top of page
সূচীপত্র
Saraswati3.jpg
জুন ২০২২
girl.JPG

লেখক ও লেখিকাবৃন্দ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

কবিতা

পার্থ সরকার

কবিতাঃ পার্থ সরকার

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

touch.jpg

ব্যস্ততার মধ্যরাত

 

ব্যস্ততার মধ্যরাত 

গভীর নক্ষত্রস্বেদ শ্রমে 
স্ফুট শব্দে মহাকাব্য পড়ে পেচক 
যাযাবর ইচ্ছা উত্তরণের দোরগোড়ায় 
সমাপতনে ভোর আসবে বলে 
বুলবুলির ল্যাজ মধ্যরাতে 

জবরদখল থাকবে না শশব্যস্ত রহস্যে 

এই আশা সুনিশ্চিত। 

ধূমপান নিষেধ মধ্যরাতে

বিত্র জলোচ্ছ্বাস সারারাত 
(লিখিত মদ্যপান নয়) 

পবিত্র ধূম উদ্গীরণ সারারাত 
(লিখিত দূষণ নয়) 

বেছে নেয় সংবাদ নক্ষত্র পবিত্র উচ্চারণে 

পুনশ্চ উদ্ভাসিত হবে বলে 
যজ্ঞ মহাজাগতিক সারারাত 

সারারাত কোন রোগ নয় মনুষ্যবাহিত 

সারারাত ধূমপান নিষেধ 

ধূমপান নিষেধ মধ্যরাতে। 

অপ্রধান স্বাক্ষর, পাথরে সূচীকর্ম

 

মাঝামাঝি ফুলের মরশুম 
ধুমধাম লৌকিক পর্ব 
অলৌকিক সান্ত্বনায় পীতনদীতে দুর্বলতা 
ঢেউ উঠছে সড়কে 
সড়কে  অবলুপ্ত ডাকপিয়ন 
তবু কেউ কড়া নাড়ছে 
অসুখী স্থবিরতা? 
হয়তো হরিণ 
হয়তো 
সখেদে মুখ ফেরানো সুখী 
হয়তো  
অপ্রধান স্বাক্ষর 
পাথরে সূচীকর্ম 
ছিটকে পড়ে পাথরকুচির সম্মেলন 
ফিরে আসে নামঞ্জুর ধোয়া তুলসীপাতা 
জলসেচে হাত পুড়িয়ে বাড়ি ফিরে খোলা হাওয়া 
কিংবা 
‘আলাপ আলোচনায় বধিরতা বাড়ে’ শহুরে প্রবাদ। 

কবিতাঃ শান্তাপ্রসাদ রায়

কবিতা

শান্তাপ্রসাদ রায় 

কলকাতা

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

শেষ ঘুমের আগে 

মার একটা রোবট চাই 
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙাবে,
অ্যালার্ম ক্লকে হবে না...

পায়ের শব্দ চাই রান্না ঘর, বিছানায়,
চুলে হাতের আঙ্গুল, অভ্যাস কথা বলার
সে হোক না একপেশে 
আমার চাই 

আমার একটা কথা বলা রোবট চাই
যে আমায় ঘুম পাড়াবে 
শেষ ঘুমের আগে। 

ধারাপাত 

কালে ঘুম থেকে উঠে দেখি
কাল যত ঘুড়ি ছিল আকাশে উধাও,

ব্যান্ডউইথ খাচ্ছে কচি কাঁচা 
স্কুল ড্রেস এ সার্কাস আর বাবা মা পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত

সন্ধ্যে বেলায় ছাদে উঠে স্পষ্ট গোঙানি শুনি 
গলা টিপে ধরেছে ওদের, 
এখন আর সুর শোনা যায় না 
এখন আর কেউ নামতা পড়ে না। 

kobitalogo.jpg

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

গৌতম দাস 

বাখারপুর, মেদিনীপুর

কবিতাঃ গৌতম দাস
gautam.jpg

আমি পশ্চিমবঙ্গ মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বাখারপুর গ্রামে অবস্থিত অখণ্ড শ্রী ক্রিয়া যোগ সাধন মন্দির সেবাশ্রম এর  একজন সেবক। এই আশ্রমেই আমি থাকি। স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লিখতাম। এখনো লিখি। 

বাঁশিওয়ালা

শূন্য তোমার ওই দু চোখ, কালো মুখখানা
প্রাণের সুরে বাজাও বাঁশি, যায় সে ধ্বনি শোনা
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।

কোথায় পেলে এমন সুর, মনকে উদাস করে
ডানা মেলে যায় সে উড়ে, সুদূর তেপান্তরে।
যদি চায় আসতে ফিরে, করি তারে মানা,
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।

আশুথ গাছের ছায়াতলে বাজাও তোমার বাঁশি

কী অকরুণ মায়ার বাঁধন, বড্ড ভালোবাসি।

প্রথম শেষের আলাপ মাঝে, হয়তো দেখা হবে না

মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।

সুরের মাঝে অসুর আমি, মন খুশিতে ভরে
ও বাঁশিওয়ালা! তোমারও কী মন খারাপ করে?
তোমার দেওয়া মন খারাপ, ভুলতে পারা যায় না 
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।

থাকে সে জন আমার কাছে, আমার পাশাপাশি 
প্রাণে মনে মিলন হলে, সেও বাজায় বাঁশি 
ছয়ের ঘরে সুর তোলে সে, হয়ে আপনমনা 
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।

তোমার মাঝেও দেখি তারে, সে জন কৃষ্ণ কালো
তার সুরেতেই তোমার বাঁশি, অন্ধেরে দেয় আলো।
দুয়ে মিলে এক হয়ে যায়, পাই যে কাঁচাসোনা
হৃদয় মাঝে তোমরা দুজন, ছেড়ে দেবো না।।

Park.jpg

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

মৌ চক্রবর্তী

কবিতাঃ মৌ চক্রবর্তী
sea3.jpg

ব নবীনের নতুন রূপ 
বোশেখ ভোরের আলো গায়ে

কেউ  আলপনা 
কেউ পুষ্পপত্র 
কেউ হাতে হাতে মিলছে 
কেউবা কবিতায়
কয়েকছত্র 

দিনভর উৎসব মিষ্টিমুখ

মিষ্টান্ন মুখর 

বাঙলার পয়লা বোশেখ 

যে আছ যেখানে যত দূর 
যে ছিল অথচ ছিল না
যে কঠিন যেখানেই যার ব্যথা
যে অসীম প্রভাত লেখে সন্ধ্যাগাঁথা 

 ছুঁয়ে দিক আজ ছুঁয়ে নিক  দিবালোকে 

প্রসন্ন আলো আলোময় 
অমল 
সহস্র টগর মাধবীলতায়
সাজুক জীবন দোঁহায় 
নববর্ষের শোভাযাত্রা 

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সায়নী আচার্য্য

কবিতাঃ সায়নী আচার্য্য

গ্রীষ্মের দুপুর

দীর পাড়ে জলের কাছে,

নিজের মুখ জলে ভাসে

গাছের ছায়ায় শান্ত বাতাস,

পড়েই চলে দীর্ঘশ্বাস।

উঠতে গিয়ে পা পিছলোয়

মুখটা যেন বিকৃত হয়,

গল্প থেকে স্বল্প করে

গল্প টল্প অনেক করে।

নদীর জলে ডুব দিয়ে সে

মুখ তুলে খালি মিষ্টি হাসে,

গাছের ছায়ায় রোদের তাপে

শুকোয় জল গরম মাপে।

হেলতে দুলতে এগোয় তারা

হাসির রোল ওঠায় যারা,

বাড়ির দিকে এগোতেই যেন

গরম হাওয়া এগোয় কেন।

গরম হাওয়ায় বকা খাওয়া 

বেড়েই চলে গরম হাওয়া,

দুপুর গ্রীষ্মে ভাতের স্পর্শে

খিদের জ্বালা বাড়ায় জোরসে।

ঘুমের গান গাইছে কারা 

ঘুম পেয়েছে ঘুমিয়ে পড়া।

সকাল সন্ধ্যে শান্ত পরিবেশ

শান্ত পুরীতে প্রবেশ নিষেধ,

গল্পের গান ছন্দ মেলায়

সমাপ্তির সময় এসে চলে যায়। 

Village3.jpg
কবিতাঃ শুকদেব দে

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

শুকদেব দে

বাঁকুড়া, পঃ বাংলা

kobitalogo.jpg

সাময়িক
 

শ্বাসরোধ করে মেরেছি প্রেমিকাকে—
এক ডালিভরা শিউলিফুল তার মুখ৷
টেনে টেনে দাহ করেছি অজান্তেই,
নদীর তীরে পাতা ছিল চাঁদ-বুক৷

অনেক ভাঁজে গুটিয়ে রেখেছি মেঘ৷
হিসেব রাখিনি ক' বার উঠেছে ঢেউ৷
কবে জ্বলেছিল শেষ কথা নিভে গেছে,
সে ধ্বনির এপারে সাক্ষী থাকেনি কেউ!

আমারও দেহ মমি ছাড়া কিছু নয়
স্তব্ধ জীবন, পিরামিড-কোনেই বাসা৷
উড়ে গেছে, তবু ঝরেছে পালক শুধু,
প্রেম তবে কী? ত্যাগেরই আজব নেশা?

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

মনোরঞ্জন দাস

কবিতাঃ মনোরঞ্জন দাস

সারসত্যে সম্পক্তlয়ন এই প্রত্যয়, এই মাধুকরি.

বেলা শেষে তাৎপর্যে কিছু প্রাপ্তি, পরম্পরায়ন --

পরিবেশে পথ থেকে পথ, বাড়ি বাড়ি এবং...

উপস্থাপনে স্থিতি, অতীব সংবাহন, এভাবেই।।

shakun1.jpg
মধ্যরাতের অতিথি

গল্প

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মধ্য রাতের

অতিথি

চন্দন চ্যাটার্জি

banglow.jpg

টা  সবাই  মানবেন চেয়ে যে লেখালিখি করার জন্য একটু নিরিবিলি জায়গা প্রয়োজন,  সঙ্গে একটু অবকাশ এবং একটু  আরামও জরুরী,  তাহলেই  মনের  ভিতরের  কথাগুলো কলমের  মাধ্যমে কাগজে ফুটে উঠবে,  আর সেটা পড়ে পাঠককুল সমৃদ্ধি ও পরিতিপ্ত হবেন । 
গল্প পড়া, গান শোনা যে কোনো জায়গায় হতে পারে, যেমন অফিস যাবার সময় গাড়িতে বসে মোবাইল বা ট্যাবলেটে বা প্রিন্টেড বই হাতে  নিয়ে পড়া যায় বা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা যায়। কিন্তু এই গান, গল্প, কবিতা লিখতে গেলে অনেক ধৈর্য, অধ্যবসায়, জ্ঞান এবং সর্বোপরি চিন্তা করার শক্তি ও পরিবেশ অবশ্যই প্রয়োজন। সকালে বাস ঠেঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে, সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, সন্ধ্যায়  বাড়ি ফিরে এসে, স্ত্রীর সঙ্গে বাক্য যুদ্ধ ও শান্তি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে যখন একটু নিরিবিলি ঘরের কোন পাওয়া যায়, তখন ঘুম ছাড়া মাথার মধ্যে আর কিছুই আসে না। 
এইজন্যে সমীর মাঝেমধ্যে শহর ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি উত্তরবঙ্গ সেবক রোডে কাছে চালসা গ্রামে চলে যায়। সমীর দেবনাথ বর্ধমান হাই স্কুলের ইকোনমিক্স এর টিচার, থাকে স্কুলের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, গরমের ও পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়ি যায়। যদিও সে ইকোনোমিক্সের টিচার তাহলেও সাহিত্যের প্রতি তার বেশ আকর্ষণ আছে। ছোটগল্প, প্রবন্ধ এইসব লেখালেখি করে তার লেখা দু-একটা গল্প স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কিছু ভৌতিক গল্প পড়ে তার একটা ভূতের গল্প লেখার ইচ্ছা হয়। কোন বিষয়ে কিছু লিখতে হলে তার সম্বন্ধে একটু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যেমন যদি কোন ব্যক্তি বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প লিখতে চান তবে তাঁকে বিজ্ঞান সম্বন্ধে বিশদে জানতে হবে। যেমন তিনি যদি লেখেন জলের কেমিক্যাল কম্পাউন্ড এইচ টু এস ও ফোর (H2so4) তাহলে এসিডে জল নয়, জলে এসিড ঢালা হয়ে যাবে। 
তাহলে পাঠকদের মনে হতে পারে ভৌতিক গল্প লিখার জন্য কি ভূতের সাক্ষাৎ পাওয়া দরকার, তা যদি করতে হয় তাহলে তো মুশকিল। কারণ ভূতের কোথায়, কবে, কখন, দর্শন হবে তা তো  তার জানা নেই, এমন কি তার পরিচিত কেউ জানে বলে মনে হয় না। আর অন্য লোককে যে জিজ্ঞেস করবে তাহলে তাকে পাগল বলে ভাববে। অতএব কল্পনার আশ্রয় তাকে নিতে হবে। এবার দুর্গাপূজার ছুটির সময় বাড়ি গিয়ে সে দু-তিনটে ভূতের গল্প লিখবে স্থির করলো। মহাষষ্ঠীর দিন স্কুল করে রাত্তিরে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে পরের দিন সকালে বাড়ি পৌঁছায়। তার বাড়ি হল চালসা গ্রামে। এই গ্রামটা পরে মাল জংশন ও সেবক রোডের  মধ্যে। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, একদিকে চা বাগান দূরদূরান্ত পর্যন্ত দেখা যায় সবুজ গাছ সার দিয়ে রয়েছে, অন্যদিকে তিস্তা নদী। 
তিস্তা নদীর ওপারে জঙ্গল, ওয়াইল্ডলাইফ ফরেস্ট। এখানে অনেক কোম্পানির চা বাগান আছে, তার মধ্যে চালসা টি গার্ডেন বেশ বড়। এই চা বাগানের ধারে একটা মডার্ন কলোনি আছে ওখানে তার বাড়ি। বাবা, মা মারা গেছেন, এখন আছে শুধু দূর সম্পর্কের কাকা বাড়িতে থাকে ও দেখাশোনা করে। সমীরের এখনো বিয়ে হয়নি, তার স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকাকে বেশ পছন্দ কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারে নি আজ পর্যন্ত। এহেন ব্যক্তি কিভাবে ভৌতিক গল্প লিখবেন তা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়। 
যাই হোক তাকে দেখেই তার কাকা বেশ খুশি, সমীরকে বলল “যা বাবু একটু বিশ্রাম করে চান করে নে আমি তোর জন্য ভালো তিস্তার তেলাপিয়া মাছ নিয়ে এসেছি বাজার থেকে, রান্না করবো“। ট্রেনে সমীরের ভালো ঘুম হয় না তাই তেলাপিয়ার ঝাল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে সমীর একটা লম্বা দিবানিদ্রা দিল। ঘুম থেকে যখন উঠল তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে । তাদের পাড়ায় কোন দুর্গাপূজা হয় না, কিন্তু মাল বাজারে বড় পূজা হয় সেটা কালকে দেখতে যাবে ঠিক করল। পুজো আসলেই প্রকৃতিতে একটা আলাদা আমেজ আসে, সেটা সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। বর্ষা গড়িয়ে শরৎ আসে, তাই চারদিকে সবুজের সমারোহ, বনজঙ্গল এখন একটু বেশি ঘন ও সবুজ দেখায়, তিস্তা নদীতে এখন বেশ জল,  সন্ধ্যের সময় একটা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসে, অনেকটা এলাচের মত, সমীর এটার নাম দিয়েছে এলাচ ফুল এটা দুর্গাপুজোর সময় ফোটে। দূর থেকে ভেসে আসছে মাইকের গান, সবমিলিয়ে সত্যিই একটা উৎসবের আমেজ। সমীরের বাড়িটা কলোনির একদম শেষ প্রান্তে, এর পরেই চা বাগান শুরু, দোতলা বাড়ি, ওপর-নিচে দুটো করে ঘর। ওপরের ঘরে একটাতে সমীর থাকে খালি, অন্যটা খালি। নীচের ঘরে একটা রান্না ও খাওয়া-দাওয়া হয় অন্যটাতে কাকা থাকে। 
দুইদিন বেশ কাটলো ঠাকুর দেখা, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাঘুরি এতেই চলে গেল, ভৌতিক গল্প লেখার কথা সে প্রায় ভুলেই বসেছে। আজ দশমী, মায়ের বিসর্জনের দিন। সকাল থেকেই আকাশটা কি রকম মুখ ভার করে আছে, বোধহয় মা চলে যাবে তাই ওর মন ভালো নেই। সন্ধ্যে হতে না হতেই কালো মেঘে চতুর্দিক ছেয়ে গেল এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই তুমুল বৃষ্টি ও তার সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হলো। মনে হচ্ছে যেন মহাপ্রলয় আজকেই শুরু হবে। পাঁজিতে লেখা ছিল দেবী দুর্গার আগমন হাতিতে, গমন নৌকায়। কিন্তু মায়ের নৌকা চালাতে কতজন লাগবে তা বোঝা যাচ্ছে না। এই দুর্যোগে বাইরে কোথাও যাবার তো প্রশ্নই নেই, যদি কেউ ভুলে বাইরে গিয়ে থেকে থাকে তবে সেও ঘরের অভিমুখে তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। একের দুর্যোগের রাত, তারপর ঘরে কোন কাজ নেই, তাই রাত ন'টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল । এত সকাল-সকাল তার অভ্যাস নেই, তাই সে উসখুস করতে লাগলো, তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই। রাত তখন কটা হবে কে জানে এমন সময় বাইরের দরজায় একটা আওয়াজ। সমীর ভাবল, কাকা এসেছে তাই জিজ্ঞাসা করল, “কে?“
বাইরে থেকে আওয়াজ আসলো, “মহাশয় আমি বিকাশ, দরজাটা একটু খুলবেন, খুব বিপদে পড়েছি তাই আশ্রয়  চাইছি। চোর ডাকাত নই সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেন।”
আওয়াজ শুনে সমীর তাড়াতাড়ি নিচে দরজা খুলে দেখল এক বয়স্ক ব্যক্তি মাথায় ছাতা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু বৃষ্টি তোরে তিনি পুরো ভিজে গেছে। বৃষ্টি তখনও পরছে তাই সমীর বলল, “ তাড়াতাড়ি ভেতরে আসুন।“
ভদ্রলোক বাড়ির ভিতরে আসলে সমীর গেট বন্ধ করে তাকে উপরে নিয়ে আসলো। ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “মাফ করবেন, এত রাত্রে আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি সত্যিই খুব লজ্জিত, আসলে আমি যাচ্ছিলাম শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার লোকাল ট্রেনে করে। চালসা স্টেশনে এসে বলল ট্রেন আর যাবে না, তিস্তা নদীর উপর রেললাইনে ফাটল দেখা দিয়েছে মেরামত করে তারপর যাবে। এখন ছুটির সময় তারপর এই দুর্যোগের রাত তাই কামরায় খুব কমই লোক ছিল,  যারা ছিল তারাও আস্তে আস্তে সব নেবে চলে গেল। আমার বাড়ি আলিপুরদুয়ার কাছে, এখানে কোন আত্মীয়-পরিজন নেই, তাই আর কার কাছে যাবো আমিও ট্রেন থেকে নেবে হাঁটতে লাগলাম। এই চা বাগান ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনার বাড়িটা প্রথমে পরায় আমি আশ্রয় চাইলাম।“

সমীর বলল, ”ঠিক আছে কোনো অসুবিধে নেই আমার পাশের ঘর খালি আছে আপনি শুতে পারবেন। আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছে?” ভদ্রলোক বলল, “ব্যস্ত হবেন না আমি ট্রেনে খেয়েছি তাছাড়া আমার কাছে ফ্লাক্সে চা ও বিস্কুট আছে, আমার কোনো অসুবিধে হবে না“। সমীর বলল, “ঠিক আছে আপনি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি আমার একটা পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি দিচ্ছি পরবেন”। ভদ্রলোক ফ্রেশ হয়ে এসে পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে বিছানায় বসলো। সমীর জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম কি জানতে পারি“। ভদ্রলোক, “নিশ্চয়ই, আমার নাম বিকাশ রায়, আলিপুরদুয়ারে বাড়ি, ওখানে একটা দোকান আছে, শিলিগুড়ি পাইকারি বাজার থেকে মাল কিনে নিয়ে যে ওখানে বিক্রি করি“। কথা বলতে বলতেই ভদ্রলোক চায়ের ফ্লাক্সটি ব্যাগ থেকে বার করে সমীরকে এক কাপ চা অফার করলেন। তারপর দুইজনে দুকাপ চা নিয়ে বসল, মাঝেমধ্যে এ  ওকে কিছু  প্রশ্ন করে  আবার ও একে কিছু প্রশ্ন করে, এইভাবে পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর, কথায় কথায় সমীর ভৌতিক গল্প লেখা প্রসঙ্গ তুলল। বিকাশবাবু বললেন, ”সেটা তো ভালো কথা”। সমীর, ”ভালো তো বটে কিন্তু ভৌতিক গল্প কিভাবে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না”। বিকাশবাবু বললেন, “আপনার হাতে যদি খানিকটা সময় থাকে তাহলে আমার সত্যিকারের ভূত দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। সমীর চিয়ারে আরেকটু নড়েচড়ে বসলো, বাইরে তখনোও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে, জানলার ওপরের পাল্লাটা খোলা আছে, তাই একটা ঠান্ডা হওয়ার ঘরে আসছে, বাইরে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা এবং কোলা ব্যাঙের ঐক্যতান শোনা যাচ্ছে, এটাই হল ভূতের গল্প শোনার আসল পরিবেশ। সমীর মোবাইলেতে দেখল রাত্রি একটা কুড়ি মিনিট অর্থাৎ দশমী শেষ, একাদশী শুরু। বিকাশবাবু শুরু করলেন, ”আমার বাবা মারা যান খুব ছোটবেলায় কাজেই সংসারের হাল আমাকে ছোটবেলা থেকেই ধরতে হয়। মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমাদের  আদি বাড়ি ছিল  হাসিমারায়, কি একটা কারণে বাবা ওখানকার সমস্ত পাঠ চুকিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে যান। ওখানে একটা দোকান করেন, নিচে দোকান উপরে আমাদের থাকার ঘর ছিল। সব ঠিকই চলছিল, তারপর হঠাৎ বাবার মৃত্যু হওয়ায় আমি দোকানের দায়িত্ব নিলাম। ধীরে ধীরে আমার বয়স ও বুদ্ধি দুটোই বারতে লাগলো। তারপর আমি ঠিক করলাম এখানকার পাইকারি বাজার থেকে কিনে খুচরো বিক্রি করলে লাভ খুবই কম হয়, কিন্তু এই মালটাই যদি শিলিগুড়ি পাইকারি বাজার থেকে কেনা যায় তাহলে কিন্তু লাভ অনেক বেশি হবে, কারণ শিলিগুড়ি পাইকারি বাজারে দাম এখানকার পাইকারি বাজারের দামের থেকে অনেক কম। তাই প্রতি মাসে একদিন করে শিলিগুড়ি বাজার থেকে

মাল কিনে নিয়ে যেতাম এবং আমার দোকানে বিক্রি করতাম। আস্তে আস্তে এইভাবে ব্যবসাটাকে সাজাতে লাগলাম যেদিন আমি শিলিগুড়ি আসতাম সেদিন আমার মা অথবা স্ত্রী দোকানে বসত। সকালের গাড়িতে শিলিগুড়ি আসতাম আর মাল কিনে রাত্তিরে ফিরে যেতাম। যখন ব্যবসা আরো একটু বড় হল তখন আমি মাল ট্রান্সপোর্ট এর কাছে দিয়ে দিতাম, ওরা আলিপুরদুয়ারে আমাকে ডেলিভারি দিয়ে দিত।এইরকম একদিন শিলিগুড়ি থেকে সওদা করে শেষ ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি, ট্রেনটি যখন আলিপুরদুয়ারে পৌঁছল তখন বাজে রাত্রি সাড়ে বারোটা। আপনি এদিককার লোক কাজেই জানবেন এদিকে সিঙ্গেল লাইন, একটা ট্রেন যদি উল্টোদিক থেকে এসে যায় তাহলে তাকে সাইড দেবার জন্য অন্য ট্রেনকে স্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এইভাবে যেতে যেতেই আমার রাত্রি গভীর হয়ে যেত। এত রাত্তিরে রিক্সা থাকে না তাই আমি পায়ে হেঁটে যেতে লাগলাম। আমাদের বাড়ি স্টেশন থেকে নেবে প্রায় ১০-১২ মিনিটের হাঁটা পথ। গ্রামের মেঠো রাস্তা তারপর রাস্তায় আলো নেই। স্টেশন ছাড়িয়ে খানিকটা গেছি, এমন সময় মনে হলো কেউ আমার পিছু পিছু আসছে, এত রাত্তিরে কেউ কোথাও নেই তাই মনে একটু ভয় করতে লাগলো। মনে হল একটা ঘুঙরুর আওয়াজ আসছে। যেন সেটা আমার সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে ফেলে যাচ্ছে। একবার আমি ইচ্ছে করে থেমে গেলাম দেখলাম আওয়াজটাও থেমে গেল। এবার আমার সত্যি ভয় হতে লাগল। খানিকবাদে দেখলাম চারদিকে একটা পচা গন্ধ ছাড়ছে মনে হল যেন মাংস পচে চারদিকে ছড়ানো রয়েছে। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তার হাত দশ বারো দূরে একটা শিমুল গাছ ছিল, ঠিক তার নীচে দপ করে একটা নীল রঙের আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। তারপর একটা আপাদ-মস্তক সাদা কাপড় মুড়ি দেওয়া ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করলাম। মূর্তিটা ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো, লম্বা হয়ে উপর দিকে উঠতে লাগল। সাদা কাপড়ের মধ্যে যেন দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তারপর তার দুটো হাত আমার দিকে প্রসারিত করতে লাগলো । অন্ধকার হলেও একটু বুঝতে পারলাম যে এটা হাত নয় কঙ্কাল, এমতাবস্থায় রাম নাম নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় আমার মাথায় এলো না। আমি পিছনের দিকে যে ফিরে আসব তার উপায় নেই কারণ সামনের দিক দিয়েই আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
আমার হাতে সবসময় একটা ছাতা থাকতো, সেইটাই খুলে আমি ঢাল হিসাবে ব্যবহার করব ঠিক করছিলাম এমন সময় একটা স্ত্রী কণ্ঠ ভেসে আসল বিকু ভয় নেই আমি তোর কোন ক্ষতি করব না অপঘাতে মরেছি, গয়ায় পিণ্ডি  দিয়ে আসবি আমার নামে, না হলে এ জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার পাঁচ-পাঁচটা ছেলে কেউ আমায় ভাত দেয় না। 
এতক্ষণে আমার সম্বিৎ ফিরে এল। আমাকে বিকু বলে ডাকত দেবুর মা। দেবু মানে দেবশংকর পন্ডিত, তারা পাঁচ  ভাই রমাশংকর, উমাশঙ্কর, রবিশঙ্কর, উদয়শংকর। দেবু আমার সমবয়স্ক তার ভাইয়েরা সবাই বড় এবং প্রতিষ্ঠিত। আমাদের এলাকায় পন্ডিত পরিবারের খুব নাম, সবাই জানে, চেনে আমি অনেকবার তার বাড়িতে গেছি, তার মাকে আমি বড়মা বলে ডাকতাম। বড়মা আমাকে মাঝেমধ্যেই আচার, সিঙরা, নিমকি মোরব্বা ইত্যাদি দিতেন। স্কুলে পড়ার অনেকবার টিফিন করার জন্য আমাকে টাকা ও দিতেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন সেটা শুনেছিলাম, কিন্তু অপঘাতে মারা গেছেন সেটা জানি না। জিজ্ঞাসা করলাম, “কবে মারা গেছ”?
উত্তর এলো  কবে কি রে হতভাগা,  এখনো আমার শরীরটা এই গাছের উপরে ঝুলছে। তুই এক কাজ কর, আমাদের বাড়িতে যা ওখানে গিয়ে সব কথা বল, তারপর ওরা যেন আমার শরীরটাকে নিচে নাবায়। 
এই কথা বলার পর সাদা কাপড় জড়ানো ছায়ামূর্তি গায়েব হয়ে গেল।  আমি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা সাদা কাপড় জড়ানো কিছু তো ঝুলছে, কিন্তু কে বা কি তা পরিষ্কার হলো না।  আমার ভয় পাচ্ছিল তাই আর নিজে রিস্ক নিলাম না। তাড়াতাড়ি পন্ডিতবাড়ির দিকে ছুটলাম। প্রথমে দেবুর কাছে গিয়ে সব কথা বললাম। সে বলল, ”আজ থেকে একমাস মা আমার বাড়ি থেকে উমাদা বাড়িতে গিয়ে থাকবে বলেছিল”। 
আমি বললাম “চল তবে উমাদার  বাড়িতে যাই”।
উমাদা চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলে বলল “এত রাতে কি ব্যাপার”।
দেবু তাকে সব কথা খুলে বলল। তারপর একে একে পাঁচ ভাই এবং পাড়ার আরো কয়েকজন মিলে আলো, লাঠি, শাবল, দড়ি ইত্যাদি নিয়ে সেই শিমুল গাছের নিচে আসলো । সেই সাদা মূর্তির মুখের উপর আলো পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। গাছের একটা ডালে দড়ি বাধা আর বড়মা গলায় দড়ির আর অপর প্রান্তটা বাধা, তার দুই হাতের মুঠো খোলা এবং সোজা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে গেছে,  জিবটা মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায় বুক পর্যন্ত এবং তার থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে। এই রকম বীভৎস দৃশ্য আমি আগে কক্ষনো দেখিনি। আমরা বড়মার শেষ পরিণতি যে এত ভয়ঙ্কর হবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। দু তিনজন মিলে আস্তে আস্তে বডিটাকে নিচে নাবাল। 
তারপর পুলিশে খবর দিল, পুলিশ এসে বডিটা নিয়ে গেল পোস্টমর্টেম করার জন্য। 
এর একদিন পরে পাঁচ ছেলে মিলে মাকে দাহ করল। জীবিত অবস্থায় যাকে দু মুঠো ভাতের জন্য ছেলেদের দ্বারে যেতে হত, মৃত্যুর পর অবশ্য পাঁচ ছেলে মিলে মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান বেশ বড় করেছিল। 
এই পর্যন্ত বলে বিকাশবাবু থামলেন। সমীর বলল, ”তাহলে এই ঘটনাটাকে লেখা যেতে পারে ? আপনি কি বলেন, হ্যাঁ আরেকটা কথা, আপনি আপনার বড়মার গয়ায় পিন্ডি দিয়েছিলেন”। ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই আমি গয়ায়  গিয়ে উনার পারলৌকিক কর্ম সেরে আসি” ।
ঠিক আছে আপনি শুয়ে পড়ো কালকে আবার কথা হবে রাত অনেক হলো এই কথা বলে সমীর নিজের ঘরে চলে গেল। খাটে শুয়ে ভাবতে লাগল গল্পটা সত্যি কিনা জানিনা কিন্তু ভদ্রলোক বলেছেন বেশ গুছিয়ে এইটাকে যদি আরেকটু রং দিয়ে লেখা যায় তবে একটা সুন্দর ভৌতিক গল্প হতে পারে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল ঠিক নেই। তখন সকাল ন'টা বাজে, কাকা ডাকছে, “সমীর বেলা হল চা খাবি তো“।
সমীর ধড়মড় করে উঠে বসল একটু পরেই তার মনে হলো পাশের ঘরে বিকাশবাবু আছেন ।  সে কাকাকে বলল, “কাকা তিন কাপ চা কর”। 
কাকা, ”কেন তুই দু কাপ চা খাবি নাকি?“
সমীর ”আরে  আমি নয় পাশের ঘরে এক ভদ্রলোক আছেন তার জন্য"।
“ভদ্রলোক, কোথা থেকে এল” কাকা একটু বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করল। 
সমীর একটু বিরক্ত হয়ে “কাল রাতিরে এসেছেন সে অনেক কথা আমি তোমাকে পরে বলব ”।  
কাকা বলল, ”পাশের ঘরে তো কেউ নেই তাহলে নিশ্চয়ই চোর এসেছিল, কিছু চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে, বোধহয়”। 
কাকার কথা শুনে সমীর কিছুটা আশ্চর্য হল, তারপর দুজনে মিলে সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে নিশ্চিন্ত হল যে কোন জিনিস চুরি যায়নি সব জিনিসই নিজ নিজ স্থানে বিদ্যমান। এমনকি সেই ভদ্রলোককে পরার  জন্য যে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি দিয়েছিল সেটা সমীর নিজেই পরে আছে। 
সমীর জিজ্ঞাসা করল, ”কাকা তুমি যখন বাইরের দরজা খুলে ছিলে তখন তা ঠিকভাবে বন্ধ ছিল”। 
কাকা বলল, ”হ্যাঁ সদর দরজা তো আমি তালা দিয়েছি রাত্রি এবং সকালে আমি খুলেছি। চাবি তো আমার ঘরে থাকে”।
সমীর ভাবল তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে বোধহয়। তাই এটাকে আস্তে আস্তে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো।  
ঘন্টাখানেক পরে বাজারের থলি হাতে নিয়ে, সমীর কাকাকে বলল, ”কাকা আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি। স্টেশন রোডের বাজারে যাবো দেখি ওখানে তিস্তার মাছ পাওয়া যায় কিনা”। 
স্টেশন রোডের  বাজারটা লাইনের ওপারে। তাইলে তাকে রেল লাইন পার করে যেতে হবে। লাইনের ধারে এসে সমীর দেখল এক জায়গায় কয়েকজন লোক জমায়েত হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখল সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা আছে একটা বডি। একজনকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল কালকে এক ব্যক্তি লাইন পার হওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা এক্সপ্রেস গাড়ি এসে তাকে কেটে দেয়। এক ব্যক্তির মৃতদেহের মুখের ওপরের সাদা চাদরটা সরালো। মৃত ব্যক্তি চেহারা দেখে সমীরের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম, তার মাথা ঘুরে গেল, বাজারের ব্যাগ হাত থেকে পরে গেল আরে এ তো বিকাশবাবু। এক রেলের অফিসার দাঁড়িয়ে ছিল, সে সমীরের অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করল আপনি একে চেনেন। সমীর কালকের রাত্রের সব ঘটনা বলল।  এই ব্যক্তির পকেটে একটা শিলিগুড়ি টু আলিপুরদুয়ারের  টিকিট পাওয়া যায়। অফিসার আলিপুরদুয়ার জংশনে যোগাযোগ করল  এবং এখান  থেকে বডি পাঠাবার ব্যবস্থা করল।
ঘরে এসে সমীর কাকাকে সব কথা খুলে বলল।  

কাকা বলল, ”তুই ক’দিন থেকে যে ভূতের গল্প লিখতে চাইছিলি তাই স্বয়ং ভুতই তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে গেছে”।
বলাবাহুল্য এর পর সমীরের আর ভূতের গল্প লেখা হয়নি। 

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ শ্রীকান্ত দাস

অন্য এক পথ 

ক অজানা স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছি আমি। 
এ বোধহয় অন্য এক পথ। 
তবু মনে হচ্ছে এ পথে হেঁটেছি আমি। 
ওই দুই পাহাড় এর ধারে, 
প্রকৃতির গন্ধ আমার চেনা। 
এই বৃষ্টি আর উষ্ণতা আমার 
শরীর ছুঁয়েছে বহুবার। 

shakun1.jpg

কবিতা

শ্রীকান্ত দাস

এই লাবণ্য চাওয়া পাওয়াকে বিদীর্ণ করেছিলও সেদিন। 
হাড়হীম দেহে আগুন জ্বলেছিল
এমন এক পথের আঁকে বাঁকেই। 
নিস্তব্ধতায়  শুনেছিলাম ...
চেনা নিঃশ্বাস এর শব্দ। 
আর মাটির সে গন্ধে সেদিনও 
জুড়িয়েছিলাম প্রাণ। 
ফিরতে পারবনা জানি সেই পথে,

অভিমানের বনে হারিয়েছে সে পথ। 
তাই অজানা স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছি আমি। 
এ বোধহয় অন্য এক পথ।

কবিতাঃ সুকান্তপাল

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সুকান্ত পাল

জিতপুর, মুর্শিদাবাদ

মরাচাঁদ

দিবসের শেষে

মরা চাঁদ হেসে

দিয়েছে জোছনা মেলে আকাশের গায়ে। 

শীতল সমীর ঢেউ

হয়তো ফকির  কেউ

দিবসের শেষ গান গায় বুঝি তমালের ছায়ে। 

তবু অঞ্জনা

মন আনমনা 

বাসনা ব্যাকুল হয় আঁধারের ঝিল্লির ডাকে

প্রদীপের বুক জ্বলে

সুরার পেয়ালা তলে

খুন হয় লাখো লাশ ভোর হয় দুহাতের ফাঁকে। 

রাঙা বৌ

বাজায় ডুগডুগিটা ঢোলক বাজায়

আ গান ধরেছে ই-তে তাইরে নাইরে না। 

ঈ আর উ ঊ ঘুঙুর বেঁধে পায়ে

কেমন মজার নৃত্য করে ঘুরে ডানে বাঁয়ে। 

সুর ধরেছে ঋ ৯ সা রে গা মা পা

সারছে গলা এ ঐ আআ আআ আ। 

তালে তালে হাতে তালি দেয় ও ঔ

চেয়ে দেখো পালকিতে ওই আসছে রাঙা বৌ।

rangasthalam2.jpg
কবিতাঃ সুব্রত মিত্র

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সুব্রত মিত্র

art1.jpg

মধ্য রাতের শেষে
                                  

রা সবাই চলে গেছে পড়ে আছি আমি একা
হবে কি? হবে কি আর বনলতা তোর সাথে দেখা?
চোরাবালির স্রোতের মতো-------
স্মৃতির কথা গুলো ভেঙে ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে যেন
তবু তোকে স্বপ্নে দেখি বলতো কেন?

