আমরা চললাম আপামর ভারতবাসী তথা বাঙালীর আবেগের দর্শন 'কন্যাকুমারীর' অভিমুখে। বিবেকানন্দ রক, কন্যাকুমারী এই শব্দ দুটি প্রতিটি বাঙালী-ভ্রমণকারীর হৃদয়ে নিহিত থাকে ধ্যানমগ্ন হয়ে। তাই সময় সুযোগ পেলেই তার পথ ছুটে চলে দক্ষিণতম শেষ বিন্দুটিতে। আর এ পথে পা বাড়ালেই সে আপনা হতেই ভ্রমণকারী থেকে হয়ে ওঠে পরিব্রাজক। কোদাই থেকে আমরা বের হলাম দুপুর দুটো নাগাদ। পথে একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়ার খেলাম। গাড়ি ছুটল তিন'শ কিমি দূরের কন্যাকুমারীর উদ্দেশ্যে। পথে বেশ ভারি বৃষ্টি নামল। মাদুরাই শহরকে পাশে রেখে গাড়ি চলল তিরুনেলভেল্লি হয়ে কন্যাকুমারী। আগে থেকেই স্থির ছিল কন্যাকুমারীতে আমরা কোনো হোটেলে উঠব না। আমরা রাত্রিবাস করব ভারতসেবাশ্রমে। বৃষ্টির জন্য আমরা নিদিষ্ট সময়ে আশ্রমে পৌঁছতে পারলাম না। তার উপর মূর্ত্তিজী ভারতসেবাশ্রমের লোকেশন জানত না।
জি. পি.এস-এ মুশকিল আসান হল। যখন আশ্রমে পৌঁছলাম তখন রাত্রি আটটা বেজে গেছে। আশ্রমে সন্ধ্যাকালীন পুজো চলছে। আমরা গিয়ে পুজোস্থলে বসলাম। পুজো শেষে আমাদের থাকার জায়গা দেওয়া হল। কিন্তু রাত্রির খাওয়ার পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল না। আশ্রম থেকে জানানো হল রাতের রান্নার প্রস্তুতি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না। রাত্রি দশটা নাগাদ একটি ছেলে এসে কড়া নাড়ল দরজায়।
হলদেটে দাঁত বের করে বলল- " আসুন, খাবেন আসুন।"
কথায় কথায় জানলাম ছেলেটির বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরে। ও ছাড়াও অনেকেই এসেছে গোপীবল্লভপুর থেকে। আশ্রমে রান্নাবান্না সহ অন্যান্য কাজ করে ওরা।টানা জার্নি। শরীরের উপর বেশ ধকল যাচ্ছে। তাই ভোরে উঠতে হবে বলে মোবাইলে এলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম। মনটা বড় অস্থির ছিল। মোবাইল জাগানোর আগেই ভেঙে গেল ঘুম। শীত শীত করছে। শীতের পোশাক চাপিয়ে চললাম সমুদ্রতীরে। পথ অচেনা, জি. পি.এস. পথ দেখাল। সমুদ্রের তীরে গিয়ে দেখি গুটিকতক লোক সমুদ্র লাগোয়া কংক্রিটের উঁচু পাড়ে বসে আছে। কেউ বা ধূমায়িত চায়ের কাপে ঠোঁট রেখেছে।
সামনে দিগন্ত প্রসারিত কালো জলরাশি। ঢেউ এর ফণা সাদা বুদবুদ হয়ে ভেঙে পড়ছে সমুদ্র তটে। অনতিদূরে আদিগন্ত নিকষ কালোয় জেগে আছে আলোর স্মারক। ভারতবাসীর পথ চলার আলোক বর্তিকা। ঐ আলোতেই আলোকিত হয়েছে ভারত। ঐ আলোতেই ধরা পড়েছে ভারতের সকল অন্ধকার। দেখতে দেখতে ভীড়টা ঘন হয়ে গেল। সূর্যোদয়ের সময় এরা আগে থেকে জানত বোধ হয় তাই পুবের আকাশে লালের আভা ফুটে ওঠার আগেই উপস্থিত হল দলে দলে। সূর্যোদয় দেখে দ্রুত পায়ে ফিরে এলাম আশ্রমে। কন্যাকুমারীর জন্য প্রথম স্টিমার ছাড়ে সাড়ে আটটায়। আমাদের ঐ স্টিমারেই চড়তে হবে। কন্যাকুমারী সেরে আজই আমরা চলে যাব রামেশ্বরম। সন্ধ্যের আগে রামেশ্বরম পৌঁছতে না পারলে পবনন সেতুর মজাটাই নেওয়া যাবে না।
