পুজো বার্ষিকী
১৪২৭
যখন সে
ফিরে আসে
স্বরূপ ঘোষ
কলকাতা
গল্প
"অধিক জ্ঞান লাভ করা আমার মত ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ আরোহণ করে তা সঠিকভাবে বিতরণ করা বোধহয় আরোই দুঃসাধ্য। বস্তুত জ্ঞান অর্জন ও সেই জ্ঞান সঠিকভাবে বিতরণের মধ্যে এক বিস্তর ফারাক আছে। প্রকৃতপক্ষে যিনি সঠিক জ্ঞান প্রদান করতে পারেন, তাহারই শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রাচীনকাল থেকে এরূপ রীতি ও ভাবনা চলে আসছে, তা শিক্ষক মহাশয়দের কাছে বহুবার শুনেছি। যদিও বহুবার এই শিক্ষিত সমাজ দ্বারাই বিজ্ঞান ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তথাপি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এইটুকু ধারণা জন্মেছে যে সঠিক জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি দ্বারা বিজ্ঞান নামক বিষয়টির এই সমাজে একটি অনস্বীকার্য গুরুত্ব আছে। আর সেই গুরুত্বের সন্ধান করতে গিয়েই আজ যে প্রকার আনন্দের সম্মুখীন হয়েছি তা বোধ করি জীবনের সমস্ত ধ্বংসের মাঝেও এক অনাবিল চিরনতুনের ডাক।" কথাগুলো একমনে বলে থামল পবিত্র। এতক্ষণ যিনি শুনছিলেন, তিনি সুচন্দ্রিমা। পাঁচ বছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়া পবিত্রর স্ত্রী। তারই ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে উঠেছিল পবিত্রর। রাত তখন গভীর। সমগ্র পৃথিবী যেন চিরনিদ্রায় শায়িত।
পবিত্র মৌলিক, বয়স বিয়াল্লিশ। মাঝারি গড়ন, ছিমছাম, সাদামাটা, সাতে-পাঁচে না থাকা মানুষ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে আজ বছর পনেরো হল তিনি ভারতবর্ষের একটি বিখ্যাত গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞান চর্চায় নিযুক্ত। একটু ভুল হল। নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আজ এক বছর হল সেই বিজ্ঞান সংস্থা থেকে তিনি প্রত্যাখ্যান হয়েছেন। পবিত্র নিঝঞ্ঝাট মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞান ও স্ত্রী এই দুটো জিনিসেই তার ভালোবাসা ছিল অগাধ। পরোপকারী ও ছাত্র দরদী এই মানুষটি কোনদিন অজান্তেও কারও ক্ষতি করেছেন শুনলে অনেকেই অবাক হতে পারেন। তবুও কি এমন হয়েছিল যে তাকে একদিন বিতাড়িত হতে হল তার কর্মস্থল থেকে।
স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই পবিত্র বেশ একা হয়ে পড়েছিল। সময়টাই যেন থমকে গেছিল তার কাছে। কোন কাজেই মন বসতো না ঠিক করে। আর সেটা হবে নাই বা কেন বলুন। পতি-পত্নীর ভালোবাসা যেন একই আত্মারই পৃথক রূপ মাত্র। পুরুষ ও প্রকৃতির এই নিরভিমান মহাযজ্ঞের গাঁথা নিরবিছিন্ন রূপে বহমান। স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও নিজের কাজ ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সবকিছু ভুলে থাকতে চেয়েছিল সে, কিন্তু সে আর হল কই! মহাকালের অমোঘ নিয়মে সবকিছুই যেন অপ্রকাশিত। পবিত্রর গবেষণার বিষয় ছিল কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম কম্পুটেশন। গবেষক হিসেবে এখনো সে সেইভাবে খ্যাতি অর্জন না করলেও, একজন ভালো শিক্ষক ও নিপাট ভালমানুষ হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু সেও এক বছর আগের কথা।
হঠাৎ যদি কম্পুটার টা কথা বলে ওঠে। হঠাৎ যদি তার সচল স্ক্রিনটা বলে ওঠে 'কেমন আছো?' তাহলে কেমন হয়? তেমনি হয়েছে আজ পবিত্রর ঘরের ছোট্ট টেবিলে রাখা কম্পুটারে। কথা বলছে তার স্ত্রী সুচন্দ্রিমা। না, একথা কোন রেকর্ড করে রাখা শব্দ নয়, একথা যেন জীবন্ত, সময়ের ও ভাবের সাথে পরিবর্তনশীল দৈনিক কথাবার্তা। পবিত্রর কম্পুটার থেকে বেড়িয়ে আসছে সুচন্দ্রিমার বলা কথা। সুচন্দ্রিমার বলা নিত্যদিনের কথাগুলো প্রোগ্রামিঙের মাধ্যমে তৈরি করেছে পবিত্র। যেন জীবন্ত তার স্ত্রী। স্ত্রীর একাকীত্ব কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠবে সে। শুধু এইটুকু হলেও হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু সেইদিন পবিত্রর সামনে থাকা একটি জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল সুচন্দ্রিমার মুখ। না এ কোন পুরানো ছবি বা ভিডিও নয়, এ যে পবিত্রর নিজের হাতে তৈরি সুচন্দ্রিমার সচল প্রতিরূপ। মৃত্যুর পর সুচন্দ্রিমার দেহ থেকে বিকিরিত শক্তি কে পার্টিকেলের বিপরীত অ্যান্টিপার্টিকেলে রূপান্তরিত করে সেই অ্যান্টিপার্টিকেল কে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে চালনা করে তার থেকে বিচ্ছুরিত দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী আজ স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। হ্যাঁ, নির্ভুল এ সুচন্দ্রিমার মুখ। ডাকছে পবিত্রকে। নিজের আবিষ্কারে নিজেই হতবাক হয়ে গেছিল পবিত্র। বিশ্বাস করতে পারেনি। সময় লেগেছিল তার সম্বিত ফিরতে। কিন্তু এখন সে রোজ কথা বলে সুচন্দ্রিমার সাথে। সুচন্দ্রিমা হারিয়ে যায়নি, সে আছে তার কাছেই।
গল্পটা এই অবধি থাকলেই বোধহয় সুন্দর হত। কিন্তু নিয়তির অস্ফুট পরিহাসে তা আর হল না। পরমাত্মার পরিকল্পনা হয়তো অন্য কিছু ছিল। তার এই আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস সংবরণ করতে পারেনি পবিত্র। এই অভূতপূর্ব কাজের কথা সে জানিয়েছিল তার সহকর্মী প্রফেসর সেন কে। প্রথমটায় সেনবাবু বিশ্বাস করতে চায়নি পবিত্রর কথা। যতই হোক, পদমর্যাদা ও সামাজিক সম্মানে তিনি পবিত্রর থেকে অনেক উপরে। বৈজ্ঞানিক মহলেও তার প্রভাব প্রতিপত্তি কম নয়। বিদেশ থেকে পাশ করা বৈজ্ঞানিক বলে কথা। সেখানে পবিত্র কোলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি। তাই তিনি মানবেন কেন পবিত্রর মত এক সাধারণ বিজ্ঞানীর কথা। কিন্তু পবিত্রর আবিষ্কার দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি প্রফেসর সেন। প্রথম দিকে হতবাক
হলেও, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে 'ব্রাভো' শব্দটুকু উচ্চারণ করে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ঐ বিজ্ঞান সংস্থা পবিত্রর বিরুদ্ধে জরুরী অবস্থা জারি করে। অভিযোগ সে নাকি কিছু নিষিদ্ধ বেসরকারি ও বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্লু – প্রিন্ট কম্পুটার প্রোগ্রামিঙের কোডিং এর সাহায্যে সে তাদের প্রদান করেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয় পবিত্র। তার উপর আগামী সাতদিনের মধ্যে তাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে বলা হলে, সাদামাটা আপনভোলা মানুষটি তা জানাতে ব্যর্থ হলে তাকে বরখাস্ত এবং তার বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
আজ ইকুয়েশনগুলো কিউবিটের মধ্যে দিয়ে দ্রুত সমাধান হয়ে গেছে। আগামীকালের কাজগুলোর পরিকল্পনা করে এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে ঘুমোতে যায় পবিত্র।
"ভোর হল, দোর খোল ..." কথাগুলো শুনে চমকে উঠল পবিত্র। চায়ের কাপ হাতে সশরীরে উপস্থিত সুচন্দ্রিমা। প্রথমে ভেবেছিল সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু চোখ কচলিয়ে বুঝতে পারল স্বপ্ন নয় বাস্তব। বিস্ময়ে হতবাক পবিত্র সুচন্দ্রিমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে এক প্রবল ঝটকায় মূর্ছা গেল। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল সুচন্দ্রিমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ লাগল পবিত্রর সেই ভ্রম কাটতে। কিন্তু পরক্ষনেই সে বুঝল এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার কারণ। অতি উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে অ্যান্টিপার্টিকেলগুলো নিজেদের সজ্জিত করে সুচন্দ্রিমার মানবী রূপ ধারণ করেছে। না, এ কোন ক্লোন নয়। এ হল অ্যান্টিপার্টিকেলের সজ্জা। পবিত্রর মূর্ছা যাবার কারণ এবং এখন সুচন্দ্রিমার স্পর্শে ঐরূপ কোন আঘাত অনুভব না হওয়ার কারণও এখন তার কাছে স্পষ্ট। উচ্চ শক্তির চৌম্বকক্ষেত্রে আবেশিত হওয়া তড়িৎ প্রবাহ এবং পরমুহূর্তে অ্যান্টিপার্টিকেলগুলোর নিজে থেকেই ঐ তড়িৎ প্রবাহকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, পবিত্রর আজ সকালের সমগ্র উত্তেজনার কারণ। সুচন্দ্রিমা কথা বলছে তারই তৈরি করা কথায় কিন্তু নিজের মুখে। এ এক অদ্ভুত জগৎ। এক নিরবিচ্ছিন্ন অনাবিল আনন্দ অনুভব করতে থাকে পবিত্র। আজ বহু বছর পর সেই স্পর্শ সেই অনুভূতি উপলব্ধি করল পবিত্র। এ যেন এক সমুদ্রতীরের দৃপ্ত আবাহন। জীবনের সমস্ত অসত্যের মাঝে এক সুগভীর সত্যের ছোঁয়া। কিন্তু পরমুহূর্তেই সুখ ও ভ্রমের অবসান হয় পবিত্রর। বুঝতে পারে, এ সশরীরি সুচন্দ্রিমার দেহ ধারণ করলেও তা সুচন্দ্রিমা নয় এবং এই শরীরের স্থায়িত্বও খুব বেশী দিনের নয়। কোন এক অজানা আতঙ্কে ধ্বংসের প্রহর গুনতে থাকে পবিত্র। এতদিন ঘরে থেকেও সে মানসিক ভাবে দৃঢ় ছিল। কিন্তু আজ কৃত্তিম সুচন্দ্রিমার মানবী রূপ, তার কথা বলা ইত্যাদি পবিত্রর সমস্ত প্রফুল্লতায় জল ঢেলে দিয়েছে। কোন এক সিঁদুরে মেঘের আশঙ্কায় শিউরে ওঠে সে।
দিনটা ছিল বৈশাখ মাসের কোন এক দিন। সকাল থেকে তীব্র দাবদাহের শেষে অপরাহ্ণের কালবৈশাখী। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে, সাথে ঝড় ও বজ্রপাতের উচ্চ কণ্ঠের গীত যেন সমগ্র প্রকৃতির বুকে প্রলয় নৃত্য করছে। সুচন্দ্রিমা বিকেলের চা করে এনে দিয়েছে পবিত্রকে। একটা নিয়মিত আলেখ্যের মত আবার সবকিছু ভুলে পবিত্র যেন এক নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে। সুচন্দ্রিমার টানে সে যেন ভুলে গেছে বাস্তব ও রূপকথার দ্বন্দ্বকে, ভুলে গেছে তার সেই দুঃসাধ্য কালজয়ী আবিষ্কারকে। ভুলে গেছে সে তার পূর্বপরিচিত মানুষগুলোকে। কৃত্রিম সুচন্দ্রিমা তার মস্তিষ্কে যেন এক নতুন জীবনের, নতুন সময়ের রূপরেখা রচনা করে দিয়েছে। যার গন্তব্য যেন তারই অন্তিম যাত্রাপথে সমর্পিত।
রাত তখন দশটা বেজে দশ। বৃষ্টি থেমে গেছে। গাছের পাতা গুলো দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে। সবুজ পাতা গুলো জলে ভিজে আরও সবুজ হয়ে গেছে। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মায়া কাটিয়ে চেতনা ফিরল পবিত্রর। আজ বহুদিন হল ওদের কাছে কেউ আসে না। সুচন্দ্রিমা আর ও, এই দুজনের একান্ত আপন পৃথিবী। তাই কলিং বেলের শব্দ এবং বিশেষত: ঘড়ির কাঁটার অবস্থান আরও কিছুটা বিস্মিত করল তাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় পবিত্র। দরজার ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে হাড় হিম হয়ে যায় তার। দরজার ওপাড়ে উষ্কখুষ্ক চুলে দাঁড়িয়ে আছে সুচন্দ্রিমা। তার রক্তাভ চোখ দুটো যেন শোণিত করছে পবিত্রকে। ঘরে থাকা সুচন্দ্রিমা ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে পবিত্রর পিছনে। হাতে তার রাতের খাবার। দুই মানবীর মুখেই এবার ফুটে উঠল হাসি। এগিয়ে আসতে থাকে দুজন দুজনের দিকে। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পবিত্রর বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়। দুই সুচন্দ্রিমা দুজনের কাছে পৌঁছতেই এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা বাড়ি। ছিটকে পড়ে যায় পবিত্র। ঘোলাটে দৃষ্টিতেও সে দেখতে পায় সেই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের দৃশ্য এবং একই সাথে কানে ভেসে আসে এক তীব্র ভৎসনা ও বিদ্রূপের হাসি। প্রফেসর সেন হেসে চলেছেন এক পৈশাচিক হাসি। প্রাণের শেষ স্পন্দনেও পবিত্র শুনতে পায় কোথায় যেন বেজে চলেছে - "আমার যাবার সময় হল, আমায় কেন রাখিস ধরে। ................."
গল্প
ক্যামেলিয়া
চৈতালী সরকার
কলকাতা
ভারতের উত্তরে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। এর উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার।' হেলেদুলে বই পড়ছে রিঙ্কা। এইবার কিছুতেই কম পেলে চলবে না। মা বলেছে, 'একশোর মধ্যে নব্বই কোনো নম্বরই নয়।' আরও আরও ছুটতে হবে। ট্রাকের পেছনে সবাইকে ফেলে শুধু ছোটা!
পিছনে কখন তন্বী এসে দাঁড়িয়েছে, সেদিকে না তাকিয়ে রিঙ্কা পড়ে চলে ভূগোলের ভূপ্রকৃতি। তন্বী মুখে বিকট আওয়াজ করতেই চমকে ওঠল রিঙ্কা।
নিজের বুকের কাছটা চেপে ধরে বলল, 'ভয় দেখাছিস কেন?'
'আর কত পড়বি? চল না একটু খেলা করি। ছাদে কিংবা আমাদের বাড়ি!' তন্বী কথাগুলো বেশ আস্তে আস্তে বলল। রিঙ্কার মা শুনলে আর রক্ষে নেই। একেবারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, না না রয়্যাল বেঙ্গল টাইগ্রেস বলে ডাকে রিঙ্কার মাকে ওর বন্ধুরা।
একবার রিঙ্কার হরিণ চোখ চারিধার দেখে নিল।
মা বোধহয় দুপুরে ভাত ঘুম দিচ্ছে। এইসময় একটু খেলা যেতেই পারে। একটা উষ্ণ ঢেউ খেলে গেল বুকের মধ্যে। তারপর বেরিয়ে পড়ল দুজনে।
ভরদুপুরে রাস্তায় লোকজন বেশি নেই। একজন ফেরিওয়ালা সাইকেল করে প্লাস্টিকের বালতি, মগ বিক্রি করছে। এরা জামাকাপড়ের বিনিময়ে জিনিষ দেয়। কিছুদিন আগে রিঙ্কার মা দুটো পুরোনো কাপড়ে জোরজবরদস্তি করে একজোড়া বালতি নিয়েছিল।
রিঙ্কা জানে, মাকে কেউ ঠকাতে পারবে না।
মায়ের কথা মনে পড়তে বুকটা কেমন কেঁপে উঠল রিঙ্কার। এইভাবে চলে আসা তবে কি ঠিক হয়নি!
'দ্যাখ কেমন হনুমানটা কলা খাচ্ছে। আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি করল। ' তন্বী আঙুল তুলে দেখাল রিঙ্কাকে। রিঙ্কা ভয়ে তন্বীর হাত চেপে বলল,' যদি কামড়ে দেয়? 'দূর বোকা, দেখছিস না ও কেমন কলা খাচ্ছে। কি সুন্দর একটা বাচ্চা দেখেছিস?' হনুমানের বাচ্চাটা হনুমানের গা ছুঁয়ে বসে আছে। নিশ্চয় ও মা হনুমান। কলার খোসা ছাড়িয়ে বাচ্চাটাকে দিচ্ছে।মায়েরা এরকমই হয়।
একবার রিঙ্কার মনে আছে মায়ের হাত থেকে একটা হনুমান কিভাবে বাঁধাকপি নিয়ে গিয়েছিল, মা একটুও ভয় পায় নি। পরে এর প্রতিশোধ নিতে অন্য একটা হনুমানকে লাঠির ঘা পর্যন্ত মেরেছিল।
কেন বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছে রিঙ্কার! তবে কি না বলে আসাটা সত্যিই অন্যায় হয়েছে। এই প্রথমবার মাকে না বলে রিঙ্কা এতোটা পথ এসেছে।
তন্বীর বাড়ি থেকে রিঙ্কার বাড়ি যেতে হেঁটে দশ মিনিট লাগে। তন্বীর একা চলার অভ্যেস আছে। ইংরেজি পড়তে তন্বীকে অনেক দূর যেতে হয়। প্রথমবার তন্বীর মা সঙ্গে গিয়েছিল। তারপর থেকে তন্বী একাই যায়।
পিঠে বস্তা নিয়ে মাঝবয়সী একটা লোক ওদের দিকে আসছে। লোকটির দৃষ্টি রাস্তার দুধারে নোংরা আবর্জনার দিকে। রিঙ্কা ভাবল ও নিশ্চয় ছেলেধরা। রিঙ্কা শুনেছে নির্জন পথে এইরকম ছেলেধরা বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একা ছোটো ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। তারপর হাতপা কেটে দিয়ে পঙ্গু করে মেলায় মেলায় ভিক্ষা করতে বসিয়ে দেয়। রিঙ্কা, তন্বীর বয়স কতই হবে! সবে দশ পেরিয়েছে, সেই হিসেবে ওরাও বেশ ছোটো। যদি ওদের ধরে নিয়ে যায়।
ঐ তো ছেলেধরাটা রিঙ্কাদের দিকে আসছে। রিঙ্কার স্থির বিশ্বাস এক্ষুনি ওদের বস্তায় পুড়বে। তারপর নির্ঘাত ভিক্ষা করতে হবে। রিঙ্কার বেশ ভয় ভয় করছে। এদিকে তন্বীর কোনো হেলদোল নেই। এইরকম বস্তা কাঁধে লোক ও প্রায়ই দেখে। রিঙ্কাকে অন্যমনস্ক দেখে তন্বী বলল, 'তাড়াতাড়ি চল। অনেক খেলব।'
একটু এগোতেই দেখল ছেলেধরা লোকটা পাশের গলিতে চলে গেল। এবার বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে রিঙ্কার।
খবরের কাগজে আজকাল বড্ড একঘেয়ে খবর বেরোয়। রাজনীতির তর্জা না হয় বিজ্ঞাপনে ভরে থাকে পাতার পর পাতা। তবু দুপুরবেলা কাজ সেরে কাগজে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে মৈত্রেয়ী। পাশে মোবাইলে চলতে থাকে মিষ্টি রবীন্দ্রসঙ্গীত। মৈত্রেয়ী কখনো গুন গুন করে ওঠে। শ্যামল এইসময় অফিসে থাকে। বেশিরভাগ ভাগ দিন বেশ রাত করে ফেরে।
বিয়ের প্রথম প্রথম অভিমান হত মৈত্রেয়ীর। তন্বী আসার পর সেসব কেটে গেছে। ছোটোবেলায় তন্বীকে অনেকটা সময় দিতে হত। কিন্তু বড়ো হওয়ার সাথে সাথে তন্বী বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। এখন নিজের সব কাজ একা করে। স্কুল, প্রাইভেট টিউশনি সব জায়গায় একাই যেতে পারে। মাঝে মাঝে মৈত্রেয়ীর চিন্তা হয়।
মফঃস্বল শহরে গাড়ি অনেক বেড়ে গেছে। রাস্তাঘাটও আর আগের মতো সেফ নয়। গোলাপ, লাল, হলুদ গোলাপী, সাদা। রিঙ্কা এতো ফুল দেখে অবাক হয়ে বলল, 'এত গাছ কে লাগিয়েছে? কি সুন্দর লাগছে।' তণ্বী রিঙ্কাকে সব দেখাতে দেখাতে বলল, 'সব মা লাগিয়েছে। মা রোজ জল দেয়। সার দেয়। আরও কত কি!'
হঠাৎ একটা গাছে চোখ পড়ল রিঙ্কার। এই ফুলগুলো কখনও দেখেনি রিঙ্কা। তণ্বীর কাছে জানতে পারল, ফুলের নাম ক্যামেলিয়া। এগুলোকে শীতের গোলাপ বলে, খুব যত্ন করতে হয়।
রিঙ্কা ভাবে, ওদের বাড়ির ছাদ তো আরো বড়। একটা ফুলবাগান করা যেতেই পারত! মায়ের ওপর খুব রাগ হল, কেন যে গাছ লাগায় না!
রিঙ্কা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখে তণ্বীর মা এক প্লেট পাপড় নিয়ে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। রিঙ্কা অবাক চোখে দেখল তণ্বীর মাকে। কি সুন্দর দেখতে! ক্যালেন্ডলারের দুর্গা ঠাকুরের মতো। রিঙ্কার মনে হল তণ্বীর থেকেও ওর মা সুন্দর। আচ্ছা উনি কি করে জানলেন ও পাপড় খেতে ভালোবাসে। মায়েরা কি সব কথা জানে! কই ওর মা তো বোঝে না। ওর পড়তে না ইচ্ছে করলেও মা কেমন জোর করে পড়ায়। খেলতে চাইলে বলে এখন খেলা নয়।
রিঙ্কার তো মন চায় এক্কা দোক্কা খেলতে, তণ্বীর মতো রাস্তা চিনে বাড়ি ফিরতে। একদম একা একা!
'কি এতো ভাবছ রিঙ্কা? 'তণ্বীর মা খুব কাছে এসে আদর সুরে বললেন। কতদিন তণ্বী বলেছে তোমাকে এখানে আনবে। ও তো তোমাদের বাড়ি কতবার গেছে। ভালোই হল তোমরা অনেক খেলা করতে পারবে। এবার থেকে মাঝে মাঝে চলে আসবে কেমন?
কি মিষ্টি করে কথা বলছেন তণ্বীর মা। মনে হয় সব কথা শুনি। রিঙ্কার মনে পড়ল, একবার তণ্বীর সাথে ওর মা খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। মায়ের ধারণা তণ্বীর জন্যই নাকি রিঙ্কা এবার ফার্স্ট হতে পারেনি। ইস তণ্বীর মায়ের মতো ওর মা যদি হতো!
আফশোসের তীর বুকে এসে বিঁধল। সেপটিপিনের খোঁচার মতো কষ্টটা চেপে নিল রিঙ্কা।
খেলতে খেলতে বিকেল হয়ে গেল। রিঙ্কা বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। কেন যে তণ্বীর ফিরতে দেরী হচ্ছে? রিঙ্কাকে ছাদে রেখে তণ্বী তো অনেকক্ষণ ঘরে গেছে। মা ঘুম থেকে উঠে ওকে না দেখে নিশ্চয় খুব চেঁচামেচি করছে! মা রেগে গেলে তো কুরুক্ষেত্র কান্ড করে। কুুরুক্ষেত্রের সঙ্গে মায়ের রাগ কতটা মেলে রিঙ্কা বোঝে না। তবে বাবা প্রায়ই এই কথাটা বলেন।
না আর ধৈর্য রাখতে পারছে না রিঙ্কা। একবার ঘরে গিয়ে দেখবে! ঘরের কাছে যেতেই বেরিয়ে এল তণ্বী। 'এতো দেরী হল কেন, এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে।' রিঙ্কা উদ্বেগের সঙ্গে বলল। আজ নির্ঘাত পিঠে মার পড়বে। মনে মনে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিল রিঙ্কা। কথার কোনো তল পাচ্ছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! বাড়ির যত কাছে আসছে তত ভয় বাড়তে লাগল। রিঙ্কা ঠিক করল আর কোনো দিন না বলে কোথাও যাবে না।
বাড়ির সামনে এসে তণ্বী বলল, 'আমি বাড়ি গেলাম। তোর মা যা রাগী নিশ্চয় আমাকেও পেটাবেন।' কথা শেষ না হতেই চড়ুই পাখির মতো পালিয়ে গেল তণ্বী। এবার রণাঙ্গনে একা রিঙ্কা।
বেল বাজাতেই রিঙ্কার বাবা দরজা খুলে দিলেন। রিঙ্কা চুপি চুপি ঘরে ডুকে দেখে, মা বিছানায় শুয়ে আছে। মা তো কখনই শুয়ে থাকে না। আর এত তাড়াতাড়ি বাবাও তো বাড়ি ফেরেন না। রিঙ্কার বেশ ভয় করছে। বাবা ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। ডাক্তার মনে হল। কেন? মার কি শরীর খারাপ। কই দুপুরে তো ঠিক ছিল। মনের মধ্যে নানা কথা উঁকি মারছে, কাউকে বলতে পারছে না রিঙ্কা। বাবা কেন এতো গম্ভীর? কই ওকে তো কিছুই বললেন না। মনে হচ্ছে না বলে বাড়ির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বাবা জানেন না। একটু ভয়ে ভয়ে রিঙ্কা মায়ের কাছে দাঁড়াল। তখন ভেতরটা তোলপাড় করছে।
'প্রেশার থেকেই অজ্ঞান হয়েছেন মনে হয়। হঠাৎ প্রেশার নেমে গেছে আর কি। টেনশন করবেন না। ভয়ের কিছু নেই।' ডাক্তারী ভঙ্গিতে বেশ গম্ভীর গলায় ডাক্তারবাবু বলে চললেন।বাবা রিঙ্কার কাছে এসে আস্তে আস্তে বললেন, 'তুই কোথায় ছিলি? ভাগ্যিস বাণ্টির মা আমার অফিসে ফোন করেছিলেন!' রিঙ্কা কোনো কথা না বলে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।চোখ বুজে আছে মা। আজ মাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগছে। ঠিক ক্যামেলিয়া ফুলের মতো। রিঙ্কা এই প্রথম অনুভব করল ওর মা সবচেয়ে সুন্দর, সবার থেকে ভালো। রিঙ্কার চোখ জলে ভরে এল।
কিছুক্ষণ পরে রিঙ্কার মা চোখ খুললেন। রিঙ্কাকে দেখে তাঁর চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। সেই চোখে কোনো রাগ নেই। আছে গভীর ভালোবাসা, উৎকণ্ঠা। রিঙ্কা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আর কক্ষনও তোমাকে না বলে কোত্থাও যাবো না।'
মা রিঙ্কার মাথায় ছোট্ট একটা চুমু খেলেন। মা মেয়ের সম্পর্ক স্নিগ্ধ ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল বিছানায় ..... বাড়িময়।
গল্প
মাতৃজা
অধীর সিনহা
ডায়মন্ড সিটি, যশোর রোড, কলকাতা
ইউ এস এ থেকে মিঃ আর মিসেস স্মিথ কাল রাতেই এসে উঠেছেন হায়াতে। ডাঃ অরুনা মিত্র তাদের জন্য হোটেলের লাউনজে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা আসতেই ম্যাডাম উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন ‘ওয়েলকাম টু কলকাতা, আই এম ডাঃ অরুনা মিত্র, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অফ আই ভি এফ ফার্টিলিটি ক্লিনিক।’
‘গ্লাড টু মিট ইউ, উই আর ডিলাইটেড টু বি ইন কোলকাতা।’
‘ফর সারোগেট মাদার উ হ্যাভ সিলেক্টেড কোলকাতা ওভার গুজরাট এন্ড মুম্বাই, থ্যাং উ ফর ইয়োর সাপোর্ট।’
‘উ আর মোস্ট ওয়েলকাম, দা রিজন ইজ লেডিজ হিয়ার আর ন্যাচারালি বিউটিফুল।’ মিসেস স্মিথ হাসি মুখে উত্তর দিলেন। ম্যাডাম মিত্র মনে মনে জানেন যে কলকাতা পছন্দের আর একটা বড় কারণ খরচ; গুজরাট আর মুম্বাই থেকে অনেক কম খরচে এখানে সারোগেট পাওয়া যায় আর পাবলিসিটি কম হওয়ার জন্যে লোক জানাজানি বেশি হয়না।
তাদের নিয়ে ম্যাডাম হোটেল থেকে সোজা তার ক্লিনিকের অবব্জারভেশন রুমে নিয়ে এলেন। সেখানে ওয়ান ওয়ে ভিউ কাঁচের জানলা, রত্না উদ্বিগ্ন চিত্তে বসে উল্টো দিকে।
ডাঃ মিত্র বললেন, ‘দেয়ার ইজ ইউর সারোগেট, বেঙ্গলি লেডি ইন হার ফরটিজ, সিটিং ইন আ ব্লু সাড়ি।
শি উইল বি সারোগেট ফর ইউর চাইল্ড।’ স্মিথ দম্পতি খুশি হলেন রত্না কে দেখে।
‘উই হোপ শি উইল বি আ ভেরি গুড মাদার অফ প্রেশাস চাইল্ড। ইউ মে নট বি নোইং হাউ ডিপ্রেশড উই ওয়ার হয়েন মাই ওয়াইফ ক্যান্ট কন্সিভ, সো উই আর ভেরি ইগার টু হাব আওয়ার চাইল্ড, হি উইল ইনহেরিট আস।’
‘সো নাইস,ইউ উইল গেট দ্য কন্ট্রাক্ট এন্ড আ ডোসিয়ার অন হুইচ উ উইল গেট আল ইনফরমেশনস, ফটো অফ সারোগেট। ’ম্যাডাম মিত্র তাদের বোঝালেন। তিরিশ হাজার ডলারে চুক্তি হল, শর্ত অনুযায়ী পনেরো হাজার ডলার পেমেন্ট নিলেন ম্যাডাম মিত্র।
কিছুক্ষণ পরে ম্যাডাম রত্নাকে ডেকে পাঠালেন। রত্না কেবিনে আসতেই ম্যাডাম রত্নাকে বললেন, ‘রত্না কংগ্রাচুলেশনস, তোমাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। দি ডিল ইজ অন। কি খাবে বলো? ইউ ডির্জাভ এ ট্রিট, আর কাল এসে কাগজপত্রে সাইন করে দু লাখ টাকার চেক নিয়ে যেও। ইন ফাক্ট ইউ আর আ গোল্ড মাইন। পেট ভাড়া দিয়ে পেট ভরিয়ে যাও।’ রত্নাকে বসিয়ে ম্যাডাম ভরপেট খাওয়ালেন আর দুপ্যাকেট ভর্তি খাবার নিখিল আর শুভর জন্যে দিলেন।
রত্না ম্যাডামকে প্রণাম করলো। খুশির আনন্দে রত্না যখনই উচ্ছল হয়ে উঠছে তক্ষুনি একটা অজানা ভয় তার মনের মধ্যে উঁকি মারতে থাকে, তাকে মা হতে হবে এক অজানা উপায়ে— আর প্রসবের পর শিশুর ওপর কোন তার অধিকার থাকবে না।
‘কি হয়েছে রত্না? তোমাকে এরকম লাগছে কেন? হাতে কিসের প্যাকেট?’ নিখিল ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
‘ওরা আমাকে পছন্দ করে নিয়েছে, আর ম্যাডাম দু লাখের চেক দিয়েছে! আমাদের খাওয়া থাকার জন্য আর কোন চিন্তা নেই।’
‘কারা?’নিখিল ঠিক বুঝতে পারেনি।
‘ঐ যে ম্যাডামের আমেরিকার লোকজন।’
‘তুমি এখন নার্সিংহোম থেকে এলে?’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম ডেকেছিল, এই সব খাবার আর চেক দিয়েছে।’ রত্না খুব আনন্দের সাথে বললেও কি রকম একটা ভয়ের ছায়া নিখিল দেখতে পেল।
‘এ সব কথা তো অনেক দিন থেকে কথা হচ্ছে। তা তোমাকে এরকম কেন লাগছে?’
‘আমার ভীষণ ভয় করছে, আমি আবার মা হবো। আমি পারবো?’ রত্নাকে খুব অসহায় লাগল।
‘কেন পারবে না, ম্যাডাম যখন সব ব্যবস্থা করছেন তিনি নিশ্চয়ই সব দিক ভেবেই করছেন। কাল আমি আরও জেনে নেব। তুমি ভয় করো না, তোমাকে যে পারতেই হবে। শুভর কথা, আমাদের সংসারের কথা ভেবে; কতো টাকা পাওয়া যাবে। আমি গার্ডের কাজ ছেড়ে ছোট্ট একটা ব্যবসা করবো, শুভকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করবো আর একটা টিভি কিনবো। তোমাকে আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে না।’
রত্না নিখিলের হাতটা চেপে ধরল, ‘টাকার লোভে আমরা ভুল বা খারাপ কিছু করতে যাচ্ছি না তো?আর দশ মাস পেটে ধরার পর, যে আসবে তাকে চিরদিনের জন্য আর দেখতে পাব না।’
‘ম্যাডাম তো বললেন ভারতের অন্য জায়গায়ও তো এইরকম অনেকেই করছে, আসলে ওরা তোমার পেটটা ভাড়া নেবে। এই আমরা যেমন ভাড়া বাড়িতে থাকি।’
নার্সিং হোমে ডঃ মিত্র নিজে রত্নার জঠরে আই ভি এফ পদ্ধতির মাধ্যমে মিঃ আর মিসেস স্মিথের স্পার্ম ইনসার্ট করলেন। দেখতে দেখতে সাত মাস কেটে গেল। মাতৃত্বের সব লক্ষণ রত্নার দেহে ফুটে উঠল। তলপেটের উঁচু ভাব আর উজ্জ্বল মুখে এ যেন আর এক রত্না। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে পেটে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতো ভিতরের ছটপটানি।গুণ গুণ করে গান গাইত তখন রত্না। ভিতরের ছট পটানি ধীরে ধীরে কম হয়ে আসত। যে দিন গানের পরেও ছটপ্টানি বন্ধ হোত না,সেদিন রত্না ছড়া শোনাত।
ওদিকে ম্যাডামের নির্দেশ আট মাস থেকে রত্নাকে নার্সিং হোমে থাকতে হবে।
ম্যাডাম এম্বুল্যান্স পাঠীয়ে রত্নাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করে দিলেন। মিঃ স্মিথ বার বার ফোন করছেন তারা ইণ্ডিয়ায় কবে আসবেন? রত্নার শারীরিক অবস্থা এক জন আদর্শ মায়ের মতো, তাই সব দিক দেখে ম্যাডাম ন্যাচারাল ডেলিভারির কথাই ভাবলেন এবং সেই মতো স্মিথ পরিবারকে আসতে বলা হল।
দশ মাসের মাথায় রত্না একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। প্রসবের পর রত্নার মনে হতো তার চারিদিকে কেমন যেন খালি খালি ভাব। দেহে, মনে চারিদিকে যেন একটা শুন্যতা তাকে ঘিরে রেখেছে। যে আত্মা এতো দিন তার আত্মার অঙ্গ ছিল, সে আজ তার আত্মাকে পরিত্যাগ করে কোন দূর দেশে পাড়ি দিয়েছে। ওকে যদি একবার তাকে কোলের মধ্যে দেয় তাহলে প্রাণ ভরে তাকে বুকের দুধ দেবে। কিন্তু অনেকবার বলেও কেউ শোনেনি। চুক্তি মতো রত্নার আর কোন অধিকার নেই তার উপর। সাত দিন পরেই রত্নাকে নার্সিং হোম থেকে ছেড়ে দিলো।
অটো থেকে যখন নিখিল রত্নাকে নিয়ে নামলো তখন বেশি বেলা হয়নি আর রবিবার থাকার জন্যে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল।শুভো ছুটে এল, ‘মা বোনু কই?’
‘না বাবা, বোনকে এখন আনা যাবেনা। ওকে হাসপাতালে রেখেছে।’
‘ভ্যাগিস ওর ছবি তুলে নিয়েছিলাম - কবে আসবে?’ শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিলো রত্নার। কিছু বলার আগেই নিখিল একটু ধমকের সুরে শুভোকে বলল, ‘শুভ তুমি এখন বড়ো হয়েছো, দেখছ তো মার শরীর ভালো নেই। পরে তুমি সব জানবে। এখন মাকে নিয়ে ভেতরে যাও আমি অটোর ভাড়া দিয়ে, ওষুধ নিয়ে আসছি।’
দশ বছর পর চিকাগো শহরে স্মিথ দম্পতির বাসস্থান;
‘শি টকস ইন হার স্লিপ এন্ড স্পিকস এ ডিফারেন্ট লাঙ্গোয়েজ।’ সাইক্রিয়াটিকরা অনেক চিন্তা ভাবনা করে বুঝতে পারল না এঞ্জেল ঘুমের ঘোরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কি ভাষায় কথা বলে। কি করে তারাই বা বুঝবে, মাতৃজঠরে থাকার সময় সে বাংলা ভাষা শুনে পৃথিবীতে আসার জন্য তৈরি হয়েছিল। এঞ্জেল নিজেও বুঝে পেত না ঘুমের মধ্যে মাঝে মধ্যে সে যেন এক অজনা জগতে চলে যায় আর হালকা সুরে গান শুনতে পায়।
‘মম ক্যান আই কল ইউ মা?’ ‘মা? ওহ নাইস - ইফ দ্যাট সুটস ইউ, মে কল মি মা।’ সেদিন হটাৎ এঞ্জেল হাতে পেল কলকাতার আই ভি ফার্টিলিটি হাসপাতালের ফাইল, যাতে লেখা সারোগেট মাদার রত্না দাস, ওয়াইফ অফ নিখিল দাস, ডেলিভারড এক গার্ল চাইল্ড অ্যাট কোলকাতা অন থার্ড ফেবরুইয়ারী ২০০০। ভেতরে এক মহিলার আলাদা ছবি, তার মা বাবার ছবি-তাদের কোলে একটি শিশু। বারবার জিজ্ঞাসা করেও এঞ্জেল মম বা ড্যাড কারো কাছ থেকেই কোন সদউত্তর পেল না এই বিষয়ে। প্রতি বছর থার্ড ফেব ঘটা করে তার জন্মদিন হয়, কেক কাটা হয় — আর সেই দিনে মম ড্যাড কলকাতা - ইন্ডিয়াতে কাকে কোলে ছবি তুলেছিল। তবে ছবির ওই ছোট্ট শিশু কি সে নিজে? কে আর এক জন মহিলা? এঞ্জেল হাই স্কুল পাস করল - সে এখন বিশ বছরের তরুণী। কিন্তু কোলকাতার অজানা মহিলার ছবি, বাচ্চা কোলে তার নিজের মা বাবার স্মৃতি সে ভুলতে পারেনি। মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে সে মা মা বলে ডাকে। ডাক্তারের নির্দেশে মিঃ আর মিসেস স্মিথ বাধ্য হলেন এঞ্জেলকে তার জন্ম কাহিনী বলতে। সব শোনার পর এঞ্জেল বলল, ‘মম আই ওয়ান্ট টু মিট মাই সারোগেট মম।’
‘হোয়াই? শি হাজ নো রাইট ওভার ইউ এজ পার কনট্রাক্ট।’ ‘মম আই এম হোপফুলি নট পার্ট অফ কনট্রাকট? আই শুড মিট মাই মা।’ মেয়ের কথা শুনে মিসেস স্মিথ হ্যাঁ, না কিছু বলতে পারলেন না। ‘শুধু বললেন আস্ক ইউর ড্যাড।’ মিঃ স্মিথ মেয়েকে খুব বোঝালেন ,‘ইটস অ্যা পুওর কান্ট্রি এন্ড সিটি — দ্যা লেডি মে নট বি স্টিল এলাইভ।’ শেষ চেষ্টা করলেন এঞ্জেলের ডি এন এ রিপোর্ট দেখিয়ে। তিনি দেখালেন সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে এঞ্জেল স্মিথের ডি এন এ চেনে কেবল দুটি সুতো আছে, একটি মিঃ স্মিথের আর অন্যটি মিসেস স্মিথের। এঞ্জেল উত্তর দিল ‘মাই মম ইজ মাই
বাইওলজিক্যাল মাদার —হোয়ার আজ দ্যা আননোন লেডি বোর মি ফর টেন মান্থস এন্ড স মি দ্যা লাইট অফ দ্যা ডে, ইজ মাই মা। আই মাষ্ট মিট মাই মা।’ ‘ইউ লুজ রাইট ওভার আওয়ার প্রর্পাটি ইফ ইউ গো টু ইন্ডিয়া’
‘আই ডোন্ট কেয়ার, বাই ড্যাড।’
এঞ্জেল চিকাগোতে বিবেকান্দ মিশনে গেল, সে শুনেছে দ্যা গ্রেট সেণ্ট ওয়াজ বর্ন ইন কোলকাতা। স্বামীজির তাকে সানন্দে তাদের মিশনের সদস্য করে নিলেন। স্বামীজির কাছ থেকে, আর লাইব্রেরি থেকে বই পড়ে এঞ্জেল ভারত,কলকাতা আর স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারল। বাংলা ভাষা এখানে এসে অনেক শিখে গেল অঞ্জলি - এখন সে বাংলায় বই পড়া শুরু করল। এঞ্জেলের মনের কালো কুয়াশা আলোর রোশনাইয়ে ঝল মল করে উঠল। স্বামীজি তাকে নতুন নামে দীক্ষিত করলেন, “অঞ্জলি”। ইন্ডিয়া যাবার সুযোগ এসে গেল, আমফান ঘূর্ণি ঝড়ে বিধ্বস্ত অঞ্চলে ত্রাণ শিবিরে কাজ করার জন্য অঞ্জলি ভারত সেবাশ্রমের হয়ে সেখানে গেল। দিল্লি হয়ে কলকাতায় পৌঁছল অঞ্জলি, সেখান থেকে সঙ্ঘের জিপে বাসন্তী পৌঁছল - মুল ত্রাণ শিবির সেখানেই চলছিল। দুর্গাপুজার আর বেশি দেরী নেই; ত্রাণ শিবিরের কাজ কমে আসতেই অঞ্জলি বেলুড়ে স্বামী নিত্যানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে গেল পরবর্তী এসাইনমেণ্টের জন্য। অবশ্য কিছু দিনের ছুটি নেবার খুব ইচ্ছে ছিলো। মহারাজ তার মনের কথা বুঝে তাকে আগে থেকেই দু সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করে রেখেছিলেন। ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্বামীজি আই অয়ান্ট টু ট্রেস মাই বার্থ মাদার এন্ড স্পেন্ড হলিডে উইথ মাই মা। আমায় যিনি জন্ম দিয়েছেন তাকে যেন খুঁজে পাই এই আর্শিবাদ করুন।’ ‘নিশ্চিই মা, জগজনণী মা আসছেন, তিনি তো বিশ্বাত্মা। তার ভেতর থেকে তুমি যার আত্মজা তাকে তিনি নিশ্চই তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন। ইউ উইল গেট দ্যা ব্লেসিংস অফ উনিভারসাল মাদার — গডেস দুর্গা।’ অঞ্জলি স্বামীজিকে প্রণাম করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিল।
এঞ্জেল প্রথমে আই ভি এফ ফার্টালিটি ক্লিনিকে পৌঁছল। অনেক চেষ্টার পর ম্যাডাম অরুনার সঙ্গে দেখা করতে পারল।
‘সো ইউ আর এঞ্জেল স্মিথ? হোয়াই অন আর্থ, কেন তুমি তোমার কেনা মায়ের খোঁজ করছ? ইন ফাকট, মিঃ স্মিথ ফোন করছিলেন, আমরা যেন তোমাকে তোমার সারোগেট মাদারের এড্রেস না দি।’ এঞ্জেল ম্যাডামের হাত ধরে অনুরোধ করল,‘ম্যাডাম, হ্যাভ পিটি অন মি — দয়া করে আমার গর্ভ ধারিণী মায়ের সঙ্গে আমায় মিলিয়ে দেন।’
অঞ্জলির চোখ ভিজে উঠল,অরুনা ম্যাডাম বললেন, ‘যত দুর মনে পরে তোমাকে ফেরত পাওয়ার জন্য তোমার মা বেশ কিছুদিন এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত আর আমকে বলত মেয়েকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। কিছুতেই বিশ্বাস করত না যে তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা মা আমেরিকায় চলে গেছে। এনি ওয়ে আমি এক কাজ করছি, এজ আই কান্ট রিভিল হার এড্রেস, আমি তোমার বাবা, কি যেন নাম – হিয়ার ইট ইজ, নিখিল দাসকে ফোন করছি। জানিনা এতদিন বাদে এই নাম্বার কাজ করবে কিনা।’ সৌভাগ্য বসতঃ ফোনে নিখিল কে পাওয়া গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সে এল।
‘ম্যাডাম কেন ডাকলেন এতদিন পর?’
‘মিঃ দাস, দেখ এনাকে চিনতে পার?’ নিখিল অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল-মনের কোনে হাতড়ে হাতড়ে সুদুর অতীতের হদিস পেতে চেষ্টা করল।
‘বাবা আমি অঞ্জলি স্মিথ, মিঃ আর মিসেস স্মিথের মেয়ে। আমি কলকাতায় আমার মায়ের পেটে জন্মেছিলাম।’ অঞ্জলি বাবাকে প্রণাম করল। ‘এত দিন পরে তুই কি করে খোঁজ পেলি মা? তোর বাবা, মা কই?’
‘আমি একাই এসেছি বাবা, আমাকে আমার মার কাছে নিয়ে চল।’
রত্নাকে ধরে শুভো বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিখিল আগেই ঘরে শুভোকে ফোন করেছিল। ট্যাক্সি থেকে নেমেই অঞ্জলি দেখল একটি যুবক একজন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিখিল সেদিকে এগিয়ে যেতেই অঞ্জলি মা বলে রত্নার বুকে ঝাঁপিয়ে এলো।
‘কেমন আছিস মা আমার, কতো বড় হয়েছিস; কোথায় আছিস, কবে এসেছিস?’
‘সব বলবো মা। এতদিন আমি তোমায় খুঁজেছি স্বপ্নে - আজ আমার স্বপ্ন সত্যি হল।’
‘কিন্তু একি রঙের সাড়ি পড়েছিস।’
‘কেন মা? এটা আমাদের মিশনের শাড়ি, আমরা এটাই পড়ি। আমি এখন থেকে কলকাতায় থাকব — রামকৃষ্ণ মন্ত্রে দিক্ষা নিয়েছি।’
‘আর কোথাও যেতে হবে না। তুই এখানেই থাকবি, আর কোথাও যাবি না।’ রত্না মেয়েকে আঁকড়ে ধরলেন। নিখিল ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে এলো, ‘থাক না ওসব কথা, তোমরা ভেতরে চলো।’
পাড়া পড়শিদের কিছু ভিড় জমেছিল তাদের চলে যাওয়া মেয়েকে দেখতে, কিন্তু গেরুয়া বসন দেখে কেউ আর কাছে এলনা। দুর থেকেই প্রশ্ন এলো, ‘এই কি সেই সাহেব মেয়ে?’ অঞ্জলি এগিয়ে গিয়ে তাদের কাছে দাঁড়ালো, ‘কাকিমা, আমিই সেই সাহেব মেয়ে এঞ্জেল আর এখন সন্ন্যাসিনী অঞ্জলি।’
‘তা বাছা সন্ন্যাসিনী হলে কি দুঃখে, তা আবার সাহেবদের দেশে গিয়ে?’
‘সন্ন্যাস নেবার জন্যে কি দেশ বিদেশ বলে কিছু আছে কি? আর দুঃখের মধ্যে না দাঁড়ালে জগজননীকে অনুভব কি করে করা যায়? আমি এসেছি সেই মায়ের খোঁজে, এবং তাঁকে পেয়েছি।’ শুভো বোনকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল, দেখ তোর ছবি।’ দেওয়ালে একটি ছোট ছবি, রত্নার কোলে শিশু পুত্র। শুভ ব্যাপারটা খোলসা করল,’ আমি মোবাইলে তুলে নিয়েছিলাম লুকিয়ে।’
রত্না একটা তাঁতের শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার বার যা তো, মুখ হাত ধুয়ে শাড়িটা চেঞ্জ করে আয়।’ অঞ্জলি শাড়ি বদলে এল।
‘এই তো আমাদের মেয়ে, ওই যোগিনী শাড়ি আর পড়িস না।’
‘ঠিক আছে মা, আমি তোমার ইচ্ছামতো এখানে যদ্দিন আছি গেরুয়া পড়বো না। এবার কিন্তু আমি চা বিস্কুট খাবো।’ শুভো দোকানে গেল চায়ের দুধ আনতে। রত্না তক্তা পোষে অঞ্জলিকে বসিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘বিয়ে থা করবি ত? আমরা খুব ভালো ঘরে তোকে বিয়ে দেব।’
‘কিন্তু মা আমি তো সন্ন্যাসিনী, আমি কিভাবে ঘর বাঁধতে পারি?’
‘অঞ্জলি মা আমার, ছোটবেলায় তোকে একবার হারিয়েছি, অনেক চেষ্টা করেও তোকে কাছে রাখতে পারিনি। আজ আবার কাছে এসে তুই এই ভাবে সন্ন্যাসী হয়ে হারিয়ে যাবি? ঘর সংসার করবিনা?’
‘মা আমি তো আর এঞ্জেল স্মিথ নেই, আমি এখন বেদান্ত মিশনের মা অঞ্জলি আর তোমাদের জন্য অঞ্জলি দাস। আর আমার তো বিশাল বড় ঘর। অনেকটা ঐ গ্লোবের মতো। যখন যেখানে থাকবো সেটাই আমার ঘর আর সেখানকার লোকেরাই আমার সংসার। আমি আমেরিকায় আমার সম্পর্কের বাবা মা, বিষয় আশয় সব ছেড়ে এসেছি। আমাকে এই ছোট্ট গণ্ডির ভেতরে আটকে দিওনা প্লিজ। আমি ত তোমার কাছে কাছেই থাকব-কখনো বেলুড়ে, কখনো এখানে।’ অঞ্জলি প্রসঙ্গ হাল্কা করার চেষ্টা করলো,‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি কিন্তু ধোঁকার ডালনা দিয়ে ভাত খাবো। আর খেয়ে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাব। তুমি আমায় গুণ গুণ করে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে। ’
‘আচ্ছা বাবা তাই হবে, তবে ঘুম পাড়াব রাতে — এখন অনেক কথা শোনা বাকি।’
রাত্রে খাওয়ার পর অঞ্জলি মার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল, ‘মা তুমি এবার সেই ছোট বেলার গান শোনাও?’
‘ছোটবেলায়? তখন তুই আমেরিকায়!’
মা, আমি গানের সুর বলছি — কথা জানি না!’ অঞ্জলি ঘুমের মধ্যে যে সুর শুনত সেটা গুণ গুণ করল।
‘ও এই গান? এটা তুই পেটে থাকতে আমি শোনাতাম। যখন তুই খুব ছট পট করতিস এই গান করতাম — তুই চুপ করে যেতিস! খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ল, বর্গি এল দেশে…।’ অঞ্জলি চোখ স্বর্গীয় আরামে বুঝে এল — প্রথম এত নির্ভানায় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
আনন্দেরকটা দিন কেটে গেল। শুভ মুম্বাইতে চাকরী করে, ‘বোনটি একবার মুম্বাই আয়।’ শুভ মুম্বাই ফেরত গেল, যাবার আগে অঞ্জলির মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘তোমার মন যা চায় তুমি তাই করো, কিন্তু ভাই ফোঁটা থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত করো না।’
‘না দাদা আমি যেখানেই থাকি না কেন, ফোঁটা তোমাকে আমি দেবই, আর সঙ্গে চাই ভালো শাড়ী।’ শুভ হেসে উত্তর দিল, ‘আই প্রমিস মাই সিস।’
রত্না ও নিখিল অঞ্জলির ইচ্ছাকেই স্বীকার করে নেবার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে লাগলো, কিন্তু যাবার দিন সকালে যখন অঞ্জলি গেরুয়া শাড়ি পরে সুটকেস গোছাচ্ছে রত্নার চোখ জলে ভরে এলো। এতো দিন ধরে লড়াই করেও মেয়ে কে সে ধরে রাখতে পারলোনা।
অঞ্জলি মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা যাবার সময় চোখের জল মুছে আমায় আশীর্বাদ করো, না হলে এই বিরাট সংসারের দায়িত্ব আমি কি ভাবে সামলাবো?’
‘অঞ্জলি তুমি আমাদের চোখে ওই দূর আকাশের তারা, তুমি ওখান থেকে সবাইকে তোমার আলো দিও; আমরা তাতেই খুশি থাকবো। যখন সময় পাবে কথা বোলো আর বেলুড়ে থাকলে দেখা কোরো।’
‘নিশ্চই মা, আমি যখনই সময় পাবো, ছুট্টে তোমার কোলে চলে আসবো’। অঞ্জলি মা, বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
গল্প
অন্তিম
শ্বাস সুন্দর
সুশোভন দাস
ফিনল্যান্ড
পর্ব: ১
- ”হ্যাঁ গো, আর কবে আমার বটি-ছুরিগুলোতে ধার দিয়ে দেবে? এগুলো দিয়ে সবজি কেনো, চোরের কানও কাটা যাবে না। সবার ছুরি-কাটারি একেবারে চকচকে করে দিচ্ছ আর নিজের ঘরের গুলো দেখো - যেন দাঁত-ভাঙা আশি বছরের বুড়ো। আজ যদি ধার না দাও তাহলে তোমার ওই কোদাল মার্কা দাঁত দিয়ে কুটনো কুটে খেও।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটা চটের ব্যাগ উপুড় করে ধরল কাজল। ঝনঝন শব্দ করে কয়েকটা ছুরি, দুটো বোঁটি, জং ধরা দুটো কাটারি এক সাথে একটার উপর আরেকটা পড়ল। হাঁপরে টান দিতে দিতে অজিত বলল, - ”ঠিক আছে রেখে যা। আমি দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় সব গুলো ধার দিয়ে নিয়ে যাবো।”
হাপরের আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠে বলল, - ”তা দুপুরে গিয়ে কি খাবে? আমার মাথা? এগুলো এখনি না করে দিলে রান্নাটা করব কি করে শুনি?”
কাজলের ভাবমূর্তি দেখে অজিত আর কিছু বলল না। হাঁপর ছেড়ে উঠে এসে শান দেওয়ার পাথরটায় দু-হাতে আঁচলা করে জল তুলে ভিজিয়ে নিল। একটা ছোটো টুলের উপর বসে একে একে শান দিতে শুরু করল।
অজিত মুখ বুজে তার ছুরি-কাটারিতেই হাত দিয়েছে দেখে কাজল আর রাগ দেখাল না। ”তুমি এগুলো করে রাখো আমি বাজার সেরে ফেরার পথে নিয়ে যাবো”- বলে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারে চলে গেল।
নিতাই কাকা গ্রামের একজন নাম করা কামার। বলতে গেলে এই অঞ্চলে কামারের দোকান একমাত্র নিতাই কাকার। নিতাই কাকার একমাত্র মেয়ে কাজল। খুব ছোটবেলায় মাকে হারায় কাজল। তাই ছোটবেলা থেকেই সংসারের কাজে সে বাবার সাথে হাত লাগায়। পেন্সিল ধরার বয়সে সে হাতে ধরেছিল খুন্তি। স্কুল জীবন বলতে তার যতদিন স্কুলে খিচুড়ি পাওয়া যেত ততদিন। গ্রামের একমাত্র দোকান হলেও তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বাপ-ঠাকুরদার আমলের দোকান, তাই কাগজ-পত্র বলতে কি বোঝায় সেটাই নিতাই কাকার জানাছিল না। আর সেই অজুহাতে কখনো পুলিশ বা কখনো রাজনৈতিক দলের লোক এসে টাকা আদায় করে নিয়ে যেত। দোকানের সব কাজ একা হাতে করাও যায় না তাই একটা কর্মচারীর খোঁজ করছিল। ক্লাবের ছেলেরাই তার একটা বিহিত করে। অল্প মাইনেতে একটা আনাড়ি ছেলেকে দোকানে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু একদিন সুযোগ বুঝে সেই কর্মচারী দোকান থেকে সব টাকা নিয়ে কেটে পড়ে। ক্লাবের ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়েছিল নিতাই কাকা। কিন্তু তারা বেমালুম সব দোষ নিতাই কাকার ঘাড়ে দেয় আর বলে- ”কর্মচারী খুঁজে দেওয়ার কথা বলেছিলে খুঁজে দিয়েছি। এবার সে কি করবে সেটা তার আর তোমার ব্যাপার। শুনেছি তুমি তাকে মাইনে দিতে না, রাত-দিন ওই আগুনের সামনে বসিয়ে রাখতে। তাকে তুমি রাখতে পারনি। তাই সে পালিয়েছে। তার জন্য আমাদের দায়ী করে কোনো লাভ হবে না। যাও পুলিশে গিয়ে কমপ্লেন করো।”
পুলিশের কাছে গেলে কি হবে তা নিতাই কাকা খুব ভালো ভাবে জানত। তাই মুখ বুজে নিজের মরা দোকান নিয়েই রইল।
নিতাই কাকার বাড়ির লাগোয়া বাড়ি হল অজিতদের। নিতাই কাকার সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। অজিতের বাবা বিপিন রাজনীতি করত আর সুযোগ পেলেই ’বিপিন বাবুর কারণ সুধা’ খেয়ে উল্টে থাকত। অজিতের মা সুধা বেশির ভাগ সময় তাকে সামনের জলা-জমি থেকে উদ্ধার করে আনত। একদিন সন্ধ্যায় বিনা মেঘে বজ্রপাত নেমে আসে তাদের ঘরে। সেই রাতের মধ্যেই অজিত নিজের বাবা-মাকে হারায়। সাথে খুনির ছেলের তকমা লেগে যায় তার কপালে। গ্রামের মানুষের আক্রোশের মুখে নিজের ভিটে বাড়িটাও ধুলোয় মিশে যায়। তাই চাইতে বা না চাইতে অজিতের দায়িত্ব এসে পড়ে নিতাই কাকার উপর। তবে পড়াশুনার থেকে অজিতের লোহার কাজের উপর আগ্রহ দেখে স্কুল ছাড়িয়ে তাকে হাতে ধরে কাজ শেখায়। দোকানের কাজে অজিত অল্প বয়সে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠল। একটা বিশ্বাসযোগ্য হাত পেয়ে নিতাইকাকা মনে ভরসা পেল। দোকানও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেল।
বাড়ির বোঁটি-কাটারিতে শান দিয়ে ব্যাগে ভরে আবার হাঁপরের কাছে ফিরে গেল অজিত। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজল ফিরে এল। ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করে মুখের সামনে ধরল।
বেশ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে ছুরির ফলায় নিজের মুখ দেখতে দেখতে বলল,- ”এইতো কত ভাল ধার হয়েছে এখন। আর গায়ে একটুও জং নেই। একেবারে পরিষ্কার। এটা দিয়ে এখন এক বছর চলে যাবে বলো।”
অজিত মুখ নিচু করেই বলল, - ”এ-গুলো কাঁচা লোহার। জল লাগিয়ে না মুছে রাখলে দু-দিনেই আবার দাঁত ভাঙা আশি বছরের বুড়ো হয়ে যাবে।”
হাতের ছুরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে একটু লাজুক গলায় কাজল বলল, - ”তা তুমি কয়েকটা ভালো ছুরি বানিয়ে দিতে পারতো বাড়ির জন্য। তাহলে আর তোমাকে কাজের মাঝে জ্বালাতে হয় না।
হাঁপর ছেড়ে উঠে নিজের বসার জায়গার তলা থেকে কাঠের বাক্স বার করে সেটা কাজলের হাতে দিয়ে বলল, - ”এটা তৈরি হতে আর কিছু দিন বাকি। সামনের জন্মদিনে এটাই তোমায় দেব।”
বাক্সটা খুলতেই একেবারে সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠল একটা সরু ছুরির ফলা। ছুরিটার ফলা এতটাই সুন্দর যে প্রায় মিনিট দুই সেটার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাজল। ছুরির একেবারে গোড়ার দিকে নজর পড়তে সে দেখল খুব ছোটো অক্ষরে কিছু লেখা। ছুরি সমেত বাক্সটা আরো একটু কাছে নিয়ে ভালো করে দেখল প্রথম শব্দ ’রিপন’।
সাথে সাথে ছুরি থেকে চোখ সরিয়ে কাজল বলল, - ”রিপন? রিপন কে? এ তুমি কোন রিপনের কথা বলছো? ”কাজলের চোখ ছোটো হয়ে এলো। কপাল কুঁচকে ভ্রূ-দুটো একে অপরকে ছুঁতে চাইছে। কপালের প্রতিটা ভাঁজে হাজার হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার।
অজিত শান্ত ভাবে কাছে এগিয়ে গেল। তার ঠোঁট দু-দিকে প্রসারিত হয়ে একটা হালকা হাসি সৃষ্টি করল যা শুধু মাত্র তার ঠোঁটেই সীমাবদ্ধ রইল। বাক্সটার ঢাকনা বন্ধ করতে করতে বলল, - ”এখনো অনেকটা কাজ বাকি। সব শেষ করে তবেই তোমায় দেবো এই উপহার।”
পর্ব : ২
হাঁপাতে হাঁপাতে কনস্টেবল দুলাল থানায় ঢুকল। থানার বড়বাবু সবে গরম চায়ে চুমুক দিতে যাবেন কিন্তু সামনে কাক ভেজা দুলালকে দেখে চায়ের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, - ”খেয়ে একটু গা-গরম করে নাও। তারপর কি হয়েছে বল।”
দুলাল চায়ের কথায় কান না দিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, - ”স্যার, কাল রাত থেকে গ্রামের পাঁচ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
বড়বাবু চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বললেন, - ”আজ না হয় কাল খুঁজে পাওয়া যাবে। এ আর এমন কি বড় কথা। এই গ্রামে আমি একাই মানুষ লোপাট করি। আমার অনুমতি ছাড়া কেউ নিখোঁজ হতে পারবে? কি বল হে রাম-দুলাল?”
এবার দুলাল বড়বাবুর টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে গলার স্বর ভারি করে বলল, - ”না স্যার। অমিত, বাপ্পা, সজল, রিপন আর মঙ্গল। এরা কাল রাত থেকে গায়েব। বিকাশবাবু খুব চিন্তিত। তাড়াতাড়ি আপনাকে খবর দিতে বলল।”
বড়বাবু এবার মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, - ”সকাল সকাল বিকাশবাবুর বাড়ি টাকা গিলতে গেছো নিশ্চয়ই। না হলে বিকাশবাবু ভালো মত জানেন তাঁর গুণধর পুত্র কেমন। এক রাত কেন, এক মাস বাড়ি না ফিরলেও কিচ্ছু যায় আসে না।”
দুলাল হাল না ছেড়ে গলা আরো একটু ভারি করে বলল, - ”স্যার, মোবাইলেও ধরা যাচ্ছে না কাল রাত থেকে।”
টেবিলের উপর রাখা পেন তুলে নিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বড়বাবু বললেন, - ”সে তো কাল রাত থেকে আমি বৌকে মোবাইলে পাচ্ছি না। আজ রাতের মধ্যে না পেলে আমার নামেই কেস ঠুকে দেবে। জানিস তো তোর বৌদিকে, যখন তখন ফোন করে খোঁজ নেয় কোনো মেয়ের সাথে চক্কর চালাচ্ছি কিনা সেটা জানতে। তুমি বলতো দুলাল, এই পুলিশের চাকরীতে অন্য মেয়ে আসবে কোথা থেকে?”
এবার দুলাল অনেকটা দমে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, - ”বিকাশবাবু কিন্তু বেশ চিন্তিত। আমায় খুব জোর দিয়ে বলেছেন।”
”আরে ধুর, তুমি থাম। বিকাশবাবু নিজে এসে যতক্ষণ না বলবেন ততক্ষণ কিছু করবো না। ওনার আর ওনার সুপুত্রের কেস চাপা দিতে দিতে মাথার চুল উঠে গেল, অথচ জল-পানি ছাড়ার কথা বললেই একটাই কথা- ’সময় মতো পাঠিয়ে দেব।’ তা তুমি যে সাত-সকালে হাজিরা দিলে সেখানে, মাল-কড়ি কিছু দিল না কথা শুনিয়ে ছেড়ে দিল?”
দুলাল মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ল।
বড়বাবু মুখটা বেজার করে বেললেন, - ”জানতাম। ওই ঘণ্টা দেবে। দাঁড়া, একবার সুযোগ পাই ওর হাতে আমি হ্যারিকেন ধরিয়ে দেব।”
দুলাল কিছু না বলে ঘর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে তখনই বড়বাবু পিছন থেকে ডেকে বললেন, -”বুঝলে দুলাল চাপটা আমারও লাগছে। গত দু-বছর ধরে যা দেখছি, মালগুলো কিছুদিনের জন্য গায়েব হয়ে যখনই ফিরে এসেছে বড়সড় কিছু কেস নিয়ে আমার ঘাড়ে চেপেছে। তাড়াতাড়ি যদি ওদের খোঁজ পেয়ে যাই তাহলে আমার চাপ কম হবে।”
এতক্ষণে বড়বাবু তার কথা শুনেছে ভেবে দুলাল বেশ উৎসাহিত হয়ে বলল, - ”একদম ঠিক বলেছেন স্যার। ওরা নিশ্চয়ই কিছু কেস পাকাচ্ছে।” একটু সময় থেকে দুলাল মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করল, - ”কিন্তু স্যার, খুঁজবেন কি ভাবে? কাউকে কিছু বলে যায় নি।”
নিজের চেয়ারে ফিরে যেতে যেতে বড়বাবু বললেন, - ”আপাতত ফোন রেকর্ড চেয়ে পাঠাও। তারপর দেখছি।”
চায়ের কাপে এক চামচ চিনি তুলে নিয়ে অধীরবাবু বললেন, - ”বিকাশদা, ছেলেগুলো তিনদিন হল কোনো খবর নেই। আপনি কিছু খবর পেয়েছেন? মঙ্গল সেদিন সকালে ওর মায়ের সাথে বেশ ঝগড়া করে আমার কাছে টাকা চাইতে এসেছিল। এতদিন কখনো মোবাইল বন্ধ রাখে না। এই প্রথমবার। রোজই আমার ওয়াইফ সকাল-বিকাল মাথা খাচ্ছে। না জানি কোথায় কি অঘটন ঘটাচ্ছে।”
অবিনাশবাবু বললেন, -”সজল ঘরে ফোনটা পর্যন্ত ফেলে গেছে। ওর মায়ের কাছে শুনলাম বৃষ্টির মধ্যে কে ডাকলো আর ওমনি দৌড়ে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে ফোনটা দেখি গ্যারাজের কাছে পড়ে আছে। লাস্ট কল দেখলাম রিপনের।” কথা শেষে আড়-চোখে একবার তিনি বিকাশবাবুর দিকে তাকালেন।
খুব বিরক্ত সহকারে চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারী করতে করতে রঞ্জনবাবু বললেন, -” এতো বড় সোনার কারবারের দায়িত্ব সবে একটু একটু করে অমিতকে বুঝিয়ে দেওয়া শুরু করেছি আর তখনই একেবারে হাওয়া। দু-সপ্তাহও হয়নি অনেক বুঝিয়ে একটু কারবারে মন এসেছিল আর ওমনি হাওয়া। তিন দিন হয়ে গেল এখনও পর্যন্ত বাপ্পার কোনো খবর দিতে পারলোনা থানার বড়বাবু। দু-দিন ছাড়া ওই চেলা দুলালটাকে পাঠায় জলপানির জন্য। কিন্তু কাজের নামে অষ্টরম্ভা”
সকালের শান্ত মেজাজে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিকাশবাবু বললেন, - ”আপনারা এতো চিন্তা করবেন না। সবাই ঠিক আছে।”
ক্ষণিকের জন্য একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো। সবাই একসাথে বিকাশবাবুর পরবর্তী কথার জন্য শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করতে থাকল।
বিকাশবাবুর দিকে তাকিয়ে নীরবতা ভঙ্গ করে নির্মলবাবু স্বভাবসিদ্ধ ভারি গলায় বললেন, -”ও মশাই, আপনি সত্যি কিছু খোঁজ পেয়েছেন নাকি? আমার প্রথম বৌ যাওয়ার আগে আমায় শুধু খুনের হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু অমিতের যদি এতটুকুও কিছু হয় তাহলে দ্বিতীয় বৌ সত্যি সত্যি খুন করে ফেলবে আমায়। কিছু জানতে পেলেন নাকি রিপনের কাছ থেকে?”
নিজের মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে হোয়াটস্যাপ থেকে রিপনের মেসেজ বক্স খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। তাড়াতাড়ি করে মোবাইলটা তুলে নিয়ে অবিনাশবাবু জোরে জোরে শেষ মেসেজটা দেখলেন। একটা পাহাড়ী জঙ্গলের ছবি গত কাল দুপুরের দিকে রিপন পাঠিয়েছিল। তার নীচে যা লেখা ছিল সেটা হল ’জলদাপাড়া ঘুরতে চলে এলাম হঠাৎ করে। এখানের নেটওয়ার্ক খুব খারাপ। আমরা সবাই ভালো আছি। দিন পনেরো জঙ্গলে থেকে তারপর ফিরবো।’
অধীরবাবু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন, - ”এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। মঙ্গল কেন সেদিন আমার থেকে বিশ হাজার টাকা ক্যাস নিল।”
”এই দুলাল, দুলাল, এমন ভয়ঙ্কর নাক ডাকার আওয়াজ কোথা থেকে আসছে? দুপুরে একটু যোগনিদ্রা দেওয়ারও উপায় নেই দেখছি।” - নিজের চেয়ারের ভিতরে আরও কিছুটা ডুবে যেতে যেতে একটা বিরক্তির সাথে কথাগুলো ছুড়ে দিলেন বড়বাবু।
ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘর পেড়িয়ে গেছে। থানার পাশেই বাদলের দোকান থেকে চা চলে এসেছে। হরি আদা দেওয়া লিকার চায়ের গ্লাসটা ধীরে ধীরে বড়বাবুর টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, - ”স্যার, আপনার চা।”
টেবিলের উপর তুলে দেওয়া দু-পায়ের মাঝখান দিয়ে বাঁ চোখটা হালকা ফাঁকা করে হরির মুখটা দেখে বলল, - ”দুলাল কোথায়? সেকি খেয়ে ফেরেনি এখনও?”
হরি বলল, - ”স্যার, সে তো কখন খেয়ে ফিরে পড়েছিল। ফেরার পথে ওই মোড় মাথায় কারা মাল খেয়ে ভর দুপুরে মারামারি করছিল, তাদেরকে ধরে এনে লকআপে পুরেছে। তারপর বেরিয়ে গেছে। শুধু বেরোনোর আগে বলে গেল যে ফিরতে দেরি হবে।”
বড়বাবু টেবিল থেকে পা নামিয়ে চেয়ারের উপর সোজা হয়ে বসলেন চায়ের গ্লাস নিয়ে সশব্দে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে এক বিকট গর্জন এলো পাশের ঘর থেকে। এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলেন তিনি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ধমকে হরিকে বললেন, - ”যা ওই অপোগণ্ডগুলোকে বনে ছেড়ে দিয়ে আয়। থানাটা যেন মামার বাড়ি পেয়েছে। বুনো শুয়োরের মতো নাক ডেকে ঘুম দিচ্ছে মহা আরামে।”
হরি বড়বাবুর মেজাজ দেখে তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে লোকদুটোকে ডান্ডা মেরে ঘুম থেকে তুলল। তারপর প্রায় টানতে টানতে তাদেরকে কোনো রকমে থানার বাইরে নিয়ে এলো। এক মাতাল তখন অন্য মাতালকে বলল, - ”ইশ কেমন বাইরে বের করে দিল দেখ। যেন ওর বাপের বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলাম।”
তা শুনে অন্য মাতাল বলল, - ”চল তবে আবার মারামারি করি। তাহলে আবার ভিতরে নিয়ে যাবে।”
কথাটা শুনে হরি ভয়ানক রেগে গেল। পাগলের মতো হাতের লাঠিটা ঘোরাতে থাকল। দু-একটা লাঠির ঘা খেয়ে মাতাল দুটো পড়ি কি মরি করে একেবারে থানার গেটের বাইরে চলে গেল। এই সময় বাইকে করে দুলাল থানায় ফিরে এলো। হরির এমন বেখাপ্পা মেজাজ আর থানার বাইরে মাতাল দুটোকে দেখে অবাক হয়ে বলল, - ”কি হয়েছে? এগুলোকে ছেড়ে দিলি কেন?”
হরি লাঠি থামিয়ে বলল, - ”বড়বাবুর অর্ডার। আর যা নাক ডাকছিল যেন কুম্ভকর্ণ, আর একটু হলে থানা ভেঙে যেত।”
দুলাল বিশেষ কথা না বাড়িয়ে একেবারে বড়বাবুর কাছে এলো। দুলালকে দেখেই বড়বাবু হেঁয়ালি করে বললেন,- ”কি সংবাদ আনিয়াছো, হে নারদ। কহ তব মনবাসনা।”
দুলাল বলল,- ”ওই স্যার একটু রঞ্জনবাবু আর বিকাশবাবু একটু ডেকেছিলেন। সামনে ভোট আসছে তাই কোথায় কোথায় পুলিশ লাগবে সেটাই একটু বলছিলেন।”
চোখ ছোটো করে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দুলালের দিকে তাকিয়ে বড়বাবু বললেন, - ”আর কিছু না?”
দুলাল এবার একটু লজ্জা লজ্জা করে বলল, - ”ওই স্যার বৌয়ের জন্মদিন বলতে একটু জলপানি দিল। এই আর কি।”
বড়বাবু রেগে গিয়ে বললেন, - ”ব্যাস, জলপানি নিয়ে কেটে পড়লে। ভিতরের কোনো খবর নেই নাকি তুমি কান দাও নি?”
বড়বাবুর কাছে একথা শুনে দুলাল একটু বোঝার চেষ্টা করল বড়বাবু আসলে কি বলতে চাইছেন সেটা বোঝার। দশ-পনেরো সেকেন্ড চুপ থেকে সে বলল, - ”ও, হ্যাঁ স্যার। ওই পাঁচ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। ওরা হঠাৎ করে জলদাপাড়া ঘুরতে গেছে। দিন পনেরো পর ফিরে আসবে। নেটওয়ার্ক নেই তাই কাউকেই ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকাশবাবু বললেন যে ওদের খোঁজায় সময় নষ্ট না করতে। তাই আমাদেরও আর খুঁজতে হবে না।”
নিজের টেবিলের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে টেবিলের উপর এক কোণায় বসে পড়লেন বড়বাবু। পেপারওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, - ”খুঁজতে হবে না সে বুঝলাম। জলদাপাড়া ঘুরতে গেছে সেটাও আজ সকালে জেনে গিয়েছিলাম অধীরবাবুর কাছে। কিন্তু আসল কথা হল, খবরটা জানার পর আমি জলদাপাড়া পুলিশ স্টেশনের সাথে কথা বলেছি। তার বলছে একপাল বুনো হাতির জন্য গত সপ্তাহ থেকে পুরো জায়গা ব্লক। কাউকে এখানে আসতে দেওয়া হয়নি।”
পর্ব : ৩
সময়টা তখন আশির দশক। সমগ্র বাংলার প্রচলিত রাজনীতিকে উপড়ে ফেলার তাগিদে রাস্তায় নেমেছে শত-সহস্র ছাত্রদল। তরুণ রক্তে ভিজেছে বাংলার ওলি-গলি। এই উত্তাল রাজনীতির আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল বিকাশও। রায়-পরিবার তথা সূর্য্যকান্তবাবু প্রচলিত রাজনীতির এক অন্যতম বাহক। কিন্তু পরিবারের একমাত্র সন্তান যখন নতুন পথ বেছে নেয়, রাজনীতির আগুন তখন সংসার পুড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দেয়। গ্রামের জমিদার সূর্য্যকান্তবাবু পরিবার বাঁচানোর তাগিদে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁর অভুত রাজনৈতিক শক্তি ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য নিয়ে নতুন দলের এক উদীয়মান যুবনেতা হিসাবে মানুষের সামনে আসে বিকাশ রায়। অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েও সূর্য্যকান্তবাবু রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয়ে সর্বদাই বিকাশকে সাহায্য করে গেছেন। অচিরেই সূর্য্যকান্তবাবুর থেকেও অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যুবনেতা বিকাশ রায়। নব্বুইয়ের দশকে এসে বিকাশবাবু বিয়ে করেন বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা প্রভাবশালী নেতার একমাত্র কন্যা নয়নতারাকে। জমিদার বিকাশ রায় তখন একাধারে সংসার ও রাজনীতির মানদণ্ড মুষ্টিবদ্ধ করেন। বংশের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য বিকাশবাবুর ইচ্ছা রিপনকেও এই পথে নিয়ে আসার। কিন্তু কখনই চাননি নিজের শৈশব ও কৈশোর জীবনের মতো রিপনের জীবন ধারা হোক। তাই কখনো রিপনকে চোখের নজরের দূরে হতে দেননি। আজ তিন-চার দিনে রিপনের মাত্র একটা মেসেজ পেয়ে বিকাশবাবু বাইরে যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছেন ভিতরে তা একেবারেই বিপরীত। নিজের খেয়ালেই একটু নির্জনতায় রিপনের সাথে নিজের ফেলে আসা জীবনে মিলিয়ে দেখলেন।
ছোটোবেলা থেকেই বিকাশের খেলার সঙ্গী হিসাবে বিপিন সব সময় থাকতো। বিপিন সারাদিন বিকাশের সাথে জমিদার বাড়িতেই খেলা করত। এমন কি মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়া করে দু-জনে একসাথে সেখানেই ঘুমিয়ে যেত। সন্ধ্যায় বিপিনের মা বিমলাদেবী তাকে কোলে করে বাড়ি ফিরিয়ে আনতো। জমিদার বাড়ি থেকে বিপিনকে নিয়ে আসতে দেরি হলে সূর্য্যকান্তের স্ত্রী বিভাবরীদেবী প্রায়ই বলতেন, - ”ছেলে মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে যখন আর ডেকে তুলে কি হবে। একেবারে কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাবে।”
বিমলাদেবী তবু মানতেন না। বলতেন, - ”ওর বাবা কারখানা থেকে ফিরে এসে ছেলেকে না দেখতে পেলে আমার উপর খুব রেগে যাবে। মাঝে মাঝে উনি বলেন যে একটা মাত্র ছেলে তবু তাকে সামলাতে পারছো না। অনেকগুলো হলে কি করতে? আমি খুব হেসে ফেলি তখন। বলি, একটাই একশোটার সমান।”
গ্রামের পাঠশালায় দুজনের মিলিত অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। বাড়িতে রিপোর্ট করার কথা ভাবলেও সেই রিপোর্ট বাড়ি পর্যন্ত আসতো না। একবার তাদের অন্যায়ের কথা সূর্য্যকান্ত বাবুর কানে তোলেন স্কুলের হেডমাস্টার। সূর্য্যকান্তবাবু হেসে জবাব দেন,-” বাচ্চারাই এমন করবে এটাই নিয়ম। দু-দিন পর বড় হয়ে গেলে দেখবেন একেবারে শান্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া স্কুলে যদি কেউ অন্যায় না করে তাহলে আপনারা কাকে শাস্তি দেবেন বলুনতো?”
শুধু হেডমাস্টার নন গ্রামের সবাই জানত, কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে যে বিকাশকে শাস্তি দেবে? গ্রামে স্কুলের গন্ডি পার হয়ে শহরে চলে আসে বিকাশ। কিন্তু বিপিন থেকে যায় নিজের গ্রামেই। এই প্রথম জ্ঞানত বিকাশ ও বিপিনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। তবে বিপিন জমিদারবাড়ি ছাড়েনি। সংসারের অবস্থা খারাপ দেখে বিপিন পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়ে। প্রথমে দলের হয়ে তারপর সূর্য্যকান্তবাবুর খুব কাছের একজন বিশ্বস্ত মানুষ হয়ে কাজ শুরু করে। সংসারে বিপিনের হাত ধরে কিছু টাকা আসায় মোটামুটি স্বচ্ছলতা আসে তাদের জীবনে।
বয়স পঁচিশের গন্ডি পার হতেই বিমলাদেবী ঠিক করলেন বিপিনের বিয়ে দেবেন। পাত্রীও ঠিক করে ফেললেন - পাশের গ্রামের রমেন তাঁতির মেয়ে সুধারানী। পুরুত ডেকে দিন ঠিক করে ফেলেন বৈশাখের একুশে। বিপিনের বিয়েতে তাদের নিজেদের বাড়ির থেকে অনেক বেশি আনন্দ লেগে গেল রায়-পরিবারে, যেন সেই বাড়ির ছেলেরই বিয়ে হবে নতুন বছরের শুরুতেই। বিভাবরীদেবী নিজে বিমলাদেবীকে নিয়ে শহর থেকে হবু বৌমার জন্য শাড়ি-গহনা কিনে আনেন। এমনকি বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য নিজেদের বাড়ির পিছনের জমিটায় মণ্ডপ তৈরির আদেশ দেন।
বিমলাদেবী একটু বিব্রত বোধ করে বলেন, - ”দিদি, আমার ছেলের বিয়েতে আপনি সব করছেন। আমায় একটু কিছু করতে দিন। বিয়েটা আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে করলে হত না? ওই মন্ডলদের বলেছি মাঠটা দু-দিনের জন্য ভাড়া দিতে। ওরা রাজিও হয়ে গেছে পাঁচশ টাকায়।”
বিভাবরীদেবী বিমলাদেবীর হাত ধরে বললেন, - ”দেখো বিমলা, বিপিনকে সেই ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি। আমাদের ঘরে খেলা করতে করতে বড় হল। ও আমার ছেলের থেকে কোনো অংশে কম নয়। এই ডামাডোলে বিকাশ এখন প্রাণ বাঁচিয়ে পালাচ্ছে। বিয়ে দূরের কথা, ভয় হয় কোন দিন দেখব প্রাণহীন দেহটা বাড়ির চৌকাঠে এসে ঠেকেছে। তার উপর আমার যা অবস্থা আজ আছি তো কাল নেই। কমপক্ষে এক ছেলের বিয়েতে নিজের মতো করে আনন্দ করে নিই।”
একথা শোনার পর বিমলাদেবী আর কিছু বলতে পারেননি। মন্ডলদের থেকে আর মাঠ ভাড়া নিতে হল না। বিয়ের প্রস্তুতিতে দুই পরিবারের মা মিলে সব দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগকরে নিলেন।
নিজের ছেলের বিয়ের দিনগুলোতে বাড়ি থাকার জন্য শিবনাথবাবু বাজির কারখানায় ওভার টাইম শুরু করেন। বিয়ের আর মাত্র দুই-পক্ষও বাকি নেই। এমনি একদিন সন্ধ্যায় কারখানা থেকে বেরনোর একটু আগে হঠাৎ শর্টসার্কিট হয়ে কারখানায় আগুন লেগে যায়। নিমেষের মধ্যে সেই আগুন আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। খবরটা যখন টিভিতে প্রচার হয় তখন বিমলাদেবী জমিদার বাড়িতে ছিলেন। শিবনাথের চিন্তায় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। খবর পেয়ে বিপিন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে জমিদার বাড়িতে। বিমলাদেবী কারখানায় যাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠায় সূর্য্যকান্তবাবুর তত্ত্বাবধানে একটা গাড়ি নিয়ে তৎক্ষণাৎ মায়ের সাথে বেরিয়ে পড়ে বিপিন।
খবরে জানালো- শর্টসার্কিট হয়ে কারখানায় আগুন লেগে দশ জন শ্রমিক একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আহতের সংখ্যা চল্লিশ।
ভোরের আলো ফুটতে আর কিছুটা বাকি তেমন সময় বিপিন ফিরে আসে মাকে নিয়ে। বিমলাদেবীর প্রায় অবচেতন অবস্থা। চোখের দৃষ্টি একেবারে স্থির। অবিশ্রান্ত সরু জলধারা চোখের কোণ বেয়ে শুকনো গালের উপর এসে পড়ছে। অনেক সময় পরপর একবার চোখের পলক বুজে চোখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নামিয়ে বিপিন মাকে ঘরের ভিতর নিয়ে যাওয়ার সময় বিমলাদেবী হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। বিপিনের হাত চেপে ধরে বললেন, - ”বাবা, একটু দেখ না সামনে এগিয়ে গিয়ে। তোর বাবা ফিরতে কখনো এতো দেরি করে না। ওই বড় রাস্তার কাছে যাবি বাবা একবার? আচ্ছা বড় রাস্তা না হয় ওই পাশের পুকুর পাড়ে যা, ওখান থেকে বড় রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়। দেখ না বাবা একটু এগিয়ে, লোকটা কেন এখনো ফিরছে না।”
মায়ের অমন অবস্থা দেখে বিপিন কিছু বলতে পারেনি, শুধু ঘাড় নেড়ে মাকে আশ্বাস দিয়েছিল। বিছানায় মাকে শুইয়ে দিয়ে গাড়িটা ফেরত দিতে যায়। জমিদার বাড়িতে আজ কারোর চোখে ঘুম নেই। সবাই জেগে আছে শুধু বিপিনের পথ চেয়ে। বিপিন আসতে বিভাবরীদেবী তাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন। সূর্য্যকান্তবাবু জানতে চাইলে বিপিন কান্না চেপে শুধু বলল, - ”কিছু খুঁজে পাই নি জ্যেঠু। একেবারে ছাই।”
ভোরের আলো ফুটে গেছে ততোক্ষণে। বাড়ি ফিরে মাকে বিছানায় না দেখতে পেয়ে বিপিন খুব ভয় পেয়ে যায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে মাকে। বিপিনের চিৎকার শুনে আসেপাশের লোকজন ছুটে আসে। সবাই মিলে বিমলাদেবীকে খুঁজতে থাকে। একটু পরেই পাওয়া গেল বিমলাদেবীকে বাড়ির উত্তর দিকের ধান জমির পাশের পুকুর পাড়ে। বিমলাদেবীর পা পুকুর পাড়ে একটা লতা গাছের সাথে আটকে আছে কিন্তু বাকি শরীর পুকুরের জলে উপুড় হয়ে ভাসছে। তাঁর ডান-পায়ের গোড়ালির এক ইঞ্চি উপরে স্পষ্ট দুটো লাল বিন্দু থেকে তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।
এই দৃশ্য দেখার সাথে সাথে বিপিন অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে গেল। চোখ খুলে দেখল সে নিজের বাড়ির বিছানায়। বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বিভাবরীদেবী বসে আছেন। অন্য দিকে চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেল টেবিলের উপর থাকা বাবা-মায়ের ছবি। গত বছর সবাই শহরে গিয়ে ছবিটা তুলে বাঁধিয়ে এনেছিল সে। ফটোফ্রেমের পাশেই রয়েছে তার বিয়ের একতোড়া নিমন্ত্রণ পত্র।
পর্ব : ৪
বৈশাখের এক রাতের কালবৈশাখী ঝড়ে বিপিন খড়-কুটোর মতো উড়ে যায়। কালরাত্রির থেকেও আরো ভয়াবহ সেই রাতের কথা মনে পড়লে বিপিন নিজের চিন্তা শক্তি হারায়। নিথর পাথর হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। জীবনের প্রতি আসক্তি যেন হঠাৎ করে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকারে। জমিদার বাড়িতে যাওয়া অনেক কমে গেছে বিপিনের। কিন্তু সূর্য্যকান্তবাবু লোক পাঠিয়ে বিপিনকে ডেকে এনে আবার কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। তবে মাঝে মাঝেই গ্রামের লোকজন সময়-অসময়ে বিপিনকে সেই পুকুরের আশে-পাশে মাতাল অবস্থায় দেখতে পায়। বিপিনের এমন অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভাবরীদেবী স্থগিত হয়ে যাওয়া বিয়ে শীতের শুরুতেই একরকম জোর করেই সম্পন্ন করেন। জীবনে সুধা আসার পর বিপিন নতুন করে জীবন গুছিয়ে নিতে শুরু করে, স্থিরতা আসে তার কাজে। বিবাহিত জীবনে পুরানো অনেক কিছু ছাড়লেও কালরাত্রির পিছু ধরে মদও একটা অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে যায়। তবে তা শুধুই দুঃখ ভোলার জন্য।
বিপিনের বিয়ে খুব-একটা জাঁকজমক করে হয়নি। কিছু পাড়া-প্রতিবেশী ও বিপিনের বন্ধু-বান্ধব ও জমিদার পরিবার নিয়েই বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিপিনের বিয়েতে বিকাশ আসতে পারেনি। আর আসবেই বা কি করে? বিদ্রোহের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুলিশের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরছে। কানাঘুষো শোনা যায় যা বিকাশ একদিন খুব ভোররাতের দিকে বাড়ি এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। শুধু মায়ের সাথে দেখা করে চলে গেছে। পরে এটা সূর্য্যকান্তবাবু জানতে পেরে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েন। ক্ষমতার পক্ষে থেকেও বার-কয়েক পুলিশ বাড়িতে এসে তাঁকে সাবধান করে দিয়ে গেছেন। এরপর থেকে সরাসরি বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখা বিকাশের সম্ভব হয়নি। তবে মাঝে মাঝে বিপিনের বাড়ি এসে কিছু সময় গা-ঢাকা দিতো কখনো একা আবার কখনো কোনো বিপ্লবী সাথে থাকতো। বিমলাদেবী অনেক খাবার তাদের সাথে পুঁটলি করে দিয়ে দিতেন। আর সেখানেই বিভাবরীদেবীর সাথে একটু দেখা করে ফিরে যেত। তবে বিপিনের মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বিকাশের কোনো খবর সে পায়নি। বিভাবরীদেবী ভিতরে ভিতরে উতলা হয়ে উঠলেও বিপিনকে তা নিয়ে কখনো কিছু বলেননি।
বিয়ের প্রায় মাস-দুই কেটে গেছে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়। গ্রামের দিকে এখন বিকালের পর ঝুপ করে রাত নেমে আসে। সন্ধ্যা বলে প্রায় কিছুরই অস্তিত্ব নেই। ঠান্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এমনই একদিন সূর্য্যকান্তবাবুর পার্টি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখে সুধা খুব ভয় পেয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে বিছানার উপর বসে আছে। বিপিন কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সুধা লেপের তলা থেকে কাঁপা কাঁপা হাত বের করে টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করল। টেবিলের উপর একটা ছোট্টো চার-ভাঁজ করা চিরকুট। বিপিন এই চিরকুটের মানে আগে থেকেই জানতো। কিন্তু সুধাকে এই নিয়ে কখনো কিছু বলেনি। তাড়াতাড়ি চিরকুটটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলে মেলে ধরল চোখের সামনে। সেখানে শুধু একটা ক্রস আঁকা। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যার প্রদীপের আগুনে চিরকুটটা পুড়িয়ে ফেলে সুধার কাছে এসে বলল,- ”ভয়ের কিছু নেই। আজ রাতে জমিদার বাড়ির ছেলে বিকাশ আমাদের বাড়ি আসবে। আর এই খবরটা আমায় এখনি বিভাবরীদেবীকে দিতে হবে।”
সুধা মুখে কিছু বলল না কিন্তু তার কপালের প্রতিটা ফুটে ওঠা ভাঁজ ও কুঁচকে যাওয়া ভ্রূ বিপিনের দিকে সহস্র প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করল। বুকের মাঝে সুধাকে জড়িয়ে ধরে বলল,- ”ভয় পেও না। তোমায় সব কিছু বলবো। তার আগে দৌড়ে খবরটা বড়মা কে দিয়ে আসি। আজ প্রায় দশ মাসের উপর হয়ে গেল বিকাশের কোনো খবর পাননি। অনেকদিন পর আজ একটু তিনি শান্তি পাবেন।”
সুধার কপালের ভাঁজ তখনও স্পষ্ট। খুব নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করল, - ”আচ্ছা, ও বাড়ির আর কেউ কি জানে না?”
