প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
গ্যালোপিং সাহিত্য
জিষ্ণু সেনগুপ্ত
শিয়ালদহ
ক্লান্তির কবিতা
আমি তো কিছুই পারি না, আমার না পারা সংলাপের, ভৌতিক বাস্তবতা আমাকেই অবাক করে। ঠিক যেমন অবাক করে বর্ষণ-বিহীন ধূসর মেঘ-পুঞ্জকে। মালিনী আমায় বলেছে, আমরা চরকের মেলায় যাব। আমার এখন ররবীন্দ্রনাথ পড়তে ভালো লাগে না। তাক ভর্তি সমগ্র ভাসিয়ে দিয়েছি, সামুদ্রিক শূন্যতায়। মালিনী আবার এনে দেবে, একটা বেশি আনবে, আমি জানি।
শাশ্বত বলেছে সবুজ দেখতে, বয়স হচ্ছে, আরাম হবে। আমার দুঃখ হয় না, মালিনীর হয়।মালিনী বলেছে কবিদের দুঃখ হয় না। সাধারণের হয়, কারণ ওরা স্বপ্ন দেখে কবিতার মত, আর আমরা কবিতা লিখি স্বপ্নের মত। আমি দুঃখ-বিহীন, দুঃখ-অভিমান আর না পারার কান্না পুড়িয়ে দিয়েছি অশোক-আগুনে। রিতর্ণা সিগারেট ছাড়তে বলেছিল, আমি ছেড়েছি আর রিতর্ণা আমায়। এখন পকেটে সিগারেট নেই, ক্লান্তি আছে।
দমদম
দুঃখের কবি
শাশ্বত বলেছে আমি কবিদের মতন দুঃখ নিয়ে নেশা করি। সকালে মালিনী ফোন করেছিল, আজ রাতে আমরা বৃষ্টি দেখতে যাব। যখন কংসাবতীর জলে জেগে উঠবে উন্মত্ত ইউনিকর্ন, তখন আমরা বসব, হিজিলের সংসারে, আকাশের প্রতিবেশী হয়ে।
মালিনী আমার বুকে মাথা রেখে প্রশ্ন করে, ”ভালোবাসো?!”, আমি মালিনীকে ভালোবাসি না, মালিনী বলেছে কবিদের ভালোবাসতে নেই, কারণ আমার না পারার কান্নায় আফিমের কারবার।
আকাশে সপ্তর্ষি, মালিনী তাকিয়ে থাকে এক জীবন উল্লাস নিয়ে। আমার ঈর্ষা হয়, আমার কিছু না পারা বোকা পেন্সিলকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বলে, ”পারবে, পারবে, পারলে তুমিই একমাত্র পারবে”।
মালিনী গোলাপ বেশি পছন্দ করে। আমি শিউলি দিয়েছি, ওকে চন্দ্রমল্লিকা বেশি মানায়। মালিনী খোপা করে না। ওর গন্ধটা কৃষ্ণচূড়ার মত, আমার প্রিয় ফুল।
সোদপুর
মন্দবাসার কবিতা
কাল শাশ্বত এসেছিল। শাশ্বত বলে আমার কবিতা দুর্বোধ্য, সাধারণ বর্জিত। তাই আমার কবিতায় রডোডেন্ড্রন, ওর স্বপ্নে উষ্ণতম বনরাজী।
শাশ্বত রাতে আসে। ও জানে আমি রাত্রি পছন্দ করি। শাশ্বত কাল নেরুদা দিয়েছে, আমি পড়িনি। আজ পড়ছি, কুড়িটি প্রেমের কবিতা। আমি ভালোবাসতে ভালোবাসি না, ভালোবাসাকে ভালোবাসি। মালিনী বলেছে ভালোবাসলে কবিতা লেখা যায় না। ভাঙলেই প্রকৃত কবি। শাশ্বত বলেছে প্রেমের কবিতা লিখতে। আমি লিখি না। ওতে সুখ হয়। মালিনী বৃষ্টি ভালোবাসে, আমি রোদ্দুর। মালিনী চলে যাবে, আমি জানি।
ব্যারাকপুর
প্রশ্ন কবি
আমি, মালিনীকে নিয়ে সুজাউদ্দিনের দরগায় যাই। আমি ঈশ্বর মানি না, মালিনী মানে। সেখানে পুরুষ ও নারীর নিরঙ্কুশ ঘনিষ্ঠতার অধিকার আছে। তাই বিদ্রোহ নেই। আমি মহাকাশে রটিয়ে দিয়েছি, স্পর্শহীন রাতের ইশতেহার। সেখান থেকেই চরকের মাঠে যাই, আকাশ দেখতে।
আকাশের বিক্ষিপ্ত কল্পনার সাহিত্যিক বাস্তবতায়, কবিতার পুষ্পবৃষ্টি। মালিনীর হলুদ ওড়নায় বৈশাখী বিশ্বাস। আমার বুকের দুটো বোতাম মালিনীর বাধ্য। আমরা চুমু খাই। মালিনীর বুকে, আমার পরিচিত ব্যর্থতার আঁচিল। আমি উর্যাকে ভালোবাসি। মালিনী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ”তোমাকে পারতেই হবে...”।
আমি প্রশ্ন করি,
“আচ্ছা মালিনী আমরা কি পালটে যাচ্ছি? এই যে তেপান্তরের মাঠ, শরতের কাশবন, আকাশ ছোঁয়া শঙ্খচিল, উড়োজাহাজ, পক্ষীরাজ, মেঘ প্রাসাদের রাজকন্যা। ওদের ধর্ম কি মালিনী?”
মালিনীঃ- উদযাপন!!! জীবনের নান্দনিক উদযাপন!
~বনে-বনান্তরে
মন্দবাসার শহরে
জোৎস্নায়, অশোক ছায়ায়
মালিনীকে, দুঃখের কবিতা
বসন্ত উদ্যমে,
জীবনের নান্দনিক উদযাপন।
মালিনী-ধ্যাত!!
নৈহাটি
প্রজাপতির কবিতা
শাশ্বত বলেছে আমার গল্পে কোনো ন্যারেটিভ নেই, বড় প্রাণের অভাব। আমার কিছু বলার নেই, আমার কোনো গল্প নেই, দুঃখ আছে। আমার হয়তো জন্মই হয়নি এখনো কিংবা মৃত্যু হয়েছে ইতিহাসে। আমার নিরুত্তাপ শব্দ, বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারার সংজ্ঞাহীন পংক্তি ”পারিবার নয় দেখিবার”।
ব্যান্ডেল(অন্তিম স্টেশন)
শেষের কবিতা
ঘুম ভেঙেছে, নামতে হবে। শাশ্বত পরে বলবে, ঘন্টাখানেক গ্যালোপিং সাহিত্যা, মিনিট ১৫ সময় নষ্ট। আমি কবিতা বিক্রি করি না, কিনতেও বলি না, ৭০৪৪৭৬৭৭১৪ এই নম্বরে ক্রয় মূল্য ফেরত দেওয়া হয়। মালিনী বলেছে আমরা চরকের মেলায় যাব আজ। আমি পৌছে গেছি। অন্তিম স্টেশন, গাড়ি থামছে। হয়তো চিরকালই মালিনীকে ভালোবেসেছি। গদ্যের প্রশয়ে বেড়ে উঠেছে কবিতার ম্যানগ্রোভ। মালিনীর আবদার, শেষ কবিতা। সময় শেষ, লোডশেডিং।
কার শেড
“একা বেঁচে থাকতে শেখো প্রিয়
তোমার নামে শিরনি দিয়েছি, তারার মাজারে।
আমায় নিয়ে আর ভেবো না, আরাম প্রিয়
মনে স্বস্তি জেনো, শুধুই ফূর্তি মেনো
দোলন-চাঁপার মৌসুমে আমি টানছি ইতি এবার,
তোমার বন্ধ ঘরে শোবার স্বভাব না করেছি কবার?!
তোমার মনের গতি
তোমার মনের গতি রাতের দুরপাল্লার গাড়ি,
আমি ধরতেও না পারি, আমি ক্যামনে যাব বাড়ি।
টিকিট কেটে রেখেছিলাম যাত্রা সময় ভুলে
এখন ইস্টিশনে বেজায় অন্ধকার।“ -আসির আমান
পুজো বার্ষিকী
১৪২৮
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
প্রদীপ প্রামানিক
সুভাষগ্রাম, কলকাতা
দলনেতা
দাদা ওরা সমাজকর্মী, দলকর্মী বললে রাগ
যেহেতু আমরা সাধারণ মানুষ তাই, সবাই ভাগ-
দাদা ওরা সমাজকর্মী সমাজ নিয়ে ভাবে- জনগণের সেবা টাকা, নিজের পকেটে ভরে
দেশের সেবায় ঘুম আসে না, ঘরের মধ্যে পায়চারি,
যত দেশের সেবা করে ততোই গাড়ি- বাড়ি।
গরিব মানুষের ঘর দেবে, মধ্যবিত্তের লোন - জনসেবায় হয়ে উঠবে, ওরাই আপনজন।
দুর্যোগ ও ত্রাণ দেবে, দেবে তাদের অর্থ -
ভিতরে ভিতরে চুক্তি থাকে, গোপন কিছু শর্ত।
জ্ঞানীগুণী ধার ধারে না, "ওরা" কোন ছা-
সুস্থ জীবন বাঁচতে হলে, "দাদার" কাছে যা।
দাদা ওরা সমাজকর্মী দেশের কথা ভাবে -
যেমন কথা তেমন কাজ, যে কোনো উপায়ে।
গিরগিটির মতো রং পাল্টায় সময়ের ব্যবধানে। জনগণের ঘুরতে হয়, তাদেরই টানে টানে-
দ্বিমত হলে এক ঘরে, জীবন সংশয়।
বোমা পড়বে, না গুলি চলবে, সেটা নিয়ে ভয়!
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
সুপ্রভাত মেট্যা
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
রূপনারায়ণের চরে আমরা
রূপনারায়ণের চরে আমরা।
দুপুর ছায়াহীন সেই চর জেগে আছে।
হোগলা বনের সারি।
অদূরতম নদীর স্বরে কথা বলছে মেয়েরা....
শীত --
ক্রমশ মৃদু হয়ে ভালো লাগছে আমাদের গায়ে।
চড়ুইভাতির ছেলেরা, অল্প হাওয়ায় পায়ে বল নিয়ে খেলা করছে।
রন্ধনের গন্ধ আসছে নাকে।
খোলা মনে উড়ে বেড়াচ্ছে কবিতারা
আমার হৃদয় থেকে উঠে এসে
নদীর ঠিক উপরে পাখিদের ডানার স্রোতে
রোদলাগা পঙ্ ক্তির
কী খুশির হাওয়ায় হাওয়ায়....
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
অর্ক চক্রবর্তী
একান্ত
ঝুম বিকালে বৈরাগী তোর আলখাল্লার খুঁটে
কয়েক জন্ম মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কিছু দেখা।
চোখ বুজে শেষ আলোয় রাঙা বসতবাড়ি ঘিরে
দুই পলকের মধ্যিখানে শূন্য আকাশ লেখা—
বিদায় প্রস্থ মৃত্যু নাহয়
পরের পায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার
আলগোছা রোখ নির্বিশেষে
গুছিয়ে তুলে রাখা—
নিঝুমতলার বটে ঝুড়ির অন্ধকারে ছায়ায় ছায়া
জাপটে ধরে রাস্তা থেকে অচিনপথে হারিয়ে যাওয়া
সঙ্গী চিনেই হাত ধরেছি বাউল হব বলে।
ধূলায় ধুধু রুক্ষ জটায় শ্রাবণ বিকেল জানে—
সর্বনাশের আশীর্বাদে
হৃৎকমলে পিদিম জ্বলা
মাটির বসত সাঁঝবেলাতে
গুছিয়ে বসার মানে।।
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
জবা রায়
ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ
'অস্তিত্ব পোড়ানোর দিনরাত'
অবিনাশী একতারা দেখে যাও
ওজনের ভারে এখানে জমেছে বিষাদ
খুব কাছে-
সাপ্তাহিক যন্ত্রণা শোনাতে আসা
বছরের শেষ সোমবার
ক্রসফায়ারে মারা গেলো পরশুদিন
এরপর থেকে ঘনীভূত গতকাল
জীবন খাতায় লিখে যাচ্ছে ভুল তথ্য
দেহ ক্ষয়ের শব্দ দিয়েও
সেসব অনুবাদ করতে পারেনি আগামীকাল
কারণ-
মহাকালের চল্লিশতম চোখটি
এখনো অপূর্ণতার কান্নায় আত্মগোপন করে।
'গায়ে মাখা সময়'
আগুনের ধোঁয়া মিলিয়ে গেলেই
অধিকার বুঝতে চায় যাযাবর পেন্ডুলাম
প্রমাণ পাওয়া প্রায়শ্চিত্ত নিয়ে
যখন সে বেজে ওঠে
পরজীবি প্রেমে জগদম্বার শেখরে
তখন আঁকে রঙিন প্রচ্ছদ
জাগতিক আলোক বিন্দু মেপে
ফাগুনের মতো নরম ব্যথার আশঙ্কা
সেও করে
বাকি কথা পরে হবে ভেবে
খসে পড়া রাত বিরাতের এককোষী মন
বেখেয়াল আবার কখনো মাতাল হয়
খুঁজতে থাকে পালাগানের রিনরিনে স্বর
কিছু দূরে-
মিলিয়ে যাওয়া শব্দের ফলাফল
ছড়িয়ে দেয় উপভোগের ঘ্রাণ।
'চক্রের সিলেবাস'
অনুভবের সঠিক অনুবাদ নিয়ে কেউ জন্মায় না
বরং...
মহাসাগরীয় প্লেট উলটে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে
মানুষ ফিরে আসে নিজের কাছে
ভূত্বক ফুঁড়ে অতীতকে স্মরণ করে
বৈধ নথিপত্র জমা পড়লেই
বুলি কপচিয়ে সে পায় মাটির স্পর্শ
চেনা গন্ধে পুরাতন বিশ্ব খুলে
যদি মিশরীয় ভুলের সম্মুখীন হয়
তাহলে অমাবস্যা গায়ে মাখে
কারণ আংশিক ক্ষয়ের যাপন নিয়ে
যত মানুষ জন্মক্ষণ ভুলে গেছে
তাদের আয়োজন ছিল কেবল দুঃখী হবার।
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
শারদ প্রাতে
শ্রেয়া বাগচী
আর মাত্র দুই দিন। তারপরই ঢাকে কাঠি পড়বে। রিটায়ারমেন্টের পর শহরের দক্ষিণ প্রান্তে এই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন অবিনাশ দত্ত। স্ত্রী অনুলেখা আর ছেলে আকাশ এই নিয়ে ছোট সংসার। যদিও ছেলে ফ্ল্যাট কেনার কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি পেয়ে চলে যায় অন্য শহরে। দূরে বলতে দেশের একদম অন্য প্রান্তে, পুনেতে। সুতরাং অবিনাশ-অনুলেখার নিঃসঙ্গ অবসর জীবনে ওরা দুজনেই একে অপরের সঙ্গী। ওনাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দুর্গাপুজোটা বেশ বিখ্যাত। অনেকবার সেরা আবাসনের পুজো হিসেবে অনেক নিউজ চ্যানেল থেকে পুরস্কার পেয়েছে। গতবার মহামারী-সচেতনতা নিয়ে যে থিম করলো অনেক স্বীকৃতিও পেলো ওদের এই "জীবন-যাপন" আবাসন। অবিনাশের মনে পড়ে তিনবছর আগের দুর্গাপুজোতেও ওনার এই দুই কামরার ফ্ল্যাটটা আলোকিত হয়ে উঠতো। না তা শুধু মা দূর্গা আসার কারণে নয় আকাশ ও বছরে এই একবারই আসতো বেশ কটা দিন হাতে নিয়ে। অনুলেখা-অবিনাশ দুজনে এয়ারপোর্ট থেকে গিয়ে রিসিভ করে আনতেন প্রতিবছর। সারাবছর ধরে অনুলেখা থাইরয়েড, কোমর, হাঁটুতে ব্যথা এসব রোগে কাহিল হয়ে থাকলেও ওই দশটা দিন যেন নিজেই দশভূজা হয়ে উঠতেন। ছেলে আসবে বলে দুদিন আগে থেকে রান্নার উৎসব লেগে যেত বাড়িতে। অবিনাশ দেখতেন লেখা একবার রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার বৌকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন আবার মাঝে মাঝে আকাশের ঘরে এসে ধুলো ঝেড়ে যাচ্ছেন। খাটের উপর উঠে ঝুল ঝাড়ছেন, পর্দা লাগাচ্ছেন, আরও কত কি অত কি লেখা যায় শুধু অনুভব করা যায়। খেয়েদেয়ে দুপুরে ভাত-ঘুম এর অভ্যাস অনেকদিনের অনুলেখার। তা আকাশ আসার দুইদিন আগে থেকে সেসব চুকে যেত। দুপুরবেলা বসে বসে নিরিবিলিতে ক্ষীরের মালপোয়া, লবঙ্গ লতিকা, রসমালাই এসব বানিয়ে যেতেন অনুলেখা। আর উঠতে বসতে বকা খেতেন অবিনাশ। "তোমাকে শুধু বাজারটা একটু গুছিয়ে করতে বলি তাও তুমি পারো না।সব ভুলে চলে আসো। এখন আমি ছেলেটাকে কি দিয়ে খেতে দেব বলতো? বেআক্কেলে মানুষ একদম।" বকাগুলো শুনতে কি যে ভালো লাগতো অবিনাশ এর যেন কলেজ প্রেম এর দিনগুলো মনে করিয়ে দিতো। আকাশ যেদিন আসতো অনুলেখা তার আগেরদিন মনে হয় ঘুমতোই না। সকাল হতেই এয়ারপোর্ট গিয়ে হাজির হতেন দত্ত দম্পতি সেই অপেক্ষা করতে যে কি ভালো লাগতো। আকাশ এলে তাকে এয়ারপোর্ট এই জড়িয়ে ধরে কি যে কান্না লেখার দেখেই বাবা-ছেলে দুজনেই লজ্জা পেয়ে যেত। তারপর যেন পরের দশ দিন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যেতো। সপ্তমীতে আকাশ এর স্কুল-কলেজ এর বন্ধুরা এসে আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে যেত। অষ্টমীর দিনটা অবশ্যই আকাশ এর তার মা-বাবার জন্য তোলা থাকতো। সকালে মা এর কেনা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে অঞ্জলি দেওয়া আর রাতে মা-বাবাকে নিয়ে আশেপাশের ঠাকুরগুলো দেখিয়ে আনা এই বাঁধাধরা ছিল আকাশের। নবমীর রাতে পুজোর কালচারাল অনুষ্ঠান এ আকাশ এর ঢাক বাজানোর ফার্স্ট প্রাইজটা যেন অবসম্ম্ভাবী ছিল প্রতিবার। ফ্ল্যাট বাড়ির সব কচি কচি মেয়েগুলো তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আকাশ এর দিকে লক্ষ্য করেছেন অবিনাশ অনেকবার। লক্ষীপুজোর পর দিন ছেলের রিটার্ন ফ্লাইট থাকতো। সেই কারণে আলাদা করে লক্ষীপুজো তুলেই দিয়েছিলেন অনুলেখা ওই ফ্ল্যাট এ বাড়োয়ারি যেটা হতো তাতেই থাকতেন। বলতেন "আকাশ যেবার ঘরে লক্ষী আনবে সেবার আবার পুজো হবে"। ফেরার সময় কোনোদিনই যেতেন না অনুলেখা এয়ারপোর্ট এ। অবিনাশ ঝাপসা চোখে দেখতেন ছেলেটা ভেতর গিয়ে হাত নাড়ছে। আবার আরেকটা বছরের অন্ধকার। অবিনাশ-অনুলেখা দুজনেই আকাশকে বলেছেন বহুবার বিয়ে নিয়ে। ছেলে এড়িয়ে যায়। অবিনাশ এর মনে পড়ে লেখা কত করে বলেছে "কেউ যদি পছন্দ থাকে বল আমাদের, আমরা কথা এগোই, দুই পরিবার এ কথা বলি"। কিছুই বলতো না আকাশ। কত সম্বন্ধ এদিক-ওদিক থেকে আসতো সব বলতেন ছেলেকে অনুলেখা। আকাশ বলতো "না মা আমি এখনো স্ট্যাবল হইনি। আমাকে আরেকটু সময় দাও"। সেই লাস্ট বার যেবার আকাশ এলো পুজোতে ওনারা এবার খুব জোর করলেন, চেপে ধরলেন। সেবার। হ্যা সেবারই তো। ছেলে বলে উঠেছিল সেই সাংঘাতিক কথাটা। প্রায় তিন বছর ধরে ছেলের একটা সম্পর্ক আছে। একসাথেই থাকে তারা। ভালোবাসে একে অপরকে। দুজনেই তারা পুরুষ ।"হ্যাঁ আমি আদিত্যকে ভালোবাসি বাবা"। যেরকম অবিনাশ দত্ত ভালোবেসে এলো অনুলেখা সেনকে আমিও বাসি আমার আদিত্যকে। কোনো পার্থক্য নেই। ভালোবাসায় ভালোবাসাটাই নিয়ম বাবা আর কিছু নিয়ম হয় না কোনো নিৰ্দিষ্ট পদ্ধতি হয় না। পারবো না আমি আর কাউকে ভাবতে"। কথাটা শুনে যেন মনে হয়েছিলো অষ্টমীতেই বিসর্জন হয়ে গেলো। অবিনাশ কিছু বললেন না। অনুলেখা কত বোঝালেন ছেলেকে। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবেন, ওখানের চাকরি ছেড়ে দিলেই হয়ে যাবে। এখানে ওর জন্য তো মেয়ের লাইন রয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আকাশ অবিচল। দৃঢ় -প্রতিজ্ঞ সে। অবিনাশ সেই দিন সন্ধেবেলা ছেলের হাতে খাম দিলেন একটা বললেন "কাল ভোরের ফ্লাইট এ তুমি চলে যাবে। এতে টিকিট আছে। মাস গেলে যে টাকা তুমি আমাদের পাঠাও তার প্রয়োজন নেই, এমনিতেও ওই টাকা আমরা তুলি না, জমাই হয়, আমার পেনশন দিয়ে আমাদের সাচ্ছন্দে চলে যায়। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ো। ফ্লাইট মিস যেন না হয়"। একটা ঘাড় নেড়েছিলো আকাশ আলতো করে। সেই শেষ কথা দুজনের। পরেরদিন নবমীর সকালে ছেলে ক্যাব ডেকে চলে গেলো এয়ারপোর্ট। অনুলেখার সেদিন খুব জ্বর এলো। আকাশ রোজ রাতে নিয়ম করে যে ফোন করতো বারণ করে দিলেন অবিনাশ। অনুলেখাকেও খুব কড়াভাবে নিষেধ করেছিলেন ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে। প্রথম প্রথম আকাশ অনেক চেষ্টা করলেও সেও ছেড়ে দিলো। যোগাযোগ কমতে কমতে মাসে একটা ফোনে এসে ঠেকেছিল। তাও অনুলেখাই শুধু কথা বলতেন। পাঁচ মিনিট হয়তো। বাজার-ঘাটে, পেনশন তুলতে, ডাক্তার এর ক্লিনিক এ ছেলের কথা জিগেস করলে এড়িয়ে যেতেন অবিনাশ। আকাশ এর বন্ধুদের সাথে দেখা হলে কথোপকথনে বুঝতেন ফেসবুকে যোগাযোগ আছে ওদের। আর তারা অনেক আগেই জানে আকাশ এর এই ব্যাপারটা। একটা জিনিস লক্ষ্য করেন ছেলের বন্ধুগুলো এই সব নিয়ে খুব মুক্ত ভাবধারার। যেন এমনটা তো হতেই পারে হয়ই তো। খুব স্বাবাভিক। তা সে ওরা মনে করতে পারে কিন্তু অবিনাশ পারবেন না। অন্তত এই জীবন এ তো নয়ই।
সবকিছুর একটা পন্থা থাকে, শৃঙ্খলা থাকে, থাকাই উচিত। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আর একটা পুজো আসে। কিন্তু তার আগে আসে মহামারী। অবিনাশ খবর পান আকাশের শহরের অবস্থা খুব শোচনীয়। সেই একবার ফোন করে খোঁজ নিতে বলেন লেখাকে যে ছেলে বেঁচে আছে কিনা একবার জানতে। না ঠিকই আছে আকাশ আর তার সঙ্গী এখনো পর্যন্ত। শুনে যেন ভেতরটা শীতল হয় দুজনের। সেবারের পুজোটা জৌলুসহীন হলো ফ্ল্যাট এর বাইরে, ভেতরে সব জায়গায় অনুলেখা কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলো একটু একটু করে। দিনে দু-একটা কথা যেটুকু না বললেই নয়, তাছাড়া আর ওনাদের কোনো কথা হতো না। সারাদিন লেখা পূজা-অর্চনা নিয়েই মেতে থাকতো দেখেছেন অবিনাশ। বেশির ভাগ দিন রাত এ কিছু খায় না। দিনেও আজ এই ব্রত, কাল ওই উপোস করে অনিয়ম করতো। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন অনেক স্ত্রীকে অবিনাশ। কিন্তু সবই মনে হয় বিফল হতো। সেবছর শীত থেকে শরীর একদম খারাপ হতে থাকে অনুলেখার। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো থাইরয়েড, সুগার সমস্ত। গত ফেব্রুয়ারী তে তারপর মহামারী কেড়ে নিলো অনুলেখাকে। দুজনেই ছিলেন হাসপাতালে। অবিনাশ ফিরলেন লেখাকে ছাড়াই। শেষ দেখাও হলো না। আসলে ডাক্তার রা বলেছিলেন ভেতর থেকে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন অনুলেখা। অসুখ এর সাথে লড়াই করার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিলো না ওনার। একথা অবশ্য অবিনাশ এর চেয়ে আর ভালো কে জানবেন? ঘরে ফিরে এসে ছেলেকে এই প্রথম বার ফোন করে বললেন "মা নেই। চলে গেলেন পরশু। আমি হাসপাতাল থেকে আজ ফিরলাম। তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি গুছিয়ে নেবো"। ছেলের শুধু আগের মতোই একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর "আচ্ছা বাবা"। তারপর থেকে সত্যিই নিঃসঙ্গ জীবন অবিনাশ এর। নিজের জন্য আলাদা করে ভাবতে বা করতে ইচ্ছে হয় না। সকালে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে দু একজন পুরোনো বন্ধুদের সাথে কথা, আর সারাদিনে কিছু আত্মীয় -স্বজন এর ফোন আর বই পড়া এভাবেই কাটে দিন। ভীষণ এক হয়ে যাচ্ছিলেন অবিনাশ। অনুলেখার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে কত কেঁদেছেন অবিনাশ। কত বার ক্ষমা চেয়েছেন। তবু যেন ভাঙতে পারেন না নিজের ভেতর এর সংস্কার এর পাহাড়টাকে। ভাইঝি-ভাইঝি জামাই ফোন করে বিদেশ থেকে বলে "এগুলো খুব নরমাল কাকু। আমাদের এখানে এসব নিয়ে কেউ ভাবেই না, বাধা দেওয়া তো দূরের কথা। আমাদের দেশেও তো দেখো সর্বোচ্চ আদালত স্বীকৃতি দিয়েছেন"। হাজার বোঝানোতেও বরফ গলতো কিন্তু বরফ এর পাহাড়টা সরতো না একটুও। তারপর এলো দ্বিতীয় ঢেউ। ততদিনে অবিনাশ ভ্যাকসিনেটেড। টিভিতে পেপার এ কি সাংঘাতিক, মর্মান্তিক খবর সব। অবিনাশ এর ভেতরটা সংশয়ে ভরে যায়। আকাশ এর শহরটা যেন মৃত্যুপুরী বহু ইচ্ছে হয় একবার খোঁজ নিতে আকাশ এর। কিন্তু ভেতর এর পাহাড়টা কে যেন টেনে সরাতেই পারেন না। তোলপাড় হয়ে যায় সব, শেষে একদিন ফোন করেই বসেন আকাশকে। ফোনের ওপাশে তখন আদিত্যের গলা। আকাশ গত সপ্তাহ থেকে হস্পিটালইজেড।আইসিইউতে। মহামারী গ্রাস করতে এসেছে তাকে। আস্তে আস্তে ফোনটা নামিয়ে রেখে দেন অবিনাশ। লেখা চলে যাওয়ার পর শুধু তাকে একা করে যান নি বড় বেশি ভীতু করে গেছেন। আর যেন ভয়কে জয় করার শক্তি পান না ভেতর থেকে। ঠাকুর -দেবতার ওপর অসীম ভক্তি কোনোদিনই ছিল না অবিনাশ এর। তবে উনি নাস্তিক নন।আজ একবার লেখার খুব যত্নের ঠাকুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ান অবিনাশ। চোখের জলে ভেসে যায় বুক। আপনা থেকেই হাতটা জড়ো হয়ে যায় যেন। পাশে থাকা অনুলেখার ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন "লেখা, আমি বড় একা আজ। দেখো আজ আমার একাকিত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য ও তুমি আর নেই। "ফটোটা নিয়ে একবার ভালো করে মুছে ভাবতে থাকেন, এই তো লেখা, এই তো তার কত সাধ এর সাধনার, যত্নের ঘর, সংসার গৃহস্থালি সব কিছু ফেলে চলে গেছে। ওনাকে নিঃশেষ করে। আজ আকাশ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। হয়তো সে ও ....। কি থাকবে পড়ে? কি থাকে পড়ে? উনি একা? কাকে নিয়ে বাঁচবেন? সেই পাহাড় প্রমাণ উঁচু সংস্কারটাকে নিয়ে? যেটাকে উনি রোজ কুঠার দিয়ে আঘাত করেও সরাতে পারেন না? আজ যখন জীবনের একেবারে কিনারায় এসে হিসেব করতে বসেছেন তখন কি মনে হচ্ছে না জীবন আর সেই জীবনকে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে বেঁধে থাকা মানুষগুলোর চেয়ে বড় সত্যি, বড় নিজের এই জগতে আর কিছুই নেই? কিছুটা নেই। পারবেন কি সাথে করে নিয়ে যেতে নিজের ভেতরের এই পাহাড়টা কে? কেউ তো কিছুই পারে না নিতে? তবু সারা জীবন ধরে জীবনের সাথে কি লড়াই। আজ যদি আকাশ ও? সেও কি পারবে তার সমাজের কাছে সিলমোহর এর অপেক্ষায় থাকা ভালোবাসা যার জন্য সে দূরে করে নিয়েছে নিজের মা-বাবার থেকে তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে? তাহলে? তাহলে কিছুই না। অবিনাশ ফোন করেছেন আদিত্যকে। খোঁজ নিয়েছেন নিয়মিত দুজনের। মহামারীকে হারিয়ে ফিরে এসেছে আকাশ তার আদিত্যের কাছে। অবিনাশ বুঝেছেন আকাশ আদিত্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। আকাশ তো কোনোদিনই আদিত্য ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। আকাশ এর কথা হয়েছে বাবার সাথে। ভিডিও কল এ কেঁদেছে অনুলেখার ফটো নিয়ে কেউ স্ত্রী এর জন্য কেউ মা এর জন্য । পুজো আসার দুই মাস আগেই অবিনাশ দুই ছেলের জন্য টিকিট কেটে পাঠিয়েদিলেন মেইল এ। আজ মহাসপ্তমী। মহামারীর প্রকোপে বেশ কম। আকাশ এ বাড়ি ছাড়ার পর দত্তবাড়ির ফ্ল্যাট এর সামনে দিয়ে আর টুনি ঝোলানো হয় না। এই প্রথম টুনি ঝোলানো হলো। অবিনাশ একা মানুষ। যতটা পেরেছেন ঘর-বাড়ি নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়েছেন।নতুন পর্দা এনে লাগানো করিয়েছেন ঘরে ঘরে। সাধ্য মতো বাজার করেছেন। দুই ছেলের জন্য পছন্দ করে ধুতি-পাঞ্জাবি কিনেছেন। অনুলেখার ফটোর কাছে গিয়ে জিগেস করেছেন কিছু আনতে ভুল হলো কিনা? রাতে উত্তেজনায় ঘুম হয়নি। ভোরবেলা ফ্লাইট এ ওঠার আগে ফোন করেছে আকাশ। ব্যালকনিটার সামনে গিয়ে দেখেন নবপত্রিকা স্নান এর তোড়জোড় চলছে। আকাশটা আজ ভীষণ রকম নীল। ভীষণ খোলা ভীষণ নির্মল যেন। আকাশ-আদিত্য নিশ্চয় প্লেন এ বসে গেছে। ঢাক বাজছে হালকা। কানের কাছে যেন অনুলেখা হেসে হেসে বলে যাচ্ছে "বেয়াক্কেলে মানুষ একেবারে"। মাইকে তখন বিরূপাক্ষের গলায় "শান্তি রূপেণ সংস্থিতা, ক্ষমা রূপেণ সংস্থিতা"।।
প্রবন্ধ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
সমাজ সংস্কারে তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকার ভূমিকা এবং অক্ষয়কুমার দত্ত
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী
অক্ষয়কুমার দত্ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংস্কারপন্থীরা সমাজ চেতনায় পরিবর্তন আনতে লেখনীকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সমাজ সংশোধক সুচিন্তিত প্রবন্ধাদি তাঁদের প্রধান হাতিয়ার হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র তথা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা এই উদ্দেশ্যে বাংলার পাঠকবর্গের সামনে নতুন বার্তা নিয়ে এসেছিল যা এককথায় ছিল অসাধারণ। এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পত্রিকার লেখক ও পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন সংস্কারপন্থী। উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। এই সমস্ত বিখ্যাত মানুষদের লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নবযুগের সূচনা হয় ।
১৮৪২ সালের জুন মাসে অক্ষয়কুমার দত্ত এবং টাকির প্রসন্নকুমার ঘোষের উদ্যোগে ‘বিদ্যাদর্শন’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি উচ্চমানের এবং বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ছয় মাসের পরেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা দেখে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে একটি আদর্শ পত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছা উদয় হয়। এর ফলস্বরূপ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্ম।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচনের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম সম্পাদক হয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। ১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট (১ ভাদ্র, ১৭৬৫ শক) অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্তের দেশের হিতার্থে লেখা বস্তুতত্ত্বের নির্ণায়ক প্রবন্ধ ও দর্শনমূলক মূল্যবান রচনা বঙ্গসাহিত্যের সমৃদ্ধির সূচনা করেছিল। বেদান্তসর্বস্ব ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং দর্শনশাস্ত্রের তাত্ত্বিক রচনাও এতে প্রকাশিত হত। তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত এই পত্রিকা। প্রাথমিকভাবে এটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসাবে যাত্রা শুরু করেছিল। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মহাভারতের অনুবাদ এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঋকবেদ সংহিতার অনুবাদও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই দুই অনুবাদ জনসাধারণের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাষায় তাহা অনূদিত হয়েছিল। তৎকালীন কলেজের শিক্ষিত তথাকথিত নব্যযুবকেরা এবং পণ্ডিত ব্যক্তিগণ ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলাভাষায় কোন পত্রপত্রিকা পড়তে কুণ্ঠিতবোধ করতেন। কিন্তু অক্ষয়কুমারের রচনা পাঠ করার জন্য উক্ত যুবসম্প্রদায় ও পণ্ডিতেরা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে আগ্রহের সাথে সেটি পাঠ করতেন।
অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদক হিসাবে প্রথম পারিশ্রমিক ছিল ৩৯ টাকা। দক্ষ পরিচালনার জন্য সেটা ৩৯ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সম্পাদক হিসাবে প্রাপ্য হয়েছিল ৬০ টাকা। চলার পথে অক্ষয়কুমারের সম্পাদনায় পত্রিকাটির অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। যেমন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত, সূচীপত্র সংযোজিত হয়েছিল। পুস্তক সমালোচনার জন্য একটি আলাদা বিভাগ যুক্ত করা হয়েছিল।
বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতিতে এই পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। বাঙালীর যুবকদের সামনে দিশা দেখাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাঙালীদের অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের উপযুক্ত করে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হত। সমাজ সংস্কার ব্যতীত শাসকবর্গের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী চরিত্র বজায় রেখেছিল এই পত্রিকা। অক্ষয়কুমার দত্ত সর্বপ্রথম এই পত্রিকায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা প্রকাশ করেন। এই সংবাদ প্রকাশের পরেই সকলেই জানতে পারেন কিভাবে নীলচাষীদের প্রতি ক্রীতদাসদের মত ব্যবহার করা হত। পরে তার সূত্র ধরেই হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট ’-এ তাঁর জ্বালাময়ী লেখনী ধারণ করেছিলেন।
‘ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন’-কে ছড়িয়ে দিতে এই পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল: ‘ব্রাহ্মসমাজ যাতে স্থানে স্থানে স্থাপিত হয় এবং যে রূপেতে সর্বোৎকৃষ্ট পরম ধর্ম বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার হয়, তাহার সাধন’। পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার মূলত এই পত্রিকার মাধ্যমেই হয়েছিল। ঢাকায় প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি ব্রজসুন্দর মিত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পাঠ করেই ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং স্বল্পসংখ্যক কর্মী থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের কর্মপরিধি ব্যাপ্ত হয়েছিল এই পত্রিকার সৌজন্যে। পত্রিকার মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনকালে পত্রিকার সংখ্যা হয়েছিল সাতশোর মত। ফুলস্কেপ কাগজের আকারের প্রকাশিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পৃষ্ঠার সংখ্যা ছিল আট থেকে বারো। ভাষার উৎকর্ষতার দিক দিয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সাধুভাষার পরিবর্তে চলিতভাষা প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমারদিগের, তোমারদিগের, করিবেক, যাইবেক ইত্যাদি শব্দগুলিকে তিনি সাধুভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় শুধু বিশুদ্ধ ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে রচনা প্রকাশিত হবে। কিন্তু অক্ষয়কুমার চাইতেন বিজ্ঞান ও জড়বাদী
বিষয়ক লেখাও পত্রিকায় ছাপা হবে। শেষ পর্যন্ত অক্ষয়কুমারের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাঁর সম্পাদনায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বিজ্ঞান ও যুক্তি -নির্ভর লেখা প্রকাশিত হত। এইসমস্ত সুচিন্তিত রচনার জন্য এই পত্রিকার মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। তত্ত্ববোধিনীতে প্রবন্ধগুলি নির্বাচিত করা হত ‘পেপার কমিটির’ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ। প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু ও মৌলিকত্বের জন্য শিক্ষিত সমাজের অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এই লেখাগুলি। সেইসময় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা নিম্নমানের বলে বঙ্গভাষাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন, কেউই বাংলা পুস্তক প্রকাশ্যে সাহস করে পড়ে দেখতেন না। দেখলেও গোপনে পড়তেন। কিন্তু তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত রচনাগুলির গাম্ভীর্য এবং প্রকাশনার মানের কারণে শিক্ষিত সমাজের কাছে লেখনীগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির আবেদন পাঠকদের মনে এমন রেখাপাত করত যে তার প্রভাব হত সুদূরপ্রসারী। একবার নিরামিষ খাদ্যের উপকারিতা নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ হলে বহু তরুণ পাঠক আমিষ খাদ্যাভ্যাস ছেড়ে নিরামিষাশী হয়েছিল। মদ্যপান বিরোধী লেখনীর জেরে বহু মানুষ মদ্যপান ত্যাগ করেছিলেন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যখন ‘ সংবাদ প্রভাকর’-এর সাহায্যে লেখকগোষ্ঠী তৈরী করছেন ঠিক তার পরেই তত্ত্ববোধিনীর জন্ম হয়। বঙ্গদেশের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ লেখক সমাজ এই পত্রিকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্তের রচনাগুলি শিক্ষিত সমাজের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য ছিল যে পাঠককুল সেগুলি পাঠ করবার জন্য ব্যাগ্রভাবে পত্রিকা প্রকাশের দিনটির জন্য অপেক্ষা করতেন। তাঁর সরল জ্ঞানপ্রদ রচনাগুলি বাংলার গদ্যসাহিত্যে যুগান্তর এনেছিল এবং এক ‘চারুপাঠই’ তাঁকে বঙ্গসাহিত্যে অমর করে রাখবে। বঙ্গসাহিত্যের মধ্যযুগের এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশনার মানের ক্ষেত্রেও উৎকর্ষতা বজায় রাখতে পেরেছিল। ‘প্রবন্ধ নির্বাচন কমিটি’ বা ‘পেপার কমিটি’-র অন্যতম সদস্য রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায় এই পত্রিকাটির প্রকাশনাকে আকর্ষক করার জন্য একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেছিলেন।
১৮৫৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা উঠে গেলে পেপার কমিটিও রদ হয়ে যায়। তখন এই পত্রিকার পরিচালনার ভার পড়ে কোলকাতা ব্রাহ্মসমাজের উপর। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয়কুমারের পর এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার পড়েছিল বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের হাতে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অয্যোধ্যানাথ পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তত্ত্ববোধিনী ধর্মবিষয়ক পত্রিকা হলেও এই পত্রিকা প্রথাগত হিন্দুধর্মকে প্রচার করেনি। সামনে এনেছিল নতুন যুগের যুক্তিবাদ-আশ্রিত ব্রাহ্ম হিন্দুধর্মকে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে এই পত্রিকা ছিল যুগচেতনার জীয়ন কাঠি। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিল অক্ষয় কুমার দত্তের মত যুক্তিবাদী, বিদ্যাসাগরের মত মানবদরদী এবং রাজনারায়ণ বসুর মত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন – ‘ব্রাহ্মসমাজের বিদ্যাবাগীশের ব্যাখান অনেকেই শুনিতে পায় না। তাহার প্রচার হওয়া আবশ্যক। আর রামমোহন রায় জীবদ্দশায় ব্রহ্মজ্ঞানবিস্তার উদ্দেশ্যে যে সকল গ্রন্থ রচনা করেন, তাহারও প্রচার আবশ্যক। এতদ্ব্যতীত যে সকল বিষয়ে লোকের জ্ঞানবৃদ্ধ্বি ও চরিত্র শোধনের সহায়তা করিতে পারে এমন সকল বিষয়ও প্রকাশ হওয়া আবশ্যক। আমি এই চিন্তা করিয়া ১৭৬৫ শকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশের সংকল্প করি।’
দেবেন্দ্রনাথের উক্তিতেই প্রকাশ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নীতিধর্ম প্রচার। সেইজন্য এর বিষয় ছিল সীমাবদ্ধ, বিদ্যাচর্চার দিকটা ছিল গৌণ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার উল্লেখযোগ্য কীর্তি ছিল মহাভারত ও উপনিষদের অনুবাদ ও প্রচার। যদিও এর লক্ষ্য ছিল ধর্মচেতনার উন্মেষ, তথাপি প্রাচীন ধর্মগৌরবেকে দেশবাসীর চেতনার মধ্যে জাগ্রত করার মানসিকতাই ফুটে ওঠে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রকৃতিতে সীমাবদ্ধতা থাকলেও নবচেতনা সৃষ্টিতে যথার্থ ভূমিকা ছিল। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার দত্তের মত ব্যক্তিত্ববান মনীষীরা থাকায় এই পত্রিকা দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল। অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’- এর মত লেখা এই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সমকালীন বিষয়ে রচনাও আলাদাভাবে গুরুত্ব পেয়েছে এই তত্ত্ববোধিনীতে। সেটা সম্ভব হয়েছিল অক্ষয়কুমার দত্তের প্রভাবেই।
তথ্যসূত্র –ঃ
(১) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ-শিবনাথ শাস্ত্রী
(২) বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা - শ্রী সুকুমার সেন
(৩) হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ- সুধীরকুমার মিত্র
গল্প
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
জমাদার
পাখি
দেবার্ঘ্য মুখার্জী
কাককে জমাদার পাখি বলে জানিস তো? কাঠের চেয়ারে শরীরটাকে হেলিয়ে দিয়ে বললো নিমাই দত্ত। কথাটা যার উদ্দেশে সেই সোমনাথ অবশ্য মুখটা না তুলেই বললো, আমরা পুলিশরা জমাদারদের থেকে কম কি?
নিমাই দত্ত এর ভুরুটা কুঁচকে গেল, মানে আমি তুই আমরা সবাই জমাদার?
তাছাড়া আবার কি? এবার মাথাটা তুললো সোমনাথ। শালা, কোন নরকের কিট, কোথায় কি নোংরা করে রাখছে, তাদের খুঁজে বের করো, কোনো তাকে খাঁচায় ভর, কোনটাকে টিপে পিষে মেরে ফেলো, এই তো করি আমরা, তাই না? তাহলে আর কাকের সাথে কি তফাৎ আছে? কাক নোংরা খেয়ে সাফ করছে, তাও তাদের মানুষ সম্মান না দিয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়, খেয়াল করে দেখো আজ পর্যন্ত কোনো মানুষকে পুলিশের লোককে সম্মান দিতে দেখেছো? যতটুকু করে মুখেই, পিছন ফিরলেন, চার অক্ষর দিয়ে সম্ভাষণ করে।
নিমাই দত্ত, পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসার, মুখে হালকা হাসি এনে বললো, কি হয়েছে তোর? প্রেমে প্রত্যাখ্যান নাকি বাড়িতে কেও কিছু বলেছে?
না না ওসব কিছুই না, বলে সোমনাথ।
হম হম বাবা, লোক চরিয়ে খাই, আমাকে বোকা বানাবে তুমি? মুচকি হেসে বললো নিমাই দত্ত ভালো লাগছে না গো নিমাইদা। রোজ রাতে ডিউটি পড়ছে, সারারাত ধরে, যত মদমাতালের দল ঘুরে বেড়ায়, সেগুলোকে সামলাও। তার ওপর গত পরশুদিন ওই যে বৈষ্ণব পাড়ার ফ্ল্যাটে বৃদ্ধা খুন হলো না, খুব খারাপ লাগলো যেন তো। সামান্য সাড়ে চার হাজার টাকা আর কানের দুল চুরি করতে পেরেছে, তার জন্য বুড়িটাকে মেরে দিলো?
কান খোঁচাটা কানে দিয়ে চোখটা আধবোজা করে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল নিমাই দত্ত, এবার সেটা থামিয়ে বললো "পুলিশের এত খারাপ ভালো বিচার করা চলে না", কটা দিন যাক, ডিউটি তো শিফট হবেই। তুই পারলে শেঠ রোডের দিকটা একটু রাতের দিকে টহল দিস, টু পাইস ইনকাম হবে। দেশি মদের ঠেকটা বারবার বলা সত্ত্বেও গভীর রাতের পরে খোলা থাকে।
আচ্ছা শোনো না, পরশু যে মিটিংটা আছে না, ওটার ডিউটি ডিস্ট্রিবিউশন কি হয়ে গেছে? বললো সোমনাথ না না, আজ ঠিক হবে, তুই আমাকে ওই রেপ কেসটার ফাইলটা দেখা।ফাইলটা এগিয়ে দেয় সোমনাথ, আবার ও নিজের কাজে মন দেয় সে। কাজের ফাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে নিমাইদা ঘড়িটা দেখে বললেন, নাঃ, বেরিয়ে পর ফাস্ট রাউন্ডটা মেরে আয়। আমিও এবার কোয়াটারে ফিরবো।
বাইক এ স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সোমনাথ। মাত্র আট মাস হলো পুলিশের চাকরিটা পেয়েছে সে। ওদের পাড়ার MLA স্বপন সাধুখাঁর হয়ে অনেক বছর খেটে, এটা সে জোগাড় করেছে। ওর বাড়ির লোকও বিশ্বাস হারিয়েছিল, কিন্তু স্বপনদার ওপর খুব ভরসা ছিল সোমনাথের। যখন বডি বিল্ডিং করতো, ক্লাব-এ, তখন থেকে স্বপনদাকে চেনে সে, সামান্য লোকাল নেতা থেকে, ধীরে ধীরে স্বপনদা যে ভাবে উঠে এসেছে, সোমনাথও তার রাজনৈতিক দাদার সাথে সাথে ক্ষমতা পেয়েছে অনেক। এক ধাপে, অনেকটা ওপরে চাকরিটা করে দিয়েছে দাদাই। এসব ভাবতে ভাবতে, মিত্তিরবাগান লেনের বামদিকের মোড়টা ঘুরতেই দেখতে পেলো সামনে কি একটা যেন বসে আছে রাস্তার ওপর।
আচমকা ওরম অন্ধকারে উঁচু ঢিপির মতো কি একটা বসে আছে দেখে হাতের কন্ট্রোলটা হারিয়ে ফেলেছিলো, একটু সামলে নিয়ে, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দূর থেকে একটা মানুষ আপদমস্তক চাপা দিয়ে বসে আছে মনে হচ্ছে।
আর ঠিক এই জায়গাটাতেই আলো নেই, এগিয়ে গিয়ে যে লাইট পোস্টটাতে লাইট আছে ওটার সামনেই দাঁড়িয়েছে সোমনাথ, ঘাড়টা ঘুরিয়ে পিছনে দেখলো সে।
তারপরই একদম পুলিশের ভঙ্গিতে বললো, কে রে? মরার জন্য এই মোড়ের মুখে বসে আছিস? কোনো শব্দ এলো না।
এই কথা বলিস না কোনো?
নঃ, সাড়া নেই কোনো।
ওরে ওই, মুখে কথা নেই কেন রে, কিছু চুরি টুরি করেছিস নাকি রে? দাঁড়া তো, বলেই, বাইকের স্ট্যান্ডটা বাম পায়ে ফেলে দিয়ে, সুঠাম শরীরটা নিয়ে দাঁড়ালো সোমনাথ।
কোমরে গোঁজা টর্চটা বের করে ফেললো সেই সন্দেহজনক কালো মূর্তিটার ওপর।সোমনাথের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে মূর্তিটা, আপদমস্তক পুরোনো কম্বলের মতো কিছু দিয়ে ঢাকা।
পিস্তলটা একবার হাত দিয়ে দেখে নিলো সোমনাথ, মনকে জোর দিলো, হা সেটা ঠিক জায়গাতেই আছে, দরকারে নিতে পারবে।
ওই ওই, কথা বল, নাহলে গুলি করে দেব, মুখে বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিলো, মূর্তির দিকে । হাত চার দূর থেকে, বাম হাতে টর্চ আর ডান হাতে পিস্তলটা নিয়ে মূর্তিটাকে ঘুরে সামনের দিকে এল সোমনাথ।
ওই মুখ টোল, টোল বলছি মুখ। সামনে কনফিডেন্স দেখালেও, বুকটা কেমন যেন দূর দূর করছিলো সোমনাথের।
আলোটা মুখের ওপর পড়তেই দেখলো, কোনো একটা মেয়ে। পাগলী টাগলী হবে।
কিন্তু তাও ভরসা নেই, যা দিন কাল, কে এমন পাগলী সেজে বসে আছে কে জানে। ওই কে রে তুই? এখানে কি করছিস?
সামান্য কাছে এগিয়ে মুখে আলো ফেলে দেখতে লাগলো সে, নাঃ এটা পাগলী কোনো সন্দেহ নেই, উফফ কত কি না ভাবছিলো সে, মুখে বলল ওই শালী, এখানে কোথা থেকে এলি, পিস্তলটা খাপে ভোরে নিলো সে, সরে বস এখন থেকে, আর একটু হলেই চাপা পড়ে মরতিস |
এক মুহূর্ত কি ভেবে নিয়ে, সোমনাথ এবার নিজের বাইক এর কাছে ফিরে আসে। রয়েল এনফিল্ডটা,একটা বিকট ভুমভুম শব্দ করে এগিয়ে যায়।
কিছুটা এসে, পাগলীটার কথা ভেবে মনে মনে হাসছিলো সে। মিত্তিরবাগান লেন, পূর্ব পাড়া, জানকী ঘোষ লেন হয়ে সোজা ললিত মোহন স্ট্রিট ধরে এগিয়ে গেল সে। আজ যেন শুধুই ওই পাগলিটার কথা মনে পড়ছিলো ওর। আগে তো ওটাকে দেখেনি কখনো, আচ্ছা ওটা মুখে কালী ঝুলি মেখে, বসে থাকা টেররিস্ট নয় তো? বা চুরি করতে বেরিয়েছিল, কিন্তু ওকে দেখেই ওরম নাটক করছিলো। ভালো করে না দেখে চলে আসাটা মনে হয় ঠিক হয়নি তার।এসব ভাবতে ভাবতে কখন আবার বাইকটা মিত্তিরবাগান লেনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো সে পিছন দিক দিয়ে আবার গলিটাতে ঢুকে এল সে।
বাইকটার আলোতে, দূর থেকে অন্ধকার কালো জীবের মতো লাগছে পাগলিটাকে। ঠিক সেই খানেই সেই ভাবেই, বসে আছে সে। ঘড়িটা দেখলো সোমনাথ, ১২:২০ বাজছে, পুরো পাড়াটা, থম থম করছে, সামনেই একটা নতুন ফ্লাট হচ্ছে বলে বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে| বাইকটা কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে পাগলির দিকে এগিয়ে গেলো সোমনাথ । পিস্তলটা নিলো না সে, শুধু টর্চটা জ্বলছে, পিছন থেকে, কম্বলটা এক ঝটকাতে খুলে ফেললো সে| পাগলী কিন্তু নড়লো না, ঠায় তেমনই বসে আছে, চুলটা খোলা আছে, হালকা আলোতে বোঝা যাচ্ছে সবুজ রঙের কোনো জামা পরে আছে, ডান কাঁধের দিক থেকে অনেকটা ছেঁড়া পিঠ পর্যন্ত। টর্চের আলো দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। বয়েস খুব বেশি না, ৩০ এর কম হবে। ময়লা জামা, নিচের দিকে তেমন ই ময়লা একটা সায়া পরে বাবু হয়ে বসে আছে মেয়েটা।
মেয়ে পুলিশ ছাড়া অপরাধী হলেও তাকে ধরতে পারে না সোমনাথ কিন্তু এভাবে রাস্তায় বসে কেন থাকবে পাগলীটা? আর কিছু উত্তর দিচ্ছে না ওর কথা, এটা যেন তার পৌরষত্বে আঘাত দিলো।
পুলিশের কালো পালিশ করা চকচকে বুটটা দিয়ে মেয়েটার পিঠের ছিঁড়ে যাওয়া জামার মধ্যে দিয়ে শরীরের যে অঙ্গ দেখা যাচ্ছে সেখানে ঘষতে লাগলো সোমনাথ।
একবার একবার মনে হলো, কাজটা ঠিক করছে না, কিন্তু ২৬ বছরের পৌরষত্ব নাকি সরকারি ফৌজির তেজীয়ান ঔদ্ধত্য কোনটা বেশি গুরুত্ব পেলো জানা নেই, একটা পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিলো সে। ধীরে ধীরে বুটটা ছেঁড়া অংশ দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল সে, আর এক ঝটকাতে, টান মারতেই, ফাঁস করে শব্দ করে জামাটা ছিঁড়ে গেল, জামার টানে একটু হোঁচট খেলেও, একজন যুবতীর উন্মুক্ত পিঠটা দেখতে মন্দ লাগছিলো না, ঈষৎ সরে গিয়ে, মেয়েটির লজ্জা অঙ্গের কতটা দেখা যাচ্ছে মুচকি মুচকি হেসে দেখতে লাগলো । শরীর চর্চার আখড়াতে, স্যার বলতেন, পুরুষ শরীর গঠন করে সমাজকে রক্ষা করবে বলে, তাই তো সে পুলিশ হয়েছে, সমাজকে রক্ষা করছে, তবে তার কি একজন মেয়ের সম্মান হানির অধিকার আছে? মনের অন্য কোনটা, বলে উঠলো, এ হলো পাগলী, আর কোনো সম্মান নেই, এর সাথে যা ইচ্ছা করে যায়, আর কি হলো কে জানে, সোমনাথ, মেয়েটার খোলা চুলটা ধরে টানতে টানতে নতুন ফ্লাটটার নিচের অন্ধকারে চলে গেল, একদমই অন্ধকার জায়গাটা, নরম বালির মতো কিছু পায়ে ঠেকতেই, মেয়েটাকে ছাড়লো সে। তারপর মেতে উঠলো সেই আদিম খেলাতে যা যুগযুগ ধরে হয়ে আসছে নারী আর পুরুষে কখনো বা ইচ্ছা কখনো বা অনিচ্ছায়। সময় কত গেলো কে জানে, ব্রাউন বেল্টটা খাঁকি প্যান্টের ওপরে আটকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো সে।
বেলা তখন ওই ৯:৩০ মতো হবে থানার ডিউটি অফিসার অশোকবাবু ব্যাংকের চেক হারানোর একটা রিপোর্ট লিখছিলেন এমন সময়, গদাধর আসে ঢুকলও থানায়, চোখটা একবার ওপরে তুলে বললেন, কিরে গদা?
গদাধর বললো, ছোড়দা আমাকে পাঠালও, ছোড়দার নতুন যে ফ্লাটটা উঠছে ওই মিত্তিরবাগান লেন এ, ওটার নিচে একটা মেয়ে খুন হয়ে পড়ে আছে।
অশোকবাবু, বললেন হুম, পাশে নিমাই দত্ত বসে ছিলেন, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, নিমাইদা একবার দেখুন না গিয়ে কেসটা কি।
সেদিন ঠিক সন্ধে ৬:৩০ এ থানায় ঢুকলও সোমনাথ। কনস্টবল সুবীর পাত্র ওকে দেখেই বললো, বড়বাবু আপনাকে ভিতরে একবার ডাকছেন স্যার। হাজিরা খাতায় এন্ট্রি করে অফিসার ইনচার্জ এর রুম এ ঢুকে শরীরটা টান্ করে স্যালুট করলো সে। ওসি সাহেব তখন বসে কথা বলছেন MLA স্বপন সাধুখাঁ আর বিল্ডার বিশ্বসর পাত্র ওরফে বিশুর সাথে, পাশে দাঁড়িয়ে গদাধর।
সোমনাথকে সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বললেন ওস।
কাল তোমার তো নাইট ডিউটি ছিল? কিছু দেখেছিলে?
