top of page
Durga1.jpg
পুজো বার্ষিকী 
১৪২৬
coverpageimage.jpg
সূচীপত্র

শিল্পী - মেঘমল্লার (ডালাস, টেক্সাস)

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

বাঙালি মানুষ হইবে কি?

প্রবন্ধ

Bhaskar Sinha.jpg

বাঙ্গালী আর মানুষ

হইবে কি?

ভাস্কর সিন্হা

দোহা, কাতার

oldman2.jpg

পরোক্ত শিরোনামায় জনৈক শুভাভিলাষী বিদ্বজন শঙ্কায়- আশঙ্কায় রবীন্দ্রস্মরণ করলে, ওনাকে আশ্বত্ত্ব করা গেল এই বলে যে, রবীন্দ্রনাথ তো বাঙ্গালীর ভাবের, চিত্তের এবং গানের জগতের মেঘমালায় চিরকালীন। তাই প্ল্য়ানচেটবিলাসী, যদিও তিনি আজ স্বর্গগগনবিহারী, তিনি প্রায়শঃই এসে থাকেন আমাদের দিবানিশির আলোচনায়। শুধু তিনি-ই বা কেন, আরও অনেক গুণীও তো আসবেন আমাদের আলোচনায়।

হ্য়াঁ বাজার এখন সরগরম, মৌসুমী বায়ু এখন প্রবেশিত। নির্বাচন আসন্ন। ঘূর্ণি আবর্তে নিম্নচাপে সব ইঁট- পাটকেল জড়ো এক জায়গায়। নির্বাচনী প্লাবনে ভাষার তোড় কোনো বাঁধাই মানে না। আ মরি বাঙ্গলা ভাষা! তা রাজনীতির উৎসবে কবেই বা ভাষণ লৌহকপাটের কারার অন্তর্বতী ছিলো? তবে গুটিকতক ঘোষিত দলবাহী সংবাদ মাধ্য়ম ব্য়তীত- যাদের কর্মই আপনার ঢাক- বাদন, বাকি সংবাদমাধ্য়মের শিরোনামাগুলি দেখলেও অত্য়ন্ত হতাশার উপলব্ধি হয়। শাসক, শাসিত, বিরোধী পক্ষের সম্বন্ধে ব্য়ঙ্গ-বিদ্রূপের সুরারোপণের মূর্ছনায় মূর্ছাপ্রাপ্তি অবশ্য়ম্ভাবী। নিতান্ত সহজেই পাঠকের নিশানায়, এবং আরও অনায়াসসাধ্য় সহজিয়া শরবিদ্ধ মৃগ। এ ভাষার তো হেথায় তুরে মানাইছে না গো অবস্থা।

এখানেই বাঙ্গালীর অস্বাতন্ত্র্য! উড়ে, বিহারী, মারোয়াড়ী, পাঁইয়া, গুজ্জু, মাদ্রাসী, কাটা ইত্য়াদি- ইত্য়াদি সবাই তরল উপহাসের পাত্র। মহামহিম বাঙ্গালী বিদ্বজ্জনের সামনে সকলেই অর্বাচীন, উজবুকের দল। কথাবার্তার শালীনতা, সুষ্ঠু আচরণ, জনপরিসরে ভদ্রতা, সর্বপোরি এক সহমানুষের প্রতি সহমর্মিতার বড়ই অভাব ঘটেছে বাঙ্গালী মানসে ও জীবনে। হয়তো শুধু বাঙ্গালী নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই। যেহেতু বাঙ্গালীই এখানে আলোচনার বিষয়, তাই বাকিদের কথা অন্য় সময়ে হবে। বাঙ্গালী বুঝতেই পারেনা যে অন্য়রা কতো শতপথে অগ্রবর্তীমান। বাঙ্গালী তো বাঙ্গালী-ই। খালি যুক্তিবিহীন একপেষে হিসাব। সুভাষ তো সুভাষ-ই। সেখানে বাঙ্গালীর কাছে স্বয়ং গাঁন্ধীও অতি অবহেলার পাত্র। বাঙ্গালী জানার প্রয়োজনবোধও করেনা নেতাদের মধ্য়ে যে পারস্পরিক সৌজন্য়বোধ ছিলো তাকে। সংঘাত ছিলো সর্বদাই তাত্ত্বিক। আত্মিক পারস্পরিক যোগাযোগের হিসাব সাধারণ বাঙ্গালীর কাছে নেই। যেখানে সুভাষও নিজেই গাঁন্ধী, নেহেরু, আজাদ ইত্য়াদি বিগ্রেড বানিয়েছিলেন। গুরুদেব আর মহাত্মা পরস্পর পরস্পরের পূণ্য় নামকরণ করেছিলেন। নেহেরু কন্য়াকে গুরুদেবের শরণে পাঠিয়ে ছিলেন কিছু দিনের জন্য়। বাঙ্গালীর আজি নিজেকে অন্তরের মধ্য়ে দেখিবার বড়ই প্রয়োজন বোধ হয়ে পড়েছে। অন্তরে আজি আলোক নাহিরে হলে ভীষণই মুশকিল, কুমঙ্গল। হতভাগা অপরকে অবহেলায় পারদর্শী বাঙ্গালী বেমালুম ভুলে যায় যে রবীন্দ্রনাথের ইয়েট্স বা পিয়ার্সন সাহচর্য। বিশ্বভারতী গঠনকল্পে মারোয়াড়ী ব্য়বসায়ীদের যোগদান। স্বামীজির বিদেশযাত্রায় খেতরীরাজার অসীম অবদান। স্বামীজির মহাজীবনে এই খেতরীর রাজারও কম ভূমিকা নেই রামকৃষ্ণের থেকে। রামমোহনের জীবনরক্ষায় এক তিব্বতীনির সুমহান ভূমিকা

ছিলো। শরৎচন্দ্রের মানসিপটভূমি তৈরীতে বর্মাদেশীয়দের সোৎসাহ। মহান নেতার অন্তর্ধানে অবাঙ্গালীভাষীদের সক্রিয়তা এবং যারপরনাই তৎপরতা। অর্বাচীন বাঙ্গালীর এহেন ভূমিকায় নিদারুণ ক্ষুব্ধ বিদ্য়াসাগর শেষজীবন অতিবাহিত করেন কর্মাটারে, অবাঙ্গালী আদিবাসীদের সাথে। যাহোক একপেষে বাঙ্গালীর একবগ্গার রোগ চিরকালের। স্বয়ং বীর সন্ন্য়াসী প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে কিছু অধ্য়য়নের পরে তাঁর বিরাগ কিয়ৎ হ্রাস পায়। বৌদ্ধ ধর্মের মঝ্ঝিম পন্থা মানবজীবনের এক অতুল অবদান। মাঝামাঝি পথে চলে উগ্রতার আর হিংস্রতার মানবিকরণ করা তো যেতেই পারে। দরকার সদ্দিচ্ছার আর জীবনকে দুই চক্ষে পূর্ণরূপে দেখা। নইলে একচক্ষু হরিণের ন্য়ায় একদিকে থাকে শুধুই আঁধার। সবাইকেই আসন ছেড়ে যেতে হয়। ভারত বা বাঙ্গলায় সেই নিয়ম অবশ্য় খাটে না। আমেরিকার মতো দেশে সর্বাধিক দুই বারের জন্য় রাস্ট্রপতির আসনপ্রাপ্তি আছে, তার বেশী নয়। এখানে চিরকালীন। যেতে নাহি দিব। শরীর, মন না চাইলেও, দল যে চাইবে শেষ দিন পর্যন্ত। রাজনীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ঢুকে গিয়েছে। পৃথিবীর যাবৎ চাকুরি বা কর্মে প্রবেশগত যোগ্য়তার প্রয়োজন। প্রবেশ যোগ্য়তা যে শুধু ছাঁকনির কাজ করে তাই নয়, মানুষকে ঐ কর্মের জন্য় পারদর্শী হতে উৎসাহিত করে এবং ঐ কর্মে সফল হবার প্রয়োজনীয় মানের সক্ষমতার অর্জনের বোধ জাগায়। অবশ্য় রাজনীতিতে প্রবেশ যোগ্য়তার কোনো প্রয়োজন নেই, তাই মাপকাঠিরও কোনো ব্য়াপার নেই। নেতা হতে হলে বংশপরিচয় আর যোগাযোগটাই জরুরী। এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক ব্য়ক্তিসমূহের কাছ হতে কি-ই বা প্রত্য়াশা করতে পারি? এদিকে রাজনীতি সম্পদ আনার আর জোগানোর মূল শক্তি। কিছু স্বার্থান্বেষী মানবের হাতে পড়ে রাজনীতি আর দেশের হয়েছে দফারফা। স্বাধীনতার আমলের সংগ্রামী রাজনীতি আর আজকের রাজনীতি অবশ্য়ই আলাদা আলাদ বিষয়। আজকের রাজনীতি ক্ষমতাপ্রাপ্তি আর ক্ষমতার কুক্ষিগততার কাহিনী বিশেষ। কিন্তু মানদন্ডহীনতায় এই রাজনীতি মাৎসন্য়ায়ের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। বাঙ্গালী হিসাব কষে: তুমি ভালো না খারাপ? তুমি কোন দলের? ঘটনাচক্রে তুমি সহমতের না হলে, বিপদ অবশ্য়ম্ভাবী। দলের আর বাহুবলীদের আস্ফালন চলবে তোমার শরশয্য়া বা কঙ্কটশয্য়ায় পতন না হওয়া পর্যন্ত। এই অভিমুখের অবশ্য় পরিবর্তন আশু কর্তব্য়। মাঝামাঝি কেউ থাকতেই পারেন। তোমার সর্বকর্মে আমার উৎসাহ- উদ্দীপনার অবকাশ নাও থাকতে পারে।  এমতবস্থায় আমি তোমার বন্ধু না হলেও, অমিত্রও না হতে পারি। কিছু তো মানদন্ডের মানবসমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই মান্য়তা থাকা উচিত। নইলে অন্য় অবোলা প্রাণীকুল হতে আমরা তথাকথিত সভ্য় কিসে? অপার বুদ্ধির অধিকারী কিসে? আত্মনিরীক্ষণ আর বুদ্ধের মঝ্ঝিম পন্থায় বাঙ্গালীমনে শান্তির অবকাশ আনবে। উগ্রতা, রূঢ়তায় ঠান্ডার প্রলেপ দেবে। আমরা একই জাতি, সবাই অমৃত্য়স পুত্রাঃ! ধংসাত্মক ভূমিকা ছেড়ে, গঠনাত্মক ভূমিকার দিকে বাঙ্গালীর সুষম মনোনিবেশ অত্য়ন্ত জরুরি।

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সাচ্চা-ঝুটা

প্রবন্ধ

SaswatiBhattachrya.png

সাচ্চা-ঝুটা

শাশ্বতী ভট্টাচার্য

ম্যাডিসন, উইস্কন্সিন

coffeehouse.jpeg

লেখক পরিচিতিঃ - যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে CSIR এর Indian Institute of Chemical Biology তে গবেষণা করেন এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে Ph.D ডিগ্রী অর্জন করেন। আমেরিকার National Institute of Health এর অন্তর্বতী National Cancer Institute এ কিছুদিন পোস্টডকের কাজ করার পর এখন ইউনিভার্সিটি অফ উইস্কসিন ইন ম্যাডিসনে ডিপার্টমেন্টের অফ মেডিসিনের সায়ান্টিস্ট। স্বামী ও কন্যা সহ ওঁনার বাস উইস্কন্সিনের শহর ম্যাডিসনে। পেশায় বিজ্ঞানী শাশ্বতী বাংলা ভাষায় লিখতে ও পড়তে ভালোবাসেন।

প্রথম দেখি অফিসের মিটিংয়ে। পিঁজা আর তার সাথে ডায়েট কোক। কি ব্যাপার? না হেলদী। এমনি কোকে তো অনেক চিনি, তাই ডায়েট কোক। শূন্য ক্যালোরি। হেলদী, স্বাস্থ্যকর। 

- সিরিয়াসলী ?

এরপরে এই শূন্য বা কম ক্যালোরির খাবার সব জায়গায় দেখতে শুরু করলাম। সভা-সমিতি, জলসা-ঘরে, বিবাহবাসরে। হোটেল-রেস্তোরায় তো বটেই। 

সত্তরের দশকে যার স্থান ছিল মেডিসিন ক্যাবিনেটে তা ছড়িয়ে পড়লো রান্নাঘরে, এমনকি পানীয় জল খাবার কুঁজোতেও। আমার ডায়াবেটিক দিদা চায়ে স্যাকারীন মিশিয়ে খেতেন, তাই ওই কেমিক্যালটিকে আমার মা ঘরে মজুত রাখতেন, অবশ্যই তা থাকত আমাদের নাগালের বাইরে, ডেটল, বার্ণল আর এ্যনাসিনের সাথে। তবুও শান্তি ছিল, সেটা তখনও পূর্নবয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তারপর একদিন ওই শূন্য ক্যালোরিকে দেখলাম শিশুদের ব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্যে। প্রিয় বন্ধুর রান্নাঘরে দুধ, ডিম, ময়দা, তেল, ইস্টের পাশে পাতার পর পাতার কৃত্রিম চিনির স্যাচেট। শুধু তাই নয়, কেকের সমারোহ বৃ্দ্ধি করার নানা রং-বেরঙএর আইসিং, ফ্রস্টিংয়ের যে সমাহার, তার উপরেও কালো কালির বড়ো হরফে লেখা শূন্য ক্যালোরি কথাটা চোখে পড়লো।

- 'এইখানে এইগুলো কি রে? তোর ছেলে তো সবে দুই, আর মেয়েটা এই সেদিন থেকে স্কুলে যাচ্ছে? ওরা কি ডায়া...? বলতে বলতে থেমে গিয়েছি। এই রকম একটা অশুভ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আমার একান্তই অনুচিত নয় কি?

- 'আরে বলিস কেন? আমার মেয়ের খুব রান্নার সখ বুঝলি? এই বয়সেই ও যা রান্না করে না! নির্ঘাত এমেরিল লাগাসের ঠাকুরমা ছিল গতজন্মে। দেখ না দেখ, এই কুকি, এই কেক, এই প্যস্ট্রি বানিয়ে চলেছে। তারপর উইক-এন্ড হলো কি না, আসে পাশের গাদাগুচ্ছের সাদা কালো সব বন্ধুবান্ধবকে ঘরে ডাকবে..., ওই সব ডেসার্ট বানাবে, খাবে আর  ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলবে।আসলে ওর বাবারও তো ভিডিও গেমের শখ, তাই আমাদের বাড়িতে ভালো স্টক আছে। হই হই করে কথাগুলো বলে বন্ধু আমার দিকে তাকায়, সম্ভবত কিছু পড়েছে আমার ভ্রকুঞ্চনে, ... চিন্তা করিস না, ওগুলো সব জিরো ক্যলোরী। ভিডিও গেম খেলাটাতে তো তেমন কোন এক্সারসাইজ নেই! বুঝলি না? এক ঢিলে দুই পাখি।

- 'না। বুঝলাম না বন্ধু। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা, সাচ্চা-ঝুটা ঝুটা-সাচ্চা সব কি আমরা গুলিয়ে ফেলছি? এতো ঠিক মঙ্গলময় বার্তা নয়। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। জিভকে নকল মিষ্টির স্বাদ পাইয়ে নয় তো ফাঁকি দেওয়া গেল, কিন্তু এই মিষ্টির ব্যপারটা জিভেই শেষ হয় কি? জিভ থেকে যে বার্তাটা মগজ মানে, যাকে আমরা ইংরাজীতে ব্রেন বলি তার কথা মনে রেখেছো তো বন্ধু? বার্তাটা পাওয়ার পর শরীরে অন্তত এক প্রকারের হরমোনের ক্ষরণ হতে পারে তার কথাটা মনে রেখেছো তো বন্ধু? সেদিন বলতে পারিনি। 

মাধুকরীতে আমার এই লেখাটা আজ তাই বন্ধু, তোমায় দিলাম।

বাজারে আরো তো চারটে স্বাদ আছে, তবে কেন মিষ্টির প্রতি এই আকর্ষণ? ব্যপারটা জটিল নয়, যদি মেনে নিতে পারি যে “মিষ্টি” শুধু মাত্র একটা স্বাদই নয়। কেন মিষ্টির দিকে আমাদের এই অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক, তা বোঝার জন্য বেশী দূর নয়, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর আগের কথা ভাবলেই চলবে।

জীবাশ্ম বিজ্ঞান অনু্যায়ী প্রায় ২.৬ মিলিয়ন খৃষ্টাব্দে মানুষের পূর্বসূরী Hominids এর দেখা পাওয়া যায়। যদিও Neolithic (New Stone age, আনুমানিক খৃষ্টাব্দ ১০,২০০ সাল) যুগকে মনুষ্য  সভ্যতার শুরুর যুগ বলা যেতে পারে, বুঝতে হবে, তারও প্রায় ১৯০ হাজার বছর আগের Paleolithic (Old-Stone age) যুগে আজকের মানুষ বা Homosapien এর আবির্ভাবকাল। সবে বন্য জন্তু জানোয়ারের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পাথরের ব্যবহার সে শিখেছে বটে, কিন্তু অন্য সমস্ত জীবিত প্রাণীর মতো নিছক প্রাণ ধারণের জন্য মানুষেরও দরকার ছিল খাদ্যের।

তার সেই অস্থায়ী যাযাবরের জীবনে না ছিল কোন বাসস্থান, না ছিল কোন নির্দিষ্ট খাবারের সরবরাহ, না ছিল বিশেষ একটা বাছ-বিচার করার পরিস্থিতি। তার বেঁচে থাকা, অথবা না-থাকা প্রধানতঃ কার্বোহাইড্রেট তথা গ্লুকোজের ওপর নির্ভর-শীল। নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সেই গ্লুকোজের রূপান্তরিত হয়ে তৈরী হবে এটিপি নামক এক অণু। যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির মুদ্রা (Currency) এই অণুটি।

অতএব, বিবর্তনের সহজাত কর্ষণে মানুষ বুঝতে শিখেছে কিভাবে পরিশ্রমকে এক রেখে বেশী গ্লুকোজ তথা এটিপি পাওয়া যেতে পারে। মিষ্টি পাকা ফলটা তাই, কাঁচাটার থেকে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয়। এইভাবেই সদ্য জাত শিশুর প্রথম খাদ্য মায়ের দুধে মিষ্টি এবং তা উপভোগ করার জন্য যেমন জিভে তার উপযোগী স্বাদ-কলিকা, ব্রেনেও তেমনি, চিনির সরসতায় নির্দিষ্ট আনন্দানুভূতি এসেছে। এর অন্য প্রান্তে অদূর ভবিষ্যতে অনাহারের সম্ভাবনায় যতটা প্রয়োজন ঠিক ততখানি খরচা করে বাড়তি গ্লুকোজকে ফ্যাটের আকারে গড়ে মজুত করে রাখার আয়োজন হয়েছে।

বন্ধু, বলা বাহুল্য এই  ভাঙ্গা আর গড়ার কাজগুলি করার জন্য যার অবদান অপরিহার্য, তিনিই সেই সুপ্রসিদ্ধ ইনসুলিন হরমোন জগতের Swish army knife, কিম্বা সর্ব-ঘটের কদলী বৃন্ত। প্রাণী জগতে এই ভদ্রলোক ইনসুলিনটি বাবুটির আবির্ভাবকাল নিয়ে নানা গবেষণা থেকে বলা যায়, ইনি অতিবৃদ্ধ।

অন্তত পক্ষে মিলিয়ন বছর আগে তো বটেই, কেউ কেউ বলেন তার চেয়েও আরও আগে!আজকাল দেখেছি অনেকে সাদা চাল, ওরফে ভাত পাউরুটি ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেটকে শুধু কার্ব বলে ডাকেন (এবং বেশ ছিঃ ছিঃ কারও করেন)। ভুললে চলবে না চাল যেমন কার্বোহাইড্রেট, যে কোন ফল, সবজি, ডাল, দুধ, আলু, ভুট্টা, ওটমিল সব কিন্তু সেই একই। কার্বোহাইড্রেট এক ধরণের অণুর বংশগত নাম। গ্লুকোজ এই কার্বোহাইড্রেটের গোত্রের সব থেকে সিধাসাদা সদস্য, এবং এই প্রবন্ধে একেই আমি সুগার, কিম্বা মাঝে মাঝে চিনি বলি ডেকেছি। নানা বিপর্যয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে, বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কার্বোহাইড্রেট আহরণ করার জন্য এবং তাকে ঠিক মতো ব্যবহার করার এই যে রীতিমতো এটা অখণ্ড (ফেল প্রুফ) একটা সিস্টেমের উদ্ভাবন হয়েছে প্রকৃতিতে, ভাবলে অবাক হতে হয়। অতএব পাঠক, পাকা আমটি মুখে দিয়ে যে সুখ, সেই সুখ এক-দুই দিনের মামলা নয়, বিগত কয়েক শত হাজারের বছরের বিবর্তনের আমদানি। মিষ্টির আকর্ষণ তো শুধু মাত্র

জিভেই সীমাবদ্ধ নেই, লাল টুক-টুকে স্ট্রবেরীটিকে তাই চোখে দেখেও সুখ! ওটা মুখে পড়লে ব্রেন যে “আহা আহ্ আহা” বলে জানান দিয়ে উঠবে। তুমি আমি বন্ধু তো নশ্বর মানুষ, মেরে কেটে একশো বছরের আয়ু।

কৌতূহলী পাঠকের জন্য জানাই, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর যাবতীয় দৃশ্য বা অদৃশ্য কাজ করার জন্য প্রয়োজন এটিপির। সাধারণতঃ  গ্লুকোজ (তথা অযৌগিক কার্বোহাইড্রেট) থেকে এটিপি উৎপাদন হয় বটে, তবে ফ্যাট এবং সবিশেষ প্রয়োজনে আমাদের শরীর প্রোটিন থেকেও এটিপি উৎপাদন করে, (তার আগে কিন্তু সেই প্রোটিন থেকে কোন প্রকারে গ্লুকোজ বানাতে হয়) তবে সেটা কেন ঠিক অভিপ্রেত নয় আজকের প্রবন্ধে সেই আলোচনায় যাবো না। মিষ্টি শুধু খেতেই নয়, মিষ্টি নিয়ে লিখতেও সুখ।  হ্যাঁ, আধুনিক মনুষ্য-সমাজ ঠিক এই রকম  পরিস্থিতির কবলে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, রাসায়নিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে, আঁখ থেকে হোক, বা  ভুট্টা দানা থেকে হোক, আমরা চিনিকে ঘনীভূত করতে শিখেছি। আর যেই না তা পেরেছি, আমাদের চেনা প্রায় সমস্ত খাদ্যে আমরা মিষ্টি দিতে শিখেছি, মুখে দেওয়ার মতো কিছু হলেই হলো, রুটি, পাউরুটি, ভাত, ডাল, মাংস, মায় ওষুধ...। A spoonful of sugar helps the medicine go down, in the most delightful way!

আর তার ফল? শিকারী খুদ ইহা শিকার হো গয়া!

বেঁচে থাকার তাগিদে যে গ্লুকোজ তথা  মিষ্টির দরকার ছিল এবং তাকে ভালো লাগার এবং সংযতভাবে ব্যবহার করার যে উপকরণ বিবর্তনের রাস্তা ধরে আমাদের মস্তিকে, শরীরের বিভিন্ন  অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রোথিত হয়েছিল তা আজ এক আশ্চর্য আসক্তি হয়ে বহু মানুষের দূর্বিসহ জীবন এবং ক্ষেত্র-বিশেষে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি বহু মানুষের কাছে অবিকল সিগারেট বা মদের মতো নেশাকারক এবং জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সেই নেশায় এনারা আক্রান্ত। বলা বাহুল্য বাড়তি চিনি ইনসুলিনের প্রভাবে ফ্যাট বা বাড়তি ওজনে পরিণত হয়েছে এবং আদমশুমারি অনুযায়ী গত ২০১৫ সালে, সারা পৃথিবীতে বাড়তি ওজন মনুষ্য সভ্যতার প্রায় ৩০ শতাংশকে (২.২ বিলিয়ন) অসুবিধায় ফেলেছে।তা হলে উপায়? নাহ, কোন চিন্তা নেই!

যে বিজ্ঞান গোটা আঁখকে ছিবড়ে করে তার হৃদয় থেকে বার করে এনেছে জমায়িত চিনির স্ফটিক মানিকটিকে, কিম্বা ভুট্টার রস থেকে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে গ্লুকোজের ভাই ফ্রুকটোজকে সেই বিজ্ঞান এবার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে বেশ কয়েক প্রকারের আর্টিফিসিয়াল সুগার, বিগত কয়েক হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হওয়া আমার মগজ যাদের মোটেও চেনে না। 

এই ‘অচেনা” চিনিগুলোকে তাদের চরিত্র অনুযায়ী গোষ্ঠীবদ্ধ করলে, যারা এক্কেবারে রাসায়নিক দ্রব্য তারা হলো Sweet'N Low (Saccharin), Equal, NutraSweet (Aspartame), Sweet One (Acesulfame potassium) Neotame (Aspartame বড়ো দাদা)। এর পরে লাইন দিয়ে এলো Erythritol, Isomalt, Lactitol, Maltitol, Mannitol, Sorbitol, Xylitol, Splenda (Sucralose) প্রভৃতি। এরা চিনি কিন্তু চিনি নয়, এরা Sugar alcohol। মোটামুটি চিনির মতো একটা অণু, তার সাথে একটা আরেকটা অণু এমন করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এদের মধ্যে যে আমাদের সেই সুপ্রসিদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ ইনসুলিন বাবা-জীবন এদের ছোঁবেনও না, এরা মোটামুটি বাহ্য পদার্থ! বহু ক্ষেত্রে জোলাপের মতো এদের আচার ব্যবহার। এর মধ্যে Stevia নামক নকল চিনিটার মধ্যে যদি ও বা একটা প্রাকৃতিক- প্রকৃতিজ ভাব আছে, আসলে কিন্তু ওটিও Stevia rebaudiana নামক এক গুল্ম-ঝাড়ের পাতা থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে বার করে আনা পদার্থ (stevioside)।

তা হলে কি দাঁড়ালো? ভেবে দেখলে ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ। স্বাদের বিচারে এরা চিনি থেকে বহুতর গুনে মিষ্টি  হওয়া সত্বেও বাড়তি চিনি সংক্রান্ত কোন ঝামেলা থাকছে না। কেন না এরা তো মোটেও চিনি নয়, তাই ইনসুলিন নিঃষ্করণ হবে না ধরে নেওয়া যেতে পারে। আর কে না জানে ওই ইনসুলিনটাই তো যত্তো গন্ডগোলের মূলে। এই সে গ্লুকোজকে কোষের কাছে বিলি করে তার থেকে এনার্জি তৈরী করতে সাহায্য করছে, এই সে বাড়তি চিনিকে ফ্যাট তৈরী করে লিভারের কাছে জমা রাখতে এগিয়ে আসছে!

তা হলে তো মুস্কিল আসান? প্রবলেম সল্ভড।

না! ধীরে বন্ধু ধীরে। গবেষণা চলতে চলতে থাকল এবং প্রথম অন্তরায় দেখা গেল...।

যেমনটি ভাবা গিয়েছিল, দেখা গেল তেমনটি ঠিক হচ্ছে না। অচেনা চিনির কয়েকজন সদস্য ইঁদুরের শরীরে ইনসুলিন বাড়িয়ে দিচ্ছে! সত্যি? কৃত্রিম চিনির সপক্ষে যাঁরা তারা বললেন, --বুঝেছি।ইঁদুর ব্যবহার করা হয়েছে না? তাই। মানুষ আর ইঁদুর এক নাকি?

আসতে থাকল, ‘এই কৃত্রিম চিনিটা ওই নকলটার থেকে ভালো’র বিবৃতি, এবং একের পর এক নকল চিনিতে বাজার ছেয়ে যেতে লাগলো।

এই সব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, সেই চাপান উতোর চলতেই থাকল, আর অন্য দিকে, ১৯৮০ থেকে আজকের ২০১৮ সাল অবধি, বাজারে এতো প্রকারের কৃত্রিম চিনি এবং তাদের বিক্রি পুরো মাত্রায় বজায় থাকা সত্ত্বেও থেকে জন-সাধারণের ওজন বাড়তেই থাকল।

কেন? কোথায় বাঁধলও গন্ডগোলটা? উত্তরের আশায় গবেষণা এবং কারণের খোঁজে জল ঘোলা হতেই থাকল। 

জানা গেল, কিছু কিছু নকল চিনি খাওয়ার পর মানুষের শরীরেও ইনসুলিনের ক্ষরণ হয়। তখন সে প্রথমে খোঁজে তার অতি পরিচিত আসল গ্লুকোজটিকে (তারপরে হাত বাড়ায় ফ্যাট কিম্বা প্রোটিনের ওপর)। ফলাফল সরূপ- রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম, এবং মগজে ক্ষুধানুভূতির বার্তা। খিদে পেয়েছে! খাবার কই? খাবার চাই! এখুনি চাই। ফলাফল সরূপ-অতিভোজন।

জানা গেল, নকল মিষ্টি স্যাকারিন কোকেনের মতো বহুপ্রসিদ্ধ নেশার জিনিষের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় এবং নেশাকারক, অন্তত গবেষণাগারের কতগুলি ইঁদুর কাছে। ২০১৭ সালে মার্চ এবং ডিসেম্বরে প্রকাশিত হওয়া সুস্থ মানুষ নিয়ে করা দুটি প্রবন্ধের (Physiol Behav. 2017, 182:17-26, এবং International Journal of Obesity, 2017 41, 450–457) কথা উল্লেখ করবো।

এই দুটোতেই বক্তব্য যদিও বা সেই ‘আরো গবেষণার প্রয়োজন’ ভাবনাটা আছে, দুটোতেই গবেষকেরা কৃত্রিম চিনির কোন উপকারীতা দেখতে পারেন নি। উল্টে নিয়মিত কৃত্রিম চিনি সেবন যে পৃথুলতা বা ডায়াবেটিস নামক রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে এমন একটা স্টাডির (CMAJ. 2017;189:E929-E939) কথা  বলা আছে একটি  প্রবন্ধে।

আমি নকল মিষ্টির সপক্ষে নই এটা হয়তো এতক্ষণে বোঝাতে পেরেছি। আর রসগোল্লার বদলে যদি আপেল কিম্বা আমে মিষ্টি রসনা তৃপ্ত হয়, সেই চেষ্টাটাও তো করে দেখা যাক না বন্ধু। জলের মতো পানীয় আর হয় না কি?

বন্ধু, শেষ পর্যন্ত মানুষ অভ্যাসের দাস, কুকির বদলে কতগুলো ব্লুবেরী বা আঙ্গুর মুখে ফেলে দেখলে হয় না? হয়তো কয়দিনেই সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

কথায় বলে না “Prevention is better than cure”?

পরিশেষে বলি, পাঠক, মিষ্টি খেতে ইচ্ছা হলে মিষ্টিই খান না! আপনি নেশাগ্রস্থ কিনা সেটা আপনারই বিচার। ভালো থাকুন, রসে বশে থাকুন। 

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস

কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস

রাণাঘাট, নদীয়া, পঃ বাংলা

Sudipta-Biswas.jpg

নদী ও প্রেমিক 

পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে

অনেক না বলা কথা আছে নীল খামে।

ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী

শুনবে নদীর গান, কান পাতো যদি।

ও নদী কোথায় যাও? ছল ছল তানে?

দাও নদী দাও বলে জীবনের মানে।

ঘন্টার ঠুন ঠুন, আজানের সুর

নদী জলে মিশে যায় সোনা রোদ্দুর।

ছোট ছোট ঢেউ তুলে নেচে নেচে যায়

সব মেয়ে তাই বুঝি নদী হতে চায়?

ও নদী চলেছ বয়ে, নদী তুমি কার?

প্রেমিকটা প্রাণপণ কাটছে সাঁতার।

সাঁতরে সাঁতরে আরো  কতদূর যাবে?

কতটা গভীরে গেলে তবে তল পাবে?

নদীটা যেই না গিয়ে সাগরেতে মেশে,  

প্রেমিক ঘুমিয়ে পড়ে সঙ্গম  শেষে...

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

বৃষ্টি রে তুই আয় না ঝেঁপে আমাদের এই গাঁয়ে 
দে ছুঁয়ে দে মিষ্টি ছোঁয়া রাঙা মাটির পায়ে।
ওই যে মাটি, মাটির ভিতর শিকড় খোঁজে জল
বল না বৃষ্টি ওদের সঙ্গে খুশির কথা বল।
টিনের চালে অল্প আলোয় যখন ঝরিস তুই
পুকুর ভরে শালুক ফোটে বাগান জুড়ে জুঁই ।
আকাশ তখন সাত রঙেতে রামধনুটা আঁকে 
সেই খুশিতে টুনটুনিটা টুটুর টুটুর ডাকে। 
রামধনুর ওই সাতটি রঙে মন হারিয়ে যায়
অনেক দূরে তারার দেশে মেঘের সীমানায়।
মাছের খোঁজে পানকৌড়ি ওই তো দিল ডুব 
বৃষ্টি নামুক  বৃষ্টি নামুক টাপুর টুপুর টুপ...

আগডুম বাগডুম

আগডুম বাগডুম ওই ঘোড়া ছুটল
ভোরবেলা চুপিচুপি ফুলটাও ফুটল।
বাগানেতে টুনটুনি টুই-টুই ডাকছে
গুনগুন মৌমাছি ফুলে মধু চাখছে।
ছপছপ দাঁড় টেনে নৌকারা চলছে

ছলছল কলকল নদী কথা বলছে।

আকাশের মগডালে ওই চিল উড়ছে

চিকচিক রোদ্দুরে পিঠ তার পুড়ছে।

চুপিচুপি মেঘ এসে সূর্যকে ঢাকল

তারপর রেগে-মেগে গুরগুর হাঁকল।

কড়কড় বাজ ফেলে মেঘ যেই থামল

টুপটাপ ঝিরঝির বৃষ্টিটা নামল...

নগ্নতা

 

রাতের কাছে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই

বরং ও রাত ঘন কালো চাদর মুড়ে

ঢেকে রাখে আমার যত নগ্নতা সব।

ওই আকাশে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই

বরং আকাশ ছাতার মত মাথার উপর

মুড়ে রাখে সবকিছু  তার বুকের ভিতর।

​জল বাতাসে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই

তারা বরং একটু বেশি খুশি হয়েই

ফিসফিসিয়ে বলে কিছু বাড়তি কথা।

​নদীর কাছেও নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই

বরং নদী ছলাত-ছলাত ছন্দ তুলে

নগ্ন হয়েই আমায় শুধু নাইতে বলে।

​বন-পাহাড়ে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই

বরং তারা খুব খুশিতে দুজনেই চায়

আমি যেন খালি পায়ে যাই হেঁটে যাই।

​পশুপাখিওদের কাছেও লজ্জা তো নেই

বরং তারা বন্দুক আর চশমা-টুপি 

এসব ছাড়াই সত্যি কোনও বন্ধুকে চায়।

​এই পৃথিবীর সত্য যারা তাদের কাছে

নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই,লজ্জা তো নেই

কারণ সত্য নগ্ন হতে লজ্জা পায় না।

​মানুষ দেখে নগ্ন হতে লজ্জা করে

মানুষগুলো লুকিয়ে রাখে নিজের মুখও

তার শুধুই মিথ্যে বলে, মুখোশ পরে।

​এই সমাজে নগ্ন হতে লজ্জা করে

গোটা সমাজ মিথ্যেবাদী, ভ্রষ্টাচারী

নগ্নতা আর সরলতার সুযোগ খোঁজে।

 ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তবে তো নাচবো ভাই

তাধিন তাধিন...

পোড়া বিড়ি দেব ছুঁড়ে ফেলে।

ফেলে দেব তামাকের শিশি

ছেড়ে দেব সব ছাইপাঁশ

তেতো জল, বিলিতি বা দিশি।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তবে তো গাইবো ভাই

গলা ছেড়ে যা আসবে মনে

বাতাসকে বলে দেব আমি কত সুখি 

আকাশকে বলে দেব আমি কত সুখি 

পাহাড়কে বলে দেব আমি কত সুখি 

তারাদের বলে দেব আমি কত সুখি। 

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তাহলে তো  ভাই

হয়ে যাব ফুল, পাখি, নদী।

ভালবাসা ফিরে পাই যদি -

নরম পালক নিয়ে

রামধনু রঙ মেখে এসে

বয়ে যাব তির-তির,

পাহাড়ের দেশে।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তবে তো বাঁচবো ভাই

সমস্ত জীবন।

প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে বেঁচে

প্রতিটা শরৎ বেঁচে বেঁচে

প্রতিটা বছর বেঁচে বেঁচে

প্রতিটা দশক বেঁচে বেঁচে

তবুও তো ভরবে না মন।

বলে যাব, 'বড় ছোট এ জীবন।'

বাক্যহারা

বলা কথারা আটকে রয়েছে চোখে

অবুঝ মনের বোবা কান্নার মত

আজকে এখন পাথর চোখেতে শুধু

হারানো আবেগ পুরানো দিনের ক্ষত।

​বুঝলে না কিছু বুঝতে চাওনি বলে

সুরের ইশারা সুরকার শুধু জানে

দূরের বাতাস দূরে চলে যায় আরও

মন শুধু বোঝে হারানো গানের মানে।

​এসেছিল যেটা একদিন নিঃশব্দে

বাতাসেও ছিল চুপিচুপি আসা যাওয়া

রূপকথা দেশে হারানো বিকেলগুলো

সবটাই যেন মিথ্যে অলীক মায়া।

জীবনের খাতা ভাসানোর পর পর

দুচোখ ভেজায় অঝোর অশ্রুধারা

অল্প দুঃখে সশব্দে কেঁদে ওঠে

গভীর দুঃখে ঠোঁটেরা বাক্যহারা

কবিতাঃ প্রসেঞ্জিত ঘোষ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ প্রসেঞ্জিত ঘোষ

"আমি আর লিখতে পারি না"

মি আর লিখতে পারি না মণি!

তোর ‌জন্য ভালো ভালো কবিতা-

আর আসেনা আমার কলমে।

জানি তুই আমার কবিতা ভালোবাসতিস

এলোমেলো যাই লিখি না‌ কেনো।

ঘুম চোখে ও বারবার পড়ে

ঠিক ভুলটা ধরিয়ে দিতিস।

আর সে সব হয় না এখন।

জানিস আমিও খুব মিস্ করি

সেইসব দিনগুলো...

যেদিন প্রথম তোর ‌জন্য কবিতা লিখেছিলাম,

খুব মনে আছে.. একদম বাজে হয়েছিল।

তবুও একমাত্র তুই ই প্রশংসা করেছিলিস

খুব বাজে হয়েছিল জেনেও।

জানিস মণি আজ খুব মিস্ করি তোকে

যখন ই একা থাকি।

কেও আর আজ‌ তোর মতো

সারাদিন বকবক করে না

প্রতি সপ্তাহে ঘুরতে যাওয়ার ও‌ আর কেউ নেই।

আমি এখন দামোদর এর পাশে

পড়ে থাকি একা হয়ে।

সময় ও কাটে ... মলিন হয়ে।

আর স্মৃতিগুলো জড়িয়ে ধরে

আস্টেপিস্টে।

কাজের ফাঁকে গোধূলি বেলায়

নানান জিনিস মাথায় আসে

কখন কখন খুব ই ইচ্ছে করে

আবার তোর জন্য কবিতা লিখি

কিন্তু সত্যি আর আমি লিখতে পারি না

তোর ‌জন্য...

মণি আমি আর লিখতে পারি না।।।

newspaper.jpg
কবিতাঃ সৌমিলি ঘোষাল

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সৌমিলি ঘোষাল

Project 118.jpg

বছর দশেক পর​

ছর দশেক পর

আমি ঠিক এমনই একটা দিনের কথা ভেবেছিলাম,

যেদিন বাতাসে ভেসেছিল আম্রমুকুলের মৃদু সুবাস,

কুসুম বনে উঠেছিল ঢেউ,

নবজাতকের আগমনের তীব্র উন্মাদনা ছিল মনে,

উথাল পাথাল ছিল -

দখিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা আমার আঁচল,

আমি ঠিক এমনই একটা দিনের কথা ভেবেছিলাম

যেদিন ছিল তোমার আসার কথা।

তারপর হয়ে গেলো বছর দশ -  বারো,

মাঝে তিস্তা তোর্সা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল,

ধূসর স্মৃতিতে লেগেছে সময়ের প্রলেপ,

কষ্ট ধুয়ে জমেছে একরাশ অভিমান,

কিন্তু ফিরে আসার কথা ভাবনি তুমি।।

মন

ই সুদূরে যায় হারিয়ে

বিস্তৃত বালুরাশি

ওই আকাশে ঐ ছুয়ে যায়

একটু নীলের আভা

হাত বাড়িয়ে যেই ছুঁতে যাই

বাঁধন হারা ওই সীমানা

অমনি সেথা যায় হারিয়ে

এক নিমেষে ছড়িয়ে ধুলো

মেঘের ফাঁকে ফাঁকে

জন্ম যেথা মৃত্যু সেথা

যুগান্তরে যায়না বৃথা

সেই সীমাতে নিমেষ হারা

পাগল পারা মন।।

বন্ধু তুই

তুই-ই আমার মনের কথা,
কান্না হাসির গান
তুই -ই আমার সুজন মাঝি ,
কুহুদের কলতান
তুই- ই আমার চাঁদের আলো,
জোৎস্না মাখা প্রহর
তুই -ই আমার অতলান্ত,
অনুভূতির অবসর।

অসমাপ্ত

মি বেসেছি ভালো ওই নীলদিগন্তের, রামধনু মাখা ওই স্বপ্নগুলোকে।

আমি বেসেছি ভালো ওই একরাশ ধুলো মাখা স্মৃতিগুলোকে,

আমি থাকতে চেয়েছি একা  -

হৃদয়ের আঁকাবাঁকা

গোলক ধাঁধার ওই শুকনো গলিতে

আমি স্পষ্ট দেখেছি ওই

সেতারের সুরে বাজে

মলিন যন্ত্রণার নীরব প্রকাশ।

তাই এসেছি ফিরে আমি

তবু বারে বারে এই

জীবনের খাতায় গল্প লিখবো বলে

হয়ত থাকবো একা

দাঁড়িয়ে থাকবো তবু,

দেখবো আমায় ফেলে

এগিয়ে যাচ্ছে সব

চোখ মেলে তবু আমি

দেখবো দুচোখ ভরে

নতুন পৃথিবীটা নতুন করে।

কবিতাঃ যশমন ব্যানার্জী

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ যশমন ব্যানার্জী

উইনচেস্টার, ভার্জিনিয়া 

দার্জিলিং


কুয়াশায় নির্জন বাঁকা পথ
হাজার বাঁক ঘুরে ঘুরে
জড়িয়ে ধরে ঘোলাটে সবুজ পাহাড়
ভোরে চান করে ঠান্ডা তুষার কনায়
ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ চোখে মুখে ছুটে আসে
কথা বলা নিশ্বাস সেই ধোঁয়াতেই শান্ত
অল্প অল্প করে বেরিয়ে আসে মানুষ বাড়ি ঘর
কেমন যেন অচেনা স্বপ্ন কেটে গেল শোরগোলে
হোল্ডঅল নিয়ে স্টেশনে গরম চা
এবার দেখব নতুন স্বপ্ন কিছুদিন
তুমিও কি বদলেছ? দার্জিলিং?

কখনও রবীন্দ্রনাথ

কটা মেটে রোদ জড়িয়ে আছে শহর
ধোঁয়ায়, শব্দে ভরে গেছে উপেক্ষিত সূর্যাস্ত
ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে হাজার কলেবর
এদিক থেকে ওদিক দিকভ্রানত উদ্দেশ্যহীন
অপ্রয়োজনের জীবন এখন জীবনমুখী সাজে
প্রিয়জন আর প্রয়োজন নেই ব্যস্ততায়
নিজের জন্যেই টিঁকে থাকার তাগিদে
ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে হাজার কলেবর
এসবের মাঝে ভুল করে চোখে পড়ে
ফুল আকাশ আর কখন রবীন্দ্রনাথ

robi.jpg
কবিতাঃ ধীমান চক্রবর্তী

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ ধীমান চক্রবর্তী

আকাশ

ছোটোবেলায় আকাশখানা..
ছিলো অনেক বড়ো,
বড়োরা সব বলতো তখন..
"বড়ো হয়ে ওঠো!"
উঠতে উঠতে ছুটতে ছুটতে..
বড়ো হবার পরে,
ছোটোবেলার বড়ো আকাশ..
হঠাৎ বড়ো ছোটো!
ইচ্ছেমতো ছোটাছুটির..
অবাধ ছেলেবেলা,
জানি না কোন ছোটার টানে..
নিলো কখন ছুটি!
ছুটির ঘন্টা মনের কানে..
হঠাৎ গেলো বলে..
"চল না আবার
..ছেলেবেলার আকাশ হয়ে উঠি!"
আকাশ হবার ইচ্ছেটাকে..
অনেক হিসেব কষে,..
.. আটকে দিয়ে সামলে চলি..
..বড়ো হবার ঠেলা,
বাচ্চাগুলোর বড়ো হবার..
..ইচ্ছে ডানা মেলে..
উড়তে থাকুক..
তোমার আমার সবার ছোটোবেলা!!

আয় বৃষ্টি

জানিনা আজ তুমি কেমন আছো..
আজকে কীসের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচো..
জানি না! তাই জানতে চাই না আর!
তবু হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করে..
দিশাবিহীন ছুটতে থাকার ভিড়ে..
সব পাখি কি এলো বাসায় ফিরে?
আলতো পায়ে নামছে অন্ধকার!
জানতে চাওয়া! কী আসে যায় তাতে?
ব্যস্ত জীবন বইছে নিজের খাতে..
দেখছি তাকে জমকালো আয়নাতে..
নিজের মাপে বানিয়ে তোলা ফ্রেমে!
ভিতরবওয়া শুকিয়ে যাওয়া নদী..
রূপকথারা বৃষ্টি হয়ে যদি
জল ভরে দেয়! আপত্তি নেই তাতে..
কাঙাল জীবন উঠুক ভরে প্রেমে!
ছুটতে থাকা সবার ক্লান্ত মুখে..
চাওয়া পাওয়ার হিসেব-জ্বলা বুকে..
চাইছি! কেবল চাইছি যে বুক ঠুকে..
ভালোবাসার বৃষ্টি আসুক নেমে!!

শ্রাবণ

কাল সারারাত ধরে.. 
আমার ঘুম আসেনি চোখে,
গাছের পাতায় জলের ফোঁটা..
পড়ার শব্দ শুনে..
সোঁদা মাটির গন্ধমাখা মনে..
সারা আকাশ আমায় নিয়ে..
বেরিয়েছিলো খুঁজতে শুধু তোকে!

নাম না জানা ফুল..
যেখানে নিজের মতো ফোটে,
মেঘেরা সব দলে দলে
নতুন কিছু করার তালে..
জানিনা আজ কীসের টানে..
সেই আকাশেই জোটে!

যে আকাশে উড়তো আমার..
ছোটোবেলার স্বপ্নমাখা ঘুড়ি,
স্বপ্নধোয়া টুকরো নিয়ে..
হেলাফেলার রং মাখিয়ে..
স্মৃতির পাতা যত্ন করে জুড়ি!

সেই পাতাটি দিয়ে আমার..
নৌকোখানা ভাসিয়ে দিলো মন,
বুকের ভেতর অঝোর ধারায়..
জলের পড়ায় পাতার নড়ায়..
ভেজাও আমায় বাইশে শ্রাবণ!!

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ ভাস্কর সিনহা

দোহা, কাতার

Bhaskar Sinha.jpg
কবিতাঃ ভাস্কর সিনহা

স্মৃতিসুধা

 

তালডিংলি পেরিয়ে, ময়নাগুড়ি এড়িয়ে,

তিস্তাপাড়ের মংপোতে

হয় দেখা।

ইল্শেগুড়ির মতো বৃষ্টি ছিলো সেসময়।

মূর্তির জলে মিলিয়ে যখন যায় চাপরামারি আর

গোরুমারার আরণ্য়িক কুহকতা।

হাজারো পক্ষীর ঐক্য়তানের আবেশ,

মনভরা রঙ্গিন সে উচ্ছ্বাস।

টিক, শাল, শিমূল, শিরীষ আর খয়েরের উদ্দামতা পেরিয়ে,

বিষহারা পালায় রাজবংশী নৃত্য় শেষে, মাগুরমারির করমে।

বন্য়েরা বনেই আনন্দিত, দেখতে দেখতেই দামাল

ঐরাবতে বস্কাদ্বার

যায় যে পেরিয়ে।

চালসা- খুনিয়া- ঝালং পথে বিন্দুপ্রান্তে সিন্ধুমাখা

কাঞ্চনজঙ্ঘা।

পুণ্য়ব্রতা তোর্সায় অবগাহনে সিদ্ধপ্রাণা।

চায়ের মেজাজী

আবেশ বয়ে চলে ভিজে, শীতে মোড়া ইংরেজী বাংলোয়।

প্রথম প্রেম

শুরুর পথে- প্রথম কর্মে আসা, এইস্থানেই।

ভোলার নয় লখুয়ার

শীতের ক্ষণেক রোদে নিস্পাপ সেই হাসি।

কেবল সাহেবের জুতাছাপ

শুকিয়ে যায় যে তার পিঠে।

আর নাম না জানা এক সুবেশী নেপালী গুড়িয়ার

উচ্চকিত হাস্য় খালি ডানা ঝাপটে নামে সমতলের মেদুর পথে।

সাঁঝের পলাশ  

ফুটপাত জুড়ে ঝেঁপে নামে সাঁঝ,

আঁধারঘিরে ধরে দিবালোকের গ্লানি।

টিমটিমি জ্বলেতারাবৎ কিছু বাতি।

দগ্ধোদর কৈশোরের জ্বলৎস্বপ্ন মিশে যায় কুয়াশায়, 

পোড়া ছাই ছন্নছাড়া দিগ্বিদিকে,

যেদিকে খুশী- হাওয়ায় ঘুড্ডি ওড়া। 

কিছু দলা ভস্ম জেদী, আঁকড়ে থাকে যেন পুঁটুলির পাশে।

দুদিনের এই রাগ, ক্রোধ, আবেগ প্রশমিত যবে রমণে,

লোভে, হীনতায়- সাধারণ মানে। 

দুহাতে কুশ্রীতা মেখেছি কতো?

জানে কি এক ভারতেই শত কোটি ভারত?

নিরন্নের, বাদীর- বিবাদীর, জাতির- বেজাতের,

ধর্মের- অধর্মের, উচ্চ- নীচের, ভাবের- অভাবের,

দুঃখের- সুখের-কারে ছাড়ি- কারে যে ধরি?

হায় রে, সব যে বসে আপনার সনে।

কখনো নিজের তরে তোমারে মানিনি।

ছিনিয়ে নিয়েছি-যত কুরুবিন্দ, ফিরাই দিয়াছি

তব শুধু কুরব আর কুরন্ড। 

মরুমহীরুহ
 
পশ্চিমের না কি, উত্তরাগত সেই হাওয়া?
সব এলোমেলো, খেঁজুরে পাতার
অবিন্যস্ত রূপে পাওয়া।

থমকে এসে দুয়ারে
শুষ্ক নিম ডাল, আধো ভঙ্গুর, হতভাগ্য পাতা।
উত্তরের সাগর মুকুটে, পূর্বে জনপদ,
এই মরুদেশে পথহারা তাই, ঢুঁড়ে মরেছি 
যোজন বিস্তর।

খুঁজে ফিরি সুবর্ণ মরীচিকায়
ঘুমে- আধোভ্রমে, গৃহস্থ মোরগের সুপ্রভাতীয় 
বন্দনায়।

কুয়াশাময় সেই প্রহেলিকা-
আদ্য়ন্ত নগ্ন যে, বাহুডোরে আগলে রেখেছে
নগ্নিকারে।

রসায়নে সিক্ত হয়ে জন্মিছে আখ্যান-
প্রেমে, আবেগে, আবিষ্ট বীজ মন্ত্র যে মহীরুহতার। 
শাখা-প্রশাখায় আকাশ চুম্বিতে,

ধর পাকড়ে
চন্দ্র-তারা।

মূলস্থ সজীবতার সন্ধানে, গহন মৃত্তিকায় আপনহারা।

crow.JPG

বিরস পরিভ্রমণ
 
শুভাকাক্ষী হে, অতি বিরস এ চলা।

কলাপত্রে পাত পেড়ে দুই দলা কিছু জ্বালা।

মদিরতার মোহ নেই যে সুলভ সুরায়-
আছে যা বিবশতায়, স্মৃতিবিবাগীতায় বা অন্তে রিক্ত বিবমিষায়।
স্বার্থকামী, স্বভূমে গগনব্যায়াপী লালসার হোমযজ্ঞে নিঃস্বের আহূতি।
প্রোজ্জ্বল যেন শীর্ষে মুকুটখানি আর অপরিবর্তনীয় সুশ্রী
কর্মকুন্ঠ সেই সিংহাসনী।

নিষ্প্রভ রিক্তের চকিত পশ্চিমা নিঃশ্বাস, 
চতুর্দিকে হারায়ে গেছে যে কবে।

ক্লেদাক্ত, মৃতপ্রায়, সর্বহারাগন উচ্ছিষ্টে খুঁজে 
মরে যে জীয়নকাঠি।

চার্চিলে হায়, আকাল কখনোই দেখে নাই কালাপানির পাড়ে।
কোন উপায়ে এই বাঁচা?

সহজিয়া আলো, বাতাসে আর জলের সন্তরণে বাঁচা যে 
অভিসম্পাতময়, পরিশ্রুতের সুদৃশ্য বিপননে দীন চেতন গেছে যে হারায়ে।
ফুরিয়ে যেতে- যেতে, প্রান্তিক হতে- হতে,

খামের রোগে মাথা কুটে মরা;
হয়তো বা মরিচঝাঁপির ছাউনিতে দুঃসহ এক দমবন্ধের দানবীয় লীলা।
জালিয়ানওয়ালাবাগ বলে যে, বা ইহুদিবস্তির নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ-
মানুষে- মানুষের সাংঘাতিক শত্রু এই শুধু নিশ্চিতরূপে বলা।

হিজিবিজি 
 
সরস সবুজাভ ডালে বয়স্থ পাতার কারিকুরি,
ইষৎ সবুজ বোঁটায় হলুদ ব্যাপ্তিতে মৌমাছির মধু চুম্বন।
বাউন্ডুলে সূর্যিজ্য়াঠা যবে পশ্চিমে দেবে পাড়ি, সধবার একাদশীতে
তবে চন্দ্রিমার ব্য়াকুলিত সম্ভাষণ।

সিক্ত জমির বীজে ফসল 
দিয়েছে উঁকি, গোলাখানায় আজ আর নেইতো কিছুই ফাঁকি। 
পেলব হস্ত ও শুভ্র শঙ্খগুলি যেন হর্ষিত কমল বনে, দূরাবাসে এসে
ক্ষণিকের স্মৃতিপটে অবিরল ছবি জন্মায় যে মনে।

আবছায়ারা খালি কথাই বলে ভোরের রাতে এসে।

আধোভ্রমে, আধোঘুমে, অধরা, নাধরা বাক্যবুলি কোথায় হারায় যে হেসে।

বেড়ার কোন গলে,
কার্নিশের ফাঁক পেলে, শীত ঘিরে আসে, শিশির ঝরে পড়ে সঙ্গোপনে। 
ঘাসের বুকে নিম ফুলের সুঘ্রাণ, ইতি- উতি ঝরে পড়া, রহস্যের আবিলতা।
মিলিয়ে যায়, হারিয়ে যায় অজানা বুনো পথের মতো।

চকিত ঝোড়ো আবহাওয়ায় যদি ফিরে আসে কিছু হারানো বাস, ধূলিধূসর কিছু ব্যথা।

নিজস্ব প্রাপ্তিযোগের স্মৃতি- সততই মেদুর।

খুঁজে ফেরা যার রঙমশাল আর হারানো সুর।

কবিতাঃ সন্দীপ ঘোষ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সন্দীপ ঘোষ

বাঁকুড়া, পঃ বাংলা

crow.JPG

রক্তচক্ষু
 

ক্তচক্ষু মুদিলে ক্ষণিক 
শান্তি একটু শান্ত নীড়ে।

মুদিত নয়নে ভাবিয়া ভাবিয়া সারা,
বিনা কবচে কবে লুটাইয়া দিবে উন্মত্ত কালবৈশাখী ঝড়ে।

আসিছে উৎসব দেখিছে জনতা, 
কি হয়! কি হয়! কি হয়!
প্রকৃতির মাঝে খাদ্য খুঁজিয়া মরে,
না-- আজ আর হয়রান নয়।

আসিছে উত্সব, আসিছে উত্সব---
তন্ত্রে তন্ত্রে হইতেছে ধ্বনি,
সঠিক ঠিকানায় পৌঁছিয়া যাইবে 
অনেকেই তাহা জানে।

অভিনব ভাবনার নাই কোন শেষ,
কলিকালে  আছে তা যে,
নিশানা ঠিকানা নিশানায়
হইলে অনুর্ত্তীন,
রক্তচক্ষুর দহনে পুড়িবে ঘিলু---

ঘিলু আর রহিবে না মগজে।

কবিতাঃ শান্তনু বসু

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ শান্তনু বসু

ছন্নছাড়া

প্রয়োজন আছে কবিতার,

তাই চাইনাও দিতে ছুটি

লিখতে পারিনা বলেই তো

গদ্য নাচায় ভ্রুকুটি।

মন চায় দিতে মতামত

ভয় দুচোখে "শমন" এর,

দুঃস্বপ্নের কারাগারে ঠাঁই মননের

সম্ভ্রম মাটিতে লুটোপুটি।

স্বপ্ন গিয়েছে ভেন্টিলেশনে

কোমায় রয়েছে বিবেক,

তেল মাখানোর দংশনে ক্ষত

বিক্ষত হাতে ভাগ্যের কাটাকুটি!

অর্থ লালসা ভোগ পুঁজিবাদে

সাজিয়েছে ডালি যৌবন,

মান সম্মান নিয়ত বিকোয়

দালাল চালছে গুটি।

শিক্ষক নামে ব্যস্ত মিছিলে

হাতে শিক্ষার বাটি

বন্ধ দরজা জোর তরজায়

বিদ্বজ্জন পরিপাটি।

দেশ গড়ার মহান কার্যে

যাতে না ঘটে দোষ ত্রুটি,

গোয়েন্দা গিরিটা ছেড়েছে প্রদোষ,

ফেলুদারা করে রাজনীতি।

strom.jpg
রবীন্দ্রনাথ ও কর্নেল মহিম

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ও কর্নেল মহিম:

বন্ধুতা-বিরোধ-বন্ধুতা

দিলীপ মজুমদার

বেহালা, পর্ণশ্রী, কলকাতা

images.png

র্নেল মহিমচন্দ্র। রাজা নন, কিন্তু ত্রিপুরা রাজপরিবারের এক প্রভাবশালী পুরুষ। বর্ণবন্ত চরিত্র তাঁর, তুলনাহীন ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক হরিশ মুখার্জীর মতো প্রথাগত শিক্ষা ছিল না তাঁর অথচ তাঁরই মতো ইংরেজি ভাষায় অনন্য পারদর্শিতা। দুজনেই স্বশিক্ষিত এবং বিচক্ষণ। দুজনেরই প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞান। তবে হরিশ ছন্নছাড়া, মদ্যাসক্ত; কর্নেল মহিম হিসেবি ও স্থিতধী।   

আগরতলার ঠাকুর পরিবারে ১৮৬৪ সালে মহিমের জন্ম। ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য মাত্র তিন বছরের। মহিমের পিতা ভারতচন্দ্র ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের রাজপরিষদ, মাতা সাবিত্রী রানি ভানুমতীর সহচরী। মহিমচন্দ্রের জীবনে সাবিত্রদেবী ছাড়া আর যে নারীর গভীর প্রভাব পড়েছিল তিনি তাঁর জ্যাঠাইমা। মহিমের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কুমিল্লা শহরে। তারপর তিনি চলে এলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না তিনি। কারণ অকৃতকার্য হলেন অঙ্কে। প্রথাগত লেখাপড়ায় ইতি এখানেই। অঙ্ক নয়, মহিমের রুচি ও অনুরাগ সাহিত্যে। তাই বলেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এবং সেই সূত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অনায়াস যাতায়াত, রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য। সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যালোচনায় হৃদয়কে রঞ্জিত করা। তবু বৈপরীত্য ও ব্যতিক্রম ছিল। রসের জগতে বিচরণ করেও মহিম রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্মের পাঠও গ্রহণ করেছিলেন। নবাব আবদুল লতিফ চিনতে ভুল করেন নি তাঁকে। তিনি মহিমকে নিয়ে এলেন লাটসাহেবের দপ্তরে। নিযুক্ত করলেন আবগারি দপ্তরের পরিদর্শকের পদে।ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র অনেকদিন ধরে নীরবে লক্ষ্য করছিলেন মহিমকে। ভাবছিলেন আর একটু পরিণত হলে বলা যাবে। কিন্তু যখন দেখলেন সরকারি চাকরিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত পাকা হতে যাচ্ছে, তখন ডেকে পাঠালেন মহিম-চন্দ্রকে নিযুক্ত করলেন তাঁর এ ডি সই পদে । সেই থেকেই মহিমচন্দ্র ত্রিপুরা রাজসভার সঙ্গে যুক্ত। সুদক্ষ প্রশাসক, নানা বিরোধের সেতু, নানা সংকটের পরিত্রাতা এবং কিছু ষড়যন্ত্রের শিকার।

ত্রিপুরার রাজপরিবারে যোগদানের কিছুপূর্বে মহিমচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। তরুণ রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ পাঠ করে আপ্লুত বীরচন্দ্র রাধারমণ ঘোষকে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন কবির কাছে। আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন:
“মহারাজ তাঁকে সুদূর ত্রিপুরা হতে বিশেষভাবে পাঠিয়েছিলেন কেবল জানতে যে, আমাকে তিনি কবিরূপে অভিনন্দিত করতে ইচ্ছা করেন।”
রাজা ও কবির পরোক্ষ পরিচয় ঘটল যখন মহিম তখন কলকাতায়। মহারাজের নির্দেশ এল তাঁর কাছে। মহিম জানাচ্ছেন:
“বাংলায় প্রকাশিত নতুন গ্রন্থ মহারাজ বীরচন্দ্রের নিকট পেশ করিবার ভার আমার মতো কিশোর সেবকের উপর অর্পিত ছিল, সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সহিত আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্বে পরিণত হয়।” বীরচন্দ্র মাণিক্যের উত্তরাধিকারী কে হবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব সংকট সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত রাধাকিশোরই রাজপদ লাভ করেন। মহিমছিলেন রাধাকিশোরের পক্ষে। রাধাকিশোরের রাজত্বকাল ছিল ১৮৯৭-১৯০৯। এই বারো বৎসরের সময়সীমায় রবীন্দ্রনাথ রাজার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ট হয়েছেন, তাঁর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন, নানা বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, প্রশাসন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। মহিমচন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা
 

বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই সূত্রপাত হয়েছে বিরোধের। ত্রিপুরা রাজ্যে তখন শোচনীয় আর্থিক অনটন। তারই মধ্যে বন্ধু রবীন্দ্রনাথের আবেদনে রাজা অন্ধকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি বরাদ্দ করেছেন, বিলাতে গবেষণার জন্য জগদীশচ্দ্র বসুকে ১০ হাজার টাকা দান করেছেন, ‘বঙ্গদর্শন’ পুনঃপ্রকাশের জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন। এসব ব্যাপারকে মহিমচন্দ্রের অবিমৃশ্যকারিতা বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
প্রশাসনিক ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের উপর রাধাকিশোরের আত্যন্তিক নির্ভরতা মহিমচন্দ্রের পছন্দ হয় নি। রবীন্দ্র ও মহিম দুজনেই রাধাকিশোর তথা ত্রিপুরার মঙ্গলাকাঙ্খী ছিলেন কিন্তু সেই মঙ্গলসাধনের পথ সম্বন্ধে দুজনের মতের পার্থক্য ছিল।
১.  রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন রাধাকিশোর মহৎ মানুষ, কিন্তু  প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ। তাই উপযুক্ত মন্ত্রী নির্বাচন করে তাঁর হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করা প্রয়োজন। মহিমচন্দ্র কিন্তু রাজার কর্তৃত্ব খর্ব করার ব্যাপারে একান্তভাবে বিরোধী ছিলেন।
২. রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্র বিশ্বস্ত বহিরাগতের উপর নির্ভর করতে বলেছিলেন। মহিমচন্দ্র কিন্তু এক্ষেত্রে ত্রিপুরার ভূমিপুত্রকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
সম্ভবত মন্তী নিয়োগের ব্যাপারে সম্ভবত মহিমচন্দ্রের একটা অভিমান ছিল রবীন্দ্রনাথের উপরে। মহিমের যোগ্যতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের উচ্চ ধারনা ছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘ইহা নিশ্চয় বুঝিয়াছি মহিমের বুদ্ধি অত্যন্ত দ্রুত ও তীক্ষ্ণ, তাঁহার ধারনা শক্তি প্রবল এবং ত্রিপুরা রাজ্যের হিত সম্বন্ধে তাঁহার যে উৎসাহ নাই তাহা নহে।’ অথচ মহিমকে মন্ত্রীপদে নিয়োগের সুপারিশ করেন নি তিনি। 
মহিম সম্বন্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন সেটাও মহিমের অভিমানের কারণ হতে পারে। মহিমকে লেখা কবির দুটি চিঠির কিছু অংশ:
১. ‘তুমি মহারাজের অনুগ্রহে পালিত, ত্রিপুরার এই অবস্থায় তুমি কি সর্বনাশের স্রোত ঠেকাইবার জন্য একাগ্র মনে চেষ্টা করিয়াছ? নাকি স্বার্থান্বেষী.......’
২. ‘লোকের সাধু উদ্দেশ্যে তোমাদের বিশ্বাস নাই—সকলকেই তোমরা সন্দেহ চক্ষে দেখ-মহারাজের স্বাভাবিক ঔদার্যকে তোমরা আচ্ছন্ন করিয়া আছ।’

রাজা রাধাকিশোরকে লেখা এক চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথ মহিমচন্দ্রের বুদ্ধিমত্তা স্বীকার করেও বলেন, ‘কিন্তু সেই সঙ্গে তাহার দুর্বলতা আছে। সে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ একেবারে ভুলিতে পারে নাই, এই আমার বিশ্বাস।’
মহিমচন্দ্রের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই ভ্রান্তির মূলে ছিল ত্রিপুরার বাঙালি কর্মচারীদের বিকৃত তথ্য পরিবেশন। মহিম সম্বন্ধে ঈর্ষান্বিত ছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের কান ভাঙানোর কাজও করে যাচ্ছিলেন ক্রমাগত।
শেষপর্যন্ত রাধাকিশোরই রবীন্দ্রনাথের ভ্রান্তি দূর করেন। বিরোধের পরে ফিরে আসে বন্ধুতা। রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরকে লেখেন: 
“মহিম সম্বন্ধে আমার যে ধারণা হইয়াছে তাহা সম্ভবত অমূলক এবং সেই অমূলকতার সম্ভাবনা মনে রাখিয়াই তাহার সহিত বন্ধুভাব রক্ষা করা আমার পক্ষে কঠিন হয় না।.... মহিম সম্বন্ধে আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হইয়া আছি।”

বিবাহ উৎসব

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

বিবাহ উৎসব

জয়দীপ চক্রবর্তী

বেলঘোরিয়া, কলকাতা

girl.jpg

রিমোট কন্ট্রোল চিরদিন একজনের হাতে থাকে না। ছেলেকে এক সময়ে খেলার মাঠ থেকে টেনে প্রাইভেট টিচারের পাঠ নিতে বাধ্য করেছে যে বাবা, সেই বাবাকেই এখন ছেলের কথা মেনে শক্তিগড়ের ল্যাংচা ছেড়ে নিম-বেগুন বা উচ্ছের তরকারি খেতে হয়। নিজের শরীরের ভালোর জন্য সে নয় খাওয়া যায়, কিন্তু নিজের একমাত্র ছোটো-মেয়ের বিয়ে কখনই পঞ্জিকা না মেনে দেওয়া যায় না। কিন্তু সেটা মেনে নেওয়ার জন্যও যুক্তি খাঁড়া করল ছেলে সৌরজ্যতি।

- 'পঞ্জিকা মেনে বিয়ের ডেট ঠিক করা যাবে না বাবা। তাতে অসুবিধে অনেক। বিয়ের ডেটটা আমাদের সুবিধে মতই ফেলতে হবে।'

- 'বিয়ে আবার নিজেদের ইচ্ছেমত ডেটে হয় নাকি? কালে কালে আর কত শুনবো!'

- 'অবাক হওয়ার কিছু নেই বাবা। বিদেশে এই কনসেপ্টেই দুর্গাপূজা হয়। ওদেশে পাঁজি মেনে চার-পাঁচদিন ধরে দুর্গাপূজা করার কারো সময় নেই। যে ডেটেই পূজা পড়ুক না কেন, ওরা উইক এন্ডেই করে। তাছাড়া দিন, ক্ষণ, লগ্ন মেনে বিয়ে হলেই যদি সবার ম্যারেজ লাইফ সুখের হয়ে যেত, তবে  এতো ডিভোর্স হতো না, আর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এতোঝগড়া বিবাদও সব সময় লেগে থাকতো না।'

- 'তাহলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করলেই হয়। এতো ঘটা করে নিয়ম মেনে বিয়ে দেওয়ার কি দরকার আছে।'

- 'না,না। রেজিস্ট্রি ম্যারেজে ভিডিও শুটের স্কোপ কোথায়? তাছাড়া মাম্পির বিয়ে বলে কথা। শুধু তো বিয়ে, বৌভাত নয়, আইবুড়ো ভাত, মেহেন্দি, সঙ্গীত, তত্ত্ব সাজানো, প্রি-ওয়েডিং ভিডিওগ্রাফি, হাজারও অনুষ্ঠান। এতো ছুটি তো পাওয়া যাবে না। আমি পেলেও পাত্র নিজেই পাবেনা। দেবসুর্যই তো ফোন করে আমাকে বলল, বিয়েটা স্যাটার ডে ফেললে ওর সুবিধে হয়। ফ্রাইডে গুড ফ্রাইডে। ওর তিন দিন পরপর ছুটি আছে। সোম, মঙ্গল দুদিন ছুটি নিলেই তবে হয়ে যাবে। আমি গ্রিন সিগন্যাল দিলে ও ফ্রাইডে ফ্লাইটের টিকিট কাটবে।'

- 'ও, সবকিছু ঠিকই করে ফেলেছ। তাহলে আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন?'

- 'বাবা, তুমি রাগ না করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর। বিয়ের পাঁচ ছয় মাস আগে বিয়ের ডেটে কোনও বিয়ে বাড়ি পাবে না। মাম্পির বিয়েতে প্রায় হাজার খানেক নিমন্ত্রিত থাকবে। যে সে বিয়েবাড়ি ভাড়া করলে চলবে? তাছাড়া বিয়েটা তো ঐ বৈশাখ মাসেই হচ্ছে। শুধু কয়েকটা দিন আগে পরে এই যা।'

মনে না নিতে পারলেও ছেলের যুক্তিকে মেনে নিতেই হল সৌম্যজিতকে। অবসর-প্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সৌম্যজিত গোস্বামীর দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে দেবস্মিতার বিয়েটা স্ত্রী মহামায়ার আপত্তি সত্ত্বেও একটু তাড়াতাড়িই দিয়েছিলেন উনি। দেবস্মিতা তখন সবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। ছেলে সৌরজ্যতি চাটার আকাউন্টেন্ট। বেশ নামকরা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত। ছোটোমেয়ে মাম্পি ওরফের ত্রিপর্ণা ছোটো থেকেই পড়াশোনায় বেশ ভালো। প্রাথমিক পড়াশোনার গন্ডীর কৃতিত্বের সাথে পেরিয়ে ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন নিয়ে পড়ার জন্যে লন্ডনে যায়। ওখানেই প্রবাসী বাঙালী দেবসুর্যের সাথে ওর পরিচয় হয়। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আপাতত নিজের দেশে ফিরে এলেও বিয়ের পর ঐ দেশের কোনও রিসার্চ সেন্টারের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে আছে মাম্পির।

দেবসুর্য ও ত্রিপর্ণার বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেল। অকাল বোধনের মতো অকাল বিয়েই ঠিক হল। আর সেই সঙ্গে চলল নানা রকম প্রস্তুতি পর্ব। ইভেন্ট ম্যানেজার নখদর্পণ ধরের উপর সম্পূর্ণ দায়িত্বটা থাকলেও প্রতিটি বিভাগ তত্ত্বাবোধনের দায়িত্ব বাড়ির লোকজনদের উপরই রইল।

বেশ বড়সড় একটা রিসোর্ট ভাড়া করা হল। সামনে অনেকটা জায়গা নিয়ে একটা উদ্যান রয়েছে। তার কিছুটা অংশে রকমারি খাওয়ারের স্টল বসবে। আর কিছুটা ছাড়া থাকবে অতিথিদের গাড়ি রাখার জন্য। বিয়েবাড়িটির সবকিছু মন মতো হলেও এটা সৌরজ্যতিদের বাড়ি থেকে পাঁচটি স্টেশন পড়ে, একটি পাণ্ডব বর্জিত জায়গায়। আশেপাশে দোকানপাট তেমন নেই। তাই প্রয়োজনীয় সবকিছু আগের থেকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যেতে হবে। বাড়ি থেকে ঘন-ঘন যাতায়াত করার কোনও উপায় নেই।  

সুসজ্জিত বিয়ের কার্ড তৈরি হল। একটি সুদৃশ্য ফিতে বাঁধা বাক্স। যার মধ্যে অনেকগুলো কার্ড। একটিতে ইংরাজিতে লেখা আমন্ত্রণ পত্র, একটিতে বাংলায়, আর একটি রয়েছে হিন্দিতে। একটি কার্ডে ইংরাজি হরফে রয়েছে অনুষ্ঠান বাড়ির যাওয়ার পথ নির্দেশ। এছাড়া প্রতিটি আমন্ত্রণ বাক্সে একটি ফর্ম রয়েছে। ঐ ফর্মে আমন্ত্রিতের সংখ্যা, উপস্থিত হইবার সম্ভাব্য আমন্ত্রিত, কার পার্কিং দরকার কিনা, ড্রাইভার সাথে যাবে কিনা, প্রভৃতি লেখার জায়গা রয়েছে। নিমন্ত্রণ করার সময় যিনি নিমন্ত্রণ করছেন, তিনি ফর্মটা বের করে নিমন্ত্রণ বাক্সটি আমন্ত্রিতের হাতে দেবেন। এবং আমন্ত্রিতের সাথে কথা বলে ফর্মটি পূর্ণ করবেন। এই ফর্ম থেকেই বিয়ের দিন সম্ভাব্য উপস্থিত আমন্ত্রিতের সংখ্যা, ড্রাইভারদের জন্য প্রয়োজনীয় পার্সেলের একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

আমন্ত্রিতের তালিকায় পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়, কিছু আত্মীয়ের আত্মীয়, যেমন দেবস্মিতা, সৌরজ্যতির মামা শ্বশুর, কাকা শ্বশুর, কাছের বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, সৌরজ্যতির অফিস কলিগ, বন্ধু-বান্ধব, সৌম্যজিত বাবুর এক্স অফিস কলিগ, বন্ধু-বান্ধব, মহামায়া, ত্রিপর্ণার বন্ধু-বান্ধব, কেউই বাদ পড়ল না।   

দেবস্মিতার মেয়ে ঐন্দ্রিলা ক্লাস এইটে পড়ে। আঁকার হাত ভীষণই ভাল। তাই আলপনার দায়িত্ব ওকে দেওয়া হয়েছে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মাসির বিয়ে। তাই পড়াশোনার চাপ নেই। নিশ্চিন্তে বিয়ে এনজয় করতে পারবে। কিভাবে আলপনা দেবে তা এখন থেকেই ভেবে রেখেছে ঐন্দ্রিলা। সাধারণ রঙ নয়। বিভিন্ন রঙের আবীর, হলুদের গুঁড়ো, চকের গুঁড়ো, প্রভৃতি দিয়ে রঙ তৈরি হবে। দোলের সময় অনেক রকম আবীর কিনে বিয়ের জন্য সরিয়ে রাখতে হবে ঐন্দ্রিলাকে। আলপনার সঙ্গে তত্ত্ব সাজানোর টিমেও ঐন্দ্রিলা রয়েছে। তত্ত্ব সাজানোর মুল দায়িত্বে রয়েছে সৌরজ্যতির স্ত্রী দেবাঞ্জনা। অনেক তত্ত্ব। একার হাতে করা সম্ভব নয়। দেবাঞ্জনা তাই চার-পাঁচ জনের একটা টিম করে নিয়েছে।

বিয়ের কেনাকাটা অনেক আগে থেকে শুরু হলেও কিছু জিনিষ বাদ থেকেই যায়। কোনের গয়না, বড় কোনের পোশাক, দেবাঞ্জনার ডিজাইনার ল্যাহেঙ্গা প্রভৃতি কেনা হয়ে গেলেও কিছু প্রণামি শাড়ি সহ তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু বাকি থেকে গেল। বিয়ের একমাসও বাকী নেই। প্রতিটি দোকানেই চৈত্র সেলের ভিড়। তার মধ্যেই কেনাকাটা সারতে হল ত্রিপর্ণা, দেবাঞ্জনাদের।

বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকেই অতিথিদের আগমন শুরু হয়ে গেল। দেবস্মিতার পরিবার, ওদের মাসি, পিসির পরিবার, ত্রিপর্ণার  র্স্কুল লাইফের এক বন্ধু, এক এক করে সকলেই এসে উপস্থিত হল। বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল করে এক সপ্তাহ ধরে খাওয়া দাওয়া চলল। এতো লোকের থাকার ব্যবস্থা ঐ বাড়িতে করা সম্ভব নয়। তাই পাড়া প্রতিবেশীর সাহায্যের আশ্রয় নিতে হল।

বিয়ের ঠিক আগের রবিবার, বাড়ির কাছে একটি অনুষ্ঠান বাড়ি ভাড়া করে ত্রিপর্ণার আইবুড়ো ভাত অনুষ্ঠিত হল। শ-তিনেক লোক আমন্ত্রিত হল এই অনুষ্ঠানে। মাংস না থাকলেও তিন রকমের মাছ সহ অনুষ্ঠান বাড়ির নিয়মিত বিভাগের সকল মেনুই খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। ফটোগ্রাফি, সেলফিগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফির মধ্যমে অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্ত পিঞ্জরিত হল। এই অনুষ্ঠান যেন মুল বিয়ের অনুষ্ঠানের ট্রেলার। মুল অনুষ্ঠানটি কেমন হবে, তা এই ট্রেলার দেখে সহজেই অনুমেয়।

বাড়ির সামনে সুসজ্জিত প্রবেশ দ্বার ও কৃত্রিম জোনাকি বাল্বের আলোক সজ্জা সৌরজ্যতিদের বাড়িটাকে আর পাঁচটা বাড়ি থেকে আলাদা করে রেখেছে। সমবয়সী মহিলা পুরুষদের আড্ডা, ইয়ার্কি, হাসাহাসি, খুনসুটি বাড়িটাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। এখন যেকোনো কারণেই কারণ-সুধা উপস্থিত থাকে। এখানেও তার কোনও ব্যতিক্রম নেই। বাড়ির এক কোনে একটা আড়াল খুঁজে সোমরসের আসক্ত, ভক্তরা তা সেবন করছে। কচিকাঁচারা বাবা-মায়ের মোবাইল ফোন নিয়ে কেউ গেম খেলছে, কেউ বা ইউটিউবে নানা ধরনের ভিডিও দেখছে। এভাবেই মুল অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে আসছে।

বিয়ের দুদিন বাকি। বিয়ে বাড়িতে মেহেন্দি উৎসব চলছে। পার্লার থেকে দুইজন ভদ্রমহিলা এসে মেহেন্দি পরাচ্ছে, আর পাত্রী সহ সব মেয়েরাই লাইন দিয়ে দুহাত পেতে মেহেন্দি পরছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় সজনের অনেকেই রয়েছে সেই মেহেন্দি পরার দলে। দুজনে পরিয়ে কুল করতে পারছে না। পরিস্থিতি সামলাতে ঐন্দ্রিলাও নেমে পড়ল মেহেন্দি পড়াতে। পেশাদারীদের চেয়ে

কোনও অংশে কম হল না ওর শিল্প। বরং নতুনত্বের স্বাদ মিশে হস্ত শিল্পগুলি আলাদা করে সকলের নজর কাড়ল। সকল হাতের শিল্পকলাই ক্যামেরা-বন্দী হল।    

বিয়ের আগের দিন মহামায়ার মনে পড়ল যে খুকুকে বলা হয়নি। খুকু হল সৌম্যজিতের খুড়তুতো বোন। ডিভোর্সি। ছেলেকে নিয়ে একাই থাকে। কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ নেই। এদিকে দেবসুর্য আসছে। ত্রিপর্ণাকে নিয়ে দেবসুর্যকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে যাবে সৌরজ্যতি। সঙ্গে থাকবে ভিডিও ফটোগ্রাফার। সবাই মিলে ইকোপার্কে যাবে প্রি-ওয়েডিং স্যুট করতে। তাই খুকুদিকে নিমন্ত্রণ করা সৌরজ্যতির পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কষ্টে নম্বর জোগাড় করে ফোন করলেন সৌম্যজিত। খুকুর ছেলে ধরল।

- 'খুকু আছে?'

- 'না, আপনি কে বলছেন?'

- 'আমি ওর সৌম্যদা বলছি।'

- 'ও, বড়মামু। মা তো নার্সিংহোমে ভর্তি। হিমোগ্লোবিন খুব কমে গেছে। ডাক্তার ইমিডিয়েটলি রক্ত দিতে বলেছে। মাকে কিছু বলতে হবে?'

-  'না, অনেকদিন কোনও খবর পাইনা, তাই ফোন করেছিলাম।'

- 'আমি তো এখন ব্লাড ব্যাঙ্কে আছি। নার্সিংহোমে গিয়ে মাকে তোমার কথা বলব। তুমি ফোন করেছ শুনলে মা খুশি হবে।'

-  'ঠিক আছে। এখন তবে রাখি। পড়ে ফোন করে খবর নেব।'

ফোন রেখে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন সৌম্যজিত।

শুটিং শেষ করে দেবসুর্যকে ওর মামা বাড়ি পৌঁছে দিল সৌরজ্যতিরা। মামাবাড়ি থেকেই বিয়ে করতে আসবে ও। ভিডিও ফটোগ্রাফাররা আজ সন্ধ্যে বেলাতেই মেয়েদের জলভরা, গঙ্গা নিমন্ত্রণের ভিডিও তুলবে। কাল অতো সকালে তাদের পক্ষে আসা সম্ভব নয়। বাড়ির কাছাকাছি পুকুর নেই। তাই একটি সুইংপুলে অধিকর্তাদের অনুমতি নিয়ে প্রক্সি জলভরা, গঙ্গা নিমন্ত্রণ হল এবং তা চলমান ক্যামেরায় বন্দী হল।

ত্রিপর্নাকে বাড়ি পৌঁছে, সৌরজ্যতি রিসোর্টে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে গেল। ত্রিপর্ণার বাড়ি ফিরে দেখল মা, বৌদিরা জল ভরার পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরেছে। ফটোগ্রাফাররা ত্রিপর্নার দধি-মঙ্গলের ভিডিও ও স্টিল ফটোগ্রাফিও ঐ দিনই সেরে নিলো। নখদর্পণ ধরের তত্ত্বাবধানে দশকর্মা সহ বিয়ের সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী রিসোর্টে পোঁছে গিয়েছে। রিসোর্টটি সুসজ্জিত হয়ে উঠছে। পেশাদার শিল্পীদের দিয়ে তত্ত্ব সাজানো হয়েছে। বিয়ের কুঞ্জ প্রস্তুত হচ্ছে। দুই একটা ছোটোখাটো সংশোধন, পরিবর্তন করতে বলে একটু রাত করেই বাড়ি ফিরল সৌরজ্যতি।

পরের দিনের গোছ-গাছ ও গল্পগুজব করে সবাই এতো রাতে ঘুমল যে বিয়ের দিন কেউই ভোরে উঠতে পারল না। তাই ত্রিপর্ণার দধি-মঙ্গলটা আর হল না। তবে আগের দিনই ফটো-স্যুট হয়ে যাওয়াতে কেউই তেমন চাপ নিলো না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে বাড়ির নানা কাজকর্ম ও ব্যস্ততা শুরু হল। অনুষ্ঠান বাড়ি ও এদিক সেদিক যাওয়ার জন্য বাড়ির গাড়িটি যথেষ্ট নয়। আরও দুটো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। প্রথমে ঐন্দ্রিলা সহ আরও কয়েকজনকে প্রাতঃভোজন করিয়ে একটা ভাড়াগাড়িতে অনুষ্ঠান বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ওখানে পোঁছে ঐন্দ্রিলা বিবাহ-কুঞ্জে নিজের আলপনা শিল্পকর্ম শুরু করল। এরপর একে একে সকলেই অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছল।

যথা সময়েও ছেলের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব এসে উপস্থিত হল। পাত্রপক্ষ প্রবাসী হওয়ায় বিয়ের নিয়ম-কানুনের সাথে অতোটা অভ্যস্ত নয়। তবে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর পরামর্শ মত যতটা সম্ভব প্রচলিত নিয়ম মেনেই ছেলের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন ওনারা। গায়েহলুদ, স্নান, খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি সেরে ত্রিপর্না, সাজতে বসল। একটি নামকরা পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান আনিয়েছে নখদর্পণ। ত্রিপর্না সহ সবার সাজগোজ সম্পূর্ণ হতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করল। ক্রমশই বাড়িটি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। বিভিন্ন খাবারের স্টলের একপাশে একটি অস্থায়ী মঞ্চে অর্কেস্ট্রা সহযোগে কন্ঠ সঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছে। তারই তালে তালে মঞ্চের সামনে কিছু আমন্ত্রিত অতিথি কোমর দোলাচ্ছে। এই কারণেই বিয়ের লগ্ন একটু রাতে ঠিক করেছে সৌরজ্যতিরা। 

সুসজ্জিত, অতিসজ্জিত, স্বল্প-বাসিত মহিলারা কখনও একক, কখনও বা সমবেত ভাবে সেলফী তুলে মোবাইল বন্দী করছে। ত্রিপর্ণার সাথে ছবি তোলার জন্যও সকলে ব্যাকুল। ত্রিপর্ণার এই চাপ এড়াতে ফটোগ্রাফাররা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছে। ওর কিছু ছবি তারা আগেই তুলে রেখেছে। এবারে যার ছবির সাথে জোড়ার দরকার তার ছবি তুলে ক্যামেরাতেই জুড়ে দিচ্ছে তারা। ছবি দুটি যে আলাদা ভাবে তোলা, তা ছবি দেখে একদমই বোঝা যাচ্ছে না। পুরো অনুষ্ঠানটি ফেসবুক লাইভ হচ্ছে। যে সকল আত্মীয় বন্ধুবান্ধবরা দূরে থাকার জন্যে, বা অন্য অসুবিধের জন্যে বিয়েতে আসতে পারেনি, তারাও অনুষ্ঠানটি দেখতে পাচ্ছে।

একটু দেরীতেই বর এসে উপস্থিত হয়েছে। বর বরণ, বর ও বরযাত্রীর আপ্যায়ন, ফটোগ্রাফির পর বরকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হল। সৌম্যজিত সম্প্রদান করবেন। নির্ধারিত মন্ত্রপাঠ চলল। নাচ গান, খাওয়া-দাওয়া সেরে বিয়ে দেখতে ভীড় করেছে সবাই। নির্ধারিত সময়ে কনেকে আনা হল। সাত-পাঁক, শুভদৃষ্টি, মালাবদলের পর কন্যা সম্প্রদান হল। সবকিছু প্রথা মতোই চলছে। তবে একটু সংক্ষিপ্ত। ফটোগ্রাফির প্রয়োজনে ফটোগ্রাফারের নির্দেশে পাত্রপাত্রীদের মাঝেমাঝেই স্ট্যাচু হতে হচ্ছে। যজ্ঞ শেষে সিঁদুর-দান পর্ব। পুরোহিতের নির্দেশে লজ্জ্বাবস্ত্র দিয়ে ঢাকা হল কনেকে। কিন্তু সিঁদুর কোথায়? পুরোহিতের ফর্দ অনুযায়ী নখ-দর্পণ যা যা এনেছে, তারমধ্যে সিঁদুর নেই। সিঁদুর তো ছেলের বাড়ির তত্ত্বের সাথে আসে। বললেন মেয়ের এক আত্মীয়া। কিন্তু সেই তত্ত্বেও সিঁদুর নেই। ছেলের বাড়ির লোক বলল, আমাদের এইসব নিয়ম কানুন ভালো জানা নেই। আমাদের সিঁদুর পাঠানোর ব্যাপারে কিছু তো বলা হয়নি।

এখন কার দোষ সেটা না খুঁজে, কিভাবে সমস্যাটার সমাধান করা যায়, সেটা ভাবতে হবে।  সৌরজ্যতির বক্তব্য।

-  'আসেপাশে কোনও দোকানও নেই। আর এতো রাতে কোন দোকানই খোলা থাকবে?'

-  'এখন বাড়িতে গিয়ে নিয়ে আসতেও বড্ড দেরী হয়ে যাবে।'

-  'একদম পাণ্ডব বর্জিত জায়গা। আসেপাশেও কোনও বাড়ি নেই।'

- 'আর বাড়ি থেকেই কি কোনও লাভ হোতো? এখন কোনও মহিলারাই গুঁড়ো সিঁদুর ব্যবহার করে না। সিঁদুর স্টীক বা লিকুইড সিঁদুর দিয়ে কাজ সারে। উপস্থিত সকলেই নানা রকম মন্তব্য করতে লাগলো। কিন্তু কারো কথাতেই সমাধান বেরিয়ে এলো না। পুরোহিত মশাই বললেন, সিঁদুর স্টীক বা লিকুইড সিঁদুরই দেখুন না উপস্থিত কোনও মহিলার কাছে পাওয়া যায় কিনা। অগত্যা ওটা দিয়েই কাজ সারি।'

- 'না, না। ওসব চলবে না। ওতে ফটো ভালো উঠবে না। নাকে সিঁদুর না পড়লে আবার সিঁদুর-দান হল নাকি?' ফটোগ্রাফার অসম্মতি প্রকাশ করল।

- 'না না। লিকুইড সিঁদুর ফিদুর চলবে না। ফেসবুক লাইভ হচ্ছে। আমার বিদেশের বন্ধুরাও বিয়ে দেখছে। লোকে দেখে বলবে কি?' কিন্তু কোনও উপায়ও তো দেখছি না। সৌরজ্যতির কথায় চাপা উত্তেজনা। বাড়ির বড় জামাই অংশুজিত এতক্ষণ চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ মেয়ে ঐন্দ্রিলাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, 'তুই যা যা দিয়ে আলপনা দিয়েছিস, তার কি কিছু অবশিষ্ট আছে?'

- 'আছে তো। আমি গুছিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছি।'

- 'ওখানে দ্যাখ তো একটু লাল আবির আছে কিনা।'

- 'হ্যাঁ আছে তো। অনেকটাই আছে। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।'

ঐন্দ্রিলা আবীর নিয়ে এলে অংশুজিত ওটা সৌরজ্যতির হাতে দিয়ে বলল, নেও এটা দিয়ে কাজ সারো। তোমার ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি বা ফেসবুক লাইভ, কোনটাতেই কিছু বোঝা যাবে না।

দারুণ আইডিয়া। সৌরজ্যতি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল।

আবীর দিয়েই সিঁদুরদান পর্ব সাঙ্গ হল। খুব সুন্দর ফটো ও ভিডিও উঠল। সোশাল মিডিয়ায় কোনও ত্রুটিই প্রকাশ পেল না। শুধু  সৌম্যজিত ও মহামায়ার মনের কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি রয়েই গেল।

শেষ থেকে শুরু

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

শেষ

থেকে শুরু

মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়

মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

girl.jpg

(১)

নিতা দেবীর বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। বারো বছর হলো তাঁর স্বামী গত হয়েছেন। দুই ছেলে মেয়েকে নিজের হাতে মানুষ করেছেন। ছেলে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার।মেয়েও এই বছরই এক নামকরা কলেজের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছে। শিক্ষকতা তাঁর ভালোবাসা ছিল, আর গান তাঁর প্রেম। সেতার বাজাতে পারেন চমৎকার। দশ বছর আগেই যদিও বিসর্জন দিয়েছেন গান। সংসারের চাপে তা আর ফিরে আসেনি অনিতা দেবীর জীবনে।

তিনদিন আগে তাঁর ছেলের বিয়ে হয়েছে, প্রেমের বিয়ে। যদিও দেখাশোনা করেই হয়েছে।বৌমা কেমন ব্যবহার করবে তাঁর সাথে, ছেলেও কি পাল্টে যাবে? দূরে সরে যাবে মায়ের থেকে?...এসব ভাবনা বিচলিত করছে অনিতা দেবীকে। যা সব শোনা যায়...পাশের বাড়ির বৌদিও বলেছিলেন..নাঃ কিসব ভাবছেন, নিজের ছেলের ওপরেও ভরসা নেই? রুমিকেও নিজের মেয়ের চোখেই দেখবেন,সে ও তো অন্য পরিবেশে এসেছে.. গুছিয়ে দিতে হবে এদের সংসার...মেয়েটারও বিয়ে দিতে হবে..তবে ছুটি আমার। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অনিতা দেবী। ছাদে গাছগুলোকে জল দিতে দিতে এসব ভাবছিলেন। হঠাৎ পিছন থেকে বৌমার গলা শুনে চমকে উঠলেন।

- "মা, হলো তোমার? চলো চলো নিচে। একটা জিনিস আছে তোমার জন্যে। চলো।"-

"কি জিনিস?"-

"চলো না দেখবে। সে, সুমি সবাই অপেক্ষা করছে।"-

"আচ্ছা বাবা চল চল।"

-"কেক! পায়েস!"

-"Happy birthday to you ma" তিনজনে একসাথে বলল, আর সাথে হাততালি।-"আমার জন্মদিন মনে আছে তোদের!"

-"মায়ের জন্মদিন সন্তানরা ভুলতে পারে, কেকটা কাটো জলদি।" বাচ্চাদের মতো বলে উঠল সুমি।

- "পায়েসটা মা বৌদি বানিয়েছে, কেকটা আমি, আর এই গিফটটা আমাদের সকলের তরফ থেকে।"

চোখে জল এসে গেল অনিতা দেবীর। সামলে নিলেন নিজেকে।

- "বাঃ বেশ হয়েছে শালটা।"

- "তোমার পছন্দ হয়েছে মা?" জিজ্ঞেস করল অরুণ।

- "হ্যাঁ রে বাবু। চল তোরা খাবি চল।"

দিনটা ভালোই কাটলো। রাত্রে শুয়ে ভাবছিলেন অনিতা দেবী। নাঃ, মেয়েটি যত্নশীলা, নিজের মায়ের মতোই আমায় দেখে..ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন।

(২)

কয়েক দিন পর খেতে খেতে অরুণ হঠাৎ বলল, "মা, তুমি এতো সুন্দর সেতার বাজাও, আবার তো শুরু করতে পারো। তোমার জন্য এক ছাত্রী আছে।"

- "এতো বছর পর! কতদিন অভ্যাস নেই বলতো! গান বল, পড়াশুনো সবটাই সাধনা। আমি কি আর পারব?"

- "কেন পারবেনা মা? তুমি তো আমায় বলোনি তুমি সেতার জানো? আমার খুব ইচ্ছে শিখবার। তোমার কাছে শিখব।"

- "হ্যাঁ  মা, বৌদি ঠিক বলছে। কেন তুমি পারবেনা? আজকালকার দিনে কজন জানে?"

- "না,না, তোরা বলিসনা আমায় এই নিয়ে। আর বৌমাকে আমার পরিচিত একজনের কাছে পাঠিয়ে দেব,যত্ন করে শেখাবে।"

- "না আমি তোমার কাছে শিখব। please মা, না কোরোনা। তুমি practice করো পারবে অবশ্যিই। এমনিও তুমি বলো সময় কাটেনা ঘরে বসে, এতে তোমার মনও ভালো থাকবে আর কিছুজন শিখতেও পারবে।" এক নিঃশ্বাসে বলল রুমি।

- "মা, সবাই এতো করে বলছে, আর সৌরভ বলেছে তার মেয়েকে সেতার তোমায় শেখাতে হবে। না কোরোনা মা।" অনুনয় করে বলল অরুণ।

- "ঠিক আছে, ভেবে দেখছি। তোরা যা জেদ ধরেছিস।"

পরের দিন ভোর বেলা সবার ঘুম ভাঙল। রাগ ভৈরবীর সুরে। সকলে বাইরের ঘরে এসে অবাক হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে তাদের মা সেতারে সুর তুলছেন! এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরী হয়েছে যেন! মায়ের সামনে এসে ওরাও বসে পড়ল। আস্তে আস্তে আকাশ অরুণ আভায় রাঙা হয়ে উঠল, পাখিদের কাকলিতে চঞ্চল হয়ে উঠল যেন প্রকৃতি। রাগ শেষ হতে অনিতা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন স্মিত হেসে, "কেমন?" - "অসাধারণ মা!" সবাই একসাথে বলে উঠল।

- "যাক পাশ করেছি তবে।"

- "আমাদের মা ফেল করতেই পারেনা।" মাকে জড়িয়ে ধরে বলল সুমি।

- "একদম ঠিক। চলো খাবার ব্যবস্থা করি।" রুমি বলল।

 

(৩)

দেখতে দেখতে এক বছর কাটল। এখন অনিতা দেবী ব্যস্ত থাকেন। সেতার শেখার ক্লাসে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, এখনই ১২ জন। রুমিও শেখে, খুব উৎসাহ তার। তাছাড়া অবসরের সঙ্গী বই তো আছেই। বিকেলে ছাদে হাঁটা অনিতা দেবীর অভ্যাস। হাঁটতে হাঁটতেই ভাবছিলেন রুমিকে আর সকলের মতো ভেবে ভুল করতে যাচ্ছিলেন। বৌমা তাঁর কাছে মেয়ের চেয়ে কম নয়। তিনি নিজেকে ভাগ্য বান মনে করে ভগবানকে ধন্যবাদ দেন এমন বৌমা পাওয়ার জন্যে। এদের সবার উৎসাহেই তো আবার সব শেষ থেকে শুরু করতে পেরেছেন।তাঁর প্রথম 'প্রেম' ফিরে এসেছে জীবনে। জীবন সায়ান্থে দাঁড়িয়েও আজ নিজেকে সুখী বলতে তাঁর কোনো রকম দ্বিধা আসেনা। শান্তির শ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন,"সবার জীবনই যেন এরকম হয় ঈশ্বর।" দিনের শেষে শ্রান্ত কুঁড়িটিও বেঁচে ওঠে নতুন উদ্যোগে বিকশিত হওয়ার অদম্যে ইচ্ছায়। মানুষ কেন পারবেনা?

এলেম দেখাল গদাই

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

এলেম

দেখালো গদাই

অমিতাভ মৈত্র

কলকাতা

kid.jpeg

লো আঁধারির মধ্যে স্পষ্ট দেখা গেল লোকটা ঘাপটি মেরে বসে আছে। অনন্ত ঘর থেকে বেরলেই লোকটার মুখোমুখি পড়ে যাবে। এখন কোন ভাবেই বেরোনো উচিৎ হবেনা। লোকটার নড়াচড়ার ওপর অনন্ত লক্ষ্য রাখছে। নিস্তব্ধ রাত। নিজের হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছে অনন্ত। লোকটা ধীরে ধীরে এবার উঠছে। পা টিপে টিপে এগোচ্ছে অনন্তর ছেলের ঘরের দিকে। মতলবটা কি তার। নিশ্চয়ই চোর।… বাড়িতে ঢুকলো কি করে?... এসব কথা পরে ভাবা যাবে। লোকটার হাতে কি একটা চকচক করছে। না কোন অস্ত্র নয়…একটা টিনের সরু কৌটো। একটা বিপদের গন্ধ পেলো অনন্ত। মাঝে মাঝে সে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখছে। না, আর অপেক্ষা করা যায়না। ছেলের ঘরের জানলাটা খোলা আর ওই খোলা জানলাই লোকটার লক্ষ্য। অনন্তর ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলেই লোকটা সজাগ হয়ে যাবে। উপায় নেই। নিঃশব্দে অনন্ত দরজা খুলে ফেললো। লোকটা টের পায়নি। এবার সে অনন্তর দিকে পিছন করে ছেলের ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে কি যেন দেখছে। অনন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কৃষ্ণ পক্ষের রাত... যেন একটু বেশী অন্ধকার। লোকটার মন পড়ে আছে ছেলের ঘরের অন্দরে। অনন্ত এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। হাতের কৌটোটার মুখে একটা স্প্রে করার ব্যবস্থা আছে। লোকটার উদ্দেশ্য অনন্তর কাছে বেশ পরিস্কার। অনন্তর বাঁ হাতটা একবার শুন্যে উঠে সবেগে এসে পড়লো লোকটার ঘাড়ে। একটা আর্তনাদ করে সে মাটিতে চিৎপাত হয়ে কাৎরাচ্ছে। অনন্তর বাঁপায়ের নীচে লোকটার ডান হাতের আঙুলগুলো তখন চেপ্টে আছে আর অনন্ত তার ওপরে চাপ আরো বাড়িয়ে চলেছে। লোকটার আর্তনাদে অনন্তর বউ বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখে হাউমাউ করে উঠলো। লোকটা এবার চিৎকার করে কান্না শুরু করতেই অনন্ত বউকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বললো, “চট করে আমার গামছাটা দাও।” ঘুম চোখে এবং আতঙ্কে গামছা খুঁজে পাচ্ছে না গিন্নী। অনন্তর আবার চিৎকার, “চোখের মাথাটা খেয়েছ নাকি? দড়িতে ঝুলছে, তোমার নাকের ডগায়।” এবার ছেলের ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। “কি হয়েছে, অ্যাঁ? বাবা তুমি…?” ছেলের কথা শেষ হলো না, অনন্তর বাজখাঁই কন্ঠ গর্জে উঠলো, “বলিহারি তোর ঘুম, বিছানার চাদরটা নিয়ে এসে বাছাধনের পাদুটো বাঁধ। গিন্নী তুমি মোড়াটা নিয়ে এসো।” ততোক্ষণে লোকটির দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়ে গেছে। ছেলে বাবার হুকুম মতো পা-দুটো একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। এবার অনন্ত তার আরো একটি শক্তির পরিচয় দেখিয়ে লোকটিকে এক অদ্ভুত কায়দায় চোখের নিমেষে তুলে মোড়ায় বসিয়ে দিলো। নিজে একটা চেয়ার আনিয়ে আগন্তুকের মুখোমুখি বসে তাকে মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকলো। লোকটি তখনও কাতরাচ্ছে এবং কাঁদছে। এবার অনন্তই মুখ খুললো, “কে তুই? এতো রাত্রে বাড়িতে ঢুকলি কোথা দিয়ে?” লোকটা মাথা নীচু করে কাতরাচ্ছে এবং কেঁদে চলেছে। “কেঁদে পার পাবি না। বল ওই ঘরের জানলায় উঁকি মেরে কি খুঁজছিলি? কনটেনার থেকে কি স্প্রে করতে যাচ্ছিলি? মেরে ফেলার ধান্দা করছিলি আমার ছেলেটাকে হারামজাদা? মুখ খোল নইলে এইখানেই একটা খুনোখুনি বা দাঙ্গা লেগে যাবে।”এই শুনে লোকটি বাবারে, মারে, মরে যাবো রে…কে কোথায় আছিস আমায় বাঁচারে বলে মড়াকান্না জুড়ে দিলো। এই শুনে অনন্তর গিন্নী মুখ ঝামটা দিয়ে অনন্তকে বললেন, “তুমি একটু থামো দিকিনি বাপু। তখন থেকে এই মারবো, সেই মারবো, খুন করে ফেলবো করে যাচ্ছ তো ও তোমার জেরার জবাবটা দেবে কোত্থেকে শুনি।” এবার আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আর তুমি বাপু এই রাত দুপুরে বাড়িতে চুপি চুপি ঢুকে কাজটা ভাল করোনি। কি মতলবে ঢুকেছিলে একবার বলো দিকিনি। তোমার নামটাই বা কি? বাড়িতে ঢুকলে কি করে?” লোকটির কান্নার দমক একটু কমলেও কাতরানি কমেনি। ওই অবস্থাতেই এইবার মুখ খুললো, “মা ঠাকরুন দুজনে মিলে এক ডজন কোশ্চেন করেচো। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ,  কোনটা ছেড়ে কোনটা অ্যানসার দেবো? এক একজন একটা করে কোশ্চেন করো। একটার অ্যানসার পেলে পর আর একটা। একে এক পাঁচমণী রদ্দার ঝাড়ে আমি হড়কে গেচি, তার ওপরে…ওরে বাবা…দেড়সো কেজি ওজনের ওই বডিটার চাপ আমার দুটো আঙুলের ওপর রেখে রগড়াচ্ছিল গো। ওরে বাবা রে…এমন জানলে কোন শালা এতো রিক্স নিতো। কেষ্টর দেখা নেই শালা আগেই বেন্দাবন দেকিয়ে দিলো। মা ঠাকরুন আমার হাতের বাঁদনটা খুলে দ্যান… যন্তনায় মরে যাবো গো। তকোন খুনের দায়ে বাবুর তিনসো দুই কে ঠ্যাকাবে মা!” গিন্নী এবার ছেলেকে এক ধমক দিয়ে চ্যাঁচালেন, “ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি এ্যাতো কতা গিলচিস? পেছনের বাঁধনটা ওর খুলে দে। কি সব তিনশো-দুই-টুই বলচে। এসবের মানে কি?” বাঁধন খোলার পর আঙুলের অবস্থা দেখে আগন্তুক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিলো আবার। আঙুল দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। এবার অনন্ত একটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, “তুই তো দেখছি মহা ছিঁচকাঁদুনে। এতো দুর্বল শরীর হলে এইসব লাইনে এলি কেন? এই মারেই যদি তোর অক্কা পাবার অবস্থা হয় তবে ধরা পড়ে জনগনের পেটানি বা শ্রীঘরে পুলিশের পেটানি পড়লে কি করবি, এ কারবার তো তুলে দিতে হবে?”

পুলিশের পেটানি কেন জুটবে না বাবু, জুটেছে। কিন্তু যে রদ্দাটা আপনি ঝাড়লেন তার আদ্দেক ঝাড়লেই যন্তোর ব্রেকডাউন হয়ে যেতো। আপনার এতো লেবার দিয়ে পুরোটা ঝাড়ার দরকার ছিলনা। সুদুমুদু এনার্জিলস কল্লেন। আজ পুরো খালাস হয়ে যাইনি এটা আমার বাপের ভাগ্যি জানবেন।” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো আগন্তুক।

“ওটাতো ট্রায়াল দিয়ে দেখলাম। কতোকাল আগের ট্রেনিং। অব্যবহারে মরচে ধরে গেল না  রিক্ষা করে দেখলাম। ওই সঙ্গে পায়ের কাজটাও একবার পরখ করে দেখে নিলাম। অতোটা ফাস্ট আমার পা তোর ডান হাতের আঙুলের কাছে না পৌঁছলে তুই আমার লুঙ্গি ধরে টানতিস। আর তারপরে গিন্নী, ছেলে আর তোর সামনে যে সিনটা তৈরী হতো সেটা সেন্সার করতো কে শুনি।” বললো অনন্ত রদ্দার ঘায়ে আমি তখন সরসে ফুলের বাগান দেখছিলুম সুদু, আপনার লুঙ্গী তো তকোন সিনেই নেই। অ্যাকোনো দু-চারটে ফুল চোকের ওপর চমকাচ্চে।” যাগগে গিন্নী আপাততঃ ওর আঙুলে একটু বরফ দিতে হবে। সকাল হলে হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে দেখতে হবে ভেঙেছে কিনা। ভাঙলে কপালে দুঃখ আছে। গদাই, দেখ তো ফ্রিজে বরফ আছে কিনা।”

আগন্তুক বলে উঠলো, “আমার তো দু-পা চাদরে বাঁদা, আমি বরফ আনবো কি করে?” আরে বাবা আমি আমার ছেলেকে বলেছি দেখতে। তোকে কেন বলতে যাবো? এই তো বাবু বললেন, গদাই, দেখ তো ফ্রিজে বরফ আছে কিনা। হ্যাঁ, আমি আমার ছেলে গদাইকে বলেছি। কি বিপদে পড়া গেল, বাবু আমার নামও তো গদাই, সবাই আদর করে আমায় কাটা গদাই বলে ডাকে। আমার লাইনে সবাই ওই নামেই আমাকে রেসপেক্ট করে। যেকোন পকেট, যেখানে বলবেন কেটে  মালকড়ি বার করে নেবো। একটা পিমড়ে  পকেটে  ঢুকলে জানতে পারবেন হয়তো কিন্তু কাটা গদাই আঙুল ঢোকালে আজ পোজ্জন্ত ওপর ওয়ালা ছাড়া কারুর সাদ্দি নেই বুজতে পারে। থানায় বড়বাবু থেকে দারোয়ান ওই নামে আমাকে সবাই চেনে। আলিপুর কোটে যান, গেট থেকে জজ সাহেব পোজ্জন্ত, এই নামের এলেম জানে। আজকেই যা একটু হড়কে গেচি।

কাটা গদাই-এর আঙুলের হাড়ে চিড় খেয়েছিল। প্লাস্টার করা ডান হাত, তার গলায় ঝুলে আপাততঃ বেশ কিছুদিনের অবসর যাপন করবে। অনন্ত তাকে আশ্বস্ত করেছে এই সময়ের জন্যে তার অর্থনৈতিক দায়ভার যতোটা সম্ভব বহণ করবে। পঞ্চাননতলার যে কলোনিতে গদাই থাকে সেখানে তাকে পৌঁছতে গিয়ে অনন্তর গদাই সম্মন্ধে সম্ভ্রম একমাত্রা বাড়লো। গদাই-এর একটি পালিত মেয়ে আছে। রাত্রে চুরি করতে বেরিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে রাস্তায় বসে কাঁদতে দেখে, নিজের কাছে নিয়ে আসে। ভেবেছিল সুযোগ পেলে কোন অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসবে। চেষ্টাও করেছিল কিন্তু নাটক নভেলে ব্যাপারটা যতো সহজে হয় ততো সহজে এই ধরা ছোঁয়ার পৃথিবীতে অনাথকে কেউ কোন আশ্রম সহজে গ্রহন করেনা। করলেও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। এতো কিছু করার সঙ্গতি বা সুযোগ গদাইদের থাকেনা। তাই অগত্যা মেয়েটি গদাই-এর কাছেই বেড়ে উঠলো। গদাই অকৃতদার ফলে সে একাধারে মেয়েটির বাবা আবার মা-ও। এখন তার ঠিক বয়েসটা গদাই জানেনা…আন্দাজ করা যায় আঠেরো-উনিশ হবে। গদাই তাকে স্কুলে পড়িয়ে সেই গোন্ডী প্রায় পার করে এনেছে। এর জন্যে গদাইকে শরীর ও হাতের কাজে যথেষ্ট পারদর্শী হতে হয়েছে এবং ঝুঁকি নিতে হয়েছে প্রতি পদক্ষেপে। পুলিশ মহলে গদাইকে সবাই চেনে এবং তার জীবন যাপন সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল। আর এই সুবাদে সে আইনের বাইরে কিছু বিশেষ সুবিধে যে পায়না তা নয়।

প্রথম দুচার দিন অনন্তর হুকুমে তার ড্রাইভার, গদাই-এর বাড়িতে রাতের এবং দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতো। গদাই অনেকবার অনন্তকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে খাবার পাঠাবার দরকার নেই কারণ গদাই-এর মেয়ে রান্না করার ব্যাপারে যথেষ্ট পটু। কিন্তু অনন্ত সে কথায় কান দেয়নি। অনন্ত জানে গদাইকে সে আপাততঃ ভাতে মেরেছে…তার দক্ষতা ভাঙিয়ে রোজকারের পথ, আপাততঃ ভাঙা আঙুলের প্লাস্টারের নীচে থমকে গেছে।

গাড়িতে রোজ দুবেলার খাবার আসছে দেখে গদাই-এর প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। পাশের ঘরের জগা এসে গদাইকে জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার গুরু, বাড়ির দুয়োরে সকালে-বিকেলে ঝাঁচকচকে গাড়ি আসছে, গাড়ি থেকে ভাল মন্দ খাবার নামছে। এমন সাঁসালো খদ্দের কোতায় পেলে? শালা গতোর খাটাতে হচ্চেনা, মাচ নিজেই জালে লাপিয়ে এসে পড়চে।” গদাই কথাটা এড়িয়ে গেছে। সত্যি কথা বললে তার অনেক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে। অনন্তর গাড়ি সকালে সন্ধ্যেয় আসাটা বন্ধ হওয়া দরকার অবিলম্বে। যা ঘটে গেল তাই সামলাতে কতো মিথ্যের আশ্রয় নিতে হচ্ছে তা গদাই আর তার মেয়েই জানে। উপায় না দেখে মেয়েকে নিয়ে অনন্তর বাড়িতে এক রবিবারের সকালে গিয়ে হাজির হলো গদাই। দিনের আলোয় লোকের বাড়িতে বেল দিয়ে ঢোকা বা ডাকার অভ্যেস কবে ছিল, গদাই মনে করতে পারে না। প্রথমতঃ যার তার বাড়িতে সে ঢোকেনা। কারুর বাড়িতে ঢোকার আগে তাকে অনেক খবর নিতে হয়, কখন হাত করতে হয় বাড়ির কাজের লোকদের, কখনও বা সিকিউরিটির লোক। সেখানেও সব সময় কোলকে পাওয়া মুস্কিল কারণ তারা বেশীরভাগ সময় এইসব ঝুঁকি নিতে চায়না। তবে পাড়ার কিছু কিছু ছেলেদের সহযোগীতা পাওয়া যায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের চ্যালা-চামুন্ডাদের, যাদের অনৈতিক সহায়তায় দল ক্ষমতার সুবিধে ভোগ করে আর তার বদলে যেকোন অসামাজিক কাজে সরকার তথা পুলিশের সার্বিক সহায়তা তারা আদায় করে নেয়। শুধু এদেরকে, মৌখিক চুক্তি মতো, রোজকারের ভাগ দিতে হয় গদাইকে। আজকাল ফ্ল্যাট বাড়িতে গ্রিলের ব্যাবহার কমে আসছে। ফলে গ্রিল কেটে ফেলার ঝামেলা ক্রমশঃ কমছে। এটা একটা ভাল লক্ষণ। নিত্য নতুন নিরাপত্তার ব্যাবস্থা যেমন হচ্ছে গদাইদের অত্যাধুনিক মস্তিষ্ক ঘাম ঝরাচ্ছে সেই নিরাপত্তার ছিদ্র অন্বেষণে। আজ তাই সকালবেলা নিরাপত্তাহীন অনন্তর বাড়ির দরজায় শরীরের বা হাতের কোন দক্ষতার ব্যাবহার ছাড়াই শুধু বেল বাজাতে সে কতোটা অদক্ষ তা উপলব্ধি করলো গদাই। গৃহস্থের বাড়িতে অতিথি হয়ে এলে, আমাদের সমাজে, হাতে মিষ্টি নিয়ে আসার চলন যে আছে গদাই তা জানে। মিষ্টির বদলে মেয়েকে দিয়ে মাছের একটি পদ আজ রান্না করে নিয়ে এসেছে গদাই। দরজা খুলে অনন্তর চাকর গদাইকে দেখে তার পরিচয় জানতে চাওয়ায় সে প্রথমে একটু থতমত খেয়ে বললো, “বাবু আমাকে চেনেন, গিয়ে বলুন গদাই এয়েচে, তাহলেই হবে।” গলায় কাপড়ের টুকরো দিয়ে প্লাস্টার করা ডান হাত ঝোলানো গদাই আর তার মেয়েকে দেখে সাদরে ভেতরে নিয়ে এলো অনন্ত। “কি খবর গদাই, কেমন আছিস? সঙ্গে এটি কে, তোর মেয়ে? বাঃ, কি মিষ্টি মুখখানি। হাত কেমন আছে? ওষুধগুলো ঠিক মতো খাচ্ছিস তো? রাতে-দুপুরে আর বেরচ্ছিস না তো?” কথার

মাঝখানেই অনন্তকে বাধা দিয়ে গদাই বলতে শুরু করলো, বাবু সেইদিন রাতের বেলা থেকে আমি লক্ষ্য কচ্চি, আপনি একসঙ্গে একশোটা কোশ্চেন করেন। এতগুলো কোশ্চেন মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায়। একটা করে করুন আমি একটা করে জবাব দিই। হ্যাঁ, একটা কোশ্চেন মনে আচে। ঠিকই ধরেচেন, এই আমার মেয়ে। খুব ভাল রান্না করে বাবু। এই দেকুন আপনাদের জন্যে কি রান্না করে নিয়ে এয়চে।” গদাই-এর কথায় অনন্ত একটু দমে গিয়েছিল কিন্তু মেয়েটি এসে এমন ভাবে প্রণাম করতেই আবার সামলে নিলো। “বাঃ, খুব লক্ষ্মী মেয়ে। আবার রান্নাও করিস ভাল। একবার পরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছে। ও গিন্নী, এই দেখ গদাই কাকে নিয়ে এসেছে। বোস তো মা, বোস। এইখানে বোস। লজ্জার কিচ্ছু নেই। গদাই তুইও বোস।” সোফায় বসতে দুজনেই ইতস্ততঃ করছিল। অনন্তর অনুমতি পাওয়ায় দুজনেই গুটিসুটি হয়ে এক কোনে বসলো। অনন্তর গিন্নীও এসে বসলেন আর একটা সোফায়। রাতের আলো আঁধারিতে দেখা সেদিনের বাড়িটা যেন গদাই-এর চোখে সম্পুর্ণ বদলে গেছে। বাড়ির ভেতর আর এই ঘরটুকু দেখলেই বোঝা যায় অনন্তর বনেদিয়ানা। ঘরের পুরণো কালের বিশাল ঝাড়বাতিটা দেখলে তাক লেগে যায়। বিশাল ঘরের এক কোণে সেকালের, এক মানুষ সমান গ্র্যান্ড ফাদার ঘড়ি। তার সঙ্গে মানানসই আসবাবে ঘর সাজানো। কতো যে সোনা রূপোর কাজ করা ফুলদানি আর পাত্র আছে তার হিসেব নেই। এরই কয়েকটা হাতাতে সেদিন রাত্রে গদাই ঢুকেছিল এই বাড়িতে। সরাতে পারলে একটা বড় দাঁও মারা যেতো। ওর কাছে খবরটা ছিল সঠিক কিন্তু কে জানতো বুড়োটা এইরকম ষন্ডা মার্কা আর রাতে ব্যাটা ঘুমোয়না।

“কি রে গদাই কি এতো ভাবছিস?” অনন্তর ডাকে গদাই নিজেকে সামলে নিলো।

“না বাবু, একটা কতা আপনাকে না বললেই নয়।” বলে ফ্যাল, এতো কিন্তু কিন্তু করছিস কেন?”     “বলছিলাম কি বাবু, কতাটা অন্যভাবে নেবেন না। আপনাদের মতো লোকের পায়ের ধুলো পড়েচে আমার ওই বস্তির ঘরে, এ আমার সাত পুরুসের ভাগ্য। সেদিনের ঘটনার পর আপনি আমার অনেক করেচেন। বাবু আর দয়া করে গাড়ি করে খাবার পাঠাবেন না দুবেলা। আসপাসের লোকজনের কতার উত্তর দিতে দিতে আর ঢপ দিতে দিতে নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে যাচ্চি বাবু। আপনি আমার হাতের এই হাল করেচেন এই কতা আমার সাগরেতরা জেনে ফেললে আমার কাজ কারবার সব মায়ের ভোগে যাবে। আর ঘাড়ের একমণী রদ্দার সেই টায়াল নাকি বেশ বললেন, সেটার কতা তো কেউ জানেনা। এইসব লাফ্রা সাত কান কল্লে আমি পুরো ডাউন হয়ে যাবো। আপনি কিচু মাইন্ড করবেন না বাবু।

“আচ্ছা আচ্ছা সেসব কথা পরে হবে। এখন বোস তো। তোর মেয়ের রান্নাটা খেয়ে দেখতে দে। দুজনে আমার এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে তবে যাবি।”

এদিকে গিন্নীর সঙ্গে গদাই-এর মেয়ের ভাব জমে গেল দারুন। মেয়েটি যে এত সুন্দরী আর মিষ্টি স্বভাবের এটা এরা কেউই ভাবতে পারেনি। শাড়ি পরে একটু বড় বড় দেখালেও বয়েস আঠেরো উনিশের বেশী নয়। পরিবেশ আর জীবনযাপনের ছাপ, গদাই-এর শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিতে বিদ্যমান কিন্তু বস্তির পরিবেশ সামান্যই ছাপ ফেলেছে মেয়েটির শরীরে বা স্বভাবে।

দুপুরে খাবারের পাতে গদাই-এর মেয়ের রান্না খেয়ে সবাই হতবাক। মাছের এই পদটা অপূর্ব রান্না করেছে মেয়েটি। অনন্ত বলল, “বাঃ এতো অতি উঁচু দরের রান্না। এই রান্না তুই কোথায় শিখলি এই বয়েসে? আরে বাবা তোর নামটাই তো জানা হয়নি।” পাশ থেকে গিন্নী বললেন, “আমি জেনে নিয়েছি, নামটাও খুব আদরের। ওর নাম চিনু। ভাল নামটা জানা হয়নি।” “বাঃ, বেশ মিষ্টি নাম। আর ভাল নামের দরকার নেই, চিনুই খুব ভাল। তা মা চিনু তুই এই রকম আর কটা ভাল রান্না জানিস? ভেবে চিন্তে বল। যা যা বলবি সব কটা পদ আমাকে রান্না করে খাওয়াতে হবে কিন্তু। কিরে খাওয়াবি তো, বুড়োটাকে?”   

দেয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা সামান্য নীচু করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো চিনু। এক কোণে গদাই গুটিসুটি মেরে বসে খাচ্ছে। বিশাল ডাইনিং টেবিলের এক কোণে অনভ্যস্ত চেয়ারে বসে খেতে তার অস্বস্তির সীমা নেই। রবিবারের ছুটির দিনে অনন্তর ছেলে, আর এক গদাই, সঙ্গী হয়েছে এই মধ্যাহ্নভোজে। এরপরে প্রায় প্রতি রবিবারে চিনু আসতো অনন্তর বাড়িতে। নানা পদের নতুন নতুন রান্না করে চিনু অনন্তকে তাক লাগিয়ে দিলো। চিনুর স্বভাবও খুব শান্ত আর একটু লাজুক। অনন্ত একদিন গদাইকে বললো, “শোন গদাই তোর মেয়েটা আমার কাছেই থাক। আমার তো মেয়ে নেই। ও থাকলে আমরা সবাই খুব খুশী হবো। আর তাছাড়া ভালমন্দ খাওয়ার লোভটা আমি আর চেপে রাখতে পারছি না। আর একটা কথা ভেবে দেখ গদাই, ওই বস্তির পরিবেশ… তোর মেয়ে বড় হয়েছে। কোনদিন কি বিপদ ঘটবে কেউ বলতে পারে?”

“না বাবু লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করাতে মেয়েকে আমি পাটাবো না। ওকে লেকাপড়া শেকাবো ভাল করে।”

“তুই আমার কথার এই মানে করলি গবেট কোথাকার? তোর মেয়েকে কি মাইনে করা রান্নার লোক ভেবেছি আমি? আমার কথা থেকে এই বুঝলি তুই?”  

“তাহলে বাবু, আপনি কি বলতে চাইছেন?”

“দাঁড়া আমাকে কটা দিন একটু ভাবতে দে। একটা কথা আমার মাথায় কদিন ঘুরছে। চিনুকে এসব কথা বলিসনি যেন। আমার কথার নিজের মতো একটা মানে করবি আর সেইটাই মেয়েটাকে বোঝাবি আর তার ফলে চিনু আমাকে ভুল বুঝবে। কটা দিন সময় যাক। ওকে আমার বাড়িতে আসতে মানা করিসনি যেন। তোর বুদ্ধির ওপর আমার ভরসা নেই।” “কি যে বলেন বাবু এই বুদ্ধিতে এতকাল এই রকম ঝক্কির লাইনে করে খাচ্ছি। দশ-বারোটা লোকের একটা দল চালাই আমি। আমাদের ল্যাইনে পতি ইঞ্চি সামনে হাঁটবেন, খোঁচোর, পুলিশ, কোট, জেল খাটা, পাবলিকের ক্যালানি লেগেই আচে। এইসব ঝক্কি অনেক বছর সামলে তবে একটা কেস্টোবিস্টু হওয়া যায়, দশটা লোক মান্নি করে। বুদ্দি না থাকলে কবে পোটকে যেতাম। আজকেরটা একটু গুবলেট হয়ে গেচে।”

মাস ছয়েক পরে একদিন রাত্রে শুতে যাবার আগে অনন্ত গিন্নীর কাছে এসে বসলো। অনন্তর বউ স্নিগ্ধা একটু সন্দেহের চোখে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি গো, এমন উসখুস করচো কেন, কিচু বলবে?”

“না তেমন কিছু নয়।”

“তেমন কিচু নয় তো ওরকম কোচ্চো কেন? শুতে যাবে তো যাও।”  

“হ্যাঁ, এই যাবো।”

উঁহু, ব্যাপার তেমন সুবিধের ঠেকছে না, কি বলবে বলেই ফ্যালো না। এতো দনমনর কি আচে?”   “বলবো বলবো করছি তো কিন্তু পারছি কই? বললেই এখন তুমি তাতে রাজী হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

“কিসের আবার রাজী হওয়া। আমি তো ছাই মাথামুন্ডু কিছু বুঝতেই পারছি না। না বললে বুঝবো কি করে? “বললাম যে, বলতে তো চাইছি কিন্তু…”  

“আবার এক কথা, বলে ফেল, একবার শুনি না কি কতা।”

“তাহলে বলেই ফেলি, কি বলো?"

আরে হ্যাঁ বলো।”

“বলছিলাম কি, ছেলের তো বিয়ের বয়েস হয়েই গেল। বিয়ে তো দিতে হবে, কি বলো?”

“হ্যাঁ সে তো আমিই তোমাকে কতবার বলিচি। তুমিই কানে নাও না। যাক এতদিনে তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে, এটাই আনন্দের কথা। কিন্তু এই কথা বলতে বাপু এতো উসখুসুনি কেন। এর মধ্যে আর কিছু প্যাঁচ আচে নাকি?”  

“না না প্যাঁচ থাকবে কেন। কোন প্যাঁচ নেই। ছেলের বিয়ের বয়েস হয়েছে, উপযুক্ত ছেলে। বাপের ব্যবসা দেখছে মন দিয়ে। আর কি চাই।” 

“উঁহু আসল কথাটাই এখনও তুমি চেপে আছো। আচ্ছা তুমি কিরকম লোক গো, নিজের ঘরের বউকে মন খুলে একটা কতা তখন থেকে বলতে পাচ্চোনি? তোমার কিসের সংকোচ আমার কাচে?”

“আচ্ছা ঠিক আছে, শোন মন দিয়ে। কোন আপত্তি থাকলে না চেঁচিয়ে শান্ত হয়ে তোমার কথা বলবে। আপোষে সব মীমাংসা হবে কিন্তু পাড়া মাথায় করে চেঁচাতে পারবে না। এই কথাটা আগে দাও, তারপরে বলবো।“

“আচ্ছা সেও নাহয় দেয়া গেল, এবার বলো।”

নিভৃতে দুজনের অনেক কথাই হলো। আসল কথাটি শুনে গিন্নী চোখ কপালে তুলে মৃদু হাসি মুখে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপরের আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী ও শান্তিপুর্ণ ছিল। অনন্ত আর তার গিন্নী ছেলের কাছে বিয়ের কথা পাড়তেই দেখা গেল চিনুর ঘন ঘন বাড়িতে আসার সুফল স্বরূপ কখন ছেলে গদাই-এর সঙ্গে তার এক আবেগ মিশ্রিত বোঝাপড়া তৈরী হয়েই বসে ছিল সবার অলক্ষে। যথা সময় বিয়ের দিন এগিয়ে এলো। বছর খানেকের মধ্যে অনন্তর বাড়িতে আত্মীয় সমাগম ক্রমশঃ বাড়তে থাকলো। বাড়ির বিশাল ছাতে বাঁশ বেঁধে মন্ডপ সাজানো শেষ হলো। অনন্ত ভেবেছিল চিনুকে ঘরের বউ করে আনতে গিন্নী এবং গদাই-এর নিশ্চয়ই ঘোর আপত্তি থাকবে। আর যাই হোক বস্তিতে থাকা চোরের মেয়ে তো। তাকে বউ করে ঘরে তুললে বনেদি বাড়ির মান সম্মান তলানিতে ঠেকবে। কথা একদম ওঠেনি তা নয় কিন্তু অনন্তর দুঃসাহসিক ব্যক্তিত্ব সেই সব আলোচনা নিয়ে টুঁ-শব্দটি করার সুযোগ দেয়নি কাউকে। বিয়ে মিটলো নির্বিঘ্নে। সেন কেটারারের রান্না খেয়ে লোকে ধন্য ধন্য করলো কিন্তু অনন্ত বললো, “আমার চিনুর হাতের মোচার ঘন্টো আর ইলিশ মাছের ভাপের কাছে সেন কাটারার নিতান্তই তুচ্ছ। বৌমার হাতের চিংড়ির মালাইকারিটাই বা কম কিসের।” অনন্তর ছেলের বিয়েতে আর বৌভাতে হাজার লোক খেলো কব্জি ডুবিয়ে।

দুদিন পরে সেন কেটারারের মালিককে ফোন করে অনন্ত তাদের বাকী টাকা নিয়ে যাবার জন্যে একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠাতে বলল। সেন কেটারারের মালিকের জবাব শুনে অনন্ত বেশ হকচকিয়ে গেল। তিনি বললেন অনন্তর কাছ থেকে একজন ভদ্রলোক গিয়ে ইতিমধ্যেই পাই পয়সা মিটিয়ে দিয়ে এসেছে। অথচ সেন কেটারারের বাকী টাকা, দুহাজার টাকার নোটে, খামবন্দী অবস্থায় অনন্তর সঙ্গে রয়েছে। ওভার কোটের ভেতরের পকেটে হাত দিয়েই অনন্ত চমকে উঠলো। Zipper লাগানো পকেটের ভেতরে টাকা সমেত খামটার চিহ্ন মাত্র নেই। অনন্ত মুখটা ঘুরিয়ে গিন্নীকে ডাকতে গিয়ে দেখে ছেলের শ্বশুর কাটা গদাই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অনন্তকে দেখে এগিয়ে এসে সামান্য কটা টাকা অনন্তর হাতে দিয়ে বলল, “এই পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা ফেরৎ হয়েচে।“

“কিসের টাকা ফেরৎ?” হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে অনন্ত।  “কেন? সেন কেটারারের বাকী টাকা মিটিয়ে এই খুচরো টাকা কটা ফেরৎ হওয়ার তো কতাই ছিল।” একটু থেমে গদাই হাসি হাসি মুখে বললো, “দেড় বচ্ছর হলো পুরণো কারবার ছেড়ে দিইচি। ভাবলুম বহুৎ দিন আগের টেনিং, কাজে না লাগিয়ে, আঙুলের গাঁটে গাঁটে মরচে ধরে গেল কিনা পরখ করে একবারটি দেকি।

দেকলাম দিব্বি চলচে, একটুও মরচে ধরেনি গো। চোট খাওয়া আঙুলে একটু টান ধরে এই যা।”

ধন্য ওয়াজেদ আলি

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

Bhaskar Sinha.jpg

ধন্য় ওয়াজেদ আলী, আপনি নির্মমভাবে সত্য়/

পরিবেশ সংস্থাপনাথায় সম্ভবামি/জগতহিতায়

ভাস্কর সিন্হা

দোহা, কাতার

essaylogo1.jpg

পরিবেশসংস্থাপনাথায় সম্ভবামি

সুন্দর জীবনের উপাদান কি? কবিত্বের উপস্থাপনায়, "আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী।" ক্ষমতা বা শক্তি-ই তো রাজত্বের চাবিকাঠি। তা সে রাজত্ব দেশের, জমির, ভক্তির বা ব্য়বসার- যারই হোক না কেন। বুদ্ধিমান মনুষ্য় খুব সহজেই এই চাবিকাঠির রহস্য়ের উদ্ঘাটন করতে পেরেছে। প্রাণীকুলেও ক্ষমতা বা শক্তির রাজত্ব চলে। তবে সেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শারীরিক সক্ষমতা বা বলশীলতা। কিন্তু মনুষ্য়কুল ঐ শারীরিক সক্ষমতা ছাড়াও, বুদ্ধির আনুকূল্য়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শিতায় পারঙ্গম হয়েই থাকে। মনুষ্য় বুদ্ধির সীমা- পরিসীমা নেই। মানুষে থেমে থাকতেও পারে না। অজানাকে জানার, অজানাতে রাজত্ব করার সীমাহীন আগ্রহ মনুষ্য়কুলকে দিগ্বিদিকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। কেউ সাহিত্য় সাধনার শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে সচেষ্ট। কেউ আপনাকে ভক্তকুলের হৃদয়রাজ প্রতিপন্ন করতে অতিব্য়গ্র। আবার বা কেউ চিত্রাঙ্কনে, কেউ কবিতায়, কেউ গদ্য়ে, কেউ ভ্রমনকাহিনীতে, কেউ সঙ্গীতে, কেউ ক্রীড়ায়, কেউ রাজনীতিতে, কেউ ব্য়বসায়ে, কেউ যুদ্ধে, কেউ প্রেমে-- এতো- শতো বিবিধ বিষয় আছে, যা বলে শেষ হওয়ার নয়। কেউ কেউ ব্য়াপার- স্য়াপারগুলিকে অতীব বিশিষ্ট করে তুলেছে। যেমন কেউ দাড়িয়াল হবার পরিবর্তে সেইস্থলে মধু-মক্ষিকার চাষবাস করেই থাকে। কেউ দীর্ঘতম নখরায়ুধ হয়ে শ্লাঘা অনুভব করে। কেউ যেমন দীর্ঘতম কেশের অধিকারী। কেউ বা দীর্ঘতম শ্মশ্রুশোভিত হয়ে শ্লাঘনীয়তা উপলব্ধি করে। আর অতি বিশিষ্টতার কথা এখানে থাকুক। হয়তো অন্য় কখনও আবার এ বিষয়ে আলোচনার অবসর হবে।

তবে আজকে মানুষের যে ক্রমাগত নিজেকে  শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর করে তোলার অভিপ্রয়াস রয়েছে, তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই।  প্রতিদিন ধরাধামে নিত্য়নতুন মানুষের আগমন ঘটছে। প্রতিদিনই একদল নতুন মনুষ্য় সাবালকত অর্জন করছে এবং প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ নিজেকে বা নিজ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ ক্ষমতার বা শ্রেষ্ঠ শক্তির উৎকর্ষিতার অর্জনে প্রয়াসী। মানুষের এই ক্ষমতালিপ্সুতার সীমা- পরিসীমা নেই। সবাই আরো, আরো, আরও চায়। মানুষ থামতেও জানে না। অবাক হতে হয় যখন ভয়ালো চলচিত্রকেও আরও ভয়াবহ রূপে, নারকীয় রূপে প্রকাশ করা হয়, গণখুনী আরো, আরও বীভৎস হত্য়ালীলা চালাতেই থাকে।

এই ক্ষমতার অধিকারকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সময় হয়ে এসেছে। ক্ষমতালিপ্সুতা, ভোগবাদ ইত্য়াদি থেকে সরে এসে অন্য় বিষয়ে মনোনিবেশের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সসাগরা ধরিত্রীতে মনুষ্য় ছাড়াও সহস্র- কোটি প্রাণীকুল রয়েছে। তার উপরে আরো সহস্র- কোটি বা তার উপর সংখ্য়ক উদ্ভিদকুল। এই সকলকেই সুস্থ ও সুন্দরভাবে এই পৃথিবীতে অধিবাসের পরিসর থাকা উচিত।

আজ এক বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয় উপস্থিত। আজ এক গণিতজ্ঞের গনণা অত্য়ন্ত আবশ্য়ক। এই আমাদের জ্ঞানবোধ্য় একইমাত্র সুজলা- সুফলা ধরিত্রীতে সবাইকেই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে কত সংখ্য়ক প্রাণের বা প্রাণীর আবশ্য়কতা? অবশ্য় কিছু প্রাণ সুমহান, কিছু প্রাণ ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ ধরলে- আবহমান কাল ধরে যা চলছে- প্রাকৃতিক নিয়মই দৃঢ়ভাবে বলবৎ হয় না কি? অতএব যা চলছে, তাই চলুক- প্রকৃতি-ই আপন খেয়ালে নিত্য়- নতুন রূপের সমাহার করতে থাকুক। প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে বেশী টানা- হেঁচড়া বা ভন্ডুল করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকাই ভালো।

উপরোক্ত ভাবনাগুলিতে সহমত হয়েও, একদল শুভচিন্তক আমাদের যথাবিধ সতর্কিকরণ করে চলেছেন। পোলান্ডের কাতোয়িসে পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষাকর্তাদের সম্মেলনে ইদানিন্তন এ নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হল। কিন্তু অনায়াস সমাধান দূর অস্ত। আমরা যদি সত্য়ি-ই আমাদিগকে "অমৃতস্য় পুত্রাঃ" মেনে থাকি, তাহলে আমাদের সত্য়ি সত্য়ি-ই পৃথিবীর তাপমাত্রার অধোগতির প্রচেষ্টা আর জাগতিক অন্য় প্রাণীকুল এবং উদ্ভিদকুলের প্রতি সহমর্মিতার মনোভাবাপন্ন হওয়া অতীব কর্তব্য়।

ধন্য় ওয়াজেদ আলী, আপনি নির্মমভাবে সত্য়

 

সেই কত দীর্ঘকাল আগে বিদ্য়ালয়ের পাঠ্য়পুস্তকে এস ওয়াজেদ আলির লেখায় পড়েছিলাম যে সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলছে। উনি দুলে দুলে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠ নিয়ে বলেছিলেন। পাঁচ হাজার বছরের ট্রাডিশন আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে গিয়েছে। শক, হূণ, পাঠান, মোগল, ইংরেজ, পর্তুগিজ, ইত্য়াদিসকল যেই আসুক না কেন, আমাদের ডিএনএ তো একই, সেই আদি অকৃত্রিম রয়ে গিয়েছে। তাই জমিদার প্রথার কাগজে- কলমে অবলুপ্তি ঘটলেও, একদিকে তথাকথিত জমিদার- জোতদার শ্রেণী ক্ষমতার কুক্ষিগততায় বিশ্বাসী, অন্য়দিকে দিশাহারা মজুর- শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতাসীনদের অঙ্গুলিহেলনে অবসন্ন। তাই দেখা যায় যে কৃষি ৠণের মকুবতার কারণে- অকারণে সরকারের পতন হয়। যদিও দেখার বিষয় যে এই ৠণ মকুবে আসল লাভ কয়েকজন ধনী কৃষকের ঘরেই পৌঁছোয়। মজুর কৃষকের ৠণ নেবারও সামর্থ্য় নেই, বা তার নম্বর আসার আগেই কেটে যায়। আর ভোটের ঘরে মালিকের বলে রাখা চিহ্নতেই ছাপ পড়ে। ভারতে এই মালিক- শ্রমিকের সমাজ অনন্তকাল ধরেই চলেছে এবং ওয়াজেদ আলির ভাষায় ট্রাডিশন বদলাওনি।

কথা প্রসঙ্গে ১৯৯১ এ আল্পস পর্বতমালার ওতজালে পাওয়া তাম্রযুগের এক প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী এক বরফ মানবের মমি যে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ৩৪০০ থেকে ৩১০০ এর কোনও এক সময়ের হবে, যে তথ্য় পাওয়া যাচ্ছে যে এত দিনেও মানবের খাদ্য়াভাস মোটামুটি একই রয়েছে- সেই দানাশস্য় আর ছাগ মাংস। আর অদ্ভুতভাবে ব্য়ক্তিটির মৃত্য়ুও হয়েছে চোরাগোপ্তা আক্রমনে, পিছন হতে কেউ আচমকা শরনিক্ষেপ করেছে।

সে যাক, অর্থনীতি একটু খোলা হাওয়া পেলে কিছু মধ্য়বিত্তের আবির্ভাব হয়েছে অস্বীকারের নয়, কিন্তু বৃহত্তর দুনিয়ার সংজ্ঞায় তারা নিম্নবিত্তই বটে। হ্য়াঁ হয়তো একটু সচ্ছ্বল, এই যা, তার বেশী কিছু নয়। বড়ো বহুজাতিক সংস্থাকেও ভারতের বাজার ধরতে নিচুক্ষেত্রের মালের উপরেই বেশী ভরসা রাখতে হয়, উচ্চক্ষেত্রের মাল কয়টাই বা বিকিকিনি হয়? সেজন্য় ভারতেই ছোটো ছোটো পাউচে সাবুন বা দন্তমাজন এবং অন্য় মাল সকল বিক্রিত হয়, যা দুনিয়ার অন্য়প্রান্তে হিসেবের মধ্য়েই পড়ে না। মোবাইল সংস্থাগুলিকে নিম্নদামের বিশেষ মোবাইল সেট আনতে হয় ভারতবাজার

 

ধরার জন্য়।ভারতে বৈদ্য়ুতিক বাহনের বাজার দু চাকার জন্য় যতটা উপযোগী সেই তুলনায় চার চাকার জন্য় নয়। সেই রাজ-রাজাদের আমল থেকেই এই চলে আসছে। একদল বলে আসছে, অন্য়দল শুনছে। পৃথিবীতে যতো নিত্য়নতুন আবিস্কার হয়েছে মূলতঃ সবই মধ্য়বিত্তের অবদান। ভারতে সেই মধ্য়বিত্ত কোথায়? এককালে ভারতবর্ষে গান- বাজনার, ধর্মালোচনার বেশ কিছু শাখাপ্রশাকার বিকাশ ঘটেছিল, তাও ঐ রাজ- রাজাদের অনুগ্রহেই। গণিতেও একটু আধটু। রাজারা নিজেরাই মধ্য়বিত্তদের বিকাশ চাইলেন না। উচ্চ আর নিম্ন বিত্তদের সমাজ  রাজাদের বেশ পছন্দসই ছিল। রাজা আর শ্রমিক সমাজ। এই যে এত দিনেও কৃষিজাত পণ্য়ের সংরক্ষণ বা উন্নতিকরণ করে লাভজনক বিশাল ব্য়বসার দিকে দৃকপাত করা হয় না, ঐ একই কারণে। মধ্য়বিত্ত কৃষিজাত ব্য়বসার বিশাল ফাঁকি আমাদের উন্নতিকল্পে বিশাল বাধা। ইংরেজরা এসে রাজাদের দেখে শিখল- এক দেশে দুই শ্রেণীর জন্য় দুই নিয়ম চালু হলো। ইংরেজরা আবার বেশী চালাক এবং সম্রাজ্ঞীর অত্য়ন্ত অনুগতপ্রাণ, তাই লাভের সব গুড় সাগরপাড়েই পাড়ি দিতে থাকল। ফুলের সব মধু খেয়ে মৌমাছি গেল উড়ে। আম্বেদকরেরা ভাবলেন যে একটা নতুন সমাজ বানানো যাক। নিম্নশ্রেণীর জন্য় চালু হল সংরক্ষণ। কিন্তু মার্কসের আদর্শ যেমন বইএর পাতাতেই রয়ে গেলো, তেমনই হলো আমাদের সংরক্ষণ। তৈরী হলো সুবিধাবাদী শ্রেণীর। ক্ষমতাবানেরা চিরকালই আপনার দলবৃদ্ধিতে সিদ্ধহস্ত। এই যেমন ওবামা রাষ্ট্রপতি হওয়াতে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেই ফেলেছিলেন যে ওবামা তো আমাদেরই মতো এবং আমাদের একজন, রংটা শুধু একটু বেশী রোদে পোড়া, এই যা। এই ধরাধামে কেউই ক্ষমতার বিনাশ চায় না, যা শুধু অন্য়রূপে, অন্য়ভাবে বিকাশমান হয়। তাই আগের দিনের রাজা- রাজরাড়ারা আজ মন্ত্রী, বা সাংসদ। আর সংরক্ষণে সুবিধাবাদীরা শুধু ফেঁপে ফুলে বড়ই হলো না, সর্বস্তরে দুর্নীতির সুবিকাশ ঘটেই গেলো।  শঙ্কা একই যে এই ঘুণপোকা তো সবই অস্থিমজ্জা খেয়ে হজম করে দেবে না তো?

জগতহিতায়

 

প্রত্য়েক দেশই তার দেশবাসীর স্বার্থান্বেষণে তৎপর। এটাই জাগতিক নিয়ম। আমেরিকা আর্থিক স্বার্থে সৌদি বা কুয়েতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলে। কতো শত কোটি ডলারের বার্ষিক বরাত নিয়ে যায় তার অস্ত্র এবং বিমান শিল্পের জন্য়। সেই একই নিয়মে, ভারতকে দুর্বল প্রতিপন্ন করার জন্য় চিন ক্রমাগত পাকিস্তানকে আর্থিক, মানসিক, সামরিক ও আরো নানাবিধ সুযোগ- সুবিধার হস্তান্তর করে চলে, এটা জেনেও যে ঐ সাহায্য়ের সিংহভাগ ব্য়বহৃত হবে ভারতের পর্যদুস্ততার জন্য়।

কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষাই কি সব? এই ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে স্বার্থান্বেষীরা কি পৃথিবীটাকে আরো টুকরো, টুকরো করে দিচ্ছে না? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের চরিতার্থতায় কি বৃহত মানবসভ্য়তা পর্যদুস্ত হয়ে উঠছে না? মানবসভ্য়তা কি ক্রমাগত এক সর্বনাশ থেকে আর এক ধ্বংসের পথে অভিমুখী হয়ে চালিত হচ্ছে না?

এই মারামারি- হানাহানির জগৎ থেকে সরে এসে আমরা যদি আমাদের উন্নতি এবং সার্বিক বিকাশের প্রচেষ্টা করতাম, তাহলে মানবসভ্য়তার যারপরনাই উন্নতি হতো না?

ধর্ম ব্য়াপারটি যে বেশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ভুক্ত হয়ে গিয়েছে, আর সন্দেহ নেই। ধর্ম তো মানুষকে শান্তি আর ঈশ্বরের নিকটগামী করে তোলার পথই মাত্র ছিলো। কিন্তু ধর্ম এখন এক ভীষণ বিধ্বংসী এবং জিঘাংসা শিকারী হয়ে উঠেছে সন্দেহ নেই।  অন্য় ধর্মকে অবমাননার মধ্য়ে কোনো মহত্ত্বের বিকাশ ঘটে না, বরং আমরাই আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাই।

সত্য় বলতে সব মানবই হোমো সেপিয়েন্স পরিবারভুক্ত। এই যেমন সর্প পরিবারভুক্ত সব সাপই সাপ, তা চন্দ্রবোড়া, কেউটে বা পাইথন যাই হোক না কেন। আবার সব গাঁদা তো গাঁদাই, তা লাল বা হলুদ বা অন্য় কোন মিশ্র রঙের ফুল হোক না কেন। সব মানুষই তো একে অন্য়ের ভাই- ভাই। আমি এই "ভাই" কথাটি সাধারণ- সর্বজনগ্রাহ্য় হিসেবে তুলে ধরছি, মহিলা পাঠিকারা এতে আশাকরি বিরাগভাজন হবেন না। আমাদের ত্বকের ভিন্ন ভিন্ন রঙ তো মেলানিন আর সূর্যকিরণের যোগসাজসে। তো এক বর্ণকে আর এক বর্ণের উপর অগ্রাধিকার তো আমরাই দিয়েছি। এক বর্ণকে আর এক বর্ণের উপর রাজত্বের অধিকার তো আমরাই মেনে নিয়েছি। বুদ্ধি মানুষের সম্বল, সাতন্ত্রতা তো মানুষের চরিত্রগত। তাই দেশে- দেশে এত শত- কোটি ভাষার উদ্ভব, এত- শত খাদ্য়াভাষের রকমফের। এত রকম পোষাকের ব্য়ঞ্জনা। তার মানেই আমরা যে আলাদা হয়ে গেলাম, তা তো নয়। হ্য়াঁ, আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারায় বা প্রয়োগে কিছু- কিছু বিভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা তো সকলেই একই- অমৃতস্য় পুত্রাঃ! হ্য়াঁ, পথে চলতে- চলতে কেউ এগিয়ে গিয়েছে। কেউ- কেউ বেশী সুযোগ পেয়েছে। কেউ- কেউ সেই বেশী সুযোগের অপব্য়বহার করেছে। কেউ- কেউ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেই থাকতে চেয়েছে। এই খানেই এসেছে বিপদ।

লঙ্কায় যে যায়, সেই হয় রাবণ। আমাদের মধ্য়ে যারা একবার ভি আই পি হয়ে গেলো, আর সেই আরাম ছাড়তে তাদের কষ্ট হোল। যেন- তেন প্রকারেণ, ওই আরামভোগ তাদের চিরকালীন ব্রত হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, সেই আরাম আর সুযোগ যেন চোদ্দ পুরুষ বা তার পরেও বলবৎ রাখতে পারে, সেই চেষ্টার চিরকালীন বন্দোবস্তের আয়োজনের শেষ থাকল না

প্য়ারেটো নিয়মানুসারে বলা যেতেই পারে যে, পৃথিবীর আশি শতাংশ সম্পদের মালিকানা শুধু সমগ্র জনসংখ্য়ার কুড়ি শতাংসর হাতে। এটা একটা মোটা -মোটা হিসেব। সূক্ষ হিসাবে কুড়ি নিশ্চয় আরো নিচস্থ হবে। তাহলে ঐ কথা যে, আমরা সবাই সমান- এ কথা তো বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেলো। যারা এই ধরণীতে আগে এল, অস্ত্র- শস্ত্র বা বাহূবলে অধিকার প্রথমেই কায়েম করল,  সম্পত্তি বা মালিকানা তাদের হাতেই রয়ে গেলো। বসুন্ধরা চিরকালই বীরভোগ্য়া, প্রান্তিকের হিসাব তো পরিধিতেই রয়ে গেলো।

খুনোখুনি বা জোর- জবরদস্তির উপায়ের আলোচনা এখানে হচ্ছে না। ওসব সভ্য়তার সমীকরণে আসে না। কিন্তু সুস্থজীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির তো সবাই কাছেই পৌঁছানো উচিত সুষ্ঠুভাবে, এনিয়ে দ্বিমত হবার অবকাশ নেই। তাই এই হানাহানির কুশ্রীতা, ভাগাভাগির নিয়ম, ধর্মান্ধতার বেড়ি, সামাজিক- অর্থনৈতিক- মানসিক ঘেরাটোপ থেকে মহামুক্ত হয়ে, বিবিধের মাঝে মানবের মহামিলনের সাধনাই মানবজীবনকে উত্তরণের পথ দর্শাতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ ও তরুন বিল্পবীরা

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ও

তরুণ বিপ্লবীরা

দিলীপ মজুমদার

পর্ণশ্রী, কলকাতা 

art1.jpg

৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। বুধবার। রাত সাড়ে ন’টা। মেদিনীপুর জেলার খড়গপুরের বন্দিনিবাসে হঠাৎ বেজে উঠল পাগলা ঘণ্টি। প্রায় ৫০ জন পুলিশ ও ২৪ জন সিপাই ‘হুকুম মিল গিয়া’, ‘শালা লোককো মারো’, ‘রামজিকা জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে ঘিরে ফেলল বন্দীনিবাস। তারপর ছুঁড়তে লাগল গুলি। ৮ টি পোস্টের সেন্ট্রি ও পুলিশ তাদের সঙ্গ যোগ দেয়। খাবার ঘরে ছিলেন বরিশালের কৃষ্ণপদ ব্যানার্জী। গুলিতে আহত হন তিনি। অন্য বন্দিরা তাড়াতাড়ি খাবার ঘরের আলো নিভিয়ে দেন।

বরিশালের তারকেশ্বর সেন ছিলেন সিঁড়ির নিচে। গুলি তাঁর মাথায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান তিনি। ঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সন্তোষ মিত্র। একাধিক গুলি লাগে তাঁর পেটে। তিনিও মারা যান। সে ঘরে ছিলেন শচীনচন্দ্রনাথ ঘোষ। একটা গুলি তাঁর মেরুদণ্ডে ও আর একটা গুলি তাঁর পায়ে লাগে। তাঁর পাশে ছিলেন কৃষ্ণনগরের গোবিন্দপদ দত্ত। তাঁর বাম হাতে গুলি লাগে।

এরপরে পুলিশ ও সিপাইরা সিঁড়ির উপরে উঠে একটি ঘরে বহরমপুরের সবিতাশেখর রায়চৌধুরীর উপর চড়াও হয়। বেয়নেট চার্জ করার ফলে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন ও অচৈতন্য হয়ে পড়েন। বরিশালের সুধীর সেন তারকেশ্বর সেনের রক্তাপ্লুত দেহের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছন থেকে গুলি করা হয় তাঁকে। পুলিশের গুলিতে আহত হন বহরমপুরের তারাপদ গুপ্ত ও বরিশালের কুঞ্জবিহারী বসু।

এরপরে পুলিশ পশ্চিম প্রান্তে দৌড়ে গিয়ে আক্রমণ করে বন্দিদের। গুলি লাগে কলকাতার সত্যেন চৌধুরী ও চট্টগ্রামের অশ্বিনী গুহের শরীরে। আক্রান্ত হন মুন্সিগঞ্জের প্রবোধ গুপ্ত। রংপুরের রমেশ চাকী ও ময়মনসিংহের নরেশ সোম গুলিবিদ্ধ হন । যশোরের হেমন্ত তরফদার লাঠি ও ব্যাটনের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঢাকার মনোহর মুখার্জীর বাম হাতে গুলি লাগে।

১৭ সেপ্টেম্বর হিজলির ঘটনা সম্বন্ধে একটি সরকারি ইশতেহার প্রকাশ করে বলা হয়:  ১৬ সেপ্টেম্বর রাত ন’টার অল্প পরে হিজলি বন্দীনিবাসের একদল রাজবন্দি চারজন সেন্ট্রির উপর পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়। এ্জন সেন্ট্রির বন্দুক থেকে তারা বেয়নেট কেড়ে নেয়, অন্য একজন তার উপর চড়াও হয়। এরকম অবস্থায় আত্মরক্ষা ও শৃঙ্খলারক্ষার জন্য তারা গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়। ফলে দুজন বন্দি নিহত ও কুড়ি জন বন্দি আহত হয়। আধঘন্টা পরে অবস্থা আয়ত্তে আসে।

হিজলির এই ঘটনার যে সরকারি তদন্ত হয় তার উপর স্বাভাবিকভাবে আস্থা ছিল না বন্দিদের। তাঁরা বাংলার গভর্নরের কাছে এক আবেদনে জানান: “গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাত্রিতে বন্দিদের ব্যারাকের মধ্যে তাঁহাদের শুইবার ঘরে, খাইবার ঘরে এবং হাসপাতালে গুলি বর্ষণ করা হইয়াছিল; তাহার ফলে দুইজন বন্দির মৃত্যু হয় ও বিশজন আহত হয়। বিনা কারণে, পূর্ব হইতে পরামর্শ করিয়া এবং অন্যায়রূপে এই গুলিবর্ষণ করা হইয়াছে। এই সম্বন্ধে গবর্নমেন্ট যে বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বিদ্বেষমূলক ও কল্পিত কথায় পূর্ণ।”

সরকারি তদন্তে প্রকৃত সত্য প্রকাশ পায় নি।

হিজলির হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে যে বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সে কমিটির তদন্তের বিবরণ পাওয়া যায় নীরদরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘হিজলির কথা’ শীর্ষক রচনায়। রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। বেসরকারি তদন্তে ধরা পড়েছে যে বন্দিশালার বন্দিদের সঙ্গে বড়কর্তা মিঃ বেকারের সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। গার্লিক ও আসানুল্লা হত্যার পরে বন্দিরা উল্লসিত হব এবং বন্দিশালা আলোকমালায় সুসজ্জিত করে বলে মিঃ বেকারের ধারনা হয়। ফলে তিনি বন্দিদের মাসোয়ারা কমিয়ে দেন এবং তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে থাকেন। প্রভুভক্ত পুলিশ ও সিপাইরা বন্দিদের শায়েস্তা করার কথা ভাবতে থাকে। শুধু মিঃ বেকার নন, পুলিশের ইন্সপেক্টর মিঃ মার্শালের সঙ্গেও বন্দিদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। বেসরকারি তদন্তকারীরা তিনটি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিলেন:

ক] আগের দিন সিপাইদের সঙ্গে বন্দিদের গোলমাল হয়েছিল। মিঃ বেকার সে গোলমাল না মিটিয়ে হিজলি ত্যাগ করে খড়গপুর চলে গিয়েছিলেন কেন?

খ] গুলিবর্ষণের আধঘন্টা পরে মিঃ বেকার এসেছিলেন ডাক্তার নিয়ে। বন্দিরা অনেকে যে গুরুতর আহত সেকথা তিনি ডাক্তারকে জানান নি। তাই ডাক্তারের পক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসা করাও সম্ভব হয় নি।

গ] ঘটনা ঘটার প্রায় দুঘন্টার পরে আহত বন্দিদের খড়গপুরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কেন?

হিজলি বন্দীনিবাসে ইংরেজদের এই অত্যাচারের প্রতিবাদে টাউন হলে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় ২৬ সেপ্টেম্বর । অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায় ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হলে তিনি রাজি হন। অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, সুভাষচন্দ্র বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, বসন্ত মজুমদার।

টাউন হলে সভা শুরু হবার কথা ৪-৩০ মিনিটে। কিন্তু দেখা গেল বেলা তিনটের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেছে টাউন হল। মানুষ শুনতে এসেছেন রবীন্দ্রনাথের কথা, যিনি বাংলার তরুণদের প্রতি মমতাবশত অসুস্থ শরীর নিয়েও আসছেন সভায়। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির আধঘন্টা পূর্বে প্রমাদ গুণতে শিরি করলেন উদ্যোক্তারা। তিল ধারণের জায়গা নেই। জনতার চাপে যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে কাঠের সিঁড়ি। তখন ঠিক করা হয় টাউন হলের পরিবর্তে সভা হবে মনুমেন্ট ময়দানে। মনুমেন্টের দিকে ছুটে চলল জনতা।

তখন মাইক্রোফোন ছিল না। খালি গলায় এত মানুষের কাছে বক্তব্য হাজির করা সম্ভব নয়। তাই ঠিক হল মুমেন্টের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি সভা হয়ে।

সভাস্থলে সাড়ে পাঁচটায় আসেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জন্য ইনভ্যালিড চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বললেন:

“এতবড় জনসভায়  যোগ দেওয়া আমার শরীরে পক্ষে ক্ষতিকর, মনের পক্ষে উদভ্রান্তিজনক,  কিন্তু যখন ডাক পড়ল  থাকতে পারলুম না। ডাক এল সেই পীড়িতদের কাছ থেকে, রক্ষকনামধারীরা যাদের কণ্ঠস্বরকে নরঘাতক নিষ্ঠুরতার দ্বারা চিরদিনের মতো নীরব করে দিয়েছে।”

বৃটিশ শাসনের বিকৃতি বর্বরতা প্রসঙ্গে তিনি বললেন :

“যখন দেখা যায় জনমতকে অবজ্ঞার সঙ্গে উপেক্ষা করে এত অনায়াসে বিভীষিকার বিস্তার সম্ভবপর হয় তখন ধরেই নিতে হবে যে ভারতে বৃটিশ শাসনের চরিত্র বিকৃত হয়েছে এবং এখন থেকে আমাদের ভাগ্যে দুর্দাম দৌরাত্ম উত্তরোত্তর বেড়ে চলবার আশঙ্কা ঘটল।  যেখানে নির্বিবেচক অপমান ও অপঘাতে পীড়িত হওয়া দেশের পক্ষে এত সহজ অথচ যেখানে যথোচিত বিচারের ও অন্যায় প্রতিকারের আশা এত বাধাগ্রস্ত, সেখানে প্রজারক্ষার দায়িত্ব যাদের পরে সেই সব শাসনকর্তা এবং তাদেরই আত্মীয় কুটুম্বদের শ্রেয়োবুদ্ধি কলুষিত হবেই এবং সেখানে ভদ্রজাতীয় রাষ্ট্রবিধির ভিত্তি জীর্ণ না হয়ে থাকতে পারে না।”

এরপর সতর্কবাণী  উচ্চারিত হল তাঁর কণ্ঠে:

“এই সভায় আমার আগমনের কারণ আর কিছুই নয়,আমি আমার স্বদেশবাসীর হয়ে রাজপুরুষদের এই বলে সতর্ক করে দিতে চাই যে, বিদেশিরাজ যত পরাক্রমশালী হোক না কেন, আত্মসম্মান হারানো তার পক্ষে সবচেয়ে দুর্বলতার কারণ। এই আত্মসম্মানের প্রতিষ্ঠা ন্যায়পরতায়, ক্ষোভের কারণ সত্ত্বেও অবিচলিত সত্যনিষ্ঠায়। প্রজাকে পীড়ন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করানো রাজার পক্ষে কঠিন না হতে পারে;

কিন্তু বিধিদত্ত অধিকার নিয়ে প্রজার মন যখন স্বয়ং রাজাকে বিচার করে, তখন তাকে নিরস্ত করতে পারে কোন শক্তি?...

“আমি আজ উগ্র বাক্য সাজিয়ে সাজিয়ে নিজের হৃদায়াবেগের ব্যর্থ আড়ম্বর করতে চাইনে এবং এই সভার বক্তাদের প্রতি আমার বিশেষ নিবেদন এই যে, তাঁরা যান এই কথা মনে রাখেন, ঘটনাটা স্বতই আপন কলঙ্কলাঞ্ছিত নিন্দার পতাকা যে উচ্চে ধরে আছে তত ঊর্ধ্বে আমাদের ধিক্কারবাক্য পূর্ণবেগে পৌঁছাতেই পারবে না।..... ” [প্রবাসী, কার্তিক, ১৩৩৮] স্যার নীলরতন সরকারের প্রস্তাব অনুসারে হিজলির ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক জে এম সেনগুপ্ত। সদস্যরা:  আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার নীলরতন সরকার, বীরেন্দ্রনাথ  শাসমল, সুভাষচন্দ্র বসু, টি সি গোস্বামী, সুরেশচন্দ্র মজুমদার, অশ্বিনীকুমার গাঙ্গুলী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভুদয়াল সিংকা, কিরণশঙ্কর রায়, বিমলপ্রতিভা দেবী, ঊর্মিলা দেবী, শান্তি দাস, হেমন্তকুমার বসু, অমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, সতীন্দ্রনাথ সেন, নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, হরিকুমার

চক্রবর্তী, অরুণাংশু দে, মৌলানা আক্রম খাঁ, অবিনাশ ভটাচার্য, মৌলভী মুজিবর রহমান। হিজলির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের যে ঘৃণা ও ক্রোধ সৃষ্টি হয়েছিল তাকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার ব্রত নিয়েছিল দুটি পত্রিকা: ইংলিশম্যান ও স্টেটসম্যান। পরের পত্রিকাটি যখন হিজলির কারারক্ষীদের অপরাধ লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করে তখন, তখন রবীন্দ্রনাথ সেই পত্রিকার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠান অমল হোমের হাতে। পত্রিকা সম্পাদক অমল হোমকে চিঠিটি ফেরত দিয়ে বলেন যে এ চিঠি প্রকাশ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

‘হিজলিকারার যে রক্ষীরা সেখানকার দুজন রাজবন্দীকে খুন করেছে তাদের প্রতি কোন একটি আ্যংলো ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র খ্রিস্টোপদিষ্ট মানবপ্রেমের পুনঃপুনঃ ঘোষণা করেছেন। অপরাধকারীদের প্রতি দরদের কারণ এই যে, লেখকের মতে, নানা উৎপাতে তাদের স্নায়ুতন্ত্রের পরে এত বেশি অসহ্য চাপ লাগে যে, বিচারবুদ্ধিসঙ্গত স্থৈর্য তাদের কাছে প্রত্যাশাই করা যায় না । এইসব অত্যন্ত চড়ানাড়িও্য়ালা ব্যক্তিরা স্বাধীনতা ও অক্ষুণ্ণ আত্মসম্মান ভোগ করে থাকে; এদের বাসা আরামের, আহার-বিহার স্বাস্থ্যকর, এরাই একদা রাত্রির অন্ধকারে নরঘাতক অভিযানে সকলে মিলে চড়াও হয়ে আক্রমণ করলে সেই সব হতভাগ্যদেরকে যারা বর্বরতম প্রণালীর বন্ধনদশায় অনির্দিষ্টকালব্যাপী অনিশ্চিত ভাগ্যের প্রতীক্ষায় নুজেদের স্নায়ুকে  প্রতিনিয়ত পীড়িত করছর। সম্পাদক তার সকরুণ প্যারাগ্রাফের স্নিগ্ধ প্রলেপ প্রয়োগ করে সেই হত্যাকারীদের পীড়িতচিত্তে সান্ত্বনা সঞ্চার করেছেন।

‘অধিকাংশ অপরাধেরই মূলে আছে স্নায়বিক অভিভূতি এবং লোভ-ক্লেশ-ক্রোধের এত দুর্দম উত্তেজনা যে তাতে সামাজিক দায়িত্ব ও কৃতকার্যের পরিণাম সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দেয়। অথচ এরকম অপরাধ স্নায়ুপীড়া বা মানসিক বিকার থেকে উদ্ভূত হলে আইন তার সমর্থন করে না; করে না বলেই মানুষ আত্মসংযমের জোরে অপরাধের ঝোঁক সামলিয়ে নিতে পারে। কিন্তু করুণার পীযূষকে যদি বিশেষ যত্নে কেবল সরকারি হত্যাকারীদের ভাগেই পৃথক করে যোগান দেওয়া হয় এবং যারা প্রথম হতেই অন্তরে নিঃশান্তির আশা পোষণ করছে, যারা বিধিব্যবস্থার রক্ষকরূপে নিযুক্ত হয়েও বিধিব্যবস্থাকে স্পর্ধিত আস্ফালনের সঙ্গে ছারখার করে দিল, যদি সুকুমার স্নায়ুতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তাদেরই জন্য একটা স্বতন্ত্র আদর্শের বিচার পদ্ধতি মঞ্জুর হতে পারে, তবে সভ্যজগতের সর্বত্র ন্যায়-বিচারের যে মূলতত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে তাকে অপমানিত করা হবে এবং সর্বসাধারণের মনে এর যে ফল ফলবে তা অজস্র রাজদ্রোহ প্রচারেও সম্ভব হবে না।

‘বে-আইনি অপরাধকে অপরাধ বলেই মানতে হবে এবং তার ন্যায়সঙ্গত পরিণাম যেন অনিবার্য হয় এইটেই বাঞ্ছনীয়। অথচ এ কথাও ইতিহাস বিখ্যাত যে  যাদের হাতে সৈন্যবল ও রাজপ্রতাপ অধবা যারা এই শক্তির প্রশ্রয়ে পালিত, তারা বিচার এড়িয়ে এবং বলপূর্বক সাধারণের কণ্ঠরোধ করে ব্যাপকভাবে ও গোপন প্রণালীতে দুর্বৃত্ততার চূড়ান্ত সীমায় যেতে কুণ্ঠিত হয় নি। কিন্তু মানুষের সৌভাগ্যক্রমে এরূপ নীতি শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না।’ [ প্রবাসী, অগ্রহায়ণ, ১৩৩৮]

হিজলিতে গুলি চালনার পরের দিন থেকে বন্দিরা অনশন করেছিলেন। কোন নেতার কথায় তাঁরা অনশমন ভঙ্গ করতে রাজি হন নি। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের মর্মস্পর্শী আবেদনে তাঁরা সাড়া দিলেন। সেই কারণে ঊর্মিলা দেবী হিজলি গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি জানালেন যে বন্দিরা রবীন্দ্রনাথের কথায় অনশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মাস দুয়েক পরেই ছিল ২৫শে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। হিজলির বন্দিদের পক্ষ থেকে সুধীরকিশোর বসু কবিকে পাঠান এক অভিনন্দন পত্র:            

হিজলি রাজবন্দীগণের অভিনন্দন

বাংলার একতারায় বিশ্ববাণীর ঝংকার তুলিয়াছ তুমি, হে বাউল কবি, তোমার জন্মদিনে আজ তোমাকে প্রণাম করি।

সংকীর্ণ-স্বার্থ-সংকুচিত দ্বন্দ্বপর বিশ্বসমাজকে মৈত্রী করুণা ও কল্যাণের মন্ত্র দান করিয়াছ তুমি, হে বিশ্বকবি, তোমার জন্মদিনে আজ তোমাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

বন্ধন-বিমূঢ় অবমানিতের মর্মবেদনাকে ভাষা দান করিয়াছ তুমি, হে দরদী, তোমার জন্মদিনে আজ তোমার কল্যাণ কামনা করি।

বিশ্বদেবতার চরণে গীতাঞ্জলি দান করিয়া বিশ্বের বরমাল্য লাভ করিয়াছ তুমি, হে গুণী, তোমার জন্মদিনে আজ তোমাকে অভিনন্দিত করি।

এই শ্রদ্ধাঞ্জলি তুমি গ্রহণ কর।

ইতি

রাজবন্দীগণ

হিজলির রাজবন্দীদের অভিনন্দনপত্রের প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:

কল্যাণীয়েষু,

কারান্ধকার থেকে উচ্ছ্বসিত তোমাদের অভিনন্দন আমার মনকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছে। কিছুতে যাকে বদ্ধ করতে পারে না, সেই মুক্তি তোমাদের অন্তরে অবারিত হোক, এই কামনা আমি করি।

ইতি

সমব্যথিত

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২২ জানুয়ারি, ১৯৩২

এই প্রসঙ্গে কবির বিখ্যাত ‘প্রশ্ন’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যায়। কবিতাটি লিখিত হয়েছিল ১৩৩৮ সালের পৌষ মাসে।  ১৮ লাইনের এই কবিতায় আক্রান্ত জাতির সংবেদনশীল প্রতিনিধির প্রশ্ন যেন বিশ্ববিধানকে বিদ্ধ করেছে। প্রথম ৬ লাইনে সভ্যতার ইতিহাসকে সামনে রেখে কবি  মানুষের বর্বরতার কারণ খুঁজতে চেয়েছেন। যুগে যুগে  প্রীতি ও প্রেমের বাণী নিয়ে এসেছেন মহামানবরা। বিপর্যস্ত বর্তমানে দাঁড়িয়ে কবির মনে হয় সেসব বাণীর উত্তরাধিকার অবলুপ্ত। নরঘাতক নিষ্ঠুরতার নীরন্ধ্র অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে তার শেষ আলোকরশ্মি। দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাসকে কলুষিত করে দিয়েছে স্বার্থ, লোভ আর লালসার বিষ:

      ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে

      দয়াহীন সংসারে,

      তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো’   

      অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো।

      বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির দ্বারে

      আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।

পরবর্তী ছয়টি লাইনে কবি শাসকশক্তির অত্যাচারের ইঙ্গিতগর্ভ বিবরণ দিয়েছেন। স্তবকটি শুরু হয়েছে ‘আমি যে দেখেছি’ বলে। প্রত্যক্ষদর্শীর নির্ভীক উচ্চারণ যেন। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা নেই:

আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে

হেনেছে নিঃসহায়ে;

আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে;

আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে

কি যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।

এই নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতা কবিকেও ক্ষত-বিক্ষত করেছে। মানবতার চরম অবমাননায় কবি যন্ত্রণাদগ্ধ:

কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সঙ্গীতহারা,

অমাবস্যার কারা

লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে-

বিশ্ববিধান কি এই অন্যায়-অবিচার, এই নরঘাতন নিষ্ঠুরতা মেনে নেবে?

সেটাই কবির প্রশ্ন:

তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে—

যাহারা  তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, 

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সোমেন চন্দের জীবন

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

সোমেন চন্দের জীবন সম্বন্ধে

তথ্যচিত্রের খসড়া

শিল্পী আক্রান্ত

দিলীপ মজুমদার 

পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা 

somen1.jpg

এক

[ন্ধ্যা। নদীর তীর। জলের শব্দ। অস্পষ্ট চলমান নৌকো। সোমেন চন্দের ছায়ামূর্তি। রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতা আবৃত্তি করছে। আর এক ছায়ামূর্তি পেছনে এসে দাঁড়ায়। সোমেনের কাঁধে হাত রাখতে সে চমকে ওঠে।]

সোমেন: আরে, সতীশদা কখন এলেন?

সতীশ: একটু আগে। তোমার আবূত্তি শুনতে শুনতে এলাম।

সোমেন: আপনার জন্য বিকেল থেকে অপেক্ষা করছি।

সতীশ:  একটু দেরি হয়ে গেল সোমেন।

সোমেন:  মিটিং ছিল?

সতীশ: হ্যাঁ। নতুন আদর্শ নিয়ে ফিরে এসেছি আন্দামান থেকে। এখন শুধু কাজ আর কাজ।

সোমেন: নতুন আদর্শ?

সতীশ: সাম্যবাদের আদর্শ। আন্দামানের বন্দী জীবনে এটাই তো ছিল নতুন আলো, নতুন পথের দিশা 

[অনেকের কথাবার্তার শব্দ। তার মধ্যে ‘লেনিন’ ‘নভেম্বর বিপ্লব’ ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ এসব ভেসে আসে]

সতীশ: আন্দামানে নবজন্ম হল আমাদের। ত্যাগ করলাম সন্ত্রাসবাদের পথ। বুঝলাম অস্ত্র নয় , ক্ষমতার উৎস হল মানুষ। সেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

সোমেন: এসব বিষয়ে আরও জানতে ইচ্ছে করে সতীশদা।

সতীশ: সেই জন্যই তো এসেছি তোমার কাছে। চলে এসো আমাদের প্রগতি পাঠাগারে।

সোমেন: যাব, নিশ্চয় যাব।

সতীশ: শুনেছি গল্প-কবিতা লেখ, লেখক হতে চাও। জানো স্পেনের কথা? কি ঘটছে সেখানে জানো কি?

সোমেন: শুনেছি কিছু কিছু।

সতীশ: ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে জনগণের লড়াই।

[পর্দায় ভেসে ওঠে স্পেনের গৃহযুদ্ধের ছবি--- র‍্যালফ ফক্স আর কডওয়েলের ছবি]

সতীশ: সে লড়াইতে যোগ দিয়েছেন কবি আর লেখকরা। মৃত্যুবরণ করেছেন বিপ্লবী লেখক র‍্যালফ ফক্স।

সোমেন: লেখকও মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল?

সতীশ: অত্যাচার যখন চরমে ওঠে, মানবতার বিকাশ যখন রুদ্ধ হয়, তখন কলম ছেড়ে ধরতে হয় তরবারি, বুকের রক্তে তৈরি করতে হয় নতুন সাহিত্য। তাই তো ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে ষোগ দিয়েছেন কবি-লেখকরা।

সোমেন: এঁরাই সত্যিকারের লেখক।

দুই

[বিশ শতকের তিরিশের দশকের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা টুকরো ছবি। সঙ্গে ভাষ্য: ১৯৩৭-৩৮ সাল। আন্দামানসহ নানা জেল থেকে বহু নেতৃস্থানীয় বন্দি মুক্তিলাভ করে ঢাকায় আসেন। কারাগারে এঁরা গ্রহণ করেছিলেন কমিউনিজমের আদর্শ। এঁদের মধ্যে ছিলেন জীতেন ঘোষ, জীবন চ্যাটার্জী, সত্যেন সেন, সুশীল ঘোষ, প্রবোধ গুপ্ত, নেপাল নাগ, বিনয় বসু, বঙ্গেশ্বর রায়, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জী, ব্রজেন দাস, বারীন দত্ত, সতীশ পাকড়াশি, সতীন রায়, অন্নদা পালিত। এঁদের চেষ্টায় ১৯৩৮ সালের মধ্যে ঢাকা প্রেস শমিক ইউনিয়ন, ইলেকট্রিক সাপ্লাই ওয়ার্কাস ইউনিয়ন, লক্ষ্মীনারায়ণ টেক্সটাইল মিল ওয়ার্কাস ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ কৃষক সমিতি গড়ে ওঠে। ছাত্র ফেডারেশন শক্তিশালী হয়।]

তিন

[ছোট মাটির ঘর। লেনিনের ছবি। চারদিকে প্রচারেপত্র ছড়ানো। লন্ঠনের চারদিকে গোল হয়ে বসে কয়েকজন আলোচনা করছে]

রণেশঃ সোমেন চন্দের সঙ্গে দেখা হল সতীশদা ?

সতীশ: হ্যাঁ, বুঝলে রণেশ সোমেন খাঁটি হিরে।

রণেশ: নিরঞ্জনবাবু তার পরিবারের অনেক খবর এনেছেন। তার বাবা নরেন চন্দ ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের স্টোর্স বিভাগে কাজ করেন। সামান্য মাইনে। কোনোরকমে সংসার চলে। ম্যাট্রিক পাশ করেছে সোমেন।

সতীশ: আমার কি মনে হয় জানো! মনে হয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ গড়ার কাজে সোমেন হাতিয়ার হয়ে উঠবে।

নিরঞ্জন: রণেশ পাবে তার যোগ্য সহকর্মী।

সতীশ: ঠিক কথা। তবে খেয়াল রেখো, সোমেনের শরীরটা ভালো নয়, সবে প্লুরিসি থেকে উঠেছে।

চার

[ঘরের সামনে সাইনবোর্ড ‘প্রগতি পাঠাগার’। ১০/১২ জন যুবক। একজন লেনিনের লেখা থেকে কিছু পড়ছে। এমন সময় এসে দাঁড়ায় সোমেন চন্দ]

সোমেন: ভেতরে আসব রণেশদা?

রণেশ: এই দ্যাখ, সোমেন এসেছে। এসো, এসো সোমেন।

[লাজুকভাবে সোমেন ঘরে ঢুকে এককোণে বসে]

রণেশ: সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে সোমেন চন্দ। বাড়ি বিক্রমপুর। এখন অবশ্য দক্ষিণ মৈশুন্ডির বাসিন্দা। গল্প-কবিতা লেখে। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার গল্প ‘শিশুতপন’। কাঁচা বয়েস কিন্তু পাকা হাত।

সোমেন : আঃ রণেশদা-

রণেশ: বড্ড লাজুক। আমাদের একজন হয়ে উঠলে অবশ্য কেটে যাবে লজ্জা। এখন থেকে সোমেন প্রগতি পাঠাগারের সদস্য।

সকলে: আমরা নতুন সদস্যের লেখা শুনব।

রণেশ: এ দাবি যে উঠবে তা জানতাম। সোমেনকে বলেও রেখেছিলাম।

সোমেন: ‘শিশুতপন’ গল্পটাই পড়ি!

রণেশ: বেশ।

[সোমেন গল্প পড়তে শুরু করে। শেষ হতে সকলে হাততালি দিয়ে ওঠে]

সোমেন: আমি কিন্তু জানতে আর শনতে এসেছি। শুনতে চাই মার্কসবাদের কথা, রুশবিপ্লবের কাহিনি, গরিব মানুষের মুক্তিপথের দিশা...

পাঁচ

[বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সোমেন। বইপত্র নাড়ছে, পড়ছে, লিখছে। ভাষ্য: শুধুমাত্র সাহিত্যের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাননি সোমেন। মানুষের মুক্তিপথের সন্ধানই ছিল তাঁর সাধনা। গভীর অধ্যবসায়ের সঙ্গে রাত জেগে পড়তেন মার্কসবাদী সাহিত্য, জানার চেষ্টা করতেন চাষি-মজুরের সমস্যা। কৃষাণের মজুরের জীবনের শরিক হতে চাইতেন।]

ছয়.

[শীতের সকাল। কুয়াশা। রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। শিফট চেঞ্জের সময়। নাইট শিফটের শ্রমিকরা বেরিয়ে আসছে। গেটের ওধারে সোমেন। গায়ে বিবর্ণ উলের চাদর, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।কথা বলছে শ্রমিকদের সঙ্গে]

সোমেন: আপনি ইউনিয়নের সভ্য হয়েছেন?

শ্রমিক১: না।

সোমেন: আপনি?

শ্রমিক২: গত বছর ছিলাম।

সোমেন: আপনি?

শ্রমিক৩: সভ্য! নাতো।

সোমেন: আচ্ছা, আপনারা কি মনে করেছেন বলুন তো! ইউনিয়নের সভ্য না হয়ে একা একা বাঁচতে পারবেন? ওরা শক্তিমান। ওদের সঙ্গে একা পারবেন লড়াই করতে! পারবেন আপনার দাবি আদায় করতে!

[আরও শ্রমিক ভিড় করে আসে। সকলে উৎসুক হয়ে শোনে সোমেনের কথা]

সোমেন: না, একা একা বাঁচা যায় না। মালিকের সঙ্গে লড়াই না করে আপনারা আপনাদের দাবি আদায় করতে পারবেন না। মালিক তো মেরতে মেরে গায়ের রঙ ফ্যাকাসে করে দিল। তবু আপনাদের চৈতন্য হচ্ছে না!

সাত

[প্রগতি পাঠাগারের সামনে সোমেন ও সতীশ]

সোমেন: আমি শ্রমিক ইউনিয়নে কাজ করতে চাই সতীশদা।

সতীশ: না, না-

সোমেন: কেন?

সতীশ: তোমার শরীর দুর্বল। তাছাড়া সে যে বড়ো পরিশ্রমের কাজ।

সোমেন: পরিশ্রমই তো করতে চাই।

সতীশ: তুমি বরং প্রগতি লেখক সংঘটা ভালো করে গড়ে তোল।

সোমেন: তা তো করছি।

সতীশ: দুটো একসঙ্গে—

সোমেন: কিন্তু একটার জন্যে আর একটা দরকার যে!

সতীশ: কি বললে!

সোমেন: শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রগতি সাহিত্য লিখব কি করে! এ যুগের পালাবদলে প্রোলেটারিয়েটের ভূমিকাই প্রধান। তাদের মধ্যে যদি কাজ না করতে পারলাম তাহলে শৌখিন কমিউনিস্ট বনে লাভ কি!

আট

[জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সোমেন লাভ করেছিল তার লেখার উপকরণ। তার বিখ্যাত ‘ইঁদুর’ গল্পের কথা ধরা যাক। গল্পের নায়ক সুকুমার আসলে সোমেনের আত্মপ্রতিকৃতি। সুকুমার ছিল মেহেনতি মানুষের আপনজন। রেলওয়ে ইয়ার্ডের পাশ দিয়ে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে সুকুমার। শশধর নামক এক শ্রমিক তাকে ডাকে]

শশধর: ও সুকুমারবাবু-

সুকুমার: আরে শশধর যে!

শশধর: কাছে আসুন কথা আছে।

[সুকুমার আসে। দুজন পাশাপাশি বসে। শশধর বিড়ি ধরায়]

সুকুমার: কি ব্যাপার শশধর!

সুকুমার: সেদিন কারখানার সাহেব আমাকে ডেকেছিলেন।

সুকুমার: কেন!

শশধর: শালা বলে কিনা: ড্রাইভার ইউনিয়ন ছেড়ে দাও, নইলে মুশকিল হবে।

সুকুমার: আপনি কি বললেন?

শশধর: বললাম ছাড়ব না। আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন। বলেই এই রকম গটগট করে বেরিয়ে এলাম-

[শশধর বীরদর্পে হাঁটার ভঙ্গি করে। সুকুমার হাসে। দুজনে উঠে দাঁড়ায়। কথা বলতে বলতে পথ চলে। দূরে এঞ্জিনের সাঁ সাঁ শব্দ। চিৎকার। কয়েকজন শ্রমিক সুকুমারকে দেখে আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে]

সুকুমার: আরে ইয়াসিন,  দেশ থেকে কবে ফিরলেন?

ইয়াসিন: দিন দুই হল।

শঙ্কর: দেশে গিয়ে ইয়াসিন খুব বীরত্ব দেখিয়ে এসেছে জানেন সুকুমারবাবু-

ইয়াসিন: খালি ইয়ার্কি-

শশধর:  তাহলে নিজেই বল না ইয়াসিন।

সুকুমার: হ্যাঁ বলুন না ইয়াসিন ভাই।

ইয়াসিন: তেমন কিছু নয়। তবে কিনা গাঁয়ের চাষিরাও জাগছে। তাদের একটা বৈঠকে হাজির ছিলাম। একজন আমাকে ইউনিয়নের কথা জানতে চাইল। আমি পকেট থেকে রসিদ বের করে দেখাতে তারা আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল-তুমি যে আমাদেরই একজন।

শশধর; জানেন সুরেন কি বলছিল?

সুকুমার: কি?

শশধর: বলছিল আপনি ব্যারিস্টার হলেন না কেন!

সুকুমার: তার মানে!

শশধর: আপনাকে কথায় হারানো যায় না। বিরোধী লোকেরা হেরে ভূত হয়ে যায় আপনার কাছে।

[সকলে হেসে ওঠে]

নয়

[একতলা মাটির ঘর।সাত-আট জন শ্রমিকের মধ্যে সোমেন। দরখাস্ত লিখছে। দরখাস্ত নিয়ে তারা চলে গেল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন অনিল মুখার্জী। দেখতে পেয়ে সোমেন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল]

সোমেন: আরে কি সৌভাগ্য, অনিলবাবু যে!

অনিল: সে কি কথা! সৌভাগ্য তো আমার।

সোমেন: এ কি বলছেন!

অনিল: পাঁচ পাঁচবার চেষ্টার পরে দেখা পেলাম।

সোমেন: বসুন বসুন।

[অনিলকে মাদুরে বসিয়ে সোমেন উঠে দাঁড়ায়]

অনিল: আবার উঠলেন যে!

সোমেন: এই আসছি, একটু বসুন ।

[সোমেন চলে যায়। স্টোভ জ্বালানোর শব্দ শোনা যায়। একটু পরে সোমেন চা নিয়ে ঢোকে]

অনিল: আবার এসব কেন?

সোমেন: অতিথি সৎকার আর কি!

অনিল: সরলানন্দ সেদিন বলছিল আপনার কথা।

সোমেন: আমার কথা! আমার আবার কি কথা!

অনিল: ঘর-সংসারের কাজেও আপনি এক্সপার্ট।

সোমেন: বাবা আর আমি এখানে থাকি। বাবা সময় পান না। তাই-

অনিল: সরলা বলছিল তাকে নাকি আপনি নিজের হাতে রান্না করে মুসুরির ডাল আর ইলিশমাছের ঝোল খাইয়েছিলেন।

সোমেন: হ্যাঁ সরলা এসেছিল একদিন।

অনিল: নতুন কিছু লিখলেন?

[সোমেন একটা পত্রিকা এগিয়ে দেয়। ওতে ‘মহাপ্রয়াণ’ গল্প ছাপা হয়েছে। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অনিল বলেন]

অনিল: এত কাজ করার পরে লেখেন কখন? আপনি তো দেখছি অসাধারণ লোক। সমীন্দ্র বলছিল শুধু লেখা নয়, আপনি পড়াশুনোও করেন সময় পেলে!

সোমেন: কোথায় আর পড়তে পারি! বিদ্যে তো ম্যাট্রিক। ইংরেজি বই ভালো করে বুঝতে পারি না। দেখুন না কডওয়েলের ‘ইলিউশন আ্যন্ড রিয়েলিটি’ পড়ার চেষ্টা করলাম। অনেকটাই বুঝতে পারলাম না।

দশ

[কলকাতার বালিগঞ্জের দোতলা বাড়ি। জানালার গরাদে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সোমেন। নিচের তলায় নির্মল ঘোষের অফিস ঘর। ‘বালিগঞ্জ’ পত্রিকার অফিস। একটু বাদে নির্মল ঘরে ঢুকলেন]

নির্মল: এ কি তুমি! এমন হঠাৎ!

সোমেন: হ্যাঁ। ঢাকা মেইলে চলে এলাম। এসে দেখি বাড়ি ফাঁকা।

[নির্মল হাসেন। কালো কোট হ্যাঙ্গারে ঝোলান। পরিচারককে চা আনতে বলেন]

নির্মল: কদিন আগেই তোমার চিঠি পেলাম। তুমি তো বড়োদিনের বন্ধে আসবে লিখেছিলে!

সোমেন: আগেই চলে এলাম। আমার উপর আবার একটা দায়িত্ব দিয়েছে কিনা!

নির্মল: কি দায়িত্ব!

সোমেন: এখানে তো প্রগতি লেখক সংঘের সম্মেলন শুরু হচ্ছে। সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। ঠিক হয়েছে ঢাকাতেও আমরা প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে তুলব।

নির্মল: সম্মেলনে যোগ দেবে?

সোমেন: হ্যাঁ।

নির্মল: বেশ। নিয়ে যাব। কিন্তু তোমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে আছে তো! সেই যে বিত্তহীন মধ্যবিত্তদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবে!

[সোমেন হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে উপন্যাসের পান্ডুলিপি বের করে নির্মলের হাতে দেয়, তারপর বলে]

সোমেন: প্লটটা শুনুন।

[আলো কমে আসে। বন্যার ছবি ভেসে ওঠে। নৌকায় আসছে স্বেচ্ছাসেবকরা। গ্রামের ধারে জলমগ্ন একটা বাড়ি। জলে পা ডুবিয়ে সেই ঘরের বারান্দায় বসে আছে একটি মেয়ে। সোমেন তন্ময় হয়ে বলে যায়]

সোমেন: এক বন্যাপীড়িত গ্রাম। সে গ্রামের এক মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মালতী। ঘরে অভাব, তবু দারুণ স্বপ্নবিলাসী। বারান্দার নিচে জল দেখে, সেই জলে নিজের ছায়া দেখে তার আনন্দ । অথচ পিছনে তার অভুক্ত সংসার, খাবার ভিক্ষা, কান্না। এসবের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে চলে সেই মেয়ে। এসময় গ্রামে ফ্লাড রিলিফ কমিটি এল। রজত এসেছে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। মালতীর অবাস্তব স্বপ্নকে আঘাত করল রজত]

এগারো

[কলকাতার রাস্তায় কখনও নির্মল ঘোষের সঙ্গে কখনও একা একা ঘুরছে সোমেন]

বারো

[আশুতোষ মেমোরিয়েল হল। প্রগতি লেখক সংঘের দ্বিতীয় সম্মেলন। বাইরে ফেস্টুন। বারবুশ, রোলাঁ, রবীন্দ্রনাথের ছবি। যুদ্ধবিরোধী বাণী। সোমেন কথা বলছে একজন স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে]

সোমেন: কে কে এসেছেন?

স্বেচ্ছাসেবক: মুলকরাজ আনন্দ, শৈলজানন্দ মুখার্জী, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার।

সোমেন: রবীন্দ্রনাথ আসেন নি?

স্বেচ্ছাসেবক: না, আসেন নি। তবে তিনি বাণী পাঠিয়েছেন।

[এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল সত্যেন্দ্রনাথের কন্ঠ। সোমেন শুনছে তন্ময় হয়ে।

সত্যেন্দ্রনাথ: এবার প্রগতি লেখক সংঘের খসড়া ইশতেহারটি আপনাদের অনুমোদনের জন্য উপস্থিত করছি।-- ভারতীয় সমাজে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চিরায়ত সাহিত্যধারার অবলুপ্তির পর থেকে ভারতীয় সাহিত্যে জীবনবিমুখতার মারাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।..... সাহিত্যের মান যাদের হাতে অবনমিত হচ্ছিল সেই রক্ষণশীল শ্রেণির হাত থেকে সাহিত্যকে রক্ষা করা এবং জনগণের জীবনের সঙ্গে তাকে বাস্তবজীবনচিত্রণের উপযোগী ও ভবিষ্যতের কান্ডারী করাই  এই সংগঠনের উদ্দেশ্য।.... ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্ব করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে আমরা সমালোচনা করব এবং সৃজনশীল ও পারস্পরিক কাজের মধ্য দিয়ে জাতির নবজীবন সঞ্চারের চেষ্টা করব।

তেরো

[চিন্তামগ্ন সোমেন হেঁটে যাচ্ছে শহরতলীর পথ দিয়ে। ভাষ্য: কলকাতার অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় ফিরে এল সোমেন। শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ গযে তোলার সঙ্কল্প তার। এই সংঘ নতুন চেতনা দেবে দেশবাসীকে। উদ্বুদ্ধ করবে নব ভাবনায়। চিনিয়ে দেবে শ্রেণিশত্রুকে। প্রেরণা দেবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের]

চোদ্দ

[বিকেল। সরুগলি দিয়ে হাঁটছে সোমেন। গলায় গণসঙ্গীতের সুর। পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত]

কিরণ: এতদিন কাটিয়ে এলে কলকাতায়। একটা চিঠি পর্যন্ত পেলাম না।

সোমেন: বিশ্বাস করো একদম সময় পাই নি।

কিরণ: উঠেছিলে কোথায়?

সোমেন: নির্মল ঘোষের বাসায়।

কিরণ:  বালিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক?

সোমেন: হ্যাঁ। জানো কিরণ, ওই পত্রিকার পরের সংখ্যা থেকে ছাপা হবে আমার উপন্যাস ‘বন্যা’।

কিরণ: বাঃ, ভালো খবর। প্রগতি লেখক আন্দোলনের খবর কি?

সোমেন: অনেক খবর এনেছি। [ঝোলা থেকে কাগজপত্র বের করে] এই ইশতেহার, এই সংবিধান।

কিরণ: আমাদের সংগঠন গড়ার কাজে লাগবে। রণেশদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

সোমেন: হ্যাঁ। পাঠাগারে মিটিং শুক্রবারে। আর শোন কিরণ, আমরা সোবিয়েতের উপর একটা চিত্র প্রদর্শনী করব। দেবপ্রসাদ আর তুমি হবে সে কমিটির যুগ্মসম্পাদক।

কিরণ: কোথায় হবে প্রদর্শনী?

সোমেন: সদর ঘাটের কাছে ব্যাপটিস্ট মিশন হলে।

পনেরো

[ব্যাপটিস্ট মিশন হলে চিত্র প্রদর্শনী। সোবিয়েত রাশিয়ার নানা চিত্র। মানুষের ভিড়। সোমেন

ঘুরে ঘুরে ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে।]

ষোলো

[হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা। চিৎকার। সরলানন্দের মুখ ভেসে ওঠে। তার কন্ঠে শোনা যায়: বৈশাখের কাঠফাটা রিদ। শহরে দাঙ্গা। রাজপথ দিনে-দুপুরে জনশূন্য। মানুষের পাশ দিয়ে গা ঘেঁষে চলতে মানুষ ভয় পায়। বুক কাঁপে। কিন্তু বিশ্রাম নেই সোমেনের। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিরাম নেই তার। অনলস শিল্পী তোমাকে নমস্কার।]

সতেরো

[বাড়ি জ্বলছে। চিৎকার। ছোটাছুটি। একদল মারমুখী লোককে থামাবার চেষ্টা করে সোমেন। তার তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চলে যায়। অন্যদিক থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ। সোমেন এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা মৃতদেহ। ভালো করে দেখে ‘আরে এ যে মকবুল’ বলে সে শোকে ভেঙে পড়ে। এই সময় আর একদল মারমুখী জনতা আসে। সোমেন তাদের দিকে এগিয়ে যায়।]

সোমেন: আপনারা মকবুলকে মেরে ফেললেন?

[জনতা চুপ]

সোমেন: কথা বলছেন না কেন? ও কি কারও ক্ষতি করেছিল?

জনতা: না তা নয় তবে-

সোমেন: তবে কি?

জনতা: ও মুসলমান। ওর জাতভাইরা যোগেনকে খুন করেছে।

সোমেন: কি বললেন?

[আর্তনাদ করে ওঠে সোমেন। তারপর নিজের মনে বলে: বাঃ ভালোই হল। মকবুল আর ষোগেন ছিল গলায় গলায় বন্ধু। আপনাদের দুই দলের পাগলামির বলি হতে হল দুই বন্ধুকে। কিন্তু এই পাগলামি আর কতকাল চলবে? বলতে পারেন কবে থামবে এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা?

 

আঠারো

 

[প্রগতি লেখক সংঘের আসরে সোমেন। অচ্যুত গোস্বামী বলে]

অচ্যুত: ঢাকায় শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ ক্ষেত্রে প্রগতি লেখকদেরও একটা ভূমিকা আছে। সাহিত্যের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে মানুষকে। গত বৈঠকে দাঙ্গাবিরোধী গল্প লেখার আবেদন জানানো হয়েছিল। কেউ কি এনেছেন গল্প?

সোমেন: আমি এনেছি ।

সকলে: পড়ুন গল্পটা ।

সোমেন: ছোট ছোট কতকগুলো চিত্রের মধ্য দিয়ে দাঙ্গার পরিস্থিতি তুলে ধরেছি। দৃশ্যগুলির পটভূমিতে আছে এক পরিবার। মা-বাবা বিভ্রান্ত। ছোট ভাই অজয় হিন্দু সোশ্যালিস্টদের অশুভ চিন্তাদর্শের শিকার। বড়োভাই অশোক কমিউনিস্ট কর্মী। তাদের বাবা আর ফিরলেন না অফিস থেকে। দাঙ্গার শিকার হলেন তিনি ........

[সোমেনের ‘দাঙ্গা’ গল্পের কিছু চিত্র ভেসে ওঠে]

১.

[দরজার কড়ানাড়ার শব্দ। মা দরজা খুললেন। অশোক ঢুকলো]

মা: একশোবার বলেছি রাস্তায় যখন-তখন বেরোবি না। কে শোনে কার কথা। যা না বাপু, মামার বাড়ি থেকে দিনকতক ঘুরে আয়।

অশোক: এত কাজ ফেলে যাই কেমন করে মা?

মা: কাজ না ছাই। কে শুনবে রে তোদের কথা? তোদের রাশিয়া পারবে জার্মানির সঙ্গে?

অশোক: পারবে না কেন? বিপ্লবের মরণ নেই মা।

[মা খাবার এনে অশোকের পাশে বসলেন। অশোক খেতে শুরু করে]

মা: হ্যাঁরে এ কি সত্যি!

অশোক: কি মা?

মা: ওই যে তোর বাবা বললেন জার্মানি সব নিয়ে নিয়েছে রাশিয়ার! তারা একেবারে এসে পড়েছে আমাদের দেশের কাছে!

[অশোক হো হো করে হেসে ওঠে]

অশোক: এঁরা হিটলারের চেয়েও লাফিয়ে চলেন।

[এই সময় অজয় ঘরে ঢুকলো]

অজয়: জানিস দাদা, নবাব বাড়ি সার্চ হয়ে গেছে?

অশোক: এটি আবার কোথ্থেকে আমদানি হল?

অজয়: বারে, নিজের কানে শুনে এসেছি।

অশোক: কচু শুনেছ ।

অজয়: তা তো বলবেই। তোমরা কমিউনিস্টরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও।

অশোক: তাহলে আমরা ইহুদির বাচ্চা নারে!

২.

[রাত গভীর। ঘরের ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারি করছে অশোক। উদ্বিগ্ন মা এলেন]

মা: তোর বাবা তো এখনো এলেন না !

অশোক: দেখি আর একটু।

৩.

[ঢংঢং করে দুটো বাজল। বাইরে সৈন্যদের টহল। মা-বোন কাঁদছে। অশোকের বন্ধু বিমল এল]

অশোক: কি হল বিমল? কোন খোঁজ পেলি?

বিমল: অফিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়েছেন।

অশোক: তাহলে!

[অশোকের অস্থিরতা বেড়ে যায়। তার চোখ ছলছল করে। এমন সময় ঘরে ধোঁয়া ঢোকে পাশের ঘর থেকে। অশোক ছুটে সে ঘরে ঢুকে দেখে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আবেদনপত্রগুলিতে আগুন দিয়েছে অজয়। সেই আগুনে তাকে হিংস্র দেখায়]

অশোক: কি করছিস এসব?

অজয়: তোমাদের ঐক্যের মড়া পোড়াচ্ছি।

অশোক: অজু ভুল করছিস।

অজয়:  দাদা রাখ তোমার কমিউনিজম। ওসব আমরা জানি।

অশোক: কি জানিস?

অজয়: জানি যে তোমরা দেশের শত্রু।

অশোক: ফ্যাসিস্ট এজেন্টদের মতো কথা বলছিস। জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস কি প্যালেস্টাইন আর আয়ার্ল্যান্ডের কথা?

উনিশ

[তন্ময় হয়ে লিখছে সোমেন। লেখাগুলো এবং সেই সঙ্গে সোমেনের কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম, ভারতীয়দের পারস্পরিক তিক্ততা আর শত্রুতা বন্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা আজ দেশপ্রেমিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য। শুধু মানবতার নিকট আবেদন এবং জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তুলে, সাম্রাজ্যবাদ আর তার এজেন্টদের স্বরূপ উন্মোচন করেই এ কাজ করা যাবে না। জনগণের প্রাত্যহিক জীবন ও সংগ্রামের গৌরবময় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে]

কুড়ি

[হকঘরের বাইরে ব্যানার—‘ বর্ধিতায়ন সভা—ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘ’। দেওয়ালের পোস্টারে লেখা: হিটলার সোবিয়েত থেকে হাত ওঠাও, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে, দুনিয়ার মজদুর এক হও। মঞ্চে উঠলেন রনেশ দাশগুপ্ত]

রণেশ; এবার বক্তব্য রাখবেন আপনাদের প্রিয় লেখক সোমেন চন্দ।

[করতালি। নানা মন্তব্য। মঞ্চে সোমেন]

সোমেন: বন্ধুগণ ১ গত ২২শে জুন হিটলার আক্রমণ করেছে সোবিয়েত রাশিয়া। এই আক্রমণ পৃথিবীর সামনে এনেছে নতুন বিপদ।

[হিটলারবাহিনী ও লালফোজের নানা দৃশ্য ভেসে ওঠে]

সোমেন: চাষি মজুরের দল রাশিয়াব এক নতুন সভ্যতার ইমারত গঢ়ে তুলেছে দেখে গাত্রদাহ শুরু হয় ফ্যাসিস্টদের। হিটলার তাদেরই প্রতিনিধি। গতবছর পশ্চিম ইউরোপকে পদানত করে হিটলার বুঝেছিল সারা দুনিয়ায় জয়পতাকা ওড়াতে হলে ধ্বংস করতে হবে সোবিয়েতকে। দুনিয়ার মেহেনতি মানুষ সোবিয়েতের উপর এই আক্রমণ সহ্য করবে না। তাই আসুন বন্ধুগণ আমরা ঐক্যের প্রাচীর গড়ে তুলি। ........

[করতালি। স্লোগান]

একুশ

[নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহির ফ্যাসিবিরোধী অনুষ্ঠানের খণ্ডচিত্র। সর্বত্র সোমেনের মুখচ্ছবি]

বাইশ

[সোবিয়েত সুহৃদ সমিতির অফিস। দরজার সামনে কিরণশঙ্কর। উত্তেজিত। রণেশ এলেন]

কিরণ: কালকের সভায় তো সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু আমাদের কান্ডারি কই?

রণেশ: কার কথা বলছ?

কিরণ: সোমেনের কথা।

রণেশ: ওর তো রাজশাহি যাবার কথা।

কিরণ: তা জানি। কিন্তু গতকালই তো ফেরার কথা।

রণেশ: তাই তো!

কিরণ: এদিকে দিনক্ষণ স্থির। কলকাতায় নেতাদের চিঠি পাঠানো হল।

[দূরে সোমেনকে আসতে দেখা যায়। এদের মুখে হাসি ফোটে। সোমেন কাছে আসে]

সোমেন: কি ব্যাপার এত উত্তেজিত কেন?

কিরণ: ঢাকায় ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সোমেন: চমৎকার।

রণেশ: তোমার উপর বিরাট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সোমেন: কি রকম?

কিরণ: বিরাট মিছিল আনতে হবে।

সোমেন: নিশ্চয় আনবো ।

তেইশ

[ঢাকার সূত্রাপুর। ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের মঞ্চ। ব্যস্ততা। এককোণে রণেশ ও এক যুবক]

যুবক: সবাই এসে গেছেন ?

রণেশ: মোটামুটি। জ্যোতি বসু, বঙ্কিম মুখার্জী...

[এক স্বেচ্ছাসেবক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে এবং রণেশকে বলে]

স্বেচ্ছাসেবক: সরলানন্দ আপনাকে তাড়াতাড়ি ডাকছে।

রণেশ: সে কোথায়?

স্বেচ্ছাসেবক: মঞ্চের পাশে টিকিট ঘরে।

[রণেশ দ্রুতপায়ে সরলানন্দের কাছে এলেন]

রণেশ: কি ব্যাপার সরলা?

সরলা: একটা গোলমালের আশঙ্কা করছি।

রণেশ: কেন?

সরলা: একটিই লোক বারে বারে এসে টিকিট নিয়ে যাচ্ছে।

রণেশ: চেনো তাকে?

সরলা: না, আমাদের কেউ নয়।

[আর এক যুবক ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে ]

যুবক: উপারে কয়েকজন জড়ো হয়েছে।

রণেশ: সংখ্যা?

যুবক: ৩০-৩৫এর মতো।

রণেশ: হাতে কিছু আছে?

যুবক: হকিস্টিক, লোহার ডান্ডা ।

[কিরণশঙ্কর  ছুটে এলেন]

কিরণ: সভা শুরু করব রণেশদা?

যুবক: কিন্তু...

রণেশ: হ্যাঁ শুরু করো সভা।

[রণেশ যুবকদের কি নির্দেশ দিলেন। তারা চলে গেল। সরলা আর রণেশ কথা বলতে লাগলেন]

চব্বিশ

[সম্মেলনের মঞ্চ। জ্যোতি বসু বসে আছেন। বঙ্কিম মুখার্জী উঠে দাঁড়ালেন বক্তৃতা দেবার জন্য]

পঁচিশ

[রেলওয়ে ইউনিয়নের অফিস। কয়েকজন শ্রমিক ও সোমেন। সমীন্দ্র হোড় এর প্রবেশ]

সমীন্দ্র: মিছিল চলে গেল যে!

সোমেন: জানি।

সমীন্দ্র: তুমি বসে কেন?

সোমেন: কয়েকজন আসবে। এলেই দৌড়াব। ধরে ফেলব মিছিল।

সমীন্দ্র: আমি যাচ্ছি। দেরি কোরো না।

ছাব্বিশ

[ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের মঞ্চ। সরলানন্দ গেটের কাছে। একজন দৌড়ে এসে কি বলল তার কানে কানে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। টলতে টলতে কোনোরকমে এল মঞ্চের কাছে। ডাকল রণেশকে। সরলার কথা শুনে হতচকিত রণেশ। তারপর কোনোরকমে নিজেকে সামলে উঠে এল মঞ্চে]

রণেশ: বন্ধুগণ! এইমাত্র খবর এল- কি ভয়ঙ্কর খবর- আমাদের সোমেন আর নেই। সম্মেলনের দিকে আসছিল সে মিছিল নিয়ে। পথে তাকে ঘিরে ধরে ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা। নির্মমভাবে খুন করে।

[সভায় তীব্র উত্তেজনা। কান্না]

সাতাশ

[ ভেসে ওঠে সোমেনের মুখ]

সোমেন: হ্যাঁ নিহত হয়েছি আমি। ব্যক্তিমানুষ চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই। তার অনুরণন চলে যুগ যুগ। আমি ভালোবেসেছিলাম মানুষকে। তাই মানুষের শত্রুদের কাছে আমি অপরাধী। কিন্তু আমার ভালোবাসা মৃত্যুহীন। তার বীজ থেকে যাবে। ভালোবাসার সেই বীজ নির্মূল করার সাধ্য কারোর নেই...........

পাঠ প্রতিক্রিয়া

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কাব্য-আলোচনা

পাঠ-প্রতিক্রিয়া

লক্ষ্মী নন্দীর স্বপ্নজবার অন্তরীক্ষ:

প্রেম ও পূজার যে আখ্যানঃ 

আলোকপাত করেছেন উদয় সাহা (কোচবিহার)

LakshmiNandi.jpg

"মাত্র একবার ---

মালা গাঁথতে দাও

স্বপ্নগুলোর...

একান্ত ব্যক্তিগত কান্নাগুলো দিয়ে

ধুয়ে দিতে দাও চরণ।

এই সহজ আবেদন গ্রহণ করো

তারপর, সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দাও

ম - ম  ভক্তির সুবাস "

 ঠিক এই ভাবেই শুরু হচ্ছে কবি লক্ষ্মী নন্দীর নতুন কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নজবার অন্তরীক্ষ'। প্রকৃত বিশুদ্ধ কবিতা রচনা করে থাকেন লক্ষ্মী নন্দী। আধুনিক তথা অতি আধুনিক কবিতার পরিমণ্ডলে বসবাস করেও তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব কাব্যভাষা। যা একাধারে স্বতন্ত্র এবং স্বকীয়। মার্কেজ একসময় বলেছিলেন, 'দৈনন্দিন অস্তিত্ব জীবনের পরিচয় নয়, জীবন হল সেই স্মৃতি যা আমরা এমনভাবে মনে রাখি,যাতে অন্যদের শোনাতে পারি।' কবি লক্ষ্মী নন্দী সেই প্রেমময় আনন্দঘন মুহূর্তের স্মৃতি দিয়েই সাজিয়েছেন মোট তেপ্পান্নটি কবিতা সম্বলিত কাব্যোপহার 'স্বপ্নজবার অন্তরীক্ষ'।

যে প্রেমে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে, তা লালনের মতে ঐশী প্রেম। ঐশী প্রেমের জন্য রুমির বাঁশি কাঁদে এবং শ্রী কৃষ্ণের মোহন বাঁশি রাধার সুরে গান করে। আলোচ্য বইটি জুড়ে তাই লক্ষ্য করা যায় আকুতি, প্রার্থনা, সমর্পণ দিয়ে সাজানো এক ঐশী প্রেমের আখ্যান। এই আখ্যানে ভক্তিরস এবং অধ্যাত্মবাদ মিলে মিশে একাকার।

এই কাব্যগ্রন্থের 'মিরাশ' কবিতায় কবি লেখেন ----

'তোমাকে অস্তিত্ব জানাবে

জং ধরা বাদ্যযন্ত্র ---- আর

জানা ভাষায় অজানা সুরে

আলখাল্লা হাতে মিরাশ।'

এক বিস্ময়কর চমক উচ্চারণে। যেখানে অনেকখানি ভালোলাগা পেরিয়ে এসেও থমকে দাঁড়াতে হয়। দীর্ঘ কাব্য জীবন আর সেইসাথে অভিজ্ঞতার কথা বলে 'জং ধরা বাদ্যযন্ত্র'। একটা স্থির ফটোগ্রাফের মত ছবি। যা আদর পেয়ে যায় খুব সহজেই পাঠক মনের।

চোখ রাখা যাক 'প্রহর' কবিতাটিতে। কবি লিখেছেন ----

'চোখের পাতায় আকস্মিক

কিছু নিভন্ত আলোকণা

অবশেষে পোষ মেনেছে।

আকাশগঙ্গার ওপারে

দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা।

কতোদিন মাকে দেখি না!

আমার চোখের পাতায় রঙিন

প্রজাপতি এসে বসে।

আমি নিশ্চুপ অনুভব করি

তুলসী পাতার শীতল স্নেহ।'

কবিতা এবং কবিতার চেতনা আমাদের যে সুদূরপ্রসারী নির্জনতার দিকে নিয়ে যায়, 'স্বপ্নজবার অন্তরীক্ষ' সেই স্থিতধী আত্মমগ্নতার নিঃশব্দ জলপ্রপাত। এক একটি স্তরভেদ হয়ে যাচ্ছে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে, উৎসারিত হচ্ছে তার গভীর আধার।

কাব্যগ্রন্থের 'অরণ্য', 'চাই নিষ্কৃতি', 'অভিমান','শীত, 'সর্বোত্তম ঠোঁট' কবিতাগুলি কবির শক্তিশালী নিজস্বতার পরিচায়ক। অকারণ জটিলতার ধার ধারেন না প্রাজ্ঞ কবি লক্ষ্মী নন্দী। তাঁর কথন অধ্যাপকীয় গাম্ভীর্যপূর্ণ। এককথায় সরল বলা যেতেই পারে। তবে কোনোভাবেই তরল নয়। কবিতার

ত্বকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন পেলব দৃষ্টিপটের সুগন্ধি। কবি একাকী অরণ্যে শুনতে পান 'বন্য ফিস ফিস'।

"শীত --- তোর সাথে বড় সুখ

তোর মতো কেউ নেই

তোর কুয়াশার ধুমল জালে ---

আমার চৈতন্য আত্মস্থ হয়।" (শীত)

'চাই নিষ্কৃতি' কবিতায় কবি লিখেছেন ----

"প্রেমের শেষ কি? প্রেম!

বলতে পারে কখনও?"

এ এক চিরন্তন জিজ্ঞাসা। শূন্যতার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে নিজেই দর্শন হয়ে ওঠে এমন প্রশ্ন। এই অংশে ছেদ-যতি চিহ্নের ব্যবহার ভাবায় বইকি। যে প্রেম দ্বারা সৃষ্টিকে সাজানো হয়েছে তার জ্ঞান লাভ করতে হলে সৃষ্টির প্রেমিক হতে হবে। আর এই প্রেমিক কেউ নয় মানুষ ব্যতীত। কবি দিব্যেন্দু পালিত তাঁর 'সুবর্ণজয়ন্তী' কবিতায় বলেছেন --- ''আলোর মৃত্যু নেই, সুতরাং, এসো আমরা জীবনকে সাজাই..." কবি লক্ষ্মী নন্দী জীবনকেই সাজিয়ে গেছেন প্রতি কবিতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।

".... তার সাথে আমি অস্তিত্ব

হয়ে উঠেছি নবান্ন উৎসবে।

...ধান শরীর রোদে

তৃষ্ণা জুরায়ের মতন হেমন্তের শিশির

সংলাপ আমাকে কতবার নিয়ে গেছে

ঘোরের মধ্যে রমণীয় সম্মোহনে।"

('স্পর্শ শিহরণ')

আসলে কবি লক্ষ্মী নন্দীর লেখার গুণে প্রতিটি কবিতাই হয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই আলোচনা শুরু যে লাইনগুলো দিয়ে, সেগুলির মাধ্যমেও বিন্দুতে সিন্ধু রচনা করেছেন লক্ষ্মী নন্দী। আর সেখানেই থেমে থাকেননি। বলেছেন,

"আমার স্বপন বলে

ও... তুমি

চুপি চুপি রাধাও হতে পারো

আমার চেনা উপলব্ধিতেই

আমি বলি সবার ভেতরেই

লুকিয়ে থাকে রাধাভাব" ('রাধাভাব')

বোধের অনন্য এক স্তর স্পর্শ করলেই হয়তো উচ্চারণ করা যায় এমন গভীর জীবনবোধ -- জাত পঙক্তি। পাতার পর পাতা যেন ঝিমঝিমে ঘোরে আবদ্ধ করে। শুধু ভাবায়। কেবল ভাবায়।

আমরা যারা কবিতাপ্রেমী পাঠককুল, তারা সহজেই বুঝতে পারব "স্বপ্নজবার অন্তরীক্ষ" সমস্ত রকম বলয় ছিঁড়ে লেখাকে বরং বলা ভালো কবিতাকে পূজার স্তরে উন্নীত করেছে। আদ্যোপান্ত পবিত্রতার বাতাবরণ; স্বপ্ন → কান্না → অক্ষর ; যেন বুক উজার করা আবেদন কবির। 'অনলের ঘর থেকে বেরিয়ে' কবি উদ্দেশ্য বিহীন। 'চিন্ময়ের মঞ্জরি ছিঁড়ে ছিঁড়ে' কবি সাজিয়ে তুলেছেন ' জন্মের পদাবলী'।

'অহল্যা' কবিতাটি দেখা যাক ---

"বিষবানে দিগঙ্গনা

নীলাচলে নিগড়িত

পৃথ্বী তাদাত্ম্য হয়ে

ধৈর্যের বন্ধনে, নিরশ্রু

অবিরাম অরণ্যের মূঢ় গর্জন ---

তাপহীন প্রশস্ত বক্ষে

গ্রাহামের বেল

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

গ্রাহামের বেল

পলাশ দাস

ন-পাড়া, বারাসাত, পঃ বাংলা

riksha1.jpg

কাল তখন দশটা - এগারোটা, বারাসাতের ব্যস্ত রাস্তা পার হয়ে সরু গলিপথ ধরে এগিয়ে চলেছে একটা  লোক। পরনে ছাপোশা জামা প্যান্ট, কাঁধে ঝোলানো আধপুরানো ব্যাগ, ব্যাগের পেটটা বেশ মোটা, লোকটার চেহারা ততটাই খারাপ, পায়ে বেল্ট দেওয়া ধুলো মাখা জুতো, চুল উস্কোখুস্কো, গালে দু-একদিনের না কামানো দাঁড়ি, পাল্লা দিয়ে মুখটা শ্রাবণের আকাশের মতো গম্ভীর।

শহরতলির সমস্ত শব্দ, ব্যস্ততা পিছনে ফেলে শান্ত গলিপথে লোকটা এগিয়ে চলেছে। রাস্তার পাশে সারি দেওয়া গাছ, তাতে বসে থাকা পাখিদের কথা বলার আওয়াজে মুখরিত হচ্ছে গলিপথ। দেখতে দেখত ধেয়ে আসে তাদের আশীর্বাদ। কোনোরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয় সে। শহরতলিতে ব্যস্ততা খুব একটা চোখে পড়ে না, তবে এখন অনেকটাই ব্যস্ত বলা যায়। এই গলিপথে কিন্তু সে ব্যস্ততা  চোখে পড়েছে না। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি, তাদের গায়ে পাখিদের প্রাতকিত্যের উজ্জ্বল উপস্থিতি।

গাছের পাতায় মুড়ি দেওয়া রাস্তা আর পাশের উঁচু বাড়ির গ্রিলের ফাঁক থেকে ক্লিপে উড়ন্ত পোশাকর রিমঝিম দোলাদুলি।  

একটা মোড় ঘুরতেই পায়ের কাছে ক্যাম্বিশের একটা বল গড়িয়ে এল। নিচু হয়ে কাঁধের ব্যাগটা সামলে বলটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দেয় খেলতে থাকা ছেলেগুলোর দিকে। ছেলেগুলো বলটা নিয়েই আবার শুরু করে দেয় খেলা। দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোর খেলা দেখে কয়েক মিনিট। তারপর ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে এগিয়ে যায়। পাশ থেকে ছেলেগুলোর খেলার চিৎকার কিছু ধুলোপড়া স্মরণীয় মুহূর্ত হয়তো মনে করায়...  

খানিকপরে এক বড় গেটের সামনে এসে হাঁটা থামিয়ে গেটের পেট ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। বেশ বড়  ভিতেরর  জায়গাটা। বাইরে থেকে মনে হয় না এতটা বড় ভিতেরর অংশ। বেশ বড় একটা গ্যারাজ রয়েছে ভিতরে। সদর দরজার পাশে এক বৃদ্ধ টুলে বসে পা দোলাচ্ছে  সেদিকে না তাকিয়েই পাশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। আলো আধারিতে মেশা পথ পার করে এসে পৌঁছায় একটা ঘরের সামনে। ঘরটি বেশ অন্ধকার। জানালার কাঁচের থেকে পিছলে আসা আলোতে দেখা যাচ্ছে - একটা টেবিল, দুপাশে দুটো চেয়ার। টেবিলে কাঁধের ব্যাগটা রেখে  জানলা খুলে দেয়। বিদ্যুৎ চমকের মতো একঝটকায় বেশখানিকটা আলো আসে। গ্লাসের জল পাল্টে ফেলে জানলার পর্দা সরিয়ে দেয়। ফ্যান চালিয়ে চায়ারে হেলান দিয়ে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম  মুছতে মুছতে জল খায়, জিরিয়ে নেয়। কাপড় দিয়ে টেবিলে রাখা ফাইলের ধুলো পরিষ্কার করে। ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটি বার করে মুখটা আলগা করে রাখে। পকেট থেকে বের করে মোবাইল টেবিলে রাখে।বাইরের রোদ ঝলমলে আকাশটা দেখতে দেখতে ব্যাগ থেকে হাতে তোলে বিখ্যাত কবির একটা কবিতার বই। বাইরের রোদ্দুরের মতো এতক্ষনের গুমোটভাব কেটে যায় মুখের। আয়েশ করে জানলায় ঠেস দিয়ে লোকটা বিড়বিড় করে লাইনগুলো পড়তে থাকে। ঠিক সেই সময় ফোন বেজে ওঠে, আলো নিভে যায়.. ফোনটা তুলে বলে, হ্যালো...!

ফোনের ওপারে থেকে বেশ ভারী একটা গলা ভেসে আসে, অফিসে ঠিক সময়ে এসেছেন তো ?

হ্যাঁ।  মৃদু স্বরে বলে লোকটি।

অফিসে থাকবেন আমি দরকারে ফোন করব। আর কোথাও বেরিয়ে যাবেন না।  

ঠিক আছে। ছোট্ট উত্তর দেয়।

ফোন করলে যেন পাই। আমি ফোন করলে কাজ শুরু হবে। বেশ ধমকের সুর ভেসে আসে ওপার থেকে।

ঠিক আছে। মনে থাকবে। 

মনে থাকলেই ভালো। সবে এক সপ্তাহ হয়েছে তাতেই কাজের যা ছিরি দেখছি...... মনে রাখবেন কথাটা। আপনার কাজ বিশেষ নেই আমার ফোনটা পেলে কাজ শুরু করবেন। কাজটা মন দিয়ে

করুন। নাহলে আপনার জন্য আমি ডুবব। মাথা নেড়ে জবাব আসে, ঠিক আছে। 

ওকে, রাখছি। ফোনটা কেটে যায়।

সব তান কেটে গিয়ে লোকটার মুখটা গম্ভীর হয়ে আসে। আচমকা আলো নিভে যাওয়ার পর যেমন হয়, ঠিক তেমন। বই স্বশব্দে ঢুকে পড়ে ব্যাগে। ঘাম মুছতে মুছতে আবার চেয়ারে এসে বসে। আর গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গ্রাহামের বেলের দিকে। হয়তো সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভীষণ রাগে ফেটে পড়তে চায়।

বাইরের টুকটাক শব্দ বেশ জোরেই ভেসে আসতে থাকে।

ভেসে আসতে চেয়ারে বাসা বাঁধা কাঠপোকার করর... করর... শব্দ।

এখন দীর্ঘ অপেক্ষা গ্রাহামের বেলের বেজে ওঠার...

এতক্ষণ যে কথাগুলি পড়লেন, সেটা আজকের গল্প। এই আজকের গল্পের পিছনে একটা গতকাল আছে। সেই গল্পটা এখন বলা যাক। যে লোকটাকে জানলেন তার নাম সুবিমল পাল।

নদী উদ্দাম গতিতে ছোটার পর মুহূর্তের বাঁক পরিবর্তনে যেমন খানিকটা থমকে যায়, তেমনই এতদিন ধরে চলা জীবনের গতিপথ পরিবর্তন ঠিক মানানসই হয়  নি সুবিমলের। সবসময় মনমরা একটা ভাব, না পাওয়ার দুঃখ তাকে সবসময় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মধ্যবিত্তের দুর্দশা চিরকালীন, দুঃখ তার চিরদিনের সাথী। যার অন্যতম কারণ তার অপূরনযোগ্য স্বপ্নের ভিড়। রাতে  চোখ বুজলেই যে স্বপ্নেরা ভিড় জমায় চোখের পাতায়। সুবিমলেরও চোখে এমনই ভিড় করেছিল স্বপ্নরা। অনেক বড়ো হওয়ার স্বপ্ন। নিজের ছায়াকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। চারপাশের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখার স্বপ্ন।  

একটা সময় হন্যে হয়ে খুঁজেছে সরকারি চাকরি। কিন্তু এই প্রবল কম্পিডিশনের বাজারে নিজেকে  উপযুক্ত করে নিতে পারে নি ফলে চাকরি হয় নি। তারপের বেঁচে থাকার তাগিদে ও সংসার বাঁচানোর কর্তব্যে চলেছে বেসরকারি  চাকরি খোঁজার লড়াই। কিন্তু  সেখানেও হাতে মিলেছে নাকোচ করে দেওয়ার পত্র। বয়স বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে তারাও নিতে চায় নি। প্রত্যেক ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়ে এসে  তার মনে হয়েছে সে কি আন্যায় করেছে, না ভুল করেছে, আর ততই তলিয়ে গেছে দুশ্চিন্তার অন্ধকার গলির ভাঁজে। রাতজাগা স্বপ্নগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে পথের কাঁটা।  

এইসময়েই এক পরিচিতের মাধ্যমে মিলেছে এই কাজ। কাজ এখানে বিশেষ নেই, সারাদিন থাকতে হবে,  মালিকের ফোন আসলে গাড়িতে প্লাই ওঠানোর তদারকি করতে হবে। সে ছাড়া মাত্র দুজন লোক এখানে কাজ করে। তবুও কেমন গা ছমছমে একটা ভাব। এখানে এসে বুঝেছে  কেউ  তার আপনার নয়, সবাই তার প্রতিপক্ষ। সবটাই তার কাছে অনভিপ্রেত। সে এতদিন যে দৃষ্টিতে দেখেছে মানুষকে, আজ দেখছে সম্পূর্ণ অন্যরূপে।এখানে সে মানাচ্ছে, অভ্যস্ত হচ্ছে বাস্তবের সাথে। এই মানানো আর মানিয়ে নেওয়ার খেলাতে যুজতে যুজতে সকাল থেকে রাত আবার রাত থেকে সকাল অতিবাহিত হচ্ছে।

অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুবিমল এই কাজটা নিয়েছে। জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন নিজের অনিচ্ছাতে মানুষকে এমন অনেক কিছু করতে হয় যা তার ভালো লাগে না। সুবিমলও ব্যতিক্রম নয়। সেও এই সমাজের মধ্যবিত্ত মধ্যবর্তী প্রাণ, তাকেও সাড়া দিতে হয়েছে। আর সেই সাড়া দেওয়াতে যত রক্তই ঝরুক সে ঝরবে একান্ত মনের গভীরে, সাবার অলক্ষে। সেখানে শুধু আমার আমি থাকবে চারপাশের ভাগিদার কেউ নেই, ফাঁকা  হাটের শূন্যতা ব্যঙ্গের হাসি হাসবে।  

সমস্ত স্বপ্নকে বাক্সবন্দি করে বাস্তবের লড়াই-এ নেমেছে সুবিমল। এখন তার কাছে কাজ বাঁচিয়ে রাখাই বড় কাজ। পুরানো সেই মানুষকে ভুলিয়ে দিয়ে চলছে নতুনের আবিষ্কার। সে পথ সহজ নয়, তবুও লড়াই চলবে চলছে। যেখানে অতীত জীবন পড়ে থাকবে উদাহরণ হয়ে, গ্রাহামের বেলের মতো ... 

অনুগল্প-স্বরূপ মন্ডল

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

হারানো দুপুর/শীতের সকাল

স্বরূপ মন্ডল

কান্দি, মুর্শিদাবাদ

kite.png

হারানো দুপুর     

জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুর। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে ভাতঘুম দিত সকলে। বাইরে বেরোনোর জন্য উসখুস করলে ছেলেধরার গল্প শোনাতো মা। গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম, ঘুম ভাঙতো সেই শেষ বিকেলে। মনে হতো বৃথা গেল দিনটা!  

কোনো কোনো দিন ভয় কাটিয়ে হাজির হতাম ডোবার পাড়ে। ছোট বড় রংবাহারি ফড়িং বসে থাকতো সোমরাজ, কালকাসুন্দি আর কালমেঘের ঝোড়ে। পূর্বপাড়ে কুলগাছের ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই এসে বসতো। কিচির মিচির শব্দে পাড়া মাথায় করতো ওরা। নারকেল গাছের পাতায় সার বেঁধে বসে থাকতো বনটিয়ারা। কি সুন্দর দেখতে ওদের! ঝোপের মধ্যে খাবার খুঁজে বেড়াত শালিক আর পাতকৌয়া। ডোবাভর্তি কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে ছিল ডাহুকের আনাগোনা। ডোবার ওপাড়ে হাটুইদের বাড়ির নক্সা করা টিনের চালে ঘুঘু বসে ডাকতো, “ও জিতু, ওঠো..ওঠো..”। দূর থেকে ভেসে আসতো “ফ..টি..ক জল..” সুর। মনটা কেমন করে উঠতো। ওরা ফটিক জল পাখি। ওদের নাকি গলায় ফুটো থাকে! গলা নিচু করে জল খেতে পারে না। পিপাসা পেলে আকাশের দিকে চেয়ে অমন করে ডাকে। ভাবতাম, “আজ ঠিক বৃষ্টি হবে!” এমনি করেই শাওড়া গাছের ছায়ায় বসে কেটে যেত দুপুরটা। সেদিন এমনি এক দুপুরের কথা বলছিলাম পীরুকে। মন দিয়ে শুনছিল ও। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো, “পাতকৌয়া কি?” আমি বললাম আর ও শুনলো। বুঝলো না। পাতকৌয়া যে ঝোপ-ঝাড়ে থাকতেই ভালবাসে। এখানে সে সব পাবে কোথায়!

শীতের সকাল

     

রা পৌষ। কনকনানি ঠান্ডা। চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। জবুথবু ভাব। কুয়াশা ভেদ করে নিস্তেজ লাল সূর্যটা মুখ দেখাত আম বাগানের ওপার থেকে। আনন্দে গান জুড়ে দিতাম আমরা-

“সুয্যিমামা, সুয্যিমামা রোদ কর গো,

তোমার ভাগ্নেকে জার লেগেছে কপাট খোলো গো;

সুয্যির মা বুড়ি, কাঠ কুড়াতে গেলি

ছ-খান কাপড় পেলি, ছয় বৌকে দিলি;

আমি মরি জারে, কলা গাছের আড়ে,

কলা পড়ে ধুপধাপ, আমি খাই কুপকাপ।”...

লাল সূর্যটা হলুদ হয়ে উঠতো ক্রমশঃ।

কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমল করতো চারদিক।

সকাল হতো আমাদের।

আজও পৌষ আসে, কনকনে ঠাণ্ডা পড়ে।

ধোঁয়াশায় ঢেকে যায় চারদিক। তিন-চারদিন পর ক্লান্ত হলদেটে সূর্যটা ধোঁয়াশার ভেতর থেকে একবার মুখ দেখিয়ে ঝুপ্‌ করে ডুব্‌ মারে।

বুঝি, আজও সকাল হয়েছিল।

গল্পঃ সনোজ চক্রবর্তী

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

SanojCharaborty.jpg

সনোজ চক্রবর্তীর গল্প সমগ্রঃ-

মেজদি-রমলার দিনগুলি

এমনটাও হয়!

আজ প্রজাতন্ত্র দিবস

অযোদ্ধায় সুরা সেবন

বিশ্বাসের রং নীল

একলব্য

শিকল

সনোজ চক্রবর্তী 

পূর্ব মেদিনীপুর

riksha1.jpg

মেজ'দি

 

তকাল স্কুলের মাইক বাড়ি পর্যন্ত নিখুঁত আসছিল। স্কুল থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুতে ধুতে স্পষ্টত শোনা যাচ্ছিল ঘোষণা-- "কিছু সময়ের মধ্যে শুরু হবে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনীত নাটক..."।
মেজ'দিকে বললাম- যাবি না? নাটকে?
মেজ'দি তার বিছানায় বসে, আদরের সাদা পায়রাটার জন্য নিজের বাটি থেকে মেঝেতে মুড়ি ছড়াচ্ছিল। পায়রাটা আমার দিকে তাকিয়ে বকবকুম শব্দে একটা বকা লাগল বোধহয়।মেজ'দি ঘাড় নেড়ে না জানাল। পায়রাটা মাস ছয় আগে অদূর এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢুকে পড়ে মেজ'দির ঘরে। পরে মালিক নানা কায়দায় বুঝিয়ে সুজিয়ে বেকুব বোনে গিয়ে জোরজবরদস্তি অপহরণ করে শখের কবুতরটিকে। কাজে দেয় নি সে চেষ্টা। একদিন বাদেই আবার মেজ'দির সিলিং ফ্যানে বসে বকবকুম শুরু হয়।

আমার স্কুলে ও আমার স্কুল বললে তো খানিক অস্পষ্টতা রয়ে যায়। আসলে আমার তো আবার অনেকগুলো স্কুল যেটায় পড়াচ্ছি সে যেমন আমার আবার যেগুলোয় পড়েছি সে তো আমারই। আমার বলতে আমার মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়ার স্কুলের কথাই বলছিলাম।
আমাদের স্কুলে প্রতিবছর নাটক হতো। আমি তখনও বড় স্কুলে যাই নি, প্রাইমারি স্কুলে, বড় স্কুলের নাটক মায়ের সঙ্গে দেখতে গেছি। খুব মনে আছে নাটকের নাম মহেশ। মহেশ মানে শরৎবাবুর মহেশ। আমার মেজ'দি করছে গফুর।
নাটক দেখতে দেখতে কেঁদেছিলাম, না ঐ বয়সে নাটকের ভেতর ঢুকতে পারি নি কেঁদেছিলাম মেজ'দির কান্না দেখে, মেজ'দির কষ্ট দেখে। নাটক শেষে সবাই মেজ'দির অভিনয়ের প্রশংসা করছিল বারবার। মায়ের মুখটা তা শুনে উজ্জ্বল হচ্ছিল। আমাদের দুঃখের সংসারে মা'কে হয়তো এতো আনন্দ পেতে দেখেছিলাম সেই প্রথমবার। আমাদের ভাই-বোনেদের একটু বাড়তি সুখের জন্য মা কম খেয়ে কম পরে কাটিয়ে দিলেন আস্ত একটা জীবন। বাবার হতদরিদ্র সংসারে মায়ের বর্তমানেও মেজ'দিও একটু একটু করে হয়ে উঠেছিল মায়ের মতন। এখনও।

বাবার অনেক চেষ্টা চরিত্রে সংসারটার যখন টলোমলো অবস্থা সে সময় থেকেই সংসারের জোয়াল একটু একটু করে নিজের কাঁধে নিয়েছিল অক্লেশে। মেজদির গফুর অতোটা জীবন্ত হয়েছিল কেন তা বুঝছি তার অনেক পরে। অনেক বড় হওয়ার পর। সংসার যে একটা যৌথ-ক্রিয়া এমনকি ইলেভেন সাইড দলে অনেক সময় একাকেই মারাদোনা হয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ লড়াই দিতে হয় আমার মেজদির থেকে অন্য কোনো উদাহরণ আমার নজরে আসে নি। অনেকদিন আমাদের একচিলতে জমিতে ভাই-বোনরা মিলে ধান বুনেছি, কেটেছি, ঝেড়েছি।
আমাদের ঘাড়ে ছোট বোঝা চাপিয়ে নিজেই নিয়েছে বেশিটা। ঘাড় সায় দেয় নি, বেঁকে গেছে তবুও ঘাড় পেতে নিয়েছে দায়-দায়িত্ব। একটু কাজ করার পর বকা দিয়েছে-- "অনেক সময় রোদে আছিস ঐ গাছটার নিচে আলটায় গিয়ে বস।" আমাদের গ্রামের দিকে সংসারের সুরাহার জন্য কেউ কেউ ছাগল বা মোরগ পুষত। আমাদের বাড়িতে অর্থকরী এই ব্যবস্থাটি চালু করে মেজ'দি। পরম মমতায় পোষ মানাত পশুগুলোকে। মেজ'দির সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ধন তৈরী হয়ে যেত ওদের। মেজ'দি বাড়ি ঢুকলে তার গলা শুনে তারস্বরে ডাক ছাড়ত ছাগলগুলো। ছাগলগুলোর শরীর খারাপ হলে মেজ'দি মেজাজ হারাত। পোয়াতি ছাগলের বাচ্চা হলে তাকে নিয়ে আদিখ্যেতার সীমাও থাকত না। যে ছাগলটাকে প্রথম আনা হয়েছিল তার প্রথম বেটাছেলে হল। মেজ'দি নাম রাখল বাঘা। কালোর উপর ছোপ ছোপ সাদা। বড্ড সুন্দর ছিল বাঘা। বাঘা বড় হল। বাবা বাঘাকে বিক্রি করতে চাইল। বর্ষা নামার আগে টালির চাল মেরামত করে নিতে না পারলে সমস্যার অন্ত থাকবে না। দিদি মত করল না প্রথমে। কিন্তু ঐ যে বললাম সংসার যৌথ ক্রিয়া আর মেজ'দি ছিল ত্রাতা। বাঘাকে যখন ব্যাপারী নিয়ে যাচ্ছিল শুরুতে বড্ড বাধ্য ছিল সে। তার সামনে সবুজ ঘাসের প্রলোভন ছিল।
ছিল ভ্রম। যখন সে বুঝল ব্যাপারটা সুবিধার নয় তখন তার সে কি তার প্রতিরোধ।
কি তার কান্না। আমাদের বাড়ির একটা কোনে আর একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সবাইকে লুকিয়ে। মেজ'দি। সে যাত্রায় বাঘা বিক্রির টাকায় দিন দশেকের মধ্যে আমাদের মাথা গোঁজার আশ্রয়টি হয়েছিল শক্ত পোক্ত। আর টানা পাঁচ-ছয় দিন মেজ'দি দাঁতে একটি দানাও কাটল না।
এমনি করে কত বার ছাগল বিক্রির টাকায় কখনও মায়ের চিকিৎসা হয়েছে কখনও হয়েছে আমার স্কুলের ইউনিফর্ম কিংবা বই-পত্তর কখনও বা চাষজমিতে নেমেছে নাঙল সারা বছরের খোরাকি পেয়ে সংসারের মুখে ফুটেছে হাসি। ঐ দিনগুলোতে একদিকে সংসারের প্রতি দায় আর অন্য দিকে পোষ্যদের প্রতি মমত্ত ছিন্নভিন্ন করেছে মেজ'দিকে। দিন শেষে সংসারের ঐ হাসিমুখের সান্ত্বনা নিয়ে কান্না চেপেছে সে। সেই কোন কালে যে দিন বাঘা বিক্রি হল সেদিন মাংস খাওয়া ছেড়েছিল মেজদি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কোন মাংসই খায় না সে।

রমলার দিনগুলি

ধনুকের মতো বেঁকে গেছে রমলার পিঠটা, কঁকিয়ে ওঠা চিৎকারে জেগে উঠেছে তাদের বছর পাঁচেকের ঘঁতন। এক অজানা আতঙ্কে শক্ত হাতে মাকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছেলেটা। মশারি ছাড়া বিছানার অন্য পাশে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে ঘঁতনের বাপ বুধন। বালিশ থেকে সরে গেছে মাথা, লুঙ্গি উঠে গেছে হাঁটুর উপরে। 
সোয়া দশটায় লাস্ট ট্রিপের পর বাসটার ধোয়া মোছা সেরে মাইল দেড়েক সাইকেল ঠেঙিয়ে বাড়ি ফেরে বুধন। সারাদিনের হাড় খাটুনি তাই গলায় একটু বাংলা ঢেলে বাড়ি ফেরার পথ ধরে রোজ। রাতের খাওয়ার খেতে বারটা বাজে। তারপর বিছানায় পড়া মাত্র নাকের হাপর খুলে যায় তার -ঘর্ ঘরর্ ঘরস্ ঘরস্ ফুতুস্ ফুস্, ঘর্ ঘরর্ ঘরস্ ঘরস্ ফুতুস্ ফুস্ -নাসিকা নাদের তালে তালে পেটটা উঠা নামা করতে থাকে। এমনিতেই মদ গেলার জন্য সারা শরীরের তুলনায় পেটটা একটু বেশীই ফোলা বুধনের।
দুপুর বেলা রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রমলা, দূর থেকে বাসটা হর্ন বাজিয়ে জানিয়ে দেয় সে আসছে। হর্নের শব্দে বুকের ভিতরটা তুলোর মতো হালকা হয়ে যায় রমলার, সারা শরীরে মুহুর্তে বেড়ে যায় রক্ত প্রবাহ, চোখে মুখে নরম জ্যোৎস্নার ঝকঝকে হাসি। বাসের কর্কশ হর্নটা হঠাৎ করেই বদলে যায় শত ঝরনার সুরে। বাসটার গতি ধীর হয়ে আসে। মানুষটা সংসারের জন্য প্রাণপাত করে তাই একটু গরম গরম ভাত তরকারি না হলে চলে।হাত বাড়িয়ে বুধনকে গরম ভাত তরকারির টিফিন ক্যারিয়ার এগিয়ে দেয় রমলা। অজান্তে হাতে হাত ছুঁয়ে যায় পরস্পরের। আর তখনই হাত বেয়ে বিদ্যুৎ শিহরন ছড়িয়ে যায় রমলার সর্বাঙ্গে। বুধনেরও কি এমনটাই হয়? কোনো দিন জিজ্ঞাসা করা হয় নি রমলার।
বিয়ের আগে মশারি ছাড়া ঘুমাতে পারতনা রমলা। চরম অস্বস্তিতে এখন মশারি নেওয়া বন্ধ। ঘুমের মধ্যেই বুধন বলতে থাকত-
-দাদা, একটু এগিয়ে যান না দাদা।
- এই যে দাদা, ভেতরের বাঁ দিকটা তো...
- মাসিমা, মাসিমা গেটে নয়, গেটে নয় গোলে যান গোলে যান...
কথা গুলো বলত আর থেকে থেকে হাত ছুঁড়ত মশারির ছাদে। এলোমেলো হয়ে যেত মশারি। তখন থেকে বিরক্ত হয়ে মশারি বাক্সবন্দী।
আজ ঘুমের মধ্যে চিল চিৎকার-
- আস্তে লেডিজ
কথাটার সঙ্গে সঙ্গে সপাটে একটা চড় রমলার পিঠে, যেমন করে বাসের বডি চাপড়ায় বুধন।
একটু একটু করে যন্ত্রনাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে পিঠময়। মায়ের আদরে ঘঁতন ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের বুকে। ঘঁতনকে পাশে শুইয়ে বুধনের উপর ঝুকে পড়ল রমলা, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মানুষটা। সমানে নাক ডাকছে। এই ঘটনায় তার কোন হেলদোল নেই। রাতের ঘটনা কাল বললে ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসবে।
রমলা সযত্নে বালিশটাকে টেনে এনে রাখল বুধনের মাথার নিচে, ঠিক করে দিল লুঙ্গিটা। দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকাল এখন তিনটে দশ। কাল ভোর সাড়ে চারটায় ফাস্ট ট্রিপ।

​​

এমনটাও হয়!

ঘাটাল থেকে ফিরছি হলদিয়া আসানসোল বাসে। বাসটা একরকম খাঁ খাঁ করছে। উঠেই সিট জুটল। একা একটা টু-সিটে বসলাম। পেছনের টু-সিটে এক মহিলা, সঙ্গে গুচ্চের ব্যাগ-পত্তর। এসব দিনগুলোতে সঙ্গে কিছু না কিছু বই থাকে। বই খুলে পড়তে পড়তে চোখ বুজে এল। গাড়ি হাওয়ার গতিতে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেল মেছেদা। আপাতত মিনিট ১৫ বিশ্রাম তারপর আবার চাকা গড়বে। মেছেদায় গাড়ি দাঁড়াতে আমার পেছনের সিটের ভদ্রমহিলা অস্থির হলেন। উঠেছেন সেই দূর্গাপুরে। এখুনি একটা বাথরুম যাওয়া জরুরী কিন্তু তিনি মেছেদার কিছুই জানেন না। পাশের সিটের এক যুবতী জানালেন স্টেশানের টিকিট কাউন্টার লাগোয়া একটা বাথরুম আছে। ভদ্রমহিলা ভরসা পেলেন না। যুবতী তার পাশে বসা প্রেমিকের চওড়া কাঁধে মাথা রাখলো।
আমি বাস থেকেই ভদ্রমহিলাকে বাথরুমের লোকেশন বলে দিলাম তাতেও সমাধান হোলো না। মহিলার আশঙ্কা বাথরুম ঠিক খুঁজে পাবেন তো আর যদি পানও শেষ পর্যন্ত শৌচকার্য শেষে বাসটি খু্ঁজে পাবেন তো!সিদ্ধান্ত নিলেন গিরিশমোড় পর্যন্ত সামলে নেবেন।
আসলে ভদ্রমহিলা গিরিশমোড় কতটা দূর হতে পারে তাই বোধহয় ঠিক মতো জানেন না।মহিলার বয়স আমার স্বর্গত মায়ের কাছাকাছি। সন্তানের দায়িত্ব বাসে-ঘাটে মাকে এ অবস্থায় সাহায্য করা। তাই করলাম। বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম যেমনটা নিজের মায়ের ক্ষেত্রে করেছি। শৌচকার্য সেরে উনি আমার পিছুপিছু বাসে এসে উঠলেন। সরকারি বাস ভাড়া একটু বেশি তাছাড়া সব স্টপেজ ধরে না তার উপর দুপুর। বাসে লোকজন কমল তো বাড়ল না। বাস ছাড়ল। কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর বাজলো--
"কাকু গিরিশমোর আর কতটা বাকি?" চারপাশটা চেয়ে দেখি আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
মনে মনে ভাবলাম ভাইঝিকে বাথরুম নিয়ে যাওয়াও কাকুর কর্তব্য।

আজ প্রজাতন্ত্র দিবস

আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের বেশি কিছু আগের ঘটনা। নেপাল আর উত্তর বিহারের মধ্যবর্তী একটি স্থান। দুটি রাজ্যের সীমানা হিসাবে বয়ে চলেছে একটি নদী-নদীর নাম রোহিনী। তারই দুই তীরে দুটি রাজ্য। একটিতে কোল আর অন্যটিতে শাক্য জাতির বাস। কোল রাজ্যের রাজধানী দেবদহ। রাজা অঞ্জন বা সুপ্রবুদ্ধ। জ্যোতিষীরা বলেছেন সুপ্রবুদ্ধের কনিষ্ঠা কন্য মহাপ্রজাপতি গৌতমীর গর্ভে যে সন্তান জন্ম নেবে সে হবে রাজ চক্রবর্তী।শাক্যরাজ বিবাহ করতে চাইলেন কনিষ্ঠাকে। রাজা সুপ্রবুদ্ধ জ্যেষ্ঠার বর্তমানে কনিষ্ঠার বিবাহ প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। শাক্যরাজ জ্যেষ্ঠা মহামায়া ও কনিষ্ঠা গৌতমী দুজনকেই বিবাহ করলেন। জ্যেষ্ঠজায়ার গর্ভে সন্তান এলো দীর্ঘ অপেক্ষার পর। যেদিন সন্তান জন্মগ্রহণ করছেন সে সংবাদে শাক্য বংশের কুলপুরোহিত ঋষি কালদেবল প্রাসাদে এসে উপস্থিত।
ঋষি কালবলদেব ভবিষ্যৎবাণী করলেন--
নবজাতের মধ্যে সুলক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে এ শিশু সংসার ত্যাগ করে সর্বজ্ঞ সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রূপে পূজিত হবেন। 
নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে আটজন দৈবজ্ঞের মধ্যে সাতজন বলেছিলেন--
এ-শিশু সংসারে থাকলে রাজচক্রবর্তী হবেন আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলে হবেন সর্বজ্ঞ।
অষ্টমজন, নাম কোণ্ডণ্য বললেন---
সংসার নয়, সংসার নয়। সন্ন্যাস। সন্ন্যাস নেবেন কুমার। হবেন আসক্তিশুন্য বুদ্ধ। মহারাজ শুদ্ধোদন ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাস করলেন--
--কি দর্শনে আমার পুত্র সন্ন্যাসী হতে পারে? কোণ্ডণ্য বললেন--
--চারটি ঘটনা-- জরাজীর্ণ পুরুষ,ব্যাধীগ্রস্ত মানুষ,মৃতদেহ ও সন্ন্যাসী।

এরপর থেকে মহারাজ শুদ্ধোদন সর্বোত্তম সচেষ্ট থেকেছেন যাতে পথে - ঘাটে রাজকুমার সিদ্ধার্থের সম্মুখে কোন ভাবে জরা, ব্যাধী,মৃত্যুর মতো জীবনের সত্যগুলি নাদৃষ্ট হয়। মহারাজ শুদ্ধোদন আশঙ্কায় ছিলেন সিদ্ধার্থ মানুষের দুঃখে কষ্টে বিচলিত হয়ে উঠবেন। রাজসুখ ছেড়ে সন্ন্যাস নেবেন।
তাই প্রতিনিয়ত রাস্তা-ঘাট থাকত ঝাঁ চকচকে। রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলা হত দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনার সকল চিহ্ন। 
আড়াই হাজার বছর পরে এখনো এমনটাই হয়। মন্ত্রী-সান্ত্রী-আমলার চলাচল ঝাঁ চকচকে রাখা হয়। সরিয়ে ফেলা হয় দুঃখী, হতদরিদ্র প্রজাদের দিনযাপনের ক্লেদাক্ত দিকগুলি। মহারাজ বিচলিত হবেন এমনটা ভেবে নয় বরং তিনি এসব দেখে রেগে যাবেন। তাঁর মেকি প্রজাবাৎসল্যের ফাঁকিটুকু ধরা পড়ে যায় সেই আশঙ্কায়।

অযোধ্যায় সুরা সেবন

পা-পা করে অযোধ্যা পাহাড়ের মাথাটা ঘুরে এলাম। মনেই হচ্ছে না পাহাড়ের উপর আছি, সবটাই প্রায় সমভূমি। আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো ঘন শাল শেগুনের জঙ্গল। মাটির ঘর- বাড়ি কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও যেন একটা সাবেকি সুন্দরতা। দোকান-পাট নেই বললেই চলে। খাওয়ার দোকানে মুড়ি, চপ, ফুলুরি, জিলিপি - এই পর্যন্ত। একশ টাকা খরচ করতে কম্ম কাবার। পর্যটকরা নিচে শহরেই বেশি থেকে যায়, উপরে এক চক্কর দিয়ে সোজা নিচে। তাই এখানে দোকান পাটে শহুরে বিলাসিতা নেই,খুব বেশি লজ বা আবাসন গড়ে ওঠে নি।
আগে থেকে অনাদি বাবুকে দিয়ে অযোধ্যা হিল টপ লজ বুক করা ছিল, রাত্রি যাপন এখানেই, এদের কাছেই রাতের খাওয়া। আমাদের দুটো রুম। রুম দুটোর সামনে এক ফালি মাঠ। বন্ধ দরজা জানালার ফাঁক থেকে এটুকু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমাদের রুমটার সামনে একদল লোক জড় হয়েছে। ওদের কথা বার্তা ক্রমশ ঘন হয়ে আসছিল।
কৌতুহল বশতঃ বেরিয়ে পড়লাম। দরজা খোলা মাত্র মিষ্টি একটা মদের গন্ধ হু হু করে আমাদের রুমে ঢুকে পড়ল। আমাদের বারান্দাটা আপাতত এদের দখলে। ঘাটিয়ালী গ্রাম থেকে এসেছে ওরা। সারা বারান্দা, মেঝে, রেলিং সর্বত্র ছড়ানো ছিটানো ছৌ নাচের সাজ পোশাক, সাজ গোজ চলছে। মাঠের মাঝে ধামসা, মাদোল নিয়ে বায়েনদাররা প্রস্তুত। এরাও আজকাল সিন্থেসাইজার ব্যবহার করে। একজন বাশী বাজাচ্ছে মেঠো সুরে। হেলোজেনের হলুদ আলো মেখে মাঠটা মায়াবী হয়ে উঠছে। জানলাম কলকাতা থেকে আসা একদল টুরিস্ট ছৌ নাচের আয়োজন করেছে। আমাদের পোয়া বারো ফুকুটসে রুমে বসে ছৌ নাচ।

কদিন আগে ক্যালকাটা ক্লাবে এক বিতর্ক সভায়, (বিষয় ছিল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সব সম্যসার জাদু বটি) সম্বিৎ পাত্র মহিষাসুর মর্দিনী মা দুর্গাকে ক্যাপিটালাইজ্ড করে ছিলেন সভার পক্ষে।

এদের আজকের নিবেদন মহিষাসুর মর্দিনী। এদের অভাব কত বেশি, চাওয়া কত কম। অথচ এদের যুদ্ধ চলতেই থাকে, চলতেই থাকে- অভাবের সঙ্গে- সভ্যতার সঙ্গে- আর রক্তবীজের মতো দুঃখ, যন্ত্রনা, অভাব, অভিযোগ প্রতি ক্ষনে ক্ষনে জন্ম নেয় এদের জীবন জুড়ে- আর এদের সংগ্রাম, এদের যুদ্ধ চলতেই থাকে চলতেই থাকে।

প্রথম যখন মদের গন্ধ পেয়েছিলাম তখন খুব রাগ হচ্ছিল এদের উপর, এতো অভাবে কেন এই বিলাসিতা! এখন মাঠটাতে আমাদের মতো বিলাসী মানুষরা একটা অর্ধবৃত্তে দাঁড়িয়ে- 
ধামসা মাদোলের তালে, নাচের ছন্দে ছন্দে মাটিতে আছড়ে পড়ছে ছৌ শিল্পীদের সারা দেহ। অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে ক্ষত বিক্ষত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে এক অপূর্ব নৃত্যশৈলী। নৃত্য সুষমার অননুকরনীয় তান্ডবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ধূলি বলয়। অনতিক্রমনীয় শীতে স্বেদ বিন্দুতে সিক্ত হচ্ছে প্রান্তর। বুঝলাম শরীর নেশায় আচ্ছন্ন না হলে ঐ আঘাত অবলীলায় অগ্রাহ্য করে অপরকে আমোদিত করা যায় না। আর আমরা যারা শীতের জমকালো পোশাকে শরীর মুড়ে রাত জাগছিলাম, জাগিয়ে তুলছিলাম তুমুল করতালির উদীপ্ত উল্লাস,ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠছিল বার বার, তাল দিচ্ছিলাম বেতালা, আর ওয়াও.... ওয়াও শব্দে আমাদের মুখ থেকে বের হচ্ছিল মদের কটু গন্ধ....
জানি না কি ব্যথার বিস্মরণে আমাদের সুরা সেবন!

​​অভ্যাস

-- একি, কিছুই তো খেলে না!
-- খিদে নেই।
-- সত্যিই কি খিদে নেই? না কি মন খারাপ?
-- ভালো লাগছে না সোম।
-- হুম বুঝতে পেরেছি, ছেলের জন্য..
-- তুমি তো জানো ও খাওয়ার ব্যাপারে কেমন নাক উচুঁ...
-- সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে সব ঠিক হয়ে যায়। আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার  দেখেছ । তিন দিন দাঁতে কিছুই কাট নি।
বিনীতা কবজি্র উপরের অংশটা দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে উঠে গেল খাওয়ার ফেলে। সোমনাথ চুপটি করে বসে রইল খাওয়ার টেবিলে। এতক্ষণ ধরে বিনীতাকে দেখানো তৎপরতার আর কোন দাম নেই। তার ডান হাত থেমে গেছে। খাওয়ার ইচ্ছে সোমনাথেরও নেই। থাকবে কি করে! কত টুকুই বা বয়স! পুরুষ মানুষের মন নাকি পাহাড়ের মতো শক্ত হতে হয়। কিন্তু বাবা'দের! চশমাটা তুলে চোখের কোনগুলোতে রুমাল ছোঁয়াল সোমনাথ।

বিনীতার মুখটা জ্বলছে আর নিভছে। সমানে ফোনটাকে স্ক্রল করে চলেছে সে। বিছানায় বসে সতুর ছেলেবেলার ছবিগুলো দেখছে বিনীতা। সোমনাথ বাড়ি থাকলে তবুও কথা বলার একজন পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়িতে কেউ না থাকলে মন খারাপেরা হুটহাট ঢুকে পড়ে। সোমনাথ স্কুল বেরিয়ে গেলে বিনীতা সতুর পুরানো খেলনা, জামা-কাপড় ছড়িয়ে বসে বিছানায়। দু'হাতে নাড়তে থাকে স্মৃতি।
বারান্দা থেকে আড় চোখে বিনীতাকে দেখল সোমনাথ। এই তিন দিনে যেন ত্রিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে বিনীতার। সিগ্রেটে একটা লম্বা টান দিল সোমনাথ। ধোঁয়াটা যতটা সম্ভব বুকের ভেতর নিয়ে ফের ছড়িয়ে দিল বাতাসে। মনে মনে ভাবল এই ধাক্কায় তার নিজের বয়স কতটা বাড়ল তা তো দেখা হল না। সোমনাথ বারান্দা থেকে পায়ে পায়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। দু'দিনের না-কাটা দাড়িতে অযত্নের হাত বোলাল। সত্যিই এই ক'দিনে তার বয়সটাও যেন লাফিয়ে বেড়ে গেছে। সাইকেল নিয়ে টলমল করতে করতে এগোছে সতু আর পেছনে পেছনে সোমনাথ। সোমনাথের চোখ দুটো স্থির সতুর উপর। হাত দুটো তেরী। একটু বেচাল হলেই ধরে নিতে হবে সাইকেল। সতু যখন প্রথম সাইকেল শেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিডিওটা করেছিল বিনীতা। সেদিন একবারের জন্য ভয় পায় নি বিনীতা কিন্তু আজ সেই ভিডিওটা দেখতে দেখতে বিনীতা ভাবছিল এই বুঝি সতু ব্যালেন্স হারাল।
সোমনাথ মাথায় হাতটা রাখতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারল না বিনীতা। কাঁদতে কাঁদতে মুখটা গুঁজে দিল সোমনাথের বুকে। কান্নাটা কোনো রকমে সামলে নিয়ে বলল--
-- শুনেছি মিশন স্কুল হলেও স্কুলটা আমাদের বি.বি. ইনস্টিটিউশনের থেকে সামান্য ভাল।
-- ভালো ভালই,তার আবার কম বেশী কি। তাছাড়া আমাদের ছেলে যথেষ্ট মেধাবী।
-- না মানে আমি বলছিলাম সে হলে সতু বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারত। এমনি করে
একা একা হোষ্টেলে...
-- একা থাকাটাও একটা অভ্যাস বিনীতা।
-- ও যে বড্ড ছোট গো, সব গুছিয়ে পেরে উঠবে!
-- বেশ পারবে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা অভ্যাসটাতো শুধু ওর একার তৈরী হবে না, আমাদেরও হবে।
-- মানে?
-- সেটাই জরুরী।
-- তুমি কি বলছ বুঝতে পারছি না!
-- আমি জানি বিনীতা স্কুলটা বিশেষ ভাল নয়
-- তবে! তবে কেন হোষ্টেলে রাখলে!
-- দেখ বিনীতা বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর এক দিন হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চিত ভাবে আমাদের ছেলে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো চলে যাবে চাকরি সুত্রে বিদেশে।হয়তো তখন তুমি আমি বৃদ্ধাশ্রমে। আজকের এই অভ্যাসে সেদিন একা থাকাটা কতটা সহজ হয়ে যাবে বলতো। কষ্ট কি আমারও কম হচ্ছে বিনীতা কিন্তু অনেক চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত বিনীতা। ভেঙে পড়লে চলে, এটাই বড় সুযোগ বিনীতা একটু কষ্ট করে এবেলাই একা থাকার অভ্যাস করে নিতে হবে আমাদের। বিনীতা শক্তকরে জড়িয়ে ধরেছে সোমনাথকে। বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইলে ভিডিওটা চলছে সমানে। সাইকেল থেকে সরে গেছে সোমনাথের হাত দুটো। সামনের দিকে তরতররিয়ে এগিয়ে চলছে সতুর সাইকেল।

বিশ্বাসের রং নীল

 

বিশ্বনাথের রবিবারগুলো আর পাঁচজনের রবিবার থেকে একেবারেই আলাদা। রোব্বার রোব্বার অন্যরা যখন দেওয়াল আর শিলিং-এ ঝুল ঝাড়ে, বেড-কভার পরিস্কার করে,বাড়ির সামনে এক ছটাক বাগানে ঘাস নিড়োয় কিংবা বৌ-এর সাথে শাক-সবজি কাটাকুটিতে হাত লাগায় সেখানে বিশু রবিবারগুলোয় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। আর রোদ পোয়ানো কুমিরের মতো শরীরটাকে টানটান করে বিছানায় ছড়িয়ে মোবাইলে লেখালেখি করে।
একেবারে আলগা একটা দিন। কোনো চাপ নেই। সাইকেল ঠেঙিয়ে টিউশন নেই। অথচ আজ এমন একটা আলসে রবিবারে বিশু লেখালেখি বন্ধ করে মোবাইলটা চার্জে রেখে সাত-সকালে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করতে শুরু করেছে-- সন্দেহটা সেখানেই। অবশ্য দিন পনেরো ধরে চলছে এই প্রস্তুতিটা। সোনালী একবার গায়েপড়া হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল--
"সাক্ষাৎটা করা সঙ্গে?" একটা শব্দে উত্তর সেরে ছিল বিশু- "বন্ধু।"
জেন্ডারের ধারে কাছে ভিড়ে নি। সকালবেলার চা-বিস্কুট দেওয়ার সময় সোনালী মনেমনে চেয়েছিল অসাবধানতার ভান করে চা'টা ফেলে দেয় বিছানায় রাখা জামাটায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয় নি। গেল বিবাহবার্ষিকীতে নিজেই পচ্ছন্দ করে কিনেছিল ঘন নীল জামাটা। বিশ্বনাথের জামার সঙ্গে ম্যাচ করে নিজেও নিয়েছিল নীল রঙা সম্বলপুর কটকি। নীলটা যে বিশ্বাসের রঙ, সোনালী তা জেনেছিল বিশুর থেকেই। আর সেই উপলব্ধির শিকড় বেশ পুরানো, বিয়েরও বেশ কয়েক বছর আগের। 
সাত জনের ব্যাচ। ওটাই ছিলো সেবারের সবচেয়ে ছোট ব্যাচ। আসলে শেষদিকে যারা আসতো যাদের আর অন্য ব্যাচে জায়গা হতো না তাদের নিয়ে বিশু ঐরকম একটা খুচরো ব্যাচ বানাতো। সাত জনের ব্যাচে একমাত্র মেয়ে সোনালী। তাছাড়া সোনালীর লেখাপড়া বরাবর গ্রার্লসে তাই ছেলেদের সঙ্গে সহজ হওয়াটা খুব সহজ ছিল না। তখন বিশু, বিশ্বনাথ স্যার। তখন বিশ্বনাথ, বিশু'দা হয় নি। কথা বলতে গিয়ে একটু ততলে যেত বিশু। ব্যাপারটা যে সবসময় হতো তা নয়। একটানা কিছু বলতে গেলে একটু লেগে যেত। এ নিয়ে বিশ্বনাথকে আড়াল করে বেশ মজার চল ছিল টিউশন ব্যাচে।

ছেলেরা যখন ব্যঙ্গ করত ভেতরে ভেতরে রাগ হত সোনালীর।সেই শুরু।সোনালী টের পেয়েছিল তোতলা বিশুতে একটু একটু করে আচ্ছন্ন হচ্ছে সে।এমনটাই হয় মন জলের চেয়েও বেশি তরল। সামান্য সুযোগে নিজের অজান্তেই এমন ভাবে গলে যায়,এমন ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় যে করার কিছুই থাকে না।সোনালী বিশুর কাছেই প্রথম জেনেছিল- " জ্ঞান হল অতল সমুদ্র। বিশ্বাস থেকে জ্ঞানের জন্ম। শুধু বিশ্বাস নয়,জন্ম গভীর বিশ্বাস থেকে। বিশ্বাস যত গভীর হয় জ্ঞান তত পরিনত হয়।"সেই যে একবার কথাগুলো ঢুকে পড়েছিল বিশ্বাসের ঘরে, তারপর থেকে বিশ্বাস-সমুদ্র-অতলনীল এগুলোকে সোনালীর বড় আপনার মনে হয়েছে বারবার। এগুলোকে চরম সত্য ধরে কেটেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। সোনালীর স্পষ্ট মনে আছে সেদিনটার কথা। সে দিনটাও ছিল একটা রবিবার। পড়ানোর ডেটের বাইরে একটা এক্সট্রা ডেট দিয়েছিল বিশু। সোনালী জানতেই পারে নি সেদিনটা কেবল সোনালীর। ব্যাচের অন্য করো নয়। পড়াতে পড়াতে হঠাৎই বিশু প্রপোজ করে বসে সোনালীকে। প্রপোজের ধরণটাও ছিল বেশ অন্য রকম।-- আচ্ছা সোনালী, যদি এমনটা হয় আমরা দুজন একসঙ্গে পড়াতে শুরু করলাম।-- কি যে বলেন! পড়াবো আমি! আমারই তো লেখাপড়া চলছে।-- না,মানে এখনই নয়। মানে পরে, মানে অনেক পরে। মানে তখন তুমি গ্রাজুয়েট হয়ে গেছ। মানে বেশ মেয়েই হয়ে উঠেছো।-- নেবেন আমাকে সঙ্গে? কি পড়াবো আমি?-- ঐ তো ইতি.. ইতিহাস, ইতিহাস।-- বেশ হবে কিন্তু। ইতিহাস এমনিতেই আমার বেষ্ট সাবজেক্ট।-- পড়ানোর মাঝে তুমি আমার জন্য একটু চা নিয়ে এলে।-- আপনার একার জন্য ! -- না মানে...-- বানালে দু'কাপ চা'ই বানাবো।-- আসলে আমি ঠিক তা বলিনি। মা.. মা..মা... মানে আমি হয়তো তোমাকে বললাম, সোনু আমায় এক কাপ চা দাও তো। শেষ কথাটাতে বিশুর জার্নিটা বুঝেছিল সোনালী। নাহ্ সোনালীর আর গ্রেজুয়শন কমপ্লিট হয় নি। বিয়ে পাশ দেওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় বিশু স্যারের সঙ্গে। অবশ্যই বাড়ির অমতে, পালিয়ে। সেই বিশুই হঠাৎ করে এমন পাল্টে যাবে এটাই বিশ্বাস হচ্ছে না সোনালীর! এমনিতেই সারা সপ্তাহের ব্যস্ততা। টিউশন নিয়ে

লেগে পড়ে থাকা। তার মাঝে বিশুর অবসরটুকু আজকাল আর সোনালীর জন্য নয়। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে সম্পর্কটা এমন ছানা কাটা ছানা কাটা হয়ে যাবে সোনালী তা দুঃস্বপ্নেও আনে নি। আজকাল টিউশন ফেরত বিশু মোবাইল নিয়ে কি যে সব ছাই-পাঁশ লেখালেখি করে বুঝে উঠতে পারে না সোনালী। লাইক, কমেন্ট এসবের মাঝে নেশাগ্রস্থের মতো বুঁদ হয়ে থাকে সে। বিশ্বাসের গভীর নীল ক্রমে ফিকে হয়ে আসে সোনালীর। এসব নিয়ে সোনালী কিছু বললে, রাগ দেখালে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয় না বিশু, বরং আরো নিবিড় হয় মোবাইলে। মাস খানেক আগে সোনালীও তার নিজের মোবাইলে একটা ফেসবুক এ্যাকাউন্ট বানিয়ে চেষ্টা করেছিল ব্যস্ত হওয়ার। চেষ্টা করে ছিল বিশুর প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে তার হৃদয় আগুন জ্বেলে দেওয়ার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। বরং একটু একটু করে দুজনের মধ্যে বেড়েছিল দূরত্ব। কথা বলার সময় ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল। রাগে নিজের মোবাইলটাই আছড়ে ভেঙে ফেলেছিল সোনালী।
আজ খারাপ লাগছে, মোবাইলটা ভাল থাকলে একটা ফোন অন্তত করতে পারত সে। সকাল ন'টায় বেরিয়েছে বিশু এখন রাত আট'টা। বারান্দার আলো নিভিয়ে চুপটি করে বারান্দায় এসে বসে সোনালী। রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে ঘিরে ধরছে তাকে।
সেই অন্ধকারে ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল--
"ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল যাপন সে কি শুধু লেখালেখি? না কি অন্য কোন মহিলার প্রতি..."
সন্দেহের বিষবাষ্পে দু'চোখ ভিজে গেল সোনালীর।

রাত দশটায় বাড়ি ফিরল বিশু। বসে থেকে থেকে চোখের পাতা লেগে গিয়ে ছিল সোনালীর।
কলিং বেলের শব্দে দ্রুত হাতে দরজা খুলল সে।
সারা দিনের ধকলেও বিশুর চোখে মুখে ক্লান্তির চিহ্নটুকু নেই। বরং সারা শরীরে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা। হঠাৎ সোনালীর চোখ আটকে গেল বিশুর ডানদিকের গালে। ডান গালের লাল রংটা সিঁদুর কিনা নিশ্চিত হতে ডানদিকটা আর একবার ভাল করে দেখল সে।
সোনালীর গলা শুকিয়ে আসছে। থুতু শুকিয়ে আঁঠার মতো জড়িয়ে গেছে ঠোঁটে।
ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র সারা শরীর অবশ হয়ে এলো তার। ঘষা কাঁচের মধ্য থেকে দেখলে যেমন অদ্ভুৎ দেখায় চারপাশটা তেমন করে তার চোখের সামনেই তার সংসারটা কেমন যেন এবড়োখেবড়ো আর অদ্ভুৎ-দর্শন হয়ে যাচ্ছে। সোনালী আলনা থেকে গামছাটা বিশুর হাতে দিয়ে নিচু গলায় বলল--
"অনেক রাত হয়েছে, ফ্রেশ হয়ে এসো। ওহ ভাল কথা বাথরুমের আয়নাটা ভেঙে গেছে, হাত আয়নাটা নিয়ে গিয়ে ডানদিকের গালটা ভাল করে পরিস্কার করে নিও।"
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জা পেয়ে গেল বিশ্বনাথ। ডানদিকের গালে লেপ্টে আছে সিঁদুর।

এতো রাতে আর বোধহয় কেউ জেগে নেই। আসলে জেগে থাকার দায় নেই যে আর কারো। কিন্তু সোনালী আর বিশ্বনাথের যে না জেগে উপায় নেই। নিজেদের কাছে নিজেদের জবাবদিহির জন্যই যে বাকি রাতটুকু জেগে থাকতে হবে তাদের।
সারা ঘরটায় এখন সোনালীর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা পাক খাচ্ছে। দু'হাঁটুর মাঝে মুখ গোঁজা হয়ে কাঁদছে সে। সোনালীর সামনে অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে বসে আছে বিশ্বনাথ। তার দু'হাতে ধরা আছে একটা সুন্দর মোড়ক। অনেক সাধাসাধির পর চোখ তুলল সোনালী। চোখ দু'টো জবা ফুলের মতো লাল। প্যাকেটটা দেখে কান্না জড়ানো গলায় সোনালী বলল--
-- কি এটা?
-- খুলেই দেখ।
মোড়ক সরাতেই বেরিয়ে এল নতুন বই-এর গন্ধ। মলাটের উপর লেখা - "বিশ্বাসের রং নীল"। মলাট উল্টাতেই মোটা অক্ষরে লেখা- "উৎসর্গ- সুখ-দুঃখের সাথি সোনালীকে"।
আদর মেশানো গলায় বিশ্বনাথ বলল--
-- আমার লেখা প্রথম বই। প্রচ্ছদটা তোমার পচ্ছন্দ হয়েছে? আজই প্রকাশ পেল। সে জন্যই গিয়েছিলাম শহরে। ফেরার পথে পাশের সিটে বসেছিলেন এক মহিলা। দেখে মনে হল শহরে শাক-সবজি বিক্রি করেন। সারা দিনের ক্লান্তি, বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর তাতেই বিপত্তি।
সবটা শোনার পর আশ্বস্ত হল সোনালী, গলায় অনুযোগ নিয়ে বলল--
--- তোমার ঐ মোবাইলের নেশা এবার ছাড়। ও মদের নেশার চেয়েও সাংঘাতিক।
-- মদ তো আমি খাই সোনু।
-- কি বল্লে! তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে মদ খাও?
-- খাই তো। 
তারপর বিশ্বনাথ সোনালীর থুঁতনিটাকে নাড়িয়ে বলল--
-- আরে না রে বাবা না। মদ কেন খাবো, তুমিই তো আমার নেশা, তুমিই তো আমার রাম।
-- হু সে তো বলবেই, আমি তো রাম হবই। তোমার লেখার যত মহিলা ভক্ত তারাই তো তোমার সীতা।
কথাটা শেষ করে সোনালী ডুব দিল বিশ্বনাথের বুকের গভীরে। সারা বিশ্ব চরাচর তখন গভীর ঘুমে, শুধু রাতজাগা নীল রাত বাতিটা নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে।

একলব্য

"তোমার এই পাগলামিটা কবে মাথা থেকে নামবে বুঝে উঠতে পারি না। নিজের মাথাটা তো গেছেই সেই সঙ্গে আমার মাথাটাও নষ্ট করে ছাড়বে। এই বয়সে আছাড় খেয়ে হাড়গোড় একটিবার ভাঙলে সে আর জোড়া লাগবে? মেনে নিতে হয়, বুঝলে মানিয়ে নিতে হয়। বয়সে যেমন ভাঙা হাড় জোড়া লাগে না তেমনি সম্পর্কের বয়স বাড়লে তার বাঁধন আলগা হয়ে পড়ে। মশাই, সময়ের রোদ-জল-হাওয়ায় সম্পর্কেও মরচে ধরে।
কপাল আমার!
দশ ক্লাস পাশ না দিয়েও যে সত্যটা আমি বুঝতে পারি,কষ্টটা এই - সে সত্যটা তুমি কোনোদিনও বুঝতে চাইলে না।"
লম্বা টুলের উপর দাঁড়িয়ে কথাগুলো নাগাড়ে বলে গেল হেমলতা। বয়স ষাটের খানিক বেশি। হাড়ের উপর গম-রঙা চামড়া জড়ানো শীর্ণ শরীর। কোন রকম টলমল করতে করতে বেলুনগুলোকে আটকে দিচ্ছেন শিলিংএ। তোবড়ানো গালটা ফুলিয়ে বুকের সমস্ত বাতাসটুকু বেলুনের ভেতর ভরে দিচ্ছেন শ্যামলেন্দু।
বছর তিন হল এই দিনটাতে সকাল থেকে পড়ার-ঘরটা নিজের মতো করে সাজাতে লেগে পড়ে শ্যামলেন্দু। সাজানো শেষ পর্যন্ত কোন অবস্থায় দাঁড়াল তা বোঝার উপায় নেই তার।
তাই হেমলতাই এখন শেষ কথা। নিঃসন্তান হেমলতা সতীন নেয়ে কাটিয়ে দিলেন কায়-ক্লেশে। হেমলতা নিঃসন্তান হলেও শ্যামলেন্দু নয়, সন্তান সুখে তাঁর ঘাটতি কোথায়! 
সাতের দশকের গোড়ায় গোড়ায় রতনপুরের জমিদার হরনারায়ন সিংহ চৌধুরী তাঁর পিতামহের নামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শ্যমলেন্দুর বয়স তখন কত.. বছর বাইশ। গোঁফে কঁচি ঘাসের রেখা ফুটেছে সদ্য। গ্রামের প্রথম গ্রেজুয়েট শ্যামলেন্দুকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় সেই স্কুলে। স্কুলে তখন শ্যামলেন্দুকে নিয়ে জন তিন শিক্ষক, রাতদিন এক করে উঠে পড়ে লেগেছেন হরনারায়নের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে। উদ্যোগী শিক্ষিত শ্যামলেন্দুকে মনে ধরেছিল হরনারায়নের। জমিদারের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় শ্যামলেন্দুর। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে হেমলতা বুঝে যায় যে সে শ্যামলেন্দুর ফাস্ট প্রায়োরিটি নয়।স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী, পুথি-পত্তর এসব নিয়ে দিব্যি রয়েছে তাঁর আরো একটা ফ্যামেলি। আর সেটাই শ্যামলেন্দুর ফাস্ট ফ্যামেলি। সেসব সামলে উদ্বৃত্ত সময়টুকু হেমলতার। প্রথম প্রথম ওসব নিয়ে হেমলতার রাগ হয়েছে, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে। কিন্তু একটু একটু করে প্রশ্রয় পেয়েছে শ্যামলেন্দুর পাগলামিটা। হেমলতা বুঝে নিয়েছে এহেন সতীন নিয়ে কলহ করে খুব একটা সুবিধা হবে না। একটা লজঝড়ে সাইকেল, স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী, কেবল এসবের মধ্যে একটা আস্ত জীবন বাঁধা পড়ে যেতে পারে এটাই হেমলতার কাছে বড় আশ্চর্যের। রাতের দিকে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিল শ্যামলেন্দুর।
জ্বরের ঘোরে একটা জট পাকানো গলায় বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিলেন..... " রোল নং ওয়ান, টু, থ্রি... "
রিটায়ারম্যান্টটা সহজ ভাবে নিতে পারেন নি শ্যামলেন্দু। মুষড়ে পড়েছিলেন ভীষণ। স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী, আর তাঁর সেই লজঝড়ে সাইকেলটা এবার বুঝি মিথ্যা হয়ে গেল! স্কুল ছুটির ঘন্টা অবসরের আগে বহুবার কানে এসেছে তাঁর কিন্তু সে দিন ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। কে যেন বুকের ভিতর থেকে থেকে নির্মম হাতুড়ি পেটাচ্ছিল। 
একটু সামলে নিয়ে আবার সাইকেল, আবার ক্রিং.. ক্রিং... আবার স্কুল। আবার সকাল সকাল নাকে-মুখে দুটি গুঁজে সটান স্কুল। স্কুলের রুটিনে নাম নেই তো কি যায় আসে, কখনও বেরা বাবু কখনও সেন বাবুদের বসিয়ে রেখে তাঁদের ক্লাসে নিয়মিত হাজির হয়ে যেতেন শ্যামলেন্দু কোন দিন হয়তো ঠাঁয় বসে রইলেন। বসে রইলেন পেছন বেঞ্চে বসা ছাত্রটির মতো আনমনা হয়ে। অতীত হাতড়াতে হাতড়াতে তলিয়ে গেলেন অনেক অনেক গভীরে।চোখের সামনে শুরুর সেই ছোট-খাটো স্কুলটা একটু একটু করে বড় হতে থাকল। মাঠের চারপাশটায় ঝাউগাছ কবে যেন বড় হয়ে গেল। হালকা হাওয়ায় নাড়তে থাকল মাথা।
একদিন হাসতে হাসতে হেডমাস্টার মশাই বলেছিলেন--
"কিছু যদি মনে না করেন স্যার,সেই তো রোজদিন আসছেন, যদি মিড ডে মিলের হিসাব পত্তরটা দেখেন।"
খুব কষ্ট পেয়ে সাইকেলটাকে তালা দিয়ে আর পাঁচটা বাতিল জিনিসের সঙ্গে গুদামঘরে রেখে দিয়েছিলেন শ্যামলেন্দু। বড় অভিমানে তারপর থেকে আর স্কুল মুখো হন নি। শিক্ষক হয়েই যেতে চেয়েছিলেন স্কুলে, অবসর তাঁকে ক্যাটারার বানিয়ে ফেলবে এ তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি!

বছর তিনেক নতুন একটা ভুত চেপেছে শ্যামলেন্দুর মাথায়। খোঁজ খবর করে ঠিকানা পত্তর জোগাড় করেছেন পুরানো ছাত্রদের। তাঁর মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে মৃত্যু। তাঁর বারবার মনে হয়েছে সোলতের তেল ফুরিয়ে এসেছে এবার। তাই জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে যদি একটিবার সেই মুখগুলোকে দেখতে পাওয়া যেত তবে বেশ হতো। আর এটা ভেবেই পোষ্ট অপিস থেকে গুচ্চের পোষ্টকার্ড আনিয়েছিলেন তিনি। গত বছরও এমন দিনে শ্যামলেন্দু সাজিয়ে ছিলেন পড়ার ঘরটা। ময়দায় জল দিয়েছিলেন হেমলতা। বাজার থেকে ভাল ভাল মিষ্টি আনিয়েছিলেন শ্যামলেন্দু। থেকে থেকে ঘর-বার হচ্ছিলেন তিনি। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির শিহরণ ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাঁকে। সকলকে ডাকেন নি শ্যামলেন্দু। সকলকে কি আর ডাকা যায়।
সব ছাত্র-ছাত্রী কি মনের মনি কোঠায় স্থান পায়! যারা মেধাবী, যারা কৃতি তাদের চিঠি দিয়েছে শ্যামলেন্দু। একটু বাদেই শ্যামলেন্দু ফিরে যাবেন তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে। ছেলেরা তাঁর পা ছোঁয়ার আগেই তিনি জড়িয়ে ধরবেন বুকে। গল্প-গাছায় কেটে যাবে সময়। না! শেষ পর্যন্ত অশেষ, বিভাস, তপেন্দু, অলকেশ, নিখিলেশরা কেউ আসে নি! অন্তহীন অপেক্ষায় বুড়ো-বুড়ি মন খারাপ করে, ঘরের সব আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সে রাতে।

হেমলতাকে দেখে দরজার ফ্রেমে দাঁড়ানো যুবকের মুখের হাসিটা একটু চাওড়া হল। সে হাসির ছোঁয়াচ লাগল হেমলতাকেও। তিনি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলেন যুককের দিকে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল অশেষ। কপালের ঘামটা সরাতে সরাতে বলল-
-- স্যার কোথায় মাসিমা?
-- পড়ার ঘরে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আচ্ছা তোমার নামটা কি বলতো? কোন ইয়ার?
-- আমি অশেষ, অশেষ সামন্ত।
কিন্তু ঠোঁট মুড়ে, কপাল কুঁচকে, মাথা চুলকে কোন ভাবেই সালটা মনে করতে পারল না সে। হঠাৎ করে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল তার-
-- ঐযে যে বছর স্যার সাইকেল থেকে পড়ে হাত ভাঙলেন, সে বছরই তো আমারা স্কুল ফাইনাল দিলাম। ঘটনাটা মনে করিয়ে দিতেই হেমলতার চোখের সামনে সাদা ধবধবে প্লাস্টারের উপর চুল জড়ানো বাঁ হাতটা ভেসে উঠল। ঐ ভাঙা হাত নিয়েই শ্যামলেন্দু স্কুল ছুটেছিলেন পরদিন। হেমলতা হাজার চেষ্টা করেও আটকাতে পারেন নি।
শ্যামলেন্দু হেমলতাকে বুঝিয়ে ছিলেন --
"সামনে স্কুল ফাইনাল। অশেষদের কাছে এখন প্রতিটা মিনিটের দাম যে অনেক।"
হেমলতা অশেষকে আপাদমস্তক দেখছিলেন।এ ছেলের কথা কতবার তিনি শুনেছেন শ্যামলেন্দুর কাছে। শ্যামলেন্দুর গল্পের সঙ্গে একেবারে মিলে যায় এ ছেলে। কত বড় ডাক্তার কিন্তু কি অসম্ভব বিনয়ী। আসবাব বলতে কয়েকটা আলমারি আর বুক সেল্ফ। আর সেগুলোয় থরে থরে সাজানো নানান কিসিমের বই। ঘরের মধ্যে ঢোকা মাত্র অশেষ টের পেল, এ ঘরে অনেক দিন মানুষজনের পা পড়ে নি। বই-পত্তরে অনাদরের ধুলো। অশেষের মনে হল বই-এর পৃষ্ঠগুলো যেন অপেক্ষা করে আছে মানুষের আঙুলের স্পর্শ সুখের আশায়- অহল্যার মতো। টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিল অশেষ। 
তার আঙুলের স্পর্শে ফরফর শব্দে হেসে উঠল পৃষ্ঠাগুলো। আর সেই শব্দে টেবিলের অন্য প্রান্তে বই-পত্তরের মধ্যে থেকে জেগে উঠলেন এক নবতিপর বৃদ্ধ। অশেষদের প্রিয় শ্যামলেন্দু স্যার। বয়সও যে কোনো মানুষকে সুন্দর করে তুলতে পারে এ ভাবনা অশেষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল এতোদিন। টানটান দীর্ঘদেহ,মাথায় কাশ ফুলের দোলা, গায়ের রং-এ কাঞ্চনের আভা। অশেষ এগিয়ে গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল স্যারকে।
দু-হাত বাড়িয়ে তাকে উঠিয়ে নিলেন স্যার। তারপর দু'টি হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিছু একটা অনুভবের চেষ্টা করতে লাগলেন। মুহুর্তে অশেষ এর দৃষ্টি ঝাপসা। দু'চোখে থৈ থৈ করছে জল। এতোক্ষণে সে বুঝেছে স্যার আর দেখতে পান না। সেই বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি, আজ শুণ্য!
অবস্থাটা কোনো রকমে সামলে নিয়ে নিজের পরিচয় দিল অশেষ। অশেষ নামটা শোনা মাত্র শ্যামলেন্দুর শরীরে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎ শিহরণ। তাঁর হাত দু'টি ঘুরে বেড়াচ্ছে অশেষের সারা শরীরে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর প্রিয় ছাত্রের সান্নিধ্যের যে একটা ঘোর তাতে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছেন শ্যামলেন্দু।
"কথা বলার মেলা সময় পড়ে রইল, এখন ছেলেটাকে দুটি কিছু মুখে দিতে দাও তো বাপু, সেই কোন সকালে বের হয়েছে বাড়ি থেকে।" আদর মিশিয়ে কথাগুলো বলল হেমলতা।
সত্যিই তো সেই কোন সকালে খেয়েছে সে, নাকে লুচির গন্ধ আসা মাত্র চাগিয়ে উঠল খিদেটা। হেমলতারা হাত থেকে প্লেটটা টেনে নিল অশেষ।
-- সত্যি সত্যি পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে স্যার।
-- খিদেটা কিন্তু তখনও তোমার এমনটাই ছিল অশেষ।
স্যারের কথায় লজ্জা পেয়ে গেল অশেষ। মুখের লুচিটাকে শেষ না করে সে বলল--
-- খুব মনে আছে স্যার ক্লাসে কতবার আপনি আমার মোটা পেটটা টিপে ধরে বলতেন "এটাকে ভবিষ্যতে ঠিকঠাক ভরাতে গেলে এখন যে বাবা বিদ্যে দিয়ে মগজ ভরতে হবে।"
কথাটা শেষ করতে পারল না অশেষ, হাসির দমকে বিষম খেল সে। তাড়াতাড়ি করে জল ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিল হেমলতা। মাথায় হাত বোলাতে লাগল পরম মমতায়।
-- আমি কিন্তু ঐ খিদের কথা বলি নি অশেষ, সে সময় তোমার জানার আগ্রহ আমাকে প্রতিদিন অবাক করে দিত।
-- এভাবে বলবেন না স্যার,আমি আর কতটা..
-- তুমি বরাবরই বড্ড বিনয়ী অশেষ। অবশ্য বিদ্যাই তো মানুষকে বিনয়ী করে।
-- আপনি কিন্তু আমার পেট টিপেছেন স্যার। একবার নয়, অনেক বার।
-- অনেক বার! হবে হয়তো। আমি তো শুধুই বকবক করে যাচ্ছি, তুমি খাও... তুমি খাও তোমার মাসিমা বরং আরও খান কতক-- না না স্যার আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিকই খাচ্ছি, আপনি বলুন না, বেশ লাগছে পুরানো কথাগুলো।
-- আসলে কি জানো,আমি বছর তিনেক চেষ্টাকরে যাচ্ছি, আমার খুব ইচ্ছে মৃত্যুর আগে
তোমাদের মতো কয়েক জন মেধাবী..-- স্যার বারবার এই মে...ধা...বী...মেধাবী বলে 
কেন লজ্জা দিচ্ছেন!
-- অশেষ আমি বুঝতে পারছিলাম আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। তাই খুব করে চেয়েছিলাম বিভাস, তপেন্দু, অলকেশ.. তুমি তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে। একটা উপলক্ষ তো চাই। একটা ছুঁতো। পোষ্টকার্ড লিখলাম তোমাদের।চলে এসো শিক্ষক দিবসে।প্রথম বছর এলে তোমাকে চোখের দেখা দেখতে পেতাম অশেষ, তখনও আমি অল্পস্বল্প দেখতে পেতাম।
-- আমি তো চিঠি পাই নি স্যার।
-- সেটাই তো ভুল ছিল অশেষ, সেটাই তো ভুল। নিরঞ্জন, তুমি চিনবে না। আমাদের রতনপুরের নতুন শিক্ষক, সে বলল এখননাকি পোষ্টকার্ডে হয় না, -মেলে যোগাযোগ করতে হয়। রতন মাস্টারই সব বন্দোবস্ত করে দিল। তবুও ভালো যে তুমি এলে। এতো ব্যস্ততার মধ্যে। এতো সব কাজ কারবার ম্যানেজ করা।
-- কি যে বলেন স্যার, আপনি ডাকছেন আর 
-- এটাই ভালো যে তুমি মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছ।
-- সবই আপনাদের আশীর্বাদ স্যার।
-- তা তুমি দিল্লী থেকে কবে এলে?
-- দি.. ই..ল..ল!
-- আমি যেটুকু খবর পেয়েছিলাম তুমি তো এইমস-এ ছিলে।
-- এ.. এ..ই...ম...স!
অশেষ মুহুর্তে ধরে ফেলল কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। স্যার এক আর একান্নকে গুলিয়ে ফেলছেন। অশেষ একবার ভাবল স্যারের ভুলটা ধরিয়ে দেয়। তারপর তার মনে হল- কি লাভ মানুষটার স্বপ্নটাকে ভেঙে দিয়ে।
কিন্তু যদি ধরা পড়ে যায়! যদিও স্যার দেখতে পান না তবুও ম্যানেজ করাটা তো আর খুব সহজ নয়। অশেষ অদ্ভুৎ এক দোটানায় পড়েছে। হ্যাঁ ও না-এর ঘুর্নাবর্তে পাক খেতে খেতে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সত্যিটা বলে স্যারকে সে আঘাত দেবে না।
-- কি হল অশেষ একদম চুপ করে গেলে যে!
-- না মানে স্যার...
এর মধ্যে দুপুরের খাওয়ারের জন্য হেমলতার হাক-ডাক শুরু হতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল অশেষের। 
গল্প-গাছায় কিভাবে সময় চলে গেছে বুঝতে পারে নি কেউই। দিনের আলো ফুরিয়ে আসার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে অশেষকে। শ্যামলেন্দু অবশ্য স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার একটা বন্দোবস্ত করে রেখেছে আগে থেকেই।
ভ্যান চালক ছোকরা অস্থির হয়ে থেকে থেকে হর্ণ বাজচ্ছে। গৃহকর্তা, অাত্মীয়-পরিজনকে যেভাবে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, সেভাবে অশেষের সঙ্গে বাড়ির উঠোনে নেমে এসেছে শ্যামলেন্দু ও হেমলতা।
-- আবার সময় করে চলে এসো অশেষ।
-- সময় পেলেই আসবো স্যার। আর আজ- কের দিনটায় তো আসবই।
-- যদি ততদিন বেঁচে থাকি।
-- আমরা যতদিন আছি অমন কথা বলবেন না স্যার।
-- সত্যিই তো কত বড়ো ডাক্তার তুমি। আচ্ছা অশেষ তোমাদের সঙ্গে আর এক অশেষ ছিলো,একটু পেট মোটা রোল নং সম্ভবত একান্ন বা বাহান্ন... মনে আছে তোমার?
সামনে একটা বিপদের গন্ধ পেল অশেষ। স্যার কি তবে টের পেলেন। অশেষ স্থির করে নিল এ অবস্থায় খুব সাবধানে এগোতে হবে।
--খুব মনে আছে, একান্নই ছিলো স্যার।
-- তা জান কি ওর কিছু খবর? কি করছে?
-- সবটা জানি না স্যার,তবে শুনেছিলাম গোটা কতক বৃদ্ধাশ্রমে ঔষধ আর প্রয়োজনের জিনিস পত্তর সাপ্লাই দেয়। মানে প্রয়োজন অনুযায়ী ফোন করলে, ঐ হোম ডেলিভারি টাইপ।
-- বাহঃ বেশ নতুন ধরণের কাজ তো! বড়ো ডাক্তারের থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাছাড়া রাত-বিরাতে যাদের কেউ নেই তাদের পাশে দাঁড়ানোই তো সত্যি কারের মানবতা।অশেষের ইচ্ছে হচ্ছিল সে বলে-
"আশীর্বাদ করুন স্যার যেন সব সময় মানুষের সঙ্গে চলতে পারি।" নে মনে তাই চেয়ে শ্যামলেন্দুর পায়ে হাত রাখল অশেষ।
দৃষ্টিহীন শ্যামলেন্দুর চোখে ভেসে উঠল বছর পঁয়ত্রিশ আগের আগের একটা ছবি যে ছবিতে মুখ নিচু করে আছে একটা পেট মোটা ছেলে আর তাকে ভৎসনা করে যাচ্ছেন শ্যামলেন্দু--
"এই সোজা অঙ্কটা পারলে না! খাচ্ছ-দাচ্ছ আর শরীরটা বাড়ছে। বুদ্ধি-শুদ্ধি বাড়ছে কই! তোমার এই মোটা মাথাটা মানুষের তো দূরের কথা, নিজের কোন কাজে আসবে শুনি?"
আজ সেই মোটা মাথাটার জন্য গর্ব অনুভব করল শ্যামলেন্দু। যতক্ষণ অশেষের ভ্যানটা অদৃশ্য হয় ততক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল সে আর হেমলতা।
হেমলতা বলল- -- এবার চলো অন্ধকার নামবে।
-- না হেমলতা অন্ধকার থেকে আজ আমি সত্যি সত্যি আলোর সন্ধান পেয়েছি। আমার শিক্ষকতা জীবন ব্যর্থ লতা। পুরোপুরি ব্যর্থ। আমি শুধু মেধার পেছনে ছুটেছি। তাদের রত্ন ভেবে অবহেলা করেছি আসল রত্নদের।
-- কি ভুল ভাল বলছ তুমি!
-- ভুল নয় লতা। এটাই সত্যি। নিরঞ্জন অশেষ নামে দু'টো ই-মেল আইডি পায়বোঝা যাচ্ছিল না কোনটা আমার প্রিয় অশেষ। তাই শেষ পর্যন্ত দু'টো তেই মেল করা হয়।এই অশেষ এক নম্বর অশেষ নয় লতা। এ অশেষ সামন্ত,রোল নং একান্ন।এক নম্বর অশেষরা এক্কেবারে দু-নম্বরী আগা-গোড়া কেরিয়ারিস্ট।

শিকল

 

এটা নিয়ে বার পাঁচেক হল। শেষবার পেচ্ছাবের জায়গাটা ঠিক মত না ধরতে পারায় পিচকিরির মতো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল খানিকটা। হাবুল তো আর শৈশবে আটকে নেই। এই বয়সের পেচ্ছাব পায়খানায় বেয়াড়া গন্ধ থাকে। যদিও জায়গাটাকে রোজদিন ফিনাইল দিয়ে সাফসুতরো করে দেয় গনেশ মাল। প্রতিদিন মোটামুটি বেলা বারটা নাগাদ মদের নেশায় টলতে টলতে হাবুলদের বাড়ি ঢোকে গনেশ মাল। তারপর স্নান করায় হাবুলকে, মেঝে পরিষ্কার করে দেয়। না এসবের জন্য কোনো টাকা পয়সা নেয় না গনেশ। নেবে কোন হাতে!
রাতুলের সুপারিশে পৌরসভায় মেথরের কাজ পেয়েছে গনেশ। কাজটায় মান নেই বটে তবে মাইনে মন্দ নয়। তাছাড়া শিক্ষাদীক্ষা তো এমন কিছুই নয়, এইট পাশ। চাকরি-বাকরির এই আকালে ঐ যোগ্যতায় আর কি কাজ পেতে পারে গনেশ। গ্রীলের ফাঁক থেকে যতদূর চোখ যায় ততটা পর্যন্ত দেখে নিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটাকে দেখে হাবুল। একটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। আজ স্নান-খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে হেব্বি। 
ছেলেবেলা থেকে মৃগীরোগী হাবুল। লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারে নি সে। তার উপর মাথার ব্যারাম। লোকে বলে ও নাকি কাম-পাগল। তা সব জেনে শুনে কোন বাড়ির মেয়েকে বিয়ে দেবে! শুরুতে রাতুলই দেখত হাবুলকে।  এখন আর পারে না।পার্টি চাপ বাড়ছে। বাড়ছে দায়িত্ব।
একটা হোমে-টোমে ব্যবস্থা করা যেত কিন্তু রাজনীতি তো আজ আর সে জায়গায় নেই। মাঠে ময়দানে পারিবারিক কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হতে সময় লাগবে না। তাই একমাত্র ভাইকে আর হোম-টোম করে নি রাতুল।
তাছাড়া নিজের কাছে রেখে এতো সবের মধ্যে যে দায়িত্বটা নিয়েছে তার পাবলিক সিমপ্যাথি তো একটা বাড়তি এডভান্টেজ। 
দু-হাত ভরা নানা রকমের রাখি। ফুলের-সুতোর-পুঁতির। অনেক কিছুর মধ্যও রবিঠাকুরকে এই একটা বিষয়ে ভোলা যায় না। আজকের এই অস্থিরতায় হিন্দু-মুসলমানকে রাখি পরাচ্ছে, ধনী-নির্ধনকে, উচুঁজাত-ইতরকে। ভাবা যায় না এমন একটা কনসেপ্ট! পার্টির উপর তলার নির্দেশ মতে বছর চার এই দিনটায় রাতুলরা রাখি উৎসব করে। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে রাখি-লাড্ডু। বিশ্বভাতৃত্ব বলে কথা। বাড়ি ঢোকা মাত্র পেচ্ছাবের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এল রাতুলের। হাতের রজনীগন্ধা-রাখির সুবাস ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পেচ্ছাবের কটু গন্ধ। পকেট থেকে রুমাল রের করে নাকে চেপে ধরল রাতুল।
সে চোখ মুখ কুঁচকে দেখল হাবুলের দিকে। তারপর রুমাল চাপা নাকি গলায় বিরক্ত নিয়ে বলল "শ্লা গনেশটা..."
হাবুল হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল রাতুলের হাতের দিকে। দু-হাত ভরা নানা রকমের রাখি। আজ কত রকমের রঙে রঙীন হয়ে সেজেছে তার দাদার হাত দু'টি। হীরার দ্যুতি ছড়াচ্ছে রাতুলের দু-হাত থেকে। হাবুলের হাতের ঘা টা কয়েক দিন হল বেড়েছে। থেকে থেকে লোহার শিকলটা বারবার ঘষা দিচ্ছে ঘা টায়। বছর তিনেক হল এই শিকলে আটকে আছে হাবুল।গনেশ মাল রোজ দিন একবার করে শিকল খুলে স্নান করায়,খাওয়ায়, পরিচ্ছন্ন করে হাবুলকে তারপর আবার পরিয়ে দেয় শিকল। হাবুল মনে মনে ভাবল, গনেশ মাল আজ আর আসবে না বোধহয়। আজ আর এই লৌহ বন্ধন মুক্ত হবে না। বেশ তো, আজ রাখি উৎসব তো। হোক না শিকল। দাদার দেওয়াই তো।

সূর্যস্নাত আন্দালুসিয়া

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভ্রমণ

Sharmistha-Bhattacharya.jpg

সূর্যস্নাত

আন্দালুসিয়া

শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য

নেদারল্যান্ড

উরোপের বড় দেশগুলোর মধ্যে স্পেনের নাম প্রথমের দিকেই আসবে। ফুটবল ছাড়াও আরও একটা বিষয় যা সবার প্রথমেই মনে আসে এই দেশ সম্বন্ধে তা হল স্পেনের জলবায়ু। নাতিশীতোষ্ণ ইউরোপের আবহাওয়াতে ব্যতিক্রমী জায়গা হল স্পেনের দক্ষিণ ভাগ যেইটি “আন্দালুসিয়া” নামেই বেশি পরিচিত।এ ই অঞ্চলটি স্পেনের অত্যন্ত জনপ্রিয় টুরিস্ট গন্তব্যস্থল কারণ এখানে বছরের সব ঋতুতেই সূর্যের অপূর্ব স্নিগ্ধ কিরণে উজ্জ্বল আর মনোরম থাকে। আন্দালুসিয়ার প্রদেশের দক্ষিণ ভাগ জুড়ে বাম দিকে আছে আটলান্টিক মহাসাগর আর ডান দিক রয়েছে ভূমধ্য সাগর। তাই ব্যবসাহিক দিক দিয়ে দেখলে সমুদ্র-বক্ষ জুড়ে গড়ে ওঠা বন্দর শহর গুলো বিশেষত আকর্ষণীয়। আরও একটা কারনে দক্ষিণ স্পেন খুবই জনপ্রিয় সেটি হল মুখরোচক স্প্যানিশ খাবার, অগুন্তি সি- ফুড আর নানারকম স্বাদের বৈচিত্র্যময় পানীয়র সম্ভার। এই সবের আকর্ষণেই সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষজন আসে এখানকার সমুদ্র সৈকতের অনাবিল আনন্দ নিতে।

আন্দালুসিয়া স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্য সবচেয়ে জনবহুল এবং বৃহত্তম। আটটি শহর মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এই আন্দালুসিয়া প্রদেশটি। আর সবচেয়ে জনপ্রিয় শহরগুলি হল - আলমেরিয়া, কাদিজ, করডোবা, গ্রানাডা, মালাগা এবং সেভিয়া। ভৌগোলিক দিক দিয়ে দেখলে এই অঞ্চলটি ভূমধ্যসাগরীয় সীমারেখার অন্তর্গত- যার উত্তরের দিকে আছে প্রশস্ত সিয়ারা মরেনা এবং বেটিকা পর্বতমালা, আর দক্ষিণ অংশে আছে দিগন্ত বিস্তৃত ভূমধ্য সাগরের অগাধ জলরাশির প্রাচীর। যদি আরও একটু দক্ষিণের দিকে যাওয়া যায় পৌঁছে যাওয়া যাবে জিব্রাল্টার প্রণালীতে যা স্পেন এবং মরক্কোকে পৃথক করেছে। কথিত আছে যে আদিম মনুষ্য সভ্যতার সূচনা হয় আফ্রিকায়। কালক্রমে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে এই আফ্রিকান মানুষ জনেরা এসে পৌঁছায় আন্দালুসিয়া অঞ্চলে এবং ক্রমশই তারা ছড়িয়ে পরে সারা ইউরোপের বুকে। ইতিহাস বলছে যে আন্দালুসিয়া অঞ্চলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সারা পৃথিবীর ধনাকাঙ্ক্ষী শাসকগোষ্ঠী, নাবিকদল এবং ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন যুগে বারবার আকর্ষণ করেছে। তাই এই অঞ্চলটি কখনো গ্রী ক, কখনো রোমান, আবার কখনো ইবেরিয়ান আর আরবিক শাসকদের ক্ষমতা ভুক্ত ছিল।

গ্যালারী - ১

আমাদের এই যাত্রায় প্রথমে এসে পৌঁছলাম দক্ষিণ স্পেনের মালাগা শহরে। একেবারে মালাগার সিটি সেন্টারে হোটেল না নিয়ে আমরা চলে আসলাম প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে টরেমলিনস নামের একটা ছোট ভিলেজে যেটি একেবারে মেডেটেরেনিয়ান সাগরের সৈকতবক্ষ জুড়ে গড়ে উঠেছে। আর বীচের সীমানা ধরে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর অনুচ্চ খনিজ সমৃদ্ধ পাহাড়ের সারি, কালচে-সোনালি বালুকাকণায় ঘেরা সমুদ্র সৈকত, ঘন আসমানি নীল সমুদ্রের জলে মিশে যাওয়া দুধসাদা তরঙ্গের ফেনারাশি, আর খেজুর গাছের ঝাড়। তাছাড়াও গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো রকমারি দোকানের স্টল, রেস্টুরেন্ট, হোটেল আর গেস্ট হাউস। সমুদ্র উপকূলের কিনারা ধরে টুরিস্টদের জন্য শায়িত রয়েছে আরাম কেদারা, যেখানে মানুষজন বসে বা শুয়ে ঠাণ্ডা পানীয়র গ্লাস হাতে ধরে সূর্যস্নান উপভোগ করতে পারবে রৌদ্রভেজা নীল সমুদ্রের দৃশ্য চোখে মেখে। সমুদ্রের তটে বসে কিছু চারুপ্রেমী মানুষজন আপনমনে রূপ দিয়ে চলেছে তাদের শিল্পকলা। কেউ করছে চিত্রকলা, কেউ বা সঙ্গীত, আবার কিছু মানুষ বালুকারাশি জড়ো করে সৃষ্টি করে চলেছে বালি-ভাস্কর্য। আর এই অপূর্ব প্রকৃতির আনন্দ পুরোমাত্রায় উজাড় করে নিতে বাচ্চা-জোয়ান-বুড়ো সবাই সমুদ্রের তরঙ্গে করে চলেছে জলকেলি, কিছু মানুষ বালির উপর শুয়ে মিষ্টি রোদে শরীর ভিজিয়ে করে চলেছে রৌদ্র-স্নান, আবার কিছুজন সমুদ্রের বেলাভূমি ধরে হেঁটে চলেছে অগাধ জলরাশি আর ঢেউ এর মজা নিতে নিতে। এছাড়াও এই সমুদ্র সৈকতে ব্যবস্থা আছে সি-সারফিং, প্যারাগ্লাইডিঙ, নৌকাভ্রমণ, অথবা অন্যকিছু জলক্রিয়ার।  

গ্যালারী - ২

সারাদিন সমুদ্র-বিলাসের পরে পেট পূজা করা যেতে পারে সি-সাইড রেস্টুরেন্ট গুলোতে। এখানকার “টাপাস” একটি চমৎকার ঐতিহ্যশালী স্প্যানিশ খাবার যাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার ছোট মাপে পরিবেশন করা হয়। এইটি প্রধানত স্ন্যাক্স হিসেবে খাওয়ার প্রচলন বেশি, তবে লাঞ্চ বা ডিনারেও এপেটাইজার হিসেবে চলতে পারে। সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে হালকা অ্যালকোহলের মিশ্রণের তৈরি ককটেল, মজিতা অথবা লোকাল স্প্যানিশ পানীয় সাংগ্রিয়া। আরও একটি অতি পরিচিত খাবার হল “টরটিলা এস্পানলা” যা প্রধানত ডিম দিয়ে তৈরি করা হয় আর পুর হিসাবে সাথে থাকে আলু, সবজি, পালং শাক অথবা মাংসের কিমার মিশ্রণ। দক্ষিণ স্পেনের আরও একটি বিশেষত্ব হোল রকমারি সি-ফুড। গলদা চিংড়ি, কুঁচো চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, স্কুইড, অক্টোপাস, স্যামন, সারিন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয় মাছভাজার ডিশ। মালাগা তথা আন্দালুসিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় বীচ-সাইড খাবার হল “এসপ্যাটোস”। সাধারণত সারিন জাতীয় মাছ কাঠ কয়লার আগুনে সেঁকে এইটি বানানো হয়। তাই এই ডিশটি যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর এবং অপেক্ষাকৃত সস্তা। আর সবচেয়ে জনপ্রিয় “মেন কোর্স” খাবার হোল “পাইয়া”। এইটি ভাতের সাথে সি-ফুড আর মাংস মিলিয়ে বানানো হয়। খেতেও বেশ ভালো। তবে আলাদা ধরণের মশলার ব্যবহারের জন্যে আমাদের আটপৌরে বাঙালিদের রসনার স্বাদের সাথে নাও মিলতে পারে। শেষ পাতে মিষ্টি মুখ করা যেতে পারে চকলেট ভেজানো চুরুস নামের ডেসার্ট দিয়ে।

মালাগা সমুদ্র বন্দরটি স্পেনের অন্যতম আন্তর্জাতিক পোর্ট। এইটি প্রায় ১০০০ বছরের পুরানো সমুদ্র-বন্দর। উনিবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বন্দরটি স্পেনের ব্যবসা বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো এবং বিদেশের সাথে আন্দালুসিয়ার যোগাযোগের প্রবেশদ্বার ছিল। বর্তমান যুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আরও কয়েকটি বন্দর স্থাপিত হওয়াতে এই বন্দরটি কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে।  মালাগা শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা হোল ক্যাসেল জিব্রাল-ফারো।

spain28.JPG

গ্যালারী - ৩

এই স্থানটি থেকে পুরো মালাগা শহর, মালাগা পোর্ট, মেডেটেরেনিয়ান সি এর দৃশ্য খুবই উপভোগ্য। এখান থেকে আরও দেখা যায় বিখ্যাত আলকাজাবা দুর্গের কিছুটা অংশ যেইটি আরবিক, মুরিশ এবং রোমান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ এর নিদর্শন আজও বহন করে চলেছে।

মালাগা শহরের বৈশিষ্ট হল যে এইটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মের শাসকগোষ্ঠীর অধীনে ছিল। তাই এখানকার সভ্যতায় আর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ইসলাম, ইহুদি, আর খ্রিষ্টান ধর্মের সুদৃঢ় প্রভাব রয়েছে। এর অন্যতম নিদর্শন হল এই শহরের ক্যাথিড্রালটি। এই গির্জাটির কাঠামো ও গড়নে  খ্রিষ্টান এবং ইসলামী কারুকর্মের প্রভাব রয়েছে। এইটি একটি রোমান ক্যাথলিক গির্জা, তৈরি হয়েছিল ১৫২৮-১৭৮২ শতাব্দী সময়ের মধ্যে। এই চার্চটি রোমান ও গ্রীক সভ্যতার ভাবনা আর আদর্শের প্রতীক চিহ্ন বহন করছে।

পুরোদিন মালাগা শহর ঘোরার পরে রাতের ডিনার সেরে আমরা দেখতে গেলাম আন্দালুসিয়ার ঐতিহ্যশালী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় “ফ্ল্যামেঙ্ক” শো। এইটি দুই ঘণ্টার একটি প্রদর্শনী এবং টিকিটের অগ্রিম বুকিং না করা থাকলে হতাশ হতে হবে। ফ্ল্যামেঙ্ক শো’তে মূলত চারটি উপাদান- কণ্ঠ সঙ্গীত, অনুপম নৃত্যকলা যাতে পায়ের পাতার এবং হাতের আগুলের অভিনব ব্যবহার করা হয়, সাথে থাকে গিটার এর সুর, এবং তার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে হর্ষধ্বনি আর হাততালি। নৃত্য শিল্পীরা শক্ত কাঠের স্টেজে বিশেষ ধরণের তৈরি কাঠের জুতো পরে নাচ করে থাকে। তাই তাদের অভিনব নাচের ঝংকারে এবং তার সাথে অনুভূতিময় গিটার আর কণ্ঠশিল্পীর উদার, খোলা গানের ধ্বনি মনের অন্তঃকরণে শিহরণ জাগিয়ে তুলবেই। এই ফ্ল্যামেঙ্ক শো’তে শিল্পীরা তাদের মনের অনুভূতি এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা খুবই সাবলীল ভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়ে পারে, তার জন্য স্প্যানিশ ভাষা জানার কোন প্রয়োজনই নেই। ফ্ল্যামেঙ্ক আন্দালুসিয়া সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই এই অসাধারণ প্রদর্শনী স্বচোখে দেখার সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

পরেরদিন আমরা চললাম গ্রানাডা শহর দেখতে। এই শহরের লোকপ্রিয়তার প্রধান কারণ হল আলহাম্বরা দুর্গ  এবং নাসরিদ প্রাসাদতলীর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের সৌন্দর্যের জন্য। প্রাসাদটি মূলত ইসলামিক সংস্কৃতির এবং ঐতিহ্যের স্মারক।  ১৩শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মরিশ শাসকরা এটি নির্মাণ করে, যা গ্রানাডার শহরের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের আসসাবিকা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। আলহাম্বরা প্রাসাদটি নাসরিদ রাজবংশের শাসনকালে তৈরি করা হয়েছিল, যেইটি রাজ-বাসস্থান এবং রাজসভা হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। এই রাজপ্রাসাদের আভ্যন্তরীণ দেওয়ালের এবং ভিতরের ছাদের স্থাপত্যের চোখ-জুড়ানো ইসলামী শিল্পের কারুকার্য সত্যিই অপূর্ব সুন্দর। পরবর্তী কালে ১৬শ শতাব্দীতে এই স্থানটি রোমান শাসনের অধীনে আসে এবং খ্রিষ্টান ভাবধারাতেও প্রভাবিত হয়।  তাই এখানে ঐ সময় গির্জা, খ্রিষ্টীয় ভাবনায় অনুপ্রাণিত ম্যানসন এবং সুসজ্জিত বাগান তৈরি করা হয়, যেইগুলো অদ্যাবধি যত্নের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো আলহাম্বরাকে এবং গ্রানাডার জেনেরালাইফকে “মানবতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করেন।

গ্যালারী - ৪

আলহাম্বরা দেখে আমরা চললাম সিয়ারা নাভেদা পর্বত মালা দেখতে। গ্রানাডা থেকে এই স্থানটি মোটামুটি ৫০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই অবস্থিত। গ্রানাডার রোদুজ্জল মনোরম উষ্ণতা থেকে কিছুক্ষণের যাত্রাতেই আমরা পৌঁছিয়ে গেলাম তুষারাবৃত সিয়ারা নাভেদার পর্বততলীর চত্বরে। এখানে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম উৎসাহী স্কি-প্রেমী মানুষজনকে। এতো অল্প দূরত্বের মধ্যেই আন্দালুসিয়ার জলবায়ুর এতো বৈপরীত্য বেশ চোখে পরার মতো - এক স্থানে সমুদ্রের মনোরম নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আবার অন্যদিকে বরফের শীতল হাওয়ার ছোঁয়া।

চতুর্থ দিন আমরা মিজাস নামের একটি “হোয়াট ভিলেজ” ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। দক্ষিণ স্পেনে অনেকগুলো এইরকম বসতি আছে যেখানে শুধুমাত্র সাদা বাড়ি। স্প্যানিশ ভাষায় এই অঞ্চল গুলোকে বলা হয় “পিউব্লস ব্লাঙ্কস”। মিজাসে পৌঁছিয়ে চারদিকে পাহাড় ঘেরা শ্বেতশুভ্র ভিলেজটি দেখে মন প্রশান্তিতে ভরে গেলো। এখানের উঁচু পাহাড়ি জায়গা থেকে দেখা যায় মেডেটেরেনিয়ান উপকূলের সীমারেখা, দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের নীল জলরাশি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ের রাস্তা আর টুকরো টুকরো গ্রামীণ বসতি। আরও একটা বিষয় বেশ লক্ষণীয় ছিল তা হোল টুরিস্টদের সংখ্যা। এই সাদা গ্রাম যে এতো জনপ্রিয় দ্রষ্টব্য স্থান সেটা আগে উপলব্ধি করি নি। এখানে স্থানীয় যান হোল গাধায় টানা কার্ট, অন্য গাড়ির ব্যবহার যথেষ্ট সীমিত রাখা হয়েছে যাতে পরিবেশ দূষণ কম হয়।

আন্দালুসিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যুভিনিওর হোল স্প্যানিশ পটারি। পোড়া মাটি অথবা সেরেমিকের উপর নানা রঙের ডিজাইন বানিয়ে রূপ দেওয়া হয় এই মৃন্ময় আর সেরেমিক শিল্পকে। নিজের সংগ্রহের জন্য অবশ্যই কেনা যেতে পারে স্পেনের শিল্পীদের তৈরি কিছু বাসনপত্র আর ঘর সাজানোর জিনিস।

আমাদের এই যাত্রার শেষদিনে আমরা প্রথমে গেলাম রণ্ডা নামের খুবই প্রসিদ্ধ জায়গাটি দেখতে। মালাগা থেকে বেশ কিছুটা রাস্তা পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে গিয়ে আমরা পৌঁছলাম রণ্ডাতে। এই স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতে মন মুগ্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ের উপরে গড়ে উঠেছে এই বসতিটি। চারদিকে সাদা বাড়ি, ক্যাথোলিক চার্চ, পাহাড়ি ঝর্ণা, ঘন সবুজ উপত্যকা, বুল ফাইটিং অ্যারেনা, রকমারি স্প্যানিশ পটারি দিয়ে সাজানো স্যুভিনিওর শপ – সব মিলিয়ে এক নজরে ভালো লেগে যাবে এই সুন্দর ছিমছাম জায়গাটি।

বার্লিন শহরের ইতিকথা

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভ্রমণ

Sharmistha-Bhattacharya.jpg

বার্লিন শহরের

ইতিকথা

শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য

নেদারল্যান্ড

barlin3.JPG

উরোপের পদার্পণের পরেই যেই বড় শহরগুলো সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার তালিকায় বার্লিন শহরের নাম প্রথমের দিকেই থাকবে। এই শহর জার্মানির রাজধানী হিসেবে যতো না প্রসিদ্ধ তার থেকেও বেশি জনপ্রিয় এই শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক অবদানের জন্যে। জনসংখ্যা গণনার হিসাবে বার্লিন শহর হোল জার্মানির বৃহত্তম এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ানের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর (লন্ডন এই মুহূর্তে রয়েছে তালিকার শীর্ষস্থানে)। ভৌগোলিক দিক থেকে বার্লিন শহর জার্মানির উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ব্র্যান্ডেনবুর্গ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এই শহরের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে স্প্রী আর হাভেল নদী। ইউরোপের সবুজ-সুন্দর মনোরঞ্জক শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম হল এই বার্লিন শহর, যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে মনোরম প্রকৃতি, আছে সুজলা সুফলা বনানী, পার্ক, অগুন্তি হ্রদ, নদী ও ক্যানাল। এই শহর ইউরোপের অতি জনপ্রিয় মহানগর এবং অন্যতম বৃহত্তম সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্রভূমি।  তাছাড়াও এই বার্লিন শহর তার অত্যন্ত উন্নত সাংস্কৃতিক জীবন, উদার লাইফ স্টাইল এবং আধুনিক ভাবধারার জন্যে সাধারণ মানুষজনের কাছে খুবই পছন্দের বাসস্থান।

বার্লিন শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হল ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেট (Brandenburger Tor)। এই বিশালাকার প্রবেশদ্বারটি ইউরোপের ঐতিহ্যপূর্ণ  মহান ইতিহাসের শরীক এবং শান্তি আর একতার প্রতীক। ১৭৯১ সালে এই সনাতনী স্মারকটি তৈরি হয়েছিল প্রুসিয়ান সম্রাট ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ২ এর নির্দেশে। জার্মানির ইতিহাসে ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেট নানা সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। যখন বার্লিন নেপোলিয়ান বোনাপার্টির  আধিপত্যে ছিল, তখন এই স্মারকটি তাদের বিজয় স্তম্ভ হিসাবে ব্যবহিত হতো। পরবর্তীকালে এইটি প্রুসিয়ান বিজয় স্মারক নামে পরিচিত ছিল এবং নতুনভাবে ডিজাইন করা হয়। এই গেটের প্রবেশদ্বারে সজ্জিত রয়েছে প্রুসিয়ান দেবী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি এবং প্রুসিয়ান পরীর স্ট্যাচু। জার্মানি যখন নাৎসি সরকারের  অধিকারভুক্ত ছিল, তখন এই গেটটি নাৎসি দলের স্মারক হিসাবেও ব্যবহিত হতো।

গ্যালারী - ১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪১-৪৫) সময় ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটটির বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় বুলেটের আঘাতে। ঐ সময়েও সাধারণ মানুষজনের এই গেটটি ব্যবহারের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে বার্লিন দেওয়াল তৈরি হওয়ার পরে (১৯৬১) এই গেটটি বন্ধ করে দেওয়া হয় যতদিন না আবার বার্লিন প্রাচীর ভস্মীভূত হয় (১৯৮৯)। প্রতি বছর অসংখ্য টুরিস্ট আসে এই ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটটি দেখতে এবং এর রোমাঞ্চকর ইতিহাসের সাক্ষী হতে। আরও একটি মনুমেন্ট টুরিস্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তার নাম হোল বার্লিন বিজয় স্তম্ভ (victory column)। এই ২২০ ফুট উঁচু স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করা হয়েছিল ১৮৭৩ সালে প্রুসিয়ান শাসকদের বিজয়কে স্মরণ করে। এই ভিক্টরি স্ট্যাচুর মাথায়ও আছে দেবী ভিক্টোরিয়ার অপূর্ব সুন্দর ব্রোঞ্জ মূর্তি। 

ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটের খুব কাছেই রয়েছে রাইখস্টাগ (Reichstag) বিল্ডিং। এই মহাকায় প্রাসাদটি 1894 সালে খোলা হয়। এইটি প্রধানত জার্মানির পার্লামেন্ট হাউস হিসাবেই ব্যবহিত হতো এবং জনসাধারণের জন্য উৎসর্গিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এই বিল্ডিংটিতে আগুণ লাগে এবং এইটি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অনেক বছর পর্যন্ত এই ভবনটির ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়।

1990 সালে জার্মান রাজ্য পুনর্গঠনের পরে এই বিল্ডিংটির পুনর্নির্মাণ করা হয়। 1999 সালে পুনর্নির্মাণ সমাপ্তির পরে এইটি আবার জার্মান সংসদের সভাস্থল হিসাবে ব্যবহিত হচ্ছে। এই ভবনটির আধুনিক নাম হল বুন্দেস্তাগ (Bundestag)। এই বিল্ডিংটির ছাদে (ডোমের কাছে) উঠতে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। তবে একবার উপরে উঠতে পারলে এখান থেকে পুরো বার্লিন শহরের দৃশ্য খুবই মনোরম।

ইউরোপের অনেক শহরের তুলনায় বার্লিন অপেক্ষাকৃত নতুন তৈরি মহানগর। তবুও এই শহরের বুকে লুকিয়ে আছে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য, বহু যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের গল্প আর অনেক মর্মস্পর্শী আশা-হতাশার স্মৃতিকথা। এই শহরের প্রথম ইতিহাস পাওয়া যায় ১৩ শ শতাব্দীতে। কোলন আর বার্লিন এই দুই শহরতলী মিলিয়ে গঠিত হয়েছিল সেই সময়ের বৃহত্তর বার্লিন শহর। উনিবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বার্লিন ছিল প্রথমে প্রুসিয়ান আর পরে জার্মান সাম্রাজ্যের অধীনে। মাঝেমধ্যেই ঘটেছে ফরাসী সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাত, নিজেদের অস্তিত্ব আর আধিপত্য বজায় রাখার লড়াই। ১৯শ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লব বার্লিন শহরের ভাগ্যলিপি একেবারেই বদলে দিয়েছিলো। এই শহর হয়ে উঠলো জার্মানির প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র, আর ইউরোপের প্রবেশদ্বার। তৈরি হল রেলওয়ের স্টেশন, বসলো টেলিফোনের যোগাযোগের কেন্দ্র, গড়ে উঠলো প্রচুর জনবসতি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর থেকেই বার্লিনে শুরু হয়েছিল শিল্পকলা, চিত্রকলা, স্থাপত্য, সিনেমার প্রতুল চর্চা। তবে নাৎসি সরকারের আধিপত্য (1933-1945) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দীর সময়কাল পর্যন্ত ছিল বার্লিনের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপেক্ষাকৃত বিষাদাচ্ছন্ন সময়।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বলিদান দিয়েছে অনেক স্থানীয় নাগরিক এবং বহু দেশ-বিদেশের সেনাবাহিনী। তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বার্লিনের রাস্তার ধারে তৈরি করা আছে স্মৃতিস্তম্ভ।

গ্যালারী - ২

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বার্লিন শহর চার ভাগে বিভক্ত ছিল- পশ্চিমদিকের অংশ ছিল ফরাসী সেনার অধীনে, কিছু অংশ ছিল ব্রিটিশ সেনার দখলে, আবার কিছুটা ছিল আমেরিকার সেনার আধিপত্যে। আর পূর্বদিকের অধিকাংশ ভাগ জুড়ে ছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনীর শাসনাধীনে। ঐ সময় পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি দুটো সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হতো। তৈরি

গ্যালারী - ৩

হয়েছিল বার্লিনের সেই মজবুদ কংক্রিটের দেওয়াল। আর ছিল বহু চেক পয়েন্ট যেখানে চলতো দিবারাত্রি সশস্ত্র   যৌথ সেনাগোষ্ঠীর পাহারা। এই রকমই একটি স্থান হল “চেক পয়েন্ট  চার্লি”। এই ভয়াবহ রাজনীতির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের খেলার বলি হয়েছিল নিরুপায় সাধারণ জনগণ। অসংখ্য মানুষ হয়েছিল স্বজনহারা, হারিয়ে ছিল তাদের ঘরবাড়ি, সারাজীবনের সঞ্চিত পুঁজি বিষয়সম্পত্তি, আর পরিবার পরিজনকে। চেক পয়েন্ট  চার্লির পাশে এখন একটি মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে নাৎসি সময়, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী কোল্ড-ওয়ারের সময়ের অনেক ছবি ও ভিডিও গল্পের আকারে বর্ণনা দেওয়া আছে। সেই বেদনাদায়ক মর্মস্পর্শী গল্প শুনলে চোখের জল ধরে রাখা ভার হবে। বার্লিনের রাস্তায় পথ চলতে চলতে বারবার মনে আসছিলো আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাসের কথা, পূর্ব আর পশ্চিম বাংলার বিচ্ছেদের কাহিনী। এই শহরের ইতিহাসের সাথে আমাদের বাংলার ইতিহাসের একটা গভীর মিল খুঁজে পেলাম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা আর বিরোধিতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আওতায় পূর্ব জার্মানি, আর ব্রিটিশ-আমেরিকা-ফরাসি মিত্রবাহিনীর ছত্রছায়ায় ডেমোক্রেটিক পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব এবং অর্থনৈতিক অসামাঞ্জস্য  বাড়তেই থাকে। তারই প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে যখন এক দিনের নোটিশে রাতারাতি তৈরি হয়ে যায়  পূর্ব-পশ্চিম জার্মানির সীমানা জুড়ে প্রশস্ত বার্লিন প্রাচীর। দীর্ঘ 28 বছর এই প্রাচীরই দূরে ঠেলে রেখেছিল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির বাসিন্দাদের। কালক্রমে ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ানের পতনের সূত্রপাত শুরু হওয়া এবং উদারবাদী রাজনৈতিক মতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা জার্মান নাগরিকদের স্বপ্ন দেখায় আর উদ্বুদ্ধ করে এই প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে এক অবিভক্ত জার্মানির জন্ম দিতে (১৯৮৯, নভেম্বর)। শোনা যায় যে ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সালের সময়সীমার মধ্যে অন্তত ৫০০০ মানুষ এই বার্লিন প্রাচীর অতিক্রম করে অন্যপ্রান্তে যেতে চেষ্টা করতে গিয়ে পাহারারত রক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। এই সব ঘটনা জার্মানির জনসাধারণের মধ্যে আক্রোশ এবং দেশের প্রতি অনুভূতি আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ পায় যখন বিভক্ত দুই জার্মানির আমজনতা মিলে এক সাথে একত্রিত হয়ে এই প্রাচীর ধূলিসাৎ করে দেয়।  ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি সরকারী ভাবে বিশ্বের দরবারে এক এবং অখণ্ড দেশের সন্মানে পুনরায় সমাদৃত হয়।

পরবর্তী কালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলন এবং শৃঙ্খল মুক্তির ইতিহাস জার্মান শিল্পীরা তাদের বিভিন্ন শিল্পকলা ও স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এই রকমই একটি স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় পশ্চিম বার্লিনের এক বিখ্যাত জনবহুল রাস্তায়। স্টিলের তৈরি এই কাঠামোটি বানানো হয় ১৯৮৭ সালে যেটির নাম “ব্রকেন চেন”। এই স্থাপত্যটির মাধ্যমে জার্মান ইতিহাসের সেই হতাশাময় সময়ের, দুই জার্মানির বিচ্ছিন্নতা এবং বন্ধনমুক্তির কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। 

বার্লিনের অত্যন্ত পরিচিত এলাকা হোল পটসডামার প্লাজ (Potsdamer Platz)। এইখানেই তৈরি হয় জার্মানির সর্বপ্রথম রেলওয়ে স্টেশন (1835)। বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসের পরে এই অঞ্চলটির উন্নয়ন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে হয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছে বহুতল অট্টালিকা, অফিস বিল্ডিং, নানারকম সাংস্কৃতিক এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান। গত দুই-তিন দশকে বার্লিন বিশ্বের দরবারে ক্রমশই অন্যরূপে ধরা দিচ্ছে। এই শহর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে বর্তমানে ইউরোপের প্রধান কেন্দ্রস্থল।

সারা বছর এই শহরের বুকে চলতে থাকে নানারকম উৎসব, মিউজিক ফেস্টিভাল, শিল্পকলার চর্চা, আধুনিক ও ক্যাসিকাল চিত্রকলা প্রদর্শনী, আন্তর্জাতিক ফিল্ম শো, প্যারেড- যা এই শহরকে প্রাণবন্ত করে রাখে। তাছাড়া জার্মানদের খোলামেলা জীবনযাপন এবং ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে স্বাগত জানানোর মনোভাব সারা পৃথিবীর মানুষকে আকর্ষণ করে বার্লিনের মাটিতে এসে জীবন কাটাতে। বার্লিন প্রকৃত অর্থেই সংস্কারমুক্ত এবং অসাম্প্রদায়িক শহর। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলনের পর থেকে প্রতি বছর এই শহরের মাটিতে “লাভ প্যারেড” আয়োজিত হতো। এই উৎসবের মাধ্যমে ভালোবাসার বার্তা সব মানুষের মধ্যে পৌঁছিয়ে দেওয়াই ছিল এই প্যারেডের উদ্দেশ্য। ২০১০ সালে দুর্ঘটনার কারনে এই উৎসব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও এই ফেস্টিভাল বর্তমানে আর পালন করা হয় না, তবুও অন্য অনেক উৎসবের আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে এই বার্লিনের আকাশ বাতাস। জার্মানদের মধ্যে উৎসব মানেই অ্যালকোহল ড্রিংকসের ফোয়ারা। এখানে মানুষদের প্রিয় হল বড় মাপের গেলাসে করে লিটার লিটার বিয়ার পান করা, সঙ্গে থাকা চাই সসেজ, চিজ-বল, আর রকমারি মাংসের স্ন্যাক্স। 

বার্লিন শহরের আরও একটি আকর্ষণ হল বার্লিন ক্যাথিড্রাল (১৪৫৪)। এই গির্জাটি প্রুসিয়ান স্টাইলে তৈরি করা হয়। তারপর বিভিন্ন সময়ে বার্লিনের সমসাময়িক শাসকদের রুচি আর নির্দেশ অনুসারে এই ক্যাথিড্রালটির বাহ্যিক স্থাপত্যের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে- যেমন কখনো গথিক স্টাইল, কখনো বারক, কখনো নিও-ক্যাসিকাল আবার কখনো নিও-রেনেসাঁস স্টাইল। এই গির্জাটির বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ স্থাপত্য অতি সুন্দর এবং পর্যটকদের চক্ষু তৃষ্ণা অবশ্যই তৃপ্ত করবে। 

এইসব ছাড়াও বার্লিন শহরের মাঝখানে টিরগারটেন অঞ্চলে আছে বিখ্যাত জিউলজিক্যাল গার্ডেন তথা বার্লিন জু। এই চিড়িয়াখানাটি হল জার্মানির প্রাচীনতম প্রাণীবিদ্যাগত বাগান এবং বহু প্রজাতির জীব জন্তুর জন্যে বিশ্বের বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এই চিড়িয়াখানায় বসবাস করে প্রায় 1,400 প্রজাতির পশু পাখী এবং সংখ্যায় তারা প্রায় ২0 হাজার। তাই ছোট বড় সবারই ভালো লাগবে এই বার্লিন জু ঘুরে দেখতে। এইটি ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিড়িয়াখানা।

আমি এই বার্লিন শহরে গিয়েছি তিনবার, আর প্রতিবারই নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছি এই শহরকে। এই শহরের রোমহর্ষক ইতিহাস, উত্থান পতনের আর আশা নিরাশার গল্প, সনাতনী ও আধুনিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন বারবার মুগ্ধ করেছে আমাকে। শহর ঘুরতে গিয়ে একটা বিষয় বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল বার্লিনের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের নগরতলির প্রগতির অসামাঞ্জস্য। বার্লিনের পশ্চিম প্রান্তের গ্ল্যামারস বহুতল অট্টালিকার পাশে পূর্ব বার্লিনের চাকচিক্য বিহীন সাধারণ জনবসতির বৈপরীত্য সবার আগে চোখে পরবে। তবে আস্তে আস্তে এই পার্থক্য যে কম হচ্ছে সেটা বলা বাহুল্য। গত শতাব্দীর অন্ধকারময় অতীতকে পিছনে রেখে নতুন উদ্যমে আর ভালবাসায় বুক বেঁধে প্রগতির দিকে এগিয়ে চলেছে এই আধুনিক বার্লিন শহর। জার্মান মানুষদের অগাধ আত্মবিশ্বাস আর অধ্যবসায় কানে শুধু একটাই গানের ধ্বনির রেশ বাজিয়ে তোলে, আর তা হল “আমরা করবো জয় একদিন”।

বিপাশা দূরে-অদূরে

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভ্রমণ

SaswatiBhattachrya.png

বিপাশা

দূরে-অদূরে

শাশ্বতী ভট্টাচার্য্য

ম্যাডিসন, উইসকন্সিন 

manali.jpg

লেখক পরিচিতিঃ- যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে CSIR এর Indian Institute of Chemical Biology তে গবেষণা করেন এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে Ph.D ডিগ্রী অর্জন করেন। আমেরিকার National Institute of Health এর অন্তর্বতী National Cancer Institute এ কিছুদিন পোস্টডকের কাজ করার পর এখন ইউনিভার্সিটি অফ উইস্কসিন ইন ম্যাডিসনে ডিপার্টমেন্টের অফ মেডিসিনের সায়ান্টিস্ট। স্বামী ও কন্যা সহ ওঁনার বাস উইস্কন্সিনের শহর ম্যাডিসনে। পেশায় বিজ্ঞানী শাশ্বতী বাংলা ভাষায় লিখতে ও পড়তে ভালোবাসেন।

পর্ব ১: আধুলি না নক্ষত্র 

মানালীর ইয়ুথ হোষ্টেলের দোতলার বারান্দায় এই নিয়ে টানা দুঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে নিতা। রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। বারান্দা থেকে নীচের দিকে তাকায়, দূরের সমতলভূমিতে সমস্ত আলো একটা একটা করে জ্বলে উঠেছে, কিন্তু সামনের দিকে সরাসরি পাহাড়ের কোলে পুঞ্জিভুত অন্ধকার জমে আছে। হঠাৎই ওর বড্ডো ক্লান্ত লাগে, শারীরিক খাটুনীই শুধু নয়, একটা গভীর মানসিক দুঃশ্চিন্তা আস্তে আস্তে ওর মনে ছেয়ে যাচ্ছে, অনুভব করে ওর পাশে দাঁড়ানো শ্রীমনের চেহারাতেও যেন একটা অসহায়তার চিহ্ন।

সারাটা দিন হইহই করে কাটিয়ে এসে বিকেলবেলায় যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে কে ভেবেছিল? ওরা তিনজন যখন ফিরে আসে, তখন বাইরে রোদ ঝলমল করছে, তাতেও ডঃ বিশ্বাসকে ব্যস্ত দেখাচ্ছিল, এখন তো গভীর রাত, ওঁনার মনের ভিতরে যে কি হচ্ছে, তার আন্দাজ করা কঠিন নয়।

“স্যার, কি ব্যাপার, আপনি বাইরে কেন? ঠান্ডা লাগছে না?”

“নাহ্” ওদের সম্মলিত প্রশ্নের উত্তরে অপ্রস্তুতের হাসি হেসেছিলেন ডঃ ব্রজকিশোর বিশ্বাস, ওরফে ডঃ বিশ্বাস ওরফে বিকেবি। হাতের বড়ো চটের থলে দেখিয়ে চোখ টিপে বলেছিলেন, “যাক, দুটো দলের একটা দল ঘরে ফিরলো তাহলে। বিদেশ বিভুই বলে কথা, কতগুলো একুশ বিশ বছরের  এঁচোড়ে পাকা কলেজ পড়ুয়া পাকা ছেলে- মেয়ে নিয়ে কলকাতা থেকে হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে এসেছি, চিন্তা হচ্ছিল......! একা থাকলে দেখবি দুশ্চিন্তা ছেঁকে ধরে। এখন তোরা তোদের ঘরে যা, যদি ডিনার খেতে বেরোস আমায় বলে যাস, আমি আর যাচ্ছিনা,  সকালের কিছু খাবার এখনও আছে, তাতেই আমার হয়ে যাবে। আমি বরঞ্চ কাল কের জন্য ব্যাগ গোছাই,  আর এই  ফেলুদাটা শেষ করি। তবে হ্যাঁ, ওরা ফিরলে আমায় একটা খবর দিয়ে যাস। সবাই না ফিরলে আমার ঘুম আসবে না । তার পর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “দেখ্ তো কেমন হলো জিনিষগুলো, দোকানদার বলল পিওর উল, দেখ্ দেখি!” একটা শাল, দুটো সোয়েটার, শান্তা আর নিতা উৎসাহ নিয়ে দেখেছিল, “হ্যাঁ স্যার, ভালো হয়েছে”

শ্রীমন প্রশ্ন করেছিল, “আপনার জন্য কি কিনলেন?”

“আছে রে” বিকেবি হেসেছিলেন, আনন্দ করে গোড়ালী দেখিয়েছিলেন, “উলের মোজা, অলরেডি পড়ে ফেলেছি, কি আরাম রে!”

হাসতে হাসতে ওরা বরাদ্দ ইয়ুত হোষ্টেলের ঘরটাতে ঢুকেছিলো। এখনও সেখানে এলোমেলো ছড়ানো বারোজন ছাত্র-ছাত্রীর স্লিপীং ব্যাগ, কম্বল, সুটকেস, চপ্পল, টুপি, সানগ্লাস, টুথব্রাশ, চিরুনী। পড়াশোনার শেষে বেড়ানো  বাবদে  কলেজ  কতৃপক্ষ থেকে পাওয়া  অনুদানে পয়সা বেশি ছিল না, তাই  দুটো মাত্র ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, পয়সা সংকুলান করার জন্য এ ছাড়া উপায় ছিল না।  একটা ওদের সবার, অন্যটা প্রফেসরের।

গত তিন বছর ধরে এক সাথে গুলতানী করা, ক্লাস করা, পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেওয়া বন্ধু-বান্ধবীর  নিজেদের  ওপর আস্থা ছিল। ওরা ঠিক করে ছিল একটা বড়ো ঘরে ওরা বারোটা ছাত্র-ছাত্রী একসপ্তাহ অনায়াসে মিলে মিশে কাটিয়ে দিতে পারবে।  প্রফেসর বিশ্বাস থাকার জায়গা নিয়ে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের  চিন্তা করার সুযোগ দেননি, নিজেই আগ বাড়িয়ে আগে ভাগেই বলে দিয়েছিলেন, সব থেকে কম দামের সব থেকে ছোট ঘরটাই ওঁনার চাই, তা নাহলে ওঁনার নাকি প্রেসার বেড়ে যেতে পারে, বড়ো ঘরে থাকা ওঁনার স্বভাব বিরুদ্ধ।

রাত আটটা বেজে যাওয়ার পরেও যখন অন্যরা ফিরলো না, ওরা সবাই মিলে বিকেবির ঘরে এসে হাজির হয়ে ছিল। খবরটা শুনে ডঃ বিশ্বাস বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে থেকে উঠে পরেছিলেন, “সে কি রে? ওরা এখনও ফেরে নি? এটা তো মোটেও ভালো ঠেকছে না!”

সকাল আটটা থেকে রাত্রি আট। মোটে তফাৎ, অথচ বারো ঘন্টায় ওদের জীবনে কি বিরাট এক পরিবর্তন আসতে  চলেছে।  কলকাতা থেকে কুলু মানালী বেড়াতে এসেছিলো বারোজন , এক সপ্তাহ মানালীতে এতো আনন্দ করে কলকাতায় ফিরবে মাত্র চারজন? এটা কি সত্যি হতে চলেছে? 

কালো পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে নীতা চোখের জল মোছে, যে ও কেন কাঁদছে সেটা ও নিজেও জানেনা, তাহলে কি ওর নয়জন বন্ধু-বান্ধবী ঐ হাঁ মুখ করা পাহাড়ের কোথাও মিলিয়ে গেল? ওদের ও আর দেখতে পারবে না? পরমুহর্তে নিজেকে বোঝায় নীতা, “না না মিলিয়ে যাবে না, আছে কোথাও নিশ্চই”।

আজ সকালেই তো, তাই না? নীতার মাথায় সিনেমার মতো শটগুলো ভেসে ওঠে।

“ব্যস হয়ে গেলো।” সকালে প্রাতঃরাশের সময় সায়ন্তন ঘোষণা করেছিল, “হয়ে গেল বেড়ানো মানলী ঘোরা! এস্কার্সানের ইতি, আমার ছুটি ফুরোলো নটে গাছটি মুরোলো, এবার কলকাতা ফিরে যাওয়া।”

“নান্ না এখনই কি? চল না সবাই মিলে আজই একটা ট্রেকিং নামিয়ে দিই, স্যার কি বলেন?”  সদ্য পর্বতারোহনের কোর্স নেওয়া তিমির বলেছিল।

বন্ধু-বান্ধবদের নিজের এই প্রতিভাটা না দেখাতে পারলে ওর ভাত হজম হচ্ছে না, এটা ওদের জানা ছিল, নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করে ওদের অনেকেই সমস্বরে বলে ওঠেছিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ”।

বিকেবি হেসেছিলেন, “তোদের যা ইচ্ছা, তোদের মধ্যে যার যার ট্রেকিংয়ের বা পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে বেড়ানোর সখ আছে, এই বেলা মিটিয়ে নে, আমি যাচ্ছি না আমাকে আজ একটু বাজার করতে হবে, আমার বসের আজ্ঞা, কুলুর বিখ্যাত সোয়েটার, শাল নিয়ে আনতে হবে।”

নীতার মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিলো, সেটা শান্তা লক্ষ্য করেছিল, “কিরে নীতা, আজ আর একবার বশিষ্ট কুন্ড যাবি না কি?”

“আমি ভাবছিলাম, এখনও তো কত কিছু দেখা হলো না...., রাহালা জলপ্রপাত, বৌদ্ধ মঠ, মনুর মন্দির...” নীতার মনে পড়ে, কি রকম করে অন্য সবাইকে লুকিয়ে গলার স্বর নিচু করে ও উত্তরটা দিয়ে ছিল।

“সে কিরে! জলপ্রপাত এখান থেকে দূর আছে, যাবি কি করে?” শ্রীমন দাঁড়িয়ে পড়েছিল, দুজন সহপাঠিনীর “সে কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে” এর উত্তরে বলেছিল “হয়েছে তাহলে! চল আমি তোদের সঙ্গে যাচ্ছি”। নীতা আর শান্তার কোন ওজর আপত্তিতে শ্রীমন কান দেয়নি, “দেখ ভেবে দেখ তোরা, আমি তোদের সঙ্গে থাকলে বরঞ্চ সবার শান্তি, ওরা যারা ট্রেকিং করতে চায়, তাদের আর বিকেবিরও শান্তি। আমি তোদের সাথে থাকলে তোদেরও ভালো। হাজার হোক, আমি একটা পুরুষ মানুষ তো বটি, দুই অবলা নারীর একটা অবলম্বন।

“আর বেশী বাতেলা মারিস না! চল তুই আমাদের সাথে।” নীতা আর শান্তা রাজী হয়ে ছিল।পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ওরা নয় জন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, প্রায় তার সাথে সাথেই নীতা, শান্তা আর শ্রীমন রাহালা জল প্রপাতের রাস্তা ধরে ছিল। সেই মুহুর্তটা এখন খুব ভালো লাগে নীতার, ভাগ্যিস! অন্ততঃ পক্ষে শ্রীমন তো আছে সঙ্গে, ওই কালো পাহাড়ের হাঁ করা মুখের মধ্যে হারিয়ে যায়নি।

“চিন্তা করিসনা।” শ্রীমন একটা হাত বাড়িয়ে নিতার কাঁধে রাখে। কখন ওর পিছনে শ্রীমন এসে দাঁড়িয়েছে ও টেরই পায়নি।

খানিকটা ঠান্ডা, খানিকটা শ্রীমনের স্পর্শের আকস্মিকতায় নীতা কেঁপে ওঠে। “চল ঘরের ভিতরে, তোর্ ঠান্ডা লেগে যেতে পারে, অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছিস।”

“না রে, আমার অভ্যেস আছে, আমার ছোটবেলা কানপুরে কেটেছে না? এর থেকে অনেক ঠান্ডা, আমার অভ্যেস আছে।”  “ছিল!” নীতা ক্লান্ত হাসে।

শ্রীমন নীতার হাতে একটা আলতো চাপ দিয়ে হাতটা সরিয়ে নেয়, “চল, ঘরের ভিতরে চল, বিকেবি আর শান্তার কাছে গিয়ে বসি।”

সিগারেটের ঘন্ধে ঘরটা ভরে আছে। মাত্র কয়েক ঘন্টায় ব্যবধানে ভদ্রলোকের বয়স যেন এক ঝটকায় কুড়ি বছর বেড়ে গেছে।

“শ্রীমন?...., শান্তা-নীতা...?” বিকেবির লম্বা দোহারা চেহারাটা চিন্তার ভারে যেন নুইয়ে পড়েছে। “আমি তো কিছু ভেবে পাচ্ছিনা, ওরা কেন যে এখনও ফিরলো না!” প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া জলন্ত সিগারেটটাতে আশ্লেষে একটা বড়ো টান দিয়ে ডঃ বিশ্বাস আরো একটা সিগারেট ধরান। “তোরা একটা কিছু খেয়ে নে এবার, অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে, আমি তো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না, তোরা কিছু বল!”

“স্যার, পুলিশে তো জানানো হয়ে গেছে, আর কি করতে পারি আমরা?” শ্রীমন শান্ত স্বরে উত্তর দেয়।

“আবার ঠান্ডাটাও জেঁকে বসছে” ডঃ বিশ্বাসের গলা ধরে যায়।

শরীরের আদ্যপ্রান্ত একটা মোটা বেড-কভারে ঢেকে শান্তা ছোট্ট ঘরটাতে মাথা নিচু করে ক্রমাগত পায়চারী করে চলেছে, ওর দিকে তাকিয়ে ডঃ বিশ্বাস অনুরোধ করেন, “এই মেয়েটা, তুই এইবারে একটু বস তো, শ্রীমন, যা তো বাবা, ওদেরকে নিয়ে বাইরে কোথাও থেকে খেয়ে আয়।”

“না স্যার, আপনাকে একা রেখে আমরা যাচ্ছিনা, যেতে হলে সবাই একসাথে।” শ্রীমন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়।

“যা না! কেন তর্ক করছিস বাবা, ওই হিমাচল প্রদেশের পুলিশগুলো এই এলো বলে, যা না তোরা।”

“প্লীজ। ” হাঁটা থামিয়ে শান্তা একটা দুই কুল রাখা উপায় বার করে। বিকেল থেকেই নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে ওর চোখ লাল হয়ে গেছে, গলার স্বর ভেঙে গেছে। “এখন নিজেদের মধ্যে কথাকাটা কাটির সময় না। শ্রীমন, তুই আর নীতা যা, আমি যাবো না,  আমি ওঁনার সঙ্গে, মানে স্যারের সঙ্গে আছি, তোরা দুইজনে যা, কিছু একটা খাবার হাতে করে নিয়ে চলে আয়, সবাই মিলে এই ঘরে বসেই খাব। না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে, কে জানে কাল সকালে কি আছে কপালে।”  ওর শান্ত, দৃঢ় আদেশ অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই৷

“নীতা, চল তাহলে, আমি আর তুই গিয়ে একটু বাইরে বেড়িয়ে দেখি, কাল সকালে মনে হয় একটা ছোট ধাবা দেখেছিলাম, এই ছোট্ট টিলাটার পাশে।” শ্রীমন হাত বাড়ায়, “ওভারকোটটা  নে, আর যে টুপী..., মাথায় পড়ে নে, হীম-পড়া শুরু হয়ে গেছে।”

নীতা নিঃশ্বব্দে কোট আর মাথায় টুপী পরে শ্রীমনের সাথে অন্ধকার রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে মাত্র দশদিন আগেও ওরা সবাই একসঙ্গে ছিল। অনুভব করে বেড়াতে আসার আগে কলকাতায় থাকা দিনগুলোর কথা ছায়া-ছবির মতো ওর মাথায় ভীড় করে আসছে।  জন্মদিন উপলক্ষে ক্লাসে সবার জন্য কেক এনেছিল নীতা।  

“জন্মদিনের জন্য আমার একটি মাত্র চাওয়া, কোথাও একটু ঘুরে আসা, কোথাও একটু যাওয়া, কোথাও একটা যেতে চাই.....।”

“কিন্তু কোথায়? কবে যাই?” শ্রীমন তির্যক চোখে তাকিয়েছিল নীতার দিকে, দাঁত বার করে হেসেছিল।

“বাব্বাঃ, এই যে দেখি জলে ভাসে শিলা, তুই যে দেখছি ছন্দ মিলিয়ে কথা বলছিস রে? কি হলো তোর? কোথায় শিখলি এটা?” নিশীথ শ্রীমনকে ঠেলা মারে।

শ্রীমন কানপুরের ছেলে, ছোটবেলা কাটিয়েছে হিন্দী ভাষাভাষি স্কুলে, বাংলা-ভাষা কিংবা তার সংস্কৃতির সাথে সহজাত ভাব জমানোর সুযোগ ওর ছিলোনা, ও যে বাংলায় কথা বলতে পারে সেটাই ওর নিজের ভাষায় ওর চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য।

“ঐ যে, নীতা ...., ওর লেখা কবিতা, ফিজিক্স পাসের নোট আনতে ওর বাড়ি গিয়েছিলাম...ওর লেখা।” শ্রীমন ঢোক গেলে উত্তর দেয়, ও যে মিথ্যা বলছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারোর, ওর খয়েরি-সবুজ রঙ্গা চোখে হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল।

“একটা থাপ্পড় খাবি...! নোট আনতে এসেছিলি, নোট নিয়ে চলে গেছিস, এক ফোঁটা বসিসনি।” নীতা চেঁচিয়ে ওঠেছিল, “আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তোকে কবিতা শোনাতে যাচ্ছি... শয়তান।” লান্চের ঘন্টায় ওদের সবাইকে ওঁনার নিজের ঘরের সামনে দেখে অবাক হয়েছিলেন ডঃ বিশ্বাস।

“এই তোরা আরম্ভ করলি কি? এতবড়ো বড়ো সব চলে মেয়ে, ছমাসের মধ্যে অঙ্ক অনার্স গ্রাজুয়েট হবি, করিডোর থেকে শুনতে পাচ্ছি, প্রাইমারী স্কুল এর বাচ্চাদের মতো হইহই... কি চাই তোদের?”

“স্যার, আমরা এখনও ভেবে পেলাম না কোথায় যাবো, শঙ্কর বলে দীঘা, তো শান্তা বলে কাশ্মীর, বিকাশ বলে পুরী, তো মন্দিরা বলে কন্যা-কুমারী। এই করতে করতে দেরী হয়ে যাচ্ছে, দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য সরকারের দেওয়া টাকা তামাদি হয়ে যাবে।” অগ্নি ডঃ বিশ্বাসকে বুঝিয়েছিল, “তারপর নিশীথ বলল আপনার কথা, আপনি পিতৃতুল্য, আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক, আপনি বলুন কোথায় যাওয়া যায় এবং সম্মতি দিন আপনি আমাদের সাথে যাবেন।”

“দাঁড়া দাঁড়া, আগে আমার বসকে জিগেস করি, মিসেস বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করছে...উনি যদি রাজী থাকেন।” ডঃ বিশ্বাস প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিলেন। “এর আগের বছরেই তামাদি হয়েছিল, টাকা সরকারের টাকা সরকারের কাছে ফেরত চলে গিয়েছিল।”

সরকারী নিয়মে একজন প্রফেসরকে থাকতেই হবে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। ডঃ বিশ্বাস পুরো এক সপ্তাহ সময় নিয়ে তার পর রাজী হয়েছিলেন ওদের সঙ্গ দিতে। “ঠিক আছে, তোরা আমায় জায়গায় নামগুলো দে। আমি লটারি করবো। যেই জায়গায় উঠুক না কেন তোরা সবাই যাবি তো?” ওরা রাজী ছিলো। ওরা জানতো একবার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে কে যে কোথায় ছড়িয়ে পড়বে, সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়ার এই সুযোগ আর আসবেনা।লটারীতে কুলু-মানালী উঠে ছিল তিনবারের মধ্যে দুইবার। সমবেত কুড়ি পঁচিশটা তরুন-তরুনীর সমবেত হই-হই সেন্ট জেভিয়ার্স এর কমোন রুমের গন্ডী ছাড়িয়ে সম্ভবতঃ গড়ের মাঠ থেকে শোনা গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু টিকিট কাটার সময় দেখা গেল মাত্র বারো জন ছাত্র-ছাত্রী উৎসাহী। তাই হোক, বারো জনই সই৷ টিকিট কাটার ভার নিয়েছিল সর্বানি, ভ্রমনের ছক করেছিল মন্দিরা আর নিশীথ। প্রতিদিন কি খাওয়া হবে মেনু করা হয়ে ছিল সবাই মিলে, ওরা হিসেব করে ছিল মেনু-অনুযায়ী খাওয়া হলে পয়সা কম লাগবে। হাড় কন্জুস বলে ক্লাসে ওর সুনামটা অদ্ভুত ভাবে কাজে লাগিয়ে টাকা পয়সার রক্ষনা-বেক্ষনের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল নীতার ওপর।

কলকাতা থেকে দিল্লীগামী রাতভোর ট্রেন। দিল্লীর কন্নট প্লেস থেকে কুলু, পাঁচশো ছিয়াশি কিলোমিটার, প্রায় এগারো ঘন্টা, মঙ্গলবার পথ পরিক্রমা সেরে সত্যি সত্যি ইয়ুথ হোষ্টলের ঘরে এসে সবাই মাইল উপস্থিত হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলেছে, নীতার মনে হচ্ছিল ও নিশ্চই স্বপ্ন দেখছে। সর্বানী অদূরে স্বরে বলেছিল ‘বাপরে!, বাপের জন্ম এতো ক্লান্ত হইনি কখনো, চলছি যেন চলছি,  শেষ হওয়ার কোন নামই নেই।”  

তবুও সেই সন্ধ্যে বেলাতেই সবাই মিলে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল, রাতের বেলার মানালীকে দেখার জন্য। ফেরার সময় অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল নিশীথ। মন্তব্য করেছিল “চাঁদ তো নয়, যেন, আধুলী, গভরমেন্ট এর মিন্ট থেকে সদ্য বার হয়ে আসা বার হওয়া ঝকমকে আধুলী” কথাটা ওরা সবাই উপভোগ করেছিল। একমাত্র শ্রীমনের অসন্তোষ শোনা গিয়েছিল, “বাঙ্গালী কথায় কথায় সব কিছুকেই চাঁদের সাথে তুলনা করে।” প্রায় সাথে সাথে তমালের প্রতিবাদটাও ঝঙ্কৃত হয়েছিলো।

“শুধু বাঙ্গালী নয়, সব ভাষাতেই সংস্কৃতমনষ্ক নারী পুরুষ প্রকৃতির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে এই রকম তুলনা আনে, সেটা বোঝার জন্য ভাষার অপর দখল নয় নয়, মন থাকার দরকার।”

 

পর্ব ২: মনুর আলয় মানবালয়

পরের দিন ভোর না হতেই আবার বেড়িয়ে পড়া হয়েছিলো। ঘন সবুজ দেবদারু আর পাইনে ঘেরা সাজানো উপত্যকাতার মধ্যে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে চলেছে খরস্রোতা বিপাশা নদী। জ্বলা কাঠের মৃদু সুবাস আর ছাপিয়ে পড়া রোদের আলোয় ভরা উপত্যকাটাকে প্রথম নজরেই ভালোবেসে ফেলেছিল নীতা। একধারে আকাশ ছোয়া পাহাড়ের নিঃসীম শান্ত কলেবর, তার পাশে বিপাশার উচ্ছলতা, আবহমান কাল ধরে বয়ে চলার কলকল্লোল।

শান্তা হঠাৎ বলে উঠেছিল, “যখন যেমন হতে পারি তাই হতে পাই যদি, আমি তবে এখনি হই এই বিপাশা নদী।”

“না প্লিজ! প্লিজ না। এইখানে তুই নদী হয়ে গেলে আমাদের আর কলকাতা ফিরতে হবে না।” সায়ন্তনের  চটজলদি উত্তরে ওরা সবাই সমস্বরে হেসে উঠেছিল। বিপাশার নাম নিয়ে একটা ছোট খাটো তর্ক লেগে গিয়েছিল অগ্নি আর সন্দীপের মধ্যে। একটা সুষ্ট সিদ্ধান্ত উপনিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সত্যবান কিন্নরের উপস্থিতি কাজে লেগেছিল। ছেলেটি সকাল-সকাল বেশি ভীড় হওয়ার আগে গুজরাটি দুই বৃদ্ধ দম্পত্তিকে নিয়ে নদীর ধারে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল, কলকাতার দুই কলেজ পড়ুয়ার তর্কের শান্তি-ভঙ্গ ও মেনে নিতে পারেনি, নিজের থেকে ওদের দলটার দিকে এগিয়ে এসেছিল, ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল “আপনারা দুজনেই ঠিক, অনেক গল্প চালু আছে এই নদীর নামে।  মহাভারত কথাকার, প্রসিদ্ধ ব্যাসদেব। ব্যাস নামক কুন্ড থেকে নদীটির সৃষ্টি করেন।”

সন্দীপ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল, “নেহি নেহি, কব্বি হো নেই সকতা, হাম জনতা হ্যায়, উস নদী কি নাম ইজ বিয়াস, বি-ই-এ-এস। আপকা নাম কেয়া হ্যায়?” তার পর সবার দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলে ছিল, “গপ্পো মারতে এসেছে।”

ছেলেটি জানিয়েছিল, ওর নাম সত্যবান কিন্নর, তার পর অগ্নিকে স্বান্তনা দেওয়ার স্বরে বলেছিল, “অনেকে বলে, বশিষ্ট মুনি পুত্র শোকে কাতর হয়ে নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিতে গিয়েছিল, কিন্তু নদী বশিষ্টকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল, পাশ থেকে মুক্তি ‘বিপাশা।” বিপাশা নামটা মনে মনে আর এক বার উচ্চারণ করেছিল নীতা, ভেবেছিল, যে যাই বলুক, ঐ চমৎকার নদীটি সারা জীবন নীতার কাছে বিপাশা নামেই থাকবে। আবেগ স্বরে বলেছিল, ‘ব্যাস্ এখানেই ট্যুরের বাকী সময়টা কাটিয়ে দিতে পারি আমি।”

“আজ্ঞে না…।”

“আমরা হিড়িম্বা টেম্বল দেখতে চাই।”

“চল এখন!”

“বিকেবি ইয়ুথ হোষ্টেলের ঘরে আপেক্ষা করছেন!।”

বেশ কয়েকজন মিলে আপত্তি জানিয়েছিল, বিপাশার ধারে ট্যুরের বাকী সময়টা কাটিয়ে দেওয়ারটার পরিকল্পনাটা অনেকেরই মনঃপূত হয়নি। কুলু উপত্যকার অন্যতম আকর্ষণ মানালী, কাজেই চব্বিশ হাজার পাচশো মিটার উচ্চতাতে থাকলেও শহরটাতে ছড়িয়ে আছে নানা ধাবা, ছোট, বড়ো নানা রেস্তেরা। খেয়ে নিয়ে হাঁটা পথেই হিড়িম্বা দেবীর মন্দিরে চলে এসেছিল ওরা এবং অভিভূত হয়েছিল। সিডার গাছে ঘেরা একটি বিরাট পাথর খন্ডের ওপর বানানো চারতলা মন্দিরটা চারটে মাটির দেওয়াল দিয়ে বাঁধানো। কাঠের টালি দিয়ে বানানো চৌকোনা তিনটে ছাউনীর একেবারে উপরের চারনম্বর তলায় একটি পিতলের ত্রিকোন। মাটির ওপরে সাদা চুনকালি লেপানো। মাটির দেওয়ালে টাঙ্গানো নানা কাঠের নানা কারুকার্য। দেবী দুর্গার আর ভূমি-মাতার মূর্তি, তবে মন্দিরের একেবারে অন্দর মহলে একটি তিন ইন্চি পিতলের মূর্তি হিরিম্বার নামে। সায়ন্তন জানিয়েছিল, ওর কাছে খবর আছে, ষোড়শ খ্রীষ্টাব্দে ষাটের দশকে তৈরি হওয়া মন্দিরের নাম পান্ডব মধ্যম ভ্রাতা ভিমের রাক্ষুসে বউ হিরিম্বার নামে হলেও ওটা নাকি তার বোন হিরিম্বির নামে উৎসর্গকৃত।  

মন্দিরটি দেখতে বেশ ছিমছাম, তবে পাথরের দেওয়ালে টাঙ্গানো একটা বড়শি বা দাঁড়ার মতন জিনিষ দেখে ওরা সবাই চমকিত হয়েছিল। ডঃ বিশ্বাস হেসেছিলেন, “চলে আয়রে, দেখেই গা ছমছম করে৷ হ্যাঁ রে, পাপের সাজা ঐখানে ঝুলছে৷ পাপিদের ধরে এনে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে তার পর পাথরের দেয়ালের দিকে ছুড়ে ছুড়ে দেওয়া হতো বোধহয়।” অগ্নি চুপিসারে নীতাকে প্রশ্ন করেছিল, “পাপ? কি ধরনের পাপের এই রকম নিষ্টুর সাজা হতে পারে? দেখগে যা, কোন মানুষ তার সমাজের বাইরে অন্য কোন মানুষের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ছি ল, তাই  তাকে এই ভাবে মেরে ফেলা হতো?”

নীতা শিউরে উঠেছিল,  “হবে হয় তো। জানি না!”

কথাটা ওকে ভাবিয়েছিলো, “সত্যি তো! কি ধরণের পাপের এই রকম সাজা হতে পারে?”

ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র-সন্তান ঘোটোৎকচের মন্দিরে অন্য বিষ্ময় আপেক্ষা করেছিল। একটি গাছ, তার আসে পাশে ছড়িয়ে আছে নানা প্রকারের খুটিনাটি। তার মধ্যে ছিলো ছুড়ি, ভেড়ার শিং, টিনের পাত দিয়ে বানানো মানুষ, এক চালা ছোট ঘর-বাড়ি, জন্তু জানোয়ার।  ব লা বাহুল্য ঘোটোৎকচের প্রতি অতি-প্রাকৃত শক্তির প্রতি ভীতি এবং সম্ভ্রম প্রতীয়মান ছিলো এই সব খুঁটিনাটির মধ্যে। কে যেন বলেছিল স্মৃতি সততই সুখের?

বুধবার সকালও রোদ ঝলমল ছিল। কিন্তু ইয়ুথ হোষ্টেলের বন্ধুদের ঘর একটা হালকা কুয়াশা দেখা দিয়েছিলো।

সকালে উঠেই তমাল জানিয়েছিল আজ কোনমতেই আর কোন মন্দিরে যাচ্ছে না ও, গতকালের হিড়িম্বা দেবীর (দেবী না ছাই, রাক্ষুসী বললেও কিছু বলা হয় না) মন্দিরে রাখা বড়শির দুঃস্বপ্ন দেখেছে ও। দ্বিতীয় নালিশ এসেছিলো মিঠুনের।  বুধবারের মেনুতে সকালে ডিম-পাউরুটি আছে, সেই অনুযায়ী কুলু থেকে পারুটি আর সেদ্ধডিম কেনা হয়েছে, কিন্তু কে জানতো নুন আর টমেটো সস ছাড়া ডিম খেতে পারে না মিঠুন। টেবিলে খাবার দেখেই ওর মেজাজ গরম হয়ে গেল৷ “এটা খাবো কি করে?”

“কেন চিবিয়ে চিবিয়ে” বলতে গিয়ে তমাল থমকে গেছিল, মিঠুন ততক্ষনে উঠে পড়েছে টেবিল থেকে, “দরকার নেই যাঃ! আমি খাবই না।”

শেষে অগ্নি ওদের থামিয়েছিল, “কি রে তোরা বেড়োবি? তোরা থাকগে। ঘরে বসে খাওয়া নিয়ে পড়ে থাক আমরা বেড়েলাম!”

বিকেবি বলেছিলেন  “তোরা  মিটমাট করে নে, এতো দূরে বেড়াতে এসে মন খারাপ করে থাকিস না। এখান থেকে বশিষ্ট মন্দির বেশি দূর নয়, তোরা আয়, আমি এগোলাম।”

ডঃ বিশ্বাস বেড়োনোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মিঠুনের রাগ পড়ে গিয়েছিল।

“দেখেছিস একটা জিনিষ?”  রাস্তায় বেড়িয়ে সর্বানী নীতাকে বলেছিল।

“একটা কিরে? অনেক কিছুই দেখেছি এই জীবনে, তুই কি দেখার কথা বলছিল?” নীতা উত্তর দিয়েছিল, “বিকেবি আমাদের ঝগড়া বিবাদে নাক গলান না কখনো।”

‘আমরা তো আর ছোট নেই আর ছোট নেই’, সুর করে নীতা গেয়ে উঠেছিল। বিয়াসের জলচ্ছ্বাসের শব্দের আর ঝকঝকে সূর্যের আলোয় দিনটাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল। কলকাতায় ডিস্মেবর শীতের মাসেও কাশ্মিরি সোয়েটার পরার সুযোগ পাওয়া যায় না, অথচ এপ্রিল মাসেই মানালীতে রীতিমতো সোয়েটার, কানঢাকা টুপি, পায়ে গরম মোজা পরার প্রয়োজন হচ্ছে, তবে একবার বাইরে বেড়িয়ে পরলে, কিছুক্ষন হাঁটতে পারলেই মানালীর ঠান্ডাটা বেশ আয়েস করে উপভোগ করার মতো। কাঠের জ্বালের গন্ধ ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে, ইউথ হোষ্টেল থেকে বেড়িয়েই একটা ছোট্ট ঝুপড়ি, মিঠুন আমতা আমতা করে বলে “একটু চা পান করলে কেমন হয়? শুনেছি, এখানে নাকি ছাগলের দুধের চা পাওয়া যায়!”

“নিশ্চুই” সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, “তোর ইচ্ছা হয়েছে যখন!” তমাল নাটুকে স্বরে যোগ দেয়।

সবাই মিলে চায়ের ফরমায়েস তো হলো, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে? ঠান্ডা লাগবে না? ঝুপড়ি ওরফে দোকানের ভিতরে পাইন কাঠের আগুন জ্বলছে, বড়ো কড়াইতে জল ফুটছে, স্বভাবতঃই ভিতরের তাপমাত্রা আরামদায়ক হবে।

“বাবুজি আপসব লগ অন্দর আইয়ে না!” স্থানীয় দোকানদার ছেলেটি ওদেরই বয়সি হবে, মাথায় শাল মাথায় বেঁধে সাত সকালে চায়ের আয়োজন করেছে রাস্তার ধারে, ওদের ভিতরে ডাকে। কিন্তু ভিতরে দুটো মাত্র লম্বা বেন্চ, বারোজন ছেলের-মেয়ের বসার জায়গা নেই।

শ্রীমন উদারতা দেখিয়েছিল, “তোরা মেয়েরা ভিতরে গিয়ে বোস, কেন বাইরে কষ্ট পাবি? আমরা বাইরে আছে, মানালী এসে কেন কলকাতার বাসের প্যাসেন্জার করে ফেলি নিজেদের?”

অগ্নি আপত্তি জানিয়েছিল, “আয় ত সবাই আয়, বরন্চ সবাই মিলে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলে ঠান্ডাটা কম লাগবে!”’

“আরে বাস্৷ মানালীতে এসে তোর কোলে বসার সুযোগ পাবো ভাবিনি তো!” তমাল বলে উঠেছিল।

“কথাটা কলকাতায় ফিরে মনে থাকে যেন, শুধু তুই ডাকলি বলেই আসছি।”

“বাবাঃ তুই কি মর্ডান!” গুটিসুটি মেরে ঠেসাঠেসি করে পাশে বসতে বসতে ছেলেগুলো নানা মন্তব্য করেছিল৷

অবশ্য মেয়েরাও কম যায়নি। মন্দিরা পরিষ্কার জানিয়েছিল, সেটা একেবারেই ঠিক না, নেহাৎ কাশ্মীরের কাছাকাছি, তাই ছেলেদের একটু ছাড় দেওয়া হলো৷ নীতা অনুভব  করে রাস্তায় না বেড়োলে তিন বছর ধরে একসাথে পরা সহপাঠীদের নতুন করে চেনা যেতো না! কে জানতো, শ্রীমনও মাঝে মাঝে বাংলা কবিতার মানে বোঝার চেষ্টা করে! অগ্নি মেয়ে বলে আলাদা কোন সুবিধে নিতে চায়না।  বিকেবি একজন ভালো অঙ্কের শিক্ষকই নন, ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপর ওঁনার অটুট বিশ্বাস। ওর হঠাৎ কান্না পেয়ে যায়, ট্রেকিং করতে গিয়ে কি মানালীর পাহাড়ে এই রকম চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে ছয়জন ছেলে মেয়ে? আনন্দবাজারের হেডিং হয়ে যেতে পারে?  বেড়াতে গিয়ে কলু মানালী পাহাড়ে চিরতরে  গায়েব কলকাতার বিখ্যাত কলেজের ছয়টি ছাত্র ছাত্রী?

“তোরা কোথায় সন্দীপ, তমাল, মিঠুন, নিশীথ, রাজীব, সায়ন্তন, মন্দিরা, অগ্নি, আর সর্বানী?  নীতার দীর্ঘশ্বাস পড়ে, উদ্গত কান্না চাপে ও।

“চিন্তা করিস না নীতা, আমার তো মনে হচ্ছে ওরা ঠিকই আছে।” নীতার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শ্রীমনের কানে গেছে।

ওর মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, ডঃ বিশ্বাস ধুমপান করতে করতে একটা পাইন গাছের কান্ডে হেলান দিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। সবাইকে একসঙ্গে দেখে খুশি হয়েছিলেন।

“এলি তোরা? আশ্চর্য! তোদের খিটিপিটি লাগতে যতক্ষন, মেটাতেও ততক্ষণ।”

সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ওদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, “দর্শনীয় একটি ছোটমন্দির আর একটি গরম জলের ফোয়ারা। সেখানে ছেলে আর মেয়েদের স্নান করার জায়গা আলাদা করা আছে। তোরা মেয়েরা এইদিকে যা, ছেলেদের নিয়ে আমি ওদিকে যাচ্ছি, বারোটা নাগাদ এখান থেকে বেরোতে পারলে, আপেল বাগিচা দেখতে যেতে পারবি।”

“জানিস শ্রীমন”  নীতা হাঁটতে হাঁটতে বলে, “বশিষ্ট গ্রামটা আমার ভারী সুন্দর লেগেছে।”

ভাবে মাত্র বারো ঘন্টা আগেই পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। মানালীর শহরের কাছেই বশিষ্ট নামে ছোট একটা গ্রাম। মানালীতে দুই পা অন্তর ট্যাক্সী স্ট্যান্ড, হোটেল আর বিভিন্ন দর্শনীয়  জায়গা বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির পোষ্টারে ব্যানারের ছড়াছড়ি। বশিষ্ট গ্রামে সেই ব্যবসায়ী চাহিদার জাঁকজমক অনেকটাই ক্ষীণ। গ্রামটার প্রধান আকর্ষন গরম জলের কুন্ডের কাছাকাছি এসে ওরা দাঁড়িয়ে পরেছি, পিরামিড আকারের বেলে-পাথরের মন্দির, ত্রিকোন চুড়া।

“স্যার, আগে অন্ততঃ মন্দিরটা সবাই মিলে দেখে নিই”, মন্দিরা হইহই করে বলে ওঠেছিল৷

“হ্যাঁরে, তোর নাম মন্দিরা কে দিয়েছে বলতো?”  শ্রীমন পিছন থেকে প্রশ্ন করেছিল৷

“এই!’ ডঃ বিশ্বাস ওকে থামিয়েছিলেন, কিন্তু উনি নিজেও হাসছিলেন, “ও, মন্দিরা ঠিকই বলেছে, মন্দিরটা দেখার প্রয়োজন আছে বইকি!”

“বালুশীলার ওপর আদ্যন্ত কাঠের কাজ, রামায়ন খ্যাত রঘুবংশের কুল গুরুদেব বশিষ্ট মুনির পদধুলিতে পুন্যে উজ্জ্বল এই পূণ্যস্থান” মন্দিরের ভিতরে স্থানীয় পুরুত ছেলেটি ছল-ছল চোখে জানিয়েছিল, হিন্দীতে প্রশ্ন করেছিল “আপনারা কলকাতা থেকে এসেছেন, পুজো দেবেন তো? কম দামে হয়ে যাবে।” নীতা লক্ষ্য করেছিল টিম টিম করে প্রদীপ জ্বলছে অনেকগুলো, তার শিখায় মন্দিরের ভিতরে একটা চিরস্থায়ী কালচে আভা পড়ে গেছে৷

ওরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, ডঃ বিশ্বাসও ঠোঁট কামড়ে ধরে কি উত্তর দেবেন ভাবছিলেন, শ্রীমন ইংরেজিতে বলেছিল, “আমায় খেলতে দে” তারপর পরিষ্কর হিন্দীতে জানিয়েছিল, “ছিঃ ছিঃ এখন কি করে পুজো দিই? সকালে আন্ডা খেয়েছি সবাই, তার পর স্নানাদি সারা হয়নি, একটু ঘুরে দেখে যাই, সময় পেলে পরে ফিরে আসবো”। ছেলেটি ওর উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সরে গিয়েছিল পরবর্তি পুন্যার্থীর আশায়। নীতা শ্রীমনকে ইশারায়  মার দেখিয়েছিল, “যাহ দিলি তো? কতগুলো পাপ জমা করে দিলি সবার নামে?” মন্দির থেকে বেরিয়ে ওরা আলাদা দলে চলে গিয়েছিল। ছোট্ট কুন্ডটাতে ঢোকার মুখেই বারুদের গন্ধ পাওয়া গেয়েছিল; পাথরে আর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা একটা চৌবাচ্ছা, তাতে নানা বয়সের মহিলা আর শিশু জলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, ওদের কারোর অঙ্গে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। অবগাহন-কারীর কারো চুল খোলা, কারোর চুল মাথার ওপরে শক্ত করে বাঁধা। গরমের ঝলকানিতে গায়ের অংশ লাল হয়ে আছে, কিন্তু লজ্জা কিংবা অস্বস্তির নাম-গন্ধ কারোর আচরণে নেই। কলকাতার থেকে আসা পাঁচটা তরুনীর প্রান চমকে গিয়েছিল।“এর মধ্যে স্নান? তাহলেই হয়েছে!” অগ্নি মুখ চাপা দিয়ে প্রাণপনে হাসি থামানোর চেষ্টা করে প্রায় দৌড়ে  বাইরে পালিয়ে গিয়েছিল। স্থম্ভিত নীতা, শান্তা, মন্দিরা, আর সর্বানীকে উদ্দেশ্য করে অবগাহনকারী বয়স্ক মহিলাটি স্থানীয় দেহাতি ভাঙ্গা হিন্দীতে বলেছিলেন, “আপনারা যদি স্নান না করতে চান চলে যান, এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আপনাদের লজ্জা হচ্ছে বুঝতে পারছি।” মন্দিরা বিড়বিড় করে বলেছিল, “আমাদের লজ্জা হবে কেন? লজ্জা হওয়ার কথা তো আপনাদের, একি  হিন্দু মন্দির না দিগাম্বর জৈন মন্দির! আমি

মন্দিরে গিয়ে বসছি।”

“আমি এখানেই স্নান করছি।” সর্বানী জোরে ঘোষণা করেছিল, না তাকিয়েই নীতা টের পেয়েছিল, টপ টপ করে সোয়েটার, মাথার টুপি, সার্ট, প্যান্ট পাশে উঁচু স্তুপে জমা হচ্ছে।

“নিশ্চয়ই।” নীতা বলেছিল, “ভাবিনি কোনদিন তোকে অনুসরণ করে জীবনে কোন কাজ করবো, আমিও আসছি।”

বন্ধ দরজার বাইরে থেকে হাসির দমকে দমকে অগ্নির সাড়া পাওয়া গিয়েছিল, “আমি বাইরে বসছি, পাহারা দিই!”

স্নান শেষ করে আবার জামা কাপড় অঙ্গে চড়িয়ে ওরা দেখেছিল ডঃ বিশ্বাস অন্যদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ওদের সবার মুখে হাসি, এর মধ্যে একমাত্র অগ্নি ব্যতিক্রম। নীতা আর সর্বানীকে দেখে ও দৌড়ে এসেছিল, “ছিঃ ছিঃ! তোরা কি করে পারলি?”

তমাল তখনও গুনগুন করে গান গাইছে, ওর দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বলেছিল, “স্নান করার সময় যে গান ধরেছিলি সেটা আমরা সবাই বুঝে নিয়েছি, এখন দয়া করে ক্ষ্যান্ত দে। চল লান্চ খাওয়া যাক।”

নিশীথ জানিয়েছিল সকালের জন্য ওর মেনুতে এখন মাংস আছে৷ খাওয়া শেষ করে আপেল বাগিচা যাওয়ার পথে রাস্তায় নীতার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সর্বানী বলেছিল, “জানিস, হঠাৎ এখন লজ্জা করছে, জ্ঞান করছে, জ্ঞান হওয়ার পর, জীবনে এই প্রথম, কারোর সামনে জন্মদিনের জামা...” বলতে বলতে নিজের মুখ চেপে ধরেছিল সর্বানী।  

নীতা সম্মতির মাথা নেড়ে বলেছিল, “যা বলেছিস! আমারও অস্বস্থি হচ্ছে এখন।”

সর্বানী হেসেছিল, ওর মুখ তখনও লাল হয়ে আছে, “আমি জানতাম তুই পারবি! এই মাত্র আমি আর তুই পরবর্তিকালে বলার মতো একটা গল্প সৃষ্টি করলাম।” হোটেল মানবালয়ে ঢুকে অগ্নী সবার সাথে একাত্মবোধ স্থাপন করার চেষ্ঠা করেছিল, হঠাৎ হোটেলের সম্বন্ধে নানা প্রশংসা মূলক কথা বলতে শুরু করেছিল।  “বেশ তো, কি সুন্দর নামটা, মানবালয়!”

ডঃ বিশ্বাস ওর সুবিধে করে দিয়েছিলেন, “মানালী শহরের নামটাই তো এসেছে, মানবালয় থেকে। মনুর নাম শুনেছিস তো? প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী প্রচন্ড প্রলয়ের পর মনু এসে মানবসমাজকে আবার নতুন করে শুরু করেন, এইখানেই ছিল ওঁনার আলয়, তার থেকে মানাবলয়”।

সায়ন্তন বিজ্ঞের মতো দাঁত চিবিয়ে বলেছিল, “স্যার আপনি বাইবেলের নোয়ার কথা বলছেন নাকি হিন্দু ধর্মের কথা বলেছেন? থীমটা তো প্রায় এক! প্রচুর জল, প্রলয়, একজনের জীবিত থাকা, যদিও বাইবেলের নোয়ার সাথে নৌকা ছিল, আর নৌকাতে ছিল আরও কতগুলো অন্য জন্তু জানোয়ারের, সেইটাই বা বাদ থাকে কেন? গল্পই যখন চলছে, দিয়ে দিন, আমাদের মনুর সাথেও কতো গুলো জন্তু জানোয়ারের আমদানী করে দিন”!

“আর নে তো, ওই একই হলো! সব জায়গার মানুষই গল্প বানিয়েছে, কেউ বেশি গাঁজা খেয়ে গল্প লেখেছে, কেউ কম, পয়সার এপিঠ ওপিঠ” শ্রীমন হেসে সায়ন্তনকে থামিয়েছিল। শ্রীমনেরর চোখে সূর্যের   আলো……,  ওর সবুজাভ চোখের মনিতে পান্নার ঝলকানি, নীতা চোখ সরিয়ে নিয়েছিল।

পর্ব ৩:- তবু কিছু তো আছে

বাইরে অন্ধকার যত বাড়ছে, রাস্তার ল্যাম্প পোষ্টের আলোর জোর যেন ততই বাড়ছে। নাকি মনের ভুল? তাহলে কি কুলু মানালীই থেকে এইটাই পাওনা ছিল। এই ক্ষতি, এই হানি? ওরা কোথায় এখন? ট্রেকিং করতে বেড়িয়ে ওরা কেন ফিরলো না যে? নীতা চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। নিশিথের সেই ঝকমকে আধুলীর আকারের তারাগুলো এতো নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে কেন এখন? মধ্যেখানে কয়েকটা দিন চলে গেছে, চাঁদের আলো বেড়েছে, কিন্তু শুধু তাই জন্য কি?

“রাস্তার দিকে তাকিয়ে চল! তুই যে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যাবি রে!” নীতার মনটাকে টেনে মানালীর রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে আসে শ্রীমন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে, “কিছু খাবি? সেই দুপুর বেলায় খেয়েছিলাম, পেট তো ভোলামন হয়ে আছে?”

নীতা হেসে ওঠে, “দূর! কথাটা ঠিক হলো না! কিন্তু কই খাওয়াবি? চিনির বড়ি?”

শ্রীমন পকেটে হোমিওপ্যাথিক চিনির বড়ি রাখে। ক্লাসে, পরীক্ষার হলে, কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখিন হলে ঢোকার দুটো চারটে বড়ি মুখে ফেলে দেয়। “না রে, আপেল!”

“আপেল?”

“হ্যাঁ রে আপেল, ভারতবর্ষের সুইৎজারল্যান্ড থেকে।” শ্রীমন উত্তর দেয়, ও জানে অন্তত কিছুক্ষনের জন্য হলেও বান্ধবীর বিষাদ ভারক্রান্ত মনে একটু সুখের চিন্তা এনেছে ও, কয়েক মিনিট হলেও নীতাকে অন্যমনস্ক করেছে ও। মানালীর বিখ্যাত আপেল-বাগান কলকাতার ছেলে মেয়েদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। নিজের অজ্ঞাতে কখন ওর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে নীতা জানতে পারে না।

এতো আপেল? সারি সারি গাছে হাজারো আপেল ঝুলে আছে, ডঃ বিশ্বাস দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, “শহরে একটা গাছ দেখতে পাস না তোরা! এই রকমই হয়, খোঁজ নিয়ে দেখ সারা ভারতবর্ষ চালান যাচ্ছে এই ফলগুলো।”

ওরা সকলে হরির লুটের বাতাসার মতো মাটিতে পড়ে থাকা ফল কুড়িয়েছিল, বাগিচার কর্মচারিরা মাঝে মাঝে চক্কর দিয়ে ঘুড়ে দেখেছে, কিন্তু আপত্তি করেনি। ডঃ বিশ্বাসের পরামর্শ ওরা সবাই একসাথে কিছু টাকা তুলে দিয়েছিল কর্মচারীদের হাতে। সায়ন্তন উদার আহ্বান জানিয়েছিল “পেষাই করা আপেলের রস খাবি? আমি পয়সা দেবো সবার জন্য।”

কায়দা দেখিয়ে বলেছিল, ‘বিদেশে এটাকে বলে আপেল সিডার বা সাইডার, ঠান্ডার দেশে শীতের সময় এই রকম সময় আপেলের রস গরম করে, তার সাথে দারুচিনি মিশিয়ে খায় সাহেবরা।’’ ওকে লুকিয়ে রাজীব, মিঠুন, তমাল, নিশীথ আর নীতা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেছিল। সায়্ন্তনের দিদির বিয়ে আমেরিকার এক বাঙ্গালী ছেলের সাথে হওয়ার পর থেকেই সায়ন্তন সময় কিংবা সুযোগ পেলেই ‘সাহেবদের’ সম্বন্ধে সুযোগ ছাড়ে না। বিপাশার জলতরঙ্গ সমান ভাবে বয়ে চলেছে, আওয়াজটা কানে বড্ডো নিষ্ঠুর নীতার, কোন তাল নেই কোন ছন্দ নেই, কেমন একঘেয়ে ঘরঘর বেদনার আওয়াজ, কোনরকমে থামিয়ে দিতে পারলে যেন ভালো লাগতো।

কানে  হাত চেপে নীতা দাঁড়িয়ে পড়ে, “কিরে?’’

“আমার বড্ডো ভয় করছে রে!”।

শ্রীমন চিন্তিত স্বরে বলে, “ভয়? দাঁড়া না, এখনি ভয় কেন করছিস?” তার পরেই কথা ঘুরিয়ে  বলে ওঠে, “দেখ মানালীতে, গরম জলের ফোয়ারা থেকে আরম্ভ করে বরফ সব আছে। রোটাঙ্গ পাসে আমার খুব মজা হয়েছিল, বিশেষ করে যখন ফুর ফুর করে তুষার পড়তে শুরু করেছিল, তখন আমার হঠাৎ ছোটবেলার শোনা একটা গান মনে পড়ে গিয়ে ছিল, সেই যে সাউন্ড ওফ মিউঝিক এ ছিল, সেই মারিয়া নামে নানের অন্যতম প্রিয় জিনিষ চোখের পাতায় বরফ কুচি!”

“বাঃ বেশ ভালো মনে করেছিস তো!” রোটাঙ্গপাস নীতারও খুব ভালো লেগেছে।

সমুদ্র তল থেকে প্রায় সরে তেরো হাজার ফুট উচ্চতায়, মানালী থেকে মাত্র ৫১ কিলোমিটার দূরে, মানালী থেকে গাড়ি ভাড়া করে রোটাঙ্গ পাসে আসতে এক ঘন্টা সময় নিয়েছিল। সকালে ওঠার ক্লান্তি আর ঠান্ডার আমাজে নীতা ঘুমিয়ে পড়েছিল, গাড়ী থামার ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে ওর ধারনা হয়েছিল ও নির্ঘাৎ স্বপ্নই দেখছে। যত দূর চোখ যায় ধূ ধূ সাদা। বিকেবি বলেছিলেন “একেই বলে স্লো লাইন৷ সব সময় তুষারবৃত হয়ে আছে এই জায়গাটা।” দশহর নামক লেকটাতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল সন্দীপ, কিন্তু দলের অনুমতি মিলল না।

“তার চাইতে চল, আমরা সবাই মিলে বরফ ছোড়াছুড়ি করি৷’’ রাজীব পরামর্শ দিয়েছিল।

“তোরা যা,’’ ডঃ বিশ্বাস সরে এসেছিলেন, “তোরা সবাই মিলে দাঁড়া, তোদের ছবি তুলে দিই।’’

তখন কে জানতো আর একদিন পরেই পুলিশের প্রয়োজনে আসতে পারে বলে ভাবা হবে, সেদিনের সেই আনন্দঘন মুহূর্তে তোলা ছবিটা। রোটাঙ্গ পাসের দক্ষিণ সিমান্তে কুলু, জনবসতীর জন্য ব্যবহার যোগ্য, কিন্তু উত্তর প্রান্তের লাহুল আর স্পিটি অন্চলে শুধু বরফ আর বরফ।

প্রচলিত কাহিনী অনুসারে এই অন্চলের মানুষের করুন আর্তিতে সাড়া দেবাদিদেব শিব ওঁনার ত্রিশুল দিয়ে ভৃগতুঙ্গ নামক পর্ব্বতমালা কেটে রোটাঙ্গ পাস সৃষ্টি করেন, কুলু উপত্যকায় যাতায়াত করার জন্য। নিকটবর্তি বরফে ঢাকা লেক বিয়াস ওরফে ব্যাস কুন্ডই বিষ্ময় জাগানো বিপাশার উৎপত্তি স্থল। কথিত আছে মহাভারত স্রষ্টা বেদব্যাস মুনি এই কুন্ডের জলে অবগাহন করতেন। বয়ে যেতে যেতে  বিয়াস নানা জায়গায় নানা নাম নিয়েছে, কিন্তু তার কদর কমে নি কোথাও। বরফের সমুদ্রের ওপর সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসিয়ে গিয়েছিল নীতার।  নানা রঙ্গের নানা বর্ণের ছোট বড় দল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ওর বিশেষ মজা লেগেছিল একটি শেতাঙ্গ পরিবারকে দেখে।  এক নারী-পুরুষ ও বছরসাতেক শিশু নিয়ে একটা ছোট দল, তিনজনেই স্লেজের ওপর ঘুরে ঘুরে আনন্দ করছিল।

“দেখেছিস কান্ডটা?” তিমির নীতার পাশ থেকে বলেছিল, “একদল শেতাঙ্গ দেখতে পেয়ে থেকে সায়ন্তন হঠাৎ করে ইংরাজিতে কথা বলা শুরু করেছে।” কাজও হয়েছিল প্রায় সাথে সাথে, একদল আমেরিকান ট্যুরিষ্ট যেচে ওদের সাথে আলাপ করেছিল, এবং সায়ন্তন ওদের গ্রুপ ফোটো তুলে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছিল।

তারপরেই সায়্ন্তনের কাছে ছবি তুলে দেওয়ার আবেদন পড়তে থাকে একের পর এক।

“কিন্তু ওরা? শ্রীমন? ওদের কি হচ্ছে?” নীতা আবার মুষড়ে পড়ে।

“ওরা ঠিক আছে, তিমির মাউন্টনেরিয়ারিং জানে।” শ্রীমন থামে, “তাছাড়া এখানে বুনো জন্তু জানোয়ার তেমন কিছু নেই।”

ঠিক তখনই হঠাৎ দূরে চোখের মতো দুটো উজ্জ্বল আলো দেখতে পেয়ে চমকিয়ে ওঠে নীতা, “শ্রীমন!, সামনে ওটা কি? দেখেছিস?”

“দাঁড়িয়ে পড়, এখানে দাঁড়িয়ে পড়, চিন্তার কিছু নেই, দুজন মানুষ হেঁটে আসছে, ওদের দুই জনে হাতে টর্চলাইট, ভয়ের কিছু নেই, ওরা চলে যাক, তারপর আমরা যাবো, ধাবাটা সামনেই, কে জানে খোলা পাবো কি না৷’

নীতার হাত টেনে নিয়ে ওকে পাঁচিলের দিকে রেখে ওর শরীরটাকে ঢেকে দাঁড়িয়ে পরে শ্রীমন, ওরা পাশ থেকে চলে যাওয়ার পর বলে ওঠে, “বাবাঃ! মদের গন্ধ পাচ্ছিস? রোটাঙ্গেও অনেকে বেশ মাল টেনে এসেছিল।” নীতা আচমকা হেসে ওঠে, “মদের গন্ধ মন্দিরার সহ্য করতে পারে না। সায়ন্তন যখন নানা ট্যুরিষ্ট গ্রুপের ছবি তুলছে, কারো কারো মুখে এ্যলকোহলের গন্ধ পেয়ে মন্দিরা স্যারের পাশ থেকে নড়েনি।

নীতা নৈরাশ্যকে দূরে  রাখার চেষ্ঠা করে। তবু কিছু তো রয়ে গেছে। সবই তো হারিয়ে যায়নি, ইয়ুথ হোষ্টেলের ঘরে শান্তা এখনও আছে, পিতৃপ্রিতম ডঃ বিশ্বাস আছেন, ওর পাশাপাশি হাঁটা শ্রীমন আছে। একটা বড়ো ঠোঙ্গায় দশটা পুরী আর অহর ডাল নিয়ে হোষ্টেলের ঘরে নীতা আর শ্রীমন৷। ডঃ বিশ্বাস খাবার দেখে মলিন হাসেন, “না, আমার একেবারেই খেতে ইচ্ছে নেই। তোরা বল, ফিরে গিয়ে আমি কি কৈফিয়ত দেবো? কি বলবো? এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশের পুলিশ দু-বার ঘুরে গেছে।’’ শান্তা জানায় ওরা বলে গেছে দু চার ঘন্টা ছাড়াছাড়া এসে  ওরা জানান দিয়ে যাবে, পুলিশ বিভাগে খবর চলছে, রাত বারোটার আগেই ওদের খোঁজার জন্য দশজনের একটা দল পাহাড়ি এলাকায় নেমে পরবে।

“স্যার, একটু কিছু খেয়ে নিন, একটু রেস্ট নিন, আমরা তিনজন তো আছি, পুলিশ আসলে আপনাকে ডেকে দেবো” সিগারেটের প্যাকেটটা সরিয়ে নিজের কোটের পকেটে ঠোকায় শ্রীমন, ‘‘এটা নিয়ে যাচ্ছি, এখন আর সিগারেট খাওয়া চলবে না। আয় তোরা, নীতা আর শান্তা,  তোরা ঘ রে যা, পারলে এক টু রেস্ট নে, আমি স্যারের কাছে একটু বসে মেইন লবিতে চলে যাবো, ওখানে টেলিভিশন আছে”

ডঃ বিশ্বাস কাতর চোখে তাকান ওদের দিকে, “আয় না, আমার ঘরে বসেই আমরা খাবারগুলো খেয়ে নি, আজ আমরা তো শুধু চারজন, আমার ঘরের ছোট্ট, আমার ঘরের ছোট্ট টেবিলটাতেই সবার জায়গা হয়ে যাবে।’’ ওঁনার গলাটা কেঁপে যায়, নীতাও কষ্ট করে গলার মধ্যে কান্নাটাকে আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করে ৷ খাবার মুখে দিয়ে নীতা টের পায় ওর ভয়ানক ক্ষিদে পেয়েছিল, অনুভব করে অন্য তিনজনের ভঙ্গিমাতেও তারই আভাষ৷

খাওয়া শেষ করে ওঠার আগেই দরজায় কলিংবেল। একজন কনষ্টেবল। ছোট খাটো শক্তপোক্ত চেহারা, ভালো করে ওদের সবাইকে জরিপ করে বলে যায় খারাপ খবর নেই যখন, ওদের কিছু করারও নেই। রাত ভোর না হওয়া অবদি কিছুই ফাইনাল কোন স্টেটমেন্ট দেওয়া  যাবে না। কোনরকমে টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢোকেন ডঃ বিশ্বাস, হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন।  

ওরা তিন জন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, বিকেবিকে যে এই অবস্থায় কোন দিন দেখতে হবে, কারোর দুঃস্বপ্নেও কোনদিন আসে নি শান্তা আস্তে আস্তে বলে, “স্যার আপনি  আলো নিবিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন, আমরা জেগে আছি।” শ্রীমনও সায়  দেয়। অসহায় শরীরটাকে কোন রকমে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ডঃ বিশ্বাস ক্লান্ত স্বরে বলেন “ঠিক আছে৷” আলো নিভিয়ে দিয়ে ওরা ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসে। ঘরে এসে শান্তা আর নীতা একে ওপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, শ্রীমন কড়িডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছে, ও আজকে বাইরেই থাকবে বলে দিয়েছে, ওর গমন পথের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে নীতা।

“শুয়ে পড় নীতা।” শান্তা নিজের গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে নীতাকে একটা স্লিপীং ব্যাগ এগিয়ে দেয়। জড়ভরতের মতো স্লিপিং ব্যাগটা টেনে তার মধ্যে ঢুকে পড়ে নীতা, ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে, শান্তা এসে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে নীতার কান্নার আবেগে টলতে থাকা শরীরটাকে স্পর্শ করে রাখে, তার পর আস্তে করে উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পরে।

দূরে কোথাও বারোটা ঘন্টা বাজে, ওরা দুজনেই চুপ করে শুয়ে থাকে অপরের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটানোর চিন্তায়৷ অথচ আজ সকালেই দিনটা কি সুন্দরই না ছিল!

“কি রে, শ্রীমন সত্যি সত্যি আমাদের সঙ্গে যাবি? বোর হয়ে যাবি না তো?’’ শান্তা প্রশ্ন করেছিল৷

‘‘সেটা ঘুরে এসে বিকেল বলব’’ শ্রীমন কথা ঘুরিয়েছিল, “চল তো এখন, সেই ছোটবেলায় কবে হুড্র, জোনা ফলস দেখেছি! আমারও যে ফলস দেখার ইচ্ছে নেই কে বলল?”

রাহালা জলপ্রপতাতের সামনে নীতা আবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, জলের সাথে সময়ের মিল পৃথিবীর নানা ভাষায়, কবিতায়-গল্পে-গাঁথায় বহুল আলোচিত,  কিন্তু চোখের সামনে যা দেখছে তার সাথে পড়া কোন বর্ণনার মিল নীতা খুঁজে পায়নি। হিমবাহ গলা অকলুষিত জল, যেন অজস্র হীরুক খন্ড, এক যাদুর মায়ায় তরল হয়ে অনন্ত ধারায় ঝরে পড়ছে। নীতা মুগ্ধ বিষ্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, কবে এই ধারা শুরু হয়েছে, কবে এই ধারা  থামবে, বৈজ্ঞানিক মতে তার একটা উত্তর আছে হয়তো, কিন্তু এই মুহুর্ত তার আলোচনায় যেতে ইচ্ছে হয় নি ওর। পিছনে তুষারাবৃত রোটাঙ্গ, দুই ধারে আকাশ ছোয়া পর্বত শিখর, আর তার মাঝে একটি জলের ধারা, সময় শব্দটার এক মূর্তমতি প্রতিচ্ছবি।

ও অভিভূত হয়ে বলে উঠেছিল, “চল রে, আমার পয়সা ওঠে গেছে, মানালী সফর থেকে আর নতুন কিছু পাওয়ার নেই।”

“সবে দুপুর এখন...., এটো তাড়াতাড়ি ফিরে যাবি? মনুর মন্দির দেখবি না?” একগুচ্ছ উৎসাহ গলায় ঢেলে শ্রীমন প্রশ্ন করেছিল৷ “চল  তাহলে।” শান্তাও রাজী ছিল।

একটা উচু টিলার অপর দোতলা মন্দির, কাঠ আর কন্চি দিয়ে বানানো, বেশ কিছু স্থানীয়, পুন্যকামী মানুষের ভীড়, বাইরে থেকে সমাগত তীর্থকামী জনসাধারনের জন্য বিজ্ঞপ্তি, হাত আর হাঁটু ঢাকা জামা কাপড় পরে মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ। পাথর বিছানো পিছল পথে বেয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয়। কাঠের কাজের নানা খুটিনাটি দেওয়ালের শোভা বাড়াচ্ছে। ফেরার রাস্তায় শ্রীমন হঠাৎ হেসে উঠে বলেছিল, “সারা ভারতবর্ষে সম্ভবত এই একটিই মন্দির তথাকথিত মানুষের সৃষ্টিকর্তা মনুর নামে উপসর্গকৃত! ইতিহাসের কি নিষ্টুর পরিহাস।”

“এই শ্রীমন, তুই যেন ভুলেও ভগবান মনুর নামে কিছু বিরূপ মন্তব্য করিস না, জানিস এই ভদ্রলোকই মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির লিপিকার মানবধর্ম শাস্ত্রর উদভাবক । ওটা অনেকটা খ্রীষ্টানদের বাইবেলের মতো বই, নিয়মাবলি সমৃদ্ধ বই।” নীতা কপট নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল।

‘মান ইয়া না মান, মৈয় তেরা মেহমান’, শ্রীমন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, ‘দেখ ভেবে,  ২০০ খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ২০০ খ্রীষ্টাব্দ অবদি ভারতবর্ষের মানুষ অরফে হিন্দু অরফে ইন্দাস নদীর তীরে বসবাস ক রা মানুষ ভগবৎ গীতার দেখানো পথে দিব্বি চলল, কোন অসুবিধে হলো না! তরপরে মনু এসে মানব সমাজকে নতুন নিয়মে বাধার চেষ্টা করতে শুরু করলেন। বলি হারি যাই!’’

‘‘বাবা তুই তো খুব জ্ঞানী!’’ শান্তা টিটকারি দিয়েছিল।

‘‘অথচ কোন অহংকার নেই,’’ নীতা যোগ দিয়েছিল।

“না রে না, তোরা যখন ভিতরে গেলি, একটা স্থানীয় ছোকরা দেখলাম একদল পর্যটকের কাছে খুব রেল্লা নিচ্ছে, শুনে নিলাম চট করে, তোদের  কাছে আমিও এলেম দেখিয়ে দিলাম।”

‘আসতে পারি? শ্রীমনের গলার শব্দ ওরা দুজনে একসঙ্গে চমকিয়ে ওঠে, “আয় আমরা তিনজনে বাইরে বসেই রাতটা কাটিয়ে দিই, পুলিস যদি আসে দেখতে পাবো,’’ শ্রীমনও ক্লান্ত৷

‘‘তাই চল।” স্লিপিংব্যাগ, কম্বল নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ওরা তিনজনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে, কড়িডোর দিয়ে হেঁটে, বিকেবির ঘর ছাড়িয়ে একটা ছোট্ট বারান্দা, ওখান থেকে বাইরের রাস্তা দেখা যায়।

“কি রে তোরা? ঘুমোতে পারলি না তো? আমাকে তো  খুব বলছিলি!’’ একটা ইজি চেয়ারে পা তুলে ডঃ বিশ্বাস কে জানে কখন থেকে বসে আছেন। ওদের দেখে মুখ তুলে তাকান, ওঁনার দুই চোখ লাল, কোটরে ঢুকে গেছে চোখ, বিড়বিড় করে বলেন, “কি বলব? ফিরে গিয়ে নয়জন বাবা-মাকে কি জবাবদিহি করবো আমি?”

শ্রীমন বলে “স্যার এখনই ভেঙে পরছেন কেন?” ডঃ বিশ্বাস হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন।

শ্রীমনের দিকে তাকিয়ে থাকে নীতা, ভাগ্যিস ও ছিল।  ভাগ্যিস ওদের সাথে সকালে শ্রীমন যোগ দিয়েছিল, তা না হলে ওর দুজন মেয়ে কি ডঃ বিশ্বাসকে  এই ভাবে বোঝাতে পারতো? বিকেবিও কেমন যেন শ্রীমনের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন।

“কি  রে? তুই স্বেচ্ছায় দুটো মেয়ের সাথে চলে এলি, অন্য ছেলেগুলো তোকে যা আওয়াজ দেবে না!’’ তিনটে নাগাদ ওরা হোষ্টেলে ফেরার পথ ধরেছিল৷

‘‘ওরা সব বখাটে অর্বাচীন,’’ নীতার কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রীমন দাঁত বার করে হেসেছিল, “তবে মন্দিরা আর অগ্নি থাকলে ব্যাপারটা আরো ভালো হতো! গত পাঁচ দিন ধরে কতো বলিউড, টলিউড হলিউডের শুটিং-স্পট দেখলাম, একটু ঝালিয়ে নেওয়া যেতো।’’

‘‘আহা রে! এলেন কোন হিরো! আয়নায় নিজের মুখটা দেখেছিস?’’ নীতা ওকে থামিয়েছিল, ‘‘হিরো হতে গেলে শুধু ভালো ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করলেই হয় না, গান আর নাচও জানতে হয়’’

‘‘বেশ তো, এখনই প্রমাণ হয়ে যাক!’’ শ্রীমন আচমকা ঝুঁকে পরে নীতাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়েছিল।

“এই এই কি করছিস?  নামা নামা এখনই, বলছি,’’ নীতা ছটফট করে ওঠেছিল৷

‘‘ঠিক আছে, মনে থাকে যেন, আবার আমার নামে কিছু বললে কিন্তু’.... শ্রীমন চোখ পাকায়, ঠোট সরু করে আনে মাথাটা নামিয়ে আনে ওর মুখের কাছে। ইংগীতটা পরিষ্কার।

 ‘‘শোন...ভালো হচ্ছে না বলে দিচ্ছি, তোর থাপ্পর খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে?’’ নীতা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। শান্তা হো হো করে হাসছে, ওর হাসিতে গলা মিলিয়েছিল শ্রীমনও।

দু-চার মিনিট জোরে হাঁটার পর গতি স্লথ করেছিল নীতা, ততক্ষণে বুকের ধুকপুকানীটা একটু কমেছে, বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে বলেছিল, ‘‘খববদার যদি কাউকে বলেছিস।”

শ্রীমন ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘‘না না মাথা খারাপ,’’ তারপর মেয়েলী ভঙ্গিমায় বলেছিল ‘গড প্রমিস, ভগবানের ইব্বি।’’

 

পর্ব ৪:- কুউ ঝিক ঝিক

দেখতে দেখতে ভোর হয়ে আসে, একটা একটা করে সূর্যের রশ্মি পাহারের গায়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে করে পাহাড়ের পশ্চাৎপট ফুটে উঠছে। নীতা তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের দিকে, কি সুন্দর অথচ কি নিষ্টুর! কোনদিন কি আবার দেখা হবে ওর কলেজের নয়জন বন্ধুর সাথে, ওরা কি তবে চিরতরে হারিয়েই গেল?

দূর থেকে একটা সাইরেনের শব্দ ভেসে আসে, সঙ্গে করে নিয়ে আসে একরাশ ভীতি। শ্রীমন চট করে পাঁচিলের সামনে চলে আসে, মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্ট করে, সাইরেনের শব্দটা আবার দুই চার বার ডাক দিয়ে আবার দূরে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। নীতা ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শ্রীমনের দিকে, পাঁচিলের ধার থেকে ও কেন নড়ছে না? একেবারে ঝুঁকে পরে কি দেখার চেষ্টা করছে ও? সূর্যের আলোটা বাড়ছে...., একেবারে ঠিক যেন চোখের ওপর, হাত দিয়ে ছায়া করার চেষ্টা করে নীতা। ঠান্ডাও যেন হঠাৎ বেড়ে গেলো, একেবারে তীরের ফলার মতো স্লিপিং ব্যাগের রক্ষা-কবচ ভেদ করে গায়ে এসে বিঁধছে। কিন্তু পাঁচিলের এতো ধারে শ্রীমন কি করছে? এবার যেন ঝুঁকে বাইরেই পরে যাবে! তাহলে কি সাইরেনটা সত্যি সত্যি ওদের জন্যেই ছিল? ইউথ হোষ্টেলের পাশে একটা ছোট্ট হাসপাতাল দেখছে মনে পরে যায় নীতার।

শ্রীমনের দিকে তাকিয়ে থাকে ও, নিজে গিয়ে যে উঠে দাঁড়িয়ে দেখবে এমন সাহস আর সামর্থ কোনটাই নেই ওর শরীরে। মুখ ফিরিয়ে দেখে ডঃ বিশ্বাসের মাথাটা একদিকে গড়িয়ে গেছে, উনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শান্তাও হাতে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, বড়ো বড়ো নিশ্বাসের সাথে সাথে ওর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

শ্রীমন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়, সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চিৎকার করে বলে “স্যার, ওরা আসছে, ওরা সবাই হেঁটে আসছে আমি দেখেছি, ঐ দূরে!”

‘‘বলিস কি? কোথায়?’’ বিকেবি টলমল করে উঠে দাঁড়ান।

‘‘সত্যিই?” শান্তা দৌড়ে গিয়ে বসে পরে,  দুই হাত মাথায় ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।

নীতা উঠে দাঁড়ায় “চলতো শ্রীমন আমার সাথে, ওদের প্রত্যেকের গালে দুটো করে থাপ্পড় লাগিয়ে আসি, চল।” একটা ঝটকায় স্লিপিং ব্যগের আবরণ থেকে বেড়িয়ে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে, জুতো পায়ে গলিয়ে, ঠান্ডার মধ্যে নীতা একলাই বেরিয়ে পড়ে৷

ডঃ বিশ্বাস আচমকা হেসে ওঠেন, দুই হাতে এক ছাত্র আর এক ছাত্রীকে বুকে চেপে ধরেন, “বাপরে! যেন দুই টন একটা হাতি বুক থেকে নেমে গেল রে! কি  ভীষণ হালকা লাগছে, ওদের কিছু বলিস না যেন! চল একেবারে মানালীর বাস স্টেশনে বসেই কথা হবে। আমাদের ফিরতে হবে তো! এখান থেকে দিল্লী,  কালই আবার  দিল্লী থেকে ট্রেন, ওরা আসলেই সবাই মিলে বেড়িয়ে পড়বো।”

বাস ষ্টেশনে বসে সব জানা যায়। বিপাশার পাশ দিয়ে হেঁটে দুই মাইল গিয়ে আবার ফিরে আসার ছক করে বেড়িয়ে ছিল ওরা নয়জন। কিন্তু দিক নির্ণয়ে গাফিলতি রয়ে গিয়েছিল, একটা পাহাড়ী পথ পাড়িয়ে মানালীর অপর দিকে চলে গিয়েছিল ওরা। যতক্ষণে খেয়াল হয়েছে যে ইউথ হোস্টেলের বিপরীত দিকে অনেকখানি হেঁটে ফেলেছে, ততক্ষণে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ী রাস্তায় চলাটা যে নিতান্তই মুর্খামি, সেইটুকু ওদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সায়ন্তন বুদ্ধি দিয়েছিল, এখন ফিরে যাওয়ার চেষ্ট না করে, এগিয়ে যাওয়া উচিত। তিমির সবাইকে গা তলায় বসিয়ে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে আবার আবার দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে সুখবর নিয়ে ফিরেছিল। সামনে একটা গ্রাম দেখতে পেয়েছে ও। তখন ওরা সবাই মিলে এগিয়ে গিয়েছিল গ্রামটার দিকে, ততক্ষণে অন্ধকার আরো ঘন হয়ে এসেছে।  একটা ধাবার সামনে রাত্রিরটা কাটিয়ে পরেরদিন ভালো করে ভোর হওয়ার আগেই ওরা বেরিয়ে পড়েছিল, আকাশে সূর্য থাকতে মানালীর রাস্তা বুঝতে অসুবিধে হয় নি।  তাছাড়া পথ-চলতি পাহাড়ী লোকেদের কাছেও সাহায্যের অভাব হয় নি কখনও। অসুবিধের মধ্যে ওরা সবাই যেমন ক্লান্ত তেমন ক্ষুধার্ত এবং সায়ন্তন মৌনব্রত নিয়েছে। সন্দীপ জানালো, সায়ন্তন রাস্তায় জানায় এই রকম ট্রেকিংয়ের ইচ্ছা থাকলে কম্পাস নিয়ে বেড়োনো উচিত, আমেরিকাতে সবাই তাই করে। কথাটা বারতিনেক শোনার পর, অগ্নি আর নিতে পারে নি। অগ্নির হাতে একটা বড় চিমটে খাওয়ার পর সায়ন্তন কথা বলা বন্ধ করেছে। তা, পুলিশের সাহায্য নেওয়া হলো না কেন? তার উত্তরে নিঃশব্দে থাকেই সায়ন্তন আঙ্গুল তুলে ধরল মন্দিরার দিকে। তিমিরের কাছে জানা গেল, মন্দিরা ওদের বুঝিয়েছে বেশি জানাজানি না করাই ভালো, তাতে আরো হই-হই হতো, অশান্তি বাড়তে পারতো। ওরা যখন সবাই সুস্থ আছেই খামোকা পুলিশের প্রয়োজন কি? মন্দিরা জানতো ফিরে গিয়ে ঝুঝিয়ে বললেই হবে, সবার রাগ পড়ে যাবে।

বিকেবি চুপ করে ওদের কথা শোনেন, তারপর বলেন, “এই শেষ, তোরা এটা জেনে রাখ, তোদের মতো ইঁচোর পাকা ছেলে মেয়ে নিয়ে পাহাড়ী এলাকায় বেড়াতে আসার ঝুঁকি আমি জীবনে আর নিচ্ছি না।”

ওরা সবাই মিলে সমবেতভাবে,  “স্যার আমরা সবাই ভীষণ দুঃখিত, প্লিজ ক্ষমা করে দিন’’  বলার আগেই উনি শ্রীমনের দিকে ফেরেন, বলেন, “প্যাকেটটা দে, আমার ছেলেও কোনদিন আমার সিগারেটের প্যাকেটে হাত দেওয়ার সাহস করে নি’’।  সায়্ন্তনের গালটা তখনও লাল, এতো কষ্ট করে সারা রাত গাছের নিচে কাটিয়ে, তারপর দুই বেলা তেরো তেরো ২৬ কিলোমিটার হাঁটার পর নীতার থাপ্পর মারার হুমকি ও ভালো মনে নিতে পারে নি৷

“নীতা?’’

চলন্ত ট্রেন-দুলনীর মাদকতায় ক্রমশঃ তলিয়ে যেতে যেতে নীতা লক্ষ্য করে শ্রীমন ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে, পিঠটা জানলায় ঠেকানো, তাতে আরো সুবিধে হচ্ছে৷

‘‘কি রে?’’ নীতা শব্দ না করে প্রশ্ন করে, চোখ সরাতে চেষ্টা করে, শ্রীমনের খয়েরি-সবুজ রঙ্গা চোখটাকে ট্রেনের চল্লিশ বাল্বের আলোয় ঘন সবুজ লাগে, মুখ সরাতেও গিয়েও আটকা পড়ে যায়, চার পাশের বাঙ্ক থেকে ঘুমের শব্দ অসছে, সামনের বেন্চে ডঃ বিশ্বাস মুখে বই চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। ওঁনার ঠিক উপরের বাঙ্কে তমাল আর মিঠুন, ওরাও অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তার পাশে উপরের বাঙ্কে অগ্নি, আধশোয়া অবস্থায় শান্তার সঙ্গে এতক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলছিল, ওরাও এখন চুপ।

“তোর চোখে ঘুম নেই?”

“তোর কথা ভাবছি, নাঃ ভুল বললাম, তোকে ভাবছি”৷ উত্তর দিতে একমুহুর্ত নেয় না শ্রীমন, যেন এই প্রশ্নটার জন্যেই এতক্ষন প্রতিক্ষা করছিল, হাসে, নীতার চোখ থেকে না সরিয়ে, আরো সোজা হয়ে বসে। নীতার ভ্রুভঙ্গী দেখে যোগ দেয়, “কেন, তোর আপত্তি আছে?’’

“নাহ্, আপত্তির কি আছে? ভাব না! আমাকে সেটা বলতে হবে না,’’ নীতা প্রায় জোর করে চোখ সরিয়ে নেয়, শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠা একটা শিহরণকে মাঝপথে রুদ্ধ করা চেষ্টা করে। কামরার হালকা আলো-আধারীর মায়ায় নিজেকে সমর্পন করতে ইচ্ছা হয়, শ্রীমনের দীর্ঘ আধশোয়া শরীরকে অচেনা লাগে।

“আয় না এখানে, আমার কাছে এসে বস না’’ শ্রীমনের ঘনে স্বরে যেন এক রোমান্চের আহ্বান। নীতার বুকে মৃদু কম্পন উপলব্ধি করে, ‘‘না রে, এইখানেই বেশ আছি।”

‘‘বেশ, তোর যা ইচ্ছে,’’ শ্রীমন মুখ ভারী করে, ‘‘আমার হাত ধরে তুই যখন একটা একটা করে পাথরের ওপর পা ফেলছিলি, পাশ দিয়ে হইহই  করে বিয়াস বয়ে চলেছে, শুধু তুই আর আমি ...’’, উদাসী ভাব করে শ্রীমন আনমনে ছুড়ে দেয় কথাটা।

‘‘সেটা আবার কখন হলো ? তুই কি স্বপ্ন দেখছিস নাকি?’’

শ্রীমন নীতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ‘‘মানালীতে সব আছে, একদিকে গরম জলের ফোয়ারা, আবার অন্য দিকে বরফের মরুভুমি আশ্চর্য, অনেকটা তোর মতন’’ ওর ঘনস্বরে ইয়ারকীর  কোন আভাস মাত্র নেই।

নীতা চমকে ওঠে, ‘‘সেটা আবার কি বলছিস?’’ ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে অন্য কেউ জেগে গেল না তো!

শ্রীমনের থামার কোন ইচ্ছা নেই, ও বলে চলে, ‘‘এই সাত দিনে তোকে অনেক কাছ থেকে দেখলাম, বিপাশা নদীটাকে যেমনি, কোন কাছ থেকে কখনও দূর থেকে, বিভিন্ন সময়। বিভিন্ন সময়ে বিপাশার বিভিন্ন রূপ।”

‘‘তা ঠিক’’, নীতা কোন রকমে মাথা নাড়ে, ওর গলা শুকিয়ে গেছে৷

শ্রীমন বলে চলে, ‘‘তোকেও নানা রূপে দেখতে পেলাম, আমাকে তুই যেই রকম বুঝিস আর কেউ কি সেই রকম বুঝবে?”

নীতার হাত ঠান্ডা হয়ে আসে, শ্রীমন কি বলতে চাইছে বোঝার চেষ্ঠা করে, অন্যমনস্ক স্বরে উত্তর দেয়  ‘হু!’৷

‘‘নীতা, চল পালিয়ে যাবি? তুই আর আমি?’’

নীতা হাসে, ‘না রে৷’

শ্রীমনও হেসে ওঠে, ‘‘তুই ত মহা কবি। কোনদিন কি এই দিনগুলোর কথা লিখবি? আমরা সাতদিনে এই যে বিরাট একটা গল্প তৈরি করলাম, তুই লিখবি না?” শ্রীমন হাই তোলে, ‘‘বিপাশা কাছে আর দূরে?”

‘‘কে জানে?” নীতা উত্তর দেয়, কিছু বলতে গেলে ও ধরা পরে যাবে, যতসম্ভব কম বলা যায় তার চেষ্টা করে।

“আমার কথা লিখবি?’’ ‘দেখি৷’ নীতা আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়৷ শ্রীমনের ঘন সবুজ চোখে পান্নার আলো ঝলঝলমল করছে, নীতার চোখে লাগে, ওর শরীর কেঁপে ওঠে, ‘‘তুই ঘুমো তো, আমার ও আমার ঘুম পাচ্ছে’’, নীতা হাই তোলে, ‘‘ঘুমিয়ে নে একটু, সোমবার গিয়ে মঙ্গলবার থেকে আবার কলেজ যেতে হবে, ফাইনাল আসছে, পড়াশোনা বাকি আছে, কেমেষ্টির ল্যাব নোটবুক লেখা বাকি আছে, অনেক কাজ জমা আছে৷’’

‘‘লিখিস কিন্তু,’’ শ্রীমন চোখের ওপর কম্বল ঢাকা দেয়, মাথায় বালিশটা টেনে নেয়। নীতা প্রায় দম বন্ধ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আর কেউ জেগে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করে৷ কলেজের চিন্তা ওর মনে ছেয়ে যেতে থাকে, ও জানতে পারে না এরই মধ্যে মানালীর মায়া আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাছে। ভোরবেলায় ও যখন আবার জাগবে, সহপাঠীদের আবার সহপাঠীই মনে হবে, ডঃ বিশ্বাস একজন দুর্দান্ত প্রফেসরের রূপে দেখা দেবেন। এই সাতদিনের অভিজ্ঞতা একটা স্বপ্ন মনে হবে।

ক্যান্ডলট্রি

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

মধ্য আমেরিকার বৃক্ষ

ক্যান্ডলট্রি  ও গুয়াজিলটে

মোহম্মদ জয়নুল আবেদিন

ডালাস, টেক্সাস

pic2.JPG
pic8.JPG

গুয়াজিলটে ফল

pic1.JPG

ক্যান্ডলট্রি ফল

০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্থলপথে কলকাতা যাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সোসাইটি অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন, ইনডিয়া’-এর বার্ষিক কনফারেন্সে যোগ দেবার জন্য। কনফারেন্স শেষে স্ত্রীর চোখের চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাই “সঙ্কর নেত্রালয়ে’। চিকিৎসা শেষে ফেরার পথে ২দিন কলকাতায় যাত্রাবিরতি ছিল। আমার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল উইলিয়াম রক্সবার্গ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের অন্যান্য দিকপালের স্মৃতিবিজড়িত ’শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন’ দেখা। গার্ডেনটি হুগলী নদীর অপর পারে হাওড়া জেলায় অবস্থিত। বৃক্ষগুরু দ্বিজেন শর্মা মহোদয়ের অনুবাদগ্রন্থ ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার” পড়ে জানতে পারি যে ১৮৪৮ সালে স্যার জোসেফ ডালটন হুকার যখন এদেশের গাছপালা সরে জমিনে সমীক্ষা করার কাজে ৩ বৎসরের জন্য বৃটিশ ভারতে এসেছিলেন তখন প্রথমেই তিনি এ গার্ডনের আতিথ্য বরণ করেছিলেন। ১৮৪৮-১৮৫১ সময়ে তার সংগৃহীত দার্জিলিং- সিকিম-তিব্বত অঞ্চলের উদ্ভিদের নমুনাগুলি এ গার্ডেনের মাধ্যমেই বিলেতে প্রেরণ করা হত।

'শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডন’ পরিদর্শন করার সময় ওখানে দেখা যে সমস্ত গাছ আমার মনে রেখাপাত করতে পেরেছে তার মধ্যে সসেজট্রি, পালান ও ৩৬০ বছরের পুরানো বট গাছ অন্যতম। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের শেষ দিন। এসময় নাম না জানা একটি গাছে মোমবাতির মত লম্বা ঈষৎ হলুদাভ সাদা একটি ফল দেখে সেটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। নরম মাংসল এই পাকা ফলটি চিড়ে মরিচের বীজের মত প্রচুর চেপ্টা বীজ পাই। বীজগুলি আমার বাসার ছাদে মাটিভরা প্যাকেটে বপন করার পর যথাসময়ে অনেক চারা গজায়। এর কয়েকটি চারা আমি আমাদের এই সাভার ডেনড্রারিয়ামের কয়েক জায়গায় রোপণ করি। পরবর্তীতে এক সময় এ গাছে মোমবাতির মত লম্বা সাদা ফল ধরে। এর পাতা, ফুল, ফল দেখে গাছটি সনাক্ত করতে সক্ষম হই ক্যান্ডলট্রি বা মোমবাতি বৃক্ষ হিসেবে। এটি ছিল আমাদের বৃক্ষ বাগানে নতুন সহযোজন।

 

বাংলা নামঃ মোমবাতি গাছ

ইংরেজী নাম: Candle Tree

বৈজ্ঞানিক নাম: Parmentiera cereifera Seem

পরিবার: Bignoniaceae

 

ক্যান্ডলট্রি বা মোমবাতি গাছ মধ্য আমেরিকার মেস্কিকো, পানামা, হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালার ছড়ানো ডালপালায় ছোট পত্রমোচী বৃক্ষ, উচ্চতা ৬-৮ মিটার। কাণ্ডের চারিদিকে শেকড়ের কাছ থেকে অনেক চারা (কুশি) বের হয়। সেগুলি কেটে না দিলে গাছটির ঝোপালো হওয়ার প্রবণতা থাকে। বাকল বাদামী মেটে রংয়ের। পাতা যৌগিক, ত্রিপত্রিক, পত্রবিন্যাস বিপ্রতীপ (opposite), পত্রবৃন্ত পক্ষল, ৫সে.মি লম্বা। পত্রিকা ডিম্বাকার, আগা চোখা, পত্রিকার কিনারা ভোঁতা খাঁজ

pic7.JPG

গুয়াজিলটে পাতা

pic4.JPG

ক্যান্ডলট্রি, ফুলের কুঁড়ি

বিশিষ্ট।  এর সবুজাভ সাদা ফুল ও মোমবাতির মত সাদা ফল কাণ্ড বা কাষ্ঠল শাখার গায়ে ধরে বলে এটি কলিফ্লোরা (Cauliflora) জাতীয় উদ্ভিদ। ফুল একক বা ৩-৪টির গুচ্ছ, ব্যাস ব্যাস ৪-৫সে.মি, বোঁটা ছোট, ফুলের দল ছড়ানো চোঙাকৃতির, লতিকা ৫টি, পুংকেশর ৪টি সাদাটে বা গোলাপি। ফল মাংসল, ঝুলন্ত, বেলনাকার (cylindrical), ৩০-৫০ সে.মি লম্বা, সাদা বা হলদেটে মোমবাতির মত দেখতে। বাহারি ফুল ও মোমবাতির মত ফলের কারণে উষ্মমন্ডলীয় এলাকার বাগানে গাছটি রোপণ করা হয়। পাতা ও ফল পশুখাদ্য। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে আমি এগাছ কোথাও দেখিনি। ইতিমধ্যে এ গাছটির ফল থেকে আমি আরো চারা করতে সক্ষম হয়েছি ও বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করেছি।

গুয়াজিলটে

২৫ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বৃক্ষগুরু দ্বিজেন শর্মা মহোদয়ের ’তরুপল্লব’-এর উদ্যোগে পূর্বাচলের জিন্দা পার্কে এক বৃক্ষচেনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। দুঃখের বিষয় যে ঐ অনুষ্ঠানেই বৃক্ষগুরুর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। আরো দেখা হয়েছিল ’তরুপল্লব’ এর সাধারন সম্পাদক মোকররম হোসেন, সমাজকর্মী রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, প্রকৃতিবিদ বিপ্রদাস বড়ুয়া ও বৃক্ষবিশারদ বোটানিষ্ট সামসুল হক সাহেবের সাথেও। এ অনুষ্ঠানে আমি আমার উত্তোলিত কিছূ অপ্রচলিত গাছের চারা প্রদর্শন করেছিলাম যা উপস্থিত সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

এ সময় আমি জিন্দা পার্ক ক্যাম্পাসে একটি নতুন গাছ খুঁজে পাই। প্রথমে এর যৌগিক পত্র ও খাঁজকাটা পত্রিকা দেখে একে আমার পূর্ব পরিচিত মোমবাতি গাছই (ক্যান্ডলট্রি) মনে করেছিলাম। কিন্তু গাছের ডালে কিছুটা লম্বাটে কামরাঙ্গার আকৃতির দুটি ফল দেখে বুঝতে পারলাম যে এটি একই পরিবারের কিন্তু অন্য প্রজাতির গাছ। লালচে আভাযুক্ত হলদেটে ফল দেখে পরিপক্কই মনে হল। ঐ গাছ থেকে একটি ’হালাপেনিও’(Jalapeno) মরিচের মত মাংসল ফল যোগাড় করতে সক্ষম হই। বাসায় এসে কেটে দেখি এগুলোও মোমবাতি ফলের মতই নরম মাংসল, বীজও তেমনি চ্যাপ্টা মরিচের বীজের মত। এর বেশীর ভাগ বীজ চিটা হওয়া সত্ত্বেও বীজগুলি আমার ছাদের নার্সারিতে পলিব্যাগে বপন করি। মাস খানেক পর ১টি মাত্র চারা গজায়। তার অনেক পর দ্বিতীয় আর ১টি চারা গজায়। মোমবাতির চারার পত্রিকার তুলনায় এর পত্রিকা আরো চোখা লতিকা বিশিষ্ট। যাক এভাবে ভাগ্যক্রমে আমি গুয়াজিলটের ২টি চারা করতে সক্ষম হই। পরবর্তীতে জুলাই ২০১৭ এর প্রথম দিকে আমি এদেরকে আমার বৃক্ষবাগানে মোমবাতির চারার পাশাপাশি রোপণ করি। এগুলো এখন পর্যন্ত এগুলো বেঁচে আছে। শীতে এদের পাতা ঝরে যায়। এটিও মোমবাতি গাছের নিকটাত্মীয়, যার আদি নিবাস মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালা।

ইংরেজী নাম: Guajilote

বৈজ্ঞানিক নামঃ Parmentiera edulis DC

পরিবার: Bignoniaceae

গুয়াজিলটে মাঝারী উচ্চতার পত্রমোচী (১৬মি.) বৃক্ষ। পাতা যৌগিক, ত্রিপত্রিক, পত্রাক্ষ পক্ষল। পত্রিকা বিভিন্ন মাপের, ডিম্বাকার, ৮-১৫ সে.মি লম্বা, আগা চোখা। ফুল সবুজাভ হলুদ, ব্যাস ৫সে.মি, চোঙ্গাকৃতির। ফল মাংশল, সবুজাভ হলুদ, ধারযুক্ত, ৬-১০ সে.মি লম্বা, আগা চোখা ও বাঁকানো। এ গাছের পাতা পশুখাদ্য, ফল খাবার উপযোগী। আমাদের মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও এ গাছটি আছে।

মধ্য আমেরিকার গাছ ক্যান্ডলট্রি ও গুয়াজিলটে যে কোন বোটানিক্যাল গার্ডেন বা উদ্ভিদ উদ্যানের সংগ্রহে রাখার উপযোগী। এ গাছ দুটি আমাদের এই সাভার ডেনড্রারিয়ামের সংগ্রহে রাখতে পেরে আমরা গর্বিত। গাছগুলির উপযুক্ত যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ রইল।

pic6.JPG

ক্যান্ডলট্রি চারা

pic5.JPG

গুয়াজিলটে চারা

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

শনি
DebdasBhattacharya.jpg

শনি

দেবদাস ভট্টাচার্য্য

ডালাস, টেক্সাস

village4.jpg

দেখতে দেখতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিলেন, নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন। চব্বিশ বছর কম সময় নয়, জীবনে অনেক কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু আবার একই রকম থেকে গেছে। আটত্রিশে গ্রাম ছেড়েছিলেন, আজ বাষট্টি। লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছেন, মেয়ের গরমের ছুটি আড়াই মাস, পুরোটাই গ্রামে মায়ের কাছে থাকবেন। খোলা মাঠ, যদিও আয়তনে অনেক ছোট হয়ে গেছে তবুও চোখ কোথাও আটকাচ্ছে না। মাঠের ধার ঘেঁষে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছেন। এ রাস্তাগুলোতে এখনো মোরাম পড়েনি, মাটির পুরো। চপ্পল থেকে পা খুলে একটু ঘষে নিলেন, শির শির করে ঊঠল শরীরটা। পুরনো ছোঁয়া খেলে গেল, অদ্ভূত, অনুভূতিগুলো এখনো তাজা আছে। প্রাণায়ামের ভঙ্গিতে নিশ্বাস নিচ্ছেন, ছাড়ছেন। সূর্য এখনো ওঠেনি, বাতাস হাল্কা ঠান্ডা কিন্তু মিষ্টি। কোলকাতার দম বন্ধ করা, চ্যাটচেটে অবস্থা নয়। গায়ের পাশ ঘেঁষে একপাল ছাগল ও কয়েকটা গরু নিয়ে নেমে গেল একটি দশ বারো বছরের মেয়ে। কিছুটা তাড়িয়ে নিয়ে মাঠের মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে ফিরে এল। এ বয়সে তিনিও ঠিক এটাই করতেন, তবে ছাগল ছিল না শুধু গরু। মেয়েটি ওকে দেখে নিয়ে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ফিরে যাচ্ছিল। অপুর্ব ডাকলেন – কি নামরে তোর? একটু থমকে দাঁড়াল মেয়েটি, আগে দেখেনি। ঘাড় বেঁকিয়ে জবাব দিল – পাতু, ভাল নাম প্রতিমা। তুমি নতুন এয়েছ এ গাঁয়ে? অপুর্ব মাথা নাড়লেন। জিগ্যেস করলেন – এগুলো ছেড়ে দিয়ে চললি যে বড়? হারিয়ে যাবে না? ফিক করে হেসে ফেলল পাতু। ভারী অবাক হয়েছে, এমনি গলায় বলল – ওমা, হারিয়ে যাবে কোথায়? চরতে চরতে অনেক দূর চলে যাবে। ইস্কুল থেকে ফিরে এখানেই পেয়ে যাব। অনেকদিন বাড়ী চলে যায়। অপূর্ব অবাক গলায় বললেন, সবগুলো? ছাগলগুলোও? পাতু বলল – মাঝে মধ্যে ওই ধাড়ি কালূটা দলছুট হয়ে যায়। ভারী লোভী। এর ওর বাড়ীতে ঢুকে পড়ে। খুঁজে পেতে আনতে হয়। গরুদুটো লালি আর বুধি ভারী শান্ত। খেয়ে দেয়ে পেট ভরে গেলে সোজা বাড়ী, অন্য ছাগল দুটোও তাই। অপুর্ব নিজের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছেন। পাঁচটা গরূকে সকাল বেলা মাঠে ছেড়ে স্কুলে চলে যেতেন। ঠিক ঠাক ফিরে আসত। মাঝে মধ্যে বেগড় বাঁই করত। শুকরি গাইটা এদিক সেদিক দলছূট হত। ভাই বোন বাবা তিন জনে তিন দিকে খুঁজতে বেরুতো। মাঝে মধ্যে খোঁয়াড় থেকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হোত। সবজি খেতে ঢুকলে কেউ কেউ তাড়িয়ে দিত, কেঊ কেঊ ধরে খোঁয়াড়ে দিয়ে আসত। হাসলেন নিজের মনে। পাতু একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, দেখছিল এক দৃষ্টিতে। অপুর্ব গিগ্যেস করলেন – কোন ক্লাসে পড়িস? – ক্লাস ফাইভ। একটা হাতের পাঁচটা আঙ্গুল তুলে দেখাল পাতু, পাছে না বুঝতে পারেন।  খুশি হলেন অপুর্ব। বললেন, তোর স্কুলে আমিও পড়তাম। আজকে বিকেলে যাব তোদের স্কুলে। - তখনতো স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, এখন সকাল স্কুল কিনা। অপুর্ব ভুলে গেছলেন। তাইতো, গরমের সময় তো সকাল স্কুল। একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন, ভালই মনে করিয়ে দিয়েছিস। পাতু ঘাড় নাড়ল। বলল – তুমি তো শিবুর জেঠু, তাই না? অপুর্ব অবাক হয়ে বললেন, তুই জানলি কি করে? পাতু বলল, মা বলছিল। কাল যখন তোমাদের গাড়ী ঢুকল বিকেল বেলা, তখন মা বাবাকে বলছিল – ওই, শিবুর জেঠুরা এল। আচ্ছা, এবার ওই নরম নরম চকলেটগুলো আনোনি? অপুর্ব হাসলেন, বললেন – নরম চকলেট? তোকে দিয়েছিলাম বুঝি? পাতু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ওমা আমাকে তুমি দেবে কেন? তুমিকি আমাকে চেনো? শিবুদাদা দিয়েছিল সে আগের বারে যেবার তোমরা কালীপূজোর সময় এয়েছিলে। অপুর্ব একটু অপ্রস্তুত হলেন। সত্যি এই সব ছোটো ছোটো জিনিষগুলো যদি মাথায় থাকতো! দু প্যাকেট চকলেট আনাটা কোন ব্যাপার হোত না। পাছে অপুর্ব্ব কিছু ভাবেন সে জন্য একটু সাফাই গাইল পাতু। - শিবুদা কিন্তু এমনি এমনি দেয়নি। হাড়কিপ্টে। অপুর্ব মজা পেলেন। বললেন, কেন কি নিয়েছিল শিবু? – তিনটে এই অ্যাতোবড় পেয়ারা নিয়ে দূটো চকলেট দিয়েছিল। বলেছিল – বাইরের জিনিষ, ফ্যালনা নয়। তোরতো দেশের জিনিষ। আচ্ছা জেঠু, দেশের জিনিষের কি দাম নেই? অপুর্ব গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালেন, আলবাত আছে। শিবু ভারী অন্যায় করেছে। আজকেই ওকে ডেকে দু কথা শুনিয়ে দেব। পাতু চোখ বড় করে ছুটে এল। বলল – ও জেঠু, শিবুদাকে কিচ্ছু বোল না। ও তো আমার গাছের পেয়ারা, এমনি কত লোকে খেয়ে যায়। বাদুড়, কাঠবেড়ালি এরাও কম যায় না। চকলেটগুলো কিন্তু দারুন খেতে জেঠু। তুমি কিছু বললে শিবুদা আর দেবে না। মা আধখানা খেয়ে বলেছিল, কি দারুন খেতে রে পাতু! তুই বড় হয়ে বিদেশে যা, যেমন শিবুর জেঠু গেছে। যখন আসবি তখন গ্রামের সব বাচ্চাদের জন্য আনবি। অপুর্ব মুখ তুলতে পারছিলেন না। লজ্জায় ভেতরটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে যাচ্ছিল। কোনদিন গ্রামের জন্য সে ভাবে ভাবেননি, বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য। একটা সামান্য মহিলা তার মেয়েকে বিদেশ যেতে বলছেন গ্রামের ছেলেমেয়েদের চকলেট খাওয়ানোর জন্য। দারুন অপরাধবোধ চেপে ধরছিল। পাতু বলল – চলি জেঠু, ইস্কুলে আসবে কিন্তু। মাষ্টারমশায়দের ঘরে তোমার নামের চেয়ার দেখেছি। শিবুদাই দেখিয়ে দিয়েছিল সেবারে সরস্বতী পূজোর দিন।  মনটা হালকা হয়ে আসছিল অপুর্বর। বললেন – এবারেও তোদের গাছে পেয়ারা হয়েছে বুঝি? পাতু বলল – হবে না কেন? তবে গাছটার বয়স হয়ে গেছেতো। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। তবে বেশ মিষ্টি। অপুর্ব একটু ছোট করে বললেন, তা হলে তো সমস্যা হয়ে গেলরে পাতু। শিবুকে তুই তিনটে পেয়ারায় এবার মানাতে পারবি না। পাতু নির্লিপ্ত গলায় বলল – আমার গাছের পেয়ারা কিন্তু এ গ্রামের সেরা। শিবুদা সেটা জানে। আর তেমন না হলে, পাঁচটা দেব, কি আর করার আছে। অপুর্ব মুখ নামিয়ে ফিস ফিস করে বললেন – অন্য পথ একটা আছে পাতু। তোর গাছের তিনটে পেয়ারাতে আমি রাজি হতে পারি। আর চকলেট দুটোর বদলে আমি চারটে দেব। তোর গাছের পেয়ারা, এ গ্রামের সেরা, তায় আবার দেশের জিনিষ। ফ্যালনা হবে কেন বল? পাতুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ঊঠল। বিশ্বাস করতেই যেন পারছিল না। কোনরকমে খুশি চেপে বলল – সত্যি জেঠু? অপুর্ব হেসে বললেন – সত্যি মানে? আলবাত সত্যি। কাল সকালে এখানেই আনিস। যা, স্কুলে দেরী হয়ে যাবে।

পাতু আর পেছন ফিরে তাকাল না। চকিতা হরিনীর মত ক্ষিপ্র পায়ে দৌড় লাগাল। একটু ছোট্ট হাওয়া এসে অপুর্বর নাকে লাগল। চোখ বুজলেন, গ্রামের ছোট্ট মেয়ের মাটি মাখা হালকা গন্ধ এত বছর পরেও কেমন জানিয়ে দিল তাঁর শেকড়ের অস্তিত্ব। মনটা আরও হাল্কা লাগছে। মাঠের দিকে মুখ ঘোরালেন। আরো আলো হচ্ছে চারধার। সূর্য ওঠার সময় হচ্ছে। মাঠে ব্যস্ততা বাড়ছে। আরো গরু ছাগল আস্তে আস্তে নেমে পড়ছে এদিক সেদিক থেকে। তাদের ক্ষুরের হালকা আওয়াজ, বিক্ষিপ্ত ডাক, লোকজনের হালকা কথা বার্তা প্রভাতী সঙ্গীতের মত কানে বাজছিল অপুর্বর। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। পাশে এসে কেঊ একজন দাঁড়াল টের পেলেন, কিন্তু মুখ ঘোরালেন না, ইচ্ছে করছিল না।

 - নমস্কার কত্তা। সাত সক্কালে গ্রাম দেখতে বেরিয়েছেন বুঝি?  হাল্কা খ্যাসখ্যাসে গলা, কিছুটা ঘসা গ্রামোফোন রেকর্ডের মত।

অপুর্ব মুখ না ঘুরিয়ে জবাব দিলেন – হুঁ। ওটাইতো মানিকচক, পিতাম্বর সাউর সমাধি, তাই না? দূরে ছোট্ট আবছা একটা মন্দির চূড়োর মত দেখা যাচ্ছিল , সে দিকেই আঙ্গুল তুলে দেখালেন অপুর্ব পাশের লোকটির দিকে না তাকিয়েই। - এক্কেবারে ঠিক কত্তা। লোকটার গলা বেশ মোলায়েম আগের চেয়ে, সে রকমই মনে হল অপুর্বর।  তা অনেক বছর পরে ঘরে ফেরা।

২৪ বছর, অনেকগুলো বছরই বটে। অপুর্ব আনমনা হয়ে গেলেন। স্মৃতি বড় বেদনার, কিছু খুশিরো বটে। তবে বেদনার দিকটাই বুঝি বেশী ঝুঁকে, তেমনটাই মনে হয় অপুর্বর। তবে যারা এই চব্বিশটা বছর এখানেই কাটিয়ে দিয়েছে তাদের অন্য মত। অপুর্ব বেঁচে গেছে এখান থেকে চলে গিয়ে। নির্ণিমেষে দেখছেন অপুর্ব মাঠের চার দিক থেকে ছোট ছোট দলে ছাগল গরুর দল নেমে আসছে, কোনটার পেছনে বাচ্চা, কোনটার পেছনে বুড়ো, বুড়ি, মাঝ বয়সি বৌ। চব্বিশ বছর আগেও এমনটা ছিল, পাল্টায়নি।

মন টিকল না ঘরে কত্তার। সক্কাল বেলায় বেরিয়ে পড়েছেন গ্রাম দেখতে? পাশের জন বেশ উৎসাহী। চেনা জানা কারোর মুখ দেখার সময় পাননি, এই সাত সক্কালে পাবেনই বা কোথায়?

তা পাইনি, স্বীকার করলেন অপুর্ব। তবে দিনটা তো এই শুরু হল।

তা খাঁটি কথা, মানল পাশের লোকটা। আমারও দিনটা শুরু হবে মনে লাগছে কত্তা।

অপুর্ব গা করলেন না কথাটায়। মাঠের দিক থেকে মুখ ঘোরাতে ইচ্ছে করছিল না। মাঠের আল ধরে ধরে খেজুর আর বাবলা গাছের সারি, এটাই বিনা যত্নে বেড়ে ওঠে, আর ছাগল গরুর রাজ্যে অন্য কোন গাছ টিকবেই বা কেন। একটা মাঝারি গোছের ধাড়ি ছাগল পেছনের দু পায়ের উপর ভর করে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে ছোট বাবলার ডালের সামনে থেকে কচি পাতা মুখে পুরছে, পেছনের দিকে বড় বড় কাঁটা, সামনের দিকটাই নিরাপদ। একদৃষ্টিতে দেখছিলেন অপুর্ব, ছোট সামান্য দৃশ্য সবার কাছে কিন্তু তাঁর কাছে আজ এত বছর পরে অসামান্য লাগছে। রাস্তার ধারেই বসে পড়লেন অপুর্ব, বেশ পরিস্কার। আগে লোকে প্রাত্যহিক কাজ সারত এই রাস্তার ধারেই, এখন প্রায় প্রতি বাড়ীতেই শৌচালয়। বেশ ভালো লাগছে। পাশের লোকটিও বসে পড়ল দেখা দেখি একটু দূরত্ব রেখেই। লোকটির উপস্থিত এবার খেয়াল করলেন অপুর্ব। - তোমার নামটিই তো জানা হোল না, কি নাম তোমার? তুমি বলে বলছি বলে কিছু মনে করনি তো?

কি যে বলেন কত্তা। আমাকে আপনি বলবেন কোন দুঃখে, লেখা পড়াই করিনি, তায় আবার আপনার চেয়ে বয়সে ছোট। আপনি মান্যি গন্যি লোক, এ অঞ্চলের লোক আপনাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে শুনেছি, এই গ্রাম থেকে কজন বিদেশে গেছে শুনি? তাও আবার সিরেফ লেখা পঢ়া করে। বিনয়ে গলে জল যেন পাশের লোকটা। নাম একটাতো নেই আমার, তা কোনটা বলব?

সবারই একাধিক নাম থাকে, আমারও আছে। একটা ডাক নাম, একটা ভাল নাম। অনেকের আবার ডাক নামও অনেকগুলো থাকে।

তা থাকে। সায় দিল লোকটা। তেমন যদি বলেন, আমার তিনটে নাম। ইস্কুলে, রেশন কার্ডে, ভোটার লিস্টে নাম আছে শ্রী নফর চন্দ্র শীট, গ্রাম পোস্টাপিস দক্ষিন কলমদান। তবে অ নাম বললে এখানে কেঊ আমাকে চিনতে পারবে না।

ও তুমি এ গ্রামের নও দেখছি। তোমার কথা বার্তায় সেটাই টের পেয়ে ছিলাম।

আরো অনেক কিছু আপনি টের পাননি কত্তা। নফরের মুখের কথা শেষ হল না। একটা বুড়ি গরু ছাগল ছেড়ে মাঠ থেকে ফিরছিল, স্বভাবতই মাথায় ঘোমটা নেই। অপুর্বর দিকে চোখ পড়া মাত্রই তড়িঘড়ি ইয়া লম্বা একটা ঘোমটা টেনে একেবারে মাটির দিকে মুখ নামিয়ে অপুর্বদের পাশ কাটিয়ে প্রায় দৌড়ে পালাল।

ভারী অবাক হলেন অপুর্ব। নতুন অথবা নিদেন পক্ষে মাঝ বয়সী অচেনা বৌদের ঘোমটা টানতে দেখেছেন অচেনা লোকের বা গুরুজনদের সামনে কিন্তু তাঁর চেয়ে বয়সে বড় বুড়ি তাঁকে দেখে এত বড় ঘোমটা টেনে পাশ কাটাবে, এটা একটু অদ্ভুত লাগল অপুর্বর। আনমনে বললেন – ভারী অদ্ভুত তো!

খিক খিক করে পাশ থেকে হাসির আওয়াজ হল। অপুর্ব বিরক্ত হয়ে বললেন – এতে হাসির কি হল, নফর?

এজ্ঞে আপনি অবাক হয়েছেন দেখলুম।

তা হয়েছি বৈকি, স্বীকার করলেন অপুর্ব।

তা হলে ওই দেখুন রাস্তার দিকে।

অপুর্ব দেখলেন একটা লোক জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে। অপুর্বদের থেকে কিছু দূরে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ল লোকটা। তারপর কোমরের গামছা তড়িঘড়ি খুলে আচ্ছা করে মুখে চোখে জড়িয়ে সাইকেল ঠেলে দৌড়ে ওদের পাশ কাটাল, তারপর গামছা খুলে কোমরে বেঁধে আবার সাইকেলে চড়ে বসল। নফরের হাসি আর ধরে না। ভারী মজা পেয়েছে, বলল – কি বুঝছেন কত্তা?

গ্রামটা কি পালটে গেছে নফর?

নিয্যস নয়, কত্তা। একটুও পাল্টায়নি। যেমনটি রেখে গেছলেন ঠিক তেমনটিই আছে। অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে জানাল নফর।

তাহলে আমাকে দেখে এরা এমন করল কেন, নফর? মনে হল যেন আমার মুখ দেখা ভয়ানক অমঙ্গলের। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ চমকে ঊঠলেন। শ্যামা সঙ্গীত গাইতে গাইতে মাঠের দিক থেকে আসা আধ বুড়ো লোকটাকে চিনতে পারছেন, নাদু সামন্ত না? উত্তেজনায় ঊঠে দাঁড়িয়েছেন অপুর্ব। আবেগে গলা বুজে আসছে। হাত তুলে চিৎকার করে ডাকলেন – নাদু, নাদু? আমিরে, চিনতে পারছিস?

অদ্ভূত কান্ড ঘটল। শ্যামা সঙ্গীত নিমেষে বন্ধ, গায়ের ফতুয়া খুলে তাড়াতাড়ি মুখে চোখে জড়িয়ে নিল নাদু। তারপর প্রায় দৌড়ে ওদের পাশ কাটাতে কাটাতে বলল – তোর আসার খবর পেয়েছিরে অপু। যাবো দেখা করতে একটু বেলা হলে। অনেক কথা আছে। ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যা।

অপুর্ব ধপ করে আবার বসে পড়লেন। কি ঘটছে তাঁকে ঘিরে? লোকজন তাঁর মুখ দেখতে চাইছে না? কেন?

ভারী অবাক হয়েছেন তাই তো কত্তা? নফরের গলায় মজার সুর।

অবাক বলে অবাক! স্বীকার করলেন অপুর্ব। এমন বিদঘুটে কান্ড তাঁকে ঘিরে ঘটছে ভাবতে পারছেন না। কি এমন ঘটল যে লোকজন তাঁর মুখ দেখতে চাইছে না? এমনকি তাঁর এত পুরনো বন্ধু নাদুও তাঁকে দেখে পালাল। স্বগতোক্তি করলেন – না হে নফর, কিছু একটা গোলমাল আছে।

তা আছে কত্তা। স্বীকার করল নফর। গোলমাল একটু না থাকলে জীবনটা কেমন পানসে পানসে লাগে, তাই না কত্তা? এ যেন বিনা নুনে পান্তার আমানি, কিংবা বলতে পারেন একপোয়া দুধে একপোয়া জল।

এতো দার্শনিক তত্ব হে নফর। ঘুরে বসলেন অপুর্ব। লোকটা ভারী মজার তো, সাধারন নয় মোটেই। এই প্রথম ভালো করে দেখলেন নফরকে। আধময়লা ধুতি, গায়ে একটা গেরুয়া ফতুয়া, দু কানে শুকনো জবা ফুল, কপালে একটা প্রায় মুছে যাওয়া সিঁদুরের টিপ, মুখে ফিচির ফিচির হাসি।

পেন্নাম হই কত্তা, হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে নমস্কার করল নফর। আপনি হলেন সত্যকারের জ্ঞানীগুনী মানুষ। আজকের সকালটা আমার এ্যমনে শুরু হবে ভাবিনি। এক হপ্তার ওপর হয়ে গেল সকালটা শুরু হচ্ছিল না, ম্যালা মামলা জমে গেছে। খুশিতে দুহাত কচলে নিল নফর।

তুমি কি কোর্টে কাজ কর?

লজ্জা দ্যান কেন কত্তা। মুখ্যু মানুষ, কোর্টে কাজ করব ক্যামনে?

এই যে বললে মেলা মামলা জমে আছে। অবাক না হয়ে পারেন না অপুর্ব।

এ পেটের মামলা কত্তা। আপনাদের পায়ের ধুলো মাথায় থাক। বলে সত্যি সত্যি হাত বাড়িয়ে পায়ে একটা খামচা মেরে মাথায় বুলিয়ে নিল। বাধা দেওয়ার সময় পেলেন না অপুর্ব। বিব্রত বোধ করলেন বেশ। কিছু একটা গোলমাল আছে, ধরতে পারছেন না। বললেন – একটু ঝেড়ে কাশো তো বাপু, আমি বেশ বোকা বনে গেছি। কি করো তুমি?

সে কি আর এক কথায় শেষ হয় কত্তা? বিনয়ে গদ্গদ প্রায়। মাস্টার বলেন, উকিল বলেন, ডাক্তার বলেন, পোস্টোমাস্টার বলেন, সবাই এক কথায় বলে দিতে পারে কি করে। আমার যে তেমনটি হবার যো নেই। আকাশের দিকে মুখ তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নফর।

একটু বুঝিয়ে বল, বুঝতে পারব।

তা কি আর না পারেন কত্তা? এত লেখা পড়া করেছেন। বাকী কথা শেষ হল না, রাস্তার দিকে মুখ ঘোরাল নফর। দেখা দেখি অপুর্বও ঘোরালেন। তেতুল বিচি, কঞ্জা ফলের বিচি, নিম বিচি, ঝ্যাটা কাঠি, তেতুল এই সব বাড়ী বাড়ী ঘুরে কেনা একটা লোক নফরকে দেখেই মাথা ঢেকে পাশ কাটাতে গেছিল কিন্তু পারেনি। বোঝা নিয়ে মাঠে উলটে পড়েছে, আর সমস্ত সওদা চারিদিকে ছত্রাকার। ফুটি ফাটা মাঠ থেকে সেগুলো কুড়োনো দুঃসাধ্য প্রায়। লোকটা প্রানপনে কূড়োচ্ছে, আর এদিকে তাকাচ্ছে। খুব কষ্ট হল অপুর্বর। সেদিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হেসেই চলেছে নফর। - দ্যাখলেন কত্তা আমার কেরামতি? এখানে বসে বসেই ভন্ডুল করে দিতে আমার একটুও সময় খচ্চা হল না। আলহাদে আটখানা নফর নিজের কেরামতি দেখাতে পেরে, যার তার কাছে নয় আবার, বিদেশ ফেরতা মানী মানুষের কাছে। ধন্দ তবু কাটে না অপ্ররবর। বললেন – তোমাকে লোকে অপয়া ভাবে, তাইতো?

অপয়া? নফরের চোখ গোল্লা গোল্লা। ভয়ানক আঘাত লেগেছে সম্মানে। অপয়া খুঁজলে এ গ্রামে মেলা পাবেন কত্তা। নফর কিন্তু পাবেন না। অপয়া দেখলে লোকে নাক সিঁটকেয়, আমারে খাতির করে। তাতেই তো করে খাই কত্তা। তা আপনিই বা জানবেন কি করে? স্বগতোক্তি করল নফর। নিজের কথা নিজে বলাটা ভাল দ্যাখায় না, তবু একটু ছোট করে বলি?

বল। বেশ উদগ্রীব হন অপুর্ব। এমন ব্যাপার জীবনে দেখেননি। এত বছ গ্রামে কাটিয়ে গেলেন, গুণীন, ওঝা, বাটি চালিয়ে চোর ধরা, সিঁদুর মাখানো আয়নায় চোরের মুখ ধরা, আরো কত কি। কিন্তু এমনটি সত্যি প্রথম।

এই ধরেন, আপনি সকালে কারোর মুখ দেখেননি, পেরথম দেখলেন আমারে, ঠিক?

ঠিক, অপুর্ব মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

আমার দিন শুরু হইল আমার মতন, আপনার শুরু হবে অন্য রকম।

কি রকম?

য্যামনে ধরুন, এখান থেকে ফিরতি পথে য্যাতে য্যাতে রাস্তার ধারে দ্যাখলেন একটা ছোট্ট ছাগল ছানা। ত্যাল চুক চুক গায়ে সক্কালের রোদ্দুর যেন পিছলে পিছলে যাইছে। আপনারে দ্যাখে ম্যা ম্যা করে বার দুই ডাক ছাড়ল। আপনার মনটা কেমন কইরা ঊঠল, আপনি আদর করার জন্য হাত বাড়াইলেন। ব্যাশ ওইখানে শ্যাষ। বাবা বা মা ছাগল কেউ একটা এসে মারছে রাম গুঁতা, আপনি রাস্তায় চিৎপটাং।

অপুর্বর মুখ হাঁ হয়ে গেল। এমনটা আবার হয় নাকি? – একানেই শ্যাষ নয় কত্তা, তাহলে আর নফর করে খাবে কি করে? আপনি ধুলা ঝাইড়্যা উঠলেন। একটু চোট লাগতে পারে। দু পা গেছেন কি যাননি, শুনলেন পেছন থেকে সাইকিলের ক্রিং ক্রিং। আপনি রাস্তার ধার ঘেঁষে পথ দিলেন, কিন্তু শ্যাষ রক্ষা হইল না। ধাক্কা মাইরল আপনারে, আরা আপনিও পড়লেন উইল্ট্যা। ভারী চোট লাগতেই পারে।

অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন অপুর্ব। বললেন – তার মানে এই টুকুন পথে এতগুলো গেরো, তাও স্রেফ সাত সক্কালে তোমার মুখ দেখে ফেলেছি বলে?

আইজ্ঞা কত্তা এখানেই শেষ হলে তো কথা ছিল। নফর আরো বিশদ হল। এ নফর কত্তা, অপয়া নয়, আর আশ পাশের দশ বিশ গ্রাম ঘুরলেও আর নফর পাবেননি। আপনি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাড়ি চললেন। হঠাত দ্যাখলেন একজনের পুকুর পাড়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে এক সিঁদরী আমের গাছ। আহা কি শোভা। সব ভুইল্যা দ্যাখছেন, হঠাত সুরুত করে এক্কেবারে পুকুরে। ভয় নাই কত্তা। চারদিক থেকে হই হই করে সব দৌড়ে এসে আপনারে তুইলল। কাদা মাখা মাখি। সবাই জিগাইব – ঝড় নাই, বাদলা নাই, কাদা নাই , পড়লেন কি কইর‍্যা? কেউ কেউ ঠিক ধরতে পাইরব। বলবে – এ নিশ্চয় ছোট শনির কাজ। ফিক ফিক করে হাসতে লাগল নফর। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে আরকি। তারপর হাসি থামিয়ে ঊঠে পড়ল। বলল – একদিন আসব কত্তা, দিনমানে। সক্কাল বেলা নয়। আমার সকাল শুরু না হলে আমার কেরামতিও নাই। গ্রামের লোকগুলো বেশ সেয়ানা হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কারোর না কারোর মুখ দেখে লিবে, না হইলে মুখ ঢাইক্যা পালাবে। এক হপ্তার উপর কুন কাজ নাই। আজ হইব। বেশ উৎফুল্ল মুখে হাঁটা লাগাল নফর। অপুর্বও দাঁড়িয়ে পড়লেন। অপসৃয়মান নফরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন, এই একুশ শতকেও কি এটা হয়? নাকি শুধু এরকম কিছু গ্রামে? সত্যি কি বাড়ী পৌঁছতে তাঁকে তিন তিনটে ছোটবড় দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে হবে? বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন অপুর্ব। আরে, সকালে সে মাকে ক্লাব ঘরের কাছে ছেড়ে দিয়ে এসেছে শুশনি শাক তোলার জন্য, পাতুর সঙ্গে এতটা কথা হল। নফরের আগে দু দুটো মুখ দেখা হয়ে গেছে। বেচারা নফর। নফরের জন্য একটু কষ্ট হল। বেচারার আজও যদি দিনটা শুকনো যায়? বেলা হলে নাদু আসবে বলেছে, তখন এ নিয়ে আরো কিছু জানা যাবে। সত্যি অবাক করার মতই বটে। হাঁটা লাগালেন অপুর্ব। মা’র শাক তোলা শেষ হয়ে গেছে বোধ হয়। 

 

                              **************************

কোথা দিয়ে প্রায় আড়াইঘণ্টা কেটে গেল স্কুলে টেরও পেলেন না অপুর্ব। পুরনো সেই মাটির দেওয়াল টালির ছাউনি স্কুল ঘর নেই, তিনতলা পাকা স্কুল ঘর, লোহার গেট। তবে ক্লাশ শুরু, শেষ, টিফিন, প্রার্থনা – সবই সেই পেটা ঘন্টা দিয়েই জানান দেয় আজও। সব মাস্টার মশাই নতুন, তরুন প্রজন্মের নতুন নতুন মুখ। কয়েকজন শিক্ষিকাও রয়েছেন। কি করে তাঁর পরিচয় সবাই পেয়ে গেছে জানেন না অপুর্ব। টিচার্স রুমে ঢুকতেই সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে নমস্কার করেছেন, কেউ কেউ তো পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে এসেছিল, হাত দিয়ে থামালেন অপুর্ব। বিদেশের গল্প, বিশেষ করে সে দেশের পড়াশোনা সম্বন্ধে সবাই জানতে চায়। ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান বই এক কপি নিয়ে এসেছিলেন, রেখে গেলেন। পাতা উলটে সবাই দেখছে। অপুর্ব বললেন – আহা মরি কিছু নয়। আপনারাও এসব পড়েছেন, এর চেয়ে বেশীও পড়ে থাকবেন। সবাই হাঁ হাঁ করে বাধা দিল। আপনি নয়, তুমি। অপুর্বরও একটু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়। সুযোগ পেয়ে বললেন - সত্যি কথা বলতে কি তোমরা সবাই আমার চেয়ে বয়সে ছোট। আপনিটা একটু বেমানান লাগছিল তাই না? সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। অপুর্ব একটু থামলেন, বললেন – বেশ, তুমি। শুধু হেডমাস্টার মশাই বললেন, আমি আপনারই বয়সী, তবে আপনার থেকে আমি তুমি শুনতে পেলেই খুশি হব। ভারী ভাল লাগল অপুর্বর। একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। চোখ বুজলেন কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খুললেন, বললেন – স্কুলটা নতুন, আগে দেখিনি, কিন্তু যে মাটির উপর এটা দাঁড়িয়ে তাকে আমি চিনি। গন্ধ পেলাম তার। তোমরাও যদি তোমাদের স্কুলে যাও, চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিও, চিনতে পারবে যত বছর পরে যাও না কেন। ভারী নিস্তব্ধতা, সবাই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। এক কাজ করা যাক। ভারতীয় গনতন্ত্রে সবাই সমান। অপুর্ব খুব ধীরে ধীরে কথা গুলো বললেন। আপনি নয়, তোমরাও আমাকে তুমি বল। অপুদাও বলতে পার। হেসে উঠল সবাই। তখনই নজর পড়ল চেয়ারটার দিকে। পাতু বলেছিল, মনে রেখেছিলেন অপুর্ব। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন চেয়ারটার কাছে। সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। সবাই জানে এই চেয়ারের কথা। এর অস্তিত্ব এত বছর টিকে আছে, ভবতে অবাক লাগল অপুর্বর। স্কুল ছাড়ার সময় হেডমাস্টার মশাই বলেছিলেন, অপু কিছু স্মৃতি রেখে যা, শুধু মনে নয়, এমন কিছু যা আমরা প্রতিদিন দেখলে তোর কথা ভাবতে পারব। অনেক চিন্তা করেও কিছু খুঁজে পায়নি অপুর্ব। শেষে হেডমাস্টারমশাই ঠিক করলেন একটা চেয়ার বানাবেন যাতে অপুর নাম ও সাল লেখা থাকে। অপু রাজী হয়ে গেছল। স্কলারশিপের টাকা থেকে চেয়ার হল। অবসরের দিন পর্যন্ত এই চেয়ারটাতে বসে গেছেন তিনি। আর কেউ বসেনি ওতে, কেউ বসতেও চায়নি। এক শিক্ষায় সর্বস্ব নিবেদিত শিক্ষক আর তার প্রিয় ছাত্রের মেধার নিদর্শন আজও এক কোনে সম্মানের সঙ্গে রাখা আছে, রোজ ঝাড় পোঁছ হয়। শিক্ষকরা সবাই চেঁচিয়ে ঊঠল – অপুদা, বস একটু ওই চেয়ারটায়, তোমার চেয়ার আজও সে ভাবে রাখা আছে। দু চোখ ছাপিয়ে আসছিল অপুর্বর। হাত দিয়ে মুছে ফেলে চেয়ারটায় হাত বোলালেন আবার, ধীরে ধীরে বললেন – এ চেয়ার স্রষ্টার, তাঁর সৃষ্টির নয়। প্রতিবাদ করল না কেউ, মেনে নিল। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজল। নতুন ক্লাশ শুরু হবে। দুজন টিচার উঠে দাঁড়াল। ক্লাস আছে। বলল – অপুদা, আমি নাইন আর টেনের ছাত্রছাত্রীদের হলঘরে ডেকেছি। তুমি চল, ওদের সঙ্গে একটু কথা বল। আমার মনে হয় ভাল লাগবে তোমার এবং ওদেরও। তড়াক করে লাফিয়ে ঊঠল অপুর্ব। বললেন, দারুন আইডিয়া। আমিও চাই ওদের সঙ্গে কথা বলতে। এই প্রজন্মের এত ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে একসাথে কথা বলা, তাও আবার আমার এই স্কুলে দাঁড়িয়ে ... কথা শেষ না করেই হাঁটা লাগালেন।

ভর্তি হলঘর। দেখে মনে হল কিছু এইট বা সেভেন ক্লাসের ছেলে মেয়েও ঢুকে পড়েছে। ফিসফাস, শুনতে পাচ্ছেন অপুর্ব। এ কান থেকে ও কান। শিবুর জেঠু। সবাই দাঁড়িয়ে। লম্বা লম্বা বেঞ্চ, চার থেকে পাঁচ জন করে এক একটা বেঞ্চে। অপুর্ব বললেন – বসো সবাই। সবাই বসে পড়তে এক শিক্ষক তাঁর চেয়ারটা এগিয়ে দিলেন, বললেন – বসো অপুদা। অপুর্ব বসলেন না, টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন – আমি কে বলতো? অনেক উত্তর একসঙ্গে ঊড়ে এল। মাথা নাড়লেন অপুর্ব – উঁহু, হোল না। আমি একজন প্রাক্তনী। তোমরাও একদিন হবে, আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে একদিন বলবে – আমার পরিচয়, আমি এ স্কুলের প্রাক্তনী। নিস্তব্ধতা উপভোগ করছেন অপুর্ব। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটু হেসে বললেন – আমি বিদেশে আছি, সেটা কোন পরিচয় নয়। নিজের যোগ্যতাই নিজের পরিচয় তা সে দেশের মাটিতেই হোক বা বিদেশে হোক। শুধু চাই, জেদ আর লক্ষ। এইবার তোমরা প্রশ্ন কর এক এক করে, আমি সাধ্যমত উত্তর দেব।

গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে গেলেন। কে একজন পেছন থেকে হাত ধরে ফেলেছে। ঘুরে দেখেন, পাতু। হেসে বললেন – কিরে, ক্লাস নেই? পাতুও হাসল। বলল – মাস্টারমশাইরা এখনতো শুধু তোমাকেই নিয়ে কথা বলছে। পেছন ফিরে দেখে বলল – নাঃ, এখনও আসেনি, এলে দেখতে পাব। অপুর্ব লক্ষ করলেন, পাতুর ফ্রকের নিচে উঁচু হয়ে আছে। হেসে বললেন – কি রেখেছিস ওখানে? পাতু মুখ গোমড়া করে বলল – জানো জেঠু, এখন না প্যান্টে পকেট দেয় না, কাপড় বাঁচায়। পেয়ারাটা কোথায় রাখব বলতো? অপুর্ব অবাক হয়ে বললেন – সেই সকাল থেকে তুই ওভাবে পেয়ারাটা সেঁটে রেখেছিস? কেউ দেখেনি?

দেখেনি আবার? মাথা ঝাঁকাল পাতু। সবাইকে বলেছি এটা জেঠুর পেয়ারা, কেউ হাত দিবি না। কেউ হাত দেয়নি, সবাই তোমাকে কত ভয় করে।

কেনরে, আমার হাতে তো বেত নেই, কান ধরে ওঠবোস করাব না, তাহলে?

তা জানি না। ওইরে, মাস্টার মশাই আসছে, আমি চলি জেঠু। পেয়ারাটা খেতে খেতে যাও। এটা এমনি। এর জন্য কোন চকলেট লাগবে না। দৌড়ে পালাল পাতু।

পেয়ারাটা হাতে নিলেন, পাতুর ছোট্ট শরীরের উত্তাপে এখনো গরম হয়ে রয়েছে। গালে ছোঁয়ালেন, স্কুল বেরোবার আগে টুক করে কখন তুলে নিয়েছে, আগলে রেখেছে সারাক্ষণ, বিদেশী জেঠুর জন্য। ছোট্ট একটা কামড় বসালেন, সত্যি ডাঁসা ও মিষ্টি।

গ্রামের পেয়ারা, কেমন লাগছে?

চমকে তাকিয়ে দেখেন, এখনকার হেডমাস্টারমশাই। হেসে ফেললেন অপুর্ব। বললেন – অদ্ভুত!

ওখানে পান না পেয়ারা?

পাই তো, মেক্সিকো থেকে আসে, ভিয়েতনাম থেকে আসে।

এ রকমই স্বাদ?

নাঃ, এ স্বাদ নয়, এ গন্ধ নয়।

কেন?

ওখানে পাতু বলে কোন মেয়ে থাকে না। পেয়ারা চিবুতে চিবুতে হাঁটা লাগালেন অপুর্ব। হেডমাস্টারমশাই চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, লোকটা যেন কেমন!

                                  **********************

গ্রামের হাটতলা কিছুটা পাল্টেছে। তেঁতুল গাছের নীচটা পাকা বেদী করে বাঁধিয়েছে, বটগাছের নীচে ছোট কালীমন্দির হয়েছে, ফাঁকা জমি একটুও নেই, পাকার দোকান সব, কতরকমের। চা দোকান আগে ছিল না, এখন গোটা ছয়েক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, রান্নার গ্যাসের দোকান, ব্যাঙ্ক, একটু দূরে ছোট হলেও একটা মাছের বাজার, জুয়েলারি দোকান, কাঁসার বাসন কোসনের দোকান, মোবাইল ব্যাঙ্কিং, আগে ঔষধের দোকান একটা ছিল এখন সাতটা, কোচিং সেন্টার – কি নেই! অবাক বিষ্ময়ে দেখছিলেন অপুর্ব, সঙ্গে নাদু, বিজয়, বিমল, সুকুমার, উৎপল, বিরাজম, অশোক, শিশির। এরা সবাই অপুর্বর স্কুলের বন্ধু, কেউ কেউ কলেজ টেনেছে, বাকীরা স্কুলেই ইতি টেনে দিয়েছিল। কিন্তু রোজ সন্ধ্যেবেলা সবাই হাটতলায় এসে জোটে, আজ এ চায়ের দোকান কাল সে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়। বিদ্যুৎ ছিল না তখ, সন্ধ্যে হলেই হাটতলা শুনশান, শুধু কিছু বখাটে বেকার কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বেলে সতরঞ্চি পেতে বসে তাস খেলত, শুনেছে রাত গভীর হলে সেখানে কিছু জুয়াড়ী এসে হাজির হত। পুলিশের ভয় নেই। রাস্তায় মোরাম পড়ার পর আর বিদ্যুৎ ফোনের লাইন এসে যেতেই চেহারা পালটে গেছে। চব্বিশ বছরের হিসেব যতটা পারা যায় দিতে ব্যস্ত সবাই। এখনতো আবার দুটো মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসে গেছে। পাশ করা ডাক্তারি পরিসেবা ছাড়া আর সব কিছুই প্রায় হাতের মুঠোয়। চব্বিশ বছরের আবেগ ধরে রাখা কষ্ট হচ্ছে অপুর্বর। বললেন – চল, মিষ্টি খাই। আমি খাওয়াব সবাইকে। এক কথায় নাকচ হয়ে গেল প্রস্তাব। মিষ্টির ধার দিয়ে কেউ গেল না। বিজয় বলল – আমরা সবাই চা খাই, লিকার। সেটাই তুই খাওয়া আজকে। অপুর্ব অবাক হয়ে বলল – আর কিছু খাবি না?  শিশির হেসে বলল – আছিস তো কয়েকদিন? আমরা একটা গেট-টুগেদার করব। তখন তোর পকেট খসাব। বিমল মানতে চাইছিল না, বলল – এত বছর পরে অপু এসেছে, ওর থেকে আমরা নেব কেন? আমরা সবাই দেব। অপুর্বকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পাশ হয়ে গেল প্রস্তাব। দিনও ঠিক হয়ে গেল। দুরাউন্ড চা আর গল্প হতে হতে রাত ন’টা বেজে গেছিল কখন খেয়াল করেনি কেউ। বাড়ী ফিরতে হবে, নাদু বলল – অপু টর্চ এনেছিস,  নাকি আমি এগিয়ে দেব? অপু হাতের ছোট্ট একটা বেতের লাঠি আর টর্চ দেখিয়ে বলল – সঙ্গে নিয়েই তো ঘুরছি, দেখিসনি? হাত মিলিয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, যে যার পথে। পালেদের বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ছোটবেলার গা ছমছমানিটা আবার টের পেলেন। এক দৌড়ে রাম রাম করতে করতে জায়গাটা পেরুতেন। আজ দাঁড়িয়ে পড়ে টর্চ ফেললেন। বিকেলে এই পথেই গেছেন, কিন্তু লক্ষ করেননি। টর্চের আলোয় মনে হল বাগানের আয়তন একই আছে, কিন্তু বেশ পাতলা হয়ে গেছে। আগে কেমন ঘন জমাট অন্ধকার ভয় ও রহস্যের উপাদান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, কত গল্প, কত ঘটনা এ মুখ সে মুখ ছড়িয়ে আরও ব্যাপক চেহারা নিত। অপুর্বর টর্চের আলো এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত অনায়াসে চলে গেল, হালকা বাধা পেলেও কোথাও প্রতিহত হল না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ভেবেছিলেন একটা না একটা জমাট অন্ধকারে আলোটা আটকে যাবে। টর্চ বন্ধ করে এগিয়ে চললেন। সামনে রাস্তার দু’পাশে দুটো করে পালেদের চারটে পুকুর ও দাসেদের একজোড়া বট আর অশ্বত্থ গাছ। চৌপুকরা বলে সবাই, তখনও বলত কিন্তু একটু সম্ব্রম মিশিয়ে। রাত বিরেতে ঝম ঝম আওয়াজ করে যক্ষ এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে মোহরের ঘড়া বয়ে নিয়ে যেত, অনেকে নাকি সচক্ষে দেখেওছে। যেতে আসতে বাচ্চাদের কৌতূহলের অন্ত থাকত না, কোন পুকুরের নীচে আজ বসে আছে বা আজ রাতে সে কোন পুকুরে যাবে তা নিয়ে জোর তর্কাতর্কি এমনকি বাজী লড়াও হত। অপুর্বর মনে হল চৌপুকুরার কাছে আজ যদি  তাঁর সামনে দিয়ে যক্ষ রাস্তা পার হয় তাহলে তিনি কি করবেন? কিন্তু ঝিঁঝি পোকা আর কয়েকটা জোনাকির ওড়াওড়ি ছাড়া আর কিছু ঘটল না। টর্চ জ্বেলে বট অশ্বত্থ গাছ পেরুতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। অস্বস্তি হচ্ছে একটু। মনে হল একটা ছায়ামূর্তি গাছ দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ নিভিয়ে দাঁড়ালেন অপুর্ব। মনে হল আলোর সামনে আসতে চাইছে না আগন্তুক। অপুর্ব হাল্কা করে বললেন – কে ওখানে? কিছু দরকার আছে আমার কাছে? একটু বিরতি, তারপর অন্ধকার ঠেলে একটা লোক এসে সামনে দাঁড়াল, আস্তে করে বলল – কত্তা, আমি। চিনতে কষ্ট হল না অপুর্বর। আজ সকালেই পরিচয় হয়েছে। বললেন – নফর, আমার কাছে কি কিছু দরকার আছে?

আছে কত্তা। মনে হল খুব কষ্ট করে কথাগুলো বলছে নফর। সকালের সে আত্মবিশ্বাস আর তেজ নেই।

কিছু বলবে?

বলব বলেই তো সে সন্ধ্যে থেকে দাঁড়াই আছি।

বাড়ীতে গেলে না কেন?

সন্ধ্যেবেলা যেতাম, দেখলাম আপনি হাটতলার দিকে যাচ্ছেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে। এত বছর পরে এয়েছেন, এ সময় হাটতলায় গিয়ে আর আপনারে ঝামেলায় ফেলতে চাইনি।

ঝামেলা? হয়েছে নাকি কিছু?

হয়েছে কত্তা। এখানে দাড়াই থাকতে থাকতে মনে হতি ছিল এই পূন্যস্থানেই যদি ঝুলে পড়ি? গলা ধরে এল নফরের। অপুর্ব বুঝলেন, ব্যাপারটা বেশ জটিল, অনেক গভীর থেকে উঠে এসে ঘা মেরেছে নফরের মনে, জীবনের প্রতি চরম বীতরাগ জন্ম নিয়েছে।

ঠিক আছে শুনব তোমার কথা। হাল্কা করতে চাইলেন পরিবেশটাকে অপুর্ব। চল হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলতে পারি আমরা।

অনিচ্ছি সত্ত্বেও হাঁটতে লাগল নফর। হাঁটার ইচ্ছে নেই বুঝতে পারছেন অপুর্ব। চাপা স্বরে বললেন – সকালেই তো বলছিলে, মেলা কেস জমে আছে, আজ সকালটাও শুরু হয়েছে তোমার অনেকদিন পরে।

আজ্ঞে, আপনারে দিয়াই তো শুরু করলাম। একটা কেস ঝুইল্যা ছিল অনেকদিন। এ সেই কেসের ব্যাপারেই। বলতে শুরু করল নফর। ভাইবলাম, যাই ধীরুবাবুর কেসটা মিটিয়ে আসি। আজ ধীরুবাবুর সঙ্গে ললিতবাবুর সাড়ে সাত বছরের মামলার রায় বাইরব। সাড়ে পাঁশশোয় রফা হয়েছিল, ধীরুবাবু আগাম একশ দিয়া দিছলেন। ধীরুবাবুরে বইল্যাও ছিলাম, আমি আছি, মামলার জিত আপনারই। শুধু ললিতবাবুকে কবে মুখটা দ্যাখাইব, সেটাই বলেন। দিনটা আজই ছিল কত্তা। কাজটা হই গেলে সাড়ে চারশো হাতে আসতো কত্তা, টানাটানির সংসার। গলা ধরে আসছিল নফরের। থামল একটু।

তা আটকালো কিসে? অপুর্ব হাঁটা থামালেন। বাড়ী এসে গেছে।

সেটাই তো আমার কাছে ধোঁয়া কত্তা। কুনদিন আটকায়নি, সবই কপাল, আজ আইটক্যা গেল। চটাস করে কপালে একটা চাপড় চালিয়ে দিল নফর।  

অপুর্ব আন্দাজ করতে পারছিলেন, কিন্তু সায় পাচ্ছিলেন না। ধীরু, ললিত দুজনকেই তিনি চেনেন, বয়সে বড়। জানতেন না দুজনে মামলা লড়ছে। ধীরু নফরকে লাগিয়েছিল শনির দৃষ্টিটা ললিতের উপর ফেলতে। অবাক লাগছে, এমনটাও হয়?  কারোর মুখ দেখা না দেখা নিয়ে মামলার রায় এ পাশ ও পাশ হবে? নফরকে কিছু জানতে দিলেন না। বললেন – ললিতবাবুও কি এসবে বিশ্বাস করেন?

একদমই না। মাথা নাড়ল নফর। তা হলে ওনারও তো আমার কাছে আসা লাগত। আসেননি। দারুন ধুরন্ধর মানুষ। আপনার কাছ থিকে উইঠ্যা ওনার বাড়ী থিকা একটুন দূরে ঠায় দাঁড়াইছিলুম। পাছে কখন সটকে পড়েন। তা সটকাতে তিনি পারেননি। ধোপদুরস্ত পোষাক পইর‍্যা রাস্তায় নেমে পানের খিলিটা মুখে পুরেছেন কি পুরেননি, আমি হাজির এক্কেবারে সামনে। নমস্কার কইর‍্যা বললুম, শহরে চললেন কত্তা? শুভ কাজে? অন্য কী হলে হয় ভিরমি খাইত, না হলে অকথ্য গালি গালাজ দিত। ললিতবাবু ভদ্দরলোক। হাইসলেন। পানের ডিবা থিক্যা পানের খিলি দিলেন। কইলেন, শুভ কাজ তো বটে। ক্যানে ধীরা বলেনি তোকে? সেই জন্যই তো তুই হাজির। কিন্তু কুন কাজ হবেনি। ওই দ্যাখ, বাশুলী মার মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। আমার কথা মিলিয়ে নিস। ধীরার থেকে সন্ধ্যেবেলা জেনে যাবি – এ মামলা আমার দিকেই আসবে। এটাই ন্যায়, তোর মত দশ বিশিটা নফরকে দাঁড় করালেও কিস্যু হবে না। নফর থামল। বলল, বড় মনে দাগা দিয়েছিল কত্তা। আমারও কেন মনে হইতেছিল এ মামলায় ধীরুবাবুর কিছু হবে না।

তা সত্যি কি কিছু হয় নি? অপুর্ব উত্তেজনা চেপে রেখে বললেন।

নফর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বলল - সারা দিন বাড়ী যাই নাই। কিছু খাই নাই। শুধু টিউবোয়েল থিক্যা জল খাইছি। বেলা থাকতে থাকতে ধীরুবাবুর বাড়ী গেছি। একটু আগে ফেরেছেন, আরাম কেদারায় বসে গড়গড়া টানতিছিলেন। আমারে দেখেই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। চোখ লাল, বুঝলাম ভাল খবর নয়। আমার এই গালে, দ্যাখেন কত্তা এইখানে, টেনে চড় কসাল। বলল – হারামজাদা, বুজরুকি করার জায়গা পাসনি তাই না? শনি ঠাকুরের ঠিকা নিয়ে রেখেছিস, ছোট শনি। টাকা দিলুম ললিতের পেছনে লাগতে, হারামজাদা দিলি আমার পেছনে গুঁজে? কালকের মধ্যে আমার আগাম টাকা ফেরত দিয়ে যাবি, না হলে তোকে তোর কোন বাপ এ গাঁয়ে রাখে দেখি। হাউ হাউ

করে কাঁদছিল নফর। কান্না জড়ানো গলায় বলল - কারোর কারোর তো কাজ হয়েছে, বেশ বিশ্বাস জম্মে গেছিল। কে জানে সেটা তুক কিনা?

মনটা ভারী হয়ে গেল অপুর্বর। বললেন – বাড়ীও যাওনি, কিছু খাওনি?

নফর মাথা নাড়ল। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল – কুন মুখে যাব কত্তা? ছেলেটা মাধ্যমিক দিবে ...

কথা শেষ হল না নফরের, অপুর্ব শেষ হতে দিলেন না। বললেন – তোমার ছেলে মাধ্যমিক দেবে? তার মানে আজ স্কুলে ছিল, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নিশ্চয়, আজতো আমি স্কুলে গেছলাম।

অন্ধকারেও টের পেলেন অপুর্ব, নফর থর থর করে কাঁপছে। বললেন – এভাবে চলতে পারে না নফর। আজকে একা ধীরুবাবুর জন্য তোমার পায়ের নীচে মাটি টলমল, পরে কোন সময় পাঁচটা ধীরুবাবু যদি তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য তোমাকে দায়ী করে তুমি সামলাতে পারবে? জনরোষ বড় সাঙ্ঘাতিক, নফর। যারা তোমার থেকে উপকার পেয়েছে তারা সেদিন তোমার পাশে দাঁড়াবে না, টাকা নিয়েছ কাজ করেছ, সমবেদনা কেন? পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে নফর? একটা সম্মান, আত্মসম্মান বাঁচার জন্য খুবই দরকার।

কাঁপছিল নফর। ধরা গলায় বলল – কি করব কত্তা, বলে দ্যান।

অপুর্বও ভাবছিলেন। সহজ নয় এই পুনর্বাসনের কাজ। কিন্তু ঠেলতেও পারছেন না। বললেন - আজ রাত্তিরে আমি একটু ভাবি। পকেটে হাত ঢোকালেন, কয়েকটা নোট হাতে ঊঠে এল, টর্চ জ্বাললেন না। নফরের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন – হাটতলা এখনও খোলা আছে, কিছু বাজার করে বাড়ি যাও। ছেলেটাকেও খাটতে হবে বেশ, তার জন্য শরীরের রসদতো দরকার। কিছু জবাব দিল না নফর। অপুর্ব টের পেলেন কেঊ তার পা ছুঁয়ে দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

 

                              ****************************

 প্রায় টানা তিন ঘণ্টার উপর জোর তর্কাতর্কির শেষে সবাই কিছুটা ক্লান্ত। ভোর হতেই অপুর্ব ফোন করে সবগুলো বন্ধুকে হাজির করিয়েছে নিজের বাড়ীতে। বিমল আর শিশির আসতে পারেনি। তার জায়গায় বিরাজ, নিখিল আর রবিকে পাওয়া গেছে। গরমের দিন, সাড়ে আটটা মানেই বেশ রোদ উঠে যায়। অপুর্বদের থাকার সময়টুকুর জন্য গিরিদের বাড়ীর কুসুম নামের একটি বৌ কিছুদিন কাজ করে দিচ্ছে। গ্রামের দিকে বাড়ীতে কাজের লোক সত্যি পাওয়া মুশকিল। বেশ চৌকস আর পরিশ্রমী। নীতাকে কিছু করতে দিল না। অপুর্ব বলা মাত্রই কুসুম বলল, কিছু ভেবো না দাদা। তোমার বন্ধুরা এলে গরম গরম হালকা মিষ্টির হালুয়া বানিয়ে দেব। লিকার চায়ের সঙ্গে ভাল যাবে। অপুর্ব কোলকাতা থেকে ভাল দার্জিলিং চা এনেছিলেন, কুসুম দেখে শিখে গেছে। টি পট গরম জল দিয়ে ধুয়ে প্রতি দু কাপ চায়ের জন্য এক চা চামচ পাতা চা দিয়ে চার মিনিট ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে দেয়। দু দিনেই বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি ভালো দেখাবে না। নীতা বলেছিল বাইরে আমতলায় বসো। কেউ কিছু বলতে আসবে না। সৎরঞ্চি বিছিয়ে বসে গেছিল সবাই। রবি ঠাট্টা করে বলেছিল – অপু, তোর এই  শক্ত জমি চলবে না। অভ্যেস নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা গ্রামেই রয়ে গেছি, অভ্যেস আছে। একটা বালিস নিয়ে এসে তার উপর বোস। অপুর্ব রাজি হয়নি। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে আড় ভাঙতে হচ্ছে, তবে চালিয়ে নিচ্ছে।

অপুর্বে একটা কথা পরিস্কার করে বলে নিয়েছিল – দ্যাখ, ঘুণাক্ষরেও এখানে কোন নাম উচ্চারিত হবে না। আমরা জানি কি নিয়ে কাকে নিয়ে আলোচনা করছি, কিন্তু কারোর নাম আনবি না।

বলতে হয়নি আর। এক আধবার গলা চড়েছে কারো কারো, কিন্তু নেমে এসেছে আবার। অপুর্ব বলেছিলেন – জানিস, তোদেরকে বিধানসভা, লোকসভায় পাঠানো উচিত। সৌজন্য না হারিয়ে কিভাবে বিতর্ক করা যায় তা তোরা দেখাতে পারতিস। খুব ভালো লাগছে আমার। হালকা হাসির ঢেউ খেলে গেল সবার মুখে। অশোক বলল – অপু, এই ব্যাপারটা মিটে যাক, সত্যি একদিন সবাই গেট-টুগেদার করব। খুব সাধারন রান্না হবে কিন্তু জমিয়ে আড্ডা মারা হবে। বৌরাও চাইলে যোগ দেবে। নাদু কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ভটভট করতে করতে হাজির অনুপম। পঞ্চায়েত প্রধান অনুপমকেও ফোন করেছিলেন অপুর্ব। ফোন ধরেই বলেছিল – জেঠু, তুমি এসেছ, দেখা করতে নিশ্চয় যেতাম। আজকে একটা মিটিং আছে বিডিও অফিসে, আমি আগে ভাগে বেরিয়ে আসব। তা কথা রেখেছে অনুপম। বাইকটা সাইডে রেখে অপুর্বর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিল, বাকি জেঠুদের নমস্কার করেছিল। রবি হাঁ হাঁআ করে বারণ করেছিল – আমরা তোর নিত্য মুখোমুখি হই, প্রনাম করতে হবে না। অনুপম বলল – তুমি আমাকে শুধু ন্য, আমাদের অনেককেই অবাক করে দিয়েছ। এত বছর পরে গ্রামে এসে তুমি এদিক ওদিক ঘুরে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতে পারতে। তা না করে গ্রামের একটা সমস্যা নিয়ে জড়িয়ে পড়লে?

নিখিল বলল – শুধু নিজে জড়িয়ে গেলে ঠিক ছিল, এই দ্যাখ সাত সক্কালে আমাদের সবাইকে টেনে এনেছে কেমন। আমরাও গাধার মত জড়িয়ে গেলুম। অনুপমের হালুয়া এসে পড়ল, কুসুম পাঠায়নি আগে, অপুর্ব সেটাই বলে দিয়েছিলেন কুসুমকে। নাদু নিজের চামচটা নাড়াচাড়া করে বলল - বিডিও অফিস থে কে মিটিং করে আসছে, তার জন্য আবার হালুয়া কেন? অনুপম হালুয়াটাকে গলার ওপারে চালান করে বলল - দুটো লেড়ি বিস্কুট আর এক খুরি চা, এই পড়েছে সকাল থেকে। 

অপুর্ব বললেন – চা আসছে, সবাই পাবে। বিরাজ, তুই একটু অনুপমকে সংক্ষেপে আজকের আলোচনার বিষয়টা বুঝিয়ে দে। অনুপমের সাহায্য দরকার।

বলতে বলতেই চা হাজির। নীতা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। বলল – এটাই লাস্ট রাউন্ড। কুসুম রান্না চাপিয়েছে, আর চা করা সম্ভব হবে না।

নীতাকে দেখে সবাই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। ঢিলে ঢালা কেতরে পড়া শরীরগুলো তড়াক করে সোজা হয়ে বসল। অনুপম কাজ করেছে সবার আগে। খপাৎ করে পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে নিয়েছে – জেঠিমা, তুমি এ অঞ্চলের মেয়ে কিন্তু সে ভাবে তোমার সঙ্গে পরিচয়ই হয়ে ঊঠল না। তোমার মুখে বিদেশের কথা শুনতে পেলে দারুন লাগত।

নীতা একটু অপ্রস্তুত হয়ে অপুর্বর দিকে তাকাল। অপুর্ব পরিচয় করিয়ে দিল – অনুপম, এই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। এই সব ইয়্যাং ছেলেরা কেমন এগিয়ে এসেছে দ্যাখো, গ্রামের উন্নয়ন অনিবার্য।

নীতাও সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল – দারুন তো। তুমি কোনদিন এসো, নিশ্চয় গল্প শোনাব।

নিখিল বলল – বৌদি, সেই বৌভাতের পর আর দেখা হয়নি তোমার সঙ্গে। আমাদের বৌদেরও কারোর সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি। একটা গেট-টুগেদার করব শিগগির। কোন আপত্তি নেই তো? কোন বৌদের রান্না করতে হবে না, কথা দিচ্ছি।

নীতা বলল – না না, আপত্তি হবে কেন? বেশতো, ব্যবস্থা করুন। আমরা আবার মাঝে এদিক সেদিক একটু বেরুবো।  আগে ভাগে একটু জানতে পারলে সব দিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। তারপর অপুর্বর দিকে ফিরে বলল – এঁরা এ গ্রামের পাকাপাকি বাসিন্দা, এঁদের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে দিচ্ছ না কেন? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মাঝে মধ্যে বন্ধ করা দরকার, সেটা বোঝ তো? সব যায়গাতেই দেখি নাক গলিয়ে বসে আছ, তাও যদি নাক থাকত।

অপুর্ব নাকে হাত বোলাতেই সবাই হেসে ঊঠল। রবি বলল – বৌদি, ও দেশেও কি বন আছে আর মোষও আছে?

নীতা বলল – নেই মানে? দেদার বন আর বড় বড় মোষ। ইয়া বড় বড় শিং, লাল চোখ, দেখলেই ভয় করে।

অনুপম চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল – জেঠিমা, তুমি কিচ্ছু ভেবো না। জেঠু কোন কিছুতে থাকবে না। তবে এমন একটা সমস্যা জেঠু তুলে ধরেছে যা আমাদেরই আগে ধরা উচিত ছিল। তাহলে একটা সাধারন মামুলি মানুষ অতিমানুষের চেহারা নিত না, আমরাই ওকে মাথায় তুলেছি।

নীতা ফিরে যেতেই নাদু ঝাঁঝিয়ে ঊঠল – এটা একটু বাড়িয়ে বললে অনুপম। কে ওই লোকটাকে মাথায় করবে শুনি? আমরা কি জানি না পুরোটাই ওর বুজরুকি?

অপুর্ব ঠান্ডা চোখে নাদুর দিকে তাকালেন। বললেন – কালকের সকালে কি করেছিস মনে আছে? আমাদেরকে দেখেই মাথা মুখ গামছায় জড়িয়ে দৌড় দিলি। আমার দিকে ফিরেও তাকাসনি।

নাদু ফুটো বেলুনের মত চুপসে এই এতটুকু। আমতা আমতা করে বলল – ওটা অভ্যেস বুঝলি, অপু। ও লোকটাকে সাত সক্কালে দেখলেই আপনা আপনি মুখে মাথায় গামছা চলে আসে। তা বলে কি আর সত্যি সত্যি ওকে সমঝে চলি?

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল নাদু, অনুপম থামিয়ে দিল। অপুর্বর দিকে তাকিয়ে বলল – তুমি কি কিছু বিশেষ চিন্তা করেছ জেঠু? আমাদের দিক থেকে যতটা সম্ভব করব। কিন্তু মনে রাখতে হবে পঞ্চায়েতের কাছে গ্রামের সব মানুষই সমান। বিশেষ সুযোগ সুবিধে কাউকে আমরা দিতে পারি না।

সবাই তাকিয়ে আছে অপুর্বর দিকে। অপুর্ব মনে মনে ভেবেই রেখেছিলেন কি বলবেন। সেটাই বললেন খুব ধীরে মেপে মেপে – আমি জানি সে কথা অনুপম। বিশেষ সুবিধে একজনকে পাইয়ে দেওয়া উচিত নয়। দুটো জিনিষ এখন একান্ত জরুরি। অপুর্ব বন্ধুদের দিকে তাকালেন। জনরোষ থেকে ওদের বাঁচাতে হবে। পুরুলিয়া, বীরভুম প্রভৃতি কয়েকটি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে কারোর কারোর দুর্ভাগ্যা, দুর্ঘটনা, অসুখ-বিসুখ গ্রামের কোন হতভাগ্য বা হতভাগিনীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ডাইন বা ডাইনি চিহ্নিত করে, পুড়িয়ে মারে জ্যান্ত পুলিশ কিছু করার আগেই। আমি বলছি না এই গ্রামে সে রকম কিছু হবে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষিপ্ত মানুষ এক হয়ে গেলে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। অপুর্ব থামলেন একটু।

অশোক বলল – আমাদের কি করতে বলিস?

আমাদের প্রত্যেকের কাজ হবে সবার মাথা থেকে এই ভ্রান্ত ধারনা দূর করা যে ঈশ্বরের সৃষ্টি কোন মানুষের দৃষ্টি থেকে কারোর কোন অমঙ্গল হয় না। তোদের কাজে সেটা প্রথম প্রমান করবি, মাথা বা মুখ ঢেকে পালাবি না। অনুপম পঞ্চায়েত লেবেলে এটা করবে, আমি স্কুলে গিয়ে গল্পচ্ছলে এটা ছাত্র-ছাত্রীদের জানাব। ধীরে ধীরে বোঝানোর মত করে বলতে লাগলেন অপুর্ব। পুরো প্ল্যানটা চোখের সামনে ধাপে ধাপে উঠে আসছে। তাড়াহুড়ো নয়, ততদিন ওদের পরিবারের খাওয়া-পরার ব্যাপারটা ভাবতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ওদের এমন একটা জীবিকার কথা ভাবতে হবে যেটা ও চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ছেলেটা ওর মাধ্যমিক দেবে এ বছর।

মোটামুটি পেট চালানোর মত একটা ব্যবস্থা নিয়ম মেনে করা যেতে পারে। অনুপম ঝুঁকে পড়ল। এক’শ দিনের কাজে কাকিমাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি, ওদের পারিবারিক অবস্থার কথা সবাই জানে, তাই কোন অসুবিধে হবার কথা নয়। হাল্কা কাজ কাকিমার মত করে দেওয়া যেতে পারে। পঞ্চায়েতের পরের মিটিঙে তুমি একটু এসো জেঠু, সুবিধে হবে, আমি বলে রাখব।

চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত কি জীবিকার কথা ভেবেছিস তুই? নিখিল জিগ্যেস করল।একটা কোন দোকান। অপুর্ব আস্তে করে বললেন। হিসেব নিকেষ ও বোঝে। কি হবে না?

চুপ করে রইল সবাই। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, এই দোটানা থেকে যাচ্ছে। অপুর্ব তো চলে যাবে, তারপর? ওর দোকানে যদি কেউ না যায়? দোকানের জন্য চাই, জায়গা আর মূলধন। আসবে কোত্থেকে?

অপুর্ব আন্দাজ করলেন টানাপোড়েনের ব্যাপারটা। বললেন – মূলধনের কিছুটা আমি ধার হিসেবে দেব, কিছুটা ব্যাঙ্ক থেকে আসবে তোরা সাহায্য করলে। আর একটা জায়গা আমার বন্ধুরা ম্যানেজ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। মুদি দোকান হলেই ভাল। তোরা সবাই ওর থেকে কেনাকাটা করলে বাকী লোকেরাও আস্তে আস্তে আসতে থাকবে আমার বিশ্বাস।

অনুপম ঊঠে পড়ল। মাথায় হেলমেট বাঁধতে বাঁধতে বলল – তুমি অনেক কিছু ভেবেছ, আমাদের উপর অনেক বিশ্বাস রেখেছ, আমরা পিছিয়ে আসব না, অন্তত আমিতো না। কথা হবে আবার জেঠু। ভট ভট করে অনেকটা ধোঁয়া উড়িয়ে বেরিয়ে গেল অনুপম। বাকীরাও উঠে পড়ল। নাদু যেতে যেতে বলল – সহজ হবে নারে অপু। কিন্তু আমিও পিছিয়ে যাব না, আমার মনে হয় না এরাও কেঊ পিছিয়ে যাবে।

একসঙ্গে বেরিয়ে যে যার দিকে ছড়িয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে হাত তুলে নিখিল অশোক আর রবিকে ডাকল। অপুর্বর চোখে পড়ছিল ব্যাপারটা, ওরা কি কিছু অপুর্বর সামনে বলতে দ্বিধা করেছিল, এখন আলোচনা করছে। পাঁচ সাত মিনিটের বেশী নয়। মুখগুলো দেখা যাচ্ছিল, একটু গম্ভীর মনে হল। ব্যাপরটাই গম্ভীর সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ওরা কি সরে যাবে? হঠাৎ চোখে পড়ল গেটের ধারে পাতু দাঁড়িয়ে, পেটের কাছটা বেশ উঁচু। অপুর্ব হাত নেড়ে ডাকলেন – কিরে, স্কুল যাসনি?

পাতু সবেগে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল – বারে, স্কুল যাব না কেন? স্কুলতো ছুটি হয়ে গেল। বাড়ীতে বইপত্তর রেখে আসছি।

অপুর্ব হাসলেন। বললেন – বেশ উঁচু লাগছে, কতগুলো আনলিরে?

পাতু দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল দুটো মুড়ে রেখে বাকী আঙ্গুলগুলো মেলে ধরলো।

অপুর্ব অবাক হবার ভান করে বললেন – বাপরে, আট আটটা পেয়ারা আনলি? কি দরকার ছিল বলতো। আচ্ছা যা, তোর জেঠিমার হেপাজতে ওগুলো দিয়ে দিস আর বলিস জেঠু বলেছে হারশ্লের একটা প্যাকেট তোকে দিয়ে দিতে।

পাতুর চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল। বলল – কি বলছ জেঠু, একটা প্যাকেট পুরোটা?

                     ********************************

গোটা গ্রাম বেশ নাড়াচড়া খাচ্ছে কিছুদিন। ছোটছোট জটলায় একই বিষয়। মনে হচ্ছিল এই গ্রাম থেকে বোধ হয় সারা রাজ্য, দেশ এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব মুছে গেছে। নীতা বিরক্ত হয়ে বলল – এসেছিলে ছুটি কাটাতে, এ কি আরম্ভ করলে? তোমাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই সেটা জান? নেহাত মুখের উপর কিছু বলতে পারে না তাই, না হলে বেশ ঝামেলা হত। আস্তে করে সরে পড়ি চল, ঢের হয়েছে আর নয়। কুসুম বলছিল ওর বাড়ীতে বা পাশের বাড়ীতেও জোর আলোচনা তোমাকে নিয়ে।

অপুর্ব হাসলেন। বললেন – সবাই কি আমার বিপক্ষে, কুসুম তাই বলেছে?

নীতা মুখ ব্যাজার করে বলল – দু’দলই আছে, যেমন থাকে। তোমার সব বন্ধুরা কি তোমাকে সাপোর্ট করছে?

তা করছে না। স্বীকার করলেন অপুর্ব। কিন্তু কি জান, আস্তে আস্তে ওরাও আমাকে সাপোর্ট করবে। ভেবেছিল্ম নাদু বোধ হয় সটকে পড়বে, কিন্তু ও আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে। একটা পরিবারকে খাদের কিনারা থেকে তুলে টেনে আনতে হবে নীতা, খাদে ঠেলে দিতে নয় যখন আমি বুঝতে পারছি ওরা খাদের মুখে দাঁড়িয়ে।

নীতা বিরক্ত মুখে চলে যায়। ও দেশেও তাই। ঘরের খেয়ে বাইরের নিয়ে মেতে থাকে, অনেকেই অপছন্দ করে কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। এখানে ওরা কয়েকদিনের জন্য এসেছে, হতে পারে এটা ওর গ্রাম কিন্তু মানুষ কি আর সেরকম আছে?

নেই, সেটা অপুর্বও জানেন। কিন্তু পিছু হটা সত্যের জন্য সম্ভব নয়। লোক ঠিক বুঝতে পারবে, কিন্তু সময় নেবে। তাঁর সময় কম, ছুটি সীমিত। অপুর্ব ঊঠে পড়েন, বসে থাকার সময় আসেনি। চৌপুকরার মোড়ে এসে আটকে গেলেন। একটা ছোটখাটো দল, সবার সামনে ধীরু। হাতে ছোট একটা লাঠি। অপুর্বর চেয়ে আট-দশ বছরের বড় তো হবেনই। গ্রামে থাকা কালীন খুব কম কথাবার্তা হয়েছে, কেমন আছ, কি করছ, কতদিন থাকা হবে, এখন কোথায় আছ, ব্যশ এই পর্যন্ত। দলটা দাঁড়িয়ে পড়ল। অপুর্ব বুঝলেন, এরা সবাই নফরের কাছে মার খেয়েছে, বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী। অপুর্বর উপরে তাই রাগ, কিন্তু সরাসরি বলতে পারছে না, হাজার হোক গ্রামের ছেলে, তুখোড়, বুদ্ধীদীপ্ত, নিজের চেষ্টায় এতদূর উঠেছে, গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ের পড়াশুনায় আর্থিক সাহায্য করে। অপুর্বর একটা আলাদা সম্মান আছে এই গ্রামে, শুধু এই গ্রামে নয় আসে পাশের অনেক অনেক গ্রামেও অপুর্বকে চেনে শুধু ওর নামে। খর চোখে তাকালেন ধীরু। - এটা কি শুরু করেছিস অপু? খট করে কানে লাগল অপুর্বর। আগে তুমি করে বলত এখন সরাসরি তুই। অপুর্ব গায়ে মাখলেন না, মুখের হাল্কা হাসি ধরে রেখে বললেন – ধীরুদা, অনেকদিন পরে দেখা , কেমন আছ? বৌদি, তরু, শ্যামল সব ভালো আছে তো?

খর ভাবটা একটু কমে গেল। তরু, শ্যামলের নামটাও মনে রেখেছে? কিন্তু দমলেন না। বললেন – হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালো আছে সবাই। যে যার মত ঘর সংসার করছে। কিন্তু একি শুরু করেছিস অপু? দু’দিন এসেছিস একটু বেড়িয়ে আড্ডা মেরে চলে যাবি।  তা না করে সমাজ সংস্কারে মন দিয়েছিস?

দলের বাকীরা সবাই মজা ভেবে একটু হেসেও নিল। অপুর্ব কোন প্রতিকৃয়া দেখালেন না। হাসিটা ধরেই রাখলেন। বললেন – তা কেন ধীরুদা, এটা তো আর বিদ্যাসাগর রামমোহনের সময়কার সমাজ নয়, যে সংস্কারের দরকার পড়বে। এখন সবাই অল্প বিস্তর পড়াশুনা করেছে, টিভি দ্যাখে, রেডিও শোনে, খবর কাগজ পড়ে, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, যুক্তি দিয়ে কাজ করে, কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, গ্রামের মাথায় প্রথম সারিতে তোমরা আছ – তাহলে? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল অপুর্ব। দলের বাকী লোকেরা একটু অপ্রস্তুত, মুখ দেখে সেরকমই মনে হল অপুর্বর। ধীরু একটু দমে গেলেও বুঝতে দিলেন না। বললেন – এটা কুসংস্কারের ব্যাপার নয় অপু। সুদৃষ্টি, কুদৃষ্টি বলে কথা আছে জানিস তো? ওই ছোট শনির কুদৃষ্টি থেকে এ গ্রামটাকে বাঁচাতে হবে। ও হতচ্ছাড়াকে আমি এ গ্রাম ছাড়া করবই। যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে যাক। তুই এর মধ্যে নাক গলাসনি অপু, তোকে সবাই ভালোবাসে, তোর অসম্মান হোক এটা আমরা কেঊ চাই না।

একটা ছোট গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল যেটা জানান দিল সবাই ধীরুর সঙ্গে একমত। অপুর্ব সবার মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কাউকে চেনেন না, বয়সে এরা কিছুটা ছোট তাঁর থেকে। হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে ধীরুর চোখে চোখ রাখলেন – তোমরা ভালোবাস বলেই তো এটা করার সাহস পেয়েছি ধীরুদা। তোমরাই তো সাহসটা যুগিয়েছ।

ধীরু একটু থতমত খেলেন, বললেন – মানে? এ কি ধরনের রসিকতা অপু?  

অপুর্ব ধীরুর চোখ থেকে চোখ সরালেন না। বললেন – সবাই আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। সবাইর মধ্যে তুমিও তো পড়, তুমিও তো আমাকে ভালোবাস, সম্মান কর তাই না, ধীরুদা?

ধীরু চোখ কুঁচকে দেখছিলেন অপুর্বকে। বয়স হয়েছে, কথার ধার এবং ভার দু’টোই বেড়েছে। পিছলে যেতে চাইছে কি? উঁহু, তা কি হয়? অপুর্বর কথার রেস রেখেই জবাব দিলেন – নতুন করে আর কি শুনবি আমার থেকে? বুদ্ধিমান ছেলে ছিলি, একাবারে নিজের চেষ্টায় এত উপরে উঠেছিস, গ্রামের ছেলেমেয়েদের আর্থিক সাহায্য করিস পড়াশুনায়, সবাই তোকে ভালোবাসে সম্মান করে, আমিও করি।

তা হলে আমি কয়েকটা কথা বলি, ধীরুদা, শুনবে তো, সময় আছে? ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করে দিলেন। এটা একটা সন্ধিক্ষণ, এ সুযোগ পাওয়া মুশকিল। একজায়গাতে একসঙ্গে সবচেয়ে দরকারী মানুষগুলোকে পেয়েগেছেন, বাকীরা ঘুরে ঘুরে এত দিনে যা করতে পেরেছে তার কয়েক’শ গুণ এই একেবারেই হয়ে যাবে। ধীরু বাকিদের দিকে তাকালেন, কেউ কোন জবাব দিল না আবার তাড়াও দেখাল না। বাইরের মানুষটা কি বলে শোনা যাক। ধীরু বুঝতে পারলেন, মানুষ চিনতে তাঁর সময় লাগে না। বললেন – বল, কি বলবি। বেশী লেকচার যেন না হয়ে যায়।

আমার যা পেশা তাতে লেকচার দেওয়ার কোন সুযোগই নেই, আর আমি তো ছেলেবেলা থেকে মুখচোরা ছিলাম, তাতো তোমার অজানা নয়। যাক আমার কথাটা সংক্ষেপে বলি। একটা কথা বলতো ধীরুদা, তোমার কি মনে হয় ঈশ্বর একচোখা? তোমার বাড়ীতে কালীপুজো হত যানি, তুমি নিশ্চয় মা কালীকে বিশ্বাস কর।

তারা, তারা! আঁতকে উঠলেন প্রায় ধীরু। ঈশ্বর কেন একচোখা হবেন? এই ভরদুপুরে এমন সর্বনেশে কথা শোনাও পাপ।

বেশ, সবাই আমরা জানি ও মানি ঈশ্বর সমদৃষ্টিসম্পন্ন। একটা গভীর শ্বাস হালকা করে টেনে বুক ভরালেন অপুর্ব, আরও একাওবার নিজেকে গুছিয়ে নিলেন, ধীরুর চোখের উপর থেকে চোখ সরালেন না। তুমি, আমি, এই তোমরা সবাই ঈশ্বরের সৃষ্টি, মায়ের গর্ভ থেকে যে দৃষ্টি নিয়ে জন্মেছি তা ঈশ্বরেরই দান। সে দৃষ্টি সবার এক, যদি সু হয় তাহলে সু, যদি কু হয় তা হলে কু। একজনের সু অন্যজনের কু, এমনটা হতে পারে না। জীবিকা হিসেবে কে কি পথ বেছে নেবে সেটা অনেক পরের ব্যাপার, নিজের ইচ্ছে, লক্ষ, পরিশ্রম আর সুযোগ সেখানে বড় ভূমিকা নেয়। কিন্তু জীবিকা যাই হোক না কেন, ঈশ্বর প্রদত্ত দৃষ্টি কিন্তু পালটায় না। অপুর্ব একটু দম নিলেন। ধীরু তাকিয়ে আছেন অপুর্বর দিকে, অনেক পালটে গেছে, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিলেন অপুর্ব। কথাগুলো এদের মনে ধরেছে। ফেলতে পারছে না। বললেন – একজন স্বাভাবিক  দৃষ্টিতে তাকাবে আর অন্যজন শনির দৃষ্টিতে তাকাবে এটা মানতে গেলে ঈশ্বরকে কাঠগড়ায় টেনে আনতে হয়, পারবে ধীরুদা?

তারা তারা, শিউরে উঠলেন ধীরু। ঠাকুর দেবতা নিয়ে আর টানা হ্যাঁচড়া করিস না অপু।

অপু হঠাৎ ধীরুর হাত দুটো ধরে ফেললেন, ধীরু প্রস্তুত ছিলেন না, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। শেষ অস্ত্রটা ছাড়তে হবে, দেরী করলেন না অপুর্ব – ও দেশেও আমার কয়েক’শ পরিচিত মানুষজনের কাছে এই গ্রাম নিয়ে আমি গল্প করি, গর্ব করি। বলি, এই তোমাদের মত মানুষজন, মাষ্টারমশাই, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী আমার মত এক সাধারন ছেলেকে ঠেলে তুলে বিদেশ পর্যন্ত পাঠিয়েছে, এ গ্রাম না থাকলে আমিও অপু হতাম না। কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে সামনে এগোচ্ছে, আরো এগোবে। আমি স্বপ্ন দেখি এ গ্রাম নিয়ে, অনেক বড় স্বপ্ন, বলব তোমাদের সবাইকে যদি বলার মত সময় আসে। কিন্তু তোমরা যেটা ভাবছ বা করবে বলে ভেবেছ তা শুধু আমার গর্বের জায়গাটা ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দেবে না, ওদেশের কারোর কাছে এই গ্রাম নিয়ে আর বলার মত কিছু থাকবে না, এক ধাক্কায় অনেকটা পিছিয়ে যাবে তোমার, আমার এবং আমাদের সবার এই গ্রাম।

অপুর্ব আস্তে করে হাত ছেড়ে দিলেন ধীরুর। ঘামছে সাঙ্ঘাতিক। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছলেন কপাল, গাল, ঘাড়। বাকীদের মুখেও কোন কথা নেই। অপুর্ব পা বাড়ালেন। বললেন – তোমরাই ঠিক কর কি করবে। খপ করে অপুর্বর জামা খামচে ধরলেন ধীরু। বললেন – চললি যে বড়? তোর স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে গ্রামের সবাই আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে, সেটি আমি হতে দেব না অপু। এই তোরা কি বলিস?

দু একটা টুকরো কথা, অসমাপ্ত বাক্য ভেসে এল দলটা থেকে যার মানে এই দাঁড়ায় ধীরুদার সঙ্গে সবাই একমত। শুধু একটা টাকমাথা মাঝবয়সী লোক এগিয়ে এসে বলল – তুমি আমাকে চিনবে না অপুদা। আমার নাম শ্রীনিবাস। তুমি যে বছর স্কুল ছাড়ছ, আমি সে বছর ঢুকছি। তোমার কথা শোনেনি এ গ্রামে এমনটা কেউ নেই। গ্রামকে তুমি এতটা ভালোবাস আজ এই প্রথম জানলাম। কি স্বপ্নের কথা বলছিলে অপুদা?

ভেতরে কাঁপুনি টের পাচ্ছিলেন অপুর্ব। জয়ের দোরগোড়ায় এভাবে পৌঁছে যাবেন ভাবেননি। এভাবেই কি ঠাকুর মানুষের সদিচ্ছাকে হারিয়ে যেতে যেতেও টেনে ধরেন? ঘামছেন তিনিও। চোখের কোল ভারী হচ্ছে। চশমা খুলে জামার এক কোনা দিয়ে মুছলেন, জামার হাতায় চোখ মুছে চশমাটা বসালেন। তারপর শ্রীনিবাসের দিকে ঘুরে বললেন – খুব ভালো লাগছে তুমি আমার স্বপ্নের খোঁজ নিয়েছ। আমাদের এই গ্রাম পশ্চিমবাংলার প্রায় বিয়াল্লিশ হাজার গ্রামের মাঝে একটি, অন্য কোন পরিচয় নেই, মানচিত্রে আলাদা করে দাগ দেওয়া নেই। বিয়াল্লিশ হাজারের মাঝে এক নয়, দশের মাঝে এক অথবা একের মাঝে এক, মানচিত্রে নতুন জায়গা করে নেবে, যে কোন শিক্ষিত মানুষ তা সে পশ্চিমবাংলার যে প্রান্তেই হোক না কেন এ গ্রামের নাম শুনে চিনতে পারবে, বাইরের থেকে আনাগোনা শুরু হবে এই গ্রামটাকে দেখতে আসার।

অপুর্ব দম নিলেন। গলা শুকিয়ে আসছে, শুকোক, একটু কষ্ট হোক। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে সবাই, কে শুনছে, এমন কথা কি কেউ কবে শুনিয়েছে? ধীরুর গলা কাঁপছে – কি বলছিস অপু? কি করে?

আদর্শ গ্রাম, ধীরুদা। মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়ার মত করে উচ্চারন করলেন কথা ক’টি। অনেক কাজ করতে হবে, মানুষজনের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে, কুসংস্কারের সেখানে কোন জায়গা নেয় ধীরুদা।

একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ধীরুর বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। বললেন – ঠিক আছে অপু, তুই যা চাইছিস তাই হবে। হতচ্ছাড়াটা থেকেই গেল দেখছি।

অপুর্ব হাসলেন। বললেন – ও ওর ওই পুরনো কাজ ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ওর সংসার চলবে কি করে ধীরুদা? অন্য কোন কাজ ও জানে না। মাধ্যমিক দেবে ওর ছেলেটা।

কেন তুই নাকি ওর জন্য দোকান করে দিবি বলেছিস? ধীরু ঝাঁঝিয়ে ঊঠলেন। পুরনো ঘা এত সহজে মেটে না। তা যাকগে তুই যা পারিস কর। আমার আর কি?

তুমি ঠিকই শুনেছ ধীরুদা, কিন্তু যেটা শোননি সেটা হল এতে তোমার অনেক কিছুই আছে।

আমার? হাত উলটে উড়িয়ে দিলেন ধীরু। তোর সত্যি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

তা গেছে, সবাই তাই বলছিল। এখন আর কেউ বলছে না, তুমিও না। সন্ধ্যেবেলা যাব তোমার বাড়ীতে কয়েকজন মিলে, তখন বুঝবে পুরোটা। এখন চলি। তুমিও যাও, খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও।

অপুর্ব পা বাড়াতেই খপ করে হাত চেপে ধরলেন ধীরু - তোর মাথায় আর কি সর্বনেশে প্ল্যান খেলছে অপু, খুলে বল। প্রেশার বাড়ছে মনে হচ্ছে। ললিত গো হারান হারাল, তুইও হারালি। আর কি হারাব বলতে পারিস?

ভেতরে ভেতরে বেশ স্বস্তি অনুভব করিছিলেন অপুর্ব। আত্মবিশ্বাসটা জমাট হচ্ছে আরো। মুখের সেই হাল্কা হাসিটা ধরেই রেখে বললেন – তুমি হারোনি ধীরুদা, সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো। ললিতদার কাছেও না।

ধীরু অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে ছিলেন। কি ঘটছে বুঝতে পারছেন না। বললেন – কি বলছিস? গতকালই তো রায় বেরুলো। উকিল বলছিল আপিল করতে, আমি রাজি হইনি। টাকা অনেক খেয়েছে ব্যাটা, আর না।

ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি। ধীরুর হাতে হাত রাখলেন অপুর্ব। ললিতদার ওই জমিতে দোকান উঠবে। কথা হয়েছে আমার ললিতদার সঙ্গে। দোকান ঘর বানানো, আর চালু করার মূলধন কিছু দেবে তুমি, কিছু আমি আর বাকী আমার কয়েকজন বন্ধু। ধার হিসেবে। দোকানের উদবোধন করবে তুমি আর ললিতদা, তোমাদের সবার মাসকাবারি বাজার যাবে এই দোকান থেকে, আর কি ভাবে টাকা শোধ হবে, কে চালাবে এ সব এখানে দাঁড়িয়ে আলোচনা করা যাবে না। সন্ধেবেলা যাব।

ধীরুর পা দুটো অসাড় হয়ে আসছিল। ধপ করে বসে পড়লেন রাস্তার উপরেই। তারপর অপুর্বর উদ্দেশ্যে বললেন – তোর মনে এই ছিল অপু, আমাকে টেনে রাস্তায় বসালি? ললিতটাও যোগ দিয়েছে তলে তলে ? ওরে শ্রীনি আমাকে প্রভাতের চেম্বার থেকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যা, প্রেসারটা দেখাতে হবে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যে পর্যন্ত টিকব না।

                       ***************************

বয়স হয়েছে বুঝতে পারেন ললিত আর ধীরু। জোরে হাঁটা লাগাতে চাইলেও পারেন না আজকাল। ধীরু বিরক্ত হয়ে বলেন – এবার এটা বন্ধ কর লিলু, আর পারা যায় না রোজ রোজ।

লিলুও থেমে যান, দাঁড়িয়ে দম নেন, বড় করে শ্বাস ফেলে বলেন – একটু আগে ভাগে বেরুলে তোর কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় ধীরু। প্রতিদিন তুই দেরী করবি, আর বুড়ো বয়সে দৌড়ুতে হবে।

খিঁচিয়ে ওঠেন ধীরু। তোর তো এটা নিয়ে একটু আমার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার ছিল, না তাও মনে করিসনি। আমাদের দিয়ে বৌনি করাবেন ওই হতভাগা শনি, না হলে কাউকে চা দেওয়া শুরু করা যাবে না। দেখবি কত লোক জড়ো হয়ে আমাদের পিণ্ডি চটকাচ্ছে। সকালে চা খেতে এসে যদি দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাহলে কার বা মাথার ঠিক থাকে? আমার হলেও থাকত না।

লিলু জবাব দেন না। নীরবে দুই বৃদ্ধ হাঁটতে থাকেন। যা ভেবেছিলেন তাই। অন্তত দশ বারোজন গুলতানি পাকাচ্ছে। দু’ই বুড়োকে দেখে একটা হাল্কা শোরগোল উঠল। একজন বললে – নফরদা , চা ঢালো। তেনারা মানে তোমার বৌনি মালিকরা এসে গেছেন। নফর ধমক দেয়, কাউকে ছাড়ে না – আঃ, অমন করে কইতে আছে নাকি? বয়স্ক মানুষ, একটু বুঝে সুঝে কথা কওনা কেন? ওনারা না থাকলে কি এই দোকান হত, চা পেতে?

শেষের কথাগুলো কানে গিয়েছিল ধীরুর, ললিতেরও। ললিত কম কথার মানুষ, জবাব দিলেন না। ধীরু ছাড়তে রাজী নন। বেঞ্চে বসতে যাচ্ছিলেন, নফর এসে গামছা দিয়ে ঝেড়ে দিল। ধীরু খুশি হলেও রাগের ভাণ করলেন – তুই আর আদিখ্যেতা দেখাসনি নফর। রোজ রোজ এত সকালে আসা এই বয়সে আসা সম্ভব? ঠান্ডা, বাদলা হলে আসতে পারব? আমাদের জন্য এতগুলো লোককে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে দিবি এটা ঠিক কথা নয়।

নফরের হাত দ্রুত চলছিল। ললিত লক্ষ করছিলেন। চাপা গলায় বললেন – ভাবতে পারিস ধীরু, হাত কাঁপত আগে নফরের চা ঢালতে গিয়ে। মাত্র সাড়ে তিনিমাসে বেশ সামলে নিয়েছে।

ধীরুর মুখ চলছিল। মারী বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে মুখে ভরে জিভের এদিক সেদিক করে সটান চালান করে দিলেন গলায়। তারপর চায়ে একটা ছোট চুমুক দিয়ে প্রতিদিনের মত তৃপ্তির শব্দ করলেন মুখে। সকালে রাগ হয়, কিন্তু এই একসঙ্গে ললিতের সঙ্গে সকালের চা, দেশ-বিদেশ-রাজ্য-জেলা এবং সবশেষে এই গ্রাম নিয়ে আলোচনা না করলে দিনটা মনে হয় শুরুই হল না। কি সর্বনেশে নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেছে হতচ্ছাড়া অপু। 

দোকান বেশ রমরমিয়ে না চললেও খারাপ চলছে না। একটু পরে নফরের বৌ এসে পড়লেই ঘুগনি চাপবে, বাড়ী থেকে মালমশলা সব রেডি করে আনে। সকালে ছেলেটা স্কুল না বেরিয়ে গেলে আসতে পারে না, মাধ্যমিক দেবে এবছর। তাকেও তো একটু নজর দিতে হবে।  বিকেলে তেলেভাজা শুরু হবে চারটের পর। মুদি দোকানের চাল-ডাল-মশলাপাতি বিক্রিটা নফর সামলায় ওসময়। রাত্রে নাদু এসে দোকানের সারাদিনের হিসেবটা চোখ বুলিয়ে ক্যাশ নিয়ে বাড়ী চলে যায়, পরদিন সকালে গ্রামের কোপারেটিভ ব্রাঞ্চে দোকানের অ্যাকাউন্টে জমা করে রসিদ নিয়ে নায়, মাসের শেষে হিসেব নিকেশ হয়, ধীরু এবং ললিত থাকেন – সেরকমই নির্দেশ অপুর্বর। দোকানের মালপত্র দেখাশোনা, কি আছে কি নেই, কহন কি আসবে ভাগাভাগি করে নিয়েছে রবি, অশোক, সুকুমার আর নিখিল। সবাই অল্প বিস্তর ব্যস্ত তাই এই ব্যবস্থা। কেউ না করেনি অপুর্বর এই প্রস্তাবে। আদর্শ গ্রামের নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেছে অপুর্ব, অনেকের মনেই স্বপ্ন, কৌতূহল – কি হবে এর পর? কিছু একটা হবে এটাই সবাই জানে। সুধীর কীর্তনীয়া সকালের রাঊন্ড শেষ করে এসে নফরের দোকানের সামনে দাঁড়াল, বিনি পয়সার চা। এটা আবার নফরের ব্যবস্থা। সারা গ্রামে প্রতিদিন কি গ্রীষ্ম কি শীত কি বর্ষা সুধীর সকলের বাড়ীতে প্রভাতী কীর্তন শুনিয়ে আসে, একমাস ধরে প্রতিদিন একটা অন্তরা। পরের মাসে অন্য। মাস শেষ হলে ধামা নিয়ে হাজির, কেউ চাল, কেউ টাকা যে যেমন পারে দেয়। বাড়ির আঙ্গিনায় সাত সকালে ঈশ্বরের নাম কীর্তন কেউ অপছন্দ করে না। নফরের বাড়ীও বাদ যায় না। নফর এই দোকান হবার পর রোজ চা খাওয়ায়, সঙ্গে বিস্কুট। সুধীর তাতেই রাজি। নফরের হাত থেকে চা নিয়ে আড় চোখে দুই প্রৌঢ়ের দিকে টিপ্পনি কাটল সুধীর – গৌর নিতাই জুটি নদীয়ার থেকে এ গ্রামে উদয় হল, এ গ্রাম আদর্শ হবে নাতো কোন গ্রাম হবে রে নফর?

ধীরুর চা শেষ হয়ে গেছিল। পায়রার পালক দিয়ে কানে আলতো করে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলেন চোখ বুজে, ললিত আনন্দবাজার শেষ করে বর্তমানে পড়েছিলেন, অবশ্য বাসি কাগজ। আজকের কাগজ আসতে আসতে সে বেলা বারোটা। কাগজ থেকে চোখ তুললেন না, এসব টিপ্পনি গায়ে মাখেন না তিনি, সবাই জানত আদায় কাঁচকলায় দু’জন, এখন একসঙ্গে রোজ চা, টিপ্পনি তো শুনতে হবেই। ধীরুর পালক নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেল, বাঁ চোখ বন্ধ রেখে ডান চোখ ছোট করে খুলে ললিতকে বললেন – সুধীর আমাদের নিয়ে কিছু বলল মনে হচ্ছে? আমার কানটা বন্ধ ছিল, তুই শুনেছিস ললিত?

ললিত কাগজ থেকে চোখ নামাল না, বললেন – তুই যখন শুনিসনি, আমিও শুনিনি। কাগজ পড়ছিলাম কিনা।

জানেন, ধীরু ঠিক শুনেছে। এবং হলও তাই। ধীরুর গলা উঠল – হারামজাদা,  গৌর নিতাই না হলে তোর শুকনো গলা দিয়ে এখন যা নামছে তা নামত? টিউবওয়েলের জল ঢক ঢক করে নামিয়ে ভেজাতে হত। নেমকহারাম সব।

ললিত মৃদু ধমক দিলেন – ছাড় তো ধীরু, সুধীর তোকে আমাকে গৌর নিতাই বানিয়ে দিয়েছে, জগাই মাধাই তো বানায়নি।

সুধীর হেসে বলল – তবেই বোঝ, ললিতদা। ভাল বললুম, মন্দ শুনল। আসলে উকিল মোক্তার জজ এত বিষ ঢেলেছে কানে এত বছর যে ভালো মগজে সেঁধুতে পারে না, টং করে ফিরে আসে। এত বছর সকাল সকাল কীর্তন শোনালুম, কিন্তু কিস্যু হয়নি। কবে যে হবে রাধা মাধবই জানেন। চলিরে নফর। আরো সাত ঘর বাকী আছে।

চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে সুধীর পিঠটান দেয়, জানে এখনি বিষ্ফোরন ঘটবে।  ঘটলও তাই। সুধীর যেতে যেতে শুনতে পেল ধীরুর গলা চড়ছে– হতচ্ছাড়া কীর্তনীয়ার আমার মগজের জন্য ঘুম হয় না। ব্যাটা ফাঁকিবাজ। সাত সক্কালে অড়ং বড়ং করে খোলের সাথে সাথে কি বলে কিচ্ছু বোঝা যায় না। কীর্তন না ঘোড়ার ডিম। এখনো সাত ঘর বাকী রেখেছে, প্রভাতী কীর্তন গাইবে। প্রভাত আর আছে রে ললিত?  

এটা নিত্যিকার ঘটনা না হলেও প্রায়ই ঘটে যেদিন কত্তা দুজন সুধীরের আসার আগে উঠে না যান। নফর গাঁ করে না, নিজের মনে কাজ করে যায়, গুন গুন করে সুধীরের কীর্তনের কলি – উঠ উঠ গৌর চাঁদ নিশি পোহাইল। খবরের কাগজের আড়ালে মখ ঢেকে রেখে ফিস ফিস করে ধীরুকে সামলান, বলেন – ওসব ছাড় ধীরু। দ্যাখ তোর ছোট শনির গলায় সুধীরের কীর্তন। ভাবতে পারিস, তোর ছোট শনি কোথায় হারিয়ে গেছে, হাজার খুঁজলেও পাবি না। ধীরু গজ গজ করেন – ছোট শনির জায়গায় যে বড় শনি উদয় হয়েছে সেটা কি তুই জানিস? লক্ষ করিসনি? তোর তো আবার এসব দিকে নজর নেই, কোন কালেই বা ছিল? ললিত অবাক হয়ে বললেন – আবার কেউ উড়ে এল নাকি এ গ্রামে?

ধীরু বিরক্ত হন। এত আলাভোলা লোক হয়েও টিকে আছে কি করে ললিত সেটাই মাঝে মাঝে ভাবেন। নফর যাতে না শুনতে পায়, সে ভাবেই গলা নামিয়ে বললেন – ঊড়ে আসবে কেন, অনেক আগে থেকেই জুড়ে বসে আছে গোটা গ্রামে। বুঝতে পারছিস না ললিত, তোর মাথা কবে খুলবে বলতো? তোকে আমাকে পুরোটা গ্রাস করে অন্য জায়গায় বসে আছে। কি দৃষ্টি, কি দৃষ্টি। তোর জমি, আমার টাকা। বলি মাথায় ঢুকছে এবার? কিছু ফেরত পাবি বলে মনে হয়? গ্রাম পঞ্চায়েত, স্কুল, সাধারন লোকজন কাউকেই ছেড়ে যায়নি হতভাগা।

ললিত হেসে ফেললেন। বললেন – ওঃ, তুই অপুর কথা বলছিস? তা খারাপ বলিসনি খুব একটা। বড় শনিই বটে। এই বয়সে কোথায় তুই মোকদ্দমা লড়তিস, উকিলের পেছনে টাকার বান্ডিল ওড়াতিস, তা না হয়ে আজ এখানে টাকা ঢেলে আমার সঙ্গে চা খাচ্ছিস।

ধীরু দমে গেলেন। বললেন – খোঁচা দিস না ললিত। আমি মোটেই আর মোকদ্দমা লড়তুম না। কিন্তু টাকা কি আর রইল? সেই তো বেরিয়ে গেল, কিছু কি পাব ভেবেছিস?

ললিত কাগজ ভাঁজ করে নামিয়ে রাখলেন বেঞ্চের উপর। ধীরুর মুখের উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বললেন – এখন যা পাচ্ছিস সেটা কি কম ধীরু? একটা তৃপ্তি, একটা স্বপ্ন, তুই আমি পাশাপাশি বসব কোনদিন ভেবেছিলি? এখান থেকে যখন বাড়ী ফিরি তখন মনে হয় আবার কখন রাত কেটে সকাল হবে, আবার ধুতি ফতুয়াটা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ব। এই বেঞ্চটা বড় টানে আমাকে। তোকে টানে না? একটা বড় শ্বাস ধীরুর বুক কাঁপিয়ে বেরিয়ে এল। ললিত শুনতে পেলেন। এটা হতাশার নয়, এট প্রাপ্তির, এটা এক স্বপ্নের। ধীরু আস্তে করে বললেন – টানে, আমাকেও টানে, মিথ্যে বলব না। কিন্তু ওই স্বপ্নটা বেশী করে টানে। আচ্ছা ললিত, আমাদের বেঁচে থাকতে ওটা হবে? বড় শনি কি যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল!

ত্রিনয়নী

গল্প

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ত্রিনয়নী

সুশোভন দাস

ফিনল্যান্ড

girl1.jpg

বৃষ্টির চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন। টানা তিন মাস ধরে অঝরে ঝরার পরেও কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মেঘ এসে পুরো আকাশটা দখল করে সবকিছু ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মহালয়ার ভোরে এমন বৃষ্টি আর ঝড় হল যে মাঠের পাশে শিমুল গাছের মোটা ডাল ভেঙে ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে প্রায় দু-দিন লোডশেডিং। সারা বর্ষাকাল জুড়ে এলাকার ওলি-গলি গুলো প্রায় সবসময়ই জলের নীচে ছিল। অফিস-স্কুল-কাছারি সবকিছুই বন্ধ ছিল অনেকদিনের জন্য। এমনকি দোকান-পাঠও দিনের বেলা মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য খোলা থাকত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি কলেরা-ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়াতে প্রাণহানির সংখ্যা দুই-অঙ্কে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির জটিলতাকে মাথায় রেখে মাস দেড়েক আগে কর্পোরেশন থেকে লোক পাঠিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করার পর জীবনযাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক গতি পায়। হাইওয়ের পাশে এই এলাকা, শিমুলতলা, এখনো পুরোপুরি শহর হয়ে না উঠলেও গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের পথে অনেকদিন আগেই পাড়ি দিয়েছে। তাই গ্রামের সরল জীবনকে ভেঙে আধুনিক শহুরে সজ্জায় সেজে উঠছে দিনে দিনে। আগেকার দিনের মাটির বাড়ি, টালি বা খড়ের ছাউনি হয়েছে কংক্রিটের দেশলাই বাক্স। বাড়ির সামনের উন্মুক্ত উঠান হয়েছে খাঁচায় বন্দি ব্যালকনি। উঠেছে অনেক বহুতল বাড়ি, ফাঁকা মাঠ গুলো দখল করেছে স্কুল কলেজ অফিস কাছারি হাসপাতাল আর ক্লাব ঘর। নিজেদের জমি-জমা হারিয়ে অনেক পরিবার যেমন উঠে গেছে অন্যত্র তেমনই অনেক নতুন মানুষের আগমন হয়েছে। সাধারণ মানুষের গায়ে ও মনে দেখা দিয়েছে শহুরে চাকচিক্য। ক্লাবগুলোর দৌলতে প্রায় প্রতি মাসে কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই  থাকে। একটা সময় যে শিমুলতলা সন্ধ্যায় শাঁখের শব্দের সাথে এক সুখের ঘুমচাদরের তলায় আস্তানা নিত সে আজ বিনিদ্র রজনী যাপন করে। সন্ধ্যায় শাঁখের শব্দের বদলে এখন শোনা যায় দাম্পত্য বা পারিবারিক কলহ কখনো টেলিভিশনে কখনো বা বাস্তবে। সূর্যাস্তের পর এখন নামে এক গাঢ় অন্ধকারের চাদর যার আচ্ছাদনে শিমুলতলা নেয় এক অন্য রূপ, দিনের শিমুলতলার সাথে যার মিল শুধু মাত্র ভৌগোলিক অবস্থানেই।   
এই এলাকার এক অত্যন্ত প্রবীণ মানুষ হলেন হৃষিকেশ গাঙ্গুলি। একটা সময় প্রচুর জমি-জমার মালিক ছিলেন কিন্তু বর্তমানে শুধু মাত্র নিজের বসত বাড়িটুকু ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারেন নি। রেলে কর্মরত অবস্থায় তিনি এই এলাকায় আসেন এবং তারপর এখানেই থেকে যান। হৃষিকেশ বাবুর একমাত্র ছেলে সুকুমার, ক্লাবঘর জুয়া আর মদের নেশায় পৈত্রিক সম্পত্তি ও নিজের যৌবন প্রায় অর্ধেক শেষ করার পর বাবার চেষ্টায় স্থান পায় রেলের অধস্তন কর্মচারীর পদে। তারপরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার জীবনে আসে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সন্তান আগমনের সম্ভাবনার খবর পাওয়ার পরপরই সুকুমারের জীবন অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসে। সুকুমারের এই পরিবর্তন দেখে হৃষিকেশ বাবু নাতনীর নাম রাখেন জ্যোতি। মা-বাবা ও দাদুর আদরে বড় হয়ে ওঠা জ্যোতির জীবনে কোনো কিছুরই কালো ছায়া তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় খুব ভালো হওয়ার সাথে সাথে নাচে ও গানে সমপারদর্শীতা তাকে সবার মনের মাঝে একটা জায়গা বানিয়ে নিতে সাহায্য করে। নিত্য-নতুন স্বপ্ন বোনা ও তা বাস্তবায়িত করাই তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। বয়সের সাথে সাথে তার স্বপ্নগুলোও আরও রঙিন ও কল্পনা প্রবণ হয়ে ওঠে। পড়ন্ত বিকালে নিজেদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গগনচুম্বী ইমারত গুলোর উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘপুঞ্জের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নের জগতে। এক হাতে দাঁড় টেনে ভাসিয়ে দেয় তার স্বপ্নের ভেলা কোনো এক অদেখা-অজানার পথে। হয়তো কোথাও থামবে ক্ষণিকের জন্য কখনো বা কিছু দীর্ঘক্ষণ, তবু এগিয়ে যেতেই হবে নাহলে তার স্বপ্নই থমকে যাবে।
মাধ্যমিক পাস করার পর জ্যোতিকে ছোটবেলার স্কুল ছেড়ে একটু দূরের স্কুলে ভর্তি হতে হয়। এই স্কুলটা  এলাকার মধ্যে হলেও হেঁটে যেতে প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে টিউশানির সংখ্যাও বেড়ে যায় সমপরিমাণে। নতুন স্কুল, টিউশানি, বেড়ে ওঠা বন্ধুদের দল, প্রথম হাতে পাওয়া স্মার্ট ফোন, বাবা ও দাদুর কাছে পাওয়া হাত খরচের টাকা, স্কুল বাঙ্ক মেরে পার্কে ও সিনেমা হলে যাওয়া, প্রথম কোনো ছেলের থেকে পাওয়া ভালোবাসার অঙ্গীকার – সব কিছু মিলিয়ে জ্যোতির জীবন হয়ে ওঠে বর্ণময় রামধনু। কিন্তু না চাইতেও কিছু টুকরো কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয় তার প্রাণোচ্ছল জীবনের আকাশে। টিউশানি ও স্কুল যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে রেলিং-এর উপর বসে থাকা কিছু বখাটে ছেলেদের দৃষ্টি ও ভাষা তার শরীর ও মনের উপর আনে বিষণ্ণতার আবেশ। ভাগাড়ে মরা জন্তু পড়লে মেঘের বুক চিরে আকাশের অনেক উঁচু থেকে শকুন যেমন নজর রাখে তেমনই শানিত ছুরির ধার এদের দৃষ্টিতে। তার উদ্দ্যেশে ভেসে আসা কিছু কথা যেন জ্বলন্ত লাভা কানে ঢেলে দেওয়ার মতই বেদনাদায়ক। তবু তাকে এই পথেই আসতে হবে প্রতিদিন। অন্য পথ আছে কিন্তু সে পথও পরিষ্কার নয়। জঞ্জালের আড়ত কোনো রাস্তাকেই অব্যাহতি দেয়নি। 

প্রথম কিছুদিন বাবা তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছিল কিন্তু ফিরতে হয়েছিল একা একা। তারপর স্কুলের কিছু মেয়ে মিলে একসাথে আসা-যাওয়া শুরু করে। দলবদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রত্যেকের মনে একটা ভয়ের বাসা অনেকদিন আগে থেকেই বেঁধেছিল। স্কুল যাওয়ার সময় ছেলেগুলোর খুব একটা দেখা পাওয়া যেত না, দৈবাৎ দু-একজন কে ছন্নছাড়া হয়ে এ-গলি ও-গলিতে দেখা মিলিত। কিন্তু বিকালে স্কুল থেকে ফেরার সময় বা একটু সন্ধ্যায় টিউশানি থেকে ফেরার পথে তাদের অবশ্যই দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু কখন কোথায় তাদের উদয় হবে তা ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কখনো হঠাৎ করে একটা গলি পেরিয়ে অন্য গলিতে ঢোকার খে একেবারে সামনাসামনি হাজির হতো কখনো টিমটিমে আলো জ্বালানো চায়ের দোকান থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতো নানাবিধ মন্তব্যের সাথে। কখনো কখনো দু-তিনটে গলি তাদের পিছু নিয়ে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যেত। বাড়িতে কয়েকবার এই ঘটনা জানানোর পর খুব যে কিছু লাভ হয়েছে তা নয়। যখনি মেয়েদের সাথে তাদের বাবা-মা বা বয়স্ক মানুষ থাকতো তাদের টিকিটিও দেখা যেত না। এমনভাবেই কেটে গেল জ্যোতির স্কুল জীবন। কলেজে ওঠার পর পরই জ্যোতি লক্ষ্য করল, ফেরার পথে প্রায় প্রতিদিন কয়েকটা ছেলে কিছুটা দূর থেকে তাকে অনুসরণ করতে করতে তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে আসছে। কয়েকদিন এমন হওয়ার পর একদিন বাড়ি ফেরার পথে জ্যোতি হঠাৎ করেই পিছন ফিরে তাকায়। সাথে সাথে সেই পাঁচ-ছয়টা ছেলে যে যার মতো এদিক ওদিকে মুখ লুকিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করল। কাকতালীয় ভাবে এরপর থেকে কয়েক সপ্তাহ তাদের উপদ্রব একেবারেই লোপাট হয়ে গেল। এমনকি দূর থেকে কোনো বাজে মন্তব্য পর্যন্ত কানে এলো না জ্যোতির। এতো সহজে এতদিনের একটা সমস্যা কেটে যাবে এটা একেবারেই তার

কাছে অভাবনীয়। জ্যোতি সেদিনের হঠাৎ করে ফিরে তাকানোর ফলাফলটা বেশ মন খুলে উপভোগ করছে, যেন অনেক দিন পর একটা মুক্তির স্বাদ তার শরীর মন জুড়ে বয়ে চলেছে। বেশ কিছুদিন এমনটা চলার পর একদিন কলেজ যাওয়ার পথে একটা কাগজের গোলা তার গায়ে লেগে গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তার ধরে চলে গেল। থমকে গিয়ে চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেল সেই ছেলেদের দলের মধ্যে একজন ইশারা করে কাগজটা তুলে নেওয়ার কথা বলছে। মুখের উপর প্রচন্ড রাগ ভাব এনে সেখান থেকে সে চলে আসে। সেদিন ফেরার পথে ওই ছেলেটাই কাগজটা হাতে নিয়ে রাস্তার এক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে জ্যোতি তার দিকে না তাকিয়ে হনহন করে রাস্তাটা পের হয়ে যায়। এরপর প্রতিদিন সেই কাগজটা হাতে ধরে ছেলেটা রাস্তার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কাছাকাছি এলে কাগজটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে আর মাঝে মাঝে বলে ওঠে -'কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখো।' একটা দৃঢ় কটাক্ষ দৃষ্টি হেনে নিজের পথে এগিয়ে যেত জ্যোতি। স্বভাববশত রাগ আর অবজ্ঞায় ভর দিয়ে কিছুদিন এমনভাবেই কাটলো। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ছেলেটা একটু একটু করে সাহস বাড়িয়ে জ্যোতির পথ আগলে ধরছে, আর অন্য দিকে একটা অজানা আশঙ্কা জ্যোতির মনে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে। সে জানতো, একবার যদি তার মনের ভয় বাইরে প্রকাশ পায় তাহলে তাকে ভয়ের অন্ধকারেই ডুবে যেতে হবে। তাই মুখে রাগ আর চোখে অবজ্ঞাটাই ধরে রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালাতে থাকে।
এই প্রথম কলেজের বন্ধুদের সাথে দুর্গা পূজায় নিজের এলাকার বাইরে পা রাখল জ্যোতি। কলেজের বন্ধুদের সাথে পুজোর চারটে দিন খুব আনন্দ করে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এলো। বিজয়া দশমীতেও সে চেয়েছিল বাবুঘাটে গিয়ে বিসর্জন দেখবে কিন্তু বাড়ি থেকে তা মেনে নিল না। দশমীর সন্ধ্যায় পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি মিষ্টি নিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করে আসার রীতি অনেক কাল থেকেই চলে আসছে। জ্যোতিকেও তা মেনে চলতে হবে। তাই সন্ধ্যার পর মিষ্টি নিয়ে অনেকগুলো বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। প্রত্যেকের বাড়িতে কিছু না কিছু খাওয়া, বসে গল্প করা- এই সব কিছু করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এসেছে তার খেয়াল ছিল না। একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতেই জ্যোতি দেখল রাস্তা একেবারে জন-মানব শূন্য। দূরে নদীর ঘাট থেকে ভেসে আসা মানুষের কোলাহল, ফুল-ভলিউমে মাইকের গান আর উজ্জ্বল আলোর ছটা ছাড়া আর কিছু তার অনুভূতির গোচরে এলো না। এখনও তাকে আরও দুটো বাড়িতে যেতে হবে। 
নির্জন রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে একটা গলির মুখে বাঁক নিতেই হঠাৎ করে একেবারে সামনে এসে হাজির হল চিরকুট নিয়ে পথ আগলে ধরা সেই ছেলেটা, যেন সত্যি সত্যিই মাটি ফুঁড়ে তার উদয় হল। নেশাগ্রস্থ হয়ে মাথা মুখ গুঁজে অসংলগ্ন কিছু কথা বিড়বিড় করে বলতে থাকল সে যার কিছুই জ্যোতি বুঝতে পারল না। বিরক্ত হয়ে ‘এই পথ ছাড়’- বলে ধমকে উঠল সে। ছেলেটা এবার চোখ তুলে তাকাল। কোটর থেকে রক্ত জবার মতো লাল হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো দেখে জ্যোতির বুক কেঁপে উঠল। সে চোখে যেন এক ধ্বংসের আগুণ ধিক ধিক করে জ্বলছে- যে কোনো মুহূর্তে তা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির রূপ নিতে পারে। অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা শক্ত পাঞ্জা জ্যোতির বাঁ হাতের কব্জির উপর এসে পড়ল। নেশাগ্রস্থ গলাটা উগ্র হয়ে বলে উঠল,-

‘তোর এতো দেমাক কিসের রে?’
ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে জ্যোতি। যতটা সম্ভব নিজের গলায় জোর এনে বলল,

-‘হাত ছার না হলে আমি চিৎকার করব।’ পৈশাচিক হাসির সাথে ছেলেটা বলল,-

‘আজ তোর সব দেমাক ধুয়ে দেব।’ জ্যোতির কব্জির উপর থেকে ছেলেটার পাঞ্জা আলগা হতেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই তার চোখ দুটো অসহ্য যন্ত্রণায় বুজে গেল, মুখের চামড়া কে যেন জোর করে তার মুখ থেকে খুবলে খুবলে তুলে নিচ্ছে। চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। পিচ ঢালা রাস্তার উপর ফুটতে থাকে তার মুখ থেকে গলে পড়া রক্ত-মাংসের তাল। তার আর্ত-চিৎকারে আসে পাশে কিছু বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো কিছু মানুষ। একটা হৈচৈ সোরগোল তারদিকে ছুটে আসতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে চোখের উপর নেমে আসে এক অন্ধকারের আবরণ। মাথার মধ্যে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে চিন্তা শক্তির অবসান হয়। তার দিকে এগিয়ে আসা কোলাহলের শব্দ গুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। নিজের চিৎকারের শব্দ ও তার কানে পৌঁছচ্ছে না এখন। গলার আওয়াজ ও নিষ্প্রভ হয়ে এল। সময়ের কাঁটা এক-পাক ঘোরার আগেই জ্ঞান হারায় জ্যোতি। গলির অন্ধকারে ছেলেটার ডান হাতে লুকিয়ে রাখা অ্যাসিড ভরা গ্লাস তার চোখে পড়েনি।

আজ বিজয়া দশমী। সন্ধ্যা হতেই চারিদিকে মাইকে ঢাকের শব্দে এলাকার কাক-পক্ষীও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এখন আর আসল ঢাক বাজানো হয়ে না, রেকর্ডিং করা ঢাকের শব্দ বাজে। আতস বাজির আলো মুহূর্তে মুহূর্তে  আকাশের অনেকটা অন্ধকার মুছে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা বাড়িতেই অতিথির আনাগোনা এতটাই বেশি যে চিৎকার চেঁচামেচিতে নিজের কথা নিজেই শুনতে পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু রাত হতে অতিথিরা সব বিদায় নিলো জ্যোতির বাড়ি থেকে। টেবিলের উপর রেখে যাওয়া খাবারের গন্ধ নাকে আসছে অনেক ক্ষণ। খুব একটা খিদে নেই, তবু রাতে কিছু না খেলে ঘুম আসবে না। বিছানার পাশে রাখা ব্লাইন্ড স্টিকটা হাতে নিয়ে উঠে বসল জ্যোতি। মেঝেতে হালকা শব্দ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলো। 
জ্যোতিকে বাইরে আসতে দেখেই তার মা বললেন,-"খাবার গুলো এখনও ফেলে রেখেছিস মা। ঠান্ডা হয়ে যাবে তো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আর কত রাত করবি বল।" 
"আর একটু খিদেটা পেলেই খেয়ে নেবো। বেশি দেরী করব না। " - বলে ধীর ধীরে বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে থামল জ্যোতি। অতিথিরা সবে মাত্র বিদায় নিয়েছে তাই দরজাটা এখন খোলা। স্টিক দিয়ে সামনেটা একটু দেখে নিয়ে দু-পা এগিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো সে। একটা দমকা হাওয়া তার খোলা চুল এলোমেলো করে দিল।

স্টিকটা গুটিয়ে নিয়ে বাঁ হাতে শক্ত করে ধরল। ডান দিকের গলি পথ দিয়ে দমকা হওয়ার পিছন পিছন একটা পাঁশুটে গন্ধ তার ঝলসে যাওয়া ভ্রূয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলল। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় আরো প্রখর হয়ে ওঠে। তৃতীয় নেত্র তার দৃষ্টির আধার হল। হয়তো গলির ওপারে শিকারের আশায় চুপটি করে বসে আছে কোনো এক ধূর্ত শয়তান। তার রক্ত হিম করা নিঃশ্বাসের প্রতিটা উপলব্ধি জ্যোতির শিরা- উপশিরায় বিদ্যুতের চাবুক মেরে মুহুর্মুহ কাঁপিয়ে তুলছে। শয়তান আজও সুযোগ খোঁজে, অন্যের উপর নিজের পাঞ্জা বসানোর নেশা তার আজীবনের। কে জানে আজ হয়তো কারোর শরীরকে নিজের বাসনার উপাদেয় বানাবে।

সবুজের প্রতিক্ষায়

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

সবুজের

প্রতিক্ষায়

সুশোভন দাস

ফিনল্যান্ড

teacher.jpg

প্রায় সাড়ে তিন বছর পর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চোখ রাখল বিজন। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলে সে। তারপর প্রথম কয়েক সপ্তাহ অনেকটা করে সময় দিয়ে কলেজের বন্ধুদের অ্যাড করে। সাথে কলেজের বিল্ডিং, ক্যান্টিন, খেলার মাঠ, ক্লাস রুম, কমন রুম, রতনদা’র চায়ের দোকানে আড্ডা- যা পেরেছে সব ছবি তুলে ফেসবুক ভরিয়ে দিয়েছে। মাস ছয় কাটতে না কাটতেই ফেসবুক কেমন যেন একটা একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করল,- এটাই যেন একটা নাটকের মঞ্চ আর সবাই কারণে-অকারণে নিজেদের কান্ড-কারখানা দিন-ক্ষণ মিলিয়ে গোটা ব্রম্ভান্ডের সামনে তারস্বরে প্রচার করছে। ধীরে ধীরে বিজন নিজেকে ফেসবুকের একঘেঁয়ে জগৎ থেকে বের করে নিজের পুরানো বাস্তব জগতে নিয়ে এলো। কিন্তু ততদিনে বাস্তব যে নিজেই ফেসবুক আর ইন্টারনেটের মায়াজালে আটকা পড়েছে এবং যতদিন যাচ্ছে সেই জালের জট আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারল না। যখন নিজের বন্ধুগুলোকে সামনাসামনি কথা না বলে শুধু মাত্র ঘাড় নিচু করে ফোনের মধ্যে ডুব দিতে দেখল  আর মুখ তুললেই কে কটা লাইক আর কমেন্ট পেল তার হিসাব করতে শুনল, তখন তার সামনে বর্তমান বাস্তব একেবারে পদ্ম পাতায় ধরা জলের মতো টলটল করে ভেসে উঠল। বন্ধুদের কাছে অন্তর্জাল যেখানে অক্সিজেন হয়ে উঠল তার কাছে সেটা ফাঁসের দড়ি মনে হতে লাগল। তাই দ্বিতীয়বার ওই অন্তরজালের জগতে নিজেকে আর ধরা দিল না। বন্ধুরা যত নিজেদেরকে জালের জটে জড়িয়েছে, বিজনের সাথে বন্ধুত্বের সুতো ততই পাতলা হয়েছে । একাকীত্ব কাটাতে গল্প কবিতা উপন্যাসের উপর তার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেল। ‘বই মানুষের সব থেকে ভালো বন্ধু’ – এই কথাটা দেখতে দেখতে বিজনের জীবনে সার্থক হয়ে উঠল।

অনেক বছর পর ফেসবুক খুলে দেখল প্রচুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আর ইনবক্সে উপছে পড়া মেসেজের ভিড়। প্রোফাইল ঘুরে পুরানো ছবি দেখতে দেখতে তার কলেজের দিনগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠল। কত সময় পেরিয়ে গেছে তবু মনে হচ্ছে সব কিছু যেন কালই ঘটেছে- সেই ক্যান্টিন-আড্ডা-বন্ধু। ফ্রেন্ডলিস্টে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল বন্ধু সংখ্যা একশো আট হয়ে আছে। একটু মুচকি হেসে মনে মনে ভাবল,-“ ইন্টারনেটের দৌলতে সত্যিই বন্ধুত্বের একশো আট।”

অনেকের প্রোফাইল ঘুরে জানতে পারল বিয়ে হয়ে গেছে, অনেকে বিদেশে আছে- কত সব বাহারি ছবি সাথে কতকিছু লেখা। কেউ আবার প্রেম করছে আর ফলাও করে তার ছবি সহ রবির গান লেখা-

‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম। 

নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম॥‘

কে একজন সেই ছবিতে কমেন্ট করেছে – ‘এই ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই’।

কমেন্টটা পড়েই হা হা করে হেসে উঠল বিজন। বিজনের হাসি শুনে বারান্দা থেকে বিজনের মা বলে উঠল,-“কি রে ! একা একাই হাসছিস! ব্যাপার কি? উঠবি না নাকি? সেই সকাল থেকে কম্পিউটারে মুখ গুঁজে পড়ে আছিস। স্নান খাওয়া করবি, নাকি কোনও ইচ্ছা নেই?”

মায়ের গলা শুনে স্ক্রিনের নীচে ডান দিকের কোণায় তাকাল। ফুটে ওঠা সময় তখন ১১:৫৭ AM।

সময় দেখেই অবাক হয়ে বিজন বলে উঠল,-“এই রে। এতো বারোটা বাজতে চলল। সাধে কি আর বলে যে ফেসবুক করলে সময়ের কোনো জ্ঞান থাকে না। কোথা দিয়ে যে তিন ঘন্টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না!”

তাড়াতাড়ি করে গান বন্ধ করে ফেসবুক লগ আউট করতে যাবে তখনই টুং করে একটা শব্দ হল আর সাথে সাথে ইনবক্স লাল হয়ে 1 দেখাল। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টেও লাল হয়ে 1 দেখাচ্ছে।

বেশ কিছুটা কৌতুহলী হয়ে মেসেজ খুলল। একটা হাত নেড়ে হাই জানাচ্ছে অনামিকা রায়। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট খুলে সেখানেও দেখল অনামিকা রায়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। অনামিকার প্রোফাইলে যাওয়ার  আগেই টুং করে আরও একটা শব্দ করে অনামিকার দ্বিতীয় মেসেজ ঢুকল-

“অজানাকে জানার আশায়

নতুন পথে পাড়ি,

হাতের মাঝে হাত রেখে

আমি কি বন্ধু হতে পারি? ”

বারান্দা থেকে বিজনের মা আবার বলে উঠলেন,- “ওরে এবার স্নান করে আয়। অবেলায় স্নান করলে আবার তোর ঠাণ্ডা লাগবে।”

তাড়াতাড়ি করে মেসেজটা দেখে প্রথমে লগ আউট তারপর কম্পিউটার বন্ধ করে ঘর বেরিয়ে এল বিজন। কম্পিউটার ছেড়ে উঠে আসলেও ফেসবুক থেকে বেরতে পারল না সে। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকল,- “কে এই অনামিকা রায়?” সাথে তার লেখা চার লাইনের ছড়ার শেষ লাইনটা – “আমি কি বন্ধু হতে পারি?”

“প্রোফাইল পিকচার থাকলেও সেটা কোনও মানুষের ছবি না। তার জায়গায় আছে এক গাদা বইয়ের স্তুপাকার ছবি। অনামিকা নামে কোনো বান্ধবী বা ক্লাসমেট কেউ ছিল বলে মনে পড়ছে না। বন্ধুদের মুখে ফেক প্রোফাইলের কথা অনেক শুনেছি। তবে কি এটাও একটা ফেক প্রোফাইল ? যদি তাই হবে তাহলে অমন একটা ছড়া লিখে পাঠাল কেন বন্ধু হওয়ার জন্য? প্রোফাইলটা ভালো করে ঘুরে দেখতে হবে -কে এই অনামিকা।”- এই সব সাত-পাচঁ চিন্তা বিজনকে বেশ কিছুটা অস্থির করে তুলল।

মনের মাঝে অস্থিরতা চেপে, তাড়াতাড়ি স্নান করে এসে খাবার টেবিলে বসল। অন্যান্য দিন খাবার টেবিলে বসে মায়ের সাথে নিজের নতুন চাকরী, নতুন জায়গা নিয়ে অনেক গল্প করে। কিন্তু আজ খাবারের থালা থেকে মুখ তুলল না একবারও। প্রায় গোগ্রাসে থালায় দেওয়া খাবার গুলো গিলতে থাকল। মায়ের নানাবিধ কথায় দু-একবার হুঁ-হ্যাঁ বলে উত্তর দিয়ে তড়িঘড়ি খাবার শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। তাড়াতাড়ি করার কারণ স্বরূপ বলল,-“একটা আর্জেন্ট মেল এসেছে। একটু কাজ করতে হবে অফিসের।”

নিজের রুমে এসে কম্পিউটার অন করতেই ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়াল ঘড়িটা দুপুর একটা বাজার জানান দিল। একটুও সময় নষ্ট না করে সরাসরি ফেসবুক খুলে বসল বিজন। ইতি মধ্যে আরও কয়েকটা মেসেজ এসেছে অনামিকার- ‘অন আছো , আমার মেসেজও দেখছ তবুও কিছু রিপ্লাই দিলে না। এটা আত্মমর্যাদা নাকি ভীরুতা? নাকি একটা মেয়ে নিজে থেকে কথা বলছে বলে নিজের ঘ্যাম বাড়িয়ে নিচ্ছ?’

এর মধ্যে কোনোটাই যে নয় সেটা বলবে কি করে সেটাই বুঝে উঠতে পারল না বিজন। অনামিকার মেসেজে লাস্ট সিন দেখাচ্ছে ১২.৩০ pm। তার মেসেজ বক্সের সবুজ আলোটা এখন আর জ্বলছে না। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে তাকে লিখে পাঠাল,-‘তোমায় চিনতে পারছি না ? কে তুমি? এই ভাবতে ভাবতেই সময় চলে গেল।’

চেয়ারের উপর একটু শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে অনামিকার প্রোফাইল দেখতে শুরু করল বিজন। যদিও সেখান থেকে বিজন খুব বেশি কিছু জানতে পারল না অনামিকার সম্পর্কে। কলকাতা থেকে পড়াশুনা করেছে। সমবয়স্কাই মনে হচ্ছে। অনেক ছবি আছে কিন্তু একটাও তার নিজের ছবি নেই। প্রায় সব ছবিতে প্রচুর প্রচুর লাইক আর কমেন্ট। সেগুলো দেখতে দেখতে কখন যে তার চোখ বুজে এসেছিল নিজেই তার টের পায়নি।

ঢং ঢং করে দু-বার দেওয়াল ঘড়িটা বেজে উঠতে বিজনের ঘুম ভাঙল। কম্পিউটারটাও তার সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। মাউসটা একটু নাড়া পেতেই জেগে উঠল আবার। মেসেজ বক্সের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল বিজন। অনামিকার লাস্ট সিন ১০ মিনিট আগে দেখাচ্ছে। অনামিকা তার মেসেজ দেখেছে অথচ কোনও রিপ্লাই দেয়নি। বিজন লিখে পাঠাল,-‘একটু চোখটা বুজে এসেছিল আর সেই সুযোগেই তুমি মেসেজ পড়ে চলে গেলে। নিঃশব্দে! তবে সব সময় সফল হবে না।’ তারপর একটা স্মাইলি পাঠিয়ে দিল। আরও কিছুটা সময় কেটে গেল ফেসবুকের দিয়ে চেয়ে। এই চৈত্রের অবসন্ন অপরাহ্ন যেন বড়ই দীর্ঘ। আবার একটা অস্থির ভাব তার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুই করার নেই এখন। একটু রোদ পড়লে বিকালের দিকে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু বিকাল হতে এখন অনেক দেরি। পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখল মা ঘুমাচ্ছে। কিন্তু এখন আর নিজের ঘুম আর আসবে না। কম্পিউটারে হালকা করে কিশোর কুমারের গান চালিয়ে দিয়ে শরৎরচনাবলী তুলে নিল। কিছুটা পড়ল-কিছুতা অন্যমনস্ক হয়ে অনামিকার কথা ভেবে সময় কাটাল।

বিকাল হতেই ক্লাব ঘর তারপর চায়ের দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে রাত ন’টার দিকে বাড়ি ফিরল বিজন। রাতের খাবার খেয়েই আবার ফেসবুক খুলে বসল। না- তার শেষ মেসেজটা দেখেনি অনামিকা। তার নামের পাশে সবুজ আলোটা জ্বলছে না। এখন সবে পৌনে দশটা। আরও একটু দেখা যাক। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁতে না ছঁতেই সবুজ আলো জ্বলে উঠল। সাথে সাথে একটা মেসেজ ঢুকল।

-আমায় সফল হতে দেবেনা কিভাবে? নজরবন্দী করে রাখবে বুঝি।

বিজন এবার আর দেরি করল না। তাড়াতাড়ি লিখল- নজরবন্দী নয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই যে এখন ধরে ফেলেছি।

-ওত পেতে বসেছিলে বুঝি ধরবে বলে?

- অনেকটা সেরকম ভাবতে পার। তবে ওত পাতে শিকারীরা আর বন্ধুরা করে অপেক্ষা।

- তাই বুঝি। তাহলে বন্ধু বলে স্বীকার করলে।

-অজানা কে জানার জন্য কিছু একটা দিয়ে শুরু করতে হয়। আমাদের না হয় বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হোক।

-আচ্ছা এতো বছর পর আবার ফেসবুকে আসার কারণ কি?

-তেমন কোনো কারণ নেই। অনেকদিন পর ইচ্ছা হল তাই। অকারণটাই কারণ হিসাবে ধরে নাও।

- ধরেই যদি নেবো তাহলে জিজ্ঞাসা করলাম কেন?

-আসলে, আফিসে একটা স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। সেই জিজ্ঞাসা করল ফেসবুকে আছি কি না। তাই একটু উঁকি মারা। তা তুমি কি করে জানলে আমি অনেক বছর পর ফেসবুকে এসেছি?

-তোমার লাস্ট আপডেট দেখাচ্ছে  july 2015। সেই লাস্ট ছবি দিয়েছো। তারপর আর কোনো কিছু নেই।

-বাঃ বাঃ! তোমার তো দেখছি বেশ গোয়েন্দা প্রতিভা আছে। ক্রাইম প্যাট্রোল থেকে ডাক এলো বলে।

-তুমি উঁকি মারতে এসেই একটা মেয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আর মেসেজ শুরু। তোমার মেয়েভাগ্য তুঙ্গে দেখছি। বাড়ির বাইরে পাত্রীর বাবাদের লাইন লাগলো বলে।

-আচ্ছা। আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে?

-তোমারটা বুঝি অন্য কিছু ছিল?

অনামিকার রিপ্লাই দেখে মুচকি হাসল বিজন। উত্তরে কি বলবে কিছু খুঁজে পেল না। একটু ভেবে নিয়ে লিখল,- তোমার কোনো ছবি নেই প্রোফাইলে। তুমি আসলে কে সেটা বুঝবো কি করে?

-তোমার প্রশ্নটা ঠিক এটা নয়। তোমার আসল প্রশ্ন আমি মেয়ে না ফেক প্রোফাইল থেকে চ্যাট করছি?

-বুঝেই যখন গেছ তাহলে উত্তরটা দিয়ে দাও।

প্রায় মিনিট পাঁচেক কোনো উত্তর এলো না অনামিকার দিক থেকে। তারপর একটা অডিও ফাইল পাঠাল সে।

অডিও ফাইলটা প্লে করতেই একটা মেয়েলী কন্ঠে গান বেজে উঠল-‘ল্যাগ যা গলে’।

গানের প্রথম দুটো লাইন শেষ হওয়ার পর একই কন্ঠ বলে উঠল-‘হাই বিজন। এবার বিশ্বাস হল তো।’

বিজন মোহিত হয়ে আবার প্লে করল অডিও ফাইলটা। ওদিক থেকে রিপ্লাই এলো-“ কি হল? কোথায় হারিয়ে গেলে?”

-তুমি কি রোজ রসগোল্লা খাও?

-এটা কেমন প্রশ্ন? গান শুনে বুঝি রসগোল্লার কথা মনে পড়ল?

-অনেকটা তাই। শিব যেমন বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ হয়েছে তেমনই হয়তো তুমি রসগোল্লা খেয়ে এমন মিষ্টি কন্ঠ বানিয়েছ।

-ইস্। এমন উপমা শোনালে আমার এখন রসগোল্লা খেতে ইচ্ছা করছে। দেখে ফ্রিজ থেকে কিছু ঝাঁপা যায় কি না।

-তুমি ফ্রিজ থেকে এখন রসগোল্লা চুরি করতে যাচ্ছ ? ধরা পড়লে একেবারে কেলেঙ্কারি কেস।

-ওরে আমার সাধু পুরুষ রে, নিজে যেন কোনো দিন বাবার পকেট থেকে টাকা ঝাঁপেনি। আর আমার বাবার ফ্রিজ থেকে চুরি করছি, অন্যের বাবার নয়।

-অল দা বেস্ট। তা আমার শেয়ার দেবে না ?

-ধরা পড়লে যেটা পাব সেটা পুরোটা তোমায় দেব। খুশি তো?

-থাক। তোমার রসগোল্লা তুমি খাও আমি গান শুনেই খুশি।

মিনিট দুই নীরবতার পর অনামিকা লিখে পাঠাল- “মিশন সাক্সেস। দুটো মেরে দিলাম।“

-বাঃ। তোমার তো দেখছি বহুমুখী প্রতিভা। তা আর কি কি প্রতিভা আছে?

- বাকি প্রতিভা ক্রমশ প্রকাশ্য। আপাতত নিদ্রাদেবীর স্মরণাপন্ন হতে হবে।

- এতো তাড়াতাড়ি ! এইতো সবে কথা শুরু হল এর মধ্যেই বিদায়ের সুর।

- ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো। বারোটা বাজল বলে। এখন না ঘুমালে আমার ঘুমের বারোটা বেজে যাবে।

সময়টা দেখে বিজন একটু চমকে উঠল। এতো তাড়াতাড়ি দু-ঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারল না। বুঝতে পারল আজ আর কথা হবে না। তাই লিখে পাঠাল,- “আবার কখন কথা হবে ?”

-আজ যেমন হল।

একে অন্যেকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল। বিজন কম্পিউটার বন্ধ করে বিছানায় এলো। ভালো সময় কেন যে এতো তাড়াতাড়ি কেটে যায় সেটাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে উঠে ফেসবুক খুলে সুপ্রভাত জানাল অনামিকাকে। কিন্তু সারাদিন কেটে গেল অনামিকার কোনো দেখা নেই। একটা চাপা অস্বস্তির মধ্যে সারাদিনটা কেটে গেল। যথারীতি রাতের খাওয়া সেরে ফেসবুক খুলে বসল বিজন। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁতেই অনামিকার চ্যাট বক্সের সবুজ আলোটা জ্বলে উঠল। সাথে সাথে একটা মেসেজ এলো- “শুভ সন্ধ্যা”

- ভেবেছিলাম সুপ্রভাতের উত্তরে শুভরাত্রি পাবো।

- একটা চাপা রাগের আভাস পাচ্ছি। সারাদিন বুঝি অপেক্ষা করছিলে?

- কেন? তুমি বুঝি চাও যে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি?

- ঈশ্ ! অভিমান দেখছি আকাশ ছুঁয়েছে। সারাদিন কাজের পর এতক্ষণে যে সময় পেলাম।

- রাত দশটার সময় যদি সন্ধ্যা হয়ে থাকে আর সেটা যদি চন্দ্র সূর্য জানতে পারে তাহলে এখুনি তারা ধর্মঘট করবে ধর্মতলার মোড়ে।

- তাই বুঝি ! তাহলে তাদের স্লোগান কি হবে ? “ধর্মতলার মোড়ে, একফালি চাঁদ আটকে গেছে ইলেক্ট্রিকের তারে।“

-তা জানি না। তবে তোমায় ইলেক্ট্রিক শক্ দেওয়ার সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবে না।

- কেন? আমি বুঝি তাদের আটকে রেখেছি?

- অবশ্যই। গায়ের জোরে রাতকে সন্ধ্যা বলে সময়কে আটকে দিয়েছ।

- বাঃ রে! কবি লেখকরা নিজেদের লেখায় সময় থমকে দাঁড় করিয়ে দেয় তখন কিছু হয় না আর আমি করলেই দোষ?

- আচমকা একরাশ অনুভূতির টানাপোড়েনের ভিড় মানসিক ভাবে স্থাবর করে দিলে তখনই সময় থমকে দাঁড়ায়। এবার বল এরমধ্যে তোমার কোনটা হয়েছে ?

- আমার তো কিছুই হয়নি। যা হওয়ার তোমার হয়েছে।

- কি রকম ?

- এই যে সারাদিন অপেক্ষা করার পর দশটা বাজার সাথে সবুজ আলো জ্বলে ওঠা, একটা মেসেজ আসা, সব মিলিয়ে ক্ষণিকের জন্য ভিড় করা অনুভূতির টানাপোড়েন- সময় যে সেখানেই থমকে গিয়েছিল তোমার কাছে, তোমার অজান্তে।

-তুমি দেখছি আমার মনের খবর আমার আগে পড়ে ফেলছ। কি নিয়ে পড়াশুনা করেছ তুমি- সাইকোলজি?​

- কিছু কৌতূহল অপূর্ণ থাকাই ভালো। সব জেনে গেলে যে জানার আগ্রহ শেষ হয়ে যায়।

- তা ঠিক। কিন্তু কিছুই যে জানা হয়নি তোমার সম্পর্কে।

- নাম, ধাম, গোত্র, বাসস্থান, কর্ম আর কর্মস্থান। নিজের মতো বসিয়ে নাও। ঠিক-ভুলটা আপেক্ষিক। আজ যা ভুল, কে জানে কাল হয়তো তা ঠিক। সময় যে প্রবাহমান।

-হুঁ। আর তুমি সেই প্রবাহমান সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছো।

- অবশ্যই। কেন তুমি বুঝি দাও নি ?

-না। আমার সময় যে থমকে গেছে ঘড়ির কাঁটার দশটায়।

- শুনেছি, রাত বাড়লে নেশা বাড়ে। তোমার দেখছি নেশা মাথায় চড়ে বসেছে।

- তোমার বুঝি রাত হয়েছে? এই না বললে সবে কলির সন্ধ্যা।

- কাল যে সোমবার। কাজ নেই বুঝি?

- কালটা কাল বুঝবো। আজ যে আছো তুমি।

- যদি কাল না থাকি কি করবে তুমি?

- রাত জাগা তারা হয়ে অপেক্ষা করব এক অন্য কালের জন্য যেখানে থাকবে তুমি।

- তুমি বড়ই কল্পনাপ্রবণ। বাস্তব কিন্তু অনেক আলাদা।

- স্বপ্ন না থাকলে সেটা সত্যি করার ইচ্ছাটাও যে থাকে না।

- তা কি স্বপ্ন দেখছ?

- আমার স্বপ্নে এসো। নিজ চোখে দেখে নাও।

- ভারি তোমার স্বপ্ন। বয়ে গেছে আমার দেখতে।

- আমন্ত্রণ পত্র প্রত্যাখ্যান করছো। বিনা পত্রে প্রবেশ নিষেধ – সেটা জানতো ?

- তোমার স্বপ্ন বুঝি সার্কাস শো? টিকিট কাটলে তবেই দেখতে পাওয়া যাবে?

- অনেকটা তাই। আমন্ত্রণ পত্র বল আর টিকিটই বল, ওটা না থাকলে অনুভূতির স্রোতে গা ভাসাতে পারবে না যে।

- আমি সাঁতার জানি না। স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে ভরা ডুবি হয় যদি?

- স্বপ্নে মানুষ বাঁচে, তাই ডুবে গেলেও মরে যাবে না।

- আশার আলো দেখাচ্ছো তাহলে। লাই্টম্যান হয়ে গেলে নাকি?

- শুধু আশা নয়, ভরসার হাতও বাড়িয়ে দিলাম। 

- হাত যখন বাড়িয়েছো আলোটা বন্ধ করে দাও আর নিদ্রাদেবীর স্মরণাপন্ন হও। সময় বলছে সোমবারের একটা ঘন্টা শেষ হতে চলেছে।

- উফ্! তোমার সাথে কথা বলতে এলেই ঘড়িটা ঘোড়া হয়ে যায়। যাই হোক, কাল আসবে তো ? আমি অপেক্ষায় থাকব একই সময়ে।

- জানি না। কিছুটা অনিশ্চিত থাক। সব কিছু নিশ্চিত হয়ে গেলে মজাটাই হারিয়ে যায় যে।

- তবুও ?

- শুভরাত্রি।

- শুভরাত্রি ও সুপ্রভাত।

অনামিকার চ্যাট বক্সের আলোটা আরও কিছুটা সময় সবুজ হয়ে রইল। তারপর সেটা নিভে যেতে বিজন নিজের রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। সারা সপ্তাহ কাজের ব্যাস্ততার মধ্যেও রাত দশটার সময় ফেসবুক খুলতে ভুল করেনি বিজন। কিন্তু অনামিকার কোনও সাড়াশব্দ পেল না। অধীর অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকল উইকেন্ডের আশায়। কিন্তু সেখানেও অনামিকার দেখা নেই। কয়েকটা মেসেজ পাঠিয়েছিল বিজন। কিন্তু সেগুলো আন্ সিন হয়েই পড়ে আছে চ্যাট বক্সে। কিছু না জানিয়ে এভাবে অনামিকার চলে যাওয়াটা বিজন মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। একটা অন্যমনস্কতা সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকত। অনামিকার পাঠানো গানটা বার বার শুনত। সারাদিন অপেক্ষা করত রাত দশটা বাজার। আর রাত দশটা বাজলেই সব কিছু ছেড়ে ফেসবুক খুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত অনামিকার চ্যাট বক্সের আলোটার দিকে- সবুজ হয়ে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়।

এক দুই করে দেখতে দেখতে প্রায় ছ’টা উইকেন্ড কেটে গেল কিন্তু অনামিকার চ্যাট বক্সের আলো আজও ফ্যাকাশে। রাতের খাবার খেয়ে কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি অনামিকার প্রোফাইল খুলে দেখতে লাগল বিজন। অনামিকার শেষ আপডেট অঞ্জন দত্তের একটা গান শেয়ার করা। শেয়ার করার ডেট ও টাইম দেখে বুঝল যে রাতে শেষ কথা হয়েছিল অনামিকার সাথে সেই সময় শেয়ার করেছিল। গানটা প্লে করার সাথে সাথে ঢং ঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা দশটা ঘণ্টা বাজিয়ে রাত দশটার সংকেত দিল। বিজন চেয়ারের উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। বাতাসে অঞ্জন দত্তের গলায় ভেসে এলো – “আমি আসবো ফিরে, ফিরে আসবো তোমার পাড়ায়।”

একটি গরুর রচনা

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রম্য-রচনা

Sudipta-Biswas.jpg

একটি

গরুর রচনা

সুদীপ্ত বিশ্বাস

রাণাঘাট

kid1.jpeg

স্ ইন্ডিকাস সত্যিই ইন্ডিয়ার বস্ ছিল কি না জানি না, তবে এই নিরীহ প্রাণীটিকে আমরা গরু বলে এক ডাকে চিনি। গোমূর্খ বলে পরিচিত এই প্রাণীটির মাথায় সার-বুদ্ধি না থাকলেও এর মল থেকে সার পাওয়া যায়। বোধ বুদ্ধিহীন এই প্রাণীটি ভারতবাসীর আইডল অর্থাৎ 'ইন্ডিয়ান-আইডল'। বৈদিক যুগ থেকেই গোমাতা পূজনীয় তবে গো-মতি/গো-বুদ্ধি নিন্দনীয়। হিন্দু  ধর্ম গরু ও মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখে না। গলায় দড়ি দিয়ে গরু মরলে তার মালিককে অশৌচ পালন করতে হয়, কিন্তু গরুর সৎকারটি পার্সিধর্ম অনুসারে হয়। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে মৃতদেহকে ভাগাড়ে ফেলে আসা হয় চিল-শকুনে খাওয়ার জন্য। ঠিক যেমন পার্সিরা মৃতদেহকে উঁচু স্থানে রেখে আসে। তবে বর্তমানে Diclofenac জাতীয় ঔষধ পশু চিকিৎসায় ব্যবহারের ফলে শকুন মারা যাচ্ছে গরুর অভিশাপে (অর্থাৎ পৃথিবীকে আর শকুন-তলা বলা যাবে না)। এজন্য উভয় ক্ষেত্রেই মৃতদেহ সৎকারের বিকল্প পন্থা ভাবা হচ্ছে।

গরু অতি উপকারী প্রাণী তবে কিছু ধর্মের ষাঁড় আছে (মানব সমাজেও আছে) যারা এই নামে কালিমা লিপ্ত করছে। গরুর মল মূত্র অবধি ব্যবহৃত হলেও ষাঁড়ের নাদ কোনও কাজেই লাগে না। সিংহনাদের মত গম্ভীর না হলেও গরুর হাম্বা ডাক কম যায় কিসে? এক

বিখ্যাত সুরকার স্বজাতীয় ডাককে যথেষ্ট সম্মান জানিয়ে 'হাম্বা- হাম্বা' শব্দটিকে একটি হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে ব্যবহার করেছিলেন। মানুষের ল্যাজও নেই গোবরও নেই, তবু কত মানুষ প্রতিনিয়ত 'ল্যাজে গোবরে' হয়। এটা কি মানুষের গো- অনুকরণ নয়? হিন্দুধর্মে গো মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ কিন্তু কোনও হিন্দু শাস্ত্রে নরমাংস ভক্ষণ বা ক্যানিবালিজম নিষিদ্ধ নয়। অর্থাৎ শাস্ত্রে গরু মানুষের চেয়ে বেশি মর্যাদা পেয়েছে। হিন্দুধর্ম ত্যাগের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে প্রকাশ্যে গো-মাংস ভক্ষণ, এতে কর্পূরের ন্যায় উদ্বায়ী হিন্দুত্ব ফুঁৎকারে উবে যায়। সেকালে ব্রাহ্ম সমাজের নও জোয়ানেরা প্রকাশ্যে সভা ডেকে গোমাংস ভক্ষণ করে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিল, অর্থাৎ ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের জন্য গোমাংসের চেয়ে উৎকৃষ্ট মাধ্যম বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে বিরল। গরু মাতা অর্থাৎ 'গোমাতা' হল হিন্দুদের মাতা। তাই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পঞ্চগব্য পান করতে হয়, যার দুটি প্রধান উপাদান হল গোমূত্র বা 'চোনা'। গরুর দুধের সঙ্গে চোনার সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। যাইহোক চোনা নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই শ্রেয় (তবে জেনে রাখা ভাল চোনার উপর আলোকপাত করাকে আলোচনা বলে)। বাঁদরের যোগ্য কিছু উত্তর পুরুষ গাছে উঠতে পটু কিন্তু এব্যাপারে গরু মানুষের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। গরু গাছে উঠতে পারে না, তবে গল্পের গরু গাছে উঠতে দক্ষ।

নয়নতারার সাজিদ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

নয়নতারার

সাজিদ

রীণা নন্দী

কলকাতা

women.jpg

স্তাবলটায় এতগুলো ঘোড়া রয়েছে – প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশটা। তবে ছটফটে কালো ঘোড়াটার কদরই আলাদা। কত লোক যে এসে খোঁজ করে মাহাতোর কাছে। উমানাথ মাহাতো দেখভাল্‌ করে এইসব রেসের ঘোড়াদের। মাহাতো জানে ঘোড়ার দলের মধ্যে সটান চেহারার ঘন কালো চিকন চামড়ার সাজিদের দর আছে। ও যখন পিঠে জকির বোঝা নিয়ে তীব্র বেগে দৌড়য় নাক মুখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোয়। জকির চাবুকের এক এক মারে পিঠ টান হয়ে যায়। মাহাতো বোঝে, দু’পাশ আঁধার, শুধু সামনের দৌড় শেষ করার জায়গাটা চোখে ভাসে ঘোড়াটার।

সুন্দর সাজগোজ করা, জুতো খট্‌খটিয়ে মেমসাহেবরা আসে। ফটর ফটর ইংরিজি বলে, এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে চিকনদার ঘোড়াটাকে দেখে। ওদের পছন্দ হয় ঘোড়াটাকে। সাহেবরা বুঝতে চেষ্টা করে; টাকা ঢাললে কতটা দিতে পারবে ঘোড়াটা।

আগে লোকজন কাছে ঘেঁষলে ভয় পেতো ঘোড়াটা। মাহাতো বোঝে, সাজিদ আজকাল আগের মত আর ভয় পায়না। উদাসিন চোখে দেখতে থাকে এইসব বাবু বিবিদের। শুধু একটা লেড়কি আছে – সে এলে সাজিদ খুশি হয়। খুড়ে আওয়াজ তুলে খট্‌ খট্‌ খট্‌ খট্‌ – নাচের বোল তোলে। ও এইভাবে খুশি জানায়। মাহাতো ঘোড়াদের মন বুঝতে পারে। কতকাল হয়ে গেল ওদের সঙ্গে রয়েছে !

প্রায় আসে মেয়েটা। মাহাতো জানে, রেসের ঘোড়া খুঁজতে আসে না ও। ওইসব পকেটে রূপিয়া ভরতে আসা বাবু - বিবিদের মত নয় ও লেড়কি। লেড়কিটা মন বোঝে। মাহাতোকে সবাই এলেবেলে এক মানু্ষ মনে করে। নিজেদের প্রয়োজনে কথা বলে শুধু। নয়তো কথাই বলে না। যেন কথা বলবার মত মানুষই নয়। ঐ লেড়কিটা কিন্তু মাহাতোর সঙ্গে কত ভালোভাবে কথা বলে। ওর ঘরের খোঁজ নেয়।

সপ্তাহের মধ্যে একদিন কি দু’দিন আসে। মাহাতোর থেকে সাজিদের কথা জানতে চায়। – ‘ওর তবিয়ত ভালো আছে তো চাচা?

ঠিকঠাক দানাপানি খায়? না কি নখ্‌রা দেখায়?’

 – ‘না গো দিদি, তবিয়ত ভালো আছে। তবে দানাপানি খেতে যেন মন নেই ক’দিন।'

 – ‘মন ভালো নেই না কি! ’

মাহাতো বোঝে, লেড়কির সাজিদের উপর মন পড়ে গেছে। একটু অবাকও হয় ভেবে। আসলে এমন তো বড় একটা দেখা যায় না।

নয়নতারার ঘুরে ঘুরে কাজ। কোম্পানীর ওষুধ নিয়ে দোকানে, দোকানে, ডাক্তারখানায় যাওয়া, অপেক্ষা করা। দোকানদারদের সঙ্গে ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলা। তবু সে ঠিক সময় বার করে নেয়। ঘোড়াদের আস্তাবলটা টানে তাকে। বলা ভালো কালো ঘোড়াটার সুতীব্র টান সে এড়াতে পারে না। আস্তাবলটায় সকালের দিকে যায় নয়নতারা। ঝিমোয় তখন সাজিদ। প্রথমদিকে নয়নতারা অবাক হয়েছিল – কেমন মানুষের মত নাম ঘোড়াটার! মাহাতো বলেছিল, ‘ঘোড়াদের ডাক্তারবাবু ওর জন্মের সময় নামটা রেখেছিল।’নয়নতারা ভাবে, ও মানুষের থেকে কম কি! কেমন নাম ডাক। নিজের কাজে কি পারফেকশন্‌! আবার মেজাজিও বেশ। ভালবাসলে কেমন বোঝে। ভেতরে

ভেতরে গলে যায় আহ্লাদে। যারা আসে শুধুই রেস খেলে নিজেদের পকেটের টাকা বাড়াতে কিংবা রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে – তাদের সামনে কেমন গুমোর দেখায়। তখন দেখবেই না ওদের দিকে। একমনে ঘাস খেয়ে যায়। জকিগুলো টেনে সামনে আনতে চাইলে জেদি পুরুষের মত ঘাড় বেঁকিয়ে রাখে অন্যদিকে। যেন বুঝিয়ে দিতে চায়, তার মর্জিটাই আসল। ইচ্ছে না হলে এক চুলও নড়বে না।

অথচ নয়নতারা দেখেছে, সে কাছে গেলে কি খুশি। চোখগুলো জ্বলজ্বল করে তখন। কখনো আবার তেরছা চোখে তাকায় নয়নতারার দিকে। তার কপালে ঘাড়ে মুখ ঘসবে। আদরে আহ্লাদে হাতে জিভ বুলিয়ে দেবে। নয়নতারা যখন আসে ওর গা ঘেঁষে বসে থাকে অনেকক্ষণ। ঘাস খেতে খেতে দেখে তাকে সাজিদ। একটুখানি দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসে ও তার কাছে। লেজের চামর গায়ে বুলিয়ে দেয়। আরামে নয়নতারার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় নয়নতারা।

কোন কোনদিন দেখে ওর মসৃণ চামড়ায় চাবুকের কেটে বসে যাওয়া দাগ। দৌড়ের উত্তেজনায় পিঠে বসা জকির ছিপ্‌টির সজোরে আঘাত ওগুলো। আঙুলের ছোঁওয়ায় বুঝতে পারে সে; কোন্‌টা পুরনো আর কোন্‌টা সদ্য তৈরী হওয়া ক্ষত। নয়নতারার হাতের স্পর্শে চোখ বেয়ে যেন জল গড়িয়ে পড়বে – এমনই ছলছল করে সাজিদের চোখ দু’টো।

নয়নতারার মন চায় সেই মুহূর্তে কোন জাদুবলে সব যন্ত্রণার নিরসন করে দিতে। কিন্তু পারে না। তার তো কোন জাদু জানা নেই। রাগে, দুঃখে, হতাশায় চোখে জল এসে যায় নয়নতারার। সাজিদের গালে গাল ঠেকায়। ফিস্‌ফিস্‌ করে বলে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে সাজিদ?’

ঘাড় নাড়ায় মাঠের কালো বিদ্যুৎ। নয়নতারার আদরে কেমন স্নিগ্ধতা নেমে আসে ওর মুখ চোখে। মৃদু হ্রেস্বাধ্বনিতে নয়নতারাকে নিজের খুশি বোঝায়। পাক খায় ওকে ঘিরে। মুখে মুখ ঘসে ভালবাসা জানায়।

নয়নতার সাজিদের কানে কানে বলে, ‘আমি একদিন ঠিক তোমাকে এই রেসের মাঠের আস্তাবল থেকে মুক্তি দেব। তখন আর তোমাকে মুখে ফেনা তুলে ছুটতে হবে না। পাই পাই চুকিয়ে দেব ওদের। তোমার জন্য দিন রাত এক করে রোদ জল মাথায় নিয়ে খাটছি সাজিদ।’ নয়নতারা যেন প্রতিশ্রুতি দেয়। এক বন্দী প্রাণকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে চায়।

সে আজকাল সত্যিই সারাক্ষণ মুখে ফেনা তুলে ছুটে বেড়ায়। এক ওষুধের দোকান থেকে আর এক দোকান, সে দোকান থেকে অন্য দোকান, ডাক্তারবাবুদের চেম্বার। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আরো বাড়াতে হবে টার্গেট। অনেক টাকা চাই তার। চড়া রোদ, অঝোরে বৃষ্টি – কিছুই আটকাতে পারে না তাকে। হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল, লাল হয়ে যাওয়া চোখ মুখ, কাঁধে ভারি ব্যাগ – যেন এক পাগলাটে অশ্ব-নারী ছুটে বেড়ায়।

নয়নতারা আজকাল মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখে, নীল আকাশের বুক চিরে উড়ছে সাজিদ। তার চিত্র-বিচিত্র দুই ডানা বাতাস কেটে কেটে ভাসিয়ে নিয়ে আসছে তাকে।  মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা নয়নতারার দিকে উড়ে আসছে সে। তাকে তুলে নেবে পিঠে। দুই ডানার আড়াল দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাকে মেঘের মধ্যে দিয়ে। নয়নতারা উন্মুখ অপেক্ষায় উপর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

পুজো বার্ষিকী ১৪২৬ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Top

Please mention the "name of the articles" you would like to comment in the following box... Thank you.

মতামত
bottom of page