জুলাই ২০২১
লেখক ও লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
ডাঃ উজ্জ্বল মিশ্র
আসানসোল, পঃ বাংলা
উপোসী আগুন
বালিশে গুঁজেছে মুখ উপোসী আগুন,
রূপসী চাঁদের আলো বিছানা ভাসায়।
কথা যে রাখে নি জানে ব্যর্থ ফাগুন,
তবু নিত্য আয়োজন মিথ্যে আশায়।
নিত্য যে দহনজ্বালা শরীরে ও মনে,
অব্যক্ত ব্যথার বিষ অন্তঃপুরময়।
রাতের চাদর ঢেকে অতি সংগোপনে
নিজেকে উজাড় করে নগ্ন সময়।
লক্ষ প্রতীক্ষার পরে উপেক্ষার জ্বালা
বুকময় দাগ নিয়ে চন্দ্রমাও জানে।
বালিশে মুখ গুঁজে যতো অবহেলা
চাদরে কুঁকড়ে খোঁজে জীবনের মানে।
কতদিন বাঁচতে ভুলেছো
কতোদিন মাখো নি গায়ে যুবতী চাঁদের থেকে
চুঁইয়ে পড়া লুটোপুটি আলো।
শ্রাবণের রিমঝিম গানে মাতোয়ারা
বেহিসেবি উচ্ছ্বাসে
কতদিন মাতো নি বলো
অবিরাম বরিষণ স্নানে।
বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসে ঘাসে
সঞ্চিত বিন্দু বিন্দু হিমেল শিশিরে
কতদিন ভেজাও নি পা,
পৌষের কোনো এক ভোরে।
কতদিন হয় নি দেখা
কুয়াশার জাল ছিঁড়ে
কমলা সূর্যোদয় নদীর ওপারে।
অকারণ পুলকে কতদিন
গলা ছেড়ে হয় নি গাওয়া গান,
অরণ্যে পাহাড়ে রহস্যময়
নীরবতা খান খান ভেঙে।
জ্যোৎস্না রাতে মাঝ গাঙে
হাল ছেড়ে নৌকায় পাল তুলে
নিরুদ্বেগ ভেসে থাকা
হয় নি কতদিন।
কতদিন কারণে অকারণে
হাসতে ভুলেছো প্রাণ খুলে।
যতো কাজ পিছুটান
সব কিছু ভুলে অখণ্ড অলসতায়
ঠাঁই বসে বসে দেখা
গাছেদের ডালে ডালে পাতায় পাতায়
জানা অজানা পাখিদের নাচ
ভুলে গেছো কতদিন।
কতদিন কত যুগ
বুক ভরে বাঁচতে ভুলেছো।
কেমন হতো
কেমন হতো হঠাৎ যদি
হারিয়ে যেতাম
ভোঁকাট্টা ঘুড়ির মতো।
বন্ধ দুয়ার দরাজ খুলে
সটান পা বাড়িয়ে দিতাম
নিরুদ্দেশে, ঠুনকো যতো
মান অভিমান, মিথ্যে মায়া,
সব পিছুটান পেছনে ফেলে।
কেমন হতো হঠাৎ যদি
চেনা পাড়া, চেনা বাড়ি,
যতো চেনা গণ্ডিগুলো
বিস্মরণের খামে ভরে
উড়িয়ে দিতাম।
কিম্বা যদি হঠাৎ করে
চেনা সুর, চেনা মুখ,
চেনা চেনা সুখ ও দুখ
চেনা যতো গল্পকথার
নটে গাছটি মুড়িয়ে দিতাম।
ফুরিয়ে যেতো নিত্যদিনের মিথ্যে নাটক।
মিথ্যে যতো কান্না হাসি,
মেকি উৎসব সাঙ্গ হতো।
কেমন হতো হঠাৎ যদি দমবন্ধ
বৃত্তটাকে ছাড়িয়ে যেতাম।
কেমন হতো সত্যি যদি
নিরুদ্দেশেই হারিয়ে যেতাম।
কবিতা
সৃজিতা ধর
মুখোশ সরলেই...
মুখোশ শব্দের অর্থ হল মুখ লুকিয়ে রাখার জন্য কৃত্রিম মুখ। আমরা জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই 'নকল' মুখের ব্যবহার করি, বা বলা ভালো ব্যবহারের দরকার হয়।
এই করোনা কালে বাড়িতে থাকার জন্য আরও বেশী মুখোশের দরকার হয়ে পড়েছে।
সত্যি বলতে কি, করোনা না হলে হয়তো জানতেই পারতাম না পরিবারের মানুষগুলোর কৃত্রিম আর আসল চেহারার পার্থক্য। একটানা প্রায় ৬ মাস এভাবে বাড়িতে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
একদম প্রথম দিন মনে হয়েছিল, বাড়ির কাছের মানুষগুলোর সাথে সবসময় লেগে থাকতে পারবো।
আড্ডা দিতে পারবো।
একসাথে খাবার টেবিলে বসে এঁটো হাতে বাজার,
রাজনীতি নিয়ে দারুণ জমজমাট আসর বসাতে পারবো।
কিন্তু, না- খুব ভুল ছিলাম।
আসলে সবাই সবার কৃত্রিম মুখগুলোকেই চিনতাম,
করোনা আসল মুখগুলো সামনে নিয়ে এলো।
নাহ্, এতটা ধাক্কা বোধহয় নিজের ব্রেকআপের সময়ও পায়নি।
বুঝতে পারলাম নিজের মানুষগুলোর আসল মানসিকতা।
আর ঠিক তখনই আবার দরকার পড়লো 'মুখোশ' এর।
করোনা হয়তো বাড়ির বাইরে চলার পথে মাস্ক পড়তে শিখিয়েছে, কিন্তু ঘরের মানুষের স্বার্থপরতার মুখোশ টেনে খুলে দিয়েছে।
সত্যিই হয়তো এতটা 'আসল' চেহারা দেখতে হবে কোনোদিন মাথায় আসেনি।
আজ ভীষণভাবে মনে হচ্ছে,
মুখোশ সরলেই যদি কাছের মানুষগুলোর কদর্য চেহারা দেখতে হয়,
তবে আমি সারাজীবন মাস্ক পড়তে রাজি।
প্রবন্ধ - কল্পবিজ্ঞান
সাল ২০২৫, সময় সন্ধ্যা ৭ টা, কলকাতা শহর। একটা ওভাল শেপের ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে আসছেন প্রফেসার চক্রবর্তী। চোখে মুখে আলোর দ্যুতি। আজ তিনি নিজের ফ্ল্যাটের মুখার্জীবাবুকে যে রোবট চাকরটা দিয়েছেন ল্যাব থেকে তার মাথাতে একটা থট রিডার প্রোগ্রামিং আর কিছু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পুরে দিয়েছেন সবার অজান্তে। এটা তার নিজস্ব গবেষণা লব্ধ অ্য়াল্গোরিদিম। তাই তিনি আজ খুব এক্সাইটেড। ষাট ঊর্ধ্ব মুখার্জীবাবুর বাড়িতে তিনি আর তার গিন্নি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, সে ও কাছেরই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। পাঁচ বছরের নাতনী প্রায় প্রতিদিনই দাদু দিদার সাথে খেলতে আসে। এখন কাজের লোকের যা ডিম্যান্ড, গ্রাচুইটি, পেনশনের টাকা দিতে হবে, তারপর হাতে গোনা কাজ, সবদিক ভেবে চিন্তে মুখার্জীবাবু ২৪ ঘণ্টার রোবট চাকরই নেওয়া ঠিক করলেন। শুধু দিনে ১ ঘন্টা চার্জ দিলেই হবে আর কোনো হ্যাপা নেই। আর পড়শি চক্রবর্তীবাবু জ্ঞানী মানুষ, আর ওনার দৌলতে ২% ডিসকাউন্ট ও পাওয়া গেল। এতদিনে গিন্নির সব সমস্যার সমাধান হবে।
মুখার্জীবাবুর রোবট চাকরের নাম হল অনুপম। ভালো করে চার্জ দিয়ে মুখার্জীবাবু চালু করলেন অনুপমকে। অনুপম - বাবা একটু চা করে আন তো। অনুপম জিজ্ঞেস করল বাবার অ্যাড্রেসটা দেবেন। মুখার্জীবাবু ঢোক গিলে বললেন মানে আমাকে এক কাপ চা করে খাওয়াতে বলছিলাম। অনুপম রান্নাঘরে চলে গেল, সে নিজেই লোকেশন ডিটেক্ট করতে পারে, ইনগ্রেডিয়েন্ট ও নিয়ে নিল। চা এর সসপ্য়ান এ হাত দিয়ে খানিক হিস্ট্রি রিড করে নিল অনুপম কত কাপ জলে কত কাপ চিনি আর চা আর দুধ দিয়ে করা হয় চা। দেখল চিনি দেওয়া হয় না চা তে, আবার মাঝে মধ্যে আদা পড়ে। অনুপম খানিক ডেটা অ্য়ানালিসিস করে চা বানিয়ে আনল। গিন্নি এখন বাড়ি নেই, অনুপম সুন্দর আদা এলাচ দিয়ে চা বানিয়ে দিয়েছে গিন্নির মতই প্রায়। মুখার্জীবাবু পুরো দিলখুস। গিন্নি বাড়ি নেই, এলে খুশি করে দেবার ব্যবস্থা করতে অনুপমকে বললেন - ঘরদোরগুলো গুছিয়ে
রাখো তো বাপু। অনুপম চট করে তাকে বাপুজি রচনা শুনিয়ে দিল। মুখার্জীবাবু তো থ। না মানে বলছি কি ঘরটা একটু গুছিয়ে ফেলো। অনুপম আধ ঘন্টা পরে ঘর একদম গিন্নি যেখানে যা রাখে ফিটফাট হয়ে গেল। অনুপমকে বলে রাখলেন, গিন্নি ফিরলেই যেন চা করে দেওয়া হয়। খানিক পরে ডিং ডং, গিন্নি ফিরলেন। দেখো নিউ ইয়ারে তোমার গিফট, তোমার সব কাজ একদম তোমার মতো করে করে দবে অনুপম. দেখো কেমন ঘর গুছিয়েছে।গিন্নি হুম বলে দুম দুম করে পা ফেলে বাথরুমে ঢুকলেন, বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনুপমের হাতের এককাপ চা খেতে খেতে গিন্নির মুখে কালো মেঘ দেখা দিল। অনুপমের থার্ড আই তাকে এলার্ট দিল গিন্নিমা তার মত কাজ করতে পারাটা ভালো মনে নিচ্ছেন না।রাতের খাবারে তরকারিতে নুন সামান্য কম হল, ভাতটা ও একটু বেশি গলা হল. গিন্নি ঘোষণা করলেন কাল থেকে তিনি অনুপমকে রান্না শিখিয়ে দেবেন। পরের দিন থেকে অনুপম মুখার্জী গিন্নির ন্য়াওটা হয়ে উঠল। গিন্নি মনে কিছু ভাবলেই অনুপমের থট রিডারে তা ধরে নিয়ে অনুপম সুন্দর ব্যবস্থা করে আর মুখার্জী গিন্নির ভোকাবুলারি ও কদিনেই রপ্ত করে নিল অনুপম বেশ চলছিল দিন কিন্তু গোল বাঁধালো ওই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অ্য়ালগোরিদিম। অনুপম আস্তে আস্তে মুখার্জী গিন্নির মায়া মমতা আর ভালোবাসার অনুভূতি নিজের মধ্যে রেপ্লিকেট করে নিল।ফলে মুখার্জীবাবুর শরীর খারাপ হলে অনুপমের ও একই রকম মন খারাপ হতে লাগল এবং অনুপম শুকনো মুখে মেয়েদের তো অভিমানী পায়ে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগল এবং সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরের কাছে কষে প্রেয়ার করল। যদি ও অনুপমের শরীরে হরমোনের কোনো প্রভাব থাকা সম্ভব নয় কিন্তু তা ও অনুপমের একটা মন জন্ম নিল, আর তার ঠেলায় মুখার্জী দম্পতি নাস্তানাবুত। তার থেকে ও মুশকিল যেটা হল দেখতে ছেলেদের মত রোবট অনুপম মনে মনে মেয়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষমেশ মুখার্জীবাবু অনুপমকে ল্যাব এ ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। প্রফেসার চক্রবর্তী সব মন দিয়ে শুনে অনুপমকে ফিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন তার কাজ।
গল্প
বেগুনকোদার
রেলওয়ে স্টেশন
চন্দন চ্যাটার্জি
যদি ইন্টারনেটে পৃথিবীর দশটি ভুতুরে রেলওয়ে স্টেশনের নাম খোঁজ করা যায় তবে পুরুলিয়ার এই বেগুনকোদার রেলওয়ে স্টেশনের নাম অবশ্যই আসবে। এই স্টেশনটি পড়ে পুরুলিয়া জেলায়, ঝালদা এবং কোট শিতা স্টেশনের মাঝখানে। এটি একটি হল্ট স্টেশন, এখানে কোন এক্সপ্রেস গাড়ি থামে না। শুধু কিছু প্যাসেঞ্জার গাড়ি থামে।