প্রথম স্টিমার পেলাম না আমরা, চললাম পরেরটায়। লাইফ জ্যাকেটে যাত্রীদের বেশ অন্য রকম লাগছিল। সমুদ্র, ঢেউ, স্টিমারে চড়ার রোমাঞ্চ এসব কিছু উপেক্ষা করে মনযোগ বারবার ছুটে যাচ্ছিল দূরে জেগে থাকা পস্তর খন্ডে। স্টিমার স্মারক স্থলে ভিড়তে লাইফ জ্যাকেট ফেলে এগিয়ে গেলাম বিবেকানন্দ মন্দিরে। চারপাশ থেকে নীল জলরাশি আছড়ে পড়ছে শিলাখন্ডে। আজ থেকে প্রায় একশ পঁচিশ বছর আগে এক সন্ন্যাসী সমুদ্র সাঁতরে তিন দিন তিন রাত ধ্যান করেছিলেন এখানেই! ভাবতেই শিউরে উঠলাম। মৃত্যু ভয় ছিল! ছিল সমুদ্রজন্তুর বিপদ! থেকে থেকে আছড়ে পড়া ঢেউ-এর হুংকার! মনে পড়ল ঋষি-মুনির ধ্যান ভঙ্গ করতে বারে বারে মোহজাল বিছিয়েছে উর্বশীরা। সেদিন উত্তাল সমুদ্রের বিধ্বংসী তরঙ্গ বিচলিত করতে পারে নি সন্ন্যাসীকে। বিবেকানন্দ বারে বারে গিয়েছেন হিমালয়ে। পরিশেষে তিনি ভাবলেন- হিমালয় আর নয় " নির্জনতার আনন্দলোক " আর নয়। তাঁর পরিব্রাজন তো ঈশ্বরের সন্ধানে নয়। সে তো মানুষের জন্য। হিন্দুধর্মের ইতিহাসে সেই প্রথম কোনো সন্ন্যাসী ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে মানুষের সন্ধানে পরিক্রমা শুরু করলেন।
সেই পরিক্রমা শুরু হল দিল্লী থেকে আর সেই পরিক্রমার আপাত সমাপ্তি ঘটল কন্যাকুমারীতে।বলা বাহুল্য চূড়ান্ত সমাপ্তি শিকাগোতে। দেবী কুমারীর স্বপ্নে তিনি সাগর সাঁতরে উঠে এলেন "শ্রীপদ পারাই" শিলায়। কথিত আছে ঐ শিলায় দেবী কুমারী তপস্যা করেছিলেন। ঐ শিলার উপর বিবেকানন্দ ১৮৯২ এর ২৪, ২৫ ও ২৬শে ডিসেম্বর গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। ১৯৭০ এ সেই ঘটনার স্মারক হিসাবে নির্মাণ হল বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। যেখানে শুধু আমি নয় আমার মতো আরো শত শত বাঙালী দাঁড়িয়ে নস্টালজিক হয়ে ওঠে। গর্বে ফুলে উঠে বুক।
সত্যি সত্যি জামায় টান অনুভব করলাম। পায়ে পায়ে ঘুরে নিলাম দেবী কুমারীর মন্দির। যে মন্দিরে ধরা পড়েছে দেবীর পদচিহ্ন। মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেল অনুপম স্থাপত্যে নির্মিত বিবেকানন্দ মন্দিরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে। মন্দিরে বিবেকানন্দের দন্ডায়মান মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অন্তর হয়ে উঠল অঞ্জলিবদ্ধ করপুট। যে পাথরটিতে ধ্যান করেছিলেন বিবেকানন্দ সেই পাথরটির উপর বর্তমানে গড়ে উঠেছে ধ্যানমন্ডপ। সেখানে দর্শনার্থীরা ধ্যান করেন। সেখানে শিশুদের প্রবেশ মানা। চোখ বন্ধ করে বসে গেলাম ধ্যানে। সে এক অন্য জগৎ।
