জুলাই
২০২৪
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
পিসেমশাই বাবাকে বললে "না, না, পিন্টুদা কত কি জানার কত কি বোঝার আছে বিয়ে না করলে জানতেই পারতাম না"। বাবা মুচকি হেসে বললে "কি কি জানলে?"
- "খুব সিম্পল, যে আমি কিছুই জানিনা সেটাই তো জানতাম না। মাথায় গোবর পোড়া। মা আমাদের ঠিকমত মানুষই করেনি। এমন কি জানো দাঁত মাজা ও নাকি শেখায় নি।" বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে পিসেমশাইর।
বাবা মুখে অসাংবিধানিক কথা বলে না। বেকায়দায় পড়লে আছি অথচ নেই টাইপ হাসি দিয়ে ম্যানেজ করে। বাবা সেরকম ই হাসি দিলে ঠোঁট চেপে।
মেজকা ঘরে ঢুকেই ক্যাঁচটা লুফে নিল।
- "ঠিক বলেছ সুভাষ। আমরা কেউই মানুষ হইনি। কোন এটিকেট সেন্স নেই। শব্দ করে চা খাই, বোতল থেকে গলায় ঢেলে ধক ধক করে জল খাই। কচ কচ করে গাজর চিবিয়ে খাই। জোরে জোরে কথা বলি। লুঙ্গি পড়ি বাড়িতে। পুরো প্রিমিটিভ ব্যাপার স্যাপার। কোনো ব্যাটা সভ্য এটা করে না। সব অসভ্য ব্যাটা চাকরি, ব্যবসা করে খাচ্ছে। দেশের উন্নতি করছে।
পিসেমশাই চারিদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললে "সভ্য হল বউ। উনি যা যা করেন সেটাই সভ্যতা। বাকি সব বুঝতেই পারছেন।
মা চা নিয়ে ঢুকে দাড়িয়ে পিসেমশাই এর কথা শুনে ফেলেছে। চা এর ট্রেটা রেখে মা হাসতে হাসতে বললে "দাড়ান, ছোড়দি কে বলছি"।
পিসেমশাই ভীতু মানুষ। মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল "এই দেখো বৌদি, আমি তো ইয়ার্কি করছিলাম।"
বাবা, মেজকা ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। বাবা বললে
- "সুভাষ ভয় পেয়েছে। তোমার নামের সঙ্গে ভয় কিন্তু মানায় না"। পিসেমশাই প্রথম একটু হাসব কি হাসব না ভেবে তারপর সবার সাথে মিলে হাসতে থাকলে।
রবিবারের সকালবেলা ছোট পিসি আর পিসে মশাই চলে এসেছে। আমাদের বসার ঘর জমজমাট। পিশেমশাই এমন মানুষ যে এলে বেশ একটা হালকা হাসির হাওয়া বয়ে যায়। ছোট বড় সবার সঙ্গেই সমান আড্ডা চালাতে পারে। একটা সহজিয়া ব্যাপার আছে পিসেমশাইয়ের মধ্যে। মা, মেজ কাকিমা খুব পছন্দ করে পিসেমশাইকে। গোবেচারা সরকারি অফিসে চাকরি করে। বাবা যে বাবা সে ও দুচার বার মুচকি মুচকি হেসে ফেলে। প্রশ্রয় ও আছে তাতে, মজাও আছে তাতে।
মেজ কাকা এই ব্যাপারে বেশ মজা পেয়ে বললে "দাদা থাকলে হয়ত কেনিয়া বা ঘানার পুরুষরা কি ভাবে বিয়ের পর নিজেকে নতুন করে জানত সেটা জানা হত"।
বাবা বললে "কি আর করা, দাদার মিশন স্কুলের গরমের ছুটি অনেক দেরী"।
আজ ছুটির দিন। ঠাকুমা তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে দুপুরের পর ফিরবে তাই মুরগির মাংস হবে বাবা ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে গতকাল রাত্রেই। ছোট পিসি খুব মুরগি ভালো বাসে।
চা খেতে খেতে মেজকা ঘোষণা করে দিলে আজ উনি ওনার শিল্প কর্ম দেখাবেন। আমি শিউরে আছি। কি হয়, কি হয়। পিসেমশাই একবার আবদার তুলে ছিল উনি নাকি দারুন একটা চিকেনের পদ শিখেছেন আজ রেঁধে তাক লাগিয়ে দেবেন। মেজকা ঠাকুমার অনুপস্থিতির সুযোগ ছাড়তে নারাজ। কাকিমাকে হুকুম করলে আমার রান্না করার ড্রেস টা নিয়ে এস।
কাকিমা চোখ গুল্লু গুল্লু করে বললে "কেন? ওটা কিসের জন্যে লাগবে? তুমি আবার নাটক করবে নাকি? ওটা তো তোমার নাটকের ড্রেস ছিল। তাহলে তো আমাদের দুপুরের খাওয়া আর হলো না"।
মেজকা বললে "উঁহু, আজ আসল রান্না হবে। ওটা নাহলে চলবে না। যে কাজ করব সেটাই সুন্দর করে করা চাই। মা এই সুযোগে বলে দিয়েছে "যা খুশি কর। কিন্তু রান্না হলে রান্না ঘরের সব কিছু গুছিয়ে, ধুয়ে রাখতে হবে। যেমন তেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে চলবে না। তাহলে কাল রান্না করতে গিয়ে আমাদের কাল ঘাম ছুটে যাবে।
সে যাই হোক। মেজকা একটা জম্পেশ তেলে ঝোলে মাখা মাখা কালো ব্রাউন একটা কিছু রান্না করেছে। মা জিজ্ঞাসা করলে "কি আইটেম করলে ঝন্টু?"
খুঁন্তি নাড়তে নাড়তে উত্তর এল "চিকেন ঝিনচাক"
- "এ্যাঁ, কি বললে? মার হেঁচকি ওঠার মত অবস্থা।
- "চিকেনের ধিন তাক? একি তবলার বোল নাকি?"
- "বৌদি? মেজকা হতাশ। এটা হচ্ছে চিকেন ঝিন চাক"।
বাবা ও কেমন নার্ভাস হয়ে গেল "খাওয়া যাবে তো"?
একটু নুন কম ছিল। একটু ঝাল ঝাল পানসে তবু মেজকার মুখে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। দেখলে তো সবই ছেলেরা পারে। আসলে ছেলেরা পারে না এমন কিছু হয় না।মেজ বৌদি তেমন কিছু বললে না। কারণ মেজকা শুনবো না।
বিকেল অবধি পুরুষ রা সব পারের জয়ধ্বনি উড়িয়ে তিনজনে পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের খুঁটি যখন পুঁতে ফেলেছে তখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে ঠাকুমা ফিরলে। ঘরে ঢুকেই মেজকা, বাবা আর পিসে মশাইয়ের সবজান্তা ভাব দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলে তারপর আর থাকতে পারলে না ।ঠাকুমা বললে "তোরা বলছিস রান্না জানিস।"
- "হ্যা, জানি তো।" মেজকা অকুতোভয়। ঠাকুমা বললে
- "তাহলে এক কাম কইরা দ্যাখা। কাল রান্না কইরা খাওয়া তালের বড়া, চিতই পিঠে, চিতল মাছের মুঠ্যা, তেঁতর ডাল লাউ দিয়া,বাবা প্রতিবাদ করে উঠলে "ওসব স্পেশাল রান্না বাদ দাও। রোজকার যা মন চায় বল।" মেজ কাকিমা এতক্ষণে একটু বুকে বল পেয়েছে, বললে
- "কেন? ওগুলো তোমাদের আমরা রান্না করে খাওয়াই না? কর, করে খাওয়াও"। ঠাকুমা বললে
- "ছাড়ান দে"। বলে বাবাকে বললে
- "তোর জামাখান দে।" বাবা অবাক।
- "কেন কি করবে?"
- "দে। খুইলা দে।" বাবা বিরক্ত হয়ে জামা খুললে । ঠাকুমা উঠে আলমারি খুলে সূঁচ সুতো বার করে দিলে। দেখা গেল বাবার পাঞ্জাবির একটা বোতাম নেই। ঠাকুমা কি করতে চাইছে ঠিক বুঝতে পারছি না। বোধহয় লাগিয়ে দেবে বোতাম। ঠাকুমা সে পথে গেল না। বললে
- "শুধু সূঁচে সুতো ভইরা দে। তারপর কথা ক। দেখি তোদের দৌড়"। মেজকা হাঁ, হাঁ করে অবহেলার হাসি দিয়ে বলল
- "মা, তুমি কি আমাদের কচি খোকা পেয়েছ? আমি এটা ছোটবেলা থেকেই জানি। এত জলের মত সোজা। এমন কি এটা যে সোনা মুখী সূঁচ সেটাও জানি। আগে বাবার শার্টের বোতাম সেলাই করার সময় কে ভরে দিয়েছে মনে নেই?" ঠাকুমা মুচকি মুচকি হাসছে। মেজকার আর তোর সইছে না, বাবা কে বললে "দে, দে, দাদা দে"। বাবা বললে
- "আমাকে দিয়েছে, আমিই ভরে দেখিয়ে দিচ্ছি। মা তুমি আরেকটু কঠিন কিছু দিলে পারতে"। এই বলে অবহেলা ভরে সূঁচটা বাবা এদিক ওদিক দেখলে। সুতোর রিম থেকে সুতো বার করে বললে
- "এই দেখো এমনি করে ধরবে আর আসতে করে ফুঁটো দিয়ে সুতোর মুখটা ঢুকিয়ে দেবে ব্যস কাজ শেষ"। এবার বাবার মুখটা একটু ত্যারছা হল।
- "ও হয় নি? এই তো। অনেকদিনের প্র্যাক্টিস নেই তাই। ঠিক আছে, এই দেখো" বলে বাবা আবার সুতোটা ঠেললে। দেখলাম সুতোটা ফুটোর মুখে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল। এবার বাবা একটু সিরিয়াস। ও মনে পড়েছে, বলে সুতোর মুখটা মুখ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। হাতে নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বললে
- "অনেকদিন বাদে তো তাই প্রথম মনে পড়ছিল না।" এবারও কিন্তু ঢুকলে না । ঠাকুমা দূরে হাত পাখার হওয়া খাচ্ছে। আর মুচকি মুচকি হাসছে। এবার বাবার চোখের মণি দুটো কাছাকাছি চলে এল। বেশ গম্ভীর লাগছে যেন মন দিয়ে দড়ির গিঁট খুলছে। পিসেমশাই একবার বললে
- "পিন্টুদা এটা আমাকে দিন। অতি সহজ ট্রিক আছে। বাবা নাছোড়। আবার নতুন করে সুতো মুখে ভিজিয়ে সরু করে গভীর মনোযোগ দিয়ে সুতোটা ঢোকালে। এবার দিব্যি সুতোটা ভিতর দিয়ে চলে গেল। বাবা মুখ সরিয়ে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বললে
- "এই নাও মা। এত সোজা কাজ আমায় দিয়া দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাবা অতি উৎসাহে ঠাকুমার সঙ্গে বাঙাল ভাষায় কথা বলে। কিন্তু পর মুহূর্তে বাবার মুখ শুকিয়ে গেল। সুতোর মধ্যে সূঁচ নেই। কি ষড়যন্ত্রে সূঁচ আলাদা সুতো আলাদা। মেজকা বললে
- "দেখলি তো ওত কনফিডেন্স ভালো নয়। তুই ভাবছিস হয়ে গেছে কিন্তু দেখ হয় নি"। এবার ঠাকুমার দিকে চেয়ে বললে
- "মা এটা কেমন ঠাট্টা হল? আমাদের আর কোন কাজ নেই? এসব কাজ মেয়েরা করে। কিন্তু আমরাও জানি। কোন ব্যাপার নয়। তুমি অন্য কিছু দাও। দেখছো দাদার চোখের পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছে"। বাবা এক ধমক দিল,
- "ঝন্টু, বড্ড বার বেড়েছিস। আমি তো তোকে চিনি। তুই এসব কোন দিনই পারবি না।"
ঠাকুমা হাত পাখা নাড়িয়েই যাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। পিসেমশাই বললে,
- "আমাকে দিন পিন্টুদা। এটা কোন ব্যাপার নয়। আগে যত রকমের ঘুড়ির কল করা, পায়জামার দড়ি ভরা সব সুক্ষ কাজ আমিই করতাম"। বাবা কোন চান্সই পেল না। পিসেমশাই সূঁচ আর সুতো হাতে নিয়ে বললে,
- "এই দেখো, এই তুমি সুতো নিলে। তারপর হাত দিয়ে সুতোটাকে সরু করে নিলে। চাইলে ভিজিয়ে নিতে পারো।" যেন স্কুলের বিজ্ঞান টিচার পড়াচ্ছে। মেজকা আর ধৈর্য রাখতে পারলে না।
- "তারপর তারপর? আগে বারো"। পিসেমশাই বললে,
- "সূঁচটা সোজা করে ধরতে হবে। ঠিক এইভাবে। সুঁচের ওপরের দিকে গর্ত তার মধ্যে দিয়ে অবলীলায় তোমাকে বেরোতে হবে। ঐটাই তোমার টার্গেট। ভালো করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে যেন তুমি অর্জুন। সূঁচ শুধ্ব সুতো পরালে তবেই দ্রৌপদীকে পাবে। কোন তাড়াহুড়ো নয়। আসতে আসতে লক্ষ্যের দিকে সুতোর মুখ চেপে ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে"। বাবা দূরে বসা ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে পিসেমশাইকে বললে,
- "কি তুমি কি খেলার ধারাবিবরণী দিচ্ছ?"। এরপরটা খুব গৌরবের হল না। তিন চার বার গোত্তা খেয়ে সুতো সূঁচএর গা বেয়ে কোন বার পাশ দিয়ে কোন বার নীচের দিকে চলে গেল। পিসেমশাই চারিদিকে হতাশ চাহনি দিয়ে বললে এরকম আলো কম হলে কি করে চলবে? মা এটা তো ষড়যন্ত্র"। মাঠে আলো কমের অ্যাপিল করলে। ঠাকুমা দুর থেকে হেসে জামাইকে বললে,
- "আমি ভইরা দেই?" মেজকা অপমানে লাল হয়ে উঠলে।
- "মা তুমি সবাইকে ঠকাতে পারলেও আমাকে পারবে না"। বলে পিসেমশাই এর হাত থেকে ঝপাত করে সূঁচ সুতো নিয়ে নিলে। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললে,
- "আমি এতক্ষণ সবাইকে দেখছিলাম কি করে। এইবার বল মা সুতো পরালে কি দেবে?" মা মেজ কাকিমা হৈ, হৈ করে উঠলে।
"মা ওরা কিছু করলে কেন প্রাইজ চায়? আমরা তো রোজদিন এই করছি। এই সামান্য সুঁচে সুতো পড়াতে পারছে না আবার পরালে প্রাইজ চাইছে। এসব চলবে না"। ঠাকুমা আজ পণ করেছে বাবা, কাকা, পিসেমশাইকে ল্যাজে গোবরে করবেই। ঠাকুমা কোন উত্তর দিলে না, বললে
- "দেখি ঝন্টুর ক্যারামতি। মেজকা পিসেমশাই আর বাবাকে বললে "তোমরা সূঁচএর গর্তটাই ঠিক মত দেখতে পাওনি। আমি আর বিশেষ কিছু বলব না। করে দেখিয়ে দিচ্ছি তাহলে তো শান্তি হবে? ঠাকুমা ফোঁকলা দাঁত বার করে খিক খিক হাসতে লাগল। মেজকা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সামনের চুলগুলো পিছনে ফিরিয়ে দিল।তেল চক চকে নাকটা মুছে এবার সূঁচ সুতো হাতে নিয়ে মেজকা প্রথম যেটা করলে পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে ফেললে। বাবা ফোরণ কাটলে।
- "হাতা গোটাচ্ছিস? মারবি নাকি? মেজকা তীব্র দৃষ্টিতে সূঁচএর দিকে তাকিয়ে বললে,
- "ওটা একাগ্রতার জন্যে লাগে। এবার দেখ আমার কামাল"। কাকিমা, মা কাছে এসে ঝুঁকে পড়েছে। আমি অপারেশনটা দেখতে মার ঘাড় সরিয়ে তাকিয়ে আছি নিস্পলক কি হয় কি হয়। এতক্ষনে শেষ হবে ঠাকুরমার টাস্ক। ঠাকুমা খানিক দূরে খাটে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে।কোন হেলদোল নেই। কোন উত্তেজনা নেই। মিটিমিটি হাসছে। হাতা গুটিয়ে বললে
- "ইসস এই কয়দিন আগেই ফেস বুকে এসেছিল। কেন যে সেভ করে রাখলাম না কে জানে। পিসেমশাই উৎসাহ দিলে "সুতোটা পরিয়ে দিন তারপর জমিয়ে চা আর মুড়ি খাব। কাকিমা ফুট কাটলে" চা আর মুড়িটা খেয়ে নিলেই ভালো করতে। দেখুন খাওয়া হয় কিনা"। মেজ কাকা এর মধ্যে তুলে নিয়েছে সুতো আর সূঁচ। মেজকার দুটোকে সামনে নিয়ে এসেছে। বাবা, আমি পিসে মশাই জানি এবার ঠিক পারবে ঝন্টু। এরপর মেজ কার মুখটা একটা হল বটে। বেশি কনসেন্ট্রেশন করতে গিয়ে মুখ টা ছুঁচলো হয়ে গেছে। জিভটা বেড়িয়ে এসেছে কোন দিয়ে। দুই ভুরু প্রায় লেগে যায় আরকি। যেন ঘড়ির মেকানিক। চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে এসেছে। একটু একটু করে নিয়ে এসে ঢোকালে। কিন্তু বেমালুম বেড়িয়ে গেল পাশ দিয়ে। আজ কি হল কে জানে। আমার মোবাইল নেই তাই তুলে রাখতে পারলাম না সেই জোকারের মতন মেজকার মুখ। ঠাকুমা বললে
- "হইসে তোদের? আর কবি মেয়েরা যা পারে তোরাও তাই পারিস? মেজকা একটু নরম হয়ে বললে
- "অনেকদিন প্র্যাকটিস নেই। আরেকটু সময় দাও ঠিক করে দেব। মাথা চুলকে একটা যুক্তি খাড়া করে বললে" সত্যিই আলোটা বড় কম। আগে তো আমি তোমায় করে দিয়েছি। এটা মা তুমি ঠিক করো নি। সকালে করলে দেখে নিতাম তোমার চ্যালেঞ্জ"। ঠাকুমা বললে
- "আমার সন্ধার পুজো হয় নাই। আমি উঠলাম। তোরা লইরা যা"। সে এক বিশ্রী করুন দৃশ্য। এত বড় বড় বিরাট দেশ উদ্বার করা, বুলি আওড়ানো মানুষগুলো ল্যাজে গোবরে মাখামাখি অবস্থা। বুলি সব শেষ। শুধু সুতো নিয়ে গুঁতোগুঁতি চলছে তো চলছেই। ছেড়ে পালিয়েও যেতে পারছে না। রাত বাড়ছে, রাগ বাড়ছে। চেষ্টা চলছে তো চলছে। এমন সময় মা এসে বললে চিও বই গুছিয়ে রাখ, তুমি খেয়ে নাও, কাল সকালে স্কুল আছে। বুঝলাম মা হাল ছেড়ে দিয়েছে। খেয়েদেয়ে ওপরে চলে গেছি। মেজকা, বাবা, পিসেমশাই লড়ে যাচ্ছে। আমার ভোর বেলা স্কুল। ছয়টার সময় নীচে নেমে বেরোচ্ছি দেখি মাটিতে টানা ঢালা বিছানায় বাবারা তিন মূর্তি চিৎপাত হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তিন রকম অদ্ভুত ঘড় ঘড় শব্দ ঘর কাঁপাচ্ছে। গতকাল খুব পরিশ্রম গেছে। সামনে টেবিলে সূঁচ আর সুতোটা আলাদা আলাদা পড়ে আছে। ওদের সারারাতেও এক করা যায় নি।
কবিতা
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
ভাবিয়া আপন
তরে ভাবিয়া আপন
রাখলাম করে যতন
এ দেহ পিঞ্জরায়।।
আশ্বাসে ভর করিয়া
বুকে বিশ্বাস রাখিয়া
জীবন যাত্রা বাহিয়া
আসা যাওয়া তোমার ইচ্ছায়।।
যাবার যদি ছিলো ধান্ধা
করালে কেন মায়ায় বান্ধা
এ পিরিতের জালে কান্দা
পদে পদে বিপদ ঘনায়।।
আদর সোহাগে ছিলো না কমতি
তবুও ভালবাসায় বসালে যতি
ফিরে না চাইলে একরত্তি
বুকের পাঁজর ভাঙ্গে ব্যথায়।।
চলে যাওয়ায় হারালাম হুস-
জ্ঞানশূন্য পিঞ্জিরা নাহি সেথা প্রাণ
লাশ বলে সবাই নিয়ে যান
অন্ধকার মাটির ঘরে রাখার দায়।।
নীতি আছে মুখে
নীতি আছে মুখে, কাগজে
রীতি শুধু অমান্য কাজে
নাই নীতির ধারা এ সময়ে।।
কোন আশার আশে
মন স্বপ্ন দেখে ভাল সাজে
প্রীতিহীন নীতি,দু:খ বুকে লয়ে।।
মন মানে না বাঁধা
নির্বাসনে ভক্তি শ্রদ্ধা
বিষাদে ঘুরে গুরু হয়ে।।
নীরব রাতে ঘুম ঘুম প্রাতে
ভাবি নিরলে হারালাম সাথে
রীতি নীতির কথা ক্ষয়ে।।
আর কি হবে না সুপ্রভাত
আচরণে নাকি দীপ্তির আঘাত
চিত্তে বোধ শ্রদ্ধা হারিয়ে।।
কবিতা
সুকান্ত দেবনাথ
বিদ্যাসাগর পল্লী, দুর্গাপুর
নিশিকান্ত ও একটি স্থির ছবি
আমি জানি মুখোমুখি বৃষ্টির থাকলে আর ফ্রাস্টেশনের কথা মাথায় থাকে না
রাত তার নিজস্ব অক্টপাস নিয়ে তখন বেহেস্ত উদার
ফ্যানায় ভাসে দেহ আর
ঊর্মির খুলে রাখা অ্যাবসার্ড রঙের ব্রা থেকে যে গন্ধ ছড়ায়
তার কাছে নিশিকান্ত ওঃ
পরিণত হয় হাইব্রিড অন্ধকারে
আলো পিছন থেকে আপ্রাণ ডাকতে থাকে দাঁড়াও দাঁড়াও আমি
এই তো সেদিন কারখানা ফেরত এক কয়লা চোরের কাছে
সংক্রমিত কঙ্কালে পেয়েছি
সে বলেছে তার নামও নিশিকান্ত ছিল
লুকিয়ে অন্ধকারে তাকে বুঝিয়ে বলেছি
পরাবাস্তব ছিল সে আলো যে পোশাক ভেদ করেছিল
নিশিকান্ত অযথাই মাঝে পড়ে গেল
এক প্যাসিভ দৃষ্টিকোণ যদিও সে জানে
নিশিকান্ত ছেলে কোলে করে হেঁটে যায় অচেনা প্রান্তরে
প্রান্তর বেজন্মা রতি-হীন লবণাক্ত জলে ডুবে থাকা অবসেশন দ্যাখে
ভেতরে ডাকবেন না ----
ঊর্মি সেই বিষাদ রঙের জামা পরে আছে
ঝুলে আছে বিগত রাত আর আগামী রাত্রির মাঝের তফাৎ
আমি বলেছি
এই সব দলাদলি আর বিষ মাখানো ঠোঁট
নিশিকান্ত পাঁচিল টপকে দেখে ছিল
কয়েকজন শ্রমিক নেতা দাঁড়িয়ে আছে
মুখে জটিল গন্ধ
নিশিকান্ত সে গন্ধ চেনে তার পকেট ভর্তি বিষ
সায়ানাইডের ফাইল সে সঙ্গে করে ঘোরে
তারপর না টাকায় না দারিদ্রে না মদে না শরীরে
শুয়ে থেকে ভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর কি হতে পারে
এই ঘর, অহেতুক স্বপ্ন পতনের শব্দ
সেদিন এক ভিখারি এসেছিলে
তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেছে, চায়নি
উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি হতে পারে
কারখানা ফেরত যে কামিনকে সে ডেকে ছিল
সেও তো তার বুকের ছেলেকে পাশে রেখে দেখিয়েছে
কর্মঠ মানুষের অসাধারণ পারফর্মেন্স
আঃ সেকি করাপশন, অস্থির পাগল পারা
দেখেছি
শহরের নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঊর্মি১ ঊর্মি২ ঊর্মি৩ ঊর্মি৪ --
শূন্যতায় স্পার্ক
অশরীরী হাত বাড়াচ্ছে তুলে নেব কোলে নাকি
তুমি তুমি তুমি একাত্ম হয়ে তাকিয়ে দেখছ বৃষ্টির মাঝে যে মাঠ
ভরে উঠেছে জলে তার মাঝে এক সরলতা স্কুল ছুটির পরেও
একা দাঁড়িয়ে আছে
তার খেলার সাথী নেই
ভিজে যাচ্ছে একটানা, রেখে যাচ্ছে বিষণ্ণ এক ফুটবল
ফেলে যাচ্ছে তাকে মাঠের মাঝে
কেউ খেলার নেই
একটা স্থির ছবি আছে কোথাও
একটি মাঠ একটি ছেলে আর একটি বল
কবিতা
পার্থ সরকার
অকল্পনীয় ঘরে ফেরা
চাঁদের ওপর জলকণা
রাত্রি নামে হাতে
করুণা শেষে
ঘরে ফিরেছে কথা,
ব্যথার পরে ধ্বস্ত রূপকথা?
ছেঁড়া প্রহেলিকা
জলবিভাজিকায় কথকতা
সাধনার ওপর রেখেছে হাত শব
কতদূর যাবে রহস্য
ঘর বন্ধের চাবিহাতে?
সীমান্ত নেই
তাই কথা নেই
থই থই উঠানে
একাই সাঁতার কাটে মেঘ।
এক সোজা হওয়া পথে
এক সোজা হওয়া পথে
ভেঙে
নুইয়ে পড়ে আছে রোদ
মঠের মধ্যপদতলে
উড়ে যায়
ভয়ে ভয়ে
ঘুম ঘুম ক্ষয়রোগের দিকে
তাপের অস্ফুট উড়ান
বিবিধ ঘনত্ব নিয়ে গভীর ঘণ্টাধ্বনির দিকে সান্ধ্য পদক্ষেপ
নাছোড় শূন্য লগ্নিপথে
পড়ে থাকে
এক বান্দা
কারোর কথা না শোনার।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
তুমি কি বন্ধু!
তুমি কি বন্ধু পেরেছো আমার সবটুকু নিতে কেড়ে
আঁখি হতে মোর কান্নাটুকু পারো নি তো নিতে পেড়ে।
রেখে গেছো ভুলে স্বরলিপি তুমি ব্যথার আখরে লেখা
মুছতে চেয়েও পারো নি মুছতে নয়নে স্মৃতির রেখা।
প্রেমের পুতলি তাও রেখে গেলে এ বুকে কবর গেড়ে
আঁখি হতে মোর কান্নাটুকু পারো নি তো নিতে পেড়ে।
প্রেমের পূজার দেবতা তুমি তোমার চরণ তলে
অঞ্জলি মোর দিয়েছি আমার দুই নয়নের জলে।
বিরহ তাপিত বেদনা আমার এই যে কাঁটার মালা
বিধি হয়ে তুমি লিখেছো ললাটে কত যে যাতনা জ্বালা।
বন্দীশালার শিকল ছিঁড়ে যাওনি আমারে ছেড়ে
আঁখি হতে মোর কান্নাটুকু পারো নি তো নিতে কেড়ে।
আজকের পুজো
প্রাচীন শরৎ নতুন হল, স্বর্নালী ওই কাশের বনে
ইউটিউবে বিশ্বজুড়ে মহালয়ার বোধন শোনে।
স্ক্রীনসেভারে ত্রিনয়নী, ওয়ালপেপারে সিংহবাহন
পাসওয়ার্ড-এ দুর্গানামে আগমনীর নিশিযাপন।
বাদল মেঘ বিদায় নিল, নীল আকাশে বকের সারি
থিমের দেশে, সাবেক বেশে, গণেশ যাবে মামার বাড়ি।
সাইকেডেলিক আলোর খেলা, রাত্রি জাগা চিকেন রোলে
কার্নিভালে পা মিলিয়ে, বন্ধুরা সব সেলফি তোলে।
পড়ছে ছায়া কাশের গোছার, কূল ছাপানো নদীর জলে
হঠাৎ করেই শীতের আমেজ, পাতা ঝরা গাছের তলে।
অনলাইনে আড্ডা জমে, উপচে পড়ে ফোনের স্ক্রীন,
প্রাচীন প্রথা যাক না মুছে, উৎসব হোক চিরকালীন।
কবিতা
রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
নতুন বছর বলল হেসে
থাকছে সারপ্রাইজ!
মুলোয়-পাতায় জব্বর মিল
ব্রাইট সানরাইজ।
ধনে মানে বাড়বাড়ন্ত
থাকবে না টেনশন।
দুখ্খু টুখ্খু বে়চতে পার
ডব্বল রিডাকশন।
কারবার আর ব্যবসাপত্রে
বৃহস্পতি তুঙ্গে।
বিদ্যে বোঝাই ভিড়বে জাহাজ।
সরস্বতীর সঙ্গে।
মদ্দা কথা ইনভারম্যান্ট
ফুলেল বসন্ত।
আঙুল চাপে উঠবে হেসে
কুসুম ফুটন্ত।
কবিতা
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ
ঘাস ফুল হোক ছোট্ট খাটো
চাষী নয় এলেবেলে।
পাঁকের গোড়ায় মস্ত পদ্ম
দলটা বদল হলে।
বাংলা দেখো জগৎ মাঝে
হবেই বড় মস্ত।
দেশ গঠনের সোনার চেয়ার
পাছায় পেলে আস্ত।
এসব শুনে "নোটা- বোতাম"
ছোট্ট আলপিন-
ফুল বাবুদের নরম পাছায়
ফুটিয়ে বলল সেদিন--
"হারামজাদা নতুন বছর
সোনার পাথর বাটি!