একবার আমার এই স্টেশনে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটাই আমি এখন বলব।আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আভ্যন্তরীণ হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কাজ করতাম। এই কোম্পানির হেডঅফিস ছিল কলকাতায়, লেলিন সরণির কমলয়া সেন্টারে। সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে তার বাইশটি শাখা অফিস ছিল। এর মধ্যে একটি শাখা অফিস হল পুরুলিয়া শহরে। আমি অফিসের অডিটিং কাজের জন্য গিয়েছিলাম তখনই অভিজ্ঞতা হয়।
সেবার দূর্গাপুজো পড়েছিল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে, কাজেই দেওয়ালী পড়েছিল প্রায় নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। দেওয়ালীর ছুটি কাটিয়ে যখন অফিসে যাই তখন আমার এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন পুরুলিয়ার অফিস খোলা হয়েছে প্রায় ছয় মাস হল এখনো একবার অডিটিং হয়নি কাজেই ওখানে একবার আমার যাবার প্রয়োজন রয়েছে এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, আমার কাজটা শুধুমাত্র অডিটিং নয়, কিছুটা শাখার কর্মীদের প্রশিক্ষণ করতে হয় অর্থাৎ কিভাবে হিসাব রাখা উচিত, ক্যাশবুক কিভাবে লিখতে হয়, ভাউচার কিভাবে তৈরি করতে হয়, কিভাবে আপলোড করতে হয়, ভেরিফাই করতে হয়। এছাড়াও প্রতিদিন হেড অফিসে একটা রিপোর্ট পাঠাতে হয় এটা সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে হয়।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কলকাতা শহরে শীত অনুভূত না হলেও গ্রামে গঞ্জে এই সময় শীতের ভালো আমেজ পাওয়া যায় আর পাহাড়ী এলাকা হলে তো কথাই নেই। বিকালের পর থেকেই শীতের পোশাক জরুরী হয়ে যায়। আমি ২৫শে নভেম্বর হাওড়া থেকে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই, পাঁশকুড়া, খড়গপুর, টাটানগর, হয়ে পুরুলিয়া যেতে হয়। ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছাড়লো সকাল ১০.১৫ মিনিটে। যখন টাটানগর পৌঁছল তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। শীতকালে গ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় বিকেলের পরেই ধোয়াগুলো একটা মেঘের মতো আকার নিয়ে মাটি থেকে কিছুটা উপরে থেকে এক সরলরেখায় অবস্থান করে, সূর্যের আলো কমতে কমতে একসময় অন্ধকার নেমে আসে। নভেম্বর মাসে দিন রাতের ফারাক বিস্তর। এখন দিনের তুলনায় রাত অনেক বেশি। ট্রেন যখন ঝালদা স্টেশন পাস করল তখন রাত্রি সাড়ে আটটা। যেহেতু এক্সপ্রেস ট্রেন তাই এই স্টেশনে থামে না, এর প্রায় ৩ মিনিট পর আমি দেখলাম ট্রেনটি বেগুনকোদর স্টেশন ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আমি ছিলাম শীততাপ কন্টোল্ড কামরায়। এটা ইঞ্জিন থেকে চারটি কামরা পিছনে। আমার মনে হয় ট্রেনের শেষ কামরাটি বেগুনকোদর স্টেশন ছাড়িয়েছে এমন সময় ট্রেনের গতি কমতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল। পরের স্টেশন কোটশিতা প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে, সবাই ভাবল সিগনাল নেই তাই দাঁড়িয়েছে।
এইভাবে প্রায় ৪/৫ মিনিট কাটলো, আমি জানালা দিয়ে দেখলাম দূরের সিগন্যাল কিন্তু সবুজ আছে অথচ গাড়ি যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি বোঝার জন্য আমি ট্রেনের দরজার কাছে এসে দেখতে লাগলাম। আমার মতই অনেকেই বিভিন্ন কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখছে। কেউ কেউ আবার ট্রেন থেকে নেবে প্রাকৃতিক কর্ম সারছে। আমিও নেবে একটু দূরে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম করার জন্য যখন প্যান্টের চেইন খুলেছি ঠিক তখনই হর্ন বাঁচিয়ে ট্রেন চালু হয়ে গেল আমিও যত সম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে প্যান্টের চেইন টানতে টানতে চলন্ত ট্রেনটাকে ধরবো বলে ছুটতে লাগালাম। যারা ট্রেন থেকে নেমে ছিল সবাই ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরে ফেলল। আমার শরীর কিছুটা স্থুল। তাই আমি বেশি জোরে দৌড়াতে পারলাম না। তবুও যতটা সম্ভব জোরে ছুটতে গিয়ে একটা বড় পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়লাম আর আমার সামনে দিয়ে ট্রেনটি সশব্দে চলে গেল। একটু পরে যখন ধাতস্থ হলাম তখন দেখলাম যারা ট্রেন থেকে নেবে ছিল তারা সবাই উঠে পড়েছে। কেবলমাত্র একজন আমার পিছন দিক থেকে রেল লাইন ধরে হেঁটে আসছে, অন্ধকারে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না তা হলেও বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক বয়স্ক, স্থূল শরীর, সুগার আছে, চাকুরীজীবী।
সুগার আছে, এটা প্রমাণ হয় এই বয়সে ও এই শরীরে কেউ স্টেশন ছাড়া নাবে না, আর চাকুরীজীবী কারণ শনিবারে এই সময় এইসব এক্সপ্রেস গাড়িতে সংরক্ষিত কামরায় সংরক্ষিত যাত্রী ছাড়াও অনেক অফিস ফেরত যাত্রী ওঠে। ভদ্রলোককে দেখে আমি একটু দাঁড়ালাম, পরে কাছে আসতে জিজ্ঞাসা করলাম আপনিও কি এই ট্রেনে আসছিলেন। ভদ্রলোক একটু গলা খ্যাঁকরে মোটা আওয়াজে উত্তর দিলেন আওয়াজে, “আজ্ঞে হ্যাঁ“
আমি বললাম, “আপনি কি পুরুলিয়া যাবেন?”
উত্তর এল, “আমার বাড়ি শিমুলতলা গ্রামে, পুরুলিয়া থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। এই প্রথম আমি লক্ষ্য করলাম তার আওয়াজ আসছে অনেক দূর থেকে যেন আওয়াজটা ভেসে ভেসে আসছে, অথচ তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার অদূরে।
একটু পরে ভদ্রলোক বললেন, “আপনাকে দেখে তো এখানকার লোক বলে মনে হচ্ছে না, তা আপনার আসা হচ্ছে কোথা থেকে?” আমি বললাম, “কলকাতা, যাব পুরুলিয়া”
ভদ্রলোক - “পুরুলিয়াতে কাউকে চেনেন?”
আমি - “ না, কিন্তু যে কোম্পানিতে যাব তার ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে জানি। সে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে, এই গাড়িতে যাব বলেছিলাম”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আপনি আমার সঙ্গে স্টেশনে চলুন মাঝরাতে একটা গাড়ি আছে সেটা যদি থামে তাহলে পুরুলিয়া পৌঁছাতে পারবেন”।
অন্য কোন উপায় না দেখে আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে বেগুনকোদর স্টেশনের দিকে চললাম। স্টেশনের কাছাকাছি আসতে অল্প আলোয় ওকে দেখলাম একটা মোটা চাদর আপাদ-মস্তক ঢাকা, মাথায় হনুমান টুপি, চোখের পুরু ফ্রেমের চশমা ও মোটা কাচ, হাতে দস্তানা, পায়ের মোজা ও রাবারের জুতো তাই চলার সময় কোন আওয়াজ হচ্ছে না।
স্টেশনে এসে দেখলাম একটা টিকিট কাউন্টার তাতে একজন লোক বসে ঝিমচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের দুদিকে দুটো লাইট জ্বলছে। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে একটা ফলকে তাতে হলদে ওপর কালো কালিতে লেখা আছে বেগুনকোদর হালট স্টেশন। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায়। সমুদ্রতল থেকে ৩৬০ মিটার উঁচুতে, দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ে রাঁচি ডিভিশন। এটা সবাই জানে স্টেশন কখনো বন্ধ হয় না, কারণ রাত্রির গাড়িকে সবুজ সংকেত দেখানোর জন্য একজন লোক থাকা অবশ্যই দরকার। ছোট ছোট স্টেশনে এক ব্যক্তি একাধিক কাজ করে থাকেন যেমন কাউন্টার সামলানো, সিগন্যাল দেওয়া, আবার প্রয়োজন হলে অফিস সাফাই ও করতে হয়। আমার মনে হয় এই স্টেশনের এই ব্যক্তিটি এই একই কাজ করে থাকে। প্লাটফর্মে একটা বসার জায়গা আছে, সেখানে আমাকে বসতে বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন ভেতর থেকে পরবর্তী ট্রেনের সময় জানতে। আমি যেখানটায় বসেছিলাম সেখান থেকে আবছা হলেও টিকিট কাউন্টার দেখা যাচ্ছিল। আমি দেখলাম ভদ্রলোক টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালো অথচ কাউন্টারের ভিতরের ভদ্রলোক যেমন ঝিমোচ্ছিল
তেমনি রইল, তাহলে কাউন্টারের ভদ্রলোক একবার মাথা তুলে কার সঙ্গে কথা বলছে সেটা দেখবার প্রয়োজন মনে করল না। একটু পরে আমার সাথী ভদ্রলোকটি এসে বলল, “পুরুলিয়া ইন্টারসিটি আসবে মাঝরাতের পর”।
আমি বললাম , “ইন্টারসিটি গভীর রাত্রি নয়”।
সে বলল, “ট্রেন লেট করেছে তাই রাত্রি পৌঁছাবে”
অগত্যা কি করা যায় আমি বসে রইলাম কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক বললেন, “একটু জল হবে ?”
আমি বললাম, “জল – খাবার সব আমার ব্যাগে ছিলো সেটা তো এখন আর পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না“।
ভদ্রলোক, “আপনার কি রিজার্ভেশন ছিল?”
আমি, “বি-৩, ২৮ সাইড লোয়ার”।
ভদ্রলোক, “আচ্ছা “
এরপর প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেছে, ইতিমধ্যে আমি প্ল্যাটফর্মের বাইরে গিয়ে একটু চা খেয়ে এসেছি মাত্র। ভদ্রলোক কোথাও দেখছিলাম না, বসে বসে ঝিমুনি ও এসেছে, এমন সময় একটা ঠান্ডা স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখলাম সেই ভদ্রলোকটি আমাকে ডাকছেন।
ভদ্রলোক, ”আপনার ব্যাগটি পাওয়া গেছে”
আমি , “কি করে?”