আমি যে বেড়াতে বেরিয়েছি সে যেন মিথ্যে। আমি যেন এক অন্য আমি। মুদিত নয়নে বসে আছি আর... দিগ্বিদিকে মন্দ্রিত হচ্ছে আদি ধ্বনি ওঁ.... ভেতরে বসে বারবার মনে হচ্ছিল বাইরের সমুদ্রের আস্ফালন তার আছড়ে পড়ার হুংকার ভেতরে এসে কোথায় যেন পাল্টে যাচ্ছে ওঁ - এ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়তে থাকল। ফুরিয়ে এল আমাদের সময়। ফেরার স্টিমারে চড়ে বসলাম। কিন্তু দু'চোখে তখনও ধরা পড়তে চাইছে ফেলা আসা 'আলোর স্মারক'। যতক্ষণ না তা আকারে ছোট হতে হতে বিন্দুতে পরিণত না হয় ততক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের দিকে। মূল ভূখণ্ডে ফিরে আমরা চললাম কন্যাকুমারীর মন্দিরে। এ মন্দিরের পিছনেই মিলিত হয়েছে তিন সমুদ্র। কিংবদন্তির শেষ নেই এ মন্দির ঘিরে। কথিত আছে বহ্মার বরে সর্বশক্তিমান বাণাসুর আক্রমণ করে স্বর্গ। এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বিষ্ণুর নির্দেশে যজ্ঞে বসেন দেবরাজ ইন্দ্র। যজ্ঞের হোমানল থেকে জন্ম হয় এক কন্যার। আসলে সে কন্যা ছিল পার্বতী। শুচীন্দ্রম থেকে শিব চললেন কন্যাকে বিয়ে করতে। কিন্তু কন্যার বিয়ে হয়ে গেলে বাণাসুর বধ সম্ভব হবে না। তাই দেবতাদের অনুরোধে নারদ পথ মধ্যে মোরগ ডাক ডাকেন। এই ডাক শুনে শিব পুনরায় ফিরে এলেন শুচীন্দমে। বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে গেলে কন্যা রইল কুমারী। দেবী কুমারীর মন্দিরে পুরুষদের প্রবেশ করতে হয় ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত হয়ে। প্রথা মতো জামা, গেঞ্জি খুলে দেবী দর্শন করলাম।
দুপুরের খাওয়া হল কন্যাকুমারীতে। এখানে বেশ কিছু বাঙালী হোটেল আছে। মিছরি দানা আর মৌরির মুখশুদ্ধি চিবাতে চিবাতে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছুটল রামেশ্বরমের দিকে।
ততক্ষণে বাবদা আমার কোলে এসে বসেছে। বিবেকানন্দ সম্পর্কে তার নানা প্রশ্ন। আমিই বা কতটুকু জানি। বিবেকানন্দের ছেলেবেলার কিছু ঘটনা বলতে থাকলাম মজা করে। গল্প শুনতে শুনতে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল বাবদা। ছোট্ট নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম - "আমার সন্তান যেন সত্যিকারের ভালো মানুষ হয়।"