কি দেখার কথা বলছেন স্যার? তেমন আলাদা কিছু তো ছিল না তেমন, শুধু শেঠ রোডের দিকে বাংলার দোকানটা খোলা ছিল বলে একটু কোরকে দিয়ে এসে ছিলাম, আর তো তেমন...
না না ওসব না, কোনো পাগলী দেখেছিলে মিত্তির লেন এর ওই দিকে? বা কোনো সন্দেহ জনক কেউ কে ওই মিত্তিরবাগান লেন এর ভিতরে?
কাল? উমমম একটু ভেবে নেবার ভান করে সোমনাথ, না স্যার, আমি কাল তো তেমন কিছু দেখিনি, আর পাগলী টাগলি তো একদমই না, ওই দিকে তো এনার ফ্লাটটা হচ্ছে, নিচে বালি পড়েছিল, বিশুর দিকে ইঙ্গিত দেয় সোমনাথ।
হা ওই বালির ওপর তেমন কিছু চোখে পড়েছিল? বললেন ওসি না তো, কি হয়েছে স্যার?
বিশু এবার মুখ খুললো, কোন শুয়ারের বাচ্চাএকটা পাগলীকে মেরে ফেলে গেছে আমার বিল্ডিংটার নিচেই, আর জায়গা পেলো না। স্যার এলাকার ছেলে না কেও, আমি আমার নেটওয়ার্ক এর সব্বাইকে বলে রেখেছিলাম, কেও হলে আমি তো জানতে পারতামই।
স্বপন সাধুখাঁ বললেন, না না, এলাকার ছেলে না, দূর থেকে কেও এসে করেছে কাজটা, আমার তো আবার কালকেই মিটিং আছে, আপনি আজকেই কেউ কে গ্রেফতার করুন, নাহলে বিরোধীরা আওয়াজ তুলবে, এটা আমার সম্মানহানি হবে, আমি চাইছি, কেউ কে একটা তুলে এনে ফাটকে রাখুন, আমি স্টেজ এ দাঁড়িয়ে পুলিশের তৎপরতা নিয়ে দুটো কথা বলে দেব। বুঝলেন কিছু? ওসি কে উদ্দেশ্য করে বললেন। হা স্যার, ওসি মাথা নাড়লেন। আমি উঠি, এই রাতের মধ্যে কোনো একটা হাড় হাভাতের বাচ্ছাকে তুলে এনে সাইজও করে দিন, শুনুন পাগলির খুন নিয়ে কেও ঠিক ভুলের বিচার করবে না, কিন্তু অপরাধীর সাজা হয়েছে, এটা পাবলিক সেন্টিমেন্ট এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেপার।
ওসি বললেন, প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন বলছে, রেপ করে খুন, কাল ফুল পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা হাতে পাবো, তারপর ডিএনএ স্যাম্পল টেস্ট বা ওসব কিছু একটা করে নেবো না হয়। পাগলির রেপ? ভুস, কেও ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, স্বপন সাধুখাঁ হেসে মন্তব্য করে । স্রেফ খুন করেছে মদের ঘোরে; এসব বলে দিন, আমি উঠলাম। যাবার আগে, সোমনাথের চওড়া কাঁধে হালকা চাপড় মেরে গেলেন স্বপনবাবু। হালকা হালকা ঘাম দিচ্ছিল সোমনাথের।ওরা বেরিয়ে যেতেই, ওসি বললেন, যাও তুলে নাও কোনো বেটাকে, রাতের দিকে ঘুরে বেড়ায় এমন কোনো হালকা ফুলকা অপরাধীকে তুলে আনবে, নিমাইদাকে বলে দাও, সার রাত জামাই আদর দিয়ে, কাল কোর্ট এ চালান করবে, আচ্ছা স্যার, সোমনাথ উঠে গেল।কনস্টবল দুজনকে নিয়ে জীপ এ করে বেরিয়ে গেলো সে অপরাধী আন্তে। রাত তখন ৮:৩০ মতো হবে ছিঁচকে চোর সন্তু ওরফে চিতুকে কোমরে দড়ি পড়িয়ে আনলো থানায়, চিতু থানায় এসে, অনেক কাকুতিমিনতি করে বোঝাতে লাগলো, সে কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছে, তাই চুরি করতে বেরোচ্ছে না। তাছাড়া এখন সে চুরির কাজ ছেড়েই দিয়েছে, এসব কাজে রিস্ক বেশি। বাড়িতে তেমন জিনিস পত্র লোকেরা এখন রাখেন, সব থাকে ব্যাংকে।নিমতার দিকে একটা ইঁটের পাঁজায় কাজ করছে সে। তার মালিককে ফোন করলেই জনাতে পারবে সবাই। জ্বরের জন্য সেখানেও বেশ কিছু দিন যেতে পারে নি চিতু। কিন্তু হয়, তার যে বিধি বাম সে বোঝেনি। ফাটকে তাকে ঢুকতেই হলো। প্রাইমারি রিপোর্ট লিখে নিলো সোমনাথ, ঠিক আগের দিনের মতো আজ ও সে বাইক নিয়ে নাইট ডিউটিতে বেরোলো|এদিক সেদিক ঘুরে মিত্তির বাগান লেন এ ঢুকলও সে। ফ্ল্যাটের নিচেতে দুজন কনস্টবল বসে আছে, রয়েল এনফিল্ডের আয়জে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলো। একবার বাইকটা থামিয়ে সোমনাথ বললো কিরে সব ঠিক তো? হা স্যার একজন উত্তর দিলো, এগিয়ে গেলো সে। পরদিন মিটিং এ স্বপন সাধুখাঁ বিস্তর হাততালি পেলেন, থানার ওসি সভায় ১০ মিনিট আর জন্য এসেও ছিলেন, ওনার পিঠ চাপড়ে
স্বপনবাবু বললেন, আমার আর আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আর সম্মান বাঁচালেন, আপনি। বন্ধুগণ একজন মানুষ আমাদের কাছে শুধুই মানুষ, সে সুস্থ না অসুস্থ আমরা দেখি না, আমরা চাই বিচার ব্যবস্থা সব দিক খতিয়ে দেখে, অপরাধীকে শাস্তি দিক, আবার ও হাততালি। সভার সেক্যুরিটিইর ডিউটিতে দায়িত্বে ছিল সোমনাথ আর তিনজন কনস্টবল। চিতু চোর, পুলিশের মারের ভয়ে বা অর্থের অভাবে উকিল দিতে পারলো না, তাই কোর্ট তাকে এক মাসের পুলিশ রিমান্ড এ রেখে দিলো, পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিলো। পাগলির বডি কেও ডিমান্ড করলো না, তাই সরকারি হাসপাতালের গাদার মড়ার লিস্ট এ আরো একটা লাশ হিসাবে শুয়ে থাকলো সে। মতের ওপৰ ৩-৪ মাসের মধ্যে সবাই ভুলে গেলো, কোনো নারী তার সম্মান আর প্রাণ দুটোই সেদিন অন্ধকার রাত্রিতে বালির স্তূপে শব্দহীন ভাবে ত্যাগ করেছিল, যার একমাত্র সাক্ষী হয়ে থাকলো জমাট বাধা নিকষ কালো অন্ধকার।
বিরোধী দলের একটি ছেলে মনোজিৎ ওরফে সোনাই গত কয়েক রাত ধরে খুব উৎপাত শুরু করেছে এলাকাতে। রাতের অন্ধকারে শাসক দলের ছেলেদের বাড়ি হামলা চালায়, শিবতলা মাঠের দিকে বিধায়ক আর তার সহযোগীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে পোস্টার লাগায়, কিন্তু সব থেকে বাড়াবাড়িটা করেছে গত পরশু, "এলাকার উন্নয়ন আটকে আছে বিধায়ক পুলিশের অশুভ গোপন আঁতাতে, এলাকার মানুষ গর্জে উঠুন"। সকাল থেকেই একটা মিটিং চলছিল আজ, এলাকার মানুষকে নিয়ে গভীর আলোচনাতে বসেছেন সদর থানার বড়বাবু লোকাল থানার বড়বাবু, এলাকার ডাক্তার অমূল্য ঘোষ, বিধায়ক মশাই, উকিল সীতারাম সেনাপতি সবাই বসে, কথা হচ্ছিলো, কি করা যাবে। স্থানীয় মানুষের পালসটা বুজে নিতে চাইছিলো সরকার আর পুলিশ।
চা, বিসকুট আরো না না খাদ্যের সুগন্ধে ভোরে উঠেছিল থানাটা, রিপোর্ট লিখতে যারা এসেছিলো, সবাই একবার করে, বড়োবাবুর রুম আর দিকে তাকাচ্ছিলো, সবাই চলে গেলে, স্বপনদা সোমনাথকে ফোন করে ডাকলেন পার্টি অফিসের মধ্যে ভিতরে বসে আছে জানা ২০ ছেলে ছোকরা, সবকটাই মার্কামারা ছেলে, চেনা মুখ, সোমনাথকে দেখেই বললেন, তোরা বাইরে যা, কথা বলবো আমি, ওরা বেরিয়ে যেতেই, একটা মুখ বন্ধ মোটা খাম আর ছোট্ট কাগজে, ঠিকানা আর সময় লিখে হাতে দিয়ে বললেন, আজ যেন হয়ে যায়, বড়বাবু কে বলা আছে।
রাতের অন্ধকারে, ভূপতি আর মনসুর আলীকে সাথে নিয়ে অপারেশন চালায় সোমনাথ, প্রথমে কিছুটা বাধা দিয়েছিলো সোনাই আর তার দল, কিন্তু সোমনাথকে পুলিশের লোক দেখে শেষে সারেন্ডার করলো সে, ও আসলে বুঝতে পারেনি, এটা সরকারি নয়, বেসরকারি কাজ। গ্রেফতার করার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে রাস্তাটার ওপরে বসিয়ে রেখেছিলো সোনাইদের তারপর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একটা একটা করে গুলি করে মারলো।
সোমনাথ পদোন্নতি করলো, আর বলাই বাহুল্য স্বপন সাধুখাঁর আশীর্বাদ ছিল তার মাথার ওপর তাই একই থানায় বহাল থাকলো সে।
একদিন ঘুমাচ্ছিলো সোমনাথ, ঠিক রাত ১২ নাগাদ, ফোনটা বাজলো তার, স্বপনদার নামটা ভেসে আছে মোবাইল এ, ঘুম জড়ানো চোখেই সে বললো হা দাদা বোলো, শিগগির আয় আমার বাড়ি, একা আসবি, থানায় জানাবি না।
কি হয়েছে দাদা, ঐদিক থেকে উত্তর এল না কেটে গেলো ফোন।
সোমনাথ রাত বিরেতে এমন বহুবার স্বপনদার ডাকে গেছে, বহু কাজ পর্দার আড়ালে করে এসেছে যা সরকারি নিয়মে করা যায় না।
সার্ভিস পিস্তলটা রেখে, অন্য পিস্তলটা জিনসের প্যান্টের পিছনে রেখে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মিনিট দশেক যাবার পরেই, চোখটা যেন ঘুমে বুজে আসছিলো, একটু মনটা অন্য দিকে গেছে, আর সামনে দেখলো, কি যেন দাঁড়িয়ে আছে, মারলো ব্রেক, উল্টে গেল গাড়িটা।
পিচের রাস্তায় শরীরটা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিয়ে চললো তার। একটু ধাতস্ত হতে, উঠে বসার চেষ্টা করলো সে, মাথায় এল, ধাক্কা মারলো কাকে? মরে গেলোনা তো!!
এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো, কেও নেই, ইস, ঘুমের ঘোরে কি বলতে কি দেখলাম, ব্রেকটা বাজে ভাবে মেরে ফেলেছি, হাতের চেটো দুটো ছোড়ে গেছে। একটু জল পেলে ভালো হতো।
পিছনের দিকে একটা জলের কল ছিল না, খেয়াল হতেই সেদিকে ফিরলো সে, আর দেখলো, তার থেকে হাত ৫-৬ দূরে সেদিনের সেই পাগলীটা দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে কোনো বস্ত্র নেই, খুব আস্তে আস্তে হেটে হেটে আসছে তার দিকে, দুটো পায়ের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে তার, শরীরের না না জায়গাতে কালশিটের দাগ।
সোমনাথ ভাবছে স্বপ্ন দেখছে, চোখটা মুছে নিলো সে, নাঃ, সত্যি সত্যি সেই পাগলীটা এগিয়ে আসছে তার দিকে।
উঠবার চেষ্টা করলো সোমনাথ, না, পায়ের সেই জোর নেই তার, আর হয় তো বা ৩ হাতে দূরে মেয়েটা, পিছন থেকে পিস্তলটা বের করে পর পর চালিয়ে দিলো, কিছুই লাভ হলো না, সে এগিয়ে আসছেই, সোমনাথ চিৎকার করে বললো, এই যা যা, নাহলে গুলি করবো, আমি পুলিশের লোক, যা সামনে থেকে।
আর একদম সামনে এসে যেতেই, মুখ থেকে রক্ত বমি করতে লাগলো মেয়েটা, ছলকে ছলকে উঠে আস্তে লাগলো লাল রক্ত, আর সোমনাথের সারা শরীর ভিজে যাচ্ছিলো। রাস্তার মধ্যে মুখটা বুজে গোঙাতে লাগলো সে, চোখটা খুলতে সোমনাথ দেখলো মাথায় আর পায়ে চোট পেয়েছে সে, শুয়ে আছে হাসপাতাল এর বেড এ। অনেকেই এসেছিলো দেখা করতে, স্বপনদা নিজে ফোন করেছিলেন ওর শরীর কেমন আছে সেটা জানতে, চোটটা সারতে ২ সপ্তাহ লাগলো তার।
আরো এক সপ্তাহ পরে ডিউটিতে জয়েনও করে গেলো। সামনেই ইলেকশন আসছে, তাই সরকারি কাজের পাশাপাশি, রাজনৈতিক কাজকর্ম বেড়ে উঠলো সবার। আজ খুন, কাল পাড়ায় বোমাবাজি, পরশু থানা ঘেরাও, সেই রাত্রির স্মৃতিটাও মুছে যেতে লাগলো আস্তে আস্তে করে বিল্ডার বিশুর সবকটা ফ্লাট বিক্রি শেষ, একদম নিচের তলাতে একটা ছোট্ট পার্টি অফিস করে দিয়েছে সে। সেটারই উদ্বোধন আজ। সামনেই ইলেকশন, এলাকাতে বুথ ভিত্তিক কাজ ভাগ করার পালা এবার, পুলিশের চাকরি করে বলে, সরাসরি কোনো কাজ সোমনাথকে দিচ্ছে না স্বপনদা তবে, বিরোধী পক্ষের ছেলেগুলোকে, একটু সান্টিং করে দিস তো, কিংবা, অমুক দিন ঘেরাও তমুক দিন ধর্ণা অবরোধ হলে, পুলিশের ভিতরের খবরাখবর সোমনাথ টাইম টু টাইম দাদার কানে তুলে দেয়।
উদ্বোধন শেষে, ফ্লাটটার একদম টপ ফ্লোর এ, নিজেরদের মধ্যে একটা পার্টি রেখেছিলো বিশু। মদ মেয়েছেলে, কোনো কিছু অভাব ছিল না, যুদ্ধে নামার আগে, যেমন সৈনিকদের উৎসাহ দেওয়া হতো, হয় তো তেমনই সবার অলিখে স্বপনদাই নির্দেশ দিয়েছিলো, কাজের ছেলেগুলোকে, একটু গরম করে দিতে। মদটা সোমনাথ বেশি খেয়ে ফেলেছিলো সেদিন, সবাই চলে গেলেও, সে আর একটা ছেলে তখনও ছিল ওই রুম এ। পার্টি এর শুরুতে ৪,৫ টা মেয়েছেলে রুম এ ছিল সেটা সোমনাথের মনে আছে, কিন্তু পরে কে, কার সাথে চলে গেছে সেটা সে দেখেনি, কিন্তু এখন নেশা চোখে, দূরে অর্ধেক শুয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিলো, ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, আধশোয়া করে মেঝের কার্পেটে পড়ে আছে মেয়েটা।
নেশা গ্রস্ত শরীরটা টানতে টানতে এগিয়ে গেলো তার দিকে সোমনাথ, পায়ের চেটোতে আদর করতে করতে ওপর দিকে উঠছিলো, বুকের কাছে আসতেই দেখলো, মেয়েটার শরীরে অনেক কালশিটের দাগ, একটু চমক লাগলো, মুখের দিকে তাকাতেই ভয়ে পড়ে গেল সোমনাথ, এটা তো সেই পাগলীটা। গলার কাছে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । সেদিন শক্ত হাতে ঠিক ওই ভাবে চেপে ধরেছিলো তার গলাটা সোমনাথ।
একটু সরে এসেই, পাশের ছেলেটাকে লাথি মেরে জাগাতে গেলো সে, নাঃ নড়লো না, এত নেশা হয়েছে তার, ছেলেটার নাম মনে পড়ছে না, আর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ ও এল না। স্বভাবসিদ্ধভাবেই, কোমরের ডান পাসটা দেখতে গেলো সে, নাঃ আনেনি পিস্তলটা আজ।
হামাগুড়ি দিয়ে পাগলীটা এগিয়ে আসছে তার দিকে, সেই একই ভাবে, উরু বেয়ে তার নেমে আসছে রক্ত, সেদিন রাতের কথাটা আবার মনে পড়ছে সোমনাথের, শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে মেয়েটাকে ভোগ করেছিল সেদিন সে, মেয়েটি একটা টু শব্দ করেনি মুখ থেকে, হয় তো বোবা সে, কিন্তু কোন পিশাচ তাকে ভর করেছিল সোমনাথ জানে না, মেয়েটার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা কানে আসছিলো তার, অসহ্য লাগছিলো রিন্ রিনে কান্নাটা।
একহাতে মুখটা অন্য হাতে গলাটা শক্ত পেশীবহুল হাতে চেপে ধরেছিলো সোমনাথ, গোঙানির শব্দ পাচ্ছিলো সে, পা দুটো বালির ওপর ছুঁড়ছিল মেয়েটা। তারপর থেমে গেল সবটা। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল তার বেশ মনে আছে, বাইক এ`ওঠার আগে, নিজের রুমালে সেই রক্ত মুছেছিল সে, সোমনাথের পাটা ধরেছে পাগলীটা। কালো কালো নখগুলো চেপে বসছে তার পায়ের ওপর।
আঃ করে ওঠে সোমনাথ, পাগলির কষ দিয়ে রক্ত মেশানো লালা ঝরছে চোখের মনি দুটো একদম সাদা,সোমনাথ পুলিশের ট্রেনিং ব্যবহার করে, উল্টে গিয়ে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে, একটা পাক খেয়ে সরে এসে দেখলো পাগলী নেই।
তাহলে সে কি নেশার ঘোরে এটা দেখছিলো, নঃ, গোটা ঘরে কোত্থাও নেই পাগলীটা, শুয়ে পড়লো মেঝেতে সোমনাথ, কি হচ্ছে তার সাথে এসব। একটা মাত্র ভুল করেছিল সেদিন, তার জন্য...
সিলিং এর দিকে তাকাতেই, চমকে গেল, পাগলীটা সিলিং এর ওপর মাকড়সার মতো করে ঝুলছে, ওপর থেকে তার শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্ত রস, সোমনাথের ওপর পড়ছে, বিশাল জোরে একটা শব্দ হলো, পাশের লাইট পোস্ট এ ট্রান্সফরমারটা ব্লাস্ট করলো, অন্ধকার সব দিকে। আর ধপাস করে একটা শব্দ হলো কোনো কিছু মেঝেতে পড়বার। প্রাণ বাঁচাবার জন্য হাত পা ছুড়তে শুরু করলো সোমনাথ, কোনো কিছু ঠাওর করতে পারছিলো না ও।
হঠাৎ কিসে যেন ইস্পাতের মতো কঠিন ফলা দিয়ে পিঠটা চিরে দিলো ওর, শার্টটা ফরফর করে ছিঁড়ে গিয়ে, পিঠে কিছুটা গভীর ক্ষত হয়ে গেলো, যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে গেল সোমনাথ।দরজাটা খুলতে হবে তাকে, অন্ধকারে, ছুটোছুটি লাগলো সে, মোবাইল ফোনটাও হাতের কাছে পেলো না খুঁজে, এই নিকষ কালো অন্ধকারে একবার এই দেওয়াল তো একবার ওই দেওয়ালে ধাক্কা খেতে লাগলো, একবার সাউন্ডবক্স এর তারে পা জড়িয়ে পড়ে গেলো সে, মাথাটা ঠুকে গেলো, কাঁচের বোতলে, কাঁচ ভেঙে কপাল ভেদ করে ঢুকে গেল তার, উফফফ মাগোওও করে আর্তনাদ করলো সে, চুপচাপ সব কিছু, কিন্তু কিছু একটা ঘরের মধ্যে ঘুরছে, বেশ ভালো বুঝেছে সোমনাথ,
এমন সময় টান পড়লো গলাতে, ইলেকট্রিকের তারটা গলায় কিভাবে প্যাঁচ লেগে গেছে তার, জানলার দিকে কিসে যেন টানছে তাকে। জিভটা বেরিয়ে আসছে ওর, দুই হাতে তারটা ছাড়াবার চেষ্টা করছে সে, ঠিক তখনই দেখলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সোনাই, কপালের ঠিক মদ্ধিখানে গুলির ক্ষতটা এখনো টাটকা, সোমনাথের কষ্ট দেখে সে হাসছে।সেদিন রাত্রিরের কথাটা মনে পড়ছে সোমনাথের, সোনাইরা শুধু কয়েকটা প্ল্যাকার্ড আর লাল রঙের কৌটো নিয়ে বেরিয়েছিল, সাথে দুজন সঙ্গী ছিল তার, তাদের সাথে ছিল শুধু মোটা লাঠি, তাই এক কোথায় তারা নিরস্ত্র ছিল বলাই যায়, সেখানে সোমনাথ, ভূপতি আর মনসুর আলীর কাছে অটোমেটিক পিস্তল ছিল, সঙ্গী ছেলে দুটো হাতের লাঠি নিয়ে তেড়ে গেছিলো ওদের দিকে ঠিকই, কিন্তু সোনাই নিজেই মানা করে তাদের। সোমনাথকে উদ্দেশ্য করে বলে, স্বপনদা এর সাথে তুই আমি একসাথেই কাজ করতাম, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য এখন আলাদা, তুই চাকরি পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত, হয়ে আদর্শের কথা হয় তো বা ভুলে গেছিস, কিন্তু আমি এখনো সেই একই আছি। আজও মানুষের দুঃখে আমার মন কাঁদে রে সোমনাথ। দিনের পর দিন, এলাকার জমি দখল, আর গরিবের শোষণ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়ে বিরোধী দলে নাম লেখালাম, তুই সরকারি কর্মচারী, জানি বাধ্য হয়েই গ্রেফতার করছিস, তবে পুরোনো সঙ্গীকে মিথ্যা মামলাতে ফাসাবি না বিশ্বাস রাখি।সোমনাথ তখন ওদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে। এবার ইশারা করে বসতে বললো।
সোনাইরা বসে যেতে, পিছন থেকে গুলি করে মারে তাদের। পুরোনো বন্ধুর কথাটা রেখেছিলো সোমনাথ, মিথ্যা কোনো কোনো মামলাই করেনি তার নামে, উল্টে সোনাইয়ের নাম একজন রাজনৈতিক দুষ্কৃতকারীর দলে লিখিয়ে দিয়েছিলো সে। পুলিশের খাতায় রেকর্ড হয়ে থাকে, নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারার সমস্যা নিয়ে খুন হয়েছে কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী সোনাই। এই কাজের জন্য বেশ গর্ব হয় তার, কিভাবে একা হাতে এত বড় অপারেশনটা সারলো সে, দুঃখের একটাই যে সরকারি তকমা ছিলো না এটাতে, নাহলে একটা মেডেল তো বাধা ছিল তার।
এবার আঘাত এল, শরীরের নিচের অংশে, সেই ধাতব কঠিন নখের মতো কি যেন তার মোটা জিনসের প্যান্টটা ফালাফালা করতে দিতে লাগলো, আর পারছে না সোমনাথ, ওরম দানবের মতো চেহারা তাও, যন্ত্রণাতে, দুম দুম করে পাটা ছুড়ছে মেঝের ওপর, নরম ফরাস পাতা আছে মেঝেতে, শব্দ হচ্ছে না তাই, শুধু রক্ত ঝরে সাদা ফরাসের রং টা লাল হয়ে যাচ্ছে।
ঘরের মধ্যে অনেকগুলো কালো কালো মূর্তির মতো কিছু যেন দেওয়াল বেয়ে ঘুরছে, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে বেশ চেনা লাগছে সোমনাথের, নকুল ওরফে হাত কাটা নকুল, দাগি আসামি ছিল, আর একজন শিবু, বিরোধীদলের হয়ে কাজ করতো, আরেকজন বটুক সোনাইয়ের ভাই, সেদিন রাত্রিতে রং আর তুলি হাতে ওই ছেলেটাই পোস্টার লাগাচ্ছিল দেওয়ালে। এদের মধ্যে একটাই মিল, এরা সবাই মৃত, আর সবারই মৃত্যু হয়েছে সোমনাথের হাতে, নানা সময়ে, আজ না জানি কোন অন্ধকার গহবর থেকে উঠে এসেছে এরা।সোমনাথের শরীরটা নেতিয়ে থেমে গেল, কালো কালো মূর্তিগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলো ঘর থেকে।
"খবর যখন তখন" এর মহিলা সাংবাদিক, বলছেন, গভীর রাত্রিতে, মদ্যপ অবস্থাতে, মার্ পিট্ বেঁধে যায় মিত্তিরবাগান লেনের বহুতলের টপ ফ্লোর এ দুই ব্যাক্তির মধ্যে, আমাদের কাছে খবর আছে, তাদের মধ্যে একজন পুলিশ কর্মচারি ছিলেন, নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে ওনাকে, অন্য ব্যক্তিটি এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী, স্থানীয় বিধায়ক আমাদের জানিয়েছেন, খুব কড়াভাবে তদন্ত করার নির্দেশ নীতি দিয়েছি, এইভাবে একটি ফাঁকা বহুতলের মধ্যে ওরা কিভাবে উঠে এসেছিলো, এবং কোনোই বা এই খুন? অনেকে বলছেন এটা হলো আগামী নির্বাচন কে লক্ষ করে এলাকাতে ত্রাস সঞ্চারের চেষ্টা, যদিও বর্তমান নির্বাচিত সরকার, এই এলাকাতে পুনরায় জিতে আসার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।ক্যামেরা তে রাজীব সেনের সাথে আমি পিয়ালী "খবর যখন তখন"।
কবিতা
ভাস্কর সিনহা
দোহা, কাতার
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
হিসাবান্তে
আলো জাগলেই
আমি আর আমি
এই, তাই সবের
বয়স্থ লেজুড়খানি।
উদ্ধত সেই পথে
মিয়ম্রাণ বাকী কুশীলব।
গর্বে কভু হলে ফাঁকি
দুনিয়া জুড়ে কম্পভূমি।
আত্মজতে শুধু বর্মাভাস-
অন্তরের শ্বাস-মাষের
না রয় নির্যাস।
বেলান্তে ঘনালে
আঁধার-
মুখোমুখি,
আমি আমার।
কি ছেড়েছি,
কি পেয়েছি-
হিসাব মিলিয়ে নেবার।
জানি আমি
দিয়ে ফাঁকি
খোলসখানা শক্তপোক্ত।
অন্তরে বাস
করিছে জেনো
চূড়ান্ত এক রিক্ত।
হঠাৎই যদি
হঠাৎ যদি তোমায় পেতুম
দামোদরের ধারে।
হঠাৎ যদি চমকাতো বাজ
শুভ্র আকাশ মাঝে।
কৈশোরের সেই মোহাবেশ
ছোটায় প্রমত্ত ঘোরে।
একবারনা পাগলামি সব
মেলে ধরতুম পাখায়
রঙবেরংএর বর্ণচ্ছটায়
প্রজাপতির মায়ায়।
কি যে চাব, কি যে পাব
জানিনে তার হিসেব।
সঙ্গী শুধু মনের সাথে
চক্ষে চক্ষে ভাসার।
ভালো থাকিস-
মজায় থাকিস!
এই তো বলি শুধু।
অন্ধকারে একটি কোণে
আপনি আপনমণি।
দিগন্তে বিলীন
ফুটপাথে ঝেঁপে
নামে সাঁঝ।
আঁধার এলানো বেলায়
হঠাৎ আগুন-
জ্বলে- পুড়ে খাক
কৈশোরের স্বপ্নগোলা-দিন।
ঘোরা-ফেরা মনখারাপ।
টুকটাক্
টুংটাং প্রেয়সীর গালি।
শালওয়ার, মার শাড়ি টাঙ্গাইল।
দলা দলা কিছু অস্থিভস্ম
ছড়িয়ে যাবে উত্তরে, পূবে, পশ্চিমে-
যেদিকে খুশী
হাওয়াসঙ্গী মনে।
দুদিনের এই রাগ,
ক্রোশ, আবেগ-
প্রশমিত হয়ে যাবে-
রমণে, আশ্লেষে
লোভে, হীনতায়।
দুহাতে কুশ্রীতা মেখেছি কতো-
ক্ষুদ্র তরঙ্গে বিলীন মহাবিশ্বে।
সব আছে, সব থাকে
আজানুলম্বিত ভূমে।
না জানা, মুখচোরা,
সুরতাল বিলীয়মান
দিগন্তছোঁয়া পটে।
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রবন্ধ
অনবদ্য লিওনার্দো ও
মানসী মোনালিসা অনিশা দত্ত
লেখিকা পরিচিতি:
প্রাঃ অধ্যাপিকা (ফলিত গণিত), বর্ধমান উওমেন্স কলেজ, নামী পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখিকা শিক্ষা মূলক পুস্তক, শিশু-কিশোর পুস্তক, গল্পের বই, স্কুল -কলেজ পাঠ্য পুস্তক প্রণেতা, রাজী ক্লাসিক্স -এর অনুবাদক, আকাশ বাণী কলকাতায় প্রাঃ কথক, 'বিজ্ঞান মেলা' পত্রিকার প্রাঃ প্রধান সম্পাদক
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির উল্লেখমাত্র প্রথমেই মনে পড়ে, Monalisa বা ফরাসী ভাষায় La Gloconda অর্থাৎ উচ্ছলা। তবে, চিত্রশিল্পী তাঁর দ্বিতীয় পরিচয়। তিনি ছিলেন Polymath বা বিশ্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর, সর্বগুণ বিশারদ ও অনন্য কীর্তিমান।
আকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠব ও অতুল্য রূপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, Vinci শহরে। পিতl ঐশ্বর্যবান Fruosino di Antonia da Vinci। মাতা কৃষক কন্যা Caterina। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মাতুলালয়ে মায়ের কাছে মানুষ। ১৪৫৭তে পিতার কাছে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষায় ল্যাটিন, জ্যামিতি ও গণিত। চোদ্দ বছর বয়স থেকে Andrea de Verrochio-র কাছে অঙ্কন শৈলীর শিক্ষানবিশীতে ছিলেন। বিশ বছর বয়সে Florence -এর Guild of St Lake -এ Master Artist এর স্বীকৃতি পান।
তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, ধীমান গণিতজ্ঞ, নিপুণ স্থপতি, অন্যতম প্রযুক্তি বিশারদ, ভূবিদ, জীববিজ্ঞানী, আবহাওয়াবিদ। প্রথম রোবট তিনি তৈরী করেন। ফরাসী সম্রাটের দরবারে সেই সিংহ রোবট সভা পেত। যেটি সম্রাটকে অভিবাদন করতো। প্রথম হেলিকোপটার তৈরীর পরিকল্পনাও তাঁর। সেলাই মেশিনে এর অটোমেটিক ববিন, ওয়াশিং মেশিনকে দ্রুতগতি ঘোরানোর কায়েদা তাঁর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ।
দ্বিতীয় পরিচিতিতে, তিনি অমর চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও সংগীতজ্ঞ। শুধুমাত্র অসাধারণ পেইন্টার নন, ছিলেন অসামান্য নকশাকার, স্থানীয় সমস্ত ক্যাথিড্রালের, গম্বুজ, মিনার, মনুমেন্টের প্ল্যানিং তাঁর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।
বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণায়, তাঁর ১৩,০০০ পাতার নোটবুকে লেখা ও ড্রয়িং লিপিবদ্ধ আছে। প্রাণী-উদ্ভিদ প্রকৃতির শিলা বিন্যাস ইত্যাদির অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণ শুধু অঙ্কনে নয়, যন্ত্র উদ্ভাবনায়ও কাজে এসেছে। লেখক-গবেষক তো ছিলেন। বিজ্ঞান ভিত্তিক অনুশীলনের সিংহভাগ বর্তমানে Bill Gates এর সংরক্ষণে রয়েছে। বছরে একবার সেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয়। একটি মানুষের মধ্যে এতো রূপ, গুণ, মেধা, বৈশিষ্ট্য ও কৃতিত্বের সমাবেশ, পৃথিবীতে দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে নেই। তিনি যেন প্রকৃতির বরপুত্র।
ঘূর্ণীঝড়ের পূর্বাভাসও তাঁর জ্ঞানের পরিধিতে ছিল। তাঁর অংকিত চিত্রে সুস্পষ্ট ঘূর্ণীঝড়ের অঙ্কন শৈলী, বর্তমানে স্যাটেলাইট ক্যামেরা থেকে গৃহীত চিত্রের অনুরূপ। বাল্যকালে তাঁর বাসস্থানের ওপর দিয়ে তোলপাড় করা ঘূর্ণীঝড় প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
Arono নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। সারা Florence শহর ছিল বন্যা কবলিত। Bellin Zones এর কাছে আল্পস থেকে নেমে এসেছিলো বিরাট ধ্বংস। এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইতিহাস গ্রাহ্য, প্রামাণ্য দলিল সমেত। তিনি নোটবুকে লেখেন, পাহাড় -উপত্যকা ভেঙে পড়েছিল, সাত মাইল জুড়ে তৈরী হয়েছিল হ্রদ। ঘূর্ণীঝড়ের তুলির টান কল্পনা প্রসূত নয়, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ।
সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি ছবি হলো, 'মোনালিসা' ও 'লাস্ট সাপার'। আরেকটি বিখ্যাত পেইন্টিং হলো, 'ভার্জিন এন্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যান', প্রাকৃতিক দৃশ্যপট তুলনাহীন। মেরী তাঁর জননী অ্যান -এর কোলে বসে আছেন ও অ্যান ঝুঁকে আছেন শিশু যীশুর দিকে। ছবি গুলি বাঁকাভাবে আঁকা, যেটি ছবির পৃথক বৈশিষ্ট্য। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রাখা এই ছবির মুখমন্ডলের সঙ্গে মোনালিসার মুখমন্ডলের সাদৃশ্য আছে।
'ষ্টার অফ বেথেলহেম' এর একটি বিশাল চিত্র (১৬০ সে মিঃ/১৪০ সে মিঃ) রঙিন কাগজে কালো চক দিয়ে আঁকেন এই ড্রয়িংগুলিতে গণিতজ্ঞের জ্যামিতি-ভিত্তিক কুশলী রেখাবিন্যাস। যেহেতু এনাটমি - বিশেষজ্ঞ ছিলেন, মানুষের দৈহিক গঠনের সাযুজ্য তাঁর অঙ্কনে এসেছে। একাধিক ড্রয়িং এ ক্যারিকেচার বা ব্যঙ্গমূলক চিত্র পাওয়া গেছে। কথিত আছে, যখনি তাঁর চোখে কোনো মুখের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়তো, তিনি তাঁকে অনুসরণ করে তাকে পর্যবেক্ষণ করতেন। 'মোনালিসা' প্রতিকৃতিটি ইতালিয়ান সম্ভ্রান্ত মহিলা লিসা গেহেরাদিন এর। তিনি বিশাল বিত্তশালী সিল্ক ব্যবসায়ী Francesco Gioconda -র পত্নী। প্রস্তাব ছিল তাঁদের দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম উপলক্ষ্যে ওটি নতুন গৃহের ড্রয়িং রুমে শোভা পাবে। 'মোনা' ইতালিয়ান শব্দের অর্থ সৌজন্যে সম্বোধন 'ম্যাডাম'।
১৫০৩ থেকে শুরু করে তাঁদের গৃহেই, অনবদ্য চিত্র মোটামুটি শেষ হয়েছিল, ১৫০৭-এ।তবু শিল্পী তাঁর শ্রেয়তম চিত্রে তুলির টান দিয়ে গেছেন আমৃত্যু। তিনি যখনি যেখানে যেতেন, এটি সাথে নিয়ে ভ্রমণ করতেন, কখনো কাছ ছাড়া করেনি।
'মোনালিসা' ছবির আসল মাপ '৩১/২০.৮"। Louvre গিফট শপে, সাধারণত: যে পোস্টার পাওয়া যায়, তার মাপ এর চেয়ে বড়। ১৯১১-এ আসল ছবি চুরি হয়ে গেছিলো। দুবছর পর এটি ফ্লোরেন্স হোটেলের ঘরের এক ট্রাঙ্কের গোপন কক্ষ থেকে উদ্ধার হয়।
'মোনালিসা' বিশ্বের অন্যতম সৃষ্টির সিংহাসনে। মোনালিসার হাসি দ্য ভিঞ্চি কোডের ঐতিহাসিক রহস্য ঘন অথবা নিগূঢ় চক্রান্তের সংকেত।
কলাবিশারদদের মতে, মোনালিসার মুখাবয়ব পুরুষ ও রমণীর সংমিশ্রণ। হিন্দুদের অর্ধ নারীশ্বরের কল্পনা নয়, একই আননে, পুরুষের কাঠিন্য ও রমণীর কোমলতা মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোনালিসার পশ্চাৎপটে বাঁদিকের ও ডানদিকের নীচের সীমারেখা একই সরল রেখায় নেই, রয়েছে ওপর নীচে। বামদিকের লাইন, ডানদিকের লাইন থেকে নীচু করে আঁকা, যার জন্য বাম দিক থেকে দেখলে, মোনালিসাকে আকারে বড় দেখায়। ওষ্ঠের দুটি প্রান্ত ও আঁখি পল্লবের সীমানা বিন্দুগুলিতে নিপুণ তুলির ছায়াঘন টানে যে রহস্য আনীত, তাতে তার হাসির সঠিক প্রকৃতি নির্ণয় দুরূহ। পেইন্টিং ও ড্রয়িং, দুয়েতেই ছিলেন সিদ্ধহস্তl জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন Left Hander, কিন্তু উভয় হস্তই সমান নৈপুণ্যে ব্যবহার করতে পারতেন। অর্থাৎ সব্যসাচী। 'মোনালিসা ' বাম হস্তের শিল্পকলা।
কিন্তু শেষ জীবনে বাম হাত খানিক অকেজো হয়ে যাওয়ায়, 'মোনালিসা' এ শেষ তুলির টান গুলি ডান হাতের।
লিওনার্দোর ধারণায়, মানবাত্মার পূর্ণ বিকাশ হতেই পারে না, যদি তাতে পৌরুষ ও নারীত্ব দুটি গুণই অর্জিত না হয়। অসামান্য বুদ্ধিমত্তা ও নৈপুণ্যের অধিকারী হওয়ায়, ছবির মধ্যে চতুর সংকেত ও ধাঁধার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। লিওনার্দোর 'স্বপ্রতিকৃতি' ও 'মোনালিসা', এই দুয়ের কম্পিউটার বিশ্লেষণে, উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্যিত হয়েছে। সর্বাংশে পুরুষ বা নারী নন, উভয়ের সার্থক সংমিশ্রণ। 'MISS -MASTER PIECE' :
উদ্দীপনা ও উর্বরতার প্রতীক মিশর-এর দেবতা হলেন 'Amon' ও দেবী 'Isis'। 'Isis' এর পৌরাণিক নাম পিক্টোগ্রাফে লেখা হতো 'Lisa'। দুটি শব্দের যোগে দাঁড়ায়, Amonlisa। খুব সহজ Anagram বা অক্ষর পরিবর্তনে দাঁড়াবে 'Monalisa'। বিজ্ঞানীর গভীরজ্ঞান ও শিল্পীর সূক্ষ চেতনা দুয়ের মেলবন্ধনে তাঁর আত্মোপলব্ধি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছবিটিতে চোখের পাতা অদৃশ্যপ্রায় এবং আবছা ভ্রূ-যুগল, কারণ বারবার পরিষ্কার করার কারণে এগুলি ক্ষতিগ্রস্ত।
বর্তমান কম্পিউটার 'মোনালিসা'র হাসির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, ৮৩% সুখী, ৯% বিরক্ত, ৬% ভীত, ২% রাগী। বলা যেতে পারে, ১% এর কম নিরপেক্ষ এবং ০% আধ্যাত্মিক। ১৫১৭তে তিনি ফ্রান্স থেকে আবার ছবিটিকে নিয়ে ইতালি আসেন। ১৫১৯-এ তাঁর প্রয়াণের পর সহকারী শিল্পী Salai অকৃতদার লিওনার্দোর শিল্পকর্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পান। তিনি লিওনার্দোর পরম মিত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী ফ্রান্সের সম্রাট ফ্রান্সিস ১ কে একসহস্র স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রয় করেন। তারপর থেকে ছবিটি ফরাসী রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন অংশে শোভা পেত। ফরাসী বিপ্লবের সময় এটিকে প্রাসাদেই গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর Louvre museum -এ আনীত হয়।
'মোনালিসা' অঙ্কনের দশ বৎসর পূর্বে লিওনার্দো এক তরুণতর 'মোনালিসা'-র ছবি এঁকেছিলেন। এই 'ইতিপূর্বা মোনালিসা' কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে এক প্রদর্শনীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এটি বিশ-বাইশ বছরের তরুণী মোনালিসা। প্রথমে এটিকে নকল মোনালিসার ধারণায় জুরিখের ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বিশেষজ্ঞগণ বাতিল করে দেন।
২০১৩-তে কার্বন টেস্টিং-এ সুনিশ্চিত হওয়া গেছে, এটিও দ্য ভিঞ্চির হস্ত নৈপুণ্যের শিল্প কর্ম। ষোড়শ শতকের গোঁড়ায় এটি আঁকা হয়। তার দশ বছর পর বিশ্ববন্দিত মোনালিসার সৃষ্টি। মূল ফ্রেমে ফাটল ধরায়, নতুন ফ্রেম লাগানো হয় ১৮৮৮ ও ১৯০৫-এ নিপুণ নবীকরণ হয়।লিওনার্দোর জীবনীকার Giorgio Vasar।
পৃথিবীর ইতিহাসে, সর্বোচ্চ বীমাকরণ 'মোনালিসা' ছবির। ১৯৬২-র মূল্যায়নে, দশ কোটি লক্ষ ডলার, ২০১৮-র মূল্যায়নে পঁষট্টি কোটি লক্ষ ডলার।
ছবিটি বর্তমানে bulletproof কাঁচের আধারে নিয়ন্ত্রিত তাপ ও শৈত্যে সংরক্ষিত আছে।বছরের পর বছর ছবিটি প্রেমপত্র ও কবিতায় অভিনন্দিত হয়ে এসেছে।
রম্যরচনা
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
পাদ সমাচার
বাসব রায়
বেসরকারি হাইস্কুল শিক্ষক
রাজবাটি , দিনাজপুর , বাংলাদেশ
'পাদ' একটি অন্যতম জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া৷ এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবে যতদূর ধারণা হয় তাতে মনে হয় পরিপাকতন্ত্রে খাদ্য হজম পদ্ধতির সাথে নিঃসৃত এসিডের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান এবং সেজন্যই গ্যাসজাত একটি ঘটনা ঘটে যা দুর্ঘটনা হিসেবে আমাদের সামনে 'পাদ' বলে পরিগণিত হয়৷ নির্জন স্থানে এই কাজটি নিরাপদে সাড়া যায় তবে জনাকীর্ণ স্থানে বিষয়টি একটি অস্বীকৃত অসামাজিক কাজ বলে মনে করা হয় যদিও এমন ভাবনা ভাবা মোটেই উচিত নয়৷
সাধারণত: প্রচলিত শিষ্টাচার অনুযায়ী এটিকে তিনস্তরে ভাগ করা যায়৷ যেমন (১) নীরব ক্ষরণ, (২) হালকা ফ্লুট সিস্টেম এবং (৩) সশব্দে ক্ষরণ৷ এসব প্রক্রিয়ার সাথে একটি গন্ধ জাতীয় বাতাসেরও উদগীরণ হয় যা কখনই সুগন্ধি বিশেষ হয় না৷ বেশিরভাগক্ষেত্রে নীরবক্ষরণ প্রক্রিয়ায় উৎকট গন্ধ নির্গত হয় যা খুবই অশোভনীয় একটি বিষয়৷ দ্বিতীয়ত: হালকা ফ্লুট সিস্টেমটা কিছুটা হারমোনিয়ামের 'পা' বা কোমল 'ধা'(দা)-র রিটের মতন একবার চাপ দিলে যেমনটি আওয়াজ বের হয়৷ এই হালকা ফ্লুট সিস্টেমে কিছুটা দুর্গন্ধ থাকে৷ সর্বশেষ প্রক্রিয়াটি বড়ই জটিল৷ সাধারণত:বাদ্যরত ঢাক বা ঢোলের চামড়া হঠাৎ ফেটে গেলে যেরকম আওয়াজ বেরোয় ঠিক তেমন শব্দের সৃষ্টি হয় তবে এই জোরালো শব্দযুক্ত পাদ প্রক্রিয়ায় গন্ধের সন্ধান কম পাওয়া গেছে আজ পর্যন্ত৷ যেহেতু প্রক্রিয়াটির সম্পূর্ণ কার্যক্রম এবং সংঘটিত স্থানটি পশ্চাৎদেশ তাই এটি একটি সেনসেটিভ আত্মসম্মানজনিত বিষয়ও বটে এবং বিশেষভাবে লজ্জাজনক কাজ৷ নীরবক্ষরণ প্রক্রিয়াটিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়৷ বিভিন্ন স্বাদের দুর্গন্ধ নিঃসৃত হতে পারে৷
পঁচা বা বাসি, কোষ্টকাঠিন্যজনিত জমাট ভারী গন্ধেরও আভাষ পাওয়া যায়৷ আফটারঅল বিষয়টি মোটেই সুখকর নয়৷ দ্বিতীয় ফ্লুট সিস্টেমটাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজেকে লুকানো কঠিন হয়ে পড়ে৷ স্বভাবগতভাবেই আমরা লোকজনের সামনে এই প্রক্রিয়াটি সারতে চাই না৷ কিন্তু নির্গত বায়ুচাপটি অধৈর্যবশতঃ নির্গত হলে ভেঁপুর মতো বেজে ওঠে যা নেহায়েতই একটা কেলেঙ্কারি বটে৷ বিশেষত: শেষতক যে প্রক্রিয়াটি এটি সবসময়ই সম্মান হানিকর৷ প্রসঙ্গত: সাউন্ডসিস্টেমটি সাধারণত বয়স অনুপাতে নির্ধারিত হয়৷ প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে পুলিশের সামনে কোনো এক ব্যক্তির সশব্দ পাদের জরিমানা করা হয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র৷ জীব বৈচিত্র্যের মাঝে এই প্রক্রিয়াটি আবহমানকালের একটি ঐতিহ্য৷ বস্তুত: এই প্রক্রিয়া থেকে প্রাণীকুলের আমৃত্যু নিস্তার নেই৷ কম হোক বা বেশি হোক এটা সবার ক্ষেত্রেই নির্ধারিত৷ যাহোক, এই পাদ প্রক্রিয়া বর্তমান সময়ে প্রাণীজগৎ ছাড়াও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা দিয়েছে৷ শব্দহীন এবং দুর্গন্ধ শূন্য পাদ সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বরাবরই চলমান৷ কে কার ওপর কখন পাদ ছুঁড়ে দিচ্ছে তা উপলব্ধি করা বেশ কঠিন৷ দলাদলি বা বৈষম্যজনিত কারণে পাদ পদ্ধতিটির প্রচলন ক্রমাগত বেড়েই চলছে৷ জীবের পাদ প্রক্রিয়া ক্ষতিকর যতখানি তার চেয়ে ঢের ক্ষতিকর সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পাদ৷ রাষ্ট্রপদ্ধতি গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক হোক রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর পরস্পরের ওপর নিয়মিত পাদ চালিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা সকলেই এসব নীরব শব্দহীন পাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার৷ একটু কৌশলী হলে পার্সোনাল পাদ নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণ নেই তবে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কিম্বা বৈশ্বিক পাদ নিয়ে একটা উৎকণ্ঠা থেকেই যায় -৷
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
স্বপ্ন
যখন সত্যি
অদিতি সুর
"ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে..."
নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে গুনগুন করে গান করাটা রঞ্জনাদেবীর অনেকদিনের অভ্যাস।গান গাইতে ওনার বরাবরই ভালো লাগে। ইচ্ছা ছিল ভালো গানের মাস্টারের কাছে গান শিখে গলাটাকে আরও খোলতাই করার। ছোটবেলা অবশ্য ওনার ইচ্ছা দেখে ওনার বাপি ওনাকে ওনার পাড়ার সুবীর নন্দী স্যারের গানের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সকালে উঠে উনি তখন রোজ মন দিয়ে রেওয়াজ করতেন। বিকেলেও স্কুল থেকে ফিরে এক ঘন্টা রেওয়াজ ছিল ওনার রোজের রোজনামচা। বাপি মা ওকে খুব উৎসাহ দিতেন। তখন টুকটাক পাড়ায় সরস্বতী পুজোর ফাংশান কিম্বা দুর্গাপুজোর বিজয়া সম্মিলনীতে গান গাইতেন রঞ্জনাদেবী।গান শেষে শ্রোতাদের করতালি শুনে ওনার মতো ওনার বাপিও ভীষণ খুশি হতেন। স্কুলের ফাংশানগুলোতেও তখন শিক্ষিকারা ওনাকে আগে গান গাইতে ডাকতেন। ঠাম্মি অবশ্য বাপির ওনাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা একদমই পছন্দ করতেন না। উনি মুখ বেঁকিয়ে বলতেন "এসব তবু নিজের ছেলের জন্য করতিস খোকা তাও মানতাম। এসব শিখে মেয়ে কি করবে শুনি? সেই তো ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে আর পরের ঘরে গিয়ে এইসব জলাঞ্জলি দিয়ে উনুনের আগুনে সব বিসর্জন দেবে।"
ওর বাপি অবশ্য ঠাম্মির এসব কথায় কোনদিনও পাত্তা দিতেন না। উনি হেসে বলতেন" আমার মেয়েকে সেই ঘরেই বিয়ে দেবো যারা ওর গানের কদর করবে।"
কিন্তু সব সুখ হয়তো সবার ভাগ্যে সহ্য হয় না। রঞ্জনাদেবীর হয়নি। ক্লাস এইটের ফাইনাল অঙ্ক পরীক্ষার দিন হঠাৎ ওনার বাপির শরীর খারাপ হয়। ডাক্তার বদ্যি ডেকেও খুব একটা লাভ হয় না। একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে সব শেষ হয় যায়।তার সাথে রঞ্জনাদেবীর সব স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে যায় চিরকালের মত।
দাদা চলে যাওয়ার পর তিন দেওর বিধবা বৌদি আর ভাইজির ভার নিতে রাজি হলেন না।এসব ঝামেলা অহেতুক নিয়ে নিজেদের মাথাব্যথা করতে তিনজনই অস্বীকার করেন। রিংকুর ঠাম্মিও ছেলেদের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেন না বা বলা ভালো বলতে চাননি।অগত্যা ওঁর মা ওদিকের সব পাট চুকিয়ে দিয়ে ওকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে আসেন।
রঞ্জনাদেবীর মায়ের বাপের বাড়িতে দাদু দিদিমা ছাড়া ছিলেন এক অবিবাহিত মাসি। তিনি জন্মান্ধ। বাপির গত হওয়ার পর সেখানেই এসে মা মেয়েটা আশ্রয় নেয়। ওঁর দাদু ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক, তাই তার পেনশনের টাকায় তখন এতগুলো মানুষের পেট চলতো।তবে তখনকার দিনে পেনশন এখনকার দিনের মত বেশি ছিল না। তাই গান শেখা তখন এক নিছক আয়েশিপনা ছাড়া আর কিছুই না। রঞ্জনাদেবীর মা ফলস পিকো আর টুকটাক সেলাই করে সংসারে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। রঞ্জনাদেবী কোনরকমে বারো ক্লাসের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই ওর জন্য ভালো ছেলে দেখে মা ওর বিয়ে দিয়ে দেন।ততদিনে দাদু গত হয়েছেন। দিদিমার শরীরও তথৈবচ। সব মিলিয়ে সংসারের অবস্থা বেশ খারাপ।এমত অবস্থায় মেয়েকে কলেজে পড়ানোর থেকে পাত্রস্থ করতে পারাটা রঞ্জনাদেবীর মায়ের কাছে অধিক জরুরী বলে মনে হয়েছিল। তাই রীতিমত ঘটক দেখে ওকে পাত্রস্থ করা হয়। মাত্র উনিশেই বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে আসেন রঞ্জনাদেবী।
*************
"কি গো জলখাবার কি হলো?"
"হ্যাঁ আনছি।"
স্বামীর ডাকে তাড়াতাড়ি লুচি বেলতে লাগেন রঞ্জনাদেবী। আজকাল বড়ো একঘেয়ে লাগে ওনার সবকিছু। আগে কত উৎসাহ নিয়ে সংসারের সব কাজ উনি করতো। বয়স তো আর কম হলো না ওঁর। তা প্রায় পঞ্চাশ। স্বামীর থেকে বারো বছরের ছোট উনি। তাই স্বামী কোনদিন ওঁর তেমন বন্ধু হতে পারেন নি। সবসময় একটা দূরত্ব থেকেই গেছে দুজনের মধ্যে।
লুচিগুলো ভেজে গরম সাদা আলুর তরকারি বাটিতে সাজিয়ে টেবিলে নিয়ে আসে রঞ্জনাদেবী। সাদা আলুর তরকারি আর লুচি খুব ভালোবাসেন ওঁর স্বামী অশোক। তবে আজ পর্যন্ত কোনদিন এই নিয়ে একটা প্রশংসা করতে শোনেনি রঞ্জনাদেবী।
"তোমাকে একটা মিষ্টি দেবো?"
পেপার দেখতে দেখতে গরম লুচি ছিঁড়ে আলুর তরকারির বাটিতে ডুবিয়ে খাচ্ছিলেন অশোক। রিংকুর কথার উত্তরে শুধু "না" বলেন।
"বলছি পাপাইরা কখন আসবে গো আজকে?"
"সন্ধ্যে ছটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। আসতে আসতে এক ঘণ্টা আরো লাগবে। কেন?"
গম্ভীর হয়ে বলেন অশোক।
"না এমনি। ওদের জন্য একটু ভালো মন্দ বানাতে হবে। দিদুন খুব ডিম ভরা ট্যাংরা মাছের ঝোল খেতে ভালোবাসে। বাজার থেকে ওটা মনে করে এনো কিন্তু। সাথে বেগুন আর অবশ্যই চালকুমড়ো।"
"আচ্ছা।"
আজ রিংকুর একমাত্র ছেলে পাপাই, বৌমা সুমি আর ওর আদরের একমাত্র নাতনি রিয়া আসবে ওঁর বাড়িতে। ওরা দুবাইতে থাকে। ছেলে বছরে একবার পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে বাড়িতে আসে। তবে এবার পাকাপাকিভাবেই দেশে ফিরছে। এখানেই বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। যদিও বৌমার তেমন একটা আসার ইচ্ছা ছিল না। রঞ্জনাদেবী বৌমার মনের কথা বুঝতে পেরেই ওদের দু -একদিন এই বাড়িতে কাটিয়ে বাড়ির পাশের পাড়াতে ছেলের জন্য কেনা ফ্ল্যাটেই ওদের থাকতে বলেছেন। উনি চান ওরা যেন ওদের মত করে ভালো থাকে। সবসময় ঝামেলা অশান্তি থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসেন রঞ্জনাদেবী।
তবে নাতনিটা বড়ো নেওটা ওনার। ওর জন্যই খারাপ লাগে একটু। বৌমা আবার ওনার সাথে বেশি মিশতে দেয় না নিজের মেয়েকে। বড়লোক বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে সুমি।ডাকসাইটে সুন্দরী সাথে উচ্চ শিক্ষিতা আর চাকুরীরতা। মফস্বলে বেড়ে ওঠা কম পড়াশুনা জানা আনস্মার্ট শাশুড়ির কোন গুণই তার কখনোই চোখে পড়ে না। অবশ্য এর মধ্যে তেমন কিছু দোষ দেখেন না রিংকু। পাপাই নিজেই যখন মাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। তার কাছে তার বাবার মতামতটাই আসল। তার কাছে মা শুধু আছে রান্নাবান্না আর বাকি সংসার সামলানোর জন্য। তবে রঞ্জনাদেবীর এটা দেখে ভালো লাগে যে নাতনিটা ক্লাস সেভেনে পডলেও সে তার মা বাবার মতো নাক উচুঁ না। রিয়া কাউকে কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না।*****
তবে নাতনিটা বড়ো নেওটা ওনার। ওর জন্যই খারাপ লাগে একটু। বৌমা আবার ওনার সাথে বেশি মিশতে দেয় না নিজের মেয়েকে। বড়লোক বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে সুমি।ডাকসাইটে সুন্দরী সাথে উচ্চ শিক্ষিতা আর চাকুরীরতা। মফস্বলে বেড়ে ওঠা কম পড়াশুনা জানা আনস্মার্ট শাশুড়ির কোন গুণই তার কখনোই চোখে পড়ে না। অবশ্য এর মধ্যে তেমন কিছু দোষ দেখেন না রিংকু।
পাপাই নিজেই যখন মাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। তার কাছে তার বাবার মতামতটাই আসল। তার কাছে মা শুধু আছে রান্নাবান্না আর বাকি সংসার সামলানোর জন্য। তবে রঞ্জনাদেবীর এটা দেখে ভালো লাগে যে নাতনিটা ক্লাস সেভেনে পডলেও সে তার মা বাবার মতো নাক উচুঁ না। রিয়া কাউকে কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না।
সমস্ত রান্নাবান্না সেরে সন্ধ্যেবেলা একটু বসার সময়ই পাপাইরা বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।রঞ্জনাদেবী অনেকদিন পর ওদের দেখে ভীষণ খুশি হন। দুদিন হৈ চৈ করে কেটে যায় ওদের। তারপরে পাপাইরা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যায়। রঞ্জনাদেবীও আবার নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আগের মত।
ছেলে রোজই বাবাকে ফোন করে কথাবার্তা বললেও মায়ের সাথে তার খুব একটা কথা বলার সময় হয় না। আর এখানে এসে বৌমা আবার নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। সে কখনোই নিজের শাশুড়ী মাকে ফোন করার সময় পায় না। তবে রিয়া রোজ দিন স্কুল থেকে ফিরে এসেই ঠাম্মাকে ফোন করে।
এরকম একদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে রিয়া রঞ্জনাদেবীকে ফোন করে।
"হ্যালো ঠাম্মি।"
"বলো দিদুন। তুমি কখন ফিরলে।"
"এই তো ফিরলাম। তুমি আগে বলো তুমি কি জানো পরশু কি ডে?"