বিপিন ঘাড় নেড়ে বলল, - ”না। বড়মা ছাড়া আর কেউ জানে না।”
তাড়াতাড়ি করে নিজের বাইক নিয়ে সে বেড়িয়ে গেল জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাইকের শব্দ যতক্ষণ কানে আসে সুধা সেই দিকে কান পেতে রইল। অল্প সময় পরেই শীতের শন শনে হাওয়ার শব্দে চাপা পড়ে গেল বিপিনের বাইকের শব্দ।
বিপিনের কাছে খবর শুনে বিভাবরীদেবী আনন্দে বিপিনকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। পরক্ষণেই কেউ দেখে না ফেলে তাই তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বিপিনকে বললেন,- ”বাবা, তুই আজ বারোটা নাগাদ পিছনের গেটের সামনে চলে আসিস কেমন।”
বিপিন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,- ”বড়মা, এতো দেরি কেন? আগে তো এগারোটায় নিতে আসতাম।”
বিভাবরীদেবী একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,- ”আরে ওর বাবা জন্য তো। আজকাল খুব দেরি করে ঘুমাতে যান। সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটা বাজায় শুধু খেয়ে উঠতে। তারপর ঘুমাতে যাবে সোয়া এগারোটার দিকে।”
বিপিন আর কথা না বাড়িয়ে বলল,- ”ঠিক আছে বড়মা, আমি এখন যাই। বৌটা একা ঘরে আছে। একটু ভয় পেয়েছে। আমি বারোটাতেই চলে আসবো।”
বিভাবরীদেবী একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন,- ”বাবা, বৌমা কে ভালো করে বুঝিয়ে বলিস। দেখিস যেন পাঁচ কান না করে। তাহলে আমার ছেলেকে আর হয়তো দেখতে পাবো না।”
তাঁর কথায় সম্মতি জানিয়ে বিপিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে তখনই পিছন থেকে তিনি ডেকে বললেন,- ”বাবা বিপিন, তখন হয়তো সব খাবার একসাথে নিয়ে যেতে পারবো না। শুকনো খাবারের পুঁটলিটা এখনি নিয়ে চলে যা।”
বিপিন কিছু সাড়া না করে পিছন পিছন রান্নাঘরের দিকে এলো। বিভাবরীদেবী একটা বড় ব্যাগ অনেক শুকনো খাবার প্যাকেট করে ভরে বিপিনের হাতে দিলেন। বিপিন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি চলে এলো।
সুধা তখনও বিছানায় বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলেছে। শনশন বাতাসের মাঝে আবার বাইকের শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। শব্দটা একেবারে তার বাড়ির দোরগোড়ায় এসে বন্ধ হল। সুধা বিছানা থেকে নেমে বাইরে এলো। বিপিনের হাতে অতো বড় ব্যাগ ভর্তি খাবার দেখে তার কপালের ভাঁজ আরো গভীর হল।
দরজার পাশে ঘরের কোণায় ব্যাগটা রেখে সুধাকে খাবার দিতে বলল। দু-জনে খাবার খেতে খেতে বিপিন একেবারে ছোটো বেলা থেকে আজ পর্যন্ত বিকাশের জীবনে যা হয়েছে তা বিশদ ভাবে বলল।
পরিশেষে বলল,- ”বিকাশ একজন বিপ্লবী। সমাজের কিছু ভালোর জন্যই বিপ্লব করছে পরিবার পরিজন ছেড়ে। আজ আসবে খাবার নিতে আর বড়মার সাথে দেখা করবে। নিজের বাড়িতে যেতে পারবে না। ধরা পড়ে যাবে। আর ধরা পড়লে কি হবে তা তো তোমায় বলেছি। তবে বিকাশ যে আমাদের বাড়ি আসে তা আমি আর বড়মা ছাড়া এই তুমি জানলে। তবে এটা ঘুণাক্ষরেও যেন আর কেউ জানতে না পারে।”
রাত বারোটার কিছু আগেই বিপিন জমিদারবাড়ি চলে গেল। বারোটা বাজার পর পরই সে ফিরে এলো বিভাবরীদেবীকে সাথে নিয়ে। একটা-দুটো কথা তিনি সুধার সাথে বললেন। এই ঠান্ডাতেও একটা চাপা উত্তেজনায় বিভাবরীদেবীর কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু করেছে। ঘরের মধ্যে এক কোণায় শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছে। ঘরের আলো আঁধারীর সাথে শ্বাসরোধ করা নীরবতা ঘরের বাতাসকে আরো ঘন করে তুলেছে।
নীরবতা ভঙ্গ করে জানলায় হালকা তিনটে খট-খট শব্দ ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল। বিপিন ঘরের দরজা খুলে দিতেই চাদরে আপাদমস্তক মোড়া একজন ঘরে ঢুকল। খাওয়া-দাওয়ার পর সুধা সেই যে ভয়ে বিছানায় উঠেছে আর সে নামেনি। ছায়া মূর্তির পাশে বিপিন দাঁড়িয়ে সুধার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,- ”আমার স্ত্রী, সুধা।” সুধা সে দিকে তাকাতেই দেখল মোমবাতির আলোয় চাদরের ভিতর দিয়ে জ্বলে ওঠা দুটো চোখ তার দিকে শুধু একবার দৃষ্টিপাত করে চাদরের অন্ধকারে বুজে গেল। আসার সময় বিভাবরীদেবী নিজের সাথে কিছু খাবার তৈরী করে এনেছিলেন। বিকাশ ঘরে ঢুকতেই অন্ধকারের মাঝে মেঝেতে সব খাবার থালায় সাজিয়ে দিলেন। সুধা দেখল একটা হাত থালা থেকে খাবার তুলছে আর তা চাদরের কাছে এসেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কি কথা হল তার কিছুই সুধার কানে গেল না। শুধু খাবার চেবানোর শব্দ ও মাঝে মাঝে বিভাবরীদেবীর চাপা ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ অন্ধকার ছিঁড়ে তার কানে আসলো। একটা সময় খাবার চেবানোর শব্দ থেমে থালার উপর জলের আওয়াজ এলো। চাদরে ঢাকা ছায়া মূর্তি উঠে দাঁড়াতেই বিভাবরীদেবী জড়িয়ে ধরলেন। কান্নার সুর একটু উপরে উঠে আবার নেমে গেল। আলো ছায়ার মাঝে আরও একবার জ্বলে উঠল চোখ দুটো। দরজার পাশে রাখা খাবার ভর্তি ব্যাগ হাতে তুলে দরজার বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। দরজা থেকেই বিপিনের গলায় ভেসে এলো,- ”একটু অপেক্ষা করো, আমি বড়মাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিপিন ঘরের আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করে দিল। হঠাৎ এক ঝাঁক আলোয় সুধার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তবু আলো দেখে তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি কিছুটা স্বাভাবিক হল। ”তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” - বলে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর বিপিন ফিরে এলো। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করতে করতে সে দেখল ঘরের দরজা খোলা আর ভিতরে কোনো আলো জ্বলছে না। পরক্ষণেই ঘরের ভিতর থেকে সুধার গোঙানি আওয়াজ ভেসে এলো। বাইক থেকে নামতে নামতে সে দেখল ঘরের ভিতর থেকে চাদরে মোড়া এক ছায়ামূর্তি দৌড়ে বেরিয়ে এক পলকের জন্য থমকে লাফিয়ে বারান্দা পেরিয়ে মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিপিন তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখল মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কাঁচের চুড়ির সাথে শাঁখা-পলার টুকরো। সুধার দুই-হাতের কাঁধের কাছে আঁচোড় কাটা রক্তের দাগ ফুলে ফুলে উঠছে। অবশ হাতে এলোমেলো বিছানার উপর থেকে কোনো রকমে লেপ টেনে নিজেকে চাপা দিল। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে তার অবিশ্রান্ত জলধারা। শুধু বিপিনকে সামনে দেখে সে কণ্ঠ রোধ করে নিয়েছে। ঘরের সামনে বাইকের একঝলক আলোয় ভেসে ওঠা সেই মুখ বিপিনের চিনতে ভুল হয় নি। চাদরের আড়ালে থাকা মুখ যাকে সে বিপ্লবী বলে জানত আজ তাকে নরখাদক রূপে চিনেছে। সে আর কেউ নয় জমিদার বাড়ির একমাত্র বংশধর, তার ছোটোবেলার বন্ধু বিকাশ।
পর্ব : ৫
সেই রাতের ঘটনার পর বিপিন জমিদার বাড়ির প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। বিভাবরীদেবীর কথা ভেবে সুধা ও বিপিন দু-জনেই সে-কথা চেপে যায়। জমিদার বাড়ির সাথে আপাত মৌখিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও পারিবারিক আন্তরিকতা থেকে নিজেদেরকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে থাকে। সকলের নজরে দুই পরিবারের সম্পর্ক আগের মতোই থাকলেও বিভাবরীদেবীর নজরে এই দূরত্ব খুবই স্পষ্ট তবুও সদ্য বিকাশের সাথে দেখা করার আনন্দে তিনি তা উপেক্ষা করে গেলেন। রাজনৈতিক আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন ও ক্ষমতার হস্তান্তর যে অবশ্যম্ভাবী তা বিপিনের বুঝতে দেরি হল না। শুধু পার্টি করে নিজের সংসার চালানো যাবে না তা বুঝতে পেরে, বাবার কারখানায় সে কাজে ঢুকে যায়। আর পার্টির কাজের জন্য বেছে নেয় কারখানা থেকে ফিরে সন্ধ্যার সময়।
মাস ছয়েক কাটতে না কাটতেই বিপিনের আশঙ্কা বাস্তবের মাটিতে এসে দাঁড়ালো। ক্ষমতার হস্তান্তরের সাথে সমাজে একটা শান্তি-শৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হল। অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর জন্য সূর্য্যকান্তবাবু ও তাঁর মতো অনেকেই নিজের দল ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন। এমতো অবস্থায় পুলিশের হাতে বিকাশের ধরা পড়া ক্ষণিকের জন্য তাঁকে বিব্রত করলেও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে দু-সপ্তাহের মধ্যে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন বিকাশকে। সংসারে মন বাঁধার জন্য কালবিলম্ব না করে সুর্য্যকান্তবাবু তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন দেবনারায়নবাবুর একমাত্র মেয়ে নয়নতারার সাথে বিকাশের বিয়ের ঘোষণা করলেন।
বিকাশের ফিরে আসা ও তার বিয়েকে ঘিরে জমিদারবাড়িতে চার চাঁদ লেগে গেল। সেই চাঁদের আলোয় সারা গ্রাম ভেসে গেলেও বিপিন ও সুধার মনকে আন্দোলিত করতে পারেনি। বরং তাদের মনে কিছুটা অন্ধকার নেমে আসে যখন বিকাশের বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায় না। যদিও ওই বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা তাদের কারোরই নেই। বিয়ের পর বিকাশ ক্ষমতার রাজনীতিতে যোগ দিল। পাঁচ বছরের বিপ্লবী জীবনের পর বিকাশ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসতেই দল তাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে যুবনেতার মুকুট পড়িয়ে দিল। ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে বিকাশ নিজের অস্তিত্ব পাকা করতে চার পুরানো বন্ধু রঞ্জন, অবিনাশ, নির্মল, অধীরকে একেবারে কাছে টেনে নেয় যারা তাকে অর্থ, লোকবল ও আইনি পরামর্শ দিবে আর পরিবর্তে বিকাশের রাজনৈতিক হাত হবে তাদের ছত্রছায়া। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন রঞ্জনবাবু যিনি সামনে জুয়েলারী দোকান খুলে রেখে পিছনে সোনা ও কাঁচাটাকার লেনদেন করেন। পার্টি ফান্ডিং-এর একটা বিশাল অঙ্ক ইনি সামলান। অবিনাশবাবু পেশায় একজন উকিল তবে এনার হাতে এখনও অবধি কোন কেস শেষ পর্যন্ত যায় নি। আইন এনার কাছে যমদন্ড, যার দিকে ছুঁড়বেন তার যমদর্শন অবশ্যম্ভাবী। তাই ইনি কোর্ট রুমের ভিতরের থেকে বাইরে কেস মিটিয়ে নিতে বেশী পছন্দ করেন। নির্মলবাবু শুধুই নামে নির্মল, প্রোমটারির সাথে একটা দল চালান যা লোক জড়ো করতে বা উৎখাত করতে সিদ্ধহস্ত। সাধারণ খবরের কাগজের চাকরী দিয়ে শুরু করে এখন সে টিভি নিউজ রিপোর্টার। বিকাশ তাকে নিজের চ্যানেল খুলতে সাহায্য করবে আর সেখানে বিকাশের শুধুই গুণগান হবে।
আপাত ভিন্ন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও সূর্য্যকান্তবাবুর অখণ্ড সমর্থনের জোরে বিকাশ কয়েকদিনের মধ্যেই প্রভূত প্রভাবশালী নেতা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু প্রতিটা ক্ষমতা সম্পন্ন নেতার একজন খুব বিশ্বস্ত কাছের লোক দরকার যাকে সময়-অসময়ে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এতদিন সূর্য্যকান্তবাবুর কাছের মানুষ হিসাবে বিপিন সেই বিশ্বাস অর্জন করেছিল। তাই বিপিনকে সূর্য্যকান্তবাবু স্বয়ং একদিন বিকাশের দলের হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। যেহেতু তিনি সব ঘটনা জানেন না তাই সরাসরি তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা বিপিনের পক্ষে সম্ভব হল না। বিপিনের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে তিনি পুরানো দলের সম্পর্কে যা মন্তব্য করলেন তা শোনার পর সূর্য্যকান্তবাবুর জন্য যে তিলার্ধ সম্মান বিপিনের বুকে ছিল তা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা সময় পরিবার-পরিজনের ঊর্ধ্বে যে সুর্য্যকান্তবাবুর কথা ও আদর্শ শিরোধার্য করেছিল আজ ছেলের জন্য স্বয়ং তিনি নিজের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে বিপিনকে জীবনের এক চরম শিক্ষা দিয়ে গেলেন। মুখ নীচু করে বিপিন বলেছিল, - ”আমি আমার দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। তাছাড়া আমি রাজনীতিতে তেমন ভাবে আর সক্রিয় নই।” সূর্য্যকান্তবাবু টাকার লোভ দেখাতেও পিছুপা হননি, কিন্তু বিপিনকে ফেরাতে পারলেন না। নিজ ব্যর্থতার আস্ফালন ঢাকতে অত্যন্ত রেগে গিয়ে তিনি বললেন, - ”এতদিন ধরে তোকে কাছে রেখে ছেলের মতো দেখলাম আর আজ তুই আমায় ফিরিয়ে দিলি। তোর এতো দম্ভের ফল তুই পাবি।” সত্যিই বিপিন সূর্য্যকান্তবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ তাঁর অবদানের জন্য। তাই তাঁর রাগে এতটুকুও বিরক্ত না হয়ে চুপ করে সব শুনে গেছে। কিন্তু সূর্য্যকান্তবাবু সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর সে মনে মনে বলল,-”আপনি যদি সব ঘটনা জানতেন তাহলে এমন প্রস্তাব আমার কাছে কখনই আনতেননা।”
মাস কয়েক পরেই সুধা বিপিনকে জানায় যে সংসারে নতুন মানুষ আসতে চলেছে। এই খবর পেয়ে বিপিন সব ভুলে একেবারে সংসারী হয়ে গেল। পার্টি অফিসের সাথে তার যোগাযোগ শুধু পূর্ণিমা-অমাবস্যায়। কারখানাতে সে এখন মাঝে মাঝেই ওভারটাইম করে বেশী টাকার আশায়। বিপিন নিজের জীবনের অনেক হেরে যাওয়া গল্পের মাঝে পুত্র সন্তানের পিতা হয়ে খুব গর্বের সাথে নাম রাখল ’অজিত’।
সুখে শান্তিতে পাঁচটা বছর তাদের সংসার বেশ ভালো ভাবেই কেটে যাচ্ছিল। একদিন সকালে কারখানা যাওয়ার পথে সে খবর পেল রান্না ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিভাবরীদেবী মারা গেছেন। খবরটা পাওয়া মাত্রই বিপিন বাড়ি ফিরে অজিত ও সুধাকে নিয়ে জমিদারবাড়ি যায় শেষ বারের মতো দেখে আসতে। চুপ চাপ বিভাবরীদেবীকে প্রণাম করেই তারা চলে আসে। বিভাবরীদেবীর প্রয়াণের পর বিকাশ এতোটাই অর্থ ও ক্ষমতা পিপাসু হয়ে গেল যে ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা তার জীবন থেকে মুছে গেল। তবে বিপিন ও সুধা যথা সম্ভব তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলল। কিন্তু একদিন কারখানায় ওভারটাইম করার সময় কিছু খুব পুরনো কারখানার কর্মচারীর থেকে এখানে আগুন লাগার ঘটনার বিবরণে বিকাশের নাম শুনলো। সেদিন সন্ধ্যায় বিকাশ ও তার দল বারুদ লুঠ করতে এসে প্রথমে দুই জন গার্ডকে গুলি করে কারখানার পাওয়ার কেটে দেয়। তারপর ভিতর থেকে যা পেরেছে নিজেদের সাথে নিয়ে সালফার ট্যাঙ্কে গুলি করে কারখানার ভিতরে ও বাইরে বেরিয়ে ট্রান্সফরমারে গুলি করে বাইরে থেকে আগুন ধরায়। যারা তাদের দেখেছিল তারা যদি মুখ খোলে তাহলে তাদের পরিবার শেষ করে দেবে এমন হুমকি দিয়ে যায়। তাই পুরো ব্যপারটা শর্ট সার্কিটের উপর দিয়ে চালানো হয়।
অনেকদিন পর সেদিন আবার বিপিন মদ খেয়ে চূড় হয়। বিপিনের হঠাৎ করে এমন অস্বাভাবিক আচরণ সুধাকে রীতিমত ভাবিয়ে তোলে। মাঝে মধ্যে সে মদ খেতো ঠিকই কিন্তু আজ সে সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বারান্দার সিঁড়িতে বসে বিপিন ঢক ঢক করে গলায় মদ ঢেলে যাচ্ছে আর বিকাশের নামে গালাগালি দিচ্ছে।
সুধা অনেক শান্ত করার চেষ্টা করলেও কিছুতেই কিছু পরিবর্তন হয় না বিপিনের। তার এমন আগ্রাসী ও প্রতিশোধ পরায়ণ মনোভাব সে কখনো দেখেনি। ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে এসে সুধা এমন করার কারণ জিজ্ঞাসা করায় বিপিন বলল,-”ওই বিকাশ সেদিন আমার বাবার কারখানা লুট করে বারুদ নিতে গিয়ে কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। আমার বাবা সেদিন ওই আগুনে মারা যায়। আমি আমার বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে পর্যন্ত পাইনি। আর ওই দিন ভোররাতে আমার মাও মারা যায় সাপের কামড়ে। ওই – ওই পুকুর পাড়ে মাকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। সব- সব কিছু পিছনে ওই বিকাশ হারামজাদা। অনেক কিছু ভেবে আমি এতোদিন চুপ ছিলাম। এমন বিষাক্ত জাতের সাপকে একটা সময় বন্ধু ভেবেছিলাম আর আজ তার ফল ভুগতে হচ্ছে। ওর মৃত্যু কামনা করি ঠাকুর, ওর মৃত্যু হোক।”
বিপিনের মুখে কথাগুলো শুনে সুধার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। প্রায় টানতে টানতে বিপিন কে ঘরে এনে মেঝেতেই শুইয়ে দেয়।
বাবার অমন অবস্থা দেখে ছোটো অজিত অনেক ভয় পেয়ে যায়। অজিতের তখন খেলার সঙ্গী বলতে তার বাবা আর পাশের বাড়ি নিতাই কাকার মেয়ে কাজল। দুজনেই প্রায় সমবয়সী। তাই বাবার অবর্তমানে কাজলের সাথে তার খেলা যেমন হত তেমন ঝগড়াও। সেই রাতে বিপিনের অমন মাতলামি শুনে নিতাই কাকা ও কাজল এসেছিল রাতে। তারা আসতে বিপিন একটু চুপ হয়েছিল। না হলে হয়তো সারারাত এমনটাই করে যেত।
অনেকক্ষণ পর বিপিন নিজের মনে বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে অজিত বাবার মুখে সব কথা শুনে সুধাকে জিজ্ঞাসা করে - ”মা, বিকাশ কে? ওই জমিদারবাবু বুঝি?”
সুধা খুব গম্ভীর গলায় হুম করে বলল, - ”বাবু, এই নিয়ে তুমি আর একটাও কথা কাউকে বলবে না আর জিজ্ঞাসাও করবে না। মনে থাকবে?”
ছোটো অজিত ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে মায়ের কথায় সম্মতি জানালো।
নিজের বাবার মৃত্যুর জন্যও যে বিকাশ দায়ী তা সে কোনদিন কল্পনায় আনতে পারে নি বিপিন। তাই ঠিক করে এই সব কিছু তথ্য সে পার্টি অফিসে জানিয়ে সামনের ভোটের প্রচারে বিকাশ ও সূর্য্যকান্তবাবুর আসল চেহারা সবার সামনে আনবে। কিন্তু বিপিন যে কারখানায় আগুন লাগার আসল কারণ জেনে গেছে তা বিকাশের কানে উঠতে বেশী সময় লাগলো না। পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে বিপিন দেখল হঠাৎ করে রাস্তার মাঝে একটা সাদা গাড়ি একেবারে তার গায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। বিপিন থমকে রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ি থেকে বিকাশ নেমে একেবারে বিপিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের বামহাত বিপিনের ডান কাঁধে রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব আসতে আসতে বলল, - ”যা জেনেছিস নিজের কাছেই চাপা রাখ। সেদিন রাতের সিনেমাটায় ইন্টারভ্যাল হয়ে থমকে আছে। বলিস তো বাকি সিনেমাটা দেখিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এবার তুই ঠিক কর সিনেমা দেখবি না যেমন আছিস তেমনই থাকবি?”
কথা গুলো শুনে বিপিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। চোখ গুলো একেবারে রক্ত জবার মতো লাল হয়ে গেল। তার সারা শরীর দিয়ে একটা শীতল সাপ যেন হিলহিল করে খেলে যাচ্ছে। দুই হাতের মুষ্টি শক্ত করে পাকিয়ে ধরে যথা সম্ভব নিজের রাগ সংবরণ করলো। বিকাশের চলে যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রতিশোধের আগুনটা তার যেন হঠাৎ করে খুবই নিজের ব্যক্তিগত মনে হল।
পর্ব : ৬
শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, ব্যক্তিগত দিক থেকেও বিকাশের সাথে দ্বন্দ্বে একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো বিপিন। সে বিকাশের সম্পর্কে আরো তথ্য সংগ্রহে মন দিল। সাথে সাথে নিজের দলের হাতে সংগৃহীত তথ্য তুলে বিকাশের মানবদরদী চেহারার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। একটা সময় বিভাবরীদেবীর কাছে সব কিছু গোপন করে যাওয়ার আফসোস এখন তাকে মাঝে মাঝেই বিব্রত করে তোলে। ফেলে আসা সময়ে যদি সরব হতো তাহলে বিকাশের রূপ হয়তো এতোটা কদর্য হতো না। কারখানায় বিকাশ ও তার ছত্রছায়ায় পালিত বন্ধুদের সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য বিপিন জানতে পারলো যা তার সাথে ঘটে যাওয়া সেই রাতের ঘটনার থেকে সহস্র গুণে মর্মান্তিক। বাড়ি লুট করা ও বাধা পেয়ে সদ্যজাত সন্তান সহ মহিলার গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংস কাজ করতেও তাদের হাত কাঁপেনি।
বিপিনের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে সুধা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। তারপর একটা সময় সে বলল, - ”সূর্য্যকান্তবাবু এখনো অনেক ক্ষমতা রাখেন। তাঁর কাছে সব কিছু বলে দেখ না যদি বিকাশকে কিছুটা হলেও আটকানো যায়।”
সুধার কথা বিপিনকে একটু ভাবায়। তারপর সে মেনে নেয়। কিন্তু একটা সন্দেহ তার মনে থেকে যায় - সূর্য্যকান্তবাবু আদৌ তার কথা শুনে বিশ্বাস করবেন তো? শেষবার তাঁর কথা না মানায় তিনি বিশ্বাসঘাতক বলে গেছেন। তবে যাই হোক একবার সূর্য্যকান্তবাবুকে কথা গুলো বলা দরকার। জানা দরকার তাঁর ছেলে আদতে রাজনীতির নামে কি করে যাচ্ছে। সন্দেহটা আরো বেড়ে যায় যখন ভাবে সূর্য্যকান্তবাবু নিজে পাল্টে গেছেন। নিজের দল থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
এইসব অনেক সাত-পাঁচ ভেবে বিপিন একেবারে সকাল সকাল সূর্য্যকান্তবাবুর চায়ের প্রথম চুমুকের সাথে হাজির হল জমিদারবাড়ির দরজায়। বাগানে বসে সূর্য্যকান্তবাবু চা খেতে খেতে বিপিনকে দেখেই তাকে হাত নেড়ে ভিতরে আসতে বললেন। তাঁর হাতের ইশারায় দারোয়ান দরজা খুলে দিল। সূর্য্যকান্তবাবুকে প্রণাম করে সে সামনের চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে সব কথা বলল। নিজের ছেলের সম্পর্কে কোনো পিতা কখনই কুখ্যাতি শুনতে পছন্দ করেন না। এখানেও তার অন্যথা হল না। তবে বিপিন যখন কারখানার ঘটনার সাথে সে-রাতের ঘটনা ও কিছুদিন আগে বিকাশের হুমকির দেওয়ার কথা বলে তখন সূর্যকান্তবাবু বিপিনের কথায় একটু বিশ্বাস করা শুরু করেন । ফিরে আসার সময় বিপিন হাত জড়ো করে অনুরোধ করে বলে,-”আপনার হাত ধরেই রাজনীতি শিখেছি। কিন্তু সেখানে কখনই কারোর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি করিনি। সামনেই ভোট। প্রস্তুতি সবাই নিচ্ছে। বিকাশের সাথে যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে তা থাকুক কিন্তু সে যেন আমার পরিবারের উপর কোনো আঘাত না হানে।”
সূর্য্যকান্তবাবু খুব গম্ভীর ভাবে ”হুম। আমি দেখছি।”- বলে বিপিনকে বিদায় দিল। বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে বিপিনের জমিদারবাড়িতে আসা থেকে চলে যাওয়া কোনোটাই বিকাশের চোখ এড়াই নি।
বিপিন চলে যাওয়ার পর সূর্য্যকান্তবাবুর ও বিকাশবাবুর মাঝে বেশ কিছুদিন ধরে একটা গরম হাওয়া চলতে থাকে। কানাঘুষো শোনা যায় যা, বিকাশের কাজের উপর অনেক বেশি নজর রাখছেন সূর্য্যকান্তবাবু এবং সাথে সাথে তার অনেক কিছুতে বাধাও দিচ্ছেন। বিপিন ভেবেছিল বিকাশ সূর্য্যকান্তবাবুর কথা শুনে একটু হলেও নিজের উপর রাশ টানবে। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল সাপের লেজে পা দিলে সাপ ছোবল মারবেই।
জমিদার বাড়ি থেকে ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহ পর একদিন কারখানা থেকে ফিরে দেখে ঘরের একটাও আলো জ্বলছে না। সুধাকেও দেখতে পাচ্ছে না। বার-কয়েক সুধার নাম ধরে ডাকতে অবশেষে সুধা ঘরের ভিতর থেকে সাড়া দিল। বাড়ির বারান্দার আলো জ্বালাতে সুধা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখা একটা রঙিন কাগজের বাক্সের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, - ”সন্ধ্যায় ক্লাবের দু-টো ছেলে এসে এটা দিয়ে গেল আর বলল বিকাশদা পাঠিয়েছে। আমি ভয়ে ওটা খোলার সাহস পাই নি। আর বাবুকেও ওটার ধারে কাছে যেতে দিই নি।”
খুব সন্তর্পণে বাক্সটা খুলতে একটা সাদা কাঁচের বোতল বেরিয়ে এলো। বোতলটা দেখে বিপিনের চিন্তে ভুল হল না- এটা বাংলা মদের একটা বোতল। বোতলটা স্বচ্ছ তরলে ভর্তি। তবে গায়ে একটা কাগজ লাগানো। সাধারণত বাংলা মদের বোতলের গায়ে কোনো কাগজ থাকে না। কাগজের ভিতরের দিয়ে কিছু একটা লেখা আছে। ভিতরের তরলটা নড়ছে বলে তা পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না। টেবিলের উপর বোতলটা রাখতেই স্থির তরলের ভিতর দিয়ে লেখাটা বড় বড় করে ফুটে উঠল - ” আজ রাতেই হয়ে যাক সিনেমার শেষাংশ। মদটা তোর জন্য। রাতটা খালের ধারে
কাটাস।” লেখাগুলো সুধা ও বিপিন একসাথেই পড়ল। বিপিন তৎক্ষণাৎ রেগে গিয়ে বোতলটা উঠোনের মাঝে আছাড় মেরে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলে। রাগে গজ গজ করতে করতে ”আজ বিকাশের একদিন কি আমার একদিন” - বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় সুধার। তারপর তাড়াতাড়ি অজিতকে নিতাই কাকার বাড়ি রেখে বিপিনের পিছু নেয়।
জমিদার বাড়িতে আজ তেমন একটা আলো জ্বলছে না। বাড়ির ভিতরে একটা – দুটো আলো নিতান্তই না জ্বললে নয় সেই রকম ভাবে জ্বলছে। লোকজনেরও কোনো ভিড় নেই। ভোটের প্রস্তুতির সময়ে জমিদার বাড়িতে এমন অস্বাভাবিক নির্জনতা সুধার খুব একটা ভালো ঠেকলো না। অনেক দূরে থেকে সে বিপিনের ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। তীর বেগে হেঁটে জমিদার বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল বিপিন। অনেকক্ষণ জমিদার বাড়ির বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভিতরে কি হচ্ছে তা বোঝার ও শোনার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই লাভ হল না। হঠাৎ করে বিপিনের তীক্ষ্ণ চিৎকার আর সাথে সাথে আবার নীরবতা সুধাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দিল এক অশনি সংকেত। তাড়াতাড়ি করে সে শব্দের উৎসস্থল স্মরণ করে দৌড় দিল জমিদার বাড়ির ভিতর।
দোতলায় উঠে ডান দিকে তাকাতেই বারান্দার অল্প আলোয় সে দেখল বিকাশ একটা চকচকে ছুরি হাতে ধরে বিপিনের উপুড় হয়ে পরে থাকা দেহটার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। বিকাশের একেবারে ডান হাতের কাছে মাটিতে রাখা আছে একটা বন্দুক। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সুধার গলা দিয়ে চিৎকার বেড়িয়ে এল কিন্তু পরক্ষণেই নিঃশব্দে একটা গুলি তার দুই চোখের মাঝ বরাবর মাথা ফুটো করে তাকে চিরতরে নীরব করে দিল।
- হ্যালো, পুলিশ ষ্টেশন?
- হ্যালো। হ্যাঁ। পুলিশ ষ্টেশন।
- আমি বিকাশ রায় বলছি।
- আরে স্যার, আপনি ! আপনি কষ্ট করে ফোন করতে গেছেন কেন? কাউকে দিয়ে ডাকিয়ে নিতে পারতেন।
- আপনি একবার তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে আসুন। বিপিন ও তার স্ত্রী আমার বাবাকে খুন করতে এসেছিল। বাবা খুব বাজে ভাবে আহত। আমি ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। বিপিন ও তার স্ত্রী বেঁচে আছে কি না জানি না। আপনি এসে বাকিটা সামলান।
- ও কে, আসছি স্যার এখুনি।
বিদ্যুতের বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ল। জমিদার বাড়ি লোকজনে ভর্তি হয়ে গেল। নিজের গাড়ি করেই বিকাশ সূর্য্যকান্তবাবুকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। খবর পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে নয়নতারা সরাসরি হাসপাতালে চলে আসে। তাড়াতাড়ি করে অপারেশন করার ব্যবস্থা করা হলেও এক ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার এসে বললেন , - ”সূর্য্যকান্তবাবু আর বেঁচে নেই।”
ডাক্তারের মুখে বাবার মৃত্যু খবর শুনে পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে বিকাশ চোখের কোণ মুছে নিল। নয়নতারা সেখানেই বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
এদিকে পুলিশ বিপিন ও সুধার মৃতদেহ জমিদার বাড়ি থেকে বের করে সোজা পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেয়। পার্টির ও ক্লাবের লোকজন সূর্য্যকান্তবাবুর হত্যার খবর শুনে বিপিনের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাদের ঘর ভেঙে দেয়। অজিতকেও তারা মেরে ফেলবে বলে কিন্তু নিতাই কাকা অনেক আকুতি মিনতি করে তাদের শান্ত করে।
দিন দশেক পর সব রিপোর্ট হাতে নিয়ে পুলিশ তার তদন্ত শেষে জানায়- সেদিন রাতে বিপিন ও সুধা সূর্য্যকান্তবাবুকে হত্যা করতে আসে একটা খুব ধারাল ছুরি নিয়ে। ছুরির হাতলে দুজনেরই ডান হাতের ছাপ পাওয়া যায়। বুকের পাঁজর ভেদ করে ছুরি গিয়ে লাগে একেবারে সূর্য্যকান্তবাবুর হৃদপিণ্ডে। আর তখনই তাঁর মৃত্যু নেমে আসে। বিকাশবাবু তা দেখতে পেয়ে যান। বিকাশবাবুকে দেখে প্রথমে বিপিন ছুরি তুলে নিয়ে তাকে আক্রমণ করতে আসে। উপায় না দেখে বিকাশবাবু নিজের আত্মরক্ষার তাগিদে গুলি চালান। গুলি গিয়ে লাগে একেবারে বিপিনের বুকে। সাথে সাথে বিপিন মাটিতে পড়ে যায়। বিপিনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সুধা ছুটে আসে। বিপিনের ডান হাত থেকে সুধা ছুরি নিজের ডান হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইলে বিকাশবাবু আবার একটি গুলি করেন সুধার দিকে তাক করে। অব্যর্থ নিশানা। গুলি সুধার দুই চোখের মাঝের কপাল ফুঁড়ে মাথায় চলে যায় ও সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।
পুলিশের বক্তব্য পরদিন খবরের কাগজে সূর্য্যকান্তবাবু, বিপিন, সুধা ও যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছে তার ছবি সহযোগে বের হয়। খবরের কাগজে ছুরিটা দেখে ও সংবাদ পড়ে নিতাইকাকার কপালে অজস্র ভাঁজ দেখা দেয়। তারপর ছুরির ছবিটার উপর হাত বোলাতে বোলাতে কপালের ভাঁজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসে যেমনটা হয় জ্ঞানের আলোয় অন্ধকারের অপসরণ।
পর্ব : ৭
নয়নতারার কাছে শ্বশুর মশাই নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিপনের জন্মের তিন দিন পরেই সূর্য্যকান্তবাবুর হঠাৎ মৃত্যু তাঁর শেষ ইচ্ছাটুকুও পূরণ হতে দিল না। নয়নতারা ও তার পরিবার রীতিমত মর্মাহত হন সূর্য্যকান্তবাবুর আকস্মিক মৃত্যুতে। তবে নতুন অতিথি আসায় বাড়িতে শোকের ছায়া অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মুছে গিয়ে আনন্দের সুর বেজে ওঠে।
জমিদার বাড়ির উত্তরসূরির পদার্পণে সারা গ্রাম যেমন একদিকে আনন্দে মেতে ওঠে, অন্যদিকে একরাতেই পাঁচ বছরের অজিত বাবা-মা সহ নিজের বাড়িটুকুও হারিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, কিছু না করেই তার গায়ে তকমা লেগে যায় খুনির ছেলে। গ্রামের স্কুলেও তাকে সবাই একঘরে করে দেয়। বন্ধু বলতে একমাত্র পাশে থাকে কাজল। যদিও নিতাইকাকার আর্থিক অবস্থা একেবারেই মন্দ তবু সে-ই তার এখন একমাত্র আশা ও ভরসা। কিন্তু নিতাইকাকার বাড়িতে থাকার জন্য অজিতের উপর লাগানো লাঞ্ছনার ছিটে কিছুটা কাজলের উপরেও লাগলো। স্কুলে তারও বন্ধু সংখ্যা একেবারেই কমে গেল। যারা শেষমেশ টিকে রইল তারা পর্যন্ত বলল, - ”তোর বাবা খুব ভুল কাজ করছে। ওই খুনির ছেলেকে তোরা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দে। না হলে কিন্তু দেখবি কোন দিন তোদের বুকে ছুরি মেরে দিয়েছে।” কাজলের খুব খারাপ লাগতো এমন কথা শুনে। অনেকবার সে স্কুল যাবে না বলে কান্না জুড়ে দিত। কিন্তু নিতাইকাকা তখন বুঝিয়ে বলত, - ”স্কুলে না গেলে খিচুড়ি পাবি কি করে? না খেয়ে থাকতে পারবি তো সারাদিন?”
নিতাইকাকার কথায় কাজল যা বুঝতো তার থেকে অনেক বেশী উপলব্ধি করত অজিত নিজে। এতো অল্প বয়সে বাস্তবের মাটিতে আছাড় খেয়ে তার উপলব্ধির পরিধি অনেকগুণ বেড়ে গেছে। সে জোর করে কাজলকে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেত। বন্ধুহীন স্কুলে দুজনেরই মন টিকলো না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্কুল ছেড়ে অজিত হাতে তুলে নিল নিতাইকাকার কামারশালার হাতুড়ি আর কাজল আঁচলে বাঁধলো সংসারের চাবি।
অজিতের কামারশালার প্রতি আগ্রহ ও কাজ শেখার নেশাকে হাতিয়ার করে নিতাইকাকা তাকে একজন দক্ষ কামার বানিয়ে তুলল। তার হাত দিয়ে লোহা পিটিয়ে সেখানেও যে সোনার গহনার মতোই কারুকার্য করা যায় তা নতুন করে সবাইকে আশ্চর্য করল। ধীরে ধীরে তাদের দোকানের হাল কিছুটা ভালোর পথে আসতে থাকে। কিন্তু সেই ভালো অনেকের চোখে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। রাজনৈতিক দল ও ক্লাবের অনাবশ্যক চাঁদার জুলুমবাজি বার বার তাদের মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এমন ভাবেই কেটে যায় পনেরোটা বছর। পরিবর্তনের মধ্যে অজিত তাদের ভাঙা ঘরের জায়গায় একটা মাটির বাড়ি বানিয়ে সেটাকে বাড়ির চেয়ে বেশী কামারশালায় পরিণত করে। সারাদিন নিতাইকাকার দোকানে আর রাতে নিজের বাড়িতে কাজ করে। তবে বয়সের ধর্ম অনুযায়ী কাজলের মধ্যে প্রভূত শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায় যা আশে পাশের অনেক পুরুষের দৈহিক বাসনার উদ্রেক করে। সারাদিনে তার কাজ বলতে দুটো বাড়ি পরিষ্কার করা আর রান্না করা। নিজের তৈরি কোদাল-কুড়ুল বিক্রি করে অজিত তাকে একটা রেডিও কিনে দিয়েছিল তার জন্মদিনে। কাজলের হাজার কাজের মাঝে সেই রেডিওটাই তার সারাক্ষণের সঙ্গী। এমনকি ঘুমানোর সময়ও সেটা একেবারে মাথার কাছে নিয়ে হালকা করে চালিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়।
বর্ষা কাল। সারা আকাশ জুড়ে কালো মেঘ দিন রাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। বর্ষার দিনগুলোতে কাজ খুব আসে। তাই একেবারে দুপুরের খাবার সেরে নিতাইকাকা ও অজিত দোকানে যায়। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে না দেখে নিতাইকাকা দোকানে যায়। অজিত তার মাটির ঘরেই নিজের সূক্ষ্ম হাতের কাজ নিয়ে সকালটা কাটায়। কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ করে আকাশ একেবারে ভেঙে পড়ে। নিতাইকাকা অবস্থা দেখে তাড়াহুড়ো করে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে আসে। খাবার পর দুজনে দোকানে গিয়ে দেখে দোকান জলে জলময়। হাপরের ভিতরেও জল ঢুকে গেছে। পরিষ্কার না করা পর্যন্ত একটা কাজও করা যাবে না। কিছুটা পরিষ্কার করার পর দিনের আলো এতোটাই কমে গেল যে বাধ্য হয়ে একটা টর্চ আনতে অজিত আবার বাড়ি ফিরল। বার-দুই কাজলের নাম ধরে ডাকার পরেও যখন কোনো সাড়া পেল না তখন সে টর্চ নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ভালো করে দেখতে লাগল। বাড়ির পিছনে কিছুটা দূরে রাস্তার উপর থেকে রেডিওর কড়কড় শব্দ আসতে অজিত সেদিকে ছুটে গিয়ে দেখল তার দেওয়া রেডিওটা বৃষ্টির জলে ভিজছে। ছাতা ফেলে রুদ্ধশ্বাসে অজিত পিছনের রাস্তা ধরে ছুটলো। ক্লাব ঘরের কাছে আসতে আসতেই সে একেবারে ভিজে গেছে। হালকা ঠান্ডাও লাগছে। ক্লাবের দরজার সামনের বারান্দায় উঠে সে একটু আশ্রয় নিল। অঝরে বৃষ্টি ঝরার শব্দের মাঝে দরজার ফাঁক দিয়ে হালকা গোঙানি শব্দ তার কানে লাগতেই তার মেরুদন্ড দিয়ে এক তীব্র শীতল শিহরণ খেলে গেল। পরক্ষণেই উন্মাদের মতো কাজলের নাম ধরে দরজা চাপড়াতে লাগলো সে। গোঙানির শব্দ এখন কান্নায় পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে দরজাটা খোলার সাথে সাথে তার মাথার উপর একটা শক্ত কাঠের সজোর আঘাত তাকে ধীরে ধীরে অবচেতন করে দিল। ক্লাব ঘরের এক কোণায় ক্যারাম বোর্ডের উপর ল্যাম্পের আলো তখনও দুলছে। অজ্ঞান হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে দেখল ঘরের এক কোণায় কাজলের নিস্তেজ নগ্ন দেহটা। আলোতে তার মুখের উপর মাছের চোখের মতো নিস্পলক চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। চোখ দুটো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে চোখের তারাটা একটু যেন নড়ে উঠল। মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে সে দিকে যাওয়ার একটু প্রচেষ্টা করতেই তল পেটের কাছে একটা শক্ত জুতোর আঘাত তাকে একেবারে কুঁকড়ে দিল। ক্লাব থেকে একে একে অমিত, বাপ্পা, সজল, রিপন ও মঙ্গলকে বেরিয়ে যেতে দেখল। বাইরে থেকে ক্লাবের দরজা বন্ধ করে তালা লাগানোর শব্দ অজিতের কানে এলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সে হামাগুড়ি দিয়ে কাজলের দিকে এগিয়ে গেল। পাশে পড়ে থাকা ওড়না দিয়ে কাজলকে ঢাকা দিতে দিতে সেখানেই জ্ঞান হারালো।
চোখ খুলে অজিত নিজেকে পেল মাথায় ব্যান্ডেজ সহ সরকারী হাসপাতালের বেডে। সামনেই দু-জন পুলিশ অপেক্ষা করছিল তার চোখ খোলার জন্য। পুলিশ দেখেই অজিত তাড়াতাড়ি করে বলতে গেল- ”স্যার ওরা…”
তার কথা শুরুর আগেই এক পুলিশ ধমক দিয়ে বলল, - ”একেবারে চুপ। একটা সাড়া করবি তো এখানেই গুলি করে দেব। তোর বাপ খুনি আর তুই রেপিস্ট।” জোর করে অজিতের বাঁ-হাতের টিপ সই একটা সাদা কাগজের উপরে নিয়ে নিলো। নার্সও যেন কোনো রকমে তাকে ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচে আর সেটাই করল। সরাসরি পুলিশের গাড়িতে করে এসে সে বন্দি হল থানার ভিতরে। থানায় এসে অজিতের সই করা কাগজে থানার বড়বাবু কিছু লিখে যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিলেন। তারপর অজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন ,- ”যত দিন কাজলে জ্ঞান না ফিরছে তত দিন তুই এখানেই থাকবি।”
এদিকে কাজল অর্ধচেতন অবস্থায় নিজের বাবা ও পুলিশের সামনে সব কিছু বলল। নিতাইকাকা সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানালো। কিন্তু সরকারী হাসপাতালে প্রায় তিন দিন থাকার পর বড়বাবু অজিতের সই করা কাগজ নিয়ে এলেন কাজল ও নিতাইকাকার সামনে। একটু অনুরোধের সুরে বড়বাবু নিতাইকাকাকে বললেন, - ”আপনি ও আপনার মেয়ে এই অভিযোগ তুলে নিন। নাহলে অজিতের স্বীকারোক্তি তাকে জেলে যেতে বাধ্য করবে।”
অবাক হয়ে নিতাইকাকা বললেন,-”কিন্তু অজিত কিছু করে নি তা জেলে যাবে কেন?”
বড়বাবু ভালো করে অজিতের টিপসই করা কাগজটা দেখিয়ে বললেন,-”অজিত সব স্বীকার করে নিয়েছে যে সেই এমন কাজ করেছে। তাই আপনারা যদি অভিযোগ করেন তাহলে তা অজিতের উপরেই পড়বে। তাই অভিযোগ তুলে নিলেই আপনাদের মঙ্গল।”
কথা গুলো শুনে কাজল কান্নায় ভেঙে পড়ল। টাকা ও ক্ষমতার জোরের সামনে নিজেরা একেবারে অসহায় হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে তারা অভিযোগ তুলে নিল। অজিত ছাড়া পেয়ে সরাসরি হাসপাতালে আসে। কাজলের হাত ধরার সাথে সাথে অজিতের দু-চোখ ভেসে যায়। কাজল নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, - ”আর একটু দেরি হলে হয়তো আমি আর বেঁচে ফিরতাম না। এতো তাড়াতাড়ি মৃত্যুটা হয়তো ভাগ্যে নেই। তাই সেদিন তুমি ওখানে চলে এসেছিলে।”
অজিত কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু গলা থেকে তার কোনো শব্দ বেরোল না। কাজলের হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে কপালে ঠেকালো।
প্রায় দিন সাতেক পর হাসপাতাল থেকে তারা বাড়ি ফেরে। এক ঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়টা নিতাইকাকার মধ্যে বেশ কিছুদিন জাঁকিয়ে বসেছে। দোকানের অবস্থা খুবই খারাপ। দিনান্তে একটাও বিক্রি নেই। চাপা ভয় ও উত্তেজনায় নিতাইকাকার শরীর দিন দিন খারাপ হতে থাকে। নিজেই একদিন অজিতে হাত ধরে বললেন, - ”অজিত, আমি চলে গেলে কাজলের তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই আমি থাকতে থাকতে তোমাদের বিয়ে দিয়ে যেতে চাই। মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে অন্তত শান্তিতে মরতে পারবো।”
নিতাইকাকার কথায় অজিত রাজি হয়ে যায়। এমনিতেই সে কাজলকে খুব ভালোবাসে। আর কাজলও তাকে চোখে হারায়। তাই একদিন সকাল সকাল মন্দিরে গিয়ে নিতাইকাকা দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। সারাদিন খুব আনন্দে আর হাসিতে মেতে ছিল নিতাইকাকা। তাকে এতো খুশি এর আগে কেও কখনো দেখেনি । কিন্তু রাত পেরোতেই তার নিষ্প্রাণ দেহ অজিতকে দ্বিতীয়বার অনাথ করে। নিজের জীবনে পর পর দুটো ধাক্কা কাজল কিভাবে সামলাবে বুঝে উঠতে পারলোনা। নিষ্প্রাণ দেহেও বাবার মুখে লেগে থাকা গতকালের হাসির দাগ কাজল নিজের কান্নায় ভিজিয়ে দেতে চায় না। তাই বারবার শুধু অতীতের কথা বলে নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
বাবার মৃত্যুর পর অজিতের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল কাজল। অনেকদিনই সকালে সে অজিতকে খুঁজে পায় তার নিজের গড়া মাটির ঘরের মেঝেতে জল-কাদা মাখা ঘুমন্ত অবস্থায়। কাজল জানতে চাইলে শুধু হাসে আর বলে, - ”কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে বহুদূর? মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।”
পর্ব: ৮
রিপন ও তার চার বন্ধুর দল বেঁধে শিকার করার কথা অনেকেই জেনে গেছে কিন্তু প্রমাণের অভাবের সাথে তাদের টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে সব সময়ই আইনের জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। কাজল তাদের প্রথম শিকার ছিল। প্রথমবারেই প্রত্যক্ষদর্শী থাকা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র আঁচ না আসার কারণে তাদের সাহস আরো বেড়ে যায়। বছর দুয়েকের মধ্যেই এমন ঘটনার পুনরাবর্তন বেশ কয়েকবার হয় আর প্রতিবারেই তারা অধরা থেকে যায়। তাদের চোখে লেগে থাকা রক্ত-মাংসের নেশা ও চলনে শিকারীর ভঙ্গি শিশু থেকে বৃদ্ধা সবারই মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তাই তারা দল বেঁধে বা একা যে কোনো পরিস্থিতিতে লোকসমাজের সামনে এলে সবাই তাদেরকে এড়িয়ে চলে। এমনকি মেয়েরা স্কুলে বা টিউশনিতে গেলে বাড়ির কোনো বড় মানুষ তাদের সাথে থাকতেই হবে এটাই এখন অলিখিত নিয়মের মধ্যে পড়ে গেছে। মেয়েদের বাড়ির বাইরে একা ছেড়ে দেওয়ার আরেক অর্থ নরখাদকের দলকে নিমন্ত্রণ পাঠানো তাদের পিপাসা নিবৃত্তি করার।
শিকারীদের শিকারের তালিকায় যাদের নাম উঠেছে তাদের জন্য সবার চোখেই আছে সহানুভূতি আর মনের ভিতরে একরাশ ভীতি। কিছুটা ভীতি কাটানোর জন্য গ্রামের প্রতিটা ঘর থেকেই দু-একটা করে ধারালো বা ছুঁচালো অস্ত্র তৈরীর অর্ডার অজিতের কাছে খুবই গোপনে আসতে লাগলো। বাড়ির মেয়েদের হাতে সব সময়ের জন্য এই অস্ত্র থাকবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুলিশ যেখানে নেতাদের ইশারায় নাচা কাঠের পুতুল সেখানে প্রতিটা বাড়ির ভিতরে এক বিদ্রোহী মনোভাবের জন্ম নেওয়াটা এতটুকুও অস্বাভাবিক নয়। আর তাদের হাতেই পেনের মতো দেখতে অথচ ঢাকনা খুললেই তিনটে সূক্ষ্ম ধারালো ফলা জ্বল জ্বল করে ওঠা অস্ত্র তুলে দিচ্ছে অজিত। সে অস্ত্র হাতে নিয়ে মনের মাঝে একটু সাহস এলেও ভীতি সম্পূর্ণ রূপে কাটে না, তা অজিত খুব ভালোভাবেই জানতো। দিনে দিনে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে, গ্রামে শিকারের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে, মনের আগুণ দাউ দাউ করে জ্বলে গগনচুম্বী শিখা উঠবে, তবু ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে থাকা ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে আর বেশী কিছু আশা করা যায় না।
অজিত মনে মনে ভাবল, - ”শিকারীদের শিকার এখন ভীত। সেই আনন্দে শিকারীও আত্মসন্তুষ্টিতে নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে চোখ বন্ধ করবে। শিকারীকে শিকার করার এর থেকে ভালো সময় আর হতে পারে না।” নিজের মনেই একটু হেসে হাপরে টান দিল। পরক্ষণেই তার কপালে রেখা ফুটে মনের মাঝে দুশ্চিন্তার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল-”কিন্তু শুরু হবে কিভাবে? শিকারীদের আলাদা করবে কি ভাবে? একসাথে থাকলে তাদের ধরা যাবে না। বরং নিজেই শিকার হয়ে যেতে পারে।”
ভাবতে ভাবতে কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে তা অজিত লক্ষ্য করেনি। দোকানের ভিতরের আলোটা পর্যন্ত জ্বালতে সে ভুলে গেছে। হাপরের লাল আগুনেই দোকানের ভিতরটা লাল হয়ে উঠেছে। এমন সময় দোকানের ঝাঁপে সশব্দে চাপড় মেরে এক অর্ধমাতাল কণ্ঠ ধমকের সুরে বলে উঠল, - ”এই অজিত, তুই নাকি সবাইকে পেনের মধ্যে ছুরি বানিয়ে দিচ্ছিস? ভেবেছিস কি আমরা কোনো খবর পাবো না? হারামজাদা! মেয়েগুলো মারা গেলে তোকেই জেলে পাঠাবো দেখিস।”
অজিত হাপর ছেড়ে উঠে এলো। আগুণের লাল আঁচেই চিনল বাপ্পাকে। গলায় তার মোটা পুরু সোনার চেন। সেটা গলা থেকে খুলে নিয়ে বলল, - ”এই সোনার লোভে কত মেয়ে লটকে যায় জানিস? তোর লোহার থেকে হাজার গুনে দামী আমার এই সোনা। তোর এই অস্ত্র তৈরী আজই বন্ধ কর। নাহলে তোর এই দোকান আর কাল সকাল দেখবে না।”
অজিত নিজের মনেই একটু ভাবল। তার কপালের ভাঁজের গভীরতা একটু একটু করে কমে জানান দিল দুশ্চিন্তার অবসান আসন্ন। ঠোঁটের মাঝে বাঁকা হাসি এনে বলল, - ”দোকান ভাঙা তোর একার কর্ম নয়। পারলে তোদের বাকি মাথাগুলোকেও ডাক।”
নিজের পকেট থেকে তাড়াতাড়ি স্মার্টফোনটা বের করে সে মঙ্গলকে কল লাগালো। ফোন লাগানোর সাথে সাথে অজিত কাল বিলম্ব না করে একটা ভারি লোহার হাতল দিয়ে সপাটে বাপ্পার মাথার পিছনে মারল। বাপ্পা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ফোনটা তাড়াতাড়ি করে তুলে নিয়ে দেখল তখনও মঙ্গল ফোন তোলেনি। আরও বার দুই রিং হওয়ার পর মঙ্গল ফোনটা তুলতেই অজিত একেবারে মুখের কাছে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলল, - ”তাড়াতাড়ি পাঁচ কান না করে চলে আয় অজিত কামারের দোকানে। খাবার একেবারে গরম। তাড়াতাড়ি।” ফোনটা কেটে অজিত ফোনের শব্দ বন্ধ করে কিছু গান চালিয়ে রাখলো যাতে সেটা লক না হয়ে যায়।
হাপরের কাছে যেখানে সে বসে, সেই জায়গা থেকে টুল ও বস্তা সরিয়ে ফেলল। ম্যানহোলের ঢাকনার মতো একটা ঢাকনা সেখানে একেবারে মেঝের সাথে মিশে আছে। সেটা তুলতেই একটা গর্ত বেরিয়ে পড়ল। বাপ্পার জ্ঞান হীন দেহটা সেই গর্ত দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে একটা মই বেয়ে নিজে নেমে এলো। হাতের আন্দাজে একটা ছোটো আলো জ্বালতেই নিচের অন্ধকার সরে একটা বেশ বড় গোল ঘরের মতো দেখা গেল। মেঝেতে দাঁড়িয়ে ঘরের ছাদে হাত পাওয়া যায়। ঘরে এই একটা আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। ঘরের মাঝে একটা লোহার মোটা দন্ড মেঝে থেকে একেবারে ছাদ পর্যন্ত ঠেকেছে। তাকে কেন্দ্র করে একটা গোল লোহার বেদী। ঘরের অন্য প্রান্তে দেওয়ালে একটা মাঝারি আকারের গর্ত দেখা যাচ্ছে। তবে সেই গর্তের মুখ একটা বড় ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা। তার পাশেই একটা খুব ছোটো আকারের টেবিল। তার উপর রাখা টেপ ও দড়ি নিয়ে খুব ক্ষিপ্রতার সাথে অজিত বাপ্পাকে লোহার দন্ডের সাথে ভাল করে বেঁধে ফেলল যাতে জ্ঞান ফেরার পরে কোনো শব্দ বা নড়া-চড়া করতে না পারে। বাপ্পার ফোনে বাজতে থাকা গান হালকা হালকা তার কানে আসছে। আলো বন্ধ করে উপরে উঠে এসে গর্তের মুখটা আবার আগের মতো চাপা দিয়ে দিল। প্রায় দশ মিনিট অন্ধকার দোকানে চুপ করে বসে থাকার পর বাইরে জুতোর আওয়াজ পেল। তা শুনে লোহার হাতলটা নিয়ে দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একেবারে দেওয়াল ঘেঁসে নিজেকে অন্ধকারে আড়াল করল। মঙ্গল দোকানের সামনে এসে একটু ইতস্তত করে দোকানের পর্দা সরিয়ে মুখ ঢুকিয়ে বাপ্পা বলে ডাকল। একটা হাত পিছন থেকে তার কাঁধ ছুঁয়ে বলল, - ”বাপ্পা এদিকে।” মঙ্গল পিছন ঘুরতে যাবে তখনই অজিত তার মাথা লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করল। মাটিতে ঢলে পরার আগেই তাকে ধরে নিয়ে বাপ্পার পাশে তার মতোই বেঁধে রাখলো। বাপ্পার ফোনে গান থামিয়ে অমিতকে একই ভাবে ফোন করে ডেকে নিল নিজের দোকানে। কিন্তু বিপদ বাঁধল যখন দূর থেকে অমিত আর সজল দু-জনকে একসাথে দোকানের দিকে আসতে দেখলো। দু-জনের হাতে ফোন জ্বলছে আর এদিকে বাপ্পা ও মঙ্গলের ফোনে মাঝে মাঝেই রিং বাজছে। মঙ্গলের ফোনটা বার দুই রিং হওয়ার পর অজিত সেটা তুলে ফিসফিস করে গালি দিয়ে বলল, - ”এমন জ্বালাস কেন বার বার কল করে? চুপচাপ আসতে না পারলে ভোগ পাবি না।” বাপ্পার ফোন না ধরে কেটে দিয়ে বলল,-”বাপ্পা চেটে পুটে খাচ্ছে। তোরা আয় তাড়াতাড়ি না হলে সব শেষ করে দেবে।”
দোকানের বাইরে বেরিয়ে অজিত দেখল, দুই ছায়ামূর্তি একেবারে তার দোকানের কাছে চলে এসেছে। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে পিছনের দরজাটা খুলে রেখেই সামনের দরজার দিকে এগোতে থাকল। অন্ধকারে কথা শুনতে পেল, - ”সজল, তুই বাইরে দাঁড়া। আমি একবার দেখে আসি।”
কথাটা শুনেই অজিত তাড়াতাড়ি পিছন দিয়ে দোকানের ভিতর এসে গা ঢাকা দিল। অমিত অন্ধকারের মধ্যে ফোন জ্বেলে দোকানের ভিতর ফেলতেই দেখল পিছনের দরজা খোলা। কিছু না ভেবেই অমিত সেই দরজা দিয়ে দোকানের বাইরে পা দিতেই তার মাথায় আঘাত করল। কিন্তু তা ফসকে গিয়ে অমিতের কাঁধে লেগে ফোনটা ছিটকে যায়। অজিত কোনো দিকে না তাকিয়ে পর পর বার কয়েক লোহার হাতলটা চালায় অমিতের মাথা লক্ষ্য কর। শব্দ পেয়ে সজল দোকানের ভিতর ঢুকে পড়ে ফোনের আলো জ্বেলে। অজিতকে ওই অবস্থায় দেখে একেবারে হকচকিয়ে যায়। অজিতের মাথায় তখন মৃত্যুর নেশা। সজল কি করবে ভেবে ওঠার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর একেবারে শিকারী বাঘের মতো। নিমেষের মধ্যে সে সজলকে কাবু করে ফেলে। তারপর সজল ও অমিতকে একই ভাবে মাটির নীচের ঘরে বেঁধে ফেলে। নীচের ঘরের আলো নিভিয়ে অজিত সবে মই বেয়ে উপরে উঠবে তখনই সে শুনলো রিপনের গলা। সজল ও অমিতের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একটা ক্ষীণ আলো সেই গর্তের দিকে এগিয়ে আসছে। অজিত তাড়াতাড়ি নেমে মইয়ের পাশে সরে গেল যাতে গর্তের উপর থেকে তাকে না দেখা যায়। আলোটা সরাসরি গর্তের উপর আসার আগেই সে চাপা গলায় বলে উঠল, - ”কামন, লেটস্ এনজয় হার হোল নাইট।”
কথাটা বলার সাথে সাথে অজিত দেখল আলোটা বন্ধ হয়ে পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। শিকার যখন নিজেই ফাঁদে এসে ধরা দেয় তখন শিকারীকে বেশী কষ্ট করতে হয়ে না। প্রথমে রিপনের কোমরে ও পায়ে তারপর পিঠে লোহার হাতল দিয়ে মেরে বাকিদের সাথে বেঁধে রাখতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। সবার ফোন সংগ্রহ করে বন্ধ করে দোকানের এক কোণে অন্য লোহার জিনিস মাঝে প্যাকেটে মুড়ে রেখে দিল। তারপর আলো জ্বেলে দোকান একেবারে আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গেল। একটা আংশিক তৃপ্তির হাসি তার মুখে এসেও চিন্তার ভাঁজে তা আড়াল হয়ে গেল। বাঘেদের রাজা যে এখনও অধরা।
পর্ব: ৯
পরদিন অজিত অনেকটা সময় ধরে নিজের মনের মতো লোহা পিটিয়ে একটা ছুরির ফলা তৈরী করল। বাকি সব কাজ ফেলে রেখে সে সারাদিন ধরে ছুরিটায় শান দিয়ে একেবারে আয়নার মতো চকচকে করে ফেলল। ছুরির ধরার জায়গায় নিজের বানানো একটা লোহার হাতল লাগিয়ে তার পূর্ণতা দিল। বাড়ি ফেরার সময় সেটা নিজের সাথে নিয়ে আসে কিছু কারুকার্য করার জন্য। পরদিন সকালে সে ছুরিটা একটা সুন্দর কাঠের বাক্সে রেখে অন্য কাজে হাত দেয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে কাজলের উপস্থিতি ও চোখরাঙানিতে বাধ্য হয়ে ছুরির কথা প্রকাশ করে ও বলে, - ”এটার কাজ এখনও কিছুটা বাকি আছে। তোমার জন্মদিনে এটা উপহার দেব। ততদিনে এটার কাজও শেষ হয়ে যাবে।”
প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় ছুরিটা সে বাড়ি আনে। সমস্ত বাহ্যিক কারুকার্য শেষ করে ফলার একদিকে সেই পাঁচ ছেলের নাম খুব শৌখিন ভাবে লেখে যারা এখন তার দোকানের নীচে বন্দী। ফলার গোড়ার দিকে বিকাশবাবুর নামটা লিখতে গিয়ে থেমে যায়। খুব অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করে কতক্ষণ তার ঠিক ছিল না। অন্যান্য দিনের থেকে আজ অনেক রাত করে সে কাজলের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পরদিন সন্ধ্যায় অজিত রিপনকে দিয়ে তার ফোন খুলে বিকাশবাবুকে হোয়াটস্যাপে মেসেজ করে একটা পুরানো পাহাড়-জঙ্গলের ছবির সাথে। মেসেজের বয়ান অনুযায়ী তার হাতে মাত্র দিন পনেরো সময় আছে। কিন্তু এতোদিন অপেক্ষা করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। এদিকে কাজলের জন্মদিনও মাত্র চার দিন বাকি। তাই আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই তাকে সব কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। তাই এই কটা দিন বিকালের পর থেকে সে বিকাশবাবুর ছায়াসঙ্গী হয়। নানান কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে সে দোকান বন্ধ রেখে হাটে বাজারে একটা ভ্যান ও তার উপর চাপানো একটা বস্তা নিয়ে ঘুরতে থাকে। দু-দিনেই সে বুঝে যায় যে বিকাশবাবু রোজ সন্ধ্যার দিকে মোটামুটি ফাঁকা থাকেন। পার্টি অফিসের কাজ সেরে একাই একটু বাজারের দিকে আসেন তারপর অনেকটা সময় মোড় মাথার চায়ের দোকানে আড্ডা দেন। ঠিক সাড়ে ন’টা নাগাদ গাড়ি আসে তাঁকে নিতে।
পরদিন সন্ধ্যায় সে এক নজর বাজারে এসে দেখে নেয় যে বিকাশবাবু জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। ঠিক সাড়ে ন’টা বাজতেই দূর থেকে বিকাশবাবুর সাদা গাড়িটা আসতে দেখে অজিত রিপনের ফোন থেকে তাঁকে মেসেজ করল - ’গাড়িটা বাড়ি পাঠিয়ে দাও। তোমার সাথে একটু কথা আছে। দাদুকে কি সত্যি সত্যি অজিতের বাবা মেরেছিল?’
নিজের ফোনের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি সেটা দেখে বিকাশবাবু হকচকিয়ে গেলেন। কিছু ভেবে ওঠার আগেই আরো একটা মেসেজ এলো, ’কাউকে জানিও না। জানালে তুমিই ফেঁসে যাবে।’
নিজের ছেলের কাছ থেকে এমন অসময়ে এইসব মেসেজ দেখে তিনি খুব অস্থির হয়ে গেলেন। ড্রাইভার কাছে এসে ডাকতেই তাকে ধমক দিয়ে বললেন, - ”তোর কি সারাদিন কাজ নেই নাকিরে? সারাক্ষণ বাবু চলুন বাবু চলুন করে যাচ্ছিস। যা তুই বাড়ি যা। আমি আজ হেঁটেই ফিরবো।”
বাবুর ধমক খেয়ে ড্রাইভার পিছু ফিরতেই বিকাশবাবু তাড়াতাড়ি করে রিপনকে মেসেজ করে বললেন,-”তুমি না জলদাপাড়া ঘুরতে গেছো। নাকি তুমি আমায় মিথ্যা বলে অন্য কোথাও গেছো?”
সঙ্গে সঙ্গে সেই মেসেজের উত্তর এলো বিকাশবাবুর ফোনে। তাতে লেখা, - ’পুকুরের পাশের বড় রাস্তার ধারে চলে এসো তাড়াতাড়ি। সেখানে সব কথা হবে।’
ছেলের থেকে এমন উদ্ধত ও বিরক্তপূর্ণ কথা বিকাশবাবু এর আগে কখনো শোনেননি। উত্তেজিত হয়ে তিনি মেসেজের লেখা মতো বড় রাস্তার দিকে একাই হাঁটাতে লাগলেন। বারবার তিনি মেসেজগুলো পড়তে কিছু বোঝার চেষ্টা করতে থাকেন। রাস্তার কাছে এসে তিনি কোনো জনমানব দেখতে পেলেন না। শুধু কিছু ছোটো ও বড় গাড়ি বড় রাস্তা দিয়ে হুস্ হুস্ শব্দে চলে যাচ্ছে। কাউকে না দেখতে পেয়ে তিনি বাধ্য হয়ে রিপনের ফোনে কল করলেন। কানে লাগিয়ে রিং হওয়ার শব্দ শুনতে পেলেন। ফোনটা কান থেকে একটু দূরে সরিয়ে ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন খুব মৃদু একটা শব্দ কানে ভেসে আসছে। কাছে পিঠে কোথাও ফোন বাজছে। ফোন নিজে থেকে কেটে যেতে বাইরের শব্দটাও যেন থেমে গেল। তিনি আবার কল করলেন। এবার বাইরের শব্দটা অনুসরণ করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকলেন। যত এগোচ্ছেন শব্দটা আরো জোরালো হতে থাকল। একটা সময় তিনি একেবারে শব্দের উৎসের কাছে এসে দেখলেন ফোনটা মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ফোনের আলো চার দিক থেকে আবছা ভাবে বেরিয়ে আসছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি বড় রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা বাঁশ বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। নীচু হয়ে ফোনটায় হাত দিতেই শুকনো পাতার উপর খস খস শব্দ পেলেন। ফোনটা হাতে নিয়ে পিছন ঘুরতেই তিনি মাথায় অনুভব করলেন এক প্রবল আঘাত। নিমেষের মধ্যে চোখের সামনে সব কিছু ঘোলা হয়ে সেখানেই পড়ে গেলেন।
অজিত কাল বিলম্ব না করে টেপ দিয়ে বিকাশবাবুর হাত পা ও মুখ বেঁধে দিল। তারপর বস্তা থেকে শুকনো পাতাগুলো ফেলে বিকাশবাবুকে বস্তায় পুরে টানতে টানতে বাঁশ বাগানের বাইরে এনে সেটা ভ্যানের উপর তুলল। বিকাশবাবু ও রিপনের ফোন কুড়িয়ে নিয়ে বাকি ফোনগুলো অন করে ফেলল। তারপর ভ্যান নিয়ে বড় রাস্তার ধার ধরে চলতে থাকল। ফোনগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাল বোঝাই করা কোনো লরি বা টেম্পো দেখলেই এক একটা ফোন ধরে সেই গাড়ির উপর ছুঁড়ে দিল। গ্রামের রাস্তা ধরার আগেই সে ফোন মুক্ত হল। গ্রামের লোক এর আগেও অজিতকে ভ্যানে করে বস্তায় জিনিস বেঁধে আনতে ও নিয়ে যেতে দেখেছে। তাই এতোটা রাতে তাকে বস্তা সহ ভ্যান নিয়ে ফিরতে দেখে কারোরই মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ হল না যে সেই বস্তায় লোহার জিনিসের বদলে সাক্ষাৎ বিকাশবাবু অবচেতন হয়ে আছেন। দোকানে ফিরে বিকাশবাবুরও স্থান হল সেই মাটির নীচের ঘরে। বাকি পাঁচ জনের তখন জ্ঞান একেবারে সতেজ। তবে তাদের চোখের তারা ছাড়া আর কোনো কিছুই নাড়ানোর সাধ্য নেই। নিজের বাবাকে দেখে রিপন আঁতকে উঠল। একটা গুমোট শব্দ তার ভিতর থেকে ভেসে এলো। এর বেশী কিছু তার আর করার রইল না। বিকাশবাবুকে একেবারে রিপনের ডান পাশে বসিয়ে একই ভাবে বেঁধে দিল। অজিতের চলে যাওয়ার সময় সবাই খুব চেষ্টা করল বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার কিন্তু আলো নিভে যেতেই তাদের সমস্ত চেষ্টা আবার থেমে গেল। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার পৌনে এগারোটা হয়ে গেল। দেরি করে অজিতকে আসতে দেখে কাজল রেগে বলল, - ”কি এমন রাজকার্য করে এলে যে এতো রাত হল?”
অজিত শান্ত ভাবে ”খাবার দেওয়া শুরু করো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।” - বলে নিজের বাড়িতে ঢুকে গেল। কাজল বিরক্ত হয়ে বলল , - ”আবার ওদিকে কেন? খেয়ে নিয়ে বসলে হতো না?”
অজিত কোনো উত্তর না করে ঘরের দরজা বন্ধ করল। ছুরিটার গোড়ায় বড় বড় করে লিখে ফেলল বিকাশবাবুর নাম। তারপর ছুরিটা বাক্সবন্দী করে খেতে চলে এলো।
খেতে খেতে বেশ অনেকটা দেরি হল। খাওয়ার পর কাজল বাসন গুছিয়ে ঘরে আসতে আসতে ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বাজল। অজিত খেয়ে উঠেই বাক্স সমেত ছুরিটা নিয়ে এসেছিল। কাজল ঘরে আসতেই তার হাতে দিয়ে বলল,-”শুভ জন্মদিন।”
উৎফুল্ল হয়ে কাজল বলল, - ”এটা নিশ্চয়ই সেই ছুরিটা।”
অজিত হেসে বলল, - ”হুম্। সেই ছুরিটাই। খুলে দেখ একটু।”
কাজল বাক্সটা খুলতে খুলতে বলল, - ”আজ আসতে দেরি করছিলে বলে মনে হচ্ছিল তুমি হয়তো ভুলে গেছো।”
বাক্স খুলে ছুরি দেখে কাজল অবাক হয়ে গেল। এতো সুন্দর হাতল যুক্ত লম্বা ও সরু ফলার এমন চকচকে ছুরি এর আগে সে কখনো দেখেনি। ফলার উপর মাঝখানে একটা হালকা চেরা দাগ একেবারে ছুরির গোড়া থেকে ডগায় এসে মিলিয়ে গেছে। বাক্সটা টেবিলের উপর রেখে হাতল ধরে ছুরিটা তুলে ধরে। ফলার এই পিঠে মাঝের দাগ ছাড়া আর কিছু নেই কিন্তু অন্য পিঠ ঘোরাতেই নাম গুলো তার চোখে ধরা দিল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতেই সে তার পুরানো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অজিতের দিকে। অজিত ক্ষণিকের জন্য চুপ করে থেকে বলল, - ”চল, আজ নতুন ভাবে জীবন শুরু করা যাক পুরানো জীবনকে কেটে বাদ দিয়ে।”
অবাক হয়ে কাজল বলল, - ”কি ভাবে শুনি? আমি কিন্তু এই ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না।”
অজিত মুখে কিছু না বলে কাজলের হাত ধরে নিজের ঘরের একেবারে মাঝখানে নিয়ে এলো। টিম টিম করে একটা আলোতে মেঝের উপর থেকে মাদুর সরাতেই একটা ঢাকনা দেখা গেল। সেটা সরাতেই একটা গর্ত ভেসে উঠল। কাজলের চোখে হাজার একটা প্রশ্ন ভিড় করেছে। কাজলের হাত থেকে ছুরি আর টেবিলের উপর রাখা টর্চ নিয়ে সে মই বেয়ে নেমে পড়ল গর্তের ভিতরে। তারপর টর্চ দেখিয়ে কাজলকেও নেমে আসতে বলে। কাজল একটু ইতস্তত করছিল সেখানে নামবে কি না। কাজলের ইতস্ততা দেখে সে টর্চের আলোর সামনে ছুরির ফলার যে দিকে নাম লেখা সেই দিকটা ধরে বলল, - ”যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।”
আলো আধাঁরির মাঝে ছুরির ফলায় প্রতিফলিত আলোতে সে যেন সেই পাঁচ জনের মুখ দেখতে পেল। নিমেষের মধ্যে তার মুখ থেকে প্রশ্ন চিহ্ন উবে গেল। মই বেয়ে নীচে নেমে এসে বলল,-”আমরা কোথায় যাব এখন?”
অজিত গর্তের ভিতরে থেকেই গর্তের মুখের ঢাকনা লাগিয়ে দিতে দিতে শান্ত ভাবে বলল, - ”এতোটা যখন এসেই গেছ তখন আর একটু অপেক্ষা কর যাও। সব দেখতে পাবে।”
অজিত টর্চ জ্বেলে ছুরি হাতে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সেই সুড়ঙ্গ ধরে এগোতে লাগলো। তার পিছন পিছন কাজলও এগিয়ে চলল। প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পর কাজল জিজ্ঞাসা করল, - ” আর কতটা যেতে হবে? হাঁটুতে যে লাগছে হামাগুড়ি দিতে গিয়ে।”
অজিত বলল, - ”প্রায় ত্রিশ বছরের জীবনের রাস্তা আর শেষ দু’বছরে বানানো রাস্তা, অতিক্রম করতে একটু তো সময় লাগবেই।”
পর্ব : ১০
রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। নিবিড় নিস্তব্ধতার মাঝে ঝনঝন করে বেজে উঠল থানার টেলিফোনটা। হন্তদন্ত হয়ে দুলাল ফোনটা ধরার জন্য দৌড়ে এলো। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক উদ্বিগ্ন মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো।
- বড়বাবু আছেন?
- না উনি এতো রাত পর্যন্ত থাকেন না। আপনি কে বলছেন?
- আমি নয়নতারা, বিকাশবাবুর স্ত্রী। এতো রাত হয়ে গেল এখনও তিনি বাড়ি ফেরেন নি। ওনার ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছেন না। ঠিক বুঝতে পারছি না । কোনো দিন এমনটা হয়নি।
- আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আমি বড়বাবুকে এখুনি খবর দিচ্ছি।
- কিছু খবর পেলে জানাবেন।
- অবশ্যই ম্যাডাম।
অন্য দিক থেকে ফোনটা ঠক করে একটা শব্দ করে কেটে গেল।
দুলাল টেলিফোনটা নামিয়ে সাথে সাথে তুলে বড়বাবুর বাড়ির নাম্বার ডায়াল করল। একটু রাত করেই তিনি ঘুমাতে যান। বার চারেক রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে বড়বাবুর গলা শোনা গেল।
- হ্যালো।
- স্যার, দুলাল বলছি স্যার। এখুনি বিকাশবাবুর ওয়াইফ ফোন করে বলল বিকাশবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না।
- দুলাল, তুমি কবে নিজে থেকে কাজে একটু মাথা লাগাবে?
- কেন স্যার?
- পাঁচ জনেরই ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ তুলছে না। হেড কোয়ার্টারে খবর দিয়েছি ফোনের লোকেশন ট্রাক করার জন্য।
- স্যার, আপনি কি করে জানলেন বাকিদের ফোনের কথা।
- দুলাল, শুধু বুদ্ধি নয় পারলে নিজেকেও ডিপ ফ্রিজে ভরে রেখো। বাদ দাও। তোমাকে বলেও কোনো লাভ নেই। তুমি বরং একটা কাজ করো। ফোনের লোকেশন পেয়ে গেলে ফোন গুলো উদ্ধার করার ব্যবস্থা করো। আশা করি সেটা ঠিক মতো করতে পারবে।
- হ্যাঁ স্যার। মানে স্যার…
অপরদিক থেকে ফোনটা আবার ঠক করে শব্দ করে কেটে গেল। দুলাল ফোনটা নামিয়ে রেখে বিরক্ত হয়ে গালি দিয়ে বলল – ”ঢপের ফোন। সবাই কেটে দিতে পারলে বাঁচে। যা আর ফোন করবোও না আর তুলবোও না।”
অনেকটা সময় হামাগুড়ি দিয়ে আসার পর টর্চের আলো সামনের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে অজিত থেমে গেল। পিছন থেকে কাজল বলল, - ”এতক্ষণ হামাগুড়ি দিলাম এবার সামনে কি আছে গো? সাঁতার দিতে হবে না ডিগবাজী?”
অজিত এবারেও কিছু সাড়া করলো না। টর্চ বন্ধ করে সে উবু হয়ে বসল।
কাজল একটু রাগী সুরে বলল, - ”তখন থেকে কত কি জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি একটা কিছুই কি বলার নেই তোমার? আমি কি একাই বকে যাবো?”
সুড়ঙ্গের মুখের ঢাকনা সরিয়ে অজিত বেরিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল সুড়ঙ্গের ভিতরে। অন্ধকারেই হাতে হাত রাখল কাজল। তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তির ভাব কথায় প্রকাশ পেল। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, - ”এ তুমি কোথায় আনলে আমায়? কি অন্ধকার আর এতো ভ্যাপসা গন্ধ কেন?”
অজিত কাজলের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, - ”জীবনের সব থেকে বড় উপহার আজ তোমায় দিতে চলেছি।” কথা গুলো বলেই অজিত ঘরের অন্য দিকে গিয়ে আলোটা জ্বেলে দিল। ক্ষীণ আলো তবু একরাশ অন্ধকারের মাঝে তা একেবারে সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে ঘরের সব অন্ধকার দূর করে দিল। চোখের সামনে বিকাশবাবু, রিপন ও তার সাথীদের হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় দেখে কাজল ভয় পেয়ে একেবারে দেওয়ালের সাথে মিশে গেল। হাত লেগে ছোটো টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাস ঠন্ করে গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। টেবিলের পাশে একেবারে গুটিসুটি মেরে কাজল বসে পড়ল। তার নিষ্পলক চোখ ফুটে বেরিয়ে আসছে আতঙ্কের ছাপ। প্রতিটা নিঃশ্বাস তার ঘন থেকে ঘনতর হয়ে উঠল। বাকশক্তি রোধ তার অনেক আগেই হয়েছে। শুধু অতীতের একটা চাপা আর্তনাদ তার বুক ফেটে গোঙানি হয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরছে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে অজিতের দিকে। টেবিলের উপর রাখা এক খণ্ড কাগজ যত্ন করে প্যাকেটের ভিতরে রাখা। অজিত এগিয়ে এসে তা তুলে নিয়ে একেবারে বিকাশবাবুর সামনে এসে দাঁড়ালো। অল্প আলোতেই ভেসে উঠল সূর্য্যকান্তবাবুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিবরণে ছাপা পরের দিনের খবরের কাগজের অংশ।
-চিনতে পারছিস বিকাশ? সেদিনের ঘটনা মনে পড়ে কিছু? আর এই ছুরিটা? এটা অবিকল এই খবরের কাগজের ছুরিটার মতো শুধু একটু বেশী লম্বা। কিরে বিকাশ চিনতে পারছিস না?
ছুরিটা একেবারে চোখের সামনে ধরে দোলাতে থাকে অজিত। অনেক কিছু বলতে চায় বিকাশবাবু কিন্তু মুখ বাঁধা তাই গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই এলো না। বিকাশবাবুর একেবারে কপালের মাঝে ছুরির ডগা দিয়ে খোঁচাতে লাগল সে। রক্ত ধারা কপাল ছাড়িয়ে নাক বেয়ে ফোঁটা কাটতে শুরু করেছে।
- জানিস বিকাশ, তুই শুধু মাত্র তুই একাই আমাদের জীবন নষ্ট করেছিস। কিন্তু তোর ছেলে কি জানে যে তুই নিজেই তোর বাপ কে খুন করেছিস?
রিপন একবার ক্লান্ত চোখ তুলে নিজের বাবার দিকে তাকালো। প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়ে বিকাশবাবু মাথা নাড়াতে থাকলেন। কিন্তু ছুরি চেপে বসে থাকায় তা কয়েক বারের মধ্যেই থেমে গেল।
- না না। বিকাশবাবু। আমি মিথ্যা বলছি না। আপনি মনে হয় জানেন না, যে ছুরিটা দিয়ে আপনি আপনার বাবাকে খুন করেছেন সেই ছুরিটা নিতাইকাকা মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে আপনার বাবাকে বানিয়ে দিয়েছিল। প্রচণ্ড ধারালো ছুরি। নীরবে বুকের পাঁজরের ফাঁক দিয়ে হৃদপিণ্ড ফুঁড়ে দিতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হয় না। তবে সেই ছুরি আমার বাবা পেল কি করে বলুন তো?
একটু থেমে অজিত কাজলের দিকে তাকালো। কাজল তখনও একই ভাবে টেবিলের পাশে বসে আছে। তবে তার মুখে ভয়ের ছাপ অনেকটা মিলিয়ে এসেছে। সে এক মনে বিকাশবাবুর নাকের ডগায় ফোঁটা কাটা রক্ত বিন্দু দেখছে।
- যদি ধরে নি আমার বাবা সেই ছুরিটা তোর বাড়ি থেকেই পেল তবে কি করে নিখুঁত ভাবে তা একবারেই বুকে ঢুকে গেল? সূর্য্যকান্তবাবু এতোটাও দুর্বল ছিলেন না যে বাধা দিতে পারবেন না।
ছুরিটা কপালের উপর ঘুরিয়ে একটা তারার আকার দিয়েছে। এখন আর একটা নয়, সরু সরু অনেকগুলো রক্তধারা কপাল বেয়ে মুখের উপর এসে পড়েছে। বিকাশবাবুর নিঃশ্বাস এতো জোরে জোরে পড়ছে যে সেই হাওয়ায় কয়েক ফোঁটা রক্ত অজিতের জামায় এসে পড়ছে।
- আমার বাবা তোর বন্ধু ছিল। আর সে বন্ধুর বৌয়ের উপরেই কুনজর দিলি। তারপর সেখানেও থেমে থাকলি না, আমার মাকে হত্যাকারী বানিয়ে দিলি ডান হাতে ছুরি ধরিয়ে। আমাদের পরিবারের উপর তোর নজর ছিল সারাক্ষণ কিন্তু একটু ঘোলাটে হয়ে এসেছিল তোর নজর। আমার মা বাঁহাতি ছিল। আর সেখানে সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করি নি। আর তোর সব কাহিনী নিতাইকাকা আমায় বলে গেছে। কি ক্ষতি করেছিল আমার বাবা-মা বলতে পারিস?
ছুরির ফলা এবার কপালের চামড়া ছাড়িয়ে শক্ত হাড়ের মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। হঠাৎ করে কাজল একেবারে স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠল, - ”এই অজিত, তোমার ছুরিটায় কি ধার নেই নাকি? তখন থেকে দেখছি একটা খুলি ফুটো করতে পারছ না।”
- কি জানি। তুমি একটু দেখবে নাকি ধার আছে কি না?
- কই দাও দেখি।
ক্ষিপ্রতার সাথে কাজল এগিয়ে এসে অজিতের হাত থেকে ছুরি নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বসিয়ে দিল রিপনের থাইয়ের উপরে। নিচের লোহার সাথে ধাক্কা খেয়ে খট করে শব্দ করে ছুরি থেমে গেল।
”না ঠিক আছে তো” - বলে ছুরি তুলে নিয়ে অন্য পা লক্ষ্য করে আবার চালাল। প্রায় বার সাতেক দুটো পায়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে একই রকম ’খট খট’ শব্দ পেয়ে কাজল বলল, - ”না। বেশ ধার আছে তো।”
ছুরিটা অজিতকে দিতে গেলে অজিত অবাক হয়ে বলল, - ”হয়ে গেল এর মধ্যেই?”
কাজল ইতস্তত হয়ে বলল, - ”কেউ কোনো চিৎকার করলো না কেন? আমি এদের চিৎকার শুনতে চাই। এদের মুখ খুলে দাও।”
অজিত কাজলের চোখে চোখ রেখে শান্ত ভাবে বলল, - ”এরা মুখোশধারী। মুখ খুলে দিলে এরা এমনিতেই চিৎকার করবে। কিন্তু তুমি যে চিৎকার শুনতে চাইছো সেটা পাবে তুমি এদের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনিতে। তোমার জন্মদিনে কেক নয় নরখাদক কেটে পালন করবো। মনের সাধে কেটে যাও আর কান পেতে শুনে যাও ওদের হৃদপিণ্ডের চিৎকার।”
কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে অজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে আচমকাই লাফিয়ে উঠল কাজল। ছুরিটা শক্ত করে ধরে ধারালো ফলা রিপনের পাঁজরের উপর লম্বা করে বসালো। তারপর সেটা নিয়ে গোল করে ঘুরে সবার পাঁজর ছুঁয়ে আবার রিপনের কাছে ফিরে এল। এক - দুই – তিন করে কাজল কত বার যে গোল করে ঘুরতে লাগল তার নিজেরই খেয়াল রইলো না। কখনো বুকের উপর কখনো বা পায়ের উপর ছুরি ধরে ঘুরছে। শাণিত ছুরির ধারে জামা-প্যান্ট কেটে রক্তধারা তাদের পরিধানের কাপড়ের রং পাল্টে লাল করে দিল। স্মৃতির চাবুক যখন মাঝে মাঝে কাজলের শিরদাঁড়ায় বিদ্যুতের ঝলক দিল, তৎক্ষণাৎ সে ছুরির সামনে যাকে পেল তার উপর চাবুকের মতো ছুরি চালাতে থাকল। বেশকিছুটা সময় পর কাজলের হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল। নিজের শরীরের উপর ছিটকে আসা রক্তে দু-হাত লাল করে কাজল উপরের দিকে তাকাল। তার সেই দৃষ্টিকে এক হাত উপরে থাকা ছাদ আটকাতে পারেনি। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি তখন তুঙ্গে। দু-চোখে ক্লান্তি তবু অপরিসীম তৃপ্তির হাসি তাকে উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড় করিয়েছে। অতীতের সাথে বর্তমানকে মিলিয়ে সে মাটিতে ঢলে পড়ল। অজিত তাড়াতাড়ি করে কাজলকে ধরে টেবিলের উপর বসিয়ে দিল।
মাটিতে পড়ে থাকা ছুরিটা অজিত তুলে নিয়ে বিকাশবাবুর মুখ লক্ষ্য করে চালায়। মুখের উপর লেগে থাকা টেপ সহ তার ঠোঁটের কিছুটা অংশ কেটে যায়। তারপর সেখান থেকে বিকাশবাবুর মুখের ভিতর থাকা কাপড়ের টুকরো এক টানে বের করে আনে। প্রচণ্ড চিৎকার করার আগেই অজিত বাঁ-হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বলে,-”যতটা আওয়াজ তোর মুখ থেকে বেরোবে ততটাই প্রাণ তোর ছেলের শরীর থেকে বেরোবে।”
বিকাশবাবুর মুখ থেকে হাত সরাতেই একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো। সাথে সাথে অজিতের ছুরি রিপনের কাঁধ লক্ষ্য করে দেহের ভিতরে প্রবেশ করল। বাঁধা অবস্থায় পাশেই তার ছেলেকে অমন ভাবে ছিটকে উঠতে দেখে বিকাশবাবু চিৎকারটা মাঝ পথেই গিলে নিলেন। সেই সাথে এক অখণ্ড নীরবতা নেমে এলো ঘরের মধ্যে। ছুরিটা রিপনের দেহ থেকে বের করে বিকাশবাবুর বাঁ-দিকের পাঁজরের উপর ধরে বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বিকাশবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে কাতর হয়ে বললেন, - ”অজিত, তুমি আমাদের ক্ষমা করো অজিত। আমরা সবাই দোষ স্বীকার করছি। আমাদের ছেড়ে দাও।”
বিকাশবাবুর বুকে গেঁথে থাকা ছুরির উপর হালকা টোকা মেরে অজিত হাসতে হাসতে বলল, - ”এতদিন মনে হল না বিকাশবাবু। আজ অন্তিম সময়ে এসে মনে পড়ছে দোষ করেছেন। এখান থেকে আর যে ফেরা সম্ভব নয়।”
বিকাশবাবু জোর করে লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার মিনতি করে বললেন, - ”এমন কোরো না অজিত। আমি তোমাদের সব ঠিক করে দেব।”
বিকাশবাবুর একেবারে মুখের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে অজিত বলল, - ”কিছু ঠিক করতে পারবেন না। আপনি ভগবান নন।”
বিকাশবাবু কোনো রকমে ঢোক গিলে বললেন, - ”তোমার বাবা দেবতুল্য মানুষ। অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তুমি তার ছেলে তুমিও দেব সন্তান। আমাদের ক্ষমা কোরো।”
”না, আমি কোনো দেব বা দেব সন্তান নই” - বলে চিৎকার করে দু-হাত পিছিয়ে এলো অজিত। দু-হাত উপরে তুলে নিজের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে উদাত্ত কণ্ঠে সে বলল, - ”আমি নরকের রাজ সাক্ষাৎ শয়তান, আমি মড়ার খুলিতে বসে গাই আজানের গান।”
পর মুহূর্তেই আবার নিশ্ছিদ্র নীরবতা। দু-জনের মাঝে ক্ষণিকের দৃষ্টি বিনিময়। এই দৃষ্টিতে ছিল না কোনো মনুষ্য জাতির স্পর্শ। যেন অতীত ঘুরে দাঁড়িয়েছে বর্তমানের সামনে, যেন কর্মের সাথে দেখা হয়েছে তার প্রসূত ফলের। নীরবতা ভঙ্গ করে সজোরে অজিতের পদাঘাতে ছুরির ফলা পাঁজরের মাঝখান দিয়ে হৃদপিণ্ড ভেদ করে লোহার দন্ডে লেগে শব্দ তুলল। বিকাশবাবুর মাথা নত হওয়ার সাথে সেই ঘরে নেমে এলো এক চিরশান্তিময় নীরবতা।
প্রায় ভোর রাতের দিকে সুড়ঙ্গ পথ ধরেই বাড়ি ফেরে দু-জনে। অনেক বেলায় তারা ঘুম থেকে উঠে। তারপর স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিতে যায়। তারা লক্ষ্য করে সারা গ্রাম জুড়ে একটা আলোচনার পরিবেশ। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মন্দিরের চত্বর সব জায়গায় বিকাশবাবুর নিখোঁজের কথা। শুধু কথা নয় কথার সাথে হাজার রকমের খেয়ালি পোলাও রান্না হচ্ছে সর্বত্র। বাজারে ও রাস্তায় পুলিশের আনাগোনা একটু বেড়েছে। এক রাতের মধ্যেই কাজল যেন অনেকটা পাল্টে গেছে। আগের থেকে অনেক বেশী ধীর স্থির শান্ত। মন্দির যাওয়ার পথে সে লক্ষ্য করে অজিত মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছে। পুলিশ দেখলে মাথা নীচু করে নিচ্ছে সে। তার ফেরার পথে অজিত চিন্তিত হয়ে বলে, - ”পুলিশ যে ভাবে লেগেছে যে কোনো দিন সব জানতে পেরে যাবে। আর কয়েক দিনের মধ্যে দোকান থেকে মাংস পচা গন্ধ বেরোলে আর তো রেহাই নেই।”
কাজল শক্ত করে অজিতের হাত চেপে ধরে। খুব শান্ত গলায় বলে, - ”সমস্ত ব্যাপারটার উপর ধামা চাপা দিতে হবে যাতে কেউ কিছু জনতে না পারে।”
তারপর একটু থেকে সে আবার বলে, - ”ধামা চাপা কেন? দিতে হলে মাটি চাপা দাও। তোমার ঘরের ভিতরে মাটি ভর্তি করে রেখেছো। আর দোকানের বাইরে দেওয়ালের গা ঘেঁষে প্রচুর মাটি স্তূপাকার করেছো। দোকান ও ঘর দুটোই ভালো করে সারাবে আর সেই সাথে মাটির তলার সব কিছু মাটি দিয়েই চাপা দিয়ে দেবে।”
কাজলের কথায় অজিত খুব আশ্বস্ত হয়। বাড়ি ফিরে দোকানে আসে। বড় পলিথিন দিয়ে সবাইকে সেই বাঁধা অবস্থায় খুব ভাল ভাবে ঢেকে টেপ মেরে দেয় যাতে পচে গেলেও দুর্গন্ধ না বের হয়। হয়তো তখনও কারোর মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কিন্তু অজিত সেদিকে এতো টুকুও নজর দিল না। সন্ধ্যার পর থেকে সে স্তূপাকার মাটি কেটে ধীরে ধীরে মাটির নীচের ঘরে ফেলতে লাগলো। আর রাতে বাড়ি ফিরে ঘরের মাটি সুড়ঙ্গ পথের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে ফেলা শুরু করে তা বুজিয়ে দিতে শুরু করল।
প্রায় তিন দিন পর পুলিশ সবার ফোন উদ্ধার করেছে। তাদের মেসেজ, লাস্ট কল, কল রেকর্ড, লোকেশন সব কিছু জেনে এটাই নিশ্চিত হল যে শেষ এক সপ্তাহে তারা গ্রামের বাইরে পা রাখেনি। ততদিনে অজিত দোকানের নীচের ঘর ও সুড়ঙ্গ ভরাট করে ফেলেছে। নিজে হাতে দোকানের চারপাশ একেবারে পরিষ্কার করে দেওয়ালে চুন করা ধরেছে। নিজের মাটির বাড়ি পাকা করে দেওয়ার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের সাথে অনেকদিন আগে কথা বলেছিল। ভোট সামনে তাই সেটার কাজও খুব শীঘ্র শুরু হবে। তাই অজিত নিজের মাটির বাড়ি ভেঙে জায়গাটা বেশ কিছুটা উঁচু করে নেয়।
বিকাশবাবুর ফোনে আসা রিপনের শেষ মেসেজ দেখে বেশ কয়েকবার পুলিশ অজিতদের ঘরে আসে ও সেই দিনের কাজ কর্ম ও অনেক অতীতে খবর জানতে চায়। কাজলের উপর ধর্ষণ ও তার থেকে প্রতিশোধের কথা উঠলে কাজল কান্নায় ভেঙে পড়ে। অজিত তাকে শান্ত করে পুলিশকে বলে, - ”প্রতিশোধ নেওয়ার হলে তখনই নিতাম বাবু। এতো বছর পর আর সেই দিনগুলো মনে করতে চাই না। আমরা আমাদের মতো করে বেঁচে নিচ্ছি। এইতো কয়েক দিন পর থেকেই আমাদের পাকা ঘর তৈরি হবে। মাথার উপর পাকা ছাদ আসবে। এতেই আমাদের সুখ।” পুলিশ চলে গেলে বারান্দায় অজিত ও কাজল একে অন্যের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। কাজলের চোখের জলের ভিতর দিয়ে একটা আনন্দের হাসি ফুটে এলো। নিঃশ্বাসে তাদের শান্তির হাওয়া। অনেকটা সময় ধরে পুলিশের ফিরে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজিতের বুকে কাজল মাথা রাখল
গল্প
অজানা প্রেম আর
অচেনা দুঃখ
পার্থ বোস
বাঙ্গালুরু
শতদল প্রায় বছর খানেক পর দেশে ফিরেছে। বিগত তিন বছর ধরে সে আমেরিকায় রয়েছে চাকরির কারণে। প্রতি আট ন মাস পর পর বাড়ী আসে। কিন্তু এবার আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বিদেশে থাকলেও তার মাতৃভূমি মালদার এই সুলতানপুর খুব প্রিয়। তাই বাড়ী ফেরার পরদিনই সকাল সকাল বেরিয়ে পরেছে সাইকেল নিয়ে। বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর চির সবুজ প্রকৃতি শতদলকে এক স্বপ্নময় জগতে পৌছে দিয়েছে। মন ভোলানো সবুজ অরণ্য শ্রেণীর মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে শতদল। এত সুন্দর সকালের জন্য মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। কিন্তু ভগবান বোধহয় তার জন্য অন্য কিছুই ভেবে রেখেছিল। শতদল যখন সুন্দর সকালের আমেজে মশগুল ঠিক তখনই অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু সোহমের সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা। বিগত সাত বছরে একবারও কথা হয়নি। সোহম কিন্তু ‘কি ? কেমন আছিস?’ দিয়ে শুরু করল না। শুধু দু-তিন লাইন বলেই চলে গেল।
- জানিস রাজদীপ আর ওর বাবার খুব বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে দু-তিন দিন আগে। ওরা দুজনেই হসপিটালে ভর্তি। পারলে একবার দেখা করিস।
খবরটা শুনে মনে দুঃখ লাগল ঠিকই কিন্তু দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল না। সেই পুরোনো তিক্ততাটা আবার মনে পড়ে গেল। শতদল সোহম রাজদীপ তিনজনই মালদা জেলা স্কুলের ছাত্র। গভীর বন্ধুত্ব ছিল তিনজনের মধ্যে। পড়াশোনায় শতদল তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছিল। শুভম আর রাজদীপও মোটের উপর ভালো হলেও রেজাল্টে শতদলের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারতো না। এই নম্বরের ফারাক তাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কখনও চিড় ধরায় নি। কিন্তু শেষ অবধি চিড় ধরেছিল তবে কারণটা ছিল অন্য।
তখন উচ্চমাধ্যমিক এবং জয়েন-এনট্রান্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। তিনজনে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। একাক দিন একাক জনের বাড়ীতে। প্রত্যেকের পরিবারও নীরবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রশয় দিয়ে চলছিল এই আড্ডার মেহেফিলকে। সেদিন আড্ডা ছিল রাজদীপের বাড়ীতে। রাজদীপের মা হঠাৎ করে আবদার করে বসল – “এই শতদল, আমাদের তপুটাকে একটু অঙ্ক শেখা না। মেয়েটার অঙ্কে একেবারেই মাথা নেই। তুই তো অঙ্কে খুব ভালো। তুই শেখালে খুব ভালো হবে। ওর দাদাকে ও পাত্তাই দেয় না।” সেই শুরু শতদলের জীবনের আরেক অধ্যায়। তপু রাজদীপের একমাত্র বোন। নাইনে পড়ে। প্রথম দিকে শতদল-তপুর অঙ্কের ক্লাস তিন চার দিন বাদে বাদে হত। কিন্তু যত দিন গেল ক্লাসের সংখ্যা বাড়তে লাগল। শেষের দিকে প্রতিদিনই ক্লাস হতে লাগল। কোন দিন সকালে নয়ত কোন দিন বিকালে। ক্লাসে যে শুধু অঙ্ক হত না সেটা বলাই বাহুল্য। অঙ্কের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত নানা বিষয়ে নানা আলোচনা। দেশ-বিদেশের নানা খবর, সিনেমা সিরিয়াল ,ভুত পেট দত্যি দানব কোন কিছুই বাদ যেত না সেই আলোচনায়। তবে এই নিয়ে রাজদীপ বা পরিবারের অন্য কারোর কখনও কোন আপত্তি ছিল না। তপুরও অঙ্কের প্রতি মনোযোগ দিনের দিন বেড়েই চলেছে। তপুর এই পরিবর্তনে বাড়ীর সবাই বেস খুশী। তবে ছাত্রীকে অঙ্ক শেখাতে মাস্টার মশাইকে মাঝে মধ্যেই ঘুস দিতে হত। ভুতের গল্পের প্রতি তপুর ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। শতদলদের বাড়ীতে ছিল এক বিরাট আলমারি ভর্তি নানা গল্পের বই। ফলে মাস্টার মশাইকে সেই আলমারি থেকে বেছে বেছে ভুতের বই নিয়ে যেতে হত – ছাত্রীকে অঙ্কের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখার জন্য। দেখতে দেখতে সময় চলে এলো শতদলদের রেজাল্ট বেরনোর।
ওদের তিন জনের মধ্যে শতদলই আই-আই-টি এন্ট্রান্স এ বসেছিল। শতদলের আশা ছিল সে চান্স পাবে। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছিল না - যদি সে চান্স পায় তবে তাকে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হবে হস্টেলে। তখন এই ক্লাসের কি হবে। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরলে কে কোথায় কি স্টিমে যাবে কেউ জানে না। তখন হয়ত এই তিনজনের নিয়মিত যোগাযোগটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সবাই নিজের নিজের ক্যারিয়ারে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন শতদল আর তপুর এই বন্ধুত্ব কি আর থাকবে ? শতদলের মনটা দুঃখে মুছরে উঠল। শতদল বারবার নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকলো – তবে কি সে তপুকে ভালবেসে ফেলেছে? শতদল জানে না এর উত্তর। কিন্তু এর পর দিন যখন সে পড়ানো শেষ করে ফিরে আসছিল - অন্য দিনের মতো তপু সঙ্গে এসেছিল বাইরের গেট অবধি। সাইকেলে বসার আগে শতদল আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।
- তপু, তোকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি রে। তুই কি আমাকে ভালবাসতে পারবি?
কিন্তু যে উত্তর দেবে সে তখন মুখ-চোখ লজ্জায় লাল করে পিছন ফিরে দৌড়ে ঢুকে গেছে ঘরের মধ্যে। অগত্যা শতদলও বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হল। কিন্তু বাড়ী ফিরে সে এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারছে না। ‘সে এটা কি উচিত করল? খুব বোকা বোকা কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু তপু কি ভালো ভাবে নিলো? যদি সে বাড়ীতে বলে দেয় কি হবে? রাজদীপ কি ভাবে নেবে?’ ঠিক এমন সময় সোহম এসে হাজির। শতদল তাকে অনেক ঠাকুর দেবতার দিব্বি-টিব্বি দেয়াল যাতে সে কাউকে কিছু না বলে। এমন কি রাজদীপকেও না। তারপর তাকে সবিস্তারে জানাল তার মনের যাবতীয় অনুভূতি । সেই সঙ্গে আজ সে কি করে এসেছে সেটাও জানাল। সোহম বিজ্ঞের মতো বলল ‘তপুকে ভালো করে বোঝাতে হবে। আমি ঠিক ফাঁকা পেয়ে ওর সাথে কথা বলব। তুই এসব নিয়ে একদম চিন্তা করিস না। রাজদীপ কিচ্ছু জানতে পারবে না।’ কিন্তু রাজদীপ জানতে পারল। পড়ের দিন খুব সকালে রাজদীপ শতদলের বাড়ীতে চড়াও হল। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওদের উঠানে দাঁড়িয়ে তীব্র চেঁচামেচি শুরু করল। ‘তুই কি ভেবেছিস – তুই পড়াশুনায় ভালো বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস। যা ইচ্ছা তাই করবি। তোকে বিশ্বাস করে বোনটাকে পড়াতে দিলাম। আর তুই এমন বিশ্বাসঘাতকটা করলি। তুই মীরজাফরের থেকে বড় বিশ্বাসঘাতক। তুই আমাদের বাড়ীতে কোন দিন ঢুকবি না।তোর সাথে বন্ধুত্ব চিরজীবনের মতো শেষ।’ ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। যা তার বলা উচিত সেটাও বলল, উচিত নয় এমন কিছুও বলতে ছাড়লো না। শতদলের বাবা মাকেও দুকথা শোনাতে কসুর করে নি।
‘ছেলেকে শুধু ভালো পড়াশুনাই শিখিয়েছেন। মানুষ করতে পারেন নি। ছেলেকে ভালো শিক্ষাদীক্ষা দিন। নয়ত ছেলে পাবলিক প্যাঁদানি খেয়ে মরবে।’ শতদলের বাবা মা তাকে অনেক করে ঘরের মধ্যে আসার কথা বললেও, সে তো আসলই না। বরং চেঁচামেচি করে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করল যা পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে মানসম্মান রাখা দায় হয়ে দাঁড়াল। শতদলের চোখ ফেটে জল আসছিল। লজ্জায় মা-বাবার দিকে তাকাতে পারছিল না। তবু রাজদীপকে হাত ধরে টেনে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করতে গেল। কিন্তু রাজদীপ তার নাকে এমন এক বিরাসিক্কার ঘুসি হাঁকাল যে তার নাক থেকে গলগল করে রক্ত বেরতে লাগল। রক্ত দেখে শতদলের মা আর্তনাদ করে উঠল। রাজদীপও ভয় পেয়ে সেখান থেকে চম্পট দিলো। পরের দিন সোহম সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে এলো এক বইয়ের স্তূপ। এই বইগুলো সে তপুকে পড়তে দিয়েছিল। বইগুলো শক্ত করে দড়ী দিয়ে বেধে পাঠান হয়েছে। সোহম শতদলের পড়ার ঘরের এক কনে বইগুলোকে রেখে বলল ‘তোকে ওদের বাড়ীতে যেতে বারণ করেছে। ভাবিস না আমি কিছু বলেছি। তপুই বলেছে। হয়তো ওর এই ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি।’ শতদল আর কথা বাড়ায় নি। সোহম চলে যায়। সেই শেষ সোহম রাজদীপের সঙ্গে বন্ধুত্ব। এর তিন-চার দিন পর পরই উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হয়। তারও ও সপ্তাহ খানেক পর আই-আই-টির রেজাল্ট বের হয়। শতদলের র্যাঙ্ক ভালো হয়। সে মুম্বাই-আই-আই-টিতে পড়তে চলে যায়। বি-টেকএর চার বছর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। তারপর অন ক্যাম্পাসে চাকরি। চাকরি সূত্রেই আমেরিকা যাওয়া। তাও হয়ে গেল তিন বছর। নিজের পড়ার ঘরে বসে পুরনো দিনের বিশ্রী স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিল শতদলের। ঘরে সেই কোনটার দিকে চোখ পড়তেই দেখল – সোহমের রেখে যাওয়া বইয়ের স্তূপ আজও একই রকম ভাবে শক্ত দড়ি দিয়ে
বাঁধা অবস্থায় আছে। এক পাহাড় ধুলো জমে আছে ওর উপর। সবচেয়ে উপড়ের বইটা ‘শতাব্দীর সেরা ভুতের গল্প’। এটা তপুর সবচেয়ে প্রিয় ছিল। কতো বোকা বোকা গল্প বইটার মধ্যে। কিন্তু পড়তে বেশ লাগত। নিজের মনেই হেসে উঠল শতদল। হঠাৎ করে আজ তারও ঐ বইটাই পড়তে খুব ইচ্ছা করছিল। তাই ধুলোর পাহার ঠেলে বইটা নিয়ে বসল। কিন্তু বইটা খুলতেই বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা রইল না। একটা চিঠি। তপুর লেখা। চিঠিতে লেখা ছিল - শতদলদা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে - তুমি আর আমাদের বাড়ীতে আসতে পারবে না বলে। আমি তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি। কিন্তু তুমি সোহমদাকে এসব বলতে গেলে কেন? ও সব দাদাকে বলে দিয়েছে। বাবা মা দাদা সবাই বলছে আমি যেন তোমার সাথে কখনো কথা না বলি। কাল সকালে আমি রতন স্যারের কাছে পড়তে যাব - তুমি কি পুরনো শিব মন্দির এর পিছনের রাস্তাটায় একটু দাঁড়াবে? অনেক কথা আছে তোমাকে বলার জন্য। প্লিজ এসো কিন্তু আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। চিঠিটা পড়ে শতদল হতবুদ্ধির মতো বসে রইল। বিনা কারণে এই সাতটা বছর বুকের উপর একটা জগদ্দল পাথর নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে সে। বার বার নিজের মনে কষ্ট পেয়েছে এই ভেবে তপু তাকে পছন্দ করতো না, টাও সে তাকে প্রেমর অফার দিয়ে একটা বিরাট পাপ করেছে। এই বিশ্রী স্মৃতির পর থেকে এই সাত বছরে কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্বও করেনি পাছে আবার সে কোন ভুল ভেবে বসে। আজ তার প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছা করছিল। আফসোস হচ্ছিল এই চিঠির কথা যদি সে সেই সময় জানতো, তাহলে সেও পারত রাজদীপের নাক ভাঙতে। তার এখন মনে হচ্ছে এখনই তপুর কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু আবেগের বসে সে আর ভুল করতে চায় না। তাই সে সরাসরি বাড়ি না গিয়ে রাজদীপকে দেখতে গেল হসপিটালে।
দেখা হল রাজদীপের সঙ্গে। হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে রাজদীপ। মাথায় হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। শতদলকে দেখে রাজদীপের মধ্যে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল। শতদলের চোখ এড়ালো না সেটা। শতদল মনে মনে একটু খুশি হল। সে জানতো রাজদীপ কোন চাকরি বাকড়ি পায়নি। বাবার বিজনেসেই ঢুকেছে। তাই রাজদীপের এই লজ্জা পাওয়াটাকে শতদল বেস উপভোগ করল।
রাজদীপ বলল – তুই ও খবর পেয়েছিস? কেমন আছিস? কবে এলি?
