প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
পুজো বার্ষিকী
১৪৩০
কবিতা
কবিতা
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
প্রবন্ধ
'মানুষ মানুষের জন্য', এই গানটাই প্রথম মনে এসেছিল ভাসমান নৌকায় ভাসতে ভাসতে এক আকস্মিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে। আর তারই ফসল আজকের এই বাড়তি পাওনা, অপূর্ব এক সবুজ দ্বীপ ভ্রমণ।
মাঝে মাঝে যেমন ঘরের ফার্নিচারের অ্যারেঞ্জমেন্ট বদলালে নতুন ঘরে বাস করছি বলে মনে হয় তেমনই মনকে সতেজ রাখতে স্থানান্তরের দরকার পড়ে, সেটা নিকট হোক বা দূর যাই হোক না কেন।
ইদানিং কর্মস্থল পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম সীমানায় অবস্থানের সূত্রে এক অন্য দুয়ার খুলে গেছে আপনা থেকেই। সেই মতো আজকের গন্তব্য আসামের এক বহু প্রাচীন বন্দর শহর, ধুবড়ি। যার সাথে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক লোকগাথা, ব্রিটিশ আমলের আন্তর্জাতিক নদী বন্দর, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, গুরু নানকের পদধূলি থেকে দেবদাস খ্যাত প্রমথেশ বড়ুয়ার নাম।
যাত্রাপথে একে একে পেরিয়ে চললাম তুফানগঞ্জ, বক্সিরহাট, হালাকুড়া, আগমনী প্রভৃতি জনপদ। একেবারেই সাদামাটা মফস্বলি জায়গা, জনজীবন চলছে আপন ছন্দে। রাস্তাঘাট এবং গ্রামাঞ্চল দেখে বোঝা যাচ্ছে জায়গা গুলো মুসলিম অধ্যুষিত। ধুবড়ি জেলা ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা সমূহের মধ্যে অন্যতম। এরই মধ্যে কখন রাস্তার পাশে রেললাইন সঙ্গী হয়েছে। রাস্তার দুপাশে মান্দার ফুলের স্নিগ্ধ লালে চোখে ঘোর লাগার উপক্রম। ফাগুনের শেষে নিম্ন আসামের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ির দিকে মান্দার গাছে আগুন রঙা ফুলের আধিক্য চোখে পড়ার মতো।
এসে পড়লাম গৌরীপুর, যার নাম বহু আগে থেকেই শুনে আসছি নানাভাবে। এখানকার রাজবাড়ির সন্তান প্রমথেশ বাবু, তার ভাই হস্তি বিশারদ লালজি অর্থাৎ প্রকৃতীশ বড়ুয়া তথা ওনার কন্যা 'মাহুত বন্ধু রে' খ্যাত প্রতিমা বড়ুয়া সকলেই নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত।
আসলে গৌরীপুর আর ধুবড়ি হল যমজ শহর। সামনের রাস্তা চলে গিয়েছে গুয়াহাটি অভিমুখে। আমরা গৌরীপুর থেকে ডাইনে টার্ন নিলাম। অনেক আগে থেকেই রেললাইন সাথে সাথে চলছিল, এখন রাস্তার বাঁ পাশে যোগ দিল গদাধর নদী যেটা ধুবড়িতে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। বর্ষায় এর রূপ একদমই আলাদা, তখন গৌরীপুর ও ধুবড়ির অনেক স্থান বানভাসি হয় এর প্রকোপে। একপাশে রেললাইন অপর পাশে নদীকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম ধুবড়ি।
শহরে এখনো পুরনো রিক্সার চল, টোটো এখনো টো টো করে ঘুরতে শুরু করেনি।
রিক্সা ধরে এগিয়ে চললাম ঘাটের দিকে, রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ছে নতুন ও পুরোনো বাড়ির মিশেল। রিক্সাওয়ালাকে এখানের ম্যাচ ফ্যাক্টরির কথা জিজ্ঞেস করাতে বললো যে সেটা তো অনেকদিন থেকে বন্ধ। কথার মধ্যে কোথাও একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে মনে হলো। হয়তো এই ফ্যাক্টরির সাথে জড়িয়ে ছিল তার সম্পূর্ণ পরিবারের জীবন যেটা বন্ধ হওয়াতে তাকে এই জীবিকা বেছে নিতে হয়। সত্যিই একসময় সারা ধুবড়ি পরিচিত ছিল এই ম্যাচ ফ্যাক্টরির জন্য। ১৯২৬ সালে সুইডিশ কোম্পানি ১৩২ বিঘা জমিতে স্থাপন করে এই ম্যাচ ফ্যাক্টরি, তখন নাম ছিল Assam match factory। সে সময় ২০০০ শ্রমিক কাজ করতো তাতে। পরে ১৯৭৯ সালে এর নাম হয় WIMCO বা Western India Match Factory। পরে ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, সংরক্ষিত জঙ্গলের গাছ কাটা যাবে না আর তারই প্রভাব এসে পড়ে এই ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে এবং সে বছরই পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই শতাব্দী প্রাচীন কারখানাটি।
এরই মধ্যে এসে পৌঁছলাম বিখ্যাত নেতাই ধুবুনীর ঘাটে। কথিত আছে সাপের দেবী মনসার ভগ্নী ছিলেন নেতাই, একজন ধুবুনী বা ধোপানী। নেতাই এর পরামর্শ মতে সতী বেহুলা তার স্বামী লখীন্দরের জীবন, যমের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এই নেতাই ধুবুনীর কাপড় কাচার ঘাট ছিল এখানে ব্রহ্মপুত্রের তীরে। ঘাটে অবস্থিত প্রকান্ড এক পাথর, যেটার উপরে কাপড় কাচা হতো, এখনো রয়েছে সেটা সংরক্ষিত অবস্থায়। আর এই ধুবুনী শব্দ থেকেই ধুবড়ি নামের উৎপত্তি বলা হয়।
কিছুক্ষণ বসে রইলাম ব্রহ্মপুত্রের অপার জলরাশির দিকে চেয়ে, পাশেই গদাধর এসে মিশেছে। স্লেট রঙা জলে ছায়া দোলে, ভাঙে, চুরমার হয়। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে গারো পাহাড়ের রেখা দৃশ্যমান। আহা, এ দৃশ্য যে ভোলার নয়। এতকিছু চোখের সামনে, ভাবতেই মন অনাবিল এক আনন্দে নেচে ওঠে অর্থাৎ আমি সঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। পাশেই রাহুল দেব বর্মণের নতুন বসানো আবক্ষ মূর্তি স্বভাবতই মন ভালো করে দিল, তাঁর সুরে মজে ছিল একসময় আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসী। আমিও তো সেই সাত বছর বয়স থেকে মজে মেহবুবার 'মেরে নয়না শাওন ভাদো' শোনার পর থেকে। যে কোন ভ্রমণ কাহিনী তো আসলে আত্মজীবনীরও একটা টুকরো।
কোনও নতুন জায়গা দেখতে হলে পায়ে হেঁটে ঘোরাই প্রকৃষ্টতম, তাই নদীর ধার বরাবর হাঁটা দিলাম। এ শহরের সাথে আমার দেখা চন্দননগরের মিল রয়েছে কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের সাথে কারো কোনো তুলনা চলে না। কেউ কেউ নদ হয়ে জন্মায়, অন্যরা নদী। জনমানসে ভাবমূর্তিকে চাঙ্গা করে রাখতে রাখতে খানিকটা পুরুষালী গাম্ভীর্য ক্রমশ তার মজ্জায় ঢুকে পড়ে। তাই একটু এগিয়েই বিরাট ব্রহ্মপুত্র চলে গিয়েছে বাংলাদেশে, নারী হওয়ার বাসনায়। এতো দিনের পৌরুষ ত্যাগ করে সে সেখানে উচ্ছল যুবতী যমুনা।
এখানে তীর বরাবর এক একটি প্রশাসনিক দপ্তর, বেশ জমজমাট এ চত্বর। চোখে পড়লো কাঠের তৈরি অপূর্ব সার্কিট হাউস, কিছুক্ষণ আমাকে স্থবির করে রাখলো এই অসাধারণ কাঠের তৈরি ইমারত। এখানকার পৌরসভা ১৮৮৩ সালের, স্বভাবতই এক পুরাতনী জৌলুসপূর্ণ ছাপ রয়েছে সারা শহর জুড়ে। পাশেই ভূমিপুত্র ভুপেন হাজারিকার বিশাল মূর্তি। ভালো লাগলো যে মূর্তিতে পাখিদের আদরের চিহ্ন লেগে নেই। এগিয়ে চললাম নদীর তীর বরাবর। অচেনা, অজানা জায়গায় একা একা হাঁটতে ভারী ভালো লাগে। একা তো নয়, যেন নিজেকেই নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ রূপে পাওয়া।
একটু পরেই এসে পড়লাম বিশালাকার গুরুদোয়ারার সামনে। ধুবড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই গুরু তেগ বাহাদুর সাহিব গুরুদোয়ারা। গুরু নানকের পবিত্র চরণধূলি মিশ্রিত এই মাটি। গুরু তেগ বাহাদুরও এসেছিলেন এই বন্দর নগরীতে। শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বড়ই পবিত্র এই ভূমি, অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও এখানে শ্রদ্ধার সাথে আসেন। গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, সামনে বিশাল প্রশস্ত চত্বর। একদিকে মূল মন্দির অপরদিকে লঙ্গরখানা সহ উপরে থাকার জায়গা।
জুতো খুলে, হাতে পায়ে জল দিয়ে, মাথার চুল ঢেকে প্রবেশ করলাম মূল মন্দিরে। আরাধনা চলছে ভিতরে, চারিদিক ঘুরে দেখলাম। অপূর্ব সব নকশা কারুকাজে সজ্জিত উপাসনাগৃহটি। আর এখানের প্রসাদ মানেই তো ঘিয়ে মাখোমাখো হালুয়া।
পাশে অফিস ঘর, ভিতরে গেলাম থাকার কি নিয়ম জানতে। যিনি ছিলেন তিনি সুপ্রসন্ন মুখে আমার দিকে চেয়ে বললেন 'আগে নাস্তা তো করে নেন'। খিদেও পেয়েছিল, তাই বাধ্য ছাত্রের মতো ওনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চললাম লঙ্গরখানার দিকে। যাওয়া মাত্রই আমাকে থালা নিতে বললেন। থালা নিয়ে বসে পড়লাম, পরিবেশিত হল রুটি, তরকা জাতীয় ডাল ও পায়েস। খেতে খেতে মনে পড়ছিল অমৃতসরের কথা, ওখানের বিশালাকার লঙ্গরখানার কথা। স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনেছিলাম ওখানের প্রত্যেক বাড়ির মেয়ে, বৌমা বা শাশুড়ি কেউ না কেউ রোজ এসে এখানে সেবা দিয়ে যান। কথাটা শুনে খুব ভালো লেগেছিল, প্রত্যহ এমন সদ্ অভ্যাসের কথা ভেবে। যাইহোক এর মধ্যেই একজন চা দিয়ে গেল। পেটপর্ব সমাধা করে বের হলাম গুরুদোয়ারা থেকে।
কিছু দূর গিয়ে দেখি রাস্তার পাশেই এক ছিমছাম ব্রাহ্মমন্দির। চারপাশ সবুজ গালিচার মতো ঘাসে ভরা। লেখা রয়েছে স্থাপনা কাল, ১৮৭৫। বন্ধ দরজার সামনে বসে পথচলতি এক কিশোর কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছে। স্থাপনা কাল দেখেই মন এক ঐতিহাসিক হিসেব মেলাতে শুরু করলো। পড়েছিলাম যে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবীর বিবাহ হয় কুচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়নের সাথে ১৮৭৮ সালে। কেবল কন্যার বিবাহ নয়, সঙ্গে সঙ্গে কেশববাবু নূতন ধর্ম ও নীতি কুচবিহারে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে কুচবিহার থেকে মাত্র ৮০ কিমি দূরের ধুবড়িতে তারো আগে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা হলো কার দ্বারা। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন কারণ এখন যে প্রকৃত সিধুজ্যাঠার বড়ই অভাব। যাইহোক এসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।
এখানের যাত্রী পরিবহনের মূল ঘাটটি হলো যোগমায়া ঘাট। সারি সারি লঞ্চ, নৌকা দাড়িয়ে রয়েছে। চারিপাশ থিকথিক করছে মানুষ জনে। সবার মধ্যেই ব্যস্ততা, কেউ ঘাটে নেমে শহরে আসছে তো কেউ লঞ্চ ধরতে ছুটছে। তারই মধ্যে চলছে হরেকরকমের বিকিকিনি, জোরকদমে। ঘাটের দুইপাশে সারি সারি খাওয়ার হোটেল, তাতেও ব্যস্ততা। প্রত্যেক হোটেলের খদ্দের ধরার তৎপরতা চোখে পড়ছে, কর্মচারীরা মেনু শুনিয়ে যাচ্ছে গড়গড়িয়ে। যেন এ এক অন্য ভারত চাক্ষুষ করছি
আমি। নিজেই মনে করার চেষ্টা করছি, এমন কি কখনো পেয়েছি আগে? না। তবে এমন বর্ণনা অনেক পড়েছি বইয়ে। সবই পূব বাংলা তথা পরের বাংলাদেশ কেন্দ্রিক লেখায় জাহাজঘাটার বর্ণনায়। তবে পড়ার সময় লঞ্চঘাটার সুস্বাদু খাবারের কথা শুনে যেভাবে জিভে জল আসতো, সেটা আর হলো না গুরুদোয়ারার উদরপূর্তি ও হোটেলের পরিবেশ দেখে। এক একটা লঞ্চ থেকে প্রায় ৫০০ মানুষ নামছে, হয়তোবা বেশীও হতে পারে। আসছে তারা তিন চার ঘন্টার পথ অতিক্রম করে ফুলবাড়ি, হাটসিংমারি থেকে। একটা লঞ্চ দিনে একবারই যাতায়াত করে। প্রত্যেক লঞ্চ বা নৌকায় উড়ছে ভারতীয় পতাকা তার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য। সত্যিই এ এক অন্য জগৎ, এখানে না এলে এক অন্য ভারত এদেখা থেকে যেত। যাত্রীরা যেখানে অপেক্ষা করছে লঞ্চ ধরার জন্য, সেরকম একটা জায়গা বেছে একটু বসলাম। যদিও সেটা আমার কাছে অবজারভেশন ব্যালকনি বলা যায়। ফুরফুরে হিমেল হাওয়া বইছে চারিপাশে। সূর্য মাথার ওপরে, তবে এ রোদ কষ্ট দেয় না, এখনো শীত এদেশে। তবে যেটা মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আমারই কোন গন্তব্যে পৌঁছবার তাড়া নেই। খবরদারি নেই ঘড়ির ওপর। মূল্যবান সময়কে পথের মেজাজের উপর ছেড়ে দিয়ে উদ্দেশ্যহীনতাকে পাথেয় করে এরকম বিরতির মজাই আলাদা।
ঘড়িতে এখন সাড়ে ১০টা বাজে, এগিয়ে গেলাম লঞ্চের খবর নিতে যদি কাছাকাছি কোথাও যাওয়া যায়। তবে খবর আশাপ্রদ নয়, কারণ এখানের প্রত্যেকটা লঞ্চ, যেটা যাবে তার গন্তব্যে, সে আর আজকে ফিরবে না কারণ যাত্রাপথ প্রত্যেকের কম বেশি তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা। ধুবড়ি থেকে একমাত্র একটা লঞ্চ সকাল ৮টায় ছেড়ে হাটসিংমারি পৌঁছায় পৌনে ১২টায়। আবার সেটা ২টোয় ছেড়ে ধুবড়ি ফিরে আসে সন্ধ্যা ৬টায়। ধুবড়ি থেকে অফিস যাত্রীরা এটাতেই অফিস করে। হাটসিংমারি জায়গাটা হচ্ছে এক নদীবন্দর শহর যার অর্ধেকটা আসাম আর বাকি অর্ধেকটা মেঘালয়। কি, শুনেই যেতে ইচ্ছে করছে না এমন এক দিকশূন্যপুর দেশে। আমি আজ ফিরবো মনস্থির করে এসেছি, তাই ও পথে আর পা বাড়ালাম না কিন্তু যাব তো অবশ্যই একদিন। তাই বিফল মনোরথে ফিরে এলাম আগের স্থানে। এদিকে মন বলেই চললো যে হাতে কিন্তু সময় আছে তাই আবার খবরাখবর নিতে পাশের নৌকা ঘাটে গেলাম। আমার প্রোগ্রাম তাদের বলাতে, তারা বললো তাহলে নৌকা করে সামনের চরটা ঘুরে আসুন না। জিজ্ঞেস করে জানলাম ১১টায় যে নৌকা যাবে সেটি সামনের চরে পৌঁছাবে পৌনে ১২টা নাগাদ। তারপর সেটা ফিরে আসবে ১২টাতে আর ধুবড়ি পৌঁছাবে সাড়ে ১২টা নাগাদ।
সেই মতো নৌকায় চেপে বসলাম। নৌকার সকলেই প্রায় সামনের চরগুলোর বাসিন্দা, নানা বয়সের মহিলা পুরুষ। আপন আপন দলে গল্প বেশ জমিয়ে চলছে। মাঝে ঝালমুড়িওয়ালা এরই ফাঁকে যাত্রী টপকে বিক্রি করে চলেছে। সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের, পুরুষদের অনেকের কাঁধে আসামের বিখ্যাত গামোছা জড়ানো। কোথাও যাওয়ার রাস্তায় সামনের অচেনা নারী পুরুষের চরিত্র, জীবিকা ও পাশাপাশি দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে ধারণা করে নি। অনেকসময় তা মেলে আবার কখনো তা মেলে না। তবু মনে মনে এই রকম অনুমানের খেলা খেলতে বেশ লাগে। যাত্রী বসার পর নৌকা ভরতে থাকলো নানারকম মালপত্রে, গ্রোসারি সামগ্রী থেকে ঝাঁকা ভর্তি মুরগী কিছুই বাদ থাকলো না। এরপর নৌকা ঘাট থেকে বেরোলো অনেককে পাশ কাটিয়ে, মাঝে মাঝে এক দুটো টক্কর যে লাগলো না তা নয়। নৌকা এবার মূল নদীতে এসে পড়লো। নৌকায় বেরিয়ে বুঝলাম, লঞ্চ ভ্রমণের সাথে এর কোনও তুলনায় হয় না। নৌকোয় বসে নদীকে অনেক বেশী কাছে পাওয়া যায়। চারিদিকের গল্পের মাঝে আমিই একমাত্র নদীকে দুচোখ ভরে চাক্ষুষ করছি কারণ বাকিদের তো এটা রোজনামচা। হাওয়ায় বেশ শীত শীত ভাব, মাঝে মাঝে ঝাঁকা ভর্তি মুরগী থেকে আসা বাতাস, আমাকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনছে।
এরই মধ্যে আমার পাশে বসা এক পরিবারের একটা ২৫-২৬ বছরের সুশ্রী যুবক মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো 'আপনি কি হাসপাতাল যাবেন?' আমি না বলে, তার এই উদ্ভট প্রশ্নের কারণ জানতে চাইলাম। তখন সে বললো যে, সামনের চরে তার বাড়ি। ওখানের গ্রামীণ হাসপাতালে মাঝে মাঝে ধুবড়ি থেকে ডাক্তার বাবুরা আসেন। আমাকে সে ডাক্তার ভেবেছিল। হঠাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেইসব পরীক্ষার দিন গুলোর কথা, যদিও জানি ডাক্তারী পরীক্ষা আমার পক্ষে একটু হেভিই ছিল। ক্লোজ বন্ধু ডাক্তার হলে পার্থক্যটা আরো ভালো বোঝা যায়। শুধু মাথায় ঢুকছিল না হঠাৎ করে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আসামে ডাক্তারী করতে আসার ব্যাপারটা। আবার মুরগীর ঝাঁকার আমিষ হাওয়া আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো।
এরপর আমাদের মধ্যে কথাবার্তা জমে উঠলো। সে বললো তার নাম সোহন হোসেন। সামনের স্থলভূমি দেখিয়ে বললো আগে ওখানে ওদের বাড়ি ছিল, এখন গৌরীপুরে থাকে, পড়াশোনা করে ব্যাঙ্গালোরে। মাকে নিয়ে দিদির বাড়ি চললো। আমার কাছে প্রোগ্রাম শুনলো যে সামনের চর ঘুরে এই নৌকাতেই ধুবড়ি ফিরে যাব। এরই মধ্যে নৌকা মাঝ নদী পেরিয়ে তীরের দিকে চলেছে। নদীর স্রোতধারার বুকেই পাশাপাশি এই রকম দু তিনটে চর, তবে সামনেরটা তো বিশাল এক দ্বীপ। সোহন বললো যে আপনার হাতে কতো সময় আছে, দু ঘন্টা আছে?
আমি বললাম কেন?
তখন সে বললো আপনি আমাদের চর ঘুরতে এসেছেন আর এভাবে ফিরে যাবেন, তাই কি হয়। আমি আপনাকে আমাদের চর ঘুরিয়ে দেব, দেড়টার মধ্যে আপনাকে আমি নৌকা ধরিয়ে দেব।
এরপর ও নদীর দিকে দেখিয়ে বললো ওই পিলারগুলো দেখতে পাচ্ছেন? দেখলাম সত্যিই দূরে নদীর মধ্যে অস্পষ্ট কয়েকটা পিলার দেখা যাচ্ছে। তখন ও বললো ধুবড়ি থেকে ফুলবাড়ি অবধি ব্রিজ তৈরি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের উপর। পরে জেনেছিলাম এটা ভারতের দীর্ঘতম ব্রিজ হতে চলেছে, লম্বায় ১৯.৩ কিমি তবে শেষ হতে এখনো কয়েক বছর। আমাদের কথাবার্তায় শুধু ব্রহ্মপুত্রের অপার জলরাশি ভাগ হয়ে যাচ্ছিল পানি ও জল এই দুই ধর্মভাষায়।
নৌকা এরমধ্যে এক একটা ঘাটে দাঁড়াতে থাকলো। যাত্রী এবং মালপত্র একে একে নামছে। কপাল খুব ভালো, প্রথম ঘাটেই কুক্কুট ঝাঁকা নেমে গেল, যাক সাময়িক স্বস্তি। ঘাটে দাড়িয়ে রয়েছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি মালপত্র বহনের জন্য। এদিকে আমার মধ্যে শুরু হয়েছে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব। সোহনের কথা মতো যেতে তো ইচ্ছা করছেই এক নতুন পৃথিবী দেখতে কিন্তু আবার ভাবছি একদম অপরিচিতের সাথে এভাবে অচেনা জায়গা যাওয়াটা ঠিক হবে? মনস্থির করতে একটু সময় লাগলো, তারপর মনে হলো মানুষকে বিশ্বাস না করলে আর কাকে করবো? সাথে মনে আসছিল আসামের আতিথেয়তার কথা। আর এরকম একটা সুযোগ নষ্ট করতেও মন চাইছিল না। তাই তৎক্ষণাৎ ওকে আমার সম্মতিটা জানিয়ে দিলাম। সে তখন ফোন করে কাকে কি বললো। নৌকা একটি দুটি ঘাট পেরিয়ে চললো, আমরা নামবো শেষ ঘাটে। এখান থেকেই ফেরার নৌকা ছাড়বে। নৌকা ঘাটে লাগলে এক এক করে নামতে থাকলাম।
চরে নেমে শরীরটাকে একটু ছাড়িয়ে নিলাম, একটানা এতক্ষণ নৌকায় বসে থাকার জন্য। সোহনের কথা মতো এগিয়ে গেলাম ওর সাথে, দেখছি সবাই ওর পরিচিত, গ্রামে যে রকম হয়। কিছুদূর গিয়ে এক বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। এদিকে আমার মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব, কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না, যার সাথে যাচ্ছি তাকেও চিনি না কিন্তু সেই এখন আমার এই অচেনা অজানা জগতে একমাত্র পরিচিত। এ এক অস্থির মানসিক দোলাচল, ফিরেও যাওয়া যায় না। এরমধ্যে দেখলাম ওর এক বন্ধুই হবে, বাইক বের করে রেখেছে। কিছু কথাবার্তার পর ওর মাকে বললো দিদির বাড়ি চলে যেতে, আমি চড়ে বসলাম বাইকে। বাইক চলতে থাকলে একটু স্বস্তি এলো মনে, একটু হালকা বোধ করলাম। ও একে একে দেখাতে থাকলো ওর পুরোনো স্কুল, মাদ্রাসা, পঞ্চায়েত অফিস। সাথে কথাবার্তাও চলছে, যেন কত দিনের পরিচয় আমাদের। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এই দেখুন মানসিক টানাপোড়েনে দ্বীপের নামটাই বলা হয়নি, এর নাম বীরসিং। দ্বীপে প্রচুর ঘোড়া গাড়ি মালপত্র বহনের জন্য, তাই এখানে সেখানে কয়েক শো ঘোড়া চোখে পড়লো। সোহন দেখালো, ওই যে আমাদের হাসপাতাল। আমি আমার রূপকথার কর্মস্থলটা একবার চাক্ষুষ করে নিলাম। শেষে দোকানে খাবার খাইয়ে আমাকে ঘন্টা খানেকের এক অনাবিল আনন্দ দিয়ে নৌকা ঘাটে পৌঁছে দিল। নৌকাও এসে পড়েছে, ১০ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে। এই ঘন্টা খানেকের আলাপে, সে এখন আমার আপনজন হয়ে পড়েছে, কত কথা বলে চলেছি দুজনে। সে আমাকে বলছে রাত্রে থেকে যেতে। বলে, আপনার জন্য তো কিছুই করা হলো না। পরের বার এসে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলাম। হঠাৎ সে বললো উঠে পড়ুন, এবার নৌকা ছাড়বে। ফিরতে তো হবেই কিন্তু কোথাও একটা টান অনুভব করছিলাম ভিতর থেকে। চেপে বসলাম নৌকায়, ছাড়ার পর যতক্ষণ অবধি দুজন দুজনকে দেখতে পাচ্ছিলাম, দুজনে হাত নেড়ে চলছিলাম। এদিকে শীতের দুপুরের আলোছায়া মেখে ব্রহ্মপুত্র কেমন স্মিতমুখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
কবিতা
সুব্রত মিত্র
কলকাতা
তলিয়েও অম্লান
আমাদের যৌবনের আবরণ মেখে
আমি স্নাতক হতে পারবো না,
প্রেমচাতক সাজবো,
তবু খরার ন্যাড়া মাথায় বৃষ্টির ঢেউ তুলব না।
প্রেম নগরে সবুজের বনে
বউ কথা কও কোকিলের কুহুবাণী
জানি আসবে কানে,
ভ্রমর নিরলস খোঁজে মধুর কলস
কোন কবি উপন্যাস লিখে চলে ধরণীর মায়াবলে।
বসন্তের রজনী, নিদ্রা লেগে তারাদের চোখে
যৌবন দেখেনি তবু, সুন্দরী রমণী
কালো কেশে প্রজাপতির কবিতা লেখে।
কবি কেন হয়েছি তারে ভালবেসেছি
এ যে মৃত্যুর প্রেরণার গান লিখে করেছি স্নান,
ভীরু কাপুরুষ তাই অসাহসে তলাই
রুক্ষ তরু বৃক্ষের পাশে আজও বসে আমি অম্লান
বঙ্গের নিয়তি
আজ দৌলতবাজিতে দোল খায় দুনিয়া
দুনিয়ায় চলছে শুধু ধ্বংসের অবলীলা
অমনোযোগীরা হয় কৃতকার্য
মনোযোগীরা হয় সদা ব্যর্থ,
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে দেখি এসব কি আয়োজন?
নেই সেথা শিক্ষা সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি
আছে শুধুই বিনোদন
আছে শুধু হাহাকার আছে শুধু আস্ফালন;
শিক্ষাঙ্গনেও নেতার মন্ত্র...!
রাজ্যজুড়ে আছে শুধু নেতা নেত্রীর রঙ্গমঞ্চ
তামাশার ভারে তারা খুঁজছে আরো কিছু সঙ্গ
দৌলতবাজির ধাক্কাতেই যাচ্ছে পিছিয়ে
আমাদের সোনার পশ্চিমবঙ্গ,
দৌলতের কারবারীরা ধাপ্পাবাজির স্কুল খুলেছে
সেই ইস্কুলেই রত্ন সম সম্ভাবেরা জ্বলছে আর পুড়ছে,
নিয়তির ফাঁড়ায় কি দশা-ই যে গিলছে তোমায় আমায়..!
আজ দৌলতবাজিতে দুনিয়াটা দোল খায়
ধাপ্পাবাজির খপ্পরে পড়ে আমরা সবাই অসহায়।
আওল ফাগুন
ফুটিলা পলাশ শাখে পিক কুহু গায়
চল চল যাব সখি শ্যামল বন ছায়।
আসিবে কালিয়া বঁধু সাথে লয়ে ধেনু
তমাল তলেতে বসি বাজাইবে বেনু।
দরশিব পিয়া মুখ হৃদয়ের আশ
জুড়াইব জ্বালা দুই আঁখির পিয়াশ।
পিয়া দরশন বিনা নহে চিত থির
কালিয়া বঁধুর লাগি হৃদয় অধীর।
দাবানল সম দহে যৌবন আগুন
অশোকানন্দন ভনে আওল ফাগুন।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা
বাংলাকে বড় বেসেছি যে ভালো, বাংলাকে ভালোবাসি
আমি একবার নয়, বারবার যেন বাংলায় ফিরে আসি।
বাংলা আমার “গীতাঞ্জলী” “শ্যামলী” “সোনারতরী”
“অগ্নিবীণা”র বাংলা আমার, বাংলায় দ্রোহ করি।
এপার বাংলা ওপার বাংলা, বাংলায় বাঁধা সেতু
দুজনেরে বড় বেসেছি যে ভালো বাংলাই তার হেতু।
বাংলা আমার চিন্তা চেতনা, বাংলায় বাঁধি গান
গর্ব আমার বাঙালি আমি, ভারতের সন্তান।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা, তারই জয়গান গাই
বিশ্বের প্রতি ভাষাকে আমার প্রাণের প্রণাম জানাই।
ভজ রে শ্রীগোরা ধন
মিছে বেলা গেল চলে না হল আর গুরু করণ
ভজ রে শ্রীগোরা ধনে ধরে নিতাই চাঁদের চরণ।
এই যে দেহ মহানগর রসে ভরা রসের সাগর
সেথায় রসে দিচ্ছে ভিয়েন মনোময় রূপ মনের নাগর
সেই নাগরের সাধন করো ওরে আমার পাগল মন
ভজ রে শ্রীগোরা ধনে ধরে নিতাই চাঁদের চরণ।
প্রেমময় কামকান্তমনি এই নগরে থাকেন শুনি
চৌদ্দভুবন চন্দ্র সুরজ তারই অধীন এমন গুণী
সুকান্ত কয় সেই নগরে দ্বারী সেজে আছেন মদন
ভজ রে শ্রীগোরা ধনে ধরে নিতাই চাঁদের চরণ।
আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়
আ...কা...শ
মহিলারা প্রচন্ড লড়াই করছে
বোম নেই, নেই বুলেট বা বেয়নেটতর্কাতীত ঐক্যের ফলে
বিনা পিস্তলে
তোমাদের দেশে
দাউদাউ আগুন
গ্রাস করে নিচ্ছে
স্কার্ফ, হিজাব আর
মেকি মর্যাদা
তেহরানের রাস্তায়
মুখে মুখে আজ অভিশাপ—
'একনায়কের মৃত্যু চাই'।
নির্দয়কে বেড়ে ওঠার
সুযোগ না দিয়ে
লড়াই করে মরাই
বেশি ভালো নয় কি?
কবিতা
প্রজ্ঞা বাজপেয়ী
ভাষান্তর: গৌতম চক্রবর্তী
দয়ার মৃত্যু
মেহসা, শুনতে পাচ্ছ
সারা পশ্চিম আজ
ফেটে পড়েছে প্রতিবাদে
নির্মম অবিচার, ঔদাসীন্য
আর হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে
প্রতিবাদীরা মরছে কিন্তু হারছে না
দেখছি, দেখতে পাচ্ছি
নীতি পুলিশের মারে
তোমার কান দিয়ে রক্ত ঝরছে
উফফ, কী নির্মম
ওদের হাতে, ওখানে
হ্যাঁ, ওখানেই
দয়ার মৃত্যু হয়েছে
সে আঘাত কি আদৌ কম?
তোমার হয়তো ঘুম ভালো হচ্ছে
কিন্তু এখানে চেতনার মৃত্যুতে
ঘুমের দফারফা, যেন
প্রিয় মেহসা,
ওই প্রবল নারীশক্তির
হয়ে প্রার্থনা কর,
প্রার্থনা কর তোমার আত্মা
যাতে সুবিচার পায়।
ওরা যাতে আরও সাহসী হয়ে
প্রাণের জোয়ারে সব
ভাসিয়ে দিতে পারে
সেই কামনা কর,
কামনা কর শেষ পর্যন্ত
যেন এই মনোবল
ওদের অটুট থাকে।
ইরান এখন এক প্রতিরোধের প্রতিমূর্তি।
(হিজাব-বিরোধী প্রতিরোধের জন্য পুলিশ হেফাজতে থাকা মেহসা আমিনির মৃত্যু হয় মাত্র ২২ বছর বয়সে। সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমস্ত ইরান প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। কবিতাটির লেখিকা ন্যাশনাল ডিফেন্স আকাদেমিতে কর্মরতা একজন কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক।)
প্রাণ পাখি
মরণ ও মরণ
দেখছি যে কাছ থেকে।
ঘোলাটে চোখে
আবছায়া পরকায়া
যেনো। অঙ্গ হচ্ছে বিকল
যন্ত্রের হাওয়ায় হাঁপর টানার
পালা। অতিথি হয়ে
রাজসরালি, ডাহুকের মতো
উড়ে যাবে সোনাদিঘি আর ঝিনাইদহ ছেড়ে।
কবিতা
ভাস্কর সিন্হা
দুবাই
কবিতা
স্বরূপ মণ্ডল
কান্দি, মুর্শিদাবাদ, পঃ বাংলা
বহুরূপে
সিংহ দেখতে দেখতে হয়ে উঠি সিংহ,
বাঘ দেখতে দেখতে বাঘ
হরিণের পানে চেয়ে উঠেছি হরিণ হয়ে,
ছাগের ভিতরে আমি ছাগ
ফুলদলে দেখি চেয়ে নিজের শোভিত রূপ,
কাঁটাতে কন্টকিত মন
আগুনের মতো করে জ্বলেছি আগুন ভরে,
পুড়িয়েছি কতশত বন।
আকাশের আসমানী, নিজেরে আকাশ মানি
বাতাসেতে মিলিয়েছি শ্বাস
জলের জলীয় ভাবে, মাটিতেই মাটি হবে
দেহ, মন আর বিশ্বাস।
কাস্পিয়ান
তোমাকে নিয়ে—
অজানার পথে,
যেখানে থাকবে না কোনো সভ্য ট্রাইব—
দৃষ্টির বাইরে গিয়ে
নোঙর ফেলা গেলে কোথাও!
যেখানে চলবে না আন্তর্জাতিক আইন—
সেখানে,
যেখানে—
হিজলের বন পেখম মেলে ছড়িয়ে পড়বে,
আরও দূর থেকে ডেকে উঠলে রামশালিকের ছানা—
আমরা খেলব ছোঁয়াছুঁয়ি।
অথবা,
আমাদের ঠিকানা হতে পারে কাসপিয়ানে
যেখানের জলকে ঘিরে আছে কেবল উত্তেজনা!
না জানি কবে মধুকর ডিঙায় ভেসে গেলে
তুমি এবং আমি—
ওরা বলবে, এই প্রেম আমাদের।
কবিতা
এস এম রায়হান চৌধুরী
গাজীপুর, বাংলাদেশ
কবিতা
ডাঃ প্রণব কুমার দাস
বিদ্যাপীঠ রোড, কলকাতা
অহল্যা অভিশাপ
আজও নিয়মে ওঠে সূর্য
প্রখর তেজ, ঝাপসা আলো।
ধোঁয়াশায় ভারি বাতাস,
শ্বাস বায়ুর নিদারুণ সঙ্কট।
দিকে দিকে হাহাকার,
দগ্ধ- আবদ্ধ, ছারখার...
সংজ্ঞাহীন চেতনা, স্থবির প্রজ্ঞা।
তন্দ্রাচ্ছন্ন যৌবন, প্রবৃত্তির ঘোর লালসা।
দ্যুতিহীন ভবিষ্যৎ, আছে ভিক্ষার দান...
দুর্বৃত্তের উদ্দাম নাচ, ক্ষমতার আস্ফালন।
বিকারগ্রস্থ শিক্ষা, বেকারত্বের কারখানা।
জীবন - মৃত্যুর নামান্তর!
শুধুই প্রবঞ্চনা।
চাটুকারিতার তরুলতা - গুল্ম হতে পূর্ণ বৃক্ষ,
সর্বনাশা প্রশস্তির নিত্য আড়াম্বর।
তবু পাষাণী হৃদয়, উচ্চাভিলাষী...
চায় আরও ক্ষমতা, বোঝে জয়-পরাজয়।
স্থিতিহীন পরিস্থিতি...
উত্তাল সময়।
লেনদেন, বোঝাপড়া আর গোপন আঁতাত।
অস্তমিত যৌবন!
অন্তহীন অপেক্ষা ...' অহল্যা অভিশাপ'।
কবিতা
অনির্বাণ দত্ত
নিউটাউন, কলকাতা
শুধু লাশ গুনি
আমরা আসলে শুধু লাশ গুনি।
সাগরপাড়ে আয়তাকার বসে
ঢেউএর লাশ গুনি।
গোধূলি বিকেলে এক চিলতে ছাদের উপরে
সহস্র আলোকবর্ষ দূরের
কোনও ছোট্টোতারার পানে চেয়ে চেয়ে
লাশ গুনি না-বলা রূপকথার।
লাশ গুনি পকেটবন্দী সেই
ঘামে ভেজা রঙ্গণ ফুলের।
পরিমার্জিত পরিমিত কথার আড়ালে
কবিতার লাশ গুনি।
টিভির পর্দায় মানুষের লাশ গুনি,
দমচাপা কোনো শহুরে রাত্তিরে
সাবধানী জানলার গায়ে
বৃষ্টির লাশ গুনি।
জন্মের পর জন্ম
আমরা আসলে শুধু লাশ গুনি।
তারপর কোনো একবার
পরশবিহীন কোনো এক প্রগাঢ় পরশে
বেঁচে উঠি অবশেষে।
একটা তারার জন্ম
যখন মাঝ সাগরের বুকের কাছে
একলা আকাশ ঘনিয়ে আসে,
(তখন) এক নতুন তারার জন্ম হয়।
যখন খুব ব্যস্ত পথের ধারে
অচিন কোনো বাঁকে,
নদীর কথা নীরব বাজে
রঙ্গন ফুলের ভাঁজে,
(তখন) এক নতুন তারার জন্ম হয়।
যখন কোনো গভীর রাতে
হঠাৎ কোনো বৃষ্টিপাতে,
জানলা দিয়ে মনের ভেতর
ভিনগ্রহের এক বাতাস আসে,
(তখন) এক নতুন তারার জন্ম হয়।
আকুল, আমূল এক আনন্দে
নটরাজের 'সৃজন ছন্দে'
ইথার যখন উথাল-পাথাল,
শূণ্য-সুখে মত্ত মাতাল,
হাজার আলোকবর্ষ দূরে
কিম্বা মনের অচিনপুরে,
উঠলো জ্বলে একটা আলো,
ছোট্টো তারা বড্ডো ভালো।
কবিতা
ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
প্রকৃতিপ্রেমী
প্রকৃতি আজ অনেক সকালেই বৃষ্টিস্নান সেরে
সারা আকাশটা গায়ে জড়ানোর পর,
গভীর সমুদ্রসম নয়নদ্বয়ে
মেঘের কাজল এঁকে
কাননের সৌরভে চারপাশ উদ্ভাসিত করতে করতে
জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে
আমার ঘুম ভাঙিয়েছে।
কিন্তু, সেইসময়
তার দিকে আর কতক্ষণ
চোখের পাতা না ফেলে
তাকিয়ে থাকতে পেরেছি!
সামনের বনানীতে তখন
কাকাতুয়া, টিয়া আর কোয়েলদের
খুব গল্প চলছিল;
আর ঝিঁঝিঁ পোকারা তো একটানা
গানের রেওয়াজ করেই যাচ্ছিলোl
চোখ কচলে, ওদের ডেকে
আমার এই আক্ষেপের কথাটা জানালে,
ওরা পরামর্শ দিলো ওদের রাজার কাছে যেতে;
তার কাছে নাকি এক চমৎকার ‘বর’ আছেl
রাজাকে খুশি করতে পারলে আমি
মানুষ হয়েও
প্রকৃতিকে চোখের পলক না ফেলে
একনাগাড়ে দেখে যেতে পারবো।
তবে, এটাও মাথায় রাখতে হবে যে
রাজার কিন্তু মোটেও মানুষদের পছন্দ নয়।
দেখলাম, ব্যাঙ আর কাঠবেড়ালিরাও
ওদের পরামর্শে সায় দিলো।
ভাবলাম
আমার সঙ্গে তো প্রকৃতির সখ্যতা আজন্মের,
কত না কথা হয় প্রতিদিন!
পরামর্শদাতা বন্ধুদের কাছে
আমার ব্যাপারে রাজা জানতে চাইলে
তখন কি ওরা অন্তত: এগুলোও
মনে করে বলবে না যে,
অস্ট্রেলিয়াতে বছরের পর বছর গাছের পরিচর্যা করে
শতশত ফুল ফোটালেও
সেই ফুল আমি কোনোদিনও গাছ থেকে তুলিনি!
যত্ন পেয়ে গোধূলিবেলায়
গাছেদের ঘুমোতে যাওয়াটাও ছিল কত আনন্দের!
আফ্রিকায় কর্মক্ষেত্রে ভয়ংকর সাপেদের
বিনা আঘাতে ধরে
তাদের জঙ্গলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা তো
আমিই করেছিলাম!
কিংবা, আমার তত্ত্বাবধানে বতসোয়ানায়
প্রতিবেশীদের বাড়িতে
সেই সুবৃহৎ বৃক্ষগুলোর
শুকনো কাঠের মধ্যে গর্ত তৈরী করে
সেখানে পাখি এবং ছোট্ট প্রাণীদের
থাকার সুযোগ করে দেওয়াটা!
আর এর পরেও তো প্রকৃতি হাসিমুখে
আমার হয়ে
রাজাকে দু কথা বোঝাবেl
প্রকৃতির কোলে তো এমনিতেই রোজ ঘুমোই,
তবে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারলে
তার অসীম সৌন্দর্য দর্শন হতে
অনেকটাই কম বঞ্চিত হতে হয়!
তাই এমন চমকপ্রদ সুযোগ,
হাতছাড়া করা যায় না।
বৃথা সময় নষ্ট না করে
বেড়িয়ে পড়লাম ওদের রাজার সঙ্গে কথা বলতে।
দুইটি রবীন্দ্রসংগীত ও বিবাহ
সত্তরের সেই রোমহর্ষক দশকে
কুহেলিকাময় এক বৈশাখী অপরাহ্নে
করেন উন্মুক্ত গৃহের রুদ্ধ দ্বার,
মরিচা লাগি লৌহদরজা নির্গত
নানান শব্দসমারোহে।
স্বল্প উচ্চতা, চওড়া ভুরু,
রৌদ্রে-জলে বিবর্ণ কিঞ্চিৎ ধূসর কান্তি,
স্বল্পকেশী, গোল মুখাকৃতি;
আত্মগৌরবে গৌরবান্বিত
যৌবনকালের সুদর্শন এক প্রৌঢ় তিনিl
স্থূল শরীরে
দুলকি চালে
আসেন বাহিরে
খড়ম পড়িয়া
খটখট শব্দে
ডান বগলদাবা
আরাম কেদারা লইয়া
গোবর নিকানো অঙ্গনপথে;
সৌরভময় থোকা থোকা প্রস্ফুটিত লাল দৃষ্টিনন্দন
মাধবীলতা পুষ্প শোভিত
বংশ নির্মিত মাচার তলদেশ দিয়া।
স্থাপিয়া আরাম কেদারাটি সযত্নে
দুয়ারের মধ্যস্থলে
সাদা আটপৌরে ফতুয়া গায়ে
আট হাতি ধুতিতে
কুঁচি লাগানো লাল হাতের চিহ্ন দেওয়া তালপাতার পাখা
চালাইতে চালাইতে
পরম তৃপ্তিতে
হন বিরাজমান সেথায়
সামনের বাড়ির জ্যাঠামশাই।
হন জমায়েত রোয়াকগুলিতে
প্রতিবেশীগণ,
সান্ধ্যকালীন নিত্যকারের সেই আড্ডায়।
কচি কাঁচারা অনেকে
খেলাশেষে হই উপস্থিত সেখানে
স্বল্প কালের লাগি
গল্পদাদুর আসরে।
ফতুয়ার বোতামগুলি তাহার অব্যবহৃত প্রায়
গুম্ফযুগলে ডান হস্তে তা দিয়া যথাসম্ভব শোভাবর্ধন করিয়া
নগ্ন লোমশ প্রকান্ড বপুতে হস্ত বুলাইয়া
চারিপাশ গোচর করিয়া
হাস্যবদনে খুঁজিয়া নেন বাম হস্তে
পিতলের ছোট্ট নস্যির ডিবা
ফতুয়ার পকেট হইতে
আপন ভঙ্গীতে l
খুলিয়া সন্তর্পণে ডিবার প্যাঁচালো ঢাকনা
তুলিয়া নস্যি এক চিমটি
দেন ঝাঁকুনি সেই হাত কয়েকবার
আনমনে,
অতিরিক্তের বিতাড়িতের তরে।
তারপর, হইলে খুশি যথাযথ পরিমাণে
টানেন তীব্র প্রশ্বাসে সশব্দে তাহা
দুই নাসারন্ধ্র দিয়া।
বার তিনেক ক্রমাগত: হাঁচির প্রচন্ড শব্দে
হয় বিদীর্ণ যাবতীয় নি:স্তব্ধতা
দেন জানান আপন উপস্থিতিরে
সারা পাড়ায়।
বাহির করিয়া রুমাল
ফতুয়ার পকেট হইতে,
বারকয়েক ঘষিয়া
মুছিয়া নেন নাসিকাস্থল আর অঙ্গুলিদ্বয়।
খুলিয়া গৃহদ্বার
লইয়া বঙ্কিম যষ্টি
আসিয়া বসিলে মোর ঠাকুরদা
ফুট দশেক চওড়া গলির অপর পাড়ের আপন রোয়াকে
জ্যাঠামশাইসহ করেন সকলে সম্বোধন তাঁহারে
আছেন কেমন কাকাবাবু?
সকল কুশল বুঝি রয়!
হইলে শেষ উপস্থিত জনের কুশল বিনিময়
হয় নিমজ্জিত একেএকে সকলে
নির্ভেজাল বৈকালিক আড্ডায়l
ছিল এক সুশীলা বিবাহযোগ্য কন্যা
জ্যাঠামশায়েরl
আটপৌরে শাড়িতে স্বহস্তে
কারুকার্যময় ঝকঝকে কাঁসারের রেকাবিতে কয়েকটি বাতাসা এবং
তদুপরি রাখা শৌখিন কাঁসারের পাত্রে এক গ্লাস জল
লইয়া আসিয়া দাঁড়াইলে সেই দিদি;
করিয়া সেবন তাহা
বর্ষাইয়া অনন্ত তৃপ্তির সুর
মুছিয়া সিক্ত মুখ ধুতির খোঁট দিয়া
কহেন সস্নেহে ফিসফিসাইয়া জ্যাঠামশায় তাহারে
শিখিতে হইবে মা দুইটি গান তোমারেl
জ্যাঠামশায়ের ফিসফিসানি
শুনিলাম অনায়াসে
উপস্থিত সকলেইl
বুঝিলাম, হইতেছে শুরু বিশেষ প্রস্তুতি
হইবে বিবাহ দিদির শীঘ্রইl
সংগীত সাধনার লাগি
হন নিযুক্ত বিশিষ্ট এক গানের দিদিমণিl
হইলো বাহির
বাক্সবন্দী পুরাতন এক হারমোনিয়াম
খাটের নীচ হইতেl
চলিল সংস্কার তাহারl
অবশেষে একদিন
আসে সেই শুভদিন
হয় শুরু দিদির সংগীত শিক্ষা
হরিকীর্তন
আর
উলুধ্বনি দিয়া।
সকল জানালা গৃহের রহে উন্মুক্ত
দিদির সংগীত শিক্ষাকালে।
গানের দিদিমণি ভারী গুণী,
বেতারশিল্পী তিনি।
ছাত্রীকে শিক্ষাকালে করিলে তিনি গান
দেন বাহবা বহুজনে।
আশপাশের ঘরগুলিতে
স্বল্পের লাগি হয় বন্ধ রেডিও।
রহে নিবৃত্ত তাহারা
করিতে শ্রবণ
সান্ধ্যকালীন বিবিধভারতীর গানের আসরও।
কিন্তু, সহসা সা রে গা মা সুর চরাইলে দিদি
ওঠে পক্ষীকুল করিয়া চিৎকার
চারিপাশের বৃক্ষরাজি হইতে।
হয় চকিত সারমেয়কুল,
করে লম্ফ ঝম্প হনুমানেরা
আর চলে সেই সঙ্গে
তর্জন গর্জন উহাদের
সামনের প্রকান্ড তেঁতুল বৃক্ষে।
জানালাগুলি হয় বন্ধ ঝপাঝপ
চারপাশের গৃহগুলিতে।
হয় সৃষ্টি ক্রমে ক্রমে এক আতঙ্কের।
ত্রস্ত সকলে
এই বুঝি হইবে শুরু দিদির সংগীতচর্চা।
স্বল্পবয়সী জননীরাও দেখান ভয় আপন শিশুদের,
অঙ্গুলি নির্দেশিয়া
খড়খড়ি তুলিয়া
করিয়া সুর
"করহ শেষ শীঘ্র গ্লাসের দুধটুকু
নইলে দিদি ধরিবে গান
পারিবে না যাইতে বেশীদূর"
চলিয়াছিলো এমনটিই সপ্তাহ খানেক
লইয়া বিভ্রান্তিতেই।
এরপর একদিন
আনিলে পুনরায় জল ও বাতাসা,
কহেন জ্যাঠামশাই
ফিসফিসাইয়া দিদির কর্ণকুহরে
কহ গিয়া দিদিমণিরে
শিখাইতে মাত্র দুইটি গান
শুধুই রবিঠাকুরের;
চলিবে উহাতেই।
গাহিবে তুমি একটি,
রহিবে রিজার্ভ দ্বিতীয়টি,
বরপক্ষের সাদর অনুরোধের,
একান্ত পীড়াপিড়ি রক্ষার
খাতিরে!
ছিলেন দিদি সুগৌরী,
সুকেশী, এবং
বেশ সুন্দরী,
ভারী মিষ্টি স্বভাব তাহার।
ছিলেন না তবুও স্বস্তিতে জ্যাঠামশাই
পার করিবারে নিশ্চিন্তে তাহারে।
আদুরে কন্যার লাগি
ছিল তাই
সেই আবদার l
হইয়াছিল বিবাহ দিদির অচিরেই
বসিয়াছিল নহবত
বাজিয়াছিল সানাই
বেশ ধুমধামে
চারপাশ মুখরিত করিয়া।
গুণী জামাইবাবুর
ছিল না প্রয়োজন তেমন
দিদির সঙ্গীতেরে।
বিবাহোত্তর মুক্ত দিদি
আসিয়া একদিন গঙ্গার তীরে
করেন সমর্পণ শোধ্যে
কষ্টের সেই আপনার
সংগীত চর্চারে।
অবশেষে একদিন
জানাজানি হয় সত্য।
পড়িল ছড়াইয়া দাবানল গতিতে সেই তথ্য
গোটা পাড়া জুড়িয়া।
জানিলও লোকে
বুঝিলও লোকে
মানিলও লোকে
বিবাহ উত্তরণের চাঞ্চল্যকর সেই উপায়,
রবি ঠাকুরের দুই সংগীত শিক্ষণে।
ওঠে তাহারা হর্ষ করিয়া l
মুচকি হাসিয়া এপার ওপার
দিদিরা এরপর
করেন বিদায়
অনিচ্ছাকৃত কঠিন সংগীত চর্চার।
রহেন তাহারা ব্রতে
বিবাহের তরে
শিখিতে কেবল মাত্র
দুইটি রবীন্দ্রসংগীতে।
কবিতা
যোগেন শর্মা
মদনপুর, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ
গ্রীষ্ম প্রেম
সূর্য জ্বলছে, দিনগুলি দীর্ঘ,
পাখিরা গাইছে, গ্রীষ্মের গান
দিনের উষ্ণতা যেন আলিঙ্গন,
একটু মনোরম হাওয়া প্রয়োজন।
গ্রীষ্মের আনন্দের একটি মৃদু অনুমান
ফুলের মিষ্টি গন্ধ, মৃদু চুম্বন
হাসির শব্দ, একটি নিখুঁত দিনে
সূর্য জ্বলছে, চলো খেলি বাগানে।
সূর্যের তাপ, গ্রীষ্মের নাচ
আইসক্রিমের মিষ্টি স্বাদ, এটা গ্রীষ্মের রোম্যান্স,
প্রকৃতির সৌন্দর্য, তার সমস্ত মহিমায়
আসুন এই গ্রীষ্মে উপভোগ করি পরিবেশ।
নদীর ঢেউয়ের আওয়াজ, শান্তিপূর্ণ বাতাস
রাতের আকাশে তারাদের দেখা,
ফুল ফুটেছে, একটি মনোরম দৃশ্য
আসুন এই গ্রীষ্মের রাতের সর্বোচ্চ সুখ অনুভব করি।
সূর্যের তাপ, গ্রীষ্মের তাপ
আসুন একটু বিরতি নেওয়া যাক,
বসুন আসুন কিছু স্মৃতি মনে করি, যা স্থায়ী হবে
এই গ্রীষ্মের জন্য মধুর করে রাখবে এই অসহ্য গরমেও।
কবিতা
রাসিক শেখ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
আকাঙ্ক্ষা
যদিও বা নেই কিছু আমার জন্য,
তবুও তো আছে কিছু না পাওয়ার জন্য,
যবে তুমি চেয়েছিলে শেষটুকু প্রাণ,
তখনো হয়নি মনের সে তো তোমারি দান।
রেখে চলে গেলে আমায় বহু দূরে ধীরে ধীরে,
চাইলে না একবারও মুখটাকে ফিরে।
সব দিয়েও যখন পায়নি হৃদয়ের চাবি,
বদ্ধ অন্ধকার ঘরে বসিয়া না জানি কেন একথায় ভাবি?
ক্ষণিক উল্লাস শুধু কিছু পেয়ে নেওয়া,
নাকি ভালোবাসার প্রতীক আকাঙ্ক্ষা হলো কিছু না পাওয়া।
কবিতা
শুভঙ্কর রানা
শামুক
কোমল দেহ কোমল করে
রেখেছ ঐ শক্ত আবরণে।
জীবন্ত কঙ্কালের মতো প্রাণ
মানুষের ভয়ে গুটিয়ে থাকে।
কতই কষ্ট সহ্য করে
মুখ বুজে মেনে নাও
সব অত্যাচার।
ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়াও,
ঠিক সেই আদিম সমাজের
শেষ উলঙ্গ মানুষীর মতো।
এছাড়া তুমি আর কি পারো
কিছু না, কিছুই না?
কতো লোকে তোমায় মারে
তোমায় ভাঙ্গে, তোমায় গড়ে;
তোমার কি মনে পরে নিজের রূপ?
ভাবো না! স্বাধীনভাবে বাঁচার কথা?
পাবে না! অন্যের হাত থেকে
চিরমুক্তির স্বাদ?
তার বদলে ভয়ে মুখ লুকাও
ঐ শক্ত খোলকের অন্তরালে।
তাই মানুষ তোমাদের পেয়ে বসেছে,
একবার বিদ্রোহী হয়ে জেগে ওঠো;
একবার দলবেঁধে চিৎকার করে বলো,
আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে,
আমাদের বাঁচতে দাও।
কবিতা
এহিয়া আহমেদ
মরিগাঁও, আসাম
তুমি বিহীন
তুমি বিহীন জীবন
নির্জন পথে তোমার সাথে
একসাথে হাঁটতে হাঁটতে
তোমার হার্ট বিট
সোনার খুব ইচ্ছে করে;
সীমানা ছাড়া স্বপ্ন দেখি
তুমি আমার স্বপ্নের রঙিন ছবি
একটু ভালোবাসা নিয়ে
কবে আসবে ফিরে (?) তুমি বিহীন জীবনে
স্মৃতিগুলো মনে পড়ে
মরুভূমির তপ্ত বালুচরে
ছটফট করে;
তোমার অপেক্ষায়
মন পাখি আমার
একটু জলের জন্য
হাহাকার করে।
হৃৎপিণ্ডটা কাদামাটি হয়ে গেলো
দিক না জেনে, পথ না চিনে
আমি এই রাস্তার ধারে;
এদেশে নেই প্রজাপতির দল
নেই কোনো পাহাড়ী ঝর্ণার
কুলুকুলু শব্দ,
তুমি বিহীন জীবনে সব
হারিয়ে গেলো।
কবিতা
ফাইয়াজ ইসলাম ফাহিম
তুমি ফুল শুকিয়ে যাবে
তুমি ফুল শুকিয়ে যাবে
থাকবে না তোমার যৌবন,
তুমি ফুল হারিয়ে ফেলবে
তোমার টইটম্বুর মৌবন।
তুমি ফুল রোদে শুকে যাবে
অলির ভালবাসা ছাড়া,
তুমি ফুল অসময়ে চুপসে যাবে
হবে সর্বহারা।
তুমি ফুল বুঝলে না অলির আদর
অলির শোকে একদিন হবে কাতর,
তুমি ফুল অলি'র সঙ্গ চাইবে একদিন
সেদিন তুমি ফুলের থাকবে দূর্দিন...
(এখানে ফুল কে হাওয়া নামক একজন নারীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে...)
উষ্ণ বালিকা
উষ্ণ বালিকা
প্রেমের চালিকা
যৌবনের শক্তি
যে বালিকা উষ্ণ
তারে পুরুষ করে ভক্তি।
উষ্ণ বালিকার উষ্ণতায়
যায় পুরুষের মন পুড়ে,
উষ্ণ বালিকায়
পুরুষের স্বর্গ-নরক
তাই ডাকে তারে প্রেম সুরে।
উষ্ণ বালিকা ছাড়া
জমে না পুরুষের প্রেম,
উষ্ণ বালিকা পুরুষের
সেরা পছন্দ
যদিও পছন্দ নারী ফ্রেম।
উষ্ণ বালিকা
পৃথিবীর সব,
উষ্ণ বালিকা ছাড়া
যৌবন ঢব।
উষ্ণ বালিকার জন্য
পুরুষ করে সকল কাম,
উষ্ণ বালিকা না থাকলে
থাকতো না পুরুষ
থাকতো না পৃথিবী
থাকতো না কোন কিছুর দাম..
কবিতা
দীপ্তেন্দু ভট্টাচার্য্য
যাত্রাপথে
ঘন্টা ছয়েক বরাদ্দ প্রতিদিন যাতায়াতে,
কিছু চেনা মুখ কতেক অচেনা, টুকরো কিছু হাসি
টুকরো সংলাপ কিছু, হালকা হওয়ায় ভাসে।
কাটানো কিছু সময় তারই মাঝে, একান্ত অবসরে,
ব্যস্ততার মোড়কে, একাকী ভিড়ের মাঝে।
কর্মহীন কর্মব্যস্ততায়, কখনো ঘরের কোনে,
মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে, কিছু খুচরো সময়;
বেহিসেবী খরচা করা, কিছু করা অপচয়।
সুদিন নাকি মৃত্যু, কি জানি কিসের অপেক্ষায়,
কিছু কথা, কথায় কথায়, মনে থেকে যায়
টুকরো কিছু ছবি, ধরা পরে কিছুবা হারায়।
কিছু বা দাগ কেটে যায়, চিরকাল মনের আঙিনায়।
কিছু ছেঁড়া হাসি, কান্না কাটি হল্লা হাটি;
কিছু উড়ো ঝর, ধুলো মাখা রাস্তায়।
ধুলো মাখা শরীর, আর মলিন কাপড়ে,
শুয়ে থাকা জীবন্ত লাশ, রাস্তার মোরে।
কিছু মুখ ঢাকা বোরখায়, কিছু বিজ্ঞাপনে,
আরও কত শত ছবি, রঙ রূপ কথা কিছু ধরা পড়ে;
তারও চেয়ে বেশি, রয়ে যায় অধরা, অথবা ধরা পড়ে,
অন্য কোনো খানে, অন্য কারো চোখে, অন্য রূপে।
চলার পথে, পথে ফুটপাতে, কত ছবি রঙিন,
কতক বা সাদা কালো, রূপ নেয় অহরহ।
ছন্দে বাঁধা পড়ে কবিতা, লেখা হয় কত গল্প
মনে হয় যাতায়াতের সময় বুঝি বা বড় অল্প।
রম্য-রচনা
এ তো
বড় রঙ্গ!
অনিশা দত্ত
সল্টলেক, কলকাতা
দাম্পত্যের দ্বাদশ বার্তা
বিবাহের প্রথম বৎসর:
স্বামী - আচ্ছা, তুমি আন্টার্টিকা বেড়াতে গিয়েছো? আমি যাই নি।
স্ত্রী - আমিও যাই নি।
স্বামী - সত্যি! আমাদের কি মিল।
স্ত্রী - প্রত্যেক শীতে আর বর্ষায় আমার সর্দি-কাশি হবেই হবে।
স্বামী - আমারও। দেখো, আমাদের ধাত ও একই রকম। দারুণ মিল। আমার না রোমান্টিক মুভি দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগে। তোমার?
স্ত্রী - আমার সবচেয়ে পছন্দ রোমান্টিক সিনেমা।
স্বামী - দেখছো তো আমরা একেবারে রাজযোটক।
*************
দুই বৎসর পর :
স্ত্রী - কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, এবার বিবাহ-বার্ষিকীতে তুমি আমাকে হীরের কানের দুল উপহার দিচ্ছ।
স্বামী - আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি, আরো দেখেছি, তোমার বাবা ওটা কিনতে চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
*************
আর ও দুই বৎসর পর:
স্বামী - আমি যদি হঠাৎ মরে' যাই, তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
স্ত্রী - কক্ষনো নয়। আমি আমার ছোট বোনের সঙ্গে থাকবো। আর যদি মারা যাই, তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
স্বামী - কক্ষনো না। আমরা দুজনে দুজনের জন্য। তোমার সঙ্গে আমি সহমত। একই সিদ্ধান্ত আমার ও। আমিও তোমার ছোট বোনের সঙ্গেই থাকবো।
*************
আর ও দুই বৎসর পর:
স্ত্রী - বিয়ের এলবামে, অত খুঁটিয়ে কী দেখছো? আমি তো সামনেই দাঁড়িয়ে। সেজেছি আজ, আমার দিকে দেখো।
স্বামী - না দেখছি, সেই ঘোর বিপদের দিনে কোন কোন বন্ধু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
*************
আর ও দুই বৎসর পর:
স্বামী - তোমাকে বিয়ে করে জেরবার হয়ে গেলাম। এর চেয়ে শয়তানের সঙ্গে বিয়ে হলেও বোধহয় অনেক ভালো থাকতাম।
স্ত্রী - কিন্তু আমি যতদূর জানি, আমাদের সমাজে এক গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ।
আর ও দুই বৎসর পর:
স্বামী - যতই চেষ্টা করো না কেন, বেড়ালটাকে কিছুতেই পোষ মানাতে পারবে না। সর্বদা ফোঁস-ফোঁস করবে।
স্ত্রী - ঠিক পারবো। দুদিন বাদেই মিউ-মিউ করে পায়ে পায়ে ঘুরবে। তোমাকে বাগে আনতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। অভ্যাস আছে।
*************
আরও দুই বৎসর পর:
স্বামী: (মদ খেতে-খেতে)- আমি তোমাকে ভীষণ-ভীষণ ভালোবাসি।
স্ত্রী (হৃষ্ট চিত্তে) - একথা কে বলছে? মাতাল না কি আমার স্বামী?
স্বামী - তোমার স্বামীই বলছে, তার মদের বোতলকে।
*************
আরও দুই বৎসর পর:
স্বামী - দিনরাত যদি অতই ঝগড়া করবে, তবে আর একটা বিয়ে করে চলে গেলেই তো হয়।
স্ত্রী - খুব ভালো হয়, বাঁচি আমি। আমার বাবা অনেক দেখে-শুনে পয়সা খরচ করে 'তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। এবার তুমি দেখে শুনে আমার একটা ভালো বিয়ে দিয়ে দাও।
*************
আরও দুই বৎসর পরঃ
কলহের জেরে, স্বামী - স্ত্রীতে বাক্যালাপ বন্ধ।
স্বামীকে ভোরের ফ্লাইট ধরতে রাত চারটে-তে ঘুম থেকে উঠতে হবে। স্বামী তাই একটা চিরকুটে লিখলেন 'কাল আমাকে রাত চারটে -তে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেবে। তারপর চিরকুটটি স্ত্রীর বালিশের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙতে, স্ত্রীর ওপর চীৎকার করতে গিয়ে দেখেন, তাঁর বালিশের পাশে- রাখা চিরকুটে লেখা 'চারটে বেজেছে, উঠে পড়ো।' **************
আরও দুই বৎসর পর:
স্বামী - আমি নিশ্চিত কাল রাতে তুমি আমার ব্যাচেলার বন্ধু রঞ্জিতের বাড়িতে রাত কাটিয়েছো।
স্ত্রী - মোটেই না, কাল আমি আমার বিধবা বান্ধবী রঞ্জনার বাড়িতে ছিলাম। বেচারী একা থাকে।'
স্বামী - তুমি অবিশ্বাসিনী জানতাম, কিন্তু এমন মিথ্যাবাদী জানতাম না। কাল রাতে রঞ্জনার বাড়িতে তো আমি ছিলাম।
**************
আরও দুই বৎসর পর:
স্ত্রী - বিয়ের সার্টিফিকেট -এ কী অত খুঁটিয়ে দেখছো? জাল সার্টিফিকেট নয়।
স্বামী - জানি তো আসল সার্টিফিকেট। খুঁজে দেখছি কোথাও এক্সপায়ারি ডেট লেখা আছে কিনা?
**************
পঁচিশ বৎসরের বিবাহ বার্ষিকী আসন্ন। রৌপ্য জয়ন্তীতে দ্বিতীয় হনিমুনে গিয়ে দম্পতি এক পাঁচ তারা হোটেলে উঠেছেন। স্বামী রাত বারোটায় হোটেলের ঘর থেকে ইন্টারকমে ম্যানেজারকে চীৎকার করে ডাকছেন 'শিগগির আসুন এ ঘরে। আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে ঝগড়া করে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়বেন বলছেন।' ম্যানেজার দুঃখিত স্বরে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন 'আমার কিছু করণীয় নেই। সম্পূর্ণ আপনাদের দাম্পত্যের আওতায় পড়ে।'
স্বামী আরও রেগে চীৎকার করে উঠলেন 'না মশাই। এখানে দাম্পত্য নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি হোটেলের মেনটেনান্সএর আওতায় পড়ে। জানালাটা খোলাই যাচ্ছে না। তুরন্ত আসুন। খুলে দিয়ে যান।'
ফেলে আসা
জাহাজের ডেক
প্রতীক মাইতি
রাজারহাট, কলকাতা
ভ্রমণ
ট্যুরটা শেষ হয়ে এলো। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে শীতবস্ত্র, আলোয়ান, কোল্ডক্রিম। ছোট ছোট টিলার মত উবু হয়ে ভাঁজ করে নিচ্ছি শুশ্রূষার আলো। শুশ্রূষাই বটে, যখন মুগ্ধ হয়ে দেখি একটা আশ্চর্য রাঙা রোদ্দুর কিভাবে বাঁকে গড়ায়, কিভাবে পথ দেখায়, উচ্চ থেকে উচ্চতর পাহাড়ের চূড়ায় নিজেকে বিছিয়ে দেয়। আদরে গলে যেতে যেতে আমাদেরও ভিজিয়ে দ্যায় সে। আমাদের গলায় তখন শুধুই বিস্ময়, আমাদের স্বরে মন্দ্র সপ্তক। এই অস্থির উদযাপনের দিনে সে কি শুশ্রূষা নয়?
ট্যুরের শেষ দিনে আমরা এসেছি নীলডি পাহাড়ে। নীলডির ভৌগোলিক অবস্থান পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড সীমান্তের কাছাকাছি। পর্যটকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয় এই পাহাড়। পর্যটনকে খুব যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এখানে তেমনও নয়। থাকার মধ্যে একটা ভাঙাচোরা চিলড্রেন পার্ক, একটা ভগ্নপ্রায় মন্দির আর বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে পিকনিকের ব্যবস্থা। তবে মূল আকর্ষণ অন্য জায়গায়। ছোট বড় বিভিন্ন পাথরের ওপর বেশ সুন্দর কিছু পেন্টিং দেখলাম। কোথাও বাঘের মুখ, কোথাও প্রকাণ্ড রাক্ষসের রুদ্র হুংকার। রুক্ষ তামাটে নীলডির বুকে আক্ষরিকই রঙিন সেলুলয়েড! একটার পর একটা ছবি দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি এমন অভূতপূর্ব নির্মাণে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী রাজু এখানকার স্থানীয়। ওর কাছেই শুনলাম যিনি পরিকল্পনা করেছেন এগুলোর, তিনি সীমান্ত লাগোয়া চেলিয়ামা বিজলীপ্রভা স্কুলের শিক্ষক অভিষেক মিশ্র। জয়চন্ডী পাহাড়েও চলছে এমন উদ্যোগ ওনার তত্ত্বাবধানে। উত্তরণ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান উনি।
পাঞ্চেত, গড়পঞ্চকোট বা অযোধ্যার ভিড় এখানে নেই। খাবার বানিয়েই নিয়ে এসেছি আমরা, ক্রমশ কুয়াশায় ঢাকতে থাকা পাহাড়ের কোলে বসে খানিক জিরিয়ে নিয়ে ফিরব আলো ফুরাবার আগেই। পথ সামান্যই, জয়চন্ডী স্টেশন থেকে নেমে রঘুনাথপুর আর রঘুনাথপুর থেকে আধঘন্টার সফর। রঘুনাথপুর থেকে মিশকালো পিচের রাস্তায় সাত-আট কিমি গেলে গোবরান্দা, সেখান থেকে তিন কিমি দক্ষিণে গেলেই পাবড়া। নীলডির পাদদেশ শুরু পাবড়া থেকেই। স্থানীয়দেরই ভিড়, বাইরের মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। দূরে পাওয়ার গ্রিড, চিমনি প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আসছে। একটা
উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়া পাহাড়ের পাঁজরে ধাক্কা খেয়ে আমাদের দৃশ্যতই কাঁপিয়ে দিচ্ছিল মাঝেমধ্যে।রটারডাম থেকে ভিডিও কলে এলো নবনীতা ও সমীরণ। আমাদের বাল্যবন্ধু। ঠান্ডা হওয়ার দাপট ওখানেও। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে সাজানো সুন্দর একটা দেশ থেকে যখন ওরা বলে উঠল হ্যাপি নিউ ইয়ার, মনে পড়ে গেল আমাদের স্কুলের দিনগুলোয় এমনই নৈসর্গিক হতো গ্রিটিংস কার্ডের কভারগুলো। বছরভর যে বন্ধুদের সাথে একই বেঞ্চে বসে ভাগ করে টিফিন খাওয়া, অর্ধেক টিফিন খেয়ে খেলার মাঠে হারিয়ে যাওয়া, কি এক অভাবনীয় উদ্মাদনা তবু কাজ করতো রঙিন খামে মুড়ে কার্ডের দেওয়া নেওয়ায়। ফেলে আসা সেই ইস্কুলবাড়ির দালান যেন জীবনের অকুলদরিয়ায় নোঙর করতে করতে ছেড়ে আসা জাহাজের ডেক। সেখানে পড়ে আছে সেই সব রঙিন খাম, তার কম্পাসে লেগে আছে ক্ষয়ে যাওয়া চকের দাগ, তার কেবিনে ঠান্ডা হয়ে আসছে আট আনার আলুর চপ, তার শার্সি খুলে ধরেছে ক্লাসের সবচেয়ে দামাল ছেলেটা, উড়ে আসছে কাঠবাদামের খোসা। শ্রাবণ সমুদ্র সাঁতরে তাকে পৌঁছতেই হবে ইস্কুলবাড়িটায় অবশেষে। আত্মভ্রমে পুড়ে যাওয়া পথিকের বোধিবৃক্ষের ছায়া সেখানেই। এমন অখ্যাত নীলডির কোলেই।
ট্যুরটা শেষ হয়ে গেল। আকাশ নদী পাহাড়ের নয়নাভিরাম যাপন ছেড়ে আবার শামুকের খোলস জীবন। আমাদের ভাষায়, আমাদের কথায়, আমাদের দূরতম কল্পনায় শুধুই জাগতিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক পাওয়া না-পাওয়ার গল্প থাকবে আবার। গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার পথে স্থানীয় দোকান থেকে কিনে নিলাম এখানকার বিখ্যাত পকোড়ি আর ভাবরা ভাজা। রঘুনাথপুর - চেলিয়ামা রোডের দুধারে সারিসারি তাল আর খেজুরের বাগান ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে সন্ধ্যের অভ্যর্থনায়। আমরা গাড়ির ভিতর প্রত্যেকেই কেমন চুপ হয়ে আছি। আসলে চুপ করে বসে থাকার ভিতর একটা জানলা আছে। দৃষ্টি পিছলে কখনও বাইরে পড়লে ভেসে ওঠে জলরঙের একটা শতছিন্ন ছবি। অপটু হাতের আঙ্গুল চুঁইয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গ্যাছে সেখানে ছাইরঙা আকাশ, জলপাই উঠোন আর হলুদ ডুরে শাড়ির মেয়েটা। সেই নাম না জানা ঠিকানা খুঁজে চলাই জীবন!
গল্প
মালী
তানভি সান্যাল (সাহেব সেখ)
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
মালী ভালো করেই জানে যে ফুলটার মালিক ও নয়।
যতদিন যায় ফুলটার প্রতি মালীর ভালোবাসা ততটাই বাড়ে। কিন্তু ও এটা মেনে নিয়েছে যে এই ফুলটা অন্যের বাগানের ফুল। যাকে সে কোনোদিনও নিজের বাগানে বসাতে পারবে না। পারবে না ফুলটাকে আপন করে নিতে।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন মালী এই ফুলের প্রতি এতটা যত্নশীল? কেন মালী ফুলটাকে সেবা করে? কী কারণে মালী ফুলটাকে এতটা ভালোবাসে? যদিও সে ভালোমতই জানে যে সে চেষ্টা করলে আকাশের চাঁদকে ছুঁতে পারবে না। আচ্ছা মালী তো ভালোমতই জানে সে ফুলটা অন্যের বাগানের আমানত. তবুও কেন ?
এর উত্তর হলো মালী সব জানে, সব বোঝে, কিন্তু সে বুকের উপর পাথর চাপিয়ে রেখেছে। ওর কিছু আসে যায় না যে ফুলটা অন্যের বাগানে বসানো হবে। কারণ ও নিজের কষ্টকে নিজের হৃদয়ের বোতলে ভরে ছিপি লাগিয়ে রেখে দিয়েছে। পরে একান্তে সে বোতলের মুখ খুলে চুমুক দেয় আর হাউ হাউ করে কাঁদে। যাকে আমরা বলি একান্ত আপন। এই শূন্য পৃথিবীতে মালীর কষ্ট ভাগ করার কেউ নেই।
কেউ তার কষ্টে আহহ বলার ও নেই। মালীর কপালটাই খুব পোড়া। পৃথিবীতে যত মানুষ আছে সবাই নিজের জীবনে সুখী। মালী কিন্তু মুখে কিছু কাওকে বলতে পারে না। কিন্তু মালীও রক্ত মাংসে গড়া একটা মানুষ তার ও মন নামক বস্তু আছে। সেও কষ্ট পায়। ব্যাথা পায়। জীবন যন্ত্রণার
আগুনে একটু একটু করে পুড়ে। যাই হোক মালী কিন্তু ফুলটাকে নিঃস্বার্থ ভাবে সেবা করবে, পূজা করবে, যত্ন করবে এটাই ভেবে নেয়। মালী ত্যাগের বিনিময়ে ফুলটাকে পাবে সে এটাও জানে যদিও এই পাওয়াটা ironical।সে ফুলটাকে হারিয়ে দেবে কিন্তু আবার ফিরে পাবে।
ফুলটাকে অন্যের বাগানে বসানো হবে। হারিয়ে যাবে ফুলটা মালীর চোখের সামনে থেকে। চলে যাবে ফুলটা মালীর কোল শূন্য করে। আচ্ছা এবার প্রশ্ন হচ্ছে সে কিভাবে তাকে পাবে?
ফুল মালীর হৃদয়ে আবার বসবে তাকে সেদিন ফিরে পাবে যেদিন সে অন্যের বাগানের অংশ হয়ে উঠবে। মালী চোখ বন্ধ করলেই ফুলটাকে দেখতে পাবে মনের মন্দিরে সেই ফুলটা চিরদিনই পূজিত হতে থাকবে। কী হয়েছে যে ফুলটা অন্যের বাগানে বসানো হয়েছে। কী হয়েছে ফুলটা সময়ের কালোস্রোতে মালীকে ভুলে গেছে? মালী তো তাকে ভুলতে পারেনি বা পারবে না?
মালী তাকে মনের মন্দিরে আসন দিয়েছে। মালী নিজেকে বলী দিয়েছে তার মুখে একটু হাসি দেখার জন্যে। আর মালী পারবে ও না তাকে ভুলে যেতে।
মালী সারাজীবন ফুলটাকে মনের মন্দিরে পুজো করবে। ভক্তি করবে। মালী তাকে সেবা করবে।
নিজেকে মাটি করে দিয়েও মালী তার সেবা করে যাবে। এটাই মালীর জীবনের লক্ষ্য। কারণ সে মালী। যে রক্ষা করে, সেবা করে যত্ন করে।
ফুলের পাঁপড়ি একটু নিস্তেজ হলে মালীর জান বেরিয়ে যায়।
মালী হাউ হাউ করে কাঁদে ফুলের কষ্টে। তাই মালী পারবে না ফুলটাকে বানের জলে ভাসিয়ে দিতে।
গল্প
আর কয়েকটা দিন, তারপরেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। আমাদের মহাকাশযান 'গন্তব্য' প্রায় রেডি। এটি প্রায় আলোর গতিতে ছুটবে মহাশূন্য দিয়ে। প্রায় পাঁচ বছরে আমরা পৌঁছে যাব আমাদের সৌরমন্ডলের বাইরে কাছাকাছি একটা গ্রহে - আমরা পৃথিবীবাসীরা ওর নাম দিয়েছি 'নতুন পৃথিবী' বা 'দ্য নিউ আর্থ'। প্রতিদিনই এসব নিয়ে বাড়িতে আলোচনা হচ্ছে, ফোনকল আসছে - তাই থেকেই সব জানতে পারছে অর্ক আর সবু। সবু মানে সবিতা - অর্কর একমাত্র বোন, ক্লাস ফোরে পড়ে। যেখানেই কান পাতবে, সেখানেই এই আলোচনা, নতুন গ্রহ সম্পর্কে কত কি নতুন নতুন তথ্য - কোনটা ঠিক, আর কোনটা বানানো - তাও বোঝা যাচ্ছে না। কেউ বলছে,
-আরে ওখানে এখন তো ইলেক্ট্রিক নেই, মানুষ থাকবে কি করে?
-কেন সিইএসসি ওখানে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করতে পারে নি? ওরা তো অনেকদিন আগেই চলে গেছে ওখানে।
-আরে না না। এত সহজ না কি? একটা নতুন সেট আপ তৈরি করতে সময় লাগবে না? তারপর তো ইলেক্ট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন। তাছাড়া এখনও ওখানে ক'জন কনজুমার আছে?
-তা ঠিক। তা বটে।
ঘাড় নাড়ে অর্কর জ্যাঠামশাই। জেঠুর আবার হার্টের অসুখ, এ. সি. ছাড়া থাকবেন কি করে? তাই দুশ্চিন্তা বাড়ে তাঁর।
অর্করা শুনেছে, 'নতুন পৃথিবী'-তে এখনও পৃথিবীর মতো কিছুই প্রায় নেই। সামান্য কিছু মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানানো হয়েছে। যারা আগে পৌঁছবে তাদের থাকার মানে মাথা-গোঁজার ঠাঁই দেওয়ার জন্য। ওখানে প্রচুর ওপেন ল্যান্ড অর্থাৎ খোলা জমি পড়ে আছে। গিয়ে চাষ-আবাদ করতে হবে তো? নাহলে মানুষ খাবে কি? অনেক মাল্টিবিলিওনিয়াররা চড়া দামে জমি কিনে রেখেছেন যাতে মনের মতো বাড়ি বা বাংলো ইত্যাদি বানিয়ে নিতে পারেন। তাঁরা বোধহয় সঙ্গে করে বিল্ডিং মেটিরিয়াল আর রাজমিস্ত্রীও নিয়ে যাবেন। তবে তার জন্য তাঁদের অনেক মূল্য দিতে হবে। সে সব সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
'নতুন পৃথিবী' মস্তবড় একটা গ্রহ, যার জলবায়ু অনেকটা পৃথিবীর মতোই। তবে পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ বড় একটি গ্রহ। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন ওর মাটি চাষবাসযোগ্য। জল আর অক্সিজেনও আছে ওখানে। কিন্তু ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে হলে পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে নানা ধরনের চারাগাছ, সব ধরনের প্রাণী, উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, ব্যাক্টেরিয়া, অ্যামিবা আর পতঙ্গ ইত্যাদি। সেসব খুব সহজ ব্যাপার নয় মোটেই।
'নতুন পৃথিবী'-কে পৃথিবীর মতো গড়া কয়েক বছরের কম্ম নয় তা জানে অর্কর মায়ের ঠাকুমাও। বুড়ি রোদে পিঠ রেখে বসে চোখ বুজে স্মৃতিরোমন্থন করে বলে,
-জানিস, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এখানে এতো বাড়িই ছিল না। আমার তো মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ওই যে দূরে পুরোনো বাড়িটা দেখছিস, ওটা ঘোষেদের বাড়ি। তখন ওটা ছিল। আর ওই যে হলুদ বাড়িটা - ওটা মিত্তিরদের বাড়ি । ওটাও ছিল। বাকি সব ফাঁকা জমি। সন্ধ্যে হলে বাজারে বা দোকানে যেতে কারও সাহস হতো না। শুধু দু'পাশে জঙ্গল, ফাঁকা জমি আর পুকুর ছিল। ঠ্যাঙারেদের উপদ্রব ছিল খুব। দিনের বেলাতেও লোকজন একসঙ্গে দলবেঁধে যাতায়াত করত। যেই না বাংলাদেশ ভাগ হলো, ওদেশ থেকে হুড়হুড় করে লোক আসতে লাগল এখানে। কোথাও আর ফাঁকা জমি রইল না।
মায়ের ঠাকুমাকে অর্ক, সবুরা 'বড়মা' বলে ডাকে। বড়মার বয়স বোধহয় একশোর কাছাকাছি কিংবা তারও বেশি। বড়মা এই বয়সেও খালি চোখে বেশ পরিষ্কার দেখতে পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এই পৃথিবীতে মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। অবশ্য বার্ধক্যের কারণে বড়মার মুখের চামড়া, হাত-পায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। গায়ের চামড়া ঝুলে গেছে। মাথার চুল যে ক'টা আছে - সব শণের নুড়ির মতো। দিনের বেলা শুধু ভাত আর নিরামিষ ঝোল খায়। রাতে খই আর দুধ।
বড়মা বলেছে, উনি আর এই পৃথিবী ছেড়ে, স্বামী-শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে 'নতুন পৃথিবী'-তে যেতে চান না। উনি এখানেই মরতে চান। একে তো এত বয়স হয়েছে, তার উপরে মহাকাশযানে চড়ে যাওয়ার ধকল সইবে না। পৃথিবীর মায়া উনি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে বড়মা এই বাড়িতেই মরবে!
সবাই একটা কথা বলাবলি করছে, পৃথিবী ধ্বংস হতে আর বেশী দেরী নেই। বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং অনেক বছর আগেই সাবধানবাণী করেছিলেন, "ধ্বংস ধেয়ে এল বলে, দ্রুত পৃথিবী ছাড়ুন!" কিন্তু "পৃথিবী ছাড়ুন" বললেই কি আর পৃথিবী ছাড়া যায়? তার প্রস্তুতি আছে তো নাকি? তাছাড়া, পৃথিবীর মত একটা গ্রহও তো খুঁজে বের করতে হবে? এত পুরাতন পৃথিবীর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আর তার মানবসভ্যতাকে এক কথায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? কিন্তু উপায়ও তো নেই কিছু। তবে ধ্বংসের দিনক্ষণ কেউই সঠিকভাবে বলতে পারছেন না। সবাই আতঙ্কিত। সবাই পালাতে চায়, যতদূর সম্ভব। কিন্তু সেটাও বাস্তবে সম্ভব নয়। কবে কখন ক'জন গিয়ে পৌঁছবে নতুন গ্রহে, সেখানে গিয়ে খাবে কি? থাকবে কোথায় - সেটাও নিশ্চিত নয়। এক একজনের যদি যেতে পাঁচবছর বা তার বেশি সময় লাগে, তবে সেই মহাকাশযানে খাদ্য সংকট বা জ্বালানি সংকটও দেখাদিতে পারে। মহাশূন্যে কোন গ্রহ বা তারার সাথে ধাক্কা হতেও পারে। ওই মহাকাশযানগুলি আবার যদি ফিরে আসে আরো চার-পাঁচ বছর কিংবা তারও পরে, খালি মহাকাশযান ফিরে আসতে হয়তো এক বছর কম সময় লাগতে পারে, তাহলে বাকিরা যাবে কবে? যতই মহাকাশযান তৈরি হোক না কেন, এই পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।
অর্কর বাবা একজন নামকরা কার্ডিওলজিস্ট, তাই তিনি একটু বেশি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বাকিরা? সাধারণ মানুষ কবে গিয়ে পৌঁছবে তাদের 'নতুন পৃথিবী' - তে তা খুবই অনিশ্চিত। সেদিন খেলার মাঠে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। অর্কর বন্ধু হাবুল বলছিল,
"তোরা যা। আমাদের আর যাওয়া হবে না। আমাদের ডাক আসতে আসতে আমরা এখানে মরেই যাব!" শুনে অর্কর চোখে জল এসে গিয়েছিল। খেলার মাঠের সব আনন্দ ঢেকে গিয়েছিল বিষন্নতায়।
অর্ক একটা নামী স্কুলে ক্লাস এইটের ফার্স্টবয়। ওদের স্কুলে ভূগোলের আন্টি বোর্ডে লিখেছিলেন - "পৃথিবীর আসন্ন ধ্বংসের কারণ কি?"
উত্তরে অর্ক লিখেছিল," এই ধ্বংসের পিছনে মানুষই দায়ী। মানুষের কারণেই দ্রুত হারে বেড়েছে জনসংখ্যা। সেই কারণেই চাপ পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশে। পরিবেশ দূষণও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। শিল্পায়নের ফলেই বেড়েছিল পরিবেশ দূষণ। জলবায়ুতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল বিশ্ব-উষ্ণায়ণ, পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা বেড়ে গিয়েছিল - তার ফলেই মেরুপ্রদেশের বরফ গলেছে, জলচ্ছাস হয়েছে পৃথিবীর বহু জায়গায় এবং বহু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময় মানুষ শুধু বাসস্থান নির্মাণ এবং সভ্যতা বিস্তারের জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলেছিল গাছপালা, তার ফলেই উদ্বেগজনক হারে দ্রুতগতিতে বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর জলবায়ু। ফুরিয়ে গেছে প্রাকৃতিক ও জৈব সম্পদ। নষ্ট হয়ে গেছে 'বাস্তুতন্ত্র' বা 'ইকোসিস্টেম'। বায়ুমন্ডলের দূষণের মাত্রা ছাড়িয়েছে এবং তার সাথে বেড়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লরোকার্বনের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস। এর ফলেই দেখা দিয়েছে অস্তিত্বের সংকট।" আন্টি ওকে দশের মধ্যে নয় দিয়েছেন।
এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই জেনেই অর্কর মতো সবারই মুখভার, মনখারাপ। দেখা হলেই শুধু একই গল্প, একই কথা। ভাল্লাগে না আর! সবাই ভাবছে, কি করে এত বড় সভ্যতার এত সুখের সম্ভার এত উন্নতির কৌশল আবার নতুন করে গড়ে তোলা হবে 'নতুন পৃথিবী' - তে।
অর্ক ওর সমস্ত বইখাতা, জ্যামিতি বক্স, রং-পেন্সিল আর গল্পের বইগুলো গুছিয়ে নিয়েছে। বাবা নিয়েছেন স্টেথোস্কোপ, ডাক্তারী যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র, সিগারেটের অনেকগুলো প্যাকেট আর বেশ কয়েকটা লাইটার আর হয়ত কিছু টাকা পয়সাও। মা নিয়েছেন প্রেশার কুকার, নুন-চিনি-তেল-মশলা, হাতা-খুন্তি আর সাংসারিক অনেক জিনিসপত্র আর কিছু জামাকাপড়। অর্কর বোন সবু নিয়েছে ওর প্রিয় খেলনা আর পুতুলগুলো। সরকার থেকে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে কেউ যেন কুড়ি কেজির বেশি জিনিসপত্র না নেয়, এক একটা মহাকাশযানে পঞ্চাশ জনের বেশি লোক নেওয়া যাবে না।
অবশেষে ওদের যাওয়ার দিন এগিয়ে আসতে লাগল। পনেরোই আগষ্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়েছে ভারতবর্ষ থেকে প্রথম দশটা মহাকাশযানকে 'নতুন পৃথিবী' - র উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য। এদেশ থেকে বাছা বাছা কয়েকজনকে পাঠানো হচ্ছে তাঁদের পরিবারের লোকজন সমেত। তবে শুধু মা-বাবা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকেই নিয়ে যাওয়া যাবে। অর্কদের যেতে হবে থিরুভানন্তপুরমে। ওখান থেকেই রওনা হবে ওরা। তার আগে অর্কর বাবা সব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সাথে একটা গেট-টুগেদারের ব্যবস্থা করলেন। এই শেষ দেখা, শেষ মিলন! শেষ আনন্দ ভাগাভাগি করার মুহূর্ত কেউ হারাতে চাইল না। কিন্তু গল্পগুজবের থেকে জরুরী কথাবার্তা আর কান্নাকাটিই হ'ল বেশি। ভালো ভালো খাবার সামনে থাকা সত্ত্বেও কেউ খেতে পারছিল না। সবাই একটা কথা জানতে চাইছিল, তারা কবে যেতে পারবে? কি করলে যেতে পারবে? অর্কদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাওয়ার সময়ে আবার কান্নার মাত্রা বেশি হয়ে গেল। অর্কের মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, সে একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য ছাদে গেল। আকাশটা কেমন ঘোলাটে, রোদের তেমন জোর/তেজ নেই। বাতাসে একটা টকটক গন্ধ। শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। অর্ক নেমে এল নীচে। সারা বাড়িতে সেন্ট্রালাইজড এ. সি.। বাইরে থাকার চেয়ে ভেতরেই ভালো লাগছিল। কিন্তু সকলে তখনও কেঁদেই চলেছে । বাড়িতে লোকেলোকারণ্য। কোথাও একটু বসার জায়গা নেই। অর্কর খুব অস্বস্তি লাগছিল।১২ই আগস্ট অর্কর বাবা-মা দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন থিরুভানন্তপুরমে। ওখানে অনেক কিছু চেকিং হবে। ওর বাবা সকলকে ফিট রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একটু অসুস্থ হয়ে পড়লেই মুশকিল। তাকে চিরতরে রেখে যেতে হবে এখানে, এই পৃথিবীতে। আর যেখানে ফিরে আসা যাবে না কোনমতে।
১৫ই আগস্ট, ঘড়িতে দশটা দশ, পৃথিবী ছাড়ল মহাকাশযান 'গন্তব্য'। ঠিক একটা বড়সড় বিমানের মতো। দুটি বিমানকে মাঝখান থেকে জুড়ে দিলে যেমন হয় আর কি। পাঁচটা বছর সময় কম তো নয়। এর মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া, শোয়া-বসা, হাঁটাচলা সব কিছু। তবে শুধু প্রিজার্ভড ফুড খেয়েই থাকতে হবে। অর্কর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল শুধু বাড়ির লোকজনের জন্যই নয়, বন্ধুদের জন্য, লেখাপড়ার জন্য, স্কুলের জন্য, আরো অনেক কিছুর জন্য। এই পাঁচটা বছর ও পড়াশোনা করতে স্কুলে যেতে পারবে না। এক অনিশ্চিত জীবনের শুরুটা কেমন হবে সেটা ভেবে ও কূলকিনারা পাচ্ছিল না।
-দাদা এখন ক'টা বাজে রে?
বোন সবুর গলা শুনে অর্কর চমক ভাঙল। হাত ঘড়িটা দেখতে গিয়ে ওর মনে পড়ল ওরা এখন পৃথিবী পাড় হয়ে চলে এসেছে। এই ঘড়ির সময়ের সাথে আর মিলবে না।
বিদায় পৃথিবী, বিদায়! আর, তোমার সাথে দেখা হবে না আর! তবু তুমি বেঁচে থাকো, অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে উঠো। রক্ষা করো এই মানবসভ্যতাকে আরো হাজার হাজার বছর ধরে।
গল্প
রাজেশ্বর মিত্তির সরকারি দপ্তরে ছাপোষা কেরানী। বাবা মা কোন সুপ্ত বাসনায় ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘রাজেশ্বর’, তাঁর অজানা। বন্ধুরা ডাকেন রাজাবাবু। ব্যঙ্গ করে কিনা কে জানে! আলোকোজ্জ্বল শহরের চৌহদ্দি ভিতর এক তস্য গলির অন্ধকার ময় দুটি কামরায় স্ত্রী মাধবী ও পুত্র নিয়ে থাকেন। ভবিতব্যহীন গতানুগতিক জীবন। জীবনযাত্রায় তাঁর আশা আকাঙ্ক্ষা নির্দিষ্ট পরিধিতে আবদ্ধ। রাজেশ্বরের এই হলো রাজত্ব।
সেদিন বাড়ি ফিরে চা’য়ের কাপ হাতে অফিসের বাতিল হওয়া সেই দিনকার বারোয়ারি খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন।
মাধবীর বিরক্তি ঝরা স্বরে চমক ভাঙে –
“কতবার বলি একটা খবর কাগজ বাড়িতে নাও, দুপুরে একটু পড়তে পারি। এখন দেখ - বাড়ি ফিরেও কাগজটা দখল নিয়ে বসে আছে! দেখ তো লটারির রেজাল্ট বেরিয়েছে কি না?”
“হ্যাঁ এই তো কি একটা লটারির নম্বরের লিস্ট দেখছি,” এবার কটমট করে তাকান স্ত্রীর দিকে –এই মাগ্যিগন্ডার বাজারে অহেতুক খরচ তাঁর একেবারেই না’পসন্দ।
“আরে পাড়ার লটারির এজেন্ট পল্টু সে দিন টিকিটটা গছিয়ে দিলে। না করতে পারলাম না। দেখ তো পোড়া কপালে কিছু লাগলো কি না?”
রাজেশ্বর প্রচ্ছন্ন বিরক্তিতে বলেন –
“টিকিটের নম্বরটা বলো দেখি। হুম! 852313-”। ভাবেন টাকাটা গেছে, পাশের ভাড়াটের টিভিতে রাজনীতির কচকচানি শোনার থেকে নম্বরটা মেলাই। মাধবীকে চটানো ঠিক হবে না।
নিরুৎসাহি রাজেশ্বর লটারি রেজাল্টে চোখ বোলাচ্ছেন। টিকিটের দাম দেখে ভাবেন ওই টাকায় তিন দিনের বাজার হয়ে যেত। হঠাৎ তিনি থমকে গেলেন – চশমার কাঁচ মোছেন, দু’চোখ ঘষেন – না: ঠিকই দেখছেন, ঘরের ঝুলের ঝালরে মোড়া বাল্বের হলুদ আলোয় এই তো স্পষ্ট প্রথম প্রাইজের 852313 নম্বরটা ঝলমল করছে। হাতের কাগজ খসে পড়ে ঘরের মেজেতে। শিরদাঁড়ায় মনোরম অনুভূতির স্রোত ওঠে নামে, আচ্ছন্ন রাজেশ্বর ককিয়ে ওঠেন –
“মাধবী, মাধবী – 852313 নম্বরটা রয়েছে, আড়াই কোটির প্রাইজ!” আবেগে কথা জড়িয়ে যায় রাজেশ্বরের। সন্দিগ্ধ মাধবী বেরিয়ে আসে রান্না ঘর থেকে।
“এই তো দেখ – 852313।“ গলা বুঁজে আসে রাজ্যেশ্বরের। মাধবী চেয়ে থাকেন রাজেশ্বরের বিস্ময় জড়ানো আতঙ্কিত মুখের পানে। বুঝলেন লোকটা সত্যি কথা বলছে। পরক্ষণে তাঁর হাতের সদ্য ধোয়া কাঁচের প্লেট মাটিতে পড়ে ঝনঝন শব্দে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চতুর্দিকে।
রাজ্যেশ্বর বোকা বোকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন মাধবীর নানান অনুভূতি খেলা মুখের দিকে। বাক্য হারা মাধবীও শেষ অবধি খুশির আবেগ সামলে নিয়ে বসে পড়েন ঘরের কোণের ভাঙা চেয়ারে। হঠাৎ খুশির দমক কমলে দুজনে হয়ে পড়েন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অভাব তাড়িত জীবনে হঠাৎ করে দু এক হাজার টাকা হাতে এলে তাঁরা সামাল দিতে পারেন কিন্তু এক্কেবারে আড়াই কোটি টাকা পাওয়ার ঝক্কি কি ভাবে সামলাবেন! এত টাকায় কি সুখ তাঁরা কিনতে পারেন? অনেক খুঁজেও তাঁরা তল পান না। দিশা খুঁজে পান না দু’জনে। দুশ্চিন্তার মাঝে স্বপ্নাতীত পাওনায় হতবুদ্ধি দুজনে পরস্পরে দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকেন নি:শব্দে।
রাজেশ্বর ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ পায়চারি করেন। জড়সড় হয়ে বসা মাধবীর মন অলীক চিন্তার কানা গলিতে মাথা কুটতে কুটতে ফিরে আসে এই সুপরিচিত অস্বাচ্ছন্দ্যের আটপৌরে জগতে। পায়চারীরত রাজ্যেশ্বর দাঁড়িয়ে পড়েন --
– “দ্যাখ, টিকিটটা যদি আমার কেনা হত - তা’হলে প্রথমে রক্ত চোষা অফিসের দারোয়ান পান্ডের হাজার পাঁচেক টাকার দেনাটা মেটাতাম। আর ধর একটু বাগানওলা, বেশ আলো হাওয়া খেলা ছোট্ট দোতলা বাড়ি কেনা – কত দাম হতে পারে বলতো? বড় সাহেব ওই রকম একটা বাড়ি কিনেছেন দমদমের ওদিকে। তারপর ধর বাড়িটা তোমার মনের মত করে সাজাতে খরচ হবে পনেরো কুড়ি হাজার, ওতেই হয়ে যাবে মনে হয়। এরপর সবাই মিলে প্রতি বছর বেশ বেড়াতে যাওয়া যাবে, তোমার দীঘা পুরী যাওয়ার কত শখ। আর বাকি টাকাগুলোর মাসকাবারি সুদে আমাদের বেশ চলে যাবে, কি বলো?”