"কি দিদুন?"
"পরশু উইমেন্স ডে। তাই আমার স্কুলে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।"
"আমি! আমি তোমার ইস্কুলে গিয়ে কি করবো দিদুন? আমি তো ইঞ্জিরিতে কথাও বলতে পারিনা।"
"উফ দিদুন। এত চিন্তার কিছু নেই। আমাদের একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে উইমেন্স ডে উপলক্ষে।আমাদের বলেছে তোমার দেখা তোমার প্রিয় ওম্যানকে কাল স্কুলে নিয়ে যেতে। তোমাদের সেই প্রোগ্রামে কিছু একটা গিফট দেবে। আর আমি টিচারদের বলেছি তুমি খুব ভালো গান গাও।তো আমার গানের টিচার রিকোয়েস্ট করেছেন তুমি যেন কাল প্রোগ্রামে একটা গান গাও।"
"অ্যা! সেকি! আমি গান গাইবো তোমার ইস্কুলে?"
"হ্যাঁ। আমার জন্য এটুকু করবে না ঠাম্মি?"
"আমি গান গাইতে ভালো পারিনা..."
"এসব তুমি একদম বলবে না। আমি তোমাকে গুনগুন করে গান গাইতে শুনেছি। ইউ আর অ্যান awsome সিঙ্গার।"
"কি যে বলো দিদুন! কিন্তু তোমার মা যাবেন তো দিদুন আমাদের সাথে।"
"মা এখনো জানে না প্রোগ্রামটার ব্যাপারে। কিন্তু আমি পুরোটা বললে নিশ্চয়ই যাবে।"
রিয়ার ফোনটা রেখে দিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যান রঞ্জনাদেবী। এই বয়সে অত লোকের সামনে কি করে যে উনি গান গাইবেন ভেবেই ওনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সেই কোন ছোট বয়েসে উনি স্টেজে গান গেয়েছেন। তখন স্টেজে ওঠার আগে বাপি ওনাকে সাহস দিতেন। আজ এত বছর বাদে আবার গান গাওয়া। সেটা কি সম্ভব! মানে উনি কি পারবেন ঠিকভাবে গাইতে? নিজের মনকেই প্রশ্ন করেন রঞ্জনাদেবী। এদিকে নাতনিটার কথা মনে পড়তেই মনে জোড় আনেন উনি। রিয়া কষ্ট পাক সেটা উনি একদমই চান না।
পরদিন সকালে রিয়া রঞ্জনাদেবীর বাড়িতে চলে আসে ওনাকে ওর সাথে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য।এদিকে সারারাত টেনসন করে ঠিকভাবে ঘুমানও নি রঞ্জনাদেবী। রিয়াকে একা বাড়িতে আসতে দেখে উনি ওকে জিজ্ঞেস করেন "তোমার মা যাবেন না দিদুন?"
"না গো। মাম্মার যেন আজ কি সব কাজ রয়েছে অফিসে।"
ছেলের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় রঞ্জনাদেবী সুমিকে ফ্ল্যাটের গেটের সামনে দাঁড়ানো দেখতে পান। উনি হাসি মুকে সুমিকে জিজ্ঞেস করেন,
"বৌমা তুমি যাচ্ছ না কেন আমাদের সাথে?"
ওর কথায় মুখ বেঁকিয়ে সুমি বলে "আপনি যান আপনার নাতনির সাথে। তার আমাকে এখন দরকার পড়ে না সেটাই দেখতে পাই।"
রঞ্জনাদেবী বুঝতে পারেন বৌমা ওনার নাতনির স্কুলে যাওয়াটা ভালো চোখে দেখছেন না।তবে রিয়ার জেদের জন্য হয়তো কিছু বলতেও পারছে না।
**************
অনুষ্ঠানে পৌঁছে রঞ্জনাদেবী রিয়ার সাথে সামনের সারিতে গিয়ে বসে। রিয়ার গানের ম্যাডাম এক এক করে সব অভ্যাগতদের স্টেজে ডেকে একটা করে ফুলের বোকে আর গিফট দেন নারী দিবস উপলক্ষ্যে। তারপর প্রিন্সিপাল ম্যাম নারী দিবস উপলক্ষে ভাষণ দেন। তার ভাষণের পরেই শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। উপস্থিত সকল দর্শকদের মধ্যে অনেকেই গান নাচ কবিতা আবৃত্তি করেন। একদম শেষের দিকে রঞ্জনাদেবী গান গাইতে স্টেজে ওঠেন। উনি একটা রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। হলে উপস্থিত সকল দর্শক ওনার গলার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে ওনার গান শুনতে থাকেন। ওনার গানটা শেষ হতেই রিয়ার প্রিন্সিপাল ম্যাম ওনাকে আর একটা গান গাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করেন। উনি আর কি করেন। আর একটি রবীন্দ্রসংগীত সাবলীল ভাবে সকলকে গেয়ে শোনান।
অনুষ্ঠান শেষে সকলেই ওনার গানের অনেক তারিফ করতে থাকেন। রিয়া ওর ঠাম্মার পুরো গানের অনুষ্ঠানটা মোবাইলে রেকর্ড করে রাখে। তারপর ও ওনার সাথে নিজের সব বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেয়। রিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড সৌমিলি রঞ্জনাদেবীকে প্রণাম করে রিয়াকে বলে "ইউ আর লাকী রিয়া উওর ঠাম্মা ইস আ ওয়ান্ডারফুল সিঙ্গার।"
রিয়া হেসে বলে "আই নো। সি ইস দা বেস্ট গ্র্যান্ড মাদার ইন দা ওয়ার্ল্ড।"
গাড়িতে উঠে ও রঞ্জনাদেবীকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বলে "ইউ আর বেস্ট ঠাম্মা।"
অনেক দিন পর এতজন দর্শকের সামনে গান গাইতে পারে আনন্দে, উত্তেজনায় রঞ্জনাদেবীর চোখেও জল চলে আসে।
রিয়া উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে ওর মাকে ফোন করে।
"হ্যালো মাম্মা"
"আজ প্রোগ্রাম কেমন হলো?"
"Awsome মাম্মা। ঠাম্মা আজ গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। এত ভালো গান গেয়েছে ঠাম্মা কি আর বলবো! আমি এখনি তোমাকে, পাপাকে আর দাদুকে ঠাম্মার ভিডিওটা পাঠাচ্ছি।"
জীবনে প্রথম এত সম্মান,ভালোবাসা পেয়ে ভীষণ খুশি হন রঞ্জনাদেবী। নিজের একরত্তি নাতনির চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে উনি বলেন "ধন্যবাদ দিদুন। তুমি অনেক বড়ো হয়ো। আরো বড়ো মনের মানুষ হও।"
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
রাখহরির রান্না
রূপা মন্ডল
হাওড়া, পশ্চিম বঙ্গ
(১)
বুড়োদার বিয়ের সময় একজন আমাদের বাড়িতে রান্নার ঠাকুর হিসেবে এসেছিলো তার নাম রাখহরি। রাখহরির সঙ্গে এসেছিলো তার তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট| সেদিন রাখহরির রান্না যারা যারা খেয়েছিলো আজও দেখা হলেই বলে সেকথা - "মুখে লেগে থাকার মতো!"
রাখহরি তখন আমাদের এলাকায় একচেটিয়া রান্নার কাজ করে যাচ্ছে। সবাই বলতো রাখহরি মা অন্নপূর্ণার বর লাভ করেছে। তাই সে যাই রান্না করুক না কেন, অসাধারণ হয়ে যায়।রাখহরির রান্না করা বিভিন্ন পদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেয়েছি তার মধ্যে সুক্ত, পায়েস, মুড়িঘন্ট, ছোলার ডালের হালুয়া প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাখহরির বাড়ি ছিল মেদিনীপুরে। সে সর্বক্ষণ মুখে পান ঠেসে রাখতো। তার সঙ্গে থাকতো একটা রুপোর কৌটো। তাতে তবক দেওয়া পানের খিলি থাকতো। মাঝে মাঝে একটা খিলি বের করে মুখে চালান করে কাঁধের গামছায় হাত মুছে আবার সে কাজে মন দিতো।
রাখহরিকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বায়নাক্কার সীমা থাকতো না - কিন্তু রাখহরি সব হাসি মুখে সামলে নিতো। কোনো জিনিসের যোগান না থাকলে সে অন্য জিনিস দিয়ে এনে দিতো আকাঙ্ক্ষিত স্বাদ। প্রত্যেকটি অভ্যাগত না খাওয়া পর্যন্ত রাখহরি কোনো কিছু মুখে তুলতো না। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে রাখহরি অনুষ্ঠান বাড়ির কমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা জমাত। সে দলে আমরাও পড়তাম।
(২)
- সে এক দিন ছিল বুঝলে খোকা। গ্রামের মাতব্বররা মিলে মিটিং ডেকে ঠিক করত কার অনুষ্ঠান বাড়িতে কি কি রকমের রান্না হবে। এক একটা অনুষ্ঠানে অন্তত: পঞ্চাশ রকমের পদ। মোচার ঘণ্ট থেকে শুরু করে মাছের বাটি চচ্চড়ি পর্যন্ত। সেই সময়ে বিভিন্ন ধরণের ঘণ্ট রান্না শেখার জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল 'ঘণ্ট' গ্রামে। সেখানে সব বাড়িতে প্রতিদিন কোন না কোন ঘণ্ট রান্না হয়। সে এক মজার ব্যাপার বুঝলে!
- ঘণ্ট গ্রামের নাম কখনও শুনিনি তো? সে কোথায় গো?
- সে অনেক দূর। বাঁকুড়া জেলা থেকে আরো দুশো কিলোমিটার যেতে হয়। পোস্তর চাষ হয় সেখানে। ঘণ্ট আর সাদা পোস্ত সেখানকার লোকজন প্রতিদিন খায়।
- তা তুমি কি কি রান্না শিখলে সেখানে?
- অনেক কিছু। ঘণ্ট, সাদা পোস্ত, আমের মোরব্বা দিয়ে চাটনি, বিউলীর ডালের ধোঁকা, পোস্ত-বড়ির সাতকাহন, মাছের সরুচাকলি, গয়নাবড়ির ঝাল-টক, মোতিচুরের পায়েস – আরও কত কি।- তারপর?
- তারপর আর কি? যখন বাড়ি ফিরে এলাম, আমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল স্বয়ং জমিদার মশাইয়ের কাছ থেকে। জমিদার গিন্নী তো ভীষণ খুশী। আমি বহাল হ'লাম তাঁদের খাস মহলের রান্নাঘরে। তার আগে সেখানে মহিলা ভিন্ন কোন পুরুষ প্রবেশ করত না।
- তারপর?
- আমাকে খাস মহলের খাস বাবুর্চি নিয়োগ করায় চাকরী গেল বহু পুরনো বামুনদি মোক্ষদার। সে তো প্রথমে অনেক কান্নাকাটি করল, হাতে-পায়ে ধরল গিন্নিমার। কিন্তু জমিদার মশাই অনড়। তখন মোক্ষদা আমাকে অভিসম্পাত দিতে লাগল। আমি পড়লাম দোটানায়। একজন গরীব মেয়ের চাকরী যাবে, তাও আমার জন্য – আমার সহ্য হচ্ছিল না। পরের দিন বললাম জমিদার মশাইকে, "বাবু, ওকেও রাখুন, গরীব মানুষ, চাকরী চলে গেলে বিপদে পড়বে।" জমিদার মশাই মোক্ষদাকেও রাখলেন তবে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে। মোক্ষদা তাতেই রাজি। সেও আবার বহাল হ'ল চাকরীতে। জমিদার মশাইয়ের বাড়িতে প্রায়ই অন্যান্য জমিদার মশাইরা কিংবা সাহেব-সুবোরা আসত। তারা এলেই আমাকে জমিদারমশাই বলতেন, "রাখহরি, মান রাখতে হবে কিন্তু। অবশ্য আমি জানি তুমি তা পারবে।" আমার যত রকমের বিদ্যেবুদ্ধি আছে উজার করে দিতাম। সবাই খুব প্রশংসাও করত।
কিন্তু বাধ সাধল ইংরেজ আমলের শেষে জমিদার প্রথার সমাপ্তির পর। সেই জমিদারীও রইল না, আর জমিদারবাবুও সেই শোকে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গত হ'লেন। শরীকী বিবাদে জমিদারীর চিহ্নমাত্র রইল না। তাই তো বলি বাবু, মানুষের দিন কখনও একরকম যায় না। সব পাল্টায়, রুচি থেকে রুজি, টাকা থেকে ফাঁকা – সব। শুধু রয়ে যায় স্বাদের স্মৃতি। কোথায় কবে কোন ভাল খাবার খেয়েছিলে – ঠিক তা মনে থাকে ।
এই বলে রাখহরি তার ঝোলা ব্যাগ আর পানের কৌটোটা নিয়ে উঠে পড়ে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে।।
ভ্রমণ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
সবুজের কোলে
একমুঠো অবসর
সৌমেন্দ্র দরবার
বাগুইআটি,কলকাতা
গ্যালারী - ১
জঙ্গল কি ভালো লাগে? সবুজ মেখে সময় কাটাতে? কিন্তু হাতে তো সময় নেই? তার ওপর বাজেট খুব কম। অথচ চাই মজা, নিরিবিলি, নির্জনতা আর সঙ্গে এডভেঞ্চার। আচ্ছা শাল, সেগুন, বাবলা, মেহগনি, হিজল, মহুয়া আর সবুজ বাঁশঝাড় যদি স্বাগত জানায়। মন্দ হয় না, তাই না। গাছের ডালে নিকষ কালো ফিঙেদের দোল খাওয়া। দূরে নাম না জানা হলুদ পাখির শিস দিতে দিতে উড়ে যাওয়া। গাছের মগডালে একঝাঁক টিয়ার গোপন মিটিং। নির্জন জঙ্গলের রাস্তায় হঠাৎ বনমুরগীর পালিয়ে যাওয়া অথবা হলুদ ছোপ হরিণদের লুকোচুরি।
পায়ে পায়ে জঙ্গলকে নিরীক্ষণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে রাস্তার ধারের মাচায় একটু জিরিয়ে নেওয়া। রং বেরঙের প্রজাপতি ও ফড়িংদের শরীরে বুলিয়ে দেবে স্নেহের পরশ। শীতের রোদে জঙ্গলের মাঝের জলাশয়ে ঘড়িয়াল আর বিরল প্রজাতির কচ্ছপের রোদ পোহানো দেখতে দেখতে ভালোই লাগবে।
এডভেঞ্চারের শখ থাকলে গাছের ডালে উঠে পূর্বপুরুষদের মতন চারিদিক অবলোকন করতে পারেন। বড়ো দীঘির ধারে চিপস বা বাদাম খেতে খেতে উপলব্ধি করতে পারেন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা আর পাতার সন সন আন্দোলন। পড়ন্ত বিকেলে দেখা হয়ে যাবে ছোট্ট কাঠবেড়ালী আর মিষ্টি খরগোশের সঙ্গে। বৌ কথা কও বলে যাবে আমিও আছি কিন্তু!
ঘড়িয়াল পুকুরের আবাসিক অনেকেই, নানা মাপের। কেউ কেউ ডাঙায় রোদ পোহায়, আবার কেউ কেউ জল থেকে মাথা বের করে রাখে শিকারের সন্ধানে। বেথুয়ার এই জঙ্গলে আছে চিতল হরিণ, শজারু, মেছোবিড়াল, বনবিড়াল, বুনো খরগোশ, বেজি, ভাম ইত্যাদি। আছে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ময়ূর, বাজ, পেঁচাও। তা ছাড়া দেখা মিলবে রংবেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির।
রাস্তার ওপর হঠাৎ সর্পের সাক্ষাতে ভয় পাবেন না, ওরা কিন্তু কারো ক্ষতি করে না। জঙ্গলের বুনো ফুলের গন্ধ করে দেবে মাতাল। সন্ধ্যার জনমানবহীন জঙ্গলে সঙ্গীর সাথে অথবা সপরিবারে হাঁটার সে এক অন্য অনুভূতি। গ্রীষ্মকালে শীতল হাওয়া আর শীতকালে শীতবুড়ির কামড় দুটোই অতি মনোরম।
এরই মধ্যে কখন যে সূর্য ঝুপ করে বিদায় নেবে বুঝতেই পারবেন না। পায়ের নীচে শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ যে পরিবেশ তৈরি করে তা শুধুই উপলব্ধি করতে হয় বলে বোঝানো যায় না। চাঁদের রুপোলি আলো জঙ্গলের ওপর বিছিয়ে দেয় শ্বেতশুভ্র চাদর। কটেজের দরজা খুলে দেখবেন মৃগরা আপনার অতিথি। রাতের খাওয়া সেরে জঙ্গলে খানিক পায়চারি নিস্তব্ধ, শান্ত, মোহময় অথচ অনাবিল উপলব্ধি। রাত গাঢ় হলে ঘুম ভেঙে শুনবেন শিয়ালের ডাক। জানালায় হরিণদের শিঙ এর টোকা পেয়ে ভয় পাবেন না, ওরা শাকাহারি, মাংসাশী নয়। নিকষ কালো অন্ধকারে ঝিঁ ঝিঁ দের ডাক এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।পরদিন ভোরে জঙ্গলের সূর্যোদয়, গাছের ফাঁক দিয়ে নেমে আসছে সূর্যের বারি ধারা। শীতোষ্ণ উত্তাপ আপনার শরীর ভিজিয়ে দেবে। জঙ্গলের মাঝে বনবিভাগের তৈরি নিদিষ্ট জায়গায় দেখতে পাবেন কয়েকশো হরিণের নিঃশব্দ প্রাতরাশ। সাবধান শব্দ করা একদম নিষিদ্ধ। ছোটদের জন্য কটেজের কাছেই আছে ছোট পশুআলোয়। সেখানে আছে নীলগাই , ময়ূর, কাকাতুয়া আর ও অনেক কিছু।
আর আছে বাটারফ্লাই গার্ডেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নামে নামাঙ্কিত প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র এবং সংগ্রহশালা।
এবার কৌতূহল নিবারণ। নদীয়া জেলার ৩৪ নং জাতীয় সড়কের ওপর কলকাতা থেকে ১৩৭ কিলোমিটার দূরের অভয়ারণ্য বেথুয়াডহরী। শান্ত, নির্জন দূষণ-হীন সবুজের কোলে দু দিন ছুটি কাটানোর অনবদ্ধ ঠিকানা। ১৮৫ একর জায়গা জুড়ে তৈরি অভয়ারণ্য সবুজের ডালি আর পশু পাখির সম্ভার নিয়ে আপনার অপেক্ষায়।
পথের ঠিকানা: কলকাতা থেকে বহরমপুরগামী বাসে বা গাড়িতে ৩৪ নং জাতীয় সড়কের ওপর বেথুয়াডহরী। সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। শিয়ালদা থেকে লালগোলাগামী ট্রেনে বেথুয়াডহরী স্টেশন। সেখান থেকে টোটো বা রিক্সায় বেথুয়াডহরী অভয়ারণ্য।
গৃহের ঠিকানা: ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেটস ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির নন এ সি কটেজ। ভাড়া সাধ্যের মধ্যে।
রসনাবিলাস: ঘরোয়া খাবার। চাইলে খেতে পারেন দেশি মুরগি কিংবা কচি পাঁঠা।
ভ্রমণকাল: অক্টোবর থেকে মার্চ। বর্ষাকালে না যাওয়াই ভালো। পোকামাকড়ের উৎপাত।
গ্যালারী - ২
প্রবন্ধ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
উপনিষদ - ১
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
শিক্ষকদিবস ফুল-চন্দন আর বক্তৃতার বিভূতি নয়.... মুন্ডকো উপনিষদ বলছে- মহাশাল অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ গৃহস্থ শৌনক একবার আচার্য অঙ্গিরসের কাছে 'বিধিপূর্বক' উপস্থিত হয়ে বললেন--
"কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীত।"
শৌনক মহাগৃহস্থ কারণ তিনি সংসারের মধ্যে থেকে সংসার ধর্ম পালন করলেও তাঁর মনে কোনো মালিন্য ছিল না। বরং তিনি ছিলেন সকল সদগুণের অধিকারী। 'বিধিবৎ' বলতে শিষ্য যখন 'উপসদন'- এ বা গুরুগৃহে যাবেন তখন তিনি রিক্ত হস্তে যাবেন না। তিনি যাবেন সমিৎপাণি হয়ে। অর্থাৎ যজ্ঞকাঠ নিয়ে যাবেন। গুরুগৃহ যাত্রায় এই প্রথাকে বিধিবৎ বলা হয়েছে। তাই শৌনক সমিৎপাণি হয়ে ঋষিবর অঙ্গিরসকে প্রণাম জানিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন--
"কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীত।"
কোন বস্তুকে জানলে সমস্ত বিজ্ঞেয় বস্তু বিজ্ঞাত অর্থাৎ বিশেষরূপে জ্ঞাত হওয়া যায়?
সেকালে গুরুগৃহে গুরুর পায়ের কাছে বসে নিতে হত শিক্ষা। উপনিষদ কথার অর্থ হল- আচার্যের কাছে বসে শিক্ষা। গুরুগৃহ হল উপসদন। শিষ্যের নিজ গৃহ ছেড়ে শিক্ষা লাভের জন্য গুরুগৃহে যাত্রা- ব্রহ্মচর্য। এই ব্রহ্মচর্য যাত্রায় শিষ্য সমিৎপাণি হয়ে উপসদনে যান।
শিষ্যের সমিৎপাণি হওয়ার একটি দিক গীতায় উল্লেখ আছে। ব্রহ্মচর্য আসলে গুরু সেবা করে তাঁর প্রসন্নতা লাভ করে বিনম্রতার সঙ্গে তাঁর কাছে প্রশ্ন নিবেদন করা।
গীতা বলছে--
"তিদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।"
প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন ও সেবা এগুলো হল শিষ্যের ধর্ম। শিষ্য আচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা পরায়ণ হবেন। তাই শাস্ত্র বলছে 'শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম।'
আচার্যের প্রতি বিশ্বাস,তাঁর প্রজ্ঞায় আস্থাটুকু না থাকলে শিষ্য আচার্যর কাছে হাত পাতবে কি কারণে! তিনিই অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যেতে পারেন এই আত্মবিশ্বাসে, শিষ্য গুরুর চরণে নিজেকে নিবেদন করে দেবেন-এই হল শিক্ষার পূর্বশর্ত। আবার শিষ্যের মধ্যে থাকতে হবে অপার অনুসন্ধিৎসা। নিরবিচ্ছিন্ন জিজ্ঞাসা।
"অসতো মা সদগময়" -- এই হবে শিষ্যের প্রার্থনা।
সে অন্তর দিয়ে চাইবে অসৎ অর্থাৎ অপূর্নতা থেকে সৎ অর্থাৎ পূর্ণতায় উত্তীর্ণ হতে। সমিৎপাণির অন্য আর একটি তাৎপর্য রয়েছে---
সমিৎ বা কাঠটি হল ইন্ধনের প্রতীক, যার মধ্যে আগুন ঘুমিয়ে আছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী মধ্যেও লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা। মানুষের মধ্যে সুপ্ত ভাবে নিহিত থাকে যে পূর্ণতা শিক্ষা হল তারই প্রকাশ। আচার্যের পরিচর্চায় সেই পূর্ণতার প্রকাশ ঘটে। শিষ্য হল অধর-অরণি, নিচের কাঠ আর গুরু হল উত্তর অরণি, উপরের কাঠ।
শিষ্য নিজেকে পেতে দেবে, বিছিয়ে দেবে, নিবেদন করে দেবে গুরুদেবের চরণে। শিষ্য অর্থাৎ নিচের কাঠটি নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে আর উপরের কাঠটি থাকবে সক্রিয়। উপরের কাঠটি নিচের কাঠটির উপর অবিরাম ঘর্ষণ করতে থাকবে তার ফলেই এক সময় দপ করে জ্বলে ওঠবে আগুন- এরই নাম অগ্নিমন্থন। এই হল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ। এখানে নিষ্ক্রিয় বলতে অনাগ্রহকে নির্দেশ করে না।
এখানে নিষ্ক্রিয়-এর অর্থ শান্ত বা অবিচল থাকা। নিষ্ক্রিয় বলতে বোঝায় শিক্ষকের কাছে সব পাব এই মনোভাব নিয়ে সম্পূর্ণ সমর্পণ।
গীতা বলছে শিষ্যের আরও লক্ষণ হল--
" ইদং তে নাতপস্কায় নাভক্তায় কদাচন।
ন চাশুশ্রষবে বাচ্যং ন চ যোহভ্যসূয়তি।"
তপস্যাহীনের জন্য শিক্ষা নয়। চতুর্দিকে সতত ধাবমান মনকে ফিরিয়ে এনে এক লক্ষে স্থির করাই তপস্যা। শিক্ষাকে যে শিক্ষার্থী সাধনা হিসাবে নেয় না তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। আবার শিষ্যের মধ্যে তপ ভাব থাকলেও যদি গুরুভক্তি না থাকে,তবে তার জন্যেও শিক্ষা নয়। আমরা ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হই কারণ তিনি সর্বশক্তিমান--
" যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবতি,অমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্"---
যাকে জানলে অশ্রুত যা তা শোনা হয়, অচিন্তিত বস্তু চিন্তিত হয়,অজ্ঞাত বস্তু জ্ঞাত হয়ে যায়- তিনিই ঈশ্বর।
গুরুও ঈশ্বরতুল্য। শিষ্য যদি মনে করে আচার্যের থেকে নেওয়ার কিছুই নেই তবে তার ভক্তি ভাব আসবে কোথা থেকে! আবার শিক্ষার্থী ভক্ত ও তপস্বী হলেও শ্রবণেচ্ছু না হলে তার শিক্ষা নয় না।
ইংরাজী hearing ও Listening শব্দ দুটির বাংলা অর্থ শোনা। hearing শোনা হলেও Listening আসলে অনুধাবন। কান দিয়ে মরমে পশা। কান আর হৃদয়ের যৌথ ক্রিয়া Listening। উপনিষদ বলছে- " ওঁ ভদ্রং কর্ণেভি শৃণুয়াম"
আমরা কর্ণসমুহের দ্বারা যেন কল্যাণ-বচন শ্রবণ করি। আচার্য আর শিষ্যের এই সহযোগী কার্যকলাপে কেমন হবেন আচার্য বা গুরু? গুরু হবেন-- " শ্রোত্রিয়ো অবৃজিনো অকামহত" তিনি হবেন নিষ্পাপ,তাঁর আচরণ হবে শুদ্ধ এবং অকামহত অর্থাৎ সবরকম বাসনার উর্দ্ধে হবেন তিনি। যেহেতু গুরুর প্রতি সেবাপরায়ন হওয়া শিষ্য হওয়ার পূর্বশর্ত তাই আচার্য হবেন অকামহত। শিষ্যের সেবার প্রতি তাঁর না থাকবে কোনো আসক্তি না থাকবে দাবী। তিনি তাঁর সকল জ্ঞান নিঃশর্তে প্রদান করবেন শিষ্যকে। এ যেন পুত্রের উত্তরাধিকার।
আজ আমরা উপনিষদের যুগ থেকে অনেক দূরে। পাল্টে গেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এখন উপসদন। ব্রহ্মজ্ঞান নয় অর্থকরী শিক্ষাই শিক্ষার মূল উপজীব্য। কর্ম সংস্থানের শিক্ষা, উপার্জনের শিক্ষা নিতেই শিষ্যর উপসদন যাত্রা। শিক্ষা এখন কেবল প্রয়োজনের শিক্ষা সেখানে অন্তরের যোগটাই নেই। সে কেবল আয়োজনের বাহুল্য। চামচ যেমন খাদ্যের স্বাদ বোঝে না ঠিক তেমনই প্রয়োজনের শিক্ষায় মস্তিষ্কে শুধুমাত্র কতকগুলো তথ্য ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। মননের কোনো স্থান নেই সেখানে। ছাত্র - শিক্ষক সম্পর্ক প্রয়োজনের আবর্তে পাক খাচ্ছে অবিরত। শ্রদ্ধা-স্নেহ-ভালোবাসার যতটুকু অবশিষ্ট তা অতি দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ার পথে। শিক্ষায় আচার্য ও শিষ্যের অনুভবের অবস্থান অবসৃত। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা যা শিখি তার কতটুকু কাজে আসে ( শিক্ষকতা,চিকিৎসা এবংবিধ কতকগুলি পেশায় শিক্ষা বা চর্চার বেশির ভাগটুকু কাজে লাগে এই মাত্র)? বরং কাজের মধ্য দিয়ে শিখি অনেক বেশি।
এক(১) এর পাশে ক্রমাগত শূন্য (০) বসালে তার মূল্য বাড়ে কিন্তু এক (১)টুকু সরিয়ে নিলে শূন্যের (০) আর কোনো মূল্য অবশিষ্ট রয় না। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যে কাজের বা জীবিকার শিক্ষা নেই সেগুলো ঐ শূন্যের (০) মতো, এক (১) ব্যতীত তার কোনো মূল্য নেই। এক (১) হল মানুষের মধ্যে নিহিত যে সদগুণ তার প্রকাশ, দেবভাবের প্রকাশ। নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসাবে প্রকাশ। নিহিত দেবভাব প্রকাশের জন্য শিষ্যকে সদগুরুর সান্নিধ্য নিতে হয়। তাঁর পায়ের কাছে বসে নিতে হয় সে শিক্ষা।
এই অস্থির সময়ে আচার্য-শিষ্য সম্পর্কের সেই ঐতিহ্য আর পরম্পরার কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই আমাদের সামনে। শিক্ষকদিবস শুধু ফুল-চন্দন আর বক্তৃতার বিভূতি নয়, শিক্ষকদিবস হোক দায়বদ্ধতা আর অঙ্গীকারের আত্মপ্রত্যয়। আমরাই পারি কারণ আমরা অমৃতস্য পুত্রাঃ। তাই আসুন আর একবার আশায় বুক বেঁধে নতুন আর এক আরম্ভের প্রত্যাশায় প্রত্যয়ী হই...
ওঁ সহ নাববতু
সহ নৌ ভুনক্তু
সহ বীর্যং করবাবহৈ
তেজস্বী নাবধীতমস্ত
মা বিদ্বিষাবহৈ
ওঁ শান্তি: শান্তি: শান্তি:
ওঁ সহ নাববতু-
পরমেশ্বর আমাদের অর্থাৎ শিষ্য ও গুরু উভয়ের চিত্তে ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের দ্বারা উভয়কে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন।
সহ নৌ ভুনক্তু-
ব্রহ্মবিদ্যার ফল যে পরমানন্দ সেই আনন্দ-অমৃতে আমাদের পরিতৃপ্ত করুন।
সহ বীর্যং করবাবহৈ-
আমরা উভয়েই যেন বীর্যবান হতে পারি।
তেজস্বী নাবধীতমস্ত-
আমাদের অধীত বিদ্যা যেন নিষ্প্রভ না হয়।
মা বিদ্বিষাবহৈ-
আমরা একে অপরকে যেন দ্বেষ না করি।
ওঁ শান্তি:,শান্তি:,শান্তি:-
আত্মজ্ঞান লাভের যাবতীয় প্রতিবন্ধক উপশান্ত হোক।
প্রবন্ধ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
উপনিষদ - ২
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
যখন কেউ কোন নিদিষ্ট বিষয়ে মনন করতে পারেন তখন তিনি ঐ বিষয়টিকে বিশেষভাবে জানতে পারেন। উপনিষদ বলছে---
"যদা বৈ মনুত্যেথ বিজানাতি।
নামত্বা বিজানাতি।"
যিনি মনন করেন তিনি বিশেষ ভাবে জানেন, যিনি করেন না তিনি জানতে পারেন না। মনন করার অর্থ হল কোনো বিষয়কে গভীরভাবে ভালোবাসা। ধ্যানের মতো গভীরে ডুব দেওয়া। ছেদহীন অসীম চিন্তা-- 'নিরবচ্ছিন্ন তৈলধারাবৎ'--
একটি পাত্র থেকে অন্য একটি পাত্রে তেল ঢাললে যেমন ছেদহীন ধারায় তেল গড়িয়ে যায় ঠিক তেমনই। মহামতি বুদ্ধদেবের সংকল্পের মতো--
"এই আসনে আমার শরীর শুকিয়ে যায় তো যাক,ত্বক-অস্থি-মাংস পচে গলে গেলেও এই আসন ছাড়ব না যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্বাণ লাভ হয়।"
কৃতসংকল্প হয়ে বিষয়ে তলিয়ে যাওয়া, বিষয়ে নিবিষ্ট হওয়াই মনন। আর মননের ফলে বিশেষভাবে জানা বা উপলব্ধিই আসলে বিজ্ঞান।
উপনিষদ বলছে-- "নায়মাত্মা বলহীননে লভ্যঃ" 'বল'-হীনের জন্য আত্মজ্ঞান নয়। অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞান উপলব্ধ হয় তখনই যখন মানুষ 'বল'-শালী হয়।
এখানে বলশালী শুধু শরীরের সক্ষমতা নয়-- সংকল্প,চিন্তা,বুদ্ধির সক্ষমতাই আসল। মন তো সকলের আছে কিন্তু মনের ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প তো সকলের সমান নয়। সংকল্প চালিত হয় চিত্ত বা বুদ্ধির দ্বারা।
"যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিভর্বতি তাদৃশী।"
যার ভাবনা যেমন তিনি তেমনই হন। তাই সত্য ও সুন্দরের চিন্তা করা উচিত। ধ্যানস্থ হওয়া উচিত তারই। আমাদের চরিত্র গঠনের মূলে রয়েছে শুদ্ধ চিন্তা। যদি আমরা উঁচু আদর্শের চিন্তা করি তবেই আমরা মহৎ হয়ে যাই।
চিন্তা এবং সৎ চিন্তাই উত্তরণের একমাত্র পথ। মানুষ যদি চিন্তা না করে তবে মনের দরকার কি? চিন্তাহীন মানুষ আসলে মৃতদেহ। পশুরা চিন্তা করতে পারে না, বিচার করতে পারে না, প্রশ্ন করতে পারে না--- মানুষ পারে--- তাই মানুষ শ্রেষ্ঠ।
এই পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণকর যা কিছু আবিষ্কার,উদ্ভাবনের ইতিহাস তার রসদ আসলে মানুষের সংকল্প-চিন্তা-মনন। যদা বৈ শ্রদ্দধাত্যম মনুতে-- মানুষ যখন শ্রদ্ধাবান হন তখন তিনি মনন করতে পারেন। শ্রদ্ধা না থাকলে আমরা কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চাই না।
বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা থেকেই বিষয়ের প্রতি অনুরাগ আসে। তাকে চিন্তা বা মনন করার ইচ্ছা জাগে।
কৃতসংকল্প হয়ে তার সবটুকু জানতে পারলে আনন্দ লাভ হয়- আলোকিত হয় অন্তর। উঁচু জায়গায় যেমন জল জমতে পারে না, গড়িয়ে যায়, তেমনি শ্রদ্ধাহীন অহংকারীর মধ্যে সৎগুণ স্থায়ী হয় না। নম্র, বিনীত ব্যক্তির মধ্যে সৎ গুণের প্রকাশ ঘটে, যে গুণগুলোই 'বল' বলে চিহ্নিত। 'প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবায়া' শিষ্য বিনয়ী হলে আচার্য তাকে শিখিয়ে আনন্দ পান। আবার সদগুরু সর্বজ্ঞ, অতিবাদী হয়েও,হন নিরহংকারী। আমরা তো সবাই বলি কিন্তু সদগুরুর কথায় জোর থাকে। তাঁর কথাগুলো নিছক কথা নয়, শব্দমাত্র নয়। তাঁর প্রতিটি কথাই অর্থবহ, সত্য। উপনিষদ আরো বলছে-- যিনি নিষ্ঠাবান তিনি শ্রদ্ধাবান-- "য বৈ নিস্তিষ্ঠত্যথ শ্রদ্দধাতি"।জানার জন্য নিরন্তর সচেষ্ট থাকাই হল নিষ্ঠা। নিষ্ঠা হল লেগে থাকা। একাগ্রতা ও আত্মসংযমের সঙ্গে কর্তব্যকর্মে লেগে থাকা।
যিনি কর্তব্যপরায়ণ হন তিনিই নিষ্ঠাবান হন--
"যদা বৈ করোত্যথ নিস্তিষ্ঠতি"।
"যদা বৈ সুখং লভত্যেথ করোতি।
নাসুখং লব্ধ্বা করোতি"।
কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষ সুখ লাভ করে। যে কাজ করে না, তার সুখ প্রাপ্তি হয় না।
সুত্রঃ - উপনিষদ
প্রবন্ধ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
উপনিষদ - ৩
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
মানুষের শরীর চোদ্দটি ইন্দ্রিয়ের উপর আধারিত। দেহের সকল গতিবিধির মূলে ঐ চোদ্দটি ইন্দ্রিয়। চক্ষু,কর্ণ, নাসিকা,জিহ্বা,ত্বক-এরা জ্ঞানেন্দ্রিয় কারণ এরা বাইরের পরিবেশ থেকে কোনো না কোনো অনুভূতি বা জ্ঞান আহরণ করে। বাক,পানি,পাদ,পায়ু,উপস্থ- এই পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়। এই পাঁচ কোনো না কোনো কাজে সাহায্য করে। মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত-এরা হল অন্তরেন্দ্রিয়।
জাগতিক সকল কাজ সম্পন্ন করে এই ইন্দ্রিয়গুলি। এরা এককভাবে কাজ করলেও পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। আর সেটিই একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা। মজার ব্যাপার হল, যে বা যারা কাজ করে, যেহেতু তারা কাজ করে তাই তাদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষণ দেখা যায় প্রায়শই।যখন আমরা কোনো উদ্যোগে বা প্রচেষ্টায় অংশ নিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনে হয় "আমি ছাড়া এ কান্ডটি অসম্ভবই ছিল।"
অহম্ আমিই, মিথ্যে আত্মঅহমিকায় বুকের ভিতর অনেকখানি বাতাস ভরে জামার বোতামে টান অনুভব এ আমাদের স্বভাব সঙ্গত। আধিপত্য বিস্তারের এই মনোভাবটি রবীন্দ্র নাথের কবিতায় উৎকীর্ণ হয়েছে রূপকের আড়ালে- কাছির টানে চাকায় এগিয়ে চলেছে রথ।
অশেষ আয়োজন আর অসীম উৎসাহে ভক্তের দল লুটাচ্ছে মাটিতে। তাদের প্রণতি নিবেদনে নিজেকে ধন্য মনে করছে রথ, পথ, মূর্তি এমন কি ব্রাহ্মণও। আর সেই আত্মাভিমান দেখে অন্তর্যামী হাসছেন অন্তরালে।
একবার বাক, চক্ষু, কর্ণ ও মন নিজেদের মধ্যে কে বড় সে নিয়ে তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাক বলেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ "বাগ্বাব বসিষ্ঠ:"
কারণ কথার দ্বারাই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করেন। অন্যকে প্রভাবিত বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উপায়ই হল বাক চাতুর্য।
চক্ষু বলেন তিনিই বরিষ্ঠ কারণ দৃষ্টিশক্তি পূর্ণ মানুষ ইহলোক ও পরলোকে নিরাপদে থাকেন।
কর্ণ বললেন যিনি প্রাচুর্যকে জানেন তার কাছে দেবতা ও মানুষের সব ভোগবস্তু অনায়াস হয়। তাই তিনি অর্থাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ই সকলের সার। মন বললেন তিনিই আশ্রয়। ইন্দ্রিয়দিগের সকল অভিজ্ঞতা তো তার কাছেই আশ্রয় লাভ করে। বিবাদের আর শেষ হয় না। আমি শ্রেষ্ঠ, আমি শ্রেষ্ঠ করতে করতে বাক, চক্ষু, কর্ণ, মন উপস্থিত হন পিতা প্রজাপতির কাছে।
বিনয়ের সঙ্গে বলেন-- "ভগবান, আমরা সকলেই দেহস্থিত হয়ে দেহকে নিয়ন্ত্রণ করি। আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ?"
পিতা প্রজাপতি সরাসরি উত্তর না করে একটু কৌশল অবলম্বন করলেন, ঘুরিয়ে বললেন-- "এ প্রশ্নের মীমাংসা তো তোমরা নিজেরাই করে নিতে পার, তোমাদের মধ্যে যে দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে দেহ সর্বাপেক্ষা হীনবল হয়ে পড়ে এবং দেহকে অশুদ্ধ বলে মনে হয়, সেই শ্রেষ্ঠ।"
ইন্দ্রিয়গণ খুশি মনে ফিরে গেল। শুরুতেই বাক দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এক বছর এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াল নিজের খুশি মত এবং এটা মনে করে উৎফুল্ল হল, তার অভাবে দেহ কত কষ্টে আছে। অন্যান্য ইন্দ্রিয়গন বেশ টের পাচ্ছে তার অভাব। হয়তো এতো দিনে মরেই গেছে দেহ।
বছর খানেক পর বাক ফিরে এল অবস্থাটা পরখ করতে। ফিরে তো চমকে গেল বাক! বেশ আছে তো শরীর! বাক জিজ্ঞাসা করল --
"আমি ছাড়া কি ভাবে কাটল এক বছর? কোনো অসুবিধা হয় নি? অভাব বোধ হয় নি?"
সবাই মিলে বলে উঠল--
"বোবা মানুষ যেভাবে বাঁচে সেভাবেই নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি আমরা। চোখ দিয়ে দেখছি, কান দিয়ে শুনছি, মন দিয়ে চিন্তা করছি, শুধু মাত্র কথা বলাটুকুই বন্ধ এই যা।"
বাক মন খারাপ করে ফের ঢুকে পড়ল শরীরে। এবার শরীর ছাড়ল চক্ষু। না জানি তার অভাবে কি নাই কি ঘটছে এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কেটে গেল এক বছর। বছর ঘুরতে চক্ষু ফিরে এল। এবার তো চক্ষুর, চক্ষু চড়ক গাছ! তাকে ছাড়া বহাল তবিয়তে রয়েছে সব। একটু হতাশ হয়ে বলল--
"আমাকে ছাড়া তোমরা বেঁচে আছ?"
বাক,কর্ণ,মন বলল--
"কেন থাকব না। তুমি ছাড়া তো তেমন কোনো অসুবিধা দেখি না। শুধু যা দেখতে পাচ্ছি না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি। বাকি সব কাজই তো চলছে। বাগিন্দ্রিয় দিয়ে কথা বলছি,কান দিয়ে শুনছি,মন চিন্তা করছে।" একথা তারা চক্ষুকে আনন্দের সঙ্গে জানাল।
চক্ষু একরাশ অবসাদ নিয়ে প্রবেশ করল শরীরে। চক্ষু শরীরে প্রবেশ করার পর শরীর ছাড়ল কর্ণ। মজা করে ফিরে এল এক বছর পর। ভাবল তাকে ছাড়া বেশ জব্দ হয়েছে অন্যরা। প্রবল ধাক্কা খেল কর্ণ। তাকে ছাড়া বিশেষ কোন অসুবিধাই হয় নি। অন্যরা জানাল --
"নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে কি আর বধির লোক বাঁচে না? তাছাড়া চোখ দিয়ে দেখা, বাগিন্দ্রিয় দিয়ে কথা বলা, মন দিয়ে চিন্তা করা সবই বজায় আছে।"
শোনা ছাড়া আর কোন কাজই বন্ধ ছিল না ঐ এক বছর এটা জেনে দম্ভ চূর্ণ হল কর্ণের সে আগের মতো শরীরে অবস্থান করল। এবার শরীর থেকে উধাও হল মন। সে ভাবল এদের অভাব যখন অনুভূত হয় নি তবে নিশ্চিত ভাবেই সেই শ্রেষ্ঠ।
এক বছর পর বেশ ফুরফুরে মেজাজে হাজির হল সে। অন্যদের মতোই সেও আশ্চর্য হল। তার অভাবে কোন অচলাবস্থা ঘটে নি। বেশ আছে সবাই। অবাক হয়ে মন জিজ্ঞাসা করল--
"আমাকে ছাড়া তোমরা রইলে কেমন করে?"
উত্তর এল একজন শিশু যেমন কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া নির্বিকার বাঁচে, সেভাবেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বেঁচে আছে তারা। চোখ, কান, বাগিন্দ্রিয় যার যার কাজ ঠিকঠাক করে যাচ্ছে। মন হতোদ্যম হয়ে শরীরে প্রবেশ করল। এরপর যখন মুখ্যপ্রাণ অর্থাৎ প্রাণবায়ু যখন শরীর ছাড়তে মনস্থ করল তখন শরীরের মধ্যে তোলপাড় শুরু হল। এর আগে বাক, চক্ষু, কর্ণ, মন শরীর ত্যাগ করায় এ পরিস্থিতি হয় নি।
যেমন ভাল ঘোড়া কষাঘাতে, পা বেঁধে রাখা খুঁটি সমূহ উপড়ে ফেলে তেমন মুখ্যপ্রাণ অন্য সকল ইন্দ্রিয়দের উপড়ে নিয়ে শরীর ছাড়ার উপক্রম হল। সেই অস্থিরতার আবহে বাক, চক্ষু,কর্ণ, মন সহ সকল ইন্দ্রিয়রা বুঝতে পারল তার কেউ স্বাধীন নয় তারা প্রাণের অধীন। প্রাণই তাদের প্রভু, তাদের নিয়ন্ত্রণকারী। তারই সেবায় তারা নিয়োজিত। সকল ইন্দ্রিয় সমবেত ভাবে প্রাণকে অনুরোধ করল শরীর না ছাড়তে। মনে নিল প্রাণই শ্রেষ্ঠ। তারা শ্রদ্ধা জানালো প্রাণকে।
জয়গান হল প্রাণের।
দেহস্থিত আত্মা প্রাণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রাণরূপে তিনিই সচল রাখেন ইন্দ্রিয়দিগকে। প্রাণহীন দেহ আত্মা হীন দেহ জড় নিশ্চল।
সুত্রঃ উপনিষদ।।
আলোচনা-কলম
সনোজ চক্রবর্তীর
কলমে
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
রাতে হঠাৎই ছুটে আসে শাঁখের আওয়াজ ঝাঁকে ঝাঁকে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে দূর পশ্চিম থেকে তরঙ্গের মতো। তখন আমরা ছাদে। স্থির বোঝার চেষ্টা করি ভূমিকম্প নয় তো! না, সেসব কিছুই নয়।
বন্যার্তের দল শঙ্খ বাজিয়ে নিজেদের অসহায় আর্তনাদ পৌঁছে দিতে চাইছে ঈশ্বরের কাছে।
অতি দ্রুত বাড়তে থাকা জলস্তরে ভয় পেয়েছে বন্যায় অভ্যস্ত পশ্চিমের মানুষজন। বিড়ির গনগনে আগুনে পাশের ছাদের এক মুরুব্বির মুখটা উজ্জ্বল হয়-
'পঁচাশির বন্যাকে ছাপিয়ে গেল! এখন বাঁধ ভাঙা ছাড়া উপায় নেই।"
কারেন্ট নেই। জলবন্দী মানুষগুলো রাতের আবছা আলোয় ছাদে ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভুতের মতো। চাঁদের আলো ভাঙছে ঢেউ জলে। চারপাশে নিঃশব্দ যাপন। ঘোর বিপদের আশঙ্কায় থম মারা জনজীবন। ডোঙা চলাচলের ছলাৎ ছল নিঃশব্দতা সরিয়ে ভয় দেখাচ্ছে থেকে থেকে। পশ্চিমে শহরে লাগোয়া পাকা বাড়ির বিপদ তুলনায় কম। ফি-বছরের বন্যা বিভ্রাট মাথায় নিয়ে বাড়ির নিচের তলাটা ছেড়ে রাখা। দূর পশ্চিমে, মাটির বাড়ি গবাদি পশুর ঘর গেরস্থালী ভয় পায় বন্যাকে। পুবের শহর ঝাঁ-চকচকে। পুব আর পশ্চিমের সীমারেখা শীলাবতী। শীলাবতীর পুব আর পশ্চিম তীরে ছড়িয়েছে ঘাটাল শহর। ব্রিটিশ শাসনে পশ্চিমের কুঠীবাজার সহ কৌলীন্য ছিল পশ্চিম তটের। পুব তট ছিল জলাজঙ্গলময়। শহর পুনঃ গঠনে ঘনবসতি পশ্চিম তট ব্রাত্য হয়ে পড়ে। পুবে ধীরে ধীরে নগরজীবনের নির্মাণ সব মাথা তুলতে থাকে।
ঝুমি বা দ্বারকেশ্বরের জলের চাপ বাড়লে বন্যা প্লাবিত হয় ঘাটালের পশ্চিম তট। সবচেয়ে আশ্চর্যের প্লাবিত হয় ঝুমি বা দ্বারকেশ্বরের বাড়তি জলে নয়, প্লাবিত হয় শীলাবতীর জলে।
দ্বারকেশ্বর ও শীলাবতী হুগলীর বন্দরের একটু আগে মিলিত হয়েছে পরস্পর। মিলিত সেই স্রোত রূপনারায়ণ। ঝুমি ও দ্বারকেশ্বরপর অতিরিক্ত জল রূপনারায়নে ঢুকতে দেয় না শীলবতীর স্রোতকে। ফুলে উঠতে থাকে শীলাবতী। ভাসিয়ে দেয় অপেক্ষাকৃত নিচু পশ্চিম তীর। যদি কোনো প্রকারে পুবের পাড় ভাঙে রেহাই পায় পশ্চিম। ফি-বছর বন্যায় পুব-পশ্চিমের কাছি টানাটানি চলতেই থাকে।
পশ্চিমের মানুষের দুর্ভোগ, দীর্ঘশ্বাস গিয়ে পড়ে পুবে। এ যেন যমে মানুষে টানাটানি। পুবের প্রতাপপুরে বাঁধে রাত জাগছে শ'দুই মানুষ। যে কোনো মূল্যে বাঁধ রক্ষা করতে হবে। বাঁধের হাল হকিকত, প্রতি মুহূর্তের গতিপ্রকৃতি তে নজর পশ্চিমের। বাঁধ না ভাঙলে জল ছুঁয়ে ফেলবে দোতলা। ভেসে যাবে চাল ধান দলিল দস্তাবেজ। পশ্চিমের মানুষদের হাত আছে কিন্তু আঙুল নেই একটাও। কেবল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা 'বাঁধ ভেঙে দাও।'
শাঁখে ফুঁ দিয়ে, দাঁড়াতে পারলেন না আমার শ্বাশুড়ি-মা। বাতের ব্যথাটা বেড়েছে-- নিচতলা থেকে সংসারটা উপরে নিয়ে আসতে সারাদিন অনেক বার উপর নিচ করতে হয়েছে যে। ঠাকুর ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে তিনি অস্ফুটে প্রার্থনা করলেন 'পুবের বাঁধটা রক্ষা কর ঈশ্বর হাসপাতাল সহ সব ভেসে যাবে। আমরা পশ্চিমের মানুষেরা বন্যার জন্য তৈরি হলেও, ওরা অভ্যস্থ নয়। ওদের রক্ষা কর।'
পশ্চিমের এমন অনেকের কাছি টানাটানিতে ইচ্ছাকৃত শৈথিল্যে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে যায় পুবের বাঁধ।
বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস-ভালুক আর সেই দুই বন্ধু
একবার দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে গভীর বনে পথ হারিয়ে ফেলল। একজন বলল বাম তো অন্যজন বলল ডান। ফলে দু'জনের কেউই ফেরার পথের সঠিক হদিশ দিতে পারল না।অগত্যা সমাধান হিসাবে শোলে সিনেমার সেই বিখ্যাত কয়েনটা বের হল পকেট থেকে। টস্ করে ঠিক হল দিক।
এবং ঐ টস্ নিদিষ্ট পথেই দু'জন এগোতে থাকল দ্রুত পায়ে। কিছুটা পথ এগিয়ে তারা বুঝল- বন থেকে বেরানো তো দূরঅস্ত, তারা আরো আরো অনেক গভীরে চলে এসেছে। চারিদিকে কেমন যেন গা ছমছম পরিবেশ। ভয়ে সারা শরীর ঠান্ডা বরফ। এদিকে দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।
হঠাৎ কিছুটা দূরে কুচকুচে কালো রং এর এক বিশালাকার ভালুক দেখতে পেল তারা। অবস্থাটা এমন যে ছুটে পালিয়ে যাওয়াও অসম্ভব। ভাবছেন এ আর নতুন কি কথা!
এর পরের ঘটনা তো সবারই জানা।
ঐ তো দু'জনের একজন গাছে চড়তে জানত। প্রিয় বন্ধুকে বিপদে ফেলে সে চড়ল গাছে। আর অন্যজন কি আর করবে! কোথায় যেন শুনেছিল ভালুক মরা মানুষ খায় না। তাই মাথা খাটিয়ে শুয়ে পড়ল মাটিতে। শুয়ে পড়ল মরা মানুষের মতো। ভালুকটা এলো শুঁকে শুঁকে দেখল শুয়ে থাকা বন্ধুটাকে। ভালুকটা যখন শুঁকে শুঁকে দেখছিল শুয়ে থাকা বন্ধুটাকে তখন তার লোমগুলো নাকের ফু্ঁটোয়, ঘাড়ে, কানের লতিতে সুড়সুড়ি জাগাচ্ছিল। সহিষ্ণুতার শেষ সীমা পেরিয়ে নড়ে উঠল শুয়ে থাকা বন্ধুটি।
ভালুকটি বলে উঠল-- "ঢের হয়েছে ওঠ ওঠ এবার। যদিও তোদের প্রতিটা দিন হল- মরে থেকেও বাঁচার অভিনয় করে যাওয়া। কিন্তু এ যে উল্টো, মরা মানুষের অভিনয় তো আর চাট্টি খানেক কথা নয়!"
ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় পড়ে গেল বন্ধুটি। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কিছুর খোঁজে তৎপর হল।
ভালুক বলল--
-- কি খুঁজছিস?
-- না না বন্ধুক-টন্ধুক নয়। মোবাইল...
-- মোবাইল! তুই কি মরার আগে সেলফি নিবি?
-- ধুর সে কি আর কোনো কাজে আসবে আসলে ছোট্ট একটা কাজ আছে।
-- কাজ?
-- আজ বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস।
-- তো!
-- আমার সঙ্গের বন্ধুটি একটু আগে আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়েছে।
-- ওঃ তাই নিয়ে স্টেটাস দিবি।
-- না না তা নয়।
-- তো!
-- আজ সাত সকালে ঐ বন্ধুটি একটা ম্যাসেজ করেছিল "...... তোড়েঙ্গে দম মগর, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে...." সেটা ডিলিট করব..
বলেই বন্ধুটি পকেট থেকে বের করল একটা মস্ত বড় মোবাইল।
আর তাই দেখে মুচকি হেসে ভালুক বলল--
-- তুই তো বেশ বোকা।
-- বোকা!
-- নয়তো কি! দেখ বন্ধু থাকবে, বন্ধুত্ব থাকবে,
বন্ধুত্ব দিবসও থাকবে, স্টেটাস থাকবে, ম্যাসেজ থাকবে। আসল থাকবে, নকল থাকবে। এটাই সিস্টেম। তার মধ্যে টিকে থাকাটাই আসল। রাখ রাখ বলছি মোবাইলটা। একটা কথা শুনে নে--
সব বন্ধু বিপদের বন্ধু হয় না আর সব ভালুক জ্যান্ত মানুষ খায় না। এই বলে ভালুকটা বনান্তরালে মিশে গেল।
-----------------------------------------------------------------------------------
অন্ধকারেরও খুব একটা প্রয়োজন আছে। অসম্ভব রকমের আড়াল করার শক্তি আছে অন্ধকারের। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে, আজীবন আলো নিয়ে থাকা মানুষটা বুঝতে পারেন এই অন্ধকারটুকু না থাকলে আজ বড্ড নেংটো দেখাত তাঁকে। এতক্ষণে মাটিতে মিশে যেতে হতো লজ্জায়।
কখনও কখনও লজ্জাটুকুও সরিয়ে দিতে হয় ফুঁ দিয়ে। লাইননের ব্যাগটা উপুড় করে দিতেই অন্ধকার সরিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ল টেবিলময়। "স্যার, এতো অনেক পুরানো, অনেক কিছুই পাল্টে গেছে যে!"