কে বড় কে ছোট এ দ্বন্দ্ব কেবল মানুষে মানুষে নয়, এ দ্বন্দ্ব অনেক বেশিকরে ছিল দেবতাদের মধ্যে। একবার বহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে তুমুল বিবাদ-কে বড় কে ছোট। বিবাদ বাড়তে থাকে তবুও এ তর্কের সমাধান হয় না। তখন দু'জনেই মহাদেবের শরণাপন্ন হন। মহাদেবের কাছে দু'জনেই দাবী করেন শ্রেষ্ঠত্বের। অবস্থা বুঝে মহাদেব একটি জ্যোতি বা আলোর স্তম্ভ দিয়ে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল বিদীর্ণ করে দেন। এবং বিবাদমান দু-পক্ষকে ঐ স্তম্ভের শেষ সন্ধান করতে বলেন। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু ঐ আলোক স্তম্ভের শেষ সন্ধান করতে পারলেন না। হতোদ্যম হয়ে ফিরে এলেন দু'জন। ব্রহ্মা মিথ্যে করে বললেন তিনি সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু বিষ্ণু পরাজয় স্বীকার করে নিলেন। মহাদেব জানতেন দু'জনের কেউই জ্যোতিস্তম্ভের শেষ খু্ঁজে পাবেন না। মিথ্যাচারিতার জন্য মহাদেব ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন, কেউ তার পুজো করবে না। ঐ আলোর স্তম্ভই হল জ্যোতির্লিঙ্গ। এবং এই জ্যোতির্লিঙ্গই হল আলো ও সৃষ্টির মূল।
উপমহাদেশে বারোটি শৈব তীর্থকে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়। আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে সাতটি তীর্থ ৭৯ ডিগ্রী দ্রাঘিমায় অবস্থিত। অর্থাৎ ঐ জ্যোতির্লিঙ্গকে যোগ করলে তীর্থগুলি একটি সরলরেখায় অবস্থান করে। যে সরলরেখার শুরু হয়েছে উত্তরে কেদারনাথ থেকে আর শেষ হয়েছে দক্ষিণে রামেশ্বরমে। কন্যাকুমারিকা থেকে আমরা চলেছি রামেশ্বরমের উদ্দেশ্যে। এই প্রথম আমাদের যাত্রাপথ পুরোটাই সমতলে। কোনো পাহাড়ি পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে না।
কন্যাকুমারী থেকে তেন্নারভেল্লী বা তিরুনেলভেল্লী হয়ে তুতিকোদী পর্যন্ত সমতল পথে তাল, খেজুর, কলা গাছের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। চারপাশের গাছ-গাছালি দেখে মনে হয় আমরা মেদিনীপুরেই আছি। তুতিকোদী থেকে যতই রামনাথপুরম বা রামনাড়ের দিকে গাড়ি এগিয়েছে ততই পরিবেশ হয়েছে রুক্ষ। গাছপালা বলতে কিছু কাঁটা জাতীয় গাছ। চোখে পড়ার মতো জলাভাব। প্রকট হয়েছে পানীয় জলের জন্য সাধারণ মানুষের সংগ্রাম। মূর্ত্তিজীর থেকে জানলাম তামিলনাড়ুর দক্ষিণ-পূর্বে মানুষের প্রধান সমস্যা হল জল। উলিপুচিতেই শেষ নদী-ভাইগাই।তারপর যতই দক্ষিণে এগানো যাবে পরিবেশ হয়ে উঠবে ততই রুক্ষ আর শুষ্ক।
