top of page

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

সূচীপত্র
Durga1.jpg
পুজো বার্ষিকী
১৪৩১
maaforall.jpg
maa durga.jpg

প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

উপন্যাস

Sudip Ghosal.jpg

পরিযায়ী জীবনের

নক্সিকাঁথা

সুদীপ ঘোষাল

পূর্ব বর্ধ্মান, পঃ বঙ্গ

bihu.jpg
পরিযায়ী জীবনের নক্সিকাঁথা

এক

স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পড়েছিলেন, কবিতা। মনে পড়তো ফুলশয্যা, আদর। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এ বাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু, ঘুঘুর ঘু। কবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুঁড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে কবিতাকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বলে, বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। কবিতার বয়স হল আটত্রিশ। বিধবা হলে কবিতার উপর নজর পড়লো তাদের গুরুদেবের। গুরুদেব বললেন, যা হবার হয়েছে বুঝলে কবিতা। আমি তো আছি। স্বামীর অভাব বুঝতে দেব না। প্রথমে গুরুদেবের আসা যাওয়া ভালো না লাগলেও একদিন তা অভ্যাসে পরিণত হল। 
কবিতার একমাত্র ছেলে রাজু  বামুন পাড়ার ছেলে। পৈতে হয়েছে বৈশাখ মাসে। উপনয়নের পর উপবীত ধারণ করতে হয়। এই উপবীতের চলতি নাম পৈতে। পৈতে কথাটি সমাজে বহুপ্রচলিত।বাহুতে গুরুদেব বেঁধে দিয়েছেন কবচ। রাজুদের বংশের গুরুদেব বলেছেন, সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এই কবচ আর পৈতে। সব কাজে সফল হবে নিশ্চিতভাবে আর সারাজীবন রক্ষাকবচের মত আগলে রাখবে জীবন।   
রাজু গরীব বামুনের ছেলে। দুবিঘে জমি, দুটো গরু আর গোটা দশেক ছাগল তাদের সম্পত্তি। রাজুর পৈতেটা একটু দেরী করেই হয়েছে। তার ফলে গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে তার ফর্দ মত। তার ফলে খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে। 
এখন তার বয়স উনিশ। বাবা মরে গেছেন অনেক আগেই। তার মা ঐ গুরুদেবের কথামত সংসার চালান। পুজো, উপবাসে মেতে থাকেন মা। আর গুরুদেবের ফলাহার রাজু তাকিয়ে দেখে। মা গুরুদেবের খাওয়ার শেষে তার উচ্ছিষ্ট খান। এটাই মায়ের গুরুর প্রসাদ। গুরুদেব মাঝে মাঝে রাতে রাজুদের বাড়িতে থাকেন। রাজু বোঝে সবকিছু কিন্তু চুপ করে থাকে। গুরুদেব মাকে বলেন, আমার কথামত চললে তোমাদের ভাল হবে। এই ভাল হওয়ার লোভে রাজুর মা গুরুদেবের সব কথা মেনে নেন। রাজুর মায়ের মিথ্যে রক্ষাকবচ হলেন গুরুদেব। এক অদৃশ্য দেওয়া নেওয়ার খেলা তিনি খেলেন নিষ্ঠুর হৃদয়ে।   
রাজু সকালবেলা মাঠে যায়। সে বামুন হলেও লাঙল ধ'রে চাষ করে। ছোট থেকেই করে আসছে। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা তার। সকলে বেশ সমীহ করে চলে তাকে। পড়াশুনা বেশিদূর গড়ায় নি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে কোনরকমে। বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে সংসারের দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত। 
সকালে গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। হাতে পাঁচন গলায় গামছা। লুঙ্গি পরে আলের উপর বসে থাকে। গরু ছাগল পালিয়ে গেলে ডাকিয়ে নিয়ে আসে ঘাসের বনে। পরের ফসল খেলে লোকে ছাড়বে না। এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে রাজুর সঙ্গে জমির মালিকদের। একদিন রমেন মোড়ল লাঠি নিয়ে এসে বলল, তোর ছাগলে আমার জমির ফসল খেয়েছে। খবরদার বলছি আমি কিন্তু ছাড়ব না। এই লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব। রাজু বললো, বেশ কাকা আর হবে না এই ভুল। আমি নজর রাখব। সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল নরম সুরে বলল, তোমরা হলে গিয়ে বামুনের ছেলে। বলতে খারাপ লাগে। বুঝলে তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। রাজু বলল, মায়ের কাছে শুনেছি সব। তবে আপনার ফসলের ক্ষতি হলে তো রাগ হবেই। আমি এবার ভাল করে লক্ষ্য রাখব। মোড়ল বললেন, বেশ বাবা বেশ। বেঁচে থাক। রাজু ভাবে ফসলের মাঠে গরু, ছাগল চড়ানো খুব কঠিন। কখন যে কার মাঠে নেমে যায় বোঝা মুস্কিল। সে ভাবল, কাল থেকে অই পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে বারান্দা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে যাবে গরু চড়াতে। ওখানে ফসলের জমি নাই। নিশ্চিন্তে বসতে পারবে। মাকে বলে, জলখাবার সঙ্গে নিয়ে যাবে। 
পরের দিন রাজুর মা সকাল থেকে আলু ভেজে দিল আখের গুড় দিল আর এক জামবাটি ভরতি করে মুড়ি দিল। রাজু গামছায় বেঁধে গরু, ছাগলের দড়ি খুলে পাঁচন হাতে চলে গেল জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখল ঘাস আছে পাতা আছে। আর ভিড় কম। পাশে ক্যানেলের পরিষ্কার জল। সেখানে মাছ ধরছে হাজরাদের একটা মেয়ে। রাজু ভাবল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। উবু হয়ে মাছ ধরছে। মেয়েটা রাজুকে দেখতে পায় নি। একটু পরে রাজু ডাকল, ও মেয়ে, তোর নাম শ্যামলী নয়? শ্যামলী বলল - হুঁ। 
- তুই রোজ এখানে আসিস মাছ ধরতে? 
- হুঁ 
- আমাকে চিনিস? 
- হুঁ 
- আয় এখানে আয়। দুজনে মুড়ি খাই। তোর মাছ নেব না। আয়। 
শ্যামলী হাত, পা ভাল করে ধুয়ে চলে এল রাজুর কাছে। রাজু গামছায় মুড়ি ঢেলে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে খেল। তারপর দুপুর হলে দুজনে চলে এল নিজের বাড়ি। 
রাজু গোয়ালে গরু বেঁধে, হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে নিল। তারপর দরজার কাছে এসে দেখল দরজা বন্ধ। দরজায় একটা ফুটো আছে। চোখ লাগিয়ে দেখল, গুরুদেব মা কে নিজের উলঙ্গ দেহ দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মাকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি মাকে বশ করেছে কবচ পরিয়ে? আমাকেও দিয়েছে কবচ। রাজুর রাগ হল। কিন্তু কোন আওয়াজ না করে চলে গেল গোয়ালে। 
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে রাজুর মা রাজুকে দেখতে গোয়ালে এল। রাজুর মা বলল -  আমি তোকে না দেখে একটু শুয়েছিলাম। আজকে তোর দেরী হল কেন? রাজু বলল, মা আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। আমি এখানে বসে খাব। তারপর বর্ষা এল। নদী, পুকুর, খাল, বিল সব কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। শুধু পূর্ণ হল না রাজুর মন। গুরুদেবের প্রতি ঘৃণায় তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখনও সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজু জানে, মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা মনের কোণে থেকে যায়। তার প্রতিকার হয় না কোনোদিন। রাজু এবার চাষ করেছিল সময়ে। কিন্তু বন্যায় ধানের চারা ডুবে থাকল দশদিন। সব পচে গেল। পচে গেল সমস্ত কৃষকের আশা আকাঙ্ক্ষা সবকিছু। আর কদিন পরেই শরৎকালের দুর্গাপুজো। সবাই নতুন জামা, কাপড় কিনবে। কিন্তু এই গ্রামের লোকগুলো খালি গায়ে গামছা কাঁধে ঘুরবে। রাজু শ্যামলীকে এইসব কথা বলে। রাজু বলে - তোকে একটা শাড়ি দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু কি করে দেব? 
শ্যামলী বলে - দিতে হবে না গো। তুমি শুধু এমনি করে আমাকে জড়িয়ে থেকো। 
রাজু আর শ্যামলী দুজনে দুজনকে ভালবাসে। তারা বিয়ে করবে। কিন্তু বামুনের সঙ্গে হাজরা বা হাড়ি জাতের বিয়ে সমাজের সেনাপতিরা মেনে নেবে না। ওরা ঠিক করল, পালিয়ে গিয়ে ওরা বিয়ে করবে পরে। ততদিনে রাজু ভাবে, একটু গুছিয়ে নেব নিজেকে। টাকা, পয়সা জমিয়ে রাখব। তারপর বিয়ে, সংসার। 
প্রায় দুবছর পরে রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল দুদিন পরে তারা শিবলুন স্টেশনে ট্রেন ধরবে। তারপর বহরমপুরে চলে যাবে। ওখানে নিশ্চয় কাজ পেয়ে যাবে। তা না হলে কুলিগিরি করবে। ওদের ঠিক চলে যাবে। 
রাজু আজ বাড়ি গিয়ে গুরুদেব আর মা কে দেখতে পেল। গুরুদেবের দয়ায় মায়ের খাওয়া পরার অভাব নেই। মেয়ের বয়সী রাজুর মা। গুরুদেব এই মেয়ের বয়সী অসহায় বিধবার সঙ্গে যে খারাপ দৃষ্টি দিতে পারে, এই ধারণা গ্রামের সরল মানুষের ছিল না। আর রাজুর দেখা সেদিনের ঘটনা একমাত্র শ্যামলী বিশ্বাস করে। আর কাকে বলবে সে। এই ঘটনার সঙ্গে যে মা জড়িত। মা যদি লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে রাজু তো মাতৃহারা হবে। তাই নিজের পায়ে কোপ রাজু মারতে চায় না। নিজের মত করে পরবর্তী জীবন সে আনন্দে কাটাতে চায়। হঠাৎ একদিন গুরুদেব রাজুকে কাছে বসালেন। বললেন - তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস নয়? রাজুর মা বললেন - কেন কি করেছে রাজু? 
গুরুদেব বললেন - তোমার ছেলে হাড়িদের মেয়ের সঙ্গে ঘোরে। মাখামাখি করে। ওদের পাড়ার অনেকে দেখেছে। আমাকে বলেছে। রাজু বলল -  হ্যাঁ, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। 
গুরুদেব বললেন - আমি হতে দেব না। তুই বামুনদের ছেলে। সমাজ মানবি তো হতভাগা। রাজু বলল - আপনার মুখোশপরা সমাজ আমি মানি না। আমি জাতপাত মানি না। এই বিয়ে হবেই। কোনো শক্তি এই বিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে দেব। 
রাজুর মা চিৎকার করে বললেন - কাকে কি বলছিস তুই? এই বিয়ে হলে আমার মরা মুখ দেখবি। আমি গলায় দড়ি দেব। 
গুরুদেব বললেন - ছি ছি রাজু। মায়ের কথা চিন্তা না করে তুই দেহের কথা চিন্তা করছিস। ছি ছি। 
রাজু মাকে বলল - মা হয়ে তুমি ছেলেকে সাজা দেবে? 
রাজু ছুটতে ছুটতে নতুন পুকুরের পাড়ে গেল। রাজুর মা ও ছেলেকে ডাকছেন - রাজু ফিরে আয়। রাজু ফিরে আয়। রাজু দূর থেকে দেখল শ্যামলী ছুটতে ছুটতে শিবলুন স্টেশনে যাচ্ছে। এখন তাকে কোনো বাধা আটকাতে পারবে না। আজ তাদের পালিয়ে বিয়ে করার দিন। রাজু অবাক চোখে দেখে, শ্যামলী খোলা মাঠে হৃদয় মেলে আনন্দে  মেঘ হয়ে ভাসছে। রাজু ভাবল, এই আনন্দ ম্লান হয়ে যেতে পারে না। সে ও হাওয়ায় উড়তে চায়। 
রাজু অসহায়। সে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে? একদিকে শ্যামলী তার প্রাণের বাঁশি আর একদিকে মা, রাজুর শ্রেষ্ঠ দেবী।   
গুরুদেবের সমস্ত মিথ্যা কথা রাজুর মনে পড়ছে। কবচ পরলে নিশ্চিতভাবে সকল কাজে সফল হওয়া যায়। পৈতে থাকলে সিদ্ধিলাভ হয়। কই রাজুর জীবন তাহলে ব্যর্থতায় ভরা কেন? রাজু ভাবে, এই সব কিছু গুরুদেবের বানানো কথা। শাস্ত্র কখনও জাতিগত ভেদাভেদ করে নি। পৃথিবীর কোন ধর্ম কোন মানুষকে ছোট করে নি। শুধুমাত্র গুরুদেবের মত স্বার্থপর লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব নিয়ম চালু রাখেন সমাজে। রাজু এই মুখোশ একা খুলতে পারবে না। তবু নিজের জীবনে তো নিজের ইচ্ছেমত থাকতে পারবে। সে মা কে বুঝিয়ে বলবে। মা নিশ্চয়ই বুঝবে।     রাজু অনেক আশা নিয়ে পৈতে খুলে ফেলল। কবচ খুলে ফেলল। দুটো বিষফলের মত, কুসংস্কারের বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলে। আর কখনও বিষফল দুটো রাজুর ভাবনার বাধা হতে পারবে না। রাজুর মনটা হাল্কা হল। তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল মানুষের মনের কুসংস্কার মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে।  
রাজু দৌড়তে শুরু করল। তারপর সে উড়তে শুরু করল। সমস্ত বাধাকে জয় করতে পারলে বোধহয় এইরকমই অনুভূতি হয়, সে ভাবল, আকাশে ওড়া শ্যামলীকে এবার ও নিজেও উড়তে উড়তে ধরবে। শ্যামলীকে ভালবেসে আকাশে ওড়াটা সে ভালভাবেই রপ্ত করেছে..

****
গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ, ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে, বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কত বড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো। ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো, আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো, কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো, একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো।

​​

দুই
গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম। মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন, এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে। আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন, এটা কি?
আমি ভাবলাম, আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন, এবছর ওকে ভর্তি করা যাবে না।
ছোড়দা ভর্তি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গী ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি, আর, জি, আর, খেমকা হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর  দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেত তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।
এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই। মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।
গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন। আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভর্তির পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন - বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে। আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভর্তি হয়ে গেলাম।
সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার। নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন। জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে। আমার টোনা মাসিকে টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে। আজকালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন। কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না। তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার, অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে। সাবধান খুনির দল, একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা। ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ। শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি। নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়। 
শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়। মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে। সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে - বুড়ো ঢ্যামনার ভীমরতি হয়েছে। সখ দেখো এখনও রঙিন জামা পড়ে। ব্যায়াম করে। মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে।
একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে - মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না।
সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি। নিজের মনে গুমরে ওঠে যত স্মৃতি। শেয়ার করার কেউ নেই। তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ। তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতু জুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা।সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক। 
আমার দুই বোন। তিন ভাইঝি। বোনেদের নাম রত্না স্বপ্না। রত্না হলো কন্যারত্ন। সব অভাব অভিযোগ তার কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে। আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার। ভাইঝিরা তনুশ্রী, দেবশ্রী, জয়শ্রী। এরা বড়দার মেয়ে আর মেজদার মেয়ে পৃথা, ছেলে ইন্দ্র। এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়। বাবুর মেয়ে তিন্নি আমার ছেলে সৈকত। 
রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায় অচেনা বলয়, মাকড়সার জালের মতো জটিল। সবাই এত অচেনা অজানা রহস্যময়। বুকটা ধকধক করছে, হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো। এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা। আর আমি একা নই, কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়...
আমার মায়ের বাবার নাম ছিল মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ, ডিম, মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া, সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল, ডাল, মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকার টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল, ডাল, গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা, মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর, গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো। আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুরবেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিস্টার্ব হতো। একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বারবার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভীতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা, হোবলো, ক্যাবলা, লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম, বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুঁড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগার পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন, ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোকা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটা। বন্ধু বললো, আমাকে অত বোকা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোঁড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পড়েছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন, আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সব কিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন, আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টি জল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো, আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম। সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দূর্বল, নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাসংগীত শোনাতো। 
সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না। দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো। দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পড়লেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা, বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক। গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস, আই মিনে আয়। সুদপে, রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো। আবার কোনো মাসি বলতেন, আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা, জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিমধ্যে গীতু, মিনেদের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে। আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।
তারপর সংসারের টানা পোড়েন। রাগ, হিংসা, ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষ জীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম, দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন, জানি না ভাই। তবে, মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ইশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপারে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন, মরে গেয়েছে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই, দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।  
অনেক বছর অপেক্ষা করেছি, দাদুর কথা শুনবো ওপার থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত। 
আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। 
আমরা জিজ্ঞেস  করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে। 
বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়।  দুঃখ শেষে আনন্দ। আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন । দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসার নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয়।
যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে। সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসার আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারীরূপী দেবির রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জাভূষণ । পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীনভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক। 

আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুরবেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশু বলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি। ভেজে খাওয়া যাবে। বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়, একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। 
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কাণ্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।  
আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি?  বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়। বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে? 

তিন

স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেডমাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস।রেজাল্ট ভালো হবে। ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশী বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।

বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের। তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মালপত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে।ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো।জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে। 

এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো।ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পড়লে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।

আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গীরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে। তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।

বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের, শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পড়লে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন, বিশু, আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা, গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানে আর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে।গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেত। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেত। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে।  মাঠেই পাওয়া যেত বেশির ভাগ শাক, সব্জী, খলসে, ও আরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, চোখো, চ্যাঙ, ছিঙুরি, গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া, তাল কাঁকড়া পাওয়া যেত। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তো আল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে।পাঁকাল, গুঁতে, কৈ, মাগুর, ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে। বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরী বউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিত জলের দরে।  আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণযুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন, ছোটো থাকাই ভালো রে, সংসার অসার। মা বলতেন, এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি। মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ...

স্বজন বন্ধুরা বলবে আর কত সময় লাগবে শেষ হতে...একটু দ্রুত করো ভাই...তবে কিসের এত অহংকার... কেন এত লোভ ... ভালোবাসায় কৃপণতা ... কে ধনী... টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই...

কৃষ্ণধনে ধনী যেজন

নিজ ধামে ফেরে সেজন...

লক্ষ্মীপুজো এলেই মা বলতেন কোজাগরীর অর্থ। তিনি বলতেন, কোজাগরী লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোন অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী।  ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তার ফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোণারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো, শিবলুনের মেলা, উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেত। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকাদি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা, রুনু, শঙ্করী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।

পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনে আছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।

বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যার ইচ্ছে মতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালাতে সোনার দোকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপারে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। 

কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়েছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত, ভব, ভম্বল, বাবু, বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল, বেল, কুল, শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।

শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। এক রাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউ এলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেড়ে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেড়ে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছে উঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে  নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পড়তো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না, ফেসবুক ছিল না। কোন পাকামি ছিল না। সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লউ হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। 

আমাদের একটা বন্ধু দল ছিল। পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি। হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ। পায়ে হেঁটে। গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কোয়ার। জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর। বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরীকে। তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো। অমিত রান্না করতো খুব ভালো। পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম। ও শেফ হতে চেয়েছিলো। অনিন্দিতা বলে বান্ধবীটা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সব স্বপ্নগুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো।

ঐ বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে। রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে। অসীম গান করে, বিচ্ছু একতারা বাজায়। অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে। হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..

ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি। এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে। ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ।

আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু। দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজী, শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু। চেনা আত্মীয়র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা। হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া, বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া, পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা, মঙ্গলচন্ডীর উঠোন, দুর্গাতলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না। কেঁয়াপুকুর, কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া, শিব তলা পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা, তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা। এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয়। মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব। সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া, কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা, কলা বা গান, দুর্গাতলার নাটমন্দির সব কিছুই। পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই। শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ। এই গ্রামেই আমার সবকিছু, আমার ভালোবাসা, আমার গান।

ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পীকে। তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না। তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী, ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে, আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত, ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।

এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভে (দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচতে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন। তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের।

সুমন্ত ভট্টাচার্য শুধু একজন যোগ্য বিজ্ঞানী নন। তিনি একাধারে চিকিৎসক, সন্ধানী গোয়েন্দা আবার কিশোর মনোবিজ্ঞান পত্রিকার সহ সম্পাদক। তিনি এক বনেদী পরিবারের সন্তান। পূর্ব বর্ধমান জেলায় পূর্বপুরুষরা বাস করতেন। ঐ বংশের একাংশ আবার জলপাইগুড়িতে বাস করতেন । কিন্তু কালের প্রবাহে কোনো কিছুই স্থির নয়। এখন কে কোথায় ছিটকে পৃথিবীর কোন জায়গায় আছেন তার সন্ধান করা সহজ কাজ নয়। জয়ন্তদা বসে বসে এইসব ভাবছেন আর মনে মনে প্রার্থনা করছেন, যে যেখানেই থাকুন, তারা যেন সবাই সুখে শান্তিতে থাকেন।

হঠাৎ রত্নাদির ডাকে সুমন্তদার লুপ্ত চেতনা ফিরে এলো। দাদা বললেন - বসো বসো আমি একটু আসছি।

তারপর দুই কাপ চা এনে বললেন - দিদি চা খাও।

- দাদা চা খুব ভালো  করেন।

দিদি বললেন - দাদা চা খুব ভালো হয়েছে।

দাদা বললেন -  ধন্যবাদ। তারপর কি খবর বলো।

দিদি বললেন - গতকাল এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য।

- কোথায়?

বীরভূম জেলার সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুর গ্রামে। দাদা নতুন জায়গা দেখতে ভালোবাসেন। ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে পরের দিন দুজনে হাওড়া রামপুর হাট এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বসলেন। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে যাওয়া অন্তরে এক অদ্ভূত অনুভূতির সৃষ্টি করে। এ রসে যে বঞ্চিত তাকে বোঝানো কঠিন। দাদা ও দিদিকে এই কথাগুলি বলছিলেন। দিদি বললেন, সত্য কথা। ট্রেন জার্নির স্বাদ আলাদা।

তারপর বারোটার সময় ওনারা মথুরাপুর গ্রামে এসে গেলেন। পরেশবাবু ফোনে খবর পেয়ে আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। জলটল  খাওয়ার পর পরেশবাবু দাদাও দিদিকে নিয়ে ময়ুরাক্ষী নদী দেখাতে নিয়ে গেলেন। নদীতে এখন বেশি জল নেই। পায়ে হেঁটে ওনারা নদীর ওপারে গেলেন। পরেশবাবুর ব্যবহার দেখে দাদা ও দিদি খুব মুগ্ধ হলেন। তারপর খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকালে গ্রাম ঘোরার পালা। কত কিছু দেখার আছে আমাদের দেশের গ্রামে। গাছপালা নদীনালা এই নিয়েই আমাদের গ্রাম। কবিগুরু তাই বলেছিলেন, "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ... একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু"। আমরা আজীবন ঘুরে বেড়াই, আনন্দের খোঁজে। আর এই আনন্দ হলো জীবনের আসল খোঁজ। কথাগুলি জয়ন্তদা বললেন।

দিদি পরেশবাবুকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন। পরেশবাবুও কথা বলে খুব আনন্দ পেলেন।

তারপর রাতে খাওয়া বেশ ভালোই হলো। পরেশবাবুর বিরাট জায়গা জুড়ে বাগান। অনেক হিম সাগর আম। গাছের টাটকা আম। আর সাঁকিরের পাড় থেকে আনা দৈ আর রসগোল্লা। রসিক মানুষ জয়ন্তদা। বললেন - পরেশবাবু কব্জি ডুবিয়ে ভালোই খেলাম।

পরেশবাবু বললেন - আপনাদের খাওয়াতে পেরে আমি খুব খুশি।

ভোরবেলা তখন চারটে বাজে। জয়ন্তদার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পরেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন - কি ব্যাপার এত কল রব কেন?

পরেশবাবু বললেন - আর বলবেন না। আমার বাগানে অনেক জবা গাছ আছে নানা জাতের। কোনোটা লঙ্কাজবা, পঞ্চমুখী, গণেশজবা, সাদাজবা, ঝুমকোজবা, খয়েরীজবা, লাল, ঘিয়েজবা প্রভৃতি। এখন একটা লাল জবা গাছে ঘিয়ে জবা হয়েছে। সবাই তাই ভোরবেলা পুজো দেয়। বলে, ঠাকুরের দয়া। তাই এক গাছে দুই রকমের ফুল। দিদি দেখছেন প্রচুর মহিলা চান করে কাচা কাপড় পরে পুজো দিতে এসেছেন।

দাদা বললেন - এদের বোঝাতে হবে। এটা বিজ্ঞান নির্ভর ব্যাপার।

দিদি বললেন - আপনারা শুনুন, এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার।

তখন মহিলাদের একজন বললেন - একথা বলবেন না দিদি। পাপ হবে।

দিদি বললেন - পরাগ মিলনের ফলে লাল গাছের পরাগ রেণু ঘিয়ে গাছের পরাগ রেণুর সঙ্গে মিলিত হয়। এই কাজটি করে পতঙ্গরা। সংকারয়নের ফলে জটিল পদ্ধতি পার করে এইসব ব্যাপারগুলো হয়। সেসব বুঝতে গেলে আরও পড়াশুনা করতে হবে। আরেকজন মহিলা বললেন - কই আর কোনো গাছে তো হয় নি।

দিদি বললেন - এত বড় বাগান ঘুরে দেখুন। নিশ্চিত দেখা যাবে। দাদা জানেন সবাই প্রমাণ চায়। প্রমাণ ছাড়া এদের কুসংস্কার মন থেকে যাবে না। দাদা ডাকলেন - আপনারা এদিকে আসুন। দেখুন এখানেও দুটি গাছে ঐ একই ঘটনা ঘটেছে। সবাই ওখানে গিয়ে দেখলেন, সত্য কথা তাই হয়েছে। লাল গাছে ঘিয়ে জবা। দাদা বললেন, মনে রাখবেন বিজ্ঞান অসম্ভবকে সম্ভব করে। বিজ্ঞান এর দৃষ্টি দিয়েই আমাদের সবকিছু বিচার করতে হবে। সবাই বুঝতে পারলেন এবং খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলেন। পরেশবাবু বললেন - এবার আপনাদের জন্য কফি নিয়ে আসি। 

বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে কবি কাশীরাম দাসের জন্মস্থান। ঐ গ্রামে আমার এক আত্মীয় বাড়িতে ক্ষেত্রপাল পুজোর সময় বেড়াতে গেছিলাম। এই পুজোর সময় এই গ্রামে খুব ধূমধাম হয়। রতন আমার থেকে বয়সে একটু ছোটো হলেও বন্ধুর মতোই ভালোবাসি। যেখানে যাই আমরা দুজন একসাথে যাই। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা কিশোর মনোবিজ্ঞানের সহ সম্পাদক সুমন্ত ভট্টাচার্য ও সহ সম্পাদনা সচিব রত্না রায়কে এই সিঙ্গিগ্রামের পুজো দেখাবো। রতনকে আগেই বলে রেখেছি। দাদা ও দিদিকেও একমাস আগে বলে রেখেছি। আজ তাঁরা আসবেন।

আমরা ক্ষেত্রপালতলায় ঢাকের তালে মত্ত। হঠাৎ একটি ছোট ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে সবাইকে বলছে, সবাই দেখে এসো মিত্র বাড়িতে ঠাকুর এসেছে। আমরা ছেলেটির কথা শুনে কৌতূহল বশত মিত্র বাড়িতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। -----কি হয়েছে রে, একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম । মেয়েটি বললো - জগন্নাথ মন্দিরের ভিতর স্বয়ং জগন্নাথ ঠাকুর এসেছেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, একটি বড় পোকা ঠিক জগন্নাথ ঠাকুরের মত সব কিছু। খুব আশ্চর্য হওয়ার কথা।

এদিকে দাদা ও দিদি এসে গেছেন। ওনাদের বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গোলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হলে গ্রামের সব কিছু ঘুরে দেখলেন। পাশের গ্রামে অনেক ভেড়া, ছাগল জাতীয় পশুদের বলি দেওয়া হচ্ছে দেখে দাদা ও দিদির খুব রাগ হলো।

ওনারা বললেন - এই সুযোগে বলি প্রথা বন্ধ করতে পারলে ভালো হয়। দেখা যাক এই নিরীহ পশু দের যদি বাঁচানো যায়। তার জন্য একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলে নিতে হবে। যাই হোক গ্রাম ঘুরে বেশ ভালো লাগলো ওনাদের। রাত্রিবেলা সোরগোল। জগন্নাথ ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে অনেকেই অসুস্থ। তারা সবাই কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। দাদা মন্দিরের ভিতর ঢুকে বললেন - এত পশুর বলি দান দেওয়া হচ্ছে এই বিপদ ঐ কারণেই হয়েছে। গ্রামের সবাই যদি প্রতিজ্ঞা করে, বলি প্রথা বন্ধ করবে, তাহলে সবাই সুস্থ হবে। সবাই ঠাকুরের সামনে তাই বললো। আর কিছু করার নেই । বলি বন্ধ হলেই হবে। অনেক কিশোর কিশোরী ,বুড়ো বুড়ি এই সিদ্ধান্তে খুব খুশি। গ্রামের বেশির ভাগ লোক পশু বলি চায় না। কিন্তু অভিশাপের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না।

হাসপাতাল থেকে সবাই সুস্থ হয়ে ফিরে এলে দিদি বললেন, এই পোকাটি জগন্নাথ ঠাকুরের মত দেখতে। কিন্তু এটি একটি বিষাক্ত পোকা। গভীর জঙ্গলে ওরা থাকে। রাতে প্রাসাদের আঢাকা থালার মধ্যে যাওয়া আসা করার ফলে বিষাক্ত ফ্লুয়িড খাবারে লেগে যায়। সেই প্রসাদ সকালে খাওয়া হয়, আবার তারপরে বলি প্রথার পাপের ফল। এই দুয়ে মিশে আমাদের গ্রামের অনেকেই অসুস্থ।বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিশ্লেষণ করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় জলের মতো। দাদা বললেন - মনে রাখতে হবে, আমরা মানুষ, পশু নই। তাই আমরা নিজেরা বাঁচার পাশাপাশি আর বাকি সবাইকে বাঁচতো দেবো। তবেই আমরা সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারবো। 

কেতুগ্রাম থানার ভুলকুড়ি গ্রামে সন্ধ্যা ছ'টার পর আর কেউ বাইরে বেরোয় না। একমাস যাবৎ এই অঞ্চলে ভূতের অত্যাচার খুব বেড়ে গেছে। গ্রামের শিক্ষিত ছেলে বাবু ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে বললো, জানো দাদা জবাদের দোতলা ঘরে জবা শুয়েছিলো। ঠিক বারোটার সময় জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে জবার মাথার চুল ছিঁড়ে নিয়েছে। 

- কবে রে বাবু

- গতকাল রাতে

- এখন কেমন আছে

- এখনি ডাক্তার খানা নিয়ে যাবে বলছে

আমি কয়েকদিন ধরে এইরকম কথা শুনছি। ভাবছি কি করা যায়। আমার বাড়িতেও তো এইরকম আক্রমণ হতে পারে। আজকে রাতে রাস্তায় কেউ নেই। আমি দোতলার বারান্দায় রাত বারোটা অবধি জেগে থাকলাম। কিন্তু, কাকস্য পরিবেদনা। কেউ নেই। একটু ভয় ভয় লাগছে। তারপর রাত্রির অপরূপ রূপে মগ্ন হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা পেপার আর চা নিয়ে কোকিলের ডাক শুনছিলাম। হঠাৎ মন্ডল পাড়ার স্বদেশ এসে আমেজটা নষ্ট করে দিলো।

- দাদা, কালকে আমাদের পাড়ায় ভূতটা ঘুরছিলো। প্রায় দশ ফুট লম্বা, বড়ো হাত আর কালো রঙ।ভয়ে আমার বাবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।

- এখন ভালো আছেন ?

না না, এখনও বু বু করছে।

আমি আবার চিন্তার মধ্যে ডুবে গেলাম। কি করা যায়, এই সমস্যা সহজে সমাধান করা খুব কঠিন।প্রকৃতির নিয়মে আবার রাত হলো। গ্রামের সহজ সরল মানুষ এই সব বিপদের দিন অসহায় হয়ে যায়। রাতে শুয়ে চিন্তা করলাম মুস্কিল আসান করার জন্য কিশোর মনোবিজ্ঞানের সুমন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়কে খবর দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে চড়খীর অমলকে ফোন করলাম। আমার মনে আছে অদৃশ্য নাথ সেই ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলো জয়ন্তদা ও হৈমন্তীদির জন্য।

অমল ফোন করে সুমন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের আসার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলো। সঙ্গে আসছেন কিশোর মনোবিজ্ঞানের সহ সম্পাদনা সচিব রত্না দিদি। তিনি বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী। আমার একটু সাহস বাড়লো। ওদের সাথে আমার বন্ধু অমলকেও আসতে বললাম। সেই রাত কাটলো ভয়ে ভয়ে। সকালে উঠে শুনলাম ব্রাহ্মণ পাড়ার দীপক বাইরে বসে গান করছিলো আর ভূতে তাকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছো। শুনে আমার খুব রাগ হলো। ভাবলাম, দাঁড়া আজকের রাতে তোদের ব্যবস্থা হচ্ছে। দাদা ও দিদি ঠিক বারোটার মধ্যে অমলকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এলেন। তাদের দেখে আমার বুকের ছাতি চল্লিশ ইঞ্চি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে।

ঠিক চারটের সময় মঙ্গল চন্ডীর উঠোনে গ্রামবাসীরা হাজির হয়ে গেলো। জয়ন্তদা বলতে শুরু করলেন, আজ আমরা সবাই রাতে জেগে থাকব। কে বা কারা এই কুকর্ম করছে আমাদের জানা দরকার। একজন বলে উঠলেন, ভূতের সঙ্গে লড়াই করে কি পারা যাবে। দিদি বললেন, ভূত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তারপর তিনি আরও কিছু কথা বললেন গ্রামবাসীদের সাহসী করার জন্য। আবার একজন বললেন, তাহলে আগুন জ্বলে উঠছে কেমন করে। দাদা বললেন, এসব কিছু বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যাপার। আগে ধরা হোক অপরাধীকে তারপর সব বোঝা যাবে।

এখন রাত দশটা বাজে। গ্রামের সবাই জেগে আছে। ঠিক রাত বারোটার সময় একটা দশ ফুটের লোক হেঁটে আসছে গ্রামের দিকে। দাদা থানায় ফোন করে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ আনিয়েছেন।সাধারণ লোকের বুদ্ধির সঙ্গে এখানেই দাদার পার্থক্য। কখন যে সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছেন কেউ জানি না। ভূত কাছাকাছি আসা মাত্র পুলিশ দু রাউন্ড গুলি চালালো ফাঁকা আকাশে। গুলির আওয়াজ শোনা মাত্র ভূতটি ভয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সাহসী ছেলেরা বিকট চিৎকার করে ধরে ফেললো ভূত বাবাজিকে। বেচারা তখন জোড়া হাতে ক্ষমা চাইছে।

তাকে বিচারের জন্য ফাঁকা জায়গায় আনা হলো। সবাই বসে পড়লেন। এবার দাদা বলতে শুরু করলেন, দেখুন সবাই এই চোরটি রণ পা ব্যবহার করেছে লম্বা হওয়ার জন্য। রণ পা টি বাঁশের তৈরী নয়। একজন বললো, তাহলে ও ছোটো বড় কি করে হতো। দিদি বললেন, রণ পা টি বিশেষ ধরণের। এর মাঝে একটি শক্ত স্প্রিং আছে। যার ফলে এ যখন লাফ দি তো তখন এটি ছোটো বড়ো হতো।

আর একজন বললো, তাহলে মুখ দিয়ে আগুন বেরোতো কি করে। দিদি বললেন, এটা তো সহজ ব্যাপার। সার্কাসে আপনারা দেখে থাকবেন মুখের মধ্যে পেট্রোলিয়াম বা কেরোসিন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে এরা মানুষকে অবাক করে দেন। এই চোরটিও তাই করেছে। দাদা এবার চোরটিকে ধমক দিয়ে বললেন, তুমি জঘন্য অপরাধ কেন করছো জবাব দাও।

এবার চোরটি উঠে জোড় হাতে বললো, আমরা মাদক দ্রব্য চোরাপথে চালান করি। তাই ভূতের ভয় দেখিয়ে আমরা মানুষকে বাড়িতে ঢুকিয়ে রাখি। এর ফলে আমাদের চোরা  চালানে সুবিধা হয়।তারপর থেকে আর ভূূতের উপদ্রব হয় নি।

চার

কানি নদীর পাড়ে মালিহা গ্রাম। হারুদাদু বলতেন - এই গ্রামে পাঁচশো বছর আগে এক রাজা এসে বড় অট্টালিকা করেছিলেন এক সুন্দরীকে ভালোবেসে। সেইসব আর নাই। কালের প্রবাহে ভেসে গেছে। গ্রামে দুইশত পরিবারের বাস। বেশিরভাগই মাটির বাড়ি। সন্তুদেরও মাটির বাড়ি। চারচালা টিনের চাল।     

সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না, চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার, অবর্তমানে অন্য ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় সাতটি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর বাবা। 

তখন সন্তুর বয়স একুশ। মেট্রিক পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়ীত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। বাবার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন সন্তুকে। এবার ভাই, বোনদের পড়াশোনা, মাকে যত্ন করা সব অই সন্তুর সামান্য মাইনের টাকায়। নতুন চাকরী তাই মাইনে কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতির মাঝে।

সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পরতো বারে বারে। 

একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পড়লো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো, কে?

- আমি, দরজাটা খুলুন।

- জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।

- আমি পাপিয়া, আপনার বাড়িওলার একমাত্র মেয়ে। 

- এত রাতে কেন? কি প্রয়োজন বল? 

- আরে খুলুন না ছাই।

দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা বাটি। বললো, আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো, মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়। জল খাবেন। এখন কি ঢাকা দিয়ে রেখে দেব।

সন্তু বলল, তাই দাও। আমি পরে খেয়ে নেব।

পাপিয়া বলল, আমি বসব। আপনার সঙ্গে গল্প করব।

- কিন্তু মেসোমশাই রাগ করবেন। রাতে গল্প।

- বকবে না। বাবাকে বলে, তারপর এসেছি। বলেছি সন্তুদা প্রসাদ খাবে। তারপর বাটি নিয়ে আসতে দেরী হবে।

- কত আর দেরী হবে খেতে।

- কিচ্ছু বলবে না, বলছি না। বাবা আমাকে বকে না। একমাত্র আদরের মেয়ে আমি। 

পাপিয়া বলল, এবার তোমার গ্রামের গল্প বলো। আমি কিন্তু তোমাকে, তুমি তুমি বলব সন্তুদা। তুমি বেশী কথা বল না কেন? কথা বলবে এখন। আমি শুনব। 

সন্তু বলেছিল, নিশ্চয় বলবো। কথা বলব না কেন? আমি তো একাই থাকি। বল, কি বলবে। 

সন্তুর মনেও একটা কোণে পাপিয়া ডাকত। কিন্তু বড় সংসারের দায়ীত্ব তার কাঁধে। মায়া কাটাতে হবে। বাউলের মন হয়ে যায় সন্তুর। সে ভাবে, এসব প্রেমের বিলাসিতা কি আমার সাজে? সন্তু ভাবে, বারবার ভাবে পাপিয়ার কথা। কিন্তু ভালবাসা সহজে কেউ পায় না আর কেউ কেউ বাউল সাধক। মানুষের মাঝেই তাঁর বাসা। উদাস ভালবাসা। হঠাৎ পাপিয়ার ডাকে সন্তু চেতনা ফিরে পেলো। পাপিয়া বলল, তুমি সবসময় বাউল মনে ঘুরে বেড়াও কেন। কোকিলের মত তোমার কি বাসাবোনার ইচ্ছে নেই। সন্তু উত্তর দেয় না। পাপিয়া আবার বায়না করে, একটা গল্প বলো না সন্তুদা। তোমার গ্রামের গল্প। তোমার মায়ের কথা, বাড়ির কথা, আনন্দের কথা। সব শুনব আমি। 

সন্তু বলল, শোনো তাহলে। বলি তোমাকে শীতকালে মেলা যাওয়ার কথা। আমার আবেগের কথা।গোরুর গাড়ি চেপে উদ্ধারণপুরের মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন, গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন, তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন - আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।

জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।

পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভর্তি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।

গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম, একটা আখ খাবো। তামালদা বললো - না পরের জমি।

- একটা তো, কিছু হবে না।

- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।

তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম। গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা। মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন - প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।

জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে। বড়দা বললেন, অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ। মানা পিসি বললেন, চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন, সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

তামালদা মাকে বললো - দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না। মা বললেন, যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও। মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।

ঘুরে ঘুরে লেখক অবধূতের আবক্ষ মূর্তি দেখলাম। শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়। কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে। জাতিতে জাতিতে, বললেন গোপাল কাকা। এই উদ্ধারণপুরের মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি। আমার ঈশ্বর, আমার অনুভব, ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পড়ছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।

দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন, থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই। তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পড়লাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়, স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বারবার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।

সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই। তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন - তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে, হুট্ হুট্, চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন - বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।

হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। সবগুলো শুয়ে পড়ে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন - ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।

তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে, আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন, অন্যায় করবি না, আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না। এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা। কোনোদিন ভুলতে পারব না।

পাপিয়া বলে - খুব সুন্দর গল্প। সন্তুদা আমাকে কোনোদিন ভুলবে না তো?

সন্তু বলে, তোমার দেওয়া প্রসাদ খেয়ে নি। ঢাকা পড়ে আছে অনেকক্ষণ। সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো। প্রসাদ এত মিষ্টি হতে পারে সন্তুর জানা ছিল না। হয়ত পাপিয়া ভালবাসা মিশে ছিল। সন্তু ভাবে একথা কিন্তু পাপিয়াকে ঘুরিয়ে বলল, তোমার বাটিটা ধুয়ে দি। 

- আমাকে দিন। আমি ধুয়ে নেব। এইকথা বলে সে চলে গেল।

সন্তু ভাবে, কোন কারিগর বানিয়েছেন মেয়েদের মন। তার মন দিলে আর ফেরাতে পারে না, ভুলতে পারে না প্রিয়জন। 

বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে, ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে, বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো, আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন, ছেলেটা ভালো। যাবি প্রয়োজন হলে।

রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো, কিছু বলবে।

- হূঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?

- কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।

- আর পড়াতে। 

- দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আমার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।

- তাই,তাহলে ভালোই হলো।

সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে, আপনি এত অগোছালো কেন? তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে। সন্তু বললো,তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা আমার কাজ করবে কেন?

- আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?

- না, না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গী পাবো।

- বাবাকে বলবেন, আমি খুব পড়ি।

- মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।

- ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না। বিছানায় বসেছি বা কাজ করেছি। 

- আমি এসব ভালোবাসি না।

সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়িত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে। একবার ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিলে বেড়ে যাবে কুমড়ো লতার মত। আমাকে শিঁকড়ে ঘা দিতেই হবে। আমার যে হাতে পা বাঁধা, আমার মন পাপিয়া। সংসারের কাছে বেইমান আমি হতে পারবে না আমার মন। 

​​পাঁচ

পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো, কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তুকে ওর মা বলে, এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।

পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো, পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো, কি এটা।

- পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।

- থাক, তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।

- কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন, প্রাণ সবকিছু।

সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।​

ছয়

সমবেত সুধীজনের হাততালিতে ভরে উঠল সভাপ্রাঙ্গণ। এবার একটি সংগীত গাইছে একজন কিশোর। ইতিমধ্যে রােমাঞ্চিত হল। এতবড় একজন পণ্ডিত মানুষ আমার পাশে। বলল - অংশুমান দেখি আমার পাশে ত্রিপলে মাটির মানুষ ডঃ স্বপন ঠাকুর। আমার দেই আদিত্যকে। আদিত্য বলল - “অবাক হচ্ছেন কেন? পৃথিবীতে যারা বড় তার এইরকমই হন। এটাই স্বাভাবিক। আমি মঞ্চে উপবিষ্ট মানেই আমি সব। এসব নিচু মানসিকতার লক্ষণ। আদিত্য আবার আলাদা। এই ধারণা শুনিলে প্রাণপাগল করা সেই গান- যারা সুজন নাইয়া, উজান বাইয়া বােকাই করে মাল স্বদেশে ফিরে গেছেন তারা, থাকিতে সকাল, থাকিতে সকাল রে, থাকিতে সকাল। এমনি কত গান পাগল আদিত্য, অংশুমানের পাড়ার ভাই। বার্তাসূচী সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক শ্ৰী দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে আশুমানের এখানেই পরিচয়। আদিত্য অংশুমানকে বলল - “বার্তাসূচীর সম্পাদক মহাশয়কে লেখা দেবেন। আপনার লেখা ছাপা হবে।" সম্পাদককে বলে দেখে অংশুমান। শ্রী দেবাশীষ রায় সমস্ত লেখককেই সম্মান দেন। তার পত্রিকা এখন বাজারে বেশ নাম করেছে। পত্রিকাটিতে সম্পাদকের ভাবনার ছাপ স্পষ্ট। আত্যি এখন সরস্বতী পূজার প্রস্তুতি নিয়ে খুব ব্যস্ত। প্রখ্যাত জি, খ্যাত কবি অসীম সরকারকে নিয়ে আসছে আদিত্য। প্রায় দশহাজার লোক জমায়েত হয় এই কবির গান শােনার জন্য। যুবকদের সঙ্গে থেকে আদিত্য এইসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। আদিত্য অংশুমান বলল - এবার সরস্বতী পুজোর সময় কবি অসীম সরকারকে দেখতে আসবেন, দেখবেন ভালো লাগবে। এবার অনেকদিন পর কাটোয়ায় অংশুমানের বাড়িতে এল। সঙ্গে পরেশ তার মাসীর ছেলে। অংশুমান ও পরেশ ছােটো থেকেই বন্ধুর মতাে। ওরা একসঙ্গেই থাকত কোনাে বিয়ে বা অনুষ্ঠান বাড়িতে। অংশুমানের পিসির ছেলে কালীচরণ ও বড়পিসির ছেলে অপু। ওরা সবাই সমবয়সী। যখন কোনাে বিয়েবাড়িতে ওরা একসাথে থাকে তখন বিয়েবাড়িও যেন আলাদা একটা মাত্রা পেয়ে যায়।। বাবু পরেশকে সঙ্গে এনেছে কারণ পরেশের ছােট দিদির ছেলের জন্য এক পাত্রী প্রয়ােজন। বিয়ে দিতে হবে। ছােট দিদির ছেলে রমেশ। কিন্তু পছন্দ মতো মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না— বলল পরেশ। পরেশকে বলল - “চলাে অংশুমানের বাড়ি ঘুরে একবার ছােট মামীর বাড়ি গিয়ে বলে দেখি।" পরেশ বলল - “হ্যা, যা করেই হােক এক বছরের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। পরেশ সাঁইথিয়া হোমিওপ্যাথি দোকানের মালিক। খুব সৎ, সত্যবান ও পরিশ্রমী। ফুটবল খেলতাে ভালো। এখন বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। পরেশ বলে - কত, জানিস অংশুমান জীবনে লােভে আদর্শ ভ্রষ্ট হয় নি। আমি আমার আদর্শ নিয়ে সঠিক এ জীবনে পরেশ কারাের সাথে খারাপ ব্যবহার কোনোদিন করেনি। সবাই তাকে সৎ, সাহসী ছেলে বলেই জানে। ওদের এ ডাকাতের উপদ্রব। রাত্রি হলেই সবাই ভয়ে ভয়ে কাটাতে। এই হয়-এরকম ভাব। পরেশ ও তার বন্ধুরা নিয়ম করে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাত পাহারা দিয়ে চিৎকার করে সমস্যার শুরু করল। ওরা হাঁক দিত, ‘ও-ও-ও হ্যাৎ'-চিৎকার করে। কিছুদিনের মধ্যেই ডাকাতদের অত্যাচার কমে গেল। সবাই ঘুমতে পারল। অংশুমান মাসির বাড়ি গেলেই পরেশের সঙ্গে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে যেত। ওখানে বালির চরে ফুটবল খেলা হত। অংশুমান বলত, পরেশ তােদের এখানেই থেকে যাবাে। পরেশ বলত, “নিশ্চয়ই থাকবি।” সেসব ছােটবেলাকার কথা মনে পড়ে আর ভালাে লাগে—অংশুমান বলল দেবীকে। সব ছােটবেলার কথা অংশুমান তার ছেলে সৈকতকে বলে। সৈকতের এসব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। সৈকত আজ মন দিয়ে বাংলা পড়ছিল। বাংলা বইয়ে ভালাে ভালাে লেখকের গল্প-কবিতা আছে। লালন ফকিরের একটা কবিতা আছে, ওটাই সৈকত পড়ছে, “বাড়ির কাছে আরশিনগর, ও এক পড়শি বসত করে।” অংশুমান সৈকতকে থামিয়ে বলল, এর অর্থটা জেনে নিস। শেষে অংশুমান নিজেই বলল, আরশি হল আত্মদর্শনের এক মাধ্যম অর্থাৎ যা নিজেকে দেখা যায়। তাই আরশি' হল মানুষের মন। আর 'পড়শি বলতে এ বােঝানাে হয়েছে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বাস করা আর এক মানুষ বা ঈশ্বর বা মনের মানুষ। যাকে অন্য গানে লালন অধর মানুষ, সহজ মানুষ। অলখ সাঁই ইত্যাদি বলেছেন। সৈকতের খুব ভালাে লাগে বাবার কথা। 

অংশুমানের ক্লাসমেট সুলেখক ডা রবীন্দ্ররনাথ মণ্ডল খুব ভালোবাসে তাকে। তার কাছে অনেক প্রয়োজনে অংশুমান উপকার পেয়েছে। কিছু লোক যদি এইরকম হৃদয়বান হতেন, তাহলে মানুষের উপকার হত। সুলেখিকা সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অংশুমান লেখা পড়ে অনেক অনা তথ্য জানতে পেরেছে। বিবেকানন্দবাবু ও আরও লােকজনের সঙ্গে দেখা হয়। টিফিনে বাড়িতেই থাকে। মানুষ কেন খাওয়া-খাওয়া করে। আর মাসে যতটুকু পারে সাহায্য করে। বড়দার হাতে দেয়, মায়ের ওষুধ দেয়। আজ কবি বলছেন সভায় "গুরুজনদের প্রণাম। সবাইকে যথাযােগ্য সম্মান জানিয়ে আমি দু-চারটে কথা বলব। ধর্ম কথার অর্থ। ধারণ করে থাকে। সমাজের শান্তি, সুস্থ মন ও কর্ম হচ্ছে ধর্মের ফল। কথাটি সন্ধিবিচ্ছেদ করলে অন্যের কথা আসে। কিন্তু সেই নিয়ম। সুস্থ নিয়ম পালন পুর্বক আমরা যদি প্রত্যেক কর্ম করি, তাহলে ধরে সেটা হল সনাতন ধন অনুশাসন সার্থক হয়। সনাতন ধর্ম। ধর্ম একটাই। সেটা হল সনাতন আর বাকিগুলাে হল সম্প্রদায় বা গােষ্ঠী। এক-একটি গােষ্ঠি করে চলতে ভালােবাসে। আমরা একদম প্রাচীন যুগে যদি চলে যখন মানুষের সৃষ্টি হয় নাই, তাহলে দেখা যাবে, এককোষী প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ এসেছে। আর একজন মানুষ পিতা থেকে আমাদের সৃষ্টি। একজন পিতা আর একজন মাতা থেকেই ধীরে ধীরে এই বিশ্বের মানুষরা এসেছেন। অনেকে বলেন এই পিতামাতার নাম আদম ও ঈভ। তাহলে প্রশ্ন আমরা মানুষ হয়ে তাহলে আলাদা ধর্মের হতে পারি কি করে? আমরা লড়াই করি কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের। শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করতে হবে। অংশুমান বলছে, আমি অনেক কথা বলেছি। আর কিছু বলব না। আপনারা সকলেই বুদ্ধিমান। সবাই আমার প্রণাম নেবেন- এই বলে অংশুমান সভা থেকে নিচে নামল। চা-বিস্কুট খেলাে তারপর সভা শেষ হলে বাড়ি ফিরল। তখন প্রায় দশটা বাজে। পরের দিন স্কুল আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে শােয় অংশুমান। মা ও ছেলে তখনও টিভি দেখছে। দু-দিন পরে ডঃ স্বপনকুমার ঠাকুর, আদিত্য ও অংশুমান একটি গ্রামে যাবে ঠিক করল। ডঃ ঠাকুর প্রত্নগবেষক। তিনি বললেন - “ভারতবর্ষ নদীমাতৃ দেশ। বড় বড় নদীর ধারে বড় বড় বসতি তৈরি হয়েছে। আমরা যেখানে যাব সেই গ্রামটিতে গঙ্গা নদীর নিকটবর্তী গ্রাম। আদিত্য বলল - “শুনেছি ওই গ্রামে একটা পুরােনাে বাড়ি আছে। ওখানে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। আমরা তার ছবি তুলে নিয়ে বললাম - "তাই হবে। এই পুরােনাে বাড়িতে রাজরাজেশ্বরীর মূর্তি আছে। আবার ওখানে একটি পরিবার বাস করেন। তারা বলেন - এইটি পাঁচশাে বছর আগেকার বাড়ি।”
শঙ্কর বললেন - “তথ্য থাকলে তবেই এসব কথা বিশ্বাস করা যাবে। ঠাকুর বললেন, কথা দিয়ে উপন্যাসের মতাে এইসব কথা বলা যায় না। তার জন্য উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণাদি প্রয়োজন।”
ওরা সবাই গিয়ে একবার গ্রামে ঘুরে আসার মনস্থির করল। অংশুমান আবার আদিত্যর কাছে গেল। আদিত্য খুব ভালাে গান করে। “নির্মল বাংলা' নিয়ে একটি গান লিখেছে খুব সুন্দর। অংশুমান গান গাইতে জানে। তবু একবার গানটি গাইবার চেষ্টা করল। অংশুমানকে উৎসাহ দেয় সবাই খুব। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখতে বলে। অংশুমান উৎসাহ পেয়ে বাড়ি এসে অনেক পড়াশােনাও করে। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার বর্ণনা করতে গেলে খুন, ধর্ষণ লেগেই আছে। সংবাদপত্র খুললেই শুধু রক্তারক্তির খবর। মানুষে মানুষে হানাহানির খবর। অংশুমানের ভালাে লাগে না। দেশে শান্তি আসবে। সবাই সুস্থভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে। বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচতে দাও'—এই আদর্শ নিয়ে সবাই চলবে। তবে হবে সুস্থ। দেশের সুস্থ নাগরিক। অংশুমান জানে সেই দিন নিশ্চয়ই আসবে। এখনও শাসকদলে অনেক ভালাে লোক আছেন। তারাই একদিন ছাত্র-যুব সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে একতার গান গাইবেন। আজ অংশুমান পুরুলেতে এসেছে। বড়দা দিলীপ বলল - “সৈকত আর বৌমাকে একদিন পাঠিয়ে দিস। অনেকদিন আসেনি ওরা।" অংশুমান বলল - "ঠিক আছে।"

রিলিফ লিলুয়া থেকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ পুরুলে এসেছে। অংশুমানের স্কুল। বড়দা মাঝে মাঝেই সৈকতকে যেতে বলে। এইসময় পাঠালে বরদার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে। অংশুমান দেবীকে বলল - “যাও তুমি আর সৈকত একবার পুরুলে থেকে ঘুরে এসে।" সে বলল, "তাহলে তুমি চলে যেও না ঘর ফাঁকা রেখে। যা চোরের উৎপাত” অংশুমান বলল - “না না, আমি বাড়ি থেকে বেরােব না। দু-দিন সবাই যাও তােমরা ঘুরে এসো। তারপর সৈকত সকালবেলা বেরিয়ে পড়ল। অংশুমান নিশ্চিন্ত হল, আর নয় এখন বেড়াতে যেতে পারে না। যখন মায়াপুর গেছি তখন মনে আছে, নজনেই গেছিল। তখন একটা ঘরে ছিল তিনজন। এখন যা হােক দুটো-একটা জিনিস হয়েছে। চোর এসে নিয়ে তাহলে আর বােধহয় অংশুমান ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। পুুরুলেতে গিয়ে সৈকত আর ইন্দ্র দু-দিন খুব ঘুরে বেড়ালাে। সেই নতুনপুকুর, হাড়ি পাড়া, পুজো বাড়ি, হাইস্কুল আর দক্ষিণের খােলা মাঠ। সেখানে। গিয়ে কি করে যে সময় কেটে যায় পাখির গান শুনে, বাতাসের শিহরনে। তা ওরা বুকতেই পারল না। সৈকত আর ইন্দ্র যেন অংশুমান আর বিডি ছােটবেলার ছবি। তারা যেভাবে যীতলায় বেলগাছের ডালে উঠে খদের গায়ে লাফ মারত। সৈকত আর ইন্দ্র আরও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে একইরকমভাবে খেলে বেড়াচ্ছে। সেই ছোটবেলা, ছোলামুড়ি আর লুকোচুরি খেলার দিন ফিরে এসেছে। ঘেঁটুফুল, ঘাসফড়িং সবকিছুই নতুন করে চেনা এক ধারাবাহিক পদ্ধতি। এত শিশু আসে আর এক শিশু বড় হয়ে যায়। আবার তার জায়গায় আর এত শিশু এসে ফনি ধরে, লুকোচুরি খেলে, ডিগবাজি খায়, হাওয়াতে দোলে। এ-এক চিরন্তন প্রবাহ জেগে ছিল, জেগে আছে, জেগে থাকবে। এক অসীম নিরবছিন্ন খেলা। দু-দিন পরে আবার ওরা কাটোয়াতে ফিরে এল। কাটোয়াতে এসে প্রায় দু-দিন ধরে সৈকত বলছে - “বাবা, ঠাকুমার জন্যে মন খারাপ করছে, ইন্দ্র জন্যে, বাড়ির সবার জন্যে, ষষ্ঠীতলার জন্যে, নতুন পুকুরের জন্যে মন খারাপ করছে?" অংশুমান বললাে - “মন খারাপ কোরাে না। আবার সুযােগ পেলে ওখানে চলে যাবে। অংশুমান বাবার চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছে। অংশুমান ও তার বন্ধুরা অনেক জায়গায় ঘােরাঘুরি করেছে। পুরী, দার্জিলিং, দিঘার সব জায়গায় গেছে। এখন ঘরে বসে অবসর সময়ে এইসব কথা লেখে। একটা জীবন একটা উপন্যাসের মতাে। 

অনিলদার বাড়ি। অনিলদা বলেন - "চলো অংশুমান, আজ আয়ের সাহিত্য আসর। চলো ঘুরে আসি। অংশুমান বলল - "চলুন ভালােই হবে, একটা কবিতা পাঠ করব। আজয়ের আসরে গিয়ে ওরা দু-জনে কবিতা পাঠ করল। তারকেশ্বর বাবু বললেন - “পরবর্তী মাসের আসর কাটোয়া মহুকুমা মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে। সাহিত্য আসরেই পরবর্তী মাসের আসরের দিন ঘোষণা করা হয়। আবার মাসের প্রথম শনিবার বিজ্ঞান পরিষদে অনিল ঠাকুর  সাহিত্য আসরে গিয়ে অনুগল্প পাঠ করল। অনিল ঠাকুর বললেন, আমরা একসঙ্গে বাড়ি যাবাে। তুমি চলে যেও না।" অনুষ্ঠান শেষে ওরা বাড়ি এল, কবি ও গবেষক অনিল ঠাকুর সতিই খুব গুণী মানুষ।

অংশুমান কথা বলে মোবাইল রেখে দিল। তারপর দেবীকে বলল - পুরুলেতে জেঠুমা মারা গেছেন। এই দশ মিনিট আগে।” তখনও খিচুড়ি, ডিমভাজা, আলুভাজা খাওয়া হয়নি। সব কুকুরকে খাওয়ানো হল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেই রওনা হল পুরুলে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় দু-ঘন্টা পরে ওরা পুরুলে পৌছে গেল। পাশের বাড়িতে জেঠিমা থাকতেন। দুই ছেলে বুড়ো আর ভােম্বল। ভবদেব মারা গেছে আগে। ওরা মোট তিন এক বোন। বড়দা, বাবু, অংশুমান সবাই কাটোয়ার শানে যাওয়ার নিল। রিলিফদাকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে। রিলিফদা বলল, "আ বোলপুর এসেছি। রাস্তায় ঠিক দেখা করে নেব।" বাবা মারা যাওয়ার সময় সব ভাইরা একত্রে শাক পালন করেছেন। আবার জ্যাঠাইমা মারা যাওয়াতে সবাই এক হল। দাহকার্য সমাপ্ত করে সবাই গঙ্গাস্নান করার পর সাদা কাপড়। পড়শীরা যারা এসেছিলেন সবাই গঙ্গাস্নান করে নিলেন। বাবু, বাবন, মলয়, নিতাইদা, গোপালদা, প্রশান্ত  ও আরও অনেকে এসেছেন। এইভাবে কথাবার্তা চলছে। এদিকে দেবী, বড় বোন মামণি, ছােটো বােন পপন ও তাদের ছেলেমেয়েরা, জামাইরা সবাই এসেছে। ঘর মানেই তো মানুষের সমাহার। যে ঘরের মানুষ যত ভালো, সেই ঘর ততটাই সুন্দর। সবাই একসাথে এখন থাকবে দু-চারদিন। কারণ চলে গেলে আবার যে লেগে যাবে। শ্মশানে গিয়ে অনেকক্ষণ হরিনাম হয়েছিল। হরিনামের মল যে ছিল ভইা। কাটোয়া শ্মশান গঙ্গার প্রায় কাছাকাছি। তখন ইংলফটিক In tv না। কাঠের আগুনে বা কয়লার আগুনে দাহকার্য সমাপ্ত এ। ভবা পাগলার সেই বিখ্যাত গান মাইকেে বাজছে। ”ও আমার ব্যথা এভাবে চলে গেলেন তা নয়, যেতে হবে আমাদের আমরা শুধু আমার আমার করেই কাটিয়ে দিই সময়। বৈরাগ্য হলেই তো হবে না। এমন আবেগ আমাদের, মানুষদের করা হল হিংসা, লোভ পাপ করে সতিকারে মানুষ এখন। আর কিছু হতে না পারি এক এ কারও মাথা নেই। ফলে থেকে সবাই যে যার  চলে গেল। পুরুলেতে থাকল বাকি সংসার পরিজন। অংশুমান নিজের পরিবার। শহরে চলে এল। দেবী তাে ঘরে এসেই ঝুল ঝাড়া, ঝাট দেওয়া করতে লাগল। সৈকত একটা গল্পের বই নিয়ে বিছানায় পড়তে গেল। অংশুমান বাজারে গেল কিছু বাজার করে আনার জন্য। ঠিকঠাক করে রেডি হতে প্রায় বেলা দুটো বেজে গেল। দেবী বলল - "সৈকত আয় খাবি আয়। সৈকত ডাকল বাবাকে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেল। দুপুরে একটু শুয়ে সকলে বিশ্রাম করে নিল। বিকেলবেলায় দেখি ও অংশুমান হাঁটতে বেরােয় আর সৈকত খেলতে যায়। প্রতিবেশীরা সকলে খুব ভালােবাসে। তারা বলে, “আপনারা সকলে বেড়িয়ে যাবেন না। একজন ঘরে থাকবেন।"

​তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে... যে স্কুলে পড়তাম, দীর্ঘ কুড়িবছর পরে সেই স্কুলের সিঁড়িতে দেখলাম স্মৃতিগুলো থমকে আছে অতীতের থাম ধরে। আমার কাঁচাপাকা চুল সহসা কালো হয়ে ফুটে উঠল। কি করি, কোনটা আগে দেখি পড়িমড়ি করে ছুটলাম রসায়নাগারে। এখানে লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে গেছে, আমরা সকলে হাসছি, এমনকি শিক্ষকমহাশয় পর্যন্ত হাসছেন। তারপর, গ্রন্থাগারের দরজা খুলে মৌন হলাম। সারি সারি বই সাজানো, আব্দুল স্যার গম্ভীর হয়ে পড়ছেন। মায়ামাখানো অপূর্ব দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ঘন্টা পড়তেই চমকে দেখি কেষ্টদা বলছেন, কেমন আছিস বাছা। অনেকদিন পরে এলি। এতদিন কি করছিলি, তোর নাম মনে পড়ে না তবে মুখটা ভুলিনি। আসবি প্রতিবার স্কুলে প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে 'ফিরে দেখা 'হয়। 

আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। আমার ক্লাসের বন্ধুরা ক্লাসে ছোটাছুটি করছে টিফিনের সময়ে। তারপর ভূগোল শিক্ষক মহিমবাবুর ক্লাস। দেখে দেখে পড়া বলা, আড়ালে গল্পের বই পড়া। আড়াল করতাম স্টিলের বাক্স দিয়ে। তখন আমরা ব্যাগের বদলে স্টিলের বাক্স ব্যবহার করতাম। আবার ঘন্টার ঢং শব্দে চমকে উঠি। ফিরে আসি বাস্তবের মাটিতে। সেই বটগাছতলা, সেই স্কুল আছে। শুধু নেই আমার পুরোনো শিক্ষকমহাশয়রা। চাকরির নিয়মে তারা প্রাক্তন হয়েছেন। তবু এই স্কুলের ইঁট, কাঠ, পাথর কত চেনা কত আপন। পুরোনো স্মৃতির মোড়কে, নব নব সুরে আমি আপ্লুত।

লিলুয়ার পটুয়াপাড়ায় আমরা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতাম বাবার চাকরিসূত্রে। ভাড়া বাড়ির সামনে একটা কুলগাছ ছিল। টালির চাল। তখন চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধ্যে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই। কিন্তু বড়দা গ্রামের বাড়িতে কাকাবাবুর কাছে থাকতেন। বাবার কাছে থাকতাম আমরা তিনভাই। বিশ্বকর্মা পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল। তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড়জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম। 

সৈকত তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য। বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলোকে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘ পনেরো  কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।

সৈকত বলল, স্যার তিন’ কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল, আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন, তাহলে দেখ,  এই একশো কিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি? সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়ে গেল, অনুভূতি বা‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না! এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল, অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে। স্যার বললেন, হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার, সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার। আমরা অবাক হয়ে হাসছি। হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাষ্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য। তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেড মাষ্টারমশাই ও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো। এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা। তারপর দশ মিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি। অমর বললো, স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি...

পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই। জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া। এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আর একটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো  দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার। আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় বলে মনে হয় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়িগুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস  করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু।  তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে। বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়। দুঃখ শেষে আনন্দ। আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসার নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয়। তারপর যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন কাকাবাবু মরে গেলেন অকালে। বাবা হতাশ হয়ে পড়লেন। ভাই অন্ত প্রাণ। বাবা বললেন, আর লিলুয়ায় থাকব না। গ্রামে গিয়ে জমিজমা দেখভাল করব। চাষ করব। বাবারা দুই ভাই দুই বোন। পিসিদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। তারপর চলে এলাম গ্রামে। গ্রামে এসে নতুন পরিবেশে মিশতে সময় লাগল। কিন্তু টাইম ইস দ্য বেষ্ট হিলার। সময়ের প্রলেপে খাপ খাইয়ে নিলাম নিজেকে। তারপর অজয়ের বন্যায় মাটির বাড়ি ভেঙ্গে গেল। ভেসে যাচ্ছিলাম বন্যার জলে। চিৎকার করলাম, আমাকে বাঁচাও... যতবার  আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে। সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসা র আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারীরূপী দেবির রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জাভূষণ। পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীন ভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক দুর্বল মানসিকতায়।

বিল্বেশ্বর স্কুলের হেড টিচার অম্বুজাক্ষবাবু বলতেন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ, ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে, বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো। ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো, আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো, কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো, একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। তারপর বিয়ে হল বন্ধু রমেশের। প্রায় কুড়ি বছর পরে ২০২০ সালে করোনা রোগ এল বিশ্বজুড়ে। রমেশের ছেলের জ্বর হল। কোনমতেই ছাড়ে না। ছেলে চোদ্দদিন পরে বলে, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল বাবা। টোল ফ্রি নাম্বারে ফোন কর। তোমাকে যেতে হবে না। রমেশ বলল, তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে যদি করোনা ভাইরাস আ্যাটাক করে আমি হাসপাতালে পাঠাব না। আইসোলেশনে রাখার পরে তুই যদি আর ঘরে না ফিরিস।

-তাহলে কি হবে। আমি একা মরে যাব। আর হাসপাতালে না পাঠালে তুমি আর মাও মরে যাবে। আমার শরীরে অসুবিধা হচ্ছে। তুমি আমাকে হাসপাতালে পাঠাও।

- তা হোক শরীর খারাপ হলে কাউকে বলার দরকার নেই। ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাবি।

- না বাবা। তা হয় না। আমি যদি পজিটিভ হই আমাকে হাসপাতালে দেওয়াই ভাল।

বাবা ভাবেন ছেলেটা সমাজের মুখ তাকিয়ে ঠিক বলছে। সমাজে এ রোগ ছড়িয়ে গেলে আরও অনেক লোক মরে যাবে। কিন্তু ছেলেটা তো বাবা হয় নি। ও কি করে জানবে বাবার দৃষ্টিকোণ। আমি কি ওর মায়ের অন্তর দেখতে পাচ্ছি। মেয়েদের বুক ফাটে মুখ ফোটে না। ছেলে হারাবার ভয়ে বা স্বামীকে হারাবার ভয়ে সে করোনা রোগের নাম করে না।

ওর মা বলে - বড্ড অপয়া রোগ। একজনকে গ্রাস করলে সারা বলয় গিলতে চায়।

বাবা ভাবেন - এখনও এই উন্নত যুগে মানুষ কত অসহায়। মিথ্যে ক্ষমতা আর টাকার বড়াই। কোনো কিছুই মৃত্যুকে আটকাতে পারে না। ছেলে আইসোলেশন ক্যাম্পে চলে গেলো। করোনা পজিটিভ। চিকিৎসায় কোন ফল হলো না। 

ছেলেটা চলে গেল...রমেশ আর তার বউ কেমন যেন হয়ে গেল। কারও সাথে আর কথা বলে না। তারপর পৃথিবীর সব রোগ সেরে গেল দুমাস পরে। সংসার সহজভাবে চলতে থাকল। সে ত থামতে জানে না।আমি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইন পড়তে ভর্তি হলাম। বড়দা বাবার মত ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন চাকরিসূত্রেই। লিলুয়ায় বড়দার বাসায় থাকতাম। ফিরে ফিরে দেখতাম ছোটবেলার পুকুরটাকে। বন্ধুরা সব বড় হয়ে গেছে। কেউ আর পাত্তা দেয় না। সেই পাই স্যার, সৈকত, বিশ্বকর্মা

পুজো আমার মনে বিষাদের বাজনা বাজায়। পরাণদার বাড়ির সামনে মিষ্টির দোকানে গেলাম।

সেখানে পান্তুয়ার দোকানের বদলে মোমোর দোকান দিয়েছে পরাণদার ছেলে। পরাণদা বুড়ো হয়েছেন এখন। আমাকে দেখে বললেন -

কে তুমি চিনতে পারলাম না তো। আমি পরিচয় দিলে তিনি আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন আমাকে -

পাই স্যার নেই তো কি হয়েছে, আমি তোমাকে পান্তুয়া খাওয়াব। আমি বললাম, 

না তুমি এখন বুড়ো হয়েছ। আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। পরাণদাকে প্রাণভরা ভালবাসা জানিয়ে চোখে জল নিয়ে বাইরে এলাম। এখনকার ছেলেরা কেউ আমাকে চেনে না। পরের দিন বিকেলবেলা পরাণদা তার বাড়িতে আমাকে ডাকলেন। থালায় চারটে পান্তুয়া। খেলাম তৃপ্তি করে। শেষে তিনি কাগজের ঠোঙায় অনেকগুলো পান্তুয়া হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন

- এটা তুমি বাসায় গিয়ে খেও। আমার আনন্দ হবে। ইতস্তত হয়ে আমি ঠোঙা হাতে ধরে একশ টাকার নোট বের করলাম। পরাণদা বললেন 

- ভালবাসায় টাকাপয়সার স্থান নেই। আমার এখন টাকার অভাব নেই। তোমাকে পান্তুয়া খাইয়ে আমি যে কতটা আনন্দ পেলাম তা আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না। পরাণদার এই কথা শুনে আমি আর কথা বলতে পারলাম না। গলা ধরা গলায় বললাম, আসছি। 

এখনও পটুয়াপাড়ায় আমি সময় পেলেই চলে যাই পুকুরের পাড়ে। বসে থাকি শটিবনের ধারে। জঙ্গলের এক বুনো গন্ধে পরাণদার কথা মনে পড়ে। এই পুকুরে খেলার সঙ্গিদের মনে পড়ে। বুকটা চিন চিন করে ওঠে। মন উদাস হয়। অতিতের এই পুকুর পাড়ে আমার বয়স, আমার স্মৃতি থমকে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিরন্তন খেলায়। আমি পুকুড়ের পাড়ে বসে আমার ছোটবেলার খেলা খেলি আপনমনে হাতে একটা ময়লপড়া ঝোলা হাতে শিলকোটানি হেঁকে চলত, শিল কোটাবে গো শিল, শিল কোটাও গো শিল...

বাড়ির বৌ-ঝিরা ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে আসত বাইরে। বাইরে এসে বলত, এসো গো আমার দ্বারে আমার শিল একবার কোটাতে হবে। শিলকোটানি লোকটা ময়লা ঝোলা থেকে বের করত ছেনি, হাতুড়ি। তারপর পাথরের শিলের উপর নক্সা ফুটিয়ে তুলতো ঠকঠক শব্দে। আশেপাশে কচিকাঁচা ছাড়াও প্রতিবেশিদের বৌরা দেখত আগ্রগভরে এই শিলকোটা। কিভাবে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে নক্সা হাত ও হাতুড়ির যুগলবন্দীতে।

তারপর একজনের দেখে প্রতিবেশিদের দশজন কুটিয়ে নিত শিল। পাশের বাড়ির অনিতা বললো, আমাদের বাঁটনা বাঁটা শিলটাও কেমন সমান হয়ে গেছে। ফুটো ফুটো না থাকলে মশলা ভালো করে বাঁটা যায় না।

শিলকোটানি লোকটা বলে, নিয়ে এসো গো মা। কুটে দিই শিলটা। আবার কবে আসব জানা নাই।

তারপর দশ বারোটা শিল কুটে রোজগার করে শিলকোটানি চলে আসত তার বাড়ি। ছেনি, হাতুড়ির সব সময় ঠিক রাখত। অনেকে পাথরের শিল মাথায় করে নিয়ে আসত তার কাছে। কত যত্নে সে শিল কুটতো। তখন তার শিল্পীহৃদয় নিয়ে যেত কল্পনার জগতে। সেখানে রঙ আর রঙীন মেঘের আনাগোনা। সেই মেঘের আশীর্বাদ পেয়ে সে বোধহয় এই কাজ পেয়েছে। সে এই কাজ পেয়ে খুব খুশি। 

অবসর সময়ে বাগানে গাছ লাগাতেন। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তেন শিকোটানোর কাজে। এখন আর শিলকোটানোর যুগ নেই। মিক্সির চাপে পেশাই হয়ে গেছে প্রচলিত এই পেশা। সেই শিলকোটানোর লোকটির বাড়িতে এখন নাতিদের মিক্সির বাজার। হারিয়ে গেছে পুরোনো সেই শিলের কথা। 

আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ  ছিল তারা হাবু গান গাইতো সাথে লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করত।  এইসব আঘাত  দেখে সহ্য করতে না পেরে বেশি টাকা দিয়ে তাদের এই খেলা দেখাতে বারণ করত। এইভাবে হাবুগান চলত কিন্তু তার প্রচলন এখনো দু-এক জায়গায় রয়ে গেছে। হাবু গানে প্রচলিত গানগুলো ছাড়াও কাউকে ব্যঙ্গ করে বা কোন সমাজের অত্যাচারকে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হতো।

বীরভূম থেকে বহুরূপী সম্প্রদায় এখানে এসে অন্যরকম সাজে অভিনয় করে দেখাতো বহুরূপী রাম সীতা হনুমান এইভাবে তারা বিভিন্ন রকম সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দিত এবং তার বদলে টাকা-পয়সা উপার্জন করে তাদের সংসার চলত। বহুরূপী সম্প্রদায় এখনো অনেক জায়গায় আছে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝে দেখা যায় হনুমান সেজে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ রাবণ সেজে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় ভান করে বা মজার ছড়া বলে না কিছু উপার্জন করছে এবং এই উপার্জিত টাকা পয়সা তাদের জীবন নির্বাহ হয়। প্রচণ্ড গরমে তারা সারা দেহে রং মেখে এইভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন অর্থ উপার্জন করে এবং দিন চলে গেলে তখন তাদের আর কাজ থাকেনা তখন তারা অন্য কাজ করে। 

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ভুলো লাগা ব্রাহ্মণ এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে তারা ছড়ার মত করে বলতো না বিভিন্ন গ্রামের নাম করত এবং বলতো যেসব গ্রাম ঘুরে এসে শেষে আপনাদের বাড়ি এলাম। হয়তো গ্রামগুলো আশপাশের গ্রামগুলোর নাম বলতো, মেলে পোশলা কোপা ভুলকুরি হয়ে তারপর মুলগ্রাম শিবলুন তাড়াতাড়ি হয়ে তারপর আমাদের গ্রামে এসেছে। দিক দিয়ে ভুলো লাগা ভূত নাকি তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেষে এইগ্রামে এনেছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে রাস্তা ধরে প্রচন্ড গরমে মালিকের বাড়িতে এলাম বাড়িতে এসে দাঁড়াতেই কথা বলতেন একথা শুনে শিশু থেকে বৃদ্ধ এবং তাকে বসিয়ে হয়তো তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চলতো সংসার চলত।

তারপর এক ধরনের ব্যবসাদার ছিল তারাও সরু লিকলিকে বাসের উপর সেই বোম্বে মিঠাই মিঠাই নানান রঙের মিঠাছড়ি এনে বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম পুতুল তৈরি করে দিতে হতো বলতো আমাকে সাপ তৈরি করেছে মিঠাই মিঠাই দিয়ে তৈরি করে দিত আর আমাকে পুতুল বানিয়ে দাও বিভিন্ন নতুন নতুন ছোটদের মনভোলানো আর দেখা যায় না এর অর্থ উপার্জন করত। এই বোম্বাই লাঠি বানানোর জন্য প্রথমে নিজেকে ফুটিয়ে ফুটিয়ে হাজারের মতো তৈরি করা হতো আটা লেগে গেলে বিভিন্ন রঙে রঙিন করা হলুদ নীল সবুজের জরিনা জরিনা হতো প্রথমে তারপর যদি না হতো এবং তাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে রাখো ধুলোবালি যাতে না পড়ে তারপর শিশুদের চাহিদামত পুতুল তৈরি করা হতো।

তাছাড়া একটা টিনের বাক্স নিয়ে শনপাপড়ি বিক্রেতা শোনপাপড়ি বিক্রি করত। তারা একটা চাকা ঘোরাতো টিনের বাক্সের মধ্যে থাকা এবং তাতে চিনির জল বিভিন্ন রং মিশিয়ে চাকা ঘুরিয়ে দিলে মাকড়সার জালের মত মিঠাই তৈরি হত। সেটাকে এক জায়গায় করে শোনপাপড়ি বিক্রি হতো। এক টাকায় হয়তো একটা দেখা গেল একটা বড় ফুটবলের মত শোনপাপড়ি। অনেকে এর নাম দিয়েছিল দিল্লিকা লাড্ডু। এখনো অনেক জায়গায় দেখা যায় ঘটিগরম বলে একটা জিনিস যেটা ভুজিয়া জাতীয় জিনিস দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সেই হাতেধরা জায়গায় থাকে একটা উনুুন এবং  সেই উনুনে গরম করে পিঁয়াজ ও নানারকম মশলা মিশিয়ে ঘটিগরম তৈরি করা হয়। 

নিজের বাড়ি থেকে অশান্তির চাপে দীনেশ চলে এল শহরে। সে বিবাহিত। ঘর নেই, চাকরি নেই অথচ একটা সন্তান আছে বৌ আছে। বউকে কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিল। নিজে একা শহরে থেকে ছাত্র পড়ানো শুরু করল। নিজেই রান্নাবান্না করে। বাসা বাড়িটা ট্রেনের কামরার মত। সেখানে একটা জলের বোতল আর একটা স্টোভ। হোটেলে খাওয়াদাওয়া করে। আর অবসরে চা খেতে মন হলে স্টোভে চা করে খায়। অন্য ভাড়াটে যারা তারা বলে - দীনেশ তুমি তো ট্রেনের যাত্রী। একটা বোতলে জল থাকে আর একটা প্যান্ট জামা পরে থাক সবসময়। দীনেশ হাসে আর মনে মনে ভাবে, আমরা সকলেই কিছু সময়ের জন্য ট্রেনের যাত্রী। স্টেশন এলেই নেমে যেতে হবে। আমরা দুদিনের সহযাত্রী। অতএব তোমার কোটি টাকা থাকলেও সব ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে স্থায়ী ঠিকানায়।

এইভাবে দীনেশের দিন যায়। এখন ছাত্র নেই। তাই ভাড়া ঘর ছেড়ে দীনেশ চলে গেল গঙ্গার ধারে একটা আশ্রমে। সাইকেলে সংসারের সমস্ত জিনিস নিয়ে চলে এল আশ্রমের ঘরে। মশারি টাঙিয়ে রাতে শোয় সে। গঙ্গার ধারে শবদেহ দাহ হয়। দীনেশ দেখে কি করে একটা মানুষ পুড়ে শেষ হয়ে যায়। আশ্রমে টাকা পয়সা লাগে না। আশ্রমের প্রধান দীনেশকে ভালবাসেন। খাওয়াদাওয়া ফ্রিতে হয়ে যায়। শুধু আশ্রমের দরজা ভোরবেলা খুলতে হয়। তারপর মন্দিরের বারান্দা জল দিয়ে ধুতে হয়। তারপর সারাদিন অখন্ড অবসর। আশ্রমের প্রধান বলেন, যা, মায়ের কাছে বোস। একটু জপ কর। তোর দুর্দিন কেটে যাবে। দীনেশ তাই করে। তারও বিশ্বাস আছে একদিন নিশ্চয় দুঃখের অবসান ঘটবে।

তারপর দীনেশ আশ্রম থেকে ফিরে আবার ঘর ভাড়া নিল। নতুন সেশন। ছাত্রছাত্রী জুটল অনেক। নব উদ্যমে শুরু করল পড়ানো। এক ছাত্রী একদিন বলল - দাদা, বৌদিকে কাছে নিয়ে এস। দূরে থাকলে মায়া কেটে যাবে। দীনেশ বলল,এলে কষ্ট পাবে। ছেলেটা আছে। আর একজন বড় ছাত্র বলল, আপনি কষ্ট করছেন ওরাও করবে। একসঙ্গে থাকবেন।

দীনেশ বউ বাচ্চা নিয়ে এল বাসা বাড়িতে। এখন রোজগার ভাল। কিছু টাকা জমেছে। বউ বলল, পরপর বাসা পাল্টে বিরক্ত হয়ে গেলাম দুবছরে। আমার গহনা নাও। বিক্রি করে আর কিছু টাকা লাগিয়ে একটা জায়গা কিনে বাড়ি কর নিজের। দীনেশ খোঁজ করল জায়গার। পেয়ে গেল দুকাঠা জায়গা। জায়গা কিনে একটা ঘর বারেন্দা করল। তারপর বাঁশের বেড়া দিল জায়গা জুড়ে। পরিবার নিয়ে মাঝমাঠে বসবাস শুরু করল। তবু শান্তি। নিজের বাড়ি তো। আশ্রমে থেকে মায়ের ইচ্ছায় বাড়ি হল নিজের। ছাত্র পড়ানো শুরু করল চুটিয়ে। বেশ চলতে লাগল পানসি নৌকো। 

মাঝমাঠ। চারিদিকে ধানচাষ হয়েছে। বর্ষাকাল। চন্দ্রবোড়া, কেউটে, কালাচ, গোখরো কত রকমের সাপ। ঘরে ঢুকে পড়েছে একদিন গোখরো সাপ। ঘরে আছে দীনেশ। বউকে ডেকে তুলে বাইরে আসে তারা। ভেতরে সাপের দখলাতি। ঘরে ঢুকবে তার উপায় নেই। ফণা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোখরো। দীনেশ ভাবে, প্রবাদ আছে, বাড়ি গাড়ি আর নারী, দেখেশুনে নিতে হয়। কিন্তু দেখতে গেলে টাকার এলেম চাই। গাড়ি কিনতে গিয়ে খুচরো গুণলে হবে না। নোট চাই নোট। দীনেশ পাশের গ্রাম থেকে সাপ ধরার লোক ডেকে আনল। কিন্তু সে খুব ভীতু। সাপ দেখে আর ধরতে পারছে না। শেষে দীনেশ তার হাত থেকে বড় সাঁড়াশি নিয়ে নিজেই ধরল সাপটা। তারপর জঙ্গলে ছেড়ে দিল।

আর একদিন রাতে চোর এসে কল খুলে নিয়ে চলে গেলো। দীনেশের ইনকাম কম। আবার কি করে জলের কল বসাবে চিন্তা করতে লাগল। কয়েকমাস দূর থেকে জল আনতে হত। সে কি কষ্ট। দূর থেকে জল এনে যে খেয়েছে সেই জানে।

বাঁশের বেড়া। চারদিক খোলা। কোন বাড়ি নেই। শুধু মাঠে চাষিরা এলে একটু আধটু কথা হয়। চাষিরা তাদের কথা বলে। খরচ করে, পরিশ্রম করে চাষ করেও ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না। গরীব আরও গরীব হয়। ধনীর প্রাসাদ ভরে ওঠে প্রাচুর্যে, গরীবের রক্তের বিনিময়ে। এ কেমন নীতি চাষিরা বোঝে না। তারা মুখ বুজে আজীবন পরিশ্রম করতে করতে একদিন বুড়ো হয়ে যায়। অবস্থার পরিবর্তন হয় না। সমস্ত রক্ত জমা হয় মাথায়। দেশের সুস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। 

সতেরো বছর কেটে যায়। একই অবস্থা সেই চাষ। কোন বাড়িঘর হয় না। দু-একটা বাড়িঘর হয়তো দূরে দূরে দেখা যায়। কিন্তু রাস্তা নেই ঘাট নেই। ঘরে সাপ ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় দিনের পর দিন ভগবানের সুবিচারের আশায় পড়ে থাকে দীনেশ।

দীনেশের ছেলে দিনেন গ্রাজুয়েট হয়। করোনার অতিমারিতে পৃথিবী অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীনেশের বউ ঝুমা বলে - এবার এ বাড়ি বিক্রি করে গ্রামে ফিরে যাই চলো। দীনেশ বাড়ি কেনাবেচার দালালদের বলে বাড়ি বিক্রির কথা। শেষে কুড়ি লাখ টাকায় বিক্রি হয় দীনেশের বাড়ি।

দীনেশ ভাবে, গ্রামে বসে থাকলে সে কুড়ি লাখ টাকার মালিক কোনোদিন হতে পারত না। ঈশ্বরের ইচ্ছে হয় তো তাই। তাই এত কষ্টের মধ্যে থেকে দীনেশের বাস মাঝমাঠে। আশ্রমের কথা মনে পড়ে দীনেশের। সেখানে সে মাকে মনের কথা বলেছিল বারে বারে।

দীনেশ এত কষ্টের ফাঁকে লিখে যেত নিজের জীবনকাহিনী। অনেক কথা সঞ্চিত হয়ে বুক ফেটে বেরিয়ে আসত কথামালা। কথামালাগুলো জড়ো হয়ে সৃষ্টি হয় এক বৃহৎ উপন্যাস। 

এখন লকডাউনের সময় দীনেশ বাইরে বেরোতে পারে না। লেখালেখির অখন্ড অবসর। সঠিকভাবে লকডাউন না পালনের ফলে দিন দিন বাড়াতে হচ্ছে বারবার। বিশ্বব্যাপী এই কোভিদ নাইন-টেনের আক্রমণে মানুষ এখন দিশেহারা। কি করে করো না কে রুখে দেওয়া যায় তার জন্য বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা শুরু করেছেন। কিন্তু সময় তো লাগবে মিনিমাম ১২ থেকে ১৪ মাস সেই সময়টা অন্তত লকডাউন এর মাধ্যমে মানুষকে ঘরে বেঁচে থাকতে হবে আর যত সুন্দর ভাবে লালন পালন করা হবে ততো তাড়াতাড়ি আমরাই করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে পারবো। কিন্তু কিছু না ছাড় লোক আছে তারা কোনমতেই বারণ শোনে না। ইতালি এবং আমেরিকায় সঠিকভাবে লালন পালন না করার জন্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে থেকে প্রথমে শুরু হয় সেই করোনা রোগ ছড়ানোর কারণ প্রথম থেকেই ধীরে ধীরে সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। সঠিকভাবে লকডাউন পালন করলে এই রোগকে সহজেই আটকানো যেত কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঠিকমত পালন না করা হলে এর ব্যপ্তি চারিদিকে বেড়ে গেল। তারপর সরকার থেকে স্টেপ নেওয়া হল পুলিশি হস্তক্ষেপে হয়তো কিছুটা কমলেও কিন্তু তবুও লুকিয়ে জোরে জঙ্গলের মধ্যে মশারি টাঙিয়ে কেউ তাস খেলে কেউ আড়ালে চার-পাঁচজন গিয়ে গাঁজা টানে এইভাবে তারা সংক্রমিত হতে লাগল এবং নিজের সংক্রমিত হয়ে অন্যকে সংক্রমিত করল। এরূপ বড্ড ছোঁয়াচে একজনের হলেও সমাজের প্রত্যেকের হয়ে যাবে যে আসবে তার সংস্পর্শে আসবে প্রত্যেকের হবে তাই প্রথমেই এই রোগের নিয়ম হচ্ছে হাঁচি-কাশিতে ঢেকে রাখতে হবে এবং সেই ঢেকে রাখা না একা একা ঢাকনাওয়ালা বালতিতে ফেলতে হবে এবং কোনমতেই খোলা জায়গায় হাঁচি-কাশি করা যাবে না।। বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে দু ঘন্টা অন্তর অন্তর অথবা করতে হবে নিজের হাতকে এবং সরকার থেকে স্প্রে করে যে পাড়ায় যে কাজে নেমেছে তাও খুব প্রশংসার যোগ্য। মোটকথা প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে এবং নিজে নিজে সচেতন হলেই তো প্রজ্ঞা অনেকটা প্রশমিত করা যায় কিন্তু সচেতনতা যতদিন না পারছে এই রোগ বাড়তেই থাকবে এবং মৃত্যুহারও বাড়তে থাকবে। মহারাষ্ট্র মুম্বাই কেরালা থেকে প্রচুর পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় প্রবেশ করছে বা অন্যান্য প্রদেশের প্রবেশ করছে এবং তাদের মধ্যে কিছু যৌন সংক্রমিত তাদের প্রথমে সে হাসপাতালে দেখা করতে হচ্ছে এবং হাসপাতালে টেস্ট করে তাদের পেপার দিলেই তবে তারা বাড়ি আসতে পারছে। পাড়ায় এসে যদি ধরা পড়ছে তখন রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয় থাকে যাচ্ছে তাই বারবার সরকার থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে পরিযায়ী যারা যারা বাইরে থেকে আসবে পরিযায়ী শ্রমিক তারা যেন প্রথমেই হাসপাতালে দেখা করে এবং হাসপাতালে নিজেদের পরীক্ষা করিয়ে তারপর বাড়িতে ঢুকে এতে কোনো বিপদ থাকবে না সুখে থাকতে পারবে বাড়িতে। লকডাউন এর ফলেই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগের সীমা নেই। তারা কতদিন বাড়ি আসতে পারেনি। ফুটপাতে, রাস্তায্‌ পুকুরের পাড়ে তারা সময় কাটিয়েছে এবং কেউ পায়ে হেঁটে কাউকে কাঁধে করে তারা মাইলের পর মাইল হেঁটে গেছে। কিন্তু সরকারের তো কিছু করার নেই এখন তো লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ট্রেন বাস সব বন্ধ আবার যদি ঘোষণা করা হয় তিনবার। সচল হবে তাহলে দেখা যাবে গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয় বেড়ে যাচ্ছে উভয় সংকটের মধ্যে তবু কিছু ট্রেন চালু করা হলো পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য। সব প্রদেশেই শ্রমিকরা নিজের বাড়ি যেতে পারছে সরকার থেকে ট্রেন চালানোর ফলে। প্রথমে গিয়ে তারা হাসপাতালে দেখা করে নিজেদের পরীক্ষা করিয়ে তারপর সঠিক সিদ্ধান্তে তারা বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে এবং বাড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে। মানুষের সভ্য সমাজে চলাফেরা এখন অন্যরকম হয়ে গেল। মুখে মাক্স হাতে গ্লাভস আর জুতো পড়ে বাইরে বেরোতে হবে। সেই জামা প্যান্টের মত নিয়মিত পোশাক হয়ে গেল। তিন মাস পরে কিছু কিছু অফিস-আদালত খোলা হয়েছে থার্টি পার্সেন্ট লোক হয়তো কাজে যোগ দিচ্ছে। এবার ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে পৃথিবী কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যথেষ্ট। একটু অসাবধান হলেই কিন্তু বিপদ ওৎ পেতে। এখনো স্কুল খোলা হয়নি। স্কুলের ছোট ছোট কচিকাঁচারা যাতে রোগে আক্রান্ত না হয় সেই জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত। ডাক্তার নার্স আর পুলিশরা নিজের জীবন বিপন্ন করে জনগনের সেবায় দিনরাত বাইরে কাজ করছে। সঠিক সাবধানতা অবলম্বন করে তারা মানুষ বাঁচানোর জন্য নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে নিজেদের সংসার ছেড়ে বাইরে আছে। দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস তাদের কত কষ্ট। তারা শান্তিতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারছে না।  

ছোটো থেকেই পড়তে ভালো লাগতো পড়ার বাইরের বই। বাবা, বড়দা বই এনে দিতেন প্রচুর।সংবাদপত্র আসতো নিয়মিত বাড়িতে। পড়ার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিলো। ফলে লেখার ইচ্ছে হলো একদিন। স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম লেখা। আমার প্রথম উপন্যাস ১৯৮৪ সালে লেখা। নামটা হলো, মিলনের পথে। জীবনের অনুভবের প্রয়োজন আছে নিশ্চয় লেখার জন্য। যে জীবন ব্যর্থ হয়নি, কষ্ট পায় নি, অভাব বোঝে নি সে জীবন তো মরুভূমি। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ তো বলেই গিয়েছেন এ কথা। তাই সকল ব্যথার অনুভূতি  থেকে উৎসারিত হয় লেখার আলো।

বাংলা ভাষাকে উন্নত করার জন্য, সর্বপ্রথম এই ভাষাকে জানতে হবে সঠিকভাবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে তার মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। বাকিটা তাদের উপরেই ন্যস্ত থাক।

ইদানিং হৃদকথন, বাংলা ক্যানভাস, সংবাদ পত্রিকা, তথ্যকেন্দ্র, আরম্ভ, শব্দসাঁকো, অক্ষরসংলাপ, আলো, কাটোয়ার কথা, ধুলামন্দির, কৃতি এখন, ইসক্রা, কবি ও কবিতা, আমাদের কফি হাউস ও আরও বহু পত্র পত্রিকায় লিখি। বাংলা ক্যানভাসে শারদীয়া সংখ্যায় এবার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। নামটি হলো, মধু বাঁশির দেশ।

ভবিষ্যতে ফেসবুকের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে বলেই মনে করি। ওয়েবজিনই ম্যাগাজিন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে পাঠকের কাছে। কবিতা  ভালো লিখতে গেলে পড়াশুনার প্রয়োজন আছে। জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগান, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার বই ও আরও আধুনিক সব কবির কবিতা পড়া উচিত। একটা ভালো কবিতা পড়লে ভালো কবিতা লেখা যায়।

তবে একটা কথা বলি, কবিতা কিন্তু অনুভবের উপর নির্ভর করে। পড়াশোনা জানেন না এমন কবির সংখ্যা কম নয়। বলে কয়ে প্রেম হয় না আর চেষ্টা করে কবিতা হয় না। এটা প্রতিভার উপর নির্ভরশীল নয় শুধু। অনুভূতির মাধ্যমে কবিতা হয়ে যায় কখনও সখনও। কবির সংখ্যা কম। কবিতা লেখক বেশি।

লেখকের জীবনাভূতি অনন্য হওয়া চাই। পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের সঙ্গে পড়াশোনা করতে হয় ভালোবেসে। দায়সারা হলে ভালো লেখক হওয়া যায় না।

বর্তমানে আমি উপন্যাস লিখছি। দুটি উপন্যাস লেখার অনুরোধ এসেছে। এছাড়া গল্প, কবিতাও লিখছি সময় হলে। ভালো লেখার সংজ্ঞা বলা কঠিন। বাজাতে বাজাতে বায়েন, গাইতে গাইতে গায়েন। লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকলেই হবে। ফেসবুকের লেখাই তো আধুনিক যুব সমাজ পড়ছে। তবে সব লেখা তো সফল মানের হয় না। এখন ফেসবুকে লিখে কিছু লাইক পেলেই কবি মনে করে নিজেকে। কিন্তু এত সহজ নয়। তাই লেখা চিনতে হবে। বেছে পড়তে হবে। সারাজীবন দশভূজার আদরে বাঁচি। প্রথম দশভূজা আমাদের মা। ছোট থেকে বড় করে সংসার গড়ে তুলে দেন আর এক দশভূজার হাতে। তিনি আমাদের সংসারের গৃহিণী। 

ঘরে আমার ঝগড়া করার সাথী সকাল থেকে ঘটি বাটি আর রান্নাঘরের ঝুলে তার বকম বকম চলতেই থাকে। একা সব কষ্ট বাঁধে হৃদয়ে, ছেলে আর স্বামীকে পালঙ্কে বসায়। বসে বসে তারা  দেখে কেমন করে চাঁদ ওঠে মাঝে অমাবস্যায় ভরে যায় দুপুর, তারা খসে পরে দুঃখের বাজার থেকে ঝুলিয়ে আনে আশার ঝুলি সব কাজ দশভূজার হাতে ভিড় করে আসে একে একে তারা ফোটে যখন, তখনও রান্নাঘরে খাওয়ার জোগাড়ে ব্যস্ত ঝগরাটে বউটা বাপের বাড়ি গেলে ঘরে আঁধার ঘনায়। আশার তারাগুলো ফুলের মত ঝরে পড়ে লেখার কথা মাথায় আসে না। স্বার্থপর এক অসহায় লোক, অধির হয়ে শুনি, গতকাল তার বলা অমৃত বাণী, আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আশার আলো দেখায়। ঝগড়াটে রোগা বউটা কষ্টগুলো জমিয়ে রাখে মনের সিন্দুকে। এখন দুজনে একটা জাহাজবাড়ি কিনেছি। কল্পনার জলে তরতরিয়ে ভাসে জাহাজ ঝগরাটে বউটা বলে, আমি গভীরতা মাপি তুমি আকাশ হও, আমি জাহাজের গতি মন্থর করি তুমি জীবনে আলো আনো অনেক প্রাণে আমরা কি জানি সমস্ত মনজুড়ে সারাজীবন আলো হয়ে থাকে আমাদের দুই দশভূজার আশীর্বাদ। 

সাত

রাজু বিয়ে করার পর ভাবলো এবার তো চাকরি-বাকরি করতে হবে আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সেখানে গুরুদেব আছে সে কোন মতেই বাড়ি ঢুকতে দেবে না মাকে বশ করে নিয়েছে। সে বিধবা মায়ের আর কোন উপায় নেই সে গুরুদেবের কথামতো ওঠাবসা করে। রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল তারা কেরালা যাবে। সেখানে গিয়ে প্রথমে তারা একটা ঘর ভাড়া করল। কিছু রান্নার সরঞ্জামাদি কিনল। একটা কাজ জুটিয়ে নিল রাজু। সোনার দোকানে। ভালোবাসায় চলে যাাচ্ছিলো তাদের জীবন। ধীরে ধীরে তারা সংসারের সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিল। সোনার দোকানের মালিক রাজুকে খুব ভালোবাসতো রাজুকাকা যে কোন পাখি ছিল না সে মন দিয়ে কাজ করতো। মালিকের সমস্ত কথাবার্তা শুনতো। যেন মালিক তাকে খুব ভালবাসত। এক্সট্রা টিফিনের পয়সা জমিয়ে রাখত শ্যামলীর জন্য। ছুটির দিনে শ্যামলীকে নিয়ে বাজার করতে যেত সেখানে এসে কিনে দিবো কাচের চুড়ি। কাচের চুড়ি পেয়ে  আনন্দ আর সোহাগ উথলে পড়ত  শ্যামলীর।রাজু বলল, আমি তো বেশি আয় করি না আমি তোমাকে সোনার গহনা দিতে পারব না শ্যামলী বলল, সোনার গহনা আমার প্রয়োজন নেই। এ কাচের চুড়ি আমার বেঁচে থাক সোহাগরূপে।

তারপর দুঃখ শোকে সবকিছু মিলিয়ে তারা বছর পাঁচেক কাটিয়ে দিল কিন্তু তারা কোন সন্তান এখনো পর্যন্ত নেয় নি। রাজু ভাবে বেশ কিছু পয়সা আয় করে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিচে জায়গা কিনে ঘর করে তারপর সন্তান নেবে। শ্যামলী বলে তাই হবে। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক মানুষের চিন্তাধারা সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো মিল নেই এখানেও তাই হল রাজু পড়ে গেল মহাবিপদে।

এক বিশাল যুদ্ধ বেধে গেল বিশ্বজুড়ে সে যুদ্ধ অস্ত্রের যুদ্ধ নয়। মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময় তার নাম নাকি করো না রাজু বলল এই করোনা ভাইরাস পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ মরে যাচ্ছে লাখে লাখে।

শ্যামলী বলল চলো আমরা আমাদের গ্রামে ফিরে যাই আমাদের গ্রামে ফিরে গেলে আমরা হয়তো এই রোগ থেকে রক্ষা পাবো। রাজু বলল আরো কিছুদিন থাকি দেখি পরিস্থিতি কি হয় ১২ এখন প্রধানমন্ত্রী ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে এখন তো যাওয়া যাবে না তাহলে কি করে কোন যানবাহন নেই কি করে যাবে স্বামী বলল আমরা  প্রয়োজনে হেঁটে যাবো।

রাজু আর শ্যামলী দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল কোন রকমে। তারা তাই সংবাদপত্রের সব খবর রাখে। তারা সংবাদপত্র পড়ে। আর বসে বসে ঘরে দিন কাটায়। রাজুকে এখন কাজ থেকে ছেড়ে দিয়েছে মালিক। ঘর ভাড়া দেওয়া খুব মুশকিল হয়ে যাবে। সামান্য কটা টাকা আছে সেই টাকা থেকে কিছু চাল-ডাল কিনে তারা ঘরে অপেক্ষায় বসে ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।

বাড়িওয়ালা দুর থেকে খবর নেন। বলেন, রাজু তুমি কি আর কাজে যাও না?

রাজু বলে,না মালিক আমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

এই মুহূর্তে আমাদের বাইরে বেরোনো উচিত নয় মালিক বলেন, তোমার চিন্তা নেই ঘর ভাড়া লাগবে না। ঘর ভাড়া তোমাদের দিতে হবে না তোমরা কোনরকম এখন গ্রামের বাড়ি চলে যাও।

শ্যামলী বলে কাকু আমাদের আর এক সপ্তাহ থাকতে দিন তারপর আমরা ঘর ছেড়ে চলে যাব।

রাজু এই এক সপ্তাহ সময়ে তার লকডাউন এর দিনলিপি লিখে রাখে তার জীবনের খাতায়। সে দিনলিপি লেখে দিনরাত। শ্যামলী তাকে উৎসাহ দেয়। আজ রাজু লেখে, করোনা আতঙ্কে ২০২০ সালের ২২ শে মার্চ রবিবার প্রথম লক ডাউন ঘোষণা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর কিছু সময় কেনাকাটি, বাজার করার পরে টানা একত্রিশে মার্চ অবধি টানা লকডাউন শুরু হয়ে গেল। বেশিরভাগ মানুষ সচেতন কিন্তু অনেকেই বাহাদুরি করে বাইরে যাচ্ছেন। চীনদেশ, ইতালি এরাও প্রথমে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে করোনা ভাইরাস কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। পুলিশ, প্রশাসন কড়া হয়েছেন। কিছু পাবলিক লাথখোড়। তার কিছুতেই নিয়ম মানতে চাইছে না। মুরগির মাংস কিনতে, মাছ কিনতে, মদ খেতে, জুয়া খেলতে বেরিয়ে পড়ছে বাড়ির বাইরে। সোম, মঙ্গল, বুধ পেরিয়ে গেল। এখনও লকডাউন চলছে। কতদিন চলবে কেউ জানে না। আজ একটা খবরের কাগজে পড়লাম বর্তমান পরিস্থিতি বাংলার। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আলাদা করে তৈরি করা হচ্ছে ‘‌করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র’‌। ৩ হাজার শয্যার করা হতে পারে এই চিকিৎসা কেন্দ্র। নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা আলাদা জায়গায় নয়, একই হাসপাতালে চিকিৎসা করা হবে। করোনা মোকাবিলায় নতুন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে রাজ্য সরকার। এখন সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, গোটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকেই করোনার চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে বিশেষভাবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে এদিন বিকেল পর্যন্ত লিখিত কোনও নির্দেশিকা আসেনি। নির্দেশিকা দ্রুত জারি হবে বলে স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর। সম্পূর্ণ একটি হাসপাতাল যদি শুধুমাত্র করোনা চিকিৎসার জন্য করার ভাবনা–চিন্তা সত্যিই হয় তাহলে রাজ্যে এটি নজিরবিহীন হবে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। সূত্রের খবর, সোমবার দুপুর থেকেই নতুন করে রোগী ভর্তি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল। এখন ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা কেন্দ্র। হাসপাতালের ৯ ‌তলার যে সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লক রয়েছে সেখানে দুটি তলা রাখা হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য। বাকি ৭টি তলায় করোনা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা করা হবে। নতুন হস্টেলও বর্তমানে ফাঁকা রয়েছে। এদিন মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে জরুরি বিভাগ ডাকা হয়। এই সপ্তাহেই সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে এই পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে বলে জানা গেছে। করোনা সংক্রান্ত সব ধরনের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কলকাতা মেডিক্যালের উপাধ্যক্ষ ডাঃ ইন্দ্রনীল বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘‌করোনা–আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন রোগীর সংখ্যা বাড়লে আমাদের চিকিৎসা দিতে হবে। তাই নতুন রোগী ভর্তি নেওয়া কমাতে হবে। না হলে করোনা–আক্রান্ত রোগীদের জায়গা দেওয়া মুশকিল হবে। আপাতত ৩০০ শয্যার সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। তবে শুধুমাত্র করোনা রোগীর চিকিৎসা হবে বলে গোটা হাসপাতাল খালি করতে হবে এরকম কোনও লিখিত নির্দেশনামা আমাদের কাছে এখনও আসেনি। যদি নির্দেশ আসে তখন সেইভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’‌  এখন ২,২০০টি শয্যা রয়েছে মেডিক্যালে। সেটি বাড়িয়ে ৩,০০০ করার পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী সব হাসপাতালেই পেডিয়াট্রিক, চেস্ট, কমিউনিটি ও জেনারেল মেডিসিন, ইএনটি এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্টদের নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড করতে হবে। সেই অনুযায়ী এখানেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রয়েছেন। তবে এখন অন্য অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন যাঁদের চিকিৎসা চলছে এখানে। শয্যা খালি করার জন্য সেই চিকিৎসাধীন রোগীদের দ্রুত অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজও অনেকে বাইরে বেরিয়েছে। কোন বিজ্ঞানসম্মত বারণ মানতে চাইছে না। যদি কাউকে মানা করা হচ্ছে সে তার উত্তরে খিল্লি করছে, হাসছে পাগলের মত। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়িতে বসে যতটা পারছি ফেসবুকে সাবধানতার পোষ্ট দিচ্ছি। কবিতা, গল্প পোষ্ট করছি। শীর্ষেন্দু বাবুর গল্পের লিঙ্ক পেয়েছি। গল্প পড়ছি। এখন পড়ছি, মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি, গল্পটা। ছেলেটা  মোবাইলে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বলছে, ভয়ঙ্কর অবস্থা, কি হবে বাবা? ওর মা ছেলেকে বকছেন, টেনশন করবি না। সাবধানে থাকবি। হাত, মুখ সাবান দিয়ে ধুবি। চান করবি। তাহলে কিছুই হবে না। বাড়িতে বসে বসে পড়। বাইরে একদম বেরোবি না। ছেলে খুব সচেতন। সে মা কে বলে, মা তুমি কিন্তু হাত কম ধুচ্ছ। রান্না করার আগে হাত ধোও সাবান জলে। আমি জানি, আমাদের এইটুকুই জ্ঞান। আর বেশি কিছু জানি না। তবে বাবা বলতেন, সাবধানের মার নেই। পাশের বাড়িতে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া চলছে এক চাষীর। চাষী তার গরু উঠিয়ে আল ভেঙ্গে দেয়। আমি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থামতে বললাম, বেঁচে থাকলে অনেক বাড়ি হতে পারে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়। একজন আমাকে মেসেঞ্জার বক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। আমার কথা বলা হয়নি তার সঙ্গে। তাই সে রেগে আমাকে ব্লক করে দিল। সব ঝগড়ার সূত্র সেই ভুল বোঝাবুঝি। যাইহোক মেসেঞ্জার কয়েকদিনের জন্য আনইন্সটল করে দিলাম। এখন একটাই চিন্তা পৃথিবীর এই কঠিন রোগ। ভাইরাস আ্যাটাকে সারা বিশ্ব রোগগ্রস্ত। এখন দূরে দূরে থাকার সময়। দূরে থাকলে বাঁচব আর একত্রে সমাবেশ করলে মরব। ভাইরাস মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে চেনের মত। এই চেনকে ভাঙ্গার জন্য লকডাউন।

প্রকৃতি শুদ্ধ হচ্ছে। লকডাউন করার ফলে দূষণ কমছে ব্যাপকহারে। এবার প্রধানমন্ত্রী একুশ দিনের লক ডাউন ঘোষণা করলেন। সচেতনতা প্রয়োজন মানুষের। গ্রামে গঞ্জে কেরালা, মুম্বাই থেকে কাজ করে ফেরা লোকগুলো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে সংক্রমণ ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। আমলা থেকে সাধারণ মানুষের ছেলেপুলে সব একই অবস্থা। রাস্তায় বেরিয়ে সেলফি তুলছে। প্রশাসন কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষের চেতনা জাগ্রত না হলে ধ্বংস হবে সভ্যতা। এখন বাংলায় বসন্তকাল চলছে। পাখি ডাকছে, ফুল ফুটছে। পাখিরা পশুরা উন্মুক্ত  আকাশের নিচে আর মানুষ ঘরবন্দি। মানুষ শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু প্রকৃতির বিচার নিরপেক্ষ। তাই আজ উল্টোচিত্র। প্রকৃতি কি হাসছে। জানি না তবু এটুকু বলতে পারি, ভাবার সময় এসেছে। কল কারখানা, ধোঁয়া আবর্জনায় পৃথিবী কলুষিত। তাই আজ এই প্রতিশোধ।চারিদিক নিস্তব্ধ। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ নেই। বাজার করা, মাছ কেনা, স্কুল যাওয়া সব বন্ধ। একটা কোকিল গান শুনিয়ে চলেছে। ফিঙেটা ইলেকট্রিক তারে বসে ডাকছে। ওরা মানুষের মত স্বার্থপর নয়। তাই হয়ত গান শুনিয়ে চলেছে এই দুর্দিনে।  আজকের খবরে শুনলাম, করোনাভাইরাসের জেরে ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। লকডাউনের জেরে উৎপাদন বন্ধ হয়েছে ছোট থেকে বড় সংস্থায়। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসে তহবিল ঘোষণা করল দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)।

এসবিআই সূত্রে খবর, চলতি ২০১৯–২০ আর্থিক বছরে মুনাফার ০.২৫ শতাংশ কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে করোনা প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি বৃহত্তম সংস্থাকে নিজেদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাত থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যয় করার পরামর্শ দেয় কিছুদিন আগে। এবার তা পালন করতে চলল এসবিআই।

এসবিআইয়ের চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার জানান, ‘এই তহবিলটি মূলত স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে জড়িত। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সংক্রান্ত খাতে ব্যবহার করা হবে। এসবিআই ভারতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই তহবিলটি মূলত সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষকে স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে।’‌

তিনি অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থার কাছেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে টুইটারে লিখেছেন, গোটা দেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্যে যাচ্ছে। মানুষের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন। সতর্কতামূলক এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীকে উদারভাবে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাই।ভরসা পেলাম। খাবারের জোগানও অব্যাহত থাকবে। রাজ্যসরকার থেকে দিন আনা দিন খাওয়া লোকেদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকার সবদিক ভাবছেন। মানুষই একমাত্র মানুষকে বাঁচাতে পারে। ডাক্তার, নার্স, আয়া, পুলিশ সকলে জীবনকে বাজি রেখে মানুষ তথা পৃথিবীকে বাঁচানোর কাজে লেগে পড়েছেন। এ এক আশার কথা। ভালো লাগছে এই কথা ভেবে যে সকলে রাজনৈতিক জীবনের উর্ধে উঠে মনেপ্রাণে এক হয়ে কাজ করছে। এই অপূর্ব মিলনের বার্তা একমাত্র ভারতবর্ষ দিতে পারে। সকলে তাকিয়ে আছে আমাদের দেশের দিকে। সারা পৃথিবী মিলিত হোক মানবতার মহান জগতে। পৃথিবী ভাল থেক। পৃথবী নিরোগ হও।আজ একটা সংবাদপত্রে পড়লাম, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এবার সরাসরি চীনের দিকে আঙুল তুলল আমেরিকা। আর এই আঙুল তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগাম বিপদ সম্পর্কে চীন সতর্ক করলে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। বেজিংকে সরাসরি এই ভাষাতেই বিঁধলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকী তিনি এই বিষয়ে সামান্য বিরক্ত বলেও মন্তব্য করেছেন। আমেরিকার চিকিৎসকদের সেখানে পরিদর্শনে যেতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প।এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন দেশের যে তিনটি জায়গাকে সংক্রমণের আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে, সেগুলো হল নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওয়াশিংটন। তালিকার প্রথমেই আছে নিউ ইয়র্ক। সেখানে ১৫ হাজার নিশ্চিত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৫৪১৮টি সংক্রমণ ঘটেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। এখনও পর্যন্ত ১১৪ জন মারা গিয়েছেন। একদিনেই প্রাণ গেছে ৫৮ জনের। গোটা আমেরিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। মারা গিয়েছেন সাড়ে চারশো।আমি ভাবি দেশের কথা, পৃথিবীর কথা।এখন দোষারোপের কথা বাদ দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচাই। সকলের সমবেত চেষ্টায় রোগমুক্তি ঘটুক পৃথিবীর। কারাবাসে যেমন বন্দি থাকা হয় এই গৃহাবাস কিন্তু ততটা বিরক্তিকর নয়। সংসারের মাঝে থেকে একটু একা একা থাকা। একটু রামকৃষ্ণ পড়ি, একটু রবীন্দ্রনাথ পড়ি, একটু জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ পড়ি। সময় কেটে যাবে আরামসে। দেরাজে রাখা বইগুলো একটু পরিষ্কার করে রাখি। রান্নায় সাহায্য করি স্ত্রীকে। দূরে থেকে সকলকে বাঁচিয়ে চলতে পারলেই জীবনের খোঁজ পাওয়া যাবে। "অসদো মা সদগময়, ত্বমসো মা জ্যোতির্গময় " এই মন্ত্রে এগিয়ে চলি নিশ্চিন্তে।আবার খবরের কাগজে দেখলাম কি মারাত্মক পরিস্থিতি সারা বিশ্বের। নাকানিচোবানি খাচ্ছে গোটা দুনিয়া। প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। মারণ ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে মৃত ১৭,২৩৫ জন। এ–‌পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৩,৯৫,৮১২। ইতালি এখন মৃত্যুভূমি। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৬০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতালিতে এখনও পর্যন্ত মৃত ৬,০৭৮। আক্রান্ত ৬৩, ৯২৭। ইতালির লম্বার্ডির অবস্থা ভয়াবহ। ইতালির মোট মৃতের প্রায় অর্ধেক লম্বার্ডির বাসিন্দা। সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৩,৭৭৬ জনের, আক্রান্ত ২৮,৭৬১।  বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে দেরির কারণেই ইতালির এই অবস্থা। শুধু প্রবীণদেরই নয়, ইতালিতে ৩০–৪০ বছরের কোঠায় যাদের বয়স, তাদের কাবু করছে করোনা। নাজেহাল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন— সব দেশেই। স্পেনের অবস্থা এখন ভয়াবহ। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে মারা গেছেন ৫১৪ জন। মোট মৃত ২,৬৯৬। আক্রান্ত ৩৯,৬৩৭। মৃতদেহ রাখার জায়গা অমিল। অনেক জায়গায় বাড়িতেই পড়ে আছে মরদেহ। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, মৃতদেহ হিমঘরে রাখা যায়, কিন্তু করোনায় মৃত্যু শুনলে কেউ মৃতদেহ স্পর্শ করছে না। অন্ত্যেষ্টির কাজে নিযুক্ত কর্মীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অবস্থা মোকাবিলায় নেমেছে সেনাবাহিনী।ওদিকে ফ্রান্সও নাজেহাল। সেখানে মৃত ৮৬০, আক্রান্ত ১৯,৮৫৬। রাজধানী প্যারিসের রাস্তা এখন খাঁ খাঁ করছে। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ। কাফে, রেস্তরার ঝাঁপ বন্ধ। লোকজনের দেখা নেই। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়। কে জানে কখন ভাইরাস ঢুকে পড়ে শরীরে!‌ আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দি। ব্রিটেনেও ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। সেখানে মৃত ৩৩৫। আক্রান্ত ৬,৬৫০। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দেশে তিন সপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা করেছেন। দেশবাসীকে ঘরবন্দি থাকতে বলেছেন। দু’‌জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ। আমোদপ্রমোদের জন্য সপ্তাহ শেষে কেউ পার্ক বা অন্য কোথাও জড়ো হলে নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা। ওষুধ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকান খোলা। বাকি সব বন্ধ। বিয়ে আর ব্যাপটাইজেশনও বন্ধ থাকবে। 

এদিকে কানাডায় করোনায় মৃত ২০। আক্রান্ত ১,৪৭৪। সংক্রমণ মোকাবিলায় ৩৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে কানাডা সরকার। সংক্রমণ এড়াতে সকলকেই ঘরবন্দি থাকতে বলছেন। কিন্তু কেউ কেউ আইসোলেশনের তোয়াক্কা করছেন না। তাতেই চটেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বলেন, ‘অনলাইনে আমরা অনেক লোকজনের ছবি দেখছি। তঁারা ভাবছেন তঁাদের কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। ভাল, তবে আপনাদের দেখা যাচ্ছে। যথেষ্ট হয়েছে। বাড়িতে যান, ঘরেই থাকুন। আমরা নিয়ম মানতে বাধ্য করব। তা লোকজনকে সচেতন করেই হোক বা জোর করেই হোক।’‌‌‌

আমেরিকায় উদ্বেগ তুঙ্গে। মৃত ৫৮২ জন। এ অবস্থায় লক ডাউনে থেকে করোনার চেন ভাঙ্গতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। গ্রাম থেকে শহরের প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতন হতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে করোনা মোকাবিলায় কলকাতা পৌরসভার উদ্যোগে জোর কদমে চলছে শহর স্যানিটাইজ করার কাজ। কিভাবে গাড়ি করে সকলের বাড়ির সামনে এসে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে সুন্দর। 

বাড়িতে যথেষ্ট খাবার মজুত নেই। ছাড় দেওয়া আছে মুদিখানা, সব্জিবাজারকে। একজন করে পরিবার পিছু ভিড় না করে বাজার করা নিয়ম। কিন্তু এটা একশ চল্লিশ কোটির দেশ। ভিড় হয়ে যাচ্ছে যেখানে সেখানে। পুলিশের টহল চলছে। আমার স্ত্রী পাড়ার  দোকান থেকে চাল, ডাল কিনে আনলেন। আমরা তিনজন। গ্রামের বাড়িতে অন্যান্য সদস্যরা আছেন। তাদের খবর রাখছি মোবাইল ফোনে, হোয়াটস আ্যপে। তাছাড়া উপায় নেই।এক একজন ধনীলোক প্রচুর খাবার মজুত করছেন বাড়িতে। এর ফলে খাবারের অভাব হতে পারে। এক সব্জীব্যবসায়ী বললেন, যার দরকার আড়াইশ আদা তিনি নিয়ে নিচ্ছেন আড়াই কেজি। চড়া দাম দিতে তারা প্রস্তুত। এ এক অদ্ভূত মানসিকতা। তারা বলছেন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম থাকবে। তবু সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। জীবনের চরম মুহূর্তের কথা তারা ভুলে যায়। কত রাজার ধনে মরচে পরেছে ইয়ত্তা নেই। শিক্ষা নিতে হয় অতীতের কাছে। আমার পাশের বাড়ির সকলেই কিছু খাবার কিনলেন। একুশ দিন যাওয়ার মত। কম খেতে হবে। প্রকৃতি তার হারানো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে জেনে আনন্দ হল। পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীর জলবায়ু যেমন ছিলো সেরকম হতে চলেছে পৃথিবী। প্রকৃতি সব দিক দিয়ে মারেন না। একদিক ভাঙ্গলে আর একদিক গড়ে  দেয়। আশার অনেক কিছু আছে। "আশায় বাঁচে চাষা। "

আমার স্ত্রী বাজারে গেছিলেন  আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা। পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ  দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী।

আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম। এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই। খবরের কাগজ পেলাম। হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর দুর্যোগ মোকাবেলায় কমিউনিস্টশাসিত কিউবা প্রায়ই তাদের ‘সাদা পোশাকের বাহিনী’ পাঠিয়ে আসছে। এর আগে হাইতিতে কলেরা এবং পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও দেশটির চিকিৎসকরা সামনের কাতারে ছিলেন। এবারই প্রথম কিউবা বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ইতালিতে ৫২ সদস্যের শক্তিশালী একটি দল পাঠাচ্ছে; যার মাধ্যমে দেশটি তাদের ‘চিকিৎসা কূটনীতির’ বড় ধরনের নজিরও স্থাপন করতে যাচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এ নিয়ে কিউবার ষষ্ঠ মেডিকেল ব্রিগেড অন্য কোনো দেশের উদ্দেশে রওনা হলো। দেশটি এর আগে তাদের সমাজতান্ত্রিক মিত্র ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়ার পাশাপাশি জ্যামাইকা, সুরিনাম ও গ্রেনাদাতেও চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে। শনিবার ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে চিকিৎসকদলের সদস্য ৬৮ বছর বয়সী লিওনার্দো ফার্নান্দেজ বলেন, ‘আমরা সবাই বেশ ভীত, কিন্তু আমাদের বিপ্লবী দায়িত্ব আছে, তাই আমরা আমাদের ভয়কে একপাশে সরিয়ে রেখেছি।

আট

এদিকে চিনের অবস্থাও ভাল নয়। আমার কাটোয়া শহরে করোনা আক্রান্ত রোগী এখনও অবধি একটাও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তৎপর আছে। বাইরে বেরোলেই পিটুনি খাচ্ছে আনাড়ির দল। ঘরে বসে ছেলেটা বই পড়ছে। আরণ্যক।আমিও মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছি। শীতের পোশাকগুলো গুছিয়ে রাখলাম। বসন্ত কেমন ম্লান হয়ে রয়েছে। একটা সবুজ ছোট্ট পাখি শিউলি গাছে বসে আছে। স্ত্রী রুটি বেলছে। জলখাবারের জন্য। এতদিন তো ঘরে বসে থাকার সুযোগ পাই না। বেশ লাগছে সপরিবারে একসঙ্গে থেকে। দোকানপাট যা করার লকডাউনের আগেই করা হয়েছে। সরকার থেকে খাবার বিতরণের কাজ শুরু হবে। ভবঘুরের দল ব্লক অফিস আর স্কুলগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। দুদিনের ঘর। তারপর তাদের ঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে হবে। 

প্রতি বছর রথ যাত্রার ঠিক আগে ভগবান জগন্নাথ স্বয়ং অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জ্বর এবং সর্দি কাশি হয়; অসুস্থতার এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে Quarantine করা হয় যেটাকে মন্দিরের ভাষায় অনাসর বলে। ভগবানকে ১৪ দিন পর্যন্ত একা বাস মানে isolation এ রাখা হয়। হ্যাঁ, ঠিক ১৪ দিন। এই সময় ভগবানের দর্শন বন্ধ থাকে এবং ভগবানকে জড়িবুটি আর জল খাবার দেওয়া হয় মানে Patients Diet,  আর এই পরম্পরা হাজারাে বছর থেকে চলে আসছে।আর এখন ২০ শতাব্দীতেও বলা হলো isolation & Quarantine এর সময় ১৪ দিন! আগের সেই বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন কৌশল যা আজও বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে!..১৪ দিন জগতের প্রভু জগন্নাথ যদি মানেন Isolation / Quarantine / light diet আমাদের কেন তা মানায় অসুবিধা?  ভগবানকে মেনে,  চাহিদা কমিয়ে এই ক'দিন আমরা তাঁর দেখানো পথে একটু চলিইনা! কিন্তু কিছু লোক আড়ালে মশারি টাঙিয়ে তাস খেলছে। জুয়ো খেলছে। কোন আইন মানতে চাইছে না। একজন মহাপুরুষ বলেছিলেন, আমাদের দেশে কম করে দুবছর মিলিটারি শাসনের প্রয়োজন আছে। তার কথাই ঠিক। তবে যদি এরা কিছু নিয়ম শেখে তাহলে দেশের দশের উপকার। 

ভারতবর্ষ ত্যাগের দেশ। আজ খবরে জানলাম, শিক্ষকরা যে যেমন পারছেন দান করছেন। এক শিখ মহাজন কয়েকলক্ষ টাকা দান করেছেন পাঞ্জাবের পিড়িতদের জন্যে। বাংলায় এক গ্রামের ধনী কয়েকলক্ষ টাকা দান করলেন পিড়িতদের কল্যাণে। খবরে প্রকাশ, রাজ্যে আক্রান্ত বেড়ে ১০। কলকাতার নয়াবাদের এক প্রৌঢ়ের শরীরে মিলল করোনার নমুনা। আশঙ্কা, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের। 

গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে একটিও করোনা আক্রান্তের সংবাদ না আসায় একটু স্বস্তিতে ছিল বাংলার মানুষ। কিন্তু বুধবার রাতেই সেই স্বস্তিতে জল পড়ল। ৬৬ বছরের ওই বৃদ্ধ সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হন। বুধবার রাতে রিপোর্ট মেলে। তাঁর বিদেশ ভ্রমণের কোনও খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাঁর পরিবারের কেউ সম্প্রতি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়নি। রাজ্যে আশঙ্কা বাড়ল। এটি তৃতীয় পর্যায়ের শুরু কিনা ভেবে। এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদ চলবে বলে সূত্রের খবর।

একের পর এক বাড়তেই থাকবে নাকি রোগীর সংখ্যা। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি ঘরে থেকে। 

আমি কাটোয়া পৌরসভার কুড়ি নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পৌরসভা থেকে বারবার মাইকিং করা হচ্ছে। সবরকম সাহায্য করার পাশাপাশি সচেতনাতামূলক প্রচারও চলছে। কাটোয়া পৌরসভা, কাটোয়া হাসপাতাল, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে করোনা মহামারী রুখে দেওয়া যায়।মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, কাটোয়ার সর্বস্তরের জনসাধারণ আমাদের যে ভাবে সাহায্য করছেন তাতে আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এতো দিন গৃহবন্দী থাকা যথেষ্ট কষ্টকর এটা আমরা বুঝি। কিন্তু এই মারনব্যাধি থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার এটাই এক ও একমাত্র উপায়।আপনাদের প্রতি আমাদের বিনীত আবেদন -  বাজার করা অথবা মুদি / রেশন / ওষুধের দোকানে কিছু কিনতে যাবার সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে অন্তত ৬ (ছয়) ফুট দুরত্ব বজায় রাখুন। খুব প্রয়োজন না থাকলে বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। অন্যথায়, অন্যের থেকে সংক্রমন আপনার তথা আপনার প্রিয়জনের মধ্যে ছড়াতে বেশি সময় নেবে না। রাস্তায় একসাথে জড়ো হবেন না। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না। সর্বোপরি, নিজে সুস্থ থাকুন, নিজের পরিবারকে ভালো রাখুন তাহলেই সমাজ ব্যাপকার্থে মানব সভ্যতা রক্ষা পাবে।

কেউ শুনছে কেউবা শুনছে না। মাছ, মাংস খাওয়ার লোভে অনেকে বেরিয়ে পড়ছেন বাইরে। এটা সংযমের সময়। সংযত হয়ে চলার সময়। এটা ভাবতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়। 

আজ খবরে পড়লাম আবার একই বিষয়ে। করোনা। করোনা। করোনা। খবরের কাগজ আর ফেসবুকের খবর ছাড়া বাইরে বেরিয়ে খবর নেওয়া উচিত নয়। তাহলে এত পরিশ্রম বৃথা যাবে। আজকের খবরে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই করোনা আতঙ্কে জেরবার দেশের মানুষ। করোনা আতঙ্ককে সাথে নিয়ে দেশের পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। সারা দেশবাসীর কাছে এখন একটাই লক্ষ্য, কিভাবে করোনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবেন তাঁরা? দেশের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা একযোগে করোনার সংক্রমণকে মহামারী হওয়া থেকে আটকাতে শুরু করেছে লকডাউন। সরকারিভাবে নোটিশ জারি করা হয়েছে এই মুহূর্তে দেশের কেউ যেন কোন রকম জমায়েতে শামিল না হন।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল চীন থেকে। সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। যার মধ্যে ভারত অন্যতম। অন্যদিকে, এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা আশার কথা শোনাচ্ছেন ভারতকে নিয়ে। এই মুহূর্তে একদিক দিয়ে যেমন ভারতে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, সেরকম অন্যদিক দিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু জন। যদিও সে সংখ্যা আক্রান্তের তুলনায় অত্যন্ত কম। কিন্তু তা সত্বেও সুস্থ হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে খুশির বলেই মনে করা হচ্ছে।

এখনো পর্যন্ত ভারতে 37 জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে স্বাস্থ্যমহল সূত্রে জানা গেছে।  ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন 492 জন। তার মধ্যে মারা গেছেন এখনো পর্যন্ত ন জন। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া 37 জনের মধ্যে 11 জন ইতালীয় পর্যটক রয়েছেন। যাঁদের সুস্থ হওয়ার পর ইতালীয় দূতাবাসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, চীনের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বলে খবর। তবে সাংবাদিক সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ এর মধ্য দিয়ে চিনে আসিম্পটোমেটিক রোগী ধরা পড়ছে। নাও ঠেলা। এক রোগে নিস্তার নেই আবার শঙ্করাকে ডাকে। অন্য আর একটি রোগ যেটি ইঁদুরবাহিত ক্রমশ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে জানালো চিন সরকার। 

আজকে একটা ভাল খবর শুনলাম, নবান্নে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, শহরের একাকী থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে খেয়াল আমাদেরকেই রাখতে হবে। কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খেতে পারছে না বা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে না জানতে পারলে সেই হাউসিং কম্প্লেক্সকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জেলাশাসক মহকুমা শাসক বা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার আবেদন জানান। প্রশাসন প্রয়োজনীয় চাল ডাল থেকে শুরু করে ওষুধ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেবেন। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিতে সকলকে মানবিক থাকার অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, “কারোর জ্বর হলে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করবেন না। প্রয়োজনে স্থানীয় থানায় খবর দিন পুলিশ অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে”অন্যদিকে ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে নাইট শেল্টারে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন তারা যেন কর্পোরেশনের স্কুল এবং কমিউনিটি হল গুলোতে যেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে থাকেন। খাবারের ব্যবস্থা পুলিশ এবং কর্পোরেশগুলি, করে দেবে। শুনে মনটা একটু হাল্কা হল। কত অসহায় ভবঘুরে পাগল মানুষ থাকে রাস্তায়। তারাও ভাল থাকুক। ভাল থাকুক ভালবাসা। রাস্তায় যখন যেতাম এই রোগ আসার আগে। তখন দেখতাম কত গোসাপ, সাপ, শেয়াল,  কুকুর চাপা পড়ে মরে আছে মানুষের দাপাদাপিতে। এখন আর তারা চাপা পড়বে না একুশ দিন। শান্তিতে ঘুরতে পারবে। আমরা ভুলে যাই তারাও এ পৃথিবীর অংশিদার। তাদের ঠকিয়েছি আমরা। তার মাশুল গুণছে মানুষ। 

ক্রিকেটার সৌরভ থেকে আমজনতার অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করছেন অভুক্ত মানুষের কথা ভেবে। সব স্তরের মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। জ্বালা যন্ত্রণা অত্যাচার বেড়ে গেলে ফিরে ফিরে আসে সমোচ্চশীলতার ধর্ম। সে যে রূপেই হোক। কখন রোগ মহামারী বা প্রলয়। তার বিচারের কাছে গরীব ধনী নেই। তার বিচারের কাছে শিক্ষিত অশিক্ষিত নেই। সব সমান করে নবরূপে তৈরি করেন প্রকৃতির প্রতিমা। আজকে একটা খবর পড়লাম,  করোনা ভাইরাসের কারনে পৃথিবীর প্রায় ৭৫% ছোট বড় ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ হয়েছে। আকাশ পথে বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০% যানবহন চলাচল বন্ধ হয়েছে।ভারী অস্ত্রের মহড়া বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীজুড়ে লকডাউন আইনের কারনে মানব সৃষ্ট দূষণ বন্ধ হয়েছে।হাঁচি, কাশি ঠান্ডাজনিত রোগ থেকে দুরে থাকতে সবাই এয়ার কন্ডিশন চালানো বন্ধ রেখেছে। করোনা থেকে বাচঁতে নিজের শরীর থেকে শুরু করে  বাড়ির আশে পাশের আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখছে। যত্রতত্র বিশেষ করে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে এসেছে।এ সব কিছুর ফলে নাসার দেয়া তথ্যমতে পৃথিবীজুড়ে নাইট্রোজেন গ্যাস ও কার্বন এমিশনের মাত্রা ২৫% কমে এসেছে।

ফলে প্রকৃতি তার নতুনরূপে সাজতে বসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমে এসেছে। গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায় গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করেছে।যেখানে নিজের ঘরের মানুষকে আটকিয়ে রাখা যায় না। সেখানে ৭০০ কোটি মানুষকে কিভাবে সম্ভব? হয়তো সৃষ্টিকর্তা করোনার অছিলায় ৭০০ কোটি মানুষকে আবদ্ধ করে প্রকৃতি মেরামত করে দিচ্ছেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবী কে একটু একটু করে ধ্বংস করে যাচ্ছিলো।করোনায় সৃষ্ট মহামারীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরবে বিশ্ব অর্থনীতিতে। কিছু কিছু দেশে দুর্ভিক্ষের ন্যায় আঘাত হানবে। 

আজ আমাদের প্রতিটি সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সময়। তারা আমাদের ভাল চাইছেন। বিশ্ববাসি প্রত্যের মঙ্গলের জন্য ঘরবন্দি থাকাটা কোন ব্যাপার নয়। এই ফাঁকে যে যার শখের কাজগুলি মন দিয়ে করতে পারবেন। ভাঙ্গা মচকা কুচটপড়া সম্পর্কগুলো মেরামত করে নিতে পারবেন। বিপদের বন্ধু প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়ে 'অমলের' মত জানালা দিয়ে পাখি আর গাছের সঙ্গে মিত্রতা করলে দেখবেন কখন অজান্তে সময় উধাও হয়ে গেছে আনন্দে। এখন আর কান্নার সময় নয়। মন মিলিয়ে দূরত্বে থাকার সময়। মনের মিল থাক ফোনে, হোয়াটস আ্যপে আর মেসেঞ্জারে। দেহের দূরত্ব বজায় থাক। মশা মাছি থেকে নিজেকে বাঁচান। আর কত দিন বলে হা হুতাশ না করে ভাল থাকুন। 

রাজ্যে লকডাউনের তৃতীয় দিন এবং দেশে প্রথম দিনে পরিস্থিতি কলকাতাসহ গোটা রাজ্যে একইরকম। তবে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এবং লাগোয়া জেলাতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু মানুষ লকডাউনের নিয়ম ভেঙেছেন। পুলিশ কঠোর হাতে তা দমন করেছে। অনেক জায়গাতেই বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরির জন্য পুলিশ তাড়া করেছে। এখনও পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১৩০২ জনকে। এর মধ্যে ৬৪০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে মাতলামোর জন্য। এবং লকডাউন ভাঙার জন্য ৬৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলকাতার নগরপাল অনুজ শর্মা জানিয়েছেন, প্রত্যেককে অনুরোধ করা হচ্ছে বাড়িতে থাকুন। এবং প্রশাসনকে সাহায্য করুন।

কলকাতায় শৃঙ্খলার চিত্রও দেখা গেছে। বেলেঘাটা, উল্টোডাঙা, গুরুদাশ দত্ত গার্ডেন লেনে বহু মানুষ রাস্তায় এঁকে দেওয়া বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। সহনাগরিকের থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওষুধপত্র, বাজারহাট সবই করেছেন। ওষুধের দোকানগুলিতে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। বেশি টাকার ওষুধ কিনলে যে ছাড় পাওয়া যেত, এখন তা দেওয়া হচ্ছে না। অড়েক জায়গায় চাহিদামতো ওষুধও নেই। হাওড়া ব্রিজে এদিন অন্য চিত্র দেখা গেল। ব্রিজের একটা দিক দিয়েই গাড়ি যাতায়াত করবে। বাকি অংশ আটকে রাখা হয়েছে। ব্রিজের দুপারেই পুলিশ মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে। গাড়ি নিয়ে কেউ গেলেই, থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিটের ছবিও একইরকম। সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোর মূল ফটকে তালা। নিয়মশৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য কয়েক জায়গায় র‌্যাফ টহল দিচ্ছে। ধর্মতলা জনহীন। শিয়ালদা স্টেশনের ছবিও এক। তবে কয়েক জায়গায় দেখা গেল দু’একটি সরকারি বাস চলছে। সাইকেল চালিয়ে কাজে যোগ দিতে চলেছেন অনেকে। টিভি আর মোবাইলে চিত্রগুলি দেখতে পাচ্ছি।বাইরে না বেরিয়ে বাইরের খবর জানতে পারা এক সুন্দর ব্যাপার। বেশ লাগছে। অনেকে ফোন করে খবর নিচ্ছেন। এক দাদা বললেন, মানুষ এত পাপ করছে যে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।ধর্ষণ,খুন বেড়েই চলেছে। অথচ এই কয়েকদিনের গৃহবন্দি অবস্থায় সব পাপ কমে গেছে। পুলিশ, প্রশাসন রাস্তায় মাস্ক পড়ে টহল দেওয়ার সুফল মিলছে। এর ভাল দিক আছে অনেক। 

অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহাভারতে আঠারোদিন যুুুদ্ধ চলেছিল আজ করোনা রোগের বিরুদ্ধে 21 দিনের যুদ্ধ চলবে।  এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে 21 দিন কেন 21 মাস হলেেও প্রয়োজনে ঘরে থাকবে। তা না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। অনেকেই চাল-ডাল মালমশলা সবজিতেে  ঘর ভরে নিচ্ছেন কিন্তু এতটা স্টক করা একজনের পক্ষে ঠিক না।সবাইকে বাঁচতে হবে সকলের জন্য চিন্তা করতে হবে তবেই" ধন্য রাজার পূণ্য দেশ" । 

নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, অর্থনীতিকে এর মাসুল গুনতে হতে পারে। আর  ব্রিটিশ ব্রোকারেজ সংস্থা বার্কলেজ় সমীক্ষায় জানাল, সম্ভাব্য সেই ক্ষতির অঙ্ক প্রায় বারো লক্ষ কোটি টাকা।

গরীব ভ্যানচালক, রিক্সাচালক সকলের কথা চিন্তা করছেন সরকার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন সরকার বাহাদুর। এ এমনএক সময় যখন সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। শুধু নজর রাখা আর অনুশাসন মান্য করাই ভারতবাসী তথা দেশবাসীর কর্তব্য। 

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-ভারতে আজ দুপুর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩।  তাঁদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। দিল্লিতে সংক্রমিত ৬ জন,  হরিয়ানায় ১৪ জন (প্রত্যেকেই বিদেশি নাগরিক),  কেরলে ১৭ জন, রাজস্থানে ৩ জন (একজন ভারতীয় নাগরিক এবং দু’জন বিদেশি নাগরিক), তেলেঙ্গানায় আক্রান্ত একজন, উত্তর প্রদেশে ১১ জন (১০ জন ভারতীয় নাগরিক এবং একজন বিদেশি নাগরিক), কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে আক্রান্ত ৩ জন,  তামিলনাড়ুতে একজন, জম্মু ও কাশ্মীরে একজন সংক্রমিত, পাঞ্জাবে আক্রান্ত একজন এবং কর্ণাটকে করোনায় সংক্রমিত ৪ জন। এইভাবে বাড়তে থাকলে তৃতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণহারে বাড়তে থাকবে রোগীর সংখ্যা।অনেকে এটাকে আমল না দেওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইতালির কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সকলের। ওরাও প্রথমে বাড়ির বাইরে বেরোনো  বন্ধ করেনি। 

সবথেকে আনন্দের খবর পশুপাখিরা আনন্দে বিচরণ করছে। দূষণের পরিমাণ কমে গিয়ে অনেক রকম পাখির আনাগোনা বেড়ে গেছে আশ্চর্যভাবে। আমরা যদি মাসে একদিন লকডাউন করে যাই নিয়মিত তাহলে হয়ত পৃথিবীর পরমায়ু বেড়ে যাবে। এ এক আশার বার্তা। 

এখন অফুরন্ত সময়। পড়ছি,   শুনছি ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছি জনসচেতনতামূলক।খবরের কাগজ আছে।  আমি আর কতটুকু জানি। তবু জানার ইচ্ছে, পিঠে কুঁজ নিয়ে চিত হয়ে শোওয়ার বাসনা। করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। ভারতেও তা মহামারির আকার নিচ্ছে। রাজ্যে যাতে করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ না করতে পারে, তার জন্য জনগণকে প্রতিদিন সতর্ক করে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাজ্য সরকার করোনা ঠেকাতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে অনেকদিন।  করোনা মোকাবিলায় জরুরী ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, প্যারাটিচার, পার্টটাইম টিচার সহ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ত্রাণ তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য আবেদন করলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যা পরিস্থিতি তাতে আগামীদিনে আর্থিক অভাব ঘটবে। আমাদের এই আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা একজোট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াব।’‌ পাশাপাশি তিনি দলের বিধায়কদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের যতটুকু সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী এই ত্রাণ তহবিলে সাহায্য করুন। বিধানসভা থেকে যে ভাতা পান, তার কিয়দংশ অনুদান ত্রাণ তহবিলে দিন। আপনারা যা ভাল বুঝবেন, তাই করুন। যেভাবেই হোক করোনার সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। মমতার পাশে দাঁড়ান।’‌ পাশাপাশি তৃণমূলের শিক্ষা সেল ও গণ সংগঠন এবং বামপন্থীদের কাছেও পার্থ চ্যাটার্জি সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছেন।

সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় পৃথিবীর এই গভীরতম অসুখ সেরে যাবে একদিন। 

" একদিন ঝড় থেমে যাবে

একদিন পৃথিবী শান্ত হবে "।​​

এক সপ্তাহ পরে রাজু আর শ্যামলী রাস্তায় নামল। রাস্তায় নেমে তারা দেখলো কোনও যানবাহন নেই পুরো রাস্তা ফাঁকা এদিকে ঘরছাড়া হয়ে গেছে ঘর ভাড়া দিয়ে তাকে জবাব দিয়ে আসা হয়েছে সেখানেও ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই এখন তারা কি করবে তারা বসে পড়লো রাস্তার ফুটপাতের উপর দূরে। তাদের অসহায়ত্ব ভিখারি ভেবে পুলিশ তাদের হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে তুলে দিল তারা আনন্দে খেলো কিন্তু খাওয়া-দাওয়া পর ভাবলো কি করে গ্রামে ফিরবে এখনতো বাস-ট্রেন কিছুই নেই তারা কেন যে ঘরটা ছাড়লো এতটা বুঝতে পারেনি রাজু বলল আগে যদি বাইরে বেরিয়ে একটু দেখে নিতাম শ্যামলী বলল বাইরে বেরোবে কি করে কোন কারন ছাড়া তো বাইরে বেরোনো যাবে না।

রাজু বলল যদি কোন রকমে আমরা গ্রামে যাই তাহলে বাড়িটা কোথায় করব। শ্যামলী বলল অত চিন্তা করো না। গ্রামে ফিরে আমরা এটাও তো দেখতে পারি যে হয়তো গুরুদেব মরে গেছে। তোমার মা একা। সেখানে হয়তো আমরা গেলে অসহায়ের সহায় হবো। আমরা তোমার বিধবা মাকে  দেখাশোনা করতে পারবো।

রাজু দেখল তাদের অদূরেই একজন সাধুবাবা বসে আছে তার লম্বা লম্বা দাড়ি। আর বগলে গেরুয়া রঙের কাপড় পড়ে বসে আছে। শ্যামলী আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ওনার সঙ্গে একটু কথা বললে হয় না। উনিও তো আমাদের মত অসহায়।

রাজু তিন ফুট দূরত্ব রেখে বলল - ও সাধু বাবা আপনি কোথায় যাবেন এখানে বসে কেন? সাধুবাবা উত্তর দিল - আমিও পশ্চিমবাংলায় যাব কিন্তু কোন বাস বা ট্রেন পাচ্ছি না। রাজু বলল - আমরাও তো পশ্চিম বাংলার লোক কিন্তু যানবাহন না পাওয়ায় আমরা এখানে বসে আছি আর কতদিন বসে থাকবে চলো হাঁটতে শুরু করি।

সাধুবাবা পথ চলতে শুরু করল। রাজু আর শ্যামলী তার পিছনে সাধুবাবা সাধুবাবা জিজ্ঞেস করল - তোমার নাম কি রাজু?  বলল -  আমার নাম রাজু। শ্যামলী বলল -  আমার নাম শ্যামলী।  শ্যামলী-  বাবা আপনার নাম কি? - আমার নাম ছিল এখন আর নেই। আমার নাম ছিল সন্তু আমি একটা সরকারি চাকরি করতাম কিন্তু আমার সারা দেশ দেখার শখ মিটলো আজ আমি ঘুরে ফিরে এসে কেরালাতে আশ্রয় নিয়েছি আজ দুই মাস হল এখন আতঙ্কে সমস্ত বন্ধ হওয়ায় আমার গ্রামে যাওয়ার পথে যতদূর চোখ যায় আমরা হেঁটে যেতে পারবো।

সাধু বাবা ও রাজু কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল। কথা বলছে শ্যামলী। কাঁধে একটা ব্যাগ। রাজুর কাঁধে একটা ব্যাগ আর সাধুবাবার বগলের ঝোলা। তিনজনেই হেঁটে চলেছে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পথের কোনো শেষ নেই। হেঁটে কি  কেরালা থেকে পশ্চিমবাংলা যাওয়া চাট্টিখানি কথা। বিরাট কঠিন ব্যাপার। তারা প্রায় ১০-১২ মাইল হেঁটে তারপর আবার  বসলো তখন সন্ধ্যা প্রায়। আর পুলিশ রা জিজ্ঞেস করছে নানা প্রশ্ন। দেখুন আমরা একসাথে এসেছি কোনো যানবাহন না পাওয়ায় আমরা হেঁটে চলেছি। আমরা এখানে একটু বিশ্রাম নেব।

সেদিনের মত রাত তো তারা সেই ফুটপাতে শুয়ে কাটিয়ে দিলো তারপরে সকাল থেকে আবার হাঁটতে শুরু করলো। রাতে কোন খাবার নেই। শুকনো খাবার কিছু বিস্কুট ছিল কিন্তু বিস্কুট খেয়ে কি আর কতদিন চলবে। সাধু বাবার কাছে কিছু কাজুবাদাম কিশমিশ ছিল সেগুলোও ফুরিয়ে গেল। তারা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। রাজু শ্যামলীকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। সাধু বাবা দেখে তো অবাক।

সাধু বাবা বলল - এতটা পথ তুমি একে কাঁধে নিয়ে যেতে পারবে। রাজু বলল কি করবো সাধুবাবা। একে তো কোন হাসপাতালে দেওয়ার উপায় নেই। হাসপাতলে এখনতো করোনা চিকিৎসাতেই ব্যস্ত। সবাই দেখছেন তো হাসপাতালের লাইন। খবরের কাগজে  আমি খবর রাখি। সবাই চলে যেতে পারে না অকারণে হাসপাতালে। সাধু বলেন, চলো যাওয়া যাক।

রাজু হাঁটতে হাঁটতেই বলে - সাধুবাবা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি আপনি কেন সাধু হয়েছেন? সাধুদের আমি দেখতে পারি না আমার এক গ্রামে গুরুদেব আছে সেই স্বাধীন নামে অসাধারণ কাজ করে সে আমার মাকে বশ করে রেখেছে সে আমাদের সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে নেবার ধান্দা তার। তার জন্যই আমি কেরালায় চলে এসেছি।

সাধু এবার আসল কথা বলল। সাধু বললো - আমাকে সাধু বাবা বলে ডাকবে না আমাকে সন্তুদা বলবে। দাড়ি আর জটের তার জন্য তুমি আমাকে সাধু মনে করো না। আমি দেশ ভ্রমণ করতে ভালোবাসি। আমি ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। তাই আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই। দেশ ভ্রমণ করি। আমি সাধু নয়। তবে হ্যাঁ আমি অন্যায় কোন কাজকে প্রশ্রয় দিই  না।

তারপর বিকেলের আলো থাকতেই সাধুবাবা বলেন আমরা বসি। চলো আজ থেকে তুমি আমাকে সাধুবাবা বলবেনা সন্তুদা বলবে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ক্ষুর বের করে রাজুর হাতে দিলেন। বললেন আমার মাথা ন্যাড়া করে দাও আর দাড়ি কামিয়ে দাও। আজ থেকে আমি তোমার মত সাধারণ মানুষ হতে চাই।

রাজু সন্তু তার কথামতো তাই করল ইতিমধ্যে একটা পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে। পুলিশের গাড়ি থেকে দু'জন পুলিশ নেমে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেছে সন্তুদা আর রাজুকে। তারা বলছে শুনুন শুনুন আমাদের কথা -শুনবো না কেন তোমরা কাছাকাছি বসে আছো 

তোমরা যাও তফাত যাও তফাত যাও তাড়াতাড়ি দূরে সরে তারা কথা বলতে শুরু করল। তারা পুরো বর্ণনা দেওয়ার পর পুলিশ বলল, চলো আমাদের সঙ্গে তোমরা। তোমাদের থানার কাছে থাকতে হবে একমাস। তারপরে তোমরা দেশে ফিরবে। এখান থেকে পশ্চিমবাংলা যাওয়া যায় ট্রেনে, বাসে।পায়ে হেঁটে নয়। সন্তুদা বলল- যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। দেখলে মার খেয়েও একটা উপায় হলো। এবার তুমি তোমার স্ত্রী শ্যামলীকে ডাক্তার দেখাতে পারবে। আর আমাদের থাকার একটা বন্দোবস্ত হলো। আমরা দু'বেলা খেতেও পারবো। আর আমরা থানার সামনে, পুলিশের নজরে আছি। আমাদের বিপদের কোন ভয় নেই। শ্যামলীর পায়ে প্লাষ্টার হল। সন্তুদা বলল, এখন শুধু খাওয়া আর গল্প করার সময়। রাজু বলল, আপনি তো অনেক জায়গা ঘুরেছেন। বলুন আমাদের সেইসব গল্প।

সন্তুদা বললেন- আমি যেমন এখন তোমাদের সঙ্গে মিশে গেছি। ঠিক এভাবেই মিশেছিলাম লক্ষদ্বীপে। আমার যেতে মনে হলো লাক্ষাদ্বীপ। লাক্ষাদ্বীপে কিছুদিন কাটিয়ে এলে মন্দ হয়না। ভাবাও যা কাজ শুরু হলো আর শুরু হল তোড়জোড়। দমদম এয়ারপোর্টে টিকিট বুকিং করে কয়েকদিন পরে কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ানে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কোচি বিমানবন্দর। যেহেতু আমরা উড়ানে গেলাম তাই সময়টা কম লাগলো। তা না হলে হয়তো থেকে জলজাহাজে ১৬ ঘন্টা লাগে। আমি বিয়ে করেছিলাম একজন গরীব মেয়েকে।  আমরা চারজন একসাথে আছি। আমি আলাদা। ওরা স্বামী স্ত্রী। আমি পাশের ভদ্রলোককে বললাম, চলুন। আমি আমার বন্ধু রতন আর আমার স্ত্রী এবং রতনের স্ত্রী। চারজনের চারটে লাগেজ। সঙ্গে টাকা পয়সা কিছু আছে এটিএম কার্ড আছে। ওখানে প্রয়োজনমতো সব কিছু কিনে নেওয়া যাবে। রতনের সঙ্গে রাস্তায় পরিচয়। 

প্রথমেই বিপত্তি একটা লাগেজ চুরি হয়ে গেছে বিমানবন্দর থেকে। থানায় একটা রিপোর্ট করে আমরা এগিয়ে চললাম। ব্যাগে অনেক টাকা পয়সা আছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে। ফিরে না পেলে খুবই অসুবিধা। থানায় আমরা পৌঁছানোর আগেই আমাদের পুলিশ আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন। চুরি নয় আমরাই হারিয়ে ফেলেছিলাম ব্যাগটা। একজন পুলিশ বললেন, নামতে গিয়ে মিস করেছেন লাগজটি। যাইহোক পাওয়া গেছে আফটার অল। এর আগে দিঘা পুরীতে সমুদ্র দেখেছি কিন্তু এখানকার সমুদ্র একদম অন্যরকম। নীল সমুদ্রের জলের সঙ্গে নীল আকাশ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নীলে নীলে নীলাম্বর...সরকার অনুমোদিত সংস্থার সঙ্গে আমরা এসেছি। সেজন্য লজের কোন অসুবিধা হয়নি রাত কাটালাম নিরাপদে। লজে ছিল কুয়ার আমিন, বলে একজন গাইড।

গাইড আমাদের সঙ্গে গেলেন এবং তিনি ইতিহাস বোঝাতে বোঝাতে আমাদের সব জায়গায় ঘোরাতে লাগলেন। ১৫৫৫ সালের কেরালা এখানকার রাজা ঘোষণা করেন প্রসাদ নির্মানের। প্রাসাদটি কিন্তু তারপরেও তাড়াতাড়ি নষ্ট করে দেয় হানাদস্যুরা। শতাব্দীর শেষের দিকে যখন অন্য রাজা এদিকে আসেন তখন এই প্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করে তারা। এরপর ক্লকটাওয়ার। তারপরে ১৭৬০ সালে তৈরি ৪৫ ফুট লম্বা চারমুখী ঘড়ি দেখলাম গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে প্রবাল পাওয়া যায় অনেক না। গাইড বলল পাওয়া যায় প্রবাল পাওয়া যায় প্রত্যেকটা দিকেই কিন্তু কোনটাই নিয়ে যাওয়া  যায়না। দু-একটা লুকিয়ে-চুরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। তারপর কেরলের বিখ্যাত মসলা বাজারে ঢুকলাম সেখানে আমার স্ত্রী এবং বন্ধু স্ত্রী খুব কেনাকাটি শুরু করলেন। আমি বললাম এত মসলা দিয়ে ব্যাগ ভরে যাবে, এত মশলা নিয়ে কি করবে? বন্ধুর স্ত্রী বলেন আপনারা কি বুঝবেন। এসব ব্যাপার আপনার নাক গলাবেন না। বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে হবে তো। এতদূর বেড়াতে এসেছি আর বারবার আসা হবে?

এরমধ্য একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে দলছাড়া হয়েছে রতন।  রতনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গাইড বলল, আমাকে না জানিয়ে কোথায় গেল? বন্ধুর বৌ কান্না শুরু করল। আমি সবাইকে বুঝিয়ে লজে নিয়ে এলাম।

বৌকে বললাম, তোমরা ফিরে যাও। আমি রতনকে নিয়ে ফিরব। বন্ধুর বৌ বলল, আমি যাব না। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। রতনের বৌ রেখা আমার সঙ্গে থাকল। চলে গেল আমার স্ত্রী। বাড়িতে তা না হলে সবাই চিন্তা করবে।পৌছে দিলাম বন্দরে টিকিট কেটে। সময় বেশি লাগবে। কিছু করার নেই।

রেখা আর আমি খোঁজ শুরু করলাম তার পরের দিন সকাল থেকে। রেখা খুব স্মার্ট আর চালাক। ক্যারাটে কুংফু শিখেছে অনেকদিন। আমাদের গাইড অন্য খদ্দের পেয়ে চলে গেছে। লজের মালিককে বলে সরকারি সংস্থাকে সব জানিয়ে রাখলাম। তারা বললেন, আমরা থানায় জানিয়ে রাখব। আপনারা সবরকমের সহায়তা পাবেন।

এখানে কেরলের শুধু নারকেলের বন নারকেলের বাগান সুন্দর সবুজ বনানী। আর নীল আকাশ আমাদের মন মুগ্ধ করল। কিন্তু বন্ধু হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের আনন্দের মাত্রা কমে গেল। এখন আমাদের খোঁজ শুরু হল নব উদ্যমে। শুরু করলাম প্রথম থেকে। মসলা বাজারে যেখানে বন্ধু নিখোঁজ হয়েছিল সেখান থেকে। হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটা গলিপথ পেলাম।

সেই গলিপথ পেয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখতে পেলাম সমুদ্র। সমুদ্রের ধারে মোটা চেনের সঙ্গে বাধা জাহাজগুলো। সমুদ্রের ধার বরাবর আমরা এগোতে লাগলাম আমাদের উদ্দেশ্য স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের বুঝিয়ে, আমাদের বিপদের কথা বলা। এত লোকেরা মাঝে যখন আমরা জাহাজে উঠতে পারলাম তখন বেলা প্রায় বারোটা। জাহাজে উঠে খোঁজ শুরু করলাম। গাইড বলেছিল, জাহাজে করে এরা চোরাপথে কারবার করে আবার জাহাজের ঘর ভাড়া দেয় যখন মাসখানেক দাঁড়িয়ে থাকে। জাহাজ তো বাসের মত সহজে যাওয়া আসা করে না। নিয়ম তাদের আলাদা। লাক্ষা দ্বীপের লক্ষ দ্বীপের কথা বলা হয়। কিন্তু পাঁচটি দ্বীপে শুদ্ধমাত্র যাওয়া আসা করা যায়। বাকিগুলো সব নিষিদ্ধ। চোর ডাকাতরা নিষিদ্ধ দ্বীপেই ডেরা নেয়। 

আমার বন্ধু কোথায় হারিয়ে গেলো খুঁজতে খুঁজতে আমরা হয়রান। বন্ধুর বউ রেখা খুব স্মার্ট এবং চালাক সে বলল কোন ভয় নেই আমরা তাকে খুঁজে বার করবোই। কেরলে প্রবাল রাজ্যের হাতছানি। এখানে লাল-নীল-সবুজ কত রকমের প্রবাল পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই।

এখানকার স্থানীয় লোকজনর সঙ্গে পরিচয় হলো। ইশারায় তারা সব ভাষা বোঝে। তবু তারা হাতের আংটি দেখিয়ে বলল যে এর ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। সেখানে লোকের প্রয়োজন হয় অনেক। আমার আশা জাগল, তাহলে এখানেই রতনের খোঁজ পাব। স্থানীয় লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল জিন্দালা আলু আলু। আমাদের সঙ্গে থেকে নিয়ে গেল ঝাল মিষ্টি পকরার দোকানে। চা খাওয়ালেন রেখা। স্থানীয় দাদা দিদিরা বসে আছেন দোকানে। ভাষার সমস্যার জন্য কারো সঙ্গে দুদন্ড কথা বলা গেল না।

জিন্দালার সঙ্গে আমরা চলে এলাম এক জঙ্গলে। মনে পড়লো বিভূতিভূষণের আরণ্যক। আমি রেখাকে বললাম, এই বিপদের মাঝে মনে পড়ছে, 'আরণ্যক'। এটা কি সত্যিই কল্পনা-লোকের বিবরণ বা বানানো গল্প হতে পারে? তাহলে সেই প্রিয় চরিত্রগুলো এতো বাস্তব কেন মনে হয়?এখানকার জঙ্গল দেখে মনে পড়ে গেলো সব কথা। 

যদি বিভূতিভূষণের ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের লোক হতাম, তাহলে নিশ্চয়ই বিহারে যেতাম। লবটুলিয়া, ফুলকিয়া বইহার, সরস্বতী কুণ্ডী, মোহনপুরা অরণ্য, মহালিখারূপ ও ধন্ঝরি পাহাড় খুঁজে বেড়াতাম।সেই প্রিয় চরিত্রগুলো সত্যিই কি আছে? খোঁজখবর নিতাম। রাজু পাঁড়ে, গনোরী তিওয়ারি, মুসম্মত কুন্তা, ভানুমতী  প্রভৃতি সাধারণ লোকদের না পেলেও অন্ততপক্ষে নন্দলাল ওঝা, রাসবিহারী সিংএর মতো বিত্তবান ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে অসুবিধে হত না। তবে এখন এতো বৎসর পরে কোনোভাবেই এই পরিকল্পনা করা যায় না। সম্বিৎ ফিরে এল। রেখা বলল, এখন রাত হয়ে গেছে আর ফেরার উপায় নেই রাতেই সে একটা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর দেখিয়ে দিল সেই ঘরে গিয়ে আমরা দুজনে ঢুকলাম খাবার-দাবারে কোন অসুবিধা হয়নি কিন্তু শোবার বেলায় খুব অসুবিধা। কোনমতে রেখা আমার সাথে শুতে চাইছেন সে নিচে শুয়েছে হঠাৎ মাঝ রাতে বারোটার সময় একটা বল্লম। দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি বললাম, রেখা তুমি কি ক্ষেপে গেলে? তোমার কি মাথা খারাপ হল? ছেড়ে দাও।

কি হলো? রেখা বলল-একটা বল্লমের  ডগায় রক্ত দেখলাম।

আমি বললাম, তাহলে আমাদের সন্ধান কেউ পেয়েছে। নিষিদ্ধ এলাকায় আমরা আছি। পুলিশ খুঁজেও পাবে না আমাদের লাশ। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, জিন্দালা।

জিন্দালা এল। ঈশারায় বলল, ভয় নেই। আমি আছি। ওদের আঁটঘাঁট সব চেনা। তাই ওরা ভয় পায় না। কী গভীর ভালোবাসায় আমাদের জন্য ও রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। চিৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। কাছে গিয়ে দেখলাম, কেউ একজন তাকে খুন করে রেখে চলে গেছে। জঙ্গলে আশেপাশে এসব লোক ভিড় করে চলে এসেছে তার চিৎকারে। সকলের চোখে মুখে একই জিজ্ঞাসা কে মারল তাকে? এখানে তার শত্রু বলতে কেউ নেই। শত্রু হয়তো আমাদের থাকতে পারে। হয়ত আমাদের সাহায্য করার পরিণতি এটা। 

কিন্তু সে আড়ালেই আছে। আমি আর রেখা খুব সাবধান হয়ে গেলাম। আমি গেলাম দুজন স্থানীয় লোক লক্ষ্য করে, আমরা বললাম আমাদের বিপদের কথা। তারা ইশারায় সবকিছু বুঝে নিল। বিপদ আমাদেরও ঘনিয়ে আসছে এখন রাত্রি দুটো। এখনো রাত শেষ হতে প্রায় ৪ ঘণ্টা বাকি। ছয়টা বাজলে আমরা বেরিয়ে পড়বো রকমে জেগে রাত কাটিয়ে দিলাম ঘরের ভেতর। খিদে পেয়েছে। কিন্তু কোন খাবার নেই। ছটা বাজতেই আমরা স্থানীয় লোকেদের বলে বেরিয়ে পড়লাম। আর ওদের সঙ্গে নিলাম না।

এবার আমাদের নিজেদের শক্ত হতে হবে। আর কারো সাহায্যের আশা করলে হবে না। তার কারণ হচ্ছে কতজন আমাদের জন্য প্রাণ দেবে। আমরা এরকম মনে করে, আমরা বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। সরকারি স্পর্শিয়ায় আমরা খবর পাঠাইনি। তারা জানেনা আমরা কোথায়। তারা হয়তো খোঁজ করছে। কিন্তু আমাদের যে বন্ধু রতনকে খুঁজে বার করতেই হবে।

সৈকতের ধার বরাবর এগোতে এগোতে আমরা চলে এলাম এক চেইন বাধা জাহাজের কাছে। সেখানে একটি পানসি নৌকা। অনেক ভেতরে চলে গেলাম। কিন্তু মাঝ নদীর সমুদ্র বরাবর। রেখা ধারে ধারে যায়। পানসি ধারে ধারে গিয়ে আমরা আরো ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আশেপাশে কেউ আমাদের ফলো করছে নাকি। আমরা লক্ষ্য করলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ আমরা একটা নেকড়ের সামনে পড়ে গেলাম। পানসি ছেড়ে ছুটতে শুরু করলাম জঙ্গলের ভিতরে। নেকড়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল আমরা ফাটা বাঁশে আওয়াজ করতেই দুমদুম করে  সে পালিয়ে গেল। বাঁশটা পড়ে ছিল বনে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোক কিছু ভিড় করে চলে এল। আমরা ইশারায় তাদের কথা বললাম। পেটে হাত দিয়ে আমরা তাদের কথা বললাম। তারা আমাদের খেতে ফলমূল দিল। ফলমুলাহার করে, জল খেয়ে যাক আমাদের ধড়ে প্রাণ এলো। এবার আমরা ইশারায় তাদের আমাদের বিপদে কথা বোঝাতে লাগলাম। আমরাএ ও বোঝালাম আমাদের বন্ধু রতন হারিয়ে গেছে। আমরা তাকে খুঁজতে এসেছি। তারা কোনরকমে বুঝল কিন্তু তারা আমাদের ভাষা বোঝে না। ইশারা করে কষ্ট করে তাদের বোঝাতে হলো। আমাদের অভিযান শুরু হলো আরও দুর্গম পথে। স্থানীয় লোকদের সাহায্যে এত কাণ্ডের পর লোহার মই বেয়ে যখন আমরা জাহাজে উঠতে পারলাম। তখন বেলা প্রায় বারোটা। এলাম চারতলায় আজ থেকে চার দিন আমাদের ঠিকানায় কাভারাত্তি। ৪০৬ নম্বর কেবিনে ঢুকে অবাক ওরে বাবা এইতো চকচকে ঝকঝকে ঘর শুধু বিছানার চেয়ার টেবিল সাজানো।। ওকে টি আমাদের পয়সার অভাব নেই কিন্তু এত সুন্দর ব্যবস্থা হোটেলের মতো সবকিছুই এখানে সহজলভ্য এটাচ বাথ গরম জল ঠান্ডা ঘর দেয়াল জড়ায় না সবকিছু এখানে আছে। ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। জাহাজে রতন নেই। এই জাহাজে করে পাচার করা হয় মানুষ, প্রবাল ও অরণ্য সম্পদ। বিশেষ করে জঙ্গলের কস্তুরী মৃগ এদের সবথেকে লোভনীয়  ব্যবসা। এদের লম্বা হাত। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে এই ব্যবসা। লোকাল পুলিশ আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল। এবার দেখলাম নিজের চোখে। জাহাজের ঘরগুলি প্রায় বন্ধ। মাংস পচা গন্ধ আসছে। 

স্থানীয়রা এতক্ষণ জঙ্গলে চলে গেছে তারা নেই এখন আমরা দুজনে আছি সকলের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে পরিচয় করলাম। পরিচয় করে তারা একটা ঘর দেখিয়ে দিল। সেই ঘরে আমরা চারদিন থাকলাম।

লোকজন উঠছে মালপত্র উঠছে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তিনি সারারাত কাজ করে নিচ্ছেন সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে। তারপর থেকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। বেশ ভাল লাগল না। রতনকে এখনও পেলাম না। ক্যাপটেন বলল, চারদিন হো গয়া। এখন আপনারা নেবে যান। জাহাজ ছাড়ব দুঘণ্টা পরে। তার আগেই, হঠাৎ করে ঘোষণা শুরু হলো এবং ইংরেজিতে ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা জাহাজে তো যাব না।

আমরা এখানে বন্ধুর খোঁজ নেব। তাই কাভারাত্তিতে নেমে জেটির উপর দিয়ে একটু ঘুরিয়ে সৈকতে এসে পৌঁছাতেই হাতে হাতে মিলিয়া বড়া খেলাম। বড় ডাক্তার নেই। রেখার জ্বর। পরবর্তী দিনগুলোতে দেখলাম ডা দীপেন আমার সঙ্গে একরকম ব্যবস্থা করেছেন চিকিৎসার।

সব লোক স্থানীয়। লোকদের। দেখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বন্ধু যদি সঙ্গে থাকত এই আনন্দ দ্বিগুণ হতো। স্থানীয়রা বলল-এখানে প্রবাল রাজ্যের হাতছানি এখানে নানান রকম প্রবাল লাল, নীল সবুজ সব রকমের ব্যবসা রমরমিয়ে চলে। চোরাচালান পথে চলে তার জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হয়। হয়ত এরা এরজন্য লোক এমনকি মহিলা পর্যন্ত চুরি করতে পিছুপা হয় না। এবার আমাদেরও আশা একটু বাড়লো হয়তো এই প্রবালের ব্যবসাদারদের কাছেই আমরা বন্ধুর খোঁজ পাব। স্থানীয়রা ইশারায় তারা বলল, আমরা সঙ্গে আছি। মহাবিপদ, কি হলো হঠাৎ আমাদের তাড়া করলো দুটো অ্যালসেশিয়ান কুকুর। লেলিয়ে দিলো কে। আমরা সমুদ্রের জলে এসে পড়লাম। অমূলকভাবে শান্ত আরব সাগরে স্নান করার মজাটাই হলো আলাদা।

এই বিপদে,সময় সুযোগে আমাদের সমুদ্র স্নান করে নিলাম।

রেখার এক্সপার্ট কিন্তু এর প্রমাণ কোনরকমে হাতের ব্যাগ একজনের কাছে জমা করে ঝাপিয়ে পড়লাম জলে। সাঁতার কাটলাম মহানন্দে। স্থানীয় লোকদের ডাকাডাকি। শুরু হয়ে গেল খবর।কুকুরদুটো আর নেই। রহস্যজনকভাবে এল আবার জলে না নেমে চলেও গেল। 

ভিজে জামাকাপড়েই আমরা এগিয়ে চললাম বন্ধুর খোঁজে। স্থানীয়রা প্রত্যেক লোককে জিজ্ঞেস করে করে দেখছে। এই নামের কোন বন্ধু আছে নাকি। কোন লোক এখানে নতুন এসেছে নাকি।

একজন খবর দিল। খবর দিল, হ্যায় ইখানে একটা নতুন লোক এসেছে। লোক কোথায় আছে তা জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বললো, ইশারায় বলল, আঙ্গুল দিয়ে সেই ঘরটি দেখিয়ে দিল।

সাহসে ভর করে আমরা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলাম অন্ধকার ঘরে হঠাৎ আমাদের পিঠে ধপাস করে আঘাত। লাঠির আঘাত। নাও এবার বন্দি হয়ে গেলাম আমরাও তাদের জালে। আর কিছুক্ষণ পরেই তাদের দলের সর্দার এল। এসে বলল যে তোমাদের সাহস তো মন্দ নয়। ইংরেজিতে বলল। এখানে এলে আর ফিরে যাওয়া যায় না। তোমার বন্ধু এই ঘরেই আছে। এই দেখো এটা কি তোমার বন্ধু?

দেখলাম হ্যাঁ রতন ই বটে। রতন তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। সেরা রুটি আর নারকেলের কিছু সব দিয়ে তারা চলে গেল। আমরা ঘরে বন্দি হয়ে রইলাম।

কি করে এই ঘর থেকে বেরোনো যায় পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও জানালা নেই। দরজা আছে। দরজা একটামাত্র। দরজাটা তালা দেওয়া।

তাহলে বেরনো যাবে কি করে?

আমরা বন্ধ হয়ে গেলাম অন্ধকার জেলে। আর চারিদিকে সশস্ত্র প্রহরী। জামা কাপড় পাল্টানোর জন্য আমাদের জামা কাপড় দেয়া হয়েছিল। আমরা সেই জামাকাপড় পরে নিলাম। যেন কাঁদিয়ে কয়েদির পোশাক যাওয়ার জন্য লাইন দিতে হলো। কিন্তু কোন উপায় নেই এই ঘর থেকে আমরা মুক্তি পাব কি করে। নৌকা দুশমনরা আমাদের চোখ বেঁধে দিল। সেই সবুজ, নীল নীল সমুদ্রের জল আমাদের চোখে ভাসছে। আমরা যে ঘরে বন্দি হয়ে আছি সেই ঘরে একটিমাত্র দরজা। সেই দরজায় কি ফুটো আছে ফুটোয় চোখ রেখে রেখা দেখল, কত রকমের প্রবাল।

তারা প্রবালগুলো নিয়ে ঘষাঘষি করে তৈরি করছে আংটি। আর মজুরদের দরকার হলে প্রয়োজনে ধমক দিচ্ছে। এমন কি মারছো। মধ্যযুগের বর্বরতা। কি করে আমরা এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাব। এই নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা শুরু করলাম। কিন্তু হা হতোস্মি। কোন দিক দিয়ে পালাবো আমরা।

আমাদের পালাবার পথ বন্ধ হয়তো সারা জীবনই এই ঘরের মধ্যে আমাদের তিনজনের কেটে যাবে। ওরা যা খেতে দেবে তাই খেতে হবে। যা কাজ করাবে তাই সেই কাজই করতে হবে কোথায় চালান করে দেবে জাহাজে তাও জানিনা। এই ভাবনায় বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগলো মনে পরতে লাগলো মা বাবার কথা আমার স্ত্রীর কথা। আর এখানে ধরে কাঁদতে শুরু করলো কি করে আমরা কি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবো না কোনদিনই কোনদিনই বাড়ি যেতে পারব না। এই ছোট্ট ঘরে মধ্যে আমাদের কাটাতে হবে। দ্বিতীয় রাত কেটে গেল তবু আমাদের কোন উপায় হলো না। কোনো রকমে খেয়ে একটু জল খেয়ে বেঁচে আছি। 

এবার হয়তো ওরা আমাদের কোথাও পাচার করে দেবে আমাদের পোশাক পাল্টানোর জন্য তারা পোশাক দিয়ে গেছে। এবার কি আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের চিন্তা হলো তাহলে সরকারি সংস্থা থেকে আমাদের তো নিয়ে এসেছে।

তারা কি পুলিশ থানায় খবর দেয় নি। মোবাইল কেড়ে নিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই খোঁজ করতে করতে এখানে আসবে। সেই মনে পড়ছে নারকেল গাছের নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আড্ডা শুরু করেছিলাম। সেই সময়টিতে নামল বৃষ্টি এখানে সমুদ্রের মজাটাও পাওয়া গেল না যতদূর হলে হাটু গেড়ে বসে পড়তে পড়তে আমাদের কখন যে ঘুম এসে গেল। আমরা সকলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

আর পরদিন সকালে আমাদের তিনজনকে নিয়ে একটা জাহাজে উঠলো। জাহাজে উঠে আমরা চিনতে পারলাম সে ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেন ইশারায় একটুখানি হাসি হাসলো কিন্তু কিছু কোন কথা বললো না।  আমরা এখন কি জাহাজে চেপে থাকতে পেরেছি। হ্যাঁ ঠিক তাই ক্যাপ্টেন সামনে। 

এতক্ষণ তো কেউ ছিলনা থেকে নিঃশব্দে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আমাদের কোলে তুলে নেবে বলে। কিন্তু আমাদের তো যাওয়ার সময় হয়নি। এমন সময়ে বিভিন্ন রকম কায়দা করতে শুরু করলো। তারপর আমরা দেখলাম তারা বেশি করে নিয়েছে প্রবাল ও কস্তুরী। সুগন্ধি কস্তুরীর গন্ধে আমরা পাগল। তাও বস্তায় প্যাকেট করা আছে। জাহাজ আমাদের তিনজনকে নিয়ে চলে এলো গেঞ্জি কারখানায়। সেখানে দেখলাম খুব ভালো সুতোর টি-শার্ট। আর কি কম দাম উপহারের জন্য অনেকে কিনে নিচ্ছে। ইশারায় আমাদের বলা হলো এখানেই তোমাদের কাজ করতে হবে। আজীবন। এখানেই তোমরা থাকবে আমাদের বন্দিদশা এখনো ঘোচেনি।

ঘুরে চা পান শেষে আবার তারা ফিরে গেল। আবার আগের ঠিকানায়। এই ঠিকানায় তারা আজ শেষ রাতে এসেছে।

নয়

কাল সকালেই হয়তো পৌঁছে যাবে কোচিতে। আমাদের মন কেমন যেন হয়ে গিয়েছে আর এই আছে তারা কর্মীরা আমাদের ভয় করতে মানা করলো তারা বলল একটা উপায় কিছু হবেই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। তারপরে তারা চলে গেল। বদমাশরা চলে গেলে এদের কাছে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এর মধ্যে একজন এগিয়ে এল। বদমাশ রহিম শেখের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করল। এখন বাধা দেয়াতেই চাবুক আলা ২৭৬০ নং কয়েদী রতনের পিঠে চাবুক মারল।

রতনের বিরক্ত হতে শুরু করলো। কিন্তু রেখা তো থেমে থাকার পাত্র নয়। সে মার্শাল আর্টে কাবু করে ফেলল যাকে তাকে একদম ধরাশায়ী করে ফেললো মেঝেতে। বদমাশ লোকটি শুয়ে পড়ল মাটিতে আহত হয়ে।

সকলে হাততালি দিয়ে উঠল। আর মালিকেরা মালিকদের লোকজন এখন কেউ নেই ওরা হয়তো পাশের ঘরে আছে। শুনতে পায়নি। আমরা পুলিশের আশায় বসে আছি। অবৈধ প্রবাল পাচারকারী দলের নেতা সহ ১০ জন আমাদের ঘরে ঢুকলো এবার তারা অত্যাচার শুরু করবে। তাদের কাছে আমরা শুনেছিলাম তারা প্রত্যেকদিন এইভাবে মারধর করে এবং ভয় দেখিয়ে রাখে যাতে ভালো কাজ পায়। কাজে ফাঁকি তারা বরদাস্ত করে না।

এইভাবে তারা ভয় দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়। মোটা লাঠি দিয়ে ওরা সবাইকে পেটাতে শুরু করল।

রক্তাক্ত হয়ে গেল মেঝে। কিন্তু ওদের মায়া দয়া নেই। ওরা পৈশাচিক। আনন্দে মশগুল। এমন সময় হঠাৎ সদলবলে পুলিশ বাহিনীর আবির্ভাবে আমরা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। এবার তাহলে একটা উপায় হবে। হ্যাঁ ঠিক আমাদের খুঁজতেই তারা এসেছেন।

তারা আমাদের সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সেই স্পোর্টস থানায় রিপোর্ট করাতে তারা আমাদের এখানেও চলে এসেছেন। এবার আমরা নিশ্চিন্ত। নিশ্চয়ই একটা বিহিত হবে। আমাদের তিনজনকে মুক্ত করতে এসে মুক্তি পেয়ে গেল ৩০ জন বন্দি। আমাদের খুব আনন্দ হল। সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে।

কি সুন্দর প্রকৃতির হাওয়া সবুজ নির্মল পরিবেশে মন জুড়িয়ে গেল আর কদিনের আকাশ দেখা মন খারাপের দিনগুলো যেন উধাও হয়ে গেল। পুলিশের আই সি বললেন আপনারা বেড়াতে এসেছিলেন। আপনারা এইদিকে কিছু স্থান দেখে তারপরে কোচি। কোচি থেকে আপনারা ফিরে যাবেন কলকাতা। পুলিশের আইসি বললেন আপনাদের তিনজনের দৌলতে ধরা পড়ে গেল বড় চোরাকারবারী দল। এরা গেঞ্জি কারখানা কাপড়ের কারখানা দেখিয়ে প্রবালগুলো গোপন পথে চোরাচালানে বিক্রি করে প্রচুর টাকা লাভ করে।

এদের ধরতে আমাদের হিমশিম খেতে হয় কিন্তু আপনাদের খুঁজতে এসে আজ আমরা আমরাই ধরতে পারলাম। পুলিশের লোকটির নাম মদনলাল খুরানা। ইনি বললেন, এই দলটা শুধু প্রবাল নয়। এখানকার জঙ্গলের সম্পদ নষ্ট করে চোরাচালান করে। গোসাপের চামড়া চালান করে। হাতির দাঁত কেটে নেয়। নিরীহ হরিণ হত্যা করে। আরও বললেন, আমরা জেনেছি বিশেষ সূত্রে বা বই পড়ে যে, কস্তুরী খুব দামী সুগন্ধি, যা মোঘলরা ব্যবহার করত বলে জানা যায়৷

বর্তমানে এক গ্রাম কস্তুরীর মূল্য প্রায় ৫৫,০০০ টাকার কাছাকাছি!! এই কস্তুরী চোরাচালান করে চোরাকারবারির দল নির্বিচারে হরিণ হত্যা করে চলেছে। পাপ শব্দটা এদের অভিধানে নেই। রতন বলল, কস্তুরী কি এবং কোথায় পাওয়া যায়, বুঝিয়ে আমাদের বলুন। 

মদনলাল বললেন, বই পড়ে যেটুকু জেনেছি তাই বলছি আপনাদের। হরিণের দশ বছর বয়সে নাভির গ্রন্থি পরিপক্ব হয়। এ সময় হরিণটিকে হত্যা করে নাভি থেকে তুলে নেওয়া হয় পুরো গ্রন্থিটি। তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তুরী গ্রন্থির ওজন প্রায় ৪০ গ্রাম। এটি বিশেষ ধরনের প্রাণিজ সুগন্ধি। হরিণের নাভি থেকে পাওয়া যায় এই কস্তুরী, যা মহামূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে পরিচিত। অনেকে নিশ্চয় নাম শুনেছেন। রেখা বলল, আমিও পড়েছি, বহু গুণসম্পন্ন এবং বহু নামসম্পন্ন, এর ঘ্রাণ যোজনগন্ধা বললে কম বলা হয়। কস্তুরীর এক তিল পরিমাণ কোন বাড়িতে ফেললে বহু বছর সেখানে এর ঘ্রাণ থাকে। তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালে সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয় কস্তুরীর ঘ্রাণে। চোরাকারবারি এগুলিকে বিদেশে পাচার করে মোটা ডলার পায়। মদনলাল বললেন, কস্তুরী সংগ্রহকারীরা এই সুগন্ধিকে প্রায় প্রকৃত অবস্থায় রাখেন না।

সচরাচর অন্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করেন। অন্য পদার্থের মধ্যে রক্ত বিশেষ একটি উপাদান। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের সঙ্গে কস্তুরীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে । কস্তুরীর সুবাসেও আছে বৈচিত্র্য। সুগন্ধি ফুলের মতোই যুগ যুগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তুরী মৃগ। এই মৃগ অর্থাৎ হরিণ এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। ইংরেজি নাম ‘মাস্ক ডিয়ার’। এরা খুব লাজুক স্বভাবের। তাই নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ করে একান্ত নির্জনে।

রতন বলল, হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলেও উৎকৃষ্ট কস্তুরীমৃগ পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে একপ্রকার ছোট আকারের হরিণ আছে, তারা ছাগলের চেয়ে বড় নয় কিন্তু দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এদের পা অতি সরু, মাথা সুন্দর এবং চোখ চমৎকার উজ্জ্বল। এই হরিণ অন্য হরিণ থেকে আলাদা নয়। অত্যন্ত শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় এদের লোম সরু না হয়ে অত্যন্ত মোটা ও পালকের মতো হয়। এ ছাড়া পামির মালভূমির গ্রন্থি পর্বতমালায় তৃণভূমি সমৃদ্ধ উপত্যকায় এই হরিণ পাওয়া যায়। এখানেও চোরাকারবারির অভাব নেই। 

মদনলাল আবার বলতে শুরু করলেন, কস্তুরী মৃগের ওপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের মতো দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। এ ধরনের দাঁত সব প্রজাতির হরিণের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এই দেখেই কস্তুরী মৃগ সনাক্ত করা হয়।

এই প্রজাতির হরিণ আত্মরক্ষায় পটু। কিন্তু তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ এদের দেহের তীব্র ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ অনুসরণ করে শিকারি ঠিকই এদের সন্ধান পেয়ে যায়। এই হরিণের নাভি থেকেই মূলত এই সুগন্ধি দ্রব্য সংগ্রহ করা হয়।

পুরুষ হরিণের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এ থেকেই সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। হরিণের ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উৎসের সন্ধানে। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের দেহ থেকেই।

বাইরের দিকটায় থাকে এলোমেলো কিছু লোম। সেগুলো ছাড়িয়ে শুকনো কোষটিকে যখন জলেতে ভেজানো হয়, তখন পরিষ্কার কস্তুরী বেরিয়ে আসে। কোনো কোনো হরিণের মধ্যে পাওয়া যায় খুব কম পরিমাণে কস্তুরী। অপরদিকে এই প্রজাতির সকল হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না; হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয় । 

দেখা গেছে, এক কিলোগ্রাম কস্তুরী পাওয়ার জন্য প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়। রতন বলল, পচা মাংসও এরা রপ্তানি করে। কিছুই ফেলে না। জাহাজে আমরা পচা গন্ধ পেয়েছি। কস্তুরী যখন সংগ্রহ করা হয় তখন এর গন্ধ এত উগ্র থাকে যে হরিণের নাভিকোষ কেটে নেওয়ার সময় শিকারিরা মোটা কাপড় দিয়ে নিজেদের নাক বেঁধে নেয়। অনেক সময় এ গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারো কারো চোখ, নাক থেকে জল ও মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। এমনকি জীবনহানিও ঘটে। এইসবই আমার বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে জানা। তবে এই লক্ষদ্বীপের আনাচে কানাচে রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই এখানে দশটি দ্বীপ ছাড়া অন্য দ্বীপে যাওয়ার পারমিশন নেই। তবু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।

মদনলাল এবার বিদায় নেবেন। সমুদ্রের ঢেউ একের পর এক দ্বীপকে ভিজিয়ে চলেছে নিশিদিন। আমরা ভেসে চলেছি অজানা কে জানার নেশায় যাযাবরের মত।

রাজু বলল, আপনি স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন কিন্তু আপনার খবর তো পায় নি। সন্তুদা বলল, আমি ওকে বিয়ে করেছি। ওর সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল না। গরীব একা মেয়ে দেখে বিয়ে করেছি। ওর বাবা, মা কেউ নেই। আমার মোবাইল ফোনে সে আমার খবর পায়।

শ্যামলী বলে, এবার সন্তুদা বাড়িতেই থাকবেন। আপনি ধনী লোক। সরকারি চাকরি করতেন। আপনার অভাব নেই। সন্তু বললো, আমি খেয়াল হলে হাওয়াই জাহাজে চড়ি আবার পয়দলেও স্বচ্ছন্দ। দেশে দেশে আমার ভালবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এবার আমরা বাড়ি যাব। তোমরাও বাড়ি যাবে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। চাষ করবে, ফসল ফলাবে। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবে। আমিও রাজুর মত শ্রমিকের কাজ করেছি। কুলিগিরি করেছি। কোন কাজই ছোট নয়। আমরা কৃষিকাজে এবার মন দেব সবাই। তাহলে দেখবে কাউকে আর গ্রাম ছাড়তে হবে না।

শ্যামলী বলল, সন্তুদা তোমার তো অভাব ছিল না। বিয়ে হয়েছে। মা বাবা ছিল। তাও তুমি ঘরছাড়া কেন হলে?

সন্তু বলল, আমার বিয়ের পরে বৃন্দাবনে গেছিলাম। তারপর লাক্ষা দ্বীপও ঘুরেছি। ফোনে বাবা জানিয়েছিলেন, একটি গ্রামের ছেলেকে নিয়ে আমার বউ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে কামের তাড়নায়। আর আমি বৃন্দাবনের দেখা মেয়েকে আবার দেখতে গেছিলাম। তার কেউ নেই। আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। সেই আমাকে গেরুয়া পরিধান করিয়েছে। আমাদের প্রেম দেহের উর্ধে। মনের সেতুবন্ধন। রাজু বলল, আমাদের বলুন বৃন্দাবনের কথা। সন্তু শুরু করল বৃন্দাবনের কাহিনীর কথা।

দুজনে ভেবে ভেবে ঠিক করলাম বৃন্দাবনে যাবো। রমার সঙ্গে পরিচয় আগে ছিল না। বিবাহসূত্রে পরিচিত হয়েছে। এখনো পরিচয়পর্ব অনেক বাকি আছে। কেউ কাউকে চিনতাম না। বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এবার নিজেদের মধ্যে পরিচিতি বাড়ানোর জন্য  বিভিন্ন সময় গল্প-গুজব করি আমরা। সময় কাটাতে আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেড়াতে যাওয়ার কথাও চিন্তা করতাম। ঠিক ভেবে ভেবে তাদের সময় পেরিয়ে বৈশাখ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় শ্রাবণ, ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন মাস হল।পুজোর ছুটিতে ঠিক করলাম বৃন্দাবনে যাবো। শুরু হল তোড়জোড়। প্রয়োজনের কিছু জিনিস নিলাম। বাকিটা কিনে নেওয়া যাবে। আমি জানি নগদ টাকা পয়সার সঙ্গে এ টি এম কার্ডটাও রাখতে হবে। 

কলকাতা থেকে দিল্লি আগ্রা হাইওয়ে ধরে ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই বৃন্দাবন। বৃন্দাবনও মথুরায় মন্দির কম করে হলেও ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার প্রায়। মন্দিরগুলি যার বেশিরভাগই কৃষ্ণ, রাধা কৃষ্ণর সঙ্গে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত। বৃন্দাবনে গিয়ে তারা প্রথমে ঠিক করল বাসা। একটি লজ পছন্দ হয়েছে। লজের নাম রাধা ভবন।

সেই রাধা ভবনে তারা আশ্রয় নিল। ভাড়া মিটিয়ে চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকল। এখানে নিরামিষ খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। রমা ও অনুপের পছন্দের খাবার এখানে আছে। লজের সামনে একটা বেশ সুন্দর রাধাকৃষ্ণের ছবি। আর কৃষ্ণের হাতে বাঁশি। স্বয়ং কৃষ্ণ যেন সাক্ষাৎ দাঁড়িয়ে একদম বাঁশি বাজাচ্ছেন। অনুপ আর রমা খুব সুন্দর ভাবে খাওয়া দাওয়া করার পর দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়ল বৃন্দাবন ঘোরার জন্য। বেড়াতে এসে তো আর শুয়ে পড়ে সময় কাটানো ভালো লাগে না। তাই  ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম একটার পর একটা মন্দিরের অভাব নেই। এখানে এসে এখনো মনে হয় যার মনে হয় যেন হাজার বছর আগে থেমে আছে। উত্তরপ্রদেশের এই প্রাচীন ভূখণ্ডটি শহর হয়ে ওঠে। শহরে নেই পাঁচতারা হোটেলের ঝলক। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং প্লাজার স্মার্টনেস কিংবা মাল্টিপ্লেক্সের উত্তরাধুনিকতা কিছুই যেন ছুঁয়ে যায়নি ব্রজভূমিকে।

সরু গলি কাচা-পাকা রাস্তা সাইকেল রিকশা মলিন স্কুল ইউনিফর্ম পরা দল মন মাতিয়ে চলে। রাস্তায় কেবলই গেরুয়া বসনধারীর সংকীর্তন ধ্বনি। কেমন লাগছে তোমার রমা। অনুপ বলল।আমার বউ রমা বলল, সব দেখে খুব ভালো লাগছে। দেখো কুমোরপাড়ায় মাটির কারুকাজ। এদের আর কোন আলাদা ইষ্ট নেই, শ্রীকৃষ্ণ চরণের এই ভূমিতে। মাটির তৈরী রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ বিস্ময় জাগায় অনুপের মনে প্রাণে। এখানে একটা দোকানে শ্রীকৃষ্ণের প্রচুর ছবি বিক্রি হচ্ছে। সেই ছবি বিক্রি করছে একজন সুন্দরী মহিলা। তার বিয়ে হয়নি কি বিধবা বুঝতে পারছে না অনুপ। কেবল তার ডাগর রূপ মনে এক অদ্ভুত সুর তোলে ক্ষণে ক্ষণে। অনুপ ভাবে, ভাগ্যিস মনের রূপ দেখা যায় না চোখে। তা না হলে কত হৃদয় যে ভেঙ্গে যেত মুহূর্ত প্রেমে। সে এতো সুন্দরী যে তাকে তাকে দেখতে মনে হয় অনেক বার। বারবার ঘুরে ফিরে তার দিকে চোখ দিয়ে ফেলছে।

স্ত্রী রাগ করে বলছে তুমি ওদিকে বারবার তাকাচ্ছ কেন। কী মনে করবেন উনি। অনুপ কিন্তু দৃষ্টি সংযম করতে পারছে না।

সুন্দরী মেয়েটি বলল, নিন বাবু দুটো ছবি নিন শ্রীকৃষ্ণের ছবি বাড়িতে থাকা খুব মঙ্গলের। এই ছবি থাকলে কোন বিপদ-আপদ আপনাদের জীবনে নেমে আসবে না। রোজ দুবেলা এই শ্রীকৃষ্ণের ছবিতে ধূপ দেখাবেন। বাতি দেখাবেন। তাহলে দেখবেন কোন বিপদ আপনাকে ছুঁতে পারবে না।

আমি বললাম দুটো নয়, আমাদের চারটে ছবি দিন। আমরা চারটে ঘরে চারটে ছবি টাঙিয়ে রাখবো।আর মনে মনে ভাবল তোমার স্মৃতি ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে। দাও চারটে শ্রীকৃষ্ণের ছবি দাও।

রমা বললো চারটে প্রয়োজন নেই। একটাই নাও।

- না একটা নিলেই তো হয় না। 

- ঠিকমতো ধুপ বাতি দেখালেই তো একটা ফটোতে ভক্তি হবে। ভক্তি দেখানোর জন্য অত ছবি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

আমি বললাম, তুমি বাধা দিও না প্লিজ। না চারটিই থাক। আমি সুন্দরী মেয়েটিকে বললাম, আপনাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি? সুন্দরী মেয়েটি বলল হ্যাঁ নিশ্চয়ই পারেন।

- আপনার নাম কি জানতে পারি। মেয়েটি বলল হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমার নাম লেখা।

- আপনি এখানে আপনি এখানে এলেন কি করে।

মেয়েটি বলল আমি বিধবা হওয়ার পর এখানে এসেছি। তারপরে আমি নিঃসন্তান। তাই একাই আমি এই ব্যবসা করি আর বৃন্দাবন ধামের প্রসাদ গ্রহণ করি। এইভাবেই আমার জীবন চলে যায় রাধামাধবের দয়ায়। জয় রাধে জয় রাধে।

রমার মনে এইবার মায়া জেগে উঠলো সে বললো আহা এত অল্প বয়সে তুমি বিধবা হয়ে গেছো আমি শুনে খুব দুঃখ পেলাম। জয় রাধে।

আমি বললাম - এই বৃন্দাবনে বেড়াতে আসার উৎকৃষ্ট সময় কোনটা বলতে পারেন? লেখা বলল, বৃন্দাবনে বেড়াতে আসতে হলে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ সময়। সে আরও বলল, বৃন্দাবনে গোবিন্দজী মন্দিরটি অসাধারণ দেখবেন। দেখবেন পুরোটা লাল পাথরে তৈরি। প্রায় হাজারখানেক  কারিগর নাকি পাঁচ বছর ধরে মূর্তি তৈরি করেন।

আমরা শুনেছি তবে এই বিষয়ে একটা কথা বলা ভালো আপনার বিশ্বাস থাক আর না থাক বেড়াতে গিয়ে সমস্ত সন্দেহ সরিয়ে রাখবেন। আপনার সন্দেহ জড়িয়ে না থাকাই রাখাই ভালো।

রমা এবার বলল - আপনাকে দেখে তো শিক্ষিত মনে হচ্ছে আপনি তো অনেক খবর রাখেন। লেখা বলল - হ্যাঁ আমি নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি। পড়াশুনা করি বৃন্দাবনের ইতিহাস নিয়ে। অনেক বই পাবেন বাংলা, হিন্দী বা ইংরাজীতে লেখা। এই বৃন্দাবনের পৌরাণিক ইতিহাস।

লেখাও বলল, আমার বরাবরই এই বৃন্দাবন ধামের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যেন আমার সেই আশাই পূর্ণ করে দিয়েছেন। জয় রাধে। 

আমি বললাম - তাহলে আপনার  দেবতা কৃষ্ণ। শুধু কৃষ্ণ। আহারে কৃষ্ণ প্রেমের কারণে আপনি এখানে এসেছেন।

লেখা বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই। ঠিক তাই। ঠিকই ধরেছেন আপনি। এই একটাই দেবতাকে ভজনা করি। তবে শুধু কৃষ্ণ প্রেমের কারণে নয় ভাস্কর্যশিল্পের দিক থেকেও মথুরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

আমি বললাম তাহলে কৃষ্ণ প্রেমই আপনাকেই বৃন্দাবনে টেনে এনেছে।আর তার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে। 

লেখা বলল - হ্যাঁ এটা বলতে পারেন। আমার জীবনে ইচ্ছে ছিল এই শ্রীবৃন্দাবনে এসে শেষ দিন কাটানো। ঈশ্বর যেন সেই আশাই পূর্ণ করলেন। আবার বলল লেখা, তবে শুধু কৃষ্ণ প্রেমের কারণে নয় ভাস্কর শিল্পের দিক থেকেও দেখবেন এই কাছের মথুরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মিউজিয়ামে প্রায় ২০০০ বছর আগে বুদ্ধের মূর্তি অপূর্ব সুন্দর দেখবেন। আপনারা থাকুন কিছুদিন এখানে। শুধু পাথরের মূর্তি সংগ্রহ প্রায় ৫ হাজারের মত। ভাল লাগবে দেখে।

রমা বললো - দুদিন দোকান বন্ধ রেখে আমাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করুন না। আপনাকে নিয়ে দেখলে সব কিছু জানা যাবে। আপনার আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা আপনাকে পারিশ্রমিক দিয়ে দেব।

লেখা বলল, ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই। আমি আপনাদের এই কৌতুহল মেটাতে রাজি।

আমি ভাবলাম, মানুষ অজান্তে খাল কেটে কুমির আনে জীবনে। হয়ত এটাই ভবিতব্য। তারপরের দিন থেকে লেখাকে নিয়ে শুরু হলো মথুরা ভ্রমণ। মথুরা জুড়ে ২,৫২৫টি ঘাট আছে। বিশ্রাম ঘাটের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। লেখা কথাগুলো বলে চলেছে আমরা শুনে চলেছি। লেখা আরো বলছে, কথিত আছে কংস বধের পরে শ্রীকৃষ্ণদেব এই ঘাটে বিশ্রামে ছিলেন। এই ঘাটে তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। বিশ্রাম ঘাটে সন্ধারতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কোন পর্যটক এটা মিস করেন না। লেখা বলল, আমাদের বিয়ের পরও আমরা প্রথম হানিমুনে বৃন্দাবনে এসেছিলাম। আমার মনে পড়ে আমরা ওই লজেই থেকেছি। আপনারাও রাধা ভবনে আছেন।

ওই রাধা ভবনে যে আমরাও ছিলাম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। কিন্তু আমাদের বিবাহ জীবন সুখের হলো না। স্বামী এক পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। জয় রাধে। আমার স্বামী ছিলেন কবি, বাউল। সংসারে তার মনযোগ ছিল না। মালিহা গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল। খুব আনন্দে থাকত আমার স্বামী। সে আমাকে তার জীবনের গল্প বলেছিল। স্বামীর নাম ছিল সন্তু। আসুন আমরা বিশ্রামঘাটে বসে তার গল্প বলি। 

সে বলেছিল আমাকে, কিন্তু বড় সংসারের দায়ীত্ব তার কাঁধে। মায়া কাটাতে হবে। বাউলের মন হয়ে যায় সন্তুর। সে ভাবে, এসব প্রেমের বিলাসিতা কি আমার সাজে? সন্তু ভাবে,বারবার ভাবে পাপিয়ার কথা। কিন্তু ভালবাসা সহজে কেউ পায় না আর কেউ কেউ বাউল সাধক। মানুষের মাঝেই তাঁর বাসা। উদাস ভালবাসা। বৃন্দাবনের শান্তি বারিতেই যেন বিশ্বের মানুষ ভালোভাবে বেঁচে আছেন। সমস্ত দুঃখ তাপ জন্ম থেকে মুছে গেল মুহূর্তে। রমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল আমি জোড়হাতে বিছানায় বসে আছি। রমা জিজ্ঞেস করল কি হল তোমার তুমি কি রাধার রাগে মগ্ন আমি বললাম, হ্যাঁ আমি আমি রাধাভাবে আচ্ছন্ন। এখন রাধার প্রেমে আমি মাতোয়ারা। জানো শ্রীকৃষ্ণ রাধা কৃষ্ণের দর্শন আমার এই ঘরে বসেই হয়ে গেল। আমি মগ্ন হয়ে থাকলাম কিছুক্ষন শ্রীরাধাভাবে মানবদেহের রাধাভাব এর মধ্যে দেখতে পেল লেখাকে।

লেখার সুন্দর মুখখানি ভেসে উঠেছে। সেই সেই মুখে কোনো ব্যথা নেই যন্ত্রণা নেই শুধু আলো আর আলো।

আমরা কয়েকদিন এসেছি। কিন্তু এই কদিন এসে আমাদের শারীরিক মিলন কিন্তু একবারও হয়নি।

কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়েছি আমি। রমা খুব অবাক হল কি হল। সে ভাবল, আমার স্বামীর এ কি হল। সে ভাবল  যে শ্রী কৃষ্ণ ভক্তিতে সে হয়তো এগুলো করতে চাইছে না। এখন বাড়ি গেলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে। পরের দিন আবার শুরু হলো বৃন্দাবনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য। লেখা সুন্দরী এসে গেছেন অমোঘ আকর্ষণে। অনুপ মনে মনে ভাবল এই কথা। হয়ত আমাদের ভালবাসা হয়ে গেছে প্রথম দর্শনে। লেখা বলল-এখানে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই যুগল ঘাঁটি সেবাকুঞ্জ ও কালিয়া ঘাটাল শ্রী কুঞ্জ গোবিন্দ কুণ্ডু শিলঘাটা মদনমোহন বাঁকে বিহারী রাধাবল্লব যুগলকিশোর রাজি দামোদর গোবিন্দ গোবিন্দ। এগুলো আমাদের দেখাও লেখা। 

আমি বললাম, আমরা একে একে সব দর্শনীয় স্থান ঘুরবো তবে প্রথমে বৃন্দাবন মন্দিরটা একবার দেখাও। লেখা বলল চলুন আজ আমরা বিদ্যামন্দিরে যাই। সেখানে এক বিরাট আকর্ষণ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। লেখা বলল মদনমোহন মন্দিরটি কালীঘাটের কাছে মথুরা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। রমা জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা মুলতানি কাপুর কি এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন? লেখা বলল,  এটিই বৃন্দাবনের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। বাঁকে বিহারী মন্দির, জয়পুর মন্দির, রাধাবল্লব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১৮৭৬ সালে।অন্যতম আকর্ষণ রাধাকৃষ্ণের বহু মূল্যবান অলঙ্কারসমূহ। এগুলো ভারতবর্ষের সম্পদ।

আমি বললাম আপনি এত কিছু জানলেন কি করে? লেখা বলল আমার এখানে প্রায় দশ বছর থাকা হয়ে গেল। আর বৃন্দাবন ভ্রমণ বৃত্তান্ত, বইয়ে পাবেন এসব কথা। এখানে বই কিনতেও পারেন।তাছাড়া বাইরের অনেক বই আছে। জানার ইচ্ছেটাই আসল। রমা ঘুরতে ঘুরতে লেখা আর আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। সে হয়তো অন্য  কোথাও ঘুরতে গেছে।

চলে আসবে চিন্তা করবেন না। এখানে চলে আসবে। আর না হলে আমার তো সব জানা জায়গা।  আমি খুঁজে নিয়ে আসবো। আমি বললাম এখন ওকে দরকার নেই। এখন আমার তোমাকে দরকার।তাই আমরা হয়ত সুযোগ পেলাম বিধির বিধানে। 

তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই। লেখা বলল, বলুন আমিও বলবো একটা কথা কিন্তু আমি কি করলাম আর কি, লেখাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বনের রত হলাম। এটাই চাইছিল লেখা। তার শরীর কেঁপে উঠল। মনে মনে তৃপ্ত হল। এর মধ্যে রমা চলে এসেছে।

তখন রমা দেখল আমি আর লেখা গল্প করতেই ব্যস্ত।

দশ

আমি বললাম আমরা সারা জীবন যদি এখানে থাকতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। রমা বললো তাহলে ঘর-সংসার ছেলে চলো দুজনেই আমরা এখানে সন্ন্যাসী হয়ে থেকে যাই।

তারপর, আহা তারপর দুজনে মিলে এখানে সারা জীবন কাটিয়ে দিই। লেখা বলল, তাহলে আজ এই অবধি থাক। এখন রাত্রি নটা বেজে গেছে এখন আপনারা বাড়ি যান। এই বলে লেখা নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। লজে এসে রহমান নিরামিষ খাওয়া দাওয়া দিয়ে গেল। আহার করে তারা বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর রমার সঙ্গে সঙ্গমে রত হলাম।

আজ এত ভালো লাগছে কেন রমা বুঝতে পারলো না। রমাকে আসলে লেখা ভেবে অনুপ আদর করতে শুরু করলাম।

তার মধ্যে লেখার ভাব পরিস্ফুট হতে দেখল। লেখাকে আমি আদরে আদরে পাগল করে তুললাম।রমা বলল আমি কোনোদিন এতক্ষণ এত আনন্দ পাইনি। তুমি আজকে আমাকে খুব আনন্দ দিলে।আমি বললাম, রমা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ চারিদিকে বাঁশির আওয়াজ। কি মিষ্টি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে।

তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বাঁশির আওয়াজ।এই বাঁশির আওয়াজ আমি শুনে এত আনন্দ  হচ্ছে কেন।রমা বলল,কই আমি তো বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না পাচ্ছি না। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে।

আমি বললাম, আমি বোধহয় ভুল শুনছি নাকি। ঠিক শুনছি। এই তুমি কি পেতে শোনো দেখো বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে চারিদিক থেকে। এমন সময় রমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। এতদিন লেখার সঙ্গে যোগাযোগ রমার সঙ্গে কথাবার্তা সব মোবাইল ফোনেই হয়েছে। লেখার মোবাইল ফোন আছে। ফোনে রমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?

চারিদিক থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে ভেসে অন্তর ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে প্রেম সুন্দরের কাছে।  সুন্দর বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে আসছে রমাদি। রমাদি আপনি শুনছেন। সন্তুদা কি শুনতে পেয়েছেন বাঁশির ইশারা। রমা নিরুত্তর হয়ে বসে রইল। হারিয়ে যাওয়ার ভয় চেপে ধরল রমার অন্তর। সে বলল, না আর নয়, এবার ফিরতে হবে। আমি বললাম,ফিরতে পারব কি? ফেরা যে কঠিন হল মরমিয়া।

রমা অনুপের কথায় হেঁয়ালির সুর খোঁজে। বাঁশির সুর তার কানে বাজে নি। সে জানে না, এখনও এখানে বাঁশি বাজে। সারা পৃথিবী জুড়ে বাঁশির খেলা চলেছে নিশিদিন। মোবাইলের ও প্রান্ত থেকে শোনা গেল লেখার গলায় বাঁশির করুণ সুর, রমার মোবাইলে সাউন্ড হাই থাকায়। হ্যালো হ্যালো হ্যালো, আমি শুনছি বাঁশির সুর। এসুরে আমি মাতোয়ারা। এ সুর ভালবাসার... 

তারপর বাড়ি চলে গেলাম কিন্তু মন পড়ে রইল বৃন্দাবনের লেখার খাতায়। আবার বাড়ি ছাড়লাম। লেখা শিখিয়ে দিল দেহ ছাড়া প্রেম। সে বৃন্দাবনের আশ্রম ছেড়ে এল না আমার সঙ্গে। আমার আর খেদ নেইন। দেখেছি পরম পুরুষের ঈশারা। আমি গ্রামে যাব। চাষ করব। আর কোন তরুণ যেন গ্রাম ছেড়ে বাইরে না যায়। আমি তোমাদের সাহায্য চাই।

রাজু বলল,আমরাও চাষ করব। আর কোথাও  যাব না। আমরাও অন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করব। এখন থেকে এটাই হবে আমাদের মন্ত্র। আজ সকালে উঠে থানার আই সির পারমিশন নিয়ে তারা ট্রেনে চেপে বসলন এক মাস পরে। আর কোন বাধা নেই। নতুন পৃথিবী গড়বে এবার নব উদ্যমে। 

কিশোর

উপন্যাস

Sudip Ghosal.jpg

হরেনবাবু ও

কঙ্কালের কেরামতি

সুদীপ ঘোষাল

পূর্ব বর্ধমান, পঃ বঙ্গ 

doctor.jpg
হরেনবাবু

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

এক
ডাঃ হরেনবাবু হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। তার ডাক্তারখানায় ঝোলানো কঙ্কালে হাত দিতে ভয় লাগত। সর্দিকাশি, পেটখারাপ বা অন্যকোন রোগ হলেই আমাদের আশ্রয় ছিল হরেনবাবুর চেম্বার। হরেনবাবু এক ডোজ ওষুধ খাইয়ে দিতেন প্রথমে তারপর কাগজ কেটে কাঁচের শিশিতে আঠা দিয়ে সাটিয়ে দিয়ে রোজকার ওষুধের পরিমাণ, নির্দিষ্ট করে দিতেন। হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেতে আমার মত সব কিশোর কিশোরীর মন্দ লাগে না। বেশ মিষ্টি, মিষ্টি। ছোট ছোট সাবুদানার মত দেখতে।
আমি, রতন, হারু, বিনয় আরও অনেক বন্ধু একসঙ্গে থাকতাম। একই স্কুলে পড়ি। একই মাঠে খেলি। ডাক্তারবাবু খুব কড়া মেজাজের লোক হলেও আমাদের ক্রিকেট দলকে খুব ভালোবাসতেন। প্রয়োজনে তিনি ব্যাট, বল কিনে দিতেন। উৎসাহ দিয়ে বলতেন, যারা খেলা করে তাদের কোন রোগ সহজে কাবু করতে পারে না। খেলবি, দূরদূরান্তে গাঁয়ের নাম ছড়িয়ে দিবি ম্যাচ জিতে শিল্ড এনে। একদিন আমরা সকল বন্ধু একসঙ্গে খেলা দেখার জন্য, ট্রেন ধরে চলে গেলাম কুমোরপুর হাটতলা হল্ট। মনে করলাম, তাড়াতাড়ি চলে আসব, দুপুরের আগে। পরীক্ষা হয়ে গেছে। বাড়িতে শাসনের দড়িটা একটু ঢিলে হয়েছে। মা বলেছেন, খাওয়ার সময় যেন ডাকাডাকি করতে হয় না। আর সবসময় স্বাধীন এই কটা দিন। বন্ধুরা ডাকল ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য। আমাদের ফুল টিম খেলা দেখতে চলে এলাম কুমোরপুর হল্টে বিনা টিকিটে। ভাবলাম খাওয়ার সময়ের আগে বেলা দুটোর সময় হাজির হয়ে যাব মায়ের কাছে। কিন্তু সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।

একটা টিম খেলতে আসে নি। এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে ভেবে আমরা কমিটির কাছে একশ টাকা দিয়ে আবেদন করলাম। কমিটি রাজি হল। আমরা মাঠে নামলাম ফুল টিম নিয়ে।পরপর অনেক টিমকে হারিয়ে আমরা ফাইনালে উঠলাম। ফাইনাল খেলা শুরু হবে বিকেল তিনটের সময়। এখন দুটো বাজে। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। ভাতের থালা সাজিয়ে বসে আছেন নিজে না খেয়ে। যেতে পারলাম না বাড়ি। খিদে লেগেছে খুব  পাশের বাড়ির কাকিমা মাঠের ধারেই বাড়ি। কাকু, কাকিমা দুজনে এসে বললেন, তোমাদের খেলা দেখে ভাল লেগেছে আমাদের। আমরা তোমাদের সাপোর্টারস। এই নাও এক থালা পিঠে তোমরা খাও। আমরা ভালোবেসে বানিয়েছি। আহা খিদে পেটে  অই পিঠে একদম অমৃত। পেট ভরে খেলাম। আমার ভাই বাবু বলল, দাদা আজ বাবা চামড়া তুলবে পিটিয়ে। আমি বললাম, কি আর করা যাবে। অন্যায় করলে তো কেউ ছাড়বে না।

তারপর ফাইনালে জিতে শিল্ড নিয়ে আমরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বিজয় নাচ দেখতে হাজির হল গ্রামের লোকজন। ডাক্তার হরেনবাবুকেও ভিড়ে দেখলাম, হাত নাড়ছেন হাসিমুখে। 
বাবা, লাঠি হাতে চিৎকার করছিলেন। খেলায় জেতা, বড় শিল্ড দেখে চুপ করে গেলেন। মাকে ডেকে দিয়ে নিজে চলে গেলেন ছাদে।

তারপর বাড়ি ঢুকলাম সন্ধ্যাবেলায়। মা তখনও উপোষী। একসঙ্গে খেলাম পিঠে আর খেজুর গুড়। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তোদের বাবা খুব খুশি। আমাকে ডেকে দিয়ে বললেন - যাও দেখ গিয়ে গ্রামের ছেলেরা খেলে শিল্ড এনেছে। গর্বের খবর গো। তারপর থেকে বাবা আমাদের আর কোনদিন গায়ে হাত দেন নি। 

দুই

প্রথমে হাঁটু মোড়ল রাস্তার ধারে গাছ লাগাত কোন লাভের প্রত্যাশা না করেই। পৈতৃকসূত্রে তার দুবিঘে জমি আছে। একদিন হাঁটুর স্ত্রী বললেন, ওসব কাজ করে তো পেট ভরবে না। গাছ লাগানোর ফাঁকে জমি দুবিঘায় সবজির চাষ কর। তারপর হাটবারে বিক্রি করে আসবা। হাঁটু ভাবে, বউটা কথাটা মন্দ বলে নি। চাষ না করলে খাব কি? তারপর থেকে হাঁটু মোড়ল সবজি চাষ করে আর বিক্রি করে আসে হাটবারে।

সপ্তাহে দুদিন হাট বসে ভুলকুড়ি গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে। প্রায় দশ বারোটা গ্রামের খরিদ্দার এই হাটে আসেন সবজি, মাছ ও আরও নানারকম জিনিস কিনতে। হাঁটু মোড়ল সবজি চাষী। তাঁর বেলুন গ্রামে, বাড়ি। তিনিও সবজি নিয়ে বসেন হাটবারে। তিনি বলেন - আমি জমিতে কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগ করি না, কারণ বন্ধুপোকা না বাঁচলে মাটির উর্বরতা কমে যাবে।
হাঁটু বলেন - খরিদ্দাররা পছন্দ করে লকলকে লাউশাক, পালংশাক বা বড় ফুলকপি। হাঁটু মোড়ল জানে ওইসব হাইব্রিড ফসলের কোন মিষ্টতা নেই। দেখতেই সুন্দর খেতে ভাল নয়। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তার ক্ষেতের সবজি দেখতে সেরকম না হলেও খেতে সুস্বাদু। কিছু বাঁধা খদ্দের হাঁটুর আছে। তারা, তার কাছেই সবজি নেয়।

হাঁটু মোড়লের কাছে একজন শিক্ষিত লোক আসেন। তিনি তার কাছেই সবজি কেনেন। তিনি বলেন কীটনাশক প্রয়োগ না করা সবজিই আমার পছন্দ। হাঁটু মোড়ল বলেন - সবাই তো তাই খায়। আমার সবজি বিক্রি হয় কম। আপনি একটু বুঝায়ে বলুন দেকি, কি কি ক্ষতি হয় কীটনাশক প্রয়োগ করলে।
শিক্ষিত ভদ্রলোক বললেন - সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কিডনি ও যকৃতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কৃষি বিভাগের নিয়মানুযায়ী সহনীয় পর্যায়ে কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত, তাহলে তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে না।
টমেটোর গাছে অধিক ফলনের জন্য বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। হাইব্রিড টমেটো চাষাবাদের কারণে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। চলতি মৌসুমে কৃষকেরা খেতে সিতারা ও সিক্সআর জাতের বিষাক্ত কীটনাশক চার-পাঁচ দিন পরপর প্রয়োগ করছেন। কীটনাশক প্রয়োগ করলে খেতের আশপাশের নদী, ছড়া, নালা এমনকি জলাভূমিতে তা ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদ, সাপ, ব্যাঙ, মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী মারা যায়।
বাজারের চকচক করা টমেটো বা সবজি কিনে না খাওয়াই উত্তম। এমনকি এগুলো কেউ বিনা মূল্যে দিলেও নেওয়া ঠিক হবে না। এ ছাড়া এ সময় তাঁরা কীটনাশকের দুর্গন্ধও পেয়েছেন। এগুলো মুছতে না মুছতে আবারও কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। কৃষি বিভাগ থেকে নিয়মিত কৃষকদের সহনীয় পর্যায়ে সার ও ছত্রাক নাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সার, ফেরোমোন বড়ি এবং হাত দিয়ে পোকা দমনসহ যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
হাটুমোড়ল খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনে বলল - মাটি হচ্ছে মা। মা কে বিষ খাইয়ে মেরে দিলে পাপ হবে। ছেলেমেয়েরা আর শুদ্ধ মাটি পাবে না। বিষাক্ত, কালো হয়ে যাবে মাটি।
শিক্ষিত না হয়েও হাঁটু মোড়লের কৃষি জ্ঞান দেখে সকলে অবাক হয়ে যান।

কয়েক বছরের মধ্যেই রাস্তার ধারে লাগানো গাছগুলো বেশ বড় আর সবুজ হয়ে উঠেছে। হাটে যাওয়ার পথে হাঁটু দেখল, গাছগুলোতে গজাল ঠুকে লেখা হচ্ছে, বেলুন পঞ্চায়েতে ঢুকুন, সবুজ উপভোগ করুন। গজালগুলো হাঁটুর বুকেও আঘাত হানল। হাঁটু বলল,ছোট গাছে গজাল ঠুকো না, ওদের ব্যথা লাগবে। লোকটা হেসে উত্তর দিল - তোমার না লাগলেই হল, হাঁটু মোড়ল। নিজের কাজে যাও। হাঁটু আর কথা না বাড়িয়ে হাট থেকে ফিরে ফাঁকা রাস্তা দেখে আবার গাছ লাগাতে শুরু করে। 

তিন

গ্রামের বাড়িতে আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি ছিলো। সন্ধ্যাবেলা হলেই হ্যারিকেন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতাম দোতলার ঘরে। আমরা ভাই বোন একসাথে পড়ছি, এমন সময়ে কালোদার গলা শুনতে পেলাম। পড়ার থেকে গল্প হত আমাদের বেশি। বড়দা সবাইকে চুপ করতে বললো, কিসের চিৎকার হচ্ছে। শুনলাম নিচে হৈ হট্টগোলে সবাই ছোটাছুটি করছে। কালোদা আমাদের বাড়ির লোকাল গার্জেন। তিনি নিচে থেকে বলছেন - ওপরে যারা আছো, কেউ নিচে নামবে না। বড়দা জিজ্ঞাসা করলো - কেন কালো দা? কালোদা জোরে চেঁচিয়ে বললেন - গোলার তলায় গুলবাঘ ঢুকেছে। সাবধান। ওরা মানুষের রক্ত খায়। বড়দা বললো - গুলবাঘ আবার কি? কালোদা বললো - বাঘের মত দেখতে। কিন্তু বাঘ নয়। সাইজে একটু ছোটো। ঠিক হায়েনার মত। ওরা খুব হিংস্র।

বাড়িতে সবাই আতঙ্কিত। সকলে ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে বসে আছে। উঠোন একদম ফাঁকা। আমার বড়দার ভালো নাম দিলীপ। কিন্তু বড় শ্রদ্ধায় ডাকনাম আমরা দিয়েছি, বাহাদুর বিশু।বাহাদুর বিশু পরোপকারী, বুদ্ধিমান, দরদী এবং সাহসী যুবক। বিশুর কাহিনী আমার স্মৃতিকথা, সাদা পাতায় জীবনরেখা গল্পে বিস্তারিত বর্ণনায় পাবেন। যাইহোক বিশু বললো - আর পারা যাচ্ছে না। গুলবাঘ গোলার তলায় ঢুকে আছে। বের হচ্ছে না। দেখি খুঁচিয়ে বের করি। এই বলে একটা গিঁট তোলা লাঠি নিয়ে নিচে নেমে এলো বিশু। একহাতে তিন ব্যাটারীর টর্চ আর এক হাতে লাঠি। সকলে চিৎকার করে উঠলো, যাস না হতভাগা। কিন্তু বিশু মনস্থির করে ফেলেছে।তার বুদ্ধিতে সে বুঝতে পারছে এটা ভয়ংকর কিছু নয়। কিন্তু বিশু লাঠি দিয়ে খোঁচা মারার সঙ্গে সঙ্গে গুলবাঘ বিশুর কাছে চলে এলো।সে দেখলো, একটা ভোঁতা মাথা। টর্চ রেখে বিশু মারলো চার লাঠি। কিন্তু একটাও গুলবাঘের শরীরে পড়লো না। জন্তুটা লাফিয়ে উঠছে তিন ফুট।তারপর বিশু মাথা ঠান্ডা করে অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। সে দেখলো, জন্তুটা বসে আছে আর মাথাটা নাড়াচ্ছে। তিন ব্যাটারীর টর্চের আলোয় দেখলো বিশু, ওটা মাথা নয়। একটা ঘটি। জলের ঘটি। ঐ চারটে ট্যাংরা মাছ বিশু ছিপে ধরে রেখে ভুলে গেছে বাড়িতে বলতে। বিশু ঘটিটা হাত দিয়ে ধরে টান মারতেই খুলে গেলো। একটা বিড়াল মাছ খেতে গিয়ে ঘটিতে মাথা আটকে যাওয়ায় এই বিপত্তি। বিশু লাঠি রেখে বিড়ালটাকে ধরে আদর করলো। সবাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। কালোদা বললো - শালা বিড়ালের লোভ আর যাবে না। মারো শালাকে। বিড়ালটা আদরে আবদারে ডেকে উঠলো - ম্যাঁও।

চার
তখন গ্রামে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধ্যে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। বাবা, মা, কাকিমা, দুইবোন সকলে একসাথে থাকতাম। বিশ্বকর্মা, সরস্বতী পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল। তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড় জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম। 
সৈকত তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য। বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলো কে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।
সৈকত বলল - স্যার তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল - আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন - তাহলে দেখ, এই একশো কিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি? সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়ে গেল, অনুভূতি বা ‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না! এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল - অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে। স্যার বললেন - হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার, সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার। আমরা অবাক হয়ে হাসছি। হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাস্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য। তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেডমাষ্টারমশাই ও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো। এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা। তারপর দশ মিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি।অমর বললো, স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি...

পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই। জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া। এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আর একটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার। আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সে সব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় বলে মনে হয় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন - আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে  গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি।  তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা।

পাঁচ

গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ, ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে, বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এইরকম হন। ফোচন বললো। ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো, আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন - আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো - কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো - একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম।
মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন - এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে। আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন - এটা কি?
আমি ভাবলাম - আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন - এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।
ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গী ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি, আর, জি, আর, খেমকা হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা  ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেত তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া। এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই। মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে। গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন। আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভর্তির পরীক্ষা হলো। হেডমাষ্টারমশাই বললেন - বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে। আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভর্তি হয়ে গেলাম।
স্কুলে আজ বাংলার স্যার দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিলেন। কবি বিহারীলাল ও অক্ষয়কুমার বড়াল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। স্যার সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন তিনি বললেন - কবি বিহারীলাল বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কবিগুরু তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার 'ভোরের পাখি' বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। অতি অল্পকালের ভিতরে তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। 

ছয়

মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে  নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিস্টার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো  বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই  বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগার পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটা। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পড়েছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে পালালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টি জল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে,  ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাসংগীত শোনাতো। সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না। দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো। দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক।গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। মামার বাড়ি গেলেই

গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কি রে গীতু ভালো আছিস, আই মিনে আয়। সুদপে, রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো। আবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা, জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিমধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে। আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে  হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে। 

 

সাত

তারপর সংসারের টানা পোড়েন। রাগ, হিংসা, ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতা পাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতা পাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম - দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন - জানি না ভাই। তবে। মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন - আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো, তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপারে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম - ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন - মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম - না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই, দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে। অনেক বছর অপেক্ষা করেছি, দাদুর কথা শুনবো ওপার থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত। আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতু গ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে। বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়। দুঃখ শেষে আনন্দ। আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসার নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয়। যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে। সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবন যুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসার আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারী রূপী দেবীর রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জা ভূষণ। পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীনভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক। আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি।  যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা নিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেন রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশু বলতো - দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি। ভেজে খাওয়া যাবে।

আট

বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয় একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়। গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো - আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেডমাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন - ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন - আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি। বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন - এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম। পরেরদিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রাম দেশ ছাড়িয়ে অভাবী বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো। আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়। বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এত বড় মন সে পেল কোথা থেকে? 
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেডমাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে। ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশী বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল। বিশু বললো - টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের। তার অভয়বাণী ভরসা করে আমরা মালপত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপ্টেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো - যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো -  ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।

 

নয়

এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাঁড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো। আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে - ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গীরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো - যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে। তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে। বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের, শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পড়লে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন, বিশু, আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা, গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানে আর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌকা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো - কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সবজি, খলসে ও আরো নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, চোখো, চ্যাঙ, ছিঙুরি, গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনেকবার তো আল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল, গুঁতে, কৈ, মাগুর, ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে। বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল, পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায় বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয়ে আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণযুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন - ছোটো থাকাই ভালো রে, সংসার অসার। মা বলতেন - এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি। মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ...স্বজনবন্ধুরা বলবে... আর কত সময় লাগবে শেষ হতে...একটু দ্রুত করো ভাই...তবে কিসের এত অহংকার... কেন এত লোভ... ভালোবাসায় কৃপণতা। কে ধনী... টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই..। কৃষ্ণধনে ধনী যেজন নিজ ধামে ফেরে সেজন..। লক্ষ্মীপুজো এলেই মা বলতেন কোজাগরীর অর্থ।


দশ

তিনি বলতেন, কোজাগরী লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষ্মী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তার ফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো, শিবলুনের মেলা, উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকাদি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা, রুনু, শঙ্করী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে। পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনে আছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খাবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যার ইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দোকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপারে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়েছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত, ভব, ভম্বল, বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়াতলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল, শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউ এলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেড়ে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছে উঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দেবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে  নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পড়তো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না। ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না। সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো। পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি । হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ। পায়ে হেঁটে। গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কোয়ার। জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর। বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরীকে। তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো। অমিত রান্না করতো খুব ভালো। পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম। ও শেফ হতে চেয়েছিলো। অনিন্দিতা বলে বান্ধবীটা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সব স্বপ্নগুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো। ঐ বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে। রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে। অসীম গান করে, বিচ্ছু একতারা বাজায়। অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে। হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..

এগারো

ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি। এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে। ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ। আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু। দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি, শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু। চেনা আত্মীয়র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা। হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া, বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া, পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা, মঙ্গল চন্ডীর উঠোন, দুর্গা তলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না। কেঁয়াপুকুর, কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া, শিব তলা, পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা, তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা। এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব। সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া, কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা, কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই। পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই। শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ। এই গ্রামেই আমার সবকিছু, আমার ভালোবাসা, আমার গান।ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পীকে। তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না। তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী, ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে, আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত, ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভে (দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচতে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন। তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনত দুদিন ধরে।

কবিতাঃ প্রণব কুমার দাস

কবিতা

প্রণব কুমার দাস
বিরাটি, কলকাতা

Pranabkumardas.jpg

দুই শালিক 


পৌষমাস.....
আলস্য মাখা সকাল,
নরম লেপের ওম,
ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা,
জানালায় মন ভাল করা - দুই শালিক,
মিঠে রোদে সেঁকা খবর,
নরম হাতের গরম রুটি-তরকারী,
পড়নে পছন্দের শার্ট, যুতসই ঘড়ি,
ব্যাগে বনলতা সেন, কলম, জল-টিফিন,
পকেটে মানিব্যাগ... আজও খুচরোর অভাব,
স্টেশনে অনাবশ্যক ভিড়,    
রেললাইনে গড়ায় চাকা... ঘর্ষণ,
কামরার দুলুনি, হকারের ছড়া,
ঘুম ঘুম মধ্যবিত্ত আবেশ....
সহযাত্রীর বকুনি, গন্তব্যের ঝাঁকুনি,
নেমে রিকশা ....... আমার ইস্কুল।
প্রার্থনার 'আগুনের পরশমণি',
ক্লাস শুরুর ঘন্টা,
শ্রেণী শিক্ষক, সপ্তম শ্রেণী, বিভাগ ‘ক’,
রোল কল শেষে এক মিষ্টি নালিশ .... সমাধান।
তারপর... নদীর ক্ষয়কার্য,
ব্ল্যাকবোর্ডে ভাস্কর্য, ভাল লাগার ক্ষণ,

জীবিত জীবাশ্ম, স্বপ্নের ভারে স্থবির।
তবুও পাশে এক উষ্ণ আবেশ
সম্বিত ফেরে তার ডাকে।
“ঝড়, চৈত্রে কালবৈশাখীর ঝড়
তছনছ করবে সে ...”
ময়দানে ধূলার কুন্ডলী, চারপাশ ঝাপসা, ধূসর।
এই ভাবে কিছুক্ষণ, পাশাপাশি দুজন...বৃষ্টির আশায়।
অতঃপর বৃষ্টি, কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি - সোঁদা আঘ্রাণ।
ভিজে যায় শরীর, শরীরের ধূলা মরে হয় কাদা,
তৃপ্ত ময়দান - মিটিয়েছে তৃষ্ণা, ছাপিয়েছে রাজপথ,
ঘাস এখন আরও সবুজ।
কিন্তু আমার মন তৃষ্ণার্ত, কাতর।
চোখের জল ঢেকেছে আকাশের জল,
তবু আগামীর লক্ষ্যে অবিচল…
বেলা শেষ, দিগন্তে রোদের ঝিলিক,
পুব আকাশে ছেঁড়া রঙধনু ফ্যাকাশে, বেমানান।
এবার ঘরে ফেরার পালা...
তবু ভেজা ঘাসে বসে থাকে এক জোড়া শালিক।                       

ক্লাস শেষে লাজুক ডাক,
জন্মদিন... এক গোছা গোলাপ,
অফ পিরিয়ডে পায়চারি,
হঠাৎ হাত ধরে টান,
‘ও স্যার আমাদের ক্লাসে এসো '...
নাছোড় ডাক, অবুঝ শৈশব, খিল খিল হাসি।

******

আবারও টান...

হাত ধরে টান, হেঁচকা টান,

জোর বড়ো বেশি!
বুক ধরফর, গাঢ় শ্বাস, ঘার্মাক্ত শরীর - অস্থির,
ভীষণ গরম! আঁতুড়ে গরম, প্রবল সংশয়....
আমি - জীবিত শরীরে মৃত আত্মা,

না কি মৃত দেহের জীবিত সত্তা?
ক্ষণিকের ভ্রান্তি.... বিস্ময়!
ঘুম? ঘোর? না দুরাশা...
আজ ২২ শে চৈত্র, আমি ধর্নায়।
সাথে একদল...
হার না মানা ক্ষয়াটে চেহারা।
রাজপথে কোলাহল, ভারি হট্টগোল,
পশ্চিমে আকাশ বিষণ্ণ, মিশ কালো,
বাতাসে মেদিনীর ভার।
আমি নিশ্চল...

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ কৃষ্ণতরু বর্মন

কবিতা

কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস

বয়েই গেছে

য়েই গেছে..

বৃষ্টি ভেজা মাটি, সদ্য স্নাত নরম ঘাসে পায়ের ছাপ

কিছুটা জল উঠে এসে- 

তোমার সকালের নেলপালিশ ভিজিয়ে দিল। 

আমার ও...

চটিতে নতুন পেরেকের সোহাগ, 

যন্ত্রণা ভুলে অঙ্গে নতুন চামড়ার গন্ধ, 

রুগ্ন শরীরে কত আনকোরা কাটাঁছেঁড়া, 

শীর্ণ আঙ্গুলের অবিরাম কারসাজি। 

আর তো কটা দিন! 

করুক শহুরে ধুলো-জলের সাথে আলগা পিরিত...

তাও গিলে নিল এই ক্ষণজন্মা বৃষ্টির সুস্বাদু জল!

​***

কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে তোমাকে লেখা আধখানা চিঠি,

মাঝদরিয়ায় উঠলো তুফান,

শব্দের টানাটানি, হাহাকার, বিজ্ঞাপনে 'সন্ধান চাই'

মাথামুণ্ডু না বুঝে ধার করা শব্দগুলো

আলগোছে পাশাপাশি, নাম দিয়েছি 'কবিতা'...

অসাধ্য সাধন! তাও শুধু তোমারই জন্য।

কাকভেজা শালিকের ডানা ঝাঁপটানো জলের ফোঁটা 

হাওয়া মিশে তোমার চোখের পাতায় খোঁজে আশ্রয়

এক বিষণ্ণ বিকেলের আর্দ্র স্নিগ্ধতায়।

কথা হয় নি কখনও আমাদের, হবেও না।

শুধু তোমার হাতটা ছিল আমার হাতের মুঠোয়...

মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী - 

তারপর, জংলা ঘাস, নেল পালিশ, চটির উপাখ্যান ...

কিছুই মনে রাখিনি।

বয়েই গেছে...

সেই সংলাপ

"হ্যাঁ রে, খেয়ে যাস, বলিস কখন খাবি?

বেরোনোর সময় ছাতা নিস, বৃষ্টি হতে পারে"

মেঘের চোখে চোখ রেখে এই দুটো কথাই! 

উঠতি বয়স, সময়ের থেকেও দ্রুতগামী,

অগোছালো পদক্ষেপে মন দিয়ে শোনা হয় নি। 

দায়সারা উত্তর - 'এসে খাবো' কিম্বা -

'ধুর! ছাতা কে নেবে'। 

যেমন বলি যৌবনে, দাম্ভিক উদ্দামতায়। 

তারপর আর কিছু মনে নেই, থাকার কথাও নয়। 

তবে শুনলে ভাল হত, আজ মনে হয়

জীবনের অপরাহ্ণে...

সেদিন ফেরেছিলাম তাড়াতাড়ি, 

কেন জানি না, ফেরার কথাও কিন্তু ছিল না...

না বৃষ্টি আসে নি ঠিকই...তবে... 

এরপর আর কখনো ছাতার

কথা মনে আসেনি হাজার বৃষ্টিতেও!! 

হয়ত প্রয়োজন পড়ে নি, কিমবা 

হয়ত মনে করানোর কেউ ছিল না বলে। 

***

চলমান সময়ের ভাঁজে ভাঁজে 

মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ফেলে আসা কিছু মুহূর্ত 

ডাইরির মলাট জুড়ে শুধু স্মৃতির ধুলো...

সরাতে গিয়ে তর্জনীতে একরাশ...

ধুলোর আড়ালেই - 

মন জমিনের গভীরেই অদৃশ্য প্লেটের ঠোকাঠুকি 

নির্গত শক্তি, রেখটার স্কেল! প্রাণহীন, স্থবির, অর্থহীন

আয়না বছর গোনে, রাখে অপর্থিব সময়ের হিসাব​

চোখের নিচে বলিরেখা নিয়ে নিদারুণ মস্করা... কিম্বা 

চোখের গভীরেই ডুবুরী নামিয়ে 

ভ্রু কুঁচকে বয়স যাচাই... 

চোখের তারা খোঁজে সত্যের জলছবি, 

পালিয়ে আসি আড়ালেই, আচম্বিতে

***

আজ আর অফিস যাই নি 

মেঘ নেমে এসে আলতো করে ব্যালকনিতে মুখোমুখি... 

আমার ফেলে আসা যৌবন 

ছেলেটার উদ্দামতায় বেঁচে,

থাকুক, যত দিন পারে... 

হঠাৎই সকালের অযাচিত তাড়াহুড়োয় - 

সেই সাবধানী সংলাপ 'ছাতা নিস, বৃষ্টি হতে পারে'

চমকে উঠি! চোখের চমশা স্থানচ্যুত - 

এ ও কি সম্ভব, সেই সংলাপ!!

তবে ভাল লাগল, ছেলেটা আমার মত ভুল করে বসেনি 

যৌবনে দাম্ভিক উদ্দামতায়!  তবে...

আমি অপেক্ষায় ছিলাম ওর ফিরে আসা পর্যন্ত... 

rainy-day-2-ibolya-taligas.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সুকান্ত পাল

এখন দুঃসময়—

 

খন দুঃসময়—

পথের সাথীরে নিতে হবে চিনে, পথে হবে পরিচয় 

প্রেমের কাব্য কবিতা গানের সময় এ তো নয়। 

এখন দুঃসময়—

পথহারা যারা ভ্রান্ত পথিক নিতে হবে সাথে তারে

অসহায় যত আর্তপীড়িত যেতে হবে তারও দ্বারে। 

ভাষাহীন মুখে দিতে হবে ভাষা দূর করে সব ভয়

নেমে এসো পথে, পথের বন্ধু, পথে হবে পরিচয়। 

এখন দুঃসময়—

যদি বাধা আসে আসুক তবু ও চলবে এ পথ চলা

এসো হে নবীন ডাকছে এ গান গাইবো মিলিয়ে গলা। 

দূর করে এসো দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব যত মনে সংশয়

মিশে যেতে হবে জনস্রোতে আর কাল বিলম্ব নয়। 

এখন দুঃসময়—

ভয় কি মরণে, করব বরণ মরণ আসলে আসুক

এ আঁধার চিরে আগত শিশুকে দেখাবো আলোর মুখ। 

আগামী ডাকছে পথে নেমে এসো, পথে হবে পরিচয়

প্রেমের কাব্য কবিতা গানের সময় এ তো নয়। 

এখন দুঃসময়—

কবিতা

সুকান্ত পাল

জিতপুর, মুর্শিদাবাদ

আস্ত রুটির অধিকার চাই

পূর্ণিমা রাত - পূর্ণ চাঁদের স্বপ্ন আমার নাই

আধখানা নয়, আস্ত রুটির অধিকার আমি চাই।

 

নেমে এসো পথে বন্ধু এখন পথে নামবার পালা

আধখানা রুটি কতদিন আর, সইবে ক্ষুধার জ্বালা!

শহর আর গ্রাম হতে হবে এক বাঁচব লড়াই করে

দু’হাতে ক্ষুধার আঁধার ছিঁড়ে পৌঁছে যাবোই ভোরে। 

ভীরু নই কেউ, নই কাপুরুষ দাবী শুধু একটাই

আধখানা নয়, আস্ত রুটির অধিকার আমি চাই। 

 

বন্ধ কলের খুলে দাও দ্বার, চলুক অচল কল

কর্মবিহীন অলস বাহুতে জাগুক পূণর্বল।  

পায়ের পিছনে শত শত পায়ে নেমে এসো সাথী পথে

বিজয়লক্ষ্মী আগুয়ান হবে আমাদেরই সাথে রথে। 

গরম ভাতে নুনের দাবীতে হতে হবে এক ভাই

আধখানা নয়, আস্ত রুটির অধিকার আমি চাই।

deadbody.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সত্যজিৎ সিংহ

দিন দুনিয়ার হরেক চালচিত্র
হার জিত তো লেগেই থাকে,
হারতে হারতে জিতে গেলে
সবাই বাজীগর বলে তাকে।

জীবন্ত দিনে জীবন মশালে
আগুন আরও তীব্র হোক,
হার জিতের হিসেব থাক তোলা
জীবনের জয়গাঁথা লেখা হোক।

কবিতা

সত্যজিৎ সিংহ

জীবন মানে

জীবন মানেই জ্বলন্ত মশাল
মৃত্যুই এই মশাল নেভায়,
চলমান দুনিয়ার এই তো নিয়ম
জীবন মানেই মনকে ভাবায়।

ভাষার মৃত্যু নিরবতায়
নির্বিকার জগত নিয়ে,
আপন পর আপেক্ষিক
সময় শিক্ষা যায় দিয়ে।​

maple_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সন্দীপ ঘোষ

কবিতা

সন্দীপ ঘোষ

বাঁকুড়া, পঃ বঙ্গ 

কবিতা একটি স্তম্ভ

র একটা পৃথিবী পেতে চাই---
কবিতাই হতে পারে,

যার ভালোবাসা প্রকৃতির মতো শাশ্বত সুন্দর।
সূৰ্যমুখী ফুল শীত আদরে কবিতার শান্ত শীতল দেহে 
আলো ছড়িয়ে তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
পাখি যখন গাছের ডালে বসে কুহু-কুহু
কিম্বা কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতিকে মাতিয়ে তোলে 
ঠিক তখনই কবিতা পেয়ে যায় একগুচ্ছ প্রেমের শব্দমালা।

কবিতা নিজেই একটা মস্ত জগত্
সব জায়গায় তার অবাধ বিচরণ
যেখানে ভালোবাসা খুঁজে পায়
খাতাকলমের গর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ হয়ে
প্রসারিত করে তার প্রেমের অনুভুতির কথা।

শীতের সকালে প্রজাপতির উল্লাস, 
আরো বেশি যেন আলোকিত হয়ে ওঠে গাঁদা ফুল।
নিজের দেহটাকে প্রেমের রসে ডুবিয়ে অপেক্ষায় থাকে
অবশেষে সেই রসে ডুব দেয় প্রজাপতি।

প্রকৃতির এই লীলা থেকে কবিতা পায় পরম প্রশান্তি।

পৃথিবী ঘুরছে, কবিতাও ঘুরছে তার আপন নিয়মে,
ভক্তিভাব ব্যকুলতায় 
যারা কবিতাকে ভালোবাসে, 
হৃদয় থেকে হৃদয়ে
হিল্লোল তুলে জন্ম নেয় নানা রূপে, নানা বর্ণনায়, নানা ভঙ্গিমায়।
কবিতা আমাদের পথ দেখায়,
কখনো প্রকটরূপে প্রকাশিত হয় তার বার্তা,
তো কখনো জীবন বোধের সংজ্ঞা শেখায়।

তাই জাতির গঠনে কবিতা একটি স্তম্ভ।

traveller2.jpg
সুপ্রভাত মেট্যা

কবিতা

সুপ্রভাত মেট্যা 

তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর, প: বঙ্গ 

চাকার সন্দেশ বিকেল

ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে 

চেনা শরীরের অচেনা রকমের রঙিন স্বপ্নগুলি,

তার কৌটো ভরা প্রাণের আকুলতা আর সেই প্রেম!

ছড়িয়ে পড়ছে স্মৃতিলিপি, সকাল থেকে সন্ধে অবধির। 

 

আমার এ'দিকেও আসছে, ধুলো উড়িয়ে-ফুড়িয়ে চাকার সন্দেশ বিকেল, হ্যাঁ তোমার। বলেছি ফিরে যেতে। ভাল লাগেনি সে কথা।

 

এখন যা ইচ্ছেয় সংসার পেতেছ তুমি,

ঢুকতে চাইনি আমি সেই অঞ্চলে, শুধু ভাল আছ কিনা জেনে নিয়ে নিজেকে সামলে নেব, রাতের অতলে একা একা। তারপর ডুবে যাওয়া চাঁদের আলোয় ভুলিয়ে রাখব সারারাত হয়তো বা! 

 

তবু, তোমার জঙ্গলে আলো ঢুকলেই,

এখনও দাবানল মনে হওয়া তোমাকে, না, চাইনি এ-চোখে। 

art1.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ দীপঙ্কর সাহা

বন্ধু আমার

​​

ন্ধু মানে ঝগড়া ঝাঁটি মিটিয়ে ভালোবাসা

দুরত্ব সে যতই থাকুক ঘুচিয়ে কাছে আসা

বন্ধু মানে এক বাটিতে মুড়ি মাখা খাওয়া

বন্ধু মানে গুমট কেটে উতল দখিন হাওয়া। 

 

নীল আকাশে ভাসছে কেমন সাদা মেঘের ভেলা

বন্ধু হলে সেই ভেলা হয় সঙ্গী সারাবেলা। 

বন্ধু সাথে পথ চলা এক দারুণ মজার গান

খুনসুটি আর টুকরো হাসি, ভোলায় মনপ্রাণ। 

কবিতা

দীপঙ্কর সাহা 

দরিন্দা, রাচী

friend1.jpg

বন্ধু মানে ঝড়ঝাপটায় জড়িয়ে ধরা ভাই

বিপদ বাঁধায় এগিয়ে আসে, আর কেহ যে নাই। 

ছাড়াছাড়ি হতেই পারে জীবন পথের মাঝে

বন্ধু সে তো প্রাণের সাথি মনেই সে বিরাজে

 

বন্ধু তোকে এই কথাটি হয়নি বলা ভাই

ভালবাসি, তোর মতো যে, আর তো কেহ নাই।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ মো: সাইদুর রহমান সাঈদ

মেঘবালিকা

 

কালোকালো মেঘগুলো কি আমার প্রিয়ার এলোমেলো চুল?

মেঘচেরা সে সোনালি আলো, তা কি কর্ণের দুল?

   ঃ কেন তুই চুপ হ'লি ওরে বুলবুল!

 

সহসা ঐ বিজলির ঝিলিক, তা কি প্রিয়ার ক্ষণিকের তরে চাওয়া?

যা হেরি আকুলে ছোটে বায়, দিশেহারা হলো হাওয়া!

    ঃ কেন থামালি গান গাওয়া!

কবিতা

মো: সাইদুর রহমান সাঈদ 

পটুয়াখালী, বাংলাদেশ 

rangasthalam2.jpg

দিগবালে বিহগের ঐ ঝাঁক, তা কি তার কণ্ঠের মতিহার?

ঘনকালো রেখাগুলো কি গাঢ়-টীকা বেদনার?

 

বুঝেছি গো, আজ আর বর্ষা ঝরিবে না হায়....

ঝরিবে আঁঁখিজল!

     ঃ ওরে বুলবুল গান থামালি কেন বল!

 

ওগো ভীরুদল মোর-প্রিয়ার গলার হার,

প্রিয়ায় বলো কাঁদিবেনা যেন...

আমি চাতক যে তার!!!

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

SyadRahman.jpg
কবিতাঃ দিশারী মুখোপাধ্যায় 

কবিতা

দিশারী মুখোপাধ্যায় 

জাগরণ 

বসময়ের মতো এখনও 
ঘুমের সঙ্গেই আছি আমি ।
সে জানে 
ভালোবাসা বলে যদি আমার কিছু থাকে 
কোষে, প্রোটোপ্লাজমে, নিউক্লিয়াসে - 
তবে সে ছিটেফোঁটা মহার্ঘ নমুনা 
তাকেই দিয়েছি কেবল।
#
যে সমস্ত পথ 
প্রতারণা করার গবেষণা চালিয়েছে 
আমাকে ব্যবহার করে - 
তারা এখন হিমোগ্লোবিনের অভাবে ধুঁকছে।
জাগিয়ে তোলার নাম করে 
যে জাগরণ এসেছিল 
নতুন পোশাক বিক্রির ছলে -
সে এখন উলঙ্গ হয়ে প্রমাণ করছে 
নগ্নতার সৌন্দর্যটুকুও তার নেই।

#আর সেই আলোর পোশাক পরা মিথ্যা আলোরা

যাদের কোয়ার্ক নেই 

যাদের তরঙ্গ নেই 

চুম্বনের হরমোন বিন্দুমাত্র নেই,

- রাস্তার মাঝে মাঝে মিথ্যা-মাইলস্টোন হয়ে তারা 

ভুল-রেস্তোরাঁয় ডেকে তুলে 

সর্বস্ব কেড়ে নেয়,

- যে সমস্ত মানুষেরা প্রেমের নবনী দিয়ে 

সন্দেশ বানাতে জানে শুধু -

তাদের এবং পরবর্তী সকল তাদের।

#ঘুম তুমি যেখানেই থাকো 

যত কম পরিমাণে থাকো 

আমার প্রেমের খোসা, রস, শাঁস, বীজ 

সবটুকু কেবল তোমার।

#
সবসময়ের মতো এখনও 
আলো জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমাতে গিয়েছিলাম।
ঘুমাবার জন্য ঘুমের 
কোনো আলোর দরকার হয় না,
তবে সে তার বিভিন্নরকম অন্ধকারের সঙ্গে 
বিভিন্নরকম অন্ধকার মিশিয়ে মিশিয়ে 
বিভিন্নরকম আলো তৈরি করে নেয়।
কেরোসিনের বা গ্যাসের বা ইলেকট্রিকের 
কোনো আলোই সে 
ঘুমিয়ে পড়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যায় না।
আমার ঘরের নির্বোধ, পণ্ডিতন্মন্য আলো তবু 
বোকার মতো জ্বলতে থাকে 
আমি ঘুমিয়ে পড়ার পরও।

​​

#আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর 

যখন স্বাধীনভাবে জেগে উঠি ঘুমের মধ্যে,

ঘুম আমাকে নিয়ে যায় স্বপ্নের দেশে।

সেখানে যে কতরকমের স্বপ্ন,

কী বলব সম্পাদকমশাই!

আপনাদের বড়ো বড়ো মলগুলোতে,

 টি-শার্টের একটাইমাত্র ঠিকানাতেও 

অতরকমের টি-শার্টের কল্পনা 

স্রেফ অসম্ভব মাত্র।

#সেসব স্বপ্ন আমি একেবারে রেলিস করে 

খাই, মাখি, পরি ও পড়ি;

কত যে নষ্ট করি বলে বোঝানো যাবে না।

অথচ আমার বিস্ময় আমাকে দেখায় -

নষ্ট করতে চাওয়া সেসব

স্বপ্ন নষ্ট হয়নি আদৌ।

সেসব স্বপ্নের গভীরে, গোপনে, যেখানে খুশি 

ঢুকে যাই আমি বারবার।

চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে ভয়ার্ত মেয়েদের মতো 
তাদের কোনো ভয় নেই।
"ওহে নির্ভীক স্বপ্ন 
আমি তোমাকে আরও নির্ভীক হতে শেখাব" -

বলে প্রত্যেকটি স্বপ্নকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে সঙ্গম শেখাই।
তাদের মতো অমন ইতিবাচক বাস্তবতা 
এই বাস্তব সংসারে আমি দেখিনি কখনো।
#
আমি যখন ঘুমাতে গিয়েছিলাম একাএকা 
আমার বহুরকমের আমিকে সঙ্গে নিয়ে,
আলো আমাদের সঙ্গে যেতে সাহস করেনি।
অথবা আলোর অনেক আলো থাকা স্বত্বেও 
ঘুমের ভেতরে রাস্তা দেখতে পাবার মতো 
যথেষ্ট আলো হয়তো তার নেই।
#
সবসময়ের মতো এখনও
ঘুমকে আমি ঘুমিয়ে না পড়ার জন্য সতর্ক করি,
অনুরোধ করে বলি বারবার - 
সেখানে অনেক রকমের, অনেক রঙের, অনেক ভাষার 
অনেক অনেক রসায়নের জাগরণ আছে।
তাকে বলি -
সেইসব জাগরণে কক্ষনো, ঘুণাক্ষরেও 
বিন্দুমাত্র প্রতারণা থাকে না।
#
সবসময়ের মতো এখনও 
ঘুমিয়ে পড়ার পরই এই জাগরণ 
কোটি কোটি আলোকবর্ষ-দীর্ঘ বিছানা পেতে দেয় 
জীবনকে জন্মের অসংখ্য সন্ধান দিতে।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ নিলাদ্রী দেব

মনোক্রম

শৈশবের চাতাল বাড়িতে

পথ ও চলতি পথের  

স্পষ্ট হয় স্থির চোখে 

উলটে শুয়ে থাকা আয়ু শিথিল হয় 

শেষ বিকেলে, আচ্ছন্নের আবিলে।

কবিতা

নিলাদ্রী দেব

নিউটাউন, কোচবিহার

village3.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

niladri.jpg
কবিতাঃ এহিয়া আহমেদ

তুমি বিহীন জীবন

 

নির্জন পথে তোমার সাথে

একসাথে হাঁটতে হাঁটতে

তোমার হার্ট বিট 

শোনার খুব ইচ্ছে করে;

 

সীমানা ছাড়া স্বপ্ন দেখি

তুমি আমার স্বপ্নের রঙিন ছবি 

একটু ভালোবাসা নিয়ে

কবে আসবে ফিরে (?)