চোখের কোণে জন্ম নেওয়া কালশিটে আবরণ
দিচ্ছে জানান বার্ধক্যের বাতাবরণ
যৌথ সমন্বয়ের বিগ্রহ চিত্ত ভেঙে গেছে কবে কোথায়
অদল বদল হয় ঋতুদের হাওয়া চক্র
এই জড়তার ভিড়ে তবু ভালোবাসা প্রাণ পায়,

শুভ প্রনয়ের ঝঞ্ঝা বিচলিত করে আজ তবু
যায় ডুবে ভাবনার সাগরে
ভিড়ের মাঝে যায় না মুছে বনলতা কভু,

একে একে চলে গেছে সবাই;

বয়ে গেছে জীবনের ঢের সময়

আগন্তুক পথের পথিক জেগে আছে মধ্যরাতের শূন্য গগনে

নিস্তব্ধ রাতের কোন আঁধারের আকাশে ভাসমান চাঁদ অতীন্দ্রিয় প্রহরায়,সজাগ ভোরের মিশ্রিত কোলাহলে মোহনায় ডুবে শেষ ফেরি ডাকছে আমায়।

আকুল প্রার্থনায় স্মৃতিতে মোড়া নীল খাম শোনায় তাহার নাম      

এই ভোর ভোর নয়;

এ যে স্বপ্নের ঘোর, 

নামের পাশেই আছে লেখা দেখো সেই চির বদনাম।          যাক চলে সবাই রব পড়ে আমি,             

জানি বনলতা গেছো চলে তুমিও;             

তবু তুমি কাছে মোর খুব যে দামী।

কবিতাঃ দুর্গেশ রঞ্জন দে

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

দুর্গেশ রঞ্জন দে

কৃষ্ণনগর, দঃ ২৪ পরগণা

জ্বলন্ত অঙ্গার

রাজ্য ক্ষুধার
তাইতো হেথাকার মানুষজন
কুৎসিত কদাকার।
অস্থিচর্মসার।
জীবনের প্রতিটি কানায় কানায় পূর্ণ
অর্ধাহার অনাহার
জীবন তাহাদের ভার।
অবশিষ্ট থাকে শুধু হাহাকার।
যোগ বিয়োগ পূরণ- ভাগ সকল
ভাজ্য ভাজক ভাগফল,
ভাগ্য রাশি ফল,
বিড়ম্বিত হয় নিষ্ফল।
তাদের ওরসে নবজাতকের জন্মলাভ,
সঙ্গে নিয়া আসে, আজন্ম পাপ-তাপ।
তাদের অক্লান্ত শ্রম দান,
গড়িয়া উঠে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান।
তাহারা একান্তই নগণ্য,
তাদের  জন্য,
বিত্ত বানরা দেশে-বিদেশে,
প্রচুর বৈভবে হইতেছে ধন্য।
এখানে হা-হুতাশ,দীর্ঘশ্বাস,
নাই আনন্দ -উল্লাস,
নিত্য ক্ষুণ্ণই বইতটির ত্রাস,
জীবনকে করিয়াছে গ্রাস।
এখানে জঠরের যাতনা,
অবারিত নিত্য আনা-গুনা,
আনন্দ উল্লাস উদ্দীপনা,
আসিতে রহিয়াছে মানা।
এখানে হাজার কষ্ট বেদনা,
তাইত আনন্দ আসিতে পারে না।
এখানে হরেক রকম,
অপুষ্টির বিচিত্র বাহার,
চুপসানো জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা সবার।
তাদের  মনের কোন আগ্রহ,
শুনিতে বুঝিতে ও দেখিতে,
চাহে না কেহ?
কেননা তাড়াত গড্ডালিকা প্রবাহ।

তাদের জীবনে নাই ছন্দ -তাল,

তারা ছিন্ন-মূল,ভুখা-নাঙ্গা কাঙ্গাল,

সন্ধ্যা-দুপুর ও সকাল,

বংশ পরম্পরায় চিরকাল।

বিত্তবানের লালসার লোলুপ আগুন,

তাদেরকে জ্বালায় দ্বিগুণ,

জ্বলে জ্বলে হয় অঙ্গার,

তারপরও তাকিতে হয় নির্বিকার।

চাহিতে পারে না প্রতিকার,

কারণ তারা হল-পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার,

তাদের উপর বার বার,

আসিবে নির্যাতনের পাহাড়।

দিন আনে,দিন খায়,

এতেই তারা আনন্দ পায়,

ভূত -ভবিষ্যৎ নিরাশায়,

কাজটাই তাদের অনন্য উপায়।

অতীতকে তারা জানে,

বর্তমানকে তারা মানে,

তাই ছুটেছে তারা বর্তমানের পানে।

আগামীকল্য কোথায় থাকিবে?

কি-খাইবে?কাজ পাইবে কি না?

সে কথা তারা জানিতে চাহে না।

তারা বস্তুই বাসী,মুখে নাই তাদের,

এতটুকু হাসি।

তারা বস্তি বাসী,সমাজে তারা-উচ্ছিষ্ট,

পচা গন্ধময় বাসি।

তারা বস্তি বাসী,তাদের দুঃখ -কষ্ট,

জ্বালা-যন্রনা রাশি -রাশি।

চলছে, চলমান

মানুষ বুদ্ধির এক-
অপরূপ কলা-কৌশলে,
দাবি করিতে চায়-
সর্বস্ব আপনার বলে।
ছলে কিংবা বলে,
কিংবা কলা-কৌশলে।
এ-জগতের সব কিছু-
আনিতে অনন্য নিজ করতলে।
দেশে-দেশে হানা-হানি,
জাতি-ভেদে টানা-টানি,
এ-কোন কাল- ছায়ার
উন্মুক্ত, উলঙ্গ হাতছানি।
জ্ঞান -বিজ্ঞানে ভূতপত্তি লাভ হইয়াছে যখন,
কথায় কথায় মুখে বলি,
আমরা সভ্য এখন।
কিন্তু হায়!
আমাদের আচার-আচরণ, এমন,
নিজ হাতে,
প্রতিনিয়ত সভ্যতার করিতেছি দাফন।
তবু বলি মুখে,
আমরা সভ্য এখন।
কত সহজলভ্য এখন-
মানুষের জীবন -যাপন।
দুরে বহু দুরে-
সাত সমোদ্র তেরো নদীর ওপারে,

cremation.jfif

নিমিষে ভাবের আদান-প্রদান করে।

কম্পিউটার, সেটে-লাইট, আরও আছে, মোবাইল, ইন্টারনেট।

বাটন চাপিলে, সব কিছু মিলে হাতের নাগালে।

তৎক্ষণাৎ যোগা-যোগ, 

একে অন্যে থাকে না-কোন অনুযোগ।

চলার পথে, কাজে বা বিশ্রামে থাকে সাথে,

হাতে আছে একটি মোবাইল ফোন,

টিপ দিয়ে, হ্যালো-তুমি শোন।

স্নেহ, মায়া, মমতা, এ-সব অতীত কথা।

স্বার্থের কি নিদারুণ দান?

এগুলি করিয়াছে প্রস্থান।

স্বার্থের কি দাপট?

প্রত্যেকে আমরা হইয়াছি কপট।

স্বার্থের অদম্য হানা-আমরা স্বার্থে হইয়াছি কানা।

উবিয়া গিয়াছে অন্তরের আবেগ,

বিজ্ঞান দিয়াছে-এক অসাধারণ বেগ। 

আমাদের অন্তর এখন, ভাব-লেশ হীন,

আরাম -বেআরাম বিহীন,

চলমান যন্ত্রের মতন, চলে হন-হন।

আমরা বর্তমান, চলছি-চলমান,

হেথা নাই, মান অভিমান।

স্বার্থের মহিমা অপরূপ,

সবার চেহারা হইয়াছে বিরূপ।

স্বার্থের নিদারুণ দান,

বর্তমান থাকিতে পারে নামান-সম্মান।

তবু,আমরা চলমান, চলছি, চলমান।

চলছে বিশ্বায়ন, বিজ্ঞান করিবে, স্বার্থের উন্নয়ন।

স্বার্থের মহা-সাগরে করিয়া অবগাহন,

স্বার্থের জন্য মনন, পঠন ও হনন।

স্বার্থের এ-কঠিন ধারা,হইয়াছি স্বার্থান্ধ, আত্মহারা।

চলছে বিশ্বায়ন,বহিতেছে উষ্ণ আয়ন ।

কবিতাঃ দেবাশিষ পট্টনায়েক
Debashis Pattanakye.jpg

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

দেবাশিস পট্টনায়েক

নিউ দিল্লী

জন্ম  ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলার (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর) তমলুক মহকুমায়। চাকরি সূত্রে দিল্লী নিবাসী, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত। কবিতা লেখা শখ। কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।

মেরির কান্না 
 

দাবানলের নগ্ন ক্ষুধায়,
সবুজ পাতা ঝরানোর উল্লাসে,
বারুদের গন্ধে, শোণিতের তৃষ্ণায়,
সাম্যের পতাকা উড়িয়ে 
লালের রঙে হোলি খেলতে
জেগে উঠেছে দানব।
ধূসর বসন্তকে বিদায় জানিয়ে,
ভালোবাসার নীড় ছেড়ে,
পাখিরা উড়ে গেল কোন অজানায়,
কুয়াশা ঘেরা না ফেরার দেশে।
না ফোটা ফুলের কুঁড়িরা
লুটিয়ে পড়েছে রাস্তায় 
গাছের আঁচলের মায়া ছাড়িয়ে।
এই ঘোর অমানিশায়
হাজারো প্রদীপ জ্বলে ক্ষমার -
সেদিন যেমন জ্বলেছিল
জীবনের অঞ্জলি দিয়ে;
শুক্রবার, শনিবারের রাত
এত দীর্ঘ, এত ব্যথার!
মেরির কান্না নিয়ত হাওয়ায় ভাসে
মহাকালের পথে।

 


প্রণয়
 

শ্যামলা ধরণী           নিশীথে মোহিনী
পরিয়া অঙ্গে জোছনা ভূষণ।
মদির পেয়ালা           যামিনী বিহ্বলা
শশীর ভেলায় মধুর মিলন।
 
বিকশিত দল             হৃদয় চঞ্চল 
পরবাস মধুকরে সৌরভ নিমন্ত্রণ।
বহিছে মলয়          ফাগের খেলায়
পরাগরেনুতে রাঙাবে বঁধূর চরণ।
 
কাজল পাখা          তড়িৎ শিখা 
কিসের অভিলাষে পাগলিনী ধায়?
কিশোরী দয়িতা           প্রেমের বারতা
করিবে রচনা অশ্রুধারায়।
 
একাকী কামিনী          ভীরু হরিণী
রাতের ওড়না, মেঘের চাদর,
মুরলীর সুর              ঝিঁঝিঁর নূপুর 
যমুনা পুলিনে গোপন অভিসার।

 

আয়না 

তাই হল যা ভয় পেয়েছিলাম,
ঝমঝম করে বৃষ্টি অফিস যাওয়ার পথে,
সাথে দমকা হাওয়া;
ভুলে গেছি ছাতা নিতে তাড়াহুড়োতে।
বোধহয় বাঁচাতে পারবো না
ঠাণ্ডা লাগার হাত থেকে 
এই পঞ্চাশতম শরীরটাকে।
বুকের উপর চেপে ধরে ব্যগটাকে
অফিস যাই, না বাড়ি ফিরে যাই,
চলছিলাম এই দ্বিধা নিয়েই -
হঠাৎই ছিটকে এসে পড়ল গায়ে কাদাজল;
রাস্তার জল ছিটিয়ে কিশোর বালকেরা
ছুটে চলেছে উদ্দাম বেগে
ভিজতে ভিজতে ইস্কুলের পানে।
আর চলেছে রাস্তা জুড়ে 
এক একটা ছাতার নীচে 
চার-পাঁচ কিশোরী ছাত্রীর দল।
ভেসে যাচ্ছে তাদের হাসির কলরোল
বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে।
মনে পড়ল -
কি খুশিই না হোতো মন
বৃষ্টি হলে ইস্কুল যাওয়ার পথে।
ছাতা থাকলেও ইস্কুলে ঢুকতাম
ইচ্ছে করে ভিজে গিয়ে;
সবাই মিলে দাবি জানাতাম ছুটির 

হেডমাষ্টার মশাইয়ের কাছে।

প্রৌঢ় মাষ্টারমশাইরা একজোট

কিছুতেই ছুটি হবে না,

ঘোরতর আপত্তি তাঁদের অসময়ে বাড়ি ফেরার।আমাদের হয়ে কথা বলতেন

ওই তরুণ মাষ্টারমশাই -

যিনি সদ্য শুরু  করেছেন ধুতি-পাঞ্জাবী পরা,

প্যান্ট শার্ট ছেড়ে।

এখন তিনি পড়াতে এলে

ক্লাসরুম ভরে থাকে সুন্দর গন্ধের আমোদে,

তিনি আর খেলেন না ফুটবল আমাদের সাথে।

ইস্কুল ছুটির পরে,রওনা দেন তাড়াতাড়ি ঘরের পানে।আজতো তাঁরও দুচোখে খুশির মাদকতা,

পাগল হাওয়া উতলা মন গাইছে 

দুটি অপেক্ষারত চোখের কাজল ধার নিয়ে

মেঘের লেখা গান।

মনে পড়ল -

কলেজ পালিয়ে কোলাঘাটে রূপনারায়ণের ধারে

বৃষ্টি ভেজা দিনটা, সৃজনার পাশে, হাত ধরে।

হাওয়া নেচে বেড়াচ্ছিল দমকে দমকে

ওর বিনুনি পালানো চুলের সাথে, আঁচলের সাথে,

আকাশে নয়, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল চোখের তারায়,

বজ্রের নাদ বাজচ্ছিল বুকের ভিতর;

বৃষ্টির জল শরীরের তাপে বাষ্প হয়ে

রচনা করছিল চোখের পাতায় স্বপ্নের কুহেলিকা।

হুরর্ হ্যাট হ্যাট -চমকে দেখি লাঙ্গল করছে চাষী ভাই।জল ছপছপ জমিতে সৃষ্টির আহ্বান,

চাষী ভাইয়ের চোখে নবান্নের স্বপ্ন।

রাস্তার দুধারে চারা গাছেরা

মেলে ধরেছে চিকন সবুজ পাতা -

এখনও লাগেনি তাতে পোকা-মাকড়ের আঁচড়-কামড়।

এই মুহূর্তে শুয়ে পড়েছে তারা মাটিতে বৃষ্টির ভারে,

পর মুহূর্তে উঠছে গা ঝাড়া দিয়ে,

খিলখিলিয়ে দুলছে হাওয়ার দোলায়।

থমকে দাঁড়ালাম -পাতা ঝরা গাছটা হেলে পড়েছে

রাস্তার উপর,যেন সকাতরে বলছে

ওরে, আর ভিজিয়ে দিস না অবেলায়,

সুজন মাটিরা দূরে সরে যাচ্ছে,

জ্বালানি হয়েও আমার বিকি হবে না যে !

চরকা

লোকে বলে মায়ের হাসি চাঁদের মুখে,
আমি দেখতে পাই না,
চাঁদকে দেখে মায়ের কান্নাভেজা মুখ মনে পড়ে যায়।
গুটিকয়েক সাদা চুল মাথায় অগোছালো,
ধবধবে রক্তহীন মুখে কালো কালো ছাপ -
গোবরের, মাটির, অজন্তের, সংঘর্ষের আর বার্ধক্যের;
তাইতো চাঁদকে দেখে মাকে খুঁজে পাই।
কি আকুলতায় চাঁদ জড়িয়ে থাকতে চায় পৃথিবীকে।
নীরবে বুকে পেতে নেয় যত মহাজাগতিক আঘাত,
সূর্যের থেকে আলো ধার করে আনে
পৃথিবীর মুখে হাসি ফোটানোর ব্যকুলতায়।
 
স্নানের পরে লাল পাড় শাড়িতে 
মন্দিরের পথে মা পূজার থালি হাতে।
মনে সংশয় ছিল না -
কে বেশি বড়, কে বেশি উজ্জ্বল,
মাথার উপরের সূর্য 
না মায়ের কপালের লাল টিপ।
স্বপ্ন দেখতাম  -
দু পায়ের উপর যখন দাঁড়াতে পারব,
রঙিন কাপড়ে সাজাব আমার সোনার চাঁদকে!
ভেবে ঠিক করতে পারতাম না -
সবুজ টিয়া রঙের, 
না হলদে ড়ুরে শাড়ি,
কোনটা বেশি মানাবে।
 
নীল আকাশে যখন ডানা মেলতে শিখলাম,
সোনালী রোদের উষ্ণতাকে
শরীরে উপভোগ করতে শুরু করলাম,
চশমার ফ্রেমে ঠিক তখনই 
ধরা পড়ল তারার বিনাশ।
সারি সারি আকাশগঙ্গার রেখা
তলোয়ারের ধার হয়ে 
কেটে দিল কৈশোরের কিশলয় ডানা।
তারপরে -
এক চৈতালি অমাবস্যা রাতে,
আকাশে বিদ্যুতের চকিত হানা,
বজ্রের নিনাদ, আসন্ন কাল বৈশাখী,
মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে একা ডানা কাটা পাখি।

maa durga.jpg

সেদিন যখন মনের শাশ্বত ইচ্ছা 
পৃথিবীর আলো দেখার দাবিতে, মুক্তির দাবিতে,
পেটের মধ্যে অজস্র আলোড়ন নিয়ে এল;
চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম সৃষ্টির আনন্দে!
রক্তাত্ত্ব এক তাল কাদাকে
কোলে নিয়ে মনে হয়েছিল -
আমার চাঁদও একদিন এমনই কেঁদেছিল,
অন্ধকার মাটির ঘরে
স্যাঁতসেঁতে খেজুর চাঁটাইয়ের উপর শুয়ে।
সে চোখের জলও বোধহয় 
জাগিয়ে ছিল মুখে এমনিই লোনা স্বাদ।
 
আজ শরৎ সন্ধ্যায় 
সবুজ ঘাসের পথ ধরে 
হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল -
ছোটোবেলায় মায়ের ছেঁড়া কাপড় নিয়ে 
খেলছিলাম পুতুল বানানোর খেলা।
কাঁচা হাতে সূঁচের খোঁচার ব্যথায় 
কাঁদতে কাঁদতে মুখ লুকিয়েছিলাম মায়ের কোলে।
পুতুলকে মনের মত না বানাতে পারার অভিমানী ব্যথা
ছিল বেশি সূঁচের খোঁচার থেকে।
চোখের জল মুছিয়ে,
ঠাণ্ডা হাতের প্রলেপ দিয়ে কপালে,
রক্ত ঝরা হাতে চুমু খেয়েছিল মা।
জল ভেজা আবছা চোখে 
হঠাৎই ধরা পড়েছিল
মেঘের ফাঁকে একফালি চাঁদের হাসি।
মাথায় ঠান্ডা ছোঁয়ায় চমকে দেখি
চাঁদের কান্না শিশির হয়ে ঝরে পড়ছে।

নীলকন্ঠ

নীল আকাশে বসত পাখিদের মেলা,
রোদের ঝালরে আঁকাছিল স্বপ্নের নকশা,
বাতাসে ছিল প্রেমের সৌরভ, 
পূজার ঘন্টায় বাজত জয়গান;
ঠিক তখনই -
আশার আলো চুরি করে,
মানবতার বুকে শক্তিশেল হেনে
ধেয়ে এল দুরন্ত ঝড় 
সর্বনাশের কালো ডানা মেলে।
কত পাখি উড়ে গেল ঘুমের দেশে,
কত পাখির ব্যথায় ডানা ঝটপট 
রক্তে ভেজা তাদের নীল পালক।
রুদ্ধঘর থেকে চিৎকার করে তোমায় ডাকলাম -
তুমি ছুটে এলে 
মাভৈ নাচের তালে 
বিশল্যকরনি হাতে নিয়ে।
ক্লেদিত শরীর, কোমল চাহনি,
পাখির বুকে তোমার 
উষ্ণ আশ্বাস ভরা ছোঁয়া,
পান করালে সঞ্জীবনী সুধা,
শ্মশানে পেতে দিলে উদাত্ত বুক।
আবার গতিশীল প্রগতির রথে বসে 
জলভেজা চোখে দেখলাম 
তোমার গলা ভরে আছে বিষে।

কবিতাঃ তাপস কুমার বর

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

তাপস কুমার বর

পৃথিবীর অন্ধকার

খনো নির্বাক পৃথিবী....
জড়ত্বের ওই ওষ্ঠগুলো মৃত মমির মতো,
কলঙ্কের রৌদ্দুরে জাদুর কাঠিতে ঘুমিয়ে আছে।
রহস্যগুলো, আজ ঠেসে শিক্ষা দেওয়ার তোতা পাখির মতো....
সত্যের পরাজয়ে,
ছলনার আশ্রয়ে শকুনির পাশার চালে লুকিয়ে আছে!
বোবা কত শালিক রক্তমাখা রণাঙ্গনে,
ওই মিশরীয় সভ্যতার পিরামিডে আজও কি কাঁদছে?
দেখো ওই সত্যের ইতিহাস.....
সেই মান্ধাতার যুগ থেকে খুঁজে খুঁজে চলছে।
আজও কি তার সমাধান মিলেছে?
কত,শত বোবাকান্না মৃত শালিক দাবানলের চুল্লিতে.....
আজও পাশার চালে ধুঁকে ধুঁকে মরছে!

পৃথিবী একদিন চৈতন্য বিহীন হয়ে পড়বে,

উন্মাদ পাগলের মতো রক্তচোষক ভ‍্যাম্পায়ার হবে।

সেদিন প্রত্যাশাগুলো দুমড়ে মুচড়ে সব চুরমার হবে....

পৃথিবীর প্রশ্বাস নিঃশ্বাসে আজ কেন.....?

দুর্গন্ধের কত, শত প্রতিবাদ ঝান্ডা উড়ছে।

এখনো গভীর নিশুতি রাতে ওরা নিরাকার হয়ে....

সত্যের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।

ওরা কি রাজ বিদ্রোহী হতে পারবে?

সেদিন ফসিলের চিৎকারে ওরা কি জেগে উঠবে?

হায়রে, সত্য সেলুকাস সেদিন কি পুরুর বীরত্ব প্রকাশ হবে?

দিনে দিনে ইতিহাস মমির কবরে চাপা পড়ছে...

সেদিন কি ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু সত্যের সন্ধান চালাবে?

পৃথিবী একদিন চৈতন্য বিহীন হয়ে পড়বে,

উন্মাদ পাগলের মতো রক্তচোষক ভ‍্যাম্পায়ার হবে।

সেদিন প্রত্যাশাগুলো দুমড়ে মুচড়ে সব চুরমার হবে....

পৃথিবীর প্রশ্বাস নিঃশ্বাসে আজ কেন.....?

দুর্গন্ধের কত, শত প্রতিবাদ ঝান্ডা উড়ছে।

এখনো গভীর নিশুতি রাতে ওরা নিরাকার হয়ে....

সত্যের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।

ওরা কি রাজ বিদ্রোহী হতে পারবে?

সেদিন ফসিলের চিৎকারে ওরা কি জেগে উঠবে?

হায়রে, সত্য সেলুকাস সেদিন কি পুরুর বীরত্ব প্রকাশ হবে?

দিনে দিনে ইতিহাস মমির কবরে চাপা পড়ছে...

সেদিন কি ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু সত্যের সন্ধান চালাবে?

শচীন মানে ক্রিকেট ইতিহাস 

২২ গজে আবেগ ভরা গর্জে ওঠা উল্লাস।

সেই একটা কিশোর

মাথায় আঘাত পেয়েও ছাড়েনি সে লড়াই।

২৪শে এপ্রিল ১৯৭৩ সাল

জন্মেছিল সকলের প্রিয় ক্রিকেট ভগবান।

বিখ‍্যাত সুরকার শচীন দেববর্মন....

পিতা নামের অক্ষরে মিলিয়ে রেখেছে শচীন তেন্ডুলকর।

মাত্র এগারো বছরের কিশোর

সেই শিবাজি পার্কে শুরু প‍্যাকটিসের শুভ আরম্ভ।

শ্রী রমাকান্ত আচরেকারের ছিল শর্ত

আউট না হলে তবেই মিলবে কয়েন।

গুরুদেবের থেকে পাওয়া কয়েন

পেয়েছে শচীন ১৩টি আউট না হয়ে।

 

সালটা ১৯৯০

ইংল‍্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি আন্তর্জাতিক লড়াই।

সেই নব্বই এর দশকের ক্রিকেট মহামানব

ভারত পেয়েছিল শান্ত ক্রিকেট ঈশ্বর।

২০০১ সালে ওয়ানডেতে ১০০০০ গন্ডি পার,

২০০২ সালে ডন ব্র‍্যাটমানের ৩০টি সেঞ্চুরি ভেঙে চূরমার!

বিশ্বের দরজায় এখন শচীন শচীন চিৎকার 

ক্রিকেট মানেই আবেগ ভরা উল্লাস।

তবু শিরোপা ওঠেনি তুমি হওনি বিশ্বকাপ জয়ী উল্লাস...

ছিল সেই ২৮টা বছরের অপেক্ষা লড়াই।

এলো ২০১১ সাল....

মহেন্দ্র সিং ধনির নেতৃত্বে ভারত বিশ্বকাপ জয়ী।

সেদিন মাঠ ভরে উঠেছে চিৎকারে শচীন শচীন শচীন...!

 

ক্রিকেট আজ তোমাকে বিদায়

বিমর্ষ আবেগে ভরে ছিল সে মাঠ।

ক্রিকেট ভগবান তুমি সকলের  মাস্টার ব্লাস্টার

ভারতরত্নের রত্ন তুমি......

ক্রিকেট প্রেরণার জাগরণ লিটিল মাস্টার।

বিশ্ব কবিতা দিবস

বিতা তুমি মনের কোরাসে...

জ্বালিয়েছো বহ্নিশিখাকে।

কবিতা শুধু তোমায় জানতে...

সপ্তর্ষিমন্ডলের দলিল হয়ে রেখেছো কি রহস‍্যে?

সেই ২১শে মার্চ সারা বিশ্বজুড়ে...

১৯৯৯ সালের সময়ের রঙিন ইতিহাসে,

কবিতা তোমার রসের মাধুর্য‍্যে...

ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব কবিতা দিবস বিশ্ব দ্বারে।

নানান ভাষাভাষী রং বাহারীতে...

কবিতা তোমার মনের ভাবনা ফোঁটাও,

কলমের কালির বিন্দু ফোঁটার শ্রেষ্ঠত্বের মানবধর্মে।

 

বিশ্ব কবি লিখে গেছে তাই,

কত কবিতা,গান,গল্প গূঢ় ভাবনার মনের সরসে।

তুমি দয়ার সাগর বিদ‍্যাসাগর.....

তোমার কলমের কালির বিন্দু ফোঁটা শুরু হয় বর্ণপরিয়ে।

ওই প্রতিবাদের রুদ্রবীণায় গর্জে উঠেছে,

হে বিদ্রোহী কবি তোমার মনের কৈফিয়ৎ।

প্রকৃতির কত শিল্পকলা বেজে উঠেছে...

জীবনানন্দের বনমালীর রূপ সৌন্দর্য‍্যের কবিতার পুঙক্তিতে।

কবিতা তুমি কি মনের আবেগে....

ডানা মেলে উড়িয়ে নিয়ে যাও,

তোমার অন্তবিহীন অচিনপুরে?

 

কবিতা তুমি মনের আবেগে...

ওই নদীর কুলু কুলু ধ্বনি কি শুনতে পেলে?

বনানীর ওই ফুল পরিরা সেজে...

ডাকছে আজও কত কবিতার রং মশালে।

কলম যেদিন থমকে যাবে...

মনের কোরাসে ভাবনার কবিতা অন্ধ হবে।

কবিতা তুমি আবেগ দিয়ে....