তবে ঐ শুকনো পরিবেশে ময়ূর দেখলাম। ওরা দলে দলে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাপ আর পোকা-মাকড়ের সন্ধানে। তুতিকোদি( তুতিকোরিন) থেকে রমনার প্রায় একশ চল্লিশ কিমি পথ গাড়ি ছুটল বায়ু বেগে। টানা কয়েক ঘন্টা গাড়িতে বসে থেকে পা ধরে আসছিল। রমনারে চা ও জলখাওয়ার খেয়ে একটু এলোমেলো ঘুরে নিলাম। রমনার থেকে মন্ডপম পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ কিমি পথ। পথের দুপাশে নুন তৈরীর কারখানা ছাড়া তেমন কোনো ঘন বসতি চোখে পড়ল না। আমরা যখন মন্ডপমে পৌঁছলাম তখন বিকেল। দিনের আলো মরে এসেছে। বাতাসে শীতলতার ছোঁয়া। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা ঢুকে পড়লাম পবনন ব্রীজে। আর মুহূর্তে সমস্ত পথশ্রম উধাও। মনের ভিতর তখন জলতরঙ্গের উচ্ছ্বাস। পমবনের কথা শুনেছিলাম। এখন তাকে প্রত্যক্ষ দেখে মনে হচ্ছে যা শুনেছি তাতো কিছুই নয়। একটা সেতু এতো অপরূপ হতে পারে তা না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। মন্ডপম আর পমবন এই দুটো দ্বীপের মাঝে উত্তাল বঙ্গোপসাগর। আর সেই নীল তরঙ্গে সুতোর মতো দুটি সেতু। একটি রেল পথ- যা নির্মাণ করেছিল ব্রিটিশরা ১৯১৪ সালে আর অন্যটি বাস পথ। বাস পথ জলতল থেকে বেশ উঁচুতে হলেও রেল পথ সমুদ্রের সঙ্গে যেন মিশে গেছে। সমুদ্রের ঢেউ থেকে থেকে ফণা তুলে দংশন করতে চাইছে লৌহ-পথকে। এই পমবন সেতু পৃথিবীর দ্বিতীয় বিপদজনক রেলযাত্রা। সেতুর দু'দিকে কোনো প্রাচীর নেই। দুলতে দুলতে চলেছে ট্রেন। তার উপর এ অঞ্চল নাকি সাইক্লোন প্রবন।রেল-পথের আর একটি বিশেষত্ব -এটি ফোল্ডিং অর্থাৎ জাহাজ বা জলযান যাতায়াতের জন্য মাঝের একটি অংশ প্রয়োজনে উন্মুক্ত করা যায়। ব্রিজের উপর সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভ্রমণকারীরা ব্রিজের উপর থেকে ছবি তুলছে। দেখছে এক অনন্য নির্মাণ।
আমরাও নেমে এলাম গাড়ি থেকে। দূরে পমবন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দিল। সমুদ্রের নীল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই শুরু হয়েছে সবুজের শ্যামলীমা। তীরে দাঁড়ানো তরীগুলো আরো অপরূপ করেছে পমবনকে। নীল সমুদ্রের দোলায় থেকে থেকে আদর নিচ্ছে কিছু স্টিমার। আর উপরের নীল মহাশূন্যে বিন্দু বিন্দু বিহঙ্গের দল। এমন একটা রেলযাত্রার রোমাঞ্চ নিতে বড় সাধ হল। মনে মনে ভাবলাম ফেরার সময় রামেশ্বরম থেকে ট্রেনে চেপে মন্ডপম আসব। দিনের আলো এখন বেশ নরম। সে আলো তলানিতে পৌঁছানোর আগেই রামেশ্বরম পৌঁছানোটাই উচিত হবে। পমবন দ্বীপের দক্ষিণ দিকটা লেগে রয়েছে রামেশ্বরম দ্বীপের সঙ্গে। পমবন থেকে আমরা পৌঁছলাম রামেশ্বরমের শ্রীরাম পাদম মন্দিরে। এ মন্দিরে রামের পায়ের চিহ্ন রয়েছে। ওখান থেকে চার কিমি দূরে লক্ষণ তীর্থম।