কবিতা

এহিয়া আহমেদ

মরিগাঁও, আসাম

village.jpeg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

তুমি বিহীন জীবনে

স্মৃতিগুলো মনে পড়ে

মরুভূমির তপ্ত বালুচরে

ছটফট করে;

তোমার অপেক্ষায়

মন পাখি আমার 

একটু জলের জন্য 

হাহাকার করে।

 

হৃৎপিণ্ডটা কাদামাটি হয়ে গেলো

দিক না জেনে, পথ না চিনে

আমি এই রাস্তার ধারে;

এদেশে নেই প্রজাপতির দল

নেই কোনো পাহাড়ী ঝর্ণার

কুলুকুলু শব্দ,

তুমি বিহীন জীবনে সব 

হারিয়ে গেলো।

কবিতাঃ মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়

বিসর্জন 

খনো অনেক দেরি পূজার,

তোমাদের দুর্গা কোথায়? 

চারিদিক শূণ্য, নিঃস্তব্ধ,

বর্বরতার শেষ সীমায় এখন

মানুষের বেশ ধরে থাকা বহুরূপীরা। 

কত সহস্র টুকরো ছড়িয়ে আছে দেখো,

তোমার আমার, আমাদের চারদিকে,

সদ্য ফোটা শিউলির বুকেও আজ 

শুধু রক্তের গন্ধ।

চিনতে পারছো সেই টুকরোগুলোর মধ্যে

ফুটে আছে তোমাদের মা, বোন, দিদিদের মুখ

ভালো করে দেখো মানুষ, 

চিনতে পারলে দুর্গার মুখ?

কবিতা

মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়

পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ

subho-bijaya_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

পার্থ সরকার 

কবিতাঃ পার্থ সরকার

আলো ধরলে আলোয় যাওয়া যায়    

 

ক জয়গান মিথ্যুক 

এক জয়গান ভাবুক 

 

আলো ধরলে আলোয় যাওয়া যায় 

অক্ষরের সূত্র ধরে সদাশয়ের পথে – 

কিন্তু ইহা এক প্রচলিত ফর্মুলা 

বিস্তর পাল্টেছে নগরের শবসাধনা 

প্রমোদতরীতে ভ্রান্তি 

তোমার এই সংকেতে পরিপূর্ণ মেদ নরকের 

অধিকন্তু আতর বোধহীন 

পতনের সম্পূর্ণ বোধ  

 

এক জয়গান মিথ্যুক 

এক জয়গান ভাবুক 

 

‘আলো ধরলে আলোয় যাওয়া যায়...’ 

 

সারা সকালের আলো যেমন আছে থাক না 

 

কেন মিথ্যেয় সাজাও নিজের জয়গান 

যখন...।

মন খারাপের হস্তাক্ষর

 

ন্ধ্যা আবলুস কাঠের মত 

ঢিবি অদ্ভত 

নেমে আসে পিলসুজের ধোঁওয়া 

তরাইদেশে 

প্রদীপ পুড়ছে? 

মন পুড়ছে? 

কোন শব্দ নেই 

হস্তাক্ষরের? 

এই শেষ স্বাক্ষর 

এরপরে

আমার হস্তাক্ষরহীনতার জন্য 

আমার 

মন খারাপের হস্তাক্ষর দায়ী। 

অন্ধ করা তারবার্তা আর কলকাতা 
 

বের হয়ে আসা তীর্থ 

(পরিবর্তনে ছুঁয়েছে আকাল) 

 

ছন্দপতন অসময়ে 

(আনন্দ খুব পতনে) 

 

মেঘ হয় খুব বিকেলে 

(ছাইপাঁশ ভাবনা আসে মর্গে) 

 

তথাগত চমৎকার 

(এক বিশ্ব গোলাকার) 

 

বিভাজিত আশ্বাস চারপাশ 

(বিবাগী মন খেলাপ করে আশপাশ) 

 

এখন বৃত্তি উচ্চারণ 

(মর্গে মৃতদেহ- খুব রোমাঞ্চ) 

village3.jpg
কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস

ফেরা


তি যান্ত্রিকতায় যারা ভেসে গিয়েছিল
তারা আকাশ থেকে ফিরে আসছে
তাদের প্রত্যেকের হাতেই এখন লাল গোলাপ
প্রাচীন গুহামানব এখন তাদের নায়ক
তারা ভেবেছিল আকাশ থেকে পেড়ে আনবে আলো
ভেবেছিল নক্ষত্র থেকে নিয়ে আসবে
এক সমুদ্র সুখ
ভেবেছিল পাখির চেয়েও দ্রুত উড়ে গিয়ে
জয় করবে ব্রহ্মাণ্ড
অথচ নিঃস্ব হয়ে তারা ফিরে এসেছে
প্রাচীন বাংলার লালমাটির গ্রামে
তাদের বর্তমান ভালোবাসা
নিকানো উঠোন, ধানের গোলা
বিদ্যুৎহীন রাতে জ্যোৎস্না মেখে
তারা উঠোনে গড়াগড়ি খায়
তাদের স্বপ্নে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়ায়
গ্রামের আধান্যাংটো শিশুরা।

Sudipta-Biswas.jpg

কবিতা

সুদীপ্ত বিশ্বাস

​রানাঘাট, নদীয়া, পঃ বঙ্গ

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ রথীন্দ্রনাথ বড়াল

কবিতা

রথীন্দ্রনাথ বড়াল
ডঃ নগেন ঘোষ লেন,কলিকাতা 

চাওয়া

মেঘলা আকাশে যদি ভেসে ওঠে চাঁদ,

ঘন কুয়াশার মাঝে ফুটে ওঠে সূর্যমুখীর হলুদ।

বদ্ধ জলায় ঘাড় তোলে এক পাতিহাঁস।

 

তুমি কি দেবেনা দুটি হাত,

তোমার উষ্ণ দুটি ঠোঁট-

শিশির ভেজানোর তরে,

কোন এক কাক ভোরে;

যখন ঈর্ষা ভরা কোন চোখ

চাইবে না। পৃথিবীটা থাকবে নরম,

নিম ফুলের মত।

download.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ ভাস্কর সিনহা

কবিতা

ভাস্কর সিন্হা
দুবাই

সংশোধনী 

রাচরে নামছে

অবিসংবাদী অভিনব রাত্রি,

স্মৃতিকরপুটে দুর্নিবার

জীবনের উৎসুক নিদান।

বেদনাও মেঘ সরিয়ে

বাতাসে মাদলের কম্পনে।

ভেসে ওঠে মৃত্যুর মাঠে

উত্তাল হাওয়ায় তরুবর।

নির্মল কণ্ঠ ছুঁয়ে আনন্দ

পুলকিত হই- চইয়ে ভাসে।

একান্ত ত্রুটিরা সংশোধনীতে

দিন ফুরালে চলে যাবে-

গোপন আদরদানীতে। আতরে

অবসাদ ভুলে যাবে ছায়াপ্রেম।

যাবতীয় যুক্তির পোশাক পাল্টেই

অভিনয়ও প্রেম হয়। শুরু আর

শেষের পর্যটনে, এক বিশ্ব খুঁজে

প্রতীক্ষার অবসান হয়, একগুচ্ছ

যুঁইয়ের শিশিরের শান্ত কোমল ওমে।

women.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Bhaskar Sinha.jpg
কবিতাঃ অনির্বাণ দত্ত

কবিতা

অনির্বাণ দত্ত 
নিউটাউন, কলিকাতা 

সেভাবে কোনওদিন ….

ব্যস্ত কীবোর্ডে যেমন‌ হঠাৎ এক হাওয়া,

গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ফুঁড়ে হঠাৎ বৃষ্টির 

যেমন‌ আমায় ছুঁতে চাওয়া, 

যেভাবে ইথার পেরিয়ে আলাপ জমায় 

রাতজাগা পাখী এসে বন্ধ জানলায়,

যেভাবে নদীর স্রোতে চেনা কোনো‌ ঘ্রাণ,

নীরব নিবিড কথা অনাদি অবিরাম,

যেমন‌ সেই দূর বহুদূর ... গভীর, গোপন‌

তারার সাথে প্রেম অযথা অকারণ...

 

সেভাবে কোনওদিন, 

কোনও এক কষ্টের কোনও কারণ থাকেনা,

কোনও কোনও দুঃখের কোনো বাঁধন থাকেনা।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

এভাবেই

সেই যেমন‌ ছুটে চলে দূরগামী ট্রেন,

সেই যেমন সরে সরে যায় পাহাড় 

দূর দূর দিগন্ত ঘেঁষে.....

সেই যেমন অচিন‌ আলপথ 

ইউক্যালিপ্টাসের সারি

হঠাৎ গজিয়ে ওঠা জলাশয় , 

কিম্বা নির্বিকার নিরাসক্ত নিঝুম ঝোপঝাড়।

দূরের বন্ধু ওরা চিরন্তন 

--- ওখানে ট্রেন থামার নিয়ম তো নেই। 

 

সারাদিন আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে 

উড়ে উড়ে কতো দূরে 

আকাশের কতো কাছে , 

কতো গভীর আবেশে

তবু ঘুমায় না কোনোদিন আকাশের দেশে।

দলবেঁধে পাখী সেই ফিরে আসে নীড়ে 

সাঁঝবেলা জ্যামিতিক ভাবে।

আর, ওই গ্রহ 

দেখেছো কেমন 

নক্ষত্রের অনাদি বন্ধনে,

ঘুরে চলে ঘিরে ঘিরে 

কতো কাল কতো যুগ, 

কখনো দূরে, কখনো একটু কাছে,

শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা 

ফিরে ফিরে আসে।

কোনোদিন কোনো গ্রহ

অনাদি নিয়ম ভেঙ্গে 

কক্ষপথ ছিঁড়ে ফেলে 

মিশেছে কি নক্ষত্রের বুকে?

ধ্বংসের আদিম উল্লাসে?

এই যে যেমন, এই এতো পরিকল্পনা 

এই এতো আনন্দ, আয়োজন ক'রে

এতো কথা, এতো কাব্যে নীরবে 

এতো গানে, ধ্যানে, ধুনে 

এই যে তোমার এতো কাছে গিয়ে 

তোমার কাছেই না যাওয়া, 

তোমার বুকে বিলীন না হওয়া ....

 

এভাবেই বুঝি সৃষ্টি টিকে থাকে,

অনিত্য, অবরুদ্ধ খেলার নিয়মে। 

anirbandutta.webp
কবিতাঃ শুভজিৎ বোস

কবিতা

শুভজিৎ বোস 

শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পঃ বঙ্গ

সব সমাধানই কি মৃত্যু?
 

য় মানুষ নৃশংস প্রেমিক হয়ে মরি
ভালোবাসা খেকো হয়ে হারিয়ে ফেলি পৃথিবীর যন্ত্রণা,
আয় মানুষ বাঁচি,

চারিদিকের অবাধ্য পচা শরীরেও বাঁচতে দেই যৌবন।
তুই যেদিন বলেছিলি

পৃথিবীর দুঃখে দুঃখে একদিন জ্বলে উঠবে সন্মান,
গরীব শ্রমিকের ঘাম সেদিন

শুষে নেবে পচা পৃথিবীর নিঃসৃত রস,
শিশুর আবেগে তখন শয়তান

চালাতে পারবে না অত্যাচারিত বুলেট!
গনগনে আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে

আঁধারের বাদশাদের কালোহাত,
আমি হাসব না,আমি কাঁদব না,

যন্ত্রের মতো খেঁটে মরব না।
ব্যথার বোঝায় যেদিন পৃথিবীর মালগাড়িটা  থমকে দাঁড়িয়ে থাকবে অভাগার বুকের উপর,
মিছিল কারাগারের দরজায় নিজেদের পুঁতে দেবে নেকড়ের মতো,
ইতিহাস মুছে যাবে সেদিন রক্তে রক্তে,
এই বলে রাখলুম, শান্ত হও যৌবন।
আয় পৃথিবী মানুষ হই ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে,
পৃথিবীর এক দিকটা যেমন মৃত্যু-হাওয়ায় হারিয়েছি,
আরেক দিকের চিবুক জুড়ে আয় ফসল ফলাই হিম্মতের।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রক্ত-ফোয়ারায় যখন দুচোখ অন্ধ নিষ্ঠুর সন্ত্রাস

তখন গজিয়ে উঠেছে মুক্তির প্রশ্নে,
রুদ্ধ বিবেক তখন বিচার চায়, সন্ত্রাস নয়,
কিন্তু জীবনের সমস্যার সব সমাধানই কি মৃত্যু?

আগমনী

হরের ঘুম ভাঙেনি এখনও, ওঠে’নি পাড়া
শিউলির রূপ আরও নিখুঁত হয়েছে মাটির শরীরে,
শিশির শুকিয়ে গেলে পীচ রাস্তা অলসতা ভাঙে,
ওঠে সূর্য,আড়মোড়া ভাঙে সহজ সকাল।
ঘৃণ্য-অন্ধকারে সহানুভূতি হারিয়ে যেতে থাকে,
বেপরোয়া যৌবনের শরীরে দ্বিধার ভাষা!
নিখাদ নির্যাস চায় খয়েরী হৃদয়।
রক্ত ঘামে চুবিয়ে নিচ্ছে অপরাধ রোজ দুপুরকে!
দুঃখ যদি তীব্র অন্ধকার হয়, সুখ তবে শপথের আলো!
গাঢ় সংশয় কাটতে থাকে প্রতিটি অবাক রাত্রির,
সভ্যতা ঠেলে দেয় উন্মুক্ত সকালকে লড়াইয়ের দিকে,
রোদের মুগ্ধতায় ছড়িয়ে যায় আগমনীর উল্লাস।
মহালয়ার পুণ্যত্বে প্রহর গোনে শারদীয় সকাল,
জেগে ওঠে সমাজ, ছড়িয়ে যায় চারিদিকে শরতের রঙ,
বর্ণমালা পৃষ্ঠায় গাঁথে শরতের জীবনপঞ্জী।

 

dhaak_edited.jpg
কবিতাঃ রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

কবিতা

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় 

সময়
 

বেলা গেলো  বয়ে 

ফিরে আসে ব্যাথা 

ফেরেনা সময় 

একদিন সে বলেছিলো কথা 

কথা ছিল দেখা হবে 

রাখা ছিল কিছু ব্যাথা 

বেলা যায় বয়ে 

ফিরে আসে ব্যাথা 

ফেরেনা সময় 

ঢলে পড়া সূর্য হাতছানি দেয় 

বলে ফিরে এসো 

এসেছিলে বালুকা বেলায় 

যেতে হবে শুন্যের কণিনিকায় 

বেলা  গেলো  বয়ে 

ফিরে আসে ব্যাথা 

ফেরেনা সময় 

আজ যে আসে ভরা জোৎস্নায় 

খেলা হলে সারা 

ঢলে পড়া সূর্য হাত ছানি দেয় 

বলে এসেছে ফেরার সময় 

বেলা যায় বয়ে 

ফিরে আসে ব্যাথা 

ফেরেনা সময়।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

যুদ্ধ

নিজের অযোগ্যতার সাথে যুদ্ধ করে চলেছি 

একদিন সফল হবার আশায় 

সোনালী মরীচিকা হাতছানি দেয় বলে এসো 

একদিন দেখা হবে সাফল্যের বাসায় 

নিজের অযোগ্যতার সাথে যুদ্ধ করে চলেছি 

একদিন সফল হবার আশায় 

জানি সাফল্য আমার জন্য নয় 

তবু চেষ্টা করি একদিন সফল হবার নেশায় 

চারিদিকে সাফল্যের ভিড়ে নিজেকে লাগে বড়ো 

একা 

আমি যে সাফল্যের  স্বপ্নে ভোগা এক বোকা 

কেউ যেন  ডাকে বলে ওঠো জাগো চলো 

জানি এ যুদ্ধ আমার জন্য নয়

তবু নিজের অযোগ্যতার সাথে যুদ্ধ করে চলেছি 

একদিন সফল হবার আশায়।

maple1.jpg
Rajashri Bhattacharya.jpg

কবিতা

সুব্রত মিত্র 

লেক গার্ডেন্স, কলকাতা ​

কবিতাঃ সুব্রত মিত্র

মজার রেল যাত্রা করেছি বহু, করবো আবার
বিশ্বসেরা মজার ভ্রমণ রেলে চড়া যেমন
বাবা-কাকা; দাদু-দিদিমার কাছে রেল যে আজও আপন

ট্রেনের জালনায় ভুবন দেখার মজা কত ভারী
নানা জনের আনাগোনা;কত কি হয় বেচাকেনা;

জিনিস কত রং বাহারি
এখন আমি যাব কৃষ্ণনগর, ফিরব আমি রাতে
রাতের শেষে দেখব আবার ছুটছে রেল নতুন দিনের প্রভাতে।

সোজা পথে যাই চলে
 

মাকে অনেকে অনেক কিছু বোঝায়
তবু আমি বুঝতে চাই না

আমাকে অনেকে অনেক কিছু শেখায়
তবু আমি ওসব শিখতে চাই না ;
আমাকে অনেকে অনেক কিছু দেখায়
তবুও আমি ওগুলো দেখতে চাই না ,

আমাকে অনেকেই ভিতরে ভিতরে ভীষণ গালাগালি দেয়
তবু আমি তাতে কান পাতি না
উপরন্ত আমি তাদেরকে আশীর্বাদ করি
আমাকে অনেকে দিবা রাত্র অভিশাপ দেয়
তবু আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিই ,

আমাকে দেখে আমার অনেক আত্মীয়রা নাক সিটকায়
আমিও সবে পাত্তা না দিয়ে ব্যস্ত থাকি

তাদের মঙ্গল কামনায়;
আমাকে কতজনের কত রকম বিলাসিতার গল্প শোনায়
ঐ বিলাসিতার গল্প শুনে আমার গা গোলায়,

আমার এই সাদামাটা জীবন দেখে অনেকে মদ; গাঁজা; সিগারেট; তাস; লটারী; জুয়ার; স্বপ্ন দেখায়
আমি দেখতে চাই না, হেঁটে চলি নিজের ভাবনায়
মোটা মোটা নোটের বান্ডিল-------
বের করতে পারি না বলে ওরা আমায় কৃপণ বলে
আমি ওসব কথা গায়ে মাখি না, সোজা পথে যায় চলে।​

ভালোবাসার মাঝে ভালোবাসা
 

মিলেছিলাম আমরা সেদিন জনে জনে প্রতিজন
আশা নিরাশার কথা ভুলে গিয়ে পেয়েছিলাম

শুধুই ভালবাসা কিছুক্ষণ
এইটুকুই প্রাপ্তির প্রার্থনা করি মোরা সারাক্ষণ
হৃদয়ের টান আর ভালবাসায় মোড়া আমাদের জীবন।কাগজ কলমের ঠিকানায় চলি ছুটে নির্দ্বিধায়
কেউ বারণ করলেও শুনি না তা, ধেয়ে যাই আপন ঠিকানায়।
ঐ তো সুনীল সাহিত্যে সৌজন্য রয়েছে বেশ ভরপুর

Subrata Mitra.jpg

আমাকে ছেড়ে দিয়ে দেখো একবার
 

মাকে দুমুঠো ডাল ভাত দাও
আমাকে সাধারণভাবে বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করে দাও
এরপর আমার হাতের বাধন খুলে দাও
এরপর আমার পায়ের শিকল খুলে দাও,

দেখ এবার আমি তোমাদের জন্য কি করতে পারি।

আমাকে তোমরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রাখো
কোন দেনা পাওনার হিসাব-নিকাশ থেকে আমায় মুক্তি দাও
আমার সাধনা তেই আমায় থাকতে দাও
ঐশ্বরিক শক্তি বলে যদি কিছু থেকে থাকে --  -- --

আমাকে তা প্রাপ্ত করতে দাও
ভোগী না হয়ে আমায় ত্যাগী হতে দাও,

দেখো এবার আমি তোমাদের জন্য কি করতে পারি।

আমার আগে পিছে ভাবার কিছু নেই
আমার ডানে-বাঁয়ে কিছু দেখার নেই
আমার শুধু সামনের দিকেই দেখার আছে
আমাকে কোন দিকে তাকাতে বলো না
আমাকে শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে দাও
এরপর শুধু দেখতে থাকো......... 
শুধু দেখতে থাকো এবার আমি

তোমাদের জন্য কি করতে পারি।
আমার হাত পা, সারা শরীর ছেড়ে দিয়ে দেখ শুধু
এবার আমি তোমাদের জন্য কি করতে পারি।

​​

ছুটছে রেল নতুন প্রাতে
 

লতে চলতে ও কত কথা শুনতে হয়
বলতে বলতেও মাঝে মাঝে থামতে হয়
আমার দুপাশের পৃথিবী এখন দুলছি
চলমান গতির ভারে দুলতে দুলতেই কিছু ভুলছি,

দুপাশের জন অরণ্য যেন শূন্য
স্থির দেবতার বেসে আছে তাকায় ঐ মহামান্য
কেঁপে কেঁপে ছুটে চলে রেলগাড়ি
গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীরা সবাই যাবে বাড়ি
রেল গাড়ির বাড়ি নেই; গ্রাম নেই
ঘুরে যায় সে সব গ্রাম, সব বাড়ি,

রেলের কামরায় দেখি সব গাছগুলো ঘুরছে
সব মাঠগুলো আকাশকে ঘাড়ে নিয়ে ছুটছে
কামরার ভিতরেরও পরিবেশ হরেক সাজের
হকারের কন্ঠে নানান পন্যের প্রশংসার সুর বাজে
গতি কমে, গতি বারে, আমাদের রেলগাড়ির
ঘুরে চলা চাকার সাথে এগোচ্ছে পথ আমাদের বাড়ির,

স্টেশন আসে এক একটা, থামে ট্রেন বারবার

এমতাবস্থায় মনের সুস্থতায় এসেছি যে এতদূর
মুহূর্তের আনন্দ জীবনী শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে যেন বহুগুণ
কোলাহল আর আনন্দ মুখরিত কথাগুলোই

আমাদের নিজস্ব গুণ।

ভালো থেকো হে আমার প্রিয় কবি বন্ধুগণ
সামাজিক প্রেক্ষাপটে যদি কিছু না থাকে পকেটে

তবু আমি মহাজন
হে মোর বন্ধু বর্গ, তোমরা আমার সুখের স্বর্গ
তাইতো এই যৌথ উদ্যোগে গড়েছি প্রেমের দুর্গ
সুসম্পর্ক দ্বারা নির্মিত আমাদের এই আলিঙ্গন
ভালোবাসার মাঝে ভালোবাসা মিশিয়ে ভরাবো সবার প্রাণমন।

তুলে দাও ঐ বজ্জাতদের হাতে
 

মরা বুঝতে পারছি সবই, কিছু করতে পারছিনা
আমরা দেখতে পাচ্ছি সবই, কিন্তু ধরতে পারছিনা
আমরা জানতে পারছি সবই, কিন্তু বুঝতে পারছি না
আমরা মরতে যাচ্ছি সবাই, কেউ লড়তে পারছি না
আমরা ভাঙতে যাচ্ছি সবাই, কেউ গড়তে যাচ্ছি না।

আমরা শাসকের হয়ে করেছি দালালি,

করেছি তাদের তোষণ পোষণ
আমরা ভীরুর মতো মরেছি সবাই, কি আর করব এখন ?
আমরা নেতাদের মাথায় পাছায় মাখিয়েছি তেল, দিয়েছি তাদের বাড়তে
লোটা কম্বল গোটাও, এবার ঘর ছেড়ে দাও,

এরপর হবে দেশ ছাড়তে।

আমাদের মা মরবে, বাবা মরবে, ভাই মরবে, বোন মরবে --
কর্ম মরবে, ধর্ম মরবে, আমাদের জাত মরবে, ইজ্জত মরবে
এভাবেই অচিরেই অস্তিত্বটুকুও মরবে অবশেষে

এখন কি আর হবে হাত তুলে ?
এখন কি আর হবে কথা বলে ?
দেশাত্মবোধ;জাতীয়তাবাদ;

মায়ের ইজ্জত সম্ভ্রমের কথা ভুলে
দাও; দাও; দাও; দাও.........
যা আছে তার সবটুকুই ঐ বজ্জাতদের হাতে তুলে।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

Rudrajit Paul.jpg

রঞ্জনবাবুর

 

সারাদিন
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল 

কসবা, কলকাতা 

grandfather.png
রঞ্জনবাবুর সারাদিন

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। দুপুরের পর থেকেই কলকাতার আকাশ মেঘে ঢাকা। কোথায় কে জানে, নিম্নচাপ হয়েছে, তার জন্য আজ দুদিন ধরে এরকম আবহাওয়া চলছে। শীত এখনও পড়েনি। কিন্তু এরকম মেঘলা আকাশের জন্য একটা হিমেল ভাব রয়েছে চারিদিকে। কখনও সখনও রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়ে চুলে। ফ্যান লাগছে না। যারা বিকেলে পার্কে ঘুরতে যান, তাদের দলটা আজকে ঘরবন্দী। বারান্দা থেকে রাস্তার দিকে তাকালে বেশ কয়েকটা মাফলার বা জ্যাকেট চোখে পড়ছে। 
অবশ্য রঞ্জনবাবুর এসবে কীই বা এসে যায়। উনি তো আর ঘুরতে যেতে পারেন না। আজকে কতদিন হয়ে গেল, উনি এই ঘরের চেয়ারে বন্দী। সামনে বারান্দার দরজা। সেটা দিয়ে একটু আকাশ দেখতে পান। সামনের তিনতলা বাড়ির ছাদ, বারান্দার পাশে রুদ্রপলাশ গাছের ডাল-পাতা ইত্যাদি। ওনার নিজের উঠে দেখার ক্ষমতা নেই। চোখটা এদিক-ওদিক করে যেটুকু দেখা যায়। সেই যে একবার কঠিন অসুখ হল, তারপরেই রঞ্জনবাবুর চলার ক্ষমতা একদম লোপ পেয়েছে। অসুখের পর কতদিন যে অজ্ঞান ছিলেন, কে জানে। তারপর যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখলেন কারা যেন ওনাকে এই চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে। এখন এই চেয়ারেই কেটে যায় ওনার সারা দিন। ওনার যতদূর মনে পড়ে, অসুখের আগেও এরকম ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওয়েদার ছিল কয়েকদিন। 
রঞ্জনবাবুর তখন এমন অবস্থা যে ঘাড় ঘোরানোর ক্ষমতাও আর নেই। ফলে ওনাকে বসিয়ে যেভাবে রেখে যায়, সেভাবেই উনি থাকেন। ভাগ্য ভালো যে চেয়ারটা বারান্দার দিকে মুখ করা। এই বারান্দাটা রঞ্জনবাবুর খুব প্রিয়। উনি সারাজীবন ব্যবসা করেছেন, বাড়িতে বসে থাকার সময় কোনদিন ছিল না। কিন্তু তাও, সময় পেলেই উনি এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে দেখতেন। এটা তিনতলা। ফলে দেখতে ভালোই লাগে। বারান্দায় ওনার লাগানো ফুলের গাছ। এখন অবশ্য উনি আর উঠে জল দিতে পারেন না। কিন্তু বাড়ির অন্যেরা দেয়। রঞ্জনবাবুর চোখে পড়ল যে একটা চাইনিজ টগর গাছের ডালে ছত্রাক হয়েছে। ওটা কেটে না দিলে পুরো গাছটাই মরে যাবে। উনি ভেবে রাখলেন যে, এরপর কেউ এলে এটার কথা বলবেন। 
রঞ্জনবাবু ঘাড় ঘোরাতে পারেন না। কিন্তু একটা উপায় উনি বার করেছেন। ঘরের এক দেওয়ালে একটা বড় আয়না আছে। সেই আয়নায় ভেতরের ডাইনিং রুমের প্রতিবিম্ব পড়ে। ফলে চোখটা একটু ঘুরিয়ে সেই আয়নার দিকে তাকালেই উনি ভেতরের ঘরে কী হচ্ছে, অনেকটা দেখতে পান। ওনার ছেলে সকালে খেয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়। বউমা সব কাজ সেরে নিজের চেম্বারে চলে যায়। নাতি স্কুলে যায়। তারপর ফিরে পড়তে বসে। ওর পড়ার জায়গা ডাইনিং টেবিলের পাশে। রঞ্জনবাবু নিজেই ওর টেবিল-চেয়ার তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। এরা সবাই ব্যস্ত। এরা বাদে বাড়িতে আর আছে সানি। সানি হল রঞ্জনবাবুর সারাদিনের সঙ্গী। সবাই বেরিয়ে গেলে সানি এসে রঞ্জনবাবুর পাশে বসে থাকে। রঞ্জনবাবু ওর সঙ্গেই সমস্ত গল্প করেন। সানি এই বাড়িতে আছে আজ প্রায় পাঁচ বছর। রঞ্জনবাবু যখন সুস্থ ছিলেন তখন সানির সাথেই বিকেলে বেড়াতে যেতেন। এখন সানি সারাদিন বসে থাকে ওনার পাশে আর দুজনেই তাকিয়ে থাকেন বারান্দা দিয়ে বাইরে। রঞ্জনবাবু কথা বলে যান, সানি শোনে। রঞ্জনবাবু কী চান, সানি সেটা বুঝতে পারে। যেমন একদিন বারান্দার একটা

টব হাওয়ায় উল্টে পড়ে গিয়েছিল। রঞ্জনবাবু দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। এটা ওনার অনেক শখ করে কেনা জেব্রা প্ল্যান্ট। উনি ওইদিকে তাকিয়ে আছেন দেখেই সানি গিয়ে সেটা সোজা করে বসিয়ে দিয়েছিল। একটা শব্দে রঞ্জনবাবু আয়নার দিকে দেখলেন। নাতি শারভ বাড়ি এল। সঙ্গে এক বন্ধু। এর নাম রঞ্জনবাবু জানেন। ইহান। ওরা দুজনে খুব বন্ধু। দুজনে মিলে ম্যাথস অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রঞ্জনবাবু আয়নায় দেখলেন দুজনে ডাইনিং টেবিলে বসে পিৎজা খাচ্ছে। এরপর পড়তে বসবে। সানি রঞ্জনবাবুর পাশেই বসে ছিল। শারভ আসায় ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শারভ ওকেও পিৎজা থেকে একটা বড় পিস খেতে দিল। রঞ্জনবাবু শুনতে পেলেন, ইহান বলছে,

“তোর দাদুকে দেখাবি না? এর আগের দিনও দেখা হল না।“
শারভ বলল,” চল, ওই ঘরে চল। দাদু ওখানেই আছে। আগের দিন তাড়া ছিল বলে আর যাওয়া হয় নি।“
রঞ্জনবাবু একটু সন্ত্রস্ত হলেন। নাতি আর তার বন্ধু আসছে। ওনাকে এই অবস্থায় দেখবে? উনি নড়তে পারেন না। ওরা কথা বললে উত্তরও দিতে পারবেন কিনা কে জানে! তারপর ওনার নিজেরই হাসি পেল। ওনার অবস্থা এখন সবাই জানে। ইহান কী ভাবল, তাতে কী এসে যায়?
ইহান আর শারভ এসে দাঁড়াল রঞ্জনবাবুর চেয়ারের সামনে। শারভ আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,

“এটাই দাদুর ছবি।“
ইহান বলল, “বাহ! দেখতে দারুণ ছিলেন তো।“
শারভ হেসে বলে, “আমার বাবা বলেন যে দাদুকে নাকি অনেকবার সিনেমায় নামার অফার দেওয়া হয়েছিল। উনি খুব ফিটফাট থাকতেন। ফ্যাশন সেন্সও ছিল দারুণ।“
ইহান ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “সেখান থেকেই তুই এই ফ্যাশন সেন্স পেয়েছিস!”
শারভ শব্দ করে হেসে ওঠে। তারপর সানির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,

“এই পোমেরানিয়ান, সানি, ছিল দাদুর প্রাণ। শেষ দিকে ও আর দাদুই একসঙ্গে থাকত।“
ইহান বলে, “উনি মারা গেলেন কী করে?”

শারভ কান্না কান্না মুখে বলে,

“হঠাৎ একদিন সিভিয়ার নিউমোনিয়া। সকালে ঘরে ঢুকে বাবা দেখে দাদু প্রায় অজ্ঞান। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু কিছুই লাভ হল না। এরকম শীতের শুরুতেই গত বছর হল এটা।“
সানি এই সময় চেয়ার থেকে নেমে বারান্দায় একটা পাখির দিকে ছুটে গেল। পাখিটা একটা ফুলের গাছের পাতা ছিঁড়ছিল। শারভ বলে,

“সানি দাদুর এই বাগান এখন আগলে রাখে। একটু কিছু হলেই ও ছুটে যায় জানিস? সেদিন একটা টব উল্টে গিয়েছিল। আমি দেখি সানি নিজেই মুখে করে সেটা সোজা করে দিল। আমাদের তো মাঝে মাঝে মনে হয়, সানি যেন ছবির দাদুর সাথে কথা বলে!”
ইহান বলল, “চল, মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।“
বারান্দার সামনের চেয়ারে রঞ্জনবাবুর ছবি স্মিতমুখে তাকিয়ে রইল।

আমার ছোটবেলার

কমিক্স
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল 

কসবা, কলকাতা

আমার ছোটবেলার কমিক্স

প্রবন্ধ

Rudrajit Paul.jpg
IndianComicswithPhantom.webp

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মাদের ছোটবেলায় ইন্টারনেট ছিল না। টিভি বলতেও ছিল সেই ডিডি ওয়ান আর টু। সুতরাং সময় কাটানোর জন্য আমাদের মূল অবলম্বন ছিল বই। বইয়ের মধ্যে মূলত তখন ছিল বাংলা বই। এর কারণ দুটো--- এক নম্বর হল, আমাদের বাড়ি ছিল কলেজ স্ট্রিট থেকে অনেক দূরে। দক্ষিণ কলকাতায় বইয়ের দোকান কোনদিনই খুব বেশি নয়। গড়িয়াহাটে গোটা তিনেক। সেই সব দোকানে ইংরেজি বই খুব বেশি থাকত না। অনলাইন বই কেনা তখনও দশ-পনেরো বছর দূরে। অনলাইন পেমেন্ট তখনও নেই। এখন যেমন একাউন্ট নম্বর জানলে বিক্রেতাকে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া যায়, আর সেই বই ডাকে করে বাড়ি চলে আসে, তখন সেটা ছিল না। ফলে বাড়ি বসে বই পাওয়ার উপায় ছিল না। দোকানেই যেতে হত। কলেজ স্ট্রিট যাওয়া মানে পুরো একটা দিন নষ্ট। সেটা দুবছরে একবার হত কিনা সন্দেহ। তাও তো আমি কলকাতায় ছিলাম, এখানে বই খুঁজলে পাওয়া যেত। বন্ধুদের কাছে শুনেছি মফস্বলে অবস্থা তখন ছিল আরও খারাপ। কোনও বই লাগলে দোকানে গিয়ে এডভান্স করে নাম লিখিয়ে রাখতে হত। সেই বিক্রেতা সপ্তাহে একদিন কলকাতা এসে সব বই কিনে নিয়ে যেতেন। তখন মোবাইল ছিল না। ফলে বিক্রেতাকে যে কলকাতায় থাকাকালীন ফোন করে বলে দেওয়া যাবে বইয়ের নাম, সেটার উপায় ছিল না! 
দ্বিতীয় কারণ হল, ইংরেজি বইয়ের দাম ছিল বাংলার তুলনায় অনেকটা বেশি। যেমন, একটা ব্রিটেনে ছাপা আগাথা ক্রিস্টির বইয়ের যা দাম, সেই দামে একটা গোটা বাংলা অমনিবাস, যাতে অন্তত তিরিশটা গল্প আছে, হয়ে যেত। ফলে ইংরেজি বই, বিশেষত কমিক্স আমি পড়েছি অনেক পরে। স্কুলে প্রাইজ পাওয়া বই দিয়েই আমার ইংরেজি বই পড়া শুরু। তখনও চীনে ছাপা কমদামি, কিন্তু ভালো মানের ইংরেজি বই এদেশে, অন্তত এই শহরে, আসেনি। এছাড়া ইংরেজি বইয়ের নাম জানার সুযোগ তখন কম ছিল। এখন আমরা জানতে পারি যে আশি বা নব্বইয়ের দশকে কত ভালো ভালো শিশু-কিশোরদের বই তখন বিদেশে প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু সেই বয়সে, সেই সময়ে আমরা জানতাম না সেগুলোর নাম। তখন কলকাতায় স্টারমার্ক বা ক্রসওয়ার্ড ছিল না। ফলে ভালো ইংরেজি বই দেখে কেনার সুযোগ ছিল না। আমার মা-বাবা আমাকে খুব একটা এনিড ব্লাইটন বা হার্ডি বয়েজ কিনে দেননি। এখন অবশ্য সেটার জন্য ওঁদের ধন্যবাদ দিই। কারণ, এইসব বই হল ফাস্ট ফুডের মত। স্বাদ আছে, কিন্তু ভেতরে সম্পদ নেই। 
তাহলে বাংলা বইয়ের মধ্যে আমাদের প্রিয় কী ছিল? একদিকে ছিল মাসিক বা দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা, যেমন আনন্দমেলা বা শুকতারা। সন্দেশ-এর নামও বলতে হবে, যদিও আমি সন্দেশ হাতে পেয়েছি সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার পর। আর অন্যদিকে ছিল বই। এই বইয়ের মধ্যে আবার রয়েছে এমনি গল্প বা উপন্যাস আর অবশ্যই রয়েছে কমিক্স। আজকে আমাদের আলোচনা এই কমিক্স নিয়েই। 
কমিক্সএর বই যেমন পাওয়া যেত, তেমন আবার আনন্দমেলা বা শুকতারায় ধারাবাহিক কমিক্স প্রকাশিত হত। এইসব বই হাতে পেয়ে প্রথমেই কমিক্সের পাতায় চোখ যেত। এর কারণ একটা পুরো গল্প পড়তে সময় লাগবে। কিন্তু কমিক্স পাঁচ মিনিটে পড়ে ফেলা যায়। কমিক্স এর মধ্যে যেমন ছিল শুধুমাত্র মজার কমিক্স, যেমন নন্টে-ফন্টে বা টিনটিন, আবার অন্যদিকে ছিল শিক্ষামূলক অমর চিত্র কথার সম্ভার। এটা অবশ্য এইসব ম্যাগাজিনে পাওয়া যেত না। অমর চিত্র কথা সিরিজের বই প্রকাশিত হত। আমার স্কুলের কাছে একটা দোকান ছিল, যেখানে এইসব বই পাওয়া যেত। সেই দোকানের লোকটা একসময় ছিল আমার প্রিয় বন্ধু। আমি দোকানে গেলেই নতুন সব বাংলা কমিক্স বার করে দেখাত। কথা শুরু করা যাক এই অমর চিত্র কথা দিয়ে।
অমর চিত্র কথা সিরিজে নানা ভাষায় দারুণ সব কমিক্স প্রকাশিত হত। ওদের সব জনপ্রিয় কমিক্সই বাংলায় পাওয়া যেত। ওদের কমিক্স ছিল মূলত জীবনীধর্মী। যেমন বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা ক্ষুদিরাম। এছাড়া রামায়ণ এবং মহাভারত নিয়ে ওদের বই ছিল। 
অমর চিত্র কথার আর্টওয়ার্ক কিন্তু দারুণ ছিল। প্রত্যেকটি চরিত্র একদম নিখুঁত করে আঁকা। “কৃষ্ণ” নামে একটা ৩১ পাতায় বইয়ে কৃষ্ণের জীবন বেশ সুন্দর করেই চিত্রিত হয়েছে। পাতার পর পাতা পৌরাণিক গল্প শুনে যে কথা জানা যায়, সেটাই এই ছোট্ট বইয়ে খুব ভালো ভাবেই রয়েছে। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী সেই সময়ের ভারতের শহর, গ্রাম, গোশালা ইত্যাদির ছবিও আঁকা খুব সুন্দর করে। পোশাক, গয়না, রাজাদের মাথার মুকুট, প্রহরীদের সাজ ইত্যাদি সব ডিটেইলই রয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম যে হিস্ট্রি বই পড়ে যেটা মুখস্থ করতে হয়, সেটাই অমর চিত্র কথা পড়লে খুব তাড়াতাড়ি শেখা যায়। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য “বুদ্ধ” কমিক্স সম্পর্কে। ইতিহাস বই যেন ছবি হয়ে চোখের সামনে উঠে আসত। যেমন, একটা উদাহরণ হিসাবে বলি, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের প্যানেল যেখানে আঁকা হয়েছে, সেখানে প্রত্যেকটি সাধু, সভার চন্দ্রাতপ, প্রহরী ইত্যাদি ডিটেলে আঁকা ছিল। এবং এইসব কমিক্সে শুধু প্রধান চরিত্র নয়, আশেপাশের অন্যান্য চরিত্রের কোথাও সমান গুরুত্ব পেত। যেমন এই বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে কমিক্সে কাশ্যপ, কৃষ্ণা গৌতমী ইত্যাদি চরিত্রের কথাও বেশ গুরুত্ব দিয়েই বলা হয়েছে। অমর চিত্র কথার সিরিজ কোনদিনই মজার বা সুপারহিরোর কমিক্স হতে চায়নি। এর উদ্দেশ্য ছিল নানা বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে শিশুদের জানানো। সেই কাজটা এই সিরিজ খুব ভালোভাবেই করেছিল। 
বাংলায় এবং ইংরেজিতে পাওয়া যেত “চাচা চৌধুরী”। এই চাচা চৌধুরী উত্তর ভারতের জীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা কমিক্স স্ট্রিপ। এর মূল চরিত্র, চাচা চৌধুরী ও তার সঙ্গী, ভিনগ্রহী বিশালদেহি সাবু। চাচা চৌধুরীর পোশাক একদম উত্তর ভারতের জাঠ কৃষকের মত, পাগড়ি সমেত। কমিক্সের আর্টওয়ার্ক মোটামুটি, ডিটেইলিং খুব ভালো নয়। কিন্তু অ্যাকশান কমিক্স হিসাবে ভালোই লাগত। চাচা চৌধুরী কখনও পাহাড় জঙ্গলে গিয়ে শত্রু সংহার করে, আবার কখনও ভিনগ্রহে গিয়ে। এইসব কমিক্সের বেশিরভাগ সমস্যাই হল টিপিক্যাল উত্তর ভারতের গ্রামের সমস্যা, যেমন ডাকাতের আক্রমণ বা চাষজমি কেড়ে নেওয়া। চরিত্রদের পোশাক, কথাবার্তা, খাদ্য ইত্যাদিও সব উত্তর ভারতের মত। সুতরাং সবার এগুলো ভালো নাও লাগতে পারে। বেশিরভাগ সময়ে চাচা চৌধুরীকে বাঁচিয়ে দিত সাবুর অমানুষিক শক্তি। গিল্টি প্লেজার হিসাবে এই কমিক্সগুলো ভালোই লাগত। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর আর এগুলো দেখিনি। 
এছাড়া আমি হাতে পেয়েছিলাম “ইন্দ্রজাল কমিক্স”-এর অনেকগুলো বই। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এই বইগুলোর বয়স ছিল আমার থেকে কুড়ি তিরিশ বছর বেশি। এগুলো ষাটের দশকে নাকি খুব জনপ্রিয় ছিল, লোকে গোগ্রাসে গিলত এগুলো হাতে পেলেই। আমার বাড়িতে এগুলো রাখা ছিল প্যাকেটে মুড়ে, মায়ের বা মামার সম্পত্তি। বেশ অদ্ভুত সব নাম---ফ্ল্যাশ গর্ডন, বাহাদুর, বেতাল, বাজ সয়ার এবং রিপ কার্বি। এছাড়া ছিল ম্যানড্রেক, যদিও ম্যান্ড্রেককে ঠিক প্রাচীন কমিক্স বলা যায় না। এখনও খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। এগুলো হাতে পাওয়ার পর আমার ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছিল এইগুলো পড়ে। 
ইন্দ্রজাল কমিক্স ছিল বিদেশি কমিক্সের বাংলা সংস্করণ। যদিও পেজ সংখ্যার জন্য অনেক সময়েই নাকি বিদেশি কমিক্সের পুরো বইটা না দিয়ে নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করা হত। বেশিরভাগ কমিক্সই সেই অর্থে হাস্যরসাত্মক নয়। সিরিয়াস অপরাধের বর্ণনাই বেশি। টিনটিনের গল্পে যেমন ক্যাপ্টেন হ্যাডকের কমিক রিলিফ থাকত, বেতালের কমিক্স সেরকম নয়। মানে, আধুনিক ভাষায় বললে, এইসব কমিক্স অনেকটাই “ডার্ক”। অবশ্য ম্যানড্রেকের কমিক্সে নানা যাদুর ব্যবহারের জন্য অনেক সময়েই উদ্ভট হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হত। 
আমি শুনেছি ষাট-সত্তরের দশকে সপ্তাহে সপ্তাহে এইসব কমিক্স বেরতো। যদিও তারিখের বিচারে আমাদের ছোটবেলায় কিছুদিন অবধি এই কমিক্স প্রকাশিত হত, কিন্তু আশির দশকের শেষ ভাগে এর জনপ্রিয়তা আর ছিল না, অন্তত বাংলায় আমার বয়সী ছেলে মেয়েদের মধ্যে। ফলে আমি সেই বাড়িতে থাকা পুরনো কমিক্স পড়েছি, কিন্তু নতুন করে একটা-দুটোর বেশি কিনিনি। যেমন, একটা অরণ্যদেব কমিক্স কিনেছিলাম, মনে আছে, যেখানে অরণ্যদেব একটা স্টেগোসোরাস খুঁজে পাবে! এর একটা কারণ যদি হয় গ্রাফিক উপন্যাসের পৃথিবীতে পরিবর্তন এবং সিনেমার প্রসারের সাথে সাথে ব্যাটম্যান বা স্পাইডারম্যানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, তবে আরেকটা কারণ হল ততদিনে টিনটিনের মত কমিক্স বাংলায় এসে গেছে। আমার বন্ধুদের মধ্যে কাউকে প্রতি সপ্তাহে ইন্দ্রজাল কমিক্স কিনতে আমি শুনিনি, যদিও আমার মায়েদের সময়ে ক্লাস ফাইভ থেকে টেনের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে এই কমিক্স কেনা একটা নেশার মত ছিল। অবশ্য নেশার যথেষ্ট কারণ ছিল। গল্পের বিন্যাস এমনই, যে একবার শুরু করলে চুম্বকের মত টানবে। টিনটিনের গল্পের মত দেশে বিদেশে ঘুরে অ্যাডভেঞ্চার বেতাল করেনি। এর বেশিরভাগ গল্প সেই জঙ্গল, পাহাড়ের মধ্যে আবদ্ধ। কিন্তু সারা কমিক্স জুড়ে “অ্যাকশান”। ফলে একবার ধরলে আর থামা যায় না। 
ইন্দ্রজাল কমিক্সের যে বইগুলো আমি পেয়েছিলাম, সেগুলোর কাগজের মান ছিল অত্যন্ত বাজে। ছাপার কোয়ালিটিও সেরকম, রঙগুলো ক্যাটক্যাটে। অন্তত এরপর যার কথা বলব, সেই টিনটিনের তুলনায় এইসব কমিক্স প্রোডাকশান মানের দিক থেকে তুলনাতেই আসে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি যে, সেই ষাটের দশকে এটাই ছিল বাংলার কিশোরদের কাছে আকাশের চাঁদ। সেই ষাটের দশকের ভারতে বিদেশি কমিক্স প্রায় পাওয়াই যেত না। হয়ত গোটা ভারতে দশটা পরিবার ছিল সেই সময়ে, যারা ইউরোপের কমিক্স কিনতে পারত। বাকিদের কাছে এই ইন্দ্রজাল কমিক্সই ছিল পিটুলিগোলা। প্রত্যেকটা বইয়ের একটা চমকদার নাম থাকত, যেটা শিশুমনকে আকর্ষণ করবেই। 

ইন্দ্রজাল কমিক্সের বইয়ের মধ্যে সবথেকে বেশি ছিল বেতাল। মানে ফ্যান্টম। আরেকটা নাম অরণ্যদেব। জঙ্গলের গুহায় থাকা একজন ইউরোপীয় সুপারহিরো। প্রিয় সঙ্গী একটি ঘোড়া আর একটি নেকড়ে-কুকুর। পরে যোগ হয়েছে দুটি শুশুক। পরের দিকের বইয়ে তার স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যার কথাও বলা হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীদের সাহায্যে এই অরণ্যদেব জঙ্গলের সম্পদ এবং বাকি পৃথিবী রক্ষা করে। সে ঘুষি মারলে চোয়ালে করোটির ছাপ পড়ে যায়। পৃথিবীর কেউ অরণ্যদেবের একটি ঘুষি খেয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে না। এই করোটি হল, যাকে বলে, বেতালের “কলিং কার্ড”। কোমরের দুদিকে থাকে দুটো পিস্তল। দরকার হলেই দুহাতে একসাথে পিস্তল চালাতে পারে। এছাড়া যেকোনো সুপারহিরোর মত বেতালও অনায়াসে পাহাড়ে উঠতে পারে, প্লেন সহ সমস্ত গাড়ি চালাতে পারে এবং অনেকগুলো ভাষা জানে। এছাড়া বহু উঁচু পাহাড় বা গাছ থেকে পড়েও বেতালের কিছু শারীরিক ক্ষতি হয় না। বেতাল সুপারম্যানের মত আকাশে উড়তে পারে না বা স্পাইডারম্যানের মত হাত দিয়ে জাল তৈরি করতে পারে না। বেতালের অস্ত্র হল বুদ্ধি এবং শারীরিক শক্তি। বেতালের কমিক্সে ভিলেনরা বেশিরভাগই হল কোনও লোভী ব্যবসায়ী বা স্মাগলার। অরণ্যদেব বংশপরম্পরায় এই কাজ করে চলে। তাই তার আরেক নাম “চলমান অশরীরী”। তার নাকি মৃত্যু নেই। তার মুখে সবসময় মুখোশ পরা থাকে। ফলে তাঁকে কেউ চিনতে পারে না। এই অরণ্যদেবের গুহায় আছে এক আশ্চর্য বেতার যন্ত্র, যার সাহায্যে সে সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এছাড়া নানা দরকারে বেতাল মাঝেমাঝেই দেশ-বিদেশ সফর করে। বেতালকে চিঠি পাঠাতে হলে এক বিশেষ পোস্ট অফিসে সেই চিঠি দিতে হয়। তারপর সেই চিঠি মানুষ এবং নানা পশুর বাহিত ডাকব্যবস্থার সাহায্যে পৌঁছে যায় সেই করোটি গুহায়। করোটি গুহায় রয়েছে প্রচুর সম্পদ এবং পূর্ববর্তী বেতালদের লেখা ডায়েরি এবং দলিল। এই বেতালের কমিক্সের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল—অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। মানে, বেতালের নানা কীর্তিকলাপ নিয়ে বন্দনা। যেমন, “বেতাল যখন নড়ে, তখন বিদ্যুৎও ধীরগতি লাগে” বা “বেতাল ক্রুদ্ধ হলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর শুধু ভাগ্যই সম্বল” এরকম সব কথা। এইসব কমিক্সে অনেক সময়েই দেখানো হত যে শ্বেতাঙ্গদের হাতে জঙ্গলের কৃষ্ণাঙ্গরা আক্রান্ত এবং বেতাল তাদের রক্ষা করছে। এর পরে যার কথা বলব, সেই টিনটিনের তুলনায় কিন্তু অরণ্যদেবের কমিক্সে কৃষ্ণাঙ্গদের গুরুত্ব অনেকটাই বেশি এবং তাদের চরিত্রগুলো বেশ শক্তিশালী। বেশিরভাগ সময়ে একটা বইয়ে একটা গল্প থাকত। কিন্তু, কিছু কিছু বইয়ে একসাথে দুটি কমিক্স থাকত। বইয়ের পাতা সংখ্যা সমান। কিন্তু দুটো ছোট গল্প একসাথে ছাপা থাকত। যদি দুটো গল্প শেষ হওয়ার পরেও জায়গা থাকত, তখন কিছু এক পাতার কমিক্স দেওয়া থাকত। যেমন, “গুণধর”। এই গুণধর কমিক্সএর বৈশিষ্ট্য হল, এখানে কোনও ডায়ালগ থাকত না। একটি বাচ্চা ছেলে এবং একটি কুকুরের নানা মজার কাণ্ড। এই গাব্লুর কমিক্স পরে আনন্দমেলায় কিছু বেরিয়েছিল। ঠিক এইরকম আরেকটা কমিক্স ছিল বীটল বেলি। অনেক সময়ে রিপ্লের “বিলিভ ইট অর নট” দেওয়া থাকত। কয়েকটাতে ধাঁধা দেওয়া থাকত, তার সমাধান থাকত শেষের দিকের পাতায়। সাধারণ জ্ঞানের তথ্য দেওয়া থাকত। এছাড়া বিনাকা বা ফরহ্যান্স টুথপেস্ট ইত্যাদি সংস্থা বিজ্ঞাপনের জন্য এক পাতার কমিক্স ছাপত। যেমন, দাঁত মাজার উপকার নিয়ে এক পাতার কমিক্স ইত্যাদি। যদিও আমি যখন এই কমিক্স হাতে পেয়েছি, তখন ফরহ্যান্স টুথপেস্ট আর বাজারে ছিল না। তার মানে দাঁড়াল, এইসব কমিক্সের বই ছিল একটা সম্পূর্ণ “প্যাকেজ”। ওপরের মলাট থেকে নীচের মলাট অবধি বিনোদনে ঠাসা। বইটা শেষ হলেও যেন শেষ হত না। বার বার খুলে দেখতে ইচ্ছে করত যে আর কি চমক লুকিয়ে আছে। ইন্দ্রজাল কমিক্সের বইগুলোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল, এর সামনের এবং পেছনের দিকে কিশোর কিশোরীদের ভালো লাগার নানা জিনিসের বিজ্ঞাপন থাকত। যেমন, কোকা কোলা (তখনও ভারতে এই ঠাণ্ডা পানীয় নিষিদ্ধ হয়নি), পার্লের নানা লজেন্স বা পিপারমিন্ট, চিকলেট ইত্যাদি। আবার বলছি, আমার ছোটবেলায় এইসব ব্র্যান্ড সবকটা আর ছিল না। কিন্তু এটা বোঝাই যায় যে, এই বই হাতে আসার পর সেই সত্তরের দশকে বাড়িতে বাড়িতে কোন কোন লজেন্স বা চকলেটের বায়না শুরু হত। বেতাল বা ম্যান্ড্রেকের মত বিদেশি হিরোর পাশে এই ইন্দ্রজাল কমিক্সের ভারতীয় হিরো ছিল বাহাদুর। একটা কমলা পাঞ্জাবী আর নীল জিন্স পরে বাহাদুর ভিলেনের সাথে লড়াই করত। তার সঙ্গী ছিল বেলা। বাহাদুর কমিক্স মূলত উত্তর ভারতের জীবনের ছবি। সেই সময়ে ভারতে ডাকাতি ছিল এক বিশাল সমস্যা। দূরের পথের যাত্রীরা অনেক সময়েই পথের মাঝে আক্রান্ত হত।

বাহাদুরের কমিক্সে এই ডাকাতদের সাথে লড়াই বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে। মার্শাল আর্ট এর ব্যবহার বেশ কয়েকবার এইসব কমিক্সে দেখানো হয়েছে। তখনকার ভারতের নানা অপরাধ, যেমন ছেলেধরা, ব্যাঙ্ক লুঠ ইত্যাদি এইসব কমিক্সের প্রধান উপজীব্য বিষয়। এছাড়া ইন্দ্রজাল কমিক্সের অন্যান্য হিরোদের মধ্যে ছিল রিপ কার্বি। একজন ধুরন্ধর গোয়েন্দা। তার সঙ্গী ডেসমন্ড। এই বিখ্যাত আমেরিকান কমিক স্ট্রিপের বেশ কিছু গল্প ইন্দ্রজাল কমিক্স বাংলায় ছেপেছিল। রিপ কার্বি বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকার প্রতিনিধি। পোশাক সেই সময়ের ফ্যাশনের অনুসারী। কিন্তু আবার শার্লক হোমসের রীতি মেনে মুখে পাইপ। মূলত বুদ্ধি দিয়ে অপরাধী পাকড়াও করে রিপ। ম্যানড্রেক একজন জাদুকর। জাদুর সাহায্যেই নানা অপরাধীদের হারিয়ে দেয়। তার বিশেষ ক্ষমতা হল সম্মোহন বা হিপনোটিজম। এর সাহায্যেই বহুবার সে অপরাধীদের ধোঁকা দিয়েছে। চরম উত্তেজনার মুহূর্তে অনেকবার হয়েছে যে ভিলেন সম্মোহনের প্রভাবে নিজের হাতের অস্ত্র চিনতে পারেনি। ফলে বন্দুকের ট্রিগার আর টেপা হয়নি। ম্যানড্রেকের সহকারী ছিল একজন বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গ, লোথার। তবে ম্যানড্রেক যেরকম সম্মোহনের কাজ করেছে, সেটা ফ্যান্টাসির পর্যায়ে পড়ে। ওভাবে হলসুদ্ধ লোককে সম্মোহিত করা সম্ভব নয়। এছাড়া টেলিপ্যাথি বা ক্লেয়ারভয়েন্সের মত আজগুবি তত্ত্বও এইসব কমিক্সে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে বেতালের কমিক্সের থেকে ম্যানড্রেকে অস্ত্রের ব্যবহার কম, বুদ্ধির খেলা বেশি। 
ফ্ল্যাশ গর্ডন এইরকম আরেকটি চরিত্র। এগুলো হল একদম নিখাদ কল্পবিজ্ঞান স্পেস অপেরা। মানে কমিক্সের হিরো মহাকাশযানে করে নানা গ্রহে ঘুরবে, সেইখানে নানা সমস্যার সমাধান করবে। এইসব গ্রহে নানা অদ্ভুত প্রাণী রয়েছে, তাদের সাথে নানাভাবে যুদ্ধ হবে ফ্ল্যাশের। এই ধরণের স্পেস অপেরাধর্মী গল্প তখন সারা পৃথিবীতেই চূড়ান্ত জনপ্রিয় ছিল। আমি যখন পড়েছিলাম, সেই নব্বইয়ের দশকে অবশ্য এরকম কমিক্স তত জনপ্রিয় ছিল না। ফলে একবার পড়ে আর ফিরে দেখার ইচ্ছে হয়নি। 
ইন্দ্রজাল কমিক্স আমার পড়তে ভালোই লাগত। তবে কিছু কিছু গল্পের সঙ্গে আমার চেনা পৃথিবী মিলত না। একটু বড় হবার পর ইন্দ্রজাল কমিক্স আর ফিরে দেখিনি। তখন নব্বইয়ের দশক। নতুন নতুন বিদেশি কমিক্স ভারতে আসছে। বিশেষত মার্ভেল কমিক্স। সেই তুলনায় ইন্দ্রজাল কমিক্স ছিল নেহাত ব্যাক ডেটেড। সত্যি বলতে, সত্তরের দশকের মধ্য ভারতের ডাকাতের কাহিনী নিয়ে লেখা বাহাদুরের কমিক্স নব্বইয়ের দশকে আমার ভালো লাগাটাই অস্বাভাবিক।  
এরপর যে বইয়ের কথা বলব, সেটা হল টিনটিন। আমাদের ছোটবেলায় পড়া শ্রেষ্ঠ কমিক্সের নাম যদি করতে হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই টিনটিন। এটা শুধু আমার কথা নয়। পরেও বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে দেখেছি যে, ছোটবেলার শ্রেষ্ঠ কমিক্স বলতে ৯০ শতাংশ এক কথায় বলে ---টিনটিন। “আনন্দমেলা” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরতো এই কমিক্স। আমি অনেককে দেখেছি আনন্দমেলা হাতে পেলেই প্রথমে টিনটিনের পাতা খুলত। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে দুটো সংখ্যা জুড়ে দুই ভাগে পুরো একটা টিনটিনের বই প্রকাশিত হত এই পত্রিকায়। এছাড়া আনন্দ পাব্লিশার্স থেকে টিনটিনের আর্ট পেপারে ছাপা বই তো ছিলই। টিনটিনের বই খুললেই একদম অন্য একটা জগত। এর একটা কারণ অবশ্যই টিনটিনের চেহারা। টিনটিন ছিল এক ম্যান-বয়। তার বয়স কত, জানা নেই। কিন্তু ছবি দেখে মনে হয় বয়স ওই উনিশ-কুড়ি। মানে আমরা নিজেদের সাথে টিনটিনকে আইডেন্টিফাই করতে পারতাম। অরণ্যদেব মধ্যবয়সী, ম্যানড্রেকও তাই। রিপ কার্বি তো যুদ্ধের “ভেটের‍্যান”। এদের তুলনায় টিনটিন অনেক কম বয়সী। এছাড়া টিনটিনের কোনও সুপারপাওয়ার নেই। সাধারণ মানুষের মতই সে সব সমস্যার সমাধান করে। শুধু তার সাহস বেশি আর সে সহজে পিছিয়ে আসে না। সুতরাং সেই বয়সে এরকম একটা চরিত্র যে আমাদের প্রিয় হবে, সেটা আর আশ্চর্যের কী? 
টিনটিনের কমিক্সে মজা ছিল দেশে বিদেশে বেড়ানো। কখনও মিশর, কখনও চীন, আমেরিকা আবার কখনও সমুদ্রের মধ্যে নাম না জানা দ্বীপ। এছাড়া রয়েছে সেই পূর্ব ইউরোপের দুটো কাল্পনিক দেশ----সিলডাভিয়া আর বর্ডুরিয়া। আর কে ভুলতে পারে চাঁদে যাওয়া? এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন যে ফ্ল্যাশ গর্ডনও তো নানা দূরের গ্রহে ঘুরে বেড়াতো। তাহলে টিনটিনের চাঁদে যাওয়া আর নতুন কী? প্রথম কথা হল, টিনটিনের গল্পের আর্টওয়ার্কের সাথে ফ্ল্যাশ গর্ডনের কোনও তুলনা হয় না। আর টিনটিনের বইয়ে যেভাবে ধাপে ধাপে চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি আঁকা আছে, তার সাথে ফ্ল্যাশ গর্ডনের তুলনা হয় না। এছাড়া টিনটিনের বইয়ে কোনও কাল্পনিক প্রাণী, কোনও উদ্ভট অস্ত্র—ইত্যাদি নেই। যা আছে, সবই বাস্তবের জিনিস। একমাত্র “ফ্লাইট ৭১৪” বইয়ে টিনটিন ভিনগ্রহীদের দেখা পেয়েছে। আর “তিব্বতে টিনটিন” গল্পের শেষ ভাগে এসেছে ইয়েতি। এছাড়া টিনটিনের বইয়ে কাল্পনিক জীব নেই। ফ্ল্যাশ গর্ডনের গল্পে প্রচুর উদ্ভট প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। কাল্পনিক অস্ত্রের তো ছড়াছড়ি। 
আশ্চর্য একটা মজা ছিল টিনটিনের বই খুলে পড়ার। এক লহমায় যেন চলে যেতাম অন্য জগতে। টিনটিনের চেহারা এমন ভাবেই আঁকা যে, তাঁকে যে কোনও দেশের মানুষ ভাবা যায়। অরণ্যদেব ইউরোপের লোক। রিপ কার্বির কথাবার্তায় আমেরিকার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু টিনটিনের চেহারা এবং কথাবার্তা যে কোনও দেশের হতেই পারে। এটাই ওর আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া টিনটিন যে দেশে যায়, সেই দেশের পোশাক পরে। এই সূত্রে বহু দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানতে পারা যেত। 
টিনটিনের চারপাশে আছে আরও মজাদার নানা চরিত্র। ক্যাপ্টেন হ্যাডক, ক্যাল্কুলাস, কুকুর কুট্টুস, দুই যমজ পুলিশ অফিসার। এদের ভাঁড়ামির মাঝে টিনটিনের সাধারণ কাজও অসাধারণ লাগে। আরেকটা যে কারণে টিনটিনের গল্প অসাধারণ লাগে, সেটা হল টিনটিনের জীবনযাত্রা সাধারণের মত। অরণ্যদেবের মত একটা গোপন গুহায় নেকড়ে নিয়ে টিনটিন বাস করে না। সাধারণ শহরের বাড়িতে থাকে, সকালে উঠে বাসে করে কাজে যায়। আর সবশেষে বলতেই হবে যে, টিনটিনের বইয়ের আর্টওয়ার্কের তুলনা নেই। চীনদেশে গেলে সেখানকার ডিজাইন, মিশরে গেলে সেই পিরামিডের ছবি, সমস্ত একদম ফটোগ্রাফির মত সুন্দর। সুতরাং বাবা মায়েরা যতই ভাবুক যে টিনটিন পড়লে পড়ার বইয়ে মন বসে না, আমাদের ছোটবেলায় এর আকর্ষণ ছিল অমোঘ। একটা বই হাতে পেলে শেষ পাতা অবধি না গিয়ে থামার প্রশ্নই ছিল না। ইংরেজি টিনটিনের থেকে বাংলা টিনটিন আরও বেশি ভালো লাগত, কারণ ওই গালাগালিগুলোর সুন্দর অনুবাদ। 
ঠিক টিনটিনের মতই আমাদের বয়সী চরিত্র নিয়ে বাংলা কমিক্স ছিল নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা-ভোঁদা আর নন্টে-ফন্টে। সমবয়সী দুটি কিশোরের নানারকম কাণ্ডকারখানা নিয়ে একটার পর একটা বই। তবে এইসব বই একদমই উঁচু মানের নয়। এমন সব দুষ্টুমির কথা এইসব বইতে রয়েছে, যেগুলো এখনকার ছেলেমেয়েরা করে না। এখন কি কেউ লোকের বাড়ির জানালা দিয়ে টেবিলের ওপর খাবার দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা চুরি করে? বা সবসময় অন্যের বাড়িতে গিয়ে খাবার চুরি করবে ভাবে? সুতরাং এইসব বই পড়লে কিশোরদের খুব বেশি মজা পাওয়া মুশকিল। এছাড়া এইসব কমিক্সে বাংলা ভাষাটাও খুব উত্তম প্রকৃতির নয়। কেমন যেন সাধু আর চলিতের মিশ্রণ। ফলে একটানা পড়তে গেলেই হোঁচট খেতে হবে। আর নন্টে-ফন্টের গল্পে রয়েছে বোর্ডিং স্কুলের জীবন। সেই জীবন এখনকার শহরের ছেলে-মেয়েরা খুব বেশি দেখেনি। ফলে, এইসব কমিক্সের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। 
নন্টে-ফন্টের কমিক্সে অনাবশ্যক ভায়োলেন্স প্রচুর। এই কারুর মাথায় হাতুড়ি এসে পড়ছে তো পরের পাতাতেই কেউ নন্টের মাথায় পাথর দিয়ে মারছে। আর ওদের স্কুলের হেডমাস্টার তো রেগে গেলে ছাত্রদের বেত, লাঠি, বাসন-কোসন—হাতের কাছে যা পান, সেটা দিয়েই চরম মারধোর করেন। এইসব কমিক্সের যে মনোভাব, সেটা উনবিংশ শতকের গ্রামের দিকে মানানসই ছিল। কিন্তু বিংশ শতকের শেষ দিকে কারুর খুব ভালো লাগা মুশকিল। টম এন্ড জেরির কার্টুনেও এরকম ভায়োলেন্স দেখানো হয়েছে। কিন্তু সেটা ইঁদুর আর বিড়াল। বাংলা এইসব কমিক্সে ছোট ছোট ছেলেদের নানাভাবে মারা হচ্ছে, আঘাত দেওয়া হচ্ছে—এটাই সিংহভাগ জুড়ে। আর সেইগুলো দেখে জোর করে হাসা। ফলে এইসব কমিক্স প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ নিয়ে পড়লেও কিছুদিন পরেই এগুলো আর ভালো লাগত না। বেশিরভাগ কমিক হত দু পাতার। আসলে শুকতারা ম্যাগাজিনে প্রথম আর শেষে দু পাতা জুড়ে এইসব কমিক্স প্রকাশিত হত। গল্পের শুরু থেকে ক্লাইম্যাক্স ওই দুপাতার মধ্যেই। ফলে, চটজলদি কাতুকুতু দিয়ে হাসানো ছাড়া আর কিছুই এইসবে হত না। কেল্টুদা বলে যে চরিত্রটা, আজকের ভাষায় সেটা হল নিখাদ বুলি। বোর্ডিং স্কুলের গুন্ডা। এরকম চরিত্র এখনকার ছেলেমেয়েদের ভালো লাগা অসম্ভব। বাঁটুল দি গ্রেট ও একই রকম চরিত্র। সারা কমিক্স জুড়ে শুধু মারামারি। ব্যাটম্যান বা সুপারম্যানের কমিক্সেও মারামারি থাকত। কিন্তু সেখানে ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট অনেকটাই হত। একটা সুন্দর গল্প থাকত। কিন্তু এই সব বাংলা সিরিজে গল্প বলে কিছুই নেই। শুধু মারামারি। ফলে একটু বড় হওয়ার পর এইসব কমিক্স আর পড়ার মত ছিল না। 
নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা বা বাঁটুল, কোনও বইয়েই মহিলা চরিত্র বলে কিছু নেই। অবশ্য এটা শুধু এইসব কমিক্সের দোষ ভাবলে ভুল হবে। বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে সাধারণ ভাবেই নারী চরিত্র অনুপস্থিত। সেটা “চাঁদের পাহাড়” হোক, “প্রোফেসর শঙ্কু” হোক বা “পাগলা দাশু”। সুতরাং সেই ধারার রীতি মেনেই এইসব বাংলা কমিক্সও পুরোপুরি পুরুষকেন্দ্রিক। এর আগে যে বেতাল, ম্যানড্রেক বা রিপ কার্বির কথা বললাম, সেখানে কিন্তু নারী চরিত্র প্রচুর। এবং গল্পের প্লটে তাদের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। সুতরাং কিশোরীদের এইসব কমিক্স ভালো লাগা মুশকিল। আমাদের ছোটবেলাও আমরা ছেলেরা এইসব কমিক্স নিয়ে কিছুটা গল্প করলেও মেয়েরা খুব বেশি এইসব নিয়ে উৎসাহী ছিল না। তখন বুঝিনি, এখন কারণটা বুঝতে পারি। 
যখন আমার টিনএজ বয়স, সেই সময়ে বাংলা অনুবাদে এল অ্যাসটেরিক্স। এগুলো যে খুব আধুনিক ছিল, তা নয়। অ্যাসটেরিক্স কমিক্সের প্রকাশন শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬০ সালে। সুতরাং অ্যাসটেরিক্সের যে ফ্লেভার, সেটা ওই ষাট-সত্তর দশকের ফ্লেভার। কিন্তু নব্বইয়ের দশকেও পড়তে কী দারুণ লাগত! কমিক্সের চরিত্রকে ইতিহাসের পাতা থেকে এনেও যে এইরকম সুন্দর গল্প লেখা যায়, সেটা আগে কে জানত? অ্যাসটেরিক্স কমিক্সের সময়কাল জুলিয়াস সিজারের রাজত্ব এবং রোমান সেনাদের ইউরোপ অভিযান। কিন্তু সেই ইতিহাস কী সরেস! মনে হয় যেন সব ঘরের চরিত্র। অ্যাসটেরিক্স বেশ বয়স্ক একজন ব্যক্তি। কিন্তু সেই বয়সে আমাদের তাঁকে ভালো লাগতে দেরি হয়নি। অবশ্যই বাংলা অনুবাদ এত ভাল না হলে এই ভালো লাগা কখনই আসত না। তখন “এটাসেটামিক্স”, “কলরবিক্স” ইত্যাদি নাম পড়ে দারুণ ভালো লাগত। এখন বুঝতে পারি যে কতটা মেধা লাগে এইসব নাম ভেবে বার করতে। অনুবাদ এতটাই সুন্দর ছিল যে কোথাও পড়ে মনেই হত না যে এই কমিক্স আসলে বাংলায় লেখা নয়। 
অ্যাসটেরিক্সের কমিক্সেও মারামারি ছিল। কিন্তু সেটা বিশেষ ক্ষেত্রে। যেমন রোমান সৈন্য দেখলে গলরা তাদের পিটিয়ে ছাতু করে দিত। কিন্তু এটা অনেকটা সেই টম এন্ড জেরির গল্পের মত। এখানে মূল বিষয় হল সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের প্রতিরোধ। বর্শা, ঢাল, তলোয়ার সম্বলিত বিশাল সেনাদলের বিরুদ্ধে অ্যাসটেরিক্স একা লড়াই করছে, এটাই আসল কথা। এছাড়া আছে তাদের গ্রামের যাদুকর, এটাসেটামিক্সের সেই বিখ্যাত ওষুধ, যেটা খেলেই সবার শরীরে সুপারহিরোর শক্তি এসে যায়। অ্যাসটেরিক্স সুপারহিরো নয়। ওই ওষুধ খেলে কিছুক্ষণের জন্য তার বিক্রম বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই মারামারি এই কমিক্সের একমাত্র উপজীব্য বিষয় নয়। এ ছাড়াও আছে প্রচুর কিছু। যেমন সেই সময়ের ইউরোপের নানা শহরের বর্ণনা, অলিম্পিক্সের কথা, মিশরে পিরামিড তৈরির কথা, জলদস্যুদের কথা। আর ইতিহাসকে এত সুন্দর করে বর্ণনা করা হয়েছে যে একবার পড়লেই মনে থেকে যায়। একশোটা ইতিহাসের মোটা মোটা টেক্সট বই যে তথ্য মাথায় ঢোকাতে পারে না, সেই তথ্য একটা অ্যাসটেরিক্স পড়লে মনে থেকে যায়। এখন এইসব বই দেখলে বোঝা যায় যে, আধুনিক সময়ের সমাজ সম্পর্কে প্রচুর স্যাটায়ার এইসব কমিক্সে ছিল। ইতিহাসের তথ্যের দিক থেকে একদম নিখুঁত ছিল এইসব বই। ফলে, মিশরের রাজা-রানীদের পোশাক, রোমান সেনাদের যুদ্ধের সাজ ইত্যাদি যে সব ছবি আঁকা আছে এখানে, সেগুলো কিন্তু মনগড়া নয়। 
এরপর যখন এইসব কমিক্স পড়ার বয়স প্রায় শেষ, সেই সময়ে এসেছিল ফেলুদা আর প্রোফেসর শঙ্কুর কমিক্স। এই গল্পগুলো সব আগেই পড়া ছিল। সুতরাং কমিক্স কিছুটা ভালো লেগেছিল আর কিছুটা আমার ধারণার সঙ্গে মেলেনি। তবে জানা গল্পের গ্র্যাফিক রূপ খুব একটা আকর্ষণীয় কিছু মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তখন ফেলুদার সিনেমা দেখা হয়ে গেছে। ফলে গ্রাফিক নভেলের আর আকর্ষণ কোথায়? 
সময় এগিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার মা-বাবাদের সময়ে ইন্দ্রজাল কমিক্স ছিল, আর ছিল কিছু শিশু পত্রিকায় ময়ূখ চৌধুরীর কমিক্স। যেমন রবিন হুড। আমাদের ছোটবেলায় হাঁদা-ভোঁদা, টিনটিন, মার্ভেল কমিক্স আর অ্যাসটেরিক্স। আর এখন?

এখন ছোটোদের জন্য এসেছে নতুন দিনের কমিক্স—জাপানের নারুতো, ড্রাগন বলস, কোরিয়ার প পেট্রোল। এছাড়া আছে পোকেমন। এটাই স্বাভাবিক। আমি এখন কী আর এইসব জাপানী কমিক্স পড়ে মজা পাব? কখনই নয়। কিন্তু এখন ছোটরা এটাই পড়বে। যদি এখন কোনও কিশোর, এই ২০২৪ সালে, বলে যে সে অরন্যদেব পড়বে, তাহলে সবাই হাসবে। তাই না? পশ্চাতের দিকে ফিরে এগোনো যায় না। আবার কোনদিন এখনকার কোনও শিশু বড় হয়ে লিখবে তার পছন্দের কমিক্সের কথা।  

প্রবন্ধ

গ্রামবাংলার হেঁয়ালিঃ 

এক আশ্চর্য জগত 
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা 

birds.jpg
গ্রামবাংলার হেঁয়ালি

Rudrajit Paul.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ধাঁধার চর্চা অনেকেই করেন। কিন্তু গ্রামবাংলার লৌকিক হেঁয়ালির এক আশ্চর্য জগত রয়েছে, যার স্বাদ বেশিরভাগ লোকেরই অজানা। আপনারা জানেন যে ধাঁধা অনেক রকমের হয়। কোনোটা আছে অঙ্কের ধাঁধা, কোনোটা শব্দ নিয়ে খেলা। এছাড়া আছে সুডোকু, কাকুরো ইত্যাদি। কিন্তু বাংলার গ্রামের যে হেঁয়ালি, তার চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এইসব হেঁয়ালি সাধারণত দুই বা চার লাইনের কবিতা বা ছড়া হয়। যে অঞ্চলের ছড়া, সেখানকার ভাষা, সামাজিক আচার ইত্যাদি না জানলে কিন্তু এই হেঁয়ালির সমাধান করা যাবে না। এর মানে হল, চট্টগ্রামের হেঁয়ালি কিন্তু বাঁকুড়ার লোক বুঝতে পারবে না। প্রত্যেকটা হেঁয়ালির উত্তর হয় একটি বা দুটি শব্দ। বেশিরভাগ সময়েই এইসব হেঁয়ালি গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ, বিশেষত মেয়েরা, মুখে মুখে রচনা করেছিল। তারপর লোক পরম্পরায় সেটাই চলে আসছে। কিন্তু এর মধ্যে অনেক হেঁয়ালিতেই রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া বা গণিতের সূত্র। 
এইসব হেঁয়ালি ব্যবহার হত বা হয় শিশুদের মুখে মুখে শিক্ষার জন্য, বা অবসর সময়ে কথোপকথনের জন্য। একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, লোকাচার এবং সামাজিক বিশ্বাস বিধৃত থাকে এইসব ছড়ার মধ্যে। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এইসব হেঁয়ালি নিয়ে খুব বেশি উচ্চস্তরের গবেষণা আমাদের দেশে নেই। এখন, যখন আস্তে আস্তে গ্রাম সভ্যতা হারিয়ে যাচ্ছে নগরায়নের চাপে এবং গ্রামের লোক আর্থিক কারণে প্রবাসী হয়ে চলে যাচ্ছেন, তখন কিন্তু অবিলম্বে যত্ন না নিলে অনেক হেঁয়ালি চিরকালের মত হারিয়ে যাবে। এবং সেইসাথে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে অনেক লোক-ইতিহাস। আসুন, কিছু উদাহরণ দেখা যাক।
চন্দ্র পৃষ্ঠে চন্দ্র দিয়া গ্রহ যুক্ত করি,
ইহাতে যে অঙ্ক হয় লোভ যত্ন করি।
ইহার অর্ধেক ত্যজি পৃষ্ঠে পুষ্প দিয়া
অবিলম্বে তত টাকা দিবেন পাঠাইয়া।
পড়ে কী মনে হল? পাগলের প্রলাপ? সেটা হতেই পারে। কারণ এই হেঁয়ালিতে যে সব ভাষা ব্যবহার হয়েছে, সেটা শহরে ব্যবহার হয় না। চন্দ্র মানে এক। গ্রহ মানে নয়। তাহলে কী হল? একের পিঠে এক যোগ করলে হয় ১১। তার সাথে গ্রহ, মানে ৯, যোগ করলে হয় কুড়ি। এবার এর অর্ধেক মানে হল দশ। দশ এর পিঠে পুষ্প, মানে হল শূন্য। দশ এর পিঠে শূন্য মানে একশো। তাহলে এখানে বলা হচ্ছে যে একশো টাকা পাঠান!!
বাংলার গ্রামের ছড়ায় এরকম রূপকের ব্যবহার অনেক আছে। একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ ইত্যাদি। 
আবার হেঁয়ালিতে যে সবসময় একটি শব্দে উত্তর হবে, সেটা নাও হতে পারে। অনেক সময়ে একটি

দৃশ্যের কথা বলা হয়। যেমন, 

বারো পা তার,

আট পা চলে

ছয়ে মুখ পরে বলে। 

কহেন কবি কালিদাসের ভাগনা 

পাঁচটি এঁড়ে একটি বকনা।

এটাও কিন্তু প্রাচীন কালের গ্রামের জীবন সম্পর্কে না জানলে বলা যাবে না। বারো পা মানে, ছয় জন মানুষ। এর মধ্যে আট পা চলছে। পাঁচজন পুরুষ আর একজন মহিলা। তার মানে কী দাঁড়াল? পালকিতে করে বর বউ যাচ্ছে আর চারজন পুরুষ বেহারা সেই পালকি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে! সেইজন্য বারোর মধ্যে আট পা চলছে। এই হেঁয়ালিতে এই গ্রাম্য দৃশ্যের বর্ণনা করা হয়েছে।
আবার আরেকটি হেঁয়ালি দেখুনঃ
ঘর আছে তার মুখ নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই।
এর উত্তর হল কবর। এরকম হেঁয়ালির উত্তর কিন্তু শুধু শব্দের খেলা দিয়ে হবে না। ছড়ার মূল ভাব কী, সেটা ভাবতে হবে। এরকম আরেকটি নীচে দিলামঃ
একটুখানি পুকুরটা সোনার ছাউনি
মেঘ নাই, বৃষ্টি নাই, ঝরে পড়ে পানি।
একটু ভেবে দেখুন, কী হতে পারে। উত্তর হল, চোখ। চোখকে এখানে পুকুর বলা হয়েছে। চোখের পাতা হল সোনার ছাউনি। আর চোখ দিয়ে যে জল পড়ে, সেটা বর্ণনা হয়েছে দ্বিতীয় লাইনে। তাহলে দেখছেন যে শুধু যে নীরস ছড়ার ধাঁধা, তা কিন্তু নয়। এর মধ্যে বেশ কবিত্বও রয়েছে। কবে কোন অজানা মানুষ এই ছড়া রচনা করে গিয়েছেন, কে জানে!
শেষে আরেকটি চমৎকার হেঁয়ালি বলে শেষ করি।
তুমিও খাও, আমিও খাই
খেতে বললে রেগে যাই।
এর উত্তর কী? কলা।
কলা সবাই খায়। কিন্তু কলা খেতে বলা মানে কাউকে অপমান করা!
বাংলার হেঁয়ালিতে এভাবেই গ্রাম সমাজের মুখের ভাষা, লৌকিক কবিপ্রতিভার ছোঁয়া ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে সুরক্ষিত রয়েছে। 

প্রবন্ধ

kalidasroy.jpg
কবিশেখরের সেতার
Sudip Ghosal.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

৮৮৯ সালে ২২শে জুন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে কালিদাস রায়ের জন্ম হয়। শঙ্খধ্বনি, উলুরবে মুখরিত আকাশ। কড়ুই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কালিদাসের পিতা মিষ্টি বিতরণ করলেন আনন্দে।

অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামের ছেলে কালিদাস ছোটো থেকেই রুগ্ন হওয়ার কারণে, কানি নদী আর ব্রম্ভানী নদীর ধারে বসে থাকত বন্ধুদের নিয়ে। খেলাধূলায় মন ছিল না কালিদাসের। মনে মনে তার একটা সুর বাজত। সে সুর অনেক বড় হওয়ার আশা জাগাত তার মনে। অনেক বন্ধু কালিদাসকে ছোটো থেকেই ভালোবাসত। গ্রামের সুখ তার বেশিদিন সইল না।

কালিদাসের বাবা যোগেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন কাশিমবাজার এস্টেটের কর্মচারী। কালিদাসের মায়ের নাম রাজবালা দেবী। চৈতন্যদেবের জীবনীকার লোচনদাস ঠাকুরের উত্তরাধিকারী ছিলেন বাবা মায়ের অষ্টম সন্তান কালিদাস। তাঁর আগের সাত ভাইবোন জন্মের পরেই মারা যায়। তিনিও ছিলেন খুবই রুগ্ন। কাশিমবাজারে বার বার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে তাঁকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে আসা হয়। বর্ধমানের গ্রামে ফিরে এসে অসুস্থতার কারণে তাঁর শৈশবের একাংশ গৃহবন্দী হয়েই কাটে। পাঁচ বছর বয়সে তিনি কাশিম বাজারে ফিরে যান। কাশিমবাজারে তিনি পড়াশুনা শুরু করেন। বয়স বাড়লে চলে আসেন বহরমপুর শহরে। সেখানে কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হন। 

তারপর কয়েকবছর কেটে গেল বহরমপুর শহরে। রাজবাড়ীর বিত্তবানদের অবজ্ঞা তাঁকে প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। প্রকৃতিই হয়ে ওঠে তাঁর পরম বন্ধু ও কাব্যের প্রেরণা। তার মনে পড়ত কড়ুই গ্রামের কথা, বন্ধুদের কথা। বহরমপুরে তাঁর জীবনের অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়।এখানে তার সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হয় ক্রমশ। নেপাল,সন্তু ছিল তার প্রিয় বন্ধু। বহরমপুরে কে এন কলেজ থেকে স্নাতক হন। এই সময়টা তিনি অনেক মানুষের সঙ্গে মেশেন। কালিদাস সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন। তাদের সংসারের সুখদুখমাখা জীবনের সদাসঙ্গি হয়ে কাল কাটাতেন। কোনো অহঙ্কার তার মনে বাসা বাঁধতে পারে নি।

১৯০৭ সালে তাঁর প্রথম কাব্য কুন্দ প্রকাশিত হয়। তখনকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তেমন সুখময় ছিল না।

যদিও ১৯০৭ সাল নাগাদ নতুন প্রদেশটিতে সাম্প্রদায়িকতা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে, তবুও কিছু সংখ্যক শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে এ ধর্মীয় বিরোধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য বিচক্ষণ ও আন্তরিক প্রচেষ্টার  প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯০৭ সালের ১৫ মার্চ তারিখে উভয় সম্প্রদায়ের একদল বিশিষ্ট সদস্য ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁর নিকট সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার পরিসমাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণ ও দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতির উন্নতি বিধানের পরামর্শ রাখেন।

নতুন প্রদেশটিতে ভূস্বামী ও প্রজাদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তা সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নেয়। বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভকারিগণ সন্ত্রাসবাদী কার‌্যাবলি পরিচালনা করলে হিন্দু ভূস্বামিগণ বিপদাশঙ্কা অনুভব করে। সরকারের প্রতি তাদের অবিচল আনুগত্যের সততার পরীক্ষা দিতে এবং বিক্ষোভের প্রতি তাদের নেতিবাচক মনোভাবের প্রমাণ রাখতে তারা যে অসাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করবে ও সরকার বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে একত্রিতভাবে কাজ করবে সে জন্য তারা মুসলমান জমিদার সম্প্রদায়ের দিকে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

যদিও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও বঙ্গভঙ্গ ও তার প্রতি হুমকি সম্ভবত এর উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের প্রথম বৈঠকে একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে: ‘এ সভা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সুস্পষ্ট স্বার্থের কথা চিন্তা করে অভিমত প্রকাশ করে যে, বিভক্তি নতুন প্রদেশটির জনগণের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমানদের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর হবে এবং (আরও অভিমত প্রকাশ করে যে) বর্জনের মতো সকল প্রকারের বিক্ষোভকে প্রচণ্ডভাবে নিন্দা ও নিরুৎসাহিত করা উচিত।’

এদিকে বাঙালি হিন্দুদের অসন্তুষ্টিকে প্রশমিত করতে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গকে রদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরকার বলে যে, নতুন প্রদেশটিতে বসবাসকারীদের মধ্যে মুসলমানগণ অত্যধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ তো ছিলই, নতুন বিন্যাসের আওতায়ও আনুমানিক সংখ্যাগত দিক থেকে তারা হিন্দুদের সমান অথবা সম্ভবত শেষোক্তদের চেয়ে কিছুটা উচ্চতর অবস্থায়ই বিরাজ করবে। মুসলমানদের স্বার্থসমূহ আইন পরিষদ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বিশেষ প্রনিধিত্বের দ্বারা রক্ষা করা হবে।

কালিদাস ‘রসচক্র’ নামে একটি সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং রবীন্দ্র-ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। রোমান্টিকতা, প্রেম, পল্লিজীবন, সমাজ, ঐতিহ্যপ্রীতি এবং বৈষ্ণবভাব তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। তাঁর মোট কাব্যগ্রন্থ ১৯টি। তন্মধ্যে কুন্দ (১৯০৭) তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য। এ ছাড়া পর্ণপুট (১৯১৪), ঋতুমঙ্গল (১৯১৬), রসকদম (১৯২৩), হৈমন্তী (১৯২৪), লাজাঞ্জলি, ব্রজবেণু (১৯৪৫), চিত্তচিতা, পূর্ণাহুতি (১৯৬৮) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এবং মেঘদূতের অনুবাদ করেন। প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, শরৎ-সাহিত্য ও সাহিত্য প্রসঙ্গ তাঁর সমালোচনা গ্রন্থ। তাঁর রচিত শিশুতোষ গল্পকাহিনীও আছে। ‘বেতালভট্ট’ ছদ্মনামে রচিত তাঁর রম্যরচনাগুলি পাঠকসমাজে খুবই সমাদৃত হয়েছে।মহাকবি কালিদাসের রচনার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন কবিশেখর। কবিশেখর পড়ে জানতে পারেন, সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকবি কালিদাসের রচনাগুলির গুরুত্ব প্রতিপাদন। কালিদাসের কবি প্রতিভা আলোচিত হল। তারপর যা বলার বলব। হাঁ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, কি হল।

সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কালিদাস বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সবথেকে উল্লেখযোগ্য সম্মান কবিশেখর উপাধি পান ১৯২০ সালে রংপুর সাহিত্য পরিষদ থেকে। বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়। তারপর থেকেই তিনি কবিশেখর নামেই পরিচিত হন। এছাড়াও তিনি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৩) ও ‘সরোজিনী স্বর্ণপদক’, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) লাভ করেন। ১৯১৩ সালে রংপুরের উলিপুর স্কুলের সহশিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সাত বছর।  ১৯২০-৩১ সালে, দক্ষিণ চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার ১১ বছর পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় সহকারী শিক্ষকরূপে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।১৯২০-এর দশক ধরে তা উন্নত হতে থাকে। এর ফলে আরও কিছু বিষয়ের সাথে ভারত নিজের নামেই ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে 'লিগ অফ দ্য নেশনস' এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয় এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের অ্যান্টওয়ার্পের গ্রীষ্ম অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় 'লেস ইনডেস অ্যাংলাইসেস' (দি ব্রিটিশ ইন্ডিস) নামে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ভারতে মূলত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের আরও বেশি ভারতীয় আত্মশাসনের অধিকার সম্পর্কে দাবি জানাতে দেখা যায়।

​১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষর এবং হোম রুল লিগস স্থাপনার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের শক্তি প্রদর্শিত হয়। একই সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়া অভিযানের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এই বিষয়টিও উপলব্ধিত হয় যে যুদ্ধ আরও বেশি সময়ের জন্য চলতে পারে। নতুন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড সতর্ক করেন যে ভারত সরকারের উচিত ভারতীয়দের দাবিগুলির প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া। এই বছরের শেষের দিকে লন্ডনে সরকারের সাথে আলোচনা করার পরে লর্ড চেমসফোর্ড প্রস্তাব দেন যে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের যুদ্ধে ভূমিকার কথা খেয়াল রেখে তাদের উপর নিজেদের বিশ্বাস প্রদর্শনের বিবিধ কর্মসূচি নেবে। তার মধ্যে ছিলে ভারতীয় রাজাদের পুরস্কার, উপাধি এবং সম্মান দান, ভারতীয়দের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পদ প্রদান এবং অপ্রয়োজনীয় তূলা আবগারি শুল্কের অপসারণ। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্রিটেন কর্তৃক ভারতের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ঘোষণা এবং কিছু দৃঢ় পদক্ষেপের ইঙ্গিত। আগস্ট ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে আলোচনার পরে ভারতের নতুন উদারপন্থী রাষ্ট্র সচিব এডউইন মন্টেগু ঘোষণা করেন ব্রিটিশ লক্ষ্য হল "প্রশাসনের প্রতিটি শাখায় ভারতীয়দের আরও বেশি অংশগ্রহণ এবং স্বশাসিত সংস্থাগুলির ক্রমোন্নতির মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ভারতে উন্নতিশীল দায়িত্ববান সরকারের গঠন"।এটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল শিক্ষিত ভারতীয়দের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে, যাদের অবজ্ঞা করা হত প্রতিনিধিহীন সংখ্যালঘু হিসাবে। যাদের মন্টেগু বর্ণনা করেছিলেন "বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে আমাদের সন্তান" হিসাবে। সংস্কারের গতি কোথায় এবং কখন বাড়ানো হবে তা ব্রিটেন স্থির করত যখন ভারতীয়দের তা অর্জন করতে দেখা যেত।যদিও এই পরিকল্পনাটি প্রথমে ভাবা হয়েছিল কেবল রাজ্যগুলিতে সীমিত স্বশাসনের কথা ভেবেই - ভারতে অথচ দৃঢ়ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে। এটি একটি অশ্বেতাঙ্গ উপনিবেশে যে কোন রকম প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের প্রথম ব্রিটিশ প্রস্তাবের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।

১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামে একটি নতুন বিভাগ খোলা হলে দীনেশচন্দ্র সেন এ বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি প্রয়োজনীয় পাঠ্যগ্রন্থও প্রণয়ন করেন। বারো বছর তিনি যোগ্যতার সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করে ১৯৩২ সালে অবসর নেন। 

সৃজনশীল লেখক হিসেবেও দীনেশচন্দ্র সেন পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলা সাহিত্য বিষয়ে গবেষণামূলক ও ইতিহাসধর্মী গ্রন্থ প্রণয়ন, পৌরাণিক আখ্যান রচনা, লোকসাহিত্য সম্পাদনা ও বাঙালির ইতিহাস প্রণয়নের পাশাপাশি তিনি রচনা করেন কবিতা, উপন্যাস ও গল্প। সব মিলে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৬০। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: বঙ্গ-সাহিত্য পরিচয় (দুই খন্ড, সম্পাদনা: ১৯১৪), The Vaisnava Literature of Medieval Bengal (১৯১৭), Chaitanya and his Companions (১৯১৭) The Folk Literature of Bengal (১৯২০), The Bengali Ramayana (১৯২০), Bengali Prose Style : ১৮০০-১৮৫৭ (১৯২১), সরল বাঙ্গালা সাহিত্য (১৯২২), ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য (১৯২২), Glimpses of Bengal Life (১৯২৫), বৃহৎ বঙ্গ (দুই খন্ড, ১৯৩৫), আশুতোষ-স্মৃতিকথা (১৯৩৬), বাংলার পুরনারী (১৯৩৯), প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০)।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ও ভালোবাসার ফল বৃহৎ বঙ্গ। এটি বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য গ্রন্থটি দীনেশচন্দ্র সেনের আত্মজীবনী। বাংলা জীবনী সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর এ গ্রন্থের মূল্য স্বীকার্য। তিনি এ গ্রন্থে নিজের বেড়ে ওঠা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতসহ তাঁর সাহিত্যিক জীবনের কথা অত্যন্ত সরল ও মনোহর ভাষায় বিবৃত

করেন। চিন্তা ও চেতনায় অনগ্রসর মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক অবদানকে দীনেশচন্দ্র সেন অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেন তাঁর প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান শীর্ষক গ্রন্থটিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের অবদান অনেক ক্ষেত্রে অগ্রবর্তীর, ভুলে যাওয়া উচিত নয় এ সত্য-এ হচ্ছে তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থটির প্রধান বক্তব্য।

সাহিত্য ও গবেষণায় অবদানের জন্য দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি পান। একই সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে এবং ১৯৩১ সালে তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণপদক লাভ করেন। 

আইন অমান্য আন্দোলন  ১৯৩০ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয়। এ আন্দোলনের পটভূমি হলো সাইমন কমিশন। ভারতের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং তা চূড়ান্তকরণের জন্য ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সাইমন কমিশন গঠিত হয়। কেবল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে এ কমিশন গঠিত হওয়ার কারণে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের সব ধরনের নেতা ও কর্মীরা এটিকে পুরোপুরি একটি শ্বেতাঙ্গ কমিশন বলে বর্জন করে। বাংলায় সাইমন কমিশনের বিরোধিতা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কমিশন গঠনের প্রতিবাদে এ প্রদেশের বিভিন্ন অংশে ১৯২৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়। ওই বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় সাইমনের আগমন উপলক্ষে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। কলকাতার ৩২টি ওয়ার্ডে একই সাথে সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৮ সালের ১ মার্চ। এসব সভায় ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করার আন্দোলন পুনরায় শুরু করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

ভারতীয়গণ কর্তৃক সাইমন কমিশনের সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ১৯২৮ সালের মে মাসে মুম্বাই নগরীতে ড. এম.এ আনসারীর সভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতের জন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। ভারতীয় মুসলমানদের একটি অংশ ব্যতীত ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরের জনগণ কর্তৃকনেহেরু রিপোর্ট গৃহীত হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে ‘নেহরু রিপোর্ট’ পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। ভারতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (ডিসেম্বর ১৯২৮) ব্রিটিশ সরকারকে কার্যত এ মর্মে একটি চরমপত্র দেওয়া হয় যে, যদি ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ভারতকে ডোমিনিয়ন মর্যাদা দান করা না হয় তাহলে সারা দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করা হবে। অবশ্য ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ সালের মে মাসে ঘোষণা করে যে, শীঘ্রই ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে। এর কয়েক মাস পর ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড আরউইন ঘোষণা করেন যে, ভারতের সাংবিধানিক সংস্কারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দান করা। তার এ বিবৃতির পর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, তেজ বাহাদুর শাপ্রু, পন্ডিত মদনমোহন মালব্য এবং  অ্যানি বেস্যান্ট-এর মতো ভারতীয় নেতৃবৃন্দ গভর্নর জেনারেলকে অধিকতর উদার ফরমুলা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমগ্র সাংবিধানিক সংকট নিরসনের আহবান জানান। তাঁরা কারাগারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দাবি করেন। তাছাড়া তাঁরা প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠক আহবানের মাধ্যমে ভারতের সাংবিধানিক সমস্যাবলী আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ইতোমধ্যে সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহেরুর মতো কংগ্রেসের তরুণ নেতৃবৃন্দ দাবি করেন যে, তাদের সংগ্রামের লক্ষ্য ডোমিনিয়নের মর্যাদা অর্জন নয় বরং ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করা। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে জওহরলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ অধিবেশন কংগ্রেস কার্যকরী কমিটিকে সারা দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার কর্তৃত্ব প্রদান করে এবং এ মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ২৬ জানুয়ারি তারিখে সারা ভারতে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ (পূর্ণ স্বাধীনতা) দিবস পালন করা হবে।

 

আগস্ট মাস জাতীয় জীবনে শোকের মাস বলে বহু বছর ধরে সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে—১৯৭৫ সালের আগস্ট ১৫ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার, শুধু তাঁর দুই কন্যা ছাড়া, যাঁদের একজন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়।

হত্যা করা হয় যুবলীগ নেতা শেখ মনি ও তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে পরিবারের আরও সদস্যসহ। হত্যার পেছনে জড়িত ছিল তৎকালীন সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক চাকরিরত ও চাকরিচ্যুত মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কিছু জওয়ান। যদিও এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে বহু জায়গায় উল্লেখ করা হয় কিন্তু আমার চোখে এ ঘটনা ছিল বিদ্রোহ। কারণ, ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল দৃশ্যত চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে।

এ হত্যার সঙ্গে বহু প্রশ্ন জড়িত ছিল, যার মীমাংসা এখনো হয়নি। তাই হয়তো তদন্ত কমিশনের কথা বলা হচ্ছে। ঘটনার দিন সকাল থেকে ঢাকা সেনানিবাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় ঘটে যাওয়া ২২টি ছোট-বড় ক্যু বা বিদ্রোহ নিয়ে ১৯৯৬ সালে আমার লেখা বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ বইয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

এর আগে আরেকটি বই লিখেছিলেন প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল হামিদ (অব.)। তিনি ওই সময় ঢাকা সেনানিবাসে স্টেশন কমান্ডার ছিলেন। আমি তখন একজন তরুণ কর্মকর্তা হিসেবে যা দেখেছি, উপলব্ধি করে ওই সময়কার সেনাবাহিনী এবং ওই দিনকার ঘটনার বর্ণনা, যতটুকু স্মৃতিতে ছিল লিখেছি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের (বীর বিক্রম) নির্দেশে সেখানে তোলা ছবির ফিল্ম জব্দ করতে ১৫ আগস্ট সকালে আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়েছিলাম। সেই বাড়িতে গিয়ে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা আমাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। ওই সময় অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মনে জেগেছিল এবং আমার বইয়ে তা তুলে ধরেছি। দীর্ঘদিন পর আমার সেই বইটিকে পরিবর্ধিত আকারে আবার নতুন নামে (রক্তঝরা দিনগুলি: ১৯৭৫-৮১, প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতায় পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের বিবরণ) প্রকাশ করতে যাচ্ছে প্রথমা প্রকাশন।

ওই দুটি বই প্রকাশের পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার সব প্রশ্নের উত্তর তেমন পাওয়া না গেলেও কিছু কিছু পেয়েছি। এগুলো পেয়েছি, ওই সময়কার সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে কিছু কর্মকর্তার লেখা বই পড়ে।

তাঁদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ বীর উত্তম, ওই সময়কার সেনাপ্রধান, তখনকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার প্রয়াত কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম, ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন বীর বিক্রম ও লে. কর্নেল (অব.) প্রয়াত আনোয়ারুল আলম শহীদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আনোয়ারুল আলম ওই সময় রক্ষীবাহিনীর পরিচালক পদে ঢাকায় অবস্থান করতেন। উল্লেখ্য, ওই সময় ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডে আমিও কর্মরত ছিলাম।

কালিদাস ছোটবেলা থেকেই বৈষ্ণব ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কাশিমবাজার রাজবাড়ির মহারাজা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। মহারাজের অনুপ্রেরণায় ও উদ্যোগে রাজবাড়ীতে দোল উৎসব, রাসযাত্রা উপলক্ষ্যে কীর্তন, যাত্রা, কবিগান, থিয়েটার প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হত। কাশিমবাজারে থাকাকালীন কালিদাস কীর্তন ও কবিগানের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন এবং ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা রচনা করার জন্য সচেষ্ট হন। উলিপুরে থাকাকালীন তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বৃন্দাবন অন্ধকার’ সৃষ্টি করেন যেটি তাঁকে কবি হিসেবে প্রথম জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তিনি ব্রজলীলা বিষয়ে আরও কিছু কবিতা এখানে থেকেই লেখেন।

১৯১৫ সালে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্রের অর্থানুকূল্যে ‘ব্রজবেণু’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে ‘ঋতুমঙ্গল’ প্রকাশিত হয় প্রকৃতি ও প্রেমমূলক কবিতার সংগ্রহ নিয়ে। উলিপুরের মহারাজার সাথে মতানৈক্যের কারণে তাঁর প্রধান শিক্ষকের পদপ্রাপ্তি অধরা থেকে যায় এবং বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়ার বই নিয়েও মতানৈক্য ঘটলে তিনি উলিপুর ছেড়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন এবং এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

কলকাতায় ফিরে তিনি জীবিকার প্রয়োজনে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে থাকেন। ১৯২৪ সালে কলকাতায় ফেরার পরে ‘হৈমন্তী’ কাব্যগ্রন্হটি রচনা করেন কালিদাস। এরপর ক্রমান্বয়ে ‘বৈকালী’ প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে ‘গীতগোবিন্দ’ এবং ১৯৩২ সালে ‘গীতা লহরী’ প্রকাশ হয়। ১৯৪২ সালে জীবন সায়াহ্নে এসে কিছু কাব্য সমালোচনা গ্রন্থও তিনি প্রকাশ করেন। প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য, সাহিত্য প্রসঙ্গ পদাবলী সাহিত্য ও শরৎ সাহিত্য যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

১৯১৩ সালে কাশিমবাজার রাজবাড়ীর সাহিত্যসভায় কালিদাস প্রথম রবীন্দ্রনাথের দর্শন পান সেখানেই রবীন্দ্রনাথের উপদেশানুসারে পরবর্তীতে তিনি অনুবাদ মূলক রচনায় হাত পাকান যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব, এবং মেঘদূতের সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ। ‘শিশুতোষ গল্পকাহিনীতে’ তিনি শিশুদের জন্য গল্প লিখেছেন। তাঁর শিশুসাহিত্যগুলির মধ্যে অন্যতম – ‘গাথাঞ্জলি’ (১৯৬১), ‘গাথাকাহিনী’ (১৯৬৪), ‘তৃণদল’ (১৯৭০) প্রভৃতি। তিনি ‘বেতালভট্ট’ ছদ্মনামে লিখতেন।

কালিদাস রায় শুধুই কবি ছিলেন না তিনি ছিলেন অসাধারণ পন্ডিত। তবে তাঁর পান্ডিত্য কখনও কাউকে হেয় করেনি। তিনি সকলের থেকেই সবরকম মতামত গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন হাস্যরসের যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ‘পূর্ণাহুতি’, ‘দন্তরুচি কৌমুদি’ ইত্যাদির মধ্যে।

তিনি ‘রসচক্র’ নামে একটি সাহিত্য চক্র গড়ে তুলেছিলেন যেখানে সাহিত্য আলোচনা ছাড়াও বিতর্ক হত। তার সাথে চলত রঙ্গ রসিকতাও। এই সংগঠনটি ছিল নবীন ও প্রবীণ সাহিত্যিকদের মেলবন্ধনের একটি ক্ষেত্র। তিনি ‘বসুধারা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করতেন সেই সময়।

১৯৫৯ সালে দিল্লিতে সাধারণতন্ত্র দিবসে আকাশবাণী আয়োজিত সর্বভারতীয় কবি সম্মেলনে বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন কালিদাস রায়। কালিদাস রায় তাঁর সারাজীবনের কৃতিত্বের জন্য বহু সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯২০ সালে রংপুর সাহিত্য পরিষদ তাঁকে সাহিত্যে অবদানের জন্য কবিশেখর কালিদাস  রায়  রবীন্দ্র-ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। এই  ১৯৭৫ সালে টালিগঞ্জে 'সন্ধ্যার কুলায়' নামক নিজস্ব বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কড়ুই গ্রামের একজন বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, পূর্ব বর্ধমানের এই স্বনামধন্য কবিকে শ্রদ্ধা  জানাই এই জেলার অধিবাসী হিসেবে। এই জেলা   তথা সমগ্র বাংলার পক্ষ থেকে অসংখ্য  কুর্ণিশ তাঁর প্রতিভাকে। তাঁর জন্মভিটা সংস্কার করা খুব প্রয়োজন বলে মনে করি।

তথ্যঋণ- কবিশেখর কালিদাস রায় ও তার জীবন ও কাব্য। লেখক - সুদাম চন্দ্র অধিকারি, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া। 
 

প্রবন্ধ

images.png
রবীন্দ্রচেতনায় বিজ্ঞান
Anisha Dutta.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

যে কোনো অনুসঙ্গে রবীন্দ্রালোচনার সুরুতেই যে কথা অবশ্য স্বীকার্য, তা’ হল গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো। মনের এমন কোন ভাব বা ভাবনা নেই যা কবিগুরু ভাবেননি বা প্রকাশ করেননি। কবির অনন্য মননশীলতাকে নাগালের বাইরে রাখলেও, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ভাবাবেগও, তাঁর প্রকাশের সৌন্দর্যে অপরূপ রূপে রূপায়িত হয়েছে। কবির দেওয়া ‘বিজ্ঞান” শব্দের সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রবন্ধের সূচনা হোক। 

‘বিজ্ঞান শাস্ত্র‘ ‌কাহাকে বলে? না, যে শাস্ত্র, জগৎ রূপ একটি মহৎ পীড়ার সমস্ত লক্ষণ, সমস্ত নিয়ম আবিষ্কার করিতে চেষ্টা করিতেছে। মনুষ্যদেহের একটি পীড়ার সমস্ত কথা জানিতে পারি না, আমরা জগৎ পীড়ার সমস্ত লক্ষণ জানিতে চাই। আমাদের নিজ দেহের একটি পীড়াকে যদি সর্বতোভাবে জানিতে পারি, তাহলে আমরা সমস্ত জগৎ পীড়ার নিয়ম অবগত হতে পারি। কারণ, এই নিয়ম জগৎ সমষ্টিকে ও প্রত্যেক পরমাণুতে কার্য করিতেছে।“ পরে পরেই তাঁর‌ মতবাদ ভারতের সেই‌ চিরাচরিত ঐক্যানুভতি: একের মধ্যে – অনু পরমাণুতে পরমোপলব্ধি। অবশ্যই বিজ্ঞান সম্পর্কে কবির সোচ্চার বক্তব্য “বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। সেই শক্তি যখন‌ সমস্ত সমাজের হয়ে কাজ করবে, তখনই সত্যযুগ আসবে। বিজ্ঞান যেখানে সত্য, সেখানে বস্ততঃ, সে সকল‌ জাতির‌ মনুষ্যকে ঐক্য দান  করিতেছে। কিন্ত তার সমস্ত শক্তির ভাগাভাগি নিয়ে মানুষ হানাহানি করতে থাকে …”। অর্থাৎ বিজ্ঞানের যথাযথ কল্যাণকর প্রয়োগের ওপর কবির ভরসা ছিল না। 

পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উৎস সম্পর্কে উৎসুক হলে, আধুনিক বিজ্ঞানে ডারউইনের বিবর্তনবাদে উত্তর খুঁজব। সৃষ্টির আদিমতম যুগে, পৃথিবীর আবহ মন্ডল ছিল ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ, তড়িৎ আন্দোলিত, চঞ্চলময়। বজ্রপাত  অগ্নুদগীরণ, ভূকম্পন ইত্যাদিতে স্বতঃ আলোড়নশীল। বিজ্ঞানের বিশ্বাসে, তৎকালীন মুহূর্মূহু আলোড়নে সদা পরিবর্তনশীল অশান্ত আবহাওয়ায় এককোষী প্রাণীর জন্ম। বিবর্তনবাদ অনুসারে, কিছুটা বংশগত ধারাবাহিকতায়, বাকিটা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে, এককোষী থেকে বহুকোষী ইত্যাদি। ক্রমিক পর্যায়ে জলজ উদ্ভিদ, মাধ্যমিক স্তরে উদ্ভিদ রাজ্য, পরিণতিতে প্রাণী জগতের প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ জড়ীভৃত চেতনা পূর্ণতা পেয়েছে প্রাণীতে । অজৈব জটিলতায় জীবনের জাগরণ এবং রবীন্দ্রনাথের স্বীয় ভাষায়, “আমরা যাহাকে প্রাণ বলি, তাহার হঠাৎ আরম্ভ নাই। আমরা যাহাকে জড় বলি, তাহা হইতেই সে অভিব্যক্ত হইয়াছে ।..প্রত্যেক জড় পরমাণু প্রাণ হইয়া উঠিতে চেষ্টা করিতেছে, প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম প্রাণ পূর্ণতর জীব হইতে চেষ্টা করিতেছে। প্রত্যেক পূর্ণতর জীবন (যেমন মনুষ্য) অপূর্ণতার হাত এড়াইতে প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে । বিশাল জগতের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে অভিব্যক্তির (Evolution) চেষ্টা অনবরত কার্য করিতেছে ।“

রবীন্দ্রনাথ ডারউইনের বিবর্তনবাদকে সমর্থন জানিয়েছেন, “বৈজ্ঞানিক মহলে এককালে প্রত্যেক জীবের স্বতন্ত্র সৃষ্টির মত প্রচলিত ছিল। জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ছিল খন্ডিত। ডারউইন যখন জীবের উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি মূলতঃ ঐক্য আবিষ্কার ও প্রচার করলেন, তখন ঐ সত্যের একটি আলোকে বৈজ্ঞানিক ঐক্য বুদ্ধির পথ, জড়ে-জীবে অবারিত করে দিলে।“

বিজ্ঞানের বিপুল বিস্ময়ে কিন্ত রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে বিচলিত বা বিমোহিত ছিলেন না। বিজ্ঞান জগতে মানুষের পারদর্শিতা নিয়ে গর্ব বোধ তো দূরস্থ, সময়ে-সময়ে, খানিক অবজ্ঞার ভাবও দেখিয়েছেন। গ্রাম্য সারল্য ও প্রাণ প্রাচুর্য যে বিজ্ঞানের সাফল্যের কারণে, অনাদৃত ও বিঘ্নিত হচ্ছে, এমন ধারণা মনে মনে লালন করতেন। গ্রামবাসীদের প্রতি তাঁর অভিভাষণে রয়েছে, “পশ্চিম দেশ যে সম্পদ সৃষ্টি করেছেন, তার অতি বিপুল প্রচন্ড শক্তি সম্পন্ন যন্ত্রের বেগে। ধনের বাহন হয়েছে যন্ত্র, আবার সেই যন্ত্রের বাহন হয়েছে মানুষ, হাজার-হাজার, বহু শত সহস্র …। এখনকার তুলনায়, অনেক অভাব আমাদের দেশে ছিল। এখন আমরা কলের জল খাই, তাতে রোগের বীজ কম। ভালো ডাক্তারখানা আছে। বিজ্ঞানের সাহায্যে অনেক সুযোগ, আমি তাকে অসম্মান করি না। কিন্ত আমাদেরও সম্পদ ছিল আত্মীয়তা, যার অভাবে সুখ শান্তি থাকতে পারে না “অর্থাৎ বিজ্ঞানের জাগতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সুখশান্তির ব্যাঘাত ঘটছে এমন ধারণার বশবর্তী ছিলেন। ‘পল্লীসেবা’ তে রয়েছে,‘ ’একথা সত্য যে, আধুনিক অনেক জ্ঞান বিজ্ঞান, সুযোগ সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। তখন আমাদের চেষ্টার পরিধি ছিল সঙ্কীর্ণ, বৈচিত্র্য ছিল স্বল্প। জীবনযাত্রার আয়োজনে উপকরণের অভাব ছিল বিস্তর। কিন্ত সামাজিক প্রাণ ক্রিয়ার যোগ ছিল অবিচ্ছিন্ন, এখন তা নেই।“ 

বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য: “বিজ্ঞান বলে, আলোকের অপেক্ষাকৃত বিশ্রামই অন্ধকার। অন্ধকারের অপেক্ষাকৃত উদ্যমই আলোক। তেমন আত্মার নিদ্রাই জড়ত্ব এবং জড়ের চেতনাই আত্মার ভাব। বিজ্ঞান বলে, সূর্য কিরণে অন্ধকার রশ্মির বিস্তার, আলোকরশ্মি তার তুলনায় অনেক কম। একটুখানি আলোক অনেকখানি অন্ধকারের মুখপাত্র স্বরূপ। তেমনি আমাদের মনেও, একটু খানি চৈতন্যের সঙ্গে অনেক খানি অচেতনতা জড়িয়ে আছে, জগতেও তাই। জগৎ একটা প্রকান্ড গোলাকার কুঁড়ি, তাহার মুখের কাছটিতে একটুখানি চেতনা দেখা দিয়াছে। সেই মুখটুকু যদি উদ্ধত হইয়া বলে, আমি মস্ত লোক, জগৎ অতি নীচ, উহার সংসর্গে থাকিব না, আমি আলাদা হইয়া যাইব, সে কেমনতর শোনায়?“

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মানুবর্তিতার নিয়ন্ত্রিত যে জগন্ময় চেতনা নিয়ত প্রবাহিত হয়ে চলেছে, জড় ও জীবনের শৃংখলার ঐকাত্মে, সেই ঐকতানের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের বাণী: “‌জড় বুদ্ধি সকল জিনিষকেই পৃথক করিয়া দেখে, বুদ্ধির‌ যতই উন্নতি ঘটে, ততই সে ঐক্য দেখিতে পায়। বিজ্ঞান বল, দর্শন বল, ক্রমাগত একের প্রতি ধাবমান হইতেছে“। বিজ্ঞান সচেতনতা প্রত্যেকের থাকুক বা না-থাকুক, বিজ্ঞান যে পরম সত্য, তাতে তো তর্কের অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “আমি কি জানি, বিশ্ব সংসারে প্রত্যেক পরমাণু অহর্নিশ আমাকে আকর্ষণ করিতেছে এবং আমিও বিশ্ব

সংসারের প্রত্যেক পরমাণুকে অবিশ্রাম আকর্ষণ করিতেছি? কিন্ত জানি না বলিয়া, কোন্ কাজটা বন্ধ রহিয়াছে?” মানব সভ্যতার ইতিহাসে, বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার করতে না পারলেও, রবীন্দ্রনাথ মন থেকে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন কি না, সে সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। কবি বলেছেন, “বর্তমান সভ্যতা, প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সন্ধি করে, জয়যাত্রায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। সেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হৃদয়বান মানুষের চেয়ে, হিসাব করা ব্যবস্থা বেশি প্রাধান্য লাভ করে।…….. উপকরণ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির কোঠায় পড়ে, শ্রেয়োবুদ্ধির সঙ্গে তার সম্বন্ধ কম। ………. ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার টানাটানিতে, মানব সম্বন্ধের জোড়গুলি খুলে গেছে। বাইরে থেকে জটিল ব্যবস্থার দড়াদড়ি দিয়ে তাকে জুড়ে রাখার চেষ্টা চলছে।  একথা মনে রাখতেই হবে, মানবিক সমস্যা যান্ত্রিক প্রণালীর দ্বারা সমাধান করা অসম্ভব।“ অর্থাৎ বিজ্ঞান সভ্যতার দৃশ্যপটে আমাদের স্বদেশীয় সমাজ ব্যক্তি নির্বিশেষে কতটা উপকৃত হচ্ছিল, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আস্থার অভাব ঘটেছিল। তবে একথাও ঠিক, মানব কল্যাণে বিজ্ঞানকে তিনি স্বতঃই স্বাগত জানিয়েছেন, “আজ শুধু একলা চাষীরা চাষ করিবার দিন নাই, তাহার সহিত বিজ্ঞানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে।…………..বস্তুতঃ ভূমিলক্ষীর সঙ্গে সরস্বতীকে না মিলাইয়া দিলে, আজকালকার দিনে ভূমিলক্ষীর যথার্থ সাধনা হইতে পারিবে না। পুত্র রথীন্দ্রনাথ কৃষি বিজ্ঞান পড়তে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন।        

পাশ্চাত্য দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির মূলে বিজ্ঞানের ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের নিকট অনস্বীকার্য ছিল। “আধুনিক ইউরোপ, আমেরিকার আদর্শে-অভিমুখে প্রয়াস দেখিতে পাই……..যখন থেকে সেখানে জ্ঞান ও শক্তি সাধনার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি বহুল পরিমাণে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়েছে…………। রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ভাবধারা মনের অতলান্তে তলিয়ে যায়, তার থৈ পাওয়া ভার। কিন্ত ভাবের গহীনে তিনি বিজ্ঞানকে বিস্মৃত হন না। ……. ”ইন্দ্রিয় যোগে, ‘ঘনদেশের’ জিনিসকে একরকম দেখা, ‘ব্যাপকদেশের,’  জিনিসকে একরকম দেখা, ‘মন্দকালের গতিকে অন্যরকম দেখান–এই প্রভেদ অনুসারে, সৃষ্টির বিচিত্রতা। ……. কিন্ত বিজ্ঞান ঘড়ির কাঁটার কাল ও গজকাঠির মাপ দিয়ে সমস্তকে দেখতে চায়। দেশকালের এক আদর্শ দিয়ে, সমস্তকে বিচার করে। কিন্ত এই আদর্শ, সৃষ্টির আদর্শই নয়। সুতরাং বিজ্ঞান সৃষ্টিকে বিশ্লিষ্ট করে ফেলে, অবশেষে অণুপরমাণুর মধ্যে দিয়ে এমন একটা জায়গায় পৌঁছয়, যেখানে সৃষ্টি নেই। ইথার কম্পনমাত্রই সৃষ্টি নয়, আলোকের অনুভূতিই সৃষ্টি। ………অর্থাৎ বিজ্ঞানের যৌক্তিকতা এবং মানবিক অনুভূতির মধ্যে বিরোধ বেধে যাচ্ছে। 

রবীন্দ্রনাথের চিন্তার চেতনায় অত্যন্ত প্রাঞ্জল, বিজ্ঞান কখনই মানবিক বোধের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। “বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতায় আমরা যে জগৎকে জানি বা কোনকালে জানবার সম্ভাবনা রাখি, সেও মানব জগতে। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধির, যুক্তির কাঠামোর মধ্যে, কেবল মানুষই তাকে আপন চিন্তার আকারে, আপন বোধের বিশিষ্টতা দিয়ে অনুভব করে। এমন কোনও চিত্ত কোথাও থাকতেও পারে,যার উপলব্ধ জগৎ আমাদের গাণিতিক পরিমাপের অতীত। আমরা যাহাকে আকাশ বলি, সেই আকাশে সে বিরাজ করে না। ……বিশ্বজগৎ গাণিতিক মনের সৃষ্টি, এমন কথা বললেও, গাণিতিক মন তো মানুষের মনকে ছাড়িয়ে গেল না। যদি যেত, তবে এ জগতের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আমরা জানতেই পারতাম না।……….” অর্থাৎ বিজ্ঞান চেতনা, মানব চেতনারদেশী একটি অংশ মাত্র, তা মানববোধকে অনুসরণ করে’, উন্নত হতে প্রয়াসী হয়, তাকে অতিক্রম করে’ এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ। তবু জ্ঞানই হোক্, বিজ্ঞানই হোক্, আমাদের দেশীও শিক্ষা নীতিতেই রয়েছে গোড়ায় গলদ। “আমাদের আধুনিক শিক্ষা বিধি বলে, একটা পদার্থের আবির্ভাব ঘটেছে, তারই নামে স্কুল কলেজ ব্যাঙের ছাতার মত ইতস্ততঃ মাথা তুলে উঠেছে। …….. মাতৃভাষার যোগে শিক্ষা বিস্তার সম্বন্ধে যখন চিন্তা করি, সে চিন্তার সাহস অতি অল্প ……. জ্ঞান লাভের ভাগ নিয়ে, দেশের অধিকাংশ জনমন্ডলীর সম্বন্ধে এত বড় অনশনের ব্যবস্থা কোন নবজাগ্রত দেশে নেই ।…….. ইংরাজী হোটেলওয়ালার দোকান ছাড়া আর কোথাও দেশের লোকের পুষ্টিকর অনরন মিলবে না, এমন কথা বলাও বা, আর ইংরাজী ভাষা ছাড়া মাতৃভাষা যোগে জ্ঞানের সম্যক সাধনা হতেই পারে না, এও বলাই তাই । ………….