- কালই এসেছি। আমার খবর রাখিস দেখছি। ভালো। আমি ভালো আছি। কিন্তু তুই বল এই অ্যাকসিডেন্টটা হল কিভাবে?
রাজদীপের চোখের কোন থেকে জল গড়িয়ে পড়ল, বলল ‘এ আমার পাপের ফল। এক সময় না বুঝে দাদাগিরি ফলিয়েছিলাম না? এগুলো সেই পাপেরই ফল। একদিন তোর নাক ভেঙ্গে ছিলাম। আজ ভগবান আমাদের পুরো পরিবারটাকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে।’
শতদল রজদীপকে বাধা দিয়ে বলল ‘কি সব আবোল তাবোল বলছিস।’
রজদীপ বলল – হ্যাঁরে ঠিকই বলছি। তপু কেমন আছে জিজ্ঞাসা করবি না?
শতদল লজ্জায় লাল হয়ে শুধু মুচকি হাসল।
রাজদীপ কান্না ভেজা গলায় বলল ‘তপু আর নেই রে।’
শতদল চরম বিস্ময় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ‘নেই রে মানে?’
- ‘তপু আজ দু মাস হল আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।‘
শতদল নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বায়ুতে যেন হঠাৎ করে অক্সিজেনের অভাব হয়ে গেছে। তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলা বুজে আসছিল। বুকের মাঝখান থেকে সুনামির মতো একটা কান্না ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। নিজের কান্নাকে যতটা সম্ভব আটকে জিজ্ঞাসা করল
- কি করে হল এসব?
রাজদীপ জল ভরতি চোখ নিয়ে বলতে লাগল – ‘এক কোটিপতিদের ঘরে সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। মাস দশেক আগে। ছেলেদের ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হোটেল আর গেস্ট হাউসের বিজনেস। বিরাট বিরাট কোম্পানির গোটা বছরের বুকিং থাকে এই সব হোটেল আর গেস্ট হাউসে। বিরাট বড় বড় লোকের সাথে ওঠা বসা। কিন্তু ওদের এই ডীল গুলো পেতে ওরা অনেক নোংরামোর আশ্রয় নিত। বাড়ীর বউ মেয়েদের ইউশ করতো এই সব পার্টিদের খুশী করার জন্য। তুই তো জানিস আমার বোনটা যথেষ্ট সাদামাটা। ও ওদের এই সব কুকীর্তিগুলোকে কখনই সাপোর্ট করত না। ওদের বিভিন্ন হাউস পার্টিতে তপুকে খোলামেলা পোশাক পরতে বাধ্য করতো। ড্রিংক করতে বাধ্য করতো। বোন বহুবার নিষেধ করেছে। কিন্তু লাভ হয় নি। উপরন্তু ওর স্বামীর সঙ্গে অশান্তি হয়েছে। আমরা কষ্ট পাবো বলে ও প্রথম প্রথম আমাদের কিছু বলতই না। এরপর একদিন একটা চরমতম ঘটনা ঘটল। একটা পার্টি চলতে চলতে হঠাৎ করে মদ্যপ অবস্থায় ওদের এক ক্লাইন্ট সবার সামনে তপুকে জড়িয়ে ধরে। তপু যত ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে তত জড়িয়ে ধরে। ঐ পাটির মধ্যে এটা যেন একটা মজার ঘটনা ঘটছে চলেছে। পার্টির সমস্ত অতিথিরা এমন কি ওর ভাসুর আর স্বামীও ওদের দেখে হাসতে শুরু করেছে। শেষে তপু কোন রকমে ছাড়িয়ে লোকটার গলায় একটা চড় কসিয়ে দেয়। আর ও ওখান থেকে দৌড়ে ওর নিজের ঘরে ঢুকে যায়। ব্যাস এই নিয়ে ওর স্বামী, ওর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু করে দেয়। এমন কি মারধরও করে। তপু নিরুপায় হয়ে আমাদের কাছে চলে আসে। আমরা সব জানার পর ডিসিশন নি যে ডিভোর্স ফাইল করবো। কিন্তু কিছুদিন পর ওর স্বামী শ্বশুর সব এসে হাতে পায়ে পরতে থাকে। বলে এ রকম ভুল আর হবে না। আমরা ভাবি শুধু সংসারটা ভেঙ্গে কি হবে। আমারাও রাজি হই পুনরায় পাঠাতে। তপু কিন্তু রাজি ছিল না। বলতে গেলে আমরাই এক রকম জোর করে পাঠাই। ইস কি ভুল যে করে ছিলাম। এর ঠিক দু সপ্তাহ পর হঠাৎ একদিন সকালে ফোন আসে তপু নাকি মাঝ রাতে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছে। অথচ ওরা খবর দিচ্ছে সকালে। আমরা যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে ওরা বডি নিয়ে শ্মশানে। ব্যাপারটা আমাদের ভালো লাগল না। আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে এসে ওদের বিরুদ্ধে মার্ডারের এফ-আই-আর করি মালদা থানায়। সেই থেকে কেস চলছে। কিন্তু ওদের অনেক পয়সা, অনেক উপর মহলের সাথে যোগাযোগ। প্রায়ই আমার কাছে, বাবার কাছে হুমকি ফোন আসছে। জানে মেরে দেবে বলছে। এমন অবস্থায় ঠিকঠাক উকিলই পাচ্ছিলাম না। কয়েকজন উকিল আগাম টাকা নিয়েও পরে ফিরিয়ে দিয়েছে। শেষে পান্ডুয়ার কাছে একজন উকিল পেলাম। সেদিন তার বাড়ী থেকে ফিরছিলাম রাস্তায় কয়েক জন আমাদের পিছু নিয়েছিল। দুর থেকে রিভলভার দেখাচ্ছিল। আমি বাইক চালাছিলাম। বাবা পিছনে ছিল। ঐ শয়তানগুলোকে দেখে তাড়াতাড়ি চালাতে গিয়েই টাল খেয়ে মারলাম এক গাছে ধাক্কা। বাবার খুব একটা লাগেনি। তবে আমার মাথা ফেটে গেছে। হাতের আর পায়ের হাড়ও ভেঙ্গেছে। এবার বুঝলি কেন বললাম আমার পাপের ফল।‘
শতদলের চোখ জলে ভর্তি। গলা বুঝে এসেছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তপুর এই পরিণতির জন্য সেও কি দায়ী নয়? সে যদি সত্যি ভালবাসত তবে কি তার উচিত ছিল না এতগুলো বছরের মধ্যে অন্তত একবার ফিরে দেখা। তাহলে আর এটা কিসের ভালবাসা? আর কিসের দাবিতেই বা সে আজ এসেছিল? এই বেদনাটা তার প্রাপ্য। নিজে যতটা সম্ভব সংযত করে সে বলল ‘’কাঁদিস না রাজদীপ। তোর এই যুদ্ধে আমি তোর পাশে আছি সবসময়। আমার এক কলিগের বাবা কলকাতা হাইকোর্টের একজন নাম করা ব্যারিষ্টার। আমি এখনি তার সাথে কথা বলব। আমি তোর কাছে প্রতিদিন আসব। তুই ভাবিস্ না। ঐ শয়তানদের উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে আমিও থামব না।‘
শতদল আর পারছিল না ওখানে থাকতে। তার খুব ইচ্ছা করছিল চেঁচিয়ে কাঁদতে। হসপিটালের কম্পাউন্ডারের বাইরে এসে আর পারলো না নিজেকে সামলাতে - হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল।
ভ্রমণ
ভূস্বর্গ নরওয়েতে
কিছু সময়
শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য
নেদারল্যান্ড
ছোটবেলায় ভূগোল ক্লাসে প্রথম শুনেছিলাম যে পৃথিবীতে কিছু দেশ আছে যেখানে নাকি বছরের কিছুটা সময় সারা রাতেও সূর্যের আলো আকাশে দেখা যায়। অবাক হয়েছিলাম সেইসব নিশীথ সূর্যের দেশের কথা ভেবে। ইউরোপে থাকার দৌলতে গ্রীষ্মের সময়ে অনেক রাত পর্যন্ত দিনের আকাশে আলোর দেখা পাই। হল্যান্ডের আকাশেও জুন-জুলাই মাসে সন্ধ্যে নামে রাত দশটা - সাড়ে দশটা নাগাদ। কিন্তু পুরো রাত দিনের আলো দেখার এই বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হলে নরওয়ের সামারের তুলনা মেলা ভার। এই নিশীথ সূর্যের দেশের অরোরা বোরিয়ালিসের অপূর্ব মেরুজ্যোতির অলৌকিক কিরণছটা দেখতে হলে অবশ্য যেতে হবে শীতকালে। আর তার সাথে পেতে হবে মেঘমুক্ত আকাশ। নরওয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় বর্ণনাতীত। প্রকৃতি এখানে উজাড় করে সাজিয়েছে নিজেকে। এই দেশের চারদিকে ছড়িয়ে আছে নীল-সবুজ রঙে রঙ্গিন দিগন্ত-বিস্তৃত আর স্বচ্ছ বারি ধারায় প্লাবিত অসংখ্য ফিওয়র্ড (fjord), শ্বেতশুভ্র হিমবাহ আবৃত পর্বতমালা, কোথাও আবার ঘন সবুজ বনানী ঘেরা পাহাড়, আর অগুন্তি ঝর্নার দুধসাদা ফল্গুধারা। নরওয়ের চারপাশের সীমানা জুড়ে রয়েছে প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার সামুদ্রিক উপত্যকা, যার থেকে উৎপত্তি হয়েছে এই সব ফিওয়র্ডের। দেশের মধ্যভাগে অনেক জায়গাতেই ফিওয়র্ডের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে রয়েছে খাঁড়া পর্বতমালা। এইসব পর্বত শৃঙ্গ থেকে ফিওয়র্ডের শান্ত স্নিগ্ধ সলিলধারা, চারদিকের কল্লোলিনী শুভ্র জলপ্রপাত আর সবুজের সম্ভারে সজ্জিত প্রকৃতির সেই অপরূপ দৃশ্য সত্যিই নয়নলোভা। তাই শীত গ্রীষ্ম নির্বিশেষে সব ঋতুতেই ভ্রমণ-প্রিয় মানুষের কাছে নরওয়ে দেশটি একইরকম আকর্ষণীয়।
গ্যালারী - ১
কিছু বছর আগে ইস্টারের ছুটিতে তিনদিনের জন্যে পরিবারের সাথে বেড়িয়ে এলাম এই স্ক্যান্ডেনিভিয়ান ভূস্বর্গ নরওয়ে থেকে। নেদারল্যান্ডস থেকে বিমানে দু’ঘণ্টায় মধ্যেই পৌছিয়ে গেলাম নরওয়ের রাজধানী অস্লোর বিমানবন্দরে। অস্লো (Oslo) নরওয়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। ইউরোপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েও নরওয়ে দেশটি তাদের স্বতন্ত্রতা আর নিজস্বতা বজায় রেখেছে। নরওয়ে নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্য - যার অর্থ হল “উত্তরের প্রবেশদ্বার”। দুর্গম মেরুপ্রদেশের অভিযানে যেতে হলে নরওয়ে দেশটি হচ্ছে সেই পথের রাস্তা। নরওয়ের পূর্বপ্রান্তে সীমান্ত জুড়ে আছে রাশিয়া, ফিনল্যান্ড আর সুইডেন। আর পশ্চিমদিক জুড়ে রয়েছে উত্তাল অ্যাটলান্টিক মহাসমুদ্র। শীতপ্রধান দেশ নরওয়েতে বেশীরভাগ জনবসতি গড়ে উঠেছে মূলত এই দেশের দক্ষিণভাগে। তার প্রধান কারণ হল এই দিকের ল্যান্ডস্কেপ অপেক্ষাকৃত সমতল এবং মেক্সিকান গালফ থেকে আসা উষ্ণ বাতাসের প্রভাবে এই অঞ্চলের শীতলতা কিছুটা কম। অস্লো শহরের বুক জুড়ে বয়ে চলেছে মনমোহিনী “অস্লো ফিওয়র্ড” আর শহরের চারদিকে নাতিচ্চ পাহাড়ে ঘেরা সবুজ বনানীর বাহার। অস্লো শহরের স্থাপত্যের সম্ভারও বেশ নজর কাড়ে। এর কয়েকটি উদাহরণ হল অস্লো অপেরা হাউস, অস্লো সিটি হল, স্কি জাম্পিং হিল হলমেলকোলেন, রয়্যাল ক্যাসেল ইত্যাদি।
হোটেলে পৌঁছিয়ে জিনিসপত্র রেখে বেরিয়ে পরলাম অস্লো শহরের প্রাথমিক ইম্প্রেশন পেতে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও বেশ হিমেল পরশ পেলাম রাস্তায় হেঁটে পথ চলতে। এই যাত্রায় আমাদের হাতে সময় কম থাকায় আমরা ঠিক করলাম একদিন পুরোটা সময় অস্লো শহর ও আশপাশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে দেখবো। আর দ্বিতীয় দিন প্যাকেজ ট্যুর নিয়ে দূরের ট্যুরিস্টিক স্পট গুলো দেখতে যাবো। সেই মতো “হপ-অন হপ-অফ” বাস ট্যুর নিয়ে প্রথমেই পুরো অস্লো সিটির একটা পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পেলাম। এই ট্যুরের একটা অংশ ছিল অস্লো ফিওয়র্ডের উপর দিয়ে ফেরিতে করে দুই ঘণ্টার ক্রুজ। খুবই মনোরম এই ক্রুজ যাত্রায় আমরা উপভোগ করলাম ফিওয়র্ডের উপর থেকে অস্লো শহরের স্নিগ্ধ ভিউ আর ফিওয়র্ডের অপরূপ শোভা। এখানে ক্যানুইং, উইন্ড সেলিং, স্পিড বোটিং, প্যারাগ্লাইডিং, উইন্ড সার্ফিং খুবই পপুলার। চারদিকে ছিল অনেক সেলিং বোট। আবার কিছু যাত্রীবাহী ক্রুজ শিপ আর মালবাহী কার্গো শিপও দেখতে পেলাম এই জল-বিহারে।
অস্লো ফিওয়র্ডের উপর দিয়ে ক্রুজে করে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছিয়ে গেলাম ছোট্ট আইল্যান্ড বগডোয়া (Bogdøya)। এখানে রয়েছে বিখ্যাত ম্যারিটাইম মিউজিয়াম যেখানে সযত্নে সাজানো রয়েছে ভাইকিং শিপ, কন-টিকি র্যাফট, পোলার অভিযানে ব্যবহৃত শিপ “ফ্রাম”, আর কিছু পোলার বিয়ারের মডেল, এই সব অভিযানে ব্যবহৃত পোশাক, জুতো, আত্মরক্ষার জন্যে ব্যবহৃত হাতিয়ার ইত্যাদি।
গ্যালারী - ২
উনবিংশ শতাব্দীর নরওয়ের একজন স্বনামধন্য এবং অত্যন্ত সাহসী সমুদ্র-অভিযাত্রী হলেন ফ্রিডফ নানসেন (Fridtjof Nansen)। কথিত আছে যে উনি মাত্র ২৭ বছর বয়সে দুর্গম গ্রিনল্যান্ড পৌঁছিয়ে যান এবং বরফাবৃত গ্রিনল্যান্ডের উপর দিয়ে স্কি করেন (১৮৮৮)। এই অভিযানের ৫ বছরের মধ্যেই উনি পুনরায় আরও এক দুঃসাহসী অভিযানে বের হন তার বিখ্যাত পোলার জাহাজ “ফ্রাম”কে সঙ্গী করে। এইবারে তাঁর লক্ষ্য ছিল সুমেরু বিজয়। এই সব দুঃসাহসিক অভিযানের সব কাহিনীর বর্ণনা আর ছবি পাওয়া যাবে অস্লোর এই ম্যারিটাইম মিউজিয়ামে। তাই অস্লো শহর বেড়াতে আসলে এই মিউজিয়াম দর্শন ভ্রমণ তালিকায় অবশ্যই রাখা যেতে পারে।
এই শহরের সবচেয়ে পপুলার ট্যুরিস্ট স্পট হল ভিজল্যান্ড স্থাপত্য পার্ক। এই পার্কটি সাজানো রয়েছে স্থাপত্যবিদ গুস্তাভ ভিজল্যান্ড (Gustav Vigeland) এর তৈরি অসংখ্য মূর্তির শিল্পকলা দিয়ে। পার্কটিতে রয়েছে শুধুমাত্র ওনারই তৈরি ১৯২ টি স্ট্যাচু। এইখানের স্থাপত্যগুলোর মাধ্যমে মানুষের জীবনের বিভিন্ন সময়ের নানাপ্রকার অভিব্যক্তি আর অনুভূতির প্রকাশ করা হয়েছে। এই পার্কের সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্যটির নাম হল “মনোলিথ”, যেটির উচ্চতা ১৭ মিটার। এই স্তম্ভটি একটি মাত্র অখণ্ড পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। একক এই স্তম্ভটিতেই রয়েছে ১২১ টি মানুষের মূর্তি। ভিজল্যান্ড পার্কের আরও একটি মূর্তি খুবই জনপ্রিয়। সেইটি হল এক ক্ষুব্ধ ছোট্ট বালক (“Angry little boy”) এর মূর্তি। এইটি এই পার্কের ছোট স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
গ্যালারী - ৩
ভিজল্যান্ড পার্কটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে নানারকম মরশুমি বাহারি ফুল, নানা প্রজাতির গাছ, মনলোভা ফোয়ারা আর ছোট ছোট জলাশয় দিয়ে। তাই দিনের আলোয় প্রকৃতির মাঝখানে এইসব আকর্ষণীয় স্থাপত্যশিল্প দেখার জন্যে ভিজল্যান্ড পার্ক এক কথায় অনবদ্য। দিনের বেলায় অস্লো শহর ঘোরার ফাঁকেই বুক করে নিলাম পরের দিনের জন্যে অস্লোর এক প্রসিদ্ধ ট্যুর কোম্পানির দ্বারা পরিচালিত এক দিনের প্যাকেজ “নরওয়ে ইন নাটসেল”। এইটি পুরো এক দিনের জার্নি। সকাল ৬ টা নাগাদ ট্রেন ধরতে হবে, আর ফিরতে ফিরতে সেই গভীর রাত। তাই সারাদিনের অস্লো শহর দর্শন শেষ করেই চটজলদি ডিনার সেরে নিলাম। রাতে হোটেলে ফিরে পরের দিনের ট্রিপের জন্যে অল্প কিছু প্রিপারেশনও সেরে ফেললাম, দেখে নিলাম কি আশা করতে পারি আগামীকালের ট্রিপে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে নরওয়ের লিভিং কস্ট ইউরোপের অন্য জায়গার তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। হোটেল ভাড়া, রেস্টুরেন্টের বিল, ট্র্যাভেল চার্জ সবকিছুরই মূল্য একটু বেশির দিকে বলেই মনে হচ্ছিল। তাই এই এক দিনের প্যাকেজ ট্যুরের দাম দেখে প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ছিলাম। প্রতিটি টিকিটের মূল্য প্রায় ৩৩৫০ নরওয়েজিয়ান ক্রোন, যা ৩০০ ইউরোর সমতুল। তবে, আশায় রইলাম যে পরের দিনের এই যাত্রায় বেশ কিছু অবিস্মরণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্বচক্ষে দেখার সাক্ষী হতে যাচ্ছি।
প্ল্যান মাফিক পরের দিন সকাল সকাল আমরা বেড়িয়ে পরলাম অস্লোর সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে। এই প্যাকেজ ট্যুরে প্রথমে দু’বার ট্রেনে করে যেতে হবে। তারপর শিপে করে ক্রুজ নিয়ে ফিওয়র্ড এর উপর দিয়ে যেতে হবে অন্য স্থানে। আর যাত্রার অন্তিম ভাগে যেতে হবে বাসে করে পর্বতের উপর দিয়ে। গন্তব্য থেকে ফেরত যাত্রা অবশ্য পুরোটাই ট্রেনে করে। এই প্যাকেজ ট্যুরটি আবার দু’ভাবে করা যেতে পারে। এক দিনের মধ্যেই অস্লোতে ফিরে আসতে হলে ভস (Vos) শহর পর্যন্তই যাওয়া সম্ভব। নতুবা ভস শহরে রাত্রিবাস করে পরেরদিন নরওয়ের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের শহর বারগেন (Bergen) পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় আমরা ভস পর্যন্ত যাবারই সিদ্ধান্ত নিলাম। সেইমতো সকাল সাড়ে ছটায় অস্লো থেকে ট্রেনে চেপে আমরা পৌঁছিয়ে গেলাম মিরডাল (Myrdal)। মিরডাল থেকে দ্বিতীয় ট্রেন নিতে হল। এইটি স্পেশাল কগ ট্রেন, যেটি পাহাড়ি রাস্তায় চলার জন্যে বিশেষ ভাবে তৈরি। এই ট্রেন আমাদের পৌঁছিয়ে দিল ফ্লাম (Flam) শহরে। এই ট্রেন যাত্রায় রাস্তায় পড়লো অসংখ্য পাহাড়ি টানেল। পুরো জার্নিতে ট্রেন থামলো বেশ কয়েকটি জায়গায়, যাতে যাত্রীরা যথেষ্ট সুযোগ পায় এই অপূর্ব সুন্দর ন্যাচারাল বিউটি একেবারে সামনে থেকে উপভোগ করতে, আর তার মনমোহিনী রূপকে ক্যামেরা বন্দী করতে। এই রেল ভ্রমণে দুচোখ ভরে রাস্তায় দেখলাম অসংখ্য ফিওয়র্ড, অগুন্তি জলপ্রপাত, গ্লেসিয়ারে ঢাকা অনুচ্চ পাহাড়। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট ভিলেজ, আর চিরসবুজ বনানীর সম্ভার। দেখে মন শুধু উৎফুল্লই হয় না, সাময়িক ভাবে দূর হয়ে যায় জীবনের সব স্ট্রেস। মুগ্ধ হয়ে গেলাম দেখে যে বিশ্ব বিধাতার এই অতি মনোরম সৃষ্টি নরওয়ের মানুষ কেমন সুন্দরভাবে অতি যত্নের সাথে রক্ষা করে চলেছে। এই খানে প্রকৃতি সুন্দরী এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য। মানুষের কৃত্রিমতার ছোঁয়া এখনো তাকে তেমন ভাবে স্পর্শ করে নি।
গ্যালারী - ৪
প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার ট্রেন জার্নির পরে আমরা পৌঁছলাম ফ্লাম শহরে। এইখানে অপেক্ষা করেছিলো ক্রুজ শিপ। প্রায় এক ঘন্টার জলবিহারে আমরা পৌঁছলাম গুডভাঙ্গেন (Gudvangen) শহরে। চারদিকের স্নিগ্ধ ফিওয়র্ডের শান্ত জলরাশি, তার মাঝে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে চঞ্চলা চপলা ঝর্নার বারিধারা, মাঝে মধ্যে হিমবাহে ঢাকা পাহাড়, আবার কোথাও বা ঘন সবুজে ঘেরা পাহাড়। একটু পরে পরেই উঁকি মারছে ছোট ছোট নরওয়েজিয়ান ভিলেজ, সেলিং বোট, আর ছিপবাহী মৎস্য শিকারি। চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে সি- গাল। এই মনোরম ক্রুজের অভিজ্ঞতা সারা জীবন মনের খাতায় লেখা থাকবে।
গুডভাঙ্গেন থেকে আমাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হল বাসে উঠতে। এই বাস সোজা আমাদের নিয়ে গেল কিছু পর্বত শিখরে। এখান থেকে ঘন নীল ফিওয়র্ড, নরওয়েজিয়ান ভিলেজ আর চারদিকের সাদা-সবুজ পাহাড়ের ভিউ এক কথায় অপূর্ব, বাক্রুদ্ধ হয়ে যায় প্রকৃতির এই ঐশ্বরিক শোভা দেখে। এই বাস জার্নিটি আরও একটা কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তা হল এই যাত্রায় দেখেছিলাম খুবই বিপদসংকুল পাহাড়ি পথ, আর ততোধিক অভিজ্ঞ বাসচালককে। একটু ভয় লাগছিল এই পাহাড়ি রাস্তা ধরে পথ চলতে। প্রায় এক ঘন্টায় আমরা পৌঁছিয়ে গেলাম ভস শহরের সেন্ট্রাল স্টেশনে। এইটি আমাদের এই যাত্রার অন্তিম গন্তব্য। এই খান থেকে ট্রেন ধরে আবার প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা জার্নি করে আমরা ফিরে এলাম অস্লো সেন্ট্রাল স্টেশনে। হোটেলে পৌঁছলাম প্রায় রাত্রি ১২ টা নাগাদ। পরদিনে ভোরে আবার প্লেন ধরতে হবে নিজের দেশে ফেরার। তাই সারাদিনের অপূর্ব সুন্দর স্মৃতি মনের মণিকোঠায় নিয়ে চলে গেলাম ঘুমের দেশে। এই ভূস্বর্গে আবার ফিরে যেতে চাই, দেখতে চাই আরও অনেক কিছু যা এই যাত্রায় করতে পারিনি। শুনেছি নরওয়ের উত্তরভাগের সৌন্দর্য ভুবন ভুলানো। তাছাড়া শীতের সময়ের নরওয়ের মেরুজ্যোতির কিরণছটা আর বরফাবৃত পর্বতের শোভা নিজের চোখে দেখার বাসনাও আছে। করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে আজকে সমস্ত বিশ্ববাসী এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা সত্যি সবাইকে ভাবতে বাধ্য করছে আমাদের জীবনের আসল মূল্য। ছোট ছোট ফেলে আসা ভালোলাগার মুহূর্ত গুলোকে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আবার কবে আমরা সবাই ফেরত পাবো আমাদের ফেলে আসা পুরনো জীবনযাত্রা, আগের অভ্যেস? নাকি বাঁচতে হবে অন্য নতুন নিয়মে, নতুন পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে। সারা বিশ্বজুড়ে এতো কিছু দেখার আছে, জানার আছে, আছে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ আঘ্রাণ করে বেঁচে থাকার আনন্দ। আমরা কি আবার ফিরে পাবো সেই সুযোগ? আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। আর বিশ্ববিধাতার কাছে মিনতি করি এক রোগমুক্ত ধরিত্রীর, যেখানে মানুষ আবার ফিরে পাবে প্রকৃতির মাঝে জীবনের আস্বাদ।
ভ্রমণ
টাইগার হিলে সূর্যোদয়
শ্যামারিমা মুখার্জী
এপ্রিল মাস, তখন বেশ গরম, তাই একঘেয়েমি কাটাতে আর গরম থেকে কিছু দিনের জন্য মুক্তি পেতে পারি দিলাম দার্জিলিং-এ। রোহিনী হয়ে কার্শিয়াং, সোনাডা, ঘুম স্টেশন তারপর বাতাসিয়া লুপ, অবশেষে দার্জিলিং। পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল, সেদিন স্নান-খাওয়া-দাওয়া করে রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। আর দার্জিলিং এর সন্ধ্যে অথচ কেভেনটার্স বা গ্লিনারিস এ যাব না এটা হতেই পারে না। তবে সেদিন ওই ইভিনিং স্নাক্স আর সাথে অবশ্যই দার্জিলিং চা, তারপর আবার হোটেলে ফিরে ডিনার সেরে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া। কারণ পরের দিন ভোরবেলায় উঠে যেতে হবে টাইগার হিল। ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া ছিল, সেইমতো তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে গেলাম আর নিচে গাড়িও চলে আসলো, নেমে বেরিয়ে পড়লাম টাইগার হিলের পথে। হিলের যত কাছাকাছি রাস্তায় এগোচ্ছে গাড়ি অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি স্থানীয় নেপালি মহিলারা তাদের মাথা থেকে, কেউ বা ঘাড়ে বড় বড় চায়ের পাত্র নিয়ে এবং সাথে প্লাস্টিকের কিছু গ্লাস নিয়ে সেই ঠান্ডার মধ্যে ভোরবেলায় পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে টাইগার হিলে। ভাবলাম সত্যিই পাহাড়ের মানুষদের জীবন কত কঠিন, তারা কত পরিশ্রমী আর আমরা সমতলে বাড়ির সামনের দোকান থেকেও একটা জিনিস এনে হাঁপিয়ে যায়। তাই হয়তো কাব্যেও বলা হয় "তৈলঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রা রসে ভরা / মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালি সন্তান"। যাক এসব ভাবনা থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে। দেখলাম আলাদা আলাদা ভাবে ভাগ করা বসার জায়গা। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছে, রয়েছে উন্নত মানের লেন্স যুক্ত বড় বড় ক্যামেরা হাতে কিছু বিদেশি পর্যটকও। হ্যাঁ তারা ফটো তুলতে এসেছেন-- পাহাড়ে সূর্যোদয়ের। এখন যে যার সঙ্গী সাথীর সাথে গরম চা এর কাপ হাতে আর ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষার দৃষ্টি নিয়ে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে রয়েছেন। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটতে শুরু করলো। সামনে তাকিয়ে যা দেখছিলাম তা যেন এতক্ষণের ঘোর কালো অন্ধকার ভরা পরিবেশের, জীবনের, মনের, সমাজের, রাজনীতির, একটা অদ্ভুত খারাপ আবরণ আস্তে আস্তে একটু একটু করে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু, একেবারে পুরোটা না প্রথমে অল্প একটু খানি আলোর আভা তারপর যেন একটি সোনার থালার
মতো সূর্য ঠিক লালচে আভা নিয়ে সমস্ত অশুভ শক্তির দমন ঘটিয়ে একটি শুভ শক্তির জাগরণ করতে করতে উঠে আসছে। আর তার থেকেও বেশি অবাক হলাম এই প্রতি মুহূর্তে সেই সূর্যের রঙে রাঙা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে। হ্যাঁ সূর্য যতই আস্তে আস্তে পুরোটা উদয় হচ্ছে ঠিক সেইমত বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যের আলোর রঙে পাহাড়ের সৌন্দর্য আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে আমাদের সামনে। এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সূর্যোদয় দেখে মনে এত ধনাত্মক ইচ্ছাশক্তির জাগরণ ঘটতে পারে জীবনে, তা এর আগে কখনো উপলব্ধি করিনি। আজ এই সূর্যোদয় এর সাথে যেন মনের ও জীবনের অদ্ভুত এক উদয় হলো। ভাবতে থাকলাম কত কথা, ভাবলাম - এই সূর্যোদয় এক একজনের কাছে এক এক রকম। যেমন: স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের প্রচন্ড কঠোর সংগ্রামের পর যেদিন দেশকে স্বাধীন করতে পারল সেদিন তাদের কাছে সূর্যোদয় ছিল স্বাধীনতার সূর্যোদয়; আবার যখন কোন রিক্সা বা ভ্যানচালক বাবা তার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু ও পুঁজি দিয়ে তার সন্তানকে তার থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে সমাজের একটা প্রতিষ্ঠিত আসনে দেখতে চাই এবং অবশেষে দেখতে পায় সেদিন সেই বাবার জীবনে আসে তার স্বপ্ন এবং পরিশ্রমের সফলতার সূর্যোদয়; আবার যখন কোন একটি বাচ্চা মেয়ে তার পরিবারের অর্থনীতির উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়, মানে ধরুন লোকের বাড়ি কাজ করে অর্থ উপার্জন ও হতে পারে, সেই মেয়েটি যখন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক তারপর স্নাতক পাস করে, সেদিন আসে তার মনের মণিকোঠায় সুপ্ত বাসনা এবং স্বপ্নের সফলতার সূর্যোদয়; প্রচন্ড কঠিন কঠোর সাধনার পর যখন কোন শিল্পী মঞ্চে তার শিল্প উপস্থাপন করার পরে, সমস্ত দর্শকদের করতালি পায় তখন সেই শিল্পীর মুখে যে এক নির্মল হাসি ফুটে উঠে সেটি তার জীবনের শিল্প সাধনার সফলতার সূর্যোদয়; আবার হয়তো কোন ছাত্র বা ছাত্রী ক্লাসে তার প্রিয় শিক্ষক বা শিক্ষিকার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের জীবনের পথ সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সেদিন ঘটে সেই ছাত্র বা ছাত্রী শুভবুদ্ধির সূর্যোদয়, আর সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকার পেশায় সফলতার সূর্যোদয়; আবার ধরুন, যেদিন কোন মা ৯ বা ১০ মাস গর্ভে তার ছোট সন্তানকে ধারণ করার পরে তাকে জন্ম দেয় সেদিন সেই মায়ের জীবনে ঘটে মাতৃত্বের সূর্যোদয়; আবার প্রেমে ব্যর্থ কোন তরুণ বা তরুণী মন খারাপে ডুবে না থেকে যখন নিজের পরিচয় বানানোর পেছনে উৎসাহী হয়, সেদিনও ঘটে তার জীবনের একটি নতুন পর্যায়ের সূর্যোদয়; যখন প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে একটি মাঝি যাত্রীবাহী নৌকা নিয়ে সুরক্ষিতভাবে কুলে এসে পৌঁছায়, ঠিক সেই মুহূর্তে সবাইকে বাঁচাতে পেরেছে জেনে সেই মাঝির মুখে যে শান্তির হাসি দেখা যায়, তখন ঘটে তার এই দীর্ঘ কঠিন পথের সফল যাত্রার সূর্যোদয়; এরকম আরো অনেক সূর্যোদয়ের কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে কি এর চেয়েও বেশি ভাবা সম্ভব বলুন! কারণ প্রত্যেকেই তো সেলফি তুলতে, সূর্যোদয়ের ফটো তুলতে, কাঞ্চনজঙ্ঘার ফটো তুলতে ব্যস্ত। আর তারপরে ঠান্ডায় চা খাওয়া তো রয়েইছে। তাই আমার দেখা সেবারের সূর্যোদয় আমার জীবনে এবং মনে একটি একদম অন্যরকম অনুভূতি এনেছিল, যার পুরোটা হয়তো বর্ণনা করা সম্ভব নয় খানিকটা চেষ্টা করলাম। আশা করি এভাবেই প্রতিদিন সূর্যোদয় আসুক, এই কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি মানুষের জীবনে। সেটা সমতলভূমি হোক, মালভূমি হোক বা পাহাড় হোক। দেশ হোক বা বিদেশ হোক।
প্রবন্ধ
জ্ঞানী মানুষ
জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী
হুগলী জেলার গৌরবময় যুগে বহু স্বনামধন্য মনীষী এই জেলায় জন্মগ্রহণ করে বাংলা তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত এমন মানুষদের অনেকেরই জন্য বাংলার বাইরে ভারতবর্ষের অন্যত্র তাঁদের স্বীয় প্রতিভার বিচ্ছুরণে সমাজজীবন আলোকিত হয়েছিল । সেই সমস্ত বিদুষী ব্যক্তিদের একজন হলেন চন্দননগরের ভূমিপুত্র জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী যিনি তাঁর মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদ বৃত্তি পেয়েছিলেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১১ জুন তাঁর চন্দননগরে জন্ম। পিতা রায়বাহাদুর বীরেশ্বর চক্রবর্তী ছোটনাগপুরের শিক্ষাবিভাগের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। ছোটনাগপু্র অঞ্চলে শিক্ষাপ্রসারে তাঁর একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত জনগণের শিক্ষার জন্য তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাল্যাবস্থা থেকেই জ্ঞানশরণের শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই কারণে প্রাথমিক পাঠ থেকেই তাঁর জ্ঞান ও মেধার পরিচয় যায় বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত কার্যকলাপে। রায়চাঁদ-প্রেমচাঁদ বৃত্তি পেয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য তাঁকে এলিয়ট স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ, মমত্ববোধ ও নিষ্ঠা বর্তমান সময়েও যথেষ্ট অনুকরণীয় ও দৃষ্টান্তস্বরূপ।
হুগলীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে জ্ঞানশরণের শিক্ষাপর্ব শুরু হয়। সেখানকার পাঠ শেষ করে জ্ঞানশরণ কোলকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। কলেজের প্রতিটি মেধা তালিকায় তাঁর স্থান ছিল প্রথম। উচ্চশিক্ষায় প্রত্যেক পরীক্ষায় তিনি বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পান্ডিত্যের দরুন উচ্চশিক্ষায় তিনি পি, আর, এ, এস; এফ, আর, এ, এস উপাধি পান। অসাধারণ মেধাবী জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী সংস্কৃত, গণিত, ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে প্রগাঢ় পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনার পাশাপাশি তিনি ঐতিহাসিক হিসাবেও স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ‘সংস্কৃত চন্দ্রিকার’ প্রতিযোগী পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান পান। এই বিশাল কৃতিত্বের কারণে তিনি ‘কাব্যানন্দ’ উপাধি পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে তিনি শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজে তিনি অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন। সেখানে থাকাকালীন তাঁর সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এলাহাবাদ বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা থাকত। সেখানে প্রবাসী পত্রিকার উন্নতিতে তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন।
লক্ষ্ণৌ কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারত সরকারের অর্থদপ্তরে চাকুরী গ্রহণ করেন। এই চাকুরীর সুবাদে তিনি রেঙ্গুন, কোলকাতা, এলাহাবাদ প্রভৃতি স্থানে বেশ কিছুদিন কাটান এবং বহু স্বনামধন্য মানুষের সংস্পর্শে আসেন । অর্থদপ্তরের গুরুত্বপূর্নপদে সুনামের সাথে চাকরী করার পরে অন্তিমলগ্নে তিনি মহীশূর রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ পান সেখানে দেওয়ান পদে যোগ দেওয়ার জন্য। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী মহীশূর রাজ্যে দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। মহীশূর রাজ্যের উন্নতিতে তাঁর অবদান ছিল প্রচুর। এই রাজ্যের জীবনবীমা কর্মসূচীতে প্রধান পরিচালক হিসাবে তাঁর সাফল্য তাঁর কর্মজীবনের দক্ষতার পরিচায়ক। কৃষিক্ষেত্রে তিনি কৃষিবীমা চালু করেন। তাঁর এই দক্ষতা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন ব্যাঙ্গালোরের রেশম ও পশম শিল্পের উন্নতিকল্পে। রেশম বোর্ডের প্রধানপদে তিনি রেশমকে বয়ন শিল্পে ব্যাবহার করে রাজ্যের অর্থনীতিকে নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিলেন।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে যার প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। মহীশূরের রাজ্যের আর্থিক উন্নয়নে জ্ঞানশরণ চক্রবর্তীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি সেখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের প্রধানপদে আসীন ছিলেন। মহীশূরের রাজ্যের অর্থসচিব হিসাবে রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধনের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ছিলেন।
বিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য তাঁর প্রণীত গ্রন্থগুলির মধ্যে পরিস্ফুট। স্বর্ণের অপচয় নিয়ে ‘The wastage of Gold in the manufacture in Jewallery in Bengal’ তাঁর একটি মূল্যবান বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা। তাঁর এই গঠনমূলক রচনা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর রচিত গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছিলেন। বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে জ্ঞানশরণ যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। গ্রামীণ জীবনে কৃষির উন্নতিতে বীমার কার্যকারিতা নিয়ে তাঁর যুক্তিবাদী চিন্তা ও তার সফল প্রয়োগ তাঁর জীবনের সাফল্যের অন্যতম মাইল ফলক। বিজ্ঞান নিয়ে বেশ কয়েকটি বই তিনি লিখেছিলেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Solutions of Differential Equitum, Agriculture Insurance, Theory of Thunderstrom। তাঁর এইধরনের গবেষণামূলক লেখা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জন্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির তিনি ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জীবনের যে কোন পরীক্ষায় উচ্চস্থানের অধিকারী জ্ঞানশরণ চক্রবর্তীর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সর্বজনবিদিত ছিল। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি সেসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর পরিচিত কাব্য গ্রন্থগুলি হল আহ্নিকম, উচ্ছ্বাস, লোকালোক (কাব্য), লক্ষীরাণী (নাটক), পিপাজী, মধ্যলীলা (নাটক), নিত্যকর্ম-বিষয়ক সংস্কৃত শ্লোক ও The language Problem of India। প্রথম জীবনে ভগবদগীতা সম্পর্কে তাঁর একটি নিবন্ধ পিতা রায়বাহাদুর বীরেশ্বর চক্রবর্তী তাঁর রচিত পুস্তকে মুদ্রিত করেছিলেন। জীবদ্দশায় বহু গ্রন্থে জ্ঞানশরণের কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। একটিতে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়।
এই বর্ণময় চরিত্রের মানুষটি জীবনে বহু সম্মানে ভূষিত হন। মহীশূর দরবার থেকে সম্মানীয় ‘রাজ-মন্ত্র-প্রবীণ’ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে বিশেষ সম্মান প্রদান করেছিলেন।
জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী মহীশূর রাজ্যে দেওয়ান পদ থেকে পরে অর্থসচিব হয়েছিলেন। তারপর তিনি যুক্তরাজ্যের কন্ট্রোলার জেনালেরের পদে নিযুক্ত হন। এই পদপ্রাপ্তি তাঁর কর্মজীবনের বিশেষ কৃতিত্ব বহন করে। সেইসময় বাঙালির মধ্যে কন্ট্রোলারের পদের আসনে খুবই অল্প লোকেরই বসার সুযোগ পেয়েছে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এই পদ অলংকৃত করেছিলেন।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর এই মৃত্যু সংবাদ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে তাঁর জীবনী নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারত সরকারের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি যে জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলেন সেই জ্ঞানের অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন মহীশূর রাজ্যে। অর্থনীতির জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সাহচর্যে তিনি এই মহীশূর রাজ্যে যে অগ্রগতির দিশা দেখিয়েছিলেন তা পরবর্তী সময়ে ভারতের বিভিন্ন পরিকল্পনায় রূপায়িত হয়েছিল। এই মহান মানুষটির সম্পর্কে আজও আমাদের অনেক কিছুই অজানা থেকে গেছে। তিনি আজ বিস্মৃতির অতলে। তবুও এই জ্ঞানী ও মেধাবী মানুষটির উন্নত চিন্তাধারা ও সফল কার্যকলাপ বাঙালী হিসাবে আজও আমাদের গর্বিত করে।
প্রবন্ধ
কালের সাক্ষী খাজাঞ্চি রেলওয়ে ব্রীজ
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ হিসেবে খ্যাত। আমরা যখন লেখাপড়া করি তখন বই পুস্তকে ও তা পড়েছি। তবে বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে নদী মাতৃক দেশ থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সরে আসছে। কারণ ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ ও টিপাইমুখ বাঁধ তৈরীর ফলে বাংলাদেশের নদীগুলি মৃত প্রায়। হারিয়েছে তার জৌলুস, নাব্যতা এবং ভরাট হয়ে কমছে প্রসস্থতা ও গভীরতা। এক সময় নদী পথই ছিল বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান ব্যবস্থা। অত:পর রেলপথ। সুতরাং সঙ্গত কারণেই সিলেট বিভাগের রেলপথের ইতিহাস জানা আবশ্যক।তবে নদী পথের গুরুত্বটা একটু নজর দিলেই বেরিয়ে আসবে অতি সহজে যে কারো। যেমন আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই পূর্বের শহর-বন্দর, হাটবাজারগুলি সহজ যোগাযোগের অবস্থা চিন্তা করেই আমাদের পূর্ব পুরুষরা স্থাপন করেছেন নদী তীরেই অধিকাংশ। তাই নদীমাতৃক দেশ বলে নামকরণের ক্ষেত্রে ও রয়েছে যথার্থতা। আর আজকাল নদী তীরের কথা কেহ চিন্তা করেন না কোন হাট-বাজার বা শহর গড়ে তোলতে। অন্য যে কোন সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করেই স্থাপনা গড়ে তোলতে ইচ্ছুক বা আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হয়।
যাক আসছি মুল প্রসঙ্গে। ১৮৯৬ সালে আসাম বেঙ্গল রেল লাইন কুলাউড়া হয়ে শিলঙর পর্যন্ত যাতায়াত করত। ১৯২২-১৫ সালে চালু হয় কুলাউড়া সিলেট রেল লাইন। ১৯২৮ সালে চালু হয় শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ এবং ১৯২৯ সালে শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা ও ১৯৫৪ সালে সিলেট ছাতক রেল লাইন চালু হয়। সুতরাং ১৯৫৪ সাল থেকে খাজাঞ্চি নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে খাজাঞ্চি নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজটি। তবে একবার এ ব্রীজটি আংশিক ভেঙ্গে পড়ায় কিছুদিন সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। কবে, কেন এবং কিভাবে ব্রীজটি ভাঙ্গা হয়েছিল তা বর্তমান প্রজন্মকে অবহিত করণার্থে সে কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এক রাত অনুমান তিন বা চারটার দিকে বিকট শব্দে ভু-কম্পনের মতো ঘরদোর কেঁপে উঠে। কান তালাবদ্ধ হবার উপক্রম। গ্রামের মানুষজন ভয়ার্ত চিত্তে শুধু আল্লাহকে স্মরণ করছেন। বয়স্করা এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত করছেন নির্জন, নি:শব্দে। আলোহীন অন্ধকারে চলছেন সকলেই। ঘটনার আদ্যোপান্ত জানার আগ্রহ সবার। কি ভয়াল ও শঙ্কিত প্রতিটি মানুষের হৃদয় মন। এই বুঝি পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করল। গ্রাম ছেড়ে যাব কোথায়? আর না গিয়েই বা কি হবে? বাঁচতে তো হবে। বয়স্কদের চুপি চুপি কথাবার্তা শুনে তখন আমার কচি প্রাণ শুকিয়ে গিয়েছিল। যাই হোক আর কোন সাড়া শব্দ নেই। এক সময় মসজিদে ধ্বনিত হয় ফজরের নামাজের আযান।তখন কিন্তু মসজিদে মাইক ব্যবহারের প্রচলন ছিল না গ্রামে। আযান ফুঁকতেন মুয়াজ্জিন টিনের তৈরী এক প্রকার বিশেষ কায়দায় তৈরীকৃত চোঙ্গার মাধ্যমে। যার শব্দ ছিল ক্ষীণতর। কাজ কর্ম সকলেই ছেড়ে দিয়েছেন। একটাই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রাতের বেলা সংঘটিত শব্দের উৎস খোজে বের করা বা কোথায় কি হয়েছে তা অবগত হওয়া। সকাল অনুমানিক ৭/৮ ঘটিকার মধ্যে অবহিত হলাম খাজাঞ্চি নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজটি ভাঙ্গার খবর। ব্রীজের পশ্চিম তীরের সম্পূর্ণ পিলারটি ভেঙ্গে ঐ স্থানে একটি মিনি পুকুরের মত হয়ে যায়। এ ভাঙ্গনে সম্পৃক্ত আছেন বাংলার দামাল ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অর্থাৎ পাকসেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রীজটি ভাঙ্গেন। বিষয়টি জানার পর মানুষ অনেকটা আশ্বস্থ হন, একটু আলোর ঝিলিক ফুটে উঠে মন মননে। বাংলার দামাল ছেলেরা আসছে এগিয়ে। তারপর ও একদম নিশ্চিত নন। কখন কি ঘটে বলা যায় না। সর্বদা মানুষের মনে আতংক, শঙ্কা ও উদ্বিগ্নতা অহরহ। কারণ এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে একদিন খাজাঞ্চি ইউনিয়নের বিশিষ্ট মুরব্বিয়ান, গুণীজন, সম্মানিত ব্যক্তিদের ডাকে আনে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে শান্তি কমিটি করার কথা বলে।
তখন প্রত্যেক মা-বাবারা এগিয়ে আসতেন। তরুণ ও উঠতি বয়স্ক যুবকদের না দিয়ে অভিভাবকরা ডাকে সাড়া দিতেন এ বলে যে, “যা হবার আমাদের হবে, আমার সন্তান বাঁচুক এ অনুধায় সিক্ত হয়ে”। সকল মুরব্বিয়ানদের একত্রিত করে পাক সেনারা সেদিন বলেছিল, “তোমাদের সন্তানরা কে, কোথায় বা কেন আসেনি”। মুরব্বিয়ানরা ইত:স্ততবোধ বা সঠিক জবাব দিতে না পারায় তাদের দৃষ্টিতে সেদিন সবচেয়ে বয়স্ক মুরব্বিয়ানদের বলেছিল উত্থাল তরঙ্গায়িত পানি ভরাট প্রবল স্রোতের মধ্যে নদী সাঁতরিয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে। অনেক মুরব্বিয়ানরা সেদিন হয়েছিলেন কাবু। বয়সের ভারে ন্যুজ ব্যক্তিরা পারছিলেন না নদী সাঁতরিয়ে সে পাড়ে যেতে। খাচিছলেন হাবুডুবু, মরার উপক্রম। তখন একটি পাকসেনা বলছিল উঠে আসতে ডাঙ্গায়। তীরে উঠার পর বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দিয়ে বিদায় দিয়েছিল। রাজাকারদের ব্যাংকার ছিল ব্রীজের উভয় পারে। আমার মামার বাড়ি নদীর ওপারে থাকায় যেতে আসতে দেখতাম তাদেরকে। অনেক সময় অনেক কিছু জিজ্ঞেস ও করত। মিথ্যা কথা বলে এই সেই বলে চলে আসতাম। নদীতে তখন থাকতো খেয়া নৌকা নদী পারাপারের নিমিত্তে। এর কয়েকদিন পর আশপাশের গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের উপর আদেশ হল প্রত্যেকে একটি করে বাঁশ প্রদান করতে। দেয়া ও হয়েছিল। আস্ত বাশঁ নদীর উভয় তীরে পুতে বেড়া দেয়া হয়েছিল রেলগাড়ী যাবার পথ রেখে। যাতে মুক্তি সেনারা আসতে না পারেন। অনেক সময় রাজাকাররা রাজাগঞ্জ বাজারে বা গ্রামে গিয়ে বলত তাদেরকে মোরগ দিতে খাবারের জন্য।না দিয়ে উপায় ছিল না। তাছাড়া প্রত্যেক পরিবার থেকে নদী রাজাকারদের সহিত পালাক্রমে পাহারার ও ব্যবস্থা ছিল। রাজাকাররা নাক ডেকে ঘুমাত সাধারণ মানুষকে পাহারায় রেখে। তবে এক দু‘জন তাদের দেখভালের জন্য অর্থাৎ পাহারা দিচেছন কিনা তদারকিতে থাকতো।আমাদের রাজাগঞ্জ বাজার এর হাটবার ছিল সপ্তাহের প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার। হাটে মানুষ আসতেন ভয়ার্ত চিত্ত নিয়ে। সবার একটি শঙ্কা ছিল সর্বক্ষণ কখন এসে হানা দেবে রাজাকাররা বা পাকসেনারা। মানুষ আতংকিত ও ভয়ার্ত মন নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সওদা করে চলে যেতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে জুন মাসের এক হাটবারে রাজা গঞ্জ বাজারে লঞ্চ যোগে এসেছিলেন এডভোকেট শহিদ আলী পাক সেনাদের সাথে। উদ্দেশ্য মিটিং করা।এলাকার সকল তরুণরা এদিন চলে গিয়েছিলেন আত্মগোপনে। কি জানি কি হয়।ওরা এসে দু’টি মাইক সেট করে আর সম্মুখে একটি টেবিল বসিয়ে বেশ কয়েকজন বক্তব্য রেখেছিলেন। তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল আবার নির্বাচন হবার। এলাকার কয়েকজন বয়স্ক মুরব্বি ছিলেন শ্রোতা। আমরা ছোট শিশুরা আড়াল আড়াল থেকে তা শুনেছিলাম। ঐ আসরে একজন বয়স্ক হালকা পাতলা ছিপছিপে ক্ষীণ দেহাঙ্গী লোক একটি গান ও পরিবেশন করেছিল। যার কলি ছিল, “পাকিস্তানী ভাইওরে, ভুল করনি চাইওরে, দফার কোম্পানী আইরা ভোটের বাজারে”। যাক অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচেছ তাই সংক্ষিপ্ত করছি। আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা হেতু। বলবো সময় করে একদিন, “এখানে নয় অন্য কোথাও, অন্যখানে”। বড়দের মুখ থেকে শুনতে পেলাম ব্রীজ ভেঙ্গে লোহার স্লিপার প্রায় এক কিলোমিটার দুরে কান্দি গ্রামে এসে পড়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর ব্রীজের নিকট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে সেখানে যাতায়াত কালে স্বচক্ষে দেখেছি এর ভীবৎসতা। দীর্ঘ সম্পূর্ণ স্লিপারটি বেঁকে গিয়ে এতদূর এসে পড়েছে। শক্তিশালী বোমা ছিল বলে আমরা অনেক সময় বলাবলি করতাম সকল ক্লাসমিট মিলে। ভাঙ্গনের পর বেশ কিছুদিন ছাতক-সিলেট ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বোমার আঘাতে সৃষ্ট অত্যন্ত গভীর গর্ত ভরাট করে স্বাধীনতার পর রেললাইনের নীচে যে কাঠের খন্ড থাকে তা একটির উপর একটি কৌশল খাটিয়ে পিলার বানিয়ে অনেক দিন ট্রেন যোগাযোগ চলে। সর্বশেষ ১৯৭৬ সালে পুন:নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে অদ্যাবধি ছাতক সিলেট ট্রেন চলাচল অব্যাহত আছে। খাজাঞ্চি নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজ দিয়ে। তাই কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই ব্রীজটি।
প্রবন্ধ
কুটিলতা
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
পৃথিবী একটি রঙ্গ মঞ্চ। এ মঞ্চে মানুষ প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচেছ। অভিনয়ের ও রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ভেদ। অভিনয়ে সফল ও সার্থকজনকে বলা হয় অভিনেতা। আর অভিনেতা ব্যতিরেকে ও যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার অভিনয় করেন তাদেরকে কিন্তু অভিনেতা বলা হয় না। আজ আমি কলম ধরেছি অদ্ভুত আচরণ সমৃদ্ধ মানুষের মধ্যে দু’একটি কথা, দু’একজনের কথা বলতে। কেন না মানুষ কখন, কিভাবে, কোথায়, কেমন অভিনয় করে অনেক সময় তা বুঝে উঠা মুশকিল। জানি না সম্মানিত পাঠকদের মনোরঞ্জনে তৃপ্তি প্রদানে কতটুকু সফলতা বয়ে আনতে পারবো। মানুষ আশা ও স্বপ্নকে বুকে লালন করে জীবন নৌকা চালিয়ে ওপারে পৌছার একটি স্বপ্নসৌধ দেখে। আমিও কলম চালালাম আশার আশে। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে।
আমি সে দিন এক বন্ধুর কাহিনী শুনে কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচিছ। যেহেতু বন্ধুকে কথা দিয়েছি তা লেখা আকারে প্রকাশ করার। শুরু করছি – আমার সে বন্ধু একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ব্যবসা করার প্রেক্ষিতে অনেকের সাথে লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে বিভিন্ন ভাবে আলাপ আলোচনা করার, সংস্পর্শে আসার, কথাবার্তা বলার সুযোগ রয়েছে।একব্যক্তি সফিক নামের সর্বদা বন্ধুর দোকানে লেনদেন করে থাকেন নগদ বা বাকিতে। তবে অধিকাংশ বাকীর খাতায়-ই হয়ে থাকে। একদিন শফিকের ভাগনা এসে বলল, আমার মামা সফিক বলেছেন এক হাজার টাকার মালামাল বাকিতে দিতে এবং এ দুই শত টাকা নগদ প্রদান করেছেন। বন্ধুটি শফিকের ভাগনাকে পূর্ব থেকে চিনে। তাই এক হাজার টাকার মালামাল দুই শত টাকা রেখে দিয়ে দেয়। বিকাল বেলা শফিকের সাথে বন্ধুটির সাক্ষাৎ ঘটে।ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বলে অকপটে। সফিক রাগান্বিত হয়ে বন্ধুটিকে জবাব দেয়, যে কেউ চাইলেই সম্পূর্ণ দোকান দিয়ে দিও। আমি জানি না। যে নিয়েছে তার কাছ থেকে উদ্ধার করে নিও। বন্ধুটি হতবাক, হতভম্ব ঘটনার আকস্মিকতায়। অথচ ঐ ভাগনাই অপরাপর সময় শফিকের কথা বলে মালামাল নিয়েছে।সফিক প্রদান ও করেছে। তথাপি বন্ধুটি নিরাশ হয়নি বা পিছিয়ে না পড়ে যুক্তি উপস্থাপন করলে সঠিক উত্তর না দিতে পারলে ও নেতিবাচক ভূমিকাতেই রাখতে চায়। যাক আপাতত বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা এখানেই সমাপ্তি ঘটে।পরদিন ভোর বেলা বন্ধুটি দোকান খোলার উদ্দেশ্যে তালা খোলার প্রস্তুতি কালে দেখা যায় সফিক তার ভাগনাকে নিয়ে আসছে বন্ধুর কাছে।বন্ধুটি হকচকিয়ে যায় ব্যাপার কি? হয়ত ভাগনাটি মালামাল নেবার কথা অস্বীকার করল নাকি, করবে নাকি? মহাচিন্তায়, ভাবনায় পতিত হয়। নিজের টাকার মালামাল প্রদান করে অস্বীকারের সংকটে ভোগবে নাকি? বন্ধুটির কাছে এসেই সফিক তার ভাগনাকে বলে, তুমি নাকি দুই শত টাকা দিয়ে এক হাজার টাকার মালমাল নিয়েছ? ভাগ্যিস ভাগনা তাৎক্ষণিক হ্যাঁ বাচক জবাব দিলে মামা ভাগনা এখন কোন কথা বন্ধুটিকে না বলে চলে যেতে উদ্যত। এমন কি ওরা চলেই যায়। বন্ধুটি তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্যটি অবলোকন করতেই থাকে। কিছুক্ষণ পর অপর একজনের সাথে বিষয়টি শেয়ার করে। ঐ ভদ্রলোক তাকে সান্ত্বনা স্বরূপ বলেন, “মানুষ আজকাল হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। সে তার ভাগনা সাথে নিয়ে এখানে না এসে, বাড়িতে জিজ্ঞেস করেই জেনে নিতে পারত। তা না করে নিয়ে এসেছে। এসে কি ফল পেল। আবার এখন উচিত ছিল তোমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাবার। সুতরাং কোন রকমে টাকাটা উদ্ধার করেই কেটে পড়”।
এ ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর শফিকের কাছে বন্ধুটি টাকা চায়। দিচিচ, দেব বলে আরো কিছুদিন অতিবাহিতে একদিন দুই শত টাকা এনে দিয়ে বলে আর পারব না। তুমি আর আমার ভাগনা জানে। এ সময় বন্ধুটি যুক্তি উপস্থাপন করলে সদুত্তর দিতে না পারলে শক্তিমত্তার পরিচয় সূচক জবাব ওর কাছ থেকে উদ্ধার করে নিও জাতীয় জবাবে কেটে পড়ে।
“দিন যায়, কথা থাকে” প্রবাদেরই মত একদিন ঐ বাজারেই শফিকের ভাগনা অপর এক দোকানীর সাথে বাকি লেনদেন নিয়ে ঝগড়ায় হয় লিপ্ত। ঘটে মারামারি, কুস্তি। বাজার পরিচালনা কমিটি তাৎক্ষণিক বিচারের আওতায় উভয়কে এনে বিচারের ব্যবস্থা করেন। অপর দোকানীর দাবী ছিল তিনির পকেটে রক্ষিত পাঁচ হাজার টাকা শফিকের ভাগনা নিয়ে গেছে ঝগড়ার সময়। এখন টাকা পাঁচ হাজার করে আমানত রেখে বিচার চলবে।এখন দেখা যায় শফিকের কর্মকান্ড।পাঁচ হাজার টাকা জামানত হিসাবে দিতে হলে শফিকের ভাগনার এ সামর্থ্য মোটেই নেই। তাই মামা সফিক পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। অনেক কষ্টে সফিক ভাগনার হয়ে যখন টাকা জামানত হিসাবে মুরব্বিয়ানদের হাতে দেন। তখন আমার বন্ধুটি যায় এগিয়ে। মুরব্বিয়ানদের শুধায়, তার টাকা প্রাপ্তির বিষয়টি। মুরব্বিয়ানরা বিচার কাজ স্থগিত রেখে বলেন, বন্ধুর টাকার পরিমাণ ও জামানত হিসাবে প্রদান করতে শফিককে। সফিক এখন কিন্তু বড্ড বেকায়দায়। এখন সফিক দ্বারস্থ
হন আমার বন্ধুর। কথা হল তোমার টাকাটা পরে দেব, তুমি বিচারটি তুলে নিয়ে আসতে। বন্ধুটির জবাব ছিল, আগে আমার টাকা নগদ প্রদান করলে বিচার তুলে আনবো। নতুবা বিচার কাজ চলবে। নিরুপায় হয়ে বন্ধুর টাকা প্রদানে হন বাধ্য। বন্ধুটি বিচার আনেন তুলে। পরবর্তী বিচারে ও তাকে জরিমানা করা হয়। এখানে কথা হল মানুষ বিপাকে পড়লে সত্য মানতে রাজি বিনা বাক্যব্যয়ে। নতুবা শক্তি, প্রভাব প্রদর্শনে খুবই পারদর্শী। আমি একদিন অপর এক বন্ধুর দোকানে বসে আমাদের শৈশব নিয়ে আলোচনায় মত্ত। ইত্যবসরে আসেন মধ্য বয়সী এক লোক খরিদ্দার রূপে। তিনি একটি ছাতা কেনার অভিপ্রায়ে। ভদ্রলোক ছাতা হাতে নিয়ে খোলে প্রত্যক্ষ বা পরীক্ষা চালান সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা? দরদাম সাব্যস্ত করে মূল্য পরিশোধান্তে ছাতা নিয়ে চলে যান। অনুমান দশ পনের মিনিটের ব্যবধানে ভদ্রলোক আসেন ফিরে দোকানে ছাতা সমেত। এসেই বলেন অনুরূপ ছাতা আর আছে কিনা?বন্ধুটি জবাব দেয় হ্যাঁসুচক। তখন ঐ ভদ্রলোক বলেন পূর্বের ছাতাটি রেখে দোকানে রক্ষিত ছাতাটি প্রদান করতে। আমি ও বন্ধুটি ভদ্রলোকের ব্যবহারে সন্দেহ আসে। তাই ছাতাটি খোলা দেখে পরখ করতে। ছাতা খোলতে ভদ্রলোক এ বলে সান্ত্বনা প্রদানে মত্ত, যে এই মাত্র নিলাম । দেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সন্দেহ আরো হয় ঘনীভূত।তিনির কথায় আমরা বিরত হইনি। তাই ছাতা খোলে নিলাম। দেখা যায় ছাতার একস্থানে বড় একটি নূতন ছিদ্র রয়েছে। আমরা জিজ্ঞেস করি ব্যাপারকি। ছিদ্র কেন। তিনির জবাব দশ বিশ টাকা নিয়ে যাও অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতে।আমরা যখন যুক্তি প্রদর্শন করি এবং ঘটনাটা দু’একজন লোককে জানাতে বলি। তখন কিন্তু ভদ্রলোক বলেন, লোক ডাকার দরকার নেই। ছাতা না রাখলে তিনি ঐ ছাতাই নিয়ে যাবেন। আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলি দু’একজন লোক ডাকলে ভাল হবে। বিষয়টি পরিস্কার হবে কেন, কি ভাবে ছিদ্র হল।ভদ্রলোক লোক ডাকতে নারাজ এবং ঐ ছাতা নিয়ে যেতেই রাজি। আমরা তিনিকে তা দিয়ে দিলাম। যাবার বেলা বলে যান, “আমার নাতি কি করেছে জানি না। শুধু বলেছে ছাতায় ছিদ্র”।
আরেকটি ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করেই আমি এ গল্পের ইতি টানব। আমার অপর এক বন্ধু তার প্রতিবেশী দ্বারা নিপীড়িত, নিগৃহীত সর্বদা সংখ্যালঘু, নিরীহ ও অসহায় বলে। কিন্তু সে বড্ড কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। প্রতিবেশীরা কখন ও চায়নি সে লেখাপড়া করুক। বিভিন্ন উপায়ে, পন্থা ওরা বেঁচে নিয়েছে লেখাপড়ায় যাতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করতে। কিন্তু বন্ধুটি মনের দৃঢ়তা ও অদম্য ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে সকল প্রকার বাঁধা উপেক্ষা করে, কঠিন ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর সহায়তায় লেখাপড়া করে। তার অংশের সঠিক প্রাপ্যটুকু কখন ও তাকে দিতে চায়নি, দেয়নি। জোরপূর্বক, কূটকৌশলে, প্রতারণায় তাকে তটস্থ রাখত। ভয়ভীতি দেখাতো। আমার এ বন্ধুটি লেখাপড়া করলে ও ভূমি সংক্রান্ত বিষয়াদি খুব কমই বুঝত। কিন্তু প্রতিবেশীরা নানাবিধ পন্থায় তার অনেক কিছু গ্রাস করে রেখেছিল। একদিন বন্ধুটি আগ্নেয়গিরি গলিত লাভার মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সে এসপার কি ওসপার একটা কিছু দেখতে চায়। জানতে চায়, আগ্রহী হয়ে উঠে। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আপন ভেবে এগিয়ে যায়। কিন্তু বন্ধুটি প্রথমার্ধেই কৌশলে প্রতারিত করতে চায়। তা সে টের পেয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ে। আল্লাহকে ভরসা করে এগিয়ে যায় সম্মুখ পানে।
তার ভূমি দাবিয়ে ভোগ করতেছে প্রতিবেশীরা। এক সময় সে গ্রামের একজন অতি মূর্খ ব্যক্তির সাহায্য কামনা করে। কারণ ঐ ব্যক্তির নিকট ঐ মৌজার ম্যাপ আছে বলে বিভিন্নজনের মাধ্যমে জ্ঞাত হয়। ঐ ব্যক্তির কাছে চাহে মৌজার ম্যাপটি একটি ঘন্টার জন্য তাকে প্রদান করতে। সে ফটো কপি করে ফেরত দিয়ে দেবে। লোকটি তাকে অশ্বত্থ করে প্রদানের। বলে আগামীকল্য এসে নিয়ে যেতে। পরদিন এক বুক আশা নিয়ে চলে যায় ব্যক্তির কাছে। চাহিবার পূর্বেই লোকটি বলে ভাই আমার ম্যাপটি উপজেলা পরিষদের তহশীলদার কিছুক্ষণ পূর্বে এসে নিয়ে গেছেন। তাদের কাছে ম্যাপ না থাকায় বড় ধরণের একটি অঘটন থেকে রক্ষা পেতে আমার ম্যাপ নিয়ে যায়। বন্ধুটি বুঝে ও না বুঝার অভিনয় করে যেতে থাকে। ঐ ব্যক্তির পিঠ চাপড়িয়ে বার বার বলতে থাকে, ভাই আমার ছোট ও ক্ষুদ্র সমস্যার চেয়ে বৃহৎ কর্মটি অবশ্যই মঙ্গলজনক।bএকটি উপজেলার উপকারের স্বার্থের কাছে আমার ব্যক্তি স্বার্থ কিছুই না। আমি ম্যাপ একটি উত্তোলন করে নিতে পারব। বন্ধুটি চলে আসে ঐ ব্যক্তির অভিনয়ে অভিভূত হয়ে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আজ আমার বন্ধুটি তার প্রয়োজনীয় সকল মৌজার ম্যাপ সংগ্রহে রেখেছে। সে দিন অর্থাৎ দুই বৎসরের ব্যবধানে আলোচিত ব্যক্তিটি এসেছেন বন্ধুটির কাছে তার চাহিত মৌজার ম্যাপটি নিতে। সত্য কখন ও হারে না, গোপন হয় না। ভেসে উঠে হয়তবা সাময়িক সময়ের জন্য যায় নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়ে। কিন্তু মানুষের অভিনয় দেখতে হলে আপনাকে সংযত হতে হবে। ফলাফল একদিন আসবেই আসবে। সংযম, সবুরের ফলাফল অতি সুমিষ্ট। কূটকৌশল সর্বক্ষেত্রে কুটিলতায় থাকে আবদ্ধ।
প্রবন্ধ
ব্রিটেনে বাংলা ভাষা
দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
ব্রিটিশরা ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে বাংলার মাটিতে এসেছিল একদিন। ছল চাতুরী, প্রতারণার মাধ্যমে একদিন তারা হয়ে উঠে এদেশের হর্তাকর্তা। প্রায় দুই শত বৎসর শাসন করে এদেশ ও জাতিকে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। তা এখানে বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি ২০১১ সালে গিয়েছিলাম ব্রিটেনে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে আমার মনটা ভরে গিয়েছিল গর্বে ও আনন্দের আতিশয্যে। আমি আমার ভ্রমণ কাহিনীতে সাধ্যমত আমার অভিব্যক্তির প্রকাশ করেছি। বাংলা ও বাঙ্গালীর কৃতিত্ব, সাংস্কৃতিক বিকাশ, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙ্গালীর অবস্থান দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমি দেখেছি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে থাকার চরম বাস্তবতার সচিত্রতা। বিশ্বনাথের গর্বিত সন্তান রোশনারা আলীর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম বাঙ্গালী ও প্রথম নারী পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করতে। সে সময় টাওয়ার হ্যামলেটের মেয়র পদে আসীন ছিলেন বাংলার সন্তান লুতফুর রহমান। এবারের নির্বাচনে লড়ছেন বাঙ্গালীর ঔরসজাত সন্তান পাঁচ নারী সদস্য।তাদের অবস্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক। বাংলার লাল সবুজের পতাকা ব্রিটেনের স্থানে স্থানে পত পত করে উড়ে জানান দিচেছ বাঙ্গালীরা মোটেই কোন ক্ষেত্রে কম নন।অচিরেই বা অদূর ভবিষ্যতে একদিন বাঙ্গালীরা ব্রিটেনের উচ্চ আসনের অধিকারী হয়ে উঠবে। সেখানে বাঙ্গালীরা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী হয়ে গর্বিত। ২০১১ সালের ৮ই এপ্রিল বৈশাখী মেলা পালন করছেন বাঙ্গালীরা প্রতি বৎসরের ন্যায়। যেখানে বিভিন্ন দেশের বা ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের অংশ গ্রহণে হয়ে উঠছে আলোর দিশারী। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ
শহরের গড়ে উঠছে বাঙ্গালীর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠন। আছে সেখানে শহিদ মিনার, আলতাব আলী পার্ক ইত্যাদি। তারই ধারাবাহিকতায় হয়েছে বাংলা টাউন। লন্ডনে বা ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যাক আজ আমার দৃষ্টি নিবন্ধিত হলো একটি পত্রিকায় দেখতে পেলাম বাংলা ভাষা সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা হিসেবে ইংরেজির পরেই স্থান করে নিয়েছে বাংলা ভাষা। বুকটা গর্বে ভরে উঠল। অর্থাৎ লন্ডনে ইংরেজির পরেই সবচেয়ে বেশি বলা বা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মুখের ভাষা বলার অধিকারী হয়েছ বাংলা। বাংলার পরে পোলিশ এবং তুর্কি ভাষার অবস্থান। এ অর্জন বাংলার মানুষের, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র ইংরেজ জাতিকে পরিচালনা করার।
“সিটি লিট” নামক একটি সংস্থা এ জাতীয় তথ্য প্রকাশ করেছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে সুস্পষ্ট ভাবে লন্ডনের এক লাখ ৬৫ হাজার ৩১১ জন বাসিন্দা বাংলা, পোলিশ ও তুর্কির মধ্যে যে কোন একটি ভাষায় কথা বলে থাকেন।বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে লন্ডন শহরে বসবাসকারী ৭১ হাজার ৬০৯ জন অধিবাসী প্রধানত বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন এ সমীক্ষারই একটি অংশ। সমীক্ষা আরো জানিয়েছে লন্ডনের ৩লাখ ১১ হাজার ২১০ জন অধিবাসী বাড়ি বা বাসায় কোন না কোন বিদেশী ভাষায় কথা বলে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো ব্রিটিশদের মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ মানুষ স্বচ্ছন্দে বাংলা বলতে সক্ষম। লন্ডনের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরা, উদযাপন করার পাশাপাশি বাসিন্দাদের একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগে উৎসাহিত করতে এ সমীক্ষা করা হয়।
প্রবন্ধ
যায় না দেখা
এ দৃশ্য
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
সত্তর দশকের প্রথমার্ধে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন সুপ্রিয় শিক্ষক প্রয়াত আলতাফুর রহমান ছাদ মিয়া ক্লাসে অনেক সময় গল্পচ্ছলে বলতেন টেলিভিশনের কথা। বলতেন তোমরা রেডিওর সাথে পরিচিত আছ। কিন্তু টেলিভিশন এখন ও দেখনি। টেলিভিশনে খবর পাঠকের ছবিও দেখা যায়। আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম তিনির কথা। স্যার চলে যাবার পর ক্লাসমেটরা একত্রিত হয়ে বলাবলি করতাম এ কি করে সম্ভব খবর পাঠকের ছবি দেখা যায়?ছোট বাক্সের মধ্যে কি ভাবে এত বড় আকৃতির মানুষ ঢুকে থাকবে বা কেমন করে ঢুকবেন। আবার স্যার আমাদেরকে সতর্ক করে দিতেন গ্রামে গিয়ে মানুষের সাথে এ কথা বল না। তাহলে গ্রামের মানুষ তোমাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করবে অসম্ভব বিষয় বিবেচনায়। অপেক্ষা কর অচিরেই তা প্রত্যক্ষ করতে পারবে। তখন মানুষ ও তা বিশ্বাস করবে।
১৯৭৮ সালে আমি যখন মদন মোহন কলেজের ছাত্র। তখন সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত সময়ের আলোচিত ব্যক্তি জনাব বাবরুল হোসেন বাবুল। একদিন শ্রুত হলাম সকাল বারো ঘটিকায় টেলিভিশনে প্রদর্শিত হবে মোহাম্মদ আলী ক্লে’র মুষ্টিযুদ্ধ। কথাটি শুনে এমন আগ্রহ সৃষ্টি হল, একই সাথে দু’টি বিষয়ের সহিত পরিচিতি লাভের আকাঙ্ক্ষায় আকর্ষিত হয়ে সে দিন আর কলেজ অভিমুখে যাত্রার কথা সম্পূর্ণ ভুলেই গেলাম। একটি হচেছ প্রথম টেলিভিশন দর্শন ও অপরটি হচেছ মোহাম্মদ আলী ক্লে’র মুষ্টিযুদ্ধ দর্শন ও মুষ্টিযুদ্ধের সহিত পরিচিত হওয়া। প্রতীক্ষিত সময়ে পৌরসভার একটি কক্ষে টেলিভিশন ছেড়ে প্রদর্শনী হয় শুরু। কক্ষে তিল ধারণের ঠাই নেই। সকল মানুষ দাঁড়িয়ে তা অবলোকন করতে লাগলাম। সে কি মহা আনন্দ।স্মৃতির পাতা হাতড়িয়ে আজো তা স্মরণে মনে জাগে আলোড়ন। টেলিভিশন দেখেছি, দেখেছি মুষ্টিযুদ্ধ খেলা। বিজয়ের যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তা শুধু অনুভব, অনুভূতির বিষয়। যেন রাজ্য জয়ের বীর সেনানী। পাঠক সঠিক সময় এখন স্মরণ নেই বহু দিন আগের কথা তো। তাই এ ব্যাপারে ক্ষমাপ্রার্থী। সম্ভবত দ্বিতীয়বার টেলিভিশন দেখি ১৯৮০ সালে সিলেট পৌরসভা প্রাঙ্গণেই। সেদিন কিন্তু দেখেছিলাম রাতের বেলা। আমি তখন দিনের বেলা করতাম সাবরেজিষ্টারী অফিসে চাকুরী। সন্ধ্যার পরই চলে যেতাম মদন মোহন কলেজে নাইট সেকশনে ক্লাস করতে। এ দিন ছিল কলেজ বন্ধ। তাই সন্ধ্যার পরই বের হয়েছিলাম সিলেট শহর ঘুরে দেখতে। সময় রাত অনুমানিক সাত বা সাড়ে সাত ঘটিকা। আজকের বা সদ্য স্থাপিত কামড়ান চত্বর এলাকা লোকে লোকারণ্য। পৌরসভার সম্মুখে কাঠের তৈরী বড় আকারের একটি স্ট্যান্ডের উপর টেলিভিশন রেখে হচিছল প্রদর্শিত।অনেক রিকশাওয়ালা রিক্সা দাড় করিয়ে বসে দেখছিলেন। সবাই কিন্তু দাঁড়ানো আর
সম্মুখভাগে থাকা লোক ছিলেন বসা। আমরা গ্রামের মানুষ। শহরে যেতাম কার্যোপলক্ষ্যে। কাজ শেষে চলে আসতাম গ্রাম অভিমুখে। রাত হোক আর দিনই হোক। আজও চলছে আমাদের জীবন যাত্রা। হতে পারিনি শহরের বাসিন্দা। তাই বলে ভাববেন না কেহ শহর বা শহরের মানুষের প্রতি হিংসুটে। মোটেই না। শহর আছে বলেই আমি গ্রাম্য জীবনের অধিকারী। আবার গ্রাম থেকে শহরে গেলে পাই নতুনত্ব ইট বালির সংযোজনে সংযোজিত প্রাসাদ, শহুরে মানুষের সান্নিধ্য, পরিচয়, পরিবেশ আর আধুনিকতার ছাপের সুস্পষ্টতার ব্যবধান। তা আলাদা অনুভূতি। পৃথিবী পরিবর্তনশীল। নতুনত্বের প্রকটতা। সেদিনের সিলেট শহর আর আজকের সিলেট শহর রাত দিনের পার্থক্য বা পরিবর্তন। সেই ১৯৭৭ সালে যখন কলেজে যেতাম বেলবটম পেন্ট পরে। হাইহিল জুতো পরে। জুতো কিন্তু নিতে হত হাতে করে। সুবিধাজনক স্থানে গিয়ে পরে নিতাম জুতো। হাই স্কুল জীবন চলেছে আমাদের জুতো বা সেন্ডেলবিহীন লুঙ্গি পরে।শহরে যেত যখন অভ্যস্ত হলাম, তখন হলাম পেন্ট পরার অধিকারী। বাড়ি থেকে বের হতাম সাত সকালে। গ্রামের কাদাযুক্ত রাস্তাঘাট মাড়িয়ে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। গ্রামের মাঠে যারা থাকতেন কাজকর্মে নিয়োজিত। অনেক সময় আমাদেরকে পেন্ট পরিহিত দেখলে তারা করতেন হাসি, তামাশা। বলতেন উচ্চস্বরে “চোঙ্গা, চোঙ্গা” বলে। কত পরিবর্তন। আমরা পেন্ট পরে চলতে অনেক সময় হতাম বিব্রত গ্রাম্য পরিবেশে। আজ গ্রামের মাঠে সকলেই কাজ করেন পেন্ট পরে। কত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ আর মন ও মননের পরিবর্তনশীলতা। যাহোক এবার চলে আসছি মুল প্রসঙ্গে। আমাদের কথা শুরু হয়েছিল টেলিভিশন নিয়ে। ধীরে ধীরে শুরু হল টেলিভিশনের অগ্রযাত্রা, সহজলভ্যতা ও প্রচলনের আধিক্যতা।আমার গ্রামে প্রথম টেলিভিশন আনেন ১৯৮৩ সালে একজন মুরব্বি আবুল হোসেন নামীয়। যিনি বর্তমানে এ জগতে নেই। হয়েছেন প্রয়াত প্রায় বিশ বৎসর পূর্বে। আর তা প্রদর্শন বা দেখার কি যে আনন্দ? টেলিভিশন ছিল কত সমাদৃত।যা আজ হয়েছে অনেকটা পানসে।সন্ধ্যা হলেই তিনির বাড়িতে ভীড় জমাতেন আবালবৃদ্ধবনিতা। সংগৃহীত ছবির মতো বসে দেখতেন উৎসুক জনতা। বিনোদনের গ্রামের মানুষের ছিল মনে মহোৎসবসম বা আনন্দের হাতিয়ার। নারীরা দেখতেন আড়ালে আবডালে থেকে সতর্কতা নিয়ে। চলত গল্প-গুজব নানাবিধ বিষয়ে টেলিভিশন দেখার পাশাপাশি। অনেক দিন ছিল তা প্রচলিত। তারপর দিনে দিনে অগ্রযাত্রা সমাজ সামাজিকতার। আজ গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে টেলিভিশনের ছড়াছড়ি। রোমে রোমে টেলিভিশন থাকার কথা বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না। মনে পড়ে সময়ের কথা, প্রবাদ বাক্যের কথা। “সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়” প্রবাদ বাক্যটির ব্যবহারের কথা। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কথা। সম্মুখপানে কি রয়েছে দেখার তা সময়ই বলে দেবে। র’লাম আশার আশে দেখার, প্রত্যক্ষ করার প্রত্যাশিত প্রত্যয়ের।
প্রবন্ধ
প্রবাসীর স্মৃতির কোলাজে
দেশের পুজো
সঙ্গীতা সাহা
মিসিসিপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
প্রবাসের জীবনে পুজোর দিনগুলোতে ভোরবেলায় আমার ঘুমে যেন ভিড় করে আসে দেশের পুজোর অনেক স্মৃতি। আমার মতো অনেক প্রবাসীরাই দেশ থেকে অনেক দূরে থাকেন, বিশেষ করে প্রত্যেক বছর সবার দেশে যাওয়া হয় না দূর্গাপুজোর সময়। তাই এই দূর্গাপুজোর সময় নিজের স্মৃতিতে জমে থাকা ছেলেবেলার বিভিন্ন স্মৃতিগুলো নিয়ে চর্চা করতেই মনে পড়ে যায় কত কথা। সেই শরতে অজয় নদীর তীরে ফুটে ওঠা সাদা কাশফুলের ছোঁয়া মনে আনে প্রশান্তি। প্রকৃতি যেন চারদিকে উৎসবের আমেজ বয়ে নিয়ে আসে। আমার বঙ্গভূমিতে পুজো মানেই বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা, হাসি, আনন্দ, ঘুরে বেড়ানো। স্মৃতির পট যে কতটা সতেজ ও তরতাজা হতে পারে তা এই দূর প্রবাসে বসে আজ টের পাই।। শরতের শারদ মেঘ ভাসে অপূর্ব নীল আকাশে, রাস্তার দু'ধারে ফুটে থাকে কাশফুল, কিছু নাম না জানা পাখি নিঝুম সন্ধ্যায় কিচিরমিচির করতে করতে পথ হারিয়ে ফেলে। শরতের নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘের দল ভেসে চলেছে দূর থেকে দূরান্তে। যেন বাঁধনছাড়া কোন উল্লাসের বার্তা নিয়ে। দিগন্ত জুড়ে সদ্য ফুটে ওঠা কাশফুলের সারি হাত নেড়ে যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। ভোরে গাছের থেকে ঝরে পড়া শিশির মাখানো শিউলি ফুলেরা গন্ধমাখানো গালিচা ছড়িয়ে রেখেছে। ঢাকের বাদ্দ্যি জানান দিচ্ছে যে ‘মা’ আসছে।চিন্ময়ী মাকে মৃন্ময়ী রূপে বরণ করে নিতে ব্যস্ত বাংলার বারোয়ারী পুজোগুলি থেকে শুরু করে বনেদী বাড়িগুলো। বর্তমানে বারোয়ারী পুজো গুলিতে থিমের হাতছানি ও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও বনেদী বাড়িগুলির দূর্গাপুজোগুলিতে ঐতিহ্যময়তা ও সৌকর্য আজও একইভাবে বণ্টন হয়। যার টানে বাংলার বিভিন্ন জেলার প্রত্যেকটা জায়গার বনেদী বাড়িগুলোতে দূর্গাপুজো দেখতে অসংখ্য উৎসুক মানুষ আজও ভিড় জমান।
পুরনো ধনী পরিবারগুলির দূর্গাপুজো ‘বনেদি বাড়ির পুজো’ নামে পরিচিত। দূর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, আনন্দের উৎসব, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে মিলিত হওয়ার উৎসব। বঙ্গদেশের দূর্গাপুজোর বিস্ময় ফুরিয়ে যায় না এখানেই। দূর্গাপুজো বা বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ উৎসবকে ঘিরে বলার মতো আছে আরও অনেক কিছু। সব জায়গার সার্বজনীন পুজোর সাথে সাথে কতগুলি বনেদি বাড়ির পুজো দূর্গাপুজোর আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে। পারিবারিক স্তরে দূর্গাপুজো প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। এরকমই বনেদি বাড়ির পুজোর গল্প আজ আমার আলোচ্য। প্রথমেই শুরু করি আমার শহরে আমাদের সাহাবাড়ির পুজো দিয়ে !
আমাদের সাহা-বাড়ির পূজো :
আমার শহর পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমায়। এই শহরে কেটেছে ২৫ টা বছর। কালক্রমে জীবন আবর্তে এসেছি আমেরিকায়। প্রবাসে বসে দূর্গাপুজোর কথা বলতেই প্রথমেই যেটা আমার মনে ভিড় করে সেটা হলো আমাদের সাহা বাড়ির দূর্গাপুজো।আমাদের এই সাহা বাড়ির পুজো প্রায় দুই দশক ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাবেকিয়ানা এখনও অটুট সাহা বাড়ির পুজোয়। এই সাহা বাড়ি পুজো শুরু করেছিলো সাহা বাড়ির ছোট ছেলে বিদ্যুৎ সাহা (আমার দাদা)। তারই উদ্যোগে প্রথা অনুযায়ী দূর্গাপুজো পালিত হয়ে আসছে এখনও। চতুর্থীতে আমাদের বাড়িতে মাকে কুমোরটুলি থেকে নিয়ে আসা হয়। মূলত মহালয়ার দিন থেকেই আমাদের একটা পুজো পুজো ভাব তৈরি হয়ে যায়। ষষ্ঠীতে বোধনের পর সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নানের মাধ্যমে দেবীর পুজো শুরু হয়। মূলত বাড়ির গৃহবধূরা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত করেন। দেবী দূর্গার বাহন পাখাযুক্ত শ্বেত সিংহ এবং বাঘ সহ গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী ছাড়াও থাকেন উনাদের বাহন। দেবীকে নবরত্নের হার ও সোনার হার পরানো হয়। দশ হাতে থাকে বালা। পরানো হয় সোনার টায়রা-টিকলি। হাতে দেওয়া হয় রুপোর অস্ত্র। ষষ্ঠী থেকে মানুষের ঢল নামে সাহা বাড়িতে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দূর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নিয়মমাফিক ভাবেই পালিত হয়। বছরভর প্রতীক্ষার পর ষষ্ঠীতেই বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে সাহা বাড়িতে শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন।
বাড়ির আত্মীয়-পরিজনে ভরে ওঠে দূর্গাদালান। দুর্গতিনাশিনীর প্রতি নিবেদিত ফুল বিল্ব পত্র এবং মন্ত্রে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাড়ি। এক একদিন এক এক ফুলের মালায় দেবীকে সুসজ্জিতা করে তোলেন বাড়ির সদস্যরা। সপ্তমীতে কলাবউ স্নান একটি বিশেষ আকর্ষণের। বাড়ির ছোট ছেলে যিনি এই পূজো শুরু করেছেন তিনি নিজেই গঙ্গা থেকে কলাবৌ সমেত ঘট নিয়ে আসেন, সঙ্গে থাকে বাড়ির অন্য অনেক সদস্যরা। সকাল হতেই সবাই দল বেঁধে যাওয়া হয় গঙ্গায়। সেসব স্মৃতিপটে আজও স্পষ্ট ধরা পড়ে। প্রবাসে দূর্গাপুজোর এরকম স্বাদ পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব নয়।
চিরাচরিত নিয়মানুসারে অষ্টমীর ভোগে নিবেদন করা হয় লুচি, আলুর দম, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, মিষ্টি এবং ফলফলাদি। পাশাপাশি সপ্তমী থেকেই চলে পুজোর নৈবেদ্যর ডালি। প্রত্যেক বছর আসা চিন্ময়ী মায়ের সমাদরের আয়োজন বিন্দুমাত্র খামতি রাখেন না সাহা বাড়ির সদস্যরা। পুজোর সবকটা দিন নৈবেদ্য দেওয়া হয়। তার আয়োজনও বিশাল। বাড়ির সকলে আনন্দে মেতে ওঠে এই পুজোর দিনগুলোতে। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন পোশাকে সজ্জিত হয় সকলে। বাড়ির ছোট সদস্যরা অর্থাৎ বাচ্চারা হই হুল্লোড় করে পুজোর আনন্দকে দ্বিগুণ মাত্রা দান করে। অষ্টমীতে একসঙ্গে ‘নারায়ণী নমস্তুতে’ মন্ত্রে অঞ্জলি, পরবর্তীতে ১০৮টি প্রদীপে সন্ধিপূজা এসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকে প্রত্যেকই। পুজোর দিনগুলোয় সন্ধ্যায় হতো আরতি; আরতির সময় ধূপ-ধোঁয়ায় চারদিক হয়ে যেত গন্ধময়। ধোঁয়াটে পরিবেশ আর ঢাক-ঢোল-কাঁসর ধ্বনিতে নাচতো অনেকে। প্রতিমার সামনে ধুনুচি হাতে নিয়ে নাচ সে তো চির-বাঙালিয়ানায় ভরপুর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় পরিজনেরা মিলিত হন এই পুজোকে ঘিরে। তবে ধ্রুবতারা জগন্ময়ীকে ঘিরে নবমী নিশি আটকে থাকতে চায় সাহা-বাড়ির এই দূর্গাদালানটিতে। দশমীর আরতি অঞ্জলিতে ভারাক্রান্ত মনে তখন একটাই রব, “আসছে বছর আবার হবে”।
দশমীর ভাসানে তা যেন উন্মাদনা। বেলা তিনটের দিকে উলু ধ্বনি করে বিসর্জন শুরু হয়। নাটমন্দির থেকে দেবীকে নামিয়ে শহর সংলগ্ন গঙ্গা নদীতে দেওয়া হয় দেবী বিসর্জন। দুর্গাপুজোয় পারিবারিক আত্মীয়দের সমাগম এবং বন্ধু-বান্ধবদের মিলন এগুলো ছিল সত্যি খুব আনন্দের। বিবাহিত রমণীদের কাছে সিঁদুর দান অনুষ্ঠানটির তাৎপর্য অনেক বেশি। তাঁরা তাঁদের স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে দেবীকে সিঁদুর দিয়ে থাকেন। তারপর অন্য রমণীদের সিঁদুরের লাল রঙে রাঙিয়ে তোলেন। তখন শঙ্খ, ঘণ্টা, ঢাক, কাঁসর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজতে থাকে। বিসর্জনের বিদায়ের সুরকে সঙ্গে রেখেই বাড়ির সদস্যরা গান নাচে মেতে ওঠে। সবার মিলনই দূর্গাপুজোর আসল রূপ। আমাদের আনন্দ সবার সঙ্গেই ভাগ করে নিই। সবার সঙ্গে পুজো করতে, আনন্দ করতে আর পুজোর প্রসাদ সবাই একসঙ্গে খেতে কী যে আনন্দ, তা বলে বোঝানো যাবে না। পূজার প্রসাদ সবাইকে দিয়ে খাওয়া হতো। প্রথম দেওয়া হতো ফলমূল। দুপুরে দেওয়া হতো ভোগ, তাতে খিচুড়ির অন্ন সঙ্গে লাবড়া অর্থাৎ নানা রকম শাকসবজি দিয়ে তৈরি নিরামিষ তরকারি, পনির, ধোঁকার ডালনা। সবার মধ্যে এই আনন্দ আর তৃপ্তি দেখে খুবই আনন্দিত হতাম। আমাদের শহরে আরো বেশ কিছু বনেদি বাড়ির পুজো হয়। বাংলার বুকে ছড়িয়ে আছে কত বনেদি বাড়ির ইতিহাস। কোথাও রাজবাড়ির পুজো, আবার কোথাও জমিদার বাড়ির পুজো। পুরনো সেই সব বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু লোকশ্রুতি, গল্পগাথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বনেদি বাড়ির পুজোর জৌলুস কমলেও, সাবেকিয়ানা এখনও অটুট ইতিহাসের গন্ধমাখা শতাব্দী প্রাচীন সব পুজোয়। দূর্গাপুজোতে সব সম্প্রদায়ের লোকই সমবেত হন পুজোমণ্ডপে। কারণ, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এই ধরণিতে আসেন। আমাদের দেবগণ নিজ নিজ দেহ নিঃসৃত তেজ দ্বারা যেমন দেবীর অঙ্গ সকল সৃষ্টি করে তাকে পূর্ণরূপ দিয়েছিলেন, সেভাবেই তাঁরা নিজ নিজ শ্রেষ্ঠ অস্ত্রও তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে করেছিলেন রণসাজে সজ্জিতা। অশুভ শক্তির প্রতীক পরাজিত অসুরকে পায়ের তলায় রেখে যুদ্ধ করে মা শিক্ষা দিলেন জীবজগৎকে। সংসার রঙ্গনে বাঁচতে মানুষের লাগে বুদ্ধি, ঋদ্ধি, সিদ্ধি ও ক্ষাত্রশক্তি। তাই তো আদ্যশক্তির মহিমায়ায় আছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক। ধনের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, দেব সেনাপতি কার্তিক, গণদেবতা ও সিদ্ধিদাতা গণেশও হচ্ছেন পূজিত। অন্যদিকে সরস্বতীর বাহন রাজহংস, লক্ষ্মী দেবীর বাহন প্যাঁচা,
গণেশ ঠাকুরের ইঁদুর ও কার্তিকের বাহন ময়ূর — প্রতিটি প্রতীকই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ভাবমণ্ডিত। দশমীর বাঙালি হিন্দুরা সবাই দূর্গাদেবীর পুজো করে। তবে প্রাচীনকালে রাজা, জমিদার আর ধনাঢ্য বণিক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এ পুজোর প্রচলন বেশি লক্ষণীয়। তবে বহুকাল থেকে আর্থিকভাবে সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিরাই পারিবারিকভাবে বংশপরম্পরায় দূর্গাপুজো করে আসছেন।
প্রতিবছর মা আসেন মর্ত্যে, ভক্তের পুজো নিয়ে আবার ফিরেও যান কৈলাসে। মায়ের আগমনে সন্তানের আনন্দ। মায়ের কাছে সন্তানের অধিকার সমান। কারণ, তিনি বিশ্ব জননী। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে দুর্গা নামটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ রোগনাশক, গ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয় শত্রুনাশক। তার মানেই দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই শ্রীদূর্গা। অন্যদিকে শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তি সমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি আমাদের দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা।
দিন রাবণ বধ করে সাড়ম্বরে বিজয়া দশমী পালন করা হয় তখন থেকে বসন্তকালে ও শরৎকালে দুর্গাপূজা ও শুভ বিজয়া দশমী পালিত হয়ে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চলে আসছে মাতৃ পূজার চিরন্তন ধারা। শক্তিপূজা কেবল মাতৃমূর্তিতেই হয়। যেমন: দুর্গা, অন্নপূর্ণা, কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি। তাই প্রাচীনকাল থেকে শক্তিপূজার অঙ্গ হিসেবে নারীমূর্তিতে কুমারীপূজা প্রবর্তিত হয়েছে। বর্তমানকালের সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নয়নশীল বিশ্বে সমাজব্যবস্থায় নারী নির্যাতিতা। তাই নারীদেহে ভগবানের পূজা সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজ স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পুজো করে মাতৃ সম্মানের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কুমারীপূজার মাধ্যমে নারী সমাজের তথা মাতৃশক্তি জাগরণের এক অত্যুজ্জ্বল ধারা বর্তমান সমাজে তুলে ধরেছে।
আমার মাতুলালয় গ্রামের সাতবাড়ির পুজো:
এর আগে আমি আমার সাহা বাড়ির পুজো অর্থাৎ আমার কাটোয়ার পুজোর কথা বললাম। এখন আমি বলব আমার মাতুলালয়ের সাতবাড়ির বনেদি পুজোর গল্প। আমার মাতুলালয় হল কাটোয়া থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত খাটুন্দি নামে একটি গ্রামে। এখানে আমার মায়ের ছেলেবেলা কেটেছে। দেশে থাকাকালীন আমারও ছোটবেলার বেশ কিছু সময় এই গ্রামে কেটেছে। এই গ্রামে সাতবাড়ি দূর্গাপুজো হল বিখ্যাত বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজো। ছোট থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগতো কেনই বা এই পুজোর নাম সাতবাড়ি দুর্গাপুজো। আবার এই সাতবাড়িকে কেষ্ট রায় উঠোন বলা হয়। এটাও একটি আশ্চর্য বিষয় একইসঙ্গে যেখানে দুর্গাপূজা হয় সেখানে আবার কি করে কৃষ্ণ পূজা হয়। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশ কিছুদিন গবেষণা করার পর এর ইতিহাস সম্পর্কে আমি অবগত হয়েছি। এখন আমি সেই ইতিহাসের গল্প বলব আপনাদের। এই সাত বাড়ির একজন শরিক দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য থাকেন কাটোয়া শহরে। কাল ক্রমে তিনি ছিলেন আমার অঙ্কের মাস্টার মশাই। সে যাই হোক এখন আসি সাতবাড়ির দূর্গাপুজোর কথায়।
এই সাতবাড়ির দূর্গাপুজোর পিছনে রয়েছে একটি বিশাল ইতিহাস। সে প্রায় আজ থেকে আনুমানিক ৬৫৮ বছর আগের কথা। কেশব ভট্টাচার্য পরবর্তীতে তিনি হন কেশব ভারতী। কেশবের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল কেশব ভট্টাচার্য, পরবর্তীতে ভারতী পদবি নেন তিনি। আমরা জানি নবদ্বীপের শচী মাতার গর্ভে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই চৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস দীক্ষাগুরু হলেন কেশব ভারতী। প্রায় ৬৫৮ বছর আগে এখন যেখানে কেতুগ্রাম থানার খাটুন্দি গ্রাম, সেই গ্রামের দক্ষিণে বয়ে যাওয়া কাঁদর নামে একটি নদীখাতের ধারে ছিল ঠাকরুণপুকুরের মাঠ। এই মাঠেই দুর্গা পুজোর সূচনা করেন এই কেশব ভারতীর বাবা রামগোপাল ভট্টাচার্য। শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস দীক্ষাগুরু কেশব ভারতীর বাবা ছিলেন এই রামগোপাল ভট্টাচার্য। কেশব ভারতী তাঁর এক ছেলে উমাপতি ঘোষ সম্প্রদায়কে দীক্ষা দেওয়ায় অপর ছেলে নিশাপতি ওই জায়গা ছেড়ে খাটুন্দিগ্রামের বিদ্যাভূষণ পটিতে কৃষ্ণমন্দির তৈরি করেন। তাঁর পাশেই দূর্গাপুজো শুরু করেন তিনি। তবে শুরুর সময় একটি প্রতিমাতেই পুজো শুরু করেছিলেন ভট্টাচার্য পরিবারের পূর্বপুরুষরা। সময়ের সঙ্গে পারিবারিক ভাগাভাগির সঙ্গে ভাগ হয়ে যায় পুজোও। বর্তমানে পরিবারের সাত বংশধর সাতটি পৃথক দূর্গাপুজোর আয়োজন করেন।
পরিবারের সদস্য দেবনারায়ণ ভট্টাচার্য একবার বলেছিলেন নিশাপতির তিন নাতি তিনটি পুজো শুরু করেন। দৌহিত্র সূত্রে আরও চারটিপুজো শুরু হয়। প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সাতটি পুজো হচ্ছে এখানে। তবে এর মধ্যে একটি পুজোয় প্রতিমা পুজো করা হয় না। ঘট বসিয়ে পুজো করা হয়। ছটি পুজো গাঁয়ে হলেও এক দৌহিত্র রাখহরি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশধররা কাটোয়ায় এসে পাকাপাকিভাবে থাকায়, তাদের পুজোটি আজও কাটোয়ার চাউল পট্টিতে অনুষ্ঠিত হয়।বাড়ির উঠোনে কৃষ্ণের পাশেই শাক্ত মতে ষোড়শ উপাচারে পূজিত হন দেবী। কৃষ্ণের পুজোর পর শুরু হয় দেবীর পুজো। কেতুগ্রামের খাটুন্দি গ্রামে ভট্টাচার্য পরিবারের এই পুজো ‘সাত বাড়ির পুজো’ নামে পরিচিত। শতাধিক বছরের প্রাচীন পুজোটিতে এ ভাবেই মেলবন্ধন বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের। শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ দেওয়ার পরেই ভোগ পান দেবী। ভট্টাচার্য পরিবারের একজন সদস্যের থেকে জানা যায় শাস্ত্র মতে দুর্গা পুজো না করলে শ্রীকৃষ্ণকে সম্পূর্ণ তুষ্ট করা যায় না। তাই এখানে ষোড়শ উপাচারে দেবীর পুজো করা হয়। বিসর্জনের আগে ছয় প্রতিমাকে নিয়ে আসা হয় শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে। মন্দির থেকে বের করে আনা হয় শ্রীকৃষ্ণকেও। আরতি শেষ হলে হরিনাম সংকীর্তনের পরে স্থানীয় পুকুরে হয় প্রতিমা বিসর্জন। গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের পুজোয় এটাই সব থেকে বড় আকর্ষণ।
খাটুন্দির এই পুজোয় বাড়ির উঠোনে মাত্র ২০ মিটারের মধ্যে হয় ছ’টি দুর্গা প্রতিমা। পাকা মন্দির রয়েছে দু’টি। বাকি চারটিতে টিনের চাল ও মাটির দেওয়াল। নবমীর দিন হয় ঘট পুজো। পরিবারের সদস্যেরা জানান, শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে ঘট রেখে প্রতিপদ থেকে শুরু হয় পুজো। পরিবার বড় হওয়ায় পুজো ভাগ হয়ে গেলেও ভট্টাচার্য বাড়ির দূর্গাপুজোয় পারস্পরিক সম্প্রীতির কোনও অভাব নেই। প্রত্যেকে মিলেমিশেই আয়োজন করেন পারিবারিক দূর্গাপুজো আর নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হল, একটাই মণ্ডপে পাশাপাশি ছটি দূর্গাপুজো আয়োজিত হচ্ছে বছরের পর বছর। ভাগ হয়ে গেলেও সম্প্রীতির সৌরভে কোনটা কোন শরিকের পুজো বোঝা দায়। এখন যেখানে পাশাপাশি ছটি পুজো সম্পন্ন হচ্ছে, তার পাশেই রয়েছে কৃষ্ণরায়ের মন্দির। তাই এই সাতবাড়িকে কেষ্টরাই উঠোন বলা হয়।
এই ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরা শুধু পশ্চিমবাংলাতেই নয়, ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন রাজ্যে। দুর্গা মূর্তিগুলি গড়েন বংশপরম্পরায় নেউল মিস্ত্রির পরিবার। বলিদানের কাজটিও একইভাবে করে আসছেন সহদেব কর্মকারের পরিবারের সদস্যরা। পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের বাসিন্দাদের খাওয়ানো, বস্ত্রদানের রীতিটাও বজায় রেখেছেন বর্তমান শরিকরা। খাটুন্দির ভট্টাচার্য বাড়ির দূর্গাপুজো তৎ সংলগ্ন বাকি পুজোর থেকে আলাদা। পুরোনো যে প্রথা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই এই পুজো করা হয়। খাটুন্দির ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোয় পরিবারের সঙ্গে মেতে ওঠে গোটা গ্রামও। পুজোর ক'দিন উৎসব মুখরিত হয়ে ওঠে ভট্টাচার্য পরিবার। আমি যখনই গ্রামে গিয়েছি একবার হলেও কৃষ্ণরাইকে দর্শন করতে সাতবাড়িতে গিয়েছি। এখনো আমি সেখানে যেতে খুবই ভালোবাসি। দূর্গাপুজোর সময় অনেকবার গিয়েছি দাদুর বাড়ি। বিশেষ করে নবমীর দিন সাতবাড়ির দেবী প্রতিমা দর্শন না করলে আমার পুজো যেন সম্পূর্ণ হতো না। তাই আজও সেসব দিনের কথা স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে আছে। বুক ভর্তি একরাশ আশা নিয়ে এগিয়ে চলেছি জীবনের পথে। আশা রাখি নিশ্চয়ই সেদিন আসবে খুব তাড়াতাড়ি যেদিন এক ছুটে চলে যাব গ্রামের সেই সবুজে।
বাঙালির স্মৃতির অকপটে অনবরত নাড়া দিতে থাকে বঙ্গভূমির দূর্গাপুজো। বিদেশে আমরা প্রবাসীরা বিদেশের দূর্গাপুজোয় অংশ গ্রহণ করি ঠিকই কিন্তু মন পড়ে থাকে সেই স্মৃতিমাখা আনন্দমুখর নিজের শহরের পুজোয় কিংবা নিজের বাড়ির পুজোয়। প্রবাসে বসে দেশেরবাড়ির পুজোর স্মৃতিচারণ করতে করতে আমি কখন পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই অতীতের স্মরণীয় দিনগুলোয় টেরই পাইনি।
ভ্রমণ
মিসিসিপির ঝর্ণায় প্রকৃতির স্নান
সঙ্গীতা সাহা
মিসিসিপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
আমি একজন প্রবাসী বাঙালি। বর্তমানে আমেরিকায় আছি। আমি সাহিত্যপ্রেমী। লিখতে ভালোবাসি। শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রী। রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমার ভালোলাগা। ঘুরতে ভালোবাসি।
এক টানা ৬ মাস লকডাউনে গৃহবন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সমুদ্রের কাছে বাড়ি হওয়ার কারণে সমুদ্রে ঘুরতে যেতে আর ইচ্ছে করে না। কোথায় যাওয়া যায় সেই ভেবে, ইন্টারনেটে একটু রিসার্চ করে বের করলাম কাছে পিঠেই একটি সুন্দর ঝর্ণা আছে। মাত্র ২ ঘন্টার ড্রাইভ। তাড়াতাড়ি সারাদিনের খাবারের ব্যবস্থা করে গাড়ি নিয়ে ভ্রমণ পিপাসু আমরা দুটিতে বেরিয়ে পড়লাম ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্যে। তাও সেটা যদি নতুন জায়গার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় মূলক ভ্রমণ হয় তাহলে তো সেই আগ্রহ বলাই বাহুল্য। জীবনের এক ঘেয়েমী দূর করার জন্য মানুষ আনন্দ বিনোদনের জন্য ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। বাস্তব জ্ঞান লাভ করার একটি প্রধান মাধ্যম হলো ভ্রমণ। ভ্রমণ থেকে অর্জিত জ্ঞান আমাদের জীবনে স্থায়ী হয়। তাই আমরাও প্রায়ই সফরে বেরোই তা সে ঝটিকা সফর হোক বা বড়ো কোনো ভ্রমণ হোক। প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করাই হল ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য। নতুন জায়গা দেখার, অজানাকে জানার, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে উপভোগ করার আমার অদম্য কৌতূহল। কল্পনার তরণকে মুক্ত করে শিক্ষাকে সজীব ও আনন্দের সামগ্রী করে তোলা একমাত্র ভ্রমণের পক্ষেই সম্ভব। বই পড়ে বনভূমিকে চেনা যায় না, জানা যায় না নানান ধরনের গাছ পালা, পশু পাখি সম্বন্ধে, জানা যায় না অন্তহীন সমুদ্রের বিশালতা তাই প্রত্যক্ষ দর্শনে ভ্রমণের গুরুত্ব কতখানি তা সে যারা ভ্ৰমণ করে তারাই বোঝে।
জর্জিয়ার আটলান্টা শহরে ডালহনেগা নামে একটি জায়গা ঘুরেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে, সেখানে অজস্র ঝর্ণা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে সেকি অপূর্ব দৃশ্য। তারপর আবার এখন যাচ্ছি মিসিসিপি রাজ্যের ঝর্ণা দেখতে। সবকিছু মিলিয়ে আমি ছিলাম ফুরফুরে মেজাজে, নিশ্চিত ভালো কিছুই হতে যাচ্ছে। জানতাম। তবে বলে রাখি আজ কে যে ঝর্ণা দেখতে যাচ্ছি সেটা একটি ঐতিহাসিক স্থানও বটে। ঝর্ণা দেখার সাথে সাথে এই জায়গার ইতিহাসও কিছুটা বলবো।
গ্যালারী - ১
টানা দুই ঘন্টা একটানা ড্রাইভ করে পৌঁছে গেলাম মেরিডিয়ান শহরের কাছে ‘ডানস ফলস ওয়াটার পার্ক’। মিসিসিপির দক্ষিণ লুডারডেল কাউন্টিতে চুনকি নদীর ধারে এক পাহাড়ে রয়েছে ডানস ফলসের ওয়াটার পার্ক। ডান্স ওয়াটার পার্কের খুব কাছ দিয়েই বয়ে চলেছে চুনকি নদী। এই নদীটি খুবই অগভীর এবং যে কেউ হেঁটেই এই নদীটি পারাপার করতে পারে।
ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম পার্কে প্রবেশের টিকিট ঘর, জনপ্রতি এটি ছিল $৩.২৫ ডলার। তারপরে আমরা পুরানো গ্রিস্ট মিলের প্রথম দুটি স্তর অনুসন্ধান করেছিলাম। অতীতের খুব ঝরঝরে পুরাতন ধ্বংসাবশেষ লক্ষিত হল। উইন্ডোজ থেকে দেখা প্রকৃতির ছবিটি অতি মনোরম ছিল। সিঁড়ির রাস্তাটা নীচে যাত্রা করার দিকে (যা মাঝে মাঝে কিছুটা খাড়া ছিল), তারপর আমরা এটির মূল আকর্ষণে পৌঁছেছি। এই সিঁড়িটি ছিল উঁচু থেকে একদম ঝর্ণার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেখানে ঝর্ণা নদীতে মিলেছে। সিঁড়িগুলো এতো নিপুণভাবে সুসজ্জিত ছিল যে এই পার্কটির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি করছিলো। এখানকার মাটিগুলো এতো শক্ত যে মনে হচ্ছে পাথর। যেতে যেত কখনও ঝর্ণার জলের স্রোত দেখে মন জুড়ায়, কখনও রাস্তার কঠিন পথ দেখে চ্যালেঞ্জ নিই।
মজার বিষয় হচ্ছে যাওয়ার পথে আমরা অনেকগুলো অদ্ভুত বন্য পাখি দেখেছি। এতো সুন্দর পাখি দেখে ভীষণ আনন্দ লাগবে যে কারো। চিড়িয়াখানার পাখি আর খোলা পাখি দেখার মধ্যে তফাৎ আছে। ঝর্ণার জলের শব্দ। খুশিতে লাফাচ্ছি। ঝর্ণার কাছে গেলাম। ঝর্ণার জলে ভিজলাম। প্রকৃতিটাও বেশ সুন্দর। পাহাড়ের অনেক উপরে। এখানে দেখলাম ৫/৬ জন ছেলে মেয়ে। ওরা এসেছে টেক্সাস থেকে।
পথে চলার সময় সূর্য ধীরে ধীরে তেজ বাড়িয়ে চলছিলো, কিন্তু পর্যটকদের উত্তেজনার পারদও যেন উপরের দিকেই উঠে চলেছিলো। চলার পথে মনোহারি দোকান থেকে গ্যাটোরেট এনার্জি ড্রিঙ্কস, চকলেট, আর জলের বোতল কিনে নিয়েছিলাম কারণ গ্রীষ্মের তাপে ভ্রমণের জন্য এগুলো জরুরি। অতীব সুন্দর পথ পেড়িয়ে পৌঁছে গেলাম ঝর্ণা যাত্রার উদ্দেশ্যে, ভ্রমণ পিপাসুদের যেমন নদীর বহমানতা, সমুদ্রের উন্মত্ততা মুগ্ধ করে, ঝর্ণার প্রলয়ংকারী সৌন্দর্যও অদ্ভুত আকর্ষণে কাছে টানে। তাই তো নানা প্রতিকূলতা পেরিয়েও দীর্ঘ পথ হেঁটে, কখনো বা খাড়া পথ বেয়ে হলেও ভ্রমণ পিপাসুরা ঝর্ণার কোলে ছুটে যায়।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো আরো অনেক কবি ঝর্ণার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন, কাব্যিক ছন্দে ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্যের গুণগান গেয়ে গেছেন।
“ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন - বর্ণা!
অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
গিরি - মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে
তনু ভরি’ যৌবন, তাপসী অপর্ণা!”
গ্যালারী - ২
এই পার্কটিতে ১৮৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আইরিশ অভিবাসী জন ডান দ্বারা নির্মিত একটি ৬৫ ফুট জলের জলপ্রপাতের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই নদীর প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ফুট উঁচুতে একটি জলাশয় রয়েছে। এই জলাশয়ে একটি ছোট স্প্রিং এর মাধ্যমে জল-সরবরাহ হয়ে থাকে। এই জলধারাটি নিচে ঝর্ণার আকারে প্রবাহিত হয়। ওখানে একটি জলচক্র (water wheel) লাগানো আছে। ডান সাহেব যখন সেখানে থাকতেন, তখন এই জলচক্রটি ব্যবহার করে গম মাড়াই করা হতো। এখনো জলচক্রের খুব কাছেই একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র সরঞ্জাম বা টুলস আছে।
সেটি একসময় ব্যবহার করা হতো শস্য পেশাইএর কাজে কিন্তু এখন শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য খোলা আছে। জলপ্রপাতটি কেবল আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য সরবরাহ করে তা নয়, তবে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ এর মাধ্যমে জলচক্রকে ঘুরিয়ে মেশিনটির পরিচালনা খুব স্বাভাবিকভাবেই অতিমাত্রায় সৌন্দর্য্য বহন করে। কৌতূহলী এবং প্রকৃতি প্রেমী হিসেবে এই শান্তিপূর্ণ স্থানটি সত্যিই আমাকে আকৃষ্ট করল। আজ, এই শস্য পেশাই মিলটি বয়স্ক এবং ধীর হয়ে গেছে, কিন্তু জলপ্রপাতটি এখনও কয়েক বছর আগের মতোই জীবন্ত রয়েছে । পুরানো মিল ঘরটি মোটামুটি একটি "বিনা অনর্থক" চিহ্ন; আমরা এর অভ্যন্তরটি অন্বেষণ করতে সক্ষম হইনি, কারণ অত্যধিক পুরোনো বাড়ি হওয়ায় বাড়িটির ভিতরে যাওয়া বিপদসংকুল,তবে এটি অত্যন্ত পুরানো সৌন্দর্য বহন করে এবং জলধারা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এই স্থানটি এখনও প্রশংসিত হতে সক্ষম।
৭০ দশক এবং ৮০ দশকে আমেরিকায় অনেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আসতো। মূলত ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে প্রায়ই আমেরিকায় মাইগ্রেন্ট করত মানুষ। এরকমই জন ডান ইউরোপ থেকে এসেছিলেন আমেরিকায় ৮০ দশকে, এই পার্কটি বর্তমানে যেখানে মিল মেশিনের স্মৃতি একসময় তিনি এখানে বসবাস করতেন। তাই এই জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইতিহাসের একটি সুন্দর চিত্র আমাদের সফরের যথার্থতাকে দ্বিগুণ করে দিয়ে অতিরঞ্জিত করল।
পার্কটিতে ১৮৫৭ সালের যে গমের মিলের বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা ১৯৮৭ সালে জর্জিয়ার ক্যাভ স্প্রিংস থেকে সরানো হয়েছিল এবং ডান সাহেবের মূল মিলের সাইটে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। এই মিলগুলি যেভাবে স্থাপন করা হয়েছিল তা অনুসন্ধান করার জন্য এটিতে একটি অ্যাক্সেসযোগ্য মিল ঘর রয়েছে। পাখির শব্দ, শ্যাওলা ভেদ করে জলের কলকল শব্দ এবং গাছের পাতার মৃদুমন্দ শব্দে পরিবেশটি ছিল বেশ মনোরম। পার্কটিতে ছিল কিছু সংক্ষিপ্ত প্রকৃতির ট্রেইল যা বনের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে। বন্য টার্কি, কাঠবিড়ালি এবং হরিণ সহ পাখিদের কলরবের জন্য এই অঞ্চলের বয়ে যাওয়া নদী সব মিলিয়ে জায়গাটি একদিনের ঝটিকা সফরের জন্য বেশ চমকপ্রদ। যদি এখানে এই মিলটি না থাকত তবে এই অঞ্চলটি প্রকৃতিএবং একটি সুন্দর পরিষ্কার নদী ছাড়া আর কিছুই থাকত না। জায়গাটি এখন প্রাকৃতিক জল উদ্যান হিসাবে জনসাধারণ উপভোগ করছেন। নদীটিতে যে জলপ্রপাত প্রবাহিত হচ্ছে সেই স্ফটিক স্বচ্ছ জল মাছ ধরার জন্য ক্যানোয়িং এবং এমনকি সাঁতারের জন্য উপযুক্ত। আমরা জলপ্রপাতের নীচে সমতলের দিকে হাঁটলাম এবং ঝর্ণার
গ্যালারী - ৩
জলধারায় তাকালাম। আমরা জলপ্রপাত এবং কাছের চুনকি নদীর ছবি এবং ভিডিওগুলি নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় কাটিয়েছি, তারপরে আমরা একটু নিকটবর্তী পর্বতারোহণের ট্রেলে পদচারণা করলাম।ট্রেইলটি চুঙ্কি নদীর পাশে দৌড়ে আসা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটি বাঁধানো ফুটপাথ। ট্রেইলের শেষটি বয় স্কাউট ক্যাম্পিং এরিয়া।
এখন যেখানে এলাম মনে হল এই ঐতিহাসিক মিলটি এবং সুন্দর পার্কটি উপভোগ করার জন্য এটি চমৎকার অবস্থান যা এই সুন্দর অরণ্য এবং জলকে ঘিরে রয়েছে! প্রান্তে সুন্দর পারিবারিক পরিবেশের জন্য কয়েকটি পিকনিক টেবিল এবং গ্রিল রয়েছে। বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে যাওয়া ফ্রাইড রাইস আর টোফুকারী দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনটা সেরে ফেললাম। প্রাকৃতিক পরিবেশে ছোট করে একটি বনভোজন হয়ে গেল, তবে এটা শীতকালের বনভোজন নয়, প্রখর গ্রীষ্মের বনভোজন। পরিবেশটি অবশ্যই এখানে শান্ত এবং যারা সত্যিই শহরের ঘনজনবসতিতে হাঁপিয়ে উঠেছে তাদের জন্য আমার মনে হয় এটা উপযুক্ত জায়গা।
এরপর আমরা জলপ্রপাতের নীচের প্রান্তে এবং নদীতে সাঁতার কাটা মানুষের দুর্দান্ত চিত্রগুলি ক্যাপচার করার জন্য একটু ঘোরাঘুরি করলাম। ঝটিকা সফরের তালিকায় এই জায়গাটি যে যুক্ত হতে পারে তা গত তিন বছর আছি মিসিসিপিতে কোনোদিন মনে হয়নি। ভ্রমণ অনুরাগী মানুষ হওয়াই এই জায়গাটি এবং পাশাপাশি আরো কিছু জায়গা আবিষ্কার করে মনে হল এটি সত্যিই মিসিসিপির পাহাড়ে লুকানো একটি দুর্দান্ত জায়গা। ভাবছেন একটা মাত্র দিনে আমরা এত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, কারণ আমরা এই ঝটিকা সফরের সিদ্ধান্ত করলাম সকাল ৮ ঘটিকায়, তারপর রেডি হয়ে বেরিয়ে আরো ২ ঘন্টা ড্রাইভ করে এলাম এই পার্কে, তারপর সারাদিন ঘুরে, বনভোজন করে আমরা নিশ্চয়ই ক্লান্ত। না! তা একেবারেই নয়, ভাবলে অবাক লাগে এই পার্কটি ঘোরার পর পাশাপাশি আরো ৩টি পার্ক সেদিন ঘুরেছিলাম।
মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই আমরা দেখতে পাবো মানুষ একসময় যাযাবর জীবন ত্যাগ করে ঘর বাঁধতে শুরু করলো। মানুষ স্থিত হল একটি নির্দিষ্ট স্থানে। সেই স্থানই হল তার বাসস্থান, তার দেশ। কিন্তু মানুষের মন এখনও সুদূর পিয়াসী। চিরকাল মানুষ বন্ধন অসহিষ্ণু। চেনা জগতের গণ্ডি ছাড়িয়ে অচেনা অজানা জগৎকে জানার আকাঙ্ক্ষা তার চিরকালের। তাই বার বার সব বাঁধন উপেক্ষা করে মানুষ পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, অরণ্য, অজানা জনপদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ভ্রমণ সংকীর্ণতার প্রাচীর ভেঙে প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করে। বেশির ভাগ ভ্রমণ করার সময় নিজের হাতে নিজেকে চালনা করতে হয়, এর মধ্য দিয়ে অনুশীলন হয় স্বাবলম্বন শক্তির। সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে মনে।
মানুষ হিসেবে অজানাকে জানার জন্য আমাদের আগ্রহ অনেক, অনন্ত উৎকণ্ঠা। আর সেই অভাব পূরণ করার জন্য আমরা ভ্রমণ করি। তাই অজানাকে জানার জন্য পৃথিবীর দুয়ার খুলে বেরিয়ে পড়ি বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ভ্রমণ করে আমরা লাভ করতে চাই প্রকৃত আনন্দ। ভ্রমণ যে আমাদের শুধু আনন্দ দেয় তা কিন্তু না। ভ্রমণের ফলে আমাদের জ্ঞানের পরিধিও বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিনের জীবনে নানান ঝামেলা ঝঞ্জাট ইত্যাদি লেগেই আছে। আমরা এরকম একভাবে প্রতিদিনের নিয়ম মাফিক কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আর তখনই আমাদের দেহ মন চায় একটু প্রশান্তি যা একমাত্র ভ্রমণের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব ডানস জলপ্রপাতের দিকে বাঁক নেওয়ার ঠিক আগে চুনকি নদীর একটি সুন্দর দৃশ্য বাদে খুব বেশি কিছু নেই। কাছাকাছি যাচাইয়ের আরেকটি জায়গা হ'ল সঃটুকই ব্রিজ। এটি ডানস জলপ্রপাতের উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ২০ মিনিটের ড্রাইভ। ১৯০০ এর দশকের শুরুর দিক থেকে এটি চুনকি নদীর ওপারে বেশ পুরানো লোহার সেতু। এটির একটি ইতিহাস রয়েছে এবং একটু ভুতুড়ে ভাব রয়েছে তবে আমরা সেখানে থাকাকালীন কিছুই অনুভব করি নি।
এরপর আমরা চলে গেলাম মেরিডিয়ান শহরটা একটু ঝলক দর্শন করতে। মিসিসিপির বুকে অত্যন্ত পুরোনো একটি শহর এই মেরিডিয়ান। সত্তরের দশকের এই মেরিডিয়ান শহরটি অত্যন্ত নিপুণভাবে সাজানো একটি শহর। বেশকিছু বিল্ডিং দেখলেই বোঝা যায় কত পুরনো। শহরটি নিতান্তই ছোট হলেও বেশ পরিপাটি। বেশকিছু ভারতীয় এই শহরে থাকে। আমরা ড্রাইভ করে শহরটি একবার পরিক্রমা করে নিলাম। শহরের ডাউনটাউন অর্থাৎ শহরের মধ্যবর্তী আকর্ষণীয় জায়গা সেটাই আমরা মূলত দেখলাম। এরপরে আমরা চলে গেলাম মেরিডিয়ান শহরের বনিতা লেক পার্ক দেখতে। ইন্টারনেটে আগে থেকেই দেখে নিয়েছিলাম এই শহরে একটি খুব সুন্দর লেক বিশিষ্ট পার্ক আছে। এই পার্কটি একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো দুটো লেকের মাঝখান দিয়ে একটি খুব সুন্দর ওয়াকিং ট্রেন এবং গাড়ি ড্রাইভ করার রাস্তা আছে। এখানে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি ড্রাইভ করলাম। তারপর একটি খুব মনোরম পরিবেশ লেকের ধারে দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণের জন্য গাড়িটা দাঁর করিয়ে লেকের ধারে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। প্রকৃতির শীতল হাওয়ায় এরকম মনোরম পরিবেশে অসাধারণ একটি অনুভূতি হচ্ছিল। এই বনিতা লেক পার্কে বেশকিছু ট্রেন আছে এবং সাইকেল চালানোর রাস্তা আছে যেখানে আমেরিকানরা প্রায়ই আসে হাইকিং করতে এবং সাইকেলিং করতে। এদের সাইকেল চালানোর উদ্দেশ্য মূলত শরীরচর্চা। দেশে আমরা সাইকেল ব্যবহার করি নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু আমেরিকানরা সাইকেলিং তাকে একটি এক্সারসাইজ মনে করে তাই প্রতিদিনের গাড়ি চালানোর অভ্যাস থেকে একটু বিরত থেকে মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এরকম কোন ফাকা পরিবেশে।
আমার যেটা চোখে পড়ল এই পাড়টা খুবই নির্জন এবং শান্তিপূর্ণ। উইকেন্ডে সেরকম মানুষের ভিড় দেখতে পেলাম না। কাছাকাছি ফ্যামিলি নিয়ে ঘোরার জন্য খুবই সুন্দর একটি পার্ক। এই পার্কে আরও একটা জিনিস দেখতে পেলাম আমার খুব অদ্ভুত লাগল। একটা পাথরের অংশ কিছুটা মূর্তির মত দেখতে লেকের ধারে রাখা আছে। আমার সেটা কি দেখে অনেকটা ছোট্ট গোবর্ধন পর্বত এর মতো লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ক্যামেরাটা নিয়ে চলে গেলাম সেই পাথরের কাছে।
অদ্ভুত আকৃতির এই পাথরটির বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করলাম। লেকের ধারে ধার দিয়ে এত সুন্দর যে হাঁটার ব্যবস্থা থাকতে পারে সেটি এখানে না এলে বোঝা যাবে না। আবার শুনেছি অনেকে নাকি এখানেই বিয়ের ছবি তুলতে আসে। বনিতা লেকটি মেরিডিয়ান শহরের একটি লুকোনো সম্পদ। সেখানে আর বেশিক্ষণ না থেকে আমাদের পরের লিস্টে আরেকটি স্টেট পার্ক ছিল। এখানে বেশী সময়ে থাকলে পরের আকর্ষণগুলো আমরা মিস করবো তাই তাড়াতাড়ি আমরা আবার ড্রাইভ শুরু করে দিলাম কারণ আমাদের সেই দিনই রাতের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।
গভীর জঙ্গলের মধ্যে ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ একটি লুকোনো কোন জায়গায় লেখা আছে ক্লার্কো স্টেট পার্ক।এই পার্কটি মেরিডিয়ান শহর থেকে একটু ছাড়িয়ে উইট ম্যান বলে একটি শহরে অবস্থিত। এই পার্কে ঢুকেই যেটা দেখলাম সেটা হল একটি বিশাল বড় লেকের মাঝখান দিয়ে একটি ছোট্ট ব্রিজ তাও সেটা নড়বড়ে তার উপর দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে যেতে হবে পার্কের অন্য প্রান্তে। প্রথমে আমার বেশ ভয় ভয় করছিল তারপর আবার মজাও লাগছিল কারণ এটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি অনুভূতি। এই পার্কের যেটা মূল বৈশিষ্ট্য সেটা হল অনেক কেবিন বা কটেজ আছে এই পার্কে।
ভ্রমণপিয়াসী মানুষ বিশেষত প্রাকৃতিক প্রেমী যারা তারা এই কেবিনে থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করে। উইকেন্ডে বাজে কোন ছুটির সময় এই কেবিনগুলো মানুষ বুক করে। কেবিনগুলো হচ্ছে লেকের ধার বরাবর অবস্থিত অর্থাৎ এই গুলোকে বলা হচ্ছে লেকফ্রন্ট কেবিন। লেক ফ্রন্ট কেবিনগুলো মধ্যে থেকে প্রকৃতিকে এত সুন্দর অনুভব করা যায় তা এই লেকের ধারে বোঝা যায়। এই পার্কেও আমরা বেশ কিছু সময় কাটালাম। বিশাল বড় একটি লেক তার পাশে একটি বড় ফ্যামিলি গেট টুগেদারের বাড়ি। সেই বাড়িটি ভাড়া নেয় ফ্যামিলি
গেট টুগেদার করার জন্য। দেখলাম লেকের মধ্যে অনেকেই স্পিডবোট চালাচ্ছে। মাঝ বয়সী আমেরিকান ছেলেমেয়েরা খুব আনন্দ করছিল লেকের মধ্যে। তারা হৈ হুল্লোড় করছে এই দেখে আমরা কিছুক্ষণ সেই লেকের ধারে বসে থাকলাম। যাই হোক ঝরনা দেখতে এসে উপরি পাওনা হিসেবে লেকের সুন্দর দৃশ্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। আমার মনে হলো এই লেক দুটো না দেখলে আমাদের আজকের ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেতে। ঝর্নার জলরাশির প্রবাহমানতা এই দুটি লেকে এসে মিলে গিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যতাকে অতিমাত্রায় রঞ্জিত করল। সেই সঙ্গে আমাদের মিসিসিপির ঝরণা দেখতে আসা সার্থক হল। এইবার বাড়ি যাওয়ার পালা।
এরপর বাড়ির উদ্দেশ্য গাড়ি ছুটছে, পথে দূর থেকে লক্ষ্য করলাম একটি হরিণ রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু বিকেলের শেষ সময় হল হরিণদের রাস্তায় দেখতে পাওয়ার সময় , সেরকমই লেখা থাকে রাস্তার ফলক চিহ্নতে। দূর থেকে আমরা গাড়ি স্লো করে দিলাম, খুব কাছ থেকে দেখলাম হরিণটি খুব সাবলীল ভাবে রাস্তা পাড় হয়ে আবার জঙ্গলে প্রবেশ করল। আজ সফরের স্মৃতির ঝুলিতে এটি উপরি পাওনা হয়ে রইল। এরপর পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমরা বাড়ি পৌঁছলাম এক রাশ ভ্রমণের স্মৃতি ভর্তি ঝুলি নিয়ে।
কবিতা
মিজানুর রহমান মিজান
সিলেট, বাংলাদেশ
অবদান
গাই বিজয়ের গান
বীর জনতার দান
ত্যাগের অপূর্ব নিশান
কেমনে ভুলি অবদান।
হানাদার করল শুরু যুদ্ধ
বীর বাঙ্গালী হল ক্ষুব্ধ
অস্ত্র আর কৌশলে করল স্তব্ধ
নয় মাসে হল জব্দ
পেলাম পরিত্রাণ।
বাংলার ঘরে ঘরে দেয় আগুন
হয়ে নিষ্ঠুর নিদারুণ
সম্ভ্রম কাড়ে মায়ের হস্তে সুনিপুণ
নির্যাতনের রোল উঠে সকরুণ
বাঙ্গালী অমিত তেজে হয় আগুয়ান।
সর্বক্ষেত্রে হানে আঘাত
করতে চায় বাঙ্গালী নিপাত
শপথে বীর জনতা করে প্রতিঘাত
জব্দ হয় ওরা হঠাৎ
উড়ে লাল সবুজের নিশান।
আঁধারে ঢেকেছে
চাঁন মিয়ার আশ্রয় হল না মা বাবার কাছে
আমার বাবার আশ্রয় হল না ভাইবোনের কাছে
গান গাইলেন মন জোগাইলেন দেশবাসীর জানা আছে।
বাড়ি তোমার জয়নগরে কবর বিলপাড়ে
সব হারাইয়া একা কেন আশ্রয় হল দুরে
বাড়ির পাশেই ঠাঁই হবার কথা ছিল চিরন্তনীতে রয়েছে।
কিবা ছিল তোমার দোষ বলে যাও আমারে
দুরের বাসিন্দা তুমি সন্তান থাকে জয়নগরে
মধ্য পথের পথিক হলাম কি কারণে জবাব কি আছে।
করোনা ভাইরাস শিক্ষা দেয় কেহ নয় কাহার
তারপরেও ছাড়ে না জিদ আর অহংকার
সন্ধ্যা বাতি আজ নিভু নিভু আঁধারে ঢেকেছে।
কবিতা
গেঁয়োযোগী
(ধীমান চক্রবর্তী)
যাও তবে
তোমার দুচোখ
ক্লান্ত বড়ো আজ..
তাকিয়ে আছি বসে তোমার কাছে..
চাইছি সে চোখ
আবার উঠুক জ্বলে..
ঝরাও আগুন যাবেই যখন চলে..
আর একটি বার দগ্ধ হতে চাই..
অগ্নিশুদ্ধ পবিত্র সেই ছাই..
পোড়াও আমায়!..
বাঁচবো আমি সেই আগুনের আঁচে!
তোমার দুহাত
ভরা আমার মুঠো..
তবু তোমায় আটকাতে পারবো না..
থাকবে তুমি
আমার সকাল সাঁঝে..
কাজের ফাঁকে হঠাৎ ছুটির সাজে..
হাসির আলোয় ভিজবে যখন..
.. মনখারাপের হাওয়া..
না পাওয়া সেই রামধনুতেই..
.. তোমায় খুঁজে পাওয়া..
.. চালিয়ে যাবো! বাকি জীবন..
তোমার খোঁজে চেষ্টা তো ছাড়বোনা!
অহল্যা তোমায়
হে অহল্যা ভূমি..
ঊষর বন্ধ্যাত্ব গ্লানি
কতোদিন মেনে নেবে তুমি?
আদিম আবহমান নিরাপত্তা..
আর কতোদিন?
পাড়ের বাঁধন মায়া ত্যাগ করো যদি
শঙ্কাবিহীন..
দুকূল ছাপিয়ে দেবো!
এনে দেবো চির উর্বরতা..
হয়ে যাবো বেপরোয়া নদী!
ভেসে যাক লোকভয় সঙ্কোচ আজ..
মুছে যাক অশালীন জড়তার সীমা,
অসীমের আলিঙ্গনে পূর্ণতা পাক..
চুরমার হয়ে যাক ভেঙে..
আরোপিত কৌমার্য মহিমা!
তোমার আমার সৃষ্টি অমরত্ব পাক
.. তুমি আমি নাইবা পেলাম!
নিয়তির দিকে চেয়ে
বলে যাই হেসে..
"অহল্যা সময়!..
শুধু তোকে ভালোবেসে..
নিঃশেষে..
অনাঘ্রাত শ্যামলিমা আমিই দিলাম!"
!! জীবন নাইয়া!!
হঠাৎ..
শতেক যোজন পার
আমি..
যেতেই পারি চলে
আমার..
আগলভাঙা দ্বার
যাবো..
ঘরের মায়া ফেলে
এখন..
কী আছে বলবার
যাবো..
কিচ্ছুটি না বলে!
যেদিন..
বলার ছিলো ঢের
সেদিন..
শুনিস নি তো কেউ
আজ..
শুনতে চাইলে ফের
শোন..
সিন্ধুপারের ঢেউ
যেন..
ভাঙছে কালের পাড়
দূরে..
নামছে অন্ধকার!
তবু..
অন্ধকারের দেশে
যদি..
আসতে পারিস ভেসে
ভেঙে..
বন্ধ ঘরের দোর
তবে..
দেখবি নরম ভোর
কেমন..
আলোর হাসি হেসে
ওঠে..
আঁধার পথের শেষে!
তবে..
দে ভাসিয়ে নাও
ছেড়ে..
যতেক পিছুটান
বাঁধ..
ছেঁড়া মনের পাল
ধর..
ইচ্ছে গুলোর হাল
পড়ে..
থাকুক ভাঙা খাঁচা
আগে..
বাড়ুক সে সাম্পান
ফেলে..
আধমরা সব বাঁচা
গেয়ে..
এগিয়ে চলার গান!!
তোর জন্যে
ছন্দেরা সব উড়তে থাকে..
তোরই আশেপাশে,
যেমন করে গঙ্গাফড়িং ওড়ে..
ভোরের আলো ডানায় মেখে..
শিশিরধোয়া ঘাসে!
শব্দগুলো তোর ছোঁয়াতেই..
আসতে পারে নেমে,
যেমনি করে পাহাড়ী এক নদী..
সহজ গভীর হয়ে ওঠে..
সমভূমির প্রেমে!
ভাবনাগুলো ভাব করে নেয়..
আমার মনের সাথে,
যেমন করে দিগন্ত যায় মিলে..
আকাশ তাকে দিলে ছুঁয়ে..
তারায় ভরা রাতে!
তোর দিকেতে চেয়েই আমার..
পদ্য লেখা খেলা,
কিশোরবেলার টুকরো স্মৃতি জুড়ে..
মাঝবয়েসেও ভাসাই আমার..
পদ্যপাতার ভেলা!!
ছন্দেরা সব উড়তে থাকে..
তোরই আশেপাশে,
যেমন করে গঙ্গাফড়িং ওড়ে..
ভোরের আলো ডানায় মেখে..
শিশিরধোয়া ঘাসে!
শব্দগুলো তোর ছোঁয়াতেই..
আসতে পারে নেমে,
যেমনি করে পাহাড়ী এক নদী..
সহজ গভীর হয়ে ওঠে..
সমভূমির প্রেমে!
ভাবনাগুলো ভাব করে নেয়..
আমার মনের সাথে,
যেমন করে দিগন্ত যায় মিলে..
আকাশ তাকে দিলে ছুঁয়ে..
তারায় ভরা রাতে!
তোর দিকেতে চেয়েই আমার..
পদ্য লেখা খেলা,
কিশোরবেলার টুকরো স্মৃতি জুড়ে..
মাঝবয়েসেও ভাসাই আমার..
পদ্যপাতার ভেলা!!
কবিতা
সাইদুর রহমান সাঈদ
পটুয়াখালী, বাংলাদেশ
চিরপথিকের বিলাপ
একদিন আমি চলে যাব!
একদিন আমি হারিয়ে যাব সুদূর অজানায়,
আমায় এত আকুল-আদরে ডাকেনি কেহ.......
সেদিন ডাকবে আমায়_জিদের মিনায়!
এতকাল এতজনের এত নিকটে ছিলেম
হেঁটেছি-চলেছি-দেখেছি,
মনের বাসনাতে আড়চোখেও কেহ_দেখেনি আমায়,
কারণ,
আমার যে দু'পাতা মেলা!!
সেদিন বন্ধ-আঁখি দেখিবারে_
আসবে দলেদলে দরজায়!
ডাকবে আমায়_মসজিদেরও মিনায়!!
সেদিনও হয়তো......দু-দণ্ড স্থবির হবেনা পা কারো,
কোনো আঁখির পাতা.. কোমলে হবে না জড়ো,
তবু!
আমাকে তারা দেখবে,
দেখতে আসবে দলে-দলে
গভীর আগ্রহ আর মনের বিহ্বলে!
চলে যাব!
চলে যাব আমি সুদূর অজানায়,
আমি দেখেছি এসব কিছু...মনের আয়নায়!!
নেইতো আজ পদযুগল,
তবু, খোঁড়ায়ে চলেছি_বিশাল সমুদ্রের মাঝে।
কেহ আমায় আজো কোলে তুলে নাই
মম স্কন্ধ আজও কারো হাতটি পায় নাই।
আজও আমার মলিন বদন... বিশ্রী গন্ধে কলেবর!
তাই,
সবাই করেছে পর!
হয়ত পরেও থাকিব পর!
সেদিন আমায় গোসলও করায়ে, কাফনও পরায়ে
দিয়ে দিবে সে-কোন অচিন বহুদূর!
সেদিনও কেহ কোলে নেবে না কো
যদি না দেই আতর-সুগন্ধি ভরপুর!!
জীবনে কভু পাইনি কাহারো হাত,
আমার কুলি হবে সেদিন_জানিনে কোন চার কাঁধ!
ফেলে দিবে গোরে.....শত যত্ন ও আদরে.............!
হে!
ওহে ধূলির ধরা-মহী!
বেঁচে আছি বলে আমি কি তোমার বোঝা?
অন্ন জোটেনি, কারো গ্রাস তো কাড়িনি
সয়েছি গো আমি রোজা!
বেঁচে আছি_কভু হাতটি ধরে সম্মুখে আসো নাই,
চলে যাব যবে, এসো পিছে তবে.....আনন্দের জানালায়!!
কবিতা
স্বরূপ ঘোষ
সন্তোষপুর, কোলকাতা
ক্ষুধার পরিহাস
ছোট ছেলেটির খাওয়া হইনি আজ,
খুঁজে পায়নি সে তার মা’কে সকাল থেকে।
বাপকেও বলতে পারেনি সে খিদের কথা।
খিদের জ্বালাই আজ মিটিয়েছে তার ক্ষুধা।
একদিন এই ছেলেটিই ক্ষুধা মিটিয়েছিল
তারই মত ছোট ছোট ছেলেমেয়ের।
কিন্তু আজ তার ক্ষুধার রাজ্যে,
দেখা নেই কারও তাদের।
চোখের লবণ ভরা জল
তাই আজ মিটিয়েছে তার তৃষ্ণা।
রাত হয়েছে।
আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে সে ভাবে
গদ্যময় পৃথিবীর কথা।
রবি ঠাকুরের জ্যোৎস্না,
না কি মোহিত বাবুর মিছে আনন্দ!
ভাবতে ভাবতে আজ ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
সকাল হবে কাল
ফুটবে এক নতুন দিনের আলো।
তিনদিনের না খাওয়া পেট
জানান দেবে ক্লান্ত ক্ষুধাই ভাল।
পেটে আর হবে না জ্বালা তার,
পাচন পথে মিটবে ক্ষুধা
জানিয়ে এক অশ্লীল হাহাকার।
তবুও তো ভোর হবে,
পাখির ডাকে খুলবে দুয়ার
রচিয়া নিত্য দিনের অলঙ্কার।
বাজবে কোথাও আগমনীর সুর,
ভুলবে সবাই ওই ছেলের ক্ষুধার কথা
পরিচিত সমাজে নির্বাক সেইসব গাঁথা।
চেনা সুর
ফুটেছে ফুল আজ বলাইয়ের শিমূল গাছটায়।
দেখা গেছে ওই চড়ুই পাখিটিকে,
যেটি ছিল লুপ্ত বহুদিন কোন এক যন্ত্রণায়।
আকাশে এখন তারারা ওঠে নিয়মিত।
বৃষ্টি হয়, কোকিল ডাকে;
ফুলগুলো ফোটে চির বসন্তকে করে প্রস্ফুটিত।
ফুল কেউ ছেঁড়ে না, গাছও কেউ কাটে না;
দূষিত বায়ুতে আজ হয় না ওদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
সবুজ ধানের ক্ষেত হয়ে ওঠে আরও সবুজ,
গঙ্গাবক্ষের কুলকুল স্রোতে আজ প্রাণোচ্ছল স্পন্দন।
প্রতিদিনের খেলার শেষে খোকা
ঘুমোয় এখন মায়ের কোলে।
গল্প শোনে রোজ বাবার কাছে চোখ বুঝে।
খুকি ভাবে বাবাটা কেমন যেন বদলে গেছে,
প্রতিদিনের যন্ত্রগুলো ফেলে এখন ওর মত বই পড়ে।
স্বপ্ন দেখে খুকি এক আশ্চর্য রূপকথার,
যেখানে নেই রাজা, নেই রাণী, নেই কোন ব্যথা।
আছে শুধু মা, বাবা
আর ওর খেলার সাথী ছোট্ট খোকা।
আছে বাস্তব ও রূপকথার মাঝে ঘুম না ভাঙা মায়ার খেলা।
কবিতা
অনীক চক্রবর্তী
হোয়াইট ফিল্ড, কোন্ডাপুর
হায়দ্রাবাদ, তেলেঙ্গানা
সানুতলে
চাঁদের ছায়ায় মাখা ইউক্যালিপটাস গন্ধ। পাহাড়ে পাহাড়ে দেবদারু স্বপ্ন। ভেসে বেড়ায় বনলতার আদিম শিহরণ। চাঁদিম অরণ্য অমোঘ মায়ায় স্নাত। জোছনা নিপুণ
অতলান্ত দেহ্রাদুন।
কাছে ডেকে লও
মাঝে মাঝে খসে পড়া টিকটিকির বাসি লেজের মত বিবর্ণ এক স্বপ্নের ভিতরে
চাঁদটাকে গলা টিপে খুন করতে ইচ্ছে করে।
নির্বাসন! নির্বাসন? কে দেবে আমায় নির্বাসন?
কার স্পর্ধা এমন অসাধারণ?
স্মার্ত
আছো কি? শুনতে কি পাও আর্ত ক্রন্দন?
বলতে কি পারো কেন এমন ক্ষমা অরণ্যের?
আদিম অদম্য স্থবির
পরব্রহ্ম প্রাজ্ঞ
জানোনা কি আমরা তোমার অশ্রুর অযোগ্য?
বোঝোনা কেন এই বিদ্বেষ, এই হিংসা
নিঃসীম?
অ-শেষ?
একদিন ফিরে যাবো, আবার তোমার সন্তান হবো।
নত জানু তোমার কোলে বেছে নেবো আমার নির্বাসন।
শত শতাব্দীর ঘুম যারা কেড়েছে আমার, সেই অন্ধকার আর নয়
এবার আমার পাখির বাসা বিবর শীতল শ্যামল নির্ভয়
এবার আমার সবুজ বেলার দুরন্ত অনন্ত লয়।
ত্রসন
একদিন
সর্বস্বান্ত হতে চেয়েছিলো সোনাঝরা রোদের চোখে ঘুঙুর পরা চাঁদের আলোর বুকে বৃষ্টির স্বপ্ন মেখে খেলে বেড়িয়েছিলো খামখেয়ালে ছড়িয়েছিলো নীল হাসি
এক ঝাঁক
আকাশ জুড়ে উড়ে গিয়েছিলো তখন যখন মহাকাল ছিলো সবুজ আর ঘাসে ঘাসে বোনা থাকতো গাঙ্ফরিঙের গুঞ্জন। ইতিহাস ঘাসফুলের কথা বলে না।
ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে পার্থিব কান্না ধুলোর ঝড় হয়ে আলাপ-জোড়-ঝালায় ঘূর্ণি নাচে আর দিনে দিনে হয়ে ওঠে রক্তচক্ষু
চন্ডাশোক
হানাদার উপড়ে নেয় আশ্বিন, এগিয়ে চলে পিশাচ, উল্লাসের ইমারত হাড়ের পাহাড় জমে ওঠে, রক্তস্রোত বন্যায় উপচে পড়ে নীলনদ, পদ্মার পাড়, ত্যেভেরে। প্রাসাদে বাজে বীণা।
আগুন-রাঙা চোখে উন্মাদ ত্র্যম্বক
নীরো
কপটাশ্রু রক্তবীজ সোঁদা মাটির গন্ধে সমুদ্রের রন্ধ্রে। নগরে নগরে বিষ হাওয়ায় সাপের শিস।
রক্ত চাপ চাপ রক্ত রক্তাক্ত পিপাসায় অন্ধ
ধৃতরাষ্ট্র
অক্ষমনিয় সময় মুখ লুকায় উন্মাদ রক্তের মরীচিকায় মড়ক সিক্ত গান্ধারী শিকল হাতে নগ্ন জল্লাদের পুনঃসরণ
ত্রসন
কবিতা
সুমন গাম্ভীর
প্রতি বৃষ্টিতে
প্রতি বৃষ্টিতে গরম বাষ্পের মতো ধোঁয়া ওঠে,
তপ্ত মাটিতে জল পড়লে যেমন হয়,
গন্ধটা মনে পড়ে?
মেঘের সাথে কিছু কবিতার লাইন আসে,
কিছুটা ঝাপটা, কিছু গানের সুরে।
সিঁড়ি বেয়ে আসা প্রেম, জলের তোড়ে
তখন ওখানেই পিছলে পড়ে।
মিষ্টতার খরা হৃদয় জুড়ে বহুকাল
তবু পাঁজরের খাঁজে খাঁজে পিঁপড়ে,
কিসের আশায় যেন হেঁটে চলে।
অ্যাসিড বৃষ্টি বুঝি, এভাবে শরীরে
পড়ে, নাহলে কেন জ্বলে?
ধুলো পরে যাওয়া স্মৃতিগুলো,
ভিজে পরিষ্কার হয় ওতে।
রোদে পুড়ে, অপেক্ষায় রাত জেগে থাকে,
যদি ভিজতে পারে আরেক বৃষ্টিতে।
কবিতা
বিধান জানা
শ্রীরামপুর, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ
একটি সকাল
কথা ছিল তোমাকে নিয়ে
নতুন একটা জায়গায় যাওয়ার
চলো তবে আজ যাই
না সাজলেই যে তুমি সবচেয়ে সুন্দর
তা তো বলেইছি অনেকবার
না সেজেই চলো তুমি আজ
আর সঙ্গে যাবে তোমার সেই
ছোট্টবেলাকার ফ্রকপরা মন
দেখো তোমার ভালো লাগবে খুব
সেখানে মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে
গরুর গাড়ি চোখে পড়বেই
দেখতে পাবে ধান ক্ষেতে
নেচে বেড়ায় সকালের রোদ
মাঠের শেষটা যেন ধোঁয়ায় মিলিয়ে যায়
খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার উনুন
দেখবে একদম অন্যরকম
ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে হাঁস মুরগী
গরু ছাগল অবশ্য সব বাঁধা
বটগাছের তলায় বাঁশের মাচা আগের মতই
এই সকালেই দেখবে জুটেছে কয়েকজন
পুকুরঘাটে বৌয়েরা বাসন মাজছে
গা ধুচ্ছে কেউ কেউ ওপারে বাঁশবন
একটু দূরে নিমকাঠিতে
দাঁত মাজতে মাজতে মস্করা করছে
রসিক দেওর দু’ একজন
খেজুর গাছে রস জমছে মাটির কলসীতে
মাঠে মাঠে সরষে ফুলের রাশি
কি অপূর্ব অনিন্দ্য সুন্দর
চোখ বড় কোরোনা অমন
তোমার চেয়ে সুন্দর বলিনি আমি
নয়ও তো, হবেও না কক্ষনো কেউ
তুমি তো জানো আমার বলার ধরন
হাঁটতে হাঁটতে কলাইশাকের জমির ভিতর
ছিঁড়ে নেব দু’একটা শুঁটি
একটু এগিয়ে গেলে আবার বাড়ি ঘর
আবার পুকুরঘাট হাঁস চই চই
এ শীতেও কারো পিঠ বেশ খোলামেলা
অনেকটা দেখা যায় মাখন পিছল
কিন্তু দু’এক জায়গায়
আমি দু’ হাতে তোমার চোখ ঢেকে
নিয়ে যাব আস্তে আস্তে
এই সকালেও পাকিয়ে উঠছে
পোড়া গন্ধ, অন্যরকম ধোঁয়া
বোবা কান্না শীতে কুঁকড়ে যায়
নধর দালান আধশোয়া
পাশাপাশি ঘরবাড়ি চিতার মতন
পোড়া পোড়া খড়ের ভিতর
আধপোড়া বুক পিঠ আবছা দেখা যায়
অস্থি অঙ্গার না কি কয়লা কাজল
হেথা সেথা ছেঁড়া পোড়া পতাকা পোস্টার
কালো ধোঁয়া মুছে ফেলে দেওয়াল লিখন
আচমকা থমকে থাকা কালো রক্ত স্রোত
এই শীতে জমে গিয়ে আড়াআড়ি রাস্তা কেটেছে
দেখো আমি ঠিক পার করে নিয়ে যাব
আমি জানি তুমি সেই ‘রাজর্ষি’র হাসির মত
বেদনায় বলে উঠবে, ‘এত রক্ত কেন’
এর কোন জানিনা উত্তর
তার চেয়ে চোখ ঢাকা থাক
লোকে বলে আজকাল এরকম হয়
একটু পেরিয়ে গিয়ে
আবার পুকুরপাড় বটতলা মাচা
আবার খেজুর রস রসিক দেওর
অনেকটা খোলা পিঠ রোদের আদর
আবার সুন্দর ঘর নিকোনো উঠোন
আবার শৈশবের সেই ফ্রকপরা পথ।
কবিতা
অরুনাভ সর
শ্রীরামপুর, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ
নির্বোধের বাক
বীরেনবাবু বড্ড বকেন, তাই নিয়ে খুব চর্চা হয়
বলতে পারো এটা নিয়ে চর্চা করাটা বকা নয়?
বেশি বকে তাই কানের পোকা মরে যায় তাতেই,
বলতে পারো, কেমন লাগে কোন পোকা জ্যান্ত
থাকলে তোমার সাথেই?
বড্ড বকেন যখন কি খুবই খারাপ লাগে?
বলতে কেন পারোনা তখন
"বীরেনদা পয়েন্ট এ আসুন আগে"
নাকি কথাটা খুব খারাপ লাগে যায় নাকো বলা
কথাতে তো কানই দেননি, দেখিয়েছিলেন কলা
স্পষ্ট করে বলোতো তোমরা কি ভেবে বলো?
কী জিনিস, কখন মাথায় কী ভাবে নিয়ে চলো
তুমি যখন কথা বলো করো খালি মজা?
বাকি রা বললে তাদের হেনস্থা?!
"তোমরা তো সব ভজা"?!
এসো দুটো কথা বলি, কথার খেই থাকলে থেকে
তখন আবার দুমুখো হয় এ বসোনা যেন বেঁকে
অকালের নিয়তি
পুলিশ বাবু ডাইরি করো, পা টি ধরি চেপে,
পুলিশ বলে - করছেন কী! গেলেন নাকি ক্ষেপে?!
জলদি বাবু ডাইরি করেন, কাল ঠিক মাঝ দুপুরে
বানের জল এসে,
তুলে গেছে কন্যা নিয়ে, বাড়ি গেছে ভেসে,
বাড়ি গেছে জলের তলায়, জীবন গেছে ডুবে,
তাড়াতাড়ি ডাইরি করেন, সূর্য নেই আর পূবে,
দাঁড়ান .. নাম - ধাম বলুন,
চিন্তিত হওয়া ছেড়ে চুপটি করে বসুন,
কিভাবে বসি বলেন, গিন্নি হসপিটালে,
শুনছি নাকি প্রাণটা যেতে পারে এই অকালে
জ্ঞান ফেরেনি যে বলবো কিনা কন্যা গেছে ভেসে,
দানব সে এক নিয়ে গেছে বন্যা রূপে এসে,
পুলিশ এর হাতের পেনটা আলগা, সরছে না আর বল,
`
চাষী ভাই এর চোখটা লাল, করছে ছলছল,
থানায় আজ সকাল থেকে তাই তো অনেক ভিড়,
কারুর উড়েছে ঘরের চাল, কারুর হয়তো পারিবারিক সংহতিতে ধরেছে চিড়,
একটি পাতা কোন খান থেকে আসে থানার দরজার পাশে,
কেই বা বলতে পারে, আজকের কোথাকার হাওয়া কাল
কোথায় আসে!
লকডাউনে ঘরে থাকুন
লকডাউনে বসছি ঘরে সময় দৌড়ে যায়,
কি যে করি আর না করি তাই ভেবে না পাই,
দাবার গুটি বেরং লাগে মোবাইল এ মত্ত,
তাই বোধয় ভুলতে বসেছি মোদের মজার আসল শর্ত,
বিছানা আর মোটেই ছাড়তে চায়না আমায়,
ক্ষুধা নিবারণ টাই আজ বুঝতে পারি বিছানা থেকে নামায়,
তুমি ভাবো শরীর আজ তৃষ্ণার্ত বাইরে যাওয়ার নাম এ,
ভেবেছো কি ঘরের কাজেই গা কতটা ঘামে?,
ভাবছো এ যে দুঃখের ২০২০ সাল,
ঘরে বসে থাকতেই আমরা হয়েছি নাজেহাল !?
চাষির এসব চিন্তা কি ! আর ঘুরবে মাঠে ঘাটে,
যখন খুশি সার কিনতে যাবে বাজার - হাট এ,
এরা খাটে মোদের জন্য তুলে দিতে অন্ন,
সেইগুলো কে মুখে পুরে করি তাদের ধন্য,
আরেক ধন্য করি চলো ঘরে বসে আজ,
ঘরে বসেই বাঁচাই তাদের, মোদের বাঁচানো যাদের কাজ ||
নমস্কার
হঠাৎ কবি
কবিতা
সুপ্রভাত মেট্যা
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
অম্লমধুর
রৌদ্র ভারি হয়ে এলে
দুপুর হয় গাছের পাতায়, রান্না হয়।
ভাতের উনুনে দুঃখ পুড়ে পুড়ে তৈরী হয়
অমৃতের সুখ, মায়ের।
ম-ম গন্ধে ভরে ওঠে, আনন্দে, ক্ষুধার নতুন পৃথিবী গ্রামে।
ছেলে মেয়েদের স্নান যোগ্য বয়স তৈরী হয়
ভেতরে, নীরবে গভীর ....
আর দূরে, পুকুর পাড়ের রাস্তা দিয়ে দেখা যায়
বাবার হেঁটে আসা গামছা সখায়
অনন্তের বোঝা মাথায় নিয়ে,
গ্রীষ্ম-সময়-ধুলোর পায়ে, ক্লান্ত, অম্লমধুর...
কবিতা
সানি
শহর, ও পরিযায়ী শীত
খুব শীত পড়েছে শহরে
ডানার মানুষ কই? ভুল বুঝেছে আহা রে
আগুন জ্বলতে নেমে এল না কেউ, তখনও
হঠাৎ কুয়াশায় একে একে এলো, দাঁড়ালো
কেউ কেউ বলে গেল, ‘ওরা শীত এনেছে
তোমরা আগুন জ্বালো’।
আগুন থেকে আগুন
মানুষ থেকে আগুন
শহর এখন উনুন জ্বলছে আগুন।
বাস পুড়ছে, গাছ পুড়ছে, আকাশ পুড়ছে,
মাটি পুড়ছে, ঘর পুড়ছে।
ঘরের মধ্যে বউ পুড়ছে।
বউয়ের কোলে শিশু পুড়ছে।
শিশুর মুখে চোখ পুড়ছে।
চোখের ভিতর সংযম পুড়ছে।
উনুন জ্বলছে…..
শুধু ডানা নেই বলে পালাবার জো নেই
সীমান্তে গেলেই কারাপ্রাচীর, তাই
মানুষ পরিযায়ী নয়, বহুকাল আগে শুনেছি।
আগুন জ্বলুক আর শীত পড়ুক
ডানার সংযোজন হয়নি কখনও।
কবিতা
তনুশ্রী রায়
লাভ-লোকসান
আহা honesty, পেঁচানো সৃষ্টি
চিরকাল হাতড়ায়
প্রিয়দের বকা খায়
ভালোবাসার ক্ষুধায়আহা অনন্য, মিষ্টি, ধন্য
দিকে দিকে হাঁকডাক
তুমি করেছো সবাক
স্তব্ধ বিজয় ঢাক
আহা আনন্দ, বেকার ছন্দ
তারাখসা খোঁজা রাত
প্রতীক্ষায় প্রভাত
অধর কামড়ে দাঁত
আহা কি তৃষ্ণা, গরলে বিষ না
মাথা কুটে মরে পাপ
একি অভিন্ন শাপ
অতীত ফেলছে ছাপ।
কবিতা
অভিজিৎ চক্রবর্তী
সোদপুর, কোলকাতা
ছুটছি ইঁদুর দৌড়
সময়ের পেছন পেছন আমরাও ছুটছি
হয়ত ভেবেই নিয়েছি, নিরন্তর ছুটে চলাই জীবন৷
আমরা ছুটছি -- অর্থ, প্রতিপত্তি,ব্যক্তি, নাম, যশের জন্য
কোথায় এ দৌড় থামাবো -- বোঝাই দায়৷
মাতৃজঠরে শুরু এ ইঁদুর দৌড়, আমৃত্যু তাই চলবে৷
না:, শ্মশান ঘাটেও ইঁদুর দৌড়ের বহর আছে --
"আগে এলে আগে পাবেন" -- এ প্রথা সর্বত্র৷
টাকাপয়সা, নাম-যশের পেছনে ছুটে দেখো --
একদিন তা পাবে, কিছু না কিছু, নিঃসন্দেহে৷
কিন্তু যে মানুষের পেছনে ছুটতে চাও
তাকে জীবনে নাও পেতে পারো৷
কারণ, সে ও হয়ত ছুটে চলেছে অন্য কারো পেছনে --
এ জগৎজুড়ে ঠিক এমনি চলছে -- নিরন্তর চক্রক্রম পদ্ধতি,
সবাই ছুটছি সবার পেছনে -- অথচ কাউকে কেউ পাইনা --
আবার, আমরা কেউ ঘুরে দেখব না পেছনদিকে --
অথচ আমরা আশা রাখি:
আমাদের অভিপ্রেতগণ পিছন ফিরে তাকাবেই৷
তাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলি সতত৷
কেননা, চেষ্টা করায় কোন দোষ নেই
হা ঈশ্বর!
কবিতা
মহেশ্বর ভক্ত (সন্দীপ ঘোষ)
বাঁকুড়া, পঃ বাংলা
ভয়ার্ত রাজা
উল্লসিত প্রজার জয়ধ্বনি জপনামে ভয়ার্ত রাজা,
টলে গেছে সিংহাসন, রাজা দৌড়চ্ছেন পথে নেমে।
অস্থিরমতি মন কুরে কুরে খায়।
যেন গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে ডুবে,
জলাঞ্জলি দেয় গণচেতনার ভাবধারাকে।
ত্রস্ত, বিপর্যস্ত -- তুঘলকি মনন, কম্পিত সারাক্ষণ,
হাস্যাস্পদ -- যখন প্রতিফলিত প্রদেশের চৌকাঠ পেরিয়ে।
অবিশ্বাসে ভরপুর ভয়াতুর আজকের রাজা!
একই পদ চারজন চারদিনে, মত্ত খেলায় কর্মী বদলে --
এ কেমন রাজা?
অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশে সাম্প্ৰদায়িকতার বীজ বপনে
জুড়ি মেলা ভার!
সর্বকালের সেরা এই ভয়ার্ত রাজা।
সাজানো বাগান লন্ডভন্ড ঝড়ে,
শক্তিহীনতার অশনিসংকেতে রাজা কি আজ
সত্যি মুখোশমুক্ত রাজা?
ভ্রমণ
চারখোল
ঐন্দ্রিলা ব্যানার্জী দে
বেলেঘাটা, কলকাতা
১৭ ই মার্চ ২০২০। অসমবয়সী দশজন মানুষ চললাম বেড়াতে পাহাড়ে। তখনও পৃথিবী মানুষের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়নি। কোভিড এর ভয়াবহতা বুঝতেই পারিনি কারণ তখনও কলকাতায় সেভাবে কোনো প্রভাবই পড়েনি। আমরাও তাই সবাই হৈহৈ করে চড়ে বসলাম পদাতিক এ। ট্রেনে উঠেও কিছুই বুঝিনি কারণ ট্রেন ভর্তি টুরিস্ট। গিয়ে নামলাম NJP তে। দুটো গাড়ি বলাই ছিল।
দুটো গাড়িতে ভাগ করে উঠে পড়লাম আমরা, গন্তব্য চারখোল। কিন্তু সবার খুব খিদে পেয়েছে তাই ড্রাইভার ভাইদের বলা হল যাওয়ার পথে খাবো আর কিছু টুকিটাকি দরকারী জিনিস কিনব। কালিম্পং থেকে একটু ওপরে চারখোল। এইদিকে বহুবার এসেছি। কিন্তু এবার যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম এটা দিয়ে আগে কখনো যাইনি। বাঁ হাতে গাজলডোবা মধ্যিখানে তিস্তা এপাশ দিয়ে একটা বাইপাস বেরিয়েছে।
অপূর্ব সুন্দর রাস্তাটা, একটু এগোলেই তিস্তা ব্যারেজ। ড্রাইভার ভাই বলল "বাঁদিকে চোখ রাখুন অনেক রকম পশুপাখি দেখতে পাবেন। ওরা এখানে জল খেতে আসে।" পাখি দেখতে পেলাম তবে আর কিছু সেভাবে দেখতে পাইনি। শুধু দূর থেকে হাতি দেখেছিলাম যদিও সেটা পোষা হাতি কি না বলতে পারব না। এরপর একটু থামলাম কারণ খিদেতে সবার পেট চুঁইচুঁই করতে শুরু করেছে। ওখানেই গামলায় বোরোলি মাছ দেখলাম যেটা ওই অঞ্চলের বিখ্যাত। কিন্তু সে মাছ আর সে যাত্রায় খাওয়া হল না। টুকিটাকি কিনে আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে। ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। চারখোল যাওয়ার এই রুটটায় রাস্তা খুব খারাপ। অসম্ভব ঝাঁকুনি হচ্ছিল। মা বাবা আর পার্থদা কে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল বটে, কিন্তু ওরা আমাদের চেয়ে বেশি স্টেডি। আর ওইরকম মনোরম চারিদিক, সেসব দেখতে দেখতে শারীরিক কষ্টের কথা বোধহয় মনেই থাকেনা। পৌঁছলাম চারখোল। উফফফ কি ঠান্ডা। দরকারী কাজকর্ম সেরে নিলাম। অলোক (কেয়ারটেকার) বলল "চলুন আপনাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দি।" আরো কিছুটা ওপরে দুটো ডুপ্লেক্স আমাদের জন্য। একটার চেয়ে অন্যটা আরো কিছুটা ওপরে। বাচ্চারা অর্থাৎ আমার মেয়ে ও তার বন্ধুরা ( ঐশানী, সায়ক, অপরাজিতা, সপ্তর্ষি, সাগ্নিক) উঁচুটায় আর পাশেরটায় আমরা। ঘরে ঢুকে মনটা ভরে গেল। ঘরের একপাশে বিশাল বড় একটা খাট। খাটটার দুই দিকে বিশাল বড় কাঁচের জানলা বা বলা যায় ওই দুটো দিকের পুরো দেওয়ালই কাঁচের জানলা তাতে পরদা লাগানো। পরদা সরালেই পাহাড়, উপত্যকা, খাদ, দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ সবটা চোখের সামনে। আর কপাল ভালো থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘাও। দুপুরের খাওয়া সেরে একটু আশপাশটা ঘুরতে বেরোলাম। এত সুন্দর জায়গা ঘরে বসে থাকা যায়?
গ্যালারী - ১
ওই জায়গার সৌন্দর্য্য বর্ণনা করা খুব কঠিন। আমাদের ঘরের সামনে দিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথুরে সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়ির ধারে বাঁশের রেলিং আর রেলিঙের ধার দিয়ে গভীর খাদ। সিঁড়ি নেমে গিয়ে সামনে কিছুটা তফাতে দুটো বাঁশ দিয়ে ঘেরা বসার জায়গা যেটা পরে আমাদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছিল। সেটা হওয়ার আরো একটা কারণ ওখানে এলে তবেই নেটওয়ার্ক এর দেখা মিলত। আর চারখোলে আমাদের ওই দিনগুলোর সঙ্গী ছিল মাইকেল (কুকুর)। সারাদিন আমাদের সঙ্গেই ঘুরত। রাতে আমাদের কারুর একটা ঘরেই ঘুমোতো। সামনে উপত্যকা। উপত্যকা পেরিয়ে আরো কিছু নিচে নামলে ডানদিকে কিছু স্থানীয় লোকের বাস আর বাঁদিক দিয়ে এগিয়ে গেলে রাস্তা পেরিয়ে ঘন জঙ্গল। যদিও সেদিন সবাই ক্লান্ত তাই কাছাকাছি ঘুরে ঘরে চলে এলাম সবাই।
গ্যালারী - ২
ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পরতে শুরু করল। সেইদিনটা ক্লান্তির জন্য সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অলোকদের ডাকে ঘুম ভাঙল, চা পকোড়া এসে হাজির। সন্ধ্যে নেমেছে। বাইরে ঘন কালো অন্ধকার। শাল মুড়ি দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বারান্দায়। অন্ধকারের এত মোহময়ী রূপ পাহাড়ে এলেই দেখা যায়। সারা আকাশ জুড়ে ঝলমলে তারা, দূরে অন্ধকারের মধ্যে ছোট ছোট আলো, মনে হচ্ছিল ওখানেও তারাদের সমাহার। ওটা নাকি কালিম্পং শহরটা। বুঁদ হয়ে দেখছিলাম, অনুভব করছিলাম।পরেরদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। বাচ্চাগুলো (যদিও তারা university students) তখনও ঘুমোচ্ছে। মেঘলা আকাশ কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলল না। মনটা খারাপ। আমরা ( মা, বাবা, পার্থদা, অশোক আর আমি) বেরিয়ে পড়লাম। উপত্যকা পেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম জঙ্গলের সামনে। এত অপূর্ব চারিপাশ, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পাওয়ার কষ্ট কিছুটা হলেও কমল। রোদের তাপ বাড়ছে, খিদেও পাচ্ছে তাই ফেরার পথ ধরলাম। ফিরে এসে দেখলাম বাচ্চারা সব রেডি। জলখাবার খেয়ে trekking এ বেরোবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমাদের রিসর্ট এর আতিথেয়তা ছিল ভীষণ ভালো। প্রত্যেকেই খুব অতিথি বৎসল। খাওয়া দাওয়া ব্যবস্থাপনা সবটাই ছিল চমৎকার, বা বলা যায় খুব ঘরোয়া।যেই রাস্তাটা দিয়ে রিসোর্টে এসেছিলাম সেটা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে বাঁহাতে একটা ছোট্ট পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তার ডানদিকটা খাদ আর বাঁদিকে পাহাড়, যে পাহাড়টায় আমরা আছি। খাদের ওপারে আরো একটা পাহাড়। পাহাড়ের খাঁজে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে আরো কিছুটা ওঠা। এরপর ঠিক রাস্তা আর নেই। সেখান দিয়ে আরো কিছুটা গিয়ে সাবধানে পাথরে পা রেখে আরো বেশ কিছুটা ওপরে উঠতে হল। এই পাহাড়ের একদম ওপরে। সেখানে কিছুটা উপত্যকা যার একদিকে বেশ ঘন গাছ গাছালি। ওরা বলছিল অসম্ভব সুন্দর নাকি জায়গাটা। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে এল ওরা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে।এই বর্ণনা পুরোটাই ওদের মুখ থেকে শোনা।
কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। অন্য সব জায়গায় বুকিং বাতিল হয়ে গেল। আমাদেরও ক্রমশ চিন্তা বাড়ছিল। ঠিকমত উপভোগ করতে পারছিলাম না কোনোকিছুই। চারখোলে আরো একদিন থেকে গেলাম। ঠিক করলাম সবাই মিলে শিলিগুড়ি নেমে আসি। চেনাজানা থাকার দরুন একটা হোটেল পাওয়া গেল যেখানে শুধু আমরাই ছিলাম। ট্রেন আরো তিনদিন বাদে। তখন মনে হচ্ছিল কতক্ষণে নিজের জায়গায় ফিরব। ট্রেন বাতিল হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। ফ্লাইট এর টিকেট কেটে ফেললাম পরেরদিনের কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দিল। ২৩শে মার্চ বিকেল পাঁচটা থেকে লকডাউন। ফ্লাইট ৩টের পর। যদি লেট করে তাহলে তো কলকাতায় ফিরতেই পাঁচটার বেশি হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরব কি করে? পুরোটাই অনিশ্চয়তা। পরে শুনলাম মা, বাবার বয়সের দরুন তাদের ফ্লাইট এ উঠতেই দেবেনা (যদিও তারা আমাদের চেয়েও ফিজিক্যালি ফিট)। আমরা আর কোনোরকম রিস্ক না নিয়ে দুটো গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম ২২ তারিখ সন্ধ্যেবেলা। সত্যি বলতে কি সারারাত ওভাবে গাড়িতে বসে থাকা, মা বাবা,পার্থদার জন্যে চিন্তাই হচ্ছিল কিন্তু ড্রাইভার দাদারা এত চমৎকার গাড়ি চালালেন আমাদের কারুর একটুও কষ্ট হয়নি। মাঝে অবশ্য দুবার দাঁড়িয়েছিলাম। একবার একদম ফাঁকা একটা ধাবায়, আর একবার চা খেতে। তবে সেই রাতটায় যেমন উৎকন্ঠা ছিল ঠিক তেমনই রোমাঞ্চও ছিল। দোলাচলে দুলতে দুলতে ভোর ভোর পৌঁছে গেলাম কলকাতায়। যদিও চারিদিকে তখন অসুখের উৎকন্ঠা। তবু সবাইকে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে নিজের শহরে নিজের বাড়িতে ফেরার স্বস্তিই আলাদা।
গল্প
অরক্ষিতা
সুস্মিতা হালদার
গেস্ট ফ্যাকেল্টি অফ ল, জর্জ স্কুল অফ ল,
কোন্নগর, পঃ বঙ্গ
(১)
বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। শপিং শেষে মলের দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে আসেন সৌমিতা। এতক্ষণ মলের ভেতর এ.সি. থাকায় গরমটা তেমন বোঝা যায় নি। বাইরে এসে দাঁড়াতেই গরমের আঁচটা বুঝতে পারেন। চৈত্রমাসের মাঝামাঝি সময় হলেও গরমের দাপট ভালোই রয়েছে। বিকেলের দিকে যদিও একটু-আধটু হালকা ঠাণ্ডা বাতাস দিতে শুরু করে, কিন্তু শহরতলিতে দূষণের জেরে সে বাতাসও গায়ে এসে লাগে না। এখন উত্তরপাড়ার অবস্থাও কলকাতার মতোই হয়ে গিয়েছে। সৌমিতার বাড়ি বালিতে। তিনি এখন কাটোয়া কোর্টের অ্যাডিশনাল ডিসট্রিক্ট অ্যান্ড সেশ্যন্স জাজ। আজ কাল দুদিনই কোর্ট বন্ধ — গুড ফ্রাইডে আর ইস্টার স্যাটারডে দু’দিনই ছুটি আছে এবছর। তাই কাল রাতেই বাড়ি চলে এসেছেন। আজ বিকেলের দিকে টুকটাক কেনাকাটার জন্য বেরোন। একাই বেরিয়েছেন। ছেলের ইউনিভার্সিটির সেমিস্টার এক্সাম চলছে, গ্রাজুয়েশনের। সময় নেই তার। আর ছেলের বাবাকে সারাক্ষণ ছেলের দেখাশোনা করতে হচ্ছে, যাতে পরীক্ষা চলাকালীন সময় নষ্ট না হয়। অগত্যা ড্রাইভারকে নিয়েই বেরোতে হয়েছে।
শপিং মল থেকে বেরিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন সৌমিতা। ড্রাইভারকে কল করতে যাবেন, সেইসময় একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “এক্সকীউজ মী, ম্যাডাম। একটু সাইড দেবেন? পেরোবো।”
সৌমিতা পিছনে ঘুরে দেখেন বছর তিরিশের একটি ছেলে।
— “ও সিওর।” সিঁড়ির একপাশে সরে আসেন সৌমিতা, ছেলেটিকে পেরোনোর জায়গা দিয়ে।
ছেলেটি নামতে গিয়ে থেমে যায়। অস্ফুটে বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, “আপনি জজ্ ম্যাডাম না? ব্যারাকপুর কোর্টের?”
— “হ্যাঁ… আমি ব্যারাকপুরে ছিলাম… বেশ কয়েক বছর আগে। তুমি? ঠিক চিনলাম না তো?” অবাক চোখে প্রশ্ন করেন সৌমিতা।
— “নমস্কার ম্যাডাম। আপনি আমায় চিনবেন না। আমি একটা… মানে আমার একটা মামলা উঠেছিল আপনারই কোর্টে। আমার বোনের কেস। দেবলীনা সাহা… আমার বোন। সৌরদীপ গোস্বামী নামে একটা ছেলের এগেইনস্টে ছিল।… আপনার হয়তো মনে নেই। অনেকদিন আগের ব্যাপার তো।”
সৌমিতা কোর্টের জাজ হলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না। খুব সাধারণভাবেই যে কোন অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে মিশে যান। রাস্তায় একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও তাঁর কোন দ্বিধা নেই। পেশাগতভাবে খুব কড়া হলেও ব্যক্তিজীবনে খুবই সহজসরল মানুষটি। তাই এই ছেলেটি যখন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলো, তখন সৌমিতাও বেশ সহজভাবেই মেশার চেষ্টা করেন।
— “ঠিক মনে পড়ছে না। অনেক কেসপত্র থাকে তো। কী ব্যাপারটা ছিল বলতো।” সহজভাবেই প্রশ্ন করেন ছেলেটিকে।
ছেলেটিও বেশ সাহস পায়। ‘জজ্ ম্যাডাম’ কথা বলছেন ওর মতো একটা সাধারণ ছেলের সাথে!... গুছিয়ে, খুব সংক্ষেপে ঘটনাটা মনে পড়ানোর চেষ্টা করে।
— “হুঁ, মনে পড়েছে। … তা তোমার বোন এখন কেমন আছে? কী করছে?... তোমায় ‘তুমি’ করেই বলছি। দেখে মনে হচ্ছে, আমার চেয়ে ছোটই হবে তুমি। কিছু মনে কোরো না।”
— “না, না ম্যাডাম, মনে করার কী আছে? … বোন ভালো নেই। আমার আর ভালো থাকা!”
— “কেন? কী হয়েছে বোনের?”
ছেলেটি একটু ইতস্তত করছিল। সৌমিতাই সাহস দিলেন, “বল, কী হয়েছে বোনের?”
— “কী বলি ম্যাডাম? বোন একেবারে পাগল হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, মেন্টাল ডিসব্যালান্সটা এমন পর্যায়ে গেছে, সারবে কিনা জানি না। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু টাকা পয়সার সমস্যা হচ্ছে, সেভাবে কিছুই করে উঠতে পারছি না ওর জন্য।”
— “কীসের থেকে এরকম হল?”
ছেলেটি এবার থমকে গেল। শক্ত চোয়ালদু’টো অনেক কষ্টে একটু নড়ে উঠে অস্ফুটে বলল, “ঐ শকটা নিতে পারে নি।… বছর ছয়েক আগের ঐ শকটা। আপনার কোর্টে যে কেসটা উঠেছিল ওটায় হেরে যাওয়াটা ওর কাছে শকিং ছিল খুব।”
ছেলেটি মনে মনে ভাবল সৌমিতা হয়তো একটু ক্ষুণ্ণই হলেন। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সৌমিতা থামিয়ে দেন, “তোমরা থাক কোথায়? তোমার ফোন নাম্বার আর অ্যাড্রেসটা দিও।”
— “আমরা তো ব্যারাকপুরেই থাকি। কিন্তু আপনি ম্যাডাম… এসব নিয়ে…?”
— “লিখে দাও। কাগজ আছে? না দেব?”
— “আছে।” ছেলেটি পকেট হাতড়ে একটা চিরকুট বের করল। বুক পকেটে রাখা পেনটা নিয়ে নাম, ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে দিল।
— “এই নিন ম্যাডাম। বোনের নামে লিখে দিলাম। নাম্বারটা আমার।” চিরকুটটা সৌমিতাকে দিয়ে দেয়, “আসি এবার।”
চলে যেতে যেতে নিজের অজান্তেই একটা কথা বলে ফেলল, “এখন আর কী হবে ম্যাডাম? … যদি ওই কেসটায় একটু…”
(২)
প্রায় দশ-বারো বছর আগেকার কথা — শুরু হয়েছিল দেবলীনা আর সৌরদীপের ‘অধ্যায়’। ব্যারাকপুরের এক ছোট্ট গলিতে একটা ফ্ল্যাটে একটুকরো সংসার দুই ভাইবোনের — দেবলীনা আর দেবজ্যোতি। বাবা-মা নেই। আত্মীয়স্বজনরা থেকেও নেই। মা-বাবার মৃত্যুর পর কেউই তেমন খোঁজ রাখেন না ওদের। দেবলীনার যখন বয়স যখন দশ, দেবজ্যোতির কুড়ি, তখনই একদিন ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় তাদের মা বাবা দু’জনেই মারা যান। বোন ছোট, স্কুলে পড়ে, তাই তার দায়িত্ব এসে পড়ে দেবজ্যোতির ওপর। সেই কুড়ি বছর বয়েস থেকেই শুরু তার লড়াই — একটা চাকরির জন্য কী-ই না করেছে। শেষ অবধি এস.এস.সি.-তে একটা হাইস্কুলে টিচারশিপ পায়। বোনের কোনদিন কোন অভাব হতে দেয়নি সে। শুনতে হয়তো নীতিকথার গল্পের মতো লাগলেও তাদের জীবন এরকমই ছিল। যা হোক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ইকোনমিক্স নিয়ে গ্রাজুয়েশনে ঢুকে পড়ে দেবলীনা। দেবজ্যোতির পড়া আর বেশীদূর হয়নি । মাস্টার্সের পরেই থমকে গিয়েছিল। বোনকে দেখতে গিয়ে বিয়ে-থাও করে নি। মনে সংশয় হয়, যাকে বিয়ে করে আনবে সে যদি ননদের সাথে মানিয়ে নিতে না পারে!
ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে করতে আই.আই.এম. ক্যালকাটার একটা অ্যাকাডেমিক কনফারেন্স অ্যাটেণ্ড করে দেবলীনা। সেটা ২০০৭-০৮ সালের কথা। একটা পেপারও প্রেজেন্ট করেছিল। সেই সূত্রেই আলাপ হয় তার সৌরদীপের সাথে— সৌরদীপ গোস্বামী, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিরই কমার্সের ছাত্র; এম. কম. করছিল। সেও ব্যারাকপুরেরই ছেলে। ব্রিলিয়ান্ট বললেও ওর বুদ্ধিমত্তাকে পুরোপুরিভাবে বোঝানো যায় না। অ্যাকাডেমিক্সের সূত্রে আলাপ হলেও সেই আলাপ একটা গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকেনি। দেবলীনার প্রেমে পড়ে সৌরদীপ। প্রথমে বলতে সাহস না হলেও পরে একদিন বলেই ফেলে সে। সেই মেসেজটাও অনেকদিন পর্যন্ত সেভ করা ছিল দেবলীনার ফোনে, অন্যান্য সব মেসেজ ডিলিট করে। খুনসুটির সময় দেবলীনা একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, “কী ব্যাপার বলতো? আজকাল এতো উদাসীন বিরহী মনে হয় তোমায়! প্রেয়সী-ট্রেয়সী লাগবে? খুঁজে দেব? আমার জানা অনেক ভালো মেয়ে আছে।”
— “…আর তুমিই যদি প্রেয়সী হও?” সাহসে ভর দিয়ে মেসেজটা পাঠিয়েই ফেলেছিল সৌরদীপ। হয়তো দেবলীনাও এই কথাটারই অপেক্ষায় ছিল। সৌরদীপের প্রতি দুর্বলতা গোড়া থেকেই কাজ করেছিল তার মনে। কিন্তু দাদা কি ওকে মেনে নেবে? — এই ভাবনায় নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারে নি প্রথমে। সৌরদীপকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় পাঁচ-ছয় মাস।
দেবজ্যোতি চায় মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘরের শিক্ষিত ছেলে। যৌথ পরিবার হলেও তার বোন যেন চাকরি, কেরিয়ার এসব নিয়ে থাকতে পারে — আর পাঁচটা মেয়ের মতো হাউসওয়াইফ হয়ে নয়। সৌরদীপ যৌথ পরিবারের ছেলে; মা-বাবা, কাকু-জেঠু, কাকিমা-জেঠিমা, ভাই-বোন মিলে একেবারে ভরাট পরিবার। সৌরদীপরা দুই ভাই; সৌরদীপ ছোট। ওর আগে এক দাদা আছে। কিন্তু জেঠুর ছেলে না থাকায় জেঠু-জেঠিমা ওর দাদাকে মৌখিকভাবে দত্তক নেন ওদের মা-বাবার কাছ থেকে। যদিও কাগজে-কলমে কোন লেখাপড়া হয় নি। সৌরদীপ নাকি এই দত্তক নেওয়ার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি। সেই পাঁচ বছর বয়েস থেকে দেখছে, দাদা নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে জেঠু-জেঠিমাকে ‘বাবা-মা’ বলে ডাকছে। এটা খুব প্রভাব ফেলেছিল ছোট্ট মনে। তাই দাদার সাথে তেমন বনিবনা নেই ওর। ওর নাকি সবচেয়ে কাছের জন ওর মা আর জ্যারতুত বোন। সৌরদীপ আর ওর জ্যারতুত বোনের পিঠোপিঠি বয়েস, একমাসের ছোট-বড়। তাই দু’জনের ভাবও খুব। বাড়িতে থাকলে বোনের সাথে নাকি সর্বক্ষণই প্রায় খুনসুটি চলে, যেন একই মায়ের পেটের বোন। দেবলীনার খুব দেখতে ইচ্ছে করে এই পরিবারটা। ... যদিও ভয়ও হয়, ছোট সংসারে মানুষ হয়েছে; সে কি পারবে এতো বড় পরিবারের সাথে মানাতে? ... আর দেবজ্যোতি যেরকম পরিবার চায় সৌরদীপরা তো ঠিক সেরকম নয়। এদিকে আর্থিকভাবে ওরা দেবলীনাদের থেকে অনেকখানিই সচ্ছল, আবার ততটা প্রগ্রেসিভও নয়। তাই প্রথমে কিছু বছর পর্যন্ত ওদের সম্পর্কের কথা দাদাকে সেভাবে কিছুই জানায় নি দেবলীনা। যদিও সৌরদীপের সাথে দেবজ্যোতির আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ওদের ফ্ল্যাটে প্রতি ছুটি-ছাটাতেই আসত সৌরদীপ। কিন্তু সেটা দেবলীনার ‘বন্ধু’ হিসেবে। ফ্ল্যাটে দেবলীনার বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়রদের যাতায়াত প্রায়ই লেগে থাকত। তাই অন্য সম্পর্ক কিছু আঁচ করার অবকাশও ছিল না দেবজ্যোতির। কিন্তু কথাটা একদিন পাড়তেই হয়। তখন ওদের সম্পর্ক প্রায় তিন বছরে পা দিয়েছে। দেবলীনা মাস্টার্স শেষ করে দু চারটে কলেজে পার্টটাইম পড়াচ্ছে। নেট কোয়ালিফাইও করে গেছে, অ্যাসিস্টেন্ট প্রোফেসরশিপের জন্য। সামনের কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসবার প্ল্যান করছে।
এদিকে সৌরদীপ তখন এম. ফিল.-এ ঢুকেছে। এম.কম.-এর পর অনেক চেষ্টা করেও পি.এইচ.ডি.-তে চান্স পেল না। শুধু শুধু বছরটা নষ্ট করে কেন, তাই এম. ফিল.-এ ঢুকে যায়। একদিন দেবজ্যোতিই কথা তোলে দেবলীনার বিয়ের ব্যাপারে। একটা ভালো পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেছে — দেবজ্যোতিরই স্কুলজীবনের এক বন্ধুর ভাই। দেবজ্যোতির ইচ্ছে ছিল, ওদের আলাপ করিয়ে দেয়। বেশ কয়েক বছর একটু মেলামেশা করুক। তারপর দেবলীনার একটা স্থায়ী চাকরি হলে বিয়ের ব্যাপারে পাকা কথা বলা যাবে। কিন্তু দেবলীনা সৌরদীপ ছাড়া আর কাওকে বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারে না। যে মেয়ে কোনদিন কোন পুরুষকে তার গা স্পর্শ করতে দেয়নি, প্রায় ‘সজারুর কাঁটা’ গায়ে লাগিয়ে ঘোরার মতো থাকত, যাতে কোন পুরুষ বিব্রত করতে না পারে, সেই মেয়ে সৌরদীপকে অবলীলায় স্পর্শ করতে দিয়েছে তার হাত, ঠোঁট — তার শরীর। তার ঠোঁটে, চোখে, কপালে লেগে আছে সৌরদীপের চুমুর স্পর্শ। একটা দিন সৌরদীপের খবর না পেলে পাগলপ্রায় হয়ে যেত সে। সৌরদীপ তার কেরিয়ার, স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। এতো সাপোর্টিভ, হেল্পফুল ছেলে এখনকার দিনে পাওয়াই যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, সে কোন দিনই দেবলীনার ওপর ডমিনেট করার চেষ্টা করেনি। বরং ওদের এই রিলেশনশিপে দেবলীনাই ছিল ডমিনেটিং পার্টনার। তাছাড়া ওদের দু’জনের মনের মিলটাও ছিল অদ্ভুত। সৌরদীপও তো বলত, “দেবী, আমি তোমার মধ্যে আমাকে, নিজেকে খুঁজে পাই। তুমি যেন পুরোটাই আমার রিফ্লেকশন। মনে হয়, আমরা দু’জনে বোধহয় একসাথে একটা সম্পূর্ণ মানুষ হই। তোমায় ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।” দেবলীনা অভিমান করলে প্রায় পঞ্চাশবার ফোন করে ওর অভিমান ভাঙায় সৌরদীপ, নিজের কাজ ফেলে। কতবার বলেছে, “আমি তোমায় হারাতে চাই না, কেন বোঝো না?” দু’জনের মধ্যে কোন বিষয়ে ঝামেলা-রাগারাগি হলে সৌরদীপ কত রাত কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে দেবলীনার জন্য। ... দেবলীনা ভাবে, ওকে কি আর কেউ কোনদিন এভাবে ভালবাসবে? যার মা-বাবা নেই, তার তো কোন মানুষের এরকম ভালবাসা পাওয়াটাই চরম সৌভাগ্যের। কী করে সৌরদীপকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে যায় সে? আর সত্যি বলতে কি — সে কোনদিন ভাবতেই পারে না সৌরদীপ ছাড়া অন্য পুরুষ তাকে স্পর্শ করবে। তাই দাদা বিয়ের কথা তুলতেই বাধ্য হয়ে তাদের সম্পর্কের কথাটা তখনই বলে ফেলে। ওর ইচ্ছে ছিল, একটা চাকরি পেলে বিয়ের কথাটা পাড়বে। দেবলীনা আধুনিক মানসিকতার মেয়ে, স্বাধীনচেতা। যদিও মনের মধ্যে একটা সংশয় ছিল, দেবজ্যোতি ওদের সম্পর্ক মেনে নেবে কিনা, তাও সেই সংশয়কে তেমন আমল দেয় নি। ওর বিশ্বাস, পায়ের তলার জমিটা শক্ত হলেই প্রেম স্বীকৃতি পায় সমাজে। আর জমিটা শক্ত করার উপায় চাকরি, ভালো কেরিয়ার। সে তো ওরা দু’জনেই চেষ্টা করে চলেছে। ততদিন পর্যন্ত থাক না হয় সেই প্রেম একটু আড়ালে — ছায়ায়।
দেবজ্যোতি অবশ্য কোন আপত্তি করে নি, ভালোভাবেই মেনে নিয়েছিল ওদের সম্পর্কটা। নিজের থেকে সৌরদীপের সাথে কথাও বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সৌরদীপ একটু লাজুক ছেলে। ভালবাসার মানুষটার পরিবারের কারো সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে বোধহয় সংকোচ বোধ করছিল। হলেই বা সে দাদা। আর তাছাড়া একটু কুন্ঠা ছিল তার —এখনও সে চাকরি পায়নি। পি.এইচ.ডি.-র প্ল্যানিং আছে সামনে। তখন স্কলারশিপ পেলেও বিয়ে করবে কীভাবে, এখনই, এত তাড়াতাড়ি? ঐটুকু টাকায় তো সংসার চলবে না। কিন্তু দেবলীনা বারবার চাপ দিতে থাকে।
- “দেখ, তুমি তো দাদাকে চেনো। এমনি তো কথা হয়েইছে। তাহলে এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন? আর তোমার যদি সামনাসামনি কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে, তাহলে দাদার সঙ্গে ফোনে কথা বলো।”
- “তুমি একবার আমার সাথে ফেস-টু-ফেস কথা বলতে পারবে? তোমার বাড়িতে না। বাইরে কোথাও। অনেককিছু বলার আছে যেগুলো এভাবে ওভার ফোন বলা যাবে না।”
ইতস্তত করে কথাটা বলেই ফেলে সৌরদীপ।
(৩)
সেই দিনটা ছিল মেঘলা একটা দিন। মাঝেমাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। দেবলীনা আর সৌরদীপ দু’জনেরই ছুটি ছিল। দু’জনেই বাড়িতে ছিল, ব্যারাকপুরে। দুপুর দিকে খাওয়া-দাওয়ার পর দেবলীনা দেখা করতে যায় সৌরদীপের সাথে, ছোট্ট একটা পার্কে। ঘাসের ওপর বৃষ্টির জল ছিল। দেবলীনার বসতে কষ্ট হবে বলে সৌরদীপ নিজের রুমালটা পেতে দেয় সেখানে। দেবলীনা বসে ওটার ওপর, আর সে নিজে ভেজা ঘাসের ওপরেই বসে পড়ে।
— “দেবী, আই অ্যাম্ রিয়েলি সরি। ...আমাদের বিয়ে হওয়াটা সম্ভব না।”
সৌরদীপের কথায় দেবলীনার মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছিল সেদিন। প্রাণপণে নিজেকে চেপে রাখার চেষ্টা করে সে।
— “কারণটা জানতে পারি?” অস্ফুটে প্রশ্ন করে দেবলীনা।
— “আমার জেঠু, কাকু ওনারা আমার অজান্তেই একজনের সাথে কথা বলে রেখেছেন। ...আমাদেরই জ্ঞাতি। জেঠুদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার মেয়ে।”
— “তুমি জানলে কীভাবে?”
— “মা’র থেকে।”
— “তুমি চেনো মেয়েটিকে?”
— “হুঁ,” মাথা নাড়ে সৌরদীপ, “আমি যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুলে ও-ও পড়তো। দু’বছরের জুনিয়র আমার চেয়ে।... মেয়েটির মা-ই চান বেশী করে। বার বার করে নাকি বলেছেন জেঠুদের। ওনার ইচ্ছে আমার এম. ফিল.- এর পরই রেজিস্ট্রি হয়ে যাক। সোশ্যালটা পরে হবে, আমার চাকরি পাওয়ার পর। আমি কী করি বল?”
— “কে কে আছেন মেয়েটির পরিবারে?” দেবলীনার চোখের ভালবাসা ক্রমশ যেন ফ্যাকাসে হয়ে আসছিল।
— “ওর মা, বাবা, এক দিদি আর ভাই। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইটা ছোট।”
— “কী করে মেয়েটি?”
— “পড়ছে। গ্রাজুয়েশন। নিউট্রিশন নিয়ে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির আণ্ডারেই একটা কলেজে। পড়াশুনোয় খুবই সাধারণ।”
— “বাঃ! অনেককিছুই জানো দেখছি, মেয়েটির সম্পর্কে।”
— “দেবী, প্লীজ আমায় ভুল বুঝো না।”
— “মেয়েটির সাথে কথা হয়?”
সৌরদীপ চুপ করে থাকে।
— “কী হল? বল। চুপ কেন?” দেবলীনার ধৈর্য্যের বাঁধ একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করেছে।
— “হ্যাঁ। বাড়িতে জানেন না। আমি মা’র ফোন থেকে কাওকে না বলে ওর নাম্বারটা নিয়েছিলাম। সেটা তোমারই জন্য। ওর সাথে কথা বলে যদি বোঝা যায় ব্যাপারটা আসলে কতদূর গিয়েছে।”
— “তা কী জানলে?”
— “মেয়েটিরও ইচ্ছে এই সেটেলমেন্টটা। আমার হাত-পা বাঁধা, দেবী। আমি কী করব? সত্যি আর পারছি না।”
দেবলীনা উঠে আসতে চায়, সৌরদীপ চেপে ধরে। ওর কোঁকড়ানো, পেঁজা তুলোর মতো নরম চুলগুলোয় হাত বোলাতে থাকে, “প্লিজ একটু বসো। ...আমি কথা দিচ্ছি, সারাজীবন তোমার পাশে থাকব, বিয়ের পরেও। দেখ, কৃষ্ণও তো রাধার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি। অথচ লোকে বলে রাধা-কৃষ্ণ! ছবিতেও তাই থাকে। বিয়ে তো শুধু একটা সামাজিক ব্যাপার।”
দেবলীনার চোখদু’টো হঠাৎ জ্বলে ওঠে, “আমাদের সম্পর্কটা কি শুধু সাধারণ প্রেম? যতটা এগিয়েছিলে তার দায় কি শুধু আমার? তোমার না? এতদূর এগোনোর পর এরকম রাধা-কৃষ্ণের তুলনা টেনে স্তোক-বাক্য শোনাতে লজ্জা করে না তোমার?”
সব কিছু প্রচণ্ড অসহ্য হয়ে উঠছিল ওর কাছে। এই প্রথম সৌরদীপের ছোঁয়াকে সে ঘৃণা করতে শুরু করে।
— “এইজন্যই কি তুমি আমায় কোনদিন তোমার বাড়িতে যেতে দাও নি? ... তোমার ফ্যামিলির ওপর যখন তোমার কোন কন্ট্রোলই নেই, তখন কেন আমায় বলেছিলে বিয়ের কথা? কেন স্বপ্ন দেখিয়েছিলে? ... আমি তো বলেছিলাম প্রথমেই, “বাপ-মা হারা কোন মেয়েকে তোমার বাড়িতে কি মেনে নেবে?” তখন তো নিজেই বলেছিলে, আমায় যে দেখবে সেই আপন করে নিতে চাইবে।”
— “সে তো এখনো বলি, তুমি এমনটাই। ভুল তো কিছু বলি নি।”
— “থাম তুমি।” দেবলীনা কেমন যেন উগ্র হয়ে ওঠে। ভেবেছিল নিজের আবেগ, যন্ত্রণা কিচ্ছুটি প্রকাশ করবে না সৌরদীপের কাছে। কিন্তু পারল না। শুধু কান্নাটুকুই চাপতে পেরেছিল। ফুঁসে উঠে বলল, “যখন নিজের ফ্যামিলির ওপর কোন কন্ট্রোল নেই তখন কেন এতদূর এগিয়েছিলে, বলো? আমায় কি খেলনা পেয়েছ? শুধু কি প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কে আটকে থেকেছ? স্বেচ্ছায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের আঁচ ঢোকানোর সময় হিতাহিত জ্ঞান ছিল না? আমি তো প্রথমে চাই নি। নিজের থেকেই তো এসেছিলে। তাও আবার মাঝরাতে। আমি তখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছি। আমি কত্তবার বলেছি তোমায় এই নিয়ে। তুমি কী বলেছ, আমি তো তোমারই থাকব, তাহলে এতো ভয় পাচ্ছ কেন? ... আর এখন কি না? ... এই তোমার পৌরুষ?”
দেবলীনার চোখদু’টো তখন হিংস্রতায় জ্বলছে। নিজেকে হাজারো সংবরণ করার চেষ্টা করেও পারে নি; একটার পর একটা কথায় অপমানে জর্জরিত করেছিল সৌরদীপকে। শুধু তার মনুষ্যত্বের “হুঁশ” ফেরাতে। কিন্তু সৌরদীপ রইল কেমন বেহুঁশ হয়েই — নির্বিকার! দেবলীনাকে শান্ত করতে আবার শুরু করে, “দেবী, একটু বোঝ। ... শান্ত হও।... তুমি তো মর্ডান মেয়ে, কেন সেকেলে ধ্যান-ধারণা নিয়ে ভেবে এরকম উত্তেজিত হচ্ছ? এতে তোমারই শরীর খারাপ করবে।”
কথাগুলো যেন সপাটে চাবুক কষালো দেবলীনার গায়ে । অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “সৌরদীপ ... তুমি কি মানুষ???”
তবুও সৌরদীপ নির্বিকারই রইল। ঠাণ্ডা গলায় বলে, “... আমায় একবার শেষ চেষ্টা করতে দেবে? যদি জেঠুকে বোঝানো যায়। আমায় একটু সময় দেবে?”
— “কতদিন?” নিজের অজান্তেই আনমনে প্রশ্নটা করে ফেলে দেবলীনা।
— “একবছর।”
— “সম্ভব না। একমাস দিতে পারি।”
— “আচ্ছা তাই সই। কাছে আস এবার।”
সৌরদীপ আবারও দেবলীনাকে কাছে টানতে যায়। প্রচণ্ড ঘৃণায় নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে চলে আসে দেবলীনা।
সেদিন সারারাত শুধু কেঁদে গিয়েছিল সে। যাকে এতো ভালোবাসতো সে তলে তলে এরকম? সৌরদীপের পরিবারের সকলেই বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাসী। সেও কণ্ঠী পরে, বৈষ্ণবের নিয়মও পালে। একজন বৈষ্ণবকে কখনো ঘৃণা করতে নেই, সেটা পাপ। দেবলীনার তাই বিশ্বাস ছিল। অথচ সৌরদীপ যা করল সেটা কি ঘৃণ্য নয়? এটাও কি ক্ষমার যোগ্য?