ওই মরচে পড়া মনের দুয়ার 

সারিয়ে তুলবে।

যোগদর্শন

প্রবন্ধ

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

যোগদর্শন

প্রোজ্জ্বল মণ্ডল

images.png

যোগদর্শন হিন্দুদর্শন-রাজ্যের এক অমূল্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থের রচিয়তা মহর্ষি পতঞ্জলি। সেইজন্য একে পাতঞ্জলদর্শনও বলা হয়। এই গ্রন্থে মহর্ষি পতঞ্জলি যোগ কি, এর সাধন উপায় এবং তার ফলাফল প্রভৃতি বর্ণনা করে মানবসমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধন করেছেন। যোগসাধনা ভিন্ন কৈবল্য বা মোক্ষলাভ করা সম্ভব নয়। যোগদর্শন বলেন —
পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব ভিন্ন আরও এক পুরুষ আছেন, যিনি অবিদ্যামূলক ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয়ের সহিত সম্বন্ধশূন্য, সেই পুরুষই ঈশ্বর। তিনি সকল জ্ঞানের আধার, তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি অনন্ত, ত্রিকালাতীত, তাঁতেই জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা। যোগ - সাধনার দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ হয়। এই জ্ঞান লাভই —কৈবল্য বা মোক্ষলাভ। এরই পাতঞ্জল দর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়। এইভাবে ঈশ্বরকে স্বীকার করায় যোগদর্শনকে *“সেশ্বর সাংখ্য”* বলা হয়।

মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের সংজ্ঞা নির্দেশ করিয়াছেন—
       *“যোগশ্চিত্ত-বৃত্তি-নিরোধঃ”*        —পতঞ্জল, ১২
--অর্থাৎ যাহা দ্বারা বা যে উপায়ে চিত্তবৃত্তি রোধ করা যায় তাহারই নাম যোগ।
--এখন চিত্ত ও চিত্তবৃত্তি কি তাহা প্রথমে বুঝা প্রয়োজন। সাংখ্যের মন , বুদ্ধি ও অহংকার এই তিনের আধারস্বরূপ চিত্ত।
তমোগুণের আধিক্যবশতঃ চিত্তের মূঢ়াবস্থা। রজোসত্ত্বাদির দ্বন্দ্বভাববশতঃ চিত্তে কখনও স্থির কখনও অস্থির ভাব উপস্থিত হলে চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়। পূর্ণ সত্ত্বগুণ লাভে চিত্তের একাগ্র অবস্থা। এই অবস্থায় মন সম্পূর্ণ অন্তর্মুখী হয়। একাগ্র অবস্থার পর চিত্তবৃত্তি সম্পূর্ণ স্থির হইলে তাহাকে চিত্তের নিরুদ্ধ অবস্থা বলে। এই অবস্থায় মন *সমাধিমগ্ন* হয়।
চিত্তবৃত্তি নিরোধ কিভাবে হতে পারে?    —এর উত্তরে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন,
        *“অভ্যাস-বৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরোধঃ”*
                           পাতঞ্জল, ১।১২
অর্থাৎ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারাই চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ হয়। এই চিত্তবৃত্তির নিরোধের অপর নাম সমাধি। তা নানাপ্রকারে সিদ্ধ হয়ে থাকে। ঈশ্বর প্রণিধান দ্বারা সমাধি হয়। ঈশ্বরের বাচক বা প্রকাশক হইতেছে প্রণব বা ওঁকার। এই ওঁকারের জপের ও তাহার অর্থভাবনার সাহায্যে মন অন্তর্মুখী হয় এবং আত্মোপলব্ধির পথে সকল বাধা দূর হয়। চিত্তবৃত্তি নিরোধের উপায় দুই প্রকার— *অভ্যাস* ও *বৈরাগ্য*। চিত্তবৃত্তিগুলিকে সংযত করে স্থির করবার জন্য বার বার যে প্রচেষ্টা তার নাম *অভ্যাস*। দীর্ঘকাল আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে অভ্যাস সুদৃঢ় হয়। আর নিজের জন্য দৃষ্ট অথবা অপরের নিকট শ্রুত ভোগ্য বিষয় সমূহের উপভোগ করবার যে তীব্র বাসনা বা ইচ্ছা তাহা পরিত্যাগ করিবার নাম হইল *বৈরাগ্য* বা *বিষয়-বিতৃষ্ণা*।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে গীতায় বলিয়াছেন—
        *অসংশয়ং মহাবাহো*
                *মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।*
         *অভ্যাসেন তু কৌন্তেয়*
                   *বৈরাগ্যেন চ গৃহাতে।।*
               ‌          — গীতা—৬।৩৫
অর্থাৎ হে অৰ্জ্জুন, মন যে দুর্নিরোধ ও অত্যন্ত চঞ্চল তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা তাহাকে সংযত করা যায়।

 চিত্তকে শুদ্ধ ও শান্ত করবার জন্য যোগদর্শনে যে সমস্ত সাধনার উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তা *অষ্টাঙ্গ যোগ* নামে পরিচিত। সেগুলি হচ্ছে— (১) *যম*, (২) *নিয়ম*, (৩) *আসন*, (৪) *প্রাণায়াম*, (৫) *প্রত্যাহার*, (৬) *ধারণা*, (৭) *ধ্যান* ও (৮) *সমাধি*।

*(১) যম :—* অহিংসা, সত্য, অস্তেয় বা অচৌর্য, ব্রহ্মচর্য্য ও অপরিগ্রহ — এই পাঁচটিকে *‘যম’* বলে। 
*“অহিংসা-সত্যাস্তেয়-ব্রহ্মচর্য্যাপরিগ্রহা যমাঃ”*।
                         —যোগদর্শন, ২।৩০

*(২) নিয়ম* পাঁচ প্রকার — শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর - প্রণিধান।
*"শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বর-*
                *প্রণিধানানি নিয়মাঃ।”*
                           পাতঞ্জল, ২।৩২
(ক) স্নানাদি দ্বারা বাহ্য শরীরের গুচিতা এবং সচ্চিস্তা সদ্ভাবনা দ্বারা চিত্তের পবিত্রতা রক্ষা করাই হইতেছে *শৌচ*। 
     *“স্নানং মনোমলং ত্যাগং*
                *শৌচ মিন্দ্রিয়-নিগ্রহঃ”*
—অর্থাৎ মনের মলিনতা ত্যাগ করাই হইতেছে —

যথার্থ স্নান এবং ইন্দ্রিয়সংযমই হইল যথার্থ *শৌচ*।

(খ) যথাযোগ্য চেষ্টা দ্বারা যাহা পাওয়া যায় তাহাতে তৃপ্ত থাকার নাম *সন্তোষ*। ইহার অর্থ দুরাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করা। সন্তোষ সিদ্ধ হইলে অতি উত্তম সুখ লাভ হয়।
(গ) শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব সহ্য করা এবং মন ও ইন্দ্রিয়াদির একান্ত সংযমের নাম *তপস্যা*। তপস্যার ফলে শরীর ও ইন্দ্রিয়ের অশুদ্ধি ক্ষয় হয়।
(ঘ) *স্বাধ্যায়* — ঋষিপ্রণীত শাস্ত্রাদি পাঠ ও গুরুমন্ত্রাদি জপ করাকে *স্বাধ্যায়* বলে। স্বাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হইলে ইষ্টদেবতার দর্শন লাভ হয়। 
(ঙ) একান্ত শ্রদ্ধা ভক্তির সহিত ভগবচ্চিন্তা এবং ঈশ্বরে সর্ব কৰ্ম্ম সমর্পণ করিয়া তাঁহাতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করাকে *ঈশ্বর-প্রণিধান* বলে। ঈশ্বর-প্রণিধান দ্বারা যোগ - সাধনার চরম ফল সমাধি লাভ হয়।

(৩) আসন :—* যোগাভ্যাস কালে যে ভাবে শরীরকে স্থির করে দীর্ঘক্ষণ রেখে কষ্ট বোধ হয় না, তাকে আসন বলে। স্থিরভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে এবং মস্তক-গ্রীবা ও বক্ষঃস্থল সমরেখায় রেখে উপবেশন করতে হয়। একাসনে অন্তত ৩।৪ ঘণ্টা অনায়াসে বসবার অভ্যাস হলে আসনসিদ্ধি লাভ হয়। এই যোগ - সাধনার পক্ষে খুবই উপযোগী। আসন - সিদ্ধি হইলে শীতোষ্ণাদি ক্ষুধাতৃষ্ণাদি দ্বন্দ্বসকল আর বাধার সৃষ্টি করিতে পারে না।

(৪) প্রাণায়াম :—* আসন - সিদ্ধি হলে প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হয়। শ্বাস ও প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করাকে *প্রাণায়াম* বলে। প্রাণায়াম তিন প্রকার— *পূরক, রেচক ও কুম্ভক*। বাইরের বায়ুকে আকর্ষণ করে দেহের ভিতর পূরণ করাকে *পূরক* বলে। ভিতরের বায়ুকে বাইরে বাইরে করে দেওয়াকে *রেচক* বলে এবং জলপূর্ণ কুম্ভের ন্যায় দেহের অভ্যন্তরে বায়ুকে ধারণ করবার নাম *কুম্ভক*। প্রাণায়ামের দ্বারা প্রাণবায়ু ও মন স্থির হয়। প্রাণায়াম সিদ্ধ হলে মোহাবরণ ক্ষয় হয়ে দিব্যজ্ঞান প্রকাশিত হয়।

(৫) প্রত্যাহার :—* ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ নিজ বিষয় হতে প্রতিনিবৃত্ত করে চিত্তের অনুগামী করার নাম *প্রত্যাহার*। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক — এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ বিষয় শব্দ , স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ হতে প্রতিনিবৃত্ত হলে ইন্দ্রিয়গণও প্রতিনিবৃত্ত হয়ে চিত্তের অনুসরণ করে। প্রত্যাহারের তাৎপর্য মনকে ইন্দ্রিয়গণ হতে বিযুক্ত করা। মন বিযুক্ত হলে চক্ষু খোলা থাকিলেও বাহ্য বস্তু দেখিতে পাওয়া যায় না, কান খোলা থাকিলেও বাহ্য শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না। প্রত্যাহার সাধনার দ্বারা এই অবস্থা যোগীর ইচ্ছাধীন হয়। চিত্তবৃত্তি - নিরোধের পক্ষে এই সাধনা একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যাহার সাধনায় সিদ্ধি হইলে ইন্দ্রিয়গণ পরম বশীভূত হয়।
যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার — এই পাঁচটিকে যোগের বহিরঙ্গ সাধন বলে।
(৬) ধারণা :—* বাইরের বিষয় হতে প্রতিনিবৃত্ত করে কোন এক বিশেষ দেশে বা স্থানে চিত্তকে স্থিরভাবে ধরে রাখার নাম *ধারণা*। এই স্থান নিজের দেহের ভিতরে কোন কেন্দ্রবিন্দুতে অর্থাৎ নাসিকার অগ্রভাবে, হৃদ্‌পদ্মে অথবা বাইরের কোন দেবতার মূর্ত্তিতে হইতে পারে।

(৭) ধ্যান :—* যে বিষয়ে চিত্ত স্থির করা হয়, সেই বিষয়ে চিত্তবৃত্তির তৈলধারাবৎ একতানতা অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্ন ভাবনাকে *ধ্যান* বলে। 
       *“ধ্যানং তৈল ধারাবৎ অবিচ্ছিন্ন*
         *স্মৃতি সংতানরূপা ধ্রুবা স্মৃতিঃ”* 
             —ব্রহ্মসূত্র, রামানুজ ভাষ্য ১।১
    *“তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্”*
                           —পাতঞ্জল, ৩।২
সাধারণত: মন এক জায়গায় বেশীক্ষণ আবদ্ধ থাকে না, ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত হয়। সেই বিক্ষিপ্ত মনকে বার বার জোর করে ফিরিয়ে এনে ধ্যেয় বস্তুতে আবদ্ধ করতে হয়। সেরূপ অভ্যাসের ফলে মন যখন ধ্যেয় বস্তুতে অবিচ্ছিন্নভাবে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয় তখনই ধ্যান হয়। ধারণা যতই গাঢ় হয় ততই অন্তরে প্রবেশ করে তখনই হয় ধ্যানের আরম্ভ। ধ্যান গাঢ় হলে চিত্তবৃত্তির নিরোধ হয় এবং ‘অন্তরে এক গভীর প্রশান্তভাব জাগ্রত হয়।

(৮) সমাধি :—* যোগের অষ্টম অঙ্গ বা শেষ অঙ্গের নাম সমাধি। কোন বিষয়ে দীর্ঘসময় ধ্যান করতে করতে মন যখন ধ্যেয় বস্তুর আকার ধারণ করে এবং তাহাতে লীন হয়ে যায়, তখন তাকে *সমাধি* বলে। ধ্যান গভীর হলে যখন কেবল ধ্যেয় বিষয়মাত্র জ্ঞানগোচর থাকে এবং তদ্ভিন্ন অন্য সমস্ত বিষয়ের বিস্মৃতি ঘটে , তখনকার সেইরূপ চরম চিত্তস্বৈর্য্যের নাম *‘সমাধি'*।
ধারণা, ধ্যান ও সমাধি — এই তিনটিকে যোগের অন্তরঙ্গ সাধন বলে। এই তিনটি একই বিষয়ে প্রযুক্ত হইলে তাহাকে *‘সংযম’* বলে।
জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যান — এটাই *‘নিৰ্ব্বাণ মুক্তি।'* তখন সেই সিদ্ধ সমাহিত মহাপুরুষ লোককল্যাণের জন্য জগতে বিচরণ করেন এবং মুমুক্ষকে মুক্তির পথে অগ্রসর হবার জন্য সাহায্য করেন। এরূপ জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ জগতে সত্যই খুব দুর্লভ।

 

উপনিষদের মূল মন্ত্র

প্রবন্ধ

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

উপনিষদের

মূল মন্ত্র

প্রোজ্জ্বল মণ্ডল

uponishad.JPG

পনিষৎ মানে ব্রহ্মবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ। উপ + নি পূর্বক সদ্ ধাতু ক্লিপ করিলে উপনিষৎ শব্দ হয়। উপ = নিকট। নি = নিশ্চয়। সৎ = প্রাপ্তি। ইহাই ব্যাকরণ গত অর্থ। আমরা ইহার অর্থ করিতেছি :- উপ = নিকট। নি = লইয়া যায়। সৎ = ব্রহ্মতত্ত্ব।
যে বিদ্যা সাধককে ব্রহ্মতত্ত্বের নিকটস্থ করে, উহার নাম উপনিষদ।
শান্তিমন্ত্রম। ওঁ পূর্ণ মদঃ পূর্ণ মিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণ পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবা বশিতে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ॥ হরিঃ ওঁ ॥
অদঃ পূর্ণম্ (ইন্দ্রিয়াতীত জগৎ [ব্রহ্মদ্বারা] পূর্ণ)। ইদং পূর্ণম্ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্ জগৎ [ব্রহ্মদ্বারা] পূর্ণ)। নির্গুণ ব্রহ্ম হইতেই ইন্দ্রিয়াতীত ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ অভিব্যক্ত হইয়াছে। তাহা হইলেও নির্গুণ এবং নিশ্চল ব্রহ্ম পরিপূর্ণই আছেন।

১। ঈশা বাস্তমিদং সৰ্ব্বং যৎ কিঞ্চজগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বি ধন।
“পৃথিবীতে যত রকম পদার্থ আছে, সবই ঈশা দ্বারা (ঈশ্বর, ব্রহ্ম বা আত্মা দ্বারা) ব্যাপ্ত। এইরূপে ব্রহ্ম দর্শন না করিলে তুমি ভােগী হইবে। তুমি কাহারও ধনে অভিলাষ করিও না।”

২। কুন্নেবেহ কৰ্ম্মাণি জিজীবিষেৎ শত সমাঃ।
এবং ত্বয়ি নাথে তােহস্তি ন কৰ্ম্ম লিপ্যতে নরে।
“ইহলােকে (সব রকম) কর্ম সকল সম্পন্ন করিবে এবং শত বৎসর বঁচিয়া থাকিবার ইচ্ছা পােষণ করিবে। ইহার অন্যথা করিবে না। মানবের জন্য লিপ্ততাহীন কর্মই বিহিত।”

৩। অসুর্যা নাম যে লােকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ।
তাভস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনাে জনাঃ॥
যাহারা আত্ম হন ও জ্ঞানহীন তমসাচ্ছন্ন মানুষ, তাহারা মৃত্যুর পর অসুরলােকে গমন করে।

৪। অনেজদেকং মনসাে জবীয়াে নৈনদেবা আপ্লব পূর্বমর্ষ।
তদ্ধাবতােইন্যানতত্যতি তিষ্ঠৎ তস্মিন্নপাে মারিশ্যা দধাতি।
তিনি এক, তিনি স্পন্দন রহিত, মন হইতেও বেগবান, (পূর্বযুগের) দেবতাগণ তাহাকে প্রাপ্ত হন নাই। তিনি স্থির হইলেও সকলকে অতিক্রম করিয়া অধিক দ্রুত বেগশীল। তাঁহাকে আশ্রয় করিয়ই মাতরিশ্বা (সগুণব্রহ্ম) স্নেহরস (আশীর্বাদ) দান করিয়া থাকেন।

৫। যথাদর্শে তথাত্মনি, যথা স্বপ্নে তথা পিতৃলােকে।
যথাঙ্গু পরীব দদৃশে, তথা গন্ধর্বলােকে,
চ্ছায়া পয়ােরি ব্রহ্মলােকে। ১০৬ ॥
দর্পণে যেমন নিজের রূপ প্রতিফলিত হয় ঠিক সেইরূপ আত্মস্বরূপে মহাশক্তি বা ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিফলিত হইয়া থাকে। স্বপ্নে যেমন জ্ঞানের ধারা প্রতিফলিত হয় পিতৃলােকে এই ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের এতটুকু প্রতিফলন হইয়া থাকে। জলের মধ্যে নিজের ছায়া যতটা প্রতিফলিত হয়, সঙ্গীত বিদ্যার মধ্য দিয়া (গন্ধর্বলােক) ততটা ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতিফলন হইতে পারে। আর ব্রহ্মলােকে আতপ ও ছায়ার মত আত্মজ্ঞান প্রতিফলন হইয়া থাকে।

৬। যস্তু বিজ্ঞানবান্ ভবতি যুক্তেন মনসা সদা।
তস্মেন্দ্রিয়াণি বস্যানি সদা ইব সারখেঃ ॥ ৬০।
যিনি বিজ্ঞানবান হন, মনও ঘঁহার বিবেকসংযুক্ত থাকে, তাহার ইন্দ্রিয়গণ সারথির সৎ অশ্বের মতন বশীভূত থাকে।

৬। যজ্ঞ সৰ্ব্বাণি ভূতানি আত্মনেৰানুপতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততাে ন বিজুগুস্পতে।
যিনি সর্বদা সর্বভূতকে আত্মতে এবং আত্মাকে সর্বভূতে দর্শন করেন, তিনি সেইরূপ আত্মদর্শনের ফলে ঘৃণা করেন না।

৭। যন্ত্র বিজ্ঞানবান্ ভবত্য মনস্কঃ সদা শুচিঃ।
ন স তৎপদমাপ্নোতি সসারং চাধিগচ্ছতি। ৬১।
যে অবিজ্ঞানবাদী, যে অমনস্ক, যে সদা অশুচি, সে সেই ব্রহ্মপদপ্রাপ্ত হয় না, সে সংসারগতি (অর্থাৎ হীনগতি) প্রাপ্ত হয়।

৭। যস্মিন সৰ্ব্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ বিজানতঃ।
তত্র কো মােহঃ কঃ শােক একত্ব মনুপশতঃ।
যে সময়, সর্বভূতই আত্মারই রূপ, সাধকের এইরূপ অনুভব হয়, তাঁহার মােহ এবং শােক থাকে না। ইহার কারণ, তিনি সর্বত্র একই চেতনা অনুভব করেন। শক্তিবাদ ভাষ্য। এই মন্ত্রে ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষের লক্ষণ কিরূপ, উহা জানা যায়। পূর্ব মন্ত্রে চেতনালক্ষণ বলা হইয়াছিল।

৮। যস্থ বিজ্ঞানবান্ ভবতি সমনস্কঃ সদা শুচিঃ।
সতু তৎ পদমাগ্লোতি যস্মভুয়াে ন জায়তে। ৬২।
যিনি (রখী) বিজ্ঞানবান, যিনি সমনস্ক এবং সদা শুদ্ধ, তিনি সেই পরমপদ প্রাপ্ত হন, যাহা প্রাপ্ত হইলে আর জন্ম হয় না।

৮। স পর্যগাঙ্গুক্রমকায়মব্রণ মম্নবির শুদ্ধমপাপবিদ্ধ।
কবির্মনীয়ী পরিভূঃ স্বয়ঃর্যাথাতথ্যতােইৰ্থাৎ ব্যদধাৎ শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।
তিনি দেশকালের বাধা অতিক্রম করিয়া সর্বব্যাপী, তিনি শুদ্ধ প্রকাশময়, তিনি কায়াহীন, তাহাতে ক্ষত নাই (অক্ষতঃ), তিনি অস্নাবিরং (শিরা রহিত, অর্থাৎ শরীর ধর্ম বর্জিত ব্যাপক তত্ত্ব), তিনি শুদ্ধ (নির্মল), তিনি অপাপবিদ্ধ (তাহাতে পাপ স্পর্শ করে অর্থাৎ পাপকর্ম তাহাতে নাই)। তিনি কবি (সর্বদ্রষ্টা), তিনি মনীষী (সর্বজ্ঞ)। তিনি পরিভূঃ (সর্বোপরি বিরাজমান, অর্থাৎ তিনি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কেহই নাই)। তিনি স্বয়ম্ভু (নিজে নিজেই আছেন)। তিনি (পরমাত্মা) শাশ্বতীভ্যঃ (শাশ্বতী শক্তিগণকে)
(সমাভ্যঃ) কালগতিতে সৃষ্টি ও লয় চক্রকে নিজ নিজ কর্তব্য সমূহকে যথাযথ করিবার শক্তিদান করিয়াছেন।

৯। বিজ্ঞান সারথি যস্ত মনঃ প্রগ্রহবা নরঃ।
সােহধ্বনঃ পারমাপ্পেতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদ৷ ৬৩।
বিজ্ঞান যাহার (যে রথীর) সারথি, মন যাহার ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বগণের সংযমিত করিবার রঞ্জুরূপী, তিনি সংসারে থাকিয়াও শ্রেষ্ঠ বিষ্ণুপদ (ব্যাপক ব্রহ্মপদ) প্রাপ্ত হন।

৯। অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো
রূপং রূপং প্রতিরূপাে বভূব।
একস্তথা সৰ্ব্বভূতান্তরাত্মা
রূপং রূপং প্রতিরূপাে বহিশ্চ৷ 
একই অগ্নি, যেরূপ জগতে প্রবেশপূর্বক বিভিন্ন বস্তুতে তদ্রুপ হইয়া অবস্থান করিতেছে এবং অগ্নি যেমন সেই বস্তু হইতে পৃথক হইয়াও অবস্থান করিতেছে ঠিক সেইরূপ আত্মা এক এবং নানা জীবে প্রবিষ্ট থাকিয়া ও সর্বজীব হইতে স্বতন্ত্র হইয়াও অবস্থান করিতেছেন।

১০। ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা হ্যর্থ অর্থেভ্যশ্চ পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধিবুদ্ধেরাত্মা মহান্ পরঃ ॥ ৬৪।
ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা অর্থ সকল শ্রেষ্ঠ। অর্থ সকল হইতে মন শ্রেষ্ঠ। মন হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধি অপেক্ষা মহানআত্মা শ্রেষ্ঠ।
১১। মহতঃ পরমব্যক্তমব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ।

পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ, সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ ॥ ৬৫।

মহত্তত্ত্ব হইতে অব্যক্ত তত্ত্ব শ্রেষ্ঠ, অব্যক্ত তত্ত্ব হইতে পুরুষ তত্ত্ব শ্রেষ্ঠ। পুরুষ তত্ত্ব হইতে শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব আর কিছুই নাই। ইহাই শেষ স্তর এবং ইহাই শ্রেষ্ঠ গতি।

১২। এষ সৰ্ব্বেষু ভূতেষু গূঢ়োত্মা ন প্রকাশতে।দৃশ্যতে ত্বয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ ॥ ৬৬।

এই আত্মা সমস্ত ভূতের অভ্যন্তরে গুহভাবে অবস্থিত আছেন। কিন্তু সকলের নিকট ইনি প্রকাশ পান না। সূক্ষ্মদর্শী মহাত্মাগণ একাগ্র বুদ্ধি এবং সূক্ষ্ম দার্শনিকতা দ্বারা ইহাকে দর্শন করেন।

১২। একোবশী সৰ্ব্বভূতান্তরাত্মা
একং রূপং বহুধা যঃ করােতি।
তমাত্মস্থং যেইনুপশ্যন্তি ধীরা
স্তেষাং সুখং শাশ্বতং নেতরেষা৷ ৯৮
বশী (সর্বনিয়ন্তা) এক, তিনিই সমস্ত জীবে অন্তরাত্মা হইয়া অবস্থান করিতেছেন। তিনি একই আত্মরূপকে বহু রূপ করিয়াছেন, সেই সর্বনিয়ন্তাকে (বশীকে) যিনি ধীর হইয়া নিজের মধ্যে অনুভব করেন, তিনিই শাশ্বত সুখ প্রাপ্ত হন, অন্যে নহে।

১৩। নিত্যোহনিত্যানাং চেতনশ্চেতনানা
একো বহুনাং যাে বিদধাতি কামান্।
তমাত্মস্থং যেহনুপশ্যতি ধীরা
স্তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষা৷ ৯৯।
সমস্ত অনিত্য পদার্থের মধ্যে যিনি অবিনাশী, যিনি সমস্ত চেতনার মধ্যে চেতনা সঞ্চার করেন, এক হইয়াও যিনি বহুর কামনা পূর্ণ করেন; নিজের (মস্তিষ্ক মধ্যস্থিত শিব পিণ্ড) মধ্যে আত্মস্থ হইয়া যিনি তাহাকে প্রত্যক্ষ করেন তাহারই শাশ্বত শান্তি লাভ হয়,
অন্যের নহে।

১৩। অঙ্গুষ্ঠ মাত্রঃ পুরুষাে জ্যোতিরেবাধূমকঃ ।
ঈশানাে ভূতভব্যস্য স এবাদ্য স উ শ্বঃ |
এতদ্বৈতৎ|| ৮৪||
অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষই জ্যোতির্ময় আত্মা, তাহাতে কোনই ধূম্র নাই অর্থাৎ অজ্ঞানতা নাই। তিনি অতীত এবং ভবিষ্যতের ঈশ্বর। তিনিই আজ এবং তিনিই কাল। ইহাই নচিকেতা জিজ্ঞাসিত আত্মতত্ত্ব।

১৩। যচ্ছেদ্বানসী প্রাজ্ঞস্ত যচ্ছে জ্ঞান আত্মনি।
জ্ঞানমাত্মনি মহতি তদ যচ্ছেচ্ছান্ত আত্মনি। ৬৭ ।
আকে
প্রাজ্ঞ ব্যক্তি (বিবেকশালী মনুষ্য) বা ইন্দ্রিয়কে মনে সংযম করিবেন। (বা যে মনে সংযমিত হইয়াছে) সেই সংযমিত মনকে আনাত্মাতে সংযম করিবেন।
মহৎতত্ত্বে সংযমিত করিবেন এবং মহত্তত্ত্বে সংযমিত আত্মাকে প্রশান্ত আত্মাতে সংযমিত করিবেন।

১৪। উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবােধত।
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গংপথস্তৎ কবয়াে বদন্তি। ৬৮ ॥

১৪। সতিঞ্চ বিনাশঞ্চ যস্তদ্বেদোভয় সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীক্বা সত্যা স মৃতমম্মুতে।
যে জানে “সতি” এবং “বিনাশের একত্র অনুষ্ঠান চলে, সে লােক বিনাশের অনুশীলন করিয়া মৃত্যুকে অতিক্রম করে এবং “সতির আশ্রয়ে অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন। উখিত হও। জাগ্রত হও। শ্রেষ্ঠ গুরুর নিকট বার বার জ্ঞান লাভে উৎসাহিত হও।
আত্মজ্ঞান বিকাশের এই পথকে আত্মজ্ঞান সম্পন্ন মহাত্মাগণ শাণিত ক্ষুরের উপর দিয়া বিচরণের মত দুর্গম বলিয়াছেন।

১৫। অশব্দম স্পর্শম রূপম ব্যয়য়ং
তথা রসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ।
অনাদ্যনমন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং
নিচায্য তং মৃত্যু মুথাৎ প্রমুচ্যতে। ৬৯।
তিনি অশব্দ, তিনি অস্পর্শ, তিনি অরূপ, তিনি অরস, তিনি অগন্ধ, তিনি নিত্য, তিনি আদি অন্তহীন, তিনি মহৎ তত্ত্ব হইতেও শ্রেষ্ঠ, তিনি ধ্রুব, তাহাকে (তপস্যা, সাধনা ও শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা) নিশ্চয়রূপে নির্ণয় করিয়া সাধক জন্ম মৃত্যু হইতে বিমুক্ত হন।

প্রতিবােধবিদিতং মতমমৃতত্ত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীৰ্যং বিদ্যয়া বিন্দতেমৃত। ৪
প্রতিটি বােধ আত্মাই করেন, এইভাবে জানাই মুক্তির সাধনা। এইরূপ জানাই (লৌকিক ঐশ্বর্য বিষয়ে) বীর্যকে জানা এবং এইরূপ জানাই অমৃতকে জানা।

যদি মনসে সুবেদেতি দমেবাপি।
নূনং ত্বং বেথ ব্রহ্মণাে রূপ।
যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষথ নু
মীমাংসমেব তে মনে বিদিত। ১
যদি মনে কর, ব্রহ্মের রূপ তুমি জানিয়াছ, তবে জানিবে উহা অল্পজ্ঞান। কারণ, ব্রহ্মের ভৌতিকরূপ (বিশ্বরূপ) এবং দৈবরূপ উভয়ই অল্প। কাজেই তােমার জ্ঞাত
ব্রহ্মরূপটি (যুক্তিতর্ক দ্বারা) মীমাংসা করা কর্তব্য।

২৪। নাবিরতাে দুশ্চরিতান্নাশান্তো না সমাহিতঃ।
নাশান্ত মানসাে বাপি প্রজ্ঞানে নৈব মাঞ্চুয়াৎ। ৫৩।
যে মনুষ্য দুশ্চরিত্র হইতে বিরত নহে, সংযতেন্দ্রিয় নহে, সমাহিত চিত্ত নহে এবং ভােগস্পৃহা রহিত নহে; সে মনুষ্য আত্মজ্ঞান লাভ করিতে সক্ষম নহে; পরন্তু যে মনুষ্য দুশ্চরিত্র হইতে বিরত, সংযতেন্দ্রিয়, সমাহিত চিত্ত এবং ভােগস্পৃহা রহিত সে মনুষ্য প্রজ্ঞানের (অর্থাৎ জ্ঞানের ক্রমবিকাশের পথে আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়।

নাহং মনে সুবেদেতি নাে ন বেদেতি বেদ চ।
যাে নস্তদুবেদ বেদ নাে ন বেদেতি বেদ চ। ২
আমি উত্তমরূপে ব্রহ্মকে জানি এইরূপ আমি মনে করি না। এবং আমি তাহাকে একেবারেই জানি না, ইহাও মনে করি না। আমাদের মধ্যে যিনি “জানি” এবং “জানি ” কথার ভাব বুঝিতে পারেন, তিনি ব্রহ্মকে জানিতে পারেন।

নায়মা প্রচলন লভ্যা
ন মেনা ন বহুনা তন
যমেনৈষ বৃণুতে তেন লভ্য-
স্তস্যৈব আত্মা বিবৃহূতে তনু স্বাম। ৫২।
কেবল প্রবচন (শাস্ত্রাধ্যায়ন ও শাস্ত্রব্যাখ্যা) দ্বারা এই আত্মাকে লাভ করা যায় না। কেবল মেধাদ্বারা বা বহু শাস্ত্রশ্রবণেও আত্মাকে লাভ করা যায় না। পরন্তু, যিনি আত্মাকে (জীবন লক্ষ্যে) বরণ করিয়া লন, তিনি (তপস্যার প্রভাবে) তাহাকে জানিতে সক্ষম হন। এইরূপ ব্যক্তির নিকটই আত্মতত্ত্ব উপদেশ দান করা যায়।

অঙ্গুষ্ঠ মাত্রঃ পুরুষাে মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি।
ঈশানাে ভূতভব্যস্য ন ততাে বিজুগুপ্সতে।
এতদ্বৈতৎ॥ ৮৩।
শরীরের মধ্যে অঙ্গুষ্ঠ পরিমিত স্থানে পুরুষ (আত্মা) বিদ্যমান আছেন। তিনি অতীতের ঈশ্বর, তিনি ভবিষ্যতেরও ঈশ্বর। তঁহাকে জানিতে পারিলে আর কিছুই অজ্ঞাত থাকে না। ইহাই নচিকেতার জিজ্ঞাসিত আত্মতত্ত্ব।

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

গীতার নির্দেশে

গীতার নির্দেশে ক্ষত্রিয়

ধর্মের আহবান

প্রোজ্জ্বল মণ্ডল

geeta.jpg

নিরুৎসাহ, ভেঙ্গে পড়া শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কাজ নয়। অর্জুন ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিপরীত দলে নিজের আপন জনদের দেখে ভেঙে পড়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে ভর্ৎসনা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন।
*কুতস্তং কস্মলমিদং বিসমে সমুপস্থিতম্।*
*অনার্য় জুষ্টমসর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুনঃ।।*
                                ---- গীতা
অর্থাৎ এই বিকট পরিস্থিতিতে মোহরুপী মলিনতা তোমার কোথা থেকে এলো? এটি অনার্য (শ্রেষ্ঠ নয়) এবং এটি স্বর্গকারি নয়; এটি মোটেও কীর্তিকর নয়।

     *ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ*
                      *নৈতত্বয়্যুপপদ্যতে।*
       *ক্ষুদ্রং হৃজয়দৌর্বল্যং*
                      *ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।*
অর্থাৎ, কাপুরষতা, কাপুরুষতাই। এটি করুণাবশত ও ভয় জনিতই হোক না – কেন। অতএব নিজের স্বত্ব ও অধিকারের রক্ষার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। অন্যায়ের প্রতিকার করা উচিত। এ ছাড়া পলায়ন নয়, পুরুষার্থ নির্বাচন করা উচিত।

          *এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা*
                   *সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।*
           *জহি শত্রুং মহাবাহো*
                  *কামরূপং দুরাসদম্।।৪৩।।*

অনুবাদঃ- হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।--এই মোহ মলিনতা ত্যাগ করে যুদ্ধ করো। যেখানে ধর্মের পরাভব হয়, অধর্মের উন্নতি হয়; সংস্কৃতির পরাভব হয়, অপসংস্কৃতি উন্নতি হয়; শ্রেষ্ঠ যোগ্য ব্যাক্তি পীড়িত হয়, আর অযোগ্য ব্যক্তি মজা করে; সেখানে যুদ্ধ করতে হয়। আজ আমরা যেমন তেমন ভাবেই ভারত দেশকে দেখছি তা আমাদের পূর্বপুরুষদের বলিদানের ফল। গুরু গোবিন্দ সিং, বীর শিবাজী, মহারানা প্রতাপ, এ ধরনের অসংখ্য বীর পুরুষদের বলিদান না হলে আমরা আজ যে রূপে নিজের দেশকে দেখছি এটাও দেখতে পেতাম না। তারমানে যোগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন রূপে আমাদেরকেই বললেন যে,--- ভয়, কাপুরুষতা, অকর্মণ্যতাকে ত্যাগ দিয়ে সংস্কৃতি ও ধর্মকে বাঁচাতে যদি প্রাণ দিতে হয় তবে দিয়ে দিন। কিন্তু মরার মত বেঁচে থেকে লাভ নেই। মৃত্যু কেবল শরীর থেকে আত্মার আলাদা হওয়ার নাম নয়। যদি আপনি নিজের সংস্কৃতি ও ধর্মের উপরে আঘাত হচ্ছে জেনেও চুপ থাকেন তাকেও মৃত্যু বলা হয়। পার্থক্য শুধু একটি যে, সেটি শরীরের মৃত্যু, আর এটি হবে