ভদ্রলোক, “আমার এক পরিচিত আপনার কামরায় সফর করছিল সে আপনাকে নামতে দেখে আপনার ব্যাগটি নিয়ে পুরুলিয়া স্টেশনে নেমেছিল, তার বাড়ি এই স্টেশনের উল্টোদিকেই, বাইরে আমার সঙ্গে দেখা হলো, কথায় কথায় আমি আপনার কথা বললাম তখন সে আপনার ব্যাগটি আমাকে দিয়ে চলে গেল”।
আমি মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম এবং এমন একটা সংযোগও যে হতে পারে সে বিষয়ে ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক বললো, “দেখুন আপনার গে সব ঠিকঠাক আছে তো“। আমি ব্যাগের চেইন খুলে দেখলাম আমার ল্যাপটপ, জলের বোতল, টিফিন, অফিসের কাগজপত্র ইত্যাদি সবই আছে।
আমি বললাম, “আপনি জল খাবেন বলেছিলেন”। এই বলে জলের বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক বললেন, “না দরকার নেই আমি বাইরে দোকান থেকে খেয়েছি”। রাত অনেক হয়েছে তাই আমি টিফিন বার করে খেয়ে, জল খেয়ে, আবার বসলাম। আমার একটু পানের নেশা আছে। রাত্রে খাবার পর খয়ের ছাড়া ১২০ জর্দা দিয়ে একটা পান দরকার হয়।
আমি বললাম, “আপনি বসুন আমি দেখি বাইরে একটা পান পাওয়া যায় কিনা”।
ভদ্রলোক বললেন, ”আমার কাছে আছে“ এই বলে একটা কাগজের মোড়ক আমার হাতে দিলেন। সেটা হাতে নিতে বুঝতে পারলাম এটা বরফের মত ঠান্ডা ।
আমি বললাম, “এত ঠান্ডা কেন?”।
উত্তর এলো, “এটা আমার পকেটে ছিল তাই“।
মনে মনে ভাবলাম পকেটে থাকলে তো গরম হওয়ার কথা, আর একটা কথা আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে যখন যেটা প্রয়োজন সবই এর কাছে আছে কেন, এই সব নানা কথা ভাবছি।
যাই হোক, আমি যে রকম পান খাই এটা ঠিক সেই রকমই। পানটি গালেপুরে চিবুতে চিবুতে তাকে একটা ধন্যবাদ জানালাম, এবং জিজ্ঞাসা করলাম, “দুঃখিত আপনার নামটা জানা হয়নি, আজ আপনি এত উপকার করলেন তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। বাই দি ওয়ে আমার নাম চন্দন চট্টোপাধ্যায়”।
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন তার নাম বিকাশ চক্রবর্তী। এরপরে বললেন, “একটা এক্সপ্রেস গাড়ি আসছে ডাউনে”।
আমি বললাম, “ ডাউন এর গাড়ি তো আমার লাগবে না যদি আপে হয় তো ভালো, তাও আবার যদি এখানে দাঁড়ায় তো“।
হ্যাঁ ঠিক বটে খানিকক্ষণ পরে সত্যিই একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলাম এবং অনেক দূরে ট্রেনের আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। ক্রমে আলোটা উজ্জ্বল হতে লাগলো, আবছা স্টেশন অনেকটা আলোকিত হতে লাগলো। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে লাইনের ধারে দেখতে গেলাম কি ট্রেন আসছে ।
আমাকে যেতে দেখে লোকটি উঠে দাঁড়ালো এবং কর্কশ আওয়াজে আদেশের সুরে বলল, “লাইনের ধারে যাবেন না মারা পড়বেন”।
“আমি কি ১০ বছরের শিশু যে মারা পড়বো, ট্রেনের হওয়া আমাকে টেনে নেবে“, এই কথা বলে আমি যেমনি আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম ট্রেনের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম ভদ্রলোকের মুখ বলে কিছুই নেই, শুধু দুটি জ্বলন্ত চোখ যেন আমাকে গিলে খেতে চাইছে। এইরকম দৃশ্য দেখার পর আমি একটা বিকট চিৎকার করে টিকিট কাউন্টারের দিকে ছুটলাম একটু দৌঁড়াতে একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা হাসপাতালে বেডে। একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে ডাক্তারবাবুকে বললাম, “আমি এখানে কি করে এলাম”।
তিনি বললেন, “বিকাশ চক্রবর্তী বলে কেউ আপনার পরিচিত আপনাকে লাইনের ধারে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে উঠিয়ে নিয়ে এসে এখানে ভর্তি করে দেয়। এখন কেমন বোধ করছেন”।
বললাম, “ভালো“
একটু পরে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। ট্রেন থেকে নামা, হোঁচট খাওয়া, এক ভদ্রলোক সঙ্গে পরিচয় হওয়া, আমার ব্যাগ ফিরে পাওয়া, পান খাওয়া, শেষে ডাউন ট্রেনের আলোতে এক জ্বলন্ত চোখ দেখা এবং জ্ঞান হারানো। আমি দেখলাম আমার ব্যাগটি মাথার কাছেই আছে। খানিক পরে ডাক্তারবাবু আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দিলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “একবার হাসপাতালের ভিজিটার বুকটা দেখতে পারি”।
ডাক্তারবাবু বললেন, “হ্যাঁ” এই বলে তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে রিসেপশনে ভিজিটর বুকটা দেখালেন। তাতে সই আছে বি. চক্রবর্তী।
হঠাৎ আমার মনে হলো হাসপাতালের লোক যদি তাকে দেখে থাকে, তাহলে হাসপাতালে সিসিটিভি ক্যামেরাতে নিশ্চয়ই তার ফটো উঠবে। আমি হাসপাতালে সুপারের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললাম এবং সিসিটিভি ক্যামেরা ক্লিপিংস দেখতে চাইলাম। তাতে দেখা গেল আমি স্ট্রেচারের উপর শুয়ে আছি, রিসেপশনিস্ট কথা বলছে, কিন্তু সামনে যে ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছে তাকে দেখা যাচ্ছে না। কলমটা যেন নিজে থেকে উঠে ভিজিটের বুকে সই করছে, আমার ব্যাগটা যেন শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা দেখে, হাসপাতালের সুপারও সিসিটিভি অপারেটর দুজনেরই জ্ঞান হারাবার অবস্থা।
প্রবন্ধ
‘মার খেয়েছি না হয় আরও খাব।
তাই বলে কি প্রেম দিব না?’
প্রেমধর্ম-রবীন্দ্র সাহিত্যে
ও চৈতন্য চরিতামৃতে
ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
শ্রীচৈতন্য বলেছেন কলিযুগে ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করা ছাড়া আর কোন ধর্ম নেই। এই দিব্য নাম হচ্ছে বৈদিক মন্ত্রের সার।
চৈতন্যদেব প্রবর্তিত নাম কীর্তনের কথা বলতে গেলে যেমন আসে, -
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”
তেমনি রবীন্দ্রনাথের ভাবনাতেও নামের মাহাত্ম্য স্বীকৃতি পেয়েছে, -
“তোমারি নাম বলব নানা ছলে,
বলব একা বসে আপন মনের ছায়াতলে॥
বলব বিনা ভাষায়, বলব বিনা আশায়,
বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে॥
বিনা প্রয়োজনের ডাকে ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই পূরবে মনস্কাম”।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে ধর্মে, সাহিত্যে সর্বোপরি নাম-সংকীর্তনের মাধ্যমে একসময় বাঙালি জাতির মধ্যে যে মহাভাব জেগে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথ আশা প্রকাশ করে লেখেন, - “তাই আশা হইতেছে- আর একদিন হয়তো আমরা একই মত্ততায় পাগল হইয়া সহসা একজাতি হইয়া উঠিতে পারিব, বৈঠকখানার আসবাব ছাড়িয়া সকলে মিলিয়া রাজপথে বাহির হইতে পারিব, বৈঠকি ধ্রুপদ খেয়াল ছাড়িয়া রাজপথী কীর্তন গাহিতে পারিব”।
শ্রীচৈতন্যদেবের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং জীবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ কতটা মুগ্ধ ছিলেন তা বোঝা যায় ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে। এই প্রবন্ধে শ্রীচৈতন্যদেবের গৌরবময় কর্মকুশলতা স্মরণ করে তিনি লেখেন, -
“বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূর্ণ করিয়াছিলেন”।
চৈতন্যদেব যেমন আপন তেজে বঙ্গবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন – এই তেজ আত্মশক্তিজাত। রবীন্দ্রনাথও তেমনি আপন তেজে বঙ্গবাসীকে কূপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে মননচর্চায় যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
মহাপ্রভু আর বিশ্বকবি। দুই মহাপুরুষের জীবনেও কি আশ্চর্য মিল। অপূর্ব দেহকান্তি নিয়ে গৌরাঙ্গ বিশ্বম্ভর জন্মগ্রহণ করেন সেকালের কলকাতা নবদ্বীপে। আর রবির আলোর মত উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের জন্ম একালের জোড়াসাঁকোর কলকাতায়। দুজনেরই আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশে। চৈতন্যদেবের আয়ুষ্কাল ৪৮ বছর। তার অর্ধাংশ কেটেছে বাংলাদেশে। বাকি অর্ধাংশ অন্যত্র। ২৪ বছর বয়সে তিনি নবদ্বীপ ছেড়ে পুরি শ্রীক্ষেত্রকে নতুন কর্মক্ষেত্র করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন আশি বছর। তিনিও জীবনের ঠিক অর্ধাংশ কলকাতায় কাটিয়ে ঠিক ৪০ বছর বয়সে নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু করেন শান্তিনিকেতনে। চৈতন্যদেব নিজে সাহিত্যস্রষ্টা না হয়েও বাংলা সাহিত্যে নতুন জোয়ার আনেন তাঁর মহিমান্বিত প্রভাবে। তাঁর জীবন অবলম্বন করে গড়ে ওঠে বিশাল জীবনী সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলী পায় নতুন প্রেরণা। তাঁর আবির্ভাবের পরেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গৌরবের সূচনা। ঐশ্বর্যবান বাংলা সাহিত্য সম্ভারের গৌরচন্দ্রিকা সেই সুসময়েই। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায়, “চৈতন্য বঙ্গভাষায় তাঁহার প্রেমাবেগ সর্বসাধারণের অন্তরে সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছিলেন” (শিক্ষার হেরফের)।
সেকালের বাংলা সাহিত্য যেমন চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিরসে আপ্লুত, একালের বাংলাসাহিত্য তেমনি রবিকরোজ্বল। সাহিত্যের পর সঙ্গীত। চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছেন দুটি সম্পদ – কীর্তন আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গর্ব এই দুটি জিনিস নিয়ে। দুটিই বাংলার প্রাণ। তাছাড়া, দুজনেই উপলব্ধি করেছিলেন, সঙ্গীত যেখানে নিঃশেষ, সেখানের শুরু নৃত্যের। ভাষাহীন সুরহীন নৃত্য-ছন্দ স্বর্গের সুষমা আনে। দুজনেই যেন বলেছেন, “নৃত্যরস চিত্ত মম উচ্ছল হয়ে বাজে”। তাই বারবার দেখি মহাপ্রভু কৃষ্ণনাম করতে করতে ভাবাবেশে নৃত্য শুরু করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথও অন্ধ বাউল বা ঠাকুরদার ভূমিকায় নেমে গানের সুরের সঙ্গে মঞ্চে হঠাৎ নৃত্যের ছন্দ তোলেন। নাচকে এমন মর্যাদা চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ দেননি।
চৈতন্যদেব ব্রাহ্মণ হয়েও ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন পতিত উদ্ধারিতে, নামগান প্রচার করেন সবার অধম সবহারাদের মাঝে। রবীন্দ্রনাথও জন্মগতভাবে উপবীতধারী বাহ্মণ, তবু অনায়াসে ঘোষণা করেন, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন’। দুজনেই মধুর রসের পথিক, কিন্তু বলিষ্ঠ মতের প্রচারক। দুজনেই ছিলেন দীর্ঘদেহী গৌরাঙ্গ। দু’জন দুই পথের পথিক হয়েও দুইভাবে বিপ্লবী। এই বিপ্লব প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী না হয়েও সুদূরপ্রসারী। আনন্দময় উৎসবকে দুজনেই প্রাধান্য দিয়েছেন জীবনে। তাঁর মধ্যে বসন্ত ঋতুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দুজনের। একজন বলেন দোললীলা, আরেকজন বলেন বসন্তোৎসব। দুজনেরই যিনি উপাস্য, তাঁর বর্ণ শ্যামল। একজনের শ্যামল কৃষ্ণ, আরেকজনের শ্যামল প্রকৃতি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর দিব্যজীবন এবং তাঁর বৈষ্ণবদর্শন প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। অনেকের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-ধারণা যেন শুধু উপনিষদ কেন্দ্রিক। উপনিষদ নিশ্চয়ই তাঁর প্রেরণার অন্যতম উৎস, কিন্তু বৈষ্ণব দর্শন ও সাহিত্য যে তাঁকে কতটা প্রেরণা দিয়েছিল, সেই সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, উপনিষদ আর বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঋণের কথা। ১৯২১ সালে বন্ধু ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, - “বৈষ্ণব সাহিত্য এবং উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে। নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন যেমন মিশে তেমনি করিয়া তাহারা মিশিয়াছে”।