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান সাধনার কথায়, কবিরচিত ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটির প্রসঙ্গ উল্লেখ্য। বইটিকে বিজ্ঞান সাহিত্য বললে, অবমাননা করা হবে, যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে, বলা উচিত, ‘বিজ্ঞান কাব্য‘। বইটি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গীকৃত। ভূমিকায় বলা হয়েছে, শিক্ষা যা্রা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞান ভান্ডার না হোক্ বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে, তাতে অগৌরব নেই ।………তথ্যের যাথার্থ্যে এবং সেটাকে প্রকাশ করার যথাযথ্যে, বিজ্ঞান অল্পমাত্র স্খলনও ক্ষমা করতে না। আমি বিজ্ঞানের সাধক নই, কিন্ত বাল্যকাল হতে, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। ……তখনকার কাঁচা হাতে একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলাম বলেই লিখছিলাম, জীবনে সেই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা। আর সেটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে। ………বিজ্ঞান থেকে যা্ঁরা চিত্তের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন,‌ তাঁরা তপস্বী……….. আমি রস পাই মাত্র। ………. বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্য পারিভাষিক এর প্রয়োজন আছে। কিন্ত পারিভাষিক চর্ব্য জাতের জিনিস……….সেই কথা মনে করে’, যতদূর পারি, পরিভাষা এড়িয়ে, সহজ ভাষায় মন দিয়েছি।………”

বইটি সমালোচনার বহু ঊর্ধে, একথা বলাই বাহুল্য। আসলে বিশ্ববন্দিত কবি যাতেই হাত দিতেন, তাঁর অনন্য প্রতিভার স্পর্শে তাই সোনা হয়ে উঠত। রসগ্রাহী গুণগ্রাহী পাঠক যথার্থই মোহাবিষ্ট হবেন, বিজ্ঞানের মনোরম কাব্যিক রূপটিতে। যাই হোক, বিজ্ঞান বিভবে, কবির উপসংহার, “ তত্ত্বজ্ঞান যা বলছে, সে এক কথা। বিজ্ঞান যা বলছে, সে এক কথা। কিন্ত কবি বলছে, আমার হৃদয় মনের তারে ওস্তাদ বীণা বাজাচ্ছেন,‌ সেই তো বিশ্ব সংগীত, নইলে কিছুই বাজত না!“

অনুবাদ

village2.jpg
উইলসনের বাড়ি

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

লেখক পরিচিতি- আরণ্যক শইকীয়া ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার অফিসার। তিনি বর্তমানে অসমের গোঁসাইগাঁওয়ের মহকুমাধিপতি হিসেবে কর্মরত। দিল্লির সেইন্ট স্টিফেন্স কলেজ এবং দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং এম ফিল আরণ্যক Economic Times, Indian Express, The Print, The Assam Tribune, Economic and Political Weeklyর মতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কাগজ এবং জার্নালে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে থাকেন। অসমিয়া সাহিত্য চর্চায় অনুরাগী এবং ইতিমধ্যে তাঁর বেশ কিছু ছোটো গল্প ‘প্রকাশ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। 

aranyak_edited.jpg
BasudevDas.jpg

অনুবাদক পরিচিতি -১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়। শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশো পঞ্চাশটিরও বেশি। সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিতভাবে অসমিয়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে সাহিত্য এবং অনুবাদ সম্পর্কে গবেষণাপত্র পাঠ করেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সন্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একত্রিশটি।

ইলসনের বাড়ি গিয়েছেন কি? যদি যান নি, এবার নিশ্চয় যাবেন। পরিচ্ছন্নভাবে নির্মিত ছোটো বাড়িটা উইলসনের প্রতিবেশীদের মধ্যে প্রথম পাকা ঘর—আমার কয়েকবার যাওয়ার সৌভাগ্য হওয়ায় পাড়াটার বিষয়ে কিছু কথা জানতে পেরেছি। এই যেমন উইলসনের পরিবার ছাড়াও এখানে প্রায় চল্লিশটি পরিবার রয়েছে — প্রত্যেকেরই বাড়ির পেছন দিকে একটা করে বাগান আছে। শীতকালে গেলে সেখানে আলু, কুমড়ো, পালেং এবং আরু কয়েকধরনের ট্ম্যাটোর চারা ঘিরে থাকা বাগানটাতে কয়েকটি মুরগির বাচ্চাকে মায়ের আশ্রয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
বাড়ির পেছনদিকে একটা গভীর জঙ্গল। শাল গাছে ভরে থাকা জঙ্গলটাতে আমা, কাঁঠালও পাওয়া যায় —সঙ্গে উনুন জ্বালানোর জন্য খড়ির মুখ্য উৎস হয়ে পড়ে এই জঙ্গলের গাছগুলি।
'এখানে এনিমিয়ার প্রাদুর্ভাব সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক' — উইলসনের সামনের উঠোনে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে একটা মোড়ায় বসে প্রেরণার কথাগুলি আমার এখনও মাঝে মধ্যে মনে পড়ে। রক্তহীনতার বিষয়ে গবেষণা করতে আসা প্রেরণা কোথাও খবর পেয়েছিল উইলসনদের গ্রামের বিষয়ে--ডক্টরেট ডিগ্রির খাতিরে ব্যস্ত শহরের নিরাপত্তা থেকে একটি ঘুমন্ত অপরিচিত গ্রামের নিরাপত্তাহীনতায় ঢুকে পড়ে সে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করছিল না।
ঠিক এভাবেই এসেছিল একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রোহণ—রক্তহীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সে এসেছিল সজাগতামূলক সভা করার জন্য। সঙ্গে এনেছিল আইরণ টেবলেটের কয়েকটি প্যাকেট।
‘কিন্তু এখানকার লোকেরা কিছুই বুঝতে চায় না,খুব গোঁয়ার প্রকৃতির।’ উইলসনের পাড়ার সন্তোষের বাগানটার মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় রোহণ বলে উঠেছিল। আমি তাকে উইলসনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম—সে হয়তো ভাবছিল যে তার বাক্য দৈব্যবাণী—তার কথাতেই কাজ হয়ে যাবে—প্রত্যেকেই আইরন টেবলেট খেতে শুরু করবে। নিজের রক্তহীনতা না হওয়ার ফলে সে কখনও না খাওয়া এই আয়রন টেবলেটের সমস্যাগুলি হয়তো অনুধাবন করতে পারে নি। 
অধিক রক্তহীনতার ফলে গর্ভবতী মহিলা কয়েকজনের কিছু সমস্যাও তৈরি হয়েছিল—এখনই সিভিলে নিয়ে যেতে হবে।’ প্রায় ধমকের সুরে বলে ওঠা, এই গ্রামের আশা দিদির কথাগুলি মাঝেমধ্যে আমার মনে আলোড়নের সৃষ্টি করে। আশা দিদি এই গ্রামের এই বাসিন্দা— শিক্ষার সুবিধা পাওয়ায় আশা দিদির চাকরিটা হয়েছিল— ট্রেনিংয়ে  শেখানো হয়েছিল রক্তহীনতার ভয়াবহতার কথা।
এইটুকু জ্ঞানে সমৃদ্ধ আশা দিদি উইলসনের বাড়িতে ঘন ঘন আসে। হাতে থাকে একটা পান সুপুরীর জন্য হলে এবং মুখটা  ঈষৎ লাল। শারীরিক খোঁচে ঢুকে থাকে চুনের ডিবে এবং উইলসনের থেকে চেয়ে নেয় একটি বাটা।
তার সঙ্গে কখনও আসে প্রতিবেশী গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের দিদিটা— উইলসনদের পাড়ায় ছয় বছরের নিচে কয়েকটি শিশু আছে। প্রায় সবগুলিরই রয়েছে পুষ্টিহীনতার লক্ষণ— অঙ্গনবাড়ির দিদির রেজিস্টারটাতে লাল কালির চিহ্ন দিয়ে রাখা উইলসন -সন্তোষদের সন্তানদের নামগুলি আমার আজো মনে আছে।
‘গ্রাম প্রধান হিসেবে আপনার দায়িত্ব আছে— বাচ্চাগুলির পুষ্টিহীনতা বৃদ্ধি পেলে ওদের ভবিষ্যতে আরও সমস্যা হবে।’— এই বলে দিদিটি সরকার থেকে যোগান দেওয়া চাল বুথ এবং ডালিয়ার প্যাকেট কয়েকটি দিয়ে যায়। তিনি আবার আগামী মাসে আসবেন— এই মাসের ভেতরে এই রেশনের সৎ ব্যবহারের দায়িত্ব আমার উপরে। তবে কখনো সিনিয়র অফিসারের পরিদর্শন থাকলে দিদিটিকে পুনরায় দেখা যায়। তিনি অফিসারকে উইলসনের পাড়ায় নিয়ে যান—পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশুগুলোকে অফিসারকে দেখিয়ে দেন।
সেই যে একবার ডাক্তারের একটা দল গ্রামে এসেছিল, তাদের মুখেও সেই একই ধরনের চিন্তা এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যয় দেখা গিয়েছিল।’ আপনি উনাকে আগেই সিভিল হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন’-- আমাকে যেন তাদের সেটাই ছিল আদেশ। ’স্যার, এরা হাসপাতালে গেলে দুদিনের হাজিরা থেকে বঞ্চিত হবে। ঘরের চালগুলিও বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে, খাবার বিশেষ কিছুই নেই। এখানে পুষ্টিহীনতা একটা সামাজিক ব্যাধি, কেবল মেডিকেল সমস্যায় নয়’ বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বললাম না। বিকেলের জোর জবরদস্তি করে পরিবারটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম— আজও মনে পড়ে ওদের মুখে ফুটে ওঠা বিদ্রোহ এবং গ্লানির ভাবগুলি।
একদিন একটা নতুন দল এসেছিল। তাদের হাতে হাতে কাগজ-কলম সঙ্গে এক একটি রেজিস্টার— কার কার পাকা ঘর নেই তাই সমীক্ষা করার জন্য এসেছি।’ দলটির সদস্যের ভেতরে নেতার কথায় আমার হাসি পেয়ে গেছিল।’ এখানে একটিও পাকা ঘর নেই— এভাবে বলতে গিয়েও আমি শেষ পর্যন্ত কিছুই বললাম না।তারা আমার বাড়িতেই বসেছিল— বিভিন্ন কথার উপরে আলোচনা হল। এখানে কয়টি পরিবার, একসঙ্গে কয়জন থাকে, কেউ বাইরে কাজ করতে গেছে কিনা ইত্যাদি। যুবক বয়সের সদস্য কয়েকজন আমার শব্দগুলি একান্ত বাধ্য ছাত্রের মত লিখিত অক্ষরের রূপান্তরিত করছিল। তারা দুদিনের কর্মসূচি নিয়ে এসেছিল যদিও প্রথম দিনেই সমগ্র পাড়া ঘুরে দ্বিতীয় দিন দেখা দেওয়া আমার মনে পড়ে না।
দৈনন্দিন জীবন নির্বাহের তাগিদায় আমরা প্রত্যেকেই আগের মতই সেই একই তাড়াহুড়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম। কেউ বেরিয়ে গেল দিন হাজিরার জন্য কেউ গেল নিজের বাগানের সবজির তদারকি করার জন্য কারো ছাগল চুরি হল।
আমাদের গ্রামে একটি পাকা ঘর হবে।’ প্রায় এক বছর পরে কোন নির্মাণ প্রকল্পে দিন হাজিরা করে ফিরে আসা সন্তোষের মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলি আমার এখনো স্মৃতির কোন এক কোণে বাজে। আমি আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না সে খবরটা কোথায় কিভাবে পেয়েছিল। হয়তো গুয়াহাটি থেকে আসার সময় খন্ড উন্নয়ন অফিসারের কার্যালয়ে সে ঢুকেছিল; সেখানেই হয়তো লোকজনদের বলাবলি করতে শুনেছিল। হয়তো সে নিশ্চয়ই খন্ড উন্নয়ন অফিসারের কার্যালয় থেকে খবরটা পেয়েছিল।
‘আপনার গ্রামে এটা পাকা ঘর বিতরণ হয়েছে।’ খন্ড উন্নয়ন অফিসারের কার্যালয় থেকে আশা কনিষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারের এই ভাষায় আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম—- ’মাত্র একটি ঘর। এই গ্রামের প্রতিটি বাসিন্দার পাকা ঘরের প্রয়োজন।’ ঘরটা বোধহয় বড়ই হবে; হয়তো একসঙ্গে কয়েকটি পরিবার থাকতে পারবে।
পরের ১০ দিনের ভেতরে উইলসনের বাড়িতে কয়েকজন অফিসার ইঞ্জিনিয়ার এসে জরিপ করে গেল— জানা গেল যে উইলসনের ব্যাংক একাউন্টে  টাকা এসেছে। তাকে নাকি নিজেই ঘরটা তৈরি করে নিতে হবে।
কেউ সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না টাকাটা দিয়ে কি করবে। আমরা প্রত্যেকে ভেবেছিলাম যে কোনো সরকারি ঠিকাদার উইলসনের জন্য একটা পাকা ঘর তৈরি করে দিয়ে যাবে।
উইলসনকে বলে রাখবে যে তার হাতে মাত্র তিন মাস সময় আছে। তার চেয়ে বেশি সময় নিলে জরিমানা দিতে হবে— সরকারি টাকা আফটারঅল, কোনো রকম জালিয়াতি যাতে না হয়।’ অফিসারটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে এভাবেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
‘তিনমাসের ভেতরে কাজটা শেষ করতে হবে—পাকা ঘর রেডি করতে হবে’— উইলসনের মুখে প্রকাশ পাওয়া বিস্ময় এবং অবিশ্বাসের ছবিটা দেখে আমি কথাটা বললাম না। তাকে যখনই বললাম যে সরকার নিজেই বাড়িটা তৈরি করে নিতে নির্দেশ দিয়েছে, তার মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রপাত হয়েছিল— সময়সীমার কথা অর্থহীন হয়ে পড়েছিল।

এত বছরে একটিও পাকাঘর না থাকা একটা গ্রাম কিভাবে হঠাৎ তৈরি করবে একটা পাকা বাড়ি?সন্তোষ এবং দুই একজন গ্রামের বাইরে দিন হাজিরা করা মানুষ ছাড়া এখানে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি নেই। কেউ জানে না ইট, বালি কোথায় পাওয়া যায়, কতটা প্রয়োজন, সিমেন্ট কোথায় পাওয়া যায়; কেউ হয়তো পাকা বাড়িতে একটা রাতও কাটায় নি।উইলসন মুখে কিছু বলল না যদিও তার যেন চোখে এবং মুখে ফুটে উঠেছিল এক বোঝাতে না পারা অসহায়তার ছবি। আমার এখনও মনে আছে রাতে সেই সময়টুকু উজাগরে কাটানোর কথা—পরেরদিন তাঁর স্ত্রী মরিয়া এসে আমাকে বিবরণ দিয়েছিল। আমি উইলসনের বাড়িতে কয়েকদিন গেলাম না।‘আপনি কীসের গ্রাম প্রধান হে!’প্রায় একমাস পরে একজন ইঞ্জিনিয়ারের মুখ থেকে একটা কটাক্ষ শুনতে পেলাম। তিনি উইলসনের বাড়ির তদারকের কাজে এসেছিলেন।

‘প্রায় একমাসের ওপর হল উইলসনের মাটিতে একটা মাটির চাপড়াও পড়ে নি।’‘কীভাবে পড়বে। সে আজ পর্যন্ত ব্যাঙ্কে যায় নি— টাকা উঠাতে পারলে তবেই তো খরচ করতে পারবে আর টাকা থাকলেই হবে কি? এই গ্রামে কোনো মিস্ত্রি আসবে কাজ করতে?’—

কথাটা প্রায় চিৎকার করেই বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মুখ থেকে কিছু বের হল না। আমার মৌনতায় ইঞ্জিনিয়ার পুনরায় বললেন –

‘কোনো অসুবিধা থাকলে আমাকে এখনই জানিয়ে দিন। না হলে আমরা ভেবে নিতে বাধ্য হব যে উইলসন সরকারি ধনের অপচয় করেছে।’ তাঁর সুর এবার কিছুটা নরম হওয়ায় আমি সত্যি কথাটা বলতে সাহস পেলাম।তাকে মনোযোগ দিয়ে শোনা বলেই যেন মনে হল, কারণ পরের দিন আমার বাড়িতে একটা মোটর সাইকেলে একজন আরোহী এসে উপস্থিত হয়ে উইলসনের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে দেখিয়ে দিলাম। পরে জানতে পারলাম যে ব্লকের কার্যালয় থেকে তিনি এসেছিলেন।উইলসনকে ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়েছে বলে শুনেছি— আমার মনে পড়ছিল কীভাবে একদিন ব্লকের অফিসারের ধমকে উইলসনকে ব্যাঙ্কে একাউন্ট খোলার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। সে এক অন্য কাহিনী, কখনও সময় হলে বলব।হাতে কুড়ি হাজার টাকার অনুভব একেবারে আলাদা— উইলসন হয়তো সেই রাতে তাকেই অনুধাবন করছিল। যে গ্রামে কারও বাড়িতে জীবঞ্জোড়া কষ্টের পরেও দশ হাজার টাকা নগদ ছিল না, তাতে উইলসনের হাতে এসে পড়েছিল চল্লিশটা পাঁচশো টাকার নোট। দু-রাত গান, নাচ, মাংস আর মদের উৎসব চলেছিল— তথাপি হয়তো মাত্র চারটির মতো নোট কমে ছিল।

‘এই কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে যাতে নিচের তলার ভিত নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে যায়, তার দায়িত্ব তোমার— না হলে তুমিও দায়ী হবে।

কথাগুলিকে আমি সতর্কীকরণ ভেবে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে তৃতীয় দিন একটি গ্রাম সভার

আয়োজন করলাম। দায়িত্ব যেন সবার উপরেই পড়েছিল— উইলসনের বাড়ি নির্মাণে সাহায্যের হাত এগিয়ে দেওয়া। এই বাড়ি নির্মাণের পরে এসে পড়বে অন্য বাড়ির সরকারি অনুমোদন। উইলসনের বাড়ি গ্রামের প্রথম পাকা ঘর— এটা পরিচ্ছন্নভাবে তৈরি হয়ে গেলে সরকার আমাদের আরও কয়েকটি নতুন বাড়ির অনুমোদন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমার কথায় প্রত্যেকেই সায় দিল—সন্তোষরা পাথর, বালি ইত্যাদি জোগান দেবে বলে আশ্বাস দিল, দরকার হলে কয়েকদিন দিন হাজিরা করে দেবে, উইলসনের প্রতিবেশী পাথর, বালি, সিমেন্টের বস্তা রাখার জন্য কিছুটা জায়গা বের করে দেওয়ার কথা বলল এবং আমি প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো দূরে থাকা গ্রামটির পরিচিত একজন মিস্ত্রির সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানালাম।’

‘এটা কী!’ খন্ড উন্নয়ন অফিসারের গর্জনে সেদিন আমাদের প্রত্যেকেরই বুক ধক ধক করছিল। গ্রাম সভার প্রায় একমাস পরে তিনি আমাদের গ্রামে উপস্থিত হয়ে দেখলেন  এক শোচনীয় ছবি —পাথর, বালি, ইটের কয়েকটি স্তূপ ছাড়া উইলসনের উঠোনে নেই কোনো পরিবর্তন। ইতিমধ্যে তিন মাসের সময়সীমা অতিক্রম করতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি ছিল।
‘স্যার, চেষ্টা করছি, কিন্তু পারি নি।’ আমি কাকুতি-মিনতি করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত থেমে গেলাম। কীভাবে বলা যায় যে সন্তোষরা দুই দিন শ্রমদান করে পুনরায় টাউনে কাজ করতে বেরিয়ে গেছে, মিস্ত্রি দুদিন কাজ করার পরে আর আসছে না, ‘এখানকার বাসিন্দা সিমেন্টের সঙ্গে কোনোদিন কাজ করেনি, পাকা ঘরে থাকার স্বাদ না পাওয়া উইলসনের চিন্তার বিষয় নিজের মেয়েকে বিয়ে দেওয়া’ কথাটা বলা যায় না, আমি ঠিক করলাম।
আমি এতক্ষণ চুপচাপ থাকায় অফিসারটি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, ’উইলসনের বিরুদ্ধে একটা মামলা করতে হবে। সরকারি ধন আত্মসাৎ করেছে।’ সবাইকে শুনিয়ে বলা কথাটা তিনি কনিষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বললেন। ইঞ্জিনিয়ার তৎপরতা দেখিয়ে পুলিশকে ফোন করতে গেল— মনে হল পরিস্থিতি গুরুতর হতে চলেছে। স্থানীয় থানার উপপরিদর্শক আসার পরে আমি সত্যি কথাটা বলে দিলাম।
আমার কথা শুনে তিনি একটিও শব্দ না করে সেখান থেকে চলে গেলেন— আমরা প্রত্যেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অগ্রহায়ণ মাসের ধুলো কাঁচা রাস্তা দিয়ে তীব্রগতিতে বেরিয়ে যাওয়া তার গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছিল— কি বা ভেবেছিলেন তিনি?
পরের দিন সকালে দুটি ট্রাক এবং কয়েকজন শ্রমিক আমার বাড়ির সামনে উপস্থিত হল। সরকারের টার্গেট পূরণের তাগিদায় খন্ড উন্নয়ন অফিসার উইলসনের বাড়ি সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নিলেন। বিগত একমাসে অপরিচিত শ্রমিকের হৈচৈ আমাদের গ্রামে এক অন্যরূপ লাভ করল— ভাতের গন্ধের পরিবর্তে রুটির সঙ্গে সুস্বাদু আচারের গন্ধ আমাদের পাড়াকে ঘিরে ধরেছিল, শ্রমিকদের তাঁবুর ভেতরে কাপড় চোপড়ের রং আমাদের পাড়ার কাপড় থেকে আলাদা ছিল, লোহা লক্কর, পাথর বালি ইট এবং সিমেন্টের বেগে পরিপূর্ণ হয়ে পড়া এই সচরাচর নিদ্রামগ্ন গ্রামটিতে এসেছিল কিছুদিনের জন্য এক নতুন উদ্যমের জোয়ার। রাতের ভেতরে দুই একটি সিমেন্টের ব্যাগ নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে তদন্ত করে জানতে পারলাম যে আশেপাশের দুই একটি ছেলে সেই ব্যাগগুলি টাউনে বিক্রি করে এসেছিল। রাজমিস্ত্রির সংস্পর্শে এসে অন্য কয়েকজন কারিগরী দিকটা কিছুটা আয়ত্ব করা বলে আমার মনে হল— আজকাল ওদেরকেও টাউনে কয়েকটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করতে যেতে দেখি।
এভাবে প্রায় এক মাসের ভেতরে উইলসনের বাড়ির ভিত গড়ে উঠল। শ্রমিক এবং মিস্ত্রির অহর্নিশ করা প্রচেষ্টার ফল ধীরে ধীরে দেখতে পাওয়া গেল— খন্ড উন্নয়ন অফিসারের মুখে সন্তুষ্টির হাসি দেখা গেল যদিও তিনি জানতেন যে এখনও অনেক কাজ করা বাকি। এক মাসের ভেতরে কাজ সম্পন্ন করতে হবে, ইতিমধ্যে সময়সীমা পার হয়ে গেছে—- তার কঠোর স্থিতিতে প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছিল কাজ শেষ হওয়ার গুরুত্ব। উইলসন নিজেই বুঝতে পেরেছিল এর তাৎপর্য— কাজ শেষ না হলে তার ওপরেই মামলা করা হবে। পুনরায় পূর্ণ গতিতে কাজ চলল—  এক মাসের ভেতরে বাড়ি প্রায় তৈরি  হয়ে উঠল। ব্লকে খবর গেল— অফিসার পুনরায় আমাদের গ্রামে উপস্থিত হলেন।
‘আগামী সোমবার আমরা বাড়িটা নির্মাণ সম্পন্ন হল বলে ঘোষণা করব।’ পরের সোমবার জাঁকজমক সহকারে বাড়ির উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল— সমস্ত আয়োজনই গ্রাম প্রধান হিসেবে আমি ঠিক করলাম। উইলসনের বাড়িতে প্রবেশ করা মুখ্য দ্বারে একটা লালফিতা গেঁথে দেওয়া হল, অফিসার এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন— কীভাবে এই বাড়ি এই গ্রামে আমূল পরিবর্তন আনবে, এই বাড়ির নির্মাণের পেছনে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী আছে, ইত্যাদি। উইলসনের মুখে আমি কোনো আবেগের চিহ্ন দেখতে পেলাম না —তাকে দুই একটি কথা বলতে বলায় সে নিজের ভাষাতেই কয়েকটি কথা বলল— ’ধন্যবাদ, নতুন বাড়িটা আমার কাছে স্মরণীয়, আমি এখানে থাকার চেষ্টা করব।’ আমাদের গ্রামের বাসিন্দা ছাড়া কেউ বুঝতে না পারায়, প্রত্যেকেই কিছু যোগাত্মক কথা বলা বলে বিশ্বাস করে হাততালি দিয়ে তার ভাষণ সমাপ্ত করিয়েছিল। খন্ড উন্নয়ন অফিসার লালফিতাটা কাঁচি দিয়ে কেটে বাড়িটা সম্পূর্ণ তৈরি বলে ঘোষণা করলেন। কয়েকটি ফোটো তোলা হল, ব্লকের কর্মচারী বাড়িটা তৈরি বলে রেজিস্টারে নোট করলেন এবং প্রত্যেকেই আত্মসন্তুষ্টিতে বাড়ি ফিরে গেলেন।
এটা ছিল ছয় মাস আগের কথা। উইলসনের পাকা বাড়ি সম্পূর্ণ তৈরি— সে আজও বাড়ির ভেতরে স্থানান্তরিত হয়নি। কয়েক পুরুষ থেকে যাওয়া মাটি দিয়ে লেপে রাখা এবং খড়ের ছাদের বাড়িটা থেকে সে এখনও বের হতে পারেনি। জীবনে আসা নানা ঝড়-ঝঞ্ঝাটের সাক্ষী এই বাড়িটার আত্মীয়তা হয়তো সে পাকা বাড়িটিতে পায়নি। 
‘এই কয়েকদিনের মধ্যে নতুন বাড়িতে যাচ্ছি’— গত ছয় মাস কখনও পাকা বাড়িতে কবে যাবে এই প্রশ্নের উত্তরে এই একটি উত্তরই তার মুখ থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। নতুনত্বের প্রতি মানুষের সন্দেহ থাকে, নতুনত্বকে আঁকড়ে ধরতে হলে কখনও মনের মধ্যে কোনটা দেখা দেয়, হয়তো সেই সন্দেহ এবং তথাকথিত আতঙ্ক উলশনের মনকে ক্ষতবিক্ষত করছিল নাকি অন্য কিছু?
বাড়ির ভেতরে রংগুলি ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, কাঠের খুঁটিতে উইপোকার ঢিবি বড়ো হতে শুরু করেছে –উইলসনের চুলো এখনো পুরনো মাটির ঘরের সামনে জ্বলছে। তার হয়তো মনে পড়ছে পাশেই থাকা পাকা বাড়িটার কথা— তবে এত বছরের নিরাপত্তা হয়তো সে নতুন বাড়িটাতে পায় না।
‘সমগ্র জীবন ক্যারোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাত কাটিয়েছি— এখন হঠাৎ কারেন্টের সুইচ কোথায় টিপতে হবে, কোথায় লাগবে না আমি কিভাবে জানব।’ একদিন উলসনকে কারও সামনে বলতে শুনেছিলাম। ঠিকই বলছে বলে মনে হয়েছিল আমার— তবে শেখা যায় না এমন কোন কাজ আছে কি? গুলশনের ছেলের একটি মোবাইল ফোন আছে, সে তার মধ্যে রেডিও লাগিয়ে রাখে। তাকেই সুইচ অফ অন করা শিখিয়ে দিতে বললেই হল— কথাটা আমি বলবো বলে ভেবে আজ পর্যন্ত বলা হয়নি। তবে এটা ঠিক যে বিদ্যুতের বিল দেশে নিয়মিতভাবে পরিশোধ করতে পারবে সেই সম্পর্কে আমার সন্দেহ রয়েছে। 
‘বাড়ির শৌচালয় কিভাবে ব্যবহার করবি এত বন্ধ বন্ধ বলে মনে হয়।’
আমি তখন আর তাকে কিছু বললাম না — আমার যুক্তি তার কাছে অমূলক বলে মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
সেদিন দেখতে পেলাম পাকা বাড়ির ভেতরে একটি গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। বর্ষার স্যাতসেঁতে পরিবেশে কয়েকটি খুঁটির কোণে শেওলা গজিয়ে উঠেছে— কখনও বন্ধ না করা দরজার মধ্য দিয়ে অনায়াসে ছাগল গরু ঢুকে যায়। মানুষ না ঢুকলেও অন্য জীবজন্তু যেন সেখানে প্রবেশ করতে কোন কণ্ঠাবোধ করছে না। উইলসনকে আমি গরুটা দেখিয়ে দেওয়ায় সে নির্বিকার ভাবে বলল— থাকতে দে গরুগুলিকে, ওখানেই থাকা ভালো— চুরি, যাওয়ার চিন্তা থাকবে না।’
‘এত কষ্টে তৈরি বাড়িটা গোয়াল ঘরে পরিণত হলে পুরোটা গোবরে আচ্ছাদিত হয়ে থাকবে।— কথাটা মনের মধ্যেই চেপে রাখলাম। দেখা গেল উইলসনের বাড়ি অবক্ষয়ের দিকে গতি করেছে। এই ধরনের পরিত্যক্ত বাড়ি একটা ফেলে যে কোনো মানুষ দখল করে নিত— তবে আমাদের গ্রামে যেন এই পাকা ঘর একটা বীভৎস আকৃতির মরণফাঁদ মাত্র। কেউ প্রবেশ করতে না চাওয়া এই বাড়িটা নিজের অন্তিমক্ষণ গুনছে।
‘ভেতরে এত গরম। সেখানে একটা ফ্যান না থাকলে থাকা যায় না। খরচ বেড়ে গেল।’ গরমের এক দিনে আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে উইলসন কথাটা বলেছিল। সে ঠিকই বলেছে — টিনের গরম ঘরের ভেতরটাকে উনুনের মতো গরম করে রেখেছে। উইলসনের পুরোনো বাড়ির মধ্যে এখনও ফ্যানের প্রয়োজন পড়ে না।
আর কতদিন এভাবে সে কাটাবে। অনেকদিন পরে আজ আবার প্রেরণা আমাদের গ্রামে এসেছে। সেই যে প্রেরণা— যে রক্তহীনতার বিষয়ে গবেষণা করার জন্য এই গ্রামকে বেছে নিয়েছিল। এখন সে নিজের গবেষণাপত্রটা ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছে— কয়েকটি আনুষঙ্গিক কাজে এদিকে আসার সময় পুরোনো স্মৃতির রোমন্থনের স্বার্থে আমাদের গ্রামে ঢুকেছে।
‘উইলসনের বাড়িটা সত্যি খুব সুন্দর। সে কবে সেখানে যাবে?’ আমার উত্তর নেই। কয়েক পুরুষের রীতি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত হয়ে রয়েছে তার পুরোনো মাটি দিয়ে লেপা বাড়িটা। 
উইলসনের মুখে এক নির্বিকার ভাব—কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি তার মনের ভেতরে চলতে থাকা তুফান। ‘আপনি এক সপ্তাহের ভেতরে নতুন বাড়িতে যান। এখন থাকা বাড়িটাকে গোয়াল ঘর বানিয়ে নিন।’—কথাটা বলতে গিয়েও আমি বললাম না।’ জিনিসপত্র এখান থেকে সেখানে নিয়ে যাওয়ায় আমরা প্রত্যেকেই সাহায্য করব। আপনি কালকের ভেতরে সেখানে যেতে পারেন।’—প্রেরণা উৎসাহের সঙ্গে বলে দিল। সে ঠিকই বলেছে– জিনিসপত্র বলার মতো  উইলসনের কিছুই নেই। কয়েকটি বাসনপত্র, কয়েকটি কাপড়-চোপড় আর দুটি বাইরে পেতে রাখা পিঁড়ি। সেই বিশাল বাড়িটাতে এত কম জিনিসের সঙ্গে আমরা কীভাবে থাকব— থাকার জন্য একটি বিছানাও নেই – পাকা মাটিতে ঠান্ডার দিনে কীভাবে ঘুমোব।’ — আরও কিছু একটা বলতে গিয়েও উইলসন বলল না । আমরা প্রত্যেকেই চুপচাপ।’

‘এর জন্য কিছু ফার্নিচার কিনতে হবে।’
প্রেরণার এই কথায় কেউ কিছু বলল না– আমিও সায় দেওয়া থেকে বিরত রইলাম —মুখ খুললেই আমার উপরে দায়িত্ব পড়বে। প্রেরণা প্রত্যেকের দিকে তাকাচ্ছে— কিছু একটা বলব বলে হয়তো আশা করছে। তবে সেও বুঝতে পেরেছে কেউ উইলসনের দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত নয়— সামর্থ্য নেই। উইলসনও  নির্বিকার মূর্তি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কয়েক সেকেন্ডের নিরাপত্তা ভঙ্গ করে সন্তোষ এসে উপস্থিত হয়েছে– দুই হাতের মধ্যে কিছু কাঠের বাটাম। উইলসনের দরজার সামনে রেখে সে বলে উঠেছে—

’এই কাঠগুলো দিয়ে বিছানাটা তৈরি করতে আরম্ভ কর, আমি আরও কয়েকটি কাঠ এনে দিচ্ছি।’— বাড়ির ভেতর থেকে একটা করাত বের করে আনল। পুনরায় প্রত্যেকে কাঠ এবং অন্যান্য সামগ্রী জোগাড় করতে শুরু করেছে। এবার গ্রামে বোধহয় উইলসনকে নতুন বাড়িতে ঢুকিয়ে ছাড়বে।
‘এখানকার পিন কোড কি?’ প্রেরণার এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। এখান থেকে আমি কখনও কোনোকিছু পোস্ট করিনি। প্রেরণা ফোনে কীসব টেপাটিপি করছে।
‘ব্লকের কার্যালয় কত দূরে?’
‘ছয় কিলোমিটারের মতো হবে।’
‘আমি আমাজনে কয়েকটি ফার্নিচারের জিনিস অর্ডার দিয়েছি— দু সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবে।আমি আপনাকে খবর দেব– আপনি ব্লক থেকে নিয়ে আসবেন। উইলসনের ফার্নিচারের অভাব হবে না। 

গল্প

আশ্রয় 

দেবপ্রতিম দেব 

p2_HeartUltrasound_HH1708_SL.jpg
আশ্রয়

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

​১. 

মেঘ বৃষ্টির একটি রাতে দশ বছরের বাচ্চা ছেলে রাতুলকে নিয়ে তার বাবা দেশ থেকে পালাল। সেই রাতেই তার পরিবারের বাকি লোকজন, এমনকি তার মা ও মর্মান্তিক দাঙ্গায় গুমখুন হয়েছিল। বাবার থেকে মায়ের সঙ্গে রাতুলের বেশিরভাগ সুখস্মৃতি জড়ানো ছিল। 

অনেকগুলো রাতের আঁধারে, কঠিন ও দুর্গম পথ পেরিয়ে এই শহরে এসেছিল তারা, বিনা কোনো সরকারি কাগজপত্র হাতে। তারপর থেকে রাস্তাতেই রাতুলদের নিবাস। রাতুলের বাবা তাকে কোথাও ফেলে রেখে কোনো কাজে ঢুকতে পারেনি। তাই অধিকাংশ দিন তাদের অনাহারে কাটাতে হয়। 

রাতুল বিদ্যালয়ে যায় না; গাবলু-গুবলু চেহারার এই বালকের স্বাস্থ্যে অবনতি ঘটেছে বিগত যে দুই বছর সে শিলচরে ছিল। একবার, সপ্তাহ দশদিনের জন্য সে এবং তার বাবা খালিপেটে ছিল। তখন একদিন শহরের রাস্তায় আবর্জনার স্তূপে কেউ ভরা প্লেট বিরিয়ানী ছুঁড়ে দিয়েছে। রাতুলের বাবা যখন ভাবতে থাকল যে ওই খাবারটাই তুলে এনে সে এবং রাতুল ভাগ করে খেয়ে নেবে, তখনই নেড়ি কুকুরের এক দল এসে বাতিল সেই বিরিয়ানীর জন্য নিজেদের মধ্যে হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছিল। রাতুলের বাবা সেই খাবার আনতে কোনো চেষ্টা করেনি। 

আগামী দিন সকাল দশটায় শিলচর শহরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য। চারিদিকে সবাই সরে দাঁড়িয়েছে ধুলো থেকে বাঁচবার জন্য। সেই লোকজনদের ভিড়ে রাতুলও তার বাবার সাথে ছিল। তখন রাতুলের বাবার পায়ের কাছে একটি বিজ্ঞাপনের কাগজ ধুলোয় ওড়ে এলে। সেখানে লেখা ছিল নরসিংহপুরে '১০০ দিনের কাজ ' এর জন্য লোক চাই। 

ঝড় থেমে গেলে, মুহূর্তেরও দেরি না করে রাতুলকে নিয়ে তার বাবা পায়ে হেঁটে নরসিংহপুরের দিকে রওনা হল। নরসিংহপুরে গিয়ে ওরা জানতে পারল যে সরকারি প্রকল্পের জন্য লোক নেওয়া হচ্ছে। যেহেতু তাদের কাছে কোনো আইনি দস্তাবেজ নেই, তাই বাবা ও ছেলে দুইজন সেখান থেকে দ্রুত সরে গিয়ে এক ধানক্ষেতের মাঝখানে শুয়ে পড়ল। শিলচর থেকে নরসিংহপুর পায়ে হেঁটে ওরা দুইজনই ক্লান্ত। 

সন্ধে নামলে পরে ওরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল যে কিনারে একটি প্রাইভেট ইট ফ্যাক্টরি ছিল। রাতুলের বাবা পরের দিনই সেটাতে ঢুকে পড়ল নুন্মতম মজুরিতে। রাতুলকে ফ্যাক্টরির কাছের বটগাছের ছায়ায় রেখে তার বাবা কাজে যেতে শুরু করল। রাতুলের বাবা তাকে অন্য কোথাও যেতে বারণ করেছিল। রাতুল সেটা অমান্য করেনি। আবার রোজ দুপুরে রাতুলকে কোনো না কোনো খাবার কিনে দিয়ে যেত তার বাবা। 

সেই বটগাছের ছায়ায় বসে রাতুল পশুপাখিদের সাথে মিলেমিশে গিয়েছিল কয়েকটা মাসে। জীবন যখন ঠিকভাবে যেতে শুরু করল তখনই অঘটন ঘটে গেল। কাজ থেকে ফিরে রাতুলের বাবা তাকে খুঁজে পায়নি বটগাছের নীচে। আশেপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করে সে জানতে পারল যে রাতুলকে ধরে স্পেশিয়েল কাস্টডিতে নিয়ে গেছে স্থানীয় এনজিওর মানুষগুলো। রাতুলের বাবা এনজিও শব্দটা শুনে চমকে উঠল এবং ভাবল যে তার কিশোর ছেলেটা হয়তো সেখানে শিক্ষা অর্জন করবে এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও পাবে সময়মতো। এটা ভেবে রাতুলকে রিট্রিভ করার কোনো পদক্ষেপ নেয় নি তার বাবা। 

স্পেশিয়েল কাস্টডিতে রাতুলকে সবাই বোবা মনে করত কারণ সে কোনো কথাই বলত না তাদের সাথে। 'রাতুল' - এই নামটি এনজিওর সদস্যরাই তাকে দিয়েছিল। সে ভয়ে ভয়ে থাকত; এবং তার বাবার কাছে কখন ফিরে যাবে - শুধু এটাই ভাবত। অন্যদিকে, রাতুলের বাবার মনেও রাতুলকে দেখার জন্য পাগল পাগল অবস্থা। 

২. 

ডাক্তার বিপিনের একমাত্র কন্যা সোনালি যখন প্রথমবার তার বাবার তৈরি করা 'নরসিংহপুর স্পেশিয়েল কেয়ার'-এ আসে তখন সে রাতুলকে দেখেছিল।

সেই সময় রাতুলের বয়স ছিল পনেরো। সে দৌড়ঝাঁপ করত না, কোনো ধরণের উত্তেজনা ছিল না তার। রাতুল তার প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে স্পেশিয়েল কেয়ারের এটেনডেন্টদের কারো কারো সাথে অল্প একটু কথা বলত। ওরা তার আসল নাম জানতে চাইলে, সে বলত 'রাতুল'। তাই এটেনডেন্টরা ধরেই নিয়েছিল যে হয়তো সে তার পরিচয় লুকোচ্ছে আর না হয় সে ভুলেই গেছে - তার আসল নাম কি? 

কোনো প্রজাপতি কাছের দেয়ালে থাকলে রাতুল তার আঙুল দিয়ে সেই প্রজাপতিকে আলগোছে স্পর্শ করত; তারপর সে তার হাতে প্রজাপতির শরীরের চিহ্নে তাকিয়ে থাকত। প্রথম প্রথম কেয়ারটেকাররা যখন বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইত, তখন রাতুল বলত যে ওই প্রজাপতিটা ওর বাবা। এখন আর কেউ তাকে এই বিষয়ে কোনো খোঁজ করে না। রাতুল এখন নিজেই ভুলে গেছে তার বাবা মা দেখতে কিরকম ছিল। রাতুলের বয়স বেড়ে গেছে। 

আজকে দশ বছর পেরিয়ে সোনালি স্পেশিয়েল কেয়ারে ফিরল তার পয়ত্রিশতম জন্মদিন পালন করতে। রাতুলের সাথে অন্যান্য যে ব্যক্তিদের সে দেখেছিল তাদের কেউই আর জীবিত নয়। রাতুলদের মতো বিশেষভাবে সক্ষম লোকদের বেঁচে থাকা খুব কঠিন।

সোনালি বহুদিন শিলচরের বাইরে পড়াশোনা করে স্কলারশিপে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল। এখন সোনালি সেখানেই ডাক্তারি করে। 

ডাক্তার বিপিন যদিও শিলচরের বাসিন্দা তিনি আজীবন নরসিংহপুরে ডাক্তারি করেছেন এবং রিটায়ারমেন্টের পর থেকে তিনি তার প্রাইভেট চেম্বারে এখনো সেখানেই রোগী দেখেন। সোনালির আমেরিকা চলে যাওয়ায় ঘোর আপত্তি ছিল তার। তিনি আশা করেছিলেন যে তার মেয়ে ডাক্তারি পাশ করে শিলচরে এসে তার নরসিংহপুরের চেম্বারে বসবে। সোনালিকে বলেছিলেন যে ডাক্তারি শুধুমাত্র পেশা নয়, সেবার মাধ্যমও বটে। তারপর একসময় নিজেদের একটা হাসপাতাল তৈরি করা যাবে। হাসপাতালের জন্য টাকাও সেইভ করছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয়নি তার। যাই হোক মেয়ের জন্মদিনে ও'সব কথা তিনি ভাবতে রাজি নন। বিপিনবাবুর আজকে রিলিফ

ক্যাম্পে যাবার কথা ছিল একটি এনজিওর সাথে। নরসিংহপুর থেকে আরো অনেক দূরে, নদী জঙ্গল পেরিয়ে এক খাসিয়া পুঞ্জিতে। তিনি এনজিও লোকদেরকে তার না আসার কথা জানাতে দেরি করে ফেলেছেন। এতক্ষণে পুঞ্জির মানুষেরা সবাই এসে উপস্থিত ডাক্তার দেখাবে বলে। এর আগেও দুবার এরকম ঘটেছিল - খাসিয়া পুঞ্জির দুস্থ লোকদের রিলিফ ক্যাম্পের আয়োজন করা হবে জানানোর পর বাতিল করে দিতে হয়েছিল। এইবার তা করা যাবে না ভেবে এনজিও-র সদস্যরা নরসিংহপুর এলাকার অনুপম ডাক্তারকে যোগাযোগ করল। 

অনুপম গত পাঁচ বছর থেকে নরসিংহপুর এলাকায় প্রাইভেট মেডিকেয়ারে রোগী দেখছে কিন্তু পেশাগত মার্কেটে ভিড় জমাতে সে এখনো পারেনি। বিপিনবাবু থেকে অনুপম অনেক নবীন। বেশিরভাগ দিন অনুপম তার চেম্বারে বসে বসে বোর হয়। সেইদিন এনজিওর লোকেরা তাকে ফোন করলে সে তাদের শর্ত অনুযায়ী - ন্যুনতম রেমুনারেশনে খাসিয়া পুঞ্জিতে যেতে রাজি হয়ে যায়। 

অনুপম নদী জঙ্গল পেরিয়ে খাসিয়া পুঞ্জিতে ঢুকবার সময় সেখানের ছোট্ট এক মন্দিরে প্রণাম করতে গিয়ে মন্দিরের কিনারে একজন মানুষকে মাটিতে নিথর শুয়ে থাকতে দেখেছিল। পুঞ্জিতে এসে অনুপম দুশোজন লোক দেখে অবাক এবং একই সঙ্গে আপ্লূত। সে আপ্লূত এই কারণে যে অনেকদিনের পর সে এতজন রোগী দেখতে পারবে। 

অনুপম যখন সেখানে পৌঁছোয় তখন দুপুর তিনটা। পুঞ্জির লোকেরা সকাল থেকে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। অনুপম রোগী দেখতে শুরু করল। সে এত ধীরগতিতে যত্ন সহকারে রোগী দেখছিল যে এনজিওর সদস্যদের মনে ভয় জাগতে শুরু করল এই ভেবে যে ওইরকম শ্লথ গতিতে দুশোজন রোগী দেখতে তিন দিন লাগবে। তাই ওরা পুনরায় ডাক্তার বিপিনকে ফোনে যোগাযোগ করল। সদস্যদের বহুক্ষণ চেষ্টার ফলে, যখন বিপিন বাবু না আসার জন্য আর অজুহাত দিয়ে পারলেন না, তখন অবশেষে রাজি হলেন এবং রাত দশটায় তিনি এসে পৌঁছোলেন। ডাক্তার অনুপম তত সময়ে ৭০ জন রোগী দেখে ফেলেছে। বিপিনবাবু এলেও দুয়েকজন ছাড়া আর কেউ ওনার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়নি। পুঞ্জির লোকেরা অনুপমকেই দেখাতে চায়। রাত বারোটায় বিপিনবাবু ফিরে গেলেন। যেতে যেতে তিনি ভাবলেন যে অনুপম আজ রাতের পর থেকে ডাক্তারির বাজার নিশ্চয় ধরে ফেলবে।

 

৩.

কাকভোরে ক্যাম্পে রোগীর সংখ্যা শূন্য। পুঞ্জির সবাই ডাক্তার দেখিয়ে যার যার ঘরে ফিরে গেছে আর এনজিওর সদস্যরা ঘুমোচ্ছে। দুপুর তিনটা থেকে কাকভোর অবধি অনুপম একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিল যে ক্যাম্পের কিনারের মন্দিরের সামনে যে লোকটাকে সে আসার সময় দেখেছিল, সেই লোকটা এতক্ষণ মাটিতে নিথর শুয়ে রইল, সেই লোকটাই ওই নিস্তব্ধ কাকভোরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাছ থেকে ফুল এনে মন্দিরে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করল। বিস্মিত অনুপম নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সে ওই লোকটার কাছে যায়। 

- 'আপনি কিভাবে দাঁড়াতে পারলেন, আসার পর থেকে দেখছি আপনি তো নিথর ছিলেন?'

- 'শুধু আমার ছেলের জন্য মঙ্গল-কামনা জানতে ভগবানকে, আমি রোজ কাকভোরে দাঁড়াই, হয়তো ভগবানের ইচ্ছেতেই হয় এটা।'

- 'আপনি কি হিন্দু?'

- 'না।'

- 'আচ্ছা আপনি কি ক্রিষ্টিয়ান?'

- ' না। '

- 'ও, বাই দ্যা ওয়ে আপনার ছেলে কোথায়?'

- 'জানি না; আমার অবুঝ ছেলেটা এখন কোথায় আছে; সত্যি জানি না।'

- 'আপনি ইংরেজি বোঝেন তাহলে দেখছি, আপনি কোন জায়গার লোক?'

- 'বাইরের।'

- 'তো এখানে , এই ভাবে কি করে এলেন ? '

- 'পাঁচ বছর ডিটেনশনে কাটিয়ে বেরিয়েছিলাম, আবার নাকি যেতে হয় - এই ভয়ে পালিয়ে এখানে চলে আসি।'

- 'আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করতে কোনো চেষ্টাই কি করলেন না?'

- 'করেছিলাম। দুই দুইবার চেষ্টা করেছিলাম। শুনেছিলাম তাকে স্পেশিয়েল কাস্টডিতে রেখেছে।'

- 'স্পেশিয়েল কাস্টডি! তারপর কি হল?'

- 'প্রথমবার গিয়ে দেখি ওটা 'স্পেশিয়েল কেয়ার', ফিরে আসার সময় ধরা পড়ে যাই; ডিটেনশনে যেতে হয়। বেরোনোর পর আবার দেখতে গিয়েছিলাম, ও তখন আঠারো, আজ থেকে সাত বছর আগের কথা।' 

- 'কথা হয়নি?'

- 'প্রথমবার হয়েছিল, ওকে বলেছি আমি রোজ আসব; দ্বিতীয়বার ও আমাকে চিনতে পারেনি। আমিও ভয়ে ভয়ে ছিলাম - পুনরায় ডিটেনশনে যেতে হবে,  তাই নতুন করে পরিচয়ের জন্য চেষ্টা করিনি।'

- 'আপনার ছেলের কি কোনো সমস্যা ছিল?'

- 'ওর ডাউন সিন্ড্রোম। ও বেশিদিন কিছু মনে রাখতে পারেনা; দুর্বল স্মৃতি শক্তি ওর।' এরপর অনুপম আর কিছু জানতে চায়নি; দুজনই কিছুসময়ের জন্য নীরব ছিল। মৌনতা ভেঙে অনুপম সেই লোকটিকে বিদায় জানিয়ে পুঞ্জি থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল একা একা। এনজিওর সদস্যরা সবাই তখনো নিদ্রাচ্ছন্ন। কিছু দূর আসার পর অনুপম ভাবতে লাগল যে - যদি সে কোনোদিনও ডাক্তারির বাজার ধরতে না-ও পারে, তার কোনো আফসোস থাকবে না, শুধু গত একদিনের রিলিফ ক্যাম্পের জন্য: তার ডাক্তারি পড়া যেন এতদিনে সার্থক হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসংখ্য প্রজাপতি আচমকা তার মাথার উপর দিয়ে নরসিংহপুরের দিকে আস্তে আস্তে ছুটতে শুরু করল। 

গল্প

হিসেব

নূপুর রায়চৌধুরী 

himadri1.jpg
হিসেব
NupurRoychoudry.webp

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রের কাগজের পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই দুই পরিবারের চেনাজানার সূত্রপাত। পাত্রপক্ষ ডাকসাইটে পরিবার, বালিগঞ্জের আদিনিবাসী। পাত্রীর বাড়ি শহরতলীতে, ছোটোখাটো মধ্যবিত্ত সংসার তাদের। পাত্রের বয়স পাত্রীর তুলনায় একটু বেশিই–দশ বছরের তফাৎ। আজকাল বড়ো একটা চলে না। কিন্তু, ‘বনেদি বাড়ির ছেলে বলে কথা, ও একটু আধটু বয়সের ফারাক নিয়ে মাথা ঘামালে চলে?’ -- পাত্রীপক্ষের মুরুব্বিরা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সায় দিলেন। 

পাত্র একে তো ঝাঁ চকচকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা, তার উপর আবার সাহেবি কোম্পানিতে চাকরি করে, তার রেলাই আলাদা, ইংরেজিতে কথা বলতেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এম এসসি পড়ুয়া মেয়েটা লেখাপড়ায় ঝক্কাস হলে কী হবে, ইংরেজিতে কথা বলতে যে ওর বড্ডো বাধো -বাধো লাগে, বলেনি তো আগে কখনো—তাই না?
ঠিকুজি-কুলজি যাচাই করা, দুই পরিবারের মধ্যে যৌতুকপত্র, নমস্কারি প্রণামী দেওয়াথোয়ার লিস্টি, আসবাবপত্র, বাসনকোসন, গহনা ইত্যাদি দেয় স্ত্রীধনের পরিমাণ নিয়ে কথাবার্তা– সবই একরকম পাকা হয়ে গিয়েছে—পয়সাকড়ির হিসেবটা পাত্রপক্ষের ভালোই আসে, মধ্যবিত্তরাই যত্তসব শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে বেকার দর কষাকষি করে। যাক গিয়ে, যাকগে, মোদ্দা কথা, এখন সানাই বাজতে যেটুকু দেরি।   

কিন্তু বিধি বাম! হিসেবের ঘরে অদলবদলের ছায়া কি শ্যেনদৃষ্টি হানতে চায়?
পরিবারের সকলের সাথে প্রথমবার, বন্ধুদের সাথে দ্বিতীয়বার, আর প্রবাসী বোন-ভগ্নীপতির সাথে তৃতীয়বার মেয়েটিকে দেখে এসেও পাত্রের মনের খুঁতখুঁতানি যায় না। সে হঠাৎ আবদার ধরেছে, পাত্রীকে একটু আলাদা করে আরও  কাছ থেকে দেখে নেওয়া দরকার— সারা জীবনের ব্যাপার বলে কথা, ভালো করে চিনে না নিলে হিসেবে যদি গরমিল হয়?

তিনমাথারা শুনেই ভুরু কোঁচকান, 'দিনকে দিন ছেলেপিলেরা ভারী নিলাজ হয়ে উঠেছে তো! আমাদের কালে এমনধারা কেউ শুনেছে বাপু?' 

কিন্তু মত না দিলে যদি বেঁকে বসে ছেলে! তীরে এসে তরী ডুববে নাকি শেষে? অগত্যা নিমরাজি হয়ে হ্যাঁ বলে দেন পাত্রীর বাবা মা।  

তা সাদার্ন এভেন্যুয়র লেকের ধারে নিরিবিলি জায়গাটাকেই বেছে নিল ইঞ্জিনিয়ারবাবু, অনেক দোনোমোনো করে সায়েন্স কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসেছে মেয়েটা। ছিপছিপে চেহারার মিষ্টি ললনার পায়ের বাটার সাধারণ চটি, পরনের তাঁতের শাড়ি আর মাথায় দোলানো লম্বা বিনুনিটা দেখে ছেলেটার বেশ মজাই লাগছিল, ওর কায়দাওয়ালা বান্ধবীদের মতো নয় মোটেই! তা দেখা হওয়া ইস্তক, ইঞ্জিনিয়ার তো ইংরেজিতে রাজা-উজির মারা কথা বলেই চলেছে, আর মেয়েটা শুধু শুনেই

চলেছে, কুণ্ঠায় জবুথবু হয়ে ভাবছে, ইসসসস, সেও যদি ইংরেজিতে অমনই ফরফর করতে পারত।যাই হোক বক্তা, শ্রোতা নামভূমিকায় দুইজনেই যাকে বলে এক্কেবারে সরেস।

তখন মে মাসের দ্বিপ্রহর, তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাবার জোগাড়। সামনেই একটা ছোট পানমশলার দোকান, দোকানি ছেলেটা হয়তো মেরেকেটে চোদ্দ বছরের হবে।

ঞ্জিনিয়ার সাহেব দুটো কোকোকোলা অর্ডার করল, প্যান্টের হিপ পকেট থেকে দামি পেটমোটা মানিব্যাগটা থেকে কড়কড়ে একটা একশো টাকার নোট বাম হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ফাঁকে আলগোছে ধরে ছেলেটার দিকে এগিয়ে দেয়।

'দাদা, আটষট্টি টাকা হয়েছে, বৌনির সময়, খুচরো দিন না,' 

'আরে ভাই, আমার কাছে আর সবই বড়ো নোট, কোথা থেকে দেব?' খিঁচিয়ে ওঠে ইঞ্জিনিয়ার। 

মেয়েটা এগিয়ে আসে এবার, কাঁধের ঝোলানো বইখাতার ব্যাগের ভিতর থেকে লাল মতো একটা পয়সার বটুয়া বের করে, দেখে ইঞ্জিনিয়ার মুখ টিপে হাসে, তা সেখান থেকে কুড়িয়েবাড়িয়ে আটটা টাকা কিন্তু হয়েই গেল।

দোকানি ছোঁড়া এক হাতে কোকোকোলার বোতল দুটো আর অন্য হাতে ব্যাল্যান্স টাকা কটা ইঞ্জিনিয়ারের হাতে ধরিয়ে দেয়। ফিরতি টাকাগুলো এক ঝলক দেখে নিয়েই ইঞ্জিনিয়ার সেখান থেকে একটা দশ টাকার নোট চকিতে মেয়েটার খোলা বটুয়ার গভীরে অসীম ক্ষিপ্রতায় গুঁজে দিয়েই বলে ওঠে, ‘এস, এস, ওদিকে গিয়ে বসি, এখানটা যুতের নয়’, বলেই বোতল হাতে হনহন করে সামনের দিকে হাঁটা মারে।
মেয়েটা তো অবাক, ফিতে টেনে বটুয়াটা বন্ধ করার সময়টুকুও দেয় না, বাব্বা ঘোড়ায় যেন জিন লাগিয়ে এসেছে মানুষটা। 

এরই মধ্যে দোকানি ছেলেটা হাঁক মারল, 'ও দাদা, আমার হিসেবে মিলছে না, দশটা টাকা বেশি দিয়ে দিয়েছি, দেখুন তো একটু'। 

ইঞ্জিনিয়ার মুখটা পিছনে ঘোরায়, বিরক্তি ঝরে পড়ছে সেখানে, কয়েক পা পিছিয়ে আসে সে, বোতলদুটো ঠক ঠক করে ছেলেটার সামনে নামিয়ে, মানিব্যাগের ভিতর থেকে সদ্য পাওয়া কুড়ি টাকার নোট দুটো ছেলেটার মুখের সামনে নেড়ে নেড়ে বলল, 'এই তো দিয়েছিস, হিসেবে করতে পারিস না তো দোকান চালাস কেন?' গাড়োল কোথাকার!'  

ছেলেটা যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকোচ্ছে।  

আর মেয়েটা? আধ-খোলা বটুয়া হাতে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ওর মাথা নিচু, বড্ডো কী দেরি হয়ে গেল, সব হিসেবই যে গোলমেলে ঠেকছে এখন। 

গল্প

nupur1.jpg
চন্দ্রালোকে স্নাত

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ন্দ্রার সাথে এখনও তিন বার তিন বয়সে দেখা হয়েছে।
প্রথম বার সুনীলদার কোচিংয়ে। এক শীতের বিকেলে ওর বাবা নিয়ে এল কোচিংয়ে। তখন মেয়েদের আর ছেলেদের আলাদা আলাদা বসার জায়গা। অঙ্ক আর ইংলিশ এর জন্যে যেতাম। অস্পষ্ট মনে আছে একটা সালোয়ার কামিজ আর ওপরে একটা কালো কার্ডিগান। তখন বয়স পনেরো, মেয়েদের সাথে একটু কথা বলা, একটু মুচকি হাসিই উথাল পাতাল করে দেবার সময়। রোজ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখার সময়। বেশ লাজুক হাবভাব, ফর্সা কুঁচকানো চুল, বড় বড় গভীর কালো চোখ। কারুর দিকে না তাকিয়ে সামনের সিটে এসে বসল। মনে হল ঘরটা একটা সুন্দর ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পিছন থেকে ওই ইংরেজি ক্লাস আর কিছুই কানে গেল না। একটা কল্পনার জগতে চলে গেলাম। পাশ থেকে সুকুমার বলেছিল সাবধান, এরা খুব বড়লোক। আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এরপর চিরদিনের লেট আসা ছাত্রর শুধু চন্দ্রার জন্যে কোচিং এর শুরুর আগেই আসা শুরু হয়ে গেল। সরস্বতী পুজোর দিন কোচিং এ এসেছিল। মনে আছে ওর মাথার পিছনের থেকে গোঁজা গোলাপ ফুল পড়ে গিয়েছিল। দৌড়ে গিয়ে তুলে ওর হাতে দেই। একটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একটা চাহনি দিয়ে নিয়ে নিল। মাটিতে পড়ে যাওয়া গোলাপ আবার মাথায় গোঁজা যায় কিনা জানি না। তবু খুব নরম করে, আস্তে ধন্যবাদ বলেছিল। সেবার পুজোটা তখনই উৎসব হয়ে গিয়েছিল। অনেক রঙ মশাল হলঘরের মধ্যেই যেন জ্বলে উঠল। একদিন ইংলিশ গ্রামার বই ফেলে গেছিল কোচিং এ। আমি ওটার মধ্যে দুটো বাগানের শিউলি ফুল দিয়ে দিয়েছিলাম। পেয়ে কোনো সারা শব্দ করেনি। মনে হয় দেখতেই পায় নি। এরপর আবারও দেখা হয়েছে। কোনদিন কথা হয় নি। মুখ নামিয়ে চলে গিয়েছে পাশ দিয়ে।
কোচিং এ সামান্য কিছুদিন পড়েছিল।
এরপর কৃষ্ণনগর থেকে স্কুল পাশ করে কলকাতা চলে যায় চন্দ্রা। শুনেছিলাম দাদুর বাড়ি থেকে বাবা মার সাথে কলকাতা গেছে। এমনিতেই কোচিং শেষ হয়ে গেছে তাই দেখা হত না। তার উপর কলকাতা চলে যাওয়াতে কেমন ফিঁকে হয়ে গেল স্মৃতি।
কলেজটা কৃষ্ণনগর থেকে শেষ করে কলকাতা যাই। আলাপটা ভালো করে হল যাদবপুরে এমে পড়তে গিয়ে। ওকে প্রথম দিন ক্লাসে দেখেই কৃষ্ণনগরে ফেলে আসা বিমর্ষমনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। এবার থেকে রোজ আবার ক্লাসে দেখতে পাবো। শুনেছিলাম বাংলায় বেশ ভালো নম্বর পেয়ে ও এখানে এসেছে। প্রতিটি ক্লাস খুব মনোযোগ দিয়ে করত। আমরা কয়েকজন মিলে প্রথম বছরের প্রথম দিকে তিন চার দিনের জন্যে দীঘা বেড়াতে গেছিলাম। আট জন ছেলে মেয়ের মধ্যে ও ছিল। ও জানত এবং চিনত সেই কোচিং থেকে কিন্তু প্রথম দিকে তেমন পুরনো পরিচয়কে প্রকাশ করতে দেখিনি। যেন আগে চিনতই না। একটু অবাকই লেগেছিল। একটু চাপা গম্ভীর প্রকৃতির। তবে ওখানে গিয়ে অনেক খোলামেলা দেখলাম। শুনত বেশি বলত কম। সবার আগে বারান্দায় এসে সূর্যোদয় দেখত চুপ করে। দেখত নাকি তাকিয়ে থেকে অন্য কিছু ভাবত জানি না। একদিন  রাতে টুরিস্ট লজের ছাদে গানের আসর বসেছিল, সঙ্গে সুধারস। আমি খাই না। দেখলাম চন্দ্রা ও খায় না। সুনন্দ গাইল, দিগন্ত  গাইল। বিদিশা, সুকন্যা, দিগন্ত সবাই চেপে ধরলে গাইতে। আমি পারি না, পারি না করে সবার অনেক অনুরোধে শেষ অবধি গলা খুলল। দুটো গান গাইল। একটা "আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।" জোৎস্না ছিল না। তবু চন্দ্রা ছিল। পিছনে সমুদ্রের গর্জন আর সাদা ফেনার ওঠা নামা ছিল আকাশে তারা ছিল। শুধু আমি ভেসে গিয়েছিলাম গানের সাথে। তখনকার মত মনে হয়েছিল ছাদে আমি আর চন্দ্রা ছাড়া আর কেউ নেই। আমাকেই শোনাচ্ছে। পরের গান "তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী"। গান জানি না তবু অনুভব করলাম আমাকেই উদ্দেশ্য করে গাইছে। গাওয়া শেষ হলে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে শেষে আড়চোখে  আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। গায়ের রোমকূপ খাড়া হয়ে গেল। এমন করে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হয়? আগে জানতাম না। প্রেম, কি জানিনা কিন্তু প্রবল আকর্ষণ অনুভব করলাম। মধ্য রাতে ঢেউয়ের শব্দ অজানা ভালোলাগার গান শুনিয়ে গেল। চাঁদ ছাড়াই চন্দ্রালোকে স্নাত হলাম।  অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। সবাই নীচে নামার সময় সবার পিছনে আমাকে খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করলে "ভালো হয় নি না?" এই বলার মধ্যে যে আন্তরিকতা মিশে ছিল সেটা আগে দেখিনি। হেসে বললাম "খুব ভালো গেয়েছিস"।
কিছুটা অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে বললে "সত্যি বলছিস? আমাকে খুশি করতে?"
বললাম "বিশ্বাস কর সত্যি বলছি"।
বাকি রাতটা সুনন্দ পাশে শুয়ে ও আমি ছিলাম না। সারা রাত সমুদ্রের ধারে যেন শুয়ে আছি। স্বপ্নের ঢেউ এসে একবার করে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
একদিন জিজ্ঞাসা করলাম একা পেয়ে "তোর কৃষ্ণনগরের কথা কিছু মনে নেই না?"
চুপ করে রইল।
"তুই কৃষ্ণনগর আর যাস না?"
বেশি কথা বাড়ায় নি। শুধু বললে "এখন কলকাতায় থাকি আমি, বাবা আর মা"।
এরপর মাঝে মধ্যেই ওর বাড়িতে আমরা যেতাম। কখনো আড্ডা, কখনো বই আদান প্রদান নিয়ে।একবার দুবার গিয়ে দেখলাম চন্দ্রারা বিচ্ছিরি রকমের বড়লোক। ওর বাবা শচীন দের বউ বাজারে এক বিশাল সোনার দোকান তার ওপর রাজনৈতিক রঙ ও আছে। ওর মা মানে মাসিমা ও খুব দাঁটিয়াল মহিলা। শুনেছি উনিও কিসব সমাজ সেবা নামক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। দামী গাউন পরে থাকেন।
গেলে ওর বাবা শচীনবাবু নিজে থেকেই কথা বলতেন। কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন আছেন টাইপ নয়। বেশ আন্তরিকভাবে নানা পছন্দ অপছন্দের কথা, রাজনীতির কথা কথা বলতেন, ইউনিভার্সিটির ক্লাস কেমন চলছে এই সব শুনতেন।
তখন ক্লাস প্রায় শেষ। পরীক্ষা বাকি আছে। ইউনিভার্সিটির বারান্দায় দাড়িয়ে চন্দ্রা একদিন বলল।

"তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে"।
"কি কথা? তোর খাতা কিন্তু এখনও টোকা বাকি আছে। ওটা ছাড়া যা কিছু আছে বল।" বললে -

" সময় লাগবে। চল মাঠে যাই"। মাঠে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
উদগ্রীব হয়ে বললাম "কি হল বল।"
খুব উদাস স্বরে বললে "কিছু কথা তোর জানা দরকার তাই বলছি। তোর বইয়ের মধ্যে দেওয়া  শিউলি ফুল আমার মার হাতে পড়েছিল জানিস?"।
এবার আমার নড়েচড়ে বসতে হয়। বললাম "এ্যাঁ, বলিস নি তো"।
দম দেওয়া পুতুলের মত বললে 'মার হাতে বইটা যায়। বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে গম্ভীর হয়ে  জিজ্ঞাসা করলে কে পাঠিয়েছে? আমি না জেনেই বলেছিলাম তোর নাম।" আমি অবাক।

"কি করে জানলে আমার নাম?

"সেটা তোর না জানলেও চলবে।"

মা প্রথম খোঁজ নিলে কতদূর এগিয়েছে ব্যাপারটা। কিছুদিন পরই মা তুমুল চেঁচামেচি শুরু করলে বাবার ওপর। তুই হয়ত জানিস না। কোচিংয়ের আরো দুটো ছেলে প্রায়ই এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। হাঁ করে । মা বুঝলে এখুনি মেয়েকে বাঁচাতে কলকাতা যেতে হবে। নাহলে একদিন মুখে কালি পড়বে।
একটু থেমে মুখের সামনের চুল সড়িয়ে আপন মনে বললে "এখন ভালো মনে নেই তবে তোর জন্যেই আমার কলকাতায় আসা।"
এমন স্বগতোক্তিতে সাংঘাতিক আনন্দ হল। ও বলেই চলেছে "বাবার ব্যবসা ছিলই কলকাতায় তারপর মেয়েদের কলেজে ভর্তি আর আসাযাওয়া। মা মাঝে মাঝেই খোঁজ খবর নিত কোথায় যাই?কি করি?"
"তারপর?"

এখন কিন্তু মা এতটা উদ্বেগ প্রকাশ করে না। বাবা বরং তোকে পছন্দ করে বুঝি। একদিন বলেছে তোকে ধরবে। তোর বাড়ির সঙ্গে কথা বলবে।"
কিন্তু আনন্দে এক মগ জল ঢেলে দিয়ে, অবাক করে বললে "কিন্তু আমি চাই না তোকে বিয়ে করতে"।
বিস্মিত হয়ে বললাম "কেন? কি কারণ?"
গভীরভাবে তাকিয়ে বললে "বিয়ে করলেই তোকে আমি হারিয়ে ফেলব"।
"সেকি? এত অদ্ভুত কথা। তুই পাগল নাকি?"
খুলে বললে না চন্দ্রা । এই কথোপকথনের শেষে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। যদিও কোনো রোজগার করি না তবু মন তো বোঝে না।
এরপর একদিন ওদের বাড়ি গেছি। একাই বসে ছিলেন । জিজ্ঞাসা করলাম "মাসিমা চন্দ্রা আছে? বিশাল বাড়ির এক তলার বাইরের ঘরে আমাকে দেখে এক মুখ হাসি ফুঁটে উঠল

"এস চিত্ত, তুমি একটু বস, ও এখুনি এসে পড়বে।" বলে মাসিমা ভিতরের ঘরের দিকে মুখ করে বললেন "এই যে শুনছো, চিত্ত এসেছে"।
বললাম "আমি তাহলে পড়ে আসব। ওকে বলে দেবেন আমি বইটা ফেরত দিতে এসেছিলাম।"
আবার এক রহস্যজনক এক হাসি মুখে খেলে গেল। "তোমার মেসোমশাই বোধহয় কিছু কথা বলতে চান"। বলেই চেঁচিয়ে উঠলেন "এই যে কই গো? কোথায় গেলে?"
এটা কিরকম হচ্ছে? এমনিতে আমাকে দেখলেই মাসিমা কেমন আগে নাক সিঁটকে কথা বলতেন। এত ভালবাসা, এত চিন্তার কথা। ওনারা কি জানেন চন্দ্রা আমাকে বিয়ে করতে চায় না? চন্দ্রা কি বলেছে কে জানে।
মেসোমশাই আসার জন্যে অপেক্ষা না করেই বললাম "ক্লাসে আর ঢুকতে দেবে না এরপর। পরে আসবো। আজ যাই " বলে এক লাফে সিড়ি টপকে একে বারে রাস্তায়।
পিছনে মাসিমার হালকা গলা ভেসে এল "চিত্ত, এইযে। এইযে"।

অনেকবার এই বিয়ের ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বিয়ে তো অনেক দূরের ব্যাপার। কারণ জানার চেষ্টা করেছি কিন্তু বলেনি।জিজ্ঞাসা  করেছিলাম "অন্য কাউকে কি তোর পছন্দ?"বিরক্ত হয়ে বললে "বিয়ে করব কিনা ঠিক করিনি। না করলে কি হয়?""সেকি? তুই বলিসনি তো"।"তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। একে নষ্ট করতে চাই না।"বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।বললাম "বিয়ে করলে ভালোবাসাকে চিরদিনের জন্যে পাওয়া যায়। এটা তো মানবি?"একটু থেমে বললে "চিরদিন মানে কি? বিয়ে হল, স্বামী বা বউ মরে, গেল তখন?"

'একবার বিয়ে করলেই আমার সব ভাললাগা শুধু স্বামীর প্রতিই থাকবে আর কোথাও কাউকে ভালো লাগতে পারবে না সেটা আমি বিশ্বাস করি না।"

বিয়ে হয়ে গেলেই যেন সব মুগ্ধতা স্বামীকে ঘিরেই হতে হবে। বাস্তব জীবনে সেটা হয় না। হতে পারে না। প্রথম বিয়ের কটা বছর কেটে গেল সব মানুষগুলো ঠিক আগের মতনই থাকে। বিয়ে একটা বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসে।
বিয়ের মধ্যে একটা বাধ্যতা, একটা অলিখিত পরস্পরের প্রতি "ও আমার" বোধ কাজ করে। আসলে তো  কেউ কারো নয়।
বললাম "একটু ভারী হয়ে যাচ্ছে না?" ও থামল না, "একজন মহিলা যতটা শ্বশুরবাড়িতে দ্বায়িত্ব নেয়, মন প্রাণ দিয়ে সেই বাড়ির যাবতীয় সুখ দুঃখে জড়িয়ে যায়। মুখে যতই বলুক একজন ছেলে সেটা করে না। অর্থনৈতিক ভাগ নিলেও মন প্রাণটা তেমনভাবে দেয় না দিতে পারে না। হয়ত যা দেখে বড় হয়েছে তার ছায়াই বাধা দেয়। বিয়ে হলেই প্রতিটি ছেলে মেয়ে কত খারাপ সেটা খুঁজে বার করা হয়, এটা ঠিক নয়।"
পোস্ট গ্রাজুয়েট হয়ে চন্দ্রা বাইরে চলে গেল পিএইচডি করতে আর আমিও চলে গেলাম কন্ট্রাক্টর এর হয়ে চাকরি করতে ধানবাদ।
শেষ পর্বে পুত্র গৌতমের কোয়ার্টার জয়ন্ত কোলিয়ারী থেকে টানা সাত ঘণ্টা গাড়িতে মোগলসরাই এসেছি। রাত্রি বেলা কলকাতা যাবার ট্রেন। একটু খাওয়াদাওয়া করতে হবে বলে সামনের ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকেছি। বেশ বড় হল ঘর। ছোট ছোট চেয়ার টেবিল ইতস্তত ছড়ানো। প্রায় সব টেবিলেই একাধিক লোকজন। চোখ কিন্তু চলে গেল দূরে একজন প্রৌঢ় ভদ্রমহিলা বসে। পাশে একটা বড় সুটকেস। বয়েসকালে সবাইকেই কাছাকাছি দেখতে লাগে। সেই কাঁচা পাকা চুল, ভারি চশমা, ঘোলাটে দৃষ্টি, আনমনা শ্লথ চলা ফেরা। খাবারে অর্ডার দিয়ে হাত মুখ ধুতে গিয়ে আর ধোয়া হল না। এক বসে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে বার বার চোখ পড়ছিল। ওনার পাশ দিয়েই যেতে হবে বেসিনের দিকে। কাছে আসতেই সোজাসুজি মুখের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে বললে

"অনেকক্ষণ আগেই দেখেছি। দেখছিলাম তুই কি করিস। এখানেই বস। ওই কোনায় বসে বসে আমার দিকে চেয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে। ঠিক কর কি করবি?
মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল চন্দ্রা, 'তুই? এখানে?"
মুখটা ভরাট হয়েছে। কিন্তু মুখের চাহনি সেই এক। উজ্জ্বল চোখ দুটো এখনো হাসে। টোল এখনও পড়ে তবে সামান্য।
এক গাল হেসে বললে "যদি বলি তুই এখানে? দেখ মনের মধ্যে থাকলে ঠিক একদিন দেখা হয়ে যায়। বল কি খাবি?" তারপর বললে 

"তোকে স্টেশনেই দেখেছি দুর থেকে। তবে এত বড় কপাল আর একথা পাকাচুল দেখে একটু দোনামনা করছিলাম"।
"সেই বল। এতদিন পর নিশ্চয়ই সিওর ছিলি না"।
"আগে হলে বলতে পারতাম না। কিন্তু এখন তো যাবার সময়, তাই স্পষ্ট বলতে পারি। তোকে যত মেকআপেই দেখি চিনতে ভুল হবে না। আমার চুল পাকলে তোর ও পাকবে। আমার চামড়া কুঁচকালে তোর তো হবে। কিন্তু যে রূপটা আয়নায় ধরা পড়ে না সেরূপ কখনো পাল্টায় না। তোর হেঁটে যাওয়া, কথা বলার ঢং, শোনার ঘাড় হেলে যাওয়া, এলোমেলো চুলের বিন্যাস, এসে দাড়ানো, মুখ ঘোরানো, কথা বলার ধরন এগুলোই ত আসল অপরিবর্তিত রূপ। সেটা আমি সেই রূপকেই যে চিনেছিলাম।
একটানা অনেকগুলো কথা বলে একটু থামল। বললে "যাক তুই বল কোথা থেকে?"
"ছেলের ওখান থেকে"। চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

"আরিব্বাস, কবে বিয়ে করেছিস? আমাকে তো জানাস নি? ইউনিভার্সিটির বন্ধুরাও কেউ কিছু বলে নি"।
রহস্য আমিও জানি। বললাম "বিয়ে ছাড়া কি ছেলে থাকতে পারেনা?"
"শুনি কেমন ভাবে"।
"কিছুদিন একটা ওল্ড হোম এ চাকরি করেছিলাম। তখন নানা ঘটনার মধ্যে চার মাসের গৌতমের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। দিদি বেচেঁ ছিল তাই ছোটবেলাটা সামলে দিয়েছে। ওর জন্যে অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছি জীবনে। আটকে গেছি"।
গালে হাত দিয়ে বললে "যেমন?"
"সিগারেট ছেড়েছি। মদ ছেড়েছি, তাসের নেশা ছেড়েছি। আর ছেড়েছি বাইরে চলে যাবার সুযোগ আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা"।
কথা ঘোরাতে বললাম "তবে শুনতে বেশ লাগছে। আয়নায় ছাড়াও আরেকটা আমার রূপ আছে তাতো জানতাম না"।
সেই গজদন্ত বার করে একটা হাসি দিল। মুহূর্তে আমার চল্লিশ বছর বয়েস কমে গেল। 

বললে "কি খাবি বল? আমি রুটি আর তরকা বলেছি।"
"এক যাত্রায় পৃথক ফল আর কি হবে। আমিও ওই খাই। তোর থেকেই ভাগ করে নেব না হয়।"
"না, না" প্রতিবাদ করে উঠলে। "এই হচ্ছে তোর কিপটামি।" বলে বেয়াড়াকে আঙ্গুল তুলে ডাকলে।
বললাম "ছেলের কাছ থেকে আসছি সেই বিন্ধ্যাচল থেকে। ট্রেন ধরব রাতে। কলকাতা ফিরছি। তুই?"
বললে "অলোক বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিল। রিটেয়ারের দু বছর আগে মারা গেছে আজ চার বছর। ছেলে ও ওখানে রিসার্চ করছে। আমি ছেলের কাছ থেকে দিল্লি যাবো মেয়ের কাছে। একটু চেয়ে থেকে আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বললে "বিশ্বাস ই হচ্ছে না। এরকমভাবে দেখা হবে । এই বয়সে এসে। তবে  জানতাম আবার একদিন দেখা হবে। দেখ বলতাম না যে খুব চাইলে সেটা ঠিক মিলে যায়?"
চন্দ্রা যেটা বললে স্পষ্টভাবে সেটা আমিও আগে প্রতিদিন আর এখন মাঝেমাঝেই ভাবি। তবু বলতে পারলাম না।
বললাম "তোর বিয়ের কথা আমি শুনেছি। তুই বাইরে থেকে ফিরে আসার বেশ কয়েক বছর পরে ধানবাদে এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম। খারাপ লেগেছিল তুই কিছু জানাস নি"।
"বিয়ে করব না বলেছিলাম। কথার খেলাপ করে পরে বিয়ে করলাম। এটা তোকে জানাতে চাইনি। কুণ্ঠিত লেগেছিল। তোকে হারাতে চাইনি। রেখে দিতে চেয়েছিলাম। মনের গভীরে যেখানে কেউ উঁকি অবধি দিতে পারবে না। তাই তোকে বিয়ে করতে চাই নি"।
অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম "বিয়ে করলে তো কাছেই তাকে পাওয়াই যায় সব সময়"।
"যায়, যায়, বলে সামান্য গলা ওপরে উঠল।" তোকে তো আগেও বলেছি। কিন্তু সময়ের মরচে পড়লে আর তাকে ছোঁয়া যায় না। সংসারের ঘর্ষণে প্রতি নিয়ত ভাঙতে থাকে লুকিয়ে থাকা টান। শেষে শুধু পাশাপাশি চলা ফেরার অভ্যেসটাই থেকে যায়। বিয়ে করেও দেখলাম আমার ভাবনা ঠিক। আছে আছে নেই নেই। অর্থ আছে, প্রতিপত্তি আছে, নাম ডাক আছে। কিন্তু সেই ভিতরের ডানা ঝাপটানো আর নেই। দেখা হলে বুকের মধ্যে ড্রিম ড্রিম মাদলের শব্দ নেই। যে শত সহস্র আলো জ্বলে ওঠা মনের মধ্যে আর থাকে না। তাকে চিরদিনের মত হারিয়ে যায়। বিশ্বাস কর, সেটার প্রতি খুব লোভ আমার, তাই চাইনি বিয়ে। চেয়েছিলাম চিরদিনের মত পেতে"।
"একটু নাটকীয় শোনাচ্ছে না?"
"কি করব আর যদি দেখা না হয় তাই বলে নিলাম। একদিন তো বলতেই হয়"। খুব করুণ দেখাল ওর চোখ। ছল ছল করছে।
সময় দাঁড়িয়ে গেল। এই জন্যেই বাঁচা। এই জন্যেই নিশ্বাস প্রশ্বাস।
একটু চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে বললে "এবার আমি উঠব। দিল্লির ট্রেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। তোর কখন?"
"তোর ট্রেনের ঘণ্টা খানেক পর"।
আবারও জিজ্ঞাসা করলে "বিয়ে কি করা যেত না? এখন কি তোর ছোড়দার কাছেই থাকা?"
এর উত্তর কি দেব? বললাম "বিয়েটা ধরে নে হল না। আমাকে কে বিয়ে করবে? সামান্য চাকরি, দেখতেও তেমন নয়। খেলোয়াড় না লেখক বা নেতা নেতা নই"।
"কাউকে আর পছন্দ হল না?"
সোজাসুজি তাকাতে পারলাম না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম "ওসব থাক"। হেসে ফেললে।
হঠাৎ বললে "হঠাৎ যদি তোর কাছে দুদিন থাকতে আসি তাহলে থাকতে দিবি? জায়গা হবে?"
হাসলাম। "তোকে সাহসী জানতাম। এখন দেখছি ছক ভাঙ্গা ও বটে। আমি এখন দাদার কাছে থাকি না"।
"তাহলে?"
"অন্য জায়গায় একা থাকি"।
"বাহ! তাহলে ভালই হল। ঠিকানাটা দিস। আমি চলে যাবো। খুব গল্প করব। যে গল্প সারাজীবন ধরে বুকে করে রেখেছি। যে গল্প আসলে মনের গহীন এ থাকে। কাউকে তো বলে যেতে হবে বল?
শেষ দিকে গলার স্বরটা একটা একাকীত্বের বেদনার প্রতিভাস।বললাম "ঠিক আছে"।
আর মুহূর্ত অপেক্ষা নয়। উঠে সামনের দিকে চেয়ে সুটকেস এর হ্যান্ডেল ধরে টান দিল। চাকা গড়াতে লাগল। তৃতীয়বারের বিচ্ছেদ অবধারিত হল, গড়াতে লাগল আমার অতীত স্মৃতি। বুকের মধ্যে একটা হাহাকার গুমরে উঠল। আর কি দেখা হবে?
অনেকদূরে গিয়ে একবার পিছন ফিরে হাত নাড়লে। তারপর স্টেশনের ভিতরে ভিড়ে হারিয়ে গেল।
স্টেশন এ গিয়ে ওকে তুলে দিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু বসেই রইলাম। এগোলে আরো কষ্ট।
ভালবাসা থাকে, বয়সের মলিনতা তাকে ঢেকে রাখে শুধু। এই অদ্ভুত সময়ে, এক দুর স্টেশনে চন্দ্রা আরোপিত প্রৌরত্বকে এক পিছন টানে যুবক করে দিয়ে গেল। মনে করিয়ে গেল কিছুই হারায়নি সবই আছে। এই বয়সে এখন সোজাসুজি। ওকে পাইনি তার জন্যে এখন আর আক্ষেপ নেই। ও যেমন আছে তেমন আর ওকে পেতাম না।
সামাজিক দিক থেকে কোথায় ও আর কোথায় আমি। এক সময় মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে গেলে  ভেবেছি  চন্দ্রা কি মনে রেখেছে আমাকে?
ওকে না পাওয়ায় কষ্ট আর নেই। এই চলে যাওয়াটা ওর চিরকালীন থেকে যাওয়ার কথাই বলে গেল। আমি পারিনি। বলতে পারিনি এখন একা থাকি কিন্তু সেটা বৃদ্ধা আবাসে।
দূরে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম এ আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বসেই রইলাম। এত বছরের একাকী জীবন বাষট্টি তে কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
চন্দ্রা লোকে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। এ আলোকে স্নাত হওয়া যায় একে ধরা যায় না। আর যতদিন জীবন থাকবে ততদিনই মনে মনে চন্দ্রাকে নিয়েই বসবাস করব। বেয়াড়া এসে বিল দিতে ঘোর ভাঙ্গল। কলকাতার ট্রেন আসার সময় হয়ে গেছে।

অনুগল্প

অনুগল্প

সনোজ চক্রবর্তী

পঃ মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ

oldman.jpg
অনুগল্প - সনোজ চক্রবর্তী
SanojCharaborty.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঞ্চাশ টাকার বান্ডিলটা হাতে পেয়ে ক্যাশিয়ার তো খুশিতে ডগমগ। অফিসে বসেছিলাম এমন সময় একজন ভ্যালুয়েবল মেম্বার বান্ডিলটা ধরিয়ে দিল নগদরক্ষকের হাতে। চাঁদার খাতায় তোলা হল পাঁচ হাজার নিয়ম মাফিক খাতায় সই করলেন মেম্বার। খুশি হওয়ারই কথা-টানাটানির বাজারে একসঙ্গে অতগুলো টাকা!

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলাম চেয়ারে। অনুষ্ঠানের শেষ দিন, কলকাতা থেকে শিল্পী এসেছেন তাঁকে টাকা দিতে হবে, পেমেন্ট করতে হবে প্যান্ডেল, মাইককেও-- টাকাটা খুব কাজে আসবে।

আমার উল্টো দিকের চেয়ারে বসে ততক্ষণে বান্ডিলটা গুনচ্ছে ক্যাশিয়ার-- একবার -দুবার- তিনবার..... জানুয়ারীর শীতেও ঘামছিল বেচারা। ফিজিক্যালি টাকাটা মিলছিল না তার। বিরক্তি নিয়ে বলেছিলাম- "নেওয়ার সময় গুনে নিলি না কেন!" বান্ডিলটা ফের একবার গুনতে গুনতে জবাব এসেছিল-- "সামনা সামনি গুনলে কেমন একটা অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়..... " খুশি হয়েছিলাম উত্তরটা শুনে।

"বিশ্বাস" সম্পর্কের গোড়ার কথা। প্রতিষ্ঠানও তো আসলে সম্পর্ক। "ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো" একদল মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক। যে নিচ্ছে সে যেমন বিশ্বাসের উপর না গুনে নিচ্ছে তেমনি যে দিচ্ছে সে আসলে জেনে বুঝে দেয় নি, হতে পারে কখন খরচ করে ফেলেছে বান্ডিল থেকে মনে করতে পারে নি। সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে গেঁথে দিয়ে বলেছিলাম--

"কি ভাবে ম্যানেজ হবে?" ক্যাশিয়ার বন্ধু দৃঢতা মিশিয়ে বলেছিল--

"ক'দিন বাদেই তো মাস শেষ হচ্ছে, সামনের মাস আর পরের মাসের টিউশনির টাকা দিয়ে মিটিয়ে দেব।"

পঞ্চাদাকে বলে সেযাত্রায় প্রেসের খরচ এক হাজার টাকা বাড়িয়ে ঘাটতি পুরণ করে দিয়েছিলাম।এমন টুকরো টাকরা জালিয়াতিতে পাপ নেই। এমন জালয়াতি পরিস্থিতি করিয়ে নেয়। অন্যের অনবধানতা ম্যানেজ করতে এমনটা না করলে প্রতিষ্ঠান চলবে কেমন করে! কিন্তু আত্মসাতের অভিপ্রায়ে হিসাবে কারচুপি--- নৈবচ নৈবচ।

সেদিন অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন হবে নাটকের দলের টাকা (দলগুলোর যাতায়াত খরচ) নাটক শুরুর আগেই আমার হাতে দিয়ে বন্ধু ক্যাশিয়ার বলেছিল--

"এই ঝামেলায় আমি নেই, যা কথা হয়েছে তোমার সঙ্গে, চার দলের চার তিনে বারো হাজার। এর বেশি চাইলে ম্যানেজ করতে পারব না।"

বারো হাজার টাকা যথারীতি আমার হাতে দিয়েও, নাটক শেষে দলগুলোকে আবার নিজেই নিজের ব্যাগ থেকে পেমেন্ট দিয়েছিল নগদরক্ষক।

সব গুছিয়ে গাছিয়ে রাতে বাড়ি ফেরার পথে বারো হাজার টাকা ক্যাশিয়ারের হাতে গুঁজে বলেছিলাম--

"টাকাটা রাখ, নইলে রাতে ঘুমাতে পারবি না, বারো হাজারের হিসাব পাবি না।" আজ হঠাৎ সেসব মনে হল! কত অনিশ্চয়তা আর্থিক ঝুঁকি আদুরে-অপবাদ নিয়ে "বনের মোষ তাড়াতে " হয়! এসব স্মৃতি কখনও ঝাপসা হয় না। সময় কতকিছু পাল্টে দেয়! পরিস্থিতি -সময় বিশ্বাসকেও নষ্ট করে দেয়! আত্মসাৎ নৈবচ নৈবচ। বললে হবে! ছেলেবেলায় আমরা বন্ধুরা চোর পুলিশ খেলতাম। হোমিওপ্যাথির পুরিয়ার মতো ছোট্ট কাগজ মেঝেতে ছড়িয়ে লটারির মধ্যে ঠিক হত সব - কে চোর কে পুলিশ। পুলিশ নির্দেশ দিত চৌকিদারকে চোর বা ডাকাত ধরে আনতে। চোর ডাকাতের নম্বর বেশি থাকলেও ঐ দুটো পুরিয়া ছিল বড্ড অসম্মানের। বড় বয়সেও কখনও কখনও চোর - পুলিশ খেলা ফিরে ফিরে আসে!

*******************************************​

একটি অবাস্তব গপ্প

'তাহলে স্যার আপনাদের বাড়ি?' সাধারণত আলাপচারিতা শুরু হয় এভাবেই। ভোটের আগের দিন আমরা যারা ভোটকর্মী তাদের হাজার ঝক্কি,তবুও এইসব অবাঞ্ছিত খেজুরে আলাপ মেনে নিতে হয়।

মেনে নিতে হয় কারন প্রায় গোটা একটা দিন এদের হাতেই তুলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

লিলুয়ার সেই প্রিসাইডিং- কি কুচকুচে কালি মেখেই না বাড়ি ফিরলেন! ঘটনাটা মনে হতেই- কাগজপত্র থেকে মুখে একটা মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বললাম -

-- কুকড়াহাটী।

-- একেবারে প্রপার?

-- হুম।

মার্ক কপি অব ইলেক্ট্রোরাল রোল থেকে পোষ্টাল ব্যালট আর ইডিসি-র সিরিয়াল নম্বর কাগজে টুকছি বটে, কান রেখেছি সতর্ক। অনেক সময় এদের কথাবার্তায় এরা বুঝিয়ে দেয় এরা কোন দলের, কি চায় এরা। এমনও হতে পারে ভাত টেপার মতো এরাও আগের রাতে আমাদের পরখ করতে আসে, আলাপটা নিছক একটা সৌজন্য। সেকেন্ড পোলিং নমস্কার জানিয়ে পরিচয় দিতেই, লোকগুলোর মধ্যে একটা ছোকরা বলল--

'ও আপনি প্রাইমারি মাস্টার।'

মাস্টার কথাটায় এমন একটা তাচ্ছিল্য মেশানো যেন মাস্টার আর শিক্ষক দুটো ভিন্ন বর্গের মানুষ।

সেকেন্ড পোলিং হাসি মুখে বললেন--

'হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ ভোট।'

'শেষ ভোট মানে?'

'মানে, মাস ছয় বাদে আমার রিটায়ারম্যান্ট।' সেকেন্ড পোলিং কে বিষন্ন শোনাল। লোকগুলো আসা থেকে নাগাড়ে ঘাঁটছে আমাদের। আসলে এটাও একটা পক্রিয়া-- ক্রমাগত এলোমেলো বলতে বলতে পোলিং পার্টিদের রাজনৈতিক মনোভাবের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা।

এমনটাও হতে পারে বাড়ি ঘরদোর জেনে এদের নিজস্ব চ্যানেল মারফত রাজনৈতিক খোঁজ খবর করে এরা। নমস্কার জানিয়ে বললাম--

'আসুন তাহলে, কাল কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে আসবেন মকপোল, সিলিং সব মিলিয়ে অনেকটা সময় প্রয়োজন। আমরা বাকি কাজটুকু এগিয়ে রাখি।'

এটুকু না বল্লে হচ্ছিল না, হাওয়া আপিস বারবার সতর্ক করছে ঝড়বৃষ্টি নিয়ে। যদি লোডসেডিং হয়!

তাছাড়া এই গায়ে পড়া ভাব জমানো,উপযাচক আত্মীয়তার কোন অর্থ হয় না। থার্ডপোলিং গেল বাইরের দিকের দেওয়ালে কিছু কাগজপত্র সাটাতে। আমি আর ফাস্ট পোলিং বসলাম ফম আর খাম নিয়ে। সেকেন্ড পোলিং মনোযোগ দিয়ে কাগজপত্রে ডিস্টিংগুইস মার্ক লাগাতে রইলেন। কি আশ্চর্য এই একটা ছাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ কাগজগুলো একটা বিশেষত্ব পেয়ে যাচ্ছে।

যা ছিল সাধারণ তাই হয়ে উঠছে অনন্য। সেকেন্ড পোলিং কে বললাম

-- স্যার কত বছর শিক্ষকতা হল?

-- আমি এক্স ম্যালিটারী ম্যান, শিক্ষকতা বেশি দিনের নয়।

-- তাহলে তো আপনার দু'টো রিটায়ারম্যান্ট।

-- দু'টো নয় তিনটে-- একটা কম্পালসারি।

চমকে গেলাম, ভোটের কাজে এসে মানুষ এতটা দার্শনিক হতে পারে। অথচ আমি একটু আগে দায়িত্বের খাতিরে কতকগুলো সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করলাম, গায়েপড়া মনে করে একপ্রকার তাড়িয়ে দিলাম,হোক সাময়িক আত্মীয়তা, তবুও তাকে অগ্রাহ্য করা যায়!

যখন এই সব সাত পাঁচ মাথায় জাকিয়ে বসতে চাইছে তখন 'অন্য আমি' এক ঝটকায় উপড়ে ফেলল আগাছা।

"দূর দূর নিজের ভাই পরিবার যেখানে নিজের নয়, যে সমাজে বাপকে ছেলে সরিয়ে ফেলছে বৃদ্ধাশ্রমে...... প্রাকটিকাল হ বাপু প্রাকটিকাল হ।"

খসে যাওয়া লুঙ্গিটাকে ভুঁড়ির উপর গিঁটিয়ে অনেকটা বসের মতো গলাটাকে ভারি করে বললাম--

"কাল আমরা রেডি হয়ে পড়ছি সোয়া পাঁচটায়, ভোর চারটায় এলার্ম, যে যার নিজের নিজের কাজটা ভালো করে বুঝে নিন। কাল কিন্তু আমরা কেউ ফাস্ট, সেকেন্ড বা থার্ড পোলিং নয়, আমরা গোটা একটা টিম-- টিম ২৬১ ঘোল আন্দুলিয়া, ওকে।"

ভোর চারটায় আবছা আলো মেখে মাঠের মাঝে কে যেন বসে। চোখ কচলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম -- কে?

আলো আধারির ভিতর থেকে খ্যাসখ্যাসে জবাব' আমি বাপু নিবারণ হাইত, এ বুথের ফাস ভোটার।'

-- ও, তা প্রতি ভোটেই কি ফাস্ট ভোটটা তুমিই দাও।

-- হ্যাঁ বাপু।

-- তা কোন বার হোড়কে যায় নি?

-- গেছে তো যে বার ছেলের প্রথম ভোট হল সে বার ছেলেকে দিয়েই ফাস ভোট দিইয়েছিলাম।

ভাবলাম নিবারণকে দিয়েই বুথের হালহকিকত জানা যেতে পারে, টুথ ব্রাস মুখে নিয়েই বললাম--

-- তোমাদের এখানকার কি খবর হাইত বাবু?

-- ফুলে ফুলে কি যুদ্ধ হয় বাবু!

মনে মনে ভাবলাম এ লোক নির্ঘাত বাম। মুখ থেকে মাজন সহ থুতু পুচ করে ফেলে বললাম--

-- হয় না!

এতক্ষন ভেজানো দরজার তেরচা আলোয় উঠে এসেছে নিবারণ, মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ক্ষয়টে শরীর নিয়ে।

-- ভোট আসে ভোট যায়, আমাদের এখানে কোন ঝামেলা নেই বাবু। তপন, শাহজামান, চিত্তদারা বুথে বসে এক ঠোঙায় মুড়ি খায়। এতো ভালো বুথ আপনি পাবেন নি বাবু।

নিবারণকে আর ভরসা হচ্ছে না, লোকটার হয়তো একটা দল আছে কিন্ত বিশ্বব্যাপী বন্ধুত্বের একটা ভুতও আছে।

-- দল একটা আলাদা আলাদা হয় বাপুু কিন্তু আজ মরলে কাল দু'দিন। পোড়াও বা কবর সবই মাটি।

নিবারণের কথায় সেকেন্ড পলিং- এর কম্পালসারি রিটায়ারম্যান্ট মনে পড়ল। না নিবারণ ভুল কিছু বলে নি। বুথটা বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে বাইরে। তপন বেরা, মহঃ শাহজামান, চিত্তরঞ্জন দোলই, জয়ন্ত,গোপাল, অদৈত্ববাবু হাত ডোবাল এক মুড়ির ঠোঙায়। হইহই করে সন্ধ্যে ছটার মধ্যে আটশ চৌষট্টি পোল হয়ে গেল। ইভিএম সিল করে কাগজ পত্র তৈরি করে বুথ থেকে আর সির জন্য বের হব।

এমন সময় লোডসেডিং। ফটফটে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে স্কুলের দাওয়ায়। হঠাৎ দরজা আটকে দাঁড়াল শাহজামান--

-- কোথায় যাবেন, দাঁড়ান। নিরবিচ্ছিন ক্লান্তি আর বাড়ি ফেরার তাগাদা অস্থির করে তুলেছে আমাদের। সমস্ত ভোট পর্ব চুকে যাওয়ার পর একি বিপত্তি! সারাটা দিন যে শাহজামানকে দেখেছি এ তো সে নয়! ভোট মেশিন আগলে নিলাম।

শাহজামানে পেছনে আবছা আলোয় ঘন হয়ে এলো আরো কয়েক জন। বুকের ভেতর আজানা আশঙ্কার কাঁপুনি। পাশের বুথে তখনও কাগজপত্রের কাজ চলছে, পুলিশ পার্শোন্যাল বোধহয় ওখানে। সব ভালোয় ভালোয় মেটার পর মেশিন লুট হয়ে যাবে না তো! এমন সময় ঘটঘট শব্দে চালু হল জেনেরেটর।

শাহজামানের পেছনের জটলায় তপন বের, চিত্তবাবু, অদৈত্ববাবু, গোপাল, জয়ন্ত আর জন দুই পুলিশ। তপন বেরা বলল আমাদের একটু সময় দিতে হবে স্যার। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। চিত্তবাবুর হাতে একটা সাদা প্যাকেট। যাক রাতে আমাদের আর অভুক্ত থাকতে হবে না। আমাদের জন্য টিফিন এনেছে নিশ্চিত।

প্যাকেট থেকে বেরাল একটা উত্তরীয় একটা বই এক প্যাকেট মিষ্টি আর সুন্দর একটা কলম। জয়ন্ত বলল--

'ভোটের ব্যাস্ততার মধ্যে আমরা এটুকুই করতে পেরেছি স্যার, ফুলটা আনতে পারলাম না, ফুলের দোকানে বন্ধ।'

আয়োজনটা সেকেন্ড পোলিং সুভাস পন্ডা বাবুর জন্য। এটাই যে তার শেষ ভোট। মুহুর্তে স্কুলঘরটা ভোটের দমবন্ধ কষ্ট থেকে যেন 'এক সব পেয়েছির দেশ'। যেখানে লড়াই এর বদলে রয়েছে সহমর্মিতা, ব্যালট কেবল একটা তুচ্ছ কাগজ মাত্র আত্মীয়তাই আসল সম্পদ। বড় ফুল, ছোট ফুল, বাম, নির্দল সমস্ত দলগুলো নিয়ে একটাই দল ২৬১ ঘোল আন্দুলিয়া যার প্রতীক আত্মীয়তা। উপহারগুলো তুলে দেওয়া হল সুভাসবাবুর হাতে। সুভাসবাবুকে কিছু বলতে বললেন তপন বেরা।

সুভাসবাবু বললেন--

"আমি আজীবন এই সম্মান মনে রাখব। কাল পর্যন্ত এটা মনে করে খুশি হয়েছি আর আমার ভোটের ডিউটি আসবে না। এই মুহুর্তে, বিশ্বাস করুন আমার আফসোস হচ্ছে, এমন একটা বুথে আমি আর নির্বাচন কাজে সামিল হতে পারব না। আপনারা যে ভালোবাসায় বাঁধলেন..... "

কথা জড়িয়ে এল সুভাসবাবুর। জয়ন্তর পিঠে হাত রেখে বললাম--

'ফুল পাওনি তো হয়েছে কি, তুমি আমি আমরা আমরা মানুষেরা প্রত্যেকেই সুন্দর এক একটা ফুল।' মনে হল কথাটা শুনে স্কুল মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে খ্যাঁকখ্যাক করে হাসছে নিবারণ!

খ্যাঁকখ্যাঁক হাসিটা বিঁধছে আমার বুকে-- গ্রামের অশিক্ষিত স্বল্প শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিতরা যা পারে তা তো আমি পারি নি। সুভাসবাবুর অবসর জেনেও আমি তো কিছু করার তাগিদ বোধ করি নি! নিবারণের হাসি আর আফসোস যখন মাথায় জাকিয়ে বসতে চাইছে তখন 'অন্য আমি' মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল--

'দূর দূর মহামান্য নির্বাচন কমিশনও তো কিছু ব্যবস্থা করেন নি!'

*************************************************

"র দূপুরে কে এল দেখ তো ভাই।" মেজ'দি-র কথা শুনে দরজা খুলে অবাক। গত দু'দিন আগের হকারটা দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি কিছু বলার আগেই আমার হাত দুটি ধরে একপ্রকার কাঁদতে শুরু করল লোকটা।

"আমায় মাফ করে দিন মাস্টার মশাই।" বাপের বয়সি লোকটা আমার হাত ধরে কাঁদছে! লোকটার উপর সমস্ত রাগ মুহুর্তে উধাও। "আরে ঠিক আছে, মানুষ নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারলে ঈশ্বরও তাকে মাফ করে দেন, হাতটা ছাড়ুন এবার।"

কে শোনে কার কথা,লোকটা উঠোনে দাঁড়িয়ে এবার রীতিমত শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল। আমাদের বাড়িটা যেহেতু রাস্তার পাশেই ফলত পথ চলতি লোকজনও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে লোকটার কান্ডকারখানা!

গোঁগানিটা একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসছে, চোখের জলে মিশছে নাকের জল। লোকটার চোখজোড়া গভীর কালোয় ডুবেছে। সম্ভবত দু'রাত ঘুমায় নি মানুষটা। শরীরে ক্লান্তি স্পষ্ট। আমি লোকটাকে একপ্রকার জোরজবরদস্তি ঘরের ভেতর নিয়ে এলাম। ফ্যানের স্পিড হাই করলাম- লোকটা রোদে পুড়ে তামাটে। ফ্রিজ খুলে জল দেব। লোকটা নিজেই বন্ধ করে দিল ফ্রিজ।

গোঁগাতে গোঁগাতে বলল "আর আমাকে ঋণী করবেন না, আগের দিনের ঘটনা শোনার পর আমার স্ত্রী পুত্রের কাছেও আমি ছোট হয়ে গেছি। তারাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনার কাছে।"

কথাগুলো শেষ করে লোকটা একটা লম্বা শ্বাস নিল। তারপর পকেট থেকে অনেকগুলো পাঁচ'শ টাকার নোট বের করে হাতে গুঁজে দিল আমার। নোটগুলো দু'দিন আগে আমিই দিয়েছিলাম তাকে।

হয়েছিল কি- বুধবার সকালে একটা লোক ঘেমে নেয়ে হাজির আমাদের বাড়িতে। কাঁধে তার মস্ত ঝোলা-- "এক গ্লাস জল খাওয়াতে পারেন?" কাতর চাওয়া। আমি তড়িঘড়ি জলের বোতল দিয়েছিলাম ফ্রিজ খুলে। লোকটা হাঁফাচ্ছিল রীতিমত। তখন বুঝিনি লোকটা হকার। কিছু বাদে ঝোলা থেকে বের হল বিষ্ণুপুরী সিল্ক।না ঠিক বের হল না,লোকটা বলেছিল-

"আমরা তিন পুরুষ তাঁতি, যদি দেখতে চান কয়েকটা শাড়ি দেখাতে পারি।" আমি লোকটাকে কাটানোর জন্য বলেছিলাম - 

"শাড়ীর আমি কিছুই বুঝিনা, ঠিকানা দিন পারলে বিষ্ণুপুর গেলে চেষ্টা করব।"

"কিনতে হবে না, দেখুন না।" লোকটা ছিল নাছোড়। লোকটা শাড়ি দেখাচ্ছিল যত্নে। ভারি ব্যাগে ঝুঁকে পড়া লোকটার কাঁধ। জবজবে ঘামে জামা লেপ্টে গেছিল ক্ষয়াটে শরীরে। সত্যি যারা ফেরি করে কত কষ্ট তাদের! দেখলে বড় মায়া হয়।

সেজ'দি স্কুলের প্রস্তুতির মাঝে দই সরবত দিয়েছিল লোকটাকে, দিয়েছিল প্লেট ভর্তি মিষ্টি। লোকটাকে বারবার বলচ্ছিলাম-

"শাড়ি দেখানোর দরকার নেই, আমার মিসেসের সঙ্গে কথা হয়েছে আমরা বিষ্ণুপুর গিয়ে নেব।" আসলে মিসেসকে ফোনে ছবি পাঠাতে, সে বারবার মানা করেছিল কিনতে। ওগুলো নাকি আসল বিষ্ণুপুরী নয়। কিন্তু লোকটা তার কথাবার্ত আচার ব্যবহার তার মধ্যে তো ভেজালের রেশ মাত্র নেই। লোকটা খুশি মনে দেখিয়েই গেল শাড়ি। শাড়িগুলো দেখে খুশি উপচে পড়ছিল দিদির। ছেলেবেলা থেকে কত কম চাহিদায় বড় হয়েছি আমরা ভাই বোন। মন খুব একটা সায় না দিলেও ঠিক করেছিলাম দিদির জন্য নেব। দিদি আমাকে আড়ালে ডেকে বলেছিল--

"রোদে রোদে ফেরি করছে একটা কিছু নে।" দুটো শাড়ি নিয়েছিলাম আমরা। চার হাজার একশো তে।

লোকটা চলে যাওয়ার পর দিদিও চলে গিয়েছিল স্কুল। হঠাৎ দিদির ফোন--

"আমাদের রাম ঠকান ঠকিয়েছে লোকটা, পম্পা ম্যাডাম বলল শাড়িগুলো দাম তিন'শ কি চার'শ।"

সেই থেকে মনটা খারাপ। টাকা কটার জন্য নয়। লোকটাকে সরবত মিষ্টি দেওয়ার পর লোকটা বলেছিল "আপনারা বড্ড ভালো মানুষ এমনটা আমার আত্মীয়রাও করে না।"

আশ্চর্য এসবের পরেও পারল লোকটা! "ভর দূপুরে কে এল দেখ তো ভাই।"-- একথা বলেনি মেজ'দি। হকারটা ফিরে আসে নি। আমি কেবল আশায় আশায় দোরগোড়ায় যাই৷ আর ফিরে আসি--

আমার খুব বিশ্বাস লোকটা ফিরবে নিশ্চিত। "মাস্টারমশাই বাড়ি আছেন নাকি?" স্নানে যাব। স্কুল বেরাতে হবে। ডাক শুনেই সিঁড়ি ভাঙলাম হুড়মুড়িয়ে। দরজা খুলে দেখি----

দুজন বয়স্ক মানুষ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে।একজনের পোশাকে পরিপাট্য থাকলেও অন্যজন হতদরিদ্র। আমি ভেবেছিলাম হকারটা বোধহয় ফিরে এসেছে। "কি ব্যাপার? "বিরক্তি নিয়ে বললাম।

"একটু সাহায্যের জন্য এসেছিলাম।" হতদরিদ্র বললে।

"আমার কাছেই!" উল্টো দিকের একটা বাড়ির দিকে আঙুলের ইশারা করে হতদরিদ্র জানলো--

"ঐ বাড়ি থেকে বলল, মাস্টার মশাই মাটির মানুষ।" লোকটার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম--

"চলে এলেন আঁচড় কাটতে।" লোকটার মুখ শুকিয়ে কাঠ। পাশ থেকে পরিপাটি পোশাক বলল--

"নমস্কার আমি একজন রিটায়ার্ড শিক্ষক।"

প্রতি নমস্কার জানিয়ে বসতে বললাম ওদের। মাস্টার মশাই সঙ্গীটির করুণ কাহিনী শুরু করলেন। সঙ্গীর স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে ক্যান্সারে, চিকিৎসায় বর্তমানে সর্বশান্ত। একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাই। আমি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম--

"সরকার তো টাকা দিচ্ছে, আবেদন করুন। এভাবে কত জনের কাছে যাবেন। তাছাড়া এই ভীষণ তাপে আপনাদেরও তো কিছু হয়ে যেতে পারে!" দিদি জল দিল মাস্টারমশাইদের। আমার হাতে ক্রমশ সময় কমছে-- স্কুলের প্রস্তুতি নিতে হবে। এমন সময় সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি-- একেবারে মেঘ না চাইতেই জল।

গত দিনের হকার কাঁধে ঝোলা নিয়ে হাজির। মেঘ আমি নিজেই তৈরি করে রেখেছিলাম। আসলে মানুষ তো খুব লোভি-- অল্পে সে কোনদিনই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেনি। গলা পর্যন্তর অস্বস্তিতে তার সন্তুষ্টি। দিদি যখন ফোন করে বলেছিল "আমাদের রাম ঠকান ঠকিয়েছে লোকটা,....." একটা জোরালো ধাক্কা লেগেছিল। ধাক্কাটা সামলে নিয়ে, ঘটনার পুনঃনির্মান করেছিলাম।

ঘটনা -১

লোকটা শাড়ি নিয়ে এল, দরজা বন্ধ জানালা দিয়ে কথা হল।

ঘটনা-২

লোকটা জল চাইল। আচ্ছা এমন তো হতে পারে আদৌ জল তৃষ্ণা ছিল না। কেবল দূরত্ব কমানোর জন্য!

ঘটনা -৩

সামান্য জল খেয়েই আমার প্রসংশা শুরু করল। "আপনি খুব ভালো মানুষ, এখন তো কেউ জলটুকুও দেয় না।" লোকটা জানে সব মানুষ নিজের প্রসংশা শুনতে চায়। যে প্রসংশা করে তাকে আপন ভাবতে শুরু করে। আমার ভেতরের আমি লোকটার প্রসংশায় খুশি হয়েছিল। যে কথাগুলো আমার আপনজন বন্ধুবান্ধবরা বলে নি সেই কথাগুলো অপরিচিত মুখে শুনে লোকটাকে প্রশ্রয় দিতে হয়েছিল উদগ্রীব।

সেই প্রশ্রয়েই লোকটা ঘরের ভেতর এলো। এর মধ্যে এল দই সরবত, মিষ্টি ইত্যাদি। সেও আসলে আরো প্রশংসার লোভ। লোকটাও সুযোগ বুঝে সাজাল নির্ভুল ঘুটি-- প্রসংশা... প্রসংশা আর প্রসংশা। এবার আর সে পণ্য নয়--- ঝোলা থেকে বেরাল বেড়াল। ঘটনার পুণঃনির্মান করতে গিয়ে, দেওয়াল খুঁজচ্ছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল মাথ ঠুকি দেওয়ালে। সারাবছর এসবই নিয়েই তো থাকি। ছেলেদের বোঝাই---

"বিক্রেতা শুরুতে নিজেকে গ্রহণ যোগ্য পণ্য করে না তুলতে পারলে বিক্রি অধরা থেকে যায়।" ক্রেতার মস্তিষ্ক অবশ করে দিতে পারলেই বিক্রেতার নিকৃষ্ট পণ্যও ক্রেতার কাছে উৎকৃষ্ট। এতোটা জেনেও বোকা বনে যাওয়া!

ঐ যে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরের আমিটা উন্মুখ হয়ে থাকে 'সুন্দর' কথাটা শোনার জন্য-- সীমাহীন প্রশস্তিতে ভেসে যাওয়ার জন্য। লোকটাকে বাড়ির ভেতরে আসতে বললাম। লোকটার ভীষণ তাড়া, গোটা কতক শাড়ি গছিয়ে ফিরতে হবে বিষ্ণুপুর। লোকটা কপালের খুচরো ঘাম সরিয়ে বলল-- "ডাকুন আপনার বৌদিকে।"

গতকাল ঘটনার পুনঃনির্মাণের পর স্থির করেছিলাম ওর অস্ত্রেই ঘায়েল করব ওকে। ফোন করেছিলাম,দ্বিতীয় রিং - এ ফোন ধরেছিল লোকটা। খুব সচতেন ভাবে শুরু হয়েছিল ফাঁদ পাতা

-- অশোকবাবু বলছেন? লোকটা একটু সময় নিয়ে জানিয়েছিল--

-- হ্যাঁ বলছি।

-- আপনি এখন কোথায়?

-- আমি মঠচন্ডিপুরে।

-- ওহ অনেকটা পথ চলে গেছেন, ঠিক আছে থাক...

-- কেন বলুন তো?

-- না, ছেড়ে দিন

-- হয়েছে কি বলুন

-- হয়েছে বলতে, আমার খুড়তুতো বৌদি শাড়িগুলো দেখে রীতিমত ঝগড়া শুরু করেছে, কেন তাকে বলা হয় নি, সে কয়েকটা নিত আরকি। যাকগে এই রোদে ফিরে আসার দরকার নেই,পরে সময় করে আসবেন কখনও।

-- মাসখানেক পরে আসব আপনার বাড়ি।

-- হ্যাঁ তাই আসুন না- সময় সুযোগ মতো। আর যাব বিষ্ণুপুর মিসেসর কিছু নেওয়া হয়নি। আর একটা কথা একদম রোদে রোদে বেশী ঘুরবেন না, আপনার জিনিসের যা কোয়ালিটি এমনিই বিকোবে। রাখছি তাহলে, ভালো থাকবেন।

লোকটাকে আসার জন্য কোন জোরাজুরি করিনি ধরেও ছেড়ে দিয়েছি অবহেলায়। কাজ দিয়েছে সেটাই। লোভ, আরো একটু বেশী লাভের নেশায় ছুটে এসেছে বেচারা।

"ডাকব একটু জল খান --- একটু দই এর সরবত।"

"না না ওসব পরে কোন দিন হবে, আজ তাড়া আছে ডাকুন ওনাকে।"

"ডাকব, এখুনি ডাকব। পুলিশ ডাকব।" এবার লোকটার মুখটা থমথমে, ভেঙে পড়তে চাইছে হুড়মুড়িয়ে। সামাল দেওয়ার জন্য আমতা আমতা করে বলল--

"কি বলছেন কি? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।" আমি চোখে চোখ রেখে বললাম--

"কি শাড়ি গছিয়েছেন।"

"কেন সিল্ক।"

"হ্যাঁ সিল্ক তো বিষ্ণুপুরী না ব্রহ্মাপুরী--- চারশ পা়ঁচশ দামের পেপার সিল্কগুলো দু'হাজারে!"

লোকটা এর মধ্য নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে, নতুনভাবে আর এক প্রস্থ ভুল বোঝাতে উদ্যত হতেই আমি বললাম-

"আর একদম নয়, আমার টাকা আমাকে ফেরত করুন, আর আপনার শাড়ি নিয়ে কেটে পড়ুন। আর কোন দিন যেন এতল্লাটে না দেখি।" লোকটা পকেট ফকেট হাতড়ে বলল--

"আমার কাছে হাজারের বেশি টাকা নেই, এই হাজার টাকা নিন আর আরো চারটা শাড়ি রাখুন।"

আমি কড়িয়ে বললাম-- "আমার একটাও লাগবে না, টাকা দিন আর ভাগুন।"

লোকটা ফোন পে তে টাকা দিল। জানতে চাইলাম "কে দিল টাকাটা?"

লোকটা বলল "ছেলে।"

ফোনের স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নামটা দুই বুড়োকে দেখিয়ে বললাম--

"বাঃ কি চমৎকার! অশোক দে এর ছেলে ইকবাল আহমেদ মল্লিক!" ঘাড় ঘুরিয়ে বলতে যাব-- পুলিশ ডাকি? ততক্ষনে ব্যাগপত্তর সহ অশোক আউট। মাস্টারমশাইয়ের হাতে পাঁচ'শ দিয়ে বললাম "এটুকুই পারলাম, আসুন তাহলে, আমারও স্কুল আছে।" স্নান করছি। শাওয়ার থেকে নেমে আসছে ঠান্ডা জল। গরম মাথা ঠান্ডা হচ্ছে ক্রমশ। হঠাৎ মনে হল যাওয়ার আগে মাস্টার মশাই কেন বলল,

"একেবারে ঠিক ধরেছেন লোকটা চিটিংবাজ, মহিষাদলে অনেকবার দেখেছি আমরা।"

বিষ্মরণের বেলায় স্মরণে রবীন্দ্রনাথ

অনিশা দত্ত

সল্টলেক, কলকাতা

বিষ্মরণের বেলায়
oldman1.jpg

গল্প

Anisha Dutta.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জকাল অবসর গ্রহণের বয়স পঁয়ষট্টি। তারপর পাঁচ বছর এক্সটেনশন। প্রবাসে থাকার দরুণ পুরানো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না, এতদিন বাদে কলকাতায় ফিরে প্রাক্তনী সম্মিলনীর নিমন্ত্রণ পত্র পেয়ে হাতে চাঁদ পেলেন সত্তরোর্ধ অভীক বসু। আগামী রবিবার সম্মেলনের দিন ধার্য হয়েছে। অভীক মনে মনে স্থির করে নিলেন, বাংলার সনাতন পোষাক ধুতি পাঞ্জাবি পরবেন। নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে দেখলেন, সমস্ত অপরিচিত মুখ।  ছোট ছোট টেবিলে মুখোমুখি দুজন বা, এক একটি টেবিল ঘিরে চার বা ছয়টি চেয়ার। বেশিরভাগই ভর্তি। হঠাৎ নজরে পড়ল, কোণের দিকে ছোট টেবিলে একটি চেয়ারে এক বর্ষীয়সী আসীনা। উল্টো দিকের চেয়ারটি ফাঁকা। কাছাকাছি এগিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে, সামনাসামনি দাঁড়াতেই, ভদ্রমহিলা হাসলেন। অভীক আবেগে আপ্লুত হলেন, ‘পঞ্চাশ বছর পর, দেখা হল আজ'। এক ঝলক দেখেই মনে হল,

‘চিনি গো, চিনি তোমারে’ - কিন্ত নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। যেমনি তুমি হাসলে, গালের টোলটি দেখেই চিনে ফেললাম। এই বয়সেও এখনও তোমার গালে কী সুন্দর টোল পড়ে।“

প্রবীণা আবারও গালে টোল ফেলে, হেসে বললেন,

“এই বয়সেও কী সুন্দর তোমার চোখে পড়ল! গালের টোল দিয়ে যখন শুরু, তখন একটা অন্তরঙ্গ প্রশ্ন শুধাই। মন - রাখা জবাব দেবে না কিন্ত, সত্যি বলবে।“ অভীক উল্টো দিকের চেয়ারটি টেনে নিয়ে বসলেন। সহাস্যে উত্তর দিলেন,

“অকপটে বল। তোমার কথা শুনতে ও জবাব দিতে আমি সমান আগ্রহী। ভাবিনি, এজীবনে আবার দেখা পাব! প্রবীণা সলজ্জে নয়ন নত করলেন -

“লাল শাড়ি পরে’ অস্বস্তি হচ্ছে। উদ্ঘট উৎকট দেখাচ্ছে না তো? এই বয়সে লাল রং কী মানায়, বল? অভীকের দৃঢ় স্বর,

“কে বলেছে মানায় না? আলবৎ মানায়। তাছাড়া, শাড়িটা তোমার বয়স জানে না। আপত্তি কোথায়? আর সৌন্দর্য? সে তো at the eyes of the beholder.” আমার চোখে তুমি নিরুপমা। কী জান? ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ, আসিতে তোমার দ্বারে। কত কাল যে বসেছিলেম, পথ চেয়ে আর কাল গুণে, দেখা পেলেম ফাল্গুনে।“

প্রবীণা সজোরে হাসলেন,” What a coincidence! সত্যিই এটা ফাল্গুন মাস। আমার মনে হচ্ছে, সমাজ – সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব। জগতে তুমি-আমি ছাড়া কেউ নেই আর।" অভীক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

“পঞ্চাশ বছর! অর্ধশতক পার করে দিলাম আমি, তুমি বিহনে, এ-তো দিন, এ-তো বছর কেমন করে বাঁচলাম, তোমাকে না -দেখে। আমরা দুজনেও তো, কেউই কখনও চেষ্টাই করিনি, পরস্পরের খো্ঁজ নেওয়ার। প্রবীণা হতাশ সুরে বললেন,

“পাশ করার পরপর, বাবা বদলি হয়ে গেলেন। আমারও বিয়ে হয়ে গেল। অভীক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

“আমাদের সময় যদি Facebook এর চল থাকতো, তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করতাম। প্রবীণা সহমত হলেন,

“যা বলেছো । এই তো আমার মেয়ে কেমন বিশ বছর আগেকার ইস্কুলের বন্ধু-বান্ধবীদের খুঁজে নিয়েছে, Facebook এর কল্যাণে। সে যাকগে যাক। গতস্য শোচনা নাস্তি। আমার চোখে চোখ রেখে আজ বল তো, তোমার কি মনে আছে, কলেজের সেইসব রোমান্টিক মুহূর্তগুলো?”

অভীক গাঢ় স্বরে বললেন,

”পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়! সে যে চোখের ব্যথা, মনের কথা, সে কী ভোলা যায়? আমাদের দিনগুলি সোনার খাঁচায় ধরে রাখতে পারিনি। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। হায় রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয়, দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।“

প্রবীণা বললেন, ”সব কি হারিয়ে ফেলেছি আমরা? আমাদের যে-দিন গেছে, তা’ কি একেবারেই গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?“ অভীক রুদ্ধ স্বরে বললেন,

“রাতের সব‌ তারাই আছে, দিনের আলোর গভীরে। প্রবীণা স্মৃতিচারণ করলেন,

“আমাদের সময়, মল্ ছিল না, ডিস্কো ছিল না, পাব ছিল না। তবে সিনেমা হল – রেস্তোরাঁ ছিল, ছিল উন্মুক্ত মাঠ-ময়দান-পথ। মনে উড়ু উড়ু। পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা ছিলাম চলতি হাওয়ার পন্থী ..। মোবাইল ছিল না, ই-মেল ছিল না। ল্যান্ড ফোন খুব একটা ভরসার স্থল ছিল না।" অভীক মাঝপথে থামালেন,

“অন্তত প্রেমালাপ মোটেই সম্ভব ছিল না। চারদিকে শ্যেনচক্ষু আমার বাড়িতে। কোনও অচেনা মেয়ে ফোন করছে নাকি? কলেজ ছুটি থাকাকালীন তো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।" প্রবীণা মুখর হলেন,

"কলেজ ছুটির দিনগুলোতে, তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম। সে কি উথাল পাথাল, আকুলি – বিকুলি অবস্থা। সব মিলিয়ে চিঠি পাওয়া, চিঠি লেখায় কী রোমাঞ্চ। এখন প্রেমপত্র তো obsolete " অভীক প্রতিবাদ করলেন,

“তাই বলে প্রেম তো obsolete হয় না। সে আমার প্রেম, তারে আমি রাখিয়া এলেম, অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে। পরিবর্তনের স্রোতে আমি ভেসে গিয়েছি। কিন্ত প্রেম তো অটুট। প্রবীণা নিঃশ্বাস ফেললেন,

“কে কোথা ছিনু দোঁহে, সহসা প্রেম এসেছিল কী মহাসমারোহে। আর এখন? তোমার -আমার এই বিরহের অন্তরালে, কত আর সেতু বাঁধি, তবু ভুলতে পারলাম কই? তুই ফেলে এসেছিস কারে? মন, মন রে আমার! তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে! ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনায় দোলা হয়নি"

অভীক হাসলেন, “তখন শুধু যাওয়া-আসা, শুধু যেতে–যেতে, ফিরে–ফিরে আসা। শুধু স্রোতে ভাসা…  লাজে-ভয়ে-ত্রাসে….. আধো বিশ্বাসে, শুধু আধখানি ভালোবাসা।“

প্রবীণা অশ্রু স্ংবরণ করলেন, “আমাদের যৌবনে মাথার ওপর অভিভাবকদের কড়া পাহারা। কত বিধি-নিষেধ, এখনকার ছেলেমেয়েদের মতন স্মার্ট বা বেপরোয়া ছিলাম না। গুরুজনদের নির্দেশ অমান্য করতে শিখিনি। অভীক মনে করিয়ে দিলেন,

“আমাদের সময়,‌ কলেজে, সহপাঠিনীদের ‘তুমি’ সম্বোধনের অনুমোদন ছিল না। প্রবীণা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন,

“মনে আছে, ‘‌আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে নামতে কত‌ সময় নিয়েছিলে ‌তুমি‌। অভীক আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

“তবু তো শেষ রক্ষা করতে পারিনি। মনে পড়ে, সেই শেষ বিদায়ের ক্ষণ! গঙ্গার পাড়, আউটরাম ঘাট। সন্ধ্যা নামছে। আকাশের শেষ অস্তরাগটুকু মিলিয়ে আসছে। সিঁদুরে মেঘে কনে-দেখা আলো । মনের মধ্যে গুণগুণিয়ে উঠেছিল, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, আমার সাধের সাধনা। গলা খুলে গাইতে পারি নি। মনে মনে গেয়েছিলাম। তোমার কানে অবশ্য পৌঁছায়নি। স্বভাব লাজুক ছিলাম তো। প্রবীণা উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন,

“কাব্য করছো, শুনতে মন্দ লাগছে না, কিন্ত সব ভুলে বসে আছ। আউটরাম ঘাট নয়, বোটানিক্যাল গার্ডেন। সন্ধ্যার মেঘমালা কোথায়? সন্ধ্যার পর, বাইরে থাকার অনুমতি ছিল নাকি আমার? সে তো ভর দুপুরের দেখা-সাক্ষাৎ। কলেজ পালিয়ে দুটি তরুন-তরুনীর একান্ত‌ নিভৃতির আকূতি। অভীক লজ্জা পেয়ে বললেন,

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। শীতের নরম দুপুর। তোমার পরণে ছিল, সুনীল শাড়ি, আকাশনীল পশমিনার শাল পায়ের ওপর জড়ো-করা। পাশাপাশি বসে আছি দুজনে। নীল রং, আমার প্রিয় রং, যা মানাতো তোমাকে। দিনটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।“

প্রবীণা বাধা দিলেন, “ভুল ভুল! আবার ভুল! বার্ধক্যে সব ভুলে বসে আছো। তোমার প্রিয় রং ছিল লাল। সেই কথা মনে রেখেই তো, লাল শাড়ি পরেছি, আশায়-আশায়, যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! তবে সত্যি যে দেখা হবে, এমনটা ভাবিনি। যাহোক, তোমার আরও ভুল শোধরাই! শীতকাল নয়, ভরা বর্ষা। সেদিন পরেছিলাম লাল ব্লাউজ আর সাদার ওপর লাল গোলাপ ফুলের প্রিন্ট ভয়েলের শাড়ি। হঠাৎ ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। আমরা দুজনে দৌড়ে গাছের তলায় আশ্রয় নিলাম। তারিখটাও মনে আছে, ষোলোই আগস্ট। তুমি বলেছিলে, ‘রাণী, জীবনের ডাকে দুজনে দুদিকে ছিটকে যাচ্ছি। কিন্ত যতদিন বাঁচবো, যে যেখানেই থাকি, এই দিনটিতে এই সময়ে, দুজনে মিলব প্রতিবছর। আমি কোনদিন যেতে পারিনি। আর, তোমার তো বর্ষা-শীত সব কিছু গোলমাল হয়ে গেছে, দেখছি। সত্যি বল তো, তুমি কি কোনও ষোলই আগস্ট গিয়েছিলে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অভীক,

”আমি বুঝি তোমাকে ‘রাণী’ বলে ডাকতাম? অথচ‌, এতক্ষণ যে নামটা মনের মধ্যে গুণগুণ করছিল, সেটা ‘মণি’। প্রবীণা হতাশ হলেন,

“ইস্ তুমি এ্যালজাইমার এর শিকার। ‌অভীক দৃঢ় স্বরে বললেন,

“এত নিশ্চিত হচ্ছ কেন? উল্টোটাও তো সম্ভব। আসলে, যখন ভাঙল মিলন মেলা, ভেবেছিলাম ভুলব না আর। …জানি না, কখন এল বিস্মরণের বেলা …… প্রবীণা অভীককে থামিয়ে দিলেন

“ব্যস্ -ব্যস্। ‘হঠাৎ দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামে না যে,’ এটা উচ্চারণ কোরো না। আজ আনন্দের দিন। বল, ’ ও চাঁদ, হাসো, হাসো, হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে্।“ 

অভীক খুশি হলেন, “বেশ, যাক্ পুরাতন স্মৃতি – যাক ভুলে যাওয়া গীতি। তোমার কথা বল। তোমার কর্তা–সন্তান-সন্ততি? দিন কেমন কাটাচ্ছ রাণী?"

প্রবীণার নীরস কণ্ঠের উক্তি, “গতানুগতিক। আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা। না আছে হাঙর – কুমীরের উৎপাত, না-আছে রাজহাঁসের নিমন্ত্রণ। দু বছর‌ হল, উনি গত হয়েছেন।‌ এক পুত্র, এক কন্যা। দুই কৃতী সন্তান, বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। সদা ব্যস্ত। সপ্তাহান্তে Facetime-এ কথা হয়। একাই থাকি, দুটি কাজের মেয়ের ভরসায়। তোমার স্ত্রী–ছেলে-মেয়ে–নাতি-নাতনি?