আত্মার মৃত্যু। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের অন্তরাত্মায় ওঠা প্রতিবাদকে যে দাবিয়ে দেয় তাকে “আত্মহত্যাকারী” বলা হয়। ------ 

     *ওম্ অসূর্য়া নাম তে লোকা*
                    *অন্ধেন তমসাবৃতা:।*
          *তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি*
                  *য়ে কে চাত্মহনো জনা:।।*   ---- (যজুর্বেদ ৪০)
অর্থাত্ এইরকম আত্মহত্যাকারীকে অসুর, রাক্ষস নাম বলা হয়েছে। যারা ঘোর অবিদ্যা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। যারা চোখের সামনে অন্যায় দেখেও পাশ কেটে যায়।তাদের আত্মহত্যাকারী বলা হয়। এবং তারা মৃত্যুর পরে মনুষ্য জন্ম পায় না, বরং প্রেত্যযোনিতে যায়।
একদিন না একদিন মরতে তো হবেই সবাইকে। যে এমনি মরে যায় তার জীবন ব্যর্থ। তাকে কেউ মনে রাখে না। কিন্তু কীর্তিমান পুরুষ বেঁচে থাকে লোকের হৃদয়ে।  

আমাদের এই ভাবনায় বসে থাকলে চলবে না যে, ঈশ্বর অবতার হয়ে আসবে আর আমাদেরকে বাঁচিয়ে দেবে। শ্রীকৃষ্ণ নিজে অবতার হয়ে যদি বাঁচাতে আসেন তবে তিনি অর্জুনকে তার জীবিত অবস্থায় কেন যুদ্ধের প্রেরণা দিয়েছিলেন। নিজেই শত্রুদেরকে সংহার কেন করলেন না? অবতারের ভাবনা করে বসে থেকে লাভ নেই। আমাদেরকে নিজের ব্যবস্থা ভাবতে হবে। এখানে কেউ বাঁচাতে আসবে না। যেমনটি গড়বেন তেমনটি ঘুরে আসে। কোন কিছুই ব্যর্থ যায়না। আম গাছ লাগালে আমের বাগানে জন্ম নেবেন। বাবলা গাছ লাগালে কাঁটার ওপরে জন্ম নেবেন। এই পরিবেশে জন্মানোর কারণ হল আমাদের কর্ম। আমরা কোথাও না কোথাও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছি। তার ফল আজ ভোগ করতে হচ্ছে। আমরা আজ যা গড়বো, তা আগে আমাদের ভোগ করতে হবে। ঈশ্বর ন্যায়কারি। তিনি যথাযথভাবে কর্মের ফল আমাদেরকে প্রাপ্ত করান। তাই আমাদেরকেই স্বর্গ বানাতে হবে, রাস্তার কাটা সরাতে হবে। এড়িয়ে গেলে চলবেনা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, অধর্মের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কারণ সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ধর্মের রক্ষার জন্য অধর্মকে এড়িয়ে গেলে অধর্ম আরো বেড়ে যাবে। তখন আপনার পরবর্তী প্রজন্ম তার কুফল ভোগ করবে। মৃত্যু প্রতিনিয়ত হচ্ছে। কে কাকে মনে রেখেছে? নিখোঁজের মতো আমরা মরে যাই। এই মৃত্যু কি কোন মৃত্যু হল?  মৃত্যু তো তাকে বলে যেমন বান্দা বৈরাগীর হয়েছিল। মৃত্যু তাকে বলে যেমন গুরু তেগবাহাদুরের হয়েছিল। আমরা নিজের ধর্মকে বাঁচাতে গিয়ে যদি মরি তবে আমরা অমর হয়ে যাব। আমার মৃত্যুকে দেখে হাজার হাজার প্রাণ আহুতি দিতে তৈরি হবে, নিজের দেশের জন্য, নিজের ধর্মের জন্য, ও নিজের সংস্কৃতির জন্য। মহর্ষি মনু বলেছেন--- ধর্মকে যে রক্ষা করে ধর্ম তার রক্ষা করে। ধর্মকে যে হত্যা করে ধর্ম তার হত্যা করে। তাই মূক পশুর মতো বোবা হয়ে থাকলে চলবে না। অন্যায় অধর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। গর্জে উঠুন। ঈশ্বর আপনার সঙ্গে আছেন।

হ্যাপি উইমেন্স ডে

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

হ্যাপি উইমেনস ডে/

শুভ নারী দিবস

দেবযানী দত্তপ্রামানিক

wedding_priests2.jpg

১. প্রত্যেক দিন  রাত ভরে যে মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে পড়ে, পরিবারের জন্য রান্না করে রাখে, নিজে স্নান করে, কোনমতে মুখে কিছু গুঁজে, অথবা শুধু জল খেয়ে ট্রেন ধরতে ছোটে, তার কাছে কোন বিশেষ দিন নেই। রোজ যা বিক্রি করতে পারে, তার থেকে সব খরচ বাঁচিয়ে যখন দুটো ঝিকমিকে দুল কিনতে পারে, অথবা, মেয়ের জন্য নিতে পারে ছোট একটি কেক, অথবা বৃদ্ধ মায়ের জন্য কিনতে পারে একটি টনিক, সেদিনই হয় তার কাছে বিশেষ দিন - শুভ নারী দিবস।

২. বাড়ির কাজের মাসির যেদিন বাড়ি ফেরার সময় দেরি হয়ে যায়, ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরবে কিভাবে চিন্তা করে, বউদিমনি কুড়িটা টাকা দিয়ে বলে, “অটো ধরে নে“, নয়ত দাদাবাবু বলে “চল স্টেশনে ছেড়ে দেই“ সেদিন তার কাছে একটি বিশেষ দিন। খুব খুশি হয় সে। আর বাড়ি ফিরে যদি দেখে তার অকর্মণ্য বরটা ভাত করে রেখেছে, সেদিনই হয় তার কাছে - শুভ নারী দিবস।

৩. রোজ সকাল থেকে রাত অবধি মলে সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি যখন ফেরার বাসে সিট পায়ে, তখনেই হয় একটি বিশেষ খুশির দিন। তার যে সব সময় পা টনটন করে। বাড়ি ফিরে যদি পায় তৈরি খাবার, বাড়ির সবার সাথে মিলে মিশে যখন মাটিতে পাত পেড়ে বসে খেতে পারে, তখন মনে হয় ওটি একটি বিশেষ দিন। সবার হাসি হাসি মুখগুলো দেখে মনে হয় সারাদিন দাঁড়ানো সার্থক। তার জন্য সেদিনেই হয়ে যায় –শুভ নারী দিবস।

৪. অসুস্থ বাবা-মা কে রেখে সারাদিনের রান্না-বান্না কোন রকমে সেরে যে মেয়েটি দৌড়য়ে কাজের জন্য। নিজের টিফিন কোন রকমে কেনা টুকটাক দিয়ে চালিয়ে নেয়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর যখন বাড়ি ফিরে দেখে, সবাই ভাল আছে, সুস্থ আছে, খুব শান্তি হয় তার। মায়ের কোল ঘেঁসে বসে সাধারণ দাল-ভাত ও অমৃত মনে হয় তার। তার মধ্য যদি আসে পাশের কেউ, অথবা কোন বিশেষ বন্ধু দিয়ে যায় একটু আলুভাজা, সেদিনই হয় তার জন্য – শুভ নারী দিবস।

৫. একা একা যারা থাকে, কোন ভাড়া বাড়িতে, অথবা কোন পিজিতে, সারাদিন পর যখন ঘরে ফেরে, তখন মায়ের একটি ফোন অথবা চিঠি, অথবা কারও হাতে পাঠানো মায়ের নিজে হাতে রান্না করা কিছু, নিয়ে যায় ওকে ওর নিজের বাড়িতে। একা থাকার সব দুঃখ ভুলে যায় ও। ওটাই হয়ে যায় তার কাছে একটি বিশেষ দিন। কখনও দরজার লক খোলার আগেই দরজা খুলে যায় আর হাসি মুখে সামনে দাড়িয়ে থাকে বাবা, ওহ তাহলে ত আর কথাই নেই, সেদিনেই তার জন্য শুভ নারী দিবস। বাড়ির গন্ধ নিয়ে আসেন যে বাবা।

৬. সারাজীবন নানা কারণে বিয়ে, সংসার না করা, রাগি দিদিমনি যখন স্কুলে পড়ান, সব ভুলে শয়ে শয়ে ছেলেমেয়েদের মা হয়ে যান। টিচার্স ডে তে দাওয়া কিছু ফুল, পেন অথবা কার্ড পেলে, সযত্নে গুছিয়ে রাখেন। এই বাচ্চাগুলো, তাদের স্মৃতি, আর তাদের ছোট ছোট ভালবাসার মুহূর্তগুলোই এনে দেয় ওনার জীবনে পূর্ণতা। ওনার জন্য বোধহয় প্রত্যেকটি এরকম ভালবাসায় ভরা দিনই বিশেষ দিন। শুভ নারী দিবস।

৭.  খুব কষ্টে সংসার চালানো একমাত্র রোজগেরে বাবা, পেরে ওঠেন না জীবনে কোন বিলাসিতা করতে। তাও দিনের শেষে ফেরার সময় একদিন একটি গোলাপ নিয়ে আসেন। ওনার লক্ষ্মীমন্ত স্ত্রীর জন্য সেদিনটাই ভালবাসার। খুবই বিশেষ। আর সেদিনটা যদি হয় তার জন্মদিন অথবা বিবাহবার্ষিকী? তাহলে সেটিই তার কাছে শুভ নারী দিবস।

৮. সারাদিন একা মহিলা যিনি সংসার চালান স্বামীর অবর্তমানে, ঘরে – বাইরে, ছেলে মেয়েদের সামলে নাজেহাল হয়ে যান। প্যারেন্ট – টিচার মিটিং এর দিন প্রশংসা শুনতে পান ছেলেমেয়ের।

একা মা হয়ে, সব দিক সামলে এত সুন্দর ভাবে ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য ও টিচার প্রশংসা করেন। খুব খুশি হয়ে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে বাড়ি ফেরেন উনি। ছেলেমেয়েদের জন্য একটু মিষ্টি নিয়ে ফেরেন। ঘরে ঢুকতেই বাচ্চারা বলে ওঠে “শুভ নারী দিবস মা“।

৯. হঠাৎ করে স্বামী মারা যাওয়াতে, সব কিছু কিরকম হয়ে যায়। শাশুড়ি ও বউমা দুজনেই কিরকম বিচ্ছিন্নভাবে একই নদীতে দুটি দ্বীপের মত থাকেন। কোনরকমে যন্ত্রের মত জীবন কাটায় ওরা। দেখতে দেখতে একদিন একবছর নারী দিবস আসে। শাশুড়ি মা বউমাকে ডাকেন। দুজনে মিলে ফুচকা খেতে যান। তারপর শাশুড়ি মা বউমাকে নিয়ে গিয়ে একটি পার্কে বসেন। বউমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেন উনি। ভেঙ্গে যায় সব বাঁধা। চোখের জলে দুজন দুজনকে বলেন “শুভ নারী দিবস “।
১০. স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবা ও মেয়ের ছোট সংসার। পাগলের মত মেয়েকে ভালবাসেন। মেয়েও বাবাকে। একদিন অফিস ফেরত এসে দেখেন মেয়ে রান্না করেছে বাবার জন্য। পোড়া ভাতে ডাল দাওয়া ও আলুসেদ্ধ। জল টল ছড়িয়ে ঘেমে নেয়ে একসা। মেয়েকে কোলে টেনে বাবা বলেন ‘শুভ মহিলা দিবস, তুই যে মা হয়ে গেলি।‘ সেইদিনটাই যে মেয়ের কাছে ভীষণ বিশেষ একটি দিন। তার জন্য শুভ নারী দিবস।

১১. বৃদ্ধা মা থাকেন একা বাড়িতে। ছেলে চাকরি করে সুদূর আমেরিকাতে। প্রত্যেক মাসের প্রথম রবিবার ছেলে ফোন করে। সেই মা যে বেঁচে থাকেন ওই দিন ওর গলা শোনার জন্যই । সেই দিনগুলো যে ওনার কাছে ভীষণভাবে বিশেষ। ওনার মা হওয়ার, মহিলা হওয়ার, অস্তিত্ব রক্ষার প্রমাণ। সেই দিনগুলোই যে ওনার কাছে শুভ নারী দিবস।

১২. বিয়ের পর বাবা-মা এমনকি দেশ থেকে দূরে চলে যেতে হয় অনেককেই। একাকীত্ব, মনখারাপ লেগেই থাকে। হঠাৎ একদিন বেল শুনে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে বাবা-মা। তার স্বামী চুপিচুপি সারপ্রাইস দেওয়ার জন্য কিছু জানায়নি। সেই দিনটা তার জীবনের খুবই আনন্দের দিন। তারিখ, মাস, সন যা হোক। তার কাছে ওটাই শুভ নারী দিবস।

১৩. খুব কমপ্লিকেসান এর পর মেয়ে হল ওর। শরীর–মন ক্লান্ত। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সে। একদিন স্বামী একজন মহিলাকে নিয়ে এলেন। বললেন ওর আর বাচ্চার দেখাশোনা করবেন ওই  মহিলা। অল্প বয়েস, তার ওপর নতুন মা, হাতে চাঁদ পেল ও। খুব খুশি হল। স্বামী একটি ফুল দিয়ে সুন্দর করে খোঁপায়ে লাগাতে বলল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু হলেও খুঁজে পেল ও। সেই দিনটাই হয়ে উঠল ওর কাছে – শুভ নারী দিবস ।

১৪. অত্যাচারী স্বামীর জন্য হিমশিম খাচ্ছিল ও। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাবা-মার “লোকে কি বলবে” র চটে ছেড়ে আসতে পারছিল না ও। তলে তলে চাকরি খুঁজতে থাকে ও। যেই চাকরিটা পাকা হয়ে,  স্বামীর ঘর ছাড়ে ও। একটি ভাড়া ঘরে উঠে ডিভোর্স ফাইল করে। বাবা- মার কাছেও যায় না। যেদিন মনের জোরে বেরিয়ে আসে ও, সেই দিনটা খুবই বিশেষ ওর কাছে। সেটাই আসলে – শুভ নারী দিবস।

১৫. রোজ কলেজ থেকে ফেরার সময় কিছু চাংড়া ছেলেদের টিটকিরি শুনতে পায় ও। কিন্তু স্পষ্ট করে দেখতে পায়না ওদের। একদিন ইচ্ছে করে একটু ঘুরে ঢোকে ওর গলিতে। পেছন দিক থেকে গিয়ে কলার ধরে একটির। স্কুলে শেখা কয়েকটা সেলফ ডিফেন্স কাট মারে। ছেলেগুলো ছিটকে পড়ে, পালায়। আসেপাশের বেশ কয়েকজন ও এগিয়ে আসে। খুব খুশি হয় ও। নিজেই নিজেকে বলে “শুভ নারী দিবস”।

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

রান্নাঘরে রাতে হানা

রান্নাঘরে

রাতের হানা বিকাশ প্রকাশ যোশী 

ভাষান্তরঃ সৈকত রুদ্র 

somiron.jpg

সংক্ষিপ্ত জীবনী

বিকাশ প্রকাশ জোশী একজন পুনে-ভিত্তিক লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক, পাবলিক স্পিকার এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি ১৭ বছর বয়স থেকে শিশুদের জন্য লিখতে শুরু করেন, ছোট গল্প এবং একটি বড় শহর-ভিত্তিক ইংরেজি পত্রিকায় একটি কলাম দিয়ে শুরু করেন, যা হাজার হাজার মানুষ পড়েন। তিনি ইংরেজিতে লেখেন এবং তার নন-ফিকশন প্রবন্ধ এবং ছোট গল্পগুলি বিদেশী এবং ভারতীয় উভয় ভাষায় ২৯টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তার প্রথম বই, ফর চিলড্রেন, মাই নেম ইজ সিনামন, পরের বছর সুপরিচিত প্রকাশনা সংস্থা হে হাউসে প্রকাশিত হবে৷ বইটি প্রায় ৩৫টি দেশের মানুষ এবং শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় লেখকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি দেশের অনেক নেতৃস্থানীয় ইংরেজি প্রকাশনায় উপস্থিত হয়েছেন এবং পাবলিক স্পিকিংয়ে 9টি পুরস্কার জিতেছেন। তার শখের মধ্যে রয়েছে রান্না করা এবং ভ্রমণ করা। তিনি বাংলাকে একটি সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত ভাষা বলে মনে করেন।

খোকা, আমরা কলকাতায় যাচ্ছি। তৈরি হয়ে নে,” মুচকি হেসে মা বললেন রোশনকে। 
রাতে খাওয়ার সময় মায়ের কথা শুনে দারুণ উত্তেজিত রোশন। সে সবসময় মুখিয়েই থাকে কবে যাওয়া হবে কলকাতায়। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে শীতের ছুটিতে পুনে থেকে কলকাতায় যায় পরাঞ্জপে পরিবার। কলকাতায় বেড়াতে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে থাকে রোশন পরাঞ্জপে। সেখানে আছে দাদু-দিদার আদর, মুখরোচক সব বাঙালি খাবার, আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা কলকাতা শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানো। 
দিনের বেলা বার্ষিক পরীক্ষা আর রাতে জিনিসপত্র গোছগাছ করা এইসব নিয়ে ব্যস্ততায় কাটলো পরের কয়েকটা দিন। সারা বাড়ি সাফসুতরো করে তালা দেওয়া হল। তারপর এক সুন্দর সন্ধ্যায় পুনে স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হল তারা। হাওড়া স্টেশনে নেমে সোজা ঢাকুরিয়া লেকের কাছে দাদু-দিদার বাড়ি। সেখানে মামাতো ভাই-বোন সৌরদীপ আর সুদক্ষিণাকেও পেয়ে মহাখুশি রোশন। 
সকালে রোশন দেখলো রান্নাঘরে কাজের মাসিকে নিয়ে নীলাঞ্জনা মাসি আর দিদিমা ভীষণ ব্যস্ত। তৈরি হচ্ছে রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম আর ল্যাংচার পাহাড়। রোশনের জিভে জল। মুখে দিলে গলে যায় এমন রসভরা রসগোল্লা, রেশমের মত নরম সন্দেশ, সোনালি বাদামি চমচম আর মিষ্টি দই। বুভুক্ষু হাতির মতো পরিবারের সবার জন্য তৈরি হচ্ছে এসব খাবার।
রোশন মনে মনে ফন্দি আঁটলো। সৌরদীপ আর সুদক্ষিণা সব সাবাড় করার আগেই কাজে নেমে পড়তে হবে। 

সেদিন বাবা, ওর দুই ভাইবোন, মেসোমশায় আর নীলাঞ্জনা মাসি সবাই মিলে সারা কলকাতা খুব বেড়ানো হল। সায়েন্স সিটি, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, চিড়িয়াখানা আর পার্ক স্ট্রিট। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। রোশন স্নান করে একটু জিরিয়ে নিলো। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে সে মনে মনে ঠিক করল রাতে বেশি খাওয়া চলবে না। 
খাওয়ার সময়ই রোশন তৈরি হল মনে মনে। জানিয়ে দিলো সে বেশি খাবে না। স্বাভাবিকভাবেই সবাই সহানুভূতি জানালো। 
“বেচারা সারাদিন রোদে-রোদে ঘুরেছে” মাসি বললেন, “একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নে তো।”  
মাথা নাড়লো রোশন। সবাই নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছে তার কথা। 
“মাথা ধরেছে?”
“না, মাথা ধরেনি...ইয়ে...মানে...হ্যাঁ, ধরেছে একটু। আমি অল্প করে খাবো।” কিছু খেলে কেউ আর সন্দেহ করবে না। 
সবাই চিন্তায় পড়ল। শুধু বাবা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। “বিকেলবেলায় তো কোনও সমস্যা ছিল না তোর। মোগলাই পরোটা, চিকেন চপ এমন করে খেলি যেন পুনেতে তোকে না খাইয়ে রাখি আমরা।” রোশন জানে তাকে একটু হলেও খেতে হবে যাতে বাবা-মা বেশি চিন্তা না করেন। 
টেবিলে বসে চটপট সামান্য ভাত আর ঘুগনি খেয়ে তাড়াতাড়ি বাংক বেডের ওপরে উঠে গেলো সে। কোল বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। এবার তাকে জেগে থাকতে হবে। সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো সে। ডাব্বায় ভরা মিষ্টিগুলোর কথা ভেবে জিভে জল এসে গেলো তার। যেভাবেই হোক জেগে থাকতে হবে তাকে। কান খাড়া করে রইলো সে। আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে গেলো বাড়ি। রাতের বাংলা সিরিয়ালের শব্দ, রাজনৈতিক আলোচনা সব থেমে গেলো একসময়। সবাই শুতে গেলো।  

এবার সময় হয়েছে। 
মনে সাহস সঞ্চয় করল রোশন। তার স্পষ্ট মনে আছে স্টেনলেস স্টিলের ডাব্বাটা রয়েছে ফ্রিজে। 
মনের মধ্যে রসগোল্লার ছবি ভেসে উঠতেই বাংকের ওপরে শুয়ে থাকা কঠিন হল। বিছানাটা আঁকড়ে

ধরে খুব সাবধানে নিচে নামলো সে। প্রথমে কিছুই চোখে পড়ল না। অন্ধকারের সঙ্গে চোখ যেন কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। এটা কি তার কল্পনা, না অন্ধকারটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গাঢ়? একটু অপেক্ষা করে সে ঠিক করল এবার কাজ শুরু করতে হবে। চোখ কচলালো রোশন। এখন কি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে? সৌরদীপের নাক-ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে বুঝলো যা-কিছু করার তা এখনই করতে হবে, নইলে আর সুযোগ মিলবে না। যেন অনন্ত অপেক্ষার পরে তার চোখে ভেসে উঠলো ঘরের জিনিসপত্রের ছায়া-ছায়া আকার। কোনটা কী বেশ বোঝা যাচ্ছে এবার। 
রোশন জানে রান্নাঘরটা কোথায় আর সেখানে কিভাবে যেতে হবে। হামাগুড়ি দিয়ে ইঞ্চি-ইঞ্চি করে ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকে পৌঁছে গেলো ফ্রিজের কাছে। তারপর ডাব্বার পর ডাব্বা খুলে মহানন্দে মিষ্টি সাবাড় করতে লাগলো সে। বিশেষ করে রসগোল্লা আর সন্দেশ। খেতে খেতে কতগুলো যে খাওয়া হল তার আর হিসেব রইল না। তবে একসময় পেট যেন ফেটে যাওয়ার জোগাড় হল। 
এবার ফিরতি যাত্রা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না চোখে। অন্ধকার যেন আরও কালো হয়ে গেছে। তবু যেতে তো হবেই। হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল সে। শোবার ঘরের দরজায় মাথায় লাগলো গুঁতো। কোনওরকমে কান্না চাপলো সে, ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তারপর আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাংকের ওপরে উঠে শুয়ে পড়লো রোশন। 
সকালে রোশনের ঘুম ভাঙল চেঁচামেচির আওয়াজে – ‘কী আছে?’ ‘কে করল?’ শোবার ঘর থেকে পা টিপে-টিপে বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল সে। তবে মা আর মাসি যখন কথা বলছেন তখন কান খাড়া করার দরকার নেই। 
মা বললেন, “এতগুলো রসগোল্লা খেয়ে ফেলেছে! মাগো!” নীলাঞ্জনা মাসি সন্দেহের চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কৌটোর ভেতরটা এমন করে দেখতে লাগলেন যেন অপরাধীকে সেখানেই পাওয়া যাবে। দিদিমাও একটার পর একটা কৌটো খুলতে লাগলেন। 
“সন্দেশ আর চমচমও!” দিদিমা চেঁচিয়ে উঠলো, “বলি, কে খেলো এতগুলো!” 
“নিশ্চয়ই সৌর। যা পেটুক!” বিরস গলায় মা বললেন।
নীলাঞ্জনা মাসি বিরক্ত চোখে তাকালেন, বললেন না কিছু। 
“আমি সত্যিই ঘুমোচ্ছিলাম,” সৌরদীপ জোর দিয়ে বলল। 
রোশন খুব খুশি। সে নিশ্চিন্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে সিংকের দিকে এগোল দাঁত মাজার জন্য। হঠাৎ মা হেসে উঠলো খিলখিল করে। 
“রোশন, এদিকে আয়,” মা ডাকলেন। রোশন মায়ের কাছে গেলো।
“নীলাঞ্জনাদি, আমাদের রোশনকে দ্যাখো একবার।” 
সবাই রোশনের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। রোশন অবাক হয়ে ভাবলো, সবাই কী দেখছে অমন করে?
“খোকা, বলছি কাল রাতে কতগুলো রসগোল্লা আর সন্দেশ খেয়েছিলি রে?” খুব মিষ্টি গলায় মাসি জিজ্ঞাসা করলেন। 
“একটাও খাইনি আমি... সুদক্ষিণা... সৌরদীপ... ওরা খেয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে হাসির ছররা ছুটলো। 
“আমি মনে হয় একটাও খাইনি,” খলখল করে হেসে বললেন দিদিমা। 
রোশনের ঘাড় ধরে টানতে টানতে মা তাকে বাথরুমে নিয়ে চললেন। চারপাশে তখন দমফাটা হাসি। 
“আয়নায় নিজের রূপখানা দ্যাখো, সোনা।” 
লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেলো রোশন। 
সারা জামায় লেগে আছে রসগোল্লা আর মালপোয়ার রস। জামাভর্তি সন্দেশ আর চমচমের কুচি। এমনকি মুখেও লেগে আছে এখনও। তাড়াহুড়ো করে বিছানায় ফেরার জন্য রোশন ভুলেই গিয়েছিল হাত-মুখ ধোয়ার কথা। “সারা মুখে মিষ্টি মাখা আমাকে যেন দেখাচ্ছে বোকা বাঁদরের মতো,” মনের দুঃখে ভাবলো রোশন। 
সকালের জলখাবারের পরে রোশনের পেট সাড়া দিতে লাগলো গত রাতের বাঙালি মিষ্টি খাওয়ার উৎসবের জেরে। বাথরুমে ছুটে গিয়ে অনেকক্ষণ কাটাতে হল সেখানে। 
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রোশনের মনে হল, মিষ্টি হলেও বেশি খাওয়া হয়তো ভালো নয়। তবে রসগোল্লাগুলো এত ভালো খেতে! না, রোশনের কোনও অনুতাপ নেই। 
  ভারতীয় শিশু হিসেবে মিষ্টি খাওয়া তার কাজের মধ্যে পড়ে। প্রত্যেক ভারতীয় শিশুর উচিত তার কাজ করা। 
  ঘটনার কথা জেনে বাবা রোশনের কাঁধ চাপড়ে তাকে লজ্জায় ফেলে বললেন, “ব্যাপারটার ভালো দিকটাও দ্যাখ, রোশন। এখন তুই বুঝতে পারছিস তো বেলুনে বেশি হাওয়া ভরলে কী হয়!”

অনুভূতি

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

অনুভূতি 

সঞ্জীব চক্রবর্তী

গড়িয়াহাট, কোলকাতা

river.jpg

ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াই খনিজ দ্রব্যের তত্ত্বতালাশে। গতকাল সকালে এসে পড়েছি চরিবুরু গ্রামের মাইল তিনেক দুরের পাহাড়ি অঞ্চল পরিদর্শনে। সাময়িক আস্তানা হয়েছে গ্রামের সীমানার বাইরে, জঙ্গলের ভিতর কোনো এক ক্ষীণতোয়া নদীর ধারে বিদ্যুৎ বিহীন পলস্তারা ঝরে পড়া বেশ পুরানো সরকারি বনবাংলোয়।
বনবাংলোর দক্ষিণে নদীর দিকে হরতকি কদম গাছের ছাড়া ছাড়া জঙ্গল। দু পাশে শাল সেগুনের ফাঁকে ফাঁকে ঘন পলাশ, কদম, বওড়া গাছের দল দৃষ্টি আটকে রেখেছে। সন্নিবদ্ধ গাছ গুলির নিচে ঘন হয়ে আছে এক ধরনের উঁচু ঘাস আর চীহড় লতার ঝোপঝাড়। বহু পুরনো গাছ গুলির ছড়ানো ডালা পালার চন্দ্রাতপের ঘেরাটোপে বাংলোর ঘাস হীন লাল মাটির আঙ্গিনা দিনের বেলাতেও ছায়াচ্ছন্ন। উপরে তাকালে উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে দূষণ মুক্ত আকাশের নীল ফালি। বাংলোর সামনে একটি গাড়ি চলতে পারা লাল মাটির রাস্তা ঢেকে রেখেছে দুপাশ থেকে নুয়ে পড়া কোমর সমান বুনো ঘাসের ঝোপ। বাংলোর বাইরে পনেরো, কুড়ি পা দুরে ঝাঁকড়া আম গাছ। তার নিচে টালি ছাওয়া রান্না ঘরের চারপাশে ঘন রাংচিতার জঙ্গল। একপাশে বনবাংলোর চৌকিদার মংলুর ঘর।
স্থানীয় মানুষরা বলে এই জঙ্গলে নাকি হুড়ার, বন শুয়োর চরে বেড়ায়। নদীর ধারের জঙ্গলে পুরনো পিপুল গাছের নিচে আদিবাসীদের অপদেবতা গদ্রবোঙ্গার থান। ছোট ছোট পুতুল রাখা সেই থানে। মনে হয় কোন বিশেষ দিনে গ্রামের মানুষেরা পুজো দিতে আসে এখানে। স্থানীয় লোককাহিনী বলে অপদেবতা কুপিত হলে, সন্ধ্যের পর বাচ্চাদের রূপ ধরে পথচারী মানুষকে জঙ্গলের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরিয়ে মারেন।
পাহাড়ি অঞ্চল পরিদর্শনে কেটে গেছে এই দু’দিন।
সন্ধ্যার পর সেদিন ফিরে এসেছি আমার অস্থায়ী আবাস এই বন বাংলোয়। দিনের আলোর ক্ষীণ রেশ কখন মিশে গেছে আকাশের ঘন অন্ধকারে। বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছি। ধীরে ধীরে নেমে আসা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে জঙ্গল। আজ বোধহয় অমাবস্যা। কানে আসে নিকটের নদীর মৃদু ছল্ ছল আওয়াজ। মাঝে মাঝে মাছের ঘাই মারার শব্দ। দুরে নদীর ওপারের কুয়াশার স্তরে ঢাকা নাম না জানা ছোট্ট গ্রামের কাঁপা কাঁপা বিন্দু বিন্দু আলোর মাদকতা। চেয়ারের পাশে রাখা লন্ঠনের আলোর চারিপাশে নানা রাতপোকার জমায়েত। রাতের মন্থর বাতাসে গাছের পাতা নড়ার ঝির ঝির, অশ্রান্ত ঝিঁঝির ঐকতান। আবেশে জড়িয়ে আসে চোখ। ঘন সন্নিবদ্ধ গাছের কালচে গুঁড়ি গুলোর গায়ে গায়ে কুয়াশার স্তর জড়িয়ে আছে। চরিবুরুর গ্রাম জঙ্গলে আঁধার নামে।
মংলু রাতে থাকে না। সে প্রথম দিনেই তার শর্ত শুনিয়েছিল, সন্ধ্যা নামার আগে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। মংলুকে ফিরতে হয় প্রায়  মাইল খানেক দুরের চরিবুরু গাঁয়ে। সেখানে তার এক সালের পুরনো জরু অপেক্ষায় থাকে। অন্ধকার নামার আগে তাকে সামনের গাড়ি চলার সরু রাস্তা পেরিয়ে ঘন শাল মহুয়ার জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া শুঁড়ি পথটা ধরে যেতে হয়। বলেছিলাম সন্ধ্যে নেমে গেলে সে আমার টর্চটা নিয়ে গাঁয়ে ফিরতে পারে। কেন জানিনা উত্তরটা সে এড়িয়ে গেছে। হয়ত কাছের অপদেবতা গদ্রবোঙ্গার থানই তার কারণ। 
আজ দ্বিতীয় রাত। এক সপ্তাহের জন্য এসেছি তারপর আবার পরের পরিদর্শনে চলে যেতে হবে। কোলকাতায় থাকতে পারিনা, নতুন নতুন কাজের বরাত নিয়ে ফিরে আসি এই অঞ্চলে।
চরৈবেতি চরৈবেতি--
জড়তা কাটিয়ে মংলুর খোঁজ করি, কোনো সাড়া শব্দ নেই। কখন উধাও হলো জানিনা, হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছি মনে করে আর ডাকে নি। মনে হয় পূর্ব শর্ত অনুযায়ী সন্ধ্যা নামার আগে গ্রামের পথে রওনা দিয়েছে। তার জরু অপেক্ষায় রয়েছে। জগতের কত মানুষ কত জনের প্রতীক্ষায় থাকে। পরিধি চিহ্নিত অগণ্য ভাসমান দ্বীপ উপদ্বীপ,তাদের নিজস্ব সার্বভৌমত্বে আবদ্ধ। তার বাইরের খবর কে কার রাখে!
রীনা হঠাৎ চলে গেল। পৃথিবী জঠরের জাগতিক খনিজ মণি রত্নের খোঁজে মগ্ন হয়ে মানবী হৃদয় অভ্যন্তরস্থ মণি রত্নের হদিস রাখিনি। প্রারম্ভিক যৌথ জীবনের সুরুতেই সে অসীম শূন্যতায় বিলীন হয়ে গেল  যাওয়ার আগে কি বলেছিল---?  
কোলকাতায় একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল রীনা। আমার সাথে প্রায় জোর করে চলে এসেছিল জনমনিষ্যি বিহীন বিহার ভূমির এক শুষ্ক পাহাড়িয়া অঞ্চলে। অস্থায়ী তাঁবু পড়েছিল পাহাড়তলি এক অনামা উচ্ছল নদীর ধারে। অতিশয় আনন্দে গুছিয়ে তুলেছিল তার অস্থায়ী তাঁবুর সংসার। সারা দিন পাহাড় জঙ্গলে কাটিয়ে তাঁবু তে ফিরে, লক্ষ কোটি তারায় মোড়া ঝকঝকে আকাশের নিচে, ডেক চেয়ারে বসে রীনার সারা দিনের জমে থাকা কথার ভিড়ে হারিয়ে যেতাম অজানা জগতে।
বুঝতে পারিনি রীনার শরীর মানিয়ে নিতে পারছিল না ওই অজ জায়গার আবহাওয়া। মুখ ফুটে কখনো প্রকাশ করেনি তার অসুবিধার কথা। এক গভীর রাতে আচমকা অস্বাভাবিক জ্বরে রীনা ঝিমিয়ে পড়েছিল বিছানায়। ওই দিন আমাকে নামিয়ে জিপটা কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি সারাইয়ের জন্য চলে গেছিল প্রায় ত্রিশ কিলো মিটার দুরের শহরে, ফেরার কথা পরের দিন দুপুরে। শহর থেকে বহু দুরে জঙ্গল পাহাড় ময় জায়গায় কিছু করতে পারিনি সেদিন। চোখের সামনে রীনার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। তারায় মোড়া আকাশের নিচে প্রবল জ্বরাচ্ছন্ন শরীরে, চলে যাওয়ার আগে জীবনের শেষ মুহূর্তে আমার অসহায় হাতে হাত রেখে অস্ফুট স্বরে বলেছিল “তোমার সাথে সাথে থাকব।” জ্বরাচ্ছন্নের বিকার?   
কাজের শেষে এখনো ওই চারটি শব্দ মাথায় মনে ঝিম ধরায়, আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারি নি। 
কি বলতে চেয়েছিল রীনা? 
বারান্দার লন্ঠনের আলো নিস্তেজ হয়ে আসছে, তেল ফুরচ্ছে বোধহয়। নদীর জল ছুঁয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে অলস শরীর আর নড়তে চাইছে না। অর্ধ নির্মিলিত চোখ ঘুরে আসে জঙ্গলের গাছ গুলোর ঝাঁকড়া মাথায় জমে থাকা অন্ধকারে, সেখানে জোনাকির দল বিন্দু বিন্দু আলোর আঁকিবুঁকি কাটে।