শ্রীচৈতন্যের জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় সেই বাল্যকাল থেকে। বিভিন্ন সময়ে তিনি চৈতন্যদেবের জীবনী পরম আগ্রহে বারবার পড়েছেন। ১৯১০ সালে লেখা একটি চিঠিতে বলছেন, -
“বৈষ্ণবকাব্য এবং চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি কাব্য অবলম্বন করে চৈতন্যের জীবনী আমি অনেক বয়স পর্যন্ত বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করেছি”। ১৯৩৬ সালে হেমন্তবালা দেবীকে আর একখানা চিঠিতে লিখেছেন, -
“কল্যাণীয়াসু, প্রথম বয়সে বৈষ্ণবসাহিত্যে আমি ছিলুম নিমগ্ন, সেটা যৌবনচাঞ্চল্যের আন্দোলনবশত নয়, কিছু উত্তেজনা ছিল না এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু ওর আন্তরিক রসমাধুর্য্যের গভীরতায় আমি প্রবেশ করেছি। চৈতন্যমঙ্গল চৈতন্যভাগবত পড়েছি বারবার। পদকৰ্ত্তাদের সঙ্গে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। অসীমের আনন্দ এবং আহ্বান যে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য্যে ও মানবপ্রকৃতির বিচিত্র মধুরতায় আমাদের অন্তরবাসিনী রাধিকাকে কুলত্যাগিনী করে উতলা করছে প্রতিনিয়ত, তার তত্ত্ব আমাকে বিস্মিত করেছে।
কিন্তু আমার কাছে এই তত্ত্ব ছিল নিখিল দেশকালের— কোনো বিশেষ দেশে বিশেষ কালে বিশেষ পাত্রে কতকগুলি বিশেষ আখ্যায়িকায় আবদ্ধ করে একে আমি সঙ্কীর্ণ ও অবিশ্বাস্য করে তুলতে পারিনি”।
তাই আমরা দেখতে পাই প্রেমিক চৈতন্য, বিপ্লবী চৈতন্য, মানবদরদী চৈতন্য এবং বাঙালি জাতির ভাষার ও সাহিত্যের উদ্বোধক চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি রবীন্দ্রনাথ এত শ্রদ্ধাশীল।
রবীন্দ্রনাথ চৈতন্যদেবকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আইন অমান্য আন্দোলন, বিক্ষোভ মিছিলের সংগঠন, আপামর জনসাধারণকে পরম স্নেহে বুকে তুলে নেওয়া, প্রেমধর্মের প্রচার ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর রচনাবলীতে মহাপ্রভু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“আমাদের আশ্বাসের কারণও আছে। আমাদের বাঙালির মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মিয়াছিলেন। তিনি তো বিঘা কাঠার মধ্যেই বাস করিতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন। তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখন তো বাংলা পৃথিবীর এক প্রান্তভাগে ছিল, তখন তো সাম্য ভ্রাতৃভাব প্রভৃতি কথাগুলোর সৃষ্টি হয় নাই, সকলেই আপন-আপন আহ্নিক তর্পণ ও চণ্ডীমণ্ডপটি লইয়া ছিল-তখন এমন কথা কী করিয়া বাহির হইল।
‘মার খেয়েছি নাহয় আরও খাব।
তাই বলে কি প্রেম দিব না? আয়। '
এ কথা ব্যাপ্ত হইল কী করিয়া? সকলের মুখ দিয়া বাহির হইল কী করিয়া? আপন-আপন বাঁশবাগানের পার্শ্বস্থ ভদ্রাসনবাটীর মনসা-সিজের বেড়া ডিঙাইয়া পৃথিবীর মাঝখানে আসিতে কে আহ্বান করিল এবং সে আহ্বানে সকলে সাড়া দিল কী করিয়া? একদিন তো বাংলাদেশে ইহাও সম্ভব হইয়াছিল। একজন বাঙালি আসিয়া একদিন বাংলাদেশকে তো পথে বাহির করিয়াছিল। একজন বাঙালি তো একদিন সমস্ত পৃথিবীকে পাগল করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল এবং বাঙালিরা সেই ষড়যন্ত্রে তো যোগ দিয়াছিল। বাংলার সে এক গৌরবের দিন। তখন বাংলা স্বাধীনই থাকুক আর অধীনই থাকুক, মুসলমান নবাবের হাতেই থাকুক আর স্বদেশীয় রাজার হাতেই থাকুক, তাহার পক্ষে সে একই কথা। সে আপন তেজে আপনি তেজস্বী হইয়া উঠিয়াছিল”।
চৈতন্যদেবের সংগ্রাম ছিল সমস্ত ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে। তাঁর অস্ত্র ছিল প্রেমধর্ম। সাম্য ও ভক্তির মিশ্রণে গঠিত তাঁর প্রেমধর্ম হরিনাম সংকীর্তনের সন্মোহনী শক্তিতে আকৃষ্ট করেছিল সর্বশ্রেণীর, বিশেষ করে পতিত অবহেলিত সমাজের লোকদের। এই বলিষ্ঠ অথচ প্রেমময় ভাববন্যার বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন,
“আসল কথা, বাংলায় সেই একদিন সমস্ত একাকার হইবার জো হইয়াছিল। তাই কতকগুলো লোক খেপিয়া চৈতন্যকে কলসীর কানা ছুঁড়িয়া মারিয়াছিল। কিন্তু কিছুই করিতে পারিল না। কলসীর কানা ভাসিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে এমনি একাকার হইল যে, জাতি রহিল না, কুল রহিল না, হিন্দু-মুসলমানেও প্রভেদ রহিল না। তখন তো আর্যকুলতিলকেরা জাতিভেদ লইয়া তর্ক তুলে নাই। আমি তো বলি, তর্ক করিলেই তর্ক উঠে। বৃহৎ ভাব যখন অগ্রসর হইতে থাকে তখন তর্কবিতর্ক খুঁটিনাটি সমস্তই অচিরাৎ আপন-আপন গর্তের মধ্যে সুড়্সুড়্ করিয়া প্রবেশ করে। কারণ, মরার বাড়া আর গাল নাই। বৃহৎ ভাব আসিয়া বলে, সুবিধা-অসুবিধার কথা হইতেছে না, আমার জন্য সকলকে মরিতে হইবে। লোকেও তাহার আদেশ শুনিয়া মরিতে বসে। মরিবার সময় খুঁটিনাটি লইয়া তর্ক করে কে বলো”।
প্রেমধর্মের আদর্শনিষ্ঠা ও তাঁর বহুমুখী আবেদন রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন মুগ্ধ রেখেছিল। ‘সমূহ’ গ্রন্থের ‘দেশহিত’ প্রবন্ধ বাংলাদেশের স্বাদেশিকতার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি চৈতন্যদেবের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, -
“চৈতন্যদেব একদিন বাংলাদেশে প্রেমের ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। কাম-জিনিসটা অতি সহজেই প্রেমের ছদ্মবেশ ধরিয়া দলে ভিড়িয়া পড়ে এইজন্য চৈতন্য যে কিরূপ একান্ত সতর্ক ছিলেন তাহা তাহার অনুগত শিষ্য হরিদাসের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ব্যবহারে প্রমাণিত হইয়াছে । ইহাতে বুঝা যায় চৈতন্যের মনে যে প্রেমধর্মের আদর্শ ছিল তাহ কত উচ্চ, তাহা কিরূপ নিষ্কলঙ্ক । তাহার কোথাও লেশমাত্র কালিমাপাতের আশঙ্কায় তাহাকে কিরূপ অসহিষ্ণু ও কঠিন করিয়াছিল। নিজের দলের লোকের প্রতি দুর্বল মমতাকে তিনি মনে স্থান দেন নাই—-ধর্মের উজ্জ্বলতাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার প্রতিই তাহার একমাত্র লক্ষ্য ছিল”।
চৈতন্য বাঙালি জাতিকে সংযুক্ত করেছিলেন বিশ্বচেতনার সঙ্গে। অখণ্ড ভারতবোধ জাগ্রত করার পশ্চাতেও তাঁর দান অনেক। তিনি দক্ষিণভারত ও উত্তরভারতকে যুক্ত করেছিলেন পূর্ব ভারতের সঙ্গে। কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে নয়, প্রেমধর্মের মাধ্যমে। সাম্য, মৈত্রী ও ভালবাসা ছিল তাঁর প্রেমধর্মের মূলমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ তাই লেখেন, “চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলা দেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন এককণ্ঠবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল? তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোল সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নূতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্রজনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব, তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর - অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্ৰন্দনধ্বনি”।
১৯১১ সালের ১৪ই মার্চ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে একটি ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, -
“একদিন চৈতন্য আমাদের বৈষ্ণব করেছিলেন। সে বৈষ্ণবের জাত নেই কূল নেই। আর একদিন রামমোহন রায় আমাদের ব্রহ্মলোকে উদ্বোধিত করেছেন। সেই ব্রহ্মলোকেও জাত নেই দেশ নেই”।
আর সেই বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। বয়স তখন বারো, তেরো, তখন থেকেই পদাবলী তাঁর প্রাণ। সেই কারণেই অলস, অন্যমনে কিশোর কবি হঠাৎ লিখে ফেলেন, “গহনকুসুম কুঞ্জমাঝে”। সেই হঠাৎ রচনা থেকেই সৃষ্টি ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। যে দুটি বৈষ্ণব পদে তিনি সুর দিয়েছেন, তাও বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের। ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর’ এবং ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’।
জ্ঞানদাসের “রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেয়া গরজন” পদটি সাহিত্য আলোচনায় বহুবার দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয়, তার অনুকরণে সোনার তরীর ‘বর্ষাযাপন’ এবং সানাই গ্রন্থের ‘মানসী’ কবিতাটাও লিখেছেন। বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদাবলী সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনা।
তিনি লেখেন - “বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডিদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নাই। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডিদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন। বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডিদাস সহ্য করিবার
কবি”! রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীতে এত মগ্ন ছিলেন যে, তাঁর যৌবনেই ‘পদরত্নবলী’ সংকলন করেছিলেন। একটি চিঠিতে লিখেছেন, “বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষার যমুনাবর্ণনা মনে পড়ে। প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈষ্ণব কবির ছন্দঝঙ্কার এনে দেয়। তার প্রধান কারণ এই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য্য নয়— এর মধ্যে একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্ছে—এর মধ্যে অনন্ত বৃন্দাবন। বৈষ্ণব পদাবলীর মৰ্ম্মের ভিতর যে প্রবেশ করেছে, সে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে সে বৈষ্ণৰ কবিতার ধ্বনি শুনতে পায়” ।
শিলাইদহ থেকে আর একটা চিঠিতে দুঃখ করে লিখছেন, - “বরাবর বৈষ্ণব কবি ও সংস্কৃত বই আনি। এবার আনিনি। সেইজন্যে, ঐ দুটোর আবশ্যক বেশি মনে হচ্ছে”।
বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেম ও প্রকৃতি বর্ণনার যে অনুভাবনা ধীরে ধীরে কবির মনে দানা বেঁধেছে, তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখা যায় ‘মানসী’-র বেশ কয়েকটি কবিতায়, -
“আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে।
শরতের পূর্ণিমায়
শ্রাবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে।
এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
এখনো প্রেমের খেলা
সারা নিশি, সারা বেলা,
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে”।
কখনও বলেছেন, “বর্ষাঋতুর মতো মানুষের সমাজে এমন এক-একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুররূপে বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পরে বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিল। তখন সমস্ত আকাশ প্রেমের রসে আর্দ্র হইয়া ছিল। তাই দেশে সে-সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া ছিল সকলেই সেই রসের বাষ্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নূতন ছন্দে কত প্রাচুর্যে এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল”।