বইঘর- এর মালিক সুদীন ঠোঁট মুড়ে বইগুলোর পাতা উল্টাতে থাকেন। উদ্বিগ্ন হন আলোক স্যার--
"কোনোটাই কি চলবে না?"
বইগুলো হাতে নিয়েই সুদীন বুঝতে পেরেছেন যখের ধন আপনা থেকেই এসেছে তার হাতে কিন্তু আনন্দ প্রকাশে পাছে বেশি মূল্য চোকাতে হয় তাই অনাগ্রহ মিশিয়ে বলেন--
"চলবে না মানে চালিয়ে নিতে হবে আর কি।" আলোক স্যার আশ্বস্ত হন। টাকাকটা কাঁপাকাঁপা হাতে বুক পকেটে রাখেন স্যার। তারপর অন্ধকার সরিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ান।
বাড়ি বলতে একটা চাওড়া বারান্দা সহ এক কামরার রুম। চারদিকে চড়ানো বইপত্তর আর ধুলো মাখা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। একলা শোয়ার একটা তক্তপোশ। ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ষাটোর্ধ রুগ্ন জীবন। এখন আর কেউ পড়তে চায় না স্যারের কাছে। স্যারের পড়ানো নাকি অচল--বাতিল হয়ে গেছেন স্যার। নতুন ছাত্র-ছাত্রী আজকাল আসে না। পুরানো কেউ কেউ আসে বছরের এই একটি দিনে।
যেমন আসবে কালকে, কেউ কেউ।
গত বছর এমন দিনে চেয়ারটাকে বিক্রি করেছিলেন স্যার- সেগুন কাঠের চেয়ার। তার ঠিক আগের বছর পড়ার টেবিলটা। পুরানো বইগুলো যে বইঘর নিয়ে নেবে এটা বিলক্ষণ জানতেন স্যার। ওগুলো কি আর শুধু বই! ওগুলো যে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি। দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে যায় দেওয়াল।
মনকে প্রবোধ দেন স্যার। এছাড়া আর উপায় কি! কাল পাঁচই সেপ্টেম্বর ছেলেগুলোর মুখ মিষ্টি করাতে হবে তো। দেওয়ালে ঝোলানে রাধাকৃষ্ণানের ছবির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকেন আলোক স্যার। পরের বছর এমন দিনে হয়তো ওটা আর থাকবে না দেওয়ালে।
-----------------------------------------------------------------------------------
ক'দিন হল একটি ছেলে খুব জ্বালাচ্ছিল। দিন নেই রাত নেই ফোনের পর ফোন। পড়াতে হবে তাকে। যতই বলি আমি স্কুল ছাড়া পড়াই না সে ততই কোবিড, লকডাউন, স্কুল শাটডাউন এসব বলে দুর্বল করে দেয়। অগত্যা তাকে একদিন ডাকলুম। পড়ার পর সে বলল--
"আমি তাহলে তিন জনকেই ছেড়ে দিচ্ছি।" অবাক হই - "তিন জন?" সে জানায় তিন জনের কাছে পড়ে সে। "তিন জন কেন?" আমার প্রশ্নে সে অকপট জবাব দেয় তিন জনই যে সেরা।
আমি বলি-- "তিন জনই যদি সেরা হয় তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় জনের কাছে গেলে কেন?" "আসলে তাঁরা নিজেরাই সেরা মনে করে।"
ছেলেটা আরো জানায় প্রথম যার কাছে পড়ত তাঁকে-- কি? কেন? এহেন প্রশ্ন করায় তিনি বিরক্ত হতেন বলে দ্বিতীয় জনের কাছে যাওয়া।
দ্বিতীয় জনও-- কি? কেন? এর উত্তর দেন নি। বলেছেন "কেউ তো জানতে চাইছে না!"তৃতীয় জন বলেছেন "অঙ্ক যখন পারছ তখন কি? কেন? কি আসে যায়!"
মনে মনে হাসি-- আসলে কমার্সের একটা বিশেষ সুবিধা রয়েছে না জেনেও পাশ করা যায়।ছক মুখস্থ করে অভ্যাসের উলবোনা। নব্বই শতাংশ তৈরি হয় ছাঁচে। দশ শতাংশ ভেতরটায় ঢোকে। কমার্সের চাকরি পাওয়াটাও সোজা। প্রতিযোগিতা ঐ দশ শতাংশে। আমি তাকে অনুরোধ করে বলি নিয়ম করে পড়ানো সম্ভব নয়, তাছাড়া আইনেরও বাঁধা আছে। ওর তিনজন স্যারের গল্প শুনে আমার গুরুদেব চিত্তরঞ্জন ঘোষের কথা মনে পড়ে। বিজ্ঞাপন নিয়ে বলতে গিয়ে স্যার বলেছিলেন গল্পটা--
এক গলিতে চারটি টেলার ছিল। প্রথম জনের বিজ্ঞাপন ছিল--- "গুড কাটার্স এন্ড ফিটার্স।"দ্বিতীয় জন লিখেছিল-- " বেটার কাটার্স এন্ড ফিটার্স।" তৃতীয় জনের সাইন বোর্ডে ঝকঝকে লেখা---"বেস্ট কাটার্স এন্ড ফিটার্স।" চতুর্থ জন কি বলেছিল?
ফিরব সে কথায় তার আগে ছাত্রটির শিক্ষকরা নিজেদের যা মনে করে সেটা বলে নেই--প্রথম জন হলদিয়া মহকুমার সেরা। দ্বিতীয় জন পূর্ব মেদিনীপুরের সেরা তৃতীয় জন অবিভক্ত মেদিনীপুরের সেরা। যাই হোক চতুর্থ টেলার সাইনবোর্ডে লিখেছিল--
" BEST OF THE LANE". খলের ছলের অভাব হয় না।
-----------------------------------------------------------------------------------
আমরা যখন পৌঁছলাম তখন গ্রান্ড ক্যানেলের উপর পোন্তে ডি রিয়ালতোতে থিকথিক করছে ভিড়টা। না ভিড়টাতে আমাদের মতো পর্যটকের থেকে স্থানীয় ভেনিশিয়ানরাই সংখ্যায় বেশি। এখানে যারা আসেন তাদের সকলেই রিয়ালতোতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন।
গ্রান্ড ক্যানেলের উপর এটিই প্রথম ব্রিজ ১১৮১ তে এ ছিল ভাসমান, ১২৫৫ নতুন করে কাঠ দিয়ে নির্মাণ হয় পোন্তে ডি রিয়ালতোর। বর্তমান পাথরের তৈরি রিয়ালতো ১৫৯১ এর। ফুটপাতে এক বাংলাদেশী ভাইয়ের থেকে যে সেল্ফি স্টিকটা কিনেছিলাম তা শেষ পর্যন্ত কাজে এলো না। বাবদা মুখ বাঁকিয়ে পোজ দিলেও ভিড়ের গুতোগুতিতে সেল্ফি নেওয়া সম্ভব হল না।
বাংলাদেশী ঐ ভাইটির থেকে জেনেছিলাম আজ এদের একটা বার্ষিক উৎসবের দিন রোগাতা স্তোরিকা- পাতি কথায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। ভেনিসে হাতের কাছে আপনি অনেক বাংলাদেশী পেয়ে যাবেন। ভেনিসের হোটেলে সামুদ্রিক মাছের রকমারি পদ আপনি ভুলতে পারবেন না। বাবদার আবার মাছে বেশ অনীহা, গতদিন বাবদার কান্না শুনে পোস্ত বড়ার সুরাহা করেছিল এনায়েত চাচা। চাচাদের দু'পুরুষের হোটেল ব্যবসা এদেশে। এতো দূর দেশে বাংলা কথা শুনতে ও বলতে পেরে দমবন্ধ কষ্ট পেরিয়ে যে অফুরান আনন্দ বোধ হল তা নিজের দেশ দক্ষিণ ভারতে পাই নি।
ভেনিস আসলে অড্রিয়াটিক সাগরের নীল জলে ভাসমান এক স্বপ্ন। তার প্রতিটি আশ্চর্যকে ছুঁতে গেলে আপনাকে ভাসতেই হবে নীল জলে। শহরের জল পথে রয়েছে এখানকার বিখ্যাত গন্ডোলা- এক ধরনের শৌখিন সুন্দর নৌকা। বাবদা, আমি আর সুপর্ণা চেপে বসলাম গন্ডোলায়। নীল জল ঠেলে এগিয়ে চলল গন্ডোলা। গাইড একে একে ঘুরিয়ে দেখালো স্বর্ণালি দ্বীপ লিডো যেখানে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বসে,বুরানো দ্বীপের নানা রঙের ঘর, বিখ্যাত অপেরা হাউস ট্যাট্রো দ্যা ফেনিস বা দ্যা ফিনিক্স, ভেনিসের ঐতিহ্যশালী গোথিক স্থাপত্য।
ভেনিসের কাঁচের শিল্প বিখ্যাত। ইচ্ছে হল এক টুকরো ভেনিস সঙ্গে নিয়ে নেওয়া যাক। দাম দস্তুর করে সুপর্ণা একটা কাঁচের রঙিন ফুলদানি পছন্দ করল। "দেখো দেখো কি সুন্দর" এই বলে ফুলদানিটা আমার দিকে এগিয়ে দিতেই বিপত্তি বাবদার হাত লেগে সেটা গেল পড়ে।ঝনঝন শব্দে সুন্দর ফুলদানিটা ছড়িয়ে পড়ল ফুটপাতে।
ঘুমটা গেল ভেঙে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ঠান্ডায় মা- ছেলে গায়ে ঢেকে নিয়েছে পাতলা বেডশিট। সারা বেডশিটের গায়ে নীল জলের ঢেউ- ভাসছে প্রিন্টটেড নৌকা। গতকাল বিকেলে বেরিয়েছিলাম বানভাসি ঘাটাল শহরে। কথায় কথায় সুপর্ণা বলেছিল ঘাটালকে নাকি পশ্চিমবঙ্গের ভেনিস বলে। অবচেতনে রয়ে গিয়েছিল বানভাসি ঘাটাল। ঘাটাল--ভেনিস মিলেমিশে এমন স্বপ্ন ভ্রমণ! লোকে বলে ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। তড়ি ঘড়ি সময় দেখলাম মোবাইলে। না এ যাত্রায় কিছু হল না রাত একটা বাইশ। বালিশে মাথা দিলাম- ভোরের আশায়।
-----------------------------------------------------------------------------------
সেই গল্পটা
"তুমি অযথাই চাপ নিচ্ছ!"
"অযথাই চাপ নিচ্ছি!" ভেঙিয়ে শ্রমনের কথা তাকেই ফেরত দেয় দিঠি।
"কবে তুমি বিবেচকের কাজ করেছ শুনি?" দিঠির গলায় অনুযোগ।
"আজই তো আর ফাইন্যাল করে ফেলছি না। দেখাই যাক না কেমন কি খরচ, কি ধরনের অ্যামিনিটিজ।" চলন্ত গাড়ি থেকেই জায়গাটাকে ঠাহর করতে করতে কথাগুলো বলে শ্রমন।
শ্রমন ভালই ড্রাইভ করে।
হাত উল্টে ঘড়ি দেখে সে। হরিশপুর যেতে এখনও মিনিট কুড়ি লাগবে ওদের। সরাসরি কোর্ট থেকেই আসছে। দিঠি শ্বশুর মশাইয়ের লাঞ্চের পর চলে এসেছিল কোর্টে। বৃদ্ধাশ্রমের সবটা বুঝে নিতে যদি মিনিট চল্লিশ লাগে তবে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সোয়া আটটা। ফিরলেই বাবার হাজারটা প্রশ্ন!
--- খোকা, এতো দেরি হল যে?
--- আজ একটা ভারচুয়াল হেয়ারিং ছিল বাবা সেনসেটিভ কেস।
--- ও, তা বৌমার তো স্কুল ছুটি, এক সঙ্গে ফিরলি?
--- মার্কেটিং ছিল।
--- তা কি কি কিনলি খোকা?
--- ঐ তো তোমার দুটো লুঙ্গি, একটা গাম... তোমার সবেতেই বেশি বেশি কিউরিওসিটি!
--- আচ্ছা যা, আগে হাত মুখ ধুয়ে....
গাড়ি চালাতে চালাতে বাবার সঙ্গে পরপর সংলাপগুলো সাজিয়ে নিল শ্রমন।
-- ভাবছি ওদের সঙ্গে যদি সবটা মিলে যায় তবে আগামী মাসেই বাবাকে....
-- সবে তো মাসের আট আজ, তেমন হলে এ মাসেই, তবে তার আগে ওনাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে, এ ব্যবস্থাটা ওনার ভালর জন্যই। সারাদিনের বেশিটাই আমরা দুজনই বাড়ির বাইরে থাকি, বয়স হচ্ছে...
ছেলেবেলায় বাবা যে দিন তাকে ভুদেবনগরের বোর্ডিং স্কুলে রেখে এসেছিল সেই দিনটা মনে পড়ল শ্রমনের। এদ্দিনে দারুণ একটা প্রতিশোধ নিতে পারবে সে। তবে বোর্ডিং এ পৌঁছে দিয়ে বাবাও ফিরেছিল কাঁদতে কাঁদতে। এক্ষেত্রে যা তেমনটা হবে না। গাড়িটা গেটের কাছে দাঁড় করাতেই, দারোয়ান গেট খুলে নমস্কার করল-- "আইয়্যে স্যারজী।"
বৃদ্ধাশ্রমটা বেশ পরিপাটি।
ঢুকেই সুন্দর একটা বাগান, গাছগাছালির মধ্যে পার্কের মতো বসার জায়গা। পাশেই পাথর বাঁধানো মন্দির-- পরিবেশ দেখে এমনিতেই ভাল লাগে যাবে। এই বয়সী মানুষদের প্রয়োজন বুঝে প্ল্যানিং।
আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, দাড়োয়ান শ্রমন ও দিঠিকে নিয়ে গেল রিসেপশনে।রিসেপশন বলতে ছোট্ট একটা রুমে একটা বড় টেবিল ও পাশাপাশি কয়েকটা চেয়ার।শ্রমনের বয়সী একটা লোক ল্যাপটপ নিয়ে উল্টো দিকের চেয়ারে। হাতের ইশারায় শ্রমনদের বসতে বলে লোকটা আবার ডুবে গেল ল্যাপটপে।
"আসলে আমাদের একটু তাড়া ছিল,কথাবার্তা কি আপনার সঙ্গেই..."
দিঠির কথায় লোকটা ঘাড় নাড়ল, এবং এটুকু বুঝিয়ে দিল ওনার সঙ্গেই কথা বলতে হবে।
"এক নজরে যেটুকু দেখলাম, খুব ভাল না হলেও এ্যাভারেজ, চলবে। আপনাদের মান্থলি চার্জ কি?"
লোকটাকে সরাসরি কথাগুলো বলল দিঠি। "চার্জ নিয়ে আপনাকে অতো ভাবতে হবে না..."
লোকটা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, শ্রমন তাড়াতাড়ি করে বলল--
"তা কি করে হয়, আমাদেরও তো একটা প্ল্যানিং আছে!" এতক্ষণে লোকটা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলল "তুই কি এমাসেই মেসোমশাইকে রেখে যেতে চাস?"
হঠাৎ তুই তোকারিতে একে অপরের দিকে তাকাল শ্রমন ও দিঠি। আবার চমকে দিল লোকটা--
"কি রে চিনতে পারলি না?"
লোকটকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখল শ্রমন, না মনে পড়ছে না, এ লোক কোনোভাবেই তার পূর্বপরিচিত নয়।
"ভুূদেবনগর শ্যামাস্মৃতি বিদ্যাপীঠ, মনে পড়ে?" একমুখ হাসি নিয়ে লোকটা তাকিয়ে রইল শ্রমনের দিকে। শ্রমন অনেক চেষ্টাতেও মনে করতে পারছে না লোকটাকে। মাঝের সময়টা তো আর কম নয়। "আসলে আপনাকে!"
"সেকি রে এখনও আপনি! মনে পড়ছে না! সেই যে তোর বাবা তুলে গালি দিলাম, আর তুই রেগে গিয়ে.... কি আশ্চর্য এখনও মনে পড়ছে না!" শ্রমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
লোকটা হো হো হাসল--
"বুঝেছি আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই গেছে। যাকগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেসোমশাইকে এখানে দিয়ে যা। কোনো সমস্যা হবে না মেসোমশাই তো আমারও বাবার মতো।" শ্রমন আমতা আমতা করে বলল--
"না মানে বাবার জন্য নয়, আমরা এসেছিলাম আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের জন্যে।যদি মান্থলি চার্জটা বলিস।"
"ওটা নিয়ে ভাবিস না তোর জন্য স্পেশাল হবে।" শ্রমনের পিঠে ভরসার হাত রাখে লোকটা।
চাকরিটা ভাল না লাগলেও, ছাড়তে পারছে না কানন। শেষ বয়সের মানুষগুলোর ছেলে-মেয়ের জন্য হাহাকার সহ্য করতে পারছে না সে।
এই নিয়ে এমাসেই চারটে ক্লায়েন্ট ভাগিয়েছে এক গল্প বলে। সবার স্কুল জীবনে এই গল্পটা থাকেই। যখনই কেউ ফোনে যোগাযোগ করে ফেসবুক থেকে তার ডিটেলস্ কালেক্ট করে নেয় কানন। ক্লায়েন্ট ওর বয়সী হলেই গল্পটা ফেঁদে দেয়।
-----------------------------------------------------------------------------------------
আজ লকডাউন। নইলে নিশ্চিত ঘুরে আসতুম। ছেলেকে দেখিয়ে দিতুম ঈশ্বরের ঘর।দু'চোখে এঁকে দিতুম বিস্ময় সাগর। পাশাপাশি বসে পড়তুম নিকোনো উঠোনে। চোখের সামনে অত্যাশ্চর্য
ঢেউয়ের পর ঢেউ।" জানিস বর্ণপরিচয়ের অক্ষরগুলো বাংলা ব্যাপী ছড়িয়ে ছিল এখান থেকেই!"
"রিয়েলি!" চমকে উঠত ছেলে।
"শুধু কি তাই! মেয়েদের স্কুল, গরমের ছুটি, দামোদরে ঝাঁপ" ঢেউ গুনতে গুনতে বেলা যেত ফুরিয়ে। ফেরার বেলায়, হয়তো মাটির বারান্দা ভেঙে- ছেলে দু'হাতে ঝেড়ে ফেলতো ধুলো যত। হনহনিয়ে ছুটে আসত মায়ের বকুনি। মুঠো ভরা মাটি ছুঁইয়ে যেত কপাল।
"কি করছিস!"
মাটি কোথায়? এ তো আশীর্বাদ!"
আজ লকডাউন। নইলে নিশ্চিত ঘুরে আসতুম বীরসিং।
-- বাবা, বীরসিং ঘাটাল থেকে কত দূর হবে?
-- হ্যাঁ, তা প্রায় সাড়ে চার ক্রোশ।
-- চার ক্রোশ, কত কিমি বাবা?
-- চার ক্রোশ- তা হবে, প্রায় কিমি পনেরো।
-- মাত্র!
বুকের গভীর অন্ধকারে আলো জ্বালল কেউ! স্পষ্ট দেখতে পেলাম হাঁটুর উপর ধুতি বেঁটে খাঁটো চেহারার একটা মানুষ ছাব্বিশ ক্রোশ হাঁটছে ক্লান্তিহীন।
মা' ডেকেছে... ডাকটাই বড় কথা।
----------------------------------------------------------------------------------
নম্বর বিতর্ক ও তার গোড়ার কথা
দুয়ারে পাশ, বা দুয়ারে নম্বর যাই বলুন না কেন এ নিয়ে সরকার যখন ঘোষণা রাখে তখন হইচই হয় নি কেন? কেন তখন চিৎকার করে জানানো হয় নি ইলিশ আর খয়রা এক হয়ে যাবে। ভুল হলে সরকারের পলিসির। ছেলেমেয়ে গুলোকে নিয়ে নিরন্তর হাসিঠাট্টা কি সংবেদনশীল মানুষদের কাজ হচ্ছে! এক সময় নম্বরটাকে যারা গুরুত্ব করত না আজ তারাই নম্বরের বাড় বাড়ন্তে নম্বরের গুরুত্ব নিয়ে চিন্তিত। আগে যখন পরীক্ষা হয়েছে। এবং পরীক্ষার্থীরা অনেক অনেক নম্বর পেত তখন একদল লোক বলত
"কি আছে ঐ নম্বরে? কি কাজে আসবে?
দেশের কিছু উপকার হবে? সেই তো আমেরিকার গোলামী। বুড়ো বাপ-মা বৃদ্ধাশ্রমে। নম্বরটা কেবল সংখ্যা মাত্র। শিক্ষা অন্য জিনিস। অনেক নম্বরের পঞ্চাননের থেকে কম নম্বরের পচা অনেক বেশি শিক্ষিত, পচা সোশ্যাল, মানুষের পাশে থাকে, বুড়ো বাপ মাকে দেখে।"
এবার সেই দলটাই বলতে শুরু করছে--
"নম্বরের কোন বাপ মা নেই। কোনো গুরুত্বই রইল না নম্বরের। পচাও স্টার মার্কস!" এর আগে প্রজেক্ট বা পাকটিক্যালের নামে কি নম্বরের ঢালাও বিতরণ হয় নি! এ ব্যবস্থা বরাবরের। এবার যেহেতু পরীক্ষা হয় নি তাই একটু বেশিই মনে হচ্ছে। যারা পরীক্ষক তাদের থেকে খোঁজ করুন প্রকৃত পক্ষে পরীক্ষার মূল্যায়নে একটি শিক্ষার্থী যে শতাংশ নম্বর পায়, আদপেও কি সে তার যোগ্য! নাকি সেখানেও কোনো সরলীকরণ ব্যবস্থা রয়েছে। সবটা জানলে দেখা যাবে এই নম্বর বিতর্ক ভুয়া। দেখুন আমরা অভিভাবকরা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির সময় দেখে নেই কোন স্কুলে ভাল লেখা পড়া হয় আর ভেতরে ভেতরে খোঁজ করি কোন স্কুল প্রজেক্ট বা পাকটিক্যালে হাত খুলে নম্বর দেয়। প্রজেক্ট বা পাকটিক্যাল আসলে যা শিখেছি তার ফলিত দিক। হাতে নাতে করে দেখানো। সেই দিক থেকে একটি শিক্ষার্থীর তত্ত্ব গত দিকটি যদি সঠিক ভাবে জানা সম্পন্ন হয় তবেই প্রজেক্ট বা পাকটিক্যালে সে সম্পন্ন হতে পারে।
পাকটিক্যালে ত্রিশ নম্বর থাকে, লিখিত সত্তর। প্রোজেক্টে কুড়ি, লিখিত আশি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি আশিতে যে শিক্ষার্থী কুড়ি পায় তার প্রোজেক্টের নম্বর কুড়ি। শতাংশের হিসাবে লিখিত পরীক্ষায় আশিতে কুড়ি মানে ২৫% আর প্রোজেক্টের কুড়ি তে কুড়ি মানে ১০০%।এতোদিন যাদের পরীক্ষা হয়েছে তাদের অনেকেই এই সুযোগ পেয়েছে মার্কসীটে। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ, নেতার চমকানি, অভিভাবকের খিস্তি, টিউশনের বাজার বজায় রাখা এবং বিধ বহু কারণে লিখিত পরীক্ষায় ২৫% পাওয়া শিক্ষার্থী প্রোজেক্টে ১০০% নম্বর পেয়ে যায়। এগুলো লুকানো খেলা অপ্রকাশ্য। খয়রাতি আসলে বরাবরের ব্যবস্থা। এবারেরটা একটু চড়া দাগের মনে হচ্ছে তার কারণ পরীক্ষা হয় নি। হিসাব মতো একটু তলার দিকের ছেলেদের সুবিধা হয়েছে।
মানে যে পলিসিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে সেটা হল শিক্ষার্থীর নবম শ্রেণীতে প্রাপ্ত নম্বরের ৫০%+দশমের পাকটিক্যালের (যেটা আমাদের সময়ে ১০ নম্বরের ওরাল ছিল) প্রাপ্ত নম্বরের ৫ গুণ। এবার হিসাবে আসুন - একটি নিম্ন মেধার শিক্ষার্থী যে নবমে পেয়েছে ২০ এবং তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক তাকে দশমে ১০ এ ১০ দেওয়া হয়েছে, তার প্রাপ্ত নম্বর ২০×৫০%+৫০=৬০
এবার আসুন মধ্য মেধার একজন ৪০×৫০%+৫০=৭০ খুব ভাল ৭০×৫০%+৫০=৮৫
সাধারণত স্কুলগুলো নবম শ্রেণীর উত্তরপত্র একটু শক্ত হাতে মূল্যায়ন করে যাতে নম্বরের খিদেটা মরে না যায়। তার মানে সব মিলিয়ে যে হিসাবটা দাঁড়াল এই ব্যবস্থায় ভাল ও খুব ভাল শিক্ষার্থীদের বিশেষ কোন সুবিধা লাভ হয় নি। (যদি স্কুল কায়দা করে পরে নম্বর না বাড়িয়ে থাকে) সুবিধা পেয়েছে খারাপ ছাত্ররা তাদের পাশ করিয়ে দেওয়ার নিরিখে যদি একটু হাতখোলা নম্বর দেওয়া হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থার সুবিধা তারাই পেয়েছে।
মূল্যায়ন যাই হোক কাজের ক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকলে যোগ্য ব্যক্তি বঞ্চিত হয় এটা বিশ্বাস হয় না।
----------------------------------------------------------------------------------
কলতলায় একমাথা রোদ নিয়ে বসেছে মেজদি। তিন কেজি চালের হাঁড়ি আর পাঁচ কেজির কড়াটা নিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা বেচারার। এগুলো তোলাই থাকে, কালেভদ্রে নামানো হয়। একটা সময় চার ভাই বোন আর মা'বাবার সংসারে মস্ত বড় না হলেও ভাতের হাঁড়িটাকে হাঁড়ি বলেই মনে হতে। জল ভর্তি হাঁড়ি উনুনে চড়াতে গিয়ে মায়ের ছোট্ট শরীরটা কোমর থেকে বেঁকে যেন হঠাৎ করে উপুড় হত হাঁড়ির মুখে। সেসময় আমরা ভাইবোনরা বাড়ছি ফলে পেটটাও বাড়ছে। রোজ দিন কেজি দুয়েক চাল ফুটত সকাল বেলা। বাবা চালের যোগানটা সামলাতে পারত না বলেই রাতে রুটির বন্দোবস্ত পাকা হয়েছিল অনেক আগেই।
এখন সংসার ছোট হয়েছে।
সামাজিক নিয়মে কেউ নিকট দূরত্বে কেউবা আবার কালের নিয়মে অনতিক্রম্য দূরত্বে। সংসার ছোট হতে হতে এখন চার'শ গ্রাম চাল ফোটে রাইস কুকারে। রাতের রুটির রুটিন থেকে গেছে আগের মতোই। সংসারের কি বিচিত্র পরিহাস একসময় ভরাপেটের সাধ্য ছিল না বলে ক্ষুধা জমিয়েছি নিয়ম করে।
এখন স্বাচ্ছন্দ্য সঙ্গে থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছেটাই গেছে শুকিয়ে। কলতলায় জল পড়ছে, দিদির মুখ ঝকঝক করে উঠল তার হাতে অনেকদিনের অব্যবহৃত তৈজসপত্র চকচকে হয়ে উঠল মুহূর্তে। এক হাতে হাঁড়ি আর অন্য হাতে কড়া দোলাতে দোলাতে মেজ'দি বলল--
"চক্কত্তি বাড়িতে কতদিন পর এমন হাঁড়ি কড়া উনুনে চাপবে!"
ছাত্র-ছাত্রীদের আমারা ভাই বোনেরা, বাড়ির একজনই মনে করেছি বরাবর।
----------------------------------------------------------------------------------
১৯৬৮ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর একটা অস্থায়ী আস্তানা। স্বপ্ন দেখার চোখ তখন থেকেই একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। সবাই তো চায় সুন্দর একটা ঘর, সামনে বারান্দা। অবসর চুপি পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। আলো হয়ে যাবে ভিতর আর বাইরের সবটুকু। তখন তো আর এমন ভারি ভারি কথা ছিল না 'কোয়ালিটি টাইম', হ্যাঁ আমরা ভালো সময় চেয়েছিলাম।
অবসর যে হেলাফেলার নয় অবসরই যে একটা এলাকার খোলনলচে পাল্টে দিতে পারে এ বিশ্বাস শক্ত করেছিলেন 'শিবুদা' নিজেই।
কিন্তু ঘর!
ঘর নিয়ে প্রত্যেকের নিজের নিজের স্বপ্ন থাকে ছবি থাকে। ঐ একটা জায়গায় আমাদের স্বপ্ন ভিন্নতর হয় নি। ছবি এঁকেছিলাম সবাই মিলে। কেউ ইঁট বসিয়েছি, কেউ পাঁক তুলেছি, কেউবা চাপিয়েছি টালি। আর সব মিলিয়ে যে ছবিটা তৈরি হল তার সঙ্গে অবাক মিলে গেল স্বপ্নটা। মিলে গেল হুবহু ৫৪' × ১২' বারান্দা সহ। শুরুতে পোদ্দারবাবু তো পাত্তাই দিলেন না। ছেলে ছোকরার দল বলে কিনা মহারাজ আসবেন। উদ্বোধন বলব না, ঘরের উদ্বোধন হয় না- গৃহপ্রবেশ হয়।
সেদিন গৃহপ্রবেশের মঞ্চে নরেন্দ্রপুরের মহারাজদের পাশে পোদ্দরবাবু বসতেই চান নি। পরে জানা যায় তাকে নাকি মানাত না ঐ মঞ্চে, তিনি যে প্যান্ট, শার্ট পরেছিলেন ঐ দিন। তারপর থেকে সুতাহাটার তৎকালীন বিডিও জ্যোতিষ পোদ্দার মহাশয় আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যান। আমরা? আমরা "পল্লীজ্যোতি পাঠাগার"। অসংখ্য উজ্জ্বল চোখ স্বপ্ন দেখেছিল যে ঘরের। আনন্দিত ঘর " পল্লীজ্যোতি পাঠাগার"।
ছবি ৫০ বছর পূর্বে গৃহপ্রবেশের আগে সদ্য নির্মিত পল্লীজ্যোতি পাঠাগার।
-----------------------------------------------------------------------------------
আজ রাখীবন্ধন। পথে ঘাটে একে অপরকে রাখী পরাচ্ছে আনন্দিত মানুষজন। শক্ত হচ্ছে সম্প্রীতি, পোক্ত হচ্ছে বন্ধুত্ব। যে লোকটা সুতো বেঁধে, লাড্ডু মুখে গুঁজে দিয়ে বুক-উপচানো কোলাকুলিতে মত্ত----
খোঁজ নিয়ে দেখুন আত্মমগ্ন সেজন প্রতিবেশীর ভালমন্দের খবর রাখে কি?
আপন স্বার্থে হচ্ছি আলগা
সমাজ এবং সংসারে-
একার মধ্যে একার যাপন
সিঁড়ি ভাঙার চক্করে।
পাশের বাড়ির একলা বুড়ো
দু'দিন হল কম্পজ্বর-
পরের কথা ভাবতে গেলে
আত্মসুখের ঘোর বিপদ।
বাপ-মা মরা কিশোরবেলা
কাকভোরেতে কাগজ দেয়-
স্কুল ছুট সে কোন গরজে
অন্ধগলির খোঁজ কে নেয়?
জীবন এখন ভাত ঘুমেতে
স্বার্থপরের ডিমে তা-
চড়তে সিঁড়ি হিসাব কষে
পরের মাথায় দিচ্ছে পা।
নিজের আখের গোছ করতে
কম্প্রোমাইজ মোটেই নয়।
লোকদেখানো সোশ্যাল হতে
ছলচাতুরী করতে হয়।
বন্ধু-পরব রাখীবন্ধন
সুতোর গুঁতোয় কিস্তি মাত।
সম্প্রীতি আর মানবতা
আত্মমগ্নের দিল-কি-বাত।
--------------------------------------------------------------------------------
গতকাল বাপ বেটা অনেকটা রাত জেগে ছিলাম। মা'কে সঙ্গে রেখেই কথাবার্তা হচ্ছিল। এই যে ক'দিন ঘাটালে আছি ছেলেকে প্রতিদিন শোয়ার আগে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প বলতে হয়। মহাভারতেই ঝোঁক বেশি। সে কারণেই ইদানিং আমাকেও পড়তে হচ্ছে। ছেলের দৌলতে জানছি অনেক কিছু নতুন করে।
বিশ তারিখ বাবা দিবস ফেসবুকে বাবাদের নিয়ে বেশ কিছু ভালোলাগা পোষ্ট আমি ওর মা'কে যখন শোনাচ্ছিলাম তখন সেসবের বাবদাও কিছু শুনেছে। গতরাতে বাবা দিবস নিয়ে ওর কত কি প্রশ্ন! গতকাল রাতে বাবদাকে ভালো ছেলেদের কথা বললাম-- জমদগ্নি ও তার ছেলে পরশুরাম। শ্রমনকুমার ও তাঁর বাবা মায়ের গল্প, যযাতি ও পরুর গল্প। শান্তনু-দেবব্রত
--মানে পিতা-পুত্র সিরিজ। গল্পের শেষে ছেলে বলল - "আমার বাবা শান্তনু হবে না।" চকাস্ করে চুম খেলাম ছেলের কপালে। শব্দ শুনলে যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তিনি তখন গভীর ঘুমে। ছেলে বলল--
-- তোমার দাদুর নাম কি?
-- পতিতপাবন।
-- কি করত তোমার দাদু?
-- দাদু মাস্টার মশাই ছিলেন।
-- তাঁর বাবার নাম?
-- চন্দ্রমোহন চক্রবর্ত্তী।
-- কি করত?
-- পুজো করত। মৃত্যুর একঘন্টা আগে বলে দিয়েছিল এবার সে মরবে, যেন তাঁর মাথার
কাছে গীতাপাঠ করা হয়।
-- তুমি কি তাঁকে দেখছ?
-- না।
-- তবে! কি করে জানলে?
-- শুনেছি।
-- চন্দ্রমোহনের বাবার নাম কি?
-- শিবনারায়ণ।
-- কি করত?
-- জানি না।
-- তাঁর বাবার নাম?
-- জানি না।
-- কে জানে? টীনা পিসি?
-- হয়তো না, কাকু জানে।
-- ছোট দাদু।
-- হু।
খানিক সময় দু'জনেই চুপচাপ। ছেলে থেকে থেকে উশখুশ করছে।
-- বাবা মশা ঢুকেছে বোধহয়। আলো জ্বেলে মশা নিধন হল। এবার নিশ্চিন্ত ঘুম।
-- বাবা পিঠটা চুলকে দেবে? শুরু করলাম।
-- হচ্ছে না, তোমার একটুও নখ নেই। এবার থেকে দাঁতে কাটা বন্ধ কর।
-- আচ্ছা বাবদা, এমনি করে তোর নাম কে জানতে চাইবে?
-- আমার ছেলের নাতি। এবার তড়িঘড়ি বিছানায় বসল ছেলে।
-- বাবা একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে-- একটা কাগজে পরপর সব নামগুলো লিখে
রাখতে হবে। ছেলের নাড়ীর টান তৈরি হচ্ছে।
-- আচ্ছা সে না হয় হবে, এখন ঘুমো।
-------------------------------
মুকুন্দপুরে হাসপাতাল লাগোয়া লজের বিছানায় কোপারেটিভ লোনের বান্ডিলগুলো ছড়িয়ে অপটু হাতে টাকা গুনছিলাম ভাই-বোন। বাবা কেঁদে উঠলে গুমরিয়ে-- ছেলে-মেয়ের প্রতি কর্তব্য না করতে পারা বাবা, অতোগুলো খরচের চিকিৎসা নিতে কষ্ট পেয়েছিল সেদিন। তাই ছেলে-মেয়ের সামনে হাউমাউ কেঁদেছিল, একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো। আরও একবার বাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম-- তখন আমি সাত-আট। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামছে। আয়নাখুপির ওদিক থেকে কান্নাটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে মিশে যাচ্ছিল অন্ধকারে। কান্নাটা যে বাবার বুঝতে সময় লেগেছিল। আসলে বাবাও যে কাঁদতে পারে, সে-বয়সে এটা অবাক করেছিল আমাকে। দাদুর তক্তপোশের নিচটাতে বসে কাঁদছে আমার চল্লিশোর্ধ বাবা। পিতা-পুত্রের সে এক আবেগঘন মুহূর্ত। দাদু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন পরম মমতায়।
"জানি তুই পারিস নি বলেই করিস নি। দেখবি একদিন ঠিক তোর অভাব ঘুচবে। মন খারাপ করিস না। ছেলেপুলেদের মানুষ কর।" মায়ের কাছে শুনেছিলাম দশ সের চাল আর এক টিন মুড়ি দিয়ে দাদু আলাদা করে দিয়েছিলেন বাবাকে। সেই থেকে অভাব লেপটে গিয়েছিল বাবার সংসারে। অভাবের দিনগুলোতে আমাদের ভাই-বোনের বুক-ভরা রাগ তাজা ভিসুভিয়াস হয়ে ফুটলেও, "পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম...." উচ্চারণে, অনাবিল শ্রদ্ধায়, বাবার পিতৃ প্রণাম জারি ছিল আমৃত্যু। আমাদের সুদিন দেখে যেতে পারেন নি দাদু।
ঐ ঘটনার মাস কয়েকের মধ্যে এক ঝকঝকে সকালে হঠাৎই চলে গেলেন দাদু। চলে গেলেন আমাদের অন্য সব পূর্বপুরুষদের মতো শেষবয়সে হার্ট বিকল হয়ে। সেই থেকে দাদুর প্রতি কর্তব্য না করতে পারার হাহাকার জন্মদাগের মতো থেকে গেলে বাবার গভীরে।
যদিও ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি বড়ছেলে হয়ে তাঁর বাবার জন্য কিছু না করতে পারার চিরন্তন গ্লানি বাবাকে বয়ে বেড়াতে। হাঁটলে যে বাবার দমে টান পড়ে, শুধুকি তাই-
থেকে থেকে চোখ ধোঁয়া, মাথা ঘুরে যাওয়া এসব উপসর্গ বেমালুম চেপে গিয়েছিল বাবা। রোগ তো আর সিন্দুকে লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়। ডাক্তারবাবু বাবার পাল্স চল্লিশের নিচে বুঝে তাড়াতাড়ি প্রেসমেকার ইনস্টল করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন হার্ট কমজোরি হচ্ছে, দ্রুত। সংসারে সবে সুখের আলো ঢুকেছে-- এরই মধ্যে হার্টের ব্যামো!
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিলাম আমরা ভাই-বোন। মাকে সবটা না জানিয়ে, পরদিনই মুকুন্দপুর। লজের ঠান্ডা ঘরে বাবাকে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে দেখে বাবার হাতটা নিয়েছিলাম মুঠোয়, থরথর কলাপাতার মতো কাঁপছিল বাবার হাত।
"সবটা টাকা লাগবে কেন! ব্যাঙ্কে এমনিতেই পড়ে ছিল তাই তুলে নিলাম।" মিথ্যেটা ঠিকঠাক বুঝেছিল বাবা। কান্না থেমে শান্ত হয়েছিল অনেকটা সময় পেরিয়ে। মুকুন্দপুর থেকে ফিরে মাস কয়েক ডাক্তারবাবুর নিয়ম মেনে সব ঠিকঠাক চললেও, পরেপরে ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল বাবা। অনুমান, বুকের ভিতর যন্ত্রটার মিথ্যে সাহসই বেপরোয়া করেছিল তাঁকে।
যন্ত্রেরও যে একটা আয়ু থাকে, অন্যায় অত্যাচারে সেই আয়ুও যে ক্ষীণ হতে পারে এটা আমরা কেউই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি বাবাকে। তুমুল অশান্তি আর মান অভিমানের মুষলপর্বে এসে শেষ পর্যন্ত চুপ করে গিয়েছিলাম ভাই- বোন। পরে মনে হয়েছিল, মায়ের চলে যাওয়া আর নিয়ম কানুন না মানার জন্য আমাদের বিরক্তিকর বকুনির জন্যই হয়তো পৃথিবীটা তেঁতো হয়ে গিয়েছিল বাবার কাছে। তাই নিজেই হয়ে উঠেছিল নিজের ভষ্মাসুর।নতুন একজোড়া চপ্পল এনে মেজ'দি বলেছিল "এতো আচার-বিচার তুই পারবি না।"
বিছানার ভার কমিয়ে নিচে রেখেছিল কয়েক গাছা খড়। দাদুর মৃত্যুর পর বাবা যখন খড়ের বিছানায় শুতো আমি ঘ্যানঘ্যানে বায়না করতাম. বাবা বুঝিয়ে বলত--
"বাবা-মা থাকতে এ বিছানায় শুতে নেই, তাছাড়া কষ্ট হবে যে।" আমি জেদ করলে মা কান ধরে টেনে নিয়ে যেত নিজের কোলের কাছে। অশৌচের দিনগুলোতে বিছানার নিচে নমুনা-খড় রেখে নরম বিছানায় শরীর এলিয়ে মনে পড়ত সেসব। পড়ন্ত শীতেও কাঁপুনি লাগত- হয়তো বাবা ছিল না বলেই। এদিক ওদিক দেখে শীত বিছানায় ব্লাংকেট টেনে নিতাম। সংসারে বাবা-মা যে কত বড় উষ্ণতা তা যারা হারায় তারাই জানে। একদিন গভীর রাতে আয়নাখুপির ওপারে বাবা আর দাদুকে দেখতে পেলাম স্পষ্ট। বাবার সেই হাহাকার নেই, দাদুর নেই বিষণ্ণতা। দুজনেই উজ্জ্বল আনন্দময়। ঘর-সংসার, বিষয়-আসয় নয়, শাস্ত্রালোচনা চলছিল বাপ-ছেলের।
বাবা তক্তপোশের নিচটাতে বসে দাদুর মুখে তাকিয়ে আর দাদু শুদ্ধ সংস্কৃতে বলছেন-
"ন পশ্যো মৃত্যুং পশ্যতি
ন রোগং নোত দুঃখতাম্।
সর্বং হ পশ্যঃ পশ্যতি সর্বমাপ্নোতি সর্বশঃ।"
বাবা চোখ দুটো বড়বড় করে জানতে চাইলে-- "মর্মার্থ?" ঘুমটা গেল ভেঙে।
উত্তেজনায়, ভয়ে শরীরটা কুঁকড়ে পুটলি হয়ে গেছে দরদর ঘামছি। ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নিচে। চাঁদের আলোয় আয়নাখুপির ছায়া পড়েছে দাদুর তক্তবোসে, দেওয়ালে। টর্চ জ্বালতেই দেওয়াল জুড়ে দাদুর ছবিটা শুকনো মালায় হেসে উঠল। না, কেউ কোথাও নেই।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে গিয়ে পা ভারি হয়ে এল, ফের যেন দাদুর গলা স্পষ্ট শুনতে পেলাম -- "ঢেউ যেমন সমুদ্র থেকে উঠে আবার সমুদ্রেই মিলিয়ে যায়। তেমনি প্রাণ, আশা, জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ সবই আত্মা থেকেই আসে আবার আত্মায় মিলিয়ে যায়। যিনি স্থিতপ্রজ্ঞ, যিনি আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত তিনি মৃত্যু দর্শন করেন না। তাঁর রোগানুভুতিও হয় না। তিনি দুঃখ বোধ করেন না। অথচ তিনি সবই দেখেন, সর্বতোভাবে সবই লাভ করেন।"
গল্প
মৃতজীবী
সনোজ চক্রবর্ত্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
ঢুকে খেঁকিয়ে উঠল লতা। আটটা বাজতে চলল এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে লোকটা। এদিকে নন্তুর স্কুলের রান্নার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভাতের হাড়িটা উনুনে চেপেছে এই যা। ঘরে একটুও সবজি নেই। একটু মাছ হলে ছেলেটা তবুও পেট ভরে খায়। গায়ের বেডসিটটা টেনে নিল লতা। তাতেও কাজের কিছু হল না।
পাশ ফিরে শুল কিঙ্কর। আর তাতেই জ্বলে উঠল লতা। বাইরের দাওয়ায় নন্তু পড়ছে। আজও সে প্রাইভেট পড়তে যায় নি। মাসের দশ তারিখ হয়ে গেল মাস্টারের মাসের টাকাটার সুরাহা করে উঠতে পারে নি কিঙ্কর।
ছেলে বড় হচ্ছে, গেল মাসে সবার সামনেই মাস্টার দুকথা শুনিয়েছিল। বাড়ি ফিরে গুম মেরে ছিল নন্তু। মায়ের মন টের পেয়েছিল নন্তুর কিছু একটা হয়েছে। লতা চেপে ধরেছিল নন্তুকে, প্রথমটাতে নন্তু ধরা দিতে চায় নি। আসলে সেও বুঝতে শিখেছে সংসারের হাল হকিকত। বাপের শত ছিন্ন সংসারে মায়ের জোড়া-তাপ্পি। ইনিয়ে বিনিয়ে নানান অজুহাতের ফাঁক-ফোকরে ধরা পড়ে গিয়েছিল নন্তু।
শেষ পর্যন্ত ছল ছল চোখে বলেছিল বিষয়টা, লজ্জায় লাল দেখাচ্ছিল ফর্সা মুখটা। কিঙ্করের পকেট কেটে, সংসার খরচের টাকা থেকে একটু একটু করে যেটুকু যা সরিয়ে ছিল তা দিয়েই পরের দিন মাস্টারের চার মাসের টাকা দিয়ে এসেছিল লতা। ছেলের কানে যাতে কথাগুলো না পৌঁছায় তাই গলা নামিয়ে দাঁতে দাঁত দিয়ে লতা বলে উঠল-
"বলি মদের খোয়ারিটাকি এখনও কাটে নি!
একটু আলু, কুমড়ো না আনলে, থালা ভর্তি সাদা ভাতই ধরিয়ে দেব দুপুরে।"
কিঙ্কর খানিক সময় শিবনেত্র থেকে আবার চোখ বুজল। অবস্থা বেগতিক দেখে ওয়াল হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কিঙ্করের প্যান্টের পকেটে টাকার সন্ধানে হাত ভরল লতা। কিঙ্করের পকেট একেবারে গড়েরমাঠ। অগত্যা লতা বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল পাশের গলির ছোট্ট দোকানে। যদি ধারে কিছু জোটে। দুটো হাতই জোড়া তাই জ্বলন্ত বিড়িটাকে দাঁতে চেপে ধরেছে কিঙ্কর। বিড়ির করকরে ধোঁয়া নাকের ফুটোয় ঢুকে অস্বস্তি জাগাচ্ছে।
কুঁচকে গেছে নাক, হ্যাঁচো পড়ার আগে খোপটা পড়া গাল দুটো তিরতির করে কাঁপছে। এক বালতি জলে একপাতা শ্যাম্পু গোলাচ্ছে কিঙ্কর। আর একপাতা নন্তু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। লতাকে লুকিয়ে শ্যাম্পুর পাতা দুটো বাথরুম থেকে সরিয়ে নিয়েছে কিঙ্কর। গাড়িটা বের করার আগে প্রতিদিন ভালো করে ধুয়ে নেয় সে।
নন্তু গাড়ি ধোয়ার সময় বাপকে সাহায্য করে। নন্তু জানে এই গাড়িটাই সংসারটাকে সচল রাখে। অন্নদাতার যত্ন না নিলে চলবে কি করে। মগ ভরে জল নিয়েছে নন্তু, রুগ্ন শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে মারুতি ভ্যানটার শরীরে। চেকারপ্লেটে নরম হয়ে যাওয়া ময়লাগুলো ব্রাশ দিয়ে খসিয়ে দিচ্ছে কিঙ্কর। গাড়িটাকে সে কিনেছিল উদয়ন সংঘ থেকে। আসলে কিঙ্করই চালাত উদয়ন সংঘের অ্যাম্বুল্যান্সটা। ওরা আর গাড়িটাকে মেনটেন করতে পারছিল না। ব্যাঙ্ক থেকে লোন করে কিঙ্কর কিনে নিয়েছিল গাড়িটা। বছর চারেকেও অ্যাম্বুল্যান্সটার হাল ফেরাতে পারে নি সে ব্যাঙ্কের ইনস্টলমেন্ট, গাড়ির ইন্সুরেন্স,আর সংসার হাঁ বোঝাতেই চলে যাচ্ছিল সব। গাড়িটায় না নিতে পেরেছিল অক্সিজেন না করতে পরেছিল এ.সি.। আর এটুকু সুবিধা ছাড়া পেশেন্ট পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছিল। কিঙ্করের অ্যাম্বুল্যান্সটা এখন নামে অ্যাম্বুল্যান্স আসলে ওটা শববাহী গাড়ি। শেষ পর্যন্ত শকুনের মতো এমন একটা জীবিকায় যেতে হবে ভাবতে পারে নি সে।
হাসপাতালের বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গাটায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাম্বুল্যান্সগুলো। বছর দশ আগে ছিল সবেধন নীলমনি পৌরসভার অ্যাম্বুল্যান্সটা। এখন এম.এল.এ. এম.পি. করে গোটা আট দশেক। মাছি তাড়ানো ছাড়া উপায় কি। কিঙ্কর তাই চালাকি করে সরে এসেছে। মানুষ মারা গেলে তার দাম বেড়ে যায় বোধহয় যাকে রিক্সা করে হাসপাতালে ঢোকানো হয় মৃত্যুর পর তাকেই নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচ ঘেরা শববাহী গাড়িতে ফুল সাজিয়ে।
একটা লোক দেখানো আভিজাত্য কাজ করে এর পিছনে। কিঙ্করের সবচেয়ে বড় শত্তুর পৌরসভা। ওরা গেল বছর কাঁচ ঘেরা শববাহী গাড়ি চালু করেছে। নামটিও বড় গাল ভরা স্বর্গরথ।
কিঙ্কর তার গাড়িটাকে পুরানো আউটডোর বিল্ডিংটার সামনে পার্ক করাল।কালুরা তাস খেলছিল সান বাঁধানো খিরিশ গাছটার নিচে। কিঙ্করকে দেখা মাত্র কালু চিৎকার করে বলল
"আজ একটা গেল কিঙ্করদা, একটু আগে এলে পেয়ে যেতে পাটিটাকে। দরে পোষাচ্ছিল না তবুও বাধ্য হয়ে নিল পৌরসভার গাড়িটাকে।" হাতে বাঁধা ঘড়িটার দিকে তাকাল কিঙ্কর, সত্যি সে আজ বড্ড দেরি করে ফেলেছে। কাল সে একটু বেশিই মদ নিয়ে ফেলেছিল কালুদের সঙ্গে। কিঙ্কর চোখ চারিয়ে দেখল সত্যিই স্বর্গরথটা নেই।
তবে কি সেই ছেলেটির....বোধহয় তাই কারণ কৃষ্ণচূড়ার তলাটা খাঁ খাঁ করছে। ওখানেই তো রোজদিন বিষণ্ণ মনে নামমাত্র একটা খবরের কাগজে মুখ গুঁজে বসে থাকত ছেলেটা। এই কদিনে ছেলেটার সঙ্গে অল্প স্বল্প পরিচয়ও গড়ে উঠেছিল। আজকের দিনে এটা ভাবা যায় না। নিজের মাকেও কেউ এমন করে দেখে কিনা সন্দেহ! সপ্তাহ দুই কি লড়াইটাই না দিয়ে গেল ছেলেটা। সেদিন কিঙ্কররা তাস খেলছিল এমন সময় অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে একটা পেশেন্ট পাটি ঢোকে।কিঙ্কররা হঠাৎ খেয়াল করে হাসপাতালের সামনে একটা খুচরো জটলা। তাস খেলা ছেড়ে
কৌতূহল মেটাতে উঠে গিয়েছিল কিঙ্কররা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তখন পেশেন্ট পাটির তুমুল বচসা চলছে। ভদ্রমহিলা তখনই কোমায় চলে গেছেন, তাই হাসপাতাল প্রথমে ভর্তি নিতে চায় নি কিন্তু যখন জানতে পারে ছেলেটা মিডিয়ার লোক তখন তড়িঘড়ি ভর্তি নিয়ে নেয়। ভর্তির পর থেকে ছেলেটা হাসপাতাল চৌহুদ্দি ছাড়ে নি। কখনও সখনও আড়ালে আবডালে অতো বড় ছেলেটাকে কাঁদতেও দেখেছে কিঙ্কর। গতকালও কিঙ্কর খোঁজ নিয়েছিল মহিলার।
ছেলেটা রূপম বস্ত্রালয়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দোলাতে দোলাতে ঢুকছিল হাসপাতালের মেন গেট দিয়ে, কিঙ্কর জিজ্ঞাসা করল--
-- কি ভাই, কি নিলে?
ছেলেটা হাত সামান্য উঠিয়ে প্যাকেট দেখিয়ে বলল--
-- মায়ের জন্য দুটো নাইট গাউন নিলাম। যদিও মা পরেন না। আসলে হাসপাতালে শাড়ির খুব ঝামেলা।
-- দুটো নিয়ে ঠিক করেছ, পাল্টে পাল্টে পরাতে পরবে। তা কেমন আছে মা?
-- ঐ এক রকম।
ছেলেটার শেষ কথাটায় কেমন যেন একটা হাতাশা ছিল।
বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করল কিঙ্কর। বিড়িটা ধরানোর আগে অভ্যাস মতো দু'আঙুলে একটু দলে নিল সে। বিড়ির মুখে ফুঁ দিয়ে, বিড়িটাকে চোপে ধরল দাঁতে। মনে মনে ভাবল--ভালই হয়েছে বড্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন মহিলা। ক্ষতিটা শুধু তারই হল। সপ্তাহখানেক সে মনে মনে ভেবে রেখে ছিল...টাকাকটা পেলে...
অবচেতন থেকে উঠে আসা সত্যিটায় একটু হলেও লজ্জা পেয়ে গেল কিঙ্কর। অথচ কয়েক বছর আগেও নিজের জীবনের পরোয়া না করে তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছে। যদি একটু আগে যাওয়া যায়, হয়তো প্রাণটা বেঁচে যায়।
আর এখন তাকে প্রতি মুহূর্তে মানুষের মৃত্যু কামনা করতে হয়। পেটের জন্য সংসারের জন্য। অন্যের মৃত্যুতেই তো তার আর তার সংসারের বাঁচা। হঠাৎ কিঙ্করের চোখে পড়ল সেই ছেলেটি ফিমেল ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসছে। যাক এতক্ষণ সে কি যা তা সব ভাবছে।
ছেলেটি একটা অ্যাম্বুল্যান্সে ঠেস দিয়ে সিগারেট ধরাল। ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে একটু হলেও চিন্তা মুক্ত সে।
কিঙ্কর এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে। তাকে কাছে পেয়ে ছেলেটি সিগারেট অফার করল।সিগারেটটা কানে গুঁজে কিঙ্কর বলল -
--কেমন আছেন উনি?
--আগের থেকে ভাল, সেন্স ফিরছে কখনও কখনও।
কথাটা শেষ করে সিগারেটে টান দিল ছেলেটি। কিঙ্কর আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বলল--
--উপরওয়ালার উপর ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এমন সময় ছেলেটির পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে চেপে ধরল সে। একটা কথাই সে বলতে পারল
"কখন!" তারপর ছুট লাগাল হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে। একটু বেশিই মদ গিলেছে কিঙ্কর। অবশ্য বডি পৌঁছানোর আগে মদ ছোঁয় নি সে। বডি বইলেই বাড়ি ফিরে গাড়িটাকে ধুয়ে ফেলে কিঙ্কর।
গাড়ি ধোয়ানোর আগে গাড়ি থেকে একটা প্যাকেট বের করে লতার হাতে দিল কিঙ্কর।প্যাকেটের মধ্যে এক কেজির একটা হরলিকস্ আর একটা নাইট গাউন। বডিটাকে হাসপাতাল থেকে বের করে গাড়িতে তোলার আগে ওদুটো চেয়ে নিয়েছিল কিঙ্কর।
গাউনটাকে নেড়েচেড়ে দেখছে লতা। বালতিতে জল ভরতে ভরতে আড় চোখে সেটা নজর করেছে কিঙ্কর। লতা দু'পাতা শ্যাম্পু এগিয়ে দিল কিঙ্করের দিকে। বিছানার একপাশে কয়েকটা কাঠির মতো পড়ে আছে নন্তু। ছেলেটা বড্ড দুর্বল তার উপর লেখাপড়ার চাপ।বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে কিঙ্কর লতাকে বলল--
-- নন্তুটাকে দু'বেলা হরলিক দিও, বেচার বড্ড রুগ্ন।
-- কাল থেকে দেবখন। তোমারও শরীরের যা অবস্থা!
কথাগুলোতে যে আদর মেশানো ছিল তা কিঙ্করকে টেনে নিয়ে এল লতার কাছে। সে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরল লতাকে। গাউনটাকে ততক্ষনে শরীরে চাপিয়েছে লতা। এমন পোশাক সে আগে কোনো দিন পরে নি। গাউনটায় হাত বোলাতে বোলাতে মিহি গলায় জানতে চাইল--
-- কত নিলো গো?
আদরটাকে লতার সারা শরীরে ছড়াতে ছড়াতে কিঙ্কর বলল-- দাম দিয়ে কি হবে! পছন্দ কিনা বলো?