ঐদিনের পর থেকে প্রচণ্ড চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল দেবলীনা। যন্ত্রের মতো শুধু কাজ করে গেছে। কলেজে গেছে, ক্লাস নিয়েছে, কিন্তু সে যেন নিছকই অভ্যাস থেকে— দায়ে পড়ে। ছুটি পাবে না তাই। অন্যমনস্কতার জন্য কাজে ভুলও হয়েছে। অপদস্থ হতে হয়েছে কলিগদের কাছে, প্রিন্সিপ্যালের কাছেও। দেবজ্যোতি অনেকবার চেষ্টা করেছে ‘কী হয়েছে’ জানতে। কিন্তু কোন উত্তরই পায় নি। শুধু এটুকু আঁচ করেছিল, সৌরদীপের সাথেই কিছু একটা হয়েছে। ভেবেছিল, বোন যা রাগী, অভিমানী হয়তো কোন ব্যাপারে কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছে। তাই ওর বিয়ের ব্যাপারে তক্ষুনিই আর কোন কথা তুলল না । কিছুদিন পর, আপনা থেকেই রাগ কমলে, মুড ঠিক হলে বলবে বলে ভেবে রেখেছিল। ... দেবলীনাও একটু একা থাকতে চাইত। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে সারাক্ষণই প্রায় নিজের ঘরে ঢুকে থাকত। কাজের অছিলায় স্টুডেন্টদের ফোনও সেভাবে ধরতো না। রাতের পর রাত ঘরের দরজা বন্ধ করে শুধু কেঁদেছে। একটু একটু করে ভাঙছিল ওর স্বপ্নগুলো — কাচের টুকরোর মতো। সত্যিই তো, দেবলীনার স্বপ্ন ছিল কাচের জিনিসের মতোই, যা যেকোন মূহুর্তে ভেঙে যেতে পারে। অথচ ভুল বিশ্বাসে মানুষ কাচের জিনিস দিয়েই ঘর সাজাতে চায়। ভাবে, দেখতে সুন্দর লাগবে— হাত থেকে না পড়লে তো আর ভাঙবে না। আগলে আগলে রাখলেই হচ্ছে। কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায়, একটু অসাবধানতায় এ জিনিস ভেঙে যায়। হাজারো সাবধানতার মধ্যেও মানুষ বড়ই অসাবধান! দেবলীনাও ‘কাচ’ নিয়ে জীবন সাজাতে গিয়েছিল, স্বচ্ছতা দেখে। অনেক আদরে, সাবধানেই আগলে রাখতো তাকে। তবু কখন কোন ফাঁকে যে অসাবধান হয়ে পড়ল...!
সেদিনের ‘ঘটনার’ পর বেশ কয়েক সপ্তাহ সৌরদীপ ফোন করে গেছে দেবলীনাকে। দেবলীনা কোন উত্তর দেয় নি। দেখাও করে নি। সৌরদীপের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণার জ্বালায়। তবুও ভুলতে চাইলেই কি ভোলা সম্ভব? যাকে ঘৃণা ভেবে সৌরদীপকে দূরে সরাতে চাইল দেবলীনা সে কি আদপে ঘৃণা? না কি নিছকই অভিমান? না হলে কেন প্রতি রাতে এভাবে সদ্য পুরোনো ‘নরম’ স্মৃতি হাতড়ে বেড়াত? ... প্রায় রোজ রাতেই সে ঘাঁটতে বসতো পুরোনো ‘সেভ’ করে রাখা মেসেজ আর সৌরদীপের লেখা চিঠিগুলো। অনেকবার ভেবেছে, মেসেজগুলো ডিলিট করে দেবে। চিঠিগুলোও পুড়িয়ে দেবে। কিন্তু পারে নি। কেন? ... কেন পারে নি? সে উত্তর থাক না শুধু দেবলীনার মনের মধ্যেই।
সৌরদীপ দেবলীনার জীবনের প্রথম ‘প্রেম’। ভরা যৌবনে ধরা দিয়েছিল সেই প্রেম। আর তাই তার ‘আবেগ’ ছিল ‘পরিপক্ব’। সেসময় প্রযুক্তিবিদ্যা আজের মতো এতটা উন্নত ছিল না। মেসেজ, ফোনে কথা বলার সময় টাকাও যেত বেশ। যদিও ওদের ফোনে সেভাবে কথা হতো না। বাড়িতে থাকলে মেসেজে হতো আর জমে থাকা কথা বেরিয়ে আসতো দেখা হলে। সপ্তাহে দু’তিনবার করে দেখা তো হতোই। কিন্তু প্রেম যে অনেক কথার জন্ম দেয়। তাই ‘ঐটুকু’ দেখায় কথা শেষ হতো না। দেবলীনাই একটা উপায় বের করেছিল — ‘চিঠি’ লেখার। আধুনিকতায় থাক না একটু পুরোনোদিনের ছোঁয়া। ‘চিঠি’ ছাড়া কি প্রেম পূর্ণতা পায়? যেদিন ওদের দেখা হতো, দেবলীনা ওর চিঠিগুলো দিত সৌরদীপকে আর সৌরদীপ নিজের গুলো দিত দেবলীনাকে। অনেকগুলো চিঠির মধ্যে মিশে গেছলো ঐ চিঠিটা। খুঁজে পেতে বারবার করে দেখে সে, রোজই। সে-ই চিঠিতেই তার স্বপ্নের জালবোনা শুরু —
“দেবী,
আজ ঘুমোনোর আগে স্বপ্নপরীকে বলেছিলাম, তোমায় নিয়ে একটা স্বপ্ন যেন আমায় দেয়। দিয়েছিল সে, কাছে থাকলে হয়তো তুমি জিজ্ঞাসা করতে, “তা কী স্বপ্ন?” ... আমিই বলে দিচ্ছি এখানে, তোমার প্রশ্নের অপেক্ষা না করে। ... তোমার দাদার কাছে তোমার হাত চাইতে গিয়েছি আমি। তুমি আমার বেখেয়ালী কাজে মিটিমিটি হাসছ। ওটাই বোঝায়, তুমি চাও আমায় হাত দিতে। ... আচ্ছা, এটা কি সম্ভব নয় সত্যি করা? আমরা তো adult। নিজেদের decision তো নিজেরাই নিতে পারি। আমি কি সত্যিই এতটা ভাগ্যবান? পাবো তোমার হাত?”
সৌরদীপ লিখেছিল দেবলীনাকে। চিঠিতে এর উত্তর দিতে পারে নি দেবলীনা। অনেক আনন্দেও হয়তো হাত অসাড় হয়ে যায়। সামনাসামনি জানিয়েছিল, “আজ থেকে, মন থেকে আমার হাত তোমায় দিলাম। হোক না সামাজিকভাবে দেওয়াটা একটু দেরীতেই।” সেইদিন থেকেই দেবলীনা ভেবেছিল, ওদের সম্পর্কটা তো আর ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’তে সীমাবদ্ধ থাকল না। সামাজিকভাবে ঘরবাঁধা এখনই সম্ভব নয়, কিন্তু দু’জনের মধ্যে বিশ্বাসে কি বাঁধা যায় না এই ঘর? বিশ্বাসই তো সব একটা সম্পর্কের। সৌরদীপ যে তার সেই বিশ্বাস ভাঙবে না কোনদিন — এটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল দেবলীনার।
আরো একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার বসন্ত উৎসবে রবীন্দ্রভারতী গিয়েছিল। সবাই যখন মেতে আছে উৎসবের আমেজে, দেবলীনাকে নিয়ে একপাশে সরে এসেছিল সৌরদীপ। সেদিন দেবলীনার পরণে ছিল তাঁতের শাড়ী, খোঁপায় পলাশফুল। এক চিলতে রাঙা আবির আঙুলে নিয়ে দেবলীনার সিঁথিতে পরিয়ে দিয়েছিল সৌরদীপ। এত লোকের মাঝে হঠাৎ সৌরদীপের এমন কাজে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল দেবলীনার ফর্সা, হাসিতে টোল পড়া গালদু’টো। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আলতো স্বরে বলেছিল, “পাগল”। এর চেয়েও ‘সুখের দিন’ এসেছিল — একবার নয় — বেশ কয়েকবার। দাদাকে লুকিয়ে, মিথ্যে বলে সৌরদীপের সাথে বেড়াতে গিয়েছে অনেকবার। একসাথে রাত কাটিয়েছে এক ঘরে। সেইরকম এক রাতে সৌরদীপ প্রথম নিজের থেকে এসেছিল দেবলীনার কাছে। দেবলীনা তখন ঘুমের রাজ্যে। ওর সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল সৌরদীপের ছোঁয়া। দেবলীনা প্রথমে বুঝতে পারে নি এ স্বপ্ন না বাস্তব। অদ্ভুত একটা নরম যন্ত্রণা মেশানো অনুভূতিতে যখন ঘুম ভাঙে, তখন দেখে দু’টো শরীর মিলনের অন্তরঙ্গতায় এক হয়ে গিয়েছে। যৌনতা, কামনা, এগুলো কখনোই অস্বীকার করে নি দেবলীনা — করতে চায় নি। যৌবনের স্বাভাবিক বিকাশ হিসেবেই দেখেছে। শুধু খানিক অন্যরকমভাবে — ভালোবাসার মোড়কে মুড়ে। কিন্তু এতোটা অন্তরঙ্গতা কি সে ‘সুখ’ বলে নেবে? না কি...? ঘুম ভেঙে সে সুখের আমেজ হারিয়ে গেল একটা ভয় মেশানো সংশয়ে। যদি দাদার কাছে ধরা পড়ে যায়? সৌরদীপ তখন মিলনের আবেগে মেতে। দেবলীনা ছাড়াতে পারে না নিজেকে। ... কে জানে, বাসর রাতের প্রথম অভিজ্ঞতায়ও কি মেয়েদের এমনই অনুভূতি হয়? ... সংশয় কাটল একটু একটু করে। সৌরদীপই কাটিয়েছিল সেই ভয়টা।
— “অর্ধাঙ্গিনী শব্দটার মানে জানো? কেন বলা হয়?” পরের দিন সকালে যখন দেবলীনা প্রসঙ্গ তোলে, ওর ঠোঁটে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সৌরদীপ।
— “জানব না কেন? ... কিন্তু সে সম্পর্ক তো...।” দেবলীনা তখনও ঠিক সহজ হতে পারছিল না।
— “কাগজে কলমে লেখাপড়া থাকলেই কি সেই সম্পর্ক সত্যি? আর না হলে মিথ্যে? ... এই সম্পর্ক তো বিশ্বাস আর ভালোবাসায় গড়া দেবী। তুমি কি এটুকু বিশ্বাস কর না আমায়?”
— “কিন্তু... যদি কনসিভ করি? দাদা জানলে...?” গলাটা ভারী হয়ে এসেছিল দেবলীনার।সৌরদীপ কাছে টানে। কী যে ছিল সেদিন ওর ঐ ছোঁয়ায়! ... দেবলীনাকে বুকে টেনে নেয়, “তোমার কি মনে হয় আমি তোমায় ছেড়ে চলে যাব? ... আমি চিরদিন তোমারই থাকব দেবী। তোমার কোন অসম্মান হতে দেব না। এটুকু বিশ্বাস তো রাখো। ”আদর, ভালোবাসা, প্রেমের মিশেলে অদ্ভুত এক ছোঁয়া, যা সত্যিই বিশ্বাস না করে পারে নি দেবলীনা। কোনদিন তো দাদা ওকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে নি, আদরও করে নি! ... ক্রমশ সৌরদীপই ওকে সহজ করে নিয়েছিল ব্যাপারটার সাথে। আরো কত রাত এসেছিল এভাবে। দেবলীনা আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারে নি এই ‘সুখটুকু’, সংশয়ের আড়ালে চাপা দিয়ে। কী যে ছিল সৌরদীপের মধ্যে! সম্মোহনী ক্ষমতা? প্রচণ্ড অন্তরঙ্গতার মুহূর্তেও ওর ছোঁয়া কোনদিন এতটুকুও ‘পাশবিক’ মনে হয় নি। বরং ছিল ভীষণই স্নিগ্ধ, মায়াবী। আর তাতেই মজেছিল সে। ভালোবাসায় পাগল হয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সৌরদীপের কাছে। শারীরিক বিষয়ে প্রচণ্ড ব্যক্তিগত কথা যা দাদাকে বলতে পারতো না, অবলীলায় বলেছে সৌরদীপকে। সৌরদীপ তার কাছে ‘প্রেমিক’ থেকে হয়ে উঠেছিল ‘জীবনসঙ্গী’ — অপেক্ষা শুধু সামাজিক ছাপ্পার। সৌরদীপের ‘স্বীকৃতি’ তো পেয়েই গিয়েছে। শুধু আইনি ছাপ্পাটা পেলেই সে পা বাড়াবে তার স্বপ্নকুঞ্জের দিকে — যা সৌরদীপেরও স্বপ্ন বলে বলতো একসময়। ছোট্ট একটা সংসার — একটা চিরন্তন জুটি, যেন ‘মেড ফর ইচ্ আদার’— তারা একসাথে গবেষণা করছে — তাদের লেখা, সৃষ্টি ছেপে বেরোচ্ছে নানান ন্যাশান্যাল-ইন্টারন্যাশান্যাল লেভেলের জার্নালে। ... সৌরদীপকে নিয়ে সে পেতে চেয়েছিল একটা ভরাট ‘পরিপূর্ণ পরিবার’, তার জীবনে মা-বাবা না থাকার অসম্পূর্ণতাকে ঢেকে দিয়ে।... ডুকরে কেঁদে ওঠে দেবলীনা, পুরোনো স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে। এই ক’দিনের রোজকার অভ্যাসের মতো সেদিনও বসেছিল ওগুলো নিয়ে। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর হাতড়াচ্ছিল পুরোনো চিঠিগুলো। খেয়াল ছিল না, দরজাটা লক করা হয় নি। বোন ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে এসেছিল দেবজ্যোতি। দরজাটা হালকা ঠেলতেই খুলে গিয়েছিল। দেবলীনা খেয়ালই করে নি কখন দেবজ্যোতি এসেছে। ঘরের বড় আলোটা বন্ধ। বিছানায় রাখা টেবিলল্যাম্পটাই শুধু জ্বলছিল। সেই আলোর আভায় দেবজ্যোতি দেখল, বোনের চোখ-মুখ ফোলা, গালদু’টো ভেজা। প্রথমটায় জানান দেয় নি, এসেছে বলে। হয়তো খোঁজবার চেষ্টা করছিল, বোনের মনের মধ্যে জমে থাকা মেঘের উৎসটাকে। দেবলীনা হঠাৎ নিজের মনে ফুঁপিয়ে উঠতেই কাছে যায়। আলতো করে পিঠে হাত রাখে, “কী হয়েছে সৌরদীপের সাথে? কাঁদছিস কেন?” হয়তো কিছু আঁচ করেছিল, বোনের চোখের চাউনিটা দেখে। দেবলীনা এতদিন পর ভাঙতে শুরু করে। দাদার কাছে আর কিছুই লুকোতে পারল না। সেদিনের ‘ঘটনা’টা বলেই দেয় পুরোপুরি। আবেগের মধ্যে বলেও ফেলে ওদের শারীরিক সম্পর্কের কথাও। দেবজ্যোতির বুকে মুখ গুঁজে প্রায় পাগলের মতো প্রলাপ বকতে থাকে, “আমি কী অপরাধ করেছিলাম রে দাদা? ভগবান আমার মা-বাবাকে কেড়ে নিলেন। তাদের পর একজন ভালোবাসার মানুষ পেলাম। একটা পরিবার পেতে চেয়েছিলাম। জীবনটা একটু সাজাতে চেয়েছিলাম। সেটাও পাপ? ও এতো ঘৃণ্য? এভাবে আমায় ঠকাতে পারল? বল্ না দাদা। আমার ভালোবাসায় কি বিষ আছে?”
— “তুই সরে আয় এই সম্পর্ক থেকে। ক্লোজ দিস চ্যাপ্টার। ভুলে যা সব। ওর সাথে আর যোগ রাখিস না। আমি আমার ঐ বন্ধুর ভাইকে বলে দিচ্ছি কন্ফারর্মড্। চেনা-জানার মধ্যেও হল। তোকে পুরোনো সম্পর্কের জন্য কোন অসুবিধা পোয়াতে হবে না। কাল সকালেই ওকে ফোন করে ‘হ্যাঁ’ বলে দিচ্ছি।” খুব দৃঢ় স্বরে উত্তর দিয়েছিল দেবজ্যোতি। দেবলীনা চেয়েছিল একটু নরম সান্ত্বনা। কিন্তু দাদার স্বরটা ভীষণই কঠিন লাগল। দেবজ্যোতি ঐ সম্বন্ধ পাকা করছে দেখে দেবলীনা ছটফট করে ওঠে। আবারও তাড়া দেয় সৌরদীপকে, সব কিছু ভুলে গিয়ে। সে এতো সহজে পারে নি তার ভালোবাসাকে ঘৃণা করতে। অপেক্ষা করেছিল সৌরদীপের উত্তরের জন্য, নানান অছিলায়। সৌরদীপ যথারীতি নির্বিকারই থাকে। কিছুই জানায় না একমাসের মধ্যে।
— “আরে, তুমি কিছু না জানালে এদিকে অসুবিধে হয়ে যাবে। যে সম্বন্ধ এসেছে ওরা হার্ডলি একমাস অপেক্ষা করবে।”আবারও নিজের থেকেই সৌরদীপকে ফোন করে দেবলীনা।
— “শোন, আমি হুট করে বাড়ির এই ডিসিশন চেঞ্জ করতে পারব না। আমায় আর দু’টো মাস দাও।... আর যে ছেলে তোমার জন্য একমাসের বেশী অপেক্ষা করতে পারবে না, সে তোমার সাথে সারাজীবন থাকবে? ওরকম অনেক ছেলে দেখেছি। অ্যাপারেন্টলি দেখে তোমায় ওদের ভালো লেগেছে। ওর সাথে তুমি যে ভালো থাকবেই তার কোনো মানে নেই। এসব এতো তাড়াতাড়ি হয় না। সময় লাগে।”উত্তর দেয় সৌরদীপ। তার এতো দেরীর জন্য দেবলীনার ঐ সম্বন্ধ ভেঙে যায়। আরো দু’টো সম্বন্ধ এসেছিল। সেগুলোও একইভাবে ভেঙে যায়। দেবলীনা তাও সৌরদীপের উত্তরের অপেক্ষায় থাকে, অনেক আশা নিয়ে। উত্তর একদিন আসে।
প্রায় সাতমাস পরে। কিন্তু সেটা কোন পার্কে দেখা করে নয়। ফোনেই কথা হয়েছিল ওদের।
— “এটা সম্ভব নয় দেবী। আমি হেরে গেছি।... আসলে ভুলটা আমারই ছিল। আমিই ঐ মেয়েটির দিদিমাকে কথা দিয়েছিলাম, ওনার মৃত্যুশয্যায়।”
— “মানে?” দেবলীনা প্রায় চিৎকার করে ওঠে।
— “ওর দিদিমা মারা যাওয়ার সময় আমায় বলেছিলেন, ওনার ছোট নাতনি আর নাতিকে যেন দেখি। ... আমিও বলেছিলাম দেখব। কিন্তু দেখা তো অনেকরকমভাবেই যায়। আমি এভাবে দেখার কথা ভেবে কিছু বলি নি।”
— “এটা কবে হল? আমার সাথে আলাপের আগে না পরে?”
— “আগে। ... তুমি আমার জীবনে একটু আগে আসতে পারলে না? ... যদি একটু আগে আসতে তাহলে এই বাঁধনে আমি জড়াতাম না।”
— “তার মানে, তুমি মেয়েটিকে চিনতে আগের থেকে? ... কী হল? চুপ কেন? ... উত্তর দাও।”
দেবলীনাকে এক অদ্ভুত হিংস্রতায় পেয়ে যায়।
— “হ্যাঁ। চিনতাম।”
— “কন্টাক্ট ছিল?”
— “বাড়িতে যাতায়াত ছিল।”
— “এসমস্ত জেনেও তুমি আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে? কেন এতদূর নিয়ে গিয়েছিলে সম্পর্কটাকে? কেন আমার শরীর ছুঁয়েছিলে? কেন আমায় মিথ্যে বিশ্বাস করিয়েছিলে যে তুমি আমায় স্ত্রীর মর্যাদাই দিয়ে এসেছো? আমায় কথা দিয়েছিলে যে তবে? আশ্বাস দিয়েছিলে, তুমি কোনদিন আমায় ছেড়ে যাবে না... তাহলে??? তুমি এতোটা পাশবিক?”
— “তখন বুঝতে পারি নি দেবী। ... আর আমি তো ঐ মেয়েটিকে ভালোবাসি না। শুধু বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি মাত্র। বিয়ে তো শুধু প্রজনন আর বংশরক্ষার স্বার্থে। তোমায় আমি ভালোবাসি। তোমার সাথে যা কিছু করেছি ভালোবাসার আবেগে মাত্র, কোন জৈবিক স্বার্থে নয়।... আর আমি এখনও যা করছি তোমার ভালো ভেবেই করছি। আমি যদি আমার বাড়ির অমতে তোমায় বিয়ে করি তাহলে তাঁরা তোমায় মেনে নেবেন না। সেটা তোমার ভালো লাগবে তো? খুব সম্মানের হবে? আর আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ... বন্ডিং এমনই যে আমি আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসতেও পারব না। এটা যদি মা-বাবা আর আমি এরকম ছোট ফ্যামিলি হতো তাহলে সম্ভব ছিল। তোমার ভালোর জন্যই আমি এটা মানতে বাধ্য হচ্ছি।”
সৌরদীপের কথাগুলো যেন বরফের ছুরি! গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছিল দেবলীনার। কোনরকমে মুখে হাত চাপা দিয়ে থামায় সে।
— “দেখ দেবলীনা, সিরিয়াসলিই একটা কথা বলছি। আমার মনে হচ্ছে, তুমি খুব ভেঙে পড়ছ। তাই তোমার ওয়েলউইশার হিসেবে এই কথাটা বলছি। আমাদের মধ্যে একটা ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল মানছি। মানছি আমি না বুঝে ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু উই আর নট হ্যাবিচুয়েটেড উইদ্ দ্যাট। আমরা যা কিছু করেছিলাম সে তো প্রিকশ্যান নিয়েই করেছিলাম, যাতে তোমায় পরে কোনরকম অসুবিধায় পড়তে না হয়। তুমি তো কনসিভ করো নি। তাহলে এই চিন্তাটা তোমার মাথায় আসছে কেন বারবার? সোসাইটি এখন অনেক ডেভেলপড। এরকম চিন্তা মাথায় আনাটাই তোমার পাগলামি, রক্ষণশীলতার ফল। একজন মেয়ের ‘ভার্জিনিটি’ এতো ঠুনকো নয়। এরজন্য কখনো বিয়ে হওয়া আটকায় না। চাইলে তুমি কারোর সাথে সংসার করতেই পারো। আমি তো আর বাধা দিতে যাব না।”
— “বাঃ! খুব সুন্দর নাটক শিখেছ দেখছি। প্রতারণার স্বপক্ষে যুক্তিও খাড়া করে ফেলেছ! রিয়েলি অ্যাপ্রিশিয়েবল।”
ব্যঙ্গ, ক্ষোভ, অপমানের কান্না মেশানো ধরা গলায় কথাগুলো বলে ফেলে দেবলীনা। স্নায়ুগুলো ক্রমশ অবশ হয়ে আসে। চিনিচিনে ব্যথা অনুভব করে সারা শরীরে।
— “প্রতারণা!” সৌরদীপের ঠাণ্ডা, নির্বিকার গলাটা চেষ্টা করে বোঝাতে ‘প্রতারণা’ শব্দটা ব্যবহারে সে যেন আহতই হয়েছে, “কী বলছো দেবী? আমি তোমায় প্রতারণা করছি? একথা ভাবতে পারলে?”
— “আমি ফোন রাখছি। ... এটুকু জেনে রেখো, তুমি যা করেছ সেটা প্রতারণাই। তোমার গায়ে মানুষের চামড়া থাকলে তোমার মনে পাপবোধ জাগতো। তুমি কোনদিন আমার ভালোবাসার যোগ্য ছিলে না। ... আমি আজ থেকে জানলাম, তুমি মৃত!”
ডুকরে কেঁদে ওঠে দেবলীনা।
— “দেবী, ফোন রেখো না। তুমি যা খুশি আমায় বলো, মাথা পেতে মেনে নেব। কিন্তু একটিবার কথা শোন। ফোন রেখো না। কিছু কথা বলার আছে।”
— “তাড়াতাড়ি বলো। আমি আর পারছি না।”
— “একটা অনুরোধ। আমি তো সংসারের জালে আটকে গেলাম। তুমি নিজেকে এভাবে শেষ কোরো না। বিয়ে, প্রেম এসব নিয়ে মাথা খারাপ না করে নিজের অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার নিয়ে ভাব। এই কয়েকমাসে তোমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ... তোমার মধ্যে অনেক পোটেনশিয়াল আছে। অনেকদূর যেতে পারবে তুমি। ... এসব নিয়ে ভাব, কেরিয়ার নিয়ে, রিসার্চের ড্রিম নিয়ে। এখনই বিয়ের জালে জড়িয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিও না।” একটানা বলে একটু দম নেয় সৌরদীপ। তারপর আলগাভাবে বলে, “জানি একদিন তুমি অনেক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। রোজ কাজের ফাঁকে আমার জন্য একটু সময় রেখো। পাঁচ মিনিট মতো হলেও চলবে। আমার যার সাথে বিয়ে হবে তার সাথে তো আর মনের মিল খুঁজে পাব না। তুমি একটু আমায় রিলিফ দিও, এই বদ্ধ জীবনে। ... আর একটা আশার পথও ভেবেছি। তার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার পি.এইচ.ডি. কমপ্লিট হলে বেঙ্গলের বাইরের স্টেটের ইউনিভার্সিটিগুলোয় অ্যাপ্লাই করার কথা ভেবেছি, ফ্যাকাল্টি পজিশনের জন্য। যদি সেটা সম্ভব হয়, মানে বাইরে কোন ইউনিভার্সিটিতে পেয়ে যাই টিচিং-এ, তখন তোমায় ডেকে নেব আমার কাছে। আমি যে স্টেটে চাকরি পাব, সেখানে তুমিও কেরিয়ার সেটেল্ড করলে। তাহলে আমরা একসাথে রিসার্চ করব। তুমি আমার কাছে থাকতে পারবে। ... যাকে বিয়ে করব তাকে নিয়ে তো আর বাইরে যেতে পারব না। বাড়ির লোকজনের দেখাশুনো কে করবে? ও বাড়িতেই থাকবে। তুমি থাকবে আমার কাছে।”
দেবলীনা আর সহ্য করতে পারছিল না। মুখের ওপর ফোনটা কেটে দেয়। সৌরদীপ তাহলে এতদিন তাকে পণ্য হিসেবে দেখেছে মাত্র? রক্ষিতার মতো? অন্য একজনকে বিয়ে করে ‘স্বীকৃতি’ দেবে, বংশরক্ষার স্বার্থে, আর দেবলীনা থাকবে সামাজিক-আইনি স্বীকৃতি-বিহীন সহবাসের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে? এই কি দেবলীনার প্রাপ্য ছিল? তবে সেবার দোলের দিন লাল আবির কেন পরিয়ে দিয়েছিল দেবলীনার সিঁথিতে? সেটা কি শুধু আবির ভেবেই পরিয়েছিল? যা অস্থায়ী, ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় খুব সহজেই! প্রেমে অন্ধ দেবলীনা কি বোঝে নি আবির দিয়ে পরানো নকল সিঁদূর কখনোই আসল সিঁদূরের জায়গা নিতে পারে না? ... দেবলীনার জগত যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। সৌরদীপ কি তাহলে তাকে কোনদিনই ভালোবাসে নি? জীবনসঙ্গীর মর্যাদা দেয় নি? শুধু রক্ষিতা হিসেবে দেখে গিয়েছে? তাই তার শরীর স্পর্শ করেছে? তার জন্যই বেড়াতে গিয়ে সেই রাতে অমন চুপিসারে এসেছিল দেবলীনার কাছে, যখন সে ঘুমে অচেতন! পরেরদিন সকালের সেই প্রতিশ্রুতি?? যখন তাকে ‘অর্ধাঙ্গিনী’র আসনে বসায়? বুকে টেনে কথা দেয়, সৌরদীপ চিরদিন তারই থাকবে, তার কোন অসম্মান হতে দেবে না? সবই মিথ্যে? ‘কথার কথা’? ... ঐ জন্যই সৌরদীপ এতো ‘প্রিকশ্যন’ নেওয়াতো, যাতে দেবলীনার শরীরে তার ছোঁয়ার প্রমাণের লেশমাত্র না থাকে! ... রাগে, ঘৃণায়, হিংস্রতায় নিজের সারা শরীর অশুচি মনে হচ্ছিল দেবলীনার। এক অদ্ভুত পাগলামি চেপে বসে তার। সে সুইসাইড করবে, কারণ হিসেবে লিখে যাবে সৌরদীপের নাম। শেষ করে দেবে ওর কেরিয়ার! দেখবে, এরপরেও ঐ মেয়েটি কেমন করে সৌরদীপকে বিয়ে করে! ... কিন্তু পরক্ষণেই দমে যায়। এভাবে ওর ক্ষতি করবে? একদিন তো দেবলীনাও তাকে ভালোবেসেছিল। ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নেওয়াও তো পাপ! ... আর একবার ভাবল, সেই মেয়েটির কাছে গিয়ে সব বলবে। ... কিন্তু এতোটাও নীচে নামবে? কেন অন্যের কাছে ভিক্ষে চাইতে যাবে সৌরদীপকে? সে তো তার হেরে যাওয়াই হয়ে গেল। ধীরে ধীরে শান্ত করে নিজেকে। কিন্তু এভাবে চুপচাপ ক্ষমা করাও তো হার মেনে নেওয়ারই সমান। যোগাযোগ তো রাখবেই না। তা-ও এতো সহজে নিজের অধিকার ছেড়ে দেওয়া যায় না। একজন বিবাহিত স্ত্রী যদি স্বামীর ওপর দাম্পত্য অধিকার ফিরে পেতে পারে; স্বামী তার সংসর্গ ছেড়ে দিলে, তা ফিরে পাওয়ার অধিকার যদি বিবাহ আইন দিয়ে থাকে, তাহলে দেবলীনা কেন তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকারটুকু ফিরে পেতে পারে না? এমন কি কোন আইনই নেই? সৌরদীপ তার সাথে যা করেছে তা শুধু তার একার নয়, নারীসমাজের অসম্মান, অপমান। ... দেবলীনা বুঝে উঠতে পারে না, কোন পথে যাওয়াটা উচিত হবে। নিজের প্রাপ্য অধিকার, সম্মান ছিনিয়ে নেবে? না কি আইনের পথে হেঁটে সৌরদীপের শাস্তি চাইবে?
দেবজ্যোতি অনেকবার বাধা দিয়েছিল। খামোখা আইনি ঝামেলায় জড়ালে যদি বোনের সারাজীবনটাই নষ্ট হয়ে যায়! আইন-আদালতের নাম শুনলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে ওর। যতই হোক ছাপোষা মধ্যবিত্ত গেরস্ত বাড়ির ছেলে। আইন-আদালতের ব্যাপারে ওদের সেরকম চেনা-শোনাও নেই। কোন উকিল ভালো হবেন! তাছাড়া টাকা-পয়সার ব্যাপারও তো আছে। উকিল শুনলেই তো মনে হয়, অনেক খরচের ধাক্কা। কিন্তু দেবলীনা কোন কথা শোনে নি। দেবজ্যোতির বাধা সত্ত্বেও খোঁজ-খবর করে উকিলের বিষয়ে। অনেক খোঁজ-টোঁজের পর একজন বয়স্ক উকিলের যোগাযোগ পেল। টাকা-পয়সার ‘খাঁই’টাও সীমার মধ্যেই। দাদাকে সঙ্গে নিয়েই দেখা করতে যায় একদিন বিকেলবেলা। ভদ্রলোকের চেম্বারে তখন ভালোই ভিড় ছিল। প্রায় ঘন্টাখানেক বসে থাকার পর যখন সুযোগ আসে, তখন দেখে, উনি ব্যাগ গুছোচ্ছেন। হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গেছে। এইমাত্র ফোন এসেছে — বেরিয়ে যেতে হবে। সময় দেন পরের দিন সন্ধ্যেবেলায়।
সেদিন সময়মতো পৌঁছে গিয়েছিল দেবলীনা। অ্যাডভোকেট প্রবীর মণ্ডল এক জুনিয়রকে দিয়ে ওদের ডেকে নিয়ে গিয়ে বসালেন চেম্বারের ভেতরের একটা ঘরে।
— “উনি থাকবেন?” অ্যাডভোকেটের পাশে বসে থাকা অল্পবয়েসি মেয়েটিকে দেখে প্রশ্ন করেছিল দেবলীনা।
— “ও আমার জুনিয়র। অসুবিধে আছে?” তির্যকভাবে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন প্রবীরবাবু।
— “আমি প্রাইভেটলি আপনাকে ম্যাটারটা বলতে চাই।”
দেবলীনার স্পষ্ট জবাবে একবার ভালো করে ওকে পর্যবেক্ষণ করেন প্রবীরবাবু। ইশারায় জুনিয়রকে বাইরের ঘরে গিয়ে বসতে বলেন।
— “বলুন। শুনি আপনার ম্যাটারটা। আপনার নামটা কী যেন?”
— “দেবলীনা... সাহা।”
দেবলীনা একটু অপেক্ষা করে জুনিয়র বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর শুরু করে।
— “আপনাদের মধ্যে কি শারীরিক সম্পর্ক ছিল?” দেবলীনাকে মাঝপথে থামিয়ে পেশাদারী স্বরে প্রশ্ন করেন প্রবীরবাবু, “দেখুন, অন্যভাবে নেবেন না। আপনি আমার ক্লায়েন্ট। তাই আপনাকে অযথা মিসগাইড করব না। একটা রিলেশনশিপ ব্রেক-আপের ক্ষেত্রে কোন লিগ্যাল-রেমেডি নেই। ইটস্ ট্যোটালি ইওর পার্সোনাল ম্যাটার। তাই আমি কিছু পার্ট্টিকুলার কোশ্চেন করছি আপনাকে। যাতে ব্যাপারটা ‘টু দা পয়েন্ট’ হয়। ... আমি হাতে আর খুব বেশী সময় নেই।”
— “আচ্ছা করুন।” প্রবীরবাবুর অত্যধিক পেশাদারিত্বে একটু অস্বস্তি ও বিরক্তি বোধ হলেও নিজেকে সামলে নেয় দেবলীনা। আর প্রশ্নের অপেক্ষা না করে আগের প্রশ্নের রেশ টেনে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ... আমাদের একটা ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল ... বেশ কয়েকবারই।”
— “আপনাদের ব্রেক-আপের কোন আঁচ পেয়েছিলেন তার আগে?”
— “না।”
— “তার মানে, ফিজিক্যাল রিলেশন হওয়ার আগে আপনি এটাই জানতেন সৌরদীপ উইল্ ম্যারি ইউ?”
— “সেরকমই বলতো ও-ও। ... ও কথাও দিয়েছিল আমায়। প্রথমে আমি এতোটা ইন্টিমেসি চাই নি। অতোটা প্রগ্রেসিভ মেন্টালিটি আমার ছিল না।... আমি লোকজানাজানির ভয় পেয়েছিলাম। তখন ও-ই অ্যাসিওরেন্স দিয়েছিল।” দেবলীনা ভেবেছিল সেই রাতের ঘটনাটা বলবে। কিন্তু দাদা কাছে থাকায় কেমন যেন অগোছালো হয়ে যায়।
— “ওঁর এই যে বিয়ের কথাটা বললেন, যেটা এখন আপনাকে জানিয়েছেন সেটা আগে জানতে পারেন নি?”
— “না। কোনদিনই কিছুই বলে নি।”
— “ওঁর ফ্যামিলি মেম্বাররা কেউ বলেন নি?”
— “ওঁদের সাথে আমার কোন ডিরেক্ট পরিচয় ছিল না। আমি অনেকবার আলাপ করতে চেয়েছি ওঁদের সাথে। কিন্তু ও দেয় নি। ইভন্ ওর মা’র সাথেও না। আমি কোনদিনই ওর বাড়ি যাই নি। আমাদের একই জায়গায় বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে ওর বাড়ি বাইকে মিনিট দশেকের রাস্তা, তাও ও চাইতো না। আমিও আর জোর করি নি।”
— “উনি এসেছেন আপনাদের বাড়ি?”
— “হ্যাঁ।”
— “স্ট্রেঞ্জ!... আপনার মনে কোনদিনও সন্দেহ হয় নি। উনি কেন যেতে দিচ্ছেন না ওনার বাড়ি বা কেন ওনার ফ্যামিলির সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন না? ... জিজ্ঞাসা করেন নি কোনদিন?”
— “আমি ওকে বিশ্বাস করতাম। ও বারবারই বলতো এখন দু’জনের কারোরই কেরিয়ার সেটেল্ড না। এই অবস্থায় ফ্যামিলিতে রিলেশনটা জানালে ফ্যামিলি থেকে সেটা ভেঙে দিতেও পারেন। তার চেয়ে একটু অপেক্ষা করে গেলেই হয়। এস্টাবলিশ্ড হয়ে বললে তখন আর কোন বাধা থাকবে না।”
— “আপনি এটা বিশ্বাস করেছিলেন??” অবাক চোখে প্রশ্ন করেন প্রবীরবাবু।
— “হ্যাঁ। কেন?”
— “আচ্ছা, আপনাদের বন্ধু-বান্ধব বা কলিগরা এই রিলেশনের ব্যাপারে জানতেন?”
— “আমার কিছু বন্ধু, কলিগ এঁরা জানতেন। ... ওর সাথে আলাপও করিয়ে দিয়েছিলাম। ... কিন্তু ও খুব শাই, ওর বন্ধুদের বা কারোর সাথে আমার আলাপ করায় নি। ওঁরা কে কতটা জানেন সে ব্যাপারে আমার সাথে ওর খুব একটা কথা হয় নি কোনদিন।”
— “হুঁ, বুঝলাম। আপনি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একটা প্রাইভেট কমপ্লেইন্ট ফাইল করতে পারেন। Section 376, Indian Penal Code।”
— “Section 376? মানে রেপ? ধর্ষণ?” দেবলীনা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, “একটু ক্লিয়ারলি যদি বলেন?”
— “হুঁ, আপনি শিক্ষিতা, কাজেই আপনাকে ক্লিয়ারলি বলছি। ... ইটস্ আ কেস সিমিলার টু রেপ। ... ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ অন দ্য প্রিটেক্সট অব ম্যারেজ অ্যামাউন্টস টু রেপ। ইন্ডিয়ান ল তাই বলে। যখন একজন পুরুষ একজন মহিলাকে বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তখন সেটা ধর্ষণ বলেই ধরা হয়। অবশ্য এতে চিটিং-এর অভিযোগও আনা যায়।” নরমভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করেন প্রবীরবাবু।
— “রেপ!” অসাড় হয়ে আসা শরীরটাকে কোনরকমে নাড়িয়ে এটুকুই শুধু বলতে পেরেছিল সে।
তার মানে সৌরদীপের মনে এই ছিল? দেবলীনাই শুধু এতোদিন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে থেকেছে? কিছুই বোঝে নি?... যা এতো অল্পসময়ে একজন তৃতীয় ব্যক্তিও বুঝতে পারলেন, দেবলীনা এতদিনেও তা বুঝতে পারল না? ... কিন্তু সৌরদীপকে সে ‘ধর্ষক’ হিসেবে কিছুতেই মানতে পারছিল না।
— “আপনি চাইলে আমি একটা কমপ্লেইন্ট ফাইল করতে পারি। তাহলে বলুন কী করবেন?”
— “কিন্তু তাতে তো সাজা হবে অনেক। অ্যাণ্ড হিজ কেরিয়ার উইল্ বি ডেস্ট্রয়েড!” দেবলীনার চোখের কোণে জল দেখা যায়। ওর এই কথাটায় প্রবীরবাবু বেশ অবাকই হন। হয়তো প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, “তাহলে এলেন কেন আমার কাছে এতোই যখন দয়া?” কিন্তু ওভাবে তো বলা যায় না। তাই একটু ঘুরিয়েই জিজ্ঞাসা করেন, “সো হোয়াট ডু ইউও ওয়ান্ট?” দেবলীনা বোঝে ওর অসংলগ্ন আচরণে প্রবীরবাবু একটু বিরক্ত হয়েছেন। পরিষ্কার করে বলতে চেষ্টা করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে, “এরকম কি কোন আইন নেই যে আমি আমার অধিকার ফিরে পাব?”
— “অধিকার? মানে, বলতে চাইছেন সৌরদীপ যাতে আপনাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন?”
দেবজ্যোতি এতক্ষণ চুপচাপই বসেছিল। কিন্তু একথার পর আর পারল না, “এতো অসম্মানের পরও তুই ওকে বিয়ে করতে চাস?” উকিলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে প্রশ্নটা করে বসে।
— “রেস্টিটিউশ্যন অব কনজুগ্যাল রাইটস্... দাম্পত্য অধিকার পুনঃস্থাপন। সেটা সম্ভব শুধুমাত্র ম্যারিটাল রিলেশনশিপের ক্ষেত্রে। আপনার এই ধরণের কেসের ক্ষেত্রে সম্ভব না। আপনি যা চাইছেন কোর্টে গিয়ে সেটা পাওয়া যাবে না। সেটা তাহলে পারিবারিকভাবে মিউচ্যুয়ালি মেটাতে হবে। ...কিন্তু একটা প্রশ্ন আমারও আছে, যেটা আপনার দাদা করলেন। আপনার সাথে যা হয়েছে তা আইনত অপরাধ। তাহলে আবার ঐ ছেলেটিকেই বিয়ের কথা ভাবছেন? ... যদি এই অসম্মানের সত্যিকারের রেমেডি চান বলব ইউ শ্যুড ফাইল আ কমপ্লেইন্ট কেস। এবার ভেবে দেখুন কোনটা করবেন।”
প্রায় একনাগাড়ে কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন প্রবীরবাবু।
বাড়ি ফেরার পথে সারা রাস্তাটাই চুপচাপ ছিল দেবলীনা। বারবার শুধু ওকে কুরে কুরে খাচ্ছিল প্রশ্নটা — এতকিছুর পরেও সে কেন আবার বিয়ে করতে চায় সৌরদীপকে, সব সম্মান খুইয়ে? দেবলীনা ভাবে একজন স্ত্রী যদি দাম্পত্য অধিকার ফিরে পেতে পারে, তবে সে অধিকার অবিবাহিত প্রেমীযুগলের ক্ষেত্রে নেই কেন? সে কী করে বোঝাবে সৌরদীপকে বিয়ে করাটা তার কাছে ‘জিতে যাওয়া’? আদালত যদি বাধ্য করত সৌরদীপকে দেবলীনাকে বিয়ের ‘স্বীকৃতি’ দিতে, তবেই তো দেবলীনার আসল জয় হতো! ... কিন্তু তার সেই পথ বন্ধ। প্রতিকারের যে পথ খোলা, সেই পথে গেলে সমাজ তারই দিকে আঙুল তুলবে। উকিলবাবুর কথা মতো সৌরদীপের বিরুদ্ধে মামলা করলে তো সে কথা আদালতের চার-দেওয়ালেই আটকে থাকবে না। পাড়া-প্রতিবেশী থেকে তার কাজের জায়গা সর্বত্রই কানাঘুষো আলোচনা শুরু হবে। তার গায়ে এই তকমাই লাগবে, সে সৌরদীপের ‘ধর্ষিতা’ — ভদ্রভাষায় তার ‘রক্ষিতা’! এভাবে কি সে সত্যিই তার সম্মান ফিরে পাবে?
দেবলীনা শুধু খুঁজে গেছে বিয়ের ‘স্বীকৃতি’। কিন্তু সামাজিক-আইনি ছাপ্পা মারা সেই সম্পর্কের বাঁধন যে আদপে কতটা পোক্ত তা বোঝে নি। যতই ‘স্বীকৃতি’র ছাপ্পা থাক, যদি স্বামী স্ত্রী বেঁচে থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে যায় তাহলেও কি স্ত্রী পারে তার হারানো দাম্পত্য সুখ ফিরে পেতে? আর স্বামী ব্যভিচারী হলে? ... বিচ্ছেদের পথটাই কি সুস্পষ্ট হয় না? যে সম্পর্ক সবরকম সামাজিক সম্পর্কের বীজ বোনে সে নিজেই বড় ঠুনকো। ... তবু এই বাস্তবটা দেবলীনা বোঝে না, বুঝতে চায় না। ... শুধু ঐটুকু ‘স্বীকৃতি’র আশায় হাজারো প্রশ্নের দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরে।...
... সে রাতে বাড়ি ফিরে এসে অবধি দেবজ্যোতি ভালো করে কথা বলে নি বোনের সাথে। অসহায় অবস্থায়, কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ শুধু নিজেকেই দুষতে থাকে। দেবজ্যোতির অবস্থাটাও তাই-ই হয়েছিল। সব রাগ এসে পড়ল বোনের ওপর, “না বুঝে শুনে এরকম সম্পর্কে যাস কেন? এরপর পাড়ায় বাস করতে পারবি? ... কেস-কাছারি করে লোক জানাজানি কর। এরপর তোর বিয়ে দেওয়াটাই একটা দায় হবে...”
দাদার মুখের কথাগুলো সেদিন দেবলীনাকে বিঁধেছিল খুব। তার মানে সে তার দাদার ‘দায়’? দাদাও তাকে ‘পতিতা’ই ভাবে? কারোর বাড়িতে চুরি-ডাকাতি হলে লোকে সেই চোর-ডাকাতকেই দুষে। তবে এ কি নিয়ম সমাজের? ভালোবাসায় বিশ্বাসঘাতকতা করলে বিশ্বাসঘাতকের দোষ হয় না কেন? ... না; হয়। যদি সেই বিশ্বাসঘাতক একজন মহিলা হয়। একজন নারী বিশ্বাসঘাতকতা করলে সমাজ সেটাকে বড় করে দেখে। আঙুল দিয়ে দেখায়, সে ছলনাময়ী, চরিত্রহীন। কিন্তু পুরুষের বেলায় অন্য নিয়ম। পুরুষ ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয়ে কোন মেয়েকে ভোলালেও এটাই শুনতে হয়, সে মেয়ে আপন দোষেই পুরুষের মোহে ভুলেছিল। ... একজন মেয়ে যদি ভালোবেসে তার শরীর ছুঁতে দেয় কোন পুরুষকে তবে সেই ভালোবাসায় কোনও পাপ নেই। তার যোনিদ্বারের ক্ষত কলঙ্ক হতে পারে না। ক্ষতযোনির কোন মেয়ে ‘পতিতা’, ‘নষ্টচরিত্র’ নয়। ‘পতিত’ সেই পুরুষ যে ভালোবাসার মোহে ভুলিয়ে, বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটা নারীর শরীর ছোঁয়। ... আর দেবলীনা আদালতে সেটাই প্রমাণ করবে। অসম্মানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ একটা প্রতিহিংসায় পেয়ে বসল তাকে। ঠিক করল, প্রবীরবাবুর কথামতোই এগোবে। সেইমতোই সে অভিযোগ দায়ের করল সৌরদীপের বিরুদ্ধে, ব্যারাকপুরের অ্যাডিশন্যাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।
(৪)
অনেক ঘুরপথে শেষ পর্যন্ত এই মামলাটাই উঠেছিল সৌমিতার কোর্টে। ২০১৩ সাল। সৌমিতা তখন ব্যারাকপুরে পোস্টেড — অ্যাডিশন্যাল ডিসট্রিক্ট অ্যাণ্ড সেশ্যনস জাজ হিসেবে। প্রতারণা আর বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ‘অল্টারনেটিভ চার্জ’ আনা হয়েছিল সৌরদীপের বিরুদ্ধে। দেবলীনা প্রতিকারের আশায় আইনি পথে এগিয়েছিল। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই বোঝে, এপথও গোলকধাঁধার মতোই। ‘লিগ্যাল অ্যাওয়ারনেস’ ক্যাম্পগুলোয় অনেক কথাই তো বলা হয়, কিন্তু তার কতভাগ বাস্তবায়িত হয় আদালতের চারদেওয়ালের ঘেরাটোপে! ‘ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা’, ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ’, প্রতিটা ধাপেই যেন বার বার মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হতে হচ্ছে শুধু দেবলীনাকেই। যেন অভিযোগ দায়ের করাটাই তার অপরাধ! কষ্ঠিপাথরে ঘষে ঘষে দেখা হচ্ছে সে খাঁটি সোনা তো? ক্রমাগত সেই একই ঘটনা তাকে মনে করানো হচ্ছে, যে ঘটনার স্মৃতিগুলো গুমরে উঠে তাকে বারে বারে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। আদালতের মানুষগুলো কি একটুও বোঝেন না ওর মনের অবস্থাটা? নিজেদের একটিবার তো ওর জায়গায় বসিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। না কি নিয়মের বেড়াজালে নিজেরাই যন্ত্রদানব হয়ে গিয়েছেন? আর কতদিন ধরে চলবে তার এই ‘অগ্নিপরীক্ষা’?...
বহু অপেক্ষার পর রায় বেরোল। সেটাও গেল সৌরদীপের পক্ষেই। যথাযথ প্রমাণের অভাবে সরকার পক্ষের উকিল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন, সৌরদীপ মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছে সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙতে। ভরা কোর্টের মাঝে ‘জাজ্’ এটাই জানালেন, দেবলীনা সৌরদীপের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা থেকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজী হয় — সৌরদীপের দিক থেকে কোন মিথ্যাচার ছিল না। প্রেম পরিণতি পেতেও পারে, না-ও পারে। প্রতিটা ব্যর্থ প্রেমই মিথ্যাচার বা প্রতারণা একথা বলা যায় না। দেবলীনা যথেষ্ট শিক্ষিত; সে যা করেছে তার পরবর্তী ফলাফল বুঝেই করেছে। সৌরদীপ নির্দোষ প্রমাণিত হল; ছাড়াও পেয়ে যায়। সেদিন সৌরদীপের চোখদু’টো খুব অচেনা লেগেছিল দেবলীনার। যার চোখে স্নিগ্ধতা আর মোলায়েম ভালোবাসা দেখে এসেছে এতকাল, সেদিন কেন সেই চাউনি এতোটা প্রতিহিংসাপরায়ণ লাগল? দেবলীনা যে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে পেরেছিল সৌরদীপ? আর তাই ঐ সর্পিল দৃষ্টি? ঐ দৃষ্টিতে ভয়ও পেয়েছিল দেবলীনা। ভেবেছিল, সৌরদীপ আবার না মানহানির মামলা করে। কিন্তু সেসব কিছুই করে নি। সেটা কি দেবলীনাকে দয়া করে? তার পরাজয় দেখে করুণা করে? না কি আত্মগ্লানিতে একটু হলেও ভুগছিল সে? তবে কি আইনের ভয়ে? ... কে জানে, হয়তো আরো বড়রকম কিছু প্রতিশোধের ছক কষছে সে দেবলীনার অস্তিত্বটাকেই শেষ করে দিতে!
একটার পর একটা মানসিক আঘাতে বিধ্বস্ত হতে হতে সহ্যের শেষসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল দেবলীনা। নিজেই বুঝতে পারছিল, মানসিকভাবে অসংলগ্ন হয়ে পড়ছে সে। ঐদিন কোর্টের রায়ে সৌরদীপের জিতে যাওয়াটা যেন আঘাতের শেষ ছোরাটা বসিয়ে দেয়। আদালতের রায় অমান্য করা চলে না। সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবুও সেই রায় কোনভাবেই মেনে নিতে পারে নি দেবলীনা। এও যেন তার ভাগ্যেরই ‘পরিহাস’ মনে হল। প্রথম উকিল প্রবীরবাবু বলেছিলেন, সরকার পক্ষের উকিলের সাথে কথা বলে হাই কোর্টে আপীল করতে। কিন্তু দেবলীনা হাল ছেড়ে দেয়, খানিকটা পরিস্থিতির শিকার হয়েই। সরকার পক্ষের উকিলের তরফ থেকেও কোন আগ্রহ তৎপরতা দেখা যায় নি। বরং নিরুৎসাহই দেখা গেছলো। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার মতোও সময় ছিল না ওঁর।
মাস কয়েকের মধ্যেই দেবলীনার মানসিক অবসাদ ভালোমতোই দেখা যায়। কথা বলার পরিসরও কমে আসে; নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। দেবজ্যোতি অসহায় হয়ে পড়ে। এতদিন ধরে দেবলীনার কথায় অসংলগ্নতা সেও দেখেছে। বিশেষ করে খটকা লেগেছিল সেইদিন, যেদিন কলেজ সার্ভিস কমিশনের কাউন্সেলিং হয়। কাউন্সেলিং শেষে বেরিয়ে এসে দেবলীনা বলতে পারে নি কোন কলেজ সিলেক্ট করেছে। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বাইরের দিকে, অনেকক্ষণ। কিন্তু তাতেও দেবজ্যোতি বুঝতে পারে নি সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কনসাল্ট করার দরকার আছে। ওর একটু মনের বিশ্রাম দরকার। শুধু দেবলীনা নিজে বুঝেছিল, অনেক আগেই। তাই কলেজের পার্টটাইম কাজগুলো ছেড়ে দেয়, কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউর আগে আগেই। যাতে অন্তত ইন্টারভিউটা ভালো করে দিতে পারে। তখন মামলার শুরুর দিক। হয়তো অবচেতন মনে মামলা জেতায় অনিশ্চয়তা আশঙ্কা করেই প্রাণপণে চেষ্টা করেছিল জীবনের আসল লড়াইটুকু নিশ্চিতভাবে জিততে — চাকরিটা পেয়ে। চেষ্টা সফল হলেও শেষরক্ষা হয় নি। সেবার চাকরিতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হতে প্রায় দু’বছরের কাছাকাছি সময় লেগে যায়। দেবলীনা সিলেক্টেড হয়। চাকরিতে জয়েনও করে। বাড়ি থেকে দেড়-দেড় ঘন্টা তিনেকের যাতায়াতের পথ। তাই আলাদা করে আর বাসা খুঁজতে হয় নি। একাই যাতায়াত করছিল। প্রথম প্রথম ঠিকই ছিল। তখনও মামলার রায় বেরোয় নি। কিন্তু রায় বেরোনোর মাস কয়েক পর থেকেই সবকিছু ওলোট-পালোট হতে থাকে।
চাকরিতে মাস ছয়েক হতে চলেছে তখন। বেশ কয়েকবার হয়েছে, অনেক রাত পর্যন্তও দেবলীনা বাড়ি ফেরে নি। দেবজ্যোতি অনেকবার ফোন করে না পেয়ে যখন আবার থানা-পুলিশ করতে যায়, তখন ফোন আসে। দেবলীনা ভুল করে অন্য স্টেশনে নেমে গেছে। সেই স্টেশনেই বসে আছে। কীভাবে ফিরবে বুঝতে পারছে না। রাতের বেলা পরিচিত বন্ধুদের থেকে বাইক নিয়ে বোনকে আনতে ছুটেছে দেবজ্যোতি। একবার তো ব্যারাকপুর স্টেশনে এসে বাড়ির পথ ভুলে স্টেশনেই বসে থাকে। দেবজ্যোতি গিয়ে আবার নিয়ে আসে। এতদিনে সে বুঝতে পেরেছিল বোন মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবটা মানতে সময় লেগেছিল সেইদিনটা পর্যন্ত যেদিন কলেজ থেকে ফোন আসে দেবজ্যোতির ফোনে। ওঁরা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেন, দেবলীনার পক্ষে চাকরি করা সম্ভব না। ওর মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন। শেষরক্ষা হয় নি। আট-ন’মাসের মাথায় চাকরিতে রেজিগনেশন দেয় দেবলীনা। ততদিনে সে প্রায় পুরোপুরিভাবেই মানসিক ভারসাম্যহীন।
(৫)
— “শোন, একটু দাঁড়াও।” দেবজ্যোতিকে পিছনে ডাকেন সৌমিতা।
— “বলুন ম্যাডাম।”
— “ছেলেটি এখন কী করছে?” এ যেন এক অন্য সৌমিতা। নিজের রাশভারী ব্যক্তিত্ব থেকে বেরিয়ে এসে প্রশ্নটা করেই ফেলেন তিনি।
— “কে? ঐ সৌরদীপ?”
“ঐ জানোয়ারটা?” বলতে গিয়েও কথাটা গিলে নিল দেবজ্যোতি। একজন ‘জজ্ ম্যাডামের’ কাছে তো আর এভাষায় কথা বলা যায় না।
— “হুঁ।” ঘাড় নাড়েন সৌমিতা।
— “ও তো শুনেছিলাম, ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করে নি, যার সাথে প্রথম থেকেই বিয়ের কথা ছিল বলে বলেছিল। অন্য একজনকে করেছে। ঐ মামলার পর পরই তো। এখন ঠিক কোথায় তা বলতে পারব না। বিদেশ টিদেশে চাকরি করছে হয়তো। শুনেছিলাম ওরকমই কিছু একটা। ওদের ম্যাডাম অনেক টাকা। পয়সা থাকলে আর আটকায় কে?”
— “তোমার বোনের আর বিয়ের ব্যবস্থা কর নি?”
— “চেষ্টা তো অনেক করেছিলাম। কিন্তু হল আর কই? পাগলকে কি কেউ বিয়ে করে ম্যাডাম? একটাই ভয় হয়, মা-বাবার মতো আমিও যদি হুট করে মরে যাই ওকে কে দেখবে? সাতকুলে তো আর কেউ নেই।”
সৌমিতা হয়তো বলতে পারতেন, “ও কথা বলে না।... এতো নেগেটিভ চিন্তা করে না।” কিন্তু বললেন না। চুপই রইলেন। শুধু একটা শ্বাস কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এলো। খানিক চুপ থেকে নিজেই প্রশ্ন করেন, “তোমার বোনের বয়েস কত এখন?”
— “আমারই তো বিয়াল্লিশ। ... ওর ধরুন একত্রিশ-বত্রিশ।” আঙুলের কড়ি গুণে বলে দেবজ্যোতি।
— “তোমার বিয়াল্লিশ? দেখে তো অনেক কম মনে হয়।... এম্মা! আমার বোধহয় ‘আপনি’ বলা উচিত ছিল।”
— “না, এ কী বলছেন?” একজন জাজের কাছ থেকে এই সম্মানটুকু পেয়ে একটু সঙ্কোচ বোধ করে দেবজ্যোতি।
— “ওকে ভালো কোন ডাক্তার দেখাও। কলকাতায় আমার চেনা অনেকেই আছেন। আমি বাড়ি গিয়ে আমার ফোন নাম্বারটা তোমায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।... সাবধানে রেখো বোনকে।”
দেবজ্যোতি চলে যাওয়ার পর আনমনা পায়ে গাড়ির দিকে এগোন সৌমিতা। একটু দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় পার্ক করা আছে। ড্রাইভারকে ফোন করে ডাকতে গিয়েও আর ইচ্ছে হল না। মেয়েটির জীবনের কথা শুনে কেমন যেন অপরাধ বোধ হচ্ছিল সৌমিতার। তাঁরই হাত দিয়ে বেরোন রায় একটা জীবন এরকমভাবে তছনছ করে দিল! কিন্তু এখানে কী-ই বা করতে পারতেন তিনি? আইন তো এসব কোর্টের বিচারকদের হাত-পা বেঁধে রাখে, একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি টেনে দিয়ে। তাঁরা তো আইন তৈরী করতে পারেন না। সে ক্ষমতা তো শুধু হাই কোর্ট আর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের। ঐ মামলা নিষ্পত্তির পর সৌমিতার একবার মনে হয়েছিল, আইনে অনেক গলদ আছে। আধুনিকতার মোড়কে মোড়া ফৌজদারি আইনের দর্শনে অভিযুক্তের নিরাপত্তাই বেশী গুরুত্ব পায়, যাতে একজনও নিরপরাধ ব্যক্তি বিচারব্যবস্থার ভুলে শাস্তি না পায়। আর যার প্রতি অপরাধ হয়েছে, সে থাকে পরিহাসের পর্দার আড়ালে। উপরি দেখানো হয়, সরকার তার হয়ে ন্যায়-বিচারের জন্য মামলা লড়ছে। পুলিশ-প্রশাসন তাকে সাহায্য করছে, তার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে। কিন্তু সে ভাবনার কতটুকুই বা লিপিবদ্ধ আছে আইনের কালো অক্ষরে? মান্ধাতার আমলের আইনের গোলকধাঁধায়, পুলিশ-প্রশাসনের অসহযোগিতায় যদি সে প্রমাণ যোগাড় করতে না পারে তাহলে অভিযুক্তই লাভবান হয়। অপরাধ করেও ছাড়া পেয়ে যায়। আর যার বিরুদ্ধে সেই অপরাধ হল সে শুধু ক্ষতির শিকার হতে থাকে। অনেক সময় পুলিশ-প্রশাসন ঠিকভাবে কাজ করলেও সঠিক প্রমাণ জোগাড় করা খুবই শক্ত হয়ে যায়— অভিযুক্ত যদি খুব বুদ্ধির চাল চালে গোড়া থেকেই— বিশেষ করে এই ধরণের মামলায় — বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস। এসব মামলায় সঠিক প্রমাণ যোগাড় করা খুবই কঠিন। কারণ এই ক্ষেত্রে ন্যায়-বিচারের ভিত্তিই তো নীতিবোধ, মূল্যবোধ। প্রতিশ্রুতির মূলেই আছে নীতিবোধ, যা পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে যাচাই করা যায় না। যায় শুধুমাত্র একটা সুপ্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে — ‘বিবেক’। প্রাচীন কাঠামোর গায়ে আধুনিকতার প্রলেপ — আইনের এই মূর্তিটাই এখন দেখা যায়। তাতে কতটুকুই বা স্থান পেতে পারে সামাজিক নীতিবোধ? সে তো আধুনিকতার কাছে একটা ‘অন্ধ সংস্কার’ মাত্র! প্রেমে প্রতারণা সামাজিকভাবে অন্যায়। অথচ আধুনিক মানবাধিকার আইন বলে, সঙ্গী পরিবর্তন করা মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার যখন অন্যজনের জীবনের অধিকারকে খর্ব করে? সামাজিক নীতিবোধ বড়ই দুর্বল, আধুনিকতার ঝড়ের কাছে। সে বারে বারেই হেরে যায় মানবাধিকার তত্ত্বের কাছে।
সমাজ দেবলীনাকে চিনল একজন পাগল হিসেবে। সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও সে আজ একঘরে। কিন্তু সৌরদীপ খুব শিক্ষিত চালে একজনের জীবন নিয়ে খেলেও হয়তো আজ সুখী। সমাজের কাছে তার পরিচয় হয়তো খুবই চরিত্রবান, নিষ্ঠাবান একজন স্বামী। একদিন তার সফলতার আলোয় আড়ালে চলে যাবে দেবলীনার জীবনের এই অন্ধকার ঘটনাটা। ... লম্বা একটা শ্বাস বেরিয়ে আসে কেঁপে কেঁপে। সৌমিতার বারে বারে অপরাধবোধ জাগে। একজন বিচারকেরও তো পাপবোধ হয়, নিজের অসহায়তার জন্য। তিনি তো কেবল ‘বিচার’ করেছিলেন এই মামলার। কিন্তু দেবলীনা ‘ন্যায়’ কি পেল?
প্রবন্ধ
ভারতবর্ষে প্রথম রেল স্থাপনে উদ্যোগী
এক প্রাণপুরুষ
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী
বাংলা তথা ভারতবর্ষের এক বিস্মৃতপ্রায় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কর্মজীবনের উজ্জ্বল ছবিটা আজও আমাদের কাছে অজানা। বাংলা নবজাগরণের পুরোধা বর্ণময় চরিত্রের এই কর্মযোগী মানুষটি প্রায় দু’শ বছর আগে ভারতীয় অর্থনীতির বিশ্বায়ন ঘটিয়েছিলেন তাঁর স্বীয় উদ্ভাবনী ক্ষমতার বলে। জীবনীকার ব্লেয়ার-বি-ক্লিং লিখেছেন – “ ভারতবর্ষে শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা দ্বারকানাথেরই ছিল, ইংরেজদের নয়”। বাষ্পীয় যুগের পথ প্রদর্শক এই মানুষটির এই বছরেই ২২৫তম জন্মবার্ষিকী।
আধুনিকমনস্ক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দ্বারকানাথ ঠাকুর একক প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে প্রথম রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগী হয়েছিলেন যা এককথায় ইতিহাস। এই ইতিহাস রচনার পিছনে ছিল তাঁর প্রথম বিলেত যাত্রার অভিজ্ঞতা। ইউরোপ ও বিলেতে রেল ভ্রমণে দ্রুতগতির রোমাঞ্চকর যাত্রা তাঁকে উৎসাহিত করেছিল এদেশে রেলপথ স্থাপনে। বন্ধু ও হিতৈষী লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর অনুপ্রেরণায় ১৮৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মেসার্স কার-টেগোর এন্ড কোম্পানি’-র সৌজন্যে দ্বারকানাথের তখন ইউরোপ, আমেরিকা ও চীনের সাথে নীল, রেশন, সোরা, চিনি, চা ও আফিং-এর সরাসরি বাণিজ্য চলত। রাণীগঞ্জে বিশাল কয়লা খনি কেনার পর ‘কার-টেগোর’ কোম্পানিকে কেন্দ্র করে যে বিশাল বাণিজ্য ও শিল্প জগতের সূত্রপাত হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৪২ সালে প্রকাশিত ফিশার্স কলোনিয়াল ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদনে লিখেছিল – “দ্বারকানাথ তাঁর জীবনের এই পর্বে সাহসিকতা, তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি, কর্মদক্ষতা ও স্বাবলম্বনের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ছিলেন, তেমনটি ইতিপূর্বে দেখা যায়নি । দ্বারকানাথের আগে কোন হিন্দু সমুদ্রপথে বিদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই”। আসলে দ্বারকানাথ বিলেত যাত্রার মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলির শিল্পের অগ্রগতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল ইংল্যান্ডের বাষ্পীয় ব্যবস্থার সাথে নিজস্ব কর্মকান্ডের নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন ।
১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারী দ্বারকানাথ তাঁর নিজস্ব জাহাজ ‘ইন্ডিয়া’ যোগে বিলেতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর প্রথম জীবনীকার কিশোরীচাঁদ মিত্রের লেখা থেকে ইউরোপে দ্বারকানাথের প্রথম রেল দেখার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে জানা যায়। ১১ এপ্রিলে লেখা একটি চিঠিতে তিনি ইতালির নেপলস শহরের সৌন্দর্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন – “এখানে আমি একটি রেল রাস্তাও দেখেছি। আমার ঘোড়ার গাড়ীর পাশ দিয়ে রেলগাড়িটা যখন হুঁশ করে বেড়িয়ে গেল ভেবে দেখো আমার মনের কি অবস্থা”। এই রেল দর্শনে রোমাঞ্চিত দ্বারকানাথ জার্মানিতে পৌঁছে বহু প্রতীক্ষার রেল গাড়িতে চাপেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে রেলগাড়িতে চেপে তিনি মাইনৎস-এ পৌঁছান। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় তিনি কোলোন থেকে রেলগাড়িতে যান শার্লেমান-এর জন্ম ও সমাধিস্থল দেখতে। ১৮৪২ সালে ১০ জুন লন্ডনে পা দেবার পর ১ নভেম্বর ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ কাগজে প্রকাশিত একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন – “......আমি বার্মিংহাম ও লন্ডনের রেল চলাচল ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে গিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের অত্যাশ্চর্য সব ব্যাপারের মধ্যে রেল চলাচল অন্যতম। এর ফলে যে সব স্থান সুদর বলে পরিগণিত হত সেগুলি হাতের নাগালের মধ্যে সন্নিকট হয়েছে । নবাগত কোন ব্যক্তি যিনি এমন বিরাট ব্যাপার ইতিপূর্বে চোখেই দেখেননি তাঁর কাছে এটি খুব লক্ষণীয় মনে হবে......”। এই রেল ব্যবস্থা তাঁর মনে এমন রেখাপাত করেছিল যে তাঁর মনে হয়েছিল এই যোগাযোগ ব্যবস্থা “ইংল্যান্ডের অত্যাশ্চর্য ব্যাপার”।
১৮৪২ সালের ডিসেম্বরে দ্বারকানাথ যখন বিলেত থেকে দেশে ফিরে এলেন তখন থেকেই তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারতের রেল ব্যবস্থা চালু করতে। তাঁর এই স্বপ্নকে সার্থক করতে পাশে পেয়েছিলেন একজন লালবাতি জ্বলা ব্যাঙ্কের মালিক তথা প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেন সনকে যিনি রেলওয়ে সম্পর্কে ছিলেন একজন অতি উৎসাহী ব্যক্তি। স্টিফেনসন সাহেব ১৮৪৩ সালে যখন কোলকাতায় পদার্পণ করলেন তখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের। দুজনেই শিল্পবিপ্লবের সুদূর প্রসারী সম্ভাবনা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন ।
স্টিফেনসন এদেশে এসেছিলেন এক স্টিম ন্যাভিগেশন কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে। তিনি ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় লিখতেন যেটার মালিক ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বয়ং। ১৮৪৪ সালে এই পত্রিকায় স্টিফেনসন ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণের জন্য একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটি “Report upon the practicability & Advantage of the introduction of Railways into British India” নামে খ্যাত। স্টিফেনসনের এই তথ্যবহুল প্রবন্ধ দ্বারকানাথকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। এখানে উল্লেখ্য ১৮৪০ দশকের পূর্বে ইংল্যান্ডে উৎসাহিত হয়ে এমন বহু রেলকোম্পানী তৈরী হয়েছিল যারা লাভজনক ব্যবসা করতে পারেনি। পাশাপাশি রেলওয়ে প্রযুক্তিতে অনেক বিপজ্জনক নির্মাণও হচ্ছিল। সেই কারণে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়াররা চেয়েছিলেন ব্রিটেনের অন্য উপনিবেশগুলিতে কাজ করতে। সেই সময় আমেরিকায় তুলা চাষের বিপুল ক্ষতিতে ম্যানচেস্টার ও গ্লাসগোর ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি পড়াছিল ভারতের তুলা চাষের দিকে। তখনই সকলের নজর এসেছিল ভারতবর্ষে রেল যোগাযোগ স্থাপনে।
বাষ্পীয়যুগে জন্ম দ্বারকানাথ নদী ও সমুদ্র পথে পরিবহনের জন্য স্থাপন করেছিলেন ‘The India General Steam Navigation Company.’ এছাড়াও Steam Tag association’ ও ‘Steam Ferry Bridge Company’ নামে আরও Steam Tag association’
ও ‘Steam Ferry Bridge Company’ নামে আরও দুই কোম্পানির সাহায্যে তিনি নদীপথে পরিবহন ব্যবসা চালাতেন। সেই কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গঙ্গার তীরবর্তী স্থানে কয়লা মজুতের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কয়লা পরিবহণের সময়। নদীপথে কয়লা পাঠাতে সময় ও অর্থ দুটোরই ব্যয় ছিল অত্যাধিক। এই কারণে ব্রিটেনের অভিজ্ঞতার দরুন দ্বারকানাথ সচেষ্ট হয়েছিলেন এদেশে রেলপথ স্থাপনে। কিন্তু ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত তাঁকে প্রথমে নিরাশ করেছিল। কেননা ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞদের মতে এদেশে রেলপথ স্থাপন হচ্ছে – “Premature & expensive Undertaking and a hazardous and dangerous Venture.” অনেকেই তখন ভারতবর্ষের জলবায়ু, ঝড়, বৃষ্টি, অসংখ্য নদীনালা, উঁচু পর্বত, ঘন জঙ্গল ও মরুভূমিতে রেললাইন পাতার সম্ভাবনায় সন্দিহান ছিলেন।
এদিকে ১৮৪৩ সালের পূর্বেই লর্ড ডালহৌসি চেয়েছিলেন বোম্বে, কোলকাতা এবং মাদ্রাজকে রেলপথের মাধ্যমে একসূত্রে বাঁধতে। ঐ বছর তিনি জর্জ. টি. ক্লার্ক নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারকে বোম্বে পাঠান এই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। অন্যদিকে রেলপথ স্থাপনে মরিয়া দ্বারকানাথও স্টিফেনসনকে নিয়ে তৎপর ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ে দুজনের মতপার্থক্য প্রকাশ্যে চলে আসে। স্টিফেনসন ‘The India General Steam Navigation Company’-র একজন অংশীদার ছিলেন। এই Navigation Company-কে নিয়ন্ত্রণ করত ‘কার-টেগোর’ কোম্পানি। স্টিফেনসন এই কোম্পানির MD হতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ‘কার-টেগোর’ কোম্পানি অন্যকে মনোনীত করে MD হিসাবে। সেই কারণে রুষ্ট স্টিফেনসন আলাদাভাবে East India Railway কোম্পানি তৈরীর প্রস্তাব করেন উত্তরভারতে নীল, আফিং ও সোরা রপ্তানির জন্য যার মূল কেন্দ্র ছিল বিহার। ১৮৪৪ সালে স্টিফেনসন কোলকাতা থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের জন্য পরিবহন ও প্রযুক্তির দিক ব্যাখ্যা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রিপোর্ট পাঠান। দ্বারকানাথও উদ্যোগী ছিলেন তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য। তিনি কোলকাতার প্রখ্যাত ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁর মতামত ব্যাখ্যা করে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং সকলের কাছে আহ্বান করেন অর্থ দানের মাধ্যমে একটি তহবিল গড়ে তোলার জন্য। ধনী ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতায় কিছুদিনের মধ্যে গঠন করা হল Great Western Bengal Railway বা সংক্ষেপে GWBR। GWBR-এর প্রস্তাবিত রেলপথ ছিল গঙ্গার তীর বরাবর উত্তরদিকে, রাজমহল পর্যন্ত। এই রাজমহলেই দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়া জেনারেল ন্যাভিগেশন কোম্পানি’-র বন্দর ছিল। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল রেল যোগে তাঁর ও কোম্পানির কয়লা এই বন্দরে পাঠিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপে গঙ্গার জলপথকে ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় সেই জ্বালানি প্রেরণ করা।
রেলপথ স্থাপন নিয়ে এই দ্বৈরথের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্টিফেনসনের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেয়। ব্যর্থ মনোরথ স্টিফেনসন ইংল্যান্ডে সেখানে তিনি ফিরে গেলেন।কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের কাছে দরবার করে E.I.R.-এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলেন। কোম্পানির সম্মতি পেতে তাঁর দেরী হয়নি। ভারতে প্রত্যাবর্তন করে ১৮৪৫ সালে তিনি সরকারী ভাবে স্থাপন করলেন ‘East India Railway.’ EIR-এর পরিচালনা কমিটিতে লন্ডনের ব্যক্তিরাই বেশী ছিলেন এবং তাঁদের যুক্তি ছিল স্থানীয়দের চাইতে EIR ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-কেই বেশী সুবিধা দিতে পারবে। স্টিফেনসন সরাসরি GWBR-র বিরোধীতায় নামেন। ইংল্যান্ডের কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিরাও মত দিলেন কোলকাতায় ‘Anti Business Sentiment’ প্রবল এবং সেখানে ‘Modern Technology’-র অভাব রয়েছে। এই বিতর্কের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার F.W. SIMMNS কোলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনকেই প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে মূল কারণই ছিল উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তুলা চাষের আধিক্য। সেক্ষেত্রে দ্বারকানাথের দূরদৃষ্টির বিপরীত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিন্তাভাবনা। বাষ্পীয় যুগে জ্বালানীর সুষ্ঠ যোগানের ব্যবস্থাকে ততটা কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা গুরুত্ব দেয়নি। হয়তো এই দেশে রেল চলাচলের প্রথম কৃতিত্ব নেবেন একজন ভারতীয় - এই সত্যটা তাঁদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল।
দ্বারকানাথ যে রেল চলাচলের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই বিরাট স্বপ্ন বাস্তবে সফল হয়নি। তাঁর দ্বিতীয়বার বিলেত যাত্রায় ১৮৪৬ সালে ১ আগস্ট লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হোটেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেঁচে থাকলে বোম্বের আগেই হয়ত এই কোলকাতায় প্রথম রেল চলাচল করত। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ১৮৪৬ সালের ফেব্রুয়ারীর একটি সংখ্যায় শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ‘ফ্রেন্ড অব্ ইন্ডিয়া’ কাগজের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে কোলকাতা ও রাজমহলের মধ্যে প্রস্তাবিত গ্রেট ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানির পরিকল্পনা রচনায় কার টেগোর কোম্পানি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জীবনীকার ব্লেয়ার ক্লিং বলেছেন: “রেল চলাচল ব্যবস্থা ভারতে ঠিক শুরু হবার মুখেই তাঁর মৃত্যু হয়, রেলপথের যুগ আসার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে মূলধন বিনিয়োগের রাস্তা খুলে যায় দিকে দিকে। দ্বারকানাথ সেই বহু-প্রতিশ্রুত স্বপ্ন রাজ্যের আভাসমাত্র দেখতে পেয়েছিলেন দূর থেকে, সে রাজ্যে প্রবেশ লাভ করতে পারেননি ।
সূত্র :- 1) দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী – ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(২) দ্বারকানাথ ঠাকুর - বিস্মৃত পথিকৃৎ কৃষ্ণ কৃপালনী
(৩) Symphony of Progress - The saga of E.Rly.` 1859-2003
গল্প
চারটি গল্প...
অবশেষ
কনফিউজড
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
ন্যাপলা পারুই
শিবাংশু মুখোপাধ্যায়
কনফিউজড
পুলিশের কাস্টডি থেকে ছাড়া পেয়ে যেদিন সকালে শুভ্র বাড়ি ফিরল, সেদিনই রাতে সে আত্মহত্যা করল। গলায় দড়ি দিয়ে। এমন কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া গেল না - যা থেকে তার আত্মহত্যার কারণ অনুমান করা যায়। শুভ্রর পার্টির লোক পুলিশকেই দোষী ধরে নিয়ে মিছিল বের করল। শুভ্রর মা আগেই মারা গিয়েছিলেন, ওর বাবা আর দিদি মিলে পার্টির প্ররোচনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল কোর্টে। পুলিশও বসে রইল না। অভ্রর ঘর তছনছ করে আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে লাগল।
এ বছর শুভ্রর ফাইনাল ইয়ার ছিল। ইনফরমেশন টেকনোলজিতে বিটেকের উজ্জ্বল ছাত্র ছিল শুভ্র। ভালো নম্বর পেয়েছিল আগের প্রত্যেকটা সেমিস্টারে। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ক্রমে ওর নাম উঠেছিল ১১৯ নম্বরে। তাহলে নিশ্চয়ই পুলিশের অত্যাচারেই ও মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অথচ যে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ থেকে পুলিশ শুভ্রকে ধরেছিল সেই মিটিংয়ে ও যেতেও চায় নি। ইদানিং খুব মন মরা হয়ে থাকত। না, কোনো বিশেষ বান্ধবী-টান্ধবীও ছিল না তার। ওই কয়েকজন ক্লাসেরই যা! আর দুয়েকজন অন্য বিভাগের। তারা কেউই স্পেশাল নয় - সেই অর্থে। সহপাঠী বন্ধুরা বলল, কেউ কেউ। কিন্তু কেন শুভ্র ইদানিং মনমরা হয়ে থাকত - সেটা কেউ বলতে পারল না। পুলিশ দিশেহারা হয়ে গিয়ে শুভ্রর আরও দুজন সহপাঠী এবং পার্টির এক নেতাকে তুলে নিয়ে গেল।
তারপর একদিন আষাঢ়ের নাছোড় মেঘে নতুন বৃষ্টি এল। আষাঢ়-শ্রাবণভর খুব বৃষ্টি হল সেবার। পুলিশ তখনও হাল ছাড়েনি। এদিকে শুভ্রর বাবার করা মামলার শুনানির দিন এগিয়ে আসছে। পুলিশও জানতে পেরেছে শুভ্র ক্যাম্পাসে এবার অ্যাপিয়ার করে নি। তার চাকরির দরকার ছিল না তাহলে? অথচ ওর বাবাও তো রিটায়ার্ড পার্সন - খুব বেশি পয়সাকড়ি জমানোও নেই। তাহলে শুভ্রর কেন দরকার ছিল না চাকরির? আর সে তো যে সে চাকরি নয়! মাল্টিন্যাশনাল বিগ হাউস। সেই চাকরিতে অনীহা শুভ্রর? নাকি ভেবেছিল দেশোদ্ধার করাটাই তার একমাত্র লক্ষ্য হবে। এদিকে আবার পুলিশ এও শুনেছে যে - ও সেদিন ওই বিক্ষোভ মিটিংয়েও যেতে চায় নি!
আঞ্চলিক থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা অরিজিৎ মণ্ডল কনফিউজড। কনফিউজড শুভ্রর বাবা-দিদি, বন্ধুরাও। শুধু তার পার্টির নেতারা কনফিউজড নন। তাঁদের স্থির বিশ্বাস পুলিশের অত্যাচারেরই ফল ওই আত্মহত্যা।
শুভ্র ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিল না কি? ও ভালো চাকরি পেয়েছে। ভালো চাকরি বলতে অনেক টাকা মাইনে। ও এমন এক সকল-স্বজন-হতে-বিচ্ছিন্ন মেরুতে চলে গেছে যেখানে ওর সঙ্গে কেউ-কেউ মাত্র গেছে চেনা বা অচেনা। অন্যমেরুতে পড়ে রয়েছে অগণিত মানুষ। চাষাভুষো, মজদুর, ওর প্রিয় বন্ধু ইতিহাসের ছাত্র মহম্মদ আমিন। আমিন বাপের ওই যৎকিঞ্চিত জমিটুকু বিক্রি করে বিএড পড়েছে এবং পাশ করেছে এ বছর। স্কুলে চাকরি নিয়ে সরকারের কীসব যেন মামলা মকদ্দমা চলছে। চাকরি-বাকরি কবে পাবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। সে টিউশন শুরু করেছে। আয় হচ্ছে চালিয়ে যাবার মতোই। ও শুভ্রর চেয়ে বয়সে দু-তিন বছরের বড়। ওর সামনে দাঁড়াতে শুভ্রর লজ্জা হত। ইংরাজির সুপর্ণার বিয়ে হয়ে চলে গেছে মহারাষ্ট্রে। সুপর্ণা ওকে ফোনে বলেছিল একদিন, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের ভবিতব্যটা আর পালটানো না, বুঝলি। কেউ কেউ জিনস প্যান্ট পড়ে সিগারেট খেল ঠিকই। মিছিলে হাঁটলোও। কিন্তু তারা পুরুষের চাইতে আলাদাই রইল। নির্ভরতা যেন মেয়েদের জেনেটিক রোগ।’ সুপর্ণা ফোন করলে পুরুষ হিসেবে শুভ্রর যন্ত্রণা হত। আর কারুর হত না। এসব কে বলল আপনাদের? কী করে জানলেন এই সামান্য কারণগুলো? এসবের জন্য কেউ আত্মহত্যা করে?
আত্মহত্যাও একটা জেনেটিক রোগ। যে বা যাঁরাই ওই পথে যান তাঁরা নিশ্চিতভাবেই ওই রোগের শিকার। কিন্তু শুভ্রর আর কোনো পূর্বপুরুষ আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা যায় না। শুভ্র মরে গেছে সাত মাস হতে চলল, এখনও অনেকেই কনফিউজড। কেউ কেউ অবশ্য বিশ্বাস করেন, মানসিক অবসাদের কোনো রাজনীতি হয় না। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন রাজনীতিই মানসিক অবসাদের একমাত্র কারণ। শুভ্র কি জানত তার মানসিক অবসাদের কারণ? নাকি সেও ছিল অনেকেরই মতো কনফিউজড?
অবশেষ
ঘরের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার। বন্ধ দরজার বাইরে কান পাতলে মেয়েলি গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়। আর নির্বোধ তৃপ্তির পৌরুষ। বেশ খানিকক্ষণ সম্পূর্ণ পৃথক এই দুই ভাষায় সংলাপ চলে। কেউ কারুর ভাষা বোঝে না। কোনো দোভাষী নেই, অথচ সংলাপ চলে। তারপর একসময়, কিছুক্ষণ, বাইরের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে যায় ঘরের অন্ধকার। তাদের মধ্যে কী দেওয়া-নেওয়া চলে কেউ জানে না। দিন পার হয়ে আসে আরেক দিন।
তার মধ্যিখানে হয়তো, একবার অন্তত, দুই অন্ধকারকে ছিঁড়ে দেয় কোনো অচেনা আলো। ঘরের ভেতরটা মুহূর্তের মধ্যে টাঙস্টেনের অহংকারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা যায়, একজন মানুষ বটে!
দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে জড়ের মতন। বুক অবধি ঢাকা সাদা চাদরে। পাশ ফিরে আর্ত হাঁটুদুটো বুকের কাছে গোটানো। হাতদুটোও ভাঁজ করে কুঁকড়ে বুকের মধ্যে রাখা। যেন হেমন্তের শুকনো ঝরা পাতা মাড়িয়ে চলে গেছে কোনো উদ্ধত জয়ী মিলিটারির বুট। যেন একটা শান্ত জলের চাদর কোনো বুনো হাঁস বেমানান সাঁতরে এফোঁড়-ওফোঁড়, তছনছ করে দিয়ে গেছে। যেন কীটবিদ্ধস্ত পচা খাবারের অবশেষ।
মাস পার হয়ে আরেক মাস।
বছরের পর বছর।
শূন্যগর্ভ সংলাপ চলে।
তারপর...
অবশেষ।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
একজন বলল, “একবার শুধু বলুন স্যার। নদীর চড়ায় সবকটাকে পুঁতে দিয়ে আসি। আগে বাঁধবো, তারপর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেব। তারপর পুড়ে ছাই হয়ে গেলে পুঁতে ফেলব বালিতে। কাল জোয়ারের জলে সব ধুয়ে যাবে।”
দ্বিতীয় লোকটা বলল, “তোর কি মাথা খারাপ! একসঙ্গে অতগুলো মানুষ...”
প্রথমজন বলল, “কত জন হবে তাও?”
তৃতীয় একজন বলল, “জনা সত্তর। পিন্টু দেখে এসেছে। বাচ্চা, বুড়ো, মেয়েছেলে, সবমিলিয়ে। বাচ্চা আর মেয়েছেলেগুলোকে ঠাণ্ডা করার দায়িত্ব আমাদের দে। আমরা তো দশ-বারোজন রয়েছি। আমি হাঁক দিলে আরও জুটে যাবে। আমি, পিন্টু, কার্তিক, তপন... সব, আর খানকির ছেলেদের তোরা সামলে নিস!”
প্রথমজন বলল, “অত সোজা না ভাই! পারবি সামলাতে? তোদের গ্রুপে ক’টা মেশিন আছে রে? সবাই জুটে যাবে – এরকম ভাববারও কারণ নেই।” বলে দ্বিতীয়জনের দিকে তাকালো।
তৃতীয়জন আবার বলল, “পারব পারব। মেশিনের কথা সিধুরা বলতে পারবে, ওতে আমি হাত দিই না। আমার এই-ই যথেষ্ট।” এই বলে, কোমর থেকে একখানা ধারালো ভোজালি বের করল সে। সেই ভোজালিটার গায়ে চাঁদের আলো পড়ে পিছলে যেতে লাগল।
প্রথমজন “জনা সত্তর” শুনে একটু দমে গেল যেন! “তাহলে? কিছু বলুন না স্যার!”
কালো জ্যাকেট পরা, গলায় সাদা মাফলার জড়ানো, স্যার চাপা গলায় বলল, “দাঁড়া দাঁড়া, একটু ভাবতে দে। আর ওই সব কোমরেই গুঁজে রাখ। যখন তখন বার করিস না।”
চাপা গলার মিটিং-এর মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়ল একটা সাদা-কালো কুকুর। প্রবল বেগে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সে দ্বিতীয় লোকটার কাছে গেল। গিয়ে প্রথমে তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেল, তারপর তার কোমর অবধি দাঁড়িয়ে উঠে তাকে আঁচড়াতে শুরু করল। দ্বিতীয় লোকটা
হয়ে, কালো কান দুটো পেছনের দিকে করে, জোরে জোরে কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগল। দ্বিতীয় লোকটা হঠাৎ বলে বসল, “ভাবাভাবি যাই করুন, আমি এর মধ্যে নেই।”
“কেন? হঠাৎ কী হল তোর?” স্যার বলল।
দ্বিতীয় লোকটা বলল, “আমি অকারণে কাউকে মারি না।”
আবার স্যার বলল, “অকারণে? আজকে হঠাৎ, মার্ডারের কারণ খুঁজছিস, কী ব্যাপার! ওরা-যে রোগটা ছড়ালো, আর তাতে যে আমাদের নিরীহ লোকগুলো মরে গেল, তার কী হবে!...ঠিক আছে, তোর মতটাও শুনি, বল।” “মতামতের কিছু নেই। প্রথম থেকেই আমার আপত্তি ছিল। শুধু শুধু এতগুলো নিরীহ লোককে মারব কেন? তার মধ্যে অতগুলো শিশু, মহিলা! একটা তো কারণ থাকতে হবে। ওরা আমাদের তো কোনো ক্ষতি করে নি! আর কেন ভুল বোঝাচ্ছেন বলুন তো সকলকে। রোগ তো ওরা ছড়ায় নি। ওদেরও তো লোক মরেছে এই একই রোগে!”
“আলবাৎ ছড়িয়েছে। ওরাই রোগটা ছড়িয়েছে। ওদের অভ্যেসগুলোই নোংরা। গা ঘিনঘিন করে। আর তুই যে এত বড় বড় কথা বলছিস, এতদিন যতগুলো খতম করেছিস সবেতেই কারণ ছিল?” তখন স্যার বেশ উত্তেজিত।
“ছিল।”
“কী কারণ?”
“টাকা”
প্রথম লোকটা আবার কথা বলে উঠল, “তুই থামলি! ওদের জন্যই তো আমাদের এতগুলো লোক মরে গেল।”
দ্বিতীয়জন বলল, “তোরা সব অন্ধ! ভালো করে ভেবে দেখেছিস কখনো কেন এই ঝামেলা করানো হচ্ছে আমাদের দিয়ে!”
প্রথমজন বলল, “ঝামেলা আবার কী! ওরা আমাদের দেশে থাকতে পারবে না। চিরকাল ওরা আমাদের দাবিয়ে রেখেছে। আমার বাবাকে মেরেছিল ওরা। আমার মায়ের ইজ্জত নিয়েছে ওরাই। ওদের আমি ঘেন্না করি। আজও ওরাই আমাদের মধ্যে অসুখ ছড়িয়ে দিয়েছে, ইচ্ছে করে। এমনিতে আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না তাই রোগ ছড়িয়ে আমাদের মারতে চাইছে। আমাদের ক্ষতি করা ছাড়া ওদের আর কোনো কাজ নেই। এখন আমাদের পালা। কী বলেন স্যার!”