পঞ্চভূত গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব ধর্মের একটা ব্যাখ্যাও করেছেন, বলেছেন, - “বৈষ্ণবধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম-সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে মা আপনার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায় না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলিয়া ঐ ক্ষুদ্র মানবাঙ্কুরটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া শেষ করিতে পারে না, তখন আপনার সন্তানের মধ্যে আপনার ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়াছে”।
রবীন্দ্রনাথ আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, -
“সেদিন রাধিকার ছবির পিছনে
কবির চোখের কাছে
কোন্ একটি মেয়ে ছিল,
ভালোবাসার-কুঁড়ি-ধরা তার মন।
মুখচোরা সেই মেয়ে,
চোখে কাজল পরা,
ঘাটের থেকে নীলশাড়ি
"নিঙাড়ি নিঙাড়ি' চলা”। (শ্যামলী: স্বপ্ন)।
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের বৈষ্ণব কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ওই একই কথা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, -
“দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে-- প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই,
তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা"।
শুধু ধর্মের ব্যাখ্যা নয়, বৈষ্ণবপদাবলীর ভাব, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন আলোচনা করেছেন। গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতীর নাম তাঁর কবিতার পঙক্তিতে প্রবেশ করেছে অনেকবার। আবার কীর্ত্তন গান সম্পর্কে ২৯ জুলাই ১৯৩৭ সালে দিলীপ কুমার রায়কে এক চিঠিতে বলেছেন, - “কীর্তনগীত আমি অনেক কাল থেকেই ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাবপ্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আর-কোনো সংগীতে এমন সহজভাবে আছে বলে আমি জানি নে। সাহিত্যের ভূমিতে ওর উৎপত্তি, তার মধ্যেই ওর শিকড়, কিন্তু ও শাখায় প্রশাখায় ফলে ফুলে পল্লবে সংগীতের আকাশে স্বকীয় মহিমা অধিকার করেছে। কীৰ্তন-সংগীতে বাঙালির এই অনন্যতন্ত্র প্রতিভায় আমি গৌরব অনুভব করি”।
কীর্তনগান ভালো লাগার আরেকটি কারণ আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, - “কীর্তনের আরও একটি বিশিষ্টতা আছে। সেটাও ঐতিহাসিক কারণেই । বাংলায় একদিন বৈষ্ণব ভাবের প্রাবল্যে ধর্মসাধনায় বা ধর্মরসভোগে একটা ডেমোক্রাসির যুগ এল । সেদিন সম্মিলিত চিত্তের আবেগ সম্মিলিত কণ্ঠে প্রকাশ পেতে চেয়েছিল । সে প্রকাশ সভার আসরে নয়, রাস্তায় ঘাটে । বাংলার কীর্তনে সেই জনসাধারণের ভাবোচ্ছসি গলায় মেলাবার খুব একটা প্রশস্ত জায়গা হল”।
এছাড়া চৈতন্যদেবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণে। প্রথমের চোখে পড়ে উভয়ের দেহসৌষ্ঠবের দিকে। চৈতন্যদেবের বিপুল জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই তাঁর দেহকান্তি। চৈতন্যচরিত কাব্যগুলি অনুসরণ করলে দেখা যায় শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন ‘সিদ্ধপুরুষের প্রায় পরম-গম্ভীর’। তাঁর ‘সিংহগ্রীব গজস্কন্ধ’, আজানুলম্বিত ভুজ কমল নয়ন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তাই তো রামানন্দ তাঁকে দেখে বলেছিলেন, -
“সূর্যশত সমকান্তি অরুণ বসন
সুবলিত প্রকাণ্ড দেহ কমল লোচন”
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরার রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, “তাহার গায়ের রঙটা কিছু উগ্র রকমের সাদা … মাথায় সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা, হাড় চওড়া, দুই হাতের মুঠা যেন বাঘের থাবার মতো বড়ো … তাহার মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো এবং অতিরিক্ত রকমের মজবুত; … ওষ্ঠাধর পাতলা এবং চাপা; তাহার উপরে নাকটা খাঁড়ার মতো ঝুঁকিয়া আছে। দুই চোখ ছোটো কিন্তু তীক্ষ্ণ”; …
গোরার দেহসৌষ্ঠব রচনায় অবশ্যই আমরা চৈতন্যদেবের প্রভাব লক্ষ্য করতে পারি। তাই তো গোরার ‘হোমের আগুনের’ মত চেহারা দেখে বিস্মিত হরিমোহিনী বলেছিল, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা! তুমিই গৌর? গৌরই বটে! ওই-যে কীর্তনের গান শুনেছি—
“চাদের অমিয়া-সনে চন্দন বাটিয়া গো
কে মাজিল গোরার দেহখানি”l
চৈতন্যদেবের মত রবীন্দ্রনাথের চেহারাতেও এমন অমোঘ আকর্ষণ ছিল যাকে এড়িয়ে যাবার সাধ্য কারও ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শী রঘুনাথ দাসের কাছে চৈতন্যদেব ‘হেমাদ্রী’ রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। 'গোরা' উপন্যাসের গৌরমোহনের মতোই রবীন্দ্রনাথের চেহারাও ছিল ‘রজতগিরির মতো’ এবং ‘তাহাকে না দেখিয়া থাকিবার জো নাই, সে সকলের মধ্যে চোখে পড়িবেই’। ১৮৯৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে যাবার সময় একবার নবীনচন্দ্রের আহ্বানে রানাঘাটে নামেন। এই উপলক্ষে নবীনচন্দ্রের ‘আত্মজীবনী’তে বত্রিশ বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ণনা আছে, “দেখিলাম সেই ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দের নবযুবকের আজ পরিণত যৌবন। কি সুন্দর, কি শান্ত, কি প্রতিভান্বিত দীর্ঘাবয়ব। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, স্ফুটনোন্মুখ. পদ্মকোরকের মত দীর্ঘ মুখ, মস্তকের মধ্যভাগে বিভক্ত কুঞ্চিত ও সজ্জিত কেশশোভা…
সুবর্ণোদর্পণোজ্জ্বল ললাট, ভ্রমরকৃষ্ণ গুম্ফ, শ্মশ্রু শোভান্বিত মুখমন্ডল … দীর্ঘ ও সমুজ্জ্বল চক্ষু; সুন্দর নাসিকায় মার্জিত সুবর্ণের চশমা”। কেবল দৈহিক সৌন্দর্যই নয়, গোরার সঙ্গে গৌরাঙ্গের জীবন ও কর্মধারার সাদৃশ্যও লক্ষ্য করতে পারি। নবদ্বীপের নিমাইয়ের ন্যায় রবীন্দ্রনাথের গোরাও ছোটবেলা থেকে পাড়ায় ও স্কুলে ছেলেদের সর্দারি করত। তার দুরন্তপনায় সকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। আবার বয়সকালে যে কোনও সভায় বক্তৃতা দিতে, নিমাইয়ের মত নেতৃত্বদানে এবং প্রতিপক্ষকে যুক্তি-তর্কে পরাস্ত করতে গোরা ছিল সিদ্ধহস্ত।
প্রথম দিকে গোরার মনে জাতপাত নিয়ে গোঁড়ামি ছিল। হিন্দু-সংস্কার, আচার-আচরণ, সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কিন্তু গোরা যখন ভ্রমণে বেরিয়ে ভদ্র শিক্ষিত কলকাতা সমাজের বাইরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেশের প্রকৃত অবস্থা ও মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করল তখন তার যাবতীয় সংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানুষের স্নেহ-ভালবাসা, আবেগ-অনুভূতি, মানবিকতার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় নিতান্ত ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বৃত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের বাড়িতে গোরা অন্নগ্রহণ, এমনকি জলস্পর্শ পর্যন্ত করেনা। সে চলে যায় সেই নাপিতের বাড়ি, যেখানে পিতৃহারা মুসলমানের ছেলে মানুষ হচ্ছে, যে নাপিত হিন্দুর হরি ও মুসলমানের আল্লার মধ্যে কোনও তফাৎ দেখে না। এইভাবে গোরার মধ্যে প্রকৃত ভারতবোধের উন্মেষ ঘটে।
এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় শ্রীচৈতন্যদেবের কথা। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের মধ্যেই আমরা প্রথম হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-পন্ডিত-বৈষ্ণব, উচ্চ-নীচ জাতি সকলকে একত্রিত করার মত নেতৃত্ব দানের শক্তি লক্ষ্য করে থাকি। তাঁর নেতৃত্বেই সেদিন নবদ্বীপের অসংখ্য মানুষ একত্রিত হয়ে কাজীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। যা ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম গণ-আন্দোলন। ঘটনাটা ছিল - মহাপ্রভু যখন প্রবল হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজীর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কাজী উচ্চস্বরে নাম-সংকীর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য সেই নির্দেশ অমান্য করে সংকীর্তন চালিয়ে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর পেয়াদা পাঠান এবং তাঁরা সেই সংকীর্তনকারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতে প্রথম আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। কাজীর আইন অমান্য করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সহযোগে বিশাল শোভাযাত্রা শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের রাজপথে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত কাজী শ্রীচৈতন্যের আশ্বাস পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দু’জনের মধ্যে হিন্দু শাস্ত্র ও কোরান সম্পর্কে আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে জগাই-মাধাইকেও কৃষ্ণ নাম দ্বারা উদ্ধার করেন। কাজীদলনের পর নগর ভ্রমণে বেরিয়ে নিমাই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ তাঁতী, গোয়ালা, গন্ধবণিক, মালাকার, শঙ্খবণিক, তাম্বুল প্রভৃতি বৃত্তিজীবীদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে অন্তরঙ্গতা স্থাপন করেন।
“নগরে আসিয়া করে বিবিধ বিলাস
সভার সহিত করে হাসিয়া সম্ভাষ”
এমনকি খোলাবেচা শ্রীধরের বাড়িতে তার দুয়ারে পড়ে থাকা লোহার পাত্র থেকে জল পান করেন, -
“নৃত্য করে মহাপ্রভু শ্রীধর অঙ্গণে
জলপূর্ণ পাত্র প্রভু দেখিলা আপনে॥
ভক্ত প্রেম বুঝাইতে শ্ৰীশচীনন্দন।
লৌহপাত্ৰ তুলি লইলেন ততক্ষণ॥
জল পিয়ে মহাপ্ৰভু সুখে আপনার।
কার শক্তি আছে তাহা নয় করিবার”॥
তাই রবীন্দ্রনাথ কাব্যে জানান, “যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।” এবং বৈষ্ণবধর্মের উদারতার মন্ত্রে দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে ‘গোরা’-র মুখ দিয়ে বলেন, - “আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন- যিনি ভারতবর্ষের দেবতা”।
বৈষ্ণব ধর্মে ভালবাসা যেমন মানুষে মানুষে, তেমনি ভগবানে ও মানুষেও। বৈষ্ণবদের মতে ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ। তিনি আনন্দময় ভগবানরূপে ভক্তের সঙ্গে লীলা করতে ভালোবাসেন। ভক্ত যেমন ভগবানকে চায়, তেমনি লীলারস আস্বাদনের জন্য ভগবানেরও প্রয়োজন ভক্তকে। এই তত্ত্বটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানের দুটি পঙক্তিতে নিবেদন করেছেন সরলতম ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, -
“তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর, তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে”।
অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ও চৈতন্যদেব বিপরীত মনের মানুষ। জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দবিরহ ও ঈশ্বরানুভবকে চৈতন্যদেব ভাবোন্মদনায় প্রকাশ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সমজাতীয় অভিজ্ঞতাকে কাব্যে, গানে প্রতীক-প্রতিমানে প্রকাশ করেছেন। চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’, মোহই তাঁর মুক্তি, প্রেমই তাঁর ভক্তি। তাই তো ‘বৈষ্ণব কবিতা’-য় লিখলেন, -
“সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান”…
ঋণঃ রবীন্দ্ররচনাবলী। একত্রে রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরি। ইন্টারনেট।
কবিতা
সপ্তর্ষি গাঙ্গুলী
খড়দা, কলকাতা
প্রণয় মরমিয়া
যে আঁখিতে রেখে আঁখি তব পলক নাহি পড়ে,
সেই আঁখিপটে বারিধারা নীরবে কেমনে সহিতে পারে!