-- পছন্দ বলেই তো জানতে চাইছি, অনেকগুলো টাকা গেল না?
কিঙ্করের একবার মনে হল সত্যিটা সে বলে দেয় কিন্তু লতার ঐ খুশিটাকে সে কেড়ে নিতে চাইল না। তার এই মিথ্যাটুকু যদি আজন্ম দুঃখিনীকে ক্ষণিকের সুখ দেয় তাতে ক্ষতি কি। হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল কিঙ্কর।
গল্প
এক বৈশাখে
দেখা হল…
অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
বরোদা, গুজরাট
“আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে…” – ‘মানসী’, রবীন্দ্রনাথ
কলেজ স্ট্রীটের বইপাড়ার ফুটপাতে ঘুরতে ঘুরতে একদিন হাতে এসে পড়ল একটা ফিতেবাঁধা মোটাসোটা ডায়েরী। তার পিছনের কভারের পকেটে আবার বেশ কিছু খাম। দেখেই কেমন কৌতূহল হল – হয়তো কোনো এক সময়ে কারুর অতি যত্নে রাখা ছিল জিনিসটা, পরে, কোনো পুরনো বইপত্রের সঙ্গে সঙ্গে রদ্দিওয়ালার বস্তায় করে এখানে পৌঁছে গেছে! দোকানদারের কাছে জিনিসটা প্রায় আবর্জনার মতোই পড়ে ছিল। আরো দুয়েকটা বইয়ের সঙ্গে, প্রায় বিনামূল্যেই পাওয়া গেল ডায়েরীটা।
ডায়েরীর কিছুটা পোকায় কাটা, ধারগুলোয় কোথাও কোথাও জলের আলপনা আঁকা, কিন্তু মূল লেখাগুলো দেখলাম অনেকটাই অক্ষত। সত্যিই অনেক যত্নে রক্ষিত – দুই তরুণ-তরুণীর কোন এক অতীতের কথামালা, একজনের চিঠির উত্তর আরেকজন দিনলিপি আকারে সাজিয়ে রেখেছে পাতার পর পাতায়। যথাসম্ভব কালানুক্রম বজায় রেখে আর কিছু আবশ্যকীয় পরিমার্জনার পরে, ব্যাপারটা সাজানোর চেষ্টা করলাম।
------------------------------------------
পয়লা জুন, ১৯৯২
শ্রীমতী পারমিতা বাগচী
সুচরিতাসু,
আমাকে কি আপনার মনে আছে? গত মাসে বম্বে আসার সময় ট্রেনে আমি আপনার সহযাত্রী ছিলাম, আপনার ঠিক নীচের বার্থটাই ছিল আমার – মনে পড়েছে?
জানিনা কেন এই চিঠি লিখতে শুরু করলাম। সেদিন সহযাত্রীদের মধ্যে একমাত্র আপনার সাথেই মাতৃভাষায় আলাপচারিতার সুযোগ ছিল – তাই আলাপ জমেওছিল ভালই। আপনারও প্রথমবার বাড়ী ছেড়ে বাইরে আসা, নতুন জায়গা, বড় শহর – তাই খানিকটা আশঙ্কা আর ভয় থাকাটাই স্বাভাবিক। সারাদিনের ফাঁকে কখন যেন মনে হতে শুরু হয়েছিল, এই মানুষটিকে বন্ধু হিসেবে পেলে মন্দ হয়না! যদিও, সারাদিনের মধ্যেও আপনার ঠিকানাটা চেয়ে নেবার সাহস হয়নি। তাই আন্দাজে আপনার institute এর ঠিকানায় লিখছি। আশা রাখি, আপনার হাতে একসময়ে পৌঁছবে। নতুন জায়গায় এতদিনে গুছিয়ে নিয়েছেন আশা করি? হস্টেলে নতুন বন্ধু হয়েছে তো? আর আপনার পুরনো কলেজের বন্ধুরা নিশ্চয়ই আপনার বড় সহায় – সেদিন যেমন দল বেঁধে অতরাত্রে স্টেশনে আপনাকে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন, দেখে খুব ভালো লেগেছিল।
এহেন পত্রাঘাত যদি অত্যাচার মনে হয়, নিঃসংকোচে দুলাইন লিখে দেবেন, নীচের ঠিকানায়।
নমস্কার জানবেন,
রক্তিম আচার্য,
বোম্বে
------------------------------------------
০২ জুলাই, ১৯৯২
পারমিতা,
আমার আগের চিঠিটা কি আপনার কাছে পৌঁছয় নি? সে বেচারা কি পথ ভুল করল? না কি জায়গামতো পৌঁছেও ..... ?
আশঙ্কায় থাকলাম।
রক্তিম
------------------------------------------
১২ জুলাই, ১৯৯২
রক্তিমবাবু,
এত সুন্দর করে কথা বলেন যিনি, তাঁর চিঠি অগ্রাহ্য করি, তেমন দুঃসাহস আমার কই? আপনার চিঠিরা কেউই পথ ভুল করেনি। গাফিলতি পত্রপ্রাপকের। আশাকরি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। নতুন জায়গায় গুছিয়ে বসতে একটু সময় তো লাগেই!
সেদিনের ট্রেন যাত্রাটা আমারও অনেকদিন মনে থাকবে। প্রথমবার বাড়ী ছেড়ে আসার মন-খারাপ ব্যাপারটা তো ছিলই, তাই প্রথমদিন অনেক রাত অবধি নিজের বার্থে মুখ গুঁজে পড়েছিলাম। আপনারা হয়তো ভেবেছিলেন আমি ঘুমোচ্ছি। কিন্তু পরদিন সকালে যখন আপনার সঙ্গে আলাপ হল, দেখলাম আপনি কেমন নানা ধরণের কথায় যেন আমাকে ভুলিয়ে রাখলেন একরকম - কিছুতেই বাড়ীর কথা মনে করতে দিলেন না। এই শহরটার ব্যাপারেও আপনি কত কিছু জানিয়ে দিলেন! তাই সারাদিনের পরে আমার মন খারাপের রেশটা অনেকটাই হালকা হয়ে গেছিল। এর পুরো credit প্রাপ্য কিন্তু আপনার!
আমার হোস্টেলের রুম ঠিকমতই পেয়েছি। দুজন রুম পার্টনার, গায়ত্রী এখানে M.Tech করছে, তামিলনাডুর ত্রিচি থেকে, আর রেশমী, চন্ডীগড় থেকে, আমারই মত Ph.D করছে, যদিও বিষয় আলাদা। দুজনেই বেশ মিশুকে, আমার সঙ্গে ভাল আলাপ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে বাড়ীতে মা-বাবার ও খুব চিন্তা ছিল – আমার কাছে এদের কথা শুনে মনে হয় খানিকটা শান্ত হয়েছে। আর আমার পুরনো কিছু বন্ধুরা এখানে আগে থেকেই আছে, কেউ M.Tech, কেউ Ph.D করছে। যাদের সেদিন স্টেশনে দেখেছিলেন। তাছাড়া, আমার বাবার দুয়েকজন সহপাঠীও এখানের facultyতে আছেন। তাঁরাও খেয়াল রাখছেন আমার।
আপনার চাকরীটা কিন্তু বেশ মজার না – কেমন মাসের অর্ধেক দিন সমুদ্রে থাকেন, আবার বাকী সময়ে বাড়ী ফিরে যান! এখন কি আপনি জলে, না ডাঙায়?
এই দেখুন, অনেকক্ষণ বকবক করে ফেললুম – bore হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই? এদিকে আমারও এখানের dinner time হয়ে গেছে। অতএব আপাততঃ আসি। ভালো থাকবেন।
পারমিতা
পুনশ্চ: ঠিকানা চাইতে কি খুব সাহসের দরকার হয় নাকি? Hostel এর ঠিকানা নীচে দেওয়া রইল।
পারমিতা
------------------------------------------
৩১ জুলাই, ১৯৯২
আরবসাগর
পারমিতা,
অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। তবে ওই সম্বোধনে বাবু-টাবু কিন্তু চলবে না! আমার পিতৃদত্ত নামটাই আমার বেশ পছন্দের, ওর সঙ্গে কোনো লেজুড় না-ই থাকল!
আপনার চিঠির শেষ কথাগুলি দিয়েই শুরু করা যাক। হ্যাঁ, একজন স্বল্প-পরিচিতার কাছে তাঁর ঠিকানা জানতে চাইতে খানিকটা সাহস দরকার বইকি! এমন একটা মিষ্টি চিঠির বদলে যদি চপেটাঘাত জুটত কপালে? সত্যি বলতে, প্রথম চিঠিটা লেখার পর থেকে খানিকটা আশঙ্কাতেই ছিলাম – এক তো ঠিকানা ঠিক না হওয়ার ভয়, তারপর সঠিক জায়গায় পৌঁছলে অন্য ভয়! আমি ভাবিইনি যে এত সহজে আপনার দরজায় প্রবেশাধিকার পেয়ে যাবো। খুব বড়ো মাপের মন আপনার। আর আপনার লেখাও খুব স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল – যেন মনে হচ্ছে চিঠি নয়, মুখোমুখি বসে আপনার কথা শুনছি! আপনি আগামী চিঠিতে প্রাণ খুলে ‘বকবক’ করে যেতে পারেন - কেউ bore হবেনা, guarantee দিচ্ছি!
আপনার চিঠি যখন এসেছে, তখন আমি জলে ছিলাম, আজ অফিসে ফিরে হাতে পেলাম। কাল ভোরের ট্রেনেই আবার বাড়ী ফিরবো, তাই এখনই লিখছি। আমাদের চাকরীতে একটা adventure component তো নিশ্চয়ই আছে, দিনের পর দিন সমুদ্রের মাঝখানে জাহাজে বসবাস করা, দিনের বেলা যতদূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল; রাতে চারপাশে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। তারই মাঝে কখনো সখনো চলমান বিন্দু বিন্দু আলো দেখে বোঝা যায়, সেগুলি মাছধরা নৌকা – হয়তো কয়েকদিনের পরিশ্রমের পরে ফিরছে – ঘাটে মহাজনকে মাছের হিসাব দিয়ে ঘরে ফিরবে!
আর আমাদের কাজ তো বলেইছিলাম – জলের নীচে মাটির মধ্যে গভীরে গিয়ে তেলের সন্ধান করা! একটা জায়গায় কাজ শেষ হয়ে গেলে, আবার নতুন জায়গায় শুরু করা। অবশ্য এর আগে এবং পরেরও অনেকগুলো ধাপ আছে। আগে নানানরকম survey করে দেখে নেওয়া হয়, কোন কোন জায়গায় তেল পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সেইমত location pinpoint করা হয়। সেসবের আবার আলাদা গ্রুপ আছেন, তাদের কাজ অফিসেই। এরপর সেই নির্দিষ্ট জায়গায় খুঁড়ে দেখা হয়। আমাদের, মানে জিওলজিস্টদের কাজ মূলত: এই পর্যায়েই। এরমধ্যে কোথাও হয়তো সাফল্য এল, কোথাও এলনা! এর পরে যেখানে পাওয়া গেল, সেখান থেকে underwater পাইপলাইন লাগানো, refinery অবধি নিয়ে যাওয়া, সে আরেক প্রস্থ ব্যাপারস্যাপার। আয়োজন মস্ত মাপের, বিশাল যন্ত্রদানব, তার নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখাশোনার জন্য আছে হরেক কাজের নানারকম মানুষ। প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট, সবাইকে সদা সজাগ থাকতে হয়, কোথাও কোনো ছোটখাট ভুলের জন্যও কখনো বিরাট মাশুল দিতে হতে পারে! আছে base support team, তাছাড়া সরবরাহের জাহাজের দল - বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে, খাবার, জল ইত্যাদি নিয়ে আসে তারা। এই পরিবেশে কোনো মানুষ একটানা বেশীদিন কাজ করতে পারেনা, তাই আমাদের নিয়ম ২ সপ্তাহ কাজ আর ২ সপ্তাহ ছুটি। তখন আমরা বাড়ী ফিরে যাই।
আজ বিকেলে গেছিলাম juhu beach এর কাছে Prithvi Theater এ একটা নাটক দেখতে। মোটামুটি সাধারণ একটা নাটক, কিন্তু পরিবেশনা খুব সুন্দর। সবচেয়ে ভাল লাগে ওখানের ambienceটা। ছোট্ট হল, অর্ধবৃত্তাকার স্টেজ, আর দর্শকের গ্যালারি যেন প্রায় স্টেজ থেকেই সোজা উঠে গেছে ওপরে। কুশীলব আর দর্শকদের মধ্যে একটা একাত্মতার সেতু আপনা থেকেই তৈরী হয়ে যায়! কখনো সুযোগ বুঝে একবার ঘুরে আসবেন, ভাল লাগবে। এছাড়াও আরো কিছু হল অবশ্য আছে, মধ্য বোম্বে/ দক্ষিণ বোম্বেতে, সেসবে আমার কখনো যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এই শহরের নাট্যচর্চা সাধারণত: যথেষ্ট উচ্চমানের। জানেনই তো, হিন্দী সিনেমার অনেক সফল নায়ক/নায়িকারা এই মঞ্চ থেকেই উঠে এসেছেন। শহরের আর কোথায় কি দেখলেন?
ভালো থাকবেন।
রক্তিম
------------------------------------------
১৪ আগস্ট, ‘৯২
রক্তিম,
এক আইআইটির পরিবেশে বেড়ে উঠে আরেকটা আইআইটিতে এসে ভেবেছিলাম খুব ফারাক হবে না। কিন্তু এটা দেখছি একেবারে ভিন্ন জগত! এখানের ছেলেমেয়েরা চিন্তা-ভাবনা, পোষাকে অনেকটাই westernized! হতে পারে আরবসাগরের জলের প্রভাব! আমাদের ওখানে, মানে খড়গপুরে শুধু ছাত্ররাই নয়, বাবার সহকর্মী, মানে faculty member দেরও আচার-আচরণ ছিল একেবারেই আলাদা। ওখানে মেয়েদের হস্টেলেও আবাসিকদের জন্য অনেক নিয়মকানুন ছিল। এখানে সেসব অনেকটাই শিথিল। ওখানে দোলের সময় বাবার কিছু ছাত্ররা হস্টেল থেকে দল বেঁধে আসত, বাবা আর মাকে আবীর দিয়ে প্রণাম করে যেত। বেশ একটা ঘরোয়া পরিবেশ ছিল! হয়তো এখানে আমার অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে কিছুটা!
আমার রিসার্চ গাইডের কথা কি গতবারে বলেছিলাম? মানুষটি খুবই রাশভারী, তবে সিনিয়রদের কাছে শুনলাম, ওটা নাকি মুখোশ – আসলে নাকি খুব স্নেহশীল আর নরম মনের। দেখা যাক! আমার সঙ্গে আমাদের প্রোজেক্টে আরো দুজন আছে, একজন এখানেরই pass-out, আরেকজন এসেছে BHU, Varanasi থেকে। তাদের সঙ্গেও ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।
আপনি কখনো বর্ষায় Matheran গেছেন? আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এরমধ্যে একদিন ঘুরে এলাম। এই ভিড়ের শহরের এত কাছাকাছি যে এমন সুন্দর জায়গা আছে, না গেলে বিশ্বাসই হত না! চারিদিকে এত সবুজ, আর কুয়াশার মাঝ থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা পাহাড়ের দৃশ্য – সে বর্ণনার ভাষা আমার জানা নেই। জানেন, ওখানে কোনও যন্ত্রচালিত যানবাহন নেই, হয় হেঁটে, কিম্বা ঘোড়া অথবা সাইকেল রিকশা নিয়ে যাতায়াত। যার ফলে পরিবেশ এত সুন্দর রাখতে পেরেছে। আমরা তো সবাই হেঁটে হেঁটেই ঘুরেছি। তার মজা অন্যরকম! আশেপাশে কয়েকটা tourist spots ও আছে, কিন্তু ওই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতিই আলাদা! রাতের পর অবশ্য একটু গা ছমছম করে, তাই আমরা আর বেশী adventure করিনি! অনেকে অবশ্য একইদিনে গিয়ে ফেরত আসে, কিন্তু আমরা ভেবেই রেখেছিলাম যে কোনো তাড়াহুড়ো করব না। তাই একটা রাত থেকে, পরদিন, মানে রবিবার সকালেই ফিরেছি।
আপনার কাজের জায়গার কথা শুনে বেশ interesting লাগছে। গাড়ীতে তেল ভরে চালানো হয়, এটুকুই আমার জ্ঞানে ছিল, কিন্তু তার পিছনে যে এত কর্মকান্ড, কি করে জানব! একটা বেশ অন্যরকমের পরিবেশ, তাই না? সবসময় ওই চারিদিকে জল দেখতে কেমন লাগে? ভয় করে না কখনো? আমরা, মানে সাধারণ মানুষজন নিশ্চয়ই সেখানে যেতে পারে না?
পারমিতা
------------------------------------------
২ সেপ্টেম্বর
পারমিতা,
আইআইটির দোলের কথায় আমারও ছাত্রজীবনের পুরোনো স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছেন। সেইসব দিনগুলো সত্যিই ভোলার নয়। বছরের অন্যান্য সময়ে আমরা একটু সিনিয়র হবার সুবাদে B.Tech এর বালকেরা খানিকটা সমীহ করে চলত ঠিকই, কিন্তু দোলের দিন আর কোনও ভেদাভেদ থাকত না। সেই দল বেঁধে স্যারেদের বাড়ি যাওয়া, কোন স্যারের বাড়িতে ভাল মিষ্টির ব্যবস্থা হয়েছে সেসব খবর নেওয়া, তারপর তখনকার সবেধন নীলমণি একমাত্র মেয়েদের হোস্টেলটির আশেপাশে সতৃষ্ণ নয়নে ঘুরে বেড়ানো … … থাক ওসব কথা এখন!
গতবার ফেরার ট্রেনে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। আমার সেবারের যাত্রা ছিল বম্বে মেল-এ। ট্রেনটা ছাড়ে রাত আটটায়, তাই সারাদিন অফিসের কাজকর্ম মিটিয়ে আরামসে গিয়ে ধরা যায়। তারপর তো খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া! কিন্তু প্রতিবারেই বিপত্তি ঘটায় ওই খাবারটা! VT ষ্টেশনের থেকে packed খাবার নামক যে বস্তুটি গাড়ীতে তোলা হয়, তেমন খাবার কেউ মানুষের জন্য তৈরী করে কিনা জানিনা! বিশেষত: সেখানে ‘পুরি’ বলে যেটা থাকে, সে জিনিস দু-হাতে টানাটানি করে যদিবা ছেঁড়া যায়, হজম করে কার সাধ্য! সঙ্গে থাকে আধসেদ্ধ ভাত, আর বিস্বাদ একটা ডাল আর সবজি। কিন্তু যারা আমার মতো যাত্রী, তাদের ওই খাবার নেওয়া ছাড়া উপায়ও থাকেনা! কারণ পরের ষ্টেশন যেখানে খাবার পাওয়া যেতে পারে, সেই ইগতপুরি আসতে আসতে মাঝরাত! বরং VT ষ্টেশনের dining hallএ একটু ভাল আর গরম খাবার পাওয়া যায়। আমি তাই হাতে সময় থাকলে সেখান থেকেই রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে ট্রেনে উঠি। কিন্তু সেদিন সময় ছিল না। তাই ট্রেনে বসেই খাবার নিয়েছিলাম। আমার টিকিটটা ছিল সেকেন্ড ক্লাসে, একটা সাইড বার্থে। সামনে ছিলেন একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা। ট্রেনে ওঠার পরে মামুলি আলাপে জেনেছিলাম, তিনি নামবেন বডনেরাতে, পরদিন সকালে। যাইহোক, একসময়ে খাবার দিয়ে গেল। সেই পুরি নিয়ে অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে শেষে হার মানতে বাধ্য হলাম। বাকী খাবারও বেশীটাই খাওয়া গেল না। ভদ্রমহিলা এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিলেন। এইবার বললেন, ‘তোমার তো দেখছি কিছুই খাওয়া হল না – এবার কি করবে’? আমি জানালাম, সামনেই কল্যাণ ষ্টেশন আসছে, কিছু নিশ্চয়ই পেয়ে যাবো। ভেবেওছিলাম তাই, কিছু না হোক কয়েকটা কলা কিনে নেবো, তাতেই রাতটুকু চলে যাবে। কথায় কথায় জানা গেল, ইনি বম্বেতে নিজের মেয়ের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন, এখন ফিরে যাচ্ছেন। বাড়ীতে দুই ছেলে আছে, আমারই মত বয়সী, তারা ব্যবসাপত্র দেখাশুনা করে। একটু পরে এসে গেল কল্যাণ – কিন্তু দুর্ভাগ্য এমনই, আমাদের কোচটা ছিল ট্রেনের প্রায় শেষপ্রান্তে, সামনের পার্সেলের ঠেলাগুলোর মাঝে একটা ম্যাগাজিনের ফেরিওয়ালা ছাড়া কাউকে দেখা গেল না। অথচ ট্রেন থামবে মাত্র দু-মিনিট, কাজেই নেমে যে এগিয়ে খুঁজবো, সেটাও risky হয়ে যাবে। বিফলমনোরথ হয়ে নিজের সীটে ফিরলাম। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই, ঘুমও পেয়েছে বেজায়। আশেপাশে সবাই ঝুপঝাপ আলো নিভিয়ে শোওয়ার আয়োজন করছে। কি করব ভাবছি, তার মধ্যে দেখি ভদ্রমহিলা অত্যন্ত কুণ্ঠা ও দ্বিধার সঙ্গে বলছেন, ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে বলব ভাবছিলাম, কিন্তু বলা উচিৎ হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বলছিলাম কি, আমার মেয়ে অনেক বেশী বেশী খাবার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে – মানে, জানিনা তো, আমাদের খাবার কি তুমি খাবে বাবা’? বলার মধ্যে এমন একটা আকুতি ছিল, মনের মধ্যে কোথায় যেন নাড়া দিয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবে যে কথা মাথায় এসেছিল, ‘না না, আপনার খাবার আমি কেন নেব’, তার জায়গায় মুখে এসে গেল, ‘কেন, আপনার খাবারে কি আছে’? সলজ্জ ভঙ্গিতে উত্তর এল, ‘না, মানে, আমরা তো মুসলমান’! চমকে উঠলাম – বাৎসল্যস্নেহেও জাতপাত থাকে নাকি? বংশপরম্পরায় চলে আসা ভেদাভেদের কুসংস্কার কি ভীষণ ভাবে গেঁথে গেছে মানুষের মনে – নইলে একজন মা তাঁর অপরিচিত কিন্তু সন্তানতুল্য কারো একটু উপকার করতে চাইছেন, সেখানেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই অন্ধ সংস্কার! চোখে প্রায় জল এসে গেছিল আমার! এবং এতক্ষণে বুঝলাম, আমার খাবারের ওই অবস্থা দেখে, উনিও নিজের খাবার তখনো অবধি মুখে তুলতে পারেননি! তাঁকে আশ্বস্ত করে, তাঁরই পাত্রে খাবার ভাগ করে আমরা দুজনে খেলাম। পরদিন সকালে যখন সেই মা তাঁর গন্তব্যে নেমে গেলেন, মনের মধ্যেটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল! আর আমাদের নেতাদের দ্যাখো – এই হিন্দু-মুসলমান, জাতপাত ভাঙ্গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে কী না করছে!
আজ এই অবধি থাক। আসছি।
রক্তিম
------------------------------------------
১৫ সেপ্টেম্বর, ‘৯২
রক্তিম,
মনটা বড়ো ভারী হয়ে গেল। জীবনে চলার পথে এমন মানবিকতার ছোঁয়া আমাদের সমৃদ্ধ করে। মনুষ্যত্বের এই সত্য ঘটনাগুলো এখনও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে, আমাদের সুস্থভাবে বাঁচার রসদ যোগায়। আসলে, মা তো মা-ই হয়, মায়ের তো কোনো জাত হয়না! যে পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠেছি, সেখানে এরকম ব্যাপারগুলো আমাদের দূরতম ভাবনাতেও আসেনা। স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে তো আমরা সবসময়েই টিফিন ভাগ করে খেতাম, কই তখন তো কে হিন্দু কে মুসলমান, সে চিন্তা কখনো মনে আসত না! আমার বাবার সহকর্মীদের মধ্যে, বা বাড়ীতে আসা ছাত্রদের মধ্যেও তো নানা সম্প্রদায়ের মানুষই ছিলেন! অথচ, এই মায়ের মনের যে সংস্কার, যা কিনা মায়ের বাৎসল্যেরও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটাও তো অস্বীকার করতে পারছিনা! আসলে, এটাই হয়তো বৃহত্তর ভারতবর্ষের সাধারণ চিত্র! যতদিন না সকলের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে, ততদিন এই অন্ধকার থেকে নিস্তার নেই!
অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটা বিরাট লেক আছে, Powai Lake বলে। হয়তো নাম শুনে থাকবেন। সেটা একরকম আমাদের সীমানাও বলা যায়, কারণ তার ওপারেই সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্ক। শুনেছিলাম, সেখানের বাসিন্দারা নাকি মাঝেমধ্যে আইআইটির হাওয়া খেতে আসেন! সম্প্রতি একটি চিতাকে কোনও এক বয়েজ হস্টেলের আশেপাশে নাকি দেখা গেছিল। অনেক বাজনা-বাদ্যি, পটকা ফাটানো ইত্যাদির পরে তিনি প্রস্থান করেছেন। তবে আমাদের সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছে, আর সন্ধ্যের পরে আর বাইরে বেরোতেই বারণ করা হয়েছে। খানিকটা ভয়ে ভয়েই আছি। তবে যারা অনেকদিন ধরে এখানে আছে, বলছে এরকম নাকি বছরে-দুবছরে এক-আধবার আসে, আবার চলেও যায়। যাইহোক, একটু গা-ছমছমে ভাবটা তো কাটাতে পারছি না! আমাদের খড়গপুরে অন্ততঃ এরকম আপদ তো ছিল না!
এর মধ্যেও একটা ভাল খবর এই, যে পুজোর সময়ে বাড়ী থেকে মা আর বাবা আসছেন আমার এখানে। আমার যেহেতু ছুটির কোনো সম্ভাবনা নেই এক্ষুনি। কয়েকদিন থাকবেন এখানে, তারপর পুণে যাবেন আমাদের এক মাসীর কাছে। ক’টা দিন খুব মজা করে কাটানো যাবে। বন্ধুরা বলছিল, এখানে নাকি অনেক বাঙ্গালী film star দের বাড়ীতে বড় বড় পুজো হয়। মায়েদের নিয়ে যাব ভাবছি। আপনি দেখেছেন কখনো? আপনি পুজোর সময়ে কোথায় থাকবেন? জলে না ডাঙায়? আচ্ছা, আপনার বাড়ীর কথা তো কই বলেননি কখনো? কে কে আছেন, বাড়ীতে? এই যে আপনি এতদিন ধরে বাইরে বাইরে থাকেন, তাদের তখন কেমন লাগে? আপনিও নিশ্চয়ই তাদেরকে miss করেন?
পারমিতা
পুনশ্চ: আগের চিঠির শেষ লাইনের সম্বোধনটাই বরাবর বজায় রাখলে কেমন হয়?
------------------------------------------
৮ অক্টোবর
পারমিতা,
আগের চিঠির শেষ লাইনে কি লিখেছিলাম? সেই চিঠিতে আবেগের বশে অনেক কথাই লিখেছিলাম মনে আছে, কিছু কি বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম? একটু ধরিয়ে দেবেন please?
হ্যাঁ, Powai Lake এর কথা তো নিশ্চয়ই শুনেছি, বোম্বে শহরে জল সরবরাহের যে কয়েকটি সংস্থান আছে, এটি তার একটি। কিন্তু কখনো যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু এরকম বন্যজন্তুর আসা-যাওয়া তো সত্যি দুশ্চিন্তার ব্যাপার! সাবধানে থাকবেন, একা কোথাও ঘোরাঘুরি করবেন না!
অত্যন্ত আনন্দের খবর – পুজোয় আপনার বাবা-মা আসছেন আপনার কাছে। পুজো খুব ভাল কাটুক, আমার আগাম শুভেচ্ছা রইল। না:, আমার কখনো বম্বের পুজো দেখা হয়ে ওঠেনি। ওই তারকাদের বাড়ীর পুজোর খবরও আমার কেবল কানে শোনা-ই থেকে গেছে! আসলে আমাদের duty scheduleটা এমনভাবে নিজেদের মধ্যে ঠিক করা থাকে যে দুর্গাপুজোর সময়টা আমরা বাঙালীরা ছুটিতে থাকতে পারি, আর উত্তর-ভারতীয়রা ছুটি নিতে পারে দীপাবলিতে - তাদের কাছে সেটা অনেক বড় উৎসব - আর আমরা তখন জলে ফিরে যাই। কাজেই পুজোর সময়ে আমার কখনোই এই শহরে থাকা হয়না। এবারে আরেকটা উপরি পাওনা হয়েছে – বাড়ী ফেরাটা এবারে আর ট্রেনে ধাক্কা খেতে হবেনা দুদিন ধরে। কাল সকালেই উড়ে ফিরে যাব। এমনিতে আমার গতকাল বম্বে ফেরার কথা ছিল, আর ট্রেন ছিল আজ ভোরের। কিন্তু কোনো কারণে আমাদের crew-change helicopterটি কাল আসতে পারেনি, আজ এসেছে। ফলে আমার মতো সকলেই বাড়ী ফেরার ট্রেন ধরতে পারেনি! এরকম ক্ষেত্রে কোম্পানী open air ticket এর ব্যবস্থা করে দেয়। আমি কাল সকালের ফ্লাইটে জায়গা পেয়েছি, ট্রেনে গেলে যখন পৌঁছতাম, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই বাড়ী পৌঁছে যাব।
আমার কর্মক্ষেত্র নিয়ে একবার আপনি কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন, মনে পড়ছে। খুবই স্বাভাবিক। সচরাচরের দশটা – পাঁচটা অফিস জীবন, বা, এমনকি কল-কারখানার ডিউটির জীবনের থেকে এটা একেবারেই আলাদা! মানসিক বৈকল্য কারুর কারুর যে হয়না তা নয় – তবে সে সংখ্যায় নগণ্য। ঝুঁকি তো আছে বটেই, আর এই কারণেই, সাধারণ মানুষজনকে সেখানে যেতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! এমনকি আমাদের অফিসেরও, যাদেরকে কাজের সূত্রে প্রয়োজন, কেবলমাত্র তারাই এখানে আসতে পারে, তাও বিভিন্ন স্তরের অনুমোদনের পরেই! আমাদেরকে নিয়মিতই নানান রকম safety drills & trainings ও অভ্যাস করতে হয়! আর, বিভিন্ন discipline এর মানুষকে যখন একসঙ্গে একই জায়গায় থেকে কাজ করতে হয়, যেখানে বিপদ যদি আসে, তো প্রাণসংশয় সকলেরই হতে পারে, তাই সবার মধ্যে একটা দারুণ ভাল bonding তৈরী হয়ে যায়! এটা এখানে একটা বড় প্রাপ্তি!
পুজো কেমন কাটল অবশ্যই জানাবেন। আপনার মা ও বাবাকে আমার প্রণাম জানাবেন।
রক্তিম
------------------------------------------
পরিমল ইদানীং কলকাতায় আসার খুব একটা ফুরসত পাননা। যাও বা আসেন, নানা কাজ থাকে হাতে। কিন্তু এবারে একটি বিশেষ অনুরোধে শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সময় বার করতে হয়েছে। প্রথমজীবনে তিনি আর্মিতে ছিলেন, ’৭১ এর যুদ্ধের কিছু পরে অবসর নিয়ে গত ১৫ বছর যাবৎ এলাহাবাদে থিতু হয়েছেন। কয়েকরকমের ব্যবসাপত্র ছাড়াও, স্থানীয় বাঙালী সমাজে তিনি একজন জনপ্রিয় মুখ। তা, কয়েকমাস আগে ওখানেরই একটি বিয়েবাড়িতে পরিচয় হয় কলকাতা থেকে আসা জনৈক মিঃ গাঙ্গুলীর সাথে। কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল, ওনাদের মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে, শ্রীরামপুরের দেবল মুখুজ্যের ছেলের সঙ্গে।
আরে দেবলদা? ওর ছেলে, মানে কি যেন নাম, বুবাই, না?
হ্যাঁ, ওটা ওর ডাকনাম। আপনি চেনেন নাকি?
আরে দেবলদা তো আমার দাদার সম্বন্ধী হয়! অবশ্য অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই!
ও, তাই? গাঙ্গুলী দম্পতি এবার একটু নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় করলেন।
সেই বিয়েবাড়ির মধ্যে আর তখন এর বেশী কথা এগোয়নি। কিন্তু তার দুচারদিন পরেই একদিন ওই দম্পতি খোঁজখবর করে পরিমলের বাড়ীতে এসে হাজির। অপ্রত্যাশিত হলেও, আতিথেয়তার অভাব রাখলেন না পরিমল। তারপর আবার দাদার সূত্রে কুটুম্বিতাও বেরিয়ে পড়েছে! কিছুটা উপক্রমণিকার পরে আসল কথা এল, -
দাদা আপনার বিশেষ সাহায্য চাইতে এসেছি, মেয়েটা আমাদের বড় কষ্টে আছে। আমাদের একমাত্র মেয়ে, অনেক আশা নিয়েই বিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন…
পরিমল বিস্মিত হলেন। দেবলদাকে তিনি যতটুকু চিনেছেন, নিপাট ভালমানুষ, কারো সাতে পাঁচে থাকেননা। ছেলেমেয়েদের মন দিয়ে মানুষ করেছেন। ওই বুবাই আর ওঁর দাদার দুই ছেলে প্রায় পিঠোপিঠি, যত ভাব, তত খুনসুটি, ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেন।
আসার আগেই বুঝেছিলেন ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু এতটা যে পরিস্থিতি জটিল হয়ে থাকবে, তা তিনি আন্দাজও করতে পারেননি। যে ছোট্ট বুবাইকে তাঁর মনে ছিল, সে নাকি এখন এক মস্ত নামী কোম্পানীর বড়সড় অফিসার হয়েছে! পড়াশুনায় বরাবরই ভাল ছিল ছেলেটা, আর ছিল বই-অন্ত প্রাণ! সুন্দর স্বভাবের জন্য আত্মীয়মহলে সবারই খুব আদরের ছেলে, আবার সেই কারণেই তাঁর ছোট ভাইপোর কিছুটা ঈর্ষারও কারণ ছিল। সেই বুবাইয়ের বিয়ে দিয়েছেন দেবলদা, মাসছয়েক হল। সম্বন্ধটা কোনো পরিচিত মহল থেকেই এসেছিল, কথাবার্তা চলেছিল কয়েকমাস, তারপর বিয়ে। গাঙ্গুলী দম্পতি নাকি বেশ কয়েকবার এসেওছিলেন এদের বাড়ীতে, বিয়ের আগে। গাঙ্গুলীমশাই নিজের পরিচয় দেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে, পুরনো চার্টার্ড ফার্ম আছে ওনাদের, এই লীনা তাঁদের একটিমাত্র সন্তান। সে তখন কলেজে পড়ছে। থাকেন সন্তোষপুরের দিকে। পরিমল জানেন, দেবলদা অত্যন্ত সহজসরল মনের মানুষ, অনেক সময়েই মুখের কথাতেই মানুষকে বিশ্বাস করে থাকেন। এই করতে গিয়ে ঠকেছেনও অনেকবার, কিন্তু মানুষের স্বভাব কি আর পালটায়! উপরন্তু এই গাঙ্গুলী দম্পতি আবার খুব মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন, এককথায় আপন করে নিতে পারেন যে কাউকে। দেবলদাও সেই মিষ্টি কথাতে বিশ্বাস করেছেন!
কিন্তু লীনা নাকি বিয়ের পর থেকেই এই “শ্বশুরবাড়ির দমবন্ধ পরিবেশ” নিয়ে নিজের মায়ের কাছে অভিযোগ জানাতে থাকে। বুবাইএর যেহেতু চাকরির কারণে নিয়মিতই বাইরে যেতে হয়, সেই সময়গুলোতে লীনা ফিরে যেত বাপের বাড়ি। তারপর বুবাইকে গিয়ে ফিরিয়ে আনতে হত। কিন্তু গত তিনমাস সে মেয়ে আর এবাড়ি আসেনি। কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করার পর বুবাইও হাল ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে আত্মীয়মহলে মর্যাদাহানির ভয়ে দেবলদাও এবিষয়ে কারুর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেননি। আজ এতদিন পরে পরিমলকে পেয়ে, এবং সে যেহেতু খানিকটা একতরফা শুনেই এসেছে, দেবল তাঁর কাছে ভেঙে পড়েছেন।
------------------------------------------
১২ই ডিসেম্বর, ‘৯২
কলকাতা
পারমিতা,
অনেকদিন পরেই লিখছি আপনাকে। জানি, ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই আপনার একাধিক চিঠি আমার অফিসের ঠিকানায় জমা পড়েছে, আর আপনিও উত্তর না পেয়ে উতলা হয়ে পড়েছেন! চিন্তা করবেন না, এখন অনেকটা ভালো আছি।
আমার হাতের প্লাস্টার খোলা হয়েছে দিন সাতেক হল। এখনো physiotherapy কিছু চলছে। পুরোপুরি জোর ফিরে পেতে আরেকটু সময় লাগবে। আশা করছি আর হপ্তাখানেকের মধ্যে ডাক্তারের অনুমতি পেতে পারি কর্মস্থলে ফেরার। ডান হাত তো, তাই লেখালেখি কিছুই এর মধ্যে করে উঠতে পারিনি! এই চিঠিও হয়তো কয়েক কিস্তিতে শেষ করতে পারব।
হয়েছিল কি, পুজোর পরে যখন dutyতে ফিরি, সেইসময়ে একদিন একটা ছোট অ্যাকসিডেন্টে ডানহাতে চোট পাই। বিপদ একটা ঘটেছিল বটে, কিন্তু তাতেও একটা silver lining ছিল। কয়েকজন মানুষকে অনেক আপন করে জানতে পারলাম। Rigএ আমি সেদিন নাইট শিফটে ছিলাম। আমার ল্যাবের পাশের একটা সিঁড়িতে পা পিছলে গেছিল, সামলাতে গিয়ে ডান হাতটা রেলিঙে আটকে গেল। একটা ‘মট’ করে আওয়াজও পেলাম – নিজের হাড় ভাঙার শব্দ! ওখানে যে ডাক্তার থাকেন, তিনি জানালেন X-Ray করে দেখতে শহরে যেতে হবে। সেইমতো special helicopter sortie-র অনুরোধ জানানো হল, base officeএ। আমার যে কোলিগ ডে শিফটে ছিল, সে-ই সব করল, এমনকি আমার ব্যাগও সেই গুছিয়ে দিল!
এদিকে আমার পক্ষে একা আর একহাতে সব সামলানো সম্ভব হবেনা জেনে অফিস থেকে একজনকে আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে পাঠানো হল। তিনি আমায় নিয়ে গেলেন হেলিবেস থেকে হাসপাতালে, সেখানে fractureই ধরা পড়ল, 3rd & 4th metacarpals, মানে আঙুল আর কবজির মাঝের হাড়গুলোর দুটোতে। সেখান থেকে আমাকে তিনি অফিসের হোটেলেও পৌঁছে দিলেন। এসব করতে করতে বিকেল শেষ হয়ে গেছিল। আমি প্লাস্টার করা হাত নিয়ে থাকতে পারব কিনা ভেবে আমাকে সাহায্য করতে তিনি নিজে আমার সঙ্গে রাতটা থেকে যেতেও চাইলেন! অথচ এই মিঃ গুনশেখরণ আমাদের সেকশনে অল্পদিন হল ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে আমার সামান্য মুখচেনাটুকুই হয়েছিল মাত্র! অনেক বুঝিয়ে, আশ্বস্ত করে তাঁকে বাড়ী ফেরত পাঠালাম!
এবার এল পরের চিন্তা। একহাতে প্লাস্টার নিয়ে বোম্বেতে থাকা তো সম্ভব হবেনা, কাজেই আমাকে বাড়ী ফিরতে হবে। তার জন্য ট্রেনের টিকিট পেতে হবে, এবং সে চেষ্টা কালই করতে হবে! পরদিন অফিসে গিয়ে ছুটিরও ব্যবস্থা করতে হবে। ইতিমধ্যে হোটেলে আলাপ হল একজন চৌধুরীদার সঙ্গে, তিনিও আমার মতোই, কলকাতা থেকে আপ-ডাউন করেন, সেদিনই offshore থেকে ফিরেছেন, পরদিন বোম্বে মেলে তাঁর টিকিট। আমার দুর্ঘটনার কথা শুনে নিজে থেকেই অফার দিলেন, যদি ট্রেনের টিকিট না পাই, ওনার কনফার্মড বার্থ আছে S7 কোচে, আমি যেন সেখানেই চলে যাই, কোনোরকমে ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে! আমি ভাবতেই পারিনি! এ যেন সত্যিই মেঘ না চাইতেই জল! তাই করতে হল পরদিন। আশঙ্কামতোই, কোনো টিকিট পেলাম না। এমন কি, আমার বর্তমান পরিস্থিতিতে রেলের emergency quotaর জন্য একটা দরখাস্ত দিয়েও কোনো লাভ হল না। স্টেশনে টিটির সঙ্গে কথা বলতে বিশেষ লাভ হল না, শুধু আমার অবস্থা দেখে “আগার আপ খুদ মেনেজ কর সকতে হো তো দেখ লো” বলে কেটে পড়লেন। মানে যাত্রাটুকু করার অনুমতি পেলাম, আপাততঃ। চৌধুরীদার কোচে গিয়ে দেখি ওনার আপার বার্থ, আর নীচের দুটো বার্থে দুজন বয়স্ক দম্পতি। কাউকে যে অনুরোধ করব, আমাদের জন্য একটা নীচের বার্থ ছেড়ে দিতে, তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। বুদ্ধি করে কিছু পুরনো খবরের কাগজ সঙ্গে এনেছিলাম। অগত্যা, সেটাই দুই বার্থের মাঝে পেতে মাটিতে শোওয়ার পরিকল্পনা করছি, তাতে আবার বৃদ্ধ দম্পতির ঘোরতর আপত্তি! ওনারা দুজনেই ডায়াবেটিক, রাতে বারবার বাথরুম যেতে হয়, ইত্যাদি! আমি আর চৌধুরীদা অনেক বুঝিয়ে ওনাদের নিমরাজি করানো গেল! পরদিন অবশ্য খুব একটা অসুবিধে হয়নি, বিকেলের দিকে দুর্গ বা রায়পুরের কাছাকাছি একটা বার্থও পেয়ে গেছিলাম।
আমি হয়তো আর হপ্তা দুয়েকের মধ্যেই বোম্বে রওনা দিতে পারব। তারপরে আবার কথা হবে।
রক্তিম
------------------------------------------
২২ ডিসেম্বর
রক্তিম!
এসব কি কাণ্ড? খুব চিন্তায় থাকলাম! এখন কেমন আছেন?
কবে ফিরছেন এখানে?
একবার দেখা হতে পারবে? খুব ইচ্ছে করছে!
পারমিতা
------------------------------------------
৩০ ডিসেম্বর ‘৯২
বোম্বে
পারমিতা,
আজ সকালেই ফিরেছি। কপালক্রমে, কালই একটা Rigএ shift change আছে, যদিও আমি নিয়মিত যেখানে যাই সেটার থেকে আলাদা। অনেকগুলো দিন ছুটি নিতে হল, তাই আমিও আর আপত্তি করিনি। কাজেই বুঝতে পারছেন তো, যে আমি এখন একদম ঠিক আছি!
আপনার চারটে চিঠি একসঙ্গে জমা হয়েছিল। কিন্তু ওই শেষের চিঠিটায় অমন অন্তর থেকে ডাক শুনে আর থাকতে পারলাম না। নিজেকে বড় গৌরবান্বিত লাগছে! আবার এ-ও মনে হচ্ছে, এতোটা সম্মানের আমি যোগ্য তো? আপনার হস্টেলে পৌঁছে গেছিলাম আজ বিকেলে, কোনো খবরপত্তর না দিয়েই। তার আর সময়ও ছিলনা অবশ্য! গেছিলাম, কিন্তু দেখা হল না। আপনিই বা কি করে জানবেন যে আজই আমি…!! আসলে ফেরার ট্রেনের টিকিট কিছুতেই পাচ্ছিলাম না, তাই সঠিক ফেরার তারিখটাও বুঝতে পারছিলাম না। মোদ্দা কথাটা হল, এ যাত্রায় আর দেখা হচ্ছে না। আবার ডাঙ্গায় ফেরা ১৪ই জানুয়ারী, কিন্তু সেই রাতেরই ট্রেন। পরদিন সকালের ট্রেনটার টিকিট পেলাম না। ও ভাল কথা, এখানে শুনলাম বাবরি মসজিদ কান্ড নিয়ে বেশ দাঙ্গা লেগেছিল? ওখানের ক্যাম্পাসের ভেতরে নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধে হয়নি? তবু, সাবধানে থাকবেন।
রক্তিম
----------------------------------------
৩ জানুয়ারী, ১৯৯৩
রক্তিম,
এত আফসোস হচ্ছে যে কি বলব! আপনি এলেন, অথচ দেখা হল না! আসলে আমার রুম পার্টনার রেশমী অনেকদিন ধরেই বলছিল, এখানে ওর এক চাচীর বাড়ি আমায় নিয়ে যাবে, কিন্তু কেন যে ঠিক ওই দিনটাতেই আমাদের যেতে হল!
আবার অন্ততঃ একমাস, তাহলে?
এখানে দাঙ্গার খবর তো কাগজে নিশ্চয়ই জেনেছেন। না, আমাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে কোনোরকম অসুবিধে হয়নি। তবে ওই কয়েকটা দিন সিকিউরিটির নজরদারী অনেক বেড়ে গেছিল, কাউকে বাইরে যেতে দিচ্ছিল না (আর যাবেই বা কে?), বাইরে থেকে কাউকে আসতেও দেওয়া হচ্ছিল না। তবে বাইরে তো ভীষণ সব কান্ড ঘটেছে, টিভিতে আর কাগজে যা দেখলাম!
পরেরবার কি তাহলে দেখা হতে পারবে? আমি কিন্তু দিন গুনছি, এখন থেকে!
পারমিতা
------------------------------------------
আরতি মাসি বুবাইএর এক দূরসম্পর্কের মাসি। কালেভদ্রে যোগাযোগ হয়। মেসো ছিলেন কোনো বড় সরকারি অফিসে। ভবানীপুর অঞ্চলের প্রাচীন ও বনেদী পরিবার। অনেক অল্প বয়সে মেসো যখন মারা যান, ওদের মেয়ে টুকাই তখন বোধহয় বছর ছয়েকের হবে। সেই টুকাই বর্তমানে ব্যাঙ্কের অফিসার! বুবাইয়ের বিয়েতে মাসি একাই এসেছিলেন। এখন সেই আরতিমাসির ফোনটা পেয়ে হঠাৎ একটু অবাকই হয়েছিল বুবাই। মাসির বক্তব্য, এরমধ্যে কোনো একদিন নাকি গড়িয়াহাটের রাস্তায় দেখা হয়েছিল লীনার সঙ্গে। ঘটনাক্রমে টুকাইও সঙ্গে ছিল, এবং পরিচয় বেরিয়ে যায় যে টুকাই ও লীনা কোনো এককালে একই কোচিং ক্লাসে বান্ধবী ছিল। বুবাই যদিও ভালভাবেই জানে যে ওদের বর্তমান পারিবারিক বিপর্যয়ের খবর আরতিমাসি কেন, প্রায় কোনো আত্মীয়মহলেই জানানো হয়নি, কিন্তু এইধরণের আত্মীয়দের সংবাদ সংস্থার অভাব ঘটেনা, বিশেষত মুচমুচে খবর হলে! গত ছমাস যে লীনা এবাড়ি ফেরেনি, সে খবরও মাসি নিয়ে নিয়েছেন। মাসি এখন নিজে থেকে একটা মধ্যস্থতা করতে চাইছেন।
সব শুনে দেবলবাবু কিছুটা নিমরাজি হয়েই প্রস্তাবে সায় দিলেন। সেবার পরিমল অনেক চেষ্টা করেছিলেন। দেবলবাবুর কাছে সব ঘটনা বিস্তারিত জেনে, নিজেই গিয়েছিলেন গাঙ্গুলীবাড়িতে। পরে দেবলবাবুকে ফোনে সব জানান। ওনার মনে হয়েছিল, লীনা যেন কোনোভাবে তার বাবা-মাকে ব্ল্যাকমেল করছে। সে যেন-তেন প্রকারেণ এবাড়িতে আসতেই চায়না। পরিমলের এও মনে হয়েছিল, হয়তো একমাত্র সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে বড় করার ফলস্বরূপ, তার বাবা-মা তাকে আজ আর কোনোরকম শাসন করার জায়গায়ই নেই! খুব দুঃখ প্রকাশ করে তিনি এলাহাবাদ ফিরে গেছিলেন।
মাঝে আরো কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। বিয়ের পরে পরেই, মূলত দেবলবাবুর উদ্যোগেই, বুবাইএর ব্যাঙ্ক একাউন্টে লীনার নামটাও জয়েন্ট হোল্ডার হিসেবে ঢোকানো হয়েছিল। বুবাইয়ের মাইনের টাকাপয়সা সেখানেই জমা হত। এর মাঝে একদিন হঠাৎ ব্যাঙ্কে গিয়ে বুবাই আবিষ্কার করে, তার একাউন্ট সাসপেন্ডেড! কারণ? জয়েন্ট হোল্ডার নাকি তার আপত্তি জানিয়েছে ব্যাঙ্ককে। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাঙ্ক আপাততঃ একাউন্ট সাসপেন্ডেড করে রেখেছে! এই নিয়ে আইনি পরামর্শ নেবার কথাও যে মাথায় আসেনি তা নয়, কিন্তু এক তো আইনজ্ঞ মহলে দেবলের কেউ চেনাজানা নেই, তাছাড়া যার কাছেই খোঁজ নিতে যাবেন, কারণটা বলতেই হবে! তাই লোকলজ্জা এড়াতে এ নিয়ে আর অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু উপায় ঠিক করা হয়ে ওঠেনি। আর, বুবাইয়ের মনে কোথাও একটা ক্ষীণ আশা বুঝি ছিল যে এ সবই লীনার ছেলেমানুষি, হয়তো কেটে যাবে একটু সময় দিলে!
যাইহোক, আরতিমাসি নিজেই বুবাইকে নিয়ে গেলেন সন্তোষপুরে। সঙ্গে টুকাইও ছিল। দেখা গেল টুকাই ও লীনা বেশ সাবলীলভাবেই গল্প করছে – যেন কিছুই হয়নি। বুবাই একপাশে চুপচাপই ছিল। আরতিমাসি নানাভাবে বোঝানোর পরে লীনা তার অভিযোগের ঝুলি খুলে বসে – তার শ্বশুরবাড়ীর পরিবেশ, সেখানের প্রাচীনপন্থী ধ্যানধারণার মানুষজন, এমনকি বুবাইও যে গত ছয়মাসে তার খবর নেয়নি, ইত্যাদি। আরতিমাসি তাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি নিজে মাঝেমাঝে শ্রীরামপুর যাবেন, আর বুবাই যেন যত তাড়াতাড়ি পারে ওকে ওর কর্মস্থলে কোয়ার্টারে নিয়ে যায়। মোটকথা, লীনা শেষ অবধি রাজী হয়ে যায় শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে, তবে যখনই বুবাই ওর কাজের জায়গায় যাবে, ওকে আবার সন্তোষপুর আসতে দিতে হবে। যদিও এ ব্যবস্থায় বুবাইয়ের আদৌ সায় ছিল না, কিন্তু মাসির মুখের ওপর কিছু বললও না।
তবে এই ব্যবস্থাও একমাসের বেশি স্থায়ী হল না।
------------------------------------------
১৭ জানুয়ারী ১৯৯৩
কলকাতা
পারমিতা,
সাঙ্ঘাতিক এক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আগের চিঠিতে জানিয়েছিলাম, ১৪ই জানুয়ারী আমার ফেরার কথা। কিন্তু ১১ই থেকেই শহরে আবার দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল! আমরা offshore থেকেই খবর শুনছি আর আশঙ্কায় রয়েছি, কি হবে – নির্দিষ্ট দিনে crew change chopper আসতে পারবে কিনা, এলেও, শহরে পৌঁছে কতদূর কি যেতে পারব, যাদের আসার কথা, তারাই বা কি করে আসবে, ইত্যাদি! এটাও খবর পেলাম যে লোকাল ট্রেন অল্প কিছু চলছে, আর সেটাই তুলনামূলকভাবে নিরাপদ! ভাবতে ভাবতেই একসময়ে খবর এল যে আমাদের chopper আসছে। আমার পরিবর্ত যে এল, chopper থেকে নামার সময় বলে গেল, শহরের অবস্থা খুবই খারাপ, কপাল ভাল থাকলে বেরিয়ে যেতে পারবি! যাইহোক, শহরের কাছাকাছি এসে ওপর থেকে দেখি, সব বড় বড় রাস্তাগুলো খাঁ খাঁ করছে, যেখানে নিয়মিত গাড়ীর লাইন লেগে থাকে, সেখানে কোথাও জনমানুষও দেখা যাচ্ছে না! হেলিবেসে আমাদের কোম্পানীর গাড়ী থাকে, কাছের Vile Parle স্টেশন অবধি ছেড়ে দেয়, কিন্তু আজ বলল হেলিবেসের গেট অবধিই যেতে পারবে। হেলিবেসের বাইরে দেখি সেই খালি রাস্তা, কোনো গাড়ীঘোড়া নেই! আমাদের অফিসের গেস্ট হাউসটা Santa Cruz East এ, সেখানে অবধি পৌঁছতে হলে কিছুটা sensitive এলাকা পেরোতে হবে। আমরা তিনজন ছিলাম, ভাবলাম হেঁটেই এগোতে থাকি, এখান থেকে প্রায় ৩/৪ কিমি রাস্তা হবে, তারপর দেখা যাবে। খানিক দূরে একটা অটো দেখতে পেলাম, কিন্তু তাকে আমাদের গন্তব্য জানাতেই, বেঁকে বসল। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পরে সে বলল যাবে, কিন্তু খানিক দূর অবধি। অগত্যা, তাই সই! একটু পরেই, SV Road থেকে বাঁদিকে ঘোরার মুখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর যাবে না। তাকে আবার একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে – ওই তো সামনে রাস্তা খালি রয়েছে, কিছু হবেনা, আরেকটু চল ভাই – এই করে করে প্রায় আমাদের গেস্ট হাউসের অনেকটা কাছাকাছিই সে পৌঁছে দিল। পুরো পথটায় কোনো দ্বিতীয় গাড়ীঘোড়া দেখতে পেলাম না! কিছু পরে, গেস্ট হাউসের ছাদের ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে উঠেছি, দেখি কিছু দূরে হাইওয়ের পাশে ঘন কালো ধোঁয়া উঠছে – মনে হল কোনো গাড়ীতে আগুন লাগিয়েছে। মাত্র আধঘন্টা আগেই, ঠিক ওই জায়গা দিয়ে আমরা হেঁটে ফিরছিলাম!
আমার অফিসে কিছু কাগজপত্র পৌঁছানোর ছিল, কিছু রিপোর্ট ইত্যাদি, কিন্তু এখন যাবো কি করে? বসকে ফোন করলাম, তিনি তো শুনেই আঁতকে উঠলেন, বললেন ভুলেও এদিকে আসতে যেও না! তোমার ট্রেন কখন? টিকিট সঙ্গেই আছে তো? সাবধানে সময় থাকতে থাকতে বেরিয়ে যেও! জানতে পারলাম, অফিসের এলাকায় গন্ডগোল শুরু হয়েছে, সবাইকে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাকে আরো বললেন, রিপোর্টটা একটা খামে করে অফিসের ঠিকানা লিখে সামনের লেটারবক্সে ফেলে দাও, যখন আসার আসবে!
আমার ট্রেন ছিল সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়, VT Station থেকে। এখান থেকে লোকাল ট্রেনে ঘন্টাখানেকের বেশী লাগার কথা নয়। কিন্তু তিনটে নাগাদই আমাদের কেয়ারটেকার এসে বলল, বাইরের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে, আপনারা বেরিয়ে পড়ুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব VT Station পৌঁছে গেলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন, সেখানে পুলিশও থাকবে। তাই করলাম। ওখান থেকে Santa Cruz স্টেশন হাঁটা পথের দূরত্বে। পুরো জায়গাটায় যেন শ্মশানের স্তব্ধতা! দুয়েক জায়গায় বন্ধ দোকানের সামনে এক-দুজনের জটলা রয়েছে। লক্ষ্য করলাম, আমাদের দেখে যেন তাদের ভ্রূকুটি বেড়ে গেল! কপালক্রমে, আমি আবার কিছুদিন হল সখ করে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছিলাম – বুঝতে পারলাম না, ওই দাড়ি দেখে আমাকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ ভেবে নিচ্ছে কিনা! আমার বন্ধুদের বললাম, তোরা একটু আমার থেকে দূরত্ব রেখে চল, যদি কিছু হয়, যেন একজনের ওপর দিয়েই যায়! যাইহোক, নির্বিঘ্নেই SantaCruz স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে VT-র ট্রেনও এসে গেল। ট্রেন প্রায় খালি, একটা-দুটো কামরায় দু-চারজন করে রয়েছে। VT অবধি রাস্তাতে মাঝেমধ্যেই এদিকে-ওদিকে লাইনের পাশে রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। রীতিমত আতঙ্কের আবহ একটা! Vadala স্টেশন থেকে আমাদের কামরায় দুজন পুলিসের লোক উঠল, খানিকটা বুকে বল এল! কিন্তু VT স্টেশনে আর এক অভাবনীয় দৃশ্য অপেক্ষা করে ছিল। দেশভাগের পর শিয়ালদা স্টেশনে শরণার্থীদের ভিড়ের কথা শুনেছিলাম, এখানে সেটা প্রত্যক্ষ করলাম! VT স্টেশনের প্লাটফর্মগুলো কিরকম লম্বা, মনে আছে তো? Suburban আর long distance, অতগুলো প্লাটফর্মের সবকটার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য জুড়ে থিকথিক করছে মানুষ, কোথাও একফোঁটাও তিলধারণের জায়গা নেই! দেখেই মনে হল, বেশিরভাগই পরিযায়ী শ্রমিক, হয়তো বিহার-ইউপি থেকে হবে, পরিবার, ছানাপোনা, বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে এসে বসে গেছে স্টেশনে, যেহেতু এখানটা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ! বিহার এবং ইউপির জন্য রেলওয়ে থেকে কিছু স্পেশাল ট্রেনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। এতো ঠাসাঠাসি ভীড় যে এর মধ্যে পা ফেলাও দুঃসাধ্য! যাইহোক, কোনোরকমে তারই মধ্যে পথ বার করে দোতলার ওয়েটিং রুমে পৌঁছে গেলাম। সেখানে অতটা ভীড় নেই। আমার ট্রেন ছাড়ার সময়ে দেখলাম, রিজার্ভ কামরাগুলোর সামনে পুলিশ রয়েছে, আমাদের টিকিট আছে দেখেই তবে উঠতে দিচ্ছে। আমার এবারের টিকিট ছিল ফার্স্ট ক্লাসের। সেখানে একজন দীর্ঘদেহী সর্দারজীকে পেলাম সহযাত্রী। একটু পরে এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এসে বসতে চাইলেন। বললেন, তিনি রেলেরই স্টাফ, যাবেন কল্যাণ অবধি, অন্য কামরায় উঠতে পারছেন না, যদি এটুকু সময় আমরা বসতে দিই। তা বসুন না, আমাদের আর কি! কিন্তু ইতিমধ্যে দেখছিলাম কামরার প্যাসেজ দিয়ে অনেক লোকজন যাতায়াত করছে। পাছে সেখান থেকে কিছু উটকো উপদ্রব এসে পড়ে, তাই মনে হল আমাদের ক্যুপের দরজাটা বন্ধ করে রাখি। সর্দারজী সেটা করতে যেতেই ওই ভদ্রমহিলা যেন ভুত দেখেছেন, এমন ত্রস্তভাবে উঠে একছুটে কামরা থেকে পালিয়ে গেলেন! বুঝলাম, দাঙ্গা এক এমনই জিনিস, মানুষের ওপর সাধারণ বিশ্বাসটুকুও উপে যায়! ট্রেন ছাড়ার পরে বাকী পথে আর তেমন কিছু ঘটেনি, নির্বিঘ্নেই বাড়ী পৌঁছে গেছি।
এইসব অবস্থার মধ্যে, স্বাভাবিকভাবেই, আর আপনার খবর নেওয়ার কোনো সুযোগই ঘটেনি। আশাকরি আপনারা ক্যাম্পাসের মধ্যে নিরুপদ্রবেই ছিলেন/আছেন। এ চিঠি যখন পৌঁছবে, ততদিনে নিশ্চয়ই পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে! আমার এবারের ফেরার কথা ছিল স্বাভাবিক রুটিনে ২৭ তারিখে, কিন্তু এখানে একটু কাজ আছে, তাই দিনকয়েক পরে ফিরব। মানে, ওমাসের ৩ তারিখে বোম্বে পৌঁছব। সেদিন কি দেখা হতে পারবে?
রক্তিম
পুঃ শখের ফ্রেঞ্চকাটটি বিসর্জন দিয়েছি, বাড়ি এসেই!
------------------------------------------
২৫ জানুয়ারী, ‘৯৩
রক্তিম,
বড় বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। ওই সময়ে আমরাও হোস্টেলের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় বসে টিভির খবরেই বাইরের দাঙ্গার ভয়াবহ সব খবর আর দৃশ্য দেখেছি/শুনেছি। আমাদের এলাকায়, মানে ক্যাম্পাসের বাইরে, বেশ কিছু গোলমালের খবর কানে এসেছে। খবরের কাগজও তো ৩/৪ দিন আসেনি। লোকাল ট্রেনও যে অনিয়মিত চলছে, জানতে পারলাম আমাদের housekeeping maid রা যখন এল কয়েকদিন পরে, তাদের থেকে! আর সেই পরিস্থিতিতে আপনি এই দাঙ্গাবিদ্ধস্ত শহরের ওপর দিয়ে গেছেন! ভাবতেই তো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! ওদিকে বাড়িতেও বাবা-মা খুব চিন্তা করছিলেন কাগজে/টিভিতে এসব দেখে।
যাইহোক, আপনি যে নিরাপদে পার হয়ে যেতে পেরেছেন, এটা শুনেই নিশ্চিন্ত হলাম। আর এই চারিপাশের অবিশ্বাসের আবহাওয়ায়, ওই ট্রেনের ঘটনাটাও হয়তো খুব অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য তার ৩/৪ দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। আর এখন তো দেখলে বোঝাই যাবে না যে মাত্র ক’দিন আগেই ওরকম পরিবেশ ছিল সারা শহরে!
আপনি আসবেন, এর চেয়ে আনন্দ সংবাদ আর কি হতে পারে? আমি হোস্টেলের ফোন নম্বর জানিয়ে দিচ্ছি, আপনি যখনই এসে পৌছবেন, একবার ফোন করলেই আমি মেন গেটের কাছে চলে আসব, যাতে আপনার কোনো অসুবিধে না হয়।
পারমিতা
পুনশ্চ: আপনাকে ফ্রেঞ্চকাটে কেমন মানিয়েছিল? দেখা হলনা!
------------------------------------------
৪ ফেব্রুয়ারি, ‘৯৩
বোম্বে
রক্তিম,
গতকালের সন্ধ্যেটা আমার অনেকদিন মনে থাকবে। আমি কোনোদিনও ওই চৌপাট্টি দেখতে যাইনি এর আগে। একবার বন্ধুদের সাথে জুহু বীচে গেছিলাম, কিন্তু সেখানে যেন বড্ড ভীড়! রেস্টুরেন্টটাও খুব ভাল ছিল। বেশ সুন্দর পরিবেশ।
আপনার দেওয়া ড্রেসটাও খুব ভাল ফিট করেছে। আমার এক রুমমেট, রেশমী তো আপনার রীতিমতো ফ্যান হয়ে পড়েছে! দেখবেন মশাই!
আরেকটা ভাল খবর আছে। আজই অফারটা পেলাম। আমার guide চাইছেন, আগামী সপ্তাহে আমি UG তে ওনার কিছু ক্লাসে assist করি। মানে, পুরোপুরি পড়ানো নয়, কিন্তু kind of! আসলে আমার যেটা রিসার্চ টপিক, সেই সঙ্ক্রান্ত বিষয়ের course টাতে আমায় স্যারের সাথে থাকতে হবে। আমার কিন্তু খুব নার্ভাস লাগছে! জানিনা কিরকম কি করব! তবে, কালই আপনার দেখা পেলাম, আর আজই এই খবর – তাই একটা feel good factor ও আছে! আপনি নিশ্চয়ই খুব lucky! খবরটা তাই প্রথম আপনাকেই জানালাম, যদিও আপনি তো এ চিঠি পাবেন সেই ১৪ দিন পরেই!
পারমিতা
------------------------------------------
২৫ ফেব্রুয়ারী
কলকাতা
পারমিতা,
না:, এবার বোধহয় সম্বোধনটা বদলে Hello Prof Bagchi! করতে হবে! আর আমিও লোকজনকে বলতে পারব, একজন আইআইটি প্রফেসর আমার বন্ধু! কিন্তু! হ্যাঁ, একটা বিরাট কিন্তু আছে এখানে! আমরা যে আগেরদিন ঠিক করলাম, আর এই ‘আপনি-আজ্ঞে’ এগুলো চলবে না? তাহলে?
তোমার নিজের বিষয়ের ওপর পড়াবে, তাতে নার্ভাস লাগার কি আছে? তাছাড়া তোমার স্যার তো সঙ্গে থাকছেনই! আর আমার মনে হয় এতে তোমারই চর্চা বাড়বে, নিজেরই সুবিধে হবে! তোমার স্যার ও নিশ্চয়ই এইসব ভেবেই তোমাকে ডেকেছেন! যাইহোক, সেসব তো এতদিনে শুরু হয়ে গেছে? কেমন লাগছে? কিরকম অভিজ্ঞতা হল? জানাতে ভুলো না যেন! তবে এই ব্যাপারটার মধ্যে আমার কিন্তু কোনো যোগসাজশ নেই, এটুকু হলফ করে বলতে পারি!
তোমার বন্ধু হঠাৎ আমার ফ্যান হতে গেল কেন? আমার সম্বন্ধে তাকে বাড়িয়ে-চড়িয়ে অনেক কিছু বলেছ, নাকি? একবার কখনো আলাপ করিয়ে দিও ‘খন!
তোমার সঙ্গে সেদিনের সন্ধ্যাটা আমার এই মান্থলি প্যাসেঞ্জারির যান্ত্রিকতার মধ্যে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিল! সাধারণত: আমরা Rig থেকে ফেরা আর পরের দিনের ট্রেন ধরার চিন্তার মধ্যেই সময়টা কাটিয়ে দিই। তার মধ্যে একজন মিষ্টি মনের সুন্দরীর সঙ্গে বম্বে শহরের সৈকতে সান্ধ্যভ্রমণ, যেন সিনেমার মত মনে হচ্ছিল!
সিনেমার কথায় মনে পড়ল। জান কি, আমি এবারে আমার কাজের জায়গায়, মানে সাগরে বসে বসেই একজন রূপোলী পর্দার নায়িকার সাক্ষাৎ পেলাম? তাও একেবারে সরাসরি আমারই কেবিনে! ব্যাপারটা কি হয়েছিল, এবারে ডিউটিতে গিয়েই দেখি, পুরো rig জুড়ে বেশ সাজ-সাজ রব। জানতে পারলাম, আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যেই একটা Parliamentary team এর visit আছে আমাদেরই রিগে। আসলে Parliament এর অনেক রকম কমিটির মধ্যে একটা থাকে COPU – Committee on Public Sector Undertakings, তারা সময়ে সময়ে বিভিন্ন PSU visit করে থাকেন। এর মধ্যে বিভিন্ন দলেরই সাংসদরা থাকেন। এনারা ঘুরে-ফিরে দেখে কোম্পানীর হাল-হকিকৎ সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করেন। এদের দেওয়া রিপোর্টের ওপর তাই সেই কোম্পানীর অনেক কিছু নির্ভর করে। কাজেই এনারা রীতিমতো তোয়াজ পেয়ে থাকেন! আমাদের এই Rigটা এবছরে আমাদের বাৎসরিক ratingএ প্রথম হয়েছে, তাই আমাদের এখানেই COPU visit ঠিক করা হয়েছে।
আমি গিয়ে দেখি, সমস্ত সেকশনের Base Manager রা, যারা সাধারণত: Officeএই বসেন, সবাই চলে এসেছেন/আসছেন। এমনকি হেডকোয়ার্টার থেকেও দুয়েকজন আসবেন শুনলাম। আমাদের চেয়ারম্যান নিজে আসবেন, ওই কমিটির সঙ্গে সেইদিন সকালে। পুরো rigটা একদম ঝাঁ-চকচকে করে ফেলার প্রয়াস চলছে। কমিটি পুরো rig এর যেকোনো জায়গায় যেতে চাইতে পারেন, এবং যেহেতু এনারা প্রায় সবাই non-technical লোক, তাই তাদের সব কাজের ব্যাপারগুলো ঠিকঠাক বোঝানো খুব জরুরী। আর আমি যেহেতু আমার sectionএর একমেবাদ্বিতীয়ম, তায় পদমর্যাদায় বেশ junior, আমাকে অনেকে মিলে বেশ পাখিপড়া করালো - কোম্পানীর স্বার্থে ঠিক কতটা বলা জরুরী, আর কোনটা না। আমাদের Sectional In-charge আসবেন ওই ভিজিটের দিনেই, একটু আগে আগে।
ভাবছ নিশ্চয়ই, এ তো ধান ভানতে শিবের গীত! কথা হচ্ছিল একজন সিনে স্টারের, আর কোথায় সব…..!! আরে শোনোই না, ওই কমিটিতে কারা ছিলেন জানো? বেশ কিছু প্রবীণ ও হেভিওয়েট নেতা – যেমন, সিপিআই থেকে গীতা মুখার্জী (আমাদের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী), তারপর কংগ্রেস থেকে Chandulal Chandrakar, এইরকম প্রায় ১০-১২ জন। কিন্তু এদের সবাইকে ছাড়িয়ে আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বিজেপি দলের সদ্য হওয়া MP, দীপিকা চিখালিয়া! নামটা চেনা লাগছে? হ্যাঁ, ওই টিভির রামায়ণ সিরিয়ালে যে সীতার ভুমিকায় ছিলেন, তিনিই! এখন তো বোধহয় কিছু কিছু সিনেমাতেও নামছেন শুনেছি। টিভির পর্দায় দেখে বোঝা যেত না, আসলে কিন্তু মানুষটা খুবই short heightএর! আর এদের বোধহয় সবসময়েই প্রচুর মেকাপ করতেই হয়! তবে perfumeটা ছিল দুর্দান্ত – ওদের ভিজিটের দুদিন পরে অবধি, সে গন্ধ আমার কেবিনে ভেসে বেড়াচ্ছিল! আর হ্যাঁ, হাতের গোলাপটি রেখে গেছিলেন আমার টেবিলে! এরা সকলেই জীবনে প্রথমবার offshore rig দেখছেন, কাজেই অবাক বিস্ময়ের ঘোর সবার চোখেই! আমাদের চেয়ারম্যান নিজেই সবজায়গায় ঘুরে ঘুরে তাদের দেখালেন পুরো রিগটা, এখানে আমরা কি কি করি, কিভাবে সব operations হয়, ইত্যাদি, তবে সব ব্যাপারেই কিন্তু ওই নায়িকাকে পুরোভাগে রেখেই! সবকিছু মিটতে মিটতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল! Visitor’s bookএ মোটামুটি ভালোই কমেন্টস লিখে গেছেন দেখলাম। ও আরেকটা কথা। সেবার বলেছিলাম মনে আছে, একবার মাদ্রাজ যেতে হবে, বাবার চোখটা দেখাতে? Sankar Netralaya থেকে ডেট পাওয়া গেছে। এবারে তাই এখান থেকে মাদ্রাজ হয়ে তারপর বোম্বে ফিরব। তাই ফিরতে দেরী হবে।ভালো থেকো।
রক্তিম।
------------------------------------------
৮ মার্চ, ‘৯৩
বোম্বে
রক্তিম,
বাব্বাঃ! এ তো বিশাল ব্যাপার! রূপোলী পর্দার নায়িকা নিজে এসে গোলাপ দিয়ে গেল! নিশ্চয়ই বেশ হীরো হীরো feel হচ্ছিল? তা গোলাপ কি শুধু একজনকেই দিয়ে গেল? অন্য বন্ধুরা কি বলল? এদিকে কিনা আমার লেগপুলিং করা হচ্ছিল! প্রফেসর হওয়া কি অতই মুখের কথা নাকি? হ্যাঁ, পড়াচ্ছি ঠিকই, কয়েকটা ক্লাস হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রথম দিকে ভয় করছিল, একদিন এক ছাত্রের প্রশ্নের একটু ভুল উত্তর দিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু স্যার সামলে নিয়েছিলেন। অনেক পড়াশুনো করতে হচ্ছে আরো। তবে এটা ঠিক, আমার রিসার্চের কাজেও সেটা helpful হচ্ছে! আবার স্যার বলছেন একটা paper লেখার কথা, সম্ভবত: December/January নাগাদ একটা International Conference হবে, Hyderabadএ, সেখানের জন্যে। এই ব্যাপারটায়ও কোনো অভিজ্ঞতা নেই, একটু দেখতে হবে। আরেকটা খবর আছে। আমার রুমমেট সেই রেশমী আছে না? তার ইদানিং একটি বয়ফ্রেন্ড জুটেছে। এখানেরই একজন Research Scholar, Chemical Engineeringএর। এখন তাকে নিয়েই বেশ মজে আছে। প্রায়ই নতুন নতুন গল্প শুনতে পাই তাদের!
মাদ্রাজে ডাক্তার কি বললেন? আশাকরি কাকু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন! হ্যাঁ, আমি হয়ত বাড়ি যাব একবার, এপ্রিলের শেষের দিকে, এখনো টিকিট কাটিনি। অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি। তখনকার schedule কিরকম থাকবে?
পারমিতা
------------------------------------------
৫ এপ্রিল
বোম্বে
পারমিতা,
খুব দুষ্টু মেয়ে তো! যেই বললাম সম্বোধনটা শুধরে নিতে, ওমনি পুরো চিঠিটাই ভাববাচ্যে? কি ভেবেছো? আমিও ভাববাচ্যে লিখতে পারি! কিন্তু কেন জানি, তোমাকে ওইভাবে লিখতে ইচ্ছে করে না!মাদ্রাজ মেল আজ পাঁচ ঘন্টা দেরী করেছিল। ভেবেছিলাম ভোর ভোর পৌঁছে যাব, কিন্তু প্রায় দুপুর হয়ে গেল। একে এই প্রচন্ড গরম, তার ওপর এসির টিকিট পাইনি। স্লিপার ক্লাসে আসতে হয়েছে। অত কম সময়ে স্বাভাবিকভাবেই, টিকিট পাওয়া গেছে এই অনেক! গতকাল পুরো দিনটাই অন্ধ্র আর বিদর্ভ অঞ্চলের ওপর দিয়ে এসেছি, কি গরম, বাপরে!
আর তার ওপর ওই লাইনের ট্রেনের খাবার, এত জঘন্য যে কি আর বলব! Meal মানে শুধু টকদই-ভাত, তাও বোধহয় কাঁচা দুধের পাতা দই, এক উৎকট গন্ধ! যাত্রীরা মনে হল বেশীরভাগই তেলুগু, তারা দেখি ওই বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে! ভাগ্যিস মাঝে এক জায়গায় কিছু ফল কিনে নিয়েছিলাম, আর সঙ্গে কিছু কেক-বিস্কিট ছিল!ওই বিধ্বস্ত অবস্থাতেই কোনক্রমে অফিসে একটু মুখ দেখিয়ে হোটেলে ঢুকে পড়েছি। যা বুঝলাম, কাল আমার রিগে যাওয়া হবে না। আমি সাধারণত: যেখানে যাই, সেটি এখন rig move পর্যায়ে আছে। মানে, এক জায়গায় ড্রিলিং শেষ করে আরেকটা লোকেশনে যাচ্ছে। এই পর্যায়ে operationটা খুব delicate হয়। পুরো বার্জটা নামিয়ে আনা হয় জলের লেভেলে (এমনিতে থাকে জলের থেকে ১৫-২০ মিটার ওপরে), তারপর তিনটে tow boat দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন লোকেশনে। এই কাজটাই ভীষণ ঝুঁকির, ওই টানাটানির হিসেবে এদিক-ওদিক হলে barge toppleও করতে পারে! তাছাড়া ওই টানাটানির কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় লোকেরা তখন এসে থাকেন। তাই regular manpower থেকে কেবলমাত্র bare minimum দেরকেই থাকতে দেওয়া হয়। আমাকে পরশু অন্য একটি রিগে পাঠানো হবে, শুনলাম। সেক্ষেত্রে আমি ২১ তারিখে জল থেকে ডাঙায় উঠব। কাল offshore যাবার ব্যাপারটা কনফার্ম হলে, বিকেলে গিয়ে টিকিট কাটব। তোমার বাড়ি যাওয়া কবে? টিকিট কিন্তু বেশি দেরি করলে পাওয়া যাবেনা, কাজেই দিন ঠিক হলেই কেটে ফেলবে। তোমাদের ওখান থেকে তো সেই VT স্টেশনেই আসতে হবে টিকিট কাটতে? কোনো এজেন্ট আছে আশেপাশে? তাহলে অনেক সুবিধে হবে তোমার!
মাদ্রাজে ডাক্তার খুব একটা আশা দিতে পারলেন না। বললেন, অনেক পুরনো কেস, আরো আগে নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। ওনাদের আর কি করে বলি, সেইসময়ে Sankar Netralayaর নাম জানাই সম্ভব ছিলনা, অন্ততঃ ওই মফঃস্বল শহরে থেকে! যাইহোক, আপাততঃ ওনারা একটা ছোট্ট সার্জারি করলেন, কিন্তু ওই চোখে দৃষ্টি ফিরবে কিনা সেটা অনিশ্চিত। দেখা যাক!
ভালো থেকো।
রক্তিম।
------------------------------------------
১৫ এপ্রিল, ‘৯৩
রক্তিম,
বাবুমশাই কি রাগ করেছেন? আচ্ছা বাবা, এই কান মুলছি, আর হবে না! নাও, এবার খুশি তো?
আমার এপ্রিলে যাওয়া হচ্ছে না, একটু কাজ আছে তাই ছুটি পেতে দেরি হবে। মে মাসে দুসপ্তাহের ছুটি পেয়েছি, তাই ৮ তারিখের টিকিট করলাম। তখন তো তোমার নিশ্চয়ই উল্টোপথে যাত্রা? ভেবেছিলাম আবার একটা একসঙ্গে ট্রেনজার্নি হবে, কিন্তু কপালে নেই! এখানে IIT স্টুডেন্টদের জন্য রেলের কোটা আছে কিছু, আর কাছেই এক-দুজন ট্রাভেল এজেন্ট আছে, তারাই ব্যবস্থা করে দেয়। একটু চার্জ নেয় বটে, আর এই summer vacation এর মরসুমে বেশ ভালোই নিল, ১০০/-, কিন্তু আমি তো অন্ততঃ দৌড়ঝাঁপ থেকে রেহাই পেলাম! গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে এসির টিকিট পেয়ে গেছি, আর কি চাই! শুধু ওইদিন ভোর থাকতে ছুটতে হবে, দাদার পৌঁছতে। অবশ্য ট্রেনে ঘুমিয়ে নিতে পারব!
কাকুর খবরটাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আসলে এই গ্লুকোমা অসুখটাই এমন, একটু সময় থাকতে ধরা না পড়লে বড় মুশকিল! আমাদের এক পিসিমারও ওইরকম হঠাৎ ধরা পড়েছিল। কিন্তু কপালক্রমে সময়মত ট্রিটমেন্ট দেওয়ায়, অল্প ক্ষতির ওপর দিয়ে যায়। দেখো, যদি কাকুর ক্ষেত্রেও সময়ের সাথে কিছু improvement হয়!
দক্ষিণের ট্রেনে খাবার দাবার নিয়ে আমারও তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। একবার বাবার একটা conference ছিল ত্রিচিতে। বাবা আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন, conference এর পরে আমরা মাদুরাই আর রামেশ্বরম ঘুরে এসেছিলাম। তখন বোধহয় ত্রিচি অবধি কোনো direct train চালু হয়নি, তাই মাদ্রাজে ট্রেন বদল করে গেছিলাম। মাদ্রাজ অবধি ট্রেনে তো অতটা কিছু বুঝতে পারিনি, কিন্তু ওই মাদ্রাজ থেকে ত্রিচি যাবার ট্রেনেও আমাদের খাবার নিয়ে একই সমস্যা হয়েছিল! সে খাবার না পারি গিলতে, না পারি ফেলতে! আমার ভাই তো তখন অনেকটাই ছোট, তার তো বমি-টমি করে একশা অবস্থা!
তোমাদের কর্মস্থলে কত বিচিত্র রকমের কান্ডকারখানা চলে! সত্যিই আমরা সাধারণ মানুষেরা এসব ভাবতেও পারিনা! আচ্ছা ওই যে একবার বলেছিলে না, একটাকার নোটের পেছনে যে একটা ছবি দেওয়া থাকে, জাহাজের মত দেখতে, সেটাই কি তোমাদের রিগ? সেটাকেও ওভাবেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়?
আজকে আসছি।
পারমিতা
------------------------------------------
২৫ এপ্রিল
কলকাতা
পারমিতা,
আশাকরি কলকাতা যাবার আগেই তুমি এ চিঠি হাতে পেয়ে যাবে। হ্যাঁ, ওই একটাকার নোটের পিছনে যে ছবি থাকে, সেটাই হল “সাগর সম্রাট”, আমাদের কোম্পানীর নিজস্ব, সবচেয়ে পুরনো রিগ। কয়েকমাস আগে অবধি ওটাই ছিল আমার কর্মভূমি। নিয়মিতভাবে ওখানেই যেতাম আমি। অফিসে একটা reshuffle হওয়ায় আমি এখন অন্য রিগে যাই। তবে ওই সাগর সম্রাটকে কিন্তু rig movement এর সময়ে ওরকম tow করে নিয়ে যেতে হয়না। এর নিজস্ব ইঞ্জিন আছে, মানে self-propelled! একটা কথা এই প্রসঙ্গে জানাই, আজকের দুনিয়ায়, এমন রিগটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! না, ঠাট্টা নয়, এইরকম self-propelled jack-up rig আজ আর পৃথিবীতে কোত্থাও নেই! আসলে, কোনো এক সময়ে জাপানের Mitsubishi কোম্পানি এইরকম চারখানি রিগ বানিয়েছিল। তার মধ্যে একটা আমাদের কেনা হয়। তারপরে কালের প্রকোপে বাকি তিনটি অনেকদিন আগেই condemned হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের এই সাগর সম্রাট দিব্যি বহাল তবিয়তে কাজ করে চলেছে! এ যেমন নিজে নিজে জাহাজের মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলতে পারে, তেমনই আবার যখন drilling করা হয়, তখন এর legগুলো সমুদ্রের নীচে মাটির মধ্যে গেঁথে দিয়ে একে এক জায়গায় stable ভাবে রাখাও যায়। অন্য jack-up rig এর সঙ্গে তফাত হল, সেগুলো ত্রিকোণাকৃতি হয়, তিনটে করে পায়া (leg) থাকে। সাগর সম্রাটের আকারটা একটু অন্যরকম, আর এর চারটে পায়া আছে। আর, যেহেতু এটি আমাদের সবচেয়ে পুরনো রিগ, তাই অফিসের বসেরা বেশীরভাগই কর্মজীবনে কোনো না কোনো সময়ে এই রিগে কাজ করেছেন। এখানের work culture টাও সবাই চেষ্টা করেছে খুব উচ্চমানের বজায় রাখতে, এখনো। তাই, ‘আমি সাগর সম্রাটে কাজ করি/করেছি’ বলাটা একধরণের status symbol, বলতে পারো, আমাদের মধ্যে!
জানো, একদিন এক ঝাঁক শুশুক দেখলাম, বেশ কাছ থেকেই! আমাদের রিগের মোটামুটি আধা কিলোমিটার দূর দিয়ে যাচ্ছিল। আমি রাতের ডিউটিতে ছিলাম, সকালের দিকে, যখন জলের রঙটা আস্তে আস্তে ফিকে হচ্ছে, অথচ সূর্য তখনো ওঠেনি, সেইসময়ে দেখি খানিকটা দূরে, জলটা কেমন অন্যরকম লাগছে! মানে, সাধারণত: হাওয়ায় যেমন ঢেউ ওঠে, তার থেকে আলাদা। ভাল করে তাকিয়ে, দেখতে পেলাম। গোটা একটা ঝাঁক চলেছে, অনবরত মাথাগুলো ওপর-নীচ করতে করতে। আমাদের রিগের একটা পাশ দিয়ে দূরে দিগন্তে মিলিয়ে গেল। আরবসাগরে এদের খুব একটা দেখা যায় বলে শুনিনি, এগুলো বোধহয় অন্য কোথাও থেকে এসে পড়েছে হবে! মাছের ঝাঁক তো রিগের আশেপাশে ঘুরতেই থাকে, বিশেষ করে আমাদের খাবারের সময়ের পরে, অতিরিক্ত খাবারগুলো যখন জলে ফেলে দেওয়া হয়। ওরা সব দল বেঁধে ভোজনপর্ব শুরু করে দেয়! আবার এখানের কেউ কেউ রিগের ওপর থেকেই, মাছও ধরে! এখানে সাধারণ কর্মচারী যারা আসে, তাদের অনেকেই হয় মহারাষ্ট্রের কোলি সম্প্রদায়ের মানুষজন, যাদের বংশগত পেশাই হল মাছ ধরা! সেইসব মাছ আবার প্যান্ট্রির লোকেদের দিয়ে রান্না করিয়ে খাওয়াও হয়! আমার অবশ্য ওই সামুদ্রিক মাছের গন্ধ ঠিক সহ্য হয়না!
যাইহোক, অনেকদিন পরে বাড়ি যাচ্ছ, কাজেই মনটা এখন সপ্তম স্বর্গে, বুঝতে পারছি। তা একা যাচ্ছ, নাকি কোনো বন্ধুদের সাথে পেয়েছ? একা গেলে, সাবধানে যেও।
ভালো থেকো।
রক্তিম।
------------------------------------------
বুবাই এর আগে কখনো কোনো আইনজীবির চেম্বারে আসেনি। মানে, আসার দরকার পড়েনি। যদিও, অনেক আদালত চত্বরেই ঘোরা হয়ে গেছে এই গত কয়েকমাসে। মহকুমা আদালত থেকে জেলা আদালত – হাইকোর্ট হয়ে আবার মামলা এখন জেলা আদালতে। এবার ট্রায়াল পর্ব শুরু হবে।
সল্ট লেক অঞ্চলে অ্যাডভোকেট রঞ্জন ঘোষালের বাড়ি খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি। ক্রিমিনাল লইয়ার হিসেবে বেশ নাম আছে। মূলত: হাইকোর্টেই প্র্যাকটিস করেন, তবে দরকার পড়লে নিম্নতর আদালতেও গিয়ে থাকেন। রিসেপশনে গিয়ে নাম বলতে, কিছুক্ষণ পরে ডাক এল। একটা মাঝারি সাইজের ঘর, সবকটা দেওয়াল জুড়ে মেঝে থেকে প্রায় ছাদ অবধি বিভিন্ন আইনের বই। যেমনটা অনেক পুরনো বাংলা সিনেমায় দেখেছে। কেবল একটা দেওয়ালের অংশে ওপরের দিকে এসি বসানো, তার খানিক নীচে স্বামী বিবেকানন্দর একটা বড় ছবি। তার নীচে বড় টেবিলে রঞ্জন ঘোষাল বসে। খুব বেশি না, হয়ত ৪০-৪৫ এর দিকে বয়স হবে। বেশ দামী পারফ্যুম ব্যবহার করেন। বড় টেবিলের ওপর একটা জোরালো টেবিল ল্যাম্প। বাকি ঘরে হাল্কা নীল আলো। প্রাথমিক পরিচয় সেরে নিয়ে সোজা কাজের কথায় এসে পড়লেন।
- কতদিন হয়েছিল বিয়ের?
- স্যার ‘৮৬এর নভেম্বরে। প্রায় বছর তিনেক হল।
- আরে স্যার স্যার কোরো না তো! আমাকে রঞ্জনদা বলতে পার। তা বিয়ে কি বাড়ির থেকে দেখে, নাকি নিজেরা পছন্দ করে?
- আজ্ঞে বাড়ির থেকেই। আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় সম্বন্ধ এনেছিলেন।
- তা সেই আত্মীয়টি এইসব জানেন?
- তিনি আসলে আমার কাকীমার পিত্রালয়ের সূত্রে কেউ হন। শুনেছি তাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়, তাদেরকে বলা হয়েছিল এই সম্বন্ধটা materialize করলে কোনো চাকরি পাইয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু কিছু হয়নি শেষমেশ।
- হুম, বুঝলাম। তা এই যে এতজনের নামে FIR হয়েছে, তোমরা কি একান্নবর্তী পরিবার?
- না, আসলে বাড়ি অনেক পুরনো, কিন্তু হাঁড়ি সব আলাদা। তবে বাড়ির যে কোনো বড় ব্যাপারে যেমন বাবা-কাকারা একসাথে বসেই সিদ্ধান্ত নেন, তেমনই সবার সবসময়ে এঘর-ওঘর যাতায়াত লেগেই থাকে। আমরা সব ভাইবোনেরা এভাবে একসাথেই বড় হয়েছি।
- আর তোমার শ্বশুরবাড়িতে?
- সেখানে সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের বলা হয়েছিল ওর বাবার চার্টার্ড ফার্ম আছে, কিন্তু অনেক পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি সেলস ট্যাক্সের অফিসে দালালির কাজ করেন।
- পয়সাকড়ি ভালই আছে!
- হ্যাঁ, ওই noveau-rich যাকে বলা যায় আর কি! ওদের কাকা-জ্যাঠাদের আবার ওই একান্নবর্তী পরিবার, একবার আমি গেছিলাম। আমার শ্বশুরই সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা থাকে। বিয়ের আগে আমাদের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল শুধু এই বাবা-মায়েরই, অন্য কোনও আত্মীয়ের নয়।
- তা এই আইন-আদালত অবধি ব্যাপারটা গড়াল কিভাবে?
- আসলে প্রথমটা না, আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি। একটু কিছু বাহানাতেই বাপের বাড়ি যাওয়ার বায়না, জেদ, শেষে চলে গিয়েই ছাড়ত। ভাবতাম হয়ত বাবা-মায়ের আদরে বড় হয়েছে, একটু মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। কিন্তু ক্রমশঃ ব্যাপার গুরুতর হতে থাকে। সামান্য সামান্য কথায় টেরা-বেঁকা জবাব দেওয়া, অপমান করে কথা বলা, এইসব!
- তারপর?
- আমি যখনই বম্বে চলে যেতাম, সেই সময়টা ও সন্তোষপুর চলে যেত। আর সেখানে এই বিয়ে/শ্বশুরবাড়ি নিয়ে নানা রকম কল্পিত অভিযোগ জানাত। আমার কাকা-কাকীমা আমাকে সন্তানতুল্য স্নেহ করেন, কেন? আমার ওই কাকার মেয়ে, আমার সহোদরার মতোই বেড়ে উঠেছে, অনেক ব্যাপারে এই দাদাকে ভরসা করে পরামর্শ করে, তার এত মাখামাখি কেন? এইরকম সব ব্যাপার! আর সেইসব শুনে তার বাবা-মা মেয়েকে বোঝানোর বদলে নানারকম উস্কানি দিতে থাকত।
- আর এই যে কি অত্যাচারের কথা জানিয়েছে? তাকে নাকি ডাক্তারও দেখাতে হয়েছিল? ঠিক কি হয়েছিল সেদিন?
- কিছুই হয়নি! তবে ওই তারিখের কিছু আগে পরে, সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই, একদিন বিকেল থেকে হঠাৎ জেদ ধরল, চায়না টাউনে ডিনার করতে যাবে, ওর বাবা-মা-ও সেখানে আসবে, ইত্যাদি। কিন্তু সেইদিন আমার বাবার শরীরটা ভাল ছিল না, তাই আমি না করে দিই। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল! শেষে তার বাবাকে ফোন করে গাড়ি আনিয়ে, চলে যাওয়া। তারপর ওর বাবা পুরো মাতাল অবস্থায় ফোনে অনেক উল্টোপাল্টা কথা শোনান। তবে লীনা সেই দিনের পরে আর ফিরে আসেনি।
- কিন্তু অভিযোগে যে বলেছে তার প্রায় একবছর পরে ও বাপের বাড়ি ফিরে যায়?
- সেটাই তো স্যার! পুরো অভিযোগটাই তো সাজানো! লাগাতার মিথ্যে সাজাতে সাজাতে খেই হারিয়ে ফেলেছে! ওটা নিয়েই তো হাইকোর্টে রীট পিটিশনে অ্যাডভোকেট সীতানাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, - অত্যাচারের অভিযোগ যদি সত্যিই হয়, তাহলে, তার পরে প্রায় এক বছর মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে রইল, অথচ আর কোনো অত্যাচার হল না? তারপর হঠাৎ সে কেন ফেরত গেল?
- হ্যাঁ, ওই রায় তো দেখেছি। আর সীতানাথদা আমাদের সকলেরই খুব শ্রদ্ধেয় একজন প্রবীণ আইনজীবী। আসলে কি জানো, এই যে বধূ নির্যাতন নিয়ে যে আইনটা হয়েছে, সেটা বড্ড একপেশে। তাই এটার অপব্যবহারও প্রচুর হচ্ছে! জানিনা কবে এই আইন সংশোধন হবে, বা আদৌ হবে কিনা! যাইহোক, তুমি এখন এসো। আমার যা দেখার দেখে নিচ্ছি। আবার দরকার পড়লে তোমায় ফোন করে নেব।
আচ্ছা, আসি তাহলে। নমস্কার।
------------------------------------------
১১ মে, ‘৯৩
খড়গপুর
রক্তিম,
পরশু দুপুরে মোটামুটি সময়েই পৌঁছে গেছি। স্টেশনে বাবা এসেছিলেন নিতে। না, আর অন্য কাউকে সঙ্গী পাইনি, আমি একাই এলাম। কোনো অসুবিধে হয়নি। তবে ট্রেনে পুরো পথটাতেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। সেবারের জার্নি, তারপর তোমার সেইসব গল্পগুলো, আর আমাদের গত কয়েকমাসের কথাবার্তা – সব! তার ওপর, হস্টেল থেকে বেরনোর আগেরদিনই তোমার চিঠিটা হাতে এসেছে।
তুমি তাহলে ওই সাগর সম্রাটের অন্যতম সম্রাট? সম্রাট মশাইকে কুর্নিশ জানাই! সমুদ্রে শুশুক আমরাও একবার দেখেছিলাম, অনেকদিন আগে, পন্ডিচেরীতে গিয়ে। তবে সে ওই দূর, সৈকত থেকে দেখা! তোমরা তো নিশ্চয়ই কত কিছু দেখতে পাও! আচ্ছা, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত রোজ দেখতে কেমন লাগে?
জানো, এবারে একটা কান্ড হয়েছে। তোমাকে বলতে না পারা অবধি আমার পেট ফুলছে। তাই বাড়ি এসে থেকে সুযোগ খুঁজছি তোমাকে লিখতে বসার! আমাকে এবারে একজনের হয়ে প্রেমপত্র লিখে দিতে হয়েছে! মানে, প্রক্সি দেওয়া! হয়েছে কি, আমার হস্টেলের পাশের ঘরে থাকে একটি মেয়ে, বলাকা। নাম শুনেই বুঝতে পারছ, বিশুদ্ধ বঙ্গতনয়া! কিন্তু বড় হয়েছে দিল্লী আর হায়দ্রাবাদে, ওর বাবার কর্মসূত্রে। তাই বাংলা ভাষাটা শেখার সুযোগ পায়নি! ফলে, বাংলার চাইতে সে বরং পাঞ্জাবী/হিন্দি বলতে, এমনকি তেলুগু বলতেও বেশি স্বচ্ছন্দ! বাংলায় কথা বলতে পারে বটে, তবে ক্রিয়াপদগুলো সব হিন্দি হয়ে যায়! একটু একটু বাংলা পড়তে পারলেও, লিখতে পারেনা একেবারেই! আমাদের হস্টেলে বাঙালি মেয়ে আর বিশেষ কেউ নেই। আর আমরা পাশাপাশি থাকার জন্য, বলাকা আর আমি বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেছি।
তা এহেন বলাকা দেবীর হাতে একটি প্রেমপত্র এসে পড়েছে কয়েকদিন আগে, বিশুদ্ধ বাংলায় লেখা! লেখকমশাই, শ্রীমান সমীরণ একটি ব্যাঙ্কের চাকরি নিয়ে এই শহরে এসেছেন কিছুদিন হল। আদি নিবাস মুর্শিদাবাদ। এখানের দুর্গাপুজোর সময়ে কোথাও একটা এদের প্রথম পরিচয় হয়, তারপর ফোনালাপ থেকে, দুয়েকবার বাইরে দেখা সাক্ষাতের পর্ব পেরিয়ে এসে এখন এই চিঠি! ও নাকি তাকে বলেছিল, ও বাংলায় লিখতে পারেনা, কিন্তু তাতে সে জানিয়েছে, ও যেমনই লিখুক, সে পড়ে নেবে। কাজেই, বলাকার তখন, সেই ওর ভাষায় বললে, “ইজ্জত কি সওয়াল হ্যায়, ইয়ার”! বসল তো তেড়েফুঁড়ে, আমাকেই মকশো করে দিতে হল কয়েক লাইনের, কিন্তু সে যা অক্ষর বেরোতে থাকল, দেখে সে নিজেই একসময়ে রণে ভঙ্গ দিল! অবশেষে হল এই, ও ওর হিন্দি-মেশানো বাংলায় যা যা বলে গেল, সেগুলো আমাকে ঠিকঠাক বাংলায় ফেরত এনে, চিঠিটা আমাকেই লিখে দিতে হল! ভাবো তো, যে নিজে জীবনে প্রেম করল না, সে লিখছে অন্যের প্রেমপত্র! অবশ্য সে পত্রের ফলাফল কি হল, সেটা জানতে পারব আবার হস্টেলে ফিরেই! হ্যাঁ, আমার ফেরার ট্রেন আবার এখান থেকে ২২শের বম্বে মেল।
আপাততঃ কাল-পরশু কয়েকদিনের জন্য কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে। পরে সব জানাব। এখন আসছি। ভালো থেকো।
পারমিতা
------------------------------------------
৮ মে
বোম্বে
পারমিতা,
তোমার বলাকা দেবীর জন্য আমার আন্তরিক শুভকামনা রইল! তিনি একেবারে সঠিক মানুষকে নির্বাচন করেছেন তাঁর হয়ে বকলমি করার জন্য! এই এতদিন ধরে যে আমাকে এই ‘প্রেমহীন’ পত্রগুলো লিখছে, তার পক্ষে একটা প্রেমপত্র লেখা কি আর এমন ব্যাপার! তাই না? তা ফলাফল কি হল, ফিরে এসে জানিও!
এ চিঠি তুমি হাতে পাবে বাড়ি থেকে ফিরে এসেই। আমি ততদিনে আবার কলকাতায়। এবার ট্রেনে বেশ একটা মজার অভিজ্ঞতা হল। আমাদের কখনো কখনো হাওড়া থেকেই একটা আমাদের কলিগদেরই বেশ ৭/৮ জনের দল জুটে যায়, তখন খুব হই-হল্লা করে আসা যায়। ওই দীর্ঘ যাত্রাপথটা প্রায় বোঝাই যায় না! সবাই মিলে যে যার বাড়ি থেকে আনা খাবার দাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া হয়, দেদার আড্ডা, এইসব চলে। এই নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে কিছু টিটি বা প্যান্ট্রির লোকজন বেশ মুখ চেনা হয়ে যায়। তো সেইরকম একজন টিটিই হলেন ঘোষদা। খানিকটা সেই সিনেমার জহর রায়ের মত চেহারা। আমাদের ওইরকম দল একসাথে দেখলে, উনিও সারা কামরার টিকিট দেখা হয়ে গেলে আমাদের কাছে এসে বসেন, কিছু গল্পগুজব হয়, কখনো খাওয়াদাওয়াও করে নেন আমাদের থেকেই। ওই চেহারা আর মাঝে মধ্যে এসে ‘এটা খাব, ওটা আছে নাকি’ এইসব করে ব’লে, লোকটাকে মনে রয়ে গেছিল। তা এবারে আমি একাই ছিলাম, আর আমার বার্থটা ছিল একটা সাইড আপারে। সেখানে আমার আবার লম্বায় একটু অসুবিধে হয়। সাধারণত: টিটিদের অনুরোধ করলে, ভেতরের বার্থ খালি থাকলে চেঞ্জ করে নেওয়া যায়। সেদিনে ট্রেনে দেখলাম ঘোষদা রয়েছে। বললাম, ভেতরের বার্থের কথা। একটু পরে করেও দিল। পরে, যখন প্রায় শুতে যাচ্ছি, দেখি ঘোষদা আবার এসেছে। সরাসরি বলেই ফেলল, দাদা, আপনার সীটটা তো দেখে দিলাম, এবার আমাকেও একটু দেখুন! আচ্ছা ছোঁচা লোক তো! বললাম, দাদা, আমার তো কনফার্মড বার্থ ছিল, আর এটা তো খালি ছিল বলেই না আপনি আমাকে দিতে পেরেছেন! সেসবে কান না দিয়ে সে নানান ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকল। এটা বুঝলাম যে আমাদের অফিসের ওই দলের মধ্যে আমাকে দেখে থাকলেও, ওনার মনে নেই। কথায় কথায় কতদূর যাবো, বম্বেতে কি করি ইত্যাদি কথা চলছে, তা আমার ওই offshore যাবার কথা শুনেই বললেন, ওই যে ওরা সব দল বেঁধে যায়, আমি বললুম, হ্যাঁ, আমিও তো ওদের মতোই! ওই যে সেবারে আপনার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল, আমাদের ব্যানার্জীদা চমচম এনেছিল, মনে আছে? ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আরে গেল মাসেই তো ফেরার সময়ে বলল, ওদের ওই কি যেন সেনগুপ্ত, ওর তো বিয়ে ছিল এই ২/৩ তারিখে!’ আমিও জানতাম সেনগুপ্তর বিয়ের কথাটা, তাই বললাম, হ্যাঁ, আপনি গেছিলেন নাকি? এইসব খেজুরের মাঝে আমি ওকে বিদেয় করতে একটা দশটাকার নোট বাড়িয়ে দিয়েছি। তখন সে আবার নববধূর মত লজ্জা পেয়ে বলল, না না, থাক থাক! বললাম, কেন, নিন, একটু আগেই তো চাইছিলেন! তখন ব্যাটা বলে কি, না, আপনি আবার ওদের বলে দেবেন না তো! বোঝো কান্ড! পেটে খিদে, মুখে লাজ! আমি বললাম, তা আপনি যখন নিতে পারছেন, আমি বলতে পারব না কেন? এই না শুনে সে একেবারে কেটে পড়ল! পরে শুনেছিলাম, লোকটা একবার নাকি রেলের যে Travelling Inspector of Accounts, বা TIA থাকে, যারা টিটিদের ওপর চেক করতে আসে, সেইরকম টিমের কাছে ধরা পড়েছিল, অনেক টাকাপয়সা সমেত!
এবারে আরেকটা অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে গেছে। সেই বলে না, রাখে হরি মারে কে! তোমাকে তো লীনার কথা খানিকটা বলেছিলাম, মনে আছে? আইন-আদালত তো চলছেই, তারই মধ্যে ওরা অন্যভাবেও উত্যক্ত করার চেষ্টা করে চলেছে। এমনকি, মাঝে এক-দুবার এই বম্বেতে আমার অফিস অবধি ধাওয়া করেছিল। আমার কপালক্রমে, আমাদের যিনি জিএম, মিঃ দেশমুখ, তিনি আমাকে সন্তানতুল্য স্নেহ করেন, আর পক্ষীমাতার মতই আগলে রাখেন। কেবল আমাকে বলে নয়, সেকশনের সব জুনিয়রদের। আর আমার ব্যাপারটা সব শোনার পরে তো আমাকে বিশেষভাবে নজরে রাখেন। ওনার সোজা কথা, তুমি গিয়ে তোমার কাজটা ঠিকঠাকমত করো, বাকিটা আমি দেখছি। তো লীনার বাবাকে উনিই স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে আমার কাজেকর্মে যতক্ষণ না কোনো গাফিলতি অফিস দেখতে পাচ্ছে, অফিস থেকে আমার ওপর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়, একজন বাইরের লোকের কথায়। আইনমত যদি কিছু হয়, সেসব পরের কথা।
তা এবারে হয়েছে কি, আমি একদিন হঠাৎ একটা ফোন পেলাম, আমার এক বন্ধু চিন্ময়ের থেকে। আমরা একইসঙ্গে অফিসে ঢুকেছিলাম, তারপর আমি যেমন বম্বে থেকে on-off করছি, ও করছে মাদ্রাজ থেকে। ওর বাড়ি রানাঘাটে। দুজনের off একইসময়ে পড়ে গেলে, আমাদের মাঝেমধ্যে ফোনে কথাবার্তা হয়। কিন্তু সেদিন একদম জরুরী তলব। ও তখন মাদ্রাজ ফেরার ট্রেন ধরতে হাওড়া যাচ্ছে। আমাকে বলল শিয়ালদা স্টেশনে ওর সঙ্গে দেখা করতে, খুব নাকি দরকার। কি ব্যাপার মাথামুন্ডু না বুঝলেও, গেলাম। তারপর ওর সঙ্গে হাওড়া অবধি যেতে যেতে শুনলাম ব্যাপারটা। ওর ওখানে একজন ডঃ ঘোষাল থাকেন, তিনি আমাদেরই কলকাতা অফিসে একটি বিভাগীয় জিএম। ওনার কাছে চিন্ময় নাকি মাঝে মধ্যে যায়। তিনি একদিন ওর কাছে আমার নাম করে জানতে চান, ও আমায় চেনে কিনা। হঠাৎ আমার কথা কেন, জানতে চাইলে, উনি বলেন, ওনার কাছে সেদিন একজন এসেছিলেন, অফিসের কোনো ওয়ার্কার ইউনিয়নের নেতার মাধ্যমে। তাঁর মেয়ের সঙ্গে নাকি আমার বিয়ে হয়েছিল। তারপর আমার সম্বন্ধে অভিযোগের নানান ফিরিস্তি জানিয়ে, ওদের বক্তব্য ছিল, ডঃ ঘোষাল যদি নিজের প্রতিপত্তি খাটিয়ে বম্বেতে আমার অফিসের বসের সঙ্গে কথা বলে, আমার কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করেন! চিন্ময় তখন ওনাকে বলে, ও বিশদে কিছু জানেনা, কিন্তু আভাসে কিছু কিছু শুনেছে। আর যেহেতু এইসব একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা, তাই এই নিয়ে কথা পেড়ে ও আমাকে বিব্রত করতে চায়নি। তবে ও অনুরোধ করে, ডঃ ঘোষাল তো একপক্ষের কথা শুনেছেন, যেন অপর পক্ষেরও কথাটা জেনে নেন। সেইমতোই আমাকে এমন জরুরী তলব, আমি যেন সেদিনই গিয়ে ডঃ ঘোষালের সঙ্গে অফিসে দেখা করি। ও সেইমত বলেও রেখেছে।
চিন্ময়কে হাওড়ায় ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি গেলাম ডঃ ঘোষালের অফিসে। বেশ সৌম্যকান্তি চেহারা, দেখেই মনে হয় বেশ ভালমানুষ। মুখে একটা হাসি সবসময়ে লেগেই রয়েছে। আমার পরিচয় জেনে একটু অপেক্ষা করতে বললেন, তারপর আমার সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বসলেন। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের কাছে নিজের ব্যক্তিগত কথা নিয়ে আলোচনা করতে স্বাভাবিকভাবেই আমি সংকোচ বোধ করছিলাম, তাও চিন্ময়ের কথা ভেবে সংক্ষেপে ওনাকে বললাম কি কি ঘটেছে বা ঘটে চলেছে বর্তমানে। উনিও শুনে বললেন, না, এইসব ব্যাপারে তো অফিসের কিছু করার থাকতে পারে না! আমি দেশমুখ সাহেবের সেকশনে আছি শুনে বললেন, আরে ও তো আমার ব্যাচমেট। আমি একবার দেশমুখের সঙ্গেও কথা বলব’খন। যাইহোক, তোমার চিন্তার কিছু নেই, এখানের ব্যাপারটা আমি দেখে নেব, তুমি এখন এসো। এখানে অফিসে এসে দেশমুখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে, বস বললেন, আরে ও ঘোষাল খুব ভালো লোক, আর আমার অনেক পুরনো বন্ধু। হ্যাঁ, আমাকে ফোন করেছিল, আমি ওকে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছি। দেখো, এই সবই ওরা করছে তোমাকে মানসিকভাবে চাপে ফেলার জন্যে। তোমার পাশে আমরা সবাই আছি, তুমি শুধু মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের কাজটুকু করে যাও!
আমি জানিনা ঈশ্বর বলে কিছু আছে কিনা, কিন্তু এইরকমের মানুষদের সামনে এলে মনে মনে আস্তিক হতে ইচ্ছে করে!
ভালো থেকো।
রক্তিম
------------------------------------------
৫ জুন, ‘৯৩
রক্তিম,
এখানে ফিরে এসেও তোমার চিঠির উত্তর দিতে অনেক দেরী হয়ে গেল। বাড়ি থেকে ফিরেই জানলাম, আমার স্কলারশিপের টাকা নাকি আসেনি! Dean অফিস থেকে আমার ডাক পড়েছিল, কিন্তু আমি তো তখন ছুটিতে! আসলে, আমাদের প্রজেক্টের নিয়ম অনুযায়ী, বৎসরান্তে CSIR কে একটা রিপোর্ট আর কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে হয়। কাজকর্মের চাপে আমার গাইডের সেসব মনেই ছিল না! অতএব, আমি ফেরার পরে আবার সেইসব paperwork তৈরী করে, দিল্লী পাঠিয়ে, সব কিছু করতে করতে গতকাল টাকা হাতে পেয়েছি! এদিকে আবার আমার হস্টেলেরও রুম shift করতে হয়েছে, কর্তৃপক্ষ কিছু অংশে মেরামতির কাজ করাচ্ছে, এখন তো গরমের ছুটি, কেবল আমাদের মত কিছু রিসার্চ স্কলার ছাড়া এখন হস্টেলে কেউ নেই। তাই এইসময়েই এই কাজগুলো হয়। আমার নতুন রুমটা পাঁচতলায়, আর সবচেয়ে ভাল কথা হচ্ছে, জানালা খুললেই Powai lake দেখা যায়!
হ্যাঁ, সেই বলাকা আর সমীরণের বেশ ভাবসাব হয়ে গেছে খবর পেলাম। আর মনে হয় ওদের via media ভাব আদানপ্রদানের প্রয়োজন পড়বে না! আর এই যে মশাই, আমি তোমাকে প্রেমহীন পত্র লিখি? খুব দুষ্টু হয়েছ, না?
তোমার ওই জহর রায়-ঘোষদা তো রীতিমতো কার্টুন একখানি! এক্কেবারে স্যাম্পেল! খুব হেসেছি ওটা পড়ে! তোমার অফিসের সেই দলের লোকজনদের বলেছিলে, এই ঘটনা?
তোমার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার কথা আমাকে সেদিন সন্ধ্যায় খানিকটা বলেছিলে, মনে আছে। তোমার মানসিক দৃঢ়তার সত্যি তুলনা হয় না। কাজের জায়গাতেই তোমাকে অত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয়, তারপরে এই চাপ! আচ্ছা, এই এত বছর ধরে কেস-কারবার চালানোর পরেও কি তারা প্রত্যাশা করছে যে তুমি তাদের কাছে নতজানু হবে? তা না হলে এরকম উত্ত্যক্ত করার মানেটা কি? আমার স্বাভাবিক বুদ্ধিতে তো বলে, একটা মেয়ে সে বিয়ের পরে তো স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে চাইবে! তার বদলে তাকে আর তার পরিবারের সবাইকে এইরকম হেনস্থা করে কি পাচ্ছে সে? তুমি তো বলেছিলে একবার বম্বেতেও নিয়ে আসার কথা হয়েছিল, না?
তবে এটা জেনে খুব ভালো লাগল যে তুমি তোমার কর্মস্থলে এত ভাল moral support পাচ্ছ! নিশ্চয়ই তোমার সুন্দর স্বভাবের কারণেই তোমার ওপরওয়ালারা তোমায় এমন স্নেহ করেন! এমনকি, তোমার কলকাতা অফিসের ওই ভদ্রলোক, তিনি তো তোমাকে চেনেনই না! মানে, এই সাক্ষাতের আগে তো চিনতেন না! অবশ্যই একটা বড় কৃতিত্ব তোমার বন্ধুর, তিনি না থাকলে তো এই যোগাযোগটাই হত না!
আসলে, এই ব্যাপারটায় আমার মনে একটা বেদনার স্মৃতি আছে, তোমাকে আগে বলিনি। আমার এক দূরসম্পর্কের দাদা, ঠিক একই ধরণের ঘটনার শিকার হয়ে শেষমেশ আত্মহত্যা করেছিল! চাকরি সূত্রে সেই দাদাও থাকত পাঞ্জাবের কোনো একটা শহরে – বোধহয় লুধিয়ানা বা রোপার কোথাও একটা। তাকেও তার বউ আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মিলে বিয়ের পরে থেকেই এরকম উত্ত্যক্ত করতে থাকে, ওর অফিসেও নানাজনের কাছে নালিশ করে। কিন্তু ওর অফিসের লোকেরা somehow মেয়েটির কথাই বিশ্বাস করতে থাকে। আমার দাদা একরকম একা হয়ে গিয়ে, ডিপ্রেশনে পড়ে প্রথমে ড্রিঙ্ক করার মাত্রা বাড়াতে থাকে, শেষে একদিন suicide করে বসে!
তোমার সঙ্গে আবার দেখা কবে হচ্ছে? নিজের খেয়াল রেখো।
আসছি।
পারমিতা
------------------------------------------
২০ জুন
আরবসাগর
পারমিতা,
এই বানভাসি বম্বেতে কেমন আছো, তুমি/তোমরা? এই first monsoon showers বম্বের মানুষজনের জন্য বড় বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে, প্রত্যেকবার!
গতকাল crew change এ আমার এক সহকর্মী এল। তার হাতেই তোমার চিঠিটাও পেলাম, আর বম্বের দুর্গতির কথাও জানলাম। আমাদের অফিসের গেস্ট হাউসের সামনে নাকি কাল এক কোমর সমান জল ছিল! রিগে যখন ও নামল, ওর পোশাক প্রায় আধাভিজে। তারপর শুনলাম ওর দুর্গতির কাহিনী! বেচারী হায়দ্রাবাদ থেকে on-off ডিউটি করে, আর আমাদের সবারই যা হয়, সঙ্গে formal পোশাক বেশি থাকে না। কারণ এখানে, রিগে কাজ করার সময়ের পোশাক আলাদা - আমরা বলি dungaree, মানে জামা ও প্যান্ট একসঙ্গে সেলাই করা, গলিয়ে নিতেও সুবিধে, আর চলাফেরা বা কাজ করতেও সহজ হয়। সেটা মোটামুটি এখানেই রাখা থাকে। তা এ বেচারী পরশু সকালে বম্বে পৌঁছেছে, আর তার আগের রাত থেকেই তো বৃষ্টি শুরু হয়েছে! ওর একপ্রস্থ জামা প্যান্ট সেদিন সকালেই অফিস যাতায়াতের সময়ে ভিজেছে। তারপর সন্ধ্যায় হোটেল থেকে যেতে হয়েছিল কোনো জরুরী কাজে সামনেই, আমাদের গেস্ট হাউসে। ফেরার সময় দেখে ওইরকম জল! অথচ, যে জামা-প্যান্টখানি পরে রয়েছে, সেটাই শেষ শুকনো পোশাক তখন ওর কাছে। পরদিন ওখান থেকে এখানে আসার জন্যেও তো একপ্রস্থ জামা-প্যান্ট লাগবে! অবশেষে আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে, শুনে হেসো না যেন, সেই শেষ সম্বল জামা ও প্যান্ট খুলে মাথায় নিয়ে, কেবল অন্তর্বাস সম্বল করে সেই জল পেরিয়ে হোটেলে ফেরে! ওর কথায়, “কি আর করব, রাস্তায় আলো নেই, আর অতখানি জলে লজ্জা নিবারণেরও বিশেষ প্রয়োজন নেই! হোটেলের সামনে এসে এক সুযোগে টুক করে প্যান্টখানি গলিয়ে নিলাম, ব্যাস”!
লীনার ব্যাপারে ‘স্বাভাবিক বুদ্ধিতে’ যা মনে হয়েছে তোমার, সেটা তো যে শিক্ষা ও রুচিবোধের মধ্যে তুমি বেড়ে উঠেছ, তারই প্রতিফলন! কিন্তু ওর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই অন্যরকম ছিল। তোমায় তো আগেই বলেছিলাম, আমার বাড়ির থেকে একরকম মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে এই বিয়েতে এগিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ওদের পরিবার সম্বন্ধে কোনোরকম খোঁজখবর না নিয়েই! কিন্তু এইসব কেস-কারবার শুরু হওয়ার পরে, বিভিন্ন সূত্রে যা খবর পাই, সেসব তো আমাদের কল্পনারও বাইরে! বাড়ির একমাত্র সন্তান, আর বাবার লাগামহীন প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠে কলেজ জীবন থেকেই তার মতিগতি অন্যরকম হয়ে পড়ে। সে নাকি তাদেরই এলাকার কোনো street ruffian জাতীয় একটি ছেলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাপারটা তার অত আহ্লাদ দেওয়া বাবার পক্ষেও মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি উঠেপড়ে মেয়ের বিয়ের চেষ্টা শুরু করে দেন, আর তখনই মেয়ে বাবাকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে। আসলে হয়ত তার ভাবনায় ছিল, নির্বিরোধী ভালমানুষ ধরণের কাউকে সামনে শিখন্ডী রেখে, সে তার প্রেমপর্ব অব্যাহত রাখবে! আমার তো এমনও মনে হয়েছে যে তার জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে হয়ত তার বাড়ীর লোকেদেরও কোনোরকম ধারণা ছিলনা। একবার সে আমাকে কথাপ্রসঙ্গে এমনও বলেছিল – জানিনা কতটা সত্যি - যে ওর জীবনের ambition হল, Playboy নামের যে adult magazine, তার cover girl হওয়া!
তার পর তো এই এতগুলো বছর কেটে গেল এক আদালত থেকে আরেক আদালত – এই পাক খেতে খেতে! এখন তো আমার দুটো মামলা চালাতে হচ্ছে – একটা criminal case, যেটা ওরা সেই ’৮৮ থেকে শুরু করেছিল, আরেকটা আমি গত বছর দেড়েক আগে civil suit ফাইল করেছি, বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানিয়ে! মজার কথা কি জানো, ওরা সেখানেও contest করেছে – অর্থাৎ আমাকে নিরুপদ্রবে কিছুই করতে দেবে না! এদিকে ওই ক্রিমিনাল কেসে আমার বাড়ির আটজন অভিযুক্ত, তাদের নিয়মিত কাঠগড়ায় উপস্থিত হতে হচ্ছে! শুনছি নাকি এই কেসটা এবার ট্রায়ালে উঠবে আগামী মাস ৩/৪ এর মধ্যে। দেখা যাক!
তোমার সঙ্গে দেখা করতে তো ভালই লাগবে, আমারও। দেখি, একদিন টুপ করে চলে আসব তোমার ওখানে! তবে মনে রেখো, আইনের চোখে আমি কিন্তু এখনো একজন অভিযুক্ত আসামী!
ভালো থেকো।
রক্তিম
------------------------------------------
৫ জুলাই, ‘৯৩
রক্তিম,
নিজেকে ওই ‘অভিযুক্ত আসামী’ তকমা দেওয়াটা কি বন্ধ করবে? অভিযুক্ত মানেই তো আর কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়ে যায়নি! তাছাড়া, আদালতের সামনে সব সত্যিটা বেরিয়ে এলেই তো পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, তাইনা? আর তো, যা লিখেছ, কয়েকমাসের অপেক্ষা! আর ঈশ্বর তোমার সহায় আছেন, নাহলে এমন যোগাযোগগুলো কি সম্ভব হত?
বানভাসি আমাদের হতে হয়নি, তবে বম্বের অনেক জায়গাতেই এই দুরবস্থা হয়েছে, কাগজে পড়লাম। আসলে আমাদের এই জায়গাটা একটু উঁচুতে, আর পুরো ঢালটা ওই Powai lake এর দিকে, তাই বৃষ্টিতে তেমন জল দাঁড়ায় না এখানে, সব চলে যায় ওই লেকে! আর তোমার বন্ধুর তো রীতিমতো নাকানি-চোবানি খাওয়া অবস্থা!
সামনের সপ্তাহে আমাকে কয়েকদিনের জন্য হায়দ্রাবাদে যেতে হবে, আমাদের প্রজেক্টের কাজে। একটা বিশেষ analysis ওখানের একটা ল্যাবে করাতে হবে, তার তদারকির জন্য আমাদের প্রজেক্ট থেকে দুজনকে ওখানে গিয়ে থাকতে হবে। ওখানে শুনলাম এখন ভাল বর্ষা নেমে গেছে, কাজেই যে প্রচন্ড দাবদাহ ওখানের গ্রীষ্মে থাকে, সেটাও কমেছে এখন! ওরা তো বলেছে তিন সপ্তাহ লাগবে, তবে আমার আন্দাজ, হয়তো আরো একটু বেশিদিন লাগতে পারে। তোমাকে বলেছিলাম কিনা মনে নেই, আমাদের প্রজেক্টের কাজ নিয়ে একটা paper publish করার প্রস্তুতি চলছিল, একটা International conferenceএ। আপাতত আমাদের manuscriptটা accepted হয়ে গেছে। সেই conferenceএর এবছরের আয়োজক এই Instituteই। সব ঠিকঠাক গেলে, আবার December 3rd weekএ যেতে হবে ওখানে।
এতকিছুর সারমর্ম হচ্ছে, আপাততঃ অন্তত মাসখানেক তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নাস্তি! কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি চিঠি লিখবে না! আমি কিন্তু এখানে ফিরেই অনেকগুলো চিঠি একসাথে পেতে চাই! আজ এইটুকুই। হায়দ্রাবাদে গিয়ে বিস্তারিত লিখব। ভালো থেকো।
পারমিতা
------------------------------------------
১২ জুলাই
পারমিতা,
এ চিঠি তুমি হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরেই হাতে পাবে। তোমার রিসার্চের কাজ বেশ তরতরিয়ে এগোচ্ছে জেনে ভালো লাগছে। কাজের প্রয়োজনে যেতে যখন হবে তো যাবে বৈকি! আরে, আমাদের দেখা হওয়া তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! তার জন্য অমন মন খারাপ না ক’রে, নিজের কাজে মন দাও।
এবার আমাদের রিগে এক মজার চরিত্র আমদানি হয়েছিল। মানুষের অহেতুক ইগো যে কখনো কখনো তাকে কেমন হাস্যাস্পদ করে তোলে, তাই শোনো। আমাদের অফিসে কর্তারা কিছুদিন হল ঠিক করেছিলেন, অফিসের manpower কে একটু রদবদল করা হবে। সবরকম কাজের অভিজ্ঞতা যাতে করে সকলেরই হয়। অনেকে আছে যারা লাগাতার ফিল্ডেই কাটিয়ে দেয়, বা কেউ ল্যাবে বা অফিসের কাজেই থেকে যায়। তা সেই রদবদলের কারণে কিছু নতুন মুখ আমাদের গ্রুপে এসেছেন, আমাদের এখান থেকেও কেউ কেউ গেছে অন্যত্র। আমি এবার রিগে আসার আগে আমাকে বস বললেন, দেখো, এই মিত্তালজি তোমার সঙ্গে যাবেন এবার, ওকে সব কাজকর্ম দেখিয়ে টেখিয়ে দিও। তা বেশ কথা। ভদ্রলোক আমার থেকে কিছুটা সিনিয়র, কিন্তু বরাবর অফিসেই থেকেছেন, এই প্রথমবার ফিল্ডে যাবেন। তাকে বেশ করে বুঝিয়ে দেওয়া হল যে, কোন সময়ের মধ্যে গিয়ে হেলিবেসে রিপোর্ট করতে হবে, আমাদের হেলিকপ্টার সর্টির সময়, ইত্যাদি। বাকি আমি তো থাকবই। আমাদের অফিসের নিয়ম অনুযায়ী, কোন রিগে কোন দপ্তর থেকে কে কে যাবে, সেটা সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে আগের দিনই লিস্ট বানিয়ে হেলিবেসে পাঠানো হয়। হেলিবেসের লোকেরা সেই লিস্ট মিলিয়ে বিভিন্ন রিগের হেলিকপ্টারের বন্দোবস্ত করে থাকেন। তা আমাদের মিত্তালবাবু হেলিবেসে এসে প্রথমেই অভিযোগ শুরু করলেন, আচ্ছা, আমি তো তোমার থেকে সিনিয়র, লিস্টে আমার নাম তোমার চেয়ে ওপরে থাকা উচিৎ তো? তাকে বোঝাতে হল যে ওতে কিছু ফারাক পড়বে না, আমরা একসাথেই রিগে যাব, এই লিস্ট অফিস থেকে যেমন লিখে পাঠিয়েছে, এরা সেই অনুযায়ী বানিয়েছে। আর আমি যেহেতু নিয়মিত যাই, আমি পৌঁছলে আরেকজন ফিরতে পারবে, তাই হয়ত আমার নাম অফিস আগে লিখেছে হবে! এখন হয়েছে কি, আমাদের যে রিগে যাওয়া, সেখানে helideck টা ছোট হওয়ার কারণে সেখানে বড় 26-seater chopper গুলো land করতে পারেনা। তাই সেখানে ছোট 9-seater chopper দিয়ে দুটো sortie করা হয়, মিনিট ১৫-২০ র তফাতে। যথাসময়ে, প্রথম সর্টির জন্য লিস্ট থেকে ক্রমানুযায়ী ৯ জনকে ডেকে নেওয়া হল। কপালক্রমে, মিত্তালের নাম ছিল দশ নম্বরে! তিনি আবারও হাঁসফাঁস করতে করতে এসে হাজির – কই, আমাকে ডাকল না কেন? তুমি ওদেরকে বল, যাতে আমাকে আগে যেতে দেয়! তাকে আবার একপ্রস্থ বোঝাতে হল, ছোট helideckএর কথা। বললাম যে চিন্তার কিচ্ছু নেই, আর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই আপনাকেও ডেকে নেবে। যাইহোক, তিনি রিগে তো পৌঁছলেন। দুচোখ ভরা অপার বিস্ময়, জীবনে প্রথমবার ড্রিলিং রিগ দেখছেন, তাও আবার সমুদ্রের মাঝখানে। সারাদিন ধরে হাজার হাজার প্রশ্ন, এটা কি, ওটা কিভাবে হয়, সেটা কেমনভাবে চালায়, ইত্যাদি। একটা সময়ে সন্ধ্যের দিকে তাকে প্রশ্ন করলাম, এখানে আমরা দুজন থাকলে তো শিফট ডিউটিতে থাকি, একজন ডে শিফটে, মানে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৭টা, অন্যজন নাইট শিফটে, বিকেল ৭টা থেকে সকাল ৭টা। আপনি কি ডে তে থাকবেন, না নাইটে? তিনি উত্তর দিলেন, আরে না, না, আমি কি এখানে শিফট ডিউটি করতে এসেছি? আমি এসেছি supervisory categoryতে! ততক্ষণে আমার রীতিমত বিরক্তি এসে গেছে, একে তো সারাদিন ধরে নিজের কাজের মধ্যে মধ্যেই পুরো রিগ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো, সব যন্ত্রপাতির কাজকর্ম বোঝানো, আমাদের কোথায় কতটুকু অবদান সেসব জানানো, তারপরে এইরকম ইগো! আমার ল্যাবের অপারেটর ছেলেগুলোর জিম্মায় তাকে রেখে বললাম, আমাকে কাল সকাল ৬টায় মিটিঙে বসতে হবে, আমি চললাম। তাতেও তিনি রাতের দিকে বার দু-তিন আমাকে ফোন করেছেন।
তারপর সেদিন তো আরো মজা হল। এটা বোঝার জন্য তোমাকে এখানের কাজের ব্যাপারটা একটু বিস্তারিত বলতে হবে। আমরা যে রিগ নিয়ে ড্রিলিং করি, সেখানে একটা পাইপের মুখে ড্রিলিং বিট মাটির নীচে গর্ত করতে করতে নেমে যায়, আর পাথরের ছোট্ট ছোট্ট টুকরো ওপরে উঠে আসতে থাকে, একটা circulating fluid এর মাধ্যমে। সেই পাথরের টুকরোগুলো দেখে আমাদের বুঝে নিতে হয়, কি ধরণের পাথর নীচে কাটা হচ্ছে, সেখানে তেল/গ্যাসের সম্ভাবনা কিছু আছে কিনা। এছাড়া বিভিন্ন যন্ত্রপাতির parameters থেকেও খানিকটা বুঝে নিতে হয়। ড্রিলিং করতে করতে কোথাও যদি সেরকম interesting কিছু মনে হয়, তাহলে সেই অংশে বিস্তারিত study করার জন্য core cut করতে হয়। মানে, ওই টুকরো পাথর নয়, পুরো আস্ত পাথরটাকেই cylindrical আকৃতিতে কেটে তুলে আনতে হয়, তার জন্য আলাদা রকমের drilling bit আর assembly লাগে। এবার ঠিক কোন জায়গায় ওই core নেওয়া হবে, সেটা জানার জন্য কিছুক্ষণ ড্রিলিং বন্ধ রেখে নীচের থেকে কাটা টুকরোগুলো ওপরে উঠে আসতে দেওয়া হয়, অবশ্যই নির্দিষ্ট সময় মেপে! এই সিদ্ধান্তটা একান্তভাবে আমাকেই নিতে হয়। এবার সেদিন ওইরকম একটা ব্যাপার চলছে, আমি ল্যাবে রয়েছি, আর মিত্তলবাবু দিবানিদ্রা সেরে এসে চা খেতে খেতে দেখেছেন যে ড্রিলিং বন্ধ রয়েছে। রিগের অন্যান্য লোকেদের কাছেও তিনি ততদিনে তামাসার পাত্র হয়ে গেছেন, তাই তারাও ওকে বুঝিয়েছে, ওই তো দেখুন স্যার, ও (মানে আমি) আমাদের কোনো কথা শোনে না, নিজের মর্জি মত কাজ বন্ধ করিয়ে দিয়েছে, অথচ দেখুন এখানে তো এত এত খরচা হয়, এখানে প্রতিটি মিনিট মূল্যবান, কত টাকা লস হয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি! তিনিও সেইসবে গ্যাস খেয়ে আমার ওপর হাঁক ডাক শুরু করলেন, তারপর আমার ল্যাবে এসে পড়লেন। তাকে শান্তভাবে ব্যাপারটা বোঝালাম, কিন্তু তিনি নাছোড়! তারপর ধরে বসলেন, অন্ততঃ অফিসের বসদের থেকে অনুমতি তো নেওয়াই উচিৎ! তাকে বললাম, সেই অনুমতি নিতে নিতে যদি আমার zone of interest কাটা হয়েই যায়, তাহলে আর অনুমতি নিয়ে হবেটা কি? এসব ব্যাপারে spot decision নিতে হয়, আর সেটাই আমার কাজ। আর আমার অফিসের বসেদেরও এ নিয়ে আমার ওপর ভরসা আছে, তাই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তাঁরা! কিন্তু না, তিনি টেনেটুনে আমাকে রেডিও রুমে নিয়ে গেলেন, অফিসে বসের সঙ্গে কথা বলতে, মানে ‘অনুমতি’ আদায় করতে। সেখানে তিনি প্রথমেই আমার নামে শুরু করলেন, ও না জেনে বুঝে এই ড্রিলিং বন্ধ করিয়ে দিয়েছে, এত টাকা লস হচ্ছে, ইত্যাদি! বস প্রথমে একটু থমকে গেলেন, হঠাৎ এইরকম কথা তো রিগ থেকে কেউ বলে না! ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমাকে ডাকলেন। আমার কাছে কি ব্যাপার, জেনে নিয়ে আবার মিত্তালকে বললেন, দেখো, তোমাকে ওখানে ট্রেনি হিসেবে পাঠানো হয়েছে, রক্তিম যা যা করছে, চুপচাপ দেখতে থাকো, যদি পারো কিছু শিখো, কিন্তু ওর কাজে কোনরকম উৎপাত কোরো না! তুমি ওখানে শিখতে গেছো, আর ও তোমার জুনিয়র নয়, নিজের কাজ ফেলে তোমাকে শেখাচ্ছে, এটা মাথায় রেখো।
তারপর থেকে সে আর কোনো গোলমাল করেনি, অন্ততঃ আমার সঙ্গে!
হায়দ্রাবাদ শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা। আমার কখনো যাওয়া হয়নি, তাই তোমার চোখ দিয়েই শহরটা দেখব। শুনেছি, একটা Salar Jung Museum আছে, সেটা পুরো দেখতে নাকি একটা গোটা দিনও কম পড়ে যায়! কোথায় কোথায় কি কি দেখলে জানিয়ে চিঠি লিখো।
আজ আসছি।
রক্তিম
------------------------------------------
১৫ জুলাই, ‘৯৩
রক্তিম,
হায়দ্রাবাদ সত্যিই খুব সুন্দর একটা শহর। কিছুটা তো ইতিহাসও আছে, জানো তুমি। আমরা এখানের Institute গেস্ট হাউসে জায়গা পেয়েছি। মূল শহর থেকে একটু দূরে, কিন্তু শহরে যাবার জন্য বাস, অটো সবই পাওয়া যায়। পুরো ক্যাম্পাসটা একটা ছোটমত টিলার ওপরে। বেশ ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। প্রচুর গাছপালা, সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান। আর গেস্ট হাউসটাও বেশ সাজানো-গোছানো। আমাদের ঘরটার পেছনেই একটা বড় নিমগাছ। সেখানে রোজ সকালে কতরকমের পাখিরা আসে আমাদের সুপ্রভাত জানাতে!
এখানের ল্যাবে দেখলাম অনেক নতুন আর sophisticated যন্ত্রপাতি রয়েছে। আমাদের যে analysis এর কাজে এখানে আসা, সেই কাজটা এখানের একটা আলাদা টীমকে দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে থেকে আমাদেরকেও শিখে নিতে হচ্ছে সব। আর যাতে ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নেওয়া যায় তাই আমরা যতটা বেশি সম্ভব সময় দিচ্ছি। তারই মধ্যে আমরা একদিন গিয়ে চারমিনার দেখে এসেছি। জায়গাটা খুব ঘিঞ্জি আর ভীড়ের মধ্যে, তবে ওই মিনারগুলোর মধ্যে গোল গোল ঘোরানো সিঁড়ি আছে, ওপরে ওঠা যায়। আর ওপরে উঠলে দারুণ লাগে। অনেক দূর অবধি পুরনো হায়দ্রাবাদ শহরটা দেখা যায়। কোথাও যেন পড়েছিলাম যে একসময়ে এই চারমিনারকে কেন্দ্র করেই এই শহর গড়ে উঠেছিল। এত ঠিক পাশেই আছে মক্কা মসজিদ, প্রায় একই বয়সী। এটা নাকি দেশের বৃহত্তম আর প্রাচীন মসজিদগুলির মধ্যে একটা। প্রচুর পায়রা ঘুরে বেড়াচ্ছে সামনের জলাধারের আশেপাশে। এখানে যারা নিয়মিত প্রার্থনা করতে আসেন, ওই পায়রাদেরকে দানা খেতে দেন, এটা নাকি খুব পুণ্যের কাজ মনে করা হয়! চারমিনারের সামনেই এখানের বিখ্যাত লাড বাজার, মেয়েদের গালার চুড়ি ইত্যাদির বাজার। মনে হল এটার জন্যই এখানে এত ভীড় হয়। গেছি যখন, আমরাও কিছু কিছু কিনলাম। আরেকটা কি বিখ্যাত মিউজিয়ামও আছে নাকি ওর আশেপাশেই, তবে আমাদের আর সেদিন সময় ছিল না। ইচ্ছে আছে একদিন Ramoji Film City দেখে আসব। ওটাও নাকি দারুণ জায়গা শুনছি। অনেক হিন্দী সিনেমারও শুটিং হয় ওখানে। তবে জায়গাটা খানিকটা দূরে, একদিন একটা weekend দেখে যাব! আর আমাদের ক্যাম্পাসের কাছেই একটা এখানের বিখ্যাত প্রাচীন মন্দির আছে, ইয়েল্লাম্মা মন্দির। এখানের সবাই নাকি খুব মানে। সবায়ের মনস্কামনা পূর্ণ করেন ইয়েল্লাম্মা। পারলে একদিন সেখানেও যাবার ইচ্ছে আছে।
আচ্ছা, তুমি কি কোনো নবীন শাঠে নামের কাউকে চেনো? এখানের ল্যাবে আছেন, আমার সঙ্গে আলাপ হল। উনিও IIT, Kharagpur থেকে Ph.D. করে এখানে জয়েন করেছেন। তোমাদের সমসাময়িকই হবে বোধহয়। তুমি তো RK Hall এই থাকতে বলেছিলে, না? ইনিও ওখানেই থাকতেন। চেনো নাকি?
আমার না, তোমার কাছে একটা আবদার আছে। রাখবে? আমি তো আগস্টে ফিরব ওখানে, তারপরে তোমার কোনো একবার offshore থেকে ফেরার সময়ে আমার জন্যে একটু সময় রাখবে? আমার খুব ইচ্ছে করছে, তোমার সঙ্গে বম্বে থেকে আশেপাশে কোথাও এক-দু দিন বেড়াতে যাব! নিয়ে যাবে? না কোরো না, please! ১৫ই আগস্টের আশেপাশে কি তোমার সময় হবে?
এবার খুব ঘুম পাচ্ছে। আজকের মত গুড নাইট। ভালো থেকো।
পারমিতা
------------------------------------------
২৮ জুলাই
পারমিতা,
তোমার হায়দ্রাবাদ থেকে পাঠানো চিঠি পড়ে নিজেকে সত্যিই বড় ক্যাবলাকান্ত মনে হচ্ছে! সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছি যে খড়গপুরের শান্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা সেই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটার গায়ে বোম্বাইয়া হাওয়া বেশ ভালোই লেগেছে! এ কি বিস্ফোরক প্রস্তাব করেছ, তুমি? তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম, কিছুক্ষণ সময় কাটালাম, সেসব ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে বাইরে রাত কাটানো? কথাতেই তো আছে, মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম! তায় আবার তোমার মতো একজন মিষ্টি, সুন্দরী মানুষের সঙ্গে! আর আমিও কিন্তু কোনো মুনি-ঋষি নই! উপোসী বাঘের সামনে খাবার সাজিয়ে দিতে চাইছ কি? কতটুকু আর জেনেছ তুমি, আমার ব্যাপারে? যেটুকু আমি বলেছি, সেটুকুই তো? তার সবটাই যে নির্ভেজাল সত্যি, সে গ্যারান্টি কে দিয়েছে তোমাকে? আমি যদি মুখে মিষ্টি কথা বলে অন্য মতলব করি? আর তারপর? আমাকে তো নাহয় আমার অফিসের চৌহদ্দির বাইরে বিশেষ কেউ চিনবে না, কিন্তু তোমাকে তো আবার সেই হোস্টেলেই ফিরতে হবে, নাকি? যতই শহরটা বম্বে হোক, আমাদের সমাজে মেয়েদের বদনাম হতে যে সময় লাগে না, এটা তো নিশ্চয়ই মানবে? তার ওপর, তুমিই না বলেছিলে, এই IITর faculty তে তোমার বাবারও চেনা পরিচিত কেউ কেউ আছেন? ভেবে বলেছ কি, যা বলেছ?
দেখো, আমার প্রতি তোমার অনুভূতিগুলো যে আমি বুঝিনা এমন কিন্তু নয়। আমার তো তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোই লাগবে! সত্যি বলতে কি, আমার ওপর তুমি যে এতটা আস্থা রেখেছ, সেটাই আমাকে অনেকখানি ভরিয়ে দিয়েছে! এই বিশ্বাস জিনিসটা না থাকলে কোনো সম্পর্কই কি দাঁড়াতে পারে? আর সে বিষয়ে আমার চেয়ে বড় ভুক্তভোগী আর তুমি কোথায় পাবে, বল? নিজেকে সত্যিই বড় ধন্য মনে হচ্ছে! কিন্তু অন্য একটা ভেবে দেখার ব্যাপার আছে। তোমার মত এমন একটা মিষ্টি মেয়ে, যার সামনে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে, সে আমার মতো একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড মানুষের জন্য এমন উতলা হয়ে পড়বে কেন? বিশেষত: আমার বর্তমান সামাজিক/আইনগত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে? তোমার নিজের বাড়ির লোকেরাই বা কি ভাববেন? আর আমিও কিন্তু কোনো one-night-stand সম্পর্কে বিশ্বাসী নই! অন্ততঃ আমাদের সমাজে সেটা চলে না, এখনো অবধি! নিজের মনে একটু তলিয়ে দেখো, আমাকে নিয়ে এটা তোমার কোনো infatuation নয় তো? আমাকে ভুল বুঝো না, তোমাকে কেবল একটু সতর্ক করে দিতেই এই কথাগুলো বললাম।
আপাততঃ আমি কাল offshore যাচ্ছি। এবার আমার একটু ছুটির দরকার আছে, তাই আমি ১৪ দিনের বদলে এবারে ২১ দিন ডিউটি করে ফিরব ১৯শে আগস্ট। ওইদিনেই রাতের ট্রেনে কলকাতা ফেরার টিকিট করে এলাম। তারপর আবার বম্বে ফিরব ৮ই সেপ্টেম্বর। আসলে এবারে কোর্টের ডেট পড়েছে ২৫-২৬ আগস্ট, ওইসময়ে আমার স্বাভাবিক রুটিনে এখানে থাকার কথা। তাই এই ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হল। কাজেই ওই ৮ই সেপ্টেম্বরের আগে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই! এরমধ্যে ওই ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবো।
আরে হ্যাঁ, নবীন শাঠে তো আমার হোস্টেলে দুটো ঘর পরেই থাকত। অল্পদিনেই বেশ ভাল বন্ধু হয়ে গেছিলাম আমরা। ও তো cryogenics নিয়ে কাজ করছিল, যতদূর মনে পড়ছে। তারপর যা হয় আরকি, আমি চাকরি পেয়ে চলে গেলাম, আর যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে একসময়ে বন্ধ হয়ে গেল! ও এখন ওখানে আছে? বাঃ!
হায়দ্রাবাদে আর কি কি দেখলে? তুমি ফিরলে তখনই জানতে পারব।
আজ আসছি। সাবধানে ফিরে এসো। তারপর কথা হবে।
রক্তিম
------------------------------------------
১০ সেপ্টেম্বর, ‘৯৩
রক্তিম,
কি ছিল বলো তো, তোমার স্পর্শে? কি যে একটা জাদু করে দিয়ে গেছ আমাকে! আমি যেন সেই থেকে পাখির মত আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি! সারাক্ষণ, সব জায়গায় তোমাকেই কেবল চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি! তোমার ওইভাবে তাকানো, তোমার পারফ্যুম সমেত ঘামের গন্ধ, তোমার… সবকিছু!
হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরে এসে তোমার ওই চিঠি পড়ে ঠিক করেছিলাম আর কথাই বলব না তোমার সঙ্গে কখনো! আমি এত অনুনয় করে বললাম, আর তুমি কিনা…! সত্যিই, ভীষণ ভীষণ রাগ হয়েছিল! সেই রাগে তোমাকে আর চিঠিও লিখিনি! তোমার বাকি চিঠিগুলোও ভালভাবে পড়ে দেখিনি! এমনকি সেদিন যখন বলাকা এসে বলল যে তুমি এসেছ, আর আমাকে খুঁজছ, আমি তখনো মাথা গরম ছিল আমার! বলাকাই আমাকে অনেক বুঝিয়ে জোর করে টেনে আনল ল্যাব থেকে! কিন্তু করিডরে দূর থেকে তোমার সিল্যুয়েটটা দেখেই আমার কি যেন হয়ে গেল! সব রাগ অভিমান কোথায় ভেসে গেল! নিজের পায়ের সাড় পাচ্ছিলাম না যেন!
হ্যাঁ, প্রথমে আমার একটু সংশয় ছিল বটে, কিন্তু যখনই তোমার হাতের একটু ছোঁওয়া লাগল, আমার সারা শরীরে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল একেবারে! ওই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আর কোথাও বাইরে যাবার তো উপায় ছিল না, ভাগ্যিস বলাকাই এক ফাঁকে বুদ্ধি করে আমাদের গেস্ট হাউসে একটা ঘর বুক করে রেখেছিল! নাহলে ওইরকম উপর্ঝান্তি বৃষ্টিতে তুমি কি আর রাতে তোমার অফিসের হোটেলে ফিরতে পারতে? না আমারই তোমাকে ওইরকম করে পাওয়া হত?
জানো, সেদিন মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেছিল। তুমি তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছিলে। কতক্ষণ একভাবে তোমার ওই শিশুর মত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে জেগে ছিলাম! ওই মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার চিঠির এক একেকটা কথা মনে পড়ছিল। এই মানুষটা নাকি আমাকে নিয়ে বদ মতলব করবে! এত কষ্ট যার জীবনে, তাকে যদি একটু হলেও আনন্দ দিতে পেরে থাকি, সেটাই বা আমার কম কি? আর আমিও কোনো one-night-stand সম্পর্কের কথা তোমায় বলিনি! ভাবিও নি, কোনোদিন, সেইভাবে! শোনো হে উপোসী বাঘ মশাই! (তা বলি বাঘমশাইয়ের উপোস কি মিটেছে?) এখনো যদি না বুঝে থাকো, তাহলে জেনে নাও! মেয়েদের একটা sixth sense থাকে, মানুষ চেনার জন্য। সেখানে আমাদের অত চট করে ভুল হয় না! আর, কেন ভাবলে যে আমার বাড়িতে তোমার কথা কিছুই বলিনি? আমার মায়ের সঙ্গে সবরকম কথাই হয় আমার। তোমার কথা মাকে বলেছিলাম, হায়দ্রাবাদ যাবারও অনেক আগেই! হ্যাঁ, ওইদিনের ব্যাপারটা জানতে পারলে হয়তো তাদের মানসিকতায় হজম করতে অসুবিধে হবে, কিন্তু তোমার সব কথা জেনে, তোমাকে মেনে নিতে মায়ের কোনও দ্বিধা দেখিনি।
তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ পরের বারে আবার আসবে। আসবে তো? অপেক্ষায় থাকব!
তোমার
পারমিতা
------------------------------------------
১৫ অক্টোবর
কলকাতা
পারমিতা,
আজ ইচ্ছে করছে একছুটে তোমার কাছে পৌঁছে যেতে! সম্ভব হলে উড়ে যেতাম! একটা মস্ত সুখবর আছে। তোমার ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করতে পারো, হয়ত তোমার সেই ইয়েল্লাম্মার কাছে প্রার্থনার ফল, এতদিনে পাওয়া গেল।
আমাদের যে উকিলবাবু শিশিরদা, এখন ফৌজদারি মামলাটা দেখছেন, তিনি একদিন হঠাৎ ফোন করেছিলেন। অপরপক্ষ থেকে নাকি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তারা মামলাটা আপসে মিটিয়ে নিতে চায়, এবং যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভাল। কারণ হিসেবে নাকি জানিয়েছে, ও পড়াশুনো করতে বিদেশে চলে যাবে, তাই তাড়া! এতদিন ধরে তারা যা যা করে এসেছে, তারপর তাদের এরকম আকস্মিক মত পরিবর্তনে আমরা সত্যিই চমকে গেছিলাম। নানাদিক থেকে চিন্তা করে দেখলাম, এমনকি আমদের শিশিরদা এর পেছনে কিছু কলকাঠি করছে কিনা, সে ভাবনাও এসেছিল। শুনেছিলাম, তিনি নাকি Public Prosecutor, মানে সরকারী উকিল হবার চেষ্টা করছিলেন, আর তার জন্য কোনো state vs কেসে তিনি থাকতে পারেন না। মানে, সেই কেসগুলো হয় নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, অথবা ওনাকে সেইসব কেস থেক বেরিয়ে আসতে হবে।
সে যাই হোক, আমাদের তরফ থেকে ভেবে দেখতে গেলে, আমার জীবনের এই এতোগুলো বছর তো নষ্ট হয়েছেই, এরপর এই কেস চলতে দিলে আরো কত বছর গড়াত কে জানে! আরেকটা বড় কথা, আমার এতজন আত্মীয়দের যে নিয়মিত কাঠগড়ায় হাজিরা দিতে হচ্ছিল, সেটাও বন্ধ হবে! সেইসব চিন্তা করে, ব্যাপারটায় রাজী হয়ে গেলাম। একটা token one-time compensation amount দিতে হল, কিন্তু সে নেহাতই নগণ্য। যদিও, নিজের মনের কাছে একটা বিবেকদংশন থেকেই গেল যে, কোনো অপরাধ না করেও, আমাকে খানিকটা নত হতে হল! গতকাল আদালতে দুপক্ষ থেকেই বয়ান জমা করা হয়েছে। আর আদালত চত্বরে লীনাকে দেখে তাড়ার কারণ আন্দাজ করলাম। আমাদের শিশিরদার এক সহকর্মী, জ্যোৎস্নাদিই দূর থেকে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে ও মা হতে চলেছে! আবার সেই, মেয়েদের sixth sense! তা বাপু, এই যদি করার ছিল, তো আমাদের এতদিন এইভাবে উৎপাত করলি কেন! আমি তো ডিভোর্সের পিটিশনও করেছিলাম, সে-ও বছর তিনেক হল! তখনও তো ওতরফ থেকেই বাধা দিয়েছিল!
আগামী পরশু আদালত রায় ঘোষণা করবেন। তারপর আরো কিছু খুচরো কাজকর্ম থাকবে। সব সেরে আমি এখান থেকে রওনা দেব ২৮শে। বম্বে পৌঁছব ৩০শে। ওইদিন আবার দেখা হচ্ছে।
দীপাবলীর উপহারটা কেমন লাগল?
রক্তিম
------------------------------------------
ডায়েরীর লেখা এখানেই শেষ। এরপর কি হয়েছিল, সে খবর তলিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তবে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, এর কয়েকমাস পরে রক্তিমের বদলী হয় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। আর পারমিতা কোনো এক রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়ে বছর দুয়েকের জন্য পাড়ি দেয় সাগরপারে, আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তার পরে? দুটি প্রাণ কি এক হতে পেরেছিল?
তারা কি আজ সুখের নীড় বেঁধেছে, পৃথিবীর কোনো কোণে? নাকি বরাবরের মত সমাজের অপশাসনে তাদের ভিন্নপথে নিয়ে গেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়ত কোনোদিনই আর পাওয়া যাবে না!
কিংবা, হয়তো যেতেও পারে! কে জানে!
গল্প
আগুন খাগির
আশুথতলা
চন্দন চ্যাটার্জি
ক’দিন অফিসের কাজে দিল্লি গিয়ে ছিলাম। কাল রাতে ফিরেছি। আজ রবিবার, ছুটি তাই সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ কিঙ্করের বাড়িতে গিয়ে দেখি, কিঙ্কর নিচে বসার ঘরেতে একটা সোফার ওপর বসে আজকের খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে আছে। আমি কোন কথা না বলে পাশে বসলাম। কাগজের ওপর থেকে মুখ না তুলে ও বলল “বস, দিল্লি থেকে কবে আসলি”
আমি বললাম, “কাল, কি করে বুঝলি যে আমি এসেছি”
কিঙ্কর, “রবিবার সকাল তুই ছাড়া কে আসবে? তাছাড়া সদ্য সদ্য একটা কেস সমাধান করেছি এখন কিছুদিন নিশ্চিন্ত”।
আমি, “কেস?”
কিঙ্কর, “ইয়েস স্যার, কাগজে বেরিয়েছে, পড়ে দেখ। বিস্তারিত আমি পরে বলব। তুই গল্প লিখিস তো এটা তোর কাজে দেবে।“ এই বলে খবরের কাগজটা আমাকে দিল।
কিঙ্কর আমার বাল্য বন্ধু। হাওড়ার মন্দিরতলা এলাকায় আমাদের বাড়ি। দুজনেই হাওড়া জেলা স্কুলের ছাত্র, তারপর শিবপুর দীনবন্ধু কলেজ। আমার অবশ্য কমার্স ছিল, কিঙ্করের সায়েন্স। বিএসসি পাস করে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ও প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর হিসাবে কাজ করে। বেশ সাফ্যল্যের সাথে কাজ করছে। আমি একটা বেসরকারি কোম্পানিতে আভ্যন্তরীণ হিসাব পরীক্ষকের চাকুরি করি। গল্প লেখাটা আমার অভ্যাস। আমার লেখা গল্প স্থানীয় পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। অবসর সময়ে কিঙ্করের সাথে থাকি, কারন ওর কাজ থেকে আমি গল্প লেখার উপাদান পাইশি। এই কেসটায় আমি থাকতে পারিনি। তাই ও যা বলেছে সেটাই আমি পাঠকের কাছে উপস্থাপনা করছি।
বীরভূম জেলার একটি জায়গা আছে নলহাটি। এখানে দেবী সতীর শ্বাসনালী পড়েছিল, তাই এটা সতীপীঠ। রামপুরহাট থেকে ট্রেনে করে যাওয়া যায়। রামপুরহাট স্টেশন থেকে প্রথমেই পরে সাদিনপুর, তারপর নলহাটি, তারপর ছাতরা, তারপর মুরারাই স্টেশন। এই মুরারাই স্টেশন থেকে যদি পূর্বদিকে যাওয়া যায়, তাহলে পরপর জায়গাগুলো হবে কাশিমনগর, মিত্রপুর, ওমরপুর হয়ে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে পৌঁছানো যায়। মুরারাই বীরভূম জেলায় পড়ে কিন্তু রঘুনাথগঞ্জ মুর্শিদাবাদ জেলায় পরে।
এই মিত্রপুরের কাছে একটা ছোট খাল আছে, সেইটা দিয়ে দুই রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হয়। মুরারাই থেকে রঘুনাথগঞ্জ প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা। বর্তমানে পাকা রাস্তা হয়েছে, কিছু ট্রেকার ও ছোট বাস চলছে বটে কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি তখন কাঁচা গ্রাম্য রাস্তা ছিল এবং রাস্তাটায় বন জঞ্জালে ভর্তি সন্ধ্যের পর চোর ডাকাতের উপদ্রব থাকত। তখন সাইকেল ও রিক্সা ছাড়া অন্য কোন যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না। তবে ১১ নম্বর যানের উপর ভরসা লোকের সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তার মানে পায়ে হেঁটে।
এই কাশিমনগর থেকে মিত্রপুরের মাঝখানে এক বিশাল মাঠ আছে। তার এদিকে-ওদিকে কিছু দেখা যায় না। বর্ষাকালে জল জমলে যেন মনে হয় সমুদ্র। এই মাঠের মাঝখানে এক বিশাল অশ্বথগাছ আছে যার নিচে এক মহাশ্মশান আছে। শোনা যায় এক তান্ত্রিক নাকি এই শ্মশানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তাই এটা মহাশ্মশান। একাত্তরের মন্বন্তরের সময় চারিদিকে অনাহারে, রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। তখন এমন একদিনও যায় নি যে এখানে মরা পোড়েনি। কোনদিন তো দুটো, তিনটে মরা পুড়েছে। তখন থেকেই বোধহয় এর নাম হয়েছে আগুন খাগির আশ্তথতলা।
এই শ্মশানে ছোট একটা মন্দির আছে, তাতে একটা মা কালীর মূর্তি আছে। বোধকরি তান্ত্রিক যখন ছিলেন তিনি প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি আর নেই, তাই মূর্তি ভেঙে গেছে অনেক জায়গায় এবং তাতে আর পুজো হয় না। এই মন্দিরের পাশে একটা ঘরও আছে। বোধহয় শ্মশানযাত্রীদের বসার জন্য করা হয়েছিল। এখন চতুর্দিকে আগাছা ও জঞ্জালে ভর্তি এবং এখানে মরা পোড়াতেও খুব কম লোকই আসে। জায়গাটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। অশ্বথ গাছটা এতবড় যে এক বিশাল জায়গা জুড়ে তার ছায়া বৃস্তিত। উপরের ডাল থেকে অনেক জুড়ি নেমেছে এবং গাছে নানা পাখির বাসা সবসময় কিচমিচ করে। কাঠঠোকরা গাছের অনেক জায়গায় গর্ত করেছে, তার মধ্যে দু'একটা সাপ থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
সম্প্রতি এখানে এক সাধুর আবির্ভাব হয়েছে। মাথায় জটা, পরনে গেরুয়া, পোশাক, পায়ে খরম, গলায় ও হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। মাকালীর মূর্তি যে ঘরে ছিল সেটা পরিষ্কার করে তিনি রোজ মায়ের পুজো করেন। তাকে প্রায় সময়ই ধ্যানস্থ দেখতে পাওয়া যায়। পাশের ঘরে তিনি রাত্রি বাস করেন।
গ্রামের লোকদের সাধুসন্তদের ওপর একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে, কারণ বেশির ভাগ মানুষ মনে করে সাধু-সন্তরা তাদের দিব্য দৃষ্টি দিয়ে বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ দেখতে পান। আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভবিষ্যতকে দেখার এক বিরাট প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকে, কারণ অতীতে সে দেখে এসেছে, বর্তমান সে দেখছে ভবিষ্যতে তার কি হবে সেটা সে দেখতে পাচ্ছে না। তাই ভবিষ্যতকে জানতে, বুঝতে ও আরও সুন্দর করতে অনেকেই অনেক কিছু করে থাকেন। অতএব এই সাধু বাবাজীর কাছে ক্রমে ক্রমে লোক আসতে লাগলো। সাধু বাবা অনেকেই অনেক কথা বলেন সেগুলো কিছু সত্যি হয়, কিছু হয় না।
যেমন গ্রামের প্রধান মশাই একবার এসেছিলেন তার ছেলেটা যেন মাধ্যমিক পাস করে। সাধু বাবাজীর আশীর্বাদে ছেলে ভালোভাবে পাস করেছিল। অবশ্য সে বছর পাসের হার অনেক বেশি ছিল অন্য বছরের তুলনায়। সেটা যাই হোক, পাস তো করেছে। কাজেই প্রধান মশাই বাবার আশ্রামটি লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দেন। ভাঙ্গা অংশ মেরামত করিয়ে দেন, জানলা কপাটগুলো ঠিক করিয়ে দেন।
এইভাবে দেখতে দেখতে শুধু এই গ্রামে নয়, আশে পাশের গ্রামেও খবরটা রটে গেল, যে আগুন খাগির আশ্তথতলায় এক সাধু বাবাজী এসেছেন। দূর দূরান্ত থেকে মাঝে মধ্যে ভক্তরা আসত।
এদিকে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদা তিন জেলায় চুরি ও রাহাজানি অনেক বেড়ে গেছে। তিন জেলার পুলিশকর্তাদের নাওয়া খাওয়া ছুটে গেছে। এই তো সেদিন দক্ষিণবঙ্গ থেকে গাড়ি করে কিছু ভক্ত আসছিল তারাপীঠে পুজো দেওয়ার জন্য। তাদের কে বা কারা লুট করে নিয়ে যায়। ভাড়শালা মোড়ের কাছে পুলিশ দেখে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সাত সকাল বেলায় এত নির্জন জায়গায় গাড়ি এলো কি করে। সেইটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ দেখল গাড়িতে যারা আছে সবাই অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। পরে ওদের থেকে জানা যায় দুইজন সাধুর সঙ্গে তাদের রাস্তায় দেখা হয়। তারাপীঠের রাস্তা জিজ্ঞেস করায়, একজন সাধু বলল আপনারা ভুল পথে চলে এসেছেন এটা তারাপীঠ থেকে অনেকদূর। আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব, সেটা আপনাদের তাড়াতাড়ি পোঁছে দেবে। এই বলে হাই রোড ছাড়িয়ে তাদের গ্রামের ভেতরে ঢোকাল। খানিক পরে সেই সাধুরা সব যাত্রীদের মায়ের প্রসাদ খেতে দিল, তারপর আর কিছু মনে নেই। কাজেই পুলিশ অফিসার বুঝতে পারল প্রসাদের মধ্যে যদি ঘুমের ওষুধ থাকলে এই কাজটা করা অনায়াসেই সম্ভব।
আর একটা ঘটনা ঘটে, কিছুদিন আগে আলিপুরদুয়ার থেকে কয়েকজন লোক মুর্শিদাবাদ ঘুরতে এসেছিল। ট্রাভেল গাইডের নাম করে তাদেরকে হাজারদুয়ারির একটা অন্ধকার জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছুরি বন্ধুক দেখিয়ে লুট করে। তারপর তারা বহরমপুর থানায় এফ আই আর দায়ের করেছিল। কিন্তু চোরকে ধরা যায় নি।
মালদাতেও একটা ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা শোনা গিয়েছিল। একটা প্রাইভেট ব্যাংক শনিবারে লুট হয়। একাউন্ট খোলার নাম করে এসে চার-পাঁচ জন মিলে ব্যাংক লুট করে। সেদিন নাকি ব্যাঙ্কের সি সি টি ভি বন্ধ ছিল। তাই চোরেদের চেহারা দেখা যায় নি। এছাড়া ছোটখাটো চুরি ডাকাতির কথা থানাতে আকসার আসতে থাকে। তবে পুলিশ এটা বুঝতে পেরেছে কোন একটা দল ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন ভিন্ন বেশে চুরি করে। কিন্তু কে বা কারা এর সঙ্গে জড়িত তা এখনো ধরতে পারেনি। কারণ প্রতি জায়গাতেই তিন-চার জনের বেশি লোক থাকে না এবং সব সময় তারা ছদ্মবেশে থাকে।
কিঙ্কর এসেছে তার দিদির বাড়ি, বহরমপুরে। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার বড় শহর। উদ্দেশ্য একটাই, ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ ঘুরে দেখবে। একদিন সে ভাগনার সঙ্গে হাজারদুয়ারি দেখতে গিয়েছিল। সেখানে তারা অনেক জিনিস দেখে ছিল, সিরাজের তলোয়ার, যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পোশাক। বিভিন্ন রকমের যুদ্ধের অস্ত্র। অন্যান্য সৈনিকদের বিভিন্ন রকমের যুদ্ধের পোশাক ইত্যাদি। তার ভাগ্না বলেছিল এত বড় তলোয়ার চাগতেই দু হাত লাগবে তো তারা সেটাকে এক হাতে চাগিয়ে লড়াই করত কি করে। আর একটা জিনিস আছে সেটা হল এক বিশেষ রকমের আয়না। তাতে নিজের মুখ দেখা যাবে না, গলা থেকে নিচের অংশটা দেখা যাবে, এমন কি অন্য কোন লোকের মুখ দেখা যাবে কিন্ত নিজেই নিজের মুখ দেখতে পাবে না। আয়নাটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও কিঙ্কর এর কৌশলটা বুঝতে পারে নি।
হাজারদুয়ারির বাইরে বের হতেই তার এক কলেজের সহপাঠী সঙ্গে দেখা হল পুলিশের পোশাকে। নাম সোমেশ্বর রায়, মুর্শিদাবাদের ডি এস পি। তারা দুজনেই বি এস সি পড়েছে হাওড়ার শিবপুর দীনবন্ধু কলেজ থেকে। তারপর ও ডব্লিউ বি সি এস দিয়ে পুলিশের চাকরি পায় আর কিঙ্কর স্বাধীনভাবে রোজগারের জন্য প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন- এর কাজ শুরু করে। কাজ মোটামুটি ভালই করে। নিজের চাহিদা কম তাই চলে যায়। কিংকরকে দেখে সোমেশ্বর বেশ খুশী হলো।
সোমেশ্বর, “এখানে কি করে”।
কিংকর, “বহরমপুরে দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসেছি এই ভাগনাকে সঙ্গে করে হাজারদুয়ারি দেখাতে এনেছি। তোর ব্যাপার কি? তদন্ত?”
সোমেশ্বর, “তদন্ত নয়, মহাতদন্ত। একটা চোরের দল খুব সম্ভবত চার-পাঁচজন হবে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ মালদা জেলাতে একেবারে লুট করছে। বিভিন্ন কায়দায়, বিভিন্ন বেশে তাদের ধরার কোন সুত্র পাচ্ছি না”।
কিঙ্কর, “আমি চেষ্টা করতে পারি, পারিশ্রমিক লাগবে কিন্তু”।
সোমেশ্বর, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই সরকারের তরফ থেকে যা দেবে তা তো আছেই, এই তিন জেলার পুলিশকর্তারও মিলে তোকে উপহার দেবে সে তাও নিহাত কম নয়”।
কিঙ্কর, ”ঠিক আছে তবে কোন একটা জায়গায় বসে আমাকে একটু ডিটেইলস বল তার পর দেখছি।“ তারা বহরমপুরের একটা হোটেলে বসে পুরো বিষয়টি আলোচনা করল।
কিঙ্কর, “তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে চোর বুদ্ধিমান ও ছদ্মবেশ নিতে বেশ পটু। এদের ধরতে হলে এদের মত মানসিকতায় হাঁটতে হবে। আজ থেকে তুই আমাকে জানিস না এবং আমি ও তোকে জানি না। ঠিক আছে”।
সোমেশ্বর, “একটু চুপ থেকে তারপর হেসে বলল ঠিক আছে”।
রঘুনাথগঞ্জ বাজারের সামনে রাস্তার ওপর একটা বড় সোনা রূপোর দোকান হয়েছে। এছাড়াও এখানে দামী দামী পাথর সব শোকেসে সাজানো আছে থরে থরে, চারিদিকে লাইট লাগানো আছে ঝলমল করছে সুন্দর দোকান। দোকানের উপর একটা সাইনবোর্ড আছে তাতে লেখা আছে এখানে পুরাতন গয়নার কেনাবেচা ও বদল করা হয়। এই দোকানের প্রচার সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনপত্র কয়েকদিন থেকে স্থানীয় কাগজে দেখা যাচ্ছে এবং ছোট ছোট প্রচারপত্র বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের অনেক জায়গায় ছেয়ে গেছে। দোকানের সামনে একজন দাড়িওয়ালা বয়স্ক ভদ্রলোক বসেন বোধকরি তিনি মালিক হবেন। তারপাশেই কর্মচারী কারিগররা সবাই বসে নিজেদের কাজ করছে। দোকানের সামনে খানিকটা জায়গা ফাঁকা সেখানে ক্রেতাদের গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে। একদিন তিনজন কিন্নরী দোকানে এসে হাজির। তাদের কাছে কিছু পুরাতন গয়না আছে সেগুলো বিক্রি করে তারা নতুন ডিজাইনের গয়না কিনতে চায়। বয়স্ক ভদ্রলোক এদের ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন, পুরাতন গয়নাগুলো হাতে নিয়ে দেখলেন। তারপর সেগুলো একটা পাথরে ঘষে দেখে একজন কর্মচারীকে ডেকে বললেন এই সোনার গয়না ওজন করে দেখো। কর্মচারী সেগুলো হাতে নিয়ে ভদ্রলোককে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলোও সব সোনার গয়না আমি দেখে নিয়েছি। তুমি শুধু ওজন করে বল কত গ্রাম হয়েছে”। “ঠিক আছে” বলে সে চলে গেল।
একটু পরে সে এসে বলল পনেরো গ্রাম হয়েছে অর্থাৎ প্রায় দেড় ভরি পুরাতন গয়না। ভদ্রলোক হিসাব-নিকাশ করে বললেন,
“আপনাদের গয়নার দাম হয়েছে সাতচল্লিশ হাজার টাকা। এখন বলুন নগদ নেবেন না অন্য নতুন ডিজাইনের গয়না নেবেন”। তাদের একজন বলল,
“ঠিক আছে নগদ টাকাই দেন” অন্যজন বলল, ”না নতুন ডিজাইনের গয়না দেখান”।
ভদ্রলোক, “ঠিক আছে” বলে ভেতরে চলে গেল।
খানিক পরে তিনি ভেতর থেকে কিছু নতুন ডিজাইনের গয়না আনলেন। বর্তমানে নাকি এইগুলো কলকাতায় খুব বেশি চলে। দু একটা বাংলা সিরিয়ালের নাম করলেন যেখানে নাকি এইরকম ডিজাইনের গয়না বেশি ব্যবহার হয়েছে। প্রতিটা গয়না এক একটা বাদামী রঙের বাস্কে ভরা। এটা ওটা দেখে তারা একটা হার পছন্দ করলো তার দাম ৫০০০০ টাকা। ভদ্রলোক বললেন আপনাদের ডিসকাউন্ট দিয়ে ৪৮৫০০ করিয়ে দিচ্ছি। একজন কিন্নরী বলল তাহলে আমাদের পুরাতন গয়না দিয়ে আর কত টাকা দিতে হবে।
ভদ্রলোক বললেন এক হাজার ৫০০ টাকা দিলেই হবে।
একটা বাদামী রঙের বাক্সে এই হারটাকে ভালোভাবে রেখে আবার একটা অন্য কাগজ দিয়ে ভাল করে মুড়ে দিলেন। বাক্সটা দেখে একজন কিন্নরী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বাবু এই বাক্সটা দেখতে খুব সুন্দর এটার জন্য কি আলাদা দাম ধরলেন”।
ভদ্রলোক বললেন,”না না এটা গিফটপ্যাক আসলে একটু ডিজাইন দেওয়া বাক্সো আমরা ব্যবহার করি যাতে কাস্টমার খুশি হয় এবং আবার আসে”।
কিন্নরীরা ১৫০০ টাকা দিয়ে গয়না নিয়ে হাসি মুখে চলে গেল। ভদ্রলোক বাকি জিনিসগুলো ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটা ফোন করলেন মুর্শিদাবাদের ডিএসপি সোমেশ্বরকে, “হ্যালো আমি কিংকর বলছি খুব সম্ভবত আমার প্রাথমিক কাজ কমপ্লিট। কন্ট্রোলরুম থেকে ১৬ নম্বর মাইক্রোফোনের সঙ্গে কানেকশন কর” কন্ট্রোলরুমের অফিসার ১৬ নম্বর স্পিকারের সঙ্গে কানেকশন করতে একটা পুরুষের আওয়াজ ভেসে আসলো। একজন বলছে দেখিলি আমার মেক আপ করার ক্ষমতা দোকানদার কিছুই বুঝতে পারলো না। আমরা ছেলে না মেয়ে না অন্য কেউ তা ধরতে পারল না। অন্য একজন বলল সোনার দোকানদার অথচ গিল্টি করা গয়না বুঝতে পারল না। আমার কিন্ত সন্দেহ হচ্ছে। ঠিক আছে আজ রাত্রিতে গুরুজীর কাছে জিনিসটা জমা করে দেবো। এখন যে যার বাড়ি চল, রাত্রির নটার সময় এখানে আসবি তারপর আশ্রমে যাব। এরপর মোটর সাইকেলের আওয়াজ শোনা গেল।
এইসব কথা জানিয়ে সোমেশ্বর কিংকরকে ফোন করল। কিংকর বলল “কাছাকাছি আশ্রম কোথায় আছে“।
সোমেশ্বর বলল মুর্শিদাবাদ আশ্রামের কোন অভাব নেই। সমস্যা হল এরা কোন আশ্রামের কথা বলছে তা কি করে বুজব। কিঙ্কর বলল তাহলে এখন আমাদের মাইক্রোফোনের উপর ভরসা রাখতে হবে। তোর অফিসারকে বল সব সময় কথা শুনতে আর আমিও একটু পরে তোর অফিসে আসছি। কন্ট্রোল রুমের অফিসার প্রথমে হেডফোনে কথা শুনছিল পরে কিংকর আসতেই সেটা লাউড স্পিকারে কানেক্ট করল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ একটু শোনা গেল, কেউ বলছে আজ আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে যেতে পারব না তুই মিত্রপুরে আমার বাড়ির কাছে চলে আয়। আমার কাছ থেকে জিনিসটা নিয়ে এখান থেকে সোজা তোরা মাঠ দিয়ে চলে যাবি গুরুজীর আশ্রামে। এই কথাটা শুনে কিঙ্কর একটু নড়ে চড়ে বসল তার মানে গুরুজীর আশ্রম আছে মিত্রপুরের খুব কাছেই।
“মিত্রপুর জায়গাটা কোথায়” প্রশ্ন করল কিঙ্কর।
এক অফিসার বলল,” জায়গাটা বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম। এখানে মাঠের মাঝখানে আগুন খাগির আশুথ তলা বলে একটা শ্মশান আছে। সম্প্রতি এক সাধু বাবা এসেছেন, তিনি নাকি এলাকায় বেশ প্রসিদ্ধিলাভ করেছেন এবং যাকে যা বলছেন অনেকাংশেই তা ফলপ্রসূ হয়েছে“।
কিঙ্কর বলল ঠিক আছে তাহলে গুরুজীর দর্শনে আমরাও যেতে পারি সোমেশ্বরকে বলল তুই এক কাজ কর বীরভূমের এসপি এর সঙ্গে যোগাযোগ কর তারা যেন তৈরি থাকে তাড়াতাড়ি অ্যাকশান নিতে পারে। এজন্য আমাদের আরও একটা নাটক করতে হবে।
তখন রাত্রি সাড়ে আটটা হবে। দুটো ছেলে মোটরসাইকেল চেপে রঘুনাথগঞ্জ মিলিত হল। তারপর তারা ওই গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা ধরে মুরারাই এর দিকে যেতে লাগল। মিনিট কুড়ি যাবার পর একটা অন্ধকার জায়গায় তারা দাঁড়ালো। মিনিট পাঁচেক দাঁড়াবার পর উল্টো দিক থেকে আরেক জন মোটরসাইকেলে করে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল, তার হাতে একটা প্যাকেট। সেইটা তাদের হাতে দিয়ে বলল তোরা যা কালকে আমি মুরারাই স্টেশনে আসব। সেখানে গুরুজী কি আদেশ করেন সেটা জানাবি। এই কথা বলে উল্টো দিক থেকে আসা ছেলেটা চলে গেল। এই দুটো ছেলে মোটরসাইকেল স্টার্ট করতেই যে আলোটা জ্বেলে উঠল তাতে দেখতে পেল একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দুরে। তার সামনে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ছেলে দুটো তার কাছে যেতেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করল ,“আচ্ছা বাবা এখানে এক মহান সাধু আছেন, তার ওষুধে নানান রোগ সেরে যায় শুনিছি। তার আশ্রাম কোন দিকে”।
তারা দুজনে কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বললো, “এত রাত্তিরে আপনারা কোথা থেকে আসছেন”।
ভদ্রলোক বলল, “নদীয়া থেকে, রাস্তাটা ঠিক জানা ছিল না তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে, আমার ছেলের ভীষণ অসুখ তাই এসেছি যদি বাবা দয়া করেন”।
একজন ছেলে বলল,”আপনারা কতজন আছেন”।
ভদ্রলোক, “আমি, আমার স্ত্রী, ও পুত্র যার ভীষণ অসুখ”।
“ঠিক আছে, আপনারা আমাদের পিছু পিছু আসুন” এই বলে তারা মোটরসাইকেল নিয়ে এগিয়ে চলল। কালো গাড়িটা এই মোটর সাইকেলের পিছনে পিছনে চলতে লাগলো। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর তারা এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো বলল, “আর তো গাড়ি যাবে না এবার আপনাদের হেঁটে যেতে হবে’। আকাশে দশমীর চাঁদে আলো ধরিত্রীতে পড়েছে, চারিদিকে ফাঁকামাঠ, শুনশান রাস্তা, শুধু একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। রাস্তাটা খুবই সরু তাই সবাইকে এক লাইন ধরে যেতে হচ্ছে। লাইনের প্রথমে দুটো ছেলে মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে চলতে লাগল আর তার পিছনে এরা চলতে লাগল।
ছেলে দুটি যদি পিছন ফিরে ভালো ভাবে দেখতো তা হলে বয়স্ক ভদ্রলোকের কিন্ত একটু মুশকিল হত, কারণ তাদের পিছনে তিনজন নয়, আট থেকে দশ জন চলেছে এবং সকলের কাছেই অস্ত্র আছে। মিনিট দশেক মাঠের মাঝখান দিয়ে যাবার পর একটা গাছের নিচে এসে তারা বলল আপনারা এখানে দাঁড়ান আমরা গুরুজীকে খবর দিচ্ছি। এই বলে তারা ভেতরে চলে গেল। এখন বাজে রাত্রি নটা, সাধারণত মাঠের মাঝখানে এত রাত্রে কেউ আসবে না। কাজেই আশ্রাম ফাঁকা। চাঁদের আলো আশুথ গাছের ফাঁক দিয়ে জায়গায় জায়গায় পড়েছে। তাতে যতটা সম্ভব বোঝা যাচ্ছে, একটা ঘর আছে গুরুজীর থাকার জন্য। পাশে একটা বসার ঘর আছে যেখানে যাত্রীদের এলে বসে। খুব সম্ভবত বসার ঘরটি নতুন করা হয়েছে। এদিকে ভদ্রলোকবেশী সোমেশ্বর অন্যসব লোকদের পুরো আশ্রম ঘিরে নিতে বলেছে কিন্ত কোন শব্দ করবে না, আমার অর্ডার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
ছেলে দুটো দরজায় টোকা দিল ভেতর থেকে আওয়াজ আসল ,”কে“?