স্যার সম্মতিসূচক মুচকি হেসে দ্বিতীয়জনের দিকে তাকালো। দ্বিতীয়জন প্রথমজনের দিকে ফিরে বলল, “গাধাই রয়ে গেলি চিরকাল। কিচ্ছু জানিস না, কেবল পরের কথায় নাচিস। এত ঘেন্না তোর আসে কোথা থেকে! যা-খুশি কর, আমি চললাম।”
সাদা-কালো কুকুরটা একদৃষ্টে স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু গোঁ গোঁ আওয়াজও বের করছিল মুখ দিয়ে। সেটা কেউ খেয়াল করে নি। এখন দ্বিতীয়জন মিটিং থেকে বেরিয়ে যেতেই সেও তার পিছু নিল।
এক যুবকের মৃতদেহ পড়ে আছে কালীকিঙ্করপুর ফেরিঘাটের লাগোয়া অংশে, বুড়ি নিম গাছটার তলায়। সঙ্গে একটা সাদা-কালো কুকুরও মরে পড়ে আছে। তার গলার নলিটা কাটা। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে যুবক। পিঠে তখনও ভোজালিটা গোঁজা। রক্ত জমাট বেঁধে কালো ছোপ পড়ে গেছে জামার পিঠে। সবে সূর্যের আলো ফুটেছে নদীর ওপার থেকে। সেই আলো পড়ে শরীর থেকে বেরিয়ে থাকা ভোজালির ধাতব অংশটা চকচক করছে। একজন কালো জ্যাকেট পরা লোক, গলায় সাদা মাফলার জড়ানো, চিৎকার করে লোক জড়ো করছে: “আমরা অনেক সহ্য করেছি, আর নয়! আমাদেরই জায়গা দখল করে থাকবে, আমাদেরই খাবে আর আমাদের লোককেই মারবে! সুভাষকে আমি ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতাম। ওকে বারণ করেছিলাম, ওই এলাকায় যাস না, ওদের মায়া-মমতা বলে কিস্যু নেই। যখন তখন মেরে দিতে পারে! কথা শোনে নি। তবে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না। সুভাষের হত্যার বদলা আমরা নেবই।
আজ একসপ্তাহ হয়ে গেল: কালীকিঙ্করপুরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। খবরের কাগজে কেবল বেরিয়েছিল একটা তিন চার লাইনের ছোট্ট খবর: গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে কালীকিঙ্করপুরে এক যুবকের হত্যা। কীসের গোষ্ঠী, কাদের গোষ্ঠী – সেসব তদন্ত করে দেখছে পুলিশ! কালীকিঙ্করপুরের লোকেরাও মরা কুকুরটার কথা ভুলে গিয়েছিল, এই ক’দিনে।
ন্যাপলা পারুই
ন্যাপলা পারুই প্রতিদিনই কাঁদে। সন্ধ্যে নামার সময় হলেই সে কাঁদে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠা মনটা নিয়ে গিয়ে সে কপাটহীন জানলায় রাখে। যদি কখনো কারুর নজর পড়ে। কিন্তু মানুষ তো আর চোদ্দ-পনেরো হাত লম্বা হতে পারে না - যে যেতে আসতে সেই দোতলার জানলায় রাখা ন্যাপলার মনটাকে সান্ত্বনা দেবে। নজরে পড়লে দু-এক কথায় কেউ কেউ তাকে হয়তো নিশ্চয়ই বলত, “কী করবে বলো ন্যাপলা। সবই ললাটের লিখন।” ওইটুকু শুনলেও তো মনটা ভালো লাগে। শোনে না। শোনার উপায় নেই তার।
এখনও অনেক বাড়িতে চিলেকোঠায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালা হয়, শাঁখ বাজে পালা করে। সেই প্রদীপ রাখা হয়, টবে পোঁতা তুলসী গাছের পাশে। শাঁখ বেজে উঠলে, ন্যাপলা কাঁদতে কাঁদতেই কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে। যতবার সে যত শাঁখের আওয়াজ শোনে ততবারই সে প্রণাম করে। কতদিনকার অভ্যাস তার, কান্নার মতোই। যখন সে প্রণাম করে - তখন তার কপাল আরও প্রশস্ত হয়। সে জানে না সেখানে আর কী কী লেখা আছে।
ঈশ্বরের কাছে সে তো কতকিছুই চাইত। ছোটবেলায় স্কুলের গণ্ডী পেরোনো, বড়বেলায় অন্তত একটা চলনসই রোজগারের পথ। সবচেয়ে বেশি চাইত, ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠুক। বউয়ের মতি ফিরুক সংসারে। ঈশ্বর তাকে কিছুই দেন নি। তার বুদ্ধি আর পাঁচটা লোকের মতো নয়। সে নিজেও বিশ্বাস করে সে বোকা। ভীষণ বোকা। সেই কত ছোট্টবেলা থেকে সে এই কথা শুনেই বড় হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে সয়েছে ঠাট্টা তামাশা। ন্যাপলা নামটা তো অরিজিনাল নয়। তার আসল নাম তো দেবোপম। তার নাক চ্যাপটা বলে পাড়ার লোকেরা ন্যাপলা বলে ডাকতে শুরু করে। কে প্রথম ওই নাম ধরে তাকে ডেকেছিল - সে আর তার মনে নেই। বাবা মারা যাবার আগে ভাগ্যিস তাকে একটা দোকান করে দিয়েছিলেন। না-হলে কী-যে হত। এই ভেবে সে তার বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কাঁদতে কাঁদতে। মুদি কাম স্টেশনারি। সেইখানে সে সকাল থেকে দুপুর অবধি দোকানদারি করে। বেশি ভিড় হয় না তার দোকানে। এ-পাড়াতে সকলেই ওর থেকে বেশি বুদ্ধিমান। চৌকশ দেবুর দোকানে বিক্রি অনেক বেশি ওর দোকানের তুলনায়। সবসময় সরগরম দোকান। বিশেষত পাড়ার মহিলারা। ন্যাপলার দোকানের পাশ দিয়ে সরু একটা প্রবেশপথ ওর বাড়ির ভেতরে ঢোকবার - সেখান দিয়ে অনেক লোক যাতায়াত করে। পাড়ার উঠতি ছেলেরা, এমনকি এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলার পর্যন্ত। তার দোকান থেকে বিড়ি-সিগারেট বা গুটকার কিনে সোজা দোতলায় উঠে যায় তারা। কাউন্সিলার এলে বাকিসব ছোঁড়াগুলো হুড়মুড় করে নেমে পালায় এদিক-সেদিক। মাঝে মাঝেই ন্যাপলা শুনতে পায় কাউন্সিলারের রঙ্গরসিকতা কিংবা তার বউয়ের খিলখিল হাসি। অথবা সে কিছুই শুনতে পায় না কখনো।
কেন তাকে ঈশ্বর এরকম বোকা করে পাঠালেন পৃথিবীতে যেখানে প্রায় সকলেই বুদ্ধিমান অথবা অনেকেই মেধাবী? যেমন বোকা হলে কেউ জানতে পারে না সে নিজে কতটা বোকা, যেমন বোকা হলে ছোটবেলায় লেখাপড়ায় মন বসে না, যেমন বোকা হলে চাকরি জোটানো মুশকিল হয়, যেমন বোকা হলে - চোখের সামনে...নাহ থাক। কেন সে তেমন বোকা হল? কোনো গুণ নেই তার! সন্ধ্যের আলো জ্বলে ওঠে - শুভাশিসদের বাড়িতে, রিয়াদের বাড়িতে, বাদলকাকাদের বাড়িতে, রাস্তার প্রায় প্রতিটা ল্যাম্পপোস্টে। তখন অতি ধীরে - গ্রীষ্মে সন্ধ্যে নামার গতির চাইতেও অনেক ধীরে ন্যাপলার কান্নার তীব্রতা কমে আসে। পূর্বদিকে ফিরে সে একটি নক্ষত্র দেখে - দীর্ঘদিন সেই লালচে তারাটা জ্বলজ্বল করে ওর চোখের সামনে - তারপর উত্তরে সরতে সরতে সে-যে কোথায় হারিয়ে যায় সেটা ন্যাপলা ঠাহর করতে পারে না। তার বুদ্ধি থাকলে হয়তো তারাটকে তার হারাতে হত না! কে জানে, বুদ্ধি থাকলে কী হয়! তবু সে অপেক্ষা করে প্রতি বছর। আবার সেই পূর্বের নক্ষত্রকে দেখবে বলে, সে অপেক্ষা করে মাসের পর মাস। দিনের পর দিন পিঞ্জরে।
গল্প
বেসুরো সুর
সন্দীপ সেনগুপ্ত
বছর কুড়ি আগেকার কথা। ভাগা দাঁড়িয়ে আছে ডাইনিং টেবিলের পাশে। মামাতো ভাই বাপন তারস্বরে চিৎকার করছে, ‘দাদা মেরেছে'। বড় মামী বছর চোদ্দ বয়সী বাপনকে বলছে 'আর কাঁদিস না বাবা, আমি তো বার বার করে ঠাকুরপোকে বলেছি ওর কাছে পড়িও না, ওর কাছে পড়িও না, কিন্তু আমার কথা কেও শুনলে হয় এই বাড়িতে।' ছোটমামী কটমট করে তাকিয়ে আছে ভাগার দিকে ‘আজ ওরা বাড়ি আসুক, একটা বিহিত করেই ছাড়বো।’
বাপন ক্লাস সিক্সে পরে। ক্লাস ফোরের পর গতবছর ক্লাস সিক্সেও ফেল করেছে। জ্যাঠা আর বাবার আদরের দুলাল। সারাদিন মোবাইলের ভিডিও গেমের মধ্যেই থাকে। মাঝে মাঝে একঘেয়ে হয়ে গেলে ভাগার কাছে এসে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করে। ভাগা কলকাতায় একটা সরকারি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আর দুটো সেমিস্টার বাকি। কলেজের বেতন সে নিজেই জোগাড় করে টিউশনি পরিয়ে।।কলেজের সব প্রফেসরদের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ভাগা। ভালো নাম ভবতোষ দত্তগুপ্ত।
ভাগা চুপ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দক্ষিণ কলকাতায় এক নির্ঝঞ্ঝাট পাড়ায় বড় দোতলা বাড়ি। ভাগা কে নিয়ে থাকার লোক মাত্র ছজন। সাতটা থাকার ঘর আছে, কিন্তু ভাগা থাকে ছাদের ঘরে। ছোট একটা ঘর। একটা খাটিয়া রাখা আছে আর লক্ষ কোটি খানা বই। ভাগার পড়তে আর পড়াতে খুব ভালো লাগে। ছোট ভাইটাকে সে পড়াতে চায়। মামাদের বড় ব্যবসা। বাড়ি ফিরতে প্রতিদিন রাত নয়টা বাজে। 'টেবিলের উপর টাকা রাখা আছে, বাজার করে দিয়ে উদ্ধার করো আমাদের, সব কিছুর যেন হিসেব থাকে, জানি না বাপু বিড়ি সিগারেট ধরেছো কিনা?' ছোটমামীর গলা খাবার ঘর থেকে শোনা গেলো। ভাগা মাথা নিচু করে টেবিল থেকে টাকাটা নিয়ে বাজারের ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলো। না, খারাপ কথা শুনলে ওর মন খারাপ হয় না। সারাদিন কাজের মধ্যে থাকে ভাগা। সকালে উঠে ছাদ ঝাড় দিয়ে, গাছে জল দিয়ে স্নান করে,মা-বাবাকে মনে মনে প্রণাম করে। তারপর পর নিচে এসে চা করে, সবাইকে ডেকে চা দিয়ে বেরিয়ে যায় কলেজে।ক্যান্টিনে আলমদার সাথে বসে চা আর পাউরুটি দিয়ে সারে জলখাবার। কলেজের প্রথম বছরে যখন ক্যান্টিনের মালিক আলম খান দেখলো একটা ছেলে গোটা একটা সেমিস্টার দুপুরে ডাল আর ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিলো, তখন একদিন ডেকে নিয়ে যায় ক্যান্টিনের পেছনে রান্নাঘরে। তারপর থেকে আজ অব্দি দুজনে একই সাথে জলখাবার করে আর দুপুরে মাছভাত খায়। কোনো টাকা নেয়নি আলমদা, সবই নাকি হিসেবের খাতায় তোলা আছে, ঠিক সময় মতো নিয়ে নেবে। ভাগা নিজেই অনেক বার আলমদার ক্যান্টিনের হিসাব করে দিয়েছে, কিন্তু নিজের নাম কোনোদিন ওই খাতায় দেখে নি।
এই সন্ধে বেলায় বাজার যেতে ভালো লাগেনা ভাগার। কিন্তু এইটুকু সে করতেই পারে মামাবাড়ির জন্য। মামাদের জন্যই কলকাতায় থেকে ভালো কলেজে পড়তে পারছে। বাজার রেখেই আবার পড়াতে চলে যায়। কলেজের পর আবার পড়ানো থাকে। পড়াতে ওর ভালো লাগে আর এই টাকা দিয়েই ওর কলেজের খরচ, বই খাতা আর অন্যান্য দরকার মেটায়।রাতের বেলায় সবার খাওয়া হয়ে গেলে, এঁটোকাঁটা তুলে টেবিল পরিষ্কার করে চলে যায় ছাদের ঘরে। প্রায় তিনটে অব্দি পড়াশোনা করে, তারপর সকাল সাতটা অব্দি ঘুম। একেক দিন খুব মন খারাপ করে।। বাবা মার মুখটাও ওর মনে নেই। ভেজা চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে ওই চাঁদের দিকে।
বাজারের ব্যাগ থেকে সব জিনিস গুছিয়ে রেখে ভাগা বেরিয়ে গেলো পড়াতে। মামারাকেও তখন আসেনি। রাতে বাড়ি ফিরে বেল বাজানোর সাথে সাথে বাপন দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলো, ঠোঁটের কোনায় হাসি। বুঝলো মামারা বাড়ি ফিরেছেন। 'ভাগা এদিকে আয়ে' ছোটমামা ডাকলেন। 'কতদিন তোকে বলেছি ভাইয়ের গায়ে হাত দিবি না, নিজে ভালো করে পড়াতে পারিসনা, লজ্জাও করে না।' 'মারলি কেন ওকে?' চিৎকার করলেন বড়মামা।ভাগা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘এখন ঢ্যাঙ্গার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি খেতে দাও, একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেলো। মা, বাবা সকলকে খেয়েছে এবার আমাদের ধরেছে’, এবার বড়মামীর গলা।
জন্মাবার একবছরের মধ্যেই বাবা মারা যায়, আর বছর দুয়েক পর মা। তারপর গ্রামে সবাই অভাগা বলে ডাকতো, সেখান থেকে ডাকনাম ভাগা হয়ে গেছে। তিন বছর বয়স থেকে ভাগা মানুষ হয়েছে তার কাকার কাছে। কিন্তু ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন কাকাও মারা যান। গণিতের শিক্ষক শঙ্করদা খুব ভালোবাসতেন ভাগাকে। এক অনাথ বাচ্চা ছেলের পড়াশোনা করার ইচ্ছা মুগ্ধ করেছিল এই মাস্টারকে। বাবা কাকা মারা যাবার পর শঙ্করদা আর শঙ্করদার ছেলে ভাগাকে যত্ন করে মানুষ করে তুলেছিলেন। কখনো পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হতে দেননি। ওনাদের বাড়িতেই ভাগার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে নব্বই শতাংশ নম্বর পায়ে ভাগা আর ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ১০০ র্যাঙ্ক করে । শঙ্করদা যখন নিজে ভাগাকে কলকাতায় মামাবাড়িতে ছাড়তে আসে তখন মামা মামী সবাইকে দেখে খুব ভালো লেগেছিলো ভাগার। কিন্তু শঙ্করদা পরেরদিন ফিরে যাবার পর সব কেমন বদলে গেলো। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলো ও মামাবাড়িতে একরকম বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়।
ভাগা মাথা নিচু করে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। কাউকে সে জানায় নি, ভাইকে মারা তো দূরের কথা কোনো দিন জোরে কথাও বলে নি। সবই বানানো। কিন্তু ও সময় পেলেই ভাইকে পড়াতে চায়, যদি এভাবেও একটু পড়া শোনা হয় বাপনের। ওর রেজাল্ট ভালো হলে, ভাগা সত্যি খুব খুশি হতো। কলেজের প্রথম বছরের খরচ শঙ্করদাই দিয়েছে। পরের বছর থেকে ও পড়ানো শুরু করে। শঙ্করদা সব সময় ভাগাকে বলে 'মন খারাপ হলে জানবি, এই পৃথিবীতে সব কিছুই সাময়িক। সময় মতো মন খারাপের কারণ ঠিক দূরে চলে যায়। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করে যাবি' এটা ভাগার থেকে ভালো আর কে জানে।
ভাগার কাছে কোনো মোবাইল নেই। শঙ্করদা প্রতি রবিবার সকাল নয়টায় মামাবাড়িতে ফোন করে। ওর গলা শুনে বুঝে যায়, মন খারাপ কিনা? খালি বলে 'জীবনটা শুধুই একটা যাত্রা, তাই হাটা চালিয়ে যা। এখানে দুঃখ, সুখ, রোমাঞ্চ, আনন্দ সবই আছে কিন্তু স্থায়ী কোনোটাই নয়। এই যাত্রা আজীবন চলবে শুধু স্থান, কাল আর পাত্রই বদলাবে। শুধু ভালোবেসে সব করে যা, মনে কোনো গ্লানি রাখবি না।’ ভাগার মাঝে মাঝেই শঙ্করদার কাছে চলে যেতে ইচ্ছা করে, সব কিছু ছেড়ে। তখনি শঙ্করদার কথা গুলো ওর কানে বাজে 'যখনি আমার কাছে আসবার ইচ্ছা করবে, সেদিন আরও দুঘন্টা বেশি পড়বি।'
এই একইরকম ভাবে ভাগার কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একদিন কলেজে গিয়ে খবর পায় কোনো একটা বড় কোম্পানি আসছে এক সপ্তাহ পর, চাকরির ইন্টারভিউ নেবার জন্য। কিন্তু গোন্ডগোলটা হয় খবরের শেষটায়। সবাইকে ফর্মাল জামা প্যান্ট পরতে হবে, কিন্তু তার সাথে কালো জুতো আর এক রঙের টাই চাই। জামা প্যান্ট ভাগার কাছে ছিলই। কিন্তু এই মুহূর্তে টাই বা ভালো জুতো কেনার মতো টাকা ওর কাছে নেই। শঙ্করদা কে ফোনে বললে ব্যস্ত হয় পরবে। কি করবে বেচারা বুঝতে পারে না। কি করবে বেচারা বুঝতে পারে না। কারোর কাছে কোনোদিন সে কিছু চায়নি।
কিন্তু টাই আর জুতো না হলেতো ইন্টার্ভিউয়েই বসতে পারবে না। কলেজের একদম বখাটে ছোকরা ছিল 'দীপঙ্কর সাহা'। বিশাল ধনী ব্যবসাদারের একমাত্র ছেলে। ক্লাসে প্রায় দেখাই যায় না তাকে। বছরে বারদুয়েক অন্তত দীপঙ্করের বাবা মা কে কলেজে আসতে হয়, বিভিন্ন নালিশের সামাল দিতে। এটা সবারই জানা। কিন্তু কেও যেটা জানতো না, সেটা হলো যে ভাগা প্রতি শনিবার দীপঙ্করকে পড়াতে যেত ওর বাড়িতে, সেই ফার্স্ট ইয়ার শেষ হবার তিন মাস আগে থেকে শুরু। চুক্তি একটাই ছিল তিন হাজার টাকা দীপঙ্করের বাবা দিতেন ভাগাকে, কিন্তু যেন কলেজে কাক পক্ষিও টের না পায়ে। সেই শনিবার দীপঙ্কর বললো 'কি রে ভাই, সিলেবাসতো শেষ করেই ফেলেছিস, বরং চল ইন্টারভিউয়ের জন্য একটু দেখে নিই।' 'হ্যা, কিন্তু আমার ইন্টারভিউ নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই রে, তুই তো সবই জানিস' জানায় ভাগা, ‘আর তাছাড়া।' কথাটা শেষ করতে দেয়না দীপঙ্কর 'তাছাড়া কি?' ভাগা বলে 'বাদ দে, তুই বল ইন্টারভিউয়ের জন্য কি জিনিস দেখা যায়' 'তুই সত্যি ভাই একফোটা বদলালিনা চার বছরে, সামনের মাসের টাকাটা বাবার কাছ থেকে আজকেই রেখে দিয়েছি। একটা টাই আর জুতো কিনে নিস।' বলে দীপঙ্কর 'না বাদ দে, তোকে দিয়ে হবে না, আমি কিনে নেবো, তুই কিন্তু আমার বাড়ি চলে আসিস সোমবার সকালে, এখান থেকে টাই আর জুতো নিয়ে যাস আর দয়া করে তোর মামাদের এই চাকরি নিয়ে কিছু বলিস না এখুনি।'
ভাগা বাড়ি ফিরে আসে। একবারও ওর মনে হয়নি যদি শেষ মুহূর্তে দীপঙ্কর কিনতে না পারে তাহলে কি হবে। রবিবার সন্ধ্যায় বাপনের জন্মদিন ছিল। বই নিয়ে বসার কোনো উপায় হয় নি। অনেকে এসেছিলো সন্ধ্যাবেলায়। মামাবাড়িতে লোকজন এলে খুব ভালো লাগতো ওর। মামাদের ব্যাবহার কিরকম বদলে যেত সবার সামনে। রাত একটার পর সেদিন যখন খাবার সুযোগ হলো, ভাগার আর খেতে ইচ্ছা করে নি। রাতে সব কাজ সেরে শুতে শুতে প্রায় দুটো বেজেছিল। সোমবার খুব ভোরে উঠে ভাগা, সব কাজ সেরে সবাইকে চা দিয়ে বেরিয়ে যায় দীপঙ্করের বাড়ি। দীপঙ্কর সবে তখন ঘুম থেকে উঠেছে, তবে তাড়াতাড়ি টাই আর জুতোজোড়া বার করে দেয়I ‘তুই তৈরি হবি না?' জিজ্ঞেস করে ভাগা। 'ওরে দুর্ভাগা চাকরিটা তোর দরকার, আমার নয়। তাছাড়া আমি চাকরি করলে বাবার এই সাম্রাজ্য দেখবে কে?' হেসে ওঠে দীপঙ্কর। 'চাকরিটা পেলে খাইয়ে দিস।'
ইন্টারভিউটা খুব ভালো হয় ভাগার। পেয়ে যায় চাকরিটা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ হতে আরও ছমাস বাকি ছিল। তারপর ওকে পুনে গিয়ে কাজে লাগতে হবে। সেখানে থাকতে হবে কোম্পানির গেস্টহাউসে কিন্তু যাতায়াত আর খাবার খরচ ভাগার নিজের। আর মাইনে? ওতো টাকা সে আজ অব্দি সারাজীবনে দেখা তো দূরে থাক, ভাবতেও পারে নি। চাকরিটা পেয়ে ছুটে গেছিলো দীপঙ্করের কাছে। না, বাড়িতে কিছু জানায় নি ভাগা। শঙ্করদাকে দীপঙ্করের বাড়ি থেকেই ফোন করে দিয়েছিলো। ‘অনেক দূর যেতে হবে ভাগা, হাটা থামালে চলবে না, এখনো অনেক কিছু করার বাকি।' দীপঙ্কর বললো 'যাক তাহলে তোর একটা হিল্লে হয়ে গেলো, কিন্তু আমাকে পাস না করানো অব্দি তোর ছুটি নেই। তবে আমি বলবো তুই এখনো মামাদের কিছু জানাস না। পাস করে তারপর জানা।' বাড়ি ফিরতে আজ একটু রাত হলো। 'ওই যে মহারাজ এলেন এখন।' কলিং বেল বাজিয়েই ছোটোমামীর গলা শুনতে পেলো ভাগা। ভিতরে ঢুকে ও মাথা নিচু করে চলে গেলো ছাদের ঘরে। খুব ইচ্ছা করছে ছাদে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেটা হবার উপায় নেই। 'ব্যাস বাবু চললেন উপরে, সবাই এবার না খেয়ে বসে থাকবে।' বড়মামীর গলা ছাদ থেকেই শুনতে পেলো।
এইভাবেই আরও ছমাস কেটে গেলো। ভাগা, দীপঙ্কর আর সব বন্ধুবান্ধবরাই পাস করে গেলো ইঞ্জিনিয়ারিং। শুরু হলো জীবনের এক নতুন অধ্যায়। মামারা যারপরনাই স্বস্তি পেলেন ভাগা চলে যাচ্ছে শুনে। প্রতিদিন এই উটকো অশান্তির থেকে মুক্তি। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কি ভাবে চাকরি পেলো, তার অঙ্কটা অনেক চেষ্টা করেও মেলাতে পারলো না।বিপদে পড়লো দুই মামী। একবেলা খেতে দিয়ে এরকম বিনেপয়সায় কাজের লোক হঠাৎ হাতছাড়া হলে যা হয়। ‘অত দূরে যাবি কেন, এখন তো পাস করে গেছিস, মামারা এখানেই কোথাও কাজে ঢুকিয়ে দেবে, বাড়িতে থাকবি। কোনো চিন্তা থাকবে না।' ছোটোমামীর গলায় যে এরকম মাধুর্য আছে ভাগা আগে বুঝতে পারেনি কখনো।
একসপ্তাহের মধ্যে পুনে পাড়ি দেয় ভাগা। একমাসের খাবার আর গাড়ি ভাড়ার খরচ শঙ্করদাই হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন। যাবার দিনও একই কথা বলেছিলেন 'এখনো চলার অনেক বাকি, হাঁটা থামাবিনা।' এরপর কেটে যায় প্রায় দীর্ঘ উনিশ বছর। পরিবর্তনের জোয়ার সর্বত্র, পৃথিবীর গতি যেন বেড়ে গেছে শতগুণ। আকাশ ভেঙে গেছে শতশত বহুতলে। আসে পাশের দোতলা বাড়িগুলো এখন সব ফ্ল্যাট। ছোট খেলার মাঠ এখন আর প্রায় দেখা যায় না। ছেলেদের দাপিয়ে ফুটবল খেলার আর সময় নেই। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় পিচ পরে গেছে। হয়তো কোনো মাস্টারমশাই এখনো নিজের খরচে কোনো ছাত্রকে পড়ান, কিন্তু আমার জানা নেই। এবার আসি ভাগার কথায়। ঝিরঝির করে বরফ পড়ছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে ভাগাI বছর চারেকের একটা ছেলের গলা, কিন্তু ইংলিশে ‘বাবা এখন আমরা বাগানে যাবো তো?' ভাগা হাসে। স্ত্রী জেনি, পুরো নাম জেনিফার আর ছেলে আশু, পুরো নাম আশুতোষ কে নিয়ে বেরোয় ওর বাড়ির বাইরে । সামনেই বড় বাগান, জুড়ে আছে নানা রকম গাছ। নিউ জার্সিতে এই সময়টায় প্রতিবছরই বরফ পরে। বছর দশেক হলো ভাগা এখানেই আছে। বাড়ি, বাগান সবই নিজের। প্রায় দশ বছর চাকরি করার পর, এখন নিজের ব্যবসা করছে আমেরিকার এই শহরেই। কিন্তু কাজের জন্য এখনো বছরে একবার করে বাংলায় আসতেই হয়। ওর মামাবাড়িটা ভেঙে ফ্লাট হয়ে গেছে। বড়মামা মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। ছোটমামা আর মামী একটা ফ্ল্যাটে থাকে আর পাশের ফ্ল্যাটে বড় মামী। বাপন অনেক চেষ্টা করে উচ্চমাধ্যমিক পেরোলেও, কলেজের গন্ডি পেরোতে পারে নি। মামাদের ব্যবসাটা এখন চলছে কোনো রকমে, বাপনই দেখে। গত দুই বছরে প্রায় লাখ খানেক টাকা দিয়েছে ভাগা। দীপঙ্কর আজ বড় ব্যবসায়ী। এক্সপোর্ট আর ইম্পোর্টার সাথে যুক্ত। নিউ জার্সিতেও যাতায়াত আছে। সেখানে গেলে যে কোনো হোটেলে থাকে না সেটা বলাই বাহুল্য।
আলমদা ক্যান্টিন ছাড়াও একটা বড় বিরিয়ানির হোটেল করেছে ‘খান বিরিয়ানি’, পার্টনার ভবতোষ দত্তগুপ্ত। ভাগাই টাকা ঢেলে পুরো হোটেলটা দার করিয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর হলো।আলমদার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। শুধু লাভের কোনো অংশ আজ অব্দি ভাগা নেয় নি। আলমদা জোর করলে ভাগা বলে সব নাকি হিসেবের খাতায় লেখা আছে। গ্রামের বাড়িতে প্রতিবছর যেতে পারে না ভাগা। কিন্তু দুই বছর অন্তর যে শংকর মেমোরিয়াল ফুটবল প্রতিযোগিতা হয় তার পুরস্কার বিতরণীতে থাকতেই হয়। শঙ্করদা আর বেঁচে নেই।বছর দশেক হলো এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ভাগার গ্রামের বাড়িটা এখন একটা স্কুল। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয়। বিভিন্ন ট্রাস্ট ও সংস্থার মাধ্যমে ভাগা ফান্ডের ব্যবস্থ্যা করে এই স্কুলের জন্য। এখানে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনার আর একবেলা খাবার সুযোগ পায়। শঙ্করদার ছেলে এই স্কুলের হেডমাস্টার। স্কুলের নাম 'শ্রীশঙ্কর বিদ্যা ভবন'।
গল্প
ময়ূরাক্ষীর
ওপারে
সুমিত গুপ্ত
ভোরের আলো তখন ফোটেনি। বাইরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে একটানা। কখনো ঝিরঝির করে কখনো মুষলধারে। লাগাতার চার দিন চার রাত এক অবস্থা। অবিরাম বৃষ্টিধারায় যেন মুছে যেতে বসেছে পৃথিবীর অস্তিত্ব, জীবনের সব স্পন্দন। প্রবল বৃষ্টির জেরে ফুঁসছে ময়ূরাক্ষী। শেষরাতের পিচঢালা অন্ধকারে ডুবে রয়েছে চরাচর। নিস্তব্ধ নিঝুম। বৃষ্টির তোড় মাঝে মাঝে যেই একটু জিরোচ্ছে অমনি দূর থেকে ভেসে আসছে ময়ূরাক্ষীর চাপা গর্জন। তালপাতায় ছাওয়া মাটির ঘরের উঁচু দাওয়ায় একটা আধভিজে ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে চুপচাপ সেই আওয়াজ শুনছে সামিরুদ্দিন। রাতভর চোখে ঘুম নেই তার। ঘরের ভিতরে দরজা বন্ধ করে শুতে সাহস হয়নি। কি জানি, যেভাবে প্রহরে প্রহরে ময়ূরাক্ষীর জলের তোড় বাড়ছে, ঘরে শুয়ে ঘুমের মধ্যেই যদি সলিল সমাধি হয়! এমন তো কতবারই হয়েছে এ গ্রামে, মরেছে কত লোকই। তাই বৃষ্টির ছাঁট খেয়েও সামিরুদ্দিন দাওয়ায় কাটিয়েছে রাতভর। কখনো শুয়ে কখনো উঠে বসে ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে দেখেছে কিভাবে প্রবল বর্ষণে ভেঙে-গলে পড়ছে কুচকুচে কালো আকাশটা। সেই কালো আলকাতরা ফেড়ে ঘন ঘন দিক-বিদিকি এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফিনকি দিয়ে উঠেছে নীল-সাদা বিদ্যুতের চেরা জিভ। আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কালো-বাদামি মেঘে মোড়া ওই আসমানে। তাই দেখে ধড়াস ধড়াস লাফিয়ে উঠেছে সামিরুদ্দিনের বুকটা। "তওবা - তওবা! রহম করো মওলা। ইয়া আল্লাহ!" মনে মনে একথাই আউড়েছে সমিরুদ্দিন। আর ভেবেছে, এ কি দুর্যোগ শুরু হলো রে বাবা! তবে কি কেয়ামতের দিন এসে গেলো! নাকি জাহান্নমের দরজাটাই খুলে গেলো, সেই দরজা দিয়ে এবার তার দিকে ধেয়ে আসবে হিঁদুদের প্রেতলোকের অধিষ্ঠাত্রী সেই সর্বনাশী, করালী, মহা ডামরীদেবী!! আতঙ্কে ভয়ে দিশাহারা হয়ে শেষ রাতে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না সামিরুদ্দিন। দাওয়ার কোনায় রাখা নিবন্ত লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে মাথায় একটা চটের বস্তা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে ঝাঁপ দিলো সে। আজন্ম চেনা উঠোন, চেনা ঘরবাড়ি, পাড়াগ্রাম, পথঘাট । চোখ বন্ধ করেও দৌড়োনো যায়। বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে ডানদিকে হিজলডাঙ্গার মাঠ। বাঁয়ে পোড়ামার্ মন্দির। চার পা তফাতেই ডানদিকে বড়হুজুরের দরগা। সেখান থেকে পূর্বদিক বরাবর আন্দাজ ২০০-২৫০ গজ পেরোলেই গ্রামের শেষ, নামো জমি আর বাদা। সামিরুদ্দিন সেখানে পৌঁছতেই ফের আকাশে ঝলসে উঠলো বিদ্যুৎ। সেই আলোয় সে দেখলো বাদার ধার দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে নদী বাঁধ। এই কদিনে মাটি ফেলে ওই বাঁধ তৈরি করেছে হিজল গ্রামের মানুষ। বাঁধের ওপর প্রচুর বানভাসি মানুষ ঘর বেঁধেছে। দূর থেকে সামিরুদ্দিন দেখলো অসংখ্য আলোর বিন্দু জ্বলছে - নিবছে বাঁধের উপর। তার মানে রাত জাগছে বানভাসিরা। হাতে হাতে মশাল জ্বলছে তাদের। তাই দেখে বুকে বল এলো সামিরুদ্দিনের। এক ছুটে মাটির বাঁধের উপর উঠতে গেলো সে। কিন্তু লাগাতার জলে মাটি - কাদা, কাঁচা বালিমাটির ধস নেমেছে জায়গায় জায়গায়। সামিরুদ্দিনের পা আটকে গেলো কাদায়। বেসামাল হয়ে প্রায় নিচে গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল সামিরুদ্দিন। কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিলেও হাতের লণ্ঠনটা রাখতে পারলো না। সেটা গড়িয়ে চলে গেলো কয়েক শো ফুট নিচে। লণ্ঠনের মায়া ছেড়ে কোনো ভাবে হাঁচোড়-পাঁচর করে বাঁধের মাথায় উঠে পড়লো সামিরুদ্দিন। বাঁধের উপর উঠে এবার সামিরুদ্দিন মশালগুলি স্পষ্ট দেখতে পেলো। বাঁধের উপর দমকা ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির দাপটে দাঁড়িয়ে থাকাটাই শক্ত।অসংখ্য মশালের হালকা আলোয় এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাঁধের অন্য পাড়টা। সেদিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সামিরুদ্দিন। মশালের ধূসর আলোয় বাঁধের ওপারে ভাগীরথীর অনন্ত জলরাশি যেন কি ভীষণ আক্রোশে ফুঁসছে। ফুলে- ফেঁপে, হাজার ঘূর্ণির উদ্যত ফণার মাথায় সাদা ফেনার মুকুটগুলো যেন শেষ রাতের গাঢ় অন্ধকারে মুক্তোর মতো জ্বলছে। সেই দিকে কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে থেকে একবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো সামিরুদ্দিন।
শুধু সামিরুদ্দিন মন্ডলের হিজল গ্রাম নয়, মুর্শিদাবাদের কান্দি ব্লকের কয়েকশো গ্রাম জাগরী আজ। ক'দিনের বেলাগাম জলে ময়ূরাক্ষীর ফুলে-ফেঁপে ওঠা কালচে-ঘোলাটে জল কালনাগিনীর ফণা হয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে তাদের ঘাড়ে। বিপজ্জনকভাবে নদীর পাড় ভাঙছে ।গাছপালা, বসতভিটে, বাড়ির উঠোন সব সমেত গিলে খাচ্ছে উন্মাদিনী ময়ূরাক্ষী। সেচ দফতরের নদীবাঁধে বড়সড়ও ফাটল ধরেছে। দফতরের বাবুরা দেখেশুনে বলে গেছেন, গতিক ভালো না, গাঁ খালি করে ত্রাণ শিবিরে চলে যেতে। অনেকে গেছেও চলে। সমিরুদ্দিন যায়নি। যেতে পারে নি। একবার ভেবেছিলো খড়গ্রামে ভাইয়ের বাড়ি চলে যাই। পরে রেডিওর খবরে শুনলো উত্তরে খড়গ্রাম, পূর্বে বেলডাঙা, দক্ষিণে ভরতপুর সবখানে এক অবস্থা। শুধু তো ময়ূরাক্ষীই নয়, ক'দিনের প্রবল বর্ষণে ক্ষেপে উঠেছে দ্বারকা, ব্রাহ্মণী আর কোপাই নদীও। পালিয়ে নিস্তার নেই। যেতে পারেনি আরও একটা কারণে। সেটা মনে পড়তেই জোরসে পা চালালো সামিরুদ্দিন।
একটু পরেই কাঁচা বাঁধ বরাবর নদীর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলো সামিরুদ্দিন। এখানে একফালি বাঁধের উঁচু মাটির উপরে মোচার খোলার মতো ভাসছে আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের হাজার খানেক পরিবার। সরকারি ত্রাণ শিবির পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি ওদের কেউই। ওরা প্রত্যেকেই প্রহর গুনছে। কখন মাথার ওপর নিঃশব্দে নেমে আসে বিধাতার অভিশাপ। কখন কে মরে, কে বাঁচে কেউ জানেনা। ওরা শুধু জানে, বানে না মরলে, সাপের কাটায় মরবে। সাপে না মারলে মরবে না খেয়ে। কপালজোরে খাবার যদি বা জোটে তবু নিস্তার নেই । জল সরলে যাবে কোথায়! তখন মরবে জল তেষ্টায়, কিংবা আদা-বাদার জল খেয়ে মারণ রোগে। মরতে কিন্তু হবেই, মরণ কে রোখে। কি অদ্ভুত মনস্তত্ব ফিবছর বানভাসিদের। ওরা জানে বন্যা আটকানো যায়না। তবু ওরা যোঝে যে যার সাধ্যমতো। প্রতি ইঞ্চি শুকনো উঁচু জমির জন্য, বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার বিরুদ্ধে। কাছে গিয়ে সামিরুদ্দিন দেখলো রাত জেগে কয়েকশো মেয়ে-পুরুষ নতুন মাটি ফেলছে বাঁধে । মাটি আসছে সেচ দফতরের ট্রাকে দূরের কোনো রাঢ় জমি থেকে কাছাকাছি কোথাও। সেখান থেকে ট্রাক্টরে করে গ্রামের লোকেরা নিজেরাই মাটি এনে ফেলছে বাঁধে। ওদিকে নদীর জল টইটুম্বুর, বাঁধের মাটি ছুঁই ছুঁই। ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে জলের তোড়। এদিকে মানুষের মাথায় মাথায় ঝুড়িতে কোদালে বাঁধের উপর পড়ছে মাটি ঝপাঝপ। মশাল সামলাচ্ছে, ত্রিপলের আস্তানায় রান্নাবান্না করছে, তুমুল বৃষ্টিতে লোটিয়া-বিস্তারা সামলাচ্ছে কিছু লোক। মাটি ফেলছে বাকিরা। মানুষে- নদীতে চলছে দড়ি
টানাটানি খেলা, টানটান স্নায়ুযুদ্ধ। বাঁধটা নদীর তীর বরাবর ধনুকের মতো বেঁকে চলে গিয়েছে মাইলটাক। এখানে নদীটা বাঁক নিয়েছে পুব থেকে পশ্চিমে। বাঁকের মুখে জলের চাপ বেশি তাই তার উপরের বাঁধে মাটি পড়ছে সবচেয়ে বেশি। সময় নষ্ট না করে সামিরুদ্দিন কাজে লাগলো সামিরুদ্দিনের বড় ছেলে বশিরও গত তিনদিন ধরে এইখানে মাটি ফেলার কাজে লেগেছে। কোদাল চালাতে চালাতে সামিরুদ্দিনের মনে পড়লো, গেলো বছর এই বাঁধের সংসারে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে সাপে কেটেছিল ছোট মেয়ে ফাতিমাকে। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে মরে কাঠ হয়ে গেলো মেয়েটা। তার নীল হয়ে যাওয়া শব দেহটা ছিপ নৌকোয় তুলে সন্ধ্যার মুখে ঐখানে ওই ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে পড়েছিল সমিরুদ্দিন। সেবার বেঁধে রাখা যায়নি ময়ূরাক্ষীকে। বাঁধের চারদিকে শুধু জল আর জল। কোনটা নদী আর কোনটা যে বানভাসি জমি বোঝা শক্ত। তারই মধ্যে কখনো দাঁড় বেয়ে কখনো নৌকার দড়ি কামড়ে বুক জল ভেঙেছিল সমিরুদ্দিন সারারাত। হাতড়ে বেরিয়েছিল একচিলতে উঁচু জমি মেয়েকে গোর দেবে বলে। শেষমেশ জমি জোটেনি, মেয়েকে একা নৌকোয় ফেলে কোনোরকমে বাঁধের আস্তানায় ফিরেছিল সে। সমিরুদ্দিনের চোখের জল সেদিন মিশে গিয়েছিলো বানের ঘোলা জলে। গেলো বছর এই বাঁধের সংসারেই মারা গেছিলো খোসবাসপুরের ওবাইদুল মন্ডল। অজানা এক জ্বরে ভুগছিল ওবাইদুল। টানা ছ’দিন বাদে জল নামলে কাদা মাটিতেই গোর দেয়া হলো তার পচা গলা দেহটা। সেবার একই রকম জ্বরে মারা গেলো আহিরীনগরের মাধব মান্ডি, শ্রীকৃষ্ণপুরের ধীরেন দাস। ওদের দাহ করা হলো বাঁধে রান্না করার বড় উনুনের পাশে। চার বছর আগের কথা। নদী বাঁধে সবে ফেলা হয়েছে নতুন মাটি। ভাদ্রের মাঝামাঝি প্রবল বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাসে শেষরক্ষা হলো না। মাঝরাতে প্রচন্ড শব্দে ভেঙে পড়ল বাঁধের পশ্চিম পাড়। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো বন্যার জল। চোখের নিমেষে তলিয়ে গেলো তিনটে ঘুমন্ত গ্রাম। আফজল মিঞার চোখের সামনে ভেসে গেলো তার গোটা পরিবার। ওদের সবার দেহের সৎকারের জন্য দরকার পড়েনি উঁচু জমি খোঁজার। সৎকার হয়েছে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে। সেই আফজল আজ বাঁধে সমিরুদ্দিনের সঙ্গে মাটি কাটছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আফজলের আরেক পড়শি আব্দুল হামিদও কাটছে মাটি। তার অবিশ্যি আফজলের চেয়ে নসিব ভালো। সেই রাত্তিরে মাটির দেয়াল চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলো আব্দুলের পরিবারের ছয়জন। ছ'টা লাশ গুনে গুনে নৌকায় তুলে যশোরী অনুখা পর্যন্ত আব্দুলকে একা ভেসে যেতে হয়েছিল লাশগুলোকে মাটি দেবার জন্য।
হ্যাজাকের আলোটা একটু উস্কে দিয়ে পাঠানোর আগে শেষরাতের বন্যার কপিতে চোখ বুলচ্ছিল রঞ্জন। পাশেই বসে সামিরুদ্দিন। এতক্ষণ তার কাছেই বাইট নিচ্ছিলও রঞ্জন। হঠাৎ তালপাতায় আড়াল দেয়া সদর দরজাটা দড়াম করে খুলে গেলো। একঝলক বৃষ্টি আর দুর্যোগের গন্ধ গায়ে মেখে ঘরে ঢুকলো বশির। সমিরুদ্দিনের বড় ছেলে, বয়স বছর আঠাশ। বেঁটেখাটো, শক্তপোক্ত গড়ন। গায়ের ফতুয়াটা ভিজে সপসপ করছে। মাথায় গামছা জড়ানো। কোমরের থ্রি কোয়ার্টার সমেত দু'পা কাদায় মাখামাখি। একঝলক রঞ্জনকে দেখে নিয়ে সামিরুদ্দিনকে বলল, "আব্বু, মোড়ল ডাকছে, শিগগির চলো।" বশির আর সামিরুদ্দিনের পিছন পিছন রঞ্জনও বেরিয়ে পড়লো। অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে পা পড়লো ঠান্ডা জলে। গ্রামের মেঠো রাস্তায় জল প্রায় হাঁটু অবধি। সেই জল ভেঙে এগোতে শুরু করল রঞ্জন। সামনে মশাল নিয়ে বশির। তার পিছনেই ছায়ামূর্তির মতো সামিরুদ্দিন। তাকে ঠাহর করতে করতে রঞ্জন এগিয়ে চললো আনাড়ি পায়ে। জল - কাদা ডিঙিয়ে, বাদা-মেঠো জমি, জংলা - আগাছা পেরিয়ে, ভেঙে পড়া মাটির দেয়াল টপকে, গোয়ালঘরের নুয়ে পড়া খড়ের চাল মাড়িয়ে এগিয়ে চললো তিনজন। সবাই চুপচাপ। ওদের পায়ের ছপ-ছপ শব্দে ভয় পেয়ে কোথায় একটা পেঁচা ডেকে উঠলো কর্কশ শব্দে। সমস্বরে চেঁচিয়ে সামিরুদ্দিন বলে উঠলো, "খবরদার বাবু। সাপখোপ থাকতে পারে।" মিনিট বিশেক এইভাবে হেঁটে ওরা তিনজন পৌঁছলো একটু উঁচু একটা জমিতে। মশালের আলোয় যেটুকু দেখা যায়, তাতে রঞ্জন দেখলো, খোলা জায়গাটায় একটা পাকা বাড়ি। সেটার আকৃতি দেখে কোনো বসত বাড়ি বলে মনে হলো না রঞ্জনের। স্কুল বাড়ি কিংবা পঞ্চায়েত অফিস হবে। তারই পাশে একটু দূরে আন্দাজ প্রায় দশ-বারো একর একেবারে ফাঁকা একটা জায়গা। মাঠ বললে ভুল হবে না। সেই মাঠের মাঝামাঝি একটা জায়গায় জমাট অন্ধকারে পাহাড়ের মতো কিছু একটা উঁচু হয়ে আছে। চারপাশে জ্বলছে অনেকগুলো মশাল। একটু ধাতস্থ হতে রঞ্জন টের পেলো প্রায় শ'পাঁচেক লোক নাগাড়ে ভর্তি ঝুড়ি খালি করছে ওই উঁচু জায়গায়। আরো একটু কাছে যেতে রঞ্জন বুঝলো, পাহাড়টা মাটির তৈরী আর ক্রমেই সেটা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ফাঁকা জমিতে। উঁচু হয়ে উঠছে একটু একটু করে। জমির একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন-চারটে মাটি বোঝাই ট্র্যাক্টর। তা থেকে একদল লোক খচাৎ-খচাৎ শব্দে মাটি কেটে পরপর ঝুড়ি ভরাচ্ছে। মানুষের মাথায় মাথায় সেই সব ঝুড়ি মাটির পাহাড়ে দ্রুত খালি হয়ে ফিরে আসছে ট্রাক্টরের কাছে। অতগুলো মানুষ একসঙ্গে কাজ করছে অথচ গোটা এলাকাটা কি অদ্ভুত রকম চুপচাপ, নিঃসাড়, নিস্তব্ধ। গোটাকয় মশাল জ্বলছে জমির গায়ে লাগা পাকা বাড়ির বারান্দায়। তারই হালকা আলোয় দেখা যাচ্ছে কয়েকশো মানুষের আবছায়ার নড়াচড়া । যেন চলমান প্রেতাত্মারা নিঃশব্দে লাইন করে মাটি কাটছে, মাটি ফেলছে একঘেয়ে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই। ঝুড়ি মাথায়, হাতে সরে সরে যাচ্ছে একদিক থেকে অন্য দিকে।
একটু পরেই সামিরুদ্দিন ফিরে এলো। সঙ্গে মাঝ বয়সী এক গ্রামবাসী। মেঘ ডাকার মতো গম্ভীর স্বরে সে বলল, "নমস্কার স্যার। আমি পিরবক্স। কান্দি পঞ্চায়েত সমিতির ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট ছিলাম।" রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, "আপনারা এখানে কি করছেন?" উত্তরে মেঘ ডেকে উঠলো আবার। পিরবক্স জানালো, "কবরখানার জমি উঁচু করছি স্যার। সরকারি মাস্টার প্ল্যান তো দূরের ডাঙার মতোই! চোখে পড়ে না। ততদিন যদি না বাঁচি! যদি বাঁধ ভেঙে বান ঢুকে যায়! আর তো সুযোগ পাবো না! তাই চারটে গেরামের লোক মিলে চাঁদা তুলে মাটি আনিয়ে কবরখানার জমি তুলছি। আজ বাদ কাল যদি বান ঢোকে তো ঢুকুক! যদি সব যায় তো যাক! সাড়ে তিন হাত জমি তো বাঁচাতেই হবে।"
কবিতা
কুণাল রায়
কলকাতা
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
আমি কুণাল রায়। পেশায় কলকাতার জর্জ গ্রুপ অফ কলেজেশের সহ অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছি। বিভিন্ন ইংরেজি পত্রপত্রিকা ছাড়া, ওয়েব পোর্টালেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশের একাধিক স্থান থেকেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। রামকৃষ্ণ ইনস্টিটিউট অফ কালচারের ভাষা ও ইন্দোলজি বিভাগ থেকে একাধিকবার পুরস্কার প্রাপ্ত। ইতিহাস, পুরাণ, কবিতা, সমাজ বিদ্যা ইত্যাদি বিষয় আগ্রহ আছে। অনুবাদক হিসেবেও স্বীকৃত।
প্রণয়
প্রথম ভাগ
নীল গগনে উঠে ছিল চাঁদ,
এক শীতল সমীরণ সৃষ্টি করেছিল শিহরণ,
আলতো কণ্ঠে পাখিদের কলতান,
নির্মাণ করে এক মায়াময় পরিবেশ!
সূর্য পাটে গেছে বহুক্ষণ,
কিন্তু সৃষ্টি ব্যস্ত তার অবিরাম লীলায়ে,
এরই মাঝে ছুটে চলেছে সে,
এক পক্ষীরাজ সম ঘোড়া করে,
হাতে এক ঘন কালো চাবুক,
মিশে গেছে যে রাতের আঁধারের সাথে!
ছুটে চলেছে সে,
কোনো বাঁধা আর পারবে না তাঁকে বন্দি করতে আজ!
এক তীব্র অনুরাগের স্পর্শ করে তুলেছে উন্মত্ত আজ!
ছুটে চলেছে সে,
পেছনে সকল অতীতের স্মৃতিকে ফেলে,
এক অজানা ভবিষ্যতের গর্ভে,
কালচক্র অধিক সক্রিয় আজ,
বিস্মৃত হয়েছে সেও বোধকরি সকল নিয়ম!
দ্বিতীয় ভাগ
এক প্রহর পর সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক সমুদ্র!
সমুদ্র দেবতা আজ অতীব অস্থির,
একের পর এক ঢেউ আঁচড়ে পড়ছে সৈকতে,
টুকরো টুকরো তাঁর অস্তিত্ব।
দর্প চূর্ণ আজ!
অকস্মাৎ এক ভয়ংকর সর্প,
সমুদ্র মাঝে বিস্তার করে তার সুবিশাল ফণা,
ভাবে সে: মায়া না বাস্তব!
এক অপরিসীম সাহস অবলম্বন করে -
পৌঁছালেন সমুদ্র মাঝে,
আশ্চর্য,
তরবারির এক স্পর্শে অদৃশ্য হল সেই করাল বদনা!
প্রেম বুঝি একেই বলে-
আপন প্রাণ তুচ্ছ করে,
মুখামুখি হয়েছে এক অযাচিত সংকটের!
সন্তুষ্ট সমুদ্রদেব,
দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল সেই জলরাশি,
আবার গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে সে!
তৃতীয় ভাগ
কিছুদূর গিয়ে লক্ষ্য করে এক বৃহৎ মরুভূমি,
চাঁদ তখনও মধ্য গগনে,
ধূ ধূ করছে চারিদিক।
হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ,
কানে এসে পৌঁছল তাঁর,
ফিরে দেখে,
ধেয়ে আসছে এক মরুঝড়!
তারই মাঝে ফুঁটে উঠেছে এক প্রাসাদের ছবি!
অদ্ভুত তার গঠন।
কিন্তু আশ্রয় নেওয়ার আশা রূপান্তরিত হল না বাস্তবে,
মরীচিকার মত মিলিয়ে গেল সেই গঠন,
সেই সাধের প্রাসাদ!
ঘোড়ায় চেপে বসল এবার,
প্রেয়সী যে ডেকেছে তাঁকে বারবার!
তীব্র ঝড় উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল সে!
ভাবল গন্তব্য আর বেশীদূর নয়,
ঘুমন্ত আকাশ একটু পরেই জেগে উঠবে,
এক ভাবনা গ্রাস করল তাঁকে,
ছুটে চলবার ছাড়া আর কোন পথ নেই আজ!
চতুর্থ ভাগ
ছুটতে ছুটতে পৌঁছায় সে এক অরণ্য মাঝে,
শেষে এক কুটির বর্তমান,
এক নিভন্ত প্রদীপের আলোয়ে দেখা যাচ্ছে তাঁর ছায়া,
প্রেমিকার মুখটা ভেসে উঠল চোখের তারার মাঝে!
আলতো করে তিন বার টোকা দিল জানলায়!
প্রেয়সীর কণ্ঠ তৃপ্ত করল তাঁর অন্তরকে!
প্রদীপের শিখায় দেখতে পেল তাঁর মুখ,
তাঁর ঘন কালো চুল বেয়ে পড়ছে পাহাড়ি ঝর্ণার মত!
হাতে হাত রাখল দুজনে,
অন্তরের ভাষা যেন প্রকাশ পেল নয়নে,
প্রেম খুঁজে পেল তাঁর ভিন্ন পরিভাষা,
আলিঙ্গন!
পূর্ণতা পায় মিলন!
পঞ্চম ভাগ
ধীরে ধীরে বিদায় নেয় চাঁদ,
আকাশে উদিত হয় সূর্য,
চারিদিক তখনও নিস্তব্ধতায়ে মগ্ন,
এক উপলব্ধি,
শীতল কায়া,
মুদিত নয়ন দুটি,
পরনে এক রেশমি নীল বসন!
প্রেমিকের কোলে চিরনিদ্রায় প্রেমিকা,
এক আর্তনাদ,
এক যন্ত্রণা,
এক পরীক্ষা!
প্রেমহীন জীবন মূল্যহীন,
দগ্ধ চিত্ত!
সঙ্গীহীন এই পৃথিবী,
মৃত্যু সম আজ!
এক বিরল সিদ্ধান্ত,
তবে তা আপন অস্ত্রে!
রক্তাক্ত দেহ দুটি পড়েছিল মাত্র,
নেই কোন উপহার,
নেই কোন স্বীকৃতি,
আছে কেবল বুকভরা হাহাকার,
একরাশ অশ্রুবিন্দু!
তবুও অনির্বাণ প্রণয় শিখা,
গেয়ে যাবে তাঁদের জয়গান,
চিরদিন,
চিরন্তন!!
অপরিহার্য
প্রকৃতির ঋতু চক্রের মাঝে,
এসে ধরা দাও তোমরা সকলে,
হয়ে ওঠ এক অপরিহার্য অংশ,
শূন্য কুম্ভ ভরে ওঠে এক অনাবিল আনন্দ ধারায়,
সিক্ত করে তোলে এই কায়া ও ছায়াকে,
গ্লানি তখন বহুদূরে,
যন্ত্রণা তখন এক অচিন পাখি!
বিষময় বাতাবরণ তখন এক অতীত,
অমৃতের স্পর্শে তখন ধন্য এই বসুন্ধরা!
এল বৈশাখ,
সূচিত হল নব অধ্যায়,
পরনে নতুন বস্ত্র, হাতে পূজার থালা,
মুখে স্নিগ্ধ হাসি ও শুভ কামনা,
তারই মাঝে নববর্ষের আগমন বার্তা!
জ্যৈষ্ঠ মাসে তীব্রতার মাঝেও,
নব দম্পতি প্রচেষ্ট হয়ে এক নতুন উৎসব পালনে,
নাম তার জামাই ষষ্টি!
এর পর একে একে আষাঢ়, শ্রাবণের ধারায়,
তৃপ্ত এই ধরণী!
জগৎপালক জগন্নাথের রথ যাত্রা বয়ে নিয়ে আসে,
মিলনের সুর,
একতার জয়গান!
শ্রাবণের সমাপ্তি ও ভাদ্রের আরম্ভে,
অনুষ্ঠিত হয় পরাধীনতার গ্লানি ভুলিয়ে,
আমাদের মুক্তির দিবস-১৫ই আগস্ট!
দেখতে দেখতে আকাশে ভিড় করে পেঁজা তুলোর- মত মেঘরাশি:
কাশফুলের সৌন্দর্যের আঙ্গিনায়,
বেজে ওঠে আগমনীর সুর!
হিল্লোল ওঠে এই মননে,
পাড়ায় পাড়ায় তখন মাতৃ উপাসনার,
এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি!
পূজা পর্যায়ের এই অবিরাম আনন্দ
চলে কার্তিক মাস জুড়ে!
তবুও যেন আরও পেতে চায় এই মন,
প্রশান্ত হতে চায় এই পার্থিব অস্তিত্ব!
হিল্লোল ওঠে এই মননে,
পাড়ায় পাড়ায় তখন মাতৃ উপাসনার,
এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি!
পূজা পর্যায়ের এই অবিরাম আনন্দ
চলে কার্তিক মাস জুড়ে!
তবুও যেন আরও পেতে চায় এই মন,
প্রশান্ত হতে চায় এই পার্থিব অস্তিত্ব!
অগ্রহায়ণ ও পৌষের দৌলতে,
ফোঁটে হাসি কৃষকের মুখে,
নবান্ন ঘরে ঘরে সৃষ্টি করে,
এক সুরক্ষা কবজ!
পরিত্রাতা যীশুর জন্মদিন,
উজ্যাপিত হয় খৃস্টমাস!
কেক পেস্ট্রি জিভে আনে জল।
মাঘের শীতল স্পর্শে,
বাগদেবীর আরাধনা-
হলুদ বসনে হয়ে ওঠে অনন্য!
চোখের পলকে চলে আসে বইমেলা-
বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যায় মনপ্রাণ,
কে জানে, কোথায়?
তবুও প্রাণের উৎসব সে,
যায় না যাকে কোনভাবেই ভোলা!
আর প্রেমের দিবস,
সে তো ফাগুনে আগুন লাগায়,
প্রেমিকের মনে-
নাম তার ভ্যালেন্টাইন্স ডে!
ছবি, উপহারে কেড়ে নিতে চাই মন,
জানে না সে প্রেম যে আজ বহুদূর!
চলে আসে সাতরঙের খেলা,
নাম তার হোলি-
রঙের স্পর্শে হয়ে ওঠে,
এই দিন ভিন্ন,
সকলের মুখে রং দে বসন্তী,
রেখে যায় এক অমর চিহ্ন!
চড়ক মেলার কথা কি ভোলা যায় আর?
চৈত্রই যে তার জন্মভূমি!
বসন্তে বাসন্তী পূজা-
মনে পড়ে শরতের দশভুজা।
যুগে যুগে বহন করে চলেছি,
আমরা এই পালাপার্বণের ধারা,
তবু নৈরাশ্য যে আজও গ্রাস করতে চায়,
আমাদের এই কায়া!
উৎসবের ঢেউ আঁচড়ে পড়ে,
এই মননের সৈকতে,
প্রদান করে এক স্বস্তি!
কিন্তু এই সুখ সূর্য অস্তিমিত হয়,
এই সামাজিক অস্থিরতায়!
বছর ঘোরে, ঋতু আসে বারবার,
জানান দেয় এক চির সত্য,
দুঃখের মাঝেই তো সুখের উপলব্ধি,
তাই বুঝি জীবন এত সুন্দর,
এত প্রত্যাশাময়,
এত আনন্দময়!!
বন্দিদশা
ক্ষুদ্র তুমি,
অতি ক্ষুদ্র,
মনুষ্য দৃষ্টির অগোচরে,
অস্তিত্ব তোমার,
তবুও কি অসামান্য তুমি,
অটুট শক্তির অধিকারী,
একছত্র আধিপত্য তোমার,
একের পর এক পালক যুক্ত হচ্ছে,
তোমারই রাজমুকুটে!
কি নিষ্ঠুর সেই জয়ের খেলা!
নির্মম ভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে,
মনুষ্য প্রাণ,
পরাভূত করছে তার অস্তিত্ব,
অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে মনুষ্য জাতির উপস্থিতি,
তার গরিমা,
তার শ্রেষ্ঠত্ব,
তার প্রভুত্ব!
গগনে, বারিতে তোমারই অট্টহাসি,
প্রতিক্ষণে সঞ্চারিত করছে -
এক অজ্ঞাত আতঙ্ক!
গ্রাস করছে চেতনার এই পার্থিব স্রোতকে!
বসুন্ধরা রূপান্তরিত হয়েছে আজ-
গৃহ বন্ধনে!
তোমারই ছলনায়,
অস্তমিত হয়েছে সুখের সূর্য,
স্মিত হয়েছে আনন্দ প্রদীপের শিখা!
কোন ক্ষণে থামবে তোমার এই বিজয় রথ,
সকলেরই আজ অজানা,
জানে শুধুমাত্র মহাকালের হৃদয়রেখা!!
এই শহর, তোমার প্রতি
পাখির কলতানে জেগে ওঠ তুমি,
জেগে ওঠ গভীর নিদ্রার গর্ভ থেকে,
জেগে ওঠ এক গভীর নিস্তব্ধতার থেকে,
জেগে ওঠ এই মহাপ্রাণের আকুতির মাঝে!
রবির কিরণ অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে তোমার ওপর,
চারিদিক তখন শুধুই আলোময়,
তবুও তাঁর তেজরাশি অসীম,
অসহনীয় হয়ে ওঠে এই কায়ায়ে!
মনে হয় সকল অপার্থিব সুখ স্খলিত হয়েছে,
শুধুমাত্র সুরের এক নব দিগন্ত উন্মোচিত করবার অভিপ্রায়ে-
যার স্থান শুধুমাত্র প্রেমিক প্রেমিকার আবেগসিক্ত হৃদয়ে!
তবু যন্ত্রনা যেন এক স্তদ্ধ সাগর,
তিলেতিলে গ্রাস করছে এই পরম শান্তিকে,
বিদীর্ণ করছে এই প্রাণশক্তি,
বিভক্ত করছে এই আত্মীক চেতনা!
ভূষিত তুমি তিলোত্তমা রূপে,
তবুও তাঁর অঙ্গে লেগে আছে রুধীর,
কেশে লেগে আছে অপমানের বিন্দু,
নারীর সন্মান আজ বিপন্ন,
সে ছুটছে,
এক চিলতে আশ্রয়ের খোঁজে!
কিন্তু ব্যর্থ তুমি আজ ।
কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে নদী,
এক আত্মমর্যাদা সম্বল করে,
প্রকাশিত হচ্ছে এক দর্প,
প্রকাশিত হচ্ছে এক গাম্ভীর্য,
নিরন্তর!!
থিম: শীতকাতুরে
শীতে তোমার প্রতি
এক নিরিবিলি স্থান,
তুষারপাতে চারিদিক আবৃত,
এক টুকরো শীতল পরশ,
সাথে হিমেল বাতাস!
শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে,
রয়েছে তোমার আমার ছোট্ট বাসা,
বুনেছি যেখানে ভালোবাসা!
ছোট্ট সেই বাসায় তুমি ও আমি,
সামনে জ্বলছে আগুন,
হৃদয় মাঝেও লেগেছে যার উষ্ণ ছোঁয়া!
দুজনের হাতেই কফির মগ,
হালকা ধোঁয়া উঠছে ,
ব্ল্যাংকেট এ মোড়ানো দুজনেই আজ,
তবু থেমে নেই প্রেম!
একটু কান পাতলেই,
শুনতে পাই ঝিঁঝি পোকার ডাক,
বিরক্ত হয় নিস্তব্ধতা!
ভাবছি একি এক অলীক স্বপ্ন,
ভাবছি তুমি সত্যি আমার সামনে,
কোন মায়াবী রজনী গ্রাস করেনিতো,
এই প্রেমিক মনকে!
বাইরে বাড়ছে শীত,
আকাশে এক ফালি চাঁদ,
কুয়াশায় চারিদিক মোড়ানো,
আর এই অন্তরে বাড়ছে তোমার প্রতি-
অনুরাগ মিশ্রিত প্রেম!
হঠাৎ ফিরে এলাম,
তুমি সত্যি আমার সামনে আজ,
রেখেছ তোমার চোখ দুটি আমার চোখে,
ধরেছ আমার হাত,
প্রেম বুঝি একেই বলে!
তাই ভালোবাসি আজও তোমায় আমি,
যেমন বেসেছিলাম সেদিন দ্বিপ্রহরে!!
কবিতা
মধুসূদন গোস্মামী
বেঙ্গালুরু
১৪২৭-নববর্ষে করোনা
আরেকটা নতুন বছরের পদধ্বনি!
মল্লিকা মনে আছে -
রঙিন বসন্তের শেষে পলাশের নিঃশব্দ পলায়ন?
ছিলনা তা পরাজয়ের গ্লানি -
কৃষ্ণচূড়া এসে ডেকে নিল তাকে,
ছিল আকুলতা থেকে যেতে আরও কিছুক্ষণ।
আরেকটা নতুন বছরের পদধ্বনি।
শুনতে পাচ্ছ কি মল্লিকা?
তোমার নতুন হালখাতায় আমার নাম লিখতে ভুলোনা।
প্রবাসের ঘেরাটোপে বন্দী যে আমি -
রাশি রাশি সংখ্যার জালে, জয়ী শুধু করনা।
আরেকটা নতুন বছরের পদধ্বনি!
মল্লিকা, তুমি ভালো আছো?
নববর্ষের স্মৃতি নিয়ে গৃহবন্দী আমি সুদূর প্রবাসে,
বুকে চাপা দীর্ঘশ্বাস, কবে ফিরি জন্মভূমি,
তোমাদের কাছে।
কবিতা
আবু আফজল সালেহ
চুয়াডাঙ্গা, বাংলাদেশ
দৃষ্টিরানী শরৎ
হালকা বাতাস বৃষ্টি দোলায়
আকাশপারে দৃষ্টি খোলায়
শিউলিরা হাসে,
দিঘি-বিলের টলোমল
চারিদিকের ঝলমল
দৃষ্টি কাড়ে কাশে।
কাশের বনে আকাশ কোণে
ভরে ওঠে পরত
সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে
দৃষ্টিরানী শরৎ।
শরতের কানাকানি
নীল আকাশের মেঘের ভেলা
চকচকে রং শাদায় ঘেরা
পাখাছাড়া গাঙচিল
মেঘের রোদে ঝিলমিল।
ঝির বাতাসের মিষ্টি দুপুর
কাঁদা-জলের পায়ের নূপুর
মাঠে-ঘাটের দৃশ্য
স্বপ্ন দোলায় বিশ্ব।
শরৎ করে কানাকানি
আকাশ বাতাস জানাজানি
চোখ বলে একটু থাম্
আয় বৃষ্টি জোরে নাম্।
কবিতা
রূপা মন্ডল
দূর্গার দূর্গাপূজো
দূর্গার এখন পাকা চুল, (শরীরে) ত্রিস্তরীয় মেদ,
চিবুকেও ভাঁজ পড়েছে, কপাল জুড়ে স্বেদ।
হাতে মোটা শাঁখা-পলা, লালপেড়ে শাড়ি,
সারাটা দিন সংসারে ব্যস্ত সে ভারি।
ঈষৎ ফাটা গোড়ালিদ্বয় আলতা দিয়ে ঢাকা,
লাল টিপ কপাল জুড়ে সিন্দুর দিয়ে আঁকা।
পুরনো বাড়ি ফাটল ধরা, বট অশ্বথের চাড়া,
ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত, বিদেশে থাকে তারা।
অলস পায়ে ছাদে গিয়ে তাকায় আকাশ পানে,
হিমেল হাওয়া লেগেছে আজ শরতের তানে।
সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে খবর দিতে,
এলো পূজো, ঘরগুলো সব হবে গুছিয়ে নিতে।
শিউলিগাছে ফুল ধরেছে, মিষ্টি সুবাস ভাসে,
আগমনী দিনগুলির বার্তা নিয়ে আসে।
ছেলেমেয়ে আসবে ঘরে মায়ের অনেক আশা,
পদ্মপাতায় জল জমেছে, বিলের জলে ভাসা।
স্মৃতির ঢেউয়ে হারিয়ে যায় মা-দুর্গার মন,
নদীর চড়ে দোলাতো চামর কাশফুলের বন।
নৌকা চড়ে যেত সে আপন পিতৃগৃহে।
চারটি দিন যেত কেটে কি যেন এক মোহে।
সবাই মিলে হাসি-খেলা, মজা হত ভারী।
ছোট্ট গণেশ করত বায়না, চড়বে রেলগাড়ি ।
কোথায় আজ সে-সব দিন, সবই আজ গল্প।
এখন পূজো ভার্চুয়াল, আয়োজনও অল্প।
ভিডিওতেই অঞ্জলি, মন্ত্রপাঠ, ও বলি।
সবার মুখ মাস্কে ঢাকা, করোনার বাহুবলী।
নীলকন্ঠ উড়ে না আর বিজয়ার পরে,
শূণ্য দালানে বাতাস কাঁদে গিরিরাজের ঘরে।।
কবিতা
দেবাশিস পট্টনায়েক
ইন্দারপুরি, নিউদিল্লী
পাথেয়
ফাগুন আগুন ছড়ায়
জঙ্গলের বুকে।
শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার গায়ে
লাল আগুন,
ঘুরপাক খেয়ে মরে
কালো ভোমরা।
ছোঁয়াচে আগুন শরীরে,
ছাই -পাঁশ দিয়ে একটা ঢাকলে,
আর একটা জেগে ওঠে
লকলকে জিভ বের করে।
চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য -
দিন গুনি কখন বর্ষা আসবে,
তেতে যাওয়া বালির রাস্তা পেরিয়ে
মেঘের ছায়া, প্রথম বৃষ্টি!
খড়ের চাল বেয়ে বেয়ে
শরীর চুইয়ে,
বর্ষার জল ছড়িয়ে পড়েছে
মাটির জঠরে!
হাওয়ায় সোঁদা গন্ধ,
হাটে যাচ্ছি সবুজ কাপড় কিনতে,
ঢল নেমেছে খালে বিলে,
বেসুরে গান ধরেছে ব্যাঙ
শিব ঠাকুরের বিয়ে!
লালের ছায়া
চলে যেওনা,
আগুন চোখে মাখতে দাও;
স্বপ্ন কেড়ে নিও না,
ব্যথা জাগুক
পথ চলতে দাও।
বসন্তবিলাপ
ছাপোষা ঘরের পড়াশোনায় একেবারে অনাগ্রহী
শরীর-রূপ অচেতন নয় বছরের মেয়ে,
ইস্কুল পালিয়ে ঘুরে বেড়াত
বনে জঙ্গলে পাড়ার ভাইদের সাথে।
সংসার তাড়নায় দগ্ধ বাবা
পারলেন না করতে লোভ সংবরণ,
বিয়ের সম্বন্ধ বর্ধিষ্ণু বাড়ির একমাত্র ছেলের সাথে।
হলুদের প্রলেপ, রঙিন শাড়ি, পালকির দোলা,
সুঠাম কৃষ্ণবর্ণ শহরে পাঠরত অষ্টাদশবর্ষের স্বামী -
নবোঢ়া নাবালিকার কোমল মনে
ছিল না স্বপ্নের ঠাঁই, জমে ছিল সংশয়ের মেঘ।
ফিরে এল কয়েকদিন পরেই
মায়ের কাছে, আপন জগতে।
গাছের সবুজ পাতায়, ফুলের কুঁড়িতে,
সংকেত - এসেছে বসন্ত চুপিচুপি।
পুকুর ঘাটে পড়ন্ত বিকেল
নিয়ে আসে সন্ধ্যা আনমনে,
আয়নায় অচেনা প্রতিচ্ছবি জাগায় মনে লজ্জা।
কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে বুকে,
মনের নিভৃত কোনে প্রদীপ জালিয়ে,
দেবালয়ে ঘটেছে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার অভিষেক।
তখনই আকাশে অশনি সংকেত -
খবর এলো শ্বশুরালয় থেকে,
দেবতা প্রনয়পাশে শহরের অন্য গোত্রের একটি মেয়ের।
বাজালে কেন বাঁশি, রাঙালে কেন মন,
যখন রবে অধরা!
খসে পড়ল সবুজ ঘোমটা - ধূসর প্রকৃতি,
চোখের জলে সামনে বিছানো রাস্তা পিচ্ছিল।
স্নেহকাতর বাবা দৃঢ় সংকল্প
আবার দেবেন মেয়ের বিয়ে।
বংশ রক্ষা হবে না যে -
শাশুড়ি মায়ের সজল অনুরোধ।
মা-বাবার চোখের জল আর আশীর্বাদ বুকে বেঁধে
শ্বশুরবাড়ি ফিরে এল কিশোরী বধূ ,
শুরু হল ব্যথার পূজা।
একটু ছায়া, একটু ছোঁয়া,
কেঁদে বেড়ায় নিশিদিন পূজারিণী -
শিক্ষিতা দ্বিতীয়া স্ত্রীর প্রতি আরক্ত দেবতা।
পাটের খেতে গ্রীষ্মের রোদ্দুর,
ধানের ক্ষেতে বর্ষার জল,
স্বর্ণাভ ছটা হারিয়ে দেবতার রঙ মেখে,
দিনে দিনে শুকিয়ে শীর্ণ হতে থাকল একালের মিরা।
সতীনের ঘরে উঠেছে খুশির কলরোল-
শিক্ষকতা চাকরির প্রথম বেতন মানিঅর্ডার করে
পাঠিয়েছে ছেলে শ্রদ্ধাসহকারে মায়ের নামে।
মনের তিমির অতলান্ত গভীরে তুমুল আলোড়ন -
দুটি পরিবারকে আলাদা করে দিয়ে,
সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দু ভাগে ভাগ করে,
দেবতা হাল ধরলেন পূজারিণীর সংসারের।
অপরাহ্ণের শুষ্ক নির্মাল্যের ম্লান হাসি,
বেসুরে বাজল মনের বীণায় খুশির তান,
প্রেমের টান নয়, দয়া হয়তো হবে,
এ তো বাবার অভিমান, লোকনিন্দার ভয়।
বংশীধারী গোপীনাথের পায়ে লুটিয়ে
ভিক্ষার আঁচল পেতে-
আওড়ানের শাঁখ বাজল আঁতুড় ঘরে,
শীর্ণ বাহুকে দূর্গ বানিয়ে ঢেকে রাখল দেবতার ধনকে।
ঘরের ভাঙা উঠোনে উচ্ছল কলরোল,
সংসারের চাপ, শিশুর চঞ্চলতা -
হাত আর লাঠি দাগ কাটে পিঠে, মনে নয়।
উথলে ওঠা স্নেহ লুকিয়ে মায়ের কপট তিরস্কার -
'ঠাকুরকে ফুল তুলসী অর্পণে হয়ত ভুল হয় কোনদিন,
নেই কোনদিন বিরাম দস্যিটার পিটুনি খাওয়ার' !
পালে যখন লেগেছে দখিনা হাওয়া,
নৌকা হেলতে দুলতে বয়ে যাচ্ছে,
তখনই হঠাৎ এল ভীষণ তুফান,
উড়িয়ে নিয়ে গেল রঙিন পাল,
ভেঙে দিল দেবতার দেওয়া আভরণের গর্ব,
খসে পড়ল উজ্জ্বল লাল তারা কুঞ্চিত আকাশ থেকে।
চোখের জল চোখেই লুকিয়ে রইল
হতবাক পাবকের অপলক চোখের দিকে তাকিয়ে।
মন্দিরে ঠাকুরের মূর্তির পাশে ফ্রেমে বাঁধনো দেবতার ছবিকে
সকাল সন্ধ্যা কান্নাভেজা প্রণাম জানিয়ে,
অভাব অনটনের রুদ্র জটাজালের দূর্ভেদ্য অন্ধকার পেরিয়ে
রক্তগঙ্গাকে আলোক ধারায় প্রবাহিত করতে
কেটে গেল দীর্ঘ পনেরটা বছর।
শাবক ডানা মেলেছে নীল দিগন্তে,
সাগর উপকূলে খুঁজে ফিরছে মুক্তা।
শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত বটগাছ পাখির কুজনে মুখরিত,
উড়ে বেড়াচ্ছে পাতায় পাতায় রঙ-বেরঙের প্রজাপতি।
ঠিক তখনই, এক চৈত্র গোধূলি বেলায়
ডাক এলো সাগর সঙ্গমের,
চোখের মনির বন্ধন মায়াজাল কাটিয়ে
দেবতার ডাকে সাড়া দিল উর্দ্ধপানে পূজারিণী।
আজও জোৎস্নাস্নাত রাতে বুকে নিয়ে পাষাণভার
চলার পথে থমকে দাঁড়িয়ে
চাঁদের পানে তাকিয়ে
সজল চোখে কি যেন খুঁজে বেড়ায় রক্তগঙ্গার ধারা।
ব্যথার পূজা
বিজন রাতে আজি কি তব অভিসার,
দেবে কি ধরা দূর গগনের তারা,
পশিবে কি আলো এ অগম নির্ঝর!
বাজিবে কি নূপুর শুকনো পাতার মাঝে,
কাননে কাননে কুসুম চয়নে
চিত্ত আকুল সকল কাজে, সকল সাজে!
শূন্য হইল ফুলের ডালা, প্রহর কাটিল গাঁথিয়া মালা,
ঘোর বরিষণ শিথিল চেতন
নিদ্রা যাচিছে, শিয়রে পূজার থালা।
নীরব প্রদীপ মলিন শিখায় মাগিল বিদায়,
ঝরিছে কামিনী ব্যথিত যামিনী
বাদল সুর বাজিছে ছিন্ন বীণায়।
জাগিল ঊষা, পূব গগনে রবি হাসে,
পাখির কূজনে ভ্রমর গুঞ্জনে
উতলা দখিনা হাওয়া ফুলের সুবাসে।
দিলে ডাক বাজিয়ে বাঁশি - হে সুন্দর;
ব্যকুল পরান খুঁজি গৃহকোণ,
পূজার লাগি নেই যে রতন মণিহার।
জীর্ণ, রিক্ত, সিক্ত - এ মোর পর্ণকুটির,
দীনতার লাজ হানিল বুকে বাজ,
ক্ষম মোরে, পারিনি খুলিতে গৃহের দুয়ার।
নিঠুর দরদি, ফিরে গেলে তুমি নীরবে দেবতা,
ত্রস্ত পদে কম্পিত হাতে
বাহির হইয়া খুঁজি তোমার বারতা।
টুটিল সরম, কপালে রাঙিয়া তব পদধূলি
ব্যথার গান করেছি রচন
হে নিরুপম, সে মোর প্রণতি, সে মোর অঞ্জলি।
তীর্থ ভ্রমণ
মনের মধ্যে এলোমেলো অজস্র স্মৃতি -
অন্যমনস্কতায় ভদ্রতার লোকরীতি উপেক্ষা করে
বসে পড়লাম লোকাল বাসের জানালার ধারের সিটে।
ধুলো উড়িয়ে ধুকধুক করে চলার গতি অতিক্রম করে
স্মৃতির জানালা দিয়ে ফেলে আসা দিগন্ত ধুসর।
লোকজনের চিৎকার আর হুড়োহুড়িতে চমকে দেখলাম
স্থানীয় ভিড় বাজারের স্টপেজে থেমেছে বাসটা।
চোখ পড়ল কাপড়ের দোকানের উপরে মরচে ধরা টিনে,
ধুলোর আস্তরণের নীচে বিজ্ঞাপন মহিলা অন্তর্বাসের।
পড়তে যাওয়া-আসার পথে এই ছবির দিকে তাকিয়ে
কালবৈশাখী ঝড়ে হারিয়ে যেত এক কিশোর মন,
হাজার কাঁসর ঘণ্টা বাজত রক্ত জমা শীর্ণ বুকে,
নিজকে মনে হতো কলম্বাস বা লিভিংস্টোন ।
বাজার ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে একতলা সেই বাড়িটা,
প্রজাপতির মত উড়ত রেলিংঘেরা বারান্দায়
এলোচুলে আয়ত চোখের শ্যামল কিশোরী।
বাস থেকে এক ছলক দেখার রসদ -
নিজেকে হারিয়ে এক কিশোর ঘুরে বেড়াত বৃন্দাবনের পথে।
গন্তব্যস্থলে নেমে শরীর হাঁটছিল,
মন ছুটছিল আগে আগে।
মাঠ-ঘাট, জলাজমি, মনসাতলা-শীতলাতলা পেরিয়ে
চার মাথার মোড়ে, বেদী বাঁধানো বটতলা।
হাত বাড়ালাম ডিপটিওলের ঠান্ডা জল খাওয়ার জন্য -
কি ভেবে প্যান্ট গুটিয়ে দেখলাম বাঁপায়ের হাঁটু,
ভাঙা মাটির কলসিতে কাটা দাগটা -
বটতলার বেদীতে বসে পলক হারানো চোখ,
কলসি কাঁখে এপাড়া-ওপাড়ার ধ্রুপদ ভঙ্গিমা।
মজার ছলে নিষেধের বেড়া উলঙ্ঘন করার শাস্তি,
হাঁটুর উপর ভেঙেপড়া খালি কলসির কামড়।
ছুটে পালানো ব্যর্থ শার্দূলের কানে আসছিল
লজ্জিত ভয়ার্ত হরিণীর কান্নাভেজা অস্পষ্ট গালাগালি।
রক্তাক্ত হাঁটুতে এঁটেল মাটির প্রলেপ লাগিয়ে
ভিতরখানার পাড়ে বসে ক্ষুধার্ত মন
বুনছিল অনুনয়ের ভণিতা ছাতা,
লাঠির বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য।
মন্দিরে প্রণাম করতে গিয়ে ইচ্ছা হচ্ছিল
আবার একবার জপকরি সেই অমৃতসম নাম -
অনেকদিন পরে বিনা খবরে হোস্টেল থেকে ফিরে
আপ্লুত হয়ে ডেকেছিলাম যে নামে।
হাতের ফুল ফেলে, পূজা আসন ছেড়ে, ঠাকুর ভুলে,
খুশির আবেগে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল,
স্রষ্টার কান্না, গান্ধারীর স্নেহার্ত দৃষ্টির অমৃত প্রলেপ।
বিগ্রহহীন দেবালয়ে স্মৃতি তাড়িয়ে ফিরছে ঘুমকে,
বিছানার নীচে থেকে উদ্ধার করলাম সযত্নে গোছানো
একগোছা পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড লেটার,
মাত্র তিন লাইনের পাঠানো কুশল সংবাদ।
চোখের পারা শ্রাবণ ধারা আকুল আর্তিতে
ছুতে চাইছে অধরা দেবতার কোমল পা।
ফেরার পথে কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়ালাম পথের এক বাঁকে,
সামনে সোজা রাস্তা -রোদ পোয়াচ্ছে অলস সাপ।
কতবার বিদায় বেলায় এইখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত,
সজল চোখে আশা বেঁধে পারের বছর আবার দেখা হবে।
গতবারে ফেরার সময় সেই প্রথম, সেই শেষবার,
দেবতার জলভেজা গালে নিবেদন শ্রদ্ধাভরা চুম্বন!
পিঠে আলতো ঠাণ্ডা ছৌঁয়ায় পিছন ফিরে দেখি-
আম জাম তালের পাতায় হাওয়ার দোলা,
শুকনো পাতার মর্মরে খুব চেনা পায়ের আওয়াজ,
মাথায় ঝরে পড়া পাতায় দেবতার আশীর্বাদ।
শোণিতের হাতছানি
অচেনাকে জানার দুর্নিবার ইচ্ছা -
কলম্বাস যেমন আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে
আবিষ্কার করেছিল অজানা পৃথিবী,
চঞ্চলতায় অধীর খোঁজে নূতন এক দেশ,
সবুজের কোমল প্রলেপে মোড়া।
পাতা উলটায় ভূগোল বইয়ের,
শিহরিত মনে
হানা দেয় অশনি সংকেত!
একদিন নিশীথ রাতে শিশির ভেজা জোছনায়
পাড়ি দিল কল্লোলিত সমুদ্রের বুকে
মাতাল উল্লাসে, কুহকী অজানার পানে।
উত্তাল ঢেউয়ের আঘাত - ডুবল নৌকা,
হারাল বসন, বাঁধন।
অসীম পারাবারে কোন মরীচিকার হাতছানিতে
শিথিল সংজ্ঞাহীন দেহ ভেসে গেল জোয়ারের টানে।
সকালে স্নিগ্ধ আলোর রেখায় নিমীলিত চোখে দেখল
শায়িত জলপরীর মত ভেসে থাকা এক দ্বীপের উপকূলে।
ছুটে গেল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে.
কি যেন খুঁজে বেড়াল দ্বীপের কোনে কোনে।
নানা রঙের ফুল ফুটেছে মাটি ভেদ করে,
লোনা হাওয়া তারই গন্ধে মাতোয়ারা।
আদি অব্যক্ত অমৃতসম সুখের উল্লাস,
মনের মন্দিরে অনুরণিত বিধাতার শাশ্বত বাণী।
প্রবন্ধ
কোভিড দমনে
মা দূর্গা
অরুন্ধতী ঘোষ
পিটস্বার্গ, ইউ এস এ
হই হই করে মাদূর্গা এসে গেলেন। এবার একটু আগেই এলেন। মহালয়া এবার একমাস আগে। এই কোভিডের যুগেও কিন্তু আমরা বাঙ্গালীরা কিন্তু ভোরবেলা যথাসময়ে মহালয়া শুনেছি- সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অসাধারণ পাঠ ও দারুণ সব গান- যা শুনে আমরা বড় হয়েছি। এছাড়াও আমরা অনেক ভারচুয়াল প্রোগ্রাম (Virtual program) দেখেছি কম্পুটারে, ইউ টিউবে। পূজা এবার ২৫-২৬শে অক্টোবরে, আমরা এবার পূজা উপভোগ করবো প্রতিবছরের মতো এবছরও, তবে ল্যাপটপে, ডেক্সটপে। অঞ্জলী এবার হবে প্রত্যেক শহরে শহরে, আমরা অঞ্জলী দেব বাড়ী থেকেই, ভারটুয়ালি জুম-লিংকের মাধ্যমে। ঠাকুর দেখা এবার বাড়ীতে বসে, নতুন জামা-কাপড় পরে।
আসুন না, আমরা এবার একটু অন্যরকম ভাবে পুরো ব্যাপারটা একটু ভাবি। দেবী দূর্গা এবছর একটু আগেই আসছেন, কেন? অবশ্যি আমি তিথি, নক্ষত্র অমাবস্যার কথা আনছি না। যদি আমরা এমনটা ভাবি, মা এবার আগেই আসছেন মর্তে কোভিড ভাইরাসের কবল থেকে আমাদের বাঁচাতে, তাহলে কেমন হয়? আমরা জানি মাদূর্গা প্রতিবছরই আসেন মহিষাসুরকে মারতে, কিন্তু এবছর একটু তাড়াতাড়ি আসছেন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে কোভিড ভাইরাসকে মারতে।
এবারে ভাবা যাক দেবী কিভাবে এই ভাইরাসকে মারবেন? তাঁর অস্ত্র-শস্ত্রগুলি সবই খুব পুরোনো। সেই পুরাণের আমলের। তাহলে এবার ভেবে নিই দেবীর এক একটি অস্ত্র আসলে এক একটি মারণাস্ত্র ভাইরাসকে মারার! কোন কোন অস্ত্র এক একটি ভাইরাস-ভেদী ড্রাগ যেমন রেমসিডিভির ইত্যাদি (যেগুলি ব্যাবহার হচ্ছে অ্যান্টিভাইরাল থেরাপিতে)। অন্যান্য অস্ত্র বিভিন্ন ধরণের ভ্যাক্সিন হতে পারে। কোনোটি এম আর এন এ ভ্যাকসিন (mRNA Vaccine), কোনোটি ডি এন এ ভ্যাকসিন (DNA Vaccine), আবার কোনোটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ভ্যাকসিন (Attenuated Virus Vaccine) ইত্যাদি। এভাবে ভাবলে মনে একটু ভরসা আসে।
এবারে ভাবা যাক মায়ের ছেলে-মেয়েদের ভূমিকা কি? আমরা ভেবে নিই মায়ের সন্তান গণেশ, লক্ষী, সরস্বতী, কার্তিক এরা সবাই তাঁর সৈন্যবাহিনীর প্রধান অংশ।এই যুদ্ধ বর্তমান কালের, পুরাণের নয়। এই যুগের ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে প্রথমেই আসবেন দেবী সরস্বতী, তাঁর জ্ঞান, তথ্য সরবরাহ করবেন বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য। তিনি মাকে দেবেন বিভিন্ন তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ে। ভ্যাকসিন রিসার্চ বা ড্রাগ তৈরী করতে লাগে অর্থ বা ফান্ডিং। সেই অর্থ দেবেন মা লক্ষী যাতে এই কাজ খুব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে। রণনিপুণ কার্তিক সরবরাহ করবেন বিভিন্ন কারিগরী সাহায্য ও আণবিক অস্ত্র (Technology and Molecular tools)। কার্তিক হলেন মায়ের সব অস্ত্র-শস্ত্রের যোগানদার। কোনোটি ভাইরাস মারার ড্রাগ আবার কোনোটি ভ্যাকসিন। এবারে আসি গণেশের কথায়, মনে করা হয় গণপতি সিদ্ধিদাতা। এবারে তিনি দেবেন সিদ্ধি ভ্যাকসিন তৈরীর গবেষণায়, যাতে আরো দ্রুতগতিতে ভ্যাকসিন তৈরী হয় এবং সারা পৃথিবীর মানুষের যোগান দিতে পারে। কাজেই সিদ্ধিদাতা দেখবেন ভ্যাকসিন প্রোডাকশনের ব্যাপার টা। আমরা জানি গণেশের বাহন হল ইঁদুর। ইঁদুরের এক বিশেষ ভূমিকা আছে ড্রাগ টেস্টিং ও ভ্যাকসিন রিসার্চে। যে কোনো ড্রাগ এবং ভ্যাকসিন আগে ইঁদুরের ওপরে প্রয়োগ করা হয়, তারপরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে মানুষের ওপরে দেখা হয়। এখানে ইঁদুর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে।আর মর্তের মানুষ কি করবেন? দেবীর কাজ যাতে সহজে হয়, তার জন্য ভ্যাকসিন রিসার্চে সাহায্য করবেন ভলান্টিয়ার হয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিয়ে অথবা নিজেকে সাবধানে রেখে। তাইতো প্রতিবারের মতো এবারেও আমরা মেতে উঠেছি মায়ের আসার খবরে। মা আসুন মর্তে, তাঁর ছেলেমেয়েদের, বাহনদের নিয়ে, আমাদের আশীর্বাদ করুন। দুষ্ট করোনা ভাইরাসকে দমন করুন, যাতে আমরা আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারি।
ইংরাজী কবিতার
বাংলা ভাবানুবাদ
প্রদীপ সরকার
ডালাস, টেক্সাস
প্রবন্ধ
আমার মজুর
জেসি রিটেনহাউস
আমি জীবনের সাথে কষেছি দারুন দরকষা -
শুধুমাত্র একটু কিছুর জন্যে -
জীবন দেয়নি এতটুকু কিছু তার বেশি,
হতাশ সাঁঝেতে চেয়েছি আমার ভিক্ষা
যখন দেখেছি ভাঁড়ার আমার শূণ্য,
গৃহকোণে আর কিছু নেই নেই, সব রিক্ত।
জীবন যখন শুধুই অন্নদাতা -
তুমি তাই পাবে, যা কিছু চাইবে তুমি
কিন্তু যখনই পারিশ্রমিক নেবে
কাজ দিতে হবে – ফোকোটে কিছুই হয়না -
দাম বুঝে নিও - দেনাপাওনার অংক।
কেনো জানো আমি ভাড়ায় খেটেছি গতরে?
তিল তিল করে দক্ষ করেছি নিজেকে -
পৃথিবীর কাছে পারিশ্রমিক চেয়েছি -
জীবনে দিয়েছে ততটুকু যা পাই আমি।
ফুল
স্টিফেন ক্রেন
তুমি কি একটা ফুল কিনতে চাইছিলে?
আমি কিন্তু বিক্রি করতে চাইনি সেটা কখনওই -
তুমি যদি একবার ধার চাইতে সে ফুল!
সবুজ বৃন্ত সহ করঞ্জলে দিতাম তোমায়,
বৃন্ত থেকে হলুদ পাপড়ি, আর কিছু গুঁড়ো করা রেণু –
ত্রিবেণী সঙ্গম নেই – তবু কিছু হলুদ বিকেলে
ঢেলে দেই সমস্ত সুবাস,
ততক্ষণে এসে পৌঁছত বেশ কিছু ভ্রমর -
তাদের পাখনায় দ্রুত মিশিয়ে দিতাম আরো একঘন্টার স্বপ্ন।
ভালোবাসা
স্টিফেন ক্রেন
একেলা ভালোবাসা একাকী পথ চলে,
পাথরে কাটে তার নরম পা।
প্রেমের মণিদীপা বেদনা ছড়ালেই,
ঝোপের কাঁটা কাটে সোহাগী হাত।
“বন্ধু, একসাথে আয় না পথ চলি -
কাজে কী লাগবে না আমার সাথ?”
“হৃদয়ে ব্যাথা নিয়ে তুমিও চলে এলে?”
পেছনে পড়ে থাক শূণ্যতা। (মার্চ ১৬, ২০১৮)
মরু ঊষ্ণ দিগন্তিকা
স্টিফেন ক্রেন
মরুভুমির মধ্যে দিয়ে কেন জানিনা হেঁটে চলেছি -
সম্বিত ফিরতেই
আর্তনাদ করে উঠলাম –
“হে ভগবান – আমাকে বাঁচাও -
এখুনি এখান থেকে নিয়ে চলো দূরে”।
নেপথ্যে ভেসে এলো হাওয়া - কন্ঠস্বর –
“ না, এ মরুভূমি নয়”
“তবে এ কী?”
নেপথ্যে –
“এই ভূমি বালুকাবেলার ঢেউ, উষ্ণতা, আর প্রসারিত দিগন্তবেলা”
“না, এ তো মরুভূমি নয়”। (মার্চ ১৬, ২০১৮)
গোপনিকা
স্টিফেন ক্রেন
আকাশ কখনও পারেনা রাখতে গোপনতা,
উপত্যকার কাছে বলে দেয় সব কথা।
উপত্যকা বাতাসের সাথে কথা বলে,
ফুলের বাগানে বাতাসেরা হাসে কলরোলে।
পাখির ঝাঁকেরা বীথিপথে খেলে গাইছিল,
ফুলের বাগানে ড্যাফোডিল কিছু নাচছিল,
তারা কি শুনেছে দখিনা বায়ের সিম্ফনি?
বসন্তে না কি আসেনি এবার বুলবুলি!
তুমি কি গোপনে রাখতে পেরেছ সব কথা?
তোমার জন্যে
স্টিফেন ক্রেন
যখন গোলাপ ফুটবেনা, প্রিয় বন্ধু,
চড়া রৌদ্রেরা গনগন করে জ্বলবে-
ভায়োলেটস সব বিবর্ণতায় ভুগবে
ভ্রমরেরা কেউ আসবেনা ফিরে কোনোদিন -
গুনগুন ডানা সাঁঝ-সূর্য্যেতে হারাবে।
যে হাত কখনও সঙ্ঘবদ্ধ হয়নি
প্রখর গ্রীষ্মে মরে যাবে সেও কোনদিন -
বসন্তে ফুল নাও যদি পাও বন্ধু -
আমার ফুলেরা তোমার জন্যে থাকবে।
তুমি ধীর ধীরে মৃত্যুর পথযাত্রী
পাবলো নেরুদা
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে চলেছ -
যদি না তুমিও ভ্রমণ বেসেছ ভালো,
যদি না তুমি পুঁথিকে করেছ সঙ্গী -
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথচারী।
তুমি কি এখনো শোনোনি গানের লহরী!
কিংবা -
দেখনি এখনও গোধূলি-সাঁঝেতে চন্দ্র!
গাঢ় শাদা মেঘ নীলবন হয়ে উঠছে
ভোর ভীরুভাবে কাকলি পাখনা মেলছে!
কী ভাষা জীবন রেখেছে প্রেমের ছায়ারূপে -
বালুচরে কাঁপে কোন্ হিন্দোলে নৈঋত -
জলতরঙ্গ বয়ে যায় কোন জলসায়!
এখনও দেখনি হৃদয়ে প্রাণের জ্বালামুখ!
এখনো কি তুমি তারিফ করোনি নিজেকে!
সেতারের তারে জোছনার চাঁদ পেলে কি!
ভন্ড জন্মে অশ্লীল সুখ পেলেনা,
বেদিত শরীরে প্রিয়তমা নাম লেখেনি!
শোনোনি – দেখোনি - পেলেনা রুপোলি লজ্জা -
লজ্জা - লজ্জা -
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথচারী।
যখন বেদনে ধীরে মেরে ফেলো নিজ আত্মা
যুবরাজ, তুমি নীলিমায় – নীল অভিসার -
ধূলায় লুটাও তোমার আত্ম-সম্মান।
যখনই তুমি ঠেলে ফেলে দাও সাদরে বাড়ানো হাতকে-
কপোলে দেখনা কত আশ্বাস – কত অক্ষর! স্বেদবিন্দু -
চুপে চুপে দ্যাখো স্বপ্ন লুকোনো গুন্ঠন -
লবন-মাটিতে কান্না অর্থ শেখাবে?
মোমের আলোতে ভেসে চলে যায় ভাসমান -
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথচারী।
যদি তুমি হও পরাধীন স্বর, স্বভাবের -
রোজ যদি হাঁটো একই একঘেঁয়ে পথ ধরে -
যদি না ফেললে পুরোনো তালিকা, লিপিগুলি-
প্রতিদিনকার জীবনের রঙ ছুঁলে না -
তুমি যদি কোনো কথা বলনিকো তার সাথে -
অপরিচিতার সঙ্গকে ভালোবাসোনি –
অবশেষে তুমি শরীরে নিয়েছো ক্লান্তি –
আড়ালে রেখেছো ভয়াল শঙ্খ শিয়রে –
স্পর্ধা হারালে – অলিন্দে আলো দেখোনি -
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে চলেছ -
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথচারী।
অবহেলা ভরে দূরে সরিয়েছ বাসনা?
উত্তাল ঝড়ে ভাসিয়ে হারালে অনুভূতি?
দেখেছো কি যারা তোমার আঁখিতে দিল আলো -
তাদের জন্যে তোমার হিয়া কি দ্রুততর!
দ্রুততর – দ্রুততর ?
না যদি হয় এমন একটি স্পন্দনও -
তুমি ধীরে ধীরে অজানা অঘোরে
মৃত্যুর দিকে চলেছো –
তুমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথচারী।
অজানা স্বপ্ন আগলে রেখেছো বুকেতে?
ঝুঁকিকে করেছ নিজের আপন সঙ্গী?
আকাশে সাজানো সমস্ত সাজ এঁকেছো?
অনুমতি দিলে অস্ফুটে কিছু বলেছো কি?
একলা শুয়েছ- বুকে স্পৃহা কেনো অনামিকা?
যদি না এখনও স্বপ্নের পিছে ছোটোনি -
একবার - শুধু একবার- এই জীবনে
দৌড়ে পালানো আঁধারের কোলে যেও না -
কোমল আলোতে দৃশরা সব ঝর্ণা।
ভালবাসো এই সুন্দরতম তুমিকে
– ভালোবাসো এই সুন্দর প্রাণ-মল্লার -
গ্রীবা তুলে ধরো গুপ্ত স্বেদের নাভিতে।
গল্প
জঙ্গলে
সেই সুর
পৃথা কুণ্ডু
দক্ষিণেশ্বর, কলকাতা
বনবিভাগের এক বাংলো তখন আমার ঠিকানা। কুয়াশাঘেরা অমাবস্যার সন্ধ্যে গড়িয়ে প্রায় রাত, নদীর জলের শব্দ, রাতচরা পাখির ডাক। বারান্দায় বসে নৈশপান সারছি; তৃষা বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। ওর সামনে গ্লাসে চুমুক দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না, একটু অপ্রস্তুত হলাম।
তৃষা আমার ভাইঝির বন্ধু। ভাইঝির বিয়েতে আলাপ। তারপর প্রায়ই চিঠি লিখত। ওর নাকি জঙ্গল খুব ভাল লাগে। সেই সূত্রেই বেড়াতে এসেছিল আমার কাছে। একাই। সাহসী বলতে হবে। দেখতে বেশ, সপ্রতিভ, কথাবার্তাও চমৎকার। ‘ঘুম আসছে না?’ অভিভাবক-সুলভ গলায় জানতে চাইলাম।
‘এমন চমৎকার জংলি পরিবেশে কেউ ঘুমোয়? আপনিও তো ঘুমোচ্ছেন না।’
শালটা গুছিয়ে নিয়ে চেয়ার টেনে বসল তৃষা। ‘জানেন, যখনই শুনেছি আপনি ফরেস্ট অফিসার, তখন থেকেই ভেবেছিলাম আপনার সাথে ভাল করে আলাপ জমাব। আপনি ঠিক আমার মত। ওয়াইল্ড, ডেস্পারেট…’
আমার ছাপ্পান্ন বছরের শিরায় উষ্ণতা। তাও বললাম, ‘বাইরে ঠাণ্ডা, চলো ভেতরে বসি’। আমার কাছে এসেছে, একটা দায়িত্ব তো আছেই। উঠতে যাচ্ছিলাম, তৃষা হাতটা চেপে ধরল। ‘আমার অভ্যেস আছে। বসুন তো, গল্প বলুন।’
হাসলাম। ‘কী গল্প শুনতে চাও?’
‘আপনার জীবনের গল্প। আপনি ভাল ছাত্র ছিলেন, গানও গাইতেন। অন্য কিছু হতেই পারতেন। সেসব ছেড়ে … ’‘জঙ্গলের নেশা। একা মানুষ, দায়দায়িত্ব নেই। তাই অন্য নিরাপদ চাকরি ছেড়ে এদিকেই চলে এলাম।… আর গান এককালে গাইতাম, কলেজের সোশ্যাল, পাড়ার জলসা… তুমি তো দেখছি আমার সম্বন্ধে ভালই খবরটবর নিয়েছ।’ ‘নেব না? আপনি তো আপনজন।…আচ্ছা, এই জলা-জঙ্গল গা-ছমছমে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে… একটা গান শোনাবেন?’ মাথা নাড়লাম, ‘আর এখন গানটান! তুমি গাও বরং।’ ‘আমার কোন গানটা গাইতে ইচ্ছে করছে বলুন তো?
‘আমি কেমন করে বলব?’ ‘ক্লু দিচ্ছি। শিবরঞ্জনীতে। আপনারই প্রিয় গান। ’খটকা লাগল। এসব কী বলছে মেয়েটা! ‘তুমি কীভাবে জানলে?’
‘আর কে জানবে?’ ওর চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করে উঠল।
হঠাৎ গা-শিরশিরে একটা দমকা হাওয়া ভেসে এল বনের দিক থেকে। শুধু হাওয়া নয়, যেন একটা সুর, একটা দীর্ঘ করুণ আর্তনাদ, ‘ও ও ও -- ও ও…’
তৃষা গাইতে শুরু করল, ‘কহিঁ দীপ জ্বলে…’
‘স্টপ ইট!’ চিৎকার করতে চাইলাম, গলায় আওয়াজ বেরোল না। আমার মুখের ভাব দেখে গান থামাল সে। ‘ভাল লাগছে না? আমি তো অত ভাল পারিনা। আচ্ছা, অন্য একটা জিনিস দেখাই’।
শালের তলা থেকে একটা ছবি বের করল। অল্প বয়সের আমি। সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে একটি মেয়ে। পেন্সিল-স্কেচ।
‘এ ... এ সবের মা- মানে কি?’ আমি ঘামতে শুরু করেছি ততক্ষণে।
‘মানেটা তো আপনি বলবেন।’
‘তু-মি... তুমি ক্-কে?’
‘রঞ্জনা সেন আমার মা। আমি তখন ছোট, এই ছবিটা কেউ পাঠিয়েছিল বাবাকে। এর জন্য বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি। অ্যাকসিডেন্টে মারা যান, তিনবছর আগে। তারপর থেকে মাও কেমন পাগলের মত হয়ে গেলেন...’
‘না -আ!’ ...রঞ্জনা... না, আমি তো এরকম চাইনি!
একটু থেমে, কেটে কেটে বলল মেয়েটা – ‘আপনারা একসাথে গান গাইতেন কলেজে... একটা ভূতুড়ে নাটকের জন্য আপনি ওই গানটা তুলিয়েছিলেন মাকে। মা কিন্তু বন্ধুই ভাবতেন আপনাকে।’
আমার মাথা ঝুলে পড়ছিল আস্তে আস্তে। ‘শেষদিকটায় মা কেবল ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতেন – মিথ্যে, মিথ্যে! বলুন, সত্যিটা তবে কি?’
‘ওই- ছ-বি-...’ বুকটা চেপে ধরলাম,‘ ...আমিই... আঁ-কিয়ে পা-ঠিয়েছি-লাম। কলেজের- একটা প্রো-গ্রা-মের গ্রুপ-ফটো থে-কে।’
অন্ধকারে তলিয়ে যাবার আগে ওই সুরটা আবার যেন শুনতে পাচ্ছিলাম – রঞ্জনা... ডাকছে।
গল্প
ক্যানাইন
কেলেঙ্কারী
সব্যসাচী বসু (শঙ্খচিল)
বর্ধমান, পঃ বাংলা
'শাক্যমুনি কাকে বলা হতো?'
'গৌতম বুদ্ধকে।'
'ভারতের কোন সম্রাট বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে যুদ্ধ করাই ত্যাগ করেছিলেন?'
'এটাতো সবাই জানে-মৌর্য সম্রাট অশোক।'
'বেশ,তাহলে বল তো, কুশীনগর বুদ্ধের জীবনের সাথে কিভাবে জড়িয়ে আছে?'
'জানি তো, ওখানেই তো বুদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল।'
'কি বলে ঘটনাটিকে?'
'মহাপরিনির্বাণ।'
'ওক্কে, তা আজকের দিনটা কী জন্য বিখ্যাত?'
এবার উত্তর খুঁজতে থাকে সতু ওরফে সাত্যকি সেন। মাথা চুলকে বোকাবোকা মুখে ঘাড় নাড়ে।
'সেকি রে! অতীতে পাস করে বর্তমানে ডাহা ফেল মেরে দিলি যেরে!'
সকালের লুচি-আলুর দমের ফাঁকা প্লেটটা টি-টেবিলে নামিয়ে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দেয় পার্থ।
'ভাবতে থাক। ডান হাতের কাজটা বন্ধ রাখিস না। আজ তোকে একটু হাঁটাবো।'
'কোথায় ছোটমামা? কখন যাবে?', আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় সাত্যকি।'
'জায়গাটা কলেজস্ট্রিটের আশেপাশে, তোর উত্তরের সাথে জড়িয়ে। আর উত্তরটা যত তাড়াতাড়ি দিবি, তত তাড়াতাড়িই বেরোতে পারবি। নাহলে গরম বাড়বে।'
'আমরা বেরোলাম রে ভাই, সতু'।
'কোথায় মা? বড়মামির সাথে এতো সকালে!'
'পূর্ণিমার পুজোটা দিয়ে আসি, দক্ষিণেশ্বরে'
'দিদি, আমরাও বেরোবো', পার্থ জানায়
'বৌদি, টিভির স্যুইচটা একটু অন করে দাও।'
'আজ কী পূর্ণিমা,বড়মামি?', সাত্যকির জিজ্ঞাসা।
'বৈশাখী পূর্ণিমা'। ওরা বেরিয়ে পড়ে।
সেটটপবক্সের স্যুইচটা রিমোটে অন করে পার্থ।খবরের চ্যানেলে অ্যাড চলছে।সাবটাইটেলে হেডলাইনস্ দেখাচ্ছে --
তাপপ্রবাহ চলবে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে--
বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই -- ডুয়ার্সে ট্রেনের ধাক্কায় আবার হাতির মৃত্যু -- এই নিয়ে সপ্তাহে দ্বিতীয়বার -- কোলকাতার মহাবোধি সোসাইটি থেকে খোয়া গেল ভগবান বুদ্ধের দাঁত -- পূর্ব মেদিনী...'
'কী!!'
ছোটমামার আর্তনাদ শুনে চমকে ওঠে সতু।
'কী হলো ছোটমামা?'
'সর্বনাশ হয়ে গেছে, সতু। ভগবান বুদ্ধের দাঁতটা চুরি হয়ে গেছে --'
'বুদ্ধের দাঁত! কোথা থেকে?'
'আমাদের তিলোত্তমা কোলকাতা থেকেই। হায় হায়, আজকের দিনেই --'
'মনে পড়েছে, আজ বুদ্ধপূর্ণিমা -- বুদ্ধের জন্মদিন'
'আমাদের দুর্ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথের নোবেলের পর বুদ্ধদেবের দাঁতটাও ধরে রাখতে পারলাম না।'
খবরটা দেখাচ্ছে। কোলকাতার কলেজস্কোয়ারে মহাবোধি সোসাইটি থেকে খোয়া গেলো ভগবান বুদ্ধের আড়াই হাজার বছরের পুরোনো একটি দাঁত। সারাবছর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও আজ, বুদ্ধপূর্ণিমায়, সর্বসমক্ষে আনা হয় ঐ দাঁতটিকে। কিন্তু প্রধান পুরোহিত দাঁতটি গুপ্তস্থান থেকে বের করতে গিয়ে দেখেন দাঁতটি সেখানে নেই।শুরু হয়েছে তদন্ত।শোরগোল পৃথিবীর বৌদ্ধদের মধ্যে। দালাই লামা--
স্যুইচ অফ করে পার্থ বলে,'চল,বেরোবো।'
'এটা প্রেসিডেন্সি কলেজ,থুড়ি ইউনিভার্সিটি।'
বিশাল সাদা বিল্ডিংটার দিকে মাথা তুলে তাকালো সাত্যকি সেন। পূর্ববর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক অখ্যাত ইস্কুলের ক্লাস সেভেনের মেধাবী ছাত্র সাত্যকির স্বপ্নের প্রেসিডেন্সি তার চোখের সামনে। কত ইতিহাস জড়িয়ে! সুভাষ বোসের স্মৃতিধন্য ভবনটার সামনের ফুটপাতে সে দাঁড়িয়ে। যদি ভেতরে যেতে পারতো।
'যাবি, যাবি, একদিন নিশ্চয়ই ভেতরে যাবি। ফিজিক্স নিয়ে পড়বি।'
'তুমি কীকরে বুঝলে, আমি কী ভাবছি?'