অভীক জানালেন, “দুই পুত্র। একজন হায়দ্রাবাদ, অন্যজন কানাডায়। যে যার জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত । আমারও একক জীবন, দিনগত পাপক্ষয়। স্ত্রী গত হয়েছেন তিন বছর। আচ্ছা! এখন‌, সমাজ‌ কত সহিষ্ণু, শিথিল! আরেক বার নতুন করে ভাবা  যায় না? একলা পথে চলা আমার করব রমণীয় । হাতখানি ওই বাড়িয়ে আন, দাওগো আমার হাতে, ধরব তারে, ভরব তারে, রাখব তারে সাথে। বাকি জীবনটা একসঙ্গে থাকা যায়? প্রবীণা চমকে উঠলেন,

“না-না, এই বয়সে? অসম্ভব! মরমে মরে যাচ্ছি। হতেই পারে না, ছিঃ ছিঃ ছিঃ! অভীক উচ্ছল হলেন,  “সখি, ক্ষতি কি? হে মাধবী, ভীরু মাধবী, দ্বিধা কেন? আসিবে কি? ফিরিবে কি" প্রবীণা আকুল হলেন,  “পরস্পরের বোঝা হয়ে দাঁড়াব না তো? ভয় পাচ্ছি, লড়াই করার ক্ষমতা নেই যে। অভীক পরম প্রত্যয়র সঙ্গে বললেন,

“আমরা পরস্পরের সহায় ও নির্ভরস্থল হবো। নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন হবেই হবে, যদি পণ করেই থাকিস, সে পণ রবেই রবে। বরং বলি: ‘এস, আমার ঘরে এস’। প্রবীণা ক্ষুণ্ণ‌ হলেন ,

“কিন্ত আমি এখনও পর্যন্ত তোমার নামটা মনে করতে পারিনি। তার কি সমাধান! অপ্রস্তুত অভীক আমতা আমতা করে উঠলেন, “একই কথা আমিও এতক্ষণ তোমাকে বলতে পারছিলাম না। তোমার নামটা আমাকে মনে করিয়ে দেবে? আবেগ-অনুভূতি সবই তো জাজ্বল্যমান! Please তোমার নাম! প্রবীণা বাধা দিলেন, “থাক্। যখন দুজনেই দুজনের নাম ভুলেছি, তখন নতুন পরিচয়। এত বিস্মরণেও কিন্ত আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথকে ভুলিনি। আমি তোমার নাম জিজ্ঞাসা করব না, তুমিও আমার নাম জানতে চেও না” --“বেশ,আমি তোমাকে ডাকবো, ‘মিতা’ বলে। জীবন সায়াহ্নে, লাবণ্য – অমিত এর না হয় মিলন হোক্”, অভীক সোচ্চার হলেন,

“তুমি আমার ‘বন্যা’। এ বাণী প্রেয়সী, হোক্ মহীয়সী। তুমি আছো, আমি আছি।“

ভাঙা 

নীড়

বনানী ভট্টাচার্য 

girl.jpeg
ভাঙা নীড়

গল্প

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বৃষ্টি ভেজা কচি সবুজ পাতাগুলির দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেঘা। কিছুদিন আগেও বিবর্ণ শুকনো পাতায় গাছটা ভরে ছিল। বৈশাখ শেষ, মাঝে মাঝেই ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, মনে হয় কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ফ্ল্যাটের ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়ালে প্রকৃতির রূপ কিছুটা নজরে পড়ে। মেঘাদের ফ্ল্যাটের পাশে একটা পুরনো বাড়ি। বাড়িটার একপাশে ছোট্ট একটা বাগান, সেখানে কিছু গাছগাছালি আছে। তার মধ্যে একটা বড় আম গাছ সবার আগে নজর কাড়ে। কিছুদিন আগেও শুকনো পাতায় ভর্তি ছিল। কিন্তু এখন কচি সবুজ পাতায় ভরে গেছে। প্রকৃতি কতো সহজে তার পুরনো সত্ত্বা থেকে বেড়িয়ে, নিজেকে নতুন রূপে  প্রকাশ করতে পারে, অথচ প্রকৃতির সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ, যাকে ঈশ্বর এতো ক্ষমতা দিয়েছেন, আজও সে ভাগ্যের হাতে অসহায়। সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব পিছুটান ঝেড়ে ফেলে নতুনের খোঁজে সহজে এগিয়ে যেতে পারেনা।
একরাশ স্বপ্ন নিয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মত মেঘাও মনোময়ের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল। ভাল ঘর ভাল বর দেখে মেঘার বাবা মেয়ের জীবন সঙ্গী বেছে নিয়েছিলেন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান মনোময়, ছিল পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। এছাড়াও তাদের নিজস্ব ফার্মেসি ছিল। অনেকটা জায়গা নিয়ে নিজস্ব বাড়ি। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে পাত্র হিসেবে মনোময় মন্দ ছিল না।
বিয়ের পর কয়েকটা মাস স্বাভাবিক নিয়মের মধ্য দিয়েই দাম্পত্য জীবনের গতি বয়ে চলছিল। কিন্তু কোথাও যেন একটা  দূরত্ব থেকে যাচ্ছিল। এ বাড়ির লোকজন কোথাও খুব একটা বেড়াতে যান না। শাশুড়ির সাথে মেঘা দু-একবার আত্মীয়দের বাড়িতে গেছে। পাড়ার লোকজনদেরও খুব একটা আসা যাওয়া ছিল না। মেঘা লক্ষ্য করেছিল শাশুড়ি তাকে কারো সাথে একা মিশতে দিতে চাইতেন না। পাশের বাড়ির একটা মেয়ে, তারই বয়সী হবে, মাঝে মাঝে আসত। কথাবার্তার সময় শাশুড়ি আশেপাশে থাকতেন। 
ধারাবাহিকতার ছন্দে বাঁধা দিনগুলি একটা করে কাটছিল। বিয়ের পর মেঘার মনোময়ের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় নি। মনোময় কোনদিন বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি, মেঘাও নিজে কিছু বলেনি। দুজন একান্তে কিছুদিন থাকলে হয়ত একে অপরকে বোঝার একটা সুযোগ পাওয়া যেতো। যে অদৃশ্য পর্দাটা দুজনের মধ্যে আছে তা হয়ত সরে যেতো। 
বিয়ের পর থেকেই মেঘা দেখছে মনোময় এর ফিরতে অনেক রাত হয়। রাতে শাশুড়িমা শ্বশুরমশাইকে খাইয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতেন। ছেলে ফিরলে বউ ও ছেলের সাথে রাতের খাওয়া খেতেন। তাই খাওয়ার টেবিলে বসেও স্বামীর সঙ্গে বিশেষ কোন কথা হত না মেঘার। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে মনোময়। তারপর অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি। গৃহস্থালীর দায়ভার ছিল শ্বশুরমশায়ের উপর। শাশুড়ি সকাল উঠে পড়তেন। তারপর রান্নাঘরে ছেলের অফিস যাওয়ার প্রস্তুতিতে লেগে পড়তেন। মেঘা ওঁকে সাহায্য করত। বৈচিত্রহীন দিনগুলি কাটছিল এভাবেই।
বিয়ের পর বাপের বাড়ি গিয়ে থাকা হয়নি মেঘার। দু-একবার মনোময় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে মেঘাকে নিয়ে গেছিল, কিন্তু থাকা হয়নি। কয়েকদিন যাবৎই মেঘা ভাবছিল বাপের বাড়ি গিয়ে থাকার আর্জি শাশুড়িকে জানাবে। রাতে খাবার টেবিলে বলেই ফেলল। শাশুড়ি যেন অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হলেন। ছুটির দিন ছিল, মনোময় মেঘাকে পৌঁছে দিয়ে এল। বাবা মার অনেক অনুরোধ সত্বেও রাতে থাকেনি।
বাপের বাড়িতে কয়েকটা দিন মেঘার বেশ অন্যরকম কাটল। একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে এসে একটু বুক ভরে শ্বাস নিতে পেরেছিল। কিছু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হয়েছিল। মাঝে শাশুড়ি একদিন ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছিলেন, কিন্তু মনোময় একবারও খোঁজ নেয়নি।মায়ের চোখে কিছুই এড়ায় না। মেয়ে যে মনমরা হয়ে থাকে তা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। কথায় কথায় জানতে চেয়েছিলেন মনোময় মেঘার খেয়াল রাখে কিনা। মেঘা হ্যাঁ-নার মাঝামাঝি দায়সারা উত্তর দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিল। সবকথা বোধহয় ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে শ্বশুরবাড়িতে সে শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে নির্যাতিতা নয়। কিন্তু একটা মেয়ে এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘর বাঁধে যে এমন একটা জীবনসঙ্গী সে পাবে যে অকৃপণ ভালবাসায় তাকে পরিপূর্ণ করে রাখবে, তাতে কোন সর্ত থাকবে না। যার আকর্ষণ ও টানে নিজেকে উজাড় করে ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন ভেঙ্গে যায়, তখন তা বোধহয় ভাষায় কাউকে বোঝানো যায় না।
জুলাই মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। মাঝে একটু আধটু বৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু গরম কমছে না। ভ্যাপসা গরমে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। মেঘা বারান্দায় গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। তখন সন্ধ্যা নামেনি। সকাল থেকেই আজ আকাশ কখনও মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসছে, আবার একটু পরেই সূর্যদেব মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছেন। যেন মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা চলছে। কোথা থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছিল। ঘামে ভিজে গা শপশপ করছে। মেঘা উঠে বাথরুমে গেল গা ধুতে। গা ধুয়ে, কাচা কাপড় পড়ে খোলা চুলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। 
এখন অনেকটাই স্বস্তি বোধ হচ্ছে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ভাবছিল, ভগবান যেটুকু রূপ তাকে দিয়েছেন তাতে যে কোন পুরুষই আকৃষ্ট হবে। তবে কেন যাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে, সে তাকে ব্রাত্য করে রেখেছে? অজান্তেই যেন দু ফোঁটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল।
বিয়ের পর থেকেই শাশুড়িমা পুজোর ঘরে সন্ধ্যা আরতির ভার মেঘাকে দিয়ে রেখেছেন। মেঘার

ভালই লাগে পুজোর ঘরে কিছুটা সময় কাটাতে। অন্য ভাবনাচিন্তা থেকে মনটা মুক্ত থাকে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম অনেক আগ্রহ নিয়ে মনোময়ের জন্য সান্ধ্য জলখাবার তৈরী করত। আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় থাকত। দুজনে একান্তে কিছুটা সময় কাটানোর স্বপ্ন দেখত। কিন্তু যখন দেখল মনোময় প্রায়ই দেরী করে বাড়ি ফেরে কোনো না কোনো কাজের অজুহাতে, তখন থেকে তার আগ্রহেও ভাঁটা পড়ল।জীবন যে ধারাবাহিকতা নয় আকস্মিকতার মালায় গাঁথা, তা মানুষ বুঝেও বুঝতে চায় না। দুদিন যাবৎ মনোময় অসুস্থ তাই অফিস যেতে পারছে না। রাতে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে ফিরেছিল, তারপর থেকেই জ্বর। মনোময় বাড়িতে থাকায় রাতে খাওয়াদাওয়ার পাটও তাড়াতাড়ি মিটে যায়। রান্নাঘরের কাজকর্ম গুটিয়ে মেঘা ঘরে এসে দেখল মনোময় ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝরাতে হঠাৎ মেঘার ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাকিয়ে দেখল পাশে মনোময় নেই। ভাবল হয়তো বাথরুমে। বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল মেঘা বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দেখল দরজাটা অল্প খোলা, ভেতরে কেউ নেই। ঘরের বাইরে যাবার দরজাটার দিকে চোখ পড়ল, দেখল সেটা লক খোলা। এতো রাতে মনোময় কি করছে? প্রশ্নটা মনের মধ্যে জেগে উঠতেই সন্তর্পণে দরজার বাইরে বেরিয়ে এল। মনোময় মোবাইলে কথা বলছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মেঘা ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অজানা আশঙ্কায় অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল; মনে হচ্ছিল যেন কিছু একটা চেপে আছে বুকের মাঝে। এপাশ ওপাশ করে রাতটা কাটল। বুকের  মধ্যে যেন একটা পাথর চেপে বসে আছে। কোনো কিছুতে মন লাগাতে পারছে না। মেঘার এই অন্যমনস্কতা শাশুড়ির চোখ এড়ায়নি। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে মেঘাকে জিগ্যেস করেছিলেন শরীর ঠিক আছে কিনা। মেঘা দায়সারা একটা জবাব দিয়েছিল। বুকের কষ্টটা যেন মাথায় চেপে বসেছিল। মাথাটায় সর্বক্ষণ একটা যন্ত্রণা অনুভব করছিল। এভাবে বাঁচা যায় না। মেঘা স্থির করল মনোময়ের সাথে খুলে কথা বলা প্রয়োজন।
মনোময় এখন সুস্থ। অসুস্থতার পর থেকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসে। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ঝড়ো হাওয়া বইছিল। রাত বাড়তেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পাট একটু তাড়াতাড়ি শেষ হল। মেঘা ঘরে এসে দেখল মনোময় খাটে আধশোয়া অবস্থায় মোবাইল দেখছে। মেঘা খাটের একপাশে গিয়ে বসল। মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েই মনোময় মেঘাকে জিজ্ঞেস করল,

“কি হল? শোবে না?” মেঘা কথার উত্তর না দিয়ে বলল,

“তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল“। মনোময় মোবাইল রেখে বলল,

“কি বলবে বল”। ডানে বাঁয়ে প্রসঙ্গ না টেনে মেঘা জিজ্ঞেস করল,

“তোমার কি অন্য কোনো সম্পর্ক আছে? আশা করি সত্য বলবে”। কয়েক মুহূর্ত ঘরে নীরবতা। মনোময় জিজ্ঞেস করল, ”তোমার এমনটা কেন মনে হল?” প্রশ্নের উত্তরে মেঘা বলল,

“তা তুমি নিজেকেই জিজ্ঞেস কর”। প্রশ্নটা মেঘা করেছিল ঠিকই তবু মন থেকে সে চাইছিল মনোময় অস্বীকার করুক। কিন্তু বিধিলিপিতে যে অন্য কিছু লেখা ছিল! মেঘা ভাবতে পারে নি মনোময় এত সহজে সবকিছু স্বীকার করে নেবে। মনোময় বলেছিল,

“সত্যিটা তোমার জানা দরকার। আমি অনেকবার তোমাকে সত্যিটা জানানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু বলতে পারি নি। আমার এক অফিস কলিগ কয়েকবছর আগে হঠাৎ এক্সিডেন্টে মারা যায়। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিল। তার বাড়িতে সবসময় যাতায়াত ছিল। সে মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছিল। ধীরে ধীরে তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার পরিবারের লোক সেটা জানত। কিন্তু এই সম্পর্ক তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। একটি সন্তান সহ একজন বিধবাকে পুত্রবধু হিসাবে মেনে নেওয়া পরিবারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কিন্তু আমি দায়িত্ববোধ থেকে সরে আসতে পারি নি। তাই সম্পর্কটা এখনও রয়ে গেছে। তবে তোমার কোনো অসম্মান বা অনাদর এ বাড়িতে হবে না এটুকু বলতে পারি”। 
ঝড় থেমে গেছে। ভোরবেলা মেঘা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সামনের বাগানের আমগাছটা ঝড়ে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। কাল অবধি যে গাছটা মুকুলে ভরে ছিল সেটা আজ বিধ্বস্ত। গাছের তলায় অজস্র মুকুল ছড়িয়ে ছিল। আকাশের কোণে একফালি রোদ উঁকি মারছে। আবার রোদ জলে গাছটা হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াবে। একটা পাখি এডাল-ওডাল উড়ছে। দেখে মনে হয় যেন কিছু খুঁজছে। হয়তো এখানে সে নীড় বেঁধেছিল। কাল রাতের ঝড়ে সে নীড় ভেঙ্গে গেছে। 
ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মেঘা বুক ভরে শ্বাস নিল। বারান্দা থেকে ধীর পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। মনোময় এখনও ঘুমোচ্ছে। মেঘা খাটের পাশে চেয়ারটাতে বসল। বড় ক্লান্ত লাগছিল। নিজের মনকে বোঝাল লোকলজ্জা, সমাজের কটূক্তি উপেক্ষা করে তাকে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। অনেক বাধার সম্মুখীন হয়ত তাকে হতে হবে, কিন্তু জীবন তো অমূল্য, একটা বিধ্বস্ত সম্পর্ককে আঁকড়ে জীবনটা সে নিঃশেষ হতে দেবে না। তাকে নতুন পথ খুঁজে এগিয়ে যেতে হবে। তবে মনোময়কে সে ক্ষমা করবে না। সে যদি মনে করে মেঘা হয় সব কিছু মেনে নিয়ে তার সাথে সংসার করবে, নয়তো স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়ে চলে যাবে তাহলে সে ভুল ভেবেছে। মনোময়ের সংসার ছেড়ে সে যাবে, কিন্তু জীবন থেকে নয়; এক ছাদের তলায় থেকে তার সাথে ঘর না করলেও সম্পর্কের বন্ধন থেকে সে মনোময়কে মুক্তি দেবে না।

ভ্রমণ

লা বোকা,

মারাদোনা, ট্যাঙ্গো

যশ চক্রবর্তী

শিকাগো, ইলিনয়

লা বোকা, মারাদোনা
jash.jpg
jash-1_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

jash-3.jpg
jash-5.jpg
jash-7.jpg

পাড়ার নাম - লা বোকা
শহরের নাম - বুয়েনোস আইরেস
দেশের নাম - আর্জেন্টিনা
যে ভগবানের হাত বিশ্বকাপ এনে দিতে পারে, যে ভগবানের পা প্রতিকূলতার বাধা কাটিয়ে এবং কাটিয়ে ও কাটিয়ে বিপক্ষকে গোল নামক এক মহার্ঘ জিনিসের মালা পরিয়ে গোটা দেশকে উত্তরণ করে দিতে পারে, সেই ভগবানের কর্মভূমি স্পর্শ করা স্বর্গ ছোঁয়ার মতো। অন্তত: আমার কাছে। ভগবান সবাই হয় না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে, দেশ ও দেশের বাইরে, সর্বত্র উনি পূজ্যোতে। উনি ফুটবলের ভগবান। উনি দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা। আমার তোমার তোর আপনার সবার মারাদোনা। 
ঘুম থেকে উঠে, ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়লাম লা বোকার দিকে। আমাদের হোটেল ৯ ডি হুলিও এভিনিউ-এর ওপর, কোনাকুনিভাবে ওবেলিস্কের পাশে। গুগল ম্যাপে দেখলাম হোটেল থেকে গাড়িতে ক্লাব অ্যাথলেটিকো বোকা জুনিয়ার্স পৌঁছতে লাগে ১৪ মিনিট। শুধু ফুটবলের ভগবান দিয়াগো মারাদোনা নয়, হুয়ান রোমান রিকেল্‌মে, মার্টিন পালেরমো, হুগো গাট্টি, অস্কার রাগেড়ি, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ক্রিশ্চিয়ান মেডিনা, ইজেকোয়েল ফার্নান্দেজ, আরও অনেক দিকপাল ফুটবলার বোকা জুনিয়ার্সে খেলে গেছে এবং খেলছে। আমাদের দেশে যেমন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের অনন্ত রেষারেষি, আর্জেন্টিনায় তেমনি বোকা জুনিয়ার্স আর রিভার প্লেটের যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধ। শুধু আর্জেন্টিনা কেনো, লাতিন আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে এই দুই ক্লাবের ডার্বি, তাকে ঘিরে ক্লাব ফ্যানদের আবেগ, উন্মাদনা গোটা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের কাছে গল্পগাঁথার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। 

jash-2.jpg
jash-4.jpg
jash6.jpg

ওয়েনসেসলাও ভিলাফেন থেকে বাঁ দিকে টার্ন নিতেই ডান হাতে নীল হলুদ রঙের ঝকঝকে লা বোম্বোনেরা স্টেডিয়াম। রৌদ্রোজ্জ্বল আর্জেন্টিনায় মনটাও তখন ফুরফুরে হয়ে গেলো। বোকা জুনিয়ার্স ক্লাবের নিজেদের মাঠ। আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল ফুটবল টিমেরও মাঠ। বিগত ৮৪ বছর

ধরে কতো যে ইতিহাস বহন করে নিয়ে চলেছে! ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। কিন্তু এখানে হোলো না। ভগবান না ডাকলে নাকি তীর্থক্ষেত্র দর্শন করা যায় না। মনে হচ্ছে এই তীর্থক্ষেত্রের বুলায়া এখনও আসে নি। অগত্যা সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম লা বোকা পাড়ার আরও অনেক ভেতরে। গোটা অঞ্চলটাই ফুটবলে মোড়া। শুধুই ফুটবলে। প্রত্যেক বাড়ির দেওয়ালে ফুটবল। ফুটবল গ্রাফিতি। ফুটবলই জীবন। হয় মারাদোনা, না হয় মেসি। তবে দেখে মনে হোলো লা বোকাতে মারাদোনা নিয়ে উন্মাদনা তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা বেশি। মারাদোনাকে নিয়ে এরকম উন্মাদনা দেখেছিলাম ইতালিতে নেপলস-এর অলিতে গলিতে। আর হ্যাঁ, লা বোকার অন্যতম আরেক আকর্ষণ - ট্যাঙ্গো ড্যান্স। রঙে রাঙা রঙিন ঝলমলে সব বাড়ি। পাড়ার মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্গো ড্যান্সাররা দাঁড়িয়ে আছে। ফিটফাট। সেজেগুজে। একবার সাধিলেই হইলো। সামান্য পেসোর বিনিময়ে মিলবে ওদের সঙ্গে ছবি তোলার সুবর্ণ সুযোগ। পোজ দিয়ে। কায়দা মেরে। তুমিও হয়ে যাও ট্যাঙ্গো ড্যান্সার। এক ঝলকে। তুলবো তুলবো করেও তোলা আর হোলো না। কারণটা খুবই জোলো। আসলে পকেটে রেস্তো নেই। পেসো ছিলো না। সেটা আর নতুন কী কথা! টাকা, ডলার বা পেসো, কারেন্সি যাই হোক না কেনো, পকেট চিরকাল ফাঁকাই থেকে গেলো। এক লহমায় ট্যাঙ্গো ড্যান্সার হয়ে উঠতে পারলাম না। একদিকে ফুটবলের দুরন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের রণক্ষেত্র, অন্য প্রান্তে রোম্যান্টিকতার জাদুতে ট্যাঙ্গো ড্যান্সের শৈল্পিক বিচ্ছুরণ। এ এক অসাধারণ মিশেলের অপার বিভিন্নতা। এই বৈচিত্র্যই লা বোকা। চোখে দেখা সব জিনিস অক্ষর সাজিয়ে শব্দ তৈরি করে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সাবলীল লেখকরা এ ব্যাপারে পটু। সিদ্ধহস্ত। আরামসে সবকিছু প্রকাশ করতে পারেন। আমার দ্বারা শত চেষ্টাতেও ওসব অসম্ভব। তাই যতোটা পারলাম লা বোকার রাস্তা, দোকান, গলি, বাড়ির ছবি তুলে রাখলাম। রিও দে লা প্লাতা নদীর ধারে টগবগে, প্রাণবন্ত, ফুটবলীয়, শৈল্পিক পাড়া লা বোকা। যেনো অনন্য বৈশিষ্টের রঙিন এক ক্যানভাস। ফিরে এসেও বারে বারে ফিরে যাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, বুলায়া তো আসতে হবে। লা বোম্বোনেরা যে বাকি থেকে গেলো!অগত্যা সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম লা বোকা পাড়ার আরও অনেক ভেতরে। গোটা অঞ্চলটাই ফুটবলে মোড়া। শুধুই ফুটবলে। প্রত্যেক বাড়ির দেওয়ালে ফুটবল। ফুটবল গ্রাফিতি। ফুটবলই জীবন। হয় মারাদোনা, না হয় মেসি। তবে দেখে মনে হলো লা বোকাতে মারাদোনা নিয়ে উন্মাদনা তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা বেশি। মারাদোনাকে নিয়ে এরকম উন্মাদনা দেখেছিলাম ইতালিতে নেপলস-এর অলিতে গলিতে। আর হ্যাঁ, লা বোকার অন্যতম আরেক আকর্ষণ - ট্যাঙ্গো ড্যান্স। রঙে রাঙা রঙিন ঝলমলে সব বাড়ি। পাড়ার মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্গো ড্যান্সাররা দাঁড়িয়ে আছে। ফিটফাট। সেজেগুজে। একবার সাধিলেই হইলো। সামান্য পেসোর বিনিময়ে মিলবে ওদের সঙ্গে ছবি তোলার সুবর্ণ সুযোগ। পোজ দিয়ে। কায়দা মেরে। তুমিও হয়ে যাও ট্যাঙ্গো ড্যান্সার। এক ঝলকে। তুলবো তুলবো করেও তোলা আর হোলো না। কারণটা খুবই জোলো। আসলে পকেটে রেস্তো নেই। পেসো ছিলো না। সেটা আর নতুন কী কথা! টাকা, ডলার বা পেসো, কারেন্সি যাই হোক না কেনো, পকেট চিরকাল ফাঁকাই থেকে গেলো। এক লহমায় ট্যাঙ্গো ড্যান্সার হয়ে উঠতে পারলাম না। একদিকে ফুটবলের দুরন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের রণক্ষেত্র, অন্য প্রান্তে রোম্যান্টিকতার জাদুতে ট্যাঙ্গো ড্যান্সের শৈল্পিক বিচ্ছুরণ। এ এক অসাধারণ মিশেলের অপার বিভিন্নতা। এই বৈচিত্র্যই লা বোকা।চোখে দেখা সব জিনিস অক্ষর সাজিয়ে শব্দ তৈরি করে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সাবলীল লেখকরা এ ব্যাপারে পটু। সিদ্ধহস্ত। আরামসে সবকিছু প্রকাশ করতে পারেন। আমার দ্বারা শত চেষ্টাতেও ওসব অসম্ভব। তাই যতোটা পারলাম লা বোকার রাস্তা, দোকান, গলি, বাড়ির ছবি তুলে রাখলাম। রিও দে লা প্লাতা নদীর ধারে টগবগে, প্রাণবন্ত, ফুটবলীয়, শৈল্পিক পাড়া লা বোকা। যেনো অনন্য বৈশিষ্টের রঙিন এক ক্যানভাস। ফিরে এসেও বারে বারে ফিরে যাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, বুলায়া তো আসতে হবে। লা বোম্বোনেরা যে বাকি থেকে গেলো!

বড়গল্প

মৃনাল ও একটি

মৃণাল ও একটি অনবহিত

সিনে সংবাদ

শাশ্বত বোস 

শ্রীরামপুর, হুগলী, পঃ বঙ্গ

mrinal1.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Saswata_Bose.jpg

লেখক পরিচিতিঃ

লেখকের জন্ম ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে। হুগলী জেলারই রিষড়া শহরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে স্টার মার্কস নিয়ে যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন। বহু স্বনামধন্য লেখক-লেখিকাদের সাথে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার শারদসংখ্যায় লেখালিখি করতেন।

পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষা ও কেরিয়ারের জন্য সাময়িকভাবে সাহিত্যচর্চার জগৎ থেকে বিরতি নিয়েছিলেন।২০১১ সালে ইলেকট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হবার পর একজন সফল আউটডোর ব্রডকাস্টিং ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে একটি খ্যাতনামা বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলে যোগ দেন ও পরবর্তীতে তিনি ইন্ডিয়ান নেভি ডেপুটেশনেও কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি একটি নামি বহুজাতিক সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত। বর্তমানে তিনি পুনরায় সাহিত্যর্চচার জগতে প্রবেশ করেছেন। তার বিভিন্ন লেখালিখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচনা “অনন্ত বিকেলের রূপকথারা”, “বৈশালী_পাড়ার_প্রতিমা রা”, “অতঃপর অশুচি বনেদিয়ানা, পুজোর বনসাই এবং .....”, "কান্না রাগের 'হোমা পাখি", “ডরাইয়া মরে”, “রূপান্তরের পথে”, “প্রবাসের বিভীষিকা”, “বইমেলা ও একটি গোলাপ”, “পুরোনো মর্গটার কাছে” এবং “পিশাচসিদ্ধ”, যা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত এবং ইতিমধ্যেই ইউ টিউবে অডিও স্টোরি হিসেবে সাড়া ফেলে দিয়েছে।এছাড়া ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য “পরবাসী টুসুর দেশে”।

তার লিখিত কবিতাগুলির মধ্যে “একটি ব্যর্থ প্রেমের ক্ষুব্ধ আখ্যান”, “উদ্বর্তিনী”, “প্রাণের পুজো”, “কালো মেয়ের উপাখ্যান”, “বাংলা ভাষার দেশ”, “অন্য বসন্ত”, “ভালোবাসা ও একটি বসন্ত”, “মন-শরীরী”, “হে নজরুল”, “সমর শেষের অসিয়ৎনামা” উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয়।

Mrinal13.jpg

খুব ভোরের জেদী একগুয়েঁ ধোঁয়া আর ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্স পুঁটুলি থেকে ভেসে আসা ভ্যাপসা গন্ধের মিশেলে, ভিজে যাওয়া সংস্কৃতিশূন্য সকালটার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। গরম ভাতের ফ্যান, ডাস্টবিনে ফুলে ওঠা মাছ কিংবা সারা রাত জেগে বাজারটার এক কোনায় পরে থাকা মুটে মজুরের গায়ের তেঁতো ঘামের গন্ধ, সব কিছু মিলে মিশে গিয়ে একটানা পচা একটা গন্ধ তৈরী হয় এই সকালটার গায়ে। মশলা বাজারটা খুলতে এখনো দেরী আছে, এখন শুধু মাছের বাজারটা ঘিরে শব্দের আনাগোনা। ভারী বরফের চাঁই মাটিতে আছড়ে ভাঙার শব্দ, মুটে মজুরদের লরি থেকে মাছ খালাস করার সময় দেহাতী হিন্দি আর বাংলা মেশানো খিস্তির বলিষ্ঠ বিস্ফোরণ, সস্তার ঠেলাঠেলি আর মাছ বাজারে দর হাঁকাহাঁকির শব্দ। হারানিধির এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে| এই শব্দটা তার কানের কাছে শ্লেষ্মা মিশ্রিত ঘড়ঘড়ে গলায় বাজে ঘন্টির মতন। একটানা বেজে চোখের বাসি ঘুমটাকে তাড়িয়ে দেয়, অ্যালার্ম ঘড়ির আর দরকার পরে না। এখন তার তক্তপোষ ছেড়ে উঠে গিয়ে লবির গায়ে ঝুলন্ত বাল্বটা নেভানোর কথা| তারপর আস্তে আস্তে হারানকে তুলে পায়খানা বাথরুম সেরে বাজারের পথ ধরতে হবে। বাজারের মধ্যেই হোটেলটা, "বেঙ্গল লজ"। একইসাথে লজ ও ভাতের হোটেল। অবশ্য হারানিধি যখন প্রথম এখানে কাজে লেগেছিল, তখন এটা শুধু ভাতের হোটেলই ছিল। এই হোটেলটার মালিক ‘শশধর গুপ্ত’, এই এলাকার ‘গুপ্ত দা’, হারানিধির হাতের ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি, হালকা হিং ফোড়ন দিয়ে, সাথে সর্ষে দিয়ে বেগুনের ঝাল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে বলেছিলেন, "কাঠ বাঙাল হয়ে ঘটি বাড়ির রান্না কি করে শিখলে হে?" বাজারের মাঝখানে সদ্য খোলা ভাতের ঝুপড়িটার খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হারানিধি উত্তর দিয়েছিল, "আজ্ঞে কত্তা, মায়ের কাছে। ছেলেবেলায় বাবা মারা গেছেন, আমরা তিন ভাই বোন, মা এদিক ওদিক করে যা পেত, রেঁধে বেড়ে খাওয়াত। মায়ের হাতের রান্না ছিল অমৃত, ছোলা দিয়ে মোচার ঘন্ট রাঁধত ঘটি বাড়িকে হার মানিয়ে দেবে।" আশেপাশে গাছের পাতার চাপে পৃথিবীটার সব ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা সময়ে শশধর তাঁকে প্রস্তাব দেয়, "আমার দোকানে কাজ করবে? উড়ে বাউনটা সেই যে দেশে গেছে আর ফেরার নাম নেই। আপাতত মাস গেলে ৩০০ টাকায় ঢোক, থাকা খাওয়া সব আমার ওখানেই, পরে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেওয়া যাবে।" সেই থেকে হারানিধি, গুপ্তদার হোটেলে নোঙ্গর ফেলল। এই এতো বছরে শিয়ালদা ব্রিজের উপর দিয়ে চলা, টিং টিং ঘন্টির ট্রামগাড়িটা চলে গেছে কয়েক লক্ষ বার। ট্রামের ভেতর বসে থাকা মুখটা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারটাকে দেখেছে কয়েক অর্বুদ মাইক্রো সেকেন্ড ধরে, ধুলোকাদা জড়ানো একটা হাওয়াকে বুকে আঁকড়ে। রামনিধি আজ রাঁধুনি থেকে হোটেলের কত্তা হয়েছে। কয়লার উনুনের গনগনে আঁচ, ছাঁকা তেলে কড়া করে ভাজা মাছ, পুইশাঁকের চচ্চড়িতে মেশানো পাঁচফোড়ন এসব ছেড়ে হারানিধি এখন খাবার সময় খদ্দেরদের দেখভাল করে। কার কি অসুবিধা, কে কি নেবেন? কার ভাত লাগবে? কার ডাল তরকারি? কে কি মাছ নেবেন, কোন টেবিলে কত হল। গুপ্তদা বাজারটা ও ছাড়া কারুর হাতে ছাড়েন না। নেহাত পড়াশোনাটা বেশীদুর শেখেনি হারানিধি, নাহলে হয়তো হিসেবের খাতাটাও ওই দেখত। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের রানাঘাট স্টেশনের বাইরে একটা মাটির দেওয়ালের বাড়িতে, খড়ের চালায় ভাতের হোটেল খুলে বসা বছর তেইশের তরতাজা

mrinal3.jpg
mrinal2.jpg

যুবক হারানিধি, কলকাতায় এসেছিল কলোনীর বিশুদার হাত ধরে। বাজারের মাঝের জামগাছটা তখন সদ্য মাথা তুলছে। ওই গাছটাই একদিন আবছা আলো-আঁধারিতে ভেবে নিয়েছিল ভবিষ্যতে সে বনবিথীকা হবে। আজ এলাকার ছেলেপুলেরা ঢিল ছুড়ে গাছটা থেকে জাম পারে, ওর শরীর জুড়ে চামড়ায় ফাট দেখা দেয়, মুছে যায় স্মৃতির জন্মদাগ। গাছটা জুড়ে কয়েকশত কাক যত্নশীল সংশয়হীনতায়, ঘিঞ্জি বাসা বেঁধেছে নির্লজ্জ বংশবিস্তারের আশায়। রোজ বিকেলে নিয়ম করে হারানিধি ওদের মুখে ছুড়ে দেয় এঁটো ডেচকির গায়ে লেগে থাকা পীতাম্বরী ভাতের দলা। কাকগুলোর মাঝে বুক চিতিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় একটা শঙ্খচিল, ঐটাই হারানিধির বাপ।বাকিগুলো হয়তো ওরই পূর্বপুরুষ সব, জন্মান্তরে অনস্তিত্ত্বের সাজা কাটছে। বাজারের মাঝখানের পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দেওয়ালে, বাড়তি চৌকাঠে আছড়ে পরে ফেটে যাওয়া রোদটার গায়ে কান পাতলে বুঝতে পারা যায় রানাঘাটের রেফিউজি কলোনীর ‘হারানিধি দাস’ এখন বেঙ্গল লজের ভরকেন্দ্র। তাকে ঘিরে হোটেলটা ফিরে পেয়েছে এক নিশ্চিন্ত যোগনিদ্রা, বিরামহীন আগডুম বাগডুম এর মাঝেও তার নড়েটি যাবার উপায় নেই। তিনশ টাকার মাসিক বেতন এখন প্রায় ছয় হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। গুপ্তদা ওর ছেলের পড়ার খরচ দেন। সেরকম কোন অভাব অভিযোগ রাখেননি এককথায়। নিন্দুকেরা কিন্তু বলে হারানিধি ‘শসাবাবুর গুপ্ত কথা’ জানে। তাই বেঙ্গল লজে তার এত খাতির। হারানিধিকে গুপ্তবাবু নিধি বলেই ডাকেন। তাই গল্পের পরবর্তী সময়ে আমরাও সেই নামটিই ব্যবহার করবো।

ঘুম থেকে উঠে পরে হারানিধি। জৈষ্ঠ্যের ঝকঝকে ভোর আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য্যের তাপ গনগনে হয়ে পোড়াবে তাবৎ ব্রম্ভান্ডকে। গরমের দিনে বাজারটাও জেগে যায় একটু তাড়াতাড়ি। তোলা ঝি টা আসে, এঁটো বাসন মাজে। বাসনের ডাঁই দেখলে রাগে গজগজ করে। নিধি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে তলায় নেমে আসে। হারানটা রান্নাঘরের মাটিতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে, রাস্তার নেড়িটার মত মুখ গুঁজে। নিধি গিয়ে তার গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিয়ে আলতো করে নাড়া দেয়।
“ওঠ বাবা হারান। উঠে পর বাবা। ভোর হয়ে গেছে। চট করে ঘরদোরগুলো ঝাড়পোঁছ করে দে দিকিনি। ওই দেখ, ঝি টা উঠোনটা ঝ্যাটাচ্ছে। তোকে কতদিন বলেছি ওটার পিছু পিছু থাকতে। ও বেটির হাতটান স্বভাব আছে। ওটাকে এবারে তাড়াতে হবে কত্তাকে বলে।" 
নিদ্রাবিলাসী ভোরের প্রপঞ্চময় বিরক্তি নিয়ে একটা চোখ কোনমতে খুলে হারান বলে, "তুমি আর ঘ্যাঁচাঘ্যেচি করোনি বাপু, ও মাগীকে ছাড়ায়ে দিলে ওর কাজ গুলো কে কইরবে শুনি? এই বাজারে তুমি হোটেলি কাইজ করার ঝি পাইবে? সেই তো মুর ঘাইরে এসে পুইরবে। এক পয়সা মাইনে বাড়াইবেনি ওই কিপ্টা ঢ্যামনা বুড়া!! যেতিছে যেতিছে বুড়ার যেতিছে তুমার কি খুড়া?"
কথাটা শুনে নিধি চুপ করে যায়, গুপ্তবাবুর নিন্দা শুনে সে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, কিন্তু হারানের কথাগুলোর উপর কিছু বলতে পারেনা। বেশ কিছু বছর আগে এই বৈঠকখানা বাজারে আধপাগলের মত ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরছিল ছেলেটা। নিধি তখন সবে হোটেলের দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে, সামনের সরু রাস্তাটায় একটা ঝরঝরে টুল পেতে বসেছে। এমন সময় ছেলেটা এসে খেতে চেয়েছিল। হেঁশেলে উনুনের আঁচ নিভে গেছে ততক্ষণে। এঁটো বাসনগুলো পাহাড় হয়ে পরেছিল এক কোণে। কদাকার ডেচকির তলা হাতড়ে কিছু আধপোড়া ভাত পাওয়া গেছিল, সাথে সেই ছোলা দিয়ে কুমড়োর সব্জী, ঠাকুরটা হয়তো তুলে রেখেছিল রাতের জন্য। শীতের ধুলো আর রোদ মাখা মায়াবী আলোয় ছেলেটার মেঘের মত মুখে, সেটুকু তুলে দিয়েছিল নিধি। হাপুস হুপুস বুভুক্ষুতায় থালাটা শেষ করে রাস্তার এক কোনে ছেঁড়া চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরেছিল ছেলেটা। রাতের খাবারটা আলাদা করে সরিয়ে রেখে যখন ওর মুখের কাছে ধরতে গেল নিধি, ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, "না মাগনা খাবুনি, আমায় কাজ দাও"। এর আগে দেশ থেকে ওর বয়সী একটা ছেলে ধরে নিয়ে এসেছিল নিধি। ব্যাটা মহা পেছন পাকা আর ওস্তাদ গোছের ছিল। কিছুদিন পর থেকেই কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করলো। কিছু করতে বললেই হাজার বায়নাক্কা| একদিন তো নিধির মুখের ওপর ছোটবড় কথা বলে, পয়সা কড়ি বুঝে নিয়ে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। নিধি পরে শুনেছিল ব্যাটা এই বাজারেই একটা মশলার দোকানে কাজ নিয়েছে। আসা যাওয়ার পথে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখত নিধিকে। এই ছেলেটাকে দেখে বেশ মায়া হয়েছিল নিধির। গুপ্তদা কে বলে ওকে রেখে দিয়েছিল, সেই থেকে হারান এই হোটেলেই আছে।

মুখহাত ধুয়ে, চান করে, গুরুর দেওয়া কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করে নিধি। সারা হোটেল, লজে গঙ্গার জল ছেটায়। কর্পূর আর ধুনোর গন্ধে ভুরুভূর করে লজের বাতাস। এই লজে গুপ্তবাবু যাকে তাঁকে ঘর দেননা। পরশু দিনই একটা ছেলে মেয়ে এসে ঘর চাইছিল, বলে কিনা ভাইবোন! বোন কে পাশের কলেজে এডমিশন করাতে নিয়ে এসেছে! নিধির দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। বন্ধ ম্যানহোলের ঢাকনা সরালে যেরকম গুমোট অন্ধকার, সেরকম অন্ধকার পেরিয়ে নিধি হেঁটে এসেছে অনেকটা দিনকাল। এখানকার অন্যান্য লজে কি হয়, নিধি খুব ভালোভাবেই জানে। আর বেঙ্গল লজ বাজারের অনেকখানি ভেতরে হওয়াতে, এসব তো এখানে সুবিধে! গুপ্তদা কে ও চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল ব্যাপারখানা। গুপ্তদাও তো কম দিন হোটেল চালাচ্ছেন না এখানে! শেষমেশ গুপ্তদা ওদেরকে বলে দিলেন, "না বাপু, এখানে ঘর খালি নেইকো, তোমরা আশেপাশে দেখো"। 

রেডিওতে এখন নীতিকথা বাজে। বাজারের মুখটা থেকে একটা চলতি হাওয়া, আঁশটে গন্ধ গায়ে করে নিয়ে এসে নিধিকে মনে করায়, এবার মাছ কিনতে বেরুতে হবে। এই বেলা গফুরের কাছে গেলে তাজা মাছ পাওয়া যাবে, কাতলা-রুই-পার্শে-পমফ্রেট, লাল কানকো, চকচকে গা। বেঙ্গল লজের ভাতের হোটেলে কিন্তু অন্য পাইস হোটেলের মত রোজ ২৪ রকমের মাছ পাওয়া যায় না।নিধি বাজারের ভেতর গিয়ে পকেটের রেস্ত বুঝে, ভালো মাছ বুঝে, যা নিয়ে আসে রোজ তাই রান্না হয় হেঁশেলে। বাজার চলতি মানুষজন, কলেজ পড়ুয়া, বাজারের মুটে, কাঠের দোকানে আসা বোটকা লুঙ্গির ‘পালিশের লোক’, পুরু চামড়া, গোত্রহীন চৈত্রমাস কিংবা সলজ্জ আষাঢ়, সবাই জলহীন মেঘরোদহীন দুপুরে খিদের মুখে দুটো ভাত খেতে আসে, সাথে হয়ত মুরগীর মাংসের লাল ঝোল, ইচ্ছেমতন চেয়ে নেয় বুক, পাঁজরা কিংবা লেগপিস কিংবা হয়তো কড়া করে ভাজা পোনা মাছ সর্ষে দিয়ে, কখনও বা শুধুই মাছভাজা, ডাল, ঝুরঝুরে আলু ভাজা সাথে চাটনী, পাঁপড়।অবৈতনিক অবিনশ্বর খিদে আর দু মুঠো ভাতের কোন জাত বা কর্ম-বর্ণ-গন্ধ বিচার নেই এই হোটেলে। 

বাজারের ভেতর তিনশ বছর পুরোনো কোনো কার্নিশে ওঁৎ পেতে বসে থাকা কাকটা নেমে আসে।চোখ বোজার কৌশলে সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় মাছের কাঁটাটা, পোষা মেনিটার মুখের থেকে। এখানে অন্য হোটেলের মত বিরিয়ানী বা চিকেন চাপ, টমেটো সস দিয়ে সাঁতলানো চিকেন কষা হয় না। তবে নিয়ম করে পয়লা বৈশাখে রেয়াজী খাসির মাংস হয়, নিধি নিজে হাতে রাঁধে। যে মাংসটা ও ওর মায়ের কাছে শিখেছিল। সাথে হাওয়ায় কচ্ছপের গতিতে ধুলো কালি এসে, খরচ-না-হওয়া জীবনটার ধর আর মুণ্ডুর মাঝখান দিয়ে ফস করে উড়ে গেছিল। ওর মা হয়তো সেই রান্নাটাই শিখেছিল খুলনার কোনো এক বিরামহীন ফুরিয়ে যাওয়া নদীর গা ঘেঁষে। এই রান্না শেখার গল্পটাই নিধি করে গেছে বারবার। হয়তো সেই সুদীর্ঘ্য ও একঘেঁয়ে বাক্যরাজির আড়ালে প্রতিবার একটা প্রায় অলৌকিক আন্তরিকতা মিশে থাকে। কিন্তু সেই একই সময়ে ওকে দেখলে মনে হয় যেন, মুহূর্তটায় ও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত, নিঃসঙ্গ ও নিঃস্ব। নির্গুণ, নির্ঘুম একটা মুখ হয়ে আশে পাশের অপরিচিত বিবর্তনকে সাক্ষী করে, উনুন ধরিয়ে কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করতে করতে, এক মুঠো চিনি ছড়িয়ে দেয় উনুনের ভেতর। 

সকালের টিফিনটায় উড়ে ঠাকুরের সাথে হারানও হাত লাগায়। কচুরী, লাল আলুর তরকারি সাথে কড়া করে চা। এই টিফিনটা মূলত কলেজের মর্নিং শিফটের ছেলেমেয়ে কিংবা সেইসব ভেন্ডরদের জন্য, যারা মাল বয়ে এনে বাজারে ঢুকেছে গত কাল রাতে। সকাল এগারোটা নাগাদ ভাত চাপে। হারান হোটেলের বাইরেটায় একটা ভিজে ফেঁসে যাওয়া গামছা পরে, থেবড়ে বসে আলুর খোসা ছাড়ায়। উড়িয়া ঠাকুর উনুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিশাল কড়া চাপায়। উনুনের গনগনে আঁচে, কলকলে ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক। কিছুক্ষণ পর থেকে সেই বাতাসে পুইঁ শাক কষার সুবাস এসে মেশে। গরম তেলে পিয়াঁজ ফোড়ন সাথে গোটা ধনে, লঙ্কা ছাড়ার গন্ধ।

পৌষের কোন হিম ধরা রাতে কুয়াশার সর সরিয়ে, মৃত্যু এসে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছিল, কোন পা টা আগে ফেলেছিল, এখন আর মনে পরে না নিধির। শুধু মনে আছে তখন ওর বারো বছর বয়স, বয়ঃসন্ধির সবে শুরু। ওদের রানাঘাটের ক্যাম্পের টিনের দেওয়ালের গা ঘেঁষে উনুনের ধোঁয়ায় নির্দোষ বিষ শরীরে নিয়ে ওর মা রান্না করছে, পিছনে দুটো বিড়াল বসে লেজ নাড়ছে, পাশের ক্যাম্পে খালি গলায় গলা সাধছে খুকিদি, লাল শাকের রংটা কমলা দেখাচ্ছে কুয়াশা কেটে গিয়ে। এখনও কয়েকটা দিন মায়ের হাতের স্পেশাল পোনা মাছের ঝোলটা রাঁধে নিধি। কড়াইতে অল্প সর্ষের তেল দিয়ে মাছগুলোকে ভেজে নিয়ে, সেই তেলেই পিয়াজ-রসুন-টমেটো-আদাবাটা দিয়ে সমানে কষতে থাকে। খুন্তি নাড়ার সাথে সাথে, ঝুল কালির মাথা থেকে চুন সুরকি খসে পরে।কয়লার ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে থাকে নিধির। রানাঘাটের বাড়ির কাঁঠালিচাঁপা গাছটা ঢলঢলে চাঁদের পাটালি গায়ে মেখে, মৃত্যুমুখী অন্ধকারকে পিছনে ফেলে ফ্যাটফ্যাটে একটা ফণা তুলে এসে দাঁড়ায় নিধির সামনে।

দুপুরের খাওয়া পর্ব মিটতে মিটতে বিকেল চারটে। এর ফাঁকে গুপ্তবাবু ফিরে যান নিজের আর্মহার্স্ট স্ট্রিট এর বাড়িতে। হারান, ঠাকুর আর বাকি ছেলেপুলে এসময়টা একটু গড়িয়ে নেয়। নিধি কিন্তু দুপুরে ঘুমায় না। দুপুরবেলাটায় বাজারটার অন্য রূপ। লোকজনের আনাগোনা কমে আসে অনেক।মশলার দোকান গুলো থেকে ঠিক দুপুর দুটো বেজে সতেরো মিনিটে অচেনা একটা গন্ধ ভেসে এসে, নিধির নাক চোখ মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে সজোরে টোকা মারে। একটা চাবুক মারা বাজারী হই হল্লা বাজারের মাঝখানের পেচ্ছাপখানার গন্ধটাকে চাপা দিতে চায়, উল্টে তাতে গুড় বাজারের তাল পাটালির চাক ভেঙে আজ্ঞাবাহী ধরণের একটা অতি আলো বা অতি শব্দের মাঝে ফ্যাকাসে হয়ে যায় চড়াই পাখিটার ঘুম। এই সমস্যা কাকেরও এই সমস্যা হোটেলের কড়ি-বরগায় বাসা বাঁধা পায়রারও। গন্ধটা নিধিকে টেনে নিয়ে যায় বাজারের উত্তর দিকে। সেখানে দোকান জুড়ে ডাঁই করে রাখা শুকনো লঙ্কা, খেজুর, কাজু কিসমিস, বাতাসার স্তুপ। শব্দহীন, ক্লান্তিহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো কত মানুষ আছড়ে পরে, আবার উঠে দাঁড়ায় এই দিকে। শুঁটকির একটা পচনশীল টক গন্ধ সারা গায়ে মেখে নাক খুঁটতে খুঁটতে হেটে চলে একটি শিক্ষিত ধোপ দুরস্ত উন্মাদ। আকাশের নীল রংটা গড়িয়ে পরে তার পায়ের কাছে। জিতে যাওয়া-হেরে যাওয়া জীবনটার হিসেব কষতে কষতে আপন মনে বলে চলে, "পচে যাবে, সব একদিন পচে ফুলে যাবে। ব্যাকটেরিয়াগুলো এই দোকানটা থেকে ছড়িয়ে গিয়ে, পচা শরীরগুলো খুবলে খুবলে খাবে।" উত্তরদিকের কোনো আবর্জনা স্তুপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিধির চোখদুটো বুজে আসে। এক অদৃশ্য প্রেতাত্মা এসে যেন ভড় করে তার উপর| নিধি ছাপাখানাটার পাশ দিয়ে গলির পথ ধরে, তারপর একসময় বড় রাস্তাটা পার করে এসে ‘সার্পেনটাইন লেন’ বরাবর খুঁজতে থাকে তার ছোটবেলার ভাতঘুমটা। সেটা বুঝি তখন ডুব দিয়েছে দুপাশের উঁচু উঁচু পুরোনো দিনের কলোনিয়াল বাড়িগুলোর মাঝের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা এক চিলতে আকাশের শূন্যতায়, নিশ্চিত ক্ষুধার সাথে প্যাঁচ কষতে গিয়ে ভোকাট্টা হয়ে পরে আছে পাশের ‘হুজুরীমল লেনে’। সেটাকে অক্সি অ্যাসিটিলিনের শিখায় গলিয়ে গয়না বানিয়ে ফেলছে সাতপুরোনো কোনো স্যাঁকড়ার দল।

​​জগৎ সিনেমায় বেশ কিছুদিন হলো শো বন্ধ যাচ্ছে। হল মালিকের সাথে স্টাফেদের আকচাআকচি চলছে কিছু নিয়ে। নিধি আজ দেখলো হলের বাইরের দেওয়ালে বিশাল বড় একটা হোর্ডিং ঝোলাচ্ছে একদল লোক। নিজেদের ভেতর খিস্তি খামারি করছে, রিকশাওয়ালা, বাসের কন্ডাকটর, বাজারের মেছুড়ে, বিহারী মুটেদের মুখের খিস্তি। নিধি দেখেছে অতি পরিচিত এই বাজারটার শরীর জুড়ে জটিলতর সমীকরণের এই যে জাল বোনে কত শত দুপুর-বিকেলহীন মানব তরঙ্গ, তাদের মুখের নিতান্ত বর্জিত অপশব্দই বলে দিতে পারে তাদের আবাস, জনপদ কিংবা কতটা ইতর অনুষঙ্গে এই দৈনিক উৎসবমুখরতার মানচিত্রে তাদের আগমন। এই চত্ত্বরে কেউ হয়তো মশলা নিয়ে এসেছে, কেউবা ত্রিপল পট্টি থেকে মাল নিয়ে গিয়ে লোকালে ব্যবসা করবে, কেউ বা এসেছে একুয়ারিয়ামের মাছ বা পাথর নিতে, আবার দু পয়সা লাভের আশায় কেউ ক্যানিং লাইন থেকে ঝুড়ি করে ফল নিয়ে এসে বসে পরেছে বাজারের বাইরেটায়। চিহ্নহারা কর্মব্যস্ত শিয়ালদহ, বাস-ট্রাম, ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্টের সাউন্ডস্কেপের সাথে লোকগুলোর থেকে ভেসে আসা শব্দের টাকডুমাডুমের মাঝে পরে, এক জটিল বর্গক্ষেত্রের কোণ বরাবর বাহকহীন পালকিতে বসে দোল খেতে থাকে নিধি। "হালায় লুঙ্গী তুইলা তর পোদ মারে নাই?", কথাটায় সম্বিৎ ফেরে নিধির। শব্দের অনুপ্রাণনে উপর দিকে তাকিয়ে দেখে, বাঁশের ভাড়ার মাথা থেকে একটা ছেলে, খৈনি-গুটখা খাওয়া কালো দাঁত বের করে হাসছে আর তলায় ওর বয়সী আরেকটা ছেলেকে কি যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে।আশেপাশের জিজীবিষু জগৎটার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এরা। বিশাল পোস্টারটার দিকে হিম হিম চোখে চেয়ে থাকে নিধি। এটা কোনো সিনেমার পোস্টার নয়। বাংলা যেটুকু পড়তে পারে তাই দিয়ে লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে। পোস্টারটার এক পাশে একটা কাঁচাপাকা চুলের লোককে দেখে চেনা চেনা ঠেকে ওর। পোস্টারটার ডান পাশে কিসের যেন একটা লিস্ট, তাতে কিছু নাম। এর মধ্যে কয়েকটা নাম আগে শুনেছে নিধি। এগুলো সিনেমার নাম, ‘খারিজ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’।ছেলেটার মুখে যেন খিস্তির ফোয়ারা। এটাই যেন ওর কাছে এখন জলভাতের মতন। শব্দগুলো বড্ডো কানে বাজতে থাকে নিধির। তলায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিধি এবার জিজ্ঞেস করে, "ও ভাই শুনছ? এদিকে শুন।"

নিধিকে দেখে ছেলেটা মুখের হাসি থামিয়ে এগিয়ে আসে, "বলেন!" "এইডা কি ব্যাপার কইতে পারো?" ছেলেটার চোখে মুখে একটা অকিঞ্চিৎকর বিরক্তি খেলে যায়, "দূর বাল, এইসব হইলো

mrinal4.jpg
mrinal8.jpg

বড়োলোকগুলার ধ্যাশডামো, ওই দাদুর বুইঝলেন শত বৎসর পূর্ণ হইলো। হালায় সেঞ্চুরি মারসে| ফিলিম বানাইতো, তাকে লইয়া নাচন কোঁদন হইবো। বুইড়া ফিলিম বানাইয়া কি ছিড়সে কেডা জানে! আমাগো কনো কামে আইসে বুড়া? কইতে পারেন?" 
নিধির চোখে একটা ভুতুড়ে স্বপ্নের ঝিম ধরা ঘোর লেগে আসে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে নামটা পরে নিধি, ‘মৃণাল সেন’। নিধির চোখের সামনে কালো জানালাটার ওপার থেকে একটা মুখ ভেসে ওঠে, ধরহীন একটা মুখ। হালকা ফুঁ দিলে উপর থেকে ধুলোবালি সরে গিয়ে মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাঙামাইমার মুখ, পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যাবাদীকে একপাশে রেখে কোনো এক অন্ধকার বিকেলে তিনি নিধিকে ডাক দিচ্ছেন, "নিধু, অ নিধু, টিভিতে সিনেমা দেখাইতেসে, দেখবা না? তর লগে মুড়ি ভাইজ্যা রাখসি, আইস চাঁদ আমার।" মা মারা যাবার পর নিধি ছোট ভাই বোনদের নিয়ে কল্যাণী সীমান্তের মামাবাড়ি গিয়ে উঠেছিল। মামা ওদের খুব একটা দেখতে পারতেন না। অথচ নিঃসন্তান রাঙা মাইমা বুক দিয়ে আগলাতেন, খালি বলতেন “নিধু মোর প্যাটের ছাওয়াল আছিল গত জনমে। জনম জনম ফিরিয়া আইস চাঁদ এই অভাগীর কোলে।" 
চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসে নিধির। পাতলা মধুর মত টলটলে বিকেলগুলোয় কানা ভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের চায়ের কাপের উপর দিয়ে পিঁপড়েটা এদিক হয়ে ওদিকে চলে যেত। পাশের কারশেড থেকে একটা মালগাড়ি চলে যেত, অনেক্ষন ধরে দীর্ঘ্য একঘেঁয়ে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে। ঐ শব্দটার পর রোদের তাঁত পরে গেলে ফিরে আসতো অনিবার্য্য রোববারের বিকেলগুলো, মস্ত একটা সোনার ডিমের ভেতর দিয়ে। টিভির পর্দা জুড়ে তখন কেবল ধোঁয়া। উনুনের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, উঠতি ছেলের মুখের সিগারেটের ধোঁয়া, শ্মশানের চিতার ধোঁয়া। সেই দুকূল ছাপানো ধোঁয়ার মাঝে পুরোনো লেপ কম্বলের উপর সাবানগুঁড়োর মত ধামসে পরে থাকে নিধির অন্ধকার কৈশোর। কুয়াশা খিমচে হঠাৎ সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে উঁকি দেয় ওদের কলোনীর গদাই দা, অল্প বয়সে যে নকশাল হয়ে গেছিল| ওকে খুঁজতে একদিন পুলিশ এলো, কলোনীটা ঘিরে ফেললো চতুর্দিক দিয়ে। প্রচন্ড জোরে একটা শব্দ, জংধরা একটা স্লোগান, আবার শব্দ। ব্যাস, প্যালিওলিথিক যুগ থেকে একটা সংবেদনশীল আলো গড়িয়ে পরে নিধির চোখদুটো সাদা হয়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের ভিতর কালীমন্দিরটায় ফলাহারিণী উৎসব। সন্ধ্যে থেকেই শ্যামাসংগীত বাজছে। এবেলা তাই হোটেলও বন্ধ। হারান ব্যাটা কোথায় বসে গ্যাঁজা টানছে। নিধি মন্দিরে একটা প্রণাম ঠুকে জগৎ সিনেমার দিকে হাঁটতে শুরু করলো। দোকান পাট একটু একটু করে বন্ধ হতে শুরু করেছে সবে। সিনেমাহলের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিধি সোজা জিজ্ঞেস করলো, “ইভনিং শো এর একটা টিকেট হবে?”
”আরে টিকিট লাগবে না, এটা সরকারী শো| ‘মৃণাল সেন রেট্রোস্পেক্টিভ’।” 
কথাটার মাথা মুন্ডু কিছু বুঝলোনা নিধি। ফ্রীতে সিনেমা! এও আবার হয়! চুপচাপ ঢুকে অন্ধকার হলে বসে পড়লো একটা চেয়ার দখল করে। হলে সর্বসাকুল্যে পাঁচটা লোকও নেই। অনেকদিন হল টা বন্ধ হয়ে পরে আছে, সিটগুলো ধুলো পরে গিয়েছে। ফাঁকা হলের সুবিধে নিতে ছেলেমেয়ে সব হলে ঢুকে কোনের সিটগুলো দখল করে নিয়েছে। এরই মধ্যে পর্দায় সিনেমা চলছে, “খারিজ”।সিনেমাটা নিধি দেখেছিল বহু বছর আগে| নিধির তখন কাঁচা বয়স। শেষ বিকেলের অতি বেগুনী রশ্মি তখন স্পর্শ করেনি ওদের ক্যাম্পের ভেতর চৌকির তলায় উপুড় করে রাখা কাঁসার বাসনগুলোকে। ছবিটাকে তখন খুব সহজ লাগেনি নিধির| দূরদর্শনের পর্দায় সেদিনও ‘পালান’ মরেছিল কলকাতা শহরের বুকে কোন এক হাঁড়কাঁপানো শীতের রাতে ভেন্টিলেটর বিহীন মৃত্যুকূপে, একটু উষ্ণতার আশায়। পালান আজ এই হলের মধ্যে আবার মরে, পালানদের জন্মই বুঝি হয় শুধু মরবার জন্য। মৃত্যুর আগের যে ব্যাথা ও বিষন্নতা, সেটা ওরা টের পায়না ঠিক করে।বড় অসাবধানী মৃত্যু। ৩০ ফুটের পর্দা জুড়ে পালান পুড়ছে, ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে গোটা হলটা। সেই নামগোত্রহীন ধোঁয়াটা কুণ্ডলী পাকিয়ে এই দমবন্ধ কালো ঘরটায় কাঁদতে থাকে, পালানের বাপের মুখ হয়ে। মৃত্যুর কম্পাঙ্ক ক্রমে স্থির হয়ে এলেও মৃত্যুবোধটা আত্মগোপন করতে পারে না কোন ভাবে। বেঙ্গল লজের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে পরে যায় নিধির, কিংবা আরো আগের কথা, যখন ও বাজারের ভিতর দোতলা ভাঙা বাড়িটার এক কোণে পরে থেকে রাত কাটাত। কালাচ সাপের মত ঘুমহীন শীতের কোন রাতে বিহারী মুটে দুটো, মৃত্যুমুখী অন্ধকারটাকে গায়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে। এক ধাক্কায় ওদের ছিটকে ফেলে দিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও। মুহূর্তে শহরটার সব জাদুগরী উধাও হয়ে গিয়ে, নিধি ফিরে গেছিল রানাঘাট ক্যাম্পের ভিটেমাটি ফেলে আসা পোড়া লেগে যাওয়া জীবনে। গলাটেপা মধ্যরাতে বাজারের অলি গলি ঘুরে, হার ভাঙা শীতটাকে সঙ্গে করে মুখোশহীন পৃথিবীর ছবি এঁকেছিল খোলা আকাশের নিচে নীল রং ধার করে। 
রাত নটায় শো শেষ হল। পুরো হল জুড়ে তখন শুধু নিধি আর তার ঠিক বিপরীত গোলার্ধের শত বসন্ত পার করা একটি মানুষ ও তাঁর সৃষ্টি করা সার্বভৌম জীবন চেতনা। গত দেড় ঘন্টা ধরে যিনি চির বিচ্ছেদের দাঁড়ে নিধিকে টেনে নিয়ে গিয়ে, ওর জীবনের আকাঙ্খাকে আরো তীব্রতর করে তুলেছেন। নিধি এখন আরো তীব্র ভাবে বাঁচতে চায়, ওর বর্তমান আর ভবিষ্যতের আবর্তে। ঠিক এমনি ভাবে বাঁচতে নিধি শেষ কবে চেয়েছিল?
হল থেকে বেরিয়ে নিধি হোটেলে ফেরে না। আজ রাতটা এমনিতেও ঘুম হবে না। একটু পর বাজারের ভেতর মন্দিরের কীর্তন বন্ধ হয়ে হিন্দি গান চালিয়ে মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ শুরু হবে। কখন থামবে কে জানে! অনেক রাতে ফিরে আসবে নিধি ওর চেনা জগতে। বাজার থেকে ধেড়ে ইঁদুরগুলো দৌড় দেবে, খেলার মাঠের গোলহীন স্টপারের মত। হোটেলের হেঁশেল জুড়ে এঁটো নিয়ে লোফালুফির প্র্যাক্টিস শুরু করে দেবে। নির্বাক দর্শক হয়ে সেই খেলা দেখবে নিধি। মনের ভেতর তপতপে একটা সেন্টিমেন্টাল মনস্তাপে, আরো ভালো দর্শক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেবে।
কাল সারারাত ধরে নিধি ভেবেছে গুপ্তদাকে বলে জগৎ সিনেমায় যদি সবকটা বই ও দেখতে পেত! পয়সা তো লাগছে না। কিন্তু কি ভীষণ একটা উত্তেজনা! যেন খামখেয়ালী মধু তামস, সংস্কারহীন যজ্ঞ চালাচ্ছে পুরো জায়গাটা জুড়ে। সেই যজ্ঞের আগুনে ওর পুড়তে ইচ্ছে করে ভীষণ। ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসে। অস্বাভাবিক খিদেতে পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে হয় গায়ে চাপানো ধার করা চামড়াটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে, লালচে মাংসটাকে প্রত্যক্ষ করে। আবার একটা শব্দ হোক, হাজার মানুষের সমবেত কোরাস হয়ে সেটা রক্তারক্তি একটা কান্ড ঘটাক। ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, সব কটা সিনেমা নিধি দেখতে চায়। ওর নিশ্চল জীবনে গলগল করে প্রাণ ফিরে আসে যেন। সন্ধ্যের পরে ওর তো আর তেমন কাজ থাকে না হোটেলে, গুপ্তদা কেন ওকে ছুটি দেবেননা কদিন হাফবেলা করে! ইনসমনিয়ার রূপ ধরে এই কথাটা বার বার নৈতিকতা আর হকের সমকালীন সংঘাত হয়ে বাজারের চার দেওয়ালের মাঝে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধি। ওর কণ্ঠ সময়ের কোন অদৃশ্য কোণ থেকে ওর মুখে মলত্যাগ করতে করতে উড়ে গেছে সংক্রান্তির দিকে।

মেয়েটা পাশের কলেজে পড়ে। রোজ সকাল-দুপুর বেঙ্গল লজে খেতে আসে। নিধিকে। ‘কাকা’ বলে। মেয়েটা খেতে এলে আবদার করে এটা সেটা। মাছের মুড়ো খাওয়ার খুব শখ মেয়েটার। একটু বড় মাছ আনলে মুড়োটা টিফিন বক্সে ভরে দেয় নিধি। মেয়েটাকে দেখে মা মরা ভাইঝিটার কথা মনে পরে নিধির, কলেরায় অকালে চলে না গেলে আজ এই বয়সেরই হত। মেয়েটার বাড়ি মছলন্দপুরে। কলকাতার কলেজে পড়বে বলে বাড়ি ঘরদোর ছেড়ে এসেছে। ঠিক যেমন একদিন নিধি এসেছিল এই মায়ার শহরটায় ওর বেড়া টপকানো ইতিহাসটাকে একটা এলেবেলে ধূলিকণা দিয়ে ঢেকে ফেলে। নিধি নিজে ইস্কুলের গন্ডি পেরোয়নি হয়তো, কিন্তু পড়াশুনার বেশ কদর করে।কলেজের দিকে যেতে গিয়ে যে প্রকান্ড পুরোনো দিনের বাড়িটা, দুধারে দুটো পেল্লাই প্রাগৈতিহাসিক থামে ভর দিয়ে পার করে দিল কাগের ডিম বগের ডিম কত গ্রীষ্মকালীন সৌরঝড়, সেটা ইদানিং লেডিস পিজি হয়েছে। মেয়েটা ওখানেই থাকে। সারাদিন কলেজের পর রোজ সন্ধ্যেবেলা মেয়েটা টিউশন পড়াতে যায় রাজাবাজার, বেলেঘাটা। নিধিকে একদিন বলছিল, "ঘরে ঠিক কইরা চাল চড়ে না কাকু, বাপডা আমাগো ছাড়ি অন্য মাইয়ার লগে পলাইসে তা প্রায় এগারো বস্যর হইলো, বাকি ভাই বোনগুলা তখন খুবই ছোট আসিল| পড়ার খরচডা নিজেরেই চালাইতে হয়।" কাল রাতে মেয়েটা খেতে আসেনি, আজ সকালেও না। আজ দুপুরে শরীর-টরীর খারাপ নাকি জিজ্ঞেস করায় ওর বন্ধুটা বললো কাল রাতে নাকি পিজিতেও ফেরেনি মেয়েটা। ফোন করলে ধরছেও না। একটা মন খারাপের দুশ্চিন্তা সন্ধ্যা কিংবা মাঝরাতের হাওয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসলো নিধির নশ্বর জীবনে। এর আগে কারো জন্য এতো ভাবনা হয়নি ওর। মেয়েটা হয়তো ওর কেউ না, আবার এই শহরটার সাথেও কোন আত্মীয়তা নেই মেয়েটার। এই শহরের রাতের আলোগুলোর বুকে গজিয়ে ওঠা অনভিপ্রেত মাংসপিন্ডের মত মেয়েটার অবস্থান। হয়তবা ওর হারিয়ে যাবার খবর, পিঠে ডানা লাগিয়ে উড়তে গিয়ে চাপা পরে যাবে, গায়ে ফোস্কা পরা আলোর কোলাহলের মাঝখানে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কে ওর খবর নেবে? নিধি কি একবার মুচিপাড়া থানায় যাবে? কি উত্তর দেবে যখন পুলিশ ওকে জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা ওর কে হয়? বাঙাল কথায় একটা প্রবাদ আছে, "আলায় বুলায় না, আমি কার মাউসা?" ভয়ানক একটা রাগ পায় নিধির। মনে হয় এই বিষণ্ণ, পরশ্রীকাতর, আত্মকেন্দ্রিক শহরটার মুখে গরম তেল ছুঁড়ে মারে। কিন্তু রাগটা কেন হয় ওর? প্রতিদিন এরকম কতশত মেয়েরা নিয়ম করে হারিয়ে যায়, এই শহরের পেটের ভেতর গজিয়ে ওঠা অর্ধেক আলো আর অর্ধেক অন্ধকারের ছায়াপথে। তাদের কজনকে পুলিশ খুঁজে বার করতে পারে? নচ্ছার হারানটা শুনে বলে "বুড়ো, তোমার ভীমরতি হইসে, ওই মেইয়ে কে লাগে তোমার? হাওয়ার খবর রাইখো বুড়ো? কলেজির ভিতর নেতা মন্ত্রীর ছেলেরা আইসে টপ মাগীদের লিয়ে ফুর্তি কইরে যায়।রাতেও নাকি কলেজির কমন রুম খুলি রেখি দেয় দারোয়ানডা। দেইখগে যাও এ মাগীও লাইনে নামিসে, পুলিশে ধরিসে নয়তো যমডায় ধরিসে।" হারানের হলদে দাঁতের নির্লজ্জ হাসিতে কাঠফাঁটা দুপুরে সারা শরীরে যেন আগুন ধরে যায় নিধির। সজোরে এক থাবড়া কষিয়ে দেয় হারানের গালে, "মুখ সামলে কথা কইস ছ্যারা, মাইয়াদের লগে কিকইরা কথা কইতে হয় জানস না?" 
"হ্যা তুমার মাইয়াডা তো সতী লক্ষ্মী ছিল। বুড়ো তুমি বইলা কিছু বুইল্লাম না অন্য কেউ হুইলে না!"
অসংবৃত মেজাজটা লাগাম ছাড়িয়ে দেশের ভাষা মুখ দিয়ে বার করে এনেছে নিধির। কিন্তু এই অনাম্নী অঙ্গনা কৃষ্ণবেনীর জন্য কেন এত রাগ আসছে নিধির? উত্তর ওর নিজের কাছেই নেই।হয়তো অনেক দিনের জমানো অনেক না বলা ক্রোধ-হিংসা-স্বার্থপরতা জমা হয়েছিল। জীবনের আলো অন্ধকার হাতড়ানো দৌড়টা শেষ করার আগে, দশমীর বিকেলে কাঁটাতার ছিঁড়ে ওর সমগ্র জাগতিক অনুভূতিগুলোকে পিছনে ফেলে উঠে আসতে চাইছে একটা উগ্র স্ফুলিঙ্গ।

বর্ষার শুরুতে বাজারটার গায়ের কাপড় ভিজে যায় ফুটো অ্যাসবেস্টসের জলে। প্রৌঢ়ার শরীরের বাড়তি মেদের মত বাজারটার ভেতর ফুটে ওঠে বেশ কিছু আঁশটে অনুষঙ্গ। ভোরের অন্ধকার চিরে হ্যালোজেন বাল্বগুলো থরে থরে সাজানো ইলিশের রুপোলী আঁশে ধাক্কা খেয়ে, আলো করে চারিদিক। শুটকির গন্ধটা এখন হোটেলে বসেই দিব্যি টের পাওয়া যায়, পেচ্ছাপখানার গন্ধটাও আরো তীব্র হয়। মশলার গন্ধটা আরো মিশে মিশে যায়। জামগাছটার শরীরে প্যারাসাইট এর মত ছাতা ফেলা কাকগুলো হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে শুরু করে দেয় ঠুমরী-টপ্পার ধ্রুপদী কলহ। সেদিন নিধি রোজকার মতন দুপুরের খাবারের তোড়জোড় করছে। হারানটা কদিনের জন্য বেপাত্তা ছিল, আজ হঠাৎ এসে হাজির, সাথে বছর ষোলোর একটা মেয়ে। শ্যামলা গড়ন, পানপাতার মত মুখ, তাতে টানা টানা ডিঙি নৌকার মত দুটো চোখ, নিটোল স্তন, উদ্যাপী নিতম্ব। মেয়েটাকে এক ঝলক দেখে নিধির পোকায় কাটা ফুটিফাটা সাদা পাতার মত জীবনের আগু পিছু তিরিশটা বছর চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে। হারান বলে, "খুড়া বিয়া কইরা আইলাম দিশ থিকা।" হারান হাত বাড়িয়ে নিধির পা ছোয়, ইশারায় কাজল চোখের মেয়েটিকেও নিধির পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলে। নিধির হাতদুটো উপরের দিকে উঠে থমকে যায়।
"আজ লাল লাল করি মাগুর এর রসা রাইন্ধ খুড়া, সাথে সর্ষির তেল ছড়ায়ে আলু পোস্ত। আর খুড়া আমাদের থাইকবার ব্যাপারখানা তোমারে ম্যানেজ দিতি হবে। নতুন বৌ, বুঝই তো! এই কয়টা টাকায় কোথায় নিয়া তুলবো? লজের দ্বিতলে যে স্টোরখান খালি পইরা আসে, ঐখানেই থাইকবে লাহয়, কি কও?" ফুলকির মত হারানের কথার তোরে ভেসে যেতে থাকে নিধি, "ছ্যাড়া কয় কি? গুপ্তরে ম্যানেজ দিবে এই হারানিধি দাস? বুইড়া এককে নম্বরের কনজুস। ঘরখান স্টোর কইরা রাখসে, সিজনে কম পয়সায় ভাড়া দেওনের লগে। আর এ আপদ কয় কিনা ওই ঘরডাতে মাইয়া লইয়া থাকব!!" মনে মনে কথার জাল বোনে নিধি, সংখ্যাহীন চোখদুটো দিয়ে আপনমনে জ্যামিতিক অংক কষতে থাকে। মেয়েটার উপর মায়া লাগে তার। ইশারায় মেয়েটাকে ওর পিছু পিছু আসতে বলে, হোটেলের ভেতর ঢুকে নিধি তাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে। স্টোরটা খুলতে বলে সামনে পরে থাকা নোংরা তক্তপোশটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে, "মা, এইখানে একটু বস, আমি দেখি ঘরখানা একটু সাফা করাই।" মনে মনে ভাবে "গেলো জনমে তুই আমার কেডা আছিলি রে? তোরে দেইখ্যা এতো মায়া লাগে ক্যান?" দূর থেকে ঠাকুর চাকর ঝি সব হাঁ করে দেখছিল ওদের। এর মধ্যে বাজার থেকে কেঁদো একখানা মাগুর কিনে নিয়ে এসেছে হারান। মুহূর্তে খবরটা আশেপাশের দোকান ছুঁয়ে বাজারের ঘিঞ্জি গলিগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, মহাত্মা গান্ধী রোড আর বি বি গাঙ্গুলী স্ট্রিট এর ক্রসিং এ এসে থমকে দাঁড়াল। শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে স্বস্তার ছাপা শাড়ীতে করে নবদম্পতির সাথে যে হাওয়াটা হোটেল অবধি এসেছিল সেটার কাঁধে করে গিয়েই উঠলো এবার ‘শসাবাবু’র কানে। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় তার পায়ের ধুলো পড়লো বেঙ্গল লজে।অন্যান্য লোকের উপর বেশ একটু চোটপাট করে উপরে উঠে গেলেন তিনি, কিছুক্ষণ পর টিউবেলাইটের ফ্যাকাসে আলোতে, উপরে ডাক পড়লো হারানিধি আর হারানের। 
"এসব কি শুনছি রে হারামজাদা, মেয়েছেলে নিয়ে ঢুকেছিস লজে? এতো সাহস তোর!! নিধির ছায়ায় নিজেকে কি মহারাজা ভাবছো বাঞ্চোৎ?" আচমকা গুপ্তদার মুখে খিস্তি শুনে চমকে ওঠে নিধি, চোখ কুঁচকে তাকায়, আজ ত্রিশ বছরে এই প্রথমবার। এতদিনে হয়তো লোকটা বাজারটার উপযুক্ত রোজগেরে হল। 
"কত্তা হারান টা ছেলেমানুষ, দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে। কোথায় যাবে কচি বৌটাকে নিয়ে? এতদিন আপনার অন্ন খেয়েছে, বেইমানি করবেনা। মেয়েটাকে এই হোটেলেই কাজে লাগিয়ে দেব ঠিক দেখবেন, অসুবিধে হবে না। দিব্যি আমাদের সবার সাথে মিশে যাবে। হারানটার মত ওকেও খাওয়া পরা দেবেন। মাইনে লাগবে না" 
"আমি কি ধর্মশালা খুলেছি হারানিধি? যাকে পারবে এনে ঢোকাবে একেনে? ওরা যে বিয়ে করেছে কে সাক্ষী আছে? তোমার কথায় এই রাস্কেলটাকে কাজে রেখেছিলাম, সে কাম-কাজ যাই করুক, আমি কোনোদিন কিছু বলিনিকো, আজকে তো সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছে। তোমার লজ্জা করছে না ওটার হয়ে দালালি করতে? না না এখানে জায়গা হবে নেকো। অত দরদ থাকলে ওই বাজারের দোতলার ঘরে রাখগে যাও গে। আমার ও ঘর সিজনের জন্য রাখা।" 
গুপ্তদার কথায় পুঁজময় অন্ধকার দেখে নিধি, তার চোয়াল তখন শক্ত। হারানটা রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। "না কত্তা ওরা ঐখানে যাইবে না", নিধির গলায় ক্রমান্বয়ী রেণুঝড় খেলে যায়। 
"এতো দরদ যখন নিজে বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রাখগে যাওনা বাপু, তোমার আদরের ধোন আর তার বৌকে। আর সাথে তুমিও বিদেয় হওনা কেন? আমার লজে এসব ছোটলোকি আমি বরদাস্ত করবো না।" 
"হ কত্তা তাই হইবো। রাস্তার কুত্তার তো আর ঘর হয়না। দেইখ্যা লইবেন, ওই মাইয়ারে আমি রাস্তায় ফেলাইয়া রাখুম না। আসি কত্তা ভালো থাইকবেন। বহুকাল আপনের নুন খাইসি, আপনের ব্যবসাডার বারোটা বাজামু না নিশ্চিন্তে থাইক্কেন। না হইলে এই হারানিধি দাস এই বেঙ্গল লজের অনেক গুপ্ত কথাই জানে।" একটি ঠান্ডা পিস্তলসম নির্জনতা তখন ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে ঘরটার সিলিং জুড়ে তারই মাঝে নিধি শুনতে পায় আশেপাশের বাড়িতে দূরদর্শনে সিনেমা হচ্ছে। ধীরগতির ইন্টারনেটের মত শব্দগুলো ওদের ওর মগজে ঢিল ছোঁড়ে, আকাশ থেকে একটা দুর্বল তীর এসে ওর পায়ের সামনে পরে। তিরটির রং নীলই থাকবে যতদিন না ওটার অন্য কোন রং কেউ খুঁজে পায়।

বর্ষাটা এখন আরো অনেক গাঢ় হয়েছে। ভিজে হাওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকে ওর সব সুখ দুঃখ। চৌকো করে মেঘ জমে বাজারটার উপর। ‘বাজারের উপর এক্ষুনি ভেঙে পড়বে’ এরকম অবস্থার দোতলার কার্ণিশটার গা ঘেঁষে বেরিয়ে থাকা অশথ্বর চারাটা, একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার শপথ নেয়। তারপর হয়তো সেটা একদিন বাড়িটাকেই ফেলে দেবে। শিয়ালদাহ স্টেশনের চার নম্বর গেটের কাছে ভাতের ঝুপড়ি খুলেছে নিধি, চাইলে বেঙ্গল লজের উল্টোদিকের বাজার চত্ত্বরেও খুলতে পারতো। এই বাজারে ওটাই নিধির আঁতুরঘর। কিন্তু বেইমানি নিধির ধাতে নেই। এখানে প্রত্যেকদিন আশেপাশের বিহারী দোকানদারগুলোর সাথে বেঞ্চি পাতা নিয়ে ঝামেলা লাগে, নিধি ঠান্ডা মাথায় সবটুকু সামলায়। রোজ সকালে হারানের বৌটা গামছা উপুড় করে ভাতের ফ্যান গালে, সেই ফ্যান পিটুলিগোলা রাস্তাটার উপর ইচ্ছেমত ছড়িয়ে গিয়ে অক্ষরলিপি আঁকে, ঊর্ণ জালের যাযাবরী চরিত্র অববাহিকায়। বিহারী ছোকরাগুলো প্রথম দিকে কটু নজর দিয়েছিল, মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। সবসময় নিধি পেছনে বটগাছের মত দাঁড়িয়েছে। কোমরে গামছা বেঁধে হারানিধি বড় কড়াইয়ে তেল ঢালে, পিঁয়াজ-রসুন-আদা ফোড়ন দিয়ে কষতে থাকে। কষে-কষার গন্ধে পথচলতি মানুষের আতশী অষ্টপ্রহর কাটে শ্রীহীন বিরিঞ্চি নগরযাপনে। হারান উবু হয়ে বসে কয়লা ভাঙে| ওরা তিনজন এখন সার্পেন্টাইন লেনের পুরোনো একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। বাড়িটায় সব ভদ্রলোকদের বাস, বলে কয়ে স্বস্তায় সিঁড়ির নিচে পুরোনো একটা ঘর ভাড়ায় পেয়েছে নিধি। আর যাই হোক এখানে মেয়েটার উপর আর কোন শকুনছায়া পরবে না। এখান থেকে ওকে আর যোগাযোগের অজানা ক্রসিংএ হারিয়ে যেতে হবে না। আসা যাওয়ার পথে একান্নবর্তী দৃষ্টিতে রাস্তার ওপারের বাজারটাকে দেখে নিধি। দেখতে দেখতে ওর প্রতিটা রন্ধ্রে ঈশ্বর প্রকট হয়ে ওঠেন। বর্ষার নিষিদ্ধ বারবেলাটায় যোগনিদ্রার শীর্ষে উঠে, ওরা স্বপ্ন দেখে মহাজাগতিক দর্শনে ওদের হোটেল বেঙ্গল লজ হয়ে উঠেছে। বেঙ্গল লজে গ্যাসে রান্না হচ্ছে। তৎপুরুষ খুন্তি নাদে, বিবস্ত্র বেগুনের নাগরিকত্ত্বকে মেনে নিয়ে রান্নাঘরদুটো মিশে গিয়ে, ক্রমশঃ একটা উদ্বৃত্ত দেশ হয়ে উঠছে। 
জামগাছের কোটর থেকে শ্রমিক মৌমাছিটা এদিক ওদিক উড়ে যায়। সামনের শীতে গাছটার নিচে লজের মিনি বেড়ালটা পোয়াতি হবে। বাজারটা কাকে ভালোবাসবে আর কাকে অবহেলা ছুঁড়ে দেবে এই ভেবে চুপ করে থাকে।

mrinal7.jpg
mrinal14.jpg

প্রবন্ধ

মাছ - দুই বাংলার 

আলোকে

রথীন্দ্রনাথ বড়াল

ডঃ নগেন ঘোষ লেন, কলকাতা

fishmarket.jpg
মাছ-দুই বাংলার আলোকে

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, আমার জন্ম কলকাতায়। বড় হওয়া কলকাতায়। যাকে ঘটি বলে আর কি। নিখাদ। মধ্য কলকাতায় আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীকে দেখেছি—ঘুড়ি উড়িয়ে, পায়রা পুষে, মোহনবাগান ক্লাব করে সুন্দর আলস্যময় জীবন কাটিয়েছে। সেটা যদি ক্রিয়া হয়—তার প্রতিক্রিয়া পরের প্রজন্মের ওপর কেমন ভাবে দেখা দিয়েছে, সেটা অন্যত্র আলোচনার বিষয়। আজকের বিষয়, মাছ। বাঙালীমাত্র মাছের কাঙাল। বিস্তৃত তালিকা মাছের। সেই মাছের সাথে ছোট থেকে পরিচয় ঘটেছে। বড় হয়ে দেখেছি, আমার জানা তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। আরো অনেক সুস্বাদু মাছ আছে—যেগুলির সাথে পরিচয় ঘটেনি – ঘটি হওয়ার সুবাদে। অর্থাৎ আরো কিছু মৎস্য সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাণী আছে—যারা পূর্ববঙ্গীয়দের কাছে অতিপ্রিয়। এই দুই তালিকায় মাছের বর্ণনা কিভাবে আপনাদের সামনে তুলে ধরা যায়—ভাবছি।
যাদের ছোট থেকে দেখেছি—মানে রসনা তৃপ্ত করেছে—তাদের তালিকা আগে পেশ করা যাক। রুই, কাতলার কথা বাদ দিন। এরা অতি পরিচিত। কিছু মানুষ দেখেছি—যারা কাঁটার ভয়ে মাছ খেলনা—কোনরকমে রুই-কাতলা দিয়ে বাঙালীত্ব বজায় রাখল। সেই দূর্ভাগাদের কথা স্মরণ করে বলি—পারশে, ট্যাংরা, গুলে, বেলে, তপশে।  তপশের ভাজা ব্যসন দিয়ে অতুলনীয়। সরষে দিয়ে পারশের স্বাদও অতুলনীয়। ভাজাও অসাধারণ। ট্যাংরাও। সর্ষে দিয়ে। ছোট ট্যাংরার তেঁতুলের টক মেজপিসিমার পেটেণ্টেড্‌। কেউ কেউ ডিমভরা ট্যাংরার ফ্যান। আমি যা পাই তাই খাই। ট্যাংরা মাছের ধনে জিরা বাটার ঝোল—অতি সুস্বাদু আর সুপাচ্য। এবার বলি, গুলের কথা। মুখটা ছাগলের মতো অনেকটা। ধড়টা লম্বাপানা। সেই গুলের ঝাল—কাঁচা সরষের তেল আর লংকায় জবাব নাই। এখন বাজারে গুলের আনাগোনা কমে গেছে। এই প্রজন্মের কাছে পরিচিতি কম। তাই প্রবীণ এদেশীয় ছাড়া ক্রেতা দূর্লভ। আলু-বেগুন দিয়ে গুলের তরকারি—আমাদের বাড়িতে বলা হত—তেল-ঝোল। নামকরণের সার্থকতা জানা নাই—তবে জিহ্বার সার্থকতা বুঝতে পারি। সাদা ফ্যাকাসে বেলেও—সেসময়ের জনপ্রিয় মাছ। এখন অবশ্যই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। আদা দিয়ে রান্না করা বেলে—এক কথায় অপূর্ব। এইসব মাছের কথা বলতে বলতে—থুড়ি, শুনতে শুনতে—আপনারা ভাবছেন—বাঙালীর আসল মাছের কথা আমি ভুলে গেছি। নানা ভুলিনি। গঙ্গা-পদ্মাপারের বাসিন্দাদের মৎস্য বিলাসের উপসংহারে তাদের কথা জমিয়ে বলা যাবে—আগে বাকিদের কথা সেরে নি। এবার বলি—গুড়জালি আর ভাঙ্গরের কথা। আমি জানি সবাই পছন্দ করে না। তবু এদের fleshy-tasty ভাবটা খুব ভাল। বাংলা প্রতিশব্দ কারুর মাথায় এলে বসিয়ে নেবেন—এই মুহূর্তে মনে পড়ল না। এদের দিয়েও নানাপদ কলকাত্তাইয়া বঙ্গ-জীবনের অঙ্গ ছিল। কিছু না মাথায় এলে সর্ষে বাটা দিয়ে দিব্য জমে যায়। আর রইল—মৌরলা—পুঁটি।
       ভাইবোন জুটি—
   কুড়মুড়ে ভাজা—
       খাবে রাজাপ্রজা।
   তেঁতুলের টক—
       NO বক্‌বক্‌।

এপার বাংলা মোটামুটি সেরে এনেছি। বাকি থাকল সেগুলো—যেগুলো যুগ্ম তালিকায় যাবে। পরে

আসছি। তালিকা পেষ করা যাক্‌। প্রথম সারিতেই—পাবদা, আড়, বোয়াল। বাড়িতে আসতে দেখিনি—তবে কাগজের পাতায় ‘বাজারদর’-র column-এ দেখেছি—তাদের চড়া দাম। এরা যে উঁচু মানের ও জনপ্রিয় বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এদের স্বাদের বাহার, আগে বর্ণিত এদেশীয় মাছের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। আর একটা পার্থক্য বোধহয়—কাঁটার স্বল্পতা। আর একটা মাছ—শোল। দুই বাংলার মানুষের প্রিয়। রন্ধন প্রণালী কিছুটা আলাদা দেখেছি। এপার বাংলার কাঁচকলা আলু দিয়ে টকের ঝোল হলে—ওপার বাংলা শোলমুলো। এটি যুগ্মতালিকায় স্থান পাবেন। তবে, আর এক বিখ্যাত মাছ—চিতল। সম্পূর্ণভাবে পূর্ব বাংলার তালিকায়। চিতল মাছের মুইঠ্যার মতো জনপ্রিয় পদের স্বাদ পেতে—ওই বাংলার বন্ধু বাড়িতে হাজির হয়েছি বহুবার। অনেকটা কাছাকাছি ঘরানার মাছ ফলুই। স্বাদে কতটা ফারাক বলতে পারব না—তবে আকার-এ অনেক ছোট। ওপার বাংলার মাছের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে—শুঁটকি মাছের নাম না করলে। ঝাল ঝাল অসাধারণ স্বাদের নানা পদের কথা শুনেছি—তবে চেখে দেখতে সাহস হয়নি। বুঝতে পারছি—দুই তালিকার অনেক মাছের কথা বলতে ভুলে গেলাম। ক্ষমা করবেন। এবার যুগ্মতালিকার আলোচনা করা যাক্‌। প্রথমেই যার কথা বলতে হয়—তিনি রূপালী শষ্য—ইলিশ। ইলিশ প্রিয় নয় এমন বাঙালীর সংখ্যা নগণ্য। এর নানা পদ—খেয়েছি। সরষে ইলিশ সবাই খেয়েছে। ভাপা ইলিশ। ইলিশ ভাজা। ইলিশের পাতুড়ি। ইলিশের টক। আর, আমার প্রিয় গরম গরম ইলিশের তেল। এই দলে অনেককেই পাওয়া যাবে—আমি জানি। ইলিশের আলোচনা শেষ করার আগে বলতেই হবে, কালজিরা দিয়ে ইলিশের পাতলা বেগুন ঝোল। এপার বাংলার মা-মাসী-দিদাদের এই পদ্‌ জানা ছিল না—এর স্বাদ গ্রহণ করতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হয়েছে। এরপরই বলতে হয়—চিংড়ির কথা। আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে চিংড়ি জনপ্রিয়। অ্যালার্জির কারণে যাদের চিংড়ির স্বাদ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে—তারা অনেকটাই miss করে গেল। চিংড়ির আবার কত বাহার—গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, ছোট-বড়-মাঝারি মাপের নানা চিংড়ি। এই চিংড়ির জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে—আজ বাংলায় এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে। নানারকম চিংড়ি সুখাদ্যে বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায়—শুধু চিংড়ির মালাইকারির উল্লেখ করলাম। আঃ হাঃ। কিস্বাদ। বেশ কম দামে বাজারে পাওয়া যেত—কুঁচো চিংড়ি আর কাদা চিংড়ি। কাদা চিংড়ি—সত্যিই কাদার মত দেখতে। তাকে খুব ভালো করে ধুয়ে—বড়া। সেই রন্ধন প্রক্রিয়া বর্তমানে কজনের জানা আছে বলতে পারব না। বাজারেও, মানে কলকাতা বাজারে এর আমদানি আজ আছে কিনা কে জানে। যুগ্ম তালিকার এক রাজা মাছ ‘ভেটকি’। ভেটকির ফ্রাই ভুবন বিখ্যাত। এই ভেটকি দামের জন্য এর Mimicry ও বাজারে আছে, জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে। তারা—ভোলা ভেটকি। কুঁজো ভেটকি। ভেটকির পদানত না থেকে—এরা স্বাদের স্বতন্ত্রতারও উজ্জ্বল হতে পারে। যুগ্মতালিকার আর এক উজ্জ্বল নাম পমফ্রেট। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। নানা স্বাদের নানা পদ্‌ সকলের প্রিয়। সমুদ্রতটে ভাজা পমফ্রেট নোনা হাওয়ায় অন্য স্বাদ এনে দেয়। 
সেই মৎস্যকুল যাদের কথা বলা হল না কিংবা যাদের গুণপনায় যথার্থ জ্ঞান না থাকায় আলোচনায় আনতে পারলাম না—তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আরো অজানা তথ্যে এই ক্ষুদ্র আলোচনা ভবিষ্যতে ভরে উঠবে এই আশা রেখে—কলম বন্ধ করলাম।

অনুগল্প

রীনা নন্দী

বউবাজার, কলকাতা 

অণুগল্প

oldman1.jpg
অনুগল্প-রীনা নন্দী

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সাঁঝবেলায়

দুপুরবেলাটা কেমন নিঝুম। নিস্তব্ধ পরিবেশ। একসঙ্গে দুটো ছুটি একদিনে! রবিবার আর জন্মাষ্টমী । রাস্তাঘাট শুনশান। সুপ্তি আনমনে খোলা জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। সামনের রেলিঙে একটা চড়াই এসে বসেছে। লাফাচ্ছে। এই কার্নিস ওই কার্নিস উড়ে যাচ্ছে। আকাশে এক ঝাঁক পায়রা দেখতে পায়। সুপ্তির বেশ লাগে দেখতে।

অন‍্যমনস্কতার মাঝেই গত সন্ধ‍্যার কথা মনে পড়ে যায় তার। কেমন অদ্ভুত শিরশিরানি বোধ করে । জন্মাষ্টমী পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলো ঠাকুরঘরে। কাজ এগিয়ে রাখার জন‍্যই। পুজোর ঘরের কিছুটা দায়িত্ব সুপ্তি রোজই সামলায়। পরেরদিন সন্ধ‍্যেবেলা পুজো। তাড়াহুড়োর মধ‍্যে সব সাজানো গোছানো যাবে না, সেইজন‍্যেই আগের দিনের এই যোগাড়যন্ত্র।

ঠাকুরঘরে কম পাওয়ারের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো সুপ্তি। বাসনগুলো নিয়ে বসে। প্রদীপ পিলসুজটা মাজতে মাজতে হঠাৎই সামনের সিংহাসনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির দিকে নজর যায়। চোখের দিকে তাকাতেই সুপ্তির দৃষ্টি চমকিত হয়। এই তাকানো যে তার খুব চেনা! খুব চেনা মানুষের সে এমন নজর দেখেছে। এমন তীব্র চোরা চাউনি ভগবানের হয়! ভগবানের অনিন্দ‍্যকান্তিতে এ কার দৃষ্টি সে দেখলো! ভালোলাগা, ভয় মিলেমিশে যেতে থাকে সুপ্তির অনুভবে ।  আর তখনই আশ্চর্য সুন্দর এক গন্ধ চিলেকোঠার ঠাকুরঘরে ভাসতে থাকে। 

কিন্তু ধূপতো জ্বালায়নি সে। সুপ্তির মনে হয় গন্ধটা কিছুটা মনোরম আর কিছুটা যেন তীব্র!

কোথা থেকে গন্ধটা এলো! সুপ্তি ভাবে, অবচেতনের কোনো গভীর তল থেকে কি এই তীব্র কিন্তু অনুপম গন্ধ উঠে এলো! ভরে যেতে থাকলো ছোট্ট ঠাকুরঘরটায়। সুপ্তি আগ্রাসীভাবে নিশ্বাস নিয়েছিল। যেন সে শুষে নিতে থাকে সেই অলৌকিক সুগন্ধ। সম্মুখের তীব্র চোরা চাহনি ক্রমশ এক অলীকতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব মায়াগন্ধে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে সুপ্তিকে।

সুপ্তির শরীর অবশ হয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। তার হাত থেকে কখন যে প্রদীপ পিলসুজ খসে পড়েছে – সে জানে না।

সুপ্তি দু'হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠেছিলো। তার মনের সমস্ত জমি উথালপাতাল করে কান্না উঠে আসছিলো। তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখের সামনে তখন শুধুই শ্রীকৃষ্ণের গভীর চোরা চোখের টান ।

তারপর রাত পেরিয়েছে। সকাল হয়ে দুপুর হলো। আজ জন্মাষ্টমী। দুপুরের পরিষ্কার আবহাওয়ায় জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সুপ্তি ভাবে, গতকালের সাঁঝবেলার সেই মুহূর্তগুলো কি সত‍্যিই এসেছিল তার জীবনে! কেমন যেন এক স্বপ্নের ঘোরের মত মনে হয় তার।

ওরা বড় হয়ে গেল

টেঁপি আর ভোম্বল। দুই ভাই বোন এখন বেশ মাতব্বর হয়ে উঠেছে। মায়ের কথা এখন আর খুব একটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার প্রয়োজন বোধ করে না দুই ভাই বোনই। দুজনেরই পুর-স্কুলের প্রাথমিক বিভাগ পেরিয়েছে। টেঁপি এখন সেভেন আর ভোম্বল সিক্স। তাদের ঝুপড়ির কাছেই বুড়ো শিবের বস্তিতে থাকে শ‍্যামলদা। সন্ধ‍্যেবেলায় শ‍্যামলদার ফ্রি - কোচিং ক্লাসে পড়তে যায় তারা।
ওদের মা এখন কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে। বাসনমাজার কাজগুলো ছেড়ে দিয়েছে। আসলে টেঁপি, ভোম্বল বলে বলে ছাড়িয়েছে। ওদের ভাল লাগে না মা ঐ কাজ করুক। তার থেকে রান্না করার কাজটাই ভাল।
একটু বেলা করে কাজের বাড়িতে যায় মা।
দিনকাল এখন বেশ পাল্টে গেছে। টেপি আর দশমীর রাতে মা দুর্গার বিসর্জনের পর গঙ্গায় ঝাঁপায় না। গঙ্গার বুক থেকে ঠাকুরের সাজ, গয়নাগাটি, গণেশ কার্তিকের ছোট কাঠামো টেনে আনার কাজটা অবশ্য সে স্বেচ্ছায় ছাড়ে নি। মা আশারানি বকাঝকা করে ছাড়িয়েছে। তার এক কথা, মেয়েটা বড় হচ্ছে। 'টেঁপি তুই যাবি না।'
ভোম্বল অবশ্য প্রতি বছরই দশমীর রাত থেকে জলে ঝাঁপায়। ছোট ঠাকুরদের কাঠামো টেনে আনে। ঠাকুরের সাজ, অস্ত্রশস্ত্র টেনে আনে। তাদের ঝুপড়ি ঘরের বাইরে একপাশটা ভরে যায়। দুর্গাপুজোর পর কটা দিন ভোম্বলকে গঙ্গা যেন টানতে থাকে। টেঁপি বাড়িতে বসে থাকে বটে কিন্তু মন মানে না। মাঝে মাঝেই গঙ্গার পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ভোম্বলের কাজ।
টেঁপি ঝুপড়ির সামনে বসে বসে সাফসুতরো করে ঠাকুরের সাজ, অস্ত্রশস্ত্র। সন্ধ‍্যেবেলায় অবশ্য দুই ভাই বোন মিলেই যায় মন্ডলবাবুর দোকানে। টেঁপির ভাল লাগে ভাইয়ের সঙ্গে যেতে।
মন্ডলবাবু গত বছর বলছিল, 'আরে টেঁপি কত বড় হয়ে গেছিস? এবার তো তোর মাকে পাত্র খুজঁ তে হবে।'
টেঁপি লজ্জা পেয়েছিল। মন্ডলবাবটুা কি যে বলে! তার কি বিয়ের বয়স হয়েছে না কি! ভোম্বলটা মন্ডলবাবুর কথা শুনে হাসছিল। টেঁপি ধমকে ছিল ভাইকে, 'এই হাসছিস কেন?'
এতে আবার মন্ডলবাবু আর ভোম্বল আরো হাসতে লাগল। ওদের হাসি দেখে টেঁপির রাগও হয়ে ছিল আবার মজাও লেগেছিল।
এ'বছর পুজোর সময় একটা শাড়ি দেওয়ার জন্য টেঁপি আগাম বলে রেখেছে মিতালি সংঙ্ঘের বুড়োদাকে। দূর্গাঠাকুরের চরণে কত শাড়ি পড়ে! লাল পাড় শাড়ি, ছাপা শাড়ি, জরি পাড় তাঁতের

শাড়ি - কত রকম! মায়ের পায়ে ছোঁয়ানো একটা রঙচঙে ছাপা শাড়ি সে চেয়েছে বুড়োদার কাছ থেকে। বুড়োদা বলেছিল দুটো দেবে। দুটোর দরকার নেই একটা হলেই হবে' - টেঁপি বলেছে তাকে। বুড়োদা তাকে পছন্দ করে বেশ। তবে টেঁপি একটু দরুত্ব রেখেই চলে। মা বলেছে টেঁপিকে - 'টেঁপি ছেলেদের বেশি লাই দেবে না। দূরে দূরে থাকাই ভাল। টেঁপি এই কথাটা মাথায় রাখে। যদি ও মায়ের সব কথা শোনে না। তাদের ঝুপড়ি ঘরের থেকে কিছুটা দূরে থাকে অশোক; এবার পুজোয় ওর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা আছে টেঁপির। এটা অবশ্য সে মাকে জানায়নি। গতবছরক করোনা রোগের ঝামেলায় কোথায় যাওয়া হয়নি। এবারে একটু বেরোবেই ঠিক করেছে সে। ভোম্বলটা জানে দিদির সঙ্গে অশোকের ভাব হয়েছে। সে ও এবার পুজোর জন্য চুলের স্পেশাল ফ‍্যাশন করেছে; ঘাড় চাঁছা, চুলের ধারে ধারেস সোনালী রঙ।

ওদের মা বলে, 'মরণ দশা একি কাট রে! এত মরুগির মত লাগছে।'

টেঁপি, ভোম্বল দুজনেই মায়ের কথায় হো হো করে হাসে। আসলে ওদের মা আশারানি বুঝতেই চায় না যে টেঁপি, ভোম্বল বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে।

অনাবষ্টি, করোনা এবং সবিতা

দেড়মাসে র উপর বষ্টি নেই। অথচ বর্ষাকাল পড়ে গেছে কবে! সামনের রাস্তায় যে কটা গাছ দে খা যাচ্ছে, পাতাগুলো সব ঝলসে গেছে। ফুটপাতের ধারে তোলা উনুনে আঁচ দিতে দিতে শুখনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সবিতা।
গতবার বন্যা হয়ে ছিল তাদের গাঁয়ে। তারপর কি যে এক রোগ এল! করোনা আর করোনা! বলাইটা গুজরাটে গেছিলো দুটো বেশি পয়সা রোজগারের আশায়। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতো বলাই। সবিতা আর তাদের ছোট্ট ছেলেটাকে বড় ভালোবাসতো বলাই। সবিতার স্বামীর কথা মনে পড়তে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসে।
কি যে রোগ দেশে এলো ঠাকুর! করোনার ভয়ে সব জায়গায় কাজকম্ম বন্ধ হয়ে গেল। গুজরাট থেকে দল বেধেঁ আসছিল বলাইরা। কত কত পথ হেঁটে আসছিলো ওরা! মানষুকে কত কিছুই যে পারতে হয়! ট্রেন বন্ধ, বাস বন্ধ।
প্রাণভয়ে কুড়ি জনের দলটা আসছিলো নিজেদের দেশ গাঁয়ের দিকে। চিঁড়ে-মুড়ি সম্বল করে আসছিলো ওরা।
আমার স্বামী বলাইটাও ঐ দলে ছিল। লোকগুলো কত পথ হেঁটে প্রায় অনেক দূর চলে এসেছিলো তো ভগবান! আর কটা দিন তুমি ওদের সঙ্গে থাকতে পারতে তো ভগবান। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসতো।
সবিতা শুনেছিল লোকজনের কাছ থেকে, ওরা হাইওয়ে ধরে নিরণ্ণ, ক্লান্ত পায়ে হাঁটছিলো। একটা কালান্তক লরি এসে পিষে দিয়েছিল তিনজন মানষুকে। বলাইটা ছিল তিনজনের মধ্যে। সবিতা ভাবে, তার মানষুটা বেঘোরে চলে গেল। পরের দিন কাগজে বড় বড় করে লেখা ছিল -- "পরিযায়ী শ্রমিকদের পথে মৃত্যু"। কতটা লেখা ছিল ওদের নিয়ে!
সবিতা ভাবে, লিখেই বা কী হলো! আর ওসব "পরিযায়ী টরিযায়ী" -- নাম দিয়েই বা কি হল। শুধু তো কেউ তো কোন কথাই বলল না, কেউ কোন খোঁজও নিল না। সব চুপচাপ হয়ে গেল। শুধু সবিতার টালির চালের ঘরটা শুনশান ফাঁকা হয়ে গেল বলাই মরে যাওয়ায়।
তাদের জমি জিরেত তো  ছিলই না, শুধু একচিলতে থাকার ঘরটুকু। কাজকম্ম নেই বলেই তো বলাইটা ভিনরাজ্যে মিস্ত্রিগিরি করতে গেছিল। তারপর একদিন পেটের দায়ে সবিতা ঘরটা বেচে দিল সঙ্গে উঠোনের দুটো আম গাছ।
সব ঐ নরেন হাঁসদা কিনে নিল। ওর বাজারে একটা চালকল আছে। জায়গাটা ওর ব্যবসার কাজে লাগবে।
তাদের পাশের গাঁয়ের নলিনের মা কলকাতায় ঝিঁগিরির কাজ করত। ওর সঙ্গে আলাপ ছিল সবিতার। ওর সাথেই চলে এল কলকাতায়। ওখানকার সব পাট চুকিয়ে দিয়ে। ছেলেটার এখন চার বছর বয়স। ওটাকে কোলে নিয়েই নলিনের মায়ের সঙ্গে কলকাতার পথে পাড়ি দিয়েছিল।
লোকজনের হাঁটাচলার পথে বাস তাদের। পাশেই নলিনের মা থাকে। আরও বেশ কিছু মানুষ মানিয়ে নিয়েছে এই পথের সংসারে। তারা এখানেই রাঁধে বাড়ে, শোওয়া-বসা করে।
সুন্দরবনের কাছাকাছি গাঁয়ে তাদের বাস ছিল। প্রায় বন্যা হত। এ'বছর শুনেছে অনাবৃষ্টি চলছে তাদের গাঁয়ে।
নলিনের মায়ের দাদা এসেছিল। ঐ বলল এ'বছর পুজো হবে না তাদের গাঁয়ে। করোনায় লোক মরছে চারিদিকে।
পুজোর আয়োজন করবে কে! তার উপর অনাবৃষ্টি।  সে কল্পনায় দেখতে পায় তাদের গাঁয়ের ফুঁটিফাঁটা মাঠ।
কলকাতায় অবশ্য পুজো হচ্ছে। সবিতা উনুনের ধোঁয়ার মধ্যে বসে থাকতে থাকতে শুনতে পায় ঢাক বাজছে। আজ সপ্তমী। সে পাশে বসে থাকা বধুনকে দেখে। আনমনে খেলছে ছেলেটা। সবিতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসে ওরদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। কে জানে কেন! সবিতা ঠিক ধরতে পারে না -- এই চোখের জল উনুনের ধোঁয়াতে নাকি অন্য কারণে! পুজোর ঢাকের গুড়গুড় আওয়াজে তার ভিতরটাকে মন উথালপাতাল করে। সবিতা বধুনকে কোলে তুলে নেয়। ছেলেটাকে বুকের ভিতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ছোট্ট বধুন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বঝুতে পারে না মা কাঁদছে কেন!

দুর্গাপুজো আমেরিকান

কায়দায়

সুব্রত মজুমদার

হিউস্টন, টেক্সাস 

গল্প

subho-bijaya_edited.jpg
দুর্গাপুজো আমেরিকান

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নে পড়ে ছেলেবেলায় নতুন বছর শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই বসে থাকতাম দুর্গা পুজার জন্য। মাকে জিজ্ঞাসা করতাম পুজোর আর কতদিন বাকি। মা বলতো পঞ্জিকা এখনও বেরোইনি, বেরোলে জানাব। পঞ্জিকা বেরোলে মা ক্যালেনডারে দাগ দিয়ে বলতো, এই দেখো এই পাঁচ দিন পুজো। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো তখন মনে হত বড্ড দেরি করছে, দিনগুলোতে পৌছতে। আমার শৈশবের কলকাতায় কাটানো প্রতিবছরের পুজোর ওই কটাদিন আজও মনে পড়ে ছবির মত।লক্ষের থেকে উপলক্ষ্য বড় হয়ে উঠত আমার কাছে। নতুন কেনা জামা কাপড় আর বাটার জুতো বড় হয়ে উঠত পুজোর থেকে অনেক বেশি হয়ে মনে পড়ে। পুজোর এক সপ্তাহ আগে ভোর বেলায় মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে বীরেন ভদ্র্রের গলায় মহালয়ার কথা। আমার পুজো শুরু হত বলতে গেলে ওই মহালয়ার গান শোনার পরের দিন থেকেই। 

পুজোর সময়ে কলকাতা মনে হত একটা আসতো পাগলখানা। সারা শহরটা মেতে উঠত ঔই পাঁচটা দিন, ঝলমল করতো আলোয় আলোয়, ঢাকের বাদ্যি আর লাউড স্পিকারের কান ফাটানো হিন্দি সিনেমার গানে। ছোট থেকে বড় সবাইকে দেখতাম পাটভাঙ্গা নতুন জামা কাপড় পরে দলে দলে ঘুরছে পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখার জন্য। কত রকমেরই না ঠাকুর, কত বড় আর কত রকম তাদের সাজ। সব প্রতিমার মুখেই আমি লক্ষ্য করতাম অদ্ভুত একটা হাসি। পান্ডেল থেকে পান্ডেল আমিও ঘুরে বেড়াতাম বন্ধুদের সঙ্গে। মনে হত এই প্রতিমাটা আগের দেখা প্রতিমাটার থেকে আরো ভালো, হাসিটা আরো সুন্দর। পাঁচটা দিন মনে হত বড্ড কম, আরও বেশিদিন ধরে পুজো চলা উচিত। ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে সব পাল্টে দেবো। অঞ্জলি দেবার সময় পুরোহিতের পড়া মন্ত্রগুলো আমার কানে বাজত। সমস্ত পরিবেশটা মনে হত সুন্দর, নির্মল, পবিত্র আর জাগ্রত।  

সে বেশ অনেক দিন আগের কথা। আমেরিকার একটি শহরে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়েছিলাম। স্কুলের অডিটোরিয়ামে ঢুকে চাঁদা দিয়ে, থুড়ি প্রনামী দিয়ে বসলাম একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে।দেখলাম আমার চেনা এক ডাক্তার বন্ধু পুজো করছেন। একটু অবাক হলাম। পাশে বসা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম নিচু স্বরে,

“আচ্ছা যিনি পুজো করছেন উনি তো  ব্রাহ্মণ নন। উনি পুজো করছেন কি করে? তাছাড়া উনি যদিও দেখে পড়ছেন কিন্তু সংস্কৃতের মন্ত্রগুলো ঠিক মত উচ্চারণও করছেন না।“

ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন আমার ওপর,

“তার মানে, পুরোহিত ব্রাহ্মণ হতে হবে এমন কথা কোথাও লেখা আছে, আপনি দেখাতে পারবেন? কতদিন আমেরিকায় আছেন? এখনও এত ব্যাক ডেডেট হয়ে আছেন কেন বলুন তো? এবারে নন ব্রাহ্মণ দিয়ে পুজো করলাম, পরের বারে দেখবেন মহিলা পুরোহিতকে দিয়ে পুজো করাব।

অনেকদিন ধরে এইসব Discrimination চলে আসছে, আমরা ঠিক করেছি আর আমরা এসব আর সহ্য করব না। আপনাদের মত লোকেদের জন্যেই আজ বাঙালিদের এত অবনতি। আর সংস্কৃতের মন্ত্রগুলো ঠিক মত বলছেন না, এটাই বা আপনি জানলেন কি করে? আপনার কি সংস্কৃতে পি-এইচ-ডি আছে? আর তাছাড়া ভুল যদি উনি বলেও থাকেন তাতে কি হয়েছে? ওটা এমনিতেও একটা অবসলিট লাঙ্গ আমরা ঠিক করেছি এবার থেকে আমাদের বাচ্চারা যাতে বুঝতে পারে তাই ওই মন্ত্রগুলো ইংলিশে ট্রান্সলেট করে ওদের দিয়েই পড়াব।“

আমি আড়চোখে এদিক ওদিক তাকালাম কেউ আমাদের কথা শুনছে কিনা। দেখলাম অনেকেই মা দুর্গার দিকে না তাকিয়া আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি ওনাকে বলতে পারলাম না যে আমি চিরকাল মাঝারি স্টুডেন্ট, জীবনে কখন ফার্স্ট হই নি, বাঙালিদের অবনতির জন্য আমার দায়িত্ব খুবই কম, প্রায় নেই বললেই চলে। আমি ওনাকে এটাও বলতে পারলাম না যে স্কুল থেকে কলেজে ওঠার পরীক্ষায় সংস্কৃতে লেটার পেয়ে ছিলাম। আমার বাবা সংস্কৃতের মাস্টারমশাই ছিলেন। বাবা ভোরে নিজে উঠে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে পুজোর মন্ত্র পড়াতেন| ভুল উচ্চারণ  করলে আমায় কানমলা খেতে হত। মনে হল আর ওনার পাশে আর কিছুক্ষণ থাকলে উনি হয়তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মানে মানে কেটে পড়লাম ওখান থেকে। 

অনেকটা দূরে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়লাম। চোখটা সরাসরি গিয়ে পড়ল মাদুর্গার ওপর|মাদুর্গা দশভূজা হয়ে পায়ের নিচে পড়ে থাকা অসুর নিধনে ব্যস্ত। তাঁর ছেলে আর মেয়েরা যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সব ঠিকঠাক। এক মিনিটের জন্য চোখটা বন্ধ করলাম - আমার মনটা দৌড়াতে শুরু করল, চলে গেল কলকাতায়। আমার সেই ছোটবেলার কলকাতায়, সেই পুজোর দিনগুলোতে – মাত্র এক মিনিটের জন্য। চোখটা আবার খুললাম – আ রে এই প্রতিমাটা এত ছোট কেন? বাঃ  ছোট তো হবেই, কুমারটুলি থেকে আনতে খরচ পড়ে না? মনে আছে আমি একবার কথাটা তুলে ছিলাম। আমায় বলা হয়েছিল – যত বড় প্রতিমা তত খরচ। ফেল কড়ি মাখো তেল।পয়সা ছাড়ুন আপনাকে চল্লিশ ফুট লম্বা প্রতিমা এনে দেব। মনে আছে কলকাতায় পুজো শেষ হলে প্রতিমার বিসর্জন হত। ঘরে ঘরে বাড়ির বাইরে মাটির প্রদীপ জালানো হত। মাটির প্রতিমা জলে ফেলে দেওয়া হত। মা গঙ্গা তাঁর বুকে টেনে নিতেন সবাইকে। ঢাকের বাজনা এত জোরে বাজতো যে সারা বাড়ি কেঁপে উঠত। আমার বুকের ভেতরটাও কেঁপে উঠত কিন্তু বাজনার আওয়াজের জন্য  নয় শুধু মা দূর্গা চলে যাবেন বলে। আমরা কলাপাতায় লিখতাম ঠাকুর আবার এসো। ঠিক এই সময়টাতে আমার দুচোখ জলে ভরে উঠত। জানতাম পরের বারের ঠাকুর হবে সম্পূর্ণ নতুন।মায়ের হাসি পরের বার কেমন হবে দেখার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকতাম। 

মনটা খারাপ হয়ে গেল আমেরিকান দুর্গাপুজোর কথা ভেবে। আমেরিকায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার দরকার হয় না। তিনি আসেন আর চলে যান প্যাকেজ ডিল হয়ে। একবছরের জন্য তিনি বন্দিনী হয়ে থাকবেন। স্টেট অফ দা আর্ট টেকনলোজির সাহায্যে তাঁকে এমন ভাবে রাখা হবে যাতে আলো আর বাতাস ঢুকে তাঁর চেহারার কোন পরিবর্তন না করতে পারে। আচ্ছা মায়ের কি ইচ্ছে করে না নতুন চেহারা নিয়ে নতুন হাসি নিয়ে দেখা দিতে? আমি মাকে বলি “কিছু চিন্তা করো না মা। কুছ পরোয়া নেই। আমরা এখান থেকে একটা মাউসের ক্লিকে দেশের যে কোন জায়গায় বিজয়ার মিষ্টি নিমেষের মধ্যে পাঠিয়ে দিতে পারি। পাঠাতে পারি ই-মেল করে খুব সুন্দর দেখতে বিজয়ার কার্ড, ঢাকের আওয়াজ সমেত, যার সঙ্গে থাকবে অবিকল প্রদীপের মত দেখতে ছবি। তুমি বুঝতেই পারবে না আসল না নকল। আর হাসির কথা ভাবছ ? ওটা কোনো ব্যাপারই না। ওটা হলো সম্পূর্ণ মাইন্ড সেটের ব্যাপার। মাইন্ড সেটটা তোমায় একটু বদলাতে হবে। এই ধর না লিয়নার্দোর আঁকা মোনালিসার হাসি। গত প্রায় পাঁচশ বছর ধরে লোকের মন জয় করে আসছে কি না? তোমায় আর কি বলব তুমি তো সবই জানো। একই হাসি অথচ যত দিন যাচ্ছে ততোই লোকের ভালো লাগছে।তোমার হাসি মোনালিসার হাসির থেকে কম নয় বরঞ্চ অনেক অনেক বেশি।

কাজের পোল

সুব্রত মজুমদার

হিউস্টন, টেক্সাস 

কাজের পোল

গল্প

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

crow.JPG

ভূত আছে বা নেই এই নিয়ে তর্কটা চলে আসছে বহুদিন ধরে। একদল আছেন যাঁরা ভুতে বিশ্বাস করেন প্রায় জন্মের থেকেই। ছোটবেলার থেকে ভুতের ভয় আর ভুতের গল্প শুনতে শুনতে তাঁরা ভুতে বিশ্বাসী হয়ে গেছেন। তাঁদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় “ভূত দেখেছেন?” এবং যদি উত্তর হয় “না” তাহলে পরের প্রশ্ন হবে,

“যদি না দেখে থাকেন তো তবে ভুতে বিশ্বাস করেন কেন?” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসবে,

“আপনি কি ভগবানকে দেখেছেন? যদি না দেখে থাকেন তবে ভগবানে বিশ্বাস করেন কেন?” অকাট্য যুক্তি শুনে অন্যদলের লোকেরা মানে মানে কেটে পড়েন। কেটে পড়লেও তাঁরা কিন্তু হাল ছাড়েন না। সময় সুযোগ পেলেই কিন্তু তাঁরা ভুতে বিশ্বাসী লোকেদের কোন না কোনভাবে আবার আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। ভুতে অবিশ্বাসী লোকদের আবার দুভাবে ভাগ করা যায়। একদল হলেন অসম সাহসী ও সৎ, তাঁরা সত্যি ভুতে বিশ্বাস করেন না। সব ব্যাপারে তাঁরা একটা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ যুক্তি তৈরী করে যে কোন ঘটে যাওয়া ঘটনার পিছনে একটা থিওরি খাড়া করেন ও ভুতের অস্তিত্ব নিয়ে বেশ গবেষণা মূলক লেকচার দিয়ে দেন। এইভাবে তাঁরা আশেপাশের লোকজনের কাছে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজেদের বুদ্ধিমান ও সাহসী বলে জাহির করে থাকেন। আর একদল আছেন যাঁরা ভুতে বিশ্বাসী লোকেদের অপদস্থ করার জন্য অবিশ্বাসী সাজেন কিন্তু যখন তাঁদের বলা হয় একটা পোড়ো বাড়িতে শুধুমাত্র একটা রাত্রি কাটানোর জন্য তখন তাঁরা চোর ডাকাতের ভয় অথবা সাপ খোপের অজুহাত দেখিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যান।

ভুতের কথা উঠলে চয়ন চুপ করে থাকে, কোন দলের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলে না সে। সে এমন একটা ঘটনার কথা জানে বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। কেউ হাসি বা ঠাট্টা তামাসা করুক সেই ঘটনাটা নিয়ে এটা তার পছন্দ নয়। মাঝেমধ্যে যখন মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা, না না দিন তো নয়, সেই রাতটার কথা ভাবলে।আজও গায়ে কাঁটা দেয় তার। কাঁপতে থাকে সারা শরীর।মৃত্যু তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, ডাক এসেছিলো তার পরপারে যাওয়ার। সত্যি কি মৃত্যুকে দেখেছিল চয়ন স্বচক্ষে? তবে সেদিন কেন তার মৃত্যু হয় নি? সে কি ভয় পেয়েছিলো? না হলে এতো ভালো ফুটবল প্লেয়ার হওয়া সত্বেও সেই রাত্রের পর থেকে আর কোনদিন ফুটবলে পা দেয় নি কেন? কেন ওইদিন ওভারটাইমের পর খেলা শেষ হলো। চোখটা বন্ধ করলে আজও মনে করতে পারে এত বছর আগের অবিশ্বাস্য সেই রাত্রির কথা। সত্যি কি সে দিন সে ভূত দেখেছিলো? না অন্য কিছু? 
চয়নের জন্ম গ্রামে। অল্প বয়সে বাবা আর মা দুজনেই কার এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায় কাকা আর কাকিমার কাছেই মানুষ। কাকা আর কাকিমা নিঃসন্তান ও অবস্থাপন্ন, তাই আদর আর যত্নের সঙ্গেই মানুষ করতেন তাঁরা চয়নকে। ছোটবেলার থেকেই চয়ন ছিলো মেধাবী, তাই পড়াশুনায় কোনদিন কোন অসুবিধা হত না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আর একটা জিনিষের প্রতি চয়নের পারদর্শিতা দেখা গেল, সেটা হল ফুটবল।
ফুটবলে পা দিলেই কি যেন একটা হত চয়নের। বলটা পাওয়ার পর বিদ্যুতের গতিতে সে ছুটে যেত অন্যপক্ষের গোলের দিকে। ওর পায়ের থেকে বল কেউ কাড়তে পারত না। মনে হত বলটা যেন চুম্বকের মত ওর পায়ের সঙ্গে আটকে আছে। এত জোরে ছুটত যেন ওর পাটা মাটিতে ঠেকে নেই, যেন হওয়ায় ভেসে চলেছে চয়ন। বিরোধী দলের খেলোয়াড়দের একের পর এক পাশ কাটিয়ে যখন ওর পায়ের থেকে কামানের গোলার মত জোরে বলটা গোল পোস্টের মধ্যে দিয়ে ঢুকে যেত, তখন গোলকিপারের অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকত না। হাততালিতে ফেটে পড়ত সারা মাঠ। অন্য গ্রামের লোকেরা অনেক সময় ভাড়া করে নিয়ে যেত তাদের দলের হয়ে টুর্নামেন্ট খেলার জন্য। বন্ধুবান্ধব, স্কুলের মাস্টারমশাই, আত্মীয়স্বজন সবাই উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করতো চয়নের। যেমন পড়াশুনায় তেমনি খেলাধুলায় সবকিছুতেই চয়ন ছিল সবার থেকে এক ধাপ ওপরে। একডাকে সবাই চিনত চয়নকে। গর্বে বুকটা ভরে যেত কাকিমার। জড়িয়ে ধরে আদর করতেন তিনি চয়নকে।
একমাত্র কাকাকে সন্তুষ্ট করতে পারত না চয়ন। তিনি ছিলেন খেলাধুলার ঘোরতর বিরোধী। চয়নের বাবা ছিলেন পড়াশুনায় খুব মেধাবী, জীবনে সেকেন্ড হতে হয় নি তাঁকে কোনদিন। কাকা নিজে খুব একটা লেখাপড়া করেন নি কিন্তু দাদাকে সন্মান করতেন তাঁর পান্ডিত্যের জন্য। এছাড়াও ভয়াবহ গাড়ির দুর্ঘটনায় দাদার মৃত্যু শয্যায় তিনি তাঁকে কথা দিয়েছিলেন চয়নকে ভালোভাবে পড়াশুনা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করবেন। কাকিমার প্রশয় যদিও ছিল কিন্তু রাশভারী কাকার দাপটে তিনিও কিছু বলতে পারতেন না। বাড়িতে প্রায়ই এই নিয়ে মনোমালিন্য হত। অবশেষে কাকিমার প্রচেষ্টাতেই ঠিক হল যে পড়াশুনার রেজাল্ট খারাপ না হলে চয়ন খেলতে পারবে। কিন্তু রেজাল্ট যদি কোন কারণে খারাপ হয় তাহলে চয়নের খেলা চিরকালের মত বন্ধ। চয়ন মনে মনে খুশী হল। খুশী হবার অন্য একটা কারণও অবশ্য ছিল। কারণটা চয়নের খুব অদ্ভুত লাগত। বিশ্বাস করতে পারত না। বারবার তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন, কোন কারণেই যেন রাত্রিবেলায় চয়ন কাজের পোলের ওপর দিয়ে না ফেরে। মাঝে মাঝে দেরি হলে কাকিমা পিছনের দরজাটা খুলে রাখতেন চয়ন না ফেরা পর্যন্ত।
চয়নের খেলার নামডাক এতদূর ছড়িয়ে পড়েছিল যে আসে পাশের গ্রাম থেকেও ওর ডাক আসত খেলার জন্য। কাকার শুধু একটাই অনুরোধ ছিল তাঁদের কাছে। গাড়ি করে নিয়ে যেতে হবে আর গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে, এবং আলো থাকতে| তাঁরাও এক কথায় রাজি। একা চয়নকে তাঁরা কখনও ছাড়তেন না। কার্জন ব্রিজ রাত্রিবেলায় নিরাপদ ছিল না। ইংরেজ আমলে তৈরী কার্জন ব্রিজের নাম উচ্চারণের সুবিধার জন্য ছোট হতে হতে কবে যে কাজের পোল হয়েছিল তার কথা গ্রামের বয়স্ক লোকেরাও বলতে পারে না। কত রাহাজানি, ছিনতাই, বলাৎকার এমনকি খুন পর্যন্ত হয়েছে এই কাজের পোলের ওপর রাত্রিবেলা তার হিসেবও এখন আর কেউ রাখে না। খুব জরুরি দরকার না পড়লে দলবল ছাড়া বা খুব সাহসী লোক ছাড়া একা একা কাজের পোলের ওপর দিয়ে রাত্রিবেলায় কেউ পা মাড়াতো না পারত্পক্ষে। গুন্ডা বদমাইসের ভয় তো ছিলই, তাছাড়া আরো একটা ভয়ের কারণ ছিলো। আর সেই কারণটাই চয়নের অদ্ভুত মনে হত। বিশ্বাস করতে পারত না। কাজের পোলের ওপরে নাকি রাত্রিবেলায় ভূতেরা ঘোরাফেরা করে। যে সব মানুষদের কাজের পোলের ওপর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল তারা নাকি ওই পোলের ওপর ফিরে আসে আলো কমে গেলে। 
কার্জন ব্রিজ এর ওপর অনেক রাত্রে ফেরা পথযাত্রিরা, অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখেছে যার কোন ব্যাখ্যা করা যায় না। এমন সব গণ্যমান্য বয়স্ক লোকেরা এইসব ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন যে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না| সবাই বাধ্য হত বিশ্বাস করতে। বড় হয়ে চয়ন গ্রামের লোকের কাছ থেকে অনেকের অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনেছে। কিন্তু কোনটা সত্যি আর কোনটা বানানো সেটা বুঝতে পারত না। এতগুলো  বছর পেরিয়ে গেছে, তাও সেই দিনটার কথা হুবহু মনে করতে পারে ঠিক সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতন। পাশের গ্রামের রমাপদবাবু ড্রাইভার পাঠিয়েছিলেন কথামত তাঁদের গ্রামে তাকে নিয়ে যাবার জন্য। চয়ন তখন পুকুরে মাছ ধরছিল তার বন্ধুদের সাথে।এই গ্রামের হয়ে এর আগে কখন খেলেনি চয়ন। এই গ্রামের কাউকে চেনেও না। চয়নের খুব একটা যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু যখন রমাপদবাবু বললেন যে চয়ন যদি ভালো খেলে তাঁর টিমকে জিতিয়ে দিতে পারে তাহলে তিনি ওকে মোহনবাগান ক্লাবে ঢুকিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন, তখন আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায় নি। কাকার কাছে চয়নের খুব প্রশংসা করেছিলেন রমাপদবাবু। প্রশংসা কার না ভালো লাগে। খবরটা পাওয়ামাত্র চয়ন এক ছুটে তৈরী হয়ে নিল।কাকিমার কাছে জানতে পারল যে কাকাকে জরুরি কাজে কলকাতায় যেতে হয়েছে, দুই তিনের আগে ফেরার সম্ভাবনা নেই। একটু যে খুশী হোল না চয়ন তা নয় কিন্তু কাকিমাকে সে কথা জানাল না। কাকিমার কাছে প্রতিবারের মত ওইদিনও শপথ করল যে একা একা কাজের পোলের ওপর দিয়ে ফিরবে না। সবকিছুই অন্য যে কোন দিনের মত, কোন পার্থক্য ছিল না। শুধু বিধাতা হাসছিলেন আড়াল থেকে। আহা চয়ন যদি সেটা দেখতে পেত। 
চয়ন প্রথম থেকেই প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তার খেলা শুরু করত। এটাই ছিলো তার খেলার ধরণ। প্রতিপক্ষ সেদিন তাদের ডিফেন্সের অর্ধেক প্লেয়ার লাগিয়ে রেখেছিল চয়নের পিছনে ফেউয়ের মত। সাধারণত চয়নের বিদ্যুতের মত গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা চলতে পারে না।কিন্তু ওইদিন কি যেন হয়েছিল চয়নের। তার স্বভাব মত খেলতে পারছিল না। বলা নেই কয়া নেই প্রতিপক্ষ হঠাৎ একটা গোল করে বসল খেলা শুরু হওয়ার ঠিক দশ মিনিট পরেই। চয়নের খেলা দেখার জন্য মাঠে ভিড় হয়েছিল ভালই। হাততালি দিয়ে তারা উৎসাহ দিচ্ছিল ভাল খেলার জন্য।কিন্তু গোল করার কোন সুযোগই পেল না চয়ন। সুযোগটা এল খেলা শেষ হওয়ার ঠিক তিন মিনিট আগে। চয়নের পা থেকে বেরিয়ে যাওয়া কামানের গোলার মত একটা বল সোজা প্রতিপক্ষের গোলে ঢুকে গেল। হাততালিতে ফেটে পড়ল সারা মাঠ। ওভারটাইমের পর খেলা শেষ আরো আধঘন্টা পরে। আরো দুটো গোল দিয়েছিল চয়ন, জিতিয়ে দিয়েছিল রমাপদবাবুর দলকে।হাততালিতে ফেটে পড়েছিল চারিদিক, চয়নকে মাথার ওপর তুলে নিয়ে তারা বেরিয়েছিল মাঠ থেকে।