নির্বাচনের ইস্তেহারে
মিথ্যে মিছিল হাঁটি।
কবিতা
সাহেব সেখ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
শৈশব হারিয়ে গেছে
শৈশব হারিয়ে গেছে, দারিদ্রের অন্ধকারে,
সময়ের যাঁতাকলে, মানুষের জীবন ঘোরে।
শৈশব হারিয়ে গেছে, দারিদ্রের অন্ধকারে,
সময়ের যাঁতাকলে, মানুষের জীবন ঘোরে
শুধু একটি আশা, রয়ে যায় মনের ভেতর,
সেই আশায় মানুষ বাঁচে, খুলে যায় খুশির দোর।
শুধু একটি আশা, রয়ে যায় মনের ভেতর,
সেই আশায় মানুষ বাঁচে, খুলে যায় খুশির দোর।
দারিদ্রের কষ্টে মানব, নিজের আবেগ করে দান,
নাপাওয়ার বেদনায় সরব, চোখের জলে সব ভাসান।
একটু একটু করে মানুষ, ক্ষুধার আগুনে পোড়ে।
জীবনটা তীর বিহীণ ধনুষ, সেটাকে সম্পূর্ণ বোঝে।
শৈশব হারিয়ে গেছে, দারিদ্রের অন্ধকারে,
সময়ের যাঁতাকলে, মানুষের জীবন ঘোরে।
শুধু একটি আশা, রয়ে যায় মনের ভেতর,
সেই আশায় মানুষ বাঁচে, খুলে যায় খুশির দোর।
কবিতা
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
স্বপ্ন দেখা
আমি ভেঙে চুরে শুরু করলাম আবার স্বপ্ন দেখা
অনেক বিষাদ যন্ত্রণা আছে স্মৃতি পটে লেখা
আগুনএ পুড়িয়েছি আমার প্রতিচ্ছবি
স্বপ্ন গুলো ঢেউ খেলে যায় যখন অস্তাচলে রবি
প্রতিচ্ছবি প্রতিচ্ছবি তুমি থেকেও তবু নেই
ফিরে ফিরে আসে স্মৃতি বিষণ্ণ হয় কবি
তবু ভেঙে চুরে শুরু করলাম আবার স্বপ্ন দেখা
স্বপ্ন আসে স্বপ্ন ভাসে মন ছবিতে লেখা
আমি আবার ভেঙে চুরে শুরু করলাম নতুন স্বপ্ন দেখা
দুঃসপ্ন গুলো হাত ছানি দেয় স্মৃতি পটে একা।
দাঁত তুলতে গিয়ে
চণ্ডীচরণ ষাট বছরের পা দিল আজ ভোরে
সারাটা দিন ঘুরে ঘুরে কাজ করে রোদ্দুরে।
শরীর টরীর সব ঠিক আছে শুধু দুটি দাঁত
পোকায় খেয়ে পোকার বংশ করছে বাজিমাত।
ডাক্তার বলে- "এত্দিন পর এলেন আপনি কেন?"
--- "ডাক্তারবাবু ইয়ে মানে লজ্জা লাগে যেন।
না না ডাক্তারবাবু হাত দেবেন না দাঁতে
যন্ত্রপাতি দেখলে আমার ব্যথা বাড়ে ক্ষতে।
তার চেয়ে বরং এমন বেডে শুয়ে খানিক থাকি
ঘন্টাখানেক শুয়ে থাকলে অসুবিধা নাকি ?
মনকে তবু প্রবোধ দেব দাঁত তুলতে গিয়ে
ফিরে এলাম ডাক্তারবাবুর সুপরামর্শ নিয়ে।"
কবিতা
দিলীপ কুমার মধু
পূর্ব বর্ধমান, পঃ বঙ্গ
কবিতা
সঞ্জীব হালদার
গড়িয়া, কলকাতা
(জন্মস্থান- কলিকাতা, শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতা “বসন্তের দুপুর” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে।)
আমাদের হারাবার কিছু নেই
আমাদের হারাবার কিছু নেই
শৈশবের খেলনা হারানো কান্না নেই
আমাদের হারাবার কিছু নেই
স্কুল কলেজের পরীক্ষায় পাস নম্বর হারানো নেই
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই বেকারত্বে প্রেম হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই সংসার হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই অলি-গলি, রাস্তা-রাজপথ হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই উত্তরসূরি হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
পার হয়ে গেছে আজ অর্ধেকটা জীবন!
কিছুই কি হারাবার নেই?
সবই কি প্রাপ্ত হয় জীবনে?
আছে ভয় মূল্যবোধ হারানোর
আছে ভয় মনুষ্যত্ব হারানোর।
হয়তো
হয়তো, মন ভালো নেই
হয়তো, কাজে আছ ব্যস্ত,
হয়তো, দিচ্ছে না শরীর—
এই সতত্ সংঘাতে।
হয়তো, আমার দুঃখ কমার পাত্রপূর্ণ,
হয়তো, তোমার দুঃখ ভরার পাত্র খালি।
হয়তো, সব-ই ভুল
হয়তো, কিছু ঠিক।
হয়তো, বিরক্ত হবে পরে
হয়তো, অর্থহীন কিছু পেয়ে—
হবে খুশী—
হয়তো, অনন্ত এই পথচলায়, ডেকে বলবে
‘একটু ছায়ায় বসি’।
কবিতা
রথীন্দ্রনাথ বড়াল
কলিকাতা
অশ্রুলিখিত
বারণ বলে বলিনি, এ-কথা ভেবোনা।
নিষেধ না মানা আমার দুইহাতই জানে গন্তব্য কঠিন, কন্টকপূর্ণ, রহস্য-অন্ধকারের পথ।
অভাবী বোনের কথা শুনতে শুনতে, অভাবী ভাইয়ের, হাঁ করে তাকিয়ে থাকার দিকে আমার দু'চোখ অশ্রু লিখিত।
ধানক্ষেতে, নতুন ফুটে ওঠা ভাতের কথা ভাবতে ভাবতে, উনুনের আঁচ এসে পড়ে রোদে।
খিদে আসে।
আরও খিদে, তারা আসবে-কি-আসবেনা এই গুনতে গুনতে, জল খেয়ে ভরে নিই পেট, খানিক রোদ ও হাওয়া। আর খুব সকালে উঠে দেখি, একটা সুন্দর কবিতা গজিয়ে উঠে বসে আছে, উদরে, নতুন পৃথিবী জুড়ে আমার।
কবিতা
সুপ্রভাত মেট্যা
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ
গল্প
ভাই বোনেরা চলে যেতেই ধুম করে দরজা বন্ধ করল দিমা। বন্ধ করার মধ্যেই একটা রাগ ফুঁটে বেরোচ্ছে। নভেম্বর এর কলকাতা। হালকা শীতের আগমনকে ঠেকিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। কিছুটা গুমোট হয়ে আছে। একদুবার দূরে আকাশে সামান্য ঝিলিক দিয়েছে। অকাল বৃষ্টি হলেও হতে পারে। নীচের প্যান্ডেলের আলোগুলো খুলছে ইলেকট্রিশিয়ান। দুচারটে ডেকরেটর এর বাসনের শব্দ ভেসে আসছে। ওপরের তলায় বাসর ঘরে পিছন ফিরে সাত্যক ঘড়িটা খুলতে খুলতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখলে দিমা ফুলের মালাটা পড়ার টেবিলে গোল করে নামিয়ে রাখছে। মুখ বেশ গম্ভীর সেই যেমন সারাদিন ছিল। সেই শুভ দৃষ্টি থেকেই পাঁচের মত মুখ করে আছে। বিয়ে থেকে বৌভাত তেমন সুযোগ হয় নি কথা বলার। তবে বেদম চটে আছে সেটা জানা। মাথার গোঁজা কাঁটা গুলো খুলে রাখছে। দেয়ালে, খাটে, টেবিলে ফুলের সমারোহ। বেশ লাগছে ওকে। নতুন গয়নার রিন রিন শব্দ এখন ঘরময়। খাটের চার কোণে রজনী গন্ধা থেকে আর খাটে ছড়ানো গোলাপের পাপড়ি যেন ফুলের গালিচা, এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। শুধু রজনীগন্ধা নয়, তার সঙ্গে কিছু বেলী ফুল ও আছে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেশ কিছু কার্ড, কাগজ চিরকুট বেরোলো। দু একজন বন্ধুর বিজনেস কার্ড। কাল সকালে উঠে সব ডেকরেটর, লাইট, টাকা নিতে আসবে। বাসন নিতে আসবে ঠাকুর। খাটের এক ধারে বসে এতক্ষণে মনে হল আজ ফুলশয্যা। দিমা ধড়াচূড়া ছেড়ে ছুড়ে বিরক্ত হয়ে বললে "আপনার ঘরে র সাথে এটাচড বাথ নেই? আশ্চর্য্য"।
"আছে তো। পর্দার জন্যে দেখতে পান নি। এই যে" বলে দেখিয়ে দিলে। ঠাকুরদার করা দোতলা বাড়ি। দরজা জানালা আধুনিক নয় কিন্তু সব শাল আর সেগুন কাঠের। বড় বড় উঁচু ঘর।
এরপরই এদিকওদিক তাকিয়ে দিমা বললে " আপনার রিমোটটা কোথায়?"
সাত্যক মুচকি হাসল "আমার রিমোট"?
দিমার এক মাথা কালো চুলের কয়েকটা মুখের ওপর চলে এসেছে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থায় মুখ ঘুরিয়ে ক্লান্ত এক হাসি দিল "আপাতত এসির হলেই চলবে"। সাত্যক খেয়াল করলে দিমাকে হাসলে ভারী সুন্দরী লাগে। হাসলেই এক মুহূর্তে বয়সটা হুস করে পাঁচ সাত বছর কমে যায়। বড় বড় চোখ দুটো ও হাসতে থাকে। দাঁতগুলো ঝকঝক করছে সুন্দর গঠন সাজানো। পান পাতার মতন ফর্সা মুখে দু গেল হালকা টোল পড়ে।
সাত্যক নতুন শ্বশুর বাড়ি থেকে আসা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা রিমোটটা তুলে দিলে।
দিমা র একটা বেশ সহজ ব্যাপার আছে যেটা খুব আকর্ষণীয়। দু পা দোলাতে দোলাতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলাতেই বললে "আমার কিছু কথা আছে। আপনার শোনা খুব দরকার।"
সাত্যক খুব সহজ ভাবে বললে "বলুন"। শোনবার জন্যে তো বসেই আছি"।
দিমা চুড়ি, বালা, হার খুলতে খুলতে একবার স্থির দৃষ্টিতে দেখলে। তারপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল "আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন? বলেছিলাম কিনা আমার তরফ থেকে অসুবিধা আছে ভাঙার?
সাত্যক এর মুখে হাসি হাসি মুখটা দেখে মাথাটা আরো গরম হয়ে গেল দিমার। মুখটা বেঁকিয়ে তেড়ে ওঠে
"চুপ কেন? যেন কিছুই জানেন না? বলেছিলাম কিনা? আমাকে দেখতে এসে বুঝেছেন নিশ্চয়ই যে আমি একদম ন্যাকামি পছন্দ করিনা। লজ্জা ব্যাপারটা আমার বেশ কম"।
পাঞ্জাবিটা খুলতে খুলতে বলে -
"হ্যাঁ সেতো দেখেইছি। আমার মা, পিসি, কাকা, ভাই আমি এসেছিলাম দেখতে। সেখানে যা দেখালেন সেটা দেখে আমি কেন আমার বাড়ির সবাই তো তাজ্জব। এরকম লজ্জাহীন মেয়ে দেখতে হবে বোধহয় কেউ আসেনি"।
"তাহলে দিলেন না কেন ভেস্তে?"
"আপনার অসুবিধাটা কি?"
এবার দু পা তুলে বাবু হয়ে বসে দিমা। হাত তুলে মেজাজে বলে "দুর ওসব ছাড়ুন তো। আমি তো দিদি আর মাকে বলেই দিয়েছিলাম আমি যাবো না জ্যাঠার বাড়ি। নেহাত শেষ মুহূর্তে জ্যাঠা ডেকে পাঠালেন তাই আসতে হল"।
"হ্যাঁ, এরকম কেউ মেয়ে দেখেছে কিনা সন্দেহ। আপনি এলেন অনেকক্ষণ পর একটা বাড়িতে পড়া সাধারণ শাড়ি পড়ে। ঘরে ঢুকলেন শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে। যাই বলুন বেশ মজা লেগেছিল"।
"আপনার মজা লাগতেই পারে কিন্তু ঐযে ন্যাকামি করে হাত গুটিয়ে সবাই মিষ্টি সামনে নিয়ে বসে ছিলেন ,সেটা খুব অন্যায়। একেই এটা জ্যাঠার বাড়ি ,তারপর এতজন এক সাথে চলে এসেছেন।মেয়ে দেখার খুব মজা তাই তো? এতকিছু মিষ্টি চা অ্যারেঞ্জ করা কি কম কথা? আপনাদের কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? তারপর আবার হাত গুটিয়ে বসে আছেন? আমি কি খাইয়ে দেব ভেবেছিলেন?"
সাত্যক হেসে মাথা নাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বলে "কেউ অচেনা লোকের বাড়িতে মিষ্টি দিলেই গপাগপ মুখে ঢোকালে কি ভালো দেখাত? সবাই ভাবত ছেলের বাড়ি কোনো ভদ্রতা জানে না। তবে আপনি ঢুকে যে রকম ধমক দিলেন তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করার জন্যে সেটা কিন্তু বেশ লা জবাব"।
"আমি তো ভেবেছিলাম ওতেই ভেঙে যাবে সম্বন্ধটা।"
"কিন্তু ভাঙল না, তাইতো?"
"ওসব বাজে কথা রাখুন। আপনি তো আমার কথা শোনেন নি। এরকম খ্যা, খ্যা করে হাসবেন না। এখন এটাও জেনে রাখুন আপনার সাথে বৈবাহিক জীবন রাখা আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। কি করবেন আপনি ভেবে নিন। আমি চাইনি এ বিয়ে হোক তবু আপনি....।"
সাত্যক সেই মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রাখে "আমি দেখলাম খেয়াল করে যে আপনার রাগী রাগী মুখটাই বেশি সুন্দর হাসি মুখের চেয়ে।"
"কি বলতে চাইছেন? কিছুটা গলা তুলে বলে দিমা। সাত্যক দু হাত জোড় করে ইশারায় গলা নামাতে বলে" ঠিক আছে কোনো চাপ নেই। জানতে পারি আপনি কেন বিয়ে করতে। চাইছিলেন না? আমি কি পাত্র হিসেবে খারাপ? আপনার কোন প্রেমিক?"
মাথা নাড়ে "আপাতত ওর অসুবিধা আছে বিয়ে করতে। মা দিদির আর তর সইছে না তারপর জ্যাঠা ও জেঠিমার তাগাদা। একটু থেমে বলে "আপনি তো মশাই ভয়ানক খারাপ লোক। এতবার বলা স্বত্বেও বিয়েটা না করলেন না। কারণটা কি? জানতে পারি কি? আপনার অন্য কোনো অন্য উদ্দেশ্য আছে নাকি? নাহলে জেনে শুনে। বেচে দেবার ধান্দা করছেন নাকি? কথা আর শেষ করেনা। চেয়ে থাকে সাত্যকএর মুখের দিকে।
সাত্যক মাথা নাড়ায় "আজ থাক। আজ ফুলশয্যা ।কাল পরশু এক সময় বলব না হয়।"
ফুল শয্যা? মুখ বেঁকিয়ে হাসে দিমা। মাই ফুট।
কি ভেবেছেন কি?"
একেবারেই পাত্তা দেয় না সাত্যক। কথা ঘুরিয়ে বলে
"আপনার এই দিমা নামটা কিন্তু বেশ। জানেন তো আমি আমার দিদিমা কে দিমা বলে ডাকতাম"।
"বাসর ঘরে কথার কি ছিরি"। লোকটা বোকা না বদমাইশ বোঝা যাচ্ছে না। কিছু তো একটা এই বিয়ের পিছনে উদ্দেশ্য আছে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না।
দিমা বললে "আমাকে কিন্তু পরশু থেকে অফিসে এ জয়েন করতে হবে"।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সাত্যক বলে "আমি বলি কি আপনি আরো কিছুদিন ছুটিতে থাকুন। অনেক আত্মীয়স্বজন যারা বৌভাতে আসতে পারেনি যেমন পিসিমা, দিদিমা এরা আসবে আপনি না থাকলে কেমন দেখায়?"
"ওসব জানি না। অফিসে আমাকে পরশু যেতেই হবে"।
কিছুক্ষণ সাত্যক চেয়ে রইল। তারপর বললে "এই অফিসটা মনে হয় ছেড়ে দিলেই ভালো।"
"মানে? মেজাজ সপ্তমে ওঠে দিমার" ঠিক এইটাই ভাবছিলাম কখন বলেন। আপনি আমাকে কি পেয়েছেন? যাবো যখন বলেছি যাবোই"।
সাত্যক চুপ করে যায়। পাঞ্জাবিটা খুলে, ফুলগুলো সরিয়ে এক পাশ করে খাটে শুয়ে পড়ে। দিমা অনেকক্ষণ প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করে তারপর খাটের ওপর পাশে গা এলালো।
শুয়ে মনে হল মা, দিদি কি করছে কে জানে? বাড়িতে মামা মাসী মামা তো ভাই, বোনেরা ভর্তি।শুধু ওকেই এই খতরনাক লোকটার সঙ্গে বনবাসে পাঠিয়ে দিল। এমন একটা আস্ত বদমাইশ লোকের সঙ্গে খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ে দিলে? লোকটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এ কি একটা ভালো চাকরি করে ব্যস। সেখানে খোঁজ নিলে কি করে হবে? কোথায় কোথায় যায় কাদের সঙ্গে মেশে জানা খুব দরকার না তো কি? এই লোকটার আসল রূপ ফাঁস করে তবে বেড়িয়ে যাবে এখান থেকে।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে দিমার চোখটা বুজে এসেছিল। হঠাৎ কি একটা প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে একটা নতুন বালিশ, খাট তোষক অচেনা একটা ঘর। ওহ! মনে পড়ল আজ তো ফুলশয্যা। বদমাইশ লোকটা উল্টো দিকে ফিরে হাঁটু মুড়ে অনেকটা দূরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে একটা হালকা আলো জ্বলছে। পাশে জানলার পর্দা ভেদ করে রাস্তার আলোর ছটা এসে পড়েছে ঘরে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। দিমা উঠে বসলে। এমন একটা পরপুরুষ শুয়ে আছে একই খাটে। হঠাৎ ভীষণ অস্বস্তি হল। কেন শেষ মুহূর্তে কেন না করতে পারলে না যখন সাত্যক বিয়েটা কাঁচিয়ে দিলে না? এবার শব্দটা বোঝা গেল একটা নীল আলোর ঝলকানি ঘরের মধ্যে আর সঙ্গে কর, কর, করাত করে সামনে কোথাও বাজ পড়ল। ঝড় বৃষ্টি বাজ পড়া এগুলো দিমা একদম সহ্য করতে পারেনা। "ওরে বাবারে", চিৎকার করে দিমা সাত্যকএর গায়ের ওপর গিয়ে পড়লে। সারাদিনের প্রচুর পরিশ্রম এর পড়ে ঘুমটা জাঁকিয়ে এসেছিল। হঠাৎ এরকম আচমকা গায়ের ওপর পড়াতে হুড়মুড় করে উঠে বসে সাত্যক। "কে? কে? দিমাকে দেখে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করে "কি হয়েছে? কিছু কি ভেঙে পড়েছে। কোন বিপদ?"
দিমা এই সুযোগে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। "দুর মশাই। কোথায় থাকেন? দুম দারাক্কা যখন তখন বাজ পড়ছে আপনাদের এখানে আর আপনার ঘুম হচ্ছে? কালা নাকি আপনি?" মনে মনে বিড়বিড় করলে এটাতো চেক করেনি মা জ্যাঠামশাই।
একেই ধাক্কা ধাক্কি তে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে তারপর আবার উল্টোপাল্টা অনুযোগ। গুম হয়ে ভাবল এখন কথা কাটাকাটি, রাগারাগি করলে ঘুমটা চটে যাবে। তার থেকে চুপচাপ পাশ ফিরে বাকি ঘুমটা শেষ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সাত্যক দিমার রাগত মুখটা এক ঝলক দেখে আবার ওপাশ ফেরে।
মেঘের গর্জন কমেছে। বৃষ্টি কিন্তু অঝোরে পড়েই যাচ্ছে। জোর ক্রমশ বাড়ছে, সঙ্গে হাওয়া। আগামী দুদিন সাত্যক এর সঙ্গেই ওর বাড়িতে শাশুড়ি, ননদ, ও দেওরের সাথে কাটাতে হবে। ভাবতে ভাবতে আবার চোখ বুজে এল। ফুলশয্যা একটা কাটল বটে।
মালবিকার ফোন এল ফুল শয্যার পরের দিন দুপুরে। "কিরে কেমন কাটছে? বর, শ্বশুর বাড়ী কেমন রে?
সাত্যক খেতে বসে শুনল। মুখ চেপে, নীচু গলায় দিমা বললে
"গিয়ে বলব। অনেক কথা আছে। এখন রাখছি। সাত্যক মোবাইল দেখতে দেখতে খাচ্ছিল। দিমার কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল। ননদ মুখ চিপে হাসল কথা শুনে। দিমা অফিসে যাবেই। এই মালবিকাটা কে?
দুপুরে খেয়ে উঠে শোবার ঘরে এসে দিমা বললে "বিকেলে আমি একটু বেরোব কিছুক্ষণের জন্যে।"
"কিন্তু পিসেমশাই পিসিমা আসবেন বলেছেন বউ দেখতে"।
দিমা চুপ করে গেল তারপর বললে" কখন আসবেন ওনারা?"
"সাতটা সাড়ে সাতটা হবে মনে হয়। পিসেমশাই অফিসে থেকে ফিরে আসবেন"।
চট করে ভেবে বললে "ওকে আমি তার আগেই ফিরে আসবো"।
সাত্যক বিশেষ কিছু বললে না। উদাস হয়ে সিগারেট ধরালে। মনে মনে একটা অপরাধ বোধ হচ্ছিল যে সিগারেট এর ধোঁয়ায় হয়ত আপত্তি হতে পারে দিমার। কিন্তু প্যাকেটটা ঢোকাতে গিয়ে আটকে গেল।"
কি ব্র্যান্ড? একটা হবে? অনেকদিনের নেশা। কেউ সামনে খেলে আরো ...."। সাত্যক কিছুটা অবাক হয়েই এগিয়ে দিল প্যাকেটটা। শুধু তাকিয়ে বললে "পুরনো দিনের লোক সব। সবার সামনে খেলে ওদের একটু খারাপ লাগতে পারে।
...,......................
মালবিকা সবটা শুনে বললে" লোকটা কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত"।
দি মা গলা মিলালে" সে আর বলতে? দিমা হাতের পেন্সিলটা এদিক ওদিক করে বললে "তৃতীয় রাতে জোর চেপে ধরাতে হাসতে হাসতে কি বলল জানিস? বললে
"আপনি না করাতে তো আমার সুবিধা হয়ে গেল"।
অবাক, বললাম "কেন? কি সুবিধা হল?"
"আরে। আমিই তো বলতে যেতাম আপনাকে বিয়েটা ভেঙে দিতে। তারপর আপনি যখন বললেন ভেঙে দিতে তখন আমার মাথায় বুদ্ধিটা এল। আপনি চান না আমিও চাইনা। সুতরাং বিয়েটা হলে দুজনেই বেঁচে যাবো"।
"মানেটা কি? কি করে বাঁচবো? মাথাটা গেছে নাকি? আর অনির্বাণ তো বসে আছে আমার জন্যে"।
"ছাড়ুন তো। অনির্বাণ কে? আপনার প্রেমিক?"
সাত্যক একটু থেমে বললে "দেখুন বিয়ে হয়ে গেল। সবাই নিশ্চিন্ত। এবার আপনার আর আমার কোনো নিজের কাজ নিয়ে আর ঝামেলা রইল না। আপনিও আপনার বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকুন আর আমি আমার। কেউ কাউকে ঝামেলায় না ফেললেই হল"।
"কি সাংঘাতিক লোক দেখ। অন্য কোনো ধান্দা আছে সিওর"। মালবিকা বললে।
তারপর হিসেবের সব খাতাগুলো এগিয়ে দেয় "একবার দেখে নে। আর হ্যাঁ, তুই ডিভোর্স করে দে। মার কাছে ফিরে যা। লোকটা তোকে অবধারিত বিপদে ফেলবে। প্ল্যান করছে"।
দিমা বললে "এমনিতে তো ভাব দেখায় ভীষণ ভদ্র। গুছিয়ে কথা বার্তা বলে, আমার বাড়ি ওনার বাড়ির সবাই খুব ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবছে। ডিভোর্স এখুনি বললে আমি খুব চাপে পড়ে যাব। ও ব্যাটা সাধু সেজে আছে ওকে আগে এক্সপোজ করতে হবে"।
"খুব দুখ্যের কথা। কিন্তু একই ঘরে দিনের পর দিন কাটানো ও তো মুশকিল"।
মালবিকা বললে "দিমা, একটা খারাপ খবর আছে। আমাদের এনজিওর এবার আগামী সব ইউএসএ এর হেল্প মিশনগুলো অ্যাপ্রভাল এজেন্ট এর মিস্টার এস ব্যানার্জী আটকে রেখেছেন"।
দিমা অবাক হয়। "কেন আটকে দিয়েছে? কোন কারণ?"
"বোঝা যাচ্ছে না। তুই ভালো কথা বলতে পারিস। একবার যা গিয়ে কথা বলে বোঝ কি অসুবিধা?"
"আমাদের হিসেব তো সব অডিট করানো আছে"।
"ঠিক আছে। কাল ঠিকানাটা দিয়ে দিও। আমি কথা বলব। এরকম হলে বাচ্চাদের পড়াশুনা আটকে যাবে হোমগুলোতে।
দিমা যায় কিন্তু দেখা করতে পারে না। মিস্টার ব্যানার্জী ভীষণ কড়া ধাঁচের মানুষ। ওনার এসিস্ট্যান্ট বললে পরের দিন অডিট রিপোর্ট নিয়ে আসতে। লোকটা গভর্নমেন্ট এর রিপ্রেজেন্টেটিভ এই থার্ড পার্টি অডির টীম এর।
অফিসে থেকে বেড়িয়ে আসার সময় দিমার মনে হয় মিস্টার ব্যানার্জীর অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই তো? ঘুষ? এখন ঘোরাচ্ছে পড়ে মুখ খুলবে। এরকম ও শুনেছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু লোকটার অফিসে বলছে লোকটা ভীষণ সৎ এবং কড়া ধাঁচের।
তিন রাত্রির দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে দিমা রাগে ফেটে পড়লে।
"আমি তোমার সঙ্গে থাকব না। কিছুতেই না। কাল আমাকে অফিসে যেতেই হবে। আমি কোনো কথা শুনব না"। একটু থেমে গলা তুলে বলে
"আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। খাবার টেবিলে কি করে আপনি বললেন কে আমরা কাল মাইথন যাচ্ছি? কে আপনাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে?"
সাত্যক চুপ করে সিগারেট ধরালো।
দিমা বললে "আমি কাল অফিসে যাবই। কেউ আমাকে রুখতে পারবে না।"
সাত্যক বারান্দা থেকে ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে বলে "একটু শান্ত হোন। আমার কথা শুনুন কাল যাবেন না অফিসে"।
"কেন যাবো না? আমি অফিসে ছুটি নেইনি। আর আপনার সাথে যাবার কথা একবারও আপনি আগে বলেছেন? অসম্ভব। কেন যাবো আমি?"
সাত্যক সেই রহস্যময় হাসিটা ঝুলিয়ে রাখে "শুনুন কাল অফিসে গেলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। তাই যাবেন না দয়া করে। ক্ষমা চাইছি আগে মাইথন যাবার কথা বলিনি বলে।"
লোকটা কি চায়? যা ইচ্ছে তাই নিজে নিজে ঠিক করছে। গা জ্বালা করছে।
"শুনুন আপনি যে মিস্টার ব্যানার্জীকে খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি আমার জুনিয়র। খুবই বন্ধু। একই জায়গায় চাকরি করি। ও ই বলেছে এখন দুদিন যাবেন না। আপনার বিপদ হতে পারে"।
দিমার মুখটা বিকৃত হয়।" খুব দর বাড়াচ্ছেন বুঝি?"
"আপনি একটা বিপদের মধ্যে আছেন"।
"কিসের বিপদ? আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না।"
"করতে হবে না। পুরোটা শুনুন। আপনি জানেন আপনাদের এনজিও তে টাকা নয় ছয় হয়?"
নয় ছয় হতেই পারে না। সমস্ত রিপোর্ট। থেমে যায় "এনাকে কেন বলছি? এরা হতেই পারে না।"
এবার সাত্যক গম্ভীর হয়।
"আগামীকাল সকালে বা রাত্রে আপনাদের ওখানে এনফোর্সমেন্ট থেকে রেড হবে আপনি জানেন"?
"কি আজে বাজে কথা বলছেন? কেন হবে? একটা এনজিও যারা গরীব দুস্থ ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা থাকার ব্যবস্থা করে। যাদের সব হিসেব রীতিমত অডিট হয় সেখানে কেন রেড হবে? যা খুশি বলবেন আর মেনে নেব?
সাত্যক এর ধৈর্য্য ভেঙে যায়। বলে
"আপনি কিছুই জানেন না। আপনি কি জানেন আপনাদের কোম্পানিতে বাইরের মুদ্রায় সাহায্য আসে তার অনেকটা অংশ ড্রেন আউট হয়ে যায়? বেশ কিছু ব্যবসায়ীর হাতে। তারা এটা কে ইউজ করে টাকা লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে"।
"আপনি কি করে বলছেন এসব? আমি এতদিন তো সেরকম কিছু দেখিনি"। রাগে ফেটে পড়ে
দিমা।
"শুনুন, রেগে যাবেন না। মাথা ঠাণ্ডা করে শুনুন।
আচ্ছা ঠিক আছে শুনতে হবে না"। মুহূর্তে রাগটা প্রশমিত করে বলে
"কাল চলুন সকালে মাইথন ঘুরে আসি। আমার ওখানে একটা পুজো দেবার ব্যাপার আছে"।
"কেন যাবো?"
"ধরে নিন এটা আমার অনুরোধ।"
প্রতি মুহূর্তে লোকটা নতুন নতুন মিথ্যে বলছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে কি বলবে? সাত্যক বাড়িতে বলেই ফেলেছে পুজো দিতে যাবার ব্যাপারটা।
প্রবল অনিচ্ছা স্বত্বেও পরদিন সকালে ওরা ট্রেনে চাপে। একদিন যাবে পুজো দেবে, একদিন থেকে কাছাকাছি কিছু ড্যাম দেখে পরদিন সকালে চলে আসবে ।
যে লোকটা কে পছন্দ নয় তার সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়াটা যে কি বিরক্তিকর সেটা দিমা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে।
ঘুম ভাঙ্গার পর মনে পড়ল দিমার আরে! মনেই ছিল না এটাতো মাইথন এর গেস্ট হাউস। সাত্যক ঘরে নেই। উঠে বসে ভাবলে পুজো তো কাল দেওয়া হয়েই গেছে। আজ দুপুর খেয়ে দেয়ে ট্রেন ধরে মার ওখানে ফিরে যাবে। নিকুচি করেছে আজ বেড়ানো, নিকুচি করেছে হানিমুন। এমন সময় মূর্তিমান ফিরল কাগজ নিয়ে। কাগজটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় খাটের ওপর রাখল। শুধু বললে
"দেখুন পড়ে। কাগজ খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ। গতকাল রাত্রিবেলা দিমার এনজিওতে এনফোর্সমেন্ট থেকে রেড হয়েছে। অফিসে সিল করে দিয়েছে মালকিন হৈমন্তী রায় কে, হিসেব রক্ষক মালবিকা সান্যালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ওদের অফিসে এ নিয়ে গেছে। রেডটা হয়েছে রাত ট টা। তখন দিমারা দ্যামের ধারে রেস্টুরেন্ট এ। কোন রিং শুনতে পায় নি। তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে খুলল। মালবিকার ফোন তিনবার। ঠিক আটটার সময়। দিমার মুখ থেকে সব রক্ত যেন নিমেষে শুষে নিয়েছে কেউ। এটা কি করে হল? কোনো রকম এনজিও তে এদিকওদিক চোখে পড়েনি। এই লোকটা তাহলে কি পুলিশের বা গোয়েন্দার লোক? চুপ করে বসে ভাবল। তাহলে এই জন্যেই ওকে নিয়ে চলে এসেছিল সাত্যক? সত্যি লোকটা ভীষণ খারাপ। ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না।
মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরে ড্যাম দেখতে গিয়েছিল। এখন কলকাতায় থাকলে প্রচুর ডাকাডাকি হত। দিমার অনেকদিনের যোগাযোগ ওদের সঙ্গে। আশ্চর্য্য, কিছুই বোঝেনি।
কাগজ খুঁটিয়ে পড়েছে। টিভিতে বলেছে অনেক বিদেশী মুদ্রার নয়ছয় হয়েছে। আশ্চর্য, দিমা জানত না।
মাইথন থেকে ফিরবার আগের দিন রাতে দিমাকে কথা বলতেই হল। লোকটা ও কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। খেতে বসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে "একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"
"বলুন" গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলে সাত্যক।
"আপনি এটা কি ভাবে জানলেন?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললে "বিয়ের ব্যাপার শুনে আমার জুনিয়র সেই বন্ধু বললে চাকরিরটা মোটেই ভালো জায়গা নয়। এরা অনেক বিদেশী টাকা এদিক ওদিক করে। বিয়ে হলে চাকরিটা ছাড়িয়ে দিস।"
"তারপর ও আপনি এগুলেন? ভয় করল না?"
"ভয় কেন করবে? বরং মনে হল আপনাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমি একবার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু ইউ denied টু মিট"।
"তারপর?"
"বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। মনে হল আপনাকে বাঁচানো দরকার। বলতে গেলে আরো ক্ষেপে যাবেন"।
"কেন আমাকে বাঁচান দরকার? আপনার সাথে তো আমার কোন সম্পর্কই নেই। তাই বিয়ে করে বাঁচানোর প্ল্যান করলেন? মোস্ট ফানি। মিলছে না। আপনার বিয়ের আসল উদ্দেশ্যটা কিন্তু এখনও বলেন নি"।
"এরপর একদিন আপনি এসেছিলেন আমার অফিসে এ। আমার পদ সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই এসেছিলেন বলতে কে আপনাদের এনজিওর টাকা স্যাংশন যেন বন্ধ না করি। কি ঠিক বলছি তো?"
দিমা মাথা নাড়ে। "কিন্তু আপনি ছিলেন না"।
"আমার বন্ধু ব্যানার্জী ছিল না। আমি ওর ঘরে ঢুকতে গিয়ে দুর থেকে আপনাকে দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে দিয়ে বলে পাঠাই ও অফিসে এ নেই"।
"বাহ! চমৎকার। চমৎকার। জেনেশুনে আপনি সামনে এলেন না"।
"হ্যাঁ। আসিনি। আপনার নেচার দেখে বুঝেছিলাম আপনাকে সত্যিটা বলে কিছু হবে না"।
"তাই বিয়ে করে আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন?" বাহ, বাহ, হাততালি দিয়ে ওঠে দিমা।
যাইহোক আমি কাল সকালেই ফিরে যাবো। কোন কথা শুনতে চাই না।" বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে দিমা।
সেদিন ও মাঝ রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। মেঘের ডাক আর বাজের শব্দ ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে। একমাত্র এই বাজ পড়ার শব্দতেই দিমা কাত। শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাত্যক যথারীতি ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। উঠে বসে ভাবছিল লোকটা কেমন? আজ কলকাতায় থাকলে ওকে নিয়ে টানাটানি হত এনফোর্সমেন্ট থেকে। কারণ এনজিও র হিসেবপত্রও ও কিছুটা তো জানে। কিন্তু ডলারের নয়ছয়টা তো কখনো শোনে নি। লোকটা ভীষণ খারাপ। কিছুই বলেনি। এতদিন ধরে খেয়াল রেখেছে। অনেকগুলো খারাপ কথা বলে ফেলেছে। অবশ্য এগুলো ওর প্রাপ্য। এমন সময় ঘর একটা নীলচে আলোয় ভরে গেল ঘর। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে বাজ পড়ল সামনে কোথায়। দু হাত দিয়ে দু কান বন্ধ করে চোখ কুঁচকিয়ে চিকার করলে
"ওরে বাবারে! কি মানুষ একটা। এই যে, এই যে। আঙ্গুল দিয়ে ঠেলতে থাকে সাত্যককে। ধড়মড় করে উঠে বসে
"কি কি হয়েছে? চারিদিক তাকিয়ে বললে
"ঘুমিয়ে দু জন বন্ধ করে শুতে পড়ুন দেখবেন কমে গেছে কিছুক্ষণ পরে। বলতে বলতেই আবার ঘর কাঁপিয়ে বাজ পড়ে। দিমা সোজা "আঃ, আঃ করে সাত্যকএর ওপর পড়ে।
"কি করছেন কি করছেন?"
"দিমা গলাটা জড়িয়ে ধরে গভীর স্বরে বলে
"আপনি ভীষণ খারাপ লোক মশাই। ভীষণ খারাপ। দু মুঠো দিয়ে সাত্যকএর বুকে মারতে থাকে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামে আকাশ ভেঙে। সাত্যক হেসে ফেলে
"যাক চিনতে ভুল হয়নি। ঘুমিয়ে পড়ুন কাল সকালে ফিরবার ট্রেন ধরতে হবে"।
"না। আপনার কি কোন মন বলে কিছু নেই? আমি বললাম কাল ফিরে যাবো আর আপনি বোকার মত কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়লেন? ভগবান কি মাথায় কি কিছুই দেয়নি? আমাদের বেড়ানো তো এখনও বাকি আছে। কাল আমি যাবই না"।
সাত্যক হেসে ফেলে" এই খারাপ লোকটার সঙ্গে বেড়ানো যাবে? ভয় লাগবে না তো?"
গুমগুম করে আরো দুটো কিল বসিয়ে দেয় দিমা সাত্যকএর বুকে।
"তাহলে টিকিট দুটো?"
"যাক গে। আমি যাবো না ব্যস"।
বৃষ্টির শব্দ চালে একটা ঝিম ধরানো শব্দ করছে। দিমার খারাপ লোকটার আর কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা জানে না। থাকলে থাকুক। আর কিছু শুনতে চায় না ও। জানলায় ছাট এসে ধাক্কা লাগছে।
বৃষ্টির ধারার শব্দে চাপা পড়ে যায় সাত্যক এর কথা ।
'নয়না নীর বহা, সখী বিন মোরা জিয়া তরসায়ে'-
পথ থেকে প্রান্তরে
শ্রীতন্বী চক্রবর্তী
প্রবন্ধ
একেকটা বারান্দায় বসে থেকে থেকে সময় কেটে যায় বেলায়, অবেলায়। পেশক চা-বাগান সবুজ আঁচল বিছিয়ে রাখে রাতভর, চা-পাতার ডগায় সূর্যের আস্তরণ মেখে শিশিরবিন্দু বন্ধু হয়ে ওঠে ময়ূরের, ময়ূরপঙ্খী, বন্য সবুজ আভরণে বন্ধু হয়ে ওঠে বাঁশকাঠি-দোকানের স্বপ্ন-পোশাক বিক্রেতাও - 'পাহাড়ি জামা নেবে? পাহাড়ি মেয়ের মত ছবি তুলবে?' বারান্দার সামনে পায়ে-হাঁটা গালিচা রাস্তা বৃষ্টিতে হঠকারী, মেঘের নাদে চুঁইয়ে পড়ে কাদম্বিনী মধু, রাধা সেজে বিস্মৃত অতীত থেকে তুলে আনি আঁখিপল্লব-ছোঁয়া চামর, পাইনের ঝিরঝিরে পাতা কখন না জানি অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়ে সন্ধ্যারাগের সন্নিকটে। বারান্দার অন্যদিকে আঙুল বরাবর রাধারাণীর নাকছাবি হীরের দ্যুতি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কালিম্পঙে, আবেগবিহ্বল হয়ে পরিজন খুঁজে চলি আমি আর অনন্যসহায় মার্জারটি, পিঙ্গল বাহারে তিস্তার হৃৎকম্প সে বুঝি বা জানতে পেরে যায়।
আনীল আকাশ রাত বাড়লে পরিযায়ী পাখির মর্মর কলতানে উচ্চকিত হয় না। অক্ষাংশের প্রাগৈতিহাসিক প্রান্তে কোথা থেকে মন্দ্রমুগ্ধ স্বরে গান জেগে ওঠে - 'আজ রাধা ব্রিজ কো চলি', নুপুরের ছন্দ থামে না, গারলাং স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে আলতা-পা নুপুরের ছন্দ ছাড়ে না, সে যদি কখনো কাউকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে সেইক্ষণ বিধ্বংসী বিনয়ে উপস্থিত হয় তার সামনে আজ আবার। দ্রাক্ষাসবুজ বন্দরে আজও অপেক্ষায় থাকে তার নাবিক, রূপকথার রাজপুত্র বেসাতি করে ফিরে আসে, চা-বাগানের শীতলপাটি পেতে নিবিড় আলিঙ্গনে রাধা আবদ্ধ হয়,
সরোদের মূর্ছনায় মনের তন্ত্রীতে বাজতে থাকে - 'সাজনা, বরষে হ্যায় কিঁউ আঁখিয়া', মেঘ কাকে গিয়ে গিয়ে বলবে, মন কেন থেকে থেকে কেঁদে ওঠে? শূন্য পথের কাঁটাপ্রান্তরে চন্দ্রজোছন সাক্ষী থাকে তাদের আলিঙ্গনের। আরো দূরের পাহাড়ে উপোষী রাত গভীর হয়, ভরন্তযৌবনা রমিতেধারা ছন্দ, অলংকার, শব্দ, বাক্যবিন্যাসের বাঁকে বাঁকে ঝরো ঝরো হয়ে ঝরে পড়ে স্তব্ধ পাথরের বুকে, বন্দরত্যাগী নাবিক রাধার অশ্রুসজল চোখে চেয়ে গেয়ে ওঠে - 'নয়না নীর বহা, সখী বিন মোরা জিয়া তরসায়ে।'রুক্ষ পাহাড় বিরূপাক্ষ, সহস্র শতাব্দী ধরে চিন্তার কোলাহল শুনে মরমে মরসুমি ভালোবাসার উদ্গীরণ জাগায়, বাসন্তী-সম্মেলনে রাধার অনুনয় পুষ্পস্তবক হয়ে উপহার হয় নাবিকের বক্ষে, সে ব্যাকুল হয়ে পাপড়ির ঠোঁটে ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট, বিদ্যুদ্দীপ্তির বর্ণিল আভা প্রবেশ করে দুজনের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে। কেন? এত আকুল কেন হয় রাধা? স্খলিত আশা-নিরাশার পরিব্যাপ্তি ত্যাগ, তিতিক্ষায় এসে শেষ হয় না, নাবিক ক্লান্ত হয়, বিদীর্ণ হয় সংযমের চিরপাপিষ্ঠ বন্ধন, তবু নাবিক হাল ছাড়ে না, উদাত্তকণ্ঠে ব্যক্ত করে কামনার পরিতৃপ্তি, রাধাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর চুম্বন করে, রাতভর, অক্লেশে, যতক্ষণ না রক্তাভ বৃষ্টিভোর বনবিহারী-রাধের বক্ষবিভাজিকায় প্রবেশ করে শারঙ্গীস্বরূপ, তার গতি হয় মন্থর, চন্দনপত্র আর গুরাসকুঞ্জের শীতলতায় শরীর এলিয়ে দেয় বৃষ্টিভোর, অপেক্ষা করে, ঘুম ভেঙে উদাত্ত কণ্ঠে রাধাকৃষ্ণ-স্বর ধাবিত হয় চারদিকে- 'ধনী ধনি বনি অভিসারে / সঙ্গিনী রঙ্গিনী প্রেম-তরঙ্গিণী সাজলি শ্যাম-বিহারে।'
প্রবন্ধ
একটা সময় ছিল যখন আমি স্কুলের পড়ার ফাঁকে সময় পেলেই ফেলুদার বইতে মুখ ডুবিয়ে থাকতাম। আমার জীবনে ফেলুদা এসেছে ব্যোমকেশের পরে। আমাদের বাড়িতে আগে থেকেই শরদিন্দুর রচনাবলী ছিল। ফলে ব্যোমকেশের সাথে পরিচয় হয়েছে প্রথমে। কিন্তু একটু দেরি করে পেলেও ফেলুদার ম্যাজিকে মন মজে যেতে বেশিক্ষণ লাগেনি। এখনও মনে আছে, প্রথম ফেলুদার বই, গড়িয়াহাটের “জ্ঞান সঞ্চয়ন” দোকান থেকে কেনা, ছিল “গোরস্থানে সাবধান”! প্রথম কয়েকটা পাতা উল্টেই মনে কেমন একটা আলোড়ন হয়ে গেল। ব্যোমকেশ ১৯২০ সালের বাঙালির প্রতিনিধি। কিন্তু সেই বই পড়ে একবারও ১৯৯৫ সালের আমার ব্যোমকেশকে বাড়ির দাদা মনে হয়নি। কিন্তু এই বই পড়ে এক মুহূর্তেই যেন মনে হল আমার পাশের বাড়ির কেউ এইসব গোয়েন্দাগিরি করছে। ফেলুদার সব কিছু খুব চেনা। আর সেই সাথে আছে দারুণ ছবি। ব্যোমকেশের বইয়ে ছবি ছিল না।
এক একটা বই যে কতবার পড়েছি, ঠিক নেই। তবে সবকটা বই বা গল্প অন্তত পঞ্চাশ বার তো হবেই। মনে আছে, ফেলুদার বইয়ের প্রথম দিকের পাতায়, যেখানে গল্প শুরুর আগে প্রকাশকের নাম ইত্যাদি থাকে, সেখানে ফেলুদার সবকটা বইয়ের নাম দেওয়া থাকত। আমি সেখানে টিক দিয়ে দিয়ে বই কিনতাম। সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর ফেলুদার নতুন একটা উপন্যাস প্রকাশ হয়ঃ রবার্টসনের রুবি। সেটা প্রকাশের কয়েক দিনের মধ্যেই মাকে দিয়ে কিনিয়েছিলাম, একটা বাংলা নববর্ষের সময়ে। আর তারও বেশ কিছুদিন পর, আমি যখন অনেকটা বড়, তখন প্রকাশিত হয় “ইন্দ্রজাল রহস্য”। সেটাও খবর পেয়েই কিনেছিলাম। তখন গড়িয়াহাটে দুটো বইয়ের দোকান ছিলঃ জ্ঞান সঞ্চয়ন আর আইডিয়াল বুক স্টোর্স। এই দুটোর সামনে দিয়ে গেলেই ফেলুদার বই কেনার ইচ্ছে হত। আর যেসব গল্প কোনও সংকলনে থাকত, যেমন “সেরা সত্যজিৎ”, সেগুলো কারুর বাড়ি গেলে ফাঁক পেয়ে পড়ে নিয়েছিলাম।
আমার ছোটবেলায় আনন্দমেলা পত্রিকায় ফেলুদা নিয়ে অনেক কিছু প্রায়ই প্রকাশিত হত। মনে আছে, একবার বিশ্বের অন্যান্য গোয়েন্দার সাথে একটা তুলনা করে লেখা হয়েছিল যে শার্লক হোমস্ এর থেকেও ফেলুদার গল্প অনেক বেশি সেরেব্রাল। সেই সময়টা আমার কাছে ছিল আইকন খোঁজার। ফলে ফেলুদা সেই বয়সে ছিল আমার আইকন। বিশ্ব সাহিত্যের সাথে তখন পরিচয় কোথায়? শার্লক হোমস পড়েছি কিছুটা। আগাথা ক্রিস্টি বা নিরো উলফ তখনও অনেক দূর। আর জেফ্রি ডিভার নামই শুনিনি। ফলে তখন যদি পত্রিকার পাতায় দেখি যে ফেলুদার গল্প পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ, সেই বয়সে সেটাই বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া স্বাভাবিক।
সোনার কেল্লা সিনেমাটা প্রথম দেখি দূরদর্শনে “ছুটি ছুটি” বলে গরমের ছুটিতে যে প্রোগ্রাম হত, সেখানে। তারপর আরও অনেকবার। এছাড়া “জয় বাবা ফেলুনাথ” তো বটেই। আমার ছোটবেলায় দূরদর্শন ছিল বাইরের জগতের একমাত্র দরজা। সেখানে এই দুটো সিনেমা ছাড়াও ওই যে ছোট ছোট টেলিফিল্ম হয়েছিল, যেমন “ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা” সেটাও বাদ দিইনি। অবশ্য এ কথাও মনে রাখতে হবে যে হিন্দিতে যে ব্যোমকেশ বক্সী তখন হচ্ছিল, সেটাও যে বাদ দিচ্ছিলাম, তা নয়।
ফেলুদার বইয়ের সবকিছুই ছিল, যাকে বলে, আমার আদর্শ। সেই বেড়াতে যাওয়ার বর্ণনা পড়ে বেড়াতে যাওয়ার আগে একটা জায়গা নিয়ে গবেষণা করার অভ্যাস হয়েছিল আমার। এমনকি একটা সময় এরকমও ছিল যে অচেনা লোক দেখলে তার পোশাক, হাত নাড়া, মুদ্রাদোষ ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা অভ্যাস ছিল আমার, যাতে সেই লোক সম্পর্কে না বলতেই অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারি। বোম্বাইএর বোম্বেটে পড়ে সেই কল্লোলের ফাইভ মিক্স সুইটস খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল আমার। যদিও সেটার কোনও অস্তিত্ব আর আমার ছোটবেলায় ছিল না। ফেলুদার বইতে পড়া জায়গাগুলোতে সব বেড়াতে যেতে হবে, এরকম একটা লক্ষ্য ছিল আমার মনে। রবার্টসনের রুবি পড়ে আমি খোঁজ করেছিলাম যে শান্তিনিকেতন যেতে সত্যিই ওরকম বিলাসবহুল ট্রেনের কামরা আছে কিনা। কিন্তু সেটা আর তখন ছিল না। এমনকি ফেলুদার বইয়ে পড়ে একটা সময়ে খবরের কাগজের খবরের কাটিং একটা খাতায় সেঁটে রাখাও শুরু করেছিলাম।
এরপর কলেজেও সেই মুগ্ধতা ছিল। বইগুলো মাঝে মাঝেই উল্টে পাল্টে পড়তাম। কলেজে ওঠার পরেই রিলিজ হল “বোম্বাইএর বোম্বেটে”। অবশ্যই দেখলাম ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। সেইদিন প্রিয়া সিনেমায় সব্যসাচী চক্রবর্তী শোএর আগে এসেছিলেন। তাঁর সাথে হ্যান্ডশেক করলাম। তারপরেও কৈলাসে কেলেঙ্কারি ইত্যাদি সিনেমা বেরোলেই সোজা হলে। ইতিমধ্যে নানা জায়গায় ফেলুদা নিয়ে প্রবন্ধ পড়ি। এর থেকে ভালো গোয়েন্দা যে আর পৃথিবীতে নেই, সেই বিশ্বাস আমার মনে দৃঢ় হয়েছে। তখন বয়েস বেশ খানিকটা বেড়েছে, কিন্তু আমার মন পড়ে আছে সেই ফেলুদার জগতেই। এমনকি যখন লন্ডনে গেলাম, তখন “লন্ডনে ফেলুদা” বই থেকে লিস্ট করে নিলাম যে কোন কোন জায়গার কথা সেখানে আছে। সেই জায়গা গুলো দেখতেই হবে যে। সেই অক্সফোর্ড স্ট্রীটের সেলফ্রিজেস, সেই ২২১বি বেকার স্ট্রিট ইত্যাদি। সেগুলো একদম লিস্ট করেই দেখেছিলাম এবং সেটা নিয়ে ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছিলাম।
এরপর কাজের চাপ বাড়ল। ফেলুদার বই ভালো করে মলাট দিয়ে (সেটাও কোন একটা উপন্যাস থেকেই শেখা) আলমারিতে তুলে রাখলাম। এগুলো আমার নিজস্ব ধনরত্ন। কাউকে দেওয়া যাবে না। এগুলো আমার সঙ্গে সারাজীবন থাকবে। এরকম একটা দৃঢ় ধারণা তখন মনে। চারিদিকে দেখি ফেলুদা নিয়ে আরও অনেক সিনেমা হয়। যদিও সেগুলো আর দেখার সময় হয় না। বয়স হয়ে গেছে। আনন্দমেলা আর কিনিনা। কিন্তু মনের মধ্যে ফেলুদার নাম থাকেই। গল্পগুলোর নাম তো সব মুখস্ত। সেই ছবিগুলোও ইন্টারনেটএ মাঝে মাঝেই দেখা যায়। আর ইউটিউবে আছে সব সিনেমা। পুরো সিনেমা দেখার সময় আর নেই। কিন্তু ক্লিপ তো দেখাই যায়।
দশ-পনেরো বছর চলে গেল। এর মধ্যে নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে আস্তে আস্তে। নানা জায়গা থেকে অনেক নতুন বইয়ের সন্ধান পেয়েছি। অনেক নতুন লেখকের সাথে পরিচয় হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, একবিংশ শতকের বিশ্বের বিভিন্ন লেখকের বই পড়তে শুরু করেছি। এইরকম একটা সময়ে, বহু বহু দিন পর হাতে এল একটা ফেলুদার বই। সেই ছোটবেলার অভ্যাসবশেই হাতে তুলে খুলে দেখলাম। এইসব বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা আছে আমার ছোটবেলার অনেকটা সময়। দশ-বারো-পনেরো বছরের আমির জীবনে বাইরের জগতের ভূমিকা যতটা, ঠিক ততটাই ভূমিকা রয়েছে এইসব বইয়ের।
কিন্তু এই এখন বই খুলে একপাতা-দুপাতা পড়েই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল। প্রথমে ঠিক বলে বোঝাতে পারলাম না। বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু কোথায়? সেই আমেজ তো নেই! পড়তে যেন কেমন কেমন লাগছে। সেই ডায়ালগ, সেই জায়গার বর্ণনা, সবই একরকম আছে, কিন্তু আমার তো আর সেই চুম্বকের মত আকর্ষণ নেই। চার পাঁচ পাতা পড়ে আর ভালোই লাগল না। বই বন্ধ করে রেখে দিলাম। মনে হল, আজকে খুব ক্লান্ত। তাই এরকম হচ্ছে। এর পর সময় পেলে আবার পড়ব।
এরপর সময় পেলাম আবার। কিন্তু পাশে ফেলুদার বই থাকলেও আর সেটা হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে হল না। বরং হাতে তুলে নিলাম অন্য একটা আধুনিক লেখকের লেখা বই। সেটাতেই মন ডুবে গেল। এরপর সেই ফেলুদার বই টেবিলে থেকে ধুলো জমতে শুরু করল। আমার আর পড়া হয় না। অবশেষে একদিন জোর করেই বইটা খুললাম। মনকে বোঝালাম, পড়ার অভ্যাস চলে গেছে। এটা ভালো না। এইসব বই চিরকালীন। কিন্তু আবার সেই এক অনুভূতি। কিছুতেই আর মন বসে না। মাঝখান থেকে পড়লাম। সব বইয়ের ভিলেন মুখস্ত ছিল আগেই। কিন্তু একটা সময় রহস্যের সমাধান জেনেও তো বারবার পড়েছি এইসব বই। কিন্তু এখন দুপাতার বেশি চোখ আর চলছে না। বরং, মনে কয়েকটা বেয়াড়া প্রশ্ন আসছে যে। এর আগে যখন পড়েছি, তখন এরকম প্রশ্ন করার মন ছিল না। কী কী প্রশ্ন?
প্রথমেই যেটা এখন চোখে লাগছে, সেটা হল, এইসব বইয়ে নারী চরিত্র কোথায়? দুজন যুবক কলকাতায় বসে কাজ করছে, এত লোকের সাথে রোজ দেখা হচ্ছে, এর মধ্যে মহিলা কোথায়? তোপসে চরিত্রের মা দু-একবার দেখা দিয়েছেন, এই পর্যন্ত। কিন্তু সেটা নেহাত অলঙ্কার। প্লটের প্রয়োজনে নয়। এই যে এত ক্লায়েন্ট ফেলুদার কাছে এল, নিজেদের বাড়ির বা ব্যবসার নানা সমস্যা নিয়ে, তার মধ্যে একজনও মহিলা ক্লায়েন্ট নেই? এই যে এত লোকের বাড়িতে যাচ্ছেন, কোনও মহিলা সদস্য নেই। আর মহিলা সদস্য থাকলেও সেটা এমন দুর্বল চরিত্র যে সেটা প্রায় সাদা কালিতে লেখার মত। যেমন, “জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা” গল্পে “খুড়িমা” চরিত্রের প্রথম বর্ণনাতেই আছে যে “মাথায় ছিট দেখা দিয়েছে”। মানে, বুঝিয়ে দেওয়া হল যে এই চরিত্র ভবিষ্যতে গল্পে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে না। ঠিক সেরকম, “অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য” গল্পেও মিসেস সেন একটা বা দুটো দৃশ্যেই শুধু এসেছেন। প্রায় সব গল্পেই নারী চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে শুধু অন্যদের
খাবার বা চা দিতে বা সম্ভাষণ জানাতে। একমাত্র ব্যতিক্রম অবশ্যই “ডাঃ মুন্সির ডায়েরি”। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। ফেলুদার কোনও গল্পেই নারীচরিত্র প্লটের অগ্রগমনে কোনও সাহায্য করে না।অথচ ফেলুদার গল্প যখন লেখা হচ্ছে, তখন কিন্তু ভারতের বাইরে যে সব গোয়েন্দা গল্প, সেখানে নারী চরিত্র একদম গল্পের মধ্যমণি। আগাথা ক্রিস্টি বাদ দিলাম। সেখানে তো গোয়েন্দা, সহকারী (টমি-টাপেন্স), খুনি, ক্লায়েন্ট—ইত্যাদি সব ভূমিকাতেই নারীর সগর্ব উপস্থিতি। এছাড়াও রেমন্ড চ্যান্ডলারের গল্প রয়েছে। কিন্তু সেই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ফেলুদার গল্প এরকম কেন? শার্লক হোমসের গল্পে অন্তত ক্লায়েন্ট বা ভিলেনের ভূমিকায় প্রচুর নারীর আগমন ঘটেছে। প্রবলেম অ্যাট থর ব্রীজ যেমন। নারীরা সেইসব গল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। সেখানে ফেলুদা নিজেই বলছে যে শার্লক হোমস ওর গুরু। কিন্তু গল্প পুরোপুরি পুরুষকেন্দ্রিক। জানিনা সেই সময়ে বাংলার পাঠক এটাকে কিভাবে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো কোনও পাঠক এটা মেনে নেবেন বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় যে প্রশ্ন এখন মাথায় আসে, সেটা হল, ফেলুদার সারাদিন চলে কী করে? মানে ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ অবধি এই ২৫ বছরে ফেলুদার কেস তো ওই তিরিশ-পঁয়ত্রিশটা। ধরলাম আরও তিরিশটা ছিল। কিন্তু তাতে কি কলকাতা শহরে একজন মানুষের চলে? শখের গোয়েন্দা তরুণ বয়সে ভালো। কিন্তু যদি সারাজীবন শখের গোয়েন্দাই থাকে, তাহলে তার কেরিয়ার প্ল্যান নিয়ে তো আজকের পাঠকের সন্দেহ হবেই। একজন যুবক সারাজীবন জ্যাঠার বাড়িতেই থেকে গেল, তার নিজের আত্মসম্মানবোধ নেই? লালমোহনবাবু নয় লেখালেখি করে উপার্জন করেন, সেই টাকায় গাড়ি চড়েন, ঘুরে বেড়ান। মানে, সেলফ এমপ্লয়েড প্রোফেশানাল। কিন্তু ফেলুদা কী করে নিজের খরচ চালায়? জ্যাঠার টাকায়? একবার বলা হয়েছে যে ফেলুদা নাকি কোন বই অনুবাদ করে কিছু অগ্রিম পেয়েছে। কিন্তু এখানে বই অনুবাদের জন্য যা টাকা পাওয়া যায়, তাতে আর কদিন চলবে? অবশ্য শকুন্তলার কণ্ঠহার গল্পে বলা হয়েছে যে ফেলুদার উপার্জন ভালোই। মাসে অনেক কেস আসে। কিন্তু সেটা দিয়ে কী চলে?
এখন যে পাঠক ফেলুদা পড়বেন, তিনি হ্যারি পটার পড়ে ফেলেছেন। এই ধরণের সিরিজে ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট থাকে। মানে, একজন চরিত্র সময়ের সাথে সাথে পালটাবেন। তাঁর বাড়িতে সদস্যদের জীবনে নানা ঘটনা ঘটবে, তাঁর নিজের জীবনে নানা ল্যান্ডমার্ক ঘটনা ঘটবে। হ্যারি পটার যেমন বড় হচ্ছে, তার নতুন বন্ধু হচ্ছে, তাদের সাথে নতুন নতুন জায়গায় সে যাচ্ছে। তার জীবনে নানা বিপদ আসছে। কখনও সে সফল হচ্ছে, আবার কখনও ব্যর্থ। একজন মানুষের জীবন এভাবেই চলে। কিন্তু ফেলুদা যেন সময়-নিরপেক্ষ এক চরিত্র। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯২ অবধি তার জীবনে নতুন ঘটনা কোথায়? কম সময় তো নয়। সাতাশ বছর। এই সময়ে তোপসেই বা কী করছিল? গল্পের শুরুতে তোপসের বয়স সাড়ে তেরো। এরপর তার স্কুল শেষ হয়েছে। কিন্তু তারপর? এই ১৯৭০-৮০ সালের কলকাতায় তোপসে বাকি জীবনে কী করল? ওর কলেজ লাইফ কোথায়? ওর বন্ধু কোথায়? যদি ধরে নিতে হয় যে তোপসের আর কোনও বন্ধু ছিল না, তাহলে তো ওকে অস্বাভাবিক বলতেই হবে। ওর বয়স যখন উনিশ-কুড়ি হল, ওর বাড়ির বাইরে বন্ধু ছিল না? আর ফেলুদা? তার কোনও বন্ধু নেই? নিজের বয়সের? সেই লালমোহনবাবু শুধু? তাঁর বয়স তো ফেলুদার থেকে অনেক বেশি। তারপর ওনার বুদ্ধির ওয়েভলেন্থ ফেলুদার থেকে আলাদা। উনি পরিচিত লোক হতে পারেন, কিন্তু বন্ধু? সম্ভব নয়। আর ফেলুদা যেত সেই সিধু জ্যাঠার কাছে। তিনিও এক বেকার লোক। সারাদিন বসে বসে পাগলের মত খবরের কাগজের খবর কেটে আঠা দিয়ে খাতায় সেঁটে রাখছেন আর রাশি রাশি উদ্ভট বই পড়ছেন। এরা কেউ কি জীবনে বন্ধু হওয়ার মত রোল মডেল? ফেলুদা বুদ্ধিমান লোক হয়ে এরকম নেতিবাচক বন্ধুই শুধু খুঁজে পেল? শার্লক হোমস এর দাদা ছিল এই সিধু জ্যাঠার মত। কিন্তু সেই মাইক্রফটের একটা সরকারি চাকরি ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরি। সুতরাং মাইক্রফট হোমস চেয়ারে বসে ভাবনা চিন্তায় সময় দিতেই পারেন। ওনার উপার্জন আছে। সিধু জ্যাঠার কী ছিল? শুধু আলমারি ভর্তি বই?
