প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
পুজো বার্ষিকী
১৪২৯
‘ও দাদা দুটো টাকা দ্যাও না, বড্ড খিদে নেগেছে’ – জামার পিছন থেকে একটা ছোট্ট টান। ধুলো ময়লা মাখা, শীর্ণ হাতের ছোঁয়া।
বেহালা সখেরবাজার মোড়। সকালের দিকে প্রাত্যহিক যানজটে শহর কলকাতা আর র্যাট রেসে অভ্যস্ত শহরবাসী। গলির মুখে বাস স্ট্যান্ডের কাছে বেশ ভিড়। কি একটা কাজে গিয়েছিলাম, অতটা মনে নেই। পিছন ফিরে দেখি বছর সাত আটেকের একটা ছেলে। তখনও ওর শুকনো মুখে ভোরের প্রত্যাশার আলো লেগে।
- ‘কেন, কিছু খাস নি?’
- ‘খেয়েছি... সে তো কোন সক্কালে’
- ‘তাহলে, চাইছিস কেন? কি খেয়েছিস সকালে?’
- ‘বিস্কুট’
এভাবেই আমাদের কথাবার্তা শুরু। নতুন কোন ঘটনা নয়। পথেঘাটে কোন না কোন সময়ে এর সম্মুখীন আমাদের সবাইকেই হতে হয়। হাতে কাঁচা পয়সা দেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই, টাকা পয়সার একটা অন্যদিক আছে, খিদে কমিয়ে দিতে পারে। ছেলেটা সামনে একটা হাত পেতে কাঁচুমাচু মুখে মাথা চুলকোতে লাগল। ওর দেখাদেখি আর একটা কখন যে এসে হাজির খেয়াল করিনি। তবে এটা বয়েসে একটু ছোট, হাঁ করে আমাদের কথা গিলছে।
‘দ্যাও না কিছু’ - মুখটা ব্যাজার করে আবার বলে উঠল। অন্যদিকে তাকালাম। ভাবলাম চলে যাবে। মনে মনে ভাবলাম, আরে যা না, এখনও দাঁড়িয়ে! অবজ্ঞাও বোঝে না!
‘ও দাদা, দ্যাও না’ – এ তো বড্ড নাছোড়বান্দা! এবার একটু বিরক্ত হয়ে বললাম – ‘সত্যিই খিদে, না তোর অন্য কোন ধান্দা আছে?’ আর এত লোক থাকতে - আর আমাকেই বা কেন বাবা! বিরক্তিকর!
- ‘বললুম তো! খিদে পেয়েছে। কতবার বলব বল দিকি? –
একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে বিরক্তি উগড়ে দিল। কাঁচা বয়স, বুঝবে কি, যে সামর্থ্য না থাকলে কিছু পেতে এই সমাজে একটু ‘কুই কুই’ করতে হয়। সচ্ছল, সামর্থ্য লোকেরাই করে স্বার্থের জন্য, আর এরা তো কোন ছাড়! এটাই নিয়ম, পেটে ভাত থাকলে তবেই মেরুদণ্ড সোজা। আমার খুব একটা তাড়া নেই, তবে বাসটা চলে এলে দুম করে উঠে পালিয়ে যেতে পারতাম, এই যা। সেটা মনে হয় আজ আর হচ্ছে না।
কিছুটা বাধ্য হয়েই বললাম – ‘না ভাই, তোদের পয়সা দিচ্ছি না। খিদে পেলে চল আমার সঙ্গে।’ দুজনেই একটু চুপ মেরে গেল। বোধহয় আশা করে নি। ভেবেছিল দু-একটা টাকা গুঁজে দেব ওদের হাতে। কিন্তু তা আর হল না। তবে কোটরের ভিতর থেকেই ওদের চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠল মনে হল। অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী, তাদের চোখের ভাষায় বিশ্বাস স্থান পায় না। প্রতি মুহূর্তেই এই বাপে খেদানো বিপিনের দল আমাদের এই ভদ্রসমাজকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। একটু চুপ করে থেকে ঘাড় নেড়ে বলল – ‘চলো তাহলে’। পাশের ছোটটা আমাদের সঙ্গ নিতেই, তাকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বড়টার এক ধমক –
‘তুই আসছিস কেন, আমি কি তোকে ডেকেছি?’ সমস্যা গভীরে। এখানেও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, ভয়। আমিত্ব অমৃত-সমান। বাঁচিয়ে রাখার লড়াই সমাজের প্রতিটি স্তরেই। আড়ালে আবডালে এর গতি প্রবাহমান। কচিটাও দমবার পাত্র নয়। টিকে থাকার লড়াইতে গলা উঁচু করে বাঁচতে হয়। গালাগাল দিয়ে বলে উঠল – ‘আমি এয়েচি তো তোর বাপের কি?’
দু-পা হেঁটে সখেরবাজারের দিকে যেতে বাঁ দিকে একটা ছোট্ট দোকান। সামনে বিশাল লোহার তাওয়া। নিচে গনগনে কয়লার আঁচ। বড্ড লাল, চোখে ধাঁধাঁ লাগে। গরম গরম পরোটার গন্ধে ছোট্ট দোকানটা ভরপুর। পাশে বিশাল একটা ডেকচিতে লাল টকটকে আলুর দম। দোকানের পাশে একটা ভাঙ্গা বেড়ার পাশে একটা সাইকেল কাত করা, নিচে একটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে, একটু ঘুম কাতুরে মনে হল।
- কি নাম তোর? বসে গেলাম ওদের সঙ্গে। ছোট্ট স্টিলের থালায় আমার জন্য এল হালকা পেটানো, ফিনফিনে, রূপসী পরোটা আর সঙ্গে বাটিতে লালচে আলুর দম।
- ‘পরেশ’। সবে পরোটা-টা ছিঁড়ে গালে পুরতে যাবে, থামিয়ে বলে উঠলাম– 'যা হাত ধুয়ে নে। দেখ... হাতে তো সব নোংরা লেগে রয়েছে’। অনিচ্ছা সহকারেই উঠল।
- ‘আর তোর’ – ছোটটা আমার ডানদিকে বসে। মুখখানা মিষ্টি। গাল দুটো ফোলা ফোলা, ঢল ঢল চোখ, এখনও শৈশবের আদল চিবুক ছুঁয়ে।
- 'ভুটে’
- 'ভুটে!!! ভুটে কারোর নাম হয় নাকি?' আমি তো অবাক।
- 'হয় তো, আমারই নাম তো ভুটে।‘ বল পড়তে না পড়তেই ছক্কা।
- 'স্কুলে যাস না?'
- 'না।'
- 'কেন?'
কোন উত্তর নেই। ঠক ঠক করে কাচের গ্লাসে চামচ নাড়ার শব্দ। গরম আগুনের আঁচ খেতে খেতে চায়ের জল নাচছে, তাতে বড় কয়েক চামচ দুধ পড়ল। এবার দুধ জলে মিশে একটা বড় সড় জলতরঙ্গের প্রস্তুতি। যার ফলশ্রতু চায়ের জলে উথলে পড়া বান, যা সামলাতে দোকানীর শকুনি দৃষ্টি।
বাচ্চা দুটোর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ছোট ছোট শীর্ণ আঙ্গুলের ফাঁকে হালকা পরোটা আর আলুর ঝোলের পিরিত চলছে। আলু চেটে পুটে খাচ্ছে, নিভছে আর একটা অদৃশ্য গনগনে আগুন। পিছনের দিকে মাথা গুঁজে চুপচাপ এঁটো বাসন মেজে চলেছে ওদের মতই আর একজন। জল বাঁচিয়ে, অল্প জলেই। নোংরা একটা তোয়ালেতে ফাইনাল টাচ।
- ‘স্কুল যাস না, সারাদিন ঘুরে বেড়াস, বাড়িতে কিছু বলে না’।
ফিক করে হাসির শব্দ। তার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা চাঁটির।
- ‘এই তুই যেতিস না, তোকে তো শম্ভুদা ভরতি করে দেছিল, তুই তো পাইলে এলি’ বলেই ভুটেকে পরেশের একটা চাটি।
- ‘তুইও তো যাস নি, আমারে বলছিস’ – গালাগালটা এসে গিয়েছিল একদম জিভের ডগায়, আমার দিকে তাকিয়ে ঢক করে গিলে নিল। রাগে গজ গজ করতে করতে মাথায় চাঁটির জায়গায় কয়েকবার হাত বুলিয়েই মুখে পুরে দিল পাতের একটা মস্ত আলু। ছোট্ট স্বচ্ছ গ্লাসে গরম চায়ের আলতো হাতছানি, যা উপেক্ষা করার সাধ্যি আমার নেই। ইশারা করতেই দোকানী বলল ‘একটু বসুন, দিচ্ছি .. এই চা ফুটতেছে’। এরই মাঝে বাইরে হঠাৎ সোরগোল। দুটি সারমেয়র এলাকা দখলের লড়াই। যেমন হয় আর কি, মানুষ পশুতে এখন তো আর কোন তফাত চোখে পড়ে না। সর্বত্রই লড়াই। একেবারে পাড়া মাথায় করে তোলে। তারই মধ্যে গলা তুলে দোকানীর শাসানি কাজের ছেলেটিকে - ‘কি রে এত দেরী হচ্ছে কেন, টেবিলের প্লেটগুলো কে তুলবে, তোর.....।‘ একবার মুখ তুলে আবার কাজে লেগে পড়ল ছেলেটি। কথাটা গায়ে মাখল বলে তো মনে হল না। অস্তিত্ব রক্ষার এই মহাকবজটিকে এই সামান্য বয়সেই বেশ ভালই রপ্ত করে নিয়েছে। আর না করেই বা উপায় কি। তবে মানতে হল, আজও ওর কাছে আমি শিক্ষার্থী।
চা-টা বেশ ভাল। ওপরে ভাসা ভাসা সর। স্বাদ আছে। রূপটা আরো খুলত যদি একটা ভাঁড় জুটত। ওদিকে ছেলেদুটোরও তো প্রায় খাওয়া শেষ।
পরেশকে বললাম – ‘তোর বাড়িতে কে কে আছে রে?’ এঁটো হাতে একটুকরো আলু লেগে, সেটা যথাস্থানে চালান করে বলে উঠল – - ‘মা, বোন,.’ .
- আর বাবা?
- আছে... একটু দায়সারা গোছের উত্তর।
- সে না হয় আছে, কিন্তু করে কি?
- জোগাড়ের কাজ... রোজ তো করে না। তাই তো মা তো রেগে যায়।’ চটপট উত্তর।
তারপর চুপ। আমার ডান পাশে ভুটে, ঝোলের ঝালে নাক টানছে আর আমাদের কথা গিলছে। ইশারায় ওকে বলি – আর তোর?
উত্তর দিল না। একবার তাকিয়ে জার থেকে গ্লাসে জল ঢালতে লাগল।
- ‘ওর তো কেউ নেই।’ ভুটের হয়ে জবাবটা পরেশই দিয়ে দিল।
- তার মানে, কেউ নেই মানে!
- নেই মানে নেই।’ পরেশের কাটাকাটা জবাব। তারপর চুপ।
মনে নানা প্রশ্নের জট। আরে বলে কি ছেলেটা! নেই।। নেই বললেই হল... এইটুকু বাচ্চা ছেলে, এখনও চিবুক ছুঁয়ে সারল্য, একা তো আর থাকতে পারে না, কারোর না কারোর সঙ্গে তো থাকে। ভুটের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, নিষ্পাপ মিষ্টি মুখটাতে সামান্য হলেও একটু পরিতৃপ্তির ছোঁয়া, ছোট্ট শরীরে ভিতরের আগুনটার সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটেছে যে!
তবে কি... ধুর।। যত্ত সব বাজে চিন্তা। আর ওর কে আছে না আছে তাতে আমারই বা কি এসে গেল।
সবে উঠতে যাব, হঠাৎ ভুটে বলে উঠল -
‘দাদা, তুমি হুই বড় বড় আপিসে কাজ কর তাই না? অনেক পয়সা পাও?’। একটু ক্যাড়ক্যাড়ে গলা, অনেক দূর থেকে শোনা যায়। ভুটের চোখ উজ্জ্বল। আমার উত্তরের অপেক্ষায়, আমার চোখে চোখ।
- ‘কেন রে’ – একটু অবাক হলাম। ওদিকে দোকানির ফিঁক করে দেঁতো হাসি।
- ‘এমনি।’ - মনের কথাটা আর ভাঙল না।
পরেশের দাদাগিরি। খেঁকিয়ে বলে উঠল – ‘এ রকম বলতি আছে? ভদ্রনোকের সঙ্গে কথা বলতে শিখিস নি’।
আড় চোখে দোকানী সবই দেখছে, শুনছে। চোখে চোখ পড়তেই হেসে বলে উঠল – ‘দাদা, এদের বেশী নাই দেবেন না, মাথায় চড়ে বসবে, সব মুক্ষু সুক্ষু মানুষ, কথা বলতি জানে না’।
হেসে ভুটেকে বলি – ‘আমি বড় অফিসে কাজ করি, আর নাই বা করি, তাতে তোর কি?’। আর একটু দার্শনিকের মত বললাম – ‘তুইও যদি স্কুলে যাস, ঠিকঠাক পড়াশোনা করিস, তাহলে তুইও চাকরী করবি, পয়সা পাবি’। কতটা বুঝলো জানি না। তবে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
পরশের ধমক খেয়ে ভুটে নিঃশ্চুপ। দুটো পরোটা আর আলুর ঝোলের মূল্য ওর কাছে অনেক। এই জটিল সমীকরণটা হয়ত ওর ঐ ছোট্ট মনে জেগে উঠেছে। এই বয়েসেই জীবনের অর্থ প্রতি-নিয়তই, প্রতিদিনই বুঝছে চড়া দামে। তবে সবই কি আর বোঝা যায়। বুঝতেও তো একটা বয়স লাগে। জ্বলন্ত খিদে কাউকে বেয়াত করে না। আগুনে সব পোড়ে। পেটের মোচড় বুকে এসে লাগে। আর কিছু বুঝুক না বুঝুক এই চরম সত্যটা বুঝেছে হাড়েহাড়ে, যার কোন বয়স-ধর্ম লাগে না।
সবাই চুপ। আড়চোখে ওদের দেখছি, আর ওরাও আমায়। ভাবছে, কে এই লোকটা, উপযাজক হয়ে, গায়ে পড়ে পড়ে গল্প করছে। পরেশের মধ্যে একটু উঠি উঠি ভাব। একটা পা সমানে দুলিয়ে চলেছে। একটু অস্থির মতির। শুধু বলার অপেক্ষায়, বললেই পালাবে।
বললাম – ‘কি রে পরেশ, তুই তোর দিদিকে ছাড়াই খেয়ে নিলি যে’। একটু অবাক চোখে ও বলে উঠলো – ‘ও তো বাড়িতে।’ পরক্ষণেই ঝাঁঝিয়েই উঠল - ‘ও যে আমারে দেয় না মাঝে মাঝে, পুরোটাই তো খেয়ে ল্যায়। কারোরেই তো দেয় না।’
‘সে যতই হোক, তোর দিদি তো! ওকে ছাড়াই...তুই... এটা ঠিক করলি?’ – ইচ্ছে করেই বললাম। দেখি না কি বলে। অবশ্য না বললেও চলত। খবরদারী করা আমাদের রক্তে। ওৎ পেতে বসি শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। ওর ঝাঁঝটা নিভে গেল দ্রুত। মুখ ভার করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। একবার আড় চোখে আমায় দেখল। একেই বলে রক্তের টান। হয়ত দিদির কথায় বুকের ভিতর কিছু একটা চলছে যা আমার সামনে লুকিয়ে রাখা খুব জরুরী।
পয়সা মিটিয়ে রাস্তায়। ভাবলাম দুটোই দৌড় মারবে। আমরা যেমন মারি, কাজ মিটলেই ধাঁ। এই র্যাট রেসের দুনিয়ায় স্বার্থের বাইরে এক মুহুর্তও না। চলতে নেই। স্মার্টনেসের আপডেটেড সংজ্ঞা এটাই। বোকারাই পরের কথা ভাবে, খোঁজ নেয়। দু-পা হেঁটে পরেশ দাঁড়ায়। ফিরে এসে পকেট হাতড়ায়। ওর ঐ নোংরা ছোট্ট পকেটে যে কি গুপ্তধন লুকিয়ে থাকতে পারে তা না দেখে আমিও নড়ছি না। আমায় দেখে থমকে গেল, একটু ইতঃস্ততভাব। এই প্রথম মনে হল যে আমার উপস্থিতি ওর কাছে আর কাম্য নয়, কিছু একটা লুকোতে চাইছে।
ও কি খুঁজছে আমার অজানা নয়। একটু এগিয়ে গেলাম, করুণ মুখে দাঁড়িয়ে। বললাম – ‘অনেক হয়েছে, যা দোকানে আমার বলা আছে, প্যাকেটগুলো নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যা’।
একটু অবাক চোখে দেখল। এক অদ্ভুত দৃষ্টি। অতি সামান্য একটু খাবার, তার জন্য কি অপরিসীম এক কৃতজ্ঞতা ওর দু-চোখে ঝরে পড়ছে! এত অল্পে কেউ খুশি হতে পারে! ধারণা ছিল না। দোকান থেকে প্যাকেটটা নিয়েই এক দৌড়। তবে এবারেও তাই, ঐ দু-পা। আবার থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে আমার চোখে চোখ। বললাম – ‘কি রে দাঁড়ালি কেন? যা... ’। মুখটা মাটিতে। কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে রইল। হাজার মানুষের ভিড়। আর এই ভিড়ের মাঝেই সবার অগোচরেই জন্ম নিচ্ছে এক বাস্তব চিত্রনাট্য। যার সঙ্গে বাইরের জগতের কোন সম্পর্ক নেই, কোন সংলাপ নেই। থাকার কথাও নয়। ব্যস্ত শহর, তার থেকেও ব্যস্ত মানুষ। আমাদের সময় কোথায়! কি এই চিত্রনাট্যের ক্লাইম্যাক্স! কার কি এসে গেল। হেসে বললাম – ‘যা, তোর মায়ের জন্যও আছে’...। একবার আমার দিকে তাকিয়েই এক দৌড়। এ দৌড় আর থামেনি। জানি আর থামবে না। ওর বুকের মধ্যে যে ছোট্ট নদীটা আছে, তার পাড় ভাঙছে অবিরত, কোন এক অযাচিত ঢেউয়ের ধাক্কায়, যার উৎস ওর একান্ত ব্যক্তিগত, সংগোপনে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার ওর একার। অনুধাবন করতে হলে ডুবুরী ফেলতে হবে ওর চোখের ভাষায়।
এই প্রবল ভাঙন বুকের এই ছোট্ট খাঁচায় আর কতক্ষণই বা সামলে রাখা যায়...। তাই আর দেরী করে নি, এক নিমেষে হারিয়ে গেছে জন অরণ্যে।
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
গল্প
পাড় ভাঙ্গার শব্দ
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস
কবিতাঃ বাসব রায়
রাজবাটি, দিনাজপুর, বাংলাদেশ
এলোমেলো হিসেব
আমার কান তোমাকে দেখে
দেখে তোমার অনন্ত সৌন্দর্য
আমার চোখ তোমাক শোনে
শোনে তোমার যৌবনভরা গান -
আমি ঝড়-বাউলের দেশের লোক
আমার হিসেবের খাতা নেই
তোমরা যেটাকে পরিহাস বলো
সেটাই আমার নিয়তি বা অদৃষ্ট -
দামাল বাতাসে আমি স্থির
দৃঢ় অঙ্গীকারে আমি নেই
স্পর্শ অধিকারে বিশ্বাসী নই
অনুভবে আমি কাতর ভীষণ -
তোমার অনুপস্থিতি উপভোগ করি
তখন পুরুষসিংহ আমি -
ওষ্ঠ যখন ছুঁয়ে যায় অকাতর
তখন আমি পৌরাণিক জড়ভরত!
অন্ধকারে আমি পূর্ণিমায় ভাসি
জোয়ারে আমি বিস্তীর্ণ বালুচরে
পড়শীরা আমায় জানে না
আমার দিনপঞ্জীতে কিন্তু ওরাই৷
কবিতাঃ ড. কোহিনূর কর
অ্যারিজোনা, ইউ এস এ
স্বপ্ন-জাল
স্বপ্ন দেখা ভালো।
(তবে) স্বপ্নের জাল বোনার শেষে দাঁড়ালো
দুটো সমান্তরাল রেখা।
শৈশব থেকে কৈশোর পার করে যৌবন;
সব বয়েসেই স্বপ্ন আসে, কাটে দৈনন্দিন জীবন।
দুটো রেখা কিন্তু এক দুরত্ব রেখে চলে।
স্বপ্নের জাল কালো;
তা সে যতই কালো হোক,
স্বপ্ন দেখা ভালো।
স্বপ্নের কত আকৃতি প্রকৃতি,
সেইসাথে শৈশব-কৈশোর-যৌবন মনের আকুতি;
ঘুম ভাঙ্গে কিন্তু রেখাদুটো মোছে না।
কে আমায় ওঠালো?
সত্যি নাহলেও বেশ দেখি তো
স্বপ্ন জমকালো।
সাধ বলে, দোষ কী আমার?
উত্তর আসে অন্য রেখার থেকে,
তোর এসব অসাধ্য, অন্য কিছু ভাব না!
চোখ ভর্তি আলো।
ঘুম ভাঙ্গানো গর্জনে ওই
বিদ্যুৎ চমকালো!
কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস
রাণাঘাট, নদীয়া, পঃ বাংলা
মৃত্যু
জলের উপর একটা বুদবুদ
এই আছে এই নেই
হঠাৎ মহাকাশের বুকে
খসে পড়ে তারা
ভোরের শিউলি টুপ করে
ঝরে যায় বৃন্ত থেকে।
কেউ কেউ টুক করে চলে যায়
অজানার আঙিনায়
কেউ যার ঠিকানা জানে না...
তুমি পরাজিত
জন্ম এবং তোমার আসা
এর মধ্যে এই যে বেঁচে থাকা
এই যে জীবনের অনুভূতি
এই যে আবেগময় অস্তিত্ব
এই যে হৃৎপিণ্ডের ছন্দিত স্পন্দন
এই যে 'ঈশা বাস্য মিদং সর্বং' অবলোকন
চেতন অবচেতনের প্রাচীন দ্বন্দ্বকে
অতিক্রম করে আজও
এই যে জীবনের পাদচারণা
তার মধ্যেই বুঝি তোমার পরাজয়
জীবনের জয়গান একটানা বেজে চলেছে
জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে...
সেই কোন সুপ্রাচীন অতীত থেকে
হে মৃত্যু, তুমি পরাজিত।
জীবনের জয়গান
মৌমাছিরা গাইল গুঞ্জন
ফুলে এসে বসল প্রজাপতি
পাতালের গভীরে শিকড় চলল জলের সন্ধানে
সন্ধানী পাতারা খুঁজল সূর্যালোক
পাখিরা ধরল গান
উড়ে চলল আকাশের বুক চিরে
মৃত্যুর শীতল ছোবলকে নস্যাৎ করে দিয়ে
সবাই চলল জীবনের জয়গান গাইতে...
মৃত্যু
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কনডেনসারের মতো
পার্থিব জীবনে মৃত্যুও এক খুব প্রয়োজনীয় ক্ষতি।
নতুন মুখের শিশু, টাটকা গোলাপ
কিছুই থাকত না, মৃত্যু না থাকলে।
মৃত্যু না থাকলে আজ পৃথিবীটা ভরে যেত
বৃদ্ধ বৃদ্ধায় আর বৃদ্ধাশ্রমে।
পোড়া
যতদিন প্রাণ ছিল পুড়িয়েছি মন
তিলেতিলে মন পোড়া,ওটাই জীবন।
আজ আর মন নেই,মন পুড়ে শেষ
চিতাতেই মহাসুখে শুয়ে আছি বেশ।
পোড়াবে? পোড়াও তবে,আজ আমি স্থির
পুড়বে না মন আর,পুড়বে শরীর।
লাশ কাটা ঘর
একদিন আমার বদলে বিছানায়
শুয়ে থাকবে আমার লাশ।
একদিন আমিও নিশ্চিন্তে
শুয়ে থাকব ওই লাশ কাটা ঘরে,
অন্যান্য লাশের পচা গলা গন্ধ
বেমালুম ভুলে গিয়ে।
যত বার হেঁটে গেছি মর্গের রাস্তায়
নাকে চেপে ধরেছি রুমাল
পেরিয়ে গিয়েছি খুব দ্রুত।
যতই এড়িয়ে চলি, যতই ছুটি না কেন
একদিন ঠিক পৌঁছে যাব
ওই লাশ কাটা ঘরে।
শ্মশান
ফিরতি ট্রেনের যাত্রীরা সব জড় হয়েছে
এখানেও খুব লম্বা লাইন।
এক এক করে সব উঠে পড়ছে
রিজার্ভ স্লিপার কামরায়।
চিচিং ফাঁকের মত দরজাটা ঝপ করে বন্ধ হল
তারপর সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
ট্রেনটা চলে গেল দূর থেকে দূরে
সেই নীল তারাদের দেশে।
বয়ে যায় রোদ বিনামূল্যে
পুড়ে গেছে গীটার
তারবার্তায় মাটির নরম ঘুম
আর যাবে না চেতনা
বাড়ি ঘরে দেনা আর পাওনা
সংলাপ অপ্রয়োজনীয়
ঈষৎ কঠিন
ঈষৎ ঢলে পড়া নগ্নিকা
বাতাসে বিভীষিকার প্রণাম
বয়ে যায় রোদ বিনামূল্যে
সাফল্য পায় বড়সড় কালীয়দমন পালা।
কবিতাঃ পার্থ সরকার
সপ্তাহের মাঝামাঝি বিবর্ণ প্রজাপতি মুখ
বিবর্ণ প্রজাপতি মুখ
সপ্তাহের মাঝামাঝি
যারপরনাই আধখাওয়া পৃথিবী
সমান সমান পঠনপাঠন
সমান সমান অজ্ঞানতা
ধূলিসাৎ মোক্ষবিদ্যা
অহমিকা শেষ
দুটো ঢিল ছুড়ল পুকুরে মাৎসর্য।
কবিতাঃ মনোরঞ্জন সাঁতরা
শত্রু স্বয়ম্ভূ
আজ আমি আমারই সবচেয়ে বড় শত্রু;
যুদ্ধে অবতীর্ণ আমিদ্বয় - এযেন এক কুরুক্ষেত্র।
কত বিনিদ্র রাত কাটছে আমার
সিদ্ধান্তহীন ব্যস্ততায়,
জিততে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছি আমি
বার বার তারই ছলনায়।
দশের সেবায় ডুবতে গিয়ে
কানে মন্ত্র - আখের গোছাও,
সুখ স্বাচ্ছন্দ্য লুটে নাও
জীবন আর কদিন মাত্র!
তারপর হয়তো বা আমি
সেবার ছাতা নিয়ে হাজির,
দাসত্বের বেড়া অজান্তেই পড়ি
ছুঁয়ে যায় মন কামনায় কামনায়।
একি রূপ! বহুরূপে কোথায় খুঁজেছি আমায়,
শুনতে পাই - বাঁধন শক্ত করো
হবে জয় নিশ্চয়।
ভোটাধিকার
কল্পনা কাকিমার বয়স অনেকটাই বেড়েছে
হাত পায়ে আগের জোর নেই
মাথাটা মাঝে মাঝে ঘোরে
চোখেও তেমন আর দেখতে পায়না
তবে খিদেটা প্রায়ই ওঠে আর মরে।
কিন্তু কাকিমার নিজের অধিকার
আজও সেটা একশ ভাগ সচেতন।
কাকিমার ভোট কোনো নির্বাচনেই
বাদ পড়ে না;
বাদ পড়ে শুধু ভাবনার!
কবিতাঃ সায়নী আচার্য্য
দুর্গাপুজো এলো বলে,
ঢাকের বাজনা কানে আসে।
শরৎ মেঘে আকাশ ঢাকে,
কাশফুল চোখে ভাসে।
নতুন নতুন জামা-কাপড়,
জমজমাট সব দোকান ঘর।
নতুন সাজে সেজে উঠতে,
ব্যস্ত যেন বাড়িঘর।
সন্ধ্যে যত এগিয়ে আসে,
চারিদিক সব সেজে ওঠে।
পুজোর মজায় মত্ত হয়ে,
রাস্তাগুলো জেগে ওঠে।
মনের সব দুঃখ ভুলে,
এগিয়ে আসে মানুষ।
গান বাজনায় মেতে উঠে,
বিভেদ ভোলে মানুষ।
ধনী-গরীব তফাত যেন,
কোথায় চলে যায়।
সব দূরত্ব ঘুচে গিয়ে,
এক হয়ে যায়।
হঠাৎ যেন ঘুম ভাঙে,
বুঝতে পারি স্বপ্ন।
আকাশ এসে বলে যায়,
সময় আসেনি এখনো।
কবিতাঃ অনিশা দত্ত
সল্টলেক, কলকাতা
গণতন্ত্র
সাধারণ তন্ত্র, জপিতেছে মন্ত্র, চিত্ত উদভ্রান্ত
কোন্ দলের হবে জয়!
ধরমেতে যুদ্ধের হাওয়া,
করমেতে খাওয়া-শোওয়া,
হেঁটমুণ্ড বেপরোয়া,
নাহি ভয়।
ফিকির-ফন্দী, নোট বন্দী
অর্থ নীতির নেইকো মাত্রা
স্বাধীন মতামত, মারদাঙ্গা
বিপদ সংকুল জীবনযাত্রা।
ক্রাইম-পেট্রল, সাবধান ইন্ডিয়া
ছাপোষা পরিবার ঊর্ধনেত্রা
স্বচ্ছ ভারত হোক অক্ষয়
মূল্য বৃদ্ধি গুণমান হ্রাস
জনগণ মরে, করে হাঁস ফাঁস
উঠল বুঝি নাভিশ্বাস
শরীরের নাম মহাশয়।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখ, মহা যুযুধান।
দেখিয়া ভারতে নানা দলের উত্থান
জগজন মানিকে বিস্ময়।
নারীবাদ
‘নারীবাদ – জিন্দাবাদ ‘, নারীবাদ – জিন্দাবাদ‘, নারীবাদ – জিন্দাবাদ‘
বাহ্ – বাহ্, তুই তো চিরকালের নারীবিদ্বেষী!
ভূতের মুখে রামনাম!
হঠাৎ নারীবাদ, নারীবাদ, জিন্দাবাদ‘
এতদিনে সারসত্য জেনেছি।
সমস্ত সুযোগ – সুবিধা থেকে নারীকে বাদ দাও, সার্থক নারীবাদ আমি তাই জীবন থেকেও
নারীকে বাদ দিয়েছি, আমি ব্রহ্মচারী।
বাজেট
ভারত গণতন্ত্র, বিশ্বে লার্জেস্ট
অর্থনীতি মানছে সকলের ইন্টারেস্ট
দেখেছো কি বুলেটিন?
বছরের বাজেট
সরকার দিলদার করছেন সাজেস্ট
গরীব পাবে সাবসিডি, উচ্চবিত্ত রিবেট
মধ্যবিত্ত, খোলো টিভি, শুনে যাও
ডিবেট উচ্চবিত্ত পাবে ঋণ,
নিম্নবিত্ত ত্রাণ মধ্যবিত্ত!
সারাদিন হাত ধুয়ে যান।
জন্ম - মৃত্যু কথা
(১)
- কারা যেন আপেল খেয়েছিলো,
আমরা জন্মাতে বাধ্য হলাম
- কারা যেন বাদুড় খেয়েছিলো,
আমরা মরতে বাধ্য হচ্ছি
(২)
ভগবান – খোকা, তুমি তোমার জন্ম ক্ষণ মনে করতে পার?
খোকা - পারি, সে রাতে বাবা মাকে একা রেখে পার্টিতে গিয়ে ছিলেন ফূর্তি করতে।
(৩)
- এমন কথা আমি তো বাপের জন্মেও শুনিনি
- শোনা সম্ভব ও নয়, তোর বাপের জন্মের সময় তুই জন্মাসনি
(৪)
অপূর্ব - আমি মরে গেলেও আপনার হাতে খেতে পারব না।
ভারতী – আমি বেঁচে থেকে খাওয়ার কথা বলছি।
কবিতাঃ প্রতীক মাইতি
রাজারহাট, কলকাতা
যে মেয়েটি সেজেগুজে কবিতা হয়েছে
সিগারেট জ্বালাতে গেলে টের পাই এক নিঃশ্বাসে আগুন নিভিয়ে দিতে পারি আমি।
বারো বছর আগে যখন মেয়েটিকে অনেকক্ষণ চুমু খেয়েছিলাম,
আমাদের নিঃশ্বাস পড়েনি,
সে বুঝেছিল শীতকাল এলে তার সংসার পুড়তে পারে খিদের আগুনে।
একটা স্ফুলিঙ্গ আর দাউদাউ আগুন এক না।
বস্তুত শীতকালও সবার এক না।
বুকের ভিতর বুদবুদ সোচ্চার, খেজুর রসের মতো টগবগ ফুটছে।
মেয়েটি ফেনা কেটে গেলে লাল টুকটুকে গুড় দিয়ে পায়েস রান্না করে
তুলে দেবে ছেলেমেয়েদের মুখে।
বারো বছর আগে সে বুঝেছিল একটা সিগারেট আর সংসারের হাঁড়ি এক না।
বস্তুত এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো কবিতাটা।
প্রবল গোঙানির স্বর চাপা দিত ছাই ওড়া চিতার উচ্ছ্বাস।
চারধারে দাউ দাউ পাণ্ডুলিপির মুখাগ্নি,
মেয়েটি বুঝেছিল একটা সংসারধর্ম আর একটা কবিজন্ম এক না।
আমার মধ্যে ছিল মৃদুল মহাকাল, হিমাংশু বৈশ্বানর।
কবিতাঃ ভাস্কর সিনহা
দোহা, কাতার
আলোক প্রতিমা
তুমি ছিলে ঝড়,
তুমি ছিলে বালি,
এলোমেলো বিবাগী হাওয়ায়-
ঘর রেখে গেলে
খালি।
তুমি এলে শান্ত উঠোনে,
ভারী কালিমেঘ কেটে
ঝরঝরে জ্য়ান্ত সকালে।
ঝলমলে রঙিন গান
হাসি, আবেগ মিলেমিশে
জীবনের কুহুগান।
নিদ্রালু, বেবাকি পথহারা
জন
তুমিই তাদেরি সহায়ে
পরমপ্রীত মন।
আলোকবর্তিকা হয়ে
রাস্তাভোলাদের
প্রাণবন্ত রুদ্র আলোকপ্রতিমা।
একটু হাতটা বাড়িয়ে দাও
একটু বাড়াও-
হাতটা
একটু বাড়াও।
কতো ক্ষয়ে যাওয়া
বিবর্ণ জীবনে
ফিরে আসে রামধনু।
পাগলাঝোরার জলোচ্ছ্বাসে
সাজানো বাগানে
যেন
চঞ্চল প্রজাপতি,
আর মধুলোভী ভ্রমরের দল।
রঙিন পাঁপড়িরা ডানা মেলে
অনায়াসে ভেসে যায়-
আনন্দধামে।
একটু ধরলেই-
আর অভয় দিলেই-
কতশত দলছুট,
কত ভয়ার্তজন
উদ্দীপনে জাগরূক
সঙ্কুচিত প্রাণ।
সবাইএর কি আসে কবিতা?
তবুও কিছু শব্দ বয়ে আনে
কবিতা,
গতিময়তা, উজ্জ্বলতা
এই ভঙ্গুর জীবনে।
শব্দ নিয়ে ছবি তুলি,
ছন্দ দিয়ে সুর তালকে-
বাঁধা বা ছাড়া।
তবলার বোলের মত,
সেতারের তার টানা।
গথিক শিল্পের মতো-
ধীরে ধীরে মেদ, ফেনা, বুদ্বুদ
বাতিল হওয়া,
প্রস্ফুটিত হওয়া
দেবরূপ।
সুছন্দে, সুতালে
সুরেলা বোল-
সবাইএর কি আসে?
কবিতাকে করেছি রাত
কবিতাকে দিন।
কবিতাকে ব্রত-
নিশ্বাসে প্রশ্বাসে
কবিতা।
অস্ফুট থেকে প্রবল-
জলদগম্ভীর।
মনে প্রাণে বাড়বাড়ন্ত
কবিতা।
প্রবল বাণ, স্ফীত ফেনাচ্ছ্বাস
সব শান্ত হয়,
নিশ্চুপ, নিরুচ্চারিত
সুশীতল গম্ভীর কবিতায়।
কবিতাঃ পলাশ দাস
বারাসাত, ন-পাড়া, উঃ ২৪ পরগণা
প্রান্তিক
জনহীন উঠোনের মতো নিস্তরঙ্গ অন্ধকার
শরীরে ধুপের গন্ধ
শাঁখের চিৎকার
তবুও, উত্তাপ হীনতা বাসা বাঁধছে, বাসা বেঁধেছে
নিভে যাওয়া জোনাকি দল
হাতে লাগছে শীতের হিম
শান্ত হতে হতে ধীর হয়ে আসছে হিমোগ্লোবিন উত্তাপ
ঠেলতে ঠেলতে ধুলো মোড়া কোণে জমা হচ্ছে দৈনিক চলাচল
আর প্রান্তিক আমি হাতে রেখে দিই
সর্ষে ফুল আর বুনো-ফুল বাতাসের ঢেউ
মেঘের মানুষ
আগুনের মাঠ পেড়িয়ে গেলে আমাদের বাড়ি
দু একটা মানুষ দিয়ে সাজানো পথ
নিঝুম জঙ্গলের মতো কিছু আস্তানা
মাথা তুলে থাকে
সারাদিন নরম রোদের নীচে
জলের স্রোত কেটে কেটে তুলে রাখে জনৈক
উঠে আসে রাস্তায় শেষ বিকেলের দিকে
পরনে লেগে থাকে ছায়ার ফ্যানা
মেঘের থলেতে ভরে নেয় দিনের রোজগার
এরপর ফ্যানা ঝেড়ে ফেলে চলে যায় সেই রাস্তা বেয়ে
পথে কোনো ছায়া পড়ে না
অণুগল্পঃ শ্রীপর্ণা নিয়োগী
রোম্যান্টিক
লোকটাক লেক, মণিপুর। খামখেয়ালি প্রকৃতির এক অদ্ভুত শিল্পকর্ম দেখতে অনেক বাঙালি টুরিস্ট ভিড় জমিয়েছেন দেখলাম। হালকা ঠান্ডা, মিষ্টি রোদ, হ্রদ এর ওপর দিয়ে বয়ে আসা ঝিলমিলে হাওয়া, জল আর নলখাগড়ার বিচিত্র আলপনা সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে শুষে নিতে চাইছিলাম ভালো লাগাটা। লেক টাকে ঘিরে অজস্র গাছ। তাতে বাবুই আর ফিংগের ওড়াউড়ি। লেকের চারদিকে ছোট ছোট টিলা। একটা ক্যাফেটেরিয়া আর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো অনেক বসার জায়গা। এক মধ্যবয়সী দম্পতি দুই কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। ছেলেরা জুম লেন্সে চোখ রেখে লেকের শোভা ক্যাপচার করতে ব্যস্ত। হঠাৎ শুনলাম, ভদ্রলোক গিন্নির দিকে তাকিয়ে গাইছেন- "যে ছিল আমার স্বপনচারিনী...."। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে তাহলে ছাপোষা মধ্যবিত্তের ও রোমান্স উথলে ওঠে!
লোকগান - কুলে নাই রে কেউ
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
দিল দরিয়ায় উঠল রে ঝড় উথাল পাথাল করে ঢেউ
আমার একূল ওকূল দুকূল ভাঙ্গে কোনো কূলে নাইরে কেউ।
আমি উজান স্রোতে যাই গো ভেসে
তোমার খোঁজে দেশে দেশে গো
কত নগর এলো গেলো বিভুঁই বিদেশে
আমায় ফেলে কোথায় বন্ধু গেলে নিরুদ্দেশে।
আমার মনোবনে শ্রাবণ ঝরে
এমন মধুর ফাগুনেও
দিল দরিয়ায় উঠল রে ঝড় উথালপাথাল করে ঢেউ।
দুই চোখে মোর জ্বলছে আঁধার নাইরে দিবানিশি
পেলেম না তো এমন সাগর যেথায় আমি মিশি
(বন্ধু যেথায় আমি মিশি)।
আমার বুকের জ্বালা রইল বুকে থাকো বন্ধু তুমি সুখে
দুখের দরিয়া আমি ভাসব আকুল দুখে।
সুকান্তর সেই একই দশা কোনো কূলে নাইরে কেউ
দিল দরিয়ায় উঠল রে ঝড় উথালপাথাল করে ঢেউ।
গল্প
ছিন্নমূল
কল্যান সেনগুপ্ত
এন এন দত্ত রোড, কলকাতা
আলোটা নেভাতেই এক মুঠো জ্যোৎস্না জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে মেঝেতে। লাল মেঝেতে নীল জ্যোৎস্না গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এসে বেগুনী রঙের আলপনা দিয়ে গেছে। ঘুম আসছে না। জানলার কাছে দাড়িয়ে রইলেন সুধাময়। পাড়ার মাটি কাঁকড় দেওয়া রাস্তা আসেপাশে একটা দুটি বাড়িতে আলো জ্বলছে। ঝিঁঝিঁ পোকার টানা ঝিম ধরানো শব্দ বেজেই চলেছে। শিউলির গন্ধ মাঝে মাঝে এসে লাগছে। ঢাকার বাড়িটার কথা এখন খুব মনে হয় নামমাত্র দামে দিয়ে এসেছিলেন। আর থাকা যাচ্ছিল না। ছেলেমেয়েরা বহুদিন কলকাতায়। নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। কলকাতায় চলে আসার সময় শেফালির কথা মনে হয়েছিল খুব। কত স্মৃতি পড়ে আছে সেখানে। ত্রয়োদশীর চাঁদ আকাশে উজ্জ্বল ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। দোতলার কোনের ঘরে সুপ্রীতি বেহালা বাজাচ্ছে। হালকা ভেসে আসছে সে সুর। বেহালার হাতটি সুন্দর। মন খারাপ হলে বেহালা বজায় সুপ্রীতি। কবে সেই বাংলা বাজারের বাড়িতে শিখেছিল। আজই শেষ রাত।
আগামীকাল সুপ্রীতি, সুধাময়, ও চাকর বনমালী চিরকালের জন্যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। প্রোমোটার আসবে বাড়ি ভাঙতে। দেবাংশু, প্রিয়াংশুর আপত্তি ছিল। অমিয়াংশু আর ছোট মেয়ে নন্দিতা বলেছিল "তুমি যা ভালো বোঝ কর। দিদি আর তুমি কোথায় থাকবে এখন?"
"প্রোমোটার ব্যবস্থা করেছে। যতদিন না ফ্ল্যাট বাড়ি শেষ হয় ততদিন সেখানেই থাকবো"।
দেবাংশু বলেছিল "সবাই দেখি আকঁড়ে রাখে। কত অশান্তি বাড়ি বেচা নিয়ে চারিদিকে, অথচ তুমি নিজেই দিয়ে দিলে প্রোমোটার কে?" কোনো উত্তর দেন নি সুধাময়। প্রোমোটারকে দেবার পর
দেবাংশু, প্রিয়াংশুর, অমিয়াংশু আর নন্দিতা বারবার প্রশ্ন তুলেছে "বাবা তুমি কি করতে চাও এই ফ্লাটগুলো পেয়ে? কেউ বললে রেখে দাও। কেউ বললে বেঁচে দাও? প্রোমোটার এর কাছে চারটে ফ্ল্যাট সঙ্গে টাকা কিছু পাওনা। কিছু কম নয়। সুধাময় বারবার বলেছেন "এসব আমি কিছু জানি না। আমি যাবার আগে তোমাদের দিদির জন্যে কিছু করে যেতে চাই। কিছু ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে। তোমাদের দিদি যে রকম ভালো বুঝবে তাই করবে। আমি তাই চাই। প্রিয়াংশু বলেছিল "ওগুলো বেচে সবাই ভাগ করে নাও। তাহলেই ল্যাটা চুকে যায়। অমিয়াংশু বলেছিল" একটাতে দিদি আর বাবা থাকুক আর বাকিগুলো বেঁচে দাও। দেবাংশু নিজে একটা বাড়ি করতে চায় তাই টাকা হলেই ভাল হয়। প্রোমোটারকে বললে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।নন্দিতার কোন মত নেই। বাড়িটাই ভেঙে যাবে। ওর অনেক স্মৃতি ওখানে পড়ে আছে সিড়ি, পাঁচিল, শিউলি ফুল ভরা পিছনের উঠোন। আমগাছটা। সুপ্রীতি ভাবল ছোটবেলা থেকে একটা বাড়িতেই সবাই থেকেছি। কেউ বললে না চল সবাই মিলে নানা ফ্ল্যাট মিলিয়ে এক হয়ে থাকি। এখন বড় হতে প্রত্যেকের আলাদা হতে হয়। তাই বোধ হয় নিয়ম। তাই বলেছে বাবার যা মত আমারও তাই।শেফালী যখন চলে যায় ছেলেমেয়েরা সবাই তখন ছোট। একমাত্র সুপ্রীতি তখন স্কুল পাশ করেছে। মায়ের অসুখের জন্যে কলেজে ভর্তি দেরি হচ্ছে। মায়ের দীর্ঘ অসুস্থ থাকা আর ঢাকার অস্থির সময় সুপ্রীতিই আগলে রেখেছিল ভাইদের। ওকালতি পশার তখন বেশ জমজমাট।
বীরভূমের
ডাইরির
অপর্ণা চক্রবর্তী
টালিগঞ্জ, কলকাতা
প্রবন্ধ
পর্ব - ১
আসলে প্রকৃত ঘোরার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা হয় না। কিন্তু, ফেরার হয়। ঘোরা বলতে শুধুই রাস্তা হতে পারে। হতে পারে নির্জনে একাকার নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় খোলা আকাশের নীচে একলা বসে থাকা। হতে পারে দিগন্ত বিস্তৃত হলদে সবুজ ধানক্ষেত। হতে পারে জলের আয়নায় ভাসতে থাকা আকাশের একফালি ধুসর নীল মুখ। অথবা আমার দিদিভাইয়ের নরম আঁচলের মতো কচি সবুজ বীজতলা ধানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিমেল হাওয়া। এসবই আমার ঘুরে বেড়ানোর অনির্দিষ্ট ঠিকানা।
আমার মামার বাড়ির পুকুরের জলের ওপর শীতের পাতলা কুয়াশা খেলা করতো। আমার দিদিভাই (দিদা) সেই ধোঁয়া ধোঁয়া সবুজ জলে স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে উঠে আসতো পুকুর থেকে। উঠানে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই বলতো "ঠান্ডা লেগে যাবে সোনা, সোয়েটার পরো"। আমার তখন সদ্য ঘুম ভাঙা চোখ। আর দিদিভাইয়ের চোখে তখন আমার ঘুম ভাঙা মুখের প্রতি অপার স্নেহ।
শীতের সকালে জলে নামলে, কাদা ঘাঁটলে আমার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে- এই একই কথা, প্রায় একই স্নেহের সুরে, আমার এই অবেলা বয়সে শুনলাম মালতী হাঁসদার মুখে। বীরভূম কখনো আমাকে ফেরায়নি। কখনো আমাকে দূরে ঠেলেনি। আমি যতবার আসি ততবার আমাকে আঁচল পেতে দেয়। এবারেও তার অন্যথা হলো না।
আলের ধারে বসে মালতী হাঁসদার বীজতলা ধান রোয়া দেখছিলাম একমনে। একবার শুধু বললাম -- শেখাবে? সে জিজ্ঞেস করলো- "তু থাকিস কুথাটো?"
আমি বললাম - কলকাতায়।
সে বলল - "আই...পাইরবি লাইকি দ্যাখ।"
তারপর আবার বলল- "ঠান্ডাটো লাগাইস না বিটি।"
এমনিই হিম হিম সকালে এই শব্দ গুলো আমার খুব পরিচিত। এ শব্দকটিই দিদিভাইয়ের বুক থেকে উঠে আসা সেই ছোট্টবেলায় আমার প্রতি তার স্নেহের সোচ্চার প্রকাশ। বীরভূম আমার দিদিভাই এর জন্মভূমি। আমার জীবনের সব থেকে প্রিয় মানুষটি, বীরভূমের হাওয়ায় তার প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছিল।
পর্ব - ২ঃ ডাইরির পাতায়
তখনকার জমিদারদের রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর যে সমস্ত অত্যাচারের এবং প্রতিপত্তি বিস্তারের গল্প শোনা যায় - ঘোষালরা নাকি তেমন প্রকৃতির জমিদার ছিলেন না। তালতোরের জমিদার বাবুরা অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, প্রজা বৎসল এবং মাটির মানুষ বলেই পরিচিত ছিলেন। গ্রামের ভিতরে এখনো জমিদার বাড়িটি রয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম এবং শরীকরা মিলে সাড়ম্বরে দূর্গা পুজোর আয়োজন করেন এখনও। পাশেই আছে ভগ্নপ্রায় কাছারি বাড়ি। এখনো সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যত্রতত্র জমিদারী এবং রাজস্ব আদায়ের দস্তাবেজ নথিপত্র ছড়িয়ে আছে। আনা - গন্ডা - কড়া - ক্রান্তির হিসাব নিকাশের কাগজ লাট করে রাখা আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের এবং পরের বহু জমিদারী রাজস্ব আদায়ের নথিপত্র, চিঠি, দলিলপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে তালতোর কাছারিবাড়িতে। জমিদারী ব্যবস্থা অবলুপ্ত; তাই এই সব হিসেব নিকেশ সংরক্ষণের আর কোন প্রয়োজন নেই। হয়তো ইতিহাসের প্রয়োজনেও কেউ সংরক্ষণের কথা ভাবেনি। কেন ভাবেনি, সেকথা আমার জানা নেই। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি আর অতীতের সেই দিন গুলোর কথা ভেবে অবাক হই আশ্চর্য হই।
কি এই কাগজের ইতিহাস! কার এই হস্তাক্ষর! কেমন ছিলেন এই কাছারি বাড়ির নায়েব! কোন সাহেবের ভারি বুটের আওয়াজ শোনা যেত এই দালানে! কাছারির সিঁড়িতে বসে বসে ভাবি আর শিহরিত হই।
আগেও বলেছি বীরভূম আমাকে কখনো খালি হাতে ফেরায় না। কিন্তু, অধরাই থেকে যায় বারবার। তাই আমাকে আবার ফিরতে হয়। বারবার ফিরতে হয় এখানেই।
"কে সে মোর, কেই বা জানে,
কিছু তার দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে..."
পর্ব - ১ঃ ডাইরির পাতায়
পরম যত্নে মালতী আমায় শেখালো কিভাবে বাঁহাত দিয়ে বীজতলা গোছা করে ধরতে হয় কিভাবে নীচু হয়ে ধান রুইতে হয়। কিভাবে রোয়ার সময় পা কাদায় আটকে রাখতে হয়, আর তালে তাল একপা করে পিছনে সরে সরে রোয়ার কাজ সম্পন্ন করতে হয়।
এরপর আমি অবান্তর প্রশ্ন করে ফেললাম --- কটা করে পুঁততে হবে। মালতী হাঁসদা আমার সরল প্রশ্নে হেসে উঠে বলল--- "কুনো হিসাব লাই রে বিটি। দুইটো চারটো যা তুর দু আঙ্গুলে উইঠ-বেক, সেইটো রুইয়ে দিবি"।
সত্যিই তো- ওভাবে হিসেব করে কি ভালোবাসার বীজতলা রোপণ করা যায়! আমার মতো শহুরে মানুষের মগজে শুধুই পাটি গণিত ঠাসা থাকে। আমরা কেবল হিসেব করেই জীবন কাটিয়ে দিলাম। আমাদের বারান্দায় পোষা শালিক পাখির মতো, একটা পোষা হেলিকপ্টার হলেও যেন মন্দ হয় না।
আর মালতীর শুধু এক পেট ভাতের জোগাড় হয়ে গেলেই দিনান্তে সে সব থেকে সুখী মানুষ। তবুও সে অনায়াসে আমার সাথে তার দুপুরের মুড়ি-জল, পিঁয়াজ- লঙ্কার স্বাদ ভাগ করতে চেয়েছিল। সকালে ভাত খেয়ে মাঠে এসেছে। দুপুরে জল দিয়ে মুড়ি মেখে লঙ্কা দিয়ে খাবে মালতী হাঁসদা। এই খাবারের স্বাদও আমার দিদিভাই-এরই স্বাদ। সকালে স্নান সেরে, পিঠে ভিজে চুল ফেলে, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ পরে তোলা উনুনে রান্না চাপাতো আমার দিদা। ততক্ষণে আমাদের সবার জলখাবারের পর্ব শেষ। আর দিদিভাই খেত - তেল জল লঙ্কা সহযোগে মুড়ি মাখা। কখনো সেই মুড়িতে রাঁধুনি ধনেপাতা ফোড়নের গরম ডালের জল খানিকটা মেখে নিতো। আমার মুখেও সেই মাখা মুড়ির দু-একটি গ্রাস তুলে দিতো বুড়ি। আমার বুড়ি দিদা। আমার ছোটবেলার রূপকথার দিদা। আমার দিদিভাই।
সেই বয়সে স্কুলব্যাগে রাখা সহজ পাঠে যতবার পড়েছি -
"ওইখানে মা পুকুর-পাড়ে
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে
হোথায় হবে বনবাসী,
কেউ কোত্থাও নেই।
ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে,
শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে
থাকব দুজনেই।"
কল্পনায় আমি ততবার সেই পাতার ঘরদোরে সংসার পেতেছি আমার দিদিভাইয়ের সাথে। মালতী হাঁসদার তেমনি একখানি ঘর আছে জানলাম।
"ধান রুইছিস, কাইটতে আইসবিক লাই?" - নরম রোদের মতো সরল হাসি ছড়িয়ে মালতী আমার কাছে জানতে চেয়েছে।
কথা দিয়েছি আসবো। ভাগ করে নেব শ্রম। ভাগ করে নেব মেহনতির ঘাম। আর তাল পাতায় ছাওয়া ওর দাওয়ায় বসে ভাগ করে নেব বাসি ভাতে নুন-লঙ্কার স্বাদও। আমি কথা দিয়ে এসেছি।
ও হ্যাঁ একটা কথা বলা হয়নি- আমার দিদিভাই এর নাম ছিল আরতি। আর এবার বীরভূম সফরে তেমনি অপার স্নেহে আমায় পরিপূর্ণ করলো মালতী।
নামের ছন্দে কি অদ্ভুত মিল, তাই না!!
ততক্ষণে আমি আর কথা না বাড়িয়ে পায়ে পায়ে চলে এসেছি মালতীর কাছে। আমার পায়ের তলায় তখন সেচ দেওয়া জমির নরম কাদা-মাটি-জল। দিদিভাই এর বুকের মতোই কোমল সেই মাটির স্পর্শ।
পর্ব - ২
প্রথম কবে আমি "শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত" ওই সাঁওতালী ছেলেটির প্রেমে পড়েছিলাম, আজ আর মনে পড়ে না। খোলা মাঠের ওপারে বাড়ি ওই কালো মেঘের মেয়ে কৃষ্ণকলির- কালো হরিণ চোখে কবে থেকে মজে আছি, সে হিসাব আমি দিতে পারবো না। হয়তো জন্মাবধি নয়তো পূর্বজন্ম থেকেই। বীরভূম আমার কাছে কখনোই সম্পূর্ণ রূপে ধরা দেয়নি। প্রতিবার অপ্রাপ্তি নিয়ে ফিরে গেছি। আবার ফিরে এসেছি সমর্পিত হতে। বৃষ্টিভেজা বীরভূমের চোখে মায়াকাজল রেখায় সম্মোহিত হতে, আমি ফিরে আসি বারবার।
বীরভূমের পশ্চিমাংশের এলাকা মূলত জঙ্গলাকীর্ণ, ছোটনাগপুর মালভূমির অংশবিশেষ। লাল মাটির বীরভূম বরাবরই এর ভূসংস্থান এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। বীরভূম নামটা সম্ভবত বীর রাজাদের থেকে এসেছে বলে মনে করা হলেও সাঁওতালী ভাষায় "বীর" শব্দের অর্থ অরণ্য, তাই বীরভূমের অর্থ অরণ্যময় ভূমিও হতে পারে।
আজ ভোরবেলা ঘুরতে ঘুরতে এসেছিলাম বীরভূমের তালতোর। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে জমিদাররাই তাঁদের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত এলাকায় রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। তালতোরের ঘোষালরা ছিলেন তৎকালীন প্রতিপত্তি সম্পন্ন জমিদার। এখানকার শেষ জমিদার ছিলেন শ্রী ভাদেশ্বর ঘোষ। গ্রামের মানুষজনের কাছে 'ভাদুবাবু' নামেই সুপরিচিত।
পর্ব - ৩
একবার পথে বেরিয়ে পড়লে পথ ঠিকই টেনে নেয় মানুষকে। প্রকৃতিও কখনো মুখ ফেরায় না। প্রকৃতির কাছে প্রেম সমর্পিত হলে, প্রকৃতিও আগলে নেয় সমস্ত মনস্তাপ।
দুপুর গড়ালে লালমাটি থেকে রোদের গন্ধ ওঠে। সেই গন্ধ বুকে নিয়ে মনে হয় - বেঁচে আছি এই তো অনেক পাওয়া! এই লালমাটি, এই শালবন, এই অদেখা বীরভূম কে ভালোবাসি বলেই, আমি আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে চাই।
সর্ষের ক্ষেতের ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে যায় নিরুদ্দেশ রাস্তার দিকে, আর শুকনো ফসলের গায়ে গায়ে লেগে অদ্ভুত ঝুমঝুমি বাজিয়ে যায় ক্ষেতের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। বুঁদ হয়ে শুনি সেই শব্দ। নেশা লাগে। নিস্তব্ধতা ঝিম্ ধরিয়ে দেয়। অচেনা গ্রামের পুকুরে জলমাকড়শা জলের ওপর ভেসে ভেসে আলপনা দেয়। রাংচিতার ঝোপ থেকে ফুল তুলে, জিভ ঠেকাই ফুলের গর্ভে। আহ্, কি মিষ্টি! এই তো আমার ফিরে পাওয়া ছেলেবেলা! খুঁজে পাওয়া আমিকে আরেকবার জাপটে নিতে ইচ্ছে করে জীবন দিয়ে।
নিঝুম সন্ধ্যা নামে কোপাইয়ের জলে।
কুকসিমে, আকন্দের ঝোপ থেকে আমারই মতো দু'একটা ঘরছাড়া জোনাকি টুপটাপ জ্বলে ওঠে একা।
-"ম্যাডাম চলুন, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। হোটেলে ফিরবেন তো!" ...উঠে পড়তে হয় আমার শহুরে ডাকের পরিচিতি তে। নিস্তব্ধতা ভাঙে। ফিরতে হবে। ভালোবাসার দলিল দস্তাবেজ ফেলে আসি সেখানেই। একাকীত্ব যে সব সময় বিষণ্ণতা নয়, নিস্তব্ধতা যে জীবনের আরও একটা বড় প্রয়োজন, লালমাটিতে নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকার, সেটাই হয়তো উপলব্ধি করতে শেখায়।
তবে আমি তো বেড়াতে এসেছিলাম, তাই মন যতই বাউন্ডুলে হোক -সেতো সংসারের খুঁটিতেই বাঁধা থাকে। তাই এ জন্মে আমি কেবলই ভন্ড রাখাল সেজে গেলাম। সত্যি সত্যি রাখাল হতে পারলাম কই!!
পর্ব - ৩ঃ ডাইরির পাতায়
পর্ব - ৪
আমি শুনেছি তোমরা নাকি,
এখনও স্বপ্ন দেখ..."
কারও ক্ষেতের ঝিঙে, কুমড়ো, চিচিঙ্গা- সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ; কারও ঘরে একটু বসার অনুরোধ, গরুর দুধের চা খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ, কারও বা মাটির দাওয়ায় বসে ঠান্ডা কলের জল, কারও আবার শুধুই ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শহুরে মানুষ দেখা। তবে সবাই একটা অনুরোধ বারবার করেছিল - সবার কাছে কিছু না কিছু খেয়ে যেতে হবে।
"আমাদের ঘরে আসেন, ভাত খেঁইয়ে যান..."
"কুটুমকে শুদু শুদু যেইতে দিতে লাই!! দুপুরে দুটো খেঁইয়ে যান গো..."
"এমনি ছাইড়বোক লাই ... কিচ্চু তো খেঁইতে হব্বেই"
বীরভূমের প্রত্যন্ত কিছু গ্রাম-
পাঁচশয়া, নমক্ষরা, দুলাইপুর, বাঁধলোডাঙা। সকাল ৬টা ১৫ নাগাদ বোলপুর থেকে বেরিয়ে- নমক্ষরা পৌঁছতে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজলো। ত্রিশ পঁয়ত্রিশটি দরিদ্র পরিবারের বাস। কাচিকাঁচা গোটা পঁচিশ জন। কোভিডে সবার স্কুল বন্ধ। পুজোয় নতুন জামাকাপড় হবে কিনা ওরা কেউ জানেনা। ওদের সাথে একথা সেকথা নানান বকবকানিতে কখন ঘড়ির কাঁটা বেলা বাড়িয়ে বসে আছে খেয়ালই করিনি।
গ্রামের চারপাশে সাদা কাশের দোলা। ক্ষেতে উপচে পড়া সবুজ হলুদ ধানের শীষ।
সেদিকে চুপকরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে যাওয়া এমন কোন আশ্চর্য ঘটনা নয়। একা বসে থাকতে থাকতে আমার শহুরে জীবনের প্রতিদিনের ব্যস্ততা, এমনকি কোথায় কোন মাঠের ধারে বসে আছি, কিছু সময়ের জন্য সেটাও জাস্ট ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।
সামনে যতদূর চোখ যায় ততদূর সবুজ! খেটে খাওয়া মানুষের পরিশ্রমে হলুদ সবুজ রঙ ধরেছে। ক্ষেত আলো করে আছে কচি ধানের শীষ। ঝিরঝিরে হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। দেখে মনে হয় এ যেন প্রকৃতির ড্রইংরুমে পেতে দেওয়া কোনো সবুজ গালিচা, নয়তো আলমারির কোনায় পড়ে থাকা সবুজ খোলের দামী জামদানিটা কেউ আজ মাঠের মাঝখানে বিছিয়ে দিয়েছে। সাদা -সবুজ -হলুদ রঙের কম্বিনেশন দেখে দেখেই আমার এবারের পুজো শপিং শর্টেড।
পুজোর আগে আমার তুচ্ছ ক্ষমতায় ওদের যা দিতে গিয়েছিলাম, তার বহুগুণ ভালোবাসা, আদর-যত্ন নিয়ে ফিরলাম। আবার আসব কথাও দিয়ে এলাম।
এবার শুধু জবরদস্তি আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দেওয়া গাছপাকা কতবেল গুলো তেল-নুন-লঙ্কা দিয়ে মেখে খেতে খেতে - আবার কবে যাওয়া যায় সেই পরিকল্পনাটা করা বাকি।
গল্প
পুজোর গল্প
রীনা নন্দী
বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, কলকাতা
পুজোয় প্রেম
বুলু নামের কোনো এক মনীষী বলেছিল বুবাইকে,
- ‘পুজোর সময় একেবারে প্রেমে পড়বি না। তখন শালা সব মেয়েরাই সেজেগুজে অপ্সরী। সকলের ফাঁট দেখলে মনে হবে, এইমাত্র বাপ গলির মুখে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গেলো। হাতে মোবাইল ফোন, চুলে কালার, মুখে মেকআপ, শরীরে চাপানো হকার্স কর্নার থেকে কেনা জিনস্, স্কার্ট, সালোয়ার, চুড়িদার, পায়ে হাইহিলে যেন সব বড়লোক বাপের দুলালী! বুঝলি মেয়েগুলো এইসময় ছিপ নিয়ে বেড়োয়। ছেলে ধরতে। পুজো কেটে গেলেই জলে পড়া ঠাকুরের মত সব রঙ চটে যায়।’
বুবাই তার বন্ধু বুলুকে এসব ব্যাপারে সত্যিই মনীষী মানে। এসব ক্ষেত্রে বুলু গুরুদেব লোক। ছোটবয়স থেকে প্রেম করে এসেছে। প্রাক্-প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে এসব ব্যাপারে সে রীতিমতো অভিজ্ঞ। তার এমন জ্ঞান দেওয়ার হক্ও আছে। সে নিজেও প্রেমে পড়েছে পুজোর সময়। সেই প্রেম গাঢ় হয়েছে ক্রমশ:। প্রেমিকাকে বিয়েও করেছে। কিন্তু তার ঝাঁ চকচকে প্রেমিকার রঙ চটকে গেছিলো ছাদনাতলায় যাওয়ার আগেই। তখন বুলুর ফাঁদে পড়া মুরগির মতই অবস্থা। তার প্রেমিকা তখন বাবা দেখাচ্ছে, পাড়ার দাদা দেখাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতা দেখাচ্ছে। বুলু তখন চমকে চিত্তির। চমকে চমকেই ছাদনাতলায় যেতে বাধ্য হয়েছে ।
তার বউ বলেছিলো, তার বাপের মাছের আড়ত আছে। শেষে দেখা গেলো জগুবাবুর বাজারের সামনে মাছ নিয়ে বসে। বউ বিয়ের আগে বলেছিলো তাকে বিয়ে করলে বাপ জামাইকে পঞ্চাশ হাজার যৌতুক দেবে। বিয়ের সময় শ্বশুর তার কাছ থেকেই ধার নিয়েছিলো দশ হাজার! আর শোধ দেয়নি সে টাকা।
সুতরাং বুলুর অভিজ্ঞতা রীতিমত ফলিত বিজ্ঞান। বুবাই অক্ষরে অক্ষরে মানে তার কথা। সে এই প্রৌঢ় বয়সেও প্রেমে পড়তে ভয় পায়। আর পুজোর সময়তো সে পথে কোনো মেয়ের দিকে পারতপক্ষে তাকায় না পর্যন্ত !
শারদীয়ার গল্প
সুবিমল শারদীয়া বইটায় অবিনাশের গল্পটা দেখে চমকে ওঠে। আশ্চর্য তো কিভাবে গল্পটা ছাপা হলো ! সে তো দু'বছর হলো মারা গেছে! আঁতিপাতি করে খোঁজে বইটায়। কোথাও কি পুনর্মুদ্রণ লেখা আছে! নাহ্, কোথাও কিছু লেখা নেই তো। একেবারে নতুন লেখা। কিভাবে হয় এটা! সুবিমল গল্পটা নিয়ে তখনই বসে যায়। পড়ে ফেলে পুরো গল্পটা। খোঁজে কিছু একটা। আসলে সে চরিত্রগুলোর মধ্যে নিজেকে খোঁজে। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। অবিনাশ বেঁচে থাকতেও সুবিমল ওর গল্প কোথাও প্রকাশ পেলেই এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করতো। অন্য কোনো লেখকের লেখার প্রতি সে তুলনায় কমই নজর দিতো।
একসময় অবিনাশ সুবিমলের বন্ধু ছিল; এখন অবশ্য শত্রু। শত্রুতার ধারাই বজায় ছিল অবিনাশের মৃত্যু ইস্তক। যখন তারা লেখার জগতে প্রবেশ করেছিল তখন তারা দুজনেই ভালো বন্ধু ছিল। গল্প, আড্ডা, একে অপরের নতুন লেখা পড়া -- কী নয়! এমনকি একবার সুবিমল অসুস্থ হয়ে পড়লে অবিনাশ তাকে হসপিটালে ভর্তি করা। সেবা শুশ্রূষা, ওষুধপত্তর সব করেছিল। মেসবাড়িতে সুবিমল তখন একা অবিনাশই তার মা হয়ে, বন্ধু হয়ে অসুখ সারিয়েছিলো। অথচ তারপর কি যে হলো! অবিনাশ হাউইয়ের গতিতে নাম করতে থাকলো। বিশেষ করে পুজোসংখ্যাগুলোতে তার লেখা বাঁধা। বেশ কিছু বছর ধরে প্রতিটা পাবলিকেশান হাউসের পুজোবার্ষিকীতে অবিনাশ রায়ের নাম জ্বলজ্বল করতো। নতুন নতুন গল্পের বই প্রকাশ পাচ্ছে প্রতি বছর।
সুবিমলের হঠাৎ কি হলো, তার ভিতর কেমন হতাশা আর হীনমন্যতা এসে জুড়ে বসলো। তার মনটাকে গ্রাস করতে শুরু করলো। মনে হতো অবিনাশ তাকে উপেক্ষা করছে। তার সঙ্গে যেন বন্ধুত্ব রাখতে লজ্জা পাচ্ছে। অবিনাশের কিছু আচরণ ইন্ধন যোগালো তার ভাবনায়। এইভাবেই একটু একটু করে ধোঁয়াতে লাগলো ক্ষোভ বিক্ষোভগুলো। মনের মধ্যে পাক খেতে খেতে একসময় ঘূর্ণিঝড় হয়ে তাদের মধ্যে যে বন্ধুত্বটা ছিল সেটা ঝড়ে ভেঙে পড়া পাখির বাসার মতই ভেঙে পড়লো। আর রয়ে গেল অদ্ভুত টানাপোড়েন। বলা যায় আকর্ষণ-বিকর্ষণ খেলা।
অথচ যেখানে যত অবিনাশের গল্প বেরোতো সুবিমল গোগ্রাসে পড়ে ফেলতো। যেন কিছু খুঁজতো।
আসলে সে নিজেকেই খুঁজতো। এইভাবেই একদিন অবিনাশ দূরে চলে যেতে যেতে, একেবারেই দূরে চলে গেলো। সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অবিনাশ মারা গেলো। এখন আর সুবিমল কিছু খোঁজে না। কোথাও কোনো গল্প বেরোয় না অবিনাশের; সুবিমলেরও খুঁজে ফেরা শেষ হয়ে গেছে চিরতরে। অথচ আজ এতদিন পর কিভাবে এই শারদীয়াটায় প্রকাশিত হলো ওর গল্প! বইটার প্রকাশক তার চেনা। ফোন নম্বরও আছে। সুবিমল ভাবে, ফোন করবে প্রকাশককে। তারপর অবশ্য সংযত হয়। ভাবে, দরকার নেই অনাবশ্যক এই আগ্রহ প্রকাশের। বাইরের মানুষ বুঝবে না এই অদ্ভুত টানাপোড়েন।
সুবিমলের মনে হয়, হয়ত বহুদিন আগে অবিনাশ ঐ প্রকাশককে গল্পটা দিয়েছিল। কিংবা---! সে কেমন ধাঁধার মধ্যে পড়ে যায়। শারদীয়া বইটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। অবিনাশের পুরনো স্মৃতি তাকে থমকে দেয়।
ওরা বড় হয়ে গেলো
টেঁপি আর ভোম্বল --- দুই ভাই বোন এখন বেশ মাতব্বর হয়ে উঠেছে। মায়ের কথা এখন আর খুব একটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার প্রয়োজন বোধ করে না দুই ভাইবোনই। দুজনেই পুর-স্কুলের প্রাথমিক বিভাগ পেরিয়েছে। টেঁপি এখন সেভেন আর ভোম্বল সিক্স। তাদের ঝুপড়ির কাছেই বুড়ো শিবের বস্তিতে থাকে শ্যামলদা। সন্ধ্যেবেলায় শ্যামলদার ফ্রি-কোচিং ক্লাসে পড়তে যায় তারা।
ওদের মা এখন কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে। বাসনমাজার কাজগুলো ছেড়ে দিয়েছে। আসলে টেঁপি ভোম্বল বলে বলে ছাড়িয়েছে। ওদের ভালো লাগে না মা ঐ কাজ করুক। তার থেকে রান্না করার কাজটাই ভালো। একটু বেলা করে কাজের বাড়িতে যায় মা।
দিনকাল এখন বেশ পাল্টে গেছে। টেঁপি আর দশমীর রাতে মা দুর্গার বিসর্জনের পর গঙ্গায় ঝাঁপায় না। গঙ্গার বুক থেকে ঠাকুরের সাজ, গয়নাগাটি, গণেশ কার্তিকের ছোট কাঠামো টেনে আনার কাজটা অবশ্য সে স্বেচ্ছায় ছাড়েনি। মা আশারানি বকাঝকা করে ছাড়িয়েছে। তার এক কথা, মেয়েটা বড় হচ্ছে। ‘টেঁপি তুই যাবি না।’
ভোম্বল অবশ্য প্রতি বছরই দশমীর রাত থেকে জলে ঝাঁপায়। ছোটো ঠাকুরদের কাঠামো টেনে আনে । ঠাকুরের সাজ, অস্ত্রশস্ত্র টেনে আনে। তাদের ঝুপড়ি ঘরের বাইরে একপাশটা ভরে যায়। দুর্গা পুজোর পর কটা দিন ভোম্বলকে গঙ্গা যেন টানতে থাকে। টেঁপি বাড়িতে বসে থাকে বটে কিন্তু মন মানে না। মাঝেমাঝেই গঙ্গার পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ভোম্বলের কাজ।
টেঁপি ঝুপড়ির সামনে বসে বসে সাফসুতরো করে ঠাকুরের সাজ, অস্ত্রশস্ত্র। সন্ধ্যেবেলায় অবশ্য দুই ভাইবোন মিলেই যায় মন্ডলবাবুর দোকানে। টেঁপির ভালো লাগে ভাইয়ের সঙ্গে যেতে।
মন্ডলবাবু গত বছর বলছিল, ‘আরে টেঁপি কত বড় হয়ে গেছিস? এবারতো তোর মাকে পাত্র খুঁজতে হবে।’টেঁপি লজ্জা পেয়েছিল। মন্ডলবাবুটা কি যে বলে! তার কি বিয়ের বয়স হয়েছে না কি! ভোম্বলটা মন্ডলবাবুর কথা শুনে হাসছিল। টেঁপি ধমকেছিল ভাইকে, ‘এই হাসছিস কেন?’
এতে আবার মন্ডলবাবু আর ভোম্বল আরো হাসতে লাগলো। ওদের হাসি দেখে টেঁপির রাগও হয়েছিল আবার মজাও লেগেছিল। এ’বছর পুজোর সময় একটা শাড়ি দেওয়ার জন্য টেঁপি আগাম বলে রেখেছে মিতালি সংঙ্ঘের বুড়োদাকে। দুর্গা ঠাকুরের চরণে কত শাড়ি পড়ে! লাল পাড় শাড়ি, ছাপা শাড়ি, জরিপাড় তাঁতের শাড়ি - কত রকম! মায়ের পায়ে ছোঁওয়ানো একটা রঙচঙে ছাপা শাড়ি সে চেয়েছে বুড়োদার কাছ থেকে। বুড়োদা বলছিল দুটো দেবে।
‘দুটোর দরকার নেই একটা হলেই হবে’ -- টেঁপি বলেছে তাকে। বুড়োদা তাকে পছন্দ করে বেশ। তবে টেঁপি একটু দূরত্ব রেখেই চলে। মা বলেছে টেঁপিকে -- ‘টেঁপি ছেলেদের বেশি লাই দেবে না। দূরে দূরে থাকাই ভালো। ’টেঁপি এই কথাটা মাথায় রাখে। যদিও মায়ের সব কথা শোনে না সে। তাদের ঝুপড়ি ঘরের থেকে কিছুটা দূরে থাকে অশোক; এবার পুজোয় ওর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা আছে টেঁপির। এটা অবশ্য সে মাকে জানায়নি। গতবছর করোনা রোগের ঝামেলায় কোথাও যাওয়া হয়নি। এবারে একটু বেরোবেই ঠিক করেছে সে। ভোম্বলটা জানে দিদির সঙ্গে অশোকের ভাব হয়েছে। সেও এবার পুজোর জন্য চুলের স্পেশাল ফ্যাশন করেছে; ঘাড় চাঁছা, চুলের ধারে ধারে সোনালী রঙ। ওদের মা বলে, ‘মরণ দশা একি কাট্ রে! এতো মুরগির মত লাগছে।’ টেঁপি, ভোম্বল দুজনেই মায়ের কথায় হো হো করে হাসে। আসলে ওদের মা আশারাণী বুঝতেই চায় না যে টেঁপি ভোম্বল বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে।
গল্প
ডি-স্কোয়ার
শংকর রায়
বৃষ্টি ধোয়া সকালে সূর্যের আলোটা চোখে পড়তেই ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল দীপা। সারা বিছানায় আধবোজা চোখে কুশকে দু হাত দিয়ে খুঁজতে থাকে। চিৎকার করে কুশকে ডাকতে থাকে, কিন্তু কোনও সাড়া শব্দ নেই। বসার ঘরের লাইটটা জ্বালাতেই চোখে পড়লো একটা সুন্দর মোমের ছোট্ট পরী, পুরনো সোফাটার এক কোণে বসে আছে যেটা কুশের ভীষণ পছন্দের ছিল। প্রাক বিবাহের অমৃত ক্ষণে কুশ দীপাকে দিয়েছিলো, তার ভালোবাসার প্রতীক হিসাবে। আষাঢ়ের রিমঝিম ধারায় মনকে অবিরত আরশি করে তুললেও শাহজাহানের মতো হাহাকার করা ছাড়া তার কাছে আর আজ কিছুই করার নেই, সে যে নিজে হাতে সব ভেঙে চুরে তছনছ করে দিয়েছে। কুশকে সে ফিরিয়ে দিয়েছে কোন অনাহুত কারণে সে আজ নিজেও জানেনা। অনেক পুরনো কথা কখনো বৃষ্টির দানা, না হলে আগুনের ফুলকির মতো ভেসে আসে, একদিকে চম্পার আতরের হাতছানি আর অন্যদিকে বুনো ফুলের ক্রন্দন - সব মিলিয়ে দীপা নিজেকে আজ এক পাতকুয়ার অনন্ত গহ্বরে নিয়ে এসেছে। গতকালই ডিভোর্সের পেপারগুলোতে স্বাক্ষর করেছে তারা দুজনেই, আর আজ সকাল হতেই সব শেষ, ভোর হওয়ার আগেই কুশ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মাত্র তিন মাসের বিবাহিত জীবন, পাঁচ বছরের মেলামেশা এবং আজ তার এই পরিণতি। দীপার চাওয়াতেই কুশ ডিভোর্স দিতে রাজি হয়েছিল, তবে আজ কেন চোখে জল। তবে কি দীপা আজও কুশকে ভালোবাসে। না, না, না, সে আর কুশকে নিয়ে ভাববে না। নুতন আলোর ঠিকানা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আর কোনও রামধনুর সাত রঙে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে না, কোনও বর্ষার কাঁচের প্রাচীরে কল্পনার জগৎ আর নয়, সে আজ সঙ্গী হবে দীপালী, রীণা, করবি আর লিলির, যারা সেই কলেজ লাইফ থেকেই দীপার অন্তরঙ্গ বান্ধবী, যারা সকলেই ডিভোর্স দিয়েছিলো তাদের ভালোবাসার মানুষগুলোকে একদিন। শুরু হোক আপন পথ চলা, আপন কথা বলা। এলোমেলো সব ভাবনার মধ্যেই পুরনো দেয়াল ঘড়িটা সকাল আটটার ঘন্টা বাজিয়ে দিলো। গতকালের দীপার ডিভোর্সের খবরটা তার চার প্রিয় বান্ধবীর অজানা নয়। একটার পর একটা ফোন আসতে থাকে, চার বান্ধবী ঝাঁপিয়ে পরে দীপাকে সাহায্য করতে। দীপা না চাইলেও তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন ধরে থাকতেই হয়। কথা বলতে বলতে দীপা ক্ষণিকের জন্য জানলা দিয়ে বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার শয্যায় শুয়ে আছে একটি অসহায় কুকুর, আর তাকে ঘিরে ধরেছে অজস্র শকুনের দল। তাড়াতাড়ি ফোনে যতি টেনে দীপা ছুটতে ছুটতে চলে আসে কুশের অতি কাছের প্রিয় কুকুর লুসিকে দেখতে, কিন্তু সে যে আর নেই, সে যে কখন চলে গেছে তা দীপার হিসাবের বাইরে। ভাবতে থাকে কুশকে ফোন করবে কিনা, পরক্ষণেই মনের সারা না পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে লুসিকে খুঁজতে থাকে। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে দীপা কাছাকাছি চলে আসে সেই কৃষ্ণচূড়ার কাছে। লুসিকে চিনতে একটু অসুবিধা হলেও, দীপা চিনে ফেলে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কি করবে, কিছু বুঝতে পারেনা দীপা। দূর থেকে ভেসে আসা গানের কলি "সে চলে গেল বলে গেল না, সে কোথায় গেল ফিরে এলো না,..... তাই আপন মনে বসে আছি কুসুম বনেতে" দীপার বিক্ষিপ্ত মনকে তার মনের কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে। বাড়ি ফিরে আসে, আর ঢুকতেই চোখে পরে এক শালিক। সব অশুভ সংকেতকে সঙ্গী করেই ফিরে আসে দীপা। সকালের বাসি বিছানায় আবার গিয়ে আশ্রয় নেয়। ফোনটা তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, দীপা না চাইলেও অবশেষে ফোনটা ধরতেই হয়।
- হায় দীপা, লিলি বলছি। কখন আসছিস ডি-স্কোয়ারে।
- ডি-স্কোয়ার, সেটা কোথায়?
- সে কিরে, তুই ডি-স্কোয়ার কোথায় জানিস না। সব জেনে যাবি। ধীরে, বন্ধু ধীরে।
- হেঁয়ালি রেখে কোথায় সেটা বল।
- যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড গেট, আজ ঠিক বিকাল পাঁচটা। দীপালী, রীণা, করবি আর আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।
দীপা কোনও উত্তর না দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রেখে আবার তার বিছানায় ফিরে যায়। কুশের সাথে প্রথম আলাপের দিনটা বেশ মনে পড়ছে। তখন দীপা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কোনও এক রিমঝিম বর্ষায় সহপাঠী অম্বালিকা একদিন তার সাথে তার দাদা কুশের পরিচয় করিয়ে দেয়, ওই সেই ফেমাস বিশ্বাসদার ক্যান্টিনে। কুশ তখন
ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর চতুর্থ বর্ষের ছাত্র । নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই মশগুল ছিল। কিন্তু দীপার ওই বৃষ্টিতে লেপে যাওয়া পদ্মপাঁপড়ি নয়ন যুগলও যে অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বাসদার ক্যান্টিনে কিছুটা সময় কাটিয়ে, একটু বৃষ্টি থামলে কুশ তার নিজের গাড়িতে করে দীপাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। এরপর শুধুই আরো কাছে আসা, আরো একে অপরকে চিনে নেওয়া। পাশ করার পর কুশ একটা বেসরকারি সংস্থায় যোগদান করে, আর তারপর পাঁচ বছর শুধুই প্রেম। ইতিমধ্যে দীপাও মাস্টার্স শেষ করে ফেলে একটা স্কুলের চাকরি নিয়েছে। পরবর্তী অধ্যায় বিবাহ, মাত্র তিন মাসের। এতো তাড়াতাড়ি দীপা এই সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলবে তা কুশ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। বিবাহের পরেই দীপা বুঝতে পারে তাকে অনেক দিতে হবে, অনেক অন্তরের না-কে হাঁ -বলা, পুরুষের মনকে খুশি করা,সব কিছু মিলিয়ে দীপা ভাবে যে সে তার নারী সত্যাকে অপমান করছে পুরুষের সব আবদার মেনে নিয়ে। চেষ্টা করে দাম্পত্য জীবনের অর্থ বুঝতে, কিন্তু বার বার লিলি, করবির কথা মনে আসে।
পরের দিন ঠিক পাঁচটায় দীপা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড গেটে চলে আসে। বর্ষায় গেটের দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কদমের মিষ্টি সুবাস যেন দীপার কন্ঠে ঢেলে দেয় এক গণ্ডূষ মহুয়ার রস, যার মাদকতা তাকে আরো বেশি পুরুষ বিদ্বেষী করে তোলে। দীপা অস্থির চিত্তে অপেক্ষা করতে থাকে তার প্রিয় বান্ধবীদের জন্য। এক এক করে চার বান্ধবীর আগমন হতেই দীপা তাদের চারজনকেই একসাথে জড়িয়ে ধরে। অবশেষে, সকলেই দীপাকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে যায় ডি -স্কোয়ারের দিকে ।
- কি রে কেমন লাগছে নতুন জীবন, লিলি হাঁসতে হাঁসতে জিজ্ঞাসা করলো দীপাকে।
- আমি জানি তোদের অনেক প্রশ্ন আছে, কিন্তু আগে বল তোদের ডি স্কোয়ার কোথায়।
অবশেষে পাঁচজনে এসে পৌঁছলও ডি -স্কয়ারে। দীপা অবাক হয়ে বললো "এটা তো কফি হাউস"। করবি হেঁসে বললো, এই কফি হাউসটাকেই আমরা ডিভোর্সি মেয়েরা আজকাল ডি-স্কোয়ার বলে থাকি। কারণ আজ এই জমানায় কম বেশি সব শিক্ষিতা এবং চাকুরীরতা মেয়েদের একটাই বোল, যে তারা কেন পুরুষের মন জুগিয়ে চলবে। কেন সংসারে তাদেরকে এখনো সমান অধিকার দেওয়া হবেনা। তাই যে সম্পর্ক নারীর স্বাধীনতা খর্ব করে, সেই সম্পর্ক ধরে রাখতে আজকের নারী বাহিনী অপারগ। দীপা শুনতে থাকে বান্ধবীদের বিবাহিত জীবনের কথা আর ভাবতে থাকে বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন, রানী রাসমণির কথা ভাবতে থাকে ব্রাহ্ম সমাজের কথা। তাদের ভাষায় নারী শিক্ষা , নারী মুক্তি বা নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা কি? তাদের নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য, সংসারে বা সমাজে তার প্রয়োগ, সুখী গৃহকোণ রচনায় সাহায্য করা সব কিছুই দীপার মনে হয় বিপরীত আজকের শিক্ষিতা চাকুরীরতা নারীর প্রেক্ষাপটে। আজকের নারী বেপরোয়া, পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাবাপণ্য। দীপা ভাবে, আগে কেন তার এসব কথা মনে হয়নি। ছিঁড়ে যাওয়া মনের হলুদ সুতোটা তাকে আজ অনেক প্রশ্ন করছে, কিন্তু কেন? তার ঘুমন্ত শুভ মনটা যেন আবার পবিত্র গঙ্গাজলের স্পর্শ পেতে চাইছে । মনিপুর রাজকন্যা কুরূপা চিত্রাঙ্গদা সুরূপায় পরিণত হয়েছিল এক বছরের জন্য, কিন্তু দীপা আজ তার বয়ে যাওয়া কুরূপ পুরুষ বিদ্বেষী মনটাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে চায় বরাবরের জন্য। এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই সকলকে গুড বাই করে দীপা ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে যায়। একটা ট্যাক্সি করে সোজা চলে যায় বাড়ি, আর তারপর নিজেকে এলিয়ে দেয় সেই বিছানায় যেখানে কুশকে সে একান্ত ভাবে পেয়েছিলো একদিন।
একটু রাত হতেই দীপা চলে আসে তাদের বাড়ির সামনের বুড়ি গঙ্গার ধারে, যেখানে সে অনেকটা সময় কাটাতো কুশের সঙ্গে। বুড়ো বট গাছটার নিচে বসে আনমনে তাকিয়ে থাকে আষাঢ়ের আধবোজা মেঘে ঢাকা তারাদের দিকে। দূরে নৌকাগুলো সরে যাচ্ছে, আর তাদের লণ্ঠনের আলোগুলো জোনাকির মতো নিভো নিভো রব তুলে হারিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার জোয়ারের উত্তাল ধনি দীপার মনকে যেন বেত্রাঘাত করে। নিজের ভুলকে দীপা আর মনের আয়নায় ধরে রাখতে না পেরে কুশকে ফোন করে, আর অনুরোধ করে বুড়ি গঙ্গার ধারের বট গাছটার তলায় আসার জন্য। কুশ আসতেই দীপা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা। দূর থেকে ভেসে আসা গানের কলি, “দে তোরা আমায় নূতন করে দে, নূতন আভরণে....” দীপার মনকে এক সঞ্জীবনী সুধায় আবিষ্ট করে। কুশের হাত শক্ত করে ধরে, চাঁদনী রাতের ছায়া নিভো পথে দুজনে ফিরে আসে তাদের প্রিয় শয্যায়।
গল্প
পথের সন্ধানে
তানভি সান্যাল
(সাহেব সেখ )
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
জামার হাতটা সরিয়ে সুনীল দেখলো ঘড়ি তাকে ১১টার টোকা দিচ্ছে। কোন রকমে তাড়াতাড়ি চা গিলে গাঙ্গুলী স্ট্রিটের বাস স্টপ এ এসে দাড়ালো, আজ আবার গাল খেতে হবে জিপি সিং এর কাছ থেকে। আর ভালো লাগে না তার এ অফিস-বাড়ি, বাড়ি-অফিস, জীবনটা কেমন যেন একঘেয়ে হয়ে গেছে। চা খাবার পর যেমন মাটির ভাঁড়টাকে ফেলে দেওয়া হয় কেও তাকে আর ছুঁয়েও দেখে না, সুনীলের ও তাই মনে হয়। ওর লাইফটা যেন ভ্যালুলেস একটা বোট যেটা সময়ের অন্ধকারের নদীতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে।
অফিস এ পৌছাতে ১২:১০ বেজে গেল। সুনীল অফিস এ ঢুকতেই জিপি সিং এর ঘর থেকে ডাক পড়লো। মরতে মরতে হাতে একটা নোটবুক নিয়ে দৌড়ল সুনীল। জিপি সিং এর ঘরের বাইরে অবধি আজ কেমন যেন অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছিল। সুনীল ঘরের দরজাটা ঠেলতেই সেটা বুঝতে বাকি থাকলো না ।
জিপি সিং বললো "তুম আ গে"। “তুমকো কলেজ সে রূপলেখা গাঁও যানা পড়েগা”।
“ওয়াহা পার ৭ দিন কা লাইভ প্রজেক্ট হোনে ওয়ালা হ্যায়। অ্যাডমিন সাপোর্টকে লিয়ে তুমকো ভেজা যায়েগা।“
সুনীল হাতে নোটবুকটা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকলো, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। প্রথমে দেরি, দেন জিপি সিং এর ঘর থেকে ডাক, ও ইসিলি বুঝতে পেরেছিলো যে ও ফাঁদে পড়েছে।
যাই হোক সন্ধেবেলা ওকে মী হঠাৎ জিগ্যেস করলো। “কি হলো তোর?
তুই চুপ কেন?
জিপি কি বলেছে?”
“অদ্ভুত মা কী সব জেনে যায়? না বলতেই মায়ের মনে ছেলের কষ্ট সারা দেয়?”