মাধবী অনেক ভেবে বলেন - “কিন্তু বাড়ির সঙ্গে জমিটা একটু বেশি নিতে হবে, শাক সবজির বাগান করতে হবে না! ছেলেটার ভালো স্কুল দরকার।” কিছুটা থেমে – “পুরীতে সমুদ্রের ধারে একটা বাড়ি নেওয়া যাবে, কি বলো? যে সময় যাব না তখন ভাড়া দিলে কিছু রোজগারও হবে।“
প্রথম ধাক্কা কিছুটা সামলে নির্দিষ্ট পরিধির আটপৌরে আশা আকাঙ্ক্ষার হরেক ছবি ক্রমশ: মিলিয়ে গিয়ে জায়গা করে নেয় অন্য আরো জমকালো চটকদার ছবি। নিজের নিজের কল্প জগতে ঘুরপাক খান তাঁরা।
রাজেশ্বর পায়চারি করেন আর ভাবেন –
‘অফিসের ওই ঝুলে ভরা ফাইলের গুদামে কাল আর ঢুকতে হবে না। দূর- কাল কেন? ওই অফিসে কোনো দিন যেতে হবে না আর। বড় রাস্তার আলো ভরপুর দোকানটায় মানুষ পুতুলগুলো কত সুন্দর সুন্দর জামা প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওই রকম কিছু কিনে নেবো। হাতে কত সময় থাকবে তখন, ধীরে সুস্থে সাজ পোষাক পরে ঘুরে বেড়াবো। পুরী নয় - দার্জিলিংয়ে বাড়ি নেব একটা। এই এঁদো পচা কাদা মাখা গলি, ইঁদুর ঘুরে বেড়ানো এই আলোহীন, বিষণ্ণ পরিবেশ চিরকালের মত ছেড়ে, দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে সকালে বেড়িয়ে, দুপুরে পাহাড়ের গা ঘেঁষা বাড়ির ফুলে ভরা বারান্দায় বসে মিঠে রোদ পোয়াবো – উফ! ভাবতেই পারা যায় না। ছেলেটাকে ওখানকার সাহেবি স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে। সে দিন বড় সাহেবের দার্জিলিংয়ের স্কুলে পড়া ছেলেটা অফিসে এসেছিল, কি চলন বলন, যেন সাহেবের বেটা!‘
রাজেশ্বরের রঙিন চিন্তায় ছেদ পড়ে। আড় চোখে মাধবী কে বলেন – “ভাবছি সিঙ্গাপুর ঘুরে আসব, বড় সাহেব গত বছর বেড়াতে গেছিল।“
“আমারও ইচ্ছে বিদেশে কিছুদিন কাটিয়ে আসা, সে দিন পাড়ার রমলার বোন আর ভগ্নীপতি
বিদেশের গল্প করছিল – সেখানে কেবল খুশি আর আনন্দ! যাক গে এখন রাত হয়ে গেছে, পল্টুকে ফোনে কাল সকাল সকাল আসতে বলো, ওর সাথে আগে পরামর্শ করতে হবে।” রাজেশ্বর ক্রমশ: বেড়ে ওঠা চাপা উত্তেজনায় ছোট্ট আলোআঁধারি ঘরটায় ঘুরপাক খেতে থাকেন। আবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে আড় চোখে নিজস্ব ভাবনায় ডুবে থাকা মাধবী কে দ্যাখেন –
‘মাধবী এ আবার কি বলে? সত্যিই বিদেশে যেতে চায় না কি? বিদেশে গিয়ে ও কি করবে! সে বার পুরী যাওয়ার সময় সারাক্ষণ ছেলে কি খাবে, কি পরবে, প্রতিটি খরচ নিয়ে খিটিমিটি, রাজ্যের পুঁটলি পোঁটলা নিয়ে আমাকেই নাস্তানাবুদ হতে হবে ......।‘- কি করতে মাধবী বিদেশে যেতে চায় বুঝি না। একবার হোটেলে উঠে আর তো বেরবে না! সেবার পুরী গিয়ে দেখা গেছে, নিজেও বেরবে না – আবার আমার একা বেরনো নিয়ে হাজার বাধা নিষেধ। কিন্তু তাঁর মন এখনো তরুণ, শখ আহ্লাদ করার ইচ্ছে শেষ হয়ে যায় নি। না না: ওকে বুঝিয়ে একাই বিদেশ যেতে হবে। মাধবীর কাছে বিদেশ বা পুরী, বেনারস একই। ওই বেনারসে একবার ঘুরিয়ে আনলেই হবে। ‘ঘরের ঝিমনো আলোয় মনে হলো মাধবী বড়ই সাধারণ --‘ অকালে বুড়ি হয়ে যাওয়া অতি সাধারণ। চুলের চওড়া খয়া সিঁথিতে ঘামে তেলে ভেজা ধ্যাবড়া সিঁদুর। শুকনো পাকিয়ে যাওয়া শরীর। রান্নার মশলা ও সস্তা জর্দার তীব্র গন্ধের মিশেলে কাছে ঘেঁষা যায় না। কিছু দিন হলো হাঁপানিতে ধরেছে। পরমুহূর্তে মনে ভেসে ওঠে বড় সাহেবের কেতাদুরস্ত সেক্রেটারির যৌবনের দীপ্তি, টিভির লাস্যময়ী নায়িকার শরীরী আকর্ষণ ...। রাজেশ্বরের শিরায় শিরায় ওঠায় রক্তের জোয়ার ---- ‘কিন্তু লটারির টিকিটটা কিনেছে মাধবী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রাজেশ্বর। ক্ষণিকের জন্য লটারির টিকিট পাওয়ার উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গিয়ে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসেন।
‘পনেরো বছর মাধবীর সঙ্গে আছি। আগে কখনো এমন চিন্তা তো মাথায় আসে নি! বোধহয় সহজে পাওয়া ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গ কখন পর্যবসিত হয়েছে অভ্যাসে, টের পান নি। আবার কখন সেই অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে শারীরিক অনীহায়! বুঝতেই পারেন নি রাজেশ্বর।’ কিন্তু কোন অতৃপ্ত আত্মার তাড়নায় আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
‘ভাবতে পারছি না মাধবী হঠাৎ বিদেশ যেতে চায় কেন? পুরী দিঘা বা সিঙ্গাপুর - ওর কাছে তো কোন তফাৎ নেই? তা’হলে কি ওর উদ্দেশ্য আমার পথে বাধা সৃষ্টি করা! টাকার জোরে আমাকে ওর ওপর নির্ভরশীল করে তোলা? আমার হাতে অল্প কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাকিটা নিজের কাছে রেখে রাজ্যের আত্মীয় স্বজনদের খোরপোশ যোগাবে! নিশ্চয় এটাই মাধবীর উদ্দেশ্য। নিজের আত্মীয়দের কথাও তাঁর মনে আসে। সবগুলোই ভণ্ড ও অপদার্থ। তফাৎ নেই।
ঘরের অন্য কোণে বসে থাকা মাধবীর দিকে ফিরতে মনে হল ওর দৃষ্টিতে যেন জড়িয়ে রয়েছে তাঁর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ, অবিশ্বাস। রাজেশ্বরের মনে ধিকি ধিকি চাপা ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে ---
‘খুব ভালো করে জানে লটারির টিকিটা ওর। একেবারে কঞ্জুস, এক পয়সাও হাতে দিয়ে গলে না। আমি বেশ বুঝতে পারছি এক পয়সা দেবে না আমাকে! আমার কপালে বাকি জীবনটা অফিসের ওই অন্ধকূপে কেটে যাবে।’
বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দ্যাখেন স্ত্রীকে। মাধবীর শীতল দৃষ্টি যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে সে’ও দিবাস্বপ্ন দেখতে জানে। তারও নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভাবনা আছে। দীর্ঘ পনেরো বছরের দাম্পত্যের অভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পারছে রাজেশ্বরের মনের অন্দরে কিসের টানাপড়েন ঝড় উঠেছে ? টাকাটা হাতে এলে রাজেশ্বর ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়ে হস্তগত করার চেষ্টা করবে। ওই তো সেদিন জোর করে লক্ষীর ভাঁড় ভেঙে পাড়ার মুদির ধার মেটালো কিন্তু এবার আমার টাকা হাতিয়ে নেওয়া খুব সহজ হবে না।
রাত গভীর হয়। অপ্রশস্ত ঘরের মাঝ বরাবর মাথা চাড়া দেওয়া অদৃশ্য প্রাচীরের দুই পাড়ে পরস্পরের প্রতি হিংস্র শ্বাপদের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন দু’জনে।
কখন ভোর হল দু’জনে টের পান নি। ঘরের এক ফালি জানলার গ্রিলে বসা পরিচিত দুটি চড়াই পাখির কিচিরমিচির জানান দিল নতুন সকালের। তারা যেন টের পেয়েছে দুটি মানুষের পুঞ্জীভূত জমাট ক্ষোভে ঘরটার পরিবেশ হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। পাশের বাড়ির ভাঙা দেওয়ালে প্রতিফলিত চুঁইয়ে আসা চিলতে ভোরের আলোয় মাধবীর রাত জাগা চোখে ক্লান্তির আভাস -রাজেশ্বরের আলোড়িত মনে জাগায় অস্বস্তি।
সদরে কড়া নাড়ার শব্দে চমক ভাঙ্গে। রাজেশ্বর শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দেখেন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে লটারি এজেন্ট পল্টু।
“দাদা – টিকিটটা দেখান দিকি –আপনার ফোনের পর রাতে ঘুমোতে পারি নি। আপনারাও ঘুমোননি মনে হচ্ছে!” মাধবী কাঁপা হাতে দলা পাকানো টিকিটটা এগিয়ে দিলেন পল্টুকে। ব্যাগ থেকে ছাপানো লিস্ট বার করে পল্টু টিকিটের নম্বর মেলায়। নিজেদের অজান্তে পরস্পরের হাত আঁকড়ে স্বামী স্ত্রীর উদগ্রীব দৃষ্টি অনুসরণ করে লটারি রেজাল্টে পল্টুর আঙুলের ওঠা নামায় -।
পল্টুর আক্ষেপ – “উফ বৌদি- কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেছে। নম্বরটা ফার্স্ট প্রাইজের বটে কিন্তু সিরিজ যে অন্য !” এবার সে এক গাল হাসে – “দু:খের কিছু নেই বৌদি। সান্ত্বনা পুরস্কার হাজার টাকা পেয়ে গেছেন। বিকেলে টাকাটা নিয়ে আসব। আপনার হাতের ইশ্পেসাল চা খেয়ে যাব কিন্তু - হা: হা:।“
পল্টুর সাইকেল ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে গলি দিয়ে চলে গেল। দু’ জনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরস্পরের হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে। পরস্পরের প্রতি রাতের বিদ্বেষ, অবিশ্বাস কোন মন্ত্রবলে হঠাৎ উধাও হয়ে – নিজেদের পরিচিত কঠিন বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে এসে দু’জনেই স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন। এজমালি চৌবাচ্চার জল মাথায় ঢালতে ঢালতে রাজেশ্বর ঠিক করেন দেরি না করে আজ সাহেবের কাছে মাধবীর হাঁপানির চিকিৎসার জন্য প্রাপ্য ভাতার দরখাস্ত জমা দেবেন। মাধবী ততক্ষণে রান্না ঘরে রাজেশ্বরের প্রিয় পরোটা আলু চচ্চড়ি বানানোর তদ্বিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এক রাতের আকাশ কুসুম স্বপ্ন চুর চুর হয়ে ভেঙ্গে – দু’জনেই তখন ফিরে এসেছেন তাঁদের দারিদ্র ভরপুর সংসারের স্বস্তিকর পৃথিবীতে।
প্রবন্ধ
শিল্পী রেম্ব্রান্টের বাড়ি। এখন মিউজিয়াম।
শিল্পী রেম্ব্রান্ট স্ত্রী সাসকিয়ার সাথে।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আমষ্টারডাম শহরের নাগরিকেরা এক অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে আসতো। শ্রীলংকা থেকে আগত এক হাতী নানারকম খেলা দেখিয়ে এ শহরের জনসাধারণকে অপরিসীম আনন্দ দিত। হাতীটির জন্ম ১৬১০ সালে শ্রীলংকাতেই (Ceylon)। ওর নাম দেয়া হয়েছিল হানস্কেন (Hansken)| একে শিল্পী রেম্ব্রান্টের (Rembrandt van Rijn (1606-1669) হাতীও বলা হয়, কারণ ১৬৩৭ সালে এই হাতীকে আমষ্টারডাম শহরে প্রথম দেখে রেম্ব্রান্ট এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ওর কয়েকটা ছবিও একেঁছেন। তামিল ভাষায় হাতী হল আন্নাই। সেদিন আমষ্টারডাম শহরের রেম্ব্রান্ট হাউজ মিউজিয়ামে এর ওপর সুন্দর Exhibition হয়ে গেল। সপ্তদশ শতকের ইউরোপে এ হাতীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
সপ্তদশ শতকে শ্রীলংকা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একটা বড় ঘাঁটি ছিল। ওখানকার ওলন্দাজ গভর্ণর প্রিন্স ফ্রেডেরিক হেনরী (Frederick Henry, Prince of Orange, 1584-1647) হঠাৎ ছোট হাতীর প্রতি কৌতূহল দেখান। ১৬৩৩ সালে হাতী হল্যান্ডে আসে, আর প্রিন্স ওকে অন্যান্য জন্তুর সাথে রাজকীয় আস্তাবল রাখেন। ওর তামিল নাম হল আন্নাই (হাতী)। ওকে এ সময় প্রায় এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনা হয়েছিল। ১৬৩৭ সালে রেম্ব্রান্ট ওকে দেখেছেন আর চক দিয়ে হাতীর চারটি ছবি আঁকেন। Amsterdam শহরের ধনী লোকেরা, যেমন কর্নেলিস ভন গ্রনভেল্ট
(Cornelis Van Groenevelt, 1580-1642), প্রায় ২০,০০০ ডাচ পয়সা দিয়ে হাতীকে কেনেন।
হাতী এ সময় অনেক কিছু শেখে, যেমন, একটি বাস্কেট শুঁড়ে নেওয়া, তরবারী নেওয়া, বন্দুক ছোঁড়া ইত্যাদি। ১৬৩৭ সালে আন্নাই আময্টারডামে থাকাকালীন রেমব্রান্ট হাতীটিকে আঁকেন। এই শিল্পকলাই হয়তো শিল্পী ওর আদম আর ইভ অঙ্কনের সাথে যুক্ত করেন। ১৬৩৮ সালে আঁকা রেমব্রান্টের এই ছবিটি তেল আভিভ মিউজিয়াম, ইসরায়েলে সংরক্ষিত রয়েছে।
হাতীটি ইউরোপের অনেক জায়গাতেই ঘুরে বেড়িয়েছে। জাহাজে বল্টিক অঞ্চল, হেঁটে ডেনমার্ক অঞ্চল, আর ইতালি ও ইউরোপের নানা দেশ।
ফ্লোরেন্স শহরের বিশেষ স্কোয়ার পিযাজ্জা দেল্লা সিনোরিয়াতে এসে হাতী হঠাৎ মাটিতে পরে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। এ দৃশ্য দেখেছেন ইটালিয়ান স্টেফানো দেল্লা বেল্লা। ইনি ফ্লোরেন্সে ছাপাখানায় লেখা সংক্রান্ত কাজ করতেন।
এরপর কোম্পানীর ভন গ্রুনভেল্ট (Van Groenevelt) হানস্কেনের শরীর তোস্কানীর ডিউক ফারদিনানদো, দ্য মেদিচীকে বিক্রি করে। ইনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পছন্দ করতেন। রেমব্রা্ন্টের প্রিয় হাতী হানস্কেনের সাথে পরিচয়ে এই জগত বরেণ্য শিল্পী ওকে কয়েকবার দরদ দিয়ে অঙ্কিত করে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন।
হাতী হানস্কেনের রেখাচিত্র।
প্রদর্শনী, রেমব্রান্ট হাউজ সংগ্রহশালা।
গল্প
যমুনার কোনোদিন কোনো অজানা অচেনা রাস্তায় হাঁটার কথাই ছিলো না। এমন কি কোনো অচেনা ভিড়ে পথ খোঁজার কথাও ছিলো না তার। আসলে যমুনাদের বাড়িটা ছিলো সেকেলে ধরনের । রক্ষণশীল গাম্ভীর্য জমাট বাঁধা থাকতো তাদের বাড়ির খিলানে, উঁচু উঁচু সিলিং-এ। উঁচু, ভারী দরজাগুলো সহজে খুলতো না তাদের বাড়ির। যমুনা বেশ শান্ত, নিস্তব্ধতায় জীবনের অনেকটা সময় সেই বাড়ির বন্ধ দরজার ওপারে কাটিয়ে দিয়েছে; অনায়াসে। তখনো তার জীবনে কবিতারা আসেনি। তারপর একদিন অনেক কিছুই অন্যরকম ঘটলো। যে কথা ছিলো না সেই কথাগুলোই সত্যি হয়ে গেলো তার জীবনে।
কবিতাই হয়তো ঘটালো। সেই কবিতা, যা বোধহয় হঠাৎই আসে। এক দৈবের মত। কিংবা বলা যায় হঠাৎ এসে যাওয়া বৃষ্টির মত। যমুনারও কাছে কবিতা এসেছিল তেমনি। একটা কবিতা সাদা পাতায় লেখা হোলো। দ্বিতীয় কবিতা মনের মধ্যে এলো; দ্বিতীয় পাখি উড়ে এলো খাতার সাদা পাতায়, ফুটে উঠতে থাকলো কবিতার অক্ষরগুলি। এইভাবে একটা, দুটো, তিনটে, চারটে করে পাখি উড়ে আসতে থাকলো। আর আশ্চর্য এক দুনিয়া খুলে যেতে থাকলো মনের আঙিনায়। সে কবিতার পর কবিতায় সাদা খাতা ভর্তি করতে থাকলো। কবি কথাটা সে নিজের নামের আগে লেখে আর কাটে। যদি কেউ দেখে ফেলে। বেশ লজ্জা পায়। কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে কবিতাগুলি রেখে দেয়। যেখানে যায় ওরাও সঙ্গে থাকে।
যমুনাদের বাড়িটা যেখানে, সেখান থেকে অনতিদূরে ছিল অন্য একটা রাস্তা। বাড়ির সামনের টানা ট্রাম লাইনটা সোজা গিয়েছে সেই রাস্তাটায়। সেই রাস্তাটা যমুনার জীবনের এক আশ্চর্য পথ। এক আলো আঁধারি তারাজ্বলা সরণি।
হঠাৎই যমুনা পৌঁছে গেছিলো সেই অচেনা অজানা রাস্তাটায়, হঠাৎ পৌঁছনো চওড়া রাস্তাটায় তখন কার্নিভ্যাল চলছে। জীবনের কার্নিভ্যাল। সে এক অন্য পথের পথিক - একা মেয়ে সেই আলো আঁধারি রাস্তায় পৌঁছে যেন জীবন উদযাপনের এক স্রোত মুখরতা অনুভব করলো।
আর সেই রাস্তার ধারেই বসেছিল এক জাদুকর। যমুনা সেখানে পৌঁছতেই, তার সাদা কালো জীবনে নিমেষে জাদুকর ছড়িয়ে দিয়েছিল হরেক রঙ। নিজের মর্জিতে নিজের আনন্দে। লাল, নীল, সবুজ , হলুদ, বেগুনির পাশাপাশি অনেকটা ধূসর রঙেরও আবির্ভাব ঘটেছিলো যমুনার জীবনে সেদিন থেকে। আসলে তীব্র আনন্দের সঙ্গে কষ্ট যন্ত্রণারও গাঁটছড়া আছে যে! সুতরাং হরেক রঙের ঝলকানি হঠাৎই আলোড়িত করেছিল যমুনাকে।
এক প্রৌঢ় জাদুকর যেন অপেক্ষায় বসেছিল। তার থেকে সঠিক ভাবে বললে বলা যায় ঘাপটি মেরে বসেছিল অপেক্ষায়। নিতান্তই এক মাঝামাঝি জীবন যাপনে ক্লান্ত যমুনা আচমকাই নানা রঙের আলোকে আলোকিত হতে হতে ভেবেছিল জীবনে কতকিছুই দেখার বাকি ছিল!
বেশ কয়েকটা অচেনা রাস্তা পেরিয়ে ট্রামটা যেদিন তাকে ঐ রাস্তাটায় পৌঁছে দিয়েছিল; যমুনার সাইড ব্যাগটার ভিতরে সবুজ মলাটের খাতায় তখন বেশ অনেকগুলো কবিতা জমে গেছে। যেন তখনও সে ছিল এক কিশোরী। কবিতাগুলো কাপড়ের কাঁধ ব্যাগের ভিতর লুকোনো প্রেমপত্র; সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। কেমন লজ্জা, কেমন ভয় ভয়; দারুণ উত্তেজনা বুকের ভিতর। আদৌ কি এগুলো কাউকে দেখানো যায়! ভেবে পেতো না সেই যুবতীর মোড়কে আদতে কিশোরী মেয়েটি।
আসলে সেই মেয়েটা এক লুকানো সময়ের খাঁজে লুকিয়ে ছিল। একদিন হঠাৎই কতগুলো খুচরো পয়সা হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া বালিকার মতই বেরিয়ে পড়েছিল ভীষণ ব্যস্ত, ভীষণ সপ্রতিভ অন্যরকম এক শহরে। অচেনা, অজানা এক ট্রামরাস্তা ধরে সে পৌঁছেছিল রঙবাহারি সেই এক রূপকথার জগতে।
এই যে মানুষ কবিতা লেখে, তার থেকে বোধহয় একরকম গন্ধ বেরোয়। খাতার মলাট খুললেই সুবাস ছড়িয়ে পড়ে কবিতা থেকে। ভাসতে থাকে সুগন্ধ আকাশে বাতাসে। মানুষের থেকে দ্রুততায় কবিতার গন্ধ পৌঁছে যায় অন্যত্র। যমুনার কয়েকটা কবিতায় বোধহয় তেমনি কোনো সুগন্ধ ছিল। সেই সুগন্ধ ঠিক গিয়ে পৌঁছেছিল প্রৌঢ় জাদুকরের নাকে। যমুনা যাওয়ার আগে সেই নতুন রাস্তায় তার কবিতাগুলো উড়ে গিয়ে বসেছিল জাদুকরের কাঁধে মাথায়। জাদুকর নতুন রাস্তার ধারে যমুনাকে দেখে কেমন হকচকিয়ে যায় প্রথম দিন। জল খাচ্ছিলো সে। বিষম খেয়ে জল তার দুই চোখে। যমুনা জিজ্ঞাসা করে, 'কি হলো?' জাদুকর সামলে নেয় নিজেকে। হেসে ঘোষণা করার ঢঙে বলে, 'কি হবে! আমি জাদুকর। ভোল পালটে সোজাকে উল্টে দিয়ে মানুষকে অবাক করাই আমার কাজ। আমার সহজে কিছু হয় না।'
সে কথা ক'টা বলে মৃদু মৃদু মোহন হাসি হাসতে থাকে। তার বহু চেষ্টায় তৈরী করা কারিগরিতে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। সে জানে এইভাবেই মানুষেরা মোহিত হয়। বিশেষ করে মেয়েরা। সুতরাং সামনের মেয়েটিও হবে।
কিন্তু পুরোপুরি সেটাতো হয় না। ভালো লাগে বটে যমুনারও। কিন্তু শুধুই মোহিত হওয়া তো হয়ে ওঠে না তার। সে যে জাদুকরকে তার নিজস্ব আতস কাঁচের তলায় দেখে নেয়! তার চোখের মণিতে কে যেন সেই কোন ছোট্ট বয়স থেকে সামনের মানুষটার বুকের ভিতর পর্যন্ত দেখে নেওয়ার যন্ত্র লাগিয়ে দিয়েছে। সে খুব সহজেই সকলকে খুব ভিতর থেকে দেখে নেয়।
সহজাত সেই স্বভাব মতই সে জাদুকরের হৃদয়ের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার সুখ, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সবকিছু নিজের হাতের তালুর মত দেখতেও পায়। আর জাদুকরের হাড় পাঁজরা গুণে ফেলে খুব সহজেই।
যমুনার ব্যাগের মধ্যে থাকা খাতার ভিতর কবিতাগুলোয় তখন ক্রমশ প্রজাপতির পাখা জুড়ে গেছে । হঠাৎ লেখা গল্পগুলোতে রামধনুর রঙ খেলে যাচ্ছে। জাদুকর বলে, 'ও মেয়ে তোমার কবিতাগুলো বেশ ভালো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে এখন।' সে মৃদু হাসে। জাদুকর বলে,
- 'তোমার লেখা গল্পগুলো নজর করেছো, বেশ চমৎকার হচ্ছে।'
যমুনা তৃপ্তির শ্বাস ফেলে।
যমুনা ভাবে, আজকাল বেশ হয়েছে -- বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুকুনি। কখন যাবো ট্রাম রাস্তা ধরে জাদুকরের চেনানো সেই গলিতে। জাদুকরকে খুঁজে পাবো তো! আসবে তো ঐ পথে! কেমন এক উচাটন। সারাক্ষণ দেখা হওয়ার অপেক্ষা। দেখা হতেই যমুনা বড় করে শ্বাস নেয় বাতাসে। জাদুকর দেখতে পেয়ে রেগে যায়। 'ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়। এমন বজ্র বিদ্যুৎ নেমে আসছে আকাশ থেকে; ঠায় দাঁড়িয়ে আছো কেন মেয়ে? তোমার কি বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, বলতো আমায়!'
যমুনা ভাবে, কি করে বলে সে, হ্যাঁ জাদুকর তাই। আগের সেই যমুনা আর এই যমুনায় যে আকাশ পাতাল ফারাক। জাদুকরের সঙ্গে দেখা না হলে যে তার মন কেমন করে। কেমন এক শঙ্কা, উত্তেজনায় ত্রস্ত হয়ে থাকে সে।
যমুনাকে ধমক ধামক দিয়ে আপনমনে হাসে জাদুকর। সেই হাসি দেখে মনে হয়, সে জানে এমন হওয়ার কথা ছিল। তার জাদু এমনই মারাত্মক। ঠিকঠাক কাজ করেছে তার জাদু। তৃপ্ত খুশির ভাব তার চোখের তারায় ঝিলিক তোলে। জাদুকরের মুখের চামড়ার তলায় খুশির কম্পন দেখতে পায় যমুনা।
তার চোখের আতস কাঁচের তলায় সেই অল্প সময়ের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে জাদুকরের হৃদয়ের সব প্রকোষ্ঠ। সে পড়ে ফেলে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো। --- লোকটা সারাটা জীবন এমন তীব্র আগ্রহের জন্যেই যেন অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তবুও পায়নি। তারপর হঠাৎ একদিন এই আকুলতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। জাদুকর একদম বেকুব বনে গিয়েছে। মানুষটা কম অবাক হয়নি! সে নিজেই জানতো না তার জাদুর এত জেল্লাও আছে!
যেতে আসতে কত যে টানাপোড়েন তৈরী হয় এই দুটি মানুষের মধ্যে। কত যে কষ্ট কাজ করে বুকের ভিতর। রোজ সেই আলো আঁধারি সরণি থেকে ফিরবার সময় বাতাস ভারী হয়ে যায়। জাদুকর আর যমুনার মধ্যবর্তী বাতাসে জলকণা ভাসতে থাকে আর কুয়াশায় অস্বচ্ছ হয়ে আসে পারিপার্শ্বিক।
---- 'জাদুকর বলোতো কেন এমন হয়। রোজ যাওয়ার সময় কি কষ্ট! কেন আমায় চলে যেতে হয় জাদুকর, কেন চলে যাওয়ার সময় এত কষ্ট হয়! কেন এত পিছুটান! কোথা থেকে জন্মালো জাদুকর!'
যমুনার দিকে ভারী বিষণ্ণ হয়ে তাকায় জাদুকর। ঘন কুয়াশা ছেয়ে থাকে তার চোখে মুখে। আত্মগত স্বরে বলে, 'এই কষ্টটাই তো মুশকিল। তার চেয়ে…….. ।'
তার শেষ না হওয়া কথা শেষ হওয়ার আগেই হাঁকুপাঁকু করে যমুনা থামিয়ে দেয়। ---'চুপ করো জাদুকর, চুপ করো। ও কথা বলো না। আমার কোনো কষ্ট হয় না। কোনো কষ্ট নাই আমার। জাদুকর, জীবন যেমন দেবে তাই তো তুমি পাবে! তার এক সুতো বেশিও না এক সুতো কমও না। আমার দেখো কোনো বিষাদ নেই চোখে মুখে। আছে? দেখো তুমি। 'সে জোর করে জাদুকরের মুখ ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে।
তার জাদুকর হাসে। যমুনার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই বিষণ্ণ হাসি! দেখে বুকের ভিতরটা টনটন করে যমুনার। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। মুখ ঘুরিয়ে আড়ালে চোখ মুছে ফেলে সে। জোর করে হেসে উঠে বলে, 'কি একটা হাসি হাসলে জাদুকর, যেন উত্তমকুমার!'
দু'জনেই সেই এক আলোকোজ্জ্বল সরণিতে বুকের মধ্যে অব্যক্ত যন্ত্রণা চেপে হেসে ওঠে জোরে। জাদুকরের চোখ দুটো ঝিকমিক করতে দেখে যমুনা নিয়নের আলোয়।
জাদুকর অন্ধকার নেমে আসা সন্ধ্যায় হাত ঘোরায় জাদুকাঠি নাড়ানোর মত। যমুনা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, জাদুকর নতুন করে আবার কি জাদু দেখাবে এখন!
জাদুকর হাসে। বলে, 'সামনের দিকে তাকাও, দেখো কি মায়া পৃথিবীর। দুনিয়ার সুর, রঙ, গন্ধ অনুভব করো মেয়ে।'
যমুনা আশ্চর্য হয়ে দেখে সামনের দিকে। চারপাশটা লক্ষ্য করে। সত্যিই তো কি ঝলমলে শহর। মায়াময় সন্ধ্যায় শহরটা যেন চমৎকার এক আলোখেলা নদী। জাদুকর আর সে পায়ে পায়ে হেঁটে যায় সেই আনন্দনগরীর পথ বেয়ে।
যমুনা ফেরার পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে জাদুকরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে,
'জাদুকর আমি তোমার কে বলতো? তোমার আমার মধ্যে কী আছে জাদুকর?'
জাদুকর রহস্যময় মুখে বলে, 'কিছু তো একটা আছে নিশ্চয়। না হলে কেন আমরা এইখানে এই এক আশ্চর্য জীবনের মোড়ে দুজনে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি। যমুনা সপ্রশ্ন চোখে তাকায়। জাদুকর মায়াবী হেসে বলে, 'তুমি আমার কল্পমানসী গো বুঝলে না মেয়ে!'
যমুনা হাসে, তার চোখের আতস কাঁচের তলায় জাদুকরকে দেখে। যমুনার মায়াকাজল লাগানো চোখ জাদুকরের ভিতর পর্যন্ত যেন দেখতে পায়। সে বোঝে, জাদুকরকে যখন প্রথম দেখেছিলো তার থেকে আকাশ পাতাল ফারাক এই সামনের মানুষটার। আগে সে যেন ছিল শুধুমাত্র টাকা নিয়ে জাদু দেখানোর কারিগর। আর আজ সে নিজের আনন্দের জন্যই জাদু দেখায়। আর তখন তৃপ্তি তার চোখে মুখে ফুলের রেণুর মতই ছড়িয়ে পড়ে। সে এখন অনায়াসে ভেল্কি দেখিয়ে ঢুকে পড়তে পারে পার্লামেন্টে, ফাটা কলারের জামা পরেই চলে যেতে পারে গ্র্যান্ড হোটেলের ভিতরে। যমুনা অনুভব করে , প্রথম দেখা দুঃখী সেই ভেল্কিবাজ আজকে যেন আশ্চর্য পরিণত এক মানুষ। সুখ দুঃখের সমব্যথী এক সত্যিকারের জাদুকর। যমুনার ইচ্ছে করে তার হাতটা শক্ত করে ধরতে। কিন্তু ধরে না। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছুঁয়ে থাকে তার হাত। এক অদ্ভুত চিরন্তন সংযোগ স্থাপিত হয়। তারা এই পৃথিবীতে দুটি মানুষ যতটা পারে একসঙ্গে হেঁটে যেতে থাকে। জাদুকর আর তার কল্পমানসীর ঝোলায় সঞ্চিত হতে থাকে অজস্র রঙ, অজস্র সুখ দুঃখের গল্প আর তারাখেলা কবিতার সঞ্চয়।
গল্প
রাজকুমারী
দেবপ্রতিম দেব
ফার্স্ট লিংক রোড, শিলচর, আসাম
এক দুই ফোঁটা বৃষ্টিতে অফিস থেকে বেরিয়ে রাজীব নিকটবর্তী মার্কেটে ঢুকেছিল; দুই তিন দিনের জন্য মাছ, সব্জি একসাথে সেরে ফেলল।
বাচ্চাদের জন্য দুটো দুটো লজেন্স নিয়ে রাজীব ঢালু রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফিরছে। বৃষ্টি নেই, বৃষ্টির জল নেমে আসছে নীচে, রাজীবের দিকে। রাস্তা এবং নালার মাঝখানে যথাক্রমে কাদামাটি আর ঘাস। সেই ভেজা সবুজ ঘাসে এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট ফুল সাদা, হলুদ।
বাড়িতে আজ তার বোন রুহি ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসবে। এপার্টমেন্টে যাবার পরে এই প্রথম।পাহাড়ের অপোক্ত মাটিতে একমাত্র এই বহুতল আবাসনটি গড়ে তোলা প্রশাসনিক কর্মী বলেই সম্ভব হয়েছে প্রোমোটারের।
বাড়িতে পৌঁছে রাজীব যথারীতি ছয়টা জুতো দেখল দরজার বাইরে। ঘরের ভিতরে তার ভাগ্নে মুস্তাফার সঙ্গে কথা বলছে, ওরা মিলেমিশে গিয়েছে তা দেখে রাজীব আপ্লূত। রাজীব দুটো চকলেট বাড়িয়ে দিতেই মুস্তাফা রাজীবকে বলল - 'পিশিএ তামিনারে গাইল্ লাইসে'। তার ভাগ্নী এবং রুহি দুজনই গম্ভীর। কি হয়েছিল তা রাজীব রুহির কাছে জেনে বলল - ও, ইতা নি কান্ড, খেলনা নিয়ে ঝগড়া!
রুহি ওঠে দাঁড়াল এবং - 'অনেক সময় তেকিয়া ওয়েইট করসি তর লাগিয়া … আর বইয়ার না আজকে' - বলে রাজীবকে বাই জানিয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে চটজলদি বেরিয়ে যেতে লাগল। রাজীব কোনোমতে তার ভাগ্নে - ভাগ্নীকে লজেন্স হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়।
রুহি চলে যাবার পর রাজীব তামিনার ঘরে তাকে খুঁজে পায়নি। রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রেখে এসে তামিনাকে ডাক দিল রাজীব - কোনো শব্দ নেই; ফের সে তামিনাকে ডাকল অনেকবার, সমস্ত বাড়িতে খুঁজে দেখল - কোনো শব্দ নেই! মুস্তাফাকে সঙ্গে নিয়ে এবার রাজীব রাস্তায় বেরোল। খুঁজতে খুঁজতে রাত ৯টা ১০টা ১১টা ১২টা ছাপিয়ে গেছে। মুস্তাফা অনেকক্ষণ থেকে রাজীবের কোলে ঘুমোচ্ছে।
সদ্য-কিশোরী তামিনা এবং শিশু মুস্তাফা ওরা অনাথ ভাই বোন। জন্মের পর থেকে রহিমের আশ্রমে ছিল অনেক বছর। সেখানে তাদের নামকরণ, সেখানেই সম্পর্ক। তামিনা মুস্তাফাকে দেখেশুনে রাখতে প্রথম থেকেই খুব সাবলীল।
রহিমের মৃত্যুর পর ডোনেশনের অভাবে আশ্রম-গেটে তালা ঝুলছে। তখন থেকে বাচ্চারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তামিনা এবং মুস্তাফাকে প্রতিদিন সকাল - সন্ধে মার্কেট এলাকায় দেখা যেত, এর কাছে ওর কাছে হাত বাড়িয়ে টাকা খুঁজত।
রাজীব দেয়নি কোনোদিন; সে স্পষ্ট বলে দিত -
'কিচ্ছু খাইতে চাইলে খাইতে পারবায় কিন্তু কেশ দিয়ার না'।
তামিনাদের ডালপুরি খুব পছন্দের। তাদের খাওয়া শেষ হলে রাজীব আপেল বা কলা দিয়ে যেত হাতে।
মধ্য-চল্লিশের রাজীব একা থাকত, একদিন তার ছোট বোন রুহিকে বলল যে সে বাচ্চা এডপ্ট করবে। রুহি বিশেষ কিছু বলেনি, দাদাকে শুধু প্রশ্ন করেছিল -
'তর এখনের সেলারি দিয়া পারবে যে তুই শিওর নি'?
সমস্ত শহরে তামিনাকে খুঁজতে খুঁজতে সময়টা ভোরের কাছাকাছি। মুস্তাফা এখনো ঘুমে। রাজীব আবার সেই ঢালু রাস্তায়, নামছে এবার, অফিস-পাড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে।
সাদা, হলুদ যে সব ছোট্ট ফুলগুলো সে গত সন্ধ্যায় দেখেছিল, সেইগুলো যেন আরো বড় হয়েছে।হাঁটতে হাঁটতে রাজীব তার ভগ্নীপতির অফিসের সামনে ভিড় দেখতে পেল; সামান্য কিছুদূর যেতেই সে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনতে পায় যেদিকে রুহিরা থাকে। কণ্ঠস্বরটা তার ভগ্নীপতির, এমনই মনে হয়েছিল রাজীবের। রাজীব থমকে দাঁড়ালো, তার যে আশঙ্কা ছিল - সেটা কি সত্যি ঘটেছে?
'ভূমিকম্প হইসে মনো হয়, তে টের পাইলাম না কেনে? '...
'রুহি তারার বিল্ডিং ঠিকঠাক আসে তো?' - এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে বহুতল আবাসনটির দিকে হাঁটা দিল।
যত এগিয়ে যাচ্ছে রাজীব, তত বেশি ধোঁয়া। ধোঁয়া ভেদ করে সে প্রথম এবং তারপর সবাই দেখতে পেল বিশাল ধ্বংসস্তূপ, যার চূড়ার দিকে কোনো জীব হামাগুড়ি দিচ্ছে।
সূর্যালোকে সবাই সেই চূড়ায় একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক, ওরা কেউ তার নাম জানে না, জানার কথা নয়। কিন্তু রাজীব জানত সেই নাম। '
তামিনা!' - মুহূর্তে সবাই রাজীবের দিকে চেয়ে রইল যখন মুস্তাফা দিদির নাম বলল।
গল্প
অপূর্ব দাশগুপ্ত
এক এক দিন হাওয়া ওঠে পাগলের মত। শুকনো যত পাতা, অশ্বত্থ, বাঁশ, পেয়ারা আর যত সব হাবিজাবি, ছেঁড়া কাগজের টুকরা, ন্যাকড়া এইসব নিয়ে মস্করা করে এলোমেলো হাওয়ার স্রোত।একবার গাছতলা থেকে এদের উড়িয়ে নিয়ে বেড়ার গায়ে চেপে ধরে, আবার ক্ষণিক পরেই তাদের পাক খাওয়ায় শুন্যে। পর্যাপ্ত ধুলো ওড়ে। বাতাসের এইসব পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতেই যেন দিনপতি, তার প্রভা সেদিন কমিয়ে আনে। চারদিকের এই ঘোলাটে আবহাওয়া দেখলে মুনিয়ার মেজাজ খুব বিগড়ে যায়। মন তার বারোমাস খারাপ। যেদিন সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, যেদিন তার জন্ম দিন, যেদিন নতুন লাভ লেটার পায়, কোনদিনই মুনিয়ার মনে খুশি নেই। আজকের এই পাগল হওয়াও তাকে বোধহয় কাঁদাবে।
কাঠের দোতালা বাড়িটির বারান্দায় একা একটি বেতের বড়ো চেয়ারে বসে আছে সে। একটা গানের লাইন মনে পড়তে চায়না কিছুতে। বড় অশান্তি।
এ এক গঞ্জ এলাকা। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে গৃহস্থদের বাড়িগুলি শান্ত দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠের দেওয়াল আর টিনের ছাউনি, মাটি থেকে একটু উঁচুতে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে। খুব হাতির ভয় ছিল নাকি একসময়, এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে তাদের ভয়। জানলা দিয়ে হাতির শুড় প্রবেশ করছে এ দৃশ্য ভালো লাগে না! তাই এই উচ্চতা। সামনে বাগান আছে প্রায় সবক'টি বাড়িতেই। আম কাঠাল, লিচু, ডেউয়া, নগকেসর, বড়ো বড়ো এইসব গাছ যেমন আছে, তেমনি আছে গোলাপ, জুঁই, কলাবতীর ঝোপ। দূরে জলরঙে আঁকা পাহাড় পূর্বে দেখ যায়। পাদদেশে অরণ্য যেন পাহাড়ের ফেন্সিং।
মুনিয়াদের বাড়িটির শ্রী একটু আলাদা, অন্য বাড়িগুলির চেয়ে বেশি সুন্দর। তাদের বাড়ির চালের রং ঝকঝকে রূপালী আর কাঠের দেওয়ালের রং বটল গ্রীন। মালিদের যত্নে তাদের বাগান সেজে থাকে প্রতি ঋতুর সঙ্গে মানিয়ে। মুনিয়ার বাবার বড় কাঠের ব্যবসা। কিন্তু এ কারণে তার সময় বড্ড কম। মুণিয়ার মাও দিনের পর দিন শুয়ে থাকেন, কোন শারীরিক অসুবিধে নেই,তবু। তিনিও অকারণে দুঃখী। সংসার চালায় মাইনে করা লোকেরা।
তিমির যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে হেঁটে, তার সাইকেল বিগড়েছে। অনিলদার দোকানে তার চিকিৎসা চলছে। মুনিয়াদের বাড়ি পাড় হলে পড়ার লাইব্রেরি। দুপুরের রসদ জোগাতে এই হাওয়ার মধ্যে সে বেড়িয়েছে। বিলে 'আবার জখের ধন' বইটি কাল ফেরত দিয়েছে। বইটি তুলতে হবে আগে গিয়ে।দশটা বেজে গেছে। লাইব্রেরি খুললো এবার।
মুনিয়া রাস্তায় তিমিরকে দেখতে পেয়েই ডাকে,
- 'তিমির, উপরে উঠে আয়, বাগানের গেট খোলা।'
- 'লাইব্রেরি থেকে বই তুলতে যাচ্ছি,ফেরার পথে আসি?'
- 'না, এক্ষুনি আয়।'
তিমির কী আর করে, 'দ' আকারের কাঠের সিড়ি ভেঙে সে দোতলার বারান্দায় পৌঁছায়। গোল বেতের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিপরীত দিকে চেয়ারে মুনিয়া বসে আছে। মলিন মুখশ্রী, তবু মুখখানি তে কী মধু মাখা। চোখদুটি গভীর দীঘির মত, গৌর বর্ণের মুখে কালো চোখদুটি কী মায়া যেন ছড়ায়। কোন ভূমিকা ছাড়াই মুনিয়া বলে,
- 'ওই গানটা তোর মনে আছে?'
- 'কোন গান বলবি তো!'
- 'তুই গতবার রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে গাইলি 'মেঘ বলেছে যাব যাব'। গাইলি না দেবব্রত বিশ্বাসকে নকল করে? তারপর আমি কোন গানটা গাইলাম, বল না শিগগিরি।'
- 'নাথ হে, প্রেম পথে বাধা, এটাই তো গেয়েছিলি।'
তিমির মুনিয়াকে খুশি হতে দেখে। খুশি গলায় মুনিয়া বলে,
- 'বোস না তিমির। গানটা মনে করিয়ে দিলি।' এইকথা বলে সে তিমিরের উপস্থিতি ভুলেই যেন গাইতে থাকে, নাথ হে প্রেম পথে বাধা……।
যে মেয়েকে সাধ্য-সাধনা করে কেউ গাওয়াতে পারে না, সে নিজে থেকে গাইছে। তিমির বসে। গান যখন শেষ হয়, তিমির মুখ তুলে দেখে, মুনিয়ার চোখে প্লাবন নেমেছে। বড় মুশকিলে পড়ে তিমির।কী বলবে এখন, তিমির ভেবে পায় না। মুনিয়াটা এমনিই মেয়ে।
মুনিয়াই তাকে উদ্ধার করে, হাতের উলটো পিঠে চোখ মুছে বলে,
তুই এবার যা তিমির।
দূর মফস্বলের এই অঞ্চলটির মানুষগুলির মধ্যে জটিলতা কম। সংসার আর রোজগার করতে গিয়ে মানুষকে স্বাভাবিক সারল্য কিছুটা বাধা রাখতে হয়েছে, যেমন হয়ে থাকে মানুষের সমাজে,তবু তুলনায় এখানকার মানুষেরা সাদাসিধে। খবর কাগজ পড়ে, রেডিও শোনে, রবিবারে রবিবারে ভাল করে বাজার করে। বেশির ভাগ মানুষ ব্যবসা করে, কেউ কেউ চাকুরীজীবী, স্কুলে, সরকারি নানা দপ্তরে তারা রুজির জন্য যায়। একটু সম্পন্ন ঘরের কর্তারা ছেলে মেয়েদের বলেন, পড়, পড়। ভালো পাস করলে কলকাতায় পড়াবো। কলকাতা বড় দূরের। বড়ই রহস্যের জায়গা, বুদ্ধিমানেদের জায়গা এদের কাছে। কেউ কলকাতা ঘুরে এলে, এরা তাকে ঘিরে ধরে। বলে, কোথায় কোথায় গেলে? কালিঘাট গিয়েছিলে, পার্টি পলিটিক্সের হালচাল কী, যুক্ত ফ্রন্ট টিকবে মনে হয়?
গঞ্জে সম্প্রতি একটা হেলথ সেন্টার খুলেছে। ডাক্তারও এসেছে একজন, কলকাতার ছেলে, একেবারে নবীন যুবক। ড.দ্বৈপায়ন বসুর নায়কদের প্রায় সব গুণাগুণ আয়ত্বে। চেহারাও দেখবার মত। সে কি না পারে! তিমিরদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়ে। কথা বলে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। তার চিকিৎসায়, তার ব্যবহারে লোকজন খুশি। ফাংশনে সে গাইল, 'মুক্তি মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলি দান।' ছেলে মেয়েরা সকলেই মুগ্ধ হয়। মেয়েরা একটু বেশি। তিমির আর তার বন্ধুদের সঙ্গে তার খুব জমে যায়।
তিমির ডক্টর বসুর অবসরে তার কোয়ার্টারে যায়। তিমিরের সঙ্গে আড্ডা মারতে দ্বৈপায়নেরও ভালো লাগে। একদিন তিমির গিয়েছে দ্বৈপায়নের সান্নিধ্যণপেতে। এটা সেটা কথার পর দ্বৈপায়ন বলে,
- 'তিমির তোর শালা মাগী পটানো চোখ।'
তারপর বের করে রং ও তুলি,ব লে, 'একটু মুখটা ঘুরিয়ে বোস।'
- 'আপনি ছবিও আঁকেন?'
- 'আরে তেমন কিছু নয়,মাঝে মাঝে সা রে গা মা বাজিয়ে নিই।'
তিমির গলায় মজা ঢেলে বলে,
- 'আপনাকে নাকি রোজ সন্ধ্যায় মুনিয়াদের বাড়িতে দেখা যাচ্ছে?'
দ্বৈপায়ন ঘাবড়ে যায় না। একটু চুপ করে থাকে, সামান্য বিষণ্ণ দেখায় তাকে। একটু পরে বলে,
- 'মেয়েটার বড্ড ইমোশন তিমির!আমার ইমোশন আমি ছবিতে প্রকাশ করে ফেলি। মুনিয়া করবে কী?'
- 'গানে প্রকাশ করবে।'
- 'না রে, তা হবে না, ওকে তবে নিজে গান লিখতে হবে, সুর দিতে হবে। ও গভীর ডিপ্রেশনের আছে তিমির। ওর বাবাকেও বলেছি। ওর দীর্ঘ চিকিৎসার দরকার। ইমিডিয়েট দরকার। কিন্তু ওর বাবা গুরুত্ব দিলেন না।'
এর পর বছর খানেক কেটে গেছে। মার্চ মাস শেষ হতে চলেছে। এখানে এ সময়েও আলতো শীত থেকে যায়, যদিও শীতের ফুল ম্লান হচ্ছে। রাত্রে আকাশ থাকে পরিষ্কার, দূরে অন্ধকারে জোনাকিরা জ্বলে, যেমন আকাশে জ্বলে নক্ষত্রমালা। একদিন সন্ধ্যার পর তিমির মুনিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যায়।
হায়ার সেগেন্ডারির টেস্ট পরীক্ষা থেকেই মুনিয়ার রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। যে মেয়ে পরীক্ষায় প্রথম হত, হায়ার সেগেন্ডারিতে সে পাস করে তৃতীয় বিভাগে। তমালরা অনেকেই কলকাতায় ভর্তি হতে যাবে। মুনিয়া পণ করেছে সে আর পড়বে না। খবরটা শুনে তিমির আজ ছুটে আসে।
- 'কী সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস এসব?'
মুনিয়া তার ঘরে বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। দু চোখ দিয়ে জল ঝরছিল আগে থেকেই।তিমিরের কথায় সে মাথা কোলে গুঁজে নিলো। তার ফরসা আঙ্গুল হাঁটু জড়িয়ে রেখেছে।
পরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে উঠে গিয়ে দেরাজ খুলে একটা চিঠি এনে তিমিরের হতে দেয়।দ্বৈপায়নের চিঠি।
মাস খানেক আগে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দ্বৈপায়ন কী এক ডিগ্রি নিতে চলে গিয়েছে দিল্লিতে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল সে। মুনিয়ার থেকেও। তিমিররা এক সন্ধ্যায় তাকে বিদায় জানিয়েছে অনুষ্ঠান করে। মুনিয়ারর গান গাইবার কথা ছিল। সে আসে নি সেদিন। দ্বৈপায়ন বলেছিল,
- 'মুনিয়া এলো না, তিমির। কী যে হয় মেয়েটার।'
- 'পড়বো চিঠি?' তিমির অনুমতি চাইলে মুনিয়া বলে,
- 'পড়তেই তো দিলাম তোকে।'
তিমির পড়ে,
মুনিয়া,
কী সন্মোধন করি তোমায় বুঝতে পারি না। তোমার চিঠির উত্তরে বলি, তোমার মধ্যে আমি সব সম্পর্কের স্বাদ পেয়েছি। প্রেমিকার, ছোট বোনের, এমনকি মায়ের। একজন নারীর সব গুণগুলি দিয়ে তুমি আমাকে ধন্য করেছ। আমাদের সম্পর্কের কোন সংজ্ঞা হয়না। একসঙ্গে জীবন যাপনে তুমি বা আমি কেউই সুখী হবো না, এটুকু বুঝেছি।
আমি তোমার সঙ্গে মনে মনে সব সময় থাকবো। চিঠি লিখবে। আমি পৌঁছে আমার নতুন ঠিকানা জানাবো তোমাকে।
তোমাদের
দ্বৈপায়ন দা।
বছর দুয়েক পরে তিমির পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরে শুনল যে মুনিয়ার বাবা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে আসামে চলে গেছেন। মুনিয়ার বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। বর পোস্টেড শিলং শহরে। সেখানেই মুনিয়া বরের সঙ্গে আছে। তিমিরদের কোন বন্ধুকেই মুনিয়া তার বিয়ের খবর জানায় নি। তিমিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিবিড় দুঃখবোধ থেকে মুনিয়া ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল কী? কে জানে!গ্রেজুয়েশনটা পর্যন্ত করলো না। পুজোর ছুটিতে তিমির বাড়ি ফিরেছে অনেক দিন পরে। অন্যান্য বন্ধুরা ছুটে আসে। হৈ হৈ করে পুজোর দিনগুলি কাটে, কিন্তু তিমিরের মনটা একটু বিগড়েই থাকে।সে ঘুর পথে লাইব্রেরি যায়, যাতে মুনিয়াদের বাড়ি আর চোখে না পড়ে তার।
জীবন কেটে যায় জীবনের নিয়ম মাফিক, বাঁধাধরা পথে। তিমির ফিজিক্সে সাম্মানিক নিয়ে পাস করে ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে চাকরি পায়। বিয়ে করে, প্রমোশন পায়, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে থাকে ঘন ঘন। এরই মধ্যে ছেলে মেয়ে মানুষ করা, বদলি আটকাতে দৌড়াদৌড়ি করা, ছা - পোষা জীবন কাটে তিমিরের।
একদিন মেয়ের কী একটা বইয়ের খোঁজে তিমির গিয়েছিল কলেজ স্ট্রিট। সেই কলেজ জীবনের প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে দ্বৈপায়নের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়।
দ্বৈপায়ন দা!
- 'তিমির না? রীতিমত জেন্টেলম্যান,সেই রোগা ছেলেটার এই হাল, ভাবা যায় না।'
হাতে সময় ছিল দুজনেরই, দুজনে কফি হাউসে বসে। 'সংসার করেছ দ্বৈপায়ন দা?'
- 'হুমম, একটি মেয়ে।'
সেই ফেলে আসা দিনগুলির কথা হয়। তিমির খবর দেয়,
- 'মুনিয়ার শিলং এ বিয়ে হয়েছিল, জানো দ্বৈপায়ন দা।'
- 'তুই খোঁজ রাখিস ওর।'
- 'না, চেষ্টা করেছি পারিনি। ফেসবুকে খুঁজেছি, নেই। বন্ধুদের কারও সঙ্গে ও যোগাযোগ রাখেনি।'
দ্বৈপায়ন চুপ করে থাকে। শেষে বলে 'ফোন নম্বরটা দে তোর। একটা মিসকল করে রাখ। আমি পরশু ফিরব ব্যাঙ্গালোর। আসিস একবার। ফোন করিস।
অবসরের পর কলকাতা থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে তিমির তার সেই অখ্যাত ভিটে বাড়িতে মাঝে মাঝে ফেরে। অতবড় বাড়ি আজ খা খা করে। মা বাবা চলে গেছেন। শুন্য বাড়ি সামলে রাখে পুরোনো এক মালি। এ বাড়ি আর রাখা যাবে না। বিক্রি করে দিতে হবে। এখানেও কত নতুন আধুনিক ধারায় বাড়ি হয়েছে। তাদের বাড়িটি এখনও টিনের চাল আর কাঠের দেওয়াল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এর সংস্কার করেও লাভ নেই।
তিমির বসেছিল খাটে। জানালার পাশে। লোহার শিকের ফ্রেমে বাঁধানো আকাশ দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে। দপ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। তিমির আলোর ব্যবস্থা কী করবে ভাবছে, এমন সময় ফোন বেজে ওঠে।অচেনা নম্বর।
-'তিমির কাকুর সঙ্গে কথা বলছি?'
- 'হাঁ, আমি তিমির।'
- 'আমি বহ্নিশিখা চক্রবর্তীর ছেলে, নীলয়।'
- 'বহ্নিশিখা? তুমি মুনিয়ার ছেলে?'
- 'মা কথা বলবে,ধরুন। কদিন থেকে আপনাদের কথাই বলছে কেবল।'
এতদিন পর মুনিয়া কথা বলতে চাইছে। ফোন নম্বর জোগাড় করলো কেমন করে?
তিমির ফোন কানে নিতেই শুনতে পায় মুনিয়ার হাসি। হাসতেই থাকে বহুক্ষণ। শেষে কোনক্রমে হাসি থামিয়ে বলে, - 'দ্বৈপায়ন এসেছিল জানিস। কী অদ্ভুত না? এতদিন পরে কোথা থেকে এসে হাজির। আমার জন্যে কত মায়া এখনো জানিস?'
তিমির বলে,
- 'তাই? তোর খবর বল?আ মি এখন এসেছি লতাবাড়িতে।'
- 'আমার আর কি খবর। বরের সঙ্গে তো অনেকদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ছেলের কাছে থাকি,বুঝলি। খুব শরীর খারাপ রে আমার। বিছানাতে জীবন কাটছে।'
এই কথা বলে সে আবার হাসতে থাকে, যেন বরের না থাকা, শয্যাশায়ী থাকা সব খুব হাসির কথা।
- 'দ্বৈপায়ন আসাতে তোর কথা খুব মনে পড়ল। ফোন নম্বর জোগাড় করলাম তোর। আমাদের বাড়িটা আছে রে টিকে?'
- 'আছে।'
- 'তুই এখন থাকিস কোথায় মুনিয়া, শিলং এ নয় নিশ্চয়।'
- 'না রে, কলকাতায়, লেকটাউনে।'
- 'আমি কলকাতা ফিরে তোর সঙ্গে দেখা করতে যাবো একদিন। ফোন করবো।'
- 'আমাকে দেখে তোর ভালো লাগবে না তিমির। দ্বৈপায়ন বলছিল, খুব খারাপ দেখতে হয়েছি নাকি।'
- 'শোন মুনিয়া, লাইট নিভে গেল হঠাৎ। আজ ছাড়ছি। আমি কাল ফোন করছি তোকে।'
পরদিন আর ফোন করা হয়নি।
পরের দিন আবার সেই পাগলা হাওয়া উঠেছে,সেই আগের মত। এত জায়গায় কাটালো তিমির, এমন হওয়া কেবল এখানেই বয়। বড়ো মন খারাপ আমদানি করে পাগল করা-উদাসী এই হাওয়া।
সন্ধ্যাবেলা মুনিয়ার ছেলের ফোন আসে। সে বলে,
- 'মা গতকাল গায়ে আগুন দিয়েছে কাকু। আমরা বাড়ি ছিলাম না……তখন।'
তিমির প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে - 'কী করে ? কেন?'
- 'মা তো বহুদিন অসুস্থ। অসংলগ্ন কথা বলত ইদানিং। শরীর ঠিক ছিল না। তোমাদের কথা শেষের দিকে বলত খুব।'
- 'দ্বৈপায়নদা এসেছিল কবে? মানে কতদিন আগে?'
- 'এরকম কেউ আসেনি তিমির কাকু। এই নাম আমিও প্রথম শুনলাম মায়ের মুখে।'
কী আর বলে তিমির। চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, শেষে বলে,
- 'সাবধানে থেকো তোমরা। তোমার মা আমার খুব বন্ধু ছিল, জানো। ফোন করো, যোগাযোগ রেখো।'
গল্প
দেশে পরিবর্তন এসেছে। এসেছে পরিবর্তন মানুষের জীবনে। সমাজ পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে মানুষের জীবন। কত রং-বে রঙের পরিবর্তন চারিদিকে। যার হিসাব করা কঠিন। শুধুই কঠিন না। যার হিসাব এখন আর কেউ করতেই চায় না। মুনির চৌধুরীর ভাষায় বলতে হয়, মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়। আসলে এই রঙিন দুনিয়ায় আমিও যে বদলে যেতে পারি, এ কথা ভুলেও কখনো ভাবিনি। সরল বিশ্বাস ছিল; আমি একদিন ফিরে আসবোই। কিন্তু কোনদিন আমার আর ফিরে আসা হলো না। রঙিন দুনিয়ায় আমিও রঙিন হয়ে ভুলেই গেছিলাম রুনা নামের কোন এক মেয়ের অস্তিত্ব আমার জীবনে কোনো একসময় ছিল।
আমার সাথেই মেয়েটি পড়াশোনা করতো। ক্লাস ওয়ান থেকে এসএসসি পর্যন্ত, পরে ওর আর পড়াশোনা করা হলো না। মেয়েটির আগ্রহ থাকলেও সে আর পড়াশোনা করতে পারলো না। তিন মাইল হেঁটে এসে বদর মাঝির ঘাট। ঘাট পার হয়ে ভ্যানে করে আরো মাইল পাঁচেক পাড়ি দিয়েই তবেই পেতাম একটা লক্কড় জক্কর মার্কা ছেড়া টিনের হাই স্কুল ঘর। এখান থেকেই আশপাশ পনেরো থেকে বিশ গ্রামের ছেলে মেয়েরা এসএসসি পাশ করে। কলেজে পড়তে হলে সেই জেলা শহর ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই এসএসসি পাশের পড় শতকরা প্রায় আশি থেকে নব্বই জন্য ছেলে মেয়ের পড়াশোনা থেমে যায়। অর্থাৎ এক থেকে দুইজন ছেলের কপালে জুটতো শহরের পড়াশোনা। আমার ব্যাচের একমাত্র আমিই কেবল কলেজে ভর্তি হওয়ার দুর্দান্ত সাহস যোগাড় করতে পেরেছিলাম। সেটা অবশ্যই আমার সাহস বললে ভুল হবে। সাহসটা ছিল রুনার। আমার যাবতীয় খরচ বহন করতো মেয়েটি। আমাকে ভালবাসার জন্য কত যে গঞ্জনা মেয়েটি সহ্য করেছে। সেটা ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না। কখনো মুখের ফাঁসা দিয়েও উচ্চারণ করে নাই। কারণ, আমি জানলে কষ্ট পাবো বলে। যাইহোক কোন এক সময় রুনার মা-বাবা আমাকে মেনে নেয়। রুনা খরচ দিলেও মাঝে মাঝে রুনার মা আমাকে খরচ পাঠাতো কাউকে না জানিয়ে, খুব গোপনে। আমিও চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম। এইচএসসি পাশের পাড়ার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। জীবনে চলে আসে পরিবর্তন। সাদাকালো পৃথিবী হয়ে যায় রঙিন। আসমানি পর্দা নীল থেকে হয়ে যায় লাল। পৃথিবীর লোভ-লালসায় আমি মেতে উঠি। ভুলে যায় অতীত। হৃদয়ে ধারণ করা রুনা নামের স্মৃতির পাতার পর্দায় আধুনিকতার কালো ধুলো পরে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায় গ্রামের সহজ সরল মেয়ে রুনা। রুনার জায়গায় জায়গা করে নেয় ঢাকার শহরের আলতা মডার্ন বড়লোকের বেটি নিকৃষ্ট নিতম্বধারিণী ছলনাময়ী কল্পনা চৌধুরী সর্ণা। সর্ণা যে আমার জীবনে দুঃখের বন্যা দিয়ে চলে যাবে সে কথা কে জান তো! তার আবেগময়ী কথায় আমি মেতে উঠি। পড়াশোনা শেষ করে আমি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করি সাভার শাখায়। সোনালী ব্যাংকে যোগদান করার কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরে মন্ত্রণালয়ে একটি চাকরি হয় আমার কিন্তু সর্ণা যোগদান দিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। এমন কাজ যে, কেন করে ছিল তখন না বুঝলেও পরে অবশ্যই বুঝেছিলাম। আমাকে সর্ণা বুদ্ধি দিলো, আমার ব্যাংক থেকে সে ঋণ নিয়ে বড় কোম্পানি খুলবে। তার সাথে তার বাবা মা ভাই কাজ করবে । কোম্পানি ভালো পজিশনে দাঁড়িয়ে গেলে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোম্পানির এমডি পদ নিতে হবে। আমি ওর কথায় রাজি হলাম না। কথায় আছে, রাজা শাসন করছে রাজ্য, রাজাকে শাসন করছে রানী। আমিও শাসিত হলাম আমার স্ত্রীর দ্বারা। অবশেষে কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম হলো। কোম্পানি হলো, ঋণ পাশ হলো। সব হলো। একদিন বাড়ীতে এসে শুনি আমার স্ত্রী বিদেশে গেছে। সাথে তার বাপ-মা সবাই। আমাকে ফাঁদে ফেলানো হয়েছে। পরে দেখি আমার নামে কারিকারি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অবশেষে সাংবাদিক লেগে গেলো আমার পিছে। আমার বিচার হলো, দশ বছর জেল।
দশ বছর জেল খেটে আমি নিঃস্ব হয়ে কারাগার থেকে বের হলাম। কোথায় যাবো। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অতীতের কথা মনে পরে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো। কেমন যেন মনে হলো রুনার সাথে আমি অন্যায় করেছি। ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। এরপরে বিদায় নিবো এই পৃথিবী নামক অযোগ্য কারাগার থেকে। জানি এতদিনে রুনা তার সংসার পেতে বসেছে। আমারই মত হয়তো সেও ভুলে গেছে যে, তার জীবনে শুফম নামের কোন একজন প্রেমিক পুরুষ ছিল। হয়তো গিয়ে দেখবো, সে তার বাচ্চা কাচ্চা স্বামীর সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে । আমাকে আর চিনতে পারছে না। অনেক কথা বলার পরে হয়তো চিনবে।
গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্য রক্তিম লাল আভা নিয়ে ডুবে যাচ্ছে। গ্রামের মাটিতে পা রাখলাম। নির্মল মৃদু হাওয়ায় আমার হৃদয় জুড়ে গেলো। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম। আমি কৃষক শুফম, মাঠে থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছি। আমার স্ত্রী রুনা আমার গোসলের জন্য টিওবওয়েল থেকে পানি তুলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন আসবে প্রাণের স্বামী, কখন আসবে প্রাণের স্বামী! যাই হোক এসব আমার কল্পনা। যা আর কখনো বাস্তবে রূপ নেবে না।
আমাদের সেই সালাসপুর গ্রাম আর সালাসপুর নেই। তার বুকেও এসেছে পরিবর্তন। কাঁচা মেঠো রাস্তা হয়ে গেছে পাকা। গ্রামে ছোঁনের ছাওনির ঘরের পরিবর্তে টিনের কিংবা বিল্ডিংয়ের ঘর উঠেছে । পরিবর্তন। সব পরিবর্তন। আমার পক্ষে আর আহমেদ আলির বাড়ী খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পথে অনেকের সাথে দেখা হলো, মনে হলো কেউ চিনতে পারে নি। চিনবে কেমনে! সেই শুফম আর আজকের শুফমের মধ্যে রাত দিন তফাৎ। দূরে একটি ছোট্ট পিচ্চি ছেলে দেখতে পেলাম, খেলা করছে। ওরে ডাক দিলাম। কাছে আসলো ও ।
"আহমেদ আলির বাড়ি চেনো?" আমি ওরে জিজ্ঞাসা করলাম।
"কোন আহমেদ আলি?" পিচ্চি আমারে জিজ্ঞাসা করলো।
"আমি তো অবাক। এখন কী বলি।"
পাশ দিয়ে একজন মাঝবয়সী মানুষ যাচ্ছিল। সে হয়তো আমাদের কথা শুনতে পেয়েছে। ঐই পিচ্চির মাথায় থাপ্পর দিয়ে বলো, "ব্যাংকারের বাড়ি নিয়ে যা।" পিচ্চি আগে আগে আর আমি ওর পিছে পিছে চললাম। আহমেদ আলি আমার দাদা। আমার বাবা মা নৌকাডুবিতে অনেক অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। বড় হয়েছি দাদার কাছেই। তিনিও মারা গেছেন আমি যখন কলেজে পড়ি। থাকার মধ্যে ছিল এক সৎ দাদী। জানি না তিনি কেমন আছেন। তার কাছেই যাচ্ছি। তার কাছ থেকে রুনাকে খুঁজে বের করে, রুনার ঠিকানায় গিয়ে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি নিবো অযোগ্য এই পৃথিবী থেকে।
কিছু দূর হাঁটার পরে পিচ্চি আমাকে নিয়ে ডুকে পড়লো একটি বাড়ীতে। খালা খালা করে চিৎকার দিয়ে বাড়ীটাকে মাথায় করে তুললো ছেলেটি। তখন সন্ধ্যার আযান চারিদিকে কলরব সুরে পড়ছে। রান্নাঘরে রান্না ফেলে রেখে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে বললো, "কী রে মধনা এত ডাকছিস কেন?"
ছেলেটি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলো, "দেখ তো কাকে নিয়ে এসেছি?"
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি তার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না। পাহাড়ের বুক চিরে যেমন ঝর্ণার পানি পড়ে নদীর বুকে ঠিক তেমনি করে তার চোখের জল ঝরতে লাগলো।
একটু কাছে তার এগিয়ে যেতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাওঁমাঁও করে কেঁদে উঠলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পিচ্চি চিৎকার করে বলে উঠলো, "রুনা খালার স্বামী শুফম ব্যাংকার বাড়ি ফিরছে, রুনা খালা তারে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।"
আমিও আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। দুচোখের জলে ভেসে হয়ে গেলাম একাকার ।
নোটিফিকেশন
দীপাঞ্জন চক্রবর্তী
নক্সভিল, টেনিসী
গল্প
আজ গেঁড়ি খুব খুশি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে তার। অনেক পরিকল্পনার পরে গেঁড়ি ও তার মহিলা ব্রিগেড যাত্রা শুরু করবে কাঞ্চনজঙ্ঘার উদ্দেশ্যে। স্বাভাবিকভাবেই আনন্দের এভারেস্টে বিরাজ করছে গেঁড়ি এখন। আর, হবে নাই বা কেন! মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল বাঙালি পরিবার থেকে মহিলা দলবল তৈরি করে ঘুরতে যাওয়া, এই একবিংশ শতাব্দীতেও বেশ কৃতিত্বের। বেড়াতে যাওয়ার ভাবনার কৃতিত্ব যে শুধুই গেঁড়ির, তা বললে কিছুটা ভুল বলা হবে বৈকি। অনেকটা অংশীদারিত্ব তার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদরও প্রাপ্য। কিছুদিন আগেই শুভ্র সমগ্র পড়তে পড়তে একটা লাইনে পৌঁছে চোখ আটকে যায়। মাথা গরম হয়ে ওঠে; প্রিয় লেখকের উপর প্রচন্ড রাগ হয়। সেই রাগের ফলশ্রুতি এই পাহাড় ভ্রমণের ঝটিকা প্ল্যান।
গেঁড়ি এখন পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করছে কলকাতার এক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে। পাঁচ বছরের দীর্ঘ সময় তাকে থাকতে হবে ক্যাম্পাসে। এক বছরও অতিক্রান্ত হয়নি; তবে বন্ধু-বান্ধবীর সংখ্যা দেখে তা বোঝা দুষ্কর। ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে গেলে বেশ একটা বড় দল হাঁকিয়ে যায়; এই একটা কারণে বেশ ঈর্ষান্বিত হয় অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলে মেয়েরা। সেদিনও দুপুরে লাঞ্চ সেরে ল্যাবে ফিরে চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রিয় লেখকের গল্পের বই পড়তে শুরু করেছিল গেঁড়ি। আসলে দিনের এই সময়টায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল সমীকরণের প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে গল্পের বইয়ের জগতে অবাধ বিচরণ করতে ভালোবাসে সে। গল্প পড়তে বেশ মজা লাগছিল তার, কারণ গল্পের মূল বিষয়বস্তু কলেজের বন্ধুদের একসাথে সমুদ্রে ঘুরতে যাওয়া। যদিও সমুদ্রের থেকে পাহাড় তার বেশি পছন্দের, তাও বেড়ানোর কথা শুনলে বা পড়লে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। খুব ইচ্ছে করে কাছের পাহাড় বা জঙ্গলে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যেতে। ইচ্ছে হয় পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা ছোট ঝর্ণার পাশে ছবি তুলতে, জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় পাখির ডাক শুনতে, ভোরের প্রথম আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে, আরো কত কি! যাইহোক গল্পের কিছু লাইন পড়ে চমকে ওঠে গেঁড়ি
- 'মেয়েরা যদি শেষ পর্যন্ত সঙ্গে যায় তাহলে এই পরিকল্পনার প্রশ্নই ওঠে না। মেয়েরা সম্ভবত যাবে না। মেয়েরা সব ব্যাপারে শুরুতে খুব উৎসাহ দেখায়, তারপর বাড়ি থেকে যেই একটা ধমক খায় অমনি সব ঠান্ডা।'
অচেনা লেখকের উপর প্রচন্ড রাগ হয় তার। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পরে মনে প্রশ্ন জাগে,
- 'এত রাগ হচ্ছে কেন? লেখক কি তাহলে অপ্রিয় সত্যিটা মুখের ওপর বলে দিতে পেরেছেন? মনে মনে শপথ নেয় যে লেখকের এই উপলব্ধি সে ভুল প্রমাণ করেই ছাড়বে।'
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, সেদিন চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের সামনে পাহাড়ে বেড়াতে যাবার প্রসঙ্গ তোলে সে। অনেক তর্কবিতর্কের পরে মেধা, পশু এবং পলুকে রাজি করাতে সক্ষম হয় সে, খানিকটা জোর করেই বলা যেতে পারে। এবার ভাবনা শুরু হয় গন্তব্যস্থল নিয়ে। খুব কাছের পাহাড় বলতে উত্তরবঙ্গ। সেখানে গেলে বাড়ির লোকজনদের রাজি করাতে সুবিধা-ই হবে। সবাই মিলে ঠিক করা হলো দীপুদার পরামর্শ নিয়ে প্ল্যান ফাইনাল হবে। পাহাড়ের ব্যাপারে দীপুদার জ্ঞানের পরিধি অসীম বললেও ভুল বলা হবে না। ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীরা তাই পাহাড়ে বেড়াতে গেলে দীপুদার পরামর্শ নিয়েই যায়। সন্ধ্যাবেলা গেঁড়ি তার দলবল হাঁকিয়ে দীপুদার কাছে যায়; মোটামুটি যে প্ল্যান ফাইনাল হয়, তার খসড়া নিম্নরূপ:
কলকাতা---নিউজলপাইগুড়ি---লেপচাজগত---দার্জিলিং---মানেভঞ্জন---শিলিগুড়ি---কলকাতা
পাঁচ দিনের ট্যুর প্ল্যান হয়। শেষ দিনে মানেভঞ্জন থেকে ছোট্ট একটা ট্রেক করার কথাও হয়। সবই অবশ্য নির্ভর করছে সমগ্র যাত্রা পথে সবার শরীর কেমন থাকে তার উপরে। রাত্রে গেঁড়ি ও পলু দায়িত্ব নিয়ে দার্জিলিং মেলের টিকিট কেটে ফেলল। পশু ও মেধা দীপুদার কাছ থেকে পাওয়া হোটেলের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে যথাযথ দিনে বুকিং করে ফেলে। যাত্রার সমস্ত আয়োজন বেশ বাধাহীন ভাবে সম্পন্ন হয়। এরপর থেকেই তাঁদের কাছে সময়ের গতি যেন বেশ খানিকটা কমে যায়। যাক অবশেষে আজ তাদের দিন গোনার পালা শেষ। শুভ যাত্রার শুভারম্ভ আর ঘন্টা চারেক পরেই।
রাত দশটা বাজতে বাকি মিনিট দশেক। গেঁড়ি, পশু, পলু ও মেধা সময় মত তাদের সিটে বসে পড়েছে। কোচ নম্বর এস সেভেন, সিট যথাক্রমে- ৩৩, ৩৪,৩৫, ও ৩৬; অর্থাৎ দুটি লোয়ার, একটা মিডিল ও একটা আপার বার্থ। পলু রীতিমতো ঝগড়া করেই আপার বার্থের মালিকানা হাসিল করেছে, বাকিরা কোথায় শোবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। কূপের বাকিদের মধ্যে রয়েছে সদ্য বিবাহিত স্বামী স্ত্রী, সম্ভবত মধুচন্দ্রিমা অতিবাহিত করতেই চলেছে; সাইড আপার ও সাইড লোয়ারে দুজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক। পলুর ধারণা অনুযায়ী তাদের দুজনেরই বয়স ৬০ পেরিয়েছে। আসলে বয়সের হিসেব-নিকেশে পলুর কাছে স্বয়ং আর্যভট্ট-ও হার মেনে যাবে। ট্রেন ছাড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পশু খাবার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। গেঁড়ির মায়ের হাতে বানানো লুচি ও চিকেন কষা একে একে প্লেটে পরিবেশন করছে সে। বিগত কয়েক বছরে রান্না ও পরিবেশনে বেশ হাত পাঠিয়েছে পশু। আসলে নিজের হোস্টেল রুমে বাকিদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর আয়োজন করতে গিয়ে এইসমস্ত কাজে পোক্ত হয়ে উঠেছে সে। বাকিদেরও বেশ খিদে পেয়ে গেছিলো। ফলস্বরূপ সবাই দ্রুতগতিতেই খাবার শেষ করে ফেলল। হাতমুখ ধুয়ে এসে সবে একটু বসেছে গেঁড়ি। হঠাৎ পাশের ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল-
- 'তোমরা কোথায় যাচ্ছো একসাথে? তোমরা কি কলেজে পড়ো?' উত্তরে গেঁড়ি বলল,
- 'আমরা সবাই মিলে লেপচাজগত, দার্জিলিং ঘুরতে যাচ্ছি। আমরা প্রত্যেকেই পিএইচডি করছি; কলেজ আমরা অনেকদিন আগেই পাশ করেছি।'
আসলে গেঁড়ির ছোট উচ্চতা ও বাচ্চা মুখ দেখলে সকলেই তাকে স্কুল পড়ুয়া বলে মনে করে, এইক্ষেত্রে ভদ্রলোক তবুও কলেজ বলেছেন। ভদ্রলোকটি আবার বলল,
- 'তোমরা কি শুধু মেয়েরা যাচ্ছ, নাকি এনজেপি থেকে তোমাদের আরও বন্ধুরাও যোগ দেবে?' গেঁড়ি এবার বেশ আত্মবিশ্বাসের সুরেই প্রত্যুত্তর দিল,
- 'হ্যাঁ, আমরা চার জনই যাচ্ছি। কেন মেয়েরা কি ছেলেদের ছাড়া যেতে পারে না নাকি?' ভদ্রলোক বললেন,
- 'হ্যাঁ, তা যেতে পারবে না কেন? আলবাত পারে। তবে দিনকাল তো ভালো না, তাই বলছিলাম আরকি।' গেঁড়ি পুনরায় উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। একই রকম হুঁশিয়ারি ছোট থেকেই সে শুনে এসেছে বাড়িতে। বিরক্তি দূর করতে হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করলো সে। বাকিরা এবার যে যার বার্থে পিঠ এলিয়ে দিয়েছে। পশু তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রেমিকের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে। কিন্তু চলন্ত ট্রেনে নেটওয়ার্ক পাওয়া মুশকিল। পশুর মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে মেধার মনে মনে হাসি পাচ্ছে। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না, আসলে যতই হোক ল্যাবের সিনিয়র দিদি বলে কথা। অন্যদিকে পলুর দৃষ্টি সেই বিবাহিত যুগলদের দিকেই নিবদ্ধ; তাদের প্রতিটি কার্যকলাপ মন দিয়ে অনুসরণ করছে সে। গান শুনতে শুনতে গেঁড়ি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম যখন ভাঙলো, বাইরে হালকা আলো ফুটেছে। একটু পরেই ট্রেন থামল। জানালা দিয়ে সে দেখল স্টেশনের নাম কিষাণগঞ্জ, সময় তখন সকাল সাড়ে ছটা। ট্রেন মিনিট দশেক লেট আছে। ভারতীয় রেলের ঐতিহ্য অনুযায়ী এই লেট যে আসলে কিছুই না তা বেশ অনুভব করতে পারে গেঁড়ি। কিছুক্ষণ পরে সে ডেকে দেয় বাকিদের। ব্রাশ করে, চা বিস্কুট দিয়ে প্রি ব্রেকফাস্ট সেরে নেয় সকলে। তারপরে গল্প করতে করতে বাকি ঘন্টা দেড়েক যে কিভাবে কেটে যায়, ঠাওর করতে পারে না কেউই। মেয়েদের গল্পের এই এক বিশেষত্ব, শুরু হলে শেষই হতে চায় না। ট্রেন যখন এনজেপি পৌঁছালো, ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৮:১৫ মিনিট। স্টেশনে নেমেই গগনদা-কে ফোন করলো পলু। জানতে পারলো বাইরেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে গগন দা, দীপুদার কথা মনে পড়ল গেঁড়ির, - 'গগনদা কিন্তু সময়ের দাম জানে।'
স্টেশনে প্রাতঃকৃত্ত সেরে নেওয়ার ফলে পশু, মেধা ও গেঁড়ির বেশ খিদে পেয়েছে। অন্যদিকে পলুর বাথরুমের ব্যাপারে খুব বাতিক আছে; ভালো হোটেলের ভালো বাথরুম ছাড়া পেট পরিষ্কার করা তার কাছে দুঃসাধ্য। গগনদা-র সুমো গাড়িতে সাত জনের সিট। তাই বেশ হাত পা ছড়িয়েই বসে গেল সবাই। সামনের সিটে অর্থাৎ ড্রাইভারের পাশে বসার জন্য একটা চার্ট তৈরি করাই ছিল। প্রথমে বসার সুযোগ পেল পশু। গগনদা গাড়ি স্টার্ট করে দিল। প্রথম গন্তব্য মিরিক লেক। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে একটা দোকানে ব্রেকফাস্ট করা হবে বলে জানালো গগনদা।
গাড়ি শুকনা দুধিয়া হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। শুকনা পৌঁছবার একটু আগে একটা দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল সকলে, ব্রেকফাস্ট এর আলু পরোটা খেয়ে সবাই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। পলু সামনের সিট দখল করেই গান চালিয়ে দিয়েছে। একের পর এক হিন্দি গান বাজছে; তার সাথে বাইরের রাস্তার সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। দুধিয়ার বালাসন নদীর উপরে ব্রিজ অতিক্রম করলেই শুরু হয়ে যায় পাহাড়ি রাস্তা। পাথরের বোল্ডারের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বালাসন নদীর ধারে প্রচুর মানুষ জমা হয় শীতের মরশুমে পিকনিক করতে। ব্রিজ অতিক্রম করে মিনিট দশেক এগিয়ে গেলেই পুরোপুরি পাহাড়ি রাস্তার সূত্রপাত। আরও কিছুদূর অতিক্রম করতেই রাস্তার একদিকে চা বাগান ও অপরদিকে দিগন্তে দূরের পাহাড়, সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপমাধুর্যে তারা সকলেই মুগ্ধ। গগনদা গাড়ি চালাতে চালাতেই বিভিন্ন গল্প বলছে, সাথে প্রত্যেকের অনুসন্ধিৎসা নিরসনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিরিকের পথে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে এই পাহাড়ি রাস্তা পলুকে মুন্নারের স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে। মেধা তো বলেই ফেলল,
- 'আর্থিক কারণে যারা মুন্নার যেতে পারে না, এই রাস্তা তাদের মুন্নারের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে।'
দুধিয়া থেকে এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করে গাড়ি এসে দাঁড়ালো টিংলিং টি গার্ডেনে। এখানে টি গার্ডেনের মধ্যে কিছু ছবি তুলে নিলো সকলে। এখান থেকে কিছুটা পথ এগোলেই আই লাভ মিরিকের সেলফি স্পট। স্বাভাবিকভাবেই সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে গেল। অন্তত খান পঞ্চাশেক সেলফি ও গ্রুপ পি তোলার পরে পলুর মন শান্ত হল। গাড়িতে আর মিনিট দশকের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল মিরিক লেক, যার ভালো নাম সুমেন্দু লেক। হালকা বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সকলেই একটা দোকানে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার অর্ডার করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে যায়, সাথে বৃষ্টি পরবর্তী লেকের সৌন্দর্য যেন হাজার গুণ বেড়ে যায়। লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে তারা ব্রিজের কাছে যায়, এই ব্রিজ বেরোলেই লেকের অপর ধারে পাইনের ঘন জঙ্গল। ব্রিজের উপর থেকে এই লেকের পুরোপুরি ভিউ পাওয়া যায়। একদিকে পাইনের ঘনজঙ্গল, অপরদিকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা মিরিক শহর, আর তার মাঝেই এই সুমেন্দু হ্রদ। অনেকেই বোটিং করছে, কেউ আবার ঘোড়ায় চড়ে পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লেকের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলেই হেঁটে চলল পাইন বনের মধ্য দিয়ে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই হ্রদের একদম সামনে এসে পড়ল তারা। এই জায়গাটা থেকে হ্রদের যে ভিউ পাওয়া যায় তা সত্যিই অবর্ণনীয়। কিছুটা এগিয়েই আবার আই লাভ মেরিকের সেলফি স্ট্যান্ড। এখানে অনেক লোকজন ছবি তুলতে ব্যস্ত; জায়গাটা ভালোই চেনা লাগছে গেঁড়ির। সম্ভবতঃ শিবাজীদার ট্রাভেল ব্লগেই দেখেছে। এখানেও সকলে মিলে অনেক ফটো তুললো। প্রায় ঘন্টাখানেক মিরিক লেক এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর পরে তারা খাবার দোকানে ফিরে এলো। খাবার অর্ডার আগে থেকেই দেওয়া ছিল, ভেজ থালি ও চিকেন কষা। গরম গরম খাবার অন্যদের খেতে দেখে সবারই জিভে জল এসে গেল। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসে পড়ল তারা। ভেজ থালি-তে ভাত, ডাল, আলুভাজা ও স্কোয়াশের তরকারি। পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে অথচ স্কোয়াশের তরকারি খায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভবই বটে। তবে চিকেন কষার দুর্দান্ত স্বাদ স্কোয়াশ খাওয়ার দুঃখ টুকু ভুলিয়ে দিল। খেতে বসে গেঁড়ি দেখতে পেল ট্রেনের সহযাত্রী সেই ভদ্রলোক দুটিকে, ধীর পায়ে হেঁটে দোকানের সামনে দিয়ে ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেন জানিনা এদের দেখামাত্রই গেঁড়ীর বেশ রাগ হলো। যাইহোক ঘাড় নিচু করে সে পুনরায় খাবারে মন দিল। প্রসঙ্গত গগন্দা তেমন কিছু খেলো না; শুধু ডিম টোস্ট আর চা খেয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলো। গাড়ির ড্রাইভাররা সাধারণত দুপুরে বেশি খেতে চায় না। তার প্রধান কারণ অবশ্যই গাড়ি চালানোর সময় অনভিপ্রেত তন্দ্রা উপেক্ষা করা। আরো কিছু ফটো তুলতে চাইছিল পলু; কিন্তু বাধ সাধলো গগনদার বকুনি। আবার যাত্রা শুরু হল তাদের। এখান থেকে তারা যাবে লেপচাজগত। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই রাস্তার দু'ধারে ঘন পাইন গাছের সারি তাদের যেনো জড়িয়ে ধরলো। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, কখনো পাইন আবার কখনো ঝাউবনের মধ্য দিয়ে যেন নদীর মতো বয়ে গেছে। রাস্তার মাঝে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। গেঁড়ি গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই মেঘ স্পর্শ করছে। সত্যিই এ যেন স্বর্গের উদ্যান। ঘন পাইন বনের মধ্যে এমনিতেই সূর্যালোক তেমন প্রবেশ করে না। আজ মেঘলা দিন রাস্তার অন্ধকার আরো বাড়িয়ে তুলেছে। গগনদা গাড়ির লাইট অন করে দিল। ঘন্টাখানেকের রাস্তা পেরিয়ে তারা পৌঁছে গেল সীমানা ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে নেপাল দেখা যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু আজকের মেঘলা আকাশ সেই সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে খারিজ করেছে। দূরের নেপাল দেখতে বড় সুন্দর লাগছে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ি, তার ওপরে মেঘের ভেসে বেড়ানো, মেধাকে তার ছোটবেলায় কল্পনায় আঁকা পাহাড়ি গ্রামের ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এখানে একটা দোকান থেকে কফি কিনে কফি কাপ হাতে এই সীমানার সৌন্দর্য দারুন ভাবে উপভোগ করল সকলে। জায়গাটা খুব পছন্দ হয়ে গেছে সবার, ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। শেষমেশ আধঘন্টা পরে গগনদার তাড়া খেয়ে সকলে গাড়িতে চেপে বসলো। গগনদা বলেই দিল,
- 'এবার একদম লেপচাজগত গিয়েই গাড়ি থামবে। মাঝে গাড়ি থামানোর আবদার করা যাবে না।' এতক্ষণের যাত্রায় গেঁড়ির মনে হলো যে গগন দা ভালো মনের মানুষ, তাদের সকলকে খুব আগলে রাখছে। আধঘন্টারও কম সময়ে তারা পৌঁছে গেল লেপচাজগত। পাখরিন হোমস্টেতে তাদের রুম বুক করা ছিল, বেশ সাজানো হোমস্টে, দুতলার ও তিনতলার ব্যালকনি থেকে পুরো দার্জিলিং নাকি দেখা যায়, কারণ লেপচাজগত দার্জিলিংয়ের তুলনায় বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। তবে রাতের দার্জিলিং দেখতে পাবার জন্য আকাশ পরিষ্কার থাকা অবশ্য দরকার, মেঘ যদি কমে তবেই দেখা যাবে।হোটেলে পৌঁছতেই হোটেলের মালিকের কথা অনুযায়ী তারা সকলেই গরম চিকেন সুপ পেয়ে গেল, দীর্ঘ পথের ক্লান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হলো। সন্ধ্যেবেলা স্নাক্সে পকোড়া, কফি দেবে বলে জানালো এখানকার ভাঁড়ারের দায়িত্বে থাকা গৌড়দা। মাঝের ঘন্টা দুয়েক সময় পেয়ে তারা ঠিক করলো পাইনের জঙ্গলে ঘুরে আসবে। পাখরিনের ঠিক পিছনেই এই পাইনের জঙ্গল, জঙ্গলের ওপরে রয়েছে সানরাইজ পয়েন্ট। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর কথা হোটেল মালিক জানতেই তাদের সতর্ক করে দিল জোঁকের সম্পর্কে। জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে সকলেই রেইনকোটের প্যান্ট পড়ে নিল, সাথে মোজা হাঁটু অব্দি। পাইন গাছের পাশে দাঁড়িয়ে গেঁড়ির নিজেকে অনেক ছোট মনে হল। এমনিতেই সে উচ্চতায় খাটো, তার ওপরে বিশাল পাইন গাছের নীচে নিজের ক্ষুদ্রতা বুঝতে পেরে এক মহান অনুভুতি হলো তার। সত্যিই আমরা প্রকৃতির কাছে কত ছোট, কত ক্ষমতাহীন, তাও কিছু মানুষের এত দম্ভ কিসের, সত্যিই সে বোঝেনা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও জোঁক তাদের পিছু ছাড়লো না। পলুর প্যান্টে প্রায় গোটা পাঁচেক জোঁক আঁকড়ে ধরেছে, তবে ভাগ্য ভালো যে রেনকোটের প্যান্ট, তাই ছাড়াতে বেশি বেগ পেতে হলো না। ধীরে ধীরে পাইন বনের মধ্য দিয়ে তারা পৌঁছল সানরাইজ পয়েন্টে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় শুনেছে, যদিও এখন সামনে মেঘের সমুদ্র, বাকি কিছু দেখা যাওয়ার কথা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। প্রায় দেড় ঘন্টা পরে তারা আবার ফিরে এলো হোমস্টেতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি ও পকোড়া রুমে দিয়ে গেল গৌড় দা, জানিয়ে গেল যে রাতে দেশি মুরগির ঝোল ও ভেজ থালি। আদ্যোপান্ত বাঙালি হলে যা হয় আর কি, খাবারের নাম শুনেই মন খুশিতে ভরে ওঠে সকলের। আগামীকাল টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে যেতে হলে ভোর রাতেই ঘুম থেকে উঠতে হবে। তাই আজ রাত আটটায় খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লো সবাই। অবশ্য শুয়ে পড়ার আগে দোতলার ব্যালকনিতে অনেকক্ষণ বসে থেকেও রাতের দার্জিলিংয়ের দেখা মেলেনি। হঠাৎ অ্যালার্ম বাজতে গেঁড়ির ঘুম ভাঙ্গলো, ঘড়িতে সকাল ৭ টা। চমকে উঠলো গেঁড়ি। অর্ধ উন্মীলিত চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গেঁড়ি দেখলো দুটি নোটিফিকেশন- একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের নোটিফিকেশন যেখানে দীপুদা লিখেছে সে কাসোল পৌঁছে গেছে; মাইকেল, সাকি, শিবু, অয়ন দের সাথে সার পাস ট্রেক করবে সে। অন্যটা আইআরসিটিসি থেকে ইমেইল যার সাবজেক্ট - 'Your ticket is cancelled.'
গত সপ্তাহে পলু ও মেধার বাড়ি থেকে আপত্তির কারণে তারা টিকিট ক্যান্সেল করায়। গতকাল পশুর শরীর একটু খারাপ হওয়ায় তার বাড়ি থেকেও ছাড়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়। অগত্যা বাকি টিকিট গতকালই ক্যান্সেল করে গেঁড়ি যার নোটিফিকেশন আজ এসেছে। গেঁড়ির স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। সকালের আকাশে যেন প্রিয় লেখকের অবয়ব দেখতে পায় সে, মুখে হালকা মুচকি হাসি।
একগুচ্ছ
রডোডেন্ড্রন
অঙ্কুর ঘোষ
গল্প
সুরজিত প্রথম মেয়েটিকে দেখতে পায়- উত্তর সিকিমের এই হোটেলের করিডরে। সে এখানে একা বেড়াতে এসেছে। এখন তার কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। তার আবার খুব ফটোগ্রাফির নেশা। মাত্র একদিনই হয়েছে বেড়াতে এসেছে- সারাদিন পাইনবনের ধারে অনেকগুলো ছবি তুলে সে নিজের রুমেই ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ দ্রুতপদে হেঁটে-চলা একটি ছায়ামূর্তির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। হাত থেকে ক্যামেরাটা আর একটু হলেই ফসকে পড়ে যাচ্ছিল, আর কি!
‘উঃ! সরি! আমায় ক্ষমা করবেন,’ বলে ওঠে ছায়ামূর্তিটি। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অন্ধকারের আস্তরণ হোটেলের এই সরু করিডরে ইতিমধ্যে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। সুরজিত মুখ তুলে চাইল। মেয়েটির মুখ সে তখন ভালো করে দেখতে পায়নি। বছর কুড়ি বয়স হবে হয়তো, মাথায় লম্বা, বিস্রস্ত চুল। তবে, তার মুখমণ্ডলে একটি জিনিস সুরজিতের মনে বিশেষ রেখাপাত করেছিল- তা হল, মেয়েটির চোখ দুটি; কেমন নিষ্প্রাণ সে চাহনি! অথচ সে চাহনির মুখোমুখি হলে ভয় হয় না, বরঞ্চ মনে হয়, এই স্বল্পবয়স্কা তরুণী যেন এত কম বয়সেই জীবনের শত সহস্র বেদনা, যন্ত্রণা, শোক উপলব্ধি করে ফেলেছে। জীবনের প্রতি তাই আর তার কোনো আগ্রহ নেই। আপনা থেকেই, তরুণীর প্রতি সমবেদনা জেগে ওঠে। সুরজিত জিজ্ঞাসা করে,
‘আপনার লাগেনি তো?’
‘না, না আমি ঠিক আছি।’ মেয়েটি মৃদু হাসে।
সুরজিত সাহস করে জিজ্ঞাসা করে বসে, ‘আজই এলেন, নাকি?’ মেয়েটি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, অন্তত তাই মনে হল সুরজিতের আলো-আঁধারিতে। কী ভেবে মেয়েটি সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’ তারপর আর বেশি কথা না বলে সে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচের তলায় নেমে গেল। কাঠের সিঁড়ির উপর তার পদশব্দের অনুরণন মিলিয়ে যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে রইল সুরজিত। তারপর, সেও নিজের ঘরে ফিরে এল।
সেদিন রাত্রে সুরজিত একটা ভারী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। দেখল, একা একটা খোলা জমিতে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারিদিক অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন। খানিক বাদে ধীরে ধীরে কুয়াশার আবরণ হালকা হয়ে আসতে লাগল, আর তখন সে দেখল- একটা গোরস্থানে সারি সারি সমাধির মাঝে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ্বেত ফলকে তাদের গায়ে মৃত ব্যক্তির পরিচয় খোদাই করা আছে। এমন সময় একটা কণ্ঠস্বর শুনে সে চমকে ঘুরে দেখে, সে একা নেই- আরও একটি মূর্তি কখন এসে বসেছে একটা সমাধির ধারে। এ যে সেদিন সন্ধ্যায় দেখা সেই মেয়েটি! তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। তারপর হঠাৎ সেই হাসি কোথায় মিলিয়ে গেল- মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। সুরজিতের উপস্থিতি উপেক্ষা করে হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সুরজিত এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার ঘুম ভেঙে যায়। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নিজের বিছানায়।
তার সারা দেহ তখনও শিহরিত হচ্ছে স্বপ্নটার কথা ভাবলে। আর কী ঠাণ্ডা ঘরে! বিস্মিত হয়ে সে দেখে, মাথার কাছে জানলাটা কখন দমকা হাওয়ার ঝাপটায় খুলে গিয়েছে। বাইরে অনর্গল বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কাছেই কোথাও বাজ পড়ল বোধহয়। সে জানলাটা ভেজিয়ে, পাশ ফিরে আবার ঘুমের চেষ্টা করল। ভোর হতে তখনও ঘণ্টা-দুই দেরি।
সকালে ব্রেকফাস্টের সময় মেয়েটির দেখা পেল না সুরজিত। তাকে সেদিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। দূরে কয়েকটা ভিউপয়েন্টে ছবি তোলার ইচ্ছা ছিল তার। বৃষ্টির পর পাহাড়ের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে যায়। সজল ধারায় স্নাত সতেজ গাছের পাতা মন ভাল করে দেয়। গতরাত্রের স্বপ্নের কথা কখন সে ভুলে গেল।
সারাদিন ভিউপয়েন্টে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে, সে হোটেলের দিকেই ফিরে আসছিল। তখন বিকেল চারটে মতো বাজে। কুয়াশায় আস্তে আস্তে ছেয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদ। তবে, পথ চলায় বাধা দেওয়ার মতো তেমন ঘন কুয়াশাও নয়। সুরজিতের এরকম নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। একটি সোজা রাস্তা ধরে সে হাঁটছিল, এমন সময় একটা জায়গায় এসে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তার ধারে একটা সাইনবোর্ডে বড়-বড় করে লেখা- ‘সামনে গির্জা’। এই গির্জাটির কথা সুরজিত হোটেল ম্যানেজারের মুখে একবার শুনেছিল। ব্রিটিশ আমলের তৈরি। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত। সেখানে তার মতো অনেক শখের ফটোগ্রাফার নাকি যায় ছবি তোলার মানানসই শটের আশায়। সুরজিত ভাবল, একবার ওইদিকটা ঘুরে দেখে আসলে মন্দ হয় না। কিছু ভালো শট পাওয়াও তো যেতে পারে?