তোপসের সাথে ফেলুদার সম্পর্ক মালিক-চাকরের মত। একদম প্রথম গল্পে দেখানো হচ্ছে যে ফেলুদা তোপসেকে গাট্টা মারছে। ওকে এমনিতে কথা বলতেই নিষেধ করছে। ওকে “ক্যাবলা” বলে ডাকছে। এর পর সোনার কেল্লাতে তোপসেকে বলছে “বিন্দু”। এর অনেক পরে “অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য” তেও তোপসে একটা সাধারণ কথা ফেলুদাকে “ভয়ে ভয়ে” জিজ্ঞাসা করছে। নিজের দীর্ঘদিনের অ্যাসিস্ট্যান্টএর সাথেও যদি এরকম ভয়ের সম্পর্ক থাকে, তাহলে সেই গোয়েন্দাকে খুব বেশি ভালো বলা যায় কি? একটু তুলনা করে দেখুন। শার্লক হোমসের সাথে পরিচয়ের পর ডাঃ ওয়াটসন বিয়ে করেছেন, নিজের প্র্যাকটিস শুরু করেছেন, নিজের ডাক্তারি নিয়ে দূরে সরে গেছেন। এটাই জীবনে স্বাভাবিক। একজন কী শখের গোয়েন্দার জন্য সারা জীবনে আর কিছুই করবে না? হোমস যেমন গোয়েন্দা, ওয়াটসন তেমন ব্যস্ত ডাক্তার। দুজনে সমান। কিন্তু তোপসে ফেলুদার পেছনে সারা জীবন অদৃশ্য হয়েই থেকে গেল। পোয়ারোর হেস্টিংস একটা সময়ের পর দক্ষিণ আমেরিকায় কাজ করতে চলে গেছে। মানুষ তো এইরকমই হবে। তবে তো সেই চরিত্র পাঠকের প্রিয় হবে। আর তোপসে? সারাজীবন শুধু হিরো ওয়ারশিপ? বরং লালমোহনবাবুর জীবনটা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। উনি নিয়ম করে লেখেন। সেই লেখা বিক্রি করে টাকা পান। সেটা দিয়ে উনি জীবন নির্বাহ করেন। যে ব্যোমকেশের কথা আগে বললাম, তার সহকারী, অজিত অবধি একটা সময়ের পর বইয়ের ব্যবসায় নেমেছে। কিন্তু তোপসে আর নিজের কৈশোর ছেড়ে মানুষ হতে পারল না।
একটা সাহিত্যে সেই সমকালের সময়ের ছাপ থাকে। কিন্তু ফেলুদার বইতে সেভাবে সময়ের ছাপ কোথায়? এর সঙ্গে তুলনা করুন ব্যোমকেশ। ভারতের স্বাধীনতা লাভ, স্বাধীনতা লাভের আগের সেই অস্থির সময়, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, দক্ষিণ কলকাতার নতুন নতুন পাড়া, সেই সময়ের যৌথ পরিবার, জমিদারের এস্টেট---এই সমস্ত ঘটনা এসেছে একদম ছবির মত। এমনকি বিহারে বাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতে অবৈধ অস্ত্র আসা—ইত্যাদিও বাদ যায়নি। কিন্তু ফেলুদার গল্পে সেই সময়ের প্রায় কোনও ছাপ নেই। নকশাল আন্দোলন, কলকাতার রাজনৈতিক অস্থিরতা, এমারজেন্সি, বিটলস্ দের বিশ্বজয়, মানুষের চাঁদে যাওয়া—ইত্যাদি কোনও ঘটনাই সেখানে নেই। এইসব গল্প ১৯৭০ সালের না হয়ে স্বচ্ছন্দে ১৯২০ সালেরও হতে পারে! সেই সময়ে ফরেন্সিক বিজ্ঞানে যে উন্নতি হচ্ছিল, তার কোনও কথা নেই। শুধু অতীতচারণা। বেশিরভাগ গল্পে প্রাচীন কোনও পুরাকীর্তি চুরি যাবে, সেটা জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা হোক বা নেপোলিয়নের চিঠি। আর সেটা উদ্ধার হবে। কলকাতার সেই সময়ের কথা এসেছে শুধু পাতাল রেলের কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে, এই বর্ণনায় আর নিউ মার্কেট ভেঙ্গে দেওয়ার কথা উঠেছিল, সেই খবরে। সত্যজিৎ রায় সিনেমার লোক। উনি টিনটিনের নাম করেছেন। তাহলে সেই সময়ের স্টার ওয়ার্স বা স্পিলবার্গের সিনেমার নাম করতে বাধা কোথায়? ১৯৮০ সালের পৃথিবীতে ফেলুদা আছে, সারা পৃথিবীর খবর রাখে। আর ভিয়েতনাম বা এইডস মহামারীর উল্লেখ নেই? ১৯৮০ সালের পরেও যে সব ফেলুদা কাহিনী লেখা হচ্ছে, যেমন ১৯৮৪ সালে এবার কাণ্ড কেদারনাথে বা ১৯৮৭ সালে ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর, সেখানেও সেই সময়ের কিছুই কথা নেই। অন্তত ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা? ফলে ফেলুদার বইয়ে সেই সময়ের ছাপ খুঁজতে গেলে মুশকিল। একদম সময় থেমে থাকা একজন ম্যান বয় হিসাবে ফেলুদাকে দেখলে তবেই ঠিক। একটু ভেতরে ঢুকতে গেলেই মুশকিল।
ফেলুদার বইয়ে মোটামুটি কুসংস্কারকে খুব একটা সামনে আনা হয়নি ঠিকই। কিন্তু তাও দুএক জায়গায় বর্ণনা কিন্তু বেশ আপত্তিকর। যেমন, নয়ন রহস্য গল্পে সেই হিপনোটিজম। ওভাবে, অত সহজে মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। এখনকার কোনও ম্যাজিশিয়ান এই খেলা দেখান না। এইসব বর্ণনা কিন্তু ভুল। সোনার কেল্লা গল্পেও মুকুল জাতিস্মর কিনা, সেই বিচার খুব ভালোভাবে করা হয়নি। জাতিস্মর মানে যে বুজরুকি, সেই কথা খুব জোরের সাথে বলা হয়নি। বরং এমন কিছু কথার উল্লেখ আছে, যেটা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত মনন মেনে নেবে না। যেমন সেই দানিকেনের বইয়ের কথা, যেখানে দেবতারা গ্রহান্তরের মানুষ কিনা, সেই আলোচনা রয়েছে।
তাহলে কি ফেলুদার বই খারাপ হয়ে গেল? একদম নয়। বই যা ছিল, তাই আছে। কিন্তু বিশ্বের অন্য অনেক বইয়ের মত এই বইও ভবিষ্যৎ পাঠকের হাতে নানাভাবে কাঁটাছেঁড়া হবে। রোয়াল্ড ডাল, ডাঃ সিউস, এনিড ব্লাইটন—ইত্যাদি সবাই এখন নানাভাবে এরকম সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। এখানকার বই বা বাদ যাবে কেন? অন্ধ ভক্তের মত আচরণ করলে কারুর লাভ নেই। এখনও হয়ত বাঙালি কিশোর এই বই নিয়েই মশগুল হয়ে থাকবে। কিন্তু বড় হয়ে যাওয়ার পর, বাকি পৃথিবীর সাথে পরিচয়ের পর, এই বই আর খুব ভালো লাগা মুশকিল। এতে প্রমাণ হয় না যে এই বই খারাপ। এতে প্রমাণ হয় যে সেই কিশোর পাঠক অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে, তার মধ্যে সাহিত্য নিয়ে একটা সাবালকত্ব এসেছে এবং সে প্রশ্ন করতে শিখেছে। যে প্রশ্ন ফেলুদার অ্যাসিস্ট্যান্ট কোনওদিনই সাহস করে করে উঠতে পারল না।
ভ্রমণ
শীতে কুয়াশা আচ্ছন্ন অন্তহীন মেঘে ঢাকা ভোরবেলায় ঠান্ডা শিহরণে গায়ে গরম জামা ও শাল দিয়ে শহর তিলোওমা থেকে একটু দূরে হাওড়া জেলার অন্তর্গত - বাকসার এর দিকে বেড়িয়ে আসলাম। প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ খুঁজে পেলাম যা আলফ্রেড লর্ড টেনিসন এর কবিতায় বা বিভূতিভূযণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি বহুবার। তাছাড়া অনেক কবির লেখাতে প্রকৃতির বর্ণনায় পেয়েছি। বই এর ভাঁজে শুধু বাঁধা পড়ে আর রইল না সেই গন্ডি পেরিয়ে নিজেই ধরা দিলাম অপরূপ শীতল প্রকৃতির বুকে।
ডিসেম্বর মাসে মা বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম, কথা ছিল অন্য জায়গায় যাওয়ার কিন্তু ট্রেন ফেল হওয়ায় আমাদের পরিকল্পনা পাল্টে যায়। বলা বাহুল্য হাওড়া বাকসার যাওয়া ভাগ্যে ছিল। বাকসারার পথ দিয়ে যেতে যেতে বাজারের দিকে রওনা দিলাম। ভোর তখন ৬:৩০, রাস্তায় তখন বেশ কিছুটা ভিড়, কর্ম ব্যস্ততা, ইস্কুল ভ্যান রিকশা ও সাইকেল করে লোকজনের আনাগোনা। পথ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি লোককে জিজ্ঞেস করলাম সাতঁরাগাছির ঝিলের কথা। সে বলল শীতের শুরুতে তেমন পাখিদের দেখা হয়তে। মিলবে না। আরও ভিতরে মিলবে ঝিলের দর্শন। তবুও মন চাইল এতটা পথ যখন এসেই পড়েছি তখন তা ক্যামেরাবন্দি করে রাখতেই হয়। সাতঁরাগাছি ঝিলে, পৌঁছে দেখলাম যেন কোনও এক নির্জন দ্বীপের মতো, যেখানে ভোরের আলো পড়তেই অনুভব করলাম সারি সারি পাখিদের দল যারা নিস্তব্ধে একসাথে বসে আছে আর জ্যামিতির আকার ধারণ করে নিয়েছে।
হাজারো পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে সাতঁরাগাছির ঝিলে, নানান রকমের পাখির সন্ধান পাওয়া যায় ও বৈচিএ্য আছে এখানে যেমন- ব্রোঞ্জ জাকানা, হোয়াইট ওয়াগটেল, গ্রেট ইন্ডিয়ান পন্ড হেরন, হোয়াইট থ্রোটেড কিং ফিশার আরও প্রভৃতি। এই শীতল আবহাওয়ায় পরিযায়ী পাখির সমারোহে মেতেছে ঝিলটি। মেঘ আচ্ছন্ন আকাশ ও নীচে জল মিলে মিশে একাকার। পাখিদের গায়ের রঙ ও আকাশ যেন এক অদ্ভুত স্বপ্নলোক তৈরি করেছে। কল্পনার এই বাতাবরণে ঝিলের জলের উপর পাখিদের ছায়া ও তাঁদের মধ্যে আলাপচারিতা, অন্তরঙ্গতা যেন আনন্দের ছোঁয়া দিয়ে যায়। দেখে মনে হয় যেন কতদিনের কথা, তারা বলতে চায় একে অপরকে। অজস্র পাখিদের ছায়া জলের উপর পড়েছে তখন ভেসে উঠেছে তাঁদের নানান ভঙ্গিমা, ধরণ ও অদ্ভুত যেন এক ব্যক্তিত্ব ভাব মানুষের মতো। এই সব কখনও মিলেমিশে যাচ্ছে স্বপ্নদেশে আবার ফিরে আসছে বাস্তবতায়। সেই দৃশ্য শিল্পীর ক্যনভাস ভরে উঠেছে ছবির মতো উজ্জ্বল। একটু পরে সেই কুয়াশা সরে গিয়ে সূর্যের
আলোর রশ্মি যখন জলের উপর পড়েছে তখন সোনার আলোর ঝলকানি লেগে চোখে তা চক্ চক্ করছে। কোনও এক জাদুকর তাঁর “ম্যাজিক" সৃষ্টি করে চলেছেন আর প্রকৃতি অবলীলায় তার রূপ বর্ষণ করছে। এ যেন অপূর্ব মায়াবী জালে আবদ্ধ। এই সুন্দর ঝিলের উপর পাখিদের আনাগোনা ও একসাথে উড়তে থাকার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার অভিজ্ঞতাই আলাদা। শুধুমাত্র ঝিলের পাখিই নয় তার পাশাপাশি চারপাশের সবুজ প্রকৃতি ও পানাপুকুরের পাতার যে গঠন যেন শিল্পীর আঁকা ছবির মতো উজ্জ্বল।
জীবনে এই প্রথমবার এত সহজ সতেজ পরিষ্কার কচুরিপানায় ভরা সাতঁরাগাছির ঝিল দেখলাম। সারি সারি কচুরিপানায় বসে রয়েছে কিছু পাখিরা - তাঁদের সরল দৃষ্টি ও পাতার সেই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে চিরযৌবনের প্রতীক। তাছাড়া কিছু ফড়িং সেখানে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে ও সোঁদা মাটির গন্ধ ছড়িয়ে আছে। একসাথে এত কচুরিপানায় ভরা পরিবেশ ভাবাই যায় না!! সেখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম মা আর আমি মিলে অনেক ছবি ফ্রেমবন্দি করে রাখলাম। ভোরের ছবির আলাদা এক মিষ্টি আলোক বর্ষণের প্রকাশ রয়েছে। এই পরিবেশে এসে বাংলার মাটির শিকড়কে অনুভব করলাম। নিজের এই বাংলায় এত রূপ যা অন্য জায়গার তকমার প্রয়োজন নেই। তাই কবি জীবনানন্দ তার কবিতায় বলেছেন- "বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর"। সাতঁরাগাছির ঝিল দেখার পর মৌখালী হাওড়া রেলওয়ে কলোনির চারপাশটা কী সুন্দর লাগলো!! গাড়িতে বসে জানালার পাশ দিয়ে দেখলাম রেললাইন আর ঠিক তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় সাইকেল নিয়ে যারা পারপার হতে চায়। সেই মুহূর্তে চোখের সামনে ট্রেন আসতে লাগলো আর সেই ট্রেনের চলে যাওয়ার দৃশ্য মনে আচমকাই ভেসে উঠল সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর সেই অপু - দুর্গার দৃশ্যটি।
ভোরের কুয়াশা সরে গিয়ে যখন একটু একটু করে সকাল আসছে; সেই প্রকৃতির পরিবর্তন ও পাখিদের উড়ে যাওয়া যেন এই বিশ্বগগনে মুক্তির আলো খুঁজে পাওয়া। হাজারও ব্যস্ততা, শহরের দৈনন্দিন জীবনযাপন, কাজের স্ট্রেস, ট্রাফিক - সময়ের সাথে মানুষ সবসময় ছুটে চলেছে। এই বাস্তবতার বেড়াজালে মানুষ জটিলভাবে বেঁধে রয়েছে ও গতির সাথে পা মিলিয়েছে এর ফলে প্রকৃতির যে আলাদা মাধূর্য রয়েছে তা আমরা খুঁজে দেখিনা। হঠাৎই এমনভাবে কোথাও ঘুরে আসলে অজান্তেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নতুন রূপে, রঙে প্রকৃতি ধরা দেয় যা অবচেতন মনে বারবার ফিরে ফিরে আসে আর শান্তি দেয়।
ভ্রমণ
রূপকথার শহর: হল্যন্ডের গিটহোর্ন
দেবযানী পাল
ওভারআইসেল (Overijssel) নদীর ধারে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা দ্য উইডেন (De Wieden ), আর জাতীয় উদ্যান ওযেররিবেনের (Werribeen) কাছে, নিজ মহিমায় মহিমান্বিত, রূপসী ছোট শহর গিটহোর্ন (Giethoorn)।
এ শহরের বিষেশত্ব হল, উঁচু, নিচু নানান ধরনের সুন্দর কাঠের সেতু দিয়ে শহরের নানান ছোট, বড় জলেভরা অগণিত খালগুলো সাজানো। জলে, জলে নৌকোয় পুরো শহর সুন্দর দেখা যায। যেখানে খুশী নামা যায়। পিওনও (postman) সেটাই করছে, চোখে পরলো। জলপথে, বিদেশী যাত্রীদের ভীড়।
নজরে পরে, পাড়ে পাড়ে, জানা অজানা বিখ্যাত দ্রষ্টব্যস্হল, আশে-পাশে বিভিন্ন লোকজনের ব্যস্ততা, সবকিছু সত্যিই দেখার মত।
গিটহোর্নকে বলা হয়, উত্তরের “সবুজ ভেনিস”। মোটামুটি ১২০০ শতকে এখানে লোকজন বসবাস শুরু করে। অতীতে অনেক ভেড়া, ছাগল চড়ে বেড়াতো এখানে। ১১৭০ সালে সেন্ট এলিজাবেথের ভয়াবহ বন্যায় সব নিহত হয়। সারা গিটহোর্ন অঞ্চলের এদের হাড, শিং ইত্যাদি পাওয়া গেছে। সেজন্যই এদেশের ভাষায় এ অঞ্চলের নাম, Gyeten Horen=(Horns of the Goats). তবে, অতীতের স্মৃতি হিসেবে এখানে অনেক বড় বড় খামার (Firm Houses) আছে। এই গ্রাম্য শহরে কোনও গাড়ী চলে না। লোকেরা প্রধানত জলপথ, সাইকেল বা হাঁটাপথ ব্যবহার করে। শীতে গিটহোর্ন অপূর্ব সুন্দর। বরফে দিনে-রাতে এর অপূর্ব রুপে রুপান্বিত। কুয়াশা - মেঘের আবরণে আচ্ছাদিত। শীতের আলো-অন্ধকারে মনে হয যেন রূপকথার দেশ। শান্ত প্রকৃতি, অন্তরীক্ষে নানা পাখীর ডাক, জলপথে হাঁসের সারি, ঢলমান বোটের শব্দ, সব মিলিয়ে এক অপূর্ব অনুভূতি।
প্রবন্ধ
দেবযানী পাল
আর হাড়কাঁপানো শীতে, আধা অন্ধকারে ঠাকুমার পুজোর ফুল আনতে যাওয়া ছিল উত্তেজনায় আনন্দের সুখ।
আমাদের শহরের জমিদারের মতিলাল ও রাজলক্ষী নামে দুটো হাতী ছিল। প্রতিদিন বিকেলে ওর মাথায় বিরাট শাকপাতার বোঝা নিয়ে ওরা আস্তাবলে ফিরতো। মনে পড়ে, আমরা, ওদের গলার ঘন্টার শব্দে দৌড়ের গিয়ে দেখতাম, দুজনে হেলতে-দুলতে চলেছে। মাহুত ওদের নাম ডাকলে, ওরা প্রত্যুত্তর করত। সুতপার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সুচরিতা বললো, এই আনন্দমাখা খুশীতে আমরা ছিলাম, সুখী।
আমার বাবা, প্রতিদিন আমাকে নিয়ে অতি ভোরে সাইকেলে রংপুর শহরের উত্তরে যেতেন। ওখান থেকে ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত, স্বর্ণবর্ণের হিমালয়ের চূড়া আলোয় উদ্ভাসিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতাম, দুচোখ ভরে। সেই সুখের কোনও শেয নেই, সে হল শ্রদ্ধা মিশ্রিত সুখ।
১৯৪৭ সালে, ভারত স্বাধীন হবার পর, সুচরিতা বললো, আমরা পূর্ববঙ্গ (এখন বাংলাদেশ) চিরদিনের মতো ছাড়লাম। এখনও মনে আছে, শেষ সন্ধ্যায়, প্রায় আলোহীন, আমাদের পিতৃভূমি ছেড়ে আসার আগে, আমার বান্ধবীকে, আমার পুতুল, খেলনাপাতি সব কিছু দিলাম, এক শর্তে, যে ফিরে এসে সব আবার ফেরত নেবো। কিন্তু আর কখনও ফিরে যাইনি। কখনও-সখনও মনের অতল গভীরে, অব্যক্ত বেদনায় মাখা স্মৃতির আলো জোনাক পোকার মত সারারাত জ্বলে কোলকাতার পথে দুর্বিষহ অবস্থা পেরিয়ে, মারামারি, ঠেলাঠেলি করে শেষে সান্ধ্য আইনের অন্ধকারে কোলকাতা এসে পৌঁছলাম। পরে শুনেছি, রংপুর থেকে শেষ ফেরার ট্রেনটি শুধু মৃতদেহ
নিয়ে ফিরেছে। সত্যিই, জন্মভূমি ছেড়ে আসার অপরিসীম মনোবেদনার যেমন কোনও সান্ত্বনা নেই, তেমনি বিপদ থেকে বেঁচে ফেরার পরম সৌভাগ্যেরও কোনও ব্যাখ্যা নেই।
আসন্ন সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সুতপা বললো, আমার মনে হয় সুখ-দুখ, আশা-নিরাশা সবই মানুষের জীবনের মানসিক সাম্যতা ও শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। সর্বজনবন্দিত বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক গুরু দালাই লামা বলেছেন,
সুখ-দুখ বলে কিছু নেই। তবে, সর্ব জীবের প্রতি অনুকম্পা আর করুণা থেকেই সুখানুভূতির জন্ম।
সুখে থাক সবাই, এই-ই প্রার্থনা।
দিনের শেষে বান্ধবী সুতপার বাগানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুচরিতা বললো, সুখ কথাটার সত্যিকারের অর্থ কি বলতো? সুখী গৃহকোন, শোভে গ্রামোফোন, আর নূতন কনের জন্য সুখে থাক-লেখা সিন্দুরের কৌটো- মনে আছে তোর?
একটু ঢুপকরে থেকে, সুচরিতা বললে, শোন আমার কাহিনী। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আমরা উত্তরবঙ্গের রংপুর শহরে ছিলাম পরম শান্তিতে। বাড়ির কাছেই ছিল সারাবছর প্রায় শুকনো একটা ছোট নদী। বর্ষার ভরা জলে খরস্রোতাকে দেখে মনে হত, যেন এক মনমোহিনী দুরন্ত মেয়ে। মনে পড়ে আমার বাবা আমাকে নিয়ে কচুরিপানা পানা, আর জলে ঢাকা নড়বরে বাঁশের সেতুটি পেরিয়ে ওপারে প্রিয় বন্ধুদর্শনে যেতেন। সে ছিল এক ঔৎসুক্যভরা সুখ। গরমে আম-কাঁঠালের মোহময় গন্ধে এক মন মাতানো সুখের অনুভূতি হত। অতি ভোরের কাঁচা সোনামাখা রোদে, সবাই মিলে মুড়ি খাওয়া ছিল খুশী হবার সুখ।
গল্প
প্রোমোশন
নূপুর রায়চৌধুরী
রাগে গা চিড়বিড় করছে তিয়াসার, সকাল সাড়ে আটটায় আসার কথা, এখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নয় ছুঁই ছুঁই, কোনো পাত্তা আছে প্রীতমের? রোজ রোজ এই একই চিত্র, কাঁহাতক সহ্য করা যায়? পাশাপাশি বসে, আর একই প্রজেক্টে রয়েছে বলে কি ওকে কিনে রেখেছে প্রীতম? আসুক আজ, এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে—মনে মনে গজরালেও মুখে কিছু বলে না তিয়াসা। সক্কাল সক্কাল মেজাজ খারাপ করার কোনো মানে হয় না, সারাটা দিন তো পড়েই আছে সে জন্য। ওর হেলথ ট্রেইনার জিমি কী যেন বলছিল সেদিন? ওহ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, টেনশন হলে আর কিছু না হোক, অন্ততপক্ষে দু-চারবার ব্রিদিং-এক্সারসাইজ করতে হবে। মনে মনে নিজের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য নিজের পিঠ চাপড়ায় তিয়াসা। মাস গেলে এক কাঁড়ি টাকা দিয়ে জিমিকে পোষার ফায়দাটাই বা কী, যদি না এরকম সময়গুলোতেই তার দেওয়া টিপসগুলো কাজে লাগানো না যায়! তড়িঘড়ি বেশ ক’টা বড়বড় শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করায় প্রয়াসী হয় সে। তারপর, একটু ধাতস্থ হয়ে নিজের কাজের টেবিলে এসে ডেস্কটপ খুলে বসল তিয়াসা। আগরওয়াল কোম্পানির ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কোম্পানির ফাইলটা খুলে একটু চোখ বোলানো মাত্রই আবার তিয়াসার মেজাজের পারা চড়তে শুরু করল। এত আলোচনার পরও ডাটা স্প্রেডশিট যেমনটি ছিল তেমনই রয়ে গেছে বেবাক, কোনো নতুন এন্ট্রি নেই! গতকাল সকালে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাজটা গোটাতে পারেনি তিয়াসা, কারণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের আর্থিক লেনদেনের চালান রেকর্ডিংয়ে কিছু অসঙ্গতি ওর নজরে আসে। দুপুরেই তাই টিম-মিটিং ডাকা হয়েছিল; খুঁজেপেতে দেখা যায় যে, কিছু ডাটা স্প্রেডশিটে তোলা না হওয়ার কারণে এই সমস্যার উদয় হয়েছে। টিমের বুককিপার হিসাবে, এটা করার কথা তো প্রীতমের। করেনি? আশ্চর্য্য! আচ্ছা, সে ঠিক দেখছে তো? আরেকটা নতুন শিট বা কলাম যোগ করেনি তো ছেলেটা? স্প্রেডশিট আতিপাতি করে খুঁজল তিয়াসা, নাহ, নেই। উহ, এখন কাজটা ফাইনালাইজ করে কীভাবে তিয়াসা? ও যে শুধু প্রধান হিসাবরক্ষক তাই নয়, প্রজেক্টের টীম-লিডারও বটে! বড়ো সাহেব মিস্টার বোমানি যদি এখন জানতে চান, কাজ কতদূর এগিয়েছে, কী জবাব দেবে ও? শেষ মুহূর্তে কিছু ভুল ধরা পড়েছে, চালানের কপি ঠিকঠাক ছিল না – এসব ছেঁদো কথা কানে তুলবেন ঘাগু ব্যবসায়ী বোমানি? কখনোই না। আর বুককিপার তার কাজ করেনি, একথা তিয়াসা মরে গেলেও বসকে বলতে পারবে না, কারণ দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে তার একটা কঠোর বোধ রয়েছে, যা তার বড়ো হয়ে ওঠার সময়কার পারিবারিক শিক্ষারই প্রতিফলন। সুতরাং, ডেডলাইনের মধ্যে প্রজেক্টের নিষ্পত্তি না হলে, তিয়াসা মনে করে, বোমানির কৈফিয়তের জবাবদিহি করার দায় শুধুই তার একার! অতএব, প্রীতমের অনুপস্থিতিতে তার কাজগুলো তিয়াসাকেই তুলতে হবে এখন। নিজের উপর বেদম রাগ হচ্ছে তিয়াসার, ওর ভালোমানুষির সুযোগটা ভালোই নিচ্ছে প্রীতম!
ছেলেটা সত্যিই খুব স্বার্থপর! নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েই সর্বদা অভিযোগে ব্যস্ত! দূর থেকে কি ও একাই শুধু অফিসে আসে? রাজীব, মন্দিরা, কিনু ওরা সকলেই তো বাসে-ট্রামে বাদুড়ঝোলা হয়েই কত দূর দূর ঠেঙিয়ে অফিসে আসে! কৈ ওরা তো প্রীতমের মতো অফিসে ঢুকেই ফিরিস্তি দিতে বসে না:ট্রেন কত লেট্ করেছে; ছোটাছুটি করে ট্রেন ধরতে গিয়ে সে কত নাজেহাল হয়েছে; তারপর হাওড়া স্টেশন থেকে চৌরঙ্গীগামী বাসে কত দমফাটা ভিড় ছিল, ইত্যাদি, ইত্যাদি, রোজ রোজ শুনে শুনে কান পচে গেছে তিয়াসার। তিয়াসার নিজের বাড়িও তো সেই কামালগাজী’র কোন ভিতরস্য ভিতরে; সেখান থেকে বাস টার্মিনাস পাক্কা আধ ঘন্টার পথ। ঠিক সময়ে আসবে বলে ওকে রিকশা নিতে হয়, আর পাবলিক-বাস ধরে অফিসে হাজিরা দিতে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে, তাই তো ও মিনিবাস ধরে নেয়। গাঁটের পয়সার অনেকটাই খসে যায় রোজকারের এই যাতায়াত ভাড়ার পিছনে, কিন্তু চাকরি রাখতে গেলে, এছাড়া উপায় কী ? পয়সার মায়া করলে তো আর চলবে না! তা ও কি কখনো এইসব কাঁদুনি গাইতে বসে অফিসে এসে?
ওদিকে, কিছু বললে আবার প্রীতমের মান হয়। সে গরিবের ছেলে, তফসিলি জাতির মানুষ, অনেক কষ্টে চাকরিটা জুটিয়েছে, এঁদো পচা গ্রাম থেকে এতদূর উঠে এসেছে, অন্যদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি,- এই সব অসংলগ্ন কথাবার্তা বলবে ইনিয়েবিনিয়ে। আর সেই মহাভারত শুরু হলে সহজে থামবেও না। খানিকটা দয়াপরবশ হয়েই প্রীতমের এই দেরি করে আসার ব্যাপারটা একরকম মেনেই নিয়েছে তিয়াসা, কিন্তু সেটা অন্যান্য দিন, প্রজেক্টের ডেডলাইনের মুখেতে নয়! আর কাজের ছিরি? বছর ঘুরতে চলল, এখনও হাজার গন্ডা ভুল থাকে ওর চালান রেকর্ডিংয়ে, কিন্তু, কার ঘাড়ে কটা মাথা যে কিছু বলে? সংরক্ষণ কোটা থেকে এসেছে বাবা! ইউনিয়নের দাদারা ঝান্ডা নেড়ে অমনি ধেয়ে আসবে!
প্রীতমের গুণের কি এখানেই শেষ? লাঞ্চ-ব্রেকের সময়, নিজের টিফিন তো সে কপাৎ করে এক নিমেষে খেয়ে ফেলে, আর তারপর তিয়াসা যখন খেতে বসে, তখন এমন জুলজুল করে চেয়ে থাকে যে, তিয়াসার মনে হয় যে প্রীতমকে না দিয়ে খেলে নিঘ্ঘাৎ ওর পেট ছাড়বে! তিয়াসার টিফিনবাক্সে ঝাঁক না মারলে বাবুর যেন পেট ভরে না, ভাবা যায়, কিরকম লোক রে বাবা!
মনে মনে গজগজ করতে করতে স্প্রেডশিট-এর ডাটা মেলাতে শুরু করে তিয়াসা। সবেমাত্র মিনিট দশেক কাজটায় এগিয়েছে, এরই মধ্যে মিস্টার বোমানির পিওন রহমত তিয়াসার ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়াল, ‘’মিস বসাক, সাহেব আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।’’ ‘’আচ্ছা, যাচ্ছি,’’ বলে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায় তিয়াসা। কিন্তু ওর মনটা কেমন খচ করে ওঠে, সাতসকালেই বসের তলব, সব ঠিক আছে তো? আগরওয়াল কোম্পানির কাজটা নিয়ে কিছু বলবেন নাকি উনি? ওরে বাবা, কী হবে এখন? কিন্তু সেই প্রজেক্টের ডেডলাইন আসতে তো এখনও দু-দিন বাকি আছে। উঁহু, সেটা নয়, তাহলে আর কী হতে পারে? টেবিলের উপর রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল গিলে, গুটিগুটি পায়ে বোমানির ঘরের দিকে এগিয়ে যায় তিয়াসা।
বন্ধ দরজায় টোকা মারতেই ভিতর থেকে বোমানির দরাজ গলায় ‘’কাম ইন’’ হাঁক শুনতে পেল তিয়াসা।
ঘরে ঢুকে তিয়াসা দেখল বোমানি বেশ খোশমেজাজেই রয়েছেন, যাক বাবা, খারাপ কিছু নয় তাহলে, স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলল সে। বোমানি হেসে হেসে হাত দেখিয়ে তিয়াসাকে তাঁর টেবিলের উল্টো দিককার চেয়ারটাতে বসতে ইশারা করলেন।
তিয়াসা একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, ''আমায় ডেকেছিলেন স্যার?''