'টেলিপ্যাথি।'
'ওহ্। ঐ টেলিপ্যাথির জোরেই তুমি বুঝেছিলে আজ আমায় মহাবোধি সোসাইটি বেড়াতে নিয়ে আসবে? আর ...'
'হবে হয়তো। সকাল থেকে তোর ফান্ডা টেস্ট করছিলাম -- গৌতমবুদ্ধের বিষয়ে। এখানে তো আসতামই।দ্যাখ,আজ ওনার জন্মদিন। হিন্দুরা বৈশাখী পূর্ণিমাকে আলাদা করে দেখে না। যেমন দেখে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা রূপে। বা কোজাগরী পূর্ণিমাকে যেদিন দেবীলক্ষ্মীর আরাধনা করে।কিন্তু বৌদ্ধদের কাছে এই দিনটার গুরুত্বই আলাদা।'
ততক্ষণে ওরা ফুটপাত ছেড়ে কলেজস্কোয়ার দিয়ে হেঁটে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে।
'আচ্ছা, ছোটমামা, কোলকাতায় বৌদ্ধরা থাকে?'
'কেন থাকবে না! চাইনিজরা তো ব্যবসার সূত্রে বহুবছরধরেই কোলকাতায় থাকে। এছাড়া বার্মিজ,সিংহলিজ... কিছু আছে। আর...'
একটা দোতলা বড় হলুদ বাড়ির সামনে ওরা দাঁড়িয়ে। গেটের ওপর ইংরেজিতে লেখা--
মহাবোধি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া হেডকোয়ার্টার্স; শ্রী ধর্মরাজিকা চেতিয়া বিহার।
'১৮৯২ সালে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধসন্ন্যাসী আংগরিকা ধর্মপাল, যার মূর্তি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেমোরিয়ালের পাশে দেখলি, এখানে মহাবোধি সোসাইটির হেডঅফিস স্থানান্তরিত করেন।'
'আগে কোথায় ছিল?', সতু কৌতুহলী হয়।
'শ্রীলঙ্কায়। চল,ভেতরে যাই।'
বুদ্ধদেবের জন্মদিনে মানুষের ঢল নেমেছে। অন্যকোথাও চুরী হলে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যেত। কিন্তু এখানে বোধহয় এটাই স্বাভাবিক -- অহিংসা। তাই শান্তির স্থান উপাসনালয়গুলিই বারবার আক্রান্ত হয় -- কখনো জঙ্গি, কখনো বা চোর-ডাকাতদের হাতে।'
ভাবছিল পার্থ। চারদিকের দেওয়ালে বুদ্ধের জীবনী আঁকা। জাতকের কাহিনীও রয়েছে।
পায়ে পায়ে ওরা এগিয়ে গেল বুদ্ধমূর্তিগুলির সামনে।
'ছোটমামা, ওগুলো কি সোনার?'
'না, পিতল।'
ক'জন সন্ন্যাসী বসে আছেন একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে। জোরে জোরে অচেনা ভাষায় মন্ত্র পড়ছেন। অদ্ভুত মাদকতাময় পরিবেশ। যেন কিছুই হয়নি এমনভাব।
পার্থ এগিয়ে যায় পাশের দরজার দিকে।
'কোথায় যাচ্ছ?'
'এদের অফিসে ঢুঁ মারি।'
বেশ সাজানো গোছানো অফিস। টেবিলের উল্টোদিকের প্রবীণ লামাই যে মহাবোধি সোসাইটির হেড, তা বলে দিতে হয় না।
'নমস্তে, ম্যায় পার্থ দত্ত।'
'নমস্তে, বোলিয়ে --', প্রবীণ লামার শান্ত স্বর।
'নিউজ মে শুনা হ্যায় কি ভগবান বুদ্ধ কা এক দন্ত যো আপকে পাস থে উয়্যো মিসিং।'
'হ্যাঁ,বাট হোয়াই আর য়্যু ইন্টারেস্টেড?'
'ম্যায় অ্যানসিয়েন্ট হিস্ট্রি মে এম.এ;এম.ফিল. কা রিসার্চ কা সাবজেক্ট বুদ্ধিস্ট ইন কেভস্।'
'আই সি। হাঁ, ভগবান বুদ্ধ কা লেফ্ট ক্যানাইন টুথ হামারা পাস থে...আপকা মালুম হ্যায় তো।'
'হাঁ। অ্যামেচার আর্কিওলজিস্ট মিঃ পেপে যো টুথ ১৮৯৮ সাল মে ইউ.পি. কা এক স্তূপ সে মিলে।', পার্থ জানায়।
'হাঁ, উনোনে থাইল্যান্ডকা কিংকো উয়ো টুথ গিফ্ট কর চুকা। বাদমে উয়ো ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল মিউজিয়াম মে আয়ে... ফাইনালি দে গিফ্টেড আস।'
'বাট, হাউ দ্য মিসিং ইস হ্যাপেন্ড?'
'ইট হ্যাডবিন কেপ্ট ইন আ কাসকেট ইন আ সিক্রেট প্লেস। হরসাল বুদ্ধপূর্ণিমাকা দিন দ্যাট টুথ বি ইন পাবলিক। লেকিন টুডে,হোয়েন চিফ প্রিস্ট মহান্যায় ওপেনড দ্য কাসকেট, ইট ওয়াজ নিল..'
প্রবীণ লামা একটানা কথা বলে ক্লান্ত।
'এনি সাসপেক্ট?'
'নো।'
'ওকে।আই ওয়ান্ট টু টক উইথ মিঃ মহান্যায়।'
'ইট'স নট পসিবল।'
'বাট হোয়াই?'
'হি ইজ গোয়িং টু বুদ্ধগয়া...'
'আই মাস্ট গো এন্ড ওয়ান্ট টু ইনভেসটিগেট।'
'অ্যাস য়্যু উইস। আই উইল হেল্প।'
'থ্যাঙ্ক য়্যু।'
-----------
'বুঝলে কিছু?'
'কী বুঝবো!'
'মানে কে চুরী করেছে?'
'বা কারা?'
'মানে!'
'মানে অনেক জটিল রে, সতু। কারা যেন উঠেপড়ে লেগেছে গৌতমবুদ্ধের রেলিকস্, মানে তাঁর শরীরের অঙ্গ, ব্যবহৃত দ্রব্য ভারত থেকে পাচারে।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেও ওসব আর রাখা যাবে না -- অনেক খরচ।প্রাইভেট এজেন্সি সংরক্ষণ করবে।'
'ও...তা এর সাথে চুরীর কী সম্পর্ক?'
'ডাইরেক্ট হয়তো নেই। কিন্তু...মহান্যায় মহাশয় এই বিশেষ দিনেই বুদ্ধগয়া গেলেন কেন?'
'এতো সোজা। বুদ্ধদেবের জন্মদিন বলে...'
'নারে, অতো সহজ নয়।'
'আচ্ছা, চুরীর সাথে কি প্রধান লামাও জড়িত?'
'তা, সন্দেহের আওতায় আছেন বৈকি।'
ওলা ক্যাবটা ছুটে চলেছিল। ওরা বাড়ি ফিরে দ্রুত দিনদুয়েকের জামাপ্যান্ট ট্রলিতে গুছিয়ে নিয়েছিল।আজ আর কোনো ফ্লাইট না থাকায় অগত্যা ট্রেনই ভরসা। ট্রাভেল এজেন্ট বিদেশদাকে ফোন করে দুপুর বারোটা কুড়ির কোলকাতা - আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট উইকলি ট্রেনের এসি থ্রিটায়ারের দুটো টিকিট বুক করেছিল পার্থ। মহাবোধি সোসাইটির প্রধানলামা পার্থকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। পার্থকে বেশ মনে ধরেছে ওনার। মহান্যায়ের একটা ছবিও পাঠিয়েছেন পার্থর হোয়াটস্অ্যাপ নম্বরে। ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় গয়া স্টেশনে নেমে অনলাইনে বুক করা ক্যাবে রওনা
দিয়ে আটটা - দশে বুদ্ধগয়ার হোটেলে লাগেজ রেখেই মহাবোধি মন্দির চত্বরে হাজির হল মামা - ভাগ্নে। 'তোর আংগরিকা ধর্মপালের কথা মনে আছে?' 'হ্যাঁ, আজ সকালেই তো শুনলাম। উনি মহাবোধি সোসাইটি স্থাপন করেছিলেন', সতুর স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর।' তা উনি আরেকটি কারনেও খ্যাত। জানিস তো?' ঘাড় নেড়ে সতু জানায় সে জানে না। 'স্বামী বিবেকানন্দ যেবার ১৮৯৩ সালে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে সবাতন হিন্দু ধর্মের উপর তাঁর যুগান্তকারী ভাষণ দেন। ঐ বছরই একই স্থানে ধর্মপালও ভাষণ দেন বৌদ্ধধর্মের ওপর।'
'বাঃ! দারুণ ব্যাপার তো।'
'হুঁ...অবশ্য তার আগেই উনি মহাবোধি সোসাইটি স্থাপন করে বৌদ্ধধর্মের বিস্তারে মন দিয়েছেন।
ভারতের বৌদ্ধক্ষেত্রগুলির সংস্কারও ছিল ওনার উদ্দেশ্য। এই মন্দির তখন জঙ্গলে ঢাকা। হিন্দুরা বৌদ্ধধর্মের নানা প্রতীককে হিন্দুধর্মের বলে চালাতে চাইছিল। সেই আগ্রাসন থেকে বৌদ্ধধর্ম রক্ষায় এগিয়ে এলেন উনি।'
মহাবোধিমন্দির চত্বরে জনসমাগম ক্রমে বাড়ছে। শুরু হয়েছে সান্ধ্য প্রার্থনা। গমগম করছে মূল মন্দির। ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।
'এতো ভিড়ে তুমি মহান্যায়কে কোথায় খুঁজবে, ছোটমামা?', সতুর কণ্ঠস্বর উদ্বিগ্ন শোনায়।
'তাইতো রে! এতো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার সামিল।'
'হোটেলগুলো খুঁজলে হয় না?'
'উনি যে সে মানুষ নন। মহাবোধি সোসাইটির হেড অফিসের রিপ্রেসেন্টেটিভ। উনি কি হোটেলে ওঠেন, বোকারাম।'
'তবে!'
'মহাবোধি সোসাইটির গেস্টহাউসে খোঁজ করতে হবে। চল।'
বুদ্ধদেবকে দর্শন করে ওরা বেরিয়ে আসে। প্রেয়ারহুইল ঘুরিয়ে সতু প্রার্থনা জানায় ভগবান বুদ্ধের দাঁত কোলকাতায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার।
---------
ডিনারের পর পার্থ খাটে আধশোয়া, সোফায় বসে সতু, চোখ মোবাইলে। 'মহাবোধি সোসাইটির আজকের চার্টটা দেখেছিলি?', পার্থ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
'হ্যাঁ,দেখলাম তো। আর বোর্ড থেকে একটা ছবিও তুলে এনেছি', সতুর উত্তর।
'বাঃ, ভেরি গুড, সতু। তা, কী বলছে আজকের চার্ট?'
'এই তো, ভোর পাঁচটায় প্রভাতফেরী -- মহাবোধি টেম্পল থেকে... সকাল ন'টায় থাইল্যান্ডের অ্যাম্বাসাডার দ্বারা থাই গেস্টহাউস উদ্বোধন ... দশটায় কোলকাতার মহাবোধি সোসাইটির সহপ্রধান লামা মহান্যায়ের ভাষণ...'
'গুড... এবার মোবাইলে মহাবোধি সোসাইটির ওয়েবসাইটে আজকের অনুষ্ঠানগুলোর ইমেজ বা ভিডিও পাস কি না, দ্যাখ তো।'
ছোটমামার উৎসাহী কণ্ঠস্বরে সতু দ্রুতহাতে ছোটমামার মোবাইলটা সার্চ করে চলে।
'হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো...ইমেজ গ্রুপে আজকের... হ্যাঁ...'
'বেশ, এবার ঐ মহান্যায় মহাশয়ের ছবিগুলো বার কর... চটপট।'
'পেয়েছি, পেয়েছি', চেঁচিয়ে ওঠে সতু।
'আরে, তুই যে সত্যিই আর্কিমিডিস হয়ে উঠলি, সেটা প্রমাণ কর।'
'মানে?'
'মানে, রাজার কাছে ছুটে যা...'
'ও, তুমিই রাজা!'
সতু বিছানায় কাত হয়ে শোয়া ছোটমামার পাশে বসে। একটা ছবিতে মহান্যায়ের ক্লোজ-আপ দেখা যাচ্ছে... হাসছেন সামনের দুপাটি দাঁত বের করে। সঙ্গী থাইল্যান্ডের অ্যাম্বাসাডার।
'এই এই থাম। এই ছবিটা বড় কর তো।'
ছবিটা বড় করে দেখতে থাকে আর চোখদুটো রসগোল্লার মতো হয়ে যায় পার্থর।
'ইউরেকা, ইউরেকা', চেঁচিয়ে ওঠে পার্থ।
'কী হলো গো, ছোটমামা?'
'বেরোতে হবে, এক্ষুণি।'
একলাফে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত চেঞ্জ করে। দেখাদেখি সতুও।
কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার ওরা রাস্তায়। ক্যাবটা হোটেলের নীচেই পার্ক করা ছিল।ফোনে বিবেককে ডেকে চেপে বসে।
'তুরন্ত ...'
'কাঁহা?', যেন তৈরীই ছিল।
'থাই প্যাগোডা...'
'ওক্কে...'
ক্যাব ছুটে চলে জ্যোৎস্নার নরম আলো মেখে।
'পেয়ে গেছো?'
'কি!'
'চোর?'
'হুঁ...'
'তাহলে, সোসাইটির গেস্টহাউসে যাওয়াটা কাজে লেগেছে,বলো ?'
'অবশ্যই। ওখানে যে মহান্যায় উঠেছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার দরকার ছিল।'
'কিন্তু, ওখানে তো তখন উনি ছিলেন না।'
'সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?'
'তাহলে,এখন ওখানে না গিয়ে থাইপ্যাগোডায়...!'
'শিম্পাঞ্জি আর মানুষের তফাৎ কী?'
'বুদ্ধির...'
'বুদ্ধি কোথায় থাকে?'
পার্থ আদর করে সতুর মাথায় একটা হালকা গাঁট্টা মারে।
'এটা কাজে লাগা, উত্তর পেয়ে যাবি।'
----------
হোটেল তথাগত থেকে বেরিয়ে পরপর নানা দেশের বৌদ্ধমন্দির পেরিয়ে চলেছে ওরা।সতু ছোটমামার কাছে চিনে নিচ্ছে কোনটা ভুটানের, জাপানের, কোনটা বা ভিয়েতনামের।
'আচ্ছা, ছোটমামা,এই দেশগুলো তো সবই হয় ভারতের নর্থে নয় ইস্টে। কেন?'
'এটা জানা উচিত ছিল।বৌদ্ধধর্ম যে ভারত ছাড়িয়ে নর্থ আর ইস্টেই ছড়িয়েছিল ।'
ক্যাবটা থেমেছে থাইপ্যাগোডায়।
'উত্তরটা পেয়ে গেছি', উৎসাহে বলে ওঠে সতু।
'বল...'
'ছবিটা মহান্যায়ের সাথে থাই অ্যাম্বাসাডারের হাসিমুখের।'
'বেশ,তা এখানে কেন এলাম?'
'দাঁতটা থাইল্যান্ডে পাচার করা হবে। এটাই সেফেস্ট প্লেস।'
'গুড,চল...'
'একা যাবো আমরা?', ভয় মেশানো গলায় সতু বলে।
'আমরা কবে থেকে সিঙ্গুলার হলো? কোমর থেকে বেল্টটা খুলে হাতে রাখ। কাজে লাগবে।'
ওরা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায়। মন্দিরের ভেতরটা একদম শুনশান।রাত সাড়ে দশটা। ওরা মূল মন্দিরের বাঁদিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়।
কোনের একটা ঘরের ভেতর থেকে চাপা কথাবার্তা ভেসে আসছে...ইংরেজিতে। পার্থর
হাতে মোবাইল। রেকর্ডার অন।
'ডু ইউ গ্ল্যাড?'
'ওহ্! সার্টেনলি,মিঃ মহান্যায়। উই উইল মেক আ রেলিক টেম্পল উইথ দিস।'
মোবাইল হাতে বন্ধ জানলার কাছে এগিয়ে যায় পার্থ। একটা একফালি ফাট জানলায়।সতুকে ফোনটা দিয়ে বেল্টটা নিজে নেয় ও। এখন ঐ একফালি ফাঁকদিয়ে ভিডিও করে চলে সতু। এবার অ্যাকসান হবে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ।
'দেন মাই চেক?' মহান্যায়ের কথায় ধ্যান ভাঙে সতুর।
ঘরের ভেতর জোরালো আলো।মিঃ অ্যাম্বাসাডারের বাঁহাতে কাচের বাক্সে একটা ছোট্ট সাদা দাঁত।ভগবান বুদ্ধের। কিন্তু ডানহাত প্যান্টের ভেতর থেকে বের করে আনলো ...ওটা
কী!!
পিস্তল। মুহূর্তে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মহান্যায় দরজার দিকে ছুটে আসে। দরজা খুলে বেরোতে যাবে,একটা কিছু ছিটকে আসে। আছাড়। গুলি গায়ে লাগেনি। ওটা পার্থর বাড়ানো পায়ের খেল। পেছনে বেরিয়ে আসা থাই গলায় বেল্টের ফাঁস লেগে কুপোকাত। জিভ বেরিয়ে এসেছে। মামার কেরামতি পুরাটাই রেকর্ড করেছে ভাগ্না। আশপাশ থেকে ছুটে এসেছে সাদা পোশাকের বিহার পুলিশ। দুজনকে টেনে তোলে।
'আসুন সাব...' ড্রাইভার বিবেক ডাকে ওদের।
'থ্যাঙ্ক য়্যু ...ঠিক সময়ে এসে পড়ার জন্য',পার্থর গলায় কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে।
'এক মিনিট...' পার্থ ছিটকে পড়া কাচের বাক্স থেকে পরম যত্নে দাঁতটা তুলে কপালে ঠেকায়।
'দেন, মহান্যায়জি, নিজের কাঁচা দাঁত তুললেন। সেখানে এই দাঁতটা পড়লেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। জলদিবাজি করে আজ সকালেই দাঁতটা খুলে ফেললেন', পার্থ হাসে,' এমন একজন বিদেশীর হাতে দেশের সম্পদ তুলে দিচ্ছিলেন হু ওয়ান্ট টু মার্ডার য়্যু। কত টাকার ডিল হয়েছিল?' পুরো কথাটাই হচ্ছিল ইংরেজিতে।
'বাট দিস ইজ আওয়ার কান্ট্রিজ প্রপার্টি। মিঃ পেপে হ্যাড গিভেন আওয়ার কিং...', মিঃ থাই ডিফেন্ড করার চেষ্টায়।
'বাট বুদ্ধ ওয়াজ বর্ন ইন ইন্ডিয়া, নট ইন থাইল্যান্ড। অ্যান্ড স্পেন্ড হিজ লাইফ ইন ইন্ডিয়া।
...সো, মিঃপান্ডে, এদের জিপে তুলুন।'
সকালের প্রথম ফ্লাইটে ওরা ফিরে চলেছে কোলকাতা। সাথে উদ্ধার হওয়া আড়াই হাজার
বছরের পুরোনো দাঁত। স্হানীয় হিন্দি খবরের কাগজে ওদের ছবিসহ খবর বেরিয়েছে।ধরা পড়া অপরাধীদের ছবিও এককোণে ছাপা।
ওদের সাথে সেই ড্রাইভারসাবও আছেন। উনি যে বিহার পুলিশের একজন অফিসার।
'কিন্তু, ছোটমামা,কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পেলাম না...'
'কী, বল...'
'তুমি কি করে নিশ্চিত হলে যে প্রধানলামাই দাঁতটা পাচার করেন নি?'
'উনি খাঁটি বৌদ্ধ ফ্রম টিবেট। আর মহান্যায় একজন ধর্মান্তরিত হিন্দু কেরালিয়ান।'
'ও,তুমি ঐ ছবিটা দেখেই কীকরে বুঝলে যে দাঁতটা মহান্যায়ই নিয়েছে?'
'কারণ... ঐ ছবিটায় মহান্যায়ের লেফ্ট ক্যানাইন টুথটা ভাঙা ছিল।'
'আর মহান্যায়ের যে ছবিটা তোমার কাছে আছে, সেখানে ঐ দাঁতটা গোটা...তাই না?'
'গুড... বোকারামের মাথা খুলেছে, তাহলে।'
ছোটমামার প্রসংশায় খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সতুর দুচোখ। পোর্টহোলের ওপার থেকে
রাঙা সূর্যের আলো এসে পড়ে আরও ঝকঝকে দেখাচ্ছে।
গল্প
বন্দীপুরে
যুগলবন্দী
সব্যসাচী বসু (শঙ্খচিল)
বর্ধমান, পঃ বাংলা
এক
গতকাল ছিল মহাষ্টমী। বাঙালির পাতে ফুলকো ফুলকো গরমাগরম লুচি। সাথে আলুভাজা বা ছোলা দেওয়া কুমড়োর তরকারী। আর বেশ কয়েকরকম মিষ্টি তো থাকবেই। জমিয়ে খাওয়ার দিন।
আজ মহানবমী। বাঙালি সকাল থেকেই খাসির দোকানে। ভোঁতা মুখটাকে স্বাদে ফেরাতে।
কিন্তু ঐসব ভেবে কি হবে! কোথায় বাংলা আর কোথায় আমি! বাঙালির কালচার থেকে কতবছরই তো বিচ্যুত। বাঙলা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে একটা নির্জন জঙ্গলে পড়ে আছি। নির্বাসনে।
তাই বা বলি কি ক’রে! এতো রাজতন্ত্রর যুগ নয়, যে আমায় কোনো রাজা কোনো অপরাধে রাজ্যের বাইরে নির্বাসনে পাঠাবে - শাস্তি দিতে! আবার রামায়ণের যুগের মতো পিতৃসত্য পালনের জন্য জঙ্গল - পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে হবে! চোদ্দ বছরের জন্য। বা পাশায় হেরে পান্ডবদের বনবাসও নয়।
এ যে স্বেচ্ছা নির্বাসন। আত্মনির্বাসনও বলা যেতে পারে। আত্মহত্যার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম কর্ণাটকের এই জঙ্গল। বলা ভালো,বেছে নিতে হয়েছিল। সভ্যসমাজ, যাকে বলা হয়ে থাকে, তার থেকে বহু বহু দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম।
তবু বাঙালি থেকে দূরে সরে থাকতে পারলাম কই! এখনে বহু বাঙালি আসে। জিপসি চেপে ঘুরে বেড়ায়। নানান প্রশ্ন করে। তাদের কৌতূহল মেটাতে হয়। নিজেদের মধ্যে বকবক, সদ্যপরিচিত বাঙালিদের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠতে বাঙালিদের মতো দক্ষ আর কোনো ভারতীয় জাতিকে দেখিনি। বিদেশী টুরিস্টরা তো মৌনতার প্রতিমূর্তি।বাঙালির এ অভ্যাস ভাল না মন্দ বুঝি না।
যাক, যেটা বলছিলাম, আজ মহানবমী। এই সময়টা এলেই মনটা হুহু করে ওঠে। বাঙালির জাতীয় উৎসব দূর্গাপুজো এলেই এতদূর থেকেও আমি কাশের দোলা দেখতে পাই।শিউলিফুলের মিষ্টি সুবাস নাকে এসে লাগে। মনকে নাকি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে!
আমি জানি, যারা যে পরিবেশে বড় হয়, সেখানকার রূপ-রস-গন্ধ তাদের মনের ভেতর গেঁথে থাকে। ইন্দ্রিয়ের দ্বার দিয়ে সেঁদে যায় মনের গভীরে। এক্কেবারে পাক্কা। তারপর সময় এলেই মনের অবচেতন থেকে ভুসভুস করে ভেসে ওঠে স্বপ্নে। দিবাস্বপ্নেও। এতো ফ্রয়েডই বলে গেছেন।
আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। সত্যি বলছি,বাঙলার জন্যে। কিন্তু এসব ভারী ভারী কথা বলছি কেন! এতো গম্ভীর ভাবনা! আমার মুখে, ভাবনাতেও, এসব কথা মানায় না। আমি যে গাইড। বন্দীপুর অরণ্যের তুচ্ছ এক ভ্রমণসঙ্গী।
দুই
টিকিট কাউন্টারের সামনে সবুজ জিপসিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সার বেঁধে। অনলাইনে বুকিং করার প্রিন্ট-আউটটা কাউন্টারে দিয়ে অপেক্ষা করছে চৈতালি।
ঘোষ জেঠু - জেঠিমা বারান্দায় বসে।চৈতালির পাশের ফ্ল্যাটের নিঃসন্তান ঘোষ দম্পতির জষ্ঠি এখন ও। বয়স্ক মানুষ দুজনকে ভোরে ঘুম থেকে তুলে নিজে তৈরী হয়েছিল। এখন একসাথে তিনটে সিট পেলেই... ভাবছিল ও।
হালকা সবুজ টপ আর চকোলেট রঙা জিন্সে নিজেকে সাজিয়েছে। মাথার কাঁধ অবধি ঝাঁকড়া চুল লাল রিবনে আবদ্ধ। একটা আসমানি ক্যাপ রোদ্দুর থেকে বাঁচতে। যদিও রোদ তেমন হবে না বলেই মনে হয়। তবু... সাজের অঙ্গ তো হবে। ভেবেছিল ও।
জীবনটাকে এখন এভাবেই দেখে চৈতলি। রিহ্যাবে থাকার ভীষণই এমব্যারাশিং দিনগুলোকে ভুলতে চায়। দ্রুত।
‘দিস ইজ ইওর টিকিট। প্লিজ শো ইওর আই.ডি.--’ অফিসারের কথায় পার্স থেকে তিনজনের আই.ডি. বার করে দেখায় চৈতালি।
‘থ্যাঙ্ক য়্যু। হ্যাভ আ নাইস জার্নি।’
‘ওয়েলকাম...’
কাউন্টার ছেড়ে বারান্দায় আসে চৈতালি। হাতে ধরা টিকিটে জিপসি নম্বর লেখা... মিলিয়ে দেখে ওদের জন্যে বরাদ্দ জিপসিটা খুঁজে ঘোষ জেঠু - জেঠিমাকে ডেকে নেয় হাত নেড়ে।
ড্রাইভারকে দেখা যাচ্ছে না। গাইডও নেই...। জেঠু-জেঠিমাকে সামনের ডানদিকের দুটো পাশাপাশি সিটে বসিয়ে নিজের জন্যে জেঠিমার পাশের সিটে ক্যামেরাটা রেখে জিপসির পাশে দাঁড়াল ও।
কাউন্টারে ভিড় জমেছে ভালই। একদিকে জিপসি আর একপাশে ক্যান্টার দাঁড়িয়ে।সারিবদ্ধ। কখন যে ওদের জিপসিটা ছাড়বে! আর ছাড়বেই বা কি করে? তিনটে সিট যে ফাঁকা।
সামনের শালগাছটার নীচে অপেক্ষারত মানুষ। চাপবে দুটো ক্যান্টারে। সবুজ রঙের জংলী শরীর। লাল বৃত্তে লেখা বন্দীপুর টাইগার রিজার্ভ।
একটা জিপ এসে থামলো।সামনের আসন থেকে লাফিয়ে নামলো একজন খাঁকি পোষাক পরা মানুষ। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখে গোল চশমা,মাথায় হ্যাট। গটগট করে চলে গেলো অফিসঘরের দিকে। খুব চেনা চেনা ঠেকলো চৈতালির। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারলো না। একটা একটা করে জিপসি ছেড়ে যাচ্ছে। ক্যান্টারদুটোও।ওদেরটা কখন ছাড়বে?
এমনসময় জিপে অপেক্ষারত পরিবারটি নেমে এলো। বছর তিরিশের যুবক, তার স্ত্রী ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে। মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল। চৈতালি একদৃষ্টে চেয়েছিল মেয়েটির দিকে।নামার করণ সেই লোকটির ফিরে আসা। হাতে টিকিট।
‘ঘেটালা আহে--’, দাড়িওলা বললো।
‘খুপা খুপা ধন্যবাদ’, যুবকটি হেসে উত্তর দিলো।
‘চলা নিঘুয়া’, বলে দাড়িওলা পেছনের সিটে ছোট্ট মেয়েটিকে তুলে দিলো। মেয়েটি মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিলো। মারাঠা দম্পতি জিপসিতে ওঠার পর নিজে উঠে এলো ড্রাইভারের পাশের সিটে।ড্রাইভার তৈরীই ছিলো। দাড়িওলা ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বললো, ‘কালিসোনা’ আর পেছন ফিরে হেসে চৈতালিদের বললো, ‘চলুন, যাওয়া যাক।’
তিন
জিপসি এগিয়ে চললো। চোদ্দ বছরের গাইড জীবনে এই প্রথমবার চমকে গিয়েছিলাম। দূর্গা নবমীর ভোর আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল এক ফেলে আসা আনন্দ।যাকে আমি ভুলতে বসেছিলাম।
একজন রঙিন নারীর সাজে জিপসিতে সওয়ার হয়ে আমার সাথে এ কে চলেছে! এই কি সেই টিন-এজার ছটফটে চৈতালি? নাকি যৌবনের দ্বিতীয় প্রহরে দাঁড়িয়ে থাকা এক সম্পূর্ণা নারী !
মাঝে ঝরে গেছে কুড়িটা বছর। এই অরণ্যের পর্ণমোচী পাতার মতোই। শুধু ঝরেই গেছে।
সেই অঝোরধারে ঝরে পড়া বৃষ্টিভেজা দিনটা খুব মনে পড়ছে। তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামার পর চৈতালিকে ছাড়তে ইচ্ছা হয়নি সেদিন। একটা রিক্সায় চাপলাম। সেটা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিন। চৈতালি চলে যাচ্ছে কোলকাতায়। রবীন্দ্রভারতীতে ক্লাস শুরু পরের দিন।সিঁথির মোড়ে মাসির ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনা করবে।
রিক্সাটা এগিয়ে চলেছে। বর্তমানকে অতীত করতে। চাকার ঘূর্ণনে। কার্জন গেটের নীচ দিয়ে, বি.সি.রোড বেয়ে বয়ে যাওয়া জলধারার মাঝে একাকী রিক্সায় দুজনে। মুখে কোনো কথা নেই।আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় মৌন।
একসময় চৈতালি জড়িয়ে ধরলো আমায়। প্রবলভাবে। সেই প্রথম। আমিও ওর হাত চেপে ধরলাম।বৃষ্টির শৈত্যে উষ্ণ হয়ে উঠলাম মুহূর্তেই।
হাসপাতালের পাশ কাটিয়ে... মেডিক্যাল কলেজ পেরিয়ে... বিধান রায়ের বৃষ্টিধোয়া মূর্তিটা অতিক্রম করে... গোলাপবাগ। আমার অতীত স্বপ্নভঙ্গের জায়গা। আমার নতুন স্বপ্নের সূচনাও ওখানেই। সুখের দিনগুলো কেটে গেল দেখতে দেখতে। সুখের সময় অতিদ্রুতই বয়ে যায়। আমাকে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে চৈতালি ফিরে গেলো। কে জানতো এটাই ওর শেষবারের মতো যাওয়া হবে! আজ এতোগুলো বছরের সব ঝরা পাতা সবুজ কিশলয় রূপে একসাথে ফিরে এসেছে শূন্য হয়ে যাওয়া আমার মন অরণ্যের ডালে ডালে শাখায় শাখায়।
আমার চৈতালিকে অরণ্য দেখাতে হবে যে। আমার চোখ দিয়ে। বন্যপ্রাণের ঘ্রাণ আমার নাসিকা ছুঁয়ে পৌঁছে যাবে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। আমার শ্রবণেন্দ্রিয় বয়ে নিয়ে যাবে অজানা পাখীর কূজন ওর কর্ণকুহরে। ওর চেতনা জুড়ে তখন আমিময় অরণ্য।
স্বাগত জানালো একজোড়া ড্রঙ্গো। দেখালাম আমার অতিথিদের। তিনজনের মারাঠা আর তিনজনের ঐ বাঙালি পরিবারটিকে। চৈতালির সাথে এঁরা কারা! ওর মা-বাবাকে কোনোদিন দেখিনি।ও কি বিয়ে করেনি! বোঝাও যাচ্ছে না।
‘এটা ঠিক,ওটা রোজউড... এই অরণ্যটা পর্ণমোচী। শুষ্ক আর আর্দ্র দুরকম অরণ্যের মিশ্রণ।এছাড়া গুল্মও পাবেন। ’
কথাগুলো বলছিলাম ইংরেজি - বাংলা দুটো ভাষাতেই। ‘এই জঙ্গলেই তো প্রিন্স থাকে?’, আচমকা প্রশ্নটা করলো চৈতালি।
‘আপনে দেখা উসকো?’, মারাঠি মহিলাটিও উৎসুক বেশ বোঝা যাচ্ছে।
‘ইয়েস,অফকোর্স। উয়ো তো ইস জঙ্গলকা রাজা। হিস ফাদার অগ্যস্ত ওয়াজ দ্য লাস্ট কিং ।’
আমি উৎসাহের সাথে বললাম। বেশ ভালো লাগলো ওর জঙ্গল সম্বন্ধে উৎসাহ দেখে। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে অনেকেই অনেক কিছু জানে।
চৈতালিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না ও আমায় চিনতে পেরেছে কিনা। অবশ্য না পারারই কথা।কোথায় সেই কলেজের আমি। দাড়ি - গোঁফ নিখুঁত ভাবে কামানো। ইস্ত্রিকরা প্যান্ট-সার্ট।স্টাইলিশ। আর কোথায় আজকের একমুখ দাড়ি - গোঁফ ওলা ঝাঁকড়া বড়বড় চুলের একটা পাগলাটে চেহারার আমি!
দুটো আমি কি এক! তা হতেই পারে না। আমরা কোনো কোনো মানুষ একজীবনে দুটো রূপে বাঁচি -- এই জঙ্গলের আগামিড গিরগিটিগুলোর মতোই -- বহুরূপী। ভোট প্রার্থী রাজনৈতিক নেতা আর ভোটে জয়ী নেতা কি একই চেহারার! আমিও বদলে গেছি অনেক।
চেহারায়। মনে। সত্ত্বায়।
চার
জঙ্গলের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে সবুজ জিপসিটা। সুবিশাল বৃক্ষগুলো দুপাশে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে। নির্বাক। একটা-দুটো পাতা খসে পড়ার মৃদু শব্দ। জিপসির চলার শব্দ ছাড়া অরণ্য শুনশান।
ওরাও অরণ্যের বিশালতার মাঝে নির্বাক হয়ে গেছে। অমন চঞ্চল শিশুও মৌন। যেন কিছুর প্রতীক্ষায়।সকলে।
হঠাৎ ক্যাঁ ক্যাঁ করে একটা ময়ূর ডেকে উঠলো। প্রভাতের জন্ম হলো। তাকে স্বাগত জানালো কেকাধ্বনি। ছয়জোড়া নয়ন খুঁজে ফিরছে জাতীয় পাখীটিকে। একবার ডেকেই চুপ করে গেছে সে।
“উয়ো দেখিয়ে,লেফ্ট...”
বাঁদিকে আঙুল তুলে কিছু একটা দেখালো গাইড। ওরা ওইদিকে তাকালো। দুটো হরিণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
“ডিয়ার...ডিয়ার...” এতক্ষণে কথা বললো বাচ্চাটা। ফুটে উঠলো হাসি।
“ইয়েস, মাইডিয়ার, দিস ডিয়ার ইজ সম্বর...” গাইড-আঙ্কলের কথায় ঘাড় নাড়লো বাচ্চাটা।
জিপসিটা থেমে গিয়েছিল। ওরা দেখছিল সম্বর হরিণদুটিকে। চিড়িয়াখানার তারজালির ওপারে থাকা কোনো প্রাণী নয়। পর্ণমোচী অরণ্যের উন্মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক।
“সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছিলেন -- ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ -- বলো জেঠমা?”, চৈতালি বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করলো।
“তাই তো রে”, অস্ফুটে উত্তর দিলেন ঘোষজেঠিমা। “লেটস্ মুভ...”, গাইড বললো।
“একটু দাঁড়ান,প্লিজ”... ক্যামেরায় হাত দিল চৈতালি। মারাঠি বধূটিও বের করলো দামি মোবাইল। উঠতে থাকলো জোড়া সম্বরের ছবি।
পাঁচ
শহুরে বাবু-বিবিরা জঙ্গলে আসেন। শোনার চেয়ে কথা বলেন বেশি। দুচোখ ভরে দেখার থেকে ক্যামেরার বা মোবাইলের ভিউ ফাইন্ডারে দেখতেই বেশি পছন্দ করেন। এখন তো আবার ডিজিটাল যুগ। যার ছবি তোলা হচ্ছে তৎক্ষণাৎ তাকে মনিটারে দেখাও যাচ্ছে।কোনো প্রতীক্ষার প্রয়োজন নেই। আগেকার দিনের রিলের যুগটাই ভাল ছিল। ছবি তুলতেও এলেম লাগত।
জিপসিটাকে এগিয়ে যেতে বললাম। গতকাল প্রিন্সকে যেখানে শিকার করতে দেখা গিয়েছিল, সেদিকে চালাতে বললাম আয়াপ্পানকে।
“পথের দিকে নজর রাখুন। পাগমার্ক দেখা যেতে পারে”, বললাম।
“পাগমার্ক কী আঙ্কল?”
ছোট্ট বাচ্চাটার সুমধুর প্রশ্নটার উত্তর দিলাম ওরই মতো ছোট্ট করে।
“বাঘ হেঁটে গেলে থাবার ছাপ পড়ে নরম মাটিতে। ওটাকেই পাগমার্ক বলে।”
“পাগমার্ক দেখে কি বোঝা যায় পুরুষ না স্ত্রী বাঘ?”, বয়স্ক মানুষটি প্রশ্নটা আলতো করে ছুঁড়ে দিলেন।
“নিশ্চয়ই... শুধু বাঘ কেন, চিতাবাঘেরও বোঝা যায়। জিম করবেট পড়লে জানা যায়।”
“ঋজুদা কাহিনীতেও ব্যাপারটা সুন্দর করে তুলে ধরেছেন বুদ্ধদেব গুহ”, চৈতালি বললো।
“উনি নিজে তো একজন ভাল শিকারী ছিলেন”, বললাম।
“সত্যিই ভাল শিকারী আবার চমৎকার শিকারকাহিনীর লেখক। এই শিকার ব্যাপারটাই উঠে গেল। তাই শিকারকাহিনীও গেল হারিয়ে”, একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো চৈতালির।
“হুঁ! বুদ্ধদেববাবু যেভাবে জঙ্গলকে দেখেছেন, বাংলাসাহিত্যে আর কোনো সাহিত্যিক দেখেননি। বা বলা ভাল, দেখলেও লেখেননি। লেখার চেষ্টা করেও দেখেননি। অবশ্য আমি আর কতটুকুই পড়েছি!”
“আপনি তো বাংলা সাহিত্যের বেশ খোঁজ রাখেন”, চৈতালি বললো।
কথাটায় শ্লেষের গন্ধ আছে যেন! সাড়া দিলাম না। ও তাহলে আমাকে চিনতে পারেনি।এখনও আপনি বলছে। নাকি সবার সামনে পরিচিতির প্রমাণ রাখতে চায়না!
কে জানে! নারী চরিত্র চেনা-বোঝা ঈশ্বরের অসাধ্য। আর এই নারীকে তো দেখলামই কুড়ি বছর পর। কতকিছুই তো অজানা রয়ে গেছে।
সুযোগ হবে কি জানার! অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।
“হাতি...হাতি...”
চৈতালির কথায় পেছন ফিরে দেখি ডানদিকের পথটায় দাঁড়িয়ে গাছের ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ছে বিশালাকায় মদ্দাটা।
“আগে বাড়িয়ে”... ড্রাইভারকে চাপাস্বরে নির্দেশ দিলাম, “রৌডি রঙ্গা”... ফিসফিসিয়ে বললাম।
“মানে?”... চৈতালি আমার দিকে ফিরে তাকালো।
তখনই চার চোখের মিলন হলো। চৈতালির দুচোখে কেমন যেন অবিশ্বাস আর অবাক হওয়ার মিশ্র অনুভূতি খেলে গেলো চকিতেই।
“আপনারা লাকি। এ ফরেস্টের সবচেয়ে বড় মদ্দা হাতিটার সাথে দেখা হলো। ওর নাম রৌডি রঙ্গা।”
চৈতালি মৃদু হাসলো... “হাতিদেরও নাম হয়?”
“কেন হবে না! তবে সবার নয়। যারা ফেমাস, তাদের।”
“কোন দিক থেকে ফেমাস... ভালো না খারাপ?”
চৈতালির প্রশ্নের উত্তরে বললাম, “মানুষের ক্ষতি করলে তাকে কি ভালো বলা যায়? জঙ্গলে কাঠ কাটতে এসে যদি কেউ হাতির পায়ে থেঁতলে যায় বা বাঘের দাঁতে ছিন্নভিন্ন হয় কেউ, দোষী কে বলুন তো? মানুষটা না জঙ্গলী প্রাণীগুলো!”।
ছয়
রৌডি রঙ্গার আজ বোধহয় মুড ঠিক নেই। গাছ ছেড়ে দু’পা এগিয়ে এলো। শুঁড়টা তুললো।
“এবার আমাদের পালাতে হবে...” জিপসিটা ব্যাক করতে আরম্ভ করলো গাইডের নির্দেশে।রৌডি রঙ্গা এগিয়ে আসছে। পর্যটকরা খানিকটা ভীত। মারাঠি যুবকটি বিরক্তি প্রকাশ করলো জিপসিটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। জিপসিটা দুটো রাস্তার সন্ধিস্থলে এসে মুখ ঘুরিয়ে রওনা দিল।পেছনে পড়ে রইলো রৌডি রঙ্গা।
“হাতিটা কিন্তু আমিই দেখিয়েছিলাম”... চৈতালি হেসে বললো।
“থ্যাঙ্ক য়্যু,ম্যাম”... হ্যাটটা খুলে ফেলে বো করলো গাইড। আর তখনই চৈতালির বুকের ভেতর একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। একটা শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেল সারা শরীরে।
“নিসর্গ!”... অস্ফুটে অজানিতে বেরিয়ে এলো হাঁ হয়ে যাওয়া ওষ্ঠ-অধর ছুঁয়ে। জিপসিটা এগিয়ে চললো লালচে সাদা পথ বেয়ে গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যে। মনের চেতনা থেকে অবচেতন স্তরে ডুবে যেতে থাকলো চৈতালি। সেই ক’টি মাসের ফেলে আসা স্মৃতির শুঁড়িপথ বেয়ে হাঁটতে লাগলো সে। সেই ঝকঝকে চেহারার ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটার আজ এ কী পরিণতি! গোটা কলেজের মধ্যে একমাত্র ফার্স্টক্লাস পেয়েও যে নিজের রেজাল্টকে তাচ্ছিল্য করতে পারে সে তো সাধারণ নয়। অসাধারণ মনে হয়েছিল সেদিন। সেই প্রথম দেখা। আশ্চর্য! তিন তিনটে বছর কলেজে কাটলো,অথচ কোনোদিন দেখা হলো না! তবে এটা খুব একটা আশ্চর্য ঠেকেনি। কোথায় ইংরেজী বিভাগ আর কোথায় অঙ্ক!খোঁজ লাগিয়েছিল। ক্লাসমেট সুগত সন্ধান দিয়েছিল। ফোন করতে নম্বরও দিয়েছিল।সুগত সাবধান করে দিয়েছিল। বলেছিল নিসর্গের প্রথম প্রেমে ব্যর্থতায় জীবনটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার কথাও। “ওকে আর যন্ত্রণা দিস না যেন, চৈতালি...” ‘আগে তো রিলেশান হোক। তারপর দেখা যাবে--’, ভেবেছিল ও।তারপর রিলেশান হলো। দ্রুত। তারপর... “ঐ দেখুন.. একটা গ্রে জাঙ্গল ফাউল -”নিসর্গের চাপাগলার কথায় ভাবনার ঘোর কেটে বাস্তবে ফিরলো চৈতালি। ডানদিকের বড় ঝোপটার ফাঁকে আশ্চর্যসুন্দর একটা বেশ বড় পাখি। বনমোরগ তাহলে এটাই! ও এতদিন ভাবতো বনে ছেড়ে দেওয়া মোরগই বংশ পরম্পরায় একদিন বনমোরগ হয়ে
অলীক ভাবনা। “ছেলে-মেয়ের তফাৎটা বোঝে কি করে, জানেন?”, নিসর্গের প্রশ্নটায় ঘাড় নেড়ে বলে চৈতালি।
“এতো সোজা। মাথার ঝুঁটি দিয়ে...পুরুষের থাকে।”
“মেয়েদের ওথাকে, ছোটো... তবে আসল তফাৎ পায়ের রঙে... ছেলেদের পা লাল ... মেয়েদের হলুদ...”
“ওটা মোরগ...”, চৈতালি বলে। মোরগটা হঠাৎ কক্কর-কোঁক আওয়াজ তুলে খানিকটা দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। জিপসিটা চলতে শুরু করলো। একটা খয়ের গাছের কাছে এসে থেমে গেল।
সাত
থামলো আমারই ইঙ্গিতে।
“বাংলায় যেমন শিরিষ, এখানে তেমনি খয়ের। পানে দেওয়া হয় মুখ লাল করার জন্যে।”
“খুব বিশ্রী ব্যাপার।খাওয়ার সময় পিচিক পিচিক করে থুথু ফেলা আর খাওয়ার পর বহুসময় ধরে মুখ লাল করে রাখা”, চৈতালি বললো।
“পান খাওয়ার মজাই তো ওটা”, বয়স্ক জেঠু হেসে বললেন।
“যেটা বলছিলাম, গাছের কোন অংশটা খয়ের হিসেবে পান-রসিকদের মুখ রাঙা করে তোলে,জানেন জেঠু?” প্রশ্ন করলাম। জেঠু ঘাড় নাড়লেন।
“গাছটার ছালে কেমন কাটা দাগ লক্ষ্য করেছেন কি? প্রথমে গাছটার ওপরের ছাল কেটে ফেলা হয়।তারপর ভেতরের নরম লেয়ারটাও... তারপর চীরে দেওয়া হয়...”
“রক্ত...গাছটার শরীর কেমন ভেজা ভেজা...”, জেঠিমা বললেন।
“একদম তাই।খয়েরগাছের রক্তই রাঙাবাবুদের ওষ্ঠকে রাঙিয়ে তোলে।”,বললাম আমি।
“হাউ ক্রুয়েল !!”.মারাঠা যুবকটি বললো। ওর নাম বিনোদ।বিনোদ খেড়েকার।
“হিউম্যান বিয়িং ইজ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস অ্যানিম্যাল,স্যার...”, জেঠু বললেন।
“কোয়েলের কাছে’ পড়েননি! খয়ের কেমন করে তৈরী করে উপন্যাসের নায়ক লালসাহেব নিজের চোখে দেখে লিখেছেন।”
“আবারও বুদ্ধদেব গুহ! আপনি বুঝি ওনার ভক্ত?”
চৈতালির কথায় চুপ করে থাকি। তখনই শুনতে পাই হুপ-হুপ মৃদু আওয়াজ। শরতের শান্ত সকালে একটানা ডেকে চলেছে নিজের মনে। আঙুল তুলে দেখালাম। রোজউড গাছটার একটা শাখায় বসে থাকা ঝুঁটিবাঁধা পাখিটাকে। লম্বা ঠোঁটদুটি ফাঁক করে সে ডেকেই চলেছে তার প্রিয়তমকে।
“চেনেন?”
“কাঠঠোকরা তো নয়, এটা নিশ্চিত।”
“ইংরেজি নাম hopie; তবে বাংলায় খুব সুন্দর একটা নাম আছে ওর...”, চৈতালির দুচোখে জিজ্ঞাসা।
“মোহনচূড়া। বনফুলের দেওয়া নাম।”
“খুব সুন্দর নাম। তেমন সুন্দর চেহারা...”, চৈতালি বললো।
“সাহিত্যিকরা না থাকলে কত গাছ, কত পাখি অনামা থেকে যেত, তাই না! দাঁতভাঙা ল্যাটিন বা কঠিন ইংরেজি নামেই চিনতে হতো তাকে।”
“তুমি তো খুব সুন্দর করে ভাবো?”...জেঠিমা বললেন... “তোমার বাড়ি কোথায়? কে কে আছেন বাড়িতে? বিয়ে করেছো?”একটানা অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেললেন জেঠিমা।
“পশ্চিমবাংলাতে বাড়ি আমার, মানে ছিল। কেউ নেই। মানে মা-বাবার কথা বলছি। আর বিয়ে করার সময়ই করে উঠতে পারিনি এখনও...” কথাগুলো বলেই চৈতালির দিকে তাকালাম। ও চোখ নামিয়ে নিল। ঝিরঝির ঝরঝর করে একটা ঝোরা বয়ে যাচ্ছে আঁকাবাঁকা সাপের মতো। মন্থরগতিতে।
জিপসিটা অলস ঝোরাটায় নেমে পড়ল। আঁচলা ভরে জল ছিটিয়ে দিল যেন বন্য কিশোরী ঝোরাটা।ভিজে গেল আমার চৈতালি এই অবেলার শরতে।
আট
একটা বাইসন দাঁড়িয়েছিল। ফেরার পথে।যেন বিদায়ী বন্ধু সেজে। দুপায়ে সাদা মোজা পড়ে।
বেশকিছু পাখী দেখাতে পারলেও বাঘ দেখাতে পারেনি গাইড। আসলে কোনোকিছু কি দেখানো যায়! ঈশ্বরের সৃষ্ট এই অরণ্যে একমাত্র তিনি চাইলেই দেখাতে পারেন তাঁর সৃষ্টিদের। আবার বিজ্ঞান মানলে বেশ কিছু ফ্যাক্টর আছে প্রাণীদের দেখা পাওয়া-না পাওয়ার মাঝে।
সময় ফুরিয়ে গেল। আনন্দের মাঝে বাঘ-না-দেখার আক্ষেপ বুকের মাঝে চেপে ওরা নেমে এলো একে একে।
“আপনারা কোথায় উঠেছেন?” নিসর্গ জানতে চাইলো।
“একটু ভেতরের দুটো কটেজে”... চৈতালি বললো... “বনরঞ্জিনী আর বনশ্রী, আমি বনশ্রীতে।”
“ও... আজ বিকেলে সাফারি বুক করা আছে?”
“হ্যাঁ...”
“আমাকে বুকিং রিসিপ্টটা দিন। আমার সাথে ঘুরতে আপত্তি নেই তো?”
“এমা! তা কেন হবে?”
চৈতালি কাগজটা বের করে দেয়। সময়ে কাউন্টারে পৌঁছে যাবার কথা দিয়ে ওরা ফিরে চলে।
চৈতালির মনটা আজ বড় উদাস হয়ে আছে। শরতের নীল আকাশে পুঞ্জীভূত ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ। পিউকাঁহা পাখীটা একটানা ডেকেই চলেছে। এই পাখীটার নাম ব্রেইনফিভার কেন যে রাখা হয়েছে এবার বোঝা গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আনমনা চলতে চলতে একটা বড় সাইজের সাদা শুয়োরের গায়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। ঘোঁৎ শব্দটা শুনে লাফিয়ে সরে এলো চৈতালি। বরাহনন্দনরা গর্ত থেকে মুখ বার করে কুতকুতে চোখে দেখছে।
জায়গাটা দ্রুত পার হয়ে কটেজের সামনে পৌঁছালো ওরা। জেঠু - জেঠিমাকে বনরঞ্জিনী কটেজে পৌঁছে ও বনশ্রীর দরজা খুলে শরীরটা এলিয়ে দিল খাটে। পিউকাঁহা পাখীটার সাথে ময়না ডেকে যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। ডানদিকের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একদল চিতল হরিণ। মুখ নীচু ক’রে একমনে ঘাস খাচ্ছে। সব দৃশ্য-শব্দকে ছাড়িয়ে মনে ভিড় জমাচ্ছে একটা নাম -- নিসর্গ। নিসর্গ বোস। সুগতর কথামত ফোনটা করেছিল নিসর্গই। ফোনেই আলাপ। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড।কলেজেরই আশেপাশে কোথাও দেখা করবে ওরা। একটা লজ্জামেশানো ভয় বুকের ভেতর চেপে রেখে পরদিন হাজির হয়েছিল নির্দিষ্ট স্থানে। ব্যর্থ প্রথম প্রেমের ক্ষতে প্রলেপ দিতে আর একটা প্রেম খুব প্রয়োজন ছিল ওর। তবে ছেলেটিকে যাচাই করারও প্রয়োজন ছিল সেদিন। তারপর থেকে সময়টা দ্রুত বয়ে গেল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে ফর্ম তোলা, জমা দেওয়া... একসাথে সারার ফাঁকে লাগাতার গল্প। এরপর কাউন্সেলিং... অথচ আশার প্রদীপটা জ্বলতে না জ্বলতেই নিভে গেল। নিসর্গ বর্ধমানে চান্স পেল আর ও পেল না। পেল পুরুলিয়ার কলেজে। নতুন মাস্টার্স খুলেছে ওখানে। একই ক্যাম্পাসে পড়া ওদের হলো না। কত স্বপ্ন দেখেছিল ওরা। নাহ্... কী হবে এসব ভেবে! ধুলোমাখা শরীরটাকে শীতল করতে চানঘরে প্রবেশ করলো চৈতালি। স্মৃতিতেও কতবছরের ধুলো জমেছিল। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ধুলো সরে গিয়ে কত কি লেখা বেরিয়ে পড়ছে। নিজেরই অজানিতে!
নয়
“এখানে সন্ধ্যা আসে না,সন্ধ্যা নামে”... চৈতালির চোখে চেয়ে বললাম।
সাফারির মাঝামাঝি,অনেকখানি ভেতরে চ’লে এসেছি। সকালের উল্টোদিকের বিটে। একটু আগেই একটা কোটরা হরিণ একনাগাড়ে ‘ব্বাক-ব্বাক..’ডেকে ক্লান্ত হয়ে গেছে।পড়ন্তবেলার পর্ণমোচী অরণ্য বড় বেশি শান্ত, নিস্তব্ধ।
“বাঃ! সুন্দর বললেন তো... সন্ধ্যা নামে। পাখির ডানায় ভর দিয়ে বুঝি!”... চৈতালি বললো।
“হ্যাঁ, তাই তো। ঐ যে ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগলটা রোদ মেখে নেমে এলো, ওরই দুডানায় ভর করে সন্ধ্যাও নেমে আসবে ঝুপ করে। অরণ্যে এমনই হয়। আচম্বিতে। অরণ্যের বৈশিষ্ট্যই এমন।”
হঠাৎই কোটরাটা আবার ডেকে উঠলো। আর একইসাথে বাঁদিকের পুটুসঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো প্রিন্স। হেলতে দুলতে। চৈতালির চোখে ভয়। আমি ইশারায় আশ্বাস দিলাম।প্রিন্স মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। জিপসি দাঁড়িয়ে গেছে। ফটাফট ছবি উঠছে ক্যামেরায়, মোবাইলে। একএকটা মুহূর্তকে মনে হচ্ছে অনন্ত। আমাদের জিপসি ছাড়া আর কোনো জিপসি এদিকটায় আসেনি। ফেরার সময় হয়ে আসছে। জিপসিকে ব্যাক করতে বলবো ভাবছি, হঠাৎ প্রিন্স ডেকে উঠলো। টুরিস্টরা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। প্রিন্সের নজর আমাদের ডানদিকে গাছের ডালে। একটা চন্দন গাছের ডালে চার-পা ঝুলিয়ে বসে একটা চিতা। দ্রুত ক্যামেরা আর মোবাইল ঘুরে গেল।কয়েক মুহূর্ত... এবার ফেরার পালা।
.......................................
চৈতালিকে অপেক্ষা করতে বলেছি। জেঠু-জেঠিমা কটেজে ফিরে গেছেন। ও আমার অপেক্ষায়। ওকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। এই পাতাঝরা অরণ্যে... এই শরতের ফুরিয়ে যাওয়া কিচিরমিচির শেষ বিকেলে... ঝাঁকবাঁধা পাখী আর দলবাঁধা চিতলহরিণদের মাঝে... একলা হয়ে যাওয়া আমার কিছু বলার আছে ... চৈতালিকে।
দশ
“ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে --
সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরে বিজন ছায়ায় আহা কি শীতল স্পর্শ হৃদয়-ললাটে, আহা, চন্দন, চন্দন
দৃষ্টিতে কী শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন
আমি বসে থাকবো দীর্ঘ নিরালায়!”
বনশ্রী কটেজের বারান্দায় দুটো চেয়ার পাতা। মুখোমুখি বসে চৈতালি - নিসর্গ। অষ্টমীর অর্ধেক চাঁদ পর্ণমোচী গাছগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে ঢেলে দিচ্ছে ফিনফিনে জোছনা।
আবৃত্তি করে চলেছে নিসর্গ...
“তবুও জীবন জ্বলে,সমস্ত অরণ্য - দেশ জ্বলে ওঠে অশোক আগুনে
আমি চলে যাই দূরে, হরিণের ত্রস্ত পায়ে, বনে বনান্তরে অন্বেষণে...”
“চাকরীটা করলে না কেন, নিসর্গ? কেমন বর্ধমানের একটা স্কুলে পড়াতে”, চৈতালির কণ্ঠে অনুযোগের সুর।
“ভালো লাগলো না...”
“কেন ভালো লাগলো না?”
“তোমার জন্য... তোমাকে তো জানালাম চাকরী পাবার কথা। তারপরেও তুমি সাড়া দিলে না। নীরব রইলে ফোনের পাশে মাকে নিয়ে বসে। কথা বলার স্বাধীনতা নেই।”
“আমার তখন স্বাধীনতা ছিল না। কেন বোঝোনি তুমি? আমার দরকার ছিল একটা চাকরী।আর আমি সেটা পেয়েও গেলাম। কিন্তু ততদিনে কোথায় তুমি আর কোথায় আমি!”
চৈতালি থামলো।
“জানো, অনেক খুঁজেছি তোমায়... সুগতও তোমার খোঁজ রাখতো না...”, চৈতালি বললো।
“তখন ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছিলাম, তখন তো আর মোবাইলে যুগ নয়। তখন দূরত্ব দূরই হতো”, নিসর্গ ঈষৎ থামলো, “তারপর কোথায় তুমি এ প্রশ্নটা মনে জেগেছে বহুবার।কিন্তু গ্রামে ফিরেও খোঁজ পাইনি। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। পরিচিতদের মধ্যে।অবশ্য ক’বারই বা ফেরার সুযোগ হলো। বাবা-মা যদ্দিন ছিল, একটা কারণ ছিল ফেরার।একদিন তাও ফুরালো...” চৈতালি নিসর্গের কাঁধে ডানহাত রাখলো। এতদিন পরেও একটা শিহরণ বয়ে গেলো নিসর্গের শরীরে। ও বাঁহাতের করতলে চেপে ধরলো চৈতালির করতল।
“...এতকাল ডাকোনি আমায়,
কাঙালের মতো আমি এত একা,
তোমার কি মায়া হয়নি,
শোনোনি আমার দীর্ঘশ্বাস?
হৃদয় উন্মুক্ত ছিল,তবুও হৃদয় ভরা এমন প্রবাস!...”
নিসর্গ আবৃত্তি করে চলে...
“নিসর্গ...”, চৈতালি ফিসফিস করে ডাকে।
“বলো...চৈতালি...”
“আর কি ফেরা যায় না...?”
“কার?”
“আমাদের...?”
“গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয়না--
শুকনো পাতার ভাঙা নিঃশ্বাসের মতো শব্দ
তলতা বাঁশের ছায়া,শালের বল্লরী
সরু পথ...”
নিসর্গ আবৃত্তি করে চলে। “তবে আমায় সঙ্গী করো, নিসর্গ...”, গাঢ়স্বরে চৈতালি বলে।
আধখানা চাঁদ মিঠে গলিত জোছনায় ভিজিয়ে দিচ্ছে সেগুনবন। শিশিরমাখা হাওয়া বয়ে আনছে চন্দনের সুবাস। নিসর্গের বুকে চৈতালির মাথা।একরাশ ঝাঁকড়াচুলের পরশ গলায়।
“এতদিন পর...কুড়িবছর? সবই তো শেষ হয়ে গেলো, চৈতালি!”
“কিচ্ছু শেষ হয়নি, নিসর্গ। আমরা শেষ থেকে শুরু করবো, দেখো...”
“কিন্তু...”
“কিসের কিন্তু, নিসর্গ? তোমার কি আমায় নিয়ে কোনো কিন্তু আছে! আমার সম্পর্কে সবই বলবো।”
“তোমার অতীত নিয়ে আমি উৎসুক নই... আমি ভাবছি আমায় নিয়ে... একজন সামান্য গাইড... তুমি ইস্কুলের দিদিমণি...”
“তুমি কি আর গাইড থাকবে চিরকাল! এই বনজঙ্গলে তো হলো অনেকগুলো বছর। এবার তুমি আমার গাইড হবে... ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড...”, আপ্লুতস্বরে বললো চৈতালি।
“আর উপার্জন? একজন উপার্জনহীন ব্যক্তি হয়ে বাঁচবো কি করে!”, কণ্ঠস্বরে অসহায়তা প্রকাশ পেল নিসর্গের।
“খুব দরকার হলে লিখবে। তোমার অভিজ্ঞতা। জঙ্গলের কথা।...কি যাবেনা আমার সাথে?
‘এবার তোমার কাছে... এ অন্য অরণ্য আমি চিনে গেছি এক মুহূর্তেই সর্ব অঙ্গে শিহরণ,ক্ষণিক ললাট ছুঁয়ে উপহার দাও সেই অলৌকিক ক্ষণ...’
এবার আমার কথা শোনো... আমার বিয়ে হয়েছিল... কিন্তু সে বিয়েটা ছিল একটা বিয়ে বিয়ে খেলা... মানে আমার স্বামী উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার হলেও বিছানায় ছিল অপদার্থ... নপুংসক... তাই আজও আমি অনাঘ্রাতা... তবু আমাকেই পেতে হলো দোষ। সন্তান দিতে না পারার পাঁচ বছরের দাঁতে-দাঁতঘষা দাম্পত্যজীবন শেষ হলো... শুরু হলো দুবছরের রিহ্যাব জীবন...”
“তারপর?”
“তারপর আর কি? দিদিমণি হয়ে আগরতলার একটা প্রাইভেট স্কুলে... চলছে একাকীত্বের পরীক্ষা।”
..........................
এগারো
“মনে আছে শেষবার সম্পর্কচ্ছেদ ঘটানোর সময় কি বলেছিলে?”, আমার প্রশ্নের উত্তরে শুধু ঘাড় নাড়ে চৈতালি।
“বলেছিলে,আমাদের মধ্যে কি এমন হয়েছে যে আমরা সম্পর্কটা ছিন্ন করতে পারবো না? ...বললাম ...“ আচ্ছা বলতো কিসের জোরে আমরা আজ আবার, ভেঙে যাওয়া সম্পর্কটাকে জোড়া লাগাচ্ছি? কি সেই আঠা?”
“এক অদৃশ্য শক্তি, বিশ্বাস করো, শুধু আমাকে টেনেছে তোমার পানে। রিহ্যাবের দিনগুলোয় ঘুমের ঘোরে... জাগরণে তোমার মুখ মনে পড়তো। মনে হতো তোমায় ঠকিয়েছি বলেই, তোমার জীবনকে তছনছ করেছি বলেই, আমার জীবনটাও শেষ হয়ে গেল।’’
চৈতালির দুচোখ ভেসে যাচ্ছে। ডিনারের পর ডাইনিং থেকে ওকে বনশ্রীতে পৌঁছে দিতে এসে ওর ঘরে খাটে বসে আছি। দরজা বন্ধ। এটাই জঙ্গলের নিয়ম। রাত ন’টার পর দরজা খুলে রাখা যাবে না। আমাকেও ফিরতে হবে। সাইকেলটা রাখা আছে কটেজের পেছনে। পাহারাদারদের টর্চের জোরালো আলো ঘুরছে চকিতে। বন্যপ্রাণ আর চোরাশিকারীদের আনাগোনা পর্যবেক্ষণে এই ব্যবস্থা।
“আমাকে এবার যেতে হবে...”, কোনোক্রমে বললাম আমি।
“নাহ্ তুমি যাবে না...”।
আবদারের সুরটা কুড়িবছর আগের এক পড়ন্ত বিকেলের স্মৃতি মনে পড়িয়ে দিল। বাড়ি ফেরতা বাসটা তখন আমার স্টপেজে থামবে। হাত জড়িয়ে ধরে চৈতালি বলেছিল ঠিক এই কথাটাই। ওর বাড়ি ছিল বেশ কিছুটা পরের গ্রাম। রাখতে পারিনি সেদিন ওর কথা। আজ কি পারবো?
“কিন্তু, আমাদের মধ্যে কি এমন সম্পর্ক যে আজ থেকে-যাবো একঘরে, একই ছাতের নীচে ?’ আমার এই কথাগুলো শুনে জানালা দিয়ে এলিয়ে পড়া বনজোছনা মেখে চৈতালি আমার হাতে হাত রাখলো।
অস্ফুটে বললো,“আজ আমাদের গান্ধর্ব মতে বিয়ে হবে... এই বনজোছনাকে, এই আদিম অরণ্যকে সাক্ষী রেখে...বন্দীপুরে বন্দী হবো আমরা। বাকি জীবনের জন্যে।” আর কথা বলতে পারলাম না। চৈতালির উত্তপ্ত অধর ক্রমে গ্রাস করছে আমায়... আমিও... চাঁদ ক্রমে ঢলে পড়ছে। সারা বনের গায়ে রাতের নিবিড় গন্ধ। ঘুমঘুম। কেউ ঘুমাবে। নিশাচর পশুপাখীরা জাগবে। আমরাও জেগে থাকবো। একটা নতুন ভোর হবে। লাল টুকটুকে সূর্যটা উঠবে। বিজয়া দশমী আসবে। আমার জীবনে এই বিজয়া দশমী বিসর্জনের বার্তা নিয়ে আসবে না... আনবে আবাহনের সন্দেশ।
প্রবন্ধ
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কতোটা কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে হার্বাল মেডিসিন?
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী
কলকাতা
লেখক পরিচিতিঃডঃ শুভময় ব্যানার্জী দিল্লি-র অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি-তে ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজি বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন। উনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্সার বায়োলজিতে পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া-র স্কুল অফ মেডিসিন-এ এবং সিটি অফ হোপ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট-এ (ক্যালিফর্নিয়া) ভাইরাল অনকোলজি বিষয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেন। সম্প্রতি লেখক অধ্যাপনা, লেখালিখি, ক্যান্সার গবেষণা ও সচেতনতা প্রসারের কাজে যুক্ত।
"নভেল করোনাভাইরাস" আর "কোভিড-১৯" শব্দদুটি এখন বিশ্বের মানুষের কাছে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক ভাইরাস, তার মারাত্মক সংক্রমণের কাছে পৃথিবীর সর্বোত্তম ক্ষমতা ও বুদ্ধির অধিকারী মানুষ আজ অসহায়!
কোভিড-১৯ অতিমারী চলাকালীন আমরা একটি নির্মম সত্য উপলব্ধি করেছি যে অত্যাধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহচর্য সত্ত্বেও এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করতে আমাদের ভরসা কেবল উপযুক্ত ভ্যাকসিন এবং হাতে গোনা কিছু সিনথেটিক অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ। কিন্তু, বাস্তবে অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ প্রয়োগে কোভিড-১৯ রোগীর শরীরে কমবেশী ক্ষতিকারক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এছাড়াও সম্প্রতি আবিষ্কৃত অ্যান্টিভাইরালগুলি কতোটা নিরাপদ ও কার্যকরী তা নিয়েও বহু সন্দেহের অবকাশ আছে। অগত্যা, কঠোর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর সাধারণ স্বাস্থ্যসচেতনতা মেনে চলা ছাড়া কোভিড-১৯ প্রতিরোধের আপাতত দ্বিতীয় কোন সুনির্দিষ্ট পন্থা নেই। এই পরিস্থিতিতে ভীষণভাবে কার্যকরী হতে পারে ঐতিহ্যবাহী হার্বাল মেডিসিন (Traditional Harbal Medicine)।
হার্বাল মেডিসিন কি এবং কেন?
ভারতে আয়ুর্বেদ, সিদ্ধা ও ইউনানী চিকিৎসায় হার্বাল মেডিসিনের বা ভেষজ ওষধির ব্যবহার সুপ্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন খ্রীষ্টের জন্মেরও ২৫০০ আগেই ভারতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার চর্চা ছিল। বস্তুত: আয়ুর্বেদ শব্দটির অর্থ হলো "আয়ুর্বিজ্ঞান" বা মানুষের জীবন কালকে প্রসারিত করার বিজ্ঞান। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন গ্রন্থে যেমন চরক ও সুশ্রুতসংহিতায় ভেষজ উদ্ভিদের মাধ্যমে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাপদ্ধতির সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। গবেষণায় পাওয়া যায়, প্রাচীন ভেষজ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী চরক, সুশ্রুত, ধন্বন্তরি ও নাগার্জুন সেই সময়ে "জাতিগত ওষধিবিদ্যা" বা এথনো-ফার্মাকোলজিতে সুপন্ডিত ছিলেন এবং বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদের গুনাগুণ ও প্রয়োগপদ্ধতি তাঁরা সুচিন্তিত ভাবে লিপিবদ্ধ করে যান। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় প্রায় ২০০০ এর বেশী ভেষজ উদ্ভিদের উল্লেখ আছে। আশ্চর্যের বিষয়, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ভারতে নয়, সারা পৃথিবীর ৭০-৮০% মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসায় হার্বাল মেডিসিনের ব্যবহার আছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশগুলিতে এবং শ্রীলঙ্কায় ভেষজ উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের বিপুল সমাহার দেখা যায়। শুধু ভারতেই ২০,০০০ এর বেশী প্রচলিত ও দুষ্প্রাপ্য ভেষজ উদ্ভিদ বা হার্ব পাওয়া যায় যার মধ্যে মাত্র ৭,৫০০টি উদ্ভিদপ্রজাতির হার্বাল মেডিসিনে ব্যবহৃত হয়।
বহু মানুষ হয়তো জানেন না, পৃথিবীতে বহুল প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতিগুলি যেমন- অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, হাকিমী, ইউনানী, ফোক এমনকি ট্রাইবাল মেডিসিনেও ভেষজ উদ্ভিদের নিয়মিত ব্যবহার আছে। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের প্রাণদায়ী ওষুধের মূল রাসায়নিক যৌগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেষজ উদ্ভিদ থেকে নেওয়া হয়। পৃথিবীতে উন্নতিপ্রাপ্ত ও উন্নতিশীল দেশগুলির চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর কথা ভেবে ১৯৭৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধের উপায় হিসাবে ভেষজ উদ্ভিদপ্রাপ্ত ওষুধের উপর গবেষণায় জোর দেয়। এমনকি বিভিন্ন হার্বাল মেডিসিনকে "প্রয়োজনীয় ওষুধের" (Essential Medicine) এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। শুরু হয় অসংক্রামক (Non-infectious) ও সংক্রামক (Infectious) রোগ প্রতিরোধে হার্বাল মেডিসিনের নতুন গবেষণা ও প্ৰয়োগ। পৃথিবীর সব দেশে হার্বাল মেডিসিন থেকে প্রাপ্ত যৌগ বা তার কাছাকাছি "সিনথেটিক অ্যানালগ" দিয়ে প্রয়োজনীয় ড্রাগ তৈরী হওয়া আরম্ভ হয়।
কেমিক্যাল অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের সীমাবদ্ধতা:
আমাদের সাধারণ জীবাণু সংক্রমণ (যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, আদ্যপ্রাণী এবং বহুকোষী পরজীবী প্রাণীরা) ও ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে প্রভেদটি সঠিক ভাবে জানা প্রয়োজন। কোষীয় জীবাণুর স্বতন্ত্র একটি সত্তা বর্তমান। দেহকোষের ভিতরে ও বাইরে সহজেই তাদের চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট ওষুধের মাধ্যমে (যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টিহেলমিন্থ ড্রাগ ইত্যাদি) তাদের ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু ভাইরাস দেহকোষের বাইরে এক নিষ্ক্রিয় বস্তু মাত্র। কেবল মাত্র সজীব কোষের মধ্যে ভাইরাস সক্রিয়। সে নিজের বংশবৃদ্ধির জন্যে কোষের যাবতীয় বিপাকতন্ত্রকে (Metabolic System) নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসে। সংক্রমণের সময়ে ভাইরাস দেহকোষের সাথে সংযুক্ত হয় ও কোষে প্রবেশ করে, কোষের ভিতর ভাইরাস তার জিনোমের প্রতিলিপিকরণ (Replication) করে প্রয়োজনীয় ভাইরাল প্রোটিন তৈরী করে। সংক্রমণের শেষ পর্যায়ে সে জিনোম ও প্রোটিন সমন্বিত একটি সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস বা "ভিরিওন" হিসাবে কোষ থেকে বার হয়ে যায়। এই হলো ভাইরাসের জীবনচক্র। ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে বিজ্ঞানীরা যে সমস্ত সিনথেটিক অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ব্যবহার করেন তাদের কোনোটি ভাইরাস ও দেহকোষের সংযুক্তিতে (Adsorption) বাধা দেয়, কোনোটি বা ভাইরাস কোষে প্রবেশের পর তার RNA বা DNA জিনোমকে সাইটোপ্লাজমে মুক্ত হতে (Uncoating) বাধা দেয়। কিছু "সিনথেটিক নিউক্লিওসাইড অ্যানালগ" (যা DNA গঠনকারী নিউক্লিওসাইডের মতো দেখতে) ভাইরাসের প্রতিলিপিকরণকে আটকে দেয়। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে যে সব কেমিক্যাল অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ বার হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, ডেক্সামেথাসোন, রেমসিডিভির, ফ্যাভিপিরাভির ইত্যাদি। কিন্তু এদের মধ্যে কোনোটিই সুনির্দিষ্ট ভাবে কোভিড-১৯ কে সারাতে পারে নি। উপরন্তু, এই অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগগুলি ভাইরাসকে প্রতিহত করতে গিয়ে দেহের সুস্থ কোষগুলিকেও ধ্বংস করতে থাকে। বহুক্ষেত্রে, এইসব অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের সার্বিক সাফল্যের হার ভীষণভাবে কম এবং এর প্ৰয়োগ সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যায়সাপেক্ষও বটে। আর সবচেয়ে
বড়ো অসুবিধা হলো করোনাভাইরাসগুলির দ্রুত মিউটেশনের ফলে তাদের জিনগত চরিত্রের ব্যাপক হারে পরিবর্তন ঘটে তাই পুরোনো অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ করোনা রোগীকে প্রয়োগ করলে কোন কাজ হয় না। সেই দিক দিয়ে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় হার্বাল মেডিসিনের প্ৰয়োগ অনেক বেশী বিস্তৃত ও নিরাপদ। উদ্ভিদের শরীরে মূলত বিপাকক্রিয়ায় উৎপন্ন প্রাথমিক ও পরবর্তী বিপাকজাত পদার্থ (Primary and secondary Metabolites) এবং রেচনক্রিয়ায় উৎপন্ন উপক্ষার (Alkaloides) থেকে বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক যৌগগুলি বিবিধ হার্বাল মেডিসিনের উৎস। রাসায়নিক তত্ত্বের বিচারে এগুলি পলিফেনল, টারপিনয়েড, ফ্লাভানল, ট্যানিন, অ্যান্থসায়ানিন ইত্যাদি জৈব-যৌগের শ্রেণীতে পড়ে। বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী এই উদ্ভিদজাত জৈব-রাসায়নিক পদার্থগুলি আমাদের শরীরে "ইমিউনো-মড্যুলেটর" (Immuno-modulator) হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ এই প্রকার বহু যৌগ ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের সঙ্গে দেহের ইমিউনিটিকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে। শুধু তাই নয়, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে হার্বাল মেডিসিনের কোন বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং জোরালো কোন কেমিক্যাল অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের সাথে হার্বাল মেডিসিনকে যৌথভাবে (Combinatorial Therapy) করোনা রোগীর শরীরে প্ৰয়োগ করা যায়। সেই ক্ষেত্রে কেমিক্যাল অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেকটা কমে গিয়ে রোগী সুস্থ বোধ করে। তাই বৈজ্ঞানিকরা হার্বাল মেডিসিনকে আবার "অনাক্রম্যতা প্রতিরোধক (Immune protective)" বলে উল্লেখ করেন।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধী প্রধান হার্বাল মেডিসিন:
সূর্যমুখী ফুলের সমগোত্রীয় Echinaceae (Asteraceae) বা ‘কোন ফ্লাওয়ার’ থেকে প্রাপ্ত ওষুধ করোনা ভাইরাসকে (HcoV, SARS CoV) দেহকোষের সাথে সংযুক্ত হতে বাধা দেয়। এই উদ্ভিদ একসাথে রাইনোভাইরাস, কক্সাকিভাইরাস, হারপেসভাইরাসের সংক্রমণকেও প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে। ইউক্যালিপটাস থেকে পাওয়া ইউক্যালিপটল তেল (Eucalyptol) নভেল করোনা ভাইরাস বা SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে কার্যকরী। ইউক্যালিপটাস থেকে জেনসিনোন (Jensenone) নামে আরো এক রাসায়নিক পাওয়া যায়, সেটিও কোভিড-১৯ প্রতিরোধী। বিজ্ঞানীরা আরো দেখেছেন, পালমেটাইন (Palmatine) ও চেলিডোনাইন (Chelidonine) দুটি উপক্ষার SARS-CoV-2 বিভাজন রোধ করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত Veronica linariifolia উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত এক প্রকার ফ্লাভানয়েড যৌগ- লিউটিওলিন (Luteolin) এবং Gallachinensis হার্ব থেকে পাওয়া পলিফেনল SARS-CoV-2 এর স্পাইক প্রোটিনের সাথে দেহকোষের সংযোগ নষ্ট করে সংক্রমণ প্রতিহত করে। আমরা প্রতিদিন যে চা (Camelia sinensis) খাই তার থেকে (মূলত ব্ল্যাক টি থেকে) পাওয়া যায় এপিগ্যালো-ক্যাটেচিন-গ্যালেট এবং ট্যানিক অ্যাসিড যেগুলি করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থামাতে খুব কার্যকরী।
হার্বাল মেডিসিন গবেষণা ও তার প্রয়োগঃ
উপরে বর্ণিত উদ্ভিদগুলি থেকে যে রাসায়নিক পাওয়া যায়, তাকে গবেষণাগারে বিশেষ ভাবে পরিশুদ্ধ করে “ইন-ভিট্রো” (ভাইরাস সংক্রমিত কোষগুলিকে কালচার করে) এবং “ইন-ভিভো” (অ্যানিম্যাল মডেলে রাসায়নিকগুলি প্রয়োগ করে) পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। হার্বাল মেডিসিনের রাসায়নিক গঠন নির্ধারণ করে ও অ্যান্টিভাইরাল কার্যকারিতা বিবেচনা করে তবেই সেগুলি পরবর্তী পর্যায়ে হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পাঠানো হয়। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সারা পৃথিবী জুড়ে ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে অ্যান্টিভাইরাল হার্বাল মেডিসিন গবেষণা। তবে, এই গবেষণার সাফল্যের হার প্রধানত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল তা হোল পরিবেশে ভেষজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য (Natural Diversity) ও গুনগত মান (Quality Standard) বজায় রাখা। পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে এবং দ্রুত নগরায়ন (Urbanization) এর ফলে ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, অতি মূল্যবান ভেষজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটের মুখে। বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global Warming) ফলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর প্রভাব ভেষজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও জীবনশৈলীকে ব্যাহত করছে। চিকিৎসকদের অভিমত, হার্বাল মেডিসিন গ্রহণে ইমিউনিটি বাড়ে এবং SARS-CoV-2 সংক্রমণজনিত শারীরিক প্রদাহ (Inflammation) কমে যায়। তাই বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্বে কোভিড-১৯ এর আক্রমণকে প্রতিহত করতে কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে সুচিন্তিত ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে হার্বাল মেডিসিন।
তথ্যসূত্রঃ
Panyod S, Ho CT, Sheen LY. Dietary therapy and herbal medicine for COVID-19 prevention: A review and perspective. J Tradit Complement Med. 2020;10(4):420-427. Published 2020 May 30. doi:10.1016/j.jtcme.2020.05.004
Ang L, Song E, Lee HW, Lee MS. Herbal Medicine for the Treatment of Coronavirus Disease 2019 (COVID-19): A Systematic Review and Meta-Analysis of Randomized Controlled Trials. J Clin Med. 2020;9(5):1583. Published 2020 May 23. doi:10.3390/jcm9051583
Lee BJ, Lee JA, Kim KI, Choi JY, Jung HJ. A consensus guideline of herbal medicine for coronavirus disease 2019. Integr Med Res. 2020;9(3):100470. doi:10.1016/j.imr.2020.100470
Lin LT, Hsu WC, Lin CC. Antiviral natural products and herbal medicines. J Tradit Complement Med. 2014;4(1):24-35. doi:10.4103/2225-4110.124335
Barati F, Pouresmaieli M, Ekrami E, Asghari S, Ziarani FR, Mamoudifard M. Potential Drugs and Remedies for the Treatment of COVID-19: a Critical Review. Biol Proced Online. 2020;22:15. Published 2020 Jul 23. doi:10.1186/s12575-020-00129-1
Rastogi S, Pandey DN, Singh RH. COVID-19 pandemic: A pragmatic plan for ayurveda intervention [published online ahead of print, 2020 Apr 23]. J Ayurveda Integr Med. 2020; S0975-9476(20)30019-X. doi:10.1016/j.jaim.2020.04.002
প্রবন্ধ
ফাইনাল
ম্যাচ
অভীক সাধু
কনকপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র সুমন পড়াশুনাতে আহামরি না হলেও খেলাধুলাতে দিব্বি ভালো। বিশেষ করে ফুটবলটা সে বেশ ভালো খেলে। পড়াশুনাতে সাদামাটা রেজাল্ট হবার একটা কারণ হলো স্কুলের বাইরে তার আলাদা করে কোনো প্রাইভেট টিউটর নেই। সুমন অবশ্য নিজেও তার জন্য আলাদা কোচিং আশা করে না। মামাবাড়িতে আশ্রিত হয়ে আর কতটুকুই বা আশা করা যায়! সুমন যে ছেলেবেলাতেই ওর বাবাকে হারিয়েছে।
সুমনের ঠাকুমার কাছে ওর মাই যেন ওনার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী! ওর মার জন্যই যেন সুমনের বাবা দুদিনের জ্বরে চলে গেছে অসময়ে। কথায় কথায় সুমনের ঠাকুমা তার মাকে মানসিক নির্যাতন করতো। তাই একরকম অনন্যোপায় হয়েই সুমনের মা সুমনকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি কনকপুরে চলে আসে। তাই সুমন মামাবাড়িতে ওর মায়ের সাথে থাকে।সুমনের বাবার পোস্ট অফিসে জমানো সামান্য কিছু টাকার এম.আই.এস তার মায়ের একমাত্র সম্বল। অবশ্য সে কটা টাকাও তার ঠাকুমা ছাড়তে চান নি। কিন্তু সুমনের কাকা তাঁর মাকে বোঝান যে ওই কটা টাকা তাঁর বিধবা বৌদিকে একটু হলেও সাহায্য করবে।
তার মামা বা মামী কেউই লোক খারাপ নয় কিন্তু তারা বড়োলোক নয়। মামা প্রাইমারি স্কুলের টিচার আর সামান্য কিছু জমিজমা আছে। সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে মামার এক ছেলে আর মেয়ের পড়ার খরচ করে সুমনের জন্য কি করেই বা তিনি আলাদা টিউটর রাখতে পারেন। সুমনের অবশ্য তা নিয়ে তেমন হেলদোল নেই। সে কিছুটা চুপচাপ - খালি ফুটবল খেলা বিশেষত মোহনবাগানের খেলা থাকলে সে একটু উৎসাহী হয়ে পড়ে। এদিকে সীমান্তের কাছের গ্রাম কনকপুরে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকই বেশি। তাই সুমনকে মাঝে মধ্যেই টিকা টিপ্পনি শুনতে হয়। এছাড়া সে মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে বসে বিদেশী ফুটবল লীগের খেলা দেখে।
কনকপুর আর নসিপুর - পাশাপাশি দুই গ্রামের মধ্যে সব ব্যাপারেই একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এরা দুর্গাপূজার উদ্বোধন টিভি সিরিয়ালের নায়িকা দিয়ে করলে ওরা খুঁজে পেতে নিয়ে আসে আরেকটা টিভি সিরিয়ালের নায়ককে। এরা কালীপুজোর মেলাতে সার্কাস করলে ওরা কলকাতার মাঝারি মানের যাত্রাদল নিয়ে এসে ভাইফোঁটার দিন যাত্রার আয়োজন করে। সব ব্যাপারেই ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতা চলে দুই গ্রামের মধ্যে! তবুও দুই প্রতিবেশী গ্রামের মধ্যে কোথায় যেন একটা পারস্পরিক সম্প্ৰীতিও আছে।
এর মধ্যে কয়েকবছর হলো কনকপুর আর তার চারপাশের কয়েকটা গ্রাম নিয়ে ব্লক থেকে ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এতে নাকি এলাকার মানুষজনের মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। কিন্তু ফুটবল প্রতিযোগিতা চালু হবার পর থেকে নসিপুর একটু অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছে। ওখানকার দুজন ছেলে বারীন আর সুদেব কলকাতার সেকেন্ড ডিভিশন লিগে খেলে। তাদের সাথে প্রাকটিস করে করে নসিপুর ফুটবল টিমটা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই শেষ দুবার যারাই ফাইনালে উঠুক তাদের নসিপুর খুব সহজেই হারিয়ে দিয়েছে।
এইবছর কনকপুর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফাইনালে উঠেছে। আর ওদিকে প্রত্যাশা মতোই নসিপুরও ফাইনালে উঠেছে। এটা অন্য কোনো কিছুতে হলে কনকপুরের উত্তেজনার পারদ হতো ঊর্ধ্বমুখী - কিন্তু এই বিষয়ে তারা চুপচাপই আছে। গ্রুপ লিগেই এবার কনকপুর নসিপুরের কাছে ২ গোলে হেরেছে। এগারোজন মিলে বক্সের সামনে ডিফেন্স করে পায়ের জঙ্গল তৈরী করাতে নসিপুর আর ব্যবধান বাড়াতে পারে নি। তাছাড়া সেদিন ডিপ ডিফেন্সে সুমনও ভারী চমৎকার খেলেছিলো! সে দুটো গোললাইন সেভ না করলে ব্যবধান আরো বাড়ে। শেষ খেলাতে ইসলামপুরকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে কনকপুর। বাকি দুটোতে কোনোক্রমে এক্সট্রা টাইমের গোলে জয় পেয়ে তারা উঠেছে। ওদিকে নসিপুর চারটে খেলাতে মোট দশ গোল দিয়েছে - আর এখনো পর্যন্ত একটা গোলও হজম করে নি।
সুতরাং নসিপুর ফাইনালে ক্লিয়ার ফেভারিট! নসিপুরের লোকেরা তো কনকপুরের লোকেদের দেখলেই বলে - তোরা পারলে রেফারির অনুমতি নিয়ে আরো দুতিন জনকে এক্সট্রা ডিফেন্সে নামিয়ে দে! দ্যাখ তাতে যদি আমাদের বারীন আর সুদেবকে আটকাতে পারিস! বলে কেউ কেউ গা জ্বালানো হাসি হাসতে থাকে। কনকপুরের লোকেরা চুপচাপ মুখ বুজে এসব টিপ্পনি সহ্য করে - আর কি করবে!
কনকপুর পঞ্চায়েত প্রধান রাঘববাবু কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন। উনি এবয়সেও খুব উৎসাহী ,যথেষ্ট পড়াশুনা করেন। উনি গ্রামের মাতব্বর আর খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা গোপন মিটিং ডাকলেন - "মিশন নসিপুর"। অসিত রাঘবকে বললেন, "দেখো রাঘব, আমাদের গ্রামের ছেলেরা চেষ্টা চরিত্তির করে যে ফাইনালে উঠেছে - সেটাই অনেক। ওদের দুটো ছেলে কলকাতার সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে। আরো একজন হয়তো এবার খেলবে। ওদের সঙ্গে আমাদের লোকাল ছেলেরা কিভাবে পারবে?" রাঘব বলে ওঠেন - "তাহলে খেলে দরকার কি?ওয়াকওভার দিয়ে দিলেই হয়!" প্রশান্ত তরুণ ছেলে, উৎসাহী। সে বলে ওঠে - " হারার আগে আমরা কখনো হারবো না - আমি রাঘবদার সাথে একমত। চেষ্টা করেই দেখা যাক না - খেলাতে অঘটন তো ঘটেই!" অনুতোষ বলে ওঠেন - "হ্যাঁ অঘটনের আশাতেই বসে আছি - যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে!" অনুতোষের কথাটা অনেকেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়তে থাকেন। মানববাবু এই টিমটার কোচিং করেন। চুপচাপ লোক, এককালে অফিস লিগে খেলেছেন। খেলা ভালোবাসেন |উনি বললেন - "খেলা মাঠে হয়, কাগজকলমে নয়! আপনারা এইটটিথ্রির ওয়ার্ল্ড কাপ জয়ের কথা ভুলে গেলেন? কে ভেবেছিলো যে বিশ্বসেরা লয়েডের টিমকে কপিলরা হারাতে পারবে? একশো তিরাশি করে অলআউট হবার পরে তো আরই নয়! তবু তারা হাল ছাড়ে নি -শেষ পর্যন্ত প্রবল পরাক্রান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন যদি কপিলরা আপনাদের মতো ভাবতো, তাহলে কি তারা লর্ডসে জিততে পারতো?"
এরকম কথা বার্তার মধ্যে মিটিং শেষ হলো - যদিও অধিকাংশ লোকই নসিপুরের বিরুদ্ধে কনকপুরের জয় আশা করেন না। রাঘব ছেলেদের বললেন রোজ মন দিয়ে প্রাকটিস কর তোরা। মানব রোজ ডিফেন্স আঁটোসাঁটো করার প্রাকটিস করান ছেলেদের নিয়ে। কিন্তু সুমন চিন্তাতে থাকে। সে ভাবে এইভাবে খালি ডিফেন্স করে নসিপুরের মতো প্রবল শক্তিশালী দলকে বেশিক্ষণ আটকানো যাবে না - একসময় না একসময় ডিফেন্স চাপের মুখে ভেঙে পড়তে বাধ্য। কিন্তু কোনো প্ল্যান তার মাথাতে আসে না!
মাঠের খানিক দূরে পোড়ো মন্দিরের পাশের জমিতে সাপখোপের ভয়ে দিনমানেই তেমন কেউ আসে না। বড়ো কিছু গাছ আর মাটিতে আগাছা বেড়ে উঠে জায়গাটা একটা ছোট জঙ্গল হয়ে গেছে; সুমনের কিন্তু এখানে আসতে খারাপ লাগে না। বেশ চুপচাপ বসে নানা কথা ভাবা যায়। কখনো মন খারাপ হলে সে এখানে এসে বসে থাকে। সেদিনও সে মজা পুকুরটার পাড়ে বসে ভাবছিলো যে কিভাবে নসিপুরের সাথে টক্কর দেয়া যায়। হঠাৎ একটা গলা খাঁকড়ানির শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে । সূর্যের আলো কমে এসেছে - আর এই জায়গাটা এতো ঝোপঝাড় যে ভালো করে মুখ দেখা যায় না। সুমন বলে "কে?" একটি লোক বলে ওঠে "নাম বললে কি চিনবে? আমরা এখানকার লোক নই, একটা কাজে এসেছি। সে যাক তুমি তো ফাইনাল ম্যাচের কথা ভাবছিলে - কি তাই না"? সুমন বলে - "কি করে বুঝলেন"? তখন আরেকজন লোক বললো (এর বাংলাটা একটু ভাঙা ভাঙা, ঠিক বাঙালিদের মতো নয়) - "আসলে কি হামরা খেলার মাঠের লোক আছি। এখন যদিও আর খেলি না। কিন্তু মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে তুমাদের প্রাকটিস দেখছিলাম। পালবাবুর তুমার খেলা দেখতে ভালো লাগছিলো। উনি নিজেও তো একসময় ফুটবল খেলতেন - আর ডিফেন্সে ভালোই খেলতেন"। সুমন বলে - "আর আপনি ? আপনি কি বাঙালি নন"? যাঁকে উনি পালবাবু বলে সম্বোধন করছিলেন তিনি এবার বললেন - "না। তাও তো এখন মেজর সাব আমাদের সাথে থেকে থেকে ভাঙা ভাঙা বাংলা শিখে গেছেন। উনি হকি খেলতেন। যাক সে কথা। তুমি ডিফেন্সে ভালো খেলেও বেশ কিছু ছোটোখাটো ভুল আমার চোখে ধরা পড়লো। ফাইনালে কিন্তু ছোট ভুলই বড়ো হয়ে দেখা দেবে। তাই মেজরকে নিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে এলাম।" এইবার সুমনের একটু বিরক্ত লাগলো। গত কয়েকদিন ধরে চেনা অচেনা লোকের কাছে জ্ঞান শুনতে শুনতে সে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়তো জীবনে ফুটবলে পাই দেননি - তবুও জ্ঞান দিতে কসুর করেন না! সুমন বললো - "হুম।" এবার পালবাবু একটু হেসে বললেন "আচ্ছা, তুমি আমার পাশ দিয়ে বল নিয়ে বেরোতে পারবে?" সুমন অবাক হয়ে গেলো। ও এতক্ষণ খেয়াল করেনি পালবাবুর হাতে একটা ফুটবল। পালবাবু সিঁড়ির উপর কিছুটা ফাঁকা জায়গাতে বলতে দুবার ড্রপ করে সুমনকে ডাকলেন। সুমন এমনিতেই বিরক্ত ছিল। সে পালবাবু আর মেজর দুজনকে দেখে ভাবলো যে তারা কলকাতা থেকে এসেছেন - কেননা দুজনেই হাফপ্যান্ট পড়েছেন। এ গ্রামের কোনো লোক সাধারণত এই বয়সে হাফপ্যান্ট পড়ে না।সুমন বিরক্তি সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো। পালবাবু বেশ বয়স্ক আর মেজরও তাই। সুমন বয়স্ক লোকেদের কথা পছন্দ না হলেও অসম্মান করতে শেখে নি! পালবাবু বলটাকে গড়িয়ে সুমনের দিকে দিলেন। বললেন -"ভাব আমি অপোনেন্টের খেলোয়াড় - স্ট্রাইকার। তুমি গোলের কাছে হঠাৎ বল পেয়েছো - একা। আমাকে কাটিয়ে এগোতে হবে। সুমন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু পালবাবুকে ক্রস করার সময় বিদ্যুৎগতিতে পালবাবু একটা ট্যাকল করেন। সুমন এই বয়সে ওনার ক্ষিপ্রতা দেখে অবাক হয়ে যায়! সে ছিটকে সরে যায় - বল পালবাবুর পায়ে। পালবাবু বলেন - "এবার তোমার পালা।" এই বলে তিনি বল নিয়ে ড্রিবল করে এগোতে থাকেন। সুমন আগে ওনার ট্যাকল আর এখন ড্রিবল করার ভঙ্গি দেখে বোঝে যে উনি এককালে খেলতেন - এবং ভালোই খেলতেন। সুমনের কাছে এসে পালবাবু অদ্ভুত ভাবে টার্ন করে বলটাকে তার বাঁপাশে ঠেলে আবার ক্ষিপ্রগতিতে ধরে নেন। এতো দ্রুত ঘটনাটা হলো যে সুমন বুঝতেই পারলো না। খালি দেখলো পালবাবু সহজে তাকে ক্রস করে গেলেন! সে দেখে মেজর মিটিমিটি হাসছেন। মেজর বলেন - "পালবাবুর কাছ থেকে বল কাড়া খালি তোমার না - খুব কম আদমির অওকাত আছে। এতে শরমের কিছু নাই! তুমি আমাদের চিনতে পারো নি, না?" সুমন হতভম্ব হয়ে বলে - "না আপনারা তো এখানকার নয়, চিনবো কি করে?" পালবাবু একটু ম্রিয়মান স্বরে বলেন - "মেজর জার্মানিতে থাকলেই ভালো করতে। ওখানে তো তোমার নামে রাস্তা পর্যন্ত বানাবে বলেছিলো?" মেজর বলে ওঠেন - "রেহনে দিজিয়ে ওহ সারে বাত! সেদিন মনসুরের সাথে আড্ডা হলো.. বললো যে এর পরে লোকে সুনীলকেই পহেচান করবে না! ক্রিকেটেরই যদি আইসা হাল, তো হামরা তো অনেক দূরের আদমি! হকি আজকাল কোন খেলে?" পালবাবু এবার সুমনের দিয়ে তাকিয়ে বললেন - "আসি।"
সুমন হঠাৎ বলে উঠলো - "আমাদের ম্যাচ তো চারদিন পর - রোববার। আপনারা কি কাল পরশু আছেন?" মেজর মাথা নাড়লেন - হ্যাঁ বাচক। সুমন ইতস্তত করে বললো - "পালজেঠু আপনি যদি আমাকে একটু গাইড করেন?" পালবাবু একটু হেসে বলেন - " দুতিন দিনে কতটুকুই বা হবে ? ঠিকাছে কাল পরশু এস এখানেই - এইসময়ে। আর ভালো কথা - আমাদের কথা কাউকে বলার দরকার নেই। লোকে বলবে তোমরা বাইরে থেকে সাহায্য নিচ্ছ!" সুমন বলে - "না, না - এটা আমাদের মধ্যে থাকবে!" পালবাবু নিচুস্বরে বললেন - "একজন মোহনবাগান যখন বিপদে পড়ে, আরেকজন মোহনবাগানী কি চুপ করে থাকতে পারে?" সুমন বলে "আমি এ মোহনবাগানকে সাপোর্ট করি সেটা আপনি জানলেন কি করে ?" মেজর তখন বলেন - "এক আদমি বলছিলো কি যে সুমন ভালো খেলে লেকিন এটিচুড নেই। যেমন মোহনবাগান কে সাপোর্টার তেমনি সোচ।" সুমন বলে -"লোকটাকে কিরকম দেখতে বলুন তো?" তখন পালবাবু গম্ভীর স্বরে বলে ওঠেন - "সুমন - খেলোয়াড়দের জবাব দেবার জায়গাটা মাঠে। তুমি এখন এস গিয়ে।" সুমন অবাক হয়ে চলে গেলো। পরের তিন দিনে সন্ধ্যে বেলাতে সুমন তার গোপন প্রাকটিস করে পালবাবুর সঙ্গে। কত ছোটোখাটো টেকনিক যে সে তার পালজেঠুর কাছে শেখে তার ইয়ত্তা নেই। সুমন বলে - "আপনি যদি আমাদের কোচিং দিতেন আমরা হয়তো অঘটন ঘটাতেও পারতাম।" পালবাবু বলেন - "অঘটন বলছো কেন? আক্রমণ করা যেমন খেলার অঙ্গ তেমনি ডিফেন্স করতে করতে হঠাৎ কাউন্টার আক্রমণ করে গোল করাও খেলারই অঙ্গ! নিজের আর অপোনেন্টের শক্তি আর দুর্বলতা ঘিরেই স্ট্র্যাটেজি সাজাতে হয়। মনে রেখো মাঠে ওরাও এগারো তোমরাও তাই।" সুমন বলে - "কিন্তু ওরা যে বেশ শক্তিশালী।" পালবাবু বলেন - " তুমি কি জানো ১৯১১ তে মোহনবাগান - গোরাদের হারিয়ে শিল্ড জিতেছিল প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে? তার আগে কেউ ভাবতেই পারতো না যে গোরাদের ফুটবলে হারানো যায়! তাও আবার এগারোজন ভারতীয় খেলোয়াড়। তার ওপর পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিং!" সুমন বলে - " কিন্তু আমি একা কতটা কি করবো?" পালবাবু বলেন - "মানছি এটা একার খেলা নয় - কিন্তু একজন লড়াকু খেলোয়াড় গোটা টিমের মনোভাব বদলে দিতে পারে। মেজরসাব আপনি বলুন না কেন - আপনি স্টিক ম্যাজিক দেখিয়ে কত ম্যাচ জিতিয়েছেন খালি ব্যক্তিগত স্কিলে!" মেজর বললেন - "আরে নেহি জি - হামারা টিমভি সলিড থা! উস ওয়াক্ত ইন্ডিয়া হকিকা বেতাজ বাদশা থা। আপ ম্যারাডোনাকা বাত লিজিয়ে।" যাইহোক এইভাবে খেলার দিন এসে গেলো।
টানটান উত্তেজনা। সুমন মনটা শান্ত করতে সেই মজা পুকুরের কাছে চলে এলো। কিছুক্ষণ বসে থেকে মাঠের পথে যেতে গিয়ে দেখে পালজেঠু আর মেজরসাব দাঁড়িয়ে আছেন। আজ পালজেঠু বহু পুরোনো একটা সবুজ মেরুন জার্সি পড়েছেন। হঠাৎ সুমন জিজ্ঞেস করেন - "আপনি মোহনবাগানে খেলতেন?" পালজেঠু অল্প হেসে মাথা নাড়ান। মেজরসাব তাড়া দিয়ে বলেন - "যা জলদি যা - খেল অভি স্টার্ট হোগা। বাদমে এসব বাতচিত করার অনেক টাইম মিলবে। অল দ্যা বেস্ট"।
মাঠে লোক ভেঙে পড়েছে। বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে নাসিপুরের আক্রমণ বন্যার জলের মতো আছড়ে পড়তে থাকে কনকপুরে ডিফেন্সে। কিন্তু আজ সুমন আজ অদম্য, চীনের প্রাচীরের মতো অটল। একের পর এক আক্রমণ দক্ষ ট্যাকলে প্রতিহত করতে থাকে সে।খেলাটা একসময় যেন সুমনের নেতৃত্বে কনকপুর ডিফেন্সের সাথে বারীন সুদেবের নেতৃত্বে নসিপুর এট্যাকের মধ্যে হতে থাকে। বল ঘুরতে থাকে কনকপুরের হাফে! সুমন একবার থ্রোইনের জন্য বল নিতে গিয়ে দেখে পালজেঠু আর মেজরসাব দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের মুখে চিন্তার ছাপ। কিন্তু সুমনের এতো চেষ্টা বৃথা হলো। বিরতির ঠিক আগে সুদেব জটলা থেকে একটা বল পেয়ে চকিত শট করে, যা বুল্টুর পায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে। গোলকিপার মোসাহারের কিছু করার ছিল না। গোলের পরেই রেফারির বাঁশি বিরতির জন্য বেজে ওঠে। সে টিমের সাথে যেতে গিয়ে দেখে মেজরসব তাকে ইশারায় ডাকছে। মাঠের পিছনে একটু দূরের একটা ঝোপে পালজেঠু আর মেজরসাব ঢুকে গেলেন। সুমন ক্লান্তভাবে অনুসরণ করলো ওদের। পালজেঠু বললেন - "খেলাটাকে এবার একটু ছড়িয়ে দে।এগারোজন মিলে ডিফেন্সে করলে আরো গোল খাবি। তোদের ডিফেন্স একলাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সেকেন্ড হাফে আর চাপ নিতে পারবে না তোদের ডিফেন্স। উইংয়ের ছেলেদের বল একটু উঠতে - আর তুই বল কেড়ে পাস বাড়া।" মেজরসাব বললেন - "কাউন্টার এট্যাক স্টার্ট কর : যা - গুড লাক!"