গির্জায় পৌঁছিয়ে, অবশ্য তার পছন্দ মতো কোনও শট ক্যামেরাবন্দি করতে সে পারল না। তবে, তার আসল বিচিত্র অভিজ্ঞতার শুরু গির্জা পেরিয়ে, পিছনের অংশে কৌতূহলবশত পা রাখবার পর। সে ফিরেই যাচ্ছিল, নেহাত কৌতূহলের বশে পিছন দিকটা চোখ বুলিয়ে নিল। এদিকে যে একটা গোরস্থান রয়েছে, তা সে আগে থাকতে জানবে কী করে? গির্জার পিছনভাগে পা রাখতেই সে হতবাক- সারি সারি শ্বেত পাথরের সমাধি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মাটি আগলে রয়েছে। কোন অদৃশ্য আকর্ষণ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল, একবার জায়গাটি ভালো করে দেখে যেতে। কয়েক পা এগোতেই অবশ্য সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটি নারীমূর্তি স্থির হয়ে বসে রয়েছে একটি সমাধির ধারে। লম্বা, ঘন কালো চুল, পরনে একটা নীল গাউন। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ফটোগ্রাফে দেখা সেকেলে আমলের মেমসাহেবদের পোশাকের কথা যেন মনে করিয়ে দেয়। সুরজিতের দিকে এতক্ষণ সে পিছন ফিরে বসেছিল। এইবার হঠাৎ তার দিকে চাইতেই একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল তার মেরুদণ্ড দিয়ে- এ যে হোটেলে দেখা সেই মেয়েটিই! তরুণীটি সুরজিতকে দেখে হালকা হাসল। তবে, তাকে দেখে বিচলিত হয়েছে বলে মনে হল না। নিজেই বোঝানোর সুরে বলল,
‘আমাকে এখানে দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হচ্ছেন?
আসলে, ব্যাপারটা আর কিছুই নয়- আমার ফ্যামিলির এক প্রিয়জনকে এখানে সমাধি দেওয়া হয়েছিল, কয়েক বছর আগে।’
তারপর যেন একটু আনমনা হয়ে বলে চলল,
‘ওর জন্যই আমি প্রতিদিন ফুল নিয়ে আসি। ওর রডোডেন্ড্রন খুব প্রিয় ছিল।’ তারপর, কয়েক মুহূর্তের জন্য দম নিয়ে আবার বলে উঠল,
‘এখানে এলেই ওর জন্য আমার মন যে কেমন করে ওঠে!’ সুরজিত এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে, এখন বরঞ্চ সমবেদনার সুরে বলল,
‘নিশ্চয়ই সে আপনার খুব কাছের মানুষ ছিল, মিস...।’
‘মার্গারেট।’ নিজের নাম বলে তরুণী। তবে, মার্গারেট সুরজিতের এই প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর দিল না। কেবল, সমাধিটির দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। সুরজিত তার পাশে এসে সমাধির গায়ে ফলকটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল- ‘মারিয়া সন্ডারর্স। মৃত্যু, ২০১৬।’ অনেক পুরনো, ফাটলধরা সমাধি ছড়িয়ে রয়েছে এই সিমেটারিতে। তার মাঝে, এই একটা নতুন সমাধি কেমন বেমানান লাগছিল সুরজিতের চোখে। তরুণীর কণ্ঠস্বরে সে আবার তার দিকে ফিরে তাকাল। মার্গারেট বলে চলেছে, কিছুটা যেন নিজেকেই,
‘আমি মারিয়ার সঙ্গে আজও কথা বলি। এই তো আজ যেমন বলছিলাম, বছরটা কার কেমন কাটছে।’ তার শেষ কথাটা সুরজিতের মোটেই ভালো লাগল না। সেটা আন্দাজ করতে পেরেই তরুণী বলল,
- ‘না, না আমায় পাগল ভাববেন না। আসলে, প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?’ এরপর দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সুরজিত অবশেষে জিজ্ঞাসা না করে পারল না, - ‘আপনি এবার হোটেলে ফিরবেন না, মিস মার্গারেট? অন্ধকারে আপনার এখানে একা থাকা সেফ নয়।’
- ‘হ্যাঁ, আমি আর কিছুক্ষণ এখানে থেকেই ফিরে যাব। আমি আসলে মারিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালে, বড্ড কাতর হয়ে পড়ি, কত স্মৃতি ফিরে আসে। আপনি বরং আগে-আগে চলুন, আমি আপনার পিছনে আসছি।’
মার্গারেটের চোখের কোণায় জলের ফোঁটা চিকচিক করে উঠল। তার স্বরে এমন কিছু দৃঢ়তা ছিল, যে সুরজিত বিদায় নিয়ে একা ফিরে যেতে বাধ্য হল। পথে দু’-একবার পিছন ফিরে তাকালও। কিন্তু মার্গারেটকে দেখতে পেল না। একবার ভাবল, তরুণীকে একা ওইরকম রেখে আসা কি ভদ্রজনোচিত হল? পরে নিজেই নিজেকে বোঝাল, তাকে এখন একা থাকতে দেওয়াই শ্রেয়। আহা, মারিয়ার মৃত্যুটা এখনও মেনে নিতে পারেনি মেয়েটি! তবে, একটা বিষয় জানা হল না তার, মারিয়া এই তরুণীর ঠিক কে হয়? পরদিন সকালেই সুরজিতের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। একবার সে ভাবল, মার্গারেটের সঙ্গে দেখা করে যায়। ছোট্ট হোটেল। একজন কর্মচারীকে তরুণীর নাম জিজ্ঞাসা করতে সে কোনও সদুত্তর দিতে পারল না। বলল, এমন কোনও নামের স্ত্রীলোক নাকি এই সপ্তাহে তাদের হোটেলে আসেইনি। আশ্চর্য! তখন, সুরজিত নিজেই মার্গারেটের সঙ্গে দেখা করার একটা উপায় বের করল- কেন, সেই সিমেটারিটা একবার ঘুরে এলে কেমন হয়?
গোরস্থানটি হাঁটা পথ হোটেল থেকে। পরিত্যক্ত গির্জার মরচে-ধরা গেট পেরিয়ে, হাঁটার সময় তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। গতকালের সেই সমাধিটার কাছে এসে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেল, একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু এ যে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক! খুব শীর্ণকায় তাঁর শরীর। পরনে কালো কোট, মাথায় হ্যাট। সেই তরুণী আশেপাশে কোথাও নেই। সুরজিতের পদশব্দ শুনে বৃদ্ধ ঘুরে তাকালেন তার দিকে। সুরজিত দোনোমনা করতে করতে প্রশ্নটা করেই ফেলল,
- ‘স্যার, এখানে কোনও ইয়াং লেডিকে দেখেছেন?’ বৃদ্ধ অল্প বিস্মিত হলেন। বললেন,
- ‘না তো, এদিকে তো কারো আসার কথা নয়। তুমি কাকে খুঁজতে এসেছ?’
- ‘আজ্ঞে, মার্গারেট তাঁর নাম... গতকালই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম এখানে... ঠিক যেখানে আপনি-’ তাকে আর শেষ করতে হল না, বৃদ্ধ কাতর কণ্ঠে ডুকরে কেঁদে ওঠার মতো বলে উঠলেন,
- ‘তুমি সত্যি দেখেছ মার্গারেটকে? বলো, আমার মেয়েকে তুমি দেখেছ? ঠিক বলছ?’ তার হাতদুটি জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
বৃদ্ধ নিজেকে খানিকটা সামলে নিতে, সুরজিত জানতে চাইল,
- ‘আপনার মেয়ে মার্গারেট?’
- ‘হ্যাঁ, মার্গারেট আর মারিয়া- দুই যমজ মেয়ে আমার। দুজনের মধ্যে যে কী ভাব ছিল! মারিয়া বিশেষ করে ভীষণ পাহাড় ভালবাসত! এখানেই আমরা সাত বছর আগে বেড়াতে এসেছিলাম। একদিন সন্ধেয় হোটেলে ফেরার পথে কীভাবে যেন মারিয়া খাদে পড়ে যায়- দুইদিন হাসপাতালে ছিল। ওর শেষ ইচ্ছে ছিল, এই পাহাড়ের কোনও সিমেটারিতেই যেন ওকে শুইয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আমি প্রতিবছর আসি ওর জন্য ফুল নিয়ে...।’
‘আর মার্গারেট বুঝি আপনার সঙ্গেই এসেছে?’ এইবার বৃদ্ধ আরও চমকে উঠলেন।
- ‘হায়! মার্গারেটও কি আর আছে? ওকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলাম লেখাপড়ার জন্য। দু’ বছর আগে, প্যান্ডেমিকের মধ্যে সেও যে আমাকে হঠাৎ করে ছেড়ে চলে গেল! ওর সঙ্গে শেষ দেখাটাও আমার হয়নি। এখন আমি যে সম্পূর্ণ একা! আই অ্যাম সো লোনলি!’
বৃদ্ধ সুরজিতকে পাশে নিয়ে সমাধির ধারে, ঘাসের উপর বসলেন। তার মুখে সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনলেন। তারপর, অনেকক্ষণ চোখ বুজে, চুপ করে বসে রইলেন। সব শেষে উঠে দাঁড়িয়ে, তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
‘এবার ওঠা যাক।’
সন্তানহারা, মুহ্যমান বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির সঙ্গে সিমেটারি থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে, সুরজিতের একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল- রডোডেন্ড্রন! মনে আসতেই, গোরস্থানের পাঁচিলের উপর বেড়ে ওঠা একটা গাছ থেকে দু’টি ফুল পেড়ে, মারিয়ার সমাধির সাদা পাথরের বুকে রেখে আসল। তারপর, চোখ বুজে, হাতজোড় করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
যখন আবার চোখ খুলল, তখন দেখতে পেল, দুটি লাল রডোডেন্ড্রন এমনভাবে পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে, যে মনে হচ্ছে- দু’জন বন্ধু যেন পরম নিশ্চিন্তে হাত জড়াজড়ি করে রয়েছে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে অজান্তেই সুরজিতের মুখে মৃদু হাসির একটি রেখা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
প্রবন্ধ
বাগানে লাগান
চন্দ্রমল্লিকা
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
চন্দ্রমল্লিকা। গন্ধ না থাকলেও রঙে-রূপে এক অনবদ্য ফুল। কোনটা সাদা, কোনওটা হলুদ আবার কোনওটা মেরুন। ঠিক সময়ে যদি গাছ লাগান, তবে সারা শীতকাল জুড়ে আপনার বাগান, সে বাড়ির সামনে একটুকরো জমিই হোক বা বাগানের ঝুলন্ত টব, রঙে রঙে ভরিয়ে রাখবে। কিন্তু যদি কারুর বাড়িতে এইরকম মনভোলানো ফুলের বাহার দেখে ভাবেন যে এই গাছ লাগালেই ফুলে ফুলে ভরে উঠবে, সেটা কিন্তু সবসময়ে হবে না। অনেকে যত্ন করে গাছ লাগিয়েও ফুল ফোটাতে পারেন না। একই গাছ, এক রকম টব, কিন্তু দেখা যায় যে কারুর ফুলের ভারে ডাল নুয়ে পড়ছে, আর কারুর ডাল-পাতা বেড়েই চলেছে, ফুলের আর দেখা নেই।
প্রথম কথা হল, টবে কী মাটি দেবেন? যে কোন মাটি দিলে কিন্তু গাছ হবে না। অনেকে রাস্তা খোঁড়ার সময়ে যে মাটি উঠে আসে, সেই মাটি নিয়ে এসে টবে ভরে দেন। এরকম ইটের টুকরো বা বালি ভর্তি মাটি দিয়ে লাভ নেই। আজকাল ফ্লাওয়ারিং প্ল্যান্টের জন্য সব উপাদান অনুপাত অনুযায়ী মেশানো মাটি অনলাইনে পাওয়া যায়। সময় কম থাকলে সেই তৈরি করা মাটি কিনে নেবেন। আর যদি হাতে অঢেল সময় থাকে তবে মাটি নিজেই মিশিয়ে বানান। ৪০% ভালো ঝুরঝুরে মাটির সাথে ২০% কোকো পিট, ২০% ভারমি-কমপোস্ট মেশাতে হবে। এঁটেল মাটি, (উদাহরণ হল গঙ্গামাটি) কিন্তু ব্যবহার করবেন না। খুব এঁটেল মাটিতে গাছের শিকড় বিস্তার হবে না। এছাড়া মাটিতে নিমখোল কিছুটা দিতে পারেন। তবে মনে রাখবেন যে মাটি কিন্তু আগেই বানাতে হবে। সেই মাটি রোদ-জল খাওয়াতে হবে কিছু দিন। নার্সারি থেকে গাছ কিনে এনে তারপর মাটি মিশিয়েই গাছ লাগিয়ে দিলে কিন্তু লাভ নেই।
এরপর বলি টবের উচ্চতার কথা। একদম ছোট টবে চন্দ্রমল্লিকা লাগিয়ে লাভ নেই। ফুল ঠিকমত হবে না। অন্তত ৮ ইঞ্চি টবে গাছ লাগাবেন। আরও উঁচু টব হলে আরও ভালো। যারা কাটিং করে নতুন গাছ বানাবেন, তারা প্রথমে ৩—৪ ইঞ্চি টবে লাগিয়ে তারপর গাছ বড় হলে ৮ ইঞ্চি টবে রি-পট করতে পারেন।
ফুলগাছ যেন সারাদিনে ঠিকমত রোদ পায়। ছায়াঘেরা জায়গায় লাগালে গাছ হয়ত বেঁচে থাকবে কিন্তু ফুল আসা মুশকিল। এবার যদি আপনার ছোট্ট বারান্দায় রোদ না আসে, তখন কী তাহলে আপনার চন্দ্রমল্লিকার শখ অপূর্ণ থেকে যাবে? এর এখন একটা উপায় আছে। অনলাইনে গ্রো লাইট পাওয়া যায়। সেটা ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
প্রচুর ফুল পেতে হলে চন্দ্রমল্লিকা লাগাতে হবে শীতের এক দেড় মাস আগেই। আরও আগে হলে ভালো হয়। সূর্যালোকের সময় যত কম থাকবে, চন্দ্রমল্লিকায় ফুল আসবে তত তাড়াতাড়ি। আপনারা জানেন যে ২১শে ডিসেম্বর অবধি আমাদের দিনের দৈর্ঘ্য কমে, তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। সুতরাং ভালো ফুল পেতে হলে চন্দ্রমল্লিকা গাছ কিন্তু এই ২১শে ডিসেম্বরের অন্তত এক-দেড় মাস আগেই লাগাতে হবে।
শীতকালে অনেকসময় বৃষ্টি হয়। তখন যে টবসুদ্ধ গাছ ঘরের ভেতর সরিয়ে আনতে হবে সেরকম নয়। একটু বৃষ্টিতে কিছু ক্ষতি হয় না। কিন্তু দেখবেন যেন গাছের গোঁড়ায় জল না দাঁড়ায়। টব কাত
করে জল ফেলে দিন। ফুলের গাছে বেশি বেশি সার দেবেন না। বেশি নাইট্রোজেন যুক্ত সার দিলে কিন্তু গাছের ডাল-পাতা বড় হতে শুরু করবে, ফুল আর আসবে না। তাই প্রথমে যেভাবে বললাম, সেভাবে টবের মাটি বানান। কিন্তু তারপর খুব বেশি সার আর দেবেন না। অনেকে আছেন রোজ সকালে চা বানিয়ে সেই ভিজে পাতা গাছের গোঁড়ায় ঢেলে দেন। এরকম একদম করবেন না, অন্তত চন্দ্রমল্লিকার জন্য। সর্ষের খোল ভেজানো জল দিতে পারেন। কিন্তু ১৫—২০ দিনে একবার। বেশি দিলে কিন্তু মাটি নষ্ট হয়ে যাবে।
চন্দ্রমল্লিকা গাছের পরিচর্যার একটি প্রধান অঙ্গ হল পিঞ্চিং। এর মানে হল মাঝে মাঝেই গাছের ডগার নতুন পাতাগুলো ছেঁটে দেওয়া। নতুন পাতার কুঁড়ি কিন্তু বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। তাহলে দেখবেন এই গাছের ডালই লম্বায় বেড়ে চলেছে; কিন্তু ফুলের কুঁড়ি আর আসছে না। প্রত্যেকটা ডালের একদম ডগার পাতা কেটে দিতে হবে বার বার। এর ফলে দেখবেন পাশ দিয়ে নতুন নতুন ডাল বেরোচ্ছে। সেই সব ডাল একটু বড় হলে (২—৩ ইঞ্চি) তাদের পাতার কুঁড়িও ছেঁটে দিতে হবে। বার বার এরকম করতে করতেই দেখবেন একসময়ে ফুলের কুঁড়ি চলে এসেছে। এই কাজটা কিন্তু শুরু করতে হবে গাছ লাগানোর কিছুদিন পর থেকেই। যদি আপনি দেরি করেন, মানে গাছ লাগানোর পর দুমাস অপেক্ষা করে তারপর পিঞ্চিং শুরু করেন, তাহলে লাভ নেই। দুমাসে দেখবেন সেই গাছের ডাল বিশাল লম্বা হয়ে ঝুঁকে পড়েছে। চারিদিকে ডাল বেরিয়ে প্রায় ছোট একটা ঝোপ হয়ে গেছে। সেই গাছে তখন আর ফুল হওয়া মুশকিল। ঠিকমত পিঞ্চিং করলে গাছটি এক-দেড় ফুট লম্বা হতে না হতেই ফুলের কুঁড়ি চলে আসবে। তখন আর গাছ লম্বায় বাড়বে না।
অনেকে গাছ লাগানোর পর সেটি একটু বড় হলেই ফসফেট সার দিয়ে দেন। একদম শুরুতেই এটা করা কিন্তু উচিত নয়। ফসফেট সার গাছে ফুলের কুঁড়ির জন্ম দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু একদম ছোট গাছে এটা দিলে কয়েকটা মাত্র ফুল দিয়েই গাছ মরে যাবে। যে গাছে একশোটা ফুল হতে পারত, সেখানে দশ-বারোটা মাত্র ফুল হবে। তার থেকে এক-দু মাস গাছের পরিচর্যা করে তারপর ফসফেট দিলে ফুলও বেশি হবে, তার রঙও ভালো হবে।
চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়ি থেকে ফুল হতে কিন্তু অনেক সময় লাগে। অনেকে এই সময়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এদিকে অপরাজিতা বা জবা গাছে আজকে কুঁড়ি এলেই কাল বা পরশু সুন্দর ফুল ফুটে যায়, আর ওদিকে চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়ি ছোট থেকে বড় হতেই সাত-দশ দিন; তার পরে সেই কুঁড়ি ফুটতে আরও দশ দিন। একদিনে তো আর ফুলের সব পাপড়ি মেলবে না, এক-এক সারি করে আস্তে আস্তে ফুল ফুটে উঠবে। তবে এই যে ধৈর্যের পরীক্ষা, এর পরে কিন্তু আপনার মুখে হাসি ফুটবেই। আর এই ফুল গাছে থাকেও অনেকদিন। প্রত্যেকদিন সকালে সূর্যস্নাত ফুল আপনাকে স্বাগত জানাবেই। তাই কুঁড়ি কেন ফুটতে দেরি হচ্ছে, সেই সম্বন্ধে অধৈর্য হবেন না।
শেষে আর দুটি কথা। প্রথমত এক টবে তিন চারটি গাছ লাগাবেন না। একটি গাছকেই টবে বাড়তে দিন। আর দ্বিতীয় হল, একবার ফুল হয়ে গেলে গাছ তুলে ফেলে দেবেন না। ডালগুলো ছেঁটে দিন। কিছুদিন পরে আবার ফুল আসতে পারে।
অনুগল্প
নিয়তি
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
ছেলে ও পুত্রবধূর জোড়াজুরি ঠেলতে পারল না অমরবাবু৷ সিমলীপাল একটা বদনামী জায়গা হয়ে গেছে৷ নিমরাজি হয়েও যেতে রাজি হলেন৷ অফিসের সহকারীরা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠল৷ ওখানে তো ম্যালিগণ্ট্যাণ্ট ম্যালেরিয়ার জন্য কুখ্যাত৷ এখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা ওসব শুনতে চায় না৷ ওরা অ্যাডভেঞ্চার পিয়াসী৷
ওদের জীবনদর্শন হল— Life is calling, Life is thrilling. অমরবাবুর স্ত্রী কমলা ছেলের কোনো কিছুতেই না নেই, পুত্রস্নেহে অন্ধ৷ পুত্রবধূ ঈশিতা বলল,
- 'যে আর কেউ যায় না, গেলেই সবাই মশার কামড়ে মারা যায়৷ যত্ত সব .......'
সবাই মিলে হৈ হৈ করে অমরবাবু, স্ত্রী, পুত্রবধূ, নাতনী ও পুত্রসহ এপ্রিল মাসে বেরিয়ে পড়লেন৷ নিষিদ্ধ সুন্দরী সিমলীপাল দর্শনে৷ বারিপোতা থেকে গাড়ি করে পৌঁছে গেলেন প্রকৃতির কোলে৷ কয়েক দিন দারুণ কাটিয়ে ফিরে এলেন ও সানন্দে আবার কর্মক্ষেত্রে যোগদান করলেন৷ অফিসের
সবাইকে মুখে মুখে গল্প ও ছবি দেখিয়ে খুব আনন্দ পেলেন৷ দশদিন বাদে ছেলের জ্বর এলো৷ বারো দিনে অমর বাবুর৷ ছেলে ও পুত্রবধূ গুরুত্বই দিতে চায় না৷ বলে রোদ লেগে জ্বর এসেছে৷ চলতি কথায় বলে নাইতে-খেতে সেরে যাবে৷ কয়েক দিন ধূম কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে, না, আর হ্যালাফেলা নয়৷ ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে উনি বললেন, দেরি করে ফেলেছেন৷ দ্রুত নার্সিং হোমে ভর্তি হতে৷ বাবা-ছেলের খুব বাড়াবাড়ি৷ অমরবাবু একটু সামলে নিলেন কিন্তু পুত্র পার্থ সামলাতে পারল না৷ সবাইকে হতাশ করে ছোট্ট পাঁচ বছরের মেয়েকে ফেলে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল৷ ছেলে চলে গেলে, অমরবাবু সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন৷ বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে৷ অফিসের সহকর্মীদের বারণটা ও পুত্রবধূর জোর করে বেড়াতে যাওয়াটা বারবার মাথায় হাতুড়ি মারছে৷ রিটায়ারমেণ্টের মুখে বড়ো দায়িত্ব, পাঁচ বছরের নাতনীকে বড়ো করতে হবে৷ অমরবাবু জানলা দিয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন৷
অনুগল্প
আধুনিক কবিতা
লেখা/কর্মফল
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
আধুনিক কবিতা লেখাঃ
“আচ্ছা অভিষেক, তুমি শুনলাম এবারে অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে কবিতায় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছ?”
“হ্যাঁ, স্যার।“
“বাহ। তুমি কবিতা লেখ জানতাম না তো!”
“হ্যাঁ স্যার। মাঝে মাঝে লিখি আর কি!”
“বাহ। কি নিয়ে লিখেছ?”
“ওই স্যার, পড়ে দেখুন না। এক কথায় তো বোঝাতে পারব না।“
“দেখি দাঁড়াও, এই তো এখানে কাগজটা আছে……………………
এক গরম জলের বালতির ভেতরে আমার অষ্টম হৃদয়ের শেষ স্টেশনের লঙ্কাকাণ্ড ঘটে চলেছে। অসীম বেগুনি আকাশের চন্দ্রাতপে সেই আগুনের ঠাণ্ডা আভা নিস্তেজ হয়ে আছে।
এর মানে কী?”
“স্যার, মানে তো এটাই। যা বোঝাতে চেয়েছি, পুরোটাই তো লিখে দিয়েছি। কোনও রাখঢাক তো রাখিনি।“
“পুরোটা লিখেছ মানে? কী লিখেছ? কিছুই তো বুঝলাম না!”
“কেন স্যার? আমার যা যা মনে হয়েছে সেটাই তো লিখেছি!”
“তুমি কী বলতে চাও? এইসব বেগুনি আকাশ, অষ্টম হৃদয়, আগুনের ঠাণ্ডা আভা এইসব তোমার মনে হয়?”
“হ্যাঁ স্যার। যখন খুব ফ্রাস্ট্রেশান হয়, রাগ হয়, তখন এইরকম কথাই ভাবি।“
“তোমাদের জেনারেশানকে আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। দেখো, আগে আমাদের সময়েও তো কবিতা লেখা হত। বিপ্লব, বিদ্রোহের আগুন, ব্যর্থ প্রেম, সবই ছিল। কিন্তু বুঝতে পারা যেত। তোমাদের কবিতা তো কিছুই বুঝতে পারলাম না।““কেন স্যার? আপনার কী কখনও রাগ হয় না? ক্ষোভ হয় না? সারা পৃথিবীকে একটা জেলখানা মনে হয় না?”“রাগ হবে না কেন? কিন্তু তা বলে এই অষ্টম হৃদয়?”“শুধু অষ্টম হৃদয় কেন স্যার? আরেকটু পড়ে দেখুন। আচ্ছা, আমিই বলছি। “নিঃসাড়ে ছুটে চলে মাটির তলায় শেষ তেঁতুলবিছের লাইন। অন্ধকারে শব্দহীন শয়তানের পদধ্বনি।“”“চুপ কর। আর একটা লাইনও তুমি পড়বে না। কে দিয়েছে তোমাকে প্রাইজ? আরেক পাগল নাকি? বেরিয়ে যাও!”“স্যার। আপনার হবে!”“মানে?”“এই যে স্যার, আপনার মধ্যে এই রাগ, আমার কবিতা শুনে যে ক্ষোভ, সেটাকে আপনি কাগজের বুকে অক্ষরদান করুন, দেখবেন আপনার কলম থেকেও রক্তরঞ্জিত লাইন বেরিয়ে আসবে। পরের বার…”“বেরিয়ে যাও। এবার কিন্তু আমি যা হাতের সামনে পাব, ছুঁড়ে মারব।““না স্যার, আমাকে ছুঁড়বেন না। আপনার এই রাগকে ছুঁড়ে মারুন কবিতার লাইনে, ছুঁড়ে মারুন বইয়ের পাতায়। এই রাগ থেকেই তো নতুন সৃষ্টি হবে।----------…আচ্ছা স্যার, আপনার মুখ লাল হয়ে গেছে। মনে হয় আপনার মধ্যে কবিতার প্রসব আসন্ন। আমি আর দেরি করব না। চললাম স্যার। এই চেয়ারে আমার আরেকটা কবিতা রেখে গেলাম। পরে চোখ বুলিয়ে দেখবেন।।“
কর্মফল
কোভিড মহামারী সবে শুরু হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় ভয়। রাস্তাঘাট খালি। দোকান সব বন্ধ। ডাঃ সেন থাকেন একটা ভাড়া বাড়ির এক তলায়। হাসপাতালে ডিউটি বেড়েছে। সকাল সেই সাতটায় বেরোতে হয় আর ফেরেন রাত্রি নটা, কখনও দশটা।
বৃদ্ধ ডাক্তার। বাড়ি কলকাতায়। হাওড়ার এই হাসপাতালে চাকরির জন্য এখানেই বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়। পাড়ায় এখনও কারুর কোভিড হয়নি। কিন্তু সবার মনেই ভয়।
একদিন রাত্রে ডাঃ সেন ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ঢুকতে যাবেন, এইসময়ে দেখা গেল লোকাল ক্লাবের দুটো ছেলে বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। “কী কাকু, ভালো আছেন তো?”
ডাঃ সেন মাথা নাড়লেন। এই সময়ে বাড়িতে এসেছে মানে নিশ্চয়ই এমারজেন্সি কেস। আবার বেরোতে হবে? ছেলে দুটো দাঁড়িয়ে রইল, ডাঃ সেন ঘরে ঢুকলেন। সবে উনি দরজাটা বন্ধ করে ব্যাগটা টেবিলে রেখেছেন, বেল বেজে উঠল। তার মানে এবার ডাক আসবে।
কিন্তু দরজা খুলে ডাঃ সেন দেখলেন তাঁর বাড়িওয়ালা চ্যাটার্জিবাবু দাঁড়িয়ে। মুখে হাসি।
“কী মানসদা, ভালো আছেন?” এই রাত্রে সবাই পাইকারি হারে কুশল জিজ্ঞাসা করতে এসেছে, ব্যাপার কী? ডাঃ সেন চুপ করে রইলেন।
“ভেতরে আসব?”
“আসুন।“
চ্যাটার্জিবাবু ঘরে ঢুকে বসলেন না। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলেন। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বললেন, “আপনার নিশ্চয়ই ভালোই পরিশ্রম যাচ্ছে?”
“সে তো যাচ্ছেই। চারিদিকের যা অবস্থা-------------”
“আপনাদের হাসপাতালে তো শুনলাম প্রচুর কোভিড পেশেন্ট।“
“কোথায় নেই? সব হাসপাতালেই তো এখন---” এইসময়ে ডাঃ সেন দেখলেন সেই দুটো ক্লাবের ছেলে আস্তে আস্তে ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। চ্যাটার্জিবাবু এবার গলায় মধু ঢেলে বললেন,
“আসলে মানসদা, একটা কথা বলার ছিল। আমার কথা নয়। এই পাড়ায় সবাই বলছেন তাই।“
“কী কথা?”
“দেখুন আমরা সবাই তো এখানে ফ্যামিলি নিয়ে থাকি। চারিদিকে খবর দেখে আমাদের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কিরে গুড্ডু, তাই তো?”
সেই দুজনের মধ্যে একজন মাথা নাড়ল। ছেলেটার এক কবজিতে মোটা সোনার বালা। গলায় বাঘের ছবি দেওয়া উল্কি।
“তাই বলছিলাম যে, আপনি তো রোজ হাসপাতাল থেকে ফিরছেন। যদি আপনার সাথে রোগের জীবাণু চলে আসে এখানে, তাহলে কী হবে বলুন?”
ডাঃ সেন চুপ করে রইলেন। এরপর কী কথা আসবে, উনি জানেন। এবার গুড্ডু মুখ খোলে। মুখে গুটখা ভর্তি। ভালো করে কথা বেরোচ্ছে না। সেভাবেই বলল,
“কা-হু। আপনি রোজ হাসপা-হা-ল গেলে তো এখানে আপনার থাকা মু-হ-কিল।“
ডাঃ সেন বললেন, “চাকরি তো করতেই হবে। আমি না গেলে চলবে?”
গুড্ডু মুখের লাল থুতু সিঁড়ির দেওয়ালে ফেলে বলল,
“তাহলে আপনি এই ক-দিন অন্য জায়গায় গিয়ে থাকুন।“ ডাঃ সেন চুপ করে রইলেন। এই ক্লাসের লোকের সাথে তর্ক করা মানে নিজে গিয়ে কাদায় ঝাঁপ দেওয়া। বাড়িওয়ালা তখন একমনে নিজের আইফোনে ছবি দেখতে ব্যস্ত।
পরের দিন বেরোনোর সময়ে ডাঃ সেন দেখলেন সেই দুটো ছেলের মধ্যে একজন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে হাতে সিগারেট। কিচ্ছু কথা বলল না। শুধু ওনার দিকে তাকিয়ে রইল।
ডাঃ সেন যা বোঝার বুঝে গেলেন। উনি হাসপাতালের কাছে একটা হোটেলে সেদিনই উঠে গেলেন। ভাগ্যে হোটেলের মালিক চেনা ছিল।
সাত মাস পরের কথা। চ্যাটার্জিবাবুর নাতির দারুণ জ্বর। টেস্ট করালেন। করোনা পজিটিভ। উনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। পাড়ায় সব ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ। ডাঃ সেন ছিলেন পাড়ার ফ্যামিলি ডাক্তার। উনি তো সেই কবেই উঠে গেছেন। এদিকে গুড্ডু এবং তার দলবল কিভাবে যেন খবর পেল যে এই বাড়িতে পজিটিভ রোগী আছে। তারা এসে বাড়ির সামনে ব্যারিকেড বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। চ্যাটার্জিবাবু ফোন করে করে সবাইকে মিনতি করলেন। কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল না। লোকাল হাসপাতাল পুরো ভর্তি। বেড নেই।
অবশেষে একজন দালাল খবর দিল যে একুশ মাইল দূরে একটা নার্সিং হোমে বেড আছে। কিন্তু দেরি করা যাবে না। চ্যটার্জিবাবু নাতিকে নিয়ে দৌড়ে বেরোতে যাবেন। চোখ গেল একতলার বন্ধ দরজার দিকে। একতলাটা এখন বন্ধ আছে। দরজায় ঝুল পড়েছে। একটা নেমপ্লেট এখনও লাগানো আছেঃ ডাঃ মানস সেন। তবে অনেকদিন পরিষ্কার হয় না। তাই নেমপ্লেটে ধুলো জমে গেছে।
অণুগল্প
সেদিন বাজারে নৈঋতদার সঙ্গে দেখা।
চুনো মাছের দরদাম করছিল।
আমি মজা করে বললাম--
"দাদা তুমি হচ্ছ রাঘববোয়াল,আর তুমি কিনা চুনো মাছ!"
নৈঋতদা ঠোঁটে লাজুক লাজুক হাসি --
"কি যে বলিস! হ্যাঁ হয়তো চুনো নয়, তা বলে রাঘববোয়ালও নয়। চারা পোনা বলতে পারিস।"
আমি কোনো ভণিতা না করেই বললাম--
"দাদা ইদানিং তোমার পাঠক সংখ্যা তো বেশ বাড়ছে।"
নৈঋতদা বিনয় মেশালো গলায়--
"ঐ আর কি।"
নৈঋতদা বছর কয়েক লিখছে। লিখছে মানে আমার মতো ফেসবুকে লিখছে। দাদা আমার সিনিয়র হলেও লেখালেখি শুরু করেছে পরে। ছাপা বইয়ের লেখকরা আমাকেতো নয়ই দাদাকেও মাস দুই আগে লেখক বলে মনেই করত না। আমি অবশ্য দাদার নিয়মিত পাঠক। আমার মতো আরও জনা কুড়ি বাঁধা পাঠল ছিল দাদার। ইদানিং সংখ্যাটা ষাট সত্তর ছুঁই ছুঁই।
হিসাব মাফিক মাস দুয়েকে গ্রোথ রেট টু হান্ড্রেড পারসেন্ট।
"ঐ আর কি মানে? পাঠক বাড়ালে কিভাবে ? মানে সিক্রেটটা কি দাদা ?"
দাদ আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল--
"ইদানিং অন্যদের লেখায় হাতখুলে লাইক, কমেন্ট দিচ্ছি। ওরাও দিচ্ছে।"
এরপর নৈঋতদা আমার পিঠে কপট চাপড়ে হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে হাসতে বলল--
"মিউচুয়াল পিঠ চুলকানি ভাই।"
আমি নৈঋতদার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বললাম--
"তাহলে তো পড়ছও অনেক?"
নৈঋতদা ভিড়ের থেকে আমাকে সরিয়ে নিয়ে বলল--
"পড়ব না মানে,রীতিমত কমেন্টগুলো পড়ে তবেই কমেন্ট করি ভায়া।"
"তার মানে বিষয়টা দাঁড়াল হয়তো চল্লিশ জন তোমার পদ্ধতিতেই তোমাকে ফেরৎ করছে! না নৈঋতদা এখন সত্যিই তুমি রাঘববোয়ালদের দলে।"
-------------------------------------------
কলেজের এক সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ঠিক দেখা হয়ে গেল এমনটা নয়-- আসলে দিন দশেক আগে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছিল। পরিচয় দিয়ে বলল, সে নির্ণয়।
আমরা নাকি একসঙ্গে পড়তাম কলেজে। নির্ণয় তার মেয়েকে কমার্স পড়াতে চায় আমাদের স্কুলে।
আমি অনেক চেষ্টাতেও মনে করতে পারলাম না নির্ণয়কে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি, কম তো নয়! অসংখ্য মুখ। অধিকাংশই তার ঝাপসা। সামনাসামনি দেখা হলে কাউকে কাউকে মনে পড়ে, কেউ ফেরে না-- তখন চেনার ভান করতে হয়।
পরে অনেক চেষ্টায় কেউ কেউ স্মৃতিতে ফিরে আসে। নির্ণয় ফিরেছিল দিন তিনেক বাদে। আমি যে নির্ণয়কে ঠিকঠাক চিনতে পেরেছি সেটা নিশ্চিত হতেই গিয়েছিলাম নির্ণয়ের কাছে। নির্ণয়ের বাসন কোসনের দোকান। দোকানটা সংসারের হাজার একটা খুঁটিনাটি জিনিস পত্রে ভরা। সেসব দেখে মনে হল আমাদের সংসারে অনেক কিছুই নেই। টুকটাক নিলাম তারই কিছু। ঐ যে বললাম নির্ণয় তার মেয়েকে কমার্স পড়াতে চায়-- খরিদ্দার সামলে সেসব নিয়ে আলোচনা হল একপ্রস্ত।
এর মধ্য ঠান্ডা পানীয় এল। না, আমি ঠিক আন্দাজই করেছি। আমাদের সময়ে সবচেয়ে লম্বা চুপটি করে থাকা ছেলেটিই নির্ণয়। বিজনেস ম্যাথেমেটিকসে বরাবরই ভয় ছিল নির্ণয়ের। আমার ছেলে এখন সবে সিক্স আর নির্ণয়ের মেয়ে মাধ্যমিক দিয়ে ফেলল! আমাদের স্কুলে ইকনমিকস্ এন্ড বিজনেস ম্যাথমেটিকস্ সাবজেক্টটাই নেই একথা শুনে হতাশ হল নির্ণয়।
আমি আমার টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে ফিরব এমন সময় --
"বাবু একটু সাহায্য করুন বাবু ঔষধ কিনবো।" এই বলে এক বুড়ি হাত পাতলো। নির্ণয় কি দিলো ঠিক খেয়াল করি নি তবে একটা কিছু দিল বুড়ির হাতে। সারাদিন অনেকেই হয়তো এমন সাহায্য করতে হয়। বুড়ি বিধবা। বয়স আনুমানিক সত্তরের এদিকে হবে না। শরীরে চামড়া আর হাড়টুকুই সার। রোদে ঝলসে গেছে বুড়ি।
আমি বুড়িকে পাশ কাটিয়ে বেরোব এমন সময় বুড়ি আমার কাছেও চেয়ে বসল। আমি বললাম--
"কি ঔষধ কিনবে?" বুড়ি একটু ইতস্তত হল। নির্ণয় হাসছে। সারাদিন এমন কত বুড়ি বুড়োকে পরখ করতে হয়!
বুড়ির চোখে চোখ রেখে বললাম--
"আমি কিন্তু টাকা দেব না তোমায়, পারলে ঔষধ কিনে দেবো। বল কি ঔষধ দরকার।"
বুড়ি কেমন যেন অস্থির হল। একটা পলিথিনের ভাজ ভেঙে ঔষধহীন, ঔষধের দুটো পাতা বের করল।
"এটা চুলকানির, এটা না খেলে সারা শরীর জ্বলতে থাকে বাবা। আর এটা গ্যাসের।"
বু্ড়ির সারা শরীর কাপড় জড়ানো, চুলকানির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। হঠাৎ করে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল।"কই এখন তো চুলকাচ্ছো না!"
"একটা ক্যাপসুল ছিল, সকালে খেয়ে বেরিয়েছি।
"বুড়ির উত্তরে লজ্জায় পড়ে গেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম--"ছেলেপুলে কটি?"
"একটি মাত্র ছেলে, শ্বশুর ঘরে থাকে। দেখে না আমাকে।"
"কি করে ছেলে?"
"ঐ তো জনমজুরি।"
"সে আর দেবে কোত্থেকে! চলুন আপনাকে চুলকানির ঔষধটা কিনে দিচ্ছি।"
বুড়ি আমার পিছন পিছন হাঁটা লাগাল। পায়ে সামান্য একটু টান আছে বুড়ির। আমি গতি কমিয়ে বুড়ির সঙ্গ নিলাম। স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম ঔষধ নিয়ে কিন্তু সরাসরি বাড়ি ফিরতে হবে। এই রোদে আর পোড়া যাবে না।
দোকানদার নীল রঙের একটা ডিবে থেকে চুলকানি আর সাদা বাক্স থেকে গ্যাসের ঔষধ দিল।
"বাবু আমাকে ঔষধ কিনে দিচ্ছে দামটা একটু কম নিও।" বুড়ির অনুরোধ শুনে হাসল দোকানদার।
আমাকে পঞ্চাস টাকা ছাড় দিল দোকানি। দু'পাতা ঔষধ পেয়ে বুড়ি বেজায় খুশি, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আশীর্বাদ করল আমাকে।
আমি বললাম --"ঠিক আছে ঠিক আছে, এবার বাড়ি ফিরুন।" বুড়ি চলল বাস ধরতে আর আমি এগোলাম উল্টো পথে, একটা টেবিল ফ্যান কিনতে। ক'দিন যা গরম বেড়েছে। একটু এগোতেই মনে হল বুড়ি আমাকে ঠকিয়েছে! ঔষধ নেওয়ার পর বুড়ি কেন খালি ঔষধের পাতা দুটো ফেরত নেবে!
নিশ্চিত ওগুলো দেখিয়ে আবার টাকা চাইবে একে ওকে। নিজের উপর রাগ হল খুব। পেছন ফিরে দেখি বুড়ি নেই। সতর্ক হয়ে চোখ চালালাম চারদিকে। না কোথাও নেই বুড়ি। আচ্ছা ঔষধটাকি সত্যিই চুলকানির?
গোগোলে গিয়ে সার্চ করে দেখি আইট্রাকোনাজল ফাঙ্গাল ইনফ্যাকশনে কাজ করে, এসমোপ্রাজল গ্যাসে কার্যকরী। বুড়িকে নিশ্চিত কোন ডাক্তার প্রেশকাইব করেছিল ঔষধগুলো, না হলে বুড়ি জানবে কি করে!
কত ছোট মন আমার সামান্য ঔষধ কিনে দিয়ে ঠকা না-ঠকার হিসাব করছি। একটা অসহায় মানুষকে সামান্য সহযোগিতা করে তার আবার চুলচেরা হিসাব! নিজেকে নিজেই গালি দিতে ইচ্ছে হল। মনে মনে ভাবলাম আর কোন দিন কাউকে নিয়ে মন্দ ভাবব না। যে দেয় না তার তো ঠকার ভয় নেই।
বরং যে দেয় তার ঠকার দায় থাকে-- তবে ঠকা না-ঠকার ভাবনা কেন! একটু আড়াল করে নিজের গালে নিজে চড় মারতে যাব, দেখি বুড়িটা সেই ঔষধের দোকানে। পাশে পরিপাটি এক মহিলা।সেল্ফ থেকে নীল রঙের ডিবেটা নামাচ্ছে দোকানি।
-------------------------------------
খাঁচা ভাঙা পাখি. সাতসকালে অবাক কান্ড! রূপম গুডমর্নিং বলতেই পাখিটা একেবারে স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠল- -"চুথিয়া।" রূপম একেবারে থ! কতদিন ধরে পাখিটাকে কথা শেখাতে চেয়েছে রূপম! আর আজ কিনা!
রূপম চোখ পাকিয়ে, ঝাঁকাল খাঁচাটাকে। দুলে উঠল খাঁচাটা-- দুলতে থাকা খাঁচা থেকে বারান্দার ঘেরাটোপ ভেঙে চুথিয়া শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল। ছড়িয়ে পড়ল দিগ্বিদিক। রাগে দাউদাউ জ্বলে উঠল রূপম।
অনেকগুলো টাকা দিয়ে কাকাতুয়াটা কিনেছিল রূপম-- আশা ছিল সকালবেলা গুড মর্নিং, রাতে গুড নাইট ওয়েলকাম, টাটা বাই বাই এসব মিষ্টি মিষ্টি বুলি আওড়াবে। ছেলেবেলা থেকেই পোষ্য -এর প্রতি নেশা রূপমের। তার বয়স যখন বারো কি তেরো সেসময় প্রতিবেশী বিনোদবাবুর খাঁচা সমেত কাকাতুয়া সাপটে দিয়েছিল রূপম।কম জল ঘোলা হয় নি সে নিয়ে- পিঠে বেতের বাড়ি নিয়ে ধুম জ্বর এসেছিল রূপমের। জ্বর বিছানায় পণ করেছিল রূপম- একদিন তার একটা কাকাতুয়া হবে।
কাকাতুয়া দিন রাত বলবে-- ' বিনোদের ঘরে যে ধন আছে রূপমের ঘরে সে ধন আছে।'
বিনোদের ধন এসেছিল রূপমের ঘরে। কাকাতুয়া হলে কি হবে, রূপমের সব প্রত্যাশায় জল ঢেলে ছিল পাখিটা। সে পাখি কথা বলে না! পাখিটাকে একটা কথাও শেখাতে পারে নি রূপম। চেষ্টার খামতি ছিল না তার, নিজেতো লেগে ছিলই, মাঝে ট্রেনার আনিয়ে তালিমের চেষ্টা চালিয়ে ছিল মাস কতক। হয় নি, কোন চেষ্টাই কাজে আসে নি।
গতকাল পর্যন্ত একটা বুলিও ঠোঁটে আনে নি পাখিটা। আজ সাতসকালে খিস্তি! কথাটায় কি ভয়ঙ্কর ঘৃণা মিশেছিল সেটা বুঝতে এতটুকউটুও অসুবিধা হয় নি রূপমের। গতকাল রাত থেকে কথাটা কানে গরম সীসা ঢুকিয়ে দিচ্ছে অবিরত। খাঁচার ভিতর হাত ঢুকিয়ে পাখিটাকে উচিত শিক্ষা দিতে চাইল রূপম। আর তাতেই বিপত্তি, ধারালো ঠোঁটে রক্তাক্ত হল আঙুল।
পাখিটার পালক ফোলানো শরীর আর কর্কশ ডাকাডাকিতে একটু হলেও ঘাবড়ে গেল রূপম।রোজদিনের মতো গতকাল রাতে মদ খেয়ে তুমুল মাতলামি করছিল রূপম, খিস্তি দিচ্ছিল সুতপাকে। সুতপার কোন অপমান সহ্য করতে পারে না পাখিটা- নাগাড়ে চিৎকার করছিল পাখিটা।
ঠোঁট দিয়ে খাঁচাটা ভেঙে ফেলতে চাইছিল অন্য দিনের মতো। পাখিটার ক্যাঁ ক্যাঁ চিৎকার অসহ্য হয় উঠছিল রূপমের কাছে। নেশার ঘোরে আছড়ে ফেলেছিল পাখি সহ খাঁচাটাকে। খাঁচার মধ্যে কাতর ডানা ঝাপটাচ্ছিল পাখি।
এতোদিন রূপমকে অনেক সহ্য করেছে সুতপা, খাঁচাটা আছড়ে দিতে আর চুপ থাকতে পারে নি সে, 'চুথিয়া' বলে একটা ধাক্কা দিয়েছিল রূপমকে। খাঁচাটা নিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলেছিল সুতপা।
হুম্বি তম্বি করতে করতে বাকি রাতটুকু বমি মেখে বারান্দাতেই পড়ে ছিল রূপম।
পাখির ডাক শুনে রান্না ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল সুতপা। বারান্দায় এসে দেখে রক্তাক্ত হাতে বসে আছে রূপম, সমানে দুলছে খাঁচা।
সুতপা তড়িঘড়ি ফাস্টএেড সেরে এগিয়ে গেল খাঁচার কাছে। মাথা নিচু করে নিল পাখিটা। গায়ে মাথায় হাত বোলাতে একটু একটু করে শান্ত হল সে। আসলে সুতপাদের পাখিটা বড্ড ভালো।পাখিটা শেখানো বুলি বলে না। স্পষ্ট করে সত্যটাই বলে।
দেবযানী দত্তপ্রামাণিক
গল্প
ইন্দ্রদেব, রুদ্রদেব ও কুমারদেব, চৌধুরী বংশের তিন প্রজন্ম। ইন্দ্রদেববাবু প্রাচীন রীতিনীতি মানেন, পুত্র সন্তান, ও তার পুত্র সন্তান এই ওনার সব কিছু। রুদ্রদেব ইঞ্জিনিয়ার, পরের প্রজন্ম, বাবার বাধ্য ছেলে তাই নিষ্ঠাভরে সব নিয়ম পালন করে। কিন্তু ওর আর ওর স্ত্রীর কাছে সন্তানই সব। কি ছেলে, কি মেয়ে। কুমারদেব আর উর্মিমালা ছোট, দুজনেই খুব বাধ্য কিন্তু আধুনিক মনষ্ক।
চৌধুরী বাড়িতে হৈ হৈ রব। ছেলে হয়েছে। রুদ্র আর সুদীপার বিয়ের ২ বছরের মধ্যেই। সবাই খুব খুশি। এই প্রজন্মের প্রথম ছেলে। ইন্দ্রদেব চৌধুরীর বড় ছেলের ঘরে প্রথম ছেলে, ওনার প্রথম নাতি। চারিদিকে হৈ হৈ রব। সুদীপাও গদগদ। রাজরানীর মত সাজিয়ে গুছিয়ে ছেলে কোলে নিয়ে ওকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই এসে ছেলে কে উপহার দিচ্ছে, আশীর্বাদ করছে। শ্বশুর, শ্বাশুড়ী, স্বামী , আর অন্য আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভর্তি। তিন দিন ধরে চললো উৎসব। ইন্দ্রদেব চৌধুরীর নাতি বলে কথা। উনি নাতির মুখ দেখে রত্ন খচিত হার দিলেন বৌমাকে, আর হীরের হার দিলেন নাতিকে। ছেলেকে ও ভুললেন না। একটি বি এম ডব্লিউ গাড়ীর চাবি তুলে দিলেন রুদ্রর হাতে। সবাই খুব খুশি।
উৎসবের তিন দিন তিন রাত, কাঙালি ভোজন করানো হলো। মন্দিরে মন্দিরে পুজো দাওয়া হলো। সবই এই নবজাতক কুমারের মঙ্গলের জন্য। ওর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য। ও যে চৌধুরী বংশের কুলদীপক। রুদ্রর পর এই বংশে ওই প্রথম পুত্র। উৎসবের আলোতে যখন সারা এলাকা আলোকোজ্জ্বল, তখন শহরের এক কোণে, একটি কুঠিতে টিমটিম করে জ্বলছে আলো। তাতে যে বড়মা, ইন্দ্রদেববাবুর স্ত্রী। রুদ্রর মা উর্মিদেবী।
সেই অন্ধকার কুঠিতে একটি দাসী। তার কোলে চাঁদের মতো আলো করে ঘুমোচ্ছে একটি পরী। সেই এই চৌধুরী বংশের প্রথম সন্তান, কন্যা সন্তান। রুদ্র ও সুদীপার প্রথম সন্তান। ইন্দ্রদেব চৌধুরীর এক পুত্র রুদ্রদেব, ও তারপর দুটি কন্যা। পূর্ণিমা ও নীলিমা। পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছে বর্ধমানের এক বনেদি পরিবারে। সে বর্ধমানেই স্বামী ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ছোট মেয়ে নীলিমা শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করে। তার ও বিয়ে ঠিক, এ বছরেই, পুরুলিয়ার এক রাজ পরিবারের ছেলের সাথে। বংশের নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত সম্পত্তি পাবে প্রথম নাতি অথবা নাতনি। ইন্দ্রদেবের এক দিদি ছিলো সমস্ত সম্পত্তির মালকিন, তবে বিয়ের ঠিক আগেই কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে ওর অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু হয়। সমস্ত সম্পত্তি এসে পড়ে ইন্দ্রদেবের হাতে। ওই দিদির মৃত্যু সত্যিই অ্যাকসিডেন্ট নাকি অন্য কিছু তা নিশ্চয়ই করে বলা যায় না। কেননা ঐ সময় দিদির সাথে একমাত্র ছিলেন ইন্দ্রদেব নিজে। এবং উনি ঘোড়াগাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন। রুদ্রর আগে, ওনার ও এক কন্যা আসে। জানতে পেরে ভ্রূণে মেরে ফেলা হয় ওকে। তারপর ভগবানের আশীর্বাদে রুদ্র হয়। এদিকে এখন ভ্রূণ নির্ণয় অবৈধ, আর রুদ্র আর সুদীপা এসব নিয়ম ও মানে না, তাই উনি হাসপাতাল থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন এই মেয়েটিকে। মেরে ফেলবেন ভেবেছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে সম্পত্তি নিয়ে কোন ঝামেলা না হয়, কিন্তু ওর রূপ দেখেই হোক আর নিজের জন্ম না নেওয়া মেয়ের কথা মনে করেই হোক, ওনার স্ত্রী সেটা আটকে দেন। এক পুরনো, বিশ্বস্ত দাসী মালতীর কাছে নাতনিকে দিয়ে দেন উনি। নিজের নামেই তার নাম দেন ঊর্মিমালা। সে ওকে নিয়ে শহরের কোনায় একটি কুঠিতে চলে যায়। আজ নাতির উৎসবের সময় কিছু টাকা পয়সা দিতে আসেন বড়মা। আর নাতনির গলায় পরিয়ে দেন ওনার একটি হার।
দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। কুমারদেব ও তার দিদি উর্মিমালা দুজনেই একটু একটু বড় হতে থাকে। গোয়ালিয়রের এক মস্ত বড় স্কুলে ভর্তি হয় কুমার। হোস্টেলে থাকে। মাঝে মাঝেই দাদু, ঠাকুমা, বাবা মা চলে যায় ওকে দেখতে। ওখানে একটি ফ্ল্যাট কিনে রাখেন ওনারা। যে রকম রাজপুত্রের মত চেহারা, সেরকম ক্ষুরধার বুদ্ধি ওর। স্কুলের টপার কুমার। সবার নয়নের মনি।
ওদিকে উর্মিমালাকেও ভর্তি করা হয় দার্জিলিংয়ের এক নামকরা স্কুলে। সেও অপূর্ব সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, বিদুষী মেয়ে। স্কুলে সেও টপার আর সবার প্রিয়। ওর পরিচয় কিন্তু সেই দাসীর মেয়ে, সবাই জানে ওর পিতা নেই, মারা গেছেন খুব অল্প বয়েসে, যুদ্ধে। কিন্তু আসল সত্যটা কেউ জানে না, শুধু দুজন ছাড়া। উর্মিদেবী মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেন দাসীর কাছ থেকে, খুব দেখতেও ইচ্ছে করে কিন্তু দার্জিলিং যাওয়ার সাহস হয় না। দাসীকে ওখানে একটি বাড়ি কিনে দিয়েছেন। ছুটি পড়লে দাসী ওখানে চলে যায় আর মেয়েকে ওই বাড়িতে নিয়ে যায়। নানা রকমের তালিমের ব্যবস্থা করা হয় তখন। উর্মি সবেতেই খুব ভালো, রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। খুব বাধ্য মেয়ে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা খুব কষ্ট পান তাই ও কিছু জিজ্ঞেস করে না। তবে স্বাভাবিক ভাবেই ওর খুব কৌতুহল বাবার সম্পর্কে । মাকে অন্তত একটি ছবি দেখাতে অনুরোধ করে। ওর মা ওকে কথা দেন যে স্কুল শেষ করে কলকাতায় গেলে ওকে দেখাবে। সেই আনন্দেই দিন গোনে উর্মি। উর্মির সাথে প্রচুর ছবি তোলে ওর মা আর সেগুলো সব পাঠিয়ে দেয় বড় মায়ের কাছে। উর্মিদেবী খুব যত্ন করে ওগুলো দেখেন আর মুছে ফেলেন। কুমার অবশ্য ছুটি পেলে বাড়ী আসে। ওর জন্য ও প্রচুর তালিমের ব্যবস্থা করা হয়। দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা সবাই ওকে চোখে হারায়। ওর পিসিরাও আসে মাঝে মাঝে। তারাও ওকে খুব ভালোবাসে। এত প্রাচুর্য ও ভালোবাসার মধ্যে থেকেও কুমার কিন্তু বখে যায় না। ও সত্যি একটি সুন্দর মনের মানুষ তৈরি হয়, সবার প্রিয় হয়ে ওঠে নিজ গুণে।
আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে দুই ভাই বোন। আলাদা আলাদা জায়গায় ,আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে। একে অন্যের থেকে অনেক দূরে। উর্মিমালার স্কুল এক সময় শেষ হয়। কুমার অবশ্য তখনও স্কুলে। ও তো এক বছরের ছোট উর্মি মালার থেকে। ওকে কলকাতায় আনা হয়। লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে ভর্তি করা হয়। হোস্টেলে রাখা হয় ওকে। উর্মিদেবীর খুব ইচ্ছে হয় নাতনিকে দেখতে। এদিকে উর্মি মালার খুব ইচ্ছে বাবার একটি ছবি দেখার। উর্মিদেবী ওনার কলকাতার বাড়িতে ওদের ডেকে পাঠান। ওরা আসার আগে রুদ্রর বিবাহোত্তর সব ছবি উনি সরিয়ে দেন। ওর মা বলেন যে উনি ওর বাবার মা, ওর বড়মা, কিন্তু ওর বাবা মায়ের অমতে বাড়ির দাসীকে বিয়ে করেছিলেন বলে সম্পর্ক রাখতে চান না। আজ এত বছর পর শুধুমাত্র উর্মিমালাকে বাবার ছবি দেখানোর জন্য অনেক অনুনয় করে রাজি করানো হয়েছে। এটা শুনে উর্মিমালার খুব খারাপ লাগে ওর মায়ের জন্য। ও কথা দেয় একবার দেখেই চলে আসবে। আর কোনোদিন দেখতে চাইবে না। ওই ঠাকুমা যে ওর মাকে সম্মান দেয় না, তাকে ও কোনোদিন ভালোবাসবে না।
ট্যাক্সি ভাড়া করে ওকে নিয়ে যান ওই বাড়িতে ওর মা। সেই সময় উর্মিদেবী ছাড়া আর সবাই ওদের দেশের বাড়িতে। কাজেই কেউ কিছু বুঝতে পারে না। বেল বাজাতেই,দরজা খুলে দেয় উর্দিপড়া এক দারোয়ান। ওর মা নিজের পরিচয় দিতেই দারোয়ান বলে ওদের ওপরে যেতে। সেখানে কর্তা মা অপেক্ষা করছেন। দুরুদুরু বুকে ওর মায়ের পেছন পেছন ওপরে ওঠে উর্মিমালা। শিফন শাড়ি পরা, মুক্তর মালা পড়া অপুর্ব সুন্দরী এক মহিলাকে দেখে ও অভিভূত হয়ে পড়ে। উনি ওর ঠাকুমা? পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ওনাকে। চিবুকে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন উর্মিদেবী। একটি বাক্স তুলে দেন ওর হাতে। খুলে দেখতে বলেন। অপুর্ব সুন্দর একটি ব্রোচ আর একটি ব্রেসলেট ওর মধ্য। অবাক হয়ে দেখে উর্মিমালা, এর ম্যাচিং হারটি কিন্তু ওর কাছে আছে। উর্মিদেবী ওদের বসতে বলে ওদের জন্য অনেক রকম খাবার আনতে বলেন খানসামাকে। টুকটাক কথা বলেন ওদের সাথে। বেশিরভাগটাই উর্মিমালার সাথে। ও কি ভালোবাসে, কি করে, কি খেতে ভালো বাসে সব জানতে চান উনি। আর দুচোখ ভরে দেখেন ওনার নাতনিকে। এত অপুর্ব সুন্দরী সে। তারপর একটি গান গাইতে বলেন। একটি মীরার ভজন গেয়ে শোনায় উর্মিমালা। চোখ বন্ধ করে গান শোনেন উর্মিদেবী। অনেক কষ্ট করে চোখের জল আটকান উনি। কতক্ষণ আর ও ভাবে থাকতে পারবেন উনি সেটা নিজেই জানেন না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ওঠেন উনি। পাশের ঘর থেকে ফ্রেম করা রুদ্রর একটি ছবি এনে ওর হাতে দেন। বলেন যে উনিই ওর বাবা, রুদ্র চৌধুরী। বাবার ছবি হাতে ধরে উর্মিমালা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। অনুমতি চায় ওই ছবিটা বাড়ী নিয়ে যেতে। উনি মাথা নেড়ে সম্মতি দেন। তারপর উনি উঠে দাঁড়ান। বলেন ওদের এবার যাওয়ার সময় হয়েছে। আর যেন কক্ষনো না আসে ওনার কাছে। এই কথাটা বলতে সত্যি ওনার খুব কষ্ট হয় কিন্তু উনি ও তো নিরুপায়। মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে ওরা।
বাড়ী ফিরে এলেও মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জাগে উর্মিমালার। কে ওই ভদ্রমহিলা? ওর ঠাকুমা? দেখেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের বউ উনি। তার ছেলে ওর বাবা? চমৎকার দেখতে ওনাকেও। ওনার নাম রুদ্র চৌধুরী। উনি মাকে কি ভাবে চিনলেন, কি ভাবে ভালোবাসলেন? সত্যি কি মা ওদের দাসী ছিলেন? অনেক অনেক প্রশ্ন ওর মাথায় ভীড় করে আসে। আর ঠাকুমাকে দেখে মনে হচ্ছিল ওকে দেখে আপ্লুত, খুব খুশি। উপহার ও দিলেন ওকে। কিন্তু আর কোনোদিন যেতে কেন বারণ করলেন? মাকে কি উনি সত্যি অপছন্দ করেন? তাহলে ওনাদের মাঝে এত ভালো বোঝাপড়া কি ভাবে। চোখের ইশারা আর তাকানো তে যেন কথা বলছিলেন ওনারা। মায়ের সাথে বাবার বিয়ের ছবি নেই কেনো? ঊর্মিমালার মনে হচ্ছিল ও পাগল হয়ে যাবে। ওকে যে এই জবাবগুলো পেতেই হবে।
অনেক কষ্টে ঘুমোতে গেলো ও। সকল বেলায় মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতেই ওর সব প্রশ্নগুলিও জেগে উঠলো। ও উঠে গিয়েই মাকে জড়িয়ে ধরল। বললো ও আজ মায়ের সাথে সাথে সারাদিন কাটাবে। আর ওর বাবার গল্প শুনবে। ওর মা হেসে ওকে কাটাতে চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু উর্মি মালা তো ছাড়ার পাত্রী না। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়েই ও মার পেছনে পড়ে গেলো। বাবার গল্প শুনবে বলে খুব আবদার করতে লাগলো। নিরুপায় হয়ে ওর মা কথা দিলেন যে সব কাজ শেষ করে ওকে ওর বাবার গল্প বলবেন।
এদিকে যেমন উর্মিমালা স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে, কুমার ওর স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষার জন্যে তৈরী হচ্ছে। ওর দাদু ইন্দ্রদেব বাবু ওখানে চলে গেছেন। কুমারকে হোস্টেল থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাড়িতে আনা হয়েছে। কয়েকজন গৃহ শিক্ষক রাখা হয়েছে ওকে সাহায্য করার জন্য। ওকে যে পুরো গোয়ালিয়রের মধ্য শ্রেষ্ঠ ফল আনতে হবে। ছোট থেকেই শ্রেষ্ঠ হতে হবে শুনে শুনে কুমার কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলে মানুষ মন, মাঝে মাঝে হাপিয়ে
ওঠে। ও ভালো গান গাইতে পারে, দারুণ এসরাজ বাজাতে পারে, খেলাধুলোতে ও সমান পারদর্শী। তবে ওর সব চেয়ে পছন্দ ছবি আঁকা। মন যখন খুব ক্লান্ত হয়ে ও তখন বাগানে বসে ছবি আঁকে।
এই একটি বছর প্রচন্ড পরিশ্রম করে পরীক্ষা দিল কুমার। এবার রেজাল্ট বেরোতে বেরোতে নানা রকমের পরীক্ষা দিতে লাগলো ও। দাদুর ইচ্ছে ও ডাক্তার হোক, বাবার ইচ্ছে ও ওনার মত ইঞ্জিনিয়ার হোক, মায়ের ইচ্ছে প্রথম দুটো না হলে ও উকিল হোক। আর কুমারের ইচ্ছে? ও পড়াতে ভালবাসে, শিক্ষক হতে চায়। কিন্তু ওর এই ইচ্ছের প্রাধান্য সব চেয়ে নীচে। তাই সব ভুলে নানা রকম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে হলো কুমারকে। সব পরীক্ষা শেষ করে গোয়ালিয়র ছাড়ল ও। দাদুও সাথে ফিরলেন।
কুমার নিজের দেশের বাড়িতে ফিরে এলো। কিন্তু চারিদিকে তখন আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো ওর। গ্রীষ্ম কাল, পাহাড়ে যেতে চাইলো কুমার, নিরিবিলিতে ছবি আঁকবে ও। বাবা, মা, দাদু আর ঠাকুমা, সবাই মিলে চললো দার্জিলিং। হঠাৎ করে ঠিক হওয়াতে আর ফুল সিজনের সময় বলে, ওদের পছন্দমত হোটেল পেতে অসুবিধে হচ্ছিল। ওদের একটি পুরনো বাড়ী ছিলো ওখানে, যায় একাংশে মালতী থাকত উর্মিমালাকে নিয়ে ওর ছুটির দিনে। সেই বাড়ী খোলা হলো। কয়েকদিন সেখানে কাটিয়ে প্রাণ ভরে ছবি এঁকে ফিরে এলো ওরা। কুমারের সব কিছুই দারুণ। ইন্দ্রদেব নাতির আঁকার হাত দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ওর সব ছবি নিয়ে বিড়লা গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। অনেক প্রচার, প্রচুর বড় বড় বোদ্ধাদের নিমন্ত্রণ করলেন। সবাই ওই টুকু ছেলের প্রতিভা দেখে বাহ বাহ করে উঠল। কাগজে, টিভি তে সব জায়গায় ওই প্রদর্শনীর উল্লেখ হলো।
উর্মিমালা ও সেই সব দেখল। খুব ভালো লাগলো যখন শুনল একটি বাচ্চা ছেলে এত অপুর্ব আঁকে। উর্মিমালা নিজেও সুন্দর আঁকতে পারত। ওর যদিও সবচেয়ে প্রিয় ছিল গান। ও ছেলেটি সম্বন্ধে জানতে চাইলো। জানা গেলো ছেলেটির বাবার নাম ও রুদ্রদেব চৌধুরী। আর মায়ের নাম সুদীপা দেবী। অবাক লাগলো ওর। ছেলেটির, ওর বাবা মায়ের চেহারা বেশ মেলে ওর সাথে। খুব কৌতুহল হলো ওর । ও ঠিক করলো যে ও ওই প্রদর্শনী দেখতে যাবে।
নির্দিষ্ট দিনে উর্মিমালা ওখানে পৌঁছল। অনেক ছবি সাজানো। ওই ছেলেটির একক প্রদর্শনী। সত্যিই ছবিগুলো খুব সুন্দর। ওই টুকু ছেলের এত অপুর্ব ছবি আঁকা ওর সৃজনশীল মনের পরিচয়। কোনো বড়োলোকের খেয়ালের ছবি নয়, প্রকৃতির জয়গানের পরিচয়। এক মনে ছবিগুলো দেখছিল ও। উর্মিদেবী সম্পূর্ন না জেনে ওই সময় এই নিজের দাদুভাইকে নিয়ে ঢুকলেন প্রদর্শনীতে। চারদিকে চোখ বোলাতেই উনি উর্মিমালাকে দেখতে পেলেন। তাড়াতাড়ি একটু জরুরী কাজের নাম করে কুমারকে রেখে, পাশের একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসলেন, যেখান থেকে উনি ওদের দেখতে পাবেন কিন্তু ওনাকে দেখা যাবে না। ওনাকে দেখে ফেললে খুব মুশকিল হবে। তাই একটু আড়াল করেই বসলেন উর্মিদেবী। কুমার প্রদর্শনীতে একা। ওর সাথে যদি উর্মিমালার আলাপ হয়ে যায়। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন উর্মিদেবী। হঠাৎ করে মনকে সামলাতে না পেরে তখন দেখা না করলেই হত। এত ঝামেলা হত না। এসব ভাবতে ভাবতেই উনি একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন উর্মিমালা এগিয়ে যাচ্ছে কুমারের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কুমারকে ফোনে করলেন উনি। এদিকে কুমারের ফোন আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল উর্মিমালা। সেই সুযোগে কুমারকে বাইরে ডাকলেন উর্মিদেবী। খুব তাড়াতাড়ি ওদের গাড়িতে উঠতে বললেন। নিজেও ক্ষিপ্র গতিতে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গাড়ি নিয়ে চললো অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। নাতিকে বললেন ওর আঁকা এত সুন্দর তাই উনি আরেকটি প্রদর্শনী দেখতে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। খুব খুশি হলো কুমার। এদিকে একটুর জন্য কুমারকে না পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো উর্মিমালার। ও খুব ভালো করে বাকি ছবি গুলো দেখতে লাগল। সেখানেও চমক। শেষের দিকের কয়েকটি ছবি তে মনে হলো, পাহাড় ছাড়াও দার্জিলিং এর ওদের বাড়িটার অংশ বিশেষ, ওই রাস্তাটা, পাশের বারান্দা। কি ভাবে এই রহস্য ভেদ করবে ও। কুমার কি ভাবে ওদের বাড়ি চিনবে। অস্থির হয়ে উঠলো উর্মি মালা।
বাড়ী ফিরেই মার কাছে গেলো উর্মিমালা। বললো একটি ছোট ছেলের যে আঁকা ছবির একক প্রদর্শনী চলছে বিড়লা একাডেমীতে, ও সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারার আগেই একটি ফোন এসে গেলো আর ছেলেটি বেড়িয়ে চলে গেল। ওর মা পুরোটাই শুনল কিন্তু কোনো ভাব প্রকাশ করল না। জিজ্ঞেস করল ছবিগুলো কেমন। খুব সুন্দর আঁকে ছেলেটি, আর ছেলেটিকে বেশ ওর মতই দেখতে, আর ওর বাবার নাম রুদ্রদেব চৌধুরী। পুরোটাই ও নেট থেকে পেয়েছে। উর্মিমালাকে ওর মা বল্লেন যে পৃথিবীতে কি সব রুদ্র চৌধুরীর নামই রুদ্রদেব চৌধুরী, আর তাছাড়া একজনই কি আছেন? আর ছেলেটি ও ওর বয়সের কাছাকাছি তো, তাই দেখতে এক রকম লাগছিল। কোনো রকমে কাটিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন মালতী। পেছন পেছন গেলো উর্মি মালা। আজ তাকে সব বলতেই হবে। অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারছিলেন না মালতী। বাধ্য হয়ে অভিনয় করলেন উনি। বললেন যে এই কথাগুলো ওনাকে এত কষ্ট দেয় যে আর যেন কক্ষ ণো এসব প্রশ্ন না তোলে ও। এই বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন উনি।
স্তম্ভিত হয়ে পড়ে উর্মিমালা। ও যে ওর মাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু ওকে যে সব জানতেই হবে। ও পরের দিন ঠাকুমার কাছে যাবে ঠিক করে। মাকে কিছু না জানিয়ে।
পরের দিন কলেজের পর অনেক কষ্ট করে ট্যাক্সি নিয়ে ওই বাড়িতে পৌঁছয় উর্মিমালা। কাছাকাছি গিয়ে পুলিশকে জিজ্ঞেস করে ঠিক বাড়িতে পৌঁছোয় ও। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই দারোয়ান ছুটে আসে বোধহয় চিনতে পারে ওকে। হেসে ওকে ওপরে যেতে বলে। ও আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে থাকে রেলিং ধরে। ওদিকে বেলের আওয়াজ পেয়ে উর্মিদেবী সিঁড়ির কাছে আসছিলেন দেখতে। উর্মি মালাকে দেখে ওনার মাথা ঘুরে গেল। বাড়িতে তখন ওনার কর্তা, ছেলে, বৌমা ও নাতি। ইন্দ্রদেববাবু যদি জানতে পারেন, হয়ত প্রাণেই মেরে ফেলবে মেয়েটাকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে নামতে লাগলেন উনি। ওনাকে নামতে দেখে উর্মিমালা দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে এসে, চাপা স্বরে, কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে খুব অপমান করলেন ওকে। উর্মিমালা জীবনেও এরকম অপমানিত হয়নি। ও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেলো বাড়ী থেকে। উর্মিদেবী সিঁড়িতে বসে পড়লেন। খুব খুব খারাপ লাগছিল একটি ফুলের মত মেয়েকে এরকম বাজেভাবে অপমান করতে। কিন্তু উনি তো ওর প্রাণ বাঁচাতেই এটা করলেন। ফোন করলেন উনি মালতীকে। বললেন যতদিন না উনি আরেকবার, ওদের ডাকেন, ততদিন যেন যেভাবে হোক ওকে চুপচাপ শান্ত করে রাখা হয়। কাঁদতে কাঁদতে উর্মিমালা বাড়ি ফেরে। মালতী ওকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। উর্মিমালা মিথ্যে বলতে পারে না, ও সব বলে দেয়। মালতী ওকে মাথার দিব্যি দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। ওর কাছ থেকে কথা নেয় যে যদি কোনোদিন উর্মিদেবী ডাকেন, তবেই যেন ও ওই বাড়িতে যায়। নয়ত ওর মা প্রাণ দিয়ে দেবেন। উর্মিমালা কিছু বুঝতে পারে না কিন্তু ভয়ে চুপ করে যায়।
এই ভাবে পাঁচ বছর কেটে যায়। উর্মিমালার বিয়ের বয়স হচ্ছে। মালতী ওর জন্য সম্বন্ধ দেখতে চায় আর উর্মিমালামা কে ছেড়ে যেতে চায় না। ও নেট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদিকে কুমার ডাক্তারি পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। এই সময় হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্দ্রদেব চৌধুরীর মৃত্যু হয়। শোকের ছায়া সারা এলাকায়। গরীব দুঃখীদের ডেকে খাওয়ান হচ্ছে। নানা রকম ভজন কীর্তন হচ্ছে। উর্মিদেবীর একটাই চিন্তা কি ভাবে উর্মিমালাকে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করবেন। উনি মালতীকে খবর পাঠালেন উর্মিমালা কে নিয়ে আসতে, ভজন গাইতে, কিন্তু উনি কিছু না বলা অব্দি কিছু না বলতে।
উর্মিমালা আর মালতী আসে। ওদের নিজেদের ছোট কুঠিতে ওঠে। তারপর গানের সময় মত ওরা বড় কুঠিতে পৌঁছয়। যথা সময়ে উর্মিমালার গানের সময় হয়। চোখ বন্ধ করে প্রাণ ঢেলে তিনটি গান করে ও। বড়মা ওদের ডেকে পাঠান। সেখানে ওনার পাশে রুদ্রদেব, সুদীপা দেবী আর কুমার দেব। উর্মিমালাকে দেখে চমকে উঠলেন ওনারা, ও যে একদম কুমারের মতই দেখতে। উর্মিমালা ও চোখ ফেরাতে পারছিল না ওনাদের থেকে। উর্মিদেবী ওনাদের ভেতরে যেতে বললেন। সবাই ভেতরে গেলেন। উর্মিদেবী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন
- "এ হচ্ছে উর্মিমালা, রুদ্রর প্রথম সন্তান। হ্যাঁ হাসপাতালে যাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। কর্তামশাই চাননি প্রথম সন্তান কন্যা হোক, তাই এই ব্যবস্থা। আমি সেই কন্যাকে মালতীর কাছে দিয়ে দেই, আর আমার নাম দেই। মালতীকে ছোট বেলায় রুদ্র হয়ত দেখেছিস, আর কেউ ওকে চিনত না। এত বছর খুব যত্ন করে ওকে বড় করেছে মালতী। আমরা দুজন ছাড়া এ ব্যাপারে কেউ জানেনা। সময় এসেছে উর্মিমালাকে ওর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করার। আমার আদেশ, রুদ্র তুই সব ঠিক করবি। আগে বংশের যা নিয়ম ছিলো, এখন থেকে ছেলে আর মেয়ে সবাই সম্পত্তি তে একরকম ভাগ পাবে। আর কালকে প্রেস কনফারন্সে ডাকো, আমি যা বলার বলে দেব।"
ঘটনার আকস্মিতায় সবাই বিহ্বল পড়লো। সবার আগে কুমার উঠে উর্মির সামনে এলো "দিদি" বলে জড়িয়ে ধরলো ওকে। চোখের জলে, খুশিতে, সবাই মিলে উর্মিমালাকে জড়িয়ে ধরলেন।
পরের দিন রুদ্রদেব প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন। উর্মিদেবী সবাইকে উর্মিমালার সাথে পরিচয় করালেন। বললেন ও ছোটবেলায় হাসপাতাল থেকে চুরি হয়ে গেছিলো। ওনারা যাতে দুঃখ না পান তাই কর্তাবাবু মৃত শিশুর কথা বলেন সবাইকে। এদিকে মালতী, ওদের পুরনো পরিচারিকা ওকে দার্জিলিং এ এক অন্য মহিলার কাছে দেখে চিনতে পারে আর ওকে যত্ন করে নিজের মেয়ের মতো পালতে থাকে। ও বড় হলে ওকে কলকাতায় নিয়ে এসে উর্মিদেবীর সাথে যোগাযোগ করে। কর্তা বাবুর বয়সের কথা ভেবে উনি চুপ ছিলেন। তারপর আজ শুভ দিন দেখে ওকে নিয়ে এসেছেন।
প্রজারা হৈ হৈ করে উঠলো। সবাই খুব খুশি সুদীপাদেবী তো মেয়েকে ছাড়তেই পারছিলেন না।কুমার গিয়ে মালতীকে ও ওখানে থেকে যেতে অনুরোধ করল। রুদ্রদেব ও অনুরোধ করলেন।বললেন যে নিজে বিয়ে না করে, সংসার না করে, সারাটা জীবন ওনার মেয়ের জন্য দিল, তার কাছে ওনারা সবাই কৃতজ্ঞ, ঋণী।
সব ভাল যার শেষ ভাল। সবাই মিলে মিশে আনন্দ করে থাকতে লাগলো।
ঢাকি
সেখ মেহেবুব রহমান
মেমারী, পূর্ব বর্ধমান
গল্প
এক সপ্তাহর দীর্ঘ পরিকল্পনার পর আমরা হরিণঘাটার উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। আমরা বলতে, বন্ধু অতিন সঙ্গে আমি। হরিণঘাটায় অতিনের দিদির বাড়ি। এই ভরপুর বর্ষায় কোনো আত্মীয়ের বাড়ি যেতে ভালো লাগে না। কিন্তু বন্ধুর জন্য এটুকু তো করায় যায়। ঠিক করেছিলাম জুলাইয়ের থার্ড ইউক করে যাব। কিন্তু আমার নিজের কিছু ব্যক্তিগত কারণের জন্য হয়ে ওঠেনি। তাই কাজের প্রেসার কমতেই বেড়িয়ে পড়লাম।
অতিন পেশায় ম্যকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম তিন বছর গুয়াহাটিতে পোস্টিং ছিল। লক ডাউনের সময় বাড়ি ফিরে আসে। প্রথম এক মাস ঘর থেকে কাজ করে। পরে অফিসে বলে-কয়ে কলকাতার ট্র্যান্সফার নিয়েছে। একজন কর্মচারীর পক্ষে এই পরিস্থিতিতে ট্র্যান্সফার নেওয়া কঠিন। কিন্তু কাজের প্রতি ওর ডেডেকাশন দেখে কোম্পানি এই সিদ্ধান্তে বাঁধা দেয়নি।
অতিনের এহেন সিদ্ধান্তের পিছনে অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। ছোটো থেকেই ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথেষ্ট পারদর্শী। গান-বাজনা নিয়ে এগোনোর সখও ছিল ভীষণ। ইচ্ছে ছিল গানের একটা একাডেমী খোলার। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মালে যা হয়। ক্লাস টুইলেভর পর তবলা, হারমোনিয়াম ছেড়ে বাধ্য হয় মোটা মোটা সব মেশিনের বইয়ের পাতায় চোখ রাখতে।
মন দিয়ে পড়াশুনা করে, মোটা বেতনের চাকরি পেয়ে গুয়াহাটি চলে গেলও হৃদয় হতে গানের সুর গুলো কখনো হারিয়ে যায়নি। বরং দেখা হলে চাকরী জীবনের কথা কম, গানের কথায় বেশি বলে থাকে। অ্যাকাডেমি তৈরি করার ইচ্ছাটা আজাও ওর মনে এতটা প্রবল দেখে, অবাক হই। গুয়াহাটি থেকে নিজের ভাবনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই এই বঙ্গে প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী ছিল। সোশ্যাল ডিস্টেন্স শিকেয় উঠল।
একমনে মানুষজনের কথা শুনছি। এই অতিমারী জীবনযাত্রা কিরূপ পাল্টে দিয়েছে-- অচেনা মানুষগুলোর কথায় যেন পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেল। কাজ হারানোর গল্প, খেতা না পাওয়ার যন্ত্রণা। বাধ্য হয়ে নিজের পছন্দের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় আসা। বৃহৎ বিশ্বের এরূপ চিত্র বড়োই করুণাদায়ক।
বৃষ্টিতে ভিজে প্রচন্ড শীত অনুভব হচ্ছে। চায়ের কাপে চুমক না দিলে এই আড়ষ্টতা কাটার নয়। দেরি না করে দুটো চা অর্ডার করলাম। নিজের কাপে চুমক দিয়ে বন্ধুকে অফার করলাম। দেখি, ও আনমনা হয়ে কিসব ভাবছে। এখানে এত জনসমাগম ওর মনে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
বললাম, “কিরে, এত আকাশ পাতাল কি ভাবছিস? নে ধর”।
ও কাপটি নিল, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। আমি ওর সামনে গিয়ে বললাম,
“লোকগুলোর কথা শুনেছিস? সব অন্যরকম হয়ে গেছে, তাই না...”
অতিন দু’বার ‘হুম-হুম’ শব্দ বের করে মাথা নাড়ল। বুঝলাম আমার কথায় ওর কোন উৎসাহ নেই। এখনও সেই অ্যাকাডেমিতেই পরে আছে। এক নিঃশ্বাসে চায়ের কাপ খালি করে দিয়ে বললাম, “অ্যাকাডেমী নিয়ে ভাবছিস, তাই না?”
অতিন গভীর উদ্বেগের সাথে বলল, “হ্যাঁ’রে ভাই। শেষ অবধি সব ঠিকঠাক হবে তো!”
“কেন হবে না। মন থেকে করছিস, কোনো অনর্থ হতেই পারে না”।
“মন কেন যে মানছে না”।
“অত-শত ভাবিস নাতো। দিদির বাড়ি যাচ্ছিস, এরকম বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে থাকলে হবে না এখন”।
অতিন জোরপূর্বক হাসল। তবে কোনো প্রত্যুত্তর দিল না। আমিও বেশি কিছু বললাম না। বরং শরীরকে চার্যড আপ করে নিয়ে বাইরের মুষলধারে বৃষ্টির সৌন্দর্যতা উপভোগ করতে শুরু করলাম। এর মাঝে অতিনের হাব-ভাবের দিকে তেমন আর নজর দিলাম না। মিনিট কুড়ি পর বৃষ্টি কিছুটা কমল। দাঁড়িয়ে থাকা দু’তিন জন বেড়িয়ে যেতে, আমরাও বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
নতুন বিপদ আসতে দেরি হল না। কয়েকশো মিটার এগোতেই বাইকটি এক অদ্ভুত শব্দ করে থেমে গেল। আত্মীয় বাড়ি যাবে না বলে হয়তো এই সশব্দ প্রতিবাদ। এটা অবশ্য আমাদের কাছে অস্বস্তির কারণ। অতিন মুখ থেকে ‘ধুর ধুর’ শব্দ বের করে বাইক থেকে নামল। সাথে আমিও। তারপর নিচু হয়ে বসে কিসব পর্যবেক্ষণ শুরু করল। মিনিট পাঁচ নাড়াচাড়ার পর স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করতে, বিফল হল। সাথে সাথে গাড়িটির ওপর চাপর মেরে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাল।
আমি তেমন গাড়ি চালাতে জানিনা না। কিন্তু বন্ধুর এইরূপ হতাশা দেখে নিজের অপারদর্শী হাত দিয়ে নিরর্থক চেষ্টা চালালাম। কোনো লাভ হল না, হবারও ছিল না।
এই রুট আমাদের দুজনেরই পরিচিত। কাছেপিঠে কোনো গ্যারাজ নেই, তা আমাদের মোটামুটি জানা। অবশ্য সামনের ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পেরিয়ে একটা ছোটো-খাটো বাইক সারানোর দোকান আছে। ওটার উপস্থিতি প্রথমে আমরা দুজনেই ভুলে গেছিলাম। অতিন ওর দিদিকে ফোন করে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দেওয়ায়ের সময় খেয়াল হল। অন্য উপায় না দেখে গাড়ি নিয়ে আমরা সেই পথেই হাঁটা দিলাম।
বারবার বিপত্তিতে আমি সত্যিই বিরক্ত। কিন্তু অতিনকে আমার থেকেও অধিক হতাশাপূর্ণ মনে হল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এরপরেও সব স্বাভাবিক হবে বলে মনে হয়! মনে হচ্ছে গাড়িটিকে ফেলে রেখে বাড়ি পালায়। ভাল লাগে না আর”।
নিজের বিরক্তি কোনোরকমে চেপে রেখে বললাম, “এত দ্রুত যদি ধৈর্য হারালে কিছুই হবে না”।
“সাড়ে আটটা কভার হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে। দোকান খুলে থাকবে বলে মনে হয়?”
“কেন থাকবে না? এটা ব্যস্ততম রাস্তা”।
“ভরসা পাচ্ছি না। শেষ অবধি রাস্তায় না রাত কাটাতে হয়!”
“এই সিচুয়েশেনে এরকম নেগেটিভ কথা কেন বলছিস”।
অতিন উত্তর দিল না। বাইক জোড়ে ঠেলতে লাগল। বুঝলাম আমার কথায় একটু রাগ হল। কিন্তু এটা যে রাগারাগির সময় নয় তা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। অতিনেরও আছে। তবে মাঝে মাঝে ও এরকম করে। এটা ওর স্বভাব। আমিও দ্রুত পা চালিয়ে ওর সাথ ধরলাম। তারপর পকেট থেকে দুটি সিগারেট বেড় করে, নিজে একটি নিয়ে অন্যটি ওকে অফার করলাম। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর জেনেও আমি নিরুপায়। গাড়ি ব্রিজের ওঠার মুখে দাঁড় করিয়ে ধূমপান ক্রিয়া সম্পন্ন করলাম। তারপর পুনরায় হাঁটার জন্য প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি এমন সময় নদীতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ আমাদের কানে এল। কেউ ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল না তো! এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে শব্দের গতিপথ অনুসরণ করে ব্রিজের এক ধারে গেলাম। নদী গভীরতা অনেক বেশি। মোবাইলের ফ্ল্যাশে নিচে ঠিক কি পরেছে অনুমান করতে পারলাম না। অতিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও কিছু বুঝতে পারছে কিনা। কিন্তু ব্রিজ তলদেশের কোনো কিছু অনুমান করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। পরমুহূর্তেই মালবাহী গাড়ির বিকট হর্ন কানে আসতেই, পিছন ফিরে দেখি, আমাদের অদূরে বছর ত্রিশের এক ভদ্রমহিলা সুসাইডের জন্য ব্রিজের রেলিংগুলোর উপর উঠে পড়েছেন। দুজনেই সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের ডাকাডাকিতে উনি যদি দ্রুত নদীতে ঝাঁপ দিয়ে দেন, তাই অতিনকে বললাম ধীরে ধীরে ওনার কাছে যেতে। সামান্য আওয়াজে বিপদ ত্বরান্বিত হতে পারে। অতিন বুদ্ধি করে কোনো শব্দ ছাড়াই ঠিক ওনার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। অতিন ওর পজিশন নিয়ে নিতেই আমি কিছুটা তফাতে দাড়িয়ে অত্যন্ত সাবধানী গলায় বললাম, “এরকম ভুল করবেন না। প্লিজ আমার কথাটা একবার শুনুন। প্লীজ প্লীজ”। উনি কোনোরকম কর্ণপাত করলেন না। বরং কিছু একটা বিড়বিড় করে নদীগর্ভের দিকে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্য আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন। আর বিলম্ব করা উচিত হবে না। আমি অতিনের দিকে তাকালাম, ও প্রস্তুত। চোখের ইশারায় আমার থেকে শেষ সম্মতি চাইল। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। অতিন মুহূর্তে ওনার ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে জাপটে ধরে রাস্তায় আছড়ে পড়ল। আমি দৌরে গেলাম। উনি এখনও ঝাঁপ দেওয়ার জন্য ছটফট করছেন। এইভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রবৃত্তি দুজনে আগে কখনো দেখিনি। অতিন ওনাকে ধরে রইল। আমি ওনার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে নিরন্তর বুঝিয়ে চললাম। যদিও উনি শুনতে ইচ্ছুক নন। দিক-ফাটা চিৎকার করে আমাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। অতিনের সফল প্রয়াস যদিও ওনার মৃত্যু ক্ষুধাকে বাস্তবায়নের রূপ দিল না।মোবাইলের আলোয় ওনার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ দেখে ব্যথার আন্দাজ করতে পারলাম। মাথার চুল এলোমেলো। না খাওয়া, না নাওয়া শরীররে কষ্ট আমার চোখে এড়িয়ে গেল না। মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। অবশেষে কিছুটা শান্ত হলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে বাইক থেকে জলের বোতল নিয়ে এলাম। এমনিতে জলের বোতল সঙ্গে নিই না। আজ সৌভাগ্যক্রমে নিয়েছিলাম, তবে এভাবে কাজে আসবে কল্পনাও করিনি। যাই হোক ওনার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে সামান্য জল খেতে বললাম। উনি তৃষ্ণার্ত ছিলেন। এক নিঃশ্বাসে বেশ কিছুটা জল খাওয়ার পর দেখলাম একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। দ্রুতগামী গাড়িগুলো কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই সশব্দে ছুটে চলেছে। সামান্য অসাবধানতা বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।ব্রিজ থেকে নামলাম। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই সেই বাইক সারানোর দোকান চোখে এল। বাইক সারাতে দিয়ে দোকানের বাইরে এসে বসলাম।
বৃষ্টিতে ওনার চুল ভিজে গিয়েছিল। অতিন ওনাকে ওর রুমালে মাথা মুছতে বলল। উনি অবশ্য রাজি হলেন না। যদিও আমদের বকাবকিতে রুমাল দিয়ে নিজের মাথা যতটা সম্ভব মোছার চেষ্টা করলেন। এতক্ষণ অবধি ওনাকে শান্ত করতেই ব্যস্ত ছিলাম। কেন এই পথ বেছে নিচ্ছিলেন কিংবা সশব্দে জলে পরা বস্তুটিই বা কি-- আমরা জানতে চায় নি। তবে এবার মনে হল ওনার থেকে সেকথা জানার সময় এসেছে। শুরুটা অতিন করল। ধীর গলায় বলল,
“বলছি, আপনার নামটা জানতে পারি?” উনি উত্তর দিলেন না। অতিন আবার বলল,
“আপনার বাড়ি কোথায়? প্লীজ বলুন। তাছাড়া এই বয়েসে এরকম স্টেপ কেন নিচ্ছিলেন?”
ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। জীর্ণ মুখে অবিরাম অশ্রুরাশি মনকে বড়োই ব্যথা দিল। বললাম, “এইভাবে কাঁদলে কোনো প্রবলেমের সমাধান কিন্তু হবে না। আমাদের বলুন। আমরা হ্লেপ করব”।
অতিনও বলল, “হ্যাঁ, নিঃসংকোচে বলুন। আমাদের ভাইয়ের মতো ভাবুন, প্লীজ”।
আমি পুনরায় বললাম, “আপনার বাড়ি কোথায়? বাড়ির লোকজনকে একবার জানানো দরকার। ফোন নম্বর মনে আছে?” শুনেই কান্না থামালেন। আঁচল দিয়ে দুচোখ মুছে বললেন,
“আমার বাড়ি ফেরার ইচ্ছা নেই। কীভাবে মেয়ে দুটোর সামনে যাবো! আমি বাঁচতে চাই না”।
আমি বললাম, “মানে? এসব কি ফালতু বকছেন? ঘরে সন্তান ফেলে রেখে নিজেকে শেষ করতে এসেছেন!”
উনি বললেন, “অসহায় আমি। হাতে কোন কাজ নেই। ওদের খাওয়াতে-পড়াতে পারছি না। বেঁচে থেকে কি করব?” অতিন বলল,
“আপনার স্বামী, সে কোথায়? তার তো আপনাদের দেখা উচিত”।স্বামীর কথা উঠতেই ওনার চোখ-মুখে রাগ পরিস্ফুটিত হল। যদিও নিশ্চুপ রইলেন। হয়তো
ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত, সেজন্য বলতে ইচ্ছুক নন। আমি জোর করলাম না। অতিন বলল,
“বেশ, এসব অপ্রীতিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাই না। কিন্তু এটুকু বলুন, এখন আপনি আমদের থেকে কি সাহায্য চাইছেন? অন্তত একথা খোলা মনে প্রকাশ করুন”।
আমিও প্রায় একই কথা বললাম।
উনি ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, “আমই কিছু কাজ জোগাড় করে দিতে পারবেন? মেয়ে দুটো’কে দু’দিন সেরকম কিছু খাওয়াতে পারিনি”।
অতিন বলল, “ওরা এখন কোথায়? আপনার স্বামীর কাছে?” কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বললেন,
“চার পাঁচ কিমি দূরেই আমার বাপের বাড়ি। ওরা ওখানেই আছে। পর পর দুটো মেয়ে হওয়ায় জানোয়ারটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। দুই মেয়েকে নিয়ে লাস্ট আট বছর একাই সংসার টানছি। আর পারছি না”।
অতিন ওনাকে থামিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলল, “আপনি একা এতগুলো বছর! কল্পনা করা যায় না। আপনার মতো কঠিন মানুষ এইভাবে কখন মরতে পারে না দিদি। দয়া করে আর এই বোকামি করবেন না”।
উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। বুঝলাম, ওনার এই দুরবস্থার কথা শুনে আগেও অনেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় কেউই পাশে থাকেনি। এখন হয়তো ভাবছেন আমরাও সেই অপদার্থ মানুষগুলোর মতোই মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছি। ভরসা দিয়ে বললাম,
“আমরা শুকনো সান্ত্বনা দিচ্ছি না। আপনার মতো মানুষকে সাহায্য করতে পারা আমাদের সৌভাগ্য”।
উনি বললেন, “জানি আপনারা মিথ্যা ভরসা দিচ্ছেন না। কিন্তু সত্যি বলতে, মন আর কাউকেই বিশ্বাস করতে চাইছে না”।
অতিন বলল, “আপনার অসহায়তা বুঝতে পারছি। আচ্ছা, আপনি কি কাজ করতেন এতদিন?”
উনি বললেন, “আমি ঢাকি। তাছাড়া হরিনাম, পুষ্পমালা, মনসাযাত্রা এইসব করে যা পয়সা পাই তাতেই দিন চলে যেত। কিন্তু এখন আর চলছে না। এই করোনাকালে মানুষ এসব আর দেখতে চাইছে না”।
অতিন ওনাকে আবার থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, “ঢাকি! আপনি ঢাক বাজান। এ’তো বিশাল গুণ”।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারাও যে একাজে নিজেদের মেলে ধরেছে উনি তার আদর্শ উদাহরণ। দূর্গাপুজোর মতো উৎসবে ঢাক বাজিয়ে ওনারাও আজ এই ঐতিহ্যের শরিক হচ্ছেন। এই মহিলা ঢাকির ভাবনা প্রথম আসে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ঢাকি গোকুল চন্দ্র দাসের মাথায়। বেশ কিছু বছর আগে আমেরিকার লস এঞ্জেলসে পারফর্ম করতে গিয়ে এক বাদ্যযন্ত্রর দোকানে দেখেন এক অল্প বয়সী মেয়ে দোকানের সমস্ত বাদ্যযন্ত্র খদ্দেরদের বাজিয়ে শোনাচ্ছে। ঘটনাটি ওনার মনে গভীর রেখাপাত করে। দেশে ফিরে স্থির করেন গান-বাজনার সাথে মহিলাদেরও ঢাক বাজানোর পেশাতেও নিযুক্ত করবেন। মহিলা ঢাকির ভাবনা সেই শুরু। অতিন এই ব্যপারে কিছুই জানে না দেখে অবাক হলাম। যদিও নিজের এহেন ইতিহাস চেতনা প্রকাশের সঠিক সময় নয় সেকথা বুঝে, শুধু বললাম,
“অতিন তুই হয়তো শুনিসনি, কলকাতার সাইডে এখন মহিলা ঢাকিরাও ঢাক বাজান। মহিলা ঢাকিদের নিয়ে টিভি সিরিয়াল হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এনিয়ে আলোচনা হয়”।
অতিন আমার কথা শুনে মাথা নাড়লেও বুঝলাম তখনও অবাক হয়েই আছে। আমি ওকে এই ব্যপারে বিস্তারিত কিছু বললাম না। তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি সত্যিই একজন অসাধারণ মানুষ। এতগুণ রয়েছে আপনার মধ্যে। সত্যি বলতে, মহিলা ঢাকির কথা শুনলেও, সামনা-সামনি কখনো দেখা হয়নি। আজ সেই সৌভাগ্য হল”।
উনি কথাটা শুনলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দিলেন না। আসলে এই কঠিন পরিস্থিতিতে অহেতুক প্রশংসা কেউ শুনতে চায় না। তাছাড়া যে মেধার জন্য এই স্তুতি তারই তো কেউ কদর করছে না।
আমি ওনার উত্তরের অপেক্ষা না করে বললাম, “এরকম পেশায় থেকেও আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন!”
গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঢাক বাজিয়ে পেট ভরে? পুজোর সময় ঢাক বাজাতাম। বাকি সময় হরিনাম, মনসাযাত্রা করতাম। কিন্তু এবারে এখনও অবধি ঢাক বাজানোর বায়না আসেনি। এই পরিস্থিতিতে হরিনাম, সংর্কীতনও বন্ধ। তিন চার মাস বিনা উপার্জনে ঘরে বসে আছি। যেটুকু জমানো অর্থ ছিল সব শেষ। দু’বেলা খাওয়ার জোগাড় করতে পারছি না। বাঁচার ইচ্ছাটাই মরে গেছে এখন। ঢাকটা নদীতে ফেলে দিয়েছি। আপনারা না আসলে হয়তো শরীরটাও এখন নদীর গতিপথ অনুসরণ করে অজানা পথে ভেসে যেত”।
অতিন বলল, “নদীতে তাহলে ঢাক পরার শব্দই শুনেছিলাম। দেখুন, ওই আপনাকে নতুন জীবন দিল। ঢাকের শব্দ কানে আসাতে আমরা সেদিকে এগিয়ে গেছিলাম। বাকিটা বুঝতে পারছেন”।
মুখে শব্দ না করে মাথা নেড়ে অতিনের যুক্তিকে সমর্থন দিলাম। উনি নিরুত্তর রইলেন।
ওনার সম্বলহীন জীবনযাত্রার কথা মনে গভীরভাবে বিঁধল। এই দীর্ঘ স্তব্ধ জীবনে আমাদের মানসিক ক্ষতি হলেও, আর্থিক ক্ষতি তেমন হয়নি। খেয়ে পরে দিব্যি বেঁচে আছি। কিন্তু এই দুর্গম পরিস্থিতিতে সবার জীবন আমাদের মতো মসৃণভাবে এগোচ্ছে না। ওনার মতো কত মানুষ যে এভাবে এক বেলা খেয়ে, কখনো না খেয়ে বেঁচে আছেন, জানি না। সংখ্যাটা অগুনতি। অনেকে হয়তো এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ইতিমধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সব যেন এলোমেলো হয়ে গেলো কয়েক মাসে। এসব নিয়ে গভীরে চিন্তা করতে শিউড়ে উঠলাম।
মন বড়োই অস্থির হয়ে উঠেছে। ওনার পাশে দাঁড়াতে না পারলে নিজেদের স্বাছন্দ্যে বাঁচার কোনো মানেই হয় না। কিছু একটা করার ইচ্ছায় মন আরও বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠল। যদিও এক্ষেত্রে অতিন আমার থেকে একধাপ এগিয়ে ভেবেছে। ওনার দিকে তাকিয়ে প্রত্যয় নিয়ে বলল, “আপনি হরিনাম সংকীর্তন করেন। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শিখবেন? আমি কয়েক মাসের মধ্যেই গানের অ্যাকাডেমি খুলছি। আমি নিজেও একজন সঙ্গীতশিল্পী”।
ওর প্রস্তাবে আমি বেশ আনন্দিত হলাম। মহিলার জন্য এর থেকে ভালো কিছু হতেই পারে না।
উনি থতমত খেয়ে গেলেন। বুঝতে পারলাম এর উত্তর ওনার কাছে এই মুহূর্তে নেই। লজ্জিতভাবে মাথা নামিয়ে মুখে কিছু একটা শব্দ করল। ঠিক বোঝা গেল না। অতিন বলল,
“জানি হরিনাম সংকীর্তনকে মূলধারার সঙ্গীতের বাইরে রাখি আমরা। কিন্তু ভেবে দেখুন, কথা আর সুরের মিলন তো সব জায়গাতেই হয়। আপনি নিজের দক্ষতায় স্থির থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখে নিলে আরও বৃহত্তর সুযোগ পাবেন”।
উনি বললেন, “এই বয়সে এসে! আমি পারব না”।
আমি বললাম, “বয়স কোন কিছুতেই বাঁধা নয়”।
অতিন বলল, “দেখুন এর জন্য আমি কোনো পারিশ্রমিক নেব না। তাছাড়া, বলছি তো ক্লাসিক্যাল শেখার সাথে আপনি নিজের দখলদারি জায়গাতেও চর্চা চালিয়ে যাবেন। আমরা আপনার বায়না এনে দেব। আপনি আরও ভালো জায়গায় নিজের প্রতিভার প্রকাশের সুযোগ পাবেন। যথেষ্ট পারিশ্রমিকও পাবেন”।
ওনার মনে লোভ নেই। আমরা লোভ দেখাচ্ছিও না। তাও এইরকম প্রস্তাব শুনে উনি শান্ত রইলেন। মনের মধ্যে উদ্দীপনার আভাস অবধি দেখতে পেলাম না। মাথা নামিয়ে ধীর গলায় বললেন,
“আমি এত কিছু এখন থেকে ভাবতে পারছি না। মেয়ে দুটো খেতে পেলেই হবে। আর কিছু চাই না”।
আমি বললাম, “আমরা আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি দিদি। আপনাকে আরও ভালোভাবে বাঁচার খোঁজ দিচ্ছি”।
উনি বললেন, “আমার বাবা এই পেশায় ছিলেন। ওনার থেকেই ছোটোবেলায় শিখে ছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি আমায় বিয়ের পর এই গানের ওপর ভিত্তি করে বাঁচতে হবে। সবই আমার ভাগ্য। না দুর্ভাগ্য”।
আমি বললাম, “এভাবে কেন বলছেন। সব কিছু ভালোর জন্যই হয়”।
উনি আমার কথা খণ্ডন করলেন। আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
“আমায় দেখার পরেও আপনাদের এইরকম ধারণা আসে! আমার সাথে আজ অবধি কিছুই ভালো হয়নি। পড়তে চেয়েছিলাম। পড়াশুনাতে ভালোও ছিলাম। অভাবের জ্বালায় বাবা আঠেরোর আগেই বিয়ে দিল। বাবার ওপর রাগ হয়েছিল। পরে ওনার অবস্থা বুঝতে পেরে সম্মতি দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পরও পড়াশুনা চালিয়ে যাব। কিছুই হল না”।
ওনার গলার স্বর ভারী হয়ে এল। বুঝলাম, ওনার মনের যে ব্যথা আমরা প্রত্যক্ষ করছি উনি তার থেকেও ঢ়ের বেশি যন্ত্রণায় জর্জরিত। তবে পড়াশুনার প্রতি ওনার আলাদা টান কথাবার্তাতে স্পষ্ট অনুভব করতে পেরেছি। এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলে ওনাকে যন্ত্রণা দেওয়া অনুচিত হবে। কিন্তু মনের কৌতূহল দূর করতে বললাম,
“আপনি ঢাক বাজানো কোথায় শিখলেন। বাবার থেকেই?”
উনি বললেন, “না। ওটা পরে শিখেছি। জানোয়ারটা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে অনেক কষ্টে হরিনাম করেন এমন কয়েকজন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসি। ওনাদের মধ্যে একজন আমায় ঢাক বাজানোর শিক্ষা দিয়েছিলেন। ওনাদের অবস্থাও আমার মতোই করুণ। কাজ না থাকলে কিছুই টেকে না”।
সত্যি উনি ঠিকই বলেছেন। কর্ম সকলকে একত্রিত করে। নতুন ভাবনার বিকাশ ঘটায়। সভ্যতার অগ্রগতি আমাদের পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়েই হয়ে থাকে। কিন্তু সেই কর্মের অবর্তমানে কঠোর পরিশ্রমী মানুষও দিশেহারা হতে বাধ্য। আমি বা আমার বন্ধু দিশেহারা ছিলাম না। অতিনের কর্ম এই অতিমারীতেও ওর হয়েই কথা বলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকের দিনে সেই সংখ্যা নগণ্য। কর্মহীনতা আজ অধিকাংশেরই গলা টিপে শ্বাসরোধ করছে। মর্মস্পর্শী এই কথোপকথনের মধ্যেই আমাদের বাইক সারানো সম্পন্ন হয়েছে। অতিন মেকানিককে পারিশ্রমিক দিয়ে, বাইক নিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। আমি কিছু বলার আগেই অতিন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“গাড়িতে চাপুন। আজ রাতে আপনাদের বাড়ি যাব। কাল সকাল দিদির বাড়ি”।
উনি অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। আমিও ঠিক এরকমই কিছু একটা ভাবছিলাম। দ্রুত অতিনের কথায় সায় দিলাম। ওনার মন আমাদের সাহায্যের প্রত্যাশী। কিন্তু এখনও বাহ্যিক জড়তা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। আমি ওনাকে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। অতিন স্টার্ট দিল।
পরিস্থিতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। যাত্রা শুরু করেছিলাম এক উদ্দেশ্যে। মাঝে গাড়ি খারাপে বিরক্ত হয়েছিলাম। বারংবার বৃষ্টিতে মন বিষণ্ণ হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই টিপটিপ বৃষ্টি, ঠাণ্ডা হাওয়াই যেন মনকে সব থেকে বেশী তৃপ্তি দিচ্ছে। গভীর অন্ধকারেও আলোর দিশা দেখতে পাচ্ছি। তিনজনে সে পথেই এগিয়ে চলেছি।।
ভ্রমণ
হ্যাভ্লকে
দিনকয়েক
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
হ্যাভ্লক দ্বীপ হল ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের এক “সিক্রেট গার্ডেন”। আন্দামান সফরে গিয়ে এই দ্বীপ না দেখলে কিন্তু ভারত মহাসাগরের সৌন্দর্য এবং সবুজ দ্বীপের শ্যামলিমা অজানাই থেকে যাবে। লোকে আন্দামানে এসে পোর্ট ব্লেয়ার দেখে, সেলুলার জেল দেখে। পোর্ট ব্লেয়ার প্রায় একটা বড় শহরের মত। অবশ্যই সুন্দর শহর, রাস্তা ঘাট ঢেউ খেলানো, মাঝে মাঝে বাড়ির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়বে ভারত মহাসাগরের ঝলক। কিন্তু তাও, পোর্ট ব্লেয়ারের গায়ে নগরজীবনের গন্ধ বড় বেশি। শুধু সেখানে ঘুরেই চলে গেলে কিন্তু এই স্বর্গদ্বীপের মায়াজগত চোখের অন্তরালে থেকে যাবে। এই লেখকের মত যারা বেড়াতে গিয়ে কংক্রিটের জঙ্গলের গোলকধাঁধা থেকে কিছুদিনের মুক্তি চান, তারা অবশ্যই হ্যাভ্লকের অভিজ্ঞতা মিস করবেন না।
আন্দামানে যে দ্বীপগুলো আছে, তার মধ্যে সত্যিকারের স্বর্গরাজ্য হল হ্যাভ্লক। ৯২ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে রয়েছে অপার্থিব সৌন্দর্য সমন্বিত বেশ কয়েকটি সৈকত। এই দ্বীপের বৈশিষ্ট্য হল, সৈকতের ঠিক পাশেই রয়েছে ঘন অরণ্য। সেই অরণ্যে যেমন রয়েছে প্রচুর ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ, তেমন সৈকত থেকে কয়েক পা দূরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে মহীরুহ-সমন্বিত আদিম রেইন ফরেস্ট। ফলে, জঙ্গলের বুকে ট্রেকিং এবং সমুদ্রসৈকতের নীলিমা, এই দুই প্রকৃতির উপহার একসাথে উপভোগ করার দুর্লভ সুযোগ রয়েছে এখানে।
এই দ্বীপের অধিবাসীদের এক বড় অংশ বাঙালি, যারা দেশভাগের পর এখানে স্থিতু হয়েছিলেন। ফলে এখানে ঘুরতে এসে ভাষা সমস্যা হবে না। এই দ্বীপে আসার একমাত্র উপায় পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ফেরি সার্ভিস। এছাড়া হেলিকপ্টার আছে বটে, কিন্তু সেটা খুব সুলভ নয়। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ফেরি সার্ভিস বেশ ভালো এবং চলছে সারা দিন ধরেই। সরকারি এবং বেসরকারি----দুরকম পরিষেবাই রয়েছে। এই আলেখ্যর লেখক নিজে বেসরকারি সার্ভিস ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই সার্ভিসের মান নিয়ে উনি খুবই সন্তুষ্ট। শুধু ভালো পরিষেবা যে আছে তাই নয়, বেসরকারি ফেরিতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ অবধি রয়েছে। এই বেসরকারি ফেরি সার্ভিস অনলাইনে বুক করা যেতে পারে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগে হ্যাভ্লকে যেতে। কিন্তু ফেরার সময়ে টাইম লাগবে আরও বেশি কারণ ফেরার পথে জাহাজকে ঢেউএর উল্টো দিকে আসতে হবে। এই লেখক যাত্রার সময়ে বহু সহযাত্রীকে সী-সিকনেস এ আক্রান্ত হতে দেখেছেন। সুতরাং আপনারা পাঠকরা যারা এই পথে যাবেন, তারা আগে থেকে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সী সিকনেস এর ওষুধ নিয়ে যাবেন।
যদি ফেরার সময়ে বিকেল চারটের ফেরি ধরেন, তাহলে ফেরার পথেই মাঝসমুদ্রে সূর্যাস্তের কমলা-লাল-হলুদ রঙের হোলিখেলা দেখতে পাবেন। মনে হবে রেম্ব্রা-র ছবি দেখছেন। তবে ফেরার কথা এখন থাক।
হ্যাভ্লক দ্বীপে নামলেই দেখতে পাবেন রাস্তার দুধারে সুপুরি আর নারকেল গাছের সারি (চিত্র ১)। আর তার মাঝে মাঝে হোটেল, রিসোর্ট আর এমনি গ্রামের পাকা বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে শুকোতে দেওয়া আছে সুপারি আর নারকেল। সৈকত রাস্তা থেকে একদমই দূরে নয়। ফলে যেতে যেতেই আপনি গাছের ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখতে পাবেন। উজ্জ্বল সবুজ বৃক্ষশোভা, আর তার মাঝে মাঝে সাগরের নীলিমা। আপনি শিল্পী না হলেও এই দৃশ্য দেখে আপনার মনে সৌন্দর্যের আকুতি জাগতে বাধ্য।
হ্যাভ্লকের হোটেলগুলির মান বেশ ভালো। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এত দূরে একটা ছোট্ট দ্বীপ, কিন্তু দেখবেন হোটেলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ফ্রিজ, টিভি, এসি--- সব আছে। খাবারের বৈচিত্র্য অবশ্য খুব বেশি নেই। কিন্তু মোটামুটি আপনার রসনাকে তৃপ্ত করার অনেক কিছুই এখানে রয়েছে। বেশ কিছু হোটেলের রেস্তোরাঁ সৈকতের সামনে। ফলে খেতে বসে বেশ কিছুক্ষণ সমুদ্রের ঢেউ এবং ভেসে চলা রঙিন নৌকার দৃশ্য উপভোগ করতেই পারেন। তবে হোটেলে থাকতে বা শুধু রসনাপরিতৃপ্ত করতে তো আর আপনি হ্যাভ্লকে আসেন নি। আপনি এসেছেন এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তাহলে এবার আসুন সেই বর্ণনায় আসা যাক।
হ্যাভ্লক দ্বীপে তিনটি মূল সৈকত রয়েছে: রাধানগর, এলিফ্যান্ট এবং কালাপাথর। এছাড়া রয়েছে বিজয়নগর সৈকত। রাধানগর সৈকত ভারতের গর্ব। এটি এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বালুকাবেলার সম্মান পেয়েছে। যতদূর চোখ যায়, সাদা বালি, আর তার পরেই সবুজ বনানী (চিত্র ২)। সেই বনের মধ্যে ট্রেকিং করা যায়। বিশাল বিশাল শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া সব গাছের গুঁড়ি চারিদিকে, সেই গাছের অগ্রভাগ যে কোথায়, সেটা মাথা তুলেও দেখতে পাবেন না (চিত্র ৩)। সেই গুঁড়ি থেকে যে শিকড় বেরিয়েছে, সেটা এতটাই চওড়া যে দশ- বারোজন অনায়াসে তার ওপর একসাথে বসতে পারে। মাঝে মাঝে বহুপ্রাচীন শিকড় রাশি জট পাকিয়ে কুণ্ডলীবন্ধ অবস্থায় যেন একটা ঘুমন্ত অজগরের মত ঝরা পাতার ফাঁকে শুয়ে রয়েছে। অনেক বৃক্ষের কাণ্ডের মধ্যে রয়েছে গভীর কোটর। মাথার ওপর ঘন সবুজ পাতার চাঁদোয়া। তার থেকেই ঝুলছে বনলতা। সকাল এগারোটার সময়ে সেই জঙ্গলের মধ্যে শুনতে পাবেন তীক্ষ্ণ ঝিঁঝিঁর ডাক; এদিক ওদিক উড়তে দেখবেন চামচিকে বা বাদুর। তার মানে বুঝতেই পারছেন কতটা ঘন জঙ্গল। তবে এইসব জঙ্গলে হিংস্র পশু কিছুই নেই। সুতরাং পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তেই কিছুটা ঘুরতে পারেন। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝেই পথ বেরিয়ে মিশে গেছে নির্জন সৈকতে। সুতরাং গভীর জঙ্গল থেকে এক লহমায় আপনি নেমে আসবেন দুধসাদা বালির গালিচায়। কোথাও কোথাও জঙ্গলের মধ্যে কাঠের বেঞ্চ পাতা রয়েছে। যারা বার্ড ফটোগ্রাফি করেন, এইসব জঙ্গলে তারা অনেক নতুন পাখির সন্ধান পেতে পারেন।
এই নির্জন সৈকতে দেখতে পাবেন বালির মধ্যে কাঁকড়ার ছোটাছুটি, আর ছড়িয়ে থাকা অজস্র ঝিনুক। সেইসব ঝিনুকের প্রাকৃতিক রঙ দেখে আপনি মোহিত হয়ে যাবেন এবং কয়েকটি পকেটে করে নিয়ে আসতে মন চাইবেই। তবে আন্দামানে কিছু কিছু প্রজাতির ঝিনুক রয়েছে, যেগুলি বন্যপ্রাণী রক্ষা আইনে সুরক্ষিত। এইসব ঝিনুক নিয়ে ফেরার সময়ে যদি পোর্ট ব্লেয়ার বিমানবন্দরে
ধরা পড়েন, তাহলে কিন্তু প্রচুর জরিমানা হতে পারে। তার থেকে বালির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এইসব ঝিনুকের ছবি ক্যামেরায় নিয়েই ফিরে আসুন। একটু লক্ষ্য করলে বালির মধ্যে অনেক কড়ি দেখতে পাবেন।
সৈকতের একদিকে সমুদ্রের জল একটি খাঁড়ি দিয়ে ঢুকে ছোট্ট একটা জলাশয় সৃষ্টি করেছে, যেন বহুকালের ইতিহাসের সাক্ষী এক সরোবর। মূল সৈকতের বাঁ দিকে, এই ছোট্ট গাছের ছায়ায় ঘেরা সরোবরের পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকতেই পারেন (চিত্র ৪)। এই সরোবরের পাশে যে বন, সেখানে কিছু জংলি মহুয়ার গাছ রয়েছে। আবার মূল সৈকতের ডান দিকে, একদম শেষে রয়েছে শেওলা ঢাকা কালো পাথর; এবং সেই পাথরের ফাঁকে কয়েকটি ম্যানগ্রোভ গাছ।
এই সৈকত দ্বীপের পশ্চিম দিকে অবস্থিত বলে এখানে সূর্যাস্ত দেখার আশায় অনেকেই শেষ বিকেল অবধি দাঁড়িয়ে থাকেন।
এরপর আসা যাক দ্বিতীয় বিখ্যাত সৈকতভূমির কথায়ঃ এলিফ্যান্ট বিচ। এই সৈকতে যাওয়ার জন্য হ্যাভ্লক জেটি থেকে স্পীড বোট ছাড়ছে। এই হ্যাভ্লক জেটিতে যেমন এলিফ্যান্ট যাওয়ার নৌকা বুক করা যায়, তেমন সেই বীচের বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টস এর টিকিটও এখানেই পাওয়া যায়। ফলে আপনি এখানেই নৌকার সাথে সাথে বিভিন্ন রাইডের টিকিট কিনে নিতে পারেন। এরপর এলিফ্যান্ট বীচে গিয়ে সেই টিকিট দেখালেই হবে। এইখানে আর দুটি কথা বলার আছে। প্রথমত, অনেক ওয়েবসাইটে দেখবেন বলা আছে যে রাধানগর সৈকত থেকে এলিফ্যান্ট সৈকত অবধি ট্রেক করে যাওয়া যায়। এটা নৌকা করে যাওয়ার দরকার নেই। এই কথা তাত্ত্বিকভাবে ঠিক কিন্তু সেই ট্রেক ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এবং সেই জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী না থাকলেও সাপ কিন্তু আছে। ফলে ফ্যামিলি নিয়ে এরকম ট্রেক করা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে যদি ইচ্ছে হয়, তাহলে সঙ্গে গাইড নিয়ে এই পথে যেতেই পারেন। মনে রাখবেন যে এই হ্যাভ্লকের জঙ্গল কিন্তু হিমালয়ের অ্যালপাইন ফরেস্ট নয়। এটা রেইন ফরেস্ট। এখানে সাপ, বিভিন্ন পোকামাকড় ইত্যাদি কিন্তু অনেক বেশি। এই লেখক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়ে বেশ কয়েকবার পোকার কামড় খেয়েছিলেন। দ্বিতীয় যে কথা বলে রাখা দরকার, সেটা হল এই হ্যাভ্লক জেটিতে ওয়াটার স্পোর্টস এর টিকিট না কাটলেও পরে বিচে গিয়েও সেই টিকিট একই দামে কিনতে পারবেন। ফলে যাত্রার শুরুতেই তাড়াহুড়ো করে, না ভেবে, সব টিকিট কিনতেই হবে, সেরকম বাধ্যতা নেই। আগে সৈকতে যান; কোন রাইড আছে নিজের চোখে দেখুন; তারপর টিকিট কিনবেন।
এরপর সেই স্পীড বোটে করে আপনি গিয়ে নামলেন এলিফ্যান্ট সৈকতে। বোটে ওঠা এবং নামার সময়ে কিন্তু প্রায় হাঁটু জলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে উঠতে হবে। ফলে এই সৈকতে যাওয়ার দিন হয় খালি পায়ে যাবেন। নইলে চটি পরে। এলিফ্যান্ট বীচে গেলেই আপনাকে কিছু নিয়ম জানিয়ে দেওয়া হবে। যেমন বীচের চারপাশে খুব বেশি দূরে যাওয়া বারণ। এরপর ওখানে লকার ভাড়া নিয়ে (১০০/-) আপনার মোবাইল, চশমা এবং ওয়ালেট রেখে আপনি নেমে পড়ুন ওয়াটার স্পোর্টসের মজা নিতে (চিত্র ৫)। স্নরকেলিং করা এখানে একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এলিফ্যান্ট বীচের একটি সুবিধা হল এখানে সৈকতের খুব কাছে, খুব কম গভীরতায় কোরাল প্রাচীর রয়েছে। ফলে এখানে সামান্য চেষ্টাতেই সমুদ্রের তলার এই আশ্চর্য জগত আপনার চোখে ধরা দেবে। যদি ভাগ্য ভালো হয়, তাহলে সেই কোরাল বাগানের মধ্যে দেখতে পাবেন রঙ-বেরঙের মাছ। এই লেখক নিজে ইন্দো-প্যাসিফিক সার্জেন্ট মাছ দেখেছিলেন (চিত্র ৬)।
আরেকটু বেশি ভালো করে কোরাল দেখার ইচ্ছে আপনার হতেই পারে। তার দুটি উপায়: গ্লাস বটম নৌকায় সমুদ্রবিহার আর স্কুবা ডাইভিং। গ্লাস বটম নৌকায় আপনাকে বেশ গভীর সমুদ্রেই নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর হঠাৎ করেই জলের নীচে দেখতে পাবেন নানা রঙের কোরাল (চিত্র ৭)। ওপরের আকাশের নীলিমা, দূর দ্বীপের গাছের সারির দৃশ্য তো ছিলই; কিন্তু এটা দেখলে জানতে পারবেন যে সমুদ্রের জলের স্বল্প নীচেও রয়েছে অদেখা এক মায়াকানন।
এছাড়া এলিফ্যান্ট বীচে রয়েছে আরও অনেক বিনোদনের উপায়: প্যারাসেইলিং, সী হক সফর, স্কুবা ডাইভিং, সী ওয়াকিং ইত্যাদি। এই লেখক দেখেছেন যে তরুণ প্রজন্মের খুব পছন্দের বিনোদন হল জেট স্কি। সেটাও করতেই পারেন।
এলিফ্যান্ট সৈকতে একটা বড় সুবিধা হল এখানে জলের গভীরতা বেশ কম। ফলে আপনি নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটতেই পারেন।
হ্যাভ্লকের তৃতীয় সৈকত যেটি না দেখলে এই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সেটি হল কালাপাথর বিচ। এই নির্জন সৈকত অবস্থিত বেশ গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সেই জঙ্গলের মধ্যে পিচের রাস্তা। সৈকত পেরিয়ে এই রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটলে চোখে পড়বে জঙ্গল কেটে তৈরি বসতি (চিত্র ৮)। এই জঙ্গলে চোখে পড়বে নানা প্রজাপতি এবং অর্কিড। কিন্তু যখন জঙ্গলের শেষে মানুষের বসতির কাছে পৌঁছে যাবেন, তখন লক্ষ্য করবেন যে গাছপালার চরিত্র পাল্টে জবা, নয়নতারা, গাঁদা বা পেয়ারা গাছ চোখে পড়ছে। আবার সৈকতের কাছে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ বেশি। সৈকত ধরে যদি হাঁটেন, অনেক জায়গাতেই গাছের ডাল একদম বালুকাতট ছাড়িয়ে প্রায় সমুদ্রে নেমে এসেছে। অনেক সময়েই সমুদ্রের জল এতটাই উঠে আসে যে গাছের নীচে দাঁড়িয়েই আপনার কোমর অবধি ডুবে যেতে পারে। এইসব গাছের কিছু কিছু প্রজাতির ফল বেশ বিষাক্ত এবং গাছের গায়ে কাঁটাও থাকে। ফলে গাছের খুব বেশি কাছে যাবেন না। তবে একটি বিশেষ গাছের কথা বলব, যেটা দেখা উচিত। সেটা হল সমুদ্রজবার গাছ (চিত্র ৯)। হলুদ এবং লাল—এই দুই রঙের ফুল হয় এই গাছে।
এছাড়াও হ্যাভ্লকে রয়েছে আরও বেশ কিছু সুন্দর সৈকত। রাস্তা থেকে নেমে দু-পা ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেলেই খুলে যাবে অজানা সৌন্দর্যের দ্বার। সেখানেও বসে সময় কাটাতে পারেন। যারা চিত্রগ্রাহক, তাদের জন্য অনেক সাবজেক্ট অপেক্ষা করে রয়েছে এইসব নির্জন বালুকাবেলায় (চিত্র ১০)। তিন-চার দিন হ্যাভ্লকে কাটিয়ে আবার ফিরে চলুন পোর্ট ব্লেয়ারে।
শেষে কয়েকটি কথা:
১। হ্যাভ্লকের সৈকতে প্ল্যাস্টিক নিষিদ্ধ। সুতরাং প্লাস্টিকের বোতল, কাপ, প্যাকেট ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে গেলে কিন্তু আবার গুছিয়ে ফেরত নিয়ে আসবেন। বালির ওপর এইসব ফেলে এলে আপনার যে শুধু জরিমানা হবে, তাই নয়; বরং আপনার এই কাজের জন্য ভারতের এই সৈকত তার মর্যাদা হারাতে পারে।
২। এলিফ্যান্ট সৈকতের সামনে রয়েছে বেশ কিছু ফলের চাটের দোকান। সাঁতার কেটে বা স্কুবা করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে এই খাবার খেতেই পারেন।
৩। কালাপাথর বীচের পাশে বেশ কিছু দোকানে দেখবেন গামলায় করে জ্যান্ত কাঁকড়া রাখা রয়েছে। আপনি বললে ওরা সেই কাঁকড়া আপনার সামনেই রান্না করে দেবে।
ভ্রমণ
গাড়োয়ালের
পথে পথে
অনিরুদ্ধ দে
১-
একশো কুড়ি দিন আগে যখন পুজোয় বেড়ানোর টিকিট কাটতে যাবো এমন সময় কেরিয়ারে বিরাট বড়ো ঝটকা, ব্যাটা চাকরিটাই গেল চলে! কম্পানিটাই বন্ধ হয়ে গেল।
আচ্ছা গেলি তো গেলি, এই সময়েই গেলি! যখন নতুন চাকরি যোগাড় করে আবার বোরোনোর চেষ্টা শুরু করলাম, তখন সপ্তমীর আর তেইশ দিন বাকি! এই সময় কি আর ট্রেনের টিকিট পাবো ? কিন্তু যাবো কোথায়? সেটাও তো কিছু পড়াশুনা করে ঠিক করিনি! অগত্যা শরণাপন্ন হলাম গ্রুপের নামকরা ফটো এডিটর এবং সুপরিচিত ব্যক্তি রাজীব নন্দীর। কিন্তু ওনার গন্তব্য নাকি ঐ কেদার নাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী, ভুজবাসা, গোমুখ! এই তিপ্পান্ন বছর বয়সে হেঁটে অতোটা যাওয়ার ভয়ে পিলে যেন চমকে উঠলো! হাঁটু বিদ্রোহ করবে না তো? সুগার আর ব্লাডপ্রেসার সম্বলিত রুগী আমি যেতে পারব তো? কিন্তু যেতে তো হবেই, তাই মনকে তৈরি করতে লাগলাম। সব কিছু টেস্ট করিয়ে আমার স্বনাম ধন্য ডাক্তার অভয় দিয়ে বললেন, আমি যেতে পারি।
আমার সহধর্মিনীর আবার হাঁটার ব্যাপারে বড্ড এলার্জী। হাঁটার গল্প শুনে তৎক্ষণাৎ 'না' করে দিলো। অগত্যা আমি একাই যাওয়া সাব্যস্ত করলাম। আমার আঠেরো বছরের ছেলের পায়ে সদ্য অস্ত্রপ্রচার হলেও, ও যেতে চাইলো। কিন্তু আমি আর রিস্ক নিলাম না! অগত্যা একা আমি।
আমার করুণ পরিণতি দেখে, বন্ধু পত্নী ও আমাদের গ্রুপেরই সদস্যা সুস্মিতা আমার জন্য পূর্বা এক্সপ্রেসেএ এ সি ত্রি টায়ার এর একটা টিকিট কেটে দিল। কিন্তু একি? তেইশ দিন আগে কাটা টিকিট তো ডব্লু এল ১১৭!!!! এ টিকিট কনফার্ম হবে কি করে? গ্রুপ সদস্য প্রদীপ ভট্টাচার্য একদা রেলে কর্মরত ছিলেন। কয়েক মাস হল অবসর নিয়েছেন। সব শুনে তিনি জানালেন.....
"দৈব অনুগ্রহ ছাড়া এ টিকিট কখনই কনফার্ম হবে না!"
অগত্যা আবার অপেক্ষায়! যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যাবেলাতেও গুগল দাদু জানালো, তখনো আমি অপেক্ষারত যাত্রী বাষট্টি। জিনিসপত্র গোছাবো কিনা তখনও ভেবে উঠতে পারছি না!
তবু সপ্তমীর ভোরে বেহালা থেকে চললাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে, পূর্বা এক্সপ্রেস ধরব বলে! কোন টিকিটই নেই আমার কাছে। কিন্তু অতো ভোরে সুস্মিতাদের ফোন করতে সঙ্কোচ বোধ করায়, ফোন ও করতে পারছি না। আরে ভাই, হাওড়ায় তো পৌঁছে ও গেলাম, কিন্তু টিকিটের কি হবে? ঠিক সময়ে আমার ফোনে এসে গেলো সুস্মিতার পাঠানো টিকিট। আরে, এ কি দেখছি!!! ভালো করে চোখ রগড়ে দেখি কোন এক দৈব বলে আমার টিকিট কনফার্ম!!! তখনকার অনুভূতি বলে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বুকে এলো বল!!! ধীর পায়ে এগিয়ে উঠে বসলাম পূর্বা এক্সপ্রেসের বি ওয়ান কোচের ছেচল্লিশ নম্বর বার্থে!
সবার প্রথমে ট্রেনে উঠেই ফাঁকা বার্থে আমার অনভ্যস্থ হাতে একখান ছেলফি তুলেই পোস্ট করে দিলাম ফেসবুকে! আমার আপার বার্থ। জানলার ধারে আমায় বসে থাকতে দেখে এক খাড়ুস বুড়ো দুর থেকেই তাঁর মেয়েকে নিয়ে এসে আমার দিকে তর্জনী তুলে বলছেন, "Hallow! That is our seat!" ব্যাটা বাঙালি! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পার হওয়ার আগেই ইংরেজী কপচাতে শুরু করেছে!
নির্দ্বিধায় আমার জায়গায় চলে গিয়ে তাঁদের জায়গা ছেড়ে দিলাম। ওনারা একশো দশ দিন আগে টিকিট কাটলেও, ওনার সহধর্মিনীর টিকিট আর এ সি ছিলো। রাতে তা কনফার্ম হতেই খাড়ুস বুড়োর সবিনয়ে অনুরোধ, বি ফাইব এর সাইড লোয়ার বার্থে আমায় যাওয়ার জন্য। ওনারা এক জায়গায় থাকতে পারেন তাহলে। আপার বার্থের ঐ মগডালে চড়া আমার ও পছন্দ ছিলো না, তাই সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম লাগেজটা ওখানে রেখেই। রাতের অর্ডার দেওয়া খাবারটা ওনারাই পৌঁছে দিলেন বি ফাইব এ।
আজ মহা সপ্তমী। ২০০৬ আর ২০১২র পর এই নিয়ে তৃতীয়বার মা দূর্গার উপর অনেক অভিমানে তাঁর মুখ না দেখেই চলেছি তাঁর ও উপরওয়ালা মহাদেবের কাছে! কিন্তু তিনি কি তা মানবেন? দুদিন আগে থেকেই কোলকাতায় জ্বলে উঠেছে আলোর রোশনাই। পথে ঘাটে তিল ধারণের জায়গা নাই। সব ছেড়ে একা চললাম মহাদেবের দর্শনে, আমার স্বপ্নের কেদারনাথে!!
কিন্তু পারব তো ঐ ষোল কিলোমিটার দুর্গম খাঁড়াই পথ পায়ে হেঁটে উঠতে? পারবো তো, গঙ্গোত্রী থেকে হেঁটে ভূজবাসা হয়ে আঠেরো কিমি গোমুখ পৌঁছতে? পারব তো গোমুখের ছবি তুলতে? সবই আজ প্রশ্ন! উত্তর তো দেবে সময়!
২-
পরদিন ৬ই অক্টোবর নির্ধারিত সময়ের দু'ঘন্টা পরে পূর্বা এক্সপ্রেস পৌঁছে গেল নিউদিল্লী। রাজীবদা রা আসছে রাজধানী এক্সপ্রেসে। এখনো দু'ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে আমায়। আর ও দু'জন নাকি আসছেন যুবা এক্সপ্রেসে। অনেকটা সময় বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া হয় নি, তাই লাগেজ নিয়েই বেরিয়ে গেলাম স্টেশনের বাইরে।
চা খেয়ে, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে স্টেশনে ঢুকতে যাবো, কিন্তু একি... আমার সাধের ট্রেকিং শু অনেক দিন পড়ে থেকে থেকে যে তার কোষ বিভাজন শুরু করে দিয়েছে!!! বডির সাথে সোল এর ডিভোর্স হতে চলেছে।
এবার ঐ বিটকেল ডিজাইনের 'রিবক' এর ত্রিস্তর সোল আমি পেস্টিং করি কি করে!! একেই তো দুরুদুরু বুকে যাচ্ছি, তার উপর পাহাড়ে উঠতে গিয়ে যদি খুলে যায়, তাহলে তো মহা কেলো! খালি পায়ে তো এক পা ও চলতে পারি না,পায়ের তলায় কর্ণ আছে বলে! জুতো থেকে চোখ তুলতেই দেখি, মুশকিল আসান এক চর্মকার বসে আছে। মারো গুলি পেস্টিং এ! অগত্যা একশো দিয়ে দুটো সোলই সেলাই করিয়ে নিয়ে, আবার ঢুকলাম দিল্লী স্টেশনে।
রাজধানী এক্সপ্রেস যথা সময়ে পৌঁছে গেছে। ষোল নং প্লাটফর্ম থেকে চলমান সিঁড়িতে উঠে যেতে হবে এবার ১নং প্লাটফর্মের ওয়েটিং রুমে। কিন্তু মালপত্র নিয়ে এসকেলেটরে ওঠার সময়, মাঝপথে আমাদের একজন পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থাকা আমাদের দলবল স্টপ বটম টিপে চলমান সিঁড়ি থামিয়ে দিলেও, ওটা আর চালু করা গেল না। অতঃপর সব লাগেজ নিয়ে হ্যাঁচকাতে হ্যাঁচকাতে আমরা চললাম ১নং প্লাটফর্মে।
যুবা এক্সপ্রেসের দুজন, আশিষদা আর পারিজাতও চলে এসেছে। কোনক্রমে স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই স্নানটা করে নিলাম, কি জানি কতোদিন যে স্নান হবে না!!! ওয়েটিং রুমের খাবারের বিটকেল দাম দেখে বাইরে থেকে লাঞ্চটা করে এসে, আমরা উনিশ জন চড়ে বসলাম আমাদের জন্য অপেক্ষারত একটা ছোট্ট সুন্দর এ সি লাক্সারী বাসে। প্রথম গন্তব্য হরিদ্বার, তখন প্রায় বেলা দু'টো।
দিল্লী থেকে হরিদ্বার ২১৯ কিমি। অক্ষরধাম মন্দির সহ শহর দেখতে দেখতে এবার ৩৩৪ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে ছুটে চলল বাস। ঝকঝকে রাস্তা। বিকেল পাঁচটা নাগাদ রাস্তার পাসের একটা ধাবায় চা পানের বিরতি দিয়ে আবার চলতে শুরু করল আমাদের গাড়ি। কিন্তু ইতিমধ্যেই আশিষদা আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে, তাঁর ইটালিয়ান জুতো "LOTTO" ও তাঁর উপর অভিমান করেছে। পড়ে থেকে থেকে শুধু কোষ বিভাজন নয়, দু পায়ের দুটো জুতোই মুখ 'হাঁ' করে ফেলেছে কুমিরের মতো। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ যখন হরিদ্বারে পৌঁছলাম, আশিষদা আতিপাতি করে খুঁজে কোথা থেকে যেন একদম ট্রেকিং শু এর মতোই দেখতে একখান জুতো মাত্র ৩০০ টাকায় কিনে ফেলেছেন। ইচ্ছা তার, মাত্র সাত দিন জীবিত থেকে যেন এই জুতো গোমুখ আর কেদারনাথ যাত্রাটা উতরে দেয়!
ইতিমধ্যেই বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আশিষদা আর পারিজাতের সঙ্গে। আমার পূর্ব পরিচিত রাজীবদা বলে দিলো, আমাদের চারমূর্তির জন্য সব জায়গাতেই ফোর বেডের একটা করে ঘর বুক করা আছে। তাই কোন জায়গায় অপেক্ষায় না থেকে আমরা যেন ফোর বেড রুমেই চলে যাই।
অগত্যা গঙ্গার প্রায় ধারেরই একটা হোটেলে উঠে, আমরা চারজন খেয়েদেয়ে একটু হুড়োহুড়ি করার পর সোজা ঘুম। পরের দিন সকালেই আমরা রওনা হবো উত্তরকাশী। হরিদ্বার থেকে ২৮৮ কিমি একটানা গঙ্গোত্রী না গিয়ে, ১৮৭ কিমি দুরের উত্তরকাশীতেই হবে রাত্রিযাপন।
৩-
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি, সূর্যিমামা একটুখানি মুখ দেখিয়েছে। হরিদ্বার একটু একটু করে জাগছে। জানলার নেটের ফাঁক দিয়ে মোবাইল ক্যামেরার লেন্সটা ঠিকঠাক সেট করে তার ছবি তুলে আমার এবারের ট্যুরের প্রথম ছবি পোস্ট করলাম গ্রুপে। আজ মহানবমীর দিনে উৎসবের মরসুম পন্ড করে কোলকাতায় বৃষ্টি হচ্ছে, জনগণ নাকাল। আর আমার মহাশত্রুরা চাইছে, এখানেও যেন আমি বৃষ্টি পাই। সব্বোনাশ! সব যে মেঘে ঢেকে গেল! ঐ একটুখানি উঁকি দিয়েই সূর্যিমামা চলে গেল মেঘের অন্তরালে।
মনে মনে ভাবলাম, গেল! ক্যামেরায় কেরামতি তো আমি কিছু করতে পারি না। আমার তুরুপের তাস একমাত্র চকচকে আবহাওয়া। ওটাই যদি বিগড়ে গেল, তো আমার ছবি তোলাও বিগড়ে যাবে। প্রকৃতি বোধহয় শুনলো আমার কথা। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সকাল দশটা নাগাদ মেঘ সরে গিয়ে উঠলো ঝকঝকে রোদ্দুর!
ঘুম থেকে উঠেই দেখি, আশিষদা ঘরে নেই। আগেই বেরিয়ে গেছেন হোটেলের ঠিক সামনেই "হর কি পৌড়ী" ঘাটে। আমি আর পারিজাত ও একটু বেরিয়ে, হর কি পৌড়ী ঘাট থেকে ঘুরে এলাম। রাজীবদার নাক তখনো আষাঢ়ের মেঘের গর্জনের মতোই ডাকছে।
ঠান্ডা খুব একটা নেই, ভালো করে স্নান করে রেডি হয়ে নিলাম। রাজীবদা ততক্ষণে হোটেলের কিচেন থেকে দেরাদুন চালের ভাত আর মুগের ডাল বানিয়ে এনেছে। কাঁচা লঙ্কা আর কোলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া ইস্কনের ঘি দিয়ে গরম গরম সেটা পেটে সাঁটিয়ে রিক্সায় চেপে চললাম জাতীয় সড়কের উদ্দেশ্যে সকাল এগারোটা নাগাদ। ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আজকের বাহন।
এই বাসটা আগের দিনের মতো অতো সুন্দর না হলেও, খারাপ নয়। এই বাহনই পুরো ট্যুরে আমাদের সঙ্গে থাকবে। ছিপছিপে চেহারার ড্রাইভার ভীম সিং এবার আমাদের নিয়ে চলল উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে।
হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ মাত্র ২২ কিমি হলেও রাস্তা সারাই আর ফ্লাই ওভার তৈরীর জন্য জ্যামে প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে গেল হৃষীকেশ পৌঁছতে। সব যেন ধুলোয় ধুলাময়! এখনও ১৬৭ কিমি যেতে হবে, উত্তরকাশী পৌঁছাতে গেলে। হৃষীকেশ থেকেই পারমিট বানাতে হয় চার ধামের। কাউন্টারে লাইন দিয়ে ছবি তুলে, সবার ছবি সহ একটা করে কার্ড ধরিয়ে দিল ওরা আমাদের সবার হাতে। অদূরেই দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীগুলোর মাথায় মেঘের লুকোচুরি। ওদিকেই যাবো কিন্তু আমরা এখন।
কিছুক্ষণ চলার পরেই পাহাড়ের প্রকৃতি নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করল। নীলচে সবুজ রং এর গঙ্গা (ভাগীরথী) কখনো আমাদের ডাইনে, কখনো বাঁয়ে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। ঝকঝকে আকাশে রোদের আলোয় যেন সব মোহময়!
আমি আর পারিজাত ছিলাম বসে ড্রাইভারের পেছনের প্রথম সিটটাতেই। প্রকৃতির অমোঘ আকর্ষণ আর রং এর খেলা দেখে আর স্থির থাকতে পারলাম না। ঝুলি থেকে এবার এই প্রথম বেরিয়ে পড়ল আমার স্নাইপার। ১৮.২ মেগাপিক্সেলের ডিজিটাল ক্যামেরাটার জুম ক্ষমতা কিন্তু অনেক। পয়েন্ট এন্ড শুট বলে, আমি ওর নাম দিয়েছি স্নাইপার। এবার লাফিয়ে এক্কেবারে ভীম সিং এর পাশেই ইঞ্জিনের উপর বসে পড়লাম। সামনেই বাসের প্রশস্ত কাঁচ, দেখি কতোটা ধরতে পারে আমার স্নাইপার গাড়োয়াল রূপসীর এই রূপকে।
অত্যন্ত দক্ষ হাতে ভীম সিং পাহাড়ের বাঁক কাটিয়ে দ্রুত তার বাহনকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কোন সাপোর্ট না থাকায় প্রতি বাঁকেই একবার আমি ডানদিক, আর একবার বাঁ দিকে কাত হয়ে পড়ছি ক্যামেরা বাঁচিয়ে। আর দুচোখ ভরে দেখছি প্রকৃতির অপরূপ রূপ। গাড়ি যতো চড়াই এ উঠছে, ইঞ্জিন ততো গরম হচ্ছে। তার উপর বসে থেকে অনায়াসেই উপলব্ধি করছি সেটা! এক দু'বার পেছন ফিরে দেখলাম, অনেকেই নিন্দ্রামগ্ন! তার মধ্যে পারিজাত ও আছে! ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা আরামদায়ক সিটে বসে! কিন্তু, ইঞ্জিনের গরম খেয়ে আমি একেবারেই সজাগ। আমার তাড়ায় হুড়মুড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে সে আবার তার ডান দিকের জানলায় মনোনিবেশ করল।
এবার লাঞ্চ ব্রেক! সকালে পেট ভর্তি থাকায়, সবাই অল্প স্বল্প কিছু খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
কিছু পরেই, এবার দেখতে পেলাম প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যাচার। পুরো চারধাম জুড়েই চলছে পাহাড় কেটে দু'লেনের রাস্তা, চার লেন তৈরি করার কাজ। চারধামে এবার থেকে নাকি বড়ো ভলবো বাস চলবে। যতক্ষণ ঐ কুকর্মের উপর দিয়ে আমাদের ছোট্ট বাস চলেছে, ততক্ষণ ধুলোয় ধুলো চারিদিক!
পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই ঐ উন্নয়নের রাস্তা দিয়ে যেতে হচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল এমনটা না হলেই ভালো ছিল। জানিনা প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেবে কিনা কোনদিন। মানুষের অপকর্মের দাম সেদিন মানুষকেই দিতে হবে।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে, চারদিক তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার।পাহাড়ের পেছন থেকে উঁকি মারছে আসন্ন পূর্ণিমার চাঁদমামা। কিন্তু চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ি গেল থেমে! এবার আমি উঁকি মেরে দেখি সামনের রাস্তা বন্ধ ধস নেমে। দুদিকে গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এবার কি হবে?
কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে গেল বিরাট এক যন্ত্র দানব। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার প্রকান্ড লৌহ হস্ত দিয়ে সাফ করে ফেলল রাস্তা। আবার চলা শুরু। ঠান্ডার প্রকোপ এবার টের পাচ্ছি। রাত নটা নাগাদ পৌঁছলাম উত্তরকাশী। বাসে পেছনের ডিকি থেকে লাগেজ নামিয়ে আবার আমরা আমাদের চারমূর্তির নির্ধারিত ঘরে গিয়ে উঠলাম। এই হোটেলে খাবার পাওয়া যায় না। তাই ফ্রেস হয়ে এসে, কাছেই একটা খাওয়ার হোটেলে ডিনার করে এসে আমরা শুয়ে পড়লাম বিছানায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল রাজীব নন্দীর কামান দাগা। সারাদিন জার্নি শেষে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরাও সবাই ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। আগামী কাল সকালে রওনা হব গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে!অনেক বছর আগে, যেটা ছিলো গঙ্গার উৎপত্তি স্থল।
৪-
ভোরে উঠেই চলে গেলাম হোটেলের ছাদে। সূর্যিমামা তখনো উদিত হন নি। হোটেলের পাস দিয়েই বইছে গঙ্গা। ২০১৩ সালের আগে তার গতিপথ নাকি আরও অনেকটা দূরে ছিলো। জায়গাটা যেন একটা গামলার মতো। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা, আর গামলার নীচে গড়াগড়ি খাচ্ছি আমরা। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর, দিনমণির আগমনে প্রথমে পশ্চিম দিকের পাহাড় চূড়া আলোকিত হল। তারপর ভাস্কর ছড়িয়ে দিলো তার দীপ্ত রশ্মি চারিদিকের পাহাড়ের মাথায়। পড়াশুনা করে আসিনি, তাই কোন পাহাড়েরই নাম জানিনা। শুধু প্রতি পলে অপলক দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে আলোকিত হতে দেখলাম। দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমাদের বেরোতে হবে এবার গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে। গিজার অন ই ছিলো। ঝটপট স্নান সেরে রেডি হয়ে নিলাম গঙ্গোত্রী যাওয়ার জন্য।
রাজীবদা আগেই বেরিয়ে গেছে, আবার কি এক পারমিশন আর ব্রেকফাস্ট জোগাড় করতে। ভীম সিং ও রেডি তার গাড়ি নিয়ে। লাগেজ সব গাড়িতে উঠে গেছে। পাহাড়ের ঢালের রাস্তায় কয়েক পা নীচে নেমে একটু চা খেয়ে নিলাম। তারপর রাজীবদা আসার আগেই আমরা তিন মূর্তি একটু বেরিয়ে পড়লাম জায়গাটাকে ঘুরে দেখার জন্য! একটু উপরে উঠতেই নজরে এলো একটা ঝুলন্ত ব্রিজ। নিচে দিয়ে বইছে গঙ্গা! তার উপর উঠে কয়েকটা ছবি টবি তুলে ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। ইতিমধ্যেই খাবারের পুঁটুলি সহ রাজীব নন্দীও ফিরে এসেছেন, বাকি সবাই তৈরী। শুরু হলো এবার গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। আমরা 'হরসিল' দেখে, গঙ্গোত্রী যাবো।
আবার আমি চলে গেলাম ঐ ইঞ্জিনের উপরেই, আমার বিশ্বস্ত স্নাইপার হাতে! ঝকঝকে আবহাওয়ায় অপার সৌন্দর্যে চারদিক ভরপুর। আজ বিজয়া, কোলকাতায় বৃষ্টি হচ্ছে কিনা তখন ও খবর পাই নি। আমার শত্তুররা এখনো খোঁচা মারেনি আমায় ওখান থেকে! খুব খারাপ ও লাগছিলো আজ আমি টাকি নেই বলে। গত বছর বিজয়াতেই তো নৌকায় কতো আনন্দ করলাম। ভাবতে ভাবতেই এক জায়গায় এসে থেমে গেল গাড়ি।
'মানেরি ভালী ড্যাম' (Maneri bhali Dam), প্রচন্ড গতিতে একটা জায়গা দিয়ে জল বেরোচ্ছে। সেখানে সবাই ছবি তুলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, আবার চলা শুরু হলো। ঝলমলে প্রকৃতি যেন পাহাড়ের প্রতি বাঁকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আমাদের। এবার প্রাতরাশের সময়। একটা পাহাড়ী ছোট্ট গ্রাম 'মল্লা বাটোয়ারী'তে আলু পরোটা আর চা খেয়ে উঠে পড়লাম আবার গাড়িতে।
আসছে এবার 'হরসিল'! আপেলের আর এক স্বর্গ রাজ্য। হিমাচলের মতোই আপেল ফলে আছে পাহাড়ের আনাচে কানাচে আর মনুষ্য সৃষ্ট বাগানে। পাহাড় থেকে এবার অনেকটা নীচে নেমে চলেছে গাড়ি। উপর থেকেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের সঙ্গী সেই নীলচে সবুজ গঙ্গা যেন ভূপৃষ্ঠে আলপনা হয়ে বয়ে চলেছে। দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম হরসিল। এখানেই 'রাম তেরী গঙ্গা মইলি'র শুটিং করেছিলেন রাজ কাপুর। একটু হেঁটে নীচে গিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পের বিপরীতেই দেখা যাচ্ছে মন্দাকিনী ফলস্ ও। কিন্তু আমি একা নীচে নামতেই দু'জন সেনা আমায় দু দিক দিয়ে ঘিরে ফেলল। ক্যামেরার লেন্স তাদের ইচ্ছা ছাড়া যে কোন দিকে তাক করা যাবে না। তাদের গাড়ি, বা ক্যাম্পের কোন ছবি তোলা যাবে না। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপার। অগত্যা চলে এলাম আবার, আমাদের বাস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
পাইনের ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি। নীলচে সবুজ গঙ্গাও চলেছে আমাদের সাথে। এবার লাঞ্চ ব্রেকের জন্য দাঁড়ানো হলো 'ধারাসু' নামের একটা জায়গায়। খাবার কি আছে জানতে চাওয়ায়, ওরা বলল, "কেয়া খাইয়েগা? চিকেন অর মছলি?
কি কেলো!!! দেবভূমিতে চিকেন? এ ক'দিন আমাদের ভেতো বাঙালির পেটে ওসব পড়েনি। তাই যে যার মতো মাছ-ভাত আর চিকেন-ভাত অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম। আমরা হঠাৎ কুড়ি জন একসাথে এসে পড়ায়, বোধহয় অন্য খদ্দেরের খাবার কম পড়ার আশঙ্কায় মাছ আবার রান্না করছে। কিন্তু ফ্রীজ থেকে কাঁচা মাছ বার করেই দেখি ঝোলে দিয়ে দিলো। ঐ দেখে আমি আর মাছ না নিয়ে, চিকেন নিলাম। খারাপ নয় মোটেই ! ভাত তরকারি সহ চার পিস চিকেন মাত্র ১০০।পাসেই মিষ্টির দোকান ও আছে, বেশ বড়ো বড়ো মিষ্টি। টেস্ট করার জন্য আমি আশিষদা আর পারিজাত একটা করে চেখেও দেখলাম। তবে তার যা মান, এমন কিছু আহামরি নয়।
আর দেরী না করে, এবার সোজা গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। আবার সেই পাহাড়ের প্রতি বাঁকেই বিধাতার সাজিয়ে রাখা বিস্ময়কর এক এক দৃশ্য! অবশেষে বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা পৌঁছলাম গঙ্গোত্রী। গুগল দাদু তখনই দেখাচ্ছে, তাপমাত্রা ১১ সেন্টিগ্রেড। আমাদের হোটেলটা ছিলো গঙ্গোত্রী মন্দিরের সামনের গঙ্গার ঠিক উল্টো দিকেই প্রায়। অসাধারণ দৃশ্যপট, কিন্তু গঙ্গায় জল খুব কম। মন্দিরের দিক দিয়েই একটা ক্ষীণ ধারা বইছে মাত্র। রাতের তাপমাত্রা যে কি হবে, তখন ই বোঝা যাচ্ছে। গায়ে চাপিয়ে নিলাম জ্যাকেট সহ সব কিছু।
আজ রাতের মেনু খিচুড়ি, তবে 'রাজীবদা স্পেশাল'! তাৎক্ষনিক-ইন্সট্যান্ট খিচুড়ির প্যাকেট উনি কোলকাতা থেকেই বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। একটা হোটেলে তাকে শুধু গরম জলে ফুটিয়ে নেওয়া হলো। আর তৈরী হয়ে গেল অসাধারণ স্বাদ ও গন্ধের খিচুড়ি। তাতে পড়ল আবার ইস্কনের ঘি! ব্যাস, সেঁকা পাঁপড় সহযোগে চেটে পুটে খেয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি সব শীত বস্ত্রের অস্ত্র গায়ে পরে থাকা স্বত্বেও কাঁপুনি লাগছে। কোন ঝুঁকি না নিয়ে জ্যাকেট, জিনস্ সব পরেই ঢুকে গেলাম ডবল লেপের তলায়।
গত ডিসেম্বরে ছাঙ্গু লেকে আমার স্নাইপার কিন্তু বেইমানি করেছিল আমার সাথে। ঠান্ডায় বাইরে পড়ে থেকে নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছিল। এমন বিগড়েছিলো, ওখানে কোন ছবিই তুলতে পারিনি ওটা দিয়ে। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসার পর আবার আপনা থেকেই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো। তাই ক্যামেরার ব্যাটারী খুলে প্যান্টের পকেটে নিয়ে (যাতে তার তাপমাত্রা ঠিক থাকে), আর তাকে তার কেস এর ভেতর ঢুকিয়ে আমার লেপের ভেতর নিয়ে শুয়ে পড়লাম। অতো ঠান্ডা জল ও খাওয়া যাচ্ছিলো না, তাই জলের বোতলকেও লেপের তলায় আশ্রয় দিলাম।
আগামী কাল এবার আমার হাঁটুর শক্তির আসল পরীক্ষা। গঙ্গোত্রী থেকে যাবো আমরা ১৪ কিমি পাহাড়ী পথে হেঁটে প্রথমে ভূজবাসা, তারপর গোমুখ।
কিন্তু যাত্রার অনিশ্চয়তার জন্য ওয়াকিং স্টিক সহ ট্রেকিং এর কোন সরঞ্জামই কিনতে পারিনি কোলকাতা থেকে, এবার কি হবে? ভাবতে ভাবতেই ঘুমের দেশে! কিন্তু একি!! নিদ্রাদেবী এতো অপ্রসন্ন কেন আমার উপর? বারেবারেই তো ঘুম ভেঙে যাচ্ছে! জেগে দেখছি চারমূর্তির সবাই নড়াচড়া করছে। রাজীব নন্দীর কামান দাগাও গোত্তা খাচ্ছে, খালি ঘড়ঘড় আওয়াজ করছে আর পাল্টি খাচ্ছে! সন্ধ্যা থেকে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া আশিষদা হাত পা ছুঁড়ছেন মাঝে মাঝেই। পারিজাত খালি মোচড় খাচ্ছে! ১১,২০০ ফুট উপরে, উচ্চতাজনিত অক্সিজেনের অভাব সবাই টের পাচ্ছে। চার পাঁচ বার হঠাৎ জাগরণের পর, আমিও গেলাম আবার ঘুমের দেশে।
৫-
ঘুম ভাঙল যেন এক বিকট বায়োলজিক্যাল সাউন্ড "ধপাস" শুনে ! ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখি, রাজীব নন্দী বাথরুমের মেঝেতে বসে আছে। কি হয়েছে জিঞ্জেস করতেই উত্তর এলো, উনি বাথরুমের সুইচ বোর্ডের উপর ওনার মোবাইল চার্জে দিয়েছিলেন। সেটা খুলে নিয়ে ঘুমচোখে বেরিয়ে আসতে গিয়েই মাথায় দরজার ঠোক্কর খেয়ে এক্কেবারে বাথরুমের মেঝেতে ভূপাতিত হয়েছেন!! আর ঘুম এলো না।
গিজার অন করে দিলাম! কারণ, হাতে জল লাগলেই মনে হচ্ছে কেউ যেন হাত কেটে নেবে! সকাল ছ'টায় বোরোনোর কথা আমাদের, কিন্তু স্নান করার সাহস হলো না। গুগল দাদু বলছে, তাপমাত্রা এখন ৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বয়স্ক যাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন বা যাঁরা ঈষৎ অসুস্থ, তাঁদের এখানেই রেখে আমাদের এগারো জনের টিম যাত্রা শুরু করলাম এবার সকাল সাড়ে আটটায়।
গ্রুপ এডমিন স্বপ্ন পালের পরামর্শ মতো আমার হাঁটুতে পরে নিয়েছি নিক্যাপ, তার উপর ইনফার্নো, তার উপর জিনস্। আর পায়ের পাতা ঢেকেছি হৃষীকেশ থেকে কেনা উলের মোজা আর দিল্লী থেকে অস্ত্রোপচার করে নেওয়া আমার পাদুকা দিয়ে! পরীক্ষা এবার তারও!!! উপরে মাল্টি লেয়ারের পোষাক হলো, শ্যান্ডো গেঞ্জির উপর প্রথমেই ইনফার্নো। তার উপর আমার বন্ধুর তৈরী করে দেওয়া উলিকটের ফ্যাশন দুরস্ত টি'শার্ট, তার উপর আমার সর্বোচ্চ ঠান্ডা প্রতিরোধকারী জ্যাকেট। মাথায় একটা উলের টুপির উপর আমার জ্যাকেটের হুড। আরে,আমার লাঠি?
আশিষদা-রা কাল রাতেই কিনে এনেছেন তাঁদের জন্য। এবার আমার লাঠির কি হিল্লে হবে? ঐ রাস্তা চলতে গেলে তো একটা ঠেকনা চাই! ওয়াকিং স্টিক সঙ্গে তো নেই! কোনো দোকান তো তখনো খোলে নি, এবার?
গঙ্গোত্রী মন্দির চত্বরেই একখান সদ্য খোলা দোকান পেয়ে কিনে ফেললাম ত্রিশ টাকা দিয়ে একটা বাঁশের লাঠি, আর কুড়ি টাকা দিয়ে একটা ছোট্ট গঙ্গা জলের ব্যারেল। যখন যাচ্ছিই গঙ্গার উৎপত্তি স্থলে, একটু গঙ্গাজল না'হয় নিয়েই আসব। মন্দির চত্বরেই এক দোকানে চা আর গোটাকতক বিস্কুট খেয়ে এবার শুরু হলো আমাদের আসল যাত্রা, গোমুখের উদ্দেশ্যে।
মন্দির চত্বরের বাঁ দিক দিয়েই সিঁড়ি উঠে গেছে গোমুখ আর তপোবন যাওয়ার। দু'চার ধাপ উঠেই আমার হৃদযন্ত্রের প্রচন্ড ব্যস্ততা আমায় বিচলিত করল!
'আরে, হলো টা কি? এতো লাফাচ্ছিস কেন তুই?'
তখন আবিস্কার করলাম, সিঁড়ির ধাপগুলোর উচ্চতা দেড় ফুট (মানে এক হাত করে)। আর উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঐ রকম অসংখ্য সিঁড়ি আমাদের অভ্যর্থনা করে গোমুখ নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী আছে!! শুরুতেই শঙ্কা!
আমাদের দলেই আছেন একজন ৬৭ বছরের যুবক। তিনি গড়গড় করে আমার আগেই উঠে যাচ্ছেন দেখি। তাঁকে দেখেই এবার চেষ্টা করতে লাগলাম। চারটে সিঁড়ি উঠি, আর থেমে কুকুরের মতো হাঁপাই! তখনো সিঁড়ি শেষ হয়নি, গলা শুকিয়ে কাঠ। মনে পড়ে গেল, নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়তে হবে। তাই শুরু করলাম এবার। অনেক নীচের গঙ্গোত্রী মন্দির আরও ছোট হতে হতে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল একসময়। অত্যাধিক পরিশ্রমে এবার জ্যাকেট ও খুলে ফেলতে হলো। তাকে কোমরে বেঁধে নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। সিঁড়ি শেষ হলেও, এবারের রাস্তা কিন্তু বেশ চড়াই। ফোনের নেটওয়ার্ক ও কমতে কমতে একেবারেই মিলিয়ে গেল। বাঁচা গেলো, এই দুদিন আর কেউ বিরক্ত করবে না! ছবিতো তুলতে হবে ওটাতেও, তাই ওকে 'ফ্লাইট মুড' করে দিলাম।
ডান দিকে অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে নীলচে গঙ্গা। সকালের সূর্য কিরণ পাইন এবং নানা রকম গাছের ফাঁক দিয়ে পথে এসে পড়ে তাকে মায়াবী রূপ দিয়েছে। ঝকঝকে নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বরফাবৃত পর্বত চূড়াগুলো। দুরের গাছগুলোর রং পথচলার সঙ্গে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। এক এক পাহাড়ের রং পাল্টে দিয়েছে এক এক রং এর গাছ। পাইন ফলের গায়ের আঠাগুলো যেন উজ্জ্বল হিরের মতো জ্বলছে সূর্যের আলোয়। কোন পাহাড়ে আবার বিরাট ধ্বস নেমে সেই রঙিন দৃশ্যপটে ধূসর রং এর প্রলেপ দিয়েছে। এসব দৃশ্য যেন চড়াই এ ওঠার কষ্টকে লাঘব করে দিলো।
ঘন্টা খানেক হেঁটে, মাত্র দেড় কিমি এসেছি। সামনেই চেক পোস্ট, ওখানেই চেক হলো আমাদের ব্যাগ। কোন প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ, বা একবার ব্যবহার যোগ্য কোন প্লাস্টিকের বোতল বা অন্য কিছু পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছি কিনা। উপরে ওসব একদম নিষেধ। কারো কাছে থাকলে, তা ওখানে টাকা জমা করে রেখে আসতে হবে। ফেরার সময় রসিদ দেখালে জিনিস আর টাকা ফেরত দেবে। আর কোন আস্তানা নেই সামনের ৭.৫ কিমি এর মধ্যে, নেই কোন দোকান পাঠ ও। সঙ্গী শুধুই প্রকৃতি।
আবার চলা শুরু হলে, কিছুক্ষণ পরেই সবাই বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল। আমরা চারমূর্তি সবার আগে, কিন্তু আমার আর রাজীবদার ফটো সেশনের জন্য আশিষদা আর পারিজাত অনেক এগিয়ে গেল। আর অনেক পেছনে বাকিরা।
পাঁচ ঘন্টার চেষ্টায় প্রায় মাঝপথে এসেছি তখন, গলা ভেজাতে ভেজাতে জলের বোতল প্রায় শেষ। সামনের দিক থেকে সকাল থেকে মুখে রোদ্দুর পড়ায়, মুখ জ্বালা করছে যেন। মাঝে মাঝেই বসে পড়ছি পাথরের উপর গাছের ছায়ায়। হাঁটু কটকট্ করছে, এনার্জি প্রায় শেষ। একমাত্র বিশ্রাম ও খাওয়ার জায়গা চিরবাসা তখনো ২ কিমি দুরে। আরও কিছুক্ষণ চলার পর দেখি, কিছু স্থানীয় লোক পাথর আর লোহার তারের নেট দিয়ে রাস্তা বাঁধাই এর কাজ করছে। বেলা সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। আর কতদূর জিঞ্জেস করাতে তারাও বলে, এখনো ২ কিলোমিটার। এ দু কিলোমিটার তো শেষ ই হয় না দেখছি। অবশেষে দুরে দেখা দিলো চিরবাসা।
এটাই এই রাস্তায় একমাত্র অস্থায়ী বিশ্রাম, আর খাওয়ার দোকান। শেডের নীচে মাটিতেই মোটা করে পাতা আছে বিছানা টাইপের। জনগণের বিপুল ব্যবহারে, তা আজ অত্যন্ত মলিন। লাঠি আর ব্যাগটা রেখে, ওতেই ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। আশিষদা আর পারিজাতকে দেখতে পেলাম না এখানেও। খাওয়ার অর্ডার দিতে গিয়ে দোকানের রেট বোর্ডে চোখ যেতেই চক্ষু চড়কগাছ! এক প্লেট ম্যাগি ৬০, একটি আলু পরোটা ৬০, এক লিটারের জলের বোতলের মূল্য ৫০, এক কাপ চা ৩০।সকালে গোটা চারেক বিস্কুট আর চা খেয়ে বেরোলেও, তেমন যেন খিদে পাচ্ছে না। একটা আলু পরোটার অর্ডার দিয়ে প্রায় অনেকক্ষণ বসে আছি। উল্টো দিক দিয়ে তপোবন গোমুখ থেকে ও ট্রেকাররা এখানেই খাচ্ছেন আর বিশ্রাম নিচ্ছেন, তাই বেজায় ভিড় এখানে। ততক্ষণে আমাদের বাকি সবাই এসে গেছেন। এবার খেয়ে দেয়ে সবাই একসাথেই রওনা দিলাম। এখনো ৫ কিলোমিটার বাকি ভূজবাসা পৌঁছতে।
কিছুটা এগোতেই দেখি একটা পুলিশ ক্যাম্প ও আছে ওখানে। ভাগীরথী শৃঙ্গ সহ সব তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলো যেন এবার হাতের নাগালে। আলো কমে আসছে, বিদায়ী সূর্যের শেষ সোনালী আলো আর মেঘেরা মিলে, ভাগীরথীর চূড়াকে এক অপরূপ রূপে রাঙিয়েছে। ভূজবাসার রাত্রি নিবাসের এক কর্মী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আমার সাথে একটু কথা বলেই আমায় ওভারটেক করে সামনে এগিয়ে গিয়ে যেন বিলীন হয়ে গেলেন। আর বলে গেলেন, "জলদি চলিয়ে, সাম হোনে ওয়ালা হ্যায়!"
রাজীবদা আর আমি এবার একসাথে চলেছি, অন্ধকার নেমে এসেছে দিগন্ত জুড়ে। বাকিরা এখনো পেছনে। রাস্তা বলে আর কিছু নেই এখান থেকে, পুরোটাই বড়ো বড়ো বোল্ডার। মাঝে আবার ছোট পাহাড়ী নদীর মতো ঝোরাও পেরোতে হচ্ছে বড়ো বড়ো পাথরে পা ফেলে। ব্যাগ থেকে বার করলাম টর্চ। আধঘন্টা খানেক চলার পর তার চার্জ ও গেলো ফুরিয়ে। ইতিমধ্যে এটা পাথরে হোঁচট গেয়ে বাঁ পায়ের হাঁটু গিয়ে ধাক্কা মারল আর আর এক পাথরে। নিক্যাপ, ইনফার্নো আর জিনসের উপর দিয়েও জ্বালাটা টের পেলাম। চার্জ বাঁচিয়ে ফ্লাইট মুডে রাখা মোবাইল টর্চ অন করলাম এবার। আরও কিছুক্ষণ ঐ ভাবে চলার পর আমরা দু'জন একটা বড়ো পাথরের উপর বসে পড়লাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের দলের বাকিরাও আসছেন মোবাইল টর্চ জ্বালিয়েই। রাস্তাও তো লোপাট সম্ভবত ২০১৩ র বিপর্যয় আর তার পরের ভূমিকম্পে। ঐ অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন গাইড ও নেই আমাদের। অগত্যা রাজীবদা নির্দেশিত পথেই চলতে লাগলাম আমরা। একসময় দুরে দেখা গেল ভূজবাসায় লালবাবা আশ্রমের ক্ষীণ আলো। তাকে ডানদিকে রেখে, বাঁদিক দিয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছলাম GMVNL এর রাত্রি নিবাসে রাত আটটার সময়। খুব বড়ো বড়ো এক একটা ঘরে ডবল আর সিঙ্গল বেড পাতা প্রায় দশ বারো জনের মতো!
পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বিছানাপত্তর, আর সবার বেডেই একটা করে মোটা কম্বল আর লেপ। একটা সিঙ্গল বেড আমি দখল করলাম আর আমরা একটাই ঘরে আশ্রয় নিলাম সবাই, শুধু রাজীবদা ছাড়া!
এখানে জেনারেটরে আলো জ্বলে, কিন্তু রাত সাড়ে আটটার পরই সব বন্ধ। তারমধ্যেই রাতের খাওয়া সহ সব কাজ সেরে নিতে হবে। আশিষদা আর পারিজাত বেলা পাঁচটাতেই পৌঁছে গেছে এখানে। আমাদের জন্য খাবার অর্ডার ওরাই দিয়ে রেখেছিল, তাই আমরা রাতে খাবার পেলাম। এসে দেখি তাঁরা ইতিমধ্যেই লেপের তলায়, আমাদের অবস্থা দেখে হাসছেন!!! তৈরী হয়ে সবাই খাবার টেবিলে পৌঁছানোর আগেই জেনারেটর অফ হয়ে গেল! অতএব 'কেরোসিন লাইট ডিনার' হবে এবার। আমি এক প্লেট খিচুড়ি নিয়ে অর্ধেক ও খেতে পারলাম না। অগত্যা রুমে গিয়ে একটা প্যারাসিটামল মেরে দিলাম, যাতে গা হাত পা ব্যাথা না হয়। আর আষ্ঠেপৃষ্টে হাঁটুতে কোমরে আর পায়ে ভলিনি স্প্রে করে লেপের তলায় ঢুকলাম।
পাসের ঘর থেকে ভেসে আসছে রাজীব নন্দীর কামান দাগার শব্দ! অবশেষে ঘুমের দেশে। কিন্তু এখানেও ঐ একই সমস্যা!! উচ্চতা জনিত সমস্যা এড়ানোর জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোকা ৩০ আগে থেকেই চলছিলো। ডাক্তার অনুমোদিত দুটো ইনহেলার ও নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। দুটোই প্রয়োগ করা স্বত্বেও আরামদায়ক বিছানাতেও চমকে চমকে জেগে উঠছিলাম রাতে। কানে আসছিল তখন শুধু ঐ কামান দাগার শব্দ!!
৬-
ভোরে উঠেই বাইরে এলাম, কাল রাতে কোথা দিয়ে এসেছি সেটা দেখতে। বিস্ময়ে অবাক হওয়ার বোধহয় এটাই বাকি ছিলো!!!
"মহারাজ, একী সাজে
এলে হৃদয় পুর মাঝে..!"
ভাগীরথী, মান্দা, শিব লিঙ্গ ইত্যাদি সবকটা পর্বত শৃঙ্গ যেন চোখের সামনে মেঘমুক্ত নীল আকাশে বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এতো কাছ থেকে এতো পরিস্কার কোন পর্বতশৃঙ্গ কোনদিন দেখিনি আমি। সূর্যের কিরণ তখনো স্পর্শ করেনি তাদের চূড়া গুলোকে।
একদৌড়ে ঘরে ঢুকে লেপের তলার নিরাপদ আশ্রয় থেকে আমার স্নাইপারকে বার করে নিয়ে এসে আবার দাঁড়ালাম বাইরে, সূর্য ওঠার অপেক্ষায়। ১২৪৫৭ ফুট উচ্চতার ভূজবাসায় হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া চলছে এখন, হাত থেকে গ্লাভস খোলা যাচ্ছে না ছবি তুলব কি? ফোনে নেটওয়ার্কের বালাই নেই, তাই গুগল দাদুকেও জিঞ্জেস করতে পারছি না তাপমাত্রা কতো। শুধু অনুভব করতে পারছি সেটা হিমাঙ্কের কাছাকাছিই হবে। আস্তে আস্তে দিনমণির আগমন সব পর্বত চূড়াগুলোকে রক্তিম বর্ণে রাঙিয়ে দিলো, তারপর সোনালী। তার আরও পরে ঝকঝকে রূপালী মুকুট পরে দাঁড়িয়ে রইলো। আর যেন তাকানো যাচ্ছে না তাদের দিকে।
এবার ফিরে এসে তৈরী হয়ে নিলাম ৪ কিমি দুরের গোমুখ যাওয়ার জন্য। আজই আমাদের ফিরতে হবে গঙ্গোত্রী। অর্থাৎ, ৪ + ৪ + ১৪ = ২২ কিমি হাঁটতে হবে আজ। সকাল সাতটা নাগাদ আমরা চারমূর্তী বেরিয়ে পড়লাম আবার চড়াই রাস্তা ধরে গোমুখের উদ্দেশ্যে। দলের দু'জন রয়ে গেল এখানেই। একজন ৬৭ বছরের আমাদের চির যুবক, আমাদের ট্রেকিং এর অনুপ্রেরণা। আর একটি ১১ বছরের মেয়ে। দুজনই খুব ক্লান্ত হয়ে গেছেন। তাও যে এতোদুর আসতে পেরেছেন, সেটাই অনেক। ডানদিকে গঙ্গাকে রেখে, বাম দিক দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। ভূজবাসা থেকেই গঙ্গা টপকে ডান দিক দিয়ে তপোবন যাওয়ার রাস্তা এখন। কিছু দুর এগোতেই দেখলাম, আর গাছপালার চিহ্ন মাত্র নেই। রুক্ষ ধূসর পাহাড়ের পেছন দিয়ে শুধু বরফাবৃত পর্বত শৃঙ্গগুলো বীর বিক্রমে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁদিকে তাকিয়েই বুঝলাম, প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় প্রচুর ধস নেমে পুরো রাস্তাই লোপাট হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো বোল্ডার আর পাথর টপকে দম নিতে নিতে চলেছি গোমুখের উদ্দেশ্যে! কিছু দুর্গম জায়গায় শুধু পাথর সরিয়ে রাস্তার মতো করে দেওয়া আছে। একটা জায়গায় পৌঁছে দেখলাম, আর যাওয়ার রাস্তাও নেই। কয়েক বছর আগে নাকি এখানেই ছিলো গোমুখ। এখন দেড় কিলোমিটার পিছিয়ে গ্লেসিয়ারের কাছে চলে গেছে গঙ্গার উৎপত্তি স্থল গোমুখ। আশাহত আমি আমার ক্যামেরার জুম সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েও তার ছবি তুলতে পারলাম না। যে ছবি এলো আমার ক্যামেরায়, সেটা আমার ফেসবুকে দেখা গোমুখের ছবি নয়। তাহলে ক'দিন আগেই যে গোমুখের ছবি দেখলাম ফেসবুকে, ওরা তুলল কি করে? একগাদা বিটকেল চড়াই রাস্তা হেঁটে ঐ ছবিটা তোলার জন্যই তো এসেছিলাম এখানে। ব্যস! গোমুখের ছবি তোলার স্বপ্ন শেষ। সে রহস্যের উন্মোচন হল ভূজবাসা ফিরে আসার পর।
ভূজবাসা থেকে গঙ্গা পেরিয়ে যারা তপোবনের রাস্তা দিয়ে যায়, তারাই তাদের পথে একদম কাছ থেকে দেখতে পায় গোমুখকে এখন। আমরা যে পথে গিয়েছিলাম, সেটাই আগে তপোবনের ও রাস্তা ছিলো। প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় গঙ্গার বাম দিকের রাস্তাটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। গোমুখের রাস্তা বলে যেটা এখন পরিচিত, সেখান থেকে মোটেই গোমুখ পৌঁছানো বা দেখা যায় না। সরকারের তরফ থেকে বেশ কয়েকটা হিন্দী আর ইংরেজীতে লেখা সাইনবোর্ড রাখা আছে, আর একটা শিবলিঙ্গ রেখে অস্থায়ী মন্দির বানানো আছে ওখানে।
ওখান থেকেই খুব বড়ো বড়ো গোলাকার বোল্ডারের গা বেয়ে সবাই নামলো গঙ্গাজল আহোরণের জন্য। ছবি টবি কিছু তুলে, অগত্যা ফেরার পালা। কাল রাতের অন্ধকারে কেরোসিনের ড্রিম লাইটে তো কিছুই দেখতে পাইনি। ভূজবাসায় GMVNL এর রেস্ট হাউসে খাওয়ার রেট চার্ট দেখে তো এবার অবাক আমি! চার পিস লুচি আর তরকারি ১৫০, একপ্লেট খিচুড়ি ১৫০, দু'পিস ব্রেডের বাটার টোস্ট ৬০, এক লিটারের জলের বোতল ৬০। যাইহোক, এবার ১৮ কিমি তো আরও হাঁটতে হবে। খেতে তো হবেই। চারটে লুচি আর সবজী পেটে ঠেসে, দেরী না করে তৈরী হয়ে নিলাম ফেরার উদ্দেশ্যে। সকাল এগারোটা, সবাই বাইরে রোদ পোয়াচ্ছে। ইতিমধ্যেই বসে থাকা অবস্থাতেই পারিজাত উল্টে পড়ল চেয়ার ভেঙে। ওর বাঁদিকের ভ্রূ কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল। GMVNL এর কর্মীরা ফাস্ট-এইড করার পর, আশিষদা সঙ্গে থাকা একটা ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিলেন।
হেঁটে গঙ্গোত্রী যেতে রাজি হলো মাত্র পাঁচ জন। আমি, আশিষদা, পারিজাত, মৃন্ময় আর তার সহধর্মিনী। বাকিদের জন্য ঘোড়া (আসলে খচ্চর) খোঁজা শুরু হলো। এখানে ঘোড়া অপ্রতুল। সারা রাস্তায় আমরা আট দশটা ঘোড়া দেখেছিলাম সাকুল্যে। যদি গঙ্গোত্রী থেকে ঘোড়া আসে তবেই এখান থেকে পাওয়া যাবে, নয়তো নয়। যাই হোক, বাকিদের জন্য ঘোড়া যোগাড় হওয়ার পর আমাদের যাত্রা হলো শুরু।
তবে আমি আশিষদা আর পারিজাত ঠিক করলাম রাস্তায় কোথাও আর অকারণ দেরী করা নয়। যেহেতু উতরাই রাস্তা, সেহেতু যতো তাড়াতাড়ি নামা যায় তার চেষ্টা করব। রাজীব নন্দী অবশ্য সবাইকে ঘোড়ায় চড়াবেন আর নিজেও চড়বেন বলে রয়েই গেলেন। যাত্রাপথের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণণা যেহেতু আগের পর্বেই দিয়েছি, তাই আবার আর না দেওয়াই ভালো। এদিন ও আকাশ ঝকঝকে নীল, আসাধারণ রঙিন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে পাহাড়ের প্রতি বাঁকেই। বেলা চারটেতেই পৌঁছে গেলাম চেক পোস্ট। এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া যায়। মৃন্ময়রাও পৌঁছে গেছে, আর মাত্র ১,৫ কিমি বাকি আছে গঙ্গোত্রী। এবার পাঁচজন একসাথেই চলা শুরু করে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম গঙ্গোত্রী।
দলের যাঁরা বয়স জনিত কারণ, অসুস্থতা বা অন্য কারণে আমাদের সঙ্গে যেতে পারেনি, আমাদের গঙ্গোত্রীর হোটেলে ঢোকার দোড়গোড়ায় এবার শুরু হলো তাঁদের অভ্যর্থনা আর বিপুল উৎসুক সব প্রশ্ন! যেন আমরা এভারেস্ট জয় করে এলাম!!! ক্লান্তিহীন আমরা সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, বিশ্রামের জন্য এবার চললাম নিজেদের ঘরে। আরে, এতো অন্ধকার নেমে এলো! রাজীবদা তো ঘোড়ায় চড়ে এখনো এলো না। ঘোড়ায় না চেপে, উটের পিঠে চড়ে রাজস্থান চলে গেল নাকি?বলতে বলতেই স্বদলে হাজির হলেন ঐ ব্যাপক কুঁড়ে মানুষটি!! হাঁটতেই যেন চায় না!!
কিছুটা দুরের এক হোটেল থেকে আমরা সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে শুয়ে পড়ার জোগাড় করলাম এবার। কাল সকালে বাসে আবার ৩১৫ পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সীতাপুর। বেশ ব্যাথা হয়ে গেছে গা হাত পা, ভলিনি স্প্রেটা প্রায় শেষ। তাতে যা ছিলো তাই ব্যাথা জায়গায় স্প্রে করে সব ওষুধ খেয়ে, শুয়ে পড়লাম এবার আমাদের চারমূর্তির জন্য নির্ধারিত ঘরে।
একে উচ্চতা জনিত সমস্যা তার উপর রাজীবদার আষাঢ়ে মেঘের মতো নাসিকা গর্জন, আমার তো ঘুমের দফারফা। কি যে করি বুঝতে পারছি না। মাথায় চুলও নেই যে বসে বসে চুল ছিঁড়বো। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হনুমান চল্লিশা কি কাজ করবে? বইটা কাছে থাকলে একবার পরীক্ষা করা যেত। দেখতে দেখতে কখন যে ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পড়ল, তা ঈশ্বর ই জানেন।
৭-
আজ যেতে হবে পাহাড়ী পথে ৩১৫ কিলোমিটার। সমতল হলে, এই দূরত্ব কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু এটা যে পাহাড়, আর উচ্চতাও অনেক। NJP থেকে দার্জিলিং ৭২ কিমি যেতেই লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা! গাড়ির গড় গতিবেগ ২০ কিমি থাকে সাধারণতঃ। সেই হিসেবে, আমাদের পনের ঘন্টা লাগার কথা সীতাপুর যেতে।
কথা ছিলো সকাল ছ'টায় যাত্রা শুরু করার। কিন্তু গতকালের ক্লান্তিতে সবারই দেরি হয়ে গেল। এই দু'দিন ভীম সিং এর ছুটি ছিলো, তাই সে গঙ্গোত্রীতেই শুয়ে বসে কাটিয়েছে দুটো দিন। এবার বার বার তাড়া লাগাচ্ছে আমাদের।
"সাব, বহুত লেট হো যায়গা, জলদি কিজিয়ে"! অবশেষে সবাই বাসের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর, ডিকিতে মালপত্র তুলে আবার শুরু হলো আমাদের বাস যাত্রা। ক্লান্তির জন্য সূরজ কুন্ড ও আর দেখা হলো না গঙ্গোত্রীতে। স্টিয়ারিং এ আবার ভীম সিং!
এতোদিন যে যে পাহাড়ে ঘুরেছি সব সময় ড্রাইভারের পাশে বসে, এর মতো এতো দক্ষ ড্রাইভার আমি দেখিনি কখনো! গাড়ি যেন খেলনার মতো চালাচ্ছে ! ঐ পাহাড়ী বাঁকেও, ডান হাতে স্টিয়ারি আর বাঁ হাতে GPS দেখছে ফোনে। আমি বললাম,
"কেয়া দেখ রহি হো, ছোড়ো না ফোন"! ও বলল,
"সাব, আপ তো অভি স্পট কা নাম পুছিয়েগা! রাস্তে তো হাম প্যায়চান্তে হ্যায়, লেকিন হর জাগাকা নাম হামকো মালুম নেহি!" আমি বললাম,
"ওরে মেরা বাপ, জরুরত নেহি হ্যায় মেরা, তু ঠিক সে গাড়ি লে কে চল!"
ও ব্যাটা ফোন তো রেখে দিলো, কিন্তু বেড়ে গেল গাড়ির গতি। অবিশ্বাস্য গতিতে ঐ পাহাড়ী পথে তার বাহন চালিয়ে নিয়ে চলল আমাদের। সুন্দর একটা জায়গায় প্রাতঃরাশের জন্য থামল গাড়ি। আবার সেই আলু পরোটা! তাই খেয়ে, রাজীবদার কোলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া দার্জিলিং চা এর 'টি ব্যাগ' ওখান থেকেই গরম জল গ্লাসে নিয়ে বানিয়ে ফেলে চিনি ছাড়া আমরা দুজন খেলাম। আর বাকিরা দোকানের মিষ্টি দুধ চা খেলেন।
ভীম সিং এর ওই গতিতে গাড়ি চালানোয় আমি আর ছবি তোলার জন্য ইঞ্জিনের উপর বসে থাকতে পারলাম না। একবার ডান দিকে ওর স্টিয়ারিং এর উপর পড়ছি, আর একবার বাঁ দিকে রাজীবদার কোলে। ধূৎ তেরী!
জানলা দিয়ে যা ছবি পাই, তাই না হয় তুলব! এবার বাসের পেছনের দিকের বাঁ দিকের একটা সিটে এসে বসেই গেলাম। আশিষদা দেখি আবার আমার ডান দিকের সিটে আগেই আশ্রয় নিয়েছেন।
চলল বাস এবার শর্টকাট রাস্তায় বাইপাস ধরে তেহেরী লেকের পাস দিয়ে। রাস্তা তৈরির জন্য সব ধুলোয় ধুলো। বাসের ভেতরেও ধূলোয় ভরে গেছে। সব কাঁচ বন্ধ করে তেহরী ড্যাম এর আসাধারণ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছি এবার। পারিজাত আবার ঘুমোচ্ছে! এ ছেলেটা এতো ঘুমায় কেন তা কে জানে!!! হঠাৎ বিকট এক "ফটাস" শব্দে সম্বিত ফিরল সবার !!!!
বাসের পেছনের বাঁ দিকের যে সিটে আমি বসেছিলাম, তার নীচের সেই টায়ারটাই উড়ে গেলো! আরে, আমি তো অতো ভারী নই, তাও টায়ার ফেটে গেল কি করে? ভীম সিং ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে গিয়ে স্টেপনি লাগাতে তৎপর হলো, আর আমরা আবার তেহরী লেকের ফটো শেষনে ! বিকেল হয়ে গেছে, খুঁজে পেতে একখান 'চা' এর দোকান আবিষ্কার করে, চিনি ছাড়া চা খেয়ে, আমি সবাইকে ডাকলাম। আরেব্বাস !
একখানা হোটেলে এই দেবভূমীতেও সামনের প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে, "মছলি অউল চাউল"! এখন আর কে খাবে, আমরা বাঙালি হলেও? কপালে যে দুর্ভোগ আছে, তখনই টের পেয়েছিলাম। কখন যে পৌঁছাবো, তা বুঝতে পারছিলাম না। টায়ার পাল্টে আবার শুরু হল যাত্রা। দেখতে দেখতে রাত ও হয়ে গেলো। আর কিছুই দেখা যাচ্ছে এখন জানলা দিয়ে। আমরা বাসে শুধু ঐ হই হুল্লোড় করতে করতেই চলেছি।
কখন যে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙলো সীতাপুর এসে, তখন রাত প্রায় বারোটা। আগেই বলা ছিলো হোটেলে আমাদের পৌঁছাতে দেরি হবে। আমরা পৌঁছানোর পর হেঁকে ডেকে হোটেল কর্মচারীদের ঘুম থেকে তুললাম। আমাদের চারমূর্তির নির্ধারিত ফোর বেড রুমে আমরা ঢুকে পড়লাম। তারপর যে যার ঘরে ঢুকে পড়ে, ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে দেয়ে সোজা ঘুম। পারিজাত আর আমি একটা বেডে, ঐ আষাঢ়ে মেঘের গর্জন এড়ানোর জন্য! ঘরটা এতোটাই বড়ো ছিলো আর দুটো ডবল বেড এতোটাই দুরে দুরে ছিলো যে, রাজীব নন্দীর নাসিকা গর্জন আর আমায় বিরক্ত করেনি। সারাদিনের বাস জার্নিতে ক্লান্ত আমরা অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সীতাপুরের উচ্চতা মাত্র ৬,৫০০ ফুট হওয়ায়, আজ আর উচ্চতা জনিত সমস্যায় ঘুমের বিঘ্ন ঘটল না। তাপমাত্রাও সহনযোগ্য। তিন দিন স্নান হয় নি, তাই ভোরে উঠেই স্নানটা ভালো ভাবে করে নিয়ে আগামীকাল সকালে কেদারনাথ যাত্রা করব স্থির করলাম।
সকালে ঘুম ভাঙল মুহুর্মুহু হেলিকপ্টার যাতায়াতের শব্দে! জেগেই তো প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম ঐ আওয়াজ শুনে, কারণ রাতে তো ঐ উৎপাত ছিলো না। যাঁরা হেলিকপ্টারে কেদারনাথ যান, তাঁদের জন্যই চালু আছে তিনটে কম্পানির কমপক্ষে পনেরোটা হেলিকপ্টার। তা থাকগে যাক! আমরা তো যাবো হেঁটে!! এখানে আর ও দু'জন আমাদের সাথে যোগ দিলেন পূর্ব পরিকল্পনা মতো। আমাদের কারো টিকিট আছে হেলিকপ্টারের, আবার কেউ বা প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছেন ঘোড়াতেই যাবেন কেদারনাথ।
এবার তৈরি হয়ে নিয়ে আমি আশিষদা আর পারিজাত ঠিক করলাম, আমরা হেঁটেই উঠব। বেজায় কুঁড়ে রাজীব নন্দী অবশ্য ঠিক করেই রেখেছে যে, সে ঘোড়া নেবে। গোমুখ যাওয়ার লাঠিগুলো বাসেই সুরক্ষিত ছিলো। বেরোনোর সময় ওগুলোকে ও সঙ্গে নিলাম।
সীতাপুর থেকে শোনপ্রয়াগ হেঁটে এক কিলোমিটার। কেদারনাথ যাওয়ার জন্য শোনপ্রয়াগেও থাকা যায়, কিন্তু এখানকার চেয়ে সীতাপুরের হোটেল অনেক ভালো, আর আরামদায়ক। শোনপ্রয়াগ থেকে ট্রেকার বা জিপে ৫ কিমি আসতে হলো গৌরীকুন্ড। এবার আসল যাত্রা আমার স্বপ্নের কেদারনাথের উদ্দেশ্যে!!!
গতকালের সারাদিনের বাস জার্নি আর লেট নাইটে ঘুমানো, তার উপর আবার তার আগের দুদিন গোমুখের উদ্দেশ্যে ঐ রকম প্রণান্তকর ৩৬ কিমি হেঁটে আমি এমনিতেই এখন প্রায় কাহিল। আশিষদা আর পারিজাত তো বীর বিক্রমে চলছে আমার সামনে। আমি তাদের পেছনে দুরুদুরু বুকে শুধু অনুসরণ করছি। পড়াশুনা না করে গেলেও এটা জানতাম যে ২০১৩র প্রকৃতির ধ্বংসলীলার পর, মন্দাকিনীর ডান দিক দিয়ে অত্যন্ত চড়াই পথে কেদারনাথ যাত্রা এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এই ক্লান্ত শরীরে পারবো তো ঐ ১৬ কিমি পথ হেঁটে পার হতে?
"চল সাকিনা! দেখাই যাক কি হয়!"
৮-
গৌরীকুন্ডে পৌঁছে যাত্রা শুরুর আগে এক চা এর দোকানে আমরা চা খেতে বসলাম। ওখানে দেখি গেরুয়া পোষাক পরে সাধুর বেশে খালিপায়ে আর ও একজন বসে আছেন। আমাদের বাংলায় কথা বার্তা শুনে, এবার সেই সাধুও পরিস্কার বাংলায় আমাদের প্রশ্ন করলেন, "আপনারা কোথা থেকে আসছেন ?"
হতবাক আমরা !
এ সাধু কি দৈব বলে আমাদের ভাষাতেও কথা বলতে পারেন ?
প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ওনার মুখেই শুনলাম, ওনার বাড়ি দক্ষিণ 24 পরগনার কুলতলির কাছে। বারো বছর এখানেই আছেন। ভয় ও হলো, ইনি কি কারণে এখানে রয়ে গেলেন তার কারণ জানার জন্য আর প্রশ্ন করলাম না। উপদেশ এর মধ্যে আমাদের শুধু বললেন উপরে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে, আর খুব ঠান্ডা !
নাজেহাল হবো অনুমান করে, আমি আরও সিঁটিয়ে গেলাম ! একে তো ঐ ঠান্ডা, তার উপর আবার দোসর বৃষ্টি ? রেনকোট টা অবশ্য পিঠের ব্যাগেই রাখা আছে আমার। ডাকব্যাক স্পেশাল আমার ঐ বাইক চালানোর রেনকোট টার ওজন ই প্রায় দু'কেজি। গোমুখ যাত্রার সময় ও ওটা সঙ্গে ছিল। একটা সময় ঐটুকু ভার ই অসহ্য লাগছিল। অজানা আশঙ্কায় এবার আমরা তিনজন মিলে রওনা দিলাম কেদারনাথের উদ্দেশ্যে !
দু'দিকে দোকানপাঠ, আর শুধুই উপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙা এবার। 6 ইঞ্চির ঐ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেও যেন এই ক্লান্ত শরীরের কষ্ট হচ্ছে।
অনেকটা উপরে উঠে এসেছি এবার, দোকানপাঠ আর নেই।
অনেক নীচে ডানদিকে দেখতে পেলাম প্রচুর ঘোড়া এক জায়গায়। ঘোড়ায় যাত্রা এখান থেকেই শুরু হয়। তার ও অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। পাহাড়ের পথে বাঁদিকে ঘুরেই দেখি অনেক উপর থেকে এক নাম না জানা ঝরনা তার অবিশ্রান্ত জলধারা রাস্তার উপর দিয়েই বয়ে নিয়ে চলে তার জলে জল মেশাচ্ছে।
চড়াই আর চড়াই এবার।
মেঘেরা যেন দূরের পাহাড় গুলোর সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর জন্য তাদের কোলে নেমে এসেছে। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ায় প্রকৃতি যেন ঝলমল করছে।
ইতিমধ্যেই 36 বছরের যুবক পারিজাত, পঞ্চাশোর্ধ আমি আর আশিষদা কে ফেলে রেখে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তার সেলফির ঝাঁপি মনেহয় ইতিমধ্যেই দেড় লক্ষ পার করে গেছে। ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে আমি আর আশিষদা একসঙ্গেই চলেছি, আর মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নিচ্ছি।
মাত্র আড়াই কিলোমিটার এসেছি তখন। একবার বাঁ দিকে টার্ন নিতেই সামনে দেখলাম যেন এভারেস্টে চড়ার মতো চড়াই। পায়ের পেশীগুলো আর আমাদের এই দৌড়াতে সার দিচ্ছিল না। একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়লাম আমরা দু'জনই !
একেবারে নীচে থেকে (গৌরীকুন্ড) ঘোড়া না নিলেও রাস্তাতেই ঘোড়া ( আসলে খচ্চর) পাওয়া যায় যদি কেউ আর না চলতে পারেন, তাদের জন্য।
বসে থাকা অবস্থাতেই দেখতে পেলাম দু'জন মানুষ দুটো খালি ঘোড়া নিয়ে উপরে উঠছেন। আমি আর আশিষদা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। দুজনেই বোধহয় দুজনের চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম। জেদ না করে শরীর বাঁচিয়ে ঐ খচ্চরের সওয়ারী হওয়াই বোধহয় যুক্তিযুক্ত কাজ হবে। আগের দিনের সারাদিন বাস জার্নি আর তার আগের দু'দিনের ৩৬ কিমি হাঁটা, আমাদের বেশ দুর্বল করে দিয়েছে।
ঘোড়া ওয়ালা দু'জন বাপ বেটা। বাপ জিজ্ঞেস করল,
"সাব, যাইয়েগা ঘোড়ে মে?"
সেল'স এ কর্মরত তুখোড় আশিষদা দরদাম করতে শুরু করলেন। গৌরীকুন্ড থেকে ২,৩৫০ টাকা ঘোড়ায় কেদারনাথ হলেও, আশিষদা ১,৮০০তেই ফাইনাল করে ফেললেন।
জেদ ছেড়ে ইজ্জতের কথা ভুলে, শরীর বাঁচিয়ে আমরা উঠে পড়লাম এবার ঘোড়ার পিঠে! কি এক অদ্ভুত কায়দায় থাই এর কাছটা চাগিয়ে, আমাদের দু'জনকেই ওরা চড়িয়ে দিলো ঘোড়ায়! এবার ....."চল ধান্নু মেরা ইজ্জত তো গয়া, অভি তেরা ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়!"জঙ্গলচটি তখনো দেড় কিলোমিটার। আর ভীমবলী ৩.৫ কিমি। এতো ঘোড়া নয়, সত্যিই খচ্চর!চলবি তো চল সেফ সাইডে পাহাড়ের গা বেয়ে, তা নয়! ব্যাটা চলছে একেবারে খাদের কিনারা দিয়ে, ঘাস খেতে খেতে। ওরে, এতো উঁচুতে কি আর ঘাস পাবি? আরে, এখান থেকে নীচে পড়লে তো বডিই আর কেউ খুঁজে পাবে না। আর পেলেও, পোস্টমর্টেম করার জন্য উত্তরাখন্ড সরকার ও চমকে যাবে! শেষে ডি এন এ টেস্ট করাতে হবে! নুন্যতম শিক্ষাও যদি থাকতো এই খচ্চরগুলোর!
প্রথম প্রথম পিলে চমকালেও, কিছু পরেই ধাতস্থ হয়ে গেলাম। কিন্তু পরিধানে থাকা জিনস প্যান্টের সামনের পকেট থেকে বার করে ছবি তোলার জন্য মোবাইলটা বা বুকে ঝোলানো ক্যামেরাটা কোন ভাবেই ব্যবহার করতে পারছি না, এ ব্যাটা ঘোড়ার টগবগানির জন্য! একটা হাত ঘোড়ার পিঠের লোহার রিং থেকে ছাড়লে যদি উল্টে পড়ি? হিমাচলের কুফরীতেও এই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। ব্যাটারা নামে ঘোড়া, কিন্তু আসলে সত্যিই খচ্চর! জায়গাটার নাম মনেহয় লিংচোলি!
ঘোড়া থেকে নেমে, এখানেই রুটি আর আলু বেগুনের সবজী দিয়ে লাঞ্চ সারলাম আমরা দু'জন। বেগুন মানে, শুধু বেগুনের বোঁটাই দেখেছিলাম ঐ তরকারির মধ্যে! সব ঘোড়া ওখানেই থেমেছে। ওদের বিষ্ঠায় জায়গাটা পুতিগন্ধময়! কোন মতে খাবারটা গিলে নিয়ে, আবার ঐ খচ্চরে উঠেই রওনা হলাম কেদারনাথের উদ্দেশ্যে!