বোমানি বললেন, ''হ্যাঁ তিয়াসা, একটা জরুরি দরকারে তোমায় ডেকেছি। তোমার এক সহকর্মীর ব্যাপারে কিছু গোপনীয় প্রশ্ন করতে চাই, আশা করি সে ব্যাপারে উত্তর দিতে তোমার কোনো আপত্তি নেই।’’
তিয়াসা একগাল হেসে বলে, ‘’না না আপত্তি কিসের? কার সম্বন্ধে জানতে চান স্যার, বলুন।’’
‘’হ্যাঁ, প্রীতম’’।
তিয়াসার বুকটা ধক করে উঠল, সে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘’কোন প্রীতম স্যার?’’
‘’আরে, ওই যে, প্রীতম মন্ডল-- গত বছর সংরক্ষণ কোটায় নেওয়া হলো যে ছোকরাটিকে, তোমার প্রজেক্টেই তো আছে!’’
কী গেরো রে বাবা! কিন্তু মুখের হাসি টেনে রেখে তিয়াসা বলে, ‘’হ্যাঁ স্যার, চিনি তো ওকে।’’
বোমানি তাঁর সামনে খুলে রাখা একটা ফাইলে চোখ বোলালেন, তিয়াসা অনুমান করল ওটা প্রীতমেরই পার্সোনাল রেকর্ড।
‘’আচ্ছা,তা ছেলেটা কেমন? কাজকম্মো ঠিকঠাক করতে পারে? টীম-স্পিরিট আছে নাকি? সময়মতো কাজ তুলে দেয় তো?’’ বোমানি যেন প্রশ্নের ঝড় তুলেছেন ।
এবার তিয়াসার গলা শুকিয়ে আসছে, ও চুপ করে ভাবার চেষ্টা করে, ঠিক কী বলবে, কারুর নামে লাগানিভাগানি করা মোটেই ওর স্বভাব নয় ।
সে আমতা আমতা করে, ‘’স্যার,আমাদের প্রজেক্টের বুককিপিংটা প্রীতমই দেখে…।’’
বোমানি এবার একটু জোর দিয়েই বলেন, ‘’সে তো জানি, টীম-লিডার হিসাবে তোমার গ্রুপের প্রত্যেককে তুমি খুব কাছ থেকে চেনো, জানো, তাই তোমাকে ডেকে পাঠানো তিয়াসা ।’’
তিয়াসা এবার তুতলে তুতলে বলে, ''হ্যাঁ, স্যার, আমি আপনার পয়েন্ট সম্পূর্ণ ধরতে পেরেছি, তবে,... ।''
‘’তবে টা কী?’’বোমানির গলার স্বরে অসহিষ্ণুতা চাপা থাকে না।
''ওর অফিসে আসার পথে কিছু বোধহয় সমস্যা আছে, আমার সেরকমটাই ধারণা হয়েছে এযাবৎ।’’
‘’মানে? ঠিক বুঝলাম না, খুলে বলো!’’
‘’না মানে ও তো অনেক দূর থেকে আসে, স্যার।’’
‘’হুম, সে তো অনেকেরই থাকে, এগুলো কোনো কথা হলো? তা ও ঠিক সময়ে অফিসে আসে তো নাকি? দেখো, তোমার সুপারিশের উপর ভিত্তি করেই কিন্তু আমি ওকে প্রমোশন দেবার কথা চিন্তা করব, তাই তোমার উত্তরের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে; তুমি কিছু রাখঢাক কোরো না যেন।’’
প্রমোশন? প্রীতমকে? ঠিক শুনছে তো তিয়াসা? বেদম কৌতূহল হলেও, মুখে কিছু বলে না সে, শুধু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে বোমানির দিকে।
‘’হ্যাঁ, আমাদের একটা নতুন শাখা অফিস খোলার কথা চলছে মানিকতলায়; মেন্ অফিস থেকে কিছু লোককে পাঠানো হবে সেখানে, বাইরে থেকেও অবশ্য কিছু নতুন লোককে নিযুক্ত করতে হবে। ভাবছি, ছোট্ট করে একটা প্রমোশন দিয়ে প্রীতমকে ওখানে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? ও কমবয়সী, দৌড়ঝাঁপ করে ওই অফিসটাকে দাঁড় করাতে পারবে! তোমাদের কর্মী-ইউনিয়নও তাল তুলেছে,সংরক্ষণ কোটা থেকে অন্তত একজনকে নতুন অফিসে পাঠাতে হবে, তো এই ব্যবস্থা সব দিক থেকেই ভালো হবে, কী বলো?’’ বোমানি যেন খানিকটা স্বগোক্তিই করছেন।
একের পর আরেক তথ্যের ভারে তিয়াসা যেন খাবি খাচ্ছে, চমকের পর চমক! উঃ, ব্রিদিং এক্সারসাইজটা করতে পারলে এখন কাজে দিত! অন্য অফিসে চলে যাবে প্রীতম? সত্যি! জয় মা কালী, তোমার কী দয়া মা তারা! আনন্দে চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে তিয়াসার।
বোমানি কিন্তু ওর দিকে কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। একটা সামান্য বিষয়ের উত্তর দিতে তিয়াসা কেন এত সময় লাগাচ্ছে, তিনি যেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। একটু অসহিষ্ণু ভাবেই উনি এবার বলে উঠলেন, ‘’তো প্রীতম সম্বন্ধে তোমার শেষ কথা কী?’’
তিয়াসা এবার বিগলিত হেসে, সোৎসাহে বলে, ‘’স্যার, প্রীতম খুবই যোগ্য ছেলে।’’
বোমানি ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘’কিন্তু তোমার একটু আগের মুখের ভাব দেখে তো মনে হচ্ছিল, তুমি প্রীতমের অফিসে আসার ব্যাপারে নেগেটিভ কিছু একটা ইঙ্গিত করছিলে।’’
এই রে, ব্যাপারটা কেঁচে গেল না তো? উত্তেজিতভাবে চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠে দাঁড়িয়ে, আর্তকণ্ঠে তিয়াসা বলে,
‘’না, না স্যার, তা মোটেই নয়, আমি বোঝাতে চাইছিলাম যে, অনেক দূর থেকে আসলে কী হবে, অফিসে হাজিরাটা কিন্তু প্রীতম এক্কেবারে ঘড়ি ধরেই দেয় ।’’
বোমানি তবু মৌন রয়েছেন দেখে তিয়াসা এবার হাত কচলাতে কচলাতে বলে,
‘’নিজের মুখে টিম-মেটের সম্বন্ধে প্রশংসা করা তো স্যার, তাই প্রথমে একটু বাধোবাধো ঠেকছিল, কিন্তু প্রোমোশনের ব্যাপার বলে কথা…। এক পলকের জন্য অধোমুখী হয় সে, তারপর আবার কথার খেই ধরে, দ্বিগুণ উৎসাহে বলে, আপনার প্ল্যান একেবারে খাসা স্যার! প্রীতমের এই প্রোমোশন সক্কলের জন্যই দারুণ হবে, এ ব্যাপারে আমি পুরো নিঃসন্দেহ স্যার।”
গল্প
সে দিন সকাল সকাল হোয়াটস অ্যাপে তানিয়ার হুকুম – ‘সন্ধ্যেবেলা চলে আয় গড়িয়াহাটে, চৈত্রের সেলে কিছু জামা কাপড় কিনে পাঠাতে হবে বাড়িতে।’ কি আর করি- সে দিন অফিসের পরের আড্ডাটা মাটি হল।
যথা সময় হাজির হলাম গড়িয়াহাটের নির্দিষ্ট কফিখানায়। প্রথম কাপ শেষ হতে না হতেই – হন্তদন্ত তানিয়ার আবির্ভাব। ল্যাপ টপের ব্যাগ- ধপাস করে পাশের চেয়ারে রেখে, অবিন্যস্ত চুলের ঢাল ঠিক করে, মুখের ঘাম মুছে – “উফ: কি গরম! খুব জোর পালিয়ে এসেছি – আর একটু হলেই পবিত্রদার লেকচারের পাল্লায় পড়তে হত।'
তানিয়া শিলিগুড়ির মেয়ে – যাদবপুরে রিসার্চ করে, ওর রিসার্চ গাইড হলেন পবিত্রদা। আর একটা কোয়ালিফিকেশন আছে তানিয়ার – সে কারাটে ব্ল্যাক বেল্ট।
কফির পর আমার হাতে ল্যাপটপের ব্যাগ দিয়ে তানিয়া ভেসে গেল গড়িয়াহাটের হকার ভরা ফুটপাথের জন জোয়ারে। রাসবিহারীর ফুটপাথের ধারে ভিড় বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কখনো কখনো প্রাগ ঐতিহাসিক ট্রামের দেখা মেলে এখানে। প্রায় দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল – তানিয়ার দেখা নেই- এই জন তরঙ্গ সঙ্কুল ফুটপাথে তানিয়াকে খুঁজে পাই কি করে৷
হঠাৎ দেখি রাস্তার মাঝ বরাবর একটা ট্রাম দুলতে দুলতে - মানুষ, গাড়ি ও বাসের ভিড় ঠেলে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। চোখে পড়ে ট্রামের জানলার ধারে বসে দেব’দা – হাতে ধরা একটা ঠোঙা। ফুটপাথের ভিড় দেখতে দেখতে আপন মনে কিছু চিবচ্ছেন। দেব’দা – দেব’দা- আমার ডাক শুনে দেব’দা তড়াক করে উঠে রোক্কে রোক্কে হাঁক পেড়ে ট্রাম থেকে নেমে চলন্ত বাস গাড়িগুলো অদ্ভুত কায়দায় পাশ কাটিয়ে ফুটপাথে এসে – “আরে সন্তু – কত দিন সাড়া শব্দ নেই!– তা এ দিকে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ ব্রাদার?” তানিয়ার পয়লা বৈশাখের বাজার শুনতেই চোখে হাসির ঝিলিক তুলে – ভুরু নাচিয়ে –
“বা বা – সাত পাকে বাঁধা না পড়তেই এই অবস্থা! নাও বাদাম ভাজা খাও।” ওনার মাথায় অদ্ভুত ধরনের টিকি ওলা টুপি দেখে ও মন্তব্যে যুগপৎ বিস্মিত ও বিরক্ত হলেও বাদাম ভাজা মুখে চালান করে – “দিল্লি থেকে কবে এলেন?”
-“আর বলো না! আবার দৌড়তে হবে – তাই ভাবলাম অনেকদিন আমাদের এই কল্লোলিনী তিলোত্তমা শহরে আসা হয় নি -- তাই---।”
এবার করুণ চোখে জনজোয়ার ও গাড়ির ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বেশ লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এরপর চারপাশ চোখ ঘুরিয়ে –
-“কিন্তু তানিয়া সিস্টারকে দেখছি না তো!”
-“এই ভিড়ে মধ্যেই কোথাও আছে বোধ হয়।” আমার একটু নিরাসক্ত স্বর শুনে – ভিড়ের দিকে চোখ ফেরালেন দেব’দা। একটু পরেই
-“ওই তো ওই তো” করে এমন বিটকেল আওয়াজ ছাড়লেন – আমাদের চারপাশের জন গুঞ্জন কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থিমিত হয়ে গেল। দেখি তানিয়া দু হাতে খান চারেক ব্যাগ সামলে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দেব’দাকে দেখে একটু যেন থমকে গেল। এর পর ভারি ভারি ব্যাগ চারটে আমাকে গছিয়ে –
-“এগুলো ধরতো - আরে দেব’দা কোথায় ছিলেন এতদিন? এ সব কি পরেছেন?”
মাথার রামধনু মার্কা বাহারে টুপিতে নজর পড়েছিল তবে দেব’দার পোষাক আসাকে তেমন আমল দিই নি। এবার ভালো করে দেখে তাজ্জব বনে যাই। মাথার রামধনুর রঙের সুতির টুপিটা অনেকটা ফেজ টুপির মত তবে কানের কিছুটা ঢেকে আছে– আবার টুপির মাথায় দোদুল্যমান টাসেল বা একটা টিকি। পরণে পাঞ্জাবী। ঢোলা পাজামা। পা’য়ে নাগরা।
“কেন? খারাপ কি পরেছি? কোলকাতায় আসার আগে সরকারি কাজে দুবাই গেছিলাম ব্রাদার। ওখানকার এক নতুন বন্ধু এই টুপিটা – একে বলে তারবুস - ভালোবেসে উপহার দিয়েছে। তোমাদের ফুলু বৌদি বলে আমার মাথার দু’পাশের অবশিষ্ট চুলের গোছা ঠিক যেন স্নান সারা ছাতারে পাখি গা ঝাড়া দিচ্ছে। তাই ওই অবশিষ্ট চুলের গোছা এই তারবুসে চাপা দিয়ে রেখেছি হে। চল কফি হয়ে যাক।”
এই ফাঁকে দেবনাথদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। বেশ কয়েক বছর আগে দেব’দার সঙ্গে দিল্লির এক আড্ডায় আলাপ। সাধাসিধে মানুষটিকে দেখেই ভাল লেগেছিল। ক্রমশ: প্রকাশ পায় ওই সাধাসিধে মানুষটির লোক ভুলানো ঠাট্টার ছলে অদ্ভুত কথাবার্তার ও আচরণের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রখর বুদ্ধিমত্তা। পরে জানতে পারি দেব’দা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের উচ্চ পদস্থ সরকারি গোয়েন্দা, তিনি কাজ করেন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সহযোগিতা ও মাঠে ময়দানে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়ে – আরাম কেদারায় বসে কথায় কথায় পুলিশি সাহায্য নিয়ে বা সৌখিন গোয়েন্দাগিরি করার তাঁর উপায় নেই। গতবারে ‘শান্তিনিকেতনে হট্টগোল’ এর পর তানিয়া এখন দেব’দার রীতিমত ভক্ত।
আবার এসে সেই কফিখানায় বসা হল। হরেক কথার পর দেব’দা বলেন –
“তানিয়া তোমাদের তো লম্বা গরমের ছুটি। চল আমার সঙ্গে – সবাই মিলে দেবভূমি হিমালয়ের পথে পথে ঘুরে আসি। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের “হিমালয়ের পথে পথে” পড় নি? ছত্রে ছত্রে কি রোমাঞ্চ ছড়ানো বল দেখি? আমাদের বাঙালী শরীরের অলস রক্ত টগবগ করে ওঠে। না না সন্তু ব্রাদার বেশী ভুরু কুঁচকিয়ো না – অফিসে ওই সময় দিন সাতেক – ওই কি যে বলে না! হ্যাঁ ওয়ার্ক ফ্রম হোম ডিক্লেয়ার করে দাও। ব্যাস – প্রবলেম সলভ্ড।”
তানিয়া একটু গাঁইগুঁই করে রাজী হয়ে গেল। দেব’দা কফির দাম না মিটিয়ে ধাঁ করে একটা ধীরে চলা বাসে উঠে “পরে দিনক্ষণ জানাবো” বলে- উধাও হলেন। টেবিলে পড়ে থাকা বাদামের ঠোঙাটা ডাস্টবিনে ফেলে এসে বলি - “দেখলি- কেমন ঘোড়েল – ।”
তানিয়া “ধ্যাৎ” বলে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে –
“চল না, ঘুরেই আসা যাক – আজকাল হিমালয়ের পথে পথে রোমাঞ্চ আছে কি না জানি না – তবে দেব’দা যেখানে রোমাঞ্চ সেখানে। চল – কাছেই জয়ন্তী মাসীর ফ্ল্যাটে চট করে একবার ঢুঁ মেরে চলে-- – ” তানিয়ার কথা শেষ না হতেই – চমকে উঠি –
“এ্যাই তোরা দু’টোয় কি করছিস রে এখানে?” দেখি হাসিরাশি জয়ন্তী মাসী সশরীরে সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে।
পঁচিশে বৈশাখের সকাল। তানিয়া সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে গরমে ঘামতে ঘামতে গানের আসরে বসে আছি। ওই সময় এলো দেব’দার ফোন –
- “মাসের শেষে দিল্লী যাব ব্রাদার। তোমাদের টিকিট পাঠিয়ে দেব ঠিক সময়। এয়ারপোর্টে দেখা হবে-। পরে বাকিটা বলব ব্রাদার।“ ফোন কেটে গেল। তানিয়াকে জানিয়ে বলি
– “কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা – কথা বলার কোন সুযোগই দিল না৷”
ঠিক সময়ে হোয়াটস-এ্যাপে আমাদের টিকিট চলে এল কয়েক দিনের মধ্যে। সকালের প্রথম ফ্লাইট।
কাক ভোরে এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম। চেক-ইন করে – দেব’দা কে ফোন করতে বলেন
“এই তো এখানে - ডিপার্চার গেটের কাছে তাড়াতাড়ি চলে এস।” সেখানে পৌঁছতে “আমার ব্যাগটা একটু দেখ” বলেই কোথায় চলে গেলেন। ফিরলেন যখন দিল্লী ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জারদের ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। দেব’দা ফিসফিস করে বলেন –
“আর বোলো না। রাত থাকতে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছি, এক কাপ চা’ও জোটেনি। এখানে চা খেয়ে একটু মুশকিল পড়লাম – এখন তোমাদের দেখে একটু --- হেঁ হেঁ –“ ইশারায় টয়লেট দেখালেন। হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না।
এমন অনিশ্চয় পরিস্থিতিতে কখনো পড়িনি – দেব’দাকে অন্তত তিন বার জিজ্ঞাসা করেছি পরের গন্তব্যটা কোথায়? উত্তরে হেঁ হেঁ আর ধৈর্য্যং ধৈর্য্যং – ব্যাস। এদিকে তাঁর সমানে মন্তব্য চলছে – “প্লেনের ভেতর আমাদের গলা কাটার জন্য দোকান খুলে বসেছে – খাওয়ার জিনিসের দাম দেখেছ ?– ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেব’দা কোমর থেকে শরীরটা বার চা’রেক সামনে পিছনে হেলিয়ে বললেন - আর কিছু কাল পরে দেখবে প্লেনের এখনকার ওই সিটগুলো উঠিয়ে বসার জন্য সারি সারি সাইকেলের সিট রেখে দিয়েছে – উফ! মাজাটা ধরে গেছে।”
তিতিবিরক্ত হয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এলে তানিয়া বলে
-“ওই দ্যাখ – দেব’দার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন।”
পার্কিং লটে একটা ডিজায়ার গাড়ির সামনে কাপড়ে মোড়া নেম প্লেট – দেখেই মনে হয় সরকারি গাড়ি। চালককে কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করতে সে বেশ অবাক হয়ে জানায় ধৌলিয়া – হৃষীকেশ থেকে ৩০ কিমি। সাহাব কো মালুম হ্যায়। আমারা তখন আর্শ্চয্য হওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়। মনে হল দেব’দা গাড়ির ড্রাইভার কে চেনেন। সামনের সিটে বসে
– “আরে রামধুন ক্যায়সা হ্যায় – বিবি বাচ্ছা সব কুশল হ্যায় তো?” – ড্রাইভারের সঙ্গে গপ্পো জুড়ে দিলেন। গাড়ি চললো এন এইচ ৩৩৪ – দিল্লী হৃষীকেশ হাইওয়ে ধরে। শুনলাম প্রায় ৫ ঘণ্টা লাগবে। দিল্লী শহর থেকে বেরোতেই দেব’দা একটা ধাবায় দাঁড়াতে বলেন –
“এখানকার চা সামোসা একে বারে ফাস্টো কেলাশ – চল নামা যাক।”
ধাবার সামনের চাতালের ছাউনির নিচে ছড়ানো চেয়ার টেবিল। একধারে পাঁচ ছ’জন গেরুয়া আলখাল্লা পরা সাধু - গোল হয়ে বসে আছেন। দূর থেকে তাদের আচার আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগে -ঠিক সাধু সন্ন্যাসী সুলভ মনে হচ্ছে না। দেব’দা হঠাৎ ‘আসছি’ বলে চলে গেলেন ওই দলটার কাছে।
-“এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা যায় না।” তানিয়া বিরক্ত হয়। দেব’দা দিব্যি তখন হাত মাথা নেড়ে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। কিছু পরে ফিরে এসে সামোসায় কামড় দিয়ে চোখ বুঁজে - মাথা নাড়তে থাকেন
- “এদের সিঙ্গাড়ার জবাব নেই ব্রাদার।” আমি এবার চুপ থাকতে না পেরে বলি –
- “আচ্ছা আপনি হঠাৎ ওই সাধুদের সঙ্গে ভিড়তে গেলেন কেন?” সামোসায় আর একটা কামড় মেরে চোখ বুঁজে উত্তর দেন দেব’দা –
“যে খানে দেখবে ছাই, উড়িয়ে দেখ তাই’ - কবি বলে গেছেন বুঝলে ! ভারি দামী কথা। আমি ওদের গা’য়ের ছাইভস্ম একটু উড়িয়ে দেখছিলাম ব্রাদার যদি কিছু অমূল্য রতন পাওয়া যায় - হেঁ হেঁ হেঁ -” এবার সশব্দে চা’য়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন –
“আচ্ছা ব্রাদার সাধু সন্ন্যাসীরা গাঁজা বিড়ি টানলেও টানতে পারেন কিন্তু এই ভর দুপুরবেলা মদ খেতে পারেন কি? আবার একজন আর্মি বুট পরে রয়েছে - আমি লোকটার পা’য়ের দিকের আলখাল্লার নিচ দিয়ে দেখে ফেলেছি । জানতে পারলাম - দলটার হৃষীকেশে আশ্রম আছে আর এদের গুরুদেবের নাকি মহাদেওজীর সঙ্গে ডাইরেক্ট বাতচিতের সম্পর্ক- আমায় ভালোবেসে ওদের আশ্রমে ইনভাইট করেছে – হে হে হে। তবে ভেরি ভেরি সন্দেহজনক ব্রাদার। চল এবার রওনা দেওয়া যাক।”
ব্রেকফাষ্ট সেরে চললাম মিরাট। সেখানে আলু পরোটা ইত্যাদির লাঞ্চ। দেব’দা মাঝে একবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে পিছন দিকে কিছু দেখার চেষ্টা করলেন। আবার চলা শুরু হল।
ঠিক এই সময় দেব’দার মোবাইল বেজে ওঠে। ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেন “চুপ চুপ – ফুলুর ফোন - আরে রামধুন ভাইয়া – জারা ইঞ্জিনটার আওয়াজ কম কিজিয়ে না।” ড্রাইভার ঘাবড়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয় রাস্তার ধারে। দেব’দা গাড়ি থেকে নেমে হাত পা নেড়ে মিনিট পাঁচেক কি সব বকে গেলেন। এরপর গাড়িতে উঠে বলেন
– “ব্রাদার এখনো বিয়ে তো কর নি – পরে বুঝবে – ফুলু বলে পাড়ার কোন পদী পিসির হৃষীকেশ এসে পরিবারের জন্য পূজো দেওয়ার বড় শখ কিন্তু বয়সের জন্য পারছেন না। তাই ওনার নাত জামাই ও তার সাত পুরুষের নামে পূজো দিতে হবে – পদী পিসি স্বপ্নে দেখেছেন সেই নাত জামাই এর উর্দ্ধতন পুরুষরা না কি এখনো মুক্তি পান নি – ত্রিশঙ্কু অবস্থায় মাঝে কোথায় ঝুলে রয়েছেন – ফুলু সেই উদ্বর্তন সাত পুরুষের নাম বলে গেল – পই পই করে বলেছে নামগুলোয় যেন ভুল না হয় – ভেরি ইম্পর্টেন্ট, আবার এক ঘড়া গঙ্গার জলও নিয়ে যেতে হবে – উফ:।” মুখটা বাংলার পাঁচ করে একটা উইলস ফ্লেক ধরিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখতে থাকেন দেবদা। তানিয়ার কানে কানে বলি –
“যত রাজ্যের গুল, কার সঙ্গে কথা বলে কে জানে - আজ অবধি ফুলু বৌদির নামই শুনেছি –দেখা পাই নি।”
-“সে তো বুঝলাম কিন্তু ভাবছি দেবদার কথায় এ্যাডভেঞ্চারে এসে শান্তিনিকতনের মত কোন ঝামেলায় না পড়ি।“ চিন্তিত মনে সে গাড়ির বাইরের দৃশ্যে মনোযোগ দেয়। গরমটা চড় চড় করে বাড়ছে। পিচ রাস্তায় যেন মরীচিকা দেখি – দূর থেকে জলে ভেজা মনে হয় – কাছে পৌঁছলেই জলের আভাস উধাও। দু পাশে ছাড়া ছাড়া কিছু গাছ - হলুদ ফুলে ভরা - প্রখর আলোয় জ্বলজ্বল করছে। তানিয়ার হাতে জিরো সুগার কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যান। হৃষীকেশ শহর পেরিয়ে - ঝকঝকে রাস্তা। খর সূর্যের আলোয় ঝলমলে ঘন মখমলি সবুজে মোড়া পাহাড় শ্রেণী। বেশ কিছুটা এগিয়ে কানে আসে কোন খর স্রোতার একটানা উচ্ছল সঙ্গীত। পাহাড়ী রাস্তার একটা বাঁকের পরেই দেব’দা গাড়ি দাঁড় করাতে বলেন একটি সরকারি রেস্ট হাউসের সামনে। ভেতরে যাওয়ার বড় কাঁচের দরজা। গাড়ির ড্রাইভার এ্যাই মোটা একটা ফাইল নিয়ে রেস্ট হাউসের ভেতরে রেখে বিরাট এক সেলাম ঠুকে চলে গেল।“
দেবভূমি তো বুঝেছিলাম কিন্তু ঠিক কোথায় আসছি আগে জানালে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হত বলেন দেখি?” ঝাঁঝিয়ে উঠি। দেব’দা তখন সামনে পিছনে ঝুঁকে কোমরের ব্যাথা উপশমের কসরত করতে করতে
–“আহা আহা! গুস্যা মাত করতং সন্তু ভাইয়া – না জানিয়ে কেমন গম্ভীর রহস্যময় তৈরি হয়েছিল বল দেখি ব্রাদার?” এক গাল হাসি মাখা মুখ দেব’দার –
“আগে থেকে তোমাদের জন্য ঘর ঠিক করে রেখেছি। চলো চলো তোমাদের ঘরটা দেখিয়ে দিই – একটু ফ্রেস হয়ে নাও – তারপর আড্ডা মারা যাবে।
”কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে দেখা গেল বড় ডাইনিং হল, সামনের এ মোড় থেকে ও মোড় কাঁচের জানলা দিয়ে সোজাসুজি দেখা যায় সামনের উঁচু সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁসে নদী খাতের মাঝখান জুড়ে প্রবল বেগে ছুটে চলেছে নীল সবুজ জলরাশি - ছোট ছোট তরঙ্গ গুলি ছোটার তালে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। জলরাশির দু’ধারে চরের সাদা বালি কণা প্রখর রোদে চিক চিক করছে অভ্র কুচির মত। কাঁচের জানলার বাইরে কাঠের চওড়া ডেক বা বারান্দা। তানিয়া দৌড়ে বাইরের বারান্দায় পৌঁছে চিল চিৎকার ছাড়ে – “ বাইরে আয় সন্তু – দ্যাখ দ্যাখ কি ছবি, অপূর্ব।” বাইরে এসে সত্যিই অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। বাঁদিক থেকে এগিয়ে এসেছে হরেক সবুজে মোড়া দু ‘দিকের উঁচু নিচু পাহাড়ের দল। দু’পাশের পাহাড় শ্রেনীর মাঝের গভীর নদী খাত জুড়ে নেমে আসছে নীলচে সবুজ জলের ঢল।– সামনের নদী খাত দু পাশের পাহাড়ের সাথে বেশ কিছুটা ডান দিকে এগিয়ে ধনুকের মত বাঁক নিয়ে চলে গেছে চোখের আড়ালে – সেই সঙ্গে নদীর স্রোতও স-গর্জনে - খাতের সাথে গলা মিলিয়ে উধাও হয়েছে পাহাড়ের আড়ালে। আমাদের দিকের পাহাড়ের গায়ে এই রেস্ট হাউস। বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমেছে নদীর উঁচু পাড়ের সবুজ ঘাসে ঢাকা জমিতে। সেই সবুজের গা ঘেঁসে পাহাড়ের গা ধরে ধাপে ধাপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবুজ ছাউনির ছোট ছোট পোড়া লাল রঙা কাঠের কটেজ বা কেবিন।সেই ভোর রাত থেকে ধিকি ধিকি জমে ওঠা বিরক্তির পাহাড় নিমেষে খান খান হয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে।