সুমন ওর টিমের কাছে ফিরতেই মানববাবু বলেন - "কিরে কোথায় বেপাত্তা ছিলি?" রাঘব বলেন "খুব ভালো খেলছিস। আমি ডি.এম সাহেবের কথা শুনছিলাম। তিনি তোর খুব প্রশংসা করছিলেন।" মানব বলে - "এসব কথা ছাড়ুন। এখন ওদের ফোকাস করতে দিন।" সুমন মইনুলকে বলে - "হ্যাঁ রে তোর এক্সট্রা মোজা আছে।" মইনুল বলে: "দ্যাখ কোণের দিকটাতে - আমি এক্সট্রা মোজা বা জার্সি ওখানেই প্লাস্টিকে রেখে দিয়েছি। "মইনুলের বাবার ব্যবসা হোসিয়ারি হোলসেলের। ওই টিমের জার্সি আর কিট স্পন্সর করে। সে প্লাস্টিকে হাত দিয়ে একটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মেরুন মোজা পায়-একটু পুরোনো যেন! যা হোক আর সময় নেই - সেটাই সে পায়ে গলিয়ে নেয়। আর ওটা পড়তেই গায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় সুমনের। সে বিকাশ আর মইনুলকে ডেকে বলে - "তোরা উইঙ্গে একটু এগিয়ে থাকে। আমি বল ফেলার চেষ্টা করবো।" মইনুল বলে - "কিন্তু মানবদা যে খালি পলাশকে ওপরে থাকতে বলেছে।" সুমন বিরক্তস্বরে বলে ওঠে - "আঃ যা বলছি কর।" সুমনের স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে ওরা আর তর্ক করে না। বরং বিকাশ আর মইনুল অবাকভাবে সুমনের দিকে চেয়ে থাকে। চিরকালের চুপচাপ সুমনের যেন হঠাৎ একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে!
সেকেন্ড হাফের খেলা ফাস্ট হাফের মতোই হতে থাকে। সময় এগিয়ে যেতে থাকে। কনকপুরের সমর্থকরা ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। তারা বুঝে গেছে এই ম্যাচেও গ্রুপ ম্যাচের মতোই হতে চলেছে। ওদিকে নসিপুরের সমর্থকটা হুইসেল, সিটি মেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকে। নসিপুরের ক্রমাগত আক্রমণ বাঁচাতে বাঁচাতে সুমনরা দিশেহারা! হঠাৎ সুমন শুনতে পায় পালজেঠু সাইড লাইনের ধার থেকে চেঁচিয়ে ওকে ধমকের স্বরে বলছেন - " খেলাটাকে ছড়া - ব্রেকে কি বললাম ভুলে গেলি নাকি!" তারপরেই সুমন একটা চমৎকার ট্যাকলে বল কেড়ে নিয়ে ডান দিকে একটা ঠিকানা লেখা পাস বাড়ায় মইনুলকে। সুমন নিজেই ওর পাসিংয়ের এক্যুরাসি দেখে অবাক হয়ে যায়! মইনুল বল নিয়ে তরতর করে উঠতে থাকে। একজন বাদে নসিপুরের সমস্ত ডিফেন্স রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো ধীরে ধীরে উঠে এসেছিলো সুমনদের হাফে। তাই স্রেফ গতিতে মইনুল ঢুকে যায় বিপক্ষ বক্সে - আর এগিয়ে থাকা গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বল তুলে দেয় গোলে!
সারা মাঠে পিন পড়ার স্তব্ধতা। হঠাৎ কনকপুরের দিক থেকে গর্জন শুরু হয়ে যায়।নসিপুরের দর্শকটা যেন বিহ্বল। তারা ভাবতেই পারে না একটাও গোল না খাওয়া টিম হঠাৎ ফাইনাল ম্যাচেই গোল খেলো! এর পরেও নসিপুর আক্রমণ শানাতে থাকে আর সুমনরা কখনো ডান বা কখন বাম প্রান্ত দিয়ে কাউন্টার করতে থাকে। খেলা এখন বেশ জমে উঠেছে। খেলার একেবারে শেষ দিকে সুমন নসিপুরের দুজনকে গতিতে ডজ করে মাঝমাঠে এগিয়ে যায়। সে হঠাৎ দেখে নসিপুরের গোলকিপার, হয়তো ভুলবশতই, গোলপোস্ট ছেড়ে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। সুমনের মাথার মধ্যে যেন পালজেঠুর কণ্ঠস্বর চেঁচিয়ে ওঠে - "গোলে উঁচু করে শট কর" সুমন যেন একটা রোবটের মতোই নিখুঁত সোয়ারভিং কিক করে - যেটা উঁচু হয়ে ডিপ করে, পোস্টের কোণ দিয়ে গোলে ঢোকে।এরপর সুমনের আর কিছু মনে নেই। রেফারির ম্যাচ শেষের বাঁশি - টিমের কাঁধে চেপে মাঠ প্রদক্ষিণ করা বা ডি.এমের কাছ থেকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার নেয়া, এমনি বিপক্ষের খেলোয়াড়দের হাত মিলিয়ে যাওয়া ..সবই যেন কিরকম ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে।
আজ রাঘব সবাইকে ডিনারে ডেকেছেন। রাঘবের ছেলে মাধব কলকাতার কলেজ পড়ান। তিনি এমনিতে খেলাধুলাতে খুবএকটা উৎসাহী নন। কিন্তু তিনিও আজ খেলা দেখেছেন আর সুমনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। সুমন একসময় একটু লজ্জাই পেয়ে গেলো। ও মাধবকে জিজ্ঞেস করলো - "মাধবদা আপনি পাল বলে মোহনবাগানের কোনো খেলোয়াড়ের নাম জানেন?" মাধব বললো - "না রে ফুটবলের তেমন খবর রাখি না। ক্রিকেট হলে তাও দেখি - তবে আইপিএল।" বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন। মাধবের মেয়ে টিনা ক্লাস সিক্সে পড়লেও খুব চৌকস। সে বাবার খুলে রাখা ল্যাপটপে কি চালাতে চালাতে বলে - "সুমনদা - গুগল সার্চ করে একজন পাল দেখতে পাচ্ছি। মোহনবাগানের ফেমাস ফুটবলার, কিন্তু তিনি তো অনেকদিন মারা গেছেন! আর তো তেমন কোনো বিখ্যাত পাল মোহনবাগানে ফুটবল খেলেছেন বলে গুগল দেখাচ্ছে না! "সুমন এগিয়ে গিয়ে ল্যাপটপ স্ক্রিনে দেখে গোষ্ঠ পাল বলে একজন পুরোনো দিনের ফুটবলারকে দেখাচ্ছে - যিনি স্বাধীনতার আগে ফুটবল খেলতেন। তিনি চীনের প্রাচীর নামে বিখ্যাত ছিলেন! সুমনের মাথাটা ঘুরে উঠলো যেন। একীকরে সম্ভব - সে যে এই লোকটাকে পালজেঠু বলে ডেকেছে। হ্যাঁ এই সেই লোক, কোনো ভুল নেই। আজো তো উনি মাঠে এসেছিলেন। তারপর সে ক্ষীণকণ্ঠে টিনাকে বলে -"দেখো তো মেজর সাব বলে কোনো হকি প্লেয়ার ছিলেন কিনা? টিনা বলে - "এটার জন্য গুগল করতে হবে না। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ মেজর ছিলেন। দেখো ওনার ছবি - বলে ল্যাপটপে টিনা গুগল ইমেজ সার্চ করে ধ্যানচাঁদের ছবি দেখায়। টিনা বলতে থাকে -"অলিম্পিকে ওনার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে হিটলার ওনাকে জার্মানিতে থেকে যেতে বলেছিলেন। আজ জার্মানিতে ওনার নামে একটা স্ট্রিট আছে ..." আরো সে কি কি বলে চলে কিন্তু সুমনের মাথাতে আর কিছু ঢোকে না। সে এক ছুটে বেরিয়ে যায়। টিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!
সুমন মোহগ্রস্তের মতো রাঘবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়োতে থাকে - মাঠ পেরিয়ে সে পোড়ো মন্দিরের পাশের ঝোপে গিয়ে ঢোকে। গলা ফাটিতে ডাকতে থাকে - "পালজেঠু, মেজরসাব" কেউ সারা দেয় না। একটা হাওয়া যেন ঘূর্ণির মতো সুমনকে জড়িয়ে ওপরে উঠে যায়। কোথা থেকে একটা অশ্বথ পাতা উড়ে এসে তার মাথায় পড়ে - যেন কেউ ওকে আশীর্বাদ করে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই! কাছাকাছি একটা শিয়াল ডেকে ওঠে। ফিরে আসতে গিয়ে সুমন দেখে পুকুরের ভাঙা ঘাটের ধরে কি যেন পড়ে আছে। এটা সেই জায়গা - যেখানে সে প্রথম দেখেছিলো ওঁদেরকে! সে তুলে দেখে - একজোড়া জীর্ণ মেরুন মোজা। এই মোজাই কি সে আজ পড়ে খেলেছিলো সেকেন্ড হাফে? সে মাথায় ঠেকিয়ে মোজা দুটো পকেটে ঢোকায়। গোষ্ঠ পাল খেলা ছাড়ার প্রায় একশো বছর পরে - আজ সুমন বুঝতে পারলো গোষ্ঠ পাল ঠিক কিরকম ফুটবল খেলতেন আর কেনই সাহেবরা তাকে চীনের প্রাচীর বলতো!
গল্প
ডাক্তার
কল্যান সেনগুপ্ত
এন এন দত্ত রোড, কলকাতা
পার্থবাবুর বাড়ির সামনে এ্যাম্বুলেন্স দাড়িয়ে। শিবুবাবু, অলকবাবু, বিমানবাবু মুখে মাস্ক পড়ে দাড়িয়ে। নিজেকে দেখতে পেলেন না। পার্থবাবু সবাইকে হাত নেড়ে, নিজেই ঢুকে পড়লেন গাড়ির মধ্যে। দোতলার বারান্দায় ওনার স্ত্রী আর মেয়ে দাঁড়িয়ে। ওদেরও অন্য কোথাও নিয়ে যাবে গাড়ি। একই শহর, রাস্তাঘাট সব চেনা কিন্তু কে কোথায় গিয়ে উঠবে জানেনা। বুকের মধ্যে একটা হাহাকার গুমরে উঠছে। তাহলে আর কি দেখা হবেনা? ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘামে জবজব করছে ফতুয়াটা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভোর রাতে আর ঘুম আসতে চায়না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লেন রজত রায়।
এখন পুরো গরম কাল। তবু এই ভোরে একটু গরম কম হওয়াতে শহরটা ঘুম দিচ্ছে। রোদ উঠলেই গনগনে বাতাসের হল্কা শুরু হবে, আর তখন পশুপাখি মানুষ হাঁপাতে থাকবে।আজ পার্থবাবুকে একবার ফোন করতেই হবে। এমন স্বপ্ন দেখবার পর মনে হচ্ছিল কেন দেখলাম এমন? তাহলে কি আমাদেরও এক এক করে এই ভাইরাসের থাবার মধ্যে যেতে হবে?
তিলক, সোমালি, তিন্নি কেউ ওঠেনি। কথাও নয়। মুখটা ধুয়ে চললেন ছাদে হাঁটতে। ছাদ এখন একদম ফাঁকা। অসুবিধা নেই। অনেকদিন বাদে ঘরের বাইরে পা ফেলেছেন। গরম ভাবটা এখন কম। পুব দিকে একটা হাল্কা ফরসা হবার ছোঁয়া। পাখীর কলকাকলি শুরু হয়ে গেছে। বিপিনপাল রোডের বাড়ির সামনে দুটো বড় গাছ ছিল। সকাল হলেই কি ব্যস্ততা পাখীদের। অনিমা চলে যাবার পর রজতবাবু তিলকের গলফগ্রীনের ফ্ল্যাটে চলে এসেছেন।বয়েস হচ্ছে, একা থাকাটা নিজের কাছে অসুবিধা না হলেও ছেলে তিলকের কাছে সব সময়েই খুব চিন্তার। ছেলে তিলকরায় ডাক্তার মানুষ, এমনিতেই সময় কম তারপর রোজ একবার বাবার জন্যে বিপিনপাল রোডের বাড়িতে খোঁজ নিতে যাওয়ার জন্যে সময় বার করতে বেশ অসুবিধাই হত। তবে পুরোপুরি ছেড়ে আসতে খুব কষ্টই হয়েছিল। এতদিন কার জীবন কাটানো সেটা কম নয়। মোহনায় এসে শেষ মোড়ে, ছেড়ে আসা কতকিছু,পাড়া পড়শি, বাজার, গলির মোড়, এমন কি পানের দোকানের কালুবাবু। আসার সময় মনে হয়েছিল আর এদের সঙ্গে দেখা হবে না। এই বাঁকে এদের ছেড়ে যেতে হল। মনে পড়ল তিলক তখনো হয়নি। এক ঝড় জলের রাতে অনিমা অসুস্থ হলে যখন বাড়ির বাইরে ট্যাক্সির জন্যে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন তখন ওনাকে দেখতে পেয়ে পানের দোকানের কালুবাবুই এগিয়ে এসেছিলেন ট্যাক্সি ডাকতে। হাসপাতাল থেকে অনিমা ফিরে আসার পর একদিন কথায় কথায় ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে খুব লজ্জায় পড়েছিলেন রজতবাবু। কালুবাবু শুধু বলেছিলেন আমার এমন অবস্থা হলে আপনি কি করতেন? আসতেন না এগিয়ে? একসাথে থাকি আশেপাশের সবাইকে নিয়েই ত চলতে হয় এরকম বলবেন না। ছেড়ে আসার সময় শুধু মনেহয়েছিল অনিমা এখানে রইল। তার স্পর্শ, তার ঘ্রাণ, তার সাজানো ঘরগুলো এবার এলোমেলো হয়ে যাবে। আরেকজন এসে তার মত সাজাবে ঘরদোর। তখন আর অনিমাকে পাওয়া যাবেনা সেই ঘরে। তবু ছেলের সুবিধা ত দেখতেই হয়। সোমালি খুব সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে শ্বশুরমশায় কে। হাজার হোক আরেকজন নতুন মানুষকে জায়গা দেওয়া এত সহজ নয়। মেয়েটির বাবা ছোটবেলায় মারা গেছে। ওর মা থাকেন দিদির কাছে। তাই প্রথম আসবার সময় রজতবাবুর নিজের যা বাধো বাধো ব্যাপার ছিল সেটা সোমালি খুব সহজেই দূর করে দিয়েছে। রজত যেতেই উৎফুল্ল হয়ে বলে - বাবা আপনি এসেছেন এখন আমি নিশ্চিন্ত। ওর বাংলা আর ইংরাজিটা আপনাকেই দেখতে হবে। আপনি ছাড়া হবেনা।
রজত একটু ইতস্তত করেছিলেন - অনেকদিন পড়ানো থেকে দূরে, তাই কতটা পারব সেটা জানিনা।আর ওদের সিলেবাসও আমি জানিনা সেরকম ভাবে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা যেরকম ভাবে পড়াতে পারবে আমি কি সেরকম পারব?
তিলক আর সোমালি দুজনই আপত্তি করে - বাবা অন্য সাবজেক্ট আসবে যাবে কিন্তু এহল সাহিত্য। এ চিরদিনের জন্যে থাকবে। এটা শক্ত হওয়া দরকার সেটা ত তুমি আমাকেই বলতে। তুমি ছাড়া তিন্নির জন্যে ভাল শিক্ষক আর কে হতে পারে?
এরপর আর না করতে পারেন নি। সোমালি খুবই সহজ মেয়ে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিজেই দ্যাখে। তারজন্যে যথেষ্ট খাটাখাটি করে বইগুলো আগে থেকেই পড়ে নেয়। ছেলে সরকারী ডাক্তার, সকাল থেকে হাসপাতাল,সন্ধ্যে বেলা চেম্বার। দেখাও হয় খুব কম। সবসময় সময়ের পিছনে দৌড়াচ্ছে। পসারও ভাল। ভাইরাস আসার আগে নাতনীকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। ফেরার সময় সাধ্যমত বাজার করে আনা, বিকেলে আবার আনতে যাওয়া এত রোজকার নিয়ম ছিল। কিন্তু ভাইরাস এসে সব ওলটপালট করে দিয়েছে রজতবাবুর।কম্পাউন্ড এর বাইরে বাজার বসে সেখান থেকে দারোয়ান এনে দেয়। তিলক মাঝে মাঝে ফেরবার সময় কিছুকিছু নিয়ে আসে। রবিবার ছাড়া ওর সময়ও নেই। ভাইরাস প্রথমে ছিল কাগজে সামান্য জায়গা নেওয়া সংবাদ। কিন্তু শেষ দুই মাসে পৃথিবীর সমস্ত সংবাদ মাধ্যম দখল করে নিয়েছে। রোজই মৃত্যুর লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। একে থামানোর কোন ওষুধ বের হয়নি। তিলকদের কমপ্লেক্সে ফরমান জারি করে বয়স্কদের বাইরে বেরোন বন্ধ করে দিয়েছে।
অনেকদিন বাদেই প্রথম সকালে ছাদে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছে। ঠিক করেছেন একটু হাঁটাহাঁটি করে নীচে নেমে যাবেন। এতদিন ঘরে বসে প্রচুর পাখীর ডাক শুনেছেন এখন ছাদে আসাতে তাদের ব্যস্ততা গাছে গাছে দেখা যাচ্ছে। শুধু মানুষ আজ শান্ত।
লেকগার্ডেন্সে তিলকদের কম্পাউন্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছটা ছয়তলা বাড়ি। মাঝখানে বেশকিছুটা উন্মুক্ত বাঁধানো উঠান। এক এক তলায় চারটি করে ফ্ল্যাট, পাঁচিলের ধার ঘেঁসে বেশ কিছু গাছ। বছর কয়েকে বেশ বড় হয়ে উঠেছে। প্রচুর পাখি তাতে থাকে। তাদেরই এক একজনের একেকরকম ডাক, সকালটাকে মাত করে রেখেছে। রজতের মনে হয়েছে সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশো মানুষ থাকেন এখানে। তিলক হার্টএর ডাক্তার, বাইরে পসার আর নাম আছে বলে এখানে অযাচিত খাতিরও বেশি। দরকারে রাতবিরেতে মানুষজন ডাকতে আসে অসুখবিসুখে। তিলক যতটা পারে করে। হাসপাতাল বা নার্সিংহোম এর ব্যবস্থা করে দেয়। ছেলে কিন্তু এত ব্যস্ত হলেও কম্পাউনডের কারুর কিছু হলে, সময় পেলেই সাধ্যমত চেষ্টা করে। মানুষজন ডাক্তারবাবুর বাবা বলেই চেনে রজতকে। মনেহয় একটু বেশি খাতির ও করে। খারাপ লাগেনা।
হাঁটতে হাঁটতে নীচে তাকিয়ে দেখেন বাঁধানো জায়গায় দুটো হনুমান বসে আছে। ইশ! তিন্নি এখন ঘুমচ্ছে নাহলে দৌড়ে গিয়ে দেখাতেন। প্রথম যখন তিলকরা এখানে আসে তখন মাঝে মাঝে আশেপাশের এর মাঠ থেকে এরা আসত। মাঝে অনেকদিন দেখেন নি। নিজেই হেসে ফেললেন এই ভেবে যে হনুমান দুটো মনে হয় ভেবেছে মানুষগুলো গেল কোথায়?আস্তে আস্তে রোদ উঠছে আকাশটা ঘন নীল, অনেকদূর অবধি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হালকা হাওয়া দিচ্ছে।
পাশের ব্লক এর ছাদ থেকে সুকুমার বাবু ডাকছেন - রজতবাবু গুডমর্নিং। অনেকদিন পর দেখা হল।ভাল আছেন ত?
হাঁটতে হাঁটতেই বলেন - এখনও ভাল আছি। জানিনা কতদিন?
এরকম বলবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওপরওয়ালা কে ডাকুন। ওনার ওপর ভরসা রাখুন।একটু থেমে বলেন - আপনার আর চিন্তা কি? ছেলে আছে সেই কিছু হলে সামলে দেবে।
রজতবাবু বলে - ডাক্তার কি আর সব মেরামত করতে পারে? দেখছেন ত।
বেরচ্ছেন নাতো? একদম বেরবেন না। বাজারহাট কে করছে? ছেলে?
রজতবাবু হাসলেন – তার সময় কোথায়? সে তো হাসপাতাল, হাসপাতাল করেই গেল। মাঝে মাঝে বউমা গেটের বাইরে থেকে আনে শাকসবজি, অনেকসময় গেটের দারোয়ান কে বললে বাইরে থেকে এনে দেয়। এই করে চলছে। হঠাৎ মনেপড়াতে জিজ্ঞাসা করলেন - আপনাদের ওষুধবিষুধ সব পাচ্ছেন ত? না পেলে বলবেন আমি তিলককে বলব এনে দিতে।
সুকুমারবাবু আশ্বস্ত করেন - এখনো তেমন দরকার পড়েনি। প্রসঙ্গ পালটে বলেন -দেখেছেন ত একটু আগে দুটো হনুমান বসে ছিল নীচে। নাতনীকে সাবধান করে দেবেন নীচে যাবার আগে।
রজতবাবু হেসে বলেন - আসলে ওরা দেখতে এসেছিল আমরা কতটা অনুতপ্ত। কোথায় গেল মানুষগুলো?
হা!হা! করে হাসতে থাকেন সুকুমার বাবু।
দুই
বাবা আসব?
রজত বাবুর ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে কাগজ পড়তে পড়তে চোখটা লেগে এসেছিল।তিলকের কথায় উঠে বসেন - আয় আয়।
তুমি ঘুমচ্ছিলে?
আরে না না। বল কিছু বলবি?
তিলক কোনদিনই বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা আজ কিন্তু সামনে একটা টুল টেনে বসে-
রজতবাবু বুঝতে পারেন ছেলে বেশ অস্বস্তির মধ্যে আছে। তিনি নিজেও কম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন না।
তিলক বলে - দেখেছ ত চারিদিকের অবস্থা। কি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, আমার ত তুই বাড়ি ফেরা পর্যন্ত চিন্তা হয়। আমাদের সবারই হয়।
এত রোগী চারিদিকে। তোর হাসপাতাল কি করে সামাল দিচ্ছে কে জানে।
- এত চিন্তা করনা। তবে ভীষণ প্রোটেকশনের, সরঞ্জামের অভাব। মাঝে মাঝে অসহায় লাগে। সঠিক ওষুধের দিশা এখনও পাওয়া যায়নি। স্টাফদের ট্রেনিং ও সেরকম নেই।
- বাবু একটা কথা বলি? একটু থেমে বলেন - এখন যেরকম ভাবে রোগটা এগোচ্ছে এবং অন্য দেশে যেভাবে বেড়েছে তাতে তোর বাড়ি থেকে আসাযাওয়া না করে পারলে হাসপাতালে বা পাশে কোন থাকার ব্যবস্থা করলেই ঠিক হয়।
তিলক রজতবাবুর দিকে তাকায় - বাবা তোমরা আছ। তোমাদের জন্যে আমারও চিন্তা থাকে। তেমন অবস্থা হলে বাজারহাট করতেও তো কাউকে দরকার।
- সেটা আমরা সামলে দিচ্ছি, ভাবিস না। তাছাড়া আমাদের কম্পাউন্ডের লোকজন,
দারোয়ান এরা ত আছেই। এরপর তিলকের কাঁধে হাত রেখে বলেন - বাবু, আমার ছেলে সরকারী ডাক্তার, দরকারে অদরকারে ত তোর সূত্রে আমাদের বেশ ভালই চেনে। মনে রাখিস যা পেয়েছিস তার শোধ করার সুযোগ এখন। এমন সুযোগ বার বার আসেনা। বুঝেছি বাবা। তিলক মাথা নিচু করে। আমিও খুব চিন্তায় থাকব।তুই আমাদের কথা ভাবিস না। ওসব ঠিক চলে যাবে। তুই ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক এই সময় কে পেরিয়ে যাব। তুই সোমালি আর আমার দিদি কে বোঝা। গেলে বেশি দেরি করিস না। আসা যাওয়া করলে অনেক বেশি সংক্রমণের ভয় থাকে। তাছাড়া তুই ডাক্তার। তুই ত এখন সামনে থেকে লড়বি। তোর লড়াইয়ের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকব। তিলক হাসপাতালে রয়েছে বার দিন হল। দিনে দুবার করে কথা হয় বউমার সঙ্গে। ক্রমশ অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠছে। সংক্রামিত ও মৃত্যুর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। টিভি তে প্রথম দিকে অনেকক্ষণ দেখতেন এখন আর নিজেদের অসহায়তার কথা শুনতে আর দেখতে ভাল লাগেনা। নিজেই অবাক হয়ে যান যে নিজেই জীবনের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে এই মৃত্যু মিছিল দেখতে হল। মানুষের মুখের দিকে তাকালে একটা ভয়, ভয় মৃত্যুর, সামনের দিন কি আসছে তার ভয়। তিন্নি স্কুল এ যেতে না পেরে বিমর্ষ হয়ে পরছে। তিনি ও বাইরে বেরতে পারছেন না। সোমালি এমনিতে বাড়িতে তেমন কিছু করতে দেয় না। তবে এখন কিছু কাজ সোমালির কাছ থেকে নিয়ে করছেন। ঘরের বইপত্র, ঘর সাজানোর জিনিস, সোফা, খাবার টেবিল এইসব পরিষ্কার করছেন। এতে সময় কাটছে ভাল। তিন্নি লাঠি দিয়ে ঘর মুছছে। বলতে পারেন না নাতনী আর ছেলের বউয়ের সামনে, কিন্তু সব সময় একটা উৎকণ্ঠা থাকে তিলককে নিয়ে। হাসপাতাল ত একটা রোগের আতুর ঘর। এত ভাইরাসের রোগী চারিদিকে সংক্রমণ বাঁচানো মুশকিল। বাঙ্গালি নতুন বছর এল এক অদ্ভুত সময়ে।সকালে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে নীচে নেমে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন আজ কাগজ আর দুধ কোনটাই দেয় নি দারোয়ান। এমন ত হয় না। সোমালি ও তিন্নি এখনও ওঠেনি। তিন্নির খুব পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে। সোমালি রান্না, ঘরের কাজ করে তিন্নি কে নিয়ে বসতেই পারছেনা। রজতবাবু নিজে সাইন্স সাবজেক্টগুলোর মধ্যে অঙ্কটা চেষ্টা করেছেন কিন্তু এতদিনের অনভ্যাসে কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। খুব খটমট সব অঙ্ক।
নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলেন। সোমালি এসে বললে - বাবা হা বল। কিছু বলবে?
হা!। ফ্লাটের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি আরও অনেকে এসেছে। আপনাকে ডাকছে।
কি হল আবার? সেরকম ত কিছু শোনেন নি।চল যাই। বলে উঠলেন।
বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন। থমথমে মুখ। বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে।বললেন - বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? কি হয়েছে? কিছু বলবেন?
না ঠিক আছে। সেক্রেটারি সবার দিকে তাকিয়ে বললে - দেখুন আঙ্কল, এই অদ্ভুত সময় দাঁড়িয়ে একটা ব্যাপার নিয়ে এসেছি।
বলুন
দেখুন আমাদের এখানে সাড়ে - চারশো থেকে পাঁচশো লোক থাকে। প্রত্যেকেই সংক্রমণের ভয়ে আছে।
পিছনে সোমালি এসে দাঁড়িয়েছে তাই বললেন - বৌমা তুমি ভিতরে যাও। আমি কথা বলছি। সোমালি চলে গেল ভিতরে, - বলুন কি বলছিলেন।
তিলকদা কোথায় আঙ্কল? সেক্রেটারি কথাটা পাড়ে।
- কেন ও ত হাসপাতালে।
- আপনি গতকাল টিভি দেখেছেন রাতে?
- না দেখিনি। টিভি এখন দেখতে ইচ্ছে করেনা। তাই খুব দেখা হয়না।
সহ সেক্রেটারি এগিয়ে আসে - দেখুন টিভিতে দেখিয়েছে তিলকদার ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার এবং নার্সদের কোয়ারান্টাইনে নিয়ে গেছে। ওখানে একজন রোগী মারা যাওয়ার পর ভাইরাস এর পজিটিভ পাওয়া গেছে।
রজতবাবু অবাক হন - তাই? কই আমাকে বা বউমাকে বাবু কিছু বলেনি ত?
হ্যাঁ টিভি তে দেখিয়েছে। আমরাও দেখেছি। হয়ত আপনারা চিন্তা করবেন বলে বলেনি।
রজতবাবু নিজেকে ধরে রাখেন - ঠিক আছে আমি আজি ফোন করব ওকে। ধন্যবাদ, এটা জানানর জন্যে।
সহ সেক্রেটারি বলে - বুঝতেই পারছেন, আমরা আপনাদের নিয়েও চিন্তা করছি।
রজতবাবু আশ্বস্থ করেন - আমরা ভালই আছি। চিন্তা করবেন না।
সেটা ঠিক আছে কিন্তু সারা কম্পাউন্ডের লোকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে। এই অবস্থায় সরকারের ঠিক করা আইসোলেসন জায়গায় আপনাদের থাকলে মনেহয় ঠিক হয়।
প্রেসিডেন্ট যোগ করেন - এতে আপনাদেরও ভাল আমাদেরও ভাল।
এটা কি বলছেন? রজতবাবু আশ্চর্য হয়ে যান। কি বলছে এরা। এটা কি করে সম্ভব? প্রচণ্ড বিরক্ত হন। তবু ঠাণ্ডা মাথায় বলেন - কিন্তু আমি। নতুন করে আইসোলেসনে যাব কেন? আমরা এমনি কেউ বেরচ্ছিনা। আর বাবু ত এখানে নেই।
লোকে ভয় পাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন।
রজতবাবু বলেন - আপনারা তাদের বোঝান। জানেন কি আমার ছেলে বারদিন ধরে হাসপাতালে রয়েছে। দিনরাত এক করে লড়াই করছে। আর আপনারা একি বলছেন? কই আপানদের কেউতো এসে আমাদের কোন খোঁজ নেননি।
ভিড়ের মধ্যে কেউ বলে ওঠে - দেখুন লোকে বলেছে কিছুদিন আগেই ওনাকে এখানে দেখা গেছে।
কি বলছেন? রজত উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আমি ওর বাবা আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করছেন না?
সেক্রেটারি বলে - রেগে যাবেন না। যেহেতু আপনার ছেলের টেস্ট হবে আর উনি এখানেই থাকেন তাই লোকে ভয় পাচ্ছে। ঠিক আছে আপনি ওনাকে ফোন করুন দেখি উনি কি বলেন।
ঠিক আছে আমি বাবুকে ফোন করছি আপনাদের সামনেই। ফোন করলেন রজতবাবু।এনাদের আসার কারণ খুলে বললেন। তিলক অবাক হয় বলে - বাবা তুমি চিন্তা করনা আমি এখানকার সুপারকে বলে আমাদের থানাকে জানাচ্ছি। থানা থেকে গিয়ে ওনাদের জানিয়ে দেবে। ফোনটা ওনাদের দাও আমি বলছি। সেক্রেটারিকে ফোনটা দেন। কিছুক্ষণ কথা বলে। তারপর ফোন রেখে বলে – কিছু মনে করবেন না। আমাদের এখানকার লোকজন অসহায় বোধ করছে। ঠিক আছে থানা থেকে এসে বললে ঠিক আছে নাহলে হয়ত আবার ফিরে আসব আপনার কাছে। বলে চলে যায় সবাই। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন রজতবাবু। বিপিনপাল রোডের বাড়ির কথা মনে পড়ল। পড়শির আন্তরিক মুখগুলো ভেসে উঠল। এত আগে এত কিছু চিন্তা করে ঠেলে পাঠালেন ছেলেকে, এরা বিশ্বাস করছেনা। বিশ্বাসটা ভয়ের আবরণের তলায় লুকিয়ে গেছে। চোখে একটা সন্দেহজনক চাহনি। বেশি কিছু বলতে গেলে এরা এক ঘরে করে দেবে। তাই আজ কাগজ, দুধ কিছু দেয়নি।
সোমালি ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে - কি বলল বাবা?
খুলে বলেন ব্যাপারটা।সোমালি মুখেও ভয় ফুটে ওঠে। কি হবে থানা থেকে এসে না বললে?
রজতবাবু আসস্থ করেন - চিন্তা করনা। বাবু যখন বলেছে তখন ব্যবস্থা ঠিকই নেবে।
সময়ের সাথে সব শান্ত হয়েছে। কিন্তু কতকিছু পালটে গেছে। কত মানুষ চলে গেছে, কতজন রাতারাতি গরীব হয়ে গেছে। পরস্পরের সম্পর্কগুলো ও অন্যরকম হয়ে গেছে।কোথাও নতুন করে গড়ে উঠেছে কোথাও ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে যারা দেখা হলে সহজ ভাবে কথা বলত আসতে যেতে। তারা কেমন ম্লান হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটের কোনে। তিলক ফিরে এসে বলেছিল – তুমি কেন বললে না যে তুমি কতদিন আগে আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছ?
রজতবাবু অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন - বলেছিলাম ওরা বিশ্বাস করেনি। তাই আমি জিজ্ঞাসা করিনি আমাদের কম্পাউন্ডের বাইরে যে একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাকে কেন এত বাসিন্দা এতটুকু চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি? কেন তোকে বাড়ি ফেরার সময় তাকে নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে হয়েছিল?
বাবা তুমিই ত বল এটা আমার ডিউটি। ওদের দৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু ছিল তাতে আমি আর কিছু বোঝাতে চাইনি। আসলে কি জানিস বিশ্বাস চলে গেলে সত্যতার পরীক্ষা নতুন করে দিতে হয়।তুই ডাক্তার বলে হয়ত ওরা ওদের দরকারে আবার আসবে রাতবিরেতে। নাহলে কিন্তু সেই যে গ্রামে একঘরে করে সেইরকম আমাদের অবস্থা হত। সেটাই আমার খারাপ লেগেছে।
তিন:
ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে রাত হয়েছে খেয়াল নেই। রাত দেড়টা বাজে। শুতে যাবেন ভাবছিলেন এমন সময় কলিং বেল। এত রাতে কে হতে পারে? উঠে দরজা খুললেন। বাইরে সেই সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, আরও দুটি ছেলে। উদ্বিগ্ন মুখ, দেখে বোঝা গেল ওনাকে কেউ ভাবে নি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল - আপনি ঘুমান নি মেশোমশাই?
ম্লান হেসে বললেন – খেলা দেখছিলাম। আপনার নিশ্চয়ই বাবুকে চাইছেন? দাঁড়ান ডেকে দিচ্ছি। বসুন ভিতরে। একটি ছেলে এগিয়ে আসে - মেশোমশাই আমার বাবার বুকে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, গা গোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে হার্টর কিছু হয়েছে। তাই ছুটে এসেছি। তিলকদা যদি একবার দেখেন। এত রাতে আর কাকে পাব?
এত সুকুমারবাবুর ছেলে? ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ওরা দাড়িয়েই বাইরে। ঘরে ঢুকে ছেলেকে ডাকেন। তিলক ওঠে, সব শোনে। শুনে তাকিয়েই থাকে বাবার দিকে। মৃদু হেসে ছেলের পিঠে হাত রাখেন - ওঠ বাবা ওঠ, সুকুমারবাবু কষ্ট পাচ্ছেন। চল একবার দেখে আসি। এই নে বলে এগিয়ে দেন পাঞ্জাবি। তারপর বলেন - মানুষ এরকমই, তুই ডাক্তার বলে অবিশ্বাসের নখটা গুটিয়ে নিয়েছে। আগের কথা মনে রাখিস না কষ্ট বারে তাতে।তিলক বাধা দেয় - আমিই ত যাচ্ছি। তোমার এত রাতে কি দরকার যাওয়ার?তুই বাধা দিস না। উনি আমার বন্ধুর মত। চল, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই পা বাড়ান বাইরে যাবার জন্যে।
গল্প
টেস্টার
পীযূষ কান্তি দাস
আমি শ্রী পীযূষ কান্তি দাস পিতা - স্বর্গীয় কানাইলাল দাস , মাতা -- স্বর্গগতা - প্রভাবতী দাস, জন্ম - অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। ইচ্ছা ছিলো সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা আর নিয়তি টেনে নিয়ে গেল অন্যপথে আর পেশা হল স্বাস্থ্যকর্মী। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পেশার চাপে সব রকমের সাহিত্য থেকে বহুৎ দূরে । পরে একটু অবসর পেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধ।
অটো থেকে নেমে সবে দুনম্বর প্লাটফর্মে পা দিয়েছে অনিক আর ডাউন ট্রেনটা হুউস করে বেরিয়ে গেল। পরের কৃষ্ণনগর লোকাল পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। মনে মনে অনিক সেই ছুকরি মেয়েটাকে গাল দিতে লাগল। দেখলে তো মনে হয় হেব্বি পয়সাওয়ালা বাড়ির মেয়ে অথচ পথের মাঝে নামার সময় সামান্য একটা টাকার জন্য অটোওয়ালার সাথে অতো কিচাইন করে পুরো পাঁচ মিনিট লেট করিয়ে দিলি! নইলে এই ট্রেনটা তো কিছুতেই মিস হবার কথা নয়। এখন পরের ট্রেন ধরে যেতে হবে। জানিনা আবার নেমে অতো রাতে রিক্সাও পাবে কিনা। যদি রিক্সা না পাওয়া যায় তবে আবার বাড়ি পর্যন্ত দু কিলোমিটার হাঁটা লাগাতে হবে। বিরক্তি ভরা চোখে অনিক প্লাটফর্মে কোথাও কোন বেঞ্চ ফাঁকা আছে নাকি খুঁজতে লাগল। নজরে পড়ল প্লাটফর্মের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা বেঞ্চ পুরো ফাঁকা। প্লাটফর্মে লোক যথেষ্ট। অনেকে ইতস্তত দাঁড়িয়ে, কিছু লোক প্লাটফর্মের মেঝেতে খবরের কাগজ বা গামছা ওই জাতীয় কিছু বিছিয়ে বসে আছে। কেউ কি ওই ফাঁকা বেঞ্চটা দেখতে পায়নি নাকি! আবার তার মনে হলো না না সেটা নিশ্চয়ই নয়। এটা নির্ঘাত সেদিনের মতো কোন গড়বড় কেসই হবে। যাই হোক না কেন আজ শরীরটা ভালো নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বেশ। তাই মন না চাইলেও গুটিগুটি পায়ে ফাঁকা বেঞ্চের কাছে গিয়ে অনিক দেখেছিলেন যে বেঞ্চের উপর একটা বুড়ি কাপড়ে-চোপড়ে হাগুমুতু করে দিব্বি শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর কি দুর্গন্ধ! বাপরে বাপ্! মনে হয় দুর্গন্ধের কারণে অন্নপ্রাশনে খাওয়া পরমান্ন ও উঠে আসবে পেট থেকে! অনিক ওয়াক তুলতে তুলতে ওখান থেকে সরে গেছিল। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর এক সময় এলো ওর নির্দিষ্ট ট্রেনটা। কোন রকমে ট্রেনের একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে বাড়ি ফিরল। তখনও তার গা-টা গুলিয়ে গুলিয়ে উঠছে। বাড়ি ফিরে সোজা বাথরুম আর সাবান মেখে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে শাওয়ার ছেড়ে করল স্নান। অনিকের স্নান করতে কখনোই পাঁচ মিনিটের বেশি লাগে না। রুপালি বাথরুম যাবে বলে দু দুবার এসে ফিরে গেল। শেষে বেডরুমের সাথে এটাচট বাথরুমে কাজ সেরে অনিকের চা আর জল খাবার করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে গেল।।
স্নানের শেষে ড্রয়িং রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে সে বডি স্প্রে বা পারফিউমের শিশিটা খুঁজতে লাগল। অনেক খুঁজেও না পাওয়ায় হেঁকেছিল, "এই যে শুনছো কোথায় গেলে গো? এদিকে একবারটি আসবে"?
অনিকের ডাক শুনে রুপালি রান্না ঘর থেকেই আওয়াজ দিল, "আমি রান্না ঘরে। আমার দুটো হাতই জোড়া । একটু সবুর করো লক্ষ্মীটি। আমি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আসছি "।
অনিক সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, "ঠিক আছে ঠিক আছে সোনা, তোমায় আসতে হবেনা এক্ষুনি। পাঁচ মিনিট পরেই না হয় এসো। কিন্তু বডি স্প্রেটা কোথায় আছে একটু বলো না প্লিজ। তখন থেকে খুঁজছি পাচ্ছিনা যে"।
অনিককে বডি স্প্রের খোঁজ করতে শুনে রুপালি কিছুটা অবাক হল। আসলে বিয়ের পর আজ একবছর হয়ে গেল অনিককে কোনদিনই বডি স্প্রে বা সেন্ট ইউজ করতে দেখেনি সে। বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্বে পাওয়া সেন্ট আর বডি স্প্রেগুলো বেমালুম পড়েই আছে। অনিক ব্যবহার তো দূরের কথা একদিনও সেগুলো টাচ পর্যন্ত করে নি। শুধু কি তাই! ফুল শয্যার দিনের কথা মনে পড়ে গেল তার। রুপালি ছোট বোন সোনালী ওদের খাটের বেডশিটে অল্প একটু পারফিউম স্প্রে করে দিদির কানে কানে বলেছিল, "তোদের সারাটা জীবন আজকের মতো সুগন্ধে ভরে থাকুক"।
ছোট বোনের পাকামিতে সেদিন রুপালি রাগ করেনি। বরং মিছিমিছি কপট চোখ পাকিয়ে বলেছিল, "বড় পাকা হয়েছিস না"!!
অনিক তখনো রুমে আসেনি। ওর অফিসের দূরের বন্ধুরা খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলে কি হবে পাড়ার বন্ধুরা তখনও যায় নি। তারা ফুলসজ্জার ব্যাপার স্যাপার নিয়ে অনিকের সাথে ইয়ার্কি ফাজলামিতে ব্যস্ত। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা এগারোর ঘর ছুল। তখন একে একে তাদেরকে বিদায় করে যখন রুমে এসেছিলো তখন প্রায় রাত বারোটা। রুমে ঢুকেই সে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল খানিকক্ষণ। তারপর একটা গভীর শ্বাস টেনে বলেছিল, "রুমে কি কেউ পারফিউম স্প্রে করেছে"?
যদিও সে শহুরে মেয়ে জড়তা -টড়তা তার নেই। তবুও তো নতুন বউ। তারপর আবার প্রথম দিন বলে কথা। বুকের ভিতর একটু রোমান্স মেশানো ভয় ভয় ভাব থাকা স্বাভাবিক। সে আস্তে করে ঘাড় নেড়ে মৃদু স্বরে বলেছিল,"হাঁ, সোনালী বেডশিটে পারফিউম স্প্রে করেছে "।
অনিক তখন বলেছিল, "আজতো এবাড়িতে তোমার প্রথম দিন। তাই জানার কথাও নয়।কোন
রকম উগ্রগন্ধের আসে পাশে ও আমার যাওয়া উচিৎ নয়। কারণটা বলছি। কিন্তু তার আগে বলো তুমি কি জানো আমি কোথায় বা কি কাজ করি"? রুপালি ঘাড় নেড়েছিল সেদিন। আস্তে আস্তে বলেছিল, "পুরোপুরি জানিনা। তবে বাপি বিয়ের আগে বলেছিলেন যে কোলকাতায় উল্টোডাঙাতে আপনার নিজস্ব একটা অফিস আছে এবং সেখানেই চা কোম্পানিগুলো আসে আর আপনি তাদের কি সব সার্টিফিকেট টিকেট দেন.... "। অনিক মুচকি হেসে বলেছিল, "ঠিকই শুনেছো তুমি। তবে সম্পূর্ণ জানাটা তোমার অবশ্যই দরকার। আমি হলাম গিয়ে টেস্টার। টেস্টার মানে হলো বিভিন্ন কোম্পানি তাদের চায়ের স্যাম্পেল নিয়ে আমার কাছে আসে আর আমি তাদের চা টেস্ট করে সার্টিফিকেট দিই। আর সে কারণেই কোন রকম উগ্রগন্ধ আমার নাকে যাতে না আসে সেদিকে আমায় যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়। আর সেটা তোমারও জানা দরকার"। তারপর সেই বেডশিট পাল্টে তাদের ফুলশয্যা হয়েছিল সেদিন।
অনিককে বডি স্প্রে বা পারফিউমের খোঁজ করতে দেখে রুপালি তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এসে বলল, "কি হয়েছে তোমার? তুমি কি পাগল হয়েছো নাকি? তুমি পারফিউম খুঁজছো"?
অনিক বললে, "আজ থেকে আর সেন্ট বা উগ্রগন্ধে আমার কোন ক্ষতি হবেনা"।
"কেন কি হলো তোমার " রুপালি প্রশ্ন করে।
"কিছুদিন যাবৎ আমার কাছে কোম্পানি গুলো আসছিলো না টেস্ট করানোর জন্য। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওদের প্রোডাকশন কম হচ্ছে তাই। কিন্তু আজ আমার সর্ব প্রথম টেস্ট রিপোর্ট দেওয়া কোম্পানির সেলস ম্যানেজার সুবর্ণবাবুর আমার অফিসে এসেছিলেন। আমাকে উনি খুবই স্নেহ করেন আর উনিই আমাকে জীবনের প্রথম কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। আজ কথা বলতে বলতে আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম যে ব্যবসাপত্র কেমন চলছে। উনি বললেন যে ভালোই তো। তখন আমি বলেছিলাম যে কই কোম্পানি গুলো তো আগের মতো আমার কাছে আসছে না। তখন উনি বললেন, "অনিক, আমি তোমায় যে স্নেহ করি তাতে তোমার কোন সন্দেহ নেই তো"?
অনিক বলেছিল, "কি যে বলেন সুবর্ণদা আমি আপনাকে.... "।
সুবর্ণদা তখনই অনিককে বলল, "অনিক আজ সে কারণেই আমি তোমার কাছে এসেছি। শুনলে তোমার খারাপ লাগবে তাই এতদিন আসবো আসবো করেও আসতে পারিনি। আসলে কোম্পানিগুলো তাদের টেস্ট রিপোর্ট নেওয়ার জন্য আর কোনদিনই তোমার কাছে আসবে না"।
অনিক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, "কেন সুবর্ণদা? আমি কি কোন অপরাধ করেছি"?
সুবর্ণদা বললেন, "অপরাধ নয় অনিক। আসলে সত্যি কথা হলো ইদানীং তোমার টেস্ট রিপোর্ট ঠিকঠাক হচ্ছিল না তাই "।
"রিপোর্ট ঠিকঠাক হচ্ছিলো না"? অনিক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
"আরে সেই কারণটাই জানতে আমি এলাম" সুবর্ণদা বললেন।
অনিক বললে, "কারণটা কি আমিও তো সেটাই বুঝতে পারছিনা সুবর্ণদা"।
"আচ্ছা মাস তিনেক আগে তুমি দিন পনেরো অফিস আসোনি বলে শুনেছিলাম। কারণ টা কি ভাই? কোথাও বেড়াতে টেড়াতে গিয়েছিলে বুঝি "?
"না না সুবর্ণদা। বেড়াতে যাবো কি!আপনি শোনেননি ওই সময় আমি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলাম। আমি তো আপনাকে নার্সিংহোম থেকে ফোন করে ছিলাম। আপনি অবশ্য আমায় দেখতে আসেন নি.... " অনিক বলেছিল।
"না রে ভাই। আমি তো তখন কোলকাতাতেই ছিলাম না। সেলসের কাজে সাউথে ছিলাম। তা কি হয়েছিল তোমার যে একেবারে নার্সিংহোমে ভর্তি হতে হয়েছিল"?
অনিক বলল, "আর বলবেন না সুবর্ণদা। রাতে খেয়ে দেয়ে যেমন দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাই তেমনি ঘুমিয়ে গেছলাম। হঠাৎ ভোর চারটার দিকে পেটের ডানদিকে অসহ্য ব্যথা। ওই দিন রাতে রুপালি মানে আপনার বউমা রান্নাটা একটু রিচ করে ফেলেছিল। তবে টেস্ট হেব্বি হওয়ায় মাটনক্যারিটা একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিল। আমি ভাবলাম গ্যাস ট্যাস হবে হয়তো। বাড়িতে খুঁজে Eno র প্যাকেটও একটা পেয়ে গেছিলাম। জলে গুলে খেলাম। দুবার বাথরুমেও গেলাম। কিন্তু ব্যথা আর কমেনা। বরং উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকলো। শেষে আর থাকতে পারিনা দেখে রুপালি নিচের তলার সুবিমলবাবুকে ডাকে আর তিনি এসে সঙ্গে সঙ্গে উবের ডেকে আমায় নিয়ে নার্সিংহোমে নিয়ে যান। ডাক্তার সাথে সাথে USG করেন আর বলেন যে যেতে যদি আরো একটু দেরি হতো তবে নাকি বিপদের শেষ ছিলনা। তৎক্ষণাৎ আমায় OT তে নিয়ে যায় আর অপারেশন করে এপেন্ডিক্সটা বাদ দিয়ে দেয়"।
"ওঃ! এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কারণটা "।
”কিসের কারণ সুবর্ণদা" অনিক প্রশ্ন করে।
উনি বললেন ওই যে অপারেশনের সময় অনিককে যে এনাস্থেশিয়া দেওয়া হয়েছিল তার কারণেই তখনই তার নাকের সেন্স নার্ভগুলো গেছে। আর কোনদিনই অনিকের পক্ষে সঠিক টেস্ট রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবেনা আর এই কথাগুলো রুপালিকে বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলো অনিক।।
গল্প
বউ-বিষয়ক
কবিতার রচনাপদ্ধতি
বিশ্বজিৎ মাইতি
প্রকাশক : স্রোত, নন্দীগ্রাম
বউ-বিষয়ক কবিতার রচনাপদ্ধতি...
বিশ্বজিৎ মাইতি। কাব্য রচনার প্রথম পর্বে নব্বইয়ের দশকে কচ সান্যাল ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। পরবর্তীকালে স্বনামে প্রায় নিভৃতে লিখে চলেছেন।দু হাজার সালে জাতক কাহিনী থেকে বর্তমান গ্রন্থ বউ -বিষয়ক কবিতার রচনা পদ্ধতি, কবির দ্বাদশ কাব্য গ্রন্থ। প্রত্যেক গ্রন্থেই কবি স্বতন্ত্র পথের সন্ধানী। তাই এই কবির একটি গ্রন্থ নয় সমগ্র কাব্য পথের ফলেই কবিকে সম্পূর্ণটাই ধরা যাবে, কবির কবিতার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা তা জানেন।
এক ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থে জীবনকে দেখেছেন বহু কৌণিক প্রিজম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। কখনো তির্যক, স্যাটায়ারিক কবি বলেন,
"কতকাল এককোষী প্রাণী হিসাবে দিনাতিপাত করেছি
কতকাল পাখি হয়ে করলাম আকাশে
মাছ হয়ে জীবকুল রক্ষা করলাম।
তাও বেশ কিছুটা এনার্জি থেকে গেল!
বট গাছের নীচে পিঠে ভাগ করছিল দুই স্যাঙাত
বানর হয়ে তাদের পিঠে ভাগে লেগে গেলাম!
(শক্তি তত্ত্ব)
গ্রন্থের শেষ কবিতা "তাহলে"তে কবির জীবনের প্রতি আস্থার প্রমাণ পাই ।
"ধরো,আমি কিছুই হতে পারলাম না!
মানে, অস্ত্র হয়ে এক কোপে মাথাও কাটতে পারলাম না
কাটা মুণ্ডু হয়ে গড়িয়ে যেতেও পারলাম না।
অস্ত্র যখন এক এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডুকে আলাদা করছে
আমি তখন কবিতা লিখতে লাগলাম
আমি তখন গান গাইতে লাগলাম!
তাহলে!"
গল্প
হোস্টেলের
রহস্যময় দিনগুলো
সঙ্গীতা সাহা
মিসিসিপি, মাঃ যুক্তরাষ্ট্র
স্নাতক শেষ বর্ষ। হোস্টেল জীবনের প্রায় বেশ কয়েক বছর হতে চলল। মল্লিকা ছিল আমার হোস্টেলের বান্ধবী। মল্লিকা পাঠভবনে ক্লাস টু থেকে পড়ছে। ওর জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে হোস্টেলে। ইতিমধ্যে আমিও হোস্টেল জীবনের সাথে অভিযোজন করে নিয়েছি। হোস্টেল জীবনটা বন্ধুদের সঙ্গে খুব আনন্দেই কেটেছে। আমাদের প্রত্যেক বছর হোস্টেলে ব্লক চেঞ্জ হত। আমি আর মল্লিকা সেই সময় বেছে নিয়েছিলাম বিদ্যাভবন ব্লক। সেই সময় বিশ্বভারতীর শ্রীসদন হোস্টেলে সেই ব্লকটা ছিল বেশ পুরনো। হোস্টেলটারও বেশ বয়স হয়েছে। আমাদের ব্লকে একটি ঘর ছিল যার দরজাটা খুব হালকা করে লাগানো থাকত। সিনিয়ররা বলত ঐ ঘরের দরজায় নাকি কোনদিন তালা লাগেনা। যখনই এই ঘরটায় কেউ থেকেছে সে তালা লাগানোর চেষ্টা করলেও কিছুতেই তালা লাগাতে পারেনি। এসবের কারণ ওয়ার্ডেন কে জিজ্ঞাসা করায় ওয়ার্ডেন সবসময় এড়িয়ে গেছে। কিছুতেই তার উত্তর দিতে চাইনি। ততই আমাদের কৌতূহল বেড়ে গেছে এর পিছনে কি ইতিহাস রয়েছে। ঘরটি ছিল আমার রুমে ঠিক বিপরীতে। আমার বেশ আগ্রহ ছিল ওই ঘরটার রহস্য নিয়ে। সে যাইহোক এইভাবেই বেশ কাটছিল হোস্টেল জীবন। মল্লিকা হঠাৎ একদিন আমাকে এসে বলল “কিরে এখানে চারটে পেয়ারা রেখেছিলাম তুই কি একটা নিয়েছিস?” গাছের পেয়ারা পেরেছে মল্লিকা, খুবই ডাঁসা পেয়ারা। মল্লিকার সাথে বন্ধুত্বটা ছিল স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকেই। তাই ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেশ ভালই ছিল । পেয়ারাটা উধাও হয়েছে দেখে মল্লিকা ভেবেছে আমি পেয়ারার লোভ সামলাতে না পেরে হয়তো একটা সরিয়ে রেখেছি। চারটে পেয়ারার মধ্যে একটি উধাও। আমি মল্লিকাকে বললাম আমি কেন পেয়ারা সরাতে যাব আর পেয়ারা খেতে যদি ইচ্ছা হয় সামনে গাছ আছে আমি পেড়ে নেব কিংবা তোকে চাইলে তুই নিজে থেকেই দিবি তাহলে কেন আমি সরিয়ে রাখতে যাব বল। আমি আর মল্লিকা খুব অবাক হলাম হঠাৎ করে একটা পেয়ারা উধাও হয়ে গেল কি করে কিন্তু এর রহস্য আমরা উদঘাটন করতে পারলাম না। আর আমাদের ব্লকটা ছিল চারিদিক ঘেরা এবং প্রত্যেকটা দরজা-জানলা বন্ধ। চারিদিক যেমন ছিল তেমনই আছে শুধু মাঝখান থেকে একটি পেয়ারা উধাও। যাক গে যা হয়েছে হয়েছে। হয়তো মল্লিকা তিনটে পেয়ারাই নিয়ে এসেছিল। এখন পেয়ারার কথা বাদ দিয়ে আমাদের রাতের খাবারের কথা চিন্তা করে আমরা বানিয়ে ফেললাম মিক্স ভেজ ডাল আর পরোটা। আমরা নিজেরাই নিজেদের খাবারটা বানিয়ে নিতাম কারণ আমরা বাইরের খাবার একেবারেই খেতে পারতাম না। এখন রাতের খাবার খেয়ে এবার পড়াশোনায় আদাজল খেয়ে লাগতে হবে কারণ সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, তার আগে ইন্টারনাল গুলো আছে। সেদিন রাতে পড়াশুনো শেষ করে আমি ঘুমোতে গেলাম প্রায় রাত দেড়টার সময়। মল্লিকার তখনও পড়া শেষ হয়নি। সেদিন পড়াশোনা শেষে আমার চোখে বেশ ঘুম, একটু পরে আমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলাম। একটু পর হঠাৎ কার যেন গলার আওয়াজ, পাশের ঘরে কে যেন গল্প করছে আমি ভাবলাম এত রাতে হয়তো আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি এইভেবে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমাকে মল্লিকা ডেকে বললো, “আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে” আমি বললাম “দেখো না বোতলে নিশ্চয়ই জল আছে।”
সে বলল ‘নারে বোতলে এক ফোটাও জল নেই’ আমি বললাম “আমিতো রাতে জল ভরে রেখে ছিলাম এর মধ্যে কিভাবে বোতল টা ফাঁকা হলো!” ঠিক আছে তুই যা কেন্ট থেকে জল ভরে নিয়ে আয় তারপরে তুই জল খা আর এত রাতে আমার আর ভাল লাগছে না, আমাকে আর ডাকিস না। এই বলে আমি আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলাম। আমার ঘুম ছিল খুবই পাতলা, একটু শব্দেই আমার ঘুম ভেঙে যায়, সেদিন বেশ গভীর ঘুমেই ছিলাম হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজ। আমি ধড়ফড়িয়ে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম মল্লিকা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে আছে। এটা হচ্ছে একতলা যাওয়ার সিঁড়ি।আমরা থাকতাম দোতলার ঘরে । আমাদের দু তলাতে জলের কেন্ট এর ব্যবস্থা ছিল। ফলে জল আনার জন্য কখনোই আমাদের একতলায় যেতে হতো না। আমি দেখলাম দোতলার কেন্ট থেকে বিন্দু বিন্দু জল পরছে বোতলের মধ্যে অর্থাৎ মল্লিক কেন্ট থেকে বোতলে জল ভরছিল কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সে সিঁড়ির মধ্যে পড়ে আছে কেন? কেনই বা সে একতলায় যেতে চাচ্ছিল এত গভীর রাতে। যাইহোক সেসব প্রশ্ন নাহয় পরে হবে এখন তো ওকে সিঁড়ি থেকে
তুলে ঘরে নিয়ে যাই। মল্লিকা নিজের পায়ে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আমার হাতটা ধরে ঘরে এলো। যদিও অনেক রাত হয়েছে ঘরে আসতেই ওকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিরে তুই সিঁড়ি দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলি? ও কোন উত্তর দিচ্ছিল না। তারপর ওকে আমি জল খেতে দিলাম। জল খাওয়ার পর সে আমাকে বলল অনেকদিন ধরে পড়াশোনার চাপে তার মন ভারাক্রান্ত ছিল। ও ছিল ভূগোল বিভাগের আর আমি ছিলাম বাংলা সাহিত্যে। মল্লিকার পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছিল সে কারণে অনেকটাই বিমর্ষ থাকতো। সেদিন রাতে সে আমাকে গল্প করতে করতে বলল তার এক দিদি ছিল, তার থেকে ৬ বছরের বড়। একথা ও আমাকে কোনদিন বলেনি। হঠাৎ কি যে হলো আমাকে বলল “জানিস দিদি ছিল ইতিহাস বিভাগের সেরা ছাত্রী বিশ্বভারতীতে। সাথে সঙ্গীত ভবনের ও সেরা শিল্পী ছিল সে”। আমি কোনদিন জানতাম না মল্লিকার দিদি আছে বা ছিল। মল্লিকা বললো দিদির ইচ্ছে ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয় করবে। ছোটবেলায় বাবা মা তাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল বলে ওর বড্ড অভিমান ছিল। ওর খুব রাগ এবং জেদ ছিল যে নিজে কিছু করে দেখাবে। সেও বিশ্বভারতীতে হোস্টেলে থাকতো বলার সঙ্গে সঙ্গে তার গলার স্বরটা কেমন ক্ষীণ হয়ে গেল। মল্লিকা ভারী গলায় বলল বসন্ত উৎসবের সময় কোলকাতা থেকে এক ফটোগ্রাফার এসেছিল। দিদির অনেক ছবি তুলেছিল। তারপরে দিদির সঙ্গে বাক্যালাপের পর ফোন নাম্বার বদল পরবর্তীতে তাদের কথোপকথন অনেক দূর এগিয়েছিল। সে ফটোগ্রাফার দিদিকে কথা দিয়েছিল তাকে নাকি বড় কাজ পাইয়ে দেবে কলকাতাতে, ছবির কাজ। দিদি একদিন কাউকে না জানিয়ে ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কলকাতায় পৌঁছে গেল ছবির কাজের সন্ধানে। তারপর বেশ কিছুদিন দিদির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। হঠাৎ কিছুদিন পর আবার সে হোস্টেলে ফিরে আসে, সে রকমই জানিয়েছিল ফোন করে। এর কিছুদিন পর সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল, তার কি কারণ সে কোথাও লিখে যায়নি। তবে গোপন সূত্রে জানা গেছে এমন কিছু হয়েছিল সেখানে যেখান থেকে ফিরে এসে সে সমাজ সম্মুখে আর দাঁড়াতে পারেনি। বাবা মা ফোন করে কথা বলে যেটুকু বুঝেছিল সেই ফটোগ্রাফার নাকি তাকে প্রতারণা করেছিল এই টুকুই এর বেশি কিছু আর কিছু জানা যায়নি। তারপর থেকেই আমি দিদি হারা। মল্লিকার এই কথা শুনে আমারও মনটা অনেক ভারী হয়ে গেল। আমি আর বেশি কিছু প্রশ্ন না করে বললাম চল এবার ঘুমিয়ে পড়, অনেক রাত হলো পরীক্ষা আছে সামনে আমাদের, আর বেশি রাত জাগা উচিত হবে না।এরপর আমার বেশ ভয় হতে লাগল হোস্টেলের ঘরে পড়াশোনা করতে। আর সামনে মাত্র কটা দিন বাকি আমি ভাবলাম বাড়ি গিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি টা করব। মল্লিকা থাকল হোস্টেলে। আরো বেশ কিছু ছাত্রীও ছিল। পরীক্ষার পর আমি যখন এলাম, তখন আমি আমার জিনিসপত্র হোস্টেলের ঘর থেকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। কারণ স্নাতকোত্তরে আমাদের নতুন হোস্টেলে যেতে হবে। সেজন্য পুরনো হোস্টেলের জিনিস শিফটিং করতে আমি সেদিন এসেছিলাম। সেদিন আমি হোস্টেলে বিভিন্ন কথোপকথন থেকে জানতে পারি মল্লিকার প্রায়ই যাতায়াত ছিল সেই দরজা না লাগা ঘরটিতে। ঘরটি ছিল দক্ষিণ দুয়ারী, সবাই বলতো দক্ষিণের ঘর। সেই ঘরেই থাকতো মল্লিকার দিদি সুজাতা। তবে কি কথোপকথনই বা হত মল্লিকার তার দিদির সাথে? আমি কোনদিনই বুঝতে পারিনি মল্লিকার ঐ ঘরে যাতায়াত ছিল। এই সব ভেবে তখন আমার গা ছমছম করতে লাগল। হঠাৎ করে মনে পরে গেল দক্ষিণের ঘরের দরজা না লাগতে চাওয়া,পেয়ারা উধাও এবং মল্লিকার সিঁড়িতে পরে যাওয়া। এই পর পর ঘটনার মধ্যে কী কোথাও অন্ত্যমিল আছে? সেই রহস্যের উদ্ঘাটন না করে আমি আমার জিনিসপত্র নিয়ে হোস্টেল থেকে চলে গেলাম। এইভাবে হোস্টেলের রহস্যমাখা স্মৃতিগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলাম ভবিষ্যতের পথে। সেই রহস্য জানি নাআজও উদঘাটন হয়েছে কিনা। ভাবলে অবাক লাগে সেই হোস্টেলে কাটিয়েছি কয়েক বৎসর সেখানে পাশাপাশি মল্লিকার দিদি ছিল একবারের জন্যও টের পায়নি। মাঝে অনেক কটা বছর কেটে গেল অনেক ছাত্রী হোস্টেলে এসেছে আবার বিভিন্ন স্মৃতি নিয়ে তারা চলে গেছে কিন্তু সেই দক্ষিণ দুয়ারী ঘর থেকে গেছে একইভাবে। মল্লিকা নিজের জীবনের তাগিদে ভবিষ্যতের পথে পারি দিলেও ওর দিদি থেকে গেছে শ্রী সদন হোস্টেলের সেই দক্ষিণদুয়ারী করে।
কবিতা
পাপড়ি গুহ নিয়োগী
কোচবিহার, পঃ বাংলা
মুখোশ নয়, মানুষ বিষয়ে
মুখোশে মুখ এঁটে ধর্ম পালনের নামে
গোটা মানচিত্রে ছড়িয়ে দিল সভ্যতা
অবশ্য তারা জানে সার্কাসের ঝুলন্ত মেয়ের
তলা থেকে নেট খুলে নিতে
আয়নায় খিল দেয় ভীতু মন
তবু মানুষের তৈরি মুখোশই নিরাপত্তা দেয়
কবিতা
দীপায়ন পাঠক
দক্ষিণ খাগড়াবাড়ী
শিলিগুড়ি রোড, কোচবিহার
যুদ্ধ
আর চোখ খুলবা না ঠিক করেছি
রাষ্ট্র যেমন চায় অন্ধ হয়ে থাকবো কিছুদিন
পকেট ফাঁকা হলেও হাসি রাখবো মুখে
চায়ের দোকানে বসে খবরের কাগজ পড়বো
ধরে নেবো আমাদের কোন কষ্ট নেই
তেলের দামও প্রয়োজনেই বাড়ে
সরকার যেমন বলে আরও কিছুদিন তোতাপাখি হবো
গ্যালারিতে বসে হাজার মানুষের সাথে চিৎকার করে বলবো
এ যুদ্ধ আমাদের জন্য
কবিতা
দীপিকা মন্ডল
ডালাস, টেক্সাস
এক্টুখানি ভালবাসা নিজের জন্য থাক
সকাল সকাল উঠে ছুটিস রান্না ঘরে,
শোবার আগেও বেরোস সেখান থেকে,
আজ একটু অনিয়ম করে,
তুই দেরিতে ওঠ বিছানা হতে,
আজ অফিস শেষে নেটফ্লিক্স তুই দেখ,
একটুখানি ভালোবাসা নিজের জন্য থাক।
একবার আজ আয়নাতে মুখ দেখে,
লিপস্টিকটা লাগিয়ে টিপটা ঠিক কর,
আজ মাছের বড়ো পেটি তুই খাস,
আজ পছন্দের শাড়ী পরে তুই সিনেমা যাস,
চুপটি করে ছাদে গিয়ে, জ্যোৎস্না আজি মাখ,
একবার তোর নারীত্ব নিজেকে খুঁজে পাক।
অনেক হল এদিক ওদিক, এবার নিজের খেয়াল রাখ।
একটুখানি ভালোবাসা নিজের জন্য থাক।
আধা সাধা
পৃথিবীর আজ যতখানি ভালো,
যতোখানিতে মিলিলো গরল
সবখানে মোর ভাগ আছে।
ষড়রিপু অনিবার্য,
কাম ক্রোধ লোভ মদ মোহ মাৎসর্য
সম্বরণে মেদিনী বাঁচে।
যে অঙ্গে হয় লক্ষ্মী,
সেই অঙ্গেই জন্মে শতাক্ষী
বিভেদ শুধুই ভক্তের।
নারী রহস্যময়ী সর্বক্ষণে,
রূপ পরিবর্তন শুধু তোমার কারণে
ঝড়ুক প্রেম তোমার আচারে।
তুমি হাসো, তুমি কাঁদো,
তুমি আজ ঘরে বসে রাঁধো
আমি গোঁসা করি বসে।
জেদ হোক বা ভালোবাসা,
পাশে থাকা বা বৃথা আশা
সবটুকু রে আধা আধা।
তুই বলবিনা জোরে কথা,
তুই চলবিনে হেথা হোথা
এইবেলা সবটুকু তুলে রাখো।
পুরুষ হই কিংবা নারী,
বিকিনি বা পরনে শাড়ী
হৃদয় যে মোদের নগ্ন।।
পত্নী-ন-ইষ্ট
খুব ছিলাম, ভালো ছিলাম,
তারপরে বিয়ে করলাম।
একখানা বউ এলো,
মিটিমিটি হাসছিলো।
পেলাম আমি শিক্ষাগুরু,
হল আমার পাঠের শুরু।
কতখানি হাসতে পাবে,
সাজলে ভালো বলতে হবে।
অফিস থেকে ফোন আবশ্যিক,
ঘুরতে চল, হও সামাজিক।
ইউটিউবে ভিডিও দেখি,
শাড়ীর কুঁচি ধরতে শিখি।
মনে করে পেঁয়াজ কেনো,
জন্মদিনে গিফট আনো।
জামা কাপড় গুছিয়ে রাখো,
ভিজে গামছা তুলতে শেখো।
করলে অন্য বৌদির রূপের কদর,
পাবেনা রাত্রে শীতের চাদর।
বউয়ের ভুল ধরা পাপ,
বলবে কথা করে মাপ।
রাগ হলে চুপ থাকবে,
হাত ধরে রাস্তা হাঁটবে।
যখন হয় তুমুল কথার চলাচল,
যেতে শেষে তার চোখের জল।
এতোকিছু বলছি বটে,
কিন্তু দূরত্ব বাড়লে বুক ফাটে।
গল্প
লকডাউন এর
এক সন্ধ্যে
অরুনাভ সর
ঝড়ে আজ পুকুর এর রাস্তা বেয়ে উঠছে গাড়ি নিয়ে কে এক উঠোনে, "হরি, ওকে আটকাও " - চিৎকার এলো পুকুর পাড় থেকে। পাশে একটা রাজাদের আমলের বাংলো আছে।বাংলোর এক দিক এর প্রায় বেশ অনেকটা অংশ, দরজা - জানলা ভাঙ্গা, মন্দির ও আছে বাইরে, ওখানে মন্দির এ পুজো হয়, মাঝখানের রাস্তাটা ঝকঝকে পরিষ্কার! সকাল সন্ধ্যা যখনই তাকাও ছোটবেলা থেকে দেখছি নোংরা চোখে পড়ে না।
এক দিকে ঢুকে আরেক দিকে বেরোবার রাস্তা আছে মধ্যিখানে আনাজ বিক্রিও হয় সন্ধেতে, কিছু রকের ছেলে গাড়ি নিয়ে পুকুর এর রাস্তা বেয়ে ঢুকে বাংলোর পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে বেরুতে দেখলে বাঁধা দেয়, আর দেবেই না কেনো প্রতিদিন সাফসাফাই করে! হরি একজন মালা - প্রসাদ ব্যবসায়ী, ও ই লোক ডেকে ঝাট দেওয়া করায়। আমি জানলা থেকে সরে এলাম। সেপ্টেম্বর এর এই মাঝামাঝি একে গরম, তারপর করোনা, ব্রাউজারে কী একটা সার্চ করছিলাম, একটা ক্লায়েন্টকে মেইল করতে হবে ৬টার মধ্যে। আমি শ্রীরামপুর এ মামার কাছে এসেছি এক সপ্তাহ হয় এ গেছে, প্রায় বেরোইনি ছ' মাস কেটে গেছে।
টোকা টক মেসেজ ঢুকছে, গল্প বইটার ভেতর মোবাইলটা চাপা দেওয়া আছে। আজকাল একা যাওয়াটা অভ্যাস করে নিতে হয়েছে।
প্রথমে জীবনটা এমনটা ছিলো না। দমকা ঝড়ে বই এর পাতাগুলো উড়তে শুরু করেছে।আজকের দিনেই মনে পড়ে গেলো যখন আসতাম, বাড়িতে আলু বোম পড়ত, আজ বেশ একা একা লাগছে, মামার ছেলেটা এখন জয়েন্টএর কোচিং করছে, একা ঘরে সারা দিন রাত পরে এক করে। অন্যমনস্ক ভাবে মোবাইলটা তুলে নিলাম ব্রাউজারে যা সার্চ করছিলাম , খুঁজে পেলাম না।
৫ টা ১০! এবার তো যা হোক রেডি করতেই হবে, ভুলে গেছি একদম, কী সার্চ করছিলাম।হিস্টরিতে গিয়ে ক্লিক করলাম, একটা ডাইনোসর দাড়িয়ে! তার মানে ইন্টারনেট কানেকশন নেই।
যাঃ! ঠিকাছে, যা হোক একটা একটা কারণ দিয়ে দেওয়া যাবে! অফিস তো আর যেতে হচ্ছে না! আরাম এখন! .. ফ্যান এর রেগুলেটরটা ৫ দিয়ে, বিছানায় গা গল্প বইটার ওপর মাথা দিয়ে ঘুমই এসে গেছিলো, কী ঠিক তখনই টোকা টক মেসেজ খুলে দেখি - দুটো ইমেইল একটাতে লেখা, "ফ্যান্টাস্টিক ওয়ারক" সঠিক পৌঁছেছে, সেটা জানানো হয়েছে, অ্যাঁ? আমি তো আজই এটা নিয়ে বসেছিলাম! একবার আবার চেক করলাম, এতো ঠিকই । আমাকে লিখেছে। ভুল করেও আমি কখন পাঠালাম মনে পড়ছে না! দ্বিতীয় টা বোঝা গেলনা, খুললাম, কাল ছুটির কথা বলছে বোধহয়। লজিক লাগালাম না, চশমাটা বন্ধ করলাম, ডান্ডিটা ধরে সরালাম। ভুলে গেলাম বিকেলে চা খাওয়া হয়নি, মেইলটা দেখে শান্তিতে এটা তো আরো ঘুম পাইয়ে দিল, এলিয়ে পড়লাম।
ভ্রেরেরেরেরের.. ভাইব্রেশন এর শব্দ.. পায়ের তলায় চোখের সোজাসুজি ছিলো, ৮ টা ৩৫, মোবাইল এর জলা আলোটা চোখে পড়তে হুশ এলো, কিছু খাওয়া হয়নি। একটা ফোন কল এসেছে ,মিনিট খানেক ঘুমের ঘোর কাটতে চোখে পড়লো, ক্লায়েনট এর কল। কী মনে হতে মেইল চেক করলাম, কোনো মেসেজ নেই! রিফ্রেশ করলাম, নেট তো আছে, একটু অপেক্ষা করলাম না, কোনো মেইল নেই, তবে "congratulaton" কোথায় সব! রিবুট করলাম, মিনিট খানেক বসে রইলাম কিছু নেই মেইল এ। নাকি সবই স্বপ্ন ছিলো! একবার ও হুশই হয়নি। ঘোর বলে এখন যা মনে হচ্ছে, তন্দ্রা তখন আসেও নি, তবে একি! আজকের কাজ গেলো তবে! পুরোটা তবে স্বপ্নই! লকডাউন কী সব দেখাচ্ছে আজকাল, ঠিকাছে, আর কী করা যাবে! কিছু একটা ব্যবস্থা করেই নেওয়া যাবে না হয়!
ভাবতে ভাবতে আবার ঘোর আসছিল, না! আর না, চশমাটা টেনে ব্যাগ থেকে মাস্ক এর সরি দুটো ধরে বার করে পড়লাম, স্যানিটাইজার টা বের করে হাতে নিয়ে আবার আটকে রাখলাম। খাওয়া হয়নি কিছু, চা - মুড়ি খেতে হবে। একটু বসে সিড়ি দিয়ে নেমে মামার ঘরের দিকে এগোলাম।
প্রবন্ধ
কুমারী দূর্গা
সুস্মিতা দত্ত
কন্যাকুমারী, ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণতম বিন্দু, যা কুমারিকা অন্তরীপ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে এটিকে কোমোরিন অন্তরীপ বলা হত। তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী জেলার নাগেরকোইল থেকে বাইশ কিলোমিটার এবং কেরালার রাজধানী তিরুভনন্তপুরম থেকে পঁচাশি কিলোমিটার দূরত্বে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের সঙ্গম তীরে অবস্থিত এই কন্যাকুমারী মন্দির। এটি কুমারী আম্মান মন্দির নামেও পরিচিত। দেবী পার্বতী এখানে কুমারী দূর্গামাতা হিসেবে পূজিত হন।
রামায়ণ, মহাভারত যজ্জুর্র বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণেও এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। কন্যাকুমারী মন্দির তিন হাজার বছরের পুরোনো, ভারতের প্রথম প্রাচীনতম মন্দির। এটি একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম এবং ভারতবর্ষের একশ আটটি দূর্গামন্দিরের অন্যতম। দেবী এখানে বালা ভদ্র, পার্বতী, আম্মান দেবী নামেও পরিচিত। জানা যায়, এখানে দেবী দূর্গার মৃত শরীরের মেরুদন্ড পড়েছিল। কথিত আছে দৈত্যরাজ মহাবলীর দৌহিত্র বনাসুর শিবের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন একমাত্র কুমারী কন্যার কাছেই তিনি পরাজিত হবেন।
পরবর্তীকালে তিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তিন ভুবনের রাজা হন। বনাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীমাতা ভূমি দেবী এবং দেবতারা অগ্নি, বরুণ, বায়ু এবং ইন্দ্র ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রতিকার চাইলে তিনি তাঁদের মহাবিশ্বমাতা সাথী (পার্বতী) মাতার আরাধনা করার উপদেশ দেন। জর্জরিত দেবতাদের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবীশক্তি নবযৌবনা কুমারী কন্যারূপে আবির্ভূত হন এবং বনাসুরের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
কুমারী পার্বতী দেবতাদের উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে বলে কন্যাকুমারী জেলার সুচিন্দ্রম এ গিয়ে শিবের চিন্তায় মনোসংযোগ করলেন। শিব পার্বতীর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কুমারী পার্বতীও রাজী হয়ে যান। স্বর্গের নারদ মুনি দেবতাদের বিপদ দেখে সেই বিবাহ পন্ড করলেন কারণ তিনি জানতেন একমাত্র কুমারী কন্যার হাতেই বনাসুরের মৃত্যু। নারদ মুনি কুমারী পার্বতীকে প্রথমে অপ্রতিভ করার চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে শিবের শক্তি বনাসুরের চেয়ে কম। তারপর তিনি শিবের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য পার্বতীকে বলেন, পৃথিবীতে পাওয়া যায় না এমন তিনটি জিনিষ শিবকে এনে দিতে বলতে-- একটি এক চক্ষু নারকেল, দুই, গাঁটবিহীন আঁখকান্ড এবং শিরাবিহীন তাম্বুল পত্রক। মহাদেব অনায়াসেই দেবীকে সেগুলি এনে দিলেন।
ঋষি নারদ মাঝরাতে বিবাহের শুভক্ষণ স্থির করলেন। মাঝরাতে শিব বরযাত্রী নিয়ে পৌছলে নারদ মুনি নকল করে মোরগের ডাক ডাকলে, মহাদেব ভাবলেন, সময় প্রত্যুষ, শুভক্ষণ অতিবাহিত হয়েছে, বিবাহ না করেই ফিরে গেলেন। মহাদেব ফিরে না আসায় বিবাহ বাতিল হল। আয়োজিত খাদ্যভান্ডার পাকানো হল না। কুমারী পার্বতী দেবী রেগে আগুন হলেন। অগ্নিগর্ভ দেবী রান্না না করা খাদ্যশস্য ছুঁড়ে ফেলে দিলেন যা ছোটো পাথরের কণায় পরিণত হয়ে আজও কন্যাকুমারীতে বিদ্যমান, যেগুলি কন্যাকুমারীতে ভ্রমণকারী দর্শকেরা আজও কিনে আনেন যা কুমারী পার্বতীর অসম্পন্ন বিবাহের প্রতীক। অপ্রস্তুত পার্বতী দেবী প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য বনাসুরের অসুরী শক্তিকে পরাজিত করার জন্য মনস্থ করলেন। সমুদ্রতীর থেকে কয়েকশো কিলোমিটার সুরে শ্রীপাদপারাই পাহাড়ে তিনি ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে বনাসুর পার্বতীর সৌন্দর্যের কথা শুনে বিয়ের জন্য পার্বতীর হাত চাইলে কুমারী দেবী তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। বনাসুর জোরপূর্বক তাকে জয় করার চেষ্টা করলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। যুদ্ধে কন্যাকুমারী থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে মহাদানাপুরামে রাক্ষসরাজ বনাসুর পার্বতীর চক্রের আঘাতে নিহত হন। মৃত্যুর সময়ে অনুতপ্ত বনাসুর পরাশক্তির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলেন এবং জলে তাকে পাপমুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। দেবী তার প্রার্থনা রেখেছিলেন। এই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণকারীরা পাপমুক্ত হওয়ার জন্য কন্যাকুমারীর সাগর সঙ্গমের পবিত্র হলে স্নান করেন। বনাসুরের অত্যাচার মুক্ত দেবতারা খুশি হয়ে ফিরে গেলেন। রাজা পরশুরাম এবং নারদমুনি দেবীকে কলিযুগের শেষ পর্যন্ত সেখানেই থাকতে অনুরোধ করলেন। দেবী পার্বতী শিবের প্রতি চিরসমর্পিত হয়ে তাঁর তপস্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলেন।
পরবর্তীকালে রাজা পরশুরাম সমুদ্রতীরে মন্দির তৈরী করেন এবং কন্যাকুমারীর এক সমুজ্জ্বল নীল পাথরের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন, দেবীমূর্তি সিংহের উপর দাঁড়ানো, ডান হাতে মালা নিয়ে মহাদেবের জন্য চির অপেক্ষারত মূর্তি, যা দর্শনার্থী মনে আত্মিক শক্তি ও মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে।
প্রতিমার একটি বিশেষত তাঁর হিরের নাকছাবি। এতো সমুজ্জ্বল যে লাল রুবি পাথরের সাথে এটিকে সমুদ্র থেকে দৃশ্যমান হয় এবং লাইট হাউস বলে ভুল হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষের মতানুসারে নাকছাবির হিরেটি কোবরা রাজের থেকে পাওয়া। কোন এক সময়ে এক নাবিক নাকছাবির ঔজ্জ্বল্যে একে লাইট হাউস ভেবে ভুল করে জাহাজ চালনা করেন এবং কন্যাকুমারী পাথরে ধাক্কা খেয়ে যান। দুর্ঘটনা এড়াতে পাঁচটি বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় ছাড়া মন্দিরের পূর্ব দরজা সবসময় বন্ধ রাখা হয়। মন্দিরের পশ্চিমদরজা প্রবেশ দেয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দর্শনার্থীদের উদ্দেশে মন্দির সকাল ছটা থেকে বেলা এগারোটা , বিকেল চারটে থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে।
কন্যাকুমারী মন্দিরে শ্রীগণেশ, সূর্যদেব এবং আপ্পান দেবের পৃথক মূর্তি রয়েছে। আপ্পান দেব, মহাদেব ভোলে শংকর ও বিষ্ণুর নারী অবতার মোহিনীর সন্তান যা হিন্দুদের বৃদ্ধির দেবতা কেরালায় ব্যাপকভাবে পূজিত হন। এছাড়া রয়েছে বিজয়া সুন্দরী এবং বালা সুন্দরীর প্রতিমা,যাঁরা কুমারী পার্বতী দেবীর বাল্যসখী এবং খেলার সাথী।
মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি কুয়ো রয়েছে যা মূল গঙ্গা তীর্থ বা পটল গঙ্গা তীর্থ নামে পরিচিত । দেবীর অভিষেকের জন্য জল এই কুয়ো থেকে সরবরাহ করা হয়। মন্দিরের পূর্ব দুয়ার সমুদ্রমুখী, নবরাত্রি উৎসবের সময়ও খোলা থাকে। এখানে দেবী কেরালার অন্যান্য মন্দিরের মত তন্ত্রসমুচয়ম পদ্ধতি অনুসারে পূজিতা হন। বর্তমানে কন্যাকুমারী মন্দির একটি কেরলীয় মন্দির, যদিও একসময়ে ত্রিভঙ্কর রাজ্যের অংশ ছিল।
চন্দন উৎসবের সময়ও মন্দিরের পূর্ব দরজা খোলা থাকে, প্রতিমা ত্রয়োদশ দিন চন্দন প্রলেপ দিয়ে ঢাকা থাকে। নবরাত্রি উৎসবের সময় নয় দিন ব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গীত শিল্পীরা দেবীর উদ্দেশ্য বিভিন্ন সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
দুর্গোৎসবের সময় নবমীতে রূপোর হাতির পিঠে দেবীর একটি প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা হয় যেটি নিকটবর্তী মহাদানাপুরমে শেষ হয় এবং বিজয়া দশমীতে বনাসুরের নিধনপর্ব অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরে প্রবেশের জন্য পুরুষদের দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাভরণ অবস্থায় প্রবেশ করতে হয়। দর্শনার্থী ভক্তবৃন্দ দেবীকে লাল শাড়ি ঘি এর প্রদীপ এবং ফুলের মালা নিবেদন করেন। মন্দিরে প্রবেশকালে দূর্গাস্তব ললিতা সহস্রনামা পাঠ পবিত্র মানা হয়।
শ্রীপাদপারাই বিবেকানন্দ রক নামে পরিচিত কন্যাকুমারী থেকে ফেরিতে যাওয়া যায়। এখানে অষ্টাদশ শতকের দেবী মূর্তির পদচিহ্ন পূজিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ এখানেই তপস্যা করতেন এবং দেবীমাতার আশীর্বাদ পেতেন।
বাইরের করিডরের দেবী প্রতিমাকে ঘিরে রয়েছে দ্বিতীয় করিডর, এখানে কলা ভৈরব মূর্তি রয়েছে যা মহাদেবের বিধ্বংসী ক্রুদ্ধ রূপ প্রদর্শন করে। এরপরেই রয়েছে ধ্বজস্তম্ভ যেখান থেকে কন্যাকুমারী দেবী মূর্তির সামনে না গিয়েও পূর্ণ প্রতিমা দর্শন করা যায়।
এটি সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র সাগর সঙ্গম যেখান থেকে পূর্ণিমায় পশ্চিমে সূর্যাস্ত এবং পূর্বে চন্দ্রোদয় একই সাথে দৃশ্যমান হয়। প্রতিটি দর্শনার্থী এই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
গল্প
আলিঙ্গন
দীপিকা মন্ডল
ডালাস, মাঃ যুক্তরাষ্ট্র
সন্ধ্যেয় মৈত্রীর বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই কেমন একটা হীনমন্যতা নিজেকে ভর করে আছে, কেন ও পারেনা কুলুঙ্গিতে পানের বাটায় পান, আলনায় থরে থরে সাজানো শাড়ী, দেওয়ালের সাথে রং মিলিয়ে মিলিয়ে ঘরের পর্দা সাজাতে। বালিশ বিছানা সব যেন একটা ফোর স্টার হোটেলের মত।
নিজের বাড়িটা পরিচ্ছন্ন তবে এমন সাজানো নয়, এখুনি আলমারি থেকে একটা শাড়ী বের করতে গেলে আর দুটো পায়ের কাছে হুড়মুড় করে পড়বে। সমৃদ্ধ অনেকবার বলেছে, কখনো ভালোবেসে, কখনো ভর্ৎসনা করে। কখনো তাই রাগ করে টান মেরে সব আলমারি খালি করে পাট করে গুছিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেই দিন পনেরো পেরোতে না পেরোতেই একই অবস্থা। জীবনে সাজিয়ে রাখা বলতে তার অফিসের ডেস্কটপটা, সেখানে সব সুন্দর করে ফোল্ডারে সাজানো, যেকোনো কিছু দরকার হলে এক ক্লিকেই সে খুঁজে পাই। কিন্তু সেও চাই ব্যালকনিতে সুন্দর মিষ্টি আলো, একটা দেওয়াল জুড়ে বড়ো পাহাড় আঁকা ক্যানভাস, পাশের বাগানে হাসনুহানা, গোলাপ, রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধ। চকচকে একটা টেবিলে একটা মাটির ভাঁড়ে ধোঁয়া ওঠা চা, সঙ্গে রেডিওতে বাজবে, "ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে..... " কিন্তু তার বদলে কি হয়?
অন্ধকার একটা ব্যালকনি, কয়েকটা ছাড়ানো ছেটানো ফুলের গাছ, একটা দোলনা আর একটা চিনামাটির কাপে গ্রীন টি, আর বাজে, "যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন.... "
চাইলেও কেন পারেনা, চাওয়াটাই কি কোনো ফাঁক থেকে যায়? নাকি প্রচেষ্টায়? এখনো সেই সমীকরণটা মেলেনি। আজ তার ঘুম এলোনা, তাই বাইরে গিয়ে বসলো, আলোটা জ্বালাইনি, যদি সমৃদ্ধর ঘুম ভাঙে। মৈত্রীর বাড়িটা দেখা যায় অপর প্রান্ত থেকে, ঠিক ওর স্বপনের বাড়িটার মতোই, আমি কি হিংসে করছি ওকে? কে জানে! ও তো আমার
মতোই অফিসে যায় তবুও ও সব পারে। আমি কেন পারিনা? হঠাৎ কাঁধে একটা হাত, খানিকটা চমকে ওঠে। "কি রে মা ঘুম আসছে না বুঝি?"
"না মা, তুমি কেন উঠেছ?"
"বাথরুমে গেছিলাম, দেখি তুই বসে আছিস, কি হয়েছে? মন খারাপ?"
"মা, আমি কেন আর পাঁচজনের মতো ঘরদোর সাজিয়ে সংসার করতে পারিনা?" মৃদু হেসে, "এই ব্যাপার? জীবনটা ঘর সাজানোর থেকে অনেক বড়ো, কখনো ভেবে দেখেছিস তোর মনটা কতটা সাজানো? সেখানে কতটা আবিল আছে? জল কতটা স্বচ্ছ?"
"এ তো তুমি আমার মন রাখতে বলছো। "
"আচ্ছা তাহলে বল, interior designer রা হচ্ছে সব থেকে বড়ো সংসারী? আমাদের সবার একটা আলাদা জগৎ থাকে, আমরা সবাই আলাদা আলাদা জিনিসে খুশি খুঁজে পাই, সমাজের আপাত দৃষ্টি সেটার সূক্ষ্মতা বুঝতে অক্ষম। আমি তো অনেক গুছিয়ে রেখেছিলাম মা আমার সংসার, কিন্তু তাকে কি আটকে রাখতে পেরেছি? সেতো অন্যের সাথে সংসার করছে আজ। তুই সেটাই কর যেখানে তুই নিজের খুশি দেখতে পাস। জীবনটা এমনই একটা মঞ্চ, যেখানে সবার আলাদা আলাদা ভূমিকা। কারোর সাথে তুলনা করে নিজেকে ছোট করিসনা মা।"
"তুমি কখনো ভাবোনি তোমার বৌমা গৃহকর্মে নিপুণ নয়, তুমি কোথাও হয়তো ঠকে গিয়েছো?"
"তুই যে আমাকে সময় করে ওষুধ খাওয়াস, গাড়ি চড়িয়ে পার্কে নিয়ে যাস। তুই যদি সারাদিন ঘর সাজাতিস, এইগুলো কে করতো পাগলী?" বুকের ভিতর থেকে একটা বড়ো পাথর সরে যায় আজ, শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে, এই প্রথমবার।
**মেয়েটার নাম দিলাম না, নিজের খুশি মতো একটা রেখে দিও।
গল্প
ডুয়ার্স-জলদাপাড়া
দীপিকা মন্ডল
ডালাস, মাঃ যুক্তরাষ্ট্র
"জঙ্গলে জংলী"
প্রথম দিবস
ট্রেনটা যখন হাসিমারা পৌঁছালো তখন সূর্য মধ্যগগনে, অনেকটা দেরীতে ঢুকেছে। আমরা গল্প পড়ে, গল্প করে, আকাশ দেখে, কেক খেয়ে, ডিম সিদ্ধ খেয়ে সময় কাটিয়েছি।হাসিমারা থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল জয়ন্তী। জয়ন্তী একটা গ্রাম আলিপুরদুয়ার জেলার, চারদিকে জঙ্গল, মাঝখানে সাদা পাথুরে নদী। একটা শান্ত শীতল পরিবেশ। লোকজন সন্ধ্যে ৯টার মধ্যে ঘুমিয়ে যায়, আবার ভোর ৪টেতে ওঠে।
যাইহোক জয়ন্তীতে ঢোকার সময় গাড়ি ও আমাদের দুজনের টিকিট লাগলো ৫০০ টাকা। ভিনদেশে স্টেট পার্কে ঢুকতে যেমন টিকিট লাগে আর কি! চারদিকে পাখিদের কিচির মিচির আর গাছের পাতাদের আদরে লালিত হতে হতে ওখানে পৌঁছলাম। জয়ন্তী নদীর ধারে বসে বসে দুপুরের খাওয়া হল।
বিকেলে গেলাম চুনিয়া জঙ্গলে। আহা! কি ঘন গাছেরা চারদিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে স্বগর্বে। সবুজ সবুজ সবুজ। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট নদী। খুব অল্প হলেও জল রয়েছে। বর্ষায় তারা নাকি ফুলে ফেঁপে ওঠে। এই বয়ে যাওয়া জল হাতিদের খুব প্রিয়। রাত্রে ওরা জল খেতে আসে। আমরা হাতি দেখিনি তবে হাতির বিষ্ঠা দেখলাম। জঙ্গলে দুটো সজারু, দুটো হরিণ আর কয়েকটা ময়ূর কৃপা করে দেখা দিলেন। কিন্তু ওই নিঝুম পরিবেশ অতুলনীয়। চারদিকে নানা পাখির ডাক। আধো আলো একটা গোধূলি। ঝিঁঝিঁর ডাক। সব মিলিয়ে অনেকটা তৃপ্তি। একটু নিঃসঙ্গতা। আচ্ছা জঙ্গল কি একাকীত্বে ভোগে নাকি একাকীত্বটাকে উপভোগ করে?
দ্বিতীয় দিবস
আগের দিনের রাতের কিছু কথা বাকি রয়ে গেছে। আজ প্রকৃতি কম, পুরুষকে নিয়ে বলি। সাদা পাথুরে রাস্তায় গাড়িতে দোলা খেয়ে খেয়ে এপারে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা নেমেছে।একটা অন্ধকার রাস্তা, চারদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা। একটু চাঁদ। সে আর আমি হাত ধরে হাঁটছি। এরকম একটা ছবি কল্পনা করে এসেছি। সেটার খানিকটা পূরণ হল বৈকি। নদীর ধারে একটা ছোট্ট হোটেল, হোটেলের মালিক গিরিশ। বাইরে থেকে দেখলে মাঝ বয়সী ছিপ ছিপে চেহারার একটা লোক দেখা যায় শুধু।
কিন্তু সেই দোকানে রাত্রে খেতে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার বাড়ি কোথায়?"
"এই তো আমার বাড়ি এখানেই, ওই পাহাড়টার উত্তর কোণে। বাড়িতে আমার অনেক লোক, মা, বোন, এক বৌদি, তার ছেলে, আমার বউ।
আমার দাদাটা মারা গেছে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতো। একদিন বন্ধুকের গুলি পায়ে লাগে, জঙ্গল থেকে বেরোতে পেরিয়ে যায় ছয় ঘন্টা।
হাসপাতালে অনেকগুলো সন্ধ্যে এবং 'পা'টা কাটিয়ে শেষে ছেড়ে চলে গেলো। বউটা আমার আট মাস পোয়াতি। সারাদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করে, ফেসবুক হোয়াটস্যাপ সব আছে, কিন্তু সারাদিন আমাকে ফোন করে। কি করবো হোটেলের কাজে সারাদিন বাইরে থাকতে হয়।"
গড়গড় করে সব কথা বলার পর বললেন," মিথ্যা বলবোনা, আজ একটু খেয়েছি, অনেক কিছু বললাম, কিছু মনে করোনা। তুমি আমার ছোটো বোনের মতো।"
কিছু উত্তর দিতে পারিনি, আমি তখন দেখছিলাম একজন ভাইকে, যে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে দাদার আরোগ্য কামনা করছে। একটা প্রেমিক, যে দিনের শেষে বাড়ি ফিরে প্রেমিকার মানভঞ্জন করছে। একজন পিতা, যে ফুলে ওঠা পেট টাই কান চেপে তার বাচ্চার হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করছে। একটা ফুল শার্টের নিচের পুরুষ নামক জীবটা বোধহয় সব ক্ষেত্রে একই, সে জঙ্গলে থাকুক বা মরুভূমিতে। গিরিশবাবুর কথা, আমাদের হাত ধরাধরি, আকাশের মেঘলা চাঁদ, এইসবের মধ্যে রাতটা কেটে গেলো।
পরদিন সকালে উঠে শুনলাম রাত্রে একটা দাঁতাল হাতি এসেছিল আমাদের রুমের সামনে। আমরা এতটাই ঘুমে ছিলাম যে কিছুই টের পাইনি। হাতির গল্প শুনতে শুনতে গাড়ি পৌঁছালো পুখরি লেকে। ওখানের মানুষের বিশ্বাস ওই লেকটা ভগবানের আশীর্বাদে তৈরি হয়েছে। চারদিকে পাহাড়, মাঝখানে খানিকটা জল। তার মধ্যে ক্যাট ফিশ আর কচ্ছপ। সেখানে মায়ের কালরাত্রি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধ পূর্ণিমাতে পুজো হয়, এখানের মাছ কেউ ধরেনা, খায় ও না। কথিত আছে এখানে মাছকে খাওয়ানো মানে মায়ের পুজো দেওয়া। আমার পতিদেব খুব খুশি হয়েছেন শুধু মুড়ি দিয়ে পুজো দিতে পেরে। মনের সুখে মুড়ি খাওয়াচ্ছি। এক বিশাল মাছ এত জোরে লাফিয়ে উঠলো আমার জামাটা অর্ধেক ভিজে গেলো, আসলে মা পুজো পেয়ে খুশি হয়েছিলেন, আশীর্বাদ দিয়ে গেলেন ।
Please mention the "name of the article and the authors" you would like to comment in the following box... Thank you.