হৃদয়াম্বরে চলে অনুক্ষণ এক অদ্ভুত মেঘরোদ্দুর খেলা,
অনেক কথাই তব আঁখিপানে চেয়ে থেকে গেল অবলা।
ঘনিয়ে এল সহসা এ কোন্ গহীন আঁধার রাতি!
মম হৃদয়প্রাঙ্গনে নিভিয়ে তব ভালোবাসার উজ্জ্বল বাতি।
সেই আঁধারে না হেরি তোমায় এক লহমা তিষ্ঠতে না পারি,
বয়ে যাক এমনই যেমনি চলেছে বয়ে ভালোবাসার নিষ্কলুষ বারি।
ব্যাকুল হৃদয়; আকুল চিত্ত নিবৃত্ত করত যে যাদুস্পর্শ,
সে যাদু আজ যেন কোথায় গিয়েছে হারিয়ে! এ বড় বেদনাতুর অচেনা স্পর্শ।
প্রণয় কুহক
জানি না এ কোন্ অজানা ঝটিকা বয়ে গেল মম জীবনে!?
যে ঝড় নিশান রেখে গেল মোর জীবনভর রোদনে।
কিসেরও প্রতীক্ষায় থাকি বসে তব পাষাণ হৃদয়দুয়ারে!?
যে দুয়ার মোরে দিয়েছে ফিরায়ে নিদারুণ অনাদরে।
কল্পনার তরণী ভেসে চলে তবু প্রেমের সিন্ধু বেয়ে,
জানি না কোথায় থামবে মম স্বপ্নউড়ান গিয়ে!?
অলীক স্বপ্ন;
তবু যে মগ্ন,
যেন কোনো তপতী করল ভগ্ন।
স্বপ্নভঙ্গে না হেরি তারে;
অঞ্চলছায়া হাতছানি দিয়ে ডাকে।
ইহলোকের অতৃপ্ত প্রেম স্বপ্নে তার স্নেহালিঙ্গনে পাড়ি দিতে চায় বাস্তবের নবজন্মালোকে।
স্নেহ পরশে ব্যথিত সে হৃদয় আকুল হয়ে হাহাকার করে কাঁদে।
বলে ওঠে যেন না পড়ি আর আমি কারও নিপুণ প্রেমাভিনয়ের ফাঁদে।
হায় রে পরিযায়ী
লাখো লাখো মাথা ঐ হয়েছে সামিল পদব্রজে রাজপথে,
বাসা ফেরবার অঙ্গীকারে অসাধ্যকে যেন তারা করবেই সাধন।
দৃঢ় প্রত্যয় পুঁজি নিয়ে তারা সকল ঝঞ্ঝা করবে লঙ্ঘন,
করবে না পরোয়া যাত্রাপথে আগত আর কোনো অদৃশ বাধন।
ওদের চোখের তারায় ক্ষণে ক্ষণে যেন স্ফুলিঙ্গের মত উঠছে জ্বলে প্রবঞ্চনার অনল।
পরিবার পরিজনেরা সব কাটাচ্ছে বসে উদ্বেগের প্রহর;
সেবন করে অধীর প্রতীক্ষার গরল।
বাজি রেখে বিধাতার নিকট তাদের ভালোবাসা,
নিরন্তর ওদের ভার্যারা যেন চেলে যাচ্ছে পতির মৃত্যুঞ্জয়ী পাশা।
ফিরে যদি আসে সকল বাধাবিপত্তি জয় করে একবারের জন্যও,
করবে পরশ প্রাণনাথের কায়া; পূর্ণ হবে চিত্তের একমাত্র নিবিড় আশা।
ওরা বহুদূর দেবে পাড়ি; মনে ক্ষীণ আশা বাসা ফিরে পাবে দেখতে সন্তানের আনন
নাই বা থাক মুক্তগগনে বিহঙ্গের ন্যায় উন্মীলিত করার মতন ওদের পেলব ডানা;
তা বলে কি আর ওদের নেই এটুক অধিকার যে
নিজ মুলুকেই প্রদেশ হতে প্রদেশান্তরে থাকবে না
ওদের অবাধ আনাগোনা!
মাইলের পর মাইল অতিক্রমণ করে
ওদের শ্রান্ত চরণযুগল ক্ষান্ত হয়ে
যখন খুঁজে নিচ্ছে বিশ্রামের জন্য একটু নির্বিদ্ম আশ্রয়
এই সড়কেই,
তখনই পণ্যবাহী কিছু শকট ঘানির মত যাত্রাপথে অক্লেশে ওদের পরিশ্রান্ত তন্বী
ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ভূতলে পিষে বিলীন করে দিয়ে যাচ্ছে পলকেই।
দিবানিশি একযোগে জনসাধারণের পায়ের নীচের ভিত যারা করছে সুদৃঢ় ;
আবার তুলছে গড়ে মাথার ওপর সুরক্ষিত এক ছাত।
অত্যাশ্চর্যভাবেই সমাজের এই বিশ্বকর্মাদের দেহক্ষরিত
নির্ঝর রক্তপাত দেখেও থেকে যায় নির্বিকার;
স্বার্থান্বেষী এই মানবজাত।
জনহিতে সমর্পিত অকালে ঝরে যাওয়া ওদের অমূল্য জীবনের সন্দেশ আর রাখে না
মূক এ সমাজ; শুধু আঙুল তুলে বলে ওদের করুণ এই পরিণতির জন্য আর কেউ নয়;
ওদের হঠকারী গৃহযাত্রাই কেবল দায়ী।
আসলে যে ওদের নেই কোনো নাম; নেই কোনো জাত; ওড়বার পাখনা না থাকলেই বা!
ওদের কেবল একটিই পরিচয় সমাজের সেঁটে দেওয়া সংকীর্ণ তকমা "পরিযায়ী"।
প্রেমচরিত মানস
লাজে নত আজ তোমার আঁখি আমার হৃদয়ের যে কথাটি শ্রবণে,
জানো কি হৃদয়কাননে কতকাল আমি তারে রেখেছি এত যতনে!?
রঙিন বসন্ত রাঙিয়ে দিয়ে যায় চলে কামনার সকল গোলাপ, হোক নয় লাজে!
তুমি বৈ আর কেই বা শুনবে আমার অন্তরাত্মার অবুঝ প্রলাপ?
তোমার মধুর পরশে মনের গোপন কথাটি রইল না আর সঙ্গোপন,
অন্তরে তোমার নিভৃতে করল আমার নিগূঢ় ভালোবাসার বীজ বপন।
লাজের অন্তরালে তোমার অমলিন হাসি;
দেয় যেন মোরে এক পরম তৃপ্তি,
কলাপ জড়ানো তোমার কেশবিন্যাসের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে সোনালি এক আলোকদীপ্তি।
দখিনা বাতাস আসে নিয়ে বয়ে তোমার চিরন্তন প্রেমের অরূপ বাণী,
স্নেহচুম্বনে আপন করে আজ এ কোন ঋণে তুমি করলে আমায় ঋণী!?
পঁচিশে পদার্পণ মধুর মিলন
এই যেন সেইদিন হাতের ওপর হাতটি রাখবার ছলে,
পানপাতাতে মোড়া লাজের অন্তরাল হতে হৃদয়হরণ খেলা চলে।
উত্তুরে হিমেল হাওয়ার মায়াবী আবেশে বাঁধা পড়েছিল সেদিন মনযুগলের যে গাঁটছড়া,
আজও খুঁজে চলে চপল সে দুই চিত্ত একে অপরের নির্বিদ্ম আশ্রয় হয়ে পাগলপারা।
অগ্নিসাক্ষী রেখে বাধাবিপত্তির দুস্তর পারাবার অতিক্রমণ করে সূচনা হয়েছিল তোমাদের যে পথচলা,
বিরল সে বোঝাপড়ায় অক্লেশে কপোতমিথুনের কেটে গেল পঁচিশটা বছর; নয় এ কাহিনী মিছেবলা।
প্রবহমান কালের দুর্বার স্রোত নিরন্তর বয়ে নিয়ে চলেছে মুহুর্তবিতানভেলা ,
পূবাকাশে প্রদ্যোতিত রবিও আজ সকলের সাথে মেতেছে প্রমোদে ; দেখতে পুণরায় চিরন্তন দুই অন্তরের মিলনমেলা।
মনের মণিকোঠায় আজও উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে তোমাদের সামীপ্যে অতিবাহিত আমার মধুর স্মৃতিবিজড়িত শৈশব —
মনে কি পড়ে রঙীন সেই সকল দিনগুলিতে ভালোবাসা আর মমতার তুলির টানে আমার মধ্যেই যেন রচেছিলে তোমাদের মানসপুত্রের অবয়ব।
নিজ অগোচরেই কখনও বা তোমাদের করেছি অতিশয় হতাশ; তবু থাকেনি কখনও এতটুক অপূর্ণ তোমাদের স্নেহাধার,
পূর্ণ হোক চাই আমার নিখাদ এ মনস্কাম — 'সময়ের ডালি প্রেমের আতরে ভরিয়ে নিয়ে জীবনে এমন মধুর পঁচিশ আসুক বারেবার'।
কবিতা
নাজমুল হক
ঢাকা, বাংলাদেশ
জন্ম: পিরোজপুর জেলায়। বাংলা বিষয়ে স্নাতক সম্মান সহ এমএ পাশ করার পর দীর্ঘ ১৭ বছর শিক্ষকতা পেশায়। বসবাস ঢাকায়।শৈশবের লেখক হওয়ার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে শুধু জ্ঞান বিতরণে নিজেকে সমর্পণ করেছি। কিন্তু একান্ত নিজের মনের খোরাক এই কবিতার হাত ধরে চলি নিজের জন্য। একান্তে অনুভূতির অনুরণন, উপলব্ধি ও বোধের বিক্ষোভ থেকেই মাঝে মাঝে জন্ম নেয় কিছু ছেলে মানুষী কবিতা। ব্লগে তা প্রকাশিত হলে কেউ কেউ তাদের ভালোলাগার কথা জানায়। তাই পত্রিকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত।
শঙ্খিনী কথন
কোন এক শঙ্খিনী নারীর হৃদয়ের স্পর্শ পাবো বলে
আমি এই পৃথিবীর পথে হেঁটে ছিলাম একদিন।
সমুদ্র মন্থনে মন্থনে চেয়েছিলাম আত্মশুদ্ধি,
থেকেছি তপস্যায় মগ্ন অশ্বত্থের মত,
তবুও মেলেনি বুদ্ধের বোধি লাভ
কিংবা শঙ্খিনীর হৃদয়ের সন্ধান।
একদিন ছিল সব পথ ধাবমান শঙ্খিনী হৃদয়ের পানে
হেঁটেছি আমি পথ পথান্তরে, বিমূর্তের মোহে।
বিমূর্ত তৃষ্ণারা জেগেছিল আত্মার ভেতর।
তবে কি সৃজন তৃষাই ঢের বেশি টানে ?