“ ওঁ গঙ্গা ওঁ গঙ্গা –” দেব’দা দু হাত জোড় করে বিড় বিড় করছেন আর বাক্য হারা তানিয়া আনন্দের আতিশয্যে জড়িয়ে ধরেছে দেব’দা কে। “ চল তোমাদের আস্তানাটা দেখিয়ে দিই।” দেব’দা এগোলেন কাঠের কটেজ গুলোর দিকে। মনে হল তিনি এই রেস্ট হাউসে এই প্রথম আসছেন না।সবুজ লন থেকে কয়েক ধাপ কাঠের সিঁড়ি উঠে কাঠের রেলিং ঘেরা কটেজের ডেক বা ব্যালকনি – তারপরই ঘরে যাওয়ার দরজা। ভেতরে আলাদা দু’টো সিঙ্গল বেড। “ আর কোনো ঘর খালি নেই সিস্টার। এখানেই তোমাদের অল্প ক’দিনের একত্র বাসের হাতে খড়ি হোক।” দুষ্টুমি ভরা ফিচেল হাসিতে বলেন দেব’দা। তানিয়া ভুরু কুঁচকানো দৃষ্টি দেখে তাড়াতাড়ি বলেন - “ না না চিন্তা করার দরকার নেই সিস্টার – ওই যে কি বলে না ‘ বিদেশে শোচনম নাস্তি’ – ঠিক বললাম? না কি? আর খুব যদি অস্বস্তি হয় তো – ওই দেখ মশারির হুক আছে কাঠের দেওয়ালে - বিছানার একটা চাদর দুই খাটের মাঝখানে আড়াআড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে ‘এই পারে আমি আর ওই পারে তুই’ গান গেয়ে রাত গুলো পার করে দিলেই হল। একটু রেস্ট নিয়ে ডাইনিং হলে চলে এস।” খিক খিকে ফিচেল হেসে বলেন – “আমার ছোট বেলায় এক বাউল রোজ সকালে গান গেয়ে ভিক্ষা করতেন কিছু কিছু মনে আছে – তোমাদের শোনাই। এবার হেঁড়ে গলায় শুরু করেন --“তুই যদি আমায় হতিসমন জ্বালা হোত হাপিস...তুই যদি আমায় হতিস~মন জ্বালা হতো হাপিস..এখন তুই আর আমি এক ঘরেতে রই~এখন তুই আর আমি এক ঘরেতে রইহায় রে! তাও ঘরের মাঝে লক্ষ মাইল ফাঁক রে- ঘরের মাঝে লক্ষ মাইল ফাঁক –” বাউল নাচের ভঙ্গিতে এক পাক ঘুরে দেব’দা ঘর ছাড়ার সময় তানিয়া রেগে গিয়ে দেবদার পিঠে এক কিল মেরে বলে “ অসভ্য একটা –“লক্ষ্য করি দেবভূমে এসে দেব’দা যখনই পারেন সংস্কৃত মিশিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন, এখন আবার লালনের গানের পিন্ডি চটকালেন।সন্ধ্যের দিকে ডাইনিং হলে হাজির হলাম। কোনের দিকের একটা টেবিলে ঘিরে জটলা। টেবিলটায় সামনা সামনি বসে ছিপছিপে চেহারার লাল সবুজ স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এক জন সাহেব আর দেব’দা । তাঁদের ঘিরে পুলিশি ও সাধারণ পোষাকে কিছু লোক দাঁড়িয়ে। দেব’দা ইংরেজীর সাথে অদ্ভুত হিন্দী মিশিয়ে আমাদের আলাপ করালেন। পরে বলেছিলেন দুটো আলাদা ভাষায় দু খেপে আলাপ না করিয়ে এক ধাক্কায় কাজটা সেরে নিয়েছেন। সাহেবটি জার্মান, নাম লিওপল্ড – দেব’দা মাঝে তাঁকে ট্যাডপল নামে ডাকতে – তিনি শুধরে দেওয়ার চেষ্টায় বিফল হয়ে ক্ষান্ত হলেন। বুঝলাম মি: লিওপল্ড ইন্টারপোলের লোক, এখানে এসেছেন কোনো আন্তর্জাতিক নামজাদা টেররিস্ট দের তত্ত্বতলাশে। ওঁদের কথার পিঠে কথায় দেব’দা রান্নায় ফোড়ন দেওয়ার মত গুটেন ন্যাচেট শব্দটা মাঝে মাঝেই আওড়ে যাচ্ছেন দেখে – ওনার কানে কানে বললাম শব্দ দুটোর মানে গুড ইভনিং – এত্ত বড় জিভ বার করে মুখ বেঁকিয়ে ফিস ফিসিয়ে বলেন - “ এই যা: আমি ভাবলাম ওটা থ্যাঙ্ক ইয়ু – জার্মান শব্দ গুলো বড়ই ইয়ে – কিছুতেই মুখস্থ হচ্ছে না।”একটু বোর হয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের ছোঁয়া লাগা আকাশে তারার দল জড় হচ্ছে। অন্ধকার ঘনাচ্ছে দূরের গিরি খাতে। খরস্রোতা নদীর জল এখন কালচে – ছোটো ছোটো ঢেউ -জল বুদ্বুদ মাথায় নিয়ে ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে চলমান কালো জলে। অনুজ্জ্বল আকাশের পটভূমিতে সামনের উঁচুনিচু পাহাড়ের সিল্যুয়ট। ফ্যাকাসে বালু চরে ইতিউতি নির্জীব কাছিমের পিঠের মত কালচে পাথর ছড়ানো। তানিয়া কে জানালাম – “ জানিস – ভাগীরথী, মন্দাকিনী ও অলকানন্দা – এই তিন নদী ধারার উৎস হিমবাহ অঞ্চলে। গোমুখী থেকে ভাগীরথী, চোরাবারি থেকে মন্দাকিনী ও সতোপন্থ থেকে অলকানন্দা নদীর উৎপত্তি। এবার মন্দাকিনী এসে অলকানন্দায় মিশেছে রুদ্রপ্রয়াগে, এরপর দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা এক হয়ে গেছে গোমুখী থেকে আসা গঙ্গা বা ভাগীরথী নদীর সাথে৷ তিন নদীর মিলিত স্রোত এখন বয়ে চলেছে সমতলের দিকে – এই হল আমাদের গঙ্গা নদী। ” একটানা ছল ছল শব্দ ও অ-জাগতিক রহস্যে মোড়া পরিবেশের মধ্যে আমরা কতক্ষণ একাত্ম হয়ে ছিলাম খেয়াল নেই। দু’জনেরই অজান্তে তানিয়ার হাত কখন আমার মুঠো বদ্ধ হয়েছে - জানি না। চটকা ভাঙে দেব’দার গলার আওয়াজে – ‘ কি হে কোথায় হারিয়ে গেছিলে ব্রাদার ? না না লজ্জার কিছু নেই – এই পরিবেশে কার সঙ্গে যে মজে মন – হরিও না জানন্তি। এই দ্যাখ না – সপ্তাহ খানেক আগে এক দিনের জন্য এখানে এসেছিলাম – ওই ট্যাডপোল সাহেব কে থিতু করাতে। এই রকম সময় এই বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে মনটা হঠাৎ তোমাদের ফুলু বৌদির জন্য কেমন কেমন করে উঠল – সেই সময় পাশে এসে কে যেন দাঁড়াল। হঠাৎ খেয়াল হয় বেয়ারা সুখিন্দরের চা এর কাপ বাড়িয়ে ধরা লোমশ হাতটা আমার মুঠোয় – আর সে ব্যাটা হাঁ করে আমার মুখের পানে তাকিয়ে। - হা–হা হা ৷ তানিয়া ফোঁস করে ওঠে – “ কি ? আমার হাতও লোমশ বলছেন ?” – “ আরে না না - চল চল ডিনার রেডি।” আমাদের কেবিনের এক পাশে মি: লিওপল্ডের কটেজ , অন্য পাশের টা দেব’দার। ডিনারের পর লিওপল্ডের কটেজের বারান্দায় বসা হল। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওয়েদার। লিওপল্ডের হাতে হুইস্কির গ্লাস – অফার করলে আমরা কোল্ড ড্রিঙ্কসে রফা করি। লক্ষ্য করি - সাহেবের দেখা দেখি দেব’দার পরনেও এখন বারমুডা আর কালো টিশার্ট, আর মাথায় সেই টার্কিশ টুপি তারবুস। মাথায় হাত দিয়ে বললেন “একে বারে কুলপি ঠান্ডা – টাক টা বাঁচাতে হবে তো।”ওনাদের কথাবার্তা চলছে – মাঝে মাঝে দেব’দার জার্মান ভাষায় টিপ্পনী কাটার চেষ্টা – ‘ ডু হ্যাষ্ট রেইস্ট’ – বোধ হয় বলতে চাইছেন ‘ তুমি ঠিক বলছ৷’
যত টুকু আন্দাজ করলাম – মি: লিওপল্ড ও দেব’দার সন্দেহ – সারা দেশে অশান্তি তৈরি করতে এক কুখ্যাত আন্তর্জাতিক টেররিস্ট গোষ্ঠী এই অঞ্চলটিকে বেছে নিয়ে গড়ে তুলেছে তাদের সমন্বয় কেন্দ্র। তারা উন্নত মানের চোরাই স্যাটেলাইট ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করছে। এখানে সাধারণত: সাধু সন্ত ও তীর্থ যাত্রীদের সমাগম বেশী থাকার দরুন এরা নানা ছদ্মবেশে ভিড়ের সাথে মিশে আছে। মি: লিওপল্ড একটি অত্যন্ত শক্তিশালী যন্ত্র নিয়ে এসেছেন যেটার সাহায্যে স্যাটেলাইট ফোনের
কথাবার্তা বা টেক্সট ধরে ফেলা যায়। তিনি নিশ্চিত এই অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে কেউ স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করছে । স্থানীয় পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ এখন যৌথভাবে তদন্ত করছে। এই সব শুনে মনে হল আমাদের মস্তিষ্কে এই সব জটিল ব্যাপার ঢুকবে না। দেব’দা বললেন – স্যাটেলাইট ফোনটা খুবই অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে – তাঁদের সন্দেহ দু তিন মিনিটের কথাবার্তা টেপ রেকর্ডারে ধরে রেখে খুব দ্রুত স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে ট্রান্সমিট করতে বড় জোর দু সেকেন্ড লাগছে। আলোচনার শেষে দেব’দার বাংলায় মন্তব্য –
“ট্যাডপলের ওই ঘোড়ার ডিম যন্ত্রে স্যাটেলাইট ফোনের সঠিক অবস্থানটা বোঝা যাচ্ছে না। আরে ব্রাদার – এ সব কি আমার মত ঘষ্টে ঘষ্টে পুলিশি পরীক্ষা পাশ দেওয়া মানুষের দ্বারা হয় ! তুমি হলে গিয়ে আই.টির লোক, তানিয়া সিস্টারের রিসার্চ করা চকমকে বুদ্ধি আর আমি হলেম গিয়ে ‘ধর তক্তা মার ডান্ডা পুলিশ’ – তা এই তিনে মিলে মাথা ঘামালে – হারি জিতি নাই লাজ।” - হা হা হা! মন্তব্যের শেষে বিকট হাসিতে মি: লিওপল্ড কে চমকে দিয়ে দেব’দা নিজের কটেজে ঢুকে গেলেন। আমি হাঁ করে ওনার বন্ধ ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“কি লোক ! কেমন আমাদের ফাঁসিয়ে দিল দেখলি !” - তানিয়ার অন্যমনস্ক চোখ তখন তারা ভরা আকাশের দিকে। চাঁদ মনে হয় আজ দেরিতে উঠবে। আকাশে এত তারা কখনো দেখি নি। লক্ষ কোটি তারার আলোয় খরস্রোতা নদী খল খল শব্দে ছুটে চলেছে। সামনের লনের বেঞ্চে দু জনে বসে পড়লাম। রাত প্রায় দশটা। এই পরিবেশে হঠাৎ তানিয়া একটা বেখাপ্পা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল – “ সন্তু – কথাবার্তার টেপ জিপ ফাইল করে স্যাট ফোনে কি পাঠানো যায় ?” একে বারে বেরসিক - যাই হোক কল্পনার জগৎ থেকে নেমে এসে একটু চিন্তা করতে হল। ভেবে চিন্তে বলি – “মনে হয় সম্ভব – কাল মি: লিওপল্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
সকালে ব্রেকফাষ্টের টেবিলে তানিয়ার ক্লু টা বলতেই লিওপোল্ড সাহেব চেবিল চাপড়ে বললেন – “ব্র্যাভো – ঠিক বলেছ – কারণ আমার স্যাট ফোন ইন্টারসেপশন যন্ত্রে ওই লুকনো স্যাট ফোনটা ব্যবহার হলেই – সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে শুধু একটা বিপ শব্দ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়, পরে চেক করলে কিছু জড়ানো যান্ত্রিক শব্দ শোনা যায়। এ বার বুঝেছি মি: ডেভনাট কেন তোমাদের নিয়ে এসেছে। ” দেব’দা গদ গদ স্বরে –
“থ্যাঙ্ক ইউ - কি দিয়েছ তানিয়া সিস্টার। এই জন্যই তো তোমাদের নিয়ে ঘুরি – এই সব কি আমাদের কাঁঠাল পাকা ভস ভসে মগজে আসে!” উফ: তানিয়া গ্যাস খেয়ে ফুলে ফেঁপে ঢোল।
পর দিন সকালে দেব’দা শহরের দিকে কোন কাজে যাওয়ার পথে ‘ গঙ্গা কুটির” ট্যুরিষ্ট লজে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলে গেলেন বিকেল চার’টের নাগাদ এখান থেকে তুলে নেবেন। আরো বললেন – “ লজের সামনের নদীর ঘাট বরাবর গিয়ে রাম ও লক্ষণ ঝুলা ঘুরে এস৷”
গঙ্গা কুটিরের সামনে নানা ঘাট ছুঁয়ে নদী বয়ে চলেছে। নদী এখন সমতলে নেমে এসেছে, স্রোতের বেশ জোর । ঘাটের সিঁড়িতে সাধু সন্ন্যাসী ও তীর্থযাত্রীদের স্নান। কিছু হকার হরেক পসরা সাজিয়ে বসে - মাছের খাবার নিয়ে বসে কেউ কেউ। নদীর জলে পাক সাট মারে নিঃশঙ্ক বড় বড় মাছ। মাছ ধরা বারণ -হৃষীকেশে আমিষ একেবারে নিষিদ্ধ। ঘাটের সিঁড়ির ধারে, গাছের নিচে বা ঘাট লাগোয়া আশ্রমের গায়ে অনেক সাধু সন্ন্যাসীর সাময়িক আস্তানা। হেঁটে চলেছি - সামনে পড়লো রাম ঝুলা। মানুষজন, সাইকেল স্কুটারের ভিড়। ভিড়ের চাপে ঝুলা ধীরে ধীরে দুলছে। ওপর পারে পৌঁছে ঘন মোষের দুধের চা খেয়ে চললাম লক্ষণ ঝুলার দিকে। বেশ অনেকটা রাস্তা। দু পাশে দোকানের সারি। লক্ষণ ঝুলার মুখে পৌঁছতেই - একটা স্কুটার - পিছনে বেশ বড় ডেকচি দড়ি দিয়ে বাঁধা - হুড়মুড়িয়ে পড়ল এসে আমার গায়ে। স্কুটারটা কাত হয়ে পড়ার সময় সেই ডেকচিটা থেকে দু তিন টুকরো বড় বড় মাংসের টুকরো রাস্তায় পড়তেই স্কুটারের লোকটা তাড়াতাড়ি সে গুলো হাতের আড়াল করে নিমেষে তুলে দিল ডেকচিটার ভেতর। এবার ঝুলা থেকে নেমে বাঁ’য়ে বাঁক নিয়ে আপাত নির্জন রাস্তা টা ধরে জোর স্পিড তুলে উধাও হল। একটু অবাক হয়ে তানিয়া কে বলি - এই আমিষ বর্জিত জায়গায় এ আবার কি কাণ্ড। এরপর লক্ষণ ঝুলায় না উঠে আরো কিছুটা এগোতে - ছাড়া ছাড়া ছোট ছোট বাড়ি। একটা ডাম্প ইয়ার্ড - চারপাশ ভেঙে পড়া কাঁটা তারের বেড়া। রাজ্যের মরচে ধরা বড় বড় লোহার বিম, লম্বা লম্বা লোহার শিকের খাঁচা, ভাঙা লোহার চাদর ইত্যাদি ডাঁই হয়ে পড়ে আছে এক দিকে। জঙ্গলে ভরে আছে ইয়ার্ডটা। এর পাশেই একটা দো’তলা বাড়ির সামনের বড় চত্বর জুড়ে শামিয়ানা – পাশে ঝোলানো ফেস্টুনে লেখা “৭২ ঘন্টা মহাদেওজী কো নাম গান”। কিছু জটাজুট ধারী সাধু - পথে দেখা সাধুদের মত রোগাসোগা নয় - বেশ ষণ্ডা চেহারা - ব্যস্ত হয়ে আছে নানা কাজে। বড় শামিয়ানাটার একটা দিক শেষ হয়েছে ওই ডাম্প ইয়ার্ডের গা ঘেঁসে - সেখানে ছোট একটা ছাউনি ঘেরা জায়গা থেকে উঠছে উনুনের ধোঁয়া। ভাঙা ছেঁড়া কাঁটা তারের বেড়ার ওপাশে জঙ্গলের ভেতর ফুটে আছে এক রাস গাড় বেগুনী রঙা ফুলের ঝাড়। তানিয়া বলে ওঠে “ দ্যাখ সন্তু কি সুন্দর ফুল - যাই দু একটা তুলে আনি” বলেই চলে গেল সেই উনুনের ধোঁয়া ওঠা ছোট ছাউনিটার পিছনে। হঠাৎ একটু হইচই - দেখি একজন ষণ্ডা মার্কা গেরুয়াধারী সাধু তাড়িয়ে বার করে আনছে তানিয়া কে। তানিয়া ভয় পেয়ে ছুটে আসে - পিছনে বিজাতীয় ভাষায় চিৎকার করছে ষণ্ডা এক সন্ন্যাসী।
“ লোকটা কি অভদ্র - আর একটু হলেই মারত আমাকে !” তানিয়ার ফর্সা মুখ রাগে লাল। - “ প্রথমে লোকটা কিছু বলে নি কিন্তু লক্ষণ ঝুলায় দেখা সেই স্কুটারটা ওখানে দেখে - এগোতেই - লোকটা তেড়ে এলো।” দু জনেই বেশ আশ্চর্য মনে ফিরে চলি লক্ষণ ঝুলার দিকে। ঝুলার মাঝ বরাবর নিচের নদীতে চোখ পড়ে। মনে আসে পর্যটক যদুনাথ সর্বাধিকারীর রোজনামচায় লক্ষণ ঝুলার বিবরণ। হাঁটা পথে, গরুর গাড়ি ও নৌকায় তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে এই শহরে এসে ছিলেন । তখন নদীর এপার ওপার জোড়া ছিল মোটা কাছি ও নিচের দুটো কাছিতে সারি সারি পা’য়ে চলার সরু তক্তা বাঁধা লক্ষণ ঝুলা – হাজার হাত নিচে প্রচণ্ড স্রোতে বড় বড় পাথর ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে নদী - প্রবল বাতাসে দোদুল্যমান সেই ঝুলা। বিবরণ পড়ে গায়ে কাঁটা দেয়। ঝুলার মাঝ বরাবর পৌঁছে তিনি নাকি দৈববাণী শুনেছিলেন -
“পন্থি সাবধান পগধ্যাণ, মুখে বল রাম নাম, হিঁয়া কহি নাহি আপনা –” । তানিয়া প্রথমে চোখ বড় বড় করে – খিল খিলিয়ে হেসে ওঠে।
বিকেল হয়ে আসছে। লক্ষণ ঝোলা পেরিয়ে শহরের বড় পথটায় এসে একটা সাটল মোটর বাইক রিকশ ধরে চলে এলাম গঙ্গা কুটির লজে। তানিয়া ফিক করে হেসে বলে – “ দ্যাখ দ্যাখ জানকী ঝুলা তৈরি হচ্ছে – রাম লক্ষণ আর মানুষের ভিড় সামলাতে পারছেন না, তাই সীতা দেবী কেই এবার ভার সামাল দিতে হবে।”
মি: লিওপল্ড এখন আমাদের তাঁর দলে জুড়ে নিয়েছেন। সন্ধ্যার পর বসল আলোচনা সভা। সেই সময় আজকের অভিজ্ঞতার জানাতে – দেব’দা বেশ উত্তেজিত হয়ে উইলস ফ্লেক ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে ফোনে মজে গেলেন।
পরের দিন দেব’দা ও আর একজন ভদ্রলোক, মনে হয় স্থানীয় পুলিশের কাউকে লক্ষণ ঝুলার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ইশারায় শামিয়ানা খাটানো জায়গাটা দেখিয়ে আমারা শহরের আর এক দিক দেখতে চলে গেলাম।
পর পর দু দিন দেবদার পাত্তা নেই। আমরা ঘুরে বেড়ালাম এই ক’দিন। তানিয়ার জোরাজুরি তে একটা দিন কাটিয়ে এলাম মনিকূট পাহাড়ে – আগেকার চৌরাসী কুটিয়া আশ্রম বা এখন কার মহেশ যোগীর বিটল’স আশ্রমে।
পঞ্চম দিন সকাল – কফি হাতে তাকিয়ে ছিলাম গঙ্গার স্রোত যেখানটায় বাঁক নিয়েছে পাহাড়ে আড়ালে - ন’টা নাগাদ একজন হাজির হলেন একটি চিঠি নিয়ে – দেব’দা লিখেছে- “ লখু ভাই এখানকার পুলিশের লোক - এনার কথা শুনে চল।” লখু ভাই আমাদের নিয়ে এল হৃষীকেশ সিটি সেন্টারে, একটা ঘিঞ্জি গলিতে। পুরনো একটা বাড়ির নড়বড়ে সিঁড়ি দিয়ে দো’তলায় যাওয়া হল ঘণ্টা খানেকের জন্য। যখন সেখান থেকে বেরলাম - আমি আর তানিয়া পরস্পর কে চিনতে পারছি না। তানিয়া একেবারে বিদেশী সন্ন্যাসিনী - গেরুয়া আলখাল্লার ওপর নামাবলী - মাথায় ছোট ছোট ওঁম লেখা সাদা উড়নির পাগড়ি - গলায় হাতে রুদ্রাক্ষের মালা আর কাঁধে গেরুয়া ঝোলা। তানিয়ার মুখ চাপা উত্তেজনায় স্থির। আমারও প্রায় ওই একই ড্রেস তবে হাতে একটা কমণ্ডলু আছে। লখুভাই এর সাজ একই। প্রথমে বুঝতে পারি নি কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ একদল তীর্থযাত্রী আমাদের ঘিরে ধরে প্রণামের সঙ্গে টাকা পয়সা ভিক্ষে দিতে শুরু করাতে মনে হল এই ছদ্মবেশ যুত্সই হয়েছে। একটু বিরক্তির সাথে লখু ভাই কে ইশারায় এ সব কি হচ্ছে বোঝাতে সে খ্যাক খ্যাক করে হেসে - তফাত যাও - হ্যাট হ্যাট করে সেই দলটাকে সরাতে আরম্ভ করে। লক্ষণ ঝুলা পার হওয়ার সময় তানিয়া বলে “ সন্তু ব্যাপার কিছু সুবিধার মনে হচ্ছে না রে ! কি ঝামেলায় আবার জড়াতে চলেছি কে জানে!”
এবার আমাদের গন্তব্য মোটামুটি ধারণা করতে পারলাম।
সেই দো’তলা বাড়ির সামনের চত্বর ঢাকা শামিয়ানা- গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো। এক ধারে চিত্র বিচিত্র রঙ্গোলি শোভিত যজ্ঞ স্থল। মাঝের যজ্ঞকুণ্ড ঘিরে মন্ত্র পাঠে মগ্ন জনা চার সাধু। শামিয়ানার বাইরে বড় দুটো মাটির উনুনে বোধহয় ভোগের খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ফেষ্টুনে হিন্দিতে লেখা ভোগ বিতরণের সময় বেলা ১টা। বাড়ির দরজার সামনের উঁচু বেদীতে - টাক মাথা, বেশ মোটাসোটা, সাদা ঘন গোঁফ দাড়ি, পদ্মাসনে বসে এক বাবাজী শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে জলদ গম্ভীর স্বরে শিব তান্ডব স্তোত্রম্ পাঠ করছেন- বেদীর নিচে সাধু সন্ন্যাসীদের ভিড়। আমরাও বসে পড়লাম সেই জটলায়। আমার থেকে আট দশ ফুট দূরে, বেদীতে বসা স্তোত্র পাঠরত বাবাজীর পা’য়ের নিচে এক সাধু- হাতের ত্রিশূলে বাঁধা ছোট ছোট ঘন্টায় আওয়াজ তুলে ক্ষণে ক্ষণে অদ্ভুত মুখ ভঙ্গিতে ব্যোম ভোলে হাঁক পাড়ছেন। তাঁকে ঘিরে প্রায় দশ বারো জন – মনে হয় চেলার দল। হঠাৎ মনে হল ঘন্টা বাজানো সাধুটি আমার নজর কাড়ার চেষ্টা করছেন। ভালো করে লক্ষ করি - আরে এ তো দেব’দা – গেরুয়া বসন, জঙ্গুলে গোঁফ দাড়িতে মুখ ঢাকা, টাক ঢাকা গেরুয়া পাগড়ি, ছাই লেপা কপালে গিরি মাটির ত্রিপুন্ড্রক বা শৈব তিলক - চেনাই দায়। তাঁর বিকট স্বরে ব্যোম ভোলে হাঁক শুনে বাবাজীর ভুরু জোড়া কুঁচকে রয়েছে। আর একটু দূরে বসে একজন সাহেব সন্ন্যাসী – হালকা পাঁশুটে গোঁফ দাড়ি, গেরুয়া বসন - মনে হল মি: লিওপল্ড।
স্তোত্রর পর স্তোত্র পাঠ চলছে। পাঠ শেষ হলে - সমবেত উচ্চস্বরে জয় ভোলে, জয় মহাদেওজী আওয়াজে আকাশ বাতাস ফেটে পড়ল। বাবাজী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে দিলেন এখন ভোগ বিতরণ হবে। ঘড়িতে দেখি বেলা একটা। এবার সামনের সাধুদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল – সবাই এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবাজীর পদধূলি নেওয়ার জন্য। হঠাৎ চোখ পড়ে দেব’দার কাণ্ড কারখানায়। দেবদা প্রায় গুঁড়ি মেরে – অন্যান্য দের পায়ের ফাঁক গলে এগিয়ে যাচ্ছেন বাবাজীর দিকে। ভিড়ের মধ্যে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে তিনি বাবাজীর পিছু পিছু চলে গেলেন শামিয়ানা ঢাকা চত্বর লাগোয়া বাড়িটার দরজায়। এবার “ বাবাজী বাবাজী হামকো পাপ মুক্ত কিজিয়ে –” বলতে বলতে- আমাদের এগিয়ে আসার ঈশারা করে- এক বারে রাগবি খেলোয়াড়দের মত ঝাঁপ দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বাবাজীর পা’দুটো। বাবাজী টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ঘরের ভেতর। এর মধ্যে দেবদার পিছু পিছু যাওয়া সাধুর দলের একজনের জটা দাড়ি খুলে পড়া দেখে –প্রায় মুক্তকচ্ছ বাবাজী কোনো ক্রমে দেব’দার হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলেন দো’তলার সিঁড়ির দিকে – ততক্ষণে ভোগ দিতে ব্যস্ত এক দল চেলা এসে ঘিরে ধরল আমাদের। হঠাৎ দেখি ব্ল্যাক বেল্ট তানিয়া , এক ঝটকায় দু’জন চেলা কে কুপোকাত করে- মেজে তে পড়ে থাকা দেব’দার ত্রিশূলটা তুলে বাবাজীর পিছু পিছু দ্রুত গতিতে উঠে গেল দো’তলায়। এবার দেব’দা নিজেকে ছাড়িয়ে ঝোলা থেকে পিস্তল বার করে ঘরের সিলিঙে পর পর দুবার ফায়ার করে বাবাজীর চেলাদের ছত্র খান করে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন দো’তলায়। দো’তলার ঘরের লাগোয়া ছোট একটা ছাদ। দেখি বাবাজী চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে সেই ছাদে – আর ত্রিশূল হাতে তানিয়া পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে বাবাজীকে। তানিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে জানায় – এই লোকটা ঘরের খাটের তলায় রাখা ট্রাঙ্ক থেকে প্লাস্টিকে জড়ানো কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলেছে নিচের রান্নার জায়গার পাশের কুয়োতে। ততক্ষণে সাধু বেশী সাত আট জনের পুলিশের দল উঠে এসেছে দো’তলার ছাদে। তাদের দাড়ি গোঁফ নিচের তলায় মার পিটের সময় কখন খুলে পড়েছে। দেবদার জটার পাত্তা নেই, দাড়ির কিছু অংশ আঠা খুলে ঝুলছে।
এই ধুন্ধুমার অবস্থাতেও শুকনো আঠা মাখা গাল চুলকাতে চুলকাতে দেব’দা পুলিশি স্যালুট দিয়ে তানিয়াকে বললেন – “সিস্টার তোমার জবাব নেই – আজ চাক্ষুষ করলাম সাক্ষাৎ অসুর নাশিনং স্বয়ং মা দুর্গার। ওঁ দুর্গা ওঁ দুর্গা।” দেব’দার সংস্কৃত বলার চেষ্টাটা যেন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে তানিয়ার হাতের ত্রিশূল খসে পড়ে – হুঁশ হারা চোখে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে।
ইতিমধ্যে বাবাজীর হুঁশ ফিরেছে। চোস্ত ইংরেজীতে তিনি হম্বিতম্বি শুরু করলেন। শহরের তাবড় রইস আদমীরা নাকি তাঁর শিষ্য। পুলিশের বড় কর্তারা তাঁকে চেনে ইত্যাদি। দেব’দার নির্দেশে এক পুলিশ নিমেষের মধ্যে ঝোলা থেকে হাত কড়ি নিয়ে বাবাজীর হাতে পরিয়ে দিলো – দেব’দা এবার হাতের মুঠো পাকিয়ে বল্লেন –
“বারে বারে বুলবুলি তুমি খেয়ে যাও চানা - এইবার দেখাব তোমায় পুলিশের থানা।”
এই পরিস্থিতিতে দেব’দার উদ্ভট ছড়া শুনে আমরা ভ্যবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকি। এবার তিনি বাবাজীর চুল দাড়ি নিয়ে একটু টানাটানি করে হতাশ হয়ে বলেন - “ নাঃ ! এগুলো আসল - বাবাজী পাক্কা ধুরন্ধর - ।”
ইতিমধ্যে নিচের তলায় সাধু ভেকধারী পুলিশ ও বাবাজীর চেলাদের মধ্যে মারপিট চরমে উঠেছে। চেঁচামেচি, হই হট্টগোল, পর পর গুলির আওয়াজ ও কিছু বিস্ফোরণে শান্ত পরিবেশ গমগম করে। দাউ দাউ করে জ্বলছে শামিয়ানা। নিচে নেমে দেখি ভোগ রান্নার মাটির উনুনের আর যজ্ঞ কুন্ডের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সাধারণ সাধু সন্তরা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়োদৌড়ি করছেন। কিছু পুলিশ ও বাবাজীর চেলা চামুণ্ডা জ্বলন্ত শামিয়ানার নিচে পড়ে কাতরাচ্ছে। পোড়া বারুদের গন্ধ ও শামিয়ানা ও অন্যান্য দাহ্য বস্তুর পোড়া ছাই উড়ছে বাতাসে। দলে দলে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে পুরো চত্বর।
একে বারে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড।
একটু সুস্থির হয়ে বলি “দেব’দা – ঘটনাটা কি হল বলুন দেখি ?”
“ ধৈর্য্যং ধৈর্য্যং ব্রাদার। তোমরাই তো কেল্লা ফতে করলে। এখন তানিয়া দিদি কে নিয়ে ধৌলিয়ার রেস্ট হাউসে চলে যাও দিকি – এই রে ফুলু এই সময় ফোন করছে।” ফোনে কথা বলতে বলতে তিনি উঠে পড়লেন আর একটি গাড়িতে।
রাত ন’টা বেজে গেল। আমরা ডাইনিং হলের বারান্দায় বসে। সকালের ঘটনা প্রবাহের ব্যবচ্ছেদ করছি। তানিয়া এখন সামলে নিয়েছে। কিন্তু দেব’দার পাত্তা নেই। রেস্টুরেন্টের লোকেরা বলে গেছে সাহেবরা আসছে – এক সঙ্গে ডিনার হবে।
রাত তখন দশটা। এত ক্ষণে আকাশ সেজে উঠেছে লক্ষ কোটি তারার মালায়।
প্রায় এগারোটা - বাইরের চত্বরে পর পর গাড়ি দাঁড়ানোর আওয়াজ ভেসে আসে। আমরা ডাইনিং হলের বারান্দা থেকে ভেতরে আসি। পাঁচ ছয় জন বয়স্ক ভদ্রলোক ভেতরে আসেন - দেখে মনে হল উচ্চ পদস্থ সরকারি অফিসার। বেয়ারা জানাল
“সাহাব লোগ দেব সাব কো সাথ মিল নে আয়া।” আরো মিনিট পনেরো পর দেব’দা এসে গেলেন —
“ ও আপ লোগ আ গিয়া ! গুড গুড – ” এবার আমাদের সঙ্গে সবার আলাপ করালেন -
“ হামারা দো এ্যাসিস্ট্যান্ট - শির মে বহুত গ্রে সেল’স হ্যায়।” এক জনের পরিচয় দিলেন - মি: শর্মা - স্টেটসের চিফ সেক্রেটারি আর এক জন মি: পোখরিয়াল হোম সেক্রেটারি। মি: লিওপল্ড ও চলে এসেছেন তাঁর কটেজ থেকে। দেব’দা যেন নিজের খেয়ালে মত্ত –
“বহুত ভুখ লাগা - পেট মে ছুছুন্দর ডান্স করতা হ্যায় – আরে সুরিন্দর ভাই জলদি জলদি খানা লাগাও - মেনু কেয়া হ্যায়?”