লন্ঠনের নিভন্ত লালচে আলোয় হাতঘড়িতে দেখি প্রায় রাত সাড়ে দশটা। না: এবার উঠতেই হয়, রাত অনেক হল, হিমে ভেজা ঠান্ডাটা বাড়ছে একটু একটু করে। কিছুক্ষণ পরে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে,বারেকের জন্যে চোখ চলে যায় জঙ্গলের দিকে।গাছেদের কালচে গুঁড়ি পাক দিয়ে জমে ওঠা

ধোঁয়াটে কুয়াশার স্তরে নদীর হালকা বাতাস ঢেউ ওঠায়। হঠাৎ মনে হল গাছের পাতার সিপ সিপ, ঝিঁঝিঁর ঐকতান যেন ক্রমশ কমের দিকে। ঝাঁক বাঁধা জোনাকিরা হঠাৎ আত্মগোপন করছে। লন্ঠনের নিভন্ত আলো দপদপিয়ে পুরোপুরি নিভে যাওয়ার সাথে সাথে আলোর চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া রাতপোকাদের গুনগুনানিও গেল বন্ধ হয়ে। আচমকা এদের আনন্দ যজ্ঞে ভাঁটা পড়ল কেন? অনেকটা সময় অবাক হয়ে চেয়ে থাকি নিশুতি নিঝুম রাতের অন্ধকারে মোড়া জঙ্গলের অপ্রাকৃতিক পরিবেশে। রাতের আকাশের আবছা আলোয় এখন শুধুই কুয়াশার ঢেউ ওঠা নামা আর জমাট নিস্তব্ধতা। ঝিমানো ভাব চলে গিয়ে বিস্মিত দৃষ্টি এখন আবদ্ধ হয় কুয়াশার ঢেউয়ের অস্বাভাবিক ওঠা নামায়। 
মংলু নিশ্চয়ই মোমবাতি রেখে গেছে ঘরে। টর্চ আছে পথ চলার সঙ্গী ঢাউস ব্যাগে,আমার চলমান সংসারের ভাঁড়ারে। 
অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়িটা দেখার চেষ্টা করে আন্দাজে মনে হল রাত প্রায় ১১টা। কখন এত রাত হয়ে গেল!  বুঝতেই পারিনি। সাবধানে পা ফেলে আন্দাজে ঘরে এসে সময় নিলাম অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে। দেখতে পাই ঘরের আধ খোলা জানালা দিয়ে রাতের নিজস্ব আবছা আলোর স্রোতে ভেসে এসেছে এক ঝলক ফিনফিনে স্তরীভুত কুয়াশা, অবাক হয়ে দেখি মেজে ও কড়ি কাঠের মাঝ উচ্চতায় ক্ষণে ক্ষণে সেই কুয়াশার আকৃতি গত পরিবর্তন। 
কোথা থেকে নাম না জানা বুনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে ঘরের ভেতর। আশ্চর্য হই! বাইরের ঝোপঝাড়ে কোনো ফুল তো দেখিনি! ঘর ভরে উঠেছে ফুলের ঝিম ধরানো মিষ্টি গন্ধের মাদকতায়। হঠাৎ অনুভব করি অনেক দুরের থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ স্বর – 
“ঘরের বাঁ’দিকের দেওয়াল আলমারিতে রাখা ব্যাগে টর্চ আছে।”
ঠিক শুনতে পাওয়া নয়, এ যেন চেতন অবচেতনের মাঝের অনুভূতি, যেন স্বপ্নে শোনা কথা। কিন্তু স্বপ্ন তো হতে পারে না! এইতো আমি ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি! ঘরের খোলা দরজার বাইরে গিয়ে চারপাশ দেখি, আধ খোলা জানলা দিয়ে উঁকি মারি। কেউ তো নেই! ভেতরে  পাক খাওয়া কুয়াশার স্তর এখন ক্ষণে ক্ষণে জমাট বেঁধে আবার ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের চারিপাশে - মাদকতাময় মিষ্টি গন্ধ মাখা কুয়াশা ঝিম ধরায়, যেন মাতাল হয়ে যাই। টর্চ জ্বালি, আলোর ফোয়ারায় ঘরের চারিদিকে ঝলমলানি।  লাগোয়া বাথরুমে উঁকি মারি, সেখানে বালতি ভরা জল রাখা কিন্তু কেউ তো নেই! কিছুক্ষণ আগে শোনা শব্দ গুলো এখনো মস্তিষ্কের কোষে কোষে পাক খায়। মনের ভুলই হবে, গা হাত পা ধুয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালাম। আশ্চর্য লাগে, ঘরের বাইরের বারান্দায় ফুলের মিষ্টি গন্ধটা তো নেই - কিছুক্ষণ পরে,সেই দূর থেকে  ভেসে আসা ক্ষীণ স্বর মস্তিষ্কের কোষে কোষে আবার অনুভূত হয়- 
“কি হলো? খাবে না? পাশের ঘরে টেবিলে খাবার ঢাকা আছে, মোমবাতিও রাখা আছে।” 
জ্বলন্ত সিগারেট খসে পড়ে। সারা শরীরে বয়ে যায় শিরশিরে আলোড়ন। স্খলিত পায়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি মংলু টেবিলে খাবার চাপা দিয়ে রেখেছে,দুটো মোমবাতিও টেবিলের উপরে রাখা। মোমবাতির নরম আলোয় বসে মনের ভেতর ভাবনা ঘুরপাক খায়। ওই কথা গুলির কোনো জাগতিক শব্দ তো পাই নি,কিন্তু কি ভাবে যেন কিছু শোনার অনুভূতি আমায় পরিচালিত করছে!
রাত প্রায় ১টা। বিছানার ধারে স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে বসে আছি। মোমের নরম আলোয়, ফুলের গন্ধে আমোদিত ঢেউ ওঠা ফিনফিনে কুয়াশাছন্ন ঘর। চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো! জাগ্রত অবস্থায় অবচেতন মন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি নাকি? আবার মস্তিষ্কের ভিতর কথা শোনার উপলব্ধির আলোড়ন- 
“শুয়ে পড়ো,কাল আবার সকাল সকাল বেরোতে হবে তো!”
আবার চমক লাগে, শব্দ নেই কিন্তু এই নির্দিষ্ট কথা গুলি তো খুবই চেনা, যেগুলো শোনার অনুভূতি এখনো আমাকে নাড়া দিচ্ছে! স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। এতো রীনার কথা! শোয়ার দেরি হলে রীনা তাড়া দিত এই ভাবে!
ছাদের কড়ি কাঠের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছি। ঘরে হাওয়া নেই, খাটের পাশের ছোট টেবিলে মোমবাতির শিখা স্থির,  ঘরের ভিতর  কুয়াশার স্তর,  নাম  না জানা ফুলের মিষ্টি গন্ধের সাথে মিশে নানা আকৃতি ধরে পাক খায় নিজের খেয়ালে ,  মস্তিষ্কে অনুচ্চারিত কথায় রীনার কাছে জিজ্ঞাসা আলোড়িত হয় – 
“তুমি বলেছিলে -  ‘তোমার সাথে সাথে থাকবে।”
রাত বেড়ে চলে - মন কারুর সান্নিধ্যের আভাসে আচ্ছন্ন, অদ্ভুত শান্তিতে সমাহিত জড় শরীর নড়াচড়ায় অপারগ। ঘরের ভিতরে কুয়াশার আকৃতি গত পরিবর্তন লক্ষ্য করি। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি কুয়াশা স্তর , কুন্ডলাকৃত আকার নিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোতের মত। মিষ্টি গন্ধটাও আবছা হতে হতে ক্রমশ যেন মিলিয়ে যায়, শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। কোথাও রাত জাগা পাখি ডেকে ওঠে।
শরীরের জড়তা কাটিয়ে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় আসি - রাত শেষ হতে দেরি নেই। কুয়াশা স্রোত ঘরের জানালার বাইরে ভাসতে ভাসতে গাছেদের চারপাশে জমাট বেঁধে স্থির হয়ে আছে, ঝিঁঝির মৃদু ঐকতান, নদীর হালকা বাতাসে গাছের পাতার সিপ্ সিপ্ শব্দ ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।  
গাছেদের ধারে ধারে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাওয়া কুয়াশার স্তর, বারান্দায় চেয়ারে বসে চেয়ে থাকি, মনে হল রীনার উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে রইলো দূর পূব আকাশে জ্বল জ্বল করা শুকতারা। জঙ্গলের একটা দুটো ঘুম ভাঙা পাখির ডাক ভেসে আসে। বড় বড় গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের নরম আলোর পরশ ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ কুয়াশার রেশ মিলেমিশে যায় ভোরের আলোয়। সাথে হারিয়ে গেল রীনার সান্নিধ্যের ছোঁয়া। 
রীনা তার কথা রেখে গেল..... 
“ সাব, চা ” – হুঁশ ফেরে কারুর কণ্ঠ স্বরে। ভোরের আলো পিছলে যাওয়া সবুজের থেকে দৃষ্টি ফেরে স্বরের উৎসে। অবাক চোখে, চায়ের কেটলি ও কাপ হাতে বান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছে মংলু। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে অপ্রস্তুত বোধ করি। চা’এর কাপ রাখতে বলে,তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে ফিরি। ঘরের ভেতর পা রাখার আগে আর একবার ফিরে তাকাই কাছের গাছ গুলোর দিকে, যেখানে রীনা ছিল কুয়াশার সাথে মিশে। বোধ হয় রেখে গেল তার “সাথে সাথে থাকার” অঙ্গীকার।

পিসিমণির পদবী

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

পিসিমণির

পদবী

তানিয়া  দত্ত ঘোষ

ladies.jpg

"ই কাজটা কিন্তু ছোড়দি ঠিক করল না" টেবিলে পড়ে থাকা বিয়ের কার্ডটা হাতে নিয়ে তিতাসের পিসিমণি কিছুক্ষণ পরেপরেই প্যানপ্যান করে চলেছেন যদিও কথাগুলো মৃদু স্বরে বলে চলেছেন, আপন মনে, তবু কথাগুলো তিতাসের কান এড়ালো না।
"তখন থেকে তুমি কি বলে চলেছ বলতো! ওই বিয়ের কার্ডে আছেটা কি?"
"আরে আর কইস না, ছোড়দির একখান মোটে নাতনী, তার কিনা বিয়া দিল নাপিত এর সঙ্গে!" পিসিমণির গলার স্বরে দুঃখ ঝরে পড়ে।
"কি বলছ আবোল তাবোল?" তিতাস এক ধমক লাগায় "নাপিত কোথায়? ঝুম্পার বর তো সাইন্টিস্ট গো। গবেষক বুঝলে, লেখাপড়ায় দুর্দান্ত।"
"বাঃ! তাই নাকি। তাইলে তো খুবই ভালো। আসলে পদবী দেইখ্যা মনে পইড়া গ্যালো, আমগো দ্যাশের বাড়িতে যে নাপিত আর তার বৌ আসত, আমাগো বাবা, দাদাগো চুল কাটতে, মা, জেঠিমা এগো আলতা পরাইতে, ওরাই এহন পেশারে পদবীতে পাল্টাইয়া ফ্যালছে। আর ছোড়দি নিজে কুলীন কায়স্থ হইয়া, এত দেইখ্যা শুইন্যা শেষে কিনা এর লগে বিয়া ঠিক করল!"
"আরে মহা মুশকিল তো! আবার এক কথা। তোমাকে কি বললাম একটু আগে? বললাম না যে ঝুম্পার বর গবেষক। এমন কি তার বাবা পর্যন্ত কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তা তার ও চার পুরুষ আগে যদি পরিবারে কেউ নাপিত থেকেও থাকে, তাতে কি হয়েছে? চোর, ছ্যাঁচোড়  তো নয়।"
"না তা নয়, ঠিকই।" মিনমিনে কন্ঠে সায় দেয় পিসিমণি।
"তাহলে? এবার বলো  দেখি ওই যে পাশের গলিতে যে ব্রাক্ষ্মণ পরিবার থাকে, ওই যে গো দুই ভাই। সেই বাড়ির দুই ছেলেই নেশা ভাঙ করে, পাড়ার রকে আড্ডা মেরে দিন কাটায়, তোমার ছোড়দির মেয়ের তার একজনের সঙ্গে বিয়ে দিলে বেশ হতো, কি বল? আর কিছু না হোক একেবারে কুলীন ব্রাক্ষ্মণ  বর হতো। তাই না?" তিতাস ঝামটে উঠে বলে।
"হইসে আর বকিস না, যা তো? তর কি আজ অফিস নাই নাকি?"
বেকায়দায় পরে ভাইঝি কে বিদায় করতে তৎপর হয়ে ওঠেন পিসিমণি। তিতাস এবার হেসে ফেলে, তারপর হাসতে হাসতেই বেরিয়ে যায়। ব্যপারটা কিন্তু এত সহজে পিসিমণির মাথা থেকে যাবে না, তিতাস জানে। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। দেশভাগের সময় কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে লড়াই করে উঠে দাঁড়ানো মহিলা তার এই পিসী। নানা ধরনের মানুষের সাথে অতি সহজে মিশে যায় যে মহিলা এমনকি যথাসাধ্য উপকারও করেন মানুষের, জাত পাত নির্বিশেষে, সেই তিনিই যে মনের কোন গোপন কুঠুরিতে তার নিজের এবং পরিবারের কুলীনত্বের অহংকারটুকু সযত্নে লালন করে চলেছেন, তা বাইরে থেকে বোঝা ভার। সময়, পরিস্থিতি বিশেষে বেরিয়ে আসে। যেমন আজ এল। অথচ মহিলা যে গোঁড়া, শুচিবায়ুগ্রস্ত, তাও না। বাড়ির ঠিকে কাজের লোক  আমিনাবিবি তার যথেষ্ট স্নেহের পাত্রী। মাঝে মাঝেই দেখা যায় পিসিমণি সোফায় বসে দেশের বাড়ির গল্প বলে চলেছে আর আমিনা খাবার টেবিলে বসে জলখাবার খেতে খেতে মন দিয়ে শুনছে। একদিন তিতাস ইচ্ছে করে খোঁচানোর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো " কি ব্যপার? তোমাদের তো নাকি দেশ ছাড়তে হয়েছিল  মুসলমানদের জন্য, তা অমিনার সাথে এত খাতির কিসের তোমার? আশ্চর্য্য!"
"ওমা, তাইতে আমিনা কি করব? ও কি তখন জন্মাইসিল নাকি? কি যে আবোল তাবোল কথা কস না।" ..... 
অকাট্য যুক্তি। শুধু ওই একই যুক্তি ছোড়দির জামাইয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু খাটলো না। তিতাসের মনে হলো হয়তো বা আমিনাদের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে একই কথা বলতো পিসিমণি। যাক গে, আপাতত ভালোয় ভালোয় বিয়েবাড়ি মিটুক। 
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে পড়লো। 
" সাবধান পিসিমণি, কাল কিন্তু বিয়ে বাড়িতে ভুলেও ওসব নাপিত টাপিত নিয়ে কথা বলবে না। মনে থাকবে?" তিতাস সাবধান করার চেষ্টা করে পিসীকে।
"হইসে তর আর লেকচার দেওন লাগবো না। তিনকাল গিয়া আমার এক কালে ঠেকসে, এহন আমারে উনি শিখাইবেন, কি কমু আর কি কমু না। হুঁ।"
তিতাস মেজাজ দেখে চুপ করে যায়। পিসিমণি একটু ফিক করে হাসেন, বলেন, " ঠিকাসে ঠিকাসে, কমু না কিছু। হইসে? এখন চল"।
বাবা, মা দিল্লীতে, আর তিতাসের কলেজ, চাকরী সবই কোলকাতায়, তাই পিসীর সঙ্গে থাকা। একসময়  সরকারী চাকরী করতেন পিসিমণি, বছর দশেক হলো অবসর নিয়েছেন, বিয়ে করেন নি। তিতাস একটু চিন্তায় ছিল, যে নতুন জামাইকে আবার পিসী কিছু জিজ্ঞেস করে না বসে, যে "তোমার বাবার কথা তো শুনছি, বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। তা তোমার ঠাকুর্দা কি করতেন?" কিন্তু আশ্চর্য্য হয়ে দেখলো তিতাস, যে জামাইয়ের সঙ্গে পিসীর দিব্য ভাব জমে গেল। আর শুধু তাই নয় মহিলা শিং ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়ে গিয়ে বাসরঘরে হাত পা নেড়ে "সোহাগ

চাঁদ বদনী" গেয়েও ফেললো। যাক একটু নিশ্চিন্ত হলো তিতাস। বিয়ে বাড়ি থেকে ফেরার পথে ট্যাক্সিতেও তিতাস দেখে পিসিমণি গুনগুন করে "সোহাগ চাঁদবদনী" গেয়ে চলেছে।
"ভালোই তো কাটালে? জামাইয়ের সঙ্গে তো দারুণ ভাব হয়ে গেল তোমার দেখলাম। আমাকে তো আর পাত্তাই দিচ্ছিলে না।" তিতাস ছদ্ম রাগ দেখায়।
"হ্যাঁ। বড় ভালো ছেলেটা। কত লেখাপড়া, অথচ অমায়িক।

"বিয়েবাড়ির রেশ রয়েছে এখনো, পিসিমণি কোলকাতার ভাষায় কথা বলে চলেছেন।

"শুধু যদি একটু ঘোষ, বোস, গুহ, মিত্র হইত, তয় আরও ভালো হইত, বুঝলি না?"
"পিসিমণি!! আবার!"
বাড়ি এসে গেছে, পিসিমণি গটগটিয়ে নেমে পড়েন ট্যাক্সি থেকে, পেছন ফিরে আর তাকান না। 

এরপর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। পিসিমণির ভয়ে ছোড়দিপিসীর মেয়ে জামাইকে নেমন্তন্ন করতে সাহস পাচ্ছে না তিতাস। কে জানে কি বলতে কি বলে বসবে জামাইয়ের সামনে। 

রমজানের মাস চলছে। আমিনাবিবি রোজা পালন করেও কাজে আসছে। খাবার টেবিলে খাবার নিয়ে না বসলেও গল্পের আসর রোজই বসছে।

একদিন হঠাৎ শোনে পিসিমণি বিয়েবাড়ির গল্প করছে আমিনার কাছে। "ছেলের পরিবার জানিস তো এক সময় নাপিত ছিল। আজ সেইখান থিকা কোথায় উইঠ্যা আসছে। এক্কেরে হীরার টুকরা জামাই। মানুষ চাইলে কোথা থিকা কোথায় উঠতে পারে। ল্যাখাপড়ার কোন বিকল্প নাই, বুঝলি রে।" আমিনাও মাথা নাড়ে।
তিতাসের মনে ক্ষীণ আশা জাগে যে পিসীর নিশ্চয়ই করে মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে, পদবীর চাইতেও শিক্ষার প্রভাবকে বেশী মূল্য দিচ্ছে যখন। 
"হ্যাঁ গো আমিনা, এই এক মাস ধরে এই গরমে জল পর্যন্ত খাবে না, শেষে শরীর খারাপ না করে। কি যে এত ধর্মের মানামানি তোমাদের বুঝি না" তিতলির এই কথায় আমিনা হেসে বলে, "ঝে কদিন পারবো মানবো। কাঝে বাইরতি হয় তো, এতো পারা যায় না।"
"জানি না বাবা এত পুণ্য করে কি হয় তোমাদের শরীরকে এতো কষ্ট যে কি করে দাও" গজগজ করে তিতাস।
"তুই পূজার কি বোঝস রে" পিসিমণি ধমকে ওঠেন। "ধমকিও না পিসিমণি। আহা তোমার নিজের পুজোর যেন কতো ঘটা! ওই তো একটা ঠাকুরের বরাদ্দ তাক, তাতে জল বাতাসা দাও আর ঘন্টা টা রোজ খানিক টিং টং করো, তাও ঘন্টার আওয়াজটা মিষ্টি বলে। ব্যস শেষ"। 
"তুই তো তাও করস না। যা ভাগ ম্লেচ্ছ কোথাকার। আমারে পেপারটা পড়তে দে একটু"। বলে হাতে খবরের কাগজটা তুলে নেন। খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়া পিসিমণির প্রিয় নেশা।
তিতাস স্নানঘর থেকে বেরিয়েই ঘন্টা বাজার আওয়াজ পায়। তার মানে পূজা চলছে। দু মিনিটে শেষ হয়ে যাবে তারপর খেতে বসা। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখে ঘন্টা হাতে আমিনা এসে পিসিমণিকে বলছে "ও পিসীমা। বাতাসা তো নাই কৌটায়। তোমার ঠাকুররে কি দেব?"
সোফায় শুয়ে পিসীমণি খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললো" রান্নাঘরে চিনি আছ, আপাতত তাই দে আজ"। আমিনা অম্লান বদনে পূজার ডিউটি শেষ করতে চললো।
"যাব্বাবা! পিসিমণি, এটা কি হলো? তুমি একটু আগে না আমায় ম্লেচ্ছ বললে? তুমি শেষে আমিনাকে দিয়ে পুজো দেওয়াচ্ছো!!" মুখে পিসীকে চাপের মুখে ফেললেও বাস্তবে তিতাসের দারুণ মজা লাগে। সে নিজে তো আসলে এটাই চায়। ধর্মবোধ থাকুক যার যার মনে, জাত পাতের ভেদাভেদ দূর হোক।
"তো? ভগবানের খাবার পাওয়া নিয়া কথা। যে দিতাসে সে মন থিকা দিতাসে কিনা খাইতে, সেইটাই আসল। আমিনার ঈশ্বর ভক্তি তোর থিকা বেশি। দ্যাখসনা কেমন কষ্ট কইরা রোজা রাখে।" 
লজ্জা লজ্জা মুখ করে আমিনা বেরিয়ে আসে ঠাকুরকে  জল চিনি দিয়ে। তিতাস মজা করে বলে, "আমিনা, তোমার তো ডাবল পুণ্যি। রোজা আর পূজা একসাথে।"
যাক, তিতাস নিশ্চিন্ত হয়, এতদিনে পিসিমণি সত্যিই জাত বিচারের ঊর্ধ্বে উঠলো। ছোড়দিপিসী আর তার মেয়ে জামাইকে এবার একদিন নিমন্ত্রণ করতে হবে, খাওয়াতেই হবে। 
সেদিনই সন্ধ্যায় অনেকদিন পর হঠাৎ করে লোডশেডিং হলো। তিতাস নিজের ঘরে বসেই টের পায় আস পাশের বাড়ির কাকিমা জেঠিমারা সব যে যার বারান্দায়। বারান্দা বারান্দায় জমিয়ে আড্ডা চলছে। তারই মধ্যে কানে আসে পিসিমণির গলা, "সে কি! এই বিয়াটাতে রাজী হইয়া মধুবাবু ঠিক করলো  না মোটেই" তিতাস কান খাড়া করে। "বোস বাড়ির মাইয়া হইয়া বিয়া করলো শেষে কিনা...!!" এই শেষ দিকে এসে গলাটা খাদে নামিয়ে ফেলেন পিসিমণি, বোধহয় মনে পড়ে যায় তিতাস আজ বাড়িতে।
নাস্তিক তিতাসের গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে, "হায় ভগবান!!! আবারও!!"

প্রবন্ধ

শ্রীকৃষ্ণবিজয়

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মালাধর বসুর

শ্রীকৃষ্ণবিজয়

দিলীপ মজুমদার

পর্নশ্রী, কলকাতা

geetgobinda.jfif

সুরদের অত্যাচারের প্রতিকার প্রার্থনায় দেবী সরস্বতী এলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে। সরস্বতীর বিবরণ শুনে ব্রহ্মা স্তব শুরু করলেন চক্রপাণি নারায়ণের। নারায়ণ তাঁকে অভয় দিয়ে জানালেন যে, কংসের ভগিনী বসুদেবের পত্নী দৈবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন নারায়ণ। তিনিই বিনাশ করবেন কংসকে।
যথাসময়ে বিবাহ হল বসুদেবের। কংসের ভগিনী দৈবকীর সঙ্গে। একদিন বয়স্যদের সঙ্গে ভ্রমণকালে কংস চমকে উঠলেন এক দৈববাণী শুনে। দৈবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান হবেন কংসের মৃত্যুর কারণ। দৈববাণী শুনে কংস আতঙ্কিত। তিনি বসুদেবকে ডেকে বলে দিলেন দৈবকীর গর্ভজাত সমস্ত সন্তানকে তুলে দিতে হবে কংসের হাতে। বাধ্য হয়ে সম্মত হতে হল বসুদেবকে।
একে একে ছয়টি সন্তান হল দৈবকীর। তাদের তুলে দেওয়া হল কংসের হাতে। কংস কিন্তু তাদের হত্যা করেন নি। হত্যা করলেন দেবর্ষি নারদের প্ররোচনায়। বসুদেব ও দৈবকীকে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে। নিযুক্ত করা হল সতর্ক প্রহরা। রোহিনী  ছিলেন বসুদেবের আর এক পত্নী। দৈবকীর সপ্তম গর্ভের সময় ভগবাতী কৌশলে সেই গর্ভকে রোহিনীর উদরে প্রবিষ্ট করালেন। সেই গর্ভ থেকে জন্ম হল বলভদ্র বা বলরামের। দৈবকীর অষ্টম গর্ভের সময় চঞ্চল হয়ে উঠলেন কংস। দৈববাণীতে বলা হয়েছিল এই অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসের প্রাণঘাতী হবে। তাই কারাগারে পাহারা আরও কড়াকড়ি ব্যবস্থা করা হল। সেখানকার খবর নিয়মিত রাখতে লাগলেন কংস।
কিন্তু দৈবমায়ায় কংসের সব সতর্কতা ব্যর্থ হল।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। রাত্রির প্রথম প্রহরে প্রহরীরা অভিভূত হল নিদ্রায়। দ্বিতীয় প্রহরে আকাশে উদিত হল চন্দ্র। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মগ্রহণ করলেন নন্দপুরচন্দ্র কৃষ্ণ। অপূর্ব তাঁর রূপশ্রী। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। দক্ষিণে লক্ষ্মী, বামে সরস্বতী। কৃষ্ণ দৈবকীকে বললেন, ‘ত্রেতাযুগে তোমরা  স্বামী-স্ত্রী নিরাহারে তপস্যা করেছিলে দ্বাদশ বৎসর। তাই আমি তোমাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছি। ’
কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। তাঁকে প্রণাম করলেন দৈবকী। দৈবমায়ায় বন্ধনমুক্ত হলেন বসুদেব। তারপর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন গোকুলের দিকে। শৃগালের ছদ্মবেশে মহামায়া তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন বাসুকী।
এদিকে নন্দালয়ে যশোদা প্রসব করেছেন এক কন্যাসন্তানের। আপন পুত্রকে নিদ্রিতা যশোদার কোলের কাছে রেখে যশোদার কন্যাকে কোলে নিয়ে বসুদেব ফিরে এলেন মধুপুরের কারাগারে। কেউ কিছু জানতে পারল না। বসুদেব দৈবকীর কোলে তুলে দিলেন সেই কন্যাসন্তানকে।  দৈবমায়ার ঘোর কেটে যাবার পর জাগ্রত হল প্রহরীরা। তারা জানল দৈবকীর গর্ভে জন্ম হয়েছে এক কন্যাসন্তানের। খবর গেল কংসের কাছে। কারাগারে তৎক্ষণাৎ হাজির কংস। নবজাত কন্যাসন্তানকে তিনি শিলাপট্টের উপর আছড়ে ফেললেন। তখনই হল এক দৈববাণী: তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
প্রথমে একটু অবাক হলেন কংস। এ কি কথা! তাহলে কি তাঁর প্রাণহন্তা আছে গোকুলে? তিনি আদেশ দিলেন গোকুলের সব নবজাত শিশুকে হত্যা করার। সন্ধান পাওয়া গেল নন্দ-যশোদার ঘরে জন্মেছে এক শিশুপুত্র। বিষস্তন পান করিয়ে তাকে হত্যার জন্য পাঠানো হল পুতনা রাক্ষসীকে। কিন্তু পুতনা নিজেই নিহত হল। এ ভাবেই নিহত হল তৃণাবর্ত অসুর। শিশুর এই পরাক্রম দেখে গোকুলবাসী তাঁকে অবতার বলে মনে করল। যশোদাও কৃষ্ণের মুখবিবরের মধ্যে দেখতে পেলেন ব্রহ্মাণ্ডকে। সন্দেহ রইল না আর।
শিশু কৃষ্ণ কিশোর হতে লাগলেন। তাঁর অলৌকিক শক্তি দেখতে লাগল গোকুলবাসী। শাপগ্রস্ত যমল অর্জুনকে মুক্ত করলেন তিনি। বৃক্ষ উৎপাটিত করে উদ্ধার করলেন বৃক্ষরূপী নল-কুবেরকে।  ব্রহ্মা তাঁর গোবৎস হরণ করেছিলেন। কৃষ্ণ সেই গোবৎসকে সৃজন করেন অলৌকিক মায়ায়। কালীদহের জল বিষাক্ত করছিল কালীনাগ। কালীদহে নেমে কৃষ্ণ হত্যা করলেন কালীনাগকে। এতে শাপমুক্ত হন কালীনাগ। তিনি কৃষ্ণের পদচিহ্ন মস্তকে ধারণ করে গমন করেন রমনক দ্বীপে। জ্যৈষ্ঠমাসে বনে দাবানল জ্বলে উঠলে কৃষ্ণ তা নির্বাপিত করেন। গোবর্ধন পর্বতকে উপেক্ষা করে ইন্দ্রপূজা অনুচিত বলে কৃষ্ণ বিধান দিলে ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হন। তাঁর নির্দেশে গোকুলে প্রবল বারিপাত শুরু হয়। কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে ছত্ররূপে ধারণ করে রক্ষা করেন গোকুলকে। যমুনার জলে স্নানরত নন্দ ঘোষকে বরুণের দূত পাতালে বন্দি করলে তাঁকে উদ্ধার করে আনেন কৃষ্ণ। বৃন্দাবনে কাত্যায়নী ব্রত উদযাপনের সময় মহাসর্পরূপী এক অভিশপ্ত গন্ধর্ব উপস্থিত হলে কৃষ্ণের পদাঘাতে তার শাপমুক্তি ঘটে।
কৃষ্ণের এই সব অলৌকিক শক্তির সংবাদ পাচ্ছিলেন কংস। আতঙ্কিত হচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন কি ভাবে তাকে হত্যা করা যায়। সে জন্য বিভিন্ন অসুরকে তিনি প্রেরণ করেন গোকুলে। করুণ পরিণাম বরণ করতে হয় তাদের। বকরূপী বকাসুরের ঠোঁট চিরে কৃষ্ণ তাকে দ্বিখণ্ডিত করেন। গলাধঃকরণ করে বকাসুর কৃষ্ণকে হত্যা করতে চান। কৃষ্ণ তখন তার উদরে প্রবেশ করে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে নির্গত হন। ফলে মৃত্যু হয় বকাসুরের। অশ্বরূপধারী কেশী দৈত্য ও ব্যোমাসুর্কেও হত্যা করেন তিনি।
গোকুলবাসী কৃষ্ণের বীরত্বের লীলা যেমন দেখছিল, তেমনি দেখছিল গোপবালিকাদের সঙ্গে তাঁর লীলাও। একদিন গোপবালিকারা যমুনায় স্নান করতে এলে কৃষ্ণ তাঁদের বস্ত্র হরণ করেন । শরৎ পূর্ণিমায় এঁদেরই সঙ্গে বৃন্দাবনে রাসলীলা করেন তিনি।
একদিন অক্রূর এলেন বৃন্দাবনে।
কংসের বার্তাবহ হবে এসেছেন তিনি। কংস আয়োজন করেছেন ধনুর্যজ্ঞের। কৃষ্ণ-বলরামকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। মথুরায় কংসের রাজসভায় যাবার সুযোগ পেয়ে কৃষ্ণ আনন্দিত হলেন। অক্রূরেরও সুযোগ হল কৃষ্ণের নারায়ণরূপ দর্শনের। মথুরায় যাবার পথে কৃষ্ণ যখন স্নান করছিলেন যমুনায়, তখন অক্রূর তাঁর নারায়ণরূপ দর্শন করেন।
মথুরায় এলেন কৃষ্ণ-বলরাম। উঠলেন অক্রূরের আলয়ে। পরদিন প্রভাতে তাঁরা কংসের রাজসভার দিকে অগ্রসরমান হলেন। পথে দেখা হল মালাকরের সঙ্গে। তিনি কৃষ্ণকে পুষ্পমাল্য দান করলেন। সুগন্ধি চন্দন দান করলেন ত্রিবঙ্কা। তাঁদের দুজনকে আশীর্বাদ করলেন কৃষ্ণ।
খবর ছড়িয়ে পড়ল। কৃষ্ণ এসেছেন রাজসভায়। রাজসভায় পদার্পণ করে কৃষ্ণ চললেন কংসের  ধর্নুময় যজ্ঞশালা দেখতে। কংস ভীত হয়ে যজ্ঞশালার প্রবেশপথে স্থাপন করলেন কুবলয় হস্তি। কিন্তু কৃষ্ণ অনায়াসে বধ করলেন তাকে। অতঃপর মল্লযুদ্ধের আসরে গেলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ও বলরামের হাতে নিহত হল চানূর ও মুষ্টিক। এবার কৃষ্ণ দ্রুতপদে অগ্রসর হলেন কংসের দিকে। মঞ্চ থেকে ভূপাতিত করে কংসকে হত্যা করলেন। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে এসে সংকল্যকেও নিহত হতে হল। অত্যাচারী কংসের মৃত্যুতে আনন্দের স্রোতে ভাসল মথুরা। কৃষ্ণ মথুরার রাজ্যভার অর্পণ করলেন উগ্রসেনকে।
অবন্তীপুরীতে সান্তিপণি নামে এক দ্বিজ ছিলেন। তাঁর কাছে কৃষ্ণ চৌষট্টি বিদ্যা শিক্ষা করেন । কৃষ্ণ তাঁকে গুরু দক্ষিণা দিতে চাইলে সান্তিপণি সমুদ্রে নিমজ্জিত পুত্রের প্রাণভিক্ষা প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণ তখন শঙ্খরূপী পাঞ্চজন্যকে সঙ্গে নিয়ে যমপুরীতে গমন করেন এবং যমরাজকে সন্তুষ্ট করে গুরুর পুত্রকে উদ্ধার করে আনেন।