একটা জায়গায় এসে, রাস্তাটা দু ভাগ হয়ে গেল। একটা সোজা মন্দাকিনীর বাম দিক দিয়ে, আর একটা ডান দিকে মন্দাকিনীর উপর দিয়ে লোহার ব্রিজ পেরিয়ে। বাম দিকের রাস্তা বেশ কিছুটা গিয়ে, ২০১৩ সালের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই ডান দিকের এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সে রাস্তা অত্যন্ত চড়াই। ঘোড়া নিয়েছিলাম বলে রক্ষে! নয়তো কিছুতেই ঐ বাঁকপুর্ণ খাঁড়া রাস্তা পার হতে পারতাম না! কিছুদূর এগোতেই দেখলাম, বামদিকের ঐ রাস্তা পাহাড়ের ধ্বসে মন্দাকিনীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেশ কিছু জায়গায় তার দগদগে চিহ্ন রেখে গেছে।
ঘোড়ার পিঠে বসে কষ্ট না হওয়ায়, এবার শুধু পাহাড়ের প্রতি বাঁকের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছি। পারিজাতের আর কিন্তু কোন হদিসই নেই, ফোন থেকে নেট ওয়ার্ক তো অনেক আগেই দুর হয়ে গেছে! তাই ফ্লাইট মুডে রাখা ফোনটা থেকে আর ওকে ফোন করার চেষ্টা করলাম না। পুরো রাস্তায় আর ওর দেখা পেলাম না। আমার ঘোড়া সবচেয়ে বলিয়ান! সব ঘোড়াওয়ালারা তাদের ঘোড়াকে চড়াই এ ওঠার সময় হাতে থাকা ডান্ডা মারলেও, আমার ঘোড়াওয়ালা 'ইকবাল' তা করছে না। ঘোড়া তার ইশারা শুনেই চলছে !
আশিষদার ঘোড়া যেহেতু আমার পেছনে চলছে, তাই আশিষদার বক্রোক্তি শুরু হল এবার! আমার ঘোড়ার ও নাকি ডায়াবেটিস আছে! আমার ঘোড়া যেখানেই থামছে, সেখানেই নাকি তার উষ্ণপ্রস্রবণ নির্গত করছে! আরে ভাই পেছন দিকে সে যে কি করছে, আমি কি আর দেখতে পাচ্ছি ? ওনার ঘোড়া পেছন দিয়ে কি ছাড়ছে, সেটা কে দেখবে?
প্রকৃতির নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে, দু'তিন মিনিট অন্তর অন্তরই কানে ভেসে আসছে হেলিকপ্টারের বিকট আওয়াজ। একেবারে কাছ থেকে বাঁদিকে তাদের দেখতেও পাচ্ছি। পরিস্কার দেখাও যাচ্ছে এবার, মন্দাকিনীর বামদিকে আগের কেদারনাথ যাওয়ার ভেঙে যাওয়া রাস্তাটাও।
চলে এলো এবার 'বেস ক্যাম্প'! ঘোড়ায় চলা রাস্তার শেষ এখানেই। এখানে নেমে ঘোড়াওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে, আরও দেড় কিলোমিটার হেঁটে গেলে তবেই আমরা পৌঁছবো কেদারনাথ। ডান দিকের অস্থায়ী একটা চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলাম এবার চা খাওয়ার জন্য। বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে তখন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, খুব উঁচু পাহাড় ও তার শৃঙ্গের মানসিকতা পরিবর্তন করে ফেলে। মেঘে ঢাকতে শুরু করে তারা। এখানেও তার অন্যথা নয়।
এবার চলতে শুরু করে বেশ কিছুটা এগিয়ে খেয়াল হল, দোকানে লাঠিটা ফেলে এসেছি। আশিষদা বললেন, "যাও নিয়ে এসো"। কিন্তু আর পেছনে যেতে মন আর শরীর দুজনের কেউই চাইল না।লাঠি হারালাম আমি !!!
সামনেই দেখতে পাচ্ছি রৌদ্রজ্জ্বল পর্বত শ্রেণী, অথচ আমাদের মাথায় টিপ টিপ বৃষ্টি! দু'জনের ব্যাগ থেকে বেরোলো এবার দুটো ছাতা। ছাতা মাথায় চলেছি যখন, ঐ হঠাৎ ভেসে আসা মেঘ গুলো আমাদের গায়ের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটুও শাসন না মেনে! কি বেআক্কেলে মেঘরা! ৩,৫৫৩ মিটার মানে ১১,৭২৫ ফুট উচ্চতায় মেঘরা তো একটু দুষ্টুমি করবেই। দেখতে দেখতেই এবার পৌঁছে গেলাম আমার স্বপ্নের কেদারনাথে।
তিনটে হেলিপ্যাডে তিনটে কোম্পানির হেলিকপ্টার পাঁচজনকে নিয়ে এসে নামাচ্ছে, আবার ইঞ্জিন চালু অবস্থাতেই পাঁচজনকে তুলে নিয়ে পাঁচ মিনিটের রাস্তা শোনপ্রয়াগের কাছাকাছি তাদের নিজস্ব হেলিপ্যাডে নামাচ্ছে। ওখানে দাঁড়িয়েই দেখলাম, আমাদের দলের তিন জনও একটা হেলিকপ্টার থেকে নামছেন।
মন্দিরে ঢোকার আগে ভারত সেবাশ্রম সহ যে সব থাকার জায়গা বা হোটেল ছিল বাম দিকে, তারা আজ নিশ্চিহ্ন। ২০১৩র মেঘভাঙা বৃষ্টি তাদের সব ধুয়ে মুছে দিয়েছে। তার উপর দু'বছর আগে উত্তরাখন্ডের ভূমিকম্প সেই ধ্বংসকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাউকেই রেয়াত করে না।
রাজীবদার দেওয়া হোটেলের কার্ডের ঠিকানা দেখে হোটেল খুঁজে নিতে অসুবিধা হল না। আমাদের হোটেল প্রায় মন্দির চত্বরেই। কেউ তখনো পৌঁছায় নি। আমরা ঘরে ঢুকে একটু ফ্রেস হয়ে নিলাম। ঠান্ডার কামড় তখনই বুঝতে পারছি। শীতের যা কিছু ছিলো সব পরে নিয়ে আমরা দুজন চললাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
ফোনে জিওর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক চলে এসেছে ততক্ষণে। আশিষদা টুক করে কেদার দর্শনটা সেরে ফেললেন। কিন্তু আমি অবাক বিস্ময়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় শৃঙ্গগুলোর মাথায় মেঘের খেলা ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করতে উঠে পড়ে লাগলাম। একবার সব ঢেকে যাচ্ছে মেঘে, পরক্ষণেই মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেদার পিক এর সোনালী মুকুট। সূর্যের শেষ আলোটুকু নিভে যাওয়ার পর, মন্দিরে জ্বলে উঠলো সুসজ্জিত আলো। হালকা শব্দে মাইকে বাজছে স্তোত্র। এবার শুরু হল সন্ধ্যারতি। ফোনে স্ট্রং ইন্টারনেট থাকায়, ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে আমার লাইভ টেলিকাস্ট। সরাসরি ভিডিও কলে সহধর্মিণী আর বন্ধুদের দেখালাম ঐসব বিরল দৃশ্য। ঠান্ডায় আর থাকা যাচ্ছে না বাইরে।
এবার হোটেলে পৌঁছে ফোন করে দেখি, পারিজাত প্রায় মন্দিরের কাছেই পৌঁছে গেছে। ও বেচারাও পুরোটা হেঁটে আসতে পারেনি। মাঝ রাস্তাতেই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছে। মৃন্ময় বাদে বাকিরা হোটেলে পৌঁছেছে। রাত ন'টায় মৃন্ময় পৌঁছালো। ওই আমাদের দলের একমাত্র সদস্য, যে হেঁটে উঠতে পারল কেদারনাথ। অতঃপর হোটেলের ডাইনিং রুমে রাজীবদার বানানো খিচুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আবার ও সেই একই সমস্যা! ১১,০০০ ফুটের উপরে উঠলেই দেখছি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। আর বারবার জেগে উঠে শুনছি রাজীবদার নাসিকা গর্জন।
৯-
ভোরে উঠেই ফোনে কেদারনাথের তাপমাত্রা দেখি মাইনাস ওয়ান!!! যাইহোক, তৈরি হয়ে নিয়ে আমরা তিনজনই এখন মন্দির চত্তরে হাজির। পারিজাত পূজো দেবে বলে, 'চাপনিসে' স্নানটাও করে নিয়েছে ঐ ঠান্ডায় (অবশ্য গিজারের জলে)। আশিষদা পূজো দেবেন না আগের দিন ডিক্লিয়ার করলেও, এখন দেখি পূজোর এক বিরাট ডালা কিনে নিয়ে এসে হাজির! উনি নাকি ওনার বসের হয়ে পূজো দেওয়ার বকল্মা নিয়েছেন। ওঁরা দুজনই দাঁড়িয়ে গেলেন লাইনে। যাঃ বাবা! আর আমি?
যথারীতি আমার স্নাইপার নিয়ে দিনমণির আলোক ছটার খেলা বন্দী করার অপেক্ষায়! ঐ ছবি তুলতেই তো এখানে আসা আমার ! যদিও সেই ছবি তোলার অস্ত্র আমার অতি ক্ষুদ্র! শুনেছিলাম মাত্র, ১৯৬২ সালের ভারত - চিনের যুদ্ধের কথা। আধুনিক অস্ত্র নিয়ে যখন চিন লড়ছিলো, ভারতীয় সেনা বাহিনীর হাতে তখনও শুধু ঐ গাদা বন্দুক! আমার হাতেও এখন তাই! Only my snyper !
ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, তখন লতা মঙ্গেসকরের সেই বিখ্যাত গান "অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো" গান রেকর্ড হয়েছিলো। পুরো ভারতবাসীর আশির্বাদও ছিলো ওদের সঙ্গে। কিন্তু এখানে আমার হাতে কমজোরি অস্ত্র থাকলেও, উদ্বুদ্ধ করার মতো কেউ নেই যে! অতএব, ঐ গাদা বন্দুক হাতে আমিও তৈরি ঐ অপার্থিব আলোর খেলা ক্যামেরা বন্দী করার জন্য।ভোরের আলো ফুটতে তখনো অনেক বাকি। ওদের সামনেই বিহার বা উত্তর প্রদেশের তিন চারজন আছেন লাইনে দাঁড়িয়ে। দেখতে দেখতে বিশ পঁচিশ জন তাদের দেশোয়ালী ভাই বোন নিয়ে একে একে ঢুকে পড়ল ওদের দুজনের সামনে। বলেও কিছু লাভ হলো না। পারিজাতরা দেখি লাইনে ক্রমাগত পিছোচ্ছে! হলোটা কি? সামনে যাওয়ার পরিবর্তে এরা পিছু হটছে কি করে? সামনে থেকে 'লোকাল ট্রেনে জায়গা রাখা'র মতো দু তিনজন দাঁড়িয়ে থেকে, বিশ ত্রিশ জনকে লাইনে ঢোকাচ্ছে হিন্দী বলয়ের লোকেরা। আমাদের তুখোড় লিডার আশিষদা ও আর এক যন্তর!
কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে আবিস্কার করলাম এক্কেবারে মন্দিরের দরজার প্রায় সামনেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আরে! এ কি পি. সি. সরকারের ম্যাজিক নাকি? মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়ানো আমায় দেখেই, চোখের ইসারায় পারিজাতকে ওখানে এসে দাঁড়াতে বললেন। একনিষ্ঠ ভক্ত ধর্মপ্রাণ পারিজাত তখনও অনেক পেছনে একান্ত সততার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কানে কানে সব বলাতে, সেও এসে আশ্রয় নিলো আশিষদার পেছনে! থাকগে যাক ওরা পূজোর লাইনে দাঁড়িয়ে!আমি আমার কাজ করি এবার!
সূর্যের প্রথম কিরণ এবার সবে ছুঁয়েছে মন্দিরের পেছনের সব চেয়ে উঁচু পর্বত শৃঙ্গ 'কেদার পিক'! ভোরের ঘন নীল আকাশে আবার সেই সোনালী মুকুট যেন তার মাথায়। তার পর ধীরে ধীরে 'কেদার ডোম', 'ভাত্রীকুন্ঠা', 'খরছ কুন্ড' ইত্যাদি শৃঙ্গ গুলো উচ্চতা অনুসারে একে একে রঙিন হচ্ছে। চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত কেদারনাথ মন্দির।
বাঘা বাঘা ফটোগ্রাফাররা তাদের ক্যামেরার চোখে বড়ো বড়ো চোঙা লাগিয়ে কেউ শুয়ে পড়ে, কেউ ট্রাইপড লাগিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আর আমার রিক্ত হস্তে শুধুই আমার স্নাইপার। কিছুটা সফল কিছুটা বিফল হয়ে, আমিও তুললাম কিছু ছবি।
আমার ফোনের লাইভ টেলিকাস্টে, আমার কোলকাতায় থাকা বন্ধুরাও দেখে ফেলল সেই সব বিরল ছবি। কিন্তু, ওসব করতে গিয়ে আর পুজোটাই দেওয়া হল না আমার। পুজো দিইনি শুনে রুষ্ঠ কন্ঠে আমার হোম মিনিস্টার ঈষৎ 'টিথ জারকিং' দিতে ও ছাড়লো না আমায় ভিডিও কলে!
"হে মহেশ্বর!
ক্ষমা করো আমায়। যদি সক্ষম শরীরে সুস্থ থাকি মৃত্যুর আগের আর ক'টা বছর, তাহলে পরের বার নিশ্চই তোমার দরবারে এসে দর্শন করব তোমায়। অবশ্য যদি তুমি চাও!" কথাটা মনে মনে বললেও, রেহাই নেই আমার। কে শোনে কার কথা! আমার এই কৃতকর্মের জন্য বিস্তর গালাগালি শুনলাম ফোনে, আমার কোলকাতায় থাকা বন্ধুদের কাছ থেকেও। তখন সকাল ন'টা প্রায়।
মন্দিরের পেছনে গিয়ে একবার দেখেও এলাম সেই প্রকান্ড ভীম শীলাকে। ২০১৩ সালে যে প্রকান্ড প্রস্তর খন্ড উপর থেকে গড়িয়ে এসে মন্দিরের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে, বাহুবলির মতো বাঁচিয়েছিল কেদারনাথ মন্দিরকে।
আমাদের দলের সবাই এসে পূজো দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন লাইনে। শুধু ঘুমকাতুরে আর রাতে আষাঢ়ে মেঘের নাসিকা গর্জনকারী বেআক্কেলে সেই রাজীবদাই নেই লাইনে! হোটেলে ফিরে দেখলাম, উনি আমাদের প্রাতরাশের জোগাড় করছেন। আবার সেই কোলকাতা থেকে আনা ইন্সট্যান্ট প্যাকেটের খিচুড়ি! অতো উচ্চতায় (১১,৭২৫ ফুট) কিছুই খেতে ভালো লাগছিলো না। কিন্তু পেট তো ভরাতে হবে, তাই ঐ খিচুড়িটাই অনেক ভালো বলে মনে হল, পাঁপড় সহযোগে। সাথে তো ছিলোই ইস্কনের ঘি!
ঠিক করলাম, আমি এবার হেলিকপ্টারে নামব। ঘোড়া ঐ যে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামবে, ওতে পশ্চাৎপ্রদেশের ব্যাথায় আমায় আরও তিন দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে!!! ঘোড়ার পিঠের ঐ চামড়ার আসন তো আর আমার বাইক, বুলেটের নরম সিট নয়! তাই ঘোড়া "নৈব নৈব চ"! তিন জনের নামার জন্য হেলিকপ্টার অফিসে কথা বলে আসা স্বত্বেও, নামার জন্য তৈরি হয়ে কপ্টার অফিসে যেতে ওরা বলল, আর জায়গা নেই। আমাদের এক সদস্যা পায়ের ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রীতিমত। ওখানকার অস্থায়ী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর, চিকিৎসা করে প্রশাসন অস্বাভাবিক দ্রুততায় তাঁর হেলিকপ্টারে ফেরার ব্যবস্থা করে দিল।
এদিকে ততক্ষণে আমার দুই সঙ্গী আশিষদা আর পারিজাত রওনা হয়ে গেছে। অগত্যা হোটেলে ফিরে এসে পারিজাতের জোগাড় করে আনা একটা লাঠি সঙ্গী করে, আর আমার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে এবার একাই চললাম হেঁটে গৌরীকুন্ডের উদ্দেশ্যে! নামার সময় খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু ঐ যে হতচ্ছাড়া মেঘগুলো! একেবারে গায়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে যেন! মাঝে একবার তো থেমেই গেলাম, সামনে কিছু না দেখতে পেয়ে ওদের জ্বালায়। এবার টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো মেঘেদের ঘনীভুত হওয়ার ঠেলায়! অথচ, সামনের পাহাড়েই আমি দেখতে পাচ্ছি রোদের খেলা। আমিও পাহাড়ের খাঁজে একটা চায়ের দোকান পেয়ে, আশ্রয় নিলাম ওখানেই। চা খেয়ে বৃষ্টি একটু কমলে, আবার চলতে শুরু করলাম। আবার ঝলমলে আকাশ। বুকের উপর ঝোলানো আমার স্নাইপার। মাঝে মাঝেই তার সার্টার বটনে আমার ডান হাতের তর্জনির উপস্থিতি টের পাচ্ছে। ক্যামেরা বন্দী হচ্ছে ঈশ্বরের নিজের হাতে সাজিয়ে রাখা প্রকৃতি ওর চোখেই, যা আমার বর্ণনার অতীত।
চা খেয়ে চলতে শুরু করে, এবার আবার হোঁচোট!!! পাশ থেকে নেমে আসা চারজনের ডুলি বহনকারীদের মুখের একটাই শব্দ শুধু ভেসে এলো আমার কানে....!
"সামালকে!"
আরে, সামালাই আর কাকে? ছিঁটকে গিয়ে আবার এক বড়ো পাথরে লাগলো আমার সেই চোটপ্রাপ্ত বাঁ পায়ের হাঁটু। কি যে হচ্ছে নিক্যাপের আস্তরনের ভেতর দিয়ে, টের পাচ্ছি তখনই! অবশেষে পৌঁছলাম গৌরীকুন্ডে। একটা শোনপ্রয়াগ যাওয়ার শাটল বোলেরো পেয়ে, উঠে বসলাম ওতে সামনের সিটে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে তখন, শোনপ্রয়াগ থেকে আরও এক কিলোমিটার হেঁটে এবার পৌঁছলাম সীতাপুর।
হেলিকপ্টারে যাদের ফেরার কথা ছিল, তাঁরা আগেই পৌঁছে গেছেন। আশিষদা আর পারিজাত ও হেঁটে পৌঁছে গিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়েছে। শুধু ঘোড়ায় সওয়ারীরাই তখনো পৌঁছায়নি। কিন্তু আশ্চর্য, সবাই কেন বসে আছে একতলায় হোটেল কর্মীদের শোয়ার ঘরে?
কেদার যাওয়ার সময় সব বড় লাগেজ আমাদের ঘরটাতে রেখে তালা বন্দী করে চাবি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম আমরা। সেই চাবি এখন ঘোড়ায় চড়ে ফেরা মানুষদের কাছে। খাড়ুস হোটেল ম্যানেজার কিছুতেই আমাদের ডুপ্লিকেট চাবি দিতে রাজী হল না, কোন ঘর ও দিলো না আমাদের জন্য। ডুপ্লিকেট চাবি নাকি ওদের কাছে নেই। শুধু বলল,
"আপলোগ কা ম্যানেজার সে বাত করাইয়ে।"
আরে ঘোড়ারডিম, তাদের ফোনে তো নেটওয়ার্কই নেই, কথা বলাবো কি করে?
আরও কিছুক্ষণ পর রাত আটটা নাগাদ ওরা ফেরায়, চাবি পেয়ে যে যার লাগেজ নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। আজ বিরাট একটা টিম এসেছে মুম্বাই থেকে এখানে। হোটেলটাও খুব বড়ো। ভাড়া মিটিয়ে চাবি দেওয়া থাকায়, আমাদের রুমটা একই থাকলেও সবার রুম পরিবর্তন হয়ে গেল। ফ্রেস হয়ে নিয়ে সোজা ছুটলাম হোটেলের ডাইনিং রুমে। হাতে গড়া রুটি, দু'রকম সবজী আর আচার দিয়ে খেয়ে ঘরে এসে কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম।
VOLINI স্প্রের শেষাংশ টুকুও এবার স্প্রে করে দিলাম কোমড়ে আর পায়ে। খেয়ে নিলাম একটা প্যারাসিটামল ও। সীতাপুরের উচ্চতা অনেক কম, তার উপর ক্লান্ত শরীর। তাই নিদ্রাদেবীর কৃপা অবিলম্বেই উপর বর্ষিত হল আমাদের উপর।
১০-
সাত সকালেই আবার ঘুম ভেঙে গেল মুহুর্মুহু হেলিকপ্টারের গর্জনে। আমরা চারমূর্তি তখনও কম্বলের তলা থেকেই গুলতানি করছি। হঠাৎ মনে পড়ল আমার, আরে! কোলকাতায় ফেরার টিকিট ই যে কাটা হয় নি আমার!! মন 'কু' ডাকলো! শেষে এখানেই সাধু হয়ে থেকে যেতে হবে নাকি? হোয়াটস অ্যাপে এ এস-এম-এস করলাম আমার টিকিট কাউন্টার সুস্মিতাকে। কিছু পরেই সে জানালো, ১৭ই অক্টোবর থেকে ২২শে অক্টোবর হরিদ্বার থেকে হাওড়া আসার সব ট্রেন ক্যানসেল। কিছুটা অবাক হয়ে সবার মাঝে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে হাসির রোল উঠলো। তখন ভাবলাম, সুস্মিতা বোধহয় ইয়ার্কি করছে।
রাজীব নন্দী তো রাজনৈতিক নেতার ঢঙে ডান হাতের তর্জনী তুলে বলেই উঠলো,
"তাহলে তো আগুন জ্বলে যাবে সব স্টেশনে!!! রেল কি কোন বিকল্প ব্যাবস্থা করেছে??"
সঙ্গে চলছে সবার অট্টহাসি। চুপ হয়ে গেলাম তখনকার মতো। সুস্মিতাকে মসৌরী এক্সপ্রেসে হরিদ্বার থেকে দিল্লী, আর দুরন্ত এক্সপ্রেসে দিল্লী থেকে হাওড়া ফেরার ১৮ই অক্টোবর এর টিকিট কাটতে বললাম। কারণ আশিষদা আর পারিজাতের টিকিট এই দুটো ট্রেনেই আছে, একসঙ্গে যাওয়া যাবে। ওদের কনফার্ম টিকিট আছে। আমাদের ফেরার টিকিট কিছু লোকের ফ্লাইটে, আর রাজীবদা সহ বাকিদের হরিদ্বার থেকে 'গাধা ট্রেন' দুন এক্সপ্রেসে। ট্রেন বন্ধ বলায়, আমায় নিয়ে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ ঘরের বাইরে গিয়েও থামছে না দেখি! তাতে অনেকেই যোগ দিয়েছে। বুঝতে পারছি, বেশ মুরগি হচ্ছি!!
আজ সীতাপুর থেকে বদ্রীনাথ যাওয়ার কথা আমাদের। কিন্তু গতকালের ক্লান্তিতে, সবাই লেট! দু'দিন স্নান হয়নি। ঠান্ডা এখানে অনেক কম, তাই ভালো করে স্নান করে ডাইনিং রুম থেকে আলু পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হতে হতেই বেলা সাড়ে দশটা বেজে গেল। ভীম সিং ও তার গাড়ি নিয়ে রেডি। সীতাপুর থেকেই বাঁদিকে উঠে গেছে ত্রিযুগীনারায়ন মন্দিরের রাস্তা। ওখানেই নাকি শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায়, ওখানে আর যাওয়া হল না।
এখান থেকে বদ্রীনাথ ২১৫ কিমি। প্রায় দশ ঘন্টার উপর লেগে যাবে। তাই ঠিক হলো, আজ আমরা ৩৯ কিমি দুরে অবস্থিত উখিমঠে রাত্রিযাপন করব। আগে পঞ্চকেদারের শীতকালীন বাসস্থল ছিলো উখি মঠ। এখন শুধু মদমহেশ্বর আর কেদারনাথের বিগ্রহই দীপাবলীর দিন যাত্রা শুরু করে শোভাযাত্রা সহকারে নামিয়ে আনা হয় এখানে। আবার ফিরতি যাত্রা শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। এবার চলতে শুরু করলাম নীল জলের নদী মন্দাকিনীকে বাঁ দিকে রেখে। রাস্তার দু'দিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব সুন্দর হলেও রাস্তা যেন বেজায় খারাপ। গাড়ি যেন লাফাতে লাফাতে চলেছে। মানে আমাদের সঙ্গের বোতলে যদি জলের বদলে দই থাকতো, কিছুক্ষণ পরেই ওটা থেকে মাখন আর ঘোল আলাদা করা যেতো। আস্তে আস্তে অনেকটাই উপরে উঠে চলেছি। এবার অনেকটা নীচে দেখা যাচ্ছে মন্দাকিনীকে। একটা ড্যাম ও তৈরি হচ্ছে ওখানে মন্দাকিনীর জলধারাকে কাজে লাগিয়ে।
দুপুরে উখিমঠ পৌঁছে একটা OYO মার্কা ছোট্ট হোটেলে ওঠা হল। ফ্রেস হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই দেখি টেবিলে মুরগি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!!!
দেবভূমীতে আবার চিকেন? কিন্তু হোটেলের অনভ্যস্থ হাতে রাঁধা মাংসটা ঠিক জমল না। যাই হোক, আমরা একটু বিশ্রাম করে বিকেলে তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়লাম ওঙ্কারেশ্বর মন্দির দেখতে। আর কিছুদিন পরেই কেদারনাথ এই মন্দিরেই ছ'মাস ধরে পুজো নেবেন।
বিকেলে স্থানীয় এক যুবক 'ওম' এর সাথে গল্প জুড়ে জানতে পারলাম, ২০১৩ সালের মর্মান্তিক প্রাকৃতিক দূর্যোগের কিছু বর্ণনা ওর মুখ থেকেই। 'ধারী দেবী'কে 'চার ধাম' এর অভিভাবক দেবতা মানা হয়ে থাকে এখানে। ড্যামের কাজের জন্য মন্দিরের বিগ্রহকে যেদিন স্থানান্তরিত করা হয়, সেদিন রাতেই শুরু হয় মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। ওম আঙুল দিয়ে দেখালো, কোন পাহাড়ে মেঘ ফেটেছিল। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে দুটো পাহাড়ের মাঝে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু জল উঠে এসেছিল। নীচে একটা ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বলল, "উঁহা পর এক গাঁও থা"। যা আজ নিশ্চিহ্ন। শ'য়ে শ'য়ে লাশ ভেসে গেছে মন্দাকিনী দিয়ে ওদের চোখের সামনেই। অনেকেই আজ ও নিখোঁজ ওদের ঐ পাহাড়ী গ্রাম থেকে। আর তাদের খুঁজে পায়নি ওরা এখনো। ওরা যারা নিরাপদ ছিল বা নিজেদের গাড়ি ছিল, তারা গাড়ি নিয়ে যতদূর পেরেছে দূর্গতদের সাহায্য করেছে। শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। যুবকটি ওর ফোন নম্বর ও দিলো। হোটেলের সামনেই বাঁদিকে ওর স্টেশনারী দোকান। বলল ওরও গাড়ি আছে, প্রয়োজনে আমরা যেন তার সাথে যোগাযোগ করি।
গুপ্তকাশী এখানকার এক বড়ো শহর। হোটেলে ফিরে দেখি, বাঁদিকের গুপ্তকাশীর পাহাড়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই লক্ষ জোনাকির আলো যেন তাকে আলোক মালায় সাজিয়ে তুলেছে। তার উল্টোদিকের পাহাড়, মদমহেশ্বরে যাওয়ার রাস্তা। ওই পাহাড়ের পেছন থেকে উদিয়মান চাঁদের আলোয় চকচক করছে চৌখাম্বা শৃঙ্গ। এখান থেকেই দেখা যায় কেদারনাথ পিক, কিন্তু সে তখন মেঘের আড়ালে।
দুপুরের চিকেন ঠিক পছন্দ হয় নি সবার। তাই কোথা থেকে যেন আবার চিকেন জুটিয়ে আনলো আমাদের লোকেরাই! লম্বা ট্যুরে আর কোথাও চিকেন পাবো কিনা, সেই আশঙ্কায় হয়তো! হোটেলের কিচেনে এবার কুকের ভুমিকায় আমাদের দলেরই তরুন ডাক্তার অয়ন সিকদার!
খেতে বসেই বুঝলাম তার অসাধারণ স্বাদ। গরম গরম হাতে গড়া রুটি, স্যালাড আর চিকেনকারী খেয়ে এবার চলে গেলাম নিজেদের ঘরে। একটা দরজা দিয়েই ঢুকে পর পর দুটো ঘর, মাঝখানে দরজাও আছে। ভুলক্রমেও আর যেন রাজীবদার ঐ নাসিকা গর্জন কানে না আসে, সেজন্য আমি পারিজাতকে নিয়েই শুয়ে পড়লাম মাঝের দরজা বন্ধ করে। আজ এতো দিনের ক্লান্তির 'রেস্ট ডে' হিসেবেই কাটল। কাল আবার শুরু হবে বদ্রীনাথ ধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা!
১১-
ভোরে উঠে দেখি, রাজীবদা ঘরে নেই! খোঁজ করে দেখি, ওনার ক্যামেরা আর উনিই শুধু ঘর থেকে উধাও! এবার আমিও বাইরে এলাম। ঝকঝকে আবহাওয়ায় পর্বত শৃঙ্গগুলোর মাথায় সূর্যের সোনালী আলোর খেলা তখন শেষ। অথচ, রাজীবদার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে পাহাড়ের মাথায় অস্তমিত চাঁদ সহ, ঐ সব অসাধারণ রং এর খেলা ওর ক্যামেরার LCD তেই দেখলাম। আমায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে একা একাই সব ছবি তুলে নিলো!! বেড়াতে এসে আমায় চাঁদ দেখালো না! পুরো চিটিং করল আমার সাথে!
এখন যারা ঘন নীল আকাশে রূপোর পোষাক পরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তারা কেদারনাথ রেঞ্জ আর চৌখামাম্বা রেঞ্জ। আমিও যা পাই তাই কিছু ছবি তুলে ঘরে ঢুকে তৈরি হয়ে নিলাম স্নান সেরে। জানা ছিল, ঠান্ডার গুঁতোয় বদ্রীনাথে আর স্নান হবে না। গরম গরম রুটি আর হলুদ ছাড়া কালোজিরে আর গোল মরিচ দিয়ে রাজীবদার বানানো সুস্বাদু আলুর তরকারি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। ওটা নাকি রাজীবদাকে তার স্ত্রী শিখিয়েছেন। ভীম সিং তার বাহন নিয়ে গতকাল আমাদের নামিয়ে দিয়ে, কাছেই তার নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। ঠিক সময়ে সেও এসে হাজির। বাসে মালপত্র তোলার পর, শুরু হল এবার বদ্রীনাথের উদ্দেশ্যে যাত্রা। উখিমঠ থেকে বদ্রীনাথ প্রায় ১৭০ কিমি রাস্তা। গুগল দাদু বলছে, প্রায় সাত ঘন্টা লাগবে ভায়া এন এইচ ১০৭এ, এবং এন এইচ ৭ ধরে বদ্রীনাথ যেতে।
বেলা এগারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম চোপতা ভ্যালি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৩,০০০ ফুট উচ্চতার চোপ্তা ভ্যালিতে আসতে আসতেই দেখলাম, সাদা হনুমান গাছে গাছে খেলা করছে। চোপতা ভ্যালি উচ্চ উচ্চতার এ্যলপাইন গাছ, রকমারি অর্কিড, আর রোডোডেনড্রনের জন্য বিখ্যাত। রাস্তার ধারে অনেক টেন্ট আছে। যারা বিরল প্রজাতির পাখির ছবি তুলতে ভালোবাসেন তারা এখানেই এসে থাকেন, আর গাইড নিয়ে পাখির ছবি তুলতে বেরোন। এবার শুধুই চড়াই পথে উঠতে লাগলো বাস। এক সময় সবাই নামলাম চোপ্তা ভ্যালি দেখতে । কিন্তু আজ বিধি বাম!
চোপতা এখন আধো আলো আধো মেঘে ছেয়ে থাকলেও, সেই আকর্ষণীয় সব পর্বত শৃঙ্গগুলোই মেঘের আস্তরণে ঢেকে আছে! আরে, ইন্টারনেট আর ফেসবুকে দেখা কোন ছবিই তো তুলতে পারছি না আমি তাদের মতো! আসাটাই বোধহয় বিফল হলো। একে আমার স্নাইপারের ক্ষমতা সীমিত, তার উপর আবার প্রকৃতির বেগড়া ? প্রকৃতি, যদি তুই ধরা দিবি আমার কাছে, তো মন খুলে দে! নয়তো চিরকাল মেঘ দিয়ে ঢেকে রাখ তোর ঐ সূর্যের ফ্লাশ লাইট সহ সবকটা শৃঙ্গকে।
শুনলো না আমার কথা এবার! একটুখানি মেঘ সরিয়ে, শুধু কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার নিজের ছবি তোলার সুযোগ দিল মাত্র। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে আর যেন ভালো লাগছিল না। বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি, কোন একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দুপুরে খাওয়ার আয়োজন চলছে। খেয়ে দেয়ে বাসে উঠে, আবার যাত্রা শুরু হল। আজ আবহাওয়া খুব একটা ভালো নয়। জানলার বাইরে বেশি মন না দিয়ে, আমরা বাসেই আড্ডা দিতে দিতে চললাম। দিনমণি অস্ত গেছে ইতিমধ্যেই, আর গাড়ি শুধুই চড়াই রাস্তায় দৌড়ে চলেছে। এবার অন্ধকারের মাঝে দূরে দেখা দিলো বদ্রীনাথের আলো। বাস থেকে নেমেই বুঝলাম ঠান্ডার কামড়। পৌঁনে আটটা নাগাদ হোটেলে যে যার ঘরে পৌঁছে খাওয়া দাওয়ার পর সোজা মোটা কম্বলের তলায়। বদ্রীনাথের উচ্চতা ১০,৮২৭ ফুট হলেও, আজ রাতে আর ঘুমের তেমন কোন অসুবিধা হল না।
পরদিন! ভোর হয়ে গেছে।
কেদারনাথে পূজো না দেওয়ার জন্য হোম মিনিস্টারের ঝাড় খেয়েছি আগেই। এবার বদ্রীনাথে পুজো না দিলে নির্ঘাত কান থেকে রক্ত বার করে দেবে। বাড়ি না ফিরে আমায় এখানেই সাধু হয়ে থেকে যেতে হবে। তাই ভোরে ঘুম ভেঙে উঠেই ঠিক করলাম, আগে পুজোটা দিয়ে নেব বদ্রীনারায়ণের।
দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, রাজীবদা সুড়সুড় করে নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। ব্যাটা রাতের বেলায় সশব্দে জাগিয়ে রাখে সবাইকে, আর এখন অন্যদের ঘুম ভেঙে যাবে বলে নিঃশব্দে বেরোচ্ছে? ঠিক আন্দাজ করেছি! হাতে ধরা আছে ক্যামেরা, আর তার 3 Axis Gimbel (crane). (ক্যামেরা যাতে না কাঁপে, তার যন্ত্র)। দাঁড়াও ব্যাটা, দেখাচ্ছি মজা!! সঙ্গে সঙ্গে কম্বল ফেলে দিয়ে আমার স্নাইপার নিয়ে আমিও অনুসরণ করলাম তাকে। আশিষদাও আমার সঙ্গী হলেন সোজা হোটেলের চারতলায়। আবার বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার পালা!
পুর্ণিমার চাঁদ মাথায় নিয়ে সামনেই যে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে নীলকন্ঠ শৃঙ্গ তার রূপোর সাজ পরে !!! ঝকঝকে নীল আকাশ। সূর্য উঠতে তখনও মিনিট পনের বাকি। হাড় কাপানো ঠান্ডা উপেক্ষা করে আমরা ও দাঁড়িয়ে আছি তার আবির্ভাবের অপেক্ষায়।
চমক শুরু এবার! আস্তে আস্তে প্রথম সূর্যের সোনালী কিরণ স্পর্শ করল নীলকন্ঠের চূড়া। দিগন্ত যেন হেসে উঠলো! লক্ষ ওয়াটের আলো যেন রাঙিয়ে দিলো নীলকন্ঠের চূড়া। সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠলো নীলকন্ঠ। আর চাঁদমামা আস্তে আস্তে লজ্জ্বায় লুকোতে লাগলো নীলকন্ঠের পেছনে। সে দৃশ্য বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই, আর পৃথিবীর কোন অমুল্য ক্যামেরারই ক্ষমতা নেই ওই দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করার। এ দৃশ্য শুধু ঈশ্বর প্রদক্ত দুটো চোখ দিয়ে দেখার আর উপলব্ধি করার। জীবনের প্রথম লেখা এটা হলেও লেখাটা লিখতে গিয়ে অনুভব করলাম, লিখতে গেলে গল্প বানাতে হয় না। মনের আসল উপলব্ধি লেখনী দিয়ে আপনিই বেরিয়ে আসে। এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই।
হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া তখনও চলছে। রাজীব নন্দীর ক্যামেরা আর মোবাইল দুটোই তখনও তাদের তেপায়ার উপর দাঁড়িয়ে তাদের মালিকের সিলেক্ট করা বটন অনুযায়ী কাজ করে চলেছে নীলকন্ঠের দিকে তাদের চোখ রেখে। বদলা নেবো ভেবে এসেছিলাম কিন্তু নিজের মধ্যেই বদল আসছে এবার। বার বার ভুলে যাচ্ছি ছবি তুলতে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। এ জগতে প্রকৃতিই প্রকৃত সত্য, বাকি সব অসাড়। এ কি মায়া প্রকৃতির! আমি কি উন্মাদ হয়ে গেছি? রাজীবদা মাঝে মাঝেই ছবি তোলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওর কথায় সম্বিৎ ফিরে আবার ক্যামেরায় চোখ রাখছি ঠিকই কিন্তু তা বড়ই সাময়িক ব্যাপার।
দেখতে দেখতে নীলকন্ঠ আর তার পাশের দুই শৃঙ্গ 'নর' আর 'নারায়ণ' সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল। এবার রং বদলানোর পালা। চন্দ্র তখন অস্তমিত, ঝকঝকে রূপোলী আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তখন। ইচ্ছা না থাকলেও নেমে এলাম এবার আমরা। বলা ভালো নামতে বাধ্য হলাম। আজ পুজো দিতেই হবে। সন্নাসী হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। ব্যাটা রাজীব নন্দী এসব দেখিয়ে আমায় বিবাগী করে এখানে রেখে যেতে চায়। ও টি হতে দিচ্ছি না আমি।
গিজার অন করাই ছিলো। পুজো দিতে হবে বলে, স্নানটাও করে নিলাম তারই জলে। চারমূর্তি এবার চললাম অনেকটা উতরাই নেমে, বদ্রীনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। কাঁপুনি শুরু হলো এবার। পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে দেখলাম, গুগল বলছে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। মন্দির চত্বরে পৌছে, কাছেই একটা দোকান থেকে পুজোর উপাচার কিনে অল্প লাইন ঠেলে পৌঁছলাম অবশেষে বদ্রীনারায়ণের দরজার সামনে। তখন সকাল আটটা, কলাপসিবল গেট তখনো খোলেনি। সাড়ে আটটায় নাকি খুলবে গেট! অথচ দেখলাম ভেতরে অনেক নরনারী বসে, প্রার্থনা সঙ্গীতে তাল মেলাচ্ছেন। কারন জিজ্ঞেস করাতে উত্তর এলো, ওটা নাকি স্পেশ্যাল পুজো! পয়সার বিনিময়ে নাকি ওখানে ঢোকা যায়। ঠকঠকে কাঁপুনিতে আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করছিলো না। পুরোহিত গোছের কেউ আমার হাতের পুজোর ডালা থেকে কিছু জিনিসপত্র ইমপোর্ট এক্সপোর্ট করে দিলো! বিগ্রহ দেখে প্রণাম জানিয়ে, তাড়াতাড়ি চললাম আমার পাদুকার উদ্দেশ্যে। মাথায় থাক পুজো দেওয়া। আগে তো আমি ওই বরফ ঠান্ডা পাথর থেকে আমার পা বাঁচাই!
বদ্রীনাথ মন্দিরের মূল বিগ্রহ হলো নারায়ণ। কষ্ঠি পাথরের তৈরি মুর্তির পাশে রয়েছেন কুবের দেবতা ও লক্ষীদেবী। এই মন্দির প্রতিষ্টা করেন আদি শংকরাচার্য অষ্টম শতাব্দীতে।
বিতর্কিত একটি মতবাদ আছে যে এখানে আগে এটা নাকি বৌদ্ধ পীঠস্থান ছিল। আদি শঙ্করাচার্য ওখানে ধ্যান করেন (৮১৪ থেকে ৮২০ শতাব্দীতে) এবং অলকানন্দা নদী থেকে মূর্তি পেয়ে ওখানে প্রতিষ্ঠা করেন। পৌরাণিক মতে ভগবান বিষ্ণু একবার কঠোর তপস্যায় বসেন। ধ্যান চলাকালীন প্রবল ঠান্ডা ও তুষারপাত হতে থাকে, কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর সেই সবে লক্ষ্য নেই। তখন দেবী লক্ষী কুল গাছ রূপ ধারণ করে বিষ্ণুকে আশ্রয় দেন। একদা ওই জায়গাতে কুল গাছের বাগান ছিল। ওই কুল গাছের আঞ্চলিক নাম হলো বদ্রী। সেই থেকে ওই জায়গার নাম হয় বদ্রীনাথ, যেহেতু বিষ্ণু ওখানে কুল গাছের তলায় বসে ধ্যান করেছিলেন। আজ আর কুল গাছ নেই। আর একটি মতে ধর্ম রাজার দুই পুত্র নর আর নারায়ণ যারা কিনা বিষ্ণুর প্রতিরূপ ওখানে তপস্যা করে বদ্রীনারায়ণকে প্রতিষ্টা করেন। প্রথাগতভাবে বদ্রীনারায়ণ এর পূজার অধিকার একমাত্র কেরালার রাওয়াল গোষ্ঠীর। আর ওখানকার পুরোহিত ও দক্ষিণ ভারতীয়। যা কিনা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
বেরিয়ে দেখি, আশিষদা আর নেই। তিনি আরও অনেকে নীচে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছেন অলকানন্দার জল আহোরণ করতে!! ইতিমধ্যেই উত্তরাখন্ডের যতো নদীর পাশ দিয়ে আমরা গিয়েছি, সব নদীরই জলের নমুনা আশিষদা কালেক্শন করেছেন, এবার ও করছেন! অনেকের ডাক টিকিট কালেকশনের নেশা থাকে জানি কিন্তু জল কালেকশনের নেশার কথা এই জানলাম।আর দেরী নয়! উনি উপরে উঠে এলে, আবার চারমূর্তি চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। পথে, গতরাতে যেখানে ডিনার সেরেছিলাম, সেখানেই পেল্লাই সাইজের আটার তৈরি পুরী (লুচি) আর সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে, চলে এলাম হোটেলে।
যাবো এবার এখান থেকে তিন কিমি দূরে ভারতের শেষ গ্রাম 'মানা' দেখতে। বাস থেকে নেমে, আবার হাঁটা পথ। ছোট্ট সুন্দর এক পাহাড়ী গ্রাম। ঘোলা জলের নদী সরস্বতী এখান থেকেই উৎপন্ন হয়ে কিছু দূরেই নীল জলের অলকানন্দার সাথে মিশেছে। রোদে পিঠ দিয়ে গ্রামের মহিলারা ভেড়ার লোম থেকে তৈরি উল দিয়ে শীতের পোষাক বানাচ্ছেন। কোন জায়গায় ডাঁই করে রোদে দেওয়া আছে ভেড়ার লোম।
নানান পৌরাণিক কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে এই গ্রামের নাম। পান্ডবদের স্বর্গে যাওয়ার সময়, সরস্বতী নদী পার হওয়ার জন্য ভীম প্রকান্ড এক শীলাখন্ড ফেলে ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা এখন এখানে 'ভীমপুল' নামে খ্যাত। এখানেই আছে ব্যাস গুহা, যেখানে ব্যাসদেব মহাভারত রচনা করেছিলেন। সেই গুহা অবশ্য আমাদের দেখা হল না। এখানে অনেক কিছুই দেখার আছে। ট্রেক করে যেতে হয় বসুধারা ফলস। সারা দিনের ব্যাপার। আমরা 'ভীম পুল' অবধি গিয়ে, ফিরে এলাম। আমাদের হাতে সময় বড্ড কম। ক্লান্ত শরীরে, মানা ভিলেজে জাস্ট এটেন্ডেন্স দিতে এসেছি মাত্র। আজ অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। ফিরতে হবে হরিদ্বার!
বদ্রীনাথ থেকে হরিদ্বার ৩১৫ কিমি। সময় লাগার কথা ১২ ঘন্টার মতো। কিন্তু 'মানা' দেখে হোটেলে ফিরতে ফিরতেই বেলা বারোটা পার হয়ে গেল। ভীম সিং জানালো আজ নাকি আমাদের কপালে দুঃখ আছে! আমি জিঞ্জেস করলাম,
"টায়ার বানালিয়া"?
ও অকপটে উত্তর দিলো, "কাঁহা সে বানাউঁ? ইঁহা কোই দুকান হ্যায় কেয়া?"
একে তো রাতের বেলা ঐ পাহাড়ী পথে চলতে হবে। তার উপর আবার স্টেপনি ছাড়া? আর একটা টায়ার ফাটলেই তো ঐ ঠান্ডায় রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে! মনে মনে আঁতকে উঠে, দূগ্গা বলে উঠে পড়লাম গাড়িতে।
১২-
বেলা তিনটে বেজে গেছে। পেটে ছুঁচো ডন দিতে শুরু করেছে এবার! যোশীমঠ পার হয়ে পিপালকোটিতে থামলো এবার গাড়ি । একটা বেশ বড় সড় হোটেলে এলাম লাঞ্চের জন্য। আমরা দেরীতে আসার জন্য তাদের খাবার ও শেষ হয়ে গেছে। আমাদের কুড়ি জনের জন্য আবার খাবার বানাতে হলো ওদের। ওখানে আবার দেরী।
উতরাই পথে এবার শুধুই চলা। গাড়ি একবার ডান দিকে, আর একবার বাম দিকে দোল খেতে খেতে বাঁক নিচ্ছে । আর সূর্যিমামা লাল হতে হতে বাসের জানলার একবার ডান দিক থেকে আর একবার বাম দিক থেকে উঁকি দিচ্ছে। উঁকি দিতে দিতে একসময় পাহাড়ের মাথায় টুপ করে ডুবে গেল দিনমণি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, এবার চা পানের বিরতি। ভীম সিং তার দুর্বল টায়ার সহ প্রতিটি টায়ার চেক করছে এবার। বেশ বড় একটা ধাবায় চা খেয়ে এবার শুরু হল শুনসান পথে আমাদের রাতের অনিশ্চিত যাত্রা। হেডলাইটের আলোয় অন্ধকারের বুক চিরে এবার তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের বাস। আর, স্টিয়ারিং এ আবার সেই ভীম সিং এর বিশ্বস্ত হাত। অন্ধকার বাসে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। গভীর রাতে শ্রীনগরে থামা হলো ডিনারের জন্য। ঘুম চোখে খেয়ে দেয়ে আবার উঠে পড়লাম বাসে। কিন্তু চোখ রগড়ে বাসের সেই টায়ারের দিকে তাকাতে ভুলিনি !! বেচারী এখনও সুস্থ আছে দেখছি !!!
ভোর চারটে নাগাদ অবশেষে পৌঁছেই গেলাম হরিদ্বার। নিজের ফোন নম্বর দিয়ে, আর আবার হিমালয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আমাদের এতোদিনের সঙ্গী ভীম সিং ও বিদায় নিলো এবার আমাদের কাছ থেকে তার অক্ষত টায়ার সমেত! হরিদ্বারের এবারের হোটেলে সব কটা ঘর ডবল বেড। OYO মার্কা একদম নতুন, আর ঝকঝকে হোটেল। আমি আর আশিষদা একটা ঘর দখল করলাম। আশিষদা ঘুমিয়ে পড়লেও, আমার আর ঘুম এলো না। বাইরে বেরিয়ে গেলাম 'চা' এর উদ্দেশ্যে। আজ আমরা এখানেই থাকব। তাই ভাবলাম হরিদ্বারটা একটু ঘুরে নেবো আজ।
হরিদ্বার নামটা এসেছে হর দ্বার থেকে। কিভাবে এই নাম এলো তার অনেক ইতিহাস আছে। যদিও আমি ইতিহাসবিদ নই!!! হর কা দ্বার থেকে এসেছে হর দুয়ার, সেখান থেকে হয়েছে হরিদ্বার। গাড়োয়ালের সব শিব মন্দির যাওয়ার মূল জায়গা হল হরিদ্বার। এখান থেকেই তুঙ্গ নাথ, রুদ্র নাথ, কেদার নাথ প্রভৃতি শৈব তীর্থে যাওয়ার রাস্তা বেরিয়েছে।
ইতিমধ্যেই সুস্মিতার পাঠানো ট্রেনের টিকিট পৌঁছে গেছে আমার ফোনে। কিন্তু আবার চিন্তা শুরু হল, ফিরতে পারব তো কোলকাতা? সাধু হয়ে হরিদ্বারে, বা 'ভীমপুল' এ থেকে যাওয়ার ইচ্ছা আমার মোটেই নেই। কারণ একটাই, আমার মসৌরী এক্সপ্রেসের টিকিট জিএনডব্লুএল-১০, আর দুরন্তু এক্সপ্রেসের টিকিট ডব্লুএল - ৬১। এই জিএনডব্লুএল- টা আবার কি? কি অলক্ষুণে ব্যাপার!!!
যাওয়ার সময় হরিদ্বার দেখা হয় নি। তাই তৈরি হয়ে নিয়ে সকালের প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম দুই পাহাড়ের মাথায় মনসা মন্দির আর চন্ডী মন্দিরের উদ্দেশ্যে। আসল গঙ্গার দুই পাড়ে দুই মন্দির। রোপওয়ে চেপে উঠতে হবে মন্দিরে। বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার! দুই মন্দির দর্শনের পুরো প্যাকেজই নিলাম আমরা জনপ্রতি ৩৮৪ টাকায়। রোপওয়ে থেকে গঙ্গা সহ পুরো হরিদ্বারই যেন দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে 'হর কি পৌড়ী' ঘাটও। বিগ্রহ দর্শন করলাম, কিন্তু এবার আর কেউই আর পুজো দিলাম না।
মনসা মন্দির থেকে নামার পর, মন্দির ট্রাস্টের বাসই আমাদের নিয়ে গেল হরিদ্বারের গঙ্গা পার হয়ে চন্ডী মন্দির প্রাঙ্গণে (প্যাকেজে)। আবার রোপওয়ে চড়ে উঠলাম চন্ডী মন্দির। দারুণ ব্যাপার !! মন্দির, বিগ্রহ দেখে ফিরতে যাবো, এমন সময় আশিষদা আর পারিজাত দেখতে চলল অঞ্জনি মাতার মন্দির, তিনি নাকি হনুমানের মা। আড়ে চোখে তাকিয়ে দেখি, রাস্তাটা বেশ চড়াই। আবার পাহাড়ের মাথায় চড়তে হবে? ঐ চড়াই দেখেই আমি বেঁকে বসলাম। পায়ের ব্যাথা এখনো সারেনি, কিন্তু আশিষদা আর পারিজাত যাচ্ছে দেখে, আমিও ব্যাজার মুখে তাদের পিছু নিলাম। ব্যাপক বাঁদরের উৎপাত এখানে। লোকের হাত থেকে জিনিসপত্র কেড়েকুড়ে নিয়ে পালাচ্ছে বাঁদরগুলো! বাঁদরের বাঁদরামী আর কাকে বলে! তাই বলে এরকম? এদের শিক্ষার জন্য অবিলম্বে উত্তরখন্ড সরকারের একটা "রাষ্ট্রীয় উচ্চ বাঁদর বিদ্যালয়" খোলা দরকার!
বিগ্রহ দর্শন করে নেমে আসার পর, মন্দির ট্রাস্টের বাস আবার পৌঁছে দিলো আমাদের হরিদ্বার। আবার পেট জ্বালা শুরু হয়েছে! দাদা বৌদির হোটেলে লাঞ্চটা চট্ করে সেরে নিয়ে, একটু রেস্ট নিয়েই যেতে হবে আমাদের গঙ্গা আরতি দেখতে। হরিদ্বারে এসে ওটা না দেখলে নাকি জীবনই বৃথা ! এখানে 'দাদা বৌদির হোটেল' নামে অনেক হোটেল আছে। তবে সবচেয়ে পুরানো আর আসলটা রাজীবদা আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে আগেই। হোটেলের কর্মচারি সহ মালিক সবাই বাঙালি। নৈহাটির আশপাশেই তাদের বাড়ি। হিন্দীভাষী এলাকাতেও সব কটাতেই বাংলায় বড় বড়ো করে লেখা আছে 'দাদা বৌদির হোটেল'। আমাদের হোটেলটায় খাবার ভালোই। নিরামিষ যদিও, তবু সুস্বাদু, আর পরিচ্ছন্ন। স্টিলের থালার উপর ল্যামিনেশন করা একটা কাগজের প্লেটে দেরাদুন চালের ভাত, নুন, লেবু আর ঘি দিয়ে প্রথম শুরু। তারপর আসবে ডাল, বেগুনভাজা অথবা বেগুনি আর তিন রকম তরকারি। সেটাও আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতি দু'বেলায়! যেমন, ধোঁকার ডালনা, আলু পোস্ত, ফুলকপির তরকারি আরও অনেক কিছু। শেষে আবার চাটনি আর পাঁপড়! হাতেগড়া রুটিও পাওয়া যায় এখানে রাতে। তবে জনপ্রতি ৬০ টাকার কুপন কেটে তবেই ঢুকতে হবে। আর সেই কুপন হাতে পেলে তবেই পরিবেশক প্লেট দেবে। তবে, যে যতো খেতে পারো! তারজন্য বাড়তি পয়সা দিতে হবে না। কিন্তু আমার খাওয়া তো পাখির মতো অল্প! ওরা যা পরিবেশন করছিলো, তার অর্ধেক নিচ্ছিলাম আমি। খেয়েদেয়ে আমাদের হোটেলেই ফিরে এলাম একটু বিশ্রামের জন্য।
তাড়াতাড়ি না গেলে জায়গা পাবো না সামনে, তাই বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা চারমূর্তি বেরিয়ে পড়লাম "হর কি পৌড়ী" ঘাটের উদ্দেশ্যে। হোটেল থেকে বেরিয়ে সবে একটু গেছি, দেখি দুই প্রকান্ড ষাড় লড়াই করতে করতে সিং বাগিয়ে এক্কেবার আমার সামনে! আমি তো তিন লাফে পেছনের দিকে দৌড়! রাজীবদার হাতের ক্যামেরা চালু হয়ে গেল তখন!! সে লড়াই আর থামেই না। ভয়ে রাস্তার মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে, দোকানদার-রা দোকান থেকে বেরিয়ে তাদের গায়ে জল দিচ্ছে, কেউ লাঠি বার করে মারছে, তবু তাদের লড়াই আর থামে না! রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য!
এবার ঘাটে পৌঁছে দেখি, চারিদিকে লোকে লোকারণ্য তখনই। প্রকান্ড এক শিবের মুর্তি, ধনুক আকৃতির একটি ব্রিজ এবং ঘড়ি লাগানো একটা ক্লক টাওয়ার ও নজরে এলো ওখানে। আসল খেলা তো এবার শুরু হবে! যা বহুদিন আমার মনে থাকবে!!!
১৩-
গোমুখ থেকে ভাগীরথী উৎপন্ন হয়ে দেব প্রয়াগে অলকানন্দার সাথে মিলিত হওয়ার পর, তার নাম হয়েছে গঙ্গা। এতো পাহাড়ী পথ অতিক্রম করার পর, হরিদ্বারে এই প্রথম তার সমতলে অবতরন। যেন শিবের জটা থেকে মুক্ত হলো গঙ্গা এখানে এসেই! হরপৌড়ী ঘাটে যে গঙ্গা বইছে, তাকে কিন্তু কৃত্রিমভাবে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। আসল গঙ্গা আরও কিছুটা দুর দিয়ে বইছে। চন্ডী মন্দির যাওয়ার সময় যে ব্রিজ দিয়ে আমরা গঙ্গা পার হয়েছি, সেটাই আসল গঙ্গা।
ঘাটের উল্টোদিকে একটা জায়গা নিয়ে আমরা বসে পড়লাম তিন জন। মাইকে বাজছে মন ভোলানো গান "গঙ্গে...গঙ্গে....জয় মা গঙ্গে"। স্বেচ্ছা সেবকরা ভীড় নিয়ন্ত্রণ করছেন, সঙ্গে আবার তাদের চাঁদা তোলার বই! কতো কি যে আছে এখানে পয়সা আয় করার জন্য! মুহুর্তের অসাবধানতায়, আমার ছেলের বয়সী একটা মেয়ে, আমার কপালে ঠাপ্পা লাগিয়েই হাত পাতলো আমার কাছে! মোদীজির নতুন ছাপানো একখান দশ টাকার নোট গচ্চা গেল আমার। তবে কপালের টিকাটা মুছলাম না সঙ্গে সঙ্গে। হোটেলে এসে আয়নায় মুখটা দেখে, নিজেকে বেশ ধার্মিক ধার্মিক মনে হচ্ছিল।
সন্ধ্যা ছ'টা নাগাদ একে একে জ্বলে উঠলো গঙ্গাপাড়ের সব আলো। গঙ্গায় সেই আলোর প্রতিফলন হরপৌড়ি ঘাটকে এক ঝলমলে মায়াবী রূপ দিলো যেন। পুরোহিতরা নানা উপাচারে গঙ্গা পুজো করার পর শুরু হল এবার সন্ধ্যারতি। বহু প্রদীপ সম্বলিত একটা প্রদীপদানি হাতে অনেক পুরোহিত লাইন দিয়ে আরতি করছেন গঙ্গার। আলোকোজ্জ্বল তখন "হর কি পৌঁড়ী" ঘাট। মিনিট দশেক চলার পর শেষ হল আরতি। কিছু ছবি তুলে, এবার আমরাও ফিরলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া আবার 'দাদা বৌদির হোটেল'। রাস্তায় যেতে যেতে দেখি, দু'পাশের ঝলমলে দোকানগুলোতে শুধু বাঙালিদেরই ভীঁড়। কোন দোকানই রুগ্ন নয়। কিছু দোকানদার আবার বাংন্দীতেও (বাংলা আর হিন্দীর মিশ্রণ) কথা বলছেন বাঙালি ক্রেতাদের সাথে।
ইতিমধ্যে আমরা যখন মনসা মন্দির গেছি, এদিকে ঘটে গেছে তখন আর এক কান্ড! এবারই তো আসল খেলা শুরু! সেটা বলি একটু? তাহলে আর একটু ধৈর্য ধরে পড়ুন দয়া করে। নিজেকে কাঠবাঙাল বলে জাহির করা রাজীব নন্দীর ফানুস ফুটো হয়ে গেছে তখন!! লম্ফ ঝম্প সব আউট ! উদ্ধত ডান হাতের তর্জনি সহ দুটো হাত তখন জিন্সের সামনের দু'পকেটে ঢুকে গেছে! চেহারা থেকে দোর্ডন্ড প্রতাপ রাজনৈতিক নেতার ছাপ উড়ে গিয়ে তখন যেন হতাশ প্রেমিকের ছাপ ফুটে উঠেছে! চুল উস্কো খুস্কো, কপালে ও যেন ভাঁজ পড়েছে! সেও কোথা থেকে যেন জেনে ফেলেছে, হরিদ্বার থেকে হাওড়াগামী সব ট্রেন ১৭ থেকে ২২শে অক্টোবর তারিখ পর্যন্ত সত্যিই ক্যানসেল!! ট্রেন লাইনে কাজ হওয়ার জন্য। এবার ছোটাছুটি শুরু করেছে সে খাঁচায় ধরা পড়া ইঁদুরের মতো!! "দেখ কেমন লাগে এবার"! আমায় মুরগি বানানো?
আমরা তিনজন বাইরে বেরিয়েছিলাম ব্রেকফাস্টের উদ্দেশ্যে, আর উনি দৌড়েছিলেন স্টেশনে ট্রেনের খবর জানতে। স্টেশনমাস্টার ওনাকে বলেছেন, ওনার 'গাধা ট্রেন' 'দুন এক্সপ্রেস' হরিদ্বার থেকে না ছেড়ে বেরিলী থেকে ছাড়বে, রাত বারোটার সময়! হরিদ্বার থেকে বেরিলী ২৪৭ কিমি, সময় লাগবে ছ'ঘন্টার মতো। অগত্যা উনি 'কিং কর্তব্য বিমূঢ়' হয়ে হরিদ্বার হইতে বেরিলী যাইবার ১৪ জনের জন্য দুইখানি গাড়ির ব্যাবস্থা করিয়া অগত্যা হাঁপাইতে হাঁপাইতে হোটেলে ফিরিয়াছেন!! একবার খালি জিঞ্জেস করেছিলাম, "দাদা, হরিদ্বার থেকে মসৌরী এক্সপ্রেসটা দিল্লী যাবে তো?" ব্যাস! রুটি করার পরে গরম লোহার চাটুতে যেন জল পড়ল !!
খেঁকিয়ে উঠে বলে উঠলো, 'হ্যাঁ,...হ্যাঁ...যাবে!" মটকা গরম আছে দেখে, আমিও সাইড হয়ে গেলাম তাই। তখন আমি চিন্তায় থাকলেও, টিকিট কনফার্ম থাকায় আশিষদা খোস মেজাজে! আর, আরও একজন কনফার্ম টিকিটের মালিক ইন্টারনেট এক্সপার্ট পারিজাত শুধু ফোনে দেখছে, আমার টিকিট কনফার্ম হলো কিনা!
বেলা এগারোটা পর্যন্তও যখন মসৌরী এক্সপ্রেসের টিকিট গুগল দাদু GNWL- ১ বলছে, তখন বাধ্য হয়েই হরিদ্বার থেকে দিল্লী যাওয়ার বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হচ্ছিলাম, বাসে দিল্লী পৌঁছানোর টিকিট কাটতে! আমি দরজার বাইরে পা রাখার আগে শেষ বারের মতো নেট সার্চ করে পারিজাত দেখলো আমার দিল্লী যাওয়ার টিকিট RAC- 47 হয়েছে। হিল্লে তাহলে একখান হয়েছে বাড়ি ফেরার ! কিন্তু দুরন্তু তখনো আমায় অনিশ্চয়তায় রেখেছে।
বাসে দিল্লী যাওয়ার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে, এবার আমরা লাঞ্চ করে এসে শুয়ে পড়লাম! আমাদের ট্রেন তো রাত ১০ঃ৫০ ! রাজীবদাদের অবশ্য একটু পরেই বেরোতে হবে! নইলে, রাত বারোটায় বেরিলী থেকে আর ঐ 'গাধা'র পিঠে চড়তে পারবে না! যাদের ফ্লাইটে যাওয়ার কথা ছিলো, তারা বেলা এগারোটার মধ্যেই রওনা দিয়েছেন! কিন্তু আমার কি হবে? 'দূরন্ত এক্সপ্রেস'এ আমার টিকিট তখনো গুগল দেখাচ্ছে WL 57!!
যা হওয়ার তা তো হবেই, যাই তো আগে দিল্লী!! রাজীবদা-রা বেলা সাড়ে চারটেতেই সবাইকে নিয়ে বেরিলী রওনা হয়ে গেল। আর আমরা রাত ন'টায় দাদা বৌদির হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে চললাম এবার স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হরিদ্বার থেকে মসৌরী এক্সপ্রেসে তিনটে কোচ জোড়া হয়। আমার সিট তার ই একটা এস-৮ এ। আর আশিষদাদের অনেক দূরে এস-২ তে। সত্যিই বহু লোক বিপদে পড়েছেন ট্রেন ক্যানসেল হওয়ায়। একটা ১৪ জনের গ্রুপ আমাদের কোচেই ছিল। তারা অনেক পয়সা দালালকে বেশি দিয়ে, তাদের তৎকাল টিকিট কাটিয়েছেন। কিন্তু তাদের আরও ১০ জনের টিকিট তৎকালেও না পাওয়ায় ৮০০০ করে জনপ্রতি গচ্চা দিয়ে ফ্লাইটে টিকিট কাটতে হয়েছে। চারজনের একটা ফ্যামিলি তো কিছু না জেনে চলেই এসেছে স্টেশনে দুন এক্সপ্রেস ধরবে বলে। তাদেরও মাথায় হাত! এই পিক সিজনে কোন নোটিশ না দিয়ে, রেলের এমনটা করা ঠিক হয়নি কিন্তু। ইতিমধ্যেই ফোনে দেখি আবার কোন এক দৈববলে আমার দুরন্ত এক্সপ্রেসের টিকিট করফার্ম হয়ে গেছে!! WL-57 , RAC না হয়ে সোজা কনফার্ম ? এবার নিশ্চিন্ত হলাম।
দিল্লী থেকে দুরন্ত বেলা ১২ঃ৫০! আর মসৌরী এক্সপ্রেস দিল্লী পৌঁছাবে সকল সাতটা। অর্থাৎ পাঁচঘন্টা আমায় বসে থাকতে হবে? যাই হোক, রাতে গুঁতোগুঁতি করে RAC তে এক বার্থে দুজন চলছি! লোকাল ট্রেন মনে হয় এর চেয়ে বেশি জোরে চলে!!! ভোরের দিকে দেখি, ট্রেন অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে একটা অখ্যাত অজানা নাম না জানা স্টেশনে। কারা যেন হুটোপাটি করতে করতে চলেছে প্লাটফর্ম দিয়ে। জানলা দিয়ে বাঙালী কন্ঠে একটা আওয়াজ শুধু কানে ভেসে এলো.... "আরে, ইঞ্জিনই তো খারাপ হয়ে গেছে......"! আরে!!! কার ইঞ্জিন রে ভাই?
সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থেকে নিচু প্লাটফর্মে নেমে দেখি বেশ কিছু লোক তাদের পোঁটলা পুঁটলি নামিয়ে নিয়ে চলেছে মেন রাস্তার দিকে, বাসে দিল্লী পৌঁছাবে বলে। কিছুটা এগিয়ে, ইঞ্জিনে ড্রাইভারের কাছ থেকে আমিও শুনে এলাম, আমাদের ট্রেনের ইঞ্জিনই খারাপ হয়ে গেছে। অন্য ইঞ্জিন আসবে, তবে ট্রেন চলবে। এবার কি করি ?
আমার বার্থে যে হিন্দী ভাষী অল্প বয়সী যুবকটি ছিলো, ঐ রুটে নিয়মিত যাতায়াত করে সে। সে বলল, স্টেশনের বাইরে থেকে টোটো নিয়ে, সতেরো কিমি দুরের মান্দি ধনুরা স্টেশনে পৌঁছে ওখান থেকে দিল্লীর ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরতে। ফোন লাগালাম আশিষদা-দের। হন্তদন্ত হয়ে পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে ওরাও নেমে এলো! স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র টোটোটা ২০০ টাকায় আমরাই বুক করে এবার চললাম মান্দি ধনুরা স্টেশনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ টোটোর যা গতি, তাতে ইন্টারসিটির টাইম অনুযায়ি স্টেশনে পৌঁছানোই মুশকিল। যাই হোক, ট্রেন ২৫ মিনিট লেট থাকায় পেয়ে গেলাম ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। কপালের গেরো কাটলো যেন! দুরন্ত ছাড়ার ঠিক ৫০ মিনিট আগে পৌঁছেও গেলাম দিল্লী। ট্রেনে উঠে দেখি, পারিজাত আর আমার একই কোচে বার্থ! ওর সাইড আপার! আর আমার ছ'টা বার্থের একদম নীচের সিট আমার পছন্দের লোয়ার বার্থ!! নির্দিষ্ঠ সময়ে দিল্লী থেকে রওনা হয়ে, এবার শুরু হল দুরন্ত এক্সপ্রেসের দুরন্তপনা! কিন্তু, ঝড়ের গতিতে ঘন্টা দুই চলার পর যেন গোত্তা খেতে শুরু করল আমার দুরন্ত ঘোড়াটা! ট্রেন লাইনে বিস্তর জায়গা জুড়ে বড়ো বড়ো যন্ত্র আর অসংখ্য লোক কাজ করছে। গতিতে লাগাম পড়ল এবার আমার ঘোড়ার ! থেমে থেমে ঢিকোতে ঢিকোতে পায়ে যেন গেঁটে বাত নিয়ে চলতে শুরু করল এবার!
হোয়াটস অ্যাপে এ এস এম এস চালাচালিতে আর ফোনে ট্রেনের টাইম টেবিল দেখে বুঝে নিলাম, রাজীবদার 'গাধা' দুন এক্সপ্রেস তখন চলছে সাড়ে চার ঘন্টা লেটে! আর আমার 'ঘোড়া' তখন গোঁত্তা খেতে খেতে চলেছে দেড় ঘন্টা লেটে। রাতেও আর ঐ লেট কভার করতে পারল না আমার 'ঘোড়া'! গাধা আর ঘোড়া অতঃপর যথাক্রমে সাড়ে চার ঘন্টা আর তিন ঘন্টা লেটে পৌঁছালো হাওড়া। অতএব, আমরা আড়াই ঘন্টার ব্যাবধানে সকলেই পৌঁছলাম এবার হাওড়ায়।
কোলকাতা থেকে ট্রেনে যাত্রাপথের দিনগুলো ছাড়া, আমাদের ট্যুর ছিল বারো দিনের। তাই তের পার্বণে শেষ করলাম এবার আমার জম্মের প্রথম লেখা আর প্রথম ট্রেকের মেগাসিরিয়াল ভ্রমণ কাহিনী। যাঁরা এই তেরো দিন ধরে আমার সঙ্গে ছিলেন আর আমায় লেখার উৎসাহ যোগালেন, তাঁদের জানাই আমার অকুন্ঠ অভিবাদন আর ধন্যবাদ।
ভুলে যাওয়া তথ্য মনে করিয়ে দিয়ে এবং নতুন কিছু তথ্য দিয়ে আমায় লিখতে যাঁরা সাহায্য করলেন, তারা হলেন আশিষ গায়েন, পারিজাত দত্ত, রাজীব নন্দী এবং স্বয়ং গ্রুপ এডমিন স্বপ্ন পাল।
আবার কখনো আসবো হয়তো আমার প্রিয় গ্রুপের জন্য আবার কোন ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে। যেমন আবার যাবো, আমার প্রিয় হিমালয়েও !!!
যদি তারে
নাই চিনি গো
স্বস্তিকা চ্যাটার্জি দাস
গল্প
ফ্ল্যাশব্যাক.........
সোমবার সকাল দশটা - আমার ফ্যাক্টরি কাম অফিসে নিজের ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে সবে জলের গ্লাসটা মুখে তুলেছি, ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠলো; ফোন তুলতেই ওপাশে রিসেপশানিসট সঞ্জয়ের পরিমার্জিত গলা,
“গুড মর্নিং স্যার; ম্যাক্সলাইন ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টের রিজিওনাল ম্যানেজার, মিঃ মাইতি কথা বলতে চাইছেন। লাইন কি দেবো?” আমি অফিসে এসে আমার কেবিনের গণেশ আর লক্ষ্মী ঠাকুরের মূর্তিতে প্রণাম না করে কাজ শুরু করি না; কিন্তু কি করা যাবে? কাস্টমার বলে কথা; তার উপর এঁদের কোম্পানির একটা বড় কাজ ফ্যাক্টরিতে দু সপ্তাহ হল শুরু হয়েছে। শশব্যস্ত হয়ে বললাম,
“হ্যাঁ, দাও।" এই সবে কাজ শুরু হল, এখনই কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টের ফোন? এঁর সাথে পরিচয় নেই, নতুন কি? ততক্ষণে ফোনের ওপাশ থেকে একটা ফ্যাসঁফ্যাসেঁ গলা,
“হ্যালো মিঃ পাত্র, গুড মর্নিং, ম্যাক্সলাইন ইন্ডাস্ট্রির শান্তনু মাইতি বলছি। আপনাদের যে অর্ডারটা দিয়েছি সেই কাজটার কোয়ালিটি প্ল্যানটা এখনও জমা দেননি কেন? ওটা তো সাতদিনের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা।"
গলায় বিরক্তি স্পষ্ট, আমি কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত,
"না, মানে আমরা তো আপনাদের দেওয়া কোয়ালিটি ম্যানুয়াল মেনেই কাজ শুরু করেছি; কিছু কি গণ্ডগোল..." কথা শেষ করতে পারলাম না, ওদিক থেকে ভেসে এলো,
"শুনুন, আমাদের কোম্পানির কোয়ালিটি সিস্টেমের কয়েকটা নিয়ম আছে; আমার মনে হচ্ছে, আপনারা সেগুলো ভালো করে দেখেন নি। যাই হোক, আপনাদের কোম্পানিতে যিনি এই কাজটার দায়িত্বে আছেন তাঁকে কাল-পরশুর মধ্যে আমাদের অফিসে এসে দেখা করতে বলবেন। এখন রাখছি।"
ওপাশে খট করে লাইন কাটার আওয়াজ। এই ফ্যাসাদ বড় কোম্পানির অর্ডার নেওয়ার – হাজার বায়নাক্কা!
ইশ, একেবারে হঠাৎ করে কোন মুখবন্ধ ছাড়াই ঘটনা বৃত্তান্ত শুরু করে দিয়েছি - মাপ চাইছি! প্রেক্ষাপটটা বলি আপনাদের....
আমি চন্দন, চন্দন পাত্র। আমার একটা মাঝারি মাপের ব্যবসা আছে - ওই বজবজের দিকে যেতে মহেশতলায় ফ্যাক্টরি, “ইউনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস প্রাইভেট লিমিটেড", যেখানে স্টিল দিয়ে ফেব্রিকেশনের কাজ করা হয়। ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন আমার বাবা এবং বেশ ভালোই দাড় করিয়েছিলেন। তারপর, বাবা হঠাৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করাতে, একমাত্র সন্তান হিসেবে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই, খানিকটা বাধ্য হয়েই আমাকে ব্যবসার হাল ধরতে হল। সেই শুরু, তখন থেকে এই ব্যবসাই আমার ধ্যানজ্ঞান। আমি "কনফারমড ব্যাচেলার" - পদবি পাত্র হলে কি হবে বিয়ের পাত্র হবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটাই আর হয়ে ওঠেনি। তাই সংসারের ঝুটঝামেলা নেই, বাড়ীতে কারুর কাছে জবাবদিহি করার নেই – বিয়ের নাড়া বাঁধা হিংসুক বন্ধুদের কথায় ঝাড়া হাত-পা!
দু মাস আগে এই বিশাল বহুজাতিক কোম্পানি ম্যাক্সলাইন ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের থেকে বেশ বড় একটা অর্ডার পেয়ে খুব চাপে আছি। অনেক চেষ্টা করে, নানা ধাপে যোগ্যতা প্রমাণ করে অর্ডারটা পাওয়া। দিনরাত কারখানায় কাজ চলছে; ইন্সপেকশন হবে আর এক মাস পরেই। আমাদের মাঝারি মাপের “বাংলা” কোম্পানি, আলাদা কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট বলে কিছু নেই; এতদিন তেমন দরকারও পড়েনি। খেটেখুটে সৎ ভাবে কাজ করে এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেটে ভালোই নাম আছে আমাদের কোম্পানির। এই প্রথম একটা এত বড় বহুজাতিক কোম্পানির কাজ নিয়েছি।
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের, তরুণ তুর্কি, নিলাদ্রি সেনকেই দায়িত্ব দিয়েছি এই অর্ডারটার যাবতীয় টেকনিকাল ও কোয়ালিটি ডকুমেন্টেশান দেখাশোনা করার। তাকেই বললাম যত তাড়াতাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা সামাল দিতে।
নিলাদ্রি তার পরের দিনই দৌড়ল ম্যাক্সলাইনের অফিসে। দিনের শেষে,ওর কাছে যা রিপোর্ট পেলাম তাতে বুঝলাম ম্যাক্সলাইনের এই কোয়ালিটি ইন্সপেকশন বেশ চাপের হবে! নিলাদ্রির গজগজানি শুনে বুঝলাম মিঃ মাইতি ওকে বেশ ভালোই রগড়েছেন! ও আরও জানালো যে, ইন্সপেকশন টিমের সঙ্গে প্রথম দিনেই এই কোয়ালিটি হেড, মিঃ মাইতি আর প্রোকিওরমেনট হেডের সঙ্গে মুম্বাই থেকে আসবেন কোম্পানির “অল ইন্ডিয়া কোয়ালিটি হেড”! তাঁদের মধ্যে একমাত্র ওই প্রোকিওরমেনট হেড, মিঃ ঘোষালের সাথে অর্ডারের আলোচনা চলাকালীনই বেশ কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে; ভালোই সম্পর্ক আছে। এখন এই কোয়ালিটি হেডুরা কি ঝামেলা পাকাবে – সেই নিয়ে কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে পড়লাম! একেবারে যাকে বলে “গোদের উপর বিষফোঁড়া”!
আমাদের কারখানার কর্মচারীরা দুরন্ত গতিতে কাজ করে ম্যাক্সলাইনের অর্ডারের মাল তো ঠিক সময় তৈরি করে ফেলেছে! তারপর সেই ইন্সপেকশন...
অফিস, কারখানা চত্ত্বর, মেশিনপত্র সব ঝকঝকে তকতকে, আমরা ফিটফাট হয়ে সকাল থেকে তৈরি। ঠিক এগারোটার সময় গেটে এসে দাঁড়ালো ম্যাক্সলাইনের গাড়ি, নামলো ইন্সপেকশন টিম; মিঃ ঘোষাল, মিঃ মাইতি, আমাদের এই প্রোজেক্টের কোয়ালিটি ম্যানেজার মিঃ মণ্ডল আর একজন ভদ্রমহিলা। বুঝলাম, এই মহিলাই সেই “অল ইন্ডিয়া কোয়ালিটি হেড”, “ম্যাডাম বর্ণালী বাসু”, যিনি কিনা শুনেছি খুবই স্ট্রিক্ট! যদিও হাবেভাবে চেহারায় সেরকম কোন ছাপ দেখলাম না। বেশ সাবলীল, মিষ্টভাষী। বরং, মিঃ মাইতির আর মিঃ মণ্ডলের মুখ অনাবশ্যক গম্ভীর – হয়তো বসের সাথে এসেছেন বলে! অফিসে বসিয়ে প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পরেই, তাঁরা কারখানায় প্রোডাকশান ফ্লোরে চলে এলেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরিদর্শন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললো। ম্যাডাম বাসু, কারখানার কর্মীদের সাথে এত সাবলীল ভাবে মিশে গিয়ে পরিদর্শন করছিলেন যে সবাই খুব উৎসাহিত হয়ে “খুল্লুমখুল্লা” বলতে লাগলেন। আমি একটু চিন্তান্বিত হয়ে পড়ছিলাম – বেশী বলতে গিয়ে কোথায় ফাঁকফোঁকর না বেরিয়ে যায়! খানিকবাদে, আমি তাঁকে বললাম,
“চলুন ম্যাডাম, আপনি অফিস ঘরে গিয়ে বসবেন, নিলাদ্রি এঁদের সব দেখিয়ে দেবে”। মনে হল তাঁর মুখে একটা হাল্কা হাসির রেশ খেলে গেলো; তারপর আমার সাথে অফিস ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অফিসে এসে উনি জল খেয়ে নিজের ল্যাপটপ খুলে বসলেন। তারপর হঠাৎ আমার দিকে সোজা তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললেন,
“ওয়েল ডান, মিঃ লালটু!!” লালটু !!! শুনে, আমার অবস্থা? মুখ হাঁ, চোখ প্রায় কপালে উঠে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড় –
“মানে, মানে...আপনি...তুমি...তুই...!!!” ততক্ষণে নিলাদ্রি, মিঃ মাইতি ও মিঃ মণ্ডলকে নিয়ে অফিসে ঢুকে পড়েছে; মনে হল বেশ খুশী; বললেন অফিসে গিয়ে রিপোর্ট আর ডেলিভারি শুরু করার অনুমতি পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু, ম্যাডাম চুপচাপ শান্ত মুখে কাজ করছেন যেন কিছুই হয়নি! ওঁদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি আর নিলাদ্রি অফিস ঘরে ফিরলাম। নিলাদ্রির স্ফূর্তি আর ধরছে না; ও আমার ঝিমধরা ভ্যাবলা হাবভাব খেয়াল করে চিন্তান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার, আপনার শরীর ঠিক আছে তো? এত ভালোভাবে ব্যাপারটা উৎরে গেলাম, তাও আপনি এত গম্ভীর ? মুখটা কেমন লাল হয়ে আছে!”
আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আরে, না, না, শরীর একদম ঠিকঠাক। এইবার তো সুষ্ঠুভাবে যাতে মাল ডেলিভারি করা যায় সেই ব্যবস্থা শুরু করতে হবে”।
“তবে সত্যি সবাই খুব ভাল কাজ করেছো; চল, কারখানায় যাওয়া যাক – ওঁদেরও অনেক অভিনন্দন প্রাপ্য”।
বর্ণালী বাসু “লালটু” বললেন? ব্যাপারটা কি? ইনি কি সেই? এরকম দেখতে ছিল কি! একটা রোগা, ছটফটে চেহারা খুব ধূসরভাবে মনে ভেসে এল;...মুখের চেহারা কই তেমন মনেই পড়ে না! ইশ, কি লজ্জার ব্যাপার! কি যে করি? একবার ভাবলাম ফোন করে জিগ্যেস করি! না,না সেটা একেবারেই ঠিক হবে না!
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফেরার পথে গাড়ীতে উঠেই অরুণকে ফোন করলাম। অরুণ আর আমি দুজনে সেই ইউনিভার্সিটি দিন থেকেই যাকে বলে হরিহর আত্মা টাইপ। অরুণ বিবাহিত, আমার মত “ফ্রি বার্ড” নয়, তবে আমাদের হাজার ব্যস্ততা – ওর চাকরি, সংসার, আমার ব্যবসা ইত্যাদি সত্ত্বেও আমাদের যোগাযোগ এবং আড্ডা এখনও দিব্যি নিরবিচ্ছিন্ন।
ফোন লাগতেই জিগ্যেস করলো, “কি রে, তোর সেই ব্যাপক অর্ডারটার খবর কি? কারখানা থেকে মাল বেরোচ্ছে?”
আমি বললাম, “আরে, ওসব ঠিক আছে। তোকে যে কারণে কল করেছি......”।
আমি উত্তেজিত ভাবে বললাম আজকের ঘটনা; ও প্রথমে অবাক! তারপর হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে হাসতে বললো, “নির্ঘাত তোর সেই “উচ্চিংড়ে”! নাহলে, “লালটু” বলে আর কোন মেয়ে তোকে ডাকবে?” আমি আমতা আমতা করে বললাম, “উচ্চিংড়ে ...আসল নাম কি তুই জানতিস বা মনে আছে? আমায় চিনে ফেললো, আর আমি চিনতে পারলাম না?” অরুণ আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললো, “আরে চাঁদু, তোকে না চিনতে পারার কোন কারণই নেই। এখনও তো দিব্যি লালটু আছিস - এই বয়সেও যা চেহারা রেখেছিস!”
প্রায়শই আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছে আমায় এরকম শুনতে হয় তারপর অবধারিত ভাবে যোগ হয়,
"সুখে আছিস মাইরি, সংসারের ঝামেলা নেই, দুহাতে টাকা রোজগার আর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো"। আরে, দুহাতে রোজগারের জন্যে যা খাটতে হয়, সেটা কি তোদের চোখে পড়ে না? আর, সংসার? - তা তোদের বউ, ছেলেমেয়েদের ছবি ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে দেখে দুএকটা হাল্কা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে কি আর আসে না?
অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ীর সিটে গা এলিয়ে মনটা ওই যাকে বলে “নস্টালজিক” হয়ে যাচ্ছিল – ওই “লালটু”, “উচ্চিংড়ে” ...কথাগুলোর প্রভাব,
তা বয়স আমার মন্দ হয়নি; আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন যারা রেডিও থেকে স্মার্ট টিভি, গোদা কালো স্থাণুবৎ টেলিফোন থেকে সারাক্ষণের সঙ্গী মোবাইল, হাতে লেখা “স্নেল মেল” থেকে ইমেইল...ইত্যাদি বিবর্তনের সাক্ষী। তার মানে বুঝতেই পারছেন বয়সের নিরিখে প্রায় প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়।
আহা, ইউনিভার্সিটির সেই অপূর্ব সোনালি রঙের দিনগুলো...।
পড়তাম প্রোডাকশান ইঞ্জিনিয়ারিং। পড়াশুনো যত না, হইহই, আড্ডা, তার শত গুণ! তবে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছেলেদের বেজায় দুঃখ ছিল - “সহপাঠিনীর" অভাব। তারমধ্যে কয়েকজন করিতকর্মা, যারা অন্য ডিপার্টমেন্টে বা "ঝিল-কা-উস্পারে" আর্টস কিংবা সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে কোন বান্ধবী জুটিয়ে ফেলতো তারা একেবারে হিরো বনে যেতো। আমি চিরকালই মুখচোরা, মানে যাকে বলে "গুডি-গুডি" টাইপের। এক-দুজনের সাথে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক উৎসবের সময়ে আলাপ হয়ে মন কিঞ্চিত উড়ু-উড়ু হলেও, আমি সাহস সঞ্চয় করে ব্যাপার দানা বাঁধানোর আগেই পাখি ফুড়ুৎ! এরকম ভাবে শেষ বছরের উৎসবের সময়ে দেখা গেল আমাদের ক্লাসের দীপ্তর সাথে দুজন মেটালারজি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের মেয়ের বেশ একটু মাখো মাখো বন্ধুত্ব; দূর থেকেই দেখতাম আর দীপ্তকে খোঁচাতাম আমাদের সাথেও আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে। কিছুদিন পরে আমার আবার একটির জন্যে খানিক ব্যথা জাগলো; তখন ফাইনাল ইয়ার বলে কথা, একেবারে “ডেস্পো” অবস্থা - দীপ্তকে বলেই বসলাম! ক’দিন বাদেই দীপ্ত মুখে চুক চুক আওয়াজ করে শুনিয়ে দিলো,
“জমলো না রে চাঁদু; ভ্যাকান্সি নেই; তারপর আবার তোর সম্বন্ধে বলে কি –ওই “লালটু” পাবলিক!” এখনও মনে আছে, শুনে আমার মত গোবেচারা ছেলেও (মানে তখন যেরকম ছিলাম আর কি!) লজ্জায়, রাগে ফেটে পড়েছিলাম,
“আমি লালটু? আর ওটা কি – একটা মিচকে উচ্চিংড়ে – আমার বয়েই গেছে...!”
তারপর মাঝেমাঝে যদি কখনো ওই মেয়ের সামনাসামনি পড়ে যেতাম, মনে হত উচ্চিংড়েটার মুখে ফিচেল হাসি – আমি কোনোরকমে মুখ লুকিয়ে পালাতে পারলে বাঁচতাম। এখন আর মনেও পড়ে না সেই মেয়ের নাম – জানতামও কি? কেমন দেখতে ছিল? – সেই স্মৃতিও অনেক ফ্যাঁকাসে! মনে পড়ে গেল তারপর বেশ কয়েক মাস বন্ধুদের কাছে হ্যাঁটা খেয়েছি “উচ্চিংড়ে হলে কি হবে, লেঙ্গির কিন্তু হেব্বি জোর!”
বর্তমানে………
আমার মনটা আজকাল মাঝে মাঝেই কেমন উড়ুউড়ু হচ্ছে। একদিন একটা ছোটখাটো বিলের পেমেন্টের ব্যাপার নিয়ে হাজির হয়ে গেছিলাম ম্যাক্সলাইনের অফিসে – যেখানে কিনা নিলাদ্রি গেলেই কাজ হতো। মিঃ ঘোষাল আমায় দেখে একটু অবাকই হয়েছেন মনে হল। তাঁর সাথে কাজ হয়ে যাওয়ার পর কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টে একবার দেখা করে যাওয়াটা উচিৎ মনে হল – মানে ওই কাস্টোমার রিলেশানশিপ, আর কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু। মিঃ মাইতির সাথেও কথা হয়ে গেল; তারপর হাল্কা ভাব দেখিয়ে জিগ্যেস করলাম,
”ম্যাডাম কি আছেন?” বুকের ভিতর ডিউস বলের বাউন্সিং, পেটের ভিতর প্রজাপতির ফড়ফড়ও বেশ টের পাচ্ছিলাম! উনি বললেন,
“বর্ণালী ম্যাডাম? না, উনি তো মুম্বাই ফিরে গেছেন।“
আহা, কি আনন্দের খবরই দিলেন! বুকে যে শেল বাজল! নিজেকে ধমকালাম – এই বুড়ো বয়সে এরকম বোকামো কেন? তারপর রাগ হল ওই মিচকে উচ্চিংড়েটার উপর – কি দরকার ছিল, পুরনো ব্যথা খুঁচিয়ে দেওয়ার? তাহলে, আর যোগাযোগ না করে কেটেই বা পড়লি কেন?
আমার খুড়তুতো বোন থাকে মুম্বাইতে। কতবারই তো বলেছে ওখানে ঘুরে আসতে। ভাবছি, পুজোর কটা দিন ঘুরেই আসি......। তাছাড়া, ভবিষ্যৎ ব্যবসার কথা ভেবে ম্যাক্সলাইনের হেড অফিসে বড় অধিকর্তাদের সাথে ভালো করে আলাপ পরিচয় করাও তো জরুরী, তাই না? –
আপনারা কি বলেন?
আর চুপিচুপি একটা কথা বলি - একজনের ফেসবুক একাউন্টে দেখে নিয়েছি স্ট্যাটাসে “সিঙ্গিল” লেখা। আরেকবার কপাল ঠুকে দেখা যাক -
কি বলেন?………জয় গুরু!!
(গল্পটি পুরোপুরি আমার কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবের কোন ঘটনা বা চরিত্রর সাথে মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।)
গল্প
আশার আলো
মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়
পশ্চিম মেদিনীপুর
সমুদ্র, আমার সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে কাছের বলতে দীঘার সৈকত। তাও অনেক বছর পর এলাম, সমুদ্রের চঞ্চল জলরাশির মতো চঞ্চল ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে। আমার এক বন্ধুও এসেছে সাথে।প্রকৃতি পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আভা আকাশ জুড়ে রঙের খেলায় ব্যস্ত, তার নিচে উত্তাল সমুদ্রের নীল জলরাশি। মন উদাস করে দেয় আমার, ফেলে আশা দিনগুলি স্মৃতির পাতা থেকে উঠে আসে।সমুদ্রতীরে বসে আছি, ছোট বড় ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছে তটে। আমার বন্ধুটি বাচ্চাদের সাথে খেলায় ব্যস্ত। তাদের থেকে একটু দূরেই বসেছি আমি, একটু একা থাকার অভিলাষে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ, চোখে physics নিয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। কয়েক মাস পরেই দেখা তার সাথে, তৃষা। প্রেমে পড়েছিলাম প্রথম দর্শনেই। আমার বিভাগের না হলেও বন্ধুত্ব করেছিলাম, প্রেমের সম্পর্ক গভীর হতে সময় লাগেনি। বড়লোক বাড়ির মেয়ে, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের।গানের গলা ছিল তার। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার প্রিয়, আমায় শোনাত গেয়ে। দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটছিল, হয়ত স্বপ্ন হলেই ভালো হতো। না। তাহলে আজ আমি এখানে থাকতে পারতাম না।
পড়া শেষ হওয়ার পর আমি আরো উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়ার জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।আমায় একদিন তৃষা দেখা করে বলল তার বিয়ের জন্য তার বাবা উঠেপড়ে লেগেছেন, উপযুক্ত পাত্র পেলে এই বছরই বিয়ে দেবেন। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি তৃষাকে বোঝালাম , আমায় একটু সময় দিতে, অবশ্যই কোনো কাজ ঠিক জোগাড় করে নেব। আশ্বস্ত করতে পারিনি হয়ত তাকে। কয়েকদিন পর রাস্তায় হঠাৎ তৃষার সাথে দেখা, সঙ্গে তার একটি ছেলে। অপ্রস্তুতে পড়ে গেছিল আমায় দেখে, চিনেও না চেনার অভিনয় করেছিলাম সেদিন। ওই ফোন করেছিল কিছুক্ষণ পরে। ঐ ছেলেটির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে ওর, ব্যাঙ্কে চাকরি করে, নভেম্বরে বিয়ে, আরো কিছু বলছিল আমি শুনিনি, শুধু বলেছিলাম, "ভালো থেকো", ফোন রেখে দিয়েছিলাম।কলকাতায় মেসে থাকতাম। খাইনি, ঘুমোইনি সেদিন। সন্ধে থেকে ঘরে ঢুকিনি, সব কিরকম ঝাপ্সা, ভিতরটা এক অজানা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছিল, চোখের জল পড়েনি এক ফোঁটাও। রাত কত হিসেব রাখিনি, জীবনের সময় থমকে গিয়েছিল যেন। এগিয়ে গেলাম তীব্র গতিতে ছুটে আসা লরির দিকে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল আলোয়, আর কিছু মনে নেই।
চোখ খুলল যখন প্রথমে বুঝতে পারিনি কোথায়। হাতে স্যালাইনের নল আর চারপাশের পরিবেশ দেখে বুঝলাম নার্সিংহোমে আমি। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। বেঁচে আছি বলে রাগ হল। কে বাঁচাল? কেন বাঁচাল আমায়? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, অসহ্য লাগছিল নিজেকে, একটা কাজও ঠিকমতো হয় না। এমন সময় একজন ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলা ছাড়াও মেয়েও বলা যায়, বয়স ২৫ এর বেশি হবে না। আমি রাগে উত্তেজিত হয়ে বসতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটি ধরে শুইয়ে দিল।
"আপনি কি পাগল? এভাবে কেউ ..", তাকে থামিয়ে আমি রাগত স্বরে বললাম,
"আপনি কেন বাঁচালেন আমায়? কে আপনি আমায় বাঁচানোর? কিছু জানেন কেন মরতে গেছিলাম? কিছু জানেন না,তবে পরোপকার করতে কে বলেছে আপনাকে?" কথাগুলো ঝড়ের বেগে বলে হাঁপাতে লাগলাম।
সে স্মিত হেসে বলল, "শান্ত হোন,শান্ত হোন।" একটু থেমে বলল,
"আমি মানুষ। তাই মানুষের প্রাণ বাঁচানো আমার কর্তব্য, তাই করেছি। আমি চিনি না,জানি না আপনার সম্পর্কে, তবুও এটুকু বুঝি নিশ্চয় কোনো কষ্ট আপনি পেয়েছেন আর তাই পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন।" কিছুক্ষণ চুপচাপ।
"আপনি এরকম আহাম্মকের মতো কাজ করতে যাচ্ছিলেন কেন?" কথাটা বলেই সে অপ্রতিভ হয়ে
চুপ করে রইল। আমি নির্বাক।
"ক্ষমা করবেন। আপনাকে ঐ ভাবে বলা উচিত হয়নি।" কিছু বললাম না।"আপনার বাড়িতে খবর দিয়েছি। ওনারা এলে আমি চলে যাব।" আমার গলা কান্নায় ভারী হয়ে আসছে।"কিভাবে কি নিয়ে বাঁচতে পারব বলবেন? আমার সব স্বপ্ন তার যাওয়ার সাথে ভেঙে গেছে, অর্থহীন লাগছে সব।" ধরা গলায় কথা কটি বললাম কোনরকমে।
সে হাসল। তার সেই হাস্যজ্জ্বল মুখটির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম।
"আপনাকে একজন ছেড়ে গেছে বলে আপনি তাদেরও ছেড়ে যাবেন? মা-বাবার মুখও মনে পড়ল না?"
আমি লজ্জিত হলাম, ধিক্কার, আমি মা-বাবাকে ভুলে গেলাম! নীরবতা ভেঙে সে বলে উঠল,
"তাদের হাত ধরুন যাদের কেউ নেই,তাদের পথ দেখান যাদের জীবনে অন্ধকার, তাদের স্বপ্ন সত্যি করতে সাহায্য করুন,.."
তাকে থামিয়ে অবাক হয়ে বললাম, "তারা'কে?" হেসে উঠল;
"আপনি বুঝতে পারেননি! 'তারা'দেশের ভবিষ্যৎ, ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা, পথে পথে ঘোরে,কাজ করে, তাদের চোখের জল মোছানোর কাজ করুন; তাদের জন্য বাঁচুন। আপনাকে সবার প্রয়োজন, নিজেকে ছোট ভাববেন না।"
অভিভূত হয়ে শুনছিলাম তার কথা। আমার সমবয়সী বা ছোট হয়েও তার সমাজের প্রতি কর্তব্য বোধ প্রশংসনীয়। হঠাৎ পায়ের শব্দে দেখি মা, বাবা, কাকু, দিদি সবাই এসেছে। মা আমায় জড়িয়ে কাঁদছে, আমিও পারলাম না চোখের জল আটকাতে। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে মা, বাবা মেয়েটিকে অনেক ধন্যবাদ দিল,আশীর্বাদ করল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সে যেতে চাইল তার পরিচয়ই জানা হয়নি! চলে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম, "আপনার নামটাই তো জানা হয়নি!"
আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, "রাগ দেখাতেই তো ব্যস্ত ছিলেন। পরিচয় কখন করবেন!" বলেই হাসতে লাগল। যতক্ষণ দেখলাম তার মুখে হাসির অভাব দেখিনি, অদ্ভুত মেয়ে!
"আমি অনামিকা, অনামিকা ব্যানার্জী। ভালো থাকবেন। আপনি পারবেন। তখন আমার কথা একবার হলেও মনে পড়বে। চলি। নমস্কার।"
আমি স্তব্ধ হয়ে শুয়ে,তার পদশব্দ মিলিয়ে গেল। বুঝিনি তার ছোট্ট নমস্কারের সাথেই ছিল আমাদের শেষ দেখা। তিনদিন পর বাড়ি এলাম। উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারি কলেজের অধ্যাপক পদে যোগ দিলাম। আর সেই সঙ্গে নতুনভাবে বাঁচা শুরু হল আমার ছোট্ট ছোট্ট পথশিশুদের নিয়ে।সেই শুরু হয়েছিল পথচলা "আমাদের"; হ্যাঁ, আমাদের, আমার জীবন ওদের ঘিরে। ওদের সুখ-দুঃখ আমার সুখ-দুঃখের সাথে অঙ্গাংগিকভাবে জড়িত।
আজ খুব মনে পড়ছে আমার 'গুরু'-কে। অনামিকাকে। 'গুরু' বলেই মনে করি তাকে, আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছিল সে। তার দেখানো পথ আমায় নতুন ভাবে ভাবতে, নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। কৃতজ্ঞ আমি। তার খোঁজ পাইনি, সম্ভবও নয়।তার সম্পর্কে কিছুই জানিনি সেদিন।ক্ষণিকের অতিথি হয়ে দিয়ে গেল বড় শিক্ষা। তার সেই মায়াভরা হাসিমুখ আমার স্মৃতির পাতায় সযত্নে রয়ছে, রইবে, আমৃত্যু।
মনে মনে গেয়ে উঠলাম,
"শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়।
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও....."