খাওয়ার সময় দেব’দার যথারীতি হাজারো বায়নাক্কা – সুরিন্দর ভাই- ওনিয়ন লে আও – আলুর দম হ্যায়? নিরামিষ খেতে খেতে পেট মে চরা পড় গিয়া” ইত্যাদি ইত্যাদি । মনে হল দেব’দার এখন মুড ভালো । এদিকে তানিয়া রেগে কাঁই। ফিসফিসিয়ে বলে - “ দেব’দা কি করছে দেখেছিস? স্থান কালের জ্ঞান নেই।”
ডিনারের পর একটা বড় টেবিল ঘিরে সবাই বসলেন। চিফ সেক্রেটারি মি: শর্মা একটু হেসে বললেন – দেবনাথ সাব – ডিটলসে কুছু বলিয়ে। হাম লোগকো অউর কিতনা টাইম লটককে রাখেঙ্গে সাব!” মনে একটু আনন্দ হল শুনে যে শুধু আমরা নই – বড় সাহেবরাও ঝুলে রয়েছে। দেব’দা মুচকি হেসে – একটু গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে তাঁর নিজস্ব স্টাইলে হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে বলা শুরু করলেন। এখন একেবারে অন্য মানুষ --
“ আপনারা জানেন এখনকার পৃথিবীতে শুধু পুলিশ আর আর্মি দিয়ে দেশকে সুরক্ষিত করা যায় না। কিন্তু এক অদৃশ্য মহা শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলার জন্য তৃতীয় একটি গোপন সুরক্ষা বলয় দরকার । বিশেষ করে আমাদের মত দেশে – - ” ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে ওঠাতে আমাদের মুখ ভঙ্গিতে “ ফুলু” – অন্যান্য দের এক আঙুল তুলে ‘ এক মিনিট’ বুঝিয়ে বারান্দায় গেলেন। প্রায় মিনিট দশেক পর ফিরে - “ হেঁ হেঁ হেঁ - ঘরওয়ালি কা ফোন থা - পুছতা উনকো পাড়াতুত সহেলির পোতি কা দামাদ কো উর্দ্ধতন পুরুষ লোগ কা পূজা দেওয়া হ্যায় কি নেহি। সন্তু ব্রাদার হিন্দী ঠিক হ্যায় না?” সবাই এর মুখের অবস্থা ও উপায় না দেখে দেব’দার কথা গুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করে দিতে হল।
দেব’দা আবার পুরো গুরু গম্ভীর স্বরে আগের কথার রেশ ধরে শুরু করলেন - -
“ --- রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার যৌথ ভাবে সেই তৃতীয় সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলেছে। ইন্টারপোলের সাহায্যে পৃথিবী ও দেশের অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া জঙ্গি কার্যকলাপ গোপনে নজরদারি করা হয়। মি: লিওপল্ডের দুবাই অফিসের মিটিঙে এই অঞ্চলে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি দলের কার্যকলাপ বেড়ে ওঠার সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়ে এখানে নজরদারি বাড়ানো হয়। মি: ট্যাডপলও এখানে চলে আসেন। এখানে বলে রাখা ভালো – দিল্লী থেকে আসার সময় এক দল সাধু কে দেখে সন্দেহ জাগাতে আমাদের অনুসন্ধানের বৃত্ত ছোট করে আনতে সুবিধে হয়। এই দুই বন্ধুর সাহায্যে লক্ষণ ঝুলার কাছে ওই নকল আশ্রম খুঁজে পেয়ে আমি ও এখানকার পুলিশ ভাই’রা সাধুর বেশ ধরে গত তিন দিন সেখানে ছিলাম।” এবার পকেট থেকে, ছোট্ট মোবাইল ফোনের মত কিছু বার করে বলেন –
“ট্যাডপল সাহেব এই ছোট যন্ত্রটা দিয়েছিলেন – এটা কাছাকাছি থাকা স্যাটেলাইট ফোনের সিগনাল ধরে ফেলতে পারে। আমরা লক্ষ্য করি ঠিক বেলা একটা থেকে দেড়টার মধ্যে – এই ছোট ডিভাইসের আলোটা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে জন্য জ্বলে উঠে নিভে যাচ্ছে – পর পর দুদিন লক্ষ্য করে আজকের এ্যাকশন প্ল্যান তৈরী করে ফেলি। আমার এই দু’জন বন্ধুর তৎপরতা ও মি: ট্যাডপল আর এখানকার পুলিশের সহযোগিতায় – হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ওই নকল ধর্মীয় সংগঠনের আড়ালে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের ভারতের উত্তরাঞ্চলে নাশকতা মূলক কার্যকলাপ বাড়ানোর উদ্দেশ্য ব্যর্থ করা সম্ভব হল। এর পরের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন।
ওই নকল আশ্রম থেকে বিশাল বিদেশী অস্ত্র ভাণ্ডার, ওদের ডেরার পাশের ডাম্প ইয়ার্ডে লুকনো প্রচুর বিস্ফোরক, আধুনিক যোগাযোগের যন্ত্রপাতি উদ্ধার হয়েছে আর বিদেশী জঙ্গি সংগঠন কে সাহায্যকারী ১৮ জন দেশীয় জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। বলে রাখি সেই কুয়োয় ছুঁড়ে ফেলা স্যাট ফোনটাও উদ্ধার হয়েছে – থ্যাংক্স টু তানিয়া সিস্টার। এখন গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।” হাতের ঘড়ি দেখে দেব’দা বললেন –
“বহুত রাত হো গিয়া –আভি থোড়া বাহার যানে হোগা।
চিফ সেক্রেটারি সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন - “এক মিনিট দেবনাথ সাহেব – সরকার পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা সবাই আর্মি ও পুলিশের কাজ জানি – তাঁদের জন্যই দেশের মানুষ নিশ্চিন্ত থাকেন। তবে আপনাদের মত যাঁরা লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে ওই অদৃশ্য শত্রুদের মোকাবিলা করে দেশের তৃতীয় সুরক্ষা বলয় সুদৃঢ় করে তুলেছেন – তাঁদের ও আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই --” বলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে “জয় হিন্দ” বলে স্যালুট করলেন। এবার অন্যান্যদের সঙ্গে আমরাও একযোগে জয় হিন্দ ও স্যালুট করে কৃতজ্ঞতা জানালাম। তানিয়া এবার গলা ছেড়ে বলে ওঠে “হিপ হিপ হুররে দেব’দা” – অন্যরাও গলা মেলালেন তানিয়ার সঙ্গে। দেব’দা এই অভিনন্দনের স্রোতে একটু থতমত হয়ে শরীরে সামনের অংশ ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ ও জয় হিন্দ বলে - “সুবে ফিন বাত চিত হোগা।” বলেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। এর পরই বাইরে থেকে গাড়ির স্টার্ট ও চলে যাওয়ার শব্দ ভেসে এল। রাত তখন সাড়ে তিনটে।
আমাদের দু’জন কে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে - চিফ সেক্রেটারী ও অন্যান্যরাও যে যার গাড়িতে উঠলেন।
ভোর হতে আর দেরি নেই। ঋিষিকেশের দক্ষযজ্ঞের কাণ্ডকারখানায় সাক্ষি হয়ে মাথা বনবন করছে। আমরা দূ’জন আর কটেজে না গিয়ে – নদীর ধারের বেঞ্চে নিজস্ব চিন্তায় ডুবে দেব’দা ও সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষায় রইলাম।
হে পূর্ণ তব চরণের কাছে
অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
ভ্রমণ
ছবিগুলি বড় ফ্রেমে দেখতে ছবির ওপর ক্লিক করুন।
দিল্লী পৌঁছানো অবধি একটু দ্বিধা ছিল, কিভাবে এগোব পরবর্তী গন্তব্যে। ইন্টারনেট মারফৎ জানা গেছিল, দিল্লী থেকে হিমাচল প্রদেশের কুলু আকাশপথে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু তার টিকিট এই অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রিতে বসে পাওয়া সম্ভব ছিল না (বলে রাখি, সময়টা ছিল ২০০৩ সাল)। তাই টিকিটের অনুরোধ রেখেছিলাম আমাদের দিল্লী অফিসে, কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি। দ্বিধা সেই কারণেই – টিকিট না হয়ে থাকলে, ব্যবস্থা করতে হবে ট্রেনে-গাড়ীতে চণ্ডীগড় হয়ে যাবার – সেক্ষেত্রে আমাদের পাহাড়বাসের সীমিত সময়সীমা থেকে আরো একটি দিন সঙ্কুচিত হবে!
কিন্তু দিল্লী অফিসে পৌঁছতে, সংশ্লিষ্ট শ্রীমতী কমল লাঞ্চব্রেকের মাঝপথেই ঝলমলে হাসিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে দিলেন পরদিন সকালের ফ্লাইট টিকিটগুলো। আমরা চলেছি ONGC Himalayan Association, Rajahmundry – র ব্যবস্থাপনায়, লক্ষ্য পাহাড়ের একান্তে কয়েকটা দিন কাটানো, শহরের ভীড় ও ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে। আমাদের অফিসে এই একটি মস্ত সুবিধা আছে, অন্যান্য খেলাধূলার মতই, পর্বতারোহণেও কর্মীদের উৎসাহিত করা হয় – তার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ছুটি থাকে, আর খরচপত্রেরও সিংহভাগ অফিসই বহন করে। আমাদের এবারের গন্তব্য হিমাচল হিমালয়ের দেওটিব্বা শিখরের পাদদেশে। মানালি, আমাদের সকলেরই অতি পরিচিত একটি জায়গা। সেখান থেকে ৭ কিমি দূরে জগৎসুখ গ্রাম। সেখানেই গাড়ির রাস্তা শেষ, হাঁটাপথের শুরু। যেতে হবে খানোল, চিক্কা ও শেরি পার হয়ে, প্রায় ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায়। আমাদের ছয়জনের দলটাতে প্রায় সারা ভারতের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে – আসাম থেকে এসেছেন শ্রী বোরা, কর্ণাটকের শ্রী রমেশ, পার্বত্য উত্তরাঞ্চল থেকে শ্রী লাল ও শ্রী ধ্যানী। এছাড়া বঙ্গসন্তান দলপতি মন্ডলদা এবং আমি। যাত্রার সিংহভাগ প্রস্তুতিই সেরেছেন মন্ডলদা – পোক্ত পর্বতারোহী, প্রত্যেক খুঁটিনাটি ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি – বন্ধুমহলে তার “হিমালয় মন্ডল” পরিচিতির সার্থকতা টের পেয়েছি যাত্রার প্রতিটি পদে। আমরা পাঁচ আনাড়িও তারই ভরসায় সাহসী হয়েছি এই দুর্গমের আরোহণে, যাকে বলা হয় deadly sport - চলার পথে কোথাও একবার পদস্খলন ঘটলে, আর চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া না-ও যেতে পারে!
দিল্লী থেকে কুলু/মানালী আকাশপথে পরিষেবা (সেইসময়ে) ছিল মাত্র একটিই বেসরকারী সংস্থার – Jagson Airlines – দৈনিক তাদের একটিই বিমান দিল্লী-সিমলা-কুলু এই পথে যাতায়াত করে। সরাসরি মানালি বা কুলুতে airport নেই, নামতে হয় Bhuntar এ, এখান থেকে কুলু মাত্র ৯ কিমি, আর মানালি প্রায় ৫০ কিমি মত। ছোট্ট ডর্নিয়ার প্লেন, মাত্র ১৬ জন যাত্রী নিতে পারে। (প্রসঙ্গত, আমরা বোম্বে হাই যেতে সমুদ্রে যে MI-8 হেলিকপ্টার ব্যবহার করতাম, সেখানেও জনা কুড়ি যাত্রী ধরে যেত, মালপত্র সো অলগ!) এখানে আমরা ছয়জন ছাড়া বেশীরভাগই মনে হল ব্যবসায়ী শ্রেণীর। দুজন বিদেশিনীও রয়েছেন, আলাপে জানলাম, কানাডা থেকে দুমাসের ভারত ভ্রমণের মাঝপথে চলেছেন মানালির আশেপাশে, আমাদেরই মত কোনও trekking এ। এইবার দিল্লী এয়ারপোর্টে ঘটল একটা মজার ঘটনা। জীবনে প্রথমবার, এবং আজ অবধি একমাত্রবার, মাছের বাজারের মত দরাদরি করে প্লেনে চড়েছিলাম! হয়েছিল কি, ওই ছোট্ট Dornier প্লেনে যাত্রী বহন ক্ষমতাও যেমন সীমিত, তেমনই, যাত্রী পিছু মাল বহনেরও খুবই নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল, বোধহয় জনপ্রতি ৭ কেজি। তার থেকে বেশি হলে আবার একটা বড়সড় রকমের অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হবে। এদিকে আমরা চলেছি ট্রেকিং করতে, সঙ্গে লটবহর তো ভালোই আছে। এই মাল বহনের সীমার কথা আমরা কিছুই জানতে পারিনি, তাহলে হয়ত অন্যভাবে পরিকল্পনা হত! সে যাইহোক, আপাতত সব ব্যাগপত্র ওজন করে আমাদের অতিরিক্ত মাশুল দাঁড়াল প্রায় ১২০০০/- টাকার মত! সেদিনের হিসেবে অনেকগুলোই টাকা! তার ওপর, আমরা যাচ্ছি ট্রেকিং এ, মাপা টাকাপয়সা সাথে নিয়ে। সেখানে আবার জানা-অজানা অনেক খরচা রয়েছে সামনে! আমরা একটু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম – অতিরিক্ত মাশুল দিয়েও যখন ওরা নিয়ে যেতে রাজী, তখন বিমানের মোট মালবহন ক্ষমতার সীমার মধ্যেই নিশ্চয়ই রয়েছে ব্যাপারটা! এদিকে, এদের সীমিত যাত্রী সংখ্যা, তার মধ্যে আমরাই মোট ছজন। কাজেই একটু কূটনীতি প্রয়োগ করতে হল। সরাসরি ওদের কাউন্টারের মেয়েটিকে বললাম, ভাই, আমাদের এত পয়সা নেই, আমরা এই ছয়টা টিকিট এখুনি ক্যান্সেল করতে চাই, ওই অতিরিক্ত মাশুলেই আমরা আরামসে দুটো গাড়ী ভাড়া করে মানালি পৌঁছে যাব! আর সেইসঙ্গে, আগামী অমুক তারিখে আমাদের মানালি থেকে ফেরারও ছটা টিকিট আছে, সেগুলোও এখনই ক্যান্সেল করতে চাই!
এইবার তারা পড়ল ফাঁপরে। কারণ এই ছটি টিকিট ক্যান্সেল করার অর্থ, ওদের পুরো ফ্লাইটই বাতিল করতে হবে! আর, সম্ভবত সেদিনের ফেরার ফ্লাইটটিও! ওদের ম্যানেজার ফটাফট এসে পড়ল, ওরাও ছাড়বে না, আমরাও বেশি টাকা দেবো না! অনেক বাকবিতন্ডার পরে, শেষে ৫০০০/- টাকায় রফা হল! এরপর আর বিশেষ কিছু অসুবিধে হয়নি। সমতল ছাড়াতেই আকাশ থেকে দেখা গেল দিগন্তবিস্তৃত নীল পাহাড়ের সারি, যেন হিমালয় উদ্বাহু হয়ে আহ্বান করছে! নিজের অভিজ্ঞতায় জানি, হিমালয় নিজের থেকে আহ্বান না করলে, তার কাছে যাওয়া যায় না – হাজার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ মূহুর্তে সব বাতিল করতে হয়। আবার যখন ডাক আসে, অগ্রাহ্য করার উপায় থাকে না – শতবাধাঁর বন্ধন তুচ্ছ করেও যেতেই হয়! সিমলা ছুঁয়ে আমরা ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম Bhuntar এয়ারপোর্টে। এখানে এসে বুঝলাম কেন কেবলমাত্র ছোট বিমান ছাড়া এখানে আসতে পারেনা। বিপাশা নদীর খুব সরু উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এখানে উড়ে আসতে হয়, দুপাশে খাড়া পাহাড় আর নীচে বিপাশার জলতরঙ্গ, তারই মধ্যে একজায়গায় নদী একটা ‘দ’ আকৃতির বাঁক নিয়েছে, সেই বাঁকের পেটের কাছ থেকেই রানওয়ের শুরু। প্লেন নামার সময়ে নদীর জল প্রায় ছুঁয়ে ফেলতে ফেলতে হঠাৎ রানওয়েতে ঢুকে পড়ে। এখান থেকে দেখি মানালি পৌঁছানোর সোজা রাস্তায় কাজ চলছে কিছু, তাই আমাদের একটু ঘুরে যেতে হল বিপাশার পূর্বধার দিয়ে, যে পথ গেছে Naggar ও পাথরিকুল হয়ে। এ পথেই পড়ে Roerich Estate, অতীতের বিখ্যাত সিনেমাশিল্পী দেবিকারানীর রুশ স্বামী, চিত্রশিল্পী Nikolai Roerich দের পরিবারের ব্যক্তিগত বাসগৃহ ও সংগ্রহালয়, মানালি বেড়াতে গেলে একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান।
মানালি আমি প্রথম দেখি এর প্রায় বছর পঁচিশ আগে, ১৯৭৮ সালে। আমূল বদলে গেছে সবকিছু – তখন ছিল উত্তাল কলরোল করে বয়ে যাওয়া বিপাশা নদীর ধারে একটিমাত্র যাত্রীনিবাস ও গুটিকয় দোকানপসার নিয়ে ছোট্ট, শান্ত জনপদ। যেন চীর-পাইনের ঘোমটায় কোনো লজ্জাশীলা গ্রামবধূ। আর আজকের মানালি যেন কোনো লাস্যময়ী যুবতী – এত আলো, এত বাড়ি, পাহাড়-বন তছনছ করে কয়েকশো হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান-বাজার, কী নেই! প্রচুর ট্যুরিষ্ট, এবং তার ৯০% বাঙালি – পায়ে চাকা লাগানো এ জাতের সত্যিই জুড়ি মেলা ভার! [আমি এর পরেও, ২০২০ তে আরেকবার গেছিলাম মানালিতে, হিমালয়ের বাণিজ্যকরণ যেন আরো দ্রুতগতিতে হয়ে চলেছে, দেখলেই মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে!]
মানালিতে একদিন acclimatization – পাহাড়ে ওঠার আগে তার উচ্চতায় শরীরকে সইয়ে নেওয়া। তারই মধ্যে কেনাকাটার মূলপর্ব সারা হল – রান্নার বাসনপত্র, স্টোভ, কেরোসিন থেকে চাল-ডাল-তেল-মশলা-আটা, ওদিকে rucksack, sleeping bag, carrymat, কিছু কিছু শীতবস্ত্র – সবই সেই দলপতির নিখুঁত নির্দেশে।
অবশেষে এসে পড়ল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১১ই অক্টোবর, ২০০৩, শনিবার সকালে মানালি থেকে গাড়িতে পৌঁছলাম ছোট্ট গ্রাম, জগৎসুখ। এখানে বিপাশা নদীতে এসে মিশেছে চন্দ্রনালা – তারই পাশ দিয়ে আমাদের চলার পথ। মানুষের অন্তরে স্থান পেতে হলে যেমন প্রীতি-প্রেমের ধারা বেয়ে চলতে হয়, হিমালয়ের অন্দরে পৌঁছতেও তেমনই গিরি-নির্ঝরিণীর গতিপথ ধরে এগোতে হয়। শৈলশিখর থেকে পার্বত্য নদী আপন প্রবাহে পাথর কেটে, পাহাড় ধসিয়ে নিজের পথ খুঁজে নেয়। সেই প্রবাহ-পথ অনুসরণ করে পথিকেরও পথ চলা শুরু হয়।জগৎসুখ থেকে সব তোড়জোড় সেরে বেরোতে বেশ বেলাই হয়ে গেল। মালপত্রের জন্য কয়েকটা ঘোড়া, আর পথপ্রদর্শক, এরাও সময়মতই এসে পড়ল। আগেরদিনই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে রাখা হয়েছিল। আমাদের পথপ্রদর্শক প্রকাশ বয়সে নবীন, তার বাবা নাকি একসময়ে এই কাজ করতেন, এখন সেও করছে। রান্নার জন্য আছে লালবাহাদুর, আর ঘোড়াদের দেখাশোনার জন্য আরো দুজন। আমাদের চলার পথে জগৎসুখ-ই শেষ জনবসতি। এরপরে শুধুই চন্দ্রনালাকে ডানহাতে রেখে অস্পষ্ট পথরেখা অনুসরণে পূর্বমুখী এগিয়ে চলা। প্রথমেই খানিকটা খাড়া চড়াই, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা নানা আকারের পাথর ও কাঁটাঝোপের পাশ কাটিয়ে। পাশে নিত্যসঙ্গী চন্দ্রনালার অবিরাম কলধ্বনি, যেন “নদী আপন বেগে পাগলপারা”! দুপাশে আকাশচুম্বী পাইনের সারি। মাঝেমধ্যেই ডেকে যাচ্ছে নাম-না-জানা কোনো পাখি। জগৎসুখ গ্রামের শেষ বাড়িটিও পিছনে পড়ে রইল তার আপেলবাগান আর গোশালা নিয়ে। পিছনে পশ্চিমে, বহু দূরে, বোধহয় মানালিও পেরিয়ে, দেখা যাচ্ছে একটি বরফঢাকা শিখর। এই শৃঙ্গটিকে আমরা বরাবর দেখতে পেয়েছি, আমাদের গন্তব্যের প্রায় শেষ অবধি। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পথরেখা কোথাও স্পষ্ট, কখনো হারিয়ে গেছে ঝোপঝাড় অথবা পাথরের আড়ালে। নদী কখনো পথের খানিকটা কাছাকাছি, কোথাও অনেকটাই নীচে। ভেঙ্গে পড়া গাছের গুঁড়ি পড়ে রয়েছে কোথাও, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, জলের ওপর। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে খানিক বসে বিশ্রাম নিয়ে, আবার পথ চলা। মাঝেমধ্যেই পিছিয়ে পড়ছি আমি, রমেশ আর বোরা। প্রথমদিনের চলা, পিঠে রুকস্যাকের বোঝা যেন দ্বিগুণ ঠেকছে। তার ওপর আমি ও রমেশ দুজনেই বিশালতনু। ধ্যানী ও লাল আদতে পাহাড়ী মানুষ, বেশ তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আর মন্ডলদার কথা তো বলাই বাহুল্য! প্রায় ঘন্টাতিনেক চলার পরে পৌঁছলাম খানোল, উচ্চতা ৭৩০০ ফুট। কোনো লোকবসতি নেই, শুধু নদীর ধারে খানিকটা প্রায়-সমতল জমি, সেখানেই আমাদের তাঁবু খাটানোর ব্যবস্থা হল। একপাশে দুটো বড় পাথরের ফাঁকে প্লাষ্টিকের ছাউনি লাগিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। দলপতি মন্ডলদার নির্দেশে লালবাহাদুর চটপট বানিয়ে ফেলল স্যুপ, তারপর পকোড়া, চা। মন্ডলদার কড়া নজর, এই উচ্চতায় শরীর সুস্থ ও সবল রাখার জন্য ঠিক কেমন খাওয়া-দাওয়া প্রয়োজন – বিশেষতঃ altitude sickness বুঝতে ও ঠেকাতে নানা পরামর্শ দিয়ে চলেছে।
দিনের বেলায় পথ চলার জন্য টের পাইনি, একটু ফাঁকা জায়গায় বসতেই, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া শুরু হল। আর সূর্যাস্তের সাথে সাথেই যেন হুড়মুড়িয়ে নেমে এল অন্ধকার! চটপট রাতের খাওয়া সেরে আশ্রয় নিলাম তাঁবুর ভিতরে। সমতলের হিসেবে তখন হয়ত ৬ ১/২টা কি ৭টা বাজে। কাজেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন রাত দেড়টা। এমনিতেই পাহাড়ে ঘুম খানিকটা কমে যায়, উচ্চতায় অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে। বাইরে তখন চাঁদের আলোয় চরাচর উদ্ভাসিত, দুদিন আগেই ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। কিন্তু তাঁবু একটু ফাঁক করতেই ঠান্ডা হাওয়ার দাপট বোঝা গেল! বাইরের তাপমাত্রা তখন বোধহয় ৬-৭° এর বেশী নয়!
সকাল ছটায় লালবাহাদুর চা নিয়ে এল। ব্রেকফাস্ট সারা হল ন্যুডলস দিয়ে। নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম দ্বিতীয় দিনের পথে। আজকের পথ প্রায় পুরোটাই পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে – প্রথমে বেশ খানিকটা চড়াই, অল্প উৎরাই পেরিয়ে আবার খানিকটা চড়াই। মাঝেমধ্যে পথ কেটে গেছে ঝর্ণার ধারা, পেরোতে হচ্ছে পিছল পাথরের ওপর সাবধানে পা রেখে। পথের দুপাশে বিশাল সব বনস্পতি – তার সবুজপাতার জালি-পথে ওপরে দেখা যায় ফালি ফালি নীল আকাশ। গায়ে লাগে হেমন্তের প্রশান্ত বাতাস। সকালের রোদে চারিদিক ঝলমল করছে, যেন স্নান সেরে পুষ্পপাত্র হাতে জননী বসুন্ধরা স্মিতবদনে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে পথের পাশে ঘাসের মধ্যে দুটো-একটা ছোট্ট হলুদ ফুল নীরবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে তাদের নতুন অতিথিদের! দেখা হয়ে গেল দুজন ফেরৎ-পথের
যাত্রীর সঙ্গে – পুণে থেকে দুবন্ধু এসেছিল চন্দ্রতাল-এর উদ্দেশ্যে, কিন্তু শেরিতে প্রচন্ড তুষারপাতের ফলে, সেখান থেকেই ফিরতে হচ্ছে। আমাদেরও সাবধান করে দিয়ে গেল।একটা ফাঁকা জায়গায় খানিক বিশ্রাম, তারই মধ্যে লালবাহাদুর এনে ফেলল সবার জন্যে গরম স্যুপ। পাশেই একটা খাড়া পাহাড়, তাই দেখে মন্ডলদার একটু rock climbing করার শখ হল। কিন্তু একটুখানি চড়েই ফিরতে হল – খালি হাতে যদিবা কোনক্রমে ওঠাও যায়, নামার পথ পাওয়া যায় না! পাথরের গায়ে নানা চিত্রবিচিত্র নকশা সেগুলির গঠনের ইতিহাসের কিছু কিছু হদিস দেয়। ভূতাত্ত্বিক মতে, এগুলো সবই রূপান্তরিত শিলা – বেশীরভাগই granite gneiss, আর কিছু quartzite ও mica schist রয়েছে। প্রকৃতির জঠরে প্রচন্ড চাপ ও তাপে রূপান্তরের ফলে, সেগুলির গায়ে বিভিন্ন ধরণের ভাঁজ সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও ফাটলের মধ্যে ঢুকে গেছে quartz এর শিরা। কোনো একসময়ে (মানে, ভূতাত্ত্বিক সময়কালে, কয়েক কোটি বছরের ব্যপ্তিতে) একটা বিরাট নাড়াচাড়ার ফলে, সেগুলি এখন উঠে এসেছে পৃথিবীর উপরিভাগের খুব কাছাকাছি। আর আজ স্রোতস্বিনীর ধারা সেগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে এনে সাজিয়ে রেখেছে আমাদের পথের পাশে।
একসময়ে পৌঁছে গেলাম চিক্কা। এখানের উচ্চতা ৯৩০০ ফুট। নদীর পাশে একটুকরো সমতল জায়গা, সেখানে প্রচুর ভেড়া নিয়ে কয়েকজন মেষপালক, ভেড়াদের লোম কেটে বস্তাবন্দী করছে। পশমের বস্ত্র তো আমরা সকলেই গায়ে দিই, কিন্তু সেই পশম আহরণের একেবারে প্রাথমিক ধাপটা প্রথম চাক্ষুষ করলাম। বিশেষ একটা কায়দায় ভেড়াগুলোকে চেপে ধরে রেখে, একটা অদ্ভুত আকৃতির কাঁচি দিয়ে কি অনায়াস দক্ষতায় লোমগুলো কেটে তুলছে, প্রাণীটির গায়ে এতটুকুও আঘাত না দিয়ে! একপাশে পাথরের গায়ে প্রকৃতির সর্পিল কারুকার্য – স্থানীয় মানুষের কাছে পূজনীয় ‘তক্ষকনাগ” দেবতা হিসেবে। যুগ যুগ ধরে ভক্তদের প্রদীপশিখা ও সিঁদুরের অভিঘাতে আদতের quartz vein এর সাদা রঙ কোথায় হারিয়ে গেছে! নইলে এই পাথরের রূপান্তরণ প্রক্রিয়ার এক সুন্দর সাক্ষ্য হতে পারত সেটি! অন্যদিকে একটা পাথর-ঘেরা জায়গায় শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল রাখা। পাথরের ওপরে লাল রঙের নিষেধাজ্ঞা – মহিলাদের বিশেষ সময়ে প্রবেশ মানা। অনুমান করলাম, বিদেশিনী পর্যটকদের জন্যই এই সতর্কবাণী। দুটো পাথরের ঘর রয়েছে, কোনো বিশেষ পার্বণের সময়ে নীচে জগৎসুখ থেকে পূজারী আসেন। একটি ঘর তালাবন্ধ, সেখানে নাকি পূজার সামগ্রী ইত্যাদি থাকে। অন্যটি খোলা, বোধহয় আমাদের মত মুসাফিরদের সুবিধার জন্যেই। সেখানেই আশ্রয় মিলল আজকের মত। মাঝারি মাপের ঘর, দুটি অসম্পূর্ণ জানালা – প্লাস্টিক শীট দিয়ে সেগুলি ঢাকা দেওয়া হল, হাওয়া ও সেইসঙ্গে ঠান্ডা আটকাতে। ঘরের মধ্যেই একপাশে মাটির উনুন করা রয়েছে, বাইরে থেকে শুকনো কাঠকুটো যোগাড় করে এনে, সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা করা গেল। পশ্চিমের জানালার লাল প্লাস্টিক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলো সারা ঘরটাকে রাঙিয়ে তুলেছে। আজ রমেশ ও লাল পায়ের ব্যথায় একটু কাতর, মলম লাগাচ্ছে। আমারও একটু altitude sickness এর মত লাগছিল, মন্ডলদার নির্দেশে কাঁচা রসুন খেয়ে আরাম পেলাম। ধ্যানী ও রমেশ এনেছে ছোট্ট রেডিও, এখন ক’দিন সেগুলোই আমাদের কাছে বহির্বিশ্বের একমাত্র সংবাদদাতা। বাইরে ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হাওয়ার দাপট শুরু হয়ে গেছে।
চিক্কাতে বিশ্রামের পর, পরেরদিন আবার চলা শুরু। এদিনের পথ বড় সুন্দর, অল্প অল্প চড়াই, একটানা চলেছে। ক্রমশঃ বড় গাছপালা শেষ হয়ে এল, এখন পায়ের নীচে শুধুই ঘাস, কদাচিৎ এক-আধটা কাঁটাঝোপ মতন। আবার কোথাও পথরেখা মিলিয়ে গেছে বড় বড় পাথরের স্তূপের মধ্যে। পাথরগুলির বেশীরভাগেরই আকারে গোলভাব রয়েছে, যার অর্থ এরা শুধুমাত্র পাহাড়ের ভগ্ন অংশবিশেষ নয়, অন্ততঃ বেশ খানিকটা জলবাহিত হয়েই এখানে এসেছে। মাপেও কোনোটাই দু-তিন ফুটের কম নয়। কি বিপুল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, এত বড় বড় পাথরকে এতখানি জলবাহিত করতে! তা-ও এই উচ্চতায়! নদীর দুপাশের খাড়া পাহাড়গুলি কম করেও হাজারখানেক ফুট উঁচু হবে, নদীগর্ভ থেকে। ভাবতে পারা যায়, কোনো এক অতীতে, হয়ত কয়েক লক্ষ বছর আগে, ওই পাহাড়ের ওপরটাই ছিল সমতল, বা প্রায় সমতল, আর এই নদী বয়ে যেত সেখান দিয়ে! সময়ের প্রভাবে, ক্ষয় পেতে পেতে, আজ এত গভীর উপত্যকার সৃষ্টি করে চন্দ্রনালা বয়ে চলেছে! আসলে, হিমালয় এত বিরাট হলেও, ভূতাত্ত্বিক সৃষ্টির জগতে, নেহাৎই ছেলেমানুষ – মাত্র ৫/৬ কোটি বছর বয়স তার; এখনও সম্পূর্ণ গড়ে ওঠেনি – প্রতি বছরেই কয়েক মিলিমিটার করে বাড়ছে! মাঝেমধ্যেই তার ভারসাম্যের হেরফের ঘটে, গিরিরাজ তখন হঠাৎ একদিন ধস নামিয়ে দেন, নদীকেও সেইসঙ্গে খুঁজে নিতে হয় নতুন কোনও গতিপথ!
Boulder zone পেরিয়ে আবার পথ চলি। ওপরে নীল আকাশ, দুপাশে খাড়া পাহাড়, মাঝ দিয়ে চন্দ্রনালার জলতরঙ্গ। থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়ে উপভোগ করি – “চক্ষুভিরিব পিবন্তি” – সত্যিই যেন দুচোখ দিয়ে আকন্ঠ পান করে নিতে চায় মন। নদী কোথাও পাথরে বাধা পেয়ে অশান্ত, কোথাও বাধাহীন, আবর্তের সৃষ্টি হয়েছে – যাকে তটিনীসুন্দরীর নাভিকূপ বলে বর্ণনা করেছেন মহাকবি কালিদাস, তাঁর মেঘদূতম–এ। হঠাৎ দূরে বরফঢাকা কোনো শিখর দেখা দেয়, শ্রান্ত দেহ-মনে আবার উৎসাহ জাগে। ক্রমশঃ ইন্দ্রাসন শিখর আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। এসে পৌঁছলাম শেরিতে, উচ্চতা ১৩,২০০ ফিট। এতক্ষণ নদীখাত ধরে চলার পরে এসে পড়লাম হিমবাহ-উপত্যকায় – ইংরাজী “V” আকৃতির জায়গায়, এখন উপত্যকার প্রস্থচ্ছেদ নিয়েছে “U” আকার। আমাদের এখন তিনদিকে বিরাট উঁচু উঁচু সব শিখর, আর পশ্চিমে যে পথে উঠে এসেছি। ঠিক পিছনেই খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, অন্ততঃ ৪০০০-৫০০০ ফুট উঁচু হবে। সামনেই, রাজকীয় মহিমায় বরফাবৃত ইন্দ্রাসন (২০,৪০০ ফিট)। স্থানীয়দের বিশ্বাস, দেবরাজ ইন্দ্র মর্ত্যে আগমন করলে এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করেন। সেই থেকেই এই নামকরণ। তবে পর্বতারোহীদের কাছে এটি পীরপঞ্জল হিমালয়ের একটি অন্যতম দুর্গম শিখর মনে করা হয়, পদে পদে crevasse ও আরো নানা ঝুঁকি থাকে। ওদিকে দেওটিব্বা (১৯,৮০০ ফিট) অংশতঃ দৃশ্যমান। আরেক পাশে দেখা যাচ্ছে নরবু, তারও উচ্চতা অনেক, অথচ বরফ বিশেষ জমতে পারেনি, বোধহয় খাড়া আকৃতির কারণে। নরবুর পাশ দিয়ে গেছে মালানা গিরিখাতের পথ। আমাদের সামনে অনেকখানি বিস্তীর্ণ সমতল, বা tableland, গোটাদুয়েক ফুটবল মাঠ স্বচ্ছন্দে ঢুকে যাবে। বছরের বেশীরভাগ সময়েই জায়গাটা থাকে বরফের আচ্ছাদনে, ফলে জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ঘাস, আর জলে কিছু শ্যাওলা ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদ নেই! বেশিরভাগ জায়গাটাই ন্যাড়া। তার দুপাশ দিয়ে তিরতির করে ছোট ছোট নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর দুটি ধারা। চন্দ্রনালার উৎপত্তি বলা যায় এখান থেকেই। চারপাশের বিভিন্ন পাহাড় থেকে অনেকগুলি ঝর্ণার ধারা এই সমতলে এসে হঠাৎ স্তিমিতগতি হয়েছে। আবার একটু নীচে গিয়েই, রূপ পেয়েছে চন্দ্রনালায়। শুনেছিলাম শেরিতে একটা পাহাড়ের গায়ে গুহা আছে, সেখানে ২০-২৫ জন মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেল সেটা জলের ধারার থেকে এতটাই দূরে, যে ঠিক সুবিধে হবেনা। তাই জলের কাছাকাছি জায়গা দেখে তাঁবু ফেলা হল। এখানে ঠান্ডা আরো তীব্র, কোনোসময়েই টুপি, মোজা বা গ্লাভস খোলার উপায় নেই। আজকের পথচলায় সকলেই ক্লান্ত, প্রায় ৬/৭ ঘন্টা চলতে হয়েছে, উঠতে হয়েছে প্রায় ৪০০০ ফুট। তবু, পড়ন্ত সূর্যের আলো যখন দেওটিব্বার মাথায় সোনা ঢেলে দেয়, সব শ্রান্তি যেন নিমেষে উধাও হয়ে যায়!
স্পেন থেকে এসেছে যুবক পেদ্রো এবং তার বন্ধু, গন্তব্য সামনের পাহাড়ের মাথায় চন্দ্রতাল লেক। পথে তাদের সিগারেট ফুরিয়েছে। খুব কুন্ঠার সঙ্গে আমাদের তাঁবুতে এসে জানতে চাইল, আমাদের কাছে উদ্বৃত্ত আছে কিনা। ওরা পয়সা দিয়েই কিনবে। তাকে বসিয়ে চা-সহ বিস্তারিত আলাপ করলাম। বুঝলাম কুন্ঠার কারণেই পয়সার উল্লেখ। আমাদের সীমিত স্টক থেকে কিছু দেওয়া হল। পরদিন সকালেও কয়েকটা নিল। সে ও তার বন্ধু সেদেশে কোনো পানশালায় বেয়ারার কাজ করে, আর অন্য সময়ে water rafting ও surfing এর প্রশিক্ষণ দেয়। এখন এসেছে একমাসের ভারতদর্শনে। হাতে বেশী সময় নেই, কালই চন্দ্রতাল দেখে, নেমে যাবে চিক্কাতে।
আমাদের সঙ্গের পাহাড়ী মানুষগুলোর সারল্য আর সেবা দেখে শহুরে তথাকথিত সভ্যতার দীনতা প্রকট হয়। এরাই আমাদের যাত্রাপথে সর্বাধিক পরিশ্রম করছে – সেই কোন ভোরে চা দিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙানো থেকে, আমরা হাঁটতে শুরু করার পরে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঘোড়াদের পিঠে চাপিয়ে, আবার আমরা পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে, সব জিনিস নামিয়ে চা/কফির ব্যবস্থা করা, পরে রাতে সবার খাওয়া-দাওয়ার পরে বাসনপত্র ধুয়ে, ওই ঠান্ডায় খাবার জল এনে দেওয়া অবধি, সারাদিনই খাটছে! আবার সর্বদাই হাসিমুখে আমাদের সব আবদারও পূরণ করে চলেছে!
শেরিতে ঠান্ডা এতই বেশী যে সূর্যাস্তের পরে আর তাঁবুর বাইরে থাকাই গেল না। রাতের খাওয়াও সারতে হল তাঁবুর ভিতরেই। বোরাদা আজ একটু বেশী কাহিল, চুপচাপ একপাশেই পড়ে রইল। আজ আর চন্দ্রনালার অবিশ্রাম ছলাৎছল শব্দ নেই, কিন্তু সে অভাব পূরণ করে দিল তাঁবুর ভিতরে রমেশের নাসিকাগর্জন। ভীমপলশ্রী থেকে ভৈরবী, সব রাগ-রাগিণীই শোনা হয়ে গেল সারা রাতে, ঘুম হল অল্পই!
সকালে উঠে দেখি, তাঁবুর বাইরের দিকে পাতলা বরফের আচ্ছাদন জমে গেছে। নদীর জলেও স্বচ্ছ বরফের আস্তরণ। ঘাসের একেকটা ফালির মধ্যে বরফ জমে, অপূর্ব সুন্দর ফুলের আকার নিয়েছে। ধূসর আকাশ ও চারিদিকের বরফের পটভূমিতে ইন্দ্রাসন শিখরের চূড়াটুকুকে উজ্জ্বল করে তুলেছে অন্তরাল থেকে প্রথম সূর্যের আলো। তখনও তাপমাত্রা শূন্যের নীচেই। একটু বেলা বাড়ার পরে, প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ, সেটা দাঁড়াল ২ ডিগ্রীতে!
আজ আমাদের চলতে হবে নদী পেরিয়ে, ইন্দ্রাসনকে পাশে রেখে, দেওটিব্বা শিখরের পাদদেশের পথে। আজ আর তাঁবু গোটানোর ব্যাপার নেই, শুধু অত্যাবশ্যকীয় কিছু জিনিস ও জল নিয়ে রওনা দিলাম। প্রথমেই নদী পেরোনো – জুতো-মোজা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে জলে পা দিতেই মনে হল, পায়ের নীচের অংশটা বোধহয় আর আমার নয়! পথপ্রদর্শক প্রকাশের দেখানো জায়গা দিয়ে পিছল নুড়িপাথরের ওপর পা রেখে নদী পেরিয়ে এলাম। হাঁটুজলের বেশী নয়, কিন্তু স্রোত ভালই রয়েছে। এবারে, গিরিসানু দিয়ে শুধুই চড়াই। বিক্ষিপ্ত পাথরে পাশ দিয়ে চলা, নির্দিষ্ট কোনো পথরেখা নেই, তাই প্রায়ই দলছুট হয়ে পড়ছিলাম। ধ্যানী ও লাল খানিকটা এগিয়ে গেছে, মন্ডলদার সঙ্গে। আমি আর বোরাদা অন্য একদিকে এসে পড়েছি, আর রমেশ বোধহয় চড়াই এড়াবার চেষ্টায় একদম নীচেই রয়ে গেছে। ঝর্ণার ধারাগুলিতে আর জল নেই, সবই বরফ! কোথাও আবার সেই বরফের নীচে দিয়ে ক্ষীণ জলধারাও রয়েছে। একটা সময়ে বরফের ওপর দিয়েই চলা শুরু হল। এ পথটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক – নরম বরফের ওপরে পদস্খলনের সম্ভাবনা প্রতি পদে! বরফের মধ্যে এখানে-ওখানে মাথা বের করে রয়েছে কালো কালো পাথর। ক্রমশঃ সব পাথরও ঢেকে গেল, শুধুই বরফের ওপর দিয়ে কিছুটা চড়াই উঠে, পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে। এখানের উচ্চতা প্রায় ১৫,৪০০ ফিট। চারিদিকে নরম দুধসাদা বরফ। দলপতি মন্ডলদা ও ধ্যানী আগেই পৌঁছে আমাদের ONGC Himalayan Association এর পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। একে একে আমরা সবাই সমবেত হলাম। এতদিনের পরিশ্রম আজ সার্থকতা পেল। উজ্জ্বল হাসিতে দেওটিব্বা শিখর যেন তারই স্বীকৃতি জানাচ্ছে! তাকে সেলাম জানিয়ে, এবং প্রথামাফিক পূজার পর্ব সেরে, রওনা দিলাম ফেরার পথে। মনে এক মিশ্র অনুভূতি – গন্তব্যে ঠিকমত পৌঁছানোর আনন্দ, আবার ভারাক্রান্ত এই ভেবে যে, এই তো সেদিন এলাম, এরই মধ্যে এসে গেল ফেরার পালা? আবার সেই শহর, সেই গতানুগতিকের জীবনযাত্রা – অপেক্ষায় থাকতে হবে, কবে আবার নতুন কোনো অভিযানের পরিকল্পনা হবে, কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ডাক পাঠাবে দেবতাত্মা হিমালয়!
পল্লীকল্যাণ
গার্লস হাই স্কুল
সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়
গল্প
“ম্যাডাম ভালো আছেন?” অচেনা ফোন কল। কন্ঠও খুব পরিচিত নয়।
“কে বলছেন?”
“ম্যাডাম আমি সোহাগ। ২০১৩ র ব্যাচ। অযোধ্যা পাহাড়ে ফিল্ডওয়ার্ক। চিনতে পারছেন?”
নামটা চেনা ঠেকলেও মুখটা ঠিক মনে করতে পারলো না বিহু। এত বছরের অধ্যাপনার জীবনে কত ছাত্রছাত্রী তার সান্নিধ্যে এসেছে। তাদের কারও নাম মনে আছে, কারও চেহারার গড়ন, কারও সুমধুর কন্ঠ আবার কারও বুদ্ধিদীপ্ত দুষ্টুমি।
“ও ম্যাডাম শুক্রবার আপনি বাড়িতে থাকবেন?”
“শুক্রবার? কলেজ…..”
“আমি এক্কেবারে ভোরবেলা পৌঁছে যাবো। আমাকে দশটা মিনিট সময় দেবেন।”
এমন নাছোড়বান্দা পুরোনো ছাত্রীকে কি কি করেই বা ফেরায়? ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায় বিহু। শুক্রবার - ৫ সেপ্টেম্বর।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়েই দরজা খুলল বিহু। আজ খুব ধমক দেবে রান্নার মাসিকে। রোজ কিছু না কিছু ভুল ওর লেগেই আছে। গম্ভীর মুখে দরজা খুলতেই সোহাগের মুখোমুখি। সঙ্গে একজন লম্বা চওড়া ভদ্রলোক।
“ম্যাডাম, ও আদর, আমার বন্ধু।”
বচ্ছরকার দিনে পুরোনো ছাত্রীকে দেখে মনটা ভরে গেল বিহুর।
“বলো কেমন আছো, কি করছ এখন?”
সোহাগ ব্যাগ থেকে একখানা কাগজ বের করল। বিহুর হাতে দিয়ে প্রণাম করল ঢিপ করে। দু চোখ ভর্তি জল।
“ম্যাডাম আপনি উৎসাহ না দিলে চাকরিটা আমি পেতাম না।”
বিহু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে। পল্লীকল্যাণ গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছে সোহাগ। বাধ্যতামূলক হলেও ফিল্ডওয়ার্কের অনুমতি দিতে প্রবল আপত্তি ছিল সোহাগের বাবার। কারণটা মূলত: অর্থনৈতিক। বিহু ওনাকে বুঝিয়েছিল আপনি সুযোগ না দিলে ও নিজেকে কি করে প্রমাণ করবে? আজ সে কথার মান রেখেছে সোহাগ। ওর এই নিয়োগপত্র বিহুর ৫ সেপ্টেম্বরের সেরা উপহার। একরাশ পুরোনো স্মৃতি উসকে দিয়ে চলে গেল সোহাগ আর আদর। পল্লীকল্যাণ গার্লস হাইস্কুলের নামটা খুব চেনা লাগে বিহুর। কোথায় যে শুনেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
প্রায় বছর আষ্টেক হলো পুরোনো কলেজ ছেড়ে নতুন কলেজে যোগ দিয়েছে বিহু। কলেজটা ছেড়েছে বটে কিন্তু ভুলতে পারেনি ওই কলেজের অনেক কিছুই। প্রতিদিনের লম্বা ট্রেন সফর। শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে। রেললাইনের দুধারের বাড়িগুলো ধীরে ধীরে কেমন হারিয়ে যেতো সবুজ ধানক্ষেতের সীমানার আড়ালে। কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া লম্বা রাস্তায় সাইকেল ভ্যানে চড়ে গুটিসুটি মেরে যাওয়া। ভুলতে পারেনি সেই সরল সাবলীল মুখগুলো যারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো বিহুর দিকে। বিহু তখন টগবগে ছুটন্ত ঘোড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী হিসাবে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে এসে চাকরি পেয়েছে মফস্বলের কলেজে। তনুমনপ্রাণ উজাড় করে দিতে চায় ছাত্রীদের কাছে। জনপ্রিয় অধ্যাপক হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শুধু জনপ্রিয়ই নয় ছাত্রীরা রীতিমতো তাদের পরিবারের একজন ভেবে নিয়েছিল বিহুকে। ফেসবুকের কল্যাণে আজও তাদের বুকে অমলিন হয়ে আছে বিহু।
“ও দিদি তোমার ফোনটা কতক্ষণ ধরে বাজতিছে …..” চেঁচিয়ে উঠল বিহুর রান্নার মাসি।
সাতসকালে কে ফোন করে রে বাবা। এই আহাম্মক গুলোর কোনও সময়জ্ঞান নেই। যখন তখন ফোন করলেই হোল…. গজগজ করতে করতে ফোনের কাছে এলো বিহু। মহিমাদির ফোন। বাবা এ তো প্রয়োজন ছাড়া কারও মরা বাঁচার খবরও রাখেনা।
“কেমন আছিস সোনা বোনু?” আদিখ্যেতার বহর দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায় বিহুর।
“এই চলে যাচ্ছে। বলো কি খবর!”
“শোন না আমার একটা উপকার করতে হবে”
এ আর নতুন কথা কি! তোমার মত ধান্দাবাজরা দরকার ছাড়া এত মিষ্টি কথা বলে?
“বলো”
“রন্টি ব্যাঙ্গালোরে একটা কলেজে দরখাস্ত করবে। কয়েকটা জায়গা বুঝতে পারছে না। আসলে বিহুমানিকে না দেখালে তো ঠিক ভরসা পায় না….. “
নিজে যেমন ধান্দাবাজ, ছেলেটাকেও সেভাবেই তৈরী করেছে।
“পাঠিয়ে দিতে বলো দেখে দেবো”
ফোনটা রেখে দিল বিহু। সাতসকালে মহিমাদির সাথে বাজে বকতে একদম ভালো লাগছেনা। যখনই কিছু দরকার থাকবে একবারে মধু ঝরবে গলা দিয়ে। আজ ছেলের দরখাস্ত, কাল নিজে কোথায় বক্তৃতা দেবে, পরশু বরের অফিসের চিঠির উত্তর।….. ডিসগাস্টিং।
কলেজে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। আলোচনার থেকেও বেশি জমে উঠেছে কর্তাব্যক্তিদের মজলিশ। মুহূর্তের মধ্যে চেতলা থেকে চিলি চলে যাচ্ছে কথার ভোজবাজিতে। বিহুর মেসেঞ্জারে শব্দ হলো - টুং। সোহাগ লিখেছে- “ভালো আছেন ম্যাডাম! রাতে একবার ফোন করব, একটু কথা আছে”। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কত কষ্ট করে কলেজে আসতো এই সোহাগ। কি মিষ্টি ব্যবহার। এখনও কত সম্মান দিয়ে কথা বলে নিজের শিক্ষিকার সঙ্গে। এখনকার প্রজন্মের সাথে কোনও মিলই নেই। বিহুর কানে বাজে উগ্র ছাত্রছাত্রীদের সেই রগরগে ভাষা- “আমাদের দাবি মানতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে”।
“ম্যাডাম আগামী রবিবার আমার মেয়ের অন্নপ্রাশন। আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করতে আপনাকে আসতেই হবে ম্যাডাম।”
রবিবার, ড্রাইভারের সমস্যা অনেক কিছু বলার চেষ্টা করল বিহু কিন্তু কোনও ওজর-আপত্তিই ধোপে টিকলো না। সোহাগ আর আদর দুজনেই নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে কথা দিতে হলো। আবার মনে উঁকি দিল সেই পল্লীকল্যাণ গার্লস হাইস্কুল। কোথায় যে শুনেছে নামটা!! সোহাগের আন্তরিক আতিথেয়তা আর পরিবারের সকলের অমায়িক ব্যবহার মন ছুঁয়ে যায় বিহুর। অধ্যাপনার এই চাকরিটা কত কিই না দিয়েছে। অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। ভিড় বেশ জমে উঠেছে। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে এসেছে সোহাগ। ম্যাডামের আশীর্বাদ নিতে। সুন্দর গোলগাল চেহারার শিশুটিকে দেখে ওর মায়ের দুষ্টুমির কথা মনে পড়ে যায় বিহুর।
“বৌদি, তোমার স্কুল থেকে সবাই এসে গেছেন, বড়দিও এসেছেন” একদিকে স্কুলের বড়দি আর এক দিকে ম্যাডাম, সোহাগের যেন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। মেয়েটাকে বিহুর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে রেখে দৌড়লো সোহাগ। “ম্যাডাম, এরা সবাই আমার সহকর্মী, আর ইনি বড়দি”
সোহাগের চোখে মুখে ঊর্ধ্বতনের প্রতি সলজ্জ শ্রদ্ধা। সত্যি কি ভালো মানুষ তৈরী হয়েছে সোহাগ। হাতজোড় করে এগিয়ে আসছেন বড়দি। কাছে আসতেই হতবাক বিহু। আরে! এতো মহিমাদি! এইবার মনে পড়েছে। মহিমাদির কাছেই তো শুনেছিল ওই পল্লীকল্যাণ গার্লস হাইস্কুলের নাম। সে বড়দি হয়েছে বুঝি! বিহু তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, মহিমা এড়িয়ে গেল। একটু অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিল বিহু। আদর্শদাও চট করে মিশে গেলো ভিড়ের
মধ্যে। সোহাগ বেশ আড়ষ্ট। বড়দি বলে কথা। একটু চোখের আড়াল হলেই কথার ঝাঁপি খুলে বসছে ম্যাডামের কাছে। ম্যাডাম যেন ওর প্রাণের বন্ধু, আত্মার আত্মীয়।
বিহু যখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সংগ্রাম করছে, তখন একবার বেড়াতে গেছিল সবাই মিলে। মহিমা তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। বৌ স্কুল শিক্ষিকা বলে আদর্শদার মাটিতে পা পড়ে না। পারলে বৌ এর পা ধুয়ে জল খায়। বিহুর মনে তখন চূড়ান্ত দোলাচল। এতদিনের কঠিন সংগ্রাম সফল হবে তো! মহিমাদি তো কি সুন্দর একটা চাকরি পেয়ে গেল। বিহুর মনে পড়ে যায় মহিমাদির সেদিনের তাচ্ছিল্য… “আমার কপালে কপালটা ঘষে নে, তোরও চাকরি হয়ে যাবে।” নিজের কপালে হাত ঠেকায় বিহু। ভাগ্যিস ঘষেনি সেদিন!
ক'দিন ধরে বেজায় গরম পড়েছে। জানলার বাইরে তাকালেই মনে হচ্ছে সর্বগ্রাসী আগুন সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ছুটির দিনের দুপুরটা কাটতেই চায় না। টিভি খুললে ঝগড়া, কাগজে শুধু রাজনীতি আর দুর্নীতির খবর। কে কত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এই নিয়ে চলছে দড়ি টানাটানি। অলস দুপুরে নির্বাক টিভিটার দিকে তাকিয়ে আছে বিহু। হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায় বেরিয়েছে সরকারী নিয়োগ দুর্নীতির বিরূদ্ধে। গরমের পারদ আরও চড়িয়ে দিয়েছে এই রায়। জব্বর এক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে ঝুলি থেকে। পচা আলু বাছতে না পেরে গোটা আলুর ঝুড়িটাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন মহামান্য আদালত। দস্তুর মত পরিশ্রম করে, কঠিন প্রতিযোগিতায় সফল হওয়া শিক্ষক আর নেতাদের নজরানা দিয়ে চাকরি পাওয়া ফেলুর দল উঠে পড়েছে একই নৌকায়। তাদের কেউ কেউ আবার ঘটি বাটি বিক্রি করে চাকরি কেনার জন্য সকলের সহানুভূতি চায়। সমাজের এই জঘন্য কীটের দল বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যায়। আর তাদের চন্দ্রযান হিসাবে ঝুলি পেতে দাঁড়িয়ে থাকে একদল ফোড়ে। টাকার পাহাড়ের উপর বসে আয়েশ করে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী। এত টাকা, যে খরচ করার জায়গা মেলে না, রেখে দিতে হয় বস্তাবন্দি করে।
সমস্ত চ্যানেলে চলছে বিচারকের বিচার। হাজার হাজার শিক্ষক এক ধাক্কায় পথে বসেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাওয়া চাকরিটা তাদের আর নেই। কলমের এক আঁচড়ে সরকারী স্কুলের শিক্ষক থেকে তারা হয়ে গিয়েছে দুর্বিনীত অপরাধী। মাথার ছাদ, পেটের ভাত, মানসম্মান সবকিছু খুইয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েছে ওরা। মধ্যগগনের সূর্য যখন লাভা বর্ষণ করছে, সেইদিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে হাজার হাজার সূর্যমুখী। ওদের তো সূর্যের দিকে তাকাতেই হবে, ওদের পেটে যে খিদের জ্বালা।
খুব নীচু গলায় সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে এক চাকরিহারা। সংসারের সব দায়িত্ব সামলে আবার চাকরির পরীক্ষা দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। বিহুর চোখ আটকে যায় টিভির পর্দায়। এ তো সোহাগ! সোহাগের জীবনের লড়াইয়ের প্রতিটা অধ্যায় জানে বিহু। কি কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রক্ষণশীল পরিবার থেকে উঠে এসেছে মেয়েটা। ওর চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কোনও সংশয় থাকতেই পারে না। শুধু সোহাগ আর আদর নয় এমন হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে পিংপং খেলছে গণতন্ত্র। ক্ষয়ে যাওয়া কালো দাঁত খিঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে নরখাদকের দল - তোমরা যোগ্য না অযোগ্য? সব হারানো মানুষগুলোর আর্তনাদ তাদের কানে পৌঁছয় না। একেবারে অতর্কিতে হ্যাভ থেকে হ্যাভ নট হয়ে যাওয়া একদল মানুষের কান্নার রোল আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে। নরখাদকের দল তখনও অবিচল থাকে।
নিজেকে বড় অসহায় লাগে বিহুর। এই দিন দেখার জন্যই কি সোহাগের মত শত শত ছাত্রছাত্রীকে উৎসাহ দেয় তার মত শিক্ষকরা! যোগ্য আর অযোগ্যর মধ্যে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকাই আজ তাদের নিয়তির লিখন। পথ হারিয়েছে প্রতিবাদ, ক্ষমতা হারিয়েছে প্রতিরোধ, অস্তিত্ব হারিয়েছে প্রতিশ্রুতি। টিভিটা বন্ধ করে বিহু। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। কিই বা করার আছে! সমবেদনা? নি:স্ব হয়ে যাওয়া হাজার হাজার সোহাগের কাছে তার কি কোনও মূল্য আছে? চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোহাগের ছোট্ট মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ। কি হবে ওর ভবিষ্যৎ? কি পরিচয়ে বাঁচবে ও? চাকরিহারা দম্পতির একমাত্র কন্যা?
পল্লীকল্যাণ গার্লস হাইস্কুল শতবর্ষে পা রাখল। এলাকার অন্যতম বিখ্যাত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে আমন্ত্রণ পেয়েছে বিহু। গোটা স্কুলের চত্বরটা ফুল আর আলপনা দিয়ে সাজিয়েছে স্কুলের মেয়েরা। প্রবল আনন্দের মধ্যেও কোথায় যেন বিষাদের সুর বাজছে। বিসমিল্লার সানাইতে আজ কন্যাবিদায়ের সুর। আপ্যায়নের প্রথম পর্বে বড়দির ঘরে বসেছে বিহু। কেমন গজগামিনীর মত চেয়ার জুড়ে বসে আছে মহিমাদি। চারিদিকে সবাই তটস্থ। পান থেকে চুন খসলেই বড়দির কড়া চোখের দাওয়াই। বিহুর মনে পড়ে যায়। এই তো সেদিন! স্কুলের প্রয়োজনে একটা দরখাস্ত লিখতে হলেও বিহুর দ্বারস্থ হতো মহিমাদি। মহিমাদিকে একটা ইংরাজি বাক্য সঠিক লিখতে কেউ কখনও দেখেনি। স্কুলের মিড ডে মিলের হিসাব থেকে ম্যানেজিং কমিটির কড়া প্রশ্নের জবাব সবকিছুতেই ঠেকনা দিয়ে গিয়েছে বিহু। স্কুলে কোনদিন পা না রেখেও এই স্কুলের অনেকের সঙ্গে বিহুর পরিচয়। আর তা শুধু মহিমাদির মানরক্ষার তাগিদে। মহিমাদিকে ছোটবেলা থেকেই কখনও খুব মেধাবী বা সম্ভাবনাময় মনে হয়নি বিহুর। মহিমাদির একমাত্র যোগ্যতা সে আদর্শদার স্ত্রী আর সম্পদ ওই চকচকে কপালটা।
মহিমাদির চাকরি পাওয়াটা অনেকটা নাকের বদলে নরুণের মতো। আদর্শদার মত হাজার হাজার হোলটাইমারের সময় আর মেহনতের পারিশ্রমিক হিসাবে স্ত্রী বা স্বামীকে একটা চাকরি পাইয়ে দেওয়াটা ছিল সে সময়ের দস্তুর। তখন না ছিল কমিশন, না ছিল যোগ্যতার বিচার। মহিমাদি যে কপালটা বিহুর সাথে ঘষতে চেয়েছিল, সে কপালে কখনও অনিশ্চয়তার ভাঁজ পড়েনি। ওরা যে দলের বেনিফিশিয়ারি। মহিমাদি তখন বি এড পড়ছে। এমনই কপাল, প্র্যাকটিস টিচিংটা পড়েছিল বিহুর স্কুলে। ছাত্রীর বেঞ্চে বসে খুব কাছ থেকে মহিমাদির পড়ানোর গুণপনা দেখেছিল বিহু। আহা কি চমৎকার রিডিং! কোথায় থামতে হয় সেটুকু বিদ্যেও ছিলনা সেই হবু শিক্ষিকার। পড়ানোর গুণে নুন দেওয়ার জায়গা না থাকলেও শুধুমাত্র আদর্শদার স্ত্রী হওয়ার সুবাদে পল্লীকল্যাণ গার্লস হাইস্কুলে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল মহিমাদিকে। আজ সে স্কুলের কর্ণধার।
আচ্ছা মহিমাদি? আমার ড্রাফট করে দেওয়া সমস্ত চিঠিগুলো কি সেভ করে রেখেছ তোমার কম্পিউটারে? সময়মতো কাজে লাগাও একটার পর একটা? ম্যানেজিং কমিটির কড়া চিঠির যে উত্তর তোমায় সেদিন উদ্ধার করেছিল তাকে কি গুটিয়ে রেখেছ তোমার আস্তিনে? খুব জানতে ইচ্ছে করে বিহুর।
অনুষ্ঠান মঞ্চে মহিমাদির ভূয়সী প্রশংসা করছে সহকর্মীরা। এই পল্লীকল্যাণ গার্লস হাই স্কুলের জন্য কতো কি করেছেন উনি। সত্যি মহিমাদি, আজ তোমার কপালে কপালটা ঘষেই নিই। কি বলো? তুমি তখন প্রবীন শিক্ষিকা, শিক্ষক সংগঠনের লড়াকু নেত্রী। স্কুলের টিউবওয়েল থেকে মেয়েদের টয়লেট, সহকর্মীর ইনক্রিমেন্ট থেকে নতুন পোস্টে লোক চাওয়া, সমস্তরকম দরখাস্ত তুমি আমাকে দিয়ে লিখিয়েছ। মনে পড়ে মহিমাদি? এতগুলো বছর ধরে হাজার হাজার ছাত্রীর কাছে আড়াল করে রেখেছ সব। আরও কতো? আজ যদি এই সবহারানো ছেলেমেয়ে গুলোর সঙ্গে তোমায় সেঁকা হত বঞ্চনার গনগনে আঁচে! তুমি কোন দলে পড়তে মহিমাদি! যোগ্য? চূড়ান্ত অযোগ্য? আ বিগ জিরো? নাকি ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকতে সেই দলের প্রতিনিধি হয়ে যারা সাম্যবাদের নামে বিনিময় প্রথা চালিয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর? মাখনের ছুরিতে ফালাফালা হয়ে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ যোগ্য মানুষ। উত্তরটা বোধহয় তোমার ঠিক জানা নেই।
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.