মগধের সম্রাট জরাসন্ধ ছিলেন কংসপত্নীর পিতা। কংসনিধনের পরে তাঁর বিধবা পত্নী স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পিতার কাছে আবেদন করেন। জরাসন্ধ সে আবেদনে সাড়া দেন। তিনি কৃষ্ণ-বলরামকে মৃত্যুদণ্ড দানের সিদ্ধান্ত করেন। কৃষ্ণের বিপদের দিনে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন দেবতারা। তাঁরা কৃষ্ণকে দান করেন শঙ্খ, চক্র, গদা; বলরামকে দান করেন লাঙ্গল ও মূষল। এছাড়া তাঁরা গরুড়ধ্বজ নামক এক যুদ্ধরথও দান করেন কৃষ্ণ-বলরামকে। অতঃপর জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল কৃষ্ণ-বলরামের। কৃষ্ণ-বলরামের পরাক্রমে অচিরে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল জরাসন্ধের বাহিনী। পালাতে গিয়ে ধরা পড়লেন জরাসন্ধ। বলরাম তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে দৈববাণী হল: জরাসন্ধ অবধ্য। ছাড়া পেয়ে জরাসন্ধ সৈন্য-সামন্ত সংগ্রহ করে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। আবারও পরাজিত হলেন। প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে লাগল জরাসন্ধের মনে। তিনি এক বিশাল বাহিনী দিয়ে শাল্বরাজকে মথুরায় পাঠালেন কৃষ্ণ-বলরামকে বধ করার জন্য। এ রকম আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কৃষ্ণ। তাই তাঁরা আত্মগোপন করলেন সমুদ্রগর্ভে। তাঁদের বসবাসের জন্য সমুদ্র তাঁদের দ্বাদশ যোজন ভূমি দান করলেন। সেই ভূমিতে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা নির্মাণ করে দিলেন এক সুরম্য প্রাসাদ। জরাসন্ধের সৈন্যরা মথুরা নগরী লণ্ডভণ্ড করতে লাগল। তারা পর্বতের পাদেশের অরণ্যে অগ্নিসংযোগ করল। ফলে ঋষিরা বিপন্ন হলেন। তাঁরা স্মরণ করলেন কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ বিশ্বম্ভর রূপ ধারণপূর্বক পর্বতকে সমুদ্রজলে নিমজ্জিত করে অগ্নি নির্বাপিত করলেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জরাসন্ধের প্রতিনিধি কালযবন পলায়ন করেন। কৃষ্ণ একটি ঘটে একটি কালসর্প স্থাপন করে দূত মারফৎ তা প্রেরণ করেন কালযবনের কাছে। চতুর কালযবন সেই ঘটে প্রচুর পিপীলিকা পূর্ণ করে আবার কৃষ্ণের কাছে প্রেরণ করেন। কৃষ্ণ ঘট খুলে দেখেন পিপীলিকাগুলি ভক্ষণ করেছে কালসর্পকে, অবশিষ্ট আছে কালসর্পের অস্থি। কৃষ্ণ বুঝলেন কালযবন যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হতে চান না।তাই যুদ্ধ বাধল আবার। কালযবনকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ তখন এক কৌশল অবলম্বন করলেন । পলায়নের ছলনা করে যে গুহায় মান্ধাতার পুত্র মুচুকুন্দ নিদ্রিত ছিলেন, সেখানে প্রবেশ করে মুচুকুন্দের মাথার দিকে লুকিয়ে রইলেন। কালযবন গুহায় প্রবেশ করে মুচুকুন্দকে কৃষ্ণ ভেবে পদাঘাত করলেন। জাগ্রত হয়ে মুচুকুন্দ কালযবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সে ভস্মীভূত হল। তারপরে মুচুকুন্দকে বরদান করে বদরিকাশ্রমে পাঠালেন কৃষ্ণ। তিনি কালযবনের সমস্ত সম্পদ নিয়েএলেন দ্বারকায়। যুদ্ধ শেষ হবার পরে দ্বারকায় এলেন রেবত রাজা। সঙ্গে তাঁর বিবাহযোগ্যা কন্যা। পিতামহ ব্রহ্মার নির্দেশে তিনি তাঁর কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিতে চান বলভদ্রের। নির্বিঘ্ন সম্পন্ন হল সে বিবাহ। কিন্তু তারপরে কৃষ্ণের বিবাহকে কেন্দ্র করে দেখা দিল গোলমাল। বিদর্ভরাজ ভিস্মকের কন্যা রুক্মিণী। তাঁর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে। রুক্মিণীর ইচ্ছা তিনি পতিরূপে বরণ করবেন কৃষ্ণকে। রাজারও সেই ইচ্ছা। কিন্তু বাধ সেধেছেন রাজপুত্র রুক্মী। দমঘোষের পুত্র শিশুপাল তাঁর ভগ্নীর পতি হবেন, এই তাঁর ইচ্ছা। রুক্মীর এই ইচ্ছাকে সমর্থন জানান জরাসন্ধের মতো রাজারা। রুক্মী ভগ্নীর বিবাহের দিনক্ষণও স্থির করে ফেললেন। তখন নিরুপায় হবে রুক্মিণী দ্বারকায় কৃষ্ণের কাছে দূত পাঠালেন সংগোপনে। বলে দিলেন তাঁর বিবাহের দিনে কৃষ্ণ যেন তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যান। কৃষ্ণ সেই মতো রুক্মিণীকে হরণ করে তাঁর রথে তুললেন সুকৌশলে। রুক্মী, শিশুপাল প্রমুখেরা আক্রমণ করলেন তাঁদের। যুদ্ধে জয় হল কৃষ্ণের।

কৃষ্ণসখা সত্রাজিৎ বাস করতেন দ্বারকায়। তাঁর কাছে ছিল স্যমন্তক নামে এক মূল্যবান মণি । সে মণি তিনি ভ্রাতা প্রসেনকে দান করেছিলেন। একদিন প্রসেন মণি পরিশোভিত হয়ে শিকারে গমন করেন। অরণ্যে প্রসেনের মৃত্যু হয়। মণিটিরও কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন অনেকের মনে সন্দেহ হল। তাঁরা ভাবলেন মণির লোভে কৃষ্ণই হত্যা করেছেন প্রসেনকে। এই অপবাদ খণ্ডন করার জন্য কৃষ্ণ মণির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। অনুসন্ধানে তিনি অবগত হলেন মণিটি প্রথমে যায় এক সিংহের অধিকারে। তারপর সেটি অধিকার করেন ভল্লুক ঋক্ষরাজ জাম্ববান। তারপর জাম্ববানের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ হয় কৃষ্ণের। পরাজিত হন জাম্ববান। অতঃপর জাম্ববান কন্যা জাম্ববতীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ দিয়ে যৌতুক হিসেবে স্যমন্তক মণিটি কৃষ্ণকে দান করেন। দ্বারকায় উপস্থিত হয়ে কৃষ্ণ সত্রাজিতের হাতে তুলে দিলেন স্যমন্তক মণি। আনন্দিত সত্রাজিৎ কন্যা সত্যভামার সঙ্গে বিবাহ দিলেন কৃষ্ণের। কিন্তু সত্রাজিৎ স্যমন্তক মণিটি সুরক্ষিত রাখতে পারেন নি। শতধন্বা নামক এক ব্যক্তি সত্রাজিতকে হত্যা করে সে মণি হস্তগত করে। সে কথা অবগত হন কৃষ্ণ । তিনি শতধন্বাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে শতধন্বা সে মণি অক্রূরের কাছে গচ্ছিত রেখে পলায়ন করতে গিয়ে কৃষ্ণের হাতে নিহত হন। মণির  সন্ধান আর পাওয়া যায় না এতে সত্যভামার মনে  ভুল ধারনার সৃষ্টি হয়। তিনি ভাবেন রুক্মিণীকে দিতে চান বলে কৃষ্ণ সে মণি লুক্কায়িত রেখেছেন। অক্রূর সে মণি কৃষ্ণকে ফেরত দিলে সত্যভামার ভুল ধারনা দূরীভূত হয়। কৃষ্ণের কর্ণগোচর হল পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যুর সংবাদ। দুর্যোধনের চক্রান্তে তাঁরা জতুগৃহে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। প্রকৃত সংবাদ জানার জন্য কৃষ্ণ গমন করলেন হস্তিনাপুর। দেখা হল পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে। শুনলেন জতুগৃহের কাহিনী। একদিন অর্জুনের সঙ্গে ভ্রমণ করতে গিয়ে কৃষ্ণ এক তপস্যারতা নবযৌবনা নারীকে দর্শন করেন। ইনি সূর্যনন্দিনী কালিন্দী । জনকনন্দিনী সীতার পরামর্শে নারায়ণকে পতিরূপে লাভ করার জন্য তাঁর তপস্যা। যুধিষ্ঠিরের উদ্যোগে কৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহ হল কালিন্দীর। তাঁকে নিয়ে দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করলেন কৃষ্ণ। মিত্রাবিন্দার স্বয়ম্বরসভায় যোগদান করে তাঁকে হরণ করেন কৃষ্ণ। ভদ্রাজিৎ রাজার কন্যা ও নগ্নজিৎ রাজার কন্যার সঙ্গেও তাঁর বিবাহ হয়। মদ্রদেশের রাজার কন্যা লক্ষণাকে বিবাহ করলেও  সেই রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় কৃষ্ণকে। মদ্ররাজ কুবেরের রথ , ইন্দ্রের অপ্সরা ০ অদিতির কুণ্ডল অপহরণ করেছিলেন। কৃষ্ণের আক্রমণে প্রথমে নিহত হন মদ্ররাজের সখা মুর। তাই কৃষ্ণের নাম হয় মুরারি। তারপর মদ্ররাজকে পরাজিত করে কৃষ্ণ তাঁর ধন-সম্পদ দ্বারকায় নিয়ে যান। একদা পর্বতের উপরে কৃষ্ণ ও রুক্মিণী মাধাই পূজায় নিয়োজিত ছিলেন। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন নারদ। তিনি কৃষ্ণকে স্বর্গের সমাচার দিয়ে রুক্মিণীকে দিলেন পারিজাতমালা। তারপর তিনি সত্যভামার কাছে গিয়ে বললেন যে কৃষ্ণ তাঁকে বঞ্চিত করে পারিজাতমালা দিয়েছেন আর এক পত্নী রুক্মিণীকে। অভিমানহতা হয়ে সত্যভামা বৈরাগিনীর বেশ ধারণ করলেন। তা দেখে নারদ কৃষ্ণের কাছে এসে সে কথা বিবৃত করলেন। কৃষ্ণ সত্যভামার মান ভাঙালেন অনুনয়-বিনয় করে। প্রতিশ্রুতি দিলেন সত্যভামার জন্য তিনি এনে দেবেন পারিজাতবৃক্ষ। তাই স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে কৃষ্ণ নিয়ে এলেন পারিজাতবৃক্ষ। পারিজাতের গুণে দ্বারকায় জরা-মৃত্যু দূর হল।

শোণিতপুরের রাজা বাণের কন্যা ঊষা। সেই ঊষা পার্বতীকে তপস্যায় তুষ্ট করে অবগত হয়েছিলেন যে বৈশাখ মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে যে পুরুষের সঙ্গে স্বপ্নে তাঁর মিলন হবে, সেই পুরুষই হবেন তাঁর স্বামী। তারপর স্বপ্নে মিলন হল বটে, কিন্তু ঊষা পুরুষটির সম্যক পরিচয় পেলেন না। তাঁর সখী চিত্রলেখা তাঁকে জানালেন যে স্বপ্নের সেই পুরুষ হলেন কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। চিত্রলেখার সাহায্যে মিলন হল ঊষা-অনিরুদ্ধের। এই সংবাদ শ্রবণ করে ক্রুদ্ধ হলেন বাণরাজা। অনিরুদ্ধকে বন্দি করার জন্য সৈন্য পাঠালে তারা পরাজিত হয়। তখন বাণরাজা নাগপাশে বন্দি করলেন কৃষ্ণপৌত্র অনিরুদ্ধকে। ধ্যানে কৃষ্ণ সে কথা জানতে পেরে অনিরুদ্ধকে রক্ষা করতে মনস্থ করলেন। গরুড়ের সাহায্যে তিনি প্রবেশ করলেন বাণরাজার সুরক্ষিত আলয়ে। বাণরাজার পক্ষে ছিলেন মহাদেব। কৃষ্ণের সঙ্গে মহাদেবের যুদ্ধ হল। কৃষ্ণের বিক্রমে অস্থির হয়ে মহাদেব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করলেন দ্রুত। এবার বাণরাজার সাহায্যে এগিয়ে এলেন পার্বতী। মোহিনী বেশে আবির্ভূতা হবে তিনি নিরস্ত্র করলেন কৃষ্ণকে। সৃষ্ট হল শিবজর ও বিষ্ণুজর। তাঁরা কৃষ্ণের কাছে পরাভূত হলেন। শূল নিয়ে যুদ্ধে প্রবেশ করলেন বাণরাজা। কৃষ্ণের সুদর্শনচক্রে কাটা গেল বাণের সহস্র বাহু । সন্ধি করতে বাধ্য হলেন বাণরাজা। আড়ম্বর সহকারে বিবাহ হল ঊষা-অনিরুদ্ধের।প্রভাসের সন্নিকটে কৃষ্ণের পুত্ররা খেলা খেলা করতে করতে তৃষ্ণার্ত হয়ে কূপের সন্ধান করেন। তাঁরা একটি কূপের ভিতর এক বৃহৎ কৃকলাসকে দেখতে পান। কিন্তু তাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ আসেন এবং বাম হাতে উদ্ধার করেন কৃকলাসকে। কৃকলাস তাঁকে জানান যে তিনি আসলে ইক্ষুগ্বানন্দন। অনেক সৎকর্ম তিনি জীবনে করেছেন। কিন্তু ধেনুদানের ব্যাপারে দুষ্ট ব্রাহ্মণকে সন্তুষ্ট না করতে পারায় যমরাজের নির্দেশে তিনি কেঙ্কলাস যোনি প্রাপ্ত হয়ে অধোমুখে ঊর্ধ্বপদে ছিলেন। কৃষ্ণের পবিত্র স্পর্শে তিনি মুক্ত হন। কন্যা লক্ষণার জন্য স্বয়ম্বরসভার আয়োজন করেছেন দুর্যোধন। নানা দেশের নানা রাজা সমবেত হয়েছেন সেই সভায়। অকস্মাৎ শাম্ব এসে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন লক্ষণাকে। অন্যান্য রাজারা আক্রমণ করলেন শাম্বকে। তাঁকে বন্দি করে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে। এ কথা শুনে বলরাম এলেন হস্তিনাপুরে। দুর্যোধনকে তিনি বললেন যে শাম্ব ক্ষত্রিয়সুলভ কাজ করেছেন, তাই তাঁকে বন্দি করা উচিত হয় নি। কিন্তু অহংকারী দুর্যোধন বলরামের কথা গ্রাহ্য করলেন না। তখন বলরামের প্রচণ্ড ক্রোধে শুরু হল ভূমিকম্প। ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম প্রভৃতিরা বলরামকে তুষ্ট করতে লাগলেন। দুর্যোধনও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, এবং লক্ষণার সঙ্গে শাম্বের বিবাহ দিলেন।

দ্বারকার রাজসভায় বসে আছেন কৃষ্ণ। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন শৃগাল-বাসুদেবের দূত। এই শৃগাল-বাসুদেব কাশীরাজ। তাঁর ভূষণ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম। দূতের মাধ্যমে কাশীরাজ জানিয়েছেন কৃষ্ণ যেন তাঁর ভূষণ ত্যাগ করেন। এ কথা শুনে কৃষ্ণ সহাস্যে জানালেন যে তিনি কাশীরাজের সম্মুখেই তাঁর ভূষণ ত্যাগ করবেন। কৃষ্ণের ঔদ্ধত্য সহ্য হল না কাশীরাজের। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। সুদর্শন চক্র দিয়ে কৃষ্ণ তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তখন কাশীরাজের পুত্র পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করলেন। তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে কৃষ্ণকে পরাভূত করার বর লাভ করেন তিনি। এই হেতু যে যজ্ঞ তিনি করেন, তার থেকে আবির্ভূত হন এক অগ্নিময় পুরুষ। সেই পুরুষ দ্বারকার দিকে ধাবিত হলে দ্বারকাবাসী ভীত হয়ে পড়েন। তারপর কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের দ্বারা তাড়িত হয়ে তিনি দগ্ধ করেন কাশীপুর। কাশীরাজ দগ্ধীভূত হবে প্রাণ হারান।দিনকয়েক বাদে নারদ এলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণদর্শন করতে এসেছেন তিনি। কিন্তু কোন পত্নীর ঘরে আছেন কৃষ্ণ? অতঃপর এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পেলেন নারদ। দেখলেন সত্যভামা, নগ্নজিতা, জাম্ববতী, লক্ষণা—সকলের ঘরেই আছেন কৃষ্ণ। লীলাময় কৃষ্ণের এই লীলায় নারদ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। দূতের মুখে কৃষ্ণ শুনতে পেলেন জরাসন্ধের নতুন

অত্যাচারের কাহিনী। যে সব রাজা কৃষ্ণের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের বন্দি করেছেন রাজা জরাসন্ধ। বন্দি রাজারা উদ্ধারের আশায় কৃষ্ণের শরণাপন্ন। কৃষ্ণ জরাসন্ধের সন্ধান চান। নারদ তাঁকে জানালেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূ্য যজ্ঞে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে উপস্থিত থাকবেন জরাসন্ধ। তাই কৌশলে আক্রমণ করতে হবে। কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুনকে ধারণ করতে হবে সন্ন্যাসীর বেশ। 

অতঃপর তাঁরা তিনজন সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে জরাসন্ধের পুরীতে গমন করলেন। পথে যেতে যেতে কৃষ্ণ জরাসন্ধ এই নামকরণের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। জরাসন্ধের পিতা মগধরাজ বৃহদথ। তাঁর পত্নী দুটি দ্বিখণ্ডিত সন্তান প্রসব করেন। সেই সন্তানকে ফেলে দেওয়া হয় বাঁশবনে। জরা নামক এক রাক্ষসী দ্বিখণ্ডিত সন্তান দুটিকে একত্রিত করে এক পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু গঠন করেন।
স্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন জরাসন্ধ। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন ছদ্মবেশী কৃষ্ণরা। তাঁরা জরাসন্ধের দানশীলতার প্রশংসা করে তাঁদের প্রার্থনা জানাতে চাইলেন। অতিথিদের শরীরে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন দেখে জরাসন্ধ বুঝলেন তাঁরা ব্রাহ্মণ নন, ক্ষত্রিয়। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্যে তাঁরা ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন। কৃষ্ণ তখন তাঁদের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে যুদ্ধের কথা বললেন। কৃষ্ণের নির্দেশে ভীম জরাসন্ধকে দ্বিখণ্ডিত করায় তাঁর মৃত্যু হল । জরাসন্ধের পুত্র সহদেবকে মগধের রাজা করে, বন্দি রাজাদের মুক্ত করে কৃষ্ণ দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন শুরু হয়েছে। এক বিস্ময়কর সভাগৃহ নির্মাণ করেছেন ময়দানব। সোনার লাঙল দিয়ে কর্ষণ করে তৈরি হয়েছে যজ্ঞবেদী। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, কৃষ্ণ, পঞ্চপাণ্ডব, শিশুপাল, যমরাজ, বরুণ, বিদূর সকলেই সমাগত। যজ্ঞের পরে কৃষ্ণকে সম্বর্ধনা দেওয়ার কথা ওঠায় আপত্তি জানালেন শিশুপাল। তারপরে কৃষ্ণনিন্দায় মুখর হবে উঠলেন তিনি। শিশুপালের আচরণে অন্যান্য অতিথি ক্ষুব্ধ হলেন। কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র বধ করল শিশুপালকে।
রাজসূয় যজ্ঞের পরে এক অসুরের মুখোমুখী হলেন কৃষ্ণ। সে অসুরের নাম শাল্ব। রুক্মিণীর সঙ্গে তাঁর বিবাহের সময় থেকে শাল্ব তাঁর বিরোধিতা করে আসছে। শিবের বরে শাল্ব অমর। ময়দানব নির্মিত রথে চেপে বিপুল সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শাল্ব বেষ্টন করল দ্বারকাপুরী। শুরু করল নির্বিচার হত্যা আর  অত্যাচার। কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন যুদ্ধে বধ করলেন শাল্বকে। তার সৈন্যবাহিনী নিক্ষিপ্ত হল সমুদ্রে। কিন্তু মহাদেবের বরে শাল্ব পুনর্জীবিত হল আবার। এবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন কৃষ্ণ। বধ করলেন শাল্বকে। কিন্তু সে আবার জীবিত হয়ে কৃষ্ণের পিতা বাসুদেবকে বন্দি করল। শেষে কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রে নিহত হল শাল্ব।
ভোজকূট দেশের রুদ্ধীর নগরে এসেছেন কৃষ্ণ আর রুক্মিণী। রুক্মীরাজের পৌত্রীর সঙ্গে কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের বিবাহ হল। বিবাহের পরে রুক্মীরাজ আয়োজন করলেন পাশাখেলার। বলরামকেও আমন্ত্রণ জানানো হল। কপট পাশাখেলায় পরাজিত হতে লাগলেন বলরাম। তারপর বলরামকে অপদস্থ করা হল। ক্রুদ্ধ বলরাম মুষল দিয়ে বধ করলেন রুক্মীরাজকে।
এক দৈত্যের নাম ছিল বজ্রনাভ। ব্রহ্মার বরে সে ছিল ত্রিভুবনবিজয়ী। নর্মদার তীরে ছিল তার সুবর্ণমণ্ডিত প্রাসাদ। দেবরাজ ইন্দ্রের পুরী সে অধিকার করতে চায়। দেবরাজ শরণ নিলেন কৃষ্ণের। কৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর পুত্র প্রদ্যুম্ন গেলেন বজ্রনাভের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। বজ্রনাভের এক কন্যা ছিল। তার নাম প্রভাবতী। প্রদ্যুম্ন ও তাঁর সঙ্গীরা ব্রহ্মার বাহন রাজহংসীদের দৌত্যকাজে নিযুক্ত করলেন। প্রভাবতীর সহচরীরা রাজহংসীর রূপ দেখে আনন্দিত হয়ে প্রভাবতীকে জানালেন তাদের কথা। প্রভাবতী সরোবরের তীরে এসে রাজহংসীদের ডাকলে তারা মানুষের ভাষায় জানিয়ে দিল যে তাদের ধরা সহজ নয়। তবে আন্তরিকভাবে ডাকলে তারা  ধরা দিতে পারে। প্রভাবতীর আন্তরিকতায় তারা ধরা দিল।
একদিন সূচীমুখী নামে রাজহংসী প্রভাবতীর কাছে কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন, গদ আর শাম্বের রূপের প্রশংসা করায় প্রভাবতী মোহিত হলেন। তিনি প্রদ্যুম্নের সঙ্গে মিলন কামনা করলেন । দ্বারকায় বসে কৃষ্ণ সে সব কথা অবগত হলেন। তিনি ভদ্রনটকে আনার আদেশ দিলেন। সে নৃত্য, গীত, অভিনয়ে পারদর্শী। কৃষ্ণের আদেশে ভদ্রনট প্রদ্যুম্ন, গদ আর শাম্বকে নিয়ে বজ্রনাভের পুরীর দিকে যাত্রা করল। তাদের নৃত্য-গীতে খুশি হলেন বজ্রনাভ। প্রদ্যুম্নরা রাজার বিশ্বাস অর্জন করে সমর্থ হলেন। সূচীমুখী প্রভাবতীকে জানিয়ে দিলেন যে  নটদের একজন হলেন প্রদ্যুম্ন। এ কথা শুনে ব্যাকুল হলেন প্রভাবতী। ফুলের মধ্যে আত্মগোপন করে প্রদ্যুম্ন প্রবেশ করলেন রাজপুরীতে। প্রভাবতীর সঙ্গে মিলন হল তাঁর। বিবাহ হয়ে গেল গান্ধর্ব মতে। তারপরে গদ ও শাম্বের সঙ্গে প্রভাবতীর অন্য দুই ভগ্নীর বিবাহ হল তিন ভগ্নীর তিন পুত্রসন্তান হল –চন্দ্রপ্রভ, গুণমন্ত, হংসকেতু। দেবতার বরে জন্মগ্রহণ করেই তাঁরা উপনীত হলেন যৌবনে। নিজেদের লক্ষ্য সম্বন্ধেও তাঁরা সচেতন। বধ করতে হবে বজ্রনাভকে। প্রহরীদের মুখে বজ্রনাভ শুনতে পেলেন অন্তঃপুরে বিচরণ করছে তিনজন অচেনা পুরুষ। তাদের বন্দি করে আনার জন্য পাঠানো হল সেনাপতি তালজঙ্ঘকে। প্রদ্যুম্ন , গদ, শাম্ব এবং তাঁদের তিন পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল তালজঙ্ঘের। অচিরে নিহত হল তালজঙ্ঘ। তখন বজ্রনাভ অগ্রসর হলেন যুদ্ধের জন্য। ততক্ষণে কৃষ্ণ ও জয়ন্ত প্রদ্যুম্নদের সাহায্যের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। বজ্রনাভ আশ্রয় নিলেন মায়াযুদ্ধের। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে প্রদ্যুম্ন অর্ধচন্দ্র বাণের সাহায্যে হত্যা করলেন বজ্রনাভকে। পুত্র, পুত্রবথূ ও প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে কৃষ্ণ ফিরে এলেন দ্বারকায়।
সুদামা কৃষ্ণের বাল্যসখা। অবন্তীনগরে তাঁর বাড়ি। তিনি খুব দরিদ্র। ভিক্ষায় তাঁর সংসার চলে । সুদামার স্ত্রী স্বামীকে কৃষ্ণের সাহায্য নিতে বললেন। স্ত্রীর কথায় সুদামা চললেন কৃষ্ণের কাছে। বন্ধু কৃষ্ণের জন্য সামান্য খুদ এনেছিলেন সুদামা। কিন্তু সামান্য সেই উপহার দিতে সংকোচ বোধ করছিলেন। কৃষ্ণ নিজেই চেয়ে নিলেন সামান্য সেই উপহার। সুদামা কিন্তু কৃষ্ণের কাছে নিজের দারিদ্র্যের কথা বলতে পারলেন না। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন সুদামার মনের কথা। বাড়ি ফিরে অবাক সুদামা। তাঁর জীর্ণ কুটির পরিণত হয়েছে অট্টালিকায়। পূর্ণ হয়েছে প্রচুর ধন-সম্পদে। 
সপরিবারে কৃষ্ণ এসেছেন প্রভাসে। গোপ-গোপী, পাণ্ডব-কৌরবরাও সমবেত হয়েছেন। বসুদেব আয়োজন করলেন যজ্ঞের। সেই যজ্ঞকুণ্ড বেষ্টন করে বসলেন ব্যাস, বশিষ্ট, পুলস্ত , নারদ, অঙ্গিরা, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ঋষি। নানা দার্শনিক আলোচনা হল। অন্তঃপুর ভরে উঠল রঙ্গ-কৌতুকে। রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী যেমন তাঁদের বিবাহ কাহিনী বর্ণনা করলেন, তেমনি দ্রৌপদীও তাঁর বিবাহ কাহিনী বিবৃত করলেন।
নৈমিষ অরণ্যে তর্ক চলছে ঋষিদের মধ্যে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—এই  ত্রি- দেবতার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তাই নিয়ে তর্ক। ঋষিদের নির্দেশে ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য ভৃগুমুনি প্রথমে গেলেন কৈলাসে, মহাদেবের কাছে। শিব ভৃগুকে দেখে আনন্দিত হয়ে আলিঙ্গন করতে যেতে ভৃগু সরে দাঁড়ালেন, বললেন যে দিনরাত যিনি ভূত-প্রেতের সঙ্গে বিচরণ করেন, তাঁর স্পর্শে তিনি অশুচি হবেন। শিব ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে তাড়া করলেন। ভৃগু তখন গেলেন ব্রহ্মার কাছে। তখন ব্রহ্মা অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তাই অতিথি সৎকারে ত্রুটি হল। ভৃগু ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাকে কটুবাক্য বলায় ব্রহ্মা তাঁকে তাড়া করলেন। ভৃগু তখন গেলেন বিষ্ণু বা কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তখন পালঙ্কে নিদ্রিত ছিলেন। কৃষ্ণের বক্ষে পদাঘাত করে ভৃগু তাঁকে জাগ্রত করলেন। ক্রুদ্ধ না হয়ে কৃষ্ণ বললেন যে অতিথিকে সমাদর না করতে পারার জন্য তিনি অপরাধী; ভৃগুর পদাঘাতে তাঁর অপরাধ দূর হয়েছে, শুদ্ধ হয়েছে শরীর। তখন ভৃগু ঋষিদের জানালেন যে তিন দেবতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন বিষ্ণু।
কংসের অনুচরের নাম বৃকাসুর। শিবের তপস্যা করে সে এক বর লাভ করেছিল। যার মাথায় সে হাত দেবে সে ভস্মে পরিণত হবে। বকাসুর শিবের মাথায় হাত দিয়ে বরের সত্যতা যাচাই করতে চাইল। মহা বিপদ। শিব ছুটে এলেন ইন্দ্রপুরীতে। কিন্তু সেখানে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে পারল না কিছুমাত্র। শিব তখন এলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণের কাছে। বৃকাসুরও হাজির সেখানে। কৃষ্ণ বৃকাসুরকে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বরের সত্যতা যাচাই করতে বললেন। এভাবে বৃকাসুর পরিণত হয় ভস্মে। শিব তখন কৃষ্ণের মাহাত্ম্য স্বীকার করলেন অকুণ্ঠচিত্তে।
দ্বারকা নগরে বাস করতেন এক  ব্রাহ্মণ দম্পতি। সুখ ছিল না তাঁদের মনে। ব্রাহ্মণী প্রসব করতেন মৃত সন্তান। একবার তাঁরা মৃত পুত্রকে নিয়ে কৃষ্ণের কাছে গেলেন। কৃষ্ণ তাঁদের পরবর্তী সন্তানকে জীবিত রাখার ভার দিলেন প্রদ্যুম্নকে। কিন্তু ব্যর্থ হলেন প্রদ্যুমন। এভাবে একে একে ব্যর্থ হলেন শাম্ব, সাত্যকি, অনিরুদ্ধ, গদ, উদ্ভব উগ্রসেন। এবার ডাক পড়ল অর্জুনের। ব্রাহ্মণী মৃত পুত্র প্রসব করলে তাকে নিয়ে চলে গেলেন যম। অর্জুন তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করলেন। কিন্তু হদিশ পেলেন না যমের। অর্জুন তখন অগ্নিতে আত্মবিসর্জন করার সিদ্ধান্ত করায় বাধা দিলেন কৃষ্ণ। এরপর কৃষ্ণ নিজে গেলেন যমরাজের কাছে। উদ্ধার করে আনলেন ব্রাহ্মণের নয়টি পুত্র।
মৃত পুত্র উদ্ধারের কাহিনী শুনে দৈবকী কংস কর্তৃক নিহত তাঁর ছয় পুত্রকে উদ্ধারের অনুরোধ করলেন। সেজন্য কৃষ্ণ গেলেন পাতালে। বলির আলয়ে। সহোদর ছয় ভ্রাতাকে নিয়ে এলেন তিনি দ্বারকায়। এমন সময়ে আকাশে বেজে উঠল দুন্দুভি। নেমে এল ছয়টি রথ । দিব্যদেহ ধারণ করে কৃষ্ণের ছয় ভ্রাতা জানালেন যে তাঁরা মরীচির পুত্র। কৃষ্ণের স্পর্শে তাঁরা শাপমুক্ত হয়েছেন। এবার তাঁর স্বর্গলোকে যাবেন। 
দ্বারকায় এসেছেন অর্জুন। ধনুর্বাণ সংগ্রহের জন্য তিনি প্রবেশ করেছেন যুধিষ্ঠিরের কক্ষে। সে সময়ে সেখানে ছিলেন দ্রৌপদী। সেই অপরাধে অর্জুনকে এক বৎসর বনবাসে যেতে হয় । বনবাসপর্ব শেষ করে অর্জুন ফিরে এলেন দ্বারকায়। একদিন কৃষ্ণের সঙ্গে ভ্রমণকালে অর্জুন সুভদ্রাকে দেখে মোহিত হলেন। বিবাহ করতে চাইলেন তাঁকে। কৃষ্ণ বিবাহ সমর্থন করলেও বলভদ্রের মত ছিল না। তাই কৃষ্ণ সখা অর্জুনকে সুভদ্রাহরণের পরামর্শ দিলেন।একদিন সুভদ্রা যখন একাকিনী স্নানের জন্য যাচ্ছিলেন, তখন অর্জুন তাঁকে হরণ করেন। সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ বলভদ্র তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করলেন মূষল হাতে। কৃষ্ণকেও তিনি তিরস্কার করেন এ রকম অপকর্মে অর্জুনকে সাহায্য করার জন্য। কৃষ্ণ বলেন যে সবদিক থেকে অর্জুন সুভদ্রার যোগ্য পতি হতে পারেন। সুভদ্রাকে নিয়ে অর্জুন হস্তিনানগরে উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাঁদের বিবাহ দেন।
অজামিল ছিলেন কান্যকুব্জের এক ব্রাহ্মণ। তিনি ব্রহ্মচর্য ব্রত ধারণ করে অন্ধ পিতা-মাতার সেবা করে দিনাতিপাত করতেন। একদিন তিনি পুষ্পোদ্যানে এক নারীকে দেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। নারীটি ছিলেন কুলটা ও ছলনাময়ী। তাঁকে বিবাহ করে অজামিল পিতা-মাতাকে পরিত্যাগ করে দেশান্তরে চলে যান। কালক্রমে তাঁর দশ পুত্র জন্মায়। সর্ব কনিষ্ঠটির নাম নারায়ণ। মৃত্যুকালে অজামিল কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ধরে ডাকায় পাপমুক্ত হন। তখন যমদূতদের বিতাড়ন করে বিষ্ণুদূত তাঁকে বৈকুন্ঠে নিয়ে যান। 
পুত্র–পৌত্র-আত্মীয়-বান্ধবদের নিয়ে সুখে কালাতিপাত করছিলেন কৃষ্ণ। এ সময়ে নিজেকে তিনি যেন বিস্মৃত হয়েছিলেন। তাই ব্রহ্মা প্রমুখ দেবতারা চিন্তিত হন। নারায়ণ তখন জানান যে চিন্তার কোন কারণ নেই, ব্রহ্মার শাপে ধ্বংস হবে কৃষ্ণের বংশ। তখন তাঁকে ফিরে আসতে হবে বৈকুণ্ঠে।
কিছুদিন পরে কৃষ্ণ দর্শনের জন্য দ্বারকায় এলেন মুনি-ঋষিরা। প্রদ্যুম্ন তাঁদের যথোচিত সমাদর করায় তাঁরা প্রীত হলেন। এমন সময়ে শাম্ব এক কাণ্ড করে বসলেন।  তিনি এক গর্ভবতী নারীর রূপ ধারণ করে হাজির হলেন ঋষিদের সামনে। তিনি জানান যে তিনি এক বছর কাল গর্ভ ধারণ করে বড় কষ্টে আছেন,  ঋষিরা যদি বলে দেন কবে প্রসব হবে হবে এবং পুত্র না কন্যা হবে, তাহলে তিনি কৃতার্থ হবেন। ঋষি দুর্বাসা শাম্বের ছলনা ধরতে পেরে ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেন যে সেই মুহূর্তে তিনি একটি মূষল প্রসব করবেন। এ হল ব্রহ্মশাপ । কাজ হল কথামতো। কৃষ্ণ বিধান দিলেন প্রভাসে গিয়ে মূষল ঘর্ষণ করতে। কিন্তু মূষল সম্পূর্ণ ক্ষয় হল না। অবশিষ্টাংশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হল। একটি বৃহৎ মৎস্য সেটি ভক্ষণ করল। এক ধীবর সেই মৎস্য ধরে তার লৌহখণ্ড এক শিকারীকে বিক্রয় করল। শিকারীটি সেই লৌহখণ্ড দিয়ে তৈরি করল অস্ত্র। এভাবে ব্রহ্মশাপ ফলতে শুরু করল। কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগের সময় ত্বরান্বিত হল।
সে কথা অনুধাবন করে উদ্ভব কৃষ্ণের কাছে তত্ত্বজ্ঞান প্রার্থনা করলেন। 
কৃষ্ণ প্রথমে বললেন সংসারের অসারতার কথা। এই অসার সংসারে একমাত্রসারবস্তু নারায়ণ । তাঁর আরাধনায় নিমগ্ন হতে হবে।  ঈশ্বর আরাধনার পথ বিবিধ--- উত্তম, মধ্যম, অধম। প্রথম স্তরের সাধকদের আত্মপর কোন ভেদ থাকে না। লাভ-ক্ষতি, সম্মান-অসম্মান, সুখ-দুঃখ সবই তাঁদের কাছে সমান। মধ্যম শ্রেণির সাধকরা সংসারকে অসার জানেন,  শ্রীহরির ধ্যান করেন তবে একেবারে বিকারমুক্ত হতে পারেন নি। অধম শ্রেণির সাধকরা পূজাপাঠ করেন তবে সংসারের প্রতি তাঁদের আসক্তি আছে।
ঈশ্বর সাধনার জন্য গুরুর প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন কৃষ্ণ। এক অবধূতের উল্লেখ করে তিনি চব্বিশজন গুরুর কথা বললেন ।
প্রথম গুরু এই বসুন্ধরা। সর্ববিধ ভার সে বহন করে। অথচ তার কোন দুঃখ নেই। সে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। দ্বিতীয় গুরু পবন। সে গুপ্ত না থেকে সর্বত্র নিজেকে সঞ্চারিত করে দেয়। তৃতীয় গুরু আকাশ। তার অস্তিত্বের কোন প্রকাশ নেই, অথচ তার অস্তিত্ব বিস্তৃত। চতুর্থ গুরু জল। সে নির্মল, সে সমস্ত প্রাণীর উপকার সাধন করে। পঞ্চম গুরু আগুন। তার কোন ভেদাভেদ নেই। ষষ্ঠ গুরু চন্দ্র। সে আপনা আপনি না মরে পুন মলা করে ক্ষয়। সপ্তম গুরু সূর্যদেব। সমস্ত চরাচরে সে পরিব্যাপ্ত। অষ্টম গুরু কপোত। কপোতীর মতো শোকে কাতর হয়ে সে সর্বনাশ ডেকে আনে না। নবম গুরু অজগর। আহার্য সন্ধানের চেষ্টা তার নেই; পেলে খায় না হলে অভুক্ত থাকে। দশম গুরু সমুদ্র। সে নিজেই পরিপূর্ণ; তার কোন তারতম্য নেই, আক্ষেপও নেই। একাদশ গুরু পতঙ্গ। বিষয়াসক্তির আগুনে সে নিরন্তর দগ্ধ হয়। দ্বাদশ গুরু মধুকর। সে মধুরূপ নারায়ণকে গ্রহণ করে পুষ্পরূপ সংসারকে পরিত্যাগ করে। ত্রয়োদশ গুরু মধুমাছি। তার মৃত্যুর কারণ হল শিক্ষা সঞ্চয়। চতুর্দশ গুরু গজরাজ। নকল হাতির প্রলোভনে সে বন্দি হয়। পঞ্চদশ গুরু হরিণী। সে সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে আপন সর্বনাশ ডেকে আনে। ষোড়শ গুরু মৎস্য। বঁড়শিতে গাঁথা আহারের লোভে সে প্রাণ হারায়। সপ্তদশ গুরু পিঙ্গলা নামক গণিকা। প্রলোভিত হয়ে সে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। অষ্টাদশ গুরু কুরল পক্ষী। তার মাংস সুস্বাদু, তাই সকলে তার প্রাণ হরণ করতে চায়। ঊনবিংশতি গুরু শিশু। তার মনে কোন জটিলতা নেই, সে সরল, সহজ ও সুন্দর। বিংশতি গুরু কুমারী। সে পবিত্র। একবিংশতি গুরু বক। তার ধ্যাননিমগ্নতা ঈশ্বরে ধ্যাননিমগ্ন হবার শিক্ষা দেয়। দ্বাবিংশতি গুরু সর্প। তার নিজের কোন নির্দিষ্ট  নিলয় নেই। ত্রয়োবিংশতি গুরু মর্কট। তার ক্ষুদ্র দেহ বহুসূতা। চতুর্বিংশতি গুরু কুমারিকা পতঙ্গ। সে কৃমি সংগ্রহ করে মৃত্তিকায় আচ্ছাদিত করে নিয়ত।
এসব কথা বলার কৃষ্ণ বললেন যে কেউ কারো গুরু নয়,  প্রত্যেকেই নিজেই নিজের গুরু।
উদ্ভব কৃষ্ণের কাছে মোক্ষযোগের কথা শুনলেন। তারপরে শুনলেন কর্মযোগের কথা। মানুষকে কর্ম করে যেতে হবে। কিন্তু কর্মে যিন মোহ না জন্মায়।
তারপর কৃষ্ণ উদ্ভবকে জানালেন তাঁকে চেনার উপায়। তিনি সংসারের প্রধান পুরুষ। তিনি সর্বভূতে বিরাজিত। দেব পুরন্দর তিনি। পশুমধ্যে সিংহ, দৈত্যের মধ্যে প্রহ্লাদ, ঋষির মধ্যে ভৃগু, মেরুর মধ্যে গিরিরাজ, বেদের মধ্যে সাম, পিতৃগণের  অর্ঘ্য, মরুতে পবন, অশ্বের মধ্যে উচ্চৈঃশ্রবা, গজে ঐরাবত, পক্ষীতে গরুড়, নাগে বাসুকি, নদীর মধ্যে সাগর, তারাদের মধ্যে চন্দ্র, সর্পে অনন্ত, ঋতুতে বসন্ত, বর্ণের মধ্যে মধ্য। তিনি প্রজাপতি। তিনি বুদ্ধিতে বৃহস্পতি। তাঁর থেকেই সকল সংসারের উৎপত্তি।
উদ্ভব দেখলেন কৃষ্ণের বিশ্বরূপ। তাঁর শরীরের উপরিভাগে ঋষিগণ, মধ্যভাগে স্থাবর, জঙ্গম ও প্রাণীকুল, নিম্নভাগে অসুর ও রাক্ষসগণ। তারপর কৃষ্ণের সাম্যরূপ দেখলেন উদ্ভব। দেখলেন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বনমালীকে।
কৃষ্ণ বললেন, আমার প্রতি মন সমর্পণ করে নিষ্কাম কর্ম করো; ঈশ্বর যে কর্ম সৃজন করেছেন তা পালন করো। ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য, পদ থেকে শূদ্রের জন্ম।  ব্রাহ্মণের কর্ম যজন-যাজন-বেদপাঠ, ক্ষত্রিয়ের কর্ম দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, বৈশ্যের কর্ম কৃষি ও বাণিজ্য, শূদ্রের কর্ম উপরের তিন জাতির সেবা।
এরপর কৃষ্ণ চতুরাশ্রমের বিবরণ দিলেন।
প্রথমে ব্রহ্মচর্য। এ সময়ে গুরুগৃহে বাস করে বেদপাঠ ও গুরু সেবা করতে হবে। দ্বিতীয় গার্হস্থ্য। সুশীলা কন্যাকে বিবাহ করে গৃহধর্ম পালন করতে হবে। তৃতীয় বানপ্রস্থ। এ অবস্থায় সংসার ত্যাগ করে সস্ত্রীক অরণ্যে গমন করে ঈশ্বরচিন্তায় দিনাতিপাত করতে হবে। চতুর্থ সন্ন্যাস। এ অবস্থায় সমস্ত মোহ ত্যাগ করে দণ্ড ও কমণ্ডুলু ধারণ করে দেশে দেশে পরিভ্রমণ করতে হবে।
কাম-ক্রোধ ইত্যাদি পাপের থেকে মোহমুক্ত হবার জন্য কৃষ্ণ উদ্ভবকে অষ্টাঙ্গ যোগ বা সিদ্ধিযোগের বিধান দিলেন। অময়াসন ও প্রাণায়াম আয়ত্ত করতে হবে। কায়াসাধনার বিস্তৃত বিবরণ দিলেন কৃষ্ণ। তিনি দেখালেন তাঁর চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপ। কৃষ্ণের উপদেশে উদ্ভব সংসার ও সম্পদ পরিত্যাগ করলেন।
কালক্রমে পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করল যদুবংশ। পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য যে কৃষ্ণের আবির্ভাব, এবার তিনি যদুবংশ ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। শুরু হল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। শুরু হল যদুবংশের সন্তানদের কলহ, যার পরিণতি খণ্ডযুদ্ধ। বলরাম সমুদ্রতীরে যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। আহত হবে কৃষ্ণ এক বৃক্ষের উপর আরোহণ করলেন। জরা নামক এক ব্যাধ কৃষ্ণের লোহিত চরণকে হরিণের কান ভেবে মুষলের আঘাত করল। সে আঘাতে মৃত্যু হল কৃষ্ণের। তাঁর মহিষীরা সহমৃতা হলেন। অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণত্যাগ করলেন বসুদেব- দৈবকী। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হল দ্বারকা নগরী।

রবীন্দ্রজীবনে নববর্ষ

প্রবন্ধ

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রবীন্দ্র-জীবনে নানা 

নববর্ষের গাঁথা মালা

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

images.png

বির নিজের আবির্ভাব বৈশাখে। ফলে গ্রীষ্মের প্রবল প্রচণ্ড প্রতাপ সত্ত্বেও বৈশাখের রূদ্ররূপ কবির বড়ো প্রিয়। তাই ‘নববর্ষ’ যাপনকে কবি রূপ দিলেন নবোচ্ছ্বাসের আগমনীতে। রাণু মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন [শুক্র ৪ বৈশাখ ১৩৪৩ – 17 Apr 1936] “গরম নিশ্চয়ই— কিন্তু তা নিয়ে নালিশ করে লাভ নেই— জন্মেছি গরম দেশে। কবিতা লেখবার সময় লিখতে হয়েছে, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’— যত গরমই হোক কথাগুলো আর ফিরিয়ে নেবার জো নেই”।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম নববর্ষ আসে [১২৬৯ – 13 Apr 1862] জন্মের পর মাত্র দ্বিতীয় বছরে পা দিয়ে। সেদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল নববর্ষ উৎসব উপলক্ষে ব্রাহ্মসমাজের কর্ণধার সস্ত্রীক কেশবচন্দ্র সেন দ্বিতীয়বার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে আসেন। এই কারণে কেশবচন্দ্রকে সাময়িকভাবে গৃহত্যাগ করতে হয়। 


নববর্ষ উপলক্ষে প্রথম গান রচনা:
রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম দিনগুলোতে পয়লা বৈশাখ বা বর্ষবরণ তেমন জাকজমকভাবে পালিত হয়নি। তারপর অনেক পরে জীবনের তেইশ বছর বয়সে [১২৯০ বঙ্গাব্দ] প্রথম বর্ষবরণের সূচনা হয় মহর্ষি ভবনে নববর্ষের উপাসনা দিয়ে। এই উৎসবে রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটি ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয়, ‘সখা তুমি আছ কোথা’ ও ‘প্রভু এলেম কোথায়’। প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন [রবিজীবনী] মাঘোৎসবের জন্য ব্রহ্মসংগীত রচনার সূত্রপাত আগে হলেও নববর্ষ উপলক্ষে তিনি এই প্রথম গান রচনা করলেন – সেদিক দিয়ে গান দুটির ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এরপর প্রায় প্রতিবছরই বর্ষশেষ ও বর্ষবরণ উৎসব পালিত হতে থাকে। 
চব্বিশ বছর বয়সে - পয়লা বৈশাখ [১ বৈশাখ, ১২৯১, সোম - 14 Apr 1884] – মহর্ষি ভবনে আদি ব্রাহ্মসমাজের নববর্ষ উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথ চারটি ব্রহ্মসংগীত রচনা করেন: ‘রজনী পোহাইল চলেছে যাত্রীদল’, ‘এ কি সুগন্ধ হিল্লোল বহিল’, ‘আজি এনেছে তাহারি আশীর্বাদ’ ও বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। পঁচিশ বছর বয়সে [১ বৈশাখ ১২৯২, সোম 13 Apr 1885] - মহর্ষি ভবনে নববর্ষ উৎসবের জন্য - আগের বছরে রচিত তিনটি ব্রহ্মসঙ্গীত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে বরণ করলেন: ১। দীর্ঘ জীবনপথ কত দুঃখতাপ। ২। দুখের কথা তোমায় বলিব না। ৩। গাও বীণা, বীণা গাওরে। বছরের শুরুতে তাঁর যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হল সেটির নাম ‘আলোচনা’। রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি মহর্ষিকে উৎসর্গ করেন। 


নববর্ষ উপলক্ষে ভাষণ:
তারপর ছাব্বিশ বছর বয়সে [১ বৈশাখ – ১২৯৩ – মঙ্গল 13 Apr 1886] মহর্ষিভবনে নববর্ষের উপাসনা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তিনটি গান রচনা করেন, সেগুলি ‘নববর্ষের গান’ শিরোনামায় তত্ত্ববোধিনীর বৈশাখ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়। ১। আমাকে করো মার্জনা। ২। বর্ষ গেল বৃথা গেল কিছুই করিনি হায়। ৩। ফিরোনা, ফিরোনা আজি, এসেছ দুয়ারে। এইদিন মধ্যাহ্নে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে সিটি কলেজ গৃহে ‘নববর্ষ’ উপলক্ষে কয়েকটি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘সত্য’ শীর্ষক ভাষণটি পাঠ করে বললেন:
সরলরেখা আঁকা সহজ নহে, সত্য বলাও সহজ ব্যাপার নহে। সত্য বলিতে গুরুতর সংযমের আবশ্যক। দৃঢ় নির্ভর দৃঢ় নিষ্ঠার সহিত তোমাকেই সত্যের অনুসরণ করিতে হইবে, সত্য তোমার অনুসরণ করিবে না। 


নববর্ষে – ‘পুণ্যাহ’:
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পুণ্যাহ উৎসব বাংলা নববর্ষের সমার্থক হিসেবে প্রতি বছর বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে নিয়মিতভাবে পালন হয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “সেদিন ছিল যাকে বলে জমিদারি সেরেস্তার 'পুণ্যাহ' খাজনা-আদায়ের প্রথম দিন। কাজটা নিতান্তই বিষয়-কাজ। কিন্তু, জমিদারি মহলে সেটা হয়ে উঠেছে একটা পার্বণ। সবাই খুশি-- যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সতে ভর্তি করে সেও। এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখবার গন্ধ ছিল না। যে যা দিতে পারে তাই দেয়, প্রাপ্য নিয়ে কোনো তক্‌রার করা হয় না। খুব ধুমধাম, পাড়াগেঁয়ে সানাই অত্যন্ত বেসুরে আকাশ মাতিয়ে তোলে। নতুন কাপড় প'রে প্রজারা কাছারিতে সেলাম দিতে আসে”।... 


নববর্ষ উপলক্ষে কবিতা:
১ বৈশাখ – ১৩০১ – [শুক্র 13 Apr 1894] রবীন্দ্রনাথের জীবনে চৌত্রিশ বছর – জোড়াসাঁকোয় লেখা ‘নববর্ষে’ কবিতাটি নূতন বর্ষের আবির্ভাবে নূতন সংকল্পে নিজেকে উজ্জীবিত করার গতানুগতিক রীতিকেই অনুসরণ করেছে: 
নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত!
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত।...
আজ চলে গেলে কাল কী হবে না-হবে
নাহি জানে কেহ,
আজিকার প্রীতিসুখ রবে কি না-রবে
আজিকার স্নেহ।
কিন্তু মৃত্যুর আভাস এখানেও দুর্লক্ষ্য নয়। বর্তমান বছরে বৈশাখ মাসে কাদম্বরী দেবীর শোচনীয় আত্মহনন দশ বছর পূর্ণ হল।


নববর্ষ উপলক্ষে বিজ্ঞাপন:
১৮১৬ শকের চৈত্রসংখ্যা তত্ত্ববোধিনীতে রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতীন্দ্রনাথের যুগ্ম স্বাক্ষরে ‘বিজ্ঞাপন’ মুদ্রিত হয়েছিল: “১ বৈশাখ নববর্ষ। এ দিনে সকলকেই অনন্তজীবনে আর একটি নতুন সোপানে উঠিতে হইবে। যখন রাত্রি অবসন্ন এবং দিবা আসন্ন সেই সন্ধিক্ষণে শুভ ব্রহ্মমুহুর্তে অর্থাৎ পাঁচ ঘটিকার সময় শ্রীমৎ প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের ভবনে ব্রহ্মের বিশেষ উপাসনা হইবে”। এই ঘোষণা অনুযায়ী, ‘বর্ষারম্ভে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা, ‘ঈশ্বরই অমৃতসেতু’, ‘উদ্বোধন’, ‘প্রার্থনা’ ইত্যাদির মাধ্যমে ১ বৈশাখ ভোরে আদি ব্রাহ্মসমাজের নববর্ষ উৎসব পালিত হ’ল। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ নতুন কোনো গান রচনা করেননি, গত বছরের মাঘোৎসবের জন্য লেখা ‘নিত্য নব সত্য তব শুভ্র আলোকময়’ গানটিই অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়।


নববর্ষের খাওয়াদাওয়া:
পয়লা বৈশাখের খাওয়াদাওয়া হত বাড়ির দোতলার টানা বারান্দায়। তেতলায় থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। টানা বারান্দায় মেঝেতে কার্পেটের আসন লম্বা করে বিছিয়ে তার সামনে কলাপাতা ঘিরে মাটির খুরিতে খুরিতে সাজানো থাকতো—কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি, মাছের পোলাও, আম দিয়ে শোল মাছ এবং আরও নানাবিধ সুস্বাদু খাবার। শেষ পাতে থাকত দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রিয় খাবার—পাঁঠার হাড়ের অম্বল - 
‘বৃহৎ রূপার থালে    পাচক ব্রাহ্মণ ঢালে
মাংসের পোলাও গাদা গাদা
কি গুণ পাঁঠার হাড়ে    অম্বলের তার বাড়ে
কে বুঝিবে ইহার মর্যাদা।’
মৃণালিনীর তৈরি নববর্ষের জনপ্রিয় মিষ্টি ‘এলোমেলো’ কবির খেতে লাগত বেশ, কিন্তু নামটা তেমন পছন্দ না হওয়ায় বদলে তার নতুন নাম দিলেন ‘পরিবন্ধ’।


শান্তিনিকেতনে প্রথম নববর্ষ উৎসব:
১ বৈশাখ ১৩০৯ – [সোম 14 Apr 1902]– শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে প্রথম বৎসরের নববর্ষের উৎসবটি সমারোহ সহকারে অনুষ্ঠিত হল। বিভিন্ন বন্ধুজনকে এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আহ্বান করেছেন। সকলেই না হলেও অনেকে যে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সেকথা জানিয়েছেন জগদানন্দ রায়:
"প্রথম বৎসরের উৎসবে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় প্রভৃতি অনেক অতিথি আসিয়াছিলেন!! শ্রদ্ধাস্পদ মোহিতচন্দ্র সেন বোধ করি সেই উৎসবেই আশ্রমে প্রথম আসিয়াছিলেন!! বেশ মনে পড়ে লাইব্রেরির মাঝের বড় ঘরটিতে সকলে বসিয়া গল্প করিতেছিলেন এবং পাশের ঘরে জলযোগের আয়োজন হইতেছিল!! গুরুদেব 'আমারে কর তোমার বীণা' গানটি গাহিলেন; সকলে অবাক হইয়া শুনিতে লাগিলেন!! তার পরে পশ্চিমে মেঘ করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় আসিল!! মোহিতবাবু এবং আরো অনেকে ঘর ছাড়িয়া সম্মুখের মাঠে দাঁড়াইলেন! মোহিতবাবু ঝড়ের প্রতিকূলে যে প্রকারে দৌড়াইতেছিলেন তাঁহার ছবি এখনো চোখে ভাসিতেছে”।


অন্তরের নববর্ষ: 
১ বৈশাখ –১৩১৮ – [শুক্র 14 Apr 1911] – নববর্ষের দিন শান্তিনিকেতন মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ নববর্ষের উপাসনা করেন। তাঁর বক্তৃতার সারমর্ম জ্যৈষ্ঠসংখ্যা তত্ত্ববোধিনী-তে ‘অন্তরের নববর্ষ’ শিরোনামে মুদ্রিত হয়:
এই-যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আজ আকাশপ্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালো, কোথাও দরজাটি খোলবারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না, আকাশ-ভরা অন্ধকার একেবারে নিঃশব্দে অপসারিত হয়ে গেল, কুঁড়ি যেমন করে ফোটে আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল--তার জন্যে কোথাও কিছুমাত্র বেদনা বাজল না। নববৎসরের ঊষালোক কি এমন স্বভাবত এমন নিঃশব্দে আমাদের অন্তরে প্রকাশিত হয়? 


নববর্ষ - আটলান্টিক মহাসাগরে: 

১ বৈশাখ – ১৩২০ – [সোম 14 Apr 1913] এবারের নববর্ষের দিনটি রবীন্দ্রনাথ উৎযাপন করলেন আটলান্টিক মহাসাগরে ‘অলিম্পিক’ জাহাজের উপর। ৬ বৈশাখ [শনি ১৯ এপ্রিল] সকালে লন্ডনে পৌঁছে পরেরদিন তিনি অজিতকুমারকে লেখেন: “এবার আমার নববর্ষের প্রথম দিন সমুদ্র যাত্রার মাঝখানে এসে দেখা দিল। প্রত্যেকবার আমার চিরপরিচিত পরিবেষ্টনের মাঝখানে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নববর্ষের প্রণাম নিবেদন করেছি – কিন্তু এবার আমার পথিকের নববর্ষ, পারে যাবার নববর্ষ। ... তাই এবারকার নববর্ষের দিন মনকে বারবার বলিয়ে নিলুম, মন চলতে হবে, ... যদি সামনের মুখে চলবার দিকেই সমস্ত ঝোঁক দেওয়া যায় তাহলেই মিথ্যার মায়া কাটানো সহজ হবে – তাহলেই কে কি বলছে, কে কি ভাবছে, কিসে কি হবে, এসব কথা ভাবনার একেবারে দরকার হবে না”।

নববর্ষে - আলপনা: ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে এলেন প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু, তৈরি হল কলাভবন। তখনও এই প্রাচীন বৈদিক পদ্ধতিতে আলপনা দেওয়ার রীতি চালু রয়েছে। শান্তিনিকেতনের আগ্রহী পড়ুয়াদের আলপনা শেখানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ থেকে

কালীমোহন ঘোষের এক বাল্যবিধবা আত্মীয়া সুকুমারীদেবীকে নিয়ে এলেন আশ্রমে। এই সময় সুকুমারীদেবী, চিত্রনিভা চৌধুরী, ইন্দুলেখা ঘোষ প্রমুখদের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে আলপনার চর্চা পুরোমাত্রায় চলতে থাকে। বিশেষ অনুষ্ঠান বা সমাবর্তন ছাড়াও বছরে চারটি দিনে শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে আলপনা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে এখনও। প্রথমটি চৈত্র মাসের শেষদিনে বর্ষশেষের আলপনা, দ্বিতীয়টি পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের আলপনা, তৃতীয়টি ২২ শ্রাবণের আলপনা এবং চতুর্থ ২৫ ডিসেম্বরের খৃষ্টোৎসবের আলপনা। এছাড়াও প্রতিবছরই পৌষ উৎসব উপলক্ষে আম্রকুঞ্জের জহর বেদি থেকে সামনের পুরো রাস্তাটিকেও আলপনায় ভরিয়ে তোলা হয়। বর্ষশেষের আলপনা হয় সাদা রঙের। সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ওই রাতের মধ্যেই সেই সাদা আলপনা ভরিয়ে দেওয়া হয় রঙে, তাতেই সূচিত হয় বর্ষবরণের রঙিন অভ্যর্থনা।


নববর্ষ - সাংহাইতে: 
১ বৈশাখ ১৩৩১ – [মঙ্গল 14 Apr 1924] - নববর্ষের দিন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সাংহাইতে। এখানে চিন ও বিশ্বভারতীর মধ্যে অধ্যাপক ও ছাত্র বিনিময়ের যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, তিনি তাতে খুবই উদ্দীপিত বোধ করেছিলেন, সেই কথাই এদিন লিখলেন রথীন্দ্রনাথকে:
এখানে খুব আদর-যত্ন পাওয়া যাচ্ছে। বেশ মনে হচ্ছে এদের সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হবে। শাস্ত্রীমশায়কে এখানে পাঠাবার দরকার আছে। আমাদের প্রস্তাব শুনে এরা ভারি খুশি হয়েছে। ওরাও ওখান থেকে অধ্যাপক পাঠাতে সম্মত আছে। তাহলে বিশ্বভারতীতে চীনিয় ভাষা শেখবার সুব্যবস্থা হবে। চীনিয় থেকে হারানো সংস্কৃত বইয়ের তর্জমারও সুবিধা হতে পারবে। এ সম্বন্ধে বীরলা ভ্রাতাদের সঙ্গে এখন থেকে আলাপ শুরু করিস্। শাস্ত্রীমশায় ছাড়া আর কারও দ্বারা কাজ হবে না। পীকিনে একজন খুব সংস্কৃত অভিজ্ঞ রাশিয়ান পণ্ডিত আছেন। আমাদের ওখান থেকে খুব বাজে লোক এলে ধরা পড়বে।


নববর্ষের দিন কবির জন্মদিন পালন: 
১ বৈশাখ – ১৩৪৩ – [মঙ্গল 15 Apr 1936] - কবি নববর্ষের দিন লিখলেন: 
বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে
শেষধাপের কাছটাতে ।
কালো জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পা ডুবিয়ে দিয়ে।
জীবনের পরিত্যক্ত ভোজের ক্ষেত্র পড়ে আছে পিছন দিকে
অনেক দিনের ছড়ানো উচ্ছিষ্ট নিয়ে।...
এই কবিতাটিকে আমরা বলতে পারি তাঁর জন্মদিনের কবিতা। কারণ সেদিন আশ্রমে তাঁর জন্মদিনের উৎসব প্রবর্তিত হয়। পঁচিশে বৈশাখ গ্রীস্মাবকাশের মধ্যে পড়ে বলে এই বছর থেকে এই নববর্ষের দিন জন্মদিনের ব্যবস্থা হল। নববর্ষের সকালে মন্দিরে কবি যে ভাষণ দিলেন [জন্মদিন] তার মধ্যে এই কবিতাটির মর্মকথা পাই, দুটি রচনা পাশাপাশি পড়লেই সেটা স্পষ্ট হবে। এই কবিতার অনেক কথা, অনেক অভিযোগ, অনেক তত্ত্ব আছে, যেটা পাঠ করলে কবির বিষাদঘন মনের দুর্বলতা প্রকাশ পায় –
দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ
ছায়ায় পরিকীর্ণ,
যেন পাহাড়তলিতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর।...
পাথর ডিঙিয়ে আপন সীমানা চূর্ণ করতে করতে নিরুদ্দেশের পথে
অজানার সংঘাতে বাঁকে বাঁকে
গর্জিত করল না সে আপন অবরুদ্ধ বাণী,
আবর্তে আবর্তে উৎক্ষিপ্ত করল না
অন্তর্গূঢ়কে।


নববর্ষের দিন - চা-চক্রের নূতন গৃহ উদ্বোধন: 
১ বৈশাখ – ১৩৪৬ – [শনি 15 Apr 1939] – নববর্ষের শুভ দিনটিতে কবির মন চিরকালই উদ্বুদ্ধ হয়। নববর্ষের ভাষণ দান কালে কবি বলেন: “এ প্রশ্নটাই আমার মনে কিছুদিন থেকে জাগছে, কী পেয়েছ জীবনে, সব চেয়ে কী বড়ো কথা তোমার অভিজ্ঞতায়। সব চেয়ে যা আমার চোখে পড়ে সে হচ্ছে পরম বিস্ময়। আরম্ভ থেকে পদে পদে বিস্ময়ের অন্ত নেই। অন্য জীবজন্তুরা শুধু তাঁদের খাদ্যহরণে তাদের বাঁধা জীবনযাত্রায় সন্তুষ্ট, তাদের তো বিস্ময় নেই”।
নববর্ষের দিন কবির জন্মোৎসব ও দিনেন্দ্রঠাকুরের স্মরণে দিনান্তিকা নামক চা-চক্রের নূতন গৃহের উদ্বোধন হল। দিনান্তিকা শান্তিনিকেতনের মধ্যে দর্শনীয় স্থান। সে বাড়ির মধ্যে নন্দলাল-পরিকল্পিত ও কলাভবনের ছাত্রদের দ্বারা অঙ্কিত প্রাচীরচিত্র আছে। এইখানে প্রতিদিন বিকালে পদ-মান-বেতন-নিরপেক্ষ সব মানুষেরা চা-পানের জন্য জমায়েত হন। রবীন্দ্রনাথ এই চায়ের মজলিসে মাঝে মধ্যে আসতেন। তিনি জানতেন এই ভেদহীন কাঞ্চনকৌলীণ্যহীন ক্লাব আশ্রমের একটি বিশেষ প্রয়োজন সিদ্ধ করছে।  এইটা নষ্ট হয়ে গেলে শান্তিনিকেতনের সমাজ জীবনের মূলে আঘাত করা হবে। একবার বিধূশেখর ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে ‘চা-স্পৃহ-চঞ্চলে’র দল কিছু টাকা আদায় করে ভোজের আয়োজন করেন। কবি এই সংবাদ পেয়ে ‘চাতক’ নামে একটি কবিতায় লিখে পাঠান, -
কি রসসুধা বরষাদানে মাতিল সুধাকর
তিব্বতীর শাস্ত্র গিরিশিরে
তিয়াষিদল সহসা এত সাহসে করি ভর
কি আশা নিয়ে বিধূরে আজি ঘিরে।


নববর্ষে - আশ্রম সম্বন্ধে শেষ ভাষণ:
১ বৈশাখ – ১৩৪৭ – [14 Apr 1940] - ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনে [১৪ এপ্রিল ১৯৪০] কবির অশীতিতম জন্মতিথি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় অপরাহ্নে আম্রকুঞ্জে। এই উপলক্ষে চীন থেকে মার্শাল চিয়াংকাইশেক শুভেচ্ছা প্রেরণ করেন ও চীনের শিক্ষামন্ত্রী Chien Li-fu কবির উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখে পাঠান। কবি উৎসব ক্ষেত্রে, তাঁর জীবনে কি চেয়েছেন এবং কী করেছেন তার মনোজ্ঞ এক বিশ্লেষণ করেন। তাঁর ধ্যানজীবন ও ভাবময় জীবনের সাথে কর্মজীবনের যোগ হয়েছে কিনা সে কথা উত্থাপন করে বলেন যে, কর্মের সাথে তাঁর যোগ যে হয়েছে তার প্রমাণ শান্তিনিকেতন।
নববর্ষ ও কবির জন্মোৎসব উপলক্ষে কবির বহু আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও প্রাক্তন ছাত্র সমবেত হয়েছেন শান্তিনিকেতন প্রাঙ্গণে। একটি সুসজ্জিত বেদীতে কবি উপবেশন করে সম্বর্ধনা গ্রহণ করেন। এবং তাঁর ‘রাজা’ নাটকের অংশবিশেষ পাঠ করেন। 
তারপর কবি তাঁর ভাষণে জানালেন তাঁর কর্মজীবন ও ভাবজীবন একসূত্রে বাঁধা, কোনটিকেই আলাদা করে দেখা যায়না। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন: শান্তিনিকেতন। “সে লোহালক্কড়ে বাঁধা যন্ত্রশালার কর্ম নয়। কর্মরূপে সেও কাব্য। একদিন শান্তিনিকেতনে আমি যে শিক্ষাদানের ব্রত নিয়েছিলুম তার সৃষ্টিক্ষেত্র ছিল বিধাতার কাব্যক্ষেত্রে; আহ্বান করেছিলুম এখানকার জল স্থল আকাশের সহযোগিতা। জ্ঞানসাধনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলুম আনন্দের বেদীতে। ঋতুদের আগমনী গানে ছাত্রদের মনকে বিশ্বপ্রকৃতির উৎসবপ্রাঙ্গণে উদ্বোধিত করেছিলুম।
এখানে প্রথম থেকেই বিরাজিত ছিল সৃষ্টির স্বত-উদ্ভাবনার তত্ত্ব। আমার মনে যে সজীব সমগ্রতার পরিকল্পনা ছিল, তার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিকে রাখতে চেয়েছিলুম সম্মানিত করে। তাই বিজ্ঞানকে আমার কর্মক্ষেত্রে যথাসাধ্য সমাদরের স্থান দিতে চেয়েছি”।
বেদে আছে—যস্মাদৃতে ন সিধ্যতি যজ্ঞো বিপশ্চিতশ্চন স ধীনাং যোগমিন্বতি...। 


জীবনের শেষ নববর্ষ – শেষ লেখা গান:
১ বৈশাখ – ১৩৪৮ – [14 Apr 1941] - শান্তিদেব ঘোষ লিখছেন, “নববর্ষ আসছে দেখে কবির কাছ থেকে একটি গান চাওয়া হয়। প্রথমে আপত্তি করলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে...বললেন ‘সৌম্য [ঠাকুর] আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে। সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি মানবের জয়গান করিনি। তাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গান।’ কাছেই ছিলেন শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী দেবী, তিনি গুরুদেবের খাতা খুলে কবিতাটি কপি করে আমাকে দিলেন। কবিতাটি ছিল একটু বড়ো, দেখে ভাবলাম এতো বড়ো কবিতায় সুরযোজনা করতে বলা মানে তাঁকে কষ্ট দেওয়া। সুর দেবার একটু চেষ্টা করে সেদিন আর পারলেন না, বললেন ‘কালকে হবে’। পরের দিন সেই কবিতাটি সংক্ষেপ করতে করতে শেষ পর্যন্ত, বর্তমানে ‘ঐ মহামানব আসে’ গানটি যে আকারে আছে, সেই আকারে তাকে পেলাম।”
ঐ মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।
এই মহামানব কি? এ তো কোনো ব্যক্তি যাকে আমরা মহাপুরুষ বলি তাঁর আবাহন নয়। এই আবাহন কবির Man-কে, যে মানব আইডিয়ারূপে, শাশ্বত ঐক্যরূপে চিরন্তন, যে মানব ভাবীকালের অভ্যুদয়ের প্রতীক্ষায় রয়েছে। সেই দিক দিয়ে গানটি বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য:


জীবিতকালের শেষ মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ:
এই নববর্ষে কবির ‘জন্মদিনে’ কাব্যখণ্ড প্রকাশিত হয়; এটাই তাঁর জীবিতকালের শেষ মুদ্রিত কাব্য। আর এটাই কবির রোগাক্লান্ত জীবনের শেষ নববর্ষ।  জীবনের শেষ নববর্ষে - শেষ লেখা ভাষণ - পাঠ করে শোনান ক্ষিতিমোহন সেন:
এবার তাঁর জন্মোৎসবের ভাষণ হল সভ্যতার সংকট। আজও ইউরোপ ও পৃথিবীর স্থানে স্থানে যুদ্ধের যে মরণতাণ্ডব চলছে, তাঁরই কারণ বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছেন এই ভাষণে: কবি বলছেন, “সভ্যনামধারী মানব-আদর্শের এতবড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারি নি; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভিতর দিয়ে বহুকোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্যজাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য। ভারতবর্ষের জনগণের নিদারুণ দারিদ্র হৃদয়বিদারক। ... “যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত। অথচ চক্ষের সামনে দেখলুম জাপান যন্ত্রচালনার যোগে দেখতে দেখতে সর্বতোভাবে কিরকম সম্পদবান হয়ে উঠল। সেই জাপানের সমৃদ্ধি আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, ... আর দেখেছি রাশিয়ার মস্কো নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের আরোগ্য বিস্তারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়-- সেই অধ্যবসায়ের প্রভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের মূর্খতা ও দৈন্য ও আত্মাবমাননা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। এই সভ্যতা জাতিবিচার করে নি, বিশুদ্ধ মানবসম্বন্ধের প্রভাব সর্বত্র বিস্তার করেছে। তার দ্রুত এবং আশ্চর্য পরিণতি দেখে একই কালে ঈর্ষা এবং আনন্দ অনুভব করেছি।    
... এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে--
অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্‌ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি॥
ঋণঃ রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। রবিজীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল। রবীন্দ্ররচনাবলী।

বাঙালির বর্ষবরণ

প্রবন্ধ

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বাঙালির

বর্ষবরণ

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

village-fair1.jpg

চার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি পয়লা বৈশাখকে বাঙালির নববর্ষ উৎসব হিসাবে মানতেই চান না। তিনি তাঁর পূজা-পার্বণ [আশ্বিন ১৩৫৮] গ্রন্থে লেখেন, “কয়েক বৎসর হইতে পূর্ববঙ্গে ও কলিকাতায় কেহ কেহ পয়লা বৈশাখ নববর্ষোৎসব করিতেছে। তাহারা ভুলিয়াছে, বিজয়াদশমীই আমাদের নববর্ষারম্ভ। বৎসরে দুইটা নববর্ষোৎব হইতে পারে না। পয়লা বৈশাখে বণিকেরা নূতন খাতা করে। তাহারা ক্রেতাদিগকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া ধার আদায় করে। ইহার সহিত সমাজের কোন সম্পর্ক নাই। নববর্ষ, প্রবেশের নববস্ত্রপরিধানাদি একটা লক্ষনও নাই”।
নববর্ষ উৎসব – হুতোমের ভাষায়: “‌ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আদর করেন। আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে নেন – নেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরানোকে বিদায় দেন। বাঙ্গালীরা বছরটি ভাল রকমেই যাক্ আর খারাবেই শেষ হোক্‌, সজ্‌নেখাঁড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরানোকে বিদায় দেন। কেবল কল্‌সি উচ্ছুগ্‌গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন!”‌
হুতোম বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপনকে দুটি পর্বে ভাগ করেছেন, একটি পর্ব নববাবুদের উৎসব পালনের বিষয়। ধর্মীয় পূর্ণকলস উৎসর্গের মতো নববাবুরা বছর শেষকে বিদায় এবং মদের কলসী উৎসর্গ করে বাগানবাড়িতে নববর্ষকে স্বাগত জানাত। অন্য পর্ব দোকানদারদের হালখাতার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করা।


ঈশ্বর গুপ্ত’র নববর্ষ উৎসব - সাহেবদের নিউ ইয়ার পার্টিকে টেক্কা দেওয়া:
তবে, কেউ কেউ বলেন, কবি ঈশ্বর গুপ্তই নাকি প্রথম ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা করেছিলেন। কবি-সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক। তিনি বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এক বার ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর একটি বিশেষ সংখ্যাই প্রকাশ করে ফেললেন এবং সেই উপলক্ষে আয়োজন করলেন এক মহা ভোজসভা। শহরের তাবড় তাবড় ‘বাবু’ নিমন্ত্রিত হলেন সেখানে। লোকে লোকারণ্য, গমগম করছে ভিড়। এর আগে ইংরেজের উপনিবেশ কলকাতা মহানগরী এরকম জনসমাগম দেখেনি কখনও বাংলা নববর্ষে। এ যেন সাহেবদের নিউ ইয়ার পার্টিকে টেক্কা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন ঈশ্বর গুপ্ত।
সেখানে আজ চাঁদের হাট বসেছে। কে নেই সেখানে? হাটখোলার দত্তরা আছেন, জানবাজারের রাণী রাসমণির জামাই মথুর বিশ্বাস আছেন। প্রসন্ন ঠাকুর আছেন, ব্রজমোহন সিংহ আছেন। শ্যামাচরণ সেন আছেন, ধর্ম্মদাস পালিত আছেন। ঘুরে ঘুরে অতিথি আপ্যায়ন করছেন ঈশ্বর গুপ্তের ভাই রাম গুপ্ত। সভাস্থলের একদিকে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ আর জয়গোপাল তর্কালঙ্কার দুজনে এক অভিনব চেষ্টা করছেন, সংস্কৃতে কবির লড়াই। সে দেখতে শুনতে লোকজন ভিড় করে এসেছে। একটা হাসির হররা উঠল, কারণ পাশ থেকে গৌরীশঙ্কর ওরফে গুড়গুড়ে ভটচায একটা আদিরসাত্মক উদ্ভট শ্লোক বললেন।
জোড়াসাঁকো থেকে এসে পৌঁছলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শোভাবাজার থেকে আগেই এসে গেছেন রাজা রাধাকান্ত দেব। এই দুজন বাঙালি সমাজের দুটি অংশের নেতৃত্ব দেন, বাঙালির টোরি পার্টি আর হুইগ পার্টি বলতে পারেন। ওঁরা দুজনেই আজকের সভার মধ্যমণি। এককালে এই ঈশ্বর গুপ্তর উদ্যোগেই দেবেন ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে রাধাকান্ত দেবের ধর্ম্মসভার মিটমাট হয়েছিল। দেবেন ঠাকুরকে সভাস্থলে পদার্পণ করতে দেখে রাজা রাধাকান্ত দেব আসন ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। 
দুজন নক্ষত্র পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন আজ ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে। রাধাকান্ত দেব আর দেবেন ঠাকুর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে যখন কোলাকুলি করলেন, সেই সময় সমবেত জনতার উল্লাস আর জয়ধ্বনি শুনে মনে হল, বাঙালির আজ বড় সুখের দিন।
কুশল বিনিময়ের পর রাধাকান্ত আর দেবেন দুজনেই একমত হলেন, আজ পয়লা বৈশাখে ঈশ্বর তার রচিত একটি কবিতা না শোনালেই নয়। গুপ্তকবি তখন খাঁটি বাংলায় ব্যঙ্গাত্মক শব্দে নববর্ষের মৌজ-মস্তি ও খাওয়াদাওয়া নিয়ে সশব্দ ফুট কাটলেন, -
নববর্ষ মহাহৰ্ষ, ইংরাজটোলায়। 
দেখে আসি ওরে মন, আয় আয় আয়॥...
সাহেবের ঘরে ঘরে, কারিগুরি নানা। 
ধরিয়াছে টেবিলেতে, অপরূপ খানা॥
বেরিবেষ্ট, সেরিবেষ্ট, মেরিবেষ্ট যাতে। 
আগে ভাগে দেন গিয়া শ্ৰীমতীর হাতে॥... 
হিপ্‌ হিপ্‌ হোরে হোরে ডাকে হোল ক্লাস।
ডিয়ার ম্যাডাম ইউ টেক্‌ দিস্‌ গ্লাস।।


নববর্ষের ইতিহাস:
তবে বাংলা নববর্ষ পালনের সূত্রপাত ঠিক কে করেছিলেন তা বলা খুবই কঠিন। তবে কয়েকজন ঐতিহাসিক বাঙ্গলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের  প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। 


হালখাতা - চোখের জলের নববর্ষ: 
সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’। স্রেফ খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য, তারিখ-ই-ইলাহি বাদ দিয়ে নক্ষত্রের নামানুসারে লিখিত বঙ্গাব্দ নতুনভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। চৈত্র সংক্রান্তির পরের দিন পহেলা বৈশাখ। উর্দু শব্দ পহেলা শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রথম এবং বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ যে একটি শুভদিন এ কথা শাস্ত্র বা বাংলা পঞ্জিকা কস্মিনকালেও দাবি করেনি। বছরের আর পাঁচটা দিনের মত এটি ছিল সাধারণ একটি দিন। তবে, এই দিনে সবচেয়ে আনন্দে থাকতেন বাংলার শাসক ও জমিদারেরা। তাঁদের কাছেই একমাত্র দিনটি শুভ ছিল। 

 

পয়লা বৈশাখ ছিল জমিদারদের খাজনা উসুল উদযাপনের দিন। বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে রাজ পুণ্যাহ (রাজকর আদায়ের উৎসব) পালন করা হত। সেই সময়ে পুণ্যাহ আর বাংলা নববর্ষ সমার্থক ছিল। ফেলে আসা বছরের বকেয়া খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য হতেন প্রজারা। এবং জমিদারের কাছারি থেকে নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। প্রজাদের অর্থশোক ভোলাতে চোখের জলে ভেজা পুণ্যাহ-এর মধ্যে সুচতুর ভাবে উৎসবের রঙ মেশানো হয়েছিল। মিষ্টিমুখের সঙ্গে সঙ্গে গান বাজনা, যাত্রা, মেলা প্রভৃতি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত প্রজাদের জন্য। প্রজাদেরই পয়সায়। ১৯৫০ সালে ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট-এর অধীনে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে। সেই সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায় পয়লা বৈশাখের রাজ পুণ্যাহ প্রথা। রয়ে যায় খাওয়া দাওয়া আর উৎসবের অংশটুকু।  


বাবুদের নববর্ষ পালন:
প্রথম বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখটি পড়েছিল ইংরেজি ১২ এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে। সোমবার। বঙ্গবাসী বাংলা ও ‌ইংরেজি দুটো নববর্ষ উনিশ শতকে কীভাবে পালন করত তার অনবদ্য বর্ণময় বিবরণ পাওয়া যায় হুতোম–‌এর নকশায়:‌ 
“বাবু আমোদ করতে যাবেন, তাই বাবুর স্ত্রীকে চুনট করা উড়ুনিটা, সোনায় কাজ করা হাতির দাঁতের ছড়িটা, রুমালটা হাতের উপর তুলে দিতে হত। রুমালটা হাতে নিয়ে হয়ত বাবু দেখলেন তাতে বোকে মাখানো নেই। ব্যাস্‌!‌ বাবু রেগে লাল, বললেন, বোকেটা আবার গেল কোথায়?‌ বাড়ির ‘‌মেয়েছেলেটা’‌ এটুকুও খেয়াল রাখতে পারে না। সে কি রাজকার্য করে!‌ কিসের জন্য তা হলে বিয়ে করা”?‌...

এদিকে শহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁসর ঘন্টার শব্দ থামলো। সকল পথের সমুদায় আলো জ্বালা হয়েছে। ‘বেলফুল’! ‘বরফ’! ‘মালাই’! চিৎকার শুনা যাচ্ছে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েছে অথচ খদ্দের ফিরছে না। ক্রমে অন্ধকার গাঢাকা হয়ে এল। এ সময় ইংরাজি জুতো, শান্তিপুরে ডুরে উড়ুনি আর সিমলের ধুতির কল্যাণে রাস্তায় ছোটলোক ভদ্দরলোক আর চেনবার যো নাই।’ তুখোর ইয়ারের দল হাসির গররা ও ইংরেজি কথার ফররার সঙ্গে খাতায় খাতায় এর দরজায় তার দরজায় ঢুঁ মেরে বেড়াচ্ছেন – এরা সন্ধ্যা জ্বালা দেখে বেরোলেন আবার ময়দা পেষা দেখে বাড়ি ফিরবেন! মেছোবাজারের হাঁড়িহাটা – চোরবাগানের মোড়, জোড়াসাঁকোয় পোদ্দারের দোকান, নতুন বাজার, বটতলা, সোনাগাছির গলি ও আহারিটোলার চৌমাথা লোকারণ্য – কেউ মুখে চাদর জড়িয়ে মনে কচ্চেন কেউ তাঁরে চিনতে পারবে না। আবার অনেকে চেঁচিয়ে কথা কয়ে, কেশে, হেঁচে, জানান দিচ্ছেন যে, তিনি সন্ধ্যার পর দুদণ্ড আয়েশ করে থাকেন।... নববর্ষ - শোভাবাজার রাজবাড়িতে:ধনী রাজগৃহে পয়লা বৈশাখে বসত শাস্ত্র-আলোচনা-সভা। সভা শেষে বাঈ-নাচের আসর।

রাজা রাধাকান্ত দেববাহাদুরের (১৭৮৩-১৮৬৭) আমলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে পয়লা বৈশাখে বসত তেমনি পণ্ডিত সম্মেলন। ভিন্ন পরিবেশের সে উৎসবের আদ্যোপান্ত ছবি মেলে দীনবন্ধু মিত্র-র (১৮৩০-১৮৭৩) সুরধনী কাব্যে—বসিয়াছে বাবুগণ করি রম্য বেশ,মাথায় জরির টুপি, বাঁকাইয়া কেশ,বসেছে সাহেব ধরি চুরুট বদনে,মেয়াম চকিছে ওষ্ঠ মোহন ব্যঞ্জনে,নাচিছে নর্তকী দুটি কাঁপাইয়ে কর,মধুর সারঙ্গ বাজে কল মনোহর,বাঙালীর নববর্ষ ও সঙদের গপ্পো:কোলকাতাতে সঙদের আবির্ভাব হয় বাবুকালচারের সময় থেকে। নানারকম পোষাক ও রঙিন সাজে সেজে, গান, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্টি করা হত হাস্যরস। মূলত গ্রামীণ লোকেদের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি হলেও, সময়ের সাথে সাথে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের হাত ধরে এটি চলে আসে শহরাঞ্চলে। ঊনবিংশ শতক থেকেই কোলকাতা ও হাওড়াতে অঞ্চলভিত্তিক সঙদের শোভাযাত্রা বেরোতে থাকে। সেই দিনে কোলকাতার গলি ও রাজপথের বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানালায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। কলকাতা হয়ে উঠত মিলন মেলার নামান্তর। গৃহস্থঘরে অতিথির জন্য তৈরি হত শরবত। থাকত পান তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের উপর সামিয়ানা টাঙানো হত। তথাকথিত ইঙ্গবঙ্গ যুবককে নিয়ে লেখা সঙের গান —

“এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপচোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপমুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপএকমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যান...তৎকালীন বাঙালি সমাজে বছরভর যে সব ঘটনা, দৃশ্য বা কথা দাগ কেটেছে তা আলোকিত হত সঙের ছড়ায় আর গানে। 

জোড়াসাঁকোয় নববর্ষ উৎসব: 
সরলাদেবী চৌধুরানী লিখছেন: আমাদেরও একটি পারিবারিক উৎসবের দিন ছিল যেদিন পরস্পরকে আলিঙ্গন প্রণামাদি করা হত। সে নববর্ষে, ১লা বৈশাখে। নতুন কাপড় পরার কতকটা রেওয়াজও সেইদিনটিতে ছিল। এক হিসেবে এইটিই আমাদের যথার্থ পারিবারিক মিলনের দিন। সেদিন অতি ভোরে ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেউড়িতে ঘণ্টা বেজে উঠত। ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে উঠে, বাড়িসুদ্ধ পুরুষেরা সকলে প্রস্তুত হয়ে নবশুভ্রবস্ত্র পরিধান করে, উঠানে উপাসনা-সভায় সমবেত হতেন, আর মেয়েরা খড়খড়িতে। উপাসনাদি হয়ে গেলে বয়সের তারতম্য অনুসারে প্রণাম আলিঙ্গনাদি শেষ করে মেয়েমহলেও-সরবৎ পান করান হত বাইরে—তার বাড়ির লোকদের সেদিন সকলের একত্র ভোজন হত মধ্যাহ্নে। 


রবীন্দ্র সাহিত্যে নববর্ষ:
বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ ও নববর্ষকে নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও বাংলা ভাষার কবিরা কম কাব্য রচনা করেননি। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বৈশাখ। অবশ্য কবির জন্মদিনটিও বৈশাখেই। আজ এই ভয়ংকর অতিমারীর দিনে, আর রাজনৈতিক হিংসার আবহে রবীন্দ্রনাথ বহুদিন আগেই তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, -
নববর্ষ এল আজি
       দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনে নি আশার বাণী,
       দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়।
প্রতিকূল ভাগ্য আসে
       হিংস্র বিভীষিকার আকারে;
তবু নববর্ষের গল্প বলতে গিয়ে সেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, “আজ নববর্ষের প্রাতঃসূর্য এখনো দিক্‌প্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করে নি--এই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমরা আশ্রমবাসীরা আমাদের নূতন বৎসরের প্রথম প্রণামটিকে আমাদের অনন্তকালের প্রভুকে নিবেদন করবার জন্যে এখানে এসেছি। এই প্রণামটি সত্য প্রণাম হোক। 
এই-যে নববর্ষ জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, এ কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে? আমাদের জীবনে কী আজ নববর্ষ আরম্ভ হল? 
এই-যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আজ আকাশপ্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালো, কোথাও দরজাটি খোলবারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না, আকাশ-ভরা অন্ধকার একেবারে নিঃশব্দে অপসারিত হয়ে গেল, কুঁড়ি যেমন করে ফোটে আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল--তার জন্যে কোথাও কিছুমাত্র বেদনা বাজল না। নববৎসরের ঊষালোক কি এমন স্বভাবত এমন নিঃশব্দে আমাদের অন্তরে প্রকাশিত হয়? 
… কিন্তু, মানুষ তো পুরাতন আবরণের মধ্যে থেকে এত সহজে এমন হাসিমুখে নূতনতার মধ্যে বেরিয়ে আসতে পারে না। বাধাকে ছিন্ন করতে হয়, বিদীর্ণ করতে হয়--বিপ্লবের ঝড় বয়ে যায়। তার অন্ধকার রাত্রি এমন সহজে প্রভাত হয় না; …


নববর্ষ - রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন: 
১ বৈশাখ – ১৩৪৩ – [মঙ্গল 15 Apr 1936] - কবি নববর্ষের দিন লিখলেন: 
বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে
শেষধাপের কাছটাতে ।
কালো জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পা ডুবিয়ে দিয়ে।
জীবনের পরিত্যক্ত ভোজের ক্ষেত্র পড়ে আছে পিছন দিকে
অনেক দিনের ছড়ানো উচ্ছিষ্ট নিয়ে।...
এই কবিতাটিকে আমরা বলতে পারি তাঁর জন্মদিনের কবিতা। কারণ সেদিন আশ্রমে তাঁর জন্মদিনের উৎসব প্রবর্তিত হয়। পঁচিশে বৈশাখ গ্রীষ্মাবকাশের মধ্যে পড়ে বলে এই বছর থেকে এই নববর্ষের দিন জন্মদিনের ব্যবস্থা হল। নববর্ষের সকালে মন্দিরে কবি যে ভাষণ দিলেন [জন্মদিন] তার মধ্যে এই কবিতাটির মর্মকথা পাই, দুটি রচনা পাশাপাশি পড়লেই সেটা স্পষ্ট হবে। এই কবিতার অনেক কথা, অনেক অভিযোগ, অনেক তত্ত্ব আছে, যেটা পাঠ করলে কবির বিষাদঘন মনের দুর্বলতা প্রকাশ পায় –
দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ
ছায়ায় পরিকীর্ণ,
যেন পাহাড়তলিতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর।...
পাথর ডিঙিয়ে আপন সীমানা চূর্ণ করতে করতে নিরুদ্দেশের পথে
অজানার সংঘাতে বাঁকে বাঁকে...
সে বছরের ৪ঠা বৈশাখ [১৭ এপ্রিল, ১৯৩৬] রাণু মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, কল্যাণীয়াসু তোর চিঠিখানি পেয়ে খুশী হলুম। … কাল রাত্রে এসেছি আশ্রমে। গরম নিশ্চয়ই— কিন্তু তা নিয়ে নালিশ করে লাভ নেই— জন্মেছি গরম দেশে। কবিতা লেখবার সময় লিখতে হয়েছে, “সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে”— যত গরমই হোক কথাগুলো আর ফিরিয়ে নেবার জো নেই। নববর্ষের আশীৰ্ব্বাদ। ইতি ৪ বৈশাখ ১৩৪৩ ভানুদাদা


বাঙালীর বর্ষবরণ ও খাওয়াদাওয়া:
বাঙালির বাঙালিত্ব এখন কিঞ্চিৎ সংকুচিত, অর্থাৎ আ-নোলামস্তক৷ জিভ দেখেই এখন বাঙালি চেনা যায়৷ বিশেষ করে এই নববর্ষে৷ সারা বছর মাখন-পাউরুটি কিংবা সিরিয়ালে প্রাতরাশী বাঙালির ঘরে আজ ধন্য লুচি, তোমার মহিমা ত্রিভুবনে৷ আর হবে না-ই বা কেন? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বঙ্গবীর বলছে, 
সাহেব মেরেছি! বঙ্গবাসীর
কলঙ্ক গেছে ঘুচি।
মেজবউ কোথা, ডেকে দাও তারে।
কোথা ছোকা, কোথা লুচি?
বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ অবশ্য আহার্য, এটা কোথাও কখনোই প্রচলিত ছিল না। কেননা বৈশাখ একটি খরার মাস, যখন কোনো ফসল হতো না আর কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুবই সাধারণ আর ছোট আকারে। কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ও চাল ভিজিয়ে রাখতেন। সকালে কৃষক সেই চালপানি খেয়ে হালচাষ করতে যেত। দুপুরবেলায় কাজের ফাঁকে পান্তা খেতো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে আবার কখনো কখনো একটু শুঁটকি, বেগুন ভর্তা বা আলু ভর্তা দিয়ে। কবির ভাষায়- 
“পান্তা ভাতে মরিচ-পেঁয়াজ
গরম ভাতে ভর্তা
সকাল বিকাল খেয়ে জবর  
ঘুমায় গাঁয়ের কর্তা।”
রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। রন্ধনপটিয়সী প্রজ্ঞাসুন্দরী, তৈরি করলেন কিছু অদ্ভুত নামের সমস্ত রান্না যেমন, ‘দ্বারকানাথ ফিরনি পোলাও’, ‘রামমোহন দোল্‌মা ভাত’, ‘সুরভী পায়েস’ ইত্যাদির সঙ্গে সেই নববর্ষে যুক্ত হল আরও একটি নতুন পদ। কবির জন্ম মাসে প্রজ্ঞাসুন্দরীর নতুন উদ্ভাবন— শীতশেষের ফুলকপি, খোয়া ক্ষীর, বাদাম-কিসমিস, জাফরান আর সোনা-রূপার তবক দিয়ে তৈরি বরফি (শোনা যায় বাদাম জাতীয় মিষ্টি নাকি কবির অত্যন্ত পছন্দের ছিল)। তিনি তার নাম দিলেন ‘কবি-সংবর্ধনা বরফি’। রবীন্দ্রনাথ যেমন জানতেন —‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়’:
শোভন হাতের সন্দেশ, পানতোয়া,
          মাছমাংসের পোলাও ইত্যাদিও
যবে দেখা দেয় শোভামাধুর্যে-ছোঁওয়া
          তখন সে হয় কী অনির্বচনীয়!


নববর্ষের চিঠি:
হালখাতা, নতুন বইয়ের আবির্ভাব, লেখক-প্রকাশক মিলন — এ সবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে। নববর্ষের চিঠির আবেগের গভীরতা বুঝি অনেকের কাছেই অতলান্ত!  প্রায় শতবর্ষ আগে ১৩২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘কল্যাণীয়াসু রাণু’-কে লিখলেন, আজ আর বেশি লেখবার সময় নেই— কেননা আজ তিনটের গাড়িতেই রওনা হতে হবে। গাড়ি ফেল্ করবার আশ্চৰ্য্য ক্ষমতা আমার আছে— কিন্তু সে ক্ষমতাটা আজকে আমার পক্ষে সুবিধার হবে না। অতএব তোমাকে নববর্ষের আশীৰ্ব্বাদ জানিয়ে আমি টিকিট কিনতে দৌড়লুম। ইতি ২ বৈশাখ ১৩২৫ শুভাকাঙ্ক্ষী শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা রানী চন্দকে অবনীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘‘নববর্ষে নতুন বন্ধুর জন্য বসে আছি, কবে এসে সে গল্প শুনবে আমার কাছে।’’ স্বামী বিবেকানন্দ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ধীরামাতাকে (ধীরামাতা, বিখ্যাত বেহালা বাদক ওলিবুলের স্ত্রী সারা সি বুল। শান্তওধীর প্রকৃতির জন্য স্বামীজী তাঁকে 'ধীরা মাতা' বলে ডাকতেন​।) লিখছেন, প্রিয় ধীরামাতা, শুভ নববর্ষ আপনার নিকট আসুক এবং বহুবার এভাবে আসতে থাকুক—এই আমার আকাঙ্ক্ষা। আমার স্বাস্থ্য পূর্বাপেক্ষা অনেক ভাল আছে এবং আবার কাজ করবার মত যথেষ্ট শক্তি পেয়েছি। কিন্তু নববর্ষের চিঠি স্মৃতি হয়ে গেছে চিরকালের মতো। আধুনিকতা আর প্রযুক্তি কি তা হলে মুছে দিচ্ছে নববর্ষের চিঠির আবেগকে? বইপাড়ার বই পাকে বৈশাখে:
আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইঁট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।
মনে আছে এই কবিতাটা? তেমনি একসময় বইপাড়ার নতুন বইগুলিও পেকে উঠত বৈশাখের আগেই৷ বই পাকা? কথাটায় কানে একটু খটকা লাগলেও এক সময়ে এই পয়লা বৈশাখ কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়ায় গিয়ে অকস্মাৎ শেলফের কোনও বই ধরে টান মারতে গেলেই প্রকাশক হাঁ হাঁ করে উঠতেন, ওটা নয় ওটা নয়, অন্য কপি দিচ্ছি, ওটা কাঁচা আছে এখনও! অর্থাৎ বাঁধাইয়ের আঠা শুকোয়নি৷ এখন অবশ্য বাঙালির বই পাকানোর অধিকাংশ উদ্যোগ, মাঘের শীতে, বইমেলায়৷


নববর্ষে রাস্তায় গান গাইতেন উত্তমকুমারঃ
একসময় পয়লা বৈশাখে দক্ষিণ কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলের সামনে সকাল বেলায় রাস্তার ওপর বাঁধা খোলা মঞ্চে গান গাইতেন মহানায়ক উত্তমকুমার। শুধু তিনি কেন, সমকালের চলচ্চিত্র জগতের তাবড় ব্যক্তিত্বরা হাজির হয়ে নিজেদের অনুষ্ঠান পরিবেশন করতেন। আসলে সকালে সেখানে বসত জলসা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক সহ সে সময়ের সব নামি দামি গায়করা হাজির হতেন সেখানে। মানুষ বসে থাকত রাস্তা জুড়ে। সব শ্রোতা দর্শককে মিষ্টি মুখ করাতেন আয়োজকরা। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হত সকলকে।
সূত্র: রবীন্দ্ররচনাবলী। ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা। ইন্টারনেট। স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলী। হুতোম পেঁচার নকসা। যোগেশচন্দ্র রায় - পূজা-পার্বণ

জুন ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page