এরা বলল, ,”অপারেশন দুই এবং তিন“।
তারপর দরজা খুলল, এরা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর ভদ্রলোকবেশী সোমেশ্বর, স্ত্রীবেশী কিঙ্কর এবং আর একজন অফিসার একদম দরজার কাছে গিয়ে ভেতরের দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করল। ভেতরে অল্প আলো, তাহলেও বোঝা যাচ্ছে এই দুইজন ছেলে ছাড়াও ভেতরে আরো দুইজন ছেলে আছে এবং গুরুজী আছে অর্থাৎ মোট পাঁচ জন। এই ছেলে দুটো খুব উৎসাহের সঙ্গে নিজেদের কাজের বিশদ বিবরণ দিল। তারপর বাক্সটা গুরুজীর হাতে দিল। বাক্সটা নিয়ে গুরুজী প্রথমে একটু অবাক হল, তারপর খুলে হারটাকে ভালো করে দেখে বাক্স সমেত হারটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “হতভাগা কি নিয়ে এসেছি এটা ইমিটেশনের গয়না। তোরা যে গিল্টি গয়না নিয়ে গিয়ে ছিলি তা দোকানদার বুঝতে পেরেছে। তার বদলে ইমিটেশনের গয়না তোদের দিয়েছে”।
ছেলে দুটো একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, “শালা কিছুই বুঝতে পারিনি লোকটা ঘাঘু মাল বলতে হবে। ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই আমরা একজন যাত্রীকে নিয়ে এসেছি মালদার পার্টি। ছেলের অসুখ, আপনি একটু দেখে নিন, তারপর আমরা ওকে দেখে নেব”।
গুরুজী বললেন, “কোথায়”
ছেলেটা, ”ওই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে”।
গুরুজী, “দেখেছি আমাকে তোরা মারবি। এত রাত্রে কোন যাত্রী কেন আনলি”।
সঙ্গে সঙ্গে সোমেশ্বর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন বললেন, ”এরা আমাদের কি আনবে, আসলে আপনার দর্শন পাবার জন্য অনেকদিন থেকেই আপনাকে খুঁজছি। বেশী চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। হাত উপরে তুলুন, আপনার আশ্রামটি পুলিশ চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে”।
গুরুজী “বাবা আমার কি অপরাধ”?
সোমেশ্বর, “আপনার অপরাধ অভিযোগ সব থানায় জমা আছে, আপাতত কোনো কথা না বলে আমাদের সঙ্গে চলুন”।
গুরুজী আস্তে আস্তে পা দিয়ে কেরোসিনের বাতিটা মাটিতে ফেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কাচ ভেঙ্গে গেল এবং আলো নিভে গেল। এরপর সেই অন্ধকারে সামনের দিক থেকে একটা গুলি এসে পুলিশ অফিসারকে ঘায়েল করেছে। কাল বিলম্ব না করে সোমেশ্বর বাঁশি বাজাতে শুরু করে দিয়েছে এবং গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের চার দিক থেকে গুলি শুরু হয়েছে। জানালা দিয়ে পুলিশ অফিসাররা এবং ভিতর থেকে গুরুজী। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি বৃষ্টি সমাপ্ত হল এবং একটা আর্তনাদ শোনা গেল। অন্যান্য অফিসার টর্চ লাইট জ্বালাতে দেখা গেল গুরুজী সহ তিন জন নিহত, আর দু জন আহত। কিঙ্কর এদের মোবাইল সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নিল এবং জিজ্ঞাসা করলো যে অপারেশান ডিপার্টমেন্টের তিন নম্বর লোকের নাম কি।
ওদের একজন একটি চালাকি করে বলল, ”কে তৃতীয় জন, আমরা কোন তৃতীয় জনকে চিনি না, আর অপারেশান ডিপার্টমেন্ট মানে”।
কিংকর বলল, ”তোরা তিন জন সকাল বেলায় রঘুনাথগঞ্জের একটা দোকান থেকে যে গয়না কিনতে এসে ছিলি কিন্নরী সেজে সেখানে আমি ছিলাম। আর যে বাক্সটায় গয়না দিয়েছিলাম তাতে মাইক্রোফোন লাগানো ছিল, আর কিছু বলার আছে”।
একজন মাথা নিচু করে বলল রসিউদ্দিন শেখ, মিরপুরের শেখপাড়ায় বাড়ি।
সোমেশ্বর বীরভূমের ডিএসপিকে সঙ্গে সঙ্গে খবর করে দিল এবং তাকে গ্রেফতার করে বহরমপুরে আনতে বলল। সোমেশ্বর পুরো আশ্রম সিল করে দিল এবং চারজন স্বতন্ত্র পুলিশকে বসিয়ে রাখল সকাল পর্যন্ত, বডিগুলো পোস্টমর্টেমে পাঠাতে বলল।
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ সোমেশ্বরের অফিসে সবাই হাজির অবশ্যই কিঙ্কররে নির্দেশ। সে কিন্ত একটু আগেই পৌঁছে গিয়ে, এই তিন ছেলের সঙ্গে অনেক কথা বলেছিল।
তারপর তিন জেলার ডিএসপি অফিসের সামনে তার বক্তব্য শুরু করলো। আসলে গুরজী ছিলেন একজন দাগী আসামি খুব সম্ববত কলকাতার। এখানে একটা আশ্রম তৈরি করে অল্প বয়স্ক ছেলেদের টোপ দিয়ে চুরি করাত। কিন্ত চুরি করার জন্য দরকার ছিল ইনফর্মেশন এবং অপারেশন। এর পাঁচ জনের দল ছিল। যে দুজন মারা গেছেন ইনফর্মেশন সংগ্রহ করত। আর এই তিনজন ছেলে অপারেশন করত। অবশ্য মালদায় যে ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে তার সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। সেটা অন্য দলের কাজ, এদের কথায় তাই বুঝলাম। তবে তারাপীঠে যে সাধু সেজে যাত্রীদের লুট করা হয়েছে সেটা এদের কাজ। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলায় নানা ছোটো বড় কাজ এরা করেছে। প্রতি অপারেশনের পিছনে এদের ২০% কমিশন ছিল। চুরি করা সম্পত্তি আশ্রমের কোন গোপন জায়গায় আছে খুব সম্ভবত মাটির নিচে রাখা আছে, এটা আপনাদের খুঁজে বার করার দায়িত্ব।
এর মধ্যে সোমেশ্বর বলল, “তুই বলেছিস গুরুজী কলকাতা লোক। তার আসল পরিচয় যদি জানতে পারা যেত তাহলে ভালো হতো“।
কিঙ্কর, ”ঠিক আছে আমাকে গুরুজীর কিছু ফটো আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট দে আমি লালবাজারে যোগাযোগ করব যদি জানাতে পারি তো তোকে জানাব”।
সোমেশ্বর,” তুই যে সোনার দোকানের দাড়িওয়ালা সেজে বসে ছিলি সেটা জানি, কিন্ত তুই কি করে বুঝলি এই কিন্নরীরা চোর।“
কিঙ্কর, “ প্রথমত এরা নিজেদের শারীরিক গঠন কিছুটা আনতে পারলেও পুরোটা পারে নি, গলার আওয়াজ ঠিক হয় নি, এবং বোধহয় একই সাইজের লেবু পায়নি। দ্বিতীয়তঃ কিন্নরীরা তালি মারে প্রায় সবসময়। এরা পুরো ঘটনায় দু বার তালি মেরেছে। সেটা মনের স্বাভাবিক আনান্দের প্রকাশ। তখনই আমার সন্দেহ হয়, তাই গোপনে মাইক্রোফোন লাগানো ষোল নম্বর বাক্সটা এদের দি আর এতেই কাজ হয়। এই বিজ্ঞাপনের প্রচার পত্র যে বিলি হয়েছে এবং স্থানীয় খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে তা গুরুজীর ইনফর্মেশন ডিপার্টমেন্ট নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। তাই একটা প্ল্যান করে অপারেশন ডিপার্টমেন্টকে পাঠিয়েছে”।
বীরভূমের এস পি বলল গুরুজী যে ভাবে অপারেশন করত তাতে উনার সৃজনশীল বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।কিঙ্কর বলল ক্রিয়েটিভ তো হতেই হবে স্যার আসলে চুরি করাটাও একটা আর্ট, যদি না পারে ধরা। উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো। এর দু দিন পর কিঙ্কর বাড়ি ফিরে আসে। তারপর লালবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে বেশ কয়েক মাস আগে ক্যানিং এর জেল থেকে এক ব্যাংক ডাকাত পালিয়ে যায়। কিন্ত সে বাক্তি ধরা পরে নি। বিবরণ দেখে এবং হাতের ছাপ পরীক্ষা করে পুলিশ কর্তারা নিশ্চিত গুরুজিই সেই বাক্তি। এই খবরটা আজকের কাগজে বিস্তারিত ভাবে ছাপা হয়েছে। কিঙ্কর সেটাই পড়ছিল।চুরি করা জিনিস একটা টিনের বাক্সের মধ্যে ছিল যেটা গুরুজীর খাটের নীচে মাটির মধ্যে পোতা ছিল সোমেশ্বর তা জানিয়ে কিঙ্করকে ফোন করে ছিল।
কবিতা
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
আছি তব চরণ আশায়
মা বাবার উছিলায়
আসিলাম এ ধরায়
দয়াল তোমার কৃপায়।
জন্ম থেকে জ্বলছি
রবের দয়ায় চলছি
মনিবের কি করছি
অকৃতজ্ঞ থাকছি
ক্ষমা ছাড়া নাই উপায়।
অগণিত পেলাম
নুন খেয়ে গেলাম
শোকর না করলাম
দৃষ্টি যেদিকে দিলাম
অফুরন্ত নিয়ামত রাখছেন স্রষ্টায়।
যাব একদিন চলে
রব না এ ভব দলে
তব পোড়ায় অনলে
দয়াল তব ছায়া তলে
রাখ আঁচলের ছায়ায়।
হিংসার আগুনে জ্বলছি
অবিরাম নিপীড়িত হচ্ছি
তোমার পানে সদা চাচ্ছি
রহমতের মায়ায় এগোচ্ছি
আছি তব চরণ আশায়।
যার মন্দটাই ভাসে চোখে
যে জনা আমায় পিছু ডাকে
সে জন আমার কে,
যার মন্দটাই ভাসে চোখে
সে কেন গো পিছু ডাকে।
যাবার যেজন সেতো চলেই যাবে
মতি-গতি, রীতি-নীতি যার না থাকবে
সুযোগ সন্ধানী সেতো ভালবাসে মন্দকে।
স্বভাবের অভাবে যে নিত্যানন্দ পায়
কুকিল বাঁধে না বাসা অপরের অপেক্ষায়
আসল ছেড়ে নকলের সদা আসক্তিতে থাকে।
কয়লার ময়লা যায় না শতবার ধুইলে
নদীর পানি কভু উজান নাহি চলে
জোছনা বিলায় চাঁদ ধরার বুকে।
টালবাহানা আর প্রতারণা যার নিত্য সঙ্গী
ভাল-মন্দ পরখ করতে ধরবেই তো ভঙ্গি
অক্ষমতা যার চিনতে সোজা পথকে।
কোথা দেব তুল্য
কোথা দেব তুল্য
এ ভালবাসার মূল্য
মায়ের ভালবাসা অমূল্য।
মায়ের আঁচল তলে
ছায়ার পরশ হলে
নেই ভয় কোন কল্য।
মা দেয় মধুর বাণী
সন্তান যে চিরঋণী
বেঁধে রাখে প্রাণচাঞ্চল্য।
যত মায়া মমতা
যত থাকে ব্যথা
মা ডাকে সব চাপল্য।
হিরা পান্নার ছোঁয়ায়
কিবা আসে যায়
পেলে মায়ের আনুকুল্য।
ভুলিবে সে কেমনে
ভুলিবে সে কেমনে, অহরহ রয়েছে নিষ্পেষণে
বার বার হয়েছে পিষ্ট।
সর্বাঙ্গে নির্যাতনের চিহ্ন, ছিল নাতো কভু ভিন্ন
চেয়েছ করতে ছিন্নভিন্ন, মুখ বুজে রাখছে দৃষ্ট।
অধিকার করে হরণ, আঘাতের পর আঘাত সর্বক্ষণ
দৃশ্য অদৃশ্য যখন তখন, এ ও কি অদৃষ্ট।
মরত দেয় না, বাঁচতে মানে না
সর্বত্র রাখছ নিশানা, ব্যথায় দেহ কৃষ্ট।
ফন্দি আঁট অপমানের, যেথ সেথা বলিদানের
মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢাকনের, বিদ্যমান আছে লিষ্ট।
যাচ্ছ রসাতলে
দুর্বল পেয়ে মারে বন্ধু সুবলে
সহ্য করে দুরে গেলে
তাও ডাকে কাছে, হিংসায় জ্বলে।
কত জ্বালা সইরে বন্ধু তর দেয়া অনলে
আকাশ-বাতাস, পশু-পাখি ভাবে নিরলে
নথি দেখে চমকে উঠে মোমের মত গলে।
তোর কেন জ্বলেরে বন্ধু তোর কেন জ্বলে
আকাশের ও বারি ঝরে ঝুমঝুমা তালে
সুবিচার কি হবে নারে ভাব নিরলে।
মরণ কথা হয় না স্মরণ
অমরতো নয়রে সুবল অভাজন
প্রতারণা, ছলনাতে মজে জীবন নৌকা ভাসালে।
মরিবে মরিবেরে অমরত্ব নাই এ ভুবনে
তোর মত ভাবে না অন্য যে জনে
আসা যাবার খেলা চলছে ভূমণ্ডলে।
মানুষ রূপে আগমন তোর কাজে পশুত্ব
প্রমাণ রাখলে শক্তির যত্রতত্র
পিছনে তাকিয়ে দেখ যাচ্ছ রসাতলে।
নিভে জীবন বাতি
যাচ্ছে নিভে জীবন বাতি
হিসেব মিলাতে দিবস হয় রাতি।
শিশুকালে দিনমান গেল বেহিসাবে
যৌবন গেল রঙ্গে ঢঙ্গে সামনে চলবে
আলস্য আর হেলায় পড়ল যতি।
পথিক হল কতজনা
সময়ে নাই একজনা
ধরে নাতো কেহ এসে ছাতি।
সঙ্গের সাথি সাদা বসন
পরের হাতে পরবে যখন
অনন্তকাল আঁধারে বসতি।
রূপ যৌবনের করলে বড়াই
পরের ধনে পোদ্দারি রাখলে জমাই
যার লাগি করলে চুরি দেবে না একরত্তি।
নৌকা যবে চলছে
মিজানুর রহমান মিজান
মানুষ মরণ কথা ভুলে গেছে
চালাকি আর প্রতারণায় মন মজাইছে।
এ দুনিয়া অস্থায়ী রঙ্গের মেলা
আসল ঠিকানা মাটির ঘরে একেলা
আলো নাই বাতাস নাই অন্ধকার আছে।
অন্যের হক কেড়ে হচ্ছ মোটাতাজা
অন্ধকার ঘরে তুমি একেলা রাজা
হবে না সঙ্গী সাথী যারা খাচ্ছে।
দায়ভার নিবে না কেহ যার যার জবাব
নিশিদিন কাঁদবে ফেলে অশ্রু হয়ে লা-জবাব
হারালে পাবে না সময় বয়ে যাচ্ছে।
ঠগছ যার ক্ষমা চাও তার কাছে
থাকতে হুশ বুদ্ধি জ্ঞান যখন আছে
পাবে না পাবে না রেহাই নৌকা যবে চলছে।
না ভেবে হিংসা লোভে অন্যকে ডুবালে
বুঝাই তরী তোমার ডুবে যাবে অতলে
সময় থাকতে হও সচেতন মিজানে বলছে।
ভ্রমণ
বেড়িয়ে
এলাম বেইজিং
অরুন্ধতী ঘোষ
পিটসবার্গ, পেনসিল্ভেনিয়া
গ্যালারী - ১
আমাদের এয়ার ক্যানাডার প্লেন যথাসময়ে ছাড়ল পিটস্বার্গ ইন্টারন্যাশন্যাল এয়ারপোর্ট থেকে। আমাদের গন্তব্যস্থল চিনের বেইজিং শহর। আমরা টরন্টো থেকে প্লেন বদলে পৌছব বেইজিং-এ। মোটামুটি পাঁচদিনের ঝটিকা সফর। বেইজিং থেকে নিমন্ত্রণ এসেছে। ওখানকার চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপিকা ডঃ ইনহুয়া হুয়াং-এর কাছ থেকে। আমাদের গবেষণা নিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। চিন অনেক দূর, কিন্তু লেকচার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটা একটু দেখে আসার লোভ আমরা সামলাতে পারলাম না। আমাদের ইচ্ছেটা ব্যক্ত করতে প্রফেসর হুয়াং বলেছেন ওঁর গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টরা আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে। আর অজানা অচেনা দেশে সঙ্গে গাইড থাকলে খুবই ভাল। তবে বাড়ি থেকে বেরোনো অনেক ঝামেলা। আমাদের কুকুর ও বেড়ালের থাকার ব্যবস্থা করে, প্রতিবেশীকে বাড়ি দেখতে বলে আমরা যাত্রা করলাম।
বেইজিং-এ পৌঁছলাম সন্ধ্যে ৭টায়। এয়ারপোর্টে সবকিছু চুকিয়ে যখন বাইরে বেরোলাম, তখন বাইরে অন্ধকার। বাইরে কিছু লোক হাতে কাগজে নাম লিখে অপেক্ষা করছে যাত্রীদের তুলবে বলে। একটু এগোতেই দেখলাম দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দুজনের হাতের দুটি বোর্ডে আমাদের দুজনের নাম লেখা আছে। তাদের মুখের হাসি দেখে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। দুজনের নাম সাওসুয়ে আর সুযে। দুজনেই প্রফেসর হুয়াং-এর কাছে গবেষণা করছে। এরপর ট্যাক্সি করে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছলাম। বেশ ভালো ছিমছাম হোটেল। আমরা ওপরে গেলাম রুমে মালপত্র রাখতে। ওরা আমাদের জন্য নিচে অপেক্ষা করছে আমাদের নিয়ে ডিনার করাতে নিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি একটু স্নান সেরে নিচে নেমে এলাম মেয়েদুটির কাছে। হোটেলের মধ্যেই রেষ্টোরেন্ট আছে যেখানে খাবার পাওয়া যাবে। আমরা ওদের সঙ্গে সেখানে গিয়ে বসলাম। খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে আমাদের মধ্যে কথা হতে লাগল। সাওসুয়ে গবেষণার কাজে বেশ এগিয়ে গেছে, সুযে নতুন শুরু করেছে। সাওসুয়ে মোটামুটি কাজ চালানো ইংরেজি বলতে পারে, চুযে অতটা সড়গড় নয়। ওদের কাছে জানলাম প্রফেসর হুয়াং এখন শহরে নেই। ইউনিভার্সিটির আরেকটা ল্যাবরেটারী আছে বেইজিং থেকে একটু দূরে আরেকটি শহরে। তিনি সেখানে গেছেন, ফিরবেন পরের দিন সন্ধ্যায়। আমাদের বক্তৃতা দুদিন বাদে। এদিকে বেইজিং-এ আমাদের মেয়াদ তিনদিন। তৃতীয়দিন রাতে আমাদের ট্রেন বুক করা আছে ইয়াংজাও শহরে যাবার। সেখানে আমাদের আরেকটা ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দিতে হবে।
খাবার এসে গেল। আমার বরের চিকেন ফ্রায়েড রাইস, আমার নুডুল। বেশ ভালোই খাবার। ওরাও খাবার নিয়েছে। আমাদের জন্য সাওসুয়ে সেদ্ধ ডিম আনিয়েছে। ডিমগুলি খয়েরি রঙের। একটু অবাক হলাম। জানলাম এগুলি চায়ের লিকার দিয়ে সেদ্ধ করা। খোলা ছাড়িয়ে খয়েরি রঙের ডিম বের হল। ভালই লাগল খেতে। ঠিক হল পরের দুদিনে আমরা যতটা পারব বেইজিং দেখে নেব। আমার ইচ্ছা ছিল চিনের প্রাচীর ও মিং সমাধি দেখব। কিন্তু জানলাম দুটি দ্রষ্টব্যই বেইজিং থেকে বেশ দূরে। তাই এবারের ঝটিকা সফরে সম্ভব হবে না। ঠিক হল সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ওদের জন্য অপেক্ষা করব আমরা। ওরা আসবে সকাল ১০টা নাগাদ। খাওয়া শেষ করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিষ্টি মেয়ে দুটি চলে গেল ওদের ক্যাম্পাসে।
নতুন শহর, অন্য ঘর, বিছানা, জেট ল্যাগ ইত্যাদির জন্য ঘুম আসতে একটু দেরী হল। ফোনে এলার্ম দেওয়া ছিল। যান্ত্রিক শব্দ নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ডেকে দিল। আমরা প্রাতরাশ সারতে নিচে এলাম। দেখলাম আমাদের খাবার কথা আগে থেকেই বলে রাখা হয়েছে। নানারকমের খাবার রাখা রয়েছে কাউন্টারে। দুধ-সিরিয়াল, পাঁউরুটি, স্ক্র্যাল্বড্ এগ, ফল, পেস্ট্রি, জুস, কফি কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাষ্ট থেকে চৈনিক প্রাতরাশের নানারকম খাবার সামগ্রী সবই মজুত। আমাদের দুজনের সকালে প্রাতরাশ করার অভ্যাস নেই। আমরা দুজনে কফি ও পেস্ট্রি দিয়ে প্রাতরাশ সারতে সারতে সেই আমাদের নতুন বন্ধু মেয়েদুটি এসে হাজির। আমাদের এবারে গন্তব্যস্থল হল সবর্গের মন্দির বা টেম্পেল অফ হেভেন। ট্যাক্সিতে চড়ে আমরা সেখানে হাজির হলাম। দেখলাম ওরা আমাদের কিছু খরচা করতে দিচ্ছে না। সবকিছুর খরচা সাওসুয়ে নিজের ফোনের একটা অ্যাপ্ থেকে করছে। আমাদের বলে দিল এখানে ক্রেডিট কার্ড ব্যাবহার করে কোন কিছু না কিনতে। আমাদের সঙ্গে কিছু চিনের টাকা ছিল, সেটাই ভরসা।
এখানে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি বর্ণনার সঙ্গে একটু ইতিহাস দিলাম।
স্বর্গের মন্দির (Temple of Heaven)
মন্দিরটি তৈরী হয়েছিল সম্রাটের ভগবানের কাছে কথোপকথনের ও প্রার্থনার জন্য। ভালো ফসলের জন্য সম্রাট স্বয়ং এখানে ঈশ্বরের কাছে আর্জি জানাতেন। সম্রাটকে মনে করা হত ভগবানের সন্তান। কনফুসিইয়ান ডিজাইনে তৈরী হয়েছিল মন্দিরটি। মন্দির সংক্রান্ত পার্কটিও খুব সুন্দর। এখানে বলিও দেওয়া হত একসময়ে।
হলগুলি গোলাকৃতি ও নীচের কাঠামো চতুষ্কোণ। কনফুসিয়ান মতে সবর্গ গোলাকার ও পৃথিবী চতুষ্কোণ। সাক্ষাৎ ভগবানের পৃথিবীতে উত্তরণের স্থান।
১) ফসল ফলনের প্রার্থনা কক্ষ (Hall of Prayer for Good Harvest)ঃ ৩৮ মিটার উচ্চ এই বাড়িটির ছাদ গোলাকৃতি, নীল রঙের। ভিতরের ছাদে একটি ড্রাগন খোদাই করা। এটি সম্রাটের চিহ্ন।
২) ইম্পেরিয়াল ভল্ট অফ হেভেন (Imperial Vault of Heaven)ঃ এখানে বিবিধ ফলকে সম্রাটদের পূর্বপুরুষদের কথা বিভিন্ন ফলকে (ট্যাবলেট) লেখা আছে।এই ভল্টের চারদিকে আছে প্রতিধ্বনির দেওয়াল।
৩) গোলাকৃতি বেদী (Round Altar)ঃ এর চৈনিক নাম “তিয়েন তান”। সম্পূর্ণ হয়েছিল মিং সাম্রাজ্যে। এখানে শুধুমাত্র সম্রাটের প্রবেশাধিকার ছিল। এখানে শুধুমাত্র সম্রাট আসতেন, নিজেকে তৈরী করতেন ভগবানের সঙ্গে কথা আদানপ্রদানের জন্য (প্রার্থনার জন্য)। সম্রাট নিজে প্রজাদের প্রতিভূ হয়ে চাষের ভালো ফলনের কামনায় ঈশ্বরের কাছে আবেদন করতেন। মিং ও কিং সাম্রাজ্যে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিলনা এখানে।
ছবি ২) তিয়েন তান, গোলাকৃতি বেদী
পুরো মন্দিরটি দেখতে দেখতে প্রায় সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। আমরা প্রায় বেলা দুটো নাগাদ পৌঁছলাম এক রেষ্টোরেন্টে লাঞ্চ সারতে। আমাদের দিমসাম খাবার ইচ্ছে জেনে ওরা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। ওরাই অর্ডার করল। এরপর আসতে শুরু করল একে একে বাঁশের ঢাকা দেওয়া পাত্রে নানান রকমের ডামপ্লিং (অনেকটা মোমোর মত, ভিতরে নানা রকমের পুর দেওয়া)। অনেকটা হেঁটে আমাদের বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল, তাই সবাই খাওয়াতে মননিবেশ করলাম। এরপর এল দু তিনরকমের মিষ্টি। একটি এল কাষ্টার্ড, মাছের আকারে। বেশ ভালো লাগল খেতে। এবারে গন্তব্যস্থল লামা মন্দির।
লামা মন্দির
বিশাল এই মন্দিরটি এখনো চিনে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের পতাকা বহন করে চলেছে।মন্দির চত্বরে অনেক তিব্বতী লামা দেখতে পাওয়া যায়। এই মন্দিরটি কিং সাম্রাজ্যের রাজপুত্র ইয়ংজেন-এর বাসস্থান ছিল। ১৭২৩ খৃষ্টাব্দে ইয়ংজেন সম্রাট হবার পর তার বাসস্থানটি লামা মন্দিরে পরিবর্তিত হয়। সম্রাট কিয়ান্লং (Qianlong) পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দিরের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।এই সময়ে প্রায় পাঁচশ লামা এখানে থাকতেন। বর্তমানে প্রায় ২৮-৩০ লামা এখানে বসবাস করেন।
মন্দিরে পাঁচটি প্রধান কক্ষ ও অনেক গ্যালারী আছে। অনেক দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য থাংকা আছে এই মন্দিরে। বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী বুদ্ধের অনেক রূপ আছে। যেমন, পথ্য ও ঔষধের বুদ্ধ, চিরজীবি বুদ্ধ, শান্তির বুদ্ধ ইত্যাদি। এই মন্দিরের স্বর্গীয় রাজাদের কক্ষে (Hall of Heavenly King) অবস্থান করছেন মৈত্রেয় বুদ্ধ, ভবিষ্যতের বুদ্ধ এবং ওয়েটউ (Weitou, চৈনিক বৌদ্ধধর্মের রক্ষক)। হল অফ হারমনি-তে (Hall of Harmony) আছেন পূর্ব, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বুদ্ধ। এছাড়াও এই কক্ষটিতে দেওয়ালে টাঙানো একটি থাংকায় আছেন “তারা” (ক্ষমার প্রতিমূর্তি)। হল অফ ইটারনাল ব্লেসিং-এ (Hall of Eternal Blessing) আছেন ঔষধের বুদ্ধ ও জীবনীশক্তির বুদ্ধ। প্রায় ৮৫ ফিট উচ্চ চন্দন কাঠের মৈত্রেয় বুদ্ধ অবস্থান করেন প্যাভিলিয়ন অফ থাউসেন্ড ফরচুন্স (Pavilion of Thousand Fortunes)। এই মূর্তিটি এতটাই লম্বা যে ঘরটিতে গিয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়। ঘরের তুলনায় মূর্তিটি বেশ বড়। মনে হয় আরো বড় জায়গায় রাখলে মূর্তিটির শোভা বৃদ্ধি পেত। বড় সুন্দর মূর্তি। দেখলে মন ভরে যায়। লামা মন্দিরের কাছেই কন্ফুশিয়াস মন্দির ও ইম্পেরিয়াল অ্যাকাডেমি। আমাদের সময়াভাবে দেখার সৌভাগ্য হয় নি।
রাতে খাওয়া সারলাম একটি স্থানীয় রেষ্টোরেন্টে। সারাদিন ঘুরে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মধ্যে স্থির হল পরেরদিন আমরা দেখব নিষিদ্ধ নগরী বা ফরবিডেন সিটি। পরেরদিন সকালে দশটার সময়ে আমাদের সঙ্গিনীরা এসে হাজির। মুখে সেই মিষ্টি হাসি। আমাদের নিয়ে চলল বেইজিং-এর বিখ্যাত নিষিদ্ধ নগরী দেখাতে। অনেক পুরোনো, কিন্তু জাতীয় সম্পত্তি বলে খুব ভালোভাবে সুরক্ষিত।
এখানে প্রায় ২৪ জন সম্রাট ৫০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছেন। ১৯১২ খৃষ্টাব্দে সাম্রাজ্য চলে যাবার আগে এটাই ছিল চৈনিক সম্রাটদের মূল ঘাঁটি। এখানেই সম্রাটরা তাদের পরিবার নিয়ে বাস করতেন। এখানেই চলত সব রাজনৈতিক জল্পনা-কল্পনা। এই নগরীর দক্ষিণে মেরিডিয়ান গেট (Meridian Gate) আর উত্তরে গেট অফ ডিভাইন প্রাওয়েস (Gate of Divine Prowess) দিয়ে এই নগরীর মধ্যে ঢোকা যায়।
আমরা দক্ষিণের মেরিডিয়ান গেট দিয়ে ঢুকলাম। এই গেটটি স্বয়ং সম্রাট ব্যবহার করতেন। এছাড়াও উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বদিকে গেট আছে। উত্তরের গেট ব্যাবহার করতো ভৃত্যরা, পশ্চিমের গেট ছিল মিলিটারিদের আর পূর্বের গেট ছিল জনসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট।এই নগরী থেকেই সম্রাট সৈন্যদের দেখতেন, অপরাধীদের দন্ড দিতেন, নতুন বছরের ক্যালেন্ডার ঘোষণা করতেন।
মেরিডিয়ান গেট দিয়ে ঢুকে একটি বিশাল চাতালে গিয়ে পড়লাম। চত্বরের বাঁদিকে ও ডানদিকে কয়েকটি কক্ষে ক্যালিগ্রাফি ও সেরামিক্সের গ্যালারী দেখলাম, ভালোই লাগল। চত্বরের অন্য প্রান্তে “গেট অফ সুপ্রিম হারমনী” (Gate of Supreme Harmony)। এই গেট দিয়ে ঢুকেই পরপর তিনটি কক্ষ।
প্রথম কক্ষ: হল অফ সুপ্রিম হারমনী (Hall of Supreme Harmony)
এটি একটি বিশাল কক্ষ।মূলত: ব্যবহার হত সম্রাটের জন্মদিন পালনে, মিলিটারি দলপতিদের নির্বাচনে এবং অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্য। এখানে একটি ড্রাগন সিংহাসন আছে। এখানে বসে সম্রাট তার সেনাধ্যক্ষদের দর্শন দিতেন।
দ্বিতীয় কক্ষ: হল অফ মিডিল হারমনী (Hall of Middle Harmony)
প্রধানতঃ ব্যবহৃত হত সম্রাটের প্রসাধন কক্ষ হিসেবে। সম্রাট এখানে এসে তৈরী হতেন সেনা সমক্ষে আবির্ভূত হবার আগে। অনেক সময়ে শলাপরামর্শ করতেন মন্ত্রীদের সঙ্গে।
তৃতীয় কক্ষ: হল অফ প্রিসার্ভিং হারমনী (Hall of Preserving Harmony)
এই কক্ষটি ব্যবহৃত হত ব্যাঙ্কোয়েট এবং রাজকীয় পরীক্ষার জন্য।
এই তিনটি কক্ষ পেরিয়ে আমরা গেলাম পরের বাড়িগুলিতে।
১) প্যালেস অফ হেভেনলী পিউরিটি (Palace of Heavenly purity)ঃ এই স্বর্গীয় পবিত্র প্রাসাদে মিং ও প্রথমদিকের কিং সম্রাটদের বাসস্থান ছিল।
২) হল অফ ইউনিয়ন
৩)প্যালেস অফ আর্থলী ট্র্যানকুলিটিঃ রাজকীয় দম্পতির শয়নকক্ষ, এখান থেকে অন্দরমহল পরিচালনা হত।
এই প্রাসাদের পরেই একটি সুন্দর বাগান দেখলাম। এখানে অসংখ্য প্রাচীন সাইপ্রাস গাছ দেখলাম। এরপরেই পড়ল উত্তরের গেট (গেট অফ ডিভাইন প্রাওয়েস্)। এছাড়াও দেখলাম পূর্ব ও পশ্চিমের প্রাসাদগুলি। এগুলি আয়তনে খুব বড় না হলেও বিভিন্নসময়ে অনেক সম্রাট এই প্রাসাদগুলিতে বাস করে গেছেন। গোটা নগরীর চত্বরে অসংখ্য গাছ, বেশ পুরোনো। সবই খুব ভালোভাবে সংরক্ষিত।
গোটা নিষিদ্ধ নগরী দেখতে দেখতে অর্ধেকদিন কেটে গেল। তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে যখন তিয়েনান্মেন্ স্কোয়ারে পৌঁছলাম, তখনো সূর্যাস্ত হতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় বাকি। আমরা গিয়ে তিয়েনান্মেন্ গেটের পাশে ফুটপাথে দাঁড়ালাম। তিয়ে্ননান্মেন্ গেটের ওপরে লাল দেওয়ালে জাতীয় নেতা মাও সে দং এর বড় প্রতিকৃতি আঁকা। যখন গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন খুব কম লোক ছিল, আস্তে আস্তে লোক বাড়তে শুরু করল।
তিয়েনান্মেন্ স্কোয়ারঃ
মাও সে দং এর সৃষ্টি এই চত্বরটি বেইজিং এ অবস্থিত। বলাই বাহুল্য প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নিষিদ্ধ নগরের (Forbidden City) “গেট অফ হেভেনলী পিস্” (Gate of Heavenly Peace) বা তিয়েন্নান্মেন্ তোরণ থেকে বেরোলেই এই চত্বরটি দেখা যাবে। এই চত্বরটির উত্তরে তিয়েন্নান্মেন্ দক্ষিণে কুইন্মেন্ (এটি চত্বরের সামনের তোড়ন), বাঁদিকে গ্রেট হল অফ পিপল (চিনের পার্লামেন্ট) এবং ডানদিকে জাতীয় মিউজিয়াম। এই চত্বরের ঠিক মাঝখানে গ্রানাইট পাথরের একটি বড় মনুমেন্ট (১২.৫ ফিট উচ্চ)। মনুমেন্টটি তৈরী হয়েছে চিনের জাতীয় বিপ্লবে শহীদ বিপ্লবীদের স্মরণে।
প্রতিদিন ভোরে অথবা সন্ধ্যায় দেশবিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন এই চত্বরে। এবারে কারণটা বলি। ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাতীয় পতাকা ওপরে তোলা হয় ও সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় নামানো হয়। রেড গার্ডরা মার্চ করে আসে তিয়েন্নান্মেন্ গেট থেকে, রাস্তা পেরিয়ে চত্বরে গিয়ে পতাকা তোলে ও নামায়। এছাড়াও জায়গাটি অসংখ্য পুলিশে ভর্তি থাকে। ভালোই লাগল দেখতে। বেইজিং এর বিখ্যাত ধোঁয়াশার জন্য সাড়ে পাঁচটায় প্রায় অন্ধকার নেমে আসে, তবে ভালোই দেখা যায়।
সেদিন রাতের ডিনারে সাওসুয়ে আর সু্যে আমাদের নিয়ে গেল বিখ্যাত পিকিং ডাক খাওয়াতে। দেখলাম একই রাস্তার দুধারে বেশ কয়েকটি রেষ্টোরেন্ট, সবাই পিকিং ডাকের জন্য প্রসিদ্ধ। ওরা আমাদের যেটিতে নিয়ে গেল বুঝলাম সেটি নামকরা, ঐতিহ্যে এবং পিকিং ডাকের জন্য। ভিতরে ঢুকতে দুজন লাল রঙের চৈনিক পোষাক পরিহিত মহিলা আমাদের আপ্যায়ন করে টেবিলে বসালো। আমাদের খাবারের অর্ডার দেওয়া হল। দেখছিলাম কয়েকটি টেবিলের সামনে একজন করে সেফ ট্রলিতে করে রোষ্টেড পিকিং ডাক নিয়ে এসে পুরো হাঁসটি নানারকমের ছুরি দিয়ে নানারকম ভাবে কেটে পরিবেশন করছে। কিছুক্ষণ পরে আমাদের পিকিং ডাকটি এসে গেল। দেখলাম কিরকম দক্ষতার সঙ্গে নিপুণভাবে হাঁসটি কেটে সেফ আমাদের পরিবেশন করলেন। একেক অংশের মাংস একেকভাবে পরিবেশিত হল। আর স্বাদ? অসাধারণ। এটা আমাদের চিনের ট্রিপের এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। পরেরদিন আমরা যাবো চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি দেখতে আর লেকচার দিতে।
চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি
এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ পুরোনো এবং বেইজিং-এ প্রসিদ্ধ। এখানে বলে রাখি চিন হল কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিবিদ্যা ও গৃহপালিত তথা পশু পক্ষীর পরিচর্যার ওপরে এদের অনেক গবেষণা চলে। কাজেই ভবিষ্যৎ কৃষিবিদ্যা-বিশারদ ও পশু-বিশারদ তৈরী করার জন্য এখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে একটু হেঁটে আমরা পৌঁছলাম প্রফেসর ইনহুয়া হুয়াং-এর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি প্রথমেই আমাদের আপ্যায়ন করে তার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসালেন। জানালেন লেকচারের আগে এক ঘন্টা সময় আছে। সেই সময়ে আমরা ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে দেখা করব। আমাদের এই সময়টা ভালই কাটল। বেশ উন্নতমানের কাজকর্ম চলছে। সবাই গাছের বা পশুদের জীবাণু নিয়ে কাজ করছেন। প্রফেসর হুয়াং এর ল্যাবরেটারীতে গেলাম। দেখলাম আর বেশ কয়েকটি ছাত্র-ছাত্রী গবেষণার কাজে রত। আলাপ করে ভালো লাগল।
এরপর প্রফেসর হুয়াং আমাদের লেকচার কক্ষে নিয়ে গেলেন। এখানে আমার লেকচার দেবার কথা। গিয়ে দেখি পুরো ঘরটি ছাত্র-ছাত্রীতে ঠাঁসা। সামনের সারিতে কিছু অধ্যাপক-অধ্যাপিকা বসে আছেন। আমার লেকচার হয়ে গেল। প্রশ্নোত্তরের পর প্রফেসর হুয়াং আমাদের নিয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ ক্যান্টিনে। আমরা একটি বড় গোল টেবিলে গিয়ে বসলাম। দেখলাম সাওসুয়ে আর সুযের সঙ্গে প্রফেসর হুযাং নিজের সহকর্মীদের কয়েকজনকে ডেকেছেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হল। আগেই লেকচার হলে দেখেছিলাম। এবার খাবার আসতে শুরু করল। অনেক রকমের খাবার, সবজি, মাছ,
মাংস, টোফু ফল, ভাত, স্যালাড আর নানারকমের পিকল্। অত্যন্ত সুস্বাদু । খেতে খেতে আমাদের আলোচনা চলতে লাগল। লাঞ্চ শেষ হতে হতে চারটে বাজল। আমরা আবার প্রফেসর হুয়াং সাথে তার অফিসে গিয়ে গল্প করতে লাগলাম। আমাদের আবার সেদিন সন্ধেবেলার টিকিট কাটা ইয়াংজাও যাবার। প্রফেসর হুয়াং আমাদের বিদায় জানালেন। সাওসুয়ে ও সুযের সঙ্গে আমরা ট্রেন স্টেশনে গিয়ে ইয়াংযাও-র ট্রেন ধরব। আমরা আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেল থেকে সকালেই চেক আউট করে বেরিয়ে এসেছিলাম। ট্রেন স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দিয়ে সাওসুয়ে আর সুযে আমাদের বিদায় জানাল। ওদেরকে বিদায় জানাতে আমাদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। গত দুদিন ওরা আমাদের নিকট-আত্মীয়ের মতো যত্ন করে ঘুরিয়েছে। ওদের জানালাম যে ফিরে গিয়ে যোগাযোগ করব।
ট্রেন স্টেশনে ঢুকে একটু হকচকিয়ে গেলাম। কোনো বিদেশী নেই। সবকিছু ম্যান্ডারিনে লেখা আর ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা। মেয়েদুটি আমাদের হাতে ট্রেনের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে বলে দিয়েছিল। আমরা সেই প্ল্যাটফর্মের সামনে গিয়ে আমাদের স্যুটকেসের ওপর বসলাম। আরো যাত্রী আসতে শুরু করল। দেখলাম এক মহিলা পুলিশ নীল ইউনিফর্ম পরে ঘোরাফেরা করছে, যাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ঠিক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছি কিনা। তার উত্তর শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। ট্রেন এসে গেল। পরের দিন ভোর ছটায় পৌঁছবে ইয়াংজাও। স্লিপার কোচ। পরিষ্কার চাদর, বালিশ দেওয়া প্রত্যেক বার্থে।নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমরা রাতের অন্ধকারে বেইজিং ছেড়ে আরেক শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
বেইজিং আমাদের বেশ ভালো লেগেছে। বর্তমান যুগের উন্নত শহর। প্রচুর লোকজন, যান-জট আর ধোঁয়াশা ছাড়াও পুরোনোকে সমান ভাবে ধরে রেখেছে।তবে প্রচুর পুলিস দেখলাম যার প্রয়োজন বুঝতে পারিনি। তবে কোনো নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার ভাষা জানা না থাকলে খুব অসহায় লাগে। বেইজিং আমাদের বেড়ানো সম্ভব হতনা যদি আমাদের সাওসুয়ে আর সুযে সঙ্গে না থাকত।
চিনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। তাই বিভিন্ন সাম্রাজ্যের একটি ছোট তালিকা দিলাম। পড়ে নিলে বর্ণনা বুঝতে সুবিধা হবে।
চিনের সাম্রাজ্য
শ্যাং সাম্রাজ্য:(খৃষ্টপূর্ব ১৬০০-১০৫০) চিনে ব্রোঞ্জ যুগের শুরু হয়েছিল। সম্রাটকে মনে করা হত ভগবানের সমান এবং প্রতিভূ।
পশ্চিম যাও সাম্রাজ্য (খৃষ্টপূর্ব ১০৬৬-৭৭১) রাজধানী সিয়াং। এই রাজত্বকালে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। অভিজাতদের মধ্যে গ্রেড সিস্টেমের সৃষ্টি হয়।
পূর্ব যাও সাম্রাজ্য (খৃষ্টপূর্ব ৭৭০-২২১) রাজধানী লুওয়াং।আশেপাশের বিরুদ্ধ রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ লেগেই থাকত। অবশেষে কিণ সাম্রাজ্যের স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের পতন হয়।
কিণ সাম্রাজ্য (খৃষ্টপূর্ব ২২১-২০৬) খুব কম সময়ের জন্য রাজত্ব করেছিল
পশ্চিম হান সাম্রাজ্য (খৃষ্টপূর্ব ২০৬- ৯ খৃষ্টাব্দ)
পূর্ব হান সাম্রাজ্য (২৫-২২০ খৃষ্টাব্দ)
এরপর ২২০-৫৮৯ খৃষ্টাব্দ অবধি চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা চলেছিল। বিভিন্ন রাজত্বের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। সুই সাম্রাজ্যের (৫৮১-৬১৮ খৃষ্টাব্দ) সময় বিভিন্ন রাজত্ব আবার একত্র হয়। পরবর্তী সাম্রাজ্য তাং সাম্রাজ্য (৬১৮-৯০৭ খৃষ্টাব্দ)।
এরপর ৯০৭-৯৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ইয়াংজি নদীর উত্তরে পাঁচটি সাম্রাজ্য একের পর এক রাজত্ব করে গেছে তবে কোনটিই বেশী টেকেনি। দক্ষিণে দশটি রাজত্বও উত্তরের মতো টালমাটাল অবস্থার মধ্যে কাটিয়েছে। এরপর উত্তর সং (৯৬০-১১২৬ খৃষ্টাব্দ) এবং দক্ষিণ সং (১১২৭-১১৭৯ খৃষ্টাব্দ) সাম্রাজ্যের পর মোঙ্গল সাম্রাজ্য ইউনিয়ান পত্তন হয়।
ইউয়ান সাম্রাজ্য (১২৭৯-১৩৬৮ খৃষ্টাব্দ) চেঙ্গিস খানের (১১৬২-১২২৭) নেতৃত্বে মোঙ্গলদের সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। চেঙ্গিস অসংখ্য মোঙ্গল গোষ্ঠীকে একত্র করে বেইজিং দখল করেন ১২১৫ খৃষ্টাব্দে। রাজত্ব ভাগ করে দেন চার ভাগে নিজের চার ছেলের অধীনে। চেঙ্গিসের নাতি কুবলাই খান সমগ্র চিনের সম্রাট হন ১২৭৯ খৃষ্টাব্দে দক্ষিণ সং সম্রাটকে যুদ্ধে পরাজিত করে। এই সময় চিনের যোগাযোগ হয় মধ্য প্রাচ্য ও ইওরোপের সংগে ব্যবসার জন্য।মহান চিন সম্রাটের রাজসভায় মিশনারী ও ডিপ্লোম্যাটদের আনাগোনা শুরু হয়। অবশেষে সময়ের সাথে সাথে এই সাম্রাজ্যের পতন হয়।
মিং সাম্রাজ্য (১৩৬৮-১৬৪৪ খৃষ্টাব্দ) মিং শব্দের মানে হল “ব্রিলিয়ান্ট”। সবথেকে বেশীদিন রাজত্ব করে এবং চিনে স্থিতি নিয়ে এসেছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জু ইউয়ানজ্যাং। খুব সাধারণ অবস্থা থেকে সম্রাট হন। নিজের নাতিকে উত্তরসূরী করেন কিন্তু তার মারা যাবার পর তার আরেক পুত্র (বেইজিং ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিকর্তা) নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নানজিং অধিকার করে নিজেকে “সম্রাট ইয়ঙ্গেল” হিসেবে ঘোষণা করেন। রাজধানী বেইজিং -এ স্থানান্তরিত করেন। এই শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত হয় “নিষিদ্ধ শহর” (Forbidden City), যেখানে সম্রাটের প্রাসাদ এই শহরের কেন্দ্রস্থলে, তার চারিধারে সরকারী দপ্তরখানা ও আমলাদের বাসস্থান এবং তার-জালির আকারে রাস্তা (Grid system of streets)। পুরো শহর দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এই সবই এখনো বর্তমান চিন সরকারের তত্ত্বাবধানে। চিনের বিশাল প্রাচীর আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা হয়, ইঁট দিয়ে গাঁথা হয়।
এছাড়াও চিন সাম্রাজ্য ক্ষমতার তুঙ্গে ওঠে। পোর্সেলিনের সামগ্রী, সিল্ক এবং অন্যান্য বিলাস সামগ্রী ক্রমশ: ইওরোপ, জাপান, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। ইয়ঙ্গেল-এর সময় ব্যবসার প্রসার ঘটে আফ্রিকার পূর্ব উপকুলে। “চা পান” চিন থেকে ইউরোপিয়ান জগতে প্রসিদ্ধ হয়। চারুকলার প্রসিদ্ধি ঘটে সম্রাট জুয়ান্দের (Xuande, 1425-1435) সময়ে। চিত্রকর ও কবি, এই সম্রাট শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শেষের দিকে মিং সাম্রাজ্য প্রচুর টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছে।
কিং রাজত্ব (১৬৪৪-১৯১১ খৃষ্টাব্দ) মাঞ্চু দলপতি নারহাচি চারিদিকে ছত্রাকার দলগোষ্ঠীকে একত্র করে জিন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন ১৬১৬ খৃষ্টাব্দে। মাঞ্চু রাজা আবাহাই ১৬৩৬ সালে সাম্রাজ্যের নাম দেন কিং (মানে শুদ্ধ)। মাঞ্চুরা চৈনিক নয়।আবার চিনে বিদেশী সাম্রাজ্য চালু হল চেঙ্গিস খানের পর। তবে মাঞ্চুরা খুবই উৎসাহী ছিল চিনের নিয়মকানুন শিখে তাদের সভ্যতার সঙ্গে চৈনিক সভ্যতার মিলন ঘটাতে। তাই প্রচুর চৈনিক ও মাঞ্চু আমলারা পাশাপাশি কাজ করতেন সরকারী কার্যালয়ে। সম্রাট কিয়ানলং-এর সময়ে (১৭৩৫-১৭৯৬) কিং সাম্রাজ্যের সবথেকে ভালো সময় শুরু হয়। সাম্রাজ্যের পরিধি নিকটবর্তী বার্মা, ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত হয়। কিং সাম্রাজ্যের আরেক সম্রাজ্ঞী কিক্সি শাসন করেন পর্দার অন্তরালে থেকে এই সাম্রাজ্যের শেষের দিকে।বৈদেশিক বণিকরা, বিশেষ করে ইংরেজরা তাদের ব্যবসার বিস্তারের জন্য সম্রাজ্ঞীকে চাপ দিতে থাকে। ওপিয়াম যুদ্ধ হয় ১৮৪০-১৮৪২। ব্রিটিশরা চাইছিল ভারতের আফিমচাষের প্রচার করতে অন্য দেশে। অবশেষে নান্জিং এ ট্রিটি ওফ পোর্ট (Treaty of Port) হয়। তাতে হংকং ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ক্রমশ: ব্রিটিশরা ইয়াংসি নদীর দুই কুলে, জার্মানরা শ্যাংডং অঞ্চল এবং ফ্রেঞ্চরা ভিয়েতনামে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। বিদেশীদের আধিপত্যে বিরক্ত হয়ে সম্রাজ্ঞীর নেতৃত্বে রাজকীয় সৈনিকরা বিদেশীদের আক্রমণ করে বেইজিং -এ ১৯০০ সালে এবং পরাজিত হয়।সম্রাজ্ঞী পিছু হটতে বাধ্য হন, বেইজিং এ ফিরে আসেন। ব্রিটিশরা রাজপুত্র সম্রাট পিউ ই (Pu Yi) কে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। শিশু সম্রাট পিউ ই মায়ের সঙ্গে থেকে যান নিষিদ্ধ শহরে (Forbidden City) শেষ চৈনিক সম্রাট হিসেবে।
১৯১২ সালের পয়লা জানুয়ারী সাম্রাজ্য চিন পরিবর্তিত হল পিপল্স রিপাবলিক হিসেবে ডাঃ সান্ ইয়াত্ সেন-এর নেতৃত্বে।
গ্যালারী - ২
কবিতা
সঞ্চিতা মন্ডল
ছবি
ধূসর কাচের শার্সি,
আঁকাবাঁকা পথে শিশির নামায়
আবছা ঘোলাটে ।
দেওয়ালে টাঙানো
কাঠের ফ্রেমে মোরা একটা ছবি।
হালকা কুয়াশার স্তর পড়ে
অস্বচ্ছ অস্পষ্ট ...
দুচোখ ধাঁধা লাগার খেলায় উঠে মেতে
ছবি না হিজিবিজি বক্ররেখার সারি?উদ্ধার করতে গেলেরীতিমতো জট পাকিয়ে যায় মাথায়।
তৈলচিত্র নয়
সাদামাটা আর্ট পেপারফুটে উঠেছে --
আঁকাবাঁকা গাঢ় জল-রঙের জল খেলা।
ছবির শিল্পী আজও অপরিচিত।
রহস্যময় তুলির টান -
একাকী জাল বুনে চলেছে অবিরত।
রঙিন কুয়াশায় ঢেকে,
ঘরের এক কোণ হতে অন্য কোণে....