খেলার পরে অনেক বক্তৃতা ও অনেক সম্বর্ধনা শুনতে হল চয়নকে। সবাই একে একে রমাপদবাবুর প্রশংসা করে গেলেন, চয়নের নাম একবারও কেউ উচ্চারণ করলেন না। চয়ন লক্ষ্য করল যে বেলা বাড়ার সাথে সাথে তার আদর ও আপ্যায়ণ ক্রমশ কমতে শুরু করল। রাত ক্রমশ বাড়ছে দেখে চয়ন রমাপদবাবুর খোঁজ করার চেষ্টা করল। রমাপদবাবুকে কোথাও দেখতে পেল না।একজনের কাছে জানতে পারল যে রমাপদবাবু অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছেন। চয়নকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছনোর ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। চয়ন যখন দেখল তার সাহায্যের কেউ এগিয়ে আসবে না তখন মনস্থির করে ফেলল। এই গ্রামের হয়ে কোনদিন আর ফুটবল খেলবে না। আর বেশি রাত হওয়ার আগে কাজের পোলের ওপর তাকে উঠতেই হবে। ভূতকে চয়ন ভয় পায় না, আর একটা কি দুটো গুন্ডা বদমাইশকে জব্দ করার মোট ক্ষমতা চয়নের আছে। নির্ভয়ে আর নিশ্চিন্ত মনে হাঁটা দিল কাজের পোলের উদ্দেশে। আপন মনে হাঁটছিল চয়ন। মনে পড়ছিল এই কাজের পোলকে নিয়ে শোনা কত ঘটনার কথা। পাড়ার বলাইদা একবার নাকি কাজের পোলের ওপর দিয়ে ফিরছিলেন রাত্রিবেলায়, হঠাৎ তাঁর মনে হল একটু দুরে কে একজন উবু হয়ে বসে আছে। আকার দেখে মনে হল একটা কুকুর। এত রাতে একটা কুকুর এই কাজের পোলের ওপর বসে আছে কেন? একটু ভয় ভয় করছিল বলাইদার। কিন্তু বলাইদা সাহসী লোক, ভূতটুত মানেন না। সাবধানে এগোলেন পা টিপে টিপে সতর্কভাবে হাতের লাঠিটাকে শক্ত হাতে চেপে। নিঝুম রাত, চারিদিক নিস্তব্ধ। একটা পেঁচা তার ডানা ঝাপটিয়ে ঠিক ওই সময় মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।বলাইদা চমকে উঠলেন ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর যা দেখলেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। সত্যি একটা রাস্তার কুকুর উবু হয়ে বসে আছে। বলাইদা কাছে আসতেই ভয় পেয়ে দৌড় দিল সে। হয়ত বালাইদাকে দেখে ভূত ভেবেছিল। চয়ন আর বন্ধুরা খুব একচোট হেসেছিল বলাইদার গল্পটা শুনে। ঘটনাটা আবার মনে পড়ে যাওয়ায় চয়নের আবার হাসি পেল। চয়ন এতক্ষণ খেয়াল করেনি যে সে প্রায় কাজের পোলের মাঝামাঝি এসে পড়েছে। খুশী হল চয়ন, আর অল্পক্ষণের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাবে। গুনগুন করে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ যাবার পর পিছন থেকে, না ভুতের নয় একজন রক্তমাংস মানুষের জুতোর শব্দ কানে এল চয়নের। চয়ন তার হাঁটার গতি কমিয়ে ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল। মনে হল এক ভদ্রলোক চয়নের দিকে তাড়াতাড়ি করে আসার চেষ্টা করছেন।

একমিনিট পরেই তিনি চয়নকে ধরে ফেললেন। আপাদমস্তক দেখল চয়ন। পুলিশের পোষাক পরা।আশ্বস্ত হল চয়ন। যাক বাকি রাস্তাটা নির্ভয়ে যাওয়া যাবে। 

“আপনার গানের গলাটা ভারী সুন্দর। তা কোথায় যাচ্ছেন এত রাত্রে কাজের পোলের ওপর দিয়ে?” ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
“আমার আজ ফুটবল খেলা ছিল পাশের গ্রামে, গাড়ি পাওয়া গেল না তাই হেঁটে ফিরছি। আমার নাম চয়ন। আপনি স্যার আমাকে আপনি বলবেন না। আমি স্কুলে পড়ি। কার্জন পোল যেখানে শেষ হয়েছে তার ডান দিক দিয়ে যে রাস্তাটা বেরিয়ে গেছে, সেই রাস্তার ওপরেই আমার বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে কার্জন পোল দেখা যায়।“ চয়ন আলাপ জমানোর চেষ্টা করল। 
“তা ভালো। আজকালকার ছেলেছোকারাদের বিশ্বাস নেই, কখন কি বলে দেবে, তাই আপনি করেই বলি। আমিও ঐদিকেই যাব, ভালই হল দুজনে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। তুমি ফুটবল খেল খুব ভাল কথা। বদ সঙ্গে মেশার থেকে অনেক ভাল। যা দিনকাল পড়েছে তাতে ভালো হয়ে থাকাই মুশকিল আজকালকার দিনে।“ ভদ্রলোক উত্তর দিলেন।
“আজকের রাতটা কেমন অদ্ভুত, তাই না স্যার? আকাশে একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না, কুয়াশাটাও বেশ ঘন। আমাদের গ্রামে এই কাজের পোলটাকে নিয়ে কত যে ভয়ের রটনা আছে আপনাকে কি বলব, সত্যি কথা বলতে কি এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার আগে আমিও অনেক চিন্তা করেছি| আমার কাকা না একদম পছন্দ করেন না আমি এই কাজের পোলের ওপর দিয়ে রাত্রিবেলা একা একা ফিরি খেলার পরে| সত্যি কথা বলতে কি আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমারও গাটা ছমছম করছিল।”  চয়ন বলল।
“তোমার ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তারপর আজকের মত এই রকমের একটা রাতে। ঐসব ভুতের গল্প আমিও অনেক শুনেছি। প্রথম যখন আমি টহল দেওয়া শুরু করি তখন আমারও যে গাটা ছমছম করতো না বললে ভুল বলা হবে।” ভদ্রলোক সহজভাবেই বললেন।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার যদি কিছু মনে না করেন?” চয়ন প্রশ্ন করল। 
“হাঁ, বল না।”
“প্রশ্নটা খুব বেকার মত শোনাবে তাই জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছিল। আপনাকে তো স্যার প্রায়ই এই পোলের ওপর দিয়ে একা একা যাতায়াত করতে হয়, তাই না? আপনি কি কখন রোমাঞ্চকর বা সেরকম ভয়ংকর কিছু দেখেছেন যাতে লোমকূপ পর্যন্ত খাড়া হয়ে যেতে পারে?” চয়ন ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল|
ভদ্রলোক একটু চুপ করে রইলেন তারপর বললেন “সত্যি কথা বলতে কি তুমি ঠিক যে রকমটি শুনতে চাইছো, আমি ঠিক সেরকম কিছু কোনদিন দেখিনি। তবে ধর আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে এমন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ফলে আমার জীবনটা সম্পূর্ণ ওলটপালট হয়ে গিয়াছিল।সেদিন আমার মনের যা অবস্থা ছিলো, তোমায় দেখে মনে হচ্ছে আজকে তোমার মনের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। ঘটনাটা তাহলে খুলে বলি, আশাকরি তোমার ভালো লাগবে।”  ভদ্রলোক জবাব দিলেন|
চয়ন একটু কাছে সরে এল একটা জমাটি গল্প শোনার জন্য। ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।চয়নের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে উনি ঘটনাটি স্মরণ করার চেষ্টা করছেন। চয়ন অপেক্ষায় রইল।
“সেই রাতটা ঠিক আজকের রাতটার মত ছিল না। দুপুরের পর থেকেই একটা বিশাল কালোমেঘ আকাশটাকে ঢেকে দিয়েছিল। ঠান্ডাটা বাড়ছিলো হু হু করে। দিনটা ফুরনোর আগেই রাত নামল।বৃষ্টিটা নামল সন্ধের পর থেকে। রাতটা বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির তেজটাও বাড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে দাঁতাল হওয়ারা নেমে এল তাদের খেলা দেখানোর জন্য। আমার আবার ঐদিন একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য তোমাদের গ্রামের কাছাকাছি একটা গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। পুলিশের জিপটা খারাপ হওয়ায় আমার কাজের পোলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না।গায়ে বর্ষাতিটা চাপিয়ে কপালে যা লেখা আছে বলে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টি ঝরছিল রমঝম রমঝম আওয়াজ করে, আর তার সাথে মাঝে মাঝে ঝড়ো দমকা হওয়া হাহা হাহা করে ডাকছিল আহত প্রেতাত্মার মত। মাঝে মাঝে আকাশটাকে দুফাঁক করে বিদ্যুতের চমক সমস্ত জায়গাটাকে কিছুক্ষণের জন্য ঝলসিয়ে দিয়ে আবার গাড় অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছিল। অথচ ঠিক আগের দিনটার কথা মনে করলে অবাক লাগে। দুটো দিনের মধ্যে কত তফাৎ। আগের দিন আমি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আমি সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। একটা জিনিষ সব কিছুকে ছাপিয়ে আমাকে বিরক্ত করছিল।সেটা হল আমার ভীষণরকম ভয় করছিল। কোথা থেকে কে জানে একটা অজানা অচেনা ভয় আমাকে গ্রাস করার চেষ্টা করছিল। কোন কারণ ছাড়াই আমার ভয় করছিল আর সেইজন্যেই আমার বিরক্ত লাগছিল।“
ভদ্রলোক থামলেন বোধহয় দম নেওয়ার জন্য। চয়নের বেশ ভালো লাগছিল গল্পটা শুনতে। গল্প বলায় ভদ্রলোকের বেশ মুন্সিয়ানা আছে। মনে মনে তারিফ না করে পারল না চয়ন। 
ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন “বৃষ্টি আর হওয়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোন কিছুর আওয়াজ পাইনি প্রায় আধঘন্টা ধরে। মনে হচ্ছিল ঝড়ো হওয়া আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমাকে বলছিল যা ফিরে যা আর এগোস না। কিন্তু যা বলছিলাম. আমার ভয় লাগছিল। আমার ব্রেনের কোন একটা অংশে এই ভয়টা বাসা বেঁধেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু ভয়টাকে কাটিয়ে ওঠার মত কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি বর্ষাতিটাকে দিয়ে শরীরটা ভালো করে ঢেকে নিলাম। মন থেকে এইসব চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলাম। আজকের তদন্তটা কি ভাবে করা যায় এই নিয়ে চিন্তা শুরু করলাম। তদন্তটা ছিল গতকাল রাত্রে কাজের পোলের ওপর একটা খুন হয়, সেই ব্যাপারে। দুজন গুন্ডার নাম আমার সন্দেহের তালিকায় ছিল। তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর করার জন্যই আমার গ্রামে যাওয়ার দরকার ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে খুনের পিছনে ওই দুজনের হাত আছে। ওদের দুজনকে জেলে ঢোকাতে না পারা পর্যন্ত আমার মনে শান্তি আসবে না। কিন্তু পুলিশের কাজে সাক্ষী সাবুদ যোগাড় করা দরকার। কি করে এইসব ঠিকভাবে যোগাড় করা যায় এইসব চিন্তায় নিজেকে মগ্ন করলাম।'
"আমরা এখন যে জায়গাটার কাছে এসেছি, হাঁটতে হাঁটতে আমি সেদিন ঠিক এই জায়গাটা অবধি পৌঁছেছিলাম| হাঁ আমার ঠিক মনে আছে, ওই যে দেখছ একটা সিঁড়ি পোল থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে| সত্যি কথা বলতে কি আমি ওই সিঁড়িটার দিকেই তাকিয়েছিলাম, তাই খেয়াল করতে পারিনি যখন দুটো লোক হঠাৎ আমার সামনে উদয় হল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। লোক দুটোকে আমি চিনি। ওদেরই আমি সন্দেহ করেছিলাম গতকালের খুনের ব্যাপারে।ওদেরই খোঁজখবর করার জন্য আজ আমি বেরিয়েছিলাম। লোকদুটো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। হাসিটার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যে ভয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কিন্তু প্রকাশ্যে আমি দেখালাম না যে আমি ভয় পেয়েছি।“
ভদ্রলোক চুপ করলেন কিছুক্ষণের জন্য।
শুরু করলেন আবার ”আচ্ছা ওই যে আলো জ্বলছে দুরের ওই বাড়িটায় ওটাই বোধহয় তোমাদের বাড়ি, তাই না? গল্প করতে করতে কখন যে এতটা পথ চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি। যাই হোক গল্পটা যখন শুরু করেছি তখন শেষ করাই ভালো। রাস্তা আর যতটা বাকি আছে তাতে আমার মনে হয় গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। আমার গল্পটা শেষ হলেই তুমি এক ছুটে বাড়ি পৌঁছে যাবে। আমি চাইনা তুমি কাজের পোলের ওপর দিয়ে ফেরার সময় আর কখন ভয় পাও। 
"হাঁ যা বলছিলাম। একটা মিনিট মনে হচ্ছিল একটা ঘন্টা। মিনিট আর ঘন্টায় মনে পড়ে গেল ওদের মধ্যে একজন আমার কাছে কটা বাজে জানতে চাইল। আমি সময়টা দেখার জন্য রেডিয়াম দেওয়া রিস্টওয়াচটার দিকে তাকালাম। দেখলাম দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। উত্তর দেওয়ার আগেই দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। বুঝতে অসুবিধে হল না আমাকে অন্যমনস্ক করার জন্যই ওরা সময়টা জানতে চেয়েছিল। একজনের হাতে ছিল ছুরি। আমি যে পুলিশের লোক এইকথাটা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম কিন্তু বৃষ্টি আর দুর্যোগের জন্য কোন কথা ওদের কানে গেল না। বর্ষাতিটা আমার গায়ে আঠার মত চেপে বসেছিল, নড়াচড়া করতে অসুবিধা হচ্ছিল। পিস্তলটাও বের করার সময় পেলাম না। আমি পুলিশের কায়দায় ওদের সঙ্গে লড়াই করলাম| কিন্তু ওরা দুজন আর আমি একা, কতক্ষণ ওদের আটকাতে পারব বুঝতে পারছিলাম না। আচ্ছা তিন মিনিট কতটা সময় জানো? আমিও জানতাম না। সেদিন প্রথম জানলাম। প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারিনি। এক পলকের জন্য দেখলাম একটা বিদ্যুতের ঝলক, বিদ্যুতটা নামল ঘাড়ের কাছাকাছি, ঢুকে গেল একেবারে শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে, ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। ভারি কিছু একটা পড়ার শব্দ কানে এল।তারপর সব চুপ চুপচাপ, সব নিস্তব্ধ। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল ঝরণার জল পড়ার আওয়াজ। ঠিক যেন কেউ জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে। কি মিষ্টি সেই সুর। আমার চোখের সামনে প্রথমে একটা তারপর দুটো তারপর বাড়তে বাড়তে অনেক অনেক আলো, মালার মত দুলতে লাগল।কয়েক মিনিট সেই শান্ত সুন্দর ও স্বর্গীয় পরিবেশটা উপভোগ করলাম। বিশ্বাস করো মৃত্যু যে এত সুন্দর হতে পারে আগে জানতাম না। আমি সেদিন মারা না গেলে কোনদিন জানতেও পারতাম না|”
চয়ন তন্ময় হয়ে শুনছিল এতক্ষণ। চোখটা তুলে তাকাল। বলতে গেল “বাঃ খুব ভালো গল্প বলেন তো আপনি, আপনি নিশ্চয়ই লেখেন টেখেন, তাই না?”
ভদ্রলোককে কোথাও দেখতে পেল না চয়ন। কর্পূরের মত উবে গেছেন ভদ্রলোক। সে একদম একা দাঁড়িয়ে আছে কাজের পোলের ওপর, তার ধরে কাছে কেউ নেই। বিস্মিত, হতবাক আর ভয়ে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে রইল কাজের পোলের ওপর অল্পক্ষণ। বহু দূর থেকে একটা বুকফাটা আর্তনাদের আওয়াজ কানে এল। কানে হাত দিল আওয়াজটা চাপা দেওয়ার জন্য। একটা কনকনে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করল তার পিঠের ওপর। গাটা শিরশির করে উঠল।  বোটকা একটা গন্ধ নাকে এল। গাটা গুলিয়ে উঠল তার। দূরে একটা আলোর মালা দেখতে পেল। মালাগুলো দুলতে দুলতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। 
কানে কানে ফিসফিস করে কে যেন কিছু বলল তাকে, কিন্তু সে বুঝতে পারল না। 
ভয়ে খাড়া হয়ে থাকা তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ তাকে বলতে লাগল পালাও চয়ন, যত জোরে তোমার পা চলে ছুটে পালাও এখান থেকে। চয়ন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো বাড়ির উদ্দেশে, ভয়ে তার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে চয়ন পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে প্রথম ধাপেই পাটা আটকে গেল চয়নের। কাকিমা দাঁড়িয়ে আছেন ওপরে, মুখটা থমথমে|
“রাত প্রায় বারোটা বাজে চয়ন। এতক্ষণে তোর ফেরার সময় হল? সব কিছুর একটা সীমা আছে।পই পই করে বারণ করা সত্ত্বেও তুই সেই কাজের পোলের ওপর দিয়ে ফিরেছিস?” কাকিমার থমথমে গলা শুনতে পেল চয়ন।
“না কাকিমা তুমি ভুল করছ, অত রাত হয়নি, এই দেখো ..........” চয়ন তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেল। তার ঘড়িটা হয়ে বন্ধ গেছে অনেকক্ষণ, সময়ের কাঁটাগুলো ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়, কাঁটাগুলো নড়ছে না। না শুধু সেই কারণে অবাক হয় নি চয়ন।
তার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে দশটা বাজার ঠিক দু মিনিট আগে। সিঁড়ির মাথার ওপর রাখা বিদেশী দেওয়াল ঘড়িটা ঠিক সেই সময় টুং টাং আওয়াজ করে রাত বারোটা বাজার সময় ঘোষণা করল। 

ভ্রমণ

হাওয়াকলের শহর

হাওয়া কলের 

শহর  

দেবযানী পাল

IMG_6176.GIF

দেবী লিডউইনা

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

IMG_6237.JPG

উইন্ড-মিল

IMG_6164.JPG

বিশেষ পুরোনো বাড়ি

জব শহর  স্কীডাম( Skidam)l এ শহরের বিশেষত্ব  হল, এখানে  এখনও বেশ কয়েকটি হাওয়া-কল (windmill) সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট-বড় খাল (canals), বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, সুন্দর পরিস্কার পথ দিয়ে শহর সাজানো। এই শহরের দেবী হলেন, সন্ত লিডউইন (saint Lidwina)I 1230 সালে স্কী (Schie) নদীর ধারে স্কীডাম শহরের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এককালে স্কীডামকে জেনিভারের (Jenever) শহর বলা হত। আর জেনিভারের ব্যবসাযের জন্য প্রখ্যাত এ শহরের অপর নাম অষ্টাদশ শতকে ছিল "Black Nazareth”। ১২৭৫ সালে স্কীডাম স্বাধীন শহর নামে ঘোষিত হয। এ ছাডা, শহরটি সন্ত Lidwina-র জন্য বিখ্যাত। এর সন্মানে এখানে লিডউইনা ব্যসিলিকা( Basilica) তৈরী হয়। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে Saint Lidwinaর জন্য, এ শহরে ভক্তদের আনাগোনা শুরু হয়, কারণ স্কীডাম থেকেই সন্তের খ্যতি সর্বত্র ছড়িয়ে পরে।লিডউইনা ব্যসিলিকা ছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটা ঐতিহাসিক মনুমেন্ট আছে।১২৩০ সালে স্কীডামের  ভিত স্থাপিত হয়। ১২৭৫ সালে এ শহর নানারকম স্বাধীনতা পায়। এ সময রিভিযেরা দূগঁ তৈরী হয স্কি নদীর ধারে। ১৫ শতক থেকে এ শহরে ভক্তদের আনাগোনা শুরু হয় l কিন্তু ১৪২৮ শতকে এ শহর অগ্নিদগ্ধ হয়। পঞ্চদশ শতক থেকেই, অপর এক কারণে এই শহর খ্যত হয়: হারিং মাছ।
স্কীডামের বিশেষত্ব হল হাওয়াকলগুলো (Windmills)| বড় ছোট মিশিযে বেশ কয়েকটি হাওয়াকল এ শহরকে সুসজ্জিত করেছে। সবকটির বিভিন্ন নাম আছে। যেমন,

1)  De Drie Koornbloemen: (The three Cornflowers)
2)  De Karmeel.
3)  De Noord. (উত্তর দিক)।
4)  De Palmboom. (তাল গাছ)।
5)  Molen de  Vrijheid.( স্বাধীনতা-কল)
6)  Molen de Walvisch(হোয়েল-মাছের হাওয়া কল)
7) De Nolet: গুলোকে বলা হয়, ঐতিহাসিক স্তম্ভ। এখানে জাতীয় হাওয়াকল দিবস মহাসমারোহে পালিত হয়। 
সত্যই দেখার মতো সব স্তম্ভগুলো। পাশ দিয়ে হাঁটলে মনে হয় যেন অতীতে ফিরে গেছি। হল্যান্ড sea level থেকে নীচে বলে ওলন্দাজেরা (ডাচ) জলের সাথে যুদ্ধ করেছে, এখনও করছে, স্কী (Schie) নদীতে বাঁধ দিযে, লবনাক্ত সমুদ্রের জল থেকে স্কীডাম শহরকে রক্ষা করা, আরও কত কী! ১২৪৭ সালে Delft, Leiden আর Haarlem, হল্যন্ডের এই তিন শহরের সাথে স্কীডামের বানিজ্য শুরু হয়, আর স্কীডামের উন্নতির ভিত্তিও স্থাপিত হয়। এ শহরে নানারকম, স্বাধীনতাও মেলে। ১৩৪০ সালে, Rotterdam আর Delft শহরের সাথে স্কীডামের যোগাযোগ হয়, কারণ স্কীডাম তীর্থ স্থান বলে মনে করা হত, সন্ত Lidwina(1360-1433)র জন্য।

বিংশ শতকে, উন্নত শহর স্কীডাম, জমজমাট। জাহাজ তৈরীর কাজ, আর সেই সংগে লিডউইনা আর, অন্যান্য ক্যথলিক গির্জাসমুহের আডম্বর, বানিজ্যের শহর স্কীডাম শুধু সামনে আপন গৌরবে শুধু সামনে এগিয়ে চলেছে। 

IMG_6247.JPG

আধুনিক সেন্ট্রাল স্টেশন

প্রবন্ধ

কেদারনাথ মজুমদার

কেদারনাথ মজুমদার

ও সৌরভ 

দিলীপ মজুমদার

পর্ণশ্রী, কলকাতা

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কেদারনাথ_মজুমদার.jpg

১.
৩১৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘সৌরভ’। প্রায় দুই যুগ নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকাটি। বাংলার বিখ্যাত পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘অরণি’, ’বান্ধব’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে একাসনে বসার দাবি রাখে ‘সৌরভ’। ময়মনসিংহ তখন ঢাকার মতো শহর হয় নি। সেই সুদূর ময়মনসিংহ থেকে এ রকম পত্রিকা প্রকাশ করা এবং তার ধারাবাহিকতা বজার রাখা কেদারনাথের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। আর একটা কথা, এই পত্রিকায় মূলত ময়মনসিংহ ও পাশ্ববর্তী লেখকদের লেখাই প্রকাশিত হয়। কলকাতা বা ঢাকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকদের লেখার জন্য কেদারনাথ লালায়িত হন নি। এ বিষয়ে  ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপদেশ সর্বদা স্মরণ রেখেছিলেন কেদারনাথ।
চন্দ্রকুমার দের বক্তব্যে এই বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘কেদারনাথ তাঁহার সমস্ত কর্মশক্তি এককালে ময়মনসিংহের সাহিত্যিকগণের বিশ্ববিদ্যালয়স্বরূপ সৌরভে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল ময়মনসিংহে একদল নতুন লেখক সৃষ্টি করা। বাঙ্গালার কোন উপবিভাগে বিশেষত ময়মনসিংহের মতো জিলায় একখানা মাসিকপত্র পরিচালনা করা কিরূপ কষ্টসাধ্য তাহা হয়ত কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না।’
এই পত্রিকার জন্য কেদারনাথ তাঁর আর্থিক ও মানসিক শক্তি ব্যয় করেছেন। শুধু তাই নয় , ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘বঙ্গদর্শন, ‘সবুজপত্র’ প্রভৃতি পত্রিকার মতো তিনি তৈরি করেছিলেন এক লেখকগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন চন্দ্রকুমার দে, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন সিংহ, পরমেশপ্রসন্ন রায়, অক্ষয়কুমার মজুমদার, অনঙ্গমোহন লাহিড়ী, কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী, প্রিয়গোবিন্দ দত্ত, উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিজয়নারায়ণ আচার্য, মনোরঞ্জন চৌধুরী, বনমালী গোস্বামী, রসিকচন্দ্র বসু, অমরচন্দ্র দত্ত, গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ, কুমুদচন্দ্র সিংহ, অমৃতলাল চক্রবর্তী, পূর্ণচন্দ্র ভট্টচার্য, অমরচন্দ্র দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র দাস, সুন্দরী দাশগুপ্তা, হেরম্বচন্দ্র চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী, মহেশচন্দ্র ভট্টচার্য, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, সুধীরকুমার চৌধুরী, ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখেরা। এই গোষ্ঠীকে ‘কেদারমণ্ডলী’ নাম দিয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য।
কেদারনাথের লেখক তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে মজার কাহিনী বলেছেন চন্দ্রকুমার দে। প্রথমে তিনি ‘সৌরভে’ প্রকাশের জন্য তিনটি কবিতা পাঠান। সেগুলি প্রকাশিত হয় নি। চন্দ্রকুমার নিরুৎসাহিত হয়ে লেখা পাঠানো বন্ধ করেন। কিছুদিন বাদে তিনি কেদারনাথের একটি চিঠি পান। চিঠিতে লেখা  ---‘ একেবারে নিভিয়া গেলেন কেন?’ তারপর চন্দ্রকুমার ময়মনসিংহের মেয়েলি সংগীত বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠালেন। সে লেখাও অমনোনীত হল। চন্দ্রকুমার প্রতিজ্ঞা করলেন আর কোন লেখা পাঠাবেন না। তারপরে কেদারনাথ তাঁকে একটি চিঠিতে লিখলেন – ‘তুমি আমার সঙ্গে দেখা কর’। দেখা হবার পর কেদারনাথ তাঁকে বাংলা বানান, বাক্যরচনাপদ্ধতি, বিষয়বিন্যাস সম্পর্কে অবহিত করেন।
কেদারনাথের উদ্যোগে ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সৌরভ সাহিত্য সংঘ’। এই সংঘের প্রথম সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত আইনজীবী সারদাচরণ ঘোষ দস্তিদার। যেসব বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন দুর্গাদাস রায়, রাজেন্দ্রকুমার শাস্ত্রী, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ।
সংঘের প্রথম অধিবেশন প্রসঙ্গে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় লেখা হয়:
‘ময়মনসিংহে সাহিত্যচর্চার জন্য একটি সুহৃদ সমাজের প্রতিষ্ঠা সৌরভের অন্যতম উদ্দেশ্য। একপ্রাণ একনিষ্ঠ  একটি সুহৃদ সমাজের প্রতিষ্ঠা এবং সাহিত্যের উন্নতি একসূত্রে গ্রথিত। কাব্যই হউক আর ইতিহাসই হউক, দর্শনই হউক আর বিজ্ঞানই হউক, ভাবের বিনিময় না হইলে হৃদয়ের শক্তি সঞ্চার হয় না, তাহার অনুসন্ধান হয় না এবং সাহিত্যের অঙ্গ পুষ্ট হইতে পারে না। সাহিত্যের সৌরভে ময়মনসিংহের সাহিত্যসেবকগণ যদি সমবেত হইতে পারেন তাহা হইলে উহার অপেক্ষা আনন্দের বিষয় আর কি আছে?’ কেদারনাথের নিরলস চেষ্টায় ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন মহকুমায় সাহিত্য সম্মেলন ও সাহিত্য আলোচনাসভার সূত্রপাত হয়। গঠিত হয়:
কিশোরগঞ্জের সাহিত্য সম্মিলনী, গৌরীপুরের পূর্ণিমা সম্মেলন, মুক্তাগাছার ত্রয়োদশী সমিতি, জামালপুরের  সাহিত্য সভা, টাঙ্গাইলের সাহিত্য সংঘ, নেত্রকোণার পূর্ণিমা সম্মিলনী।
সৌরভ সাহিত্য সংঘের লেখকদের কেদারনাথ ময়মনসিংহের গ্রাম্য শব্দ সংগ্রহ, প্রাচীন কবিদের গীত সংগ্রহে  উৎসাহিত করেন। প্রাচীন লুপ্তপ্রায় সাহিত্য উদ্ধারে তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর। পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যকে তিনি ঘাটুগান, সারি গান, রাখালের গান, মেয়েলি গীত সংগ্রহ করতে পরামর্শ দেন। মহেশচন্দ্র কবিভূষণকে পরামর্শ দেন রামগতির টপ্পা সংগ্রহ করতে। তাঁরই উৎসাহে চন্দ্রকুমার দে লোকগীতি সংগ্রহ শুরু করেন। তিনিই চন্দ্রকুমারকে দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি দীনেশচন্দ্রের অনেক ভ্রম-প্রমাদ সংশোধন করে দেন; বিশ্ববিদ্যালয়ে ময়মনসিংহ গীতিকা পড়াতে গিয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হলে কেদারনাথই তাঁকে সাহায্য করেন।

২.  

বহু বছর আগে, এম এ পড়ার সময়ে প্রায় প্রতিদিন যেতাম জাতীয় গ্রন্থাগারে। পুরাতন পত্রিকার পাতা ওল্টানো ছিল আমার একটা নেশা। এভাবেই একদিন পেয়ে যাই ‘সৌরভ’ পত্রিকাটি।

আমি মাস দুয়েকের চেষ্টায় সে পত্রিকার পূর্ণাঙ্গ সূচিপত্র তৈরি করি। যেমন সূচি তৈরি করেছিলাম ‘অরণি’র। প্রায় কুড়ি বছর বাদে ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায়ের পরামর্শে সেই সূচিকে নিয়ে তৈরি করি একটি বইএর পাণ্ডুলিপি: ‘কেদারনাথ মজুমদার ও সৌরভ’। নিশীথরঞ্জন রায়ের উদ্যোগে কলকাতার ময়মনসিংহ সম্মিলনী সেই বই প্রকাশ করেন। আবার বহু বছর বাদে সে বইএর নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে চলেছেন ঢাকার সাহিত্য প্রকাশের কমলকান্তিবাবু। আমার ইচ্ছা ছিল ‘সৌরভে’র একটা সংকলন প্রকাশ করা। সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয় নি। তবে ঢাকার বাংলা একাডেমি সে সংকলন প্রকাশ করেছেন  ‘নির্বাচিত সৌরভ’ নামে। ৬৮৮ পৃষ্ঠার এই সংকলন গ্রন্থের সূচিপত্রটি এই রকম:
১] ভাষা ও সাহিত্য,
২] সমাজ ও সংস্কৃতি.
৩] ইতিহাস ও সভ্যতা,
৪] মুদ্রণ ও প্রকাশনা,
৫] গল্প,
৬] কবিতা, 
৭] সৌরভ ও কেদারনাথ প্রসঙ্গ,
৮] পুস্তক পরিচয় ,
৯] সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গ,
১০] বিবিধ,
১১] পরিশিষ্ট,
১২] নির্বাচিত আলোকচিত্র
পত্রিকাটি প্রথম পাঁচ বছর ঢাকার ২৬ নম্বর বেচারাম দেউড়ির জগৎ আর্ট প্রেস থেকে সতীশচন্দ্র রায় কর্তৃক মুদ্রিত হয়। পঞ্চম বর্ষের ষষ্ঠ সংখ্যা থেকে ‘সৌরভ’  মুদ্রিত হতে থাকে ময়মনসিংহের লিলি প্রেস থেকে। মুদ্রক ছিলেন রামচন্দ্র অনন্ত। এর পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে নিজগৃহে একটি প্রেস স্থাপন করেন কেদারনাথ। তিনি নিজেই অক্ষরস্থাপনা করতেন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ৩২ পৃষ্ঠা ছিল, পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ পৃষ্ঠায়। ময়মনসিংহে ছাপা হলেও কলকাতা থেকে তৈরি হত ব্লক এবং ঢাকার প্রেস থেকে মুদ্রিত হত ছবি।
দেবেন্দ্রনাথ মহিন্তা, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, মনমোহন সেন, চন্দ্রকুমার দে, গোবিন্দচন্দ্র দাস, হৈমবতী দেবী, রমণীমোহন ঘোষ, অম্বুজাসুন্দরী দাসগুপ্তা, সুরেশচন্দ্র সিংহ, নরেন্দ্রনাথ ঘোষ, অমরেন্দ্রনারায়ণ আচার্য চৌধুরী, কুমুদবন্ধু ভট্টাচার্য, হরিপ্রসন্ন দাসগুপ্ত প্রমুখ কবিরা এই পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন।
গল্প লিখেছেন সুরেশচন্দ্র সিংহ শর্মা, কেদারনাথ মজুমদার, গিরীশচন্দ্র চক্রবর্তী, কমলাদেবী, নরেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমুখেরা।
‘সৌরভে’ কয়েকটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল কেদারনাথ মজুমদার, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত , রেবতীমোহন সেন, সুরেন্দ্রলাল সেনগুপ্তের।
পত্রিকার মূল আকর্ষণ ছিল এর প্রবন্ধাবলী। প্রবন্ধগুলি ছিল যুক্তিনিষ্ঠ।

আমরা এমনি কয়েকটি প্রবন্ধ ও তার লেখকের নাম উদ্ধৃত করছি।  
চীনা চিকিৎসক / বঙ্কিমচন্দ্র সেন; জাপানে সাহিত্যচর্চা / যদুনাথ সরকার; হোমরীয়যুগের গ্রীক সমাজ / গৌরচন্দ্র নাথ; ময়মনসিংহের কবি কাহিনী / বিজয়নারায়ণ আচার্য; ঋগ্বেদে চন্দ্রগ্রহণ / তারাপদ মুখোপাধ্যায়; রবীন্দ্র জয়ন্তী / ফণীভূষণ রায়; খেলা বনাম ব্যায়াম / রবীন্দ্রনাথ গুহ; ময়মনসিংহের প্রাচীনকথা / গিরিশচন্দ্র সেন কবিরত্ন; উপন্যাস ও আর্ট / যতীন্দ্রনাথ মজুমদার; উপন্যাস ও অশ্লীলতা / যতীন্দ্রনাথ মজুমদার; ভারতীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন / বঙ্কিমচন্দ্র সেনগুপ্ত; ভাওয়ালের সন্ন্যাসীকুমার / রাজেন্দ্রকুমার শাস্ত্রী; গীতায় স্বরাজ / ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী; চিত্রাঙ্গদা কাব্যপ্রসঙ্গে / উপেন্দ্রকুমার কর; রামায়ণী যুগের বাণিজ্য / কেদারনাথ মজুমদার; বৈধ ও অবৈধ প্রণয় / চন্দ্রকুমার দে; ব্যাধি ও জীবাণু / যতীন্দ্রনাথ মজুমদার; রামায়ণী যুগের বয়ণ শিল্প /  কেদারনাথ মজুমদার; শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের রচনাকাল / বনমালী গোস্বামী; পূর্ব ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ / অচ্যুতচরণ চৌধুরী; প্রমাণ না বিশ্বাস / প্রিয়গোবিন্দ দত্ত; ব্রাহ্ম ও বৈষ্ণব / অমরচন্দ্র দত্ত; জ্ঞান ও কর্ম / উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য; খাদ্য / হরিচরণ গুপ্ত; গৌড়ের ভগ্নাবশেষ / রামপ্রাণ গুপ্ত; প্রাচীন পুঁথির পরিচয় / চন্দ্রশেখর তরফদার; সেকালের দণ্ডবিধান / রাজেন্দ্রকিশোর সেন; বাঙ্গালা বানান / বীরেশ্বর সেন; একান্নবর্তী পরিবার / যতীন্দ্রমোহন সিংহ; বাঙ্গালার সমাজ / রঞ্জনবিলাস রায় চৌধুরী; স্যমন্তক মণি বা হোপ ডায়মণ্ড / আশুতোষ ভট্টাচার্য; হিন্দু বিবাহ/কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী; গোবিন্দ প্রসঙ্গ / কেদারনাথ মজুমদার; পতঙ্গ ও মশক / যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য; ফিজির আদিম অধিবাসী / কেদারনাথ মজুমদার; নূতন রোগ / গিরিশচন্দ্র সেন; বাঙালীর দুর্গোৎসব / পূর্ণিমাপ্রভা রায়; সৌন্দর্য্য / বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী; স্ত্রীশিক্ষার আদর্শ / এস হাসান জামাল; প্রার্থনা / প্রভাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; আনন্দমোহন / চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; ওয়ার্ধা পরিকল্পনা / আবদুল হাকিম; মানুষের ব্যক্তিত্ব / বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

অথ মার্জার

কথা    

অদীপ রায়

ক্যালিফোর্নিয়া

girl.jpg
অথ মার্জার কথা

গল্প

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

adip_roy.webp

শুভেন্দুকে অকস্মাৎ ব্রেক কষে গাড়ির গতি কমাতে হল। রাস্তার পাশে বসে থাকা কালো-সাদা বিড়ালটা হঠাৎ রাস্তা পার হবার সিদ্ধান্ত নিলো। সকাল সাড়ে ন’টা বেজে গেছে তাই স্বরূপনগরের এই রাস্তাটা এখন একটু নির্জন। গাড়ি ঘোড়া বা লোকজন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। স্বরূপনগর একটি অভিজাত শ্রেণীর লোকদের বসবাসের জন্য খ্যাত। এখানে বেশিরভাগ বাড়িই বাগান সমেত, বাংলো ধরনের। আর সদ্য গজিয়ে ওঠা কিছু ফ্ল্যাট বাড়িও বেশ দামি আর সেগুলি অভিজাত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য তৈরি। অফিস কাছারি বা দোকান পাট বিশেষ নেই। দু’চারটে দোকান আছে, তাই দিনটা সোমবার হলেও রাস্তায় এই নির্জনতা। বেশিরভাগ আবাসিকই এই অঞ্চল থেকে কর্মসূত্রে সকাল ন'টার মধ্যে বেরিয়ে চলে যায়। বেলা বারোটার পর আবার স্কুল বাসের আনাগোনা শুরু  হবে। শুভেন্দুর সকাল দশটায় ডেন্টিস্ট বা দন্তচিকিৎসকের এর কাছে পৌঁছানোর কথা, হাতে একটু সময় আছে। তাই ভাবলেন, একটু অপেক্ষা করে, অন্য কোন গাড়িকে বিড়ালের পার হওয়ার জায়গাটা অতিক্রম করতে দেবেন। একসময় শুভেন্দুর এক বিহারী চালক ছিল, যে বিড়াল এইরকম রাস্তা “কেটে” দিলে কিছুতেই গাড়ি নিয়ে যেত না অন্য গাড়িকে আগে পার হয়ে যেতে দিত। ওর মতে বিড়ালের ‘রাস্তা কাটা’টা অশুভ লক্ষণ। শুভেন্দু এইসব কুসংস্কার মুখে না মানলেও এখন সেটা অগ্রাহ্য করতে সাহস পেল না। আজ মানসিকভাবে ও একটু দুর্বল। তবে এখন নির্জন রাস্তায় কোন গাড়িই আসছিল না। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মনে মনে বিড়ালটার বাপান্ত করে জায়গাটা অতিক্রম করে গেল; যা থাকে কপালে দেখা যাবে। 
গত সপ্তাহ থেকেই শুভেন্দুর একটি নিচের পাটির ‘মুলার টুথ’ যেটি ভেতরের দিকের খাদ্য চেবান’র দাঁত, বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছিল। নিজের চিকিৎসায় দুদিন ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়েও খুব একটা কাজ হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে গত বৃহস্পতিবার ওর  দাঁতের ডাক্তার অনন্ত যোশীর কাছে এসেছিল। উনি ঠোকাঠুকি করে সব দেখে শুনে, একটা এক্সরে করলেন। তারপর এক্সরে প্লেটটা  নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্য। দু চার মিনিট পর তার এক সহকারি এসে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে দিয়ে গেল। সেই সব যন্ত্রের মধ্যে সাঁড়াশি গোছের একটি যন্ত্রও ছিল। সেটা দেখেই ৬৫ বছরের শুভেন্দুর বুকটা কেঁপে উঠেছিল। প্রায় ছ ফুট লম্বা সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী শুভেন্দুর গা হাত পা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। একেই দাঁতের যন্ত্রণায় খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। রাতের ঘুমও ঠিকমতো হচ্ছে না। তার উপর এই অবস্থায় দাঁত তোলা হলে কি হবে এটা ভাবতেও পারছিল না? 

একটু পরেই ডক্টর যোশী ঘরে ঢুকে দস্তানার দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলেন। উনার চেম্বারে দামি ডেন্টাল চেয়ারে আধা শোয়া শুভেন্দু জিজ্ঞেস করেছিল,
- তুমি কি এখনই দাঁতটা তুলে ফেলবে?
মৃদু হেসে ডঃ যোশী বলেছিলেন,
- উপায় কি? তুমি ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছ আর ব্যথার ওষুধ কাজ করছে না। তাই এই অবস্থায় দাঁতটা তুলে ফেলাই ভালো, তাই না?      
ডক্টর যোশী উত্তরের জন্য শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বোধহয় ওর মুখের চেহারাটাতেই উত্তর পেয়ে গেলেন। তাই একটু হেসে বলেছিলেন। 
- ঠিক আছে আমি একটা এন্টিবায়োটিক আর আরও একটু কড়া পেন কিলার লিখে দিচ্ছি। তুমি এটা কদিন খেয়ে আবার আমার কাছে আগামী সোমবার সকাল দশটায় এসো। 

আজ সেই সোমবার। ইতিমধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করেছে। পেইন কিলার প্রায় খেতেই হয়নি শুভেন্দুকে।বলা-বাহুল্য রাতের ঘুমও ফেরত এসেছে। 

শুভেন্দুর গাড়ি এখন পাড়ার রাস্তা পার করে বড় রাস্তায়। আর সেই রাস্তায় যথারীতি সোমবারের যানজট। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে নজর গেল পাশের গাড়িতে। অত্যাধুনিক এক মহিলা সেই গাড়িতে বসে আছেন। আর ওনার কোলে একটি নাদুসনুদুস সায়ামিস  বিড়াল। অধুনা থাইল্যান্ড  দেশটি  ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত  সিয়াম নামে  পরিচিত ছিল। সেখানে এই বিশ্ববিখ্যাত সায়ামিস (সিয়াম থেকে) বিড়ালের জন্ম ও খ্যাতিবৄদ্ধি। এই জাতের বিড়াল নাকি কি খুবই বুদ্ধিমান হয় তাই সারা পৃথিবীর

বিড়াল-প্রেমীদের কাছে এর বিশেষ আকর্ষণ। তবে এখন ঐ হালকা ধূসর রঙের হৃষ্টপুষ্ট বেড়ালটা চোখের কাছে কালো ছোপ; তার মধ্য দিয়ে ওর নীল-সবুজ রঙের চোখটা দেখতে শুভেন্দুর মোটেও ভালো লাগছিল না। কেমন যেন রাগী রাগী দৃষ্টি। এই বিড়ালকে কি ভালোবাসা যায়?  
কুকুর, শুভেন্দুর প্রিয় গৃহপালিত জন্তু। যদিও তার নিজের বাড়িতে কুকুর নেই, তবে যেখানেই সে কুকুর দেখতে পায় তাদের আদর করতে ছাড়ে না।  এমনকি সকালে হাঁটতে গিয়েও বেশ কয়েকটি রাস্তার কুকুরের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। কিন্তু বিড়ালের প্রতি ওর একটু বিতৃষ্ণাই আছে। 

ইতিমধ্যে ট্রাফিক সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছে আর শুভেন্দু দশটার আগেই ডক্টর যোশীর চেম্বারে হাজির হল। দিনের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা নির্ধারিত সাক্ষাৎকার শুভেন্দুর। তাই গাড়ি পার্ক করার সঙ্গে সঙ্গেই ডক্টর যোশীর এক সরকারি এসে ওকে ভেতরে নিয়ে গেল। 

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ডক্টর যোশীর চেম্বার এর সব যন্ত্রপাতি একদম আধুনিক। কথিত আছে ১৭৯০ সালে একজন মার্কিনী দাঁতের ডাক্তার জোসিয়া ফ্ল্যাগ প্রথম একটি ডেন্টাল চেয়ার তৈরি করে দাঁতের ডাক্তারদের কাজের খুব সুবিধা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনকার সুদৃশ্য বৈদ্যুতিক চেয়ারের মধ্যে তার কোন নিদর্শনই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুভেন্দু ওই লাখ টাকার চেয়ারে আত্মসমর্পণ করল।
ডক্টর যোশী চেম্বারে ঢুকেই শুভেন্দুর কাছে দাঁতের খবর নিলেন। ভালো আছে জেনে, মাথার উপরের আলোটা টেনে নিয়ে, শুভেন্দুর দাঁত একটু ঠোকাঠুকি করে ভালো করে পরীক্ষা করলেন।
  - ফোলা ভাবটা একদম নেই মনে হচ্ছে সংক্রমণ যা হয়েছিল তা সেরে গেছে। আমি আর একটা এক্সরে করবো এখন।  

এক্সরে প্লেটটা মুখে ঢুকিয়ে, পোর্টেবল বা সহজে বহনীয় এক্সরে যন্ত্রে এক্সরে করে, এক্সরে প্লেটটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। এক্সরে প্লেটটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ছবি ফোটাতে হয়। 

এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত এবং শুভেন্দুর জন্য আনন্দদায়ক। হাতে এক্সরে প্লেটটা নিয়ে উনি ঘরে ঢুকে বললেন। 
- দাঁতটায় একটা ছোট্ট গর্ত আছে সেটা আপাতত ভর্তি করলেই কাজ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের সংক্রমণও বোধহয় রোধ করা যাবে। আর ওই দাঁতটা খাবার চেবানোর জন্য খুবই দরকারি। তাই রেখে দেওয়াই ভালো।

উনি পরবর্তী মিনিট দশেকের মধ্যে সেই সব করে ফেললেন। শুভেন্দুর বুকের থেকে যেন একটা মস্ত বড় পাথর নেমে গেল। নিজেকে পাখির মত হালকা আর খুশি মনে হচ্ছিল। ও এখন ইচ্ছে করলেই বোধহয় উড়তেও পারে।  

বাড়ি ফিরবার সময় যানজটকে আর অত বিরক্তিকর মনে হচ্ছিল না। সেই সব পার হয়ে খুব সহজেই ও স্বরূপ নগরের সেই নির্জন রাস্তায় এসে পড়ল। এবার গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার দু’পাশে ভালোভাবে নজরও রাখছিলো। আবার সেই সাদা-কালো বিড়ালটা দেখতে পেল। এখন বিড়ালটা রাস্তার পাশে প্রাণপণে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট মুখ দিয়ে খোলা চেষ্টা করছে। অন্য কোন দিকে তার মন নেই। শুভেন্দু আস্তে আস্তে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে, একটা দোকান থেকে এক ছোট প্যাকেটের দুধ কিনে সন্তর্পণে বিড়ালটার খুব কাছে হাজির হল। বিড়ালটা প্লাস্টিকের প্যাকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শুভেন্দুর আগমন টেরই পেলনা। এবার টের পেয়ে প্যাকেটটা ছেড়ে শুভেন্দুর দিকে তাকাল। তার চোখে ভয় মেশানো এক অসহায়তা। ভীত বিড়ালটা এখন পালাবার জন্য তৈরি। কিন্তু শুভেন্দুর হাতের দুধের প্যাকেটের দিকেও নজর রয়েছে তার। শুভেন্দু আস্তে আস্তে দুধের প্যাকেটটা বিড়ালটার দিকে দূর থেকে ঠেলে দিল। বিড়ালটা চোখে -মুখে সন্দেহের ছাপ। শুভেন্দু কয়েক পা পিছিয়ে এল। প্রথমে একটু সন্দেহের চোখে দেখে দ্রুতগতিতে বিড়ালটা দুধের প্যাকেট দাঁতে কেটে দুধ খেতে লাগল।

শুভেন্দু গাড়ির দিকে পা বাড়াল। উপরে তাকিয়ে দেখল রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ অজস্র লাল লাল ফুলে ভরে গেছে। পাতা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। অপরূপ সে দৃশ্য, শুভেন্দুর মন এক অব্যক্ত আনন্দে ভরে উঠল।   
 

গল্প

সায়াহ্নে 

শ্রেয়া বাগচী

ladies.jpg
সায়াহ্নে

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বশেষে কাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো। আর সবকটা আবাসিক এর মতো "সায়াহ্নে" বৃদ্ধাবাসও সাজবে এবার শারদীয়ার রংএ। আর দুইদিন পরেই মহাষষ্ঠী, প্রস্তুতি একদম শেষ পর্যায়ে । আয়োজন বিশাল বড়ো না হলেও উৎসাহ যেন উপচে পড়ছে সবার থেকে। কাহিনীর মনে পড়ে যায় তিন বছর আগের কথা। মা ও তো এরকম সময়েই চলে গেলেন। কাহিনীর মনে পড়ে শেষের দিকে মা আর কেমোথেরাপি টা নিতে যেতেন না, অনেকবার অনুরোধ করলেও পরচুলটা পড়তে চাইতেন না। ততদিনে কাহিনী সাইকোলজিস্ট  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শহরের নাম করা হাসপাতাল এ তার ভালোই সুখ্যাতি। মা চলে যাবার পর কোনো পুজোতেই কাহিনী শহরে থাকে না। কারণ পিছুটান তার নেই কোনো। বাবার কথা তো মনেই পড়ে না। না মনে পড়ে খুব আবছায়া অনেকটা ঘোলাটে পুকুর এর জল এর মতো। ভীষণ ভালো তবলা বাজাতেন বাবা। আর ছিল পাহাড়ে ট্রেকিং এর অদম্য ইচ্ছা। মা এর বারণ না শুনেই বাবা যে কত দুর্গম জাগায় যেতেন দলবল নিয়ে তা আজ আর কাহিনীর মনে নেই। সেই ট্রেকিংই তো শেষ করলো সব। আজীবন পাহাড় প্রেমী মানুষটা পাহাড়ের কোলেই চির ঘুমে ঢোলে পড়লেন। কাহিনীর তখন পাঁচ বছর বয়স হবে মনে হয়। মা বাবার পরেই যাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলো কাহিনী সে হলো আশুতোষ। সেই কলেজ এর সময় থেকেই আলাপ। আশুতোষ বরাবরই খুব মেধাবী, ইউনিভার্সিটির পর গবেষণায় চলে গেলো আশুতোষ। তারই মধ্যে বিয়েটা করে নিয়েছিল ওরা। কিন্তু আশুতোষ এর বিদেশ যাওয়ার পর থেকেই ওদের সম্পর্কের সমীকরণটা বদলাতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম দূরত্বের কারণ বলে নিজেকে বোঝানোর পর কাহিনী জানতে পারে আশুতোষ এর এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেসন এর ব্যাপারে। তারপর থেকেই ডিভোর্সটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেয়েছিলো কাহিনী তাই মা চলে যাওয়ার একবছর এর মধ্যে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা হয়েও গেলো ওদের। তারপর আর ওদের মধ্যে যোগাযোগ হয়নি। মা চলে যাবার ঠিক দুইদিন পর আশুতোষ একদিন ফোন করেছিল। যখন প্রথম যুক্ত হয় কাহিনী সায়াহ্নের সাথে তখন মাস এ দুটো রবিবার করে আসার কথাই ঠিক হয়েছিল কিন্তু এই দুই বছরে কাহিনী প্রায় সময় পেলেই, ছুটি পেলেই চলে এসেছে এখানে সায়াহ্নের কাছে, সায়াহ্নের মানুষগুলোর কাছে। সায়াহ্নে শহরের একটি নাম করা বৃদ্ধাশ্রম। কাহিনী এই বৃদ্ধাশ্রম এর সাথেই মা চলে যাওয়ার পর যুক্ত হয়। সায়াহ্নের বাসিন্দাদের কাছে কাহিনী যে কতটা তা বোধহয় বলে বোঝানো যাবে না। রবিবার বা ছুটির দিনগুলোতে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকেন সায়াহ্নের বৃদ্ধারা তাদের পরম স্নেহের পরম ভরসার "মনদিদির"জন্য। কাহিনীও যেন জড়িয়ে গেছে সায়াহ্নের সাথে মিশে গেছে এই মানুষগুলোর আবেগ, স্মৃতি, একাকীত্ব আর নিরাপত্তাহীনতার সাথে । আর কাহিনীর জীবন এর দুঃখকষ্টগুলোকেও তারা যেন নিজের বলে আলিঙ্গন করেছে। তাই কাহিনী ঠিক করেছে এবারের পুজোটা পুরোটাই ও এখানে কাটাবে। সাথে সাথে সায়াহ্নেও প্রথমবার দূর্গাপুজোর কথা মাথায় এসেছে। তবে ঝক্কি কম নিতে হয়নি ওকে। প্রথমে কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমতি, ডোনেশন, এডভার্টাইসমেন্ট, চাঁদা কালেকশন সবকিছুই ওকে শুরু করতে হয়েছে।বৃদ্ধাবাস এ যাঁরা আছেন তাদের থেকেও চাঁদা পেয়েছে কাহিনী। তবে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না , যে যেমন পেরেছেন দিয়েছেন। কিন্তু নিরাশ করেনি কাহিনীকে কেউই ওনারা। সবাই নিজের সাধ্যমতো দিয়েছেন। কাহিনীর অফিস কলিগ পৃথা আর বিদিশা আর কাহিনী মিলে গোটাটাই প্রায় গুছিয়ে এনেছে। আজ প্রতিমাও এসে গেছে। এক চালা মা এর প্রতিমা, হাতে অস্ত্রগুলো পরিয়ে দিচ্ছে বিদিশা। প্যান্ডেল সাজানোর কাজ ও প্রায় শেষ। মা এর গা এ কাগজ এর গয়না পড়ানোর পালা। দীপা পিসি, সায়াহ্নের বহুদিন এর বাসিন্দা কাছে এসে বললেন,

- "ও মনদিদি শোন্ এই টিকলি টা পরিয়ে দে না রে একটু মা এর কপালে। ওই উঁচুতে হাত যাবে না আমার। তুই বললি যবে পুজো করবি দেখ পেনশন এর টাকা জমিয়ে বানিয়ে ফেলেছি এটা"।

হাত এর একটা ছোট্ট সোনার দোকানের ব্যাগ থেকে বার করে দিলেন সোনার টিকলিটা। মুখার্জি দিদা দিলেন একটি সোনার টিপ। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন,

- "কি বা ক্ষমতা আমার, ছেলের কাছে বাড়তি টাকা চাইতে পারি না, ওষুধ কেনার টাকা থেকে বাঁচিয়ে এটা কিনলাম"। কণিকা দিদু ডাকলেন কাহিনীকে,

- "মনদিদিভাই এদিকে শোন্ একটু, তোর বন্ধু দিদিদের ও ডাক। দেখ প্রতিবার পুজোয় মেয়েকে বলি পুজোর কটা দিন আমাকে ওর কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে আর ছেলেরা তো সেই দেশ থেকে আসতেই পারে না এই সময়। এবার ও বলেছিলাম মেয়েকে আমায় নিয়ে যেতে, ওর আর আসা হয় না। মেয়ে আর দুই বৌমার জন্য এই তিনটে শাড়ি কিনেছি। প্রতিবারই কিনি শীত এর সময় ওরা যখন আসে দিয়ে দি। এবার এ তুই আর তোর বন্ধুদিদিরা এগুলো রাখ, ওরা যখন আসবে দেখা যাবে। আমি জানি বাপু তোদের ঢের আছে। হয়তো এগুলো একটু সেকেলে শাড়ি। তবু এগুলো পড়তে হবে তোদের। কতদিন কাউকে কিছু দিতে পারি না রে। দিতে তো পারি কিন্তু নিতে পারার লোক নেই। নেওয়া কি এতই কঠিন রে দিদিভাই"? বলেই শাড়ির ব্যাগটা আগে  ধরিয়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে যান প্যান্ডেল এ। ধীরে ধীরে পুজোর আয়োজন শুরু হয় দেবীর বোধন এর মাধ্যমে। কাহিনী চেয়েছিলো আবাসিক এর কোনো বৃদ্ধাই পৌরোহিত্য করুন কিন্তু আপত্তি করেন ওনারাই। কাহিনী জানে এই মানুষগুলোর জীবন লব্ধ সংস্কার আর বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই তারা সারাজীবন কাটিয়ে এসেছেন। এইখানে আঘাত করা একেবারেই উচিত হবে না। তাই দুজন পুরোহিত রয়েছেন সায়াহ্নের দুর্গাপুজোয়। সপ্তমীর সকাল থেকেই বৃদ্ধারা কেউ পুজোর কাজে কেউ ফল কাটতে কেউ নবপত্রিকা স্নান এ ব্যস্ত। ওদিকের বারান্দায় চৌধুরী জেঠিমা আর বেনুদিদি ব্যস্ত ভোগ এর দায়িত্বে। কাহিনী বারবার ওদের কাছে গিয়ে বলেছে এতো পরিশ্রম তার ওপর উপোস করে টানা চারটে দিন এতকিছুর প্রয়োজন নেই। জোর বোকা খেয়েছে চৌধুরী জেঠিমার কাছে ।

- "পরিশ্রম এর তুই কি জানিস মন? একান্নবর্তী পরিবার এ বৌ হয়ে এসেছিলাম সেই কোন জন্মে।কতগুলো দূর্গাপুজোর ভোগ এর দায়িত্ব শুধু ভোগ রান্না নয় গোটা পুজোটাই নিজের দায়িত্বে সামলেছি তুই কি জানিস। এই খাটনি তো কোনো খাটনিই নয়।"

কাহিনী বুঝতে পারে চৌধুরী জেঠিমা ফিরে পেয়েছেন বহুদিন পর তার একান্নবর্তী পরিবার যেখানে তিনি প্রতি দূর্গাপুজোয় ভোগ রাঁধতেন। দূর্গাপুজোর দিনগুলো যেন চোখ এর পলকে বেরিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে কাহিনীর। সন্ধ্যেবেলা আরতির সময় সায়াহ্নের সকলে মিলে ঢাক এর ছন্দে মেতে ওঠে।সুপ্রিয়া মাসিমা বলতে থাকেন- 'এরকমই তো পাড়ার পুজোর ঢাকের তালে নাচ দেখে প্রেমে পড়েছিলেন অসিত মেসো। সোজা এসে একেবারে বাবার কাছে এসে বলেছিলেন সুপ্রিয়াকে বিয়ের কথা।' কাহিনী দেখে মাসিমার চশমার কাঁচ টা তাঁর স্মৃতির  মতো স্পষ্ট  নয় ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। অষ্টমীর অঞ্জলিতে বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সবাইকে বোঝাতে পারলেও এক জায়গায় এসে থমকে যাচ্ছে কাহিনী। সেটা হলো আফসানা মাসি। বহুবার করে অনুরোধ করলেও কিছুতেই তিনি পুজোর 

কাজ এ নিজেকে জড়াচ্ছেন না। খালি সেই এক কথা,

- "আমি চাইনা আমার কারণে পুজোয় কোনো ভুল-ত্রুটি হোক", আমার কারণে সব কিছু পন্ড হোক।' শেষে কাজ হলো বিন্দু দিদুর কথায়। খুব ধমকের সাথে বলে উঠলেন,

 "এমন যদি করিস জেনে রাখ আর তোর সাথে আমি কোনদিন রোজা রাখবো না। আর বানাতে 

বলিস সিমুউ এর পায়েস দেখিস কি দি তোকে আমি? এখানে এসেছি সাত বছর হয়ে গেলো। তোর সাথে সেই শুরু থেকেই এক ঘরে এক সাথে থেকেছি। একটা বার ও রোজা বাদ দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। শুধু তোকে ভালোবেসে, তোর ঈশ্বর ভক্তি তোর নিষ্ঠাকে ভাগ করে নেবো বলে এই ভাঙা শরীরেও যতটা নিয়ম তুই মেনেছিস আমি ও কিছু কম মানি নি। কৈ তখন তো আমাকে একবার ও বলিসনি দিদি তুমি এসব করো না তোমার কারণে আমাদের কিছু ভুলচুক হোক চাই না। না আমি মাথায় এনেছি কোনোদিন। আফসানা টিকিট তো সকলের কাটা আছে রে আমাদের। মনে হয় প্লাটফর্ম এ ট্রেন এসে দাঁড়িয়েও পড়েছে। হয় তুই আগে উঠবি নাহলে আমি আগে উঠবো। চল না ট্রেন এ ওঠার আগে অব্দি পুরোটা সময়ই একসাথে থাকি এক হয়ে থাকি"।

বলেই নতুন একটা শাড়ির প্যাকেট আফসানা মাসির হাত এ ধরিয়ে বললেন,

''যা স্নান করে এইটা পড়ে নিচে আয় অঞ্জলি দিবি। তুই না এলে আমিও অঞ্জলি দেবো না।" সকলেই প্রায় নতুন শাড়ি পড়েছেন। এই বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক বছর এখানের বাসিন্দাদের দুর্গাপুজোয় নতুন একটা করে শাড়ি দিয়ে থাকেন। কাহিনীরা কণিকা দিদুর দেওয়া শাড়িগুলো পড়েছে। অঞ্জলি শেষ হয়ে গেলে সবাই যেন একটু ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বৃদ্ধাদের পরিবার এর কেউ কেউ আসতে  থাকেন। এই বুদ্ধিটা পৃথার। সে কাহিনীকে বলেছিলো সকল বৃদ্ধাদের পরিবারে ফোন করে আজকে আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানাতে। আজকে ও ভোগ এর দায়িত্বে চৌধুরী জেঠিমা রয়েছেন তবে দুপুরের আয়োজন এর জন্য রান্নার ঠাকুর এর ব্যবস্থা করা হোক চেয়েছিলো কাহিনী । কিন্তু আগের মতোই সবকিছু এসে ভেস্তে দিয়েছেন আফসানা মাসি। তিনি একা হাত এ রাঁধবেন আজ দুপুরের খিচুড়ি আর লাবড়া। এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি যে বিন্দুদিদির ধমকেও কোনো কাজ হয়নি এবারে। অনেক কষ্টে কাহিনী রাজি করতে পেরেছে ওনাকে যে অঞ্জলীর পর যেন একটু কিছু মুখে দিয়ে উনি রান্নার কাজে যান। বারবার আফসানা মাসির মুখে এক কথা,

- "এই মেয়েটা আমাকে দিয়ে পাপ করিয়েই ছাড়বে আর ইচ্ছে করে বিন্দুদিদির কাছে আমাকে বকা খাওয়াবে"। আজকে যে পরিবার এর লোকেরা আসবেন তা কিন্তু জানতেন না বৃদ্ধারা। ইচ্ছা করেই জানায়নি কাহিনী। অনেকেই এসেছেন আবার অনেকেই আসেননি। অনেকেই বলেন,

- "মা চলো  পুজোর বাকি কটা দিন থাকবে আমাদের সাথে"। কেউ যেতে রাজি হন না। কৃষ্ণা পিসি তো বলেই দিলেন, 

- "যেতে পারি যদি পুজোর পরেই না আবার আমাকে পাঠিয়ে দিস। কি ভয় পে গেলি তো?" বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,

- "না রে আমার আর যাওয়া হবে না এখান ছেড়ে কোথাও। তোরা পারলে আবার আসিস সামনের বার"। গভীর রাতে মহাসন্ধি পুজো হয়। ভক্তিভরে পুজো দেখেন ওনারা সকলে। ঘুম নেই কারো চোখে, ক্লান্তি নেই কারো অথচ উপোস করে আছেন প্রায় সকলেই সন্ধির অঞ্জলীর জন্য। নবমীর দিন হোম হয় নিষ্ঠা ভরে। নবমীর সন্ধ্যায় ছোট করে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নাচ -গান আবৃত্তি যে যেমন পারে। বেনুদিদি যে এতো সুন্দর নাচে জানেই না কাহিনী। সুপ্রিয়া দিদু গান করেন "আজ সবার  রং এ রং মেশাতে হবে"। সবচেয়ে অবাক করে দিয়ে আফসানা মাসি গান করলেন "বাজলো তোমার আলোর বেনু" কাহিনী কিছু না বললেও চোখে মুখে অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট বুঝলেন আফসানা। বললেন,

"শোন্ মনদিদি সেই যে আমার বন্ধু মালতি ওই তো আমাকে শিখিয়েছিলো এই গানটা ।মহালয়ার দিন ফাংশন এ ও এই গানটা গাইতো। আমি শুনে শুনে গলায় তুলে নিতাম এই আজ প্রথম গাইলাম, আমি জানি মালতি উপরে বসে সব দেখছে আর হাসছে,' বলেই কেঁদে ফেললেন ঝরঝর করে। এই দিদু-পিসি-মাসি-জেঠিগুলোর মধ্যে আজ ও এখনো এতো অবহেলার পরেও এতখানি প্রতিভা অবশিষ্ট আছে ভাবলেই অবাক লাগে কাহিনীদের। বেশিরভাগই বলতে থাকেন সাংসারিক প্রতিবন্ধকতার কথা। যার কারণে এই প্রতিভাগুলো কুঁড়ি হয়েই ঝরে পড়লো ফুল হয়ে ফোটার আগে। অথচ সংসারটাই আর তাদের থাকলো না অথবা তারাই আর সংসারটায় থাকলেন না। অবশেষে এসে গেলো বিজয়া দশমী। ঘট বিসর্জনের পর অপরাজিতা পুজোর কাজ সমাধা হয় । এই আবাসিক এর বেশির ভাগ বৃদ্ধারাই বিধবা কেউ কেউ আছেন অবিবাহিতা। কিন্তু কাহিনী এখানে ভীষণ কঠিন। কারোর কোনো ওজর-আপত্তি শোনেনি। প্রত্যেক বৃদ্ধা বরণ করেছেন মা কে । পানপাতায় গাল মুছিয়ে, মুখে সন্দেশ লেপে, জল খাইয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে প্রায় সব মা এরাই বলেছেন উমার কানে কানে "আবার এসো মা'। আর সিঁদুর? যাঁরা চেয়েছেন তাঁরাই সিঁদুর পড়িয়েছেন মা কে। যাঁরা চাননি তাঁরা শুধু ওটুকুতেই বিরত থেকেছেন। কিন্তু বরণ সকলেই করেছেন। তারপর? হ্যাঁ, তারপর সিঁদুর খেলাতেও মেতেছেন অনেকেই। আসলে আনন্দ উদযাপনের একটা সাবলীল স্রোত আছে সেই স্রোতেই গা ভাসিয়েছেন সকলে। সেখানে সধবা-বিধবা, কুমারী-বিবাহিতা, অবিবাহিতা-ডিভোর্সি, যুবতী-বৃদ্ধা এই সব শব্দগুলো ভীষণ অর্থহীন আর বেমানান ও। জীবন এর সায়াহ্নে এসে ওরা বোঝেন এই শব্দগুলো কিছু পারুক আর না পারুক বিভক্ত করে কোণঠাসা করতে পারদর্শী। আর কোণঠাসা হয়ে যাওয়া মানে তো একা হয়ে যাওয়া।সায়াহ্নের মানুষগুলো তো একা হতেই ভয় পান একা হতেই ভয় পেয়ে এসেছেন আজীবন। এরই মধ্যে গেট এর কাছে একটা বড়ো গাড়ি এসে দাঁড়ালো। শহরের বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা থেকে সমাজচেতনায় সেরার শিরোপা দেওয়া হলো সায়াহ্নের শারদীয়া উদযাপনকে। বিদিশার বর নিজেই এখানে সাংবাদিক। সেই সূত্রেই ওনারা জানতে পারেন বৃদ্ধাবাস এ দুর্গাপুজোর ব্যাপারে। পুজো কমিটির পক্ষ থেকে কাউকে কিছু বলতে অনুরোধ করলে সবাই কাহিনীকে এগিয়ে দিলো। কাহিনী মাইকের সামনে নিয়ে যায় এখানে বয়োজৈষ্ঠ্যা নিরুপমাদিদুকে। কাঁপা কাঁপা গলায় নিরুপমা বলেন - "আমার এই বিরাশি বছরের জীবনে কেউ প্রথমবার আমার কথা শুনতে চাইলো তাও আবার এত্তলোকের সামনে। কিন্তু কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না"। কাহিনী আস্তে করে কান এর কাছে গিয়ে বলে "আহ দিদু ঠিক করে বলো টিভি তে দেখাচ্ছে তোমায়''। নিরুপমা দিদু ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন,

"ওহ আচ্ছা টিভি হচ্ছি না আমি? আজ তো বিজয়া দশমী শোনেন সকলে আমার আশীর্বাদ নেবেন আর বড়োরা আমার প্রণাম। আর এই যে আমার খবর পড়া দাদা দিদিরা, ইসস রোদে রোদে ঘুরে মুখগুলো শুকিয়ে গেলো একেবারে। তোমরা সকলে কিন্তু খেয়ে যাবে দুপুরে এখানে। আজকের দিনে না খেয়ে গেলে আমার ঘরের অকল্যাণ বুঝেছো।" সবাই হো হো করে হেসে ওঠে এই মানুষ গুলোর সারল্যে। সায়াহ্নের উঠোনে তখন বিসর্জন এর বাজনা ছাপিয়ে আনন্দ আর অকৃত্তিমতার ঢেউ। সেই ঢেউ এ ভেসে যাচ্ছে কাহিনীর তিলতিল করে গড়ে তোলা বড়ো গাছেদের নার্সারীটা।পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়েছে মণ্ডপ এর সামনেতে। নিরঞ্জন এর অপেক্ষায় থাকা মাতৃ প্রতিমার মুখেও যেন সেই ঢেউ এর  খেলা।           
 

নিতাই ক্ষ্যাপা

চন্দন চ্যাটার্জ্জী

গল্প

women.jpg
নিতাই ক্ষ্যাপা
Chandan Chatterjee_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

হাওড়া জেলার সাঁকরাইল থানার অন্তর্গত বানিপুর গ্রাম আছে, গঙ্গার পাশেই এই ছোট্ট গ্রাম। বিখ্যাত বলতে এখানে কিছুই নেই, বানিপুর হাই স্কুল, খেলার মাঠ, সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দির, গঙ্গারপার, বানিপুর পঞ্চায়েত অফিস,  ইত্যাদি মামুলি সব। হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে বেশ কয়েক ঘর লোকের বাস। 
বছরে একমাত্র উৎসব সিদ্ধেশ্বরী মাতার বাৎসরিক উৎসব, বৈশাখ মাসের প্রথম শনিবার এই উৎসব হয়, সেই সময় প্রায় সমস্ত গ্রামের মানুষ এই মন্দিরে প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়, আর একটা উৎসব হল এই গ্রামের আমরা ক’জনা ক্লাবের দুর্গাপুজো। সাম্প্রতিক এই ক্লাবের কর্মকর্তাগণ আন্দুল স্টেশন রোডের দুর্গোৎসবের মতো মন্ডপ সজ্জা, বিশাল প্রতিমা, আলোক রোশনাই ইত্যাদি করছে। এটাও এখানকার একটা আকর্ষণ তবে তা চার দিনের জন্য। 
আন্দুল স্টেশন রোড থেকে সোজা যে রাস্তাটি দক্ষিণ দিকে চলে গেছে সেইটা ধরে ২০ মিনিট হাঁটলেই এই গ্রাম। 
আর হ্যাঁ আরেকটা আকর্ষণ হল নিতাই ক্ষ্যাপা। বানিপুর পঞ্চায়েত অফিসের বারান্দায় খানিকটা জায়গা ঘিরে তার একটা গুমটি মত ঘর, এটাকে  ঘর না বলে তাঁবু বলাই ভালো। সে এই এলাকারই লোক, পাগল হয়ে গেছে বলে বাড়ির লোক ঘরে তোলে না। তাই পঞ্চায়েত সমিতি থেকে তাকে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দোকানে দোকানে ভিক্ষে করে একটা পেট চলেই যায়। 
পাঠকদের মনে হতে পারে এতে আর বলার কি আছে এই রকম ঘটনা তো বাংলার অনেক গ্রামেই আছে। হ্যাঁ ঠিকই, কিন্তু সেখানে নিতাই ক্ষ্যাপা নেই। তাহলে এবার নিতাই ক্ষ্যাপার পুরো পরিচয় দেওয়া যাক।
তার পুরো নাম নিতাই চন্দ্র ব্যানার্জি, বড়দাদা নিমাই ব্যানার্জি। পিতা নিত্যানন্দ ব্যানার্জি। ওই যে পঞ্চায়েত অফিসের পাশ দিয়ে একটা ঢালাই রাস্তা নিচের দিকে নেমে গেছে সেটা ধরে গেলে প্রথমে অধিকারী পাড়া, তারপর রায়দীঘি, তারপর ব্যানার্জি পাড়া। এই ব্যানার্জি পাড়ায় সর্বসাকুল্যে দশটি পরিবার। 
এদের অধিকাংশরই চাঁপাতলা বাজারে দোকান আছে, কেউ কেউ শিক্ষকতা করেন। নিত্যানন্দ ছিলেন বানিপুর হাই স্কুলের কেরানি। তার অকালে মৃত্যু হওয়ায়  নিমাইকে পিতার চাকুরীর পরিবর্তে ব্যবস্থা করে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। নিমাই খেলাধুলায় খুবই ভালো, শরীর সুঠাম, ব্যায়াম করে রোজ । ছোটবেলা থেকেই তার মিলিটারিতে যোগ দেওয়ার বাসনা ছিল কারণ সে বন্দুক খুব ভালো চালাতে জানতো। পঞ্চায়েতের মাঠে যখন মেলা বসে তখন সে এয়ার গান দিয়ে ঘুরন্ত চাকির উপর রাখা দশটি বেলুন দশ শটে ফাটিয়েছিল। নিশানা বাজিতে সে গ্রামের সেরা, তাই সবাই তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলতো  
হঠাৎ করে বাবার মৃত্যু এবং বড় দাদা চাকুরী নিয়ে সংসার সামলাচ্ছে তাই একটা অজানার দায়িত্ববোধ তারও মাথায় চাপলো। এছাড়া তার এক বোন ও আছে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছিল তারপর আন্দুল কলেজ থেকে ফাস্ট ইয়ার বি এ তে ভর্তি হয়েছিল কিন্তু তার আর স্নাতক হয়ে ওঠা হয়নি। কলেজের গেটের কাছে একজন বিভিন্ন প্রকার সরকারি চাকুরীর ফর্ম বিক্রি করতো, নিতাই রোজই তার থেকে ফর্ম নিয়ে দেখতো কোনটা তার কোয়ালিফিকেশনের সঙ্গে ম্যাচ করে। একদিন দেখলো আর্মিতে লোক নিচ্ছে আন্ডার গ্রাজুয়েট এবং শরীরের যা মাপ যোগ দিয়েছে তা তার আছে তাই সে একটা ফর্ম কিনে এনে দাদাকে দিয়ে ফিলাপ করাল। এরপর বেশ কিছুদিন পর তার বাড়িতে এক মুখ বন্ধ খামে চিঠি এলো ফোর্ট উইলিয়াম থেকে, তার প্রাথমিক ইনটারভিউ। এর জন্য সে ট্রেনে করে হাওড়া, তারপর বসে করে ফোর্ট উইলিয়াম হাজির হল। আমি যখন কার কথা বলছি তখন বিদ্যাসাগর সেতু হয় নি। চার রাউন্ড এ ইনটারভিউ হল। অনেক ছেলে সেখানে এসেছিল নানা প্রান্ত থেকে। 
নিতাই আর কয়েকজনের মতো চারটি রাউন্ড সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। সেখান থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে গেল তারপর বাস ট্রেন ধরে সে যখন বাড়ি পৌঁছালো তখন রাত্রি দশটা বাজে। দাদা অবশ্য তার জন্য অপেক্ষা করছিল, নিতাই এসে দাদাকে প্রথমে সুখবরটা দিল, ট্রেনিংয়ের জন্য লেটার দিয়েছে ১৫ দিন পর ট্রেনিং হবে তারপর পোস্টিং। তার মা ও বোন এই কথা শুনে খুব কাঁদছিল নিমাই তাদের বুঝিয়েছে। যখন নিতাই এর এই খবরটা পাড়ার মধ্যে রটে গেছে তখন পাড়ায় তার অনেক দাম বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই। যেমন নিতাই চায়ের দোকানে চা খেলো দোকানদার ভজাদা দাম নিল না বলল, “তুই এত বড় কাজ পেয়েছিস দেশ সেবা করার তোর থেকে দাম নেব না”। 
এইভাবে পাড়াপড়শি ও বাড়িতে আদর যত্ন খেতে খেতে তার ১৫ দিন পার হলো। তারপর একদিন ভোরবেলায় নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতাই চলল দেশ মাতৃকার সেবায়। 
ফোর্ট উইলিয়ামে তাদের ট্রেনিং হয়েছিল দেড় মাস ধরে, বন্দুক চালানো, টানেলের মধ্যে দিয়ে চলা, শুয়ে বন্দুক চালানো, এমন কি চোখ বেঁধে নিশানা লাগানো ইত্যাদি নানান প্রকার ট্রেনিং হয়েছিল। দেড় মাস পরে ছেলে যখন বাড়ি এলো তখন আর তাকে চেনা যায় না। একটা পাক্কা মিলিটারি সৈনিক, মাথায় টুপি পরনে জলপাই রংয়ের প্যান্ট শার্ট, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জুতো। সাত-দশ দিনের ছুটি তারপর তাকে কোথায় পোস্টিং হবে সেটা স্থির হবে। 
ছুটিতে নিতাই কিন্তু একদিনও শরীর চর্চা ছাড়া থাকেনি। এদিকে দশদিনের মধ্যে তার পোস্টিং অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার বাড়িতে এলো লাদাখে পোস্টিং হয়েছে। এই কথা শুনে বাড়িতে আবার কান্নার ররোল, কোনরকম ভাবে তাদের সবাইকে সামলে নিতাই বেরিয়ে পড়ল লাগাখের উদ্দেশ্যে। প্রথমে হাওড়া থেকে দিল্লি তারপর বাসে করে লাদাখ। 
তিনদিন পরে সে লাদাখ পৌঁছালো। সেখানে ক্যাম্প দেখে নিতাইয়ের ভালো লাগলো চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় তাতে নানান রঙের ফুলের শোভা, পরিবেশ শান্ত, সব সময় ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এই রকম শান্তির দেশে যে কোন অশান্তি হতে পারে তা তার জানা ছিল না। প্রথম দশ দিন বেশ নিরাপদেই কাটল খালি খাওয়া, শোয়া আর শরীর চর্চা করা। তাদের প্রতিদিন শরীর চর্চা করতে হতো কারণ এতে উদ্যম ঠিক থাকে এবং ক্লান্তি আসে না। যে কোনো সময় যে কোন কাজ করার জন্য তারা প্রস্তুত থাকে। 
এরপর একদিন ডাক পড়ল সীমান্তে যেতে হবে। সেখানে পাকিস্তানি উগ্রপন্থীর কার্যকলাপ বেড়েছে ।  আসলে এটা ছিল বেস ক্যাম্প এইটাকে কেন্দ্র করে আশেপাশে অনেক ছোট ছোট ক্যাম্প আছে বা সাময়িক তাবু আছে সেখান থেকে মিলিটারিরা তাদের ডাইরেক্ট অপারেশন করে। তারা চারটে দলে ভাগ হয়ে সীমান্তে কাঁটাতার লাগোয়া জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রইল। 

তারপর তারা মাটির উপর থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো তারপর ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। দুই চার পা গেছে এমন সময় ঘাসের উপর দিয়ে নিতাইয়ের পায়ে কিছু ফুটলো বলে মনে হল, সে নিচু হয়ে বন্দুকটা মাটিতে রেখে দেখতে লাগলো। এমন সময় ওপার থেকে পরপর কয়েক গ্রাউন্ড গুলি চললো, নিতাই পুনরায় মাথা নিচু করে শুয়ে পড়ল। তারপর হাতের বন্দুক নিয়ে আবার গুলি চালাতে লাগলো। তার সাথীরা খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল তারা কেউই বাঁচল না, তাদের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। নিজের সাথীদের এমন অবস্থা দেখে নিতাইয়ের মাথায় ১০০% রক্ত চড়ে গেল বাঁ হাতে চোখের জল মুছতে লাগলো আর পাগলের মত এলোপাতাড়িগুলি চালাতে লাগলো। এইভাবে সে কতক্ষণ গুলি চালিয়েছে সেটা মনে নেই, তারপর একটা বড় পাথরের নিচে সে পড়ে গেল। তার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে মিলিটারি হাসপাতালে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হাত দিয়ে দেখলো ব্যান্ডেজ বাধা, অন্য হাতে স্যালাইনের বোতল। 

বিকালে মেজর সাহেব তাকে দেখতে এলেন। তিনি জানালেন নিতাইয়ের আক্রমণাত্মক লড়াই এর জন্যে জঙ্গিদের ২৫ জনের দলে অনেক মারা গেছে, বাকিরা পিছু হটেছে। মেজর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন তুমি একা এত বড় লড়াই লড়েছ কি করে?
তার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল নিতাই, ”কি জানি স্যার নিজের সঙ্গী সাথীদের মৃত্যু দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল তাই গুলি বৃষ্টি করেছিলাম, সাথে তিনটে গ্রেনেড ছুড়ে দিয়েছিলাম তখন অনেক বড় বিস্ফোরণ হয়েছিল। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই”। 
মেজর সাহেব বললেন, ”ঠিক আছে তুমি খানিক সুস্থ হয়ে গেলে বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে”। 
নিতাই ঘাড় নেড়ে সায় দেয় দিয়ে ছিল। কিন্তু তার এই বীরত্বের কথা কোন কাগজে প্রকাশ হয়নি। 
এরপর নিতাই কিছুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সে বাড়িতে আসতেই, একদম খুশির হাওয়া । কিন্তু নিতাইয়ের মনে একটা দুঃখ আছে কারণ মৃত্যুকে সে এত কাছ থেকে দেখেছি যে সে জীবনে কখনো এইরকম অভিজ্ঞতার শিকার হয়নি। এই পাঁচ জন শহীদের মত তারও দশা হতে পারতো, যদি না সে নিচু হয়ে পায়ে কি ফুটেছে তা দেখতে যেত। এবার সে বেঁচে ফিরেছে ঠিকই। পরের বারে যদি না ফিরতে পারে তাহলে তার শরীর কফিন বন্ধ করে আসবে। এই সব ভেবে ভেবে রাত্তিরে তার আর ঘুম হয় না। এই সব কথা নিজের মনে মনে সে আওরাতো আর কি করা যায় তাই ভাবতো।
একদিন সে তার দাদার কাছে এইসব কথা খুলে বলল। নিমাই বলল, “দেখ ভাই যেহেতু তুই বন্ডে সই করেছিস তাই তোকে যেতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই, কিন্তু যে উপায় আছে যার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে পারে সেগুলি যদি হয় তবে সে ফিরে যাওয়া থেকে মুক্তি পাবে। যেমন হাত বা পা হারালে, বিশেষ কোনো মারণ রোগ বা ছোঁয়াচে রোগ ধরা পড়লে, যথা ক্যান্সার ইত্যাদি আর মস্তিষ্ক বিকৃত হলে। 
এই সব কিছু  নিমাইয়ের মনে আছে কারণ সে বন্ড পেপার পড়ে সই করেছিল। নিতাই মনে মনে ভাবল হাত-পা কাটা তো আর হবে না, মারণ রোগ হয়েছে বললে মিলিটারি ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করবে কাজেই মিথ্যে ধরা পরে যাবে। একমাত্র উপার মস্তিষ্ক বিকৃতি। অবশ্য এর জন্য তাকে ভালোভাবে অভিনয় করতে হবে, ওইখানে ডাক্তারি পরীক্ষা খুব একটা কাজে আসবে না। 
তাকে আক্রমণাত্মক হতে হবে, সবসময় কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরে এই মনে করতে হবে যেন শত্রুপক্ষ আক্রমণ করেছে, হাতের কাছে যা কিছু থাকবে তা নিয়ে সামনের লোককে ছুঁড়ে মারতে হবে, তবে ডাক্তারি ও মিলিটারি দল চলে যাবে। অভিনয়ে কোথাও ভুল হলে বা মিলিটারি ডাক্তার কে যদি এটা মিথ্যে বলে সন্দেহ হয় তাহলে কিন্তু কোর্ট মার্শাল হতে পারে যেটা নাকি আরো ভয়ঙ্কর। এই কথা নিমাই ও নিতাই শুধুমাত্র জানবে, বাড়ির ও পাড়ার অন্য কেউ জানবে না। 
নিতাই যথারীতি রাজি হলো কারণ অন্য উপায় তার আর নেই। পরের দিন থেকেই কাজ শুরু। সকালে জল খাবার খেতে বসে আধ কাপ চা খেলো বাকিটা উঠানে শুয়ে থাকা কুকুরটার উপর ছুঁড়ে দিয়ে, চেঁচাতে লাগলো শত্রু আক্রমণ করেছে মারো মারো, এই বলে নিতাই কুকুরের পিছনে ছুটলো। কুকুরটাও গরম চা গায়ে পড়তেই কেঁউ কেঁউ করতে করতে বাড়ি ছাড়লো। রাস্তায় বাঁশের সরু কঞ্চিকে একটা বন্দুক ভেবে সবাইকে গুলি মারতে লাগলো, আর হাত পা ছুঁড়ে চেঁচাতে লাগল । রাজগঞ্জের বাজারে মোড়ের মাথায় গজাদার চায়ের দোকান, যেখানে আগে নিতাই রোজ চা খেত, আজ সেখানে এমন  কান্ড শুরু করল যে সবাই তার ভয়ে চায়ের ভাঁড় ফেলে দোকান ছেড়ে চলে গেল। গজাদা তাড়াতাড়ি দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছিল, তা না হলে উনুনের গরম জল তার গায়ে পড়তো । এরপর দুপুরবেলায় বিশ্বাসবাবুদের পচা পুকুরের পাড়ে যে কতবেল গাছ আছে তার ডালে ওপরে উঠে বসে ওত পেতে আছে শত্রু আসার আর আশায়।
মহাদেব চক্রবর্তী বড় ছেলে সেই মাত্র  বিশ্বাসবাবুদের বাড়িতে নারায়ণের নৃত্য সেবা করে ফিরছিলেন সাইকেল চড়ে। আজকের পুজোয় ভালোই আমদানি হয়েছে দক্ষিণাও ভালো পেয়েছেন, তাই একটা শ্যামা সংগীত গুনগুন করতে করতে গাইছিলেন নিজের মনেই, আর সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পচা পুকুরের ধার দিয়ে সরু আল এর মত রাস্তা খানিকটা গেলেই অবশ্য বড় রাস্তায় পড়বেন। এমন সময় নিতাই আক্রমণ করে, হাতের কঞ্চিটাকে বাগিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। 
চক্রবর্তীমশাই তো হঠাৎ এই রকম একটা ঘটনায় বেসামাল হয়ে সাইকেল নিয়ে সোজা পচা পুকুরের মধ্যে গিয়ে পড়লেন। তিনি সাঁতার জানেন ঠিকই কিন্তু বর্তমানে স্থুল শরীর। একেবারে জলের মধ্যে হাবুডুবু খেতে লাগলেন। পচা পুকুরে জল বেশি ছিল না তিনি পাকে পুঁতে যেতে লাগলেন। কোনো রকমে নিজেকে সামলে মাথা তুলে দেখলেন, নিতাই হাতের কঞ্চিটাকে বন্দুকের মতো তাক করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে তিনি খানিক ভয় পেয়ে গেলেন তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “নিতাই তুই কি ক্ষেপে গেছিস, মিলিটারিতে গিয়ে তোর কি মাথা পাগল হয়ে গেছে?”
নিতাই কোন জবাব দিল না শুধু পাথরের মূর্তির মত একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। উপায়ান্তর না দেখে চক্রবর্তীমশাই হাতে করে খানিকটা পাক তুলে তার দিকে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন। খানিক পরে নিতাই চলে গেল। 
চক্রবর্তীমশাই এই ঘটনাটি পুরো গ্রামে চাউর করে দিলেন যে নিতাই পাগল হয়ে গেছে। সেটা নিতাইয়ের জন্য ভেবে নয়, নিতাইয়ের জন্য তার যে ক্ষতি হয়েছে সেইটা ভেবে। এইভাবে সাত- দশ দিন পার হলো পাড়ার লোকেরা সবাই নিমাইকে বলল এমন পাগল ঘরে রেখো না, পাগলা গারদে পাঠাও না হলে তুমি মরবে। কিন্তু নিমাই এর আসল কারণ সে জানে তাই সে একটা দড়ি দিয়ে ভাইকে বেঁধে রাখত, সারা দিন ঘরের রোয়াকে বসে থাকত। একদিন চিঠি এলো যে তার ছুটি ফুরিয়েছে আবার ডাক পড়েছে জম্মু কাশ্মীরে।
চিঠি পড়েই নিতাইয়ে বুক দূর দূর করতে লাগলো, কিন্তু মুখে কিছু বলল না এবং ফিরেও গেল না। দশদিন পরে আবার একটা চিঠি এলো এবার চিঠিতে লেখা ছিল যদি ইমিডিয়েট জয়েন না করে তবে তার বাড়িতে মিলিটারি আসবে, এটা রেজিস্ট্রি চিঠি ছিল। এরপর ১৫ দিন পর সত্যি সত্যি একদিন বাড়িতে মিলিটারি ভ্যানে করে অনেক লোক এলো তার মধ্যে দু একজন ডাক্তারও ছিল। তারা নিতাই এর বর্তমান অবস্থা দেখে বিগলিত হল। নিজের বাড়িতে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে । অন্য সাথীরা দেখে তো অবাক, কি ছেলের কি অবস্থা হয়েছে ডাক্তাররা মামুলি কিছু পরীক্ষা করল ।   
সব সময়ই নিতাই তার পাগলামি চালিয়ে গেল। এরপর মিলিটারি দল চলে গেল। ডাক্তাররা মিলিটারি হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল নিমাই মানা করল বলল এখানে একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারকে দেখানো হচ্ছে। এছাড়া ঘৃতকুমারী ওষুধ দিয়ে তার মাথায় প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। তারা জানাল যদি কিছু অসুবিধে হয় যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর আরো চার মাস কেটে গেছে। এখন নিতাই রাত্তিরে কম ঘুমায়। দিনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরায়। 
কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, বাড়িতে কম থাকে, কখনো গঙ্গার ধারে কখনো রাজগঞ্জের শ্মশান তলায় শুয়ে থাকে। বাড়ির লোক তাকে খুঁজতে খুঁজতে আশা ছেড়ে দিয়েছে। পাগলের অভিনয় করতে করতে নিতাই সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে।  
ইতিমধ্যে নিমাইয়ের বিয়ে হয়েছে, তার বোন শ্বশুরবাড়ি গেছে, মা মারা গেছে। নিতাই এখন বানিপুর পঞ্চায়েত অফিসের কম্পাউন্ডের মধ্যে এক তাঁবুর  মধ্যে থাকে। নিমাই মাঝে মধ্যে কিছু খাবার দিয়ে আসে আর মনে মনে ভাবে প্রার্থনা করে যেন এমন ভাগ্য কারোর কপালে না আসে। 

গল্প

পিউ কাঁহা

সঞ্জীব চক্রবর্ত্তী

হিন্দুস্থান রোড, কলকাতা    

oldman1.jpg
পিউ কাঁহা

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

আগাথা ক্রিষ্টির Philomel Cottage ছায়া অবলম্বনে... 

বাজারটা এই সময় ঘুরে আসি। এখানে বিকেলের পর দোকানপাট আবার সব বন্ধ হয়ে যায়। একা কিছুক্ষণ থাকতে পারবে তো?” বেশ চিন্তার স্বরে বলে সম্বরণ।
“না না এক্কেবারে চিন্তা করো না – এইটুকু সময় গান শুনে ঠিক কাটিয়ে দেব। তুমি তাড়াতাড়ি দুপুরের আগেই ফিরে এস।“ সম্বরণের পিছু পিছু শ্রীমনা এগিয়ে যায় বাগানের গেটের কাছে।   
শ্রীমনা সেন তাদের ছোট্ট বাগানের সাদা রঙের গেটে অলস হাত রেখে, ভালোবাসা ভরা চোখে পাহাড়ি গ্রাম্য বাজারে যাওয়ার লাল নুড়ি মাটির পথ ধরে সম্বরণের ক্রমশ দুরে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নি:শব্দে মাথা নাড়ে। ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির রেখা ফুটে ওঠে, সম্বরণটা একেবারে পাগল! শ্রীমনাকে এক মুহূর্ত একা ফেলে কোথাও যেতে চায় না। নুড়ি ঢাকা সরু রাস্তাটা কিছুটা গিয়ে ছোট টিলাটার বাঁকে হারিয়ে গেছে। সম্বরণকে আর দেখা যায় না। 
শ্রীমনা বাগানের গেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যমনস্ক চোখ ঘুরে বেড়ায় অনেক দূরে সকালের নরম আলো মাখা নাতি উচ্চ টিলাগুলির চুড়ায় চুড়ায়। হঠাৎ ছোট্ট ঘূর্ণি হাওয়ায় মুখে পড়া ঘন চুল অভ্যস্ত হাতে সরায়। অদূর অতীতের ঘটনাবলী প্রবাহে মনের অবগাহন – তার দৃষ্টি স্বপ্নতুর হয়ে ওঠে।
শ্রীমন্ত সেন ঠিক সুন্দরী নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে মোটামুটি ভালো দেখতে পর্যায় পড়ে না সে - তবে তার চোখ দুটি বড়ই প্রাণবন্ত। জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে তার কিশোরী বয়সের স্বাভাবিক মাধুর্য কখন অকালেই ঝরে গেছিল, নজর দেওয়ার অবকাশ ছিল না। এখন কৈশোরের স্বল্প কিছু বন্ধু বান্ধব হয়ত তাকে চিনতেই পারবে না। কিশোরী শ্রীমনার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র থেকে গেছে অলীক কল্পনায়,বাস্তবে তার দেখা মেলেনি। তার বয়:সন্ধির স্বপ্নের ফানুস আকাশে মিলিয়ে গেছিল সেই কবে। মাত্র আঠেরো বছর বয়সে নেমে আসতে হয়েছিল স্নেহ ভালোবাসাহীন কঠিন বাস্তবের পৃথিবীতে। ছোট সওদাগরি অফিসের সামান্য সহকারি হয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এর মধ্যে সাত সাতটি বছর সঙ্গী ছিল কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী মায়ের দেখাশোনা আর পরিচর্যায় --- দীর্ঘ পনেরোটা বছরে শ্রীমনা হয়ে উঠেছিল এক যন্ত্র মানুষ, তার জগৎ হয়ে উঠল বাড়িতে মায়ের পরিচর্যা আর অফিসের কাজ। ক্রমশ পরিচিতি হল অফিসের দক্ষ কর্মচারী হিসেবে। বাড়ির কাজ আর চাকরি বাঁচিয়ে রাখার কঠোর শ্রম তার নারী সত্তার শেষ বিন্দু শুষে নিল শরীর ও মন থেকে। বেঁচে থাকার যুদ্ধে হারিয়ে গেল নারীর স্বপ্ন। কাঠিন্যের রেখা মুছে নিল তার মুখের কমনীয়তা।  
এই তেত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে কখনো প্রেমের ইঙ্গিত পায়নি বলাটা হয়ত ঠিক হবে না। জীবন যুদ্ধে বিধ্বস্ত আর একজন মানুষ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে কাছে এসেছে, অফিসের সহকর্মী বিপ্লব বোস। সহানুভূতি সম্পন্ন, নরম মনের মানুষ। সামান্য মাস মাইনেতে সে সাংসারিক কর্তব্য ও ছোট ভাইকে পড়া শোনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে উদাসীন, পরিকল্পনাহীন। তবে শ্রীমনা একজন সমব্যথী পেয়েছিল, অবচেতনে বিপ্লবের সহানুভূতির আভাস পেয়েছে সে অনেকবার। বিপদ আপদে বিপ্লব সব সময় কাছে থেকেছে, খুব কাছের বন্ধু হিসেবে সে বিপ্লবের একাত্ম হতে পেরেছিল। তবে শ্রীমনা তাদের এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি, বিপ্লবের কাছে কোন সাড়া পায়নি। বিপ্লব কখনো তাকে প্রেম নিবেদন অথবা তাদের ভবিষ্যত জীবন বিন্যাস নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি। দীর্ঘ এগারো বছরের সম্পর্কে যা অবশ্যম্ভাবী, হয়ত তা নিয়ে আলোচনার দরকার মনে করেনি বিপ্লব, হয়ত কারণটা লুকিয়ে ছিল তার আর একজন মানুষের দায়িত্ব বহনের অর্থনৈতিক অপারগতা। কিন্তু তবু সে ধরেই নিয়েছিল একদিন সে বিপ্লবের জীবন সাথী হবে। তারা দুজন সচেতন মানুষ, পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। ধীরেসুস্থেই এগোবে তারা, সময় তো শেষ হয়ে যাবে না।
সময় বয়ে চলেছিল এই ভাবে, গতানুগতায়।
এরপর হঠাৎই সেই বিধ্বস্ত মেয়েটির জীবনে বছরের পর বছর বেঁচে থাকার সংগ্রামের সমাপ্তির ইঙ্গিত নিয়ে বয়ে এল ঈশ্বর প্রেরিত খবর। শ্রীমনার অকৃতদার মামা, যিনি কোনদিনই তাদের খোঁজ খবর রাখেননি – হঠাৎ দেহত্যাগ করেছেন আর বেশ কিছু টাকা পয়সা দিয়ে গেছেন তাঁর একমাত্র ভাগ্নী শ্রীমনাকে। শ্রীমনার প্রথমেই মনে এলো এই ক্লান্তিকর গতানুগতিক বেঁচে থাকার সংগ্রামের ইতি। স্বাধীনতা আর জীবনের স্বাতন্ত্রতার আগাম ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে এই খবর। এবার বিপ্লবকে আর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অপেক্ষার দরকার হবে না। অদেখা মামার প্রতি কৃতজ্ঞতায় শ্রীমনা সজল চোখে প্রণাম জানায়।
শ্রীমনা কল্পনা করতে শুরু করে তার ভবিষ্যত জীবনের রঙিন ছবি। 
পরের দিন অফিস ছুটির পর নিয়ম মত দুজনে কফি নিয়ে নানা কথার শেষে, শ্রীমনা তার ভাগ্য পরিবর্তনের সংবাদ বিপ্লবকে জানায়। সে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করে বিপ্লবের চোখে মুখে এক অপ্রত্যাশিত ভাবান্তর, যাতে সে নিশ্চিত, খুশির ছোঁয়া ছিল না। তাদের স্বাভাবিক কথাবার্তায় হল ছন্দপতন। অবাক শ্রীমনার একতরফা কিছু কথার পর যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
এর পর কিছুদিন শ্রীমনা অনুভব করে বিপ্লবের মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন, থমকে যাওয়া হতাশাগ্রস্থ মানুষের যেন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার নি:শব্দ প্রয়াস। অতি পরিচিত কাছের মানুষ শ্রীমনা কে এড়িয়ে চলার প্রকট চেষ্টা। অব্যক্ত যন্ত্রণায় শ্রীমনা দিশেহারা বোধ করে।
অফিসের কাজের মাঝে শ্রীমনা যেন সত্যিটা খুঁজে পায়। আজ অবধি বিপ্লব কখনো তার ভালোবাসা প্রকাশ করেনি – হয়ত ইতস্তত করেছে নিজের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে। পাকেচক্রে শ্রীমনা এখন বিত্তশালী। সেটাই হয়ত বিপ্লবের কাছে আরো বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! হয়ত এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিপ্লবের প্রচ্ছন্ন আত্মাভিমান যা তাকে কুন্ঠিত করছে বিত্তশালী শ্রীমনাকে বিয়ের প্রস্তাব জানাতে!
গভীর আত্ম পর্যালোচনায় শ্রীমনা দিশা পায়। এখন তার মন বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে। ঠিক করে, সে নিজেই বিপ্লবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব জানাবে। এর মধ্যে বেশ কিছু সময় বয়ে যায়।  
কিছু দিন বাদেই ভাগ্যের খেয়ালে শ্রীমনার জীবন নতুন দিকে মোড় নিল, নিয়ে এল নতুন দিশার সন্ধান - আর প্রয়োজন রইলো না বিপ্লবকে কোন প্রস্তাব জানানোর। 
কয়েক দিন আগের এক সন্ধ্যায়, বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সম্বরণ সেনের সাথে আলাপ হয়ে গেল তার। প্রথম আলাপেই সম্বরণ পড়ে গেল শ্রীমনার প্রেমে। নানা কথায়, দৃষ্টিতে সে তার মনের ভাব গোপন করার চেষ্টা করেনি। এই রকম অভিজ্ঞতা শ্রীমনার জীবনে প্রথম। পরপর কয়েক দিন সম্বরণ দেখা করে তার বাড়িতে। গত এগারো বছর বিপ্লব যা প্রকাশ করেনি শুধু বন্ধুই থেকে গেছে, সেখানে সম্বরণ সংকোচ, দ্বিধা উপেক্ষা করে শ্রীমনাকে তার প্রেম অবলীলায় নিবেদন করেছে। শ্রীমনা যথেষ্ট বাস্তবমনা, হঠাৎ কারুর প্রেমে পড়ে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। কিন্তু তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা হীনমন্যতার জড়তা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, সম্বরণ তার নারীত্ব জাগিয়ে তুলেছিল বিনা আয়াসে। শ্রীমনা ভেসে গিয়েছিল সেই বাঁধ ভাঙ্গা ভালবাসার তোড়ে, খুঁজে পেয়েছিল তার আত্মমর্যাদা। জীবনের এতগুলো শুষ্ক বছর পেরিয়ে তার নিজের কাছে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হলো - সে এক জন নারী। মানুষের বাহ্যিকরূপ কখনো প্রকৃত ভালোবাসার বাধার কারণ হয় না। সম্বরণের প্রতি সে অনুভব করে কোনো অমোঘ বন্য আকর্ষণ। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সম্বরণের কাছে। এক সপ্তাহের ঝোড়ো প্রেমের পরিণতি হলো এক মাসের মধ্যে সম্বরণের সাথে রেজিষ্ট্রীকৃত বিয়েতে। দ্বিধাগ্রস্ত আনন্দে এক দিন কাছের মানুষ বিপ্লবকে পাঠিয়েছিল তার নতুন জীবনের শুভ সূচনার সংবাদ।   
খবর পেয়ে রাগে আবেগে প্রায় উন্মাদ বিপ্লব তার বাড়িতে পৌঁছেছিল। বিপ্লবের মানসিক অবস্থা শ্রীমনাকে ভয় পাইয়ে দিল। সে উপলব্ধি করে, যেন নিজের অজান্তে  জাগিয়ে তুলেছে বিপ্লবের ভিতরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যার উপস্থিতি এতদিনেও সে টের পায় নি। ---
“তোমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ওই লোকটা! তুমি ভাল ভাবে না চিনে, তার অতীত না জেনে তাকে বিয়ে করেছ?”
“কি করে জানলে অচেনা মন থেকে তাকে আমি চিনি। আমি ভালোবাসি সম্বরণকে।”
“মাত্র এক সপ্তাহে একজন সম্পূর্ণ অচেনা লোককে কি করে চিনতে পারলে শ্রীমনা?”
শ্রীমনা রেগে যায় - “আর সবাইয়ের একজন মেয়েকে ভালোবাসে বুঝতে এগারো বছর লাগে না বিপ্লব।”
বিপ্লবের মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে যায় রাগে ---
“দেখা হওয়ার দিন থেকে তোমায় ভালোবেসে ছিলাম। আমার ধারণা তোমার মনোভাবও তাই ছিল শ্রীমনা।”
শ্রীমনার মনের থেকে সত্যিটা বেরিয়ে আসে - “আমিও এত দিন তাই ভেবে এসেছিলাম বিপ্লব- কিন্তু এখন বুঝি একজন পুরুষকে ভালোবাসাটা কি? – তখন আমি বুঝতে পারি নি।”
বিপ্লবের অন্তরের নানা ভাব, ক্রোধের বিস্ফোরণ- আগ্নেয়গিরির লাভা স্রোতের মত বেরিয়ে আসে। প্রথমে অনুনয়, মিনতি,- এবার তার হিংস্র হুমকির নিশানা হয়ে ওঠে সম্বরণ। শ্রীমনা বিস্মিত হয়। সাধারণ শান্তশিষ্ট বিপ্লব, যাকে সে এত দিন চিনত বলে মনে করে এসেছে, তার ভেতর লুকিয়ে ছিল এই রকম ভয়ঙ্কর উন্মত্ততা!! ভাবতেই পারেনি কোনদিন! বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা এই উন্মত্ততাই কি তার প্রতি বিপ্লবের ভালোবাসার বহি:প্রকাশ!
বিপ্লবের সঙ্গে এরপর আর দেখা হয় নি শ্রীমনার।
আজ এই সুন্দর সকালে, নানা রংবেরং ফুলে ভরা সবুজ বাগানের সাদা গেটে হেলান দিয়ে শ্রীমনার বিক্ষিপ্ত মন ফিরে গেছে – বিপ্লবের সঙ্গে বাক্‌বিতণ্ডা ওলটপালট হওয়া সেদিনের সকালে। তার বিবাহিত জীবনের এক মাস হয়ে গেছে। সে আজ যথার্থই সুখী। সম্বরণকে ঘিরে এখন তার জীবন আবর্তিত হয়। সম্বরণের স্বল্প সময়ের অনুপস্থিতি তাকে ব্যাকুল করে, কিন্ত শ্রীমনা যেন বুঝতে পারে মনের অতল গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনো উৎকণ্ঠার মেঘ তার এই সুখী জীবনে অস্বস্তি জাগিয়ে তুলছে। শ্রীমনার অবচেতন জানান দেয় সেই উৎকণ্ঠার কারণ হলো বিপ্লব। এ’হলো বিপ্লবের সেদিনের উন্মত্ত আচরণ আর সম্বরণের প্রতি তার হিংস্র হুমকির প্রতিক্রিয়া।
একা দাঁড়িয়ে একটা চিন্তা তাকে কুরে কুরে খায়। সম্বরণের সাথে বিয়ের পর থেকে একটি বিশেষ স্বপ্ন তার ঘুমের মধ্যে বারে বারে ফিরে এসেছে। এই এক মাসে তিন বার তো হবেই, স্বপ্নের পটভূমি হয়ত বিভিন্ন – কিন্তু ঘটনাটা একই ভাবে ঘটছে। সে দেখছে সম্বরণের পড়ে থাকা নিথর মৃত শরীরের পাশে বিপ্লব একা দাঁড়িয়ে, শ্রীমনার মনে খোদিত হয়ে আছে স্বপ্নে দেখা তার মুখের ক্রুরতার ছাপ। হাজার চেষ্টাতেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না সেই ছবি। তার দৃঢ় বিশ্বাস, স্থির ভাবে নিশ্চিত – স্বপ্নে দেখা হলেও, ঘটে যাওয়া বীভৎস ঘটনার জন্য বিপ্লবই সম্পূর্ণ দায়ী।
স্বপ্নটা ভয়াবহ কিন্তু তার থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার নিজের অবচেতন মন। এই স্বপ্নটা সে মনে করছে পুরোপুরি স্বাভাবিক – হয়ত অবশ্যম্ভাবী। যে পুরুষের উদ্দাম ব্যক্ত ভালোবাসার সোনার কাঠির ছোঁয়া - শ্রীমনার শুষ্ক জীবনে আনন্দের বীজ রোপণ করেছিল – সে আবিষ্কার করেছিল জীবনের সুখ, সেই সম্বরণের নিথর দেহ শ্রীমনার মনে যেন অস্বাভাবিক নিশ্চিন্ততার আভাস আনছে!! আরো অস্বাভাবিকতা হলো, সে হত্যাকারীর দিকে প্রশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার অন্য কোন এক রাতের স্বপ্নে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে সেই হত্যাকারীকে!! স্বপ্নগুলোর সব সময় সমাপ্তি ঘটেছে এক ভাবে – সেই ভয়াবহ পটভূমিতে নিজেকে দেখেছে বিপ্লবের আলিঙ্গনে খুশি মনে ধরা দিতে - শিউরে ওঠে শ্রীমনা।
শ্রীমনা কাউকে বলতে পারেনি স্বপ্নের কথা। সম্বরণকে তো নয়ই - যা সুপ্ত রয়ে গেছে তার মনের কন্দরে। যদিও মনের অন্দরে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নের ঘটনাবলী তাকে ক্ষিপ্ত করেছে, এতটাই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে যে - স্বপ্নটা শ্রীমনার কাছে সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে প্রশ্ন জেগেছে স্বপ্নটা কি কোন আগাম সাবধানতার সংকেত বয়ে নিয়ে আসছে?        
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা ফোনের ঝনাৎকারে শ্রীমনার চিন্তার স্রোত থমকে যায়। ভেতরে এসে ফোন তুলেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোনক্রমে দেওয়ালে হাত রেখে টাল সাম্‌লায়।
“কি নাম বললেন?”
“আরে শ্রীমনা, তোমার কি হলো? চিনতে পারলে না?