লক্ষণ তীর্থম সারতেই সন্ধ্যা হয়ে এল। রামেশ্বরম ভারতসেবাশ্রমে গিয়ে কোনো রুম পেলাম না। মহারাজ(সাধু) বললেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রুম মিলবে। কারণ অনেকেই রাতের ট্রেনে করে ফিরে যাবেন। সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। ঘর মিলল তিনটি। সারা আশ্রম ফাঁকা। সবাই চলে গেল। আমাদের পর আরো দু'দল এলো। লোকজন কম তাই রাত্রে রান্না হল না। আমরা হোটেল থেকে খাওয়ার নিয়ে এলাম।
আর একটু হলেই ট্রেনটা মিশ হতো। সুবিধা এই যে সঙ্গে কোনো ব্যাগ পত্তর নেই। সেগুলো সব মূর্ত্তিজীর গাড়িতে। তাই ট্রেন ছাড়ার সামান্য আগে তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠতে পারলাম।মূর্ত্তিজী আমাদের জন্য মন্ডপমে অপেক্ষা করবে। কারণ পমবন ব্রীজে ট্রেনের গতি খুবই কম থাকে। ট্রেনটা চলছিল বেশ, ভয় যে একদম হয় নি তা নয় কিন্তু তাকে লুকানো ছাড়া তো আর কোনো উপায় ছিল না। হঠাৎ ট্রেনের কালো ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। সে অন্ধকার এতো ঘন যে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। থেকে থেকে সমুদ্র গর্জন ঘিরে ধরছিল আমাদের। তখন ট্রেনের কূপজুড়ে এক অসহায় আর্তনাদ। বাবদা কাঁদছে তার মাকে জড়িয়ে। চরম এক অনিশ্চয়তায় দুলছি আমরা। আর থেকে থেকে ডাকছি ঈশ্বরকে। ট্রেনের পাটাতনে আছড়ে পড়ছে ঢেউ, পায়ে জল লাগা মাত্র পা'টা ঠান্ডা হয়ে গেল।
ভোরের আলো জানালা ভেঙে ঢুকে পড়েছে আশ্রমের ঘরে। ঘুমের মধ্যে কখন পায়ের নিচের দিক থেকে সরে গেছে বেডশিট। ভোরের ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে খোলা পায়ে। বিশ্রী একটা স্বপ্নে মনটা তেতো হয়ে গেল। বিছানার উপর চুপটি করে বসলাম। পাশে বাবদা তার মাকে জড়িয়ে শুয়ে। মনে মনে রাম রাম বললাম... স্থির করলাম -মূর্ত্তির গাড়িই ভাল।
রোমাঞ্চ! সে গৃহীদের জন্য নয়।
ভোরবেলায় রামেশ্বরমে বঙ্গোপসাগরে সূর্যোদয় এক অনন্য রূপ নেয়। সূর্যোদয় দেখে মন্দির দর্শন। রামেশ্বরমকে দক্ষিণের কাশী বলা হয়। কাশীর বিশ্বনাথ দর্শনে যে পুণ্য রামেশ্বরমের রামনাথ দর্শনে সেই পুণ্য। বঙ্গোপসাগরে স্নান সেরে মন্দিরে প্রবেশ। মন্দিরের মধ্যে বাইশটি কুয়ার জলে স্নান তারপর পুজো নিবেদনের বিধান। তবেই পূর্ণাঙ্গ পুজো। তবেই অখন্ড পুণ্য।
এটাই ছিল রামেশ্বরম ভ্রমণের প্রথম পর্ব। পুজো নিবেদনের পর সিক্ত শরীরে থরথর কাঁপতে কাঁপতে আশ্রমে ফেরা। আশ্রম থেকে ব্যাগ পত্তর নিয়ে দ্বিতীয় তথা শেষ পর্বের যাত্রা। পরিকল্পনাতো আর শেষ কথা নয়। পরিস্থিতি যে প্রতিনিয়ত পরিকল্পনায় লাগাম লাগায়। দীর্ঘ পথশ্রম আর ভোরের অত্যল্প শীতে ব্যাঙ্কেটের ওম বারোটা বাজালো। বাবদার বাথরুম তাড়নায় ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাত। সূর্যদেব দিগন্তরেখার অনেক উপরে। বিলম্বিত বিছানা বিয়োগে বিঘ্নিত হল বর্গ(পর্ব) বিভাজন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হল বাঁধা-ছাঁদা। লঙ্কা যুদ্ধে রাম রাবণকে হত্যা করে সীতাকে নিয়ে রামেশ্বরমে পৌঁছলে ঋষি পুলস্ত রামকে বিধান দেন শিব পুজো করার। রাবণ যেহেতু ঋষি পুলস্তের বংশধর তাই তাকে হত্যায় রামচন্দ্রের ব্রহ্ম হত্যার পাপ হয়েছে। এ অবস্থায় একমাত্র প্রতিকার শিবের আরাধনা। পুলস্তের বিধান মতো রামচন্দ্র হনুমানকে নির্দেশ দেন কৈলাশ থেকে শিবলিঙ্গ আনতে।হনুমানের বিলম্বে সীতা নিজেই বালি দিয়ে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করেন। পুজো হয় শিবের। কিন্তু পুজো শেষের অব্যবহিত পরেই হনুমান হাজির শিবলিঙ্গ নিয়ে। রামচন্দ্র বুঝতে পারলেন পুজো হয়ে যাওয়ায় হনুমানের অভিমান হয়েছে। তাই তিনি হনুমানকে সীতার তৈরী শিবলিঙ্গ সরিয়ে সেই স্থলে কৈলাশ থেকে আনীত শিবলিঙ্গ স্থাপন করতে বলেন। হনুমান তার সর্বশক্তি দিয়েও সরাতে পারলেন না বালির তৈরী শিব। সেই থেকে রামেশ্বরমে দুই শিবই পূজিত হয়ে আসছে। কৈলাশ থেকে আনীত শিবের নাম বিশ্বলিঙ্গ বা বিশ্বনাথ আর সীতাদেবীর বালি নির্মিত শিব রামলিঙ্গ বা রামনাথ। তবে রামচন্দ্র হনুমানকে সন্তুষ্ট করতে বিধান দেন রামলিঙ্গের আগে বিশ্বলিঙ্গের পুজো হবে। আজও তার অন্যথা হয় না। রামেশ্বরমে আমার বাড়তি খুশির অন্য একটা কারণ আছে। আমার রামেশ্বরম দর্শন হলে ভারতের চারধামের আর একটি মাত্র ধাম দর্শন আমার অবশিষ্ট রইবে।
ভারতের চারধাম - উত্তরে বদ্রীনারায়ন( ২০১৫ তে গিয়েছিলাম), পূর্বে শ্রীধাম( দু'বার গিয়েছি), দক্ষিণে রামেশ্বরম দর্শন হলে বাকি থাকছে পশ্চিমে দ্বারকা। রামেশ্বরম মন্দিরের চারদিকে রয়েছে চারটি গোপুরম( বিচিত্রিত প্রবেশদ্বার)। পূর্বের গোপুরমটি সবচেয়ে উঁচু,১২৬ ফুট। রামেশ্বরম মন্দিরের বারান্দা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ বারান্দা। মন্দিরে মোবাইল, ক্যামেরা নিষিদ্ধ তাই সে সব বাইরে রেখে পূর্ব গোপুরম দিয়ে প্রবেশ করলাম মন্দিরে। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দিরের স্থাপত্য আজও বিস্ময়াবহ। পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে কি অদ্ভুত নৈপুণ্যে রচিত হয়েছে ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম উপাসনালয়। ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামিতে আশ্চর্যজনক ভাবে অক্ষত থেকে যায় মন্দির। মন্দিরের মধ্যে অগণিত ভক্তদল ভেজা কাপড়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে তাদের নিবেদন নিয়ে। এতো বড় মন্দির কে যে কোন পথে আসছে আর কোন পথে বেরিয়ে যাচ্ছে তা ঠাহর করা মুশকিল। মন্দিরে যে বাইশটি কুয়ো আছে তার প্রত্যেকটির জলের স্বাদ ভিন্ন। কিন্তু আমাদের পরখ করার সুযোগ নেই। রামনাথ মন্দির, বিশ্বনাথ মন্দির,বরধিনী মন্দির, নন্দীদেবর মন্ডপ দর্শন শেষ করে আমরা চললাম ধনুষকোডির পথে। রামেশ্বরমের অন্যতম আকর্ষণ হল ধনুষকোডি। মূল দ্বীপ থেকে প্রায় তিরিশ কিমি পথ চলে গেছে দু'দিকে সমুদ্র রেখে। আগে বড় গাড়ি যেত পঁচিশ কিমি পথ এখন পুরোটাই চলা যায় বড় গাড়িতে। ধনুষকোডিপয়েন্ট হল দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের শেষ স্থলভাগ।
রোমাঞ্চিত হলাম যখন দু'পাশে সুদূর নীল জলরাশি নিয়ে এগিয়ে চলল কালো পিচ রাস্তা। দু'দিকে উত্তাল সমুদ্র আর তার বুক চিরে এগিয়ে চলেছি তিরিশ কিমি। যতই সমুদ্রের শরীরে প্রবেশ করছি ততই সশব্দে ভেঙে পড়ছে সমুদ্র। শেষ পর্যন্ত আমরা ধনুষকোডিপয়েন্টে পৌঁছলাম। অশোক স্তম্ভের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে মস্তবড় পর্যটক মনে হল। মূর্ত্তিজির থেকে জানা গেল এখান থেকে রাতে শ্রীলঙ্কার আলো দেখা যায়। গাড়ি থেকে নেমে বালি মাড়িয়ে চললাম সমুদ্রের কাছে। এখানকার বিচ অপ্রসস্থ। স্নান নিষেধ। সমুদ্র ছোঁয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে। হাওয়ায় ঢেউ এর বুঁদবুঁদ উড়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে মুখে-মাথায়, শরীরে। সমুদ্রের ঢেউ এসে ধুঁয়ে দিচ্ছে পা। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে বালি। সত্যিই এই বিচ বেশ বিপদজনক। ফেরার পথে দেখে নিলাম কোথান্ডা রাম মন্দির এটাকে বিভীষণ মন্দিরও বলে। যুদ্ধ যাওয়ার আগে এখানেই প্রথম বিভীষণের অভিষেক হয়। যুদ্ধে জয়ের পর লঙ্কায় পুনরায় বিভীষণের রাজ্যাভিষেক হয়। মন্দিরের পুরোহিত আমাদের খুব যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন সে ইতিহাস। ঐ মন্দিরের পাশ থেকেই তৈরি হয়েছিল লঙ্কা যাওয়ার সেতু। সেই সেতুর অস্তিত্ব নাকি নাসার গবেষণায় ধরা পড়েছে। সেতু ধরে একদল স্থানীয় লোককে এগিয়ে যেতে দেখলাম। একটা শিলা এখনও রাখা আছে ওখানে। জানা গেল ওটা নাকি রামশিলা। জলে ভাসে। পরখ করার জন্য প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লাম জলে। সত্যিই পাথরটা ভাসছে জলে। হাতে নিলাম পাথরটাকে, বেশ ভারি। তবে ভাসছে কি ভাবে! পাথরের শরীরে অসংখ্য ছিদ্র। ঐ ছিদ্রগুলোতে লুকিয়ে আছে ভাসমান পাথরের রহস্য।
Top
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.