সুনীল কিছু বলেনি। কিন্তু টপ টপ করে দু ফোটা নোনা জল ভাতের ওপর পড়লো। সুনীল রূপলেখা পৌঁছানোর দিন বৃষ্টিতে সব ভেস্তে গেল। বরুণ দেব যে এত বড় অন্যায় করবেন তা সুনীলের জানা হলো। পথ ঘাট জলে ডুবে। একটা হাফ শার্ট ও কালো টেরিকট প্যান্ট পরে সুনীল ঘাড়ে ব্যাগের বোঝা নিয়ে যাই বয়ে। কি জানি এই গ্রামে আর কি দেখতে হবে। কপালে মহা বিপদের মেঘ আছে ঘনিয়ে।
যাই হোক ঠাঁই পেল সুনীল আর তার স্যার একটা পোড়ো বাড়িতে। বাড়িতে একটা বুড়ি আর তার একটা নাতনি একা থাকে। উফফ এই জীবনের থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়া ভালো। তারচেয়ে ভালো এক বোতল বিষ পান করে চলে যাওয়া সব করে কালো। যত রাজ্যের কাজের চাপ সুনীলের মতো চব্বিশ বছরের একটা ছেলের ঘাড়ে। সুনীলের মন বলে সবাই ভালোবাসে বন্দুকটা তার ঘাড়ে রেখে গুলিটা চালাতে। সুনীলের মনে হয় জীবন তা একেবারে হলদেটে হওয়া শুকনো পাতার মতো। কিছুই বাকি নেই সব শেষ। বেঁচে থাকাটা তার কাছে কেমন যেন একটা অভিশাপ লাগে।
যাই হোক রূপলেখা জায়গাটা এমন অশুভ যে পরেরদিন সকালে সুনীলের সিনিয়রের হয়ে গেল জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। তাই ভিজিট গেল ভেস্তে এখন কিভাবে এই গ্রাম থেকে পালানো যায় এই চেষ্টায়। সুনীল কেবল ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখবে ঘুরে আসে পাসে। হঠাৎ তার দৃষ্টি এমন কিছু দেখল যা ওর এই গ্রামের প্রতি ও জীবনের প্রতি অনীহা তা পাল্টে দিল।
একটা ১৪/১৫ বয়সী মেয়ে ছাদের ওপর চুল শুকাচ্ছে। পাতলা ছিপছিপে শরীর, ফর্সা, চুলগুলি লালচে। চোখ গুলি বেশ গভীর কালো হরিণের মতো। সবুজ একটা শাড়ী পরে সে রোদের আলোয় চুল শুকাচ্ছে। সুনীলের মনে কেমন যেন একটা কিছু হলো। মেয়েটাকে দেখে মনে হলো এই গ্রামের মতোই সে স্থগিত হয়ে রয়েছে। কোনো পরিবর্তন নেই। সব একই জায়গায় থেমে আছে।
বাজার থেকে ফিরে সুনীল দেখে মেয়েটা তার সিনিয়রের মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে।
অদ্ভুত? সে এখানে কিভাবে এলো?
মেয়েটা বললো “বাবু স্যারের শরীরটা বেশ খারাপ।“
“আপনি পাশের ঘরে যান, আমার ঠাকুমা আছে ওনার কাছ থেকে কাঁড়াটা নিয়ে আসুন।“
সুনীলের কাছে জলের মতো সব সাফ হয়ে গেল।
পাশের ঘরে যেতেই সুনীলকে বলল বুড়িটা,
“সুনীলবাবু তোমার স্যারকে কাঁড়াটা দাও, তৃষা ওখানেই আছে তো?”
"হুম ঠাকুমা আছে"। কাঁড়াটা এনে সুনীল ওর হাতে দিলো। দিয়ে চেয়ার নিয়ে বসে পড়লো।
“স্যার আপনি ঠিক আছেন তো?”
স্যার বললো “হ্যাঁ জ্বরটা কমে যাবে তুমি করুণ নয়নে দুটো মুক্ত দেখা যাচ্ছিলো। সুনীলের মনটাও কেমন যেন হুঁ হুঁ করে উঠলো।
(২)
পরের দিন সকালে আবার অফিস পৌছাতে দেরি হলো। যেমন হয় আর কি? গাল খেতে হলো জিপি সিং এর কাছ থেকে। সুনীল কেমন যেন একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলো রূপলেখা থেকে ফিরে এসে। জিপি সিং এর গাল, অফিসের ওয়ার্কলোড, বাড়ির চাপ এখন ওর কাছে কিছু মনে হয়না। কেমন যেন সয়ে গেছে।
সন্ধ্যে বেলা অফিস থেকে ফিরে ও এখন মীয়ের সাথে কথা বলে না। চুপ করে ছাদে গিয়ে বসে থাকে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেটটা বার করে ধরায় আর চিন্তার সাগরে ডুব দেয়। কেমন যেন সুনীলের মনে হয় ও কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে। ওর কাছ থেকে সেটা যেন বহু দূরে কোথাও চলে গেছে। যেমন পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার আগের দিন স্টুডেন্টসের অবস্থা হয় সুনীলের ও তাই হয়েছে। সুনীলের চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
পরের দিন সকালেই সুনীলকে দেখা গেল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ও চলে আসছে। তৃষা ছাদে চুল শুকাতে শুকাতে ওকে আসতে দেখে অবাক হয়ে গেল। মূর্তি হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
সুনীল যে ফিরে আসবে এটা যেমন অদ্ভুত ছিল আবার সম্পূর্ণ অবিশ্বাসযোগ্য।
কে তৃষা? কেন এই গ্রামের সাদা সিধে মেয়ের জন্য ও আসবে? কি করতে আসবে?
সম্পূর্ণ অদ্ভুত এবং অবাস্তব।
সুনীল এসে দরজায় টোকা দিতেই তৃষা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দরজা খুললো।
সামনে এই মানুষটাকে দেখবার জন্য যে কত ছটপট ছটপট করেছে সে তা বিধাতা স্বয়ং সাক্ষী।
ইভেন সুনীল একটু হেসে বললো। “তৃষা ঠাকুমা আছে?”
“হাঁ আছেন। আপনি ভেতরে আসুন।“
সুনীল তৃষাকে ডেকে বললো। “তুমি অপেক্ষা করছিলে?”
“ভেবেছিলে যে আমি আসবো না।“
তৃষার চোখটা ছল ছল করে উঠলো। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
মৃদু হেসে চলে গেল।
ওদিকে অফিসে সুনীল নেই দেখে সবাই হতচকিত। ছেলেটা তো কোনোদিন এইভাবে হুট করে কোথাও যায়না। গত তিন দিন হলো সুনীল অফিস আসেনি। ওকে বাড়িতে ও পাওয়া যাচ্ছে না। ওর কিছু একটা হয়েছে সবাই বুঝতে পারছে। জিপি সিং চান্ডাল হলেও ওনার মনে কোথায় যেন একটা আঘাত করলো।
ছেলেটা কোথায় গেল? পুরো অফিস এ হুলুস্থুল পড়ে গেল। ফোনেও পাওয়া যায় না। এমনকি কাউকে কিছু বলে যায়নি সে।
সুনীলকে দুদিন পরে দেখা যায়। আবার সেই অফিসের টেবিলে। কিন্তু সে এবার সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। এক গাল হাসি। অকারণে মেজাজ হারায় না।
সুনীল সম্পূর্ণ চেঞ্জড? এমনকি জিপি সিং ওকে কিছু বললেও ও হেসে উড়িয়ে দেয়। সুনীলের মনে হয়েছে সে কিছু পেয়েছে । হাঁ সুনীল পেয়েছে। তার জীবন এখন পুরনো ফেলে দেওয়া পুজোর ঘটের মতো না। সে তার জীবনে এমন কিছু পেয়েছে যেটা তাকে মানুষ করে তুলেছে। তার
জীবনের প্রতি অনীহাটাকে প্রেমের আগুনে সে জলাঞ্জলি দিয়েছে। তার জীবনে একটা এমন অধ্যায়: লেখা হবে সে কি আদৌ কল্পনা করেছিল? সে কি ভেবেছিল যে জীবনটা মনোরম এতো? সেকি ভেবেছিলো তৃষার মতো ভালো একজন মানুষকে সে পাবে? তৃষা কি ভেবেছিল এইরকম হতদরিদ্র মেয়ে মানুষের জন্য সুনীল ফিরে আসবে?
হাঁ সুনীল ফিরে গিয়েছে।
কিন্তু কীসের টানে?
কী হলো যে তাকে সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে গেল?
তৃষা?
একটাই নাম ।
তাকে তৃষা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো।
যাই হোক এবার খেয়াল থেকে মূল ঘটনায় ফিরে আসা যাক। শরৎ যেমন এক খুশির বার্তা নিয়ে আসে। নীল আকাশে যেমন প্রেম, আনন্দ ভেসে আসে। ঠিক তেমনটাই হলো সুনীলের জীবনে।পুজোর পরেই তৃষা আর সুনীলের বিয়ে হবে। সুনীল কাজের মধ্যে ডুবে থেকেও ১৫ দিন অন্তর অন্তর রূপলেখা যেত। সেই গভীর হরিণীর মতো চোখটার জন্যে হয়তো। তার সেই শান্ত, স্নিগ্ধ রূপটার দর্শন করার জন্য। সেই মানুষটার জন্য যে এই জঙ্গলের মতোই স্থগিত হয়ে রয়েছে। সুনীল চোখের দেখা দেখেই ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসতো কলকাতায়। কিন্তু সুনীলের মনটা পরে থাকতো সেই পোড়ো বাড়িটায়। সেই দুটো কালো নয়নে সুনীল খুঁজে পেয়েছিলো শান্তি। সুনীলের মনে হয়েছিল জীবনের একটা অর্থ রয়েছে। যাহা কে ও এতদিন বুঝতে পারেনি।
(৩)
অক্টোবর ১৩ সুনীলকে দেখা গেল আবার সেই ছাদে দাঁড়িয়ে। একটা ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি পরে তবে এবার একা নেই। তৃষা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে। উচ্ছল নয়নে সুনীলের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। সুনীল সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বার করে মুখে ধরিয়ে বলল ।
“তাহলে তৃষা আগামী সোমবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
আর মাত্র ৬ দিনের অপেক্ষা।“
তৃষা মৃদু হেসে সুনীলের বুকে মাথা রেখে বললো।
“হ্যাঁ এই ৬ টা দিন আমার কাছে যেন ৬ টা যুগ। আমি কিভাবে যে এই দিন কটা পার করবো? আমি আর পারছি না সুনীল থাকতে?”
সুনীল বললো “চিন্তা করো না তৃষা । আর কটা দিন। এইরকম করলে হবে?“
সুনীলের চোখ থেকে অশ্রু তৃষার গালের ওপর পড়ল। সুনীল ব্যাগ নিয়ে বেরল। হাত নেড়ে তৃষাকে বিদায় জানালো। তারপর ব্যাগটা নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আজ সকাল থেকে সুনীলের মনে খুশি ধরে না। সুনীল যেন জীবনের সব আজকেই পাবে। পাবে আজ সুনীল তৃষা কে পাবে? আজ সুনীল তৃষা এক অটুট বন্ধনে বেঁধে যাবে। সুনীল সকাল থেকেই বেশ উচ্ছ্বাসিত। হলুদ, স্নান সব হয়ে গেছে। জিপি সিং ও এসে আশীর্বাদ করে গেছে। হঠাৎ সুনীল মীয়ের সাথে দেখা করতে পাশের ঘরে ঢোকে।
এমা মীয়ের মন উদাস? “কি ব্যাপার মী?
আপনি কেন কাঁদছেন? আপনার কি হয়েছে?
মন খারাপ কেন?”
মী বলল - "কিছু না রে পাগলা, তুই আজকে একটা বড় বন্ধনে বেঁধে যাবি। তোর সংসার হবে।
তুই তোর মনের মানুষ কে পেয়েছিস। এর থেকে বেশি খুশি কার বলত?
আমি আজকে খুব খুশি। কিন্তু মনে কেন যেন একটা ভয় করছে।
কিসের ভয় মী?
তুই বিয়ের পর পর হয়ে যাবি না তো?
সুনীল বললো “কি যা তা কথা বলো?
আজকের যুগে এইসব?
আমরা কতটা লিবারেল আমাদের বাড়িতে এইসব কি কোনোদিন হয়েছে যে হবে।
আমি তোমার সুনীল যেমন ছিলাম তেমনই থাকবো।”
যাক হোক সুনীল চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
(৪)
বাড়ি ঢোকার কিছুটা আগে সুনীল দেখলো কী কিছুই নাই। এমা এটা কি ব্যাপার? গড়ের বাদ্য নেই, কোনো আওয়াজ আসছে না। বাড়িটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সেই একই রকম। কোন সাজানো হয়নি।
অদ্ভুত ব্যাপার? বিয়ে বাড়ি বলে কথা কোনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না?
সুনীলের মনে খটকা লাগলো। কী হলো রে বাবা? ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত গোলমেলে মনে হচ্ছে ।
কাছে যেতেই সুনীল দেখে বাড়ির সামনে এক গাদা লোক জড়ো। লোক ঢুকছে আর বেরোচ্ছে।বাড়ির ভেতরে থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
সুনীল বললো “গাড়ি থামান দাদা এখনি গাড়ি থামান।“ সুনীলের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। অস্থির হয়ে গেল সে।
“চলুন তো দেখি কী হয়েছে?” ভেতরে ঢুকতেই সুনীলের পা থেকে মাটি সরে গেল।
একী? যা সুনীল স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। সুনীলকে সেটাই নিজের চোখে দেখতে হলো। সুনীল ভাবতেও পারেনি এইভাবে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। এইভাবে তাকে এই সময়টার সম্মুখীন হতে হবে। মেঝেতে পড়ে রয়েছে তৃষার নিথর দেহ। সেই লাল পেড়ে বিয়ের শাড়ীটা পড়েই রয়েছে তৃষা। চলে গেছে সে সব কিছু ছেড়ে।
সুনীলের মনে হচ্ছিল সে স্বপ্নে রয়েছে। এটা কি সম্ভব? সে মাত্র ছয়দিন আগেই তো তৃষাকে হাসি খুশি দেখে গিয়েছিলো। কেন এমনি হলো? সুনীলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
সুনীল কাঁদতে লাগলো। “তৃষা কেন তুমি আমায় ছেড়ে গেলে তৃষা? আমি কী দোষ করেছিলাম যে তুমি আমায় একা ফেলে চলে গেলে। মনের আশা মনে নিয়ে তুমি চলে গেলে তৃষা।“ কথা বলো তৃষা।
কেন সাড়া দিচ্ছ না। তুমি কেন করলে এমন। হেঁ ভগবান তুমি আবার সব কেড়ে নিয়ে তুমি আমায় সর্বস্বান্ত করলে?”
সুনীলের কাছে তৃষা আর নেই। সে ইহ লোক ছেড়ে এমন এক দেশে পাড়ি দিয়েছে যেখান থেকে ফেরা অসম্ভব। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তৃষা ছাদের ওপরে অপেক্ষা করতে করতে পা পিছলে নিচে পড়ে গিয়ে এই মহা দুর্ভোগ ঘটে। সুনীলকে সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। সে তার মীয়ের কোলে মাথা রেখে অশ্রুপাত করতে থাকে।
হঠাৎ সুনীল উঠে দাঁড়ায়।
সোজা মণ্ডপের দিকে যায়। সবাই অবাক হয়ে দেখে। সুনীল মণ্ডপ থেকে সিঁদূর তুলে আনে। সিঁদূরের কৌটো থেকে সিঁদূর বের করে তৃষার মাথায় পড়িয়ে দেয়। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে সুনীল। সুনীল কোনোদিন ভাবেনি এই রকম একটা সময় তার জীবনে আসবে। সেই মানুষটা যে তাকে নতুন জীবন দিয়েছিল। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিলো। জীবনের যে একটা মূল্য আছে বুঝিয়েছিল, সে ওকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাবে। সুনীল সব কিছু হারালো।
পরদিন সকালে জামার হাতটা সরিয়ে সুনীল দেখলো ঘড়ি তাকে ১১টার টোকা দিচ্ছে। কোনরকমে তাড়াতাড়ি চা গিলে গাঙ্গুলী স্ট্রিটের বাস স্টপ এ এসে দাঁড়ালো।
প্রবন্ধ
যমজ জাতক জন্মকথা
অনিশা দত্ত
সল্টলেক, কলকাতা
শত বৎসর পূর্ব প্রকাশিত বিশ্ব পরিসংখ্যানের প্রতিবেদনে সহস্র বৎসরের জন্ম কাহিনীতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে সাথে সারা পৃথিবীতে যমজ শিশু জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে হাজার প্রতি তেত্রিশ জোড়ায়। সে তুলনায় এশিয়াতে যমজ শিশু জন্মের হার যথেষ্ট অল্প, হাজার প্রতি নয় থেকে দশ জোড়া।
যুক্তরাষ্ট্রে গত শতকের হিসাবে যমজ সন্তান জন্মের হার ছিল হাজার প্রতি আঠারো জোড়াl এখন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে হাজার প্রতি তেত্রিশে। সর্বাধিক যমজ সন্তান জন্মের হার আফ্রিকায়। নাইজিরিয়ায় হাজার প্রতি বর্তমানে চল্লিশ থেকে ষাট জোড়া যমজ শিশু জন্ম নিচ্ছে।
সম্প্রতি এক চমকপ্রদ সংবাদে প্রকাশ, কেরালার কোধিন্হি গ্রামে দুহাজার পরিবারে আড়াইশো জোড়া যমজ সন্তান। ২০০৮ সালে এই গ্রামে তিনশোটি পরিবারে পনেরো জোড়া, ২০১৫তে হাজার প্রতি ষাট জোড়া যমজ সন্তান জন্মেছে। এই গ্রামে কেন এই যমজ সন্তানের আধিক্য, চিকিৎসকদের কাছে এক বিশাল বিষ্ময়। যমজ সন্তানের জন্ম সূত্র এযাবৎ দুটি ভিন্ন আঙ্গিকে স্বীকৃত ছিল।
প্রথমত: fraternal বা সমগোত্রীয়, যেখানে দুটি ডিম্বাণু ও দুটি শুক্রাণুর মিলনে ভিন্ন ভিন্ন দুটি ভ্রূণকোষ তৈরী হয়। ফলত: যমজ পুত্র বা যমজ কন্যা বা একটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম, কিন্তু একে ও পরের অবিকল প্রতিরূপ নয়।
দ্বিতীয়ত: identical বা অবিকল প্রতিরূপ, যেখানে একটি ভ্রূণকোষ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে দুটি সদৃশ আকৃতির সন্তানের জন্ম দেয়। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীগণ তৃতীয় এক সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছেন। সেটি হলো মাতা দিচ্ছেন একটি ডিম্বাণুর X ও X দুটি সম ক্রোমোসোম এবং পিতা
দিচ্ছেন একটি শুক্রাণুর X ও Y দুটি অসম ক্রোমোসোম। ফলত: দুটি ভ্রূণকোষ X X ও XY তৈরী হচ্ছে অর্থাৎ একটি কন্যা ভ্রূণ ও অপরটি পুত্র ভ্রূণl এই যমজ সন্তানকে বলা হচ্ছে semi – identical বা প্রায় সদৃশ। গর্ভাবস্থার শুরুতে আল্ট্রাসোনো পরীক্ষায় দেখা গেছে দুটি ভ্রূণ কোষ একই Placenta বা অমরা ব্যবহার করছে। এখানে পিতা সন্তানকে দিচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন ডি এন এ, কিন্তু মাতা দিচ্ছেন একই DNA। যমজ সন্তানের জন্ম লগ্নে এ এক নূতন উদ্ভাবন। পুরাণে যমজ সন্তান প্রসঙ্গে উল্লেখ্য লক্ষণ - শত্রুঘ্ন, লব-কুশ, যম - যমুনা, দ্রৌপদী-ধৃষ্টদুম্ন্য ইত্যাদিl শেক্সপেয়ার এর উপন্যাস 'কমেডি অফ এররর্স' বা বিদ্যাসাগরের 'ভ্রান্তিবিলাস' -এ হুবহু যমজে বিভ্রান্তির একশেষl হিন্দি চলচিত্র 'সীতা ঔর গীতা', 'চালবাজ', 'রাম ঔর শ্যাম' -এ গন্ডগোলের চূড়ান্ত। বর্তমানে, পিতৃত্ব যাচাই করতে ডি এন এ পরীক্ষা সহজ প্রচলিত পদ্ধতি। যমজ -বৃত্তান্ত -র সাম্প্রতিক এক অভাবনীয় মামলার কাহিনী শুনিয়ে যমজ - বৃত্তান্ত শেষ করবো।
Goias এর ব্রাজিলিয়ান রাজ্যে এক মাতা, পুত্রের পিতৃত্বর দাবী জানিয়ে মামলা রুজু করেন। অভিযুক্ত যুবকের ডি এন এ পিতৃত্ব চিহ্নিত করলেও, যুবক তা অস্বীকার করে', তার হুবহু এক রকম দেখতে যমজ ভাইয়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। যমজ ভ্রাতার ডি এন এ পরীক্ষার ফল -ও একইl তবু সেও পিতৃত্ব অস্বীকার করেl যেহেতু, যমজ ভ্রাতৃদ্বয় একে অপরের অবিকল প্রতিরূপ, মাতাও সনাক্ত করতে পারেন নি, কে তার পুত্রের পিতা?
সুতরাং Reo -de - jenero -র বিচারপতি মামলার রায়ে আদেশ দেন, 'দুই ভ্রাতার আয় থেকেই ত্রিশ শতাংশ মাতা-পুত্রের ভরণ - পোষণে যাবে। পুত্রের পড়াশুনা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয় ভার দুই ভাইকেই পঞ্চাশ শতাংশ করে বহন করতে হবে।'
গল্প
স্প্লিট পেরেন্টস
স্বাতী দে
অষ্ট্রেলিয়া
এবার শিলংয়ে ঠান্ডাটা খুব জাঁকিয়ে এসেছে। ডিসেম্বরের শুরুতেই তাপমাত্রা দশ ডিগ্রির নিচে চলে গেছে। এবারের মনসুনটাও অনেক দিন থেকে সবে বিদায় নিয়েছে। তবু রেশটা যেন রেখেই গেছে। রাতে আজকাল ঘুমাতেই পারি না। জয়েন্টের ব্যথাগুলো বড় ভোগায় আজকাল। আর্থারায়টিসের ব্যথাটা আজকাল আর কোনো ওষুধেও কমে না। শিলংয়ের আবহাওয়া আমার কোনদিন সহ্য হয় না। তবুও আগে যখন সুমনের বাবার সাথে বছরে একবার করে সুমনের বাড়িতে বেড়াতে এসে দিন দশেক থেকে যেতাম, তখন ব্যথাটা এতটা কষ্ট দিত না। বয়সটাও তখন অনেক কম ছিল। তাছাড়া রাতে সুমনের বাবা নিজে হাতে ব্যথার ওষুধ লাগিয়ে দিত। কবেই মুছে গেছে সেই সব দিন স্মৃতির পাতা থেকে।শুধু সত্তর বছরের এই শরীরটা পড়ে আছে, শিলংয়ে, আমার ছেলে সুমনের বাড়িতে।
অর্ণব আর আমার বিয়ে হয়েছিল, বাড়ি থেকে দেখেশুনে। অর্ণব কলকাতায় কলেজে পড়াতো। আমার আবার ছোট থেকেই পড়াশুনার থেকে গানের দিকে বেশি ঝোঁক ছিল। সবাই আমার মাকে বলত, “কমলা, তোমার মেয়ে অনিশা তো নামেও সরস্বতী, গুনেও সরস্বতী। দেখবে, ও একদিন গানের জগতে খুব নাম করবে।“ সঙ্গীতকেই নেশা এবং পেশা হিসেবে নেবার ইচ্ছে ছিল।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না নুতন বউ সারাদিন গান গেয়ে কাটাক। আমিও সবাইকে খুশি করার জন্য আস্তে আস্তে রেয়াজের সময় কমিয়ে দিলাম। তারপর তো এক বছরের মাথায় সুমন আর সৃজনের জন্ম হয়। ওরা দুভাই আইডেন্টিকাল টুইন। দেখতে, স্বভাবে, পড়াশুনায় সব দিক দিয়ে ওদের দুজনকে আলাদা করা যেত না।
এরপর অর্ণব ওর কলেজের কাজে ব্যস্ত থাকতো, আর আমি ছেলেদের মানুষ করার কাজে লেগে গেলাম। মধ্যবিত্ত বাঙালির সংসারে যা হয় আর কি! গান-বাজনা? সে নয় পরে হবে। এই জীবনে না হয়, অন্য জীবনে হবে। কিন্তু দুটো ছেলেকে তো আর অবহেলা করা যায় না! ওরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ!
দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেল। সুমন – সৃজন দুজনেই বড় হয়েছে, তবে মানুষ হয়েছে কিনা, জানি না। দুজনেই ভাল চাকরি করে। সুমন শিলং এ থাকে, এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। বৌমাও এখানকার স্কুলে পড়ায়। ওদের একটাই ছেলে, এখন আমেরিকায় পড়াশুনা করছে। বাড়িতে লোক বলতে আমরা তিনজন, সুমন, শ্রীজা আর আমি। তাছাড়া, দুটো কাজের মেয়ে আসে, সকালে। ঘরের কাজ আর রান্না করে দিয়ে যায়। আমার সঙ্গী বলতে ওরা দুজনই। সারাদিনে সকালের এই সময়টুকুই তো আছে যখন কারো সাথে একটু কথা বলতে পারি।
সৃজনও ওর চাকরিতে খুব নাম করেছে। এখন টাটাতে আছে, পরিবার নিয়ে জমশেদপুরে থাকে। ওরও একটাই মেয়ে। বাবার মত ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। এখন হাসবেন্ডের সাথে বাঙ্গালোরে থাকে। বাড়িতে লোকজন বলতে বৌমা, সৃজন, ওর বৃদ্ধ বাবা আর অর্ণবকে দেখাশোনা করার জন্য একজন কাজের মাসি। বৌমা রেখা আর সৃজন দুজনকেই অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়।
অর্ণব সারাদিন নিজের ঘরে, একা একাই কাটায়। কখনো টিভি দেখে, কখনো বা পুরনো কোনো বই পরে। আজকাল তো আর নিজে গিয়ে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসতে পারে না। হাঁটাচলা করতে খুবই অসুবিধে হয়। ডাক্তার একা একা বাইরে যেতেও বারণ করেছে। তবে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমাকে রোজ ফোন করে। দিনের এই একটা সময়ই আছে যখন আমরা বাড়ির আর কাওকে ডিস্টার্ব না করে, নিজেদের মত একটু কথা বলতে পারি। তবে, উইকেন্ড এ সাধারণত ছেলেরা ফোন করে খবর নেয়, খবর দেয়।
আমাদের জীবনটা তো এরকম ছিল না! বা এরকম যে হতে পারে, তা কখনো কল্পনাও করিনি! ছেলে দুটো বড় হয়ে যাবার পর আমি আবার একটু একটু করে গান গাইতে শুরু করলাম। তবে সময়ের কাজ সময়ে না করলে যা হয়! এই বয়সে এসে আর নুতন করে জীবন শুরু করা সম্ভব নয়। তবুও গান গেয়ে মনের একাকীত্ব তো দূর করা যায়। তারপর, অর্ণবও রিটায়ার করলো।
এই প্রথম আমরা দুজনে একসাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেলাম। তখন আমরা আমাদের বালীগঞ্জ এর ফ্ল্যাট এই থাকি। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তাম দুজনে মিলে, কোথাও ঘুরে আসতাম। সমুদ্র আমাকে বড় টানে। আমার প্রিয় বীচ ছিল হেভলক আইল্যড এর রাধানগর বীচ।
আমরা বেশ কয়েকবার আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে গিয়েছি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রাধানগর বীচ থেকে সূর্যোদয় দেখতে আর সাদা বালুর উপর হাটতে আমার ভীষণ ভাল লাগতো। অর্ণব আর আমি হাত ধরে সেই বালুর উপর দিয়ে কত পথ যে হেঁটেছি, কত গান গেয়েছি, কত ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণ করেছি। দুই ছেলের বাড়িতে বছরে একবার করে ছুটি কাটাতে যেতাম। ওরাও ছুটি পেলেই সপরিবারে কলকাতা চলে আসত। নাতি নাতনীর সাথে সময় কাটাতে অর্ণব খুব ভাল বাসত। মাঝে মাঝেই অর্ণব আমাকে বলত, “দেখ, সুমন আর সৃজন কে তো তুমি প্রায় একা হাতেই মানুষ করেছ। আমি তো তখন আমার কলেজের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতাম যে তোমাকেও সময় দিতে পারি নি, আবার ছোটবেলায় ওদের দুভাইয়ের বড় হয়ে ওঠাটাও এনজয় করতে পারিনি। আজ ভগবান আমার সেই দুঃখ মিটিয়ে দিয়েছেন আমার দুই নাতি নাতনী দিয়ে।“
এত সুখ হয়তো আমাদের কপালে ছিল না! পাঁচ বছর আগে হঠাৎ একদিন বাজার করে ফেরার পথে অর্ণবের মাথা ব্যথা করে, শরীরের টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পরে যায়। আশেপাশের লোকজন সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যায়। খুব তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট হওয়াতে অর্ণব সেবারের মত বেঁচে যায়। কিন্তু স্ট্রোক ওর শরীরে অনেকটাই স্মৃতি চিহ্ন রেখে গেছে। ওর পায়ের জোর এখন অনেকটাই কমে গেছে। লাঠি ছাড়া একা একা হাটতে পারে না।
খবর পেয়ে সাথে সাথেই সুমন আর সৃজন চলে আসে কলকাতায়। আমাদের দুজনকে ওদের সাথে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু অর্ণব রাজি নয়। ছেলেদের বুঝিয়ে বলে, ”আমাদের এখানে অনেক পরিচিত লোকজন আছে, সময়ে অসময়ে তারা ছুটে আসে সাহায্য করার জন্য। তোমাদের ওখানে গেলে তোমাদের অসুবিধে হবে। তাছাড়া, তোমরা তো সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকবে, আমাদেরও সারাদিন একা একা কিছু করার থাকবে না।“ কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অর্ণবের শরীর আরো খারাপ হতে শুরু করে। হাটা চলা একদমই প্রায় করতে পারে না। সারাদিন বাড়িতে একজন কাজের মাসি রাখা হয়েছে। কিন্তু রাতের সময় খুব অসুবিধে হয়। আমার আর্থারায়টিসের ব্যথার জন্য আমিও ওকে নিয়ে বাথরুমে যেতে পারি না।
পুজোর ছুটিতে দুই ছেলে বৌমাদের নিয়ে বেড়াতে এল। আজকাল আমরা দুজন তো আর কোথায় যেতেও পারি না। আমাদের দুজনের অবস্থা দেখে ছেলেরা আলোচনা করে ঠিক করলো যে আমাদের এখানে এভাবে একা একা থাকাটা আর ঠিক নয়। ওরা এবার আমাদেরকে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। অর্ণব এখন আর না বলার মত শারীরিক অবস্থায় নেই। তাই চুপচাপ ছেলেদের আলোচনা শুনে যাচ্ছে! প্রথমে ঠিক হল ছ‘মাস ছ‘মাস করে দুই ভাই আমাদের রাখবে। তারপর বুঝতে পারে যে ওদের বাবার পক্ষে প্রতি ছয় মাস পরপর শিলং-জমশেদপুর জার্নি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, কেই বা বারবার সাথে যাবে? অনেক চিন্তা ভাবনার পর ঠিক হল বাবা জামশেদপুরে সৃজনের সাথে থাকবে আর আমি শিলং এ সুমনের সাথে। রেখা বরাবরই আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তাই বলল, “বাবা আমাদের সাথে জামশেদপুরে চলুন।“ অর্ণব জানে যে আমার শিলংয়ের আবহাওয়া সহ্য হবে না। আর্থারায়টিসের ব্যথাটা বাড়বে। তবুও কিছু না বলে অসহায়ের মত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমরা দুজন, দু প্রান্তের বাসিন্দা এখন। শুধু দুপুরের কিছুটা সময় আমরা নিজেদের সাথে কাটাই। কখনো কখনো ভিডিও কলেও কথা হয় আজকাল। তবে ভিডিও তে কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। কিছু না বললেও মনে হয় অর্ণব আমার মনের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছে। কোনো ভাবনাকেই আড়াল করতে পারি না ওর সামনে। শুধু চুপ করে বসে থাকি ফোনটা নিয়ে। নীরবতাই যেন আমাদের না বলা কথাগুলো সারা ঘরে প্রতিধ্বনি করতে থাকে।
বিকেলের দিকে যখন খুব একা লাগে তখন মাঝে মাঝে একটু গান গাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিকেলে বৌমার বিশ্রামের সময় গান গাইলে তার ডিস্টার্ব হবে, সেজন্য আমার পুরনো হারমোনিয়ামটাও যে আনা হয় নি।
বিদেশে তো শুনি অনেক ওল্ড এজ হোম আছে! এখানে নেই কেন? তাহলে তো আমাদের এভাবে একা একা জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে হত না! আজ শিলং এর ঠান্ডায়, একা ঘরে বসে বার বার মনে পড়ছে আমাদের আন্দামানে কাটানো সেই দিনগুলো। একবার, শুধু আর একবার যদি যেতে পারতাম সেখানে, একসাথে, দুজনে মিলে যদি শেষ বারের মত সূর্য প্রণাম করে আসতে পারতাম! এখন যে আর কিছুই করার নেই। শুধুই প্রতীক্ষা .. !
গল্প
মনের মণিকোঠায়
এক টুকরো তোয়ালে
মঞ্জুশ্রী সরকার
কলকাতা
১৯৭২ সালে আমার বিয়ে হয়, তারপর আমি কলকাতায় আসি। আমার বিয়ের ৯-১০ বছরের মধ্যে আমাদের তিন সন্তান হয়। বিয়ের আগে কোনদিনও আমার পুরী যাবার সৌভাগ্য হয়নি। একবার, আমার ননদ ও নন্দাই পরিবার সহ পুরী বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করেন এবং আমার স্বামী সেই শুনে আমাদের সকলের একসাথে টিকেট কেটে দেন।
আমার স্বামী চাকরির সূত্রে বাইরে থাকতেন। অফিসে ছুটি পাওয়ার অসুবিধার জন্য উনি আমাদের সাথে যেতে পারেন নি। সেটা কোন সাল ছিল একদম মনে করে বলতে পারব না।
অবশেষে প্রতীক্ষার রজনী শেষ হলো, আমরা সবাই নির্দিষ্ট দিনে পুরীতে এসে পৌঁছলাম। আমরা হলিডে হোম এ ছিলাম এবং রান্না ও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই হোলো। আমরা নিজেরাই রান্না করতাম। সমুদ্রের কাছেই ছিল হলিডে হোম। তবুও অনেকটা পথ তপ্ত বালির চর পেরিয়ে সমুদ্রে যেতে হতো।
প্রথম দিন শ্রী জগন্নাথ দর্শনে মন্দিরে গেলাম, কিন্তু দর্শন হল না। জানতে পারলাম, শ্রী জগন্নাথের স্নান যাত্রার পর জ্বর হয় এবং মন্দির বন্ধ থাকে। ঠাকুরের জ্বর হয় জানতাম কিন্তু মন্দির বন্ধ থাকার নিয়ম জানা ছিল না। ৭ দিন মন্দির বন্ধ থাকবে জেনে আমরা আর সময় নষ্ট না করে পর্যটন স্থান গুলো ঘুরে দেখে নিলাম। আমাদের এ যাত্রায় আর শ্রী জগন্নাথ দর্শন হল না। তবে, ২/৩ বার সমুদ্রে স্নান করার সুযোগ পেলাম।
কোনও এক দিনের অভিজ্ঞতা আমার মনের মণিকোঠায় মাঝে মাঝেই নাড়া দিয়ে জানান দেয় আমি আজও এর মধ্যে বাঁচি। সেদিন সকালে জলখাবার খেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সকলে মিলে সমুদ্রে
স্নান করতে গেলাম। আমি নিজেও চটি পরে যাইনি, আর বাচ্চাদেরও জুতো নেওয়া হয়নি। বড়োরা স্নান করতে এতটাই আনন্দ উপভোগ করছিলো যে তাদের আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে ইচ্ছে ছিল না। যাই হোক, এদিকে বেলা বাড়ছে দেখে আমি নিজেই ছেলেমেয়েকে নিয়ে লজের দিকে রওনা দিলাম। কেবল দু এক পা এগিয়েই বুঝতে পারলাম বালি কি প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে। কিভাবে এতো বড়ো বালির চড়া পার হবো ভাবছি! আমাদের কারো পায়ে চটি নেই। বাচ্চাদের ছোট্ট ছোট্ট নরম পাগুলো গরমে লাল হয়ে যাচ্ছে। মন কে দৃঢ় করলাম এই বলে যে, এই বালির চড়াটা আমাকে একাই ওদের নিয়ে যেমন করেই হোক পার হতেই হবে। আমার ছোট ছেলে আমার কোলে। আমার কাছে খুব মোটা একটা তোয়ালে ছিলো, তাকেই ভরসা করলাম। আমি গরম বালির ওপর তোয়ালে লম্বা করে বিছিয়ে দিলাম আর তিন জন তার ওপর উঠে দাঁড়ালাম। আবার গরম বালিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তোয়ালে সামনে ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে সবাই তোয়ালের ওপরে দাঁড়ালাম। এইভাবে ওদের নিয়ে একটু একটু করে মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বাচ্চাদের কষ্ট দেখে নিজেই মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। যাই হোক, তবে তোয়ালে যে এইভাবে আমাদের কাজে লাগতে পারে তা কখনো ভাবতেও পারিনি। তোয়ালেকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সকলকে সুস্থ ভাবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবার জন্য। আমি যত দিন বাঁচবো, এই ঘটনাটা আমার স্মৃতিকে সজীব করে জানান দেবে - আমি তো আছি তোমার সাথেই। এখন ওদের ঐ নরম পা দুটো কিন্তু খুব দৃঢ় এবং কঠিন কঠোর হয়েছে। ঐ পা দুটোর ওপর ভর করেই ওরা জীবনে চলার পথের সমস্ত বিপর্যয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে চলেছে। আমার আশীর্বাদে, এভাবেই ওরা জীবনের শেষ প্রান্তে পারি দিতে পারবে। ওদের জয় সুনিশ্চিত।
গল্প
দেবরাজ
তন্ময় হালদার (তুফান)
"এই ঈশান!!"
চমকে পাশে তাকালাম। অঙ্কিত বলল, "এতো বার ডাকছি, কি দেখছিস ওমন ভাবে? বৃষ্টি ? না মেঘ?"
- "Thunder!"
- "কি! বজ্রপাত দেখার কি আছে?"
- "কত সুন্দর!"
- "Idiot! অঙ্কিতা, অর্পিতা বজ্রপাতের শব্দে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আর তুই সুন্দর বলছিস! জানিস, Hindu Mythology-তে বজ্র One Of The Most Powerful Weapons."
- "দেবরাজ ইন্দ্রের। তাই তো?"
- "হ্যাঁ।"
৯ বছরের পরের কথা।
রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। চাঁদের আলো Lamppost-এর অনুপস্থিত ভালো ভাবেই Fullfil করেছে। মেঘশূন্য, তারা ভরা আকাশ। আহ্! কাল অবশ্যই কপাল জ্বলানো রোদ হবে। কিন্তু, কাল তো.... মনে হচ্ছে,কিছু একটা মাথার দিকে ছুটে আসছে। Body Reflex-এর জন্য ডান মাথার সামনে চলে এল। আঘাতটা হাতে লাগল। পিছিয়ে গেলাম।
কেউ দাড়িয়ে আছে, হাতে লম্বা লাঠি। বললাম, "কে?" সামনে থেকে সে রাগী গলায় বলল, "তুই বাবাকে কি কি বলেছিস?" বুঝতে পারলাম আমার সামনে রতন দাঁড়িয়ে আছে। আজ বিকালেই তো ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
রতন এ পাড়ায় এক অসহ্য চক্ষুশূল। সমস্ত দিন রাস্তার পাশে কিছু ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো মেয়েকে দেখলেই বিরক্ত করে, বাজে Comments করে। আজ সকালে তো একটা মেয়ের পথ আটকে আজে বাজে গান গাইছিল। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, একটা ছেলে আমাকে আটকালো। বলল,
- "তুমি এখানে নতুন?"
- "হ্যাঁ।"
- "এজন্য কিছু জানো না। রতন ভদ্র-দাদার ছেলে। ভদ্র দাদা এই গ্রামের মাথা বলতে পারো। তার ছেলের Against-এ কেউ কিছু বলতে পারে না। তুমি একটু ঠাণ্ডা হও। দিনের বেলায় বাড়াবাড়ি কিছু করবে না।"
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর, একজনের থেকে Mr. ভদ্রের Address জেনে নিলাম। Mr. ভদ্রের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম, একজন 55+ বয়সের কেউ উঠানে বসে আছে। থমকে গেলাম। এমন সময় সৌম্য এসে বলল, "কি হল ঈশান-দা?"
- "Mr. ভদ্রের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।"
- "ভদ্রকাকা তো ওই যে উঠানে বসে।"
- "হ্যাঁ। আচ্ছা, একটু Help করবি?"
- "হ্যাঁ। বলো।"
- "যেদিন ভদ্রকাকার বাড়িতে দুই তিন জনের বেশি লোক আসবে, আমাকে Phone করে বলবি।"
- "ওহ! আজ বিকালে, পুজোর Function নিয়ে Meeting হবে। তখন Phone করে দেব।"
- "Thanks।"
বিকালে Phone পেয়ে চলে এলাম Mr. ভদ্রের বাড়ির সামনে। Meeting এখনো শুরু হয়নি। Wait
করতে থাকলাম। Meeting শুরু হওয়ার ৫ মিনিট পর, গিয়ে বললাম, "কাকা, একটা কথা বলার ছিল।" সবাই আমার দিকে তাকালো। Mr. ভদ্র বললো, "ও নতুন ছেলেটা। কি যেন নাম?"
- "ঈশান।"
- "আচ্ছা। Function নিয়ে কিছু বলবে?"
- "না। অন্য বিষয়ে।"
- "এখন তো Meeting-এ আছি। বসো। Meeting শেষে বলো।"
- "আমি বেশ সময় নেব না।"
পাশ থেকে একজন বললো, "বেশি Important কিছু না হলে, একটু বসো। দেখতেই পাচ্ছো, Meeting চলছে।" বললাম, "Actually, এটাও একটা Important বিষয়। তাই Late করতে চাইছি না।" অন্য একজন বললো, "তাই নাকি! তাহলে বলো কি Important বিষয়, যেটা পূজোর Meeting-এর মাঝেই বলতে হবে। আমরাও শুনব, বলো।" আমি বললাম, "Okay. বলছি। তার আগে এটা দেখানো দরকার।"
সকালে রতনের Eve-teasing টা Record করেছিলাম। সেই Video-টা সবাইকে দেখালাম। সবাই চুপ হয়ে দেখলো। Mr. ভদ্র পাথর হয়ে গিয়েছেন। তারপর রতনের সমস্ত কার্যকলাপ একে একে বললাম। সবাই চুপ করে শুনল। তারপর কেউ কেউ রতনের অন্যান্য ঘটনার কথাও বললো। সব শুনে, Mr. ভদ্র কাঁপতে কাঁপতে গম্ভীর গলায় বললেন, "দেখছি।" তারপর, আস্তে আস্তে উঠে ঘরে চলে গেলেন। আমি ও বাড়ি ফিরলাম।
হয়তো Mr. ভদ্র বেশ কড়া হয়েই শাস্তি দিয়েছে। তাই হয়তো রতন আমাকে মারতে এসেছে। মনে মনে হাসলাম।
রতন রেগে বললো, "বল কি বলেছিস? বাবা আমাকে ত্যাজ্য পুত্র করে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। তোর জন্য।" বললাম, "যা যা বলেছি, তার থেকেও কম শাস্তি দিয়েছে।"
রতন আরও রেগে গিয়ে ছুটে এসে লাঠি Swing করলো। আমি Dodge করার জন্য পিছনে সরতে গিয়ে পড়ে গেলাম। Shoe ছিঁড়ে গিয়েছে।
মা কতোবার বলতো, "একটা জুতো কিনে নে।"
আমি বলতাম, "লাগবে না। আরো ২ মাস লাফিয়ে লাফিয়ে যাবে।" হলো তো লাফানো! Traitor Shoes!
রতন লাঠি ফেলে দিয়ে একটা Knife বের করলো। আমি উঠার চেষ্টা করতেই বুঝলাম, পা মচকে গিয়েছে। Damn Shoes!
রতন দুইহাতে Knife-টা ধরে আমাকে Stab করতে গেল। আমি চিৎকার করে বললাম, "দেবরাজ!" মূহুর্তেই এক অতি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখলাম। অন্ধ হয়ে গেলাম। Second-এর মধ্যেই তীব্র ও তীক্ষ্ণ একটা Sound শুনলাম। কান বন্ধ হয়ে গেল। সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি রাস্তার উপর শুয়ে আছি। আমার সামনে, যেখানে রতন দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে একটা কালো Lower Half Body দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ছাই। আমি ওই Body-টা Touch করতেই ছাই-এর স্তূপের মতো ধসে পড়ল।
মেঘশুন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র-কে প্রণাম করলাম। তারপর, কোনোমতে উঠলাম। ছেঁড়া জুতো জোড়াকে English-এ গালি দিতে দিতে, মচকে যাওয়া পা নিয়ে Weird-ভাবে নাচতে নাচতে বাড়ির দিকে চললাম।
গল্প
জীবন্ত লাশ
চন্দন চ্যাটার্জি
কোটালপাড়া গ্রামীণ হাসপাতাল এ একটা অদ্ভুত বিষয় সম্প্রতি ঘটে চলেছে কয়েকদিন পর পর থেকেই লাশকাটা ঘর থেকে একটা করে লাশ গায়েব হচ্ছে। সাধারণত দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা হলে, বডি পোস্টমর্টেম করে দেখা হয় আত্মহত্যার কারণ। মূলত লাশের মাথাটা খুলে ব্রেনটাকে বিশ্লেষণ করে দেখা হয় যেই সময় ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল তখন তার মনে কি চলছিল। যদি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা হয় তবে পাকস্থলীর চিরে ডাক্তাররা দেখেন কি বিষ, কত পরিমাণে খাওয়া হয়েছে ইত্যাদি। অবশ্য এমন অনেক বিষ আছে যেগুলি পাকস্থলীতে পাওয়া যায় না, রক্তের মধ্যে পাওয়া যায়, যেমন সাপের বিষ । সে যাই হোক মৃত্যুর যে কোনো কারণই হোক না কেন কোটালপাড়া হাসপাতাল থেকে যে লাশ গায়েব হচ্ছে তা মৃত্যুর কোন কারণকে অপেক্ষা রাখে না।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন কোটালপাড়া জায়গাটি হল হাওড়া ও হুগলী জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম। হুগলীর চাঁপাডাঙ্গা থেকে দামোদরের বাঁধ ধরে উদয়নারায়ণপুর। কৃষিপ্রধান গ্রাম, তাই মূলত লোকে এই গ্রামীণ হাসপাতালকে ব্যবহার করে। এই গ্রামীণ হাসপাতাল এর ডাক্তারবাবু যদি মনে করেন কোন রোগীকে এখানে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয় তখন তিনি অন্য কোনো বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া ছোট খাটো রোগের সমস্ত চিকিৎসায় এখানে হয়। গ্রামীণ ছোট হাসপাতাল হলেও এখানে একটি মর্গ আছে, তাই পোস্টমর্টেম এখানেই হয়। একজন ডাক্তার আছেন তিনি পোস্টমর্টেম করেন আর একজন ডোম আছে, সে সব কিছু দেখাশোনা করে। কিন্তু এই লাশ গায়েব হওয়ার কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বোধগম্য হচ্ছে না। এক মৃত ব্যক্তির পচা গলা শরীর নিয়ে কার কিই বা কাজ হতে পারে। স্থানীয় চায়ের দোকানের বৈঠকে এই বিষয়টি সকলের কাছে মুখরোচক আলোচ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল টিচার সুরেন মিত্র মহাশয় বললেন - এটা হতে পারে কোন একটা দলের কাজ যারা মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবসা করে। অখিলবাবু বলিলেন, ”দেখ গে যাও হাসপাতালে কোন লোক এই লাশ পাচারের সঙ্গে যুক্ত আছে, তা না হলে একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে থেকে একটা মৃত ব্যক্তির লাশ তো নিজে পায়ে হেঁটে উধাও হয়ে যেতে পারে না“।
এই রকম নানা মুণীর, নানা মত, নানা মন্তব্যে পুড়ো পাড়া সরগরম। কিন্তু সঠিকভাবে কেউই লাশ পাচারের সঠিক কারণ, উপায় এবং উদ্দেশ্য বলতে পারছে না। এত সবের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটা ভয় আছে যদিও এখানে পোস্টমর্টেম এর পর অনেকেই মৃত ব্যক্তির শরীর নিতে আসেন না তার আত্মীয়-স্বজন, কিন্তু কেউ যদি কেউ নিতে আসে তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা দিতে বাধ্য থাকিবে। কারণ পোস্টমর্টেম এর পর মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর তার আত্মীয়-স্বজন এর একটা অধিকার আছে। এইজন্যে হাসপাতাল সুপার সূর্যকান্তবাবু পুড়শুড়া থানায় একটি এজাহার দাখিল করলেন এবং যদি সম্ভব হয় তবে একটা কনষ্টেবলকে যেন হাসপাতালে পোস্টিং করেন বিশেষ করে মর্গে সেই কথাও থানাতে জানালেন। রাতে পাহারা দেবার জন্য থানা থেকে কোন লোক এখনও আসেনি ইতিমধ্যে আরও একটা লাশ গায়েব হয়েছে। মৃত ব্যক্তির নাম সমীরণ মজুমদার, বয়স আনুমানিক চল্লিশ বছর হবে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে শ্মশানের ধারে যে আশুথ গাছ আছে, তাতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, গত দু-তিন দিন আগে। পুলিশ এসে লাশ নামিয়ে রিপোর্ট লিখে মর্গে পাঠিয়ে দেয়। তার স্ত্রী এসে লাশ সনাক্তকরণ করে গেছে। কিন্তু বাড়ির অন্য আত্মীয়স্বজন বডি নিতে আসে একদিন পরে। মর্গে গিয়ে ডোম কালু দেখে চার নম্বর টেবিলের লাশ নেই, শুধু সাদা কাপড়টা পড়ে আছে টেবিলের ওপর। ঘর চারিদিকে বন্ধ, সম্প্রতি একটা নতুন তালা লাগানো হয়েছে মর্গের মেন গেটে, তারপরও এই দুর্ঘটনা ঘটে কী করে। কালু প্রথমে ঘটনাটি সুপারের কাছে বলে। সুপার নিজে গিয়ে ব্যাপারটি তদন্ত করেন ও নিশ্চিন্ত হন যে সমীরণ মজুমদারের বডি গায়েব। ততক্ষণে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন হইচই, চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে ব্যাপারটা হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে সূর্যকান্তবাবু তাদেরকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভালো করে বোঝালেন। তারপর তারা চলে গেলো ঠিকই কিন্তু সূর্যকান্তবাবুর মনে মূল প্রশ্ন এখনো অনুত্তরিত হয়ে রইল। সমীরণ মজুমদারের লাশ কে, কোথায়, কিভাবে, কেন সরিয়েছে।
এটা নিয়ে এখন পর্যন্ত তিন তিনটে লাশ গায়েব হয়েছে। ব্যপারটা এখন আর কোনভাবে সামলানো যাচ্ছে না। এই ঘটনার পর পুড়শুরা থানা থেকে একজন কনস্টেবল এখানে পোস্টিং করানো হয়েছে । পাড়ার কয়েকজন যুবক ছেলে মিলে স্ব-ইচ্ছায় হাসপাতালে চারিদিকটা রাতের বেলায় পাহারা দেবে বলে ঠিক করেছে। অবশ্য এতে সূর্যবাবু অনুমতি দিয়েছেন এবং তিনি তাদের কয়েকটি বড় টর্চলাইট কিনে দিয়েছেন। এই দলের মধ্যে আছে পল্টু, বিশু, রাখাল, কেষ্ট এবং হাবা লালু। লালু কথা বলতে না পারলেও বুদ্ধি খুব বেশি। একবার চক্রবর্তীদের বাগান থেকে কে আম পেড়ে নিয়ে পাঁচিল টপকে চলে যায় সেইটা জানার জন্য সে সারারাত আম গাছের উপর বসে ছিল। চোর যেই আসে অমনি সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর তার হাত-পা বেঁধে ফেলে দড়ি দিয়ে, সেই থেকে গ্রামের কোন সাহসিক কাজ করতে হলে লালুর ডাক পরে সর্বপ্রথম। এই পাঁচ ছয় - জন যুবক, দুজন করে এক একটা দলে ভাগ হয়ে হাসপাতালে বিভিন্ন দিকে পাহারা দিচ্ছে। মাঝরাতে লালুর পেট খারাপ হয়, লালু আর বিশু দায়িত্ব নিয়েছিল হাসপাতালের পূর্বদিক পাহারা দেবে। আসলে দামোদর নদীর পশ্চিম পাড়ে আছে এই হাসপাতাল তাই হাসপাতালের পূর্বদিক মানে দামোদর নদীর দিক। অতএব বিশুর পরামর্শ মতো লালু দামোদরের চরে গেল পায়খানা করতে। শেষকালে শৌচকর্ম করার জন্য যখন সে দামোদর নদীতে নেমেছে তখন হঠাৎ তার মনে হল নদীর পাড়ে শ্মশানের কাছে যে আশুথগাছটা আছে তার মধ্যে যেন কেউ নড়াচড়া করছে। প্রথমটায় সে ভাবল শিয়াল বা ভোঁদড় হবে কারণ এরা নদীর চরে গর্ত করে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে, রাত্রিবেলা বের হয় শিকারের সন্ধানে। এরা হাঁস মুরগি এমনকি ছোট ছাগল ছানা ও বাদ দেয় না। একটু ভালোভাবে দেখবে বলে সে এগিয়ে গেল, ঝোপের ধারে খানিকটা যেতেই তার মনে একটা অজানা ভয় মিশ্রিত আশঙ্কা উপস্থিত হল, এটাতো ভোঁদড় বা শিয়ালের কীর্তি নয়।
সে ছুটে বিশুকে ডাকতে যাবে ভাবল হঠাৎ একটা কি সে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। বিশু তার থেকে বয়সে কয়েক বছরের ছোট তাই টর্চ লাইটটা তাকে দিয়ে, সে চাঁদনী রাতে খালি হাতে এসেছিল পায়খানা করতে। সেই আবছা চাঁদের আলোয় সে বুঝতে পারলো এটা কোন হাঁস বা মুরগী পা নয়, এটা একটা মোটা প্রমাণ সাইজের মানুষের শরীর। তাহলে কি শিয়াল বা বড় কোন জন্তু একটা গোটা মানুষকে গ্রাম থেকে ধরে এনেছে। তাতো সম্ভব নয়, তাছাড়া একটা জ্যান্ত মানুষকে যদি কোন জন্তু ধরে সে তো স্বাভাবিকভাবেই চিৎকার করবে বা নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে। এটা তো নিথর হয়ে মরার মত পড়ে আছে। তবে কি শিয়ালের দল হাসপাতাল থেকে লাশ গায়েব করেছে। এইরকম একটা সূত্র পাওয়া গেছে এই ভেবে লালু একটু পুলকিত হলো বটে কিন্তু পরমুহুর্তে তার সমস্ত আনন্দ কর্পূরের মত উবে গেল। সে সামনে দেখতে পেল একজোড়া জ্বলন্ত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে চোখটা যখন আরেকটু অভ্যস্ত হয়ে গেল তখন সে দেখল শুধু চোখ নয়, একটা নর কঙ্কাল তার থেকে ১০ -১৫ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা হাতে এই মৃত ব্যক্তির কাটা হাত যেটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সেই ভয়ঙ্কর কঙ্কালটি এই কাটা হাত থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এহেন দৃশ্য দেখে সে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বিশুকে ডাকার চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হলো। অতএব সে প্রাণপণে দামোদরের চরে বালির উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে লাগল হাসপাতালের দিকে। বিশুর কাছে গিয়ে সে কোন কথা বলতে পারলো না, শুধু ইশারাতে দামোদরের চরের দিকে একবার আঙ্গুল দিয়ে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল, বিশু তা বুঝতে পারল না চিৎকার শব্দ তাই সে শুধু হাত নেড়ে ইশারা করে আবার জিজ্ঞাসা করল সে কি বলতে চায়। তার উত্তর দেবার আগেই লালু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। বিশু তাড়াতাড়ি বাকি সব ছেলেদের ডাকলো, এরপর লালুকে একটা স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নিয়ে এলো। ডাক্তারবাবু তাকে দেখে ওষুধ দিলেন। সবাই মিলে সেই রাতে তাকে ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দিল। বাকি সবাই যে যার ঘরে চলে গেল, সেই রাতে কারো আর পাহারা দেওয়া হলো না। পরের দিন সকালে, সকলে মিলে লালুর বাড়িতে গিয়ে দেখল তার ধুম জ্বর হয়েছে, তার মা মাথায় জলপট্টি দিয়েছে আর সে জ্বরের ঘোরে বিকার বকতে শুরু করেছে। কেউ এটা ভুলতে পারল না কাল পর্যন্ত এই দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহসী শক্তিমান যে ছেলে, এক রাতে কি দেখলো যে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। হঠাৎ বিশু বলল গত কাল রাতে ও পায়খানা করতে নদীর চরের দিকে গিয়েছিল, ওখান থেকে যখন সে ফিরে আসে সে অত্যন্ত ভীত ছিল এবং কিছু একটা ভয়ংকর জিনিস সে দেখেছিল ওখানে, সেটাই বারবার আঙ্গুল দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিল। লালুর পর পল্টু হল এই দলের মধ্যে একটু সাহসী।
সে বলল, ”চল একবার আমরা সবাই মিলে যাই ওখানে”। রাখাল ছাড়া বাকি সবাই চলে গেল দামোদরের চরে। এই দিকটায় লোকেরা বেশি আসা-যাওয়া করে না। প্রথমত শ্মশান তারপর এখানে আশুথ গাছ। গ্রামের লোকেদের ধারণা রাত্তিরে যদি কেউ একলা এই আশুথ গাছের কাছে আসে তবে তাকে ভুতে ধরবে অবশ্যই।
অনেকে নাকি নিশির ডাক শুনে রাত্রিয়ে এখানে এসেছে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি, সকালে তার লাশ পাওয়া যায় নদীর ধারে। এছাড়া অন্য কারণও আছে এইদিকে নদীটা একটু বেশি গভীর। আশুথ গাছ থেকে ডালপালা ও ঝুড়ি নেবে একটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। যদি কেউ আশুথ গাছে চড়তে গিয়ে পা পিছলে নদীতে পড়ে তবে তার মৃত্যু অবধারিত।
বল্টু বলল, ”তোর একটা পচা গন্ধ পাচ্ছি” বাকিরা প্রায় একসাথে বলে উঠল “হ্যাঁ পাচ্ছি”। ইতিমধ্যে পাড়ার একটা ঘিয়ে ভাজা কুকুর একটা বড় হাড় মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর তারা আরও খানিকটা আশুথ গাছের দিকে এগোতে গিয়ে যেটা দেখতে পেল সেটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। একটা মৃত ব্যক্তির লাশ পড়ে আছে নদীর চরে, শরীরটা পচে গেছে তার থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তার শরীরে দুটো হাত নেই এবং পেটের কাছে একটা বড় গর্ত মনে হচ্ছে কেউ ওখান থেকে মাংস খুলে খেয়েছে । দুটো কুকুর তখন এই লাশটাতে কামড় দিয়ে চলেছে। এমন দৃশ্য দেখে বিশু ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল পলতু বলল, ”তাহলে এই এটা মনে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে গায়েব হয়ে যাওয়া একটি লাশ এই কুকুরের দল নিয়ে এসেছে”। বিশু বলল, ”কুকুর কি করে আনতে পারবে? হাসপাতালের গেটে তো তালা বন্ধ”। পলতু বিশুকে বলল “তুই একবার দৌড়ে গিয়ে সূর্যবাবুর কাছে এই কথা জানাবি, ততক্ষণ আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি”। বিশু চলে গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যবাবু সঙ্গে একজন ডাক্তার, ডোম কালু এবং আরও দুই একজন লোক নিয়ে এসে হাজির হলেন। প্রথমেই সূর্যবাবু মুখটা দেখেই চিনতে পারলেন এটা সমীরণ মজুমদার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে বন্ধ মর্গ থেকে এই লাশটাকে এখানে এলো কি করে। একজন ডাক্তারবাবু বললেন “স্যার বন্ধ মর্গ থেকে এটা কিভাবে এখানে এল সেটা পরে আলোচনা করা যাবে, আগে এই লাশটাকে দাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ পচা লাশ থেকে যা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তাতে রোগ ছড়িয়ে পরতে পারে”। কথাটা সূর্যবাবুরও মনে হয়েছিল। তাই তার অনুরোধে পাড়ার কয়েকজন লোক মিলে এবং কালু ডোম শ্মশানে লাশটার দাহর ব্যবস্থা করল। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে, ইতিমধ্যে লালু সুস্থ হয়ে উঠেছে, সে আকারে ইশারায় সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করল সেই রাতে কি দেখেছিল কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারলো না সকলে তাকে হাবার প্রলাপ বলে এড়িয়ে গেল। এরপর প্রায় আরও একমাস কেটে গেছে, মর্গ শূন্য কারণ কোনো দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যার খবর নেই এই গ্রামে। তাই রাত্তিরেতে পাহারাদারি উঠে গেছে। একদিন স্থানীয় কোটাল পাড়া স্কুলের বাংলার শিক্ষক সুরেন মিত্র মহাশয় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা যান, তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে গত বছরে, এক পুত্র কলকাতায় থাকে, গ্রামের বাড়িতে সুরেনবাবু একাই থাকতেন। পাশের বাড়ির উমা বউদি সুরেনবাবুকে দুই বেলা খাবার দিয়ে যান। গত কাল রাতে খাবার দিয়ে যাবার পর সুরেনবাবু গেট বন্ধ করেন। আজ সকালে উমা বউদি চা দিতে এসে দেখেন গেট বন্ধ। অনেক ডকাডাকির পরও যখন গেট খুললো না, তখন তাঁর একটু ভয় হল। তিনি পাড়ার সকলকে ডাকলেন। পাড়ার লোক এসে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখেন সুরেনবাবু বিছানায় শুয়ে আছেন চিত হয়ে। পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তার বীরেন ঘোষ দেখে বলেন হৃদ যন্ত্র বিকল হয়ে ইনি মারা গেছেন, বোধহয় ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। তাঁর একমাত্র পুত্রকে খবর দেওয়া হয়েছে। তার আস্তে আস্তে প্রায় রাত দশটা তারপর শব নিয়ে সুরেনবাবুর পুত্র পিতার অন্তিম যাত্রায় চলল, সঙ্গে কয়েকজন লোক শ্মশানে গেল শ্মশান যাত্রী হিসাবে। যারা শ্মশান যাত্রী ছিল সকলেই মদ খেয়ে চুর শুধুমাত্র সুরেনবাবুর এক মাত্র পুত্র সন্তোষ ছাড়া। কোটাল পাড়া শ্মশানের চিতাটি নদীর দিকে এছাড়া একটা ছোট আটচালা মত আছে সকলের বসার জন্য। সেখানে দু চারজন লোক বসে মদ খাচ্ছে এবং মাঝে মধ্যে হরিবোল দিচ্ছে। সুরেনবাবুর চিতা জ্বলছে, তার পুত্র অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। একটা লোক মাঝেমধ্যে গিয়ে চিতার আগুনটা ঠিক করে দিচ্ছে এবং কাঠের যোগান দিচ্ছে যাতে করে আগুনটা
ঠিক ভাবে জ্বলে। হঠাৎ সন্তোষের মনে হল যে চিতার মধ্যে শুধু কাঠ জ্বলছে মৃত ব্যক্তির শরীর নেই। এই কথা মনে হতেই প্রথম সে একজনকে জানালো। শ্মশান যাত্রীরা অধিকাংশই মদ খেয়ে চুর ছিলো তাই তারা উল্টে সন্তোষকে সান্ত্বনা দিলো বাপ মরলে এই রকমই মনে হয় বাবা। এর মধ্যে একজন ব্যক্তি যে চিতায় কাঠের যোগান দিচ্ছিল সে বিষয়টি লক্ষ্য করলো। তখন আর বাকি লোকরা তার কথা ফেলতে পারল না। এক মৃত ব্যক্তির লাশ জ্বলন্ত চিতা থেকে কে নিয়ে যাবে আর এটা তার কি কাজে লাগবে। তাই সকলে মিলে আশ-পাশটা দেখতে লাগল। হঠাৎ একজন বলে উঠল,” ওই দেখো লাশ”।
সবাই একসাথে সেই দিকে তাকিয়ে দেখল। একটা নর কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে তার শরীরে কোন মাংস-চামড়া নেই শুধু হাড়, চোখ দুটো যেন আগুনের গোলা, দুটো হাত দিয়ে আধপোড়া শবটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। ইতিমধ্যে উপস্থিত সকলের নেশা ছুটে গেছে, তারা মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। কাজেই এটা সকলের একসাথে চোখের ভুল নয়, কঠিন কঠোর বাস্তব। এর মধ্যে একটা লোক পিছন থেকে গিয়ে সেই নরকঙ্কালের মাথায় এক সজোরে বাঁশের বাড়ি মারতে উদ্যত হয়। সেই আঘাত তার গায়ে লাগার আগেই কঙ্কালটি ভূতের মত অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার হাত থেকে আধপোড়া সুরেনবাবুর লাশটি মাটিতে পড়ে যায়। তারপর সবাই সেটাকে ধরা ধরি করে চিতায় তোলে। বাকী রাতটুকু মরা পোড়াতেই চলে যায়। পরের দিন এই কথা আগুনের ফুলকির মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
কালীজ্যাঠা গ্রামের সব থেকে বয়স্ক এবং পন্ডিত ব্যক্তি এবং তন্ত্র বিদ্যা কিছু জানেন, সারা গ্রামের লোক তাকে মান্য করে। পরের দিন সন্তোষ, পিতার শ্রাদ্ধের কথা কালীজ্যাঠাকে বলতে গিয়েছিল। কথায় কথায় শ্মশানের সেই রাত্রির কথাটা এসে পাড়ে। এই কথা শুনে কালীবাবু বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর হাত চেলে দেখলেন একটা অমঙ্গলের ছায়া যেন গোটা গ্রামটা ঘিরে আছে।তিনি বললেন, ”তোমাদের ভাগ্য ভালো তোমরা সব থেকে বেঁচে ফিরে এসেছ। একটা অতৃপ্ত প্রেতআত্মা গোটা গ্রামের দিকে কু-দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে। তাই নানা অমঙ্গল হচ্ছে। শ্মশানে একটা কালীপূজো করা দরকার এবং সেটা সাধারণ ব্রাহ্মণ দিয়ে নয়, বর্ধমানের রায়না থেকে বিশেষ তান্ত্রিক ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসতে হবে। তিনি পরের দিনই গ্রাম সভায় এই কথাটি পারলেন, অমঙ্গলের কথা শুনে সকলেই একবাক্যে রাজি হলো। পাড়ার ছেলেরা তখন বাড়ি বাড়ি কালী পুজোর চাঁদা আদায় করতে ছুটে গেল। এর মধ্যে একজন রায়নাতে চলে গেল তান্ত্রিকের সন্ধানে। কালীবাবু এক তান্ত্রিককে জানতেন তাঁর কাছে লোক পাঠানো হয়েছিল। তিনি শ্মশান জাগাতে পারেন এবং বেতাল সিদ্ধ তান্ত্রিক। কোটালপাড়া কালীবাবুর কাজ থেকে আসছে শুনে সেই তান্ত্রিক যত্ন পূর্বক এদের কথা শুনলেন। তারপর একটা চক দিয়ে মাটিতে অনেকক্ষণ নানা আঁকিবুকি কাটলেন এবং গণনা করে বললেন, “কোন এক অতৃপ্ত আত্মার শব এখনও তোমাদের গ্রামে আছে, সেইই সব অপকর্ম করছে । তিনি কে বা কোথায় আছেন সেই সব কিন্তু আমি এখনই বলতে পারব না। তার জন্য শ্মশানে বিশেষ পূজা ও শ্মশান জাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী অমাবস্যায় একটা ভালো দিন আছে তোমরা চাইলে ঐদিন আমি পূজা করতে পারি। সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল, তান্ত্রিক মহাশয় তার হাতে পূজার সামগ্রীর তালিকা তুলে দিলেন।
আজ অমাবস্যা সকলে মিলে শ্মশানে চারিদিক পরিষ্কার করেছে, আটচালায় পুজো হবে। শ্মশান কালী পূজার নিয়ম হলো, ওই দিনই ঠাকুর তৈরি হবে, সারারাত পুজো হবে এবং সূর্য ওঠার আগে বিসর্জন হবে। তান্ত্রিকমশাই সকালেই এসে গেছেন, তিনি মাটি দিয়ে একটা কালী প্রতিমা বানাচ্ছেন, মূর্তির পাশে একটা পাত্রে আগুন জ্বলছে, তার তাপে মূর্তিটা শুকাচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী জিনিসপত্র সব এসে গিয়েছে, এখানে বিজলিবাতি আনা সম্ভব নয়, তাই কয়েকটি কেরোসিন তেলের বাতি জ্বালানো হয়েছে। সন্ধ্যেবেলায় কালীজ্যাঠা এসে একবার দেখে গিয়েছিলেন এবং তান্ত্রিকমশাইয়ের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। তান্ত্রিকমশাই তার একজন সঙ্গীকে নিয়ে এসেছেন কারণ শ্মশান জাগাতে গেলে একজন পুরোহিত ও একজন তন্ত্রধারক এর প্রয়োজন হয়। ইতি পূর্বে কোটাল পাড়া শ্মশানে এত বড় কালীপুজো হয়নি তাই পল্টুর দল খুব খুশি।
বিশু জিজ্ঞাসা করল, ”ঠাকুরমশাই এখন ঠাকুর গড়ছেন আর আজ রাতেই পুজো হবে, এই সময়ের মধ্যে ঠাকুর শুকিয়ে যাবে তো, কারণ কুমোরপাড়ায় দেখেছি সরস্বতী ঠাকুর অনেকদিন আগে তৈরি হয়, আমরা পুজোর দিন ঠাকুর আনতে যেতাম”। তান্ত্রিকমশাই তার কথাগুলো শুনে একটু মুচকি হাসলেন আর সহকারী মশাই উত্তর দিলেন, “সেই জন্যই তো আগুন জ্বালিয়ে রেখে ঠাকুরকে শুকানো হচ্ছে”।
এখন রাত্রি দশটার বাজে। আটচালার মধ্যে ঠাকুর বসিয়ে পুজোর ব্যবস্থা হয়েছে। একদিকে কাটা ফল ও মিষ্টান্ন আছে অন্যদিকে ফুল-বেলপাতা ও পূজার অন্যান্য সামগ্রী আছে। একটা বোতলে কারণ সুধা, যাকে বাংলায় বলে দেশী মদ এবং একটা জীবন্ত মাগুর মাছ। মাগুর মাছ ও কারণ সুধা শ্মশান কালী পুজোর বিশেষ উপকরণ, যেটা নাহলে পুজো অসম্পূর্ণ থাকে বলে তান্ত্রিকদের ধারণা।
তান্ত্রিকমশাই আসনে বসে পূজা শুরু করলেন, সহকারী মশাই তাকে নানাভাবে পূজোর সামগ্রী হাতে হাতে জুগিয়ে দিয়ে সাহায্য করলেন। তিনি পুঁথি খুলে নানান মন্ত্র বলে একটা করে ফুল মায়ের পায়ে দিতে লাগলেন। ছেলের দল এক দিকে বসে ছিল, উল্টো দিকে গ্রামের কিছু লোক বসে ছিল। তারাও বেশ কিছুক্ষণ ধরে পূজা দেখছিল।
এখন রাত্রি বারোটা বাজে, চতুর্দিক নিশুতি, একটা ঠাণ্ডা হওয়া বইছে, দূরে কোথায় শিয়ালের দল প্রহর গুনিয়ে যাচ্ছে। বলির সময় উপস্থিত। একটা কাঠের পাটার উপর মাগুর মাছটাকে রেখে, কাঠারি দিয়ে দু টুকরো করে দিলেন। মাছের ধড়ের দিকটা বেশ খানিকক্ষণ ছটফট করতে লাগলো। সেই মাছের রক্ত একটা কলাপাতায় দিয়ে তাতে ফুল-বেলপাতা পূজার অন্যান্য উপকরণ দিয়ে একটু কারণ সুধা দিয়ে মায়ের কাছে রাখলেন। এইভাবে পূজা করতে করতে আরও প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে গেল।
এখন রাত্রি দ্বিপ্রহর চারিদিক আরও নিস্তাব্দ হয়ে গেছে। এই সময় ঠান্ডা বেশি তারপর নদীর ধার, কুয়াশার হিমেল একটা চাদর যেন পুরো গ্রামটাকে ঢেকে দিয়েছে। তান্ত্রিকমশাই ও তার সহকারী, কিছু পুজোর উপকরণ নিয়ে চললেন শ্মশান জাগানোর জন্য। উপস্থিত সমস্ত লোককে তিনি বললেন, - “তোমরা ওই দিকে যাবে না, যদি আমরা ডাকি তবে যাবে”।
আটচালা থেকে শবদেহ দাহ করার জায়গাটি একটু দূরে, কিন্তু তা হলেও আটচালা থেকে সবই স্পষ্ট দেখা যায় ওখানে কি হচ্ছে, না হচ্ছে। তান্ত্রিকমশাই চিতার উপর আসন পেতে বসলেন। প্রায় সপ্তাহখানেক আগে গ্রামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন তারই শব দেহ পোড়ান হয়েছিল। ভাঙা কলসিটা এখনও তার মাথার কাছে আছে। একটা নামাবলী ডাকা দিয়েছিল সেটা গুটিয়ে গিয়ে একদিকে পড়ে আছে, একটা ফুলের মালা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে, একটা গীতার বুকের ওপরে আছে, মাথার পাশে তুলসী গাছ শুকিয়ে গেছে জলের অভাবে। তান্ত্রিকমশাই তার ওপর বসে নানান মন্ত্র বলে পূজা করতে লাগলেন ও মধ্যে মধ্যে একটু করে কারণ শুধা তার মুখে দিতে লাগলেন। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে তার ঠিক নেই। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা হাওয়ায় চারদিকটা ভরে গেল, আশুথ গাছের ডালপালাগুলো যেন কেমন জোরে জোরে দুলতে লাগল, এরপর সহকারী মশাই উপস্থিত কয়েকজন লোককে ডাকল। তান্ত্রিকমশাই তখনও চিতার ওপর বসে পূজা করছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ ও তীব্র চিৎকার শোনা গেল। তান্ত্রিকমশাইের মাথাটি ধীরে ধীরে আন্দোলিত হতে লাগল, তাকে যেন মনে হলো একটা গভীর ঘুম পেয়েছে, তারপর তিনি ধীরে ধীরে চাপা আওয়াজে সরকারীকে জিজ্ঞেস করলেন - কেন তোরা আমাকে ডেকে এনেছিস।
সরকারী মশাই প্রত্যুত্তরে বলল, - কে তুই? কি চাস?
তান্ত্রিকমশাইয়ের কন্ঠ দিয়ে আবার আওয়াজ আসলো, - আমি এক কালী সাধক ছিলাম, আমার মৃত্যুর পর তোরা আমার শরীরটাকে যথাবিধি দাহ না করে, অর্ধ দগ্ধ অবস্থায় দামোদরের চরে ফেলে দিয়েছিস। আমি এখনও মুক্তি পাই নি, আশুথ গাছের নিচে যে ঝোপে আছে সেইখানে এখনো আটকে পড়ে আছি, শরীরে বড় যন্ত্রণা, যতদিন না তোরা আমার দেহকে যথাবিহিত দাহ কর্ম করবি, ততদিন আমি তোদের উপর অত্যাচার করবো। সরকারী বলল, - ঠিক আছে আমরা তোর মুক্তির ব্যবস্থা করছি তুই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবি, আর এখন গুরুজীর শরীর ছেড়ে চলে যা, যাবার সময় ওই আশুথ গাছের একটা ডাল ভেঙে দিয়ে।
এর খানিক পরেই মর মর করে একটা আশুথ গাছের ডাল ভেঙে দামোদরের জল পড়লো, আর যে ঠাণ্ডা হাওয়াটা বইছিল সেটাও কমে গেল, এবং তান্ত্রিকমশাইও ধীরে ধীরে খানিকটা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন। সকলে মিলে আবার তাকে ধরে আটচালায় নিয়ে আসল।
প্রতিমার সামনে বসে তান্ত্রিকমশাই - সরকারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছিল”।
সরকারী তাকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর তান্ত্রিকমশাই উপস্থিত লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কে এই কালী সাধক ছিল, তিনি কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?”
উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন মাতব্বর গোছের লোক ছিল সে বলল, ”প্রায় বেশ কয়েক বছর আগে এক সাধু কোথা থেকে এসে এখানে তার আস্তানা বানিয়েছিল। তাকে আমরা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তিনি উত্তর সামান্যই দিতেন। এই শ্নশানটা ছিল গ্রামের বাইরে, দামোদরের পাড়ে। তখন এই এলাকায় চুরি-ডাকাতি খুব হতো। রাত্রিরে এখানে সকলে এসে জমায়েত হতো তারপর গ্রামের চুরি করতে যেত। এই সাধু থাকায় চোরের দল আর এখানে আসতো না। তাই গ্রামের লোকেদের বিশেষ আপত্তি ছিল না। তিনি মাঝে মধ্যে গ্রামে গিয়ে ভিক্ষা করে নিয়ে আসতেন তার পর তা রান্না করে খেতেন। এরকমভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। হঠাৎ এক দিন এক ছেলে বলল সেই সাধুবাবা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আটচালার মধ্যে, নড়েও না চড়ে না। ওরা নদীর পাড়ে বল খেলতে গিয়েছিল, হঠাৎ বলটা ঐ দিকে চলে যায় সেটা আনতে গিয়ে একটা ছেলে দেখেছিল। তখন আমরা কয়েকজন মিলে এখানে দেখতে আসি। দেখি সাধু বাবা মারা গেছেন বোধহয় ঘুমের মধ্যে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেছেন। হরিশ ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। তারপর গ্রামের কয়েকজন লোক মিলে তাকে দাহ করে দেয়। যেহেতু তার আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই তাই দায়ভার গ্রামের লোকেরা নিয়ে ছিল। তখন বর্ষাকাল বাঁশ-কাঠ সবই ভিজে। আমার মনে হয় যারা দাহ করতে এসেছিল তারা কোন উপায়ে খানিকটা দাহ করে বাকি শব দেহ নদীতে ফেলে চলে যায়। এরপর দেহটা যথাবিহিত অন্তিম সংস্কার হয়নি তাই জন্যই তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। বর্ষাকালে তখন দামোদরে বন্যা এসেছে। সবাই ভেবেছিল ওর শব নদীতে ভাসতে ভাসতে অনেকদূর চলে যাবে, কিন্তু তা হয়নি, যার মাটি যেখানে কেনা আছে অন্তিমকালে সে সেইখানে অবশ্যই যাবে। ওনার মাটি এখানে কেনা আছে, তাই বর্ষাকালে ভরা নদী জলে ফেলে দিলেও শবদেহ আশুথ গাছের নিচে ঝোপের মধ্যে আটকে যায়। শরীর থেকে মাংস পচে-গলে নদীর জলে মিশে যায়, কিন্তু কঙ্কালটি এখনো আটকে আছে “।
এতক্ষণ কথা বলার পর মাতব্বর ব্যক্তি খানিকটা থামলেন তান্ত্রিকমশাই বললেন, ”ঠিক আছে কাল এখান থেকে শবটাকে তুলে আমি পুজো করে দেবো তারপর তোমরা দাহ করবে“।
এই বলে তিনি কালীপুজোর বাকি অংশটা সারতে লাগলেন। পুজোন্তে আরতি শুরু করলেন এবং তারপর সমস্ত জিনিসপত্র এবং কালীর মূর্তি সহ দামোদরের জলে বিসর্জন দিলেন। তখন ভোর হয়ে এসেছে ।
পরদিন সকালে তান্ত্রিক মশাই কালী জ্যাঠার বাড়ি গিয়ে তাদের রকে বসে সব কথা বললেন। তিনি শুনে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন তারপর বললেন, “মৃত ব্যক্তি কারো শত্রু হয় না, কারো মিত্র হয় না। মৃত ব্যক্তির নিজের ধর্ম অনুযায়ী যথাবিহিত সংস্কার না করলে সংসারে অমঙ্গল হয়”।
এরপর তান্ত্রিকমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”তুমি ভাই এর যথাবিহিত পূজা করে, শব দাহের ব্যবস্থা করে দিও”।
তান্ত্রিকমশাই তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না আমি সব কাজ ঠিক করে দেব”। এরপর একজন এসে বলল, ”তান্ত্রিক মশাই শবদেহ নদীর থেকে তোলা হয়েছে আপনি যাবেন?”।অতঃপর তান্ত্রিকমশাই নিজে গিয়ে সেই শবকে যথাবিহিত পূজা করার পর শবদেহের ব্যবস্থা করলেন ।
সমস্ত কাজ সম্পাদন করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল। তান্ত্রিকমশাই ও তার সহকারী দুপুরে কালী জ্যাঠার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন করলেন। হাসপাতালের সুপার সূর্যবাবু তান্ত্রিকমশাইকে একটা এক হাজার টাকার নোট দিয়েছিলেন। এরপর আর কোটালপাড়া গ্রামে কোন শব দেহ গায়েব হবার ঘটনা ঘটেনি। সবাই এখন নিশ্চিন্ত।
গল্প
রেইনফিল্ডস
সিনড্রোম
অদিতি সুর
সাঁঝবাতি অনেকদিন পর আলমারি খুলে ওর সব অগোছালো শাড়ি, জামাকাপড়গুলো গোছানোর চেষ্টা করছিল। এই কাজটা করতে ওর কোনোদিনই তেমন একটা ভালো লাগেনা। গত ফেব্রয়ারিতে শান্তনুর সাথে বিয়ে হওয়া ইস্তক এই বাড়িতে আসার পর থেকে এই দশ মাসে একবারও নিজের আলমারিটা ভালো করে গুছায়নি সাঁঝবাতি। সময় যদিও ও অনেক পেয়েছে, তবুও শুধুমাত্র ল্যাদ লাগার কারণে ও কাজটা করেনি।
আজ রাত্রে বাড়িতে শান্তনু ফিরবেনা। বিয়ের পর এই প্রথম রাত্রে ওর বর আসবেনা বাড়িতে।ছোটবেলা থেকে কোনদিন বাড়িতে একা থাকতে হয়নি ওকে। শান্তনু অফিসের ট্যুরে কলকাতার কাছেই একটা মফস্বল এলাকায় গেছে। সকাল থেকে বিকেল অব্দি একরকম ভাবে কেটে গেলেও সন্ধ্যে নামার পর থেকে ওর সময়টা যেন কাটতেই চাইছে না। অগত্যা ও সময় কাটাতে নিজের আলমারিটা খুলে বসে।
বেশ নামী কোম্পানির আলমারিটা ওর বাবা বিয়েতে ওকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। যদিও শান্তনু সেসব দিতে বারণ করেছিল। তবু ওর বাবা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে জামাইয়ের কেনা নতুন ফ্ল্যাটটাকে আসবাব দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন।
আলমারি খুলে একে একে নিজের শাড়িগুলো তাক থেকে নামাতে থাকে সাঁঝবাতি। বিয়ের আগে ও নিজের জন্য তেমন করে কখনোই শাড়ি কিনতো না। তবে এখন ওর অনেক শাড়ি। বেশিরভাগই অবশ্য বিয়েতে উপহার হিসেবে পাওয়া। সব শাড়ীর নামও ও জানেনা। প্রথম তাকের সব শাড়ি বিছানার ওপর নামানোর পরে সাঁঝবাতি পরের তাকের শাড়িগুলোও এক এক করে নামাতে থাকে।তখনই হঠাৎ করে একটা শাড়ির ভাঁজে খুলে একটা ছোটমত ব্লেড নিচে পড়ে যায়। ব্লেডটা দেখে একটু অবাক হয় ও। আলমারির মধ্যের এই শাড়িগুলো ওর তেমন খুলে দেখা হয়না। এর আগেও ঘরের টেবিল বা তাকের ওপর ব্লেড দেখেছে ও। যদিও ও শান্তনুকে দেখেছে ইলেকট্রিক রেজার দিয়ে দাড়ি কাটতে। তাহলে ব্লেড আসে কোথা থেকে....!
তখনই ওর ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে। সাঁঝবাতি উঠে গিয়ে বিছানার ওপর থেকে ফোনটা ধরে।
"হ্যালো।"
"হ্যালো সাঁঝবাতি, আজ আমি ফিরে আসছি। কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে।"
"ওহ খুব ভালো। সাবধানে ফিরে এসো।"
শান্তনুর বাড়ি ফেরার খবরে বেশ খুশি হয় ও। আলমারির সামনে এসে আবার জামাকাপড় গুছাতে থাকে।শাড়ির ভাঁজ থেকে পাওয়া ব্লেডটাকে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দেয় ও।
ঠিক রাত নটার দিকে শান্তনু বাড়ি ফিরে আসে। সাঁঝবাতি ভীষণ খুশি হয় ওকে দেখে, আফটার অল ওকে রাতটা আর একা কাটাতে হবে না। শান্তনু ফ্রেস হয়ে আসলে দুজনে একসাথে বসে রাতের খাবার খায়। খাওয়া শেষে শান্তনু বলে ওর কিছু অফিসের কাজ বাকি আছে তাই ও কাজগুলো শেষ করে একটু দেরি করে ঘুমোবে। বিয়ের পর থেকেই সাঁঝবাতি দেখে ওর শুয়ে পরার বেশ অনেকক্ষণ পরে শান্তনু বিছানায় শুতে আসে। তা সে ও যতই ক্লান্ত থাকুক। জিজ্ঞেস করলে বলে অফিসের কাজ থাকে। এমনকি রবিবারের দিনেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। এই নিয়ে অনেকদিন শান্তনুর ওপর অভিমান করেছে সাঁঝবাতি। রাগ করে কথাও বলেনি। তাতেও বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। শান্তনু ওকে একসময় মানিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া নতুন বিয়ের গন্ধ এখনও ফিকে হয়ে যায় নি, তাই বেশিক্ষণ রাগ অভিমানের পালা চলে নি দুজনের মধ্যে।
আজও খাওয়ার পর বেডরুমে গিয়ে একাই শুয়ে পড়ে সাঁঝবাতি। ও জানে শান্তনুর শুতে আসতে এখনও বেশ দেরি হবে। নিজের খাটে শুয়ে ও মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। তারপর কখন যেন ওর চোখ দুটোতে নিদ্রা দেবী ভর করেন। আর বেশিক্ষণ মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে পারে না ও। কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল ও তার ঠিক নেই তার মধ্যেই একটা হোয়াটস অ্যাপে মেসেজের রিংটোন মৃদু শব্দে বেজে ওঠে। অন্য দিন শোয়ার আগে ইন্টারনেট কানেকশানটা ফোনে বন্ধ করে দেয় সাঁঝবাতি। তবে আজ সেটা করতে ভুলে যাওয়ার জন্য অসময়ে মেসেজটা এসে ওর ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয়। ও ঘুম জড়ানো আলস্য ভরা চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর প্রিয় বন্ধু তন্বীর একটা ফরোয়ার্ডেড মেসেজ এসেছে ওর ফোনে। ও মেসেজটা ঢুলু ঢুলু চোখে পড়ে ফোনটা বন্ধ করে দেয়। তারপর পাশে হাত রেখে দেখে তখনও শান্তনু শুতে আসেনি। ও আবার ফোনটা খুলে সময়টা দেখে। রাত দুটো প্রায়। সাঁঝবাতি বিছানায় উঠে বসে তারপর হাই তুলে খাট থেকে নেমে পাশের ড্রইং রুমে যেখানে বসে শান্তনু অফিসের কাজ করে ওখানে এগিয়ে যায়। ড্রইং রুমে ঢুকতেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে ও একদম সিটিয়ে যায়। ওর পা দুটো যেন মাটিতেই আটকে যায়। তবে শান্তনু ওকে দেখার আগেই ও তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরে ফিরে আসে।ঘরে এসেই ও ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা জলের জগ থেকে খানিকটা জল ঢক ঢক করে খায়। নিজের কপালের স্বেদবিন্দুগুলো শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নেয়। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ে। যদিও ওর ঘুম আর আসে না, বিছানায় ও এপাশ ওপাশ করতে থাকে। খানিকক্ষণ পরে শান্তনু শোয়ার ঘরে আসলে ও চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে বিছানায় মটকা মেরে শুয়ে থাকে। শান্তনু ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সাঁঝবাতি। সকালে শান্তনু অফিসে যাওয়ার পর তন্বীকে ফোন করে ও। "হ্যালো, কিরে এত সকালবেলা ফোন করলি? তোর তো আবার বিকেলের আগে ফোন করার সময় হয় না। বড্ড গিন্নি হয়ে গেছিস আজকাল।" কথাগুলো বলে ফোনের ওপর প্রান্তে হাসতে থাকে তন্বী। তবে এসব শুনেও কিছু বলে না সাঁঝবাতি। তন্বী বন্ধুকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলে" লেগ পুল করলাম বলে রাগ করলি নাকি রে?"
"না। আমি তোর সাথে কিছু শেয়ার করতে চাই। আজ দুপুরে একটু মিট করতে পারবি?" কথাগুলো গম্ভীর হয়ে বলে ও।
"এনিথিং সিরিয়াস রে?"
"হুম। তবে ফোনে বলতে পারবনা। জানিনা তুই বুঝবি কিনা!"
"ওকে। বাট আজ হবে না। আমার সম্বিতের সাথে এক জায়গায় যাওয়ার আছে। কাল দুপুরে ডেফিনিটলি মিট করবো একদম। পাক্কা। আমার অফিসের সামনের সিসিডিতে দুপুর তিনটের দিকে তোর জন্য অপেক্ষা করবো।"
"হুম, ঠিক আছে।"
ফোনটা রেখে সাঁঝবাতি ভাবে ভালোই হলো আজকের রাতটা একটু ভালো করে ব্যাপারটা দেখে নিতে পারবে ও। এখনও ও কিছুতেই গত রাত্রের ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে ওর মনে হয় তন্বীকে কথাগুলো বললে ও খানিকটা ওকে সাহায্য করতে পারে। সত্যি কি ড্রাকুলা বা রক্ত চোষাদের অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবীতে? নাকি সবটাই ওর চোখের ভুল?
পরেরদিন তন্বীর সাথে দেখা করে সবকিছু ওকে খুলে বলে সাঁঝবাতি। বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে তন্বীর চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে যাচ্ছিল। এই যুগেও ড্রাকুলা হয় নাকি! সেসব তহ ওরা ছোটবেলাতে রূপকথার বইতে পড়েছে কিংবা এখনকার ইংরেজী ভয়ের সিনেমাতে দেখেছে।তাহলে..... ওর নিজের মানতেই কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে যে শান্তনুদা একজন ড্রাকুলা বা রক্তচোষা।আর বন্ধুর কথা ভেবে আরো দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সব জেনেও ও কী করে ওই লোকটার সাথে এক ছাদের তলায় থাকবে! যদি শান্তনুদা ওর কোন ক্ষতি করে?
"কিরে? প্লিজ কিছু বল! আমি এখন কি করবো?"
সাঁঝবাতির উদ্বেগে ভরা মুখটা দেখে মায়া হয় তন্বীর। ও ওর দিকে তাকিয়ে বলে
"আমার একজন মনোবিদ বন্ধু আছে, নাম ডক্টর রজত তরফদার। ও মিন্টো পার্কের দিকে একটা হসপিটালে বসে। আজ তো শুক্রবার। আমি যতদূর জানি ও সোম বুধ শুক্র বার ওখানে বসে বিকেল পাঁচটা থেকে। একবার দেখা করবি ওর সাথে? যদি ও কিছু করতে পারে!"
একটু আমতা আমতা করে সাঁঝবাতি বলে" কোন তান্ত্রিকের কাছে গেলে হতো না?" তন্বী ওর কথা শুনে ওকে ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে" গ্রো আপ সাঁঝবাতি। এই যুগে তান্ত্রিক! সিরিয়াসলি! তোর মাথা কি কাজ করছে না?" তন্বীর বকা শুনে চুপ করে থাকে সাঁঝবাতি। সত্যি ওর মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দুজনে আর দেরি না করে সিসিডি থেকে বেরিয়ে একটা ওলা বুক করে মিন্টো পার্কের ডক্টর তরফদারের হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গাড়িতে যেতে যেতে তন্বী ওকে বলে শান্তনুকে একটা মেসেজ করে জানিয়ে দিতে যে ও আজ বাড়ি ফিরবে না, তন্বীর বাড়িতে থাকবে। তন্বীর শরীরটা খারাপ, আর ওর বর সম্বিত আউট অফ টাউন আছে। তন্বীর কথামত মেসেজটা টাইপ করে সাঁঝবাতি শান্তনুকে পাঠায়। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মেসেজের রিপ্লাই করে শান্তনু। "ওকে, নো প্রব্লেম।তবে কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাতে দ্বিধা করবে না কিন্তু।" মেসেজটা পড়ে গাড়ির জানলার বাইরে ফোনটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে সাঁঝবাতি। এই কেয়ারিং মানুষটা একজন রক্তচোষা! ভাবতেও কেমন যেন লাগে ওর।সবকিছু যেন পরশু থেকে ওলোট পালোট হয়ে গেছে ওর। ও ভেবেছিল ও ভুল দেখেছে। কিন্তু কাল রাত্রে ও একই জিনিস দেখেছে। দুদিন কীকরে চোখের ভুল হয় ওর!
"কিরে নাম গাড়ি থেকে।"
তন্বীর ডাকে ওর দিকে তাকায় সাঁঝবাতি। ও দেখে হসপিটাল এসে গেছে। তাড়াতাড়ি ওলা থেকে ও নেমে পড়ে। হসপিটালে ঢুকে রিসেপশানের দিকে ওরা দুজনে এগিয়ে যায়। তন্বী রিসেপশনিস্ট মেয়েটির সাথে কথা বলে জানতে পারে আজ তেমন রোগী নেই ডাক্তার তরফদারের চেম্বারে। পাঁচজন মতো আছে, ওনাদের সেশন শেষ হতে দুই ঘণ্টা লাগবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করলেই ওরা ওনার সাথে দেখা করতে পারে। তন্বী ফোন করে ডাক্তার তরফদারকে তাড়াতাড়ি দেখা করতে বলতেই পারতো কিন্তু ও চায় একটু সময় ধরে ওর সাথে ঠিক মত কথা বলতে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ওদের ডেকে বলে ওরা যেন ডাক্তার তরফদারের রুমে যায়। তন্বী সাঁঝবাতির হাত ধরে রজতের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
"আসতে পারি।"
ডাক্তার তরফদারের রুমে নক করে বলে ওঠে তন্বী।
"ইয়েস, কাম ইন।"
কথাটা বলে দরজার দিকে তাকাতেই ডাক্তার রজত বন্ধুকে দেখতে পায়। ও হেসে বলে
"আরে তুই এখানে? কি মনে করে? একটা ফোন করতে পারতিস তো?"
"আমি তোর সাথে সাঁঝবাতির একটা প্রব্লেম শেয়ার করতে এসেছি রে। আমি নিশ্চিত তুই কিছু একটা সল্যুশন বের করবি।"
সাঁঝবাতি এরপর রজতকে সব কথা খুলে বলে।রজত বেশ গম্ভীর হয়ে পুরোটা শোনে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সাঁঝবাতির দিকে তাকিয়ে বলে
"মানে আপনি বলছেন আপনি আপনার স্বামীকে দুদিন রাত্রেই ব্লেড দিয়ে হাতের আঙ্গুল এবং কনুই কেটে চুষে চুষে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিজের রক্ত খেতে দেখেছেন?"
"হ্যাঁ। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ওর হয়তো কেটে গেছে তাই ক্ষত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। যেমন অল্প রক্ত বের হলে আমরা ঘরোয়া টোটকা হিসেবে জিভের লালা লাগানোর জন্য মুখে দি তেমন কিছু।তারপর দেখলাম ও আরো অনেক জায়গায় ব্লেড চালিয়ে রক্ত বের করে চুষছে রীতিমত। আর আমি বিয়ের পর থেকে ওর গায়ে অনেক জায়গায় স্পেশালি হাত পায়ে এমন দাগ দেখেছি। যদিও ও সবসময় ফুল স্লিম শার্ট বা গেঞ্জি পড়ে।কিন্তু কখনো কখনো সেই দাগগুলো আমার চোখে পড়েছে।আমি জিজ্ঞেস করলে ও কখনো কোন উত্তর দেয় নি। কায়দা করে এড়িয়ে গিয়েছিল। আর সত্যি বলতে কি এগুলো আমার কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু লাগেনি তাই...."
"বুঝলাম।"
কথাটা বলে আবার গালে হাত দিয়ে বসে রজত। তন্বী অধৈর্য হয়ে বলে
"কিরে কি বুঝছিস? শান্তনুদা কি ড্রাকুলা আই মিন রক্তচোষা?"
রজত বলে
"না রে। উনি তোর আমার মতই মানুষ। তবে উনি একটি জটিল রোগাক্রান্ত। রোগটার নাম রেইনফিল্ডস সিনড্রোম। পৃথিবীতে খুব খুব কম মানুষের এই জটিল মস্তিষ্কের রোগটা হয়। মানে এটা একটা মনোরোগ। এরকম রক্তচোষা মানুষদের বলে স্যানগুইনারিয়ান। এরা মনে করে রক্ত পান করলে সুস্থ আর সবল থাকা যায়। এরা প্রথম প্রথম নিজের রক্ত পান করে। যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় আমরা বলি অটো ভাম্পায়ারিসম। ধীরে ধীরে তাদের মস্তিষ্কের যত বিকৃতি ঘটা শুরু হয় তখন এরা বিভিন্ন পশু পাখির রক্তও পান করতে থাকে।"
"কিন্তু এমন রোগ কেন হয়?"
তন্বী জিজ্ঞাসা করে।
"ছোটবেলার কোন ট্রমা মেইনলি এর জন্য দায়ী। এরা ধীরে ধীরে স্কিথজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যত বয়স বাড়তে থাকে।"
"এই রোগটা কি কখনো সারে না?"
উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে সাঁঝবাতি। ওর গলাটা ধরে আসে কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে।
"হুম সারে। কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে। যদি সময় থাকতে থাকতে প্রথম অবস্থাতেই কাউন্সেলিং করানো যায়। তবে পুরোপুরি মানসিকভাবে সেরে উঠতে রোগীর সাথে সাথে রোগীর পরিবারেরও প্রচণ্ড ধৈর্যের দরকার। কারণটা আগেও বলেছি রোগটা বিরল।"
"আমি কবে আমার হাসব্যান্ডকে নিয়ে আপনার কাছে আসবো?"
"দেরি না করে সোমবারই চলে আসুন।"
ডাক্তার রজতের সাথে সবকিছু আলোচনা সেরে দুই বান্ধবী রজতের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে।দুজনেই রজতের সাথে কথা বলে একটু যেন নিশ্চিন্ত হয়েছে।
এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই বছর। দীর্ঘ সময় কাউন্সিলিং করানোর ফলে আজ শান্তনু সম্পূর্ণ সুস্থ। ও স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে এখন সক্ষম। ডক্টর তরফদার সাঁঝবাতির কাছে সাক্ষাৎ ভগবান। যদিও উনি নিজেও শান্তনুর কেসটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন।
শান্তনুর অবশ্য নিজের স্যানগুইনারিয়ান হওয়ার কথা তেমন মনে পড়ে না আজকাল। ওর সেই অভ্যাসের স্মৃতি ক্রমশ ফিঁকে হয়ে আসছে। সেদিন রাত্রে অফিসের কাজ করতে গিয়ে টেবিলের ওপর একটা ব্লেড দেখতে পায় শান্তনু। ও ব্লেডটা হাতে তুলে ভাবতে থাকে ব্লেডটা এখানে এলো কিভাবে। তখনই ওর ঘরে ঢোকে সাঁঝবাতি। ও শান্তনুর হাতে ব্লেডটা দেখে আবার মনে মনে প্রমাদ গোনে। ঠিক তখনই ওকে অবাক করে দিয়ে শান্তনু ব্লেডটা টেবিলের পাশের ডাস্টবিনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এটা দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সাঁঝবাতি। ক্ষণিকের জন্য ওর মনে যে পুরনো স্মৃতি ফিরে এসেছিল সেটা মন থেকে আবার মুছে ফেলে দিয়ে ও নিজের স্বামীকে ডাকে
"কি গো আর কত রাত করবে? কাল আবার তোমার অফিস আছে যে!"
"আসছি।" বলে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসে শান্তনু।
শ্রুতি নাটক
ঠাম্মি
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
চরিত্রঃ নীলা—মা, রিয়া—মেয়ে।
স্থানঃ রিয়ার পড়ার ঘর।
নীলাঃ একি!দুদিন বাদেই না তোমার টেস্ট পরীক্ষা! আবার মোবাইল?
রিয়াঃ পরীক্ষা তো কি হয়েছে?এটা তো টেস্ট। ফাইনাল নাকি!
নীলাঃ টেস্ট পরীক্ষা কি পরীক্ষা নয়?
রিয়াঃ হ্যাঁ, পরীক্ষা! বাট্ টেস্টে সব্বাইকে অ্যালাও করে দেবে। অল অ্যালাও বুঝলে মা। অল অ্যালাও।
নীলাঃ আমি ওসব কিচ্ছু শুনতে চাই না। মোবাইল রেখে পড়তে বসো। মাসে মাসে এই জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা তোমার পিছনে ঢালছি?
রিয়াঃ ও সব বাবা মা’ই এখন ঢালে। এ আবার নতুন কথা কি। বলতে পারো এটা একধরনের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস। লোককে বলতে পারবে —
নীলাঃ তুমি কি বলতে চাও?
রিয়াঃ কিছুই না। তুমি এখান থেকে যাও তো।
নীলাঃ আসুক তোমার বাবা। এভাবে চলতে পারে না।
রিয়াঃ বাবা আসলে কি হবে? পিঠে বড় জোর দু’চার বাড়ি কঞ্চি পড়বে। কঞ্চির তো আর রবিবার নাই — ধর্মঘট ও নাই।
(নেপথ্যে কলিং বেল বেজে উঠল।)
নীলাঃ ওই বোধহয় পেপার দিতে এসেছে। অনিমা দেখো তো দরজা খুলে।
(নেপথ্যেঃ দেখছি। দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ শোনা গেল। কাগজ দিয়ে গেল)
নীলাঃ টেবিলে রাখো। ভাতটা দেখো একটু।
রিয়াঃ এখানে চিৎকার কোরো না। যাও তো।
নীলাঃ তোমার ব্যবহার দিন দিন অমানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা’র সাথে কিভাবে কথা বলতে জানো না?
রিয়াঃ ব্যবহার! মা তোমার মুখে এসব মানায় না।
নীরাঃ রিয়া!
রিয়াঃ হ্যাঁ। আমি ঠিকই বলছি। তুমি! তুমি কি বাবার মা, মানে তোমার শাশুড়ি মা - তার সাথে কি সঠিক ব্যবহার করেছিলে? একজন বৃদ্ধা অসহায় মানুষকে এই বাড়ি থেকেই তো তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আর বাবা তোমার ভয়ে মুখে রা পর্যন্ত কাড়ে নি।
নীলাঃ আমি মোটেও তাঁকে তাড়িয়ে দিই নি। তোমার বাবা সারাদিন বাইরে থাকে ব্যবসার কাজে। আমি এখান থেকে বিশ ক্রোশ দূরে স্কুল যায়। ওই বৃদ্ধা মহিলাকে বাড়িতে কে দেখতো? তাই তার ভালোর জন্যই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি।
রিয়াঃ মা, তুমি দায়িত্বটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছো।
নীলাঃ দায়িত্ব? এড়িয়ে গেছি? আমি গত তিনবছর প্রতিটি রবিবার ছুটে গেছি তোমার ঠাম্মির কাছে। যাতে তার এটা মনে না হয় যে তিনি একা।
রিয়াঃ তুমি ইচ্ছা করলে এ ফ্ল্যাটেই ঠাম্মিকে রাখতে পারতে মা। আন্টি তো সকাল সাড়ে ছ’টা-সাতটা থেকে রাত সাড়ে আটটা-ন’টা পর্যন্ত এখানেই থাকে।
নীলাঃ থাকবে তো ঘর কই। একটা ঘরে তুমি আর একটা ঘরে তোমার বাবা আমি থাকি। থাকা বলতে তোমার পড়ার ঘরটা। তিনি এখানে থাকলে তুমি পড়বে কোথায়?
রিয়াঃ তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমার পড়ার জন্য তুমি ঠাম্মিকে —
নীলাঃ ধর তাই। তোমার বাবার মত ছিল না ঠিকই কিন্তু তোমার পড়াশোনার কথা ভেবেই তিনি আর অমত করেন নি। আর—
রিয়াঃ আর?
নিলাঃ একথা তোমার ঠাম্মিও জানেন। তাই তো তিনি হাসি মুখে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেছেন।
রিয়াঃ মা!
রিয়াঃ একটা ছেলে মেয়েকে মানুষ করতে বাবা মা আর ঠাম্মিদের যে কত ত্যাগ করে তার খবর যদি রাখতে তাহলে এই সাত সকালে বই নিয়ে বসতে, মোবাইল নিয়ে বসতে না।
রিয়াঃ তুমি ঠাম্মিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো মা আমি কথা দিচ্ছি আর মোবাইল দেখবো না। তুমি চেয়েছিলে না মা আমি নিট ক্র্যাক করি?
নীলাঃ হ্যাঁ চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তুমি ডাক্তার হবে। মানুষের ডাক্তার। তোমার ঠাম্মিও তাই চেয়েছিলেন।
রিয়াঃমা এই নাও মোবাইল। ফিরিয়ে দাও আমার ঠাম্মিকে। ফিরিয়ে দাও
(কান্নায় ভেঙে পড়ে রিয়া)
নীলাঃ কেঁদো না। তোমার বাবা ফিরে আসুক আমরা কালই যাব। ফিরিয়ে দেবো তোমাকে তোমার ঠাম্মী। এখন ওঠো।হাত ধুয়ে পড়তে বস। অনিমাদি তোমাকে চা আর ব্রেকফাস্ট দিয়ে যাচ্ছে।
(রিয়া উঠে যায়। নেপথ্যে ট্যাপ থেকে জল পড়ার শব্দ। অনিমাদির কন্ঠে শোনা যায় চা আর স্ন্যাক্স রইল রিয়া। আমি রান্নাঘরে আছি। কিছু দরকার হলে বোলো। উত্তর ভেসে আসে ভিজে গলায়ঃ বলব।)
অনুবাদ গল্প
তর্পণ
মৃণাল কলিতা
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
লেখক পরিচিতি– ১৯৭৪ সালে অসমের কামরূপ জেলার বামুনি গ্রামে গল্পকার মৃণাল কলিতার জন্ম হয়। অসম্ভব মেধাবী ছাত্র মৃণাল ১৯৮৯ সনে হাই স্কুল শিক্ষান্ত পরীক্ষায় সমগ্র অসমের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিএসসি পরীক্ষাতেও গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি তে গণিত বিষয়ে প্রথম শ্রেণি লাভ করে বর্তমানে পান্ডু কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপনায় রত আছেন। মৃণালের প্রকাশিত গল্প সংকলন 'অনুশীলন', 'অযান্ত্রিক অনুশীলন',' মৃত্যুর সিপারে'। 'বকুল ফুলর দরে' কিশোর উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমির ২০২১ বাল পুরস্কার লাভ করেন।
আগুন প্রায় নিভে এসেছিল। আমার সামনে পড়েছিল অঙ্গার এবং ছাই। আমার চারপাশে পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষ তখনও ছিল। পেট্রোমেক্সের আলোতে মানুষগুলির মুখ অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছিল। মানুষগুলি কীসব বলাবলি করছিল। কথাগুলি আমার কাছে অর্থহীন এবং বিড়বিড় করার মতো মনে হচ্ছিল। এমন কোনো মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না যে মুখ দেখে মনটা কিছুটা শান্ত হতে পারে। অথচ প্রতিটি মুখে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কিছুটা ভালোবাসা–সান্ত্বনা। একটা হাত খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম– যে হাত খামচে ধরে সাহস পেতে পারি। এক জোড়া চোখের খোঁজে ছিলাম, যেখানে খুঁজে পেতে পারি কিছুটা নিরাপত্তা।পাই নি।মমতায় কোমল হয়ে পড়া একজোড়া চোখ, সাহস দিতে পারা একটি সুদৃঢ় হাত, সান্ত্বনা দিতে পারা একটি মুখ– কোথাও ছিল না। আকস্মিকভাবে সমস্ত কিছু হারিয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে। মানুষের গুণগুণ শব্দ এবং ফুরফুরে বাতাসের শব্দের মধ্যে আমি কোনো তফাৎ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।বুকটা হালকা মনে হচ্ছিল না ভারী, বুকে বেশ কিছু বরফ জমা হয়েছিল না বরফ গলে গলে চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল– নাকি হৃদয়টাই ক্রমশ হয়ে আসছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত– আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না।
পাহাড়ের নিম্ন অঞ্চলের নদীটি পরিত্যক্ত জলস্রোত। নদীটি এবং পাহাড়ের মাঝখানের সংকীর্ণ জায়গাটিতে আমরা জমায়েত হয়েছিলাম। জায়গাটা অন্ধকার ঘিরে ধরেছিল। ফুরফুরে বাতাস বইছিল। ছয় ফুট দীর্ঘ, তিন ফুট প্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছিলাম। একবার- দুবার – সাত বার। কেন্দ্রে শুয়ে ছিলেন তিনি। নির্বাক নিস্পন্দ। তাকে কেন্দ্র করে ঘুরেছিলাম কি? নাকি তিনি এতদিন আমাদের কেন্দ্র করে ঘুরছিলেন? একজন বলেছিল– 'মুখাগ্নিটা করে নে বাবা।' হঠাৎ যেন সমস্ত বাধা ভেঙ্গে প্রচন্ড একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসবে, পাড় ভেঙ্গে চোখের জলের স্রোত বয়ে যাবে। বুকটা যেন ভেঙ্গে যাবে। যেন মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদব– সেই সব কিছুই করিনি। স্থাণুর মতো নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একজন এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে জোর করে মুখাগ্নি করিয়ে দিয়েছিল।
তাঁর শরীরে আমি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে সেই আগুন বেড়ে চলল। সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়ে এসেছিল তাঁর রক্তমাংসের শরীরটা। এভাবেই আগুন জীবিত মানুষটিকেও পুড়িয়ে ছিল কি? আমরা কি সেই আগুন দেখতে পেয়েছিলাম?
আগুনের উত্তাপ বেড়ে চলছিল। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা মানুষগুলিকে আগুন উষ্ণতা দান করছিল। নিজে পুড়ে ছাই হয়ে তিনি আমাকে শীতের সন্ধ্যায় উষ্ণতা দান করেছিলেন। আমার বুকের ভেতরে বয়ে যাচ্ছিল একটা স্রোত। মৃত্যুর মতো শীতল একটি তীব্র স্রোত।
তাঁর শরীরটা আগুন জড়িয়ে ধরেছিল। ক্রমে ক্রমে দেখার অতীত হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর যে কোনোদিনই তাকে দেখতে পাব না! তিনি ছিলেন– একটু আগেও আগুন প্রায় নিভে এসেছিল। আমার সামনে পড়েছিল অঙ্গার এবং ছাই। আমার চারপাশে পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষ তখনও ছিল। পেট্রোমেক্সের আলোতে মানুষগুলির মুখ অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছিল।
মানুষগুলি কীসব বলাবলি করছিল। কথাগুলি আমার কাছে অর্থহীন এবং বিড়বিড় করার মতো মনে হচ্ছিল। এমন কোনো মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না যে মুখ দেখে মনটা কিছুটা শান্ত হতে পারে। অথচপ্রতিটি মুখে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কিছুটা ভালোবাসা–সান্ত্বনা। একটা হাত খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম– যে হাত খামচে ধরে সাহস পেতে পারি। এক জোড়া চোখের খোঁজে ছিলাম, যেখানে খুঁজে পেতে পারি কিছুটা নিরাপত্তা। পাই নি। মমতায় কোমল হয়ে পড়া একজোড়া চোখ, সাহস দিতে পারা একটি সুদৃঢ় হাত, সান্ত্বনা দিতে পারা একটি মুখ– কোথাও ছিল না। আকস্মিকভাবে সমস্ত কিছু হারিয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে। মানুষের গুণগুণ শব্দ এবং ফুরফুরে বাতাসের শব্দের মধ্যে আমি কোনো তফাৎ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।বুকটা হালকা মনে হচ্ছিল না ভারী, বুকে বেশ কিছু বরফ জমা হয়েছিল না বরফ গলে গলে চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল– নাকি হৃদয়টাই ক্রমশ হয়ে আসছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত– আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না।
পাহাড়ের নিম্ন অঞ্চলের নদীটি পরিত্যক্ত জলস্রোত। নদীটি এবং পাহাড়ের মাঝখানের সংকীর্ণ জায়গাটিতে আমরা জমায়েত হয়েছিলাম। জায়গাটা অন্ধকার ঘিরে ধরেছিল। ফুরফুরে বাতাস বইছিল। ছয় ফুট দীর্ঘ, তিন ফুট প্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছিলাম। একবার- দুবার – সাত বার। কেন্দ্রে শুয়ে ছিলেন তিনি। নির্বাক নিস্পন্দ। তাকে কেন্দ্র করে ঘুরেছিলাম কি? নাকি তিনি এতদিন আমাদের কেন্দ্র করে ঘুরছিলেন? একজন বলেছিল– 'মুখাগ্নিটা করে নে বাবা।'
হঠাৎ যেন সমস্ত বাধা ভেঙ্গে প্রচন্ড একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসবে, পাড় ভেঙ্গে চোখের জলের স্রোত বয়ে যাবে। বুকটা যেন ভেঙ্গে যাবে। যেন মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদব– সেই সব কিছুই করিনি। স্থাণুর মতো নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একজন এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে জোর করে মুখাগ্নি করিয়ে দিয়েছিল। তাঁর শরীরে আমি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম।
দেখতে দেখতে সেই আগুন বেড়ে চলল। সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়ে এসেছিল তাঁর রক্তমাংসের শরীরটা। এভাবেই আগুন জীবিত মানুষটিকেও পুড়িয়ে ছিল কি? আমরা কি সেই আগুন দেখতে পেয়েছিলাম?
আগুনের উত্তাপ বেড়ে চলছিল। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা মানুষগুলিকে আগুন উষ্ণতা দান করছিল। নিজে পুড়ে ছাই হয়ে তিনি আমাকে শীতের সন্ধ্যায় উষ্ণতা দান করেছিলেন। আমার বুকের ভেতরে বয়ে যাচ্ছিল একটা স্রোত। মৃত্যুর মতো শীতল একটি তীব্র স্রোত।
তাঁর শরীরটা আগুন জড়িয়ে ধরেছিল। ক্রমে ক্রমে দেখার অতীত হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর যে কোনোদিনই তাকে দেখতে পাব না! তিনি ছিলেন– একটু আগেও
অনুবাদক পরিচিতি -
১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়। শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা চারশো আশিটিরও বেশি। সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া
গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়,নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে সাহিত্য এবং অনুবাদ সম্পর্কে গবেষণা পত্র পাঠ করেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সন্থা NEINAD এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঁচিশটি।
কল্প-গল্প
জিহাকাংচুর
পৃথিবীতে আগমণ
সুদীপ ঘোষাল
নন্দন পাড়া, পুর্ব বর্ধ্মান
সৌরজগতের বাইরে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র আছে যার হিসাব রাখা অসম্ভব। ড. তুফান বকসি বসে বসে চিন্তা করেন আকাশ-পাতাল। তিনি একজন সহজ, সরল, বুদ্ধিমান মানুষ। নিজেকে বেশিরভাগ সময়ে মানব সমাজের বাইরে গুটিয়ে রাখেন। বসে বসে তিনি চিন্তা করেন এই বিশাল মহাবিশ্বের কথা আর আশ্চর্য হয়ে যান কোন বিশ্বপিতা এই সব নিয়ন্ত্রণ করেন। মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করতে তিনি ভালোবাসেন। নিজের ঘরে লক্ষ লক্ষ টাকার বই কিনে আলমারিতে ভরে রেখেছেন। আর সবসময় বই নিয়ে পড়ে থাকেন। গ্রামের সব লোক তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তার কথা শোনেন এবং মান্য করেন।।
ড. তপন বকসি চিরদিন আপনভোলা মানুষ। অবসর সময়ে তিনি সংগীত শোনেন। মহাকাশে যে কোটি কোটি অজানা গ্রহ নক্ষত্র আছে তার একটি মধ্যে থাকে এক বিচিত্র ধরনের প্রাণী। গ্রহটির নাম টেকটিনো-২৫।
সে প্রায় আড়াইশো বছর পরে আজ পৃথিবীতে পদার্পণ করেছে। তার কোনো যানবাহনের প্রয়োজন হয় না। বেশ কয়েক হাজার কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় অনায়াসে উড়ে চলে মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার কাছে কোন বাধা নয়।
সে পৃথিবীতে নেমে সবুজের ভক্ত হয়ে গেছে। গাছ তার খুব পছন্দের জিনিস। গিরিগিটির মতো সে রং পাল্টাতে পারে। গাছের সবুজে মিশে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে। একদিন একটি লোককে সে গাছের আড়ালে বসে মলত্যাগ করতে দেখলো। মানুষের থেকে কয়েক হাজার গুণ বুদ্ধিমান এই গুটিয়ে প্রাণী। সে বুঝলো মানুষ এখনও কত বোকা। 'মাঠে ঘাটে পায়খানা মৃত্যুর পরোয়ানা' এই সহজ কথাটাও তারা জানে না ধিক। মনুষ্য সমাজ।' বিড় বিড় করে বললো প্রাণীটি।
লোকটি পিছন ফিরে আওয়াজ শুনে ভূত ভূত বলে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে গেলো। ভাষা বোঝার বাধা এই বুদ্ধিমান প্রাণীদের কাছে কোনো বাধা নয়। তাদের মগজে ভাষা ধ্বনি, প্রতিফলিত হয়ে বোধগম্য হয়ে ওঠে, এতটাই উন্নত তাদের মস্তিষ্ক। মানুষের এখনও এত কুসংস্কার দেখে সে লজ্জিত হলো। আড়াইশো বছর আগে এসেও এইসব কাটি দেখেছে, এবার বুদ্ধিমান প্রাণীটির দেহ বর্ণনা করতে গিয়ে, চিত্র ভূত দেখা লোকটি বলছে- ঠিক মাটির কুঁজোর মতো - দেখতে, মাথাটা বিরাট মোটা, যেন কুঁজোর ওপরে একটা পর্ণ বড়ো গামলা বসানো আছে। দেহ ওদের বড়ো নয়। একটা খাদ্য-পেলে কুড়ি বছর চলে যায়— কথাটা বলেন ড. তপন বকসি। উনি বললেন— আমি পড়েছি এরা খুব বুদ্ধিমান কান প্রাণী। পুনরায় দেখলে আমাকে ডেকে নিয়ে যেও। কিন্তু ওদের তো সহজে দেখা যায় না। রং পাল্টাতে পারে। এবার এক ব্যক্তির বাড়িতে জলের ট্যাঙ্কের পাশে বুদ্ধিমান প্রাণীটি লুকিয়ে থাকলো মানুষের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য। এরা বিভিন্ন
এবার যুগের ইঁদুর দৌড়ের দৌরাত্ম্যে গৃহশিক্ষক কিশোরটি খোলামেলা জায়গায় যেতে সুযোগ পায় না। বুদ্ধিমান প্রাণীটি তার হাতে স্পর্শ করলো। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরটি টিকটিক ঘড়ির আওয়াজ শুনতে পেলো। প্রাণীটির ভাষা পৃথিবীর মানুষের বোঝা শক্ত। প্রাণীটি উন্নত মগজের গেছে। প ঝগড়া ব টেকনোলজির জোরে সব ভাষা বুঝতে পারেন। স্পর্শ গুলে নিঃশ্বাসে কিশোরটি তাই উন্নত প্রাণীটির সব কথা বুঝতে পারল। প্রাণীটি বলল- তোমার নাম কী? (ডুং টং কেটা কিং)। প্রাণীটির ভাষা এইরকম ধরনের। কিন্তু উনি সব ভাষা সহজেই বলতে পারেন। নিজেদের ভাষা প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তবু কিশোরটিকে নিজের আগমণ বার্তা বোঝানোর জন্যে বাংলা ভাষা ব'লে নিজের ভাষায় অনুবাদ করে শোনালেন। কিশোরটি স্পর্শ গুণে (Touching Technology) সব বুঝতে পারলো। সে বলল, আমার নাম নীল গোপাল।
প্রশ্ন করল – তোমার নাম? প্রাণীটি বলল – জিহাকাংচু, জিহাকাংচু।
সে আরও বলল— তুমি চুপ করে থাকবে কাউকে কিছু বলো না, আমি বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন দেখতে এসেছি। আমি এখন তোমার কষ্টের কথা মগজ টেকনো’র ফলে জেনে গেছি। এবার দেখি তোমার বাবা মাকে।
কিশোরটি সাহস পেয়ে বললো – ঠিক আছে, তাই হবে। একটু পরেই নীলগোপালের বাবা মা ছাদে এলেন ঝগড়া লক্ষ করতে করতে। কিশোরটির সামনেই বাবা, মা ঝগড়া করছে। নানারকম কটু কথা, গালাগালি দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ পরে বাবা, মা নীলগোপালকে বলল— যাও তাে, পড় গিয়ে।
নীলগোপাল ধীরে ধীরে নীচের ঘরে চলে গেল— এবার বাবা, মা পুনরায় ঝগড়া শুরু করলেন। ঝগড়ার ফলে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। জিহাকাংচু খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। পৃথিবীর মানুষের অধঃপতন দেখে। তিনি দেখছেন এই অবস্থা। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীব এরকম।
তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে আরও খারাপ অবস্থা হবে নিশ্চয়।
‘জিহাকাংচুর’ নীচে নেমে কিশোরটির টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকল। ছেলের ঘর আলাদা, বাবা মা অন্যঘরে। একটুপরেই গৃহশিক্ষক এসে পড়লেন, এক ঘণ্টার মধ্যেই আজ কঠিন কঠিন অংক নীলগোপাল করে ফেলল অনায়াসে। গৃহশিক্ষক অবাক। জিহাকাংচুর স্পর্শ গুণে কিশোরটির মস্তিষ্ক উন্নত হয়ে গেছে। পড়াশুনার পরে বাবা মা'র কাছে সে বলল, তোমাদের বাগড়া বন্ধ হল কেন? ডিভোর্স নিয়ে নাও, তাহলেই শাস্তি হবে তো। আর আমি যাযাবরের মতো ঘুরে ঘুরে কোনো এক সন্ত্রাসবাদীর দলে ঢুকে থাকব। এটাই কি তোমরা চাও? এক নিঃশ্বাসে নীলগোপাল ব্যাখ্যা করে সব কিছু বুঝিয়ে দিলো। ইংরাজিতে সে বাবাকে পরোক্ষভাবে উপদেশ দিলো যে জীবন খুব ছোটো, এটাকে এনজয় করতে শেখো।
ছেলের কথা শুনে বাবা মা লজ্জিত হলেন এবং আর কোনোদিন ঝগড়া করবেন না প্রতিশ্রুতি দিলেন। ছেলের মঙ্গল কোন বাবা, মা আর না চায়?
পরিণতির ভালো দেখে ‘জিহাকাংচু’ নীলগোপাল আসার আগেই উধাও হল। তাকে যে আরও অনেক কিছু দেখতে হবে, বুঝতে হবে। পৃথিবীর মানুষ, পশুপাখি এখন কেমন আছে এই নিয়েই,তার গবেষণা, তারপর সে ফিরবে তার নিজের দেশে।
জিহাকাংচু আড়াইশো বছর আগে যখন পৃথিবীতে এসেছিলো তখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসতো। মাও বোনের সম্মান ছিলো, চুরি, ডাকাতি এসব কম ছিলো। তখন পৃথিবীতে ছিল ভালবাসা। পশুপাখিও ছিল নিশ্চিন্ত। খুব ভালোবেসে ফেলেছিল, সেই ভালোবাসার টানে টেকটিনো-২৫ গ্রহ থেকে আবার একবার ফিরে দেখা, পৃথিবীর মাটিতে এসে।
জিহাকাংচু’র গ্রহের নাম টেকটিনো-২৫। মহাকাশে লক্ষ লক্ষ গ্রহ নক্ষত্র আছে। মানুষ চন্দ্রে পদার্পণ করেছে। মঙ্গলগ্রহে গেছে। কিন্তু ‘জিহাকাংচু' লক্ষ লক্ষ গ্রহ নক্ষত্র পরিভ্রমণ করেছে। সে তার নিজস্ব গতিবেগ বাড়াতে বা কমাতে পারে। তাদের কোনো যানবাহনের প্রয়োজন হয় না, নিজের গতি নিয়ন্ত্রণে রেখে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে আর উড়ে যেতে পারে। পৃথিবীর এমন কোনো যান নেই যে তার গতির সঙ্গে সে পাল্লা দেবে। পৃথিবীর মানুষ বিজ্ঞানের উন্নতি নিয়ে খুব বড়াই খুব করে। তারা কি আমাদের মতো উড়তে পারে। গতিবেগ বাড়াতে বা কমাতে পারে উড়ে যাবার সময়। এক লাফে পাঁচশো ফুট অতিক্রম করতে পারে'— বললো জিহাকাংচু।
বিজ্ঞানের উন্নতির কোনো শেষ নেই। তবু সবাই কেন এত অহংকার করে? শুধু বিজ্ঞানের কচকচানি জীবনে সব নয়, মানুষের পরমায়ু তো মাত্র একশ বছর। তারা কি আমাদের মতো পাঁচশো থেকে হাজার বছর বাঁচতে পারে। ‘জিহাকাংচু' কিন্তু চিন্তা করে জীবনের মানবিক গুণের সব থেকে বেশি প্রয়োজন। পারমাণবিক বোমার ভয়ংকর ধ্বংস রূপ ‘জিহাকাংচু' নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। দয়া, মায়া, মমতা, প্রেম না থাকলে জীবনে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়। না। 'জিহাকাংচু’ অনেক চিন্তা করে মানুষের রূপগ্রহণ করলো। সে দেখতে চায় পৃথিবীর মানুষের মানবিক রূপ। রূপ পাল্টাতে তার এক মিনিটের বেশি লাগে না। সে এবার মানুষের মতো রঙের পরিবর্তিত রূপে প্রকাশিত হলো।
পশ্চিমবাংলার কিশোর নীলগোপালকে বলল— মানুষের মতো হয়ে গেছি আমি। তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি জানি। তাই তুমি আমার একটা নাম দাও। 'জিহাকাংচু’র নাম রাখলো নীলগোপাল সিতিকণ্ঠ। এখন থেকে ‘জিহাকাংচু’ সিতিকণ্ঠ হয়ে ঘোরা শুরু করলো। নীলগোপালের মামার বাড়ি নীলপুরে। সেখানে তার মামার পরম বন্ধু ড. তপন বকসি। নীলগোপাল পেটে কথা চাপে রাখতে পারলো না। সে মামার বাড়ি গেলো। ড. বকসি তখন পড়াশুনা করছিলেন। নীলগোপাল অনুমতি চেয়ে ঘরে প্রবেশ করে সব কথা খুলে বলল। সিতিকণ্ঠর আসল নাম ‘জিহাকাংচু'। সে টেকটিনো ২৫ গ্রহ থেকে এসেছে এবং তার অন্যান্য গুণাবলী। ড. তপন বকসি আগে এই প্রাণীটি সম্বন্ধে নিজের গ্রামের লোকের কাছে মানুষের কান্তের পরিবর্তিত কালে প্রকাশিত হে
আমি আনি। তাই তুমি আমার মা। নাম রাখলো ননীগোপাল সিকি। এখন থেকে বাড়ি নীলপুরে। সেখানে তার মামার পরম মামার বাড়ি গেলো। ড. বকসি তখন পড়াশুনা করছিলেন। নীলগোপাল অনুমতি চেয়ে ঘরে প্রবেশ করে সব কথা মুঙ্গে বলল। সিতিকন্ঠির আসল নাম 'জিহাকা'। ২৫ গ্রহ থেকে এসেছে এবং তার অন্যান্য গুণাবলী। ড. তপন বকসি আগে এই প্রাণীটি সম্বন্ধে নিজের গ্রামের লোকের কাছে শুনেছেন। সে ভূত মনে করে ‘জিহ্যকাছে’র বর্ণনা করেছিলো। আর ড. তপন বকসি নীলগোপালের কাছে একই কথা শুনলেন। তিনি বললেন, 'তুমি আমাকে সিতিকণ্ঠের সঙ্গে পরিচয় করাতে পারবে??
নীল গোপাল বলল- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এবং যদি সিতিকণ্ঠ এখানে থাকতে চায় আপনি রাখবেন তো?
ড. বকসি বললেন— অবশ্যই, তার সম্পর্কে আমি সবকিছু জানতে চাই।
নীলগোপাল ফিরে এসে সব কথা বললো। সিতিকণ্ঠকে ঘুমিয়ে এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলো। সে এখন এক করে দ বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গ চায়। বোকা লোককেও সে খুব ভালোবাসে। সে জানে তারা সহজ, সরল, ভালো মানুষ।
সিতিকণ্ঠ নীলকে কোমরে জড়িয়ে ধীরে পাখির মতো উড়ে ড. তপন বকসির বাড়ি চলে এলো। সিতিকণ্ঠর সঙ্গে ড. বকসি আজ মুখোমুখি। ড. বকসি বিশ্বাস করতে পারছেন না। একজন মানুষের মতো দেখতে প্রাণীটি কী করে রূপ পরিবর্তন করতে পারে। সিতিকণ্ঠ বা 'জিহাকাংচু' এবার মানুষ থেকে কুকুরের রূপ ধারণ করলো। আবার বিড়ালের মতো সাদা বর্ণের হয়ে গেলো। আবার কালো কুঁজোর মতো হয়ে গামলার মতো মাথা রূপে পরিবর্তিত হলো। ছাদে গিয়ে মানুষ হয়েও Ed পাখির মতো উড়ে দেখলো। এবার ড. তপন বকসি আনন্দে আত্মহারা, তিনি জিহাকাংচু' বা সিতিকণ্ঠকে জড়িয়ে বুকে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার স্পর্শ গুণে ড. তপন বকসি বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো কেঁপে উঠলেন। তার মনে শক্তির আলো, জ্ঞানের আলো বৃদ্ধি হলো। এবার ‘জিহাকাংচু’ সারা পৃথিবীতে 1. একবার ঘুরে আসতে চায়। তারপর বাংলায় এসে মানুষের মানবিক গুণগুলো পর্যালোচনা করতে চায়। ড. তপন বকসির মনে প্রশ্নের ভিড় জমা হলো। সিতিকণ্ঠ বা জিহাকাংচু ধীরে ধীরে সব প্রশ্নের উত্তর দিলো।
“জিহাকাংচু’ ড. তপন বকসির কোমর জড়িয়ে ধরল। বলল – এবার আমি আপনাকে নিয়ে সারা পৃথিবী একবার ঘুরে আসবো। তারপর আপনার সঙ্গে বসে সবরকম কথা হবে।
মানুষ তো খুব বেশি গতিবেগের হাওয়া সহ্য করতে পারে না। তাই ‘জিহাকাংচু’ বেগের হার নিয়ন্ত্রণে রেখে চলা শুরু করলো। মাঝে মাঝে রাত্রিতে কোথাও কোনও স্থানে বিশ্রাম নেবার জন্যে নামে। “জিহাকাংচু’র খাবার প্রয়োজন হয় না, নিদ্রারও প্রয়োজন হয় না। রাত্রির সময়টুকু অভিজ্ঞতার কাহিনী মগজে স্থাপন করে। ওরা লিখে রাখে না কাগজে কিংবা পাতায়। ওরা হৃদয়ে লেখে মগজে মনে রাখে।
ড. তপন বকসির খাবার প্রয়োজন হয়। নিদ্রারও প্রয়োজন হয়। তাই রাত্রিবেলা বিশ্রামের পালা। 'জিহাকাংচু'র শরীর পরিবর্তিত হলো। ছাদে গিয়ে মানুষ হল, পাখির মতো উড়ে দেখালো। এবার ড. তপন বকসি আনন্দে আত্মহারা, তিনি 'জিহাকাংচু বা সিতিকণ্ঠকে জড়িয়ে বুকে ধরলেন। সঙ্গে
সঙ্গে তার স্পর্শে ড. তপন বকসি বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো কেঁপে উঠলেন। তার মনে শক্তির আলো, জ্ঞানের আলো বৃদ্ধি হলো। এবার 'জিহাকাংচু' সারা পৃথিবীতে একবার ঘুরে আসতে চায়। তারপর বাংলায় এসে মানুষের মানবিক গুণগুলো পর্যালোচনা করতে চায়। ড. তপন বকসির মনে প্রশ্নের ভিড় জমা হলো। সিঁতিকণ্ঠ বা জিহাকাংচু ধীরে ধীরে সব প্রশ্নের উত্তর দিলো। ‘জিহাকাংচু' ড. তপন বকসির কোমর জড়িয়ে ধরল। বলল – এবার আমি আপনাকে নিয়ে সারা পৃথিবী একবার ঘুরে আসবো। তারপর আপনার সঙ্গে বসে সবরকম কথা মানুষ তো খুব বেশি গতিবেগের হাওয়া সহ্য করতে পারে না। তাই 'জিহাকাংচু’ বেগের হার নিয়ন্ত্রণে রেখে চলা শুরু করলো।
মাঝে মাঝে রাত্রিতে কোথাও কোনও স্থানে বিশ্রাম নেবার জন্যে নামে। ‘জিহাকাংচু’র খাবার প্রয়োজন হয় না, নিদ্রারও প্রয়োজন হয় না। রাত্রির সময়টুকু অভিজ্ঞতার কাহিনী মগজে স্থাপন করে। ওরা লিখে রাখে না কাগজে কিংবা পাতায়। ওরা হৃদয়ে লেখে মগজে মনে রাখে।
ড. তপন বকসির খাবার প্রয়োজন হয়। নিদ্রারও প্রয়োজন হয়। তাই রাত্রিবেলা বিশ্রামের পালা। “জিহাকাংচু’র হাসি পায়। এরা বিজ্ঞানের উন্নতির বড়াই করে। মানুষ শুধু ঘুমিয়ে গড়ে আট ঘণ্টা নষ্ট করে। খাওয়া, প্রাতঃকৃত্য, স্নান করে দুই ঘণ্টা এরা নষ্ট করে।
আগে এস্কিমোরা ইগলু তৈরি করতো স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ বরফ সাজিয়ে। যাতে করে ভেতরের গরম বায়ু, বাইরে বেরিয়ে যায়। মানুষ নিজেদের ধ্বংসের জন্যে পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে। আর 'জিহাকাংচু ইচ্ছে করলে বুড়ো আঙুলের চাপে বোতাম টিপে সারা পৃথিবী এক মুহূর্তে ধ্বংস করতে পারে। গতির ক্ষেত্রে 'জিহাকাংচু'র একশো ভাগের এক ভাগও পৃথিবীর যানবাহনের নেই। 'জিহাকাংচু তার গতিবেগ ইচ্ছেমত যত খুশি বাড়াতে বা কমাতে পারে। তার জন্যে কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। তাহলে মানুষ এখনও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কতটা পিছিয়ে আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ‘জিহাকাংচু’ পরমায়ুর ক্ষেত্রে দেখেছে মানুষে বড়জোর দেড়শো বছর বাঁচাতে পারে। কিন্তু 'জিহাকাংচু’ ইচ্ছার জোরে বাঁচতে বা মরতে পারে। তবে সাধারণত এরা পাঁচশো থেকে হাজার বছরের মতো বাঁচতে চায়। একটা খাদ্যের ট্যাবলেটে এদের কুড়ি বছর চলে যায়। আবার মলত্যাগ, মূত্রত্যাগ বারবার করতে হয় না। বছরে একবার এরা জল পান করে এক কাপের মতো। শরীরে এদের অটোমেটিক ওয়াটার, উৎপাদনের অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
পরের দিন ‘জিহাকাংচু’ ড. বকসিকে নিয়ে আমেরিকা ঘুরলেন। এখন শুধু ঘোরার পালা। সমস্ত পৃথিবী ঘোরার পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজ্য বাংলায় পদার্পণ। এবার পর্যালোচনার পালা। মানুষ বিজ্ঞানের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। তাই বিজ্ঞানের বিষয়ে আর যাচ্ছি না, বললো ‘জিহাকাংচু'। কিন্তু মানবিক গুণগুলো আড়াইশো বছর আগে পৃথিবীতে যেমন ছিলো ঠিক তেমনটি দেখছি না। অনেক অধঃপতন হয়েছে। এর কারণ কী? ড. তপন বকসি বললেন, মানুষের অতিরিক্ত লোভ প্রকৃতিকে ধ্বংস করার কাজে লাগছে। মানবিক গুণ বলতে সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
মানুষের অনেক অধঃপতন হয়েছে। এর কারণ কী বুঝলাম। ড. তপন বকসি লজ্জিত হলেন। পৃথিবীর বাইরের অন্য জগত থেকে আসা বুদ্ধিমান প্রাণীর কাছে মানুষের লজ্জা। আপনারা ছেলেদের কিছু ভুল শিক্ষা দেন। আপনারা শেখান একে চন্দ্র। এটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে সত্য। কিন্তু মহাবিশ্বে কি চন্দ্ৰ একটা। বহু চন্দ্ৰ মহাবিশ্বে বিরাজ করে। আপনারা শেখান নবগ্রহ। মহাবিশ্বে কোটি কোটি গ্রহ আছে। কুয়োর ব্যাঙ না হয়ে কেন আপনারা এখনও মহাসমুদ্রে স্নান করছেন না' — খুব আফসোসের সঙ্গে বলল- 'জিহাকাংচু'। অনেক দেশ শুধু যৌন আবেদনকে শ্রেষ্ঠ মনে করছে। কেন ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার কি কোনো দাম নেই। পৃথিবী পরিভ্রমণ করে ‘জিহাকাংচু’ খুবই হতাশ। প্রেমের নামে সবাই অনাচারে মত্ত।মানুষে মানুষে ভালোবাসার নামে ছলনা। এবার বাংলায় মানবিক গুণ দেখতে ‘জিহাকাংচু’র বড়ই আগ্রহ হল।
‘জিহাকাংচু’ এখন এক সুন্দর মনুষ্য রূপ ধারণ করেছে। এত সুন্দর দেখতে যে যে কোনো বঙ্গ ললনা ‘জিহাকাংচু’র প্রেমে পড়তে বাধ্য। 'জিহাকাংচু’ এখন ড. বকসির বাড়িতে থাকে। সেখানে অনেক ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে। তার মধ্যে খুশি গৌরী নামে একটি মেয়েকে ‘জিহাকাংচু’ পরীক্ষা করার নামে প্রেমের অভিনয় করতে চায়। ড. বকসি সব কিছুই জানেন। তিনিও সম্মতি দিলেন।
এবার প্রথম দর্শনে গৌরী ‘জিহাকাংচু’র প্রেমে পরে গেলো। সে জিজ্ঞাসা করলো আপনার নাম কি? ‘জিহাকাংচু’ নাম পাল্টে বলল— আমার নাম সিতিকণ্ঠ। সিতিকণ্ঠের প্রেমে পড়ে এখনকার মেয়ে গৌরী একবার চা পান করতে সিতিকণ্ঠকে নিয়ে টি-হাউসে গেলো। সেখানে সিতিকণ্ঠ দেখছে দুটো করে সিট আর একটা করে চটের আড়াল। সবাই মুখে মুখ লাগিয়ে কিস করছে। কোনো কথা নেই। শুধু কেলোর কীর্তি। আর মোবাইলে অশালীন দৃশ্য দেখে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা। সিতিকণ্ঠ কিছুক্ষণ বাদেই গৌরীকে নিয়ে বাইরে এলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো সিতিকণ্ঠর। একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গেছে। মিনিট পাঁচেক পরে পিছন ফিরে দেখে গৌরী নেই। সিতিকণ্ঠ মুহূর্তের মধ্যে নিজের গতিবেগ বাড়িয়ে কয়েক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বনবন করে পাক খেয়ে নিলো। সে দেখলো গৌরীকে চারজন পুরুষ একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে জোর করে ধর্ষণ করতে চলেছে। এখন রাত্রি দশটা, সিতিকণ্ঠ মুহূর্তের মধ্যে গৌরীকে উদ্ধার করল চারজনকে ধরাশায়ী করে। সিতিকণ্ঠর কাছে এটা কোনো কঠিন কাজ নয়।
কি করে এটা সম্ভব হলো, মানুষের কি এতটা ক্ষমতা আছে। গৌরীর মনে সন্দেহ দেখা দিলো। সে সিতিকণ্ঠকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করতে লাগল। সিতিকণ্ঠ এখন ভালোবাসার অনুভবে বন্দি।
জিহাকাংচু বলে, আড়াইশো বছর আগে মানুষ এত জটিল ছিলো না। সরল, সহজ ছিলো। কী করে মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হলো। অনেক দেশে সন্ত্রাসবাদীর আক্রমণে মানুষ মারা যাচ্ছে শুনে তার মনে - ভালোবাসা, আক্রোশ আর ঘৃণার সৃষ্টি হলো। তাহলে পৃথিবী ঘুরতে এসে একি অভিজ্ঞতা। সিতিকণ্ঠ গৌরীকে নিয়ে আজ কলকাতায় নাচঘরে মত্ত। ঘুরতে গেছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরের মধ্যে অন্যতম এই শহর কলকাতায়।
গৌরীকে নিয়ে আজ হোটেলে ঢুকেছে। বেশ ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়া সেরেছে গৌরী কিন্তু সিতিকণ্ঠের শরীর খারাপের বাহানায় খাওয়া বন্ধ রেখেছে। গৌরীর সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। চায়ের দোকানে সেদিনও সিতিকণ্ঠ চা খায়নি আজও খেলো না। কি অদ্ভুত ধরনের লোক। এমন লোক জন্মেও দেখেনি গৌরী। যেদিন গৌরী বিপদে পরেছিল সেদিনও সে দেখেছিলো এক লহমায় লাথির আঘাতে চারজনের ধরাশায়ী দেহ। কী করে সম্ভব? এত শক্তি কি একটা মানুষের থাকতে পারে? এইসব চিন্তা করতে করতে সে আর সিতিকণ্ঠ এগিয়ে চলেছে। এমন সময় গৌরী দেখলো একটা দশ চাকার লরি জনতার উপর দিয়ে চলেছে। উদ্দেশ্য মানুষকে মারা। একটার পর একটা মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী, শিশু কেউ বাদ যাচ্ছে না। সকলের চিৎকার, কান্নাতে অনেকে সতর্ক হয়ে পাশ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। তবু তারা গুলি করছে সরে যাওয়া মানুষের দিকে, এ কোন দেশ? কোনো মায়া নেই, দয়া নেই। গৌরী সিতিকণ্ঠকে ডাকতে গিয়ে দেখতে পেলো না। সিভিকণ্ঠ কোথাও যেন উধাও হয়ে গেছে। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করেন সে কিছু দেখতে পেলো না। এবার দেখতে পেলো গাড়িটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আর একটু। তারপরেই সব শেষ। এইসব ভাবছে গৌরী। এমন সময় অবাক কাণ্ড। দশ চাকার লরির ড্রাইভার এখন সিতিকণ্ঠ,
গৌরী দেখলো একটা দশ চাকার লরি জনতার উপর দিয়ে চলেছে। উদ্দেশ্য মানুষকে মারা। একটার পর একটা মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী, শিশু কেউ বাদ যাচ্ছে না। সকলের চিৎকার, কান্নাতে অনেকে সতর্ক হয়ে পাশ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। তবু তারা গুলি করছে সরে যাওয়া মানুষের দিকে, এ কোন দেশ? কোনো মায়া নেই, দয়া নেই। গৌরী সিতিকণ্ঠকে ডাকতে গিয়ে দেখতে পেলো না। সিডিকণ্ঠ কোথাও যেন উধাও হয়ে গেছে। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করেন সে কিছু দেখতে পেলো না। এবার দেখতে পেলো গাড়িটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আর একটু। তারপরেই সব শেষ। এইসব ভাবছে গৌরী। এমন সময় অবাক কাণ্ড। দশ চাকার লরির ড্রাইভার এখন সিতিকণ্ঠ, ব্রেকে পা দিয়ে লরিটা থামিয়ে দিলো। লরি থেমে গেছে। আর কোনো মানুষ মারা যাচ্ছে না। সিতিকণ্ঠ গৌরীর হাত ধরে। বাড়ি ফিরে এলো। খবরে দেখলো প্রায় একশো জন লোক মারা পড়েছে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায়। আর কোনো এক অদৃশ্য ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদীদের হত্যা করে প্রাণ বাঁচিয়েছে— শত শত মানুষের, পুলিশ পৌঁছানোর আগেই। কে এই ব্যক্তি, কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। জানে শুধু দু’জন গৌরী আর ড. বকসি।
‘জিহাকাংচু’ ওরফে সিতিকণ্ঠ, রাত্রির বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তখন রাস্তায় বেরোলো। সে দেখলো সেই আগের দিনের সরলতা জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষ, মানুষ ঠকানোর খেলায় মেতে উঠছে। নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের পথে টেনে আনছে। রাত্রিতে অসহায় নারী ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে বিক্রি করার ছলনার ছলে মেতে উঠেছে। কত বৃদ্ধ, শিশু ফুটপাতে শুয়ে আছে। রাত্রিতে কত নিশাচর উদ্যত ফণা নিয়ে মনের আনন্দে লুটের পসরা সাজায়। এই পৃথিবী সে
দেখতে আসেনি। নাঃ আর দেরি নয়, যা বোঝার তা বুঝে বীর গেছে। গৌরীকে সমস্ত কথা খুলে বলতে হবে। আর সময় নেই।
পরের দিন সকালবেলা গৌরীর ঘুম ভাঙ্গার পরে দেখলো ‘জিহাকাংচু’ বা সিতিকণ্ঠ নিজেই চা করে এনেছে। বর্তমানে গৌরী, ড. বকসি আর সিতিকণ্ঠ একসাথে থাকে। এবার গৌরীর প্রশ্ন— তুমি কী করে অসম্ভবকে সম্ভব করো? ড. বকসি বোঝাতে শুরু করলেন। আর সিতিকণ্ঠ মানুষের রূপ ছেড়ে প্রকৃত রূপ ধারণ করলো। গৌরী তো অবাক। টা একটা উল্টানো কুঁজোর ওপর গামলার মতো মাথা। রং পরিবর্তন ও নিজস্ব সব ক্ষমতার পরিচয় দিলো ‘জিহাকাংচু’। আর ছদ্মনাম নয়। এখন নিজস্ব রূপে পরিবর্তিত হয়ে ‘জিহাকাংচু’ তার স্পর্শ গুণে গৌরী ও ড. বকসির মস্তিষ্ক আরও উন্নত করলো।
‘জিহাকাংচু’ বলল – তোমরা এই পরিবেশ পাল্টে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাও।
ড. বকসি বললেন— সেটা কি শুধু দু'জনের পক্ষে সম্ভব?
‘জিহাকাংচু’ বলল – না, কখনোই নয়, সমস্ত মানুষ যখন একই মিলনের মেলায় সমবেত হবে। জাতি ধর্ম, নির্বিশেষে, একমাত্র তখনই এটা সম্ভব হবে।
ইত্যবসরে ‘জিহাকাংচু'র অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে অনেক, কিন্তু সঠিক ধারণা করতে পারেনি। তারা সবাই একজন মানুষকে দেখেছে। সাংবাদিক, জনগণ, সবাই গৌরীকে দেখেছে এবং খবর নিয়ে ঠিক জায়গায় এসে একসাথে থাকে। এবার গৌরীর প্রশ্ন- তুমি কী করে অসম্ভবকে সম্ভব করো? ড. বকসি বোঝাতে শুরু করলেন। আর সিভিকণ্ঠ মানুষের রূপ ছেড়ে প্রকৃত রূপ ধারণ করলো। গৌরী তো অবাক। একটা উল্টানো কুঁজোর ওপর গামলার মতো মাথা। রং পরিবর্তন ও নিজস্ব সব ক্ষমতার পরিচয় দিলো ‘জিহাকাণ্ডু'। আর ছদ্মনাম নয়। এখন নিজস্ব রূপে পরিবর্তিত হয়ে ‘জিহাকাংচু’ তার স্পর্শ গুণে গৌরী ও ড. বকসির মস্তিষ্ক আরও উন্নত করলো।
‘জিহাকাংচু’ বলল – তোমরা এই পরিবেশ পাল্টে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাও। ড. বকসি বললেন- সেটা কি শুধু দু'জনের পক্ষে সম্ভব?
‘জিহাকাংচু’ বলল – না, কখনোই নয়, সমস্ত মানুষ যখন একই মিলনের মেলায় সমবেত হবে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, একমাত্র তখনই এটা সম্ভব হবে।
ইত্যবসরে ‘জিহাকাংচু'র অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে অনেক, কিন্তু সঠিক ধারণা করতে পারেনি। তারা সবাই একজন মানুষকে দেখেছে। সাংবাদিক, জনগণ, সবাই গৌরীকে দেখেছে এবং খবর নিয়ে ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছে। তারা সবাই একবার দেখতে চায় শুনতে চায় সেই সাহসীর কথা। 'জিহাকাংচু’ বাইরে এলো, এই অদ্ভুত প্রাণী দেখে অনেকে ভয় পেলো। 'জিহাকাংচু' পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলল— আমি অন্য জগতের প্রাণী, তোমাদের দেখতে স দেখলো সেই এসেছিলাম, পৃথিবী ঘুরে অনেক ভালো অভিজ্ঞতা নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি হতাশ হলাম। পৃথিবীর প্রায় সত্তর সের পথে টেনে শতাংশ মানুষ দুর্নীতিমুক্ত ও স্বার্থপর। আমি আর তোমাদের পৃথিবীতে কোনদিন আসব না। সামান্য কয়েকটি বাক্য বলে ‘জিহাকাংচু’ সবাইকে বিদায় চর উদ্যত ফণা জানিয়ে প্রচণ্ড বেগে উড়ে চলে গেলো। তারপর তাকে আর দেখা গেলো না।
প্রবন্ধ
অনাচ্ছিষ্টি'র
এই শরতে
সুদীপ দাশ
বাঁশদ্রোণী, কলকাতা
মানুষ যতই হোক মহামারীর আতঙ্কে আঁকুপাঁকু, যতই একদিনে গতবছর বাবা বিশ্বকর্মার সাথে সাথে মায়ের আসার অনাচ্ছিষ্টি অঘটন ঘটে যাক, তেলের দাম যতই হোক আকাশবিদীর্ণকারী, এন আর সি যতই পাঁচ দশটা আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের নিক প্রাণ, যতই সরকার বাহাদুর বলুন তাঁরা পরিযায়ী মানুষের পথে হারিয়ে যাওয়ার হিসেব রাখেন নি, যতই যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীজোড়া হোক টালমাটাল অবস্থা, - আকাশে কিন্তু ক্রমশঃ সাদা মেঘ জড়ো হচ্ছে, - মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বিকেলের দিকচক্রবালে আশ্চর্য রঙের বিচ্ছুরণ, প্রতিবারের মতোই, আকাশের রঙ কি আশ্চর্য নীল, সুকনুকার উজ্জ্বল দাঁতের মতো ঝলোমলো রোদ্দুর, হাওয়াতে ফের স্নিগ্ধ-মৃদু স্বাদ। আসছে মহালয়া।
বাইরে হাহাকার হলেও বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজব্যাবস্থা তার প্রকৃতি বদলাতে গররাজি বরাবরই, কিন্তু মহামারীর কড়াকড়িতে সেই পুজোই আজ বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রথামতো সর্বজনীন নাগরিক উচ্ছলতা, দোকানে, শপিং মলে যথারীতি কেনা কাটার ভিড়, লেডিজ টেলরিংএর দোকানে সুবেশা মহিলাদের লম্বা লাইন -- সবই গত ২০২০তে ছিল অদৃশ্য আর ২০২১ থেকে ক্রমবর্ধমান। এখন তো কেনাকাটার দস্তুর অনেকটাই ভীড় এড়িয়ে 'অন লাইন' 'নিউ নরমাল' মাধ্যমে।
তাই বলি, ভাবের ঘরে চুরি করে ঢাক ঢোল কাঁসর পেটানো উৎসব-লীলা আমরা চালাবই, তাতে ভাইরাস আরও ভয়ঙ্কর হোক - কুছ পরোয়া নেহি। এবছর শুনছি ভাইরাস নতুন নতুন প্রজাতি নিয়ে আবারো কত বিচিত্র খেল্ দেখাতে চতুর্থ তরঙ্গ নিয়ে উপস্থিত।
মনে পড়ে সেই পঞ্চাশ বছর আগের ছোটবেলায় রেডিওর ব্যাটারি ঠিক ঠাক আছে কিনা,তা দেখে রাখতে হত মহালয়ার আগে থেকেই।এই শরতের ভোর চারটের সেই বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান হত মহালয়ার - আকাশবাণীর 'মহিষাসুরমর্দিনী'। তার আগে থেকেই ঘুম থেকে উঠে পড়তে হত। আবার বিভিন্ন বয়সের গ্রুপের সারারাত ব্যাপী ফিস্টি চালু ছিল সেই সময়। ওই ভোরে উঠেই ছুটতাম শেফালি বা শিউলি ফুলতলায়।
গাছতলায় শিউলি ফুল বিছানো থাকত। গিয়ে দেখতাম আমার আগেই শিউলি ফুল তুলে নিয়েছে পাড়ার এক দিদি। মন খারাপ না করে ওই গাছ ধরে ঝাঁকুনি দিলে আরও কিছু শিউলি ফুল মাটিতে পড়ত টুপ টাপ। সে এক আশ্চর্য শব্দ! তখন যে কি আনন্দ হত! কে জানে আজও কি অমন টুপটাপ শিউলি ঝরে পড়ে? স্মৃতিতে এখনো শুনি সেই টাপুর টুপুর শিউলি ঝরে পড়ার শব্দ। এখন কোথায় সেই এক ফালি উঠোনের শিউলি গাছ? হারিয়ে গেছে কোন প্রোমোটারের গ্রাসে। বছর খানেক আগে সেই গাছটির খোঁজে গিয়েছিলাম, পাই নি। ভোরবেলাতে পাড়ার মোড়ে মোড়ে লাউডস্পিকারে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের 'মহিষাসুরমর্দিনী' বাজত। আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম। রাস্তায় ঘুরে ঘুরেই গানের ভেলায় ভাসতে ভাল লাগত। তারপর যখন বাড়ি ফিরতাম তখন রেডিওতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর "তব অচিন্ত্য' গান চলছে। এরপর গানের ভেলা আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রসহযোগে "বিমানে বিমানে, তব জয়গানে" কোন সুদূর যে পাড়ি দিতাম কে জানে। তারপর পঙ্কজ মল্লিকের সেই "রূপং দেহী,জয়ং দেহী" দিয়ে শেষ হওয়া মহিষাসুরমর্দিনীর পর আবার আমরা বেরিয়ে পড়তাম প্রাতঃভ্রমণে। দেখতাম কিছু বয়স্ক লোকজন ওই ভোরে পাজামা, গামছা
ইত্যাদি নিয়ে হন্ত দন্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। মাকে একবার এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় মা বলতেন - "ওরা তর্পণ করতে যাচ্ছেন।" গত দু'বছর সেই চেনা চিত্রে কিছুটা ভাটা পড়েছিল - লোকে মহামারীর ভয় পেয়েছিল। কিন্তু এই বছর তো লকডাউন উঠে গিয়ে মানুষের আশ্চর্য ছন্দে ফেরার মরিয়া চেষ্টা। আমাদের বাড়িতে যদিও কোনদিন ওই তর্পণ প্রথার বালাই ছিল না।
মাকে প্রশ্ন করতাম - "ওই তর্পণটি কি?"
মা বলতেন - "মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষের শেষে পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে জলদান বা শ্রদ্বাঞ্জলী দিতে হয়।" আমার প্রশ্ন যেন শেষ হতে চাইত না।
আমি আবার প্রশ্ন করতাম-
"আমাদের বাড়িতে তো হয় না। আমাদের ও তো পূর্বপুরুষ ছিল।"
মা বলতেন - "ওসব তুই বুঝবি না।"
আমার মনে হয়েছিল যেন আমার মা-বাবারা ঘটমান - বর্তমান নিয়ে যতটা বিব্রত থাকতেন, পূর্বপুরুষ নিয়ে ততটা নয়।
তারপর যখন মহালয়ার ভ্রমণ সেরে গরম জিলিপি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম তখন রেডিওর 'বিবিধ ভারতী'র বর্ণালী অনুষ্ঠানে সুপ্রভা সরকারের কন্ঠে বিখ্যাত গান - "মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা" হত।
আকাশে যতই না হোক মহামারীর করাল থাবার ভ্রুকুটি, তেমনই দেশের ভাগ্যাকাশে জি ডি পি র যতই হোক পতন, যতই রোজগার হারিয়ে মানুষ করুক হাহাকার, এরই মধ্যে দেবী দশভূজার আবাহনের জন্য বাঙালী প্রস্তুত। মিষ্টির দোকানে লাইন পড়ল বলে। Zoমাটো, সুইগি - এইসব খাদ্য ডেলিভারির অ্যাপের আজ রমরমা ব্যবসা।দেখে মনে হচ্ছে কি কয়েকলক্ষ মানুষের চাকরি গেছে, রোজগার কাটঁছাঁট হয়েছে এই দেড় বছরে? নিশ্চয়ই ওই সব অ্যাপের কল্যাণে এই 'ডেলিভারি বয়ে'র চাকরি আজ ছড়িয়ে পড়েছে।
তাই বলি, মস্ত ভরসার কথা, গরীবগুলি দিব্যি ভদ্রলোকের মতো মারা যাচ্ছে ভাইরাসে বা অভুক্ত হয়ে বা অবসাদে, কোন প্রতিবাদ করছে না, খাদ্যের গুদাম লুঠ হচ্ছে না, মন্ত্রী - সান্ত্রীদের শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে না, এ বি সি ডি ই এফ, এন আর সি, বা জি এস টি তে কারোরই তেমন অসুবিধা হচ্ছে বলে ঠাওর হচ্ছে না, সবাই কি সুন্দর লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বে, তা সে স্বর্ণালঙ্কারে বিভূষিতা মাতৃ মূর্তি দর্শনই হোক বা রাজ্য সরকারের 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' কর্মসূচির লাইনই হোক বা মিষ্টি বা ঠাকুরের ফুল কেনার লাইনই হোক, নিজেকে নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত থাকবে এই মহান দেশে। আর উৎসব হতে উৎসবান্তরে, পূজা হতে পূজান্তরে গা ভাসাতে হবে। তাই শারদোৎসবেও যতি পড়বে বলে মনে হচ্ছে না।
যাদের মুখ থুবড়ে মরবার তো মরবে, করোনাসুর যাদের খাবে খাক না, শরৎকাল উজ্জ্বল রোদ্দুর আসন্ন, সুনীল আকাশে হাল্কা তুলোর মতো মেঘ ভেসে এসেছে, চারিদিকে কাশফুলের সাজ, আসুন গলা ডুবিয়ে আনন্দসাগরে অবগাহন করি আর তুড়ি মারি মহামারীকে।
চোর
সায়ন্তী মিস্ত্রি
সল্টলেক, কলকাতা
প্রবন্ধ
দুপুর বেলা সবে চোখটা জুড়িয়ে এসেছে অবনীবাবুর। এমন সময় নিচের কলিং বেল বেজে উঠল কিরিঙ করে। অনেকদিন অবনীবাবু ভেবেছেন কলিং বেলের টোনটা পাল্টাবেন। গেল ভাত ঘুমটা ভেঙে। উঠতে আলস্য লাগছিল। পাশের ঘর থেকে গিন্নির গলা
- কি গো। শুনতে পাচ্ছ না?
অগত্যা উঠতেই হয়। রবিবার দিনও একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর উপায় নেই। অবনীবাবু সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে। নিচতলাটা এখন নিঝুম। কাজের মাসি দুপুরবেলা বাড়ি চলে যায়। পায়রাদের বকমবকম ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। কলিং বেল আবার বেজে উঠল।
- যাচ্ছি রে বাবা। অবনীবাবু বলে ওঠেন।
দরজা খুলে অবনীবাবু একটু বিরক্ত হন। কাঁধে ঝোলা নিয়ে এক দেহাতি লোক। পরনে কাপড় ময়লা। গলা আর মাথায় একটা গামছাকে জড়িয়ে রোদ্দুর থেকে বাঁচার চেষ্টা। তবে মুখে কিছু চিবিয়ে যাচ্ছে।
অবনীবাবু বিরক্ত স্বরে বললেন, - কি চাই?
- আজ্ঞে আমি রতন। তালা চাবি সারাই।
দুপুরবেলা ঘুম ভাঙিয়ে তালা চাবি সারানো।
- তা তুমি কলিং বেল টিপলে কেন?
- আপনারা হলেন বাবু মানুষ। এমনি হাক দিলে তো তেমন গেরাঝ্যি করবেন না, তাই।
- বড় সাহস যে দেখছি তোমার।
- তা সাহস একটু করতে হলো বাবু। না হলে গেরামের ছেলে শহরে কলকে পাব না যে।
অবনীবাবুর মাথাটা গরম ছিলো। একে ত কাঁচা ঘুমটা মাটি করেছে। তবু নিজেকে সামলে নিলেন।
- না তালা চাবি কিছু সারানোর নেই।
- কোন বাক্স বা দেরাজ? মানে আটকে গেছে এরকম।
- না নেই। তুমি এসো।
এমন সময় ওপরের জানালা থেকে গিন্নির কণ্ঠ।
- শুনছো? বলি তেতলার ঘরের সিন্দুকটা একবার দেখাও না। যদি খুলতে পারে।
মহিলাদের বোঝার ক্ষমতা অবনীবাবুর আজও হল না। গিন্নি নাকি ঘুমোচ্ছিল। সব শুনেছে।
-আজ্ঞে একবার সিন্দুকটা দেখিয়ে দিন গিন্নিমা। রতনমিস্ত্রি পারে না এমন কাজ নেই।
অবনীবাবু আর কি করেন। গিন্নি যখন ধরেছে তখন আর আজকে ঘুমের আশা নেই।
দরজা খুলে রতনকে ভিতরে আসতে দিলেন অবনীবাবু। তেতলার ঘরের সিন্দুকটা অবনীবাবু তার ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছেন। অবনীবাবুর ঠাকুমা ঐ ঘরে থাকতেন। ঠাকুমা বিছানাতে শুয়েই থাকতেন। কেউ গেলে শুধু বলতেন "খোকা এলি।" ঐ ঘরেই আছে সিন্দুকটা। অবনীবাবু কোনোদিন ঐ সিন্দুক খুলতে দেখেন নি। কি আছে সে কৌতূহল থাকলেও কোনোদিন সেটা খোলার উপায় হয় নি।
সিঁড়ি দিয়ে তেতলা উঠতে উঠতে অবনীবাবু অতীতে পৌঁছে গেছিলেন। পিছনে রতন বকবক করতে করতে উঠছিল।
"আমাদের গেরামে বাবু সবাই একডাকে রতনমিস্ত্রিকে চেনে। আপনি গিয়ে একবার নাম বললেই হল। কোন কাজটা রতন পারে না সেটা বলুন। শিমুলতলার কোন বাড়ি নেই যার তালা রতনমিস্ত্রি খুলতে পারে না।
অবনী বাবু থমকালেন।
- তুমি চোর নও তো।
রতন এক হাত জিব কেটে বলে
- কি জে বলেন বাবু।
অবনীবাবুর মনটা খচখচ করতে লাগলো। তবু গিন্নির হুকুম ভেবে মুখে কিছু বললেন না। তেতলার ঘরে এসে রতনকে সিন্দুকটা দেখিয়ে দিলেন। রতন পোটলা থেকে কিছু যন্ত্র বের করে কাজ শুরু করল।আর মুখে বকবক চলল। এই ঘরটায় বিশেষ আসা হয়না। অবনীবাবু একটা চেয়ারের ধুলো ঝেড়ে বসলেন। অবনীবাবু গত বছর অবসর নিয়েছেন। এক ছেলে থাকে ব্যাঙ্গালোরে। বৌমা নাতিও সেখানে। গিন্নি আর অবনীবাবু। তাতে অবশ্য অবনীবাবুর খুব একটা দুঃখ নেই। অবনীবাবু বাজার করতে, খেতে ভালোবাসেন। রবিবার দিন বাজার ঘুরে ভালো পাঠার মাংস নিয়ে আসেন। আজও যেমন এনেছিলেন। গিন্নির যতই দোস থাক রান্নার হাতটি চমৎকার। খাসির মাংস যেন অমৃত। মুখে লেগে থাকে। অবসরের পর অবনীবাবুর দুপুরে ঘুমের অভ্যাস হয়ে গেছে। বিকেল পর্যন্ত ঘুমিয়ে একটু হাটতে বেরোন। আজ সব উল্টো পাল্টা হয়ে গেল।
- একটা ছুরি হবে বাবু? রতনের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো। কিন্তু ছুরি।
- ছুরি দিয়ে কি করবে হে?
- আজ্ঞে কাটতে হবে।
- সেকি _না না ওসব কাটাকাটি হবে না। এমনি খুলতে পারো কিনা দেখ।
- সে কি আর রতনমিস্ত্রি পারবে না। তবে কিনা টেকনিক।
বিরক্ত হলেন অবনীবাবু।
- আরে সেতো সেই একতলায় রান্নাঘরে। তুমি দেখছি জালালে।
তবু আশা সিন্দুক থেকে যদি খোলে। অবনীবাবু একতলা থেকে ছুরি আনলেন। অবনীবাবু চেয়ারে বসে হাপাতে থাকলেন। অবনীবাবুর আর্থিক অনটন নেই। পৈত্রিক সম্পত্তি ভালোই পেয়েছেন।নিজেও সারাজীবণ চাকরি করে এখন পেনশন পান। সিন্দুকটায় কি আছে জানেন না। ধনদৌলত নিয়ে অবনীবাবুর বিশেষ আগ্রহ নেই। অবনীবাবুর সখ খাওয়া। কিন্তু গিন্নির ইচ্ছে। মহিলাদের কৌতূহল বোধকরি একটু বেশিই।
ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়ে গেল। রতন তার পোটলার সব যন্ত্র মেঝেতে বের করে ফেলেছে। নিচতলা থেকে আরো কিছু জিনিস অবনীবাবু এনে দিয়েছেন। তবু সিন্দুক খোলেনি। রতন এখন মরিয়া। গিন্নি বার দুই খোজ নিযেছেন। কাজ হয়নি।
- কি হে তুমি যে দিন শেষ করে ফেললে। কোনো কিছুই তো বাদ রইল না। তোমার কম্ম নয় দেখছি।
রতন হার মানতে নারাজ। - এই হয়ে এসেছে বাবু। বাগে এনে ফেলেছি।
অবনীবাবুর একটা হাই তুলে বললেন
- সে তো দেখ্তেই পাচ্ছি।
রতন আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বিদায় নিল। অবনীবাবু জামাকাপড় পড়ে বিকেলবেলা ঘুরতে বেড়োবেন।বেড়োনোর সময় গিন্নি বললেন
- দেখে শুনে লোকজন লাগতে পারো না? সারাদিনটা মাটি করল। কাজও হোলো না।
- আহা চেষ্টা তো করল। তাছাড়া ঐ সিন্দুকে আছেই বা কি। দলিল টলিল থাকবে হয়তো।
গিন্নিই যে ওপর থেকে রতনকে দিয়ে সিন্দুক খুলতে ডাকল সেটা আর অবনীবাবু তুললেন না। মোড়ের মাথার দোকানে সন্ধ্যেবেলা গরম সিঙাড়া ভাজে। অবনীবাবু প্রায় রোজকার খদ্দের।
রাত্রিবেলা গিন্নি লুচি আলুর দম আর পায়েস করেছিলো। হয়ত নিজের ভুলটা বুঝে। যাই হোক অবনীবাবুর দিনটা খারাপ গেল না। দুপুরে ঘুম হয়নি। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন।
পরদিন সকালে গিন্নির চিৎকারে অবনীবাবুর ঘুম ভাঙলো। অবনীবাবু নিচের তলায় নেমে এলেন।সদর দরজা হাট করে খোলা। রান্নাঘরের দরজাও। আর বাসন কোসন যা ছিলো সব উধাও। গিন্নি হাওমাও করে কাঁদছেন। অবনীবাবু হাঁ হয়ে বসে পড়লেন। রতনমিস্ত্রি সিন্দুক খুলতে না পারলে কি হবে। সে যে তালা খুলতে ওস্তাদ সেটা আর অবিশ্বাসের উপায় নেই।
হারানখুড়োর
নাভি
স্বর্ণপালি মাইতি
কলকাতা
গল্প
হারানখুড়োর কোলন ক্যান্সার হয়েছিল। ভাইফোঁটার দু দিন বাদে সদর হাসপাতালে বালতি বালতি রক্ত বেরিয়ে মরে গেল। তা বয়েস মন্দ হয়নি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র যখন আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে ইংরেজদের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছেন, সেই সময় খুড়োও বাহিনীতে যোগ দেবেন ভাবছিলেন। ছেলের স্বদেশী মতিগতি দেখে খুড়োর বাবা খুব কম বয়েসে হারানের সাথে ফুলির বিয়ে দিয়ে দ্যান। দেশপ্রেম এর জোয়ার ছাপিয়ে দাম্পত্য প্রেম এর এমন বন্যা এল যে বছর পনের যেতে না যেতে খুড়োর একেবারে চার ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। কৃষ্ণের দয়ায় সবাই বেঁচে বর্তে নিজেদের বংশ বিস্তারে মনোযোগী ও হয়েছে। সব মিলিয়ে আঠেরো জন নাতি-নাতনী আর তাদের ঘরে পুতি মিলিয়ে আরো জনা পনেরো। তাদের আবার কারো কারো কোল আলো হয়েছে কিছুদিন হল।
খুড়োর শবযাত্রীর সংখ্যা দেখে সবার পিছনে থাকা গুলে পাগলা তার পোষা কুকুর ভুলোর দিকে তাকিয়ে বললে - 'সেই রবি ঠাকুর আর উত্তম কুমারের মরণ যাত্রায় এমন ভিড় হয়েছিল রে! খুড়ো আমাদের বেশ ভালো লোক ছিল বলতে হবে।'
খুড়োর শেষ ইচ্ছে ছিল তাঁকে চিতায় পোড়ানো হোক। ভালোই চলছিল কিন্তু শেষের দিকে নাভির কাছটায় কর্কট রোগের যে মাংসপিন্ডটার জন্যে খুড়োর এই গতি হল, সেটাকে তিন মগ ঘি ঢেলেও পুরো পোড়ানো গেল না। খুড়োর পুরো পেটটাই যেন একতাল পাথর। খুড়োর ছোট নাতি গজ গজ করতে করতে বল, এর চেয়ে ইলেকট্রিক চুল্লীতে দিলে ভালো হত না? কতবার বললাম শহরে চলো। শ্মশানকালী মন্দিরের পুরোহিত ভটচায বললেন "ম্লেচ্ছ মাংস খেত কিনা, তাই বৃহদন্ত্রটা পোড়ানো যাচ্ছে না"।
গজানন মোদক খেঁকিয়ে উঠে বললে - "মাংসের আবার ম্লেচ্ছ - অম্লেচ্ছ কি বাপু?"
- "আরে ঐ যে সসেজ না কি বলে, শুয়োরের মাংস থেকে তৈরী, ঐ নাতিই তো এনে এনে খাওয়াতো!"
- "তা তুমি বাড়ি বাড়ি মাংসের কেত্তনের এত খোঁজ কেন রাখো গো ভটচায্যি? তুমি না পুরুতঠাকুর ?"
- "আহাম্মক। আমার মন্দিরের মা কে দ্যাখ! কাঁচাখেগো দেবী যে রে! আমার অভ্যেসটাও ওরম হয়ে গেছে!"
প্রথমে ভাবা হল আধপোড়া পিন্ডটা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। মা গঙ্গা যা করেন করবেন। খুড়োর মেজ নাতি খুঁতখুঁত করল - ক্যান্সার এর মাংস। নদীতে মাছ টাছ খুঁটে খাবে। এভাবে ফেলা কি উচিত?
শেষ পর্যন্ত কালু ডোম দু'শ টাকার বিনিময়ে পিন্ডটাকে শ্মশানেরই পেছন দিকে ঢিপিটার মধ্যে পুঁতে দিতে রাজী হল।
....
বাংলা মদের নেশায় কালু নড়তে চড়তে পারছে না। বিকেল হল। মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। সকালে শেষকৃত্য হওয়া খুড়োর চিতায় এখনো ধিকি ধিকি কাঠের টুকরো জ্বলছে।' এ লক্ষণ ভালো না'। বিড় বিড় করল কালু। এরপর বৃষ্টি এলে কাদায় চচ্চড়ি হয়ে যাবে সব। একটা কালো প্লাস্টিকে পিন্ডটাকে ভরে ঢিপিটার কাছে কোদাল হাতে উঠে এল কালু। ফণিমণসার জঙ্গল। চারদিকে ছোট ছোট হাড়। এখানে বাচ্চাদের গোর দেওয়া হয়। তিন চারবার কুপিয়ে হাঁপ ধরে উঠল। কালুর ও বয়েস হয়েছে, তিন কুড়ির ওপরে। শ্মশানকালী মন্দিরের পেছনে গর্ত খুঁড়ে থাকে শেয়ালের এক পরিবার। এখন ই হুক্কা হুয়া ডাকছে শেয়াল গুলো। মাত্র সাড়ে পাঁচটা বাজে। কিন্তু কি অন্ধকার হয়ে এসেছে। শেয়াল গুলো ও এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে কেন? গুলের কুকুরটাকে রেখে দিলে হত। ওটা আশেপাশে থাকলে শেয়ালগুলো বেরোয় না।
ধ্যার শালা, পাঁশুটে শুকনো বুড়োর টিউমার নিয়ে পাব্লিকের কত চিন্তা। জলে ফেলে দিলে ল্যাটা চুকে যায় তো!
কে যেন ডান কানের কাছে বললে - 'নেমক হারাম! এটার জন্যে দু'শ টাকা পেলি। মদও গিলে এলি, এখন লজ্জা করে না?'
যা ভেবেছে কালু ঠিক তাই। বিকেল থেকেই তার মনে হচ্ছে খুড়ো যেতে পারে নি। যে মড়া মুক্তি পায় তার চিতার কাঠ এতক্ষণ জ্বলে না। কালু একটু কেঁপে উঠল। তবে মন শক্ত করে গলা খাঁকরিয়ে বলল
- তা বটে। ঠিক বলেছো গো খুড়ো। দাঁড়াও গোর দিয়ে নি আগে। তোমার শ্রাদ্ধ না হওয়া অবধি সদগতি নেই। এতেই তুমি আটকে আছ।
- ব্যাটাচ্ছেলেরা আর কয়েক মণ কাঠ জোগাড় করতে পারল না? হাড়কেপ্পন সব।
- তোমার ধাত পেয়েছে খুড়ো। এসব রক্তে থাকে! এখন বোঝ। ইহলোক আর পরলোকের মাঝে থাকো আটকিয়ে।
- আটকুঁড়োর ব্যাটা ঠিক করে চাপা দে। নয়তো তোর শ্মশান কালীর পোষা শেয়ালরা খুঁড়ে বের করে এখানে ডে-নাইট ম্যাচ খেলবে।
- খুড়ো তো এমন করছো যেন ধনরত্ন চাপা দিচ্ছ!
- আবার কি? বছর তিনেক ধরে কত যত্নে পেটের মধ্যে বেড়েছে ভাব। এটার জন্যেই তো মরতে
- কি আর লাভ হল! এতেই তো আটকে গেলে।
- ও তো আর কয়েক দিন। নাতি পুতিরা পূজো দিয়ে দিলেই মুক্তি।
- তা খুড়ো বেঁচে থাকতে ঘেন্না কিসের? আমার তো বাপু বাঁচতে ভালোই লাগে!
- ধুর ধুর। চারপাশে যা দেখছি। তার ওপর চক্ষুলজ্জার ও তো ব্যাপার আছে। চোখের সামনে দিয়ে টাটকা তাজা ছেলেমেয়েগুলো পটল তুলছে। আমায় আর ভগবান নিচ্ছে না।
- আচ্ছা খুড়ো তুমি যাবে কোথায়, সোজা স্বর্গ না নরক দর্শন ও করতে হবে?
- দেখি, নরক ব্যাপারটা খারাপ না, বুঝলি? প্রথম দু'দিন একটু কষ্ট হয়, তারপর যমদূতগুলোর সঙ্গে ভাব হয়ে গেলে আর বিশেষ চিন্তা নেই।
- তবে সগগে গেলে অপ্সরা টপ্সরা পেতে...
- নাহ, সগ্গে গেলে তোদের খুড়ীকে আগে খুঁজে বের করব।
- খুড়ী ওখানেই আছে বলছ?
- হ্যাঁ। এ নিয়ে সন্দেহ নেই রে। ওরম মানুষ মরলে দেবতারা এসে নিয়ে যায়। আমার ভয় হচ্ছে তোদের খুড়ীকে ওরা ছোটখাটো কোন পোস্ট দিয়ে দিল কিনা! তাহলে তো দেমাকে আমাকে আর পাত্তাই দেবে না।
- পোস্ট? কি রকম পোস্ট?
- আমার সন্দেহ তোদের খুড়ী ওখানকার হেড রাঁধুনি হয়ে গেছে। ওর হাতের তেলাপিয়ার ঝাল তো খাসনি রে কালু! নিজেকে সগগের রাজা মনে হবে।
- আমার কি আর সে কপাল! ছোট জাত! আমাদের আর মাছের ঝাল করে কে খাওয়াবে খুড়ো...
আলোচনায় ছেদ পড়ে। আর একটা মড়া এসেছে। পেট ফুলে গেছে। তাড়াতাড়ি করতে হবে। বৃষ্টি আসছে। গভীর রাতে নদীর জলে ঠ্যাং ডুবিয়ে বসে ছিল কালু। অল্প বৃষ্টি হয়ে এখন আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে। কুল কুল করে কালো জল বইছে। ওপারে টিম টিম করে জ্বলছে ঘাটের আলো।
...ও খুড়ো? আছ নাকি?
- আছি আছি। আর তর সইছে না রে। কবে যে ফুলিকে দেখব? সেই এত্তটুকু বয়েসে এসেছিল। কত আর? তেরো -চোদ্দ! কি মিষ্টি গলা। নাকে একটা নোলক পরে থাকত। আমি এই আশরাফ গঞ্জে পোস্টমাস্টার হয়ে এলুম। ও থাকত আমার বাবা -মা র কাছে। আঁকা বাঁকা অক্ষরে সে কি চিঠি
- "আমি আপনার কাছে যাব"।
- 'হ্যা হ্যা হ্যা'।
- 'হাসিস নে রামছাগল। আজকের দিনে কয়জন বলে এ কথা? আমি তোমার কাছে যাব.. আহা!
- আমার আর কি খুড়ো। বৌ নাই, ছেলেপিলে নাই। মানুষও একেবারে মরে গেলে তবে আমার কাছে আসে। আমি এসবের কিছু বুঝি না। শুধু বুঝি একটা কথা,কোন মানুষ মরলে তার জন্যে সত্যি কারের দুঃখু সাকুল্যে খুব কম লোকের হয়। "
- মানে?
- মানে এই যে তোমার ছোটছেলে হাঁউমাউ করে কাঁদলে খুড়ো, ওর কিন্তু বিশেষ দুঃখ হয়নি। আবার পবন মাস্টারের বৌ মরে যেতে আমাদের গজা কেমন কেঁদেছিল সে তো দ্যাখোনি। ওটা সত্যিকারের দুঃখ।
- ফুলি মরে যেতে আমি কাঁদিনি একটুও। যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিল বড্ড। মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
-তবে এটা খুব চিন্তার কথা গো খুড়ো। এত বছর বাদে খুড়ী যদি তোমায় নাকচ করে দেয়? ধরো সগগেই কোন ছোটখাটো দেবতা-টেবতা কে মনে ধরে গেল!
- তুই কি আমায় ভয় দেখাচ্ছিস?
- আহা চটো কেন? তুমি নিজেই তো এখন একটা ভয়ের বস্তু। আমি বলে কথাবার্তা কইছি। আজকাল কার ছেলেপুলে হলে অক্কা পেত।
-তাহলে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিসনি তো বাপ! সে একবার তোর খুড়ী বিয়েবাড়ি গিয়ে আমার এক দূর সম্পর্কের গাইয়ে জামাইবাবুর গানের প্রশংসা করেছিল। সেই অবধি ঠিক ছিল। তারপর বলে বসলে
- "কি সুন্দর দেখতে গো মানুষটা কে! যেমন গলা, তেমনি রূপ!" সারারাত কাঠপিঁপড়ের কামড়ের মত জ্বালা নিয়ে শুয়েছিলুম। পরদিন ভোরের ট্রেন ধরে ফিরে তোর খুড়ীকে ঘরে ঢুকিয়ে তবে আমার শান্তি।
-হ্যা হ্যা হ্যা... তোমার জোয়ান বয়েসের ছবি দেখেছি মিউনিসিপালিটি অফিসে খুড়ো, তুমি নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলে! তা তোমার যা চেহারা দেখলুম খুড়ী তোমায় সত্যি খুব ভালোবাসত বলতে হবে।
-আবাগীর ব্যাটা!
মাথায় একটা রাম গাঁট্টা খেল কালু। খুড়ো রেগে গেছে। এখন আর কথা কইবে না। যাক, খুড়োর একটা সদগতি হোক। খুড়ীকে যেন সগগে গিয়ে পেয়ে যায়। ছিলিমে আগুন দিয়ে একটা সুখটান নেয় কালু। গুণ গুণ করে ওঠে...
- বিস সাল বাদ... বিস সাল বাদ... জয় শ্মশানকালী! রক্ষা করো মা! তুমি ই ভরসা মা গো!
গল্প
চাওয়া
আর পাওয়া
সুব্রত মজুমদার
হিউস্টন, ইউ এস এ
তনুশ্রী আর সলিল উঠে গেল বেয়ারাকে বিলের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে। সলিলই সবাইকার পয়সা দিয়েছিল। শাশ্বতকে কোন সুযোগই দেয়নি। যাবার আগে তনুশ্রী আড়চোখে শাশ্বতর দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়েছিল কি? মনে করতে পারল না শাশ্বত। শাশ্বত তাকিয়ে রইল দরজার দিকে অনেকক্ষণ। আজ অনেক আশা নিয়ে এসেছিল শাশ্বত। তার সব আশা ভেস্তে দিল তনুশ্রী। তনুশ্রী না সলিল কাকে দোষ দেবে বুঝতে পারল না শাশ্বত। তনুশ্রীকে কি তাহলে প্রথম থেকেই ভুল বুঝেছে সে।
অনেক সকালেই ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল শাশ্বতের, অন্যদিনের মতই, অ্যালার্ম ক্লকের আওয়াজে। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে নিজের মনেই হেসেছিল। আজ তো শনিবার, ছুটির দিন। শনিবারের সকাল, অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। গতরাত্রে ঘরে দেরি করে ফেরার জন্য অ্যালার্মটা ওফ্ করতে ভুলে গিয়েছিল। অন্যদিন হলে হয়ত নিজেকে গালাগাল দিতো এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু আজ খুশিতে মনটা ভরে গেল। তনুশ্রীর নামটা মনে মনে গুন্গুন্ করল কয়েকবার। সুন্দর দেখতে মেয়েটা। প্রথম যেদিন দেখেছিল সেইদিন থেকেই মনটা কেড়ে নিয়েছিল। মাত্র দু সপ্তাহের আলাপ, অথচ মনে হচ্ছে যেন কত দিনের চেনা। তার ভাবুক মন স্বপ্নের রঙ্গিন আকাশে ডানা মেলে দিল। আজ ঠিক তিন মাস হল ও কলকাতায় এসেছে নতুন চাকরি নিয়ে। দুর্গাপুজোর আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। পুজোয় দু সপ্তাহ ছুটির ব্যাপারটা চাকরি নেওয়ার আগেই চুক্তি করে নিয়েছিল শাশ্বত। মায়ের তাগিদেই করতে হয়েছিল। প্ল্যান ছিল বাবা মা ছোট বোন আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কাটাবে এই কয়েকটা দিন। কোন কাজ নয় শুধু আড্ডা আর মায়ের হাতের ভাল ভাল রান্না। জানলা দিয়ে ভোরের রোদ ঘরে ঢোকার জন্য উঁকিঝুঁকি মারছে, শাশ্বত বালিশটা দিয়ে মুখটা ঢেকে সারা শরীরে সকাল বেলার রোদের আমেজটা উপভোগ করল অনেকক্ষণ ধরে।
ভাবতে অবাক লাগে যে তিন তিনটে মাস কেটে গেছে কোলকাতায়। অথচ এখানে আসার আগে কত চিন্তাই না করেছিল শাশ্বত। সত্যি তাহলে কোলকাতায় যেতে হচ্ছে তাকে। বরাবর বম্বেতে মানুষ শাশ্বত খারাপ ছাড়া ভাল কিছু কখন শোনেনি কোলকাতার সম্বন্ধে। চারিদিকে নোংরা, পচা দুর্গন্ধ, বৃষ্ঠি হলে জল জমা, নর্দমা, রাস্তায় রাস্তায় ভিখারী, গরু, বস্তি, এই সব দৃশ্য ভেসে ওঠে কোলকাতার কথা ভাবলে। কোম্পানি বলেছে ওকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে। দু দুটো প্রোমোশন দিয়ে তবে পাঠাচ্ছে কোম্পানি। আপত্তি করার আর কি কারণ থাকতে পারে ভাবতে পারেনি শাশ্বত। বাড়িতে সবাই খুশি শুধু খবরটা শোনার পর থেকে মায়ের মুখটা শুকনো হয়ে গিয়েছিল। শুকনো মুখে একটু হাসি ফুটেছিল যখন কোলকাতা থেকে বাবার বন্ধুর চিঠিটা এল। ওনাদের ফ্লাটের ঠিক উল্টো দিকের ফ্লাটটা খালি হয়েছে কয়েকদিন আগে। উনি ব্যবস্থা করছেন, চিন্তা করার কোন কারণ নেই। বাবাকে লেখা সেই চিঠিটা পড়ছিল শাশ্বত। হঠাৎ ছোট বোন বিত্তা এসে ওর হাত থেকে চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলল "কিরে তুই কোলকাতা যাওয়ার আগেই প্রেম পত্র পেতে শুরু করেছিস নাকি?’’
চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে গলাটাকে গম্ভীর করে নিয়ে বলল ‘‘ও তুই অনুকূল কাকুর ওখানে থাকবি? খুব ভাল কথা, মার আর কোন চিন্তা থাকবে না। তোকে না মা ভাবে যে তুই এখনো সেই খোকা হয়ে আছিস। অবশ্য মাকে খুব একটা দোষ দেওয়াও যায় না। আমি অনেক ছোটবেলায় গেছি। ওনাদের দুটো মেয়ে। ছোটমেয়েটা আমার বয়সী। ওর সঙ্গেই আমি খেলতাম, খুব ভাল ছিল মেয়েটা। নামটা মনে পড়ছে না। আমার হয়ে ওদের হাই বলে দিস্। আর দেখিস্ তুই আবার যেমন হাবাগোবা ওদের একটার প্রেমে টেমে পড়ে যাস না যেন। অন্তত পড়ার আগে আমায় একটা ছবি পাঠাবি। আমি মত না দিলে কিছু হবে না কিন্তু, বলে দিলাম।’’
মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে বোনের হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে শাশ্বত বলেছিল ‘‘তুই চুপ করবি, সব সময়ে তোর এই ডেঁপোমি ভাল লাগে না বিত্তা, আমি তোর থেকে কতটা বড় জানিস?
‘‘জানি পাঁচ পাঁচটা বছর।’’ বাঁ হাতটা তুলে পাঁচটা আঙ্গুল দেখিয়ে, একটা ভেংচি কেটে, কলা দেখিয়ে চলে গিয়েছিল বিত্তা মায়ের কাছে, হয়ত নালিশ করার জন্য।
কোম্পানি প্লেনে যাওয়ার ফেয়ার দিয়েছিল, কিন্তু শাশ্বত নেয়নি। তাড়াহুড়ো না থাকলে ট্রেনে যাওয়াই পছন্দ করে সে। দুর পাল্লার ট্রেনে যেতে ভালই লাগে, তার পর যদি রাত্রে হয় তো কথাই নেই। অনেক রাত্রে কোন থেমে থাকা স্টেশনে কাঁচা ঘুমের মধ্যে চাওয়ালার ‘‘চায়ে গরম, চায়ে গরম’’ ডাক শুনে প্ল্যাটফরমে নেমে সেই গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার সঙ্গে কোন কিছুর তুলনা হয় না। মা মাসি কাকু বা দাদা পাতিয়ে জমিয়ে আড্ডা আর যদি ভাগ্যক্রমে কলেজে পড়া সুন্দরী তরুণী সহ কোন বাঙ্গালী পরিবার পাওয়া যায় তো সোনায় সোহাগা।
মায়ের চোখমুখ সেই সকাল থেকেই ভার ভার। শাশ্বত যা যা খেতে ভালবাসে সব রকমের রান্না করেছিল তার মা। তার সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছিল বিত্তা বুড়ি পিসিমার মত। বাবা মনে করিয়ে দিয়েছিল কাগজপত্র ঠিক মত নিয়েছে কিনা। বিত্তা আর বাবা এসেছিল স্টেশনে শাশ্বতকে তুলে দিতে। মা আসেনি। বিত্তা বলেছিল প্ল্যাটফরমটা নাকি চোখের জলে ভেসে যাবে তাই মা আসেনি। মায়ের জায়গাটা বিত্তাই অবশ্য পুষিয়ে দিয়েছিল। পাকা গিন্নির মত মুখ করে শাশ্বতকে বলেছিল ‘‘রোজ ঠিক মত খাওয়াদাওয়া করবি, বেশি রাত্তির জেগে বই পড়বি না, রোজ ফোন করবি, পোঁছেই চিঠি দিবি আর পুজোর জন্য কোলকাতা থেকে ভাল ভাল শাড়ী আমার জন্য কিনে আনবি।’’ ট্রেনটাও বোধহয় বিত্তার কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত বোধ করছিল, হঠাৎ চলতে শুরু করে দিল। জানলা দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে শাশ্বত দেখল বাবা আর বিত্তা ছোট হতে হতে একসময়ে হারিয়ে গেল। আর দেখতে পেল না।
ট্যাক্সিওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে চারতলায় উঠে বেল বাজানোর পর অনুকূল বাবুই দরজা খুললেন। পরিচয় দেওয়ার পর আদর আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে এসে বসালেন। শাশ্বত প্রণাম করার পর উনি আন্তরিক সুরে জানতে চাইলেন বাবা মায়ের খবর। আশার পথে কোন কষ্ট হয়েছিল কিনা? কি খাবে চা না কফি? শুভ্রা কাকিমাকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন।
‘‘এই দেখ এই শাশ্বত। শেষ বার যখন দেখেছিলাম তখন কত ছোট ছিল। আর এখন পূর্ণ যুবক।’’
শুভ্রা কাকিমা চলে গেলেন চা বানাতে। শাশ্বত গল্প শুরু করে দিল অনুকূল বাবুর সাথে। একটু বাদে শুভ্রা কাকিমা ট্রেতে করে গরম চা আর সিঙ্গাড়া নিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগদান করলেন। একসময়ে অনুকূল বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন ‘‘চলো শাশ্বত গল্প করতে করতে বেলা হয়ে যাছে তোমাকে তোমার উল্টো দিকের ফ্লাটটা দেখিয়ে আনি। চাবিটা এক সপ্তাহ আগে পেয়েছি। একটা লোক দিয়ে তোমার কাকিমা পরিষ্কার করিয়ে রেখেছে, দেখো তোমার পছন্দ হয় কিনা? ফ্লাটটা ভাড়া করা ফার্নিচার দিয়ে এখন সাজানো। তোমার পছন্দ মত পরে কিনে নিও।’’
শাশ্বত লজ্জা পেল অনুকূলবাবুর কথায়। ভদ্রলোক এত কিছু করেছেন তার জন্য।
‘‘আপনি এত কিছু করেছেন আমার জন্য, কি বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছিনা।’’
‘‘আরে তোমায় ধন্যবাদ দিতে হবে না। তুমি তো আমার ছেলের মত। তুমি সিঙ্গল ছেলে তোমার ফ্লাটটা অপছন্দ হবার কথা নয়, তবু একবার দেখে নেওয়া ভাল।’’
শুভ্রা কাকিমা রাত নটায় ডিনারের কথাটা মনে করিয়ে দিলেন। ফ্লাটটা শাশ্বতর পছন্দ হল তার থেকেও পছন্দ হল শুভ্রা কাকিমার সাজানোর কায়দা। অল্প জিনিষপত্র দিয়ে সুন্দরভাবে তিনি সাজিয়ে রেখেছেন প্রত্যেকটা জায়গা। ট্রেন জার্নি করে শরীরটা ক্লান্ত লাগছিল শাশ্বতর। অনুকূলবাবু বুঝতে পেরেই বোধহয় একটু পরেই বিদায় নিলেন, শুধু যাবার আগে মনে করিয়ে দিলেন রাত্রে ডিনারের কথা। ডিনারের সময়ে হাজির হয়ে শাশ্বত অবাক। শুভ্রা কাকিমা কি তাকে ভীম সেনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন? এত রকমের খাবার তার মাও তাকে কোনদিন একসঙ্গে খাওয়ায়নি। ভদ্রভাবে শাশ্বত কাকিমাকে জানালো যে অল্প আহারেই সে অভ্যস্থ।
সারা সপ্তাহ শাশ্বত ব্যস্ত থাকে তার অফিসের কাজে। শনিবার হলে অনুকূলবাবু শাশ্বতকে ডেকে নিয়ে আসেন তাঁদের ফ্লাটে ব্রেক্ফাস্ট্ করার জন্য। তারপর তিনজনে জমিয়ে গল্প শুরু করে দেয়। অনুকূল বাবু একাই একশ। তাঁর বলা একটার পর একটা মজার গল্প শুনতে ভালই লাগে শাশ্বতর। কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় শাশ্বত বুঝতে পারে না। অনুকূলবাবু দিলদরিয়া মানুষ। অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে আপন করে নিতে পারেন। শুভ্রা কাকিমা কম কথা বলেন, শুধু মুখ টিপে টিপে হাসেন অনুকূলবাবুর কথা শুনে। এর মধ্যে তিনি জেনে নিয়েছেন শাশ্বত কি পছন্দ করে আর কি ভালবাসে। সেইভাবেই তিনি শাশ্বতর যত্ন করেন। ছেলের মতই ভালবেসে ফেলেছেন তাঁরা শাশ্বতকে। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম বাইরে কোথাও থাকছে শাশ্বত। এক মুহূর্তের জন্যেও তাঁরা সেইকথা বুঝতে দেননি তাকে। মাঝে মধ্যে উইকেন্ডে ওনাদের নিয়ে শুভ্রা কাকিমার অনেক আপত্তি সত্ত্বেও শাশ্বত চায়নিজ্ অথবা ভাল মুগলাই খাওয়ার রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় জোর করে। ধীরে ধীরে কোলকাতাকে কে ভাল লাগতে শুরু করছে শাশ্বতর। শহরটার ভিতরে একটা কিছু আছে, অল্প সময়ের মধ্যে একজন অচেনা মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
এই ভাবেই দিন চলছিল শাশ্বতর। হঠাৎ এক শনিবারের ভোরবেলায় দরজায় বেলের আওয়াজ শুনে শাশ্বত একটু অবাক হয়ে গেল। সাধারণত অনুকূলবাবু আর একটু বেলায় আসেন শাশ্বতকে ডাকতে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য। দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল অনুকূলবাবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। শাশ্বত ভাবল নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়েছেন অনুকূলবাবু। শাশ্বতর মুখ দেখে অনুকূলবাবু বুঝতে পেরেই বলে উঠলেন ‘‘এত সকালে তোমায় ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত। তোমার একটু সাহায্য লাগবে। অবশ্য যদি তোমার অসুবিধে না হয়। আমার দুই মেয়ে আজ আসছে দিল্লী থেকে। তুমি তো জান যে আমার দুই মেয়ে দিল্লীর কলেজে পড়ে। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে, ছুটি কাটাতে আসছে। ওদের ট্রেনের আসার সময় হয়ে এসেছে। তুমি যদি একটু আমার সঙ্গে আসো তো ভাল হয়। আসলে বয়স হয়েছে তো তাই তোমার কাকিমাও চায় আমি তোমাকে নিয়ে যাই। আমি একা একা গাড়ি চালিয়ে ওদের নিয়ে আসব, ভরসা পাছে না। তুমি কি পারবে? আমারও একটা কোম্পানি হবে।’’
‘‘কি বলছেন আপনি? নিশ্চয়ই আসব। আমায় পাঁচ মিনিট খালি সময় দিন আমি রেডি হয়ে আপনার কাছে আসছি।"
গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলছিলেন অনুকূলবাবু ‘‘ওদের আসার কথা ছিল না এত তাড়াতাড়ি। ওদের এক বন্ধু থাকে মাদুরাইতে। সেখানে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে কয়েকদিন থেকে তারপর কোদাইকানাল বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। লাস্ট মিনিটে সেই বন্ধুটি যেতে পারবে না বলেছে। তাই সব প্ল্যান চেঞ্জ করে ওরা সোজা কোলকাতায় আসছে। বলতে গেলে ট্রেনে ওঠার ঠিক আগে আমাদের জানিয়েছে। আগে থেকে কিছু জানায়নি। এদিকে আমার দিদি থাকেন মধুপুরে, উনি খুব অসুস্থ। আমি আর তোমার কাকিমা এদিকে প্ল্যান করেছি দিদিকে দেখতে যাব মধুপুরে। খুব খারাপ দেখলে দিদিকে হয়ত নিয়ে আসব আমাদের সঙ্গে। ট্রেনের টিকিট কাটাও হয়ে গেছে। আগামীকাল রওনা দেওয়ার কথা। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে তোমাকে সব কথা বলারও সময় হয়নি। মুস্কিল হয়েছে যে আমাদের যেতেই হবে, অথচ দুটো মেয়েকে একলা রেখে যেতেও আমাদের মন চাইছে না। শুভ্রার দিদি অবশ্য বলেছে আমাদের এখানে এসে থাকবে কয়েকটা দিন। তাও মনটা মানতে চাইছে না। বাধ্য হয়ে তোমায় একটা রিকোয়েস্ট করতে চাই। তুমি তো এখনো দশটা দিন আছো এখানে, আর উল্টো দিকের ফ্লাটেই থাকো। একটু যদি ওদের দেখ এই কয়েকটা দিন তো আমি আর তোমার কাকিমা নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারি। তোমার কি অসুবিধে হবে?’’
‘‘কি বলছেন আপনি? আপনি কিছু ভাববেন না। আমি যতদিন আছি আপনার কোন চিন্তা নেই।’’
‘‘ধন্যবাদ, তুমি আমাকে বাঁচালে। আসলে আর একটা মুস্কিল আছে। তুমি জান কিনা জানিনা আমার বড় মেয়ে মাস্টার্স করতে ঢুকেছে আর ছোট মেয়ের এই সবে সেকেন্ড ইয়ার। আজকালকার মেয়েতো, তার ওপর খুব স্বাধীনচেতা। ওদের সামনে এসব কথা বলা যাবে না, তাই তোমাকে এখানেই বললাম। তুমি আবার ঘুণাক্ষরেও ওদের কাছে এসব কথা বলো না যেন। যদি কোনরকমে জানতে পারে যে আমি তোমাকে বলেছি ওদের দেখাশোনা করার জন্য তাহলে আর রক্ষে নেই।’’
‘‘আরে আপনি কোন চিন্তা করবেন না এই ব্যাপারে। আমি ঠিক সব ম্যানেজ করে নেব, ওরা জানতেও পারবে না। ’’
স্টেশনে ওরা একটু আগেই পৌঁছেছিল, অপেক্ষা করছিল ট্রেনের জন্য। ধিকোতে ধিকোতে দিল্লী থেকে আসা ট্রেনটা একসময়ে প্যাটফরমে এসে ঢুকল। বড় মেয়ের নাম যে তনুশ্রী সেটা শাশ্বত আগেই জেনেছিল কাকিমার কাছে, আজ প্রথম দেখা হবে। একটা চাপা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল শাশ্বতর ভিতরটা। এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে দরজার হাতল ধরে দাঁড়ান সানগ্লাস ও সালোয়ার কামিজ পরা ছিপছিপে একটি মেয়ের দিকে নজরটা গিয়ে পড়ল। ওদের দিকে হাতটা নাড়িয়ে ‘‘বাপি’’ ডাকটা শুনে শাশ্বতর মনে হল অনুমানে ভুল হয়নি। ছোট একটা সুটকেস হাতে নিয়ে নেমে মেয়েটি এগিয়ে এল তাদের দিকে। সুটকেসটা মেয়েটির হাত থেকে নিয়ে অনুকূলবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন শাশ্বতর সাথে। মৃদু হেসে হাতদুটো জড় করে নমস্কারের ভঙ্গি করে দুজনেই আবার নামিয়ে নিল। হাত দুটো শাশ্বত নামিয়ে নিল বটে কিন্তু চোখ দুটোকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিতে পারল না। ঠিক এই সময়ে আর একটি মেয়ে দৌড়ে এসে অনুকূলবাবুকে জড়িয়ে ধরল। অনুকূল বাবুও মেয়েটিকে আদর করতে লাগলেন মাথায় হাত বুলিয়ে। মেয়েটির হঠাৎ শাশ্বতর দিকে চোখ পড়ায় লজ্জা পেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল বাবার কাছ থেকে। তারপর শাশ্বতর দিকে ফিরে বলল ‘‘ মার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আমার নাম বন্যা।’’ হাতটা বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক্ করার জন্য। মেয়েটির সহজ সরল ব্যবহারে শাশ্বত একটু অবাক হয়ে গেল। মেয়েটির বয়স কম, বিত্তার বয়সী হবে মনে হল।
‘‘ব্যাপারটা কি হল? দিদির ব্যাগটা বাপি নিল, আর আমার ব্যাগটা আমি নিজে বইব নাকি?’’
‘একনম্বরের হিংসুটি।’’ তনুশ্রীর ভ্রুকুটি গিয়ে পড়ল বন্যার ওপর।
লজ্জা পেয়ে শাশ্বত তাড়াতাড়ি বন্যার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল।
অনুকূল বাবু আর তনুশ্রী এগিয়ে গেল। বন্যা আর শাশ্বত ওদের পিছন পিছন হাঁটতে লাগল। বন্যা কলকল করে অনেক কথা বলছিল শাশ্বতকে, কিন্তু শাশ্বতর কানে সব কথা যাচ্ছিল না।
পার্ককিং এর জায়গায় পৌঁছে ব্যাগগুলো ডিকিতে তুলে দিয়ে শাশ্বত সামনের সিটে অনুকূল বাবুর সঙ্গে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু বন্যা হঠাৎ তাকে সরিয়ে দিয়ে দরজাটা খুলে তার বাপির পাশে গিয়ে বসে পড়ল।
‘‘আপনি পিছনের সিটে দিদির সঙ্গে বসুন প্লিজ। আমি বাপির সঙ্গে গল্প করতে চাই।’’
শাশ্বতর একটু লজ্জা করছিল তনুশ্রীর পাশাপাশি বসতে। অনুকূলবাবু কি ভাববেন, তনুশ্রী কি ভাববে। ঘটনাটাকে লঘু করে দিল তনুশ্রী।
‘‘বনি তুই না আর বড় হবি না কোনদিন।’’
ব্যাপারটা সহজ করে দিল তনুশ্রী। নিজে আগে ঢুকে শাশ্বতকে আহ্বান জানাল ভিতরে আসার জন্য।
শাশ্বত তার শরীরটাকে গুটিয়েসুটিয়ে তনুশ্রীর গা বাঁচিয়ে কোন ঘেঁষে কোনক্রমে বসে পড়ল। এত কাছাকাছি অচেনা কোন সুন্দরী যুবতি মেয়ের পাশে সে এর আগে কোনদিন বসেনি। বসে পড়ার পরেই তার সারা শরীরে এল একটা শিহরণ, যেটাকে সে আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও চেপে রাখতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল তনুশ্রীর কাছে ধরা পড়ে যাবে।
অনুকূলবাবুর কিছুক্ষণ লাগল স্টেশন এর ট্র্যাফিক জ্যাম্ কাটিয়ে অবশেষে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তায় পড়তে। শাশ্বত লক্ষ করল সবাই চুপচাপ। অনুকূলবাবুর মনঃসংযোগ যাতে নষ্ট না হয় তার প্রচেষ্টা বলেই মনে হল শাশ্বতর। নিস্তদ্ধটা ভাঙ্গল বন্যাই।
‘‘জানো বাপি দিল্লীর গরম না কোলকাতার থেকেও খারাপ।’’
‘‘না মোটেও নয়, কোলকাতার গরমটা কি করম যেন ভ্যাপসা গরম, দিল্লীর গরমটা তাও সহ্য করা যায়।’’ তনুশ্রী প্রতিবাদ করে উঠল।
‘‘দিদি তোর কাছে দিল্লীর সব কিছু ভাল, আর কোলকাতার সব কিছু খারাপ।’’
‘‘হাঁ ভালই তো, কোলকাতা কি রকম গরম আর নোংরা, দিল্লী অনেক পরিষ্কার। কলকাতায় কি মশা, দিল্লীতে মশা নেই বললেই চলে।’’
‘‘কোলকাতা এখন আর অত নোংরা নয়, মশাও অনেক কমে গেছে। কোলকাতায় এখনো মেয়েরা রাত্রে একা বেরোতে ভয় পায় না। তুই খুব ভাল করে জানিস দিল্লী এই ব্যাপারে কোলকাতার থেকে কতটা খারাপ। বাপি আমি ঠিক বলেছি কিনা?’’
‘‘ঠিক আছে বাড়িতে গিয়ে ওসব কথা হবেখন। এখন আমাকে গাড়ি চালাতে দাও।’’ অনুকূলবাবু দুই মেয়েকে জোর করে থামিয়ে দিলেন।
দুই বোনের ঝগড়া আর কোলকাতা সম্বন্ধে বিপরীত মতামত উপভোগ করছিল শাশ্বত। বেশ মজা লাগছিল, ফলে তার বুকের ধড়ফড়ানিটার কথাও ভুলে গিয়েছিল।
বাড়িতে পৌঁছে সময় দেওয়ার জন্য, ওদের বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল শাশ্বত বিশ্রাম নেওয়ার অজুহাতে। শুভ্রা কাকিমা অবশ্যই বারবার মনে করিয়ে দিলেন রাত্রে ডিনারের কথাটা।
ডাকতে এসেছিল বন্যা।
‘‘কি ব্যাপার আমাদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন নাকি? মা এদিকে আপনার জন্য জলখাবার করে বসে আছে। গরম গরম মায়ের হাতের ফুলকপির সিঙ্গাড়া, অনেকদিন খাইনি। শিগ্গির আসুন, নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে যে।’’ বলতে গেলে জোর করে ধরে নিয়ে এল শাশ্বতকে।
সন্ধ্যেবেলা থেকেই মজলিশ্ বসল। গল্প শুরু হলে কোন খেই থাকেনা, চলতে থাকে নদীর স্রোতের মত। শুরু হয়েছিল আবার দিল্লী কোলকাতা আর মুম্বাই নিয়ে আলোচনা দিয়ে। তনুশ্রী আর বন্যার ভিন্ন অথচ যুক্তিপূর্ণ মতামত কোলকাতা সম্বন্ধে আর একবার উপভোগ করার সুযোগ পেল শাশ্বত। ডিনারের পর শুরু হল লুডো খেলা, জোড়ায় জোড়ায়। শাশ্বত, তনুশ্রী একপক্ষে বন্যা আর অনুকুলবাবু অন্যপক্ষে। জোড়টা ঠিক করেছিল বন্যা। শুভ্রা কাকিমা বন্যা আর অনুকূলবাবুকে সাহায্য করছিলেন। শাশ্বতর ভালই লাগছিল। ঘুঁটি সরানোর সময় আচমকা তনুশ্রীর আঙ্গুলের স্পর্শ, চুড়ির রিনঝিন আওয়াজ, তনুশ্রীর উপদেশ শোনার সময় চোখাচোখি সবই উপভোগ করছিল সে। রাত তখন গভীর হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। শুভ্রা কাকিমা তাড়াতাড়ি উঠে সব ঘরের জানলা বন্ধ করতে শুরু করলেন। অনুকূলবাবু আর দুই বোনও উঠে দাঁড়াল সাহায্য করার জন্য।
শাশ্বত নিজের ঘরের জানালা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াল, পা বাড়ল বিদায় জানিয়ে।
বন্যা হঠাৎ বলে উঠল ‘বাপি আজকে আইডিয়াল দিন। তুমি খালি এড়িয়ে যাও, বলো ভুতের গল্পের জন্য এট্মোস্ফিয়ার দরকার। আজকের থেকে ভালো এট্মোস্ফিয়ার আর হবে না। আজ তোমায় কিন্তু ভূতের গল্প বলতেই হবে।’’
শাশ্বত অবাক হল যখন তনুশ্রী তার সুরেলা গলায় তাকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘‘আপনি কখনো বাপির কাছে ভুতের গল্প শুনেছেন? বাপি ভীষণ ভাল ভুতের গল্প বলে। ভীষণ ভয়ের। জানলাগুলো বন্ধ করে চলে আসুন না। অবশ্য যদি আপনার অসুবিধে বা আপত্তি না থাকে।’’
শাশ্বত মনে মনে বলল - অসুবিধে? কি বলছো কি? অসুবিধে হবে কেন? তুমি বললে আমি হিমালয় পাহাড়ের মাথার ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে পারি। তুমি বললে আমি আসব না, তাও কি হয়?
‘‘এতো খুব ভালো কথা। আমি এখুনি আসছি, আমারও ভুতের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে।’’ শাশ্বত চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
অনুকূলবাবু ভুতের গল্প শুরু করার আগে তনুশ্রী ঘরের আলোগুলো নিভিয়ে দিয়ে কয়েকটা মোমবাতি জালিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুকূলবাবু সবাইকে জমিয়ে দিলেন তাঁর গল্প বলার কায়দায়। ঘরের ভিতরে আবছা অন্ধকার, বাইরে প্রবল জোরে ঝড়, বৃষ্টির আওয়াজ তার সাথে বিদ্যুৎ এর চমক সব মিলিয়ে একটা গা ছম্ ছম্ করা ভৌতিক পরিবেশ। আবছা অন্ধকারে তনুশ্রীকে যেন আরো সুন্দরী দেখাছে। অনেক রাত্রে আড্ডা ভাঙ্গার পর যখন ঘরে ফিরেছিল তখন বিছানায় শুতে গিয়ে তনুশ্রীর মুখটাই বার বার ভেসে উঠছিল। এরই নাম নিশ্চয়ই প্রেম। ছোট বোন বিত্তার সাবধান বাণীর কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় হাসি পেল শাশ্বতর।
অনুকুলবাবুরা চলে গেলেন মধুপুর পরের দিন। দুই বোন গেল ওনাদের স্টেশনে পৌঁছে দিতে। অফিসে কাজ থাকায় শাশ্বত যেতে পারেনি। শাশ্বত ভেবেছিল অনুকুলবাবু না ফেরা অবধি ওনাদের ওখানে আর যাবে না। মাঝে মাঝে খবর নেবে। স্বাধীনচেতা দুটি মেয়ের জন্য ওপর পড়া হয়ে কিছু করাটা তার ঠিক বলে মনে হল না। যদি দরকার পড়ে ওরা নিজেরাই এসে খবর দেবে। অনুকুলবাবু তাই বলেও গেছেন ওদের। অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে বসে ডাকে আসা চিঠিগুলো নিয়ে দেখছিল শাশ্বত। প্রথমেই চোখে পড়ল তার বোনের লেখা চিঠিটা। না পড়েও বলতে পারে কি লেখা আছে চিঠিটায়। আর নয় দিন মাত্র বাকি বাড়ি যাওয়ার। এবার প্লেনেই যাবে, সময়টা বাঁচবে। বোনের চিঠিটাই আগে খুলে পড়তে শুরু করল। যা ভেবেছিল তাই। বাড়ি আসার আগে কোলকাতা থেকে কি কি জিনিষ আনতে হবে তার একটা বড় ফর্দ। বেল বাজার আওয়াজে একটু অবাক হয়ে গেল। এ সময়ে আবার কে বেল বাজাল? দরজা খুলে দেখল বন্যা দাঁড়িয়ে আছে।
‘‘কি ব্যাপার? অফিস থেকে এসে একবারও আমাদের খোঁজ করলেন না? বেঁচে আছি না মরে গেছি একবারের জন্যেও দেখতে এলেন না? আপনি তো আচ্ছা লোক, বাপি আপনাকে আমাদের দেখাশোনার ভার দিয়ে গেল আর আপনি কিছুই করছেন না? আপনার রিপোর্ট কার্ড খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু। পাশ মার্কটাও পাচ্ছেন না। যাই হোক মাসিমণি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। চা আর টা বানিয়ে বসে আছে। আপনি না এলে কাউকে খেতে দেবে না। তাছাড়া আরো একজনও বসে আছে আপনার পথ চেয়ে।’’
বন্যার ঠোঁটের কোনায় অদ্ভুত একটা হাসি লক্ষ্য করল শাশ্বত। মেয়েটার বয়স কম কিন্তু গুছিয়ে কথা বলতে পারে, অনেকটা বিত্তার মত। অনুকুলবাবু বলেছিলেন মেয়েদের কিছু না বলতে, তাহলে বন্যা এসব জানল কি করে? কি বলবে কি করবে ভাবছিল, বন্যা শাশ্বতর হাত ধরে প্রায় জোর করে নিয়ে এলো ওদের ফ্লাটে। মাসির সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল শাশ্বতর। খুব হাসিখুসি মহিলা। মজার মজার কথা বলেন ভদ্রমহিলা। অল্প সময়ের মধ্যে শাশ্বতর সঙ্গে এমন ভাব জমিয়ে ফেললেন, যেন কতদিনের চেনা। শাশ্বত ঠিক করেছিল অনুকূলবাবুরা না ফেরা পর্যন্ত
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা অফিস থেকে ফেরার পথে কোথাও সেরে নেবে। মাসি কোন কথা শুনতে চাইলেন না। তনুশ্রীকে আজ কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। খুব একটা কথা বলছিল না। ডিনারের পর ফিরে এল শাশ্বত একটা বাহানা করে।
কয়েকটা দিন এইভাবেই কেটে গেল। বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে এল, আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। অথচ কেনাকাটা কিছুই হয়নি। মাসি সেকথা জানতে পেরে দুই বোনকেই ধমক দিলেন ‘তোরা কিরে? ও ছেলে ও কি করে করবে, তোরা ওকে দোকানে নিয়ে গিয়ে কিনে দেনা।’’
ঠিক হল পরের দিন অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে, দুই বোনকে নিয়ে শাশ্বত ঘুরবে দোকানে দোকানে বোনের দেওয়া লিস্ট দেখে সব কিছু কেনাকাটা করার জন্য। কেনাকাটা করতে কখনই ভাল লাগে না শাশ্বতর, কিন্তু বোনের জিনিষ না নিয়ে গেলেও বিপদ। তাছাড়া এই সুযোগে তনুশ্রীর সঙ্গ পাওয়া যাবে সেটাও মন্দ নয়। ঠিক হয়েছিল শাশ্বত অফিস থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে মিট করে, কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর কেনাকাটা করতে যাবে। রেস্টুরেন্টের নাম আর সময়টা ঠিক করেছিল তনুশ্রী। সময়মত পোঁছেছিল শাশ্বত। একটু অপেক্ষা করার পরেই দুই বোন নামল গাড়ি থেকে। তিনজনে মিলে ভিতরে ঢুকে জায়গা নিয়ে বসার পরেই উদয় হয়েছিল সলিলের। আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তনুশ্রী। সফট্ওয়ার কোম্পানিতে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। কয়েকবার আমেরিকা ঘোরা হয়ে গেছে। কোন ভণিতা না করে সলিল সোজা গিয়ে বসে পড়ল তনুশ্রীর পাশের চেয়ারটায়। শাশ্বতর বুঝতে অসুবিধে হল না যে তনুশ্রী পুরো ব্যাপারটা প্ল্যান করেই করেছে। বয়সে হয়ত শাশ্বতর থেকে এক আধবছরের বছরের বড়ই হবে, কিন্তু সলিলের মুখের মধ্যে এখনো একটা ছেলেমানুষি ভাব লেগে আছে। চেহারাটা চোখে পড়ার মত। লম্বা সুদর্শন সলিলের পাশে নিজেকে কেমন যেন খেলো মনে হল শাশ্বতর। তনুশ্রীর মনে যদি এই ছিল তো পরিষ্কার বলে দিলো না কেন। এইভাবে অপদস্থ করার কি দরকার ছিল। মজার মজার জোক বলছিল সলিল, একটার পর একটা। আর তনুশ্রী হেসে কুটিপাটি হচ্ছিল। সলিলের গায়ে ঢলে পড়ছিল। যতসব বস্তাপচা জোক। ওর থেকে অনেক ভাল জোক শাশ্বত বলতে পারে। কিন্তু শুনছে কে? শাশ্বতর মনে হচ্ছিল ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে যেন তনুশ্রী আরো জোরে জোরে হাসছিল।
একদিকে খুশী হল ওরা যখন উঠে চলে গেল। বিলটা পর্যন্ত দিতে দিল না শাশ্বতকে। এমনভাবে হেরে যাবে ভাবতে পারেনি। মেয়েদের চরিত্র ভগবানেরও অসাধ্য জানত, আজ তার প্রমাণ পেল। জীবনে এই প্রথম কাউকে ভালো লেগেছিল, আর তাতেই ধাক্কা। অবশ্য সবটা দোষ তনুশ্রীকে দেওয়া যায় না। বলতে গেলে আলাপ হয়েছে তনুশ্রীর সঙ্গে এই মাত্র কয়েকটা দিন। এর মধ্যে ভাব ভালোবাসা হবার সময় পেল কোথায়। শাশ্বত তো কখন মুখ ফুটে বলেনি তনুশ্রীকে যে সে ওকে ভালোবাসে। সবটাই তো শাশ্বতর নিজের কল্পনা। সমস্ত ব্যাপারটাই একতরফা। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দোষ দিতে পারল না শাশ্বত। চুপ করে বসে সব কিছু হজম করা ছাড়া আর কি করার থাকতে পারে?
‘‘দিদিকে আপনার খুব ভালো লাগে তাই না?’’
হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে সচকিত হয়ে শাশ্বত ঘাড়টা ঘোরাল। নিজের চিন্তায় এত মগ্ন ছিল যে বন্যার কথা একদম ভুলেই গিয়েছিল। বন্যা যে এখনো টেবিলের বাঁ দিকের চেয়ারে বসে আছে সে কথা মনেই ছিল না তার। লজ্জা পেল বন্যার মত একটা বাচ্চা মেয়ের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়ায়।
‘‘না মানে তা ঠিক নয়, তবে.......’’
‘‘না আবার কি? আমি সব জানি, আমি সব লক্ষ্য করেছি। মেয়েরা অনেক কিছু দেখতে পায় যা ছেলেদের চোখে পড়ে না। আসলে ছেলেরা ভীষণ বোকা। আপনারা অনেক কিছু বুঝতে পারেন না মেয়েদের ব্যাপারে।’’
এতটুকু মেয়ে কিরকম পাকা পাকা কথা বলে, ঠিক বিত্তার মত। শাশ্বত কোন উত্তর দিল না।
‘‘যাই হোক আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি। আমার থেকে ভালো দিদিকে আর কেউ চেনেনা, বা জানেনা।
আপনি যদি দিদিকে পেতে চান তাহলে আমি যা যা বলব আপনাকে শুনতে হবে। অর্থাৎ আপনাকে আমার কাছে ট্রেনিং নিতে হবে। বলুন রাজী আছেন? আপনি যখন কিছু বলছেন না তার মানে আপনি রাজী। আমার এই ট্রেনিংটা হবে ধাপে ধাপে। আর প্রত্যেক ধাপে আমি আপনার পরীক্ষা নেব। যদি প্রত্যেকটা পরীক্ষায় আপনি পাশ করেন তবেই আমি বুঝতে পারব যে ট্রেনিং শেষ হয়েছে। ঠিক আছে?’’ বন্যা উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল শাশ্বতর দিকে।
বন্যার কথাশুনে এত দুঃখের মধ্যেও হাসি পাচ্ছিল শাশ্বতর। মনটা এখন একটু হাল্কা লাগছে। বেয়ারাকে আরো দুকাপ চা আনতে বলে দিল।
‘‘ধর রাজী। তাহলে কি করতে হবে এখন আমাকে?’’ শাশ্বত প্রশ্নটা করল একটু মজা করার জন্য।
বন্যা গম্ভীরস্বরে বলল ‘‘আমি বললাম না যে আমার দিদিকে আমি খুব ভালো করে চিনি। ছেলেরা হ্যাংলামি করে ওকে দেখলে, সেটা ও ভালো করেই জানে। না আমি বলছি না যে আপনি হ্যাংলামি করেছেন। ওটা হল বাত কি বাত। আপনি তো মেয়েদের ব্যাপারে কিছুই জানেননা তাই প্রথম থেকেই শুরু করছি। দিদি খুব ভালো করে জানে যে ওকে আপনার পছন্দ হয়েছে। ও শুধু আপনাকে খেলাচ্ছে। এবারে ধরা যাক সলিলদার কথা। আপনার আর সলিলদার মধ্যে যদি তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে আপনারা দুজনেই কাছাকাছি। কেউ একটা ব্যাপারে একটু বেশী আবার কেউ একটা ব্যাপারে একটু কম। ওই যাকে বলে উনিশ আর বিশ। দিদিও সেটা জানে ভালো করে। আমি জানি দিদি সলিলদাকে কোন রকম পাকাপাকি কথা দেয়নি। অতএব খুব একটা দেরি হয়নি আপনার। একটাই কাজ শুধু এখন করতে হবে আপনাকে আর সেটা হল দিদির মনে ঈর্ষা জাগাতে হবে।’’
‘‘ঈর্ষা জাগাতে হবে? তার মানে?’’ শাশ্বত প্রশ্ন করল বুঝতে না পেরে।
‘‘বুঝতে পারলেন না তো? জানতাম আপনি বুঝতে পারবেন না। না আপনাকে নিয়ে সত্যি পারা যায় না। যে কোন মেয়েকে একবার বললেই বুঝতে পারত। আপনাকে অন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়তে হবে। এই ধরুন দিদি যদি দেখে যে আপনি অন্য কোন একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছেন, তাহলে দিদি ভাববে যে ও হেরে গেল ওই মেয়েটির কাছে। তখন দেখবেন দিদি মরিয়া হয়ে আপনার কাছে ছুটে আসবে। আমি বাজি রাখতে পারি আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে। মেয়েরা কখন আর একটা মেয়ের কাছে হার মানতে চায় না।’’
শাশ্বত বেশ উপভোগ করছিল বন্যার কথাগুলো। ভিতরে ভিতরে মজা লাগছিল।
‘‘ঠিক আছে তোমার কথা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমি এই রকম একটি মেয়ে এখন পাব কোথায়?’’ শাশ্বত একটু হেসে উত্তর দিল।
‘‘কেন? আমি তো আছি।’’ এতটুকু ইতস্তত না করে উত্তর দিল বন্যা।
‘‘ধ্যুত্ তুমি তো বাচ্চা মেয়ে।’’
‘‘আপনি আমায় বাচ্চা মেয়ে বলছেন।? আপনি জানেন আমার বয়স কত? আমি দিদির থেকে ঠিক তিন বছরের ছোট। আমি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার বয়স কুড়ি। কুড়ি বছরের মেয়েকে আর যাই বলুন বাচ্চা বলবেন না প্লিজ। স্কার্ট ব্লাউজ আর প্যান্টের সঙ্গে ছোট কামিজ পরে থাকি বলে বয়সটা কম লাগে। হাঁ একটা কথা আমি কিন্তু আপনাকে প্রথমেই বলে রাখছি যে আমি শুধু আপনাকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য এই অ্যাক্টিং করব আপনার সঙ্গে। আপনি আবার অন্য কিছু ভেবে বসবেন না যেন। কি রাজী?’’
শাশ্বত দেখল বন্যার মুখ সিরিয়াস। আরো মজা পেল শাশ্বত। কিন্তু মনের ভাব গোপন রেখে বলল ‘‘অন্য কোন মেয়ে হলে আলাদা কথা, কিন্তু তোমার দিদি যদি দেখে যে তার নিজের বোন আমার সঙ্গে প্রেম করছে তখন অন্য কিছু ভাববে না?’’
‘‘না মশাই একেবারে নয়। বরঞ্চ উল্টোটা হবে। অন্য মেয়ে হলে অতটা ঈর্ষা হবেনা যতটা আমায় দেখলে হবে। আমাদের মধ্যে সিব্লিং রাইভ্যাল্রি আছে না, সেই ছোটবেলা থেকে। আপনার কাজ আপনি করুন আমার কাজ আমি করব, আপনাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমার হাতে সব কিছু ছেড়ে দিন তো। যে দিন সলিলদার কাছ থেকে দিদিকে সরিয়ে এনে আপনার হাতে তুলে দোব সেইদিন আমার ছুটি। আপনার বম্বে যাওয়ার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, সব কিছু তাড়াতাড়ি করতে হবে। উঠুন চা খাওয়া হয়ে গেছে, বেয়ারাটা ঘোরাঘুরি করছে অনেকক্ষণ ধরে। এবার কান ধরে বের করে দেবে আমাদের। বসে থাকলেই হবে মশাই? শপিং করতে হবেনা?’’ বন্যা উঠে দাঁড়াল প্রস্তুত হয়ে।
ট্যাক্সি করে ঘুরে বেড়ালো দুজনে এ দোকান থেকে সে দোকানে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা এসে পোঁছাল গড়িয়াহাটায়। বাড়ির চেনা একটা শাড়ীর দোকানে ঢুকে অদ্ভুত একটা কান্ড করে বসল বন্যা। শাশ্বতর বোনের ফরমায়স্ করা ফর্দটা হাতে নিয়ে সেলস্ম্যান্কে বলল কয়েক ধরনের শাড়ী দেখাতে। সেলস্ম্যান্ শাড়ীগুলো রাখার পর, একটা শাড়ী তুলে নিয়ে নিজের গায়ে জড়াল।
‘‘দেখুন তো এই শাড়ীটায় আমায় কেমন দেকাচ্ছে? আপনার বোনেরও দেখছি আমার মত নীল রং পছন্দ। ’’
‘‘ভালই তো লাগছে।’’ আর কি বলবে ভেবে পেল না শাশ্বত।
বন্যা শাশ্বতর একটু কাছে সরে এসে নিচু গলায় বলল ‘‘আহা ওরকম করে বললে কি করে হবে। ভালো করে দেখে বলুন। কারণ এই শাড়ীটা আমার পছন্দ হয়েছে। এটা আপনি আমাকে কিনে দেবেন, বুঝলেন? মেয়েদের মাঝে মধ্যে জিনিষ কিনে দিতে হয়। সব সময়ে যে দামী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। মেয়েরা এতে খুশী হয়। এটা হল আপনার প্রথম শিক্ষা। বাকি শিক্ষাগুলো আমি নিজেই পরীক্ষা করে নেব, আপনি জানতেও পারবেন না। যখন পাশ করবেন তখন অবশ্য বলতে বাধ্য হব। যাই হোক শাড়ীটা কিন্তু আবার আজকেই কিনবেন না। আমি সেলস্ম্যান্কে বলে রাখছি, ও আমাদের চেনা, আমার জন্য রেখে দেবে। যখন আমরা আবার আসব কেনাকাটা করার জন্য তখন কিনলেই হবে। প্রথম দিনেই গিফট নেওয়াটা ভালো দেখায় না। বাড়িতে এসে আবার দেবেন না যেন। তাছাড়া আমার মতও আমি পালটাতে পারি। এটাও মেয়েদের আর একটা স্বভাব, একথাটাও খুব ভালো করে জেনে রাখুন মশাই। ’’
‘‘কিন্তু তোমায় শাড়ি দেওয়াটা কি ঠিক হবে? তোমার মাসি আর দিদি কি ভাববে?’’
‘‘মাসির কথা ছেড়ে দিন। আমি সব বুঝিয়ে বলব মাসিকে। আর সবাইকার সামনে আপনাকে দিতে হবে কে বলেছে? আপনি আমায় দেবেন যখন আমি বলব, আর আমি সেটা বাড়িতে এমনকরে বলব যাতে দিদির কানে কথাটা ওঠে। ’’
‘‘কিন্তু তোমার দিদি যদি কিছু মনে করে?’’
‘‘মনে করবে বলেই তো আমি বলব। আমি জানি দিদির এই শাড়িটা পছন্দ হবে। আপনি দিয়েছেন শুনলে ওর আরো হিংসে হবে। আর হিংসে হোক এটাই তো চাই আমরা তাই না?’’
‘‘কি জানি বাবা, আমার মাথায় কিছু আসছে না। তুমি যা ভালো বোঝ কর। খালি দেখো তোমার বাবা মা আমার ওপর যেন অসন্তুষ্ট না হন।’’
‘‘কোন ব্যাপারই না। আপনি সব কিছুতে অত ভয় পান কেন বলুন তো? চিন্তা করবেন না, আমি সব ঠিক ম্যানেজ করব।’’
বন্যার কথায় জানা গেল যে শপিং করতে আরো কয়েকদিন লাগবে। বন্যাই ঠিক করে দিল কবে কখন কোথায় দেখা করে ওরা শপিং করবে।
‘‘জানেন আমার ভীষণ ভালো লাগছে আপনার বোনের লিস্ট দেখে দেখে শপিং করতে। বাড়িতে আমায় কেউ শপিং করতে দেয়না। আমায় সবাই বেবি করে রাখে। দিদি আর মাই সব করে। আপনাকে একটা কথা কিন্তু বলা হয়নি, আপনি যদি দেখেন শাড়ি আর কামিজগুলো দেখার পর আপনার বোনের পছন্দ হয়নি তাহলে বলবেন যে ওগুলো আপনি কিনেছেন। আর যদি দেখেন পছন্দ হয়েছে তাহলে বলবেন আমি ওগুলো ওর জন্যে পছন্দ করে কিনেছি। মনে থাকবে তো?
বন্যার সহজ সরল ব্যবহার শাশ্বতর ভালো লাগছিল। একদিন এক মজার ঘটনা ঘটল। বন্যা যথারীতি শাড়ি দেখায় ব্যস্ত সেলস্ম্যানের সাথে। হঠাৎ এক সুন্দরী তরুণীর আবির্ভাব হল দোকানে। হালফ্যাসানের জামাকাপড় পরা মেয়েটি দোকানে প্রবেশ করার সাথে সাথে সেলেস্ম্যান থেকে শুরু করে খরিদদার সবাইকার চোখ গিয়ে পড়ল ওই মেয়েটির ওপর। শাশ্বতর চোখদুটোও আটকে গিয়েছিল মেয়েটির ওপর কিছুক্ষণের জন্য। ব্যাপারটা যে এতটা গুরুতর হবে ভাবেনি শাশ্বত। দোকান থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল দুজনে।
‘‘অমন হ্যাঁংলার মত মেয়েটাকে দেখছিলেন কেন? সুন্দর দেখতে বলে?’’
প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে পালটা উত্তর দিয়েছিল শাশ্বত ‘‘যাই বল মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী তাই না?’’
‘‘একটা কথা এখনই আপনার জেনে রাখা খুব দরকার। একটি মেয়ের সামনে কখন অন্য আর একটি মেয়ের প্রশংসা ভুলেও করবেন না। তাহলে আপনি সাথে সাথে ফেল। আর কোন পরীক্ষা আপনার আর দেওয়ার দরকার নেই। আপনাকে ট্রেনিং দিচ্ছি বলে আপনার সাতখুন মাপ। দিদির সঙ্গে যদি করেন তো আপনি মারা পড়বেন বলে রাখলাম। এই কথাটা খুব ভাল করে জেনে রাখুন বুঝলেন?’’
বন্যার কথামত আরো কয়েকটা দিন ওদের বেরতে হল বাজার করার জন্য। মাাসিকে শাশ্বত বলেছিল এই কয়েকটা দিন ওরা বাজার করে বাইরে খেয়ে নেবে। তাই কেনা কাটির পর বন্যাকে বিদায় জানিয়ে শাশ্বত সোজা চলে যেত তার নিজের ফ্লাটে। মাসি আর তনুশ্রীর সঙ্গে দেখা হচ্ছিল না বটে কিন্তু বন্যার কাছ থেকে রানিং কমেন্টারি পেয়ে যাচ্ছিল ঠিকমত। বন্যা একদিন জানাল যে সে বাড়িতে দেখিয়েছে শাশ্বতর দেওয়া শাড়িটা। মাসি কিছু বলেনি, কিন্তু তনুশ্রীর নাকি মুখটা ভার হয়ে গিয়েছিল শোনার পর থেকে।
‘‘জানেন দিদি আমায় বলল তুই কতটুকু চিনিস শাশ্বতকে? একটা অচেনা লোক তোকে শাড়ি কিনে দিল আর তুই অমনি শাড়িটা নিয়ে নিলি? তুই কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি করছিস্। তোর বয়স কম, ভেবে চিনতে কাজ করবি। রোজ রোজ ওর সঙ্গে বেরোচ্ছিস এটা ভালো দেখায় না। আমার কথা যদি না শুনিস্ তাহলে বাপিকে বলতে বাধ্য হব। আসলে হিংসে হচ্ছে বুঝলেন না। জ্বলে পুড়ে মরছে দিদি। ভাবছে কি ভুলটাই করেছে, কিন্তু মুখফুটে বলতে পারছে না। আমিও সমানে ঝগড়া করেছি, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে দেইনি যে আমি সব কিছু করছি শুধু ওর জন্যে। দেখা যাক না কতদূর যায়।’’
সেদিন ফিরতে একটু দেরী হল। দেরীটা হল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে। কেনাকাটার শেষ দিন, টুকিটাকি কয়েকটা কেনার ছিল, শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল দুজনে একটা দোকানের গাড়ি বারান্দার নিচে। কিন্তু বৃষ্টি থামল না। দেখতে দেখতে জল জমতে শুরু করল। আরো জল দাঁড়ানোর আগে যাতে বাড়ি পৌঁছুতে পারে তার জন্য ট্যাক্সির খোঁজ করল শাশ্বত, কিন্তু পেল না।
‘‘চলুন আমরা এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হেঁটে যতটা পারি চলে যাই। এখান থেকে আমাদের বাড়ি আমরা হেঁটেই চলে যেতে পারব। বেশি দেরী করলে আরো জল দাঁড়িয়ে যাবে।’’ বন্যা শাশ্বতকে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। বৃষ্টির ছাঁট আর ঠান্ডা হাওয়ার ভিতর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল শাশ্বতর। বন্যা যে আরো বেশি কষ্ট পাছে এটা ভেবে আরো খারাপ লাগছিল। কিছুদূর হাঁটার পর শাশ্বতর মনে হল বন্যার শরীর খারাপ লাগছে কিন্তু মুখ ফুটে বলছে না। শেষের কিছুটা পথ আর চলতে পারছিল না বন্যা। শাশ্বতর বাড়ানো হাত আর কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে লাগল বন্যা। জ্বরে গাটা পুড়ে যাছে বন্যার, কিন্তু মুখে তখনও লেগে আছে হাসি। বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছাল রাত তখন অনেক। লিফট থেকে বেরিয়ে শাশ্বতকে ধরে ধরে দরজার কাছে পৌঁছে বেল বাজাল বন্যা।
দরজা খুলে দিল তনুশ্রী, থমথমে মুখ ‘‘একি চেহারা করেছিস বনি? দেখি দেখি।’’ কপালে হাত দিল বন্যার।
‘‘জ্বরে গা পুড়ে যাছে। শিগ্গির ভেতর যা। মাসি ওকে ভেতরে নিয়ে যাও।’’
মাসি একবার শাশ্বতর দিকে আর একবার তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বন্যাকে তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে গেলেন একটাও কথা না বলে।
‘‘আই এম সরি। আমাদের একটু দেরী হয়ে গেল। দোষটা ঠিক আমার নয় .......যদি কোন রকম সাহায্য ....’’ শাশ্বতর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না।
‘‘কি রকম লোক আপনি? বাপির কাছে শুনেছিলাম আপনি ভদ্রলোক, এই তার নমুনা? একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে আপনি ..... ছিঃ ছিঃ আপনার লজ্জা করছে না? আপনি প্লিজ এখন আসুন, আর কোন কথা শুনতে চাইনা আপনার।’’
‘‘আমি কি কিছু করতে পারি?’’
‘‘না আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। শুধু দয়া করে বন্যার পিছনে আর লাগবেন না। অন্তত এইটুকু করলে আমরা খুশী হব।’’
শাশ্বতর জবাবের অপেক্ষা না করে তনুশ্রী দরজাটা বন্ধ করে দিল শাশ্বতর মুখের ওপর।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল শাশ্বত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। অপমানে মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে তার বুঝতে পারছে শাশ্বত, কিন্তু কি করবে ভেবে পেল না। লজ্জায় ঘেন্নায় মাথাটা হেঁট হয়ে গেছে তার। তনুশ্রী যে এইভাবে হুল ফুটিয়ে কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি। মাথাটা ঝাঁঝাঁ করছে। ধীরে ধীরে পা বাড়াল তার ফ্লাটের দিকে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়ল শাশ্বত। উল্টোদিকের ফ্লাটের দিকে চোখটা চলে গেল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বন্যা কেমন আছে? বেলটা বাজিয়ে খোঁজ করবে কিনা একবার চিন্তা করল। তনুশ্রীর মুখটা মনে পড়ে গেল। কান দুটো লাল হয়ে উঠল। না নিচে নেমে খোলা বাতাস নেওয়ার ভীষণ দরকার। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এল। বিকেলের ফ্লাইটে বম্বে যাওয়ার কথা। কত খুশী মনে যাবে ভেবেছিল, তার বদলে চোরের মত চলে যেতে হবে। বন্যা কেমন আছে জানা খুব দরকার। আর একবার চেষ্টা করবে? কি করবে তনুশ্রী? অপমান করবে? করুক তাও যাবে শাশ্বত। মনস্থির করে উল্টোদিকের দরজার বেলটা বাজাল।
দরজা খুলে দিল তনুশ্রী, সেই থমথমে মুখ।
‘‘বন্যা কেমন আছে? ভালো আছে তো?’’
‘‘এখন অনেকটা ভালো আছে। আপনার আর কিছু জানার আছে?’’
‘‘আমি আজকের ফ্লাইটে বম্বে যাচ্ছি, তাই তোমাদের বিদায় জানাতে এসেছিলাম। বন্যার সঙ্গে কি একবার দেখা হবে?’’
‘‘আপনার যাত্রা শুভ হোক। বন্যা এখন শুয়ে আছে, এখন দেখা হবে না। আমাকে এখন একটু বেরুতে হবে, আপনার যদি আর কোন প্রশ্ন না থাকে তো তাহলে ......’’
শাশ্বতর মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরল না। মাথাটা হেঁট করে ফিরে এল নিজের ফ্লাটে। টিভি খুলে দেখার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ, মন বসল না। সুটকেসটা গুছতে হবে। ওত জিনিষ কিনেছে, কি করে ওই সুটকেসের মধ্যে ঢোকাবে শাশ্বতর মাথায় এল না। শাশ্বত বলেছিল বন্যাকে এত জিনিষ কিনো না, আমার একটা সুটকেসে এত কিছু ধরবে না। বন্যা বলেছিল ‘‘আমি এসে সব গুছিয়ে দোব। আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না।’’
কি হবে এখন? যতটা ধরাতে পারবে তাই নিয়ে যাবে আর কি করা যাবে? তন্ময় হয়ে এইসব কথায় ভাবছিল। হঠাৎ বেল বাজার আওয়াজে তার চিন্তায় বাধা পড়ল। এই সময় আবার কে এল। নিশ্চয়ই চাঁদা নিতে এসেছে কেউ। বিরক্ত মুখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল শাশ্বত। বন্যা দাঁড়িয়ে আছে, একগাল হাসি নিয়ে।
‘‘কি ভেতরে ঢুকতে দেবেন? না বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন? যাক আপনার শেষ পরীক্ষায় আপনি কিন্তু ভালোভাবে পাশ করে গেছেন। ’’
মেয়েটা পাগল নাকি?
‘‘শেষ পরীক্ষা? আগে বল তুমি কেমন আছ?’’
‘‘ভাল আছি। তার আগে আপনাকে বলি, ওই যে আপনি সকাল বেলায় এসে দিদির কাছে গতকাল ওত গালাগাল খাওয়ার পরেও আমার খোঁজ করলেন ওটাও তো একটা পরীক্ষা ছিল। আপনি শুধু পাশ করেননি, ফুল মার্ক্স পেয়েছেন মশাই। না দিদিটা সত্যি লাকি। আপনার মত একটা ভালো লোক পেয়ে গেল।’’
না মেয়েটা নির্ঘাত পাগল। শাশ্বত হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না।
‘‘কি হল অমন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে? সরুন আপনার সুটকেসটা গুছিয়ে দিতে হবে না?’’
শাশ্বতকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বন্যা এগিয়ে গেল খোলা সুটকেসের দিকে।
‘‘না তুমি যাও বন্যা, তোমায় কিছু করতে হবে না। আমি সব কিছু করে নিতে পারব। তুমি ভাল আছো এটাই শুধু আমার জানার ছিল। তোমার দিদি যদি জানতে পারে তো কেলেঙ্কারী হয়ে যবে।’’
‘‘আরে সেটাই তো বলা হয়নি আপনাকে। আপনাকে গতকাল বকাবকি করার পর কি মন খারাপ দিদির। আসলে মনে মনে তো চায় আপনাকে, না হলে ওরকম করবে কেন বলুন? আপনাকে দিদির হাতে তুলে দিয়ে তবে আমার শান্তি।’’
‘‘না বন্যা তোমার দিদির কথা থাক। আমি আমার কথা বলতে চাই। আমায় বলতে দাও। আমি তোমার দিদিকে ভালোবাসিনা। না- না - না আমি তোমার দিদিকে চাইনা। সে সলিলের কাছে যাক না যাক আমার কিছু এসে যায় না। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না- আমি শুধু তোমাকে-শুধু তোমাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস কর আমি আমার মন থেকে বলছি -আমি শুধু তোমাকে চাই- শুধু তোমাকে চাই। বন্যা তুমি কি বুঝতে পারোনা? তুমি কি অন্ধ? তুমি কি....’’
বন্যা এগিয়ে এল, দাঁড়াল শাশ্বতর মুখোমুখি। শাশ্বতর গলাটা আদর করে দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল ‘‘ওমা ছেলেরা কি বোকা হয়। তুমি কি সত্যি সত্যি ভেবেছিলে আমি দিদির হাতে তোমাকে তুলে দোব বলে তোমায় ট্রেনিং দিচ্ছিলাম?’’
সুখ
দেবযানী পাল
গল্প
ছোটবেলায় আমি অবিভক্ত বাংলার উত্তরে এক ছোট শহরে থাকতাম। আমার বাল্যকালের স্মৃতি হল: রূপসী চওড়া নদী, সুদূর বিস্তৃত ক্ষেত আর আমগাছ, কলাগাছ, তালগাছের সারি। আমাদের শহরের, জমিদারের দুটো হাতি ছিল। ওদের নাম ছিল মতিলাল আর রাজলক্ষী। প্রতি সন্ধ্যায় ওরা বিরাট কাঠের আর গাছ শাকপাতার বোঝা নিয়ে আস্তাবলে ফিরতো। দূর থেকে গলার ঘন্টার শব্দে বুঝতাম ওরা ফিরছে। ওদের নামধরে ডাকলে ওরা উত্তর দিত। ওদের দেখে আমরা মহানন্দের খুশীতে উচ্ছল হতাম।
কখনও অতি ভোরে আমার বাবা আমাকে সাইকেলে বসিয়ে শহরের উত্তরে নিয়ে যেতেন। ওখান থেকে হিমালয় পাহাড়ের চূড়া দেখা যেত। এখনও মনে করতে পারি সেই সোনা রংএর
রক্তাভ পাহাড় চূড়া। আমার পিতৃদেব বলতেন ওই দেখো, দেবতাত্মা হিমালয় আর স্বর্ণবর্ণের চূড়া, কাঞ্চনজঙ্ঘা।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরই আমার বাবা পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ ছেড়ে একেবারে ভারতে চলে আসা মনস্থ করলেন। একেবারে ফিরে আসার শেষ সন্ধ্যায় আমার সব পুতুল আর অতি প্রিয় জিনিষ ফেলে-ছড়িয়ে, বান্ধবীদের দিয়ে দিলাম। ওদের আশ্বাস দিলাম আমি ফিরে আসবো। কিন্তু আর ফেরা হয়নি। আমার দেশ ছেড়ে কোলকাতা পৌঁছলাম আমার বাবার সাথে অন্ধকার কারফিউ-এর সন্ধ্যায়। শুনলাম পরদিন এই ট্রেনই জীবন্ত মানুষ নয়, শুধু মৃতদেহ নিয়ে ফিরেছে। কোলকাতায় ফেরা আমাকে সুখী করেনি। কিন্তু জীবিত অবস্থায় ফিরেছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য।
কবিতা: দীপঙ্কর শুভ
মৃত বাদুড়ের চোখে জল
আমি মৃত গাছের জন্য শোক করা মানুষ
অথচ তার জন্য কাঁদলাম না পর্যন্ত।
মানুষটা পূবের হাওয়া হয়ে,
আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে ঢেউ লাগা আমনের মতো
তবুও ক্ষতের মতো বাঁচিয়ে রেখেছি যারে
অসহ্য; যদিও এড়াতে পারি না তারে।
আমি মৃত গাছের জন্য শোক করা মানুষ
অথচ তার জন্য কাঁদলাম না পর্যন্ত।
কবিতা : সুব্রত মিত্র
হলো না প্রতিকার
ঝড় হয়েছে গতকাল
ভেঙেছে কত গাছের ডাল
রক্তকরবীরা পড়েছে লুটায়ে ঐ শত শত
ভাঙ্গা আকাশের দিকে তাকায়ে আছি অবিরত
আগ্রাসী পবন হয়নি আপন যুদ্ধ আনে ক্রমাগত।
স্বপ্নগুলো ঝরে যায় অহরহ
শ্রেণীকক্ষের স্মৃতিগুলো হয়ে ওঠে দূর্বিসহ
ঘোলাটে মেঘ এই ঘোলাটে জীবন হতে কত ঋণ নিয়েছিল গতকাল
পুনর্জন্মের প্রায়শ্চিত্তের মহা রণনের প্রাক্কালে
চেতনার আবির্ভাব হবে চিরকাল,
নিশ্চিত প্রতিলিপির শেষ প্রান্তে এসে
যাবেনা; যাবেনা; যাবেনা; সবটুকু মিশে।
গহীন মেঘের রাগান্বিত মেঘালয়---------
হেঁটে চলে যায় মেঘ হতে বহুদূর
প্রতীক্ষার অজস্র প্রাণ চেয়েছিল অবসান এই পন্থার
অপ্রাপ্ত ক্ষুধা রয়ে গেল
অবশেষে হলো না যে কারণের প্রতিকার।
কবিতাঃ জবা রায়
ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ
'জন্মান্তর '
হে ঈশ্বর! কি এক বিষণ্ণ পারাপারের পোস্ট স্ট্রাকচারাল মন তোমার/!
জন্ম জন্ম করে তার সূত্রের মেরামত
এখনো ঝুলিয়ে রেখেছ আমার ভেতর
'অমনোযোগী হাওয়া'
গ্রীষ্মের কিছু পাতিলেবু গুনছিল
কত গ্লাস জলে জীবন হালকা শরবত হবে
আর এসব ঘটনায় মনোনীত সাক্ষীরা
কিভাবে গরমের ছুটি নেবে
ঠিক তখনই দেখলাম
জমকালো স্মৃতির স্রোত অনাদিকালের কথা বলে
ডুবে যাচ্ছে মনের ভেতর!
মৌন মিছিলের এক ঝাঁক কাক
কোন প্রশ্ন না করেই ছুটছে
ধবধবে সাদা কোচিং সেন্টারে
সেখানে কোন পাখি নেই, শব্দ নেই
সে চোখে বহুকাল কেউ জন্মায়ওনি
বর্ণের ভূতলে হৃদয় যাবে কি করে?
'কাটাকুটি'
দুর্বোধ্য সব আমাকে এখনো চিনতে পারিনি
হাঁটতে গেলে ভুলে যাই
এই আমি পোকামাকড়ের পোশাক পরে আক্রমণ করছি
আমার পাঁচ হাজার বছরের পাঁজরকে এভাবে
খুন হতে থাকা নিজেকে জড়িয়ে গল্প তৈরি হলে
বিষ্ণুপুরাণের দুপুরে দেখি কেউ নেই চোখের ভেতর
বাস্তুচ্যুত অংকের মতো শব্দেরা কেবল ভাঙছে প্রতিশ্রুতি
দিশেহারা বোধের বোঝা ঝুলিয়ে এদিকে ভাবছ-
খৈ ফুলে প্লাবিত ভূমিতে আমাকে স্নান করাবে,
এনে দেবে সাতশো ত্রিশূলের প্রাকৃতিক মায়া!
'বনজ সংলাপ '
শূন্যতার আলোক বিন্দু ছেদ করে গেছে
হৃদয়ের কয়েকটি রশ্মি
চেনা জনপদ থেকে কিছুটা দূরে
শুনতে পেলাম তার জখম হবার শব্দ
ছুটে গিয়ে দেখি হার মেনে নেয়া নিঃশ্বাস তখনও
আগলে আছে অগোছালো শেকড় ধরে
তার গন্ধ আমার গর্ভাশয় ভেদ করে
বের করছে কিছু ডালপালার বন
সেসব দেখেই হালকা জাফরানি মমতা
বিছিয়ে দিলো সাবলীল ধৈর্য্যের চাদর
কিন্তু ফুটো হওয়া চামড়ার দাগ
দেয়াল ঘড়ির মতো লেগে যাবার পর
বুঝতে পেলাম এক অভ্যস্ত বন
এই চলমান সভ্যতাকে সাক্ষী রেখে
বহু রকমের ফুল নিয়ে কথা বলছে
এরপর থেকে এক ধাপ পিছিয়ে
প্রায়ই মনে হয় এ দর্শন বইটা শুধু আমার না হয়ে
আমাদের ভুলে যাওয়া বোধ হতে পারতো!
কবিতাঃ তাপস কুমার বর
সাহিত্য সম্রাট
উনিশ শতকের উন্মাদনায়
বাংলা ভাষা রূপ পেয়েছে।
ভাষার একটা সতন্ত্র জালে
মুগ্ধতা রাশি রাশি ছড়িয়ে আছে।
তুমি, সাহিত্য সম্রাট
বাংলা গদ্যের নতুন রূপ দেখালে।
আজ বাংলা ভাষা গর্জে উঠেছে....
বিপ্লবীদের কন্ঠে সেই স্তোত্র মন্ত্র মুগ্ধ করেছে।
"বন্দে মাতারম্"
আজও এই বাণী শাশ্বত কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
কত কত লেখনী তোমার
জনকন্ঠে প্রতিভার বিস্ময় জাগিয়েছে।
ভাষার ছটায় রচিত হয়েছে
কত উপন্যাস প্রতিভার গুণে বঙ্কিম সমগ্রে।
"কপালকুণ্ডলা" মনে আছে?
নাটকের চিত্রপট চোখের সম্মুখে ভাসছে।
আরো কত রচনার,স্বদেশ ভাবনায়
বিপ্লবী জেগে উঠেছে।
বিশ্বকবি বলে গেছে
বঙ্গদর্শনে তুমি নতুন সূর্যোদয় দেখালে।
যুগের ইতিহাস শাশ্বস....
তুমি বাংলা গদ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে।
মাদিবা
সাতাশটা বছর যন্ত্রণার কারাবাসে
তবু বিদ্রোহ থামেনি কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ বৈষম্যের আন্দোলনে।
বিশ্ব নেতা তুমি...
কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা নামে!
বর্ণ বৈষম্যের তীব্র সংগ্রামে,
দক্ষিণ আফ্রিকা সংগ্রামের প্রতিবাদে
তুমি রক্ত ঝরে যাওয়া কত দরিদ্রের প্রমাণ থেকে গেলে....।
তুমি কৃষ্ণাঙ্গ শ্রেণীর প্রথম প্রেসিডেন্ট
বর্ণ বৈষম্যের জাতিভেদে দিয়েছো মানবধর্মের নতুন সন্ধান বিশ্বের ইতিহাসে!
তোমার মহানুভবতার কার্যলাভে
তুমি কিংবদন্তি দক্ষিণ আফ্রিকার মাদিবা নামে।
জাতিভেদ প্রথার অত্যাচারে
পায়ে শিকল বেড়ি পরিয়ে....
চলতো অ-কথ্য তীব্র অত্যাচার জেলের চার দেওয়ালে!
সভ্য তুমি কি হয়েছো প্রশ্ন বার বার জাগে?
রঙের বিচারে মানুষ বিচার হয় না
সভ্য নিজেদের কি করে বললে?
কালো হীরা তুমি বিশ্বের একটা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে
নোবেল জয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা নামে।
যার জীবন ছিল প্রতি পদক্ষেপে কষ্টে মোড়া ধুঁকে ধুঁকে
বেঁচে থাকতে ছেলেদের মৃত্যু দেখেছে যে পিতা চোখের সামনে।
আজ সে বিশ্বনেতা
ভারতরত্ন নেলসন ম্যান্ডেলা নামে।
জীবন ছিল ন্যায় নীতিতে ভরা
দক্ষিণ আফ্রিকায় অবিস্মরণীয় জাতির পিতা হয়ে থাকবে!
ফুটপাতের কান্না
দাউ দাউ করে জ্বলছে পেট
নীরব পাথর হয়ে
এখনো কি গ্রাম-নগর-রাজপথ?
নিথর অলিগলি অবাঞ্ছিতের অন্ধকারে
ওরা বলছে,
খাদ্য চাই মানবতা বিবেকগুলো অভুক্ত হয়ে মরছে!
আমি প্রতিশ্রুতি চাই না গো দরদী
প্রলাপগুলো অভুক্তে বকছে।
আমার খাদ্যের একমুখো ভাতে
নীরব শতাব্দীর চুল্লি,যুগের ইতিহাসে নিভে গেছে!
ইতিহাস বড়োই নিষ্ঠুর,
ফুটপাতগুলো এখনো কাঁদছে!
বোবাকান্না আর কতদিন ফটপাতে থালা ধরবে?
ভবিষ্যৎ গুলো কি অন্ধকার হয়ে গেছে?
ঝুপড়ির তাল পাতার ছাউনি,
নিরুপায় হয়ে বৃষ্টিঝরা সন্ধেতে
বোবাকান্নার মতো,ফুটো থালা হাতে কাঁদছে।
আমি বিপ্লব চাইনা প্রতিশ্রুতি
খাদ্যের তীব্র জ্বালায় কে বাঁচাবে?
দরদী,তুমি কি একবার আমায় বলে যাবে?
একদিন সব রাজপথ শূণ্য হবে
অভুক্তের চিৎকার তোমরা কি শুনবে?
দহন যন্ত্রণায় ওরা দাউ দাউ করে জ্বলছে,
ওদের ভবিষ্যৎ, ইতিহাস তুমি কি বলবে?
বিশ্ব পরিবেশ দিবস
পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডে দেখো জ্বলছে আগুন
প্রকৃতির মহাপ্রলয়ে কেন ধ্বংসের বুলবুল?
খাদ্য-খাদকে কত টান পড়েছে
বিলুপ্তির অন্ধকারে সব হারিয়ে যাবে!
প্রকৃতি কেন আজ কাঙাল হয়েছে?
প্রশ্বাস নিঃশ্বাসে দাবদাহে জ্বলছে।
পরিবেশ কতদিন এভাবে কাঙাল থাকবে?
অন্ধকারের অন্তিম সীমানায়.....
প্রকৃতি দাউ দাউ করে জ্বলবে?
পৃথিবীর নাভিতে দূষণ বেড়েছে
খাদ্যের অনাহারে দেশগুলো মরছে।
আর কতদিন এভাবে তোমরা অসচেতন থাকবে,
বিলুপ্তির বিকলাঙ্গে কত দূষণ ছড়াবে?
ধ্বংসের ছাইভস্মে পৃথিবী হাসবে
দেখো,মানব সমাজ অভুক্ত লঙ্গরখানায় ছুটছে।
সচেতন হতে হবে.....
হে জনগণ,বিশ্ব পরিবেশ দিবসে!
পৃথিবীর ইতিহাসে কত বিলুপ্ত হয়ে গেছে!
বাঁচাও জনগণ তোমার আমার ঐশ্বর্য একে একে...
না হলে ভবিষ্যতের অন্ধকারে
কত মানুষ মানুষকে ছিঁড়ে খাবে।
গাছ লাগাতে হবে
আবার,
পরিবেশ ভরে উঠুক নতুন সবুজে সবুজে!
প্রবন্ধ
হিন্দু ধর্মে
বর্ণভেদ এর রহস্য
প্রোজ্জ্বল মণ্ডল
বাঁকুড়া, পঃ বাংলা
হিন্দু ধর্মে বর্ণ ভেদ জন্মের ভিত্তি তে নয় কর্মের ভিত্তিতে এবং ইহা শাস্ত্র এ উল্লিখিত আছে।
যত্ পুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয় । মুখং কিমস্যাসী কিং বাহূ কিমূরূ পাদা উচ্যেতে।।
10
ব্রাহ্মণােহস্য মুখমাসীবাহ্ রাজন্যঃ কৃতঃ । ঊরূ তদস্য য বৈশ্যঃ পদ্ভাং শূদ্রো অজায়ত।।
11
যজুর্বেদ_অধ্যায়_31_মন্ত্র_10-11
ঋগ্বেদ মন্ডল_10_সূক্ত_90_মন্ত্র- 11-12
পদার্থ: (অস্য) সেই পরমত্মার সৃষ্টিতে (ব্রাম্মণঃ) বেদের জ্ঞাতা ও ঈশ্বরের উপাসক ব্রাহ্মণ ( মুখ) মুখের তুল্য (অসীম) হয়। (বাহু) বাহুর তুল্য বল ক্ষমতাযুক্ত পরাক্রমশালী (রাজন্যঃ) ক্ষত্রিয় হিসেবে (কৃতঃ) সৃষ্টি করেছেন। (যৎ) যিনি (উরু) উরুর তুল্য বেদ্যগাগী কর্ম করেন , (তদ) সেই ব্যক্তি (অস্য) এই পরমত্মার নিকট (বৈশ্যঃ) বৈশ্যরূপে পরিচিতি হয়। (এ্যাম) পাঁযের সমান পরিশ্রমী অবং অভিমান রহিত, সেবার যােগ্য ব্যক্তি (শুদ্রঃ) শুদ্র বলে পরিচিত হন। (অজায়ত) এভাবেই সকলের উৎপন্ন হয়েছে।
ভাবার্থ: যে মানুষ বেদ বিদ্যা শম - দমাদি উত্তম গুনে মুখ্য, ব্রহ্মের জ্ঞাতা এবং মুখের মাধ্যেমে জগৎকে জ্ঞানদান। করেন তিনি ব্রাহ্মণ। যিনি অধিক পরাক্রমশালী বাহুর তুল্য কার্যসিদ্ধ করেন তিনি ক্ষত্রীয়, যিনি ব্যাবহার বিদ্যায় প্রবীন হয়ে উরুর ন্যায় জগৎকে ধারণ করেন তিনি বৈশ্য এবং যিনি সেবায় প্রবীণ, কর্মে কঠোর তিনি পায়ের ন্যায় পরিশ্রমী শূদ্র এই বর্ণ ব্যবস্তা কর্ম অনুসারে বেদে কথিত হয়েছে।
‘জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ সংস্কারাদ্দিজ উচ্যতে।
বেদ - পাঠাৎ ভবেৎ বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণঃ।।'
‘জন্ম' দ্বারা - শূদ্রত্ব, সংস্কার দ্বারা - দ্বিজ,‘ বেদ - পাঠ' দ্বারা - বিপ্রত্ব এবং ব্রহ্মজ্ঞান’ দ্বারা - ব্রাহ্মণত্ব লাভ হইয়া থাকে। অর্থাৎ বর্ণ ভেদ নির্ভর করে কর্মের উপর জন্মের উপর নয়।
যথা ষন্ডােহ ফলঃ স্ত্রী যথা গৌর্গবি চাফলা।
যথা চাজ্ঞেহফলং দানং তথা বিপ্ৰােহনৃচোহফলঃ।।
মনুস্মৃতি_অধ্যায় দ্বিতীয়_শ্লোক 158
অনুবাদ -- নপুংসক যেমন কোনও স্ত্রীলােকের কাছে অকেজো, একটি স্ত্রী জাতীয় গরু যেমন অন্য একটি স্ত্রী জাতীয় গরুতে নিষ্ফল এবং অজ্ঞ ব্যক্তিকে দান যেমন বিফল হয় তেমনি অন্চ অর্থাৎ বেদ অধ্যয়ন বর্জিত ব্রাহ্মণও অচল বা অকেজো।
শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চেতি শূদ্ৰতাম্। ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবস্তু বিদ্যাদ্বৈশ্যাত্তথৈব চ।।
মনুস্মৃতি - অধ্যায় - দশ_শ্লোক_65
অনুবাদ- যদি কেউ শূদ্র কূলে উৎপন্ন হয়ে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যর গুণ - কর্ম - স্বভাব বিশিষ্ট হয় তবে সে, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য হবে। সেইরূপ, কেউ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যকূলে জন্মগ্রহণ করে শূদ্রের গুণ - কর্ম - স্বভাব বিশিষ্ট হলে সে শুদ্র হবে। অর্থাৎ, চার বর্ণের মধ্যে যে, যে বর্ণের সদৃশ হবে, সে সেই বর্ণেরই হবে।
স্বাধ্যায়েন ব্রতৈহােমৈস্ত্রৈবিদ্যেনেজ্যয়া সুতৈঃ। মহাযজ্ঞশ্চ যজৈশ্চ ব্রাহ্মীয়ং ক্রিয়তে তনুঃ ।।
মনুস্মৃতি - অধ্যায় দ্বিতীয় শ্লোক_28
অনুবাদ - বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা, হােম ও পঞ্চ মহাযজ্ঞ পালন, ধর্ম অনুসারে সন্তান উৎপাদন ইত্যাদি দ্বারা এই শরীর ব্রাহ্মণের করা যায়। জন্মসূত্রে আমরা কেউ ব্রাম্মণ বা ক্ষত্রীয় নই। সমস্ত মানুষ জাতির বেদ অনুযায়ী চলাই উচিত এবং অন্যকেও বেদ অনুসারে চালনা করা উচিৎ।
গীতাতেও একই কথা বলা হয়েছে -
চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধকর্তারমব্যয়ম।
..গীতা ৪ | ১৩ শ্লোক
অর্থ; প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং কর্ম অনুসারে আমি মনুষ্য সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমিই এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে||
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ||
প্রবন্ধ
বেদে
একেশ্বরবাদ
প্রোজ্জ্বল মণ্ডল
বাঁকুড়া, পঃ বাংলা
বৈদিক ধর্মে এক আর বহু দেবতায় কোন বিরোধিতা নাই। তাঁহাদের অনুভব একের ভাবনা বহুকে লইয়া। বহুকে বাদ দিয়া নহে। বৈদিক ভাবনায় বহু দেবতা একই ঈশ্বরের প্রকাশ বা মহিমা। এক আর বহু পরস্পর বিরোধী নহে, বহু একেরই বিভূতি।
বেদের বহু দেবতা মূলতঃ একজন।“ একো দেবঃ” এই কথাটি বেদের বহু স্থানে বলা হইয়াছে। ইহা হইল এক প্রকার সংকেত। আর এক সংকেত হইল একং সৎ।
মন্ত্রে দীর্ঘতমা ঋষি বলিয়াছেন—
“ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্য স সপর্ণো গরুত্মান্।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।। “এই মন্ত্রে ঋষি বলিতেছেন— ইন্দ্র, মিত্র বা অগ্নি ও দ্যুলোকের সুপার্ণ সকলেই সৎস্বরূপের প্রকাশ। এই বহু মন্ত্রে একং সৎ উক্ত হইয়াছে।
আর একটি সংকেত হইল” একং তৎ“ ঋদ্বেদ ২/১২৯/২ মন্ত্রে ঋষি প্রজাপতি বলিয়াছেন—
“ন মৃত্যু বাসীদমৃতং ন তর্হি ন বাত্র্যা অহ্ন আসীৎপ্রকেতঃ।
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তসমাদ্ধান ন্ন পরঃ কিং চ নাস।।
এই বিশ্বজগৎ প্রকাশিত হইবার পূর্বে অসৎকে বা অব্যক্তকে বলা হইয়াছে “তদেকম্”।
তখন মৃত্যুও ছিল না অমরত্বও ছিল না।
রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না কেবল সে একমাত্র বস্তু বায়ুর সাহায্য ছাড়া আত্ম মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস প্রশ্বাস যুক্ত না হইয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।
পূর্বোক্ত এক যখন প্রকাশিত, তখন তিনি সৎ, যখন অপ্রকাশিত তখন তৎ। সব দেবতা এই সৎ স্বরূপের বিভূতি।
বিশ্বের অনন্ত কার্য- পরম্পরাকে ভিন্ন ভিন্ন দেবতা নামে স্তুতি করা হয়। সে কার্য সমূহ ভিন্ন নহে একই। তাঁহাদের দেব ক্ষমতা ও ঐশ্বরিক বল একই।
একই বহু হইয়াছেন, আবার বহু প্রকাশের মধ্যে একই বিরাজমান আছেন। তাইতো ঋষিদের বাক্য “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি “, একো বশী সর্বভূতাত্মারাত্ম”, এবং “একং রূপং বহুদা যঃ করোতি“ (কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় কঠ উপঃ ২/২/১২)।
একই ইচ্ছা বহু হইয়াছেন, আবার বহুর মধ্যে একই অনুসৃত হইয়া রহিয়াছেন। তাই ঋষিরা বলেন— “একমেবাদ্বিতীয়ম্“, আবার বলেন “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম“।
গীতায় একটি পরাশক্তির কথা বলা হইয়াছে যিনি বিশ্ব জগৎ ধারণ করিয়া আছেন “যয়েদং ধার্যতে জগৎ। নিখিল বিশ্ব ময় প্রাণ শক্তি বিরাজিত, প্রাণ শক্তির তরঙ্গে বিশ্ব সঞ্জীবিত। এই প্রাণ শক্তির যাহা মূল তাহাই অসুরত্ব। অসুরত্বম্একম্।
গীতায় শ্রী কৃষ্ণের উক্তি “সর্বস্য হৃদি সন্নিবিষ্টঃ “আবার শ্রুতিতে আছে“ তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রবিশৎ“। এক যদি বহুর মধ্যে প্রত্যেক অনুপরমাণুর মধ্যে অনুসৃত হইয়া থাকেন তাহা হইলে একত্ব ও বহুত্বের দ্বন্দ্ব কোথায় থাকে?
ঋষি দর্শন করিয়া ধন্য হয়েন, সকল বস্তুর মধ্যে একই ইষ্টদেবতার প্রকাশ, আলোর মধ্যে তাঁহাকে প্রকট দেখা যাইতেছে। বায়ুর মধ্যে তাঁহারই দেওয়া প্রাণের অভিব্যক্তি, অগ্নির মধ্যে তাঁহারই দেওয়া ঔজ্জ্বল্য, সর্বভূতে ঈশ্বরের অনুভবে হৃদয় তাঁহার আনন্দ পূর্ণ। তাইতো ঋষি নিঃ সংশয়ে বলিয়াছেন— “সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম, ঈশা বাস্যম্ ইদং সর্বং“ সকল কিছু আচ্ছাদিত করিয়া সেই একই ঈশ্বর বিরাজিত।
প্রবন্ধ
সনাতন ধর্মে বৃক্ষের
জীবত্বের প্রমাণ
প্রোজ্জ্বল মণ্ডল
বাঁকুড়া, পঃ বাংলা
গাছের জীবন আছে - এই বাক্যটির সাথে আমরা সকলেই ছোটকাল থেকে পরিচিত। আমরা সকলেই জানি, বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তিতে গাছের জীবত্বের প্রমাণ করেন।
কিন্তু, প্রশ্ন থেকে যায়, সহস্র বছরের পুরনো কিন্তু আজও আধুনিক এই বৈদিক সভ্যতার দর্শনে কি গাছের জীবত্ব সম্পর্কে কিছু বলা নেই? আজ এরই উত্তর নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সাংখ্য দর্শনের ৫ম অধ্যায়ের ১২৪ নং সূত্রে বলা হয়েছে যে,
ত্রিধা ত্রয়ানাং ব্যবস্থা কর্মদেহোপভোগদেহোভয়দেহাঃ।। (৫/১২৪)
পদঃ—ত্রিধা ত্রয়াণাং। ব্যবস্থা। কর্মদেহোপভোগদেহোভয়দেহাঃ।
সরলার্থ— কর্মদেহ, ভোগদেহ, কর্ম ও ভোগ উভয় দেহ এই তিন প্রকার স্থূল শরীরে কর্মের এবং ভোগের ব্যবস্থা আছে।
এর আলোকে, পরবর্তী সূত্রে এ এই আশঙ্কা উপস্থাপন করা হয়েছে যে, বৃক্ষ যদি ভোগ চক্রে পরে, তবে সে কোন ভোগ দেহের মধ্যে পরবে?
এর ব্যাখ্যায় ৫/১২১ সূত্রে বলা হয়েছে,
ন বাহ্যবুদ্ধিনিয়মো বৃক্ষগুল্মলতৌষধিবনস্পতিতৃণবী রুধাদীনামপি ভোক্তৃভোগায়তনত্বং পূৰ্ব্ববৎ।
অর্থাৎ, বৃক্ষাদির শরীরে ভোক্তার অধিষ্ঠান না হইলে বৃক্ষের বিভিন্ন গুণ যেমন পরিপুষ্ট হওয়া বা শুষ্কতা ইত্যাদি হইতে পারে। শ্রুতিতে লিখিত আছে যে, এই বৃক্ষের যে শাখাকে জীবাত্মা পরিত্যাগ করে, সেই শাখাই শুষ্ক হইয়া যায়; অতএব বৃক্ষাদির শরীরেও জীবের অধিষ্ঠান আছে।
এখন যে উদ্ভিজ্জশরীর উক্ত হল, তাতে সংশয়বাদীরা এইরূপ দোষারোপ করে থাকেন যে, উদ্ভিজ্জশরীরে বাহ্যবুদ্ধির অভাববশত তার শরীরত্বই অসিদ্ধ অর্থাৎ উদ্ভিদের শরীর আসলে শরীরই না। যার বাহ্যজ্ঞান নাই, তাকে শরীর বলা যায় না, এইরূপ নাস্তিকপরিকল্পিত দোষের নিরাসার্ধ সাংখ্যকার বলছেন।"—
যাহাতে বাহ্যজ্ঞান আছে;
তাহাই শরীর, এমন কোন নিয়ম নাই। কিন্তু বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, ঔষধি, বনস্পতি, তৃণ, বীরুধাদির পক্ষে ভোগায়তনই শরীর বলিয়া জানিতে হইবে। যাহাতে ভোগসাধন হয়, তাহাই বৃক্ষাদির শরীর বলিতে হয়।"
অর্থাৎ উদ্ভিদ যে সকল অঙ্গের দ্বারা আলো, বায়ু, জল এবং বাহ্যিক প্রকৃতির সাথে ক্রিয়া করে, তাই উদ্ভিদের শরীর।
এর পরের সূত্রে আরও ব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে-
ন কিঞ্চিদপ্যনুশয়িনঃ।। (৫/১২৫)
পদঃ–ন। কিঞ্চিৎ। অপি। অনুশয়িনঃ।।
সরলার্থ — বৃক্ষাদি জন্মকে অনুশয়ী জন্ম বলে, পাষাণ কল্প স্থাবর জন্ম। যেমন কোন জমি
সম্পূর্ণ উর্বরতাশুন্য হলে সেই জমিতে বারবার সার দেয়া সত্ত্বেও কৃষক কোন ফসল উৎপাদন করতে পারেন না, জমি কিছু কাল পতিত অবস্থায় রাখা হয় যাতে এর উর্বরতা শক্তি ফেরত আসে, সেইরূপ যখন মনুষ্য অত্যধিক অন্যায় কর্ম—বিশেষ করে বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অত্যধিক অন্যায় কর্ম করে তার স্থূল ও সূক্ষ্ম সমস্ত ভোগের করণাদি অকর্মণ্য করে ফেলে, তখন পতিত জমির মত তাহাকে নিস্ক্রিয় অবস্থায় ফেলিয়া রাখিবার প্রযোজন হয় বলে পরমেশ্বর তার শোধন করার জন্য তাহাকে ভোগের ইন্দ্রিয়াদি ও শারীরিক করণাদি অর্থাৎ স্থূল ও সূক্ষ্ম যন্ত্রাদি হতে বঞ্চিত করে পাষাণের ন্যায় স্থাবর জন্ম দান করেন।
এসকল সূত্র হতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, বৃক্ষ অবশ্যই জন্মান্তরের অধীনে। আমরা জানি, জীব ভিন্ন আর কারোরই জন্মান্তর হয় না। শুধু অপর জীবের সাথে তার ভীন্নতা এই টুকুই যে, বৃক্ষের শরীরে কোনো ইন্দ্রিয় ভোগ হয় না।
প্রাচীন সাংখ্য দর্শন শুধু বৃক্ষের জীবত্বের প্রমাণ করেই শেষ করেনি। সাথে এরও যুক্তি দিয়েছেন যে, কেনই বা শাকাহারে বৃক্ষের কষ্ট দেয়ার কোন বিষয়ই থাকে না-
আশ্রয়াসিদ্ধেশ্চ।। (৫/১২৭)
পদঃ-আশ্রয়াসিদ্ধেঃ। চ।।
সরলার্ধ- বৃক্ষের জ্ঞানের ও অনুভূতির অভাব কারণ তাদের ইন্দ্রিয় গোলকের অভাব রয়েছে। আমাদেরও যে বিষয়ের গোলকের অভাব হয় সেই বিষয়েরই জ্ঞানের ও অনুভূতির অভাব হয়ে থাকে। এটা প্রত্যক্ষ সিদ্ধ। যেমন, মানুষের চোখ থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টিশক্তি না থাকলে সে দেখতে পারে না। সেই কারণে বৃক্ষের সামষ্টিক অনুভূতি হতে পারে না - এটা সুনিশ্চিত। আমাদের দেহের কোনো অংশের ক্ষতি হলে শরীরের সেই অংশ থেকে আসা জৈব রাসায়নিক সংকেত মস্তিষ্ক দ্বারা উপলব্ধ হয়। মস্তিষ্ক হলো কেন্দ্রীয় স্নায়বিক অঙ্গ যা আমাদেরকে বিভিন্ন অনুভূতির আস্বাদ দান করে। মস্তিষ্ক না থাকলে আমাদের কোনো অনুভূতিই থাকতো না। বৃক্ষের এরকম কোনো কেন্দ্রীয় স্নায়বিক অঙ্গ না থাকায় বৃক্ষের দেহের কোনো অঙ্গের ক্ষতি হলেও সেই জৈবরাসায়নিক সংকেত কোনো দুঃখ বা ব্যাথার অনুভূতি প্রকাশ করে না। সেইসকল জৈবরাসায়নিক প্রবাহ উদ্ভিদের ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গের আশেপাশের কোষসমূহকে ক্ষতি সারিয়ে উঠতে সংকেত প্রদান করে মাত্র।
সনাতন আর্য পরম্পরা এমন এক পরম্পরা, যার বিশ্বাসের মুলে রয়েছে যুক্তি। যে পরম্পরার ঈশ্বর বিশ্বাসের পিছনেও যুক্তি শিরোধার্য, জগত সম্পর্কে প্রশ্ন উপস্থাপন এবং শঙ্কা সমাধানও বরাবরই যুক্তি নির্ভর।
ইন্দ্রং বর্ধন্তো অপ্তুরঃ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্য্যম্।
অপঘ্নান্তো আরাবণঃ।। (ঋগবেদ ৯/৬৪/৫)
-হে মনুষ্য! ঈশ্বরের মহীমাকে বৃদ্ধি কর, স্বতাপহারী অনার্য্যকে আত্মদর্শনের শিক্ষা দাও, বিশ্বের সকলকে আর্য্য কর।
গল্প
শেষ বিকেলের
হাতছানি
মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়
পশ্চিম মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
১)
তারিখ- ২২.৩.২০১২ ৪.৫০ pm
হয়তো এটাই আমার শেষ বিকেল। আর কিছুক্ষণ সময় আছে হাতে তাই লিখছি। আমাকে ঠকিয়েছে রিনা। আমি আসল উত্তরাধিকারী সম্পত্তির, আংটিরও। আমি বাধ্য হলাম কাজটা করতে, যদিও অনুতপ্ত নই তার জন্য । এই ডায়েরিটা আমার অবর্তমানে যদি কেউ পড়ে সে হয়তো বুঝবে আমি ভুল করিনি। বুঝবে না? যাই হোক সব প্ল্যান মাফিক হলে এর পরেও সান্ধ্য ভ্রমণে যেতে পারব স্কুবির সাথে। আমি জানিনা আমার কিছু হলে স্কুবির কী হবে। আমার পোষ্য কুকুরের দায়িত্ব কে নেবে? পৃথিবীতে এখন আমার আপন ওই। আমার সাথে ওর এভাবে দেখা হবে ও ভাবতেই পারবেনা। একটা পরিবার এভাবে ভেঙে যাবে ভাবিনি। শুধু একটা আংটির জন্য শত্রুতা। যাই হোক আজ এখানেই শেষ করলাম। যদি ফিরে আসি তবে নতুন করে আবার সব শুরু করব।
ডায়েরিটায় এটাই শেষ লেখা। এখনো অনেক পাতা খালি আছে। ভদ্রমহিলা নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সবকিছুই ইংরেজিতে লেখা।
ডায়েরিটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা সাদা-কালো ছবি। দুজন মেয়ের কম বয়সের ছবি। আমি প্রদ্যোতের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।
- ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে মিসেস লি আর তার বোনের।
- হুম সৎ বোনের। গম্ভীর গলায় বলল প্রদ্যোত।
-কি মিস্টার চ্যাটার্জী, কিছু পেলেন? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞাসা করলের ইন্সপেক্টর রায়।
-সেরকম কিছু নয় এই ডায়েরিটা আর একটা পুরোনো ছবি পেয়েছি। ডায়েরিটা ইন্সপেক্টরের হাতে দিতে দিতে বলল প্রদ্যোত।
- তাই নাকি? পরে পড়ে দেখছি। ছবিটায় ঐ মহিলা আছে আর এক জন মেয়েও আছে, এটা কে?
- বুঝলেন না? মিসেস ক্লার্ক। বললাম আমি।
আমরা বেরিয়ে এলাম মিসেস লির বাড়ি থেকে। এখন বাকিটা পুলিশের কাজ।
(২)
বাড়ির গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঢং ঢং করে দশটার ঘন্টা বাজল। আমি আর প্রদ্যোত বসে আছি আমার ঘরের দোতলার বারান্দায়। একটা গাড়ি থামার শব্দ হলো। একটু পরেই দরজায় ডোরবেলের শব্দ।দুজনেই নিচে নেমে এলাম। আমি দরজা খুলতেই দেখি এক ভদ্রমহিলা।
- মিস্টার চ্যাটার্জী আছেন? ওনার সাথে একটু জরুরি দরকার ছিল।
- ভিতরে আসুন।
ভদ্রমহিলা ভিতরে আসতেই প্রদ্যোত ওনাকে সোফায় বসতে ইঙ্গিত করল। ভদ্রমহিলা বসেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মিস্টার বোস?
সম্মতি সূচক মাথা নাড়লাম। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হলো বয়স চল্লিশের ঘরে হবে। গায়ের রং অত্যধিক ফর্সা আর চেহারাও বেশ ধরে রেখেছেন এখনো।
- আমি রিনা ক্লার্ক। আমার বাড়ি পার্কস্ট্রিটে। আসলে একটা বিপদে পরে ছুটে এলাম। এতো রাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য সত্যিই দুঃখিত। এক গ্লাস জল হবে?
আমি মাধুকে হেঁকে জল দিয়ে যেতে বললাম।
- আপনার বিপদের বিষয়ে জানতে পারি কি? তবে আশা করব কোনো কিছু গোপন না করেই বলবেন। সোফায় গা এলিয়ে বলল প্রদ্যোত।
- অবশ্যই। আপনার বাড়িতে গিয়ে জানলাম আপনি এখানে আছেন তাই এলাম এখানে। ঘটনাটা বলি। আমার বাড়িতে গত পরশু একটা পার্টি আয়োজন করেছিলাম। সেখানে আমায় কেউ খুন করার চেষ্টা করে।
-খুন? প্রদ্যোত সোজা হয়ে বসল।
-হ্যাঁ, খুন। পার্টি চলাকালীন একবার হঠাৎ সব আলো নিভে যায় আর তখনই কোনো মহিলা আমার গলা টিপে ধরে আর এক হাতে মুখ চেপে ধরে। কয়েক মুহূর্ত পর কারেন্ট চলে আসে। কিন্তু আমি ঐ মহিলাকে খুঁজে পাইনি। বাগানে পার্টি চললেও সি সি টিভি ছিল, কিন্তু পরে দেখেছি ঘটনার কোনো চিহ্নই ক্যামেরায় রেকর্ড হয়নি! একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন মিসেস ক্লার্ক।
- তবে আমি দুটো ক্লু পেয়েছিলাম। একটা আংটি ছিল মহিলার হাতে আর একটা গন্ধ, ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। বাড়িতে দুজন কাজের মেয়ে আর একজন গার্ড ছাড়া কেউ নেই। আমি আগের মাসেই কলকাতায় এসেছি কিছুদিনের জন্য। একাই এসেছি। এখন তো একা থাকতেই ভয় লাগছে। আপনি প্লিজ কিছু উপায় করুন, আমি জানতে চাই আমায় কে মারতে চায়, কেন মারতে চায়। ভদ্রমহিলা একটু ধরা গলায় বললেন শেষ কথাগুলো। বাস্তবিকই ভয়ে ভয়ে আছেন।
- দেখুন আপনি থানায় একটা কমপ্লিট ফাইল করে রাখতে পারেন। আপাতত আমার কিছু করার নেই।
প্রদ্যোতের কথায় মনে হলো ভদ্রমহিলা হতাশ হলেন। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে বলল,
- কোনো দরকার পড়লে ফোন করবেন, সাহায্যের চেষ্টা করব।
ভদ্রমহিলা একটু হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন।
বিষয়টা নিয়ে আমাদের মধ্যেও আর কথা হলো না। রাত অনেক হয়েছে। দুজনেই ঘুমোতে গেলাম।
(৩)
পরের দিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ থেকে সবে ফিরেছি, প্রদ্যোতের ফোন বেজে উঠল। এই প্রান্তের কথা শুনতে পেলাম শুধু।
- হ্যালো
- হ্যাঁ বলুন মিসেস ক্লার্ক
- ফটোফ্রেম?
- ঠিক আছে আমরা আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি।
কথা শুনে বুঝলাম মিসেস ক্লার্কের বাড়ি যেতে হবে এখন। কিন্তু ফটোফ্রেমের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। গাড়িতে যেতে যেতে প্রদ্যোতকে প্রশ্ন করে এটুকু জানতে পারলাম যে ওনার বাড়ির গেটের সামনে কেউ ভাঙা ফটোফ্রেম রেখে গেছে আর তার সাথে একটা চিরকুট।
মিসেস ক্লার্ক বসার ঘরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
- গুড মর্নিং মিস্টার চ্যাটার্জী, গুড মর্নিং মিস্টার বোস। বসুন। পাশের সোফায় বসা ভদ্রমহিলার দিকে দেখিয়ে বললেন, পরিচয় করিয়ে দিই; ইনি মিসেস ডরোথি লি; আমার খুব কাছের বন্ধু।
মিসেস লি আমাদের দিকে হেসে জোড়হাত করে নমস্কার জানালেন। আমরাও প্রতি নমস্কার জানালাম। টেবিলের ওপরেই রাখা ছিল সেই ভাঙা ফটোফ্রেম। প্রদ্যোত সেটা কাগজের বাক্স থেকে তুলে হাতে নিয়ে দেখল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আমিও দেখলাম হাতে নিয়ে। পুরনো আমলের ফ্রেম; উন্নতমানের কাঠের তৈরী; সুন্দর নকশা করা চারদিকে। তবে শূন্য! চিরকুটটা দেখল প্রদ্যোত। পরিস্কার গোটা গোটা বাংলা হরফে লেখা, 'যার জিনিস তার কাছে ফিরবে, আর কিছু সময়।'
কাগজটা মিসেস ক্লার্কের হাতে দিতে দিতে প্রদ্যোত বলল,
- আপনি কখন দেখলেন বাক্সটা?
- ভোরবেলা বাগানে হাঁটতে বেরিয়ে।
- আপনার দারোয়ান কাউকে দেখেনি এটা রেখে যেতে?
- না, দেখেনি তো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বলল দেখেনি।
- হুম।
পরিচারিকা এসে চা আর কিছু খাবার দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রদ্যোত মিসেস লির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কখন এসেছেন এখানে?
- আপনি আসার কিছুক্ষণ আগেই।
- আপনার বাড়ি কোথায়?
- আমার বাড়ি কাছেই, এখান থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট লাগে।
-আপনার সাথে মিসেস ক্লার্কের পরিচয় হলো কিভাবে?
- এয়ারপোর্টে। আমরা একই ফ্লাইটে এসেছিলাম। মধ্যরাত্রিতে উনি সমস্যায় পড়ে গেছিলেন; ওনার গাড়ি না আসার জন্য, তখন আমিই বাড়ি পৌঁছৈ দিয়ে গিয়েছিলাম।
- আচ্ছা। আজ আসি। আমি দেখছি বিষয়টা। দরকারে ফোন করবেন। প্রদ্যোত যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই থমকে দাঁড়ালো। বাম হাতের দেওয়ালের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জিগ্যেস করল,
-মিসেস ক্লার্ক, দেওয়ালে ওটা কিসের দাগ?
দেখলাম সাদা দেওয়ালের গায়ে হালকা আয়তক্ষেত্রাকার দাগ।
- ওটা, ওটা মনে হয় কোনো ছবিটবি ছিল; অনেক পুরোনো কেনা বাড়িতো। একটু থতমত খেয়েও সামলে নিয়ে বললেন মিসেস ক্লার্ক।
ফিরতে ফিরতে হঠাৎ প্রদ্যোত আমায় প্রশ্ন করল;
- লেখাটা দেখে কী মনে হোলো?
- যে লিখেছে সে খুব ভালো বাংলা জানেনা। কেমন বাচ্চাদের মতো হাতের লেখা।
- ভেরি গুড।
আর কোনো কথা হোলো না আমাদের মধ্যে। আমাকে আমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোথায় একটা গেল। জিগ্যেস করতে বলল কাজ আছে। ফিরতে বিকেল হতে পারে।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নামল। গাড়ির শব্দ শুনে বুঝলাম প্রদ্যোত ফিরেছে। দরজা খুলতেই তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকলো।
- আমায় আজই মুম্বাই যেতে হবে। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতো, চট্ করে রেডি হয়ে নিই।
খেতে খেতে যা বলল মিসেস লির বিষয়ে খবর নিতেই মুম্বাই যাওয়া।
- মুম্বাইয়ে মিসেস লি তো ছিলেন না? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
- কে বলল ছিলেন না? দুজনেই ছিলেন। ভেতর থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ঐ দিন লন্ডনের ফ্লাইটে ঐ নামের কোনো প্যাসেঞ্জার ছিলনা। মুম্বইয়ের ফ্লাইটে ছিল।
- হোয়াট! তবে দুজনেই মিথ্যে বলেছেন। কিন্তু কেন?
আরো অবাক হয়ে বললাম।
- সেই জন্যই আমার মুম্বাই যাওয়া। আশা করি কালকেই ফিরব।
- ফোন করিস।
- হুম।
প্রদ্যোত চলে গেল। দরজা লাগিয়ে বসে বসে ভাবছি। ব্যাপারটা সাজানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিনা। প্রদ্যোত যদিও ওর একজন লোকের ওপর মিসেস ক্লার্কের বাড়ির নজরদারির ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছে মিসেস ক্লার্কের অজান্তেই। ভদ্রমহিলা আসলে কী চায়?
(৪)
পরের দিন দুপুরে প্রদ্যোতের ফোন এলো।
- হ্যাঁ বল্।
- মিসেস ক্লার্ক আমায় ফোন করেছিলেন। বললেন আর কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা যখন কেসটা নিয়ে আর ভাবার দরকার নেই; উনি টাকা পাঠিয়ে দেবেন আমার অ্যাকাউন্টে।
- সে কি? তুই কী বললি?
- আমি সম্মতি জানিয়েছি। আর শোন আমার ফিরতে রাত হবে। তোর ওখানেই খাবো।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
ফোন রেখে তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য তৈরী হতে লাগলাম।
সারাদিন কাজের মাঝে ব্যস্ততায় কাটল।
রাত্রি এগারোটার দিকে প্রদ্যোত এলো।
ও জামাকাপড় পাল্টে, স্নান করে এসে খেতে বসল।
- কিছু খবর পেলি?
- হুম, পেলাম। বিষয়টা যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততোটা সহজ নয়। দুজনেরই স্বামী লন্ডনে থাকেন। মিসেস লি ডিভোর্সি। দুজনেই একই দিনে মুম্বাইয়ে এসেছিলেন আর সেখানে দুজনেরই ফ্ল্যাট আছে।
- তবে তো বড়লোক ভাই।
- সে তো বটেই। ভদ্রমহিলার বাড়ি দেখিসনি? আর ঘরের শৌখিন শো-পিসগুলো? আমি ভাবছি অন্য কথা। কথাটা বলেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল প্রদ্যোত।
- কী কথা? জিগ্যেস করলাম।
- পরে বলব। বলেই খাওয়া শেষ করে উঠে গেল প্রদ্যোত।
দুদিন হোলো প্রদ্যোতের দেখা নেই। নিজের বাড়িতে চলে গেছে; আসেনি এখানে , ফোনও করেনি। আমারও কাজের চাপে আর সময় হয়নি ওর বাড়ি যাওয়ার। অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরীই হয়ে গেল সেদিন। সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ফুটপাথের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম মিসেস লি একটা লোকের সাথে কথা বলছেন। লোকটা রাস্তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে। মিসেস লির মুখটা রাস্তার হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সিগন্যাল সবুজ হতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। তখনই ফোন করলাম প্রদ্যোতকে। নট্ রিচেবেল। ম্যাসেজ করে দিলাম ব্যাপারটা। কে বলতে পারে যদি কাজে লাগে?
(৫)
পরের দিন অফিসে যাব রেডি হচ্ছি, এমন সময় প্রদ্যোতের ফোন।
- কিরে তোর ব্যাপার কী বলতো? একেবারে বেপাত্তা!
- সে কিছু কাজ ছিল, ইনফরমেশনের দরকার ছিল। শোন এখনই আমাদের বেরোতে হবে। আজ অফিস যাসনা। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। বলেই ফোনটা কেটে দিল।
পনেরো মিনিট পরেই প্রদ্যোত এসে হাজির।
- আমাদের দশ মিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে ছদ্মবেশে।
- ছদ্মবেশে? কেন? কোথায় যাব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
- পার্ক স্ট্রীটের একটা রেস্তরাঁয়। আমি টেবিল বুক করেছি দুজনের জন্য। বাকি কথা পরে বলছি। আগে রেডি হতে হবে।
দুজনেই গোঁফ আর তিল লাগিয়ে এমন ছদ্মবেশে বেরলাম, হলফ করে বলতে পারি মা- বাবা যদি দেখত চিনতে পারতো না আমাদের। সব ক্রেডিট প্রদ্যোতের।
রাস্তায় যেতে যেতে প্রদ্যোত বলল,
- যাকে মিসেস ক্লার্কের বাড়ি নজরে রাখতে বলেছিলাম, সে মিসেস ক্লার্ককে গোপনে অনুসরণ করে বিমানবন্দরে গিয়ে দেখেছে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে সাথে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে মিসেস ক্লার্ক বেরোলো। কথাবার্তায় সে অনুমান করেছে ঐ ভদ্রমহিলা মিসেস ক্লার্কের আন্টি হন।
- তাহলে আমরা রেস্তঁরায় কেন যাচ্ছি?
- কারণ ওনারা রেস্তঁরায় যাবেন। আমার মন বলছে আজ কিছু একটা ঘটবে যা মোটেই সুখকর হবেনা।
আর ওখানে পৌঁছে আমরা আলাদা টেবিলে বসব। সেই ব্যবস্থা করে রেখেছি। ওখানে কেউ কারো সাথে কথা বলব না।
- বেশ। বুঝেছি।
রেস্তরাঁয় পৌঁছে নিজের নিজের টেবিলে বসলাম। কিছু স্ন্যাকস অর্ডার করলাম আমি আর সাথে কফি। প্রায় আধঘন্টা পর তিনজন ভদ্রমহিলা রেস্তরাঁয় ঢুকলেন। ঘাড়টা হালকা ঘুরিয়ে দেখলাম প্রদ্যোতের ইনফরমেশন একদম ঠিক। মিসেস ক্লার্ক আর মিসেস লি পাশাপাশি বসলেন আর ওনাদের মুখোমুখি বসলেন তৃতীয় জন। আমার দিকে পিক করে বসেছিলেন বয়স্কা ভদ্রমহিলা। ওঁদের ঠিক কোনাকুনি টেবিলে প্রদ্যোত বসে। আমার নাকে তীব্র একটা গন্ধ এসে লাগল। এটা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ না? গন্ধটা ঠিক আমার পিছন দিক থেকে আসছে। তবে কী বয়স্কা ভদ্রমহিলা এই ব্যাপারে যুক্ত? সেই কী সেদিন খুন করতে চেয়েছিল?
কিন্তু সেদিন উনি কী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন? সেটা তো অজানা।
মনে পড়ল, মিসেস ক্লার্ক হাতের আংটির কথা বলেছিলেন না?
আমি প্রবীণার হাতে আংটি আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলাম। পারলাম না।
এক ঘন্টা পরে তিনজনেই উঠল। ওঁরা চলে যাওয়ার একটু পরে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম।
গাড়িতে বসে ল্যাভেন্ডারের গন্ধের কথাটা বললাম প্রদ্যোতকে। ও শুনে বলল,
- আচ্ছা? গুড ইনফরমেশন।
আমি জিগ্যেস করলাম,
-ঐ বয়স্কা ভদ্রমহিলার হাতে আংটি ছিল?
ঘাড় নেড়ে প্রদ্যোত বলল, ছিল।
একটু থেমে বলল, তবে ঐ বয়স্কা বিপদে আছেন।
- মানে?
- উনি যখন ছোটো আয়না বের করে ঠোঁটের লিপস্টিক ঠিক করছিলেন তখন মিসেস ক্লার্ক কিছু একটা ওনার কফিতে মিশিয়ে ছিলেন। হয়তো কোনো লেথাল মেডিসিন, অথবা ঘুমের ওষুধ। তবে ঘুমের ওষুধ হবার সম্ভাবনা কম।
- আমাদের এখন কী করণীয়?
- এখন বাড়ি গিয়ে আগে জামাকাপড় পাল্টানো।
বাড়ি এসে জামাকাপড় পাল্টেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল প্রদ্যোত। কথা শুনে বুঝলাম লোকাল পুলিশ স্টেশনের ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলছে। তারপরেই ফোন করল কাকে জানিনা, তবে ঐ বয়স্কা ভদ্রমহিলার বিষয়ে কিছু খোঁজ- খবর নিল। এরপর ফোন করে সেই লোকটিকে নজর রাখতে বলল মিসেস ক্লার্কের বাড়ির ওপর, আর একজনকে পাঠাতে বলল মিসেস লির বাড়ির ওপর নজর রাখতে।
দুপুরটা আমার বই পড়ে কাটল। প্রদ্যোত বসার ঘরে ছিল। মাঝে একবার গিয়ে দেখলাম পায়চারি করছে ঘরে। আমি জানি ওর মস্তিষ্ক এখন প্রশ্নের জট ছাড়াতে ব্যস্ত।
ওকে বিরক্ত না করে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। প্রদ্যোতের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল।
- অতীন ওঠ্ , ওঠ্; আমাদের বেরোতে হবে।
ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ন'টা বেজে গেছে! এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি!
তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে দশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
এবারে আমি জিগ্যেস করলাম,
- কী হয়েছে রে? কী খবর?
- মিসেস লিকে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে লুকিয়ে ঢুকতে দেখেছে আমার লোক। নিশ্চয়ই কিছু একটা অঘটন ঘটবে। মিসেস লির লুকিয়ে ঢুকবার কারণ কী হতে পারে? চুপ করে গেল প্রদ্যোত।
আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা। কে খুনের মোটিভ নিয়ে এসেছিল?
গাড়ি থেকে নামার আগে ইন্সপেক্টরকে ফোন করল প্রদ্যোত। ইন্সপেক্টর রায় প্রদ্যোতের বন্ধু, আমারও পরিচিত।
আমরা সরাসরি সামনের গেট দিয়ে ঢুকলাম না। বাড়ির পিছন দিকের ছোটো গেটটার তালা আগেই ভেঙে রেখেছিল প্রদ্যোতের লোক। সন্তর্পণে পা টিপে টিপে আমরা ঢুকলাম। বাড়ির পিছন দিকের দরজাটা একটু ঠেলতেই খুলে গেল। মনে হয় মিসেস লি লাগিয়ে যেতে ভুলে গেছেন।
(৬)
আমরা শব্দ না করে ঘরে ঢুকলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে বাম হাতে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। অদ্ভুত লাগছে। বাড়িটা নিঃস্তব্ধ। একবার মনে হলো এটা কোনো ফাঁদ নয়তো?
দোতলায় উঠে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডান হাতের প্রথম ঘরটার থেকে আলো সরু রেখার মতো বারান্দায় এসে পড়েছে। ঘরের ভিতর থেকে চাপা গলায় ইংরেজিতে কেউ কাউকে কিছু বলছে। গলার স্বর শুনে মনে হলো মিসেস ক্লার্ক কথা বলছেন।
- গিভ মি দ্যাট।
- নো ওয়ে রিনা, ওহহ্ সরি, মাই সুইট সিস্টার। মিসেস লির স্বর।
- ইউ ডোন্ট ডিজার্ভড ইট। গিমি অর আই উইল কিল ইউ ।
- রিয়েলি? আই গট ইট ফার্সট, সো ইটস্ মাইন।
হঠাৎ কাঁচের কিছু একটা পড়ে ভাঙল আর সাথে সাথে আমাকে চমকে দিয়ে প্রদ্যোত ঘরে ঢুকলো। আমিও ঢুকলাম।
ওঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। সামলে নিয়ে শান্ত গলায় মিসেস ক্লার্ক বললেন,
- আপনারা এখানে কেন? আপনাদের তো বলেছিলাম কেসটা আমি তুলে নিয়েছি।
- এখানে না এলে কি করে জানতাম যে সবটাই আপনার সাজানো ঘটনা। প্রদ্যোতের কথায় মুখ শুকিয়ে গেল মিসেস ক্লার্কের।
- এটা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা। আমরা মিটিয়ে নেব। আপনারা আসতে পারেন।
প্রদ্যোত বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।
ফাঁকা বিছানায় কী আছে বুঝলাম না।
মিসেস ক্লার্ক ভয় পাওয়া গলায় বললেন,
- কি করছেন মিস্টার চ্যাটার্জী?
ততক্ষণে বক্স বেডের ড্রয়ার টেনে খুলেছে প্রদ্যোত।
বক্স বেডের ভিতরে শায়িত মিসেস ক্লার্কের বয়স্কা আন্টির ডেডবডি। বুকে টাটকা রক্তের ছাপ।
প্রদ্যোত মিসেস ক্লার্কের দিকে ঘুরে বলল,
- দারুণ ব্যবস্থা করেছিলেন দুজনে মিলে।
মিসেস লি এবারে মুখ খুললেন,
- কি বলছেন আপনি! আমি এসবের কিছুই জানিনা। উনি কে?
- ভালো অভিনয় করতে পারেন তো আপনি। প্রদ্যোত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল।
- এবার বলুন খুনের মোটিভ কী?
-আপনি কিন্তু মিসেস ক্লার্ককে থামিয়ে প্রদ্যোত বলল
- আপনি ভেবেছিলেন আপনাদের আন্টিকে খুন করে আজ রাতেই লন্ডনে চলে যাবেন, আর খুনের দায় এসে পড়বে বাড়ির পরিচারিকার ঘাড়ে। একবার দেশের বাইরে যেতে পারলেই আর চিন্তা নেই। মিসেস ক্লার্ক ভুল বললাম?
মিসেস ক্লার্ক কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারলেন না।
বাকিটা মিসেস লি বলুন। মিসেস লির দিকে তাকিয়ে প্রদ্যোত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল।
মিসেস লি কাঠের একটা আলমারির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মিসেস ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে বললেন,
- আমি খুন করিনি মিস্টার চ্যাটার্জী। আমি শুধু আমার জিনিস নিতে এসেছিলাম।
-আপনি খুন করতে সহায়তা করেছেন। রেস্তোঁরায় কফিতে লেথাল ড্রাগ মেলানোয় আপনি সহযোগিতা করেছিলেন কারণ ওষুধ আপনি এনেছিলেন; একজন ডাক্তারের পক্ষে এটা কঠিন কাজ নয়; তাই না? আর আপনি জানেন যে ঐ ওষুধেই মৃত্যু ডেকে আনবে কিন্তু আপনার বোন সেটা নিশ্চিত ছিলেন না তাই ছুরিটা আপনার বোন চালিয়েছেন।
- বেস লেস কথা বন্ধ করুন। মিসেস ক্লার্ক রাগত স্বরে বললেন।
ভারী গলায় প্রদ্যোত বলল, থানায় গিয়ে বলবেন বাকিটা। এখন একবার বসার ঘরে চলুন।
- কেন?
-সেটা তখনই দেখতে পাবেন।
বসার ঘরে এসে প্রদ্যোত সোজা চলে গেল ঘরের শেষ প্রান্তে যেখানে দেওয়ালে দাগটা ছিল।
- এটা কিসের দাগ মিসেস ক্লার্ক?
- বলেছিলাম তো ছবিটবি কিছু ছিল হয়তো। অসহিষ্ণু গলায় বললেন মিসেস ক্লার্ক।
- হয়তো নয় মিসেস ক্লার্ক। ফটোফ্রেম ছিল, ছবিহীন ভাঙা ফটোফ্রেম, যেটা ইচ্ছাকৃত ভাঙা হয়েছিল আর নিজেকে নিজে গিফট করা হয়েছিল।
- আপনি পাগলের মতো বলছেন। কেউ কেন নিজের বাড়ির জিনিস ভাঙবে? এরপর তো বলবেন আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল যে সেটাও গল্প। মিসেস ক্লার্কের স্বরে শ্লেষের আভাস।
- এক্সাক্টলি। ঐ গল্পটি আপনার বানানো।
- রাবিশ। মিসেস ক্লার্ক রাগত স্বরে বললেন।
- না মিসেস ক্লার্ক। আপনার দিকে যাতে সন্দেহের দৃষ্টি না পড়ে তার জন্যই এই গল্প বানিয়েছিলেন আর আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি ভাবেননি আপনার বোন এসে সব প্ল্যান ভেস্তে দেবে।
প্রদ্যোত কথা বলতে বলতেই ঐ আয়তক্ষেত্রাকার দাগের পাশে একটা ছোটো সাদা প্লেটের মতো জিনিসে হাত দিয়ে চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। প্লেটের মতো জিনিসটা এমন ভাবে দেওয়ালের সাদা রঙের সাথে মিশিয়ে লাগানো যে খুব কাছ থেকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেনা।
বাইরের আলো ভিতরে পড়তেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। নীল হীরে!
সাথেসাথেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যার জন্য আমরা দুজনেই প্রস্তুত ছিলাম না।
চোরাকুঠুরিটা খুলতেই মিসেস লি আমাকে আচমকা ধাক্কা মারলেন। আমি প্রদ্যোতের ঠিক পিছন দিকেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধাক্কার বেগ সামলাতে পারলামনা। পড়ে গেলাম প্রদ্যোতের উপর। আর সেই বেগে প্রদ্যোত পড়তে পড়তে কোনো রকমে সামলে নিল নিজেকে। আর সেই সুযোগে মিসেস লি সেই হীরে বসানো আংটিটা বের করে নিয়ে পালাতে গেল; মিসেস ক্লার্কের বাম হাতে ধরা ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা আমূল ঢুকে গেল মিসেস লির পেটে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে।
হিসহিস গলায় মিসেস ক্লার্ক বললেন,
- যার জিনিস তার কাছে ফিরেছে। সরি সিস্টার।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটল, আমরা কিছুই করতে পারলাম না!
মিসেস লির নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। সেই মুহূর্তে পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর রায়।
প্রদ্যোতের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-একবার মিসেস লির বাড়িতে যেতে হবে প্রদ্যোত। আমি এদিকের কাজ মিটিয়ে আসছি। তোমরা একটু অপেক্ষা করো।
- ঠিক আছে। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।
ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালাম। মিসেস লির শিথিল হাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বল করছে সেই নীল হীরক।
সরকার
বাড়ির রহস্য
সঞ্জীব চক্রবর্তী
গড়িয়াহাট, কলকাতা
গল্প
(আগাথা ক্রিষ্টির “লিস্টারডেল মিস্ট্রি”র গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
মণিকুন্তলা দেবী গালে হাত রেখে ঘরের ছোট জানালার ধারে চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। জানলাটা দিয়ে অল্প একটু দিনের আলো প্রতিফলিত হয়ে এই ঘুপসি ঘরটায় আসে। হাতে তাঁর রোজকার খরচের হিসেব লেখার একটি ছোট খাতা। কপালে হাত রাখেন তিনি। ক’দিন ধরে মাথাটা কেমন যেন ধরে আছে। এই রোজকার হিসাব লেখা যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা দিনের দরকারি জিনিসগুলো কমবেশি করে যে ভাবেই হিসেব করা যাক না কেন,রোজকার বরাদ্দ খরচের মধ্যে কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। পাড়ার মুদির দোকানে ধার বেড়েই চলেছে। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আবার হিসেবটায় চোখ বোলান তিনি – আরে এইতো! রোজকার ফর্দে একই জিনিস দু’বার লিখে ফেলেছেন! পাঁচটা টাকা খরচ হিসেবে বেশি দেখানো হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পাঁচ টাকা বাদ দিয়ে আবার যোগ করেন। না: আজকের ধারের অঙ্কটা কিছু কমলেও, মাসের শেষ দিনের খরচটা রোজের বরাদ্দ থেকে তেমন কমলো না।
দারিদ্রের যন্ত্রণা, মণিকুন্তলা দেবীর চেহারায় অতীতের আভিজাত্যের ছাপ কিছুটা হলেও পুরোটা কেড়ে নিতে পারেনি। তবে সহজাত বনেদিয়ানার প্রচ্ছন্ন গর্ব এখনো উঁকি দেয় তাঁর হাবেভাবে। এখন খরচ সামলানোর চিন্তায় আবার হিসেবের খাতায় ঝুঁকে পড়েন তিনি। মাথার যন্ত্রণাটা আজ যেন বেশ বেড়ে গেছে। ঘরের দরজা খোলার শব্দে, চোখ তুলে দেখেন, তাঁর মেয়ে রঞ্জনা এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েকে দেখে তাঁর মনের কষ্টটা যেন বৃদ্ধি পায়। ঘরের অল্প আলোয় মেয়েকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন। বাইশ বছর বয়স হলো। সত্যিই সুন্দরী, ছিপছিপে শরীর, বংশগত আভিজাত্যের ছোঁয়া অঙ্গে অঙ্গে প্রতিফলিত। কিন্তু কঠোর দারিদ্রের চাপে ম্রিয়মাণ। অনেকটা তাঁর মতনই দেখতে রঞ্জনাকে। তাঁর নিজের ছোটবেলার ছবি মনে পড়ে যায়। এই পরিবেশে রঞ্জনা একেবারেই বেমানান।
“মা, সকাল থেকে কি করছ বলো দেখি? সেই এক হিসেব আর হিসেব! সরিয়ে রাখ দেখি তোমার ওই হিসেবের খাতা!”
“বা রে, পাগলী মেয়ে! দেখতে হবে না হাতের টাকা পয়সার অবস্থাটা কি? কলসির জমা জল তো বেরিয়েই যাচ্ছে।” দুশ্চিন্তা ঝরে পড়ে মণিকুন্তলার স্বরে।
রঞ্জনা অধৈর্য হয়ে পড়ে –
“দেখ মা, এই বাড়িটায় আসা অবধি দেখে আসছি একই অবস্থা। সব সময় আমরা হাতের শেষ পয়সাটুকু গুনে চলেছি। আমাকে কিছু করতেই হবে। উপায় নেই মা।”
“আমি ভাবছি –” মণিকুন্তলা দেবী কিছু বলার আগেই, রঞ্জনা থামিয়ে দেয় –
“না - মা, আমাকে চাকরি খুঁজে বার করতেই হবে।” রঞ্জনা বিক্ষিপ্ত মনে, ছোট্ট ঘরটায় পায়চারি করতে থাকে।
“খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেখ গ্র্যজুয়েশনের পর কম্পিউটারের কোর্সটা তো করেছি। চাকরি খুঁজতে গিয়ে দেখছি, আমার মতো কত মেয়ে এই কোর্স করেছে – ইন্টারভিউতে প্রথমেই প্রশ্ন করে –
‘আগে কোথায় কাজ করেছো?
‘এখনো কিছু করিনি – তবে ---’
‘ওহো! অভিজ্ঞতা নেই?
– ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে পরে জানাব।’
দিনের পর দিন কেটে যায়। কোনো উত্তর নেই। আমাকে কাজ যোগাড় করতেই হবে মা, যে করেই হোক।”
“কেন অত অধৈর্য হচ্ছিস তুই? আর একটু অপেক্ষা কর।” মণিকুন্তলা দেবী সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
রঞ্জনা ঘরের ছোট জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গলির একপাশের তিনতলা বাড়িটা সূর্যের আলো আসার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। তার অন্যমনস্ক দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় সূর্য’র আলো না আসা নোংরা ছড়ানো জলকাদা জমে থাকা সরু গলিতে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর বেড়ালদের স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা, মশা মাছি ভন ভন করা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আজকাল রঞ্জনার মনে কোনো বিকার হয় না।
“মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো মা।” রঞ্জনা বাইরে থেকে চোখ না সরিয়ে ধীরে ধীরে বলে – “গত শীতে করবী মাসি আমাকে ওদের ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে নিয়ে গেছিল। তোমরা যেতে পারলে না কেন, মনে নেই। খুব আনন্দ করেছিলাম ক’দিন। ভুলেই গেছিলাম এই পরিবেশের ছবি। শহরটা ওরা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল আমায়। জীবনে সত্যি প্রথম এত আনন্দ পেয়েছিলাম, আবার পাব কিনা জানি না। কিন্তু যখন এই পরিবেশটায় আবার ফিরে এলাম, বাস্তবের কঠিন আঘাতে কেমন যেন দিশেহারা বোধ করেছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় মা, আমি ভুল করেছিলাম কাবেরী মাসির সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে।”
এবার রঞ্জনার দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় তাদের ঘরটার ভিতরের চারদিক। মণিকুন্তলা দেবীর অস্বস্তি বেড়ে চলে। তাঁর চোখ এখন অনুসরণ করে মেয়ের দৃষ্টি। তাঁরও এখন মনে হয় এ যেন কোনো নিম্নস্তরের বস্তির ঘর।
ধূলিমলিন সস্তা আসবাব, দেওয়ালের স্থানে স্থানে খসে পড়া পলস্তারা, ইঁট বেরিয়ে আছে। ওপরে বাঁশের মাচায় করোগেটের ছাউনি, দেওয়ালে ঝোলানো সস্তা কাঠের তাকে চটা ওঠা কয়েকটা কাপ ডিশ, পুরনো সস্তা ফুল তোলা ছেঁড়া চাদর দিয়ে ভাঙাচোরা সোফাটা ঢাকার চেষ্টা হয়েছে। আর এক ধারের দেওয়ালে প্রায় কুড়ি বছরের পুরনো ফ্যাশানের পোষাকে সজ্জিত এক তরুণীর ঝাপসা হয়ে যাওয়া পেইন্টিং, ভালো করে দেখলে মণিকুন্তলা দেবীর সাথে মিল পাওয়া যায়।
“এই পরিবেশ বিসদৃশ লাগতো না মা-” রঞ্জনা অন্যমনস্ক স্বরে বলে চলে – “যদি আমাদের অন্য কোথাও থাকার অভিজ্ঞতা না থাকত, কিন্তু যখনই মনে পড়ে ‘রায় ভিলা’র কথা --- ”থেমে যায় সে।
তাদের রায় পরিবারের বহু বহু বছরের স্মৃতি যুক্ত প্রাসাদোপম বাড়ির কথা মনে পড়লে, সে নিজেকে সামলাতে পারে না। সেই বাড়ি আজ কোন এক অচেনা লোকের হেফাজতে চলে গেছে।
“যদি বাবা – - ধার করে ফাটকার ব্যবসায় না যেত – -”
“ রঞ্জনা - তোর বাবা কখনই টাকা পয়সার ব্যাপারটা ঠিক বুঝত না। ব্যবসায়ী বুদ্ধি একেবারেই ছিল না ওনার।” মণিকুন্তলার স্বরে বিষাদ ঝরে পড়ে।
মণিকুন্তলা দেবী আবার কলম তুলে নিয়ে ঝুঁকে পড়েন হিসেবের খাতায়।
জানলার ধারে আবার গিয়ে দাঁড়ায় রঞ্জনা। এখন সে ধীর স্বরে বলে – “আজ সকালে গৌতম বলছিল, ও আমাদের এই বাড়িতে আসতে চায়।”
মণিকুন্তলা দেবী চমকে উঠে হিসেবের খাতা থেকে চোখ তোলেন – “এখানে আসবে?”
“এখানে না’তো কোথায় আসবে? – আমরা তো আর ওকে পার্ক হোটেলে ডাকতে পারি না!” হাল ছাড়া হতাশায় হাসে রঞ্জনা। তার সুন্দর মুখটা যন্ত্রণায় কুঁচকে যায়।
রঞ্জনার মুখে কষ্টের ছায়া মণিকুন্তলাকে অসহায় করে তোলে। আবার তিনি ঘরটায় চোখ বোলান – ‘সত্যিই এই ঘরে কাউকে এনে বসানো যায় না।’
“একেবারে ঠিক মা” রঞ্জনা এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে। “এটা জঘন্য জায়গা। গরীবের আভিজাত্য? শুনতে খুব ভালো লাগে। সাধারণ ভাবে কোনরকমে সাজানো ছোট্ট দুটো ঘর, টিমটিমে আলো, টেবিলে প্লাস্টিকের ফুল দানে নকল ফুলের তোড়া, মান্ধাতা আমলের পোর্সিলিনের একটা দুটো কাপ ডিশ। কাজের লোক নেই - নিজেদের ঘর ঝাড়া মোছা করতে হয়, রাস্তার কল থেকে জল আনতে হয় - বইতে এসব পড়তে খুব ভালো লাগে, মা। আচ্ছা ভেবে দেখ! আমাদের সত্যি অবস্থাটা কি? রায় বাড়ির ছেলে আমার ভাই, এখন সংসারের খরচ যোগাতে শহরের সাধারণ অফিসে চাপরাশির কাজ করে। অসভ্য বাড়িওয়ালা, নোংরা, ধুলো কাদা মাখা বাচ্চাগুলো সবসময় গলিতে জটলা পাকাচ্ছে – আশপাশের লোকগুলো বেশির ভাগ সময় মাতাল হয়ে থাকে – আর কি বলবো বলো তো?
“কিন্তু-” মণিকুন্তলা দেবী বলার চেষ্টা করেন – সত্যিটা কি জানিস – আমার মনে হচ্ছে এই ঘরদুটোর খরচও আর বোধহয় বেশি দিন চালানো যাবে না।”
“তার মানে বলতে চাইছ – আমাদের এবার এই দু’ঘরের আস্তানা ছেড়ে, আরো খারাপ জায়গায় এক কামরার কোনো ঝুপড়িতে চলে যেতে হবে – যেখানে কেবল তোমার আর আমার থাকার জায়গা হবে। আর রাতে আমার ভাই, সৌমেন্দ্র’কে থাকতে হবে ঘরের বাইরে, রাস্তার ধারে? আর আমি কি ভাবে গৌতমকে এই পরিবেশে আসতে বলবো মা? তুমি তো দেখছ আস পাশের লোকজনদের। মেয়েগুলো অসভ্যরমত সিঁড়িতে বসে সর্বক্ষণ নিজেদের মধ্যে নীচ ভাষায় ঝগড়া করে আর মাতাল লোকগুলোর দিনরাত বেলেল্লাপনা করছে। এই জায়গায় কোনো ভদ্রলোককে নিয়ে আসা যায়?”
ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
“রঞ্জনা – তুই কি গৌতম কে! মানে –তুই --?”
মণিকুন্তলা যেন একটু ইতস্তত করে থেমে যান। তিনি অসহায় বোধ করেন।
“দেখ মা, এত ইতস্তত করার কোনো দরকার নেই। আর আজকাল কেউ করেও না। তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছো, আমি গৌতমকে বিয়ে করতে চাই কিনা? তবে শোনো - হ্যাঁ, গৌতম যদি আমাকে বিয়ে করতে চায় – আমি রাজি হয়ে যাব। কিন্তু আমি জানি – সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব কখনো দেবে না।”
রঞ্জনার কথায়- মণিকুন্তলার বুক যেন ব্যথায় মুচড়ে ওঠে। রঞ্জনা বলে যায়-
“মা, চিন্তা করে দেখ – কাবেরী মাসি আর তিন্নীর সঙ্গে আমি সেই কয়েকটা দিন ঘুরে বেড়িয়েছি ব্যাঙ্গালোরের অভিজাত মহলে। গৌতম আমাকে দেখেছে সেই বিশেষ পরিবেশে। সেই সামান্য কটা দিন আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি খোলা মনে। সেই পরিবেশে আমাকে দেখে সে হয়ত আকৃষ্ট হয়েছিল।– তোমার মনে আছে হয়তো সিন্ডেরেলা গল্পটা। রূপকথার রাজপুত্ররা অনেক কিছু উপেক্ষা করতে পারে কিন্তু বাস্তবের রাজপুত্ররা অতটা দরাজ নাও হতে পারে কারণ তাদের নিজেদের সমাজের কথা মাখায় রাখতে হয়।
আর গৌতম এখানে – এই বস্তির ঝুপড়িতে এসে আমাকে দেখবে! সিন্ডেরেলার রাজপুত্র আর বাস্তবের রাজপুত্রের ধ্যান ধারণার ফারাক আছে মা। গৌতম দরাজ মনের, সম্ভ্রান্ত কিন্তু খুঁতে খুঁতে সাবেকিয়ানার মানুষ। সেই জন্যই হয়ত ওকে আমার ভালো লেগেছে। গৌতমের চালচলন, দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় আমাদের ‘রায় ভিলা’র পরিবেশ, পুরনো আভিজাত্য, সম্ভ্রান্ত আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা। আমাদের বাড়িতে ঢুকলেই যেন পৌঁছে যেতাম কোন পুরনো রূপকথার কল্পনার জগতে। টের পেতাম কত দিনের পুরনো ইতিহাসের গন্ধ যেন জড়িয়ে আছে ওই বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে। আমাদের এই এখনকার পরিবেশের থেকে যেন কত দুরে – অন্য কোন অচেনা এক জগৎ।
রঞ্জনার লজ্জা পায় তার ভেতরের আক্ষেপ বেরিয়ে আসাতে। রঞ্জনার খারাপ লাগে কথাগুলো বলে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে, কয়েক পা এগিয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে – “আমার মা--, আমি কখনো আর ওই কথাগুলো বলব না মা।”
“দ্যাখ রঞ্জনা- গৌতমরা সম্ভ্রান্ত পরিবার। আমাদের পালটি ঘর।” মণিকুন্তলা দেবী আন্তরিক স্বরে বলেন –“তুই গৌতমকেই বিয়ে কর।”
“আমিও চাই, মা” – রঞ্জনার কথায় হতাশার আভাস- “কিন্তু আমাদের এই অবস্থাটা আমি মেনে নিতে পারছিনা একেবারেই।”
মণিকুন্তলা দেবীর মন ভেঙে যায় রঞ্জনার হতাশায়। তিনি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন – “আমার মনে হয় আমাদের এই বর্তমান পরিবেশে গৌতমের তোকে দেখা উচিত। তোকে ছেলেটা ভালোবাসে, দেখবি ও কিছু মনে করবে না।” রঞ্জনার কষ্ট হয় মা’কে দেখে। বাবা মারা যাওয়ার পর, এত বিষয় সম্পত্তি কয়েক দিনে ধূলিসাৎ হয়ে গেছিল। এক কাপড়ে ছোট দুই ছেলে মেয়ের হাত ধরে, সামান্য কিছু নিজের জমানো টাকাপয়সা আর অল্প কয়েকটা গয়না নিয়ে পরের দয়ায় এই বস্তিতে মা’কে উঠতে হয়েছিল এক সকালে - সে দোষ তো মা’র নয়। তাঁকেও তো মানিয়ে নিতে হচ্ছে এই পরিবেশে। রঞ্জনা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে মা’কে –“তুমি ঠিক বলেছ – নিজেকে সামলাতে না পেরে, আজ অনেক বাজে কথা বলে ফেলেছি। আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন।” মা’কে আদর করে রঞ্জনা। মণিকুন্তলার রোজকার এই হিসেব নিকেশ আর ভালো লাগলো না। উঠে এসে ঘরের কাল জীর্ণ শতচ্ছিন্ন সোফাটায় এসে বসলেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁর এখন কর্তব্য কি!‘ এটাও ঠিক, পরিবেশ মানুষের মন পাল্টে দেয়। কিন্তু যদি পরস্পরের ভালোবাসা নিখাদ হয় – আমার মিষ্টি মেয়েটাকে যে অবস্থাতেই গৌতম দেখুক না কেন – আমাদের এখনকার দৈন্যদশা তার ভালোবাসায় দাগ কাটতে পারবে না। তিনি নিশ্চিত। কিন্তু তবু তাঁর মন তোলপাড় হয়, আজকালকার ছেলেরা সহজেই সবকিছুর ওপর স্থান দেয় বর্তমানকে। আবার ভাবেন তাঁর সৌমেন্দ্র কত সহজে তার বড় হয়ে ওঠার জীবনযাত্রা ভুলে এই বর্তমান পরিবেশের সাথে কেমন মিশে গেছে। কিন্তু আমি কিছুতেই চাই না আমার ছেলেমেয়েরা এই অবস্থায় আবদ্ধ হয়ে থাকুক। কিছুতেই নয়। আমি জানি সৌমেন্দ্র পাড়ার মোড়ের ওই বজ্জাত পানওলার মেয়েটির সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। মানছি মেয়েটি ভালো কিন্তু তারা আমাদের সমগোত্রীয় নয়। এই অসমতার বিষয়টি হয়ত আজকালকার দিনে চলে’না কিন্তু মানতে পারিনা। আর আমার রঞ্জু –ওর খুশির জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি – হ্যাঁ, সব কিছু। কিন্তু টাকাপয়সা কোথায়? যা অল্প কিছু গয়না নিয়ে আসতে পেরেছিলাম – তা’ও বিক্রি হয়ে গেছে সৌমেন্দ্রকে স্কুলের গণ্ডি পার করাতে। আর এখনকার খরচপত্রও চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে।” এই চিরস্থায়ী অভাবের নিয়ত চিন্তা থেকে মন সরাতে সামনে পড়ে থাকা কয়েক দিনের পুরনো খবরের কাগজটায় অন্যমনস্ক চোখ বোলান বিজ্ঞাপন গুলিতে। সাধারণ তবে অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপন। কেউ খুঁজছে বিনিয়োগকারী আবার কেউ চাইছে লাভজনক ব্যবসায় লগ্নি করে অল্প সময়ে টাকা তিন গুণ করতে। কেউ আবার পুরানো কিছু আসবাব বিক্রি করতে চায় নতুনের দামে। তাঁর এই দুর্দশার মধ্যেও হাসি পেয়ে যায় দেখে এক বৃদ্ধ অনুর্দ্ধা তিরিশের পাত্রী খোঁজার চেষ্টায় রয়েছেন। আশ্চর্য হন মণিকুন্তলা দেবী। হঠাৎ একটি বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি সোজা হয়ে বসেন। দু’বার তিন’বার ভালো করে বিজ্ঞপ্তিটা পড়েন।“ শহরের বর্ধিষ্ণু অভিজাত এলাকায় সব রকম সুবিধা যুক্ত বাড়ি, উপযুক্ত আসবাবপত্র সমেত নাম মাত্র ভাড়ায় দেওয়া হবে। শুধুমাত্র নিম্ন মধ্যবিত্ত যথার্থ ভদ্র পরিবার যোগাযোগ করবেন যাঁরা বাড়িটি নিজেদের মনে করে দেখাশোনা করতে সক্ষম হবেন। দালাল মারফত যোগাযোগ নিষ্প্রয়োজন।” খুবই সাধারণ একটি বিজ্ঞাপন। আসবাব শুদ্ধু পুরো একটা বাড়ি আবার ‘নাম মাত্র’ ভাড়া’! বিশ্বাস হয়’না, এই রকম বিজ্ঞাপন তিনি অনেক দেখেছেন। বোধহয় এখানেই কোনো চালাকি লুকিয়ে আছে। রঞ্জনার বিষাদে ভরা মুখটা তাঁর মনে ভেসে ওঠে। বিক্ষিপ্ততা গ্রাস করে তাঁকে। এঁদের সাথে কথা বলতে তো আর দোষ নেই! মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে, ছাতাটা নিয়ে তড়িঘড়ি তক্ষুনি বেরিয়ে পড়েন তিনি। বিজ্ঞপ্তির ঠিকানায় পৌঁছতে শহরের ওই দিকটায় যাওয়ার বাস ধরেন মণিকুন্তলা দেবী। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পৌঁছলেন ঠিকানাটায়। একটি গলির ভেতর, পুরানো আমলের জরাজীর্ণ বাড়ির এক তলায় অফিস। ঢুলু ঢুলু চোখ, মাথা ভরা সাদা চুল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক অফিসে একা বসে । একটু ইতস্তত: করে পুরনো খবরের কাগজ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসা বিজ্ঞাপনের অংশটুকু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে দিয়ে বাড়িটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন। বিজ্ঞাপনের অংশটি হাতে নিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ কুন্তলাদেবীকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করেন – “ঠিক,একেবারে ঠিক। বাড়িটা সম্পর্কে আপনাকে তো জানতেই হবে। বিজ্ঞাপনের বাড়িটা খুব কাছেই, ওই বড় রাস্তার ওপারে কিছুটা গিয়ে--। আপনি কি বাড়িটা শর্ত অনুযায়ী ভাড়া নিতে ইচ্ছুক?”- ভদ্রলোক ঠিকানাটা যা বললেন সেটি শহরের সর্বোৎকৃষ্ট এলাকা।“ ভাড়াটা আগে না জেনে রাজি হওয়া কি সম্ভব?”
“ওহো! বাড়ির ভাড়া কত জানতে চাইছেন? কিন্তু বাড়ির মালিক ভাড়াটা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেননি। তবে বলতে পারি ভাড়াটা হবে খুবই সামান্য।”
“দেখুন ওই ‘সামান্য’ কথাটা খুবই গোলমেলে। বিভিন্ন মানুষের কাছে এই ‘সামান্য’ কথাটার পরিমাণ নানারকম হতে পারে।” মণিকুন্তলা দেবী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন। বৃদ্ধের মুখে চাপা হাসি। “আপনার ধারণা একেবারে সঠিক। সত্যি, এই “সামান্য’ শব্দটা খুবই বিভ্রান্তিকর। তবে আমার কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। আমার ‘সামান্য’ শব্দটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি ‘খুবই কম’। এই ধরুন মাসিক পাঁচশো টাকার মধ্যে, এর বেশি হবে না। আপনি বাড়িটা দেখে আসতে পারেন।” মণিকুন্তলা দেবীর চিন্তিত হন - বাড়িটা ভাড়া নিতে পারবেন কিনা? কিন্তু সংসারের সব খরচ আরো কম করলেও মাসে পাঁচ’শো টাকা ভাড়া দেওয়া খুবই মুশকিল। তবু কৌতূহল হয় এত কম ভাড়া কেন? নিশ্চয়ই বাড়িটার কোনো গোলমাল আছে সেই জন্য এত কম ভাড়ায় বাড়িটা পাওয়া যাবে! যদি গোলমাল থাকে, বাড়িটা নেব না বলতে আর কতক্ষণ। আর শুধু একবার দেখতে তো দোষ নেই। তিনি ঠিক করলেন ফিরে যাওয়ার আগে বাড়িটা একবার দেখবেন। বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই – তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সামনের গেটে সিকিউরিটি গার্ড, তাঁকে দেখেই এগিয়ে আসে – বোধহয় এজেন্ট ভদ্রলোক তাঁর আসার খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন।প্রায় মানুষ প্রমাণ উঁচু পাঁচিল ঘেরা কি সুন্দর বাড়িটা! বলতে গেলে রাজকীয় – রক্ষণাবেক্ষণ অপূর্ব। দুপাশে ছোট বাগানের মাঝ দিয়ে নুড়ি ছড়ানো অল্প কিছুটা পথ পেরিয়ে ঝাঁ চকচকে মেহগনি কাঠের সদর দরজা। বাগানে একটি মালী ফুল গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। সদর দরজায় এসে দাঁড়াতেই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ধুতি ফতুয়া পরিহিত একজন বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। বেশ লম্বা, সাদাটে ধূসর ব্যাক ব্রাশ করা চুল, যত্নে রাখা পুরুষ্টু গোঁফ। বেশ লম্বা সম্ভ্রান্ত, সৌম্য চেহারা। মণিকুন্তলা দেবীর মনে হলো লোকটি বোধহয় বাড়ির কেয়ার টেকার। মানুষটিকে বাড়ির কাজের লোক ভাবতে অস্বস্তি হয়। এই লোকটির কথাই বোধহয় এজেন্ট ভদ্রলোক বলেছিলেন। তবু কথামতো এজেন্টের দেওয়া চিঠিটা তার হাতে দিলেন।“ আসুন আসুন ম্যাডাম, বাড়িতে থাকার মত সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা আছে। আপনাকে দেখিয়ে দেব সব।” তিনি মণিকুন্তলা দেবীকে নিয়ে একের পর এক ঘর দেখাতে থাকেন।“ এই ঘরটা বসার, পাশের ঘরটা লাইব্রেরী আর এটা খাওয়ার, সব ঘরের সঙ্গে বাথরুম-।” এরপর দেখা হলো দো’তলার বারান্দা লাগোয়া শোওয়ার ঘরগুলি। ঠিক স্বপ্নের মত পুরানো কলোনিয়াল ধাঁচের দো’তলা বাড়ি। প্রতি ঘরে অতি যত্নে পালিশ করা রুচিপূর্ণ ভিক্টোরিয়ান আমলের এ্যান্টিক আসবাবপত্র। কিছুটা ম্লান হয়ে যাওয়া সুন্দর পুরানো নকশার পার্শিয়ান কার্পেটে ঢাকা প্রতিটি ঘরের মেজে। ঘরে ঘরে বাড়ির বাগানের তাজা ফুলে সাজানো এ্যান্টিক ফুলদান। দো’তলার বারান্দা থেকে দেখা যায় বাড়ির পিছনের মাঝারি সবুজ লন। এক কথায় অপূর্ব। পুরানো আমলের মাধুর্য ছড়িয়ে আছে বাড়িটির সর্বত্র। কর্মচারীর নাম জানলেন মণিকুন্তলা – তার নাম বিপ্রদাস। মণিকুন্তলা দেবীর বাষ্পাকুল দৃষ্টি বাড়িটার আনাচকানাচ ঘুরে বেড়ায়। তাঁদের ‘রায় ভিলা’র ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ওই বাড়িটা সেই তুলনায় ছোট হলেও মিল খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। আবার চিন্তায় ফেলে ভাড়ার অঙ্কটা – না:,সম্ভব হবেনা। বিপ্রদাসের দৃষ্টি এড়িয়ে রুমালে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিলেন মণিকুন্তলা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিপ্রদাস তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবোচ্ছ্বাস দেখে ফেলেনি তো? তিনি একটু লজ্জা পেলেন। মনে হলো, প্রশিক্ষিত কর্মচারীরা যদি দেখেও ফেলে, তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে না। তিনি এই পুরানো লোকদের পছন্দ করেন। ঠিক পারিবারিক বন্ধুর মত। এদের কাছে থাকলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, নিজেকে নিরাপদ মনে হয়। “বাড়িটা খুব সুন্দর, সত্যি অপূর্ব, বাড়িটা দেখে আমার খুব ভালো লাগলো।” আয়ত্তে রাখা শান্ত স্বরে বলেন মণিকুন্তলা।
“আপনি কি একাই থাকার জন্য বাড়ি খুঁজছেন ম্যাডাম?”
“আমি আর আমার দুই ছেলে মেয়ের থাকার জন্য বাড়ি খুঁজেছিলাম। তবে মনে হচ্ছে......”
তিনি থেমে গেলেন। বাড়িটা তাঁর ভীষণ ভালো লেগেছে। ছেড়ে চলে যেতে মন চাইছে না। তবে ওই ভাড়ার টাকার অঙ্কটা তাঁর কাছে অনেক। তিনি যোগাড় করবেন কি করে? তাঁর অবচেতন বলছে বিপ্রদাস বোধহয় আসল ব্যাপার বুঝতে পেরেছে। সে মণিকুন্তলার দিকে না তাকিয়ে নির্লিপ্ত উদাসীন ভদ্র স্বরে বলে –
“দেখুন, আমি জানি কর্ত্তামশায়ের ইচ্ছে। তিনি এমন একটি পরিবারকে বাড়িটা ভাড়া দিতে চান-যাঁরা সত্যি সত্যি বাড়িটাকে ভালোবাসবে, নিজেদের মত করে যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তাঁর কাছে ভাড়ার টাকার অঙ্কের কোনো মূল্য নেই।”
“আমি মন থেকে বাড়িটিকে ভালোবেসে ফেলেছি বিপ্রদাস।” মণিকুন্তলা দেবী মৃদু স্বরে ব’লে – সদর দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
“বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।” রাস্তায় বেরনোর গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সৌজন্যের সাথে বলেন মণিকুন্তলা দেবী। বিপ্রদাস হাতজোড় করে তাঁকে নমস্কার জানায়। মণিকুন্তলার মাথা উঁচু করে, গর্বিত পদক্ষেপে একবারও ফিরে না তাকিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে চলে যাওয়ায় দিকে তার সম্ভ্রমের দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে। মণিকুন্তলা নিজের মনে ভাবেন-‘তাঁর অসুবিধেটা কোথায় লোকটি বুঝতে পেরেছে, বোধহয় আমার জন্য দু:খও পেয়েছে। তিনি অনুভব করেন এই জাতের মানুষেরা বর্তমান যুগ থেকে ক্রমশ: উধাও হয়ে যাচ্ছে। লোকটি চাইছে আমাদের পরিবার বাড়িটায় থাকুক নচেৎ কোন লোহা লক্কড়ের ব্যবসায়ী হয়ত শেষ অবধি বাড়িটা দখল নেবে। ক্রমশ: অবলুপ্তির পথে বনেদীয়ানা, ওই লোকটিও একই দলে – আমাদের মত এই শ্রেণীর মানুষদের এক জোট হওয়া উচিত। কিন্তু তালপুকুরে আর ঘটি ডোবে না।’ মণিকুন্তলা পথ চলতে চলতে ঠিক করেন এজেন্ট লোকটির অফিসে আর যাওয়ার দরকার নেই। লাভই বা কি? যা হোক করে টেনে টুনে হয়ত মাসের ভাড়াটা দেওয়া যাবে কিন্তু অন্যান্য খরচা? ওই বাড়িতে থাকতে হলে কাজের লোক জরুরী, তা ছাড়া নিজেদের দৈনন্দিন খরচ? পরের দিন সকালটা তাঁর অনেক দিন মনে থাকবে। যথারীতি তিনি বসেছিলেন হিসেবের খাতা নিয়ে। ওই সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দে, উঠে গিয়ে দেখেন ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে আছে চিঠি নিয়ে। আশ্চর্য হয়ে চিঠিটা পড়ে তিনি হতবাক। চিঠিতে বলা হয়েছে বাড়ির মালিকের নির্দেশে ওই বাড়িটা দু’শো টাকা মাসিক ভাড়ায় ছয় মাসের জন্য মণিকুন্তলা দেবীকে দেওয়া হলো। চিঠিটা পাঠিয়েছেন এজেন্ট ভদ্রলোক, সংক্ষিপ্ত কথায় আরো বলেছেন
– “নির্দেশ অনুযায়ী – কাজের লোকজনরা বাড়ির কাজের জন্য থাকবে মালিকের খরচে। আশা করি বাড়ির মালিকের প্রস্তাবে আপনি রাজী হবেন।
”সত্যিই অবাক করা প্রস্তাব। তিনি আশ্চর্য হয়ে নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য চিঠির শব্দগুলি একটু উঁচু স্বরে পড়েন। হতবাক অবস্থার শেষ সীমায় শুনতে পান তাঁকে কেউ পর পর কিছু জিজ্ঞাসা করছে। হুঁশ ফিরতে দেখেন রঞ্জনা আর সৌমেন্দ্র, দু’জনেই ঘরে রয়েছে
- “চুপি চুপি বাড়ি দেখে এসেছে মা!” আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে রঞ্জনা।
“বাড়িটা কেমন দেখলে? ভালো?”
মণিকুন্তলা দেবী অল্প কথায় ছেলে মেয়েদের বাড়িটার বর্ণনা দিলেন। সৌমেন্দ্র একটু সন্দেহের চোখে পুলিশের মত জেরা শুরু করে –
“এর পিছনে নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে। ব্যাপারটা রহস্যজনক। আমি নিশ্চিত এর ভেতর গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।”
“তুই চুপ কর সৌম্য,” রাগত স্বরে বলে রঞ্জনা।
“এটার ভেতর সন্দেহর কি আছে’রে ? ওই রাবিশ ডিটেকটিভ বইগুলো পড়ে পড়ে সব কিছুতে রহস্য খুঁজে বেড়াস।”
“দ্যাখ দিদি, ভাড়ার টাকার অঙ্কটাই রহস্য জনক,” সৌম্য বিজ্ঞের মত বলে
– “আমাদের শহরে, ওই এলাকায় এত কম ভাড়ায় ওই রকম একটা বাড়ি কি করে সম্ভব?” গম্ভীর স্বরে আবার তার মন্তব্য
- “আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। আমার মনে হচ্ছে, এইরকম অদ্ভুত প্রস্তাবের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।”
“বাজে কথা বলিস না,” রঞ্জনা রাগত হয়ে বলে।
“ঘটনাটা খুব সাধারণ, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কোনো পয়সাওয়ালা লোকের খুব প্রিয় ওই বাড়িটা। মনে হয় বেশ কিছু দিনের জন্য তিনি এখানে থাকবেন না। সেই জন্য কোনো ভদ্র পরিবার খুঁজেছেন যাঁদের হাতে বাড়ির ভার দিয়ে যাবেন। এর মধ্যে রহস্যটা কোথায়?
“তুমি বাড়িটার ঠিকানা কি বললে যেন?” সৌমেন্দ্র তার মা’কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঠিকানাটা আবার জানালেন।
“উফ!” সে ভাঙা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়
- “বলেছিলাম এর মধ্যে নিশ্চয়ই রহস্য আছে। তোমরা কি জানো, শহরের নামকরা ব্যবসায়ী বিশাল পয়সাওয়ালা রণেন্দ্র সরকার হঠাৎ একদিন ওই বাড়িটা থেকে উধাও হয়ে যান?”
“তুই সত্যি জানিস?” মণিকুন্তলা দেবীর সন্দেহের সুর।
“আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত মা। ভদ্রলোকের এই শহরে অনেকগুলো বাড়ি আর ফ্ল্যাট আছে, কিন্তু তুমি যে ঠিকানার বলছ, তিনি ওই বাড়িটায় থাকতেন। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল তিনি একদিন অনেক রাতে ক্লাবে থেকে বাড়িতে ফেরেন আর সেদিনের পর থেকে কেউ আর তাঁকে দেখেনি। অনেকে ভেবেছিল ভদ্রলোক কাউকে না জানিয়ে বিদেশে কোথাও উধাও হয়েছেন। চেনাজানা লোকেরাও ওনার উধাও হওয়ার কারণ খুঁজে পায়নি।” সৌম্য কিছুক্ষণ থেমে, বলতে থাকে -
“এই জন্য আমার স্থির বিশ্বাস ওই বাড়িতে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুন হয়েছেন। আর তুমি বলছিলে না বাড়ির দেওয়ালগুলো কাঠের প্যানেলে মোড়া?
“হ্যাঁ” মণিকুন্তলা চিন্তান্বিত হন – “তবে --”। সৌম্য তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অতি উৎসাহে বলে যায়-
“প্যানেলিং ছিল তো! তা’হলে চিন্তা কর – নিশ্চয়ই প্যানেলের আড়ালে কোথাও লুকানো খুপরি ঘরে মৃত দেহটা সেই খুনের রাত থেকে পড়ে আছে। দেখ হয়ত পচন রোধক ওষুধ দেওয়া কাপড় জড়িয়ে রাখা আছে যাতে গন্ধ না বেরোয়।”
“দ্যাখ সৌম্য, বাজে বকার একটা সীমা আছে,” মণিকুন্তলা বিরক্ত হন।
“বোকার মত কথা বলিস না, ওই সব বস্তা পচা ডিটেকটিভ গল্পগুলো পড়ে তোর মাথাটা নিরেট হয়ে গেছে। আর তুই যখন বলছিস তিনি যথেষ্ট পয়সাওয়ালা মানুষ, তার মানে দাঁড়ায় এই সামান্য ভাড়ার জন্য তাঁর কোনো চিন্তা নেই।”
রঞ্জনাও রেগে ওঠে।সৌম্য তার রোগাসোগা লম্বা শরীরে আর কুড়ি বছর বয়সের যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার শেষ কথা জানিয়ে দেয় –
“বাড়িটা নিয়ে নাও মা। তবে দেখো একদিন আমি ওই বাড়ির আসল রহস্যটা ঠিক খুঁজে বার করবো।”
অফিসে দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা আর মেয়ে পরস্পরের দিকে চিন্তান্বিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
“খরচ চালানো কি সম্ভব হবে মা?” রঞ্জনা কাঁপা স্বরে বলে।
“যদি একটা চাকরি জোগাড় করতে পারতাম!”
“দ্যাখ রঞ্জু – সেখানে অনেকগুলো কাজের লোকজন আছে,” মণিকুন্তলা কিছুটা যেন ভেঙে পড়ে বলেন, “তাদের হয়ত মাইনে দিতে হবে না কিন্তু তাদের খাওয়াদাওয়া তো আছে, তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে, তখন তো ভার নিতে হবে – ওইটাই বেশ মুশকিলে ফেলবে। আমাদের নিজেদেরটা কমবেশি করে চালিয়ে নেওয়া যায় – কিন্তু সঙ্গে থাকা কাজের লোকজনদের --
”তিনি করুণ দৃষ্টিতে তাকান মেয়ের দিকে, রঞ্জনা নি:শব্দে সায় জানায়। “
"দেখি একটু চিন্তা করে,” মণিকুন্তলা বলেন। মণিকুন্তলা দেবী, ‘রায় ভিলা’ থেকে চলে আসার পর, এখন বাস্তব অবস্থাটা ভালো বোঝেন। এই নতুন ভাড়া বাড়ি নিয়ে আলোচনার সময় দেখেছেন রঞ্জনার চোখ দুটো আশার আনন্দে ঝলমল করে উঠতে। তিনিও ভেবেছেন রঞ্জনাকে যথোপযুক্ত পরিবেশে দেখুক গৌতম। সৌম্যরও দরকার তার বড় হয়ে ওঠার জন্য সঠিক পরিবেশ। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে – এই সুন্দর সুযোগটা তিনি হারাতে চান না। আবার রায় বাড়ির পারিবারিক বনেদীয়ানা ধরে রাখার উপায়ও পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে সংসার চালানোর খরচ আরো হিসেব করে করতে হবে। তিনি মন ঠিক করে ফেলেন। .তিনি তখনি ভাড়ার নতুন শর্তাদি স্বীকার আর বাড়িটায় ওঠার দিনক্ষণ জানিয়ে এজেন্টকে চিঠি লিখে দিলেন। মণিকুন্তলা দেবী দিনক্ষণ অনুযায়ী সরকার বাড়িতে উঠে এলেন। একদিন সকালে -
“বিপ্রদাস- রোজ এতো গোলাপ কোথা থেকে আসে? বাড়ির বাগানে তো দেখিনি! এত দামী ফুল আমি কিন্তু কিনতে পারবো না।”
“ফুল তো আসে কর্ত্তামশাইয়ের বারাসাতের বাগান বাড়ি থেকে। এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বাগানের মালী রোজ সকালে ফুল দিয়ে যায়।”
পরিপাটি পরিষ্কার ধুতি ফতুয়ায় সজ্জিত বিপ্রদাস বিনীত স্বরে কৈফিয়ত দিয়ে নি:শব্দ পা’য়ে ঘরের বাইরে চলে যায়। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেন মণিকুন্তলা।গত দু’মাস, বিপ্রদাসের ব্যবস্থাপনা তাদের জীবন মসৃণ গতি পেয়েছে। কোনো চিন্তা করতে দেয় না লোকটি। ক্রমশ তিনি কি পুরোপুরি বিপ্রদাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন! মনে হয় এই লোকটিকে ছাড়া তিনি আর বোধহয় চলতে পারবেন না। তিনি ভাবেন ‘কোনো ভালো, বেশী দিন টেকে না। হঠাৎ জেগে উঠে দেখবেন, সবই স্বপ্ন।’ এ’যেন স্বপ্নের জীবন। বাড়িটায় থাকতে এত ভালো লাগছে। ‘রায় ভিলা’র দিনগুলো মনে পড়িয়ে দেয়। এই দুটো মাস যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল, বোঝা গেল না।’
জীবনটা সত্যি হয়ে উঠেছে আশ্চর্যজনক মনোরম। বিপ্রদাসের হাবভাবে প্রকাশ পায় এই বাড়িতে তার একছত্রতা। একদিন সে সসম্ভ্রমে বিনয়ের সাথে জানিয়েছিল
“বাড়ির সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দিন ম্যাডাম। দেখবেন আপনি নিশ্চিন্তে থাকবেন।”
প্রতি সপ্তাহে, বিপ্রদাস হিসেবের খাতা নিয়ে আসে। কুন্তলা দেবী অভ্যাস মত হিসেব পরীক্ষা করেন। তিনি আশ্চর্য হন ভেবে – তাঁর বস্তিতে থাকার সময়ের সাপ্তাহিক খরচের থেকে এখনকার খরচ অনেক কম হচ্ছে! এই বাড়িতে বিপ্রদাস ছাড়া, রাঁধুনী, মালী আর পরিচারিকা আছে। তার খুবই ভদ্র ও কর্মঠ, কিন্তু বিপ্রদাস পুরো বাড়ির দেখাশোনা করে। প্রায় রোজ খাওয়া টেবিলে নানা রকম মাছ মাংসের পদ লক্ষ্য করে মণিকুন্তলা দেবীর উদ্বেগ প্রশমিত করে বিপ্রদাস-
“এই বাড়ির বরাবরের নিয়মানুযায়ী মাছ মাংস সব কর্ত্তামশাইয়ের বারাসাতের বাগান বাড়ির পুকুর,পোলট্রি থেকে আসে।”
মণিকুন্তলা মনে মনে চিন্তা করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন বিপ্রদাস তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি যেন একটু বেশী অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। সে যেন তাঁকে খুশি দেখার জন্য সবকিছুই অতিরিক্ত করছে। তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। এখন তাঁর সন্দেহ হয় বাড়ির মালিকের তার এই এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজে বা কথায় সম্মতি আছে কিনা।
সৌম্যর সেদিনের কথাগুলোয় তাঁর মনে অতিরিক্ত চিন্তার মেঘ ঘনায়। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে এর মধ্যে একদিন বাড়ির এজেন্টের অফিস গিয়ে অন্য কথার ভেতর তিনি বাড়ির মালিকের প্রসঙ্গ তুলতেই, সাদা চুলের বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিষয়টা স্পষ্ট করে দিলেন –
“খুব স্বাভাবিক আপনার প্রশ্নটা। রণেন্দ্র সরকার আজ প্রায় দেড় বছর হলো মুশৌরির ল্যান্ডর কলোনি কাছের একটি গ্রামে তাঁর বাংলোতে থাকেন। উনি একটু ছন্নছাড়া প্রকৃতির মানুষ।” একটু হাসলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
“সরকার সাহেব হঠাৎ একদিন শহর ছেড়ে চলে যান। আপনার মনে আছে বোধহয় এই নিয়ে সেই সময় খবরের কাগজে কিছু লেখালেখি হয়েছিল? তিনি কাউকে কিছু জানিয়ে যান নি। পুলিশও অনেক তদন্ত করেছিল। ভাগ্যক্রমে সবকিছু জানিয়ে তিনি পুলিশকে চিঠি দিয়েছিলেন, হইচই সব থেমে যায় সেই সময়। যদিও তাঁর এক ভাগ্নে আছেন কিন্তু তিনি শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তাঁর সব বৈষয়িক ব্যাপার সামলাবার জন্য শহরের এক নামী সলিসিটরকে নিযুক্ত করে দিয়ে যান। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন – তিনি বেশ খাপছাড়া, খামখেয়ালী মানুষ। যদিও তাঁর বয়স হচ্ছে কিন্তু অদ্ভুত খেয়ালে তিনি জনবিরল বন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বা থাকতে পছন্দ করেন। আমার মনে হয় তিনি এই শহুরে জীবনে কবে ফিরবেন বা আদৌ ফিরবেন কিনা, কেউ জানেনা। আর বিপ্রদাস তাঁর খাস খানসামা। সে সরকার সাহেবের পছন্দ অপছন্দয় পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।”
শুনতে শুনতে মণিকুন্তলা দেবীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনেক দিন আগে কোনো বিদেশী ম্যাগাজিনে দেখা একটি ছবি। খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো পোড় খাওয়া বৃদ্ধ নাবিকের, দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা বলী রেখাঙ্কিত মুখে ক্লে পাইপ। -
“মি:সরকারের বোধহয় খুব একটা বয়স হয়নি?” জিজ্ঞাসা করেন তিনি।
“মাঝবয়সী বলতে পারেন, সরকারি পরিচয় পত্র অনুযায়ী, ওনার তিপ্পান্ন বছর বয়স হবে।” বলেন সাদা চুলের ভদ্রলোক। .
সৌম্য সব শুনে নিজের ধারণা আরো সুস্পষ্ট করে-
“মা দ্যাখো – ব্যাপারটা আমার কাছে আরো জটিল হয়ে উঠছে- ওই ভাগ্নেটি কে? ও ঠিক জানে, রণেন্দ্র সরকারের কিছু হয়ে গেলে পুরো সম্পত্তি তার হয়ে যাবে। মুশৌরির থেকে পুলিশকে পাঠানো চিঠিটা নিশ্চয়ই জাল। আমি বইতে পড়েছি, আইন অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রণেন্দ্র সরকারের হদিস না পাওয়া গেলে, তাঁকে মৃত ধরে নেওয়া হবে আর ভাগ্নে সম্পত্তি পেয়ে যাবে।”.
মণিকুন্তলা দেবী আজকাল লক্ষ্য করেছেন সৌম্যর পরিবর্তন। সে যেন ধীরে ধীরে তার কট্টর ধারণা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে বাড়িটার প্রতি যেন সদয় হয়ে উঠছে। কিন্তু ছুটির দিনগুলোয় সে মাঝে মাঝে, বাড়ির দেওয়ালের কাঠের প্যানেলিঙ ঠুকে ঠুকে দেখে, গজ ফিতে নিয়ে কি সব মাপজোক করে, বোধহয় ওগুলোর আড়ালে চোরা কুঠরি আছে কিনা খোঁজে। তবে মনে হচ্ছে সে বোধহয় রণেন্দ্র সরকারের নিরুদ্দেশ রহস্য খোঁজাতে ক্রমশ নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছে। তিনি আরো লক্ষ্য করেন সৌম সেই বস্তির পানওলার মেয়েটিকে নিয়ে আজকাল বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য করে না। পরিবেশ মানুষকে পাল্টে দেয়।
আর রঞ্জনা? এই বাড়িটায় এসে সে এখন আনন্দে খুশিতে উচ্ছল। গৌতম এখন ঘন ঘন এই বাড়িতে আসে। সময় পেলেই মণিকুন্তলা দেবীর সাথে ছেলেটি গল্প করে। তিনিও তাকে পছন্দ করেন। একদিন গৌতম নানা কথার মধ্যে রঞ্জনাকে বলা কিছু কথা তাঁর কানে আসায় তিনি আশ্চর্য হন।
“দ্যাখ রঞ্জনা – এই বাড়িটা দেখে মনে হয়, তোমার মা’র সাথে বাড়িটা আর এর পরিবেশ কেমন যেন সুন্দর ভাবে মিশে গেছে।”
“মা’র সঙ্গে?” রঞ্জনার স্বরে আশ্চর্য ভাব।
“হ্যাঁ – তাই বলতে পারো। মনে হয় এই বাড়িটা যেন তৈরি হয়েছে ওনার জন্যই। তোমার মা আর বাড়িটা যেন একাত্ম হয়ে আছে। ভালো করে দেখলে কিছু অস্বাভাবিকতা, বলতে পারো কিছুটা অপার্থিব, রহস্যময় পরিবেশ জড়িয়ে আছে বাড়িটায়।”
“সৌম্যর মতো কথা বোলো না,” – রঞ্জনা বকুনি দেয় গৌতমকে। “ওর মাথায় সবসময় ঘুরছে, রণেন সরকারের ভাগ্নে ওনাকে খুন করে মৃতদেহ এই বাড়ির কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।”
গৌতম হেসে ফেলে।
“ছেলেটার গোয়েন্দাগিরি নিয়ে প্রবল উৎসাহ দেখে বেশ মজা লাগে। কিন্তু আমি সেই ভাবে কিছু বলতে চাইছি না রঞ্জনা। আমার শুধু মনে হয় এই বাড়ির বাতাবরণ যেন কেমন অন্য রকম, এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশটা ঠিক পরিষ্কার বোঝা যায় না।”
বাড়িটায় কুমণিন্তলা দেবীর পরিবারের প্রায় তিন মাস কেটে যাওয়ার পর, রঞ্জনা একদিন উৎফুল্ল হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে –
“মা, আমরা বিয়ে করব ঠিক করেছি। গতকাল সন্ধেবেলা ঠিক হলো। আমার মনে হচ্ছে যেন কোনো সত্যিকারের রূপকথার জগতে পৌঁছে গেছি।”
মণিকুন্তলা দেবী মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন আনন্দে।
“জানো মা, গৌতম আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে,” রঞ্জনার চোখে দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়। মণিকুন্তলা দেবী একটু লজ্জিত হয়ে মজা পেলেন।
“ হ্যাঁ মা- গৌতম বলেছে,” রঞ্জনা আরো উৎসাহের সাথে বলে – “আমার থেকে নাকি তোমায় বেশী মানিয়েছে এই বাড়িটার পরিবেশে।”
“বাজে কথাগুলো আর বলিস না রঞ্জনা।”
“বাজে কথা নয় মা। গৌতম বলেছে ‘এই মায়াময় বনেদীয়ানা জড়ানো বাড়িটার স্বপ্নিল পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তোমার মা, যেন গর্বিতা রাজকুমারী আর বিপ্রদাস হল – বলতে পারো!! হ্যাঁ - ঠিক যেন– কোনো এক হিতৈষী জাদুকর’।”
মণিকুন্তলা দেবী হেসে ফেলেন। তবে তিনি মেনে নিলেন রঞ্জনার কথার শেষ অংশ
– ‘বিপ্রদাস হল হিতৈষী যাদুকর’।
সৌম বাড়ি ফিরে দিদির বিয়ের খবরটা শান্তভাবে শুনে -
“আমি ঘটনাটা আন্দাজ করেছিলাম মা।” বেশ বিজ্ঞের মত তার মন্তব্য।
সেই রাতে রঞ্জনা বেরিয়েছিল গৌতমের সঙ্গে – সৌম্য ও মণিকুন্তলা রাতের খাওয়া সারছে। বিপ্রদাস ধীর স্থির পা’য়ে এসে এক প্লেট নানা রকম মিষ্টি টেবিলে রেখে নি:শব্দে চলে যায়।
“আজব বুড়ো একটা”-বন্ধ হওয়া দরজা দিকে ইঙ্গিত করে সৌম্য, “বুড়োটার হাবভাব ঠিক সুবিধের নয়, কিছু যেন ---”
মণিকুন্তলা মৃদু হেসে সৌম্যকে থামিয়ে বলেন – “রহস্যময় বলতে চাইছিস?”
“তুমি কি করে বুঝলে কি বলতে চাইছি?” সৌম্যর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা।
“ওটা তোর কথা সৌম্য, আমার নয়। তুই সব কিছুতে রহস্য খুঁজিস। তোর মাথায় সব সময় ঘুরছে বিপ্রদাস খুন করে রণেন্দ্র সরকারের দেহ বাড়ির মেজের নিচে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে?”
“মেজের নিচে নয়, দেওয়ালের কাঠের প্যানেলের পিছনে কোথাও। তুমি সব সময় ভুল কথাটা মনে কর মা। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ভদ্রলোক যেদিন উধাও হলেন, বিপ্রদাস সেদিন ছিল তাঁর বাগান বাড়িতে, এখানে নয়।”
মণিকুন্তলা দেবী একটু হেসে, খাওয়ার ঘর থেকে বসার ঘরের দিকে চলে যান। তাঁর মনে হয় সৌম্য যেন বয়সের অনুপাতে বেশ বড় হয়ে গেছে।
হঠাৎই তাঁর চিন্তায় এই প্রথম বার এলো, রণেন্দ্র সরকার জানাশোনা কাউকে না জানিয়ে আচমকা এই শহর ছেড়ে চলে গেলেন কেন? ভদ্রলোক খামখেয়ালী হতে পারেন কিন্তু হঠাৎ এত বড় সিদ্ধান্তের পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে! তাঁর ঘটনাটার কারণ নিয়ে চিন্তার সময় বিপ্রদাস কফির ট্রে নিয়ে বসার ঘরে আসে। মণিকুন্তলা ভাবেন এই লোকটা তাঁর সামান্যতম অভ্যাসগুলো মাথায় রেখেছে। ঠিক সময় কফি নিয়ে হাজির। তাঁর পুরনো দিনের অভ্যাস রাতের খাওয়ার পর এক কাপ কফি খাওয়া। তাঁর মনটা নরম হয়ে যায়। তবুও তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে তাঁর ধন্দ দূর করতে চান।
“বিপ্রদাস তুমি বোধহয় সরকার সাহেবের সঙ্গে অনেক দিন আছো? তাই না?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, বলতে পারেন আমার একুশ বছর বয়স থেকে। তখন সাহেবের বাবা মালিক ছিলেন। আমি তখন এই বাড়ির খুব সাধারণ কাজগুলো করতাম।”
“তুমি তা’হলে এখনকার মালিককে ভালো করেই চেনো, কেমন ধরনের মানুষ তিনি?”
বিপ্রদাস ট্রেতে রাখা চিনির পাত্রটা একটু কাছে সরিয়ে দিল তাঁর সুবিধের জন্য, সেই সঙ্গে নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দেয় –
“সরকার সাহেব ভীষণ স্বার্থপর মানুষ ছিলেন ম্যাডাম, অন্যের ভালমন্দের দিকে তাঁর কোনো নজরই ছিল না।”
সে স্বভাব মত খালি ট্রে নিয়ে নি:শব্দে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মণিকুন্তলা দেবী কফির কাপ হাতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকেন।
বিপ্রদাসের তার মালিকের ব্যাপারে মন্তব্য ছাড়াও তাঁর হঠাৎ অন্য কোনো কথায় যেন খটকা লাগে। পর মুহূর্তে তাঁর মনে পড়ে যায় শব্দগুলো।
বিপ্রদাস তার মালিক সন্মন্ধে মন্তব্যে তাঁর উদ্দেশ্যে একটি শব্দ উল্লেখ করেছে-- ‘ছিলেন’’, যে শব্দে অতীত বোঝায়। তার মানে বিপ্রদাস পুরোপুরি ওয়াকিবহাল বা সে জানে তার মালিক আর নেই? তিনি সোজা হয়ে বসেন। তাঁর চিন্তাধারা কি সৌম্যর পথে চলেছে!! কি যেন এক অস্বস্তিতে তিনি জর্জরিত হতে থাকেন। সেই মুহূর্ত থেকে একটা সন্দেহ তাঁর মনে দানা বাঁধতে থাকে।
রঞ্জনা জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছে, সে এখন সুরক্ষিত। তাঁর এবার সময় এসেছে নিজের চিন্তায় মনোনিবেশ করার। কিন্তু তিনি আশ্চর্য হন, – তাঁর চিন্তা এখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবর্তিত হচ্ছে রণেন্দ্র সরকারের নিরুদ্দেশ রহস্যে। সত্যি ঘটনাটা কি হতে পারে? বিপ্রদাস সত্যি কি কিছু জানে? এই পরিবারের এতদিনকার লোক হয়েও, সে ওই অদ্ভুত মন্তব্য কেন করল-
“ভীষণ স্বার্থপর মানুষ, অন্যের ভালোমন্দের দিকে কোনো নজর ছিল না” – কথাগুলো বলার পিছনে কি ছিল? মনে হলো বিপ্রদাস যেন এই সমাজের বিচারকের ভূমিকায় নিরপেক্ষ রায় ঘোষণা করছে !! বিপ্রদাস কি রণেন্দ্র সরকারের নিরুদ্দেশ ঘটনার সাথে জড়িত? সে ওই ঘটনায় সক্রিয় অংশ নিয়েছিল? রণেন্দ্র সরকারের পুলিশের কাছে পাঠানো চিঠি নিয়ে সৌম্যর ধারনাটা আগে হাস্যকর মনে হলেও সন্দেহ জাগিয়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, বিপ্রদাস ঘটনাটার সাথে জড়িত।
মণিকুন্তলা তাও ছোট্ট মেয়ের মত বারে বারে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন – বিপ্রদাস এ কাজ করতে পারে না, সে সত্যি ভালো মানুষ। বিপ্রদাসের মতো মানুষ খারাপ হতে পারে না। কিন্তু সে কি কিছু জানে?
ওই দিনের পর, তিনি আর কখনো বিপ্রদাসের সঙ্গে তার মালিককে নিয়ে কোনো কথা বলেন নি। ক্রমশ তিনি ভুলে গেছিলেন বিষয়টা। রঞ্জনা আর সৌম্য, যে যার নিজের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা হয়নি।
কয়েক মাস পরে তাঁর মনের কোনে উঁকিঝুঁকি দেওয়া অস্পষ্ট সন্দেহটা হঠাৎ দানা বেঁধে বাস্তব হয়ে ওঠে। সৌম্য দিন চারে’কের ছুটি পেয়ে তার এক বন্ধুর সাথে মোটর বাইক নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। তার বেড়াতে যাওয়ার একদিন বাদে,মণিকুন্তলা দেবী তখন তাঁর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত, তিনি অবাক হন সৌম্যকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে।
“সৌম্য, কি হলো!” তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন।
“আমায় এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে আমি জানি তুমি আশ্চর্য হবে কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমার বন্ধু সুনন্দর নির্দিষ্ট কোন জায়গায় যাওয়ার ঠিক ছিল না। আমরা ঘুরতে ঘুরতে বারাসাতের কাজীপাড়ার কাছে হাট বসেছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। পরে মনে হল এর কাছেই তো সরকার সাহেবের সেই বাগান বাড়ি! ভাবলাম বাগান বাড়িটা একবার দেখে যাই ---”
“তুই বারাসাত গেছিলি কিন্তু কেন?”
“তুমি তো ভালো করেই জানো, আমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলাম এই বাড়ির ব্যাপারটা রহস্যময়, কিছু গোলমাল আছে। যাইহোক, লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে সেই বাড়ি খুঁজে পেলাম। কি দেখলাম জানো, বাগান বাড়ি একটা আছে বটে, তবে জঙ্গল ভরা, ভাঙ্গাচোরা একটা বাড়ি-–- লোকজন কেউ নেই। অবশ্য আমি কোনো আশা করিনি কারণ জানতাম আমার সন্দেহটা ঠিক।”
সৌম্যর হাবভাব এখন যেন অনেকটা শিকারী কুকুরের মত। সহজাত প্রবৃত্তির বশে মনের খুশিতে ব্যস্ত হয়ে অজানা শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে।
“হাটের থেকে একটু দূরের গ্রামটা দেখার জন্য খানিকটা এগোতেই রাস্তায় কাউকে দেখে চমকে উঠি – লোকটাকে ওখানে দেখতে পেলাম।”
“কোন লোক’কে দেখলি তুই?”
“বিপ্রদাসকে—সেই গ্রামের একটা ছোট বাড়ির ভেতরে তাকে যেতে দেখলাম। মনে হল ব্যাপারটা খুব রহস্যময়। বাইক থামিয়ে,কিছুটা পথ পিছিয়ে সেই বাড়িটার দরজায় আওয়াজ করতে, সেই লোকটা নিজেই বেরিয়ে আসে।”
“কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তুই বেড়াতে যাওয়ার দিন থেকে বিপ্রদাস বাড়ির বাইরে একবারও বেরোয়নি সৌম্য?
“তুমি কথার মাঝে বাধা না দিয়ে, একটু চুপ করে শোনো, এবার আসল কথায় আসছি, মা। এটা ঠিক, সে আমাদের বিপ্রদাস নয় কিন্তু লোকটা আবার বিপ্রদাসই বটে। আমি কি বলতে চাইছি – তুমি বুঝতে পারছো কি না জানি না।”
মণিকুন্তলা দেবী সত্যি বুঝতে পারেন না সৌম্যর কথা, সৌম্য তখন বিশদ করে--
“লোকটা বিপ্রদাস,কিন্তু আমাদের বিপ্রদাস নয়। কিন্তু সেই হলো সাচ্চা বিপ্রদাস।”
“সৌম্য!” মণিকুন্তলা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।
“তুমি পুরোটা শোনো আগে। প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসা করি ‘তোমার নাম বিপ্রদাস, তাই না?’
বুড়ো বলে- ‘ঠিক –আমারই নাম বিপ্রদাস। আমার সঙ্গে কি দরকার?’ তখনই আমি বুঝেছিলাম লোকটা আমাদের বিপ্রদাস নয়, যদিও তার চেহারা প্রায় একই রকম, বা কিছু মিল আছে। আমি তখন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে সব জানতে পারলাম। লোকটির কোনো ধারণা নেই কি রহস্যময় ঘটনা ঘটে চলেছে তাকে আড়ালে রেখে। সে - রণেন্দ্র সরকারের আসল খানসামা বিপ্রদাস-- লোকটা স্বীকার করে নেয়। সরকার সাহেবের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিক ওই সময়ে তাকে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাকে থাকার জন্য ওই গ্রামের ছোটা বাড়িটা আর মাসিক পেনসনের ব্যবস্থাও করা হয়।
তা’হলে তুমি এখন বুঝতে পারছ পুরো রহস্যটা। আমার ধারণাটা কেমন মিলে যাচ্ছে দেখ। এখানকার লোকটা ভণ্ড, সে নিজের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যর জন্য বিপ্রদাস সেজে রয়েছে। আমার যুক্তি বেশ পরিষ্কার। সরকার সাহেব উধাও হওয়ার দিন এই লোকটা বারাসাতের আসল বিপ্রদাস সেজে রাতের বেলা এখানে এসে সরকার সাহেবকে খুন করে এই দেওয়ালের কোনো প্যানেলের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে। এইসব পুরনোর বাড়িতে নিশ্চয়ই চোরা কুঠরি ---”
“উফ! তোর ওইসব ধারণার কথা এবার রাখ,” মণিকুন্তলা দেবী রেগে গিয়ে থামিয়ে দেন সৌম্যকে।
“তোর এই রকম সব বিদঘুটে ধারণা আর সহ্য করতে পারছি না। আমি জানতে চাই, বিপ্রদাস, মানে এখানকার বিপ্রদাস কেন এই ধরণের জঘন্য অপরাধ করবে – কেন? যদি সন্দেহ থাকে - মনে রাখিস আমি একবিন্দু বিশ্বাস করছি না, তবু জানতে চাই কারণটা কি হতে পারে?”
“তুমি ঠিক ধরেছ,”
সৌম্য বলে – “উদ্দেশ্যটা কি? এই নিয়ে আমি খোঁজখবর করেছি। এই শহরে সরকার সাহেবের অনেকগুলো বাড়ি, ফ্ল্যাট আছে। জানতে পেরেছি আমাদের মতন পরিবারদের অতি অল্প টাকায় আর কাজের লোকেরা বাড়িতেই থাকবে এই শর্তে, প্রায় প্রতিটি বাড়ি গত দেড় বছরে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
মজা হলো, আমাদের বিপ্রদাস, মানে যে লোকটা নিজেকে বিপ্রদাস হিসেবে পরিচয় দিয়েছে, প্রতিটি বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য খানসামা সেজে কাজ করে। তার মানে হচ্ছে- কোনো দামী কিছু – ধরো গয়না বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ দলিল – বাড়িগুলোর কোনো একটায় লুকিয়ে রাখা আছে যার খোঁজ চোরের দল জানে না। আমার মনে হয় কোনো সংগঠিত চোরের দল আছে যারা সেগুলো খুঁজে বার করার চেষ্টায় আছে। আবার হতে পারে এই ভণ্ড বিপ্রদাস একাই কাজটা করছে। আবার মনে হয়------”
“সৌম্য! তুই চুপ করবি?” মণিকুন্তলা দেবী ধমকে থামিয়ে দেন সৌম্যকে-
“তোর আজেবাজে কথায় আমার মাথা ধরে গেছে। যাই হোক এই সব ভিত্তিহীন কথার কোনো মানে নেই – চোরের দল আর লুকোনো দলিল – যত সব আজগুবি কথা।”
“আর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে।” অদমিত সৌম্য বলে চলে –
“আমাদের বাড়ির এই নকল বিপ্রদাস হয়ত অন্য এমন কেউ একজন যাকে সরকার সাহেব কোনো ভাবে ক্ষতি করেছিলেন। সত্যিকারের বিপ্রদাস একটা ঘটনার কথা বলেছে- ঘটনাটা হয়েছিল এই বাড়ির আগের মালী বৈকুণ্ঠ – যার চেহারার সাথে আমাদের এই ছদ্মবেশী বিপ্রদাসের কিছুটা মিল আছে, গোঁফটা ছাড়া। হতে পারে সেই পুরনো মালীর হয়ত রাগ আছে সরকার সাহেবের -----”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় মণিকুন্তলা দেবী চমকে ওঠেন।
‘অন্যের ভালো মন্দের দিকে কোনো নজর ছিল না।’ বিপ্রদাসের নির্লিপ্ত উদাসীন স্বরে বলা নির্দিষ্ট কথাগুলো তাঁর মনে এসে যায়। খুব সাধারণ কথাগুলো, কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনো অর্থ কি ছিল?
চিন্তা ভারাক্রান্ত মনে তিনি ভালো করে সৌম্যর কথা শোনেন নি। শেষ দিকে সে তাড়াহুড়োয় কি সব বলে – ব্যস্ততার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে তাঁর হুঁশ ফেরে। সৌম্য তাড়াহুড়ো করে গেল কোথায়? তার বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলা কথাগুলো তিনি ভালো করে শোনেন নি। কোথায় গেল সে? খুব সম্ভবত: পুলিশে গেছে। তা’হলে ---
তিনি তাড়াতাড়ি সোফা থেকে উঠে ঘণ্টা বাজিয়ে বিপ্রদাসকে ডাকেন।
বিপ্রদাস সঙ্গে সঙ্গে ঘরে আসে - “আপনি ডেকেছেন ম্যাডাম?”
“দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে এস।”
বিপ্রদাস কথামতো ঘরের ভেতর আসে। মণিকুন্তলা দেবী শান্তভাবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিপ্রদাসকে জরিপ করেন।
তিনি ভাবেন: ‘অল্প কিছু দিনের মধ্যে লোকটি তাঁর প্রতিটি পছন্দ অপছন্দ জানে আর সবে’তে খেয়াল রাখে – কেউ জানে না আমার প্রতি সে কতটা যত্নশীল। ছেলে মেয়েরা এসব বুঝতে পারবে না। সৌম্যের গল্পটা হ’তে পারে আজগুবি – আবার জানি না - কিছু সত্যি লুকিয়ে আছে হয়ত! সত্যি মিথ্যের বিচার কে করবে? কিন্তু তিনি অন্তর থেকে বোঝেন -- এই লোকটি সত্যিই খুব ভালো মানুষ। নিজের জীবন বাজি রেখে প্রমাণ করতে পারেন তিনি – ঠিক, বাজি রাখতে পারেন!”
“বিপ্রদাস, সৌম্য ঘুরতে ঘুরতে বারাসাতের কাছে একটা গ্রামে গিয়েছিল – এখুনি সে ফিরেছে সেখান থেকে ........।”
বলতে বলতে তিনি থেমে গিয়ে লক্ষ্য করেন বিপ্রদাসের সামান্য ভাব পরিবর্তন যা সে লুকোতে পারল না।
“সেই গ্রামে সৌম্য – কাউকে দেখতে পেয়েছে,” তিনি শান্ত মাপা স্বরে বলেন।
তাঁর মনে হলো – ‘বিপ্রদাস যেন একটু সতর্ক হয়ে উঠেছে। তিনি নিশ্চিত বিপ্রদাস এখন বেশ সতর্ক।’
প্রথম চমকের পর, বিপ্রদাসের আবার সেই পরিচিত নির্বিকার হাবভাব, কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু রয়েছে যা তিনি আগে কখনো দেখেন নি। এই প্রথম তাঁর মনে হলো ওই অদেখা চাউনি কখনোই খানসামার হ’তে পারে না, এই দৃষ্টি একজন পুরুষের।
কয়েক মুহূর্ত বিপ্রদাস ইতস্তত: করে। এরপর তার গলার স্বরে ও হাব ভাবে যেন আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করেন –
“মণিকুন্তলা দেবী – আমাকে এসব কেন বলছেন?”
তাঁর উত্তর দেওয়ার আগেই, ঘরের দরজা জোর ধাক্কায় খুলে সৌম্য হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে আসে। তার সঙ্গে আসে আর একজন পুরুষ্টু গোঁফ ধারী, ভয় জড়ানো হাব ভাবের মাঝ বয়সী লোক।
“এই দ্যাখো মা-” – সৌম্য উত্তেজিত হয়ে বলে –
“ইনি হলেন আসল বিপ্রদাস। আমি আজ সকালে বারাসাত থেকে ফেরার সময় এনাকে সঙ্গে নিয়ে এসে রাস্তায় চা’য়ের দোকানে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম।“ এবার সৌম্য সঙ্গে আসা লোকটিকে বলে--
“বিপ্রদাস, এই সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে ভালো করে দেখ – এই লোকটা কি সেই অন্যায়ভাবে বরখাস্ত হওয়া বাগানের মালী বৈকুণ্ঠ?”
সৌম্যর জয়োল্লাসিত মুহূর্ত, বিশেষ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। হঠাৎ সে বুঝতে পারে কোথাও যেন মস্ত কিছু ভুল হচ্ছে। তার সঙ্গে আসা আসল বিপ্রদাস তখন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আর নকল বিপ্রদাসের অস্বস্তির হাসি রূপান্তরিত হলো অপার মজা পাওয়ার প্রাণখোলা হাসিতে।
তিনি এগিয়ে এসে আসল বিপ্রদাসের পিঠে চাপড় দিয়ে বলেন-
“ঘাবড়িয়ো না বিপ্রদাস, থলি থেকে এবার বেড়ালটাকে বার করে দাও দেখি! আমার ঠিক পরিচয় তুমি এখন বলে দিতে পার।”
আসল বিপ্রদাস নিজেকে সামলে নেয় কিছুটা।
“যে আজ্ঞে হুজুর,” সে জড়োসড়ো হয়ে বিনীত স্বরে বলে – “ইনি আমার মালিক সরকার সাহেব, আমাদের কর্তা মশাই।”
পর মুহূর্তে পট পরিবর্তন হলো। প্রথমে অতি আত্মবিশ্বাসী সৌম্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। ঘটনার অতি আকস্মিকতায় তার ঝুলে পড়া মুখে, কি ঘটতে চলেছে বোঝার আগেই সে টের পায় কেউ তাকে ধীরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের দরজার বাইরের দিকে - সাথে কোনো আন্তরিক গম্ভীর স্বর, সেই স্বরে কোথাও যেন পরিচিতির আভাস -
“বেশ বুদ্ধি করে আমাকে এই ভাবে খুঁজে বার করেছ। তোমায় তারিফ জানাই। কিন্তু সব ঠিক আছে – কারুর কোনো ক্ষতি হয়নি। এখন তোমার মা’র সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
সৌম্য, দো’তলায় ওঠার সিঁড়ির পাশে হতভম্ব হয়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। হতবিহ্বল আসল বিপ্রদাস তার পাশে দাঁড়িয়ে। তার বুদ্ধিতে ঘটনাটা সে যা বুঝেছে, তার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। ঘরের ভেতরে রণেন্দ্র সরকার তখন মণিকুন্তলা দেবীর সম্মুখীন হয়েছেন।
“যতটা সংক্ষেপে পারি – আমি পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে চাই। তারপর আপনি যা মনে করেন তাই করবেন।
“সারাটা জীবন আমি নিজের স্বার্থোদ্ধারে পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছি। হঠাৎই একদিন উপলব্ধি করলাম আমার এই আত্মম্ভরিতার পরিণাম। অনুশোচনায় ভরে উঠেছিল আমার মন। প্রায়শ্চিত্তের পথ খুঁজছিলাম। সেই সময় ঠিক করলাম, বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদানের পরিবর্তে, আমি নিজেই সরাসরি কিছু করবো। আমার সবসময় খারাপ লাগতো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর নিখাদ ভদ্র মানুষদের অবস্থা দেখে। যাঁরা নি:শব্দে দারিদ্র, দু:খ কষ্ট সহ্য করেন কিন্তু সরাসরি অর্থ সাহায্য নিতে অপমানিত বোধ করেন। আমার অনেকগুলো বাড়ি, ফ্ল্যাট আছে এই শহরে। ঠিক করলাম আমার বাড়িগুলি নাম মাত্র টাকায় ভাড়া দেব সেই শ্রেণীর অভাবী ভদ্র মানুষদের যাঁরা অভাবে পড়েও নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দেন না। যেমন ধরুন সবে জীবন শুরু করতে চলেছে এমন তরুণ দম্পতি অথবা স্বামী হারা কোনো মহিলা, যাঁর ছেলে মেয়েরা সবে জীবনে দাঁড়ানোর কঠিন সংগ্রাম শুরু করছে।
আমার কাছে ওই বিপ্রদাসের স্থান খানসামার থেকে অনেক উঁচুতে – বলতে পারেন এই বাড়িতে আমরা বড় হয়ে উঠেছি এক সঙ্গে, সে আমার বন্ধুর মত। ওর সঙ্গে আলোচনা করে, সম্মতি নিয়ে – ওর চরিত্রটা, বলতে পারেন আমি ধার করি। শুনে হাসবেন না, আমি ছোটবেলায় স্কুল কলেজে নাটক করতাম। সেদিন অনেক রাতে ক্লাব থেকে ফেরার সময় একটি উপায় মাথায় আসে। সঙ্গে সঙ্গে বিপ্রদাসের কাছে গিয়ে তার সাথে আলোচনা করে সব ঠিক করে ফেলি। আমার বাস্তব জীবনে অভিনয় আরম্ভ হলো। তারপর দেখলাম আমার নিরুদ্দেশ নিয়ে বড় হইচই শুরু হয়েছে। উপায় না পেয়ে, তখন আমি পুলিশ আর আমার সলিসিটর কে সব জানিয়ে চিঠি পাঠাই। এই হলো আমার গত দেড় বছরের স্বল্প ইতিহাস।”
জাঁদরেল সরকার সাহেব দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া করুণ চোখে তাকিয়ে থাকেন মণিকুন্তলা দেবীর দিকে। তিনি তখন সোজা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে রণেন্দ্র সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আপনার পরিকল্পনাটা খুবই মানবিক, ”মণিকুন্তলা দেবীর শান্ত স্বর-
“আবার খুবই অদ্ভুত। আপনাকে বাহবা দেওয়া উচিত। আপনার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ থাকবো চিরকাল। অবশ্য আপনিও বুঝতে পারছেন এই পরিস্থিতিতে আমাদের হয়ত আর এখানে থাকা সম্ভব হবে না।”
“আমি ঠিক এই রকম কিছু প্রত্যাশা করছিলাম,” সরকার সাহেবের ম্লান স্বর।
“জানি সব শুনে আপনার আত্মসম্মান বাধা দেবে এই বাড়িতে থাকতে – বুঝতে পারছি আপনি কিছুতেই কারুর দাক্ষিণ্য স্বীকার করতে রাজী হবেন না।
“দাক্ষিণ্য কথাটাই তো ঠিক - তাই কি’না?” মণিকুন্তলা দেবী একটু কঠিন স্বরে বলেন।
“না, দাক্ষিণ্য নয় – কারণ পরিবর্তে আমি কিছু চাইছি আপনার কাছে।”
“পরিবর্তে কিছু চাইছেন, মানে?”
“সব কিছু।” সরকার সাহেবের চিরকালের অভস্থ্য আধিপত্যের স্বর গমগম করে ওঠে।
“আমার যখন তেইশ বছর বয়স,” সরকার সাহেব বলে চলেন,” আমি একজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। সে মারা গেলো ঠিক এক বছর পর। সেই সময় থেকে আমি ভীষণ একা। অনেক পরে আমি ভেবেছিলাম যদি এমন কাউকে পাই, যে সত্যিকারের সম্ভ্রান্ত মহিলা – আমার স্বপ্নের মানুষ----- ”
“আমাকে কি সেই রকম মনে হয়?” মণিকুন্তলা দেবীর অবাক বিহ্বল স্বর কিছুটা ম্লান শোনায় –“ আমার বয়স হয়ে গেছে, সমাজ, ছেলে মেয়েরা আছে, তা’ছাড়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”
সরকার সাহেব হেসে ওঠেন -
“বয়স হয়ে গেছে? আমার মনে হয় ছেলে মেয়ের থেকে তুমি অনেক তরুণ। বরং বলতে পারো আমার বয়স হয়ে গেছে। আর সমাজ ?” সরকার সাহেব আবার সজোরে হেসে ওঠেন।
এবার মণিকুন্তলা দেবীর হাসি ঘরের পুরনো দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। স্নিগ্ধ হাসির লহরী – খুশির ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘর ময়।
“তোমার বয়স হয়ে গেছে?” মণিকুন্তলার স্বরে যেন তাঁর কত দিনের অতি পরিচিত বন্ধুর সাথে কথা বলার আন্তরিকতা প্রকাশ পায়।
“আমার মনে তুমি এখনো বাচ্চা ছেলেই আছো যে এখনো নানা পোষাকে সাজগোজ করে নাটক করতে ভালোবাসে।”
মণিকুন্তলা ধীর পা’য় এগিয়ে এসে - রণেন্দ্র সরকারের বাড়িয়ে দেওয়া দু হাতে ধরা পড়লেন....।
হঠাৎ ঘরের দরজা হাট হয়ে খুলে যায়। যৌথ হাসির আওয়াজে বিস্মিত চোখে একে একে ঘরে আসে রঞ্জনা, গৌতম আর সৌম্য। সরকার সাহেবের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় মণিকুন্তলা দেবীকে দেখে, তাদের মুখের ভাব ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। রঞ্জনা দৌড়ে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরে। সমবেত আনন্দোচ্ছাস ও এক সাথে সবারই কিছু বলার চেষ্টায় ঘর গমগম করে ওঠে।
আসল বিপ্রদাস তার পুরুষ্টু গোঁফের ফাঁকে হাসি চাপার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
গল্প
খেলা,তবু
খেলা নয়
বিবেকানন্দ পণ্ডা
ডুমুরজলা, হাওড়া
১
কোলকাতায় গরমটা এবার বেশ পড়েছে। বেলা পড়ে এসেছে, তবু বাইরে দাঁড়ালেই দরদর করে ঘামতে হচ্ছে। আমি আমার এ সি চেম্বারে বসে রোগী দেখছিলাম। সামনে দেওয়ালে লাগানো টিভি তে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলা চলছিল সাউণ্ড মিউট করে। রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছিলাম খেলার দিকে। ইষ্টবেঙ্গল একটা গোল দিয়ে চাপে রেখেছে মোহনবাগানকে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা আমার নেশা ছিল, কিন্তু মাধ্যমিকের পর লেখা পড়ার চাপে খেলার পাঠ উঠে গেল। আমার চেম্বারের বাইরে বসে আমার সহকারী রতন একজন একজন করে রোগী পাঠাচ্ছিল। আমার কাছে এক জুনিয়ার ডাক্তার মিহির ইন্টার্ন করছে। ডঃ মিহির প্রথমেই রোগীদের সঙ্গে কথা বলে রোগের একটা ইতিহাস বানিয়ে ফেলে আর তারপর পাঠায় আমার কাছে। সব মিলিয়ে আজ সেই দুপুর থেকে প্রায় ২৭ জন রোগী দেখলাম। আর ভালো লাগছে না, তাছাড়া আজ একটা বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ আছে, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। আমি সাধারণত: ২৫ জনের বেশি রুগী দেখি না। এমন সময় বাইরে একটা হালকা গোলমাল শুনে একটু বিরক্ত হয়েই রতনকে জিজ্ঞাসা করলাম “কি ব্যাপার রতন! এত গোলমাল কেন?” রতন এসে বলল “স্যার, আজ লিস্টে ২৭ জনের নাম ছিল কিন্তু এখন একজন এসে বলছে সে অনেক দূর মানে মেদিনীপুরের কোন পলাশ ডাঙ্গা গ্রাম থেকে এসেছে, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারে নি। আমি নামটা আগামীকাল লিখে রাখবো বলেছিলাম, কিন্তু ওরা বলছে ওদের আজই রাতের ট্রেনে ফিরে যেতে হবে, এখানে কোন থাকার জায়গা নেই। আমি না বলেছিলাম তাই আমার সাথে কথা কাটাকাটি করছে। ”পলাশ ডাঙ্গা শুনেই বুকের ভিতর টা ছ্যাঁৎ করে উঠল, বললাম, “কি বললি, পলাশ ডাঙ্গা থেকে এসেছে?” রতন থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ তাই তো বলল।” আমি বললাম “ডঃ মিহিরকে বল এই রোগীটা দেখে নিতে, আমার গ্রামের লোক তো। তার পর চেম্বার বন্ধ করব।” রতন বলল, “তাই নাকি স্যার, আপনার গ্রামের লোক। তাহলে তো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।” রতন চলে যেতেই টিভির দিকে চোখ পড়ল, দেখলাম মোহনবাগানের এক ফরোয়ার্ড দুরন্ত শটে গোলটা শোধ করে দিল। গোল কিপার নড়ার সুযোগই পেল না। আমার মাথায় দপ করে জ্বলে উঠল অনেক দিন আগের হুবহু একটা দৃশ্য।
অমল বলটা পাশ কাটিয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে গেল গোলের দিকে। আমি বাধা দেওয়ার সময়ই পেলাম না। আমাদের গোলকিপার তপন বল ধরার একটা মরিয়া চেষ্টা করে ঝাঁপ দিল, কিন্তু তার আগেই বল জড়িয়ে পড়েছে গোলের জালে। আর কয়েক মিনিট পরেই রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। আমরা হেরে গেলাম। আমাদের ক্যাপ্টেন শৈবালদা চোখ বন্ধ করে মাঠের মাঝেই বসে পড়ল। আমারও খুব খারাপ লাগছে। অমলের কাছ থেকে যদি শেষ মুহূর্তে বলটা ছিনিয়ে নিতে পারতাম তাহলে আজ আর আমাদের ১-০ গোলে হারতে হত না বরদাচরণ বিদ্যা নিকেতনের কাছে। অমলকে নিয়ে ওদের উচ্ছ্বাস তখন তুঙ্গে। অমল আমার বন্ধু, দুজনে একই পাড়াতে থাকি, দুজনেই নবম শ্রেণীতে পড়ি। তবে ওর আর আমার স্কুল আলাদা। ও পড়ে বরদাচরণ বিদ্যা নিকেতনে আর আমি পড়ি কেনারাম শিক্ষামন্দিরে। পলাশ ডাঙ্গা তে এই দুটো স্কুল–ই আছে, আর খেলাধুলোর ব্যাপারে এই দুই স্কুলের মধ্যে সব সময়েই এক অলিখিত প্রতিযোগিতা রয়েছে। গতবছর ফুটবল খেলায় বরদাচরণ জিতেছিল ২-১ গোলে, আর এবারেও জিতল ১-০ গোলে। ওদের ফরোয়ার্ড অমল এতটাই ভাল খেলে যে কিছুতেই আটকানো যায় না। গতবারের আন্তঃ স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতাতে ও সেরা খেলোয়াড়ের শিরোপা পেয়েছিল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ মাঠের মধ্যে বসে ছিলাম মুখ নিচু করে। একটা হ্যাঁচকা টানে ফিরে দেখি অমল আমার হাত ধরে টানছে। “কি রে বেলা তো পড়ে এল এবার বাড়ি যাবি তো!” আমি উঠে দাঁড়াতেই অমল বলল, “তুই খুব ভালো খেলেছিস। আর একটু হলেই তো আমার পা থেকে বলটা কেড়ে নিচ্ছিলি।” হেসে বললাম, "আমি এত ছোট নেই যে আমায় সান্ত্বনা দিতে হবে। তুই দুর্দান্ত খেলেছিস আর তাই তোরা জিতেছিস।” অমল আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, "আচ্ছা তোর কথা মেনে নিলাম, তবে এখন আর খেলার কথা নয়, আমাদের বাড়ি চল। মা আজ কড়াইশুঁটির কচুরি বানাবে বলেছিল। আমার তো খিদেতে পেট চুঁই চুঁই করছে, তোর ও তো তাই। মা বলে দিয়েছে তোকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। আমার বাড়িতে কচুরি খেয়ে তার পর তোর বাড়ি যাস।”
অমলের বাড়িতে যেতেই চার বছরের পুঁচকে বিমল ছুটে এল। তারপরই চিৎকার করে বলতে থাকলো, "মা দাদা ফিরেছে, আর বাবলুদা কে নিয়ে এসেছে।” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “ আমার কাছে অনেকগুলো চকোলেট আছে।” আমি ওর কাছে হাত পেতে বললাম, "আমায় দে একটা।” বিমল ছিটকে আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে বলল, "আগে বল আজকে খেলায় কে জিতেছে। যে জিতেছে সে দুটো পাবে আর যে হেরেছে সে একটা পাবে।” আমি হাসতে হাসতে বললাম, "তাহলে আমাকে আর দিতে হবে না সবগুলোই তোর দাদাকে দিয়ে দিস।” বিমল অমলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, "তুই জিতেছিস দাদা!” অমল বিমলকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, "না রে আমরা দুজনেই জিতেছি, কেউ হারেনি।” বিমল খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, "তোমরা দুজনেই জিতেছ? তাহলে তোমাদের দুজনকেই দুটো করে চকোলেট দেব।” চকোলেট বিমলের খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে চকোলেটের জন্য খুব পাগলামি করে। অন্য সময়ে ওদের বাড়িতে গেলে পকেটে ১/২ টো চকোলেট রাখি বিমলের জন্যে, কিন্তু আজ আর সে সুযোগ পাই নি, উল্টে বিমল আমার হাতে দুটো চকোলেট দিল। ভেতর থেকে সুমিত্রা কাকিমা বেরিয়ে এলেন, “ও কি হচ্ছে অমল। বাইরে থেকে এসে হাত পা না ধুয়েই ভাইয়ের সাথে খেলতে শুরু করেছিস। তুই আর বাবলু তাড়াতাড়ি হাত পা ধুয়ে আয়। ”ঊর্মীদি বলল, “হ্যাঁ বাবলু আগে খেয়ে নে, তার পর আবার গল্প করিস তোরা।“
২
একটু পরে ডঃ মিহির আমার ঘরে ঢুকে বলল, “স্যার কেসটা খুব সিরিয়াস। লোকটার বয়স ৪৫ এর আশেপাশে হবে। কোন এক কোলিয়ারীতে কাজ করত। বেশ কিছুদিন ধরেই ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছে। অনেক দিন থেকেই হালকা জ্বর আর কাশি আছে। হালকা রক্ত আসছে কাশির সাথে। পয়সার অভাবেই হয়ত আর চিকিৎসা করাতে পারে নি আগে, এখন বাড়াবাড়ি হওয়াতে এখানে এসেছে।“ আমি বললাম, “তুমি কি ওনার আগের রিপোর্টগুলো দেখেছো?”
“হ্যাঁ স্যার দেখেছি। এক্স রে রিপোর্টে বুকে জল আছে।”
“টি বি র টেস্ট কি করানো হয়েছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু নেগেটিভ।“
“তাহলে আমাদের CT scan আর FNSC করে দেখতে হবে ম্যালিগনেন্সি আছে কি না। তুমি এক কাজ করো ওনাকে টেস্টটা করিয়ে কয়েকদিন পরে আসতে বল। তার পর আমি দেখবো।“
চেম্বার বন্ধ করে রতন আমার ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল। আমি বললাম, “হ্যাঁ রে, শেষের যে patient ছিলেন, তার নাম কি বলত!” রতন কিছুতেই নামটা মনে করতে পারল না। গাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করতেই আবার মনে ভেসে উঠল পলাশ ডাঙার পুরনো ছবি।
সেদিন সুমিত্রা কাকিমা এত কড়াই শুঁটির কচুরি খাইয়েছিলেন যে বাড়ি ফিরে আর রাতে খেতে পারি নি, সটান শুয়ে পড়েছিলাম। পরদিন বেশ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। তাই সকালে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে কোন রকমে নাকে মুখে সামান্য কিছু গুঁজে দৌড় দিয়েছিলাম স্কুলে। স্কুলে টিফিন ব্রেকের সময় শৈবালদা আমায় ডেকে পাঠাল। শৈবালদা একাদশ শ্রেণীতে পড়ে, ভালো খেলে তাই গত দু বছর যাবৎ আমাদের স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, বেশ কড়া মানুষ। স্কুলের মাঠ লাগোয়া পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখি আমাদের পুরো ফুটবল টিমটাই তপন, করিম, রতন, পলাশ দা, সুশোভন, বিপ্লব, প্রবীর দা, প্রশান্ত, অঞ্জন সবাই সেখানে হাজির। আমি পৌঁছতেই শৈবালদা আমার দিকে কট্মট্ করে তাকিয়ে বলল, কি রে বাবলু, গতকাল খেলার শেষ সময়ে বরদা চরণের অমলকে আটকানোর চেষ্টা না করে স্কুলের নামের বারোটা বাজালি!” হঠাৎ এমন কথা শুনে আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম, বললাম, “তা কেন? আমি তো অমলকে আটকানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অমল বল নিয়ে এমন কেটে বেরিয়ে গেল যে কিছুই করতে পারলাম না।“ শৈবালদা একটা ঘাস নিয়ে হাতে পাকাতে পাকাতে বলল, “খেলার শেষে তো দেখলাম বন্ধুর গলা জড়িয়ে খোস গল্প করতে করতে চলে গেলি, দেখে তো মনে হয় না তোর সবটা কালকে খেলায় দিয়েছিলি।“ শৈবালদার কথা শুনে আমার গা হাত পা জ্বলে গেল, সিনিয়র মানুষ, তাই কিছু বলতে পারলাম না। তপন বলল, “তা কেন শৈবালদা, অমল তো আমারও বন্ধু। তবে সত্যি বলতে কি অমলের মতো ফরোয়ার্ড আমাদের এই এলাকাতে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।“ শৈবালদার বন্ধু পলাশ দা ফরোয়ার্ডে খেলে, বলা যায় আমাদের গোল মেশিন, বলল“ দ্যাখ শৈবাল, ওই সব কথা বলে কোন লাভ নেই। বাবলু খুবই ভালো খেলেছে, কিন্তু অমলকে আটকানোর ক্ষমতা সত্যি আমাদের কারুর নেই।“ শৈবালদা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “তা বলে কি ওই একটা ছেলের জন্য আমরা প্রত্যেক বারে রানার্স আপ হয়ে থাকব নাকি?“ সবাই চুপ করে বসে ছিলাম। টিফিন ব্রেক শেষের ঘণ্টা বাজতেই শৈবালদা বলে উঠল, “আর মাস দুই পরেই পলাশ ডাঙ্গার অবসর সম্মিলনীর মাঠে বসবে আন্ত স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা। ওটাতে কিন্তু কোন ভাবেই বরদা চরণ বিদ্যামন্দিরকে জিততে দেওয়া যাবে না। এখন চল ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।“
অমলের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। স্কুল থেকে ফিরেই মাঝে মাঝে আমরা আড্ডা দিতে বেরিয়ে পড়ি। পাড়ার উত্তরের মাঠে কিছু সময় ফুটবল খেলে দুজনে গিয়ে বসি নদীর পাড়ে, গল্প করি। ছোটবেলা থেকেই অমলের ফুটবলের প্রতি টান। ওর স্বপ্ন বড় হয়ে ও খুব বড় হয়ে ফুটবলার হবে। অমলের বাবা পরিমল কাকু ছিলেন পোষ্টমাস্টার। এক সময় নিজে ভালো ফুটবল খেলতেন, ছেলের এই সখ কে তিনি বেশ উৎসাহ দিতেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাকু বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে যখন পরপারে চলে গেলেন তখন বিমলের বয়স মাত্র ২ বছর। অমলও তখন খুব ছোট, ক্লাস সিক্সে পড়ে আমার মতোই। আর ঊর্মীদির ক্লাস এইট। কাকুর তো তেমন টাকা পয়সা ছিল না, তাই দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সুমিত্রা কাকিমা পড়লেন অথৈ জলে। পাড়ার সবার চেষ্টাতে অঙ্গনওয়াড়ির কাজটা না জুটলে কাকীমা হয়ত ছেলে মেয়েদের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দিতে পারতেন না। এত কষ্টের পর তিনিও ছেলের সখকে বাধা দেন নি, তাই এখনো অমল খেলা চালিয়ে যেতে পারছে। খুব ছোট বয়েসে বাবাকে হারিয়ে বিমল অমলের খুব নেওটা হয়ে পড়ে, আর অমলের তো বিমল অন্ত প্রাণ। সেদিন অমল আড্ডা দিতে দিতে বলে উঠল, “জানিস বাবলু পলাশ ডাঙ্গার অবসর সম্মিলনীর মাঠে যে আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা হবে শুনছি সে সময় নাকি সেমিফাইনাল থেকে ফাইনালের খেলাগুলো দেখার জন্যে জাতীয় ফুটবল একাডেমির লোকজন ও খেলোয়াড়রা আসবেন। ওনারা এখানে কোন ভাল ফুটবল খেলোয়াড় পাওয়া যায় কি না তা দেখবেন। যদি একটু ভালো খেলতে পারি আর ওনাদের নজরে পড়ে যাই তাহলে বড় কোচের তত্ত্বাবধানে কোচিং নিতে পারব। শুনলাম ওনারা ভালো প্রতিভা পেলে কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করবেন সরকার থেকে।“
দিন পনের পর থেকেই আমাদের পিটি স্যার মনিবাবু স্কুল ছুটির পর থেকেই আমাদের পুরো ফুটবল টিমকে নিয়ে প্রাক্টিস করাতে শুরু করলেন। মনিবাবু খুব কড়া ধাতের মানুষ, অন্ধকার না নাম পর্যন্ত আমাদের প্র্যাকটিস করাতেন, বাড়ি ফিরে আর বাইরে বেরিয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় পেতাম না, ক্লাসের লেখাপড়া শেষ করতেই সময় লেগে যেত। প্রায় দু-সপ্তাহ অমলের সাথে আমার দেখা নেই। সেদিন রবিবার বিকেলে অনেকদিন পর বেরিয়ে নদীর পাড়ে অমলের সাথে দেখা হল। বিভিন্ন কথার মাঝে বললাম, “পরের বছরই তো মাধ্যমিক পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন চলছে? খেলার সাথে সাথে নিশ্চয়ই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিস!” আমার কথা শুনে অমল হো হো করে হেসে উঠল। আমি একটু হতচকিত হয়ে বললাম, “এ তে হাসির কি হল?” অমল গম্ভীর হয়ে বলল, “হাসির কথা বললে হাসব না! দ্যাখ ভাই আমার কাছে ফুটবলই ধ্যান জ্ঞান। স্বপ্ন দেখি বড় হয়ে কোলকাতার বড় ক্লাবে ফুটবল খেলব একদিন, ভারতের জার্সি পরে ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করব। কোলকাতার ক্লাবে খেলতে পারলে যে রোজগার হবে তাতে বিমলকে ভালো করে লেখা পড়া করাতে পারব। লেখাপড়া আমার জন্যে নয়, মাধ্যমিকে কোনভাবে পাস নম্বর পেলেই হবে।“
আমার লেখা পড়ার দিকে বাবার খুব কড়া নজর ছিল। খেলাতেও বাবা বাধা দিতেন না খুব তবে বাবার কথা ছিল আগে পড়াটা ঠিক করে শেষ করে তার পর খেলা চালিয়ে যাও। তাই লেখাপড়া, স্কুল, খেলা আর আড্ডা দিতে দিতে কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। পলাশ ডাঙ্গার অবসর সম্মিলনীর মাঠে শুরু হয়ে গেল আমাদের জেলার আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা। এবারের প্রতিযোগিতাতে সব মিলিয়ে ৩২টা স্কুল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ৪টে গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে দলগুলোকে। সব খেলা হবে নক আউট পদ্ধতিতে। আমরা পড়েছি এ গ্রুপে আর বরদাচরণ বিদ্যা নিকেতন পড়েছে বি গ্রুপে। আপাতত অমলদের সঙ্গে সেমিফাইনালের আগে মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের প্রথম খেলা ছিল ভূপতি নগর বটকৃষ্ণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাথে। পলাশদার দেওয়া শেষ মুহূর্তের গোলে আমরা বটকৃষ্ণ স্কুলের সাথে ম্যাচটা জিতি ১-০ গোলে। তার এক দিন পর আমাদের ম্যাচ ছিল বালিচক ভজহরি হাইস্কুলের সাথে। ভজহরি স্কুলের টিম খুব ভালো। তাই এবারে শৈবাল দা ম্যাচের আগের দিন সবাইকে নিয়ে মিটিং করল। ঠিক হল আমি রাইট ব্যাকে না খেলে পলাশ দার সাথে ফরোয়ার্ডে খেলব। খেলার শুরু থেকেই ভজহরি হাইস্কুল দুরন্ত খেলছিল। অনেক চেষ্টা করেও আমরা হাফ টাইম অবধি কোন গোল দিতে পারি নি। প্রথমার্ধের খেলা গোল শূন্য থাকল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটের মাথায় আমি হঠাৎ একটা বল পেয়ে গেলাম। তবে আমি বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ভজহরির তিনজন খেলোয়াড় তিনদিক থেকে ঘিরে ধরল। আমি কোন উপায় না দেখে বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে থাকা করিমের দিকে বল টা উঁচু করে বাড়িয়ে দিলাম। করিম অসম্ভব সুন্দর একটা হেড করল আর বল গিয়ে জড়িয়ে পড়ল গোলের জালে। এবারেও আমরা জিতে গেলাম। গ্রুপ বি তে বরদাচরণ বিদ্যা নিকেতন প্রথম ম্যাচ টা জিতেছে সবং সারদাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে। অমল একাই অবিশ্বাস্য খেলে পরপর তিনটি গোল দিয়ে হ্যাট্রিক্স করেছে। আগামীকাল ওদের খেলা মোহাড় ব্রহ্মময়ী উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে। ব্রহ্মময়ী হাইস্কুল খুব ভালো টিম। ওদের ডিফেন্স এত শক্তিশালী যে তা ভেদ করে গোল দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। গতবার আমরা ওদের কাছে ২-০ গোলে হেরে খেলা থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম। এবারে অবশ্য ওরা অন্য গ্রুপে আর বরদা চরণের মুখোমুখি। এই ম্যাচটাতে যে জিতবে তাদের সাথেই আমাদের খেলা তিন-দিন পর। বুধবার ওটাই সেমিফাইনাল। সেমি ফাইনাল দুটি আর ফাইনালের খেলা দেখার জন্য কোলকাতা থেকে আসবেন জাতীয় দলের দুই ফুটবলার প্রদীপ ব্যানার্জী আর কৃশানু দে। এছাড়াও বুধবার থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাননীয় ক্রীড়া মন্ত্রী নরেন দাস। ব্রহ্মময়ী ও বরদা চরণের খেলা দেখার জন্য আমরা মুখিয়ে আছি। আমাদের সেমিফাইনালের গেম প্ল্যান সব কিছু নির্ভর করছে ওই ম্যাচের ওপর। তাছাড়া আমার প্রাণের বন্ধু অমল খেলবে ওই ম্যাচে।
টুর্নামেন্ট চলার সময় কয়েকটা দিন আমার আর বই খাতার সাথে বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। যেদিন আমার ম্যাচ থাকতো না সেদিন রাতের দিকে বা সকাল বেলা বই নিয়ে বসতাম। পরদিন অমলদের খেলা দেখার উত্তেজনাতে সেটুকুও আর হয়ে উঠল না। দুপুরে ভাত খেয়ে কিছু পরেই সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম পলাশ ডাঙ্গার অবসর সম্মিলনীর মাঠে। আশপাশের গ্রাম থেকে প্রচুর জন সমাগম হয়েছে, হ্যাঁ প্রায় হাজার দুই তো হবেই। চারিদিকে বেশ মেলা মেলা ভাব। চপ ফুলুরীর দোকান বসে গেছে। বাচ্চাদের বেলুন ও বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য প্রত্যেক বারেই ফুটবল প্রতিযোগিতা সময় পলাশ ডাঙ্গা এমনই চেহারা নেয়। আমাদের স্কুলের পলাশদা ছাড়া পুরো টিমটাই উপস্থিত ছিল। মাঠের কোনে বড় বটগাছের তলায় বসে আমরা খেলা দেখছিলাম। দুটো বড় বড় প্যাভিলিয়নের একটাতে বসেছে ব্রহ্মময়ীর সমর্থকেরা আর অন্যটাতে বসেছে বরদা চরণের ছেলেরা। খেলার প্রথম থেকেই ব্রহ্মময়ীর ছেলেরা খুব এটাকিং মুডে ছিল, বরদা চরণের ছেলেরা খুব সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। খেলার ২০ মিনিটের মাথায় ব্রহ্মময়ী কর্ণার থেকে গোল করে ১-০ তে এগিয়ে গেল। একটা গোল খেয়ে বরদা চরণের ছেলেরা যেন গুটিয়ে গেল, বিরতি পর্যন্ত ফলাফল একই থাকল। বিরতির পর গোল শোধ করার চেষ্টা করতে লাগল বরদা চরণ। অমল অনেক বার আক্রমণে উঠে গেলো কিন্তু ব্রহ্মময়ীর জমাটি ডিফেন্স ভাঙতে পারল না। সব মিলিয়ে আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে খেলা তখন জমজমাট। আমরা সবাই মিলে আড্ডায় মেতে গিয়ে বোধহয় কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, একটা চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি প্রায় মাঝ মাঠ থেকে পায়ে বল নিয়ে ব্রহ্মময়ীর চার পাঁচজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে অমল। ব্রহ্মময়ীর রাইট ব্যাক বাধা দিতে ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ব্রহ্মময়ীর গোলকিপার উপায় না দেখে এগিয়ে এসে বল ধরার চেষ্টা করল। অমল সুযোগ বুঝে আলতো পায়ের টোকায় বল ঠেলে দিল গোলের মধ্যে। একটা অবিশ্বাস্য গোল, ভাবা যায় না। এখন বরদাচরণ অনেক উজ্জীবিত। ৬০ মিনিটের খেলাতেও নিষ্পত্তি না হওয়ায় খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। আবার একটা অসাধারণ গোল করল অমল আর মাঠ জুড়ে তখন একটাই আওয়াজ “অ – মল, অ – মল”। শৈবালদা চোয়াল শক্ত করে আমাদের বলল, “দেখলি তো ম্যাচটা।
পরশুর ম্যাচে জিততে হলে অমলকে ঠেকাতেই হবে। কথাটা মনে রাখিস সবাই।“ আমাদের টিমের সবাই চলে গেলেও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। মাঠের উত্তেজনা কমলে আমি অমলকে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে এলাম। অমল বলল, “ভাবছি পরশু ম্যাচে বিমলকে নিয়ে আসবো। ওর তো খেলা দেখার খুব শখ।” বললাম “তা নিয়ে আসিস। তবে ও তো খুব ছটফটে, তোদের কাউকে বলে দিস একটু নজর রাখতে”।
৩
পরের কয়েকটা দিন চেম্বার, মেয়ের লেখা পড়া দেখা আর টিবিতে খেলা দেখেই কাটিয়ে দিলাম। একদিন চেম্বারে বসে আছি এমন সময় ডঃ মিহির এসে বলল, “স্যার গত সপ্তাহে মেদিনীপুর থেকে যে রুগী এসেছিলেন, আজ আবার এসেছেন সব টেষ্ট করিয়ে। ”আমি বললাম, “কে বল তো, সেই পলাশ ডাঙার রুগী?”
“হ্যাঁ স্যার ওই আপনার গ্রামের রুগী।”
“রিপোর্ট কিছু দেখেছো?”
“লাংসে ম্যালিগনেন্সি আছে স্টেজ ফোর।”
“বল কি?” আমি একটু আঁতকে উঠি। “ রতনকে বল রোগীকে পাঠাতে।”
একটু পরেই এক জীর্ণ শরীরে জীবন্ত কঙ্কাল নিয়ে একটি লোক ঢুকল আমার চেম্বারে। চেহারা দেখে আমার ভেতরটা কেমন ধক্ করে উঠল, এই রোগীর যা অবস্থা তাতে টেনে টুনে মাসখানেক বাঁচবেন কি না সন্দেহ। অবচেতন মনে কেমন একটা ভয় দানা বেঁধে রয়েছে। হয়ত পলাশ ডাঙার লোক বলেই একটা চাপা আশঙ্কা কাজ করছে। চেহারা দেখে তো চেনা কেউ মনে হচ্ছে না। আর হবেই বা কি করে, নয় নয় করে প্রায় ৩০ বছর হতে চলল পলাশ ডাঙা ছেড়েছি। এই দীর্ঘ সময়ে চেনা মানুষের শরীরেও এমন পরিবর্তন আসে যে সে তখন অচেনা হয়ে যায়। দুজনকেই সামনের চেয়ারে বসতে বললাম। রোগীর সাথের ভদ্রলোকটি বলে চলেন “দাদার শরীর এত তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে গেল যে আমাদের গ্রামের ডাক্তার আপনার কাছে রেফার করে দিলেন। ডাক্তারবাবু আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, আমি কিছুদিন হল প্রাথমিক স্কুলে একটা চাকরী পেয়েছি। দাদা আমাদের এতদিন আগলে রেখেছে। মায়ের শরীরও ভালো নয়। আপনি দয়া করে আমার দাদাকে বাঁচান।” আমি ডঃ মিহিরের কাছ থেকে রিপোর্টটা নিয়ে চোখ বোলাতে গিয়ে নামের জায়গায় অমলেন্দু দাস দেখে চমকে উঠলাম। বিশ্বাস করতে পারছি না আমার বন্ধু অমল আমার সামনে চেয়ারে বসে আছে। অমলের সেই সুঠাম চেহারা কোথায় গেল, এ কি দশা হয়েছে ওর! কেমন নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার চেম্বারের দেওয়ালে ঝোলানো কঙ্কালের ছবিটার দিকে। ও কি আমায় চিনতে পারে নি! না কি আমার ওপর অনেক অভিমান জমে রয়েছে ওই ক্ষয়ে যাওয়া, শেষ হতে চলা মানুষটার মনের মাঝে! বিমল আরো কিছু বলছিল কিন্তু আমার কানে আর কিছু ঢুকছে না, আমি আবার হারিয়ে গেছি পলাশ ডাঙ্গায়।
কাল বাদ দিয়ে পরশু প্রথম সেমি ফাইনালের খেলা কেনারাম শিক্ষামন্দির আর বরদাচরণ বিদ্যা নিকেতনের মধ্যে। উত্তেজনায় রাতে ঘুম হল না ঠিক মতো। সেমি ফাইনালে আমরা অনেকবার উঠেছি, কিন্তু বরদাচরণের গাঁঠ গত তিন বছর আমরা পেরোতে পারি নি। সত্যি বলতে কি, এই মুহূর্তে অমল দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীর হয়ে আমাদের ফাইনালের পথে। অমলের খেলায় ইতিমধ্যেই মুগ্ধ আমাদের জেলা স্তরের সমস্ত ফুটবল কর্মকর্তারা। জেলার ফুটবলাররা সেমি ফাইনালের দিন রাজ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশানের কাছে স্কলারশিপের ব্যাপারে অমলের নাম রেকমেণ্ড করবে শুনলাম। আমি মনেপ্রাণে চাই অমল স্কলারশিপ পাক আর কোলকাতায় গিয়ে নিজেকে আরো ভালো খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলুক। স্কলারশিপ পেলে ওদের পরিবারটার ও কিছুটা সুরাহা হবে।
সেমি ফাইনালের দিন বিকেলে মাঠ কানায় কানায় ভরা। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে প্রায় হাজার পাঁচেক লোক ভিড় জমিয়েছে খেলা দেখার জন্যে। ক্রীড়ামন্ত্রী নরেন দাস, জাতীয় দলের দুই খেলোয়াড় প্রদীপ ব্যানার্জী ও কৃশানু দে আর রাজ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশানের কর্মকর্তারা সবাই পৌঁছে গেছেন। খেলা শুরু হওয়ার আগে শৈবালদা দলের সবাইকে নিয়ে টিম মিটিং করল আর বলে দিল প্রথম থেকেই এটাকিং গেম খেলতে। এদিন আমি আগের মত আমার নিজের জায়গা রাইট ব্যাক পজিশনে খেলতে লাগলাম। প্রথম থেকেই আক্রমণ প্রতি আক্রমণে খেলা গতিময় হয়ে উঠল। অমলের আক্রমণের ঝাঁঝ ক্রমে বেড়েই চলল। এর মধ্যেই অমল পর পর দুটি দুরন্ত শট নিয়েছে গোল তাক করে তবে আমাদের গোলকিপার তপন কোনভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি, প্রশান্ত আর অঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিহত করে চলেছি বরদাচরণের আক্রমণ। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না, খেলার ২০ মিনিটের মাথায় অমল একটা বল পেয়ে আক্রমণে গেল। প্রশান্ত আর অঞ্জন দুজনেই পরাস্ত হল ওর ড্রিবলিংয়ের কাছে। অমল আলতো করে বলটাকে উড়িয়ে দিয়ে তপনকে বোকা বানিয়ে গোলের জালে জড়িয়ে দিল। সারা মাঠ গর্জন করে উঠল আর আমরা ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়লাম। প্রথমার্ধের খেলা শেষ করে আমরা যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছিলাম তখন পলকের জন্য মাঠের পাশে বিমলকে দেখতে পেলাম, আনন্দে তালি দিচ্ছে। পলাশদা বলল, “এ ভাবে খেললে আমরা এবারেও ফাইনালে খেলতে পারবো না।“ শৈবালদা বলল, “আমি second half এ খেলবো না।” আমরা সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম, “সে, কি!” শৈবালদা পলাশদার কানে কানে কিছু একটা বলল, তারপর বলল “চিন্তার কিছু নেই। আমার পায়ে চোট লেগেছে, তাই খেলবো না, আমার জায়গায় করিম খেলবে। আমি না খেললেও আমাদের টিমকে জেতানোর জন্য যা যা করার তা সব ই করবো।”
Second half এর শুরু থেকেই বরদাচরণের ছেলেরা আমাদের খুব চাপে রাখছিল। খেলার মাঝেই খুব জল তেষ্টা পেতে ছুটে মাঠের পাশে আমাদের প্যাভিলিয়নে গেলাম, দেখলাম একটা ছেলে বিমল কে সাইকেলে চাপিয়ে ভিড়ের মাঝে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে, বিমলের গোটা মুখ চকোলেট মাখা। আমি ভয় পেয়ে বললাম, “এ কি করছ শৈবালদা?” শৈবালদা ফিসফিসিয়ে বলল, “চুপ, একটা কথাও বলবি না, অমলের ভাইকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।” তাড়াতাড়ি মাঠে ফিরে এলাম মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে। কিছুক্ষণ পর থেকে দেখলাম অমল খেলার ছন্দ হারাচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বার বার মাঠের বাইরে তাকাচ্ছে, নিশ্চয়ই ভিড়ের মাঝে বিমলকে খুঁজছে। ওর আক্রমণের ঝাঁঝ কমে এল। বল ধরতে ভুল করছে আর সহজ পাস করতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে, খুব অন্যমনস্ক। বেশ কয়েকবার অমলের মুখোমুখি হতে হল আমাকে, তবে ছন্দ হারানো অমলের পা থেকে বল কেড়ে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। একবার তো অমল বলের নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সত্যি কথাটা অমলকে বলতে না পারার জন্যে একটা অপরাধ বোধে ভুগছিলাম তবু মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। বরদাচরণের চাপ কমতেই কেনারাম শিক্ষামন্দির প্রতি আক্রমণে উঠে এল।খেলার ৪৫ মিনিটের মাথায় করিমের একটা লম্বা পাসে বিপ্লব গোল করে খেলায় সমতা ফেরালো। নির্ধারিত সময়ে খেলার ফলাফল ১-১, এবার খেলা গড়াবে অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরুর আগে আমাদের টিমের সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল পরের খেলার কৌশল কি হবে তা নিয়ে। শৈবালদা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “সাবাস ছেলেরা, একটু ধৈর্য ধরে খেলে যাও, এবারে আমরাই জিতবো। ওষুধে কাজ হয়েছে। ”আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমন সময় অমল আমার দিকে ছুটে এল। ঝোড়ো কাকের মত চেহারা, বলল, “বাবলু তুই কি বিমলকে দেখেছিস? বিমলকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।” আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দুর থেকে চোখ গোল গোল করে শৈবালদা আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমতা আমতা করে বললাম, “আ—আ—আমি! আমি তো দেখি নি, নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে।” শৈবালদা পাশে এসে নির্লিপ্তভাবে বলল, “যাবে আর কোথায়, হয়ত বাড়ি চলে গেছে।” অমল বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “বাড়ি তো অনেকটা পথ ও যাবে কি করে! এখন আমি কি করি, খেলা তো এখুনি শুরু হবে।” অমল দ্রুত বরদাচরণের প্যাভিলিয়নের দিকে চলে গেল। অতিরিক্ত সময়ের খেলায় অমলকে আর মাঠে নামতে দেখলাম না, বেশ বুঝতে পারছিলাম ও এখন হন্যে হয়ে বিমলকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল। কিসের লোভে আমি অমলকে এমন মিথ্যে কথা বললাম! মঞ্চে এখন কলকাতা থেকে আসা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের লোকজন। ওদের সামনে অমল খেলতেই পারল না। ছিঃ ছিঃ, নিজের বন্ধুর এমন সর্বনাশ করলাম। অমল মাঠে না থাকায় কেনারাম শিক্ষামন্দিরের কাছে খেলাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। শেষমেশ ম্যাচটা আমরা ২-১ গোলে জিতেছিলাম।
৪
“স্যার কিছু ভাবছেন?” ডঃ মিহিরের কথায় ঘোর কাটল। রিপোর্টগুলো দেখে কি বলব খুঁজে পেলাম না। অমলের আয়ু মেরে কেটে আর এক মাস। আমি বললাম, “মিহির, আমি রিপোর্টগুলো দেখেছি। ”অমল কে দেখিয়ে বললাম “তুমি রতনকে বল ওনাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাতে, আমি ওনার ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলব।” রতন অমলকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যেতেই বিমল বলে উঠল, “ডাক্তারবাবু, দাদা কে কেমন দেখলেন?” বললাম, “খুব খারাপ, ফুসফুসে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে আর বেশ Advanced stage, চিকিৎসা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আপনার দাদার এই অবস্থা কি করে হল বলুন দেখি, খুব অস্বাস্থ্যকর জায়গায় দীর্ঘদিন না থাকলে বা ধুমপানের অভ্যাস না থাকলে তো সচরাচর এমন হয় না।”
“না, না, দাদা কখনো বিড়ি বা সিগারেট কিছু খেতো না, তবে ঝরিয়ার কয়লা খনিতে দীর্ঘ দিন কাজ করেছে। দাদার শরীর তো প্রথমে খুব ভালো ছিল, কোনদিন কোন অসুবিধা হয় নি। মাসখানেক আগে যখন বাড়ি ফিরল তখন দেখি খুব শ্বাসকষ্ট আর মাঝে মাঝে কাশি। গ্রামের ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, উনি আপনার কাছে রেফার করলেন। আচ্ছা দাদা সুস্থ হয়ে উঠবে তো।”
“দেখুন আপনার দাদার শরীরে রোগ যে ভাবে বাসা বেঁধেছে তাতে বেশি আশা করা মুশকিল। দেখুন, জন্ম মৃত্যু সবই ভগবানের ইচ্ছে। তবুও ওনার এখন যা অবস্থা তাতে উনি হয়ত আর এক মাস আপনাদের মাঝে থাকবেন।”
“মাত্র এক মাস!” বিমল বিস্ফোরিত চোখে বলে, “আমিও তেমন ই ভয় পাচ্ছিলাম। আজকাল তো দাদা ঠিক মত ঘুমোতেও পারে না সব সময় বুকে ব্যথা হয়।
“ভগবানের ইচ্ছে হলে আয়ু হয়ত আর দু / চার দিন বাড়তে পারে। রেডিয়েশন দিলে হয়ত আরও এক মাস বাড়বে, কিন্তু ওই পর্যন্তই, তার বেশি নয়। তাই শেষ সময়ে রেডিয়েশন দিয়ে আর বেশি কষ্ট না দেওয়াই ভালো। ওনাকে যতটা পারেন ভালো রাখুন। পরে ব্যথা যন্ত্রণা আরো বাড়বে, আমি কিছু যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ দেব। আর খাওয়া দাওয়া ভালো করে করাবেন, একটু মন ভালো রাখার চেষ্টা করবেন।”
“ঠিক আছে ডাক্তারবাবু আমাদের তো তেমন টাকা পয়সা নেই, তাই কতটা খরচ করতে পারব বুঝে উঠতে পারছি না, তবু চেষ্টা করব।”
“ওষুধ আর টাকা পয়সার ব্যাপারে ভাববেন না, ওটুকু আমি ব্যবস্থা করব।”
“আ—আপনি করবেন...?” বিমল প্রায় আঁতকে ওঠে।
“হ্যাঁ আমি। আমি ও ওই গাঁয়ের-ই ছেলে। ছোটবেলাতে অমলের সাথে কত খেলেছি। আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। আর আপনি মানে তুমি তখন অনেক ছোট। তাই তোমার হয়ত মনে নেই, তোমাদের বাড়িতে খুব যেতাম, মাসীমার হাতের কড়াইশুঁটির কচুরি অনেক খেয়েছি। অনেক দিন গ্রাম ছাড়া, যোগাযোগ নেই। তবে ওর দুঃসময়ে বন্ধুর প্রতি এই যৎসামান্য কর্তব্যটুকু আমি করতে চাই।”
“আপনি কি তাহলে......”
“বাবলুদা!” বিমলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উত্তর দিই।
“ও হো হো...” বিমলের মুখে হালকা হাসির ঝিলিক দেখা যায়। “আসলে আমরা তো আপনার পোশাকি নামটা ঠিক মতো জানতাম না। তাই ডঃ সংকর্ষণ রায়, অঙ্কোলজিষ্ট নামটা দেখে ঠিক মতো চিনতে পারি নি।”
“তোমার দাদার তো ফুটবল অন্ত প্রাণ ছিল, খেলা ছেড়ে দিল কেন?”
“বাবা মারা যাওয়ার পর মা তো একা সংসার টানতে পারছিল না। দিদির বিয়ে আর আমার লেখাপড়ার খরচ যোগাতে মা পারছিল না। তাই দাদা আমাদের এক দূর সর্ম্পকের কাকার সাথে ঝরিয়া কোলিয়ারিতে চলে যায়। দাদা যেটুকু আয় করত সব খরচ করত সংসারের পেছনে নিজে বিয়েও করেনি আর আজ তো মৃত্যুর পথে এক পা বাড়িয়ে আছে। সাথে সাথে খেলাও বন্ধ হয়ে যায়। দাদার তো খুব স্বপ্ন ছিল কোলকাতায় কোচিং নিয়ে একদিন জাতীয় দলে খেলবে। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে দাদা নিজের স্বপ্নকে বলি দিয়েছে।” বিমলের মুখে একরাশ বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।”
আমি ভাবতে থাকি অমলের স্বপ্নের অপমৃত্যুর আসল কারণটা যে কি, তা তো বিমল জানে না। কিন্তু অমল কি তাকে সন্দেহ করে! এতদিন পরে হয়ত সেই প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। আবার এক লহমায় মনের পর্দায় ভেসে ওঠে পলাশ ডাঙায় সেমিফাইনালের দিনের ছবি। খেলা শেষ হতেই কেনারাম শিক্ষা মন্দিরের উচ্ছ্বাস তুঙ্গে, বেশ কয়েক বছর পর বরদাচরণ বিদ্যা নিকেতনকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে আমাদের দল। আমি হাজার চেষ্টা করেও সেই উচ্ছ্বাসে যোগ দিতে পারলাম না, মনের মধ্যে তখন পাপবোধ কাজ করছে। অমলের ব্যাপারে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। বরদাচরণ স্কুলে অমলের বন্ধুরা জানালো যে বিমলের খোঁজে পাগল পারা হয়ে অমল মাঠ ছেড়েছে অনেক আগেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, ছুটলাম অমলের বাড়ি। দেখলাম বিমল উঠোনে একটা গাড়ি নিয়ে খেলা করছে আর ঊর্মীদি একটা কাপড়ের ওপর কিছু সেলাই করছে। বিমলকে বললাম “কি রে তুই মাঠ থেকে হঠাৎ বাড়ি চলে এলি দাদাকে না বলে”। বিমল বলল, “ওখানে একটা নতুন দাদা আমায় বলল তুই যদি বাড়ি যাস তাহলে তোকে অনেক চকোলেট দেব। ওই দাদাটা খুব ভালো, আমায় সাইকেলে করে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে গেছে আর এতো চকোলেট দিয়েছে।” ঊর্মীদিকে বললাম “অমল কে দেখছি না, কোথায় সে?” ঊর্মীদি কিছু না বলে পাশের ঘরের দিকে দেখিয়ে দিল। পাশের ঘরে অমল গম্ভীর হয়ে বসে ছিল। আমিও ওর মুখোমুখি হয়ে কোন কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম। একটু পরে অপরাধীর মত নিঃশব্দে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। এত কিছু করেও আমরা সেবার ফাইনালে মনোহরপুর বান্ধব হাইস্কুলের কাছে ৩-১ গোলে হেরে গিয়েছিলাম।
এর পরের দিনগুলো লেখা পড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, মাঠে যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলাম। অমলের সাথেও দেখা হত কচ্চিৎ কদাচিৎ। অনেকদিন পর একদিন নদীর পাড়ে বিকেলে ওর সাথে দেখা হল। দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম, হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে অমল বলল, “আমি খেলা ছেড়ে দিয়েছি।” আমি অবাক হয়ে বললাম “সে, কি, কেন?” অমল বলল, “ফুটবল খেলে কি হবে বল। সেমি ফাইনালের দিন তো বিমলের বোকামোতে আমি খেলতেই পারলাম না, অথচ ওই দিনই জাতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সব কর্তারা ছিলেন। সেদিন কে যে বিমলকে চুপিচুপি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আমার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল রে। আমি যাতে স্কলারশিপ পাই ও কোলকাতায় কোচিং নিতে পারি সেজন্য আমাদের জেলার ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সুরেশ ভৌমিক অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেমিফাইনালে আমার second half এর খেলা দেখে জাতীয় ফেডারেশনের কর্তারা হতাশ। স্কলারশিপ তো পেলাম না, এখন ফুটবল খেলে বেড়ালে সংসার চলবে কি করে?” সেদিনও আমি কিছু বলতে পারি নি, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। ক্রমে মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল। আমি প্রত্যাশা মতো ভালো নম্বর পেলেও অমল পাশ করতে পারল না। মাধ্যমিকের পর পরই বাবার চাকরির ট্র্যান্সফার অর্ডার এসে গেল আর আমরা পলাশ ডাঙা ছেড়ে মেদিনীপুর সদরে চলে গেলাম। পলাশ ডাঙা ছাড়ার আগের দিন অমলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, ও বাড়িতে ছিল না, তাই আর দেখা হয় নি। অবশেষে ডাক্তারি পাস করে থিতু হলাম কলকাতায়। আমার আর কোনদিন পলাশ ডাঙা যাওয়া হল না। কিন্তু সেদিনের অপরাধ বোধ এখনো আমি মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি।
এর পরের কাহিনী খুব ছোট। সেদিন বিমলের হাতে অমলের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বেশ কিছু টাকা পয়সা দিয়েছিলাম। বলছিলাম যখনই কোন অসুবিধা হবে আমার সঙ্গে যেন ফোনে যোগাযোগ করে। আমি অমলের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করার সাহস আর করে উঠতে পারি নি সেদিন, হয়ত পরে বিমলের কাছ থেকে সব জেনেছে। এর দিন পঁচিশ পর একদিন সকালে বিমলের ফোন পেলাম। অমলের সব যন্ত্রণার অবসান হয়েছে, ও পরপারের পথে যাত্রা করেছে। অনেক বছর আগে চালাকি করে অমলকে সেমি ফাইনালে আমরা হারিয়ে দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু জীবনের খেলায় নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে মা, ভাই ও দিদি সবার প্রতি নিজের যথাযথ কর্তব্য পালন করে আমাদের সবাইকে টেক্কা দিয়ে, আমাদের অপরাধী বানিয়ে আগেভাগেই ময়দান ছেড়ে চলে গেল আমার বন্ধু অমল। নিজের অজান্তে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বললাম, “পারলে আমায় ক্ষমা করিস বন্ধু।”
কৈবর্ত বিদ্রোহ:
বাঙ্গালীর প্রথম
রাষ্ট্রবিপ্লব
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী
প্রবন্ধ
লেখক পরিচিতিঃ জন্ম ১৯৬৪ সালের ১১ নম্ভেম্বর কাঁচড়াপাড়ায়। ১৯৮৭–তে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে বালুরঘাট কলেজ থেকে ডিগ্রী লাভ। পরবর্তী সময়ে পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে এম এস সি। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লেখালেখি। কর্মজীবন শুরু ব্যাংকে। বর্তমানে ভারতীয় রেলে কর্মরত।
বাঙলা অঞ্চলের মানুষের অতীত ইতিহাস শুধু নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রার ইতিহাস নয়। এই অঞ্চলের মানুষের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার প্রতিবাদ কাহিনীও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। ইতিহাসের বর্ণিত সেই ঘটনা পরম্পরা কখনও সাফল্য লাভ করেছে কখনও বা বৃহৎ শক্তির হাতে পদর্যুস্থ হয়েছে। সেইসব ঘটনার অতীত নিদর্শন আজও বাঙালীর শৌর্যগাথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই কারণে বাংলা অঞ্চলে ইতিহাসের প্রথম সফল গণবিদ্রোহের ঘটনা উল্লেখ করতে গেলে চলে আসে একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সংঘটিত কৈবর্ত বিদ্রোহের নাম। ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ বা ‘বরেন্দ্র বিদ্রোহ’ বলতে ইতিহাস সাক্ষ্য দেওয়া ‘কৈবর্ত সম্প্রদায়ের’ তৎকালীন দ্বিতীয় মহীপালের (১০৭৫-১০৮০) সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহকে নির্দেশ করা হয় যা ১০৮০ সালে ঘটেছিল। কৈবর্তদের একটা শ্রেণী ছিল কৃষিজীবি। তাই ইতিহাসে অনেকে এই বিদ্রোহকে ‘কৃষক বিদ্রোহ’ বলেও মত দিয়েছেন । বাংলাদেশে এমনকি ভারতবর্ষের প্রথম সফল বিদ্রোহ হিসাবেও ঐতিহাসিকরা একে আখ্যা দেন। ঐতিহাসিক রামস্মরণ শর্মা ও বী এন এস যাদব এটিকে গণবিদ্রোহ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ শুধু গণবিদ্রোহ ছিল না বরং তাতে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন সামন্তদের একটা বড় অংশের রোষ। তাই দেখা যায় পালরাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে যাঁরা পালরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁরাও সামন্ত বলে সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে উল্লেখ করেছেন। চন্দ্র লিপিমালায় সামন্ত ও মহাসামন্ত উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার পরবর্তীকালে রামপাল যাঁদের সহায়তায় কৈবর্তদের পদানত করে পিতৃরাজ্য বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করেছিলেন তাঁদেরও সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে ‘সামন্ত’ আখ্যাই দিয়েছেন যাঁরা সকলেই স্ব স্ব জনপদে প্রায় স্বাধীন নরপতি ছিলেন। তাই বলা যেতে পারে, পাল আমলে সামন্ততন্ত্র আরও দৃঢ়প্রতিষ্ঠ ও দৃঢ়সংবদ্ধ হয় যা তাঁদের শক্তিশালী হওয়ার পক্ষে বড় কারণ ছিল এবং সামন্তরা একজোট হয়ে যে কোন স্বাধীন রাজাকে পরাজিত করার মত ক্ষমতা রাখত।
ইতিহাসে দেখা যায় দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপাল রাজ্যাভিষেকের পরেই শুধু যে পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন তা নয় বিলুপ্ত সাম্রাজ্যেরও অন্তত বৃহদাংশের উদ্ধার সাধন করে পাল-বংশের লুপ্ত গৌরবও খানিকটা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সারনাথের অনেক জীর্ণ মন্দির ও বিহারের সংস্কারসাধন করেছিলেন। রংপুর জেলার মহীগঞ্জ, বগুড়া জেলার মহীপুর, দিনাজপুর জেলার মহীসন্তোষ ও মহীপালদীঘি, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘি প্রভৃতি নগর ও দীঘি এখনও এই নৃপতির স্মৃতি বহন করছে। পুনরুত্থানের চেষ্টা ও অভ্যাসে বাঙালীর দেশ ও রাষ্ট্র আত্মগৌরব এবং প্রতিষ্ঠা খুঁজে পেয়েছিল। সেই কারণে বাঙালীর লোকস্মৃতি ও লোকগাথায় মহীপালের গানে মহীপালকে ধারণ করে রেখেছে। লোকে আজও ‘ধান ভাঙতে মহীপালের গীত’ ভুলে যায়নি। মহীপাল- ভোগীপাল- যোগীপালের গান আজও তাঁদের গলায়। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে আরেক মহীপাল (দ্বিতীয়) যিনি তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র হিসাবে চরম কলঙ্কিতরূপে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে নিষ্ঠুর, দুর্বল এবং রাষ্ট্রবুদ্ধ্বিবিহীন হিসাবে তুলে ধরেছেন তাঁর হাত ধরেই বরেন্দ্রতে কৈবর্তাধিপত্য বিস্তার লাভ করে। সন্ধ্যাকর নন্দী এই দ্বিতীয় মহীপালকে অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ বলে কটূক্তিও করেছেন। এই দুই মহীপালের বিপরীত চরিত্র পাল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে উল্লেখযোগ্য করে রেখেছে।
পুণ্ড্রবর্ধনের কেন্দ্র স্থানের অঞ্চলটিকে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী নামে ইতিহাসে অভিহিত করা হয়। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’ গ্রন্থে বরেন্দ্রীকে পাল রাজাদের পিতৃভূমি বলে উল্লেখ করেছেন এবং এর অবস্থান গঙ্গা ও করতোয়া মধ্যবর্তী স্থানে নির্দেশ করেছেন। সিলিমপুর ও দিনাজপুরের তর্পণদিঘীতে প্রাপ্ত শিলালিপিতে বলা হয়েছে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেন রাজাদের পট্টোলিগুলিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে বর্তমান বগুড়া-দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা প্রাচীন বরেন্দ্রভূমির বর্তমান প্রতিনিধি। পুণ্ড্রবর্ধনের মধ্যটি এই বরেন্দ্রভূমিতেই কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যে পাল আমলে উল্লিখিত কৈবর্তদের প্রথম ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। পাল আমলে (৭৫০-১১৬০) কৈবর্ত নামে একটি ধনবান ও বিত্তবান উপবর্ণ ছিল। অনেকে বলেন কৈবর্ত শব্দটির উৎপত্তি ‘ক’ (জল) এবং ‘বর্ত’ (জীবনযাপন) শব্দদুটি থেকে। কৈবর্তরা ছিলেন জেলে সম্প্রদায় এবং তাদের জলকে কেন্দ্র করে ছিল জীবনধারণ। অধ্যাপক লাসেন মত দিয়েছেন, ‘কৈবর্ত শব্দটি মূলত এসেছে কিম্ভর্ত শব্দ থেকে যার অর্থ ‘নিচু পেশার মানুষ’। মনুস্মৃতিতে নিষাদ পিতা এবং আয়োগব মাতা হতে জাত সন্তানকে বলা হয়েছে মার্গব বা দাস, এদের অন্য নাম কৈবর্ত। মনু কৈবর্ত সম্প্রদায়ের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘তারা সংকর বর্ণ’, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ তাদের বলেছেন ‘অব্রাহ্মণ্য’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ও লিখেছেন, ‘বিষ্ণুপুরাণে কৈবর্তদের বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও সংস্কৃতি বহির্ভূত’। ভবদেব ভট্টের মতে কৈবর্তরা হল অন্ত্যজ পর্যায়ের। বরেন্দ্রী কিছুদিনের জন্য দিব্য, রুদোক ও ভীম এই তিন কৈবর্তরাজার অধীনতা স্বীকার করেছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সমসাময়িক উত্তরবঙ্গ –সমাজে কৈবর্তদের সামাজিক প্রভাব আধিপত্য, জনবল ও পরাক্রম যথেষ্ট ছিল। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ধীব্র ও কৈবর্তদের স্থান বলা হয়েছে অসৎশূদ্র পর্যায়ে, অর্থাৎ কৈবর্তরা মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী নয়। তবে কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দুটি ভাগ দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে হুগলী, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের চাষী কৈবর্তরা নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। এরা আবার হেলে বলেও সম্যক পরিচিত। আবার পূর্ববঙ্গে মৎস্যজীবী ( ঢাকা, ত্রিপুরা, মৈমনসিংহ, শ্রীহট্ট অঞ্চলে) ধীবর ও জালিকারা কৈবর্ত বলে পরিচিত। কিন্তু বৃহৎ গোষ্ঠী হিসাবে সামাজিকভাবে নিচুজাত হওয়ায় তাঁরা ছিলেন বৈষম্যের শিকার। তাই দেখা যায় বরেন্দ্র অঞ্চলের জনগোষ্ঠী স্বভাবে ছিল শান্ত ও নিরীহ হলেও সেই বৈষম্যের সামাজিক ব্যাধিতে তারা কতখানি আক্রান্ত হয়েছিল যাতে এই ধীবর সম্প্রদায় কয়েকশত বছরের রাজত্ব করা পরাক্রান্ত পাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল? ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল পাল রাজ্যের গরিমার শিখর। সেই ইতিহাসেরই সন্ধান খুঁজে দেখি।
ইতিহাসে ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ সংক্রান্ত কোন ঐতিহাসিক দলিলের প্রমাণ মেলেনি। কেবল এই বিদ্রোহ সম্পর্কে সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে সবিস্তারে আলোচনা করা আছে। যদিও ঐতিহাসিকগণ এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুকে পক্ষপাতদুষ্ট ও কল্পিত বলে আখ্যা দিয়েছে তাহলেও বলা যেতে পারে এটাই বিদ্রোহ উপর একমাত্র ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থ। পালরাজা রাজ্যপালের মন্ত্রী ছিলেন কৈবর্ত যশোদাস। তারপর থেকেই কৈবর্তদের রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়। তবে ধর্মীয় কারণকে এই বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে ধরা হয়। কৈবর্তরা মৎস্যজীবী হওয়ায় তাদের পূর্বপুরুষ ধরে জীবিকাই ছিল মাছ ধরা। অন্যদিকে পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন বলে ধর্মীয় কারণে অহিংস নীতিকে মান্যতা দেওয়ায় তাঁরা মাছ, মাংস ইত্যাদি আমিষ ভক্ষণের বিরোধী ছিলেন। কৈবর্তদের পেশাকে হিংসার কারণে মাছ ধরা থেকে বিরতি দেওয়া ছাড়াও পাল রাজারা তাঁদেরকে নানানভাবে বাধাগ্রস্থ করতেন। এর ফলে সমাজে কৈবর্তদেরকে অহরহ হেনস্থা ও নির্যাতিত করা হত। কিছুক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হত কঠোর শাস্তির নিধান। এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেতেই এই বিদ্রোহের উত্থান। সুদীর্ঘ চারশো বছরব্যাপী পালরাজারা বাংলার শাসনভার পরিচালনা করেছিলেন। এই চারশো বছরের শেষ পর্যায়ে পালবংশের রাজা দ্বিতীয় মহীপালের আমলে বাংলার এই প্রথম রাষ্ট্রবিপ্লব ইতিহাসের পাতায় নাম করে নিয়েছিল। এছাড়াও ঐতিহাসিকদের মতে আরও একটি কারণ বিদ্রোহের পিছনে যুক্ত হয়েছিল। ইতিহাসে লেখা আছে ষষ্ঠ পালরাজা বিগ্রহপালের পুত্র নারায়নপালের সময়কাল হতেই পাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। নারায়ণ পালের মৃত্যুর পর মহীপাল পাল সাম্রাজ্যের হৃত-
গৌরব কিছুটা পুনরুদ্ধার করলেও তাঁর মৃত্যুর অব্যাহতি পরেই সাম্রাজ্যের পুনরায় অবক্ষয় শুরু হয় এবং তা চরম আকার ধারণ করে দ্বিতীয় মহীপালের শাসনকালে। দুর্বল পাল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অনেকটাই দখল করে নিয়েছিল বর্মণ রাজারা। তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের মৃত্যুর পরে তাঁর জ্যোষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল পাল সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশের অধিকারী হয়ে ছিলেন। সেইসময় পালরাজের ঘরে –বাইরে তখন চক্রান্তের চক্রব্যূহের জাল বিছানো। জনসাধারণের মধ্যে পালরাজের বিরুদ্ধে তীব্র ধূমায়িত ক্ষোভ। চারিদিকে অরাজকতার ঘটনার চিত্র। মহীপাল রাজ্যাধিকার পেয়ে মন্ত্রীগণের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে অনৈতিক ও স্বেচ্ছাচারী কার্যে লিপ্ত হলেন। অথচ প্রজাদের মধ্যেকার অসন্তোষ দূর করলেন না। খল স্বভাবের ব্যক্তিদের পরামর্শে কিংবা সিংহাসন হারানোর ভয়ে তিনি দুই ভাই শূরপাল ও রামপালকে কারাগারে আবদ্ধ করেন। অন্যদিকে দেশব্যাপী অপশাসনে সামন্তরাও ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গোপনে বা প্রকাশ্যে দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কোন কোন ইতিহাসবিদদের মতে বিদ্রোহের পিছনে রামপালের সমর্থক সামন্তদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তবে এই মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এই বিদ্রোহ রামপালের কোন উপকারে আসেনি। বরং তিনিই পরবর্তী সময়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন। সুতরাং মহীপালের অপশাসন ও অত্যাচারের কারণে কৈবর্তরা বিদ্রোহ করতে এককথায় বাধ্য হয়েছিল। ইতিহাসের এই ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। পালরাজা রাজ্যপালের মন্ত্রী ছিলেন কৈবর্ত যশোদাস। তারপর থেকেই কৈবর্তদের রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়। এই উত্থানের রেশ ধরে কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন দিব্যক, দিব্বোক বা দিব্য নামে একজন রাজকর্মচারী বা একজন সামন্ত। রামচরিত-এ ১/৩৮ নং শ্লোকের টীকা থেকে জানা যায় দিব্যক মহীপালের অধীনে উচ্চ রাজকর্মচারী হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। দ্বিতীয় মহীপালের রাজসভায় কৈবর্তরা উঁচু উঁচু পদে নিযুক্ত হন। প্রশাসনের উঁচু পদে থাকার জন্য পাল রাজাদের দুর্বলতা বা ত্রুটি সম্পর্কে দিব্যক সম্যক অভিহিত ছিলেন। তবে দিব্যক এই যুদ্ধে রাজপরিবারের নিকট লোকজনদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তিনি কৈবর্তদের জোটবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী সেনাদল তৈরী করেন এবং কৈবর্তদের সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহের ডাক দেন। বিদ্রোহে দিব্যক বেশ কিছু সামন্ত রাজার সাহায্য পেয়েছিলেন। কৈবর্তরা নৌকা চালাতে পারদর্শী ছিলেন বলে তারা নৌ - যুদ্ধকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। ১০৮০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় মহীপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে দিব্যকের নেতৃত্বে সংঘটিত এই বিদ্রোহকে দমন করতে গিয়ে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। এর ফলে গৌড় রাজধানী ও বরেন্দ্র দিব্যকের হাতে চলে আসে। পরে দিব্যকের নেতৃত্বে বরেন্দ্রকে রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা হয়। লোকগাথায় দিব্যকে একজন সাধু (সন্ত) এবং দেশপ্রেমীরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি তখন ‘বরেন্দ্র নায়ক’।
রামচরিত কাব্যগ্রন্থে বরেন্দ্র বা কৈবর্ত বিদ্রোহকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘অনীকম ধর্মবিপ্লবম’ হিসাবে। গ্রন্থের টীকাকার ‘অনীকম’ শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন অপবিত্র বা অশুভ অর্থে। ‘অনীকম ধর্মবিপ্লবম’-এর অর্থ করা হয়েছে ‘বেসামরিক বিদ্রোহ’ বা কর্তব্য থেকে বিচ্যুতি হিসেবে। রামচরিত-এ ১/৩১ নং শ্লোকের টীকায় বর্ণনা করা হয়েছে মহীপাল কিভাবে প্রাণ হারান। সন্ধ্যাকর লিখেছেন, মহীপাল যুদ্ধকামী হয়ে মন্ত্রীবর্গের আদেশ অমান্য করে ‘অনন্ত সামন্তচক্র’-এর বিরুদ্ধে অপরিমিত সেনাদল নিয়ে বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ সামন্ত প্রধানদের সৈন্যসমাবেশ দেখে মহীপালের সৈন্যবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং একটি অসম যুদ্ধে মহীপাল নিহত হন। রামচরিত-এ ১/৩৮ নং শ্লোকের টীকায় দিব্যকে ‘উপাধিব্রতী’ বলা হয়েছে। টীকাকার উপাধিব্রতীর ব্যাখ্যা করেছেন ‘ অবশ্য কর্তব্য পালন করার ভানকারী’ যার অর্থ দিব্যক রাজকর্মচারী হিসেবে বরেন্দ্র অধিকার করেছিলেন এই ভান করে যে, কর্তব্যবশে তিনি রাজার পক্ষে বরেন্দ্র অধিকার করেছেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণায় বিদ্রোহকারী সামন্তগণের সাথে যে তাঁর গোপন আঁতাত ছিল সেটা প্রকাশ পায়। রামচরিতের টীকাকার বলেছেন, এই যুদ্ধ ছিল মিলিত অনন্ত সামন্তচক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু এই মিলিত সামন্তচক্রে কারা ছিল গ্রন্থে তার কোন উত্তর নেই। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত বলেছেন, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে দিব্যক জনসাধারণকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। কারণ সুযোগ পেলেই সামন্ত রাজকর্মচারীরা রাজা হতে চাইতেন। ক্ষমতার অলিন্দে এই কুটিল জিঘাংসার খেলা সন্ধ্যাকর নন্দীর কাছে নিন্দনীয় ও কুৎসিত মনে হয়েছিল। সুতরাং এই অনৈতিক কার্যকলাপকেই তিনি ‘ধর্মবিপ্লবম’ বলেছেন। তবে সে যুগে সামন্তগণের বিদ্রোহ কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। সার্বভৌম রাজশক্তি ও সামন্তদের মধ্যে আনুগত্যের প্রকৃতি নির্ভর করত উভয়ের তুলনামূলক শক্তির উপর। রাজা শক্তিশালী থাকলে সামন্ত তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখাতেন কিন্তু সাম্রাজ্যের দুর্বলতা দেখা দিলেই তাঁরা আনুগত্য অস্বীকার করতেন। তবে সন্ধ্যাকর নন্দীর অনেক কথা ঐতিহাসিকগণের কাছে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হয়। কেননা তিনি পালরাজা রামপালের সভাকবি ছিলেন। মহীপালের উপর তিনি যে খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা নয়। তিনি মহীপালকে নিষ্ঠুর এবং দুর্নীতিপরায়ণ বলে অভিযুক্ত করেছেন।
রাজা হয়ে কৈবর্ত নায়ক দিব্যক স্বাধীন রাষ্ট্রকে উন্নতির পথে নিয়ে যান। দেশের প্রজাদিগের ক্ষোভ প্রশমনে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। দিব্যকে যুদ্ধে বর্মণ-বংশীয় বঙ্গরাজ জাতবর্মার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে কৈবর্ত-রাজ্যের কোন ক্ষতি হয়নি। দিব্যকের পর রাজা হন তাঁর ভাই রুদ্যোক এবং তারপর রাজা হয়েছিলেন রুদ্যোকের পুত্র ভীম। এই তিন কৈবর্ত রাজা মিলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বৎসর রাজত্ব করেন। রাজা হয়ে দিব্যক ‘দনুজমর্দন দেব’ উপাধি গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এর থেকেই ‘দিনাজপুর’ শহরের উৎপত্তি। রুদ্যোকের রাজত্বে বরেন্দ্র রাষ্ট্র আরও উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। রুদ্যোকের পুত্র ভীম যথেষ্ট পরাক্রমশালী এবং জনপ্রিয় ছিলেন। দিব্যকের সময় উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের মাটিতে ‘দীবরদীঘি’ ও ‘তপনদীঘি’ তৈরি হয়। মনে করা হয় ‘তপনদীঘি’-র নামেই এলাকার নাম হয়েছে ‘তপন’। শেষ পালরাজা রামপাল দিব্যকের পর রুদ্যোকের আমলে কৈবর্ত রাজ্যের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারেনি। রুদ্যোকের রাজত্বে বরেন্দ্র রাষ্ট্র আরও উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। রুদ্যোকের পুত্র ভীম যথেষ্ট পরাক্রমশালী এবং জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর স্মৃতি আজও জীবিত উত্তরবঙ্গের মাটিতে।
এই জনবিদ্রোহের কিছু স্মৃতিচিহ্ন আজও অমর হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দিব্যক স্মৃতিস্তম্ভ। দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত ও হত্যা করে পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বিদ্রোহের সাফল্যকে স্মরণীয় রাখতে দিব্যক স্বয়ং কিংবা তাঁর উত্তরাধিকারী রুদ্যোক অথবা ভীম এই জয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন। বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পত্নীতলা নামক জায়গায় একটি দিঘীর মধ্যস্থলে এই জয় স্তম্ভটি প্রোথিত আছে। স্তম্ভের মোট উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহতৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন – ‘কৈবর্তরাজ ভীমের খুল্ল পিতামহ দিব্বোক দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত ও নিহত করিয়া বিজয়োল্লাসে যে স্তম্ভ উত্থাপিত করিয়াছিলেন তাহা এখনও রাজশাহী জেলার এক দীঘির উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া বিদ্যমান’। উল্লেখ্য পূর্বে নওগাঁ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। দিবর দীঘি নামক এই জলাশয়ের মাঝখানে স্থাপিত অখণ্ড গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ সুদূর অতীতের বাঙ্গালীর শৌর্যবীর্যের সাক্ষ্য বহন করছে আজও। মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘিতেও একটি বিজয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতিসরূপ। সেটা পালরাজ্য পুনরুদ্ধারের পর ভেঙ্গে ফেলা হয়।
তথ্যসূত্র –
বাংলাদেশের ইতিহাস- রমেশচন্দ্র মজুমদার
বাঙ্গালীর ইতিহাস- নীহাররঞ্জন রায়
বাঙ্গালার ইতিহাস- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
কৈবর্ত জাগরণ - সমর পাল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হত্যার
ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল?
ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
প্রবন্ধ
কথাটা শুনে চমকে গেলেন তো? উইকিপিডিয়া লিখছে, “১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রানসিসকোর একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল ভারতীয় চরমপন্থী রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়”। চলুন তাহলে গল্পটা বলাই যাক, ৩০ সেপ্টেম্বর [১৯১৬] কবি সদলবলে সানফ্রানসসিকোয় আসলেন। সানফ্রানসসিকো ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের প্রধান শহর ও প্রশান্ত মহাসাগরের প্রধানতম বন্দর; - এখানে শ্বেতাঙ্গ ছাড়াও জাপানী, চীনা ও হাজার হাজার পাঞ্জাবী শ্রমিক ও ছাত্র বাস করেন। এখানে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ একজন দর্শনপ্রার্থীকে বললেন – “Here in the United States you have a great material empire but my idea of a nation is that it should have ideals beyond material ends. You have a worship of organization, Capital organizes, labour organizes, religion organizes, - all of your institutions organize. It all makes for endless strife. If there would be more of the fundamental idea of brotherhood and less of organization, I think occidental civilization would be immeasurably the gainer”.
সাধারণ আমেরিকান ভারতীয়দের কাছ থেকে এমন কথা শোনবার জন্য প্রস্তুত নয়, তাই একটা কাগজে ঠাট্টার সুরে বললেন, “দেখা-যাক্ কবি দার্শনিক চীন ও ভারতের দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও কিভাবে তাঁর মতবাদকে ব্যাখ্যা করেন”। মোটকথা তাঁর বিরোধিতা তাঁর বক্তৃতাদানের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল।
সানফ্রানসিসকোতে থাকবার সময় রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে এমন একটা বিশ্রী জিনিস গড়ে উঠল যার জের বহু বছর চলে। ক্যালিফোর্নিয়ায় তখন বহু পাঞ্জাবী ও শিখ বিপ্লবীদলভুক্ত ছিল। এদের বলা হত ‘গদর’ বা ‘বিদ্রোহী’ দল। ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হলে পাঞ্জাবের সৈন্যদের মধ্যে কিভাবে বিদ্রোহ জাগাবার চেষ্টা হয়, কি করে ভারতের বাইরে থেকে সাহায্য আনবার চেষ্টা হয় – তার ইতিহাস জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস পাঠকমাত্রেই জানেন। এইসব ব্যাপারে ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু ভারতীয় বিশেষ ভাবে লিপ্ত ছিল। তবে মোটামুটি তারা ধরে নিয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথ ‘ন্যাশনালিজমে’র বিরুদ্ধে বক্তৃতা করে দেশবাসীকে উদ্ধার করবেন। তিনি ১৯১৫ সালে বৃটিশরাজের কাছ থেকে ‘স্যার’ উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছেন - ‘হিন্দুস্থান গদর’ নামে এক পত্রিকায় রামচন্দ্র নামে একজন লেখক রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার এখান সেখান থেকে বাক্য তুলে তার কদর্থ করে তীব্র ভাষায় এক প্রবন্ধে মতামত প্রকাশ করেন।
৫ অক্টোবর চারিদিকে গুজব ছড়াল যে গদর দল রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করবে। এই কথা শোনামাত্র স্থানীয় পুলিশ ও ডিটেকটিভ রবীন্দ্রনাথের হোটেল ও কলম্বিয়া থিয়েটারে তাঁর বক্তৃতার স্থান বিশেষভাবে রক্ষা করতে লাগল। বহু হিন্দুকে তারা সভায় প্রবেশ করতে দিল না। ইন্টারন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সির লোকেরা কবিকে সভার পর বের করে নিয়ে যায় এবং হোটেলের পিছনের ঘরের দরজা দিয়ে তাঁর ঘরে পাঠিয়ে দেয়।
এইসব ব্যাপারের মূলে ছিল সামান্য একটি ঘটনা। স্টকটন নামে একটি শহর থেকে বিষণ সিং মণ্ডু নামে একজন লোক রবীন্দ্রনাথকে সেই শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতে আসছিলেন। হোটেলের কাছে দুজন লোক তাঁকে বাধা দেয়; তাঁরা চায়না রবীন্দ্রনাথ স্টকটনে গিয়ে বক্তৃতা করুন। এখানে মারামারি হয় এবং তারপর রবীন্দ্রনাথকে হত্যার গুজব রাষ্ট্র হয়।
রামচন্দ্র এর জবাবে লেখেন, “আমাদের দলের এরকম কোনও অভিসন্ধি নেই। প্রথমত রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ, তাঁর কাজ কাব্য, রাষ্ট্রনীতি নয়। সেইজন্য তাঁকে আমরা বিশেষ গ্রাহ্য করি না। তাঁর ক্ষতি করলে আমাদেরই আমেরিকার সর্বনাশ, সে কথা আমরা জানি। পথে মারামারির কারণ এই যে আমরা চাইনি যে লোকটি এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করে। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমাদের একমাত্র আপত্তি এই যে বৃটিশের সম্মান তাঁকে কিনে ফেলেছে; তিনি ব্রিটিশ নাইট হয়ে আজ পৃথিবীর কাছে দেখাতে চান যে বৃটিশ শাসন ভারতের কত মঙ্গল করেছে। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক মহিমা পাওয়ার আগে তিনি বিদেশীদের বিরুদ্ধে ষাটখানা বই লিখেছেন”। [Portland Telegram 21 Oct, 1916]।
আমেরিকায় যাওয়ার পথে জাপান ভ্রমণকালে কট্টর জাতীয়তাবাদের যে নিন্দা কবি করেছিলেন, তা প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে সুখপ্রদ হয়নি। ফলে শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গদর পার্টির দ্বন্দ্ব। আমেরিকায় কবিকে স্বাগত জানাতে পারেননি গদর পার্টি ও এর মুখপাত্র হিন্দুস্তান গদর-এর সম্পাদক রামচন্দ্র। তাঁদের বক্তব্য হলো, “কবির আমেরিকা যাত্রার উদ্দেশ্য হিন্দু বিপ্লবকে মন্থর করা। ২ অক্টোবর সেন্ট ফ্রান্সিস হোটেলে রবীন্দ্রনাথ নাকি বক্তৃতায় বলেছেন যে মোগল সাম্রাজ্য এবং অন্য সব শাসকবর্গের তুলনায় ব্রিটিশ শাসক শ্রেয়। তিনি এমনও নাকি বলেছেন যে ‘ভারত স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রস্তুত নয়”। তাঁর এমন সব কথাবার্তা যেন আগুনে ঘি ঢালে। গদর পার্টি আপ্রাণ চেষ্টা করে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা বন্ধ করার ব্যাপারে। খালসা দিওয়ান সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক বিষেণ সিং মাট্টু তাঁর দুই সঙ্গী উমরাও সিং ও পারদাম সিংকে নিয়ে হোটেলে রবীন্দ্রনাথকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে গেলে রামচন্দ্রের দুই সহযোগী এক হাত কাটা জিওয়ান সিং ও এইচ সিং হাতেশি তাঁদের বাধা দেন। বচসার একপর্যায়ে বিষেণ সিংয়ের পাগড়ি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাধাদানকারীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করলে তাঁদের পরিচয় স্পষ্ট হয়। বিচারে যে অর্থদণ্ড হয় তাঁদের, সেটি পরিশোধ করেন রামচন্দ্র। ঘটনাটি সাধারণ হলেও সংবাদপত্রে এর পরিণামটি ছিল অসাধারণ। ‘Tagore Visitor Hit by Hindus’ থেকে শুরু করে ‘Plot Against Hindu Poet’ বহু কিছু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শহর থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন এমন সংবাদও ছাপা হয়েছিল ‘Hindu Poet Flees from Reported Assassination Plot’।
পরবর্তীকালে, ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ New York Tribune লিখেছিল ‘U. S Jury Sifting India Plot to Get Von Igel’s Papers’। অভিযুক্ত হিসেবে যাঁদের নাম ছাপা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী (১৮৭৭-১৯৭১)। বলা হয়েছে, চন্দ্র নিয়মিত রামচন্দ্রের নিকট সংবাদ পাঠাতেন। দীর্ঘ সংবাদটির নিচে আরও একটি সম্পর্কযুক্ত সংবাদ হলো ‘German Plots to Aid Revolutions in India known at Washington’। একই তারিখে The day book পত্রিকাটি সংবাদ ছেপেছিল ‘Sun Francisco Hindus plant Revolution’ শিরোনামে। বলা হয়েছিল, দু-মাস তদন্ত শেষে প্রমাণিত হয়েছে যে সানফ্রানসিসকোতে বসবাসরত হিন্দুদের ইন্ধনে চিনের সহযোগিতায় ভারতজুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ দখলের ষড়যন্ত্র চলছে।
এক মাস পর ৮ এপ্রিল Daily Missourian পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয় রামচন্দ্রকে আটক করা নিয়ে। বলা হয়েছে, মোট নয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনায় দোষী আটক ব্যক্তিরা বিচারের মুখোমুখি হবেন। তিন মাস পর ১৩ জুলাই Ogden Standard পত্রিকায় এ বিষয়েও সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘HINDU CONSPIRATOR BROUGHT/TO OGDEN AND HIS HEARING/SET BY JUDGE W. H. REEDER’। যে ষড়যন্ত্রকারী এখানে আটক তাঁর নাম মুনশি রাম বা মুঙ্গা রাম। মুঙ্গা রাম আদালতে তাঁর যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, তিনি হিন্দু বিপ্লবী নেতা রামচন্দ্রের নির্দেশে প্রথমে লস অ্যাঞ্জেলেস ও পরে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় ষড়যন্ত্র বিস্তারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯১৮ সালের ১০ জানুয়ারি নিউইয়র্ক ট্রিবিউন ‘Hindu Plot Witness Brings in Braun’ শিরোনামে লেখে চিন থেকে ১০ লাখ রাইফেল ক্রয়ের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে আটককৃতদের একজনের সে সংবাদ। ২৫ ফেব্রুয়ারিতে একই পত্রিকায় ‘Goldman Worked with German Spy, Letters Indicate’ শিরোনামের সংবাদে ‘Letters Made Public’ উপশিরোনামে জানানো হয়েছে, সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রকাশিত Ghadr নামের যে পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদক রামচন্দ্র, সেটির প্রতিষ্ঠাতা হরদয়াল। আরও জানানো হয়, ১৯১৪ সাল থেকে বার্লিনে রয়েছেন এবং জার্মান বিদেশি দূতাবাসের সহযোগিতায় বিদ্রোহ সংগঠনের চেষ্টা করছেন। পত্রিকাটি ২৬ অক্টোবর তারিখে লেখা একটি চিঠি ছেপে দিয়েছে, যাতে হরদয়াল জার্মানিতে বিপ্লবের সহযোগিতার জন্য লোক চেয়েছেন। পরের মাসে ২৫ ফেব্রুয়ারি Herald পত্রিকাটি ব্যানার হেডিং করে লেখে ‘LANCING TO TESTIFY IN HINDU PLOT’। যদিও সংবাদটি ডান দিকে মাত্র দুই কলামে ছাপা হয়েছিল। প্রতিবেদনের একটি উপশিরোনাম ছিল ‘Tagore’s Testimony’। তখন জাপান ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ ‘Testimony’ করতে গিয়ে আমেরিকায় যাবেন স্বীকারোক্তিতে এমন কথা বলেছিলেন রামচন্দ্র। আর এভাবেই ক্রমে রবীন্দ্রনাথের নামটি হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা বা গদর বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
দুই দিন পরেই ২৮ ফেব্রুয়ারির সংবাদে বোমা ফাটল যেন। নিউইয়র্ক ট্রিবিউন লিখল: ‘Tagore Named with Japanese at Plot Trial’। উপশিরোনাম হিসেবে এল ‘Ocuma and Terauchi Figure in Hindu Correspondence’ উল্লেখ করে বলা হলো যে সরকার কর্তৃক গোপন নথিপত্রের ভিত্তিতে এটি দাবি করা হয় যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি, তার আগের প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভারতীয় ষড়যন্ত্রীদের যোগাযোগ রয়েছে। দীর্ঘ সেই সংবাদের একটি ছায়া সংবাদ প্রকাশিত হয় ১ মার্চ Interior Journal পত্রিকায়। ১৯ মার্চ ‘Two German Plots Exposed’ শিরোনামের সংবাদের একটি অংশ হলো ‘Two Arrests in Second Gmp’। আটককৃতদের মধ্যে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের নাম এসেছে। ২৮ মার্চে দুটি সংবাদ ছাপা হয় ‘Hindu Plotters had Two Marked for Death Here এবং Hindu on Trial Gets many Death Threats, He Admits to Police’ শিরোনামে, এখানে ‘He’ হলেন চন্দ্রকে চক্রবর্তী। Evening Public Ledger ২ এপ্রিল তারিখে ছেপেছে ‘US INDICTS AMERICAN GIRLS AND FIVE HINDUS’। নাম এসেছে পুলিন বি বোস, তারকনাথ দাস, যদু গোপাল মুখার্জি ও ভগবান সিংয়ের। ২৪ এপ্রিল নিউইয়র্ক ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত ‘Hindu Kills and Skilled at Plot Trail’ শিরোনামটি চমকে দেওয়ার মতো। ১৩ এপ্রিল ছিল ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণার দিন। ঘোষণার পর যখন দর্শকেরা বেরোচ্ছিলেন এবং অভিযুক্তদের মধ্যে রামচন্দ্র অস্থিরভাবে বিচরণ করছিলেন, রাম সিং পিস্তল বের করে রামচন্দ্রকে গুলি করেন এবং এতে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়, যদিও কোর্টে দায়িত্বরত অস্ত্র বহনকারী কর্মকর্তা (মার্শাল) মুহূর্তেই পিস্তলের গুলিতে ভূপতিত করেন রাম সিংকে। ভয়াবহ উত্তেজনা সৃষ্টিকারী দিনটি নিয়ে ২৮ এপ্রিল নিউইয়র্ক ট্রিবিউন পৃষ্ঠাজুড়ে সংবাদ ছাপে।
শিরোনাম দেয় HINDU PAWNS LOST IN KAISER’S GAME OF EMPIRE। প্রতিবেদকের নাম L. J. D. BEKKER। আধা পৃষ্ঠাজুড়ে সংবাদের মাঝে ছয়টি ছবি ছিল, যাঁদের একটি হলো রামচন্দ্রের, আরেকটি রামচন্দ্রের হত্যাকারী রাম সিংয়ের। ২৩ এপ্রিল সানফ্রান্সিসকো কোর্টে রামচন্দ্রের হত্যাকাণ্ডসহ পুরো বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ এই প্রতিবেদন।
১৯১৭ সালের ২০ নভেম্বর শুরু সেই মামলার ৩২ জন আসামির মধ্যে ২৯ জন কম-বেশি মেয়াদে সাজা পান। কোর্ট প্রাঙ্গণে মৃত্যু হয় দুজনের। আর একজন বেকসুর খালাস পান। যদিও মামলার রায় হলেও রবীন্দ্রনাথ মুক্তি পাননি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে। রায় ঘোষণার চার মাস পর ১৬ আগস্ট কোর্টের বরাত দিয়ে Ocean Standard পত্রিকাটি লেখে ‘Woman Attorney Exonerates Tagore’। জানানো হয়, ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ ছিল একটি দুর্ঘটনা মাত্র। পত্রিকাটির ভাষায়: ‘Tagore was mentioned incidentally in the letters of the conspirators as having favoured a change in the Indian government. There was no evidence of any sort against him and any connection he may have had with the conspirators was entirely innocent of wrong doing’. ১৯১৮ সালের ১৭ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ‘Tagore Maintains Loyalty/Offers Letter From Indian/Governor to Disprove Plot’।
ষড়যন্ত্র মামলায় নিজের নাম যুক্ত হয়ে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হওয়ায় ১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ পূর্বপরিকল্পিত আমেরিকা সফর বাতিল করতে বাধ্য হন। তৃতীয়বার যখন তিনি আমেরিকায় যাত্রা করলেন, তত দিনে দুই বছর পার হয়ে গেছে। ১৯২০ সালের ২৮ অক্টোবর পুনশ্চ তাঁর আমেরিকা পদার্পণ। কিন্তু ইতিমধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু। ১৯১৬ সালে তাঁকে নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত যে আমেরিকা তিনি রেখে এসেছিলেন, জীবনের বাকি ২০ বছরেও আমেরিকা থেকে সেই উষ্ণতা তাঁর আর ফিরে আসেনি। আর ১৯২৯ সালে কানাডা থেকে যখন আমেরিকায় রওনা হওয়ার পথে, তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় নোবেল বিজয়ী কবিকে চূড়ান্ত অপমান করতেও সামান্য দ্বিধা করা হয়নি।
Sanfransisco Call লিখেছিল, “রবীন্দ্রনাথের এই দর্শন ভারতের জন্য কি করেছে! আর আমাদের কি দশা হত যদি আমরা সেই তত্ত্ব জীবনে গ্রহণ করতাম”? “বৃদ্ধ ভারত কুব্জ, অর্ধভুক্ত, ছিন্নকন্থা পরিহিত – বোধিদ্রুম তলে বসিয়া আছে, আর অনন্তের চিন্তা করিতেছে! আত্মসমর্পন খুব বড় গুন তা সে খৃষ্টানের মধ্যেই হউক আর পৌত্তলিকের মধ্যেই হউক। ভারতবর্ষ আত্মসমর্পন মন্ত্র প্রচার করুন, - আমরা আমেরিকানরা দৃঢ় সংকল্পকে ভাল করিয়া সাধন করি”।
L. A. Express আরও বিদ্রূপ করে লিখল: “যাই হোক, অর্থ রোজগার হিসাবেও আমেরিকানদের প্রয়োজন আছে দেখিতেছি। ঠাকুর-মহাশয় তাহাদিগকে তাহাদের ধনের জন্য সমালোচনা করিয়াছেন – কিন্তু সেখানে আসিয়াছেন তো তাহাদের উপার্জিত ধনের কিছু অংশ গ্রহণ করিতে। ... ধন খুবই হীন পদার্থ, ধনোপার্জন বৃত্তি আরও গর্হিত। ... কিন্তু আমাদের এই সান্ত্বনা যে আমাদের এই তুচ্ছ ধন – যাহা তিনি এতই ঘৃণা করেন তাহাই তাঁহাকে এতদূর টানিয়া আনিয়াছে। তিনি যাহা নিন্দা করেন, তাহাই পাইবার জন্য আসিয়াছেন, এবং এখানে আসিয়া সেই কাজই নিজে করিতেছেন যাহার জন্য এত নিন্দাবাদ”।
এই ঘটনার ৭/ট বছর পর রবীন্দ্রনাথ যখন চীনে গেলেন (১৯২৪) তখন সেখানেও কিছু কাণ্ড ঘটেছিল। দিনটা ছিল, ২৪ এপ্রিল, ১৯২৪ - রবীন্দ্রনাথের প্রথম পাবলিক সম্বর্ধনা – স্থান পিকিং-এর রাজকীয় উদ্যান। বহু যুগ আগে এই উদ্যানে সম্রাটরা বিদেশী দূতদের দর্শন দিতেন। পিকিং-এর নানা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এই সম্বর্ধনা সভায় উপস্থিত হলেন। রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত করে লিয়াং চি চাও এক দীর্ঘ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ পাঠ করেন। লিয়াং চি চাও তাঁর ভাষণে বলেন, “আমরা সাত-আটশ বছর পরস্পরকে ভালবেসে শ্রদ্ধা করে স্নেহশীল ভাইয়ের মত বাস করেছিলাম। আমরা উভয়েই বিশ্বজনীন সত্যের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারে আত্মোৎসর্গ করেছিলাম। আমরা মানবজাতির লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাবার জন্য যাত্রা করেছিলাম। আমরা পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম। আমরা চীনেরা আমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভারতীয়দের নেতৃত্বে ও পরিচালনার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভব করেছিলাম। আমাদের উভয়ের মধ্যে কেউই বিন্দুমাত্র স্বার্থপরতার প্রেরণার দ্বারা কলঙ্কিত হইনি – সেটা আমাদের মোটেও ছিল না”। এই ভাষণে ভারতের কাছে চীনারা কত বিষয়ে ঋণী, তার একটা ঐতিহাসিক রেখাঙ্কন আছে। পরদিন [২৫ এপ্রিল] অ্যাংলো-আমেরিকান এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে Wagonlits হোটেলের হলে কবি-সম্বর্ধনা হল। সভাপতিত্ব করলেন স্যার ফ্রান্সিস আগলেন – সমিতির সভাপতি। কবিকে সভায় পরিচয় করিয়ে দেন Dr. G. Schurman – ইনি আমেরিকান; আমেরিকায় কবির সাথে পরিচিত হন, তাঁর বক্তৃতা শোনেন; উপস্থিত ভদ্রদের মধ্যে তিনিই কবিকে জানতেন। কবি প্রতি ভাষণে যা বললেন, তার মধ্যে নতুন কথা বিশেষ নেই; যে পাশ্চাত্য সভ্যতার সমালোচনা তিনি আগে করেছেন – সেটাই বিস্তারিত ভাবে বললেন, এর সঙ্গে ভাবাত্মক, গঠনমূলক বিশ্বমৈত্রীর কথা ছিল। তিনি বললেন: “পৃথিবীর সকল অমর কীর্তি – সাহিত্য কলা সংগীত – জাতির জীবনে শান্তি না থাকলে প্রকাশ পায় না। চীনের এই আত্মঘাতী সংঘাত বন্ধ করা প্রয়োজন - for the sake not only of Chaina, but of Asia Humanity. তিনি আরও বলেন, যে “পশ্চিমের যে আদর্শ জাপানকে ধনলোলুপ, শক্তিমত্ত করে তুলেছে, তা যেন পূর্বকে গ্রাস না করে; পূর্বদেশের আজ এই বড় ভয় যে, সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে দ্বন্দ্ব করতে গিয়ে আজ তার নিজস্ব সাত্ত্বিকটা হারিয়ে ইউরোপের অস্ত্র গ্রহণ করছে”। তিনি শ্রোতাদের বললেন: “not to acquire the mentality of the primitive man, the mentality of the west eternally striving after power. The world was waiting for that moral idealism, for that spiritual standard of life to save it from the demon, the worship of power”. কবির এই ভাষণে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। পাশ্চাত্যজাতীরা তো খুশি হলই না, যুব চীনের মনোভাবও কঠোর হয়ে উঠল। কবির আগমন সূচনার সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে মার্কসিস্টদের প্রচার কার্য আরম্ভ হয়েছিল। চীনের তরুণ ভাবুক ও কর্মী কুও-মুড়ো [Kuo-Muro] চীনা পত্রিকায় সে সময় যা লেখেন – তার সারমর্ম পাঠ করলেই যুব চীনের একশ্রেণীর মনোভাবের আভাস পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথকে পিকিং থেকে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে – এই সংবাদ ১৯২৩-এর অক্টোবর মাসের মধ্যে চীনে নিশ্চয়ই প্রচারিত হয়েছিল। কুও-মুড়োর প্রবন্ধ ১৪ অক্টোবর এক চীনা পত্রিকায় [Creation Weekly] প্রকাশিত হয়; অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ চীনে পদার্পণের প্রায় ছ-মাস আগে থেকেই কম্যুনিস্টরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারকার্য আরম্ভ করে। [প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ১৯২৩ সালে পূজাবকাশের কোনো সময়ে যুগলকিশোর বিড়লা কবির চীন সফরের ব্যয় নির্বাহার্থে এগার হাজার টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হলে, সে সময় কবি পিকিং-এর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে খবর দেন; সেই সংবাদ পিকিং-এ প্রকাশিত হবার পর কুও-মুড়োর রবীন্দ্রবিরোধী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়]। এই কুও-মুড়ো যৌবনে পরম রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা ইংরেজি থেকে চীনাভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশের জন্য বহু চেষ্টা করে কিভাবে ব্যর্থ হন সেকথা তিনি বলেছেন। কিন্তু কম্যুনিজমের ভাবধারার স্পর্শে তাঁর মতের আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ চীনে আসছেন এই সংবাদ রাষ্ট্র হওয়ার পর তিনি লিখলেন, “ব্রহ্মার প্রকাশ, আত্মন-এর গরিমা, ‘প্রেম’-এর বাণী কেবলমাত্র কর্মবিরল মানুষের অহিফেন বা তাড়ি; নিঃস্বের পক্ষে অনবরত শরীরের ঘাম আর রক্তক্ষয় করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সমন্বয়ের প্রচার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সাংঘাতিক বিষ, সমন্বয়ের প্রচার হচ্ছে বিত্তবানদের ছলনার আশ্রয়, নিঃস্বদের লোহার শৃঙ্খল। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ইচ্ছায় চীনদেশে বেড়াতে আসছেন, এতে আমরা তাঁকে অন্তরের আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু চীনা সর্বসাধারণের ডাকে চীনদেশে আসছেন – এ কথা বললে আহ্বানকারীর বিরুদ্ধে আমাদের যথেষ্ট অভিযোগ থেকে যায়”। এই আবহাওয়ার মধ্যে কবির প্রথম ভাষণ শুনে যুব চীনের ধারণা হল ভারতীয় কবি প্রতিক্রিয়াশীল (Reactionery)। তিনি প্রাচীনের জয়গৌরবে পঞ্চমুখ, আধুনিক এশিয়ার নবজাগরণ আন্দোলন তাঁর দ্বারা প্রতিহত হবে। নবীনচীনের একদল যুবক ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতই পশ্চিমমুখী – প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাহীন। তারা পশ্চিমের নতুন বাণীর জয়গানে মুখর ও নিজের দেশের বৈশিষ্ঠ সম্বন্ধে সন্দিহান।[নন্দলাল বসু লিখছেন: “গুরুদেব যে মৈত্রীর কথা বলতে আজ চীনে এসেছেন, এরা তাতে কর্ণপাতও করে না, একেবারে গোঁয়ার-গোবিন্দ হয়ে বসে আছে”।]
যাই হোক, তারা সভার আগে ছোট ছোট বিজ্ঞাপনীতে এইসব কথা লিখে প্রচার করত; তাঁরা বলত, “রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধেয়, কিন্তু তাঁর মতামত আমরা গ্রাহ্য করতে পারি না’; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কোনো সভায় তারা কখনো কোনো অভদ্র আচরণ করে নি।
এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “নিছক সম্মান পাবার সৌভাগ্য আমার হয় নি। সেখানেও একদল লোক আছে – তাও বলি তাদের দল খুব ভারি নয় – তারা বললে এ লোকটা ভারতবর্ষ থেকে এসেছে আমাদের মাথা খারাপ করতে; এখন আমরা এ সমস্ত কথা, ভারতবর্ষের বাণী বৌদ্ধধর্ম যা দিয়েছে শুনতে পারিনে। তাতে ক্ষতি হয়েছে, গায়ের জোর কমিয়ে দিয়েছে, হিংসা প্রভৃতি খর্ব করেছে: এ লোকটি একে কবি, তা’তে ভারতবাসী, ও আমাদের মাথা খারাপ করতে পারে” [৮ শ্রাবণ ১৩৩১ কলকাতা ইউনিভার্সিটি হলে বক্তৃতার অনুলিখন থেকে সংগৃহীত]। তারপর একদিন [২৬ এপ্রিল] পিকিং-এর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হলে নানা বিদ্যায়তনের ছাত্রদের সাথে কবির সাক্ষাত হল। ঘরোয়াভাবে কথাবার্তা হয়। কবি বললেন যে, “তিনি যখন চীন থেকে আমন্ত্রণ পান, তখন তিনি জানতেন না যে, এদেশের সকল শ্রেণীর লোক ভারত-আগত মানুষটিকে চায় না। এ কথা সত্যি যে তিনি তাদের কোনও সাহায্য করতে পারবেন না – তার জন্য শত সহস্র অধ্যাপক আছেন। তবে তাঁর বক্তব্য এই যে, যারা বলেন শক্তিশালী নেশন হতে হলে বস্তু-আশ্রয়ী শক্তির প্রয়োজন – তাঁরা কবির মতে, পৃথিবীর ইতিহাস জানেন না। শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বর্বরতারই বৈশিষ্ট্য। যে সব জাতি এই পশু শক্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল – হয় তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে না-হয় বর্বরই আছে। কবির বক্তব্য ধর্মের পথই সত্যের পথ – seek righteousness through success be lost। এর ফল হল আশাতীত”।
এ সম্বন্ধে কবির সঙ্গী ও সেক্রেটারি মিষ্টার এলমহার্স্ট লিখেছেন, “His first talk to them has completely won their hearts and minds. They found that he had all time been as much of a revolutionary in the field of letters as any of them”.
ঋণ: রবিজীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল। রবীন্দ্র জীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
শিলং-এ বাস্তব
শেষের কবিতা
ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
গল্প
“আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত”॥….
গানটা শুনতে শুনতে ইন্দ্রানী অনেকক্ষণ চোখ বুজে ছিল। আজ কেমন যেন অবসাদগ্রস্ত লাগছে। মনটা ছটফট করছে। কান থেকে হেডফোনটা নামিয়ে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একবার বাইরের দিকে তাকাল। প্রকৃতিও কেমন শান্ত ধীর স্থির হয়ে রয়েছে। তাদেরও কি মন অবসন্ন। গাড়ি চলছে তার আপন বেগে। সারি সারি গাছ আর পাহাড়ি উপত্যকা ক্রমশ যেন পিছনের দিকে চলছে। দুজনেই এখন অ্যাডাল্ট, চাকরিবাকরি করে। মনকে রিফ্রেস করতে আজ তারা শিলং যাচ্ছে। ইন্দ্রাণীর মনটা আজ কেমন যেন রবিঠাকুরে আচ্ছন্ন। একের পর এক কবিতা আর গান মনের অবচেতনে গেয়ে উঠছে।
আসলে রবীন্দ্রনাথও শিলং-এ এসেছিলেন তিন-তিনবার (১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭)। দ্বিতীয়বারের সঙ্গী ছিলেন রাণু। রাণুর বিয়ে হয় ১৯২৫-এ। ১৯২৭-এ শিলং-এ এসে রবি ঠাকুর রাণুকে লিখলেন, ''রাণু, শিলঙে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু এ আর এক শিলং।'' এসব ভাবতে ভাবতেই ইন্দ্রাণীর মনটা কেমন আনমনা হয়ে গেল।
কৃষ্ণেন্দু ইন্দ্রাণীর দিকে তাকিয়ে দেখল, ইন্দ্রানী বাইরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞেস করল কি হল রে, কার কথা এত ভাবছিস? শিলং-এ যাচ্ছিস, রবিঠাকুরের কথা ভাবছিস না তো? এতো ওনার প্রেমকাহিনী লেখার প্রেমনগর। দেখ ড্রাইভারকে আবার গল্পে গল্পে Inspire করিস না, তবে দেখবি ও হয়ত অমিত-লাবণ্যর মত গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে বসেছে। চল, এবার গাড়ি থেকে নাম। সামনের ওই দোকান থেকে চা খাই। মনটা একটু ফ্রেশ হবে। মাঝে মাঝে আমার একটু চা পানের দরকার হয়ে পড়ে। না হয় একদিন তোকে চা পানের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে একটা সেশন দেব। আর তোর রবিঠাকুরের ওই অমিত রায় সে তো ফিরপোর দোকানে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে চা খেয়ে বেড়াত। ইন্দ্রানী সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুকে জিজ্ঞেস করল তুই এসব জানলি কি করে? কৃষ্ণেন্দুর চটপট উত্তর, একবার বন্ধুদের চাপে পড়ে তোদের রবিঠাকুরের একটা নভেল পড়েছিলাম, তবে তোর গুরুদেব রবিঠাকুরকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু জানিস ওই নভেলের কাহিনীর সঙ্গে আমাদের প্রেম কাহিনীর অনেক মিল খুঁজে পাই। থাক ওসব কথা, ওই পাহাড়টাকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে দাঁড়া, তোর একটা ছবি তুলি। তোর রবিঠাকুর এমন সময়ে হয়ত ছবি তুলতে তুলতেই আপনমনে কবিতার প্লট তৈরী করে নিত। যেভাবে অমিতের গলা দিয়ে লাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিল,
“সুন্দরী তুমি শুকতারা
সুদূর শৈলশিখরান্তে,
শর্বরী যবে হবে সারা
দর্শন দিয়ো দিক্ভ্রান্তে”।
রবিঠাকুরের মত অত কষ্টকর শব্দ দিয়ে কবিতা আমার আবার আসে না। আমি হলে হয়ত লিখতাম,
“শাড়ীতে তোকে মানিয়েছে বেশ ভালো,
নজরকাড়া, মন মাতিয়ে দিলো
বয়স হয়েছে বোঝাই যায় না তোকে।
তুই তো এখন অচিন দেশের পাখি
উড়ে এসে করিস ডাকাডাকি
চিনতে পারবি আমায় দূরের থেকে”?
চল্ এবার গাড়িতে ওঠ্। আর কিছুক্ষণের মধ্যে শিলং পৌঁছে যাব। ওখানে গেলেই পাবি পাহাড়, মেঘ, বৃষ্টি আর পাবি রডোডেন্ড্রন্ আর তোর গুরু রবীন্দ্রনাথ। তোদের সেই বুড়ো রবি ঠাকুর সে তো কবে মরে ভুত হয়ে গেছে। শুনেছি এখনো অমিত, লাবণ্য আর রানুর ছায়ারা ঘুরে বেড়ায়। সেই ওদের প্রেমের প্রথম সাক্ষাতে নিবারণ চক্রবর্তীর কন্ঠ দিয়ে কবিতা আওড়েছিল,
“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।…
…উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেনড্রনগুচ্ছ”।…
দেখ তোকে নিয়ে যদি আরও আগে এখানে আসতাম, যেভাবে রাণু এসেছিল রবিঠাকুরের কাছে। ১৯২৩-এ 'নির্জলা যৌবনের' অধিকারী 'ছাব্বিশ'-এর রবীন্দ্রনাথ (আনুমানিক বয়স ছিল ৬১বছর) অমিতের মতোই, শিলং-এর পথে পথে ঘুরছিল এক সপ্তদশী সুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে। মেতেছিল গল্পে, কৌতুকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দুজনকে অসমবয়সী মনে করলেও, কবির ভ্রমণসঙ্গিণীর কাছে তিনি ছিলেন 'সাতাশ' বছরের তরুণ! কবি ঠাট্টা করে বলতেন, 'সাতাশ'কে লোকে 'সাতাশি' শুনবে, বরং 'ছাব্বিশ' ভাল! অনেকে বলেন, শিলং পাহাড়ে কবির সেই ভ্রমণসঙ্গিণীর নাম ছিল রাণু-- রাণু অধিকারী। তবে, এটা হলফ করে বলা যায় না! কিন্তু মিল রয়েছে অনেক।
'রবীন্দ্রনাথ রাণু ও শেষের কবিতা'য় এমন কিছু সাদৃশ্যে তুলে ধরা আছে যেখানে, রাণু ও লাবণ্য, দুজনেই রবি ঠাকুরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। পোশাক-আষাকেরও মিল রয়েছে অনেক। শেষের কবিতা লেখার সময় কবি বলেছেন, লাবণ্য তাঁর খুব চেনা। দু'জনের বাবার একই পেশা। লাবণ্যর বাবা অবিনাশ দত্ত এক পশ্চিমি কলেজের অধ্যক্ষ, রাণুর বাবা ফণিভূষণ অধিকারী ছিলেন দিল্লির হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ।
শোভনলালের সঙ্গে যেমন লাবণ্যর, তেমনি আট বছরের সম্পর্কর শেষে রাণুরও বিয়ে হয়ে যায় শিল্পপতি পুত্র বীরেন্দ্রর সঙ্গে। শেষের কবিতার সমাপ্তি যেমন, কেটির সঙ্গে অমিতের এবং লাবণ্যর সঙ্গে শোভনলালের আসন্ন বিয়ের খবর দিয়ে, তেমনি রাণু-রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে যে জীবন-উপন্যাস, তারও সমাপ্তি রাণুর বিয়ের সম্ভাবনার সংবাদেই! যাই হোক আমি হলে লিখতাম,
তুই আর আমি এক কলেজেই পড়ি
আমার কমার্স, বাংলা অনার্স তোর
প্রায়ই কলেজ কেটে ভিক্টোরিয়ার ঘুরি
দুজনার কলেজ একই বিদ্যাসাগর।
কলেজটা ঠিক বড় রাস্তার পাশে
ক্লাসের ফাঁকে বসি গাছের তলায়
যদি লেট হয়, জ্যামে আটকে বাসে
ক্লান্ত হই তোর মিসড কলের ঠেলায়।
আমার বাড়ি সুদূর পটাশপুরে
মা-গঙ্গা বইছে উথাল-পাতাল স্রোতে
আজ পথ বেঁধেছি বন্ধনহীন সুরে
চলেছি মেঘের রাজ্য শিলং পর্বতে।
ইন্দ্রানী মুখ বেঁকিয়ে বলল, কি রে কবি হয়ে গেলি নাকি? আমি জানি তুই রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করিস না। এ অসুখ তো তোর আগে কখনো ছিল না ।
একটা নভেল পড়ছি ম্যাডাম, নাম হল ‘শেষের কবিতা’, নাম শুনেছিস?
না, শোনার ইচ্ছেও নেই।
তবে শোন, তোর আর আমার প্রথম আলাপের দিনটা মনে পড়ে? তোর সেদিন কিসের এতো তাড়া ছিল জানি না। তুই হনহন করে কলেজের করিডোর দিয়ে আসছিলি আর আমি উল্টোদিক দিয়ে এসে তোকে পাশ কাটাতে যাব হঠাৎ প্রবল ধাক্কায় তোর হাত থেকে পড়ে গেল মোবাইল, ডাইরি আর একটা বই।
Sorry! Extremely sorry! আমি তোর জিনিসগুলো কুড়াতে কুড়াতে, তোর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলাম ।
তুইও লজ্জায় বলে উঠেছিলি, “I’m also sorry! দোষটা আমারই, এত জোরে আসা উচিত হয় নি, আসলে”…
সঙ্গে সঙ্গে আমিও প্রত্যুত্তরে তোকে বলেছিলাম, “It’s okay’ – আর জিনিসগুলো হাতে নিয়ে হন হন করে এগিয়ে চলে গিয়েছিলি ইন্দ্রানী।
এবার তুই একটু মনে কর্ অমিত আর লাবণ্যর সেই কার অ্যাকসিডেন্টের সিকোয়েন্সটা।
দুর্ঘটনা হওয়ার পরে অমিত যখন পাওনা শাস্তির অপেক্ষায় লাবণ্যের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলেছিল, "অপরাধ করেছি।"
লাবণ্যও হেসে হেসে উত্তর দিয়েছিল, "অপরাধ নয়, ভুল। সেই ভুলের শুরু আমার থেকেই।"
এখন তোর উত্তর আর লাবণ্যর উত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখ ঠিক মিলে যাবে।
তারপর, তো তোর সঙ্গে আমার বারে বারেই দেখা হয়েছে, কখনও কলেজ করিডরের বাঁকে, ধোঁয়া ওঠা ক্যান্টিনের মুখের ফাঁকে ফাঁকে। আলাপ থেকে পরিচয় হয়েছে। গাঢ় হয়েছে ভালোবাসার রঙ। দিয়া জ্বলে উঠেছে হৃদয়ে। কখনও কবিতায় বলে উঠেছি
কতবার ভেবেছি ‘ভালবাসি’ কথাটা বলার
পিছিয়ে এসেছি লজ্জায়। সম্মানের ভয়ে।
স্বপ্নে, কল্পনায় সে দৃশ্য দেখেছি বারবার
তবু বলতে পারি নি। এক অদ্ভুত সংশয়ে।
তারপর একসঙ্গে পথ চলেছি কত, তিলোত্তমা কলকাতার কোণায় কোণায় হেঁটে দেখেছি, ট্রামে চড়ে দেখেছি, নৌকায় চড়ে দেখেছি। সাক্ষী আমাদের দুরন্ত যৌবন, সাক্ষী রয়েছে ভিক্টোরিয়ার মাঠ, সাক্ষী রয়েছে গঙ্গার বাতাস, সাক্ষী রয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। হাতে হাত রেখে তোকে চিনেছি, ঠোঁটের আদরে নিয়েছি শরীরের ঘ্রাণ, চিরে চিরে দেখিয়েছি ভালোবাসার মানে, লুকিয়ে সে কোথায় শরীরে না মনে? ওগো কবিতা তুমি জেগে ওঠো কৃষ্ণেন্দুর কন্ঠে –
তুই মোহময়ী সুপার ডুপার রোলে
আমি বাদল দিন। ঝরা কদম ফুলে।
তুই পথের দিশা ওড়াস পরাগসুখ
আমি ছুটে মরি সামান্য বেতনভুক।
থাম্ থাম্ তোকে এত কাব্যি করতে হবে না। গাড়িটা দাঁড় করাবি প্লিস। ওই লাগেজে জিন-এর বোতলটা আছে, আমাকে দে একটু গলায় ঢেলে নি।
তোর কি হল রে ইন্দ্রানী? এত চাপ খাচ্ছিস কেন? Relax ইয়ার। বেড়াতে এসে মুখটা ভেটকে থাকিস না । বরং আমাকেও একটু প্রসাদ দিস। -তুই নেশায় মাতাল হোস দু-এক পেগে দেবী প্রসাদ দেবে? নয়তো মায়ের ভোগে।
কেন সাজিস সতী? না হয় হ’লি উদার ঢাল বিষের জ্বালা। কেন ছলের বাহার?
খাই তোর’ই বিষ প্রাণের আশা ছেড়ে জীবন সঁপেছি তোকে। তবু যাস অভিসারে।
কেন আঘাত হানিস? খেলার ছলে ভাসাস?
দেখি খেলিয়ে আমায় কত সাহস নাচাস?
গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। কৃষ্ণেন্দু এবার রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা বইটা খুললো । ইন্দ্রাণীকে বললো, শোন এই জায়গাটা, তোর ভালো লাগবে – … “একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল।… মেয়েটির পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট, পায়ে সাদা চামড়ার দিশি ছাঁদের জুতো। তনু দীর্ঘ দেহটি, বর্ণ চিকন শ্যাম, টানা চোখ ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় স্নিগ্ধ, প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল আঁট করে বাঁধা, চিবুক ঘিরে সুকুমার মুখের ডৌলটি একটি অনতিপক্ক ফলের মতো রমণীয়। জ্যাকেটের হাত কব্জি পর্যন্ত, দু-হাতে দুটি সরু প্লেন বালা। ব্রোচের-বন্ধনহীন কাঁধের কাপড় মাথায় উঠেছে, কটকি কাজ-করা রুপোর কাঁটা দিয়ে খোঁপার সঙ্গে বদ্ধ”।…
ইন্দ্রানী বলল – ধুর গাড়ির শব্দে সব ঠিকঠাক বুঝতেই তো পারছি না। বইটা বন্ধ করে দেয় কৃষ্ণেন্দু। পেছনে ফিরে তাকায়, দেখে, ফেলে যাওয়া রাস্তা আর ফেলে আসা অতীত।
গাড়ি ছুটে চলে নিজের গতিতে। ইন্দ্রানী আবার একটু জিন গলায় ঢেলে বোতলটা কৃষ্ণেন্দুর দিকে বাড়িয়ে বলে, নিবি?
না থাক।
ইন্দ্রানী? হুঁ! তোকে কেমন যেন upset লাগছে। তুই কিন্ত আগের মত আর respond করছিস না।অন্যমনষ্ক ইন্দ্রানী বলল – কিসে? যখন তোকে আদর করি। তোর sensasion excitement টা কি মরে গেছে, আমার প্রতি? তোর কৃষ্ণেন্দুর ভাষায়, ফুলের প্রয়োজন নেই। মন শুধু চায়সাহসের। যা তোকে দেয় প্ররোচনা আজ প্রেমের ক্ষুধা চাই এই অবেলায়জীবন তো শিখিয়েছে শুধু যন্ত্রণা। ইন্দ্রানী চুপ করে থাকলো, বলল – কি জানি, ঠিক বুঝতে পারি না। কৃষ্ণেন্দু বলল – জানিস, আমার মনে হচ্ছে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে glimmer টা ছিল, সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে। ভলকানোর লাভা কমে আসছে। তাই আমার কবিতা বলে, হও বন্য পশুর মত হিংস্র, জ্বলুক আগুন শরীরে শরীরে জাগুক চেতনা, বিপ্লব খুন। লেখাটা কি তোর ভালো লেগেছে কৃষ্ণেন্দু? ইন্দ্রানী জানতে চাইল ।একটু থামলো কৃষ্ণেন্দু, বলল, লেখার ভাষা খুব back-dated লাগছে, obviously লাগবেই। Conversation ও খুব actual মনে হচ্ছে না, বড্ড আঁতলামো মনে হচ্ছে। তবে, লেখার মধ্যে কিছু তো একটা আছে বুঝলি। যেটা আমাকে খুব স্পর্শ করেছে। অমিত, যে গল্পের নায়ক, বাবার অগাধ পয়সা। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে বি.এ পড়ার আগেই ওনার বাবা অক্সফোর্ডে ভর্তি করে দিলেন। প্রায় সাত বছর লাগল পাশ করে বেড়িয়ে আসতে। বেশ বুদ্ধি আছে। তার বাবাও চাইতেন ছেলের গায়ে একটু অক্সফোর্ডের রঙ লাগুক। ভীষণ বকবক করে। বিষয় পেলেই হলো, সব কিছুতেই তার মতামত দেওয়া চাই। একটু নতুন স্টাইলে কবিতা লেখে। রবীন্দ্রনাথ ঘরাণা একদম পছন্দ করে না। আসলে সেই সময়ে, মানে ১৯২০-তে বা ওই পিরিয়ডে অনেক young writer রা রবীন্দ্রনাথকে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। তিনি তখন নোবেল জয়ী, কবিগুরু। কিছু নতুন লেখক তাঁর ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন স্টাইল আনতে চাইছিল। তারা বিদ্রোহী। সব জায়গাতেই কিছু বিদ্রোহী থাকবেই। তারাই তো সমাজ সাহিত্য এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই কথা তিনি এই লেখায় দেখিয়েছেন। গল্পের নায়ক অমিত সেই বিদ্রোহী দলের নতুন মুখ বলতে পারিস। প্রায় সত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথ লিখলেন সেই সময়ের সাড়া জাগানো প্রেমের উপন্যাস। মানে, এই লেখাটা – শেষের কবিতা।
গল্পটা কি? একটু ছোট্ট করে বল।
- গল্প নয় রে ইন্দ্রানী, বল a great novel। আরে ওই হল, তা story line টা একটু বল দেখি। নভেলে অমিত একবার বলছে – রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওয়ার্ডসওয়ার্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে –
ইন্দ্রানী বলল, তার মানে রবি ঠাকুর তার নিজের গল্পের ভেতরে ঢুকে গেছে?
- হুঁ তা বলতে পারিস। অনেকটা মহাভারতের মত, যে লেখক সেই গল্পে চরিত্র হয়ে ঢুকে পড়ছে। তা অমিত একবার একা একা শিলং পাহাড়ে বেড়াতে এলো। একবার পাহাড়ের বাঁকা পথে উপর থেকে নেমে আসা আরেকটা গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে জায়গা পেল না। ব্রেক কষতে গিয়ে ধাক্কা মারলো লাবণ্যর গাড়িতে। লাবণ্য হল নায়িকা। রবি ঠাকুরের কল্পনায় এক আলাদা জগতের মানুষ। এই, তোর মনে আছে, তোর আমার ধাক্কা ধাক্কি হয়েছিল কলেজের করিডরে? তারপর তো আমাদের প্রেম জমে গেল। হা হা করে হেসে উঠল ইন্দ্রানী। ঠিক তাই, অমিত আর লাবণ্যর প্রেম ও হয়ে গেল এই প্রবল ধাক্কায়। তাদের প্রেমের সাক্ষী রইল শিলং পাহাড়, আকাশ বাতাস, বন। আর জানতো লাবণ্যর মাসিমা, যাকে লাবণ্য মায়ের মত ভালোবাসতো। তারা দুজনে প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল। লাবণ্যর কাছে এই প্রেম ঝড়ের মত, সমুদ্রের ঢেউ এর মত। সে নিজেকে আটকাতে পারে নি।
- কেমন মেয়ে এই লাবণ্য? – ইন্দ্রানী জানতে চাইল। স্নিগ্ধ, সুন্দর, শান্ত, পড়ন্ত বিকেলের আলোর মত, একটা বিরাট দিঘীর টলটলে জলের মত। চুপচাপ চেয়ে থাকতে হয়। তার মানে অমিতের উল্টো, তাইতো? হুঁ তাই।
ইন্দ্রানী বলল – এ প্রেম তো টিকবে না। কৃষ্ণেন্দু অবাক হয়ে জানতে চাইলো
– তুই কি করে বুঝলি? এরকম দুটো reverse personality একসঙ্গে থাকতে পারবে না রে। থাকেও নি। শেষ পর্যন্ত কেতকী বলে একটি মেয়ে এসে বলে যে অমিত তার সঙ্গে বিয়ে করবে কথা দিয়েছে।
Just a minute – ইন্দ্রানী বলে ওঠে
– তুই সে জন্যই আমাকে এখানে নিয়ে এলি? এই শিলং পাহাড়ে?
কৃষ্ণেন্দু চুপ করে থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার হঠাৎ মনে হয় তাদের গাড়ি ছুটছে নাকি পাশের গাছ-পাহাড় ছুটছে! তার অনেক কথাই বলার আছে। কিন্তু কি বলবে ইন্দ্রাণীকে? কিরে কৃষ্ণেন্দু চুপ করে গেলি কেন?
কৃষ্ণেন্দু বলল – কোথাও একটা যাওয়ার দরকার ছিল, শুধু তুই আর আমি। কলকাতা-আমাদের চাকরি-আমাদের পরিবার-একঘেয়ে সিনেমা দেখা এই cycle এ শুধু ঘুরেই যাচ্ছিলাম। আমাদের worm relationship এই cycle এ একটা part হয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রানী। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছিস ইন্দ্রানী?
ইন্দ্রানী অন্যমনষ্ক হল। সেও বুঝতে পারছে কৃষ্ণেন্দু এর ব্যক্তিত্ব আর তাকে খুব একটা টানছে না।
কিন্তু কেন? একটা কারণ হতে পারে – সে নতুন দুজনের থেকে WhatsApp message পেয়েছে, তারা তার প্রেমে পাগল। সে কি এই relationship ভেঙে নতুন relation এ যাবে? ঠিক বুঝতে পারে না। আর তাই একটুতে রেগে যায়। মুখ খারাপ করে। WhatsApp message পেয়েছে, তারা তার প্রেমে পাগল। সে কি এই relationship ভেঙে নতুন relation এ যাবে? ঠিক বুঝতে পারে না। আর তাই একটুতে রেগে যায়। মুখ খারাপ করে।
সে বলল – ঠিক
বুঝতে পারছি না কৃষ্ণেন্দু। মাঝে মাঝেই আমি তাই অস্থির হচ্ছি। তবু এক কথায় এখানে আসতে রাজি হলাম। বাড়ির সবাই আমাদের relationship টা মেনে নিয়েছে, in fact তারা বলে আমি খুব whimsical, তুই আমাকে নাকি ঠিকঠাক সামলাতে পারবি। আমার ও তো বুঝতে হবে আমাদের এই relation কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।
কৃষ্ণেন্দুর কথা বলতে গলা কেঁপে যায়, তবু সে জিজ্ঞেস করে – তুই কি সম্পর্কটা শেষ করতে চাইছিস?
কথাটা শেষ প্রশ্নের মত সজোরে ধাক্কা মারে, ইন্দ্রানী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বাইরে তাকিয়ে দেখে গাছের সবুজ পাতাগুলো সব লাল হয়ে যাচ্ছে। সে জানে না কেন, সে জানে না কি করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
ওয়ার্ডস লেক এসে গেছে। ড্রাইভার বলল – একটু ঘুরে ছবি তুলে নিন। এখন আকাশ বেশ পরিষ্কার । এত পরই আমরা শিলং শহরে ঢুকবো। বোটিং ও করতে পারেন, খুব ভালো লাগবে।
ইন্দ্রানী দেখলো লাল রঙ সরে গিয়ে আবার গাছে গাছে সবুজ ফিরে আসছে। লেকের জলের ভেতর নীল রঙ খেলা করছে।
ড্রাইভার বলল – ম্যডাম, ৩১০০ ফুট উঁচুতে এত বড় আর সুন্দর লেক কমই দেখা যায়। আসল নাম উমিয়াম লেক। উমিয়াম নদীর ওপর ড্যাম, তৈরি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। খুব বড় লেক, ২২০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
স্পীডবোটে বসে ইন্দ্রাণীর মাথা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে। জলের নরম হাওয়ায় ইন্দ্রাণীর মনে হল, কতদিন কলকাতার বাইরে যাওয়া হয় নি। কলকাতায় যত মজা থাক না কেন মাঝে মাঝে বেড়িয়ে পড়লে ভালোই লাগে। এখন যেমন লাগছে। কৃষ্ণেন্দুটা জোর না করলে আসাই হতো না। পাশে বসা কৃষ্ণেন্দুকে জড়িয়ে ধরতে গেল। গায়ে জড়ানো লাইফ জ্যাক্যাটে তারা মোটা হয়ে আছে। হেসে বলল – thank you কৃষ্ণেন্দু। স্পীডবোটের ড্রাইভারকে বলল – অর থোড়া জোরসে।
লেক ঘুরে, প্রকৃতির ছবি তুলে, সেলফিতে মজে তারা ফিরে এল।
কৃষ্ণেন্দু বলল, দেখ ইন্দ্রানী এরকম ওয়েদারেই তো অমিত এর গলা দিয়ে তোর রবিঠাকুর John Donne এর Canonization কবিতার প্রথম লাইন লাবণ্যের কানে তর্জমা করে বলেছিল,
For God's sake hold your tongue, and let me love
“দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর্।
ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।"
আমি না হয় একই কবিতার সেই stanza-র’ই শেষ লাইনটা তোকে কানে কানে বলি
Contemplate; what you will, approve,
So you will let me love.
তোর অনুমোদন আর বিবেচনার অবসর
জানি তুই আমায় ভালোবাসবি অতঃপর
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভার বলল – শিলং হল মেঘালয়ের রাজধানী। ছবির মত সুন্দর শহর। দেখলেই ভালো লেগে যাবে। গড় উচ্চতা হল ৪৯০০ ফুট। তবে প্রায় দেড় লাখ মত লোকের বাস জানেন তো । এও সেই ইংরেজদের তৈরি করা। মেঘালয় রাজ্য তৈরি হওয়ার আগে শিলংই তো ছিল অসমের রাজধানী।
ওয়াও মেঘ এসে গেল! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ইন্দ্রানী।
হ্যাঁ ম্যাডাম, এই হল মেঘের আলয়, তাই মেঘালয়। কখন যে মেঘ এসে বৃষ্টি বয়ে আনবে তার ঠিক নেই। জানেন তো এই মেঘালয় রাজ্যে একটা জায়গা আছে তার নাম মৌসিনরাম, শিলং থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে। যেখানে পৃথিবীর সবচাইতে বেশী বৃষ্টিপাত হয়। আপনারা চাইলে একদিন ঘুরিয়ে আনতে পারি।
হোটেলটা বেশ ভালো। আগে থেকে বুক করা ছিল। সব কিছু প্রি-প্ল্যানড্। তবু? কৃষ্ণেন্দুর খটকা লাগল, ইন্দ্রানী এত কি কথা বলছিল হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে? যদিও সন্দেহ করা তার ঠিক আাসে না, তবু, ইন্দ্রাণীর গায়ে পড়া আলাপ ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। ম্যানেজার স্থানীয় ছেলে। বেশ সুপুরুষ দেখতে। রুমের ব্যালকনিতে দুজন বসে চা খাচ্ছিল ইন্দ্রানী, কৃষ্ণেন্দু। সামনে শিলং শহর আর বৃষ্টি।কি রে কৃষ্ণেন্দু এত চুপচাপ হয়ে গেলি কেন? আমার কিন্তু জায়গাটা অসাধারণ লাগছে। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে যে প্রেমের গল্প লিখবে এটা স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ নিজে খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন। কি রে কিছু বল।
কৃষ্ণেন্দু হেসে বলল – তোর জায়গাটা ভালো লাগাছে? বাপস্ যা মুখ গোমড়া করে ছিলি। আজ আর বেরোনো যাবে না। যা বৃষ্টি হচ্ছে। কাল সকাল সকাল ঘুরতে বের হব। শিলং এ কয়েকটা দেখার জায়গা আছে। আমার কিন্তু পুরোনো কথা খুব মনে পড়ছে। তোর আর আমার সেইসব দিন।
দরজায় নক্ করলো কেউ। বৃষ্টি অনেকটাই ধরে এসেছে। ঠান্ডা শিরশিরানি মেঘ মেঘ আবহাওয়া শিলং জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এরকম রোমান্টিক মুড অফ্ করতে কে এল রে বাবা।
কৃষ্ণেন্দু দরজা খুলে দেখলো সুপুরুষ ম্যানেজার সামনে দাঁড়িয়ে। Sorry to disturb you sir, রাতের ডিনারে কি খাবেন যদি বলে দেন।
– বাংলা তো ভালোই বল দেখছি। তুমি কি বাঙালি?
– না স্যার, আমি শিলং এর ছেলে, এত বাঙালি ট্যুরিস্ট আসে বলে বাংলায় কথা বলা শিখে নিয়েছি। আপনারা কোলকাতা থেকে আসছেন?
ইন্দ্রানী উঠে এসে বলল – একদম খাস কোলকাতার লোক….ওদের আলাপ চলতে থাকলো, কৃষ্ণেন্দু এসে চেয়ারে বসে পড়ল। সামনে কুয়াশা বৃষ্টি কমে আসা আলো। তার ভালো লাগছে না…একদম ভালো লাগছে না। এতদূরে ছুটে আসা কি বৃথা হয়ে যাবে? যে ভালোবাসার খোঁজে এতদূর আসা, তা কি সফল হবে না? সে কখনও সেভাবে ভগবানকে ডাকে নি। ভগবানকে ডাকলে কাজ হবে কিনা সে জানে না। তাকে কি পথ দেখাতে পারবেন রবীন্দ্রনাথ? অনেকদিন আগে সে একটা কবিতা লিখেছিল। তার আবৃত্তি করতে ইচ্ছে হল –
রবি ঠাকুর, তোমার কাছে ইচ্ছে করে যেতে
তোমার টোটকায় বুকের ব্যথায় শান্তি খুঁজে পেতে।
চাকরি-বাকরি সবই আছে গার্লফ্রেন্ডরাও ঘোরে
তবু কষ্ট মনের কোণে জাপটে জড়িয়ে ধরে।
কলেজ করিডোরের ধাক্কায় প্রেমের ফাঁদে পড়ি
পড়াশুনায় মন বসে না টো টো করে ঘুরি।
কি পেয়েছি তার হিসাব মিলাতে ভাবি প্রতিদিন
ইন্দ্রানী হৈ হৈ করে ঢুকে এল – চল চল চার্চটা দেখে আসি….. কৃষ্ণেন্দুর মাথায় শেষ লাইনটা এল –
কেমন হবে যদি আমি, হই চরিত্রহীন?
এখন?
হ্যাঁ চল না। সঙ্গে তো গাড়ি আছে না কি?
তুই রেডি হয়ে নে, আমি একটু ওয়াশরুম হয়ে আসছি।
কৃষ্ণেন্দু নেমে এসে দেখলো ইন্দ্রানী ম্যানেজারের সঙ্গে গল্পে মশগুল। কৃষ্ণেন্দু ভ্রু কুঁচকালো। ম্যানেজারের দিকে আর একটু বেশি ঝুঁকে হেসে কথা বলল ইন্দ্রানী।
পরের দিন এলিফ্যান্ট ফলস্। রাজু বলল – ফলস্ টা খুব সুন্দর ম্যাডাম, তবে অনেকটা নিচে নামতে হবে। একটু দেখে যাবেন। ইন্দ্রানী বলল – তুমি চল রাজু।
রাজু বলল – না না আপনারা যান।
কৃষ্ণেন্দুর একেবারেই যাওয়ার ইচ্ছে নেই। গাড়িতে বসেই বলল – যাও, তোমরা ঘুরে এসো।
সিগারেট ধরিয়ে আয়েস করে ধোঁয়া ছাড়লো কৃষ্ণেন্দু।
আজ কৃষ্ণেন্দুর খুব মনে পড়ছে সংযুক্তার কথা। আসলে সে তো ভালোবেসেছিল দুটো সত্ত্বাকেই। কি আর করে কৃষ্ণেন্দু, যে রবিঠাকুর কে সে একদমই পছন্দ করত না আজ তাঁরই ভাষায় তাকে বলতে হচ্ছে, “যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব-কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে, সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।" অর্থাৎ এতদিন সে ডানা মেলে উড়েছে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে, আজ সে ক্লান্ত। আজ সে ঘর বাঁধতে চায়। ডানা সে গুটিয়ে রেখেছে। আজ তার ঘরও হোল আকাশও রইল। আজ সম্পর্কের শেষ কথাটা কবিতা হয়ে বেড়িয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দুর কন্ঠে
তুই আর আমি একসাথে হেঁটেছি অনেকটা সময়
এক-পা দু-পা তিন-পা করে সাত-পা আরও কত
একসাথে সাত পা হাঁটলে, সম্পর্ক নাকি চিরস্থায়ী হয়!
দুজনে একসাথে আমরা কতো পা হাঁটলাম বল্ তো?
হেঁটেছি কতদিন? কতো-মাস? কতকাল? এর মাঝে –
কতবার অবস্থান বদলালো দূর আকাশের নক্ষত্রেরা,
কতো বর্ষা গেলো, কতো শীত জমলো শরীরের ভাঁজে
কতো দাঙ্গায় মারা গেলো, কতো এলো নতুন মানুষেরা।
আজ হাঁটতে গেলে পাশ ফিরে দেখলেই যায় বোঝা
পায়ে-পা, হাতে-হাত থাকবে? না কি হারিয়ে খোঁজা?
রাজু let’s go –
রাজু আর ইন্দ্রানী নীচে নামতে লাগলো। আগে রাজু তার পরে পরে ইন্দ্রানী।
ইন্দ্রানী বলল – হাতটা ধরো রাজু, যা অবস্থা পড়ে না যাই।
খুব ইতস্তত করে রাজুর হাত ধরে ম্যাডামকে নীচে নামতে সাহায্য করছে। তুলোর মতো নরম হাত, মনে হয় পিচ্ছলে না যায়। রাজুর হাত কাঁপে ঘেমে ওঠে। এই সুন্দর ম্যাডামের মত যদি তার এক বউ থাকতো, হাত ধরে নামিয়ে আনতো ঝর্ণা দেখাতে। দামি মোবাইল কিনে সেলফি তুলে ফেসবুকে দেখাতো সবাইকে। নিচে নেমে দেখলো অনেকেই এসে গেছে।
ইন্দ্রানী বলল – অসাধারণ লাগছে তো!! কৃষ্ণেন্দুটা কি যে করে না, ওপরেই থেকে গেল।
আরো অনেক জায়গা দেখে তারা ফিরে এল। আবার সেই হোটেল। ব্যালকনি। পাশাপাশি দুজন।
অনেকক্ষণ দুজনে চুপ থাকার পর ইন্দ্রানী মুখ খুলল – কৃষ্ণেন্দু একটা কথা বলি?
বল।
তুই জেলাস ফিল করছিস না?
কেন?
এই, আমি যে দুজনের সঙ্গে বেশি close হচ্ছি।
সেটা তোর ইচ্ছে। আমি কি বলব। মেয়েরা সব পারে। এই আমার সঙ্গে এই অন্য করোর সঙ্গে।
পাশ থেকে সজোরে ধাক্কা মারে ইন্দ্রানী – mind your language, মেয়েরা মানে সব মেয়েই সমান ? কেন তুই জেলাস ফিল করছিস না? আমিতো ইচ্ছে করে করছিলাম, তোকে দেখানোর জন্য। দেখতে চাইছিলাম আমার প্রতি তোর সেই টানটা আছে কিনা। শোন, তোদের রবি ঠাকুর ও জেলাসি দেখিয়েছেন, তবে খুব stylishly। তুই কি ভাবলি আমার শেষের কবিতা পড়া নেই? পড়ে ফেললাম রবি ঠাকুরের ‘‘শেষের কবিতা”।
কৃষ্ণেন্দু অবাক – কখন?
রাত জেগে। একটা জিনিস খেয়াল করেছিস কৃষ্ণেন্দু? বেড়াতে এসে আমরা physically close হই নি। গালে গাল, ঠোঁটে ঠোঁট, শরীরে শরীর কিচ্ছুটি না, কেন বলতে পারিস? আমরা কি একে অপরকে ঘেন্না করছি কৃষ্ণেন্দু?
তোর গলায় হাহাকার ইন্দ্রানী! আমিও তো খুঁজছি রে।
আবার দুজনে চুপ থাকার অনেকক্ষণ পরে, -
ইন্দ্রানী বলল – কাল আমি চলে যাচ্ছি।
কৃষ্ণেন্দু বলল – আরো কটাদিন আমাদের বুকিং আছে।
তুই থাক, আমি চলে যাব। তোদের রবি ঠাকুরও তো বিচ্ছেদ চাইলেন। বললেন মহান এই সরে যাওয়া । কিন্তু আমি বুঝলাম না লাবণ্য বিয়ে করবে মোহনলালকে আর ভালোবাসে যাবে অমিতকে, অমিত বিয়ে করবে কিটিকে মানে কেতকীকে সারাজীবন লাবণ্য লাবণ্য করে হেদিয়ে মরবে? তুই জিজ্ঞেস করেছিলি না আমি এই relation টা কে টানতে চাই কিনা – না – লাভ নেই। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবলাম, ছেলেদের সঙ্গে বেশি করে মিশে দেখলাম। নতুন ছেলেদের ভালো লাগছে। আমার মন নতুন relation চাইছে। কাল আমি অন্য গাড়ি নিয়ে নেব। রাজুর সঙ্গে তুই চলে যাস।
ইন্দ্রানী প্লীজ যাস না। এত সহজে আমাদের গভীর সম্পর্কটা শেষ করিস না।
সম্পর্কটা আর গভীর নেই কৃষ্ণেন্দু। শুকিয়ে গেছে পুরোনো হয়ে গেছে।
আমি বিশ্বাস করি না।
আমি করি। তুই বলতো কৃষ্ণেন্দু, এই কদিনে আমাকে আদর করতে এসেছিস? জোর করে হলেও তো আসতে পারতিস। কেন এলি না? তোর ভেতরে লাভা ও শেষ হয়ে গেছে। তাই না? বল? তাই তো?
আজ ইন্দ্রাণীর বার বার মনে পড়ছে জয়ন্তর কথা। যে তার চুড়ির ঠনঠন আর নূপুরের নিক্কনের শব্দে আসতে চেয়েছিল যৌবনের প্রথম বেলায়। যার কিনা একজনের কথা বলতে গিয়ে গলা ভার হয়ে এসেছিল। হায় রে ভবিতব্য একদিন চুড়ির হাতের ধাক্কায় যাকে ঘর থেকে পথের মধ্যে ছিটকে পড়তে হয়েছিল, কেন জানিনা মনে হচ্ছে সেই অব্যক্ত কথাটা শোনার জন্যেই সে পথেই চলতে চলতে পা মেলাতে হবে।
কৃষ্ণেন্দু উঠে পায়চারি করে, সে ছটপট করে, হাতে হাত ঘসে – এত সহজে কোনো conclusion এ আসা যায় না ইন্দ্রানী। দুদিন কাছে না এলেই সব কিছু ফুরিয়ে যায় না। সব কিছুতেই ভালো খারাপ সময় থাকবেই, তা বলে… তুই তুই খারাপটাকেই নিয়ে decision নিয়ে নিবি?
শোন কৃষ্ণেন্দু আমি খুব strait forward মেয়ে। তাই মিথ্যে না বলে সোজাসুজি যা বলার বলে দিলাম। আমরা অনেকটা সময় আনন্দে কাটিয়েছি মানছি। এখন, এই equation ভেঙ্গে গিয়ে নতুন equation হোক না। রবি ঠাকুর ও তো সম্পর্ক ভেঙ্গে নতুন ভাবে গড়লেন। কৃষ্ণেন্দু বলল দেখ ইন্দ্রানী তাই বলে এই ছেড়ে-যাওয়াটাই চরম কথা নয়। তোর রবিঠাকুর কি বলবে জানি না তবে আমার ভাষায়.
তোর দীর্ঘ অনুপস্থিতি বেঁচে থাকা শেখাবে আমাকে
তোর চলে যাওয়া চোখে জল নিয়ে হাসি দেবে মুখে
হাত বাড়িয়ে ছুঁতে না পারার বেদনা শীতল করবে আমায়
আমাকে দেখাবে, শেখাবে এভাবেও বেঁচে থাকা যায়।
না পাওয়ার অসহ্য যন্ত্রণায় তোর বুকে কাঁদতে না পেরে
তোর কাছেই শিখেছি কান্না গিলে ফেলতে হয় কি করে
জীবনের প্রতিটি আঘাত আমাকে দৃঢ় করবে সংযমে
আমাকে দেখাবে, বুঝাবে, জীবন কাটবে জীবনের নিয়মে।
শিলং শহরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। ইন্দ্রাণীর ভাড়া গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ছুটতে থাকে। সূর্যের সোনালি আলো গাছেদের ফাঁকে ফাঁকে খেলা করতে থাকে। ইন্দ্রানী জানালা দিয়ে মুখ বের করে নতুন সূর্যের আলোর সঙ্গে খেলা করে। প্রতি পলে আলো আসে আবার ছায়া আসে…ছায়া আসে আবার আলো আসে। পেছনে পড়ে থাকে – শিলং, সম্পর্কের কত ভাঙা টুকরো, পড়ে থাকে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কত হাসি ঠাট্টার কত কোলাজ, সিনেমার ফ্রিজ শটে জমে যাওয়া কত মূহুর্ত। ইন্দ্রাণীর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নামে………… অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের সুরে, লাবণ্যর মত করে ইন্দ্রানীও কৃষ্ণেন্দুর জন্য কবিতা লিখে ফেলল, অনেকটাই রবিঠাকুরকে অনুসরণ করে,…
কখনো কাজের অবকাশে, কখনো পলাশের মাসে
অতীতের স্মৃতিগুলো যদি ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাসে।
সেইখানে খুঁজে দেখিস, নিশ্চয়ই পাবি তুই আমায়
নতুনের ডাকে, ছুটে যাই হেসে, কৃষ্ণেন্দু, বিদায়।
দুঃখ করিস না, ভেসে চল পরিবর্তনের স্রোতে,
বাকী আছে অনেক কাজ, এ মায়া সংসারের ব্রতে।
যা চেয়েছি দু-হাত ভরে ঈশ্বর দিয়েছেন আমায়-
তোর জীবনের ছন্দ ছেড়ে, বহুদূরে, কৃষ্ণেন্দু, বিদায়।
কবিতাঃ দেবাশিস পট্টানায়েক
নিউ দিল্লী
জন্ম ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলার (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর) তমলুক মহকুমায় চাকরি সূত্রে দিল্লী নিবাসী, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত। কবিতা লেখা শখ। কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।
‘প্রতীক্ষা’
শ্রাবণ -
আরো ঢাল, আরো ঢাল,
তপ্ত ধূসর বুকে,
বাড়ুক সবুজের তৃষ্ণা;
ধিকিধিকি তূষের আগুন
জেগে উঠুক দাবানল হয়ে।
মেঘ -
হঠাৎ হঠাৎ, বারবার,
মিলনের খুশিতে গেয়ে উঠো মল্লার;
না ফোটা সব সুর,
ছিঁড়ে যাওয়া সব গানের কলি
খুঁজে পাক ছন্দের বাহার।
পূবালী হাওয়া -
নাচের তালে, যখন খুশি, ছুঁড়ে মারো
বৃষ্টির সাতরঙা আবির;
ভাসুক ছায়া ছায়া বেদনা,
সোনালী স্বপ্নের আভা
পলকহারা চোখের তারায়।
রজনীগন্ধা -
বিনিদ্র রাতের সাথী,
বুলিয়ে দিও শরীর মনে
তোমার মধুর গন্ধসুধা;
নেশার রক্তিম মাদকতা
বাজুক শিরায় শিরায়।
সে আসবে -
হয়তোবা নিশিভোরে,
বাতায়ন খুলে দিয়ে,
আশার প্রদীপ জ্বেলে,
বিরহী একতারা গাইছে
ছলছল কলকল নদীর গান।
‘কানীন’
ঘুটঘুটে অন্ধকার,
কনকনে ঠাণ্ডা পঁচিশে ডিসেম্বরের রাত;
গোয়াল ঘরের উঠোন থেকে
পাগলীর কান্না ভেজা চিৎকার।
কিছুক্ষণ পরে আর একটা কান্না
পাগলীর কান্না ছাপিয়ে,
লালের পতাকা নগ্ন শরীরে এঁকে
মুষ্টিবদ্ধ হাতে দুপায়ের দাবিতে।
সপ্তর্ষীমন্ডলের, কালপুরুষের তারারা কি
নেমে এল পৃথিবীতে
আশীর্বাদের ফুল নিয়ে?
রাতের শুকতারা কি পথ দেখাল?
নিশুতি রাতে ব্যথার শিশির
টুপটাপ -টুপটাপ।
আলুথালু, ছিঁড়ে যাওয়া ময়লা পোষাকে
বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলতে বলতে
পাড়াময় ঘুরে বেড়াত পাগলী।
গত জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা রাতে
খাওয়ারের লোভ দেখিয়ে কে যেন
ডেকে নিয়ে গিয়েছিল দূরে পুকুর পাড়ে।
তাড়ি খেয়ে খিলখিল করে হাসছিল পাগলী-
সারাগায়ে সুড়সুড়ি,
কি যেন খুঁজছিল লোকটা তার শরীরে;
তার পরে শুধু ব্যথা, অবশতা, অলসতা,
গোয়াল ঘরের উঠোনে শুয়ে বসে।
ভাষাহীন চোখের পাতায়
উড়ে উড়ে যাওয়া, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া
কুয়াশা কুয়াশা গন্ধহীন দিনের দল
পদ্মফুল হয়ে ফুটেছে কুমারীর কোলে।
ঘুম ঢুলুঢুলু রাতের ঘোলাটে চোখে
টিম-টিম ধ্রুবতারা জ্বলে।
মোহময়ী কাসল
এ কোন ইন্দ্রজালের মায়ায়
বাঁধা পড়েছে দশপাকে
সবুজের ওড়নায় নীলের উত্তরীয় !
অভিসার রসে আত্মবিহ্বলা কিশোরী
ঘুঙুর পায়ে নেচে নেচে
সপ্তম সুরে গেয়ে বেড়ায় পাহাড়ি রাগ;
শিশির স্নাত হাওয়া প্রেমজ্বরে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তার ঠাণ্ডা সাপিলা শরীর।
মেঘের কালো চুলে মুখ ঢেকে
রূপসী বনিতা চাঁদ
লজ্জার মোহময়ী হাসি হেসে
পাথরের পেয়ালায় রূপালী জ্যোৎস্নার মদ ঢালে।
রূপের নেশায় মাতাল হয়ে
অচেনা বেদনার পিপাসায়
চোখের আগুনে রাতের সায়াকে
ছিঁড়ে ফেলার খেলার মাঝে
শিথিল মনকে ঢাকা দিয়ে যায়
খুব চেনা মিষ্টি গন্ধেভরা
এ কার ভালোবাসার আঁচল!
মনের আকাশে আবছা স্বপ্নে
ভাসে এ কার মুখচ্ছবি!
শ্রুতিনাটক
হরিশ মুখার্জীর জীবন অবলম্বনে শ্রুতি নাটক
যোদ্ধা
দিলীপ মজুমদার
পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা
হরিশ মুখার্জী
[এক সাহেবের ক্রদ্ধ গর্জন। চাবুক মারার শব্দ। একজন মানুষের আর্তনাদ]
জেফারসন। কি দাদন লইবি না? লইতে হইবে। হইবেই। ইমপার্টিনেন্ট বেগার। দেখিতেছিস হাতে কি ! [চাবুকের শব্দ] ইহার নাম শ্যামচাঁদ। [চাবুকের শব্দ। সাহেবের হাসি]
লোক। ধনে-প্রাণে মারা পড়ব সাহেব। দয়া করো সাহেব।আমারে বাঁচাও।
জেফারসন ।হোয়াট? লইবি না? এত বড় স্পর্ধা? তোরে বাঁচাইব? [হাসি] বাঁচাইতেছি। [চাবুক মারার শব্দ। আর্তনাদ]
নায়েব। করেন কি সাহেব! লোকটা যে মরে যাবে!
জেফারসন। চোপ।
নায়েব। না, মানে –
জেফারসন স্টপ ব্লাডি নিগার। [নায়েবকে চাবুক মারে। নায়েবের আর্তনাদ]
জেফারসন। নো টক নো প্রটেস্ট। আমি রাজা, আমিই জমিনদার। আই অ্যাম দ্য ল। বুঝিলি। আমার উপর কথা বলিলেই শ্যামচাঁদ আছড়াইব।
নায়েব। ঠিক কথা সাহেব।
জেফারসন। দ্যাটস রাইট। এই শালা, বল দাদন লইবি কিনা! [চাবুক মারে। আর্তনাদ]
নায়েব [অস্ফুটে]। নাক দিয়ে রক্ত ……. মেরেই ফেলবে বোধহয়।
জেফারসন। এই নায়েব, কি বলিতেছিস!
নায়েব। কিছু বলি নি তো সাহেব।
জেফারসন। লোকটা চুপ মারিয়া গেল কেন? দেখ তো বাঁচিয়া আছে না মরিয়া গিয়াছে।
নায়েব। রক্ত রক্ত…..সাহেব, এ যে একেবারে নিথর।
জেফারসন। হোয়াট ডু ইউ মিন?
নায়েব। মরে গেছে সাহেব।
জেফারসন। মরিয়া গিয়াছে? বেশ হইয়াছে। [হাসি] মরিতে তো হইবেই। ইংল্যান্ডের স্বার্থে, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রেভলিউশনের স্বার্থে মরিতে হইবে।
নায়েব। এখন কি করব সাহেব?
সাহেব। ইহার পূর্বে কি করিয়াছিলে চাঁদ?
নায়েব। কতক গুম ঘরে, কতক নদীর জলে …
জেফারসন। এই তো মনে পড়িয়াছে। হেজিটেশন কেন? আপন হাতে যখন জগাছার বংশীকে কাটিয়াছিলে, মোল্লাহাটির মণ্ডলকে মারিয়াছিলে তখন কোথায় ছিল হেজিটেশন? যাও ডেড বডি নদীতে ফেলিয়া দাও।
[মৃতদেহ টানতে টানতে নায়েব চলে গেল]
জেফারসন। মরিতে তো হইবেই। নো কম্প্যাশন। দয়া দিয়া বাণিজ্য চলে না। নেভার। দয়া দেখাইতে গেলে লিভারপুলে তালা পড়িবে। ইণ্ডিগো চাই। নীল বুনিতে হইবে। ধানের জমির মায়া ত্যাগ করিতে হইবে। মরিয়া গিয়াছে? হা হা হা। ভাবনা নাই। আমদিগের মিশনরিরা উহাদের আত্মার জন্য প্রেয়ার করিবে। উহাদের মুক্তি হইবে।
দৃশ্যান্তর
[সেকালের কলকাতার পথ দিয়ে হাঁটছে রমাকান্ত ও হারাধন]
রমাকান্ত। নীল বানরে সোনার বাংলা করল এবার ছারখার। জ্বাইলে পুইড়ে সব ছারখার করল।
হারাধন। ও ভাই রমাকান্ত আর কদ্দূর?
রমাকান্ত। বেশি দূর নয়। পা চাইলে চল।
হারাধন। যা বলবার তুমিই সব বলবে, বুঝলে?
রমাকান্ত। বলব।
হারাধন। ওদিককার খপর তো সব জানেন মুখজ্জেবাবু।
রমাকান্ত। সব জানে রে হারাধন। এ সব খপর তাঁর কাগজ পেট্রিয়টে ছাপা হয়।
হারাধন। কি নাম বললে?
রমাকান্ত। ইনজিরি কাগজ। হিন্দু পেট্রিয়ট। সে কাগজের নেখা পড়ে সাহেবরাও ভয়ে কাঁপে। দ্যাশের চাষিরা আপনজন বলে জানে মুখুজ্জেবাবুকে। চাষিদের জন্যে কি পরিশ্রম করেন তিনি। ওই যে হুলুদবাড়ি। [দরজা ঠেলার শব্দ]
হরিশ। আরে রমাকান্ত যে! সঙ্গে কারে এনেছ?
রমাকান্ত। এর নাম হারাধন। নীল বানরের থাবড়া খেয়ে এয়েচে আপনার কাছে। দাদনের চুক্তিভঙ্গ। আপিলের একটা দরখাস্ত লিখি দিতে হবে এ রে।
[ভেতর থেকে হরিশের মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে: হরিশ, ও হরিশ, তোর যে আপিসে যাবার সময় হল। সকাল থেকে কিছু মুখে দেবার সময় পেলি নি]
রমাকান্ত। আপনার আপিসের সময় হল। অন্য দিন আসব না হয়।
হরিশ [হেসে]। মায়ের কথা শুনে ভয় পেলে বুঝি! চলে যাবে! এতদূর এসে চলে যাবে? না না তা হয় না। বেরিয়েচ কখন?
রমাকান্ত। সেই ভোর রাতে।
হরিশ। তা হলে তো এখকনও পেটে কিছু পড়ে নি। আমার সঙ্গে দুটি ডাল-ভাত খেয়ে নেবে। বোস। আমি আসচি।
দৃশ্যান্তর
মা। কি, দুজন লোক খাবে?
হরিশ। হ্যাঁ মা। বহুদূর থেকে আসচে।
মা। তা তো বুঝলাম। আগে বলতে হয়। কি যে কাণ্ড করিস! এ রকম ঘরের খেয়ে বনের মোষ কদ্দিন তাড়াবি? তোমার বাড়ি বুঝি মোচ্ছব বাড়ি?
হরিশ। ওদের অবস্থা যদি বুঝতে মা। নীলকর সাহেবরা কি অত্যাচার করে ওদের উপর।
দৃশ্যান্তর
[কোলাহল। নীলকরদের আস্ফালন। চাষিদের আর্তনাদ। জেফারসনের কণ্ঠ]
জেফারসন। গ্রাম জ্বালাইয়া দাও। বিদ্রোহীদের ধরিয়া আনো। নীল বুনিবে না? বলিলেই হইল! নীল না বুনিলে মরিতে হইবে। দেখিব বিশে ডাকাত কয়টা আছে। ফেডির অপমানের প্রতিশোধ লইব।
[কোলাহল। আর্তনাদ]
জেফারসন। প্রতিশোধ লইব। দেখিব শিবনাথের দলের কত দম। ব্লাডি নিগার। নীলকর সাহেবকে মারিতে চায়! সকলের বিষদাঁত ভাঙিয়া দিব। গ্রাম জ্বালাইয়া দাও। পুড়িয়া মরিতে মরিতে দর্প চূর্ণ হইয়া যাইবে। কালি শুকাইয়া যাইবে হরিশ মুখার্জীর। তালা পড়িবে হিন্দু পেট্রিয়টের আপিসে। ব্লাডি ইণ্ডিয়ান এডিটর।
দৃশ্যান্তর
হকার। হিন্দু পেট্রিয়ট। হিন্দু পেট্রিয়ট। নীল বিদ্রোহের টাটকা খবর। হরিশ মুখার্জীর আগুন ঝরানো কলমের লেখা।
লোক। দেখি ভাই একটা কাগজ।
হকার। এই নিন। হিন্দু পেট্রিয়ট। হিন্দু পেট্রিয়ট।
লোক। আমাকে একখানা দাও।
লোক। আমাকে একটা।
হকার। এই নিন। কিনুন। কিনুন। টাটকা খবর। হরিশের কলমের আগুন। এই নিন।
দৃশ্যান্তর
[ছাপাখানা। মেশিনের শব্দ। দুজন কর্মচারী কথা বলছেন]
রমেশ। ও তারিণী, যে ম্যাটার ছিল তার কাজ শেষ। ম্যাটার চাই। হরিশবাবুকে বল।
তারিণী। এখনও লেখা শেষ হয় নি। হলেই আসবেন। আজ এক নতুন নীলকর সাহেবকে নিয়ে লিখচেন।
রমেশ। সত্যি ভাই, এরা দ্যাশটাকে ছারখার করে দিল। তারিণী তুই নীলের গান শুনিচিস?
তারিণী। শুনিচি বইকি। [বেসুরো গলায় গান গায়]
না বুনলে নীল মেরে কিল
‘কিল’ করে নীলকরে
দেশের ছোট কর্তা দিলেন তাদের
হর্তাকর্তা করে
[পেটা ঘড়িতে রাত নটা বাজে]
রমেশ। বেজায় রাত হল রে। হরিশবাবু এখনও নিখে চলেচেন। পারেনও বটে।
তারিণী। সে কথা বলতে! সকালে নীলচাযিদের সঙ্গে কথা, তাদের দরখাস্ত নেখা, সারা দুপুর আপিস , সেখান থেকে ফিরে এই প্রেস, নেখা, প্রুফ দেখা।
রমেশ। হ্যাঁ রে তারিণী, হরিশবাবু কলকেতার মানুষ, মানে এখানকার আদি বাসিন্দা?
তারিণী। না গো দাদা, বাবুর দ্যাশ বর্ধমানের শ্রীধরপুরে। ছমাস বয়েসে তেনার বাবা গত হলে তেনার মা দুই ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন এই ভবানীপুরে বাপের বাড়িতে।
রমেশ। তারপর?
তারিণী। বাবুরা বড্ড ধকল সয়েচেন গো। মামার বাড়িতে লাথি-ঝ্যাঁটা খেতে হয়েচে। ইস্কুলের পাঠ চুকেচে।
রমেশ। হরিশবাবু ইস্কুলে পড়েন নি? যাঃ, বাজে কথা বলচিস।
তারিণী। বাজে কথা নয় গো রমেশদা।
রমেশ। ইস্কুলে না পড়লে অমন ইনজিরি শিখলেন কি করে?
তারিণী। সব নিজে নিজে শিখেচেন। নিজের চেষ্টায়। খাবার পয়সা জোটে না, ইস্কুলে পড়া, মাস্টার রাখার প্যসা পাবেন কোথা থেকে?
[দরজার কড়া নড়ার শব্দ। ডাক – ও হরিশ, হরিশ]
রমেশ। গিরিশবাবু এয়েচেন। যা দরজাটা খুলে দিয়ে আয়। হরিশবাবুকে খবরটাও দিবি।
হরিশ। এসো গিরিশ। রাজশাহী কেমন ঘুরলে?
গিরিশ। সব আগুন হয়ে আছে হরিশ। একটা স্ফুলিঙ্গ দাবানল তৈরি করে দেবে। শিশির ঘোষ কোথায়?
হরিশ। এসেচে কলকাতায়। সেও একই কথা বললে।
গিরিশ। মনোমোহন ঘোষ আর দীনবন্ধু মিত্র?
হরিশ। ওরা কেউ আসে নি। তবে ওদের রিপোর্ট আমার হাতে এসেচে।
গিরিশ। আর তোমার সেই ভুঁড়িওয়ালা দারোগা?
হরিশ। গিরিশ বোস?
গিরিশ। হ্যাঁ।
হরিশ। পরশু এসেছিল। নদিয়ার খবর দিয়ে গেল।
গিরিশ। তাহলে তো খবরে খবরে তোমার কাগজের পেট মোটা হচ্চে।
হরিশ। ধীরে বন্ধু ধীরে। ওই নীলকরদের আসল চেহেরা আমি তুলে ধরব। দীনবন্ধুও তৈরি হচ্চে।
গিরিশ। কি রকম?
হরিশ। নীল চাষ, নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে সে একটা দারুণ নাটক লিখচে।
গিরিশ। বাঃ চমৎকার।
[পেটা ঘড়িতে দশটা বাজল]
গিরিশ। তাহলে ওঠা যাক। আরে তুমি কোথাও যাবে না কি?
হরিশ। হ্যাঁ, একটু কাজ আছে।
দৃশ্যান্তর
[ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সভা শেষ হয়েছে। সবাই বেরিয়ে যাচ্ছেন। দুই ব্যক্তির কথোপকথন]
আশুতোষ। কেমন লাগল তোমার কৃষ্ণকিশোর?
কৃষ্ণকিশোর। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাশোসিয়েশনের সভার কথা বলচ?
আশু। বলচি হরিশ মুখুজ্জের বক্তৃতার কথা। হি ইজ অ্যা গ্রেট অরেটর।
কৃষ্ণ। ঠিক
আশু। কি চমৎকার যুক্তিজাল।
কৃষ্ণ। রাইট।
আশু। এখনও কানে ভাসচে তাঁর কথা [হরিশের কণ্ঠস্বর: বন্ধুগণ! সিপাহী বিদ্রোহে আমাদের ভূমিকা ছিল দর্শকের। আমরা বুঝতে পারি নি সে বিদ্রোহের চরিত্র। আজ নীল আন্দোলন আমাদের সামনে এক নতুন সুযোগ এনে দিয়েচে। নীল চাষ শুধু কৃষক নয়, জমিদারকেও আঘাত করচে। কৃষকরা আত্মরক্ষার তাগিদে প্রতিরোধের পথ নিয়েচে। কোথাও কোথাও জমিদাররাও তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্চে। ব্রিটিশ অ্যাশোসিয়েশনকেও এদের পাশে দাঁড়াতে হবে]।
কৃষ্ণ। জমিদার হিসেবে আমাদেরও চাষির পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু আমরা কতদূর যেতে পারি?
আশু। তার মানে?
কৃষ্ণ। প্রতিবাদ এক কথা, কিন্তু প্রতিরোধ? তার অর্থ ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে লড়াই। হরিশের ইঙ্গিতটাসে দিকেই। নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ব্রিটিশরাজকে চটিয়ে লাভ কি?
আশু। ভাবার মতো কথা।
কৃষ্ণ। ব্রিটিশের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তারা শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করেচে, শিক্ষা বিস্তার করেচে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আমাদের মতো নতুন জমিদারের উদ্ভব হয়েচে।
আশু। ঠিক বলেচ। আসলে কি জানো, হরিশের তো কোন ল্যান্ডেড ইন্টারেস্ট নেই আমাদের মতো। কথায় বলে না, ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়।
কৃষ্ণ। নীল আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। হরিশ তার নিজের রিস্কে যা খুশি করুক।
দৃশ্যান্তর
[নীলচাযিদের কোলাহল]
জনৈক চাযি। ভাই সব, জান কবুল, চাযের জমিতে নীল আমরা বুনব না।
সকলে। কিছুতেই বুনব না।
এক চাযি। ভাই সব, পাষণ্ড নীলকরদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হও সবাই।
দৃশ্যান্তর
[চিঠি ও রিপোর্ট পড়তে পড়তে হরিশ আপন মনে বলছেন: জেগে উঠেচে নীলচাষির গলা। প্রতিবাদ পরিণত হয়েচে ক্রোধে। তাই আগুন জ্বলতে শুরু করেচে। সোনার বাংলাকে যারা ছারখার করচে, তাদের যেতেই হবে। …………… এই সময় বাইর থেকে রাধিকার গলা শোনা যায়: হরিশ, হরিশ]
হরিশ। আরে রাধিকা যে! তোমাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্চে!
রাধিকা। শুনলে তুমিও স্থির থাকতে পারবে না।
হরিশ। খুলে বলো।
রাধিকা। কৃষ্ণনগরের কাচিহাটা নীলকুঠির ভারপ্রাপ্ত সাহেব আর্চিবল্ড হিলসের বর্বরতা। সে হরমণি নামে এক কুলবধূর উপর পাশবিক অত্যাচার করেচে।
হরিশ। তারপর?