ইতালির সেই
অসমাপ্ত গল্পটা
নুপূর রায়চৌধুরী
গল্প
এরোপ্লেন থেকে ইতালির ফ্লোরেন্স ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট `আমেরিগো ভেসপুচ্চি'তে নেমেই দিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল একগুচ্ছ দেশি মানুষের সঙ্গে, দল বেঁধে বেড়াতে এসেছে সব। ওরা তো অবাক, এক রত্তি মেয়ে, অথচ ভয়ডর বলে কিছু নেই, একা একাই কেমন চলে এসেছে এই বিজন বিভূঁইয়ে! হ্যাঁ, দিয়া বেশির ভাগ একা একাই চলে যায় এধার ওধার। মন্দ লাগে না, সবাই ওর অচেনা, ও নিজেও সবার কাছে অজানা। কোনো কৌতূহলী চোখের ছায়া ওর চলার পথে ধন্ধ সৃষ্টি করে না, আশেপাশ থেকে কোনো প্রশ্নের তীর ওকে বিদ্ধ করে না, সম্পূর্ণ স্বাধীন, মানুষের ভিড়ে মিশে যাওয়া এক নাম-গোত্রহীন আগন্তুক; দুই চোখ দিয়ে নিতি শুষে নেয় সে নতুন দুনিয়ার রং রূপ রসের নির্যাস ।
টাস্কানির রাজধানী, ইতালির এই ফ্লোরেন্স ওরফে ফিরেঞ্জে’কে পৃথিবী চেনে রেনেসাঁসের আঁতুরঘর বলে। সেই স্বর্ণযুগের বহু স্থাপত্য, ভাস্কর্য আর চিত্রকলার জন্মস্থান দক্ষিণ ইউরোপের এই শহর। ব্রুনেলসচি’র টেরাকোটা-টাইলের ডুওমো, গিওতো’র ‘বেল টাওয়ার’, মিকেলেঞ্জেলো’র ‘ডেভিড’, বত্তিচেল্লি’র ‘দা বার্থ অফ ভেনাস’ আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’র ‘এনান্সিয়েশন’ স্বপ্নে ডাক দিয়ে যায় বিশ্বের পর্যটকদের, সূক্ষ্ম অনুভূতির নর-নারীদের। বহু কষ্টোপার্জিত সঞ্চয় সংগ্রহ করে দেশ দেশান্তর থেকে তাঁরা আসেন ফ্লোরেন্সের প্রাচীন ভূমিতে; এই অমৃতের একটু স্বাদ আহরণ করতে, অমরত্বের মানে খুঁজতে; কেউ কেউ হয়তো বা পেয়েও যান এই নশ্বর মনুষ্যজীবনের এক ভিন্ন অর্থ, বাঁচার এক নতুন আলো ।
ইতালীয়রা তাদের আবেগ এবং জীবনের প্রতি ভালবাসার জন্য বিখ্যাত, তাঁদের সংস্কৃতি এবং সমাজে সততই তা প্রতিফলিত হয়। সে আপনি যেটাই ধরুন না কেন, মিলানের ফুটবল ভক্তদের উত্সাহ থেকে ভেনিসের লেগুনে ভ্রমণরত গন্ডোলিয়ার্সদের প্রশান্ত নীরবতা পর্যন্ত, ইতালির বাতাসে একটি অনস্বীকার্য আবেগের মূর্ছনা অনুভূত হয়। সত্যি কথা বলতে কি, ইতালির শহরগুলোর অলিতে গলিতে যেন রোমান্টিকতার গোলাপি বুদ্বুদ ভেসে বেড়ায়- তার পাথর বসানো রাস্তা, মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, বর্ণাঢ্য সূর্যাস্ত, নিওক্লাসিক্যাল বিল্ডিং, মার্বেলের মনোমুগ্ধকর শিল্পকলা, এই সবই মিলেমিশে যেন কল্পনা, আবেগ এবং স্বাধীনতা’র এক রোমান্টিক পটভূমি রচনা করে।
দিয়া কিন্তু এমনি এমনি বেড়াতে আসেনি এখানে, একটা আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে নিজের গবেষণার চাঞ্চল্যকর ফলাফল বিজ্ঞান-দুনিয়ার তাবড় তাবড় রথী মহারথীদের সামনে তুলে ধরার জন্যই এসেছে। ওদের চারদিনের এই সম্মেলন শুরু হয়েছে ফিরেঞ্জে ফিয়েরা কংগ্রেস সেন্টারে। সেন্টারটা কিন্তু জব্বর, সারা পৃথিবীর নামী দামী এক্সিবিশন, ফেয়ার, মিউসিক ইভেন্ট, গ্যালা পার্টি, ট্রেনিং কোর্স ইত্যাদি, ইত্যাদি, হরবখত লেগেই থাকে পিয়াজা আড়ুয়া’র এই একশো হাজার স্কোয়ার মিটার-এর পেল্লাই প্রাসাদে। আজও তার অন্যথা হয়নি, মানুষের যেন ঢল নেমেছে এই চত্ত্বর জুড়ে । সময়টা এখন অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ, গ্রীষ্ম শেষ হয়ে গিয়ে, বৃষ্টি শুরু হয়েছে, কখনো মুষলধারে, কখনো বা ঝিরিঝিরি। আঙ্গুর আর জলপাইয়ের সম্ভার কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আজ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। সকাল আটটা থেকে লেকচার শুরু হয়েছে আর এখন দুপুর বারোটা–একটার পর একটা লেকচার শুনতে শুনতে দিয়ার মাথা বেজায় ভারী হয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা পানীয়ের খোঁজে কনফারেন্স রুমের বাইরে আসে সে। এখনই লাঞ্চ ব্রেক শুরু হয়ে যাবে, তারপর আধ ঘন্টা বাদেই আবার সেশন চালু হবে। ওবেলার বিষয়বস্তুগুলো দিয়ার কাজের ক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, বক্তারাও তেমন আহামরি কিছু নয়। নাহ, আর ফেরত যেতে ইচ্ছে করছে না ওই কনফারেন্স রুমে। এবেলা স্রেফ ডুব মেরে দিলে কেমন হয়? এত দূর থেকে এসেছে, কিছু না দেখেই ফিরে যাবে? এর মধ্যেই এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ের কলকাকলিতে লবি মুখর হয়ে উঠল, একটু কান পাততেই বোঝা গেল যে, ওরা প্ল্যান করছে, ভেনিস, রোম অথবা সিয়েনা ঘুরে আসবে। চারদিনের এই সিম্পোসিয়ামে দিয়া কোনো পরিচিত মুখ দেখেনি, আর একাচোরা মানুষ সে, সহজে মিশেও যেতে পারে না কোনো দলের সাথে। দুচ্ছাই, অত ভেবে কাজ কি! পথেই মিলে যাবে পথের দিশা, ভাবতে ভাবতে, ভারী পায়ে, আনমনে বের হয়ে আসে সে কংগ্রেস সেন্টার থেকে।
কী ঝকঝকে একটা দিন আজকে! নীল নীল উজ্জ্বল নির্মেঘ আকাশ। এন্টারিয়াম, আনিমন, কার্নেশন, ক্রিসানথিমাম, ডেলফিনিয়াম-এর সুগন্ধে ম ম করছে চারপাশ। এরকম একটা দিনেই বোধহয় বাঁধাধরা জীবনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভবঘুরে হওয়ার সাধ জাগে! কংগ্রেস সেন্টার থেকে মাত্র ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ফ্লোরেন্স শহরের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন`ফিরেঞ্জে সান্তা মারিয়া নোভেলা’’; পায়ে পায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায় দিয়া। স্টেশনের ঠিক বিপরীতেই `সান্তা মারিয়া নোভেলা চার্চ’’। ওই গির্জা’র নামেই এই স্টেশনের নাম। দেখার মতোই একটা জিনিস বটে! অন্তর্জাল বলছে, প্রতিদিন ১৬০,০০০ মানুষ নাকি এটা দিয়ে যাতায়াত করে। স্টেশনের প্রবেশপথের মুখেই রেলের টিকিট অফিস, কয়েকটি দোকান ও রেস্তোরাঁ; একটু এগিয়ে যেতেই দিয়ার নজরে এল ফ্লোরেন্স পর্যটনের একটা শাখা অফিস। এছাড়াও এই ফ্লোরে রয়েছে একটা ঝাঁ চকচকে যাত্রী-লাউঞ্জ ও মুদ্রা বিনিময় কাউন্টারl ১৯টা প্ল্যাটফর্ম, লাগেজ অফিস, পোস্ট অফিস এবং বিশ্রামাগার, ব্যবস্থাপত্র ভালোই, যেদিকে তাকাও সেদিকেই অজস্র মানুষের ভিড়, ট্যুরিস্টদের স্বর্গ বলে কথা!
ঘুরে ঘুরে দিব্যি সব দেখছিল দিয়া, কিন্তু এরই মধ্যে সেমিনারের চিন্তাটা হুট করে মাথায় চাড়া দিয়ে উঠল। কাল ওর নিজের প্রেজেন্টেশন, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বস উড়ে আসছেন সেই গ্যালারিতে। ওহ, বীভৎস চাপের ব্যাপার! আজ রাতে অন্য কিছু নয়, শুধু শেষ মূহূর্তের প্রস্তুতির ঝালাই! সুতরাং দিয়ার হাতে থাকল আজকের এই অপরাহ্নের মাত্র ৬-৭টি ঘন্টা। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে দিয়া স্টেশনের তথ্য-কেন্দ্রে ঝোলানো চার্ট থেকে কাছাকাছি দর্শনীয় স্থানগুলোর নাম, আর সেখানে যাওয়ার সময় দূরত্বের আঁক কষে চলে, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। দিয়ার নিজেকে কেমন অসহায় লাগছিল। দুই একজন যাত্রীকে প্রশ্ন করল সে, নাহ, ইংরেজি ভাষা ঠিক কাজে লাগছে না। সবাই ব্যস্ত, অহরহ এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে কোন লাইনে, কোন ট্রেন আসছে বা ছাড়ছে। ইসসস, এখন যদি ইংরেজি-জানা একজন স্থানীয় মানুষ পাওয়া যেত, তবে বেশ হত, কিন্তু মুখ দেখে কে চিনবে? সারা পৃথিবী তো জড়ো হয়েছে এই ট্রেন স্টেশনে, উহঃ!
এদিক ওদিক তাকাতেই দিয়ার চোখ পড়ে যায় প্ল্যাটফর্ম নাম্বার ৩-এর অনতিদূরে, ইউনিফর্ম গায়ে কর্মরত একজন কাস্টোডিয়ানের উপর। ব্যস্তভাবে ট্রেন-চত্বর ধোয়ামোছা করছে সে। দিয়া তার কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখের রোদ-চশমা-টা সরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, সেনিওর, বুন জোড়নো’’, মানে ওই `শুভ দিন’’ গোছের সম্ভাষণ আরকি। লোকটি মুখ তুলে দিয়াকে দেখে স্মিত হেসে বলে, `আলট্রেতানতো সিনোরিনা’। কিন্তু তারপর দিয়া আর স্পিকটি নট। ইতালিয়ান ভাষায় তার পান্ডিত্য বলতে ঐটুকুই -গোটা কয়েক বহুল প্রচলিত সৌহার্দ্য সূচক শব্দাবলী, তাও, প্লেনে চেপে আসার সময়, পতিত পাবন গুগুলদেবের দয়ায় শেখা, এরপর এগোয় কীভাবে? মানুষটা এবার দিয়াকে জরিপ ক’রে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে’? দিয়া ইতস্তত: করে বলে `সে ব্যাপারেই তো পরামর্শ চাই’। এইবার হা হা করে দরাজ গলায় হেসে ওঠে লোকটি, তারপর আন্তরিকভাবে বলে, `আমি জর্জিও, তুমি?’
আমি দিয়া, কামিং ফ্রম ইউ এস এ।
ওহ, আমেরিকানা, দিয়া? কী অন্যরকমের নাম!
এভাবেই আলাপ পরিচয় হয়। দিয়া জানায় কোথা থেকে, কেন, কবে সে এই শহরে এসেছে, আর তার সমস্যার কথা। জর্জিও সোৎসাহে বলে,`দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার এই শিফ্টের কাজ এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে, আমি তোমায় সব বলে দিচ্ছি’’। একটু বাদেই, জর্জিও তার কাজের সাজ-সরঞ্জাম জমা করে দিয়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর পরনে এখন জিন্স আর টি শার্ট। জর্জিও একটু মাঝারি চেহারার, ৫-৭'' মতো লম্বা, মাথাভর্তি কাঁচাপাকা ব্যাকব্রাশ করা চুল, চোখ দুটো ভারী উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ণ; মানুষটা বেশ আলাপী এবং সহানুভূতিশীল, কথায় কথায় হাসে, আর হাসলে ওর সারা শরীর কাঁপে। এর গায়ে বোধহয় খুব জোর, লোকটার দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে, মনে মনে ভাবে দিয়া, টি-শার্টের আড়ালে বাইসেপ্সগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আর হাতের পাঞ্জা-ও নজর করার মতোই বড়োসড়ো।
জর্জিও-ও যে ওকে লক্ষ্য করছে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারে দিয়া। ইতালীয়রা তো আবার ফ্যাশন সম্পর্কে খুব সচেতন! দিয়া এদিকে পড়ে আছে একটা এ-লাইন নেভি-ব্লু স্কার্ট, সাদা ব্লাউস, আর হালকা নেভি-ব্লু ব্লেজার, গলায় সাদা-কালো চেক-কাটা স্কার্ফ, পায়ে ব্লক হিলের জুতো– নেহাতই কেজো পোশাক, সেমিনারে’র যেরকম দস্তুর আর কি। কিন্তু জর্জিও’র চোখ যে এই মুহূর্তে পোশাক ছাপিয়ে দিয়ার অঙ্গসৌষ্ঠবই পর্যবেক্ষণ করছে, তা অনুভব করতে অসুবিধে হয় না দিয়ার। ওর টান টান চেহারা, কোমর ছাপানো কালো মেঘের মতো চুলের রাশি, দীঘল চোখ, আর টিকোলো নাক যে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয়, তা দিয়া ভালোই জানে। হাসলে ওর গালে এত্তটুকু একটা টোল পড়ে আর বাঁদিকের নিচের পাটির ছোট্ট গজদাঁতটা অমনি টুক করে উঁকি মারে। সুচারু দন্তরাজির মাঝে সেটাকে কিন্তু মোটেই বেমানান লাগে না, বরং ওর হাসিটাকেই যেন সেটা আরও মিষ্টি করে তোলে-এ সবই তো কতবার শুনেছে। তবু দুনিয়ার সেরা রোমান্টিক দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, অজানা, অচেনা, সোমত্ত এক ফ্লোরেন্টিয়ান পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি ওকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, ভাবতেই দিয়ার আশিরনখ কেঁপে ওঠে, কী এক মেয়েলি লজ্জায়। লোকটাও কী অদ্ভুত দেখ, একটাও কোনো কথা না বলেই যেন দিয়ার মনের মধ্যে সোজা সেঁধিয়ে যাচ্ছে!
জর্জিও বলে,`শোনো দিয়া, একটু আগে যে বিশাল কাজকম্মের ফিরিস্তি দিলে, কাছাকাছির মধ্যে পিসা শহরটা ঘুরে আসাটাই তোমার সময়, সুযোগের সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যাবে।’’
সম্বিৎ ফিরে পায় দিয়া, পিসা? ট্রেন আছে এখান থেকে?
`বা রে, থাকবে না? পিসাতে যাবার দুধরণের ট্রেন আছে, তুরন্ত গতির ‘এক্সপ্রেস ট্রেন’ আর ‘লুঙ্গা পারকোরেনজা’ মানে ধীর গতির ট্রেন, প্রথমটা ৫০ মিনিটেই তোমায় গন্তব্যে পৌঁছে দেবে আর দ্বিতীয়টা দেড় ঘন্টা মতো সময় নেবে। কথাটা শুনেই চিন্তায় দিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল দেখে, জর্জিও বরাভয়ের হাত তুলে বলল, যদি তুমি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ভালোবাসো, তাহলে এই দ্বিতীয়টা’র টিকিট কেটে ফেল, আমি আর বেশি কিছু ফাঁস করব না, তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।’’
দিয়া হৈহৈ করে বলে উঠল, 'দ্বিতীয়টা, ওটা দারুণ হবে, ওটাতেই যাব।’'
জর্জিও হোহো করে হেসে উঠে বলল, `লো তি কোনোস্কো, আই নো ইউ'। দিয়া অপ্রতিভ হয়ে যায়, একটু আশ্চর্য্যও হয়, ভাবে, লোকটা হিপনোসিস জানে নাকি?
`এই পিয়াজ্জা মারিয়া সান্তা নোভেলা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে। সেটা করে তুমি পৌঁছে যাবে পিসা সেন্ট্রাল স্টেশন। সেখান থেকে ফ্রান্সেস্কো ক্রিস্পি রাস্তা ধরে হাঁটা পথে ২০-৩০ মিনিট চললেই এক্কেবারে পিসার হেলানো টাওয়ার।’
জর্জিওকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, দিয়া টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। মনে মনে ভাবে, যাক বাবা, দেখার জায়গা ঠিক হলো, সেখানে যাওয়া আসার আঁটঘাঁটও সব জানা গেল, এবার টিকিট-টা কেটে নিলেই নিশ্চিন্ত। জর্জিও তো বলেই দিয়েছে যে, ৩০ মিনিট বাদে বাদেই ট্রেন যাচ্ছে, ও আসছে। সুতরাং এই ২-টোর ট্রেন-টা ধরে পিসা চলে গেলে, সন্ধ্যেবেলায় স্বচ্ছন্দে ফিরে আসতে পারবে ও। রাতের ডিনার তো কংগ্রেস সেন্টারে বাঁধাই আছে, ব্যস, খেয়েদেয়ে সোজা হোটেল। প্ল্যান-টা বেশ জম্পেশই লাগছে। দিয়ার বেশ রোমাঞ্চই হচ্ছে।
ট্রেনইটালিয়া টিকিট কাউন্টারে এসে তো ওর চক্ষু চড়কগাছ, ওরে বাবা, এত লোক! এই লাইনে
দাঁড়িয়ে টিকিট হাতে পেতে গেলে, ২-টো কেন ৪-টে’র ট্রেনও ধরার কোনো আশা নেই! বিমর্ষ হয়ে গেল দিয়া। তার উপর, ওর সামনেই লাইনে দাঁড়ানো দুই ক্রেতা, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, টিকিট-ভেন্ডিং মেশিনে’র গায়ে নাকি গোটা গোটা করে লেখা আছে যে, দশ ইউরোর চেয়ে বড়ো বিল নেওয়া হবে না। হায় ভগবান! এদিকে দিয়ার কাছে তো সব কুড়ি ইউরো'র নোট – পুরো মরার উপর খাঁড়ার ঘা! শুকনো মুখে এদিক ওদিক তাকাতেই দিয়ার বুকটা ধক করে উঠল! জর্জিও চলে যায়নি, একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই জর্জিও ওর কাছে এসে বলল, `দাও, দাও, আমি ভেতর থেকে টিকিট কেটে আনছি'। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দিয়ার টিকিট আর ফেরত ইউরো নিয়ে ফিরে এল সে। দিয়া যে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, এত উপকারী মানুষও আছে এই ফ্লোরেন্সে, নাকি……..। পশ্চিমা দেশের সৌজন্যতা দিয়ার রক্তেও এতদিনে মিশে গিয়েছে, অভ্যেসবশেই, তাই জর্জিও’র সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল সে। জর্জিও’র বিশাল হাতের পাঞ্জার মধ্যে, দিয়ার ছোট্ট হাত-টাযেন হারিয়েই গেল। জর্জিও একটু বেশিক্ষণ পর্যন্তই দিয়ার হাত-টা ধরে রইল, সঙ্গে সেই অন্তর্ভেদী স্মিত হাসি। দিয়া’র আপাদমস্তক শিউরে উঠল। ভয় হল, টের পেল না তো জর্জিও? মনকে বোঝাল, ইতালীয়রা এরকমই উষ্ণ এবং অভিব্যক্তিপূর্ণ মানুষ, শারীরিক স্পর্শ, ওদের কাছে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এরপরই জর্জিও দিয়ার দিকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, `তুমি সন্ধ্যে ৭ থেকে ৭-৩০ এর মধ্যেই পিসা হয়ে এখানে ফিরে আসতে পারবে। আমি তোমার জন্য যাত্রী-লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে পারি, তাহলে একসাথে ডিনার করা যেতে পারে। বেশি দূর যেতে হবে না, স্টেশনের মেজানাইন ফ্লোরেই একটি দুর্দান্ত রেস্টুরেন্ট আছে। ওদের প্রসেকো ওয়াইন একবার খেলে আর ভুলতে পারবে না! দিয়া এবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, একেবারে নৈশভোজের আমন্ত্রণ? সাধে কি ইতালীয়দের বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক বলা হয়! ফ্লার্ট করতে ওদের জুড়ি নেই! কিন্তু যে মানুষটা এই কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই ওর এত বড়ো উপকার করল, তার এই মিষ্টি আহ্বান অগ্রাহ্য করা কী করে সম্ভব? বিশেষত: মানুষটা যখন সামনেই জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছে, আর তার চোখে মুখে একরাশ প্রত্যাশা। দিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু না বলার ক্ষমতা ওর হল না। নিমরাজী ভাবে, ঘাড়-টা একটু হেলিয়ে সে সম্মতি জানাল, আর সঙ্গে সঙ্গেই নিজের উপরই ওর রাগ হতে থাকল। কত সহজেই না অন্যের ইচ্ছায় সায় দিয়ে দেয় ও! জর্জিও কিন্তু বেজায় খুশি, শরীর ঝাঁকিয়ে উত্তেজিত ভাবে দিয়াকে সে প্রথমে একটা কুর্নিশ করল, তারপর দুম করে এগিয়ে এসে দিয়ার দুই গালে আলতো করে দুটো চুমু দিয়ে দিল। দিয়া চমকে উঠল, যেন সাপের ল্যাজে পা পড়েছে। তারপরেই নিজেকে আশ্বস্ত করল, এটাও নিছকই একটা ইতালীয় অভিবাদনের রীতি। হোটেলে প্রথম দিন চেক-ইন করার সময়, রিসেপশন ডেস্কের অল্পবয়সী মেয়েটাও ওকে এমনটিই করেছিল। দিয়া অবাক হয়েছে দেখে, মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে বলেছিল, `এটাই এখানে চল, এই ছোট্ট চুমু'কে বলে ``বাছেতো’’।
কিন্তু, এই মুহূর্তে দিয়া মোটেই স্বস্তি পাচ্ছে না। কেমন এক বিহ্বলতা তাকে আচ্ছন্ন করে তুলছে। জুলিয়েনের সাথে অনেক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ওর চোখের সামনে ক্যালিডোস্কোপের মতো একের পর এক ভেসে উঠতে থাকল ।
জর্জিও’র মেজাজ এখন দারুণ শরীফ। সে প্রবল উৎসাহে দিয়াকে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দিল। ট্রেনে উঠিয়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে, দিয়াকে `চাও’’ মানে বাই করে শেষমেশ ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হল ।
ফ্লোরেন্স থেকে পশ্চিমমুখে লুকা এবং পিস্টোইয়া হয়ে ছুটে চলেছে ওদের ট্রেন। একেবারে জানালা ঘেঁষে বসেছে দিয়া, যাতে কিচ্ছুটি মিস না হয়ে যায়। আঙুরের খেত, মধ্যযুগীয় গ্রাম, টানেল, ওভার-ব্রিজ সব মিলে মিশে সবুজ, পাহাড়ী ভূখণ্ডের টাস্কানি যেন ঠিক একটা রূপকথা। ভালো লাগায় যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল দিয়ার । তখনও ও জানত না যে, আসল চমকের অনেকটাই এখনও বাকি আছে! একটু বাদেই উন্মোচিত হল তা: ঘোরানো ঘোরানো পাহাড়ের সারি– দেখেই খুশিতে বাচ্চা মেয়ের মতো চেঁচিয়ে উঠে, এক পাক নেচেই নিল দিয়া, পাহাড় যে ওর খুব খুব প্রিয় । ওর কান্ড দেখে, উল্টো দিকে বসা, দুই প্রবীণ দম্পতি তো হেসে আকুল। দিয়া একটু লাজুক মুখে ওনাদের জিজ্ঞেস করল, `কী নাম এই পাহাড়ের’’? বৃদ্ধটি বললেন, অ্যাপেনাইনস—-ইতালির দ্বিতীয় প্রধান পর্বতমালা। এই উঁচুনিচু পর্বতশ্রেণীগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণে পর্যায়ক্রমে ইতালীয় মূল ভূখণ্ড অতিক্রম করেছে। উপদ্বীপীয় ইতালির ১,৪০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বরাবর সমান্তরালভাবে প্রসারিত এই পর্বতশৃঙ্খল। উত্তর-পশ্চিমে এই পর্বতমালা, আলতারে এসে লিগুরিয়ান আল্পসের সাথে মিলেছে আর দক্ষিণ-পশ্চিমে উপকূল মুখের শহর রেজিও ডি ক্যালাব্রিয়াতে এসে শেষ হয়েছে। রোমান যুগে অধিবাসীদের সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ঢেলে উপহার দেওয়ায় অ্যাপেনাইনস-এর অবদান অসামান্য। তার গভীর কন্দর থেকে উৎসারিত পো এবং টাইবার নদী উপত্যকার উর্বর মাটি রোমানদেরকে জলপাই এবং বিভিন্ন ধরণের শস্যের ফসল ফলানোর বরদান করেছে। অ্যাপেনাইনস শুধু ইতালির শক্তিশালী মেরুদণ্ড নয়, ইতালির আত্মাও বটে, তার পরতে পরতে জড়ানো আছে ইতিহাসের পদস্পর্শ । দিয়া শুনছিল আর ক্ষণে ক্ষণে চমৎকৃত হচ্ছিল।
দেখতে দেখতে চলে এল ওর গন্তব্যস্থল– পিসা। ট্রেন স্টেশনের কাছে আসার সাথে সাথে পিসার হেলানো টাওয়ারটা এক ঝলক উঁকিও মেরে গেল। দিয়ার কিন্তু এখন একটু বিমর্ষও লাগছে, এই অত্যাশ্চর্য নৈসর্গিক যাত্রাপথ, যদি আরও সুদীর্ঘ হতো, তাহলে বেশ হত! ট্রেন থেকে নেমে, ফ্রান্সেস্কো ক্রিস্পি’র পাথুরে রাস্তা ধরে টাওয়ারের দিকে এগুতে এগুতে দিয়া ভাবছিল, ভাগ্যিস আজ স্টিলেটোর পরিবর্তে ব্লক হিলের জুতোটা পড়া রয়েছে, নইলে এতটা রাস্তা হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হত! এরই মধ্যে, হঠাৎ ওর কানে এল, চেনা ভাষায় কথাবার্তার আওয়াজ, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, একটু পিছনেই আসছে চার ভারতীয় যুবক। আলাপ হতে জানল, ওরা এসেছে মিলান থেকে, কাজ করে টেক মাহিন্দ্র কোম্পানিতে। পথের সঙ্গী মিলে যাওয়ায় দিয়া যেমন খুব খুশি, ওরাও।
সকলে মিলে হৈহুল্লোড় করতে করতে ওরা এসে পৌঁছাল পিসা সিটি স্কোয়ার, সেখানে পিসা ক্যাথেড্রালের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে পিসার হেলানো টাওয়ার। কী আশ্চর্য্য এক সৃষ্টি! ওদের সঙ্গের গাইড, মার্কো লম্বার্ডি বললেন, উল্লম্ব অবস্থা থেকে প্রায় চার-ডিগ্রি হেলে রয়েছে টাওয়ারটি। হাজার প্রশ্ন ওদের মাথায় কিলবিল করছে, কিন্তু দেখা গেল উত্তরগুলো ওদের সকলের কাছেই খুব ভাসা ভাসা। অগত্যা মিস্টার লম্বার্ডিই ভরসা। তা তিনি জানালেন, পিসার টাওয়ারের স্থপতিরা কিন্তু কাঠামোটি এরকম হেলিয়ে মোটেই গড়তে চান নি, ওটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু মজার কথা হলো: সেটাই শেষপর্যন্ত এটিকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেয়; এমনকি ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধও করে।
ওরা সকলেই টাওয়ারে ওঠার জন্য উৎসুক, তা মিস্টার লম্বার্ডি ঠাট্টা করে বললেন, আপনাদের কপাল ভালো বলতে হবে! ১৯৯০ থেকে ২০০১– এই এগার বছর, কিন্তু অস্থিতিশীলতার কারণে টাওয়ারটা বন্ধ ছিল। ছেলে চারটে জোর তাল তুলল, টাওয়ারের মাথায় উঠবে, দিয়ার কিন্তু একটু ভয় ভয়ই করছিল, কিন্তু লম্বার্ডি সাহেব আশ্বস্ত করলেন: টাওয়ারটি যাতে না ভেঙে পড়ে সেজন্য প্রকৌশলীরা নানারকম সংশোধনমূলক কাজ করেছেন আর তাই, টাওয়ারটা'র বর্তমানে একটু কম হেলে রয়েছে। বস্তুত, ২০০ বছর আগে এর যে অবস্থা ছিল, এখন এটি সেই একই প্রবণতায় রয়েছে । উৎসাহ জিনিসটা ভারী সংক্রামক! সুতরাং, দেশোয়ালি ভাইদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ঝোলায় ভরে, দিয়া টাওয়ারের সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। জুতোটা পা থেকে খুলে সোজা হাতে ঝুলিয়ে নিল সে, আঃ, কী আরাম! সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সময়ই দিয়া লক্ষ করল, প্রতিটি স্তরে একটা করে গ্যালারি আর তোরণ রয়েছে, শুধু শেষ ধাপটা ছাড়া, সেখানে ঝোলানো আছে ৭টা ঘণ্টা৷ হাঁচড়পাঁচর করে, ২৯৪টা জীর্ণ ধাপ পেরিয়ে দিয়া যখন টাওয়ারের মাথায় এসে দাঁড়াল, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা! দূরে দূরে পাহাড়, পিসার লাল লাল ছাদ-ওয়ালা ঘরবাড়ি, আর অত্যাশ্চর্য "পিয়াজা দে মিরাকোলি"! নান্দনিক সৌন্দর্যের নেশায় বুঁদ হয়ে যায় দিয়ার সমস্ত জাগতিক চেতনা!
হাসি-মস্করায় কোথা দিয়ে যে ৩-৪ ঘন্টা কেটে গেল, ওরা কেউ বুঝতেই পারল না, ফিরতি পথে জেলাটো খেতে খেতে ওরা এল অর্ণ নদীর উপর ব্রিজ পন্টি ডি মেজো’য় । দিনমণি ততক্ষণে পাটে বসেছেন, ব্রিজের মাথায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা সূর্যাস্ত উপভোগ করল। সে এক অলৌকিক দৃশ্য! চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে নরম লাল-হলুদ-কমলা রঙের বন্যায়; অর্ণ'র জল যেন গলানো সোনা, সোনালী রঙে স্নান করে অর্ণ'র তীর বরাবর সুন্দর রাজকীয় বাড়িগুলোও হয়ে উঠেছে কেমন পরাবাস্তব ।
এবার ফেরার পালা, ভারাক্রান্ত মনে ওরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেয়, দিয়ার চোখেও নোনাজল টলটল করে। ফিরতি ট্রেনে উঠেই দিয়ার মনে পড়ে গেল, জর্জিও ওর জন্য অপেক্ষা করবে ফ্লোরেন্স স্টেশনে। একটা অস্বস্তিতে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ওর।
দিয়ার সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত আছে অজানা অচেনা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্পর্শকাতরতার শিক্ষা; কিন্তু মান্ধাতা আমলের সে নিয়ম ভেঙে কবেই তো বেরিয়ে এসেছে সে। অবশ্য তা সহজে হয়নি, রীতিমতো বিদ্রোহ করেছিল সে, এবং তার পরিবারের অনেকের কাছে আজও সেটা বেয়াদপি বলেই পরিগণিত হয়। হ্যাঁ, পুরুষের স্পর্শে দিয়ার কোনো ছুঁৎমার্গ নেই, কিন্তু জুলিয়েনের ছেঁচড়ামি আর ফেরেব্বাজিতে তার বিশ্বাসের ভিত অনেকখানিই নড়ে গিয়েছে, তাই প্রেম-ভালোবাসার ছুটকো-ছাটকা নাটকীয়তা থেকে এযাবৎ সযত্নে সরে থেকেছে, কর্মব্যস্ততার মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। ওর বন্ধুবান্ধবেরা উস্কানি দিয়েছে, উত্যক্ত করেছে, কিন্তু দিয়া কৌশলে প্রতিটি সিঙ্গেলস মিক্সার পার্টি, প্রতিটি ডেটিং ইভেন্ট এড়িয়ে চলেছে– সে কত কত দিন! আজ জর্জিও’র কাছাকাছি আসতেই পুরোনো রেশমি আবেশের স্মৃতিগুলো ওকে দুর্বল করে তুলেছিল । পাথর-চাপা আবেগগুলো কতদিন, কতদিন রুদ্ধদ্বার আস্তাবলে নিস্তেজ হয়ে শীতঘুম পার করছিল, বসন্তের ইশারা পেতেই, ঘুম ভেঙে ওরা যেন চনমনিয়ে উঠেছে, বল্গাহীন ঘোড়ার মতো অচেনা পথ আবিষ্কার করার আনন্দে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু আজকের পর এই শহরে আর মাত্র দুটো দিন থাকবে দিয়া, তার মধ্যে কোনো সম্পর্ক কি দানা বাঁধতে পারে? বাঁধলেও তার স্থায়িত্ব কতটুকু? কেবলমাত্র শরীরের সুখের জন্য এক রাতের সম্পর্ক! নাহ, ওতে দিয়ার আর রুচি নেই। ভালোবাসা? সে তো অমরত্বের আর এক নাম; সহস্র জীবনের একান্ত সাধনার ফল– এত সহজে কি তার দেখা মেলে? তাছাড়া, জর্জিওকে ও চেনেই বা কতুটুকু? বরঞ্চ ওর মনের রংমহলে, আজ দ্বিপ্রহরের, এই এক ফোঁটা ভালোলাগার মিষ্টি আস্বাদ, বেঁচে থাক সবুজ, পাহাড়ী ভূখণ্ডের এক রোমাঞ্চময় হাতছানির গল্প হয়ে, কথা দিয়ে কথা ভাঙার বেদনা হয়ে। সেই ভালো! দিয়ার মুখ পাথরের মতো কঠিন, কিন্তু চোখের কোলে এক বিন্দু জল মুক্তোর দানার মতো টলটল করে, টোকা মারলেই এই বুঝি তা ঝরে পড়বে!
ট্রেনটা সান্তা মারিয়া নোভেলা স্টেশনের পূর্ব উইং-এর ১৭ নাম্বার প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াল। মূল স্টেশন ভবন এখান থেকে সম্পূর্ণ ঘোরা পথ। যাত্রীদের সুবিধার জন্য একটা ছোট গেট আছে, সেটা দিয়েই সোজা স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দিয়া, যাক, জর্জিও’র মুখোমুখি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর রইল না। ভাগ্য দেবতার উদ্দেশ্যে সে তার অন্তরের অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমেই, স্কার্ফটা ওড়নার মতো করে মাথা-মুখে জড়িয়ে নিল দিয়া, তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে প্রস্থান-পথের অসংখ্য মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে যেতে অস্ফুটে বলল, বিদায় বন্ধু, ভালো থেকো, আমার অক্ষমতাকে ভুলে যেও।
গল্প
বাস্তববাদী
কল্যান সেনগুপ্ত
জ্যাঠামশাই বললেন "নন্তু, মিলি কে খবর দিয়েছিস? ডাক্তার কি বলল সেটা অবশ্যই জানাস"।বাবা কাগজ থেকে মুখ তুলে বললে,
"মিলিকে তো দুটো ওষুধ ও আনতে বলেছি। এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। ও বলেছে আজ হবে না কাল চরকিকে নিয়ে আসবে। এবার এসে কয়দিন থেকেই যাবে"।
"সলিল আসবে না? বাবা বললে,
"সলিল বলেছে অফিসে কাজ আছে। অফিস করে ওরা ফিরবার দিন রাত্রে আসবে। একটু থেমে বললে, "আর এসেই তো নানা সাজেশন দিতে থাকবে। ওকে সামলানো এক মুশকিল"। জ্যাঠামশাই বললেন, "নন্তু, সলিল আমাদের জামাই। একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে আমাদেরই"।
বাবা বললে "হ্যা সে তো জানি। ভালো হয়েছে চরকিটা এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে। বোঝাই যায় না। ছোটবেলায় কি ছিচ্কাঁদুনে ছিল"।
চরকি একটা চিজ ছিল ছোটবেলায়। কি চেঁচাতে পারত। কানে তালা ধরে যাবার জোগাড় ছিল। ছোটবেলায় সামান্য কারণে ঘ্যান্ঘ্যান্ করা একটা ওর অভ্যেস ছিল। ক্ষিধে পেয়েছে, এ্যাঁ, এ্যাঁ, ঘুম পেয়েছে এ্যাঁ, এ্যাঁ। এটা আমার, ওটা আমার। দেখ না দিচ্ছে না, মা, মা, মা করে পাড়া মাথায়।এমন ছিচ্কাঁদুনে হলে চলে? মাথা ধরে যাচ্ছে। সলিল পিসেমশাই কিন্তু তখন থেকেই দেখেছি একদম ঠাণ্ডা। বরং এতে উৎসাহই দিত। এতে নাকি গলার জোর বাড়ে। জেদ বাড়ে, শরীর ঠাণ্ডা থাকে, পার্সোনালিটি তৈরি হয়। শরীর ঠাণ্ডা থাকে কি করে? একবার জিজ্ঞাসা করাতে চমৎকার উত্তর দিয়েছিল।
"বুঝলে না এনার্জি ডিসিপেট করছে শরীর থেকে। আর তাতেই শরীর ঠাণ্ডা। আজব চিন্তা ধারা। পিসেমশাই এর চিন্তা ভাবনা আমাদের কারুর সঙ্গেই মেলে না।
একবার গরমে, চরকির যখন আট নয় মাস বয়স, মেজ পিসি, চরকি আর পিসেমশাই এসেছে আমাদের বাড়িতে। দুপুরবেলা বেজায় গরম। চরকি খাটে শুয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ঘুমাচ্ছে না। ওপরে ফ্যান ঘুরছে তবু গরমের কষ্ট কমছে না। পিসেমশাই দূরে চিরুনি দিয়ে পিঠের ঘামাচি মারছিলে। হঠাৎ উঠে সেই বেজায় চাঁদি ফাটা গরমে ফ্যানটা বন্ধ করে দিলে। একি? একি? আমি হাই হাই করে উঠেছি "আরে ফ্যান বন্ধ করছেন কেন?" আর চরকির গলা সপ্তমে, আরো উপরে। পিসেমশাই উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে হাত তুলে ব্যস্ত না হতে ইশারা করলে। ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না। এই রকম বর্বরোচিত ব্যবহার তো আদিমকালে চলত শাস্তি দেবার জন্যে। এতে স্বস্তি কোথায়? এক ছটাক ও কি দয়া মায়া দেন নি ভগবান? কিছুক্ষণ চেঁচানোর পর যখন চরকি ঘেমে নিয়ে একশা তখন ফ্যানটা অন করে দিলে। আমি পাশের ঘরে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে এসে দেখি। ওমা! চরকি অকাতরে ঘুমোচ্ছে। আমার মুখ হাঁ দেখে একটা সবজান্তা ভাব দেখিয়ে মুচকি হাসলে।
"অর্থাৎ দেখ দেখ কত কি দেখার আছে। পিসেমশাই এরপর সরল করে প্রফেসরদের মত বুঝিয়ে বললে,
"প্রথমে ঘাম বেরোনো, এনার্জি কমে যাওয়া, তারপর ফ্যানের হাওয়ায় ঘাম ইভাপোরেশন অ্যান্ড বডি কুলিং ডাউন। চাহনিতে কেমন দিয়েছি বল? কি সাংঘাতিক চিকিৎসা। ঘাম শুকোলো আর শরীর ঠান্ডা হল আচমকা।"
জ্যাঠামশাই কিন্তু খুব এটা দেখে খুব চটেছিলেন। সামনে কিছু বলেন নি তবু সলিল পিসেমশাই চলে যাবার পর এরকম আচরণ একদম ভালো চোখে দেখেন নি। বলেই ফেলেছিলেন,
"সলিলটার বড় কঠিন হৃদয়। রসকষহীন, অমানবিক। মিলিকে কেমন রেখেছে কে জানে? এমনিতেই পিসেমশাইএর একটু চালাক চতুর, কথাবার্তা, "হয়ে যাবে, আমি তো আছি" ধরনের ভাব। জ্যাঠামশাই, ও বাবা এই ওপর চালাকি একদম ভালো চোখে দেখে না। জামাই বলে কিছু বলতেও পারে না। কিন্তু গরমে যখনই ঘুমোতে পারি না তখনই পিসেমশাইয়ের অভিনব অমানবিক প্রয়োগের কথা মনে হয়। ওটা একা ঘরে শুলে করা যায়। নাহলে পাশের লোকের পিটুনি খেতে হবে।
মেজ পিসির বাড়িতে আরেকটা বাজে ব্যাপার হচ্ছে প্রত্যেক রবিবার বাড়ির কিছু উন্নতি সাধন করা।পরিষ্কার করা। কি উন্নতি সাধন সেটা সারা সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে শনিবার সকালে অফিসে যাবার আগেই কর্তা জানিয়ে দেন। এখন মেয়ে চরকি আর ছেলে ভুতু কিছুটা যুতসই হয়েছে। চরকি বারো আর ভুতু দশ। ওদেরই জুড়ে দেন কাজে। সে একটা হুলু স্থুলু কান্ড। মেজ পিসি শুধু চেকার। রান্না করছে আর কি কি বেড়িয়ে যাচ্ছে, ওলোট পালোট হচ্ছে খুঁটি হাতে তার হিসেব রাখছে। খুব একটা সমর্থন আছে বলে মনে হয় না তবু পিসেমশাইয়ের প্রবল প্রতাপে সইয়ে নেয়। রবিবার সকালে ওখানে গেলে একটা হৈ হৈ অবস্থা দেখা যাবে। আলমারি থেকে খালি হচ্ছে পুরনো কাপড়, ছেঁড়া জামা, পুরনো বই, ঘরের কোণ থেকে মাদুর, ঝাঁটা, পুরনো জুতো আরো কত কি। মনে হবে হঠাৎ করে নিলাম হচ্ছে। সেদিন বাড়ি থেকে কিছু না কিছু খালি করতেই হবে। নীচে পিসেমশাই খালি গায়ে লুঙ্গি পরে কোমরে হাত দিয়ে হাঁক পারছে,
"কই রে কোথায়? এবার? চরকি একটা ঘরে, ভুতু আরেকটা ঘরে।
চরকি বললে "ভুতুর টুর অঙ্কের বই।
নীচে থেকে উত্তর এল "ফেলে দে"। ব্যস বারান্দা দিয়ে উড়তে উড়তে নেমে এল বই, পিসেমশাই পাকা খেলোয়াড়ের মত দু হাতে পাকড়াও করে বাইরে চালানের জন্যে জমা করলে। গোটা বাড়ি চোদ্দবার ওঠা নামা তো চলতেই থাকে। ভাঙ্গা ফ্লাওয়ার ভাস, জং ধরা টেবিল ল্যাম্প, এগুলোর জন্যে তো ছুড়ে ফেলা যায় না। শেষে বারোটার সময় যুগল জমাদার ময়লা নিতে আর উঠোন ধুতে এসে যখন বলে,
"বাবু, এ আপনি কি করিয়েছেন? বাচ্চাদের লিয়ে এইসব করেন? আপনার মায়া দয়া কুচু কি নাই? উদের কষ্ট দিখেন না বাবু? আমি আপিসে ই রকম অত্যাচার বলিয়ে দেব"।
যুগলকে এক ধমক দিয়ে পিসে মশাই থামেন। সব এক জায়গায় জড়ো কর হল। সোমবার কাগজ ওয়ালা নাচতে নাচতে এল। সব কাঁচিয়ে নিয়ে গেল। দাম সামান্য কিছু গুঁজে দিয়ে গেল মেজ পিসির হাতে। তার বক্তব্য এসব নিয়ে ভাগারেই ফেলতে হবে। শুধু চেনাজানা বলে নিয়ে গেল।মঙ্গলবার থেকে মেজ পিসি ডাক পাড়তে লাগল,
"এটা কোথায় গেল? ওটা কেন পাচ্ছি না? হ্যায়, হ্যায়, আমার বেলন চাকি? চিমটে? পাউরুটি শ্যাঁকার জালি?" কে কার কথা শোনে। পিসেমশাই মাথা চুলকে বললে,
"আমি তো ফেলবার সময় দেখতে পাইনি"। বুধ থেকে শনি নিশ্চিন্তে গেল, কিছু নতুন কেনা হল হাতা খুন্তি, হারিয়ে যাওয়া দৈনন্দিন জিনিষ। আবার রবিবার এলেই সেই হাঁক,
"কই রে নীচে ফেল। এত জিনিষ, এত জিনিষ কোথায় যে রাখবো কে জানে"। এইভাবেই চলছে পিসেমশায়ের বাড়ি। পিসেমশাই সব হিসেব করে, ভেবেচিন্তে চলেন। বলেন,
"এই রবিবাসরীয় চিরুনি তল্লাশি, এতে মাংসপেশীর শক্তি বাড়ে। শরীর গঠন হয়। কত কখন লাগবে তার একটা হিসেব আছে, বা চলতেই থাকে। চৈত্রের সেলে পুজোর বাজার করেন। শীতের পোশাক গরমের সময়ের সেলে কেনেন। পুজোর ঠাকুর দেখেন বিসর্জনের ঘাটে বা চতুর্থীতে। তখন ভিড় নেই ঠাকুর আছে। সরকার যত রকমের সুবিধা, ভাতা দিয়েছে সব দু হাতে বুকে জাপটে নিয়ে চলে। ডিসকাউন্ট ছাড়া কিছু কেনে না। তাও সেটা যখন সবচেয়ে বেশি হয় তখন তার জন্যে বসে থাকে। একবার এক্সচেঞ্জ অফার এ বিগ বাজারে ভাঙ্গা কমোডটা নিয়ে রিকশাওয়ালাকে নিয়ে গেছিল। কোথায় কে কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে সব আঙ্গুলের ডগায়। এই হিসেব করে চলা, আগে থেকেই ওত পেতে থাকা একেবারেই পছন্দ নয় জ্যাঠামশাই এর। মেজ পিসির বৌভাতের সময় নাকি প্যান্ট শার্ট পড়ে জ্যাঠামশাই অভর্থনা করেছিল। বাবা রা বউ ভাতে গিয়ে প্রথম চিনতেই পারেনি নতুন জামাইকে। বাবা যখন বললে,
"একই বেশ? আজ তো ধুতি পাঞ্জাবি পড়তে হয়"।
পিসেমশাই বলেছিল "আসলে সব দিক দৌড়ে দেখাশুনা করতে হবে তো তাই। বাড়িতে আর লোকজন?"
"আছে তো। কিন্তু মুশকিল আমি সবার ওপর সব দায়িত্ব ছাড়তে পারি না। এই যে আপনারা এলেন, সবাই তো আপনাদের সবাইকে চেনে না। আমাকে থাকতে হবে আপনাদের কাছাকাছি। সবাই ঠিকমত খাচ্ছে কিনা নিজে না দেখলে শান্তি হয় না। আর আমার আত্মীয় বন্ধুরাও আমাকে এই ড্রেস এই চিনেছে। এই একবার একতলা একবার তিনতলায় ছাদে খাবার জায়গায় যাওয়া, বুঝলেন না কত ঝামেলার। তারপর যদি পা ধুতিতে আটকে গিয়ে তাড়াহুড়োতে পরে যাই তাহলে তো ডাক্তার হাসপাতাল ......। জ্যাঠামশাই মাঝখানে থামিয়ে দেন,
"বালাই ষাট। আজ এই শুভ দিনে থাক ওসব।"
এক গাল হেসে পিসেমশাই বললেন "যাক নিশ্চিন্ত হলাম। সবাই আবার বুঝতে পরে না। তাই আর ওসব জগঝম্প ড্রেস পড়িনি। জ্যাঠামশাই জামাই একটু বাচাল বলে দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু মুখে কিছু বলেন নি।
কিছু মানুষ থাকে খুব লেগে থাকতে পারে যতক্ষণ না নিজের দলে আনতে পারছে। পিসেমশাই হচ্ছে সেই রকম। কে কি ভাবল, বলল তাতে কুছ পরোয়া নেই। সেই জ্যাঠামশাই আর বাবা কেও একদিন পকেটে পুরে ফেললে পিসেমশাই। আমাদের বজবজের কাছে পুজালিতে বাড়ি। জ্যাঠা মশাই ইলেকট্রিক সাপ্লাইতে কাজ করেন। বাবা কলকাতায়। সেবার মেজপিসির সবে বিয়ে হয়েছে। ঠাকুমা যায় যায় অবস্থা চলছে কিছুদিন। বাড়িতে বাবা, জ্যাঠামশাই বড় পিসি ছোট পিসি মিলিয়ে সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। মেজ পিসি কলকাতায় থাকে। আসা যাওয়া চলছে। ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে দিন। নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ সবার। ঠাকুমার জীবন দীপ টিম টিম করছে। কোন সময় মনে হচ্ছে আর ধরে রাখা গেল না। এই বোধহয় বেড়িয়ে গেল। আবার ডাক্তারবাবুদের দড়ি টানাটানিতে ফিরে এলেন। দুয়েক দিন স্থিতিশীল, আবার যে কে সেই। ছেলে মেয়ে রা সত্যি উতলা। বউ রা এক ডিগ্রী বেশি। দেখনদাড়ি চলছে। পুজালীর দোতলা বাড়ি একেবারে নিস্তব্ধ। কারুর হাত থেকে গ্লাস পড়ে গেলে, হঠাৎ করে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে ফেললে সবাই বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছে। যেন সে চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। একতলার ঘরে কেউ কেউ এসে দাড়াচ্ছে, চারিদিক মেপে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছে। ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার, লিকুইড ওষুধ, স্যালাইন ঝুলছে। নার্স ঘন ঘন পালস দেখছে। ইনজেকশন দিচ্ছে। ঠাকুমার জ্ঞান নেই। মেজ পিসি সব হিসেব নিকেষ করে পিসেমশাই কে ফোন করলে একটু সরে গিয়ে। পিসেমশাই শহরের হিসেবী মানুষ। অফিসকে প্রায় মেরে এনেছেন, বললেন,
"দুঘন্টা পরে বেরিয়ে সব ব্যবস্থা করে বাড়ি হয়ে আসছি।" পিসেমশাই মিশুকে লোক। আমাদের পাড়াতে অনেক বন্ধুবান্ধব করে নিয়েছেন। রাত দশটায় পিসেমশাইও এলেন আর ঠাকুমা ধরাধাম ছাড়লেন। রাত দশটার পর পাড়াতে আর কেউ ঘুমোতে পারলে না। পাড়ার লোক দেখল মরা কান্না কাকে বলে। মাইমা রা, তার মেয়েরা গলা এইসা জি শার্প এ তুললে "ঠাকুমা গো, কোথায় গেলে গো,। ব্যস ঠাকুমাও এই হঠাৎ ধাক্কায় একটু যেন নড়েও উঠল। গোল হয়ে ঘিরে একবার ওপরে ওঠে পরমুহুর্তে ঠাকুমার পায়ের ওপর বুকের ওপর আঁচড়ে পড়তে লাগল। ভাগ্যিস মরে যাবার পর এত আকুলি বিকুলি হচ্ছে না হলে ওতেই চলে যেত। শম্ভু পাগলা আকন্ঠ মদ খেয়ে যাচ্ছিল নীচে রাস্তা দিয়ে, হঠাৎ করে ঠাকুমা গো, কোথায় গেলে গো শুনে গোত্তা খেয়ে একেবারে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ল। পড়েও জড়ানো গলায় বলতে লাগল "কে, কে গেল? সবাই যাবে.....। পাড়ার কান্নার ঢেউ এ রাস্তার শেষে পুলিশ থানা ও নড়ে
গেল। হাবিলদার বেটা অর্থাৎ বট কেষ্ট ও চেয়ার থেকে ঘুমোতে ঘুমোতে পড়ে যেতে যেতে সামলে গেল। আশেপাশের বাড়িতে কাঁচা ঘুমের মধ্যে এমন গলা ছেড়ে আচমকা আর্তনাতে প্রায় প্রত্যেকেই উঠে বসে পড়ে ভাবতে লাগল ডাকাত পড়েছে নাকি। একটু ধাতস্থ হয়ে সবাই বুঝলে পাড়ার ঠাকুমা দেহ রেখেছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গলা ফাটানোর পর কান্নাটা গুমরে গুমরে উঠতে লাগল। কেউ এলে, হঠাৎ কথা উঠলে স্বর ওপরে যেতে লাগল। জ্যাঠামশাই পিসেমশাইয়ের ওপর খুব ভরসা করেন না। আসতে আসতে বাড়ি ভর্তি লোক হয়ে গেল। রাত বারোটা বাজলে উঠোনে দাঁড়িয়ে পিসেমশাইকে সামনে রেখে স্বগতোক্তির মত মাথা চুলকে বললেন,
"ভায়া, মা তো খুব বিপদে ফেলে দিল"। পিসেমশাই সরল উদ্বিগ্ন মুখে বলল্
"কি রকম দাদা? একটু খুলে যদি বলেন?"
"এখন মা কে নিয়ে যাবো কি করে?"
"কেন দাদা? শ্মশান তো বেশি দূরে নয়।" বাবা যোগ দিল,
"আরে বুঝনা কেন? সব দোকান খুলতে তো কাল আটটার আগে নয়। নতুন শাড়ি?"
পিসেমশাই এর এক ব্যাপক রোগ আছে সব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেয়। তার ওপর জামাই। একটু লড়ে না গেলে চলে? বললে,
"চিন্তা করবেন না হয়ে যাবে" জ্যাঠামশাই এত দুঃখের মধ্যেও হতচকিত হয়ে গেলেন
"এত রাতে?"
"হ্যা বলছি তো হয়ে যাবে"। জ্যাঠা মনে মনে বললেন "বেশি কথা বললে এই হয়"। মুখে বললে,
"তুমি তো এখানে থাকনা তাই জানো না। বজবজ বাজার এ এসব পেতে সকাল দশটা বেজে যাবে"।
পিসেমশাই বললে " আর কি কি লাগবে যদি একটু বলেন।"
জ্যাঠামশাই এর শোকের মধ্যেও অবিশ্বাস্য এক চাহনি দিয়ে বললেন "সে অনেক কিছু যেমন গীতা লাগবে"।
পিসেমশাই বললে "চিন্তা করবেন না"।
বাবা বললেন "নামাবলী, অগুরু সেন্ট, সাদা চাদর দুটো, একটা বালিশ,"
নতুন জামাই বলে কথা, চোখ বুজে বলে দিলে "হয়ে যাবে"।
জ্যাঠামশাই বললেন "আর সব কিছু হলেও খাটটা তুমি পারবে না আজ রাতে"।
পিসে মশাই নেশাগ্রস্তর মতন বললে "তাও হবে দাদা"। জ্যাঠামশাই সব শোক ভুলে নতুন ভগ্নিপতি কে মাপতে শুরু করেছেন। নেশা করে এসেছে নাকি? বাবাকে একটু কেউ ডেকেছিল বলে দূরে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করেছিল। খাটএর কথা শুনে ফোন কেটে তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে বললে "দেখো সলিল তুমি এত চিন্তা করো না। আমরা দেখছি কি করতে পারি"।
পিসেমশাই খুব মর্মাহত হয়ে বাবার হাত ধরে বললে "শাশুড়ি মায়ের জন্যে এটুকু করতে পারবো না ছোড়দা?"
ওদিকে ফুসফুস, ফিসফিস, গুমরে, গুমরে ফোঁফানো কান্না চলছে। রাত বাড়ছে, আসেপাশের বাড়ির লোকজন একবার করে ঘুরে গেছে। নাক টানা, ফ্যাঁচর ফ্যাঁচর চোখের জল, সব শেষ। এবার শুধু বডি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হয়। পিসেমশাই শেষ অবধি নাছোড়বান্দা, বললে "বলুন কখন বেরোব আমরা?"
বাবা বললে "কোথায়? দোকান খুলতে তো আটটা থেকে নয়টা"। আর এভাবে মাকে নেওয়া যায় না"।
জ্যাঠামশাই যখন বুঝলেন ভগ্নিপতি শুধু সান্তনাই দিচ্ছে। ওর পক্ষে সম্ভব নয় এই অচেনা জায়গায় ঠিক তখনই পিসেমশাই বললে বাবাকে "ছোড়দা, আপনারা এক জোড়া বাঁশের কথা তো বললেন না? সেটাও তো লাগবে"।
জ্যাঠামশাই মায়ের শোকে মুহ্যমান হয়ে চেয়ে রইলেন তারপর মাথা নাড়লেন "হ্যা, তাই তো লাগবে"। বাবা ও পাড়ার লোকেদের সাথে কথা বলে বুঝেছেন রাতে আর কিছু হবে না। তখন পিসে মশাই বাবাকে পাশের ঘরে ডাকলে। ফিসফিস করে বললে "দাদা সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বলুন কখন বেরোবেন?"
বাবা কিছু বলবার আগেই এক এক করে চাদর বালিশ অগুরু, এমন কি মাল আর রজনীগন্ধার স্টিক আর মালাও কাগজ খুলে দেখাতে বললে পাড়ার মন্টুদাকে। বললে "মিলিয়ে নিন সব আছে কিনা। বাবা এই শোকের মধ্যেই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, এসব দেখে তাড়াতাড়ি ছুট্টে জ্যাঠামশাই কে ডাকতে গেল যে ঘরে ঠাকুমা শেষ শয্যায়। জ্যাঠামশাই কে গিয়ে বললে "দাদা সব হয়ে গেছে।উনি কানে কম শোনেন। এত লোকের মাঝে শুনলেন "দাদা সব গেছে"।
জ্যাঠামশাই এর গলা ওপরে উঠল "আবার কে গেল? হায়, হায়। কি হবে? ঘরের সবাই জানে এবার আরেক প্রস্থ কান্নার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে, কিন্তু বাবা বিপদ বুঝে কানের কাছে মুখ এনে জোরসে বললে। "দাদা, সলিল সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।"
জ্যাঠামশাই ধরেই নিয়েছিলেন সলিল আর যাই করুক পুজালির গণ্ড গ্রামে রাতারাতি সব ব্যবস্থা করে ফেলবে এটা হতেই পারে না। সব চাদর, ফুল মালা দেখে জ্যাঠামশাই এতক্ষণ নিজেকে যদিও ধরে রেখেছিলেন কিন্তু নতুন খাট উঠোনে পাতা দেখে আর পারলেন না। পিসেমশাইয়ের হাত ধরে নাক টেনে, গুমরে কেঁদে উঠলেন। কেউ জ্যাঠামশাইকে কোনোদিন কাঁদতে কেন নাক টানতে ও দেখেনি। সবাই রাত জাগা, তার ওপর কি করবে বুঝে না উঠতে পেরে কেমন হতচকিত। সবাই ঠাকুমাকে ছেড়ে জ্যাঠামশাইয়ের পিঠে হাত বোলাতে লাগল। "আহা! বড় ছেলে বলে কথা। জ্যাঠা মশাই খুব জোর সামলে নিয়ে পিসেমশাইয়ের পিঠে হাতটা বুলিয়ে দিলেন। এবার সবাইকে সরিয়ে দিয়ে পিসেমশাই ঠাকুমারই খাটের তলায় ঢুকে নিজেই থেকেই টেনে বার করলে দুটো বাঁশ। পাড়ার লোকেরা ভাবলো জামাইয়ের মাথাটা গেছে। সবার মুখ হাঁ। বাবা, বড় পিসি, মেজ পিসি, মা, সবার চোখ গুল্লু গুল্লু হয়ে গেল। বড় পিসি বললে "সলিল, কে রেখেছে বাঁশ মার খাটের তলায়? আমরা তো জানতাম না। কবে থেকে এগুলো এখানে?
পিসে মশাই চুপ। উঠোনে খাট পাতা হল।খাটের সঙ্গে বাঁশ বাঁধা হল। ঠাকুমাকে তোষক সমেত তুলে পিসেমশাই আর পাড়ার দু শক্তিশালী দুজন দাদা এনে শুইয়ে দিল। এর ওপর চড়ল মালা, চন্দন, রজনী গন্ধার স্টিক। বাঁধা হল। অগরু, গীতা সব পটাপট চলে এল ভোর রাত্তিরে। সব যখন রেডি পিসেমশাই দৌড়ে গিয়ে এক পিস নামাবলী এনে চড়িয়ে দিলে ঠাকুমার গায়ে। মা, জেঠিমা বাবা, এমন কি জ্যাঠামশাই ও চমৎকৃত এতসব ব্যবস্থা দেখে।
তখনও আলো ফোটেনি। এক ধামা খই আর তামার পয়সা ছড়িয়ে সামনে পিসেমশাই প্রথম বোল তুললে "বল হরি, হরি বল। পিছনে পাড়ার লোকজন নীচু স্বরে তান ধরলে। বল হরি, হরি বল। পিসে মশাইয়ের নেতৃত্বে বীর দর্পে আধ অন্ধকার ভেদ করে মিছিল এগিয়ে চলল শ্মশানের দিকে। দুপুর বারোটা নাগাদ কাজ মিটিয়ে ফিরে এল সবাই। জ্যাঠামশাই পুরো কুপোকাত। পাড়ার মন্টুদা যিনি গিয়েছিলেন সঙ্গে, এসে বললে তোর সলিল পিসেমশাই তো কামাল পাশা। একাই চলে গেল কাঠ, পুরোহিত পিন্ডর ব্যবস্থা করতে। মনে হল এই খানটা সব হাতের মুঠোর মত চেনা। বাবা, জ্যাঠামশাই পুরো গলে গোবর। এতদিন চিনতেই পারেনি। শেষে শ্মশান এ এসে চিনতে পারলে ভগ্নিপতিকে। লজ্জায় আর পিসেমশাইয়ের দিকে তাকাতেই পারছে না। কিন্তু ওনাকে আর ধরে রাখা গেল না। কাজের লোকরা নিজের গুণগান শুনতে পছন্দ করে না। অফিসের কাজ আছে বলে দুপুরেই চলে গেল অন্য কারুর উপকার করতে।
সন্ধ্যেবেলা বাড়ির শোকটা একটু ফিঁকে হয়ে আসার পর ধাতস্ত হয়ে বাবা, জ্যাঠামশাই এসে মেজ পিসি কে চেপে ধরলে,
"কিরে? তখন মাথায় আসেনি কিন্তু সলিল এত কিছু রাতারাতি ব্যবস্থা করলে কি ভাবে? ও কি ম্যাজিক জানে? ও তো এখানকার সব কিছু চেনেই না"।
মেজ পিসি চুপ।
বাবা বললে "মেজদি খুলে বল তো ব্যাপারটা কি? এর সহজ নয় সব ব্যবস্থা করা রাত বিরেতে এখানে"
মেজ পিসি বিছানায় বসে মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে লাগল।
শেষে জ্যাঠামশাই চোখ বড় বড় করাতে, চেপে ধরাতে বললে,
"সন্ধ্যেবেলা মেজ পিসির কাছে অবস্থা শুনেই নাকি খাট, মালা, গীতা, ফুল সব ব্যবস্থা করে নিয়ে এসে গোয়াল ঘরে রেখেছিল"।
"এ্যাঁ, গোয়াল ঘরে? হায়, হায়, কেন? আর বাঁশ? আরে ছ্যা, ছ্যা। মা বেঁচে থাকলে বা জানতে পারলে পাড়া ছাড়া করে দিত। শেষে গোয়াল ঘর?"
"আর কোথায় রাখবে? অন্য কোথাও রাখলে তোমরা কি মনে করবে সেটা বল?
মেজ পিসি ফস করে হাটে হাড়ি ভাঙল। "বাঁশ কটা ও আগের সপ্তাহেই রেখে গেছিল"।
জ্যাঠামশাই আর্তনাদ করে উঠলেন "তখন তো মা ভালই ছিল।
বাবা বললে "এরকম বাস্তববাদী ও মানুষ হয়?"
মেজ পিসি চাপে পড়ে ভেঙে পড়ল। "তোমায় বলেছিলাম না। ও সব তিন ধাপ আগে থেকেই ভেবে নিয়ে চলে। কিসে কি হতে পারে আন্দাজ করে সব নিয়ে এসেছে"।
জ্যাঠামশাইর মাথায় হাত। আরে? তখন তো মা বেঁচে? মা কি দেখে গেল? খাটের তলায় বাঁশ রাখা হচ্ছে ওনারই জন্যে?"
মেজ পিসি ঘাড় নাড়লে। নাহলে কি পারতে এত সকালে শ্মশানে নিয়ে যেতে?
বাবা, জ্যাঠামশাই পুরো মাত। বললেন "শত কোটি প্রণাম তোর বরকে। মেজ পিসি খুশিতে বলেই ফেলল "জানো, আমাদের পাশের বাড়ির পল্টুর বাবা যায় যায় যখন তখন ও একদিন পল্টুর সাথে কথা বলে নতুন খাট বিছানা নিয়ে এল। সে ঘরেই পাতবে সব পুরনো খাট বিছানা সরিয়ে।
বাবা বললে "কেন রে?"
"ওর যুক্তি হচ্ছে মৃত্যুর কাছে হারতেই হবে যখন তখন, আগেই কেন হারবে?"
"তাহলে? কি সব হাবিজাবি বলছিস?"
"ও বলে মৃত্যুর কাছে আগেই মাথা নত করার কি আছে? রাজার মতন যাও। নতুন খাট বিছানা গুলো তো পরে মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে লাগে তারপর ডোমরা নিয়ে নেয়। ভোগ করে নাও"।
"বলিস কি? এত মারাত্বক ব্যাপার! "জ্যাঠামশাই এর চোখ বড় বড় ,তাজ্জব।
"যাবেই যখন, ওর কথা হল নতুন খাটে কিছুদিন শুয়ে নাও। তারপর সময় হলে সাজিয়ে গুছিয়ে দেব। নতুন জামা পড়িয়ে, মালা পড়িয়ে, চন্দন পড়িয়ে রওনা করিয়ে দেব। উপযুক্ত সম্মান নিয়ে রাজ বেশে সেজে গুজে যাবে"।
"কি হল শেষে?"
মেজ পিসি ঠোঁট উল্টে করুণ মুখে বললে "দিল না পল্টুর জ্যাঠা। উনি এসে প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়ে ওর মাথার গন্ডগোল আছে বলে মানা করে দিল"। একথা শুনে জ্যাঠামশাই কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলেন। বাবা শুধু বললে,
"সলিল দেশের প্ল্যানিং মিনিস্টার হলে কিম্বা দাবা প্লেয়ার হলে গ্র্যান্ড মাস্টারটা বাঁধা ছিল। ওটা কাজে দিত।
মেজ পিসি কিছুটা লজ্জায় কিছুটা গর্বে আর বসে থাকতে পারলে না। উঠে গিয়ে বললে,
"যাই তোমাদের জন্য চা করে আনি।"
প্রবন্ধ
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
-জাদু-বাস্তবতার
এক আদিজনক?
ঋদ্ধিমান বসু
জাদু-বাস্তবতা বা ম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম (magical realism) বলতে আমাদের মূলত লাতিন আমেরিকা বা ইউরোপের কথা মনে পড়ে। এর শুরু হয়েছিল ল্যাটিন আমেরিকায়, কিউবান লেখক অ্যালেজো কার্পেন্টিয়ার এর হাত ধরে। তাঁর 'Kingdom of This World' কেই ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্ট ধারার প্রথম উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। তার পরে আমরা এই জ্বঁরে (genre)/ধারায় অনেক কাজই পেয়েছি - যেমন কলম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর 'One Hundred Years of Solitude', 'Love in The Times of Cholera' ইত্যাদি; জার্মানির গুন্টার গ্রাসের 'The Tin Drum'; এবং ভারতীয় সলমন রুশদীর 'Midnight's Children', 'The Ground Beneath Her Feet' ইত্যাদি।
এই সব উপন্যাস গুলো থেকে জাদু-বাস্তবতার বিশেষত্ব সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায়। এগুলো কে জাদু-বাস্তবতার কয়েকটা মাপকাঠি বলা যায়। সেগুলো কি দেখা যাক:
১। উপন্যাস বা গল্প যাই হোক, তাতে লৌকিক এবং অলৌকিক পাশাপাশি থাকতে হবে, মানে দুটোরই অস্তিত্ব একই সঙ্গে থাকবে। জাদু হলেও তাতে একটা যৌক্তিকতা থাকবে, তা স্পষ্ট হবে, বাস্তবের মতোই তার পিছনে কার্য-কারণ থাকবে।
একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে।
যেমন, 'Alice in Wonderland' এ সেই ওয়ান্ডারল্যান্ড এক ভিন্ন জগত, এক খরগোশের গর্ত দিয়ে বাস্তব দুনিয়া থেকে সেখানে পৌছনো যায়। কাজেই সেটা এই প্রথম শর্ত পূরণ করছে না। তাই তাকে ম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম বলা যাবে না ('অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড' জাদু-বাস্তবতার এক পূর্বসূরি)।
অন্যদিকে 'মিডনাইটস চিল্ড্রেন' এ একগুচ্ছ বাচ্চা ভারতের স্বাধীনতার ব্রাহ্মমূহুর্তে নানারকম অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। এই উপন্যাসের ঘটনাবলি প্রাক স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা উত্তর সময় পর্যন্ত বিস্তৃত, পটভূমি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। এখানে জাদুর উৎপত্তি স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মানো। এটা জাদু-বাস্তবতার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটা পূরণ করে, তাই একে এই কারনেম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম এর একটা রোল মডেল হিসেবে ধরা হয়।
এর সঙ্গে পরাবাস্তব বা সুরিয়ালিসম (surrealism) কে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়; সেখানে সবসময় অলৌকিক বিষয় গুলো ততটা স্পষ্ট নয়, কার্য-কারণও ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঘোলাটে, অবচেতন মন ও রূপকের খুব বড় ভূমিকা থাকে। বাস্তবতার ও যৌক্তিকতার ওজন সেখানে একটু কম। (আরো অনেক অন্যধরনের বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলো এই লেখায় আলোচ্য নয়।)
২। প্রথম বৈশিষ্ট্য টা কেই এই ধরনের সাহিত্যের সংজ্ঞা বলা যেতে পারে। আরেকটা বৈশিষ্ট্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়; এই আখ্যানগুলো কোন এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং কিছু ঘটনাবলী কে তুলে ধরে। যেমন 'মিডনাইটস চিল্ড্রেন' এ স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং ইন্দিরা গান্ধী আরোপিত ইমার্জেন্সির কথা পাওয়া যায়, 'দা টিন ড্রাম' এ ড্যানজিগ শহরের একটা লম্বা সময়কাল পাওয়া যায়, যাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির অধিগ্রহণ, হিটলার কৃত ক্রিস্টালনাচ (ইহুদি দের দোকান চুরমার করা, এক রাতের মধ্যে) এর উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু উল্লেখ বলা ভুল হবে, এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে উপন্যাসের বক্তব্য ও পাত্রপাত্রীরা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বলতে, সেটা রচনাকালের সমসাময়িক কিছু ঘটনাবলী নিয়েও হতে পারে। ভবিষ্যতে সেগুলো কে আমরা ঐতিহাসিক ঘটনা বলেই ধরব। পরের দিকে অবশ্য এই জ্বঁরেই কিছু কাজ পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে ইতিহাসের সেইভাবে সম্পর্ক নেই। সেইজন্য, এই শর্তটা একেবারে বাধ্যতামূলক নয়।
৩। এই ধরনের সাহিত্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমালোচনা ও টিপ্পনি থাকে, যাকে স্যাটায়ারধর্মী (satire) বলা যেতে পারে। উপরোক্ত দুটো উপন্যাসের পটভূমিকা অনুযায়ী যে এরকমটা থাকবে, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। মার্কেজ এর 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড' এ ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর স্যাটায়ার আছে। তবে এর ব্যতিক্রম ও আছে বেশ কিছু, তাই একেও বাধ্যতামূলক শর্ত বলা যায়না।
এবার ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (২২ জুলাই, ১৮৪৭- ৩ নভেম্বর, ১৯১৯) কথায় আসা যাক। উনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ওনার জীবন সংগ্রামের কাহিনী খুবই রোমহষর্ক, প্রায় রূপকথার মতো। তাঁর কর্মজীবন ও খুব বিচিত্র ছিল। কখনও হাতি ধরার দলে তো কখনও পুলিশের দারোগা। কখনও ইস্কুল মাস্টারের চাকরি, আবার কখনও ভারত সরকারের (ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারত) রাজস্ব বিভাগের আধিকারিক। পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, আবার শেষ জীবনে কলকাতা মিউজিয়মের বিভাগীয় অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ওনার ইউরোপ যাত্রারও সুযোগ হয়েছিল। এই সবকিছুর প্রভাবই হয়ত ওনার লেখার ওপরে পড়েছিল।
উনি ইংরেজি, ফারসি, ওড়িয়া, সংস্কৃত ইত্যাদি বহু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তবে ওনার মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল। শোনা যায়, এক সময় তিনি বাংলা কে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, অবশ্য সফল হননি।
এইরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষের লেখনীতেও বৈচিত্র্য পাওয়া যাবে, এটা প্রত্যাশিত।
একাধারে উনি ইংরেজি ভাষায় ওনার ইউরোপে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং অন্যান্য বিবিধ বিষয়ে বই লিখেছেন('A visit to Europe', 'Handbook of Indian Products'); উল্টোদিকে বাংলা ভাষায় চমকপ্রদ কল্পনাশক্তির পরিচয় দেওয়া উদ্ভট, অলৌকিক ও হাস্যরসাত্মক গল্প/উপন্যাস (যাকে weird fiction ও বলা যায়) লিখেছেন। বাংলা 'বিশ্বকোষ' এর সম্পাদনা করেছেন, প্রচুর প্রবন্ধও লিখেছেন। ওনার প্রথম উপন্যাস 'কঙ্কাবতী' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে। এই বইতেও উপরোক্ত কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, কিন্তু এর মুল কল্পনার জায়গাটা একটা স্বপ্নের
মধ্যে ঘটে, তাই সেটা জাদু-বাস্তবতার প্রথম শর্ত পূরণ করেনা। তবে একে জাদু-বাস্তবতার পূর্বসূরি বলা যায়। ('Alice in Wonderland' বা 'Gulliver’s Travels' এর মতোই)। এই উপন্যাসের জন্য উনি প্রভূত সাধুবাদ পান। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ 'সাধনা' পত্রিকায় এই বইয়ের অনুকূল সমালোচনা প্রকাশ করেন। এর পর আর ওনাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
পরবর্তী সময়ে, ওনার এই ধরনের গল্প ও উপন্যাস একের পর এক প্রকাশ হতে থাকে। তাঁর লেখার এই ধরণ কে উনি আরও উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। এগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, 'ডমরু চরিত' উপন্যাস। এটা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে, ওনার মৃত্যুর চার বছর পরে। তাঁর এই অন্তিম সৃষ্টি, বাংলা সাহিত্যের জগতে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই পর্যায়ের কিছু অন্যান্য কাজের মতো এটাকেও একেবারে ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্ট জ্বঁরেই ফেলা যায়।
'ডমরু চরিত' বইটা ৭টা বড়গল্পের সমষ্টি। গল্পগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতা আছে(অর্থাৎ continuity), তাই সব মিলিয়ে একে একটা উপন্যাস হিসেবেও গণ্য করা যায়।
এই সব কটা গল্পেরই মূল চরিত্র ডমরুধর। সে একজন মাঝবয়সী বিত্তশালী মানুষ, একজন অ্যান্টিহিরো। অনেকগুলো গল্পেই বলা আছে, যে উনি একসময় গরীব ছিলেন, তারপর নানান উপায়ে এত বড়লোক হয়েছেন। সেই উপায়গুলো যে খুব আদর্শ নয়, সেটা বোঝাই যায়। ডমরুধর ধুরন্ধর, শঠ, হাড় কিপ্টে, দুশ্চরিত্র, কিন্তু দারুণ রসবোধ আর গল্পে সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারেন। প্রত্যেক বছর পুজোর সময় দালানে বসে উনি ওনার বন্ধুবান্ধব কে ওনার জীবনের নানান চমকপ্রদ ঘটনা বলেন। এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই অলৌকিক, যেখানে মা দূর্গা, যমরাজ থেকে শুরু করে, চড়ুই পাখির আকারের মশা, ভালমানুষ ভূত ও আরব্য উপন্যাসের জিন এর কথাও আছে। এইগুলো নিয়েই মোট সাতটা গল্প। দ্বিতীয় গল্পে ওনার গরীব থেকে বড়লোক হবার কাহিনী আমরা জানতে পারি। বাকি গল্প গুলো বর্তমান (উপন্যাসের রচনাকালের পরিপ্রেক্ষিতে) সময়ের। এবার জাদু-বাস্তবতার নিরিখে, প্রত্যেকটা উল্লিখিত মাপকাঠি দিয়ে, এই উপন্যাসকে বিশ্লেষণ করা যাক:
১। জাদু ও বাস্তবতার পাশাপাশি সহাবস্থান -
'ডমরু চরিত' অলৌকিক ব্যাপারে ভরপুর। এর সবই আমরা জানতে পারি ডমরুধরের মুখে। প্রত্যেক বছর পুজোর দালানে বসে তিনি নানান চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা শোনান; সেখানে সূক্ষ্ম শরীরে জমালয়ে ভ্রমন এর কথা আছে, শরীরের নিম্নভাগ গরুতে পরিনত হবার কথা, শবসাধনা, এমনকি এক বিশেষ মন্ত্রের মাধ্যমে (জিলেট মন্ত্ৰ) আত্মার উদ্ধার করার উপাখ্যান ও আছে। তৃতীয় গল্পে উনি নিজেকে কার্তিকের অবতার বলে জাহির করেছেন। এক গনৎকারের কাছ থেকে নাকি তিনি এই গূঢ় সত্য জানতে পারেন। জ্যোতিষী বলেছিলেন, "বিবাহ করিবার নিমিত্ত একদিন আপনি মায়ের নিকট আবদার করিয়াছিলেন। ভগবতী বলিলেন - বাচ্চা, এ দেবলোকে তোমাকে কেহ কন্যা প্রদান করিবে না। যদি বিবাহ করিতে সাধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে পৃথিবীতে গিয়া অবতীর্ণ হও।"
বেশিরভাগ গল্পগুলোতে পৌরাণিক কাহিনী র যোগসূত্র আছে। আর আছে বাংলার লোককথার উল্লেখ। এই জাদুর পাশাপাশি বাস্তব নানান ঘটনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিজের একটা পুরোনো বাড়িতে ইচ্ছাকৃতভাবে গুপ্তধনের সঙ্কেত পুঁতে রেখে, বাড়ির দাম বাড়িয়ে নেবার মতো ধূর্ততা, এর একটা উদাহরণ। দুটো দিকই অবিচ্ছেদ্য।
এখানে জাদুর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্য্য-কারণ সম্পর্ক আছে, সে মা দূর্গার আশীর্বাদই হোক, নন্দীর অভিশাপই হোক, বা 'জিলেট' মন্ত্রই হোক।
ডুমরুধরের গল্পগুলো যে গাঁজাখুরি, সেই ইঙ্গিত ও অনেকবার দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় গল্পে উনি বলেন যে সরখেল মশাইয়ের বাড়িতে এক বৃহদাকার চুম্বকের সাহায্যে তাঁর লোহার সিন্দুক কে চোরেরা টেনে নিয়ে যায়। এই ঘটনা উনি নিজের চোখে দেখেছেন। তখন বন্ধু লম্বোদর বলেন - "এ তোমার আজগুবি গল্প। এ অনেক দিনের কথা, কিন্তু আমরা শুনিয়াছিলাম যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়িতে যথার্থই চুরি হইয়াছিল, এবং সে চোরগন তোমার অপরিচিত লোক ছিল না"
এর উত্তরে ডমরুধর বলেন - " সমুদয় মিথ্যা কথা, হিংসায় লোক কি না বলে"।
এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে ডমরুধরের গল্পগুলো বানানো হতে পারে, এবং তার উদ্দেশ্য আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়া। এই ব্যাপারটা অনেকটা আনরিলায়েবল ন্যারেশান (unreliable narration) এর মত। প্রসঙ্গত, 'দা টিন ড্রাম' এও এই ধরনের বিষয় আছে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র অস্কার, যেগুলো পাঠকদের জানাচ্ছে, সেগুলো যে পুরোটাই কল্পনা হতে পারে, (অলৌকিক ব্যাপারগুলো) সেরকম কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এটা ম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম এর পরিপন্থী নয়। কাজেই সব দিক থেকে বিচার করলে 'ডমরু চরিত' জাদু বাস্তবতার প্রথম শর্ত পূরণ করছে।
২। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট -
এই বইয়ের রচনাকাল ১৯১০ দশকের শেষের দিকে। তাই, এতে সেই সময়ের কথা বিভিন্ন জায়গায় চলে আসে। এসময়ের বিলেতযাত্রা নিয়ে গোঁড়ামি(সপ্তম গল্পে - ডমরুধরের বন্ধু ঢাকমশাই এক যায়গায় তাঁর জামাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, "কিছুতেই আমার কন্যাকে ও দৌহিত্রকে তাহার বাড়ি পাঠাইব না। সে সমুদ্র পার হইয়া বিদেশে গমন করিয়াছে। তাহার জাতি গিয়াছে"), ইংরেজি কে মাতৃভাষার তুলনায় উচ্চস্থানে রাখার মানসিকতা(পঞ্চম গল্পে - "সেই যাহারা ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন, যাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া স্কুল-কলেজের ছোঁড়াগুলো আনন্দে হাততালি দিয়া গগন ফাটাইয়া দেয়, আমরা সেইরূপ দুজন বক্তা জোগাড় করিয়াছিলাম") এবং দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে লোক ঠকানোর উদ্দেশ্যে স্বদেশী কোম্পানি খোলা ইত্যাদির কথা আছে। (পঞ্চম গল্পে - ডমুরুধর, শঙ্কর ঘোষ নামে একজনের সাথে একটা স্বদেশী কোম্পানি খুলেছিলেন। কোম্পানির উদ্দেশ্য পুরোপুরি অবাস্তব - এঁটেল মাটি থেকে কাগজ বানানো। কিন্তু তাঁরা ভাল বক্তা এনে এরকম অসম্ভব জিনিসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন। ডমরুধরের কথায়, " আমাদের কোম্পানির নাম হইল - 'গ্র্যান্ড স্বদেশী কোম্পানি লিমিটেড'... বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, যে ব্যাক্তি একশত টাকার শেয়ার বা অংশ কিনিবে, প্রতিমাসে লাভস্বরূপ তাহাকে পঁচিশ টাকা প্রদান করা হইবে।...প্রথম প্রথম শত শত লোকে শেয়ার কিনিতে লাগিল। হুড় হুড় করিয়া টাকা আসিতে লাগিল।...কয়েক মাস গত হইয়া গেল। শঙ্কর ঘোষ এঁটেল মাটি দিয়া একখানিও কাগজ প্রস্তুত করিলেন না। মাসে যে পঁচিশ টাকা লাভ দিবার কথা ছিল, তাহার একটি পয়সাও কেহ পাইল না। আসল টাকার মুখও কেহ দেখিতে পাইল না।...অনেকগুলি টাকা লোকে দিয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, সে টাকাগুলি সমুদয় আমি লইলাম।")
বইটা পরে প্রকাশিত হলেও, এর সময়কাল নির্ধারণ করা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটা বিশেষ উল্লেখ থেকে। সপ্তম ও শেষ গল্পে এক জায়গায় আছে, ডমরুধরের বন্ধু ঢাকমশাই এর (ডমরুধরের কথায় যিনি গুরুগিরি করেন) কিছু উচ্চশিক্ষিত শিষ্য তাঁকে বলছেন, "মহাসংগ্রামে পৃথিবী টলমল করিতেছে। জর্মনদিগকে যদি সম্পূর্ণ পরাজিত না করা যায়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে পৃথিবীর ঘোর অনিষ্ট ঘটিবে।" এর থেকে কাইসারের নেতৃত্বে জার্মানির আগ্রাসন (১৯১৮ পূর্ব) এর কথা বোঝা যায়। (ত্রৈলোক্যনাথের জীবনকালে উনি একটাই বিশ্বযুদ্ধ দেখেছিলেন।) যেহেতু এই উপন্যাস একটা নির্দিষ্ট সময়ের কথা তুলে ধরে (সেটা লেখকের অনুপাতে বর্তমান সময় হলেও), এবং তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ঘটনাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করে, তাই, এটা দ্বিতীয় শর্তটাও পূরণ করছে।
৩। স্যাটায়ার -
ত্রৈলোক্যনাথের সব রচনার মতো এতেও প্রচুর স্যাটায়ার রয়েছে।
প্রথম গল্পে ডমরুধর সন্ন্যাসীর ষড়যন্ত্রে সূক্ষ্ম শরীরে তাঁর স্থূল শরীর থেকে নির্গত হন, ও সন্ন্যাসী তাঁর শরীরে প্রবেশ করেন। এই সঙ্কট থেকে ডমরুধর কিভাবে মুক্তি পান, সেটা প্রথম গল্পের বিষয়। যাই হোক, সূক্ষ্ম শরীরে ডমরুধর উপরে উঠতে উঠতে অবশেষে যমালয়ে গিয়ে পৌঁছোন।
সেখানে তিনি দেখেন, বৃন্দাবন গুঁই নামে একজনের বিচার চলছে। তাঁর সম্বন্ধে চিত্রগুপ্ত যমরাজকে বলছেন - "মহাশয়! এ লোকটি অতি ধার্মিক, অতি পুন্যবান। পৃথিবীতে বসিয়া এ বার মাস তের পার্বণ করিত, দীন-দুঃখীর প্রতি সর্বদা দয়া করিত, সত্য ও পরোপকার ইহার ব্রত ছিল।"
এ কথা শুনে যমরাজ বললেন - "চিত্রগুপ্ত! তোমাকে আমি বারবার বলিয়াছি যে, পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাহা আমি বিচার করিনা। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয়না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়। তবে শিবোক্ত তন্ত্রশাস্ত্র মতে সংশোধন করিয়া খাইলে পাপ হয়না।" অনেক প্রশ্নোত্তরের পর জানা গেল বৃন্দাবন একাদশীর দিন একবার পুঁইশাক খেয়ে ফেলেছিলেন। এই শুনে যমরাজ খুব ক্ষেপে গেলেন। বললেন - "সর্বনাশ! করিয়াছ কি! একাদশীর দিনে পুঁইশাক। ওরে এই মুহূর্তে ইহাকে রৌরব নরকে নিক্ষেপ কর। ইহার পূর্বপুরুষ, যাহারা স্বর্গে আছে, তাহাদিগকেও সে নরকে নিক্ষেপ কর। পরে ইহার বংশধরগনের চৌদ্দ পুরুষ পর্যন্তও সেই নরকে যাইবে। চিত্রগুপ্ত! আমার এই আদেশ তোমার খাতায় লিখিয়া রাখ।"
এইধরনের ব্যঙ্গের পিছনে, সেইসময়ের উঠতি গোঁড়া হিন্দুত্ত্বের প্রতি তির্যক মন্তব্য আছে। অনেকের কাছেই, একজনের কর্মের থেকেও, সে কি খায় সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, এবং এ ব্যাপারটা যে কতটা হাস্যকর ও অযৌক্তিক, তা এই কৌতুকের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন লেখক।(এটা আমাদের বর্তমান সময়েও বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে)
শেষ গল্পে, এক জায়গায় ডমরুধরের বন্ধু ঢাকমশাই তাঁকে পরামর্শের জন্যে ডাকেন, তাঁর আট বছরের বিধবা মেয়ে কুন্তলা, জ্বরে পড়েছে তাই। তবে জ্বরের জন্য না, তাঁর কাছে ধর্মরক্ষাই প্রধান চিন্তা। তিনি বলেন - "আজ একাদশী। বিধবা। সেই জন্য জল দিতে বারণ করিয়াছি। কিন্তু জল দিতে আমার গৃহিণীর ইচ্ছা। এখন করি কি? সেইজন্য তোমাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছিলাম।" এর উত্তরে ডমরুধর বললেন - "বাপ রে! জল কি দিতে পারা যায়? ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা। একাদশীর দিন জল খাইতে দিলে তাহার ধর্মটি একেবারে লোপ হইয়া যাইবে।"
ঢাকমশাই তাই করলেন। এমনকি কেউ যাতে দয়াপরবশ হয়ে কুন্তলা কে জল না দিতে পারে, সেইজন্য তাকে নিচের ঘরে তালাবন্ধ করে রাখলেন। পরেরদিন সকালে কুন্তলা মারা গেল। এই ঘটনার জন্যে সবাই ছিঃছিক্কার করবে, এটাই আমরা ধরে নেব। কিন্তু, তার পরেই বলা আছে, এই ঘটনার কথা যখন প্রচার হল, তখন সবাই ঢাকমশাইয়ের এই ধর্মনিষ্ঠার জন্য ধন্য ধন্য করতে লাগল। তারা বলল - "কি দৃঢ় মন! কি ধর্মের প্রতি আস্থা, এরূপ পুণ্যবান লোক কলিকালে হয় না।"
এটাকে কালো হাস্যরস (Black Humour) এর উদাহরণ স্বরূপ ধরা যেতে পারে। স্যাটায়ার তো অবশ্যই। এটুকু ছোট্ট জায়গার মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ বুঝিয়ে দিলেন, সেই সময়ে বাল্যবিবাহের চল ছিল, এবং বিধবাদের (স্বাভাবিক ভাবেই বাল্যবিধবা দেরও) জন্যে কি ধরনের নিষ্ঠুর নিয়ম ছিল। এবং বৃহত্তর সমাজ, তার বিরোধিতা না করে বরং তা নিয়ে আস্ফালন করত। এ সবই হত ধর্মের নামে। (মূলত বাল্যবিধবা দের দূর্দশা দেখেই বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করার ব্রত নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, 'কঙ্কাবতী' তে বিদ্যাসাগরের উল্লেখ আছে, এবং এও বোঝা যায় যে লেখক এই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন।)
যে উদাহরণ দুটো দেওয়া হল, তার মধ্যে সাদা ও কালো বিদ্রূপের মাধ্যমে লেখক সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। এইরকম, এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এটা তৃতীয় শর্তটাও পূরণ করছে।
জাদু-বাস্তবতার বৈশিষ্ট্যের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে প্রথম শর্তটা পূরণ করলেই, একটা সাহিত্য কে ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্ট বলা যায়। সেখানে, 'ডমরু চরিত' এই তিনটে শর্তই পূরণ করছে। কাজেই এটা একটা জাদু-বাস্তব ধারার সাহিত্য।
পরিশেষে, এই লেখার শিরোনাম এর যৌক্তিকতা নিয়ে বলতে হয়। 'ডমরু চরিত' এর আগে, ত্রৈলোক্যনাথেরই 'নয়নচাঁদের ব্যবসা' বলে একটা বড়গল্পেও এইধরনের সব বৈশিষ্ট্যই আছে। তাই সেটাও একটা ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্ট ঘরানার কাজ, সম্ভবত প্রথম। ত্রৈলোক্যনাথের এই সাহিত্যকর্মের আগে, এইধরনের নজির যে একেবারেই নেই, তা নয় অবশ্য। ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'লোকরহস্য' বইতে, 'সুবর্ণ গোলক' বলে একটা ছোটগল্প আছে, যাকেও জাদু-বাস্তবতার একটা উদাহরণ বলা যেতে পারে। তবে বঙ্কিমচন্দ্র এই ধরনের আর কোন গল্প বা উপন্যাস লেখেননি। বিশ্বসাহিত্যের নিরিখে ওনেকেই দাবি করতে পারেন যে নিকোলই গোগোল এর ছোটগল্প, 'The Nose' (১৮৩৬ সালে প্রকাশিত), বা ফ্রাঞ্জ কাফকার লেখা উপন্যাস 'The Metamorphosis' (১৯১৫ সালে প্রকাশিত) এর মধ্যেও ম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম এর বৈশিষ্ট্য আছে। তবে সাহিত্যের ইতিহাসে এগুলো কে পরাবাস্তব ও স্যাটায়ার ধর্মী লেখা বলেই গণ্য করা হয়। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো'র (১৮০৯ - ১৮৪৯) কিছু ছোটগল্প কেও এই জ্বঁরে ফেলেন অনেকে। তবে, সেগুলোতে ম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম এর ছোঁয়া থাকলেও, আধুনিক জাদু-বাস্তব সাহিত্যের নিরিখে, সেগুলো একটু অন্যরকম। এ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে।
আরেকজন লেখকের কথা না বললেই নয়। ফ্রাসোয়া রাবেলে নামের এক রেনেসা যুগের ফরাসি লেখকের 'Gargantua and Pantagruel' সিরিজের উপন্যাস গুলোতে এই ধরনের উপকরণ, প্রচুর পাওয়া যায়। এই বইগুলোর আরেক বৈশিষ্ট্য, তার weird fiction হয়ে ওথার প্রবৃত্তি। বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, যে ত্রৈলোক্যনাথ সম্ভবত এগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন, এবং এগুলোর অনুপ্রেরণা তাঁর ডমরু চরিতে (ও অন্যান্য কিছু লেখায়) ভীষণভাবে পাওয়া যায়।
এরও আগে রোমান যুগের লেখক অ্যাপিউলিয়াস এর ''The Golden Ass' এর মধ্যেও এই ধরনের উপাদান পাওয়া যায়। সূত্র খুঁজতে গেলে হয়ত আরো পিছোনো যায়, এর কোন শেষ নেই। এই ধরনের কাজ কে প্রাচীন বলা যায়, তাই এদেরকে আধুনিক সংজ্ঞা অনুযায়ী ম্যাজিক্যাল রিয়ালিসম বলা যাবে কিনা, সেটা নিয়ে পর্যালোচনা হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ত্রৈলোক্যনাথের উল্লিখিত রচনাগুলোর মধ্যে আধুনিক জাদু-বাস্তবতার সব কটা বৈশিষ্ট্যই পাওয়া যায়। এগুলো সেই উপাদান, যেগুলোর জন্য অ্যালেজো কার্পেন্টিয়ার এর 'কিংডম অফ দিস ওয়ার্ল্ড' কেই প্রথম ম্যাজিক্যাল রিয়ালিস্ট উপন্যাস বলে ধরা হয়। এটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। অর্থাৎ, 'নয়নচাঁদের ব্যবসা' এবং 'ডমরু চরিত' লেখা ও প্রকাশের সময় অনুযায়ী ত্রৈলোক্যনাথ কে জাদু-বাস্তবতার একজন আদি জনক বললে, খুব একটা অত্যুক্তি হবেনা।
দুঃখের বিষয়, এই অসাধারণ সাহিত্যিকের কাজ, এমনকি তাঁর নামের সঙ্গেই এখন আর অধিকাংশ বাঙালির পরিচিতি নেই। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে, যদি এই বিস্মৃত লেখক ও তাঁর কাজের ব্যাপারে পাঠক ও বিশেষজ্ঞদের আগ্রহ তৈরি হয়, তাঁর সাহিত্যের পূনর্মূল্যায়ন করার ব্যাপারে যদি তারা সচেষ্ট হন, তবেই এই প্রবন্ধের সার্থকতা।
তথ্যসূত্র:
১। ত্রৈলোক্যনাথ রচনাবলী - কামিনী প্রকাশনালয়
২। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় - Wikipedia
৩। এ কোন ত্রৈলোক্যনাথ - আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন - ১০ জুলাই ২০২২
৪। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় : বিস্মৃত বই বিস্মৃত লেখক – আবদুশ শাকুর
মেছোপেত্নি
হিয়া রাজা
দুবাই
গল্প
বুড়ির পুকুরের দিকটা একেবারে নির্জন, এই সময় কেউ থাকেনা, ঝিনকির একবার মনে হলো গিয়ে কাজ নেই এই ভর সন্ধ্যের মুখে। কিন্তু কচি ছেলেটা কদিন হলো মাছ মাছ করে খুব বায়না ধরেছে। কাঁহাতক আর রোগা ছেলেটাকে ভাত আর কচু সেদ্ধ খাওয়ানো যায়। সে না হয় বড় মানুষ, তায় বিধবা, মুখ বন্ধ করে ভাত আর কচু ঘেঁচু খেয়ে, শাক পাতা খেয়ে কাটিয়ে দেয়, কিন্তু ছ বছরের বাচ্ছাটা আজ কতদিন ভালো করে খায়নি, তার মুখ চেয়ে সে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললো। লোকে বলে, বুড়ির পুকুরে নাকি মেছোপেত্নি আছে, শাকচুন্নি, অনেকেই দেখেছে। রাতদুপুরে জলের ওপর হেঁটে বেড়ায়, পুকুরের ওপরে হেলে পড়া বড় জামরুল গাছটার ডালে পা ঝুলিয়ে বসে মিহি সুরে গান গায়। লম্বা ভূষ কালো শরীর, সাদা থান পড়া, মাথায় বড়ো করে ঘোমটা টানা, ছপাৎ ছপাৎ করে পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে হাঁটে, গেঁড়ি গুগলি তুলে খায়। বছর খানেক আগেই তো ভর দুপুরে কয়েকটা সঙ্গী সাথী নিয়ে মিত্তিরদের বড়ো ছেলেটা জামরুল গাছে উঠে জামরুল পেড়ে খাচ্ছিলো, হঠাৎ কি যে হলো, পা পিছলে সোজা পড়লো পুকুরে, আর উঠলো না। সাঁতার সে জানতো না তা কিন্তু নয়, কিন্তু সাঁতার দেবেটা কে! বডিটা তোলার পর দেখা গেলো, বুকের মধ্যিখানে একখানা বড় লোহার শলা বিঁধে আছে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে। পুলিশ এলো দেখলো, বুড়ির পুকুরের মালিক মানিক দত্তর সাথে কি সব অনেক কথা হলো, তারপর বডি নিয়ে চলে গেলো। লোকে বলে, শাকচুন্নি নাকি জলের ভেতর ফালি নিয়ে বসে ডাকছিলো ছেলেটাকে, মাছ খেয়ে খেয়ে নাকি তার মুখ মেরে গিয়েছিলো, মানুষের তাজা রক্ত খাবার সাধ হয়েছিল। তাই মিত্তিরদের কচি ডাগর ছেলেটাকে আওতার মধ্যে দেখে আর লোড সামলাতে পারেনি, পা ধরে টেনে জলে নামিয়ে তার পর প্রাণ ভরে ---!"
ঝিনকির গাটা ছমছম করে উঠলো পুকুরের কাছে এসে। দুপুরে যখন ঘুনি, মানে বাঁশকাঠির মাছ ধরার ফাঁদটা পেতে গিয়েছিলো, তখন এতটা ভয় করেনি। ভেবেছিলো, সন্ধ্যে সন্ধ্যে এসে ফাঁদটা তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা রেশনের দোকানে এতো লাইন হবে সেটা বুঝতে পারেনি ঝিনকি। রেশনের ফিরি চালটা না তুললে গোটা হফতা উপোষ করে কাটাতে হবে। জেলের মেয়ে সে, জেলের বৌ। জলে তার ভয় নেই, তার ভয় মেছোপেত্নিকে, শাকচুন্নিকে। আসতো না সে, জ্বর থেকে উঠে কচি ছেলেটা তার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে মাথা না খেলে কক্ষনো আসতো না সে। অনেক ভুগলো যে বাপ মরা রোগা ছেলেটা তার। অনেক ডাক্তার বদ্যি করে, জমানো যা দু দশ টাকা ছিল এখানে ওখানে লুকোনো, সেগুলো খরচা করে, কেলাবের ছেলেগুলোর হাতে পায়ে ধরে ওষুধ পত্তর আদায় করে ছেলেটা তার ভালো হলো। চুপচাপ ছেলেটা তার, কোনো বায়না নেই, রোগা ডিগডিগে শরীরে এতো বড় মাথা, বড় বড় কালো চোখ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, মাকে জড়িয়ে থাকে সবসময়। ঝিনকির বড় মায়া হয়, আহা, বাছা আমার একটু মাছ খেতে চেয়েছিলো, তাই বুড়ির পুকুরে আসা। ঝিনকির হাতে পয়সা থাকলে কক্ষনো সে এ ভাবে মাছ চুরি করতে বুড়ির পুকুরে আসতো না। বুড়ির পুকুরে বেশ বড় চ্যাং, ছিমড়ি আর শোল মাছ আছে, খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই দেখা যায়, ঘন কালো জলে ঘাই মারে, বুড়বুড়ি কাটে। ঝিনকি বেশি কিছু চায়না, একটা বড় শোল মাছ কি কালবোস হলেই হবে। দুদিন চলে যাবে আরামসে। পেয়াঁজ আদা রসুন দিয়ে রাঁধবে বেশ করে সেও একটু খাবে। গত মাসের থেকে খানিকটা সর্ষের তেল সে জমিয়ে রেখেছে ঘরে। ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা রাস্তা চলে এলো ঝিনকি।
এদিকটা খুব একটা আলো নেই, দিনের আলো প্রায় মরে গেছে, আধো আলো অন্ধকার। ঝোপে ঝাড়ে লুকোনো গর্তে পা পড়ে গেলে খুব মুশকিল হবে। ঘরে ছেলেটা ঘুমোচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি হয় ফিরতে হবে ঘরে। মাছ পেলে ভালো, যদিও মন বলছে পাবেই আর যদি নিতান্তই না পাওয়া যায়, কম সে কম কঞ্চির ফাঁদটা তুলে নিয়ে যেতেই হবে। এখন এই লক ডাউনের বাজারে হয়তো কেনার লোক নেই, কিন্তু অন্য সময় হেসে খেলে শ খানেক টাকায় এটা বিক্রি হয়ে যাবে। ছিনাথ কৈবত্তর হাতে তৈরি পাকা বাঁশের কঞ্চি কেটে তৈরি ঘুনি,- জাত জেলের কাছে এর অনেক দাম। যদিও এ দিকটায় লোকজনের আসা যাওয়া খুবই কম, তবু জলে ফেলে রাখলে কারো না কারো চোখে পড়বেই, আর তাহলেই হলো আর কি।
মানিক দত্ত, মানে শয়তান টুপি মানকেকে ভয় করে চলে না তল্লাটে এরকম লোক পাওয়া মুশকিল। গ্রীষ্ম বর্ষা শীত - সব ঋতুতে তার মাথায় একটা বিশেষ ধরণের টুপি থাকে ব'লে লোকে তাকে টুপি মানকে বলে। মাথার সামনের দিকে তার লাল রঙের মস্ত একখানা আব, টুপিটা না থাকলে সেটাকে দেখতে আধকাটা শিঙের মতো লাগে। লোকে বলে, শয়তান হতে হতে মানকে মানুষের রূপ পেয়ে গেছে। তা মানিকের তাতে আপত্তি নেই। হ্যাঁ, বেশ, সে শয়তান, কারণ শয়তান না হলে এই দুনিয়ায় কিছু পাওয়া যায়না। লেখাপড়া সে কোনোকালেই করেনি, ছোটো থেকে শয়তানীতে হাত পাকিয়েছে। বাপ বড়োলোক ছিল, পৈতৃক বসত বাড়ি, রেশন দোকান, পুকুর আর পুকুরের সামনের কুড়ি কাঠা জমি, আর তার শয়তানি সঙ্গী সাথী, এই সব নিয়ে টুপি মানকে এলাকায় দাদা হয়ে দাপায়। বাপের পছন্দ করা গরিব ঘর থেকে আনা বিয়ে করা বৌ দু বছরের মধ্যে অসহনীয় অত্যাচারে গলায় দড়ি দিয়ে মুক্তি পেয়েছে। তারপর মানিক দত্ত আর সে ঝামেলায় জড়ায়নি। নাম কাটা সেপাইয়ের মতো এরপর টুপি মানকে পঞ্চ 'ম'কারের সাধনায় এলাকায় যথেষ্ট নাম কিনেছে। তার আর তার সঙ্গী সাথীর নজর থেকে নিষ্কৃতি পেতে এলাকার পাঁচ থেকে পঁচাশির মেয়ে বৌয়েরা তার শত হস্ত দূর দিয়ে চলে। থানা পুলিশ আর পলিটিক্সের দাদাদের ডান হাত সে, ভয়ে তাকে কেউ ঘাঁটায় না। এ হেন টুপি মানকে, শয়তানের দুসরা নাম, মানিক দত্ত, মালের বোতলটা ভাল করে সাপ্টে নিয়ে রাস্তায় নামার আগে মাথার টুপিটা আরো একটু সামনের দিকে টেনে নিলো, তারপর বুড়ির পুকুরের দিকে বাড়ির রাস্তায় পা বাড়াল।
নেশাটা আজ ভালোই জমেছে, মানিক দত্তর মালের তেষ্টাটা কিছুতেই মিটছে না আজ। আজ অনেক দিন পরে গেদুর ঠেকে সরেস মাল ছিল, মুখে ঠেকাতেই চনচন করে উঠেছিল জিভের ডগাটা। ঝাল ঝাল চাখনা নিয়ে গলায় ঢালতে ঢালতে প্রথম দিকটায় খেয়াল ছিলোনা। মানিক দত্ত সাধারণত হপ্তার মাঝে কাজের দিনে এতখানি কখনো খায়না। কিন্তু আজ রেশন দোকানের বাইরে লাইনে ওই ছিনাথ কৈবত্তর সরেস বিধবা বৌটাকে দেখেই কেমন যেন মাল খাওয়ার আগেই ঘোর লেগে গেল মানিকের। মানিক বিড়বিড় করলো নিজের মনে, 'শালা, আমার কি দোষ, এক বাচ্ছার মা বিধবা ঝিনকিটাকে দেখলে যে কোনো পুরুষের রক্ত গরম হয়ে যাবে!’ জেলের ঘরের বৌ, পঁচিশ ছাব্বিশের ডবকা যুবতী, সদ্য বিধবা, ভালো করে খেতে পায়না দিনেমানে, কিন্তু শরীর দেখো, যেন পাথর কোঁদা উর্বশী, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে যায় মানিক দত্তের। সাপের মতো হিলহিলে শরীর। মানিকের মনে হয়, ওই নিকষ কালো শরীরে বিধাতা পুরুষ যেন তার কামনার বস্তু যা যা হতে পারে সব উপর্যুপরি ঢেলে দিয়েছেন। সস্তা পাতলা শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে উদ্ধত যৌবন, যতখানি না ঢাকে, তার চেয়ে মানিককে দেখায় আরো অনেক বেশি। সে শরীরের দিকে তাকালে মানিকের চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা। মালের পর মাল টানে মানিক, কি এক অনির্দেশ্য তেষ্টা, কলজে পোড়ানো বাংলা মালে মেটাতে চায়।
মনে পড়ে আর একদিনের কথা, সেদিনও এমনি সকাল থেকে মেঘলা করে ছিল, আর সন্ধ্যে হতেই ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল। মানিক দত্তের ভাষায় "আবগারি ওয়েদার !" সন্ধ্যে হতেই বোতল নিয়ে বসেছিল মানিক। বাইরের ঘরে বসে একলা একলাই ঢুকুঢুকু করে চলছিল ঠিকঠাক। নেশাটা আর একটু জমলেই হাটখোলায় লক্ষ্মীর ঘরে যাবে বলে ঠিক ছিল, হঠাৎই মনে হলো, জানলার পাশ দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বাচ্চা মেয়ের মতো কে যেন চলে গেল ! প্রথমটা গা করেনি। তারপর কি মনে হতে চুপি দরজা খুলে বাইরে গিয়ে যা দেখে ছিল তাতে আচমকাই চল্লিশ বছরের মানিকের রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিলো। বুকে মাথায় যেন ঝাঁ করে একঝলক আগুনের হলকা উঠে মুহূর্তে কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। বৃষ্টিতে উপুড়চুপুড় ভিজে ফুলি বলে মেয়েটা বাইরের চালার নীচে পরনের জামাখানা নিংড়োচ্ছিলো। গেনি বুড়ির হাবলা ক্যাবলা নাতনীটা কবে এতো বড়ো হয়ে গেছে মানিকের আগে জানা ছিলোনা। বোবা মেয়েটা সাধ্যমতো বাধা দিয়েছিল, কিন্তু শয়তান ভর করেছিল মানিক দত্তের মাথায়, হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না।
গেনি বুড়ি থানায় গিয়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এখন আর যায়না। থানার দারোগা ভূদেব ঘোষাল, ট্যারা চোখে বলেছিল, ‘নাতনীর বয়স কত ?’ বয়স শুনে মেজোবাবুর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলেছিল, ‘এই তো হারাবার বয়স গো বুড়ি, ভেবোনা, গরম নামলে বছর খানেক পর দেখবে নাতনী তোমার ফ্রিতে ভরা পেট নিয়ে ঠিক ফিরে আসবে !’ ইদানিং গেনি বুড়ি একলাই ঘোরে, বিড়বিড় করে, ‘ফুলি ফুলি’ বলে ডেকে বেড়ায় এখানে সেখানে। কখনো ভিক্ষে ক'রে, চেয়ে চিনতে, কখনো মানিক দত্তের পুকুর ধারে শাক পাতা আর গেঁড়ি গুগলি যা পায় সেদ্ধ করে খায়। পুকুরের ধারে গেনি বুড়িকে অনেক বার দেখেছে মানিক। প্রথম দিকে একটু ভয় লাগতো, কে জানে, কিছু জেনে গেল নাকি ! যদি কোনোক্রমে কোনো চিহ্ন খুঁজে পায় নাতনিটার, তাড়াহুড়োতে ভালো করে গর্ত খোঁড়া হয়নি প্রথম দিন। পরে ব্যাপারটাকে সামলে নিয়েছিল মানিক, আর ভুল করেনি, কমসে কম চার পাঁচ হাত গর্ত খুঁড়েছিল নতুন করে। এখন সে ভয় নেই, এতদিনে বছরখানেক পর পুকুর পারের ভেজা মাটিতে সব মাটিতে মিশে গেছে, তাই গেনি বুড়িকে গেঁড়ি গুগলি তুলতে দেখলেও মানিক কিছু বলেনা। একশো বছর ধরে গেঁড়ি গুগলি তুললেও ফুলির -- মানিক দত্ত চোখ বুঁজে মালের ঘোরে মনে মনে একবার সেদিন সন্ধ্যের ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে ঝালিয়ে নিল। সেই সন্ধ্যেটার কথা ভাবতেই বুঝলো, ভেতরে ভেতরে সেই শয়তানটা জাগছে, মাথা তুলছে একটু একটু করে। নেশাটাও জমে উঠেছে মানিকের, চোখ বুঁজে ওই জেলের বিধবা মেয়েটার চেহারাটা ভেবে চনচন করে উঠলো শরীরের সব শিরা উপশিরাগুলো। এতদিন ভয় ছিল, মাগীটার বর ছিনাথ জেলেটা ছিল সাংঘাতিক রাগী, লাল চোখ করে চুপচাপ থাকতো, কিন্তু চোখ কথা বলতো, সেদিকে তাকালে মানকেরও মতো শয়তানেরও ভয় করতো। এখন শালা ছিনাথ মালটা গতবারের সাইক্লোনে ফৌত হবার পর আর ভয় নেই। এবার খালি সময়ের অপেক্ষা, আজ না হয় কাল। ওই সাপের মত হিলহিলে শরীরের মাগীটাকে টেনে না নামাতে পারলে শালা মানকের---- , ভাবনাটা ভেবে আরেকটা বড় মালের ঢোঁক গিলতেই মানকের বুকের ভেতরটা অন্য কোন অস্বাভাবিক জৈব তাগিদে আবার গুড়গুড় করে উঠলো। মনে মনে একটা কাঁচা খিস্তি করলো মেয়েটার শরীর নিয়ে। শয়তানটার খিদে চাগাড় দিচ্ছে, একবার হাটখোলার ধারে বিন্দির ঘরে যাবে কিনা চিন্তা করলো। গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ একটা পচ পচ করে শব্দ শুনে চমকে উঠলো মানকে ! ভিজে পাতার ওপর দিয়ে কেউ হাঁটছে, দ্রুত,- কান খাড়া করে শুনতে লাগলো শব্দটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছে বুঝতে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখতে পেলো, তাতে মানিকের বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠলো। ও কে আসছে ? ঝিনকি না ? ভালো করে চোখ মুছে দেখলো মানকে, শিরা উপশিরায় আগুন ধরে গেল যেন, ঝাঁঝাঁ করে উঠলো মানকের সারা গা। আজ শালা স্বয়ং শয়তান নিজে হাতে তাকে উপহার পাঠিয়েছে, একে কোনো অবস্থায়ই ছাড়া নেই ! আজ শালা হবে এক চোট, তারপর যা হয়ে দেখা যাবে। সাপের মতো হিলহিলে শরীর নিয়ে
জঙ্গুলে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে সরুপথ দিয়ে হনহন করে আসছে ঝিনকি, দ্রুত পায়ে যাচ্ছে বুড়ির পুকুরের দিকে, দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আগুনের মতো শরীরে তার ভিজে কাপড় লেপ্টে। ধকধক করে উঠলো মানিকের বুক, আরেকবার মনে মনে আউড়ে নিলো মানিক, যা হবে হোক, আজ একে ছাড়া হবে না। আশেপাশে জনপ্রাণী নেই, চেঁচিয়ে গলা ফাটালেও কেউ শুনতে আসবে না। অবশ্য সে সুযোগ মানিক দিলে তো ! দেয়ালে ঝোলানো দড়ি থেকে এক টানে গামছাটা হাতে নিয়ে নিল মানিক। মানিক দত্ত পুরোনো খেলোয়াড়, জানে, এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করতে নেই। খুব সাবধানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে রক্তের স্বাদ পাওয়া ক্ষুধার্ত হিংস্র হায়নার মতো পা টিপে টিপে বুড়ির পুকুরের দিকে যেতে থাকলো মানিক, রক্তের ভেতরে জাগতে থাকা শয়তানের তীব্র ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে।
জ্ঞানদা, মানে গেনিবুড়ি গজগজ করে, মাঝে মাঝে হাপুস কাঁদে! শোনার কাউকে পেলে উজাড় করে দিতে চায় দুঃখের কথার ঝাঁপি। তা কেউই শোনে না, শোনার সময় নেই, ইচ্ছেও নেই কারো। একা একাই নিজের মনে বিড়বিড় করে বেড়ায় গেনি। ফুলির বাপটা যখন চোলাই খেয়ে মোলো, বৌটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কি বেদম মারটাই না দিতো বৌটাকে ফুলির বাপ। বুড়ি মাটাকেও মারত, মা ব’লে একটুও রেয়াত করতো না! মদ খেলে তো কথাই নেই। তবে লোকটা মেয়েটাকে ভালোবাসতো খুব। বোবা মেয়ের গায়ে কোনোদিন হাত তোলেনি ফুলির বাপ! তারপর হঠাৎই একদিন ফুলির বাপ মরলে, ফুলির মা কার একটা হাত ধরে পালিয়ে বাঁচলো। লোকে বলে কেউ কেউ তাকে নাকি শহরের খারাপ পাড়ায় রং মেখে খদ্দের ধরতে দেখেছে। তা মরুক গে, যার যা আছে, ভাঙিয়ে খাবে, লোকের কি এত বলার আছে গেনিবুড়ি বোঝে না। পেটের দায় বড় দায়! কে রং মাখেনা? বাবুদের বাড়িতে ওই সিনেমার বাক্সে গেনি বুড়ি দেখে, রং মেখে সুন্দর পুতুলের মত ছেলে মেয়েগুলো দিনরাত্রির এক গাদা লোকের মধ্যে আধা ন্যাংটা হয়ে নাচানাচি করে, লেপ্টালেপ্টি করে, সেখানে দোষ নেই? সেসব বেশরম বেলেল্লাপনাগুনো বাপ মা মেয়ে ছেলে একসাথে চোখ বড়বড় করে গেলে, তাতে দোষ নেই! শুধু পেটের দায়ে ফুলির মা রং মেখে ভাতের জোগাড় করলেই দোষ! তা, করুক গে, গেনির কিছু যায় আসে না!
এরকম ফুলির বাপ মা ছেড়ে যাওয়ার পর গেনির আপন বলতে ওই একজনই ছিল। ফুলি, ছোট্ট নাতনিটা। নাতনি বলো নাতনি, মেয়ে বলো মেয়ে। পেটে ধরা নয় তো কি হয়েছে, কোলেপিঠে মানুষ করা তো। ফুলের মতো ছিল ছোট বেলায়, বাপ সাধ করে নাম দিয়েছিল ফুলেশ্বরী, সংক্ষেপে ফুলি। নিজে আধপেটা খেয়ে, নাইয়ে ধুইয়ে আদর দিয়ে মাথায় তুলে ছোট্ট ফুলিটাকে কষ্টে ছিষ্টে বড় করছিল গেনিবুড়ি। বেশ ডাগরটিও হয়েছিল, তা, বলা নেই কওয়া নেই, সেই ফুলিটাও একদিন কোথায় যে পালিয়ে গেলো দুম করে, বুড়ি ঠাকমাটাকে একলা ফেলে! ফুলি থাকতে দুজনে মিলে এর ওর ঘরে বাসন মেজে, টুকরো টাকরা কাজ করে, কচুর শাক আর গেঁড়ি গুগলি তুলে দু মুঠো জুটে যেত দুজনের। তা হঠাৎ একদিন বর্ষার সন্ধ্যেয় বেরিয়ে আর ফিরলো না ফুলিটা! দিন ফুরিয়ে রাত, হফতা পেরিয়ে মাস আর মাস গড়িয়ে বছর গেলো, এক বর্ষা গিয়ে আর এক বর্ষা এলো, ফুলির পাত্তা নেই।
থানায় গেলে বলে, ফুলি কার সাথে পালিয়ে গেছে। কার হাত ধরে পালালি বাছা আমার? বাড়ন্ত বয়সের খিদে মা গো তোর, তা ভালো করে পেটভরে খেতে দিতে পারতাম না, শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় ওই দুটি জামা, তাও ছেঁড়া, লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা, রাজ্যের শেয়াল কুকুরের চোখ থেকে! তা পালালি পালালি, একবার কি গেনি বুড়ির কথা মনে পড়ে না? বুড়ি কি খেলো, বাঁচলো কি মরলো দেখতে ইচ্ছে করে না? এখানে ওখানে কেঁদে কেটে লাভ হলোনা। ফুলির জন্য ভাঙা বুকে ধিঁকি ধিঁকি অপেক্ষার আগুন জ্বেলে পোড়া কাঠের মতো গেনি বুড়ি হেঁটে হেঁটে চষে ফেলে অঞ্চলের পথঘাট, বন, জঙ্গল। খুঁজে সে বার করবেই ফুলিটাকে। আজ না হলে কাল। পেলে নিশ্চয়ই ছোট্ট মেয়েটাকে বুকের মধ্যে চেপে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভিজিয়ে, জিজ্ঞেস করবে – ‘বুড়িকে এই অবস্থায় ফেলে কোন চুলোয় গেছিলি বাপ?’
গেনি বুড়ির আর ভালো লাগে না, এক পেট খিদে আর বুক জুড়ে ফুলির ফিরে আসার ভাবনা নিয়ে গেনি ওই বুড়ির পুকুরের দিকে যায়! ও দিকটায় লোকজন কম, পাড়ের কাছেই গেঁড়ি গুগলি পাওয়া যায় আর হাঁটু জলে কলমি শাক তুলতেও বেশি পেতে হাঙ্গামা নেই। বৃষ্টি বাদলার রাতে আর কিছু জুটবে না, সন্ধ্যে সন্ধ্যে পুকুরের শাক পাতা আর শামুক তুলে এনে নুন দিয়ে সেদ্ধ করে খাবে।
গতকাল সন্ধেয় দুটো শেয়াল দেখেছিলো পুকুরের দিকে জঙ্গলটায়, ঝোপে ঝাড়ে কি খুঁড়ে বার করে খাচ্ছিলো, মরা কোনো জানোয়ার হবে, একটা অস্তর থাকা ভালো, জানোয়ার বলে কথা! কি মনে করে গেনি বুড়ি ঝুপড়ির নিচু ছাতের ভেতরে গোঁজা কোঁচটা বার করে হাতে তুলে নেয়। লম্বা তেল মাখানো হিলহিলে বাঁশের লাঠির আগে তীক্ষ্ণফলা ইস্পাতের ফোঁড়! জেলে বাগদি মাছমারার হাতে কোঁচ বড় ভয়ানক অস্ত্র, তাক করে মারলে সাপ, শেয়াল কোন ছাড়, একঘায়ে বাঘের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে এই ইস্পাতের ফলা লাগানো কোঁচ।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা গিয়ে পুকুর পারে থমকে দাঁড়ালো গেনি, নরম মাটি খুঁড়ে শেয়ালে কি বার করছিল, মানুষ আসতে দেখে ছুটে পালালো। কাঁকড়া নয়ত? জলে ভেজা নরম মাটিতে কাঁকড়া ডিম পাড়তে আসে। গেনি দ্রুত পা চালালো সেই দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি নরম হয়ে গেছে, শেয়ালে অনেক খানি জুড়ে মাটি খুঁড়ে গর্ত গভীর করেছে। গেনিবুড়ির কৌতূহল হলো, কন্দ বা কচু নাকি? কিন্তু শেয়ালে তো কচু কন্দ খাবে না, সে তো শুয়োরে খায়! তাহলে? গর্তটার কাছাকাছি এসে পায়ে একটা কি ফুটলো। এতো একটা লম্বা হাড়! তাতে এটা কি? গোল মতো? জং লাগা একটা ভাঙা লোহার বালা আটকানো! আর গর্তে ওগুলো কি? অর্ধেক খোঁড়া গর্তটার কাছে নিয়ে আধো আলো আঁধারিতে কি জানি কিসের হাড়গোড় আর কঙ্কাল দেখে গেনি বুড়ি মাটিতে বসে পড়লো। তারপর কঙ্কাল থেকে হাতে করে ছেঁড়া খোঁড়া একটা বিবর্ণ ফ্রক আর কালো কারে আটকানো একটা সস্তা লকেট তুলে চোখের কাছে নিয়ে ভাল করে দেখে স্তম্ভিত হয়ে বসে পড়লো, তার পর প্রথমে ফুঁপিয়ে, তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলো।
কতক্ষণ পরে সে নিজেই জানে না, কিন্তু এবার যখন গেনিবুড়ি উঠে দাঁড়ালো, তখন তার হাতে কিন্তু কোনো হাড়গোড় নয়, বিবর্ণ মাটি মাখা একটা কিছু! ভালো করে দেখলে চিনতে অসুবিধা হয় না। সেটা একটা রংচটা, নোংরা লাল টুপি! বোকা সোকা গেনি বুড়ি, অনেক ফরিয়াদ করেছে, অনেক কেঁদেছে। তার আর কাউকে কিছু বলার নেই তার, কাঁদারও নেই! গর্তের মধ্যে ক'খানা জীর্ণ হাড়, লোহার বালা, লকেট, বিবর্ণ ফ্রক, ভাঙা কাঁচের চুরি, পাশের ঝোপে লুকোনো মদের বোতল, কোদাল আর হাড়গোড়ের গর্তে অনেকবার দেখা বিশেষ ধরণের একটা রংচটা নোংরা লাল টুপি তাকে সব বলে দিয়েছে।
গেনি বুড়ি সরকারি আদালত নয়, যে মীমাংসা আর রায়দানের জন্য কাঠগড়া, উকিল, পুলিশ, অনন্ত সময়, হলফনামা, সাক্ষী সাবুদ আর ছেলেভোলানো জ্ঞানগর্ভ নিরর্থক কথার কচকচি চাই।ঝিনকি আস্তে আস্তে হাঁটুজলে নেবে ঘুনিটা তুলেই অবাক হয়ে গেলো। একটা মস্ত শোল মাছ, ঘুনির ভেতরে চুপ করে বসে ছিল, ঘুনিটা তোলার সাথে সাথে ছটফট করে উঠলো। ঝিনকি এতটা আশা করেনি। আস্তে আস্তে সাবধানে পারে উঠে এসে নিচু হয়ে ঘুনিটা মাটিতে রাখতেই হঠাৎ পেছন থেকে একখানা গামছা মুখের ওপর দিয়ে ঝপ করে ঘুরে ঝিনকির গলাটা পেঁচিয়ে ধরলো। আর তার সাথে সাথে এক ধাক্কায় কে যেন তাকে মাটিতে ফেলে কোমরে হাঁটু দিয়ে মাটিতে ঠেসে ধরলো। সে যেই হোক, তার গায়ে যেন মত্ত হাতির বল। আচমকা এই অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত ঝিনকি ভয়ে একেবারে অবশ হয়ে গেলো। গায়ে এক ফোঁটা শক্তি রইলো না, সমস্ত শক্তি যেন এক লহমায় মাটিতে গ'লে মিশে গেলো ঝিনকির। চূড়ান্ত ভয়ে জ্ঞান হারাবার আগে ঝিনকি বুঝতে পারলো, শাকচুন্নিটা চেপে ধরেছে তাকে, এবার ঘাড় মটকে রক্ত খাবে। অবশ অঙ্গে ঝিনকি ঝটপট করছে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য, কিন্তু বুঝতে পারছে, ছাড়া পাবার কোনো উপায়ই নেই। কিন্তু সাথে সাথে ভয়ে অচেতন ঝিনকি বুঝতে পারলো, মেছোপেত্নীটা যা করতে চাইছে তা স্বাভাবিক নয় মোটেই! এতো ঘাড় মটকে রক্ত খেতে চায় না, বরং নোংরা হাতে ঝিনকির শরীরটা নিয়ে নাড়ে ঘাঁটে! কি মতলব? পরনের শাড়িখানাতে তার কিসের রাগ?’
প্রথম ঘোরটা কেটে গেল কয়েক সেকেন্ডে, ‘মেছোপেত্নির গায়ে মদের গন্ধ কেন? এবার তার নারীত্ব এক লহমায় বুঝে গেল, পেছনে থেকে যেটা তাকে পাকিয়ে ধরেছে সেটা মোটেই মেছোপেত্নী নয়, সেটা একটা ক্লেদাক্ত লালসাদীর্ণ লোভী পুরুষ আর সেটা ঝিনকির শরীর ছিঁড়ে কি চায় !
এবারে একটা দুরন্ত রাগ, ঘেন্না আর বিতৃষ্ণা উঠে আসছে ঝিনকির গোটা শরীর আর চেতনা জুড়ে। ঝিনকি প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাটি থেকে উঠে বসার, দু হাতে গলার ফাঁসটা আলগা করার চেষ্টা করছে. কিন্তু পারছে না। লড়ছে প্রাণপণ, কিন্তু গলায় ফাঁসের মতো কাপড়টা চাপ হয়ে বসে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গায়ের সমস্ত জোর চলে গেছে ঝিনকির ! ছটফট করছে ঝিনকি, মনে হচ্ছে ডুবে হচ্ছে কোন এক অতল অন্ধকারে, আঁধার নামছে ঝিনকির চোখে, গলায় ফাঁস পেঁচিয়ে পেছন থেকে ঝটকার পর ঝটকা দিচ্ছে জানোয়ারটা, আরো চেপে বসছে গলায় কাপড়টা। ঘিনঘিনে হাতটা, ময়লা নোংরা লালসাভরা একটা থাবা, আথালি পিথালি করে খুঁজছে ঝিনকির শরীর, ফেড়ে ফেলছে ঝিনকির শরীরের সমস্ত অন্ধিসন্ধি, পিষছে গোটা দেহটা, লালসাদীর্ণ চরম অপমানের পেষণে ছারখার করে দিচ্ছে ঝিনকির বিপন্ন জগৎ। ঝিনকির বিপন্ন অপমানিত শরীরের পাকদন্ডী বেয়ে নোনতা রক্ত, কান্না আর মৃত্যুর স্বাদ উঠে আসতে চাইছে দমকে দমকে! দম আটকে আসছে ঝিনকির, ঝিনকি আর পারছে না! শয়তানটা এবারে পুরোপুরি কব্জা করে ফেলছে ঝিনকির বিবশ অসহায় শরীরটাকে, ক্লেদাক্ত নরকের জীবটা এবার ঝিনকির শরীরটা অধিকার করছে দ্রুত! চেতনা হারাবার আগে ঝিনকি প্রাণপণে কোনোক্রমে একবার শেষ চেষ্টা করলো শয়তানটাকে ঝেড়ে ফেলার, আর তখনই মনে হলো ‘ক্যাঁক!’ করে ঝটকা দিয়ে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ করে উঠলো পশুটা! আওয়াজের সাথে সাথেই আবার একটা খুব জোর ঝটকা দিয়ে হঠাৎই আলগা হয়ে গেল ঝিনকির গলার কাপড়ের ফাঁসটা।
তারপর আরো কয়েকটা উপর্যুপরি ঝটকার সাথে সাথে ধড়ফড় ধড়ফড় করতে করতে কি করে যেন ধীরে ধীরে কামার্ত জানোয়ারটার বাঁধন আলগা হয়ে গেলো, তারপর আরও কয়েকটা অর্থহীন অবশ ঝাঁকুনি দিয়ে হতচকিত, ক্লান্ত ঝিনকির পিঠ থেকে জানোয়ারটা গড়িয়ে পরে গেল মাটিতে।
মুক্তি পেয়ে অবসন্ন, ভয়ার্ত, বিবশ ঝিনকি মাটিতে লুটিয়ে প্রায় অচেতনে দেখলো, কালো পোড়াকাঠ এক মেছোপেত্নী, হাতে তার লম্বা ইস্পাতের ফলা লাগানো বাঁশের কোঁচ, আরেক হাতে এফোঁড় ওফোঁড় রক্তমাখা অর্ধনগ্ন টুপি পরা শয়তানের নোংরা আঁশটে ধড়ফড় করা দেহটা অবলীলাক্রমে টানতে টানতে বুড়ির পুকুরের গভীর কালো জলের মধ্যে নেমে গেলো।
কবির কবীর অথবা
রবীন্দ্রনাথের কবীর
দিলীপ মজুমদার
পর্ণশ্রী, কলকাতা
প্রবন্ধ
কবীর। শব্দটা এসেছে আরবি থেকে – আল-কবির, যার অর্থ মহান। আমাদের দেশের মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কবীর। তাঁর প্রামাণ্য জীবনী পাওয়া যায় নি। জানা যায় না তাঁর সঠিক জন্ম সাল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্য থেকে জানা যায় তিনি মুসলমান ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন (এ সম্পর্কেও অবশ্য ভিন্ন মত আছে), বড় হয়েছিলেন তাঁত শিল্পের মধ্যে। তাই হয়তো তাঁর রচনায় বার বার এসেছে বুনন শিল্পের কথা। দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ হন তিনি। লেখাপড়া শেখা সম্ভব ছিল না। তবে তাঁর সহজাত কবিত্ব ছিল, সহজাত প্রজ্ঞা ছিল। মুখে মুখে গান ও দোহা রচনা করতেন। কালে কালে সে সব গান ছড়িয়ে যায় কাশী, দিল্লি, পঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট, বিহার, বাংলা ও ওড়িশায়। ধর্মীয় ভেদাভেদ মানতেন না তিনি। মানতেন না জাতপাত। সরল লোকায়ত উপাদান ব্যবহার করতেন গান ও দোহায়। তাই সে সব রচনা জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর সময়কালে এবং কিছু পরে তাঁকে নিয়ে রচিত হয় অনেকগুলি গ্রন্থ; যেমন, খেমরাজ কৃষ্ণদাসের ‘বীজকমূল’, পূর্ণদাস সাহেবের ‘বীজক কবীর সাহবকা’, স্বামী যুগলানন্দের ‘কবীর সাগর’, শিবহরের‘, ‘সত্য কবীরকী সাথী’, প্রমাণন্দজি-মকনজি কুবেরের ‘কবীর মনশূর‘ ইত্যাদি।
আমাদের দেশের একজন শ্রেষ্ঠ গীতিকবি, প্রতিভাশালী রবীন্দ্রনাথ কবীরর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁর গানের সংকলন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব আলোচনার আগে আমরা কবীর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা উল্লেখ করব। কবিতার নাম ‘অপমান-বর’। কবিতাটি রবীন্দ্রের ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থে আছে। তিনি কিছুটা বাস্তব উপাদানের সঙ্গে তাঁর কবি-কল্পনা মিশিয়ে রচনা করেছিলেন কবিতাটি:
ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে।
কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নর-নারী এসে।
কেহ কহে, ’মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো’,
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।
কেহ বলে, তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে’,
কেহ কয়, ‘ভবে আছেন দেবতা বুঝাও প্রমাণ করে‘।
কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড় করে,
‘দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে—
ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব,
সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব।
এ কি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি।
বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে না কি ‘!’
ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি—
লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি!
চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা,
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা।
ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে—
গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল, কাঞ্চন দিল হাতে।
বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে,
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে।
কহিল, ’রে শঠ, নিঠুর কপট, কহি নে কাহারও কাছে-
এমনি করে কি সরলা নারীরে ছলনা করিতে আছে!
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো,
অন্নবসন বিহনে আমার বরণ হয়েছে কালো।‘
কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ,
‘ভণ্ডতাপস, ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ!
তুমি সুখে বসে ধুলা ছাড়াইছ সরল লোকের চোখে,
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে!’
কহিল কবীর, ‘অপরাধী আমি, ঘরে এসো নারী তবে-
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে!’;
দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি
কবীর কহিল, ‘দীনের ভবনে তোমারে পাঠাল হরি।‘
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে,
‘লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ, মরিব সাধুর শাপে।‘
কহিল কবীর, ‘ভয় নাই মাতঃ, লইব না অপরাধ-
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপরাধ।
ঘুচাইল তার মনের বিকার, করিল চেতনা দান-
সঁপি দিল তার মধুরকণ্ঠে হরিনামগুণগান।
রটি গেল দেশে- কপট কবীর, সাধুতা তাহার মিছে।
শুনিয়া কবীর কহে নতশির,‘আমি সকলের নীচে।
যদি কূল পাই তরণী-গরব রাখিতে চাহি না কিছু-
তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব – নিচু।‘
রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাঁথা।
দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা।
কহিলেন, ‘থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা মাঝে,
আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে!’
দূত কহে, ‘তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ,
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ।‘
রাজা বসেছিল সভার মাঝারে, পারিষদ সারি সারি-কবীর
আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী।
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি, কেহ রহে নতশিরে,
রাজা ভাবে-এটা একম নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে!
ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী,
বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গে কইয়া নারী।
পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল , কৌতুকভরে হাসে-
শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে।
তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে-
কহিল, ’পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে!
কেন অধমেরে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান!’
কহিল কবীর, ‘জননী, তুমি যে আমার প্রভুর দান।‘
ঠিক এই রকম ঘটনা কবীরের জীবনে না ঘটতেও পারে। কিন্তু এতে কবীরের যে জীবনদৃষ্টি ফুটে উঠেছে, সেটা সত্য। তাঁর ভক্তি অহেতুকী। তিনি তাঁর ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিবেদন করেছেন। এই ঈশ্বরের কোন আকার নেই। এই ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান। এই ঈশ্বর তাঁর প্রভু, বন্ধু, তাঁর প্রিয়জন। আর এই ঈশ্বরকে ভালোবাসতে হলে সমস্ত জীবকে ভালোবাসতে হবে। এটাই কবীরের জীবনদৃষ্টি।
কবীরের প্রসঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেনের (১৮৮০-১৯৬০) নাম এসে পড়ে। ইনি নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেনের মাতামহ। কাশীতে তাঁর জন্ম। কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে এম, এ । শিক্ষা বিভাগে চাকুরি করতেন। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। কবীর, দাদু, মধ্যযুগের মরমিয়া সাধক ও বাউল গানসংগ্রহ ছিল তাঁর নেশা। সম্ভবত তাঁর কাছেই রবীন্দ্রনাথ কবীরের বিশদ পরিচয় পান। তবে মধ্যযুগের ভক্ত সাধকদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল। পারস্যের সুফি সাধকরা তাঁকে আকর্ষণ করেছিলেন। বাবা দেবেন্দ্রনাথের মুখে তিনি হাফেজের কবিতা শুনতেন। ইরানে গিয়ে তিনি সেখানকার মানুষদের বলেছিলেন সে কথা। আর কাশী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হিন্দু সাধুদের আস্তানায় যাতায়াতের সূত্রে ক্ষিতিমোহনের কবীর প্রেমের সূচনা হয়েছিল। কবীরের গান সংগ্রহের ব্যাপারে এবং সেগুলি বাংলা ভাষায় পরিবেশনের ব্যাপারে ক্ষিতিমোহনকে তাগাদা দেন রবীন্দ্রনাথ।
কবীর, রবীন্দ্রনাথর প্রিয় কবীর কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনে দুটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। ক্ষিতিমোহন সেন যখন কবীরের গানগুলি অনুবাদ করে প্রকাশের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’র কাজও করছিলেন। এই সমকালীনতাকে সামনে রেখে কেউ কেউ মনে করেন যে কবীরের রচনার সঙ্গে পরিচয় লাভ করে রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’ লেখার অন্তর- অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত হন। এই মতের সমর্থক ড. রামেশ্বর মিশ্র প্রভৃতি সমালোচকেরা। নাগরী প্রচারিণী সভা সম্পাদিত কবীর গ্রন্থাবলীর ভূমিকায় বলা হয়েছে, “বাংলার কবীন্দ্র রবীন্দ্রকেও কবীরের ঋণ স্বীকার করিতে হইবে। রহস্যবাদের (mysticism) বীজ তিনি কবীরের কাছই পাইয়াছেন। শুধু তাহাতে জমকালো পাশ্চাত্য পালিশটি দেওয়া হইয়াছে। ভারতীয় রহস্যবাদকে তিনি পাশ্চাত্য ঢঙে সাজাইয়াছেন, ইহাতেই ইউরোপে তাঁহার প্রতিষ্ঠা।“ কিন্তু রবীন্দ্র জীবনচরিতকার প্রশান্তকুমার পাল সে কথা স্বীকার করেন না। স্বীকার করেন না প্রণতি মুখোপাধ্যায়। দেখা যাক, ক্ষিতিমোহন নিজে কি বলেছেন। ক্ষিতিমোহন সেন বলেছেন, “‘গীতাঞ্জলি’র মধ্যে মধ্যযুগের বাণীর কিছু ভারসাম্য দেখিয়া আমিই কবীরের বাণীর বিষয় তাঁহাকে প্রথম জানাই। তাতেই আমি কবির কাছে ধরা পড়ি। তাহা ঘটে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। তাহার কিছুকাল পরে আমার কবীরের প্রথম খণ্ড বাহির হয়। কবীর বাণী দেখিয়া তিনি গীতাঞ্জলি লেখেন নাই। গীতাঞ্জলি দেখিয়া আমি তাঁহাকে কবীর বাণী দেখাই।‘
আবার ‘গীতাঞ্জলি’তে শুধু তো কবীরের প্রভাব নেই, আছে বৈষ্ণব পদাবলি ও সুফিবাদের প্রেমসাধনারও প্রভাব।
এবার কবীর রবীন্দ্রনাথের জীবনে যে দ্বিতীয় সমস্যা সৃষ্টি করলেন, তার কথা আলোচনা করা যাক। আমেরিকা যাবার আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইভলিন আণ্ডারহিল নামে এক ধর্মযাজিকার পরিচয় হয় , যিনি মিস্টিসিজমের অনুরাগিনী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কবীরের কথা বলেন, বলেন অজিতকুমার চক্রবর্তীর কথা যিনি কবীরের গানের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। ওড়িশার চাঁদিপুরে গ্রীষ্মাবকাশ কাটানোর সময়ে পিয়ার্সনের সহায়তায় অজিতকুমার কবীরের ১১৪টি দোহা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। ঠিক হয় যে কবীরের দোহার ইংরেজি অনুবাদ অজিতকুমারের নামেই প্রকাশিত হবে বিদেশ থেকে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড, শেষ পর্যন্ত ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে One Hundred Poems of Kabir নামে যে বইটি প্রকাশিত হল, সেখানে অনুবাদক হিসেবে আছে রবীন্দ্রনাথের নাম। অথচ একটি চিঠিতে অজিতকুমারকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কবীর গ্রন্থ সম্বন্ধে তুমি একটু ভুল বুঝেছ। প্রথমত গ্রন্থ থেকে তোমাকে বাদ দেওয়া হবে Evelyn Underhill এমন ইচ্ছা করেন না। দ্বিতীয়ত আর্থিক হিসেবে তোমাকে ও ক্ষিতিমোহনকে বাদ দেওয়া হবে এমন ইচ্ছা আমার নয়।‘
এবার One Hundred Poems of Kabir বইটিতে ইভলিনের ভূমিকার শেষাংশ উল্লেখ করা যাক: “This version of Kabir’s songs is chiefly the work of Mr. Rabindranath Tagore, the trend of whose mystical genius makes him as who read these poems will see a peculiarly sympathetic interpreter of Kabir’s vision and thought.” এটা যে ক্ষিতিমোহনের বাংলা অনুবাদের উপর নির্ভর করে সম্ভব হয়েছে তা ইভলিন স্বীকার করেছেন, অজিতকুমারের ইংরেজি অনুবাদের কথাও বলেছেন তিনি, “We have also had before us a manuscript of English translation of 116 songs made by Mr. Ajit kumar Chakravarty from Mr. Kshiti Mohan Sen’s text, and a prose essay upon Kabir from the same hand.” ইভলিন অজিতকুমারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সেজন্য। কিন্তু অনুবাদক হিসেবে বইতে তাঁর নাম বাদ গেল কেন?
তাহলে কি ম্যাকমিলান কোম্পানি ব্যবসাবুদ্ধি তাড়িত হয়ে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের নাম? রবীন্দ্রনাথ কি এর প্রতিবাদ করেছিলেন? [লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক]
ঋণ:
রবি জীবনী/প্রশান্তকুমার পাল।
ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধ শতাব্দীর শান্তিনিকেতন? প্রণতি মুখোপাধ্যায় ।
মজিদ মাহমুদের প্রবন্ধ ।
গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন/সৈয়দ মুজতবা আলি ।
Hundred Poems of Kabir / Rabindranath Tagore.
Esaay of Subhendra kumar published in Pune Research World l
গল্প
মৃত্যু কখনও
মনোজ কুমার গোস্বামী
মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি - ১৯৬২ সনে অসমের নগাঁও জেলায় গল্পকার, লেখক, সাংবাদিক মনোজ গোস্বামীর জন্ম হয়। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র শ্রীগোস্বামী অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ‘নতুন দৈনিক’, ‘আজির বাতরি’, ‘আমার অসম’, ‘দৈনিক জনসাধারণ’ ইত্যাদি পত্র পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে ‘আমার অসম’ পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক। ‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’, ‘মই রাজেন বরুয়াক সমর্থন করো’, ’এলুমিনিয়ামর আঙ্গুলি’ লেখকের অন্যতম গল্প সংকলন। ‘ভুল সত্য’ গল্প সংকলনের জন্য ২০২২ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
অনুবাদক পরিচিতি - ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশো পঞ্চাশটিরও বেশি।সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে সাহিত্য এবং অনুবাদ সম্পর্কে গবেষণা পত্র পাঠ করেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সন্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একত্রিশটি।
পুরুষকন্ঠ: আঃ তুমি কল্পনাই করতে পারবে না। ষোলো মাস কোনো সান্ত্বনা নেই, টাকা নেই, প্রেম নেই, অবসর নেই।
নারী কন্ঠ: এটা আধুনিক জীবনই তো?
পুরুষ কন্ঠ: হ্যাঁ, বলতে গেলে আধুনিক জীবনই। যেখানে দিনের চব্বিশ ঘন্টাই তুমি লিমিটলেস অথরিটির সামনে দণ্ডিত পরিত্যক্ত। ষোলো মাসে কেবল এটা প্রমাণ হল যে একজন ফরাসি তরুণের পক্ষে এমনকি আপেক্ষিক স্বাধীনতাটুকুও কর্তৃপক্ষ থেকে আদায় করা কঠিন। বিশেষতঃ…
গ্রন্থাগার প্রেক্ষাগৃহের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, স্তব্ধ হয়ে গেল শব্দ প্রবাহ। সম্ভবত একটি বিদেশি চলচ্চিত্রের প্রদর্শন চলছে এবং খুব সম্ভব একটি ফরাসি ছবি। দরজা খুলে যে মানুষটি বাইরে বেরিয়ে এল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তিনি এদিক-ওদিক তাকালেন। আক্লান্ত মুখে একটা সিগারেট জ্বালাতে চাইলেন, জলন্ত দিয়াশলাই কাঠিটার আলোতে তার শীৰ্ণ কিঞ্চিত সূঁচলো মুখাবয়ব দেখা গেল। প্রেক্ষাগৃহের সামনে এক সারি সাইকেল এবং স্কুটার, বিশৃঙ্খলভাবে পার্ক করে রাখা কয়েকটি গাড়ি। কয়েকজন চানাচুরওয়ালা নিজেদের মধ্যে আড্ডা জমিয়েছে এবং একজন চৌকিদার লাইব্রেরিটার দরজা জানালাগুলি একটি একটি করে বন্ধ করতে শুরু করেছে।
বাধাগ্রস্ত আড়ষ্টভঙ্গির দুর্গাদাস এগিয়ে এলেন। একবার আস্তে করে কাশলেন প্রধানতঃ বারান্দার ধূমপানরত মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। তিনি চিনতে পারলেন। মানুষটা করুণাবাবু।
– দুর্গাদা আপনি এখানে!
দুর্গাদাস মাথা নাড়লেন, ঈষৎ বিষণ্ণভাবে। ইতিমধ্যে সিগারেট সমেত করুণাবাবুর বাঁহাতটা পেছনদিকে লুকিয়ে পড়েছে।
– শুনেছিলাম, আপনার শরীরটা নাকি ভালো নয়। এখন কেমন আছেন? করুনাবাবু মুখে একটা আন্তরিকতার ভাব আনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্ৰয়াসটা খুব স্পষ্ট।
দুর্গাদা মুখের দু একটি রেখা কেঁপে উঠল, তিনি সসংকোচে জিজ্ঞেস করলেন - 'নীলমণি এদিকে এসেছিল নাকি?'
— নীলমণি মানে? আপনাদের নীলমণি? করুণাবাবু গেটের পেছন দিকে তাকালেন। সিগারেটটা বাঁ হাতে নিলেন এবং হাত ঘড়িটার কাঁটা দুটি নিকট দূরত্ব থেকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলেন।
'না, নাতো, অন্তত আমি দেখিনি। দেখতেই পাচ্ছেন আমাদের সিনে ক্লাবের রুপালি জয়ন্তী চলছে। খুব ব্যস্ত রয়েছি।' করুণাবাবু বিব্রতভাবে হাসলেন – 'কে আসছে কে যাচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না।'
দুর্গাদাস পুনরায় সায় দিলেন। দরজার পর্দা এবং আয়নার মধ্য দিয়ে সিনেমার পর্দার থেকে কিছু রং এবং ছবি এক মুহূর্তের জন্য ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এল। তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন, অন্ধকারের দিকে তাকালেন। করুণাবাবু আর কী বলবেন ভেবে পেলেন না।
'আচ্ছা ভেতরে আসবেন নাকি? জাঁ লুক গডারের ভালো সিনেমা একটা চলছে দেখে খুশি হবেন'
অসহায়ের মতো দুর্গাদাস মাথা নাড়লন, রাস্তায় ঘোরাফেরা করলেন, হেডলাইটের তীব্র আলো নিয়ে অন্ধকার কেটে কেটে একটি স্কুটার প্রবেশ করছে, চানাচুরওয়ালাগুলি আগের মতোই ব্যস্ত। চৌকিদারটি লাইব্রেরির ভেতরের লাইটগুলি এক এক করে নিভিয়ে দিচ্ছে। করুণাবাবু — যে এক সময় নীলমণির সহকর্মী ছিলেন – এখন তার জন্য সেই দুঃস্বপ্নময় অতীত থেকে একটি নিরাপদ দূরত্বে সরে এসেছেন, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির সুদৃঢ়‐সুদৃশ্য প্রেক্ষাগৃহের এই বর্ণময় বর্তমান থেকে তিনি বেশি সময় বেশি দূরে সরে থাকতে চান না। সিগারেটের স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে করুণাবাবু স্কুটার আরোহীর সঙ্গে একটা রসিকতা করলেন, দুজনেই সশব্দে হেসে উঠলেন। দুর্গাদাস আকাশের দিকে তাকালেন, আকাশ নিৰ্মেঘ নীল পরিচ্ছন্ন — সম্পূর্ণ নিৰ্বিকার। করুণাবাবুরা প্রেক্ষাগৃহের দরজা খুলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলেন —
আবহসঙ্গীত, প্রধানত:ড্রাম এবং রক গিটারের উচ্ছল হাসি এবং কাপ গ্লাসের ঠুংঠাং, সম্ভবত একটি কাফে।
নারী কন্ঠঃ বিটলস আমার খুব প্রিয় এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্ষেত্রে জোহান সিবাস্টিয়ান বাখ।
পুরুষ কণ্ঠঃ বাখ? নিঃসন্দেহে খুব ধ্রুপদী। কিন্তু আপনি যে ধরনের গান গান, তার সঙ্গে বাখ খাপ খায় না।
নারী কন্ঠঃ আচ্ছা, তাতে ক্ষতি কী? (হাসি)
পুরুষকণ্ঠ। আপনার কোন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে?...
রাস্তাটিতে দুর্গাদাসের তিনটি ছায়া পড়েছে। কোনোটি দীর্ঘ কোনোটি ছোটো ছায়াগুলির দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন — তিনি খুব বুড়ো হয়ে গেছেন নাকি? তার পদক্ষেপগুলি এত দুর্বল দেখাচ্ছে!আর মাথাটা যেন একটা অবলম্বনের আশায় কিছুটা আনত হয়ে পড়েছে। দিনটা খুব কষ্টের সঙ্গে পার হয়ে গেছে। শহরের অলিতে গলিতে, রাস্তায় বাজারে সারাটা দিন ঘুরে ফিরে দুর্গাদাস এখন উপলব্ধি করেছেন আর খুব বেশি শক্তি তার দেহে নেই।। দিনের আলো কখন মুছে গিয়েছে, গাছের পাতায় সালোক সংশ্লেষণের রসায়ন বন্ধ হয়েছে সেই কখন। গাছের ডালে কোনো পাখির কলরব শোনা যায় না। এখন দিগন্ত ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এসেছে এবং ধারাসার বৃষ্টির মতো অন্ধকার খসে পড়ছে পৃথিবীর বুকে।হাই স্কুলের দেওয়ালটাতে বসে কয়েকটি ছেলে আড্ডা মারছে। অন্ধকারে ওদের মুখ দেখা যায় না। কিন্তু কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারা যায় — ওরা একটি নাটক করার কথা ভাবছে।‘ আমলাপট্টির রুমিকে কি ওর বাবা এই পরীক্ষার সময় নাটক করতে দেবে? প্রাণজিৎ-- তুই কথাটা জিজ্ঞেস করে দেখিস তো!’ যদিও চোখের শক্তি খুবই ক্ষীণ হয়ে এসেছে, দুর্গাদাস ছেলেগুলিকে লক্ষ্য করে গেল।না, ওদের মধ্যে নীলমণি থাকে না — থাকতে পারে না। ওদের বয়সে নীলমণি কীরকম ছিল — দুর্গাদাস ভাবে। ছেলে তো নয়, এক টুকরো উল্কা। কী অসম্ভব অদম্য প্রাণশক্তি! ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে স্থানীয় কলেজটিতে প্রবক্তা হিসেবে যোগ দেওয়ার পরেও সে দমে গেল না। পার্টির কাজ, সংগঠনের কাজ— এইসবে সে তারপরেও পূর্ণোদ্যমে ঝাপিয়ে পড়েছিল। কলেজ বন্ধ থাকলে সঙ্গের বাণী, অজিত, বিশ্বজিৎ, অতুলদের সঙ্গে নিয়ে সে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত তার হিসাব দুর্গাদাস রাখতে পারত না। তিনি কেবল জানতেন অনেক রাতে সে বাড়িতে ঢোকে এবং তারপরেও অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে লাইট জ্বলতে থাকে। যথেষ্ট বই পড়ে এবং গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ায় তার চেয়ে অনেক বেশি। একদিন যেন কার সামনে সে বলেছিল একটি বই পড়ার চেয়ে একটি গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে সে বেশি ভালোবাসে। দুরন্ত গতিতে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া একটি গাড়ির শব্দে দুর্গাদাস তার গতিশীল বর্তমানে ফিরে এল। নেই নেই, নীলমণিকে এখানে পাওয়া যাবে না।এখান থেকে দেখা যায় দূরে, যাকে এই শহরের প্রায় হৃদপিণ্ড বলে যেতে পারে, পাশাপাশি থাকা দুটো সিনেমা হল নিজের নিজের উগ্র
লাইটগুলি জ্বালিয়ে দিনের মতো করে রেখেছে। রাস্তা দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত অভিমানী চঞ্চল নানা ধরনের গাড়ি-মোটর, যার হেডলাইটের তীব্র আলোর উৎপাতে বারবার অন্ধকার পালিয়ে এসেছে এখানে। রেস্তোরাগুলির সামনে একঝাঁক ঝলমলে মানুষ। দুর্গাদাস দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তারপরে কী হয়েছিল? স্মৃতির পাতাগুলি এলোমেলোভাবে উল্টে যান তিনি। কিছু মানুষ নীলমণিদের কাজকর্মগুলি কেন ভালোবাসত না দুর্গা দাস আজও বুঝতে পারল না। পড়াশোনা করে এসেছিস, তাতে সন্তুষ্ট থাক! কিন্তু খবরদার! রাজনীতি, সমাজ চিন্তা এইসবে তোরা প্রবেশ করার কথা ভাববি না — তাদের মনোভাব ছিল অনেকটা এই ধরনের। আরেকদিন রাতে, রাত তখন অনেক হয়েছি্ল, কেউ নীলমণিকে খুব খারাপ ভাবে মারধর করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে গেল। কাঁধে ডেগারের গভীর আঘাত, মাথায় লোহার রড দিয়ে কয়েকবার আঘাত করেছিল,রক্ত এবং ধুলোয় জমাট বেঁধেছিল সমস্ত শরীরটা। নাইট শিফটের ডিউটি থেকে ফিরে আসার সময় অচিন্ত্য বরা তাকে সেই অবস্থায় দেখে হুলুস্থুল না লাগালে হয়তো সে বেঁচে থাকত না। দুর্গাদাসকেও এত দুর্ভোগ ভুগতে হত না।তিনটি মেয়ে আগুনের মতো ঘরে ধীরে ধীরে বুড়ি হচ্ছে। ছোটো ছেলে বুমণির তো এই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অবশ্য মাসের শেষে সে টাকাগুলি পাঠিয়ে দিচ্ছে বলে দুর্গাদাসকে এখনও কারও কাছে হাত পাততে হচ্ছে না।
_ দুর্গাদা নাকি? বিপরীতমুখী একজন মানুষ বলল।
_ কে? ও ছোটো বাপু। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল — যেন দ্বিধায় পড়েছে। একটা অস্বস্তি তার মুখ থেকে শরীরে ছড়িয়ে গেল। মহা বিপদে পড়েছি হে। নীল সকাল থেকে বাড়িতে নেই। সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কোথাও দেখেছ তুমি?
মানুষটা মাথা নাড়ল। না তো। সে দূর্গাদাসের দিকে সোজাসুজি তাকাল না। তার পেছনে একটা স্ট্রীট লাইট। তার মুখে ছায়া পড়েছে। তাই তার ভাবান্তর লক্ষ্য করতে পারা গেল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল, সে কিছু একটা ভাবল—
- ‘ও নীলমণি। সে বেরিয়ে এল কীভাবে?’
‘ভাগ্য বুঝেছ।’ দুর্গাদাস আর্দ্র কন্ঠে বলল। সব সময় ওদেরকে বলেছি হুকটাই যথেষ্ট নয়, তার ঘরের দরজায় একটা তালা বাইরে থেকে লাগিয়ে রাখবি। অনবরত সে দরজাটাতে কিল, ঘুসি, লাথি মারতে থাকে। সব সময় সেই ভয়টাই করছিলাম। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি দরজা হাট করে খোলা।সে ভেতরে নেই। তারপরে সব জায়গায় সারাদিন ঘুরে ঘুরে খুঁজে — হাজার হোক পেটের ছেলে তো!’ দুর্গাদাস পুনরায় নিঃশ্বাসের সঙ্গে শব্দটা ছেড়ে দিল’ ভাগ্য!’
_ 'শুনেছি সে নাকি আজকাল খুব ভায়োলেন্ট হয়ে পড়েছে?'
_ 'হ্যাঁ, খুবই ভায়োলেন্ট। দিন দিন খুব ওয়াইল্ড হয়ে পড়েছে। আকুল মুখে দুর্গাদাস বলল। নিজের চিন্তার ভার এক মুহূর্তের জন্য অন্যের কাঁধে দিয়ে সে অবকাশ নিতে চাইল।
- ‘খায় না, ঘুমোয় না চুল দাড়ি লম্বা হয়ে বনমানুষের মতো হয়েছে, স্নান করে না, কাছে যাওয়া যায় না, কী দুর্গন্ধ! দিনরাত কেবল দরজাটাতে কিল লাথি আর আহত জন্তুর মতো বিকট ভাবে চিৎকার করবে। আর কি জান— খুব গোপন খবর জানানোর মতো এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দুর্গাদাস বলল,আজকাল সে কাপড়-চোপড় পরতে চায়না, সো ওয়াইল্ড!
মানুষটার মুখে ছায়াটা দৃঢ়ভাবে লেগে রইল। মুখ না দেখলে মানুষের মনোভাব বোঝা যায় না। শোনা গেল সে বলছে— রীণা, হেমাদের খবর ভালো তো? ওদের কাউকেই অনেকদিন দেখিনি। বোঝা গেল সে এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটা বদলাতে চাইছে। সিনেমা হলটার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্গাদাস রাস্তার জনপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে রইলেন— কৃপণ সংকীর্ণ কুটিল শহর। বিশৃঙ্খল দোকান-পাট, উচ্ছৃঙ্খল মানুষ।হীরামল দত্তের অর্ধেক সজ্জিত প্রকাণ্ড অট্টালিকাটি থেকে কয়েকটা লোহার রড এগিয়ে রয়েছে এখানে সেখানে খুব উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে টিভির এন্টেনাগুলি এবং এই জিঘাংসা দেখে আকাশটা খুব অসহায় এবং বিমর্ষ হয়ে পড়েছে।
রেস্তোরাটির (যার নাম মিষ্টিমুখ)সামনে এক ঝাঁক বর্ণাঢ্য যুবক-যুবতি,ল-কলেজের ক্লাসগুলি সম্ভবত শেষ হয়েছে।রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দ কৌতুক এবং অসম্ভব উচ্ছলতা,কয়েকটি আয়না টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার শব্দে মেয়েগুলির কাছ থেকে হাসি ভেসে আসছে…দুর্গা দাস সেখান থেকে সরে এল।না না,নীলমণি এখানে থাকতে পারে না।ভগবান যেন তাকে এখানে আসতে না দেয়।এণ্ডি চাদরের নিচে দুর্গাদাসের হাত দুটি প্রণামের ভঙ্গিতে জোড়া হয়ে গেল।আচ্ছা ,নীলমণি কী পরেছিল?দুর্গা দাস ভাবে।ঘরের ভেতরে সে প্রায়ই উলঙ্গ হয়ে থাকে।এই আলো,এই হাসি,এই প্রাচুর্যের মধ্যে একটা উলঙ্গ অর্ধ চেতন পশুবৎ মানুষ ,দুপাশের পথচারীরা সকৌ্তুকে তাকে লক্ষ্য করছে,এই নৃশংস বীভৎস দৃশ্যটি কল্পনা করে দুর্গাদাস কেঁপে উঠলেন।না এরকম হতে দিতে পারা যায় না,তাঁর তিনটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে।তিনটি আগুনের টুকরা নিয়ে সে বসে থাকতে পারবে না,তাঁর ছেলে-বৌমা বিরক্ত অপমানিত হয়ে ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে চলে গেছে।বন্ধ ঘরের ভেতরে গুজরে-গুমরে নীলমণি নিজের বিরাট অস্তিত্ব এভাবে প্রমাণ করছে যে বোনেদের জন্য কোনো সুপাত্র বাড়ির চারসীমা মাড়ায় না।
_কে? কে ডাকল?ও অপূর্ব! দাঁড়াও শোনো। আমাদের নীলমণিকে দেখেছিলে নাকি?কোথাও, আজকের দিনটিতে? সারাদিনে দেখনি? আচ্ছা, ঠিক আছে। ঠিক আছে।
রেলস্টেশনের মধ্য দিয়ে দুর্গাদাস পার হয়ে গেলেন। সাড়ে নটার ট্রেনটার জন্য স্টেশনটা অপেক্ষা করছে। হ্যালোজেনের আলোতে কিছু হলদে মানুষ—একজন ফেরিওয়ালা নিজস্ব দ্রুত ভাষায় কিছু একটা ফেরি করছে,ট্রাঙ্ক এবং পুঁটলির ওপরে কয়েকজন ক্লান্ত অর্ধশায়িত মানুষ, নিম্নকন্ঠে কয়েকটি মহিলা কথা বলছ।কয়েকটি কুলি মজদুর জাতীয় মানুষ মেঝেতে বসে খৈনি মারছে।এক সারি স্তব্ধ অপেক্ষারত কামরা, কয়লার সারি সারি স্তূপ…।
স্বপ্নালোকিত দুটি গলির মধ্য দিয়ে এসে তিনি নদীর তীরে নির্জন রাস্তায় উঠলেন। অতন্দ্র প্রহরীর মতো রাস্তার পাশাপাশি অপেক্ষা করছে লাইট পোস্ট গুলি, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারের জন্য ওদের আলো খুব শীর্ণ এবং সংকুচিত বলে মনে হচ্ছে, রাস্তার পাশে চুল মেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি মহিলার মতো কয়েকটি গাছ।… বিস্মৃতির অতল থেকে কথাগুলি পুনরায় ভেসে আসতে চায়। তার বিকৃতিটা ঠিক কখন আরম্ভ হল?মাথার আঘাতটাই একমাত্র কারণ কি? তারপরেও তো সে কিছুদিন পার্টির কাজে ঘুরে বেরিয়েছিল। তিনি শুনেছিলেন যে সে নাকি কোথাও কোথাও কয়েকদিন অপমানিত হয়েছে। পুনরায় একদিন রাতে কেউ পাথর মেরে তার ঘরের দরজার জানালার কাচ গুলি চুরমার করে দিয়েছিল, তখনই?
…নদীর তীরে রাতের নিটোল শরীর। ঝিল্লির ডাক নৈশব্দ তীক্ষ্ণ করে তুলেছে।।নদীর তীরে থাকা বিষ্ণু মন্দিরটা পার হলেন তিনি।তার ঠিক কাছেই কোনো দাতা কর্ণ এক সারি বিরাট সিঁড়ি দিয়ে নদীর তীরটা বেঁধে দিয়েছে,নদীর চাঞ্চল্যহীন জলে মন্দিরটার আলো বিম্বিত হয়ছে।এখানে শহরের কোলাহল,আকুলতা এসে পৌছায় না,চারপাশে নিখাদ স্তব্ধতা ।সিঁড়িটার ওপরে দাঁড়িয়ে দুর্গাদাস নিচের দিকে তাকাল।
একেবারে নিচের সিঁড়িটাতে নীলমণি— দুর্গাদাসের জেষ্ঠপুত্র নীলমণি দাস পড়ে আছে। বাঁ পা এবং বাঁ হাত নদীর নিস্তরঙ্গ জলে ডুবে আছে। চোখের পাতা নিমিলিত, দেহ নিস্পন্দ। ওপরের বিরাট এবং নিঃসঙ্গ আকাশ, আকাশ অস্পষ্ট নক্ষত্র, একটা কৃষ্ণচূড়া একটা অশ্বত্থের পাতলা পাতাগুলি দীর্ঘছন্দ বাতাসে কাঁপছে। নীলমণির গায়ে দুটো একটি ঝরা পাতা। চারপাশে স্তব্ধতার রাশি রাশি অন্ধকার, নির্জনতার নীল ঢেউ, এখন মগ্ন এই প্রকৃতির কুশীলব তিনি আর নীলমণি— তার প্রতি কৃতজ্ঞতায়, ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নত হয়ে এল। বাঁচিয়ে রেখে গেল। একটা দুটো ধাপ করে দুর্গাদাস সিঁড়ি দিয়ে নামলেন– নীলমণির কাছে। তার বুক কাঁপল না। সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে দুর্গাদাস তার বিকৃত মস্তিষ্কের পুত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন কোনো কোনো সময়ে মৃত্যু আসে এক দেবদূতের মতো…।
… দীর্ঘশ্বাস নয়, রাতের মতো কিছু একটার সঙ্গে তার বুকের মধ্যে এতদিন জমা হয়ে থাকা অবরুদ্ধ বাষ্প ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।ইস— আগামীকাল সে একটা পরিচ্ছন্ন দিনের সঙ্গে মুখোমুখি হবেন, মুখোমুখি হবেন এক জীবনের, অনেক জীবনের এবং জীবনের অনেক সম্ভবপরতার। শেষ সিঁড়িটাতে তিনি এসে দাঁড়ালেন। নীলমণি পড়ে আছে, অস্পষ্ট আলো এবং নির্জনতায় তার মুখটা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। চোখের নিচে দুটো গভীর অর্ধবৃত্ত, মৃত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দুর্গাদাসের মনে কোনো অনুকম্পা, কোনো পিতৃত্ববোধ জেগে উঠল না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি হাঁটু গেড়ে বসলেন… হঠাৎ বুকটা তার স্যাৎ করে উঠল, তিনি দেখলেন– নীলমণির বুকটা, খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, খুব নিঃশব্দে ওঠা-নামা করছে– সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে— বাতাস থেমে গেল, আকাশ বর্ণহীন হয়ে গেল, এক গভীর হতাশা দুর্গাদাসকে পীড়িত করে ফেলল, কোনো তৃষ্ণার্তের ঠোঁট থেকে যেন খসে পড়ল উচ্ছল পানপাত্র, যেন স্বর্গের দরজার সামনে থেকে খসে পড়লেন তিনি… এক আশাহত ক্লিষ্ট ভঙ্গিতে পিছিয়ে এলেন কয়েক পা, রাস্তায় উঠলেন নড়বড়ে পায়ে এবং দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
ভ্রমণ
সবুজরাণী
দুয়ারসিনি
সৌমেন্দ্র দরবার
বাগুইআটি, কলকাতা
কথায় আছে বাঙালির পায়ে সরষে বাঁধা। বাঙালি মানেই ২-৩ দিনের ছুটি পেলেই বেরিয়ে পরা প্রকৃতির সন্ধানে। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি বলে মন চাইছিলো নতুন কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসতে। সবুজ প্রকৃতি আর তার কোলে শান্ত, নিরিবিলিতে দু দিন নিশ্চিন্তে অবসর। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আমাদের এবারের গন্তব্য সবুজ রানী দুয়ারসিনি। ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির ইকোট্যুরিসম ওয়েবসাইট থেকে রুম বুক করে ট্রেনের টিকিট ও কেটে ফেললাম। সকাল ৬ টা ৪৫ মিনিটের হাওড়া বারবিল জনসতাব্দী এক্সপ্রেসে করে শুরু হলো যাত্রা। জানলা দিয়ে সবুজ প্রকৃতিকে দুচোখ ভোরে উপভোগ করতে করতে ট্রেন এগিয়ে চললো। খড়গপুর স্টেশনে ভাঁড়ে চা আর সঙ্গে গরম সিঙ্গারা মনটাকে সতেজ করে দিলো। ১২ মিনিট লেট করে ঠিক ৯টা ১০ মিনিটে ট্রেন ঘাটশিলা পৌঁছলো।আমাদের গন্তব্য এখানেই শেষ। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে অটো স্ট্যান্ডে এসে দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ায় জন্য নিদিষ্ট ভাড়ার চাট টাঙানো আছে। দুয়ারসিনির নিদির্ষ্ট ভাড়া ৮০০ টাকা। ঘাটশিলা থেকে দুয়ারসিনির দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। অটোর সাথে কথা বলে পাড়ি দিলাম দুয়ারসিনির উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যাওয়ার পর ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা দুদিকের প্রাকৃতিক নির্জন আর শান্ত পরিবেশ মন ভালো করে দিলো। ৩ দিনের জন্য রোজকার ঝামেলা থেকে মুক্তি। রাস্তার ধরে ছোট্ট একটা দোকানে অটো দাড় করিয়ে গরম গরম কচুরির সঙ্গে জিলিপি খেতে খেতে উপভোগ করলাম প্রকৃতির কোলে গ্রাম্য জীবনের সরলতা। প্রায় ১ ঘন্টা পর অটো এসে উপস্থিত হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দুয়ারসিনি প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রে। ঝাড়খণ্ড সীমান্ত ঘেঁষা বান্দোয়ানের অরণ্যসুন্দরী দুয়ারসিনি এককথায় অনবদ্ধ। টিলার উপর ছবির মতো তিনটি কটেজ। মাঝের ২ নং কটেজটি অনলাইন এ বুক করা ছিল। অটো ভাড়া মিটিয়ে রিসেপশনে এন্ট্রি করে কটেজে এলাম। কটেজের ভেতরটা অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো। সমস্ত আসবাবপত্র কাঠের তৈরি। হাত মুখ ধুয়ে ব্যালকনিতে বসতে বসতেই চা চলে এলো। দুপুরের লাঞ্চ আগেই ফোনে বলা ছিল। এখানে খাবার দাবার ঘরোয়া কিন্তু সুস্বাদু। সেগুন গাছের মাঝে বাঁশের তৈরি ছাওয়ায় খাওয়ার ব্যবস্থা যেন স্বাদটা আরও বাড়িয়ে দেয়। দ্বিপ্রাহরিক আহার সাঙ্গ করে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে চললাম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে। ২৯৪ হেক্টরের প্রাকৃতিক জঙ্গলে ঘেরা দুয়ারসিনি। গভীর অরণ্যের মাঝে ছোট ছোট টিলা। কেন্দু-সেগুন-আসন-কুসুম-করণ-শাল-মহুয়া-আমলকী-বহেড়ায় ছাওয়া টিলাগুলি। ফাগুনে পলাশ ও শিমুলের রঙে রাঙা হয় দুয়ারসিনির আকাশ। কিছু দূরেই পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে শীতল সাতগুড়ুম নদী। কাচের মতো স্বচ্ছ জল, ছোট ছোট মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। গাছে গাছে কত নাম না জানা পাখির কলরব। নাম না জানা কত গাছে কত ফুলের বাহার। নিজেকে মনে হলো হারিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতির গহন অরণ্যে। কাঠবেড়ালিগুলো খেলে বেড়াচ্ছে এক গাছ থেকে অন্য গাছে। সূর্য আস্ত যেতেই বুঝতে পারলাম প্রকৃতির কোলে সন্ধে নামছে। সে এক মোহময় পরিবেশ যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। ফিরে এলাম প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রে। সন্ধেবেলায় চিকেন বলের সাথে গরম কফি। সন্ধেটা কাটলো লনে ব্যাডমিন্টন খেলে। রাতে পরোটা আর কষা মাংস দিয়ে ডিনার সেরে মেঘহীন আকাশে তারাদের শুভরাত্রি জানিয়ে বিকেলের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। টিয়া, ফিংয়ে, দোয়েল, ময়না, মুনিয়া, কোকিল আরও কত নাম না জানা পাখি। চা খেয়ে বেরোলাম পাশের জঙ্গলে ঘুরতে। দেখা হলো বনমুরগী, গোসাপ, গিরগিটি আর রং বেরঙের প্রজাপতিদের সাথে। কটেজে ফিরে প্রাতরাশ সেরে গাড়ি নিয়ে
বেরোলাম ভালোপাহাড় আর বান্দোয়ানের উদ্দেশে। পথে দেখে নিলাম দুয়ারসিনি মাতার মন্দির, গ্রাম্য হাট, বি এস এফ বারাক। হাটে দেখলাম শাক সবজি, খাজা গজা থেকে শুরু করে জামাকাপড়, চটি-জুতো, মাছ মুর্গি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেচা কেনা চলছে। কোথাও কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ভালোপাহাড়ে এসে মনটা ভালো হয়ে গেল। ১৯৯৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কমল চক্রবর্তীর হাতে এর সূচনা। হরেক রকম গাছ গাছালি, মাছ, গৃহপালিত প্রাণীদের থাকার ঠিকানা। এখানে আছে একটি অনাথ স্কুল আর দাতব্য চিকিৎসালয়। সারা বছর এরা যুক্ত থাকে বিভিন্ন সামাজিক গঠনমূলক কাজে। ভালোপাহাড়ে এলে আপনার মন ভালো হবেই। বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে গেলাম বান্দোয়ানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সবুজ যে এত সবুজ হতে পারে তা এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না। ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু রেস্ট নিয়েই বিকেলের দিকে আমরা অলস পায়ে হাঁটা লাগালাম দুয়ারসিনি গ্রামের দিকে। গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছোট ছোট মাটির বাড়ি, নানারকম সুন্দর সুন্দর আলপনা আঁকা বাড়ির দেওয়ালে, দরজায়। গ্রাম দেখে গেলাম সানসেট পয়েন্টে। সানসেট পয়েন্টের রাস্তাটা অতীব মনোরম। এখানে এসে তো অবাক। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি উড়ে যাচ্ছে এ গাছ থেকে ও গাছে। এতো টিয়া পাখি আগে কখনো দেখিনি। দেখতে দেখতে চারিদিক রঙিন চাদরে মুড়ে অস্ত গেল সূর্য। সে এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য। ফিরে এলাম কটেজে। চিকেন পাকোড়া আর কফি খেয়ে আবার মেতে উঠলাম ব্যাডমিন্টন খেলতে। রাতে রুটি আর দিশী মুরগি। কেয়ারটেকার বাড়ি যাবার আগে বলে গেল রাতে যেন কমপ্লেক্সের বাহিরে না যাই। জঙ্গলের এলাকা, এদিকে রাতের দিকে নানা রকম জংলী জানোয়ার ঘোরাফেরা করে। দলমা হাতির দলও নাকি এ রাস্তায় যাতায়াত করে মাঝেমাঝেই। বাইরে চারিদিকে ঘন অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মাঝে জোনাকিদের যেন আসর বসেছে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে আনন্দে। সেগুন পাতা বাতাসের তালে খসখস শব্দ তুলছে। দূরের থেকে ভেসে আসছে মাদলের আওয়াজ। জ্যোৎস্না রাতে ভেসে যাচ্ছে অরণ্য।
পরেরদিন সকালের মিষ্টি রোদ্দুর গায়ে মেখে আমরা চলে গেলাম ঝোরার ধারে। গিয়ে বসলাম পাথরের উপর। পায়ে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঝোরার ঠান্ডা জল। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। সকাল বড় মধুর হয়। তার মিষ্টি আলোয় ঝলমল করে ওঠে চারিদিক। হরেক রকম পাখির দেখা মিলছে এখান থেকে। এদিকটায় প্রচুর সজনে গাছ। সব ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। সজনে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলে ফুলে। মনোরম এক পরিবেশ যেখানে শুধু বসে থেকেই অনেকটা সময় কাটানো যায়। ফেরার সময় সজনে ফুল কুড়িয়ে এনে বড়া ভাজার জন্য রাঁধুনিদের দিয়ে এলাম।
কটেজে ফিরে আসে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম ঘাটশিলার উদ্দেশে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। মন ভারাক্রান্ত। ছেড়ে যেতে হবে এই নির্ভেজাল সৌন্দর্য। আবার ইঁট, কাঠ, পাথরের কংক্রিটের শহরে রোজকার ব্যস্ততা। অটোকে আগেই বলা ছিল, তাই ঘুরে নিলাম ঘাটশিলার সমস্ত দর্শনীয় স্থান। পড়ন্ত বিকেলে বারবিল হাওড়া জনসতাব্দী এক্সপ্রেসে পাড়ি দিলাম বাড়ির পথে। চোখে লেগে রইলো অবর্ণনীয় সবুজের সৌন্দর্য্য।
পথের ঠিকানা: কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘাটশিলা। সেখান থেকে অটো বা গাড়িতে দুয়ারসিনি। নিজের গাড়িতেও যেতে পারেন দুয়ারসিনি। সময় লাগবে মোটামুটি ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। কলকাতা থেকে ঘাটশিলা প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। সেখান থেকে দুয়ারসিনি ২৬ কিমি।
গৃহের ঠিকানা: ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেটস ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির এ সি কটেজ। ভাড়া ওয়েবসাইট এ পেয়ে যাবেন। আছে ডরমেটরি। যাওয়ার আগে অবশ্যই অনলাইন এ রুম বুক করে যাবেন।
কি কি দেখবেন: দুয়ারসিনির প্রকৃতিই দুয়ারসিনির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। পাখিদের কিচিরমিচির , সদ্গুরুম নদীর কুল্কুলানি, ঘন জঙ্গল, নাম না জানা সব জংলী ফুলের বাহারে মন ভরে যায়। দুয়ারসিনির জঙ্গল ভাল্লুক, বুনো শূকর, হাতি, হায়না এবং নেকড়ের মতো বুনো প্রাণীর আবাসস্থল। ভাগ্যবান হলে এদের মধ্যে কাউকে এক ঝলক দেখতেও পেতে পারেন। তবে রাত্রে না থাকা গেলে সে সুযোগ কম।ঘুরে দেখতে পারেন আশেপাশের উপজাতি গ্রামগুলি। এছাড়া দুয়ারসিনি মায়ের মন্দির, গ্রামের সাপ্তাহিক হাট অন্যতম আকর্ষণ।
রসনাবিলাস: গ্রাম্য ঘরোয়া খাবার। চাইলে খেতে পারেন দেশি মুরগি কিংবা কচি পাঁঠা।
ভ্রমণকাল: অক্টোবর থেকে মার্চ। বর্ষাকালে না যাওয়াই ভালো। পোকামাকড়ের উৎপাত।
গল্প
শেষ অভিনয়
স্বাতী দে
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া
পর্ব ১
গতকাল অনিন্দ্য চলে গেছে সাত দিনের বিজনেস ট্যুরে। মালবিকাকে এই সময় সব কিছু একা হাতেই সামলাতে হবে। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। গত তিন বছর হল অনিন্দ্যর একটা প্রোমোশন হবার পর থেকে এটা আরো বেড়ে গেছে। সকালে উঠে আরিনের লাঞ্চ বক্স রেডি করে, ওকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে স্কুলের জন্য তৈরি করতেই বেশ কিছুটা সময় কেটে যায় মালবিকার। তারপর আবার আরিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে কি খাবে, ওদের রাতের খাবার কি হবে, এসব মায়া মাসিকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজে অফিসের জন্য তৈরি হয়। অনিন্দ্য বাড়িতে না থাকলে ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে দেবার কাজটা অন্তত মালবিকাকে করতে হয় না।
অনিন্দ্য আর মালবিকার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দশ বছর হল। দু সপ্তাহ পরেই ওদের দশম বিবাহ-বার্ষিকী আসছে। অনিন্দ্যর কোন ব্যাপারেই তেমন কোন হুঁশ থাকে না। তাই মালবিকা ঠিক করেছে এবার একটা সারপ্রাইজ পার্টি অর্গানাইস করবে।
অফিসে পৌঁছে প্রথমে দিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “আজ আমার সাথে লাঞ্চব্রেক-এ একটু বেরোতে পারবি? কিছু কেনা-কাটা করার ছিল।“
“হ্যাঁ, পারবো না কেন। এখন তো হাতে কোন প্রজেক্টের চাপ নেই। চল, বারোটা নাগাদ বেরিয়ে, বাইরেই কোথাও লাঞ্চ করে নেব।“
অফিসের সামনে থেকে ট্যাক্সি নিয়ে শপিং মল এ যেতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল। দিয়া আর মালবিকা একটা রেস্তরাঁতে ঢুকে খাবার অর্ডার করল।
“এবার বল তো তোর প্ল্যানটা কি? এত শপিং করার তাড়া কেন? তোকে তো কখনো এভাবে অফিস থেকে বেরোতে দেখি নি এর আগে?“ দিয়া অবাক সুরে জিজ্ঞেস করল।
মালবিকা একটু সময় নিয়ে বলল, “আসলে সামনেই আমাদের বিবাহ-বার্ষিকী, অনিন্দ্যর জন্য একটা সারপ্রাইজ পার্টির ব্যবস্থা করতে চাই। এই সাত দিন অনিন্দ্য বাড়িতে থাকবে না, তাই এই সময় অনেকটা কাজ গুছিয়ে রাখতে পারব।“
খাওয়া দাওয়ার পর দুই বন্ধু মিলে অনেক কিছু শপিং করল। প্রায় সব কিছুই অনিন্দ্যর পছন্দের জিনিস। অনিন্দ্য শপিং করতে ভালোবাসে না, তাই বাড়ির সবার জন্য মালবিকাকেই শপিং করতে হয়। ছুটির দিনে বা উইক এন্ড-এ অনিন্দ্য মালবিকাকে শপিং মলে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়। তারপর মালবিকার শপিং হয়ে গেলে, অনিন্দ্যকে ফোন করলে আবার এসে ওকে নিয়ে যায়।
ওদের শপিং প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎ দিয়া ছুটতে ছুটতে মালবিকার কাছে এল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখেছে। “কি হয়েছে? এরকম করছিস কেন?” দিয়ার অবস্থা দেখে মালবিকাও কিছুটা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল। মনে হল দিয়া কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শুধু হাত তুলে পাশের দোকানটার দিকে দেখাল।
মালবিকা কিছু বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল, “কি ওখানে?”
এবার দিয়া একটু দম নিয়ে বলল, “দেখতে পারছিস না, অনিন্দ্য দা একটা মেয়ের হাত ধরে পাশের দোকানে ঢুকছে?”
“কি যা তা বলছিস, অনিন্দ্য তো কালই অফিসের কাজে দিল্লী গেছে।“
“আমি যা তা বলছি না, তুই একটু কাছে গিয়ে দেখ।“
মালবিকাকে অবশ্য আর কাছে গিয়ে দেখতে হল না। ঠিক তখনই মালবিকা দেখতে পেল অনিন্দ্য রিমলীর হাত ধরে পাশের দোকান থেকে বেরোচ্ছে। রিমলীকে মালবিকাও চেনে। ও অনিন্দ্যর সেক্রেটারি। মালবিকার বুঝতে বাকি রইলো না যে অনিন্দ্য অফিস ট্যুরের নাম করে দিল্লী না গিয়ে বাঙ্গালোরেই আছে, আর রিমলীর সাথে সময় কাটাচ্ছে।
দিয়া একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি রে, এখন কি করবি?”
মালবিকা খুব শান্ত স্বরে বলল, “কিছু করব না। সব কিছু একই রকম চলবে আমাদের বিবাহ-বার্ষিকীর দিন পর্যন্ত। যা করার সেই দিন করব। তোকে কিন্তু সেদিন অবশ্যই আসতে হবে আমাদের বাড়িতে।“
দিয়া অবাক চোখে মালবিকার দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলো, “ও কি বলতে চাইছে? কি করতে চাইছে?” উচ্ছল প্রাণবন্ত মালবিকাকে দিয়া আগে কখনো এরকম শান্ত হয়ে যেতে দেখে নি। তাই ওর মনের কোণে ভয়ের একটা কালো মেঘ জমল।
মালবিকা দিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, “তুই চিন্তা করিস না। আমার হাতে এখনও দু সপ্তাহ সময় আছে। আমি চিন্তা ভাবনা করেই এরপর সিদ্ধান্ত নেব। তবে একটা কথা, তুই এখনই কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলিস না, প্লীজ।“
পর্ব ২
আজ বিকেলে অনিন্দ্যর টূর থেকে ফেরার কথা। মালবিকা মায়া মাসিকে বলল, “তুমি আজ একটু বিশ্রাম নাও, আমি রান্না করছি।“মায়া মাসি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল, “কেন? দাদা বাবু কি আমার হাতের রান্না পছন্দ করছেন না?”“না না, সেরকম কিছু না। দাদা বাবু আজ সাত দিন পর আসবে তো, তাই আমিই কিছু রান্না করে খাওয়াতে চাই। তুমি না হয় আমাকে সব কিছু যোগাড় করে দাও, আমি রান্না করছি।“ রাতে আরিন বাবার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে থাকতে শেষে ক্লান্ত শরীরে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মালবিকা মায়া মাসিকেও খেয়ে নিতে বলে অফিসের কিছু কাজ নিয়ে ড্রইং রুমে গিয়ে বসল। কাজগুলো যে খুব একটা জরুরী তা নয়, হয়ত বাস্তবতাকে ভুলে থাকার ছল মাত্র। অনিন্দ্য বাড়ি ফিরল বেশ রাতে। মধ্য রাত বললেই হয়তো ঠিক বলা হবে। দরজা খুলে ওকে ভেতরে আসতে দিয়ে মালবিকা জিজ্ঞেস করল, “এত দেরি হল যে তোমার, সব ঠিক আছে তো?”অনিন্দ্য ঘরে ঢুকে মালবিকা তখনো জেগে আছে দেখে যেন একটু অবাক হল। ভেবেছিল হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, আর সেই সুযোগে ও চাবি দিয়ে দরজা খুলে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে যাবে। এই নিশুতি রাতে বাড়ি ফিরে কারো মুখোমুখি হতে হবে না। মালবিকা ওর হাত থেকে ব্যাগটা নেবার সময় বলল, “অনেক রাত হয়েছে, তুমি তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে নাও। আমি ততক্ষণ আমাদের খাবারগুলো গরম করছি।“টেবিলের উপর সাজানো খাবারগুলো দেখে অনিন্দ্য অবাক হবার ভান করে বলল, “তুমি এখনও খাও নি কেন? আমি খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়ে নাও।“ “ঠিক আছে, তাহলে তুমি যাও, আমি খাবারগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে আসছি,” বলে মালবিকা নিজেও না খেয়ে সব কিছু ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে বেড রুমে গিয়ে দেখে অনিন্দ্য শুয়ে পড়েছে। এত তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমাতে পারে না। তবে ঘুমানোর অভিনয় তো করা যেতেই পারে। তাই মালবিকা আর কথা না বলে লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়ল। আরিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, তুমি কাল রাতে এত দেরিতে এলে কেন? আমি তোমার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম।““সরি আরিন, আমার প্লেনটা লেট ছিল, তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে।“ মালবিকা বাথরুম থেকে অনিন্দ্যর মিথ্যে কথাগুলো শুনে মনে মনে হাসল। “আমার জন্য কি এনেছো, বাবা?” বলেই আরিন ঘরের চারদিকে খুঁজতে লাগলো। “আমি এবার শপিং করার একটুও সময় পাইনি, আরিন। আমি প্রমিস করছি এর পরের বার তোমার জন্য কিছু কিনে আনবো।“ বাবার কথাগুলো শুনে আরিন শুকনো মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে ওর ঘরে চলে গেল। মালবিকাও রান্না ঘরের দিকে এগোল। আরিনকে স্কুলের জন্য তৈরি করে ওকে অফিস যেতে হবে। রান্না ঘরে যেতেই মায়া মাসি বলল, “কি গো দিদি, তোমরা কাল রাতে খাও নি? সব খাবার তো দেখছি ফ্রিজে পড়ে আছে। তুমি সারাদিন এত কষ্ট করে দাদা বাবুর জন্য কত কিছু রান্না করলে, আর শেষে কিনা না খেয়েই শুয়ে পড়লে?”
মায়া মাসির কথার উত্তর দেবার আগে মালবিকার চোখে পড়ল অনিন্দ্য ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। তাই আর মায়া মাসির কথার উত্তর না দিয়ে অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি চা খাবে তো?”
“হ্যাঁ, বানাও,” বলে অনিন্দ্য বাথরুমের দিকে গেল। মালবিকা আরিনকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে এসে নিজেও তৈরি হতে যাবে, এমন সময় অনিন্দ্য বলল, “আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আজ আর অফিস যাবো না।“ “ঠিক আছে, মায়া মাসিকে বলে যাবো তোমার খেয়াল রাখতে। আমাকে আজ অফিসে
যেতে হবে। কিছু জরুরী কাজ আছে। নাহলে আমিও বাড়ি থেকে যেতাম।“
“না না, তোমায় ছুটি নিতে হবে না। একটু ঘুমালে বিকেলের দিকে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।“
মনে মনে আবার হাসি পেল মালবিকার। ভাবল, “সারা সপ্তাহ গার্লফ্রেন্ড-এর সাথে কাটিয়ে এসে এখন ক্লান্ত লাগছে। আর তোমার মনে হয় আমি এখন অফিস ছুটি নিয়ে তোমার সেবা করব? অনেকগুলো বছর বোকা বানিয়েছো। আর নয়”।
অফিস থেকে ফেরার পথে আরিনের জন্য কিছু খেলনা কিনে নিয়ে এল মালবিকা। সকালে ওর শুকনো মুখটা দেখে খারাপ লেগেছে। মালবিকাকে খেলনা হাতে ঢুকতে দেখে আরিন বলল, “তুমি এসব আনলে কেন, মাম্মাম”।
“এমনি, জানো তো বাবা শপিং করতে ভালবাসেনা। তাছাড়া, কাজের চাপে সব সময় মনেও থাকে না। তাই আমার অফিসের পাশেই একটা দোকান আছে, সেখান থেকে নিয়ে এলাম।“
“থ্যাংক ইউ, মাম্মাম”, বলেই আরিন প্যাকেটগুলো খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর হাসি মাখা মুখটা দেখে মালবিকার মনটা ভরে গেল। ছোটদের কত সহজেই সুখী করা যায়। কিন্তু গত দশ বছর হল নিজের সবটুকু দিয়েও ঐ একটা মানুষকে মালবিকা সুখী করতে পারল না।
পিছন থেকে অনিন্দ্য এসে বলল, “তুমি আমায় বাঁচালে। সকালে ওকে না বলতে আমারও ভাল লাগে নি।“
পর্ব ৩
আজ মালবিকা আর অনিন্দ্যর দশম বিবাহ-বার্ষিকী অনুষ্ঠান। মালবিকা অনিন্দ্যর খুব কাছের কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছে। তার মধ্যে রিমলীও আছে। দিয়া আর ওর কলেজের কিছু বন্ধুও আসবে। মালবিকা সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিল। আরিনকে ওর মার কাছে রেখে এসেছে। ওখানে আরিন এক সপ্তাহ থাকবে। এই সময়টা যে মালবিকার খুব দরকার, নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে হবে। আরিন কোনো রকম অপ্রিয় ঘটনার সাক্ষী থাকুক সেটা মালবিকা চায় না।
বিকেল থেকেই এক এক করে সবাই আসতে শুরু করেছে। মায়া মাসি সবাইকে ড্রিংক্স আর খাবার দিচ্ছে।
দিয়া একবার মালবিকাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “কি রে, তুই সব কিছু জেনেও কি করে এত কিছুর আয়োজন করেছিস? তোর কি মাথাটা পুরোটাই খারাপ হয়ে গেছে?”
“না রে, এই প্রথম মাথাটা ঠিক হয়েছে। এখন ইমোশনগুলো পাশে সরিয়ে রেখে শুধু মাথা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছি। দেখিস, আমি আর ভুল করব না।“
দিয়ার মুখ দেখে মনে হল না যে ও কিছু বুঝতে পেরেছে, তাই মালবিকা আবার বলল, “আর একটু অপেক্ষা কর, সব বুঝতে পারবি।“
পার্টিতে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করল মালবিকা আর অনিন্দ্য ‘আদর্শ দম্পতি’। মেড ফর ইচ আদার। কত সহজেই আজকাল লোকেরা এই সব মন্তব্য ছুড়ে দেয়। ভিতর থেকে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। আমরা সবাই জীবনের নাট্য মঞ্চে এক একজন দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী। অনিন্দ্যকে দেখলে কে বলতে পারবে ও এত সুন্দর ভাবে একসাথে দুটো চরিত্রে অভিনয় করে চলেছে! খাওয়া দাওয়ার পর সুখী দম্পতির দাম্পত্য জীবনের সুখ সমৃদ্ধি আর দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করে কেক কাটা হল।
সবাই মালবিকার সারপ্রাইজ পার্টিতে খুব খুশি হয়েছে। গত পনের দিন ধরে মালবিকা এই সময়টার জন্যই তো অপেক্ষা করে আছে। তাই সবাইকে কাছে ডেকে বলল, “আমার আরেকটা সারপ্রাইজ দেবার আছে”।
অনিন্দ্য অবাক হয়ে মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আবার কি?”
“অপেক্ষা কর, জানতে পারবে। এত তাড়া কিসের?” মালবিকা একটু দূরে সরে গিয়ে বলল।
সবাই কাছে এসে জড়ো হতে মালবিকা বলতে শুরু করল, “আমাদের আজকের এই আনন্দের দিনে তোমাদের সবাইকে কাছে পেয়ে আমরা দুজনেই খুব খুশি হয়েছি। তোমরা অনেকেই হয়তো জানো, আমি বাবা-মার অমতে অনিন্দ্যকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। তারপর দু’বছরের মাথায় আমাদের একমাত্র সন্তান, আরিনের জন্ম হয়। আমি অনিন্দ্যর কাছে ঋণী, ও আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার সব থেকে বড় প্রাপ্তি হল আরিন।“
তারপর একটু থেমে অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে এই আনন্দের দিনে আমারও অনিন্দ্যকে কিছু দেবার আছে।“
সবাই খুব আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কি? আরিনের কোন ভাই বা বোন?”
মালবিকা একটু সময় নিল। ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছে। ভাবছে, “আমাকে পারতেই হবে”।
“না, সেরকম কিছু নয়।“ একটু দম নিয়ে আবার বলল, “এটাই আমাদের একসাথে শেষ বিবাহ-বার্ষিকী অনুষ্ঠান। আজই অনিন্দ্য এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আজ আমি ওকে মুক্তি দিচ্ছি।“
মুহূর্তের মধ্যে সকলে স্তব্ধ। সবাই যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। একটা আনন্দের দিনে হঠাৎ করে এরকম একটা অলক্ষুণে কথা শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। সবাই প্রথমে ব্যাপারটাকে হেঁসে উড়িয়ে দিতে চাইল।
এবার মালবিকা অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে একটু জোরের সাথেই বলল,
“না, আমি মজা করছি না। আমি চাই তুমি আজই তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে। তুমি রিমলীর সাথে যাবে বা অন্য কারো সাথে, অন্য কোথাও যাবে, সেটা সম্পূর্ণই তোমার ব্যাপার। আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু, এই বাড়িটা আমার বাবা আমাকে বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন, তাই এখানে কে থাকবে, না থাকবে, সেটা সম্পূর্ণই আমার ব্যাপার।“
এতক্ষণে সবাই বিষয়ের গভীরতাটা বুঝতে শুরু করেছে। সবাই একে অপরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তবে একটা বিষয়ে মালবিকাও অবাক হল। মনে মনে ভাবল, “এবারের অস্কার অ্যাওয়ার্ডটা অনিন্দ্যর-ই পাওয়া উচিত।“ অনিন্দ্যর বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে মালবিকার বুঝতে অসুবিধে হল না যে অনিন্দ্য কতটা পাকা খেলোয়াড়। শুধু মালবিকাই নয়, ওর বন্ধুরাও কেউ ওর অভিনয় ধরতে পারেনি। কি যেন, অভিনয় করতে করতে হয়ত নাটকের চরিত্র গুলোই ওর জীবন হয়ে গেছে।
অনিন্দ্য মালবিকার কাছে গিয়ে আস্তে করে বলল, “একি হচ্ছে, মালবিকা? ওরা আমাদের গেস্ট। ওদের সামনে এটা কি রকম ব্যবহার?”
সবার চোখ এখন রিমলীর দিকে। রিমলী ঘরের এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“আমরা এই ব্যাপারে পরেও কথা বলতে পারি। এখন এসব বন্ধ করলে হয় না?” গলার স্বর নিচু করে অনিন্দ্য জানতে চাইল।
“না, হয় না। আমি তোমাকে আমাদের সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্তি দিচ্ছি। এরপর তোমাকে আর অফিস ট্যুরের নামে মিথ্যে কথা বলে রিমলী বা অন্য কারো সাথে সময় কাটাতে যেতে হবে না। আমিও আমাদের এই ফাটল ধরা সম্পর্ক আর বয়ে বেড়াতে নারাজ।“ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে মালবিকা দম নিল।
অনিন্দ্য যেন আকাশ থেকে পড়ল। ও ভাবতে পারেনি যে ওর সব মিথ্যে অনেক আগেই ধরা পরে গেছে মালবিকার কাছে। দু’নৌকায় পা দিয়ে জীবনটা তো বেশ ভালোই কাটছিল। এখন কি ওকে শেষ পর্যন্ত এ কূল, ও কূল, দু’কূলই হারাতে হবে!