"আমি বিপ্লব – চিনতে পারছ না?”
“ওহো” -  শ্রীমনা কোনক্রমে উত্তর দেয় “তুমি এখন – কোথায়?”
“অনেকদিন পর ছুটি পাওয়া গেল। তোমাদের এখানকার ছোট্ট হোটেল ‘অতিথি’তে উঠেছি। হোটেলের লাগোয়া পুকুরে মাছ ধরে সময়টা বেশ কেটে যাচ্ছে, ভাবলাম অন্য কোন কাজ যদি না থাকে তা’হলে আজ সুন্দর বিকেলেটা তোমাদের সঙ্গে কাটিয়ে আসতে পারি।”
“না না”-  শ্রীমনার ত্বরিত স্বর “এখানে তোমার আসার দরকার নেই বিপ্লব।”
ফোনের অপর প্রান্ত কিছুক্ষণ নীরব থাকে -
“মনটা খুব খারাপ লাগছিল”  বিপ্লবের স্বর যেন আহত গম্ভীর--

“মনে হ’ল এত কাছে এসেছি, একবার খোঁজ নিয়ে দেখি। সত্যিই তোমাকে একেবারেই বিরক্ত করা উচিত হয়নি আমার।”
শ্রীমনা অস্বস্তিতে পড়ে। তার ব্যবহারটা বিপ্লবের খুবই অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। আসলে ওই স্বপ্নের বিষয় আত্মপর্যালোচনার পর পরই বিপ্লবের ফোন তাকে দিশেহারা করে তুলেছে। ফোনে তার নিষ্প্রাণ বাক্যালাপ বিপ্লবের মনে অবশ্যই দ্বিধা জাগিয়েছে। তার নিস্পৃহতা বিপ্লবকে নিশ্চয় আঘাত দিয়েছে।
শ্রীমনা চট জলদি সহজ হতে চেষ্টা করে –
“কিছু মনে করো না। আসলে বলতে চেয়েছি – আমাদের আজ বিকেলে অন্য জায়গায় নেমন্তন্ন আছে, তুমি বরং কাল রাত্রে কি আসতে পারবে?”
শ্রীমনার স্বরে আন্তরিকতার অভাব লক্ষ্য করে বিপ্লব –
“চিন্তা করো না শ্রীমনা – আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। ভুলে গেছিলাম এক বন্ধুর আজ এখানে আসার কথা আছে– সে আসুক বা না আসুক আমাকে হয়ত যে কোন সময় এখান থেকে চলে যেতে হতে পারে।” বিপ্লব একটু থেমে বলে –

“ভালো থেকো শ্রীমনা” আবার একটু থেমে গভীর স্বরে বলে-

“তোমাদের নতুন জীবনে আমার শুভ কামনা রইল।” 
শ্রীমনা স্বস্তির নি:শ্বাসে ফোন রেখে দেয়।
‘বিপ্লব এখানে যেন না আসে’ -  শ্রীমনার স্বগতোক্তি- ‘বিপ্লব কখনোই যেন না আসে-হে ভগবান! ভাবতেই পারি না কি ভাবে বিপ্লবের সামনে আমি দাঁড়াতে পারব! যাই হোক – নিজে থেকে বলেছে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। উফ! বাঁচলাম।’
শ্রীমনা টেবিলে রাখা গ্রামের লোকেদের তৈরি তালপাতার টুপিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসে বাগানের বাইরে। কয়েক নিমেষ তার চোখ স্থির হয় গেটের পিলারে পাথরের ফলকে লেখা বাড়ির নামে – ‘পিউ কাঁহা’।         
বিয়ের আগে এই বাড়িটা দেখেই সে বলেছিল- “বাড়ির নামের কি সুন্দর কল্পনা!” জবাবে সম্বরণের প্রাণ খোলা হাসি মনে পড়ে যায়।
“তুমি একেবারেই শহুরে মেয়ে।“ অনুরাগের স্বরে বলেছিল সম্বরণ।
“জানি তুমি কখনো “পিউ কাঁহার” ডাক শোনোইনি। একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে তুমি শোনো নি। “পিউ কাঁহা” পাখি ডাকে তাদের প্রেমিকাদের – ‘প্রিয়া তুমি কোথায়’ ‘প্রিয়া তুমি কোথায়’ – তার ডাক শুনে অভিসারিকা প্রিয়া খুঁজে ফেরে প্রেমিককে। গ্রীষ্মের গোধূলি আলোয়, এই বাগানে বসে আমরা দুজনে শুনব ‘পিউ কাঁহা’র প্রণয় ব্যাকুল গান।”
শ্রীমনার আবেগ ঘন স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় – নতুন বাড়িটায় আসার পর, এই বাগানে বসে তারা কত সুন্দর বিকেলগুলো কাটিয়েছে পাখিদের মিষ্টি গান শুনে। তার কপোল রাঙা হয়ে ওঠে।
সম্বরণই খুঁজে পেয়েছিল এই “পিউ কাঁহা” নামের বাড়িটা। ব্যস্ত হয়ে এসে তাকে বাড়িটার খবর শুনিয়েছিল। উত্তেজিত আনন্দে সে জানিয়েছিল তাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশে বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে। শ্রীমনাও বাড়িটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। চারপাশটা বড়ই নির্জন। গ্রাম থেকে বাড়িটা প্রায় দু কিলোমিটার দুরে। গাছে ছাওয়া নাতি উচ্চ একটি টিলার গা ঘেঁসে নির্জন ঘন গাছ গাছালির ছায়ায় ঘেরা সব রকম সুবিধা নিয়ে যত্নে গড়া বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর পুরানো আমলের বাড়িটা। সম্বরণ বলেছে আশেপাশের গাছগুলোতে আছে ‘পিউ কাঁহা’ পাখিদের অগুনতি বাসা। সন্ধ্যের আগে পাখিদের সমবেত “পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা” গানে চারিদিক আমোদিত হয়ে ওঠে। সেই জন্য বাড়িটার নাম ‘পিউ কাঁহা’। বাড়ির সামনের গ্রাম্য সরু রাস্তার অপর দিকে বিস্তৃত অসমতল প্রান্তরের শেষ ভাগে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে নানা উচ্চতার টিলা শ্রেণী। দেখার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমনা বাড়িটাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। 
বাড়ীর মালিক ধনী, খামখেয়ালী কিন্তু ওনার কথা শুনে তারা চিন্তায় পড়েছিল। বাড়িটা ভাড়ায় পাওয়া যাবে না – পুরোপুরি কিনতে হবে।
শ্রীমনা শুনেছে সম্বরণের উপার্জন ভালোই। তার সাথে আলোচনায় বুঝেছিল কিছু টাকা হয়ত সে যোগাড় করতে পারবে কিন্তু তার ব্যবসার মূলধনে হাত দিতে সে অপারগ। শ্রীমনার এতই পছন্দ হয়েছে – সে বাড়িটা হাতছাড়া করতে চায় না। শ্রীমনা তাদের যৌথ জীবন এখানেই শুরু করতে চাইল। সে মনস্থির করে,সম্বরণ যেটুকু যোগাড় করতে পারে করবে, বাকি টাকা যার পরিমাণ যদিও হতে পারে বাড়ির দামের প্রায় সিংহ ভাগ সে তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া থেকে দিয়ে দেবে। যৌথ উৎসাহে তাদের বিবাহোত্তর জীবন শুরু হল “পিউ কাঁহা’য়। কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়ির কাজের সাহায্যকারিদের পারিপার্শ্বিক নির্জনতা মানিয়ে নিতে অসুবিধা হওয়ায়, সবাই জবাব দিল। চিরাচরিত সাংসারিক জীবনে অভিজ্ঞতা শূন্য শ্রীমনা কিন্তু অপটু হাতে দৈনন্দিন সাংসারিক, ঘরদোরের কাজ তার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।   
হরেক রকম মরসুমি ফুলে ভরা সুন্দর বাগানের পরিচর্যায় নিযুক্ত হলো কাছের গ্রামের এক বৃদ্ধ মালী, রহিম চাচা। ঠিক হল সে সপ্তাহে দু দিন আসবে – প্রতি সোম আর শুক্রবার। 
শ্রীময়ী বাগানে নেমে এসে আশ্চর্য হয়ে দেখে বৃদ্ধ মালী বাগানের কাজে ব্যস্ত। আজ তার আসার কথা নয়! আজ তো বুধবার! সে এগিয়ে যায় মালীর কাছে।
“আরে - রহিম চাচা! আজ’তো বুধবার তুমি কাজে এসেছ যে?”
বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখে মাথায় জড়ানো গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সোজা হয় দাঁড়ায় –

“জানতাম দিদিমণি আপনি অবাক হবেন। আসলে সামনের শুক্রবার গ্রামে মেলা বসবে। তাই ভাবলাম আপনাদের কোন অসুবিধে হবে না যদি শুক্রবার না এসে আজ বুধবার বাগানের কাজটা সেরে যাই।”
“ঠিক আছে রহিম চাচা, গ্রামের মেলা কেমন হলো জানাবে তো আমাকে?”
“নিশ্চয়ই জানাবো, তা ছাড়া মেলার দিন দুপুরে চড়ুইভাতি হবে। গ্রাম শুদ্ধ লোকের নেমন্তন্ন, যে যা পারে খেতে পারবে, চাঁদাও দিতে হবে না।” এক গাল হেসে জানায় মালী।

“তা’ছাড়া শুনলাম কাল আপনারা শহরে যাচ্ছেন,কবে ফিরবেন তার দিন তো ঠিক হয় নি এখনো! আমার মনে হল, শুক্রবার আপনি থাকবেন না, তাই আজকেই জেনে যাই লনের সীমানায় কোন ফুল গাছ লাগালে আপনার ভালো লাগবে!" 
“কিন্তু আমি তো কোথাও যাচ্ছি না রহিম চাচা!" আশ্চর্য হয় শ্রীমনা।
মালী তাকিয়ে থাকে শ্রীমনার দিকে – “আপনি কাল শহরে যাচ্ছেন না?”
“না, তো, তোমার মাথায় এই অদ্ভুত কথা এলো কি করে?”
বৃদ্ধ প্রবল ভাবে মাথা নাড়ে-
“বাবুর সাথে গ্রামে দেখা হলো যে - শুনলাম আপনারা দুজনেই কাল শহরে যাবেন আর আপনি কবে ফিরবেন এখনো ঠিক হয় নি!”
শ্রীমনা হেসে বলে “দূর! - তুমি ভুল বুঝেছ চাচা।”
যাই হোক, সে চিন্তিত হয়। সম্বরণ কি এমন বলেছে যা এই বৃদ্ধ এমন অদ্ভুত ভুল ভেবেছে! সম্বরণ তো জানে সে ঠিক করেছে জীবনে আর শহরে পা রাখবে না! আর সেই বলেছে আমি শহরে যাচ্ছি?
অজান্তে শ্রীমনা অস্ফুট স্বগতোক্তি - “ওই শহরটাকে আমি মনে প্রাণে ঘেন্না করি।”
রহিম এবার শান্ত স্বরে জানায়  – 
“দিদিমণি - আমার মনে হলো বাবু তো পরিষ্কার তাই বললেন! তবে বুড়ো হয়েছি তো, হতে পারে আমি হয়ত ভুল বুঝেছি। তবে আমার খুব ভালো লাগলো শুনে দিদিমণি – আপনার এই সুন্দর জায়গাটা ছেড়ে শহরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। চারপাশের গাছগুলো দেখুন মা – সবুজে ভরে আছে-আকাশ পানে তাকান মা – এত নীল, শহরের আকাশে পাবেন? বিকেল হলেই দলে দলে “পিউ কাঁহা”র ডাক মনটা কত ভালো করে দেয় - এই বাড়ির আশ পাশের গাছে গাছে তাদের বাসা। তাই তো এই বাড়ির নাম ‘পিউ কাঁহা’। আমি দিদিমণি শহরে এক বার গেছিলাম। পথে পথে গাড়ি ঘোড়া মানুষের জড়াজড়ি, নি:শ্বেষ নেওয়ার বাতাস নেই গো- ওখানকার মানুষ গুলো আকাশ কাকে বলে জানেই না। শহরটা গুণ করে মানুষগুলোকে ভুলিয়ে রাখে। এই ধরেন আমাদের বিশ্বম্ভরবাবু – কত যত্নে অঢেল খরচ করে এই বাড়ি বানালেন – ঘরে ঘরে গোসলখানা – কল খুললেই জল – ঘরের ভেতরেই স্নান করো, সুইচ টিপলেই বিজলী বাতি। আর যেই তিনি শহরে আর একটা বাড়ি কিনলেন –তার  দু মাসের মধ্যেই এত খরচ করে তৈরি করা এই বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। আমি বাবুকে আগে বলেছিলাম এত খরচ করা বাড়ি বিক্রি করবেন, আপনার খরচ উসুল হবে না গো বাবু। বাবু হেসে হেসে বলেছিলেন ‘শোন রহিম – খরচের প্রতিটি পয়সা আমার উসুল হয়ে লাভও হবে। দাম ধরেছি পুরো চল্লিশ লাখ – তুমি দেখে নিও-‘ বিশ্বাস করিনি দিদিমণি। পরে অবাক হয়ে শুনেছিলাম তিনি সেই টাকাই পেয়েছেন।“
“না রহিম চাচা, তিনি পুরো পঞ্চাশ লাখ পেয়েছেন।” শ্রীমনা হাসতে হাসতে বলে।
“চল্লিশ লাখ দিদিমণি” বৃদ্ধ রহিমের পুনরাবৃত্তি –

“সেই সময় গ্রামের মাথারা বলাবলি করত– সবাই বলেছিল দামটা বড়ই বেশী রেখেছেন বিশ্বম্ভর বাবু।”
“তুমি ভুল শুনেছো রহিম চাচা, দাম দেওয়া হয়েছে পুরো পঞ্চাশ লাখ” শ্রীমনা দৃঢ়তার সাথে বলে।
রহিম গোঁ ধরে বলে-
“মাপ করেন দিদিমণি - মেয়েরা এসব টাকা পয়সার ব্যাপার ঠিক বোঝে না। বিশ্বম্ভরবাবু আপনার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বলতে পারবেন এই বাড়ির জন্য তিনি পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়েছেন?”
শ্রীমনা বলেন “তিনি ঠিক আমার কাছ থেকে টাকাটা নেন নি – আমার স্বামীর থেকে নিয়েছেন।”
বৃদ্ধ চিন্তিত মুখে নিচু হয়ে ফুল গাছের পরিচর্যায় হাত লাগায় –
এবার মুখ তুলে গভীর প্রত্যয়ের সাথে বলে- 
“না দিদিমণি, বাড়ির দাম চল্লিশ লাখ-ই।" 
বৃদ্ধ রহিমের সাথে আর তর্ক না বাড়িয়ে শ্রীমনা বাগান থেকে কিছু ফুল তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে পা বাড়ায়। তার মনের মধ্যে রহিম চাচার কথা ঘোরাফেরা করে – শত চেষ্টায় সরাতে পারছে না।
কিছুটা এগিয়েই তার চোখ পড়ে ফুল ঝোপের পাতার আড়াল থেকে উঁকি মারছে ছোট সবুজ বই এর মত কিছু। একটু ঝুঁকে তুলে নিয়ে দেখে সেটা সম্বরণের চির সঙ্গী পকেট ডায়েরী। নিশ্চয়ই আজ সকালে গাছের আগাছা পরিস্কারের সময় সম্বরণের পকেট থেকে পড়ে গেছে।
ডায়েরীটার পাতা উল্টে পাল্টে লক্ষ্য করে তাদের বিয়ের দিন থেকে নানা ঘটনাবলী পরিস্কার সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ, ভারি মজা পায় শ্রীমনা। এই কদিনে সে বুঝেছে আবেগ প্রবণ উচ্ছল সম্বরণের মধ্যে লুকিয়ে আছে সুশৃঙ্খল চিন্তা ধারায় পরিচালিত এক কর্মঠ ও কঠোর নিয়মে চলা মানুষ, যে পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট সময়সূচীতে চলতে অভ্যস্ত। সম্বরণ বিরক্ত হয়ে ওঠে সামান্য সব অনিয়মে- এমন কি ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে খাবার না পেলেও।
একটি পাতায় নজর পড়তে সে হেসে ওঠে – ১৪ই মে ২:৩০ – “শ্রীমনার সাথে বিয়ের রেজিস্ট্রি হলো।”
“পাগল একটা”- হেসে আবার পাতা ওল্টায় শ্রীমনা। হঠাৎ তার দৃষ্টি স্থির হয় একটি পাতায়। এই দিনের ডায়েরীর পাতায় সম্বরণের হাতের মুক্তাক্ষরে লেখা-
বুধবার, ১৮ই জুন, “রাত ৯টা” – “আরে! আজই তো ওই দিন।“
আর কিছু লেখা নেই, তার মনে কালো মেঘের সমাগম – আজ ওই সময়টায় সম্বরণের কি করার আছে? ক্ষীণ সন্দেহের আভাস শ্রীমনার মনে ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়। এই রকম পূর্বাভাসের ইঙ্গিত সে অনেক গল্পে পড়েছে। কিন্তু এখন শ্রীমনা নিশ্চিত, তার বিক্ষিপ্ত ভাবনায় ডায়েরীর ওই অংশটা সন্দেহাতীত ভাবে তার জীবনে কোন আলোড়নের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে আসছে। অধৈর্য হয়ে ডায়েরীর শেষ পাতা অবধি চোখ বোলায়। পাতাগুলো নানা ব্যবসায়িক মন্তব্য, বিভিন্ন তারিখ ইত্যাদিতে ভরে আছে। পুরো ডায়রীতে কেবল একটি মহিলার নাম পেয়েছে – সেটা হল তার নিজের। ডায়েরীটা তার বটুয়াতে রেখে ফুলের তোড়াগুলো নিয়ে বসার ঘরে আসে। তার ভাবাকাশে এক অস্পষ্ট অজানা জ্বালা অসহায়তা নিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে, তার ভাবনায় বিপ্লবের উপস্থিতি টের পায় – মনে পড়ে যায় তার কথা গুলো ‘ওই লোকটা তোমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তার অতীতের পরিচয় তুমি কিছুই জান না।‘ 
কথাটা তো সত্যি। বিয়ের আগে সম্বরণকে সে কতটা জেনেছে! সম্বরণের প্রায় চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই মেয়েরা তার জীবনে এসেছে। আসেনি কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য....?
শ্রীমনা অধৈর্য হয়ে মাথা নাড়ে। না না, চিন্তাগুলো একেবারেই অমূলক – প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত হবে। তার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখন মনোনিবেশ করা উচিত। সে ভাবছে – বিপ্লবের ফোনের কথা সম্বরণকে এখন বলা উচিত, কি উচিত নয়!!
সম্বরণ আজ আবার গ্রামে গেছে। পুরো মাত্রায় সম্ভাবনা রয়েছে বিপ্লবের সাথে তার দেখা হওয়ার। বিপ্লবও তো গ্রামের ছোট হোটেলটায় রয়েছে! যদি দেখা হয় তা’হলে বিপ্লব নিশ্চয় তাকে বলবে শ্রীমনার সঙ্গে আজ সকালে কথা হয়েছে। যদি বলে সেও হালকা হবে – সম্বরণকে আর কিছু বলতে হবে না। আর না দেখা হলে — শ্রীমনা অবচেতনে টের পায় সে বিপ্লবের ফোন নিয়ে সম্বরণ কে কিছু বলাতে যেন আর উৎসাহ পাচ্ছে না।
যদি সে সম্বরণকে বিপ্লবের ফোনের কথা বলে, সে নিশ্চিত, সম্বরণ বলবে ‘পিউ কাঁহা’য় বিপ্লবকে ডাকতে। তখন বলতেই হবে বিপ্লব নিজেই বলেছিল সে আসবে আর শ্রীমনা ভিত্তিহীন কারণ দেখিয়ে বিপ্লবের আসা ঠেকিয়েছে। যদি প্রশ্ন উঠে আসে বিপ্লবের আসা কেন সে আটকেছে? সে তখন কি উত্তর দেবে? অদ্ভুত ওই স্বপ্নের কথা বলবে? শ্রীমনা জানে – কারণটা শুনলে সম্বরণ হেসে উড়িয়ে দেবে, হয়ত শ্রীমনার কাছে স্বপ্নের গুরুত্বটা সে পাত্তা দেবে না।
এতক্ষণের টানাপড়েন শেষে - শ্রীমনা দ্বিধা জর্জরিত মনে ঠিক করে স্বপ্নের বা বিপ্লবের ফোনের কথা সম্বরণ কে কিছুই বলবে না। এটাই হবে তার বিবাহিত জীবনে প্রথম কিছু লুকিয়ে রাখা, এখন যেন সে বেশ স্বস্তি অনুভব করে।
বাগানের ফটক খোলার শব্দে শ্রীমনার সম্বিত ফেরে। সম্বরণ দুপুরের খাওয়া সময়ের ঠিক আগে ফিরে এসেছে। মনের এলোমেলো অবস্থা গোপনের উদ্দেশ্যে সম্বরণ ভেতরে আসার আগেই, সে রান্নাঘরে গিয়ে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করে।
সম্বরণ ভেতরে এসে বিপ্লবের ব্যাপারে কিছু না বলায় বোঝা গেল তার সাথে বিপ্লবের দেখা হয়নি, ঠিক করে ফেলে পুরো ব্যাপারটা গোপন থাকুক। এতে সে স্বস্তি পায়, আবার সম্বরণের কাছে এই প্রথম বার কিছু লুকনোর জন্য অস্বস্তিবোধ করে। নিয়মমাফিক দুপুরটা কেটে গেল।
রাতের খাওয়ার পর বসার ঘরে এসে তারা দুজনে বসে। মেহগনি কাঠের টেবিলে রাখা সবুজ আচ্ছাদন ঢাকা বাতির নরম আলোর বৃত্তের বাইরে, ঘরের কোনে কোনে জমে থাকে হালকা অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসে ফুলের মিষ্টি গন্ধমাখা রাতের বাতাস। 
শ্রীমনার এখন মনে পড়ে যায় সম্বরণের সবুজ ডায়েরীটার কথা।  
“আজ সকালে তুমি কি এই ডায়েরী দিয়ে ফুল গাছে জল দিচ্ছিলে নাকি?” ডায়রিটা আলগোছে সম্বরণের দিকে এগিয়ে দেয় শ্রীমনা।
“ওহো -  এটা বোধহয় ফুল গাছের কাছে পড়ে ছিল?”  
“হ্যাঁ, তোমার সব গোপন কথা এখন আমি জেনে গেছি কিন্তু।”
“ওরে বাবা! কি জেনে গেলে?” কৃত্রিম ভয়ে মাথার ওপর দু হাত তোলে সম্বরণ।
“ রাত ৯টায় তোমার কি কাজ আছে আজ?”
“ওই টা –” সম্বরণ কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়ে জোরে হেসে ওঠে, যেন কিছু মজার কথা শুনেছে। বলে- 
“কাজটা হলো একটি সুন্দর মেয়ের সঙ্গে দেখা করার – যার মাথার চুল মনে করায় রাতের আকাশ আর চোখ দুটি যেন দুপুরের রোদে খেলে বেড়ানো পিউ কাঁহা পাখি। মেয়েটিকে ঠিক তোমার মত দেখতে!”
“তুমি আসল কথা এড়িয়ে যাচ্ছ।”- কপট রাগে শ্রীমনা বলে ওঠে-
“না, তা নয়। সত্যি কথা বলতে হলে, এখন মনে পড়ে গেল – সকালে ঠিক করেছিলাম আজ রাতে তোমার একটা ছবি আঁকব, ক্যানভাসে ধরে রাখব তোমায় চিরকালের মত। বসবে তো ? বেশীক্ষণ নয় – আপাতত আজ রাতে যতটা পারি শুধু স্কেচ করব–আর তোমার মন আবার যে দিন ভাল থাকবে সেদিন ছবি পুরোটা করে ফেলব।”
শ্রীমনা জানে সম্বরণ খুব ভাল ছবি আঁকে। বাড়ির পিছনের একটা ছোট ঘরে রাখা আছে তার আঁকার সরঞ্জাম।
“তা হলে তুমি আগেই ভেবেছিলে আজ রাত ঠিক ৯টায় স্কেচটা করবে!” সম্বরণকে সে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করে।
বিরক্তির ছোঁয়া সম্বরণের দৃষ্টিতে ---
“উফ! শ্রীমনা”- তার শরীরী ভাষায় যেন কর্কশতা ফুটে ওঠে-
“জেনে রাখ, বিশেষ কিছু কাজ করার সময়টা প্রত্যেকের আগে থেকে ঠিক করে রাখা উচিত, তা’হলেই সব কাজই ঠিক ঠাক করা যায়।”
শ্রীমনা কয়েক মিনিট নি:শব্দে লক্ষ্য করে চেয়ারে আধ শোয়া সম্বরণের ঘন চুলে জানলা দিয়ে আসা বাতাসের খেলা। প্রায়ান্ধকার ঘরের আলো ছায়ায় নিখুঁত দৃঢ় পুরুষালী মুখ। যা তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার সিগারেটের ধোঁয়া পাক খেয়ে ঘরের সিলিঙের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ - কোনো অজানা ভয়ের হিমশীতল ঠাণ্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে আসে। ভয়টা শ্রীমনার গলা চিরে নিষ্পেষিত গোঙানি হয়ে বেরিয়ে আসে, চেপে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না-
“কেন জানি না, হঠাৎ মনে হচ্ছে তোমাকে আমি পুরোপুরি চিনি না, তোমাকে আরো চেনা উচিত ছিল আমার।” 
সম্বরণ কিছুটা অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকায় –
“তুমি তো আমার সব কিছুই জানো শ্রীমনা। আমার ছোটবেলা কেটেছে রাঁচী শহরে, তারপর অনেক বছর কানপুরে আর উন্নতির মুখ দেখেছি গত দশ বছর নেপালে ব্যবসার কাজে।”
“উফ – তোমার ওই ব্যবসার কথা সবসময়!”
শ্রীমনার কথায় সম্বরণ হেসে ফেলে –
“এবার বুঝেছি, জানতে চাইছ আগে কারুর প্রেমে পড়েছি কি না? উফ! তোমরা মেয়েরা সব এক রকম – এই সব প্রেম ঘটিত ব্যাপার খুঁজে বার করাতেই তোমাদের যত আনন্দ।”
শ্রীমনা গলা যেন শুকিয়ে আসে, সে আড়ষ্ট হয়ে বলে – “বলতে চাইছি -এতটা সময়ের ভেতর তোমার কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়নি? আমায় বিশ্বাস করতে বল? আমি শুধু জানতে চাইছি সম্বরণ?”
ঘরের ভেতর কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা নেমে আসে-
সম্বরণের হালকা চালের কথাবার্তায় এবার গম্ভীরতার ছোঁয়া লাগে ---
“শ্রীমনা – জানো, পুরনো একটা গল্প মনে পড়ছে – খুব পয়সাওয়ালা এক বুড়ো, মুখে দাড়ি। সে বেছে বেছে কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে করে কিছুদিন পর তাদের খুন করে তার বিশাল বাড়ির নিচের ঘরে রেখে দিত। শেষে এক বুদ্ধিমতী মেয়ে, বিয়ের পর ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে তার শাস্তির ব্যবস্থা করে। আমার সে রকম কোনো ঘটনা নেই শ্রীমনা।” এবার একটু সহজ হয়ে বলে –

“আমার জীবনে মেয়েরা নিশ্চয়ই এসেছে। যদি অস্বীকার করি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না। তবে আমি শপথ করে বলতে পারি – তারা কেউই আমার মনে রেখাপাত করতে পারে নি।”
সম্বরণের কথায় আন্তরিকতার ছোঁয়া শ্রীমনাকে আশ্বস্ত করে। 
এরপর কৌতুহলি দৃষ্টিতে শ্রীমনার দিকে তাকিয়ে বলে-

“এবার নিশ্চিন্ত হলে তো? এমন এক সুন্দর রাতে তোমার মনে এই সব বিদঘুটে চিন্তা কোথা থেকে উদয় হলো বলো দেখি? আগে এ ধরনের কথা বলোনি তো কখনো!”
কোনো কথা না বলে অন্যমনস্ক শ্রীমনা দাঁড়িয়ে উঠে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে থাকে।
“আমি জানি না সম্বরণ” - সে বলে -

“আমার মন আজ সারা দিন অদ্ভুত এক অস্থিরতায় ভরে আছে।”
“আশ্চর্য” –  সম্বরণ মৃদু স্বরে বলে – “তোমার হলোটা কি!”
“কেন? তোমার আশ্চর্য লাগছে কেন?”
“আরে শ্রীমনা, হঠাৎ এত রেগে উঠছ কেন বলতো? তুমি সাধারণত: এত সুন্দর, শান্ত স্বভাবের মেয়ে – সেই জন্যই কোনো কারণ ছাড়া তোমার এই অস্থিরতা অদ্ভুত লাগছে। তুমি কি ভেবে অস্থির হচ্ছ শ্রীমনা? সেই বুড়োর লুকোনো ঘরের কথা শুনে?”
মনের অস্থিরতার মধ্যেই জোর করে হাসে শ্রীমনা --
“আজ যেন সবাই ষড়যন্ত্র করে আমাকে উত্যক্ত করে মারছে। রহিমচাচার মাথাতে উদ্ভট চিন্তা এসেছে – আমরা নাকি শহরে চলে যাচ্ছি। তুমি নাকি তাকে বলেছ।“
“তার সঙ্গে তোমার আজ কোথায় আবার দেখা হল?” সম্বরণের তীব্র প্রতিক্রিয়া।

“শুক্রবারে বদলে আজ সে কাজে এসেছিল যে। বুড়োর মাথায় নির্ঘাত গণ্ডগোল হয়েছে-”  সম্বরণ অস্বাভাবিক রাগে চেঁচিয়ে ওঠে। শ্রীমনা স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে সম্বরণের দিকে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না এই সামান্য কারণে সম্বরণের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। সম্বরণের এমন রাগ সে আগে কখনো দেখেনি। তার হতভম্বতা নজরে আসায়, সম্বরণ প্রাণপণে নিজেকে শান্ত করে। সে রাগ চাপা দিয়ে আবার বলে ওঠে “বুড়োটাকে ভীমরতিতে ধরেছে। ওকে ঠিক কি বলেছিলে বলতো? সে এরকম ভাবল কেন?”

“আমি বুড়োটাকে কিছুই বলিনি। ওহ, হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে--মনে পড়েছে – রহিম জিজ্ঞাসা করেছিল সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছি – মজা করে বলেছিলাম কাল সকালে শহরে যাব তাই দরকারী কিছু জিনিষ কিনতে যাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে রহিম সেটা সত্যি মনে করেছে হয়ত আবার ঠিক করে শোনে নি। তুমি সত্যিটা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছ নিশ্চয়ই?” বলেই সে সাগ্রহে চেয়ে থাকে উত্তর শোনার জন্য।“ বুঝিয়ে ছিলাম। কিন্তু বুড়ো মানুষের মাথায় একবার কিছু যদি ঢুকে যায়, বুঝতেই পার, ঠিক কথাটা তখন বোঝানো খুব শক্ত হয়ে যায়।” এর পর শ্রীমনা জানায় বাড়ির দামের ব্যাপারে রহিমের দৃঢ় ধারণা। সম্বরণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ধীর স্বরে বলে-

“বিশম্ভরবাবু চল্লিশ লাখ ড্রাফ্টে আর বাকি টাকা নগদে চেয়েছিল। আমার মনে হয়, ভুল বোঝার কারণ এটাও হতে পারে।”

“ঠিক -সেটাও হতে পারে,” – শ্রীমনা সায় দেয়। এরপর ঘড়ির দিকে আঙুল তুলে সে হাসে –“যাক’গে! ৯টা বেজে ৫ মিনিট হয়ে গেল যে! এবার তোমার আঁকার ঘরে যাবে না?” এক অদ্ভুত হাসি সম্বরণের মুখে এসেই মিলিয়ে যায়, শান্ত গলায় বলে –

“না: থাক, আজ আর আঁকতে ভাল লাগছে না। মনটা ঠিক নেই।” সাধারণত: মেয়েদের মন নিজেদের কাছেও দুর্বোধ্য। সে দিন রাতে যখন শ্রীমনা শুতে যায় তার মনে প্রগাঢ় তৃপ্তি আর শান্তি। সম্বরণের কথায় সারাদিনের পর এই ক্ষণেকের প্রশান্তি তাকে সব ভুলিয়ে দেয়, গত এক মাসের আনন্দ ফিরিয়ে আনে। কিন্তু পরের দিন, বৃহস্পতিবার বিকেলেই, সে তার মানসিক পরিবর্তন অনুভব করে - তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কোন অশুভ উপলব্ধির আভাস, যা তার ক্ষণিকের সুখ যেন ছিনিয়ে নিতে চাইছে। সে দিনের পর বিপ্লব আর যোগাযোগ করেনি। তা সত্ত্বেও আজ বিকেল থেকে বিপ্লবের সেই কথাগুলো শ্রীমনার মনে আলোড়ন তোলে। বারবার অনুরণিত হয় বিপ্লবের কথাগুলো–

‘ওই লোকটা পুরোপুরোই একজন অচেনা মানুষ – সে সম্পূর্ণ অজানা তোমার কাছে।’ পরক্ষণেই ভেসে ওঠে সম্বরণের দৃঢ় পুরুষালি মুখাবয়ব, তার শুষ্ক নারী জীবনের অমোঘ আকর্ষণ। শ্রীমনার মনে গেঁথে আছে ছবির মত। আর এক দিকে তার ঠিক প্রতিমুখ বিপ্লব। আবার সম্বরণের বলা অদ্ভুত সেই বুড়োর গল্পটা? কুরে কুরে খেতে থাকে ঘুণ পোকার মতো।

‘কি ভাবছো শ্রীমনা? সেই বুড়োর লুকোনো ঘরের কথা?’- এই কথাটা সম্বরণ তাকে বলল কেন? গল্পটা কি কিছুর পূর্বাভাস? কোনো ভয়াবহ বিপদের ইঙ্গিত? হয়ত গল্পটা বলার উদ্দেশ্য ছিল তাকে প্রকারান্তরে জানানো – ‘আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে উঁকি না মারাই ভাল নচেৎ বিপদের সম্ভাবনা আছে শ্রীমনা।’ আবার এটাও সত্যি, কিছুক্ষণ পরেই তার জীবনে অন্য নারীর অস্তিত্ব নেই শপথ করেছে সম্বরণ কিন্তু শ্রীমনার দ্বিধাগ্রস্ত মন এখন সম্বরণের শপথের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব অনুভব করে। তার এখন মনে হচ্ছে সম্বরণের উচিত ছিল তার নিজের আন্তরিকতারও শপথ নেওয়া।

বৃহস্পতি বারের রাত দোলচালের ভেতর কেটে যায় শ্রীমনার।আজ শুক্রবারের সকাল। সে এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে সম্বরণের জীবনে প্রেমিকারা ছিল – ঠিক ওই  বুড়োর বাড়িতে লুকোনো ঘরের গল্পটার মত যা সম্বরণ তার কাছে লুকোচ্ছে। তার ধিকি ধিকি জ্বলা ঈর্ষা আজ সকালে চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছয়।সম্বরণ কি ওই দিন রাত ৯টায় তার প্রেমিকার সাথে মিলিত হতে যাচ্ছিল? আমার ছবি আঁকার গল্পটা কি সম্বরণের মিথ্যা ঢাকার তাৎক্ষনিক চিন্তা? তিন দিন আগেও শ্রীমনা হলপ করে বলতে পারত – সে সম্বরণকে পুরোপুরি চেনে, বিশ্বাস করে – স্ত্রী হিসেবে সম্বরণে ওপর তার নি:শঙ্ক নির্ভরতা। কিন্তু এখন তার মনের কোনায় সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে – এই সম্বরণ

যেন অচেনা কেউ – একেবারেই অপরিচিত ! চোখে ভাসছে তুচ্ছ কারণে রহিম চাচার প্রতি তার তীব্র রাগের বহি:প্রকাশ –ঠাণ্ডা মেজাজের সম্বরণের সঙ্গে একেবারেই যেন বেমানান। ঘটনাটা আপাত দৃষ্টিতে হয়ত নগণ্য, কিন্তু যেন আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে তার স্বামী কে সে একেবারেই চেনে না।
ভারাক্রান্ত মনে শ্রীমনার খেয়াল হয় – আজ শুক্রবার তার সাপ্তাহিক বাজার করার দিন। সপ্তাহের এই একটা দিন গ্রামে যায় কেনাকাটা করতে, আবার তার ভালোও লাগে সদ্য পরিচিত দোকানীদের সাথে গল্প করার সময় স্থানীয় খবরাখবর শুনতে। শ্রীমনা বেলার দিকে বলে রহিম চাচা আজ তো আসবে না, সম্বরণ বরং আজ বাগানের কাজ কিছু করুক। সে তা’হলে বাজারটা ঘুরে আসবে, কিন্তু আশ্চর্য হয় যখন সম্বরণ স্বভাববিরুদ্ধ কিছুটা রুঢ় স্বরে শ্রীমনাকে বাধা দিয়ে অকারণ জেদের সঙ্গে বলে তার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই – সম্বরণ নিজেই আজ বাজার যাবে।
সম্বরণের জেদে শ্রীমনা বাধ্য হয় বাড়িতে থাকতে। সম্বরণের অহেতুক জোরাজুরিতে সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। তার বাজার যাওয়া আটকাতে সম্বরণের কেন এই আশ্চর্য ব্যগ্রতা?  
হঠাৎ তার মনের সংশয় পরিষ্কার হয়ে যায়। খুব সম্ভবত বিপ্লবের সঙ্গে গ্রামে কাল সম্বরণের দেখা হয়েছে কিন্তু সে শ্রীমনার কাছে সেটা প্রকাশ করেনি। হতে পারে তার যেমন সম্বরণের অতীত জীবনের প্রতি সন্দেহ জেগেছে – সম্বরণেরও কি বিপ্লবের উপস্থিতি জড়িয়ে তার প্রতি একই সন্দেহ? বিপ্লবের সঙ্গে শ্রীমনার আবার দেখা হতে পারার আশঙ্কাই কি সম্বরণকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে? সেই জন্যই কি তার বাজার যাওয়া সম্বরণের মন:পুত নয়? এখন সে যেন এক প্রকার স্থির নিশ্চিত, সম্বরণের এ কদিনের অস্বাভাবিকতার কারণ সে খুঁজে পেয়েছে। সেই জন্যই কি যেনতেন প্রকারে শ্রীমনার বাজার যাওয়া আটকেছে? শ্রীমনার এ কদিনের বিক্ষিপ্ততায় যেন স্বস্তির প্রলেপ পড়ে। সদ্য বিবাহিত জীবনের আনন্দ ফিরে আসে। সম্বরণের যদি সন্দেহ হয়ে থাকে, শ্রীমনা জানে ওই অমূলক সন্দেহ কি ভাবে তার মন থেকে মুছে দেবে। 
বেলা গড়িয়ে যায়। দিনের আলোর উজ্জ্বলতা হ্রাস পেতে থাকে। বিনা কারণে তার আবার অস্থিরতা ফিরে আসে। সম্বরণ বেরিয়ে যাওয়ার সময় থেকে সে অনুভব করে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরা কোনো দুশ্চিন্তা তাকে আবার অশান্ত করছে, এর থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা স্বত্বেও। বিহ্বলতার আচ্ছন্নতা তাকে গ্রাস করছে। অবশেষে নিজেকে বুঝিয়ে শ্রীমনা জোর করেই ব্যস্ততার সাথে ঘরদোর গোছানোতে মন দেয়। কিন্তু নিজের সন্দেহের প্রবলতায় প্রথমেই যায় সম্বরণের পড়ার ঘরে, পরিষ্কার করার অছিলায়।  
‘হে ভগবান! আমার ধারণা যেন ভুল হয়’ শ্রীমনার আবার অসহায় স্বগতোক্তি- ‘আমি যদি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারি—’
সম্বরণের পড়ার ঘরে প্রবেশের আগে সে নিজেকে আবার বোঝায় – পড়ার ঘরে কারুর থেকে পাওয়া চিঠিপত্র নাও থাকতে পারে কারণ খুব স্বাভাবিক অনেক আগেই সেগুলো নিশ্চয় নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। অবশ্য সে জানে পুরুষরা মাঝে মাঝে এই সব চিঠি স্মৃতি হিসেবে লুকিয়ে রাখে। শেষ কালে শ্রীমনা হার মানে নিজের সন্দেহের কাছে। সম্বরণের পড়ার ঘরে প্রবেশ করার উদ্দেশ্য মনে করে- তার মনে অপরাধ বোধ জেগে ওঠে। জোর করে নিজেকে শক্ত করে, ঘরের টেবিলে রাখা কাগজ পত্র, টেবিলের  ড্রয়ার, আবার সম্বরণের শার্ট ট্রাউজার্সের পকেট গুলোও তন্ন তন্ন করে খোঁজে – সন্দেহজনক কিছুই নেই। এরপর দেখে টেবিলের নিচের দুটো ড্রয়ার চাবি বন্ধ। এখন সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার দৃঢ় ধারণা হল ওই দুটো বন্ধ ড্রয়ারেই নিশ্চয় সে যা খুঁজছে, তা পাবে – তার সেই কল্পিত নারীর লেখা চিঠিপত্র ঠিক ওই ড্রয়ারগুলোতেই আছে। 
শ্রীমনার মনে পড়ে গেল সম্বরণের নিজস্ব চাবির গোছা নিচের বসার ঘরে টেবিলে পড়ে আছে। চাবি গুলো নিয়ে এসে একটার পর একটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করে বন্ধ ড্রয়ার খুলতে। তৃতীয় চাবিটায় টেবিলের নিচের ড্রয়ারটা খুলে যায়। ড্রয়ারটা খুলে পায় ব্যাঙ্কের একটি চেক বই, টাকায় ভরা একটা মানিব্যাগ, তারপর ড্রয়ারের একেবারে পিছনের থেকে পেল রাবার ব্যান্ড জড়ানো এক বাণ্ডিল চিঠি।
তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়। চিঠির গোছা খুলে সে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। চিঠিরগুলো তাড়াতাড়ি রেখে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দেয়। চিঠিগুলো বিয়ের আগে সে’ই সম্বরণকে লিখেছিল কিন্তু তার মন মানে না, তন্নতন্ন করে সব ড্রয়ারগুলো খুঁজতে হবে, দেখতেই হবে সম্বরণ কোথায় সেগুলো লুকিয়ে রেখেছে।
শ্রীমনা অধৈর্য হয়, সম্বরণের কোনো চাবিতে দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলছে না – কিন্তু এই  ড্রয়ারটা যে খুলতেই হবে! সে অনেক খুঁজে একটা ডুপ্লিকেট চাবির গোছা পেয়ে ফিরে আসে সম্বরণের পড়ার ঘরে। তার পরিশ্রম সফল হল। পুরনো চাবির গোছার একটি চাবিতে শেষ ড্রয়ারটা খুলে যেতে - শ্রীমনা হাঁপ ছাড়ে। কিন্তু আশ্চর্য – এখানে পুরনো চিঠিপত্র কিছু নেই তো! দেখে বহু পুরনো ধুলো ময়লায় বিবর্ণ খবরের কাগজের কিছু বাণ্ডিল পড়ে আছে ড্রয়ারের এক কোনায়।
শ্রীমনার স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে। তা সত্ত্বেও তার কৌতূহল মাথা চাড়া দেয়, এত পুরনো ধুলো ময়লায় বিবর্ণ খবরের কাগজগুলোয় কি আছে? সম্বরণ কেন এগুলো এত কষ্ট করে ড্রয়ারে বন্ধ করে রেখেছে? এক এক করে খবরের কাগজগুলো খুলে দেখতে থাকে। সবগুলোই প্রায় পাঁচ বছরের পুরনো তারিখের নেপালের ইংরেজী কাগজ। সব কাগজেই কোন এক কুখ্যাত জুয়া চোরের এক সাথে বহুবিবাহ, নানা মহিলাদের ঠকানো সম্পর্কীয় খবর। কুখ্যাত মানুষটির নাম জগন পান্ডে। নেপাল পুলিশের দৃঢ় সন্দেহ এই পান্ডে লোকটা বহু নারীর হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত। সেই সময় অবধি এই জগন পান্ডের বিয়ে করা বহু মহিলার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
আর একটা খবর তার নজরে আসে – এই জগন পান্ডের অনেকেগুলি ভাড়া বাড়ির কোনো একটির ঘরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে মহিলাদের অস্থিবশেষ। 
খবরে আরো রয়েছে – পান্ডে নিখুঁতভাবে সেই দেশের দক্ষতম উকিলদের সাহায্যে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। সেই দেশের উচ্চতম আদালত প্রমাণাভাবে তাকে হত্যাপরাধ থেকে বেকসুর মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে। পরিবর্তে অন্যান্য বহু গুরুতর অপরাধে উচ্চ আদালত পান্ডের লম্বা হাজত বাসের শাস্তি জারি করে।
শ্রীমনার মনে পড়ে যায় – সেই সময় এদেশের কাগজে কাগজে উত্তপ্ত আলোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল জগন পান্ডের মহিলাদের প্রভাবিত করার বিশ্বয়কর ক্ষমতার বিবরণ – আদালতে তার নাটকীয়তা, নিজে কে নিরপরাধ প্রমাণের পক্ষে আবেগ কম্পিত সওয়াল আবার তার দুর্বল হৃদযন্ত্রের কারণে আচমকা শারীরিক অসুস্থতার ঘটনা প্রবাহ। যদিও অনেকের সন্দেহ আদালতে জগন পান্ডের আবেগজনিত কর্মকান্ডে ছিল তার নিখুঁত নাটকীয়তার নিদর্শন।   
অনেকগুলো খবরের কাগজের কাটিংয়ে জগন পান্ডের ছবি ছাপা রয়েছে – ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবি গুলো শ্রীমনা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে। ছবিগুলো পরিষ্কার নয়। তার নির্নিমেষ দৃষ্টি এখন স্থির হয় পুরনো আর একটি খবরের কাগজের পাতায় একজন শান্ত গম্ভীর চেহারার যুবকের ছবিতে - বেশ পরিষ্কার ছবিটা।
ছবিগুলো কি কাউকে মনে করিয়ে দিচ্ছে? একেবারেই অপ্রত্যাশিত চমকে বিহ্বল শ্রীমনা বোঝে – এতো সম্বরণের ছবি! জানলার কাছে গিয়ে আরো ভালোভাবে দেখে - সে এখন নিশ্চিত। সেই চোখ, ভ্রু,সুগঠিত চোয়াল!! পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে সম্বরণের সঙ্গে! খবরে কিছু তারিখ উল্লেখিত রয়েছে। এবার তার মনে পড়ে সম্বরণের ডায়েরীর পাতায় পাতায় কিছু তারিখের উল্লেখ ছিল। সম্ভবত: এই কারণেই বোধহয় সম্বরণ পুরনো কাগজগুলো এখানে লুকিয়ে রেখেছে? আবার সে খবরের কাগজের ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে – কোন ভুল নেই! তার এখন স্থির বিশ্বাস – ডায়েরীতে লেখা তারিখগুলো আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন – কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই সেই দিনগুলিতে বোধহয় অসহায় মেয়েগুলিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার পুরনো খবরের কাগজে চোখ বোলায় শ্রীমনা। অপরাধীকে চিহ্নিত করার পরে একজন ভুক্তভোগী মহিলার জবানবন্দীর বয়ান-

“আসামির হাতের কব্জিতে জড়ুল চিহ্ন আছে - বাঁ করতলের ঠিক নিচে।”   
শ্রীমনার চারিপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়, তার সমস্ত শরীর মন দুলে ওঠে। পড়ে যেতে যেতে সামনের টেবিল ধরে কোন রকমে নিজেকে সামলায়, অসাড়ত্ব গ্রাস করে তার সারা শরীর। খবরের কাগজগুলো অজান্তে হাত থেকে খসে পড়ে – সম্বরণের বাঁ কব্জির, করতলের ঠিক নিচে অতি পরিচিত ক্ষত চিহ্নটা তার মনের ভেতর দগদগে হয়ে ফুটে ওঠে ---
পড়ার ঘরটা পাক খায় ঘুর্ণীর মত– বিধ্বস্ত শ্রীমনার অবচেতনের আড়াল থেকে তাৎক্ষনিক ভেসে ওঠা অদ্ভুত ভাবাবেগ তাকে পৌঁছে দেয় সঠিক নিশ্চয়তায় – জগন পান্ডে আর সম্বরণ – একই লোক! তার অবচেতনে সে যেন জানতোই – কিন্তু এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত। তার মনের অসংযুক্ত টুকরো টুকরো চিন্তাগুলো এখন খাপে খাপে যেন মিশে যাচ্ছে।  
সে এখন বুঝতে পারছে এই বাড়ির আসল দাম চল্লিশ লক্ষ দেওয়া হয়েছে – তার টাকায়। পুরোটাই তার নিজের টাকা যা সম্বরণের কাছে সরল বিশ্বাসে রাখা ছিল। সম্বরণ তার নিজের এক টাকাও দেয় নি বাড়ির জন্য। তার অদ্ভুত স্বপ্নগুলো এখন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারে মনের গহন গভীর অবচেতনে সম্বরণকে সে ভয় পেত – তার থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল। সেই অদ্ভুত স্বপ্নে কি নিজের অজান্তে সে বাঁচার জন্য হাত বাড়িয়েছে বিপ্লবের দিকে? তার অবচেতনের তাগিদেই কি এত সহজ সত্যটা কোনো ইতস্ততা: ছাড়াই এখন সে সরাসরি উপলব্ধি করতে পারছে? এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস –সে নিজেই এবার সম্বরণের পরের শিকার – তার মন বলছে – সম্ভবত খুব শীঘ্র সেই ভয়ঙ্কর দিন আসছে।
কোনো কিছু মনে পড়ায় - বেরিয়ে আসা চাপা কান্না আটকানোর চেষ্টা করে শ্রীমনা। সম্বরণের ডায়েরী গত বুধবারের পাতায় লেখা ছিল ‘রাত ৯’ টা। বাড়ির পেছনের সম্বরণের আঁকার ঘরের মেজের টাইলসগুলো একটু নড়বড়ে - সহজেই ওঠানো যায়। কাগজের খবর অনুযায়ী শেষ মহিলার দেহ পাওয়া গেছিল ওইরকম একটি ঘরের মেজের নিচ থেকে। তার মানে পরিকল্পিত ভাবেই এবারের ঘটনাটার জন্য ডায়েরীর তারিখটা আগে লেখা হয়েছিল! ভাবতে পারছে না শ্রীমনা – সম্বরণ নামে লোকটার এটাই কি মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ? না – না, জগন পান্ডের পূর্ব কার্যকলাপের সাথে মিলিয়ে দেখলে পরিকল্পনাটা খুবই ঠাণ্ডা মাথায় করা মনে হচ্ছে!
সম্বরণকে সে দেখেছে ব্যবসায়িক কাজের দিনক্ষণ আগে থেকে ডায়েরী লিখে রাখতে – তার কাছে খুন করাটাও খুব স্বাভাবিক ভাবে অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রীমনার বিক্ষুব্ধ মনে চিন্তা আসে – শিউরে ওঠে কি ভাবে সে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ পেল? কোন পূর্বাভাস কি ছিল? কি ভাবে অজানা সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে তার মনে? সে নিজেই কি আঁচ করতে পেরেছিল? না - হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকে মনে এল কারুর কাছে কিছু একটা শুনেছিল সে – কার কাছে? হ্যাঁ, রহিম চাচা।
গত বুধবার রহিমচাচার কথাগুলো বলাতে – সম্বরণের হঠাৎ রাগে উন্মত্ত হয়ে ওঠা মনে পড়ে গেল। এখন সে নি:সন্দেহে বুঝতে পারে সম্বরণ গ্রামের সবাইকে বলেছিল তারা পরের দিন শহরে যাচ্ছে। সরল মনা মানুষ, রহিমচাচা অপ্রত্যাশিতভাবে শুক্রবারের পরিবর্তে বুধবার কাজে আসে। অন্যান্য কথার মাঝে তাদের পরের দিন শহরে যাওয়ার কথা বলাতে শ্রীমনা তার ভুল ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছিল। সম্বরণের পক্ষে হয়ত সে রাতে শ্রীমনাকে সরিয়ে ফেলা ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে যেত কারণ রহিম চাচা তাদের কথাবার্তা গ্রামের লোকেদের নিশ্চয় বলত। কি জোর বেঁচে গেছে শ্রীমনা –রহিমের কাছে শোনা সামান্য কথাগুলি সম্বরণকে যদি না বলত?  শ্রীমনার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে।
শ্রীমনা নিচে বাগানের গেট খোলার শব্দে পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়। কখন বিকেল হয়ে গেছে খেয়াল করেনি সে। সম্বরণ গ্রাম থেকে বোধহয় ফিরেছে।
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে, শ্রীমনা নি:শব্দে পা ফেলে জানলার পর্দার আড়াল থেকে নিচের গেটের দিকে দেখে।
ঠিক- সম্বরণ গেট খুলে ভেতরে আসছে। বিকেলের হালকা আলোয় দেখে মৃদু হাসির ছোঁয়া তার মুখে, গুন গুন স্বরে তার গান ভেসে আসে। তার হাতে কিছু দেখে ভয়ার্ত শ্রীমনার হৃৎস্পন্দন যেন থেমে যায় – সম্বরণের হাতে সদ্য কেনা একটা মাটি খোঁড়ার কোদাল! 
এক লহমায় শ্রীমনা সজাগ হয়ে ওঠে – আজ রাতেই কি তবে ----!
কিন্তু তার মনে হচ্ছে নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ এখনো বোধহয় হারায়নি। জানলা দিয়ে দেখে সম্বরণ বাড়ির ভেতরে না এসে, শিষ দিতে দিতে ধীর পদক্ষেপে বাগানের পায়ে চলা সরু পথ ধরে বাড়ির পিছনে তার আঁকার ঘরের দিকে চলে গেল। 
তাকে সম্বরণের হাত থেকে বাঁচতেই হবে। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের গেটের কাছে পৌঁছয়। পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বাইরে বেরোনর আগেই দেখে সম্বরণ খালি হাতে, বাড়ির আরেক দিক দিয়ে তার কাছে এগিয়ে আসছে। 
“আরে”- সম্বরণ কৌতুক স্বরে বলে ওঠে- “তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছ কোথায়?”
শ্রীমনা মনে জোর এনে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত রাখার। এখন সম্বরণের নাগালের বাইরে যেতে পারলো না বটে, কিন্তু এই মুহূর্ত থেকে সাবধানে পা ফেলে চেষ্টা চালাতে হবে যেন সম্বরণের মনে সন্দেহ না জাগে। পরের সুযোগের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরা ছাড়া আর উপায় নেই।
“এই একটু হেঁটে আসি – ওই টিলার বাঁক অবধি গিয়েই ফিরে আসব-” গলার দুর্বল স্বর যেন নিজের কাছেই অচেনা লাগে। 
“বা:” সম্বরণ বলে – “আমারও বাড়ির ভেতর যেতে এখন ভালো লাগছে না – কি সুন্দর সন্ধ্যে নেমে আসছে দেখ! শুনতে পাচ্ছ বাসায় ফেরা কিছু পিউ কাঁহার ডাক ভেসে আসছে? চলো আমারা এক সঙ্গে হেঁটে আসি।”  সম্বরণের কথায় যেন বিয়ের পরের দিনগুলোর ছোঁয়া। 
“না সম্বরণ, আজ নয়, মনটা বড় অস্থির লাগছে – মাথাটাও টন টন করছে, আজ আমি একাই যাই।”
সম্বরণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে, দৃষ্টিতে যেন অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
“কি হয়েছে বলো তো শ্রীমনা? মুখ চোখ কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছে – তুমি কেঁপে কেঁপে উঠছ কেন? জ্বর আসেনি তো?” 
ভয়ার্ত শ্রীমনার মনে হয় - এটা কি সম্বরণেরর অভিনয়?

“সে রকম কিছু না” শুকনো হেসে বলে “মাথাটা একটু ধরেছে। একটু হাঁটাহাঁটি করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”  জোর করে তার স্বরে মৃদু বিরক্তির আভাস আনে।
“তোমার একা যাওয়া ঠিক হবে মনে হচ্ছে না”- সম্বরণ সহজ হেসে জোর দিয়ে বলে

“তোমার শরীর ভাল নেই, তুমি চাও বা না চাও, আমি তোমার সঙ্গে যাবই।”
সে সাহস করে আর প্রতিবাদ করে না। যদি সন্দেহ করে - আমি সব জেনে গেছি!!.....
অনেক চেষ্টায় সে তার ব্যবহারে কিছুটা স্বাভাবিকতা নিয়ে আসে।
বাড়িতে ফিরে আসার পর সম্বরণ জোর করে তাকে সোফায় শুইয়ে ওডিকলোন নিয়ে এসে পরম যত্নে কপালে প্রলেপ দেয়। একেবারেই একজন প্রেমময় স্বামী। কিন্তু শ্রীমনার নিজেকে হাত পা বাঁধা বলির পশুর মত অসহায় অবস্থায় পড়েছে মনে হয়। .
বাড়ি আসার পর থেকে, এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে একা থাকতে দিচ্ছে না সম্বরণ। সে শ্রীমনার সঙ্গে সঙ্গে রান্না ঘরে গিয়ে আগে তৈরি করে রাখা খাবার নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। খেতে গিয়ে ভয়ে তার গলায় খাবার আটকে গেলেও শ্রীমনা জোর করে খেয়ে নিয়েছে। সে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক, খুশি দেখানোর। সে জানে এখন যে কোনো প্রকারে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা তাকে করতেই হবে। বোঝে নিকটতম জনবসতির থেকে বহু দুরে এই লোকটার সঙ্গে সে একেবারে একা, সম্পূর্ণ ভাবে এই অপরাধীর নিয়ন্ত্রণে। সম্বরণ মনের সংশয়ে ক্ষীণ আভাস টুকু যে করেই হোক মুছে দিতে হবে, যাতে সে কিছুক্ষণের জন্য একা হতে পারে। সেই সুযোগে সে সাহায্যের জন্য গ্রামের কাউকে ফোনে ডাকতে পারে, এইটুকুই তার ক্ষীণ আশা। 
আচমকা সে আশার আলো দেখতে পায়, মনে এলো সম্বরণের আগের পরিকল্পনা বাতিলের কারণ কি ছিল। রহিমচাচার বুধবার কাজে এসে তাদের শহরে যাওয়ার কথাগুলি বলা। যদি সে এখন বলে বিপ্লবের আজ সন্ধ্যায় এখানে আসার কথা আছে?
কথা গুলো বলতে গিয়েও সে থেমে যায় – না না এই লোকটা হয়ত তার দ্বিতীয় বারের পাওয়া সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইবে না। 
না না– সে যদি বিপ্লবের আসার কথা বলে – তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হতে পারে। এখন সম্বরণের শান্ত স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে সে অসুস্থ বোধ করছে। তার হাবভাবে যেন প্রকাশ পাচ্ছে কিছুর দৃঢ় সংকল্পের আভাস – কোন সুপ্ত উল্লাস। অন্তরে সে জানে, যদি বিপ্লবের কথা এখন বলে, সেটাই হবে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। সম্বরণ সেইক্ষণে তাকে খুন করবে - হে ভগবান! বিপ্লব যদি এই সন্ধ্যেতে এখানে, এই মুহূর্তে “পিউ কাঁহা”য় চলে আসে! কিন্তু গত বুধবার সে বিপ্লবকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। আত্মসম্মান আছে এমন মানুষ আর আসবে না তার কাছে। কিন্তু যদি বিপ্লব  ...।
অপ্রত্যাশিতভাবে একটা বুদ্ধি বিদ্যুতের মত তার মাথায় খেলে যায়। ভয়ার্ত শ্রীমনা তির্যক দৃষ্টিতে সম্বরণের দিকে তাকায়, ভয় হয় যদি তার মনের ভিতরের কথা সে বুঝে যায়! শ্রীমনার মনে ধীরে ধীরে একটা পরিকল্পনা রূপ নিচ্ছে। নিজের ওপর তার আস্থা ফিরে আসে। মনের ভয় দুরে ঠেলে –নিজেকে এত দ্রুত পুরোপুরি সহজ স্বাভাবিক করে ফেলে, সে নিজেই নিজেকে বিস্মিত করেছে।
রাতের খাওয়া কোনক্রমে শেষ হয়। স্বাভাবিক চালচলনে রান্না ঘর থেকে কফি নিয়ে সে বারান্দায় আসে যেখানে তারা দুজনে এইরকম সুন্দর রাতে সচরাচর এসে বসে।
.“ওহ বলতে ভুলে গেছি” সম্বরণ হঠাৎ বলে ওঠে

“আজ একটু পরে রাত ন’টা নাগাদ তোমার ছবিটা আঁকব ঠিক করেছি।” 
শ্রীমনার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় কিন্তু সে সহজ হয়ে বলে

“আমার আজ খুব ক্লান্ত লাগছে সম্বরণ, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। তুমি তো আগেও আমার উপস্থিতি ছাড়াই ছবি এঁকেছো? 
“তুমি দেখো – আজ বেশী সময় লাগবে না” মৃদু হেসে বলে সম্বরণ

“কথা দিচ্ছি আজকে ছবিটা আঁকার পর তুমি একেবারেই ক্লান্ত হবে না।”
তার মনে হল -কথাগুলো বলে সম্বরণ যেন মজা পাচ্ছে, কথাগুলো শ্রীমনাকে কাঁপিয়ে দিল। আর সময় নেই, তার মাথায় একটু আগে ভাবা পরিকল্পনাটা ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই অনুযায়ী কাজটা করতে হবে নচেৎ আর সময় পাবে না।  
শ্রীমনা উঠে দাঁড়ায়।
"এই যা:! কথায় কথায় মাছের দোকানের ইউসুফকে ফোন করতে একেবারে ভুলে গেছি” নির্লিপ্ত স্বরে সে বলে ওঠে “দাঁড়াও, তোমার ওঠার দরকার নেই – আমিই করছি।” 
“ফোন করবে ইউসুফ কে? এত রাতে?”
“জানি মাছের দোকান এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আরো আগে ফোনটা করা উচিত ছিল। আমার শরীরটা খারাপ লাগছিল। কিন্তু ইউসুফ নিশ্চয় বাড়িতে আছে। কাল আবার শনিবার, আমাদের জন্য ভালো দেখে কিছু মাছ আগে থেকে রেখে দিতে বলতে হবে, নইলে অন্য কেউ আবার এসে নিয়ে নেবে। ইউসুফ আমাকে খুব খাতির করে, যা বলি ঠিক শুনবে।”
সে তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। সম্বরণ চেঁচিয়ে বলে

“দরজা বন্ধ কোরো না – খোলা রাখো,”  শ্রীমনা চটপট হালকা স্বরে উত্তর দেয়

“বন্ধ না করলে রাজ্যের পোকামাকড় ভেতরে এসে যাবে – গায়ে এসে বসলে ঘেন্না করে। ভয় নেই ইউসুফের সঙ্গে প্রেমালাপ করব না,  তোমাকে নিয়ে আর পারি না!”
ভেতরে এসেই সে তার ফোনটা তুলে নেয়-
“অতিথি হোটেল?”
“বিপ্লব রায় কি হোটেলে আছেন? তাঁর সাথে কথা বলতে পারি?”
সেই মুহূর্তে তার বুক কেঁপে ওঠে। বন্ধ দরজা ঠেলে সম্বরণ ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ায়।
“সম্বরণ তুমি বারান্দায় থাকো – ফোনে কথা বলার সময় কেউ থাকলে আমার ভালো লাগে না।” খিঁটখিটেয়ে ওঠে সে। সম্বরণ স্রেফ অবজ্ঞা ভরে হেসে সামনের চেয়ারে বসে পড়ে।
“তুমি সত্যিই কি ইউসুফের সঙ্গে কথা বলছ?”
শ্রীমনা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। তার পরিকল্পনা বোধহয় ব্যর্থ হতে চলেছে। যে কোনো সময় বিপ্লব ফোন ধরতে পারে, সে কি ঝুঁকি নিয়ে চেঁচিয়ে সাহায্যের আকুতি জানাবে?
না না – চিৎকার করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ভয়াতুর সে ফোনের বোতামগুলোয় অন্যমনস্কতায় আঙুল রাখার সময় একটা ব্যাপার তার মাথায় আসে – এই মিউট বোতামটা চেপে রাখলে অপর প্রান্ত গলার স্বর শুনতে পায় না, আবার ছেড়ে দিলে শুনতে পায় –উপলব্ধি হয় ফোনের এই বিশেষ অংশের উপযোগিতা। বিদ্যুৎ ঝলকে নিজেকে বাঁচানোর আর একটি উপায় সে খুঁজে পায়।
--এটা করা খুব কঠিন হবে -- সে চিন্তা করে -- মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ঠিক শব্দটা বলার আগে ভেবে নিতে হবে, মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হলেই বিপদ –কিন্তু বাঁচতে হলে স্থির হয়ে এটা আমাকে পারতেই হবে।--
তার ভাবনার মাঝেই অপর প্রান্তে বিপ্লবের গলার আওয়াজ শুনতে পায়।
শ্রীমনা গভীর নিঃশ্বাসে সাহস সঞ্চয় করে। এখন সে স্থির স্বরে কথা বলতে শুরু করে।
“পিউ কাঁহা থেকে মিসেস সেন বলছি। (এবার মিউট বোতামটা আঙ্গুলে চেপে রাখে) কাল সকালের মধ্যে ভালো দেখে কাটলেটে বানানোর মাছ নিয়ে - (ফোনের বোতামটা ছেড়ে দেয়) তাড়াতাড়ি আসতে হবে - ভীষণ জরুরি (আবার বোতাম চেপে রাখে) অনেক ধন্যবাদ ইউসুফ, কিছু মনে কোরো না এত রাত্রে ফোন করার জন্য কারণ কাটলেটের মাছগুলো কাল সকালে খুব দরকার। তা হলে কাল সকালে -(বোতামটা ছেড়ে) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দেরি না হয়।”
হাঁপিয়ে পড়ে শ্রীমনা, ফোনটা টেবিলে রেখে সম্বরণের দিকে তাকায়। সম্বরণ তখন উঠে দাঁড়িয়েছে --
“তুমি এই ভাবে কথা বলো নাকি মাছওলার সঙ্গে?”
“কথায় মেয়েলী ছোঁয়া বলতে পার”-  শ্রীমনা হালকা স্বরে জবাব দেয়।
উত্তেজনায় থরথর করে। সম্বরণ কিছু সন্দেহ করেনি। বিপ্লব পুরো বুঝতে না পারলেও, ঠিক আসবে।
বসার ঘরের সব আলো জ্বেলে দেয় সে। সন্দেহাতুর দৃষ্টিতে সম্বরণ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“এখন বেশ প্রাণবন্ত হাসিখুশি লাগছে তোমায়”- চেয়ারে আবার বসে পড়ে সম্বরণ।
শ্রীমনা বলে- “হতে পারে, আমার মাথা ব্যাথাটা আর নেই।”
এবার নিজের চেয়ারে বসে হাসিমুখে তার উল্টো দিকে বসা সম্বরণের দিকে তাকায়। সে বেঁচে গেল বোধহয়। এখন মাত্র রাত ৮.১৫। বিপ্লব নিশ্চয়ই রাত ৯টার অনেক আগেই এখানে পৌঁছে যাবে।
“কফিটা তেমন ভালো লাগলো না ” - সম্বরণ অভিযোগের সুরে বলে-

“কেমন যেন বিস্বাদ লাগছে!”
“কফিটা নতুন বেরিয়েছে বাজারে, তবে তোমার যদি ভালো না লাগে, আর ওটা আনবো না।”
শ্রীমনা পাশের টেবিলে রাখা সম্বরণের জন্য অর্ধেক বোনা সোয়েটারটা তুলে বুনতে শুরু করে। সম্বরণ একটা বইয়ের পাতায় চোখ বোলায়। এরপর সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আলগোছে বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।
“৮.২০ বাজলো – চলো এবার আঁকার ঘরে গিয়ে কাজ শুরু করা যাক।”
শ্রীমনার হাতের বোনা নিচে পড়ে যায়।
“ও না! এখনি নয়। বললে তো রাত ৯টায় শুরু করবে, বসা যাক এখন, তোমার সোয়েটারের বোনাটা একটু এগিয়ে রাখি।” 
“না শ্রীমনা –ঠিক করেছি এখনি আরম্ভ করব। তা’হলে কাজটা মিটে গেলে তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যেতে পারবে।”
“কিন্তু আমি চাইছি এখানেই বসি ৯টা অবধি।”
“ভালো করে জানো, আমি যখন কোনো কাজের জন্য সময় ঠিক করি, তা মেনে চলি। চলো শ্রীমনা। আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করব না।”.
শ্রীমনা চোখ তুলে তাকায়, সে শক্ত থাকা সত্ত্বেও ভয়ের শীতল স্রোত ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীরে, এখন সম্বরণের মুখোশ খুলে গেছে। তার হাত দুটো কাঁপছে, স্থির নেই। চোখ উত্তেজনায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে, জিব বোলাচ্ছে শুকনো ঠোঁটে। তার উত্তেজনা গোপন করার পরোয়া নেই।শ্রীমনার মনে হলো ‘সত্যিই লোকটা নিজেকে সামলাতে পারছে না। পুরো উন্মাদের দৃষ্টি চোখে।’
সম্বরণ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে শ্রীমনাকে চেয়ার থেকে টেনে দাঁড় করায়- 
“এক্ষুণি আসতে হবে, না’হলে তুলে নিয়ে যাব -” যেন জোর করে হাসতে হাসতে বলে সম্বরণ।
তার হাসি মুখে এই নির্লজ্জ বল প্রয়োগের অপ্রচ্ছন্ন নিষ্ঠুরতায় শ্রীমনা হতবাক হয়। সে দেহের শেষ বিন্দু শক্তি দিয়ে এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে সরে যায় ঘরের এক কোনে। চরম অসহায়তায় মুহ্যমান শ্রীমনা ঘর থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। তার আর নড়ার শক্তি অবশিষ্ট নেই – আর সম্বরণ হাসি মুখে এগিয়ে আসছে তার দিকে। 
“ তা’হলে শ্রীমনা—” তার চোখে এখন যেন শীতল দৃষ্টি।
“ না – না--”
ভয় জড়ানো তীব্র আর্তনাদে, ঘরের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায় – দু’হাতের ব্যর্থ চেষ্টায় সম্বরণকে ঠেলে সরাতে যায় শ্রীমনা। অসফল শ্রীমনা ছিটকে সরে যায় ঘরের অপর দিকের দেওয়ালের ধারে।
"সম্বরণ, দাঁড়াও – কিছু বলতে চাই, তোমাকে। তোমার জানা দরকার সম্বরণ -”
সম্বরণ থমকে দাঁড়ায়।
“কি বলতে চাইছ?” একটু হতভম্ব হয় সম্বরণ।
“হ্যাঁ, তোমার অতীত আমি জানি না কিন্তু এত দিন পর আমার অতীত সম্পর্কে তোমায় কিছু জানাতে চাই” মরিয়া শ্রীমনা, সম্বরণের সাময়িক হতচকিতার সুযোগ নিতে চায়।
কিন্তু সম্বরণের হতভম্বতা ক্ষণেকের ভেতর কেটে যায় – পরিবর্তে গলার স্বরে ভেসে ওঠে তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা।
“মনে হচ্ছে তোমার জীবনে কোনো পুরনো প্রেমিকের ফিরে আসার কথা বলতে চাইছ নাকি?” বিদ্রূপ মন্তব্য সম্বরণের। 
“একেবারেই নয়” - বলে শ্রীমনা।

“অন্য কিছু বলব যা তোমার চিন্তার বাইরে, হ্যাঁ – একে আমার জীবনে লুকিয়ে থাকা পাপের স্বীকারোক্তি বলতে পার, যা আর কেউ জানে না।”
এখন শ্রীমনা লক্ষ্য করে সম্বরণের ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে সে। সম্বরণের হতচকিত অবস্থা আবার ফিরে এসেছে। বাঁচার জন্য অবস্থাটা ধরে রাখতে হবে। অবাক হওয়া সম্বরণকে দেখে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। সে বোঝে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ এখন সাময়িকভাবে তার হাতে। নিজেকে গুছিয়ে নেয় শ্রীমনা।
“তুমি যদি শুনতে চাও নিজের জায়গায় গিয়ে আগে বোসো দেখি।” শান্ত সহজ স্বরে বলে শ্রীমনা।
সে এখন দেওয়ালের ধার থেকে দৃঢ় পদক্ষেপে নিজের পছন্দের চেয়ারে বসে, মেজেতে পড়ে থাকা বোনার উল কাঁটা তুলে নেয়।
কিন্তু ঝড়ের পর তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বিপদ সাময়িক ভাবে কেটেছে। এখন তাকে এক্ষুণি কিছু বলতে হবে সম্বরণের উৎসুক মনকে দমিয়ে রাখতে - যতক্ষণ না বিপ্লব এসে পৌঁছয়, তার দৃঢ় ধারণা বিপ্লব আসবেই। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় নেপালের পুরনো খবরের কাগজে উল্লেখ ছিল সম্বরণের বা জগন পান্ডের হৃদরোগের কথা। সে তার মন ঠিক করে নেয়। বাঁচার জন্য চরম পদক্ষেপ নিতেই হবে। নিজেকে বাঁচানোর পথ সে বেছে নেয়। বাঁচার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে পথ দেখায়। সম্বরণের অস্ত্রেই তাকে আটকাতে হবে।
“তোমার মনে আছে সম্বরণ – আমি অফিসে সামান্য কর্মচারী হিসেবে ১৫ বছর কাজ করেছি। তোমার কাছে আজ স্বীকার করছি কথাটায় বেশ কিছুটা অসত্য ছিল। ওই পনেরো বছরে, কোনো কারণে কিছু দিন সাময়িকভাবে আমার অফিস বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়টুকু আমি একটি হাসপাতালে কাজ নিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স বাইশ বছর। সেই সময় কোনো সূত্রে আমার আলাপ হয়ে যায় একজন ধনী পৌঢ়ের - “হতাশাগ্রস্থা মেয়েটির প্রতি তার সহানুভূতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিছু দিন মেলামেশার পর সে আমার প্রেমে পাগল হয়ে – বিয়ের প্রস্তাব দেয়।”  মুচকি হেসে সে বলে “ ঠিক তোমার মত বলতে পার।” এবার উলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে শুরু করে - 
“কিছুদিন দোনামনার ভণিতা করে - আমি রাজি হযে গেলাম।”  একটু দম নেয় শ্রীমনা-

“নরম মনের মানুষটার ওপর এরপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকি জীবনবিমা করার জন্য – স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে তার বিমার স্বত্ব-ভোগী হিসেবে উল্লেখ করতে বলি।”
সে অবাক চোখে দেখে সম্বরণের চোখমুখ হঠাৎ যেন উৎসুক হয়ে উঠছে – এক অপরাধী আর এক অপরাধীর স্বীকারোক্তি শুনেই বোধহয়। শ্রীমনা নিজেই তখন আরো উৎসাহিত হয়ে বলতে থাকে --
“সেই হাসপাতালের ওষুধের স্টোরে কাজ করতাম। সেখানে আমাকে নানা রকম ওষুধ নিয়ে কাজ করতে হত- যার মধ্যে বিষাক্ত ওষুধও ছিল। হ্যাঁ –বিষাক্ত ওষুধ।”
শ্রীমনা কথা থামিয়ে কি যেন চিন্তা করে। সন্দেহ নেই, সম্বরণের মনোযোগ ক্রমশ গাড় হয়ে উঠেছে। খুব স্বাভাবিক! খুনের সম্ভবনার ইঙ্গিত একজন হত্যাকারীকে উদ্দীপ্ত করবেই। গল্পটা বলে যেন সে নিজের জীবনকে বাজি রেখে জুয়া খেলতে বসেছে। মনে হচ্ছে এখনো অবধি সে জিতে যাচ্ছে এই মারণ খেলায়।
শ্রীমনা আড় চোখে দেখে ঘড়িতে এখন ৯টা বাজতে ২৫ মিনিট বাকি। 
“কাজের জায়গায় একটি বন্ধ আলমারিতে নানা রকম বিষাক্ত ওষুধ রাখা থাকত। তার মধ্যে একটা ছোট শিশিতে রাখা ছিল মারণ বিষ। সাদা পাউডারের মত। শুনেছিলাম সেটার এতটুকু হৃদরোগীর শরীরে গেলেই নির্ঘাত মৃত্যু। তোমার নিশ্চয় বিষ সম্পর্কে ধারণা আছে?” 
বিদ্রূপে সুরে সে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়, যদি সম্বরণের এই ব্যাপারে কিছু জ্ঞান থাকে – তাকে সাবধানে কথা বলতে হবে।  
“না” সম্বরণ উত্তর দেয় “আমি খুব একটা বুঝি না।”
সে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে।
“ওই ছোট শিশির বিষটা ভীষণ শক্তিশালী। দুর্বল হৃৎপিণ্ড অথবা হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছে রোগীদের এই বিষ ভীষণ মারাত্মক – কোনো পরীক্ষায় ধরা পড়েনা কারণ এর বিষক্রিয়ায় কেউ মারা গেলে শরীরে আলাদা কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ডাক্তাররা মনে করতে পারে রুগী হৃদরোগেই মারা গেছে- বিনা দ্বিধায় হৃদরোগে মৃত্যু লিখে দিতে পারে। এই বিষের শিশিটা হাসপাতাল থেকে সরিয়ে আমার কাছে রেখেছিলাম ।”
থেমে নিজের মনের জোর আনার চেষ্টা করে শ্রীমনা।
“বলে যাও” –সম্বরণ অধৈর্য হয়ে পড়ে।
“আর নয়, ভয় লাগছে বলতে। বাকিটা আর এক দিন বলব।
“না”- রেগে ওঠে সম্বরণ - “আমি এক্ষুণি শুনতে চাই।”
“আমাদের তখন বিয়ে হয়েছিল প্রায় এক মাস। পৌঢ় মানুষটি খুব ভালোবাসত আমাকে। একনিষ্ঠ স্ত্রীর মত আমিও তার সেবা যত্ন করতাম। সে বন্ধু বান্ধব প্রতিবেশীদের কাছে আমার প্রশংসা করে বেড়াত। সবাই জানত আমি তার প্রতি কত অনুরক্তা। প্রতি সন্ধ্যায় নিজে হাতে অতি যত্নে কফি বানিয়ে তাকে খাওয়াতাম। বিয়ের পর শুনেছিলাম তার হৃৎপিণ্ড দুর্বল ছিল। এক সন্ধ্যায়, ঠিক আজকের মত, আশেপাশে কেউ ছিল না, আমরা দুজনে কফি নিয়ে গল্প করছিলাম। কথা বলার সময় ওনার অলক্ষ্যে সেই সাংঘাতিক বিষ বেশ কিছুটা তার কফিতে মিশিয়ে দিয়েছিলাম--”
শ্রীমনা একটু থেমে কাঁটায় উল পরাতে শুরু করে। সে জীবনে কোনোদিন অভিনয় করেনি – কিন্তু এই মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোনো শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীকে হারিয়ে দিতে পারে। এখন একজন ঠাণ্ডা মাথার বিষ প্রয়োগকারী খুনীর চরিত্রে অভিনয় করছে শ্রীমনা।
“পরিবেশটা বড়ই শান্তিময় হয়ে গেছিল বুঝলে, দমবন্ধ হয়ে একটু বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে করতে তিনি আমার কাছে সাহায্য চাইতে – আমি তার মাথার দিকের জানলাটা খুলে দিলাম। চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টা করলেও – সে পারছিল না। অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলতে চেষ্টা করেছিল। তারপর – সব শেষ।”
শ্রীমনা হাসিমুখে থেমে যায়। এখন ন’টা বাজতে আরো পনেরো মিনিট বাকি। সে জানেনা আর কতক্ষণ অভিনয় দিয়ে একজন জাত অপরাধীর কৌতূহল জাগিয়ে রাখতে পারবে। সে নি:শব্দে প্রার্থনা করে – বিপ্লব যেন আসতে আর দেরি না করে।
সম্বরণের কৌতুহলি মন্তব্য - “বিমার টাকা কত ছিল?”
“প্রায় কুড়ি লাখ হবে। কিন্তু শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলতে গিয়ে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। পুরনো অফিস এরপর খুলে যাওয়ায় আবার সেখানে আমার আগের নামেই কাজে যোগ দিই, যদিও ওই বাজে কাজে আমার বেশী দিন থাকার ইচ্ছে ছিল না। কিছু দিন পরে আমার আর একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তিনি আমার আগের বিবাহিত সম্পর্কের কথা জানতেন না। তার বয়স বেশী নয়, বিত্তশালী, আবার দেখতেও ভালো – আর তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ সে ছিল প্রচুর টাকাপয়সার মালিক যা আমাকে স্বাভাবিকভাবে বেশী আকৃষ্ট করেছিল। আমরা লোক জানাজানি এড়িয়ে লুকিয়ে অন্য শহরে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রী করলাম। কিন্তু মুশকিল হল বিয়ের পর সে জীবন বিমা করতে কিছুতে রাজি হল না। অবশেষে আমার ভালোবাসায় ভুলে তার সবকিছু আমার নামে উইল করে দেয়। আমার উদ্দেশ্য সফল হল।” 
“জানো আগের স্বামীও আমার বানানো কফি খুব পছন্দ করতো, ঠিক তোমার মত।”
শ্রীমনা একটু উদাস স্বরে হেসে যোগ করে “তুমি তো জানোই - আমি খুব ভালো কফি তৈরি করি।”
সম্বরণ একটু উত্তেজিত মনে হল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শ্রীমনা আবার শুরু করে -
“যেখানে থাকতাম, সেখানে আমার অনেক বন্ধু হয়েছিল। ওই অল্প বয়সে আমার স্বামী হঠাৎ রাতের খাওয়ার পরেই হৃদরোগে মারা যেতে, আর ঠিক বিয়ের পরেই - তারা খুব কষ্ট পেয়েছিল। আমার অবস্থা দেখে, সবাই দলে দলে এসে আন্তরিক সহানুভূতি জানিয়েছিল। জানো সম্বরণ, ডাক্তার ডেকে ছিলাম – কিন্তু আমার ওই ডাক্তারের হাবভাব একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। আমার স্বামীর অল্প বয়সে হঠাৎ হৃদরোগে মৃত্যুতে তিনি কেমন যেন আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন – কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। যদিও কথাবার্তায় মনে হয়নি আমার প্রতি তাঁর কোনো সন্দেহ হয়েছে।” এবার গাঢ় অন্তরঙ্গতার স্বরে বলে –

“সম্বরণ – এখনো জানিনা, আমি আবার কেন পুরনো কাজে ফিরে গেলাম – অভ্যাস হয়ত! যাই হোক – দ্বিতীয় স্বামীর সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় ষাট লাখ টাকা পেয়েছিলাম। এবার কিন্তু আমি শেয়ার বাজারে যাইনি –ব্যাঙ্কে রেখেছিলাম টাকাটা। তারপর তুমি দেখ-- –”
কিন্তু তার কথা থেমে যায়। সে দেখে দমবন্ধ হয়ে সম্বরণের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে – তার দিকে আঙ্গুল তুলে কিছু বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। 
“ওই কফিটা – উফফ! ওই কফিটা!!”
শ্রীমনা চুপ করে দেখে --
“এখন বুঝতে পারছি কফিটা এত বিস্বাদ কেন ছিল! তোমাকে চিনতে পারিনি– কোনক্রমে সে বলে-

“তুমি কফির সাথে বিষ মিশিয়েছ!” এবার আমাকে খুন করলে, নীচ মেয়ে মানুষ!”.
চেয়ারের হাতলে চাপ দিয়ে উঠে শ্রীমনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যায় সম্বরণ। সম্বরণের চেয়ারের কাছ থেকে শ্রীমনা জানলার দিকে পিছিয়ে যায়।
“হ্যাঁ ঠিক” - দূর থেকে সে বলে ওঠে –

“তোমার কফিতে বিষ মিশিয়েছি, বুঝতে পারছ? বিষের ক্রিয়া এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তোমার শরীরে। তুমি চেয়ার থেকে আর নড়তে পারবে না সম্বরণ – যতই চেষ্টা কর, পারবে না –”
ঘড়ির দিকে তাকায় - উফফ ভগবান!  আর কিছুক্ষণ যদি সম্বরণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি---
ওই তো বাগানের বাইরের নুড়ি পথে পায়ে চলার আওয়াজ না? বিপ্লব এসে গেছে বোধহয়? বাগানের গেট খোলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলাম যেন? হে ভগবান আর একটু শক্তি দাও – আর পারছি না। আমাকে শেষ করতে সম্বরণের এক মিনিট লাগবে না।
সে আবার বলে “তুমি আর নড়তে পারবে না সম্বরণ।”
এরপর শক্তি সঞ্চয় করে ভীত শ্রীমনা কোনক্রমে সম্বরণের পাশ কাটিয়ে ঘরের বার হয়ে চেতনা হারায়, জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্তে সে অনুভব করে বিপ্লবের হাতের পরিচিত স্পর্শ। 
“কি হয়েছে শ্রীমনা!” বিপ্লবের কাতর স্বর।
বিপ্লব, সঙ্গে আসা শক্ত সমর্থ লম্বা পুলিশের পোষাক পরা লোকটির দিকে ফিরে তাকায় -- 
“আপনি যদি ভেতরে গিয়ে দেখেন কি হয়েছে।”
সাবধানে প্রায় অচেতন শ্রীমনাকে বারান্দায় রাখা সোফায় শুইয়ে দেয় বিপ্লব। 
“শ্রীমনা”- বিপ্লবের অনুচ্চ স্বর- “বলো শ্রীমনা তোমার এই অবস্থা কে করেছে? বলো আমাকে –’’ 
শিহরিত শ্রীমনা ধীরে চোখ মেলে মৃদুস্বরে ডাকে “বিপ্লব?” পুলিশ অফিসারের মৃদু ঝাঁকুনিতে চিন্তায় ডুবে থাকা বিপ্লবের হুঁশ ফেরে। 
“ঘরেতে কোন ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখলাম না বিপ্লববাবু, তবে একজন চেয়ারে বসা অবস্থায় রয়েছে – দমবন্ধ হওয়া মুখে কোনো কিছুতে অসম্ভব ভয় পাওয়ার ছাপ, আর লোকটির বিস্ফারিত চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। আর ---”
“কি দেখলেন আর?”
“আর -- তিনি – বেঁচে নেই।”
শ্রীমনার গলার আওয়াজে সচকিত বিপ্লব ফিরে তাকায় – তার চোখ দুটো তখনো বন্ধ - স্বপ্নাচ্ছন্ন অস্পষ্ট স্বরে সে কিছু বলতে চাইছে যেন।  মনে হল -  শ্রীমনা বলছে
“এখন ওই খুনীটাও মারা গেল –

ভ্রমণ

বৃষ্টিভেজা অপরূপা

সামথার 

সৌমেন্দ্র দরবার

বাগুইআটি, কলকাতা

যুগে ফলস.jpg
বৃষ্টিভেজা অপরূপা সামথার
soumendra.webp

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

তুমি কি কখনো বর্ষায় বৃষ্টি ভেজা পাহাড় দেখেছ? তুমি কি বৃষ্টির রাতে পাহাড়ি নদীর কলতান শুনেছ? তুমি কি বর্ষার জলে ভরপুর পাহাড়ি নদীর উদ্দামতা উপভোগ করেছ? যদি তোমার উত্তর না হয়, তাহলে অবশ্যই একবার বর্ষার অপূর্ব রূপ উপভোগ করতে পাহাড়ের কোলে থেকো। বর্ষা সিক্ত পাহাড়ের সেই নয়ন জুড়ানো রূপ তুমি কখনোই ভুলতে পারবে না। সবুজের ওপর রুপোলি বারিধারা দেখতে দেখতে মনে হবে কোন শিল্পী যেন তার তুলির আঁচড়ে একটার পর একটা ছবি এঁকে চলেছেন। ঘন ঘন তার পট পরিবর্তন হচ্ছে। শান্ত প্রকৃতির সে রূপ উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তোমার মনের মণিকোঠায়, এ গ্যারান্টি আমি দিলাম। 
১১ই জুন, আমরা ছয় বন্ধু, সপরিবারে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের পথে। উদ্দেশ্য একটাই পাহাড়ে বর্ষার রূপ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা। রাত ১০.০৫ এর দার্জিলিং মেল হুইসেল দিয়ে শিয়ালদা স্টেশন ছেড়ে রওনা দিলো নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে। ট্রেন ছাড়তেই সবাই মেতে উঠলো গল্পে। কতদিন বাদে যেন দেখা হলো সবার। মনের জমানো কথা যেন আজই বলতে হবে। কর্তা, গিন্নি আর মেয়ে। এই নিয়ে আমাদের এক একটি পরিবার। রবি দা, পপি বৌদি আর আফিয়া , অরিন্দম, ঝিনুক আর আদ্রিকা, জয়ন্ত দা, সুমিতা বৌদি আর শিঞ্জিনী, রোমো (রামনাথ) দা, ফুল (ফুলেশ্বরী) বৌদি আর সায়ানী, আলোক দা, নূপুর বৌদি আর আরাধ্যা এবং আমি, শ্রীময়ী আর আমার মেয়ে রাই। শুধু জয়ন্তদার সাথে ছিল আর একটা লিটল মাস্টার, হীরালাল। ছয়টি পরিবার পাড়ি দিলো তিন দিন পাহাড়ের কোলে বৃষ্টি উপভোগ করতে। গল্প শেষ করে বাড়ি থেকে আনা রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন ১০ মিনিট লেট করে দার্জিলিং মেল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছলো। বাইরে বেরিয়ে চা খেতে খেতেই আমাদের আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়ির ড্রাইভার বসন্ত ও শৈলেশ হাজির হলো। ওদের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে নিলাম । তারপর গাড়ির মাথায় সমস্ত লাগেজ তুলে আমাদের দুটি গাড়ি এগিয়ে চললো পাহাড়ের পথে। কিছুটা রাস্তা যাবার পর, এবার সবার খিদে পেয়ে গেল। রাস্তার ধরে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে দাঁড়ালো আমাদের গাড়ি। ব্রেকফাস্ট হয়নি বলে সবার খুব খিদে পেয়েছিলো। কেউ নিলো ছোলা বাটুরে, কেউ বা ডিম টোস্ট আবার কেউ নিলো মোমো। রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরের ভিউ ছিল অসাধারণ। ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমাদের ড্রাইভার বসন্ত আর শৈলেশের সাথে কথা বলে আমরা ঠিক করলাম আমরা কালিঝোরা হয়ে যাবো। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে উচ্ছল তিস্তা।  জলে ভরপুর তিস্তার এই রূপ আমি আগে কখনও দেখিনি।  সবুজ পাহাড়ের বুকচিরে বয়ে চলেছে  তিস্তা।  সে অপরূপ নয়ন জড়ানো দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এখানে তিস্তা আরও ভয়ঙ্কর।  হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। কালিঝোরা ড্যামের ওপর দিয়ে গাড়ি চললো অন্য পারে।  বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয় এই রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে। তবে অসুবিধা হবে না আগে থেকে হোম স্টে বুক করা থাকলে। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে তখন অঝোরে বৃষ্টি।  চারিদিকে শুধুই ঘন সবুজ। বৃষ্টি একটু থামতেই গাড়ি থামাতে বললাম।  চারিদিকের দৃশ্য ফ্রেম বন্দি না করা অবধি মন মানছিল ন। দুদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম পানবু দারা ভিউ পয়েন্ট এ। এখানে এই বর্ষায় শুধুই মেঘের খেলা। গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে মেঘ।  কখনো মেঘ সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা, তিস্তার নয়নাভিরাম দৃশ্য আবার মুহূর্তে তা ঢেকে যাচ্ছে মেঘে। পাহাড়ের কোলে মহাদেবের সুবিশাল মূর্তি সত্যি নজর কেড়ে নেয়। যারা একটু নিরিবিলি পছন্দ করেন তারা একদিন কাটিয়ে যেতেই পারেন পানবুতে।  কথা দিলাম মন ভালো হয়ে যাবে। বসন্ত বললো আমরা প্রায় আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। একটু চা খেয়ে আর ছবি তুলে রওনা দিলাম। অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম কালিম্পঙের একটি ছোট্ট গ্রাম সামথারএ। আমাদের এবারের গন্তব্য। 

 

পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম সামথার। নির্জন আর শান্ত। মাত্র কয়েকটি নেপালি পরিবার নিয়ে কালিম্পংয়ে এই ছোট্ট গ্রাম সামথার। একদিকে ঘন বন, একদিকে উপত্যকা আর শুধুই মেঘের খেলা। মেঘ সরে গেলে সূর্যিমামা উঁকি মারছে আবার মুহূর্তেই তা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।  আমরা সবাই হোমস্টেতে নিজের নিজের ঘর নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। লাঞ্চের ডাক পড়লো। খুব খিদে পেয়েছে। পাহাড়ে এলে এই এক মুস্কিল, খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া হজম হয়ে যায়। লাঞ্চে ছিল ভাত, ডাল, দুটো সবজি, ডিমকষা, চাটনি আর  পাঁপড়। লাঞ্চ খেয়ে ঘুরে এলাম সামথার লেক। লেকের জলে ঝলমল করছে পাহাড় আর গাছের প্রতিবিম্ব। তার মাথার ওপরে নীল আকাশ আর শুধুই মেঘের খেলা। বর্ষাকাল না হলে আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই আকাশের বুকে জেগে থাকে তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। এখানকার ইউএসপি হল কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ। গোটা রেঞ্জটাই দেখা যায় । কিন্তু সে যাই হোক বর্ষার রূপ কিন্তু আলাদা। নাই বা হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা।  এবার জায়ান্ট দা চাপ দিতে থাকলো ঝান্ডি ভিউ পয়েন্টে যাবে।  ১০৫০ টা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে।  অবশেষে আমি, জায়ান্ট দা, রবি দা আর রোমো দা রাজি হলাম। সঙ্গে সাত খুদে পরিবেশবিদ। বেশ চড়াই কিন্তু ট্রেকিং টা ভালোই লাগছিলো। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো।  কিছুটা উঠে একটু জিরিয়ে নিলাম।  সামনে মেঘ, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আমাদের ছোট্ট খুদেরা বললো চলো শেষ অবধি যাবো। অগত্যা আবার চল। অবশেষে ঘাম ঝরিয়ে যখন টপে পৌঁছলাম তখন জলীয় মেঘ আমাদেরকে ভিজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের তখন শিখর জয়ের আনন্দ। এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। মোবাইল ক্যামেরা শুধু ফ্রেম বন্দি করতে থাকল অপরূপ সৌন্দর্যকে। এবার ওপর থেকে নামার পালা। হঠাৎ দেখি ছোট্ট হীরালালের পায়ের আঙ্গুল থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। বুঝলাম জোঁকে ধরেছে। পায়ের পাতা হাতে নিয়ে দেখলাম অনুমান ঠিক। জোঁক ছাড়িয়ে নিয়ে আবার নিচে সাবধানে নামতে লাগলাম। বর্ষায় পাহাড়ে এটা একটা সমস্যা।  জোঁকের উৎপাত।  আস্তে আস্তে সবাই সাবধানে নিচে নেমে এলাম। হোমস্টেতে এসে হীরালালের পা টা প্রথমে নুন দিয়ে ওয়াস করলাম, পরে ফাস্ট এইড করে ব্যান্ড অ্যাড লাগিয়ে দিলাম। এদিকে আস্তে আস্তে সন্ধে নামলো। চারিদিক নিস্তব্ধ। চা আর পাকোড়া খেয়ে আবার বেরোলাম গ্রামটা একটু হেঁটে দেখতে। নিঝুম রাস্তা, নিকষ কালো উপত্যকা আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সে এক মোহময় পরিবেশ। বেশকিছুটা হাঁটার পর মেঘের গর্জন। বুঝলাম বৃষ্টি নামবে। ফিরে এলাম হোমস্টেটে। হোমস্টেটে ফিরে এক কাপ চা খাওয়ার পর শুরু হলো মুষল ধারায় বৃষ্টি। ব্যালকনিতে বসে সবাই         

মিলে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলাম পাহাড়ের বুকে দামাল বৃষ্টির আস্ফালন। ব্যালকনির কার্নিশ চুঁইয়ে অঝোরে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির জল। সামনে নিস্তব্ধ পাহাড়। এর মধ্যেই ডাক পড়লো ডিনারের। স্যালাড, রুটি, ডাল, তরকারি, চিকেন, পাঁপড় আর মিষ্টি।  সঙ্গে সঙ্গী বৃষ্টি। ডিনার শেষ করে আরো বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সবাই কে গুড নাইট করে চললাম ঘুমের দেশে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো হালকা বৃষ্টির শব্দে। নাম না জানা কত পাখি ডেকে চলেছে অবিরাম। ব্যালকনিতে এসে দেখি বৃষ্টিতে পাহাড় যেন আর ও সবুজ।  মনে হলো কে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। একটু পরে বৃষ্টি থামলো। আমি,  জয়ন্ত  দা,  রোমো  দা  আর  আলোক  দা হাঁটতে বেরোলাম  সামথার বাজারের  দিকে। মেঘ আমাদের সঙ্গী হল। নির্জন নিস্তব্ধ। পাহাড়ি একটা ঝোরা কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে।  শুধু পাখির ডাক আর গায়ের ওপর দিয়ে প্রজাপতির ভেসে বেড়ানো। আমরা গ্রামের ভেতর চলে এলাম। বৃষ্টির দিন, সবাই ঘুমিয়ে। ছোট্ট একটা মন্দির দেখে নিলাম। ফিরলাম সামথার লেক দেখে। গাছে গাছে ঢাকা লেক যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটুকরো ছবি। গতকাল দেখেছিলাম অন্য রূপ, আজ আবার অন্য রূপ। হোমস্টেতে তে ফিরে আমরা সবাই রেডি হয়ে নিলাম। বসন্ত আর শৈলেশ আজ সাইট সিনে নিয়ে যাবে। এক এক করে দেখে নিলাম রাই দারা, বুদ্ধ টপ, হনুমান টক আর যুগে ফলস। প্রকৃতির বুকে যে কত কি লুকিয়ে আছে তার জানতেই পারতাম না যুগে ফলসে না এলে। বর্ষায় অফুরন্ত জলরাশি নেমে আসছে পাহাড়ের ওপর থেকে।‌ মন্ত্রমুগ্ধের মত সবাই বেশ কিছু সময় চেয়ে রইলাম। বাচ্চাদেরও মন খুশিতে ডগমগ করছে। অনেকটা সময় কাটানোর পর ঘড়িতে চোখ গেল। সাড়ে তিনটে। না সবার খিদে পেয়েছে। ফিরে এলাম। স্মৃতি হয়ে রইল নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আজ লাঞ্চে ছিল মটন। জমিয়ে লাঞ্চ করে জমিয়ে ঘুম। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় উঠে দেখি চা আর পাকোড়া রেডি। আজ শুধুই জমিয়ে আড্ডা। বাবাদের একটা গ্রুপ, মায়েদের একটা আর বাচ্চাদের একটা। আড্ডার বহর দেখে বুঝলাম সবাই খুব খুশী। দশটায় ডিনারের ডাক পড়লো। ডিনারে আজ ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন। তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়ে অন্ধকার পাহাড়ের কোলে কিছুটা হেঁটে সবাইকে গুড নাইট বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো নাম না জানা পাখির ডাকে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে। আবার একটা বৃষ্টি ভেজা সকালে পাহাড়ের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম। দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম প্রকৃতিকে। ‌সবুজের বুকচিরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মন ভারাক্রান্ত! আজই তো আমাদের ফিরে যাওয়া। ব্রাশ করে ছাতা নিয়ে আবার চললাম বৃষ্টি উপভোগ করতে। আজ আমরা দুজন, আমি আর জয়ন্ত দা। খানিকটা দূরে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। আমরা ঠিক করলাম ওখানেই যাব। ভিউ পয়েন্টটা খুব সুন্দর। বসার জন্য বেঞ্চ আছে। বেঞ্চে বসে কোন কথা না বলে শুধু প্রকৃতির রূপ দেখতে থাকলাম। অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে উদ্দাম তিস্তা। সামনের দোকানের দিদি জিজ্ঞাসা করল ‘চা’ খাব কিনা। চা - তে কি বাঙালি না বলে। মনেমনে ভাবলাম আরো কিছুটা সময় পাওয়া গেল প্রকৃতিকে দেখার। চা খাওয়া শেষ হলে জয়ন্ত দা বলল এবার চলুন সাড়ে সাতটা বাজে। মন না চাইলেও হোমস্টেতে ফিরে এলাম।
গোছগাছ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে ডাইনিংয়ে এলাম। দেখলাম বাচ্চারা সবাই সেজেগুজে রেডি। আজকে আমাদের ব্রেকফাস্ট আলুর পরোটা, আচার আর দই।  মনটা ভোরে গেল। বৃষ্টির দিনে মনের মত খাবার সামনে থাকলে আর কি চাই। এর মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। খেতে খেতে আমাদের সবার বাগপত্তর বসন্ত আর শৈলেশ গাড়িতে তুলে প্লাস্টিক দিয়ে ভালো করে বেঁধে দিলো যাতে ভিজে না যায়। সবার খাওয়া শেষ হলে একটা গ্রুপ ফটো তুলে নিলাম। এবার সামথারকে বিদায় জানানোর পালা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু যেতে তো হবেই। ছোট্ট নির্জন পাহাড়ি গ্রামটা মনের মণিকোঠায় স্মৃতি হয়ে থাকবে। গাড়ি ছেড়ে দিলো।  যাওয়ার পথে  দেখে  নেবো ডেলো পার্ক, সায়েন্স সেন্টার, বুদ্ধ মনেষ্টি। গাড়ি চললো চোখের আরাম দিতে দিতে। চারিদিকে সবুজে মোড়া জলছবি। ডেলো পার্কে আমরা অনেকটা সময় কাটালাম।  বাচ্চারা খুব এনজয় করলো। অনেক ছবি তোলা হলো।  পাহাড়ের কোলে একটি সুন্দর ছিমছাম রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে লাঞ্চ খেলাম। ঘড়িতে তখন তিনটে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। আমরা শিলিগুড়ির পথ ধরলাম। সঙ্গী হলো তিস্তা।  সন্ধে নাগাদ আমরা নিউ জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছলাম। এবার বসন্ত আর শৈলেশকে বিদায় জানানোর পালা। তিনটে দিন ওদের সাথে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ওদেরকে নিয়ে একটা ছবি তুলে নিলাম। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফুড প্লাজা থেকে নিয়ে নিলাম রাতের খাবার। রাত ৮.০৫ এ নিদিষ্ট সময়ে পদাতিক এক্সপ্রেস আমাদের সবাইকে নিয়ে রওনা দিল কলকাতার পথে।  চোখে লেগে রইলো সবুজ বনানী, উন্নতশির পাহাড় আর অবিরাম বৃষ্টিধারা।  
 
পথের ঠিকানা: হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে প্রথমে নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি। এখান থেকে সামথার ৭১ কিলোমিটার। নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পংয়ের সামথার যাওয়ার রাস্তা দুটি। একটি কালিঝোরা ড্যামের ওপর দিয়ে। আরেকটি রুট হল ২৭ মাইল ড্যামের ওপর দিয়ে। সামথার থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে পানবু ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে পাহাড়, তরাই, তিস্তা সব দেখা যায়। 
গৃহের ঠিকানা: এখানে বেশকিছু হোমস্টে আছে। আমরা ছিলাম গ্রিনউড হোমস্টেতে। ছাড়া আছে সামথার হোমস্টে, দ্যা নেস্ট ফার্মস্টে, লামা দারা হোমস্টে। আগে থেকে বুকিং করে আসাই ভালো।
কি কি দেখবেন: ঘরে বসে উপভোগ করতে পারেন সামথারকে। আর সেই অভিজ্ঞতাও হবে অসাধারণ। কারণ এখান থেকে ডুয়ার্স-এর তরাই অঞ্চল দেখা যায়। তাই বসে বসে সেই দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগবেনা। পায়ে হেটে ঘুরে নিতে পারেন সামথার গ্রামটি।এখান থেকেই আপনি চাইলে কালিম্পং শহরের পার্শ্ববর্তী দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখতে পারেন। পানবু ভিউ পয়েন্ট, রাই দারা, সিনজিতে বুদ্ধ টপ আর হনুমান টক। পাবং, চারখোল, যুগে ফলস, পেমলিং এক দিনের সাইটসিইং করতে পারেন। একদিন যাওয়া যেতে পারে নকদাড়া আর ডাবলিং দারা। হোমস্টেতে বলে রাখলে সব রকম গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে তারাই।
রসনাবিলাস: গ্রাম্য ঘরোয়া খাবার। চাইলে খেতে পারেন মোমো, থুকপা, নুডুলস, সাফল্যে। দার্জিলিং চা তো আছেই।
ভ্রমণকাল: আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে মার্চ। তবে বর্ষাকালে অন্য রূপ। বর্ষায় জোঁক থেকে সাবধানে থাকবেন।

নাটিকা

সুরভির

ভবিষ্যৎ

স্বরূপ মণ্ডল

বাঘডাঙ্গা, কান্দি, মুর্শিদাবাদ

সুরভির ভবিষ্যৎ
talking.jpeg
swarup.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নেপথ্যে বিদ্যালয় প্রারম্ভের ঘণ্টাধ্বনি পড়ে। শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত। জাতীয় সংগীত শেষ হলে পুনরায় পঠনপাঠন শুরুর ঘণ্টাধ্বনি বাজে। একটা ক্লাসরুমের মধ্যে ছেলেমেয়েদের হইচই শোনা যায়। তারপর কয়েক সেকেণ্ডের জন্য নিস্তব্ধতা।
পর্দা সরতেই দেখা যায় একটা ক্লাসরুম। জনা দশেক ছেলেমেয়েকে মঞ্চে পিছন ফিরে বসে থাকতে দেখা যায়। মাস্টারমশায় হাজিরা খাতায় উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের হাজিরা নিতে থাকেন। নাম ডাকতে গিয়ে একটা নামে চোখ আটকে যায়। কিছুক্ষণ থেমে স্বগতোক্তি করতে থাকেন,

- ‘একটানা ন’দিন হল, স্কুলে আসছে না। কী হল মেয়েটার? অসুখ-বিসুখ হয় নি তো?’ হাজিরা নেওয়া শেষ হলে পর ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বলেন—
মাস্টারমশায়ঃ হ্যাঁ রে, তোদের মধ্যে সুরভির খবর কেউ কিছু জানিস?
একজন ছেলে উঠে দাঁড়ায়। ছেলেটির নাম সুজন।
সুজনঃ মাস্টারমশায়, আমাদের বাড়ি ওদের বাড়ির কাছেই। আমরা একসাথে স্কুলে আসি। আসছে না দেখে ওকে একদিন ডাকতে গেছিলাম। ওর মা বলল, ও পিসির ঘর গেছে।
মাস্টারমশায়ঃ স্বগতোক্তি (কিন্তু এতদিন স্কুল কামাই করার মেয়ে তো সে নয়! বৃষ্টি-বাদল, ঝড়-ঝঞ্ঝায় যে মেয়ে স্কুল কামাই করে না, পড়াশোনায় এত আগ্রহ যার সে কি পিসির বাড়ি গিয়ে এমন করে স্ফুর্তি করবে! নাহ্‌, নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো অসুখ বাঁধিয়েছে! দেখি, স্কুল শেষে মেয়েটার একটা খোঁজ নিতে হবে।) পরে ছেলেটির উদ্দেশে বলেন, আচ্ছা, বস্‌ তুই।
(বাংলা বইখানি হাতে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে)
আজ আমি তোদের কবিতা পড়াব। বল তো ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি কার লেখা?
সবাইঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
মাস্টারমশায়ঃ ঠিক বলেছিস। এবার আমার শুনে শুনে তোরাও বলবি, কেমন?
সবাইঃ ঠিক আছে, মাস্টারমশায়।
কবিতা আউড়াতে শুরু করেন মাস্টারমশায়। সকলে মাস্টারমশায়ের সুরে সুর মেলাতে থাকে।
‘মাগো আমায় ছুটি দিতে বল
       সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা,
এখন আমি তোমার ঘরে বসে’
           করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।
তুমি বল্‌ছ দুপুর এখন সবে
          না হয় যেন সত্যি হ’ল তাই,
একদিনো কি দুপুরবেলা হ’লে
        বিকেল হ’ল মনে করতে নাই?
আমি ত বেশ ভাব্‌তে পারি মনে
         সূয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে,
বাগ্‌দিবুড়ি চুব্‌ড়ি ভরে’ নিয়ে
          শাক তুলছে পুকুরধারে এসে।
আঁধার হ’ল মাদার গাছের তলা,
          কালী হ’য়ে এল দীঘির জল,
হাটে থেকে সবাই এল ফিরে,
          মাঠের থেকে এল চাষির দল।
মনে কর না উঠ্‌ল সাঁঝের তারা
           মনে কর না সন্ধ্যে হ’ল যেন!
রাতের বেলা দুপুর যদি হয়
           দুপুরবেলা রাত হয় না কেন?’

কবিতা পাঠ শেষ হতেই পিরিয়ড সমাপ্তির ঘণ্টা বাজে। মাস্টারমশায় সকলকে কবিতাটি ভাল করে পড়ে আসতে বলেন। তারপর মঞ্চের ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যান। পাঁচ সেকেণ্ডের জন্য মঞ্চে উপস্থিত চরিত্রগুলো ফ্রীজ হয়ে থাকে। নেপথ্যে পাখির কিচিরমিচির ডাক সঙ্গে লো ভল্যুমে

সানাই বাজতে শুরু করলেই ছেলেমেয়েরা খেলার ভঙ্গিতে নড়াচড়া শুরু করে। ডানদিক থেকে মাস্টারমশায় প্রবেশ করেন। ইশারায় ছেলেদের থেকে সুরভির বাড়ির ঠিকানা জানতে চান। একটি ছেলে হাতের ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে দেয়। মাস্টারমশায় সেই মোতাবেক মঞ্চের বামদিকে চলে যান। খেলার ভঙ্গিতে ছেলেমেয়েরা একে একে ডানদিক দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করে। নেপথ্যে সানাই বাজতে থাকে; সাথে পাখিদের কলকাকলি। মঞ্চের ডানদিক দিয়ে চাষির বেশে খগেনের প্রবেশ। মঞ্চের বামদিক থেকে খগেনকে ডাকতে ডাকতে মাস্টারমশায় প্রবেশ করেন। খগেন থমকে দাঁড়ায়।
মাস্টারমশায়ঃ এই যে খগেন, আছো কেমন?
খগেনঃ (নমস্কার জানিয়ে) আজ্ঞে, কিষ্টর আশীব্বাদে ভালই আছি। তা, এই সাঁঝের বেলা ইদিকে কুথায় চোললেন, মাস্টারমশায়?
মাস্টারমশায়ঃ আমি তোমার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম; পথে দেখা হল, ভালই হল। আচ্ছা, সুরভির কী ব্যাপার বলো দেখি? আজ ন’দিন হল, ও স্কুলে যাচ্ছে না।
খগেনঃ (ইতস্তত করে) ওর জ্বর হইছিলু, মাস্টারমশায়। এ ক’দিন খুব ভুগলু কিনা!
মাস্টারমশায়ঃ কিন্তু সুজন যে বলল, সে পিসির বাড়ি গিয়েছে। সুরভির মা নাকি তাকে বলেছে।
খগেনঃ (কাঁচুমাচু করে) হ্যাঁ হ্যাঁ, পিসির ঘর থেক্কি ফিরেই তো তার ধুম জ্বর এলু। এখুন ওনেকটাই ভালোর দিকি। আসছে হপ্তা থেক্কি স্কুলে পাঠাবু। আমি এখুন যাই, তাইলে? আমার আবার হাটে যেতি দেরি হয়ি যেছে। (যেন কোনোক্রমে পালিয়ে বাঁচল সে)
খগেনের চোখমুখ দেখে মাস্টারমশায়ের সন্দেহ হল। মাস্টারমশায়ের স্বগতোক্তি—
(কথা শুনে মনে হল, কিছু একটা লুকোচ্ছে খগেন। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার।)
খগেনের বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ালেন। মঞ্চের ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রেবতীঃ (সুরভির মা) বামদিক থেকে সাঁঝের প্রদীপ হাতে উলুধ্বনি দিতে দিতে প্রবেশ করে। মঞ্চের চারপাশে এক পাক ঘুরে বামদিকের একটা উঁচু জায়গায় রেখে দেয়। তারপর গলায় কাপড় জড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় ডানদিক থেকে মাস্টারমশায় প্রবেশ করলেন।
মাস্টারমশায়ঃ খগেনের বউ, বাড়ি আছো?
রেবতীঃ কে? মাস্টারমশায়, আপনি!
মাস্টারমশায়ঃ হ্যাঁ গো, আমি। সুরভি কেমন আছে? ওর জ্বর হয়েছিল শুনলাম।
রেবতীঃ (ইতস্তত করে) সুরভি তো মামাবাড়ি গেইছে।
মাস্টারমশায়ঃ কিন্তু খগেন যে বলল, সুরভির জ্বর হয়েছিল।
রেবতীঃ (কিন্তু কিন্তু করে ঢোক গেলে) না, মানে ওর মামাবাড়িতেই জ্বর হইছিলু। ও সেইঠিঁইয়ে আছে।
মাস্টারমশায়ঃ (কঠোর ভঙ্গিতে) বউমা, আমাকে সত্যিটা বল। সুরভি আমার স্কুলের গর্ব। ওর কোনোরূপ ক্ষতি আমি বরদাস্ত করব না। দরকার পড়লে পুলিশের সাহায্য নেব।
হাউমাউ করে কেঁদে মাস্টারমশায়ের পায়ে পড়ে রেবতী।
রেবতীঃ আমরা বড়ই ওন্যায় করি ফেলাইছি! আমাদের আপুনি ক্ষেমা করি দ্যান, মাস্টারমশায়।
মাস্টারমশায়ঃ না কেঁদে, কী হয়েছে সেটা বলো আমাকে।
রেবতীঃ আমাদের বড় মেয়ি, রূপসার বিহা দিইছি, মাস্টারমশায়। সুরভি সেইঠিঁইয়ে আছে।
মাস্টারমশায়ঃ (আফশোসের স্বরে) এ কী করেছ তোমরা! রূপসার বয়স তো সবে পনেরো। তোমরা জানো, পুলিশ জানতে পারলে তোমাদের কী হবে?
রেবতীঃ দোহাই আপনার! আপুনি কাউকে কইবেন না। আমাদের অবস্থা তো সবই জানেন। দু’বেলা খেয়ি-পরি কুনুরকমে দিন চলি যায়। একটা ভাল সম্বন্ধ পেইছিলাম, দাবি দাওয়াও তেমুন ছিলু নাকু, তাইতে আর না করতি পারি নি। লোক জানাজানির ভইয়ে ওর পিসির ঘর থেক্কিই বিহা দিইছি।
মাস্টারমশায়ঃ কাজটা মোটেই ভাল করো নি। বিয়েটাই মেয়েদের জীবনে সব নয়। মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াটা খুব দরকার। তাছাড়া, আঠারো বছর না হলে মেয়েদের শরীরের ঠিকমতো বিকাশ হয় না। সর্বনাশ যা হবার তা তো হয়েই গেছে। সুরভিকে সোমবার থেকে স্কুলে পাঠাবে। আর হ্যাঁ, মনে রেখো, ভবিষ্যতে সুরভির প্রতি এ ধরণের অন্যায় আমি কোনোভাবেই বরদাস্ত করব না।
মাস্টারমশায় ডানদিক দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন। রেবতী নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে। নেপথ্যে করুণ সুরে সানাই বাজতে থাকে।

গল্প

সিংহ বাড়ির

চাকর

প্রসূন কুমার দত্ত

দিল্লী

সিংহ বাড়ির চাকর
thief.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ত্তর কলকাতার গিরীশ পার্ক অঞ্চলে সিংহ নিবাস প্রসিদ্ধ বনেদি বাড়ি। কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাবেকি বাড়িগুলোর অনেককটাই প্রোমোটারের হাতে গিয়ে বহুতল ফ্ল্যাটের আকার নিয়েছে। বেশ কয়েকটা জরাজীর্ণ অবস্থায় ধুঁকছে। এরাও হয়ত প্রোমোটারের হাতে বিলীন হয়ে যাবে। তবে কিছু বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভাল। এরা নিজেদের ঐতিহ্যপূর্ণ চাকচিক্য বজায় রাখতে পেরেছে। সিংহ নিবাস এরকমই একটা বাড়ি। ইউরোপের স্থাপত্য শিল্পের আদলে তৈরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দেশের তৎকালীন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সিংহ পরিবারের দুই ভাই দেব নারায়ন আর ইন্দ্র নারায়ন  পূর্ববঙ্গে জমিদারি বিক্রি করে কলকাতায় চলে আসেন। ওনারাই এই বাড়ি কিনে আপাদমস্তক সংস্কার করিয়ে সিংহ নিবাস নাম দিয়েছেন।

বাড়িটা‌ ঠিক বড় রাস্তার ওপর বলা যায় না। বরং সিংহ নিবাসের সিংহ দুয়ারের বাইরে একটা সাধারণ গলি। সিংহ দুয়ার লিখলাম বটে তবে সিংহের কোনো ব্যাপার নেই। দুপাশে লাল সিমেন্টের রোয়াক। মধ্যিখানে লোহার মজবুত পেল্লায় দরজা। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই সামনের খোলা জমিতে সবুজ ঘাস, দুপাশে  রকমারি ফুলের গাছ আর মাঝখানে একটা শ্বেত পাথরের হাতির মূর্তি। সেটা একটা ফোয়ারা ও বটে, শুঁড় দিয়ে জল পড়ে। বড় না হলেও সুন্দর এই বাগান। রাতের মৃদু রঙিন আলোয় আরও সুন্দর দেখায়।

বাগানটার দুপাশ দিয়ে নুড়ি বিছানো ছোট রাস্তা দুটো সামনের গাড়ি বারান্দার নিচে মিলেছে। বাঁদিকেরটা ঢোকার আর ডান দিকেরটা বেরোনোর।‌ রাস্তা দুটোর শেষে বর্মা সেগুনের বিশাল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই প্রশস্ত অভ্যর্থনা কক্ষ। সোফা আর গোটা কয়েক চেয়ার পাতা। মাঝখানে মাথার ওপর ঝাড় লন্ঠন। বাঁদিকে দোতলা যাবার মার্বেলের সিঁড়ি আর ডান দিকটায় ঠাকুর দালান। পেছনের দিকে রান্নাঘর আর কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা। তা পুরুতমশাই, পাহাড়াদার, ড্রাইভার, রাঁধুনি, আর অন্যান্য কাজের লোক মিলিয়ে কর্মচারীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

দোতলায় আছে সুসজ্জিত বসার আর খাবার ঘর সমেত বাড়ির মালিকদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের অংশ। প্রতিটা অংশে প্রশস্ত শোবার ঘর, ব্যক্তিগত লাউঞ্জ আর সংলগ্ন বাথরুম। অতিথি ঘর‌ও আছে কয়েকটা। সাজসজ্জা সব‌ই ঝকঝকে আধুনিক আর রুচিসম্পন্ন। এই বাড়ি দেখেই মালিকদের আর্থিক প্রতিপত্তি উপলব্ধি করা যায়। 

দোতলায় সবচেয়ে প্রশস্ত আর আরামদায়ক অংশে থাকতেন দেব নারায়ণ। তিনি আর ইহজগতে নেই। এখন একলাই থাকেন দেব নারায়ণ পত্নী সুভদ্রা। এই বাড়ির অবিসংবাদী দোর্দণ্ড প্রতাপ কত্রী। ওনার অমতে এ বাড়িতে কিছু হ‍ওয়া সম্ভব নয়। স্বয়ং দেব নারায়ণ ওনার কথা মেনে চলতেন।‌ এখন ছেলে সৌম্য নারায়ণ আর ছেলের বৌ সুধা একবাক্যে মেনে চলেন। অকৃতদার ইন্দ্র নারায়ণ অবশ্য স্বাধীন প্রকৃতির। বৌদির কথা মেনে চলার পাত্র তিনি নন। ওনার ওপর সুভদ্রাদেবী নিজের মত চাপান না। বিয়ের পর থেকেই ওনাদের বন্ধু সুলভ হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক। এ বাড়িতে তাই সুভদ্রা দেবীর সিদ্ধান্তে নড়চড় করতে হলে ইন্দ্র নারায়ণের সাহায্য ছাড়া গতি নেই। অবশ্য আর একজনের সব আবদার এক কথায় মেনে নেন সুভদ্রা। সে হল ওনার অতি আদরের নাতি আদিত্য। সৌম্য নারায়নের একমাত্র সন্তান।

কাজের লোকেদের মধ্যে একজনকে পরিবারের সদস্য ধরে নেওয়া যায়। সে হল সুমিত্রা। জগবন্ধুর বিধবা স্ত্রী। জগবন্ধুর বাবা নিমাই ছিল দেব নারায়নের ড্রাইভার। ওপার বাংলা থেকে ওনার সঙ্গেই এসে ছিল। খুব বিশ্বস্ত ছিল নিমাই। সে মারা যাবার পর জগবন্ধু গাড়ি চালাত। এক রাতে উত্তর বাংলা থেকে আসার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় জগবন্ধু মারা যায়। পেছনের সিটে ছিলেন দুই মনিব দেব নারায়ন আর ইন্দ্র নারায়ন। আহত হলেও ওনারা বেঁচে যান। সুমিত্রা আর তার বছর দশেকের ছেলেকে মনিবরা সিংহ নিবাসে আশ্রয় দিয়েছিলেন। জগবন্ধুর প্রাপ্য মাইনের টাকা সুমিত্রা পেত আর সেই সঙ্গে পেয়েছিল বাড়ির মালকিন সুভদ্রার বিশেষ পরিচারিকার মর্যাদা।

এই ধরণের সাবেকি জমিদার পরিবারে সাধারণত আয়েসি আর বাবুয়ানা আর্থিক অবনতি ডেকে আনে। এই সিংহ পরিবারে তা হয় নি। তার কারণ রমরমা ব্যবসা। সিনহা ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডের দুটো ব্যবসা ওষুধ আর ইলেকট্রনিক্স। কলকাতায় অনেকগুলো দোকান। শিলিগুড়িতেও। লাভজনক ব্যবসা। সেই কারণেই আর্থিক স্বচ্ছলতা। ব্যবসার আর্থিক দিকটা দেখতেন দেব নারায়ন আর বাণিজ্যিক দিকটা ইন্দ্র নারায়ন। এখন অবশ্য ব্যবসার একমাত্র কর্ণধার ইন্দ্র নারায়ন। ইনি শৌখিন মানুষ। দামি পোশাক পরেন, দামি মদ খান, দামি রেস্তোরাঁয় যান, বছরে অন্তত একবার ইউরোপ কী আমেরিকায় বেড়াতে যান। বিদেশ থেকে অবশ্যই সুভদ্রার জন্য উপহার আনেন। অনেকে বলাবলি করে সেই কারণেই সুভদ্রা ইন্দ্র নারায়নের কোনো অনুরোধ অমান্য করেন না। এমনকি কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে ইন্দ্র নারায়নের সম্মতি আছে কি না জেনে নেন।

সৌম্য নারায়নের ছেলে আদিত্য আর সুমিত্রার ছেলে ভোলা সমবয়সী। আদিত্য আর ভোলার মেলামেশা নিয়ে ঠাকুমা আর মা দুজনেরই আপত্তি ছিল। কিন্ত কিছুটা উদার প্রকৃতির মানুষ ইন্দ্র নারায়নের সায় ছিল, তবে সম্পর্কে চাকর আর মনিবের ভেদ বজায় রেখে। ওদের ছোট বয়সে দেশ বিদেশের অনেক খেলনা তিনি আদিত্যকে দিয়েছেন। অথচ ভোলাকে কদাপি নয়। আদিত্যর মন ভরে গেলে বা ভেঙে গেলে ভোলাকে দান মিলত। ভোলা তাতেই খুশি ছিল। চাকরানির ছেলে আর মালিকের ছেলের তফাৎ কতটা সুমিত্রা ওকে ছোটবেলাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিল।

একটা নামকরা ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে আদিত্য ভর্তি হল। ভোলার স্কুলে যাবার কী প্রয়োজন?  ঘরের কাজকর্ম করুক, ফাই ফরমাস খাটুক, বড় হয়ে ড্রাইভারি শিখবে, এই ছিল সকলের মত, বিশেষত সুভদ্রার। পাড়ায় ইন্দ্র নারায়নের ভাবমূর্তি ছিল সাম্যবাদী পুঁজিপতি। নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। স্কুল কলেজের মাইনে, মেয়ের বিয়ে বা চিকিৎসার প্রয়োজনে এদের অবলম্বন ছিলেন। তবে সামাজিক প্রতিষ্ঠার দূরত্ব বজায় রাখতেন। তিনি বড়লোক আর ওরা গরিব সেটা আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়েও দিতেন। এ হেন লোক নিজের চাকরের ছেলেকে স্কুলে পাঠাবেন না সেটাতো হতে পারে না। বাড়ির কাছে বাংলা মিডিয়াম স্কুলটায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন।

দেব নারায়নের মৃত্যুর পর সুভদ্রা চেয়েছিলেন সুমিত্রা ছেলে নিয়ে সিংহ নিবাস ছেড়ে চলে যাক। ওনার ভয় ছিল ভোলার কুপ্রভাব আদিত্যর ক্ষতি করবে। ইন্দ্র নারায়ন ও সেটাই চেয়ে ছিলেন। থাকা খাওয়ার জন্য মাসিক পেনশনের বরাদ্দ করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু সুমিত্রা যেতে চায় নি। বাধ্যতা ছিল না। দলিলে সিংহ নিবাসের মালিক ছিলেন দেব নারায়ন। উনি উইল করেছিলেন। ওনার অবর্তমানে সম্পত্তির অর্ধাংশ পাবেন ইন্দ্র নারায়ন আর বাকি অর্ধাংশ সুভদ্রা। সেই সঙ্গে সিংহ নিবাসে সুমিত্রার আজীবন বসবাসের অধিকার‌ও কায়েম করেছিলেন। ওর জন্য বরাদ্দ ছিল নিচের তলার দুটো ঘর, সংলগ্ন বাথরুম আর এক চিলতে রান্নার জায়গা। সেই নিমাই এর আমল থেকেই বাড়ির এই অংশটায় থাকত তার পরিবার। 

ছোটবেলায় ভোলা ছিল আদিত্যর ব্যক্তিগত চাকর আর বডি গার্ড। ফাই ফরমাস খাটত। পাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে রঞ্জনের সঙ্গে আদিত্যর রেষারেষি ছিল। এক‌ই স্কুলে আদিত্যর এক ক্লাস ওপরে পড়ত সে। স্কুল বাসে ওদের প্রায়ই ঝগড়া হত। একদিন তো মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এসেছিল আদিত্য। পরের দিন ভোলা রঞ্জনের ভাল রকম ধোলাই করেছিল। তারপর থেকে রঞ্জন আর আদিত্যকে ঘাঁটাত না। স্কুলের পর কাছের পার্কে খেলতে যেত আদিত্য। ভোলা যেত খেলার সরঞ্জাম বয়ে। খেলার মাঠে কেউ আদিত্যকে কুকথা বললে ভোলা তাকে দুকথা শুনিয়ে আসত। তবে মনিব চাকরের সম্পর্ক কখনোই বন্ধুত্বের পর্যায়ে আসে নি। আদিত্য ক্রিকেট ফুটবল খেলত, সাঁতার কাটত আর গিটার বাজাত। সময় পেলে ভোলা স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার গলিতে খেলত। ব্যাট বল, ডাংগুলি বা মার্বেল। এক কথায় এক‌ই বাড়িতে থাকলেও আদিত্য আর ভোলার জগৎ ছিল একেবারেই আলাদা। প্রতিবছর ঘটা করে আদিত্যর জন্মদিন পালন হত। অনেক খাওয়া দাওয়া হৈচৈ হত। ভোলার জন্মদিনে সেসব কিছুই হত না। মা সুমিত্রা শুধু পাড়ার কালি মন্দিরে পুজো দিত। ভোলার দুঃখ হত। ছোটবেলায় মা র কাছে অনুযোগ করত। মা সুমিত্রা বুঝিয়েছিল জন্মদিন পালন হয় বড়লোকদের ওদের মত গরীবদের নয়। বড় হতে হতে সে বুঝে গিয়েছিল আর্থিক বৈষম্যের পাঁচিলটা অনেক উঁচু। টপকানো সহজ নয়। তবে স্বপ্ন দেখায় কোনো বাধা ছিল না। ভোলা বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখত।  

ছোটবেলা থেকেই আদিত্য পড়াশোনায় ভাল। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে খড়গপুর আইআইটিতে পড়তে গেল। ইন্দ্র নারায়ন সিংহ নিবাসে অনেক বড় পার্টি দিয়েছিলেন। নিজের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রেখে এলাকার গরিবদের পেটপুরে কাঙালি ভোজন‍ও করিয়েছিলেন। সন্ধ্যেবেলা জমজমাট পার্টিতে দু পেগ দামি স্কচে গলা ভিজিয়ে ভোলাকে কাছে ডেকে ঘোষণা করেছিলেন চাকর বাকররাও সিংহ পরিবারের সদস্য। বলেছিলেন ভোলাও যদি কোনো ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পায় পড়ার খরচ তিনি দেবেন। 

প্রতিশ্রুতি দিলেও ইন্দ্র নারায়ন জানতেন তা পূরণ করার প্রয়োজন হবে না। পড়াশোনায় ভোলা ছিল গবেট একটা। মাধ্যমিকের গন্ডিটা কোনোরকমে পেরিয়েছিল একবারের আর উচ্চমাধ্যমিকেরটা দুবারের চেষ্টায়।

পাড়ায় একটা নতুন দোকান খুলেছে। খোলা থাকে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নটা। মচমচে চপ, মুচমুচে মুড়ি আর আর গরম গরম চা। লোকেরা পছন্দ করেছে। বিক্রি বাটা ভাল। খদ্দেরদের লাইন লেগে যায়। দোকানদার একটা বিশ্বাসী হেলপার খুঁজছিল। ইন্দ্র নারায়নের সুপারিশে ভোলা সেই কাজটা পেয়েছিল। তার প্রথম রোজগার।

এই দোকানে বছর খানেক কাজ করার পর ভোলার নতুন সুযোগ আসে। সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউতে কাছেই একটা ম্যাকডোনাল্ড ছিল। ওদের ওখানে কাজ পেয়ে গেল ভোলা। মাইনেটাও একটু বেশি।

ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে ভাল চাকরি নিয়ে আদিত্য হায়দ্রাবাদে ছিল বছর দুয়েক। তারপর ম্যানেজমেন্ট পড়তে আইআইএম কলকাতায় যায়। ইন্দ্র নারায়ন সিংহ নিবাসে আর‌ও বড় পার্টি দিয়েছিলেন। ভোলাকে কেউ সেখানে ডাকে নি। ও ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করছিল। আইআইএম থেকে ডিগ্রি নিয়ে আদিত্য মুম্বাই চলে যায় বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি নিয়ে। ভোলা সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউতেই ছিল। ম্যাকডোনাল্ড ছেড়ে কেএফসি। কাজ এক‌ই। খদ্দেরদের খাওয়া শেষ হলে টেবিল পরিষ্কার করা। 

এক দিন সকালের শিফটে ডিউটি সেরে বেরিয়ে একটা বছর পনেরোর মেয়েকে নিশ্চিত গাড়ি চাপা থেকে বাঁচিয়েছিল ভোলা। মেয়েটা ব্যস্ত সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউতে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ছুটে গিয়ে তাকে চলন্ত বাসের সামনে থেকে টেনে এনেছিল। কেএফসির পাশেই হলদিরাম। সেখান থেকে বেরিয়ে একটা ঢাউস প্যাকেট হাতে নিয়ে নিজের নতুন বিএমডব্লিউতে উঠছিলেন মাঝবয়সী মাড়োয়ারি ভদ্রলোক কুশল বাজোরিয়া। মেদহীন সুঠাম চেহারা। এনাদের পরিবার চার পুরুষ ধরে কলকাতায় আছেন। সুস্পষ্ট বাংলা বলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে চাটার্ড এ্যাকাউন্ট্যাট। পারিবারিক ব্যবসার কর্ণধার। মানুষ চেনেন। ভোলার সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি আর মানবিকতা দেখেই বুঝেছিলেন ছেলেটার ওপর ভরসা করা যায়। 

কুশল বাজোরিয়ার দুটো ব্যবসা। মশলা আর চা। দিল্লির চাঁদনি চকে খারেবাউলিতে বড় মশলার আড়ৎ। দার্জিলিংএ চা বাগান। কলকাতায় বড়বাজারে মশলা ‌আর চা এর পাইকারি দোকান। তিনটে ঠিকানা। দিল্লির পঞ্চশীল পার্ক, কলকাতার আলিপুর আর দার্জিলিঙে সাহেবি বাংলো।‌ তিনি বড়বাজারের মশলার দোকানে একজন নির্ভরশীল লোক খুঁজছিলেন। ভোলাকে সেখানে চাকরি দিলেন। ভোলা নিরাশ করে নি।‌ মনযোগ আর মেহনত দিয়ে বছর দুয়েক কাজ করেছিল। কুশলজি খুশি ছিলেন। ওকে দিল্লির আড়ৎ দেখাশোনার প্রস্তাব দিলেন। দায়িত্ব অনেক। খারেবাউলি থেকে শুধু কলকাতায় নয় সারা ভারতে মশলা যায়। ভোলা প্রথমে ইতস্তত করেছিল। মা সুমিত্রার‌ও অপছন্দ ছিল। পরে ভোলা দিল্লি এসেছিল।

ভোলা বুঝেছিল উন্নতির রাস্তা ব্যবসা। সে দেখেছিল ম্যাকডোনাল্ড বা কেএফসির মত বিদেশি কোম্পানিরা মামুলি বার্গার আর চিকেন ফ্রাই বেচে জগৎ জুড়ে বিশাল ব্যবসা করছে। ওর মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছিল। ভাবছিল ভারত জুড়ে চপের দোকান খুলবে। সঙ্গে মুড়ি আর চা। সাহস করে আদিত্যকে ফোনে বলেছিল। সে পাত্তা দেয় নি। বিদ্রুপ করতেও ছাড়ে নি।

কুশলজি দিল্লিতে প্রায়ই আসতেন। ব্যবসার কাজে ভোলা মাঝে মাঝে ওনার বাড়ি যেত। একবার ওনাকেও ভোলা তার আইডিয়া শুনিয়েছিল। তিনি মুচকি হেসেছিলেন মাত্র।

​​মাস তিনেক বাদে কুশলজি ভোলাকে ডেকে পাঠান। বলেন ভোলার আইডিয়াটা ভাল। বললেন প্রথমে এই আইডিয়ার পেটেন্ট নিতে হবে। তারপর দিল্লি কলকাতা আর মুম্বাইতে নিজস্ব আউটলেট।ব্যবসা চললে ভারতজুড়ে ফ্রাঞ্চাইজি। কুশলজি টাকা লাগাতে রাজি হলেন। শর্ত পঁচাত্তর শতাংশ মুনাফা ওনার। ভোলা মেহনত করবে। ভোলা কলকাতার পাড়ায় চপের দোকানে কাজ করত। চপ তৈরি হতে দেখেছে। নিজের হাতে করে নি। তাই সে কলকাতায় কিছু দিন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে রাঁধুনিদের কাছ থেকে কিছু টাকার বিনিময়ে চপের রেসিপিগুলো যোগাড় করল। তারপর কিছু ইনোভেশন দরকার ছিল। পটলের দোরমা থেকে ডাল বা মাছের পুর বাদ দিয়ে

ভরা হল আলু আর পনির। ওপরে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজা হল নতুন মচমচে পটল চপ। নারকেল আর পোস্ত দিয়ে তৈরি হল সবার প্রিয় পোস্ত চপ। ব্রকলি আর সয়াবিন চপ‌ও বাদ গেল না। শুধু নিরামিষ নয় আমিষ চপেও অঢেল ভ‌্যারাইটি। গালোটি কাবাব রূপান্তরে হল গালোটি চপ আর শামি কাবাব শামি চপ। স্কুইড আর অক্টোপাসের কিমা থেকে তৈরি হল চমক দেওয়া সি ফুড ডিলাইট চপ। সব মেনুর পেটেন্ট নেওয়ার দরকার ছিল। প্রথমে পেটেন্ট ব্যপারটা ভোলা ভাল বোঝে নি। কুশলজি বুঝিয়েছিলেন পেটেন্ট নিলে আইনত এই খাবারের নকল করে আর কেউ ব্যবসা করতে পারবে না।

তবে চেইন আউটলেট খুললে স্ট্যান্ডার্ডাইজড করতে হবে। সব আউটলেটে রান্নার পদ্ধতি, খাবারের স্বাদ ও মান আর পরিবেশনের স্টাইল এক রকম হতে হবে। যেমনটা ম্যাকডোনাল্ড বা কেএফসিতে। এই কাজটা ভোলা পারত না। কুশলজি একজন অভিজ্ঞ ফুড টেকনোলজিস্ট খুঁজে আনলেন। বছর তিরিশের স্মার্ট ছেলে। যাদবপুরে ফুড টেকনোলজি পড়েছে। আমেরিকায় বার্গার কিংএ কাজ করেছে। সে সুন্দরভাবে সব ব্যবস্থা করে দিল। বাংলায় তিন জায়গায় ভাল মুচমুচে মুড়ি পাওয়া যায়‌। হুগলির সুগন্ধা, বীরভূমের প্রান্তিক আর জলপাইগুড়ির ফালাকাটা। এদের সঙ্গে চুক্তি হল। কুশলজির চা বাগানের চা কিনে একটা নাম করা কোম্পানি টি ব্যাগ বানাত‌। ওরাই হল টি ব্যাগ সাপ্লায়ার। মশলার  ভার কুশলজি নিজেই নিলেন। ঠিক হল দিল্লির সবচেয়ে পুরনো উচ্চ মানের সর্ষের তেল নির্মাতা তেল সরবরাহ করবে। এদের মালিক‌ও বাজোরিয়া। কুশলজির আত্মীয়।চেইন আউটলেট। তাই সব দোকানের বাইরের আর ভেতরের অবয়ব হবে এক‌ইরকম হতে হবে। সেই স্ট্যান্ডার্ডাইজড। কুশল বাজোরিয়ার ভাইপো ইন্টিরিয়র ডিজাইনার। সব কটা আউটলেট তার টিম বানিয়ে দেবে। দৃষ্টি নন্দন ঝকঝকে তকতকে। ঢুকলে মনে হবে গ্রাম বাংলার মাটির বাড়ি। খাবার দেওয়া হবে শাল পাতার প্লেটে আর চা মাটির ভাঁড়ে। দোকানের একটা মানানসই নাম দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে নাম রাখা হল বেঙ্গল চপ হাউস। ইংরিজিতে বিসিএচ. লোগোটাও হল দুর্দান্ত। 

দিল্লিতে ইদানিং চপ আর মুড়ির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অবাঙালিরাও খাচ্ছে। কুশলজির চেষ্টায় দিল্লি হাটে জায়গা পাওয়া গেল।‌ আরও দুটো আউটলেট খোলা হল। একটা বাঙালি এলাকা চিত্তরঞ্জন পার্কে। অন্যটা দিল্লি ইউনিভার্সিটির নর্থ ক্যাম্পাসের কাছে কমলা নগরে। তরতরিয়ে বিক্রি। বছর খানেক পরে লাভের অঙ্কটা হল আশাতরিক্ত। কুশলজি চুক্তি অনুযায়ী পঁচাত্তর শতাংশ নিলেন। ভোলার তাতে দুঃখ ছিল না। ওর প্রাপ্য অংশটাও কম কিছু ছিল না।

ছেলের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়তে সিংহ নিবাসে সুমিত্রাও পদোন্নতি হল। সে আর কাজের লোক থাকল না। বরং অন্য কর্মচারীদের ম্যানেজার হয়ে গেল। সুভদ্রা খুশি হন নি। কিন্তু ইন্দ্র নারায়নের তাই ইচ্ছে, বাধা দিতে পারলেন না। পাড়ার বারোয়ারি পুজোয় সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন ভোলার প্রতিভা আর সম্ভাবনা তিনি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। বলেছিলেন ওর সাফল্যে তিনি গর্বিত। উদার সিংহ পরিবারে যে মনিব আর কর্মচারীর সম্পর্কের ভিত্তিই হল মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ, সেটাও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

দিল্লিতে বিরাট সাফল্যের পর কলকাতায় দুটো দোকান খোলা হল। একটা হাতিবাগানে আর অন্যটা গড়িয়াহাটে। চপের শহর কলকাতা। কিন্তু এই চপের নতুনত্ব গ্রাহকদের মন কেড়ে নিল। কলকাতাবাসী খাদ্যরসিক। বিক্রি হল তরতরিয়ে। মুনাফার অঙ্কটা ছয়মাসেই দিল্লিকে ছাড়িয়ে গেল।

সিংহ নিবাসে প্রতি বছর ঘটা করে মা সিংহবাহিনীর পুজো হয়। হাতিবাগানে বিসিএচ এর আউটলেট খোলার পর‌ মাস দুয়েকের মধ্যে এই পুজো। ভোলা বললো পুজোর সব খরচ দেবে। সুমিত্রা চেয়েছিল পুজোয় সংকল্প ভোলার নামে হোক। সুভদ্রা রাজি হলেন না। ইন্দ্র নারায়নেরও অমত ছিল। বললেন পুজোর ঐতিহ্য অবহেলা করা সম্ভব নয়। সংকল্পে সিংহ পরিবারের বংশোদ্ভূতদের একমাত্র অধিকার। সংকল্প হয়েছিল আদিত্যর নামে। সুমিত্রা একটু দুঃখ পেয়েছিল। ক্ষুব্ধ ভোলা কিছু বলে নি। কুশলজি বলেছিলেন নিরাশ না হতে। প্রতিশোধের সুযোগ সে পাবে।

কুশলজির দুই ছেলে। বড় ছেলে ডাক্তার। দক্ষিণ কলকাতায় তার একটা নার্সিং হোম আছে। গুরগাঁওতে খুলবে সেই নিয়ে ব্যস্ত আছে। ইদানিং সে গুরগাঁওতে থাকে। ছোট ছেলেটা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। নিউ ইয়র্কে থাকে। তার উদ্যোগে একজন আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় এই চপের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে রাজি হলেন।

বিসিএচ এর নাম ছড়িয়ে পড়েছে।  ফ্রাঞ্চাইজি দেওয়া হবে। অনেক আবেদন এল। খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে প্রতিটা ফ্রাঞ্চাইজি নির্বাচন করা হল। দেখতে দেখতে কলকাতা সমেত বাংলার প্রমুখ শহরে, আর দিল্লি,  মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, আমেদাবাদ ও লক্ষ্ণৌতে বিসিএচ খুলে গেল।

ভোলা এখন ব্যবসা বুঝেছে। টাকা আসছে। একটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হল। ভোলা, কুশলজি আর বিনিয়োগকারী আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় তিনজন সমান অংশীদার। সিংহ নিবাসের গ্যারেজে একটা নতুন আর সবচেয়ে দামি গাড়ি ঢুকল। টয়োটা ফরচুনার। গাড়িটা ভোলার।

আর‌ও বছর দুয়েক কেটে গেল। বিসিএচ তর তর করে এগিয়ে চলেছে। ভোলার অনেক নাম ডাক হয়েছে। মোটামুটি ইংরিজি বলতে শিখেছে। একটা সফল অভিনব ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সে কয়েকটা টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়েছে। সঙ্গে কুশলজি অবশ্য‌ই ছিলেন। তবে তিনি কৃতিত্ব দাবি করেন নি। ওনার নিউইয়র্ক নিবাসী ছোটো ছেলের নিউ ইয়র্ক টাইমসে জানাশোনা ছিল। ওদের ভারতীয় প্রতিনিধি দিল্লিতে ভোলার ইন্টারভিউ নিয়েছিল। সেই ইন্টারভিউ প্রকাশ হলে ভোলার পরিচিতি আর বিসিএচ এর বিক্রি এক লাফে বেড়ে গিয়েছিল। ফুড ব্লগারদের অঢেল প্রশংসায় জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। ভারতের বড় বড় এয়ারপোর্টে আর মলগুলোতে বিসিএচ আউটলেটের বিক্রি বাটা ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি তো বটেই এমনকি হলদিরামকেও পেছনে ফেলেছিল। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে দিল্লির বঙ্গভবনে বিসিএচ আউটলেট খোলা হল। উদ্বোধনী ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ভোলা বাংলার গৌরব। 

সিংহ নিবাসের রক্ষণাবেক্ষণে অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট ছাপ দেখা দিল।‌ সৌম্য নারায়ন ব্যবসা বুঝতেন না। বোঝার চেষ্টাও করেননি বিশেষ। মুনাফার অংশটা পেলেই তিনি খুশি। তাঁর এক প্রেমিকা ছিল। বিধবা মহিলা। স্ত্রী সুধা জানতেন কিন্তু লোক জানাজানির ভয়ে চুপ থাকতেন। ঝগড়াঝাঁটি হত বন্ধ দরজার ওপারে। কালক্রমে সুধার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। চাকর বাকররা জেনে ফেলেছে। মুখরোচক খবরটা পাড়াতেও ছড়িয়েছে। সুভদ্রা আর ইন্দ্র নারায়ন সৌম্য নারায়নকে বোঝাবার চেষ্টা করে সফল হন নি।

এদিকে ব্যবসার অবস্থা ভাল না। প্রতিযোগিতা বেড়েছে। লাভের অঙ্ক কমেছে। ইন্দ্র নারায়ন অনেক ধার নিয়ে ফেলেছেন। দুশ্চিন্তায় তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। ব্যবসা সামলাতে উনি খুব গোপনে ভোলার কাছে ধার নিয়েছিলেন। শোধ করতে পারেন নি।

সিংহ নিবাস বিক্রি হবে এই খবরটা কুশলজি এনেছিলেন। বলেছিলেন ভোলা কিনতে চাইলে সাহায্য করবেন। না কোনো রকম অর্থসাহায্য তিনি করেন নি। ওই অঞ্চলের দালালদের তিনি জানতেন। দাম যাতে বেশি না ওঠে তার ব্যবস্থা করেছিলেন। দেনায় অনেকটা ডুবে আছেন ইন্দ্র নারায়ন। বছর দেড়েক  কেটে  গেল। বাড়ির ঠিক দাম না পেয়ে মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাই ভোলা যখন কিছুটা ভদ্রস্থ দাম অফার করলো রাজি হয়ে গেলেন।

বাড়ির চাকর হল বাড়ির মালিক। এই অপমানের জ্বালা সহ্য করতে পারলেন না সুভদ্রা। সেই কারণেই বোধ হয় রেজিস্ট্রেশনের দিন দশেক আগেই মারা গেলেন। বাড়ির দোতলায় তাঁর বসবাসের অংশটা খালি হয়ে গেল। এর নতুন বাসিন্দা হল ভোলা আর তার মা সুমিত্রা। চাইলে ভোলা সিংহ পরিবারের বাকিদের উৎখাত করতে পারত। সে তা করে নি। বরং বিনা ভাড়ায় যত দিন খুশি থেকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। এও এক লজ্জা। আদিত্য কলকাতায় থাকত না। স্বামী সৌম্য নারায়নের সঙ্গে সম্পর্কটা তলানিতে এসে ঠেকেছিল। সুধা তাই নিজের বাবার বাড়ি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। থেকে গেলেন শুধু সৌম্য নারায়ন আর ইন্দ্র নারায়ন।

সিংহবাহিনী পুজো কিন্তু বন্ধ হয় নি। বরং ধূমধাম একটু বেশিই হল। পুজোর সংকল্প হল সুমিত্রার নামে। ইন্দ্র নারায়ন সিংহ বংশের ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ তুলে মৃদু আপত্তি জানিয়ে ছিলেন। বিনম্রতার সঙ্গে ভোলা শুনিয়েছিল অপ্রিয় সত্যিটা।  বাড়িটাই তো আর সিংহদের নেই। পাড়ায় সিংহদের সম্ভ্রম আর প্রতিপত্তি ধাক্কা খেয়ে প্রায় চুরমার হয়ে গেল। ইন্দ্র নারায়ন ছিলেন পাড়ার পুজো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। কানা ঘুষো শোনা যাচ্ছিল ওনাকে সরিয়ে ভোলাকে প্রেসিডেন্ট করার চেষ্টা চলছে। পদত্যাগ করে তিনি নিজেই ভোলার নাম প্রস্তাব করলেন। বললেন মানুষের পরিচিতি তার কাজ বংশ নয়। ভোলা প্রেসিডেন্ট হল।

আদিত্য অবশ্য ধাপে ধাপে উন্নতি করেছে। অনেক কোম্পানিতে লিডারশিপ রোলে কাজ করেছে। ব্যস্ত মানুষ রোজগার অনেক কিন্তু সময় কম। সংসার আর দুই ছেলে মেয়ে সামলায় তার ব‌উ। কর্মস্থল কলকাতা নয়। তাই এই শহরে আসা হয় না বললেই হয়। তবে সিংহবাহিনী পুজোয় প্রতি বছর সপরিবারে আসে আর দিন কয়েক থাকে। ভোলাও এই পুজোয় সিংহ নিবাসেই থাকে। দুজনের দেখা হয়। সৌজন্য বিনিময় হয়। এবারে আদিত্য  সিংহবাহিনীর পুজোয় বাড়ি আসে নি। আসার ইচ্ছে তার ছিল না। কেননা বাড়িটা এখন ভোলার। সিংহ পরিবারের নয়। এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।

হায়দ্রাবাদে একটা টেকনোলজি কোম্পানিতে সিইও হয়ে দিব্যি ছিল আদিত্য। বহুজাতিক কোম্পানির ভারতীয় ইউনিট। হেড অফিস আমেরিকায়। আদিত্য জয়েন করে এদের ব্যবসা অনেক বাড়িয়ে ছিল। লাভের অঙ্কটাও লাফিয়ে ছিল। বিদেশি মালিকরা খুব খুশি ছিল। প্রোমোশন দিয়ে গ্লোবাল রোলে হেড‌অফিসে পাঠাবার কথাও চলছিল। এই সময় হঠাৎ তার পদস্খলন হল। ওর শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিল ওর‌ই এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি। আমেরিকার উর্ধ্বতন অফিসাররা তদন্ত করেছিলেন। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। কোম্পানির বদনাম বাঁচাতে ওনারা ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। রফাদফা হয়েছিল। মেয়েটা অভিযোগ তুলে নিয়েছিল। বিনিময় আদিত্যকে দিতে হয়েছিল মোটা অঙ্কের খেসারত। চাকরি থেকেও তাকে পত্রপাঠ বরখাস্ত করা হয়েছিল। 

কর্পোরেট জগতে উচ্চপদস্থ এক্সিকিউটিভদের আচরণের রসাল খবরগুলো গোপন থাকে না। বিজনেস মিডিয়াতে খবর ফাঁস হয়ে গেল। আদিত্য নতুন চাকরি খুঁজছিল। যোগ্যতা আর কর্মকুশলতা সন্দেহাতীত হলেও কোনো কোম্পানি ওকে নিতে চাইছিল না। কলকাতায় ফিরে এল। ভোলার বাড়ি সিংহ নিবাসে না এসে সপরিবারে দক্ষিণ কলকাতায় মামার বাড়িতে আশ্রয় নিল। তার মা সুধা ওখানেই থাকেন। মামারা কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিবার।

বিসিএচ বেশ বড় হয়ে গেছে। কুশলজির নিজের ব্যবসাও বেড়েছে। প্রবাসী নিবেশক প্রস্তাব দিলেন একজন দক্ষ সিইও নিয়োগ করা হোক। তিনি কলকাতায় এলেন। সিংহ নিবাসের দোতলায় ভোলার প্রাইভেট লাউঞ্জে ওনার সঙ্গে মিটিং হল। ভোলা ছিল কুশলজিও ছিলেন। ঠিক হল আদিত্যকে সিইও পদের প্রস্তাব দেওয়া হবে। ভোলা ওর সঙ্গে কথা বলবে।

ভোলা আদিত্যকে সপরিবারে দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন করেছিল। আদিত্য একটা অজুহাত দিয়ে বৌ বাচ্চা নিয়ে খেতে আসে নি। তবে ভোলার অনুরোধে একা বিকেলে চা খেতে এসেছিল। চপ আর চায়ের সাথে মিটিংটা হয়েছিল ভোলার প্রাইভেট লাউঞ্জে। কুশলজি উপস্থিত ছিলেন। বিসিএচ প্রাইভেট লিমিটেডের সিইও হল আদিত্য।  কোম্পানির বোর্ডকে রিপোর্ট করতে হবে আদিত্যকে। বোর্ডে তিনজন সদস্য। ভোলা, কুশলজি আর বিদেশনিবাসী নিবেশক।

ভোলার কোম্পানিতে চাকরি করবে আদিত্য! এই চরম লজ্জার খবরটা শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সৌম্য নারায়ন আর সুধা। বলেছিলেন এই চাকরি নেওয়ার চেয়ে গলায় দড়ি দেওয়া উচিত ছিল। আদিত্য কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে নি। আকর্ষণীয় মাইনে আর বোনাস ছাড়া বিসিএচ এ  সে দেখেছিল ভবিষ্যৎ।

আস্তে আস্তে সিংহ নিবাস সিংহ বিহীন হয়ে গেল। বিসিএচ প্রাইভেট লিমিটেডের হেড অফিস কলকাতায় সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভে। কোম্পানির তরফে সিইও আদিত্যকে বাংলো দেওয়া হল সল্টলেকে। সৌম্য নারায়ন হার্টের অসুখে হঠাৎ মারা গেলেন। সুধা নিজের বাবার বাড়িতেই পাকাপাকি থেকে গেলেন। ইন্দ্র নারায়ন ব্যবসা গুটিয়ে নিউ টাউনে একটা ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেলেন। তিনি অবসর জীবনের অলসতায় ডুবে নিউটাউন বিজনেস ক্লাবে মদ খেয়ে আর ব্রিজ খেলে সময় কাটাতে লাগলেন। 

আদিত্য ব্যবসা খুব ভাল বাড়িয়েছিল। সারা ভারতের বড় শহরগুলোতে বিসিএচ ছেয়ে গিয়েছিল। একটা দেশি আর একটা বিদেশি কোম্পানি চড়া দামে  বিসিএচ কিনে নেবার প্রস্তাব দিয়েছিল। বিসিএচ এর বোর্ড রাজি হয় নি। আদিত্যের স্বপ্ন ছিল বিসিএচ এক বহুজাাতিক সংস্থা হবে। এই স্বপ্ন চরিতার্থ করতে সে নিরন্তর পরিশ্রম করত।

সম্পর্কে মনিব আর চাকরের বিভেদ আর ছিল না। আদিত্য আর ভোলা হল পরষ্পরের বন্ধু। সমবয়সী হয়ে আর এক বাড়িতে থেকেও ছোটবেলা যা সম্ভব হয় নি।

গল্প

বিশ্বাস

স্বাতী দে

ওয়েষ্ট পিনাট হিলস, অস্ট্রেলিয়া 

বিশ্বাস
rainy-day-2-ibolya-taligas.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

SwatiDey.jpg

মুখার্জী বাড়ির একমাত্র ছেলের বৌ কবিতা বিয়ে হয়ে এসে থেকে দেখছে মালতীকে। বয়স কুড়ির আশেপাশে, লম্বা, প্রাণবন্ত মেয়েটি মুখার্জী বাড়ির বিশ্বাসী কাজের লোক। মালতীর মা আগে এ বাড়িতে কাজ করত। মালতী তখন ছোট ছিল, মার হাত ধরে মুখার্জী বাড়িতে আসত। মাঝে মাঝে মাকে সাহায্য করত এটা সেটা হাতে হাতে করে দিয়ে। দেখতে দেখতে বড় হল মালতী। অভাবের সংসারে ঠিক যেমনটি হয়! রাতারাতি মালতী ফ্রক ছেড়ে শাড়ি, মার পিছু পিছু ঘুরে বেড়ান ছেড়ে ফুল টাইম কাজের লোক। মালতীর মা মালতীকে মুখার্জী বাড়ির  কাজে লাগিয়ে নিজে একটু ঝাড়া হাত পা হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার কপালেও সেই সুখ বেশিদিন টিকলো না। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই মালতীকে একা রেখে এই জীবনের মায়া কাটালেন তিনি। 

মালতী সেই থেকে লোকের বাড়ি কাজ করে একা একাই নিজের জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। মুখার্জী বাড়িতে সবাই ওকে ছোট থেকে দেখে এসেছে, তাই ওকে সবাই একটু অন্য চোখে দেখে, ঠিক কাজের মেয়ের মত নয়। ওর আপদে বিপদে সব সময় কবিতা দেখেছে ওর শ্বশুরবাড়িতে সবাই ওকে সাহায্য করে। 

সৌমেন মুখার্জী বাড়ির একমাত্র ছেলে। পেশায় উকিল। হাই কোর্টের স্বনামধন্য উকিল সুদর্শন মুখার্জীর ছেলে আর কী বা হতে পারে! কবিতা আর সৌমেনের বিয়ের প্রায় তিন বছর পর কবিতা মা হতে চলেছে। বাড়িতে সবাই খুব খুশি। তবে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছে মালতী। কবিতার জন্য যেন ওর চিন্তার শেষ নেই। সারা দিনের শেষে সবার বাড়ির কাজ হয়ে গেলে ও এসে কবিতার পা টিপে দেয়, ওকে পুদিনা পাতা দিয়ে স্পেশাল চা বানিয়ে খাওয়ায়। এরপর কবিতার মেয়ে দিশার জন্মের পর ওর দেখাশোনা করার জন্য একজন লোকের প্রয়োজন হয়। মালতী অন্য বাড়ির কাজ ছেড়ে মুখার্জী বাড়িতেই থেকে যায় দিশাকে দেখাশোনা করার জন্য। 

দেখতে দেখতে মালতীর জীবনেও বসন্ত এল। আর আসবে নাই বা কেন? কুড়ি বছরের উপচে পড়া যৌবন, শুধুই কি অর্থের অভাবে ব্যর্থ যাবে! তাই সঙ্গী জুটাতেও বেশি সময় লাগলো না। কিছুদিন পর এসে কবিতাকে বলল, “দিদিমনি আমার এক সপ্তাহের ছুটি চাই।“

কবিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন রে, তুই এক সপ্তাহ বাড়িতে বসে কী করবি? আর তুই চলে গেলে আমাদের যে কত অসুবিধা হবে সে খেয়াল আছে তোর? দিশা তো তুই না থাকলে খাওয়া দাওয়াই করবে না।”

“না দিদিমনি, আমাকে ছুটি দিতেই হবে। আমি বিয়ে করব, তাই ঘর-দোরগুলো একটু গুছ-গাছ করতে হবে যে।“

কথাটা শুনে কবিতা একটু অবাক হল, তবে খুশি হল অনেক বেশি। তারপর ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে একটা নতুন শাড়ি এনে মালতীকে দিয়ে বলল, “এই নে, এটা তোর বিয়ের উপহার। তবে এক সপ্তাহের বেশি ছুটি নেওয়া চলবে না কিন্তু। তোকে ছাড়া দিশাকে নিয়ে একা হাতে আমি সবকিছু সামলাতে পারবো না, সেটা তো তুই জানিস।“

“না দিদিমনি, আমি সময়মত ঠিক চলে আসব। তাছাড়া, দিশাকে না দেখে থাকতে কী আমার ভাল লাগবে?”

সেদিন মালতী কাজ শেষে হাসি মুখে শাড়িটা নিয়ে বাড়ি চলে গেল। বিয়ে করে দিন সাতেক পর আবার যথারীতি কাজে ফিরে এল। নতুন বিয়ের পর সব মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। মালতীকেও দেখাচ্ছে। মালতী একটা লাল রঙের ছাপা শাড়ি পরে এল মুখার্জী বাড়িতে কাজ করতে। অভাব এখনও ওর সব সৌন্দর্য কেড়ে নিতে পারে নি। 

দেখতে দেখতে বছর ঘুরল। মালতী মা হল। ছোট্ট মেয়ে মীনাকে কোলে নিয়েই মুখার্জী বাড়ির কাজে আসত মালতী। টাকা রোজগার না করলে বাচ্চাকে খাওয়াবে কী? মুখার্জী বাড়িতে দিশাকে দেখাশোনার ফাঁকে ফাঁকে নিজের মেয়েটাকেও বড় করে তুলছিল মালতী। দিশার পুরনো জামাকাপড় আর খেলনা ব্যবহার করে মীনা বেশ ভালই বড় হচ্ছিল। 

কবিতার শ্বশুরমশাই সুদর্শন মুখার্জীর চাকুরী জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। সারাদিন বারান্দায় চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়েন, আর মাঝে মাঝে মালতীকে ডেকে চা বানাতে বলেন। মীনা কে দেখলে আজকাল উনার খুব কষ্ট হয়। মনে মনে ভাবেন মীনা একটু বড় হলে ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। ওদের এই তিন পুরুষের দাসী বৃত্তি উনার আর দেখতে ভাল লাগে না। 

সুদর্শন মুখার্জী সেদিন মালতীকে ডেকে বললেন, “দেখ মালতী, তোর মা আর তুই আমাদের বাড়িতে কাজ করেছিস ঠিক আছে, কিন্তু আমি মীনাকে আর লোকের বাড়ি কাজ করতে দেব না। তুই ওকে লেখাপড়া শেখাবি।“

মালতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু বাবু সে তো অনেক খরচ, আমি এত টাকা কোথায় পাবো?”

“তোকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। সেই চিন্তাটা আমাকেই করতে দে। মীনা একটু বড় হলে আমি ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেব।“ 

এইভাবেই আরো কয়েক মাস কাটল। হঠাৎ একদিন মালতী কাজে এল না। মুখার্জী বাড়িতে সবাই ভাবল, “হয়তো কোন অসুবিধা হয়েছে, নাহলে মালতী তো কখনো এমনি ছুটি নেয় না।“

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল, কিন্তু মালতী আর কাজে এল না। মালতীর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল মালতী ওর বর আর বাচ্চাকে ফেলে রেখে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছে। মুখার্জী বাড়িতে সবাই খুব কষ্ট পেল খবরটা শুনে। মালতীকে ওরা ছোট থেকে দেখেছে। মালতী যে এরকম একটা কিছু করতে পারে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি। 

কবিতা রেগে গিয়ে বলল, “মালতী শুধু পালিয়েই যায় নি, ও আমাদের বিশ্বাসটাকেও সাথে করে নিয়ে গেল। এরপর তো আর কাউকে বিশ্বাসই করা যাবে না।“ 

সৌমেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সুদর্শনবাবু মুখ খুললেন। তাই সৌমেন কিছু না বলে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলো। 

সুদর্শন বাবু বললেন, “একতরফা শুনে কোনো মানুষকে বিচার করাটা বোধ হয় ঠিক না, বৌমা। কি যেন কেন, আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা গোলমাল রয়েছে। নাহলে মালতী ওর মেয়েটির কথা একবারও ভাববে না, সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। ও তো মীনাকে খুব ভালোবাসে।“

কবিতা ওর শ্বশুরের সাথে একমত হতে পারল না, তবে আর তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করেই রইলো। কবিতা জানে সুদর্শন বাবুর সাথে কোর্ট রুমে নামী দামী উকিলরাও তর্কে পেরে ওঠে না। তাই কবিতা সে দুঃসাহস দেখায় না। 

এরপর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে। মুখার্জী বাড়িতে নতুন কাজের লোক বহাল হয়েছে। মাঝে কানা-ঘোষা শোনা গিয়েছিল মালতীর বর ওকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর মালতী কোথায় গেছে, কেউ জানে না। কালের স্রোতে ঠিক যেমন টা হয়, মালতীকে সবাই ভুলে গেছে।

আজ হঠাৎ সুদর্শনবাবু রোজকার মত প্রাতঃভ্রমণে বেরোনোর সময় গেট খুলতেই দেখতে পেলেন একটা বাচ্চা মেয়ে গেটের বাইরে মাটির উপর শুয়ে আছে। রাতে বেশ ঠাণ্ডা ছিল। মেয়েটির গায়ে শুধু একটা জামা ছাড়া আর কিছুই নেই। গেট খোলার শব্দেই হয়তো মেয়েটির ঘুম ভেঙে গেছে। মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে উঠে বসল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও ঠাণ্ডায় কাঁপছে। আর কথা না বাড়িয়ে সুদর্শনবাবু মেয়েটিকে নিয়ে ভেতরে এলেন। ভেতরে ঢুকেই সুদর্শনবাবু হাঁকাহাঁকি শুরু করলেন, “তোমরা সবাই কোথায়? বৌমা একটু বাইরে আসবে?”

এত সকালে উঠে শ্বশুরমশাই এরকম চিত্কার শুরু করলেন কেন বুঝতে না পেরে হন্তদন্ত হয়ে কবিতা নিচে নেমে এসে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে বাবা? আজ আপনি হাঁটতে যাননি?”

“হাঁটতেই তো যাচ্ছিলাম, কিন্তু যেতে আর পারলাম কোথায়?”

“কেন কি হয়েছে?”

“দেখছ না এই মেয়েটিকে? গেট খুলে দেখি গেটের বাইরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সারারাত এই ঠাণ্ডার মধ্যে গেটের বাইরে শুয়ে ছিল।“ তারপর একটু ভেবে আবার বললেন, “ওকে গরম জামা-কাপড় কিছু দাও তো। আর একটু কিছু খেতে দাও। মনে হয় কাল থেকে ওর পেটে কিছু পড়েনি।“

এতক্ষণে কবিতার চোখ পড়ল মেয়েটির দিকে। মেয়েটিকে ডেকে বলল, “তুই এই সিঁড়িতে এসে বস। আমি তোর জন্য গরম জামা-কাপড় নিয়ে আসছি।“ বলেই ছুটে গিয়ে উপর তলা থেকে দিশার আলমারি থেকে ওর কিছু গরম পোশাক নিয়ে এল। “এই নে, আগে এগুলো পড়ে নে। ঠাণ্ডায় যে একেবারে জমে গেছিস। আমি তোর জন্য খাবার আনছি।“ মেয়েটি হাত বাড়িয়ে জামা গুলো নিতে গেলে কবিতা এবার ভাল করে মেয়েটির মুখটা দেখতে পেল। কবিতা অবাক হয়ে বলে, “কি রে, তুই মীনা না? মালতীর মেয়ে, মীনা?” মেয়েটি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। 

এতক্ষণে সুদর্শনবাবুও পাশে এসে দাঁড়িয়ে ভাল করে মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “তাই তো, বৌমা।“ তারপর মেয়ে টির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি রে মীনা, তুই এভাবে সারারাত বাড়ির বাইরে শুয়েছিলি কেন? ভেতরে এসে আমাদের ডাকিস নি কেন?”

মীনা কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমার মা আমাকে খুব মারে। কাল রাতে আমাকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।“

“তোর মা কোথা থেকে এল? মালতী তো কবেই তোদের ছেড়ে চলে গেছে, সে কি আবার ফিরে এসেছে নাকি?” কবিতা গলার স্বরে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিন বছর আগের রাগ এখনও কমেনি।  

“না, আমার মা কে তো বাবা মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর আবার একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। সেই মা আমাকে খুব মারে, সব কাজ করায়। আমি কিছু ভুল করে ফেললে আমাকে খেতে না দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখে।“

“এরা কি রকম মানুষ রে বাবা? এদের শরীরে কি মায়া-দয়া বলে কিছু নেই?” এবার কবিতার গলা শুনে মনে হল রাগ অনেকটাই কমেছে। 

“কাল রাতে আমাকে খুব মেরেছে। তারপর আমাকে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।“ কথাগুলো বলতে বলতে মীনা কাঁদতে লাগলো। একটু থেমে আবার বলল, “অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে শেষে দাদুর কথা মনে পড়ল। তাই তোমাদের বাড়ির দরজায় এসে বসেছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, মনে নেই।“

সুদর্শন মুখার্জীর মনটা খারাপ হল। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, “আমি মালতীকে একদিন কথা দিয়েছিলাম মীনার পড়াশুনার ভার আমি নেব। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল। মালতী যে কোথায় উধাও হয়ে গেল, কেউ তার কোনো খবর পেল না। কিন্তু আমি তো আর কখনো মীনার কোনো খোঁজ খবর নেই নি। আমার একটা বড় ভুল হয়ে গেছে।“ 

এই সব কথার ফাঁকে বাড়ির সব লোকজন এসে হাজির হয়েছে। সৌমেন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নীচে নেমে এসে এই সব ঝামেলা দেখে যে একেবারেই খুশি নয় সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হল না। কবিতাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল,

“এই মেয়েকে কিছু জামা-কাপড় আর টাকা দিয়ে এক্ষুনি বিদায় কর। এদের আমি আর বিশ্বাস করি না।“ 

“দাড়াও, আস্তে কথা বল, বাবা শুনতে পাবে।“ কবিতা এই সাত সকালে কোনো রকম ঝামেলা করতে চাইছে না। 

“বাবা শুনতে পেলেই বা কি? মনে নেই ওর মা কি করেছে? আদর যত্ন করে এ বাড়িতে রেখে, শেষে কিনা .....। ছি ছি ছি!”  

কবিতা চেষ্টা করেও সৌমেনকে চুপ করাতে পারল না। আর সুদর্শন মুখার্জী পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের সব কথাই শুনতে পেয়েছেন। তাই এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“দেখ সৌমেন, আমি তোমাদের সেদিনও বলেছিলাম, আমরা মালতীর জীবনের সত্যটা জানি না। আবার আজও তোমাদের বলছি, এই মেয়েটি সত্যি কথাই বলছে। পৃথিবীর সবাই খারাপ নয়। আমরা যদি মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি তাহলে বাঁচবো কি নিয়ে বলো তো?”

তারপর মীনার দিকে ফিরে সুদর্শনবাবু বললেন, “আমি তোর মা কে একদিন কথা দিয়েছিলাম তোকে পড়াশুনা শেখাবো। আয়, আজ থেকে তুই এই দাদুর সাথেই থাকবি। আমি তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে তুলব। পড়াশুনা শিখলে কেউ কখনো তোর গায়ে হাত তুলতে পারবে না। আজ যারা তোকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছে, একদিন দেখবি তারাই এসে তোর কাছে ক্ষমা চাইবে।“ 

মুখার্জী বাড়ির সবাই জানে সুদর্শন মুখার্জী ‘এক কথার মানুষ’। তিনি যখন একবার বলেছেন, এ কথার আর নর চর হবার জো নেই। তাই সবাই মীনাকে মনে না নিলেও, এই বাড়িতে মেনে নিল।   নিচ তলায় বাসন্তী মাসির ঘরে মীনার থাকার ব্যবস্থা হল। দিশার পুরনো জামা-কাপড় পড়ে, বাড়িতে সবার হাতে হাতে ফুট-ফরমাশ খেটে মীনার দিন কাটছিল। কিন্তু তারই মধ্যে সুদর্শনবাবু ওর মধ্যে শিক্ষার আগুন জ্বালিয়ে দিতে লাগলেন। মেয়েটি পড়াশুনায় বেশ ভাল। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কাজকর্ম করে রাতে একা একা পড়তে বসে। এই সময় কাজের কথা বলে ওকে কেউ বিরক্ত করে না। এই সময় টুকু ওর একান্তই নিজের। 

দেখতে দেখতে পনেরটা বছর কেটে গেল। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে মীনা এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। দাদুর মত ওর উকিল হবার ইচ্ছে। সময় পেলে সুদর্শনবাবুর সাথে বসে গল্প করে, বড় হয়ে ও একদিন হিউম্যান রাইট্স ল-ইয়ার হবে। সমাজের গরীব, অবহেলিত আর বঞ্চিত মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, ঠিক যেমনটি ওর দাদু ওর পাশে দাঁড়িয়েছে।  

সুদর্শনবাবু মীনাকে নিজের নাতনীর মতই ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। যদিও দিশার সাথে উনার সম্পর্কটা ঠিক মীনার মত নয়। দিশাও এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তবে ওর সময় নেই দু’দন্ড দাদুর সাথে বসে গল্প করার। দিশা সারাদিন পার্টি করে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে কাটায়। মধ্য রাতে সবার বারণ সত্ত্বেও সিগারেট খেয়ে, মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে। সৌমেন বা কবিতা কারো কথাই শোনে না দিশা। বাবার অঢেল সম্পত্তির একমাত্র দাবিদার দিশা জানে ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে এভাবে টাকা নষ্ট করলেও ওর কখনো টাকার অভাব হবে না। 

কিন্তু মীনা তো মুখার্জী বাড়ির সবার দয়ায় বড় হচ্ছে। তাই ছোট থেকেই সময় আর টাকা, দু’টোর মূল্যই বুঝতে শিখেছে ও। ছোট থেকেই টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই উপার্জন করতে শুরু করেছে। ইউনিভার্সিটিতে এখন স্কলারশিপ পাচ্ছে। ওর স্কলারশিপের সব টাকা সুদর্শনবাবুর হাতে তুলে দেয়। দাদু ওর কাছে ভগবান। ও জানে দাদু না থাকলে এতদিনে হয়তো ওকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে হত।  

আজ রবিবার, ছুটির দিন। সবাই বাড়িতে, একমাত্র দিশাই বাড়িতে নেই। রাত এগারোটা নাগাদ বাড়িতে ফোন এল। সবাই তখনও জেগেই আছে, দিশার অপেক্ষায় বসে আছে। সৌমেন ফোনটা ধরল, “হ্যালো, কে বলছেন?”

“আমি দীপ্ত বলছি, আঙ্কেল, দিশার বন্ধু।“

“তা এত রাতে? দিশা কোথায়?”

“দিশার মোটর বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ওকে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করেছি। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন, আঙ্কেল।“ একটু থেমে দীপ্ত আবার বলল,

“আঙ্কেল, ডাক্তার বলেছেন দিশাকে এক্ষুনি রক্ত দিতে হবে। কিন্তু ওর গ্রুপের ব্লাড এখানের ব্লাড ব্যাংকে নেই।“

“দেখছি আমি কি করতে পারি,” বলে সৌমেন ফোনটা রাখতেই চারদিক থেকে সবাই দিশার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল। 

“সৌমেন সংক্ষেপে সব জানিয়ে বলল আমাকে এখনই রক্ত যোগাড় করতে বেরোতে হবে, সেখান থেকেই আমি হাসপাতালে চলে যাবো। কিন্তু বি-নেগেটিভ ব্লাড তো খুব সহজে পাওয়াও যাবে না।“ সৌমেনকে রীতিমত চিন্তিত দেখাচ্ছে। 

তখনই মীনা এগিয়ে এসে বলল, “কাকু আমাকে নিয়ে চল। আমি ব্লাড দেব।“

“কিন্তু তুই দিলে তো হবে না। বি-নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাড চাই যে।“ একটা বাচ্চাকে বোঝানোর মত করে সৌমেন কথাটা বলল। 

“আমার ব্লাড গ্রুপ বি-নেগেটিভ।“ বেশ দৃঢ়তার সাথে মীনা বলল। 

সবাই অবাক হয়ে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “তুই জানলি কি করে?”

“কেন, আমি তো গত বছর কলেজের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে রক্ত দিয়েছি। আমি জানি।“ 

এরপর সৌমেন আর কথা না বাড়িয়ে মীনাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। রক্তটা সাথে সাথে দিতে পারায়, সে যাত্রায় দিশাকে বাঁচিয়ে তোলা গেল। 

পরদিন সকালে সুদর্শনবাবু আর সৌমেন হাসপাতালে এসে দেখতে পেল দিশা আর মীনা দুজনকেই একই ঘরে পাশাপাশি বেড-এ শুইয়ে রাখা হয়েছে। আসলে মীনা অনেকগুলো রক্ত দিয়ে একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারের পরামর্শ মত ওকে হাসপাতালে অবসারভেশনে রাখা হয়েছিল। এখন দুজনই ভাল আছে।   

সুদর্শনবাবু মীনার মাথায় হাত রেখে বললেন, “দিদিভাই, তুই আজকে আমায় জিতিয়ে দিলি। আমি তোকে বিশ্বাস করে ঠকিনি। বিশ্বাসই মানুষকে বাঁচার রসদ দেয়।“

সৌমেন এবার বাবার কাছে এসে বলল, “বাবা, সেদিন তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। আর তাই আজ আমি একটা নয়, দুটো মেয়েকে ফিরে পেলাম। আজ থেকে মীনার সব দায়িত্ব আমার।“

গল্প

লঞ্চ-রহস্য

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা 

sea.jpg
লঞ্চ-রহস্য

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Rudrajit Paul.jpg

শেরার দিন। স্ট্র্যান্ড রোডে এক ছোট জেটিতে বেশ ভিড়। একটা সুসজ্জিত লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে, লঞ্চের সারা গায়ে আলো দিয়ে সাজানো; যাত্রীরা উঠছে। এই জেটি বাবুঘাট আর শিপিং কর্পোরেশান ঘাটের মাঝখানে, একটা পুরনো গুদামের পাশে। আগে খুব সম্ভবত এটা ছিল একটা বড় কারখানার নিজস্ব ফেরির ঘাট। সরাসরি গঙ্গা দিয়ে মালপত্র আসত কারখানার ওয়ার্কশপে। কিন্তু বছর পনেরো হল সেই কারখানা উঠে গেছে। মালপত্র নেওয়ার লঞ্চ আর এদিকে আসে না। ফলে ফেরিঘাটের লোহার কাঠামো দাঁড়িয়ে ছিল এক প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কালের মত। সম্প্রতি এক বেসরকারি টুরিস্ট কোম্পানি এই ফেরিঘাট কিনে নিয়ে প্রমোদভ্রমণের ব্যবসা চালু করেছে। ওদের রয়েছে ছোট ছোট লঞ্চ। সেই লঞ্চগুলি সুন্দর করে সাজিয়ে তার ওপর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, তার সাথেই থাকে কোনো উঠতি গায়কের “লাইভ” গান। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় ঘাট থেকে ছাড়ে লঞ্চ, তারপর নদীর ওপর ঘুরে বেড়ায় ঘণ্টা পাঁচেক। প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে আবার ফিরে আসে ঘাটে। 
খুব জনপ্রিয় হয়েছে এই নতুন পরিষেবা। সন্ধ্যেবেলা গঙ্গার বুকে একটু হাওয়া খাওয়া, গান শোনা, আর সেই সাথে বিশেষ কুইজিনের হাতছানি। আজকাল অনেকেই এই লঞ্চের ভ্রমণে উৎসাহী। যাই হোক, সেই দশেরার দিনে ছোট্ট লঞ্চ, “প্রবালকন্যা”তে বেশ ভিড়। ঘাটে ঝালমুড়ি বিক্রি করে রবি পাসওয়ান। এক যাত্রী লঞ্চে ওঠার আগে তার স্টলে খাচ্ছিলেন। উনি প্রশ্ন করেন, “রোজ এরকম ভিড় থাকে নাকি?”
রবি মাথা নাড়ে, “রোজ নয়। আজকে দেখছি পুরো হাউস্ফুল! আশিসদার কপাল ভাল।“
আশিসদা মানে আশিস পাত্র। এই টুরিস্ট কোম্পানির মালিক। উনিই এই ফেরিঘাট কিনে লঞ্চের ভ্রমণ চালু করেছেন। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশেই। বোধহয় লঞ্চের ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলছিলেন আর বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলেন। রবি ঘাড় নেড়ে দেখাল, “উনি আগে এখানে রাস্তায় কাপড় বিক্রি করতেন। এর এখন দেখুন………”
সেই যাত্রী ভদ্রলোক তাকিয়ে দেখলেন। “ব্যবসা ভালোই চলছে তার মানে?”
“খুব ভালো নয়। এই বছর তো একদমই চলেনি। কিন্তু আজকে সব লস পুষিয়ে যাবে।“ বলে রবি গলা তুলে জিজ্ঞাসা করে, “আশিসদা, এক ঠোঙ্গা ঝালমুড়ি দেব?”
আশিস পাত্র ফিরে তাকাল, “না রে রবি। আজকে থাক। রাত্রে মায়ের পুজো আছে বাড়িতে। এখন উপোষ।“
ইতিমধ্যে সেই যাত্রীর স্ত্রী এদিকে এগিয়ে এলেন, “কি হল? তুমি উঠবে না? লঞ্চ তো ছেড়ে দেবে।“ ভদ্রলোক মুড়ি খেতে খেতে বললেন, “আরে দাঁড়াও। এত লোক ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। ছেড়ে দিলেই হল? সরো সরো!” এই শেষ কথাটা বলার কারণ একটা বিশাল গাড়ি ঘাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রায় লোকের গা ঘেঁষে। রাস্তায় চারিদিকে যে দুর্গাপূজার আলো সাজানো, সেই আলো গাড়ির গায়ে যেন পিছলে যাচ্ছে। এক দামী শেরওয়ানি পরা ব্যক্তি নেমে এলেন গাড়ি থেকে। উনি নামতেই আশিস পাত্র এগিয়ে এলেন। বোঝা গেল যে এর জন্যই উনি বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলেন। সেই ব্যক্তির সাথে করমর্দন করে তাকে নিয়ে চললেন লঞ্চের দিকে। সঙ্গে ক্যাপ্টেন আর লঞ্চের নিরাপত্তারক্ষী। অন্য সব যাত্রীকে সরিয়ে সেই ব্যক্তিকে তুলে দেওয়া হল লঞ্চে। 
রবির দোকানে তখন আরও দু-তিনজন খদ্দের। রবি হাত চালাচ্ছে। এমনি দিনে এই ঘাটে লোক থাকে না। সারা সন্ধ্যে জুড়ে দশটা খদ্দের হয় কিনা সন্দেহ। আজকে দশেরার দিন স্পেশাল ট্রিপ। টুরিস্ট ভর্তি। পুজোর শেষ দিনে এত বিক্রি হওয়ায় রবি খুব খুশি। একজন খদ্দের সেই গাড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কে এলেন ইনি? চেনা চেনা লাগছে!”
রবি একবার সেইদিকে তাকিয়ে বলে, “আরে চিনলেন না? উনি তো রাকেশ দাগা।“
একজন বলে, “মানে সেই বিজনেসম্যান?”
রবি বলে, “আরে বিজনেসম্যান মানে? কলকাতার সব ব্যবসায়ীর বাবা। সুন্দরম মার্কেটের মালিক।“
খদ্দেররা ফিরে ফিরে দেখতে থাকে। সুন্দরম মার্কেট কয়েক বছর ধরে চালু হওয়া পার্ক স্ট্রীটের এক বিশাল শপিং মল। পাওয়া যায়না, এরকম জিনিস নেই। পার্ক স্ট্রীটের এক দিকের প্রায় একচতুর্থাংশ দখল করে নিয়েছে এই মল। সারাদিন ক্রেতা উপচে পড়ে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের “হ্যাংআউট” করার এক জনপ্রিয় কেন্দ্র এই মল। 
আরেকজন পাশ থেকে বলে, “মানে লঞ্চের মালিকের আজকে দশেরার ব্যবসা ভালোই হবে বল। এরকম ব্যবসায়ী আজকের দিনে যাচ্ছেন মানে তো ওনার জন্য স্পেশাল রেট!”
এদিকে মিঃ দাগা লঞ্চে উঠে একটা নীল আলো দেওয়া কেবিনে ঢুকতেই মাইকে ঘোষণা শুরু হল, “আমরা অবিলম্বে লঞ্চ ছাড়ব। সবাই উঠে আসুন।“
একজন বয়স্ক যাত্রী বিরক্ত ভাবে বলল, “এই হল আমাদের দেশের প্রবলেম। সেলিব্রিটি দেখলেই সবাই নিয়ম ভুলে যায়। আমরা যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কেউ ছাড়ার কথা বলেনি। আর এখন স্পেশাল যাত্রী এসে যেতেই তাড়াহুড়ো।“ এই বলে উনি হাতের চায়ের কাপ গঙ্গার জলে ছুঁড়ে দিয়ে লঞ্চের দিকে রওনা হলেন। আরেকজন কেউ ভিড়ের মধ্যে চীৎকার করে বলল, “দাদা, এখন ঝালমুড়ি খেয়েই পেট ভরাবেন নাকি? রাতে লঞ্চে তো বিরিয়ানি আছে শুনলাম!” কাকে বলল, কে জানে? 
আস্তে আস্তে ঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। চায়ের দোকানদার আসলাম রবিকে বলে, “কি গো? ভালো বিক্রি হল?”
রবি মাথা নাড়ে। আসলাম আবার বলে, “আজকে এই ট্রিপে স্পেশাল একটা আইটেম আছে জানো?” রবি ওর দিকে তাকাল। “কী? কেউ গান করছে?” 
“না। আজকে গান নেই। তার বদলে লঞ্চ নাকি কিছুক্ষণ পরে খিদিরপুরের দিকে যাবে। ওখানে গঙ্গার ধারে কোন একটা মাঠে বিশাল রাবণ পোড়ানো হয়। সেই সাথে মাঠ জুড়ে লেজার শো। লঞ্চ থেকে সবাই সেই দৃশ্য দেখবে। তারপর ফিরবে।“ রবি হেসে বলে, “বাবুদের নানা শখ। এইসব আমরা ছোট থেকেই দেখছি।“
আসলাম বলে, “জানো, আমি লঞ্চের গার্ডকে বলেছিলাম আমাকে টুক করে তুলে নিতে। এই একটু আগে। গার্ড মানে বুঝেছ তো? আমাদের সেই দত্তদা। এই যে দেখলে, রাকেশ দাগাকে নিয়ে লঞ্চে উঠল। রাজিও হয়েছিল। কিন্তু যখন ওকে বলছিলাম, হঠাৎ করেই দুজন টুরিস্ট সেটা শুনে দারুণ আপত্তি করল। বলল, বাইরের কাউকে নেওয়া যাবে না।“
রবি বলল, “তুই দুঃখ করিস না। পরে তোকে দেখাব ওই শো। আজকে দশেরার দিন আশিসদা সব বেশি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে। যারা সেইসব কিনেছে, সবাই চড়া মেজাজের লোক। এদের সঙ্গে যেতে হবে না।“ 
এইসময়ে দেখা গেল দুটি তরুণ ঘাটে দাঁড়িয়ে লঞ্চের ক্যাপ্টেনের দিকে হাত নাড়ছে। ক্যাপ্টেন বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী হল?”
“স্যার একটু দাঁড়ান। আমাদের এক বন্ধু, রনি, আসছে। প্রায় এসে গেছে। আর এক মিনিট।“
ক্যাপ্টেন বিরক্ত মুখে বললেন, “আমাদের গেস্টরা আর অপেক্ষা করতে চাইছেন না। তাড়াতাড়ি করুন।“
রবি আসলামকে বলে, “আজকাল, বুঝলি, কেউ আর সময় মেনে আসে না। সবাই লাটসাহেব। আগে দেখতাম ফেরিঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ে ঘড়ি ধরে। যে আসতে দেরি করে, সে পরের লঞ্চে যায়। আর এখন দেখ। লোকে লঞ্চকে দাঁড় করিয়ে রাখে।“
যাই হোক, সেই বন্ধু অবশেষে এল। রোগা একটা ছেলে। এক কানে দুল। হাতে বিশাল ট্যাটু। একটা বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে গেল লঞ্চে। রবি আবার বলে, “তিন ঘণ্টার জার্নি। তার জন্য ব্যাগ এনেছেন বাবু সাত দিনের। লঞ্চে কী বিছানা পেতে শোবেন নাকি?”
একটা বেশ বড় ঠাকুর দেখতে বেরনো দল হেঁটে যাচ্ছিল ঘাটের পাশ দিয়ে। এই লঞ্চ দেখে দুজন এগিয়ে এল। আশিস পাত্র তখন ঘাটের গেট বন্ধ করছিলেন। গেটের ওপর ব্যানার টাঙ্গানোঃ দশমীর স্পেশাল গঙ্গা সফর। সেই ব্যানার দেখে সেই দলের একজন ওনাকে জিজ্ঞাসা করল, “লঞ্চে করে গঙ্গার ঘোরাচ্ছেন?”
আশিস তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ। কিন্তু বুকিং শেষ। আমরা এখন ছাড়ছি।“
“দেখুন না। একটু জায়গা হবে না। এই আমাদের পাঁচ জনের?”
আশিস পাত্র লঞ্চের দিকে তাকাল। লঞ্চের ওপর তখন যাত্রীদের ভিড়। উনি মাথা নাড়লেন। “সরি। আজকে নয়। কিন্তু আমাদের এই সার্ভিস রোজ হয়। আপনি আমাদের ওয়েবসাইট দেখে নেবেন।“ সেই দলের একজন বলল, “আমরা অনলাইনে বুক করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রথম থেকেই আপনাদের সব সীট ফুল দেখাচ্ছিল।“ আশিস পাত্র কিছু বললেন না। সত্যিই এই দিনের সফরের সব টিকিট এক-দুদিনের মধ্যে বুক হয়ে গিয়েছিল। 
অবশেষে লঞ্চ ছাড়ল। ধীরে ধীরে মাঝ গঙ্গার দিকে চলে গেল লঞ্চ। ওপরের কেবিন থেকে লাল-নীল আলো এসে পড়ছে গঙ্গার জলে। গঙ্গার উল্টো দিকের ঘাটে অনেক জায়গায় এমনিতেই পুজোর জন্য আলো দিয়ে সাজানো। সব মিলিয়ে গঙ্গার জল হয়ে উঠেছে রঙিন। রবি এবং তার মত আরও কয়েকজন হকার দোকান বন্ধ করে চলে গেল।
আশিস পাত্র গাড়িতে ওঠার আগে একবার শেষবার গঙ্গার ওপর নিজের লঞ্চের দিকে তাকালেন। তারপর কী একটা মনে পড়ায় ফোন বার করে ফোন করলেন, “হ্যালো, শিবাজি?” শিবাজি কাঁড়ার হল লঞ্চের ক্যাপ্টেন, “রান্নাঘরের দিকে খেয়াল রেখ। আর মিঃ দাগার যেন কোনও অসুবিধা না হয়। তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখো।“ শিবাজি উত্তর দেয়, “স্যার চিন্তা করবেন না। আপনি বাড়ি গিয়ে পুজো করে নিন।“ 
……………………………………

পরের দিন সকালে আশিস পাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন বেশ দেরি করে। দশমীর দিন উনি বাড়িতে একটা বিশেষ পুজো করেন। সেই করে শুতে শুতে প্রায় রাত তিনটে। ফোন চার্জ দেওয়া হয়নি। উনি হাতে নিয়ে দেখলেন ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ফোন চার্জে বসালেন। কালকের ট্রিপের খবর নিতে হবে। লঞ্চটার একদিকে একটা ফাটল কাল রাতেই দেখেছেন। সেটার জন্য মিস্ত্রি ডাকতে হবে। উনি দাঁত মাজতে মাজতেই ফোন বেজে উঠল। “কী গো আশিসদা। এতবার ফোন করছি। ফোন বন্ধ করে রেখেছ কেন?” অনির্বাণ প্রায় চীৎকার করে ওঠে। 
“আরে ফোন অফ হয়ে গিয়েছিল।“ অনির্বাণ হল কোম্পানির সেক্রেটারি। আশিস পাত্র যেমন ব্যবসার দিকটা দেখেন, তেমন অনির্বাণ দেখে মার্কেটিং আর অ্যাকাউন্টস। 
“কী হয়েছে তোর? এত চীৎকার করছিস কেন?”
“তুমি কিছু জানো না?”
“না তো। কী হয়েছে?”
“প্রবালকন্যা কাল রাতে ফেরেনি?”
“মানে? কোথায় গেছে?”
“সেটাই তো কেউ জানে না। তুমি টিভি খুলে দেখ।“
আশিস টেবিল থেকে রিমোট নিয়ে দেয়ালের টিভি অন করলেন। একটা নিউজ চ্যানেলে “ব্রেকিং নিউজ” দেখাচ্ছে। “গঙ্গায় লঞ্চের সলিলসমাধি”। পাশে গঙ্গার ঘাট থেকে ক্যামেরার সামনে সুমন রাউত। সুমন রাউত এখন কলকাতার নামকরা সাংবাদিক। ভালো স্টোরি মানেই টিভির পর্দায় সুমন। 
আশিস কিছুক্ষণ বেকুবের মত টিভির দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুই ওনার মাথায় ঢুকছে না। প্রবালকন্যা ডুবে গেছে? কখন? রাত তিনটে অবধি তো উনি ফোনের সামনেই ছিলেন। তখন তো কিছু হয়নি।
উনি আবার অনির্বাণকে ফোন করলেন। প্রথমে লাইন এনগেজড এল। তারপর সে ফোন ধরল। “দেখলে?”
“কী হয়েছে আমাকে বল। ডুবে গেছে? কোথায়?”
“সেটা তো আমি জানি না। কিন্তু কালকে লঞ্চ ঘাটে ফেরেনি। গঙ্গার ওপর কোথাও লঞ্চ দেখা যায় নি। সুতরাং টিভি আজ সকাল থেকে এটাই দেখাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি এস।“
আশিস পাত্র সব ভুলে জামা গায়ে গলিয়েই গাড়ি নিয়ে ছুটলেন ফেরিঘাটে। ওনার অফিস ওই ঘাটের এক পাশেই। আগে একটা মালের গুদাম ছিল। উনি ঘাট কিনে সেই গুদামঘরকে অফিস বানিয়েছেন। ঘাটের সামনে এসেই উনি দেখলেন প্রায় পাঁচ-সাতটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে। সব কটার সামনে ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিক। সুমন রাউত একজন স্থানীয় হকারের সাথে কথা বলছে।
পাশের কারখানার পেছন দিয়ে একটা রাস্তা ছিল। উনি সেই দিক দিয়ে চুপিচুপি ঢুকে পড়লেন ঘাটে। অফিসে ঢুকেই দেখেন অনির্বাণ একা বসে আছে।
“কী হল? কিছু খবর পেলি?”
“না দাদা। কিচ্ছু জানি না। এদিকে পুলিশ থেকে ফোন করেছে। তোমাকে এক্ষুনি যেতে হবে থানায়।“
“থানা?” আশিস চমকে ওঠে। 
“হ্যাঁ। মিস্টার দাগার ফ্যামিলি সেখানেই আজ সকালে কমপ্লেইন করেছে। ওরা থানাতেই আছে।“
“কী করব?”
“তুমি যাও। পেছন দিয়ে বেরিয়ে চলে যাও। অবশ্য থানার সামনেও টিভি ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যদি কোনও খবর পাই, জানাচ্ছি। আর আমি এখন অফিস বন্ধ রাখছি।“
………………………………

আশিস পাত্র বেরিয়ে থানায় ফোন করলেন। এমনিতে ওসি ওনার চেনা। ব্যবসার ব্যাপারে বেশ হেল্পও করেন। কিন্তু আজকে ওনার গলাটা একদম আলাদা। “কী ব্যাপার? আপনি সকাল থেকে কোথায় ছিলেন?”
“স্যার আসছি।“
আশিস প্রায় দৌড়ে থানায় ঢুকলেন। বাঁচোয়া একটাই, থানার সামনে যে সাংবাদিকরা ছিল, তারা কেউ ওনার মুখ চেনে না। ফলে এখানে তাঁকে আর জেরার সামনে পড়তে হল না। থানায় ঢুকতেই ও সি ওনাকে দেখে একটা ছোট ঘরে ডেকে নিলেন। “কী হয়েছে আপনার লঞ্চের?”
“জানি না স্যার। বিশ্বাস করুন। কালকে লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে আমি বাড়িতে পুজো করতে ঢুকেছি। আর এই এলাম। আর কিচ্ছু জানি না।“
“কিন্তু সেটা বললে হবে না। মিঃ দাগার বাড়ির লোক বসে আছেন আমার ঘরে। আর জানেন তো ওনার হাত কতটা লম্বা। আমার কাছে সকাল থেকে লালবাজারের ফোন আসছে। পাগল হয়ে যাচ্ছি। এদিকে পুজোর মধ্যে হাওড়া স্টেশনে দুবার কোকেন নিয়ে ড্রাগ পেডলার ধরা পড়েছে। সেই এনকোয়ারি করার সময় পাচ্ছি না। তার ওপর আবার আপনার এই গোটা লঞ্চ কাল থেকে নিখোঁজ! “
আশিস পাত্র চুপ করে থাকে। ও সি আবার বলে, “আপনার ক্যাপ্টেনের সাথে ফোনে কোথা হয়েছে?”
এই রে! আশিস পাত্রের এই কথাটা একবারও মনে হয়নি। সত্যি তো। শিবাজি কাঁড়ার তো একবারও ফোন করেনি। উনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন। সুইচ অফ। পর পর ফোন করলেন লঞ্চের বাকি সব কর্মচারীকে। ক্যাপ্টেন, তারপর গার্ড, মানে দত্ত। তারপর রান্নাঘরের কুক। এছাড়া হেল্পার। সবার ফোন বন্ধ। আশিস ও সির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর আশিস হোয়াটসঅ্যাপ চেক করল। নাহ। কাল রাতে লঞ্চ থেকে কোনও স্টাফ মেসেজ করেনি। 
ও সি বললেন, “আপনি লঞ্চে কারা কারা ছিল, সেই লিস্ট আমাকে দিন। সবার নম্বর, ঠিকানা। আর সেই সাথে আপনার ফোন জমা দিন।“
“কেন স্যার?”
“আপনিও এই কেসে সাস্পেক্ট।“
“সাসপেক্ট মানে?”
“মানে জানেন না? এতগুলো লোক যদি মরে থাকে, তার দায় কার?”
“স্যার আমি ব্যবসা করি। খুন করি না।“
“সেটা আমি জানি না। কিন্তু আপনার লঞ্চ কাল থেকে নিখোঁজ। যদি লঞ্চ ডুবে গিয়ে থাকে, সেই দায় আপনার। কতজন প্যাসেঞ্জার ছিল?”
“৫১ জন স্যার।“
“ঠিক আছে। আপনি ফোন জমা দিয়ে যান। তারপর লঞ্চের কাগজপত্র নিয়ে আসুন। কালকের টিকিট বিক্রির হিসাব নিয়ে আসুন। আপনার লাইসেন্স নিয়ে আসুন।“

…………………………

আশিস পাত্র থানা থেকে বেরিয়েই অনির্বাণকে ফোন করলেন, “কী রে? কিছু খবর?”

“না দাদা। আমি সব জায়গায় ফোন করলাম। কেউ প্রবালকন্যা দেখেনি।“

“মানে কী? এতবড় লঞ্চ, মিলিয়ে তো আর যেতে পারে না! তুই অন্য কোম্পানিগুলোকে ফোন করেছিস?”

“হ্যাঁ দাদা। সেটাই করছি। পাইন ট্র্যাভেলস এর রাজীববাবু, মুক্তি ট্র্যাভেলস এর মানস। সবাইকে করলাম। ওদের লঞ্চ ওই পথেই কালকে ছিল। কেউ কিছু দেখেনি। এছাড়া জলপুলিশের সাথেও কথা বলছি। আমার চেনা যত নৌকার মাঝি আছে, সবাইকে বলেছি যদি কেউ নদীর বুকে কোনও লঞ্চের টুকরো দেখতে পায়, যেন আমাকে ফোন করে।"

আশিস বাড়ির দিকে যাওয়ার সময়ে বার বার শিবাজিকে ফোন করার চেষ্টা করলেন। কিছুই হল না। বাড়িতে ফিরে সব কাগজ নিয়ে আশিস আবার উপস্থিত হলেন থানায়। এবার ওসির ঘরে ঢুকে দেখলেন আরেকজন উর্দিপরা ব্যক্তি বসে আছেন। আশিস ও সির হাতে কাগজ সব দিতেই উনি বললেন, “মিঃ শেরপা লালবাজার থেকে এসেছেন। উনি এবার আপনাকে সব জিজ্ঞাসা করবেন।

মিঃ শেরপা সরাসরি প্রশ্ন শুরু করলেন, “আপনার লঞ্চে কোনও মেকানিক্যাল প্রবলেম ছিল?”

“না স্যার। আমি রেগুলার চেক করাই।“

“আপনি লঞ্চে রান্না করিয়ে খাবার দেন শুনলাম।“

“হ্যাঁ স্যার। সেটাই তো টুরিস্ট অ্যাট্রাকশান।“

“কিন্তু এভাবে জলের ওপর চলন্ত লঞ্চে রান্নার করার পারমিশান আছে আপনার?”

আশিস চুপ করে থাকে। মিঃ শেরপা আবার বলেন, “এভাবে রান্না করলে যে লঞ্চে আগুন লেগে যেতে পারে, সেটা জানেন?” আশিস বলে, “স্যার, আমি অনেকদিন এই কাজ করছি। এই লাইনে আরও অনেক লঞ্চ এরকম করে। কারুর আজ অবধি কিছু হয়নি। আমরা সব ফায়ার সেফটি নিয়েই কাজ করি।“

“হয় না মানে যে কালকে হয়নি সেটা কী করে জানলেন?” আশিস পাত্র চুপ করে রইলেন। মিঃ শেরপা আশিসের দেওয়া কাগজপত্র সব উল্টেপাল্টে দেখছিলেন। হঠাৎ একটা কাগজের দিকে চোখ রেখে উনি বললেন,

“এই হেল্পার ছেলেটি, বলরাম ওঝা, এ তো দেখছি একদম নতুন। জাস্ট পুজোর আগেই এঁকে রেখেছেন।“

“হ্যাঁ স্যার। আগের যে হেল্পার ছিল, সেই কৃপাসিন্ধু পুজোর ছুটিতে ছিল। ওই একে দিয়ে গেছে।“

“মানে এর সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না?”

“স্যার লঞ্চের হেল্পার। ওই একটু মালপত্র তুলে দেওয়া, ঝাঁট দেওয়া, এইসব কাজ। এর জন্য কত খোঁজ নেব? তার ওপর এ আবার খুব কম টাকায় কাজে ঢুকেছিল।“

“কেন? কম টাকায় কেন?”

“সে তো বলেনি স্যার। তবে আমার মনে হয় কাজ ছিল না হাতে, তাই। আর লোকটা বেশ ভালো কাজ জানত। এমনকি একদিন লঞ্চের মেশিন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ও নিজেই ঠিক করে দিল।” মিঃ শেরপা কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন,

“মিনিমাম মাইনের কমে লোককে কাজ করানো যে অপরাধ, সেটা জানেন? এই ফাইলে এর ছবি নেই কেন?”

“ছবি নেই?” আশিস পাত্র বেশ অবাক হলেন, “আমি তো ছবি নিয়ে এই ফাইলেই রেখেছিলাম।“ মিঃ শেরপা ফাইল দেখিয়ে বললেন, “দেখুন। ছবি নেই।“ 

………………………………… 

টিভি আর অনলাইন নিউজ সাইটগুলো পুরো ঘটনাটা নিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল। সুমন রাউত টিভির পর্দায় পুরো গ্রাফ এঁকে এঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে গঙ্গার কোন খানে ঘূর্ণি আছে এবং রাত্রে লঞ্চ সেখানে চলে গেলে কিভাবে জলের টানে ভেসে যেতে পারে। লঞ্চের ক্যাপ্টেন, শিবাজি কাঁড়ারের ছবি বার বার ভেসে উঠতে লাগল টিভির পর্দায়। পরদিন ভোর চারটের সময়ে গঙ্গায় মিলিটারির ডুবুরি নামল। এতক্ষণ অবধি চারিদিকে খোঁজ করেও কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি “প্রবালকন্যা”র। ডুবেই গেল লঞ্চটা? সুন্দরম মার্কেট এর মেইন লবিতে মিঃ দাগার একটা ছবি রাখা রইল। সেখানে অনেকেই এসে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেল। কিন্তু ডুবুরি খোঁজ করেও কিছুই পেল না। সেই ফেরিঘাট থেকে দুদিকে প্রায় দশ মাইল অবধি পুলিশের লঞ্চ তন্নতন্ন করে খুঁজল। তার সাথে যোগ হল ফেসবুকের অনেক অ্যামেচার গোয়েন্দা। অনেকে নিজের ড্রোন নিয়ে নদীর দুপাশে খুঁজতে লাগল এবং সেই ছবি ফেসবুক লাইভে সবাই দেখতে থাকল। সেদিন ছিল দশেরা। নদীর দুই পাশেই অনেক ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হচ্ছিল। কিন্তু সেই লঞ্চ কেউ দেখেনি। মানে লক্ষ্য করেনি। অনেক টুরিস্ট এই সময়ে নদীর বুকে লঞ্চে করে ঘুরে বেড়ান। তার মধ্যে একটা বিশেষ লঞ্চ কে আর খেয়াল করবে?ওদিকে কৃপাসিন্ধু, মানে সেই লঞ্চের পুরনো হেল্পার, আর ফিরে আসেনি। মিঃ শেরপা দুজন লোক পাঠালেন মেদিনীপুরে তার বাড়িতে। বাড়ির লোক জানাল যে কৃপাসিন্ধু চার দিন হল একটা জাহাজের চাকরি নিয়ে ইন্দোনেশিয়া রওনা হয়ে গেছে।থানায় বসে এই খবর শুনে আশিস পাত্রের মাথা ঘুরে গেল। কৃপাসিন্ধু জাহাজের চাকরি নিল কবে? আর ও তো সেরকম পড়াশুনাও করেনি। ওকে জাহাজের চাকরি দিল কে? ওর বাড়ির লোক জানিয়েছে যে পুজোর ঠিক আগেই নাকি কৃপাসিন্ধু একদিন জানিয়েছিল যে ওদের ফেরিঘাটে একজন লোক এসে ওকে এই প্রস্তাব দিয়েছে। এবং বলেছে যে চাকরিটা নিতে হলে দুদিনের মধ্যে জানাতে হবে। এত ভালো মাইনে ছিল যে কৃপাসিন্ধু আর দুবার ভাবেনি। আর না! কৃপাসিন্ধু বলরাম বলে কাউকে জানে না। ও কিভাবে এঁকে কাজে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে, সেটা বাড়ির লোক জানে না। বলরামের বাড়ি কোথায়, সেটাও কেউ জানে না। 

বাকি যে সব লঞ্চের কর্মচারী, সবার বাড়িতেই যাওয়া হল। শিবাজি কাঁড়ারের বাড়িতে আছেন দুই বোন আর বাবা। মা নেই। তাদের কারুর আর কথা বলার অবস্থা নেই। শিবাজি টাকা জমাচ্ছিলেন দুই বোনের বিয়ের জন্য। পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে বড় বোন জানাল যে সেদিন রাত্রে লঞ্চ ছাড়ার পর শিবাজি একবার তার হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়েছিল। মাঝগঙ্গা থেকে দুই পাড়ের আলোকসজ্জার দৃশ্য। তারপর আর কোনও মেসেজ আসেনি। বাড়ির সবাই পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে ছিল। তারপর সকালে টিভিতে সবাই এই খবর শুনেছে। বাকি দুজন স্টাফ, অর্থাৎ গার্ড কৌশিক দত্ত এবং রাঁধুনি, আখতারের বাড়িতেও কিছু খবর পাওয়া গেল না। সেইদিনের পর বাড়ির লোক কারুর সাথেই যোগাযোগ করতে পারেনি। পুলিশ থেকে লঞ্চের সব স্টাফের ফোন ট্র্যাক করা হয়েছিল। কিন্তু সেইদিন মাঝনদীর পরে সবার ফোনের লোকেশান হারিয়ে গেছে। শিবাজি বাড়িতে লাস্ট যে ছবি পাঠিয়েছিল, সেটা দেখে মনে হয় মাঝনদী থেকেই তোলা। তার মানে এই ছবি পাঠানোর পরেই ফোনের লোকেশান হারিয়ে গেছে। যে দশেরার মেলার কাছে লঞ্চের যাওয়ার কথা, সেখানেও গিয়ে খোঁজ করা হল। সেদিন সেখানে সবাই রাবণ পোড়ানো দেখতেই ব্যস্ত ছিল। নদীর বুকে অনেক লঞ্চ সেই সময়ে দাঁড়িয়ে হয়ত রাবণ পোড়ানো দেখছিল। কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি যে প্রবালকন্যা সেখানে ছিল কিনা। একজন বৃদ্ধ দোকানদার শুধু বললেন যে উনি একবার কিছু এঁটো শালপাতা ফেলতে নদীর দিকে একটা ঝোপে গিয়েছিলেন। তখন ওনার মনে হয়েছিল দূরের জঙ্গলের পেছনে নদীতে বোধহয় একটা লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওদিকটা অন্ধকার ছিল। উনি আর যান নি। পরের দিন সকালে যারা সেই নদীর দিকে গেছে, তারা কেউ কিছুই দেখেনি। 

পুলিশের লোক তাও সেই জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। সেখানে নদীর পাড়ে কিছু ভাঙ্গা লোহালক্কড়

ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মিঃ শেরপা চিন্তিত মুখে ঘরে বসে ছিলেন। মিঃ দাগার ফ্যামিলি এবার কোর্টে গেছে। তাদের সি বি আই তদন্ত চাই। দুদিন পার হয়ে গেছে। পুলিশ সেই লঞ্চের কোনও কিনারা করতে পারেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা থিওরি ঘুরছে। মিঃ শেরপা নিজের আই টি ডিপার্টমেন্টের পাঠানো সেই সব খবর দেখছিলেন। এখন ফেসবুকে সবথেকে বেশি চলছে কিডন্যাপের খবর। টুইটারে একটা হ্যাশট্যাগই চালু হয়ে গেছে #কলকাতালঞ্চকিডন্যাপ। আবার আরেকটা গ্রুপ আছে যারা দাবি করছে যে লঞ্চের ক্যাপ্টেনের ভুলেই লঞ্চ ভেসে গেছে। এরা অন্য একটা হ্যাশট্যাগ চালু করেছেঃ #শিবাজিইজকালপ্রিট। 
মিঃ শেরপা ভাবছিলেন, যদি কিডন্যাপ হয়, তাহলে তো বাড়িতে ফোন আসার কথা। কিছুই ফোন আসেনি। কিন্তু এতগুলো লোক নিয়ে একটা লঞ্চ গেল কোথায়? যদি বিপদ হয়েও থাকে, তাহলে তো লঞ্চের স্টাফরা বাড়িতে ফোন করত। কিন্তু সারারাত কেউ বাড়িতে ফোন করেনি কেন? আর ওই বলরাম ওঝা লোকটি কে? ফাইলে ওর ছবি নেই কেন? 
এই সময়ে লালবাজার থেকে ফোন এল। মিঃ শেরপার বস। উনি বললেন, “সঞ্জয়, তোমার কাছে একজন যাচ্ছে থানায়। ইনি দিল্লি থেকে এসেছেন। এই ঘটনার ব্যাপারে।“
"দিল্লি? দিল্লি কেন? একটা লঞ্চ হারিয়ে যাওয়া যতই বড় ঘটনা হোক, দিল্লির কেউ আসার মত ব্যাপার তো নয়।"
মিঃ শেরপা ফোন রাখতেই সেই বসের মেসেজ এল হোয়াটস অ্যাপে। “সাবধানে থাকবে। ইনি কিন্তু এন আই এর লোক।“
মানে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার লোক। এই ঘটনায় ইনি এলেন কেন? যাই হোক। এই সময়ে আর্দালি এসে খবর দিল যে পাইন ট্র্যাভেলস এর মালিক রাজীব পাইন একবার দেখা করতে চান। সঞ্জয় শেরপা আসতে বললেন তাঁকে।
মিঃ পাইন এসেই বললেন, “স্যার, কিছু খবর পেলেন?”
মিঃ শেরপা বিরক্ত স্বরে বললেন, “সেটা পেলে আপনারা সবাই খবর পাবেন। আপনাকে আলাদা করে তো আর বলব না।“
“না না স্যার। সে কী কথা? আসলে আমাদের একই লাইন তো। একজনের দুর্ঘটনা হলে সবার ক্ষতি। এই দেখুন না, এই ঘটনার পর আমরা যারা লাক্সারি লঞ্চ চালাই, সবাই হাত তুলে বসে আছি। গত কয়েকদিনে সব বুকিং ক্যান্সেল। কেউ আর লঞ্চে উঠতেই চাইছে না।“
“সে আমি কী করব? একটা আস্ত লঞ্চ হারিয়ে গেলে মানুষের মনে ভয় তো হবেই।“
“তবে স্যার, একটা কথা বলি। ওই আশিস কিন্তু ব্যবসা করলেও লঞ্চের যত্ন করত না।“
“মানে?”
“মানে স্যার, আমাকে একজন বলল যে ওর সেই লঞ্চে ফাটল ছিল। ও দশেরার দিনের বুকিং ক্যান্সেল করবে না বলে সেই লঞ্চ কোনরকমে জোড়াতালি দিয়েই সেদিন চালাচ্ছিল। সেই জন্যই তো স্যার ডুবে গেল।“
মিঃ শেরপা কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, “ডুবে গেছে জানলেন কী করে? এখন অবধি লঞ্চের একটাও টুকরো কোথাও পাওয়া যায় নি। ডুবুরি নীচে গিয়েও কিচ্ছু দেখতে পায়নি।“
“স্যার আর কী হবে? লঞ্চ তো আর মিলিয়ে যেতে পারে না। আমি বলছি শুনুন, লঞ্চ নিয়ে ওরা গাদিয়ারার দিকে গিয়েছিল। ওদিকে অনেক সময়ে ঘূর্ণি থাকে। সেখানে লঞ্চ পড়ে ভেসে গেছে। আপনি ওইদিকে খোঁজ করে দেখুন, পেয়ে যাবেন। আর যদি স্যার সাগরের জলে ভেসে গিয়ে থাকে, তাহলে আর পাবেন না।“
মিঃ শেরপা বললেন, “ঠিক আছে, আপনি যান।“
মিঃ পাইন বেরিয়ে যেতেই একজন কালো চশমা পরা লোক কিছু না বলেই এসে ঘরে ঢুকল। মিঃ শেরপা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে কিছু বলার আগেই সে হাত বাড়িয়ে দিল, “শিবা”। মানে এ হল সেই এন আই এ-র লোক! লোকটি আবার কোন কথা না বলে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল সঞ্জয় শেরপার দিকে। সেই কাগজে পুলিশের বড়কর্তার নির্দেশ ছাপা আছে যে শিবার সাথে যেন পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়। সঞ্জয় শেরপা ফাইলটা খুলে এগিয়ে দিলেন। 
…………………………………………

সেদিন বিকালেই আশিস পাত্র আবার এল থানায়। মিঃ শেরপা বসে ছিলেন ঘরে; উনিই ডেকে পাঠিয়েছেন। ঘরে তার সঙ্গে ছিলেন আরেকজন। কালো স্যুট পরা একজন লোক। চোখে কালো কাঁচের চশমা। এক পাশে চুপচাপ বসে ছিলেন। আশিস একবার তার দিকে দেখল। কিন্তু সেই লোকের মুখে কোনও ভাবান্তর হল না। 
মিঃ শেরপা সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার লঞ্চের রুট কী ছিল সেদিন?”
“স্যার, রুট তো কিছু থাকে না। মাঝগঙ্গায় এদিক-ওদিক ঘুরে চলে আসে। বেশিদুর যায় না।“
“সাউথের দিকে গিয়েছিল কী? মানে সাগরের দিকে?”
“না স্যার। ওদিকে জলের টান বেশি। বিপদ হতে পারে। অতদুর আমরা যাই না।“
সেই কালো চশমা পরা ব্যক্তি এবার মুখ খুললেন। কথার টানে মনে হয় তামিল। উনি হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাকি যাত্রীদের নাম জানেন?”
আশিস পাত্র একবার দুজনের মুখের দিকেই তাকিয়ে বলল, “না স্যার। এখানে তো টিকিট কাটলেই হয়। নাম তো জিজ্ঞাসা করি না।“ 
“কোনও ছবি আছে সেদিনের?” 
আশিস একবার মিঃ শেরপার মুখের দিকে তাকাল। মিঃ শেরপা মাথা নাড়তেই ও বলল, “না। যাত্রীদের ছবি আমি তুলিনি।“ সেই লোকটি বলল, “তার মানে সেদিন মিঃ দাগা ছাড়া আর কে কে লঞ্চে ছিলেন, সেই সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না?” 
মিঃ শেরপা এবার গম্ভীর গলায় বললেন, “সেদিন আপনার লঞ্চ ফাটল ছিল? সেই নিয়ে আপনি লঞ্চে অতজন টুরিস্ট তুলেছিলেন?”
“না স্যার। কে বলেছে? আমি লঞ্চের যত্ন করি।“
“যেই বলুক। সত্যি কিনা বলুন।“ 
“না স্যার।“
“ঠিক আছে। কিন্তু যদি প্রমাণ হয় যে ভাঙ্গা লঞ্চ নিয়ে আপনি সেদিন ট্রিপ করেছিলেন, আর সেই জন্যই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাহলে কিন্তু আপনার জেল হবে।“
……………………………………
পুলিশ টিভি এবং ফেসবুকে আবেদন করেছিল এই সম্পর্কে কেউ কিছু জানলে পুলিশকে জানাতে। এই নিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসতে লাগল অজস্র কল আর মেসেজ। সব কটাই ক্র্যাঙ্ক কল। কেউ বলল যে গঙ্গার ধারে এক পুরনো কারখানার মধ্যে নাকি অনেক লোকের চীৎকার শোনা গেছে। মনে হয় সেখানেই সবাইকে আটকে রেখেছে। কেউ বলল লঞ্চটাকে নাকি একদিন দুপুরে মাঝগঙ্গা দিয়ে বজবজের কাছে দেখা গেছে। অনেকে দূর থেকে দেখা লঞ্চের ছবি তুলেও ফেসবুকে পোস্ট করতে শুরু করল। কিন্তু সব কটাই শেষে দেখা গেল ভুয়ো। 
মিঃ শেরপা কয়েকদিন পর থানার ওসিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাড়ির লোকেদের কিভাবে ম্যানেজ করছেন?”
“স্যার কেউ তো আসেনি।“
“মানে? ৫১ জন লোক ছিল ওই লঞ্চে। তাদের বাড়ির লোক কেউ আসেনি?”
“না স্যার। আমরা তো কারুর নাম জানিনা যে নিজে থেকে কন্ট্যাক্ট করব।“
“আপনি বলতে চান যে একটা লঞ্চ ভর্তি লোক হারিয়ে গেল, কেউ খোঁজ করে নি?”
“না স্যার। ওই ক্যাপ্টেন বা গার্ড, এদের বাড়ির লোক এসেছে। কিন্তু মিঃ দাগা বাদে অন্য কোনও যাত্রীর পক্ষ থেকে কেউ আসেনি।“
মিঃ শেরপা অবাক হয়ে বসে রইলেন। এটা কী করে সম্ভব? উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “সেই বলরামের খোঁজ পেলেন?”
“না স্যার। আশিস পাত্র তো ওর ঠিকানা জানেন না। কোনো ছবিও ওনার কাছে নেই। লোকটা যে কোথা থেকে এসেছিল, কেউ জানে না।“
“আচ্ছা, ওনার কাছে নিশ্চয়ই আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড আছে ওর?”
কিন্তু দেখা গেল সেটাও নেই। পুজোর আগে নিয়মিত লোক চলে যাওয়ায় আশিস তখন পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থায় ছিল। এই সময়ে নতুন লোক পেয়ে গিয়ে ও আর কিচ্ছু দেখেনি। 
পরদিন লালবাজারে নিজের ঘরে ঢোকার সময়ে মিঃ শেরপা দেখলেন সেই শিবা করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। উনি ডেকে বললেন, “সেই দিনের লঞ্চের বাকি যাত্রীদের কিছু খোঁজ পেলেন?” শিবা শুধু মাথা নাড়ল। মিঃ শেরপা আবার বললেন, “কারুর বাড়ির লোক কিন্তু আসেনি। এতগুলো লোক হারিয়ে গেল, আর কেউ খোঁজ করল না?” শিবা আর কথা না বলে চলে গেল। ………………………………… 
দিন দশেক পর, যখন টিভি-কাগজ বা অনলাইন নিউজ সাইটে খবরটার গুরুত্ব কমে এসেছে, সেই সময়ে হঠাৎ একদিন আবার শিরোনামে এলেন রাকেশ দাগা। বা বলা ভালো সন্দরম মার্কেট। একদিন সকালে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাল যে সুন্দরম মার্কেটে পুলিশ রেইড হচ্ছে। জানা গেল যে এই মার্কেটে নাকি অন্য জিনিসের আড়ালে চলত ড্রাগের ব্যবসা। এই রেইড হল কলকাতা পুলিশ আর দিল্লির ভারত সরকারের এন আই এর যৌথ উদ্যোগে। শুধু সেখানে নয়, একইসাথে রেইড হল কলকাতার আরও একুশ জায়গায়। বিশাল এক চক্র ধরা পড়ল। 
মিঃ শেরপা লালবাজারে নিজের ঘরে বসে “প্রবালকন্যা”র ফাইল দেখছেন। এই সময়ে বসের ফোন এল। “সঞ্জয়, শিবা যাচ্ছে, সব ফাইল ওনার হাতে তুলে দেবে। আমাদের আর কাজ নেই।“
“কিন্তু স্যার…” মিঃ শেরপা প্রতিবাদ করার আগেই বস ফোন কেটে দিলেন। তারপরই তার ফোন থেকে এল একটা মেসেজ। মিঃ শেরপা খুলে দেখলেন একটা সরকারি আদেশের পিডিএফ। আদেশের নীচে যার সই, সেটা দেখে মিঃ শেরপা আর কোনও কোথা বললেন না। দিল্লি থেকে আসা সেই কালো স্যুট পরা লোকটি নিজের নাম বলেছিল “শিবা”। কোনও পদবি বলেনি, আর কোনও পরিচয় দেয়নি। মিঃ শেরপা টেবিলের ফাইল জড়ো করতে করতেই শিবা ঘরে এসে ঢুকল। মিঃ শেরপা নিঃশব্দে সব কাগজ তুলে দিলেন ওর হাতে। শিবা একবার হেসেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
……………………………………
আশিস পাত্র আবার লঞ্চের ব্যবসা শুরু করেছেন। তবে এবার সব লঞ্চে জিপিএস ট্র্যাকার বসানো। আস্তে আস্তে টুরিস্টও আবার হচ্ছে। 
প্রবালকন্যার খবর আস্তে আস্তে মুছে গেছে লোকের মন থেকে। সুন্দরম মার্কেট এখন বন্ধ। শোনা যাচ্ছে এক আমেরিকান বহুজাতিক ইলেকট্রনিক ব্র্যান্ড নাকি মলটা কিনে নেবে। তারপর সেখানেই শুরু হবে রকমারি ফোন এবং গ্যাজেটের দোকান। 
এরমধ্যে দুটি ঘটনা ঘটেছে। প্রথম হল, কলকাতা থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় গঙ্গার পাড়ে কয়েকটা ঝুপড়ি আছে। সেই ঝুপড়ির মধ্যে একটা বাড়ির জানলায় লাগানো একটা কাঠ এক ব্যক্তির চোখ টেনে নিল। উনি ছিলেন সেই দুর্ঘটনার সময়ে উৎসাহী অ্যামেচার গোয়েন্দার মধ্যে অন্যতম। উনি সেই জায়গায় নদীর পাড়ে একটা প্রাচীন মন্দির দেখতে এসে মন্দিরের পাশে এই ঝুপড়িতে কাঠের টুকরোটা দেখলেন। কী মনে হওয়ায় উনি ছবি তুলে নিয়ে এলেন। তারপর বাড়িতে কম্পিউটার খুলে সেই প্রবালকন্যার ছবি বার করে উনি মিলিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, ভুল নেই। এই কাঠের ওপর যে নকশা, ঠিক সেরকম নকশা ছিল প্রবালকন্যার গায়ে। উনি খবরটা আর ছবিটা পাঠালেন পুলিশের ফেসবুক পেজে। 
মিঃ শেরপা খবর পেয়ে ছবিদুটো বারবার দেখলেন। তারপর উনি নিজেই গেলেন সেই গ্রামে। খুঁজে বার করলেন সেই ঝুপড়ি। কিন্তু সেই মন্দিরের পাশের বাড়িতে গিয়ে দেখলেন সেই কাঠ আর নেই। জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে এরকম একটা কাঠের টুকরো সত্যিই সেই জানলায় ছিল। সেই বাড়ির মালিক একদিন নদীতে কাঠটা ভেসে আসতে দেখে সেটা তুলে এনে জানলার ফুটো বন্ধ করেছিলেন। সেটা প্রায় দুমাস আগেকার কথা। মানে সেই ঘটনার ঠিক পরের সময়ের কথা। কিন্তু সেই কাঠ গেল কোথায়? মালিক জানালো যে গতকালই নাকি একজন বাবু এসে কাঠটা কিনে নিয়ে গেছেন। উনি অনেক টাকা দিয়েছেন। ওনার নাকি নকশা করা কাঠ জমানোর শখ। ওটা নিয়ে উনি যা টাকা দিয়েছেন, তাতে মালিক নতুন কাঠের জানলা করে নিতে পারবেন। মিঃ শেরপা হতাশ হয়ে চলে এলেন। একটু অবাক উনি হলেন, এই অজ গ্রামে কে এল কাঠের নকশা কিনতে? 
আর দ্বিতীয় ঘটনা হল রবির সাথে। রবি মানে সেই ফেরিঘাটের ঝালমুড়ি ওয়ালা। ও এখন চা বিক্রি করে হাওড়া স্টেশনের বাইরে। হঠাৎ একদিন ওর দোকানের সামনে দিয়ে একটা লোককে যেতে দেখে রবি চীৎকার করে উঠল, “আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান।“
লোকটি ঘুরে তাকাল। রবি বলল, “আপনি তো সেই দশেরার দিন লঞ্চে ছিলেন। আমার দোকান থেকে ঝালমুড়ি কিনলেন। আপনাদের লঞ্চ ফিরে এসেছে?”
লোকটি অবাক হয়ে বলল, “আপনি কাকে বলছেন? আমি তো সবে কলকাতা এসে নামলাম। গত দুবছর আমি বারানসী ছিলাম।“ 
এই সময়ে এক খদ্দের ডাক দেওয়ায় রবি পিছন ফিরে তাকাল। তারপর সামনে ফিরে দেখল সেই লোক আর নেই। ভিড়ে মিশে গেছে।
………………………………

শিবাজি কাঁড়ারের বাবা বিশ্বনাথ কাঁড়ার একা ঘরে বসে থাকেন। দুই মেয়ে ছোটখাটো কাজ করে শহরে। উনি এখনও আশা করে আছেন ছেলে ফিরে আসবে। কাগজে যেখানে যা বেরোয়, কেটে রেখে দেন। থানায় যান মাঝে মাঝে। কিন্তু সম্প্রতি আবার সেই থানার ও সি বদলি হয়ে চলে গেছেন সেই কোচবিহার। ফলে আর চেনা কেউ নেই। ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে উনি চুপ করে ভাবেন শুধু। শিবাজি সাঁতার জানত। যদি লঞ্চ ডুবেও গিয়ে থাকে, তাহলেও ওর তো সাঁতরে পাড়ে ওঠার কথা। 
এই সময়ে একদিন বাড়িতে একটা চিঠি এল। বেশ মোটা খামের।
চিঠি? কে পাঠাবে? থানা থেকে? 
বিশ্বনাথ কাঁড়ার তাড়াতাড়ি হাতে নিয়ে দেখলেন। দুই মেয়ে এখন বাড়ি নেই। চিঠিটা এসেছে ওনার নামেই। সাদা খাম। প্রেরকের নাম লেখা নেই। 
উনি খুলে দেখলেন। মোটা সাদা কাগজে প্রিন্ট করা, বাংলায় লেখা চিঠি। বেশ বড়। খামের মধ্যে কী যেন একটা শক্তমত রয়েছে। উনি হাত দিয়ে বার করে আনলেন। একটা চাবি! কিসের চাবি? উনি এবার চিঠিটা পড়া শুরু করলেন। 
“প্রিয় মিঃ কাঁড়ার। আপনার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় চলেছে, সেটা আমরা বুঝতে পারছি। এই চিঠি দিয়ে আপনাকে আমরা কয়েকটা কথা বলতে চাই। প্রথমেই বলে দিই যে, এই চিঠি আপনি কোথাও পেশ করতে পারবেন না। এটা শুধু আপনার জানার জন্য। এই চিঠিতে কেন কোনও প্রেরকের নাম নেই, সেটা আপনি পড়লেই বুঝতে পারবেন। 
আপনার ছেলে, শিবাজি কাঁড়ার, দশেরার দিন প্রবালকন্যা লঞ্চে করে বেরিয়ে হারিয়ে গেছেন। ওনার কথা জানানোর জন্যই এই চিঠি।
আমরা ভারত সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোক। আমাদের নাম আপনি কোনদিন শোনেন নি, কারণ আমাদের কাজ করতে হয় সম্পূর্ণ গোপনে। দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের মোকাবিলা করাই আমাদের কাজ। এর মধ্যে একটা বড় কাজ হল ড্রাগের ব্যবসার ওপর নজর রাখা। যাই হোক, আমাদের সংস্থা অনেক দিন ধরেই রাকেশ দাগার ওপর নজর রাখছিল। রাকেশ দাগা অন্য ব্যবসার আড়ালে সারা ভারত জুড়ে ড্রাগ সাপ্লাই করত দশ বছর ধরে। কিন্তু এমন ওর কাজের ধারা, যে কোনোভাবেই ওকে হাতেনাতে ধরা যেত না। গত কয়েক বছরে রাকেশ নিজের ব্যবসা পুরো এনে জড়ো করেছিল কলকাতায়। এখান থেকেই ও সারা দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ড্রাগ কেনাবেচা করত। 
আমরা অনেকবার ওর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কিন্তু ওকে স্পর্শ করার আগেই ও পালিয়ে গেছে। বা এমনভাবে কেস সাজিয়েছে যে ওকে স্পর্শ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই সব জেনেও ওকে কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আর ওকে সবসময় ঘিরে থাকত ওর বিশ্বস্ত সহকারীর দল। ফলে আমাদের কোনও লোক যে ওর কাছাকাছি গিয়ে ওর ইনার সার্কেল ভেদ করবে, সেটাও হচ্ছিল না।দুবার আমাদের লোককে ওর ব্যবসার কর্মচারী করে আমরা পাঠিয়েছিলাম। দুবারই সেই লোক নিখোঁজ হয়ে গেছে। 
এইসময়ে আমরা খবর পেলাম যে রাকেশ একা লঞ্চ সফর বুক করেছে দশেরার দিন। কেন ও এরকম করল, জানি না। হয় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, নইলে বোকামো। যাই হোক, এটা জানতে পেরেই আমরা ঠিক করলাম যে এই সফরে, যেভাবেই হোক, ওকে কোণঠাসা করে ওর কাছ থেকে খবর বার করতে হবে।
সেইমত আমাদের কাজ শুরু হল। প্রথমেই সেই লঞ্চের আরও যে কটা টিকিট ছিল, সব আমাদের লোক কিনে নিল। তার মানে, রাকেশ দাগা ছাড়া সেই লঞ্চে আর সব যাত্রী ছিল আমাদের লোক। কিছু অন্য টিকিট বুক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমরা সেই সংস্থার ওয়েবসাইট হ্যাক করে সব বুকিং ক্যান্সেল করে আমাদের লোকের জন্য টিকিট কিনে নিলাম।
এরপর আমাদের দরকার ছিল লঞ্চের কর্মচারীদের মধ্যে আমাদের লোক রাখা। আপনার ছেলেকে বাদ দেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ রাকেশ হুঁশিয়ার লোক। লঞ্চের ক্যাপ্টেন পাল্টে গেছে শুনলে ও আর হয়ত আসবেই না। আমরা খবর পেয়েছিলাম যে রাকেশ পুজোর পরেই পালিয়ে যাবে মাল্টা। ফলে এই পুজোর মধ্যে ওকে হাতে না পেলে আমাদের আর কিছুই করার থাকত না।
অবশেষে লঞ্চের হেল্পারকে আমরা হাত করলাম। জাহাজের চাকরি দিয়ে আগের হেল্পারকে সরিয়ে তার জায়গায় এলেন আমাদের সিনিয়ার অফিসার টি মেনন, বলরাম ওঝার নাম নিয়ে। উনি আমাদের অন্যতম দক্ষ অফিসার। গত তিরিশ বছর ইস্ট কোস্টে ইন্টেলিজেন্স-এর কাজ করছেন এবং ওনার ছদ্মবেশ নেওয়ার ক্ষমতা তুলনাহীন। আপনি যদি আশিস পাত্রকে জিজ্ঞাসা করেন, দেখবেন সে বলবে যে বলরাম ওঝা ছিল একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের গ্রামের লোক। কিন্তু মিঃ মেননের বয়স ছাপ্পান্ন। এরপর সব কাজ হল নিয়ম মত। মেনন একদিন সুযোগ পেয়ে কোম্পানির অফিসের ফাইল থেকে নিজের ছবি সরিয়ে নিল। ফলে ঘটনার পর পুলিশ সেই ফাইল দেখে ওনার কোনও হদিশ পায়নি। মিঃ মেনন লঞ্চের সবথেকে সুরক্ষিত ঘরটা রাকেশের জন্য সাজিয়ে রাখলেন। 
দশেরার দিন আমরা সবাই যাত্রী সেজে লঞ্চে উঠে পড়লাম। আমাদের ট্রেনিং এমন যে আমাদের অভিনয় দেখে আপনি ধরতেই পারবেন না যে সেই লঞ্চের যাত্রীরা সব সহকর্মী ছিল। রাকেশ যথা সময়ে উপস্থিত হল। আশিস পাত্র ওনাকে নিয়ে গেলেন স্পেশাল কেবিনে। এখানে বলে রাখা ভালো যে আশিস পাত্র কিন্তু এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না। উনি রাকেশ দাগাকে স্পেশাল গেস্ট হিসাবেই খাতির করেছেন। আমাদের জন্য নয়।
শেষে একটাই প্রবলেম হল। আমাদের যিনি মেইন ইন্টারোগেটার, “রনি” দেশ্মুখ, ওনার আসতে একটু দেরি হচ্ছিল। যাই হোক, উনি সব জিনিস নিয়ে শেষে পৌঁছে গেলেন।
লঞ্চ ছাড়ল। মাঝনদীতে যেতেই আমাদের কাজ শুরু হল। আমাদের মধ্যে অনেকেই যাত্রী সেজে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। একজন গিয়ে গার্ডকে বন্দী করে রাখল। আর রনি সহ তিনজন সিনিয়ার অফিসার ঢুকলেন গিয়ে রাকেশের কেবিনে।
আমিও ছিলাম তার মধ্যে। আমাদের দেখেই রাকেশ বুঝতে পারল আমাদের কী চাই। ওকে নড়ার সুযোগ না দিয়ে আমরা ঘিরে ফেললাম।
শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। লঞ্চ তখন এগিয়ে চলেছে কোনও এক দশেরার মেলার দিকে। বেশি সময় আমাদের লাগেনি। রনির কাছে সব জিনিস থাকে। প্রথমে নানা ভয় দেখিয়েও যখন দেখা গেল যে রাকেশ পুরো কথা বলছে না, তখন রনি নার্কো টেস্ট শুরু করল। রাকেশকে একটা ইঞ্জেকশান দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাকেশের মুখ থেকে আমরা জেনে নিলাম ওর ব্যবসার নেটওয়ার্ক এর কথা এবং কলকাতার অন্য ডিলারদের কথা। এও জানলাম যে আমাদের আসার খবর কিছুটা হলেও ওদের নেটওয়ার্কএ পৌঁছেছে। ফলে এই বছরের মধ্যেই সব পালের গোদা দেশ ছেড়ে পালানোর মতলব করছে। 
ইতিমধ্যে সমস্যা হল একটাই। লঞ্চ তখন পৌঁছে গেছে সেই দশেরার মাঠের সামনের নদীতে। আপনার ছেলে, লঞ্চের ক্যাপ্টেন, তখন স্পেশাল গেস্টের জন্য উঠে এসেছেন ওপরের কেবিনে। আমরা সবে কাজ শেষ করে রাকেশের দেহ নদীতে ফেলার জন্য রেডি করছি, সেই সময়ে শিবাজিবাবু ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমাদের প্ল্যান এমনিতে ছিল যে রাকেশের কাছ থেকে কথা বের করে ওকে নদীর বুকে সমাধি দেওয়া হবে। আর ঘটনাটা দেখানো হবে দুর্ঘটনা হিসাবে। লঞ্চের সব যাত্রী একসাথে চীৎকার করবে যে রাকেশ দাগাকে উপরের কেবিনের বারান্দা থেকে সবাই জলে পড়ে যেতে দেখেছে। ও যা জিনিস, তাতে কোনদিন কোর্টে ওকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। হাজার হাজার লোকের জীবন ড্রাগ দিয়ে নষ্ট করলেও ও চিরকাল থেকে যাবে জেলের বাইরে। তাই আমাদের পরিকল্পনা ছিল ওর বিচার আমরাই করব। এই ধরণের লোকেরা এমনভাবে ঘুঁটি সাজায় যে আইনের পথে এদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। 
যাই হোক, শিবাজি ঘরে ঢুকে সব দেখে চীৎকার শুরু করলেন। ফলে ওনাকে একটু শান্ত করতেই হল। তারপর আমাদের চিন্তা শুরু হল, এবার কী করা যায়। যতই হোক, যদি শিবাজী এবং অন্য স্টাফরা কাউকে এই কথা বলে দেয়, তাহলেই পুরো ড্রাগ নেটওয়ার্ক এক মিনিটে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমাদের দশ বছরের কাজ ব্যর্থ হবে। লঞ্চ তখন মাঝনদীতে। সামনের মাঠে চলছে রাবণ পোড়ানো। তখন আমাদের মধ্যে একজন লঞ্চ চালিয়ে নিয়ে এল সেই নদীর পাড়ে। এক জায়গায় অনেকটা জঙ্গল ছিল। তার আড়ালে লঞ্চ দাড় করানো হল। 
তারপর আমাদের সব টিম মেম্বার মিলে লঞ্চটা পুরো খুলে ফেলা হল। আপনি হয়ত অবাক হচ্ছেন। কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে এমন কিছু ব্যাপার নয়। প্রত্যেকের ব্যাগেই নানারকম যন্ত্র ছিল। লঞ্চটা পুরো টুকরো টুকরো করতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগেনি। সামনে দশেরার মেলার চীৎকার থাকায় এবং প্রচুর বাজি ফুটতে থাকায় আমাদের কাজ আরও সহজ হয়েছিল। নদীর পাড়ে, জঙ্গলের আড়ালে, একটু ঠোকাঠুকির শব্দ সেই সময়ে কেউ শুনতে পায় নি। 
এরপর আমাদের মধ্যে দশজন সেই লঞ্চের সমস্ত কাঠ ভাগে ভাগে নিয়ে সেই দশেরার আগুনের কুণ্ডে নিক্ষেপ করে এল। রাত্রি প্রায় দুটোর সময়ে শেষ হল আমাদের অপারেশান। লঞ্চের সমস্ত কাঠ ততক্ষণে পুড়ে ছাই। তবে অন্ধকারে দু-একটা কাঠ বোধহয় জলে ভেসে গিয়েছিল। সেরকম একটা টুকরো কিছুদিন আগেই পাওয়া গিয়েছিল গঙ্গার পাড়ে একটা ঝুপড়িতে। ফেসবুকে আমাদের টিম সবসময়ে মনিটর করছে। কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে ছবি দেখেই আমাদের লোক সেই রাতেই সেখানে গিয়ে সেই কাঠের টুকরো সরিয়ে দিয়েছিল। 
বাকি যা লোহালক্কড় ছিল, সেগুলো ওখানেই গলিয়ে এমনভাবে শেপ পাল্টে দেওয়া হল যে কারুর বোঝার সাধ্য রইল না যে ওগুলো আগে কী ছিল। কিছু নদীতে ফেলে এলাম, আর কিছু আমরা সবাই সাথে করে করে নিয়ে এসে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ফেলে দিলাম। 
এই কাজ শেষ করে তারপর রাকেশের দেহ নদীতে সমাধি দিয়ে আমরা ভাগে ভাগে ফিরে চললাম কলকাতায়। 
রাকেশের কাছে পাওয়া তথ্য পাঠানো হল দিল্লিতে। তারপর তো আপনি কাগজেই দেখেছেন রাকেশের পুরো সাম্রাজ্য রেইড হওয়ার খবর। এত সফল ড্রাগ বাস্ট ভারতে আগে কখনও হয় নি। 
আপনার ছেলে সেই সময়ে ঘরে ঢুকে পড়ায় তাঁকে আমাদের শান্ত করতে হয়েছিল। কিন্তু খুব দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে ওনাকে শান্ত করতে গিয়ে উনি চিরশান্তির দেশে চলে গেছেন। আপনার কষ্ট লাঘব করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু সান্ত্বনা হিসাবে এই চিঠির শেষে একটি ব্যাঙ্কের নাম ঠিকানা এবং একটি নম্বর দেওয়া আছে। আর খামের মধ্যে রয়েছে একটি চাবি। এই নম্বর এবং এই চাবি একটি সরকারি ব্যাঙ্কের লকারের। সেই লকার আপনার নামেই খোলা হয়েছে। 
সেই ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে গিয়ে ওই নম্বরের লকার যদি আপনি খোলেন, তাহলে আপনার দুই মেয়ের বিয়ের সমস্যা হয়ত মিটে যাবে।

প্রবন্ধ

Sukhamay Ghosh_edited.jpg

ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশনা 

ও বেঙ্গল হরকরা

সুখময় ঘোষ

শ্রীরামপুর, হুগলী, পঃ বঙ্গ

ভারতবর্ষে সংবাদপত্র

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

newspaper.jpg

প্রেস বা মুদ্রণালয়  আবিষ্কার এক নির্বাক  বিপ্লবের সুত্রপাত  ঘটিয়েছে এই পৃথিবীর বুকে। মানব সভ্যতার ইতিহাসকে সবাক করে দিয়ে এই মুদ্রণযন্ত্র অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহের ইতিবৃত্তকে ঐতিহাসিক রূপদান করেছে সংবাদপত্র প্রকাশনার মধ্যে দিয়ে। অতীতের পরিসর বেয়ে ধাবমান ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ হয়ে মানব জাতির সম্মুখে উন্মুক্ত করেছে ইতিহাসের দুয়ার। এই অসাধ্য সাধন হয়েছে কেবলমাত্র মুদ্রণযন্ত্রের আশীর্বাদে। 

পৃথিবীর প্রথম মুদ্রণযন্ত্র জার্মাণীর জোহানেস গুটেনবার্গ ১৪৪০ সাল থেকে ১৪৫০ সালের মধ্যে উদ্ভাবন করেন। এই আবিষ্কারের পূর্বে মুদ্রণযন্ত্র সম্পর্কে কোন ধ্যান ধারণা মানুষের সামনে অজ্ঞাত ছিল। তবে চীন, জাপান ও কোরিয়াতে অতীতকালে ছাপার যন্ত্র ব্যবহার না করে মুদ্রণ পদ্ধতি চালু ছিল। ইতিহাস বলে চীনের তাং শাসকদের রাজত্বকালে (৬১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯০৬ খ্রিস্টাব্দ) পৃথিবীর প্রথম সংবাদপত্র ‘তিপাও’ প্রকাশিত  হয়। সেইসময় ভারতবর্ষে পাণ্ডূলিপি সংবাদপত্র প্রচলিত ছিল। গ্রীক পরিব্রাজক ও কূটনীতিক মেগাস্থেনিস রচিত ‘ ইন্ডিকা‘ গ্রন্থ থেকে জানা যায় প্রায় খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩০০ অব্দে ভারতবর্ষের উত্তরভারতের শাসকেরা পাণ্ডূলিপি সংবাদপত্র প্রচলন করেছিলেন নিজেদের শাসনকার্যের সুবিধার্থে। এইসব সংবাদপত্রে বিভিন্ন সত্য ঘটনার বিবরণ  প্রকাশিত হত। 

কথিত আছে এশিয়া মহাদেশ হচ্ছে সংবাদপত্রের আতুঁর ঘর। চীন দেশের পর ভারতবর্ষে মোগল রাজত্বে সংবাদপত্রের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। দিল্লি হতে পারস্য ভাষায় প্রকাশিত ‘পয়গম-এ-হিন্দ‘- নামক পত্রে সম্রাট আরঙ্গজেবের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায় (নব্য ভারত ১৩০৫)। চীনদেশে মুদ্রাযন্ত্র প্রথমে আবৃষ্কিত হলেও কেরী সাহেব তাঁর – Good Old Days Of Hon’ble John Company নামক গ্রন্থে ভারতবর্ষের হিন্দুগণ ও চিনাগণ মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারক বলে উল্লেখ করেছেনঃ It is known that the Hindoes and Chinese  contened  for invention of the press.

ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে পর্তুগীজ মিশনারিরা এদেশে প্রথম মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তন করেন। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে গোয়াতে প্রথম ছাপাখানা চালু করেছিল পর্তুগীজরা। বিশেষত খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই ছাপাখানাগুলো ব্যবহৃত হত। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ ভাষায় রোমান অক্ষরে খ্রীষ্টবিষয়ক একটি পুস্তক মুদ্রিত হয়েছিল। এটাই ছিল ভারতের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। তবে বাংলাভাষার মুদ্রণের ইতিহাসও বেশ  পুরনো। ১৭৩৪  সালে পাদ্রী মনো-এল- দা-আসসুম্পসাঁও পর্তুগীজ ভাষায় বাংলা শব্দকোষ ও ব্যাকারণ রচনা করেন। ভাষা বাংলা হলেও হরফ হত রোমান। জানা যায় ১৬৯২ সালে প্যারিসে ছাপানো ফরাসী ভাষার একটি বইয়ে প্রথম বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৭৭৮ সালে বাংলাদেশে ডাচ অধিকৃত শ্রীরামপুর শহরে খ্রীষ্টান মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের বিষয়টি সামনে রেখে ছাপাখানা স্থাপন করেছিল। তবে মিশনারিরা চেয়েছিলেন কোলকাতায় তাঁদের এই উদ্যোগকে বাস্তয়াবিত করতে। কিন্তু তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলে শ্রীরামপুরেই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দের ২৩মে শ্রীরামপুর থেকেই উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান সাহেব এক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র “সমাচার দর্পন” প্রকাশ করেন যা বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র হিসাবে বিবেচিত। এই সংবাদপত্রের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুর।                                                                   ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারী জেমস অগাস্টাস হিকি তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা থেকে ভারতবর্ষের প্রথম ইংরাজী ভাষায় সংবাদপত্র “দি বেঙ্গল গেজেট অব দি ক্যালকাটা জেনারেল এডভ্যাটাইজার“ সাপ্তাহিক হিসাবে প্রকাশ করেন। এরপরে ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় সংবাদপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয় “ইন্ডিয়া গেজেট“, এবং তারপরে “ক্যালকাটা গেজেট“। এইভাবে কোলকাতায় ৬ বছরের মধ্যে পাঁচটি সাপ্তাহিক ও একটি মাসিক সংবাদপত্র  প্রকাশ হয়েছিল।  

বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশনার জগৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্বে এক বিরাট ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিল। দেশের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে, শিক্ষাব্যবস্থায় ও অর্থনীতির সংস্কারের দাবীতে বাংলাভাষার সংবাদপত্রগুলি প্রতিনিয়ত সংবাদ পরিবেশন করে যেত। দেশের এই পরিবর্তনশীল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্রগুলির মধ্যে ‘বেঙ্গল হরকরা‘ নামে একটি সংবাদপত্র                                      

বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকা নীলকর সাহেবদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকাটি তেমন জনসমর্থন না পাওয়ায় কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। এর দুই বছর পর ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দের ২০ ফ্রেবুয়ারী ডঃ চার্লস ম্যাকলীন নামে জনৈক ইংরেজ ঐ একই নামে একটি পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন।পত্রিকারটির মূলত নাম ছিল “দ্য বেঙ্গল হুরকারু“। বাংলা শব্দ ’হুরকারু’ যা ফার্সি শব্দ ‘হরকরা’ ( বার্তাবহ) থেকে এসেছে, যা এক কথায় সংবাদপত্রটি ‘বেঙ্গল হরকরা‘ নামে পরিচিতি পায়। এই ‘বেঙ্গল হরকরা‘ ভারতীয়দের সমর্থনে যথেষ্ট খবরাখবর প্রকাশ করত। সেই কারণে দেশীয় নাগরিক সমাজের কাছে এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এই পত্রিকার গ্রাহকেরা ছিলেন মূলত  ব্রিটিশ  আর্মির  সদস্যরা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বেসামরিক লোকজন এবং কিছু বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মানুষ। 

এই স্বল্প পরিসরে ‘বেঙ্গল হরকরা ’-র প্রসঙ্গ অবতারণার একমাত্র উদ্দেশ্য যে জন্মলগ্ন থেকেই কোম্পানীর বিরূদ্ধাচারণ করার জন্য এই পত্রিকাকে রাজরোষে পড়তে হয়েছিল। প্রারম্ভেই এই পত্রিকা সাপ্তাহিক হিসাবে প্রকাশ হয়েছিল, পরবর্তীকালে ১৮১৯ খ্রীস্টাব্দে ২৯ এপ্রিল দৈনিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। “বেঙ্গল হরকরা”- পূর্বে একমাত্র ‘বেঙ্গল র্জানাল‘ পত্রিকাই উদার দৃর্ষ্টিভঙ্গীর জন্য হরকরার মত সমগোত্রীয় ছিল।

‘বেঙ্গল হরকরা‘ ভারতবর্ষের প্রথম দৈনিক পত্রিকা যা ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ এপ্রিল Quarts কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমদিকে মঙ্গলবারের সকালে ছোট Folio কাগজ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করত এই পত্রিকা। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারী এই পত্রিকা Indian Daily News নামে পরিচিত হয়। ‘বেঙ্গল হরকরা’-র  প্রধান অংশীদার ছিলেন তৎকালীন ‘বিজনেস টাইকুন’ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। অন্য দুই স্বত্ত্বাধিকারী ছিলেন কর্ণেল ইয়ং এবং স্যামুয়েল স্মিথ। ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘বেঙ্গল হরকরায়‘ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বেশ কিছু আমলাদের  দুর্নীতির বিরূদ্ধে  লেখনী প্রকাশ পায়। কোম্পানীর বোর্ড অব ডাইরেক্টরেরা রুষ্ট হয়ে পড়ায় পত্রিকার সম্পাদক ক্ষমা চেয়ে নেন। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক ম্যকলীনকে বন্দী করে জেল হাজতে অকথ্য অত্যাচারের পর সরকার বিলেতে ফেরত পাঠায়। কিন্তু ম্যাকলীন দেশে গিয়েও লর্ড ওয়েলেসলির কাজকর্মের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ম্যাকলীনের অহরহ চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় গর্ভনর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলিকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিতে।

সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাটি ছিল অভূতপূর্ব। কারন লর্ড ওয়েলেসলি ভারতের সংবাদপত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রনের জন্য ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মে প্রথম সেন্সরশিপ প্রথা চালু করেন। যেটা Press Regulation Act হিসাবে কুখ্যাত হয়ে আছে। এই  Act-এর নিয়ামানুযায়ী প্রত্যেকটি সংবাদপত্র প্রকাশের আগে সংবাদগুলি ভারত সরকারের সচিবের কাছে দেখিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। ‘বেঙ্গল হরকরা‘ প্রথম এই সেন্সরশিপের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জনমত গঠন করে। হরকরা-র এই প্রতিবাদী ভূমিকা সংবাদপত্রটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। এই সংবাদপত্রে অনেক নামী সরকারী কর্মচারী কলম ধরতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হেনরি মেরিডিথ পার্কার, সরকারী চিকিৎসা বিভাগের অন্যতম প্রধান ডাঃ জন গ্রান্ট এবং কোলকাতার করনার ও মেরিন বোর্ডের সেক্রেটারী চার্লস বেকেট। 

হরকরা-য় লেখা প্রবন্ধের জন্য ইংলন্ড ও ভারতের মধ্যে জাহাজ সংযোগ ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছিল। হরকরা-র সংবাদপত্র অফিসে বিশ্বের সেরা লেখকদের পুস্তক সম্ভারের বড় লাইব্রেরী ছিল। তাদের ছাপাখানা থেকে “লিটারারি গেজেট“ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বার হত। ভারতীয় সংবাদপত্র ইতিহাসের অন্যতম এই সংবাদপত্র ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে বন্ধ হয়ে যায়। পেছনে রেখে যায় এক মূল্যবান ইতিহাস। ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সংখ্যায় পত্রিকার প্রকাশনা স্তব্ধ হওয়ার বার্তা দিয়ে পাঠকবর্গকে জানানো হয়, “We hope that the announcement will cause as much regret to our readers and the public as it does to ourselves, that with this issue , the HARKARU which first solicited public favor on the 19th February  1795, will disappear from the rolls of the Indian Press .”

প্রবন্ধ

নেব্রা ঢাকতিতে

মহাকাশ   

দেবযানী পাল

nebra.jpg
নেব্রা চাকতি

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ন্ধকার রাতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকালে কি অদ্ভুত অনুভূতি হয় বলতো? হাজার, হাজার বছর ধরে পরম ঔৎসুক্য নিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দূর-দূরান্তরের অসীম নীল সীমাহীন আকাশের গভীরতার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে মানুষ কি অনুসন্ধান করেছে কেউ বা কারা আছে নীল গগনের পাশে? ঐ অসীমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন জাগে,আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি, আর কোথায় যাব?
এই সেদিন দক্ষিণ-পূর্ব জার্মানির নেব্রা (Nebra) অঞ্চল থেকে পাওয়া bronze এর এক বিশেষ গোল চাকতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটিতে সূর্য, চন্দ্র আর তারাভরা আকাশ খোদিত রয়েছে। একে নাম দেয়া হয়েছে নেব্রার (Nebra-r) স্বর্গীয় চাকতি(disk)। নেব্রা গোলকটি উনিটিস (Unitice) জাতের লোকেরা বানায় ১৮০০ খৃষ্টাব্দে। তবে, অনেক কিছু এখনও জানা যায় না, সেজন্য অজানার গভীরতাতেই সবাই রয়েছে।
ব্রোঞ্জের (Bronze) চাকতিটি প্রায় ৩০oo বছরের পুরোনো, হয়তো এটি খৃষ্টপূর্ব ১৮০০ শতকে তৈরী হয়, এবং প্রমাণ করে যে মানুষ সেই কবে থেকেই “দূরে, বহুদূরে, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য

কোথা, অন্য কোনখানে*র কথা হয়তো ভাবতো। এই স্বর্গীয় চাকতিটিকে ১৬০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে দান হিসেবে মাটিতে পুতে রাখা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে এটি নেদারল্যন্ডে আসেন (Assen) শহরের বিশেষ সংগ্রহশালায় প্রদর্শিত হয়। তখন দেখে এসেছি, আর,  বেশ আশ্চর্যও হয়েছি।
নেব্রা চাকতি(disk) পাওয়া গেছে আগের পূর্ব জার্মানির Sax en -Anhalt থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০০ সালে, আর খ্রীষ্টপূর্ব ১৬০০ সালে মাটিতে পোঁতা ছিল, মনে হয়, দান(offer) হিসেবে। এই আবিষ্কার জ্যোতির্বিদ্যার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের চিন্তাধারারও বদল এনেছে। এটি জার্মানির হালে(Halle) অঞ্চলের লান্ডেস(Landes) মিউজিয়ামের সম্পত্তি।
১৯৯৯ সালে এই অপূর্ব ঢাকতিটি (মেডালিয়ন) আবিষ্কার হয়। এককালে এই জিনিষটি হয়তো ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহার হত। হালে শহরের মিউজিয়ামে এটি দেখানো হয়, এরপর ২০২২ British  Museum, London প্রদর্শিত হয়। যখন  Drents Museum, Assen এ আসে, তখনই এটি পৃথিবীর নানান অমূল্য জিনিষের মধ্যে এটি এক বিশেষ স্থান পায়। মহাকাশের মানচিত্রের এটাই বোধহয় সবচেয়ে পুরনো চিত্র ।

ভ্রমণ

Screenshot 2024-09-07 210842.png

বেনারসের 

টানে

তিতলি চক্রবর্তী

সাঁতরাগাছি কেদারনাথ ইনস্টিটিউশন ফর গার্লস

(নবম শ্রেণী)

হাওড়া- পশ্চিমবঙ্গ

baranasi-7.jpg
বেনারসের টানে

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

০২৩ এর ২৪ ডিসেম্বর আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। কারণ ছোটবেলা থেকে আমার মনে সুপ্ত থাকা একটি স্বপ্ন এই দিনেই বাস্তবায়িত হয়েছিল। বহু আগে থেকেই প্রতীক্ষায় ছিলাম এই শহরে ঘুরতে যাব বলে যেখানে আমার প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার কান্ডকারখানা সেই শহরের সাথেই জড়িয়ে ছিল। তাই রওনা হওয়ার আগের দিন থেকেই খুব উত্তেজিত ছিলাম। আর ব্যস্ত ছিলাম সুটকেস গোছানো ও দিদির উপর খবরদারি নিয়ে। এখানে চুপ করে বলে রাখি, আমার যত আবদার ও সমস্যা দিদিকেই মেটাতে হয়। এত কথা তো বলে যাচ্ছি  কিন্তু গন্তব্যস্থল কোথায় সেটাই তো বলিনি? আমি যাচ্ছি দিদি, দাদাভাই, প্রতিবেশী মামীমা, দিদা, মাসি ও মেসোর সাথে “ জয় বাবা ফেলুনাথ” - এর পটভূমি পৃথিবীর প্রাচীনতম আধ্যাত্মিক শহর বেনারস বা বারাণাসীতে।   

২৪ ডিসেম্বর রাত ৮.৩০ মিনিটে দুন এক্সপ্রেসে বাতানূকুল তৃতীয় শ্রেণীতে আমাদের যাত্রা শুরু। ট্রেনে ওঠার পর থেকে অনেক মজা করেছিলাম সাথে সেলফি তোলা। অনেক রাত পর্যন্ত বসে বসে পরিচিত নামের বড় বড় স্টেশনগুলো দিদি ও দাদাভাইয়ের সাথে দেখেছি। কৌতূহল মিটিয়ে কখন যে বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। সকালে ঘুম  উঠে দেখি বাইরের সুন্দর আবহাওয়া আমদের যেন স্বাগত জানাচ্ছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা জাতীয় কিছু খাবার খেয়ে আবার জালনার ধারে বসে গেলাম। যখন বারাণসীর কাছাকাছি ট্রেন চলে এল তখন সবাই মিলে নামার প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। স্টেশনে পৌঁছালে প্রত্যেকে নিজ নিজ ব্যাগের দায়িত্ব নিয়ে  প্ল্যাল্টফর্মে নেমে  এলাম। দেখে নিলাম সবাই সবকিছু নিয়ে নেমেছে কিনা! আমার আরও একটা দায়িত্ব বর্তে ছিল আমাদের সফরসঙ্গী পুঁচকে ভাইটাকে সামলানো। তাই ভাইকে নিয়ে সকলের সাথে স্টেশনের বাইরে এলে একজন কুলিদাদা আমদের সাহায্য করলেন, কোথা থেকে টোটো পাব তার হদিশ দিয়ে। তাঁর সাহায্যে মালপত্র বাইরে নিয়ে এসে আমরা টোটোতে চেপে বসলাম। টোটো রওনা দিল আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে যেহেতু গলির ভিতর টোটো ঢুকতে পারেনি তাই মাসী হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন করে কর্মচারী ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁরই সাহায্যে মালপত্র নিয়ে আমরা হোটেলে প্রবেশ করলাম। 

হোটেলটা ছিল গঙ্গার খুব কাছে। তাই স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে বসলাম সেইখান থেকেই তখন গঙ্গার দৃশ্য সুন্দর দেখা যাচ্ছিল। বিকেলে বেড়ানোর প্রোগাম থাকায় দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে হল। যদিও আমি ট্রেনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিন্তু বিকেল হতেই দিদির ডাকে সাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে নিজেকে তৈরী করে নিলাম গঙ্গার দিকে যাওয়ার জন্য। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছাতেই “জয় বাবা ফেলুনাথের” দৃশ্যটি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে হল যেন ঘাটের কোন কোনায় হয়ত “মছলী বাবা” দর্শন দিচ্ছেন। নৌকায় চেপে ঘাটগুলো দেখতে লাগলাম। বারাণসীর ঘাটগুলো সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা। এখানে মোট ৮৮টি ঘাট আছে। প্রধান ঘাটগুলো হল দশাশ্বমেধ ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট, অসি ঘাট, হরিশ্চন্দ্র ঘাট ইত্যাদি। ১৮শ শতকে মারাঠারা অনেক ঘাট পুনর্নির্মাণ করান। মণিকর্ণিকা ঘাটে অনেক মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছিল । দিদার মুখে শুনলাম এই ঘাটে যাকে দাহ করা হয় তাঁর দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ হয় না, তাঁর আত্মা বিলীন হয়ে যায়। ঘাটগুলো ঘুরে দেখে সোজা হোটেলে ফিরে এলাম। কারণ ট্রেন জার্নিতে আমরা সকলেই কম-বেশী সেদিন ক্লান্ত। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে রাতের খাওয়া সেরে সকলের ঘুমানোর উদ্যোগ। ঘুমানোর আগে আমার প্রিয় একমাত্র দিদিকে একটু জ্বালালাম। কারণ দিদিকে জ্বালাতে আমি খুব পচ্ছন্দ করি। এই পচ্ছন্দের পর্ব সেরে তাড়াতাড়ি বিছানায় আশ্রয়। কেননা পরের দিন ২৬ ডিসেম্বরসকাল থেকেই শুরু হবে আমাদের দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ পর্ব।

বারাণসী নামের উৎস ‘বরুনা’ ও ‘অসি’ এই দুইর নামের সংযোগে। প্রাচীন এই সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক শহর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন ক্ষেত্র। এই তীর্থক্ষেত্রে মন্দির ও মসজিদের পাশাপাশি সুন্দর সহাবস্থান। বারাণসীর ঘরাণার সঙ্গীতের চর্চার জন্য বহু বিদেশী এখানে মাসের পর মাস কাটিয়ে যান। বেনারসের অলিগলিতে এইসব বিদেশীদের দেখা মেলে। সকালে জলখাবার খেয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম মন্দির দর্শনে। দূর্গা মন্দিরসহ নাম জানা-অজানা বেশকিছু মন্দির দেখে চলে এলাম বহু প্রতীক্ষিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে যেটা নতুন নির্মিত হয়েছে। অসাধারণ কারুকার্য করা মন্দিরটি। ভেতরটা যেন ঠান্ডায় মোড়া। পুরো মন্দির ঘুরে দেখলাম। তারপরে গাড়ী করে চললাম প্রয়াগে ত্রিবেণী সঙ্গমের উদ্দেশ্যে। প্রয়াগে গঙ্গায় স্নান করা হয়নি। কেননা ঐ দিন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর আসার কথা থাকায় গঙ্গায় নৌকা করে ঘোরা নিষিদ্ধ ছিল । তাই আমরা গঙ্গার অপর প্রান্তে যেতে পারিনি। এছাড়া বহু রাস্তা “নো এন্ট্রি“ থাকায় কার্যত এলাহাবাদ-এ

২৭ ডিসেম্বর সকালে আমাদের যাত্রা পথ আবার এলাহাবাদের দিকে। দেখতে যাব বারাণসী ও এলাহাবাদের মাঝে বাহরি জেলায় অবস্থিত সীতামারহী মন্দির। মন্দিরটি গঙ্গার তীরে অবস্থিত। পুরাণে আছে জনকরাজা চাষের জমিতে হলকর্ষন করতে গিয়ে এই স্থানে নবজাতক সীতাকে মাটি থেকে উদ্ধার করেন। সীতামারহী মন্দির দেখে আমরা রওনা দিলাম বিন্ধুবাসিনী মন্দিরের উদ্দেশ্যে।উত্তরপ্রদেশের সংক্ষিপ্ত সফর করে চলে গেলাম হনূমান মন্দির-এ। বিশাল বড় এই মন্দিরে হনুমানের বিরাট মূর্তি অধিষ্ঠান। চারিদিকে পুলিশে ছয়লাপ। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মন্দিরে পূজো দিলাম। পূজো সাঙ্গ করে সোজা এক হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য চলে এলাম। সুন্দর সাজানো এই হোটেলে খাওয়ার সাথে সাথে চলল ফটো তোলা। সকলে মিলে খুব মজা করলাম। এরপর আবার বারাণসীর দিকে যাত্রা। সন্ধ্যার সময় হোটেলে ফিরে আবার একটু বিশ্রাম ও ফটো সেশন ছোটরা মিলে। সবকিছুর পরে রাতের খাবার খেয়ে বিছানা যাত্রা। কারণ পরেরদিন সকালে আবার বেড়োতে হবে। মির্জাপুর জেলার একটি ছোট জনপদ বিন্ধ্যাচল-এ এই মন্দির অবস্থিত। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল ঐখানে পৌঁছাতে। এতদূর গাড়ীর ধকল নিয়ে আমরা তখন সবাই বেশ ক্লান্ত। দাদাভাইয়ের শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল। যা হোক বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে আমরা মন্দিরে পৌঁছালাম এবং দিদা পূজো দিলেন। সীতামারহী মন্দিরে আসার আগে আমরা সারনাথ হয়ে এসেছিলাম। বারাণসী থেকে ১৩ কিমি দূরত্বে সারনাথ। এখানে রাজা অশোকের সময়ে তৈরী বিখ্যাত “ধামেক স্তূপ” অবস্থিত। ২৪৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। এই স্থানে বুদ্ধদেব তাঁর পাঁচ শিষ্যকে প্রথম ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। কিন্তু দুভার্গ্যবশতঃ সারনাথের মিউজিয়াম দেখা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম । কারণ বিকেল চারটের মধ্যে মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যায়। আমরা পৌঁছেছিলাম চারটের পরে। দুঃখ থেকে গেল প্রাচীন বৌদ্ধ ভাস্কর্য ও শিল্পকলা দেখতে পেলাম না বলে। আরো দুঃখ ছিল মিউজিয়ামে রক্ষিত জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ না দেখতে পাওয়ায়।

পরের দিন অর্থ্যৎ ২৮শে ডিসেম্বর সকালবেলায় বেড়িয়ে পড়লাম বিশ্বনাথ মন্দিরে পূজো দিতে। দিদির শরীরটা খারাপ লাগায় দিদি যায়নি। তাই পূজো দিয়ে কিছু কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরলাম । সন্ধ্যেবেলায় যাব গঙ্গায় পাড়ে সন্ধ্যা আরতি দেখতে।

দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যা আরতি সত্যিই খুব সুন্দর দৃশ্য। আরতির ফটোগুলোও খুব চমৎকার উঠেছিল । সন্ধ্যা আরতি উপভোগ করে হোটেলে ফিরে এলাম অন্য কোথাও গেলাম না। কেননা পরেরদিনের ফিরে যাওয়ার বাঁধাছাদা করতে হবে। মনটা খারাপ ছিল এই কারণে ফিরে গিয়ে আবার সেই গতানুগতিক জীবনে চলতে হবে। বারাণসীতে আমাদের সব জায়গায় ঘোরা সম্ভব হয় নি। ভবিষ্যতে কোনদিন  যদি আবার আসি  সেই আশা পূরণ করব এই ভেবেই মনকে সাত্ত্বনা দিলাম।  ২৯ ডিসেম্বর রাত্রে আমাদের ট্রেন। দুপুরে বিখ্যাত বিশ্বনাথের গলিতে বেরোলাম কিছু পছন্দের জিনিস কিনতে। কিন্তু পছন্দের কাঁচের চুড়ি পেলাম না। দিদি ও মাসিকে বলেছিলাম কেনাকেটা করতে গেলে আমার জন্য যেন কাঁচের চুড়ি নিয়ে আসে। দিদি কথা রেখেছিলো। সন্ধ্যার সময় দিদির ফোনে মেসেজ এলো হিমগিরি এক্সপ্রেস ঘণ্টা দুই লেট হবে। সেইমত আমরা সময় দেখে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু দুর্ভোগ কপালে ছিল। ট্রেন আরও লেট করে এল রাত দুটোর কাছাকাছি। অর্থ্যাৎ তারিখ হয়ে গেল ৩০ জানুয়ারী যেটা আমার জন্মদিনের তারিখ। স্টেশনেই আমকে সবাই জন্মদিনের উইশ করে ছিলো। রাত ২ টো নাগাদ ট্রেন এলে  নির্দিষ্ট কামরায় ওঠার পর সোজা ঘুমের দেশে। ভোরের দিকে একটা হৈ চৈ-এর  শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। জানতে পারলাম আমাদের ফ্ল্যাটের মামীমার (যিনি আমাদের সাথে বারাণসী গিয়াছিলেন) মোবাইলসহ ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। এই ব্যাপারে ট্রেনের টিটিই ও জি আর পি-র কাছে অভিযোগ দায়ের করা হল। মনে মনে ভাবছিলাম এই কামরায় আমাদের সাথে যদি ফেলুদা থাকতেন তাহলে খুব তাড়াতাড়ি চুরির সমাধান হয়ে যেত। সব কল্পনাতো আর বাস্তবে ঘটে না – এইসব ভাবতে ভাবতে কখন দেখি হাওড়ায় পৌঁছে গেছি খেয়াল করিনি। প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির কাঁটা তখন  বেলা ১২টার কাছাকাছি। ট্রেন থেকে ধীরে সুস্থে নেমে যে যার বাড়ীর অভিমুখে রওনা দিলাম। শুধু স্মৃতিতে থেকে গেল গত কয়েকদিনে বারাণসীর জয়যাত্রা। 

তবে দুটো প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলাতে পারছি না। প্রথমতঃ টাটাসুমোতে অতদূর যাত্রা করে আমরা যখন ক্লান্তিতে অবসন্ন তখন দিদা কি করে, কোন প্রাণশক্তিতে বিন্দুবাসিনী মন্দিরে হেঁটে গিয়ে পূজো দিলেন?  দ্বিতীয়তঃ আমার খুনসুটি ও সীমাহীন আবদার সহ্য করে কি করে দিদি হাসি মুখে আমার সব চাহিদা মিটিয়েছিলো সেটাই আশ্চর্যের! আসলে মনে হয় সবই বাবা বিশ্বনাথের অপার মহিমা! 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page