রাধিকা। পরিণামে মৃত্যুবরণ করেচে হরমণি।
হরিশ। এই হল সভ্য ইউরোপের আচরণ। এই তার স্বরূপ। অথচ জাতিগর্বে আচ্ছন্ন ইংরেজ বলে নেটিভরা অসভ্য, বর্বর। সময় ঘনিয়ে এসেচে রাধিকা। আগুন জ্বলবে এবার। এই দেখো, নদিয়া থেকে কি লিখেচে দীনবন্ধু মিত্র। … প্রজারা ছটি কোম্পানিতে নিজেদের বিভক্ত করে লড়াইএর প্রস্তুতি নিয়েচে। তির-ধনুক, পিতলের থালা,,কাঁচা বেল এসবই তাদের অস্ত্র। স্ত্রীলোকরাও প্রস্তুত মাটির বাসন নিয়ে।
রাধিকা। বিদ্রোহ, চারিদিকে বিদ্রোহ আজ।
হরিশ। এই দেখো যশোর থেকে শিশির লিখেচে চৌগাছার বিশ্বাসরা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্চে। বরিশাল থেকে আনিয়েচে লাঠিয়াল। এই দেখো মুর্শিদাবাদ থেকে মনোমোহন জানিয়েচে নীলকররা গ্রাম আক্রমণ করলে দুন্দুভিধ্বনির সাহায্যে এক গ্রামের রায়ত অন্য গ্রামের রায়তদের সাংকেতিকভাবে খবর দিচ্চে। কয়েক মুহূর্তে জমা হচ্চে হাজার মানুষ। নীলকরদের ভাড়াটে সৈন্য পেরে উঠচে না তাদের সঙ্গে।
রাধিকা। পাবনার খবর আমি জানি। দ্বিতীয় বেঙ্গল পুলিশ ব্যাটেলিয়নের হাবিলদার সেভো খাঁ এসেচিল বিদ্রোহ দমন করতে। সশস্ত্র কৃষকদের দেখে তারা পালিয়ে যায়।
হরিশ। রাধিকা, অগ্নিগর্ভ হয়ে আচে দেশ। কৃষকের আত্মদান বৃথা যাবে না। তুমি এখন যাও রাধিকা। আমি লিখব এখন। লিখব সভ্য ইংরেজের অসভ্যতার কথা। লিখব দরিদ্র ভারতবাসীর আত্মরক্ষার অধিকারের কথা।
দৃশ্যান্তর
[কাগজ বিক্রি করছে হকার]
হকার। হিন্দু পেট্রিয়ট…. হিন্দু পেট্রিয়ট…. পড়ুন আর্চিবল্ড হিলসের কীর্তি … হতভাগিনী হরমণির করুণ কাহিনি … হরিশ মুখুজ্জের হিন্দু পেট্রিয়ট……….
দৃশ্যান্তর
নায়েব। এই দেখুন সাহেব, কি লিখেচে হিন্দু পেট্রিয়ট। সেই যে আপনি …. হরমণি ….
হিলস। দেখি, দেখি।
[কাগজ ওল্টানোর শব্দ]
নায়েব। হরিশ মুখুজ্জে ভেতরের সব কথা ফাঁস করে দিয়েচে সাহেব।
হিলস। হরিশের বড় বাড় বাড়িয়াছে। রাস্তায় একা পাইলে উহাকে চাবকাইব। ব্লাডি ইন্ডিয়ান। ভুলিয়া গিয়াছে যে আমরা কিং আর উহারা সারভেন্ট। ইয়েস, উহাকে শায়েস্তা করিতে হইবে।
[জেফারসনের প্রবেশ]
জেফারসন। কাহাকে শায়েস্তা করিবে হিলস?
হিলস। হ্যালো জেফারসন। হরিশ মুখুজ্জের কথা বলিতেছি।
জেফারসন। উহাকে আর কি করিয়া শায়েস্তা করিবে? আমাদের স্বজাতি হইয়া জেমস লঙ কি করিতেছে? সে হরিশের পক্ষ লইয়াছে তাহা কি জানো?
হিলস। হ্যাঁ, শুনিয়াছে।
জেফারসন। আর সিটনকার?
হিলস। দে আর ট্রেটরস। বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু ব্রিটিশ ক্রাউন আমাদের কথা শুনিবে।
জেফারসন। নো নো। লেফটন্যান্ট গবর্নর গ্রান্টের কথা শুনিয়াছ কি?
হিলস। কিছু কিছু শুনিয়াছে। বেঙ্গল হরকরায় একটা ছড়া বাহির হইয়াছিল। হা হা হা।
জেফারসন। হাসিতেছ? গ্রান্ট কিন্তু ইন্ডিগো প্লান্টারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা লইতেছে। ট্রান্সফার অব দ্য ক্রউনের পর ব্রিটিশ সরকারও আমাদের পক্ষে নাই।
হিলস। বল কি? কারণ?
জেফারসন। সিপাহী বিদ্রোহের শিক্ষা আর নীল চাযিদের আন্দোলন।
হিলস। ইন্ডিগো প্লান্টিং করিতে দিবে না?
জেফারসন। নো। করিতে দিবে না। অ্যাট দ্য কস্ট অব আদার ইন্টারেস্ট। গ্রান্ট কি ঘোষণা করিয়াছে শুনিয়াছ? নীলচাষির উপর ফোর্স প্রয়োগ করা চলিবে না।
হিলস। হোয়াট?
জেফারসন। ইয়েস মিস্টার হিলস। ইন্ডিগো কমিশন ফর্মড হইয়াছে। সিটনকার উহার প্রেসিডেন্ট।
হিলস। মেম্বারস?
জেফারসন। মিঃ রিচার্ড টেম্পল। রেভারেন্ড জে সেল, মিঃ ফার্গুসন, চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী।
হিলস। তুমি বড় খারাপ খবর শুনাইলে।
জেফারসন। আমাদের দিন বোধহয় শেষ হইল।
দৃশ্যান্তর
[ইন্ডিগো কমিশনের অধিবেশন]
ঘোষক। মিঃ সিটনকার ইন্ডিগো কমিশনে এবার কার জবানবন্দি, কাকে ডাকবো?
সিটনকার। হরিশ মুখার্জীকে কল করো।
ঘোষক। হরিশ মুখার্জী হাজির।
[হরিশ ঘরে ঢুকলেন]
সিটনকার। আপনি হরিশ মুখার্জী?
হরিশ। হ্যাঁ আমি হরিশ মুখার্জী।
সিটনকার। আপনি কি কর্ম করেন?
হরিশ। মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে কাজ করি।
সিটনকার। আপনি কি হিন্দু পেট্রিয়ট কাগজের সম্পাদক?
হরিশ। দা্য়ী সম্পাদক নই, তবে ওই পত্রিকার সত্ত্বাধিকারীর উপর আমার প্রভাব আছে।
সিটনকার। আপনি কি বিশেষ উৎসাহসহকারে নীল আন্দোলনের বিষয় পর্যালোচনা করেন নাই?
হরিশ। হ্যাঁ, করেচি।
সিটনকার। প্রজারা কি আপনার পরামর্শ চায় নাই?
হরিশ। হ্যাঁ, পরামর্শ চাইতো।
সিটনকার। কোন কোন বিষয়ে তাদের পরামর্শ দিতেন?
হরিশ। দাদন-চুক্তি, আইন এইসব বিষয়ে।
সিটনকার। কি রকম পরামর্শ দিতেন?
হরিশ। জেলার প্রধান কর্মচারীর নিকট দরখাস্ত করার, আইন মাফিক পথে অগ্রসর হওয়ার, প্রয়োজনে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা করার পরামর্শ দিতাম।
সিটনকার। মফঃস্বল হইতে কি চিঠি-পত্র আসিত?
হরিশ। হ্যাঁ আসিত।
সিটনকার। আপনি কি যশোর, কৃষ্ণনগর, মুর্শিদাবাদ এই সব জায়গায় গিয়াছিলেন?
হরিশ। আমি বারাসত ও হুগলি ব্যতীত অন্য কোথাও যাই নাই। তবে অন্যান্য জেলার বহু লোকের সহিত আমার পরিচয় ছিল। তাঁরা আমার কাছে আসতেন।
সিটনকার। সংবাদ সংগ্রহের জন্য ওই সব জেলায় আপনি কি লোক প্রেরণ করিয়াছিলেন?
হরিশ। হ্যাঁ।
সিটনকার। মিঃ ফার্গুসন এবার আপনি প্রশ্ন করিতে পারেন।
ফার্গুসন। আপনি কি কলিকাতা হইতে আইন ব্যবসায়ী এজেন্ট পাঠাইতেন?
হরিশ। প্রজারাই তাঁদের নিয়ে যেতেন।
ফার্গুসন। আপনার জ্ঞানানুসারে কলিকাতা হইতে কতজন মোক্তার যায়?
হরিশ। তিনজন।
ফার্গুসন। আপনি কি নীল বিষয়ের সার্কুলার প্রজাদের মধ্যে বিতরণ করিয়াছিলেন?
হরিশ। সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
ফার্গুসন। নীলকরদের অত্যাচার বিষয়ে আপনি কি পরামর্শ দিতেন?
হরিশ। হ্যাঁ, দিতাম।
ফার্গুসন। কি রকম অত্যাচার হইত?
হরিশ। সম্পত্তি লুঠ, গুমঘরে আটক, স্ত্রীলোকের লাঞ্ছনা, খুন ইত্যাদি।
ফার্গুসন। নীলচাষ বিষয়ে আপনার মত কি?
হরিশ। নীলচাষ প্রজাদের পক্ষে হিতকর নয়। আমার এই মত কাগজে স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করি।
সিটনকার। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।
দৃশ্যান্তর
[হিলসের মদ্যপান। আপন মনে বলেন: নীলকরদের পাততাড়ি গুটাইতে হইবে। কিন্তু তৎপূর্বে হরিশ মুখার্জীকে শিক্ষা দিতে হইবে। আমার প্রেস্টিজ সে ধুলায় লুটাইয়াছে। আমিও তাহাকে ধুলায় লুটাইয়া দিব। তাহার নামে মানহানির মামলা ঠুকিয়া দিব। খেসারত দশ হাজার রূপিয়া। হাঃ হাঃ হাঃ]
দৃশ্যান্তর
[হরিশের বাড়ি। হরিশ অসুস্থ। কাশছেন। রাধিকার প্রবেশ]
রাধিকা। হরিশ কেমন আচে বউঠান?
হরিশের স্ত্রী। ভালো নয়। তাঁকে এমন কখনও দেখি নি। মুখে কতাটি নেই। কি যেন ভাবেন সর্বদা।
রাধিকা। ভাবনার তো কতাই। হিলস যে মামলা করেচে। মামলা চালানোর অনেক খরচ।
হরিশের স্ত্রী। কি যে হবে ভগবান জানেন।
রাধিকা। যাই তার সঙ্গে একবার দেকা করে আসি। [হরিশ ও হরিশ]
রাধিকা। কেমন বোধ করচ এখন?
হরিশ। শরীরে যুত পাচ্চি না রাধিকা। তার উপর চিন্তা রাধিকা। হিলস থাবা মেরেচে। হয়তো বন্ধ করে দিতে হবে হিন্দু পেটিয়ট।
রাধিকা। মামলা চালাবে কি করে?
হরিশ। তাই তো ভাবচি।
রাধিকা। একটা আপোষের সূত্র-----
হরিশ। কি বললে? আপোষ, বর্বর হিলসের সঙ্গে আপোষ? না, রাধিকা কোন আপোষ নয়।
[হরিশের স্ত্রীর প্রবেশ। দুধ খেয়ে নেবার অনুরোধ]
রাধিকা। হরিশ, বউঠানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেচ কি?
হরিশ। দেখেচি, দেখেচি। তোমরা কি ভাবো আমার বুকটা পাথর দিয়ে তৈরি? সংসারকে কিছু দিতে পারি নি। তার জন্য কষ্ট পাই, বড় কষ্ট পাই রাধিকা। কিন্তু তাই বলে অন্যায়ের সঙ্গে রফা করতে পারবো না। আমার বিত্ত নেই, বংশগরিমা নেই, মুরুব্বি নেই; আছে শুধু সততা, সাহস আর প্রত্যয়। সেটুকু কেড়ে নিও না রাধিকা। [প্রবল কাশি] আমাকে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষের কথা বলো না রাধিকা। আমি যোদ্ধা। অন্যায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। এবার মৃত্যুর সঙ্গেও যুদ্ধ করবো। [কাশি]
ব্রিটেনে রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্স
ম্যানেজার বিশ্বনাথের
আব্দুল লতিফ ফরহাদ
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
আব্দুল লতিফ
প্রবন্ধ
আসা-যাওয়ার খেলাঘর এ পৃথিবী। মানুষ আসছে।আবার একটি নির্ধারিত সময় শেষে চলে যাচ্ছে অনন্ত জীবনে। যেখান থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা মোটেই নেই। হাজার হাজার সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে ঘোষিত স্রষ্টা কর্তৃক। প্রত্যেক মানুষই প্রতিভা নিয়ে জন্মায়।কিন্তু সবার প্রতিভা প্রস্ফুটিত হয় না নানাবিধ কারণে। আবার কেহ কেহ একটু পরিচর্যার মাধ্যমে বা সহজিয়াভাবে প্রাপ্ত হন সফল মানুষের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। একটি চারা রোপণ করেই যেমন সুন্দর, সুষ্ঠু, সফল, পরিপুষ্ট ফলন, ফল প্রাপ্তি আশা করা হাস্যস্পদ। চারা রোপণের পর অনেক কাঠখড়, পরিশ্রম, পরিচর্যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি গাছকে ফুল, ফল প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে নিতে হয়। সঠিক সময়ে সঠিক ও সুন্দর ফল প্রাপ্তি আশাব্যঞ্জক। মানুষের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ধীরে ধীরে, ক্রমান্বয়ে সিঁড়ি বেয়ে জীবন গড়ে তুলতে হয়, একজন সফল ও সার্থক মানুষ রূপে গড়ে উঠেন। আমাদের আজকের নিবন্ধ যাকে নিয়ে লিখার আশা ভরসা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। তিনি এভাবেই হয়েছেন, গড়ে উঠেছেন সফলতার শীর্ষে।
সফলতার গল্প আনন্দের, খুশির বন্যার। বাঙ্গালীরা আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গৌরবের সহিত বসবাস করছেন। এগিয়ে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার, অনুসরণের মডেল রূপে। কৃতিত্ব ও সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন সুনামের সহিত। মূলত: বাঙ্গালী হলে ও বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে উচ্চাসনে আরোহণের মাধ্যমে। কর্ম দক্ষতায় অর্জন করছেন সুখ্যাতি। কাজ বা কর্ম দক্ষতাই মানুষকে সফল মানুষ রূপে সুখ্যাত করে তোলে। এহেন সুখ্যাতিতে জন্মস্থান কিংবা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাঙ্গালী কমিউনিটির মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে একের পর এক। প্রবাসী বা রেমিটেন্স যোদ্ধারা স্বদেশে যোগান দিচ্ছেন সিংহভাগ অর্থনৈতিক যোগান। অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি পেয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাদের অবদানের বিনির্মিত ফসলে। হচ্ছি আমরা গর্বিত ও আনন্দিত।
বলছিলাম সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জয়নগর (নোয়াপাড়া) গ্রামের পিতা মরহুম আব্দুল মছব্বির (বশীর মিয়া) ও মাতা জাহানারা বেগমের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান আব্দুল লতিফ ফরহাদের কথা। তরুণের তারুণ্যে ভরপুর ফরহাদ বর্তমানে ব্রিটেনে করছেন অবস্থান। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সহিত। কুড়াচ্ছেন সুনাম ও সুখ্যাতি। ব্রিটেনের মত দেশে রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিষয়ক দায়িত্ব পালন কতটুকু যোগ্যতা, মেধা ও মননের মাধ্যমে পালন করতে হয় তা একটু সুক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করলেই সহজে অনুমেয় হবার কথা যে কারো। ফরহাদ রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন গত ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে। এর পূর্বে তিনি ব্রিটেনের পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সহকারি প্রকল্প পরিচালক পদে ২০২০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে যোগদান করে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।তাই বর্তমান সময়ে বাঙ্গালী কমিউনিটিতে ফরহাদ একজন সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়েছেন।
ব্রিটেনে কর্মরত ফাইন্যান্স ম্যানেজার আব্দুল লতিফ ফরহাদ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৮৯ সালে সবুজে ঘেরা নিভৃত পল্লী বিশ্বনাথের খাজাঞ্চি ইউনিয়নের জয়নগর (নোয়াপাড়া) গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ফরহাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ফরহাদসহ ৬ ভাই ও ৪ বোনের এক গর্বিত পরিবার। ভাইদের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং দুই ভাই রয়েছেন বাংলাদেশে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফরহাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১৯৯৫ সালে জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৯৯ সালে কৃতিত্ব পূর্ণ ফলাফলের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে তিনি সিলেটের শাহজালাল জামেয়া পাঠানটুলা মাদ্রাসা থেকে ২০০৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সমাপ্ত করেন। তাঁর বর্ণিল শিক্ষা জীবনের পরবর্তী ধাপ মানে গ্রাজুয়েশন সমাপন করেন রাজধানী ঢাকার স্টাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে। সে সময় পাডি জমান ব্রিটেনে। সেখানে গিয়ে তিনি আবারো ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বি.এস.সি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ২০১৬ সালে। অত:পর আব্দুল লতিফ ফরহাদ বিপিপি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার্টার্ড একাউন্টিং বিষয়ে পড়ালেখা করছেন। এ ধাপে দু’টি বিষয়ে পরীক্ষার বাকি রয়েছে। তবে এ বছরই তা সমাপ্ত হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদী। সফলতার সহিত তিনি উত্তীর্ণ হলে ব্রিটেনের বাঙ্গালী কমিউনিটিতে একজন গর্বিত বাঙ্গালী চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট হিসেবে সুখ্যাতির অধিকারী হবেন। আমাদের দোয়া র’ল স্নেহাস্পদ আব্দুল লতিফ ফরহাদের তরে তিনি প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করে আমাদের মুখ করবেন প্রজ্বলিত, আমরা হব আনন্দে উদ্বেলিত ও গর্বিত।আব্দুল লতিফ ফরহাদের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী আসকর ও ব্রিটেনে রয়েছেন চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট হিসেবে কর্মব্যস্ত। জনাব আলী আসকর আব্দুল লতিফ ফরহাদের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা যিনি চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট। তিনি ২০০৮ সালে লন্ডন থেকে বিজনেস ফাইন্যান্সে (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন।তারপর ২০১৪ সালে ব্রিটেনের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট ডিগ্রি কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের মাধ্যমে অর্জন করেন।প্রথমে সিনিয়র ফাইনান্স ম্যানেজার, ডিপার্টমেন্ট ফর ডিজিটাল কালচার এন্ড স্পোর্টস (২০১৭-২০১৮)। কমনওয়েলথ গেমস বার্মিংহাম ২০২২ সালের ১১,৫০০ কোটি টাকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি চার্টার এ্যাকাউন্ট্যান্ট চলাকালীন সময়ে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন ২০১৫ সালে। অত:পর তিনি সরকারি খাতে চলে আসেন এবং যুক্তরাজ্যের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন।যুক্তরাজ্যের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন সময়ে ৮০০০ কোটি টাকার বাজেট অত্যন্ত দক্ষতার সহিত পরিচালনা করেন। ২০১৮ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস ছেড়ে বেসরকারি খাতে সিনিয়র ফাইন্যান্স বিজনেস পার্টনার হিসেবে যোগদান করে দায়িত্ব পালন করছেন।অপর দিকে উভয় ভ্রাতার আপন চাচা ছিলেন বাংলাদেশে সিনিয়র রেঞ্জার।অন্য দিকে বলতে গেলে সোজা কথায় বা ভাষায় খাজাঞ্চি ইউনিয়নের একই গ্রামের একই পরিবারের দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন হচ্ছেন চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট ও আরেকজন চ্যাটার্ড একাউন্ট্যান্ট হিসেবে সফলতার দ্বারপ্রান্তে করছেন অবস্থান।সেক্ষেত্রে আব্দুল লতিফ ফরহাদ উত্তীর্ণ হলেই আমরা পেয়ে যাব একটি প্রস্ফুটিত পুষ্পকানন জয়নগর গ্রামের মধ্যে এবং বিলেতের মাটিতেও। এ দু’ভাই-ই হবেন আত্মজাগরণের পথিকৃৎ প্রতিভাত বিচ্ছুরণ। তাঁদের প্রতিভা, আদর্শ ও সফলতা আমাদের পরিচয়ের স্বভাব ও স্বরূপ হিসেবে হবে পরিগণিত।
সবচেয়ে আশার সঞ্চার করে যখন মোহাম্মদ আলী আসকর মাঝে মাঝে আমাকে ফোনে আলাপের মাধ্যমে জানান দেন কাঙ্ক্ষিত, ঈপ্সিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যক্ততা। শিক্ষা বিস্তারে কি ভাবে অবদান, উচ্চশিক্ষার হার বর্ধিতকরণে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দৃঢ়তর আশাবাদ। আমি আলী আসকরের মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। গরিব, অসহায়দের শিক্ষাক্ষেত্রে যে সকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূরীকরণে সচেষ্টতার পুরো লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে।এমন কি আলী আসকর সে বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আংশিক কাজ শুরু করেছেন। পরিসর বর্তমানে ক্ষুদ্র হলেও যাচাই বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত ফলাফল দেখে পরবর্তীতে বৃহদাকারে পদক্ষেপ গ্রহণের পথে চলেছেন মনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণের নিমিত্তে। আলী আসকরের সহিত রয়েছেন তাদের পরিবারের সকল সদস্যদের মতামত সম্পৃক্ততা। আলী আসকরের গৃহীত পদক্ষেপ, স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীসহ এলাকার মানুষের সহযোগিতা খুবই গুরুত্ববাহী। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের নজরদারী, সচেষ্টতা, সক্রিয় অংশ গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। বর্তমান সময়ে গ্রামে অবস্থানরত তরুণদের উৎসাহ, উদ্দীপনা আশাব্যঞ্জক সাড়া জাগায়, আশান্বিত করে।আশা ও স্বপ্ন নিয়ে মানুষের জীবন ও অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালিত হয়, হচ্ছে। এ পরিবারের চিন্তা ভাবনাকে মহান আল্লাহ যেন বাস্তবায়ন,সফলতায় সহায় হোন এ আর্তি আমার হৃদয়জ।
কবিতাঃ সিদ্ধার্থ ঘোষ
জয় পরাজয়ের চিঠি
প্রিয় বন্ধু রণজয়,
সেদিন দুম করে বলে গেলি চলে
"মাথাটা পুরো গেছে"
সেকি আর আজ গেছেরে-
বরাবরের যাওয়া মাথা আমার।
মাথার ঠিক থাকলে-
কেও কি গরিব বাড়ি জন্ম নেয়?
অঙ্কে আমিও খারাপ ছিলাম না
কিন্তু বাঁধ সাধলো সেই মাথা।
মাথার ঠিক থাকলে-কেও?
কেও কি অঙ্ক ছেড়ে বাংলা পড়ে?
কোনো সুস্থ মানুষকে দেখেছিস -
ক্যরিয়ার, চাকরির, ভাত ভুলে- বিয়ে করতে?
আমি করেছি; তারপর অনেকগুলো প্রেমও করেছি।
কিছু নির্বোধ শিক্ষার জন্যে অবশ্য শরীর ছুঁতে পারিনি।
প্রিয় মিথ্যে বলতে আজও পারিনা;
(অ)বন্ধু তাই পোষ মানে না।
প্রিয় বন্ধু রণজয়,
'রণপরাজয়'রা যে জিততে পারে না, পারেনা গাইতে
এমনটা কিন্তু নয়; আসলে ভয় পায় জয়ে।
আসলে বেশ কিছু মানুষ বোধহয় বাঁচে
যাদের 'রণ' শব্দটাতেই আপত্তি আছে।
বোকা সংসার নিজেই পাগল হয়ে পাক খেতে খেতে
ভুলে যায়; যে রণ বোঝেনা তার কিবা যায় আসে
জয় পরাজয়ে।
পরাজয় দেয়-
গ্লানি, বুক ভরা অভিমান, অপমানের জ্বালা,
সঙ্গে আগামীর হিসাবি নিজস্ব উৎকর্ষতা।
এখানে নেই জয়ের অহংকার।
আছে শুধু উন্নতির প্রচেষ্টা চিৎকার।
দেখ আমি আবার বলছি মাথাটা এদের সবার গেছে
কি বোকা, জয় ছেড়ে কেও পরাজয়ে মাতে...
তবে এটাও মানি, এটাও বুঝি -
নদীর জলের মত, জয় পরাজয় কেওই নয় দীর্ঘজীবি।
সময়ের তালে, কালের আগুনে
রণজয়, রণপরাজয় এক চিতাতে জ্বলে।
সে দ্যাখে আর মুচকি মুচকি হাসে!
ইতি- রণপরাজিতা।
রাত জাগা
গোটা ঘরটা অন্ধকারের ঘোরে,
মিটমিট করে জ্বলছে নিঃসঙ্গ চোখ।
বহুকাল হলো, চোখের পাতা মুক্তি দিয়েছে ঘুমকে
শুয়ে ও বসে; রাতের পর রাত পার।
রাস্তার সব জ্বলন্ত ল্যাম্পপোস্টের মাঝে দাঁড়িয়ে
একলা একটা আলো ভয়ের অপেক্ষায় ধপধপ করছে।
একলা একটা সিঁড়ি পাক খেতে খেতে,
বিড়বিড় করতে করতে
নেমে গেল মাটির নিচে।
মাঝে মাঝে আকাশ থেকে ঝরে পরে
সংসারী চিৎকার শীৎকার।
ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে মরে
ঘর না পাওয়া বিড়াল কুকুর।
একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো
দশতল্লার লক্ষীকে নামিয়ে, গাড়িটা হাওয়া হয়ে গেল...
পেঁচাটা হাওয়ার পিছু নিল।
গোটারাত ভরে যায় ধোঁয়াতে।
ক্লান্তির হাঁফানি
মৃত্যুর মাঝে প্রাণপনে জীবনকে খুঁজছে।
জীবনের পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা; পারছে না
আধপোড়া সিগারেট, আধপড়া বই পথে বাধা।
নিঃসঙ্গ একলা রাত একটা শরীর,
নারীর শরীরের মতই কাব্যিক।
ভোর হতেই, নিঃসঙ্গতাকে জড়িয়ে ধরে
একঘেয়েমি একটা রাত ঘুমিয়ে পড়ে।
সাদা বাড়ি
প্রান্তিক স্টেশন ঢুকতেই ধবধবে যে সাদা বাড়িটা
সেই বাড়ির ছাদ থেকে উড়ে গেল সাদা পায়রা।
সাদা বাড়ির পায়রা যে সাদা হবে, সে তো খুব স্বাভাবিক!
সেই বাড়ির বৌ যে ফর্সাই হবে এমন না -
তবে সম্ভাবনা তো প্রবল!
এই সুন্দর সাদা বাড়ির মালিক যে পয়সাওয়ালা
তা একদম নিশ্চিত।
কিন্তু বাড়ির টাকার রং নিয়ে বিভ্রান্ত অনেকেই!
উড়ন্ত সাদা পায়রার ভিড় থেকে দৌড়ে এলো
এক কৃষ্ণ কালো শিশু -
সে টেনে দিলো কালো মেঘ গোটা বাড়ির উপর!
কৃষ্ণ-গহ্বর
জটিল থেকে জটিলতর, তর থেকে তম জীবন
অসহ্য থেকে অসহ্যতর, তর থেকে তম জীবন
জমে জমে জমাটি এঁটেল কৃষ্ণ-গহ্বর চুক্তি
গহ্বর অস্তিত্ব অধরা, বুকে সুপ্তপূর্ণ নিনাদ!
ভরা সংসারে ছুটতে থাকে পাগল খোকা
আয়ন প্লাজমা দোলে, নিশ্চুপ আলোকছটা।
মনের ভিতর টানটান রহস্য মোড়া
আড়িবৃক্ষও টের পায়না সেই দামামা।
এগিয়ে আসে সে, কামুক সঙ্গম সন্ধানী
আজন্ম অপেক্ষা অন্ধকার অশান্ত মুখগহ্বর
ছলকে ওঠে রক্তপ্রাণ, কেঁদে ওঠে অমেঘ অস্তিত্ব
আরেক অন্ধকারিনী, জ্বলন্ত সঙ্গম-পিপাসী মৃত্যু!
কবিতাঃ ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
বন্যা
গত বছরের ভয়াল বন্যাগ্রাসে,
মরে হেজে গেছে ধান গাছ, কাশবন
জল নেমে গেছে, পড়ে আছে মরা পাতা,
আর পড়ে আছে শূন্য অগ্রহায়ণ।
তুলাইপঞ্জির অনেক স্বপ্ন নিয়ে,
এককালে বীজতলা ছিল ভরা।
একরাত্রের বাঁধভাঙ্গা জলরাশি,
ফেলে গেছে শুধু প্রাণহীন বালুচরা।
ছিল আলপথ, শ্রান্ত দিনের চালা
দুদিন পরেই ধানকাটা হত শুরু
নীল আকাশের লুকোচুরি ছিল দিনে
আর রাতে ছিল সাদা মেঘ উড়ু উড়ু।
এক বিকেলের মেঘভাঙ্গা বারিধারা
বাঁধ ভেঙ্গে দিল, চারিদিকে কাড়াকাড়ি;
মুক্ত সলিল উল্লাসে ছুটে চলে,
ক্ষীণস্রোতা নদী হয়ে ওঠে ফণাধারী।
মাঝরাতে দূরে অলীক শব্দ ওঠে
পাড় ভাঙছে নাকি বুনো বরাহের দলে?
কিন্তু হঠাৎ আঁধার ঘরের মেঝে
ভরে ওঠে কুচকুচে কালো জলে।
সন্ধ্যাবেলায় কাজ সেরে ঘরে ফেরা,
তুলসীমঞ্চে দীপশিখা থরথরো।
রাতের আঁধারে নদী এল দ্বারে দ্বারে,
দীপ নেভা রাতে ঘরদোর পড়োপড়ো।
কথা ছিল কাল হাটে নিয়ে যাবে বাবা,
ঘরে ঢাকা ছিল পান্তা ভাতের সরা;
ধানক্ষেত জুড়ে থৈথৈ নোনাজলে
ভেসে চলে যায় বইখাতা, হাড়িকড়া।
দেউলের পাশে কাজলা জলের পুকুর,
অনেক টাকার মাছ ছিল জলে ছাড়া।
বন্যার জল উপচিয়ে ওঠে মাঠে,
এক হয়ে যায় ডোবা -দীঘি-জলধারা।
সাশ্রুনয়নে চেয়ে দেখে গ্রামবাসী,
ভেসে চলে যায় রুই কাতলার ঝাঁক—
একগলা জলে ধান গম আলু মুলো
কানে ভেসে আসে জলভাসি পশুডাক।
এই বছরের মনসা পুজোর সময়
হয়েছিল কী অন্যায় দোষত্রুটি?
কেন ভেসে গেল আটচালা বাড়িকোঠা?
ভেঙ্গে গেল ঝড়ে শালকাঠ বাঁশ খুঁটি?
পরদিন ভোরে ভিড় করে আসে মেলা,
নিরন্ন মুখে মাইক্রোফোনের বুম
ঘোলা জলে ভাসে বাস্তুসাপের দেহ
বন্যার জলে চিরঘুমে শীতঘুম।
গরু বাছুরের সাথেই একঘরে বাস
অসহায় ক্ষুধা সাইক্লোন শেল্টারে।
জল চারিদিকে, তবু বুক ফাটে তৃষা
মানুষ ও পাখি চালের বস্তা কাড়ে।
এইখানে ছিল ছককাটা খেলাঘর,
দোপাটি বীজের কচিপাতা ফুটেছিল,
দিগন্তময় জলরাশি ঢাকা মাটি
শত বছরের হাসি কথা মুছে দিল।
কবিতাঃ জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ সরকার
কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
প্রেমিক হতে পারি নি
বড়জোর তোকে নিয়ে কয়েকটা কবিতা লিখতে পারি।
তা সে আবোল তাবোল হলেও।
চেষ্টা করলে এখান ওখান থেকে শব্দ কুড়িয়ে একটা গল্পও।
তোকে নিয়ে অলীক হলেও আমি স্বপ্ন দেখতে পারি,
ঘড়ির কাঁটার তোয়াক্কা না করে।
সে স্বপ্নে তোকে না জানিয়ে ফুলদানি সাজিয়ে রাখি গোলাপে,
তোকে চমক দেওয়ার ছলে।
তোর যদি ঘুম পায় খুব, তোর মাথার নিচে,
পেতে দিতে পারি আমার কোল, আমার কাঁধ,
চুলে আলতো বিলি কেটে দিতে দিতে জেগে
থাকতে পারি সারারাত।
হটাত ভয় পেলে ঘুমের ঘোরে,
বাড়িয়ে দিতে পারি আমার হাত,
তোর ভয় কেটে যায় এক পরম ভরসার হাসিতে।
বিশেষ কোনো ঋতু ছাড়াই মন হারাই, আলিঙ্গনে।
মনে মনে কষ্ট পেতে পারি, তোর অনুপস্থিতিতে।
পথ চেয়ে রই দীর্ঘ প্রতীক্ষায়।
নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারি -
অতীতের আঙিনায়, পুরানো কিছু হাসির সাথে,
যত পুরানো হয়, তত বেশি ভালোবেসে ফেলতে পারি।
কিন্তু, এ জন্মে আমি প্রেমিক হতে পারি নি।
কারণ, প্রেমিক হওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই আমার নেই।
আমি চিনি তোমার মন
দেখো তো চিনতে পারো কিনা!!
অবশ্য চিনতে না পারাটাই স্বাভাবিক।
২০ কিংবা ৩০ বছর হবে বোধহয় সেই দেখা।
চোখে মুখে এখন বয়সের ভাঁজ, মাথাতেও।
তাই হিসাব একটু এদিক ওদিক হয়ে যায়।
ওতে কিছু মনে করো না যেন।
সাদা চুল, অর্ধেকের বেশি ফাঁকা।
দৃষ্টিও কমেছে অনেকটা।
তোমারও শরীরে লেগেছে বয়সের ছোঁয়া।
কিন্তু মনের বয়স বাড়ে নি একটুও।
আমি চিনি তোমার মন,
তুমি দেখেছিলে শুধুই আমার অবয়ব।
কবিতাঃ অনিন্দিতা ব্যানার্জী
আর আমি...
অসংখ্য প্রশ্ন মাঝে আরেকটি প্রশ্ন চিহ্ন...
সে আমি।
অসংখ্য সংশয় মাঝে.. গভীর যে সংশয়, সে আমি।
সমস্ত সংকট মাঝে অনন্ত সংকট যা,
সে আমি..
রামধনু রং এর সম্ভাবনাময় বুদ্বুদ রংহীন হয়ে ফেটে পড়বে,
কিংবা পড়বে না.. ওরা ভালো নেই।
আর আমি?
কথা ছিল, ঘন বরষার রহস্যময়তা রেশ রাখবে দিনলিপিতে.. হল না।
সততা শেখা হল না।
অসদাচার নাকি তোমার ঠিকানা..
এ তোমার ভালো থাকা?
আলো ছায়া নষ্টামী..
আর আমি?
ভ্রমণ
ঘেন্ট শহরে
কয়েকদিন
দেবযানী পাল
এককালের বয়নশিল্পের জমজমাট ধর্মীয় শহর ঘেন্ট দেখার সাধ ছিল অনেকদিনের। চারদিনের মধ্যে শহর দেখার পরিকল্পনা করে প্রথমদিনে শহরের মধ্যাঞ্চল দ্য কাউপে(De Kuip) এলাম।এই ঐতিহাসিক ধর্মকেন্দ্রে যানবাহন চলাচল নিষেধ। এখানেই ঘেন্টের রক্ষাকর্তা সেন্ট বাভোর ক্যথিড্রাল, দশম থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে গোথিক শৈলীতে তৈরী। এখানে ট্রিপটিকে রয়েছে শিল্পীদ্বয়, ইয়ান ভন এইক (Jan Van Eyck (১৩৮৫-১৪৪১), আর তার ভাই, হুবের্ট ভন এইকের (Hubert Van Eyck) ১৪৩২ এ অঙ্কিত ফ্লান্দের্স চিত্রকলার অপূর্ব নিদর্শন, দ্য এডোরেশন অফ দ্য মিষ্টিক ল্যাম্ব (The Adoration of the Mystic Lsmb)।
এরপর রাজকীয় নাট্যশালা পেরিয়ে ৯৫ মিটার উঁচু ৫৪ টি ঘডিতে সজ্জিত ঘন্টাঘর দেখে, ধনী বনিক সংঘের একজোট হবার জন্য স্থাপিত সেন্ট নিকোলাস গির্জা দেখলাম।কাছাকাছি বিখ্যাত সেন্ট মাইকেল গির্জা। অনতিদূরে মধ্যযুগের বাজার আর বন্দর অন্চল। মোটামুটি এই অঞ্চল থেকে একাদশ শতক খেকেই নানান সামগ্রী ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলিতে রপ্তানী হত। এদিকে জলের দুধারে ধাপে, ধাপে অপূর্ব প্রবেশপথযুক্ত বাড়িগুলো, শস্য রাখার আর ওজন করার আলাদা, আলাদা
বাড়িগুলো দেখলে মনে হয় যেন বূপকথার দেশে এসেছি। মধ্যযুগের আগে থেকেই ইউরোপের ফ্লান্দের্স শহরগুলিতে, বিশেষ করে আটরেক্ট দোরনিক, লীল, ঘেন্ট ইত্যাদি অঞ্চলে উচ্চমানের উল মিশ্রিত বিশেষ সুতোর কাপড় দিয়ে ধনী আর অভিজাতদের জন্য বিভিন্ন রংএর নানা শৈলীর, রকমারী জামাকাপড় ও রকমারী জিনিষ তৈরী হত। নানা জটিল উপায়ে তৈরীর পর বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষ প্রতীক চিহ্ন ছবি দিয়ে উৎপাদিত বয়ন শিল্পদ্রব্য বাজারে ছাড়া হত। কিন্তু তার আগে বস্ত্ররক্ষণের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত বাঁডিতে এনে ওজন ইত্যাদি করা হত। লীল, ঘেন্ট, বেলজিযামের নানা অন্চল ছাড়া হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলও বয়নশিল্পের ব্যবসায়ে বিখ্যাত হয়য়।
এরপর ডিজাইন ও ফাইন আর্টস মিউজিয়াম দেখে দিন শেষে পবিত্র মাসেসের( Masses) রচয়িত। বিখ্যাত সুরকার ইয়াকব ওবরেকত (Jacob Obercht ১৪৫৭-১৫০৫), আর কবি, নাট্যকার আর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মরিস মাতেরলিঁকের (Maurice Materlinck, ১৮৬২-১৯৪৯) অবদানের কথা স্মরণ করে ফ্লান্দের্সের রত্ন ঘেন্ট ছেড়ে ঘরমুখে পাড়ি দিলাম।
গল্প
চোখ/
চিন্ময়ী
দেবযানী দত্তপ্রামানিক
চোখ
সুন্দরী আফরীন, ডানা কাটা পরী যেন। আর নিখিল একটি সাধারণ ছেলে, পেশায় চার্টার্ড একাউন্টেন্ট।
পর্ব ১ -
একদিন নিখিল অফিসে যাচ্ছিল। ট্র্যাফিক জ্যামে ওর গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দেখলো ,পাশের একটি বাসে এক জোড়া অপূর্ব চোখ। ওর চোখ দেখতে গিয়ে নিখিল ভুলেই গেলো ও কোথায়। হঠাৎ করে সিগন্যাল সবুজ হলে পেছনের গাড়ীগুলো হর্ন বাজাতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি সম্বিৎ ফিরে গাড়ী স্টার্ট করে অফিসের দিকে রওনা দিল ও। ওই অপূর্ব চোখ দেখতে গিয়ে বাসের নম্বরটাও খেয়াল করেনি নিখিল। এবার ওই চোখ পাবে কোথায়।
পর্ব ২ -
সেদিনটা প্রচন্ড অস্থির-অস্থির লাগছিলো ওর। এমনিতে বাড়ীতে সবাই ওর বিয়ের কথা বলছিল কিন্তু ও বোনের বিয়ে আগে হোক বলে কোনোভাবে কাটাচ্ছিল। সেই নিয়ে ওর বন নীতু ওকে প্রচন্ড খেপাতো। বাড়িতে ভাই-বোনের খুনসুটি লেগেই থাকতো। সেদিন কিন্তু বাড়ী ফিরে ও বোনকে সবটা বললো। আশ্চর্যভাবে নীতুও বুঝলো যে এবার দাদা সত্যিই ওই পাগল করা, অপূর্ব চোখের প্রেমে পড়েছে।
পর্ব ৩ -
নীতু ও নিখিল থেকে ওই চোখের পুরো বর্ণনা শুনে নেয়। কিন্তু প্রধান সমস্যা ওই চোখ খুঁজবে কিভাবে। পরদিন আবার একই সময়ে বেরোয় নিখিল, কিন্তু কোথাও সেই চোখ দেখতে পায় না। এভাবে পরপর রোজ ওই চোখের খোঁজে পাগলের মতো করে। গাড়ি ছেড়ে বাসে করে কয়েকদিন যাতায়াত করে। ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে নিখিল। নীতুও কলেজ যাবার সময় চারদিকে খেয়াল করে।
পর্ব ৪ -
বাড়িতে কিছু না বললেও, সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। এদিকে নীতুও বাসে সবার মাঝে অপূর্ব কোনো চোখ খোঁজে। এর মধ্যে একদিন কলেজে যেতে গিয়ে এরকম অপূর্ব দুটি চোখ একটি বোরখার মধ্য দিয়ে দেখতে পায়। তাড়াতাড়ি বাসের নাম্বার লিখে নেয়। পরদিন ভাই-বোন দুজনে মিলে ওই রুটের বাস গুমটিতে যায়। বোরখা ও অপূর্ব দুটি চোখের কথা বলাতে একবারেই চিনতে পারেন গুমটির ভদ্রলোক। বলেন একটু অপেক্ষা করতে, কেননা মেয়েটির আসার সময় হয়েছে।
পর্ব ৫ -
একটু পরেই আসে সে মেয়েটি। হালকা নীল রঙের বোরখা, কিন্তু হাতে একটি লাঠি। মেয়েটি অন্ধ! চমকে ওঠে নিখিল। পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকে দু ভাই-বোন। আস্তে করে এগোয় নিখিল। কাছে যেতেই টের পায়ে মেয়েটি।
"কে আপনি? কিছু বলবেন? মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করে সে।
"আমরা দু ভাই-বোন, নিখিল ও নীতু। আপনার চোখ দুটি খুব সুন্দর, ভীষণ ভালো লেগেছে। আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করবেন? নিখিল বলে।
পর্ব ৬ -
খিলখিল করে ঝর্ণার মতো হাসে মেয়েটি।
"আমার চোখ? আমি তো অন্ধ। তবে বন্ধুত্ব? নিশ্চয়ই। আমি আফরীন।" বলে হাত জোর করে নমস্কার করে ও।
"আজ তো হবে না, আমি রাসবিহারী যাচ্ছি, ওখানে একটা ব্লাইন্ড স্কুলে পার্টটাইম পড়াই আমি। আজ আসি। কখনো নিশ্চয়ই আপনাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে।" বলে বাসের দিকে এগোয় ও। "দাদার গাড়ী আছে তো", বলে নিতু।
"না, এক্ষুনি নয়, কোনোদিন পরে, বাই" বলে বাসে উঠে পড়ে আফরীন।
"যত ঝামেলাই হোক না কেন, বিয়ে আমি একেই করবো।" বলে ওঠে নিখিল। ওর হাত ধরে বলে নীতু
"দাদা, আমি তোর সাথে আছি"।
পর্ব ৭ -
তিন বছর পর, আজ নিখিল আর আফরিনের মেয়ে হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ চোখ তার। বাবা-মা কেও নিয়ে এসেছে নীতু। সব মান অভিমানের পালা শেষ আজ। ছোট্ট মেয়ে সবার কোলে কোলে ঘুরছে। আফরীন ও হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। এবার শঙ্কর নেত্রালয়ে নিয়ে যেতে হবে কিছুদিন পর আফরীনকে। এবার ওর চোখ দিয়ে মেয়েকে দেখবে সে।
চিন্ময়ী
রাগিণী দেবীর বিয়ের সময় যৌতুকের সাথে একটি হারমোনিয়াম, ও একটি তানপুরা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু যৌথ পরিবারের বৌমার গান বাজনার প্রতি ভালোবাসাকে কেউ ভালো চোখে দেখেনি। উল্টে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে। ওনাকে যখন এ বাড়ি থেকে দেখতে যায়, একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন উনি। সবাই ওনার গানের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন রাগিণী দেবী, এরকম এক সঙ্গীত প্রেমী বাড়িতে বৌ হয়ে যাচ্ছেন ভেবে। উনি যে ভীষণ ভীষণ গান ভালোবাসেন। ওনার স্বামী খুব শান্ত মানুষ, মুখে কিছু বলেননি, কিন্তু ওনার চোখে ওর গানের প্রতি মুগ্ধতা দেখেছিলেন উনি। কিন্তু বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে বুঝলেন, বৌমার গান বাজনার শখকে সবাই ছোট করে দেখছে। শ্বশুরমশাই নাকি একদম বাড়িতে গান সহ্য করতে পারেন না। স্বামীকে অনুরোধ করতে উনি বললেন যে বাড়ির কেউ বৌমার গান - বাজনার শখকে ভালো চোখ দেখছেন না, আর উনি কোনো অশান্তি চান না, তাই কিছু বলতে পারবেন না। উনি এও বলেছিলেন রাগিণী দেবী চাইলে যেন রাতে, একান্তে শুধু ওনাকে কানে-কানে গান শোনান, আর কেউ যেন শুনতে না পারে। সেই রাত থেকেই, রাগে, দুঃখে গান ছেড়েছিলেন উনি। তবে হারমোনিয়াম আর তানপুরাকে ঘরে, ঠাকুরের পাশে রেখে পুজো করতেন উনি।
ওনার শাশুড়ি মা একবার ঠাট্টা করতে উনি বলেছিলেন,
- "বাগদেবীর পুজো করি মা, দয়া করে ঠাট্টা করবেন না, বাড়িতে ছেলেমেয়েরা আছে, ওদের বিদ্যার জন্যেও তো মা সরস্বতীর আশীর্বাদের প্রয়োজন।"
শাশুড়ি মা আর কিছু বলেননি। কিন্তু আর একটি দিনের জন্যেও গান করতে পারেননি রাগিণী দেবী। মুখ বুঝে, হাসি মুখে সংসারের সব কাজ করে গেছেন উনি। কিন্তু ওনার অন্তরের একটি ভাগ যেন হারিয়ে গেল ওনার গানের সাথে। কিছদিনের মধ্যে ওনার একটি মেয়ে হলো, নাম রাখলেন ইমন। বাড়ির কেউ অবশ্য সেই নামে ডাকতেন না, ইমু ডাকতেন। রাগিণী দেবী নিজেও বাধ্য হয়ে ইমু নামেই ডাকতে লাগলেন। কালের নিয়মে শ্বশুরমশাই মারা গেলেন। এদিকে ছোট্ট ইমনের গলার মিষ্টি গান শুনে স্কুলে ওকে গানের ক্লাসে নেয়া হলো। রাগিণী দেবীকে টিচাররা অনুরোধ করলেন ওকে তালিম দিয়ে গান শেখাতে। রাগিণী দেবী বাড়ির পরিস্থিতির কথা বলে নিজের অপারগতা জানালেন। বাড়িতে ছোট্ট ইমু কোনো গান করতে পারতো না, কিন্তু স্কুলের সব ফাংশান এ ওর গাওয়া চাই ই। নাতনির গানের গলা যে খুব সুন্দর, সেটা বুঝতে পারতেন শাশুড়ি মা, ওর আনা প্রাইজগুলোও দেখতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। অবাক লাগতো রাগিণী দেবীর, এতো রাগ কেন গানের প্রতি।
দেখতে দেখতে ওদের বাড়ি খালি হয়ে গেলো, বাড়ির সব ছেলে মেয়েরা বাইরে পড়তে, অথবা চাকরি নিয়ে অথবা বিয়ে করে চলে গেলো। সব চেয়ে ছোট ইমু ক্লাস টেন এ। ভাসুর আর জা দিল্লিতে ছেলের কাছে চলে গেলেন। দুই ননদের ছেলে মেয়েরাও দূরে দূরে চলে গেলো। ইমুদের স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আগের সরস্বতী পুজোর প্রোগ্রামে রাগিণী দেবী শাশুড়ি মা কেও যেতে অনুরোধ করলেন। ইমু ও খুব জোর করে ঠাকুমাকে সাথে নিয়ে গেলো। অনুষ্ঠানের শেষে ইমুকে ডেকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হলো। পড়াশোনা ও গানের জন্য। ওকে স্কুলের শেষ প্রোগ্রামে গান গাইতে অনুরোধ করলেন স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যার। কিন্তু ইমু গাইতে চাইলো না, বললো ওর এই বিশেষ দিনে ওর ঠাম্মি এসেছেন সাথে, আর উনি একদম গান ভালোবাসেন না। খুব অবাক হলেন স্যার। ওর ঠাম্মিকে ডাকলেন ইমনের হাতে বিশেষ পুরস্কারটি তুলে দিতে আর গান না ভালো লাগার কারণ জানতে চাইলেন। কেঁদে ফেললেন ঠাম্মি, বললেন
- 'তিনি রাগিণী দেবী ও ইমুর অপরাধী। ওনাদের বংশের কোনো এক কন্যা বাড়ি ছেড়ে বেনারস চলে গেছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতে, আর ফেরেননি তিনি। সংসার, ধর্ম, সব ত্যাগ করে ওখানেই থেকে যান উনি সংগীতের সাধনায় মগ্ন হয়ে। প্রচুর বদনাম হয় আত্মীয় স্বজনের মধ্যে, সবাই ত্যাগ করে ওনাকে। সেই থেকে এ বাড়িতে সঙ্গীত নিষিদ্ধ।" বললেন,
- শ্বশুরমশাই এর ও গানের চমৎকার গলা ছিল, কিন্তু পিসির ওই কর্মর জন্য ত্যাগ করেছিলেন নিজের সঙ্গীত প্রীতিকে, এবং নিষিদ্ধ করেছিলে সবার মধ্যে।"
তবে অনেক প্রায়শ্চিত্ত, অনেক বহু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, এবার থেকে রাগিণী দেবী আর ইমনকে আটকাবেন না কথা দিলেন। ওনার কথা শুনে সবার চোখে জল এসে গেল। রাগিণী দেবী আর ইমু জড়িয়ে ধরলেন ওনাকে। রাগিণী দেবীর স্বামী ও খুব খুশি হলেন। এবার থেকে বাড়ি মুখরিত হবে মা- মেয়ের গানের আওয়াজে। মৃন্ময়ী মা সরস্বতীর বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফিরলেন শাশুড়ি মা, দুজন চিন্ময়ী সরস্বতী মাকে নিয়ে।
আড্ডা
সুর্য্ মন্ডল
গল্প
আজকের আড্ডাটা মনে হচ্ছে খুবই জমজমাট। হাসি, ঠাট্টা, আর চা বিস্কুটের সাথে সব বন্ধু গুলো বিকালবেলায় শ্মশানের ধারে বসেছে আমাদের আড্ডা প্রায় বসে এমন সময় এই ধরো চারটের দিকে। আমি, তুতু, বারুণ, সাগর, অরূপ আর সৌমেন ছ-জনের নিয়ে বসে এই আড্ডাটা।আজকে ও বসেছে। আমরা ছ জন বসে আছি শ্মশানের ধারে ভেরীর উপর ওটা পুরো শ্মশানের ধারে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ জমে উঠছে আমাদের আড্ডাটা। অন্য দিন এই আড্ডাটা একটু তাড়াতাড়ি বসে কিন্তু আজ একটু দেরি হয়ে গেলো আড্ডাটা বসতে। সাগর কলেজ থেকে আসতে একটু দেরি করে ফেলেছে তাই। যাই হোক, কথা হাসি ঠাট্টায় অনেকটা সময় কেটে গেলো। বাড়ি যাওয়ার জন্য সকলে উঠে গেছি। এমন সময় শ্মশানের পাশ দিয়ে বলা যাই শ্মশানের পিছন দিক দিয়ে যেদিকে ফিশারি সেই দিক দিয়ে একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথমে বোঝা গেলো না যে ওটা কোনো লোক কিনা। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেলো যে ওটা একটা লোক।প্রথমে সবাই একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই দেখে সৌমেন বললো দাঁড়া দেখছি ওটা কে? সৌমেন আর সাগর আড্ডার জায়গা থেকে উঠে একটু এগিয়ে গেলো। আর আমরা নিজেদের জায়গায় চুপচাপ বসে রইলাম। একটি ভয় ভয় লাগছিলো কারণ আমাদের এলাকাটা শ্মশানের ধারে আর সন্ধ্যা ও হয়ে এসেছে তার মধ্যে যদি কেউ অমন ভাবে একটা কালো চাদর মুরি দিয়ে হেলতে দুলতে আসে তো ভয় লাগাটাই তো স্বাভাবিক। লোকটার কাছে সাগর আর সৌমেন যাওয়ার আগেই লোকটা আমাদের কাছে চলে এলো। লোক তাকে দেখে মনে হলো বয়স
পঞ্চাশের উপর। লোকটার কথাবার্তাগুলো যেন কেমন লাগছে অদ্ভুত অদ্ভুত মতো। কিছুক্ষণ আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে তার বুক পকেট থেকে একটা সিগারের আর দেশলাই বার করে সিগারেটটা ধরালো। লোকটা কিছুক্ষণ সিগারেটটা টানার পর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
- 'আমরা ও ছোটবেলায় তোমাদের মতো এরকম অনেক আড্ডা দিয়েছি বুঝলে তো প্রায় সময় স্কুল যাওয়ার নাম করে এই শ্মশানের ধারে বসতাম। আমরা ছিলাম তিন জন দুই জন তো আকাশে আর আমি এখনো মাটিতে' বলার পর আবার খিল খিল করে হেসে উঠলো।
লোকটার কথায় একটু হলেও রস কস বলে যে কিছু একটা আছে তা ওনার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। অনেক দেরি হয়ে গেলো বরুণ বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠছে অমনি লোকটা বলে উঠলো,
- 'কোথায় যাচ্ছ বসো বসো'।
বারুণ উঠে আবার বসে পড়লো। ধুরতেরি আর ভালো লাগে না বলে যেই উঠতে যাবো অমনি তুতু হাত ধরে বললো - 'কোথায় যাচ্ছিস এখন চুপ করে বস।'
কিছু করার নেই বসতেই হলো। ছ-জনের জায়গায় আজ সাত জনের আড্ডাটা আজ জমে উঠছে। লোকটাকে যতই অন্য রকম ভাবি না কেনো লোকটা সত্যিই মজার। কত গল্প কত মজা করলাম লোকটার সাথে। সত্যি বলতে আজকের আড্ডাটা খুব ভালো ছিলো। কিছুক্ষণ পর লোকটাও চলে গেলো আর আমরা ও যে যার বাড়িতে চলে এলাম। মনে হলো প্রতিদিন না হোক কিছু কিছু দিন এমন একটা আড্ডা বসলে হয় ।
বর্ষায়
হিমালয় ভ্রমণ
অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
বরোদা, গুজরাট
ভ্রমণ
হ্যাঁ, এটাই মনে হল একমাত্র উপযুক্ত শিরোনাম এই লেখাটার। পরিকল্পনা ছিল Valley of Flowers যাবো। ভাবনাটা অবশ্য আজকের নয়, বেশ কয়েকবছরেরই আগেকার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ব্যাপারটা বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি। একটা প্রধান কারণ অবশ্য সেখানে যাবার সময়টা – বলে, ওখানে সবচেয়ে ভাল ফুল দেখা যায় আগস্ট শেষ/সেপ্টেম্বর গোড়ার দিকে। আর সেই সময়টায় না পাওয়া যায় অফিসের ছুটি, না স্কুল-কলেজের কোনও ফাঁকফোকর! তাই এবছরে মাঝ-আগস্টে একটা সুযোগ করে বেরিয়েই পড়লাম। তবে সবাই মিলে আর হল না, যাচ্ছি আমি, স্ত্রী ও আমার বড় মেয়ে – Valley of Flowers দেখার আগ্রহটা তারই বেশী ছিল, সেই ছোটবেলা থেকে! ছোটমেয়ের কলেজ চালু থাকায়, সে রইল ভুবনেশ্বরের হোস্টেলেই!
Valley of Flowers যেতে হলে নিকটতম রেলষ্টেশন হল হৃষীকেশ। আর এয়ারপোর্ট হল জলি গ্র্যান্ট, সে-ও সেই হৃষীকেশ/দেরাদুন থেকে প্রায় সম দূরত্বেই। এরপর থেকে গাড়ির রাস্তাই ভরসা। হৃষীকেশ থেকে বদ্রীনাথের রাস্তায়, বদ্রী পৌঁছানোর প্রায় ৩০/৪০ কিমি আগে আছে গোবিন্দঘাট। আগে এই অবধি গাড়ির রাস্তা ছিল, তারপর থেকে হাঁটতে হত। এখন গোবিন্দঘাট থেকে আরো ৪ কিমি দূরে, পুলনা অবধি ছোট গাড়ি যাবার রাস্তা হয়েছে। এখান থেকে পায়ে চলার পথ। যাদের হাঁটার অসুবিধে, তাদের জন্য অবশ্য ঘোড়া বা কান্ডি (মানুষের পিঠে বাস্কেটে বসে যাওয়া)ও আছে, আর এখন তো হেলিকপ্টারও চলে। ১০ কিমি দূরে আছে ঘাংরিয়া নামের একটা ছোট্ট গ্রাম মতন। এখানের উচ্চতা প্রায় ১১,০০০ ফিট। এখান থেকে একদিকে Valley of Flowers, অন্যদিকে শিখদের এক পবিত্র ধর্মস্থান, হেমকুন্ড সাহিব। থাকার ব্যবস্থা যা কিছু সে ওই ঘাংরিয়াতেই! শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রচুর ভীড় হয় এখানে, ছোটখাটো হোটেল ছাড়াও একটি বৃহৎ গুরুদ্বারা আছে, সেখানে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে। এখান থেকে একদিনে Valley of Flowers দেখে আসা যায়, আবার একদিন হেমকুন্ড সাহিব। তবে হেমকুন্ড যাবার রাস্তাটা খুবই চড়াই, এবং উচ্চতাও অনেকটা, প্রায় ১৫,০০০ ফিট। কারুর কারুর অক্সিজেনের জন্য অসুবিধেও হয়। আমরা যাবার সময়ে বরোদা থেকে সোজা হৃষীকেশ অবধি ট্রেনে গেছিলাম, আর ফেরার সময়ে হরিদ্বার নেমে এসে সেখান থেকে ট্রেনে ফিরেছি। হৃষীকেশ/হরিদ্বার থেকে গোবিন্দঘাট গাড়ীতেও প্রায় ১১-১২ ঘন্টা লাগে। তায় এই ভরা বর্ষার সময়ে, পাহাড়ী রাস্তায় ধস নামা ইত্যাদি আকছার লেগেই থাকে। তাই আমরা মাঝে একটা করে জায়গায় বিরতির ব্যবস্থা করেছিলাম। যাবার সময়ে হৃষীকেশ থেকে থেমেছিলাম শ্রীনগর (উত্তরাখন্ড)এ, আর ফেরার সময়ে নন্দপ্রয়াগে।
কিন্তু বিপত্তি যেন শুরু থেকেই – বা, বলা ভাল শুরুর আগে থেকেই, সঙ্গী হয়েছিল। রওনা হবার দিন কুড়ি আগে আমার শ্রীমতী হঠাৎ একটা কোমরে ব্যথা পেলেন। ডাক্তার দেখিয়ে, এক্স রে ইত্যাদির পরে তেমন কিছু না পাওয়া গেলেও, কিছু spondylytis এর লক্ষণ দেখা গেল। ডাক্তার অবশ্য সব হাঁটাহাঁটির কথা শুনেও, ভরসা দিয়ে বললেন, সাবধানে থাকলে যাওয়া যেতেই পারে। তবে ঘোড়ায় চড়া একেবারেই চলবে না! এইসব নিয়ে, যাবো কি যাবোনা করতে করতে, শেষে যাওয়াই ঠিক হল। যাত্রার দিনে, বাড়ির থেকে বেরোতেই Uber চালকের খানিকটা অভব্য ব্যবহার পেলাম। তারপর স্টেশনে পৌঁছতেই আমার অনেকদিনের বিশ্বস্ত ভ্রমণসঙ্গী, আমার রুকস্যাকটি দেহ রাখল। মানে, সেটি পিঠে ঝোলাবার দুখানি স্ট্র্যাপের একটি ছিন্ন হয়ে পড়ল। পুরো ভর্তি ব্যাগ, কোনোক্রমে টেনে নিয়ে ট্রেনে উঠলাম। এভাবে ট্রেনে হৃষীকেশ অবধি তো পৌঁছানো যাবে,
গ্যালারী - ১
ছবিঃ লেখক
পৌঁছানো যাবে, কিন্তু তার পরে তো বিবিধ যানবাহন থাকবে, সেখানে এই ছেঁড়া রুকস্যাক টেনে নিয়ে চলা অসম্ভব ব্যাপার। আর এটা কোথাও মেরামতও করা যাবে কিনা জানিনা, গেলেও তা সময়সাপেক্ষ হবে। অতএব, হৃষীকেশে নেমে একটা নতুন ব্যাগ কিনে নিতে হবে, এমনটাই ঠিক করা হল। আমাদের ট্রেনটা ছিল কেরালার ত্রিবান্দ্রমের কাছে কোচুভেলি থেকে এসে হৃষীকেশ অবধি, অর্থাৎ প্রায় ৫৬-৫৭ ঘন্টার যাত্রাপথ। অথচ, ট্রেনে কোনো প্যান্ট্রি কার রাখা হয়নি! এমনকি, পরদিন সকাল থেকে, দুপুর অবধি কোনও হকার/ভেন্ডার পেলাম না, যে একটু জল বা চা দেবে, খাবারের কথা তো ছেড়েই দিলাম! রেল কর্তৃপক্ষের এ এক অদ্ভুত বিবেচনা! যাইহোক, হৃষীকেশ পৌঁছলাম ঠিকঠাক সময়েই। এখন আবার নতুন ঝাঁ চকচকে ষ্টেশন হয়েছে, নাম রাখা হয়েছে ‘যোগনগরী হৃষীকেশ’। সেই বৃটিশ আমলের রেল লাইন পাতা হয়েছিল হরিদ্বার অবধি, তার থেকে দুটো ছোট শাখা চলে গেছিল, একটা দেরাদুন, আরেকটা হৃষীকেশ পর্যন্ত (দেরাদুন ষ্টেশনের বাইরে বোর্ড দেখেছি, সেটি স্থাপিত ১৮৯৯ সালে)। অতি সম্প্রতি সরকার উদ্যোগ নিয়েছেন সেই লাইন পাহাড়ে আপাততঃ কর্ণপ্রয়াগ অবধি বিস্তারিত করার। এই নতুন যোগনগরী হৃষীকেশ ষ্টেশন তারই অংশ। আমরা পরে পথেও দেখতে পেয়েছি, এই রেল লাইন সম্প্রসারণের কাজ জোর কদমে চলছে। হৃষীকেশ ষ্টেশনের বাইরে তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই একবার বেরিয়ে গিয়ে ব্যাগের দোকান খুঁজে নতুন একটি ব্যাগ কিনে নিলাম। এরপর একটা গাড়ি নিয়ে শ্রীনগর পৌঁছতে প্রায় রাত আটটা বেজে গেল। পথে পড়ে দেবপ্রয়াগ, যেখানে অলকানন্দা আর মন্দাকিনী দুই নদীর সঙ্গম ওপরের রাস্তা থেকেই সুন্দর দেখা যায়, একদম দুটো আলাদা রঙের জল একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার কারণে আর নীচে কিছু দেখা গেল না! তবে অনেক হোটেল, দোকান-পসার বেড়েছে, দেখতে পেলাম!
অলকানন্দা নদীর ধারে শ্রীনগর একটি মোটামুটি বড় শহর, একদা গাড়োয়াল রাজ্যের রাজধানীও ছিল। বর্তমানে এখানে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেমন HN Bahuguna University, NIT, একটি Medical College, ইত্যাদি। আমরা অবশ্য পরদিন সকালেই বাস ধরলাম, গোবিন্দঘাটের উদ্দেশ্যে। সেই অলকানন্দার ধার দিয়ে দিয়ে রাস্তা চলেছে, এই বর্ষার কারণে পাহাড়ে গাঢ় সবুজ মখমলের সাজ, এইসব উপভোগ করতে করতে চলেছি, কিন্তু আবার বিধি বাম! একসময়ে বাস থেমে গেল। দেখলাম, বহুদূর অবধি পাহাড়ের গায়ে যে সর্পিল রেখায় রাস্তা দেখা যাচ্ছে, সেখানে যতদূর দেখা যাচ্ছে, গাড়ির লাইন দাঁড়িয়ে রয়েছে! অন্ততঃ একশো-দেড়শো গাড়ি তো হবেই! শোনা গেল, একটা বড় ধ্বস নেমেছে একটা জায়গায়, মেরামতের কাজে সময় লাগবে! একটু চেষ্টা করে দেখতে পেলাম, অনেক দূরে, পাহাড়ের একটা বাঁকে, গেরুয়া-হলুদ মাটি নেমে আসছে ঢাল বেয়ে, সেখানে দুদিক থেকে দুটো JCB মেশিন কাজ করে চলেছে। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে, ঠিক সেখানে পাহাড়ের নীচে কাজ চলছে হৃষীকেশ-কর্ণপ্রয়াগ রেল লাইনের। একটা টানেলের মুখ দেখা যাচ্ছে, আরো নানান যন্ত্রপাতি ছড়ানো। শুনলাম, এখান থেকেই JCB গুলো গিয়ে ধ্বসের জায়গায় কাজ করছে। মোটামুটি ঘন্টাতিনেক লাগল লাইন চালু হতে। তারপর আবার পাহাড়ের নিয়ম অনুযায়ী, ওপর থেকে নেমে আসা গাড়িগুলোর priority আগে। ধীরে ধীরে যখন ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাটায় এলাম, দেখি বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে পাথর ভেঙ্গেছে, তখনো অল্প অল্প জল গড়াচ্ছে কাদামাটির ওপর দিয়ে, তার ওপর দিয়েই আমাদের ড্রাইভার দাদা অতীব কুশলতায় বাসটি বের করে আনলেন। এর পরেও অবশ্য বেশ কয়েকটি জায়গায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত ছিল, ধীরা ধীরে সেইসব জায়গা পার হয়ে গেছি, কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়তে হয়নি আর কোথাও। রাস্তার এই অবস্থার জন্যই, যোশীমঠ হয়ে গোবিন্দঘাট পৌঁছতে একটু দেরীই হল। এখানের উচ্চতা প্রায় ৬০০০ ফিটের ওপর, অল্প অল্প শীত করছে। দেখলাম বেশ ভালো ভীড়, হয়তো এই সপ্তাহে বেশ কয়েকটা দিন ছুটি থাকায় অনেকেই চলে এসেছেন, আমাদেরই মতন! বেশীরভাগ গাড়ীতেই দেখলাম হরিয়ানা
গ্যালারী - ২
ছবিঃ লেখক
/দিল্লী/চন্ডীগড়ের নম্বর। আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল না, এতটা দেরী হবে সেটাও হিসেবে ছিলনা। অবস্থা বুঝে হোটেলে যে যেমন খুশি দাম চাইছে, তার মধ্যেই দেখে শুনে একটা হোটেল নিলাম।
এই গোবিন্দঘাট থেকে খানিকটা নীচে হেঁটে গেলে, আসে গুরুদ্বারা গোবিন্দধাম। এর সামনে থেকেই পুলনা যাবার গাড়ীগুলো পাওয়া যায়। গাড়ি বলতে, টাটা সুমো জাতীয় গাড়ি, সেখানে প্রতি গাড়িতে ১০ জন বসতে পারে, শেয়ারে মাথাপিছু ৩০ টাকা করে। কাছাকাছি একটা হেলিপ্যাড আছে, যেখান থেকে ঘাংরিয়া অবধি হেলিকপ্টার যায়, আকাশ পরিষ্কার থাকলে। আমরা যেহেতু হেঁটেই যাব ভেবেছি, তাই ওই গাড়িতেই পুলনা পৌঁছে গেলাম। এবার হেঁটে চলার পথ। অনেক মানুষজন পথে, মনে হচ্ছে আমরা বোধহয় একটু দেরি করেই চলতে শুরু করেছি। আমাদের পথের সঙ্গী একটি পাহাড়ী ধারা, যেটা গোবিন্দঘাটে গিয়ে অলকানন্দায় মিশেছে। এখানে তার নাম লক্ষ্মণগঙ্গা । নদী উপত্যকা ক্রমশঃ সরু হতে থাকল, আর দুপাশের পাহাড়গুলো যেন উঁচু থেকে আরো উঁচু হতে থাকল। একদম খাড়া উঁচু পাহাড়, তাদের মাথাগুলো গিয়ে আকাশে ঠেকেছে। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের গায়ে পেঁজা তুলোর মত মেঘের দলা জমে রয়েছে।
মাঝে মাঝে ধাপে ধাপে পাহাড়ী ঝর্ণা নেমে এসেছে। এদিকে রাস্তাটা উঠেছে চড়াই-উৎরাই মিলিয়ে, কোথাও সেটা কিছুটা পাথর দিয়ে দিয়ে ধাপে ধাপে বাঁধানো, আবার অনেক জায়গাতেই এবড়ো খেবড়ো, সেখানে পা বাঁচিয়ে আর পাথর এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। কিছুটা পরে পরেই পথে ছোট ছোট দোকান রয়েছে, বিভিন্ন খাবারের পসরা সাজিয়ে। সেখানে ম্যাগি, নিম্বু-পানি, কাটা ফল থেকে চা-বিস্কিট-ভুজিয়ার প্যাকেট, সবই পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্যই, মহার্ঘ্য বিনিময়মূল্যে! যেমন, সিঙ্গাপুরি কলা – আসার পথে রুদ্রপ্রয়াগে কিনেছিলাম, ৩০ টাকা ডজন, সেটাই গোবিন্দঘাটে হল ৬০ টাকা, আর এখানে ২টো ২০ টাকা, অর্থাৎ ১২০ টাকা ডজন! আমাদের পাশ দিয়েই ঘোড়া ও খচ্চর বোঝাই হয়ে মালপত্র চলেছে, সম্ভবতঃ ওপরের দোকান বা হোটেলের জন্য। আবার যাত্রীরাও কেউ কেউ ঘোড়া নিয়েছে, তাদের মালপত্রও একেকটা ঘোড়ায় চলেছে। আমাদেরও মালপত্র এরকম একটা ঘোড়াতেই চাপিয়ে দিয়েছি নীচে থেকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ পাহাড়ের মাথায় আরো বেশি বেশি করে মেঘ জমতে থাকল। তবে তার ফাঁক দিয়ে কিন্তু মাঝে মাঝেই পরিষ্কার নীল আকাশের টুকরো উকি মারছে! রাস্তাও মাঝে মাঝে বেশ steep হতে থাকল। একটা সময়ে আমার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আমার জন্য ঘোড়া নেওয়ার ঠিক হল। এদিকে এরা মা-মেয়ে তো ঘোড়ায় চড়বে না, একজনের ডাক্তারের বারণ, আর অন্যজন, সঙ্গতভাবেই, মাকে একা ছাড়বে না। পথে মাঝে মাঝে ঘোড়াওলা পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু এরা জোড়ায় ছাড়া ঘোড়া দেবে না, এ এক অদ্ভুত নিয়ম! মানে, হয় দুজন যাত্রী চাই, অথবা একজন যাত্রী ও তার মালপত্রের জন্য আরেকটি ঘোড়া – এইরকম এদের হিসেব! দেখতে দেখতে এ সমস্যারও সমাধান হল, আরেকটা দলকে পাওয়া গেল, তারাও তাদের একজনের জন্য ঘোড়া খুঁজছিল। ঘোড়ায় তো চড়লাম, কিন্তু যেন এর চাইতে হেঁটে আসাই কম ঝামেলার ছিল! একটা ঘোড়ার লেজের মধ্যে দিয়ে অন্য ঘোড়ার লাগাম বাঁধা, তাই সামনের ঘোড়া এদিক-ওদিক কিছু করলেই, পরের জনও সেই পথে চলেছে! আর তার ওপরে থাকা অনভ্যস্ত সওয়ারীর তো ছেড়ে-দে-মা অবস্থা! আবার এরই মধ্যে যেখানে একটু উৎরাই রয়েছে, সেখানে সাবধানে পেছনে ঝুঁকে বসতে হবে, ঘোড়াওয়ালা জানিয়ে দিল।
গ্যালারী - ৩
ছবিঃ লেখক
সেটাতেও অভ্যস্ত হতে একটু সময় লাগল! পথে যত সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য ছিল, কেবল দুচোখ ভরেই দেখতে থাকলাম। এই অবস্থায় পকেট থেকে মোবাইলই বের করতে ভরসা হচ্ছেনা, তো পিঠের ব্যাগে রাখা বড় ক্যামেরা তো পিঠেই রয়ে গেল! কেবল, ঘোড়ায় করে সময়টা অনেক কম লাগল, আর আমি প্রায় তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদই ঘাংরিয়া পৌঁছে গেলাম। ঘাংরিয়া একটা ছোট্ট গ্রাম মতন, উচ্চতা প্রায় ১০,০০০ ফুট, এই পথে শেষ বসবাসের জায়গা। দুপাশে একদম খাড়া পাহাড়, একপাশ দিয়ে সেই লক্ষ্মণগঙ্গা বয়ে চলেছে। গ্রামের অন্যপাশে দুটো আলাদা আলাদা ধারা – হেমকুন্ড থেকে আসা হেমগঙ্গা আর Valley of Flowers থেকে আসা পুষ্পবতী, মিশে এই লক্ষ্মণগঙ্গা সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামে ঢোকার আগে একটা প্রায়-সমতল মত জায়গায় একটা হেলিপ্যাড রয়েছে, আর তার পাশেই অনেক টেন্ট লাগানো। গ্রামের মধ্যে ছোটোখাটো হোটেল কয়েকটা রয়েছে, আর আছে একটা গুরুদ্বারা। আমি আসার আগে এখানেই কথা বলেছিলাম, এনারা জানিয়েছিলেন, যখনই আসুন, থাকার জায়গা পেয়ে যাবেন। শুনেছিলাম এদের আলাদা ঘর আছে, তাছাড়া dormitoryও আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এরা এখন কেবলই dormitory দেয়, তবে gents dorm hall আর family dorm hall আলাদা। চারতলা বাড়ি, নীচে একদিকে প্রার্থনার জায়গা, তার পাশে লঙ্গরখানা, ওদিকে রান্নার জায়গা। মাঝে একটা বড় খোলা জায়গা। সেখানে কিছু বসার ব্যবস্থা, একটা গরম খাবার জলের কল, আর মাঝে একটা বিরাট বড় – প্রায় ৫ ফুট মত উঁচু স্টীলের সিলিন্ডারে গরম গরম চা পাওয়া যাচ্ছে, সবসময়ে। কল খোলো, চা খাও! (তবে তারপরে গ্লাসটা ধুয়ে একটা নির্দিষ্ট পাত্রে রেখে দিতে হবে!) মাঝে মাঝে দেখছি কেউ এসে মই বেয়ে ওপরে উঠে বালতি বালতি চা ভরে দিচ্ছেন সেই পাত্রে।
এইসব ব্যবস্থা দেখে আমি বাইরে গিয়ে বেশ কয়েকটা হোটেলে খোঁজ করলাম, কোত্থাও জায়গা নেই। এমনিতেও দেখতে পাচ্ছি, রাস্তায় প্রচুর মানুষজন রয়েছে। হয়তো এই extended weekend এর কুফল! অগত্যা, বুঝলাম, সেই গুরুদ্বারা ছাড়া গতি নেই, যদিও ওই পরিস্থিতিতে কতটা স্বস্তিতে ঘুমোতে পারব জানিনা! এবার ওদের জন্য অপেক্ষা করা। ক্রমশঃ ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা – ছটা পেরিয়ে এগিয়ে চলল, পাহাড়গুলোর মাথায় মেঘেরা ঘন হয়ে আসতে লাগল। বেশ ঠান্ডাও হয়ে আসছে। কিন্তু ওরা কতদূরে আছে জানার কোনো উপায় নেই! এখানে আসার আগে নেটে পড়েছিলাম কোথাও, এখানে ফোনের নেটওয়ার্ক বলতে একমাত্র BSNLএরই পাওয়া যায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল গোবিন্দঘাট ছেড়ে আসার পরে, পুরো পথটায় কোনও ফোনেরই কোনো নেটওয়ার্ক নেই! ঘাংরিয়া পৌঁছানোর পরে, কেবল Airtel এর নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল, তাও সবসময়ে নয়। এদের আসতে আসতে প্রায় সাতটা বেজে গেল।
এবার গুরুদ্বারাতে আশ্রয়ের পালা। আমাদের হল যেটা দিয়েছে, সেটা তিনতলায়। হলে সারি সারি খাটিয়া রাখা আছে, ট্রেনের বাঙ্কের মত, তিনটে তলা বিশিষ্ট। ট্রেনের বাঙ্কে একজন কোনোক্রমে শুতে পারে, কিন্তু এখানে একেকটা খাটিয়া প্রায় ৬ ফিট x ৬ ফিট মত মাপের, তাতে একেক তলায় তিনজনও শুয়ে পড়তে পারে। মানে, একটা ছোট পরিবারের জন্য যথেষ্ট। খাটে একটা করে পাতলা ম্যাট্রেস, আর অনেক অনেক কম্বল রাখা। একটা নীচে পেতে, আরেকটা রোল করে বালিশ বানিয়ে, আরেকটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়া। আমাদের যে হলে দিল, সেখানে সারি সারি এরকম প্রায় ৩৫-৪০ টা খাটিয়া লাগানো। আর, এতজনের জন্য টয়লেট/বাথরুম সব কমন, কিন্তু মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে, গরম জলের ব্যবস্থা কোথাও নেই। এরকম এদের নাকি ১৫/১৬টা হল আছে। আর, এই সব সেবা-ই নিঃশুল্ক, আপনি ইচ্ছে হলে কিছু দান দিয়ে যেতে পারেন, না দিলেও কেউ কিছু বলবে না! তবে, বুকিং কেবলমাত্র একদিনের জন্যেই দেওয়া হবে। পরদিন আবার নতুন করে বুকিং নিতে হবে! এদের একটা cloak roomও আছে, সারাদিন বাইরে থাকার সময়ে মালপত্র সেখানে রেখে যাওয়া যায়। আরেকটা জিনিস খুব ভাল লাগল। আমরা যখন সারাদিনের বিধ্বস্ত চেহারায় মালপত্র নিয়ে তিনতলায় উঠতে হিমশিম খাচ্ছি, হঠাৎ চেনা নেই জানা নেই এক শিখ যুবক এসে আমাদের দুটো ভারী ব্যাগ অনায়াসে ওপর অবধি তুলে দিলেন! তারপর, ওপরে নিজেদের বেডে এসে যখন খাবার জলের খোঁজ করছি, পাশের বেডের প্রবীণা আন্টি যেচে বললেন, আমাদের কাছে জল আছে, দেবো? তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে জেনে নিলাম, খাবার জলের ব্যবস্থা এখানে সেই একতলায়, সেখানে উষ্ণ খাবার জল পাওয়া যায়। আমাদের আশেপাশে কিছু বাঙালী পরিবারও আছে, বুঝলাম আওয়াজে! অবশ্য, আসার সময়ে পথেও বেশ কিছু বাঙালী দলের দেখা পেয়েছিলাম। আমরা বাইরেই রাতের খাবার সেরে এসেছিলাম, কোনক্রমে বিছানার ব্যবস্থা করে শুয়ে পড়লাম।
এরকম ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই ঘুম তো যৎসামান্যই হল, তার ওপর ভোর রাত থেকেই আশেপাশের কিছু কিছু লোকজন নড়াচড়া করতে লাগল। তারা উঠে তখন থেকেই তৈরী হতে শুরু করছেন, বোধহয় ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়বেন! তার একটু পরেই, প্রায় চারটের সময় থেকে গুরুদ্বারায় প্রার্থনার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। কম্বলের বাইরে তখন বেশ ঠাণ্ডা। আমাদের আজকের পরিকল্পনা Valley of Flowers যাবার, সেটা হয়ত একটু পরে রওনা হলেও চলবে, সেই ভেবে আমরা আরেকটু দেরী করেই উঠলাম। যদিও, পুরো হলভর্তি লোকজনের মাঝে ঘুম আর হলই না!
গড়িমসি করে আমাদের বেরোতে বেরোতে দশটা বেজে গেল। এই গুরুদ্বারা পেরিয়ে, গ্রাম ছাড়িয়ে আরো খানিকটা গিয়ে দুই ধারা, হেমগঙ্গা আর পুষ্পবতীর সঙ্গম, যদিও তার সামনেই ঘোড়ার আখড়া থাকায় সেটা বিশেষ নজরে পড়ে না। এই রাস্তায়, মানে Valley of Flowers যাবার পথে ঘোড়া চলে না। বেশ কিছু বছর আগে থেকেই নাকি বনদপ্তর থেকে এই Valley of Flowers পার্কে গবাদি পশু ইত্যাদির প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। তবে হেমকুন্ডে ঘোড়া, কান্ডি, পালকি সবই চলে। প্রায় ১ কিমি মত যাবার পরে, রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়ে গেল, ডানদিকের রাস্তা চলে যাবে হেমকুন্ডের পথে, আর আমরা যাব বাঁদিকে। দূর থেকে একটা ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছিলাম, অনেক ওপর থেকে ধাপে ধাপে নেমেছে। রাস্তার ধারে ধারে মাঝে মাঝেই ছোট্ট ছোট্ট নাম না জানা ফুল দেখা দিতে শুরু করেছে। আমরা একটা অন্য valley তে প্রবেশ করছি। আসল Valley of Flowers অনেকটা বিস্তৃত একটা সমতল মত জায়গা, সেখানে অনেক ভেতর অবধি যাওয়া যায়, আর ততোই ফুলের বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর আগে অনেকটাই খাড়াই চড়তে হবে। খানিক গিয়ে, একটা বনদপ্তরের চৌকি আর গেট, সেখানে নামধাম লিখিয়ে, আধার কার্ড দেখিয়ে, আর জনপ্রতি ১৫০/- টাকা প্রবেশ মূল্য জমা করতে হল। তবে, আসল Valley of Flowers এখান থেকে ৪/৫ 8 কিমি দূরে। এখানের গেট বিকেল ৫টার মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়, কাজেই আমাদের তার মধ্যেই নেমে আসতে হবে। বনদপ্তরের লোকেরা আমাদের বলে দিলেন, যতদূর পারি, দুটো অবধি এগিয়ে যেতে, তারপর ফেরার পথ ধরতে। অতএব, চরৈবেতি! পথ এখন আরো সরু, কিছু কিছু জায়গায় পথ বলে কিছু নেই, পাথরে পাথরে পা ফেলে ফেলে এগোনো। আর দুপাশের পাহাড়গুলো একদম খাড়া উঠে গেছে, বোধহয় এক/দেড় হাজার ফুট অবধি, কি আরো বেশি হবে! তাদের মাথায় মেঘেদের দল জমতে শুরু করেছে, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে গাঢ় নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে, এত সুন্দর নীল যে আকাশের রঙ হয়, আমরা শহরের দূষণ ভরা আকাশ দেখতে দেখতে সেটা ভুলেই গেছি! মাঝে এক জায়গায় সাঁকোর ওপর দিয়ে একটা বড় ঝর্ণা পার হয়ে নদীর অন্য পাড়ে এলাম। এবার পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ খাড়া চড়াই। এদিকে কাল থেকে সারাদিনের যাত্রা, তারপরে রাতেও ঠিকমত বিশ্রাম না পাওয়ায়, শরীরও আস্তে আস্তে জানান দিতে শুরু করছে। আরো কতটা চড়াই উঠতে হবে, তাও বুঝতে পারছিনা ঠিকমত! যারা ওপর থেকে নেমে আসছেন, তাদের একেকজনের কাছে একেক রকমের feedback পাচ্ছিলাম।
কেউ কেউ উৎসাহ দিয়ে বলছেন, এই আর খানিকটা গেলেই চড়াই শেষ, তখন আর হাঁটতে খুব অসুবিধে হবে না! আবার কেউ কেউ হতাশ করে দিয়ে বলে গেলেন, এখনো ২/৩ কিমি উঠতে হবে! দুয়েকজন তো এমনও বললেন যে ওখানে তেমন ফুলটুল কিছু নেই, যা কিছু এই পথের আশেপাশে দেখছেন, সেইরকমই সব! এসময়ে মনের একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। যেই কারুর থেকে একটু নেগেটিভ তথ্য পাচ্ছি, মনটা দমে যাচ্ছে, শরীরেও যেন আর শক্তি পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে আর হবেনা, এবার ফিরে যাই। আবার কেউ হয়ত একটু আশার কথা বললেন, মনে হচ্ছে, এগোই তাহলে! এইরকম মনের দোলাচল নিয়েই আরো খানিকদূর উঠে গেলাম। এদিকে বেলা ক্রমশঃ বাড়ছে। আজ দেরী করে বেরনো, এটাও আমাদের একটা ভুল হয়ে গেছে, এখন বুঝতে পারছি! হয়ত এইজন্যেই সবাই ভোর থাকতেই বেরিয়ে পড়ে! এরমধ্যে একজন দেখিয়ে দিলেন, ওই যে পাহাড়ের মাথা, সেটা পার করলে একটা সমতল মত জায়গা আসবে, তারপর আরো ১ কিমি মত গেলে আসল valley of flowers আসবে। এদিকে আমার একটা হাঁটুর পাশের লিগামেন্টে কাল থেকেই বেশ ব্যথা হয়েছে, বিশেষ করে নীচের দিকে নামার সময়ে রীতিমতো ব্যথা করছে, যতই সঙ্গে ভর দেবার জন্য হাতে লাঠি থাকুকনা কেন! আমার স্ত্রীরও এতটা হাঁটাহাঁটির পর বেশ কাহিল অবস্থা, মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। একটা সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম যে valley of flowers দেখা আমাদের কপালে নেই! বেলা তখন দেড়টা। একটা জায়গায় বসে, একটু খাবার খেয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলাম। এতদিনের এত ইচ্ছে আর পরিকল্পনা, সবই বৃথা গেল!
ঘাংরিয়া এসে আজও কয়েকটা হোটেলে খোঁজ করলাম, যদি একরাতের জন্যেও ঘর পাওয়া যায় – নাঃ, কোনো আশা নেই! তখন অনেক আলোচনা করে ঠিক হল যে আর আমাদের হেমকুন্ড সাহেব গিয়ে কাজ নেই, সেটা আরো খাড়া চড়াই, এইরকম শরীরের অবস্থা, তায় ঠিকমত বিশ্রামেরও ব্যবস্থা নেই গুরুদ্বারায়। হয়ত ঘোড়ায় করে যাওয়া যেত, কিন্তু সেক্ষেত্রে সবার যাওয়া হবেনা, আর আমার হার্টের কথা ভেবে কেউ কেউ আগে থেকেই আমাকে বারণই করেছিলেন। তাই আমরা কাল এখান থেকে নেমে যাবো গোবিন্দঘাট। সেইমত পরদিন সকালে নেমে এলাম গোবিন্দঘাট। এবারে আর হাঁটার চেষ্টা করিনি, একটা কান্ডিতে সোমাকে চড়িয়ে, আমি আর মেয়ে দুটো ঘোড়ায় নেমে এলাম। গোবিন্দঘাট থেকে একটা শেয়ারের গাড়ি পেয়ে গেলাম যোশীমঠ অবধি। রাতটা সেখানেই কাটিয়ে, পরদিন গেলাম নন্দপ্রয়াগ, আমাদের আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী। নন্দপ্রয়াগে স্থানীয় নন্দাকিনী নদী এসে মিশেছে অলকানন্দায়। ওপর থেকে সঙ্গমটি দেখা যায়। এগুলো সবই ছোট্ট ছোট্ট জায়গা, কিন্তু একবেলা আশেপাশে ঘুরে দেখা যায়। তার পরের দিন নন্দপ্রয়াগ থেকে এলাম হরিদ্বার, তারপর ট্রেন ধরে ঘরে ফেরা।
গ্যালারী - ৪
ছবিঃ লেখক
কাব্য-আলোচনা
কবি মলয় পালের কবিতার বই এর রিভিউ
লিখেছেন - অপর্ণা চক্রবর্তী
পাতা ঝরা দিন
কবির কাছে ঋণ...
============================
কবিতার বই পেলে আমি কখনো প্রথম পাতা থেকে পড়া শুরু করতে পারি না। আজও পর্যন্ত কোনো কবিতার বই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ পাতার ক্রম অনুসরণ করে পড়িনি। বদ অভ্যাস কিনা জানিনা, ওটাই আমার অভ্যাস। প্রচ্ছদ, প্রকাশক, মুখবন্ধ, উৎসর্গ, লেখক পরিচিতি দেখার পর এলোমেলো পাতা উল্টে পড়তে শুরু করি। তারপর এপাতা, ওপাতা ঘুরতে ঘুরতে থমকে দাঁড়াই কবিতার কাছে। একাত্ম হই, একাধিকবার একই লাইন পড়তে থাকি। বইয়ের ভাঁজে আঙুল ঢুবিয়ে বই বন্ধ করে, আকাশ দেখি। এভাবেই কবিতার সাথে আমার একলা যাপন। একলা দুপুরে, একলা সফরে, একলা গাছের ছায়ায়, একলা কোপাইয়ের পাশে, একলা অজয়ের ধারে, একলা লালমাটির রাস্তায়, একলা শাল বনে- কবিতার সঙ্গে আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
গত দু-তিন বার একলা ট্রেন সফরে আমার সঙ্গী ছিল মলয়ের লেখা কবিতা সংকলন "শালপাতার শহর"।প্রকৃতি প্রেমী, অরণ্য প্রেমী কবি - তার এই ছোট্ট কবিতার বইয়ের পাতায় পাতায় এঁকেছেন অরণ্যের প্রতি
অপার ভালোবাসার ছবি। মানুষের প্রতি সমবেদনা, গাছের সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক, তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিতার রূপ পেয়েছে। লিখেছেন --- "আমার এপিটাফে শাল ফুল দিও"।লিখেছেন --- "সহসা শান্তির খোঁজে শেষবেলায় ডুব দিয়েছি সবুজের সামিয়ানায়। / বিভূতি ভূষণের জঙ্গলে হারিয়ে যেতে চেয়েছি কিছুক্ষণ, / ফেরার দায় ছিল না।" ঠিক এভাবেই আমিও বারবার একলা হতে চেয়েছি প্রকৃতির সাথে।
মলয় লিখেছেন--
"যেভাবে একলা হতে হয়" ---
"সব মেলামেশা সঙ্গত নয়
সঙ্গত নয় প্রেম, পরিণয় কিংবা অসুখে,
নিশ্চিত কোথাও ভুল করেছিলে তুমি
.................এসো, বিপন্নতায় দুহাত পাতি
গাছের নীচে এসে!"
শেষের এই বিপন্নতায় আমিও এমনই করেছি বহুবার। শেষের এই কথাটুকু আমার নিজস্ব উপলব্ধি, যা মলয়ের কলমে কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে।
"শালপাতার শহর" বইটির পাতায় পাতায় কুসুম গাছ, সাঁওতালী মেয়ে, সেগুন মঞ্জরী, মহুল ফুল, 'শালুকের শতরঞ্জি পেতে সকালের মতো ফুটে আছে'। আবার কোথাও বা তার কবিতায় ইঁটকাঠের শহর জীবন রূপকের আশ্রয়ে নাম নিয়েছে "জঙ্গল মহল"।
"ওই তো শালবন হলুদ নিয়নের আলোয় গাছ দুলছে, /মঞ্জরী ছড়িয়ে পড়েছে কাঁকুরে পথে, /কংক্রিটের পথ লাল মাটিতে ভরে গেছে।
সবকটা ফ্ল্যাটে বাতাসের কলিং বেল বাজছে।
৬, বালিগঞ্জ প্লেস আবাসনের নাম জঙ্গল-মহল"
কবি মলয় পাল
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.
পুজো বার্ষিকী ১৪২৯ ।। সূচীপত্র