দিয়া এসে মালবিকার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। আজকে তোর জন্য আমার গর্ব হচ্ছে।“
অনিন্দ্যকে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়তে দেখে মালবিকা আবার বলল, “ওরা সবাই চলে গেলে, তুমিও তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যাবে। আমি এই জন্যই আরিনকে আমার মার কাছে রেখে এসেছি। আমি চাই না ও এসব দেখুক বা জানুক।“
সবাই আস্তে আস্তে চলে গেল। রিমলী আর অনিন্দ্য তখনও সোফায় বসা। নির্বাক! মালবিকা বেড রুমের দিকে এগোতে এগোতে মায়া মাসিকে বলল, “মাসি ওরা চলে গেলে দরজাটা বন্ধ করে দিও।“ বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল মালবিকা।
গল্প
দেবী মরুবাসিনী
তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য
সন্তোষপুর, কলকাতা
প্রীতি পরিণাম
মধুপের সনে ফুলের মধু
খাইতে গিয়াছি মধুবনে
পীরিতি রসেতে করিল আটক
কেমনে তরিব কে বা জানে।
রাঙিল যে প্রাণ প্রেমের বরণে
দিবানিশি শুধু সাথীর স্মরণে
ব্যাকুল কভু বা আতুর বিরহে
সংসার বোধ আর নাহি রহে
পরিশেষে আসি সংসারে পশি
যাঁতাকলে পড়ি বারিধারা বহে নয়নে।
পদ্যটি পাঠ মাত্র দুইজন আড্ডাধারী হর্ষে কলরব করিয়া উঠিলেন। তাঁহারা কেহই প্রকৃতিস্থ নহেন। আর একজন কয়েকবার করতালি দিয়া কহিলেন 'আবার পড়, আবার পড়।'
আমি মরুধরবাবুর দিকে চাহিলাম। তাঁহার দৃষ্টি উদাসীন, মুখ গম্ভীর। তিনিও যে প্রখর প্রকৃতিস্থ, সে কথা কহি না। অনুরোধ রক্ষা করিয়া পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে পদ্যটি পাঠ করিলাম।
মরুধর বাবুর আমন্ত্রণে অদ্য এই আড্ডায় আমি উপস্থিত হইয়া পড়িয়াছি। সম্প্রতি মরুধর বাবু বিবাহ করিয়াছেন। অদ্য বিবাহ পরবর্তী একটি বৈঠক তাঁহার আয়োজনে তাঁহার বাটীতে সম্পন্ন হইতেছে। আমরা কয় মিত্র আর স্যাঙাত আসিয়া হাজির হইয়াছি। মুখে মুখে শুনিয়াছিলাম বিবাহের পরে সংসার করিতে করিতে মরুধর বাবুর নাভিশ্বাস উঠিতেছে, সেই কারণে কৌতুকবশতঃ আজ এরূপ পদ রচনা করিয়া আড্ডা জমাইতে আসিয়াছিলাম। মিত্রগণের অনুরোধে অদ্য আমার পদ রচনা করিয়া আসিবার কথা ছিল; বান্ধবমহলে আমার কাব্যপ্রতিভার একটা পরিচিতি আছে।
এই পদ্য আজিকার সন্ধ্যার যিনি মুখ্য আড্ডাধারী, তাঁহাকেই উদ্দেশ্য করিয়া রচিত। বস্তুতঃ মরুধর বাবুর কর্মক্ষেত্র ছিল পশ্চিমের রাজস্থানে। সেস্হল হইতে কর্ম পরিবর্তন করিয়া তিনি এদেশে আসিয়া বসবাস করিতে শুরু করেন। সেসময়ে এক মহিলার সহিত তাঁহার প্রণয় হইয়া গিয়াছিল। প্রণয় ঘনতর হইলে তাঁহার বিবাহ স্থির হয়। তাঁহার এক পিসিমার গৃহে আমার কতিপয় মিত্র বাসা লইয়া ভাড়া বসবাস করিত, সেসূত্রে পিসিমা সেই মেসবাড়িতে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছিলেন। দৈবাৎ সেইদিন আমি তথায় তাস দাবা খেলিবার জন্য উপস্থিত ছিলাম। তাই বাকি সুহৃদ গণের সহিত আমারও নিমন্ত্রণ হইয়া যায়। তখনই আমি জানিতে পারিয়াছিলাম যে মরুধর বাবু ডমরুধর চরিত প্রসিদ্ধ শ্রীডমরুধর বাবুর পারিবারিক বংশধর। শুনিয়া আমি নিতান্ত কৌতূহলী হইয়া পড়ি।
পরিণয়ের রজনীতে আমি বিবাহবাসরে সবান্ধবে উপস্থিত হইয়াছিলাম। মরুধর বাবু এবং তাঁহার নববিবাহিতা স্ত্রীকে শুভকামনা জ্ঞাপন করিয়া সেদিন যারপরনাই তোষ লাভ করিয়াছিলাম। সেদিনই তিনি আমার সহিত বাকি বান্ধবগণকে বিবাহ পরবর্তী এক সন্ধ্যায় সমাগমের অনুরোধ করিয়াছিলেন। সেই সন্ধ্যা আজিকার।
মরুধর বাবুর বিবাহের বয়স অধিক হইয়াছিল। কহিতে লাগিলেন ' ভায়া, অধিক বয়সের সংসারে সুখ নেই জানবে।' একজন কহিল ' নতুন সংসারে সুখ কোনো বয়সেই নেই জানবে।'
-' বিবাহের পূর্বে আর পরে স্ত্রীর মূর্তি বদলাইয়া হীরা থেকে কয়লা হইয়া গেল।' বলিলেন মরুধর।
আমি এইরূপ আলাপ শুনিতে লাগিলাম। নেশা চলিতে লাগিল। আমার ত নেশায় রুচি নাই। আমি অভ্যাগতদের নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। অভ্যাগতদের মধ্যে দেখিলাম সেদিনের বিবাহের পুরোহিত মহাশয়ও বিরাজ করিতেছেন। তিনি প্রকৃতিস্থ।
মিত্রবর্গের মুখে শুনিয়াছিলাম ডমরুধর বাবুর অর্থ, দালান আর আবাদ তাঁহার বংশধরদিগের মধ্যে ভাগাভাগি হইয়াছিল। আমাদের মরুধর বাবুর মাতা পিতা কর্মসূত্রে রাজস্থানের মরুপ্রদেশে চলিয়া যান। সেখানেই জন্ম বলিয়া তাঁহারা পুত্রের নাম রাখিয়াছিলেন মরুধর। সেদেশেই মরুধর বাবুর জন্ম, বিদ্যা শিক্ষা ও কর্ম। তাহার পরে দেশে ফিরিয়া বসতবাটি ও পরিণয় এবং এক্ষণে সংসার। পুরোহিত কহিলেন ' সংস্রতে যতঃ ইতি সংসারঃ।'
সকলে হাসি তামাশা করিতেছে। একজন একটা গান গাহিল। খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করিয়া গেল দুইটি পরিচারিকা। সবই চলিতে লাগিল। একজন বন্ধু বলিল
' আচ্ছা ঐ যে আপনার বাটি ঘুরিয়া দেখিলাম, দেখিলাম যে পূজার আসনে একটি সবুজ রঙের চকচকে পাথর মত। ভারি সুন্দর, ঠিক যেন কোঁদা একখান ফুল। ঐটি কী? কোথা থেকে পাইয়াছেন?' মরুধর বাবু কহিলেন
' ঐটিই আমার নয়নের মণি। অভ্র। উহা অভ্রের ফুল, মরুদেশ হইতে পাইয়াছিলাম। মনোস্কামনা সিদ্ধি বস্তু। উহার প্রভাবেই আমার কপালে ভার্যা, প্রণয়, সংসার, কর্ম সবটাই।' পুরোহিত কহিলেন' আর যে পাথরটা আমি আপনাকে পরাইলাম দেড় মাস আগে- তার জন্য যে বিবাহ সম্পন্ন হইল তাহা ভুলে গেলেন?'
মরুধর বাবু কহিলেন' ওগুলি হল দোসর। ওরকম অনেক আসবে যাবে, কিন্তু ঐটি আমার ধ্রুবতারা। সাক্ষাৎ মাতা ত্রিলোকেশ্বরীর আশীর্বাদ। এই যে সংসারে এত খ্যাচ খ্যাচ, এ থেকে ত্রাণ দেয় এটিই।'
আমি বুঝিলাম পূর্বপুরুষের ন্যায় ইনিও মাতৃ উপাসক। আমি উদগ্রীব হইয়া উঠিলাম, কহিলাম
' এ কোথায় পাইলেন?' বাকি সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিল। সংসারের খ্যাচ খ্যাচ কি করিয়া থামাইবে জানিবার জন্য সকলে ব্যতিব্যস্ত করিতে লাগিল মরুধর বাবুকে। একজন কহিল
' আমার অবস্থা নিতান্ত সঙ্গীন, একটু ভাঙ্গিয়া আমাকে দেন না। নিদান করিব।'
মরুধরবাবু কহিতে লাগিলেন -
এই যে দেখিলে ও হল ধরণীগর্ভস্হ অভ্রের স্ফটিক। ঠিক যেন ফুল। ইহা আমি অতি পুণ্যবলে দেবী মরুভারতীর স্থান হইতে পাইয়াছিলাম। একবার হইল কি, অল্প বয়সে আমার অকস্মাৎ এক খেয়াল হইল। আমি এক অভিযাত্রী দলে ভিড়িয়া পড়িয়া মরুদেশ ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। সেই তাহাদের সহিত ঘুরিতে ঘুরিতে একবার এক প্রত্যন্ত এলাকায় পড়িলাম। তখনই সেখানে এক ভয়ানক মরুঝঞ্ঝা আবির্ভূত হইল।
মরুঝঞ্ঝার কবলে পড়িয়া আমাদের শিবির, মালপত্র আর সাথীরা কে কোথায় চারিদিকে ছিটাইয়া গেল কিছুই ঠাহর করিতে পারিলাম না। শুধু দুই চক্ষে বালি আর চারিদিকে চীৎকার। সর্বাঙ্গে আর চোখে মুখে বালি আসিয়া পড়িতে লাগিল। দুই হস্তে চক্ষু চাপিয়া কোনোক্রমে মাথা মাটিতে ঠেকাইয়া পড়িয়া রহিলাম। কিছুই দেখিতে পাইলাম না।
এই ঝঞ্ঝার কোনোরূপ পূর্বাভাস কিছু ছিল না । সকলে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলাম। আমি টের পাইলাম ঝড়ে আমাকে আছড়াইয়া ফেলিল। যেখানে পড়িলাম সেস্হলে ফের তদ্রূপ পড়িয়া রহিলাম।
কতক্ষণ পড়িয়া ছিলাম জানি না, ঝড়ের ভয়ানক শব্দ যখন আর নাই, ধীরে ধীরে উঠিলাম। ঝঞ্ঝা আর ছিল না। চতুর্পাশ্বে তাকাইয়া বহু দূর অবধি জনপ্রাণী দেখিলাম না। আমার মালপত্র, শিবির কোনো কিছুর চিহ্নমাত্র কোথাও দেখিতে পাইলাম না। গরম বোধ হইতে লাগিল। কিছুদূর দিশাহারা হাঁটিলাম। মরুপ্রান্তর ছাড়া কিছুই দেখিতে পাইতেছিলাম না। তৃষ্ণা লাগিল। জল নাই। ক্লান্ত হইয়া বালির ওপর বসিয়া পড়িলাম।
কিছুক্ষণ বাদে বালির তাপে আর তৃষ্ণায় অধীর হইয়া উঠিলাম। প্রাণধারণের আশা ত্যাগ করিয়া বসিয়া আছি এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে খুব জোর একটা হাওয়া দিতে লাগিল। পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম অদ্ভুত কাণ্ড! বাল্যকালে রূপকথায় আর গ্রীক পুরাণে পক্ষীরাজ ঘোটকের কথা শুনিয়াছিলাম; সেদিন চাক্ষুষ দেখিলাম। প্রায় আট দশটি ঊষ্ট্র উড়িয়া আসিতেছে।
-' কি বলিলে? উট উড়িয়া আসিতেছিল?'
সকলে পারস্পরিক মুখাবলোকন করিতে লাগিলাম আমরা। মরুধর আমাদের প্রতি দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম
'আপনি দেখলেন? উটের ডানা ছিল?'
- 'হ্যাঁ নতুন ভায়া, তাহাদের পক্ষ ছিল।' কিয়ৎক্ষণ দম লইয়া মরুধর শুরু করিলেন-
আমি ত দেখিয়া রীতিমত স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। ঊষ্ট্রের পক্ষের বাতাস আসিয়া লাগিয়াছিল। ঊষ্ট্রগুলি উড়িয়া আসিয়া নামিল। আমার অনতিদূরে সেগুলি দৌড়াদৌড়ি ওড়াউড়ি খেলা করিতে লাগিল। ডানা মেলিয়া উড়িতেছিল। আমি তাহাদের বিস্মিত হইয়া দেখিতে লাগিলাম তৃষ্ণা ভুলিয়া। বেশ খানিক পরে বেলা গড়াইয়া আসিলে তাহারা এক এক করিয়া উড়িয়া ফিরিতে লাগিল। আমি তাহাদের পানে সর্বশক্তি দিয়া চলিতে লাগিলাম। এ স্থানে জল নাই, জনপ্রাণী নাই, তাপে জীবন যায়- আমি মরীয়া হইয়া তাহাদের পানে দৌড়িতে লাগিলাম। একখানাকে বাগে পাইয়া তাহার দীর্ঘ ঠ্যাঙ দুই হাতে জড়াইয়া ধরিলাম। সে আমার প্রতি দৃকপাত মাত্র না করিয়া উড়িয়া চলিল। আমি ভয় পাইতেছিলাম সে পা ঝাড়িয়া আমাকে না ফেলিয়া দেয়। বালির 'পরে পড়িলে আহত হওয়ার আশঙ্কা নাই মনে করিয়া আরও ভরসা হইল।
যাহা হউক সেই ঊষ্ট্র তাহার যূথের সহিত শূণ্যপথে উড়িয়া চলিল। অনেক উচ্চে উঠিয়াছিল। আমার শির বনবন করিয়া ঘুরিতেছিল। আমি ভয়ে চক্ষু বুজিয়া ফেলিতেছিলাম একেকবার। দুই হস্তে তাহার পা আমি চাপিয়া ধরিয়াছিলাম।
আমার সেই অবস্থা কাটিতে অধিক বিলম্ব হয় নাই। উহারা আসিয়া একস্হানে নামিল। আমি তাহার পা ছাড়িয়া দিলাম। অবসন্ন দেহে আমি দেহ এলাইয়া শুইয়া পড়িলাম। সেখানেও বালুকা ছিল, কিন্তু তাহা তপ্ত নহে, শীতল।
আমার শরীর জড়াইয়া গেল। আমি উর্দ্ধে দেখিলাম আমাকে ঘিরিয়া শূণ্যে ঊষ্ট্রের যূথ উড়িয়া পরিক্রমণ করিতেছে।
কিছুক্ষণের জন্য নিদ্রাগত হইয়া পড়িয়াছিলাম। উঠিয়া দেখিলাম রাত্রি হইয়াছে। ঊষ্ট্রগুলিকে দেখিতে পাইলাম না। গাত্রে বল পাইতেছিলাম। আমি পদে পদে অগ্রসর হইলাম। একটি বৃহৎ বালুকার ঢিবির পার্শ্বে আসিয়া আমি দাঁড়াইয়া পড়িলাম। সম্মুখে বিশাল এক দেবীমূর্তি। এই দেবীমূর্তি আমি পূর্বে কভু দেখি নাই। রাত্রি হইয়াছিল কিন্তু আমি নক্ষত্রালোকে দেখিয়াই বুঝিলাম মূর্তি মর্মর প্রস্তরে নির্মিত। আমি করজোড়ে নমস্কার করিয়া দেবীর নিকট জলের জন্য আর্তি করিলাম। অগ্রসর হইলাম মূর্তির দিকে।
যতই অগ্রসর হইতেছিলাম সুরম্য মূর্তির শোভা আমাকে ক্রমাগত বিমোহিত করিতেছিল। অমন সৌন্দর্য্য আর সুষমা আমি আর কোথাও দেখি নাই। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সমীপে চলিয়া গেলাম।
মূর্তির পাদদেশে গিয়া বুঝিলাম এ স্থান হইল একটি খনি। এখানে জনমানব নাই কিন্তু নির্জন স্থানে খনি। কোথাও কোনো জনপ্রাণী দেখিলাম না। সেই স্হলে একটি শিলার বেদী দেখিতে পাইলাম। তাহার পার্শ্বে রাখা একটি ঘট। আমি ধাইয়া সেই ঘট লইলাম। তাহাতে জল ছিল। উন্মাদের ন্যায় পান করিতে লাগিলাম জল। বিলক্ষণ তৃষ্ণা পাইয়াছিল। জল পান করিতে থাকিলাম। পান করিয়া করিয়া তৃষ্ণা যেন মেটে না। অথচ ঘটের জল কিন্তু ফুরাইল না। জল খাইতে খাইতে উদর ভরিয়া উঠিল- চাপ লাগিল- তবু জল শেষ হইল না ঘটে। জল যথাসাধ্য খাইয়া আমি সেস্হলেই অবসাদে বসিয়া পড়িলাম। সেখানেই অচেতনপ্রায় নিদ্রিত হইলাম।
যখন জাগিলাম তখন ঊষালগ্ন। জাগিয়াছিলাম ঊষ্ট্রের ডাকে। দেখিলাম অদূরে ঊষ্ট্রগুলি রোমন্থন করিতেছে। বুঝিলাম মরূদ্যান নিকটেই আছে। সম্মুখে মূর্তি ছিল। প্রাতে উত্তম রূপে দর্শন করিলাম। রাত্রে যা দেখিয়াছিলাম সৌন্দর্য্য তাহার শতগুণ। মূর্তি সবুজাভ শ্বেতপ্রস্তরনির্মিত। অসাধারণ শিল্পকর্ম। দেবী ধ্যানমূর্তিতে উপবিষ্টা, জটাধারিণী অর্ধনিমীলিত নয়ন। যে খনিতে মরকৎ ও মর্মর উভয় পাওয়া যায় সেই খনির মরকৎ মিশ্রিত বিরল মর্মর প্রস্তরে নির্মিত এই মূর্তি। অপূর্ব সে মূর্তি দেখিয়া ভক্তি আপ্লুত হইয়া পড়িয়াছিলাম। পদতলে পড়িয়া গেলাম। তখন বয়স অল্প তো, আপ্লুত হইলাম।
পদতলে পড়িয়া ছিলাম। পশ্চাৎ হইতে পদসঞ্চার আর ওঙ্কারধ্বনি শুনিয়া চমকিয়া তাকাইলাম। দেখিলাম এক জটাধারী সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী মাড়োয়ারি ভাষায় কহিল ' আমি জানি তুই কে। তোর নাম মরুধর।' আমি ভক্তিতে গদগদ হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম ' তুমি কে সাধুবাবা?' সন্ন্যাসী কহিল ' সে কথা থাউক। তোর পূর্বপুরুষের অশেষ পুণ্যে তুই এ স্থানে পৌঁছিয়াছিস। তোর সিদ্ধি হবে।' আমি করজোড়ে নমস্কার করিলাম। সন্ন্যাসী আমাকে একদিকে নির্দেশ করিয়া দিল। সেদিকে মরূদ্যান আছে। সেখানে গিয়া জলাশয়ে স্নান সারিয়া আসিতে আমাকে বলিল। ' আমি নিজে এখন পূজায় বসিলাম।' বলিয়া সন্ন্যাসী পূজায় বসিয়া পড়িল বেদীর উপর।
সন্ন্যাসী যে দিকে অঙ্গুলি দেখাইয়া দিল আমি সেদিকে আন্দাজ করিয়া চলিতে চলিতে মরূদ্যান আর জলাশয় দেখিতে পাইলাম। স্নান সারিয়া আসিয়া সন্ন্যাসীর নিকট দাঁড়াইলাম। সন্ন্যাসী পূজা শেষ করিয়া উঠিতেছিল। ' স্নান করে এসেছিস?' মেঘমন্দ্রস্বরে সে কহিল। আমি করজোড়ে সম্মতি করিলাম। ' বোস এই বেদীতে।' বসিয়া পড়িলাম। বেদীতে কিছু খর্জ্জুর রাখা ছিল। সন্ন্যাসী কহিল ' ঐ হল পূজার নৈবেদ্য আর ঐ হল ফুল।' ফুলের মত আকারের কয়েক খণ্ড অভ্র আকরিক সেখানে ছিল। আমি দৃষ্টিপাত করিলাম। ' যতক্ষণ না আমি ফিরি মন্ত্র জপ করে যাবি।' বলিয়া সে তাহার দণ্ড লইয়া বালুকার উপরে মাড়োয়ারি বর্ণে এক মন্ত্র লিখিয়া দিল। আমি মাড়োয়ারি বর্ণ পড়িতে জানি না, তাহার মুখপানে চাহিলাম। সে এক প্রবল অট্টহাস্য করিয়া উঠিল-এক আকস্মিক দমকা হাওয়ায় দেখি বালুকার ওপর সে লিখন ওলোট পালোট হইয়া গেল। চাহিয়া দেখিলাম বাংলা বর্ণে তাহা পরিণত হইয়াছে। চমৎকৃত হইয়া সন্ন্যাসীর দিকে চাহিতে গেলাম- তাহাকে দেখিলাম না- অন্তর্হিত হইয়াছে।
মরুধর জল পান করিতে থামিলেন। সে অবসরে পুরোহিত প্রশ্ন করিলেন 'আপনার স্মরণে আছে সেই মন্ত্রটি?' - আলবাত আছে। দিন আপনাকে আমি লিখিয়া দিতেছি। পুরোহিত তাঁহার কাগজ কলম আগাইয়া দিতে মরুধর লিখিলেন। সকলের হাত ঘুরিয়া আমার হাতে তাহা আসিল। কাগজটা হস্তে লইয়া দেখি লিখা আছে-
পরাকান্তাং প্রসন্নবদনাং মরুপ্রদেশ নিবাসিনীম্।
বন্দে সততং শ্যামলাঙ্গীং বিভাময়ীম্ মরুভারতীম্।।
আমি পড়িয়া তাহা পুরোহিতের হস্তে প্রত্যর্পণ করিলাম। পুরোহিত লইয়া শিরে ঠেকাইল পড়িয়া। কহিল ' এ ত আগে কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না।' মরুধর কহিলেন আমিও ঐ একটিবারই দেখিয়াছি। অন্য কোথাও এই মন্ত্র পাই নাই। যাহা হউক, সেই সুবিশাল মূর্তির মনোহর শোভা দেখিয়া আপ্লুত হইতে হইতে পূজা করিতে লাগিলাম। মূর্তির ছায়া সেখানে বহুদূর অবধি বিস্তৃত ও শীতল ছিল। রৌদ্রালোকে মূর্তি আরও শোভাময়ী হইল। লক্ষ্য করিলাম মূর্তির প্রস্তরে অভ্রচূর্ণ রহিয়াছে; তাহার চমকে মূর্তির শোভা বৃদ্ধি হইতেছে। পূজা শেষ করিয়া মন্ত্র জপিতে লাগিলাম।
সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হইল অনেক পরে। আমাকে দেখিয়া খুশি হইল। এইরূপে কয়েকদিন গেল। জপ আর পূজা আর তাহার সাথে সন্ন্যাসীর সঙ্গ করিতেছিলাম। অবসর সময়ে এক ঊষ্ট্রশাবক আমার নিকট আসিতে শুরু করিল। একদিন তাহার গাত্রে আকরিক অভ্রের শিলা দিয়া আলপনা আঁকিয়া দিলাম। ঠিক যেমন হাতির গাত্রে আঁকিয়া দেয় পশুশালায়। বড় আহ্লাদ হইল তাহার। করভ তাহার মাতার নিকট গেল। মাতা আমার নিকট উৎফুল্ল হইয়া ছুটিয়া আসিল। আমি পলাইতে গেলাম কিন্তু সে ঊষ্ট্রিনী পক্ষ মেলিয়া লম্ফ দিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল। আমি বসিয়া রহিলাম আর সে আমাকে চাটিতে লাগিল।
তাহার পর দিন হইতে যূথের সব ঊষ্ট্রগুলি আমাকে চাটিতে আসিত। সকলে মিলিয়া আমাকে চাটিয়া চাটিয়া আদরে ভরাইয়া দিত।
তাহারও কিছুদিন পর সন্ন্যাসী একদিন আমাকে ডাকিল। কহিল আমাকে সে এবারে বিদায় দিবে। আমি একটু বিষণ্ণ বোধ করিয়াছিলাম। তথাপি প্রত্যাবর্তনের আনন্দে ব্যাকুল হইয়া উঠিলাম। বিদায়ের দিন সে আমার ললাটে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ঠেকাইয়া চাপ দিল। আমি নমস্কার করিয়া আসিলাম।
সন্ন্যাসী হস্ত উত্তোলন করার সঙ্গে সঙ্গে সেই করভের মাতা ঊষ্ট্রিনী ছুটিয়া আসিল। আমি তাহার পা জড়াইয়া ধরিলাম। সে উড়িয়া চলিল। বহুদূর আসিবার পর এক উচ্চ বালুকার পর্বতের উপর সে পা ঝাড়িয়া আমাকে ফেলিয়া দিল। আমি পড়িয়া গড়াইতে গড়াইতে যেখানে আসিলাম, নগরের বড় রাস্তা সেখান হইতে দেখা যাইতেছিল। আমি নগরে আসিয়া সাহায্য চাহিলাম। লোকেরা থানায় লইয়া গেল। অবশেষে পুলিশ আমাকে শনাক্ত করিল। আমার অভিযাত্রী দলের বাকিদের সন্ধান পাওয়া গেলেও আমার সন্ধান পুলিশ তখনও পায় নাই। পুলিশ আমাকে নিজ সদনে পৌঁছাইয়া দিল। সে দেবালয় হইতে আসিবার সময় আমি অভ্র আকরিক খণ্ডের সেই কুসুমাকৃতি সুদৃশ্য একটি আকরিক আশীর্বাদ স্বরূপ লইয়া আসিয়াছিলাম, তাহাই তোমরা আজ দেখিলে।
গল্প শুনিয়া সকলে পারস্পরিক মুখাবলোকন করিতে লাগিলাম। আমার স্যাঙাত দেখিলাম মুচকি মুচকি হাসিতেছে। পুরোহিত উর্দ্ধনেত্রে কিছু চিন্তা করিতেছে।
আমার বোধগম্য হইল মরুধর বাবু তাঁহার পূর্বপুরুষের ন্যায় গুণী না হইলেও চরিত্রগুণগুলির কিছু কিছু বিলক্ষণ প্রাপ্ত হইয়াছেন।
গল্প
বাল্যবন্ধু
সোমদেব পাকড়াশী
লেক গার্ডেনস্, কলিকাতা
ভর দুপুর। খাওয়া দাওয়া সেরে আধোঘুমে - উঠেই কয়েকটা জরুরি কাজে বেরোতে হবে। কাল বাদে পরশু আবার বিদেশে কাজের জায়গায় ফেরা। একটা ফোন কলে ঘুমের চটকাটা গেল ভেঙ্গে।
'নীহার বলছি', ফোনে পরিচিত গলার আওয়াজ। বহুদিন বাদে সেই স্কুলবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নীহার … গোড়ার ক্লাসগুলোতে আমাদের ফার্স্ট বয়! কিছুটা বিপদে পড়েই ও পুরানো বন্ধুকে স্মরণ করেছে, ‘সেদিন কে যেন বলল তুই এখন কলকাতায়.....অনেকদিন পর …. জানিস তো, আমি এখন একটা ব্যাঙ্কে আছি, ক্যাশিয়ার হিসাবে....,’ ইত্যাদি অল্প কিছু কথার পর নীহার জানাল, 'আজ ক্যাশে কাজ করতে করতে হঠাৎ ধরা পরে যে কিছুটা ক্যাশ শর্ট হয়েছে ... প্রায় বাইশ হাজার টাকা'। ওর মতে, পরে সব হিসাবই নাকি মিলে যাবে। কিন্তু ব্যাঙ্কের নিয়ম মতো আজই কাজের সময়ের মধ্যে ওই টাকা 'যেভাবেই হোক জমা করতে হবে' এবং 'এ ব্যপারে যদি কিছু করতে পারিস - খুব উপকার হয়',।সনির্বন্ধ অনুরোধ নীহারের। স্কুল জীবনে নীহার আর আমি ছিলাম, এক কথায়, হরিহরাত্মা। কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর বয়স্ক শিক্ষকরা আমাদের মজা করে কখনো ‘মানিকজোড়’ নামে অভিহিত করতেন। কারণ, নীহার আর আমি লেখাপড়ায় যেমন ছিলাম তুখোড় আবার দুজনেই কিছুটা বিন্দাস টাইপের। বন্ধুর এই আকস্মিক অসুবিধার সুরাহা করতে বেশ কিছু বাকী কাজ কাটছাঁট করতে হল। আমার কলকাতার ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে টাকা তুলে তড়িঘড়ি পৌঁছলাম নীহারের অফিসে। নীহার আর আমার বন্ধুত্ব এবং যুগলবন্দী ক্রিয়াকলাপের সূত্রপাত সেই স্কুল জীবনের গোড়া থেকে।এখন ভেবে অবাক হই কেমন করে ওই অল্প বয়সেই দুজনে মাঝে মাঝে ক্লাস কেটে বিভিন্ন সিনেমা হলে ঢুঁ মারতাম। আবার গড়ের মাঠে বড় ক্লাবের ফুটবল খেলা দেখায় আমাদের ছিল প্রভূত উৎসাহ। এছাড়া সেই সময়ের বিভিন্ন শীতকালীন জলসায় আমাদের যুগলমূর্তি প্রায়শই দৃশ্যমান হতো কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে। এসব নিয়ে দুই বাড়িতে কিছু উষ্মা থাকলেও আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফল বরাবর ভাল হওয়াতে বিশেষ অসুবিধায় কখনো পড়িনি। নীহারের ব্যাঙ্কে লাঞ্চের বিরতির পর পৌঁছে জানা গেল বন্ধুটি ম্যানেজারবাবুর চেম্বারে। নীহারের অপেক্ষায় আছি - এক ব্যাঙ্ক কর্মী হঠাৎ কিছুটা নিচুস্বরে শুধোলেন, ‘কোনো টাকা পয়সা দেনা পাওনার ব্যাপার আছে নাকি?’ কী উত্তর দেব ভাবতে ভাবতে বন্ধুটি হাজির। প্রায় সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় টাকাটা ওর হাতে দিয়ে আশ্বস্ত হলাম। সামান্য কিছু কথার পরেই ফিরে যেতে হল - কয়েকটা জরুরী দেখা সাক্ষাৎ,।যাত্রার প্রস্তুতি ইত্যাদির অনেকটাই বাকি। ব্যাঙ্ক থেকে বেরোব - দরজার কাছে দাঁড়ানো সিকিউরিটি কর্মীটি জানাল যে বাইরে তুমুল শিলা বৃষ্টি হচ্ছে। এতে কিছুটা শ্লথগতি হতে সে মৃদুকন্ঠে জানাল, ’নীহারবাবু তো বছরখানেক এর মধ্যে ‘ভি আর’ নিচ্ছেন’। হঠাৎ এ’কথার কী উদ্দেশ্য ভেবে পেলাম না। এর আগে ফোনে স্বেচ্ছাবসরের সব খবর নীহার তো নিজেই জানিয়েছে আমাকে। স্কুলের শেষদিকে নীহারের উপর পারিবারিক কিছু চাপ ছিল শুনেছি। সেকারণে ওর শেষ স্কুলপরীক্ষার ফলও আশানুরূপ হয়নি। এর জেরে সে পাস এ বিএসসি পাস করে। আমিও তার বছর দু এর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করি। কিছু পরে চাকরী নিয়ে বিদেশ যাত্রা। কলকাতা ছাড়ার আগে আমাদের মেলামেশা, আড্ডা ইত্যাদি যথারীতি বজায় ছিল। ওখানে যাওয়ার দু তিন বছর পর স্বাভাবিক নিয়মে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান ধীরে ধীরে কমতে থাকল। তবু বিভিন্ন সুখস্মৃতিতে বন্ধুটিকে ইচ্ছামতো খুঁজে নিতে দেরী হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতে খেয়ালই হয়নি কখন বৃষ্টি থেমে গেছে। অবিলম্বে রওনা হলাম - আজ বাকি কাজগুলো শিগগির সেরে ফেলতে হবে। এবার কর্মস্থলে ফিরে নানা কাজ সময়ে শেষ করার চাপে কয়েকটা মাস হু হু করে কেটে গেল। এর মধ্যে কলকাতার বাড়িতেও যোগাযোগ হয়েছে কম। নীহার অবশ্য এরই মধ্যে একবার ফোন করে জানিয়েছিল যে ঋণ শোধ করতে তার কিছু দেরী হবে - পুত্রের ভাল কলেজে ভর্তি করাতে ইতিমধ্যে ডোনেশন খাতে নাকি বেশ কিছুটা অর্থের প্রয়োজন হয়েছিল। এর মাস ছয়েক পর হঠাৎই কোম্পানির বিশেষ কাজে দেশে আসতে হল। আসার দিন কয়েক বাদে নীহারের অফিসে ঢুঁ মারলাম বিকেলের দিকে, যাতে সময় নিয়ে অফিসের পরেও দুটো কথা বলা যায়। বসার জায়গায় ওকে না পেয়ে অপেক্ষা করছি - কিছু পরে সেই পুরোনো সিকিউরিটি কর্মীটি এগিয়ে এসে আমাকে অবাক করে প্রশ্ন, 'নীহারবাবুকে খুঁজছেন বুঝি?’ কি বলা যায় ভাবছি - কর্মীটি আমার ভূমিকার অপেক্ষা না রেখে স্মিতমুখে জানালেন, 'আসলে গত কয়েক মাস থেকেই তো বেশ কয়েকজন নীহারবাবুর খোঁজ করছেন - তাই আরকি।’ অল্প কথায় আরো জানা গেল যে নীহার প্রায় মাস তিনেক হলো রিটায়ার করেছে। অবশ্য ‘বাকি কাগজ পত্র বুঝিয়ে জমা দিতে ব্যাঙ্কে ওনাকে আবার আসতে হবে'। পাশে দাঁড়ানো একজন সহকর্মী যেন আশ্বস্ত করলেন। এরপর কিছুটা ইতস্তত করে উনি শুধোলেন নীহারের থেকে আমার কোনো আর্থিক প্রাপ্তির ব্যাপার আছে কিনা এ সব শুনে সামান্য আহত হলাম। এই হঠাৎ অবসরের খবর তো নীহারের কাছ থেকেই
আমার পাওয়ার কথা। ওকে অবাক করে দেব ভেবে ব্যাঙ্কে এসে - নিজেই অবাক হয়ে ফিরব ভাবিনি। পরে অবশ্য নিজেই বুঝতে পারলাম - নীহার অস্বাভাবিক কিছু করেন। রিটায়ারমেন্টের সময়ে পরবর্তী অফিসারকে কাজ বুঝান এবং আরো নানা পেপার ওয়ার্কে ও হয়তো খুবই ব্যস্ত ছিল। আর জমা ছুটি কাজে লাগিয়ে কয়েক মাস আগে অবসর নেওয়াটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। পরে আমাকে ব্যাপারটা কখনো জানাতে চেয়ে হয়তো ফোনে পায়নি, বা নানা কাজে নাতিদীর্ঘ কথাবার্তায় জানা গেল বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের থেকে বেশ কিছু টাকা নানা সময়ে নীহার নিয়েছে।কখনো আত্মীয়ার চিকিৎসা, কখনো পুত্রের ভাল কলেজে ভর্তির ক্যাপিটেশন ফী হঠাৎ জমা করা বা কোথাও অন্য কোন প্রয়োজনে। অথচ শোধ করেনি প্রায় কোনখানেই। নীহারের এহেন হাল চাল নাকি ছোটবেলা থেকেই। তবু আমার মনে হলো কোথাও যেন ওকে আমরা ভুল বুঝে চলেছি। বহু বছর ধরে নীহার আমার ঘনিষ্ঠ। স্কুল বা কলেজ জীবনে আমাদের ছোট ছোট জমায়েত বা আড্ডাগুলো জমে উঠতো অনেকটাই নীহারের অকৃপণ আর্থিক বদান্যতায়। ওর সম্পর্কে এই অভিযোগগুলো তাই মানতে কষ্ট হচ্ছিল। ব্যাপারটা যে ভুলে ভরা তা যেন প্রমাণ করতে নীহারের উত্তমর্ণের লিস্ট থেকে আরো দু’একজন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা হলে প্রায় একই ধরণের খবর পেয়ে সেখানেই ক্ষান্ত হলাম। পরশু বেরোতে হবে কলকাতা ছেড়ে। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে আমার গিন্নী রমলার সাথে নীহারের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললাম। ওর প্রশংসা সহ নানা গল্প রমলাকে অবশ্য আগেও করেছি।গিন্নী সব শুনে বলল,
'ঠিক আছে। তোমার বন্ধুকে কাল বাড়িতে ডেকে নাও না। কথার মাঝে তোমার পাওনার ব্যাপারে একবার সোজাসুজি বলে দেখ। আমি তো যাব মাস খানেক বাদে -এর মধ্যে যে কোন একদিন আমার হাতে টাকাটা উনি দিয়ে গেলেই হবে। তাগাদা না দিলে কি টাকা আদায় হয়? আমি তোমার জায়গায় হলে কবে কড়ায় গন্ডায় টাকাটা আদায় করতাম,’ - এই সহজ সমাধানের পথনির্দেশ দীর্ঘায়ত হবার আগেই রমলাকে এক কাপ চায়ের অনুরোধে নিরস্ত করা গেল ।
পরেরদিন নানাকাজের ব্যস্ততায় বেলা এগারোটায় খেয়াল হল নীহারকে সকালের দিকে আসতে বলার ছিল। কি করব ভাবছি - কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে দেখি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে নীহার! বিশদ কিছু বলার আগেই ও স্মিতমুখে সোফায় বসে একটা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওর আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করল,'সমরের কাছে জানলাম তোর কলকাতায় আসার কথা। চলে যাবি নাকি কাল পরশু। শুনেই দৌড়ে এলাম নিজেরই একটা কাজে। ও অনুরোধ করল, ‘খামে আমার বায়োডাটা আছে। তোর যোগাযোগে কোথাও যদি কাজে লেগে যেতে পারি, উপকার হয়।ছেলে চাকরী পাওয়া পর্যন্ত একটা বাড়তি রোজগার খুব দরকার।' একথা শেষ হতেই রমলা আমার দিকে অপাঙ্গে তীব্র দৃষ্টি হেনে মিঠে গলায় বলল, 'তোমরা গল্প কর, আমি চা আনছি।’ 'নীহারদা, কতদিন পর আসলেন বলুনতো? আজ কিন্তু আপনাকে না খাইয়ে ছাড়ছি না', নিষ্ক্রান্ত হবার আগে রমলার সংযোজন। এদিকে আমরা দুই বন্ধু বহুদিন পর একসাথে - সময়টা আনন্দে উচ্ছ্বাসে যেন উড়তে লাগল। আমাদের স্কুল কলেজ জীবনের নানা স্মৃতি, মান অভিমান। সুখ-দুঃখ, এডভেঞ্চার, দুষ্টুমি সবই একের পর এক এমনভাবে দুজনের কথায় উঠে আসতে লাগলো মনে হচ্ছিল, সেগুলো যেন কাল পরশুর ঘটনা। সেই সেদিন পন্ডিতবাবুর ক্লাসে আমার মন্তব্য যে ‘…. বিষকুম্ভম পয়মুখম' শ্লোকটি মোটেই ঠিক ঠাক নয় কারণ এতে পয়োধি ও হলাহল মিশে কান্ড হয়ে যাবার কথা’ …… ফলত সারা ক্লাসে পাখির ডাক সহ উচ্চ হাস্যরোল এবং পন্ডিতবাবুর অতি প্রিয় পাঞ্জাবি চাবুক দ্বারা শাস্তি প্রদানের হুঙ্কার, .... আবার একদিন সিনেমা পাড়ায় মনমত হলে টিকেট না পেয়ে স্কুলে টিফিনের পরে থেকে ক্লাস শুরু করতে গিয়ে ধরা পড়তে পড়তে বাঁচা... ইত্যাদি হরেক খাট্টা মিঠা স্মৃতির সাগরে ভাসতে ভাসতে কখন যে খাদ্য খানা শেষ হয়ে গেল, কখন দুই বন্ধুর প্রাণখোলা হি হি হা হা হৈ চৈ শেষ না হতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল,ঠাহর হলনা।
বসার ঘরে চা দেবার ফাঁকে রমলা বললো,
’তোমাদের মানিকজোড় নামটি যে খাঁটি ছিল আজ তা বেশ বুঝলাম। নীহারদা, পরের বছর এইসময় আমাদের আসার কথা - আসবেন কিন্তু তখন'।
বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত নীহারকে এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। ঘরে ঢুকতেই গৃহকর্তী ঘ্যাঁক করে ধরল,
'অনেক কথাই তো হল - সারাটাদিন; তা, টাকা ফেরতের কথাটা বলা হয়েছে তো? ‘না:, বলিনি কিছু', নির্বিকার আমি। ‘তোমাদের বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপার - যা ভাল বোঝ করবে।’ , কিছুটা যেন আশাহত রমলা।
এর পর কেটে গেছে বহু বছর। এর মধ্যে দুই বন্ধুর যোগাযোগ বা দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে নানা সময়ে।কিন্তু ওই আর্থিক দেনা পাওনার ব্যাপারটা কেন যেন আমার উল্লেখ্য বলে মনে হয়নি কখনো।
গল্প
আলোয় ভরা
আকাশ
রত্না রায়
আজ সকাল থেকে মেজাজটা একেবারে খিঁচড়ে আছে সুভাষের। শালা বাড়িওয়ালা, ভাড়া নেবার সময় তো পাঁচ তারিখের একটু এদিক-ওদিক হলেই খিস্তিতে বাপের বিয়ের ভোজ খাইয়ে দেবে। অথচ বারোভাতারি উঠোনে একটা পায়খানা, একটা কলঘর। কলঘর তাও ঠিক আছে। রাস্তার কলের নিচে বসে পড়লে বা দরকারে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেলেই চলবে। কিন্তু পায়খানা! এ তো গ্রামঘর নয় যে পেট ডাকলেই বদনা হাতে ঝুলিয়ে মাঠে কম্মো সারো।
এমনিতে রাত থাকতে উঠে সুভাষ কাজ সেরে রাখে। খুব ভোর রাতে গাড়ি নিয়ে উঠে চলে যায়। এই সময়ে এয়ারপোর্টের ওদিকে অনেক প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায়। যত বেশি প্যাসেঞ্জার ততো বেশি ইনসেনটিভ। কিন্তু কাল সারারাত একটুও ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েই এই বিপত্তি।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক মুচড়ে উঠে আসে। মাধ্যমিক পাস করার পরে এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়েও আর পড়া হয়নি ওর। বাবার জুটমিলটায় হঠাৎ একদিন সকালে উঠে সবাই দেখলো তালা ঝুলছে। বন্ধ গেটের সামনেই দিনরাতের পালা করে ধর্নায় বসে গেল বাবা আর বেশ কয়েকজন। তারপর সেই যেদিন স্বাধীনতা দিবস। স্কুল কলেজ সব ছুটি। চারদিকে মাইকে শুধু ভেসে আসছিলো দেশের গান। সুভাষ কোথায় একটা যাবে বলে জামা পরছিলো ঘরের ভেতর। বাইরে হারুণ চাচার গলার শব্দ। সুভাষের নাম ধরেই হাঁক পাড়ছিলো হারুণ চাচা। ছুটে এসেছে বাড়িতে খবরটা দিতে। জুটমিলের গেটের সামনে বোমা পড়েছে। দু'জন সাথে সাথেই মারা গেছে। বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মা বাবাকে দেখতে যাওয়ার জন্য সুভাষকে একটা হাঁক মেরে বাড়ি থেকে ছুটে বেরতে গিয়ে চৌকাঠ আটকে মুখ থুবড়ে সেই যে পড়লো আর উঠতে পারলো না। দু'মাস পরে বাবা একটা পা হাসপাতালে গচ্ছিত রেখে ফিরে এলো।
সুভাষের তখন দিশেহারা অবস্থা। নিজের স্বপ্নকে শিকেয় টাঙিয়ে রেখে রোজগারের ধান্ধায় টঙটঙ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধুমাত্র এই দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য কিছু টাকার ভীষণ প্রয়োজন। চারদিকে অভাবের একশোটা হাঁ মুখ। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে ঝুলে পড়ে সব জ্বালা জুড়িয়ে দিই। কিন্তু এই অসহায় মুখগুলোর দিকে চেয়ে পারে নি। তারপর আস্তে আস্তে সবকিছু সামলে নিলো। দীপকদা আর বন্ধুরা না থাকলে হয়তো ভেসেই যেতো। দীপকদাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ড্রাইভিং স্কুলে। লাইসেন্স নিয়ে দীপকদার একটা গাড়িই ও প্রথম চালাতো। তারপর লোন নিয়ে নিজের গাড়ি। সেটাও প্রায় শেষ করে এনেছে। ছেলেটা অসুস্থ না হলে এতোদিন শোধ হয়ে যেতো। ছোট বোনটার পড়াশোনায় মাথা আছে। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এবারে বারো ক্লাস পাস দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কয়েকটা টিউশন জুটিয়ে নিজের খরচটা নিজেই চালিয়ে নেয়। বউটারও পেটে একবছর কলেজের জল পরেছিলো। কিন্তু রুগ্ন ছেলেকে ছেড়ে কিছু বিশেষ করতে পারে না আর। বাড়িতে বসেই কিছু সেলাইফোঁড়াই করে শতচ্ছিন্ন কাপড়ে তাপ্পি দেবার চেষ্টা একটা চালিয়ে যায়, এই আর কি.,..
মাথাটা ঝাঁকিয়ে সুভাষ চেষ্টা করলো চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলতে। মাথাটা ভার থাকলে গাড়ী চালাতে অসুবিধা হবে। এমনিতেই রাতে ঘুম হয়নি ঠিক করে। চোখটা কড়কড় করছে।
- "এই নাও ছাতুর শরবত।" বেলা অন্যদিনের মতো বড়ো গ্লাসে করে শরবত নিয়ে আসে।
- "এই সিগন্যালে আটকে যাওয়া পেটে আবার শরবত!"
- "তা কি করবে, সারাদিন পেটে আর দানাপানি পড়বে না।
- "শোনো, ছেলেটাকে এভাবে বাড়িতে ফেলে রাখা আর ঠিক হচ্ছেনা। রক্ত পাল্টানোর সময় হয়ে গেছে। এবারে হসপিটালে নিতেই হবে।"
- "হুম, দেখছি কি করা যায়।"
- "কি করা যায় না, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আজই খবর নেবে তুমি। কাল সারারাত কী কষ্টটা...."
- "আহ্ বলছি তো দেখছি। কাজে বেরোনোর সময়ে এখন ভ্যানভ্যান করিস না।"
- "আমি ভ্যানভ্যান করছি! ছেলেটার কষ্টটা চোখে দেখেও একথা বলতে পারলে তুমি!"
উফ্ কাজে বেরনোর সময় এসব চেল্লামেল্লি ভালো লাগে না। একটা কথা থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটে। এ ক্যাঁচক্যঁচানি এখন চলতেই থাকবে। যেন সুভাষ জানে না কি করতে হবে। সুভাষের বলে সংসারের সাতআনি তিন আনির হিসেব কষতে কষতে পেছনের সূতো খুলে আসছে। আর উনি এলেন সক্কাল সক্কাল ঝামেলাবাজি করতে। সুভাষ আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির চাবিটা পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে আসে।
- "কি ব্যাপার সুভাষ দা আজ এত দেরি?" গ্যারেজের লালটু দাঁত কেলিয়ে এগিয়ে আসে।
- "আর বলিস না। কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। দমের কষ্টে ছেলেটা হাঁসফাঁস করেছে। অথচ হসপিটালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়ে যেতেও ভয় লাগছে। এক করতে না আর এক হয়ে যায়।"
- "নার্সিংহোমে করিয়ে নাও।"
- "আরে হসপিটালে যেটা সাতশো টাকায় হবে। নার্সিংহোমে সেটা ষাট হাজারেরও হবে না। অত টাকা পাবো কোথায়? এদিকে বাপটাও চোখে দেখতে পাচ্ছে না। অপারেশন করাতে হবে..."
- "হেলথ ক্যাম্পগুলো তে একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। ওখানে তো বিনাপয়সায় হয় এসব।"
- "হুম। ওখানেই করাবো। এই অসুখের চক্করে সব ঘেঁটে গেলো।"
- "তোমার বোনের বিয়ের কি হলো গো? সেই যে দেখতে এসেছিল বলছিলে......"
- "বললো তো পছন্দ হয়েছে। কিন্তু খাঁই বড় বেশি। হাতে কানে গলায়, খাট বিছানা, পঞ্চাশ হাজার টাকা। মাইরি, পরের পয়সায় পেলে কব্জি ডুবিয়ে সব একেবারে লবরচবর করে খাবে।"
সুভাষের মোবাইলটা শব্দ করে ওঠে।
- "চলি রে, শ্যামের বাঁশি বেজে উঠেছে।"
- "ভালো বলেছো শ্যামের বাঁশি। তা কোথাকার শ্যাম?"
- "শ্যাম তো দশ মিনিট দূরে কিন্তু যমুনা শালিমার। কপালে দুর্ভোগ আছে। আগে জ্যাম তার ওপরে ফিরতি পথে প্যাসেঞ্জার পাওয়া মুশকিল। বউনি ছেড়ে দিতেও পারবো না।" রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে সুভাষ গাড়ি স্টার্ট করে।
- "দাদা, ডিকিটা একটু খুলবেন।"
- "কুকুর নিয়ে উঠবেন নাকি?"
- "একে কোথায় রেখে আসবো বলুন!"
- "আগে বলবেন তো?"
- "কাকে বলবো বলুন? বুক করার সময় তো এইরকম কোনো রুলস নেই কুকুর নিয়ে ওঠা যাবে না।"
- "আহ্ টুলটুল, ও তো বকছিস কেন? কুকুরটা পোষা ভাই। কিছু করবে না।"
- "কিছু না করলেই ভালো।"
ভৌ, ভৌ,ভৌ
- "ছিঁচোরা, ছিঁচোরা"
- "কি হলো গালাগালি দিচ্ছেন কেন!"
- "গালাগালি! আপনাকে! আপনাকে কিছু বলিনি আমি!"
- "এই তো বললেন ছিঁচোরা!"
- "এতো এটার নাম।"
সুভাষ আকাশ থেকে পরে। মনে মনে বলে কুকুরের নাম ছিঁচোরা! আজীব পাবলিক মাইরি। ততক্ষণে মেয়েটা কুকুরটাকে সামলাতে হিমসিম। সে কিছুতেই কোলে চুপ করে বসে না।
- "কি হলো! কি হলো সোনা, এইতো আর একটু পরেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাবো।"
- "তোর ফোনটা বাজছে। ধরবি তো। দ্যাখ তোর মা হয়তো ফোন করছে।"
- "হুঁ, মা,ই। এছাড়া আর এমন বেটাইমে কে ফোন করবে।"
- "বকবক না করে ফোনটাকে তোল। বেরিয়েই ফোন করতে বলেছিল। তোর ছিঁচোরার জ্বালায় সব ভুলে গেছি"
- "উফ্ আর পারি না, এই সর্বক্ষণ মনিটারিংএর জ্বালায়। তা তোমাকে না করে আমাকে কেন!"
ভদ্রলোকের কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ফিঁক করে হেসে ফেলে।
- "আবার কথা বন্ধ! মান করেছে মানিনি! পারোও বটে বাপি তোমরা। সারাক্ষণ টম আর জেরির মতো লড়ে যাচ্ছো। আমি চলে গেলে তোমাদের দুটির যে কি অবস্থা হবে! ভেবে ভেবেই আমার চার কেজি ওয়েট কমে গেছে।"
- "থাক, ফক্কোরিগুলো পরে করিস। তোর মায়ের আবার পারা চড়ছে। সামনে বিরাট কাজ। এখন তেনার পেসার বেড়ে গেলে আমি মুশকিলে পরে যাবো।"
- "হ্যাঁ,মা বলো? আরে ফোন তো ব্যাগে ছিলো। শুনতে পেলে ধরবো না কেন বলতো! হ্যাঁ, হ্যাঁ, চা বিস্কুট খেয়ে নিয়েছি আমরা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবাও খেয়েছে। আরে বাবা, জানি তো, বাবাকে ওষুধ খেতে হবে। খালি পেটে থাকলে চলবে না। হ্যাঁ, হ্যাঁ ট্রেনে কিছু কিনে খেয়ে নেবো। অত সকালে কি টিফিন করবো আমি! ও বাইরের খাবারই খেতে হবে কিছু করার নেই। অত পিটপিট করলে তুমি নিজে এলে না কেন বাবার সাথে! নাও তুমি বাবার সাথে কথা বলো। কি বলবে না! বেশ রাখো ফোন.... রাখো এবারে। হ্যাঁ রে বাবা সাড়ে এগারোটাতেই পৌঁছে যাচ্ছি। হ্যাঁ, আরণ্যকে। তোমাকে ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি টিকিট। তোমার প্রশ্নবাণ শেষ হওয়ার নয়। আমি রাখছি এখন। বাকি সেবা, যত্ন, কথা সব পৌঁছে হবে। ছিঁচোরাটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে।"
মেয়েটা ফোনটা কট করে কেটে দেয়।
- "উফ্ অসহ্য। তোমাদের খুড়ে খুড়ে প্রণাম বাপি। এদিকে প্রেম একেবারে উথলে উঠছে ওদিকে ঝগড়া করতেও ছাড়বে না।"
ততক্ষণে মেয়েটার অন্যমনস্কতার সুযোগে কুকুরটা মেয়েটার হ্যান্ডব্যাগটা খেলনা ভেবে কামড়ে ধরে তাকে খোলার কসরতে মত্ত
- "তোর ব্যাগটার বারোটা বাজাবে। দে ওটাকে ওপরে তুলে রাখি।"
ভৌ,ভৌ,ভৌ.....
- "আরে, কি হয়েছে বেবি। ব্যাগটা দেবে না! দিয়ে দাও, দিয়ে দাও। তুমি তো আমার লক্ষ্মী সোনা।"
অনেক কষ্টে কুকুরের মুখ থেকে ব্যাগটাকে নিয়ে। পিছনে রেখে দেয় মেয়েটা।
- "বাপি,ভাবছি ছিঁচোরাকে সাথে নিয়ে নির্বাণদের বাড়ি যাবো।"
- "মাথা খারাপ নাকি! তোর শ্বাশুড়ি তাহলে হার্টফেল করবেন। দেখছিলি না, ছিঁচোরা বাঁধা ছিলো। তাও কেমন সিঁটিয়ে বসেছিলেন ভদ্রমহিলা।"
- "হি হি হি হি"।
- "কি রে পাগলের মতো হাসছিস কেনো অকারণে!"
- "আন্টি তো আসতেই চায়নি আমাদের বাড়ি। নেহাতই আদরের ছেলে বায়না ধরেছিল তাই। এমনিতেও আন্টির আমাকে খুব একটা পছন্দ নয়। স্কুলমাস্টারের মেয়ে।"
- "নে বাদ দে, স্টেশন এসে গেছে। তুই ছিঁচোরাকে সামলা। আমি জিনিসগুলো নামাই। আর বেশি সময় নেই। পনেরো মিনিট আছে ট্রেন আসতে।"
- "হ্যাঁ ভাই এই নাও ভাড়াটা। আর ডিকিটা একটু খুলে দাও।"
প্যাসেঞ্জার নামিয়ে সুভাষ একটা বিড়ি ধরায়। উফ্! আচ্ছা ঝঞ্ঝাটিয়া প্যাসেঞ্জার ছিল মাইরি। কুকুর আর তার মনিবানী। পুরো মাথা ধরিয়ে দিলো। যে বাড়িতে যাবে একেবারে হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দেবে।
- "আজও তোমার ফিরতে রাত হয়ে গেলো সুভাষদা। সব গাড়ি গ্যারাজ হয়ে যায় শুধু তোমার জন্য জেগে থাকতে হয়। আজ আবার মানুমাসির চায়ের দোকানের পিছনে গিয়েছিলে নাকি!" লাল্টুর মুখে একরাশ বিরক্তি।
- "না রে বাবা। গরীব মানুষের ওসব টনিক রেগুলার চলে না। ও এক আধদিনই ঠিক আছে। আজ পোচুর খাটনি গেছে। সারা কলকাতা চষে ফেলেছি।"
- "তা ভালো তো,যত প্যাসেঞ্জার, ততো লক্ষ্মী লাভ।"
- "হুঁ" কথা বাড়ায় না আর সুভাষ। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পরছে। এখন বিছানায় বডি ফেলতে পারলে বাঁচে। একঘুমে একেবারে রাত কাবার। গাড়ি লক করে পেছনে ফিরতেই লাল্টুর গলা।
- "বউদির জন্য ব্যাগটা কিনলে নাকি সুভাষদা? লাল্টু গাড়ির পিছনটার দিকে চেয়ে বলে ওঠে।
- "কোন ব্যাগ!"
- "ওই যে সিটের পিছনে উঁচু হয়ে আছে। বেশ সুন্দর দেখতে কিন্তু।"
লাল্টুর লোভে চকচকে দৃষ্টিকে অনুসরণ করে গাড়ির ভিতরে তাকিয়ে ব্যাগটা নজরে পরে সুভাষের। আরে এটা তো ওই কুকুরওয়ালির ব্যাগ। গাড়িতে ওঠবার সময় কুকুর সামলাতে গিয়ে এই ব্যাগের খোঁচা মেরেছিল মেয়েটা। একবার সরিও বলেনি। এ আর এক ঝঞ্ঝাট হলো। ও মেয়েকে দেখেই মনে হয়েছিল ঝঞ্ঝাটিয়া। লাল্টুকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। এ ব্যাটা ভীষণ লোভী।
- "হ্যাঁ রে তোর বউদির জন্য কিনলাম।"
- "বউদির জন্য! কিনলে! নাকি মোটা দাঁও দেখে আমাকে সিন থেকে কাটিয়ে দিতে চাইছো দাদা?আরে, আমি কাউকে কিছু বলবো না, দুজনে ভাগাভাগি করে নি এসো?"
- "মেলা ফ্যাচফ্যাচ করিস না তো। যা ঘুমুগে যা।" সুভাষ গাড়ির মধ্যে মুন্ডু ঢুকিয়ে ব্যাগটা বার করে এনে গলায় ঝুলিয়ে নিলো
- "নে শাটার নামিয়ে দে।" কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে সুভাষ বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়। পিছনে তখন লাল্টু পিচ করে একদলা থুতু মাটিতে ফেলে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
- "শাল্লা, চারশো বিশ, ভাবটা যেন যুধিষ্ঠিরের ঠাকুরদা। আমি দেখালাম আর উনি পুরো মালটা হজম করবেন।"
- "বাবলু কেমন আছে?"
- "ভালো আছে। খেয়ে, ঘুমিয়েছে। হসপিটালে ভর্তির কিছু করলে?"
- "হুম, দীপকদার সাথে কথা বললাম। পরের মাসে পাঁচ তারিখের ডেট ফেলেছে।"
- "পাঁ..চ তারিখ! সে তো অনেক দেরি। তুমি বরঞ্চ কোনো নার্সিংহোমে চেষ্টা করো।"
- "হুম, দেখছি। এখন খেতে দে। আমি দুমগ জল ঢেলে আসছি। যা গরম আজকে।"
সুভাষ গলা থেকে ব্যাগটা খুলে আলনায় ঝুলিয়ে দেয়।
- "এটা কার ব্যাগ?"বেলার চোখ পরে ব্যাগটার ওপর।
- "ও এক প্যাসেঞ্জারের। কাল কাজে বেড়ানোর সময় থানায় জমা দিয়ে যাবো।"
- "যতো অশান্তি কি তোমার কপালেই জোটে...."
সুভাষ চান করে জামা-কাপড় তারে মেলে দিয়ে ঘরে এসে দ্যাখে, বেলা ব্যাগটার সামনে আর বেলার সামনে একটা স্টিলের টিফিন বাক্সের মধ্যে ঝকঝক করছে একরাশ গয়না।
- "ব্যাগটায় হাত দিয়েছিস কেন তুই?"
- "না দিলে কি করে জানতাম কি আছে ভেতরে।"
- "জানবারই বা কি দরকার?"
- "থানায় যখন জিজ্ঞেস করবে কি বলবে? গতবারের সুটকেসটা জমা দিতে কতো ঝামেলা হয়েছিল মনে নেই! দেখছো কতো গয়না! বেশ কয়েক লক্ষ টাকার হবে।"
- "না, না, ওসব ইমিটেশন।"
- "ইমিটেশন! তুমি আমাকে সোনা আর ইমিটেশন চিনিও না। "
- "হ্যাঁ হ্যাঁ সোনা দেখে দেখেই তো বড়ো হলি।"
- "সোনা না দেখি ইমিটেশন দেখে বড়ো হয়েছি।"
- "এই রাতদুপুরে আর প্যাঁচাল পারিস না। যেমন ছিল তেমন রেখে দে। "
- "শোনো, থানায় যাওয়ার দরকার নেই। একটা দুটো খুশির জন্য রেখে বাকিগুলো শম্ভু স্যাকরার কাছে বিক্রি করে দাও।"
- "কী! কী বল্লি!;ছোটলোকি মন যতো। খবরদার আর একবারও দুঠোঁট ফাঁক করেছিস তো।" সুভাষ হিতাহিত জ্ঞান ভুলে চিৎকার করে ওঠে।
- "হ্যাঁ, আমার তো ছোট মন। ছেলেটা যে পয়সার অভাবে শুষে শুষে মরে যাচ্ছে। আমি কি নিজের জন্য বলেছি। তোমার বোন, তোমার ছেলে।" বেলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।
- "আমার কত্তোব্বো আমি বুঝে নেবো। কিন্তু পরের ধনে পোদ্দারি এই শর্মা কখনো করেনা। পুরো মেজাজটাই চটকে দিলো। খাবার ইচ্ছেটাই চলে গেল। ধ্যুততেরিকা সংসারের ইয়েতে আমি....," রাগে গজগজ করতে করতে সুভাষ গয়নাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে মাথার কাছে ব্যাগটা নিয়ে শুয়ে পরে। টের পায় বেলা একবার রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে ছেলেকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে চৌকিতে শুয়ে পড়লো। আজ দুজনেরই হরিমটর। কাল ভোরেই ব্যাগটার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজ্যের চিন্তা মাথায় চেপে বসে। আচ্ছা গয়নাগুলোর জন্য বিয়েটা আবার ভেঙে যাবে না তো? থানার ওই পুলিশগুলোকে তো একদমই বিশ্বাস নেই। আসল মানুষ কবে জিনিসগুলো ফেরত পাবে তার ঠিক নেই? নাকি পুরোটাই গায়েব হয়ে যাবে। না, ওকেই কিছু করতে হবে। দেখি ব্যাগটায় কিছু হদিস পাই কিনা।
ধরফড়িয়ে উঠে লাইটটা জ্বালিয়ে ব্যাগটা খুলে বসতেই চৌকির ওপর থেকে বেলা বলে ওঠে।
- "ও তে বিয়ের কার্ড আছে। দ্যাখো তাতে হয়তো ঠিকানাটা পাবে। ফোন নাম্বারও পেতে পারো।"
- "তুই ঘুমাস নি!"
- "না, ঘরে পরের এতোগুলো টাকার জিনিস। ঘুম আসে কখনও। আর তোমাকে তো আজ দেখছি না। সেই যখন শরীরটা শেয়াল কুকুর খাওয়ার পর নিজের লোকেরাও দূর দূর করেছিল আমাকে। মরবো বলে বেড়িয়ে তোমার গাড়ির সামনে এসে পড়ি। আর তুমি আগুপিছু না ভেবে সবার সামনে দিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছিলে। মাথার ওপর ছাদ দিয়েছিলে, সম্মান দিয়েছিলে। এমনকি এই যে বাবলু এও হয়তো তোমার ছেলে.......,"
সুভাষ তাড়াতাড়ি এসে বউএর মুখে হাত চাপা দেয়।
- "একথা আজ বললি,বললি, আর কখনও যেন না শুনি। তুই তো আমার লক্ষ্মী বউ। তুই, বাবলু তোরাই তো আমার শক্তি। চিন্তা করিস না। সবঠিক হয়ে যাবে।"
- "তুমি আমার পাশে থাকলে আমার আর কিচ্ছু চাই না গো। আসলে ছেলেটার অবস্থা দেখে মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।"
- "বুঝি রে বুঝি, সব বুঝি আমি।"
- "একটা কাজ করো বরঞ্চ, কার্ড থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে একটা ফোন করে জানাও জিনিসগুলো নিয়ে তুমি যাচ্ছো।"
- "না না, জানানো যাবে না। একেবারে বরণডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সব তাহলে। এখন বরণডালায় ফুলের মালা, না, লাঠিসোটা কি থাকবে বলা মুশকিল।"
- "হিহি.., মাথায় আসেও বটে।
- "শোনো, ভাতটাতে জল ঢেলে রেখেছি। একটু আলুসেদ্ধ মেখে দেবো। কাল লেবু দিয়ে মেখে খেয়ে বেরিও। পেটটা ঠান্ডা থাকবে নাও আর মাদুরে শুতে হবে না। চৌকিতেই গড়িয়ে নাও।"
সুভাষ বউকে জড়িয়ে ধরে চৌকিতে উঠে আসে।
- "রোকখে, রোকখে, এই তো শীতলামন্দির, তার পাশে পুকুর। হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাই, এই বাড়িটা মনে হচ্ছে। ম্যারাপ করা বিয়েবাডি। তুমি একটু অপেক্ষা করো ভাই। আমি এক্ষুণি ফিরে আসছি।"
একটা ছেলেকে বাড়ির থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে আসতে দেখে, কাঁধের ব্যাগটা বুকের কাছে চেপে সুভাষ এগিয়ে যায়।
- "আচ্ছা,এটা মনোহর পালিতের বাড়ি?"
- "হ্যাঁ,"
- "ওনার সাথে একটু দেখা করা যাবে? ভীষণ প্রয়োজন।"
- "কাকু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর সবাই বিয়ে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আপনি আমাকে বলতে পারেন।"
- "না, ওনাকেই দরকার। বিয়ে সংক্রান্ত।"
- "ঠিক আছে, আমি দেখছি। আপনার নামটা কি বলবো.."
- "নাম বললে তো চিনবে না ভাই। বলো গয়না সংক্রান্ত ব্যাপারে একজন কথা বলতে চায়।"
ছেলেটা ভুত দেখার মতো চমকে উঠে তীরবেগে ভিতরে দৌড়ে গেলো। দুমিনিটের মধ্যেই বিধ্বস্ত একজন লোক আর তার পিছনে আধা বিয়েবাড়ির লোক এসে হাজির। আর সবার সামনে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছিঁচোড়া। সুভাষ মনে মনে বলে ওঠে যাক বাবা ঠিক জায়গায় এসেছি।
- "একটু ভিতরে যাওয়া যাবে?"
- "হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। ঘরে তে...."
- "না, না, ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। উঠোনে দাঁড়িয়েই হয়ে যাবে।"
সুভাষ হাতের ঝোলা থেকে মেয়েটার ব্যাগটা বার করে ভদ্রলোকের হাতে তুলে দেয়।
"এই নিন আপনাদের জিনিস। ঠিকানা খোঁজার জন্য জিনিসগুলোতে হাত দিতে হয়েছিল। মিলিয়ে নিন সব ঠিক আছে কিনা। আমি অপেক্ষা করছি।"
ভদ্রলোক ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ভিড়ের কিছুটা গেল। কিছুটা ওকে নজরে রাখার জন্য বাইরে থাকলো।
দশ মিনিট পরে ভদ্রলোক বেরিয়ে আসে। সাথে কালকের সেই মেয়েটা।
- "প্রণাম কর, দাদাকে প্রণাম কর।"
- "না না। থাক থাক। আমি বোনকে এমনিই আশীর্বাদ করছি। খালি একটু খেয়াল করো বোন। দামি জিনিস। তবে সব দোষ আপনাদের এই ছিঁচোড়ার।" সুভাষ হেসে ওঠে।
মেয়েটাও ছিঁচোড়াকে কোলে তুলে নেয়।
- "হ্যাঁ ভীষণ দুষ্টু।"
- "যাক গে, আজ চলি, রিক্সা দাঁড় করিয়ে এসেছি।"
- "সেকি যাবেন কি? একটু কিছু মুখে দিয়ে যান। না হলে অমঙ্গল হবে। আর কাল বোনের বিয়েতে অতি অবশ্যই আসবেন।"
- "বলছেন যখন অমঙ্গল হবে, একটা মিষ্টি আনুন। তবে কাল আসতে পারবো না। কাল আমার মা আমাকে ছেড়ে একেবারে চলে গিয়েছিল। এই দিনটা আমি বারুইপুরে অনেক মায়ের সাথে কাটাই। এক বৃদ্ধাশ্রম। আমার পথ চেয়ে ওরা থাকেন। আমিও আমার মাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে পাই। এই দিনটা কিছুতেই হবে না । কিছু মনে করবেন না। পরে আসবো আর একদিন।"
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক হঠাৎ এগিয়ে এসে একটা খাম সুভাষের হাতে গুঁজে দিতে যায়।
- "এটা আপনি রাখুন।"
- "কি এটা! টাকা! এটা বরঞ্চ এই বোনটাকে দাদার তরফে বিয়ের উপহার। আচ্ছা আজ চলি। অনেকটা রাস্তা আবার যেতে হবে।" সুভাষ এগিয়ে চলে আলোয় ভরা আকাশের মাঝে।
প্রবন্ধ
চীনদেশে আর্তের সেবায়
এক ভারতীয় ডাক্তার
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী, পঃ বঙ্গ
দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিস ভারত ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের প্রতীক হিসাবে দুই দেশের মানুষের কাছেই সমান সম্মানীয় ও দৃষ্টান্তস্বরূপ। বর্তমানে গালোয়ান উপত্যকা ও অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে দুই দেশের উত্তেজনার আবহে ডাঃ কোটনিসের মানবতাবাদী ভূমিকা ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ একযোগে স্মরণ করার সময় এসেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই চিকিৎসকের মানবিক মুখ সারা পৃথিবীর কাছে শান্তির বার্তা এনে দিয়েছিল। বিদেশ ভূমিতে অচেনা জায়গায় সেবাপরায়নতার এই উদাহরণ যে বিরল ঘটনা তাতে কোন সন্দেহ নেই।
দ্বারকানাথ কোটনিস মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শান্তারাম কোটনিস তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যাকে সাধ্যমত চেষ্টায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন । ১৯৩৮ সালে কোটনিস বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেঠ গোবর্ধন দাস সুন্দরদাস মেডিক্যাল কলেজ থেকে মেডিসিন বিভাগে স্নাতক হন। তিনি যখন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অধ্যয়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই বছরেই ১৯৩৮ সালে জাপান চীন আক্রমণ করে। চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন খুব সংকটে।
আক্রান্ত হওয়ার পর চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মাও জে দং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাছে সাহায্য চান। পাশাপাশি কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল জু দে জওহরলাল নেহেরুকে অনুরোধ করেন কয়েকজন চিকিৎসককে চীনে পাঠাতে। মাও জে দং সাহায্যের আর্তি নিয়ে বলেছিলেন - “ ভারতীয় জনগণ ও চীনাবাসীদের স্বাধীনতাযুদ্ধ পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত ও পদদলিত মানুষের স্বাধীনতা হিসাবে চিহ্নিত থাকবে”। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ জুন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু সর্বস্তরের ভারতবাসীর কাছে চীনের আর্ত ও পীড়িত জনগণের সেবার জন্য সাহায্যের আবেদন করেন। সুভাষ বসু সেবারই জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। চীন আক্রমণ নিয়ে তিনি মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় দূর প্রাচ্যে জাপানের ভূমিকা বিষয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন চীনের সেই সময়কার পরিস্থিতি। সেই কারণে তিনি দেশবাসীর কাছে চীনের পাশে থাকার আবেদন জানান।
কোটনিস সুভাষ বোসের আহ্বানে সাড়া দিতে বিলম্ব করেন নি। তিনি ছাত্রাবস্থায় পিতার কাছ থেকে দেশপ্রেম ও মানব সেবার ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই পিতার কাছে অনুমতি চাইলেন চীনে যাওয়ার জন্য। ছাত্রাবস্থা থেকে থেকে কোটনিসের স্বপ্ন ছিল ছিল ডাক্তার হয়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সেবা করবেন। চীন সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞান সত্ত্বেও ডাঃ কোটনিস দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন ঐ যুদ্ধবিধস্ত দেশে আর্তের সেবায় আত্মনিয়োগের জন্য। সুভাষচন্দ্রের ডাকে সাড়া দিয়ে এলাহাবাদ থেকে মদনমোহন অটল, নাগপুর থেকে এম চোলকর, কোলকাতা থেকে দেবেশ মুখোপাধ্যায় ও বিজয়কুমার বসু এবং শোলাপুর থেকে কোটনিস চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী মেডিকেল টিমে যোগদান করেন। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পরিজন ও দেশবাসীর উষ্ণ বিদায় দানের মধ্যে দিয়ে এই চিকিৎসকের দল চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কোটনিসের ছোটবোন মনোরমা দেবী পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – “ঐ সময় দ্বারকানাথ বা আমাদের পরিবারের চীনদেশ সম্বন্ধে কোন ধারনাই ছিল না। শুধু জানতাম চীন থেকে ব্যবসায়ীরা রেশম বস্ত্র বিক্রির জন্য এই দেশে আসে“।
চীনের উহান শহরে হানকো বন্দরে এই পাঁচ জনের দল পদার্পণ করলে তাঁদের সকলকে ইয়েনাণে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অভ্যর্থনা জানাতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন মাও জে দং, জু দে ও কম্যুউনিস্ট পার্টির অন্যান্য শীর্ষ নেতারা। এই দলটিই ছিল প্রথম কোন বিদেশী ‘মেডিকাল টিম’ যারা চীনাবাসীদের সেবায় স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিল। চীনে যাওয়ার পরেই কোটনিস তাঁর পিতার মৃত্যুর সংবাদ পান, কিন্তু সেবার ব্রত পরিত্যাগ করে তিনি দেশে ফিরে আসেননি। চীনের উত্তারংশে আহত সৈন্যদের সেবায় কাজ করার পর ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি উটাই পর্বতের কাছে জিন-চা-জি সীমান্তে মাও দে জং-এর নেতৃত্বে থাকা অষ্টম রুট বাহিনীতে যোগদান করেন। ভারতীয় এই পাঁচজন চিকিৎসক বিদেশে তাঁদের এই সেবাধর্মকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন। ভ্রম্যমান চিকিৎসালয় নিয়ে অত্যন্ত জীবনের ঝুঁকি হাতে করে তাঁরা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। যুদ্ধ চলাকালীন অসম্ভব প্রতিকূল পরিবেশে এই চিকিৎসকরা গড়ে প্রায় ৮০০ জন আহত সৈন্যের চিকিৎসা করতেন। কোটনিস কোন কোন দিন টানা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে আহত সৈন্যদের জরুরীভাবে শুশ্রূষা করতেন। প্রতিদিন তিনি অত্যন্ত মানসিক চাপ নিয়ে কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এইসময় কিছুদিন তিনি জিন-চা-জি সৈন্য বিভাগের ডাঃ বেথুন স্বাস্থ্যবিধি বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক
ভাষণের দায়িত্ব পান। পরে তাঁকে ইয়েনানের ডাঃ বেথুন আন্তর্জাতিক শান্তি হাসপাতালে প্রথম অধিকর্তার দায়িত্ব আরোপ করা হয়। অবশেষে যুদ্ধের অবসানে পাঁচজনের এই দলের বাকি চারজনই দেশে ফিরে আসেন একমাত্র ডাঃ কোটনিস বাদে। তিনি চীন দেশের মানুষের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বাকি জীবনটা চীনেই কাটিয়ে দেবেন। শোলাপুরে তাঁর পরিবারের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে ছত্রে ছত্রে থাকত এই দেশটার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের কথা। মনোরমাদেবী একবার ভাইয়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেছিলেন – “তাঁর চিঠিতে বোঝা যেত চীনাবাসীদের হৃদয়ে তিনি কতখানি স্থান করে নিয়েছিলেন। কতখানি জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর”। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এই তরুণ চিকিৎসককে চীনাবাসীরা আদর করে নাম দিয়েছিলেন কেদিয়াহুয়া দাই ফু (কেদিয়াহুয়া চীনা ভাষায় নাম এবং দাইফু ঐ ভাষায় অর্থ ডাক্তার)।
কোটনিস চীনা ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। তিনি ঐ ভাষায় সুন্দর গান করতে পারতেন। তাঁর এই গুণের জন্য ডাঃ বেথুন শান্তি হাসপাতালের সেবিকা গোঁড়া খ্রীস্টান পরিবারে বেড়ে ওঠা ২৩ বছরের গুয়ো কুইংলান কোটনিসের প্রেমে পড়ে যান। পরবর্তীকালে কুইংলান এক সাক্ষাৎকারে কোটনিসের প্রসঙ্গে বলেছিলেন – “কোটনিস ছিলেন অসম্ভব প্রাণবন্ত, সুদর্শন এবং চীনা ভাষায় সুন্দর গান করতেন। ………. চীনা জোক শুনিয়ে সকলকে হাসাতেন“। প্রথম দর্শনেই কোটনিসের ছেঁড়া সামরিক জ্যাকেট দেখে কুইংলান একটি সোয়েটার তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসে দুজনে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দের ২৩ আগস্ট তাঁদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। বিখ্যাত কমিউনিস্ট শাসক রংঝেনের উপদেশ মত ভারতের চীনা প্রতিশব্দ “ইন” ও চীনের প্রতিশব্দ “হুয়া” মিলিয়ে সন্তানের নাম হয় ইনহুয়া।
কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য জীবন বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। প্রতিকূল যুদ্ধকালীন পরিবেশে অক্লান্ত পরিশ্রমের দরুন কোটনিসের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ইনহুয়ার জন্মের মাত্র তিন মাস পরেই এপিলেটিক সিজার রোগে আক্রান্ত হন। পরপর একটানা খিঁচুনির প্রভাবে ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৩২ বছর বয়সে কোটনিসের মৃত্যু হয়। চীনের নানকুয়ান গ্রামে তাঁকে বীরের মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সারা চীন সেদিন শোক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রখ্যাত চীনা নেতা মাদাম-সান-ইয়েত-সেন ডাঃ কোটনিসের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে সম্মান জানিয়ে বলেছিলেন – “His memory belongs not only to your people and ours but to the noble roll-call of fighters for the freedom and progress of all mankind. The future will honour him even more than the present because it was for the future that he struggled. গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জনক মাও জে দং তাঁর স্মৃতিতে বলেছিলেন – “কোটনিসের মৃত্যুতে দেশের সৈন্যবাহিনী তাদের এক সাহায্যকারী যোদ্ধাকে হারাল আর জাতি হারাল এক বন্ধুকে। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদী উদ্দীপনাকে হৃদয় ধারণ করি“। এই শোক বার্তাটি একখণ্ড রাইস পেপারে মাও নিজের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফিতে স্বহস্তে লিখেছিলেন।
১৯৪২-এর ৭ জুলাই কোটনিস কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেছিলেন। কমিউনিস্ট নেতাদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা ও সাধারণ মানুষদের জন্য প্রাণপাত করা – এই দুই সহজ সরল দিক তাঁকে পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। পড়ার জন্য বই অমিল হওয়ায় কোটনিস ছাত্রদের জন্য দুটি বই লিখেছিলেন। একটি বই হোলো ‘জেনারেল ইন্ট্রোডাকশান টু সার্জারি’ এবং অন্যটি হল ‘ সার্জারি ইন ডীইটেল’। দ্বিতীয়টি লেখা বইটি অসম্পূর্ণ ছিল।
ডাঃ শান্তারাম কোটনিসের জনপ্রিয়তায় দুই দেশেই তাঁর জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে। ভি শান্তারামের প[রিচালনায় ও খবাজা আহমেদ আব্বাসের রচনায় ১৯৪৬ সালে ‘ডাঃ কোটনিস কি অমর কহানী’ নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। চীনা ভাষায় ১৯৮২ সালেও ‘কে ডি হুয়্যা দাইফু’ নামে একটি চলচ্চিত্র তাঁর জীবন নিয়ে তৈরী হয়। ২০০৯ সালে চীনে ইন্টারনেট নির্বাচনে ঐ দেশের শতাব্দীর সেরা দশ বিদেশী বন্ধুর মধ্যে কোটনিসকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। চীন ও ভারতে তাঁর সম্মানে ডাক টিকিটও প্রকাশিত হয়েছে।
ভারত-চীন মৈত্রীর ক্ষেত্রে ডাঃ কোটনিসের ভূমিকা দু-দেশের নেতৃত্ব বারেবারেই স্মরণ করেছে। যে কোন কূটনৈতিক আলোচনায় তাঁর প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে চীনের আগ্রাসী ভূমিকা যেমন আমাদের ক্ষুদ্ধ করে তেমনি চরম অসম্মান প্রদর্শন করা হয় ঐ তরুণ চিকিৎসকের প্রতি যিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সে এক অজানা দেশে যাত্রা করেছিলেন জীবনের চরম অনিশ্চয়তার ও ঝুঁকির মধ্যে। চীনের শিজিয়াঝুয়াং-এ দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিসের প্রতিষ্ঠিত মূর্তিটি যেন আজ বড় অসহায়, চরম অপমানিত।
প্রবন্ধ
ইতিহাসের সন্ধানে
বরেন্দ্রভূমির এক সুসন্তান
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী, পঃ বঙ্গ
ইতিহাসের সন্ধানে বরেন্দ্রভূমির এক সুসন্তান একটি জাতির সভ্যতা ও প্রগতির স্মারক তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়। উত্তরবঙ্গ তথা বরেন্দ্রভূমির এই ঐতিহ্যের ইতিহাসকেই বিদ্যোৎসাহী ও গবেষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন ইতিহাসবেত্তা প্রত্নতত্ত্ববিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী। ১৯১২ সালে এম .এ ডিগ্রী অর্জন করার পর তাঁর কর্মজীবনের সূত্রপাত বালুরঘাটে। ১৯১৩ সালে বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন । এরই কিছুদিন আগে ১৯১২ সালে ঢাকার নর্থব্রুক হলে প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে এক বক্তৃতায় ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল, ‘ পূর্ববাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির নিয়ে জাদুঘরে ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা’। লর্ড কারমাইকেল এই ধারালো বক্তৃতায় তরুণ নলিনীকান্তের অদম্য ইচ্ছা ও আগ্রহ দেখে ২০০০ টাকা পুরস্কার হিসাবে দেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট গভর্নর কারমাইকেল ঢাকায় নবনির্মিত সচিবালয়ের একটি কক্ষে ‘ঢাকা জাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। লিপিবিশারদ ও মুদ্রাবিজ্ঞানী নলিনীকান্ত ভট্টশালী মাত্র ২৮ বছর বয়সে হলেন ঢাকার জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর।
উত্তরবাংলাসহ পূর্ববাংলার অতীত ইতিহাস পুনরুদ্ধারে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে কোটালিপাড়া, দেউলবাড়ী, বড়কামতা, মহাস্থান ও ময়নামতির মত ঐতিহাসিক স্থানগুলি বিস্মৃতির অতীত থেকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছিল। তিনি ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রাচীন পুঁথিগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করে এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ মূর্তিগুলির বিজ্ঞানভিত্তিক বিবরণ
উন্মোচনের মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে দেশী ও বিদেশী পত্রপত্রিকায় নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মৌলিক ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের যথেষ্ট আগ্রহের সঞ্চার করেছিল।
ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা এবং পরে বহু বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভট্টশালী মহাশয় প্রাচীন বাংলা সাহিত্য ও হস্তলিপিবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়িয়েছেন। “বাংলার স্বতন্ত্র সুলতানি শাসনের সালতামমি এবং মুদ্রা” এই গ্রন্থের জন্য (১৯২২ সালে কেম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত) তিনি গ্রিফিথ পুরস্কার লাভ করেন। এই গ্রন্থে তিনি রাজা গণেশের সম্পর্কে বহু তথ্য প্রকাশ করেন যা গৌড়ের ইতিহাস বির্বতনে বহুভাবে সাহায্য করেছিল। ‘Bengal Past and Present’ গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর ‘বেঙ্গল চীফস স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স ইন দ্যা রিজিয়ন্স অফ আকবর এন্ড জাহ্ণগীর’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি বাংলার বারো ভুঁইয়ার ইতিহাসকে পন্ডিত সমাজের কাছে নতুনভাবে উন্মোচিত করেছিল।
বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ও স্বাতন্ত্র্য দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
অসামান্য নিষ্ঠা ও কর্মশক্তি বলে নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকার জাদুঘরের মত এক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে এই উপমহাদেশে এক বৃহত্তর মহীরূপে পরিণত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৩৩ বছর তিনি এই দূরূহ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বল্পবেতন এবং গবেষণায় আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি জাদুঘর ছেড়ে চলে যাননি। জাদুঘরের প্রতি তাঁর এই অপত্যস্নেহ আমৃত্যু অটুট ছিল।
গল্প
খাঁচার পাখি
অদিপ রায়
লস এঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া
সুদীপ অফিস থেকে ফিরে সাধারণত চেঞ্জ করে বারান্দায় ওর একটা প্রিয় চেয়ারে বসে এক কাপ চা খায়। অভ্যাসমত আজও চেঞ্জ করে বারান্দায় গিয়ে অবাক হয়ে গেল! চেয়ারে না বসে ও বারান্দার একপাশে রাখা পাখির খাঁচাটার কাছে গিয়ে দেখল সেটা একদম খালি! কোথায় গেল পাখিটা? সেই মুহূর্তেই সুদীপের স্ত্রী ইন্দিরা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসেছে । সুদীপের মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল “কোথায় গেল পাখিটা?”
আজ কাজের লোক না আসায় এমনিতেই ইন্দিরা বিরক্ত ছিল, তাই গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে উত্তর দিল, “সেটা তোমার আদরের ছেলেকেই জিজ্ঞাসা কোর”।
ইন্দিরা দ্রুত পায়ে আবার ঘরে ফিরে যাওয়ায় সুদীপের আর উত্তর জানা হল না। এটা বোঝা খুবই সহজ ছিল যে ইন্দিরা আজ বেশ রেগে আছে। তাই সুদীপ পিন্টুর জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করল।
শৌভিক যার ডাকনাম পিন্টু, সে ওদের একমাত্র সন্তান, তাই বোধহয় একটু বেশী আদরও পায়। আট বছর বয়সের পিন্টু এক নামী স্কুলের কৃতি ছাত্র। প্রায় প্রতি বছরই প্রথম স্থান অধিকার করে। পড়াশুনার সঙ্গে ওর আঁকার হাতও ভাল, তাই ও একজনের কাছে এখন আঁকা শিখতে গেছে। তাই সুদীপকে পিন্টুর ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে উত্তর জানার জন্য। সুদীপরা দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত সোসাইটিতে থাকে। অভিজাত সোসাইটি তাই ফ্লাটের দামও বেশী আর সে কারণে সুদীপের একটি ছোট দুই বেডরুমের ফ্লাটেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সুদীপের বাবা ছিলেন ডাক্তার। কলকাতার উপকণ্ঠে বেহালাতে ওদের বাগান-পুকুর সমেত বিশাল বাড়িতে ওর ছোটবেলা কেটেছে। সেই বেহালার বাড়িতে বাবা মারা যাবার পর ওর দাদা সপরিবারে হাত-পা ছড়িয়ে থাকে। আর এই ছোট্ট দুই বেডরুমের খাঁচার মত ফ্লাটে সুদীপের যেন দমবন্ধ হয়ে যায়। দাদা বহুবার সুদীপকে বেহালার বাড়ীতে থাকতে অনুরোধ করে করে ক্লান্ত। কিন্তু ইন্দিরা বলে যে ভাল পাড়ায় না থাকলে, নামী স্কুলে না পড়লে নাকি ছেলে কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের জন্য তৈরি হতে পারবে না। বেহালা নাকি মধ্যবিত্ত সরকারি কেরানীদের থাকার জায়গা। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে ইন্দিরার বাপের বাড়ি ওদের ফ্লাটের কাছেই আর ইন্দিরার বাবা এক নামকরা কোম্পানির ডিরেক্টর। কাজেই ইন্দিরার কথা বেদবাক্য।
চায়ের কাপটা পাশের ছোট টেবিলে রেখে সুদীপ আজকের খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিলো। প্রথম পাতায় ফলাও করে এক মন্ত্রীর চুরির খবর ছাপা হয়েছে। আজকাল এই ধরনের খবর সুদীপের আর কৌতূহল জাগায় না। আজ যে মন্ত্রীর নামে কেলেঙ্কারির খবর ছাপা হচ্ছে, পরের ভোটে আবার সেই জিতবে, দেশ থেকে চুরি জোচ্চুরি নির্মূল করার আশ্বাস দিয়ে। আর এই কাগজ তারই ছবি ছাপবে ভাষণের বিশদ খবর দিয়ে। সুদীপ কাগজটা মুড়ে রেখে আবার শূন্য খাঁচার চিন্তায় ফিরে গেল।
পিন্টুর সবচেয়ে প্রিয় আঁকার বিষয় পাখি। তাই সুদীপ ওর জন্য একটা সুন্দর পাখির ছবির বই কিনে দিয়েছে – যেটা ওরা দুজনেই পাতা উল্টে উল্টে দেখতে খুবই ভালবাসত। ঐ বইটার পাতায় পাতায় ঝকঝকে ছাপা রঙিন দেশ বিদেশের পাখিরা শুধু ছবি ছিল না, মনে হত তারা একদম জীবন্ত। দেখলেই মনে হত এখনই বোধহয় ডানা মেলে উড়ে যাবে বইয়ের পাতা থেকে। বার বার ছবিগুলো দেখেও আঁশ মিটত না পিন্টুর আর ইন্দিরার কাছে বকুনি খেত বাপ-ব্যাটা, “কি এক ছবির বই জুটেছে। ছেলেটার পড়াশুনা গোল্লায় গেল। বাপের সেদিকে কোন হুঁশই নেই”।
বইটাতে নানান ভারতীয় পাখির ছবি আর বিবরণ তো আছেই যেমন ময়ূর, মাছরাঙা, উডপেকার (চলতি ভাষায় কাঠঠোকরা), হর্ন-বিল ইত্যাদি চেনা পাখির। তার সঙ্গে প্রচুর বিদেশী পাখির ছবি আর তার সম্বন্ধে বিবরণও আছে। পাকিস্তানের জাতীয় পাখি ইউরেশিয়ানের ছবি দেখে পিন্টুর ভীষণ মজা লেগেছিল। ইউরেশিয়ানের বাদামি রঙের গা, সাদাকালো ডোরাকাটা ডানা, তার উপর মাথায় সুদৃশ্য ঝুঁটি – ভারি সুন্দর পাখি। ঐ বইটিতে অন্তত পনেরো রকমের মাছরাঙা বা কিংফিশারের ছবি-সমেত বর্ণনা আছে। প্রতিটি পাখির গায়ে আশ্চর্য রকম সুন্দর রঙের বাহার। পাখি বোধহয় ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। দেখলে চোখ আর মন দুটোই জুড়িয়ে যায়। তার উপর কিছু পাখির ডাকও ভারী সুরেলা।
একদিন দুজনে মিলে পাখির ছবি দেখতে দেখতে সুদীপের মনে হল পাখি পোষার কথা। সুদীপের
ছোটবেলায় ওদের বাড়িতে একটা এলসেশিয়ান কুকুর ছিল, যেটা ছিল ওর খেলার সাথী। এখনকার ছোট ফ্লাটে কুকুর রাখা মুস্কিল, তার উপর ইন্দিরা কুকুর একদম পছন্দ করে না তাই আর সুদীপের কুকুর পোষা হয়নি। তার বদলে পাখি পোষার কথা মাথায় এলো। বাপ-ছেলেতে মিলে ঠিক হল টিয়াপাখি পুষবে। ইন্দিরাও খুব একটা আপত্তি করলো না। এক রবিবার দুজনে মিলে হাতিবাগানে পাখি কিনতে গেল। সেখানে গিয়ে পিন্টু মাহা খুশি। শুধু পাখি নয় সেখানে বাচ্চা কুকুর, রঙিন মাছ ফুল-ফলের গাছ সব কিছুই ছিল। অনেক দেখে শুনে একটা টিয়া পিন্টুর খুব পছন্দ হল। পাখিটার উজ্জ্বল সবুজ রঙের গা, লাল ঠোট আর লম্বা ল্যাজ দেখে পিন্টুর ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। পাখিটার গলায় একটা কলারের মত কালো দাগ, যেটা পাখিটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। যে লোকটা পাখিটা বিক্রি করছিল, সে বলেছিল, পাখিটা নাকি চন্দনা টিয়া, এরা কথা বলতে পারে। তাই দামটাও একটু বেশী নিয়েছিল। তবে সুদীপ বিশ্বাস করে যে জিনিষটা পছন্দ হয় তার দামটা নিয়ে মাথা ঘামানো উচিৎ নয় তাতে ভাল লাগাটা নাকি ব্যাঘাত পায়! পাখির সঙ্গে একটি সুন্দর খাঁচাও কেনা হল। সেই খাঁচায় খাবার আর জল দেবার জন্য পাত্রটাও ছিল । বেশ পরিপাটি ব্যাপার। সুদীপ ছোটবেলায় দেখেছে টিয়া পাখি সাধারণত: দাঁড়ে থাকতো আর পায়ে শিকল। সেটা পিন্টুর ভীষণ অপছন্দের, তাই খাঁচা । সুদীপের তিনতলার ফ্ল্যাটের বারান্দাটাই শুধু একটু খোলামেলা, তার একপাশে খাঁচা-সমেত টিয়া বেশ মানিয়ে গেল। ইন্দিরারও সমস্ত ব্যাপারটা খুব একটা অপছন্দ হল না। ওর মতে পাখি আর কুকুরের অনেক ফারাক; কুকুর ভয় পাবার আর পাখি ভালবাসার প্রাণী!ইন্দিরা আর পিন্টু মিলে পাখির একটা নামও দিল – বনি। বনির ভেজান ছোলা খাওয়ার ব্যাপারটা ছিল দেখার মত। ও একটা একটা ছোলা ওর সুন্দর লাল ঠোঁটে নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খেত। এ ছাড়া পেয়ারা, কাঁচালংকা ইত্যাদিও বনির জুটত। বনি এক পায়ে কাঁচালংকা ধরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সেটা ঠুকরে ঠুকরে খেত; এসবের ছবিও তোলা হয়েছে ইন্দিরার ফোনে আর তা অনেককে দেখানও হয়েছে।
সব ভালই চলছিল, কিন্তু সমস্যা হল বানির কথা বলা নিয়ে। পিন্টু রোজ স্কুল থেকে ফিরে হাতে স্কেল নিয়ে মাস্টারমশাই সেজে বনিকে বাবা, মা, পিন্টু বলানোর যতই চেষ্টা করুক না কেন – বানির তাতে কোনও উৎসাহই ছিল না। ও ওর খাঁচায় পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝে ট্যাঁ ট্যাঁ করে শুধু ডেকে উঠত। তাকে কোনোমতেই কথা বলা বোধহয় বলা উচিৎ নয়।
অফিসের বিজয়বাবু একদিন বললেন যে ওনার শালীর টিয়া নাকি সুন্দর শিস দেয়। ব্যাস সেদিন সন্ধ্যাবেলা পুরো তিনজনের পরিবার পাখির খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে শিস দেবার প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিল। আর ওরা আশ্চর্য হয়ে দেখল বনি ঘাড় কাত করে ওদের শিস শোনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বনির মুখে তালা।
এইসব ভাবতে ভাবতেই পিন্টু আঁকার ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরল। তবে ওকে বেশ খুশি আর উত্তেজিত লাগছিল। সুদীপ কিছু প্রশ্ন করার আগেই ও বলে উঠলো,
- “জানো বাবা আজ কি হয়েছে ?“
সুদীপের কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই এক নিঃশ্বাসে বলে গেল,
- “আজ আমাদের বারান্দার রেলিঙে বনির এক বন্ধু এসেছিল। তাকে দেখে বনির খুশী যদি তুমি দেখতে! ওরা দুজনে কিচির মিচির করে কত কথা বলে যাচ্ছিল। তখন বনির জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তাই আমি খাঁচার দরজাটা খুলে দিলাম। ওরা দুজনে একসঙ্গে উড়ে গেলো খোলা আকাশে।
"ভাল করিনি আমি? মা আমাকে ভীষণ বকেছে! ওদের খাঁচায় বন্ধ করে রাখা বোধহয় পাপ? তাই না বাবা?”
সুদীপেরও হঠাৎ ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। সে নিজে যা পারেনি তা একটা আট বছরের ছেলে অনায়াসে করে দেখিয়ে দিল। সুদীপ ভাবল আমরা নিজেরা স্বেচ্ছায় খাঁচার জীবন বেছে নিয়ে নিজের অজান্তে বোধহয় জীবনের সত্যিকারের আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে বসে আছি!
“ঠিকই করেছ তুমি। আমরা আর খাঁচায় পাখি পুষবো না। খুব তাড়াতাড়ি আমরা জঙ্গলে যাব প্রকুতির বুকে পাখি দেখতে। সেটাই ওদের আসল জায়গা, সেখানেই ওরা সবচেয়ে সুন্দর।“
আট বছরের ছেলের কাছে সুদীপ বোধহয় শিখল সত্যিকারের আনন্দ কাকে বলে!
কবিতা
সাহেব সেখ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
হৃদয়উচ্ছিত বেদনা
আজকে যখন সমাজের মুখে কুলুপ আটে,
তখনও তারা সমাজের যাঁতাকলে পিষে।
তাদের হেয় করি আমরা, দিনে ও রাতে,
শিকল ধরে তারা লাঞ্ছিত সেই হাতে।
দিয়েছি আমরা তাদের কত পরিচয়,
অবজ্ঞার চোখে দেখেছি।
করিয়াছি তাদেরকে নিয়ে অভিনয়,
বর্জিত করিয়াছি মোক হৃদয় থেকে।
অনুধাবন করিনি তাদের কষ্ঠিত জীবন,
তাদের শাড়ির দিকে নেত্রসঞ্চালন করেছি।
ভাবিনি একবারও মহাপ্রভুর এযে সৃষ্টি অনীয়তন,
তাদেরকে কলঙ্কের প্রতিরূপ বলে জেনেছি।
বৃষ্টির ফোঁটা কিংবা শীতের রোদের মতো আসে তারা,
নিয়ে আসে যন্ত্রণামলিত হৃদয়।
যদিও সমাজদেবীর নেই,ওদের আছে,
একটু মিষ্টি হাসি ও খুশির থই থই।
চিনেনা ওরা নিষ্ঠুর সমাজদেবীর মুখ,
লড়াই এর সঙ্গী হয় অকারণ।
লড়তে থাকে হঠাৎ সবাই চুপ,
ওরে দু টুকরো হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ধারে,
জগতবন্ধু এটাই সমাজের স্ফটিক নিদর্শন।
বেরোবেনা আর আনন্দবাজার ওদেরকে নিয়ে,
হইবেনা ওদের শ্রেণীর সুবিচার।
পড়িয়া থাকিবে রাস্তার ধারে এইভাবে,
সমাজদেবীর ছাইয়ের বাটিতে রইবে চাপা বার বার।
জীবন জ্বালায় জর্জরিত এরা,
ডুবে থাকে নিজেদের খেলায়।
শুকনো হলদেটে পাতার মতো ঝরে যায় এরা,
রয়ে যায় লেখকের বইয়ের পাতায়।
মানবসমাজ খোঁজে কালি,
এদের সমাজে গিয়ে।
ভোলা মহেশ্বর দেয় হাততালি,
মোদের অমানবিক আচরণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
হে জগৎবন্ধু শোনো এ তান,
দিয়ে যাও মানবকে মানবতার মহাজ্ঞান।
ভরিয়ে দাও বর্ষিয়ে এ সমাজ মিলন ও ঐক্যের গান,
হইবে পুরো আশা, পূর্ণ হইবে রক্তফুলে ফুটে ওঠা এ পরান।
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.