তবে কি মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে কিংবা
বিমূর্ত ভাবলোকে শঙ্খিনী নারীর সৃজন।
নিশিকন্যার কাব্য
১.
শুনেছিস মেয়ে
তোকে বলে কলঙ্কিনী সবে
যারা রাতে মধুর লোভে
ঢিল মারে তোর চাকে।
শুনেছিস মেয়ে
তারাই নাকি দিনের বেলা
সাজে চকচকে পোশাকে।
সুগন্ধি আতর মাখে।
জানিস কি তুই
সভ্য লোকের সমাবেশে
তোকেই অসভ্য ভাষায়
নানান নামে ডাকে।
এরাই আবার রাতের বেলায়
কড়া নেড়ে তোর দরজায়
কেমন করে মধুর স্বরে
প্রাণহরিণী ডাকে।
ভাবছিস মেয়ে
ডুবে গেছিস পাপের পাঁকে
পেটের ক্ষুধা মিটবে বলে
দিচ্ছিস সাড়া ডাকে।
সেই পাঁকেতে ডুব দিয়ে যে
খুঁজছে মনের রত্ন আকর,
পাপ পঙ্কিল বলছে তোরই
পেটের ক্ষুধাটাকে।
হাসিস নে মেয়ে
ঘৃণা চোখে, উপহাস মেখে ঠোঁটে,
সাধু সন্তর লেফাফা জড়ানো
আমার কথা শুনে।
ভাবিস মুখটি মুখোশেই ঢেকে চলি
নিশিকন্যাকে দিনের আলোয় ভুলি।
আবার রাতে কামনা কুকুর হয়ে পাড়া
জাগাবো আকাশ বিদীর্ণ ডাকে।
২.
দেখ মেয়ে তোর চাউনি বাঁকা
স্বপ্ন আঁকা চোখের কোণে
চাঁদের আলোর ঝলক লাগে।
অন্ধকারে পথের ধারে
কিংবা পার্কে বেঞ্চে বসে
আয়েশ করে বেনুনী নিয়ে
খেলা করিস মগ্নতাতে।
ঠোঁট রাঙানোর সস্তা প্রলেপ
আলগোছে তুই মেখেই চলিস
চোখ এঁকেছিস কাজল দিয়ে
লাল ফিতেতে বেনুনী বাঁধিস।
এমনি করে প্রতিটি রাতে
পসরা সাজাস নিজ শরীরে
দেহের দামে দেহের ক্ষুধা
অপুরুষগুলো নেয় মিটিয়ে।
ডাকে তোকে নিশিরানী
রানীর মতই দানের শরীর।
উপঢৌকন দিচ্ছে তোকে
প্রজারা সব পালা করে।
তোকে নিয়েই কাব্য করি
চাটুকারি নেই ভাড়ারে।
হতে চাই তোর সভা কবি
নিজেকে বিকিয়ে বাজারে।
আমায় দেখে তাইতো হাসিস
এই হাসিটা তোকেই মানায়।
নপুংসক আবেগটা দেখে
বিদ্রূপ হানিস কাব্য কথায়।
গল্প
ঘোষালবাবুর
প্রত্যাবর্তন
গীতাঞ্জলী ঘোষ
১)
- অ্যাই প্যালা, ঐ ইংরেজি বইগুলো খুঁজলি?
- কোন ইংরেজি বইগুলো?
- ক্লাস সেভেনের।
- ওগুলো এখন কোথায় পাব? ওগুলো তো দুদিন আগেই বিক্রি করে দিলে টিন ভাঙা, লোহা ভাঙাকে।
- কবে? ও হ্যাঁ, তাই তো। আর কি বিক্রি করেছি বল তো?
- উফ্ দাদাবাবু, তুমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাও কি করে? ঐ বড়বাবুর আলমারিতে কি সব পুরনো গল্পের বই, শেষ হওয়া হোমিওপ্যাথির কাচের শিশি, তারপর ঐ হরিতকি, বোতাম ভর্তি ছোটো কৌটোগুলো। কালি ফুরিয়ে যাওয়া এক বাক্স পেন সবই তো টেনে বার করলে গো তুমি আর বৌদি মিলে।
- আবার সব ফেরত আনতে হবে। তুই একটু খোঁজ ঐ টিন-লোহা বিক্রির ছেলেটা যদি আবার পাড়ায় আসে।
কথাটা বলেই প্যালার প্রত্যুত্তরের আশা না করে রমাপতি ঘোষাল অন্দরমহলে ছুটলেন। ধুলিগড়ের জমিদার হল ঘোষালরা। তাদের পাঁচ পুরুষ আগে দশপতি ঘোষাল ছিলেন একজন দাপুটে জমিদার। তাঁর দাপটে বাঘে, গরুতে একঘাটে জল খেত। দশপতি ঘোষালের জমিদারি শুধু ধুলিগড় নয়, আশে পাশে আরও কয়েকটি গ্রামের ওপর তিনি রাজত্ব করতেন।
তখন চলছিল ইংরেজ শাসনকাল। পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ের পর নতুন করে আরও প্রবল ক্ষমতায় হাজির বাংলায় ইংরেজ শাসন। যে সমস্ত জমিদাররা তখন ইংরেজদের তাবেদারি করে জমিদারি চালাতেন, দশপতি ঘোষাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। গরিব কৃষকদের কাছ থেকে কি ভাবে খাজনা আদায় করা যায়, তা তিনি মোক্ষম জানতেন। কিন্তু ঘোষালদের এই রাজত্ব বেশি পুরুষ টেকেনি। বংশ পরম্পরায় তাদের প্রতিপত্তি, সাম্রাজ্য সবকিছুই সংকুচিত হতে থাকে। কালক্রমে তলানিতে ঠেকে। এখন তাদের উপার্জনের একমাত্র রাস্তা হল ঐ পেল্লাই যৌথ বাড়ি আর কিছু যৌথ সম্পত্তি। এই বাড়ির ষষ্ঠ বংশধর হলেন রমাপতি ঘোষাল। সেই পুরোনো জমিদারি না থাকলেও গ্রামের মানুষ এখনও তাদের এককালীন জমিদার জ্ঞানে সম্মান করে। রমাপতি ঘোষালরা তিন ভাই। রমাপতি ছাড়া বাকি ভাইয়েরা তাদের চাকুরে ছেলের কাছে চলে গেছে। কেউ কলকাতায়, কেউ মুম্বাই আবার কেউ নিউ ইয়র্কে। রমাপতির দুই ছেলে অকর্মণ্য, তারা শুধু বাপ ঠাকুরদার সম্পত্তির ওপর শ্যেন দৃষ্টি হেনে বসে আছে। অবশ্য তাদের বাকি কাকা, জ্যাঠারাও কেউ কম যায় না। দূরে থেকেও সম্পত্তির ভাগ ছাড়তে তারা কেউ রাজি নয়। দুমাস কুড়ি দিন হতে চলল রমাপতি ঘোষালের বাবা উমাপতি ঘোষাল গত হয়েছেন। আর তাঁর শ্রাদ্ধ শান্তি শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সম্পত্তি নিয়ে শুরু হয়ে গেছে খণ্ডযুদ্ধ। পারিবারিক উকিলের থেকে জানতে পারা গেছে ঈশ্বর উমাপতি ঘোষাল সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কোনো উইল করে যাননি। তারপর থেকেই সকলের মাথায় হাত- কি হবে এবার। শ্বশুর মারা যাওয়াতে বাড়ীর তিন জা বেশ মনের সুখে নিজেদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা করে ছিলেন, ঠাট্টা হাসি-মজা ভালোই চলছিল। ভেবেছিলেন এই বাড়ি এবার ভাগ হবে। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে কথা বন্ধ, একে অপরের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছেন- এই বুঝি কেউ কারোর ভাগটা মেরে দিল। অন্যদিকে ভাইয়েরা সব ফেরার টিকিট ক্যান্সেল করে দিয়েছেন, একটা হেস্তনেস্থ করে তবেই যাবেন সবাই। শেষ কিছুদিনে এত তর্কাতর্কি হয়েছে যে সকলে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর তার ফলেই সমগ্র বাড়িতে এখন হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে। সেইদিনের সিদ্ধান্তে ঠিক হয়েছে যে একটা প্ল্যানচেটের আয়োজন করা হবে। তাতে স্বর্গবাসী পিতাকে মর্ত্যে ক্ষণিকের জন্য নামিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে কার ভাগে কতটা সম্পত্তি পড়া উচিত। রমাপতি ঘোষাল যেহেতু এই বাড়ির দেখাশোনা করেন তাই তাঁর মতে তাঁরই সর্বস্ব প্রাপ্য। তাঁর মাথায় চিন্তা, বাবা এসে যদি নিজের শখের জিনিসগুলো খোঁজেন, তাহলে কি হবে। বাবার শখের সকল জিনিস তিনি তো বিক্রি করে দিয়েছেন। রমাপতি ভাবলেন, তাকে যেহোক করে সব জোগাড় করতে হবে। কোনোভাবে যদি স্বর্গীয় বাবাকে ম্যানেজ করা যায়, তাহলে তো কেল্লা ফতে।
(২)
মাথার ওপর দুপুরের চড়চড়ে কড়া রোদ। জ্যৈষ্ঠের হাঁসফাঁস গরম। মাথা থেকে দরদর করে ঘাম বয়ে চলেছে পা অবধি। প্যালা তাও থামছে না। সে সাইকেলটা যতটা জোরে পারা যায় প্যাডেল করছে। বাড়িতে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবরটা তাকে দিতে হবে। আজ সকাল সকাল সে ছুটেছিল পুরনো বইয়ের দোকান, পুরনো লাল হয়ে আসা পাতার বই চাই। উমাপতি ঘোষাল লাল হয়ে আসা পুরনো বইয়ের সোঁদা গন্ধ ভালোবাসতেন। তাই এখন সেই খোঁজ চলছে। প্যালা ঘোষাল ফটকের সামনে এসে সাইকেলের ব্রেকটা কষল। দেওয়ালে সাইকেলটা ঠেসিয়ে হাওয়াই চটির শব্দ তুলে ঘরে ঢুকল। চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বৈঠক খানায় গিয়ে উঁকি দিল। রমাপতি বাবু চেয়ারে বসে ঢুলছেন।
দাদাবাবু,
কে? অ তুই। এত তাড়াতাড়ি চলে এলি। কি হল? আর খালি হাত কেন? বইগুলো কই?
আরে বই আনব কি করে। গিয়ে যা দেখলাম।
কী দেখলি?
বলছি বলছি, প্যালা গলার স্বরটা আরও নামিয়ে বলল। গিয়ে দেখলাম মেজোবাবু আর ছোটোবাবুও হাজির।
মানে? ওরা জানল কী করে?
সে আমি কি জানি। আমি যখন বইয়ের দোকানে কালুদা বলে জোরে চেঁচাতে যাব, মানে গলা দিয়ে ডাকটা বেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখি ঐ ওদের দোকানের ঠিক পাশটায় যেখানে পুরনো বই বাছাই হয়, ওখানে মেজবাবু আর ছোটবাবু দাড়িয়ে আছে। আমি তো ওদের দেখেই চুপচাপ কেটে পড়লাম। দিয়ে তাড়াতাড়ি করে আসছি খবরটা তোমায় দেব বলে। যা গরম পড়েছে, পুরো গ্রামটা মনে হচ্ছে আগুনের কুন্ডে ঢুকে পড়েছে। উফফ!
বলে প্যালা তার কাঁধে রাখা রংচটা গামছা নিয়ে মাথার কাছে হাওয়া করতে লাগল। কথা গুলো শুনতে শুনতে রমাপতি ঘোষালের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে খুঁজতে লাগলেন তাঁর ভাবনাটা কি করে জানল মেজো আর ছোটো। তিনি তো কাউকে বলেননি।
যাই হোক, তোকে আর কিছু করতে হবে না। আজ রাতে ঝন্টু বাবা আসবেন, তাঁর সাহায্যে আগে আমরা বাবামশায়কে নামাই, তারপর দেখা যাবে। কথাটা বলে দুহাত জোর করে মাথায় ঠেকালেন।
এদিকে সমগ্র বাড়ি জুড়ে তোড়জোড় চলছে স্বর্গীয় পিতাশ্রিকে মর্ত্যে আহ্বানের। তিনি কি খেতে ভালোবাসেন, তাঁর হুকো, কলকে সব এনে হাজির করা হয়েছে। জমিদারি শেষ হয়ে গেলেও স্বর্গীয় উমাপতী ঘোষালের জমিদারীয়ানা ছিল বহাল তবিয়তে। তাই সবকিছুর আয়োজনই চলছে। এখন চিন্তা একটাই। ওপর থেকে নেমে তিনি এই বাড়িতে কতদিন থাকবেন কে জানে। থাকলেই তিনি গোটা বাড়ি ঘুরে সব ঘেঁটেঘুঁটে দেখবেন। বিক্রি করে দেওয়া জিনিসপত্রের খোঁজ করলেই ভয়।
(৩)
বৈঠক খানার দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটার ঘন্টা পড়ল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই ঘরেই যে আরও মানুষ আছে বোঝার উপায় নেই। বাড়ির মহিলারা সব ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে বসে আছেন। পারিবারিক সদস্যদের বাইরেও আছেন ঝন্টু বাবা। তিনি একজন সিদ্ধ তান্ত্রিক। তিনিই প্ল্যানচেটের রাস্তা দেখাবেন সকলকে। ক্ষণে ক্ষণে ব্যম ভলে উচ্চারণে জানান দিচ্ছেন এই অন্ধকারেও তিনি আছেন। আর আছে পারিবারিক উকিল খগেন চাটুজ্জে। তাঁকেও রাখা হয়েছে যদি বাবা সম্পত্তি ভাগের কাজকর্ম নেমেই শুরু করে দেন। প্যালা তো আছেই, বসে বসে ঢুলছে। ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে তিন ভাই। মধ্যিখানে ধরানো হয়েছে একটা মোমবাতি। তার শিখা হাল্কা নড়ছে। সেই আধো অন্ধকারে বেশ এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ঘরের কোণায় জ্বলছে চন্দনের ধূপ। ঝন্টু বাবা আদেশ করলেন, সবাই একে অপরের হাত ধরে একমনে নিজেদের বাবাকে স্মরণ করুন। ব্যম্ ভোলে। সকলে তার কথামতো তাই করল, চোখ বন্ধ করে এক মনে শুরু হল প্ল্যানচেটের ক্রিয়া।
পুরো ঘর নিস্তব্ধ, পিন ফেললে আওয়াজ পাওয়া যাবে। গ্রীষ্মের রাতে মৃদু হাওয়া বইছে। কোথাও একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় পনেরো মিনিট হতে চলল কোথাও কিছু নেই। রমাপতি বাবু তার মেজ ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, এই নারায়ণ, এতক্ষণ ধরে তো বসে আছি। বাবামশায় কই এলেন?
কে জানে। কিছু বুঝতে পারছি না দাদা।
বোম ভোলে। ঝন্টু বাবা চেঁচিয়ে উঠল। পাশ থেকে ছোটো ভাই গণেশপতি বললেন,
বাবাজি, আপনি ভোলানাথ কে কেন ডাকছেন? আমরা তো ভুত ডাকছি। ভগবানের নাম শুনলে ভুত যে আর আসবে না।
বলার সাথে সাথে মোমবাতির আলো নিভে গেল। হাওয়ার গতি বেড়ে গেল। বাইরে বোধ হয় কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছে। মেঘ ডাকছে গম্ভীর স্বরে। সবাই চোখ খুলে ফেলেছে। কি হল কি হল রব সকলের দৃষ্টিতে। ঝন্টু বাবাও এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন- কি হল রে বাবা। হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর গলা,
আমায় ভুত কে বললি রে? কেউ বুঝতে পারছে না গলাটা কার। সবাই খালি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তুমুল ঝড়ে পূর্ব দিকের জানালার একটা পাল্লা খুলে গেল, সাথে সাথে ভিজে হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল বন্ধ ঘরে। গণেশপতি বাবু উঠে জানালাটা বন্ধ করে মোমবাতিটা আবার জ্বালালেন। ঘরে আবার আলোক দীপ্তি। সেই আধো আলোয় দেখা গেল প্যালার শরীরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এল। এবার স্পষ্ট বোঝা গেল,
কে ভুত বললি রে আমায়? তুই? বলেই ঝান্টু বাবাকে টুটি টিপে এক হাতে তুলে ধরল। তুই বলেছিস? এত সাহস তোর। জানিস আমি কে? আমি হলাম জমিদার উমাপতি ঘোষাল। তুই বেটা কে? অবস্থা বেগতিক দেখে গণেশপতি বললেন, বাবামশাই, আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আপনি উনাকে ছেড়ে দিন। ভুল হয়ে গেছে বাবামশাই। এই কান মুললাম।
শুনে প্যালার দেহে উমাপতি ঘোষাল ঝন্টু তান্ত্রিককে ছুড়ে ফেললেন মেঝেতে। সে পড়ি কি মরি করে দৌড় দিল। উমাপতি ঘোষাল চেয়ারে নবাবি কায়দায় বসলেন যেমন বসতেন। সকলেই বুঝে গেল, প্যালার শরীরে স্বয়ং তাদের বাবামশায় উপস্থিত। সকলে করজোড়ে প্রণাম করল। পাশের ঘরে বৌমায়েরা মাথায় ঘোমটা দিল। নাইটি পরিহিতা ছোটো বৌমা ওড়না টানল মুখের সামনে।
(৪)
বোস্টন, অফিসের পশ্চিমদিকের করিডোরে ব্যস্তভাবে পায়চারি করছে নিখিলেশ ঘোষাল। পরনে রাত্রি পোশাক। নিখিলেশ নিজের কাজকে এত ভালবাসে যে সে বাড়ি যায় না তাই আর অফিসের পোশাক পরার দরকার হয় না। নিখিলেশের স্ত্রী মহুয়া আর দু বছরের মেয়ে অ্যানা অফিসেই আসে মাঝে মাঝে দেখা করতে। নিখিলেশ প্যারানর্মাল বিষয় নিয়ে রিসার্চ করে। সে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন আধিভৌতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করা যায়। শুধু তাই নয়, তার কাছে এমন এক রাডার আছে যেখানে ধরা পড়ে মানুষ তার জৈবিক দেহ থেকে কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে সেকেন্ড ডাইমেনশন অর্থাৎ পারলৌকিক দুনিয়ায় যায়, দুই প্যারালাল ডাইমেনশনে পপুলেশন ডেনসিটি কতটা ইত্যাদি আরও আনুষঙ্গিক বিষয়। নিখিলেশের সৃষ্টি করা সন্ধিতরঙ্গ সমগ্র পৃথিবীকে চাঁদোয়ার মতো বেষ্টন করে রয়েছে। যে কোনো প্রাণী যে স্টেটেই যাক না কেন সব ধরা পড়ে যাবে তার ল্যাবের কম্পিউটারে।
স্যার, স্যার একবার আসুন। জরুরী দরকার। নিখিলেশর অ্যাসিস্ট্যান্ট জোন্স ডাকল। ছুটে গেল নিখিলেশ।
হোয়াট হ্যাপেন্ড জোন্স ?
স্যার, এই দেখুন সেকেন্ড ডাইমেনশন মানে পারলৌকিক স্তরে পপুলেশন লিমিট ক্রস করে যাচ্ছে। স্ক্রিনের এই জায়গাটা দেখুন কেমন কনজেসটেড। এই ডাইমেনশন থেকে আমাদের ডাইমেনশন মানে মানবস্তরে এবার কিছু আত্মার অনুপ্রবেশ হবে। কিন্তু জৈবিক দেহের যে অভাব স্যার।
মানেটা বুঝলে না জোন্স? এর মানে সেকেন্ড ডাইমেনশনের সূক্ষ্ম শরীর মানব ডাইমেনশনে কোনো জীবন্ত দেহে প্রবেশ করবে। একই জৈবিক দেহে দুটো আত্মা থাকবে। ক্ল্যাশ করবে।
তাহলে এখন কি করতে হবে স্যার?
অপেক্ষা। বলে নিখিলেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনের ওপারে মেয়ে অ্যানার গলা, পাপা, হয়েন ইউ উইল কাম? পাপা, দাদুন ফোন করেছিল। আমরা ইন্ডিয়া যাব পাপা। মেয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মহুয়া বলল, হ্যাঁ, নিখিলেশ। বাবা আর মা ফোন করেছিলেন। একবার গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। ঐ যে সেই প্যালা বলে ছেলেটা আছে না সে নাকি কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। তোমার বাবা তো বললেন, যে দাদু নাকি ওর শরীরে চেপেছে। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না তুমি জান। কিন্তু বাড়িতে সবাই তোমার সাথে আলোচনা করতে চায়, তাই একবার যেতে বলছেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, নিখিলেশ ঘোষাল বাড়ির মেজো ছেলে নারায়ণপতি ঘোষালের একমাত্র ছেলে। সব কথা মন দিয়ে শুনে নিখিলেশ ফোনটা ডিসকানেক্ট করল। তার ঠোঁটে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি, যেন এটার অপেক্ষাতেই ছিল। জোন্স জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে স্যার?
হ্যাঁ অনেক কিছু। আমাদের ধুলিগড় যেতে হবে।
(৫)
পাঁচদিন হতে চলল প্যালার শরীরে সমগ্র ঘোষাল বাড়িতে উমাপতি ঘোষাল নবাবি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর ভয়ে সকলে নিশ্চুপ। রমাপতি ঘোষাল যা আশঙ্কা করেছিলেন, তাই হয়েছে। তিনি
এসেই তাঁর পুরনো বই এর খোঁজ করছেন। উমাপতি ঘোষালের নাতি, নাতনিদের পড়ানোর জন্য যে সমস্ত স্কুলের বই কিনে দিয়েছিলেন, তা তিনি যত্ন করে বেঁধে তুলে রেখেছিলেন। তাঁর জমিয়ে রাখা একগাদা কালি শেষ হয়ে যাওয়া পেন, হোমিওপ্যাথির শিশি কিচ্ছু দেখতে না পেয়ে তাঁর মেজাজ সপ্তমে। উঠতে বসতে তিনি সকল ছেলেদের তেজ্য পুত্র করে দেওয়ার কথা বলছেন। তাঁর সব শখের জিনিস খুঁজতে ছেলে, বৌমাদের গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে।
নারায়ণপতি আর গণেশপতি প্রত্যেকদিন পুরনো বই এর দোকান ছুটছে। শুধু পুরনো বই নয় যা কিছু ফেলে দেওয়া হয়েছে সব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই যা হোক করে সম্পত্তি ভাগ এবং আইনি উপায়ে নিজেদের নামে করতে হবে। এরই মধ্যে তিনভাই বার পাঁচেক উকিল বাবুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কে কোন ভাগটা নেবে তা ঠিক করে সেইমতো আইনি কাগজপত্র তৈরি করতে দেওয়া হয়ে গেছে। এবার সুযোগ বুঝে শুধু সাইনটা করাতে হবে।
নিখিলেশ দুদিন হল তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ধুলিগড়ের বাড়িতে এসেছে। সাথে তার সহকারী জোন্সও এসেছে। নিখিলেশদের বহু বছরের পুরনো বাড়ি দেখে ধরেই নিয়েছে এখানে অবশ্যই সেকেন্ড ডাইমেনশনের সদস্যরা এসে বসতি স্থাপন করেছে। তার কব্জিতে বাঁধা আছে রিস্ট মনিটর যা অন্য ডাইমেনশনের লোকজনের উপস্থিতিকে মনিটর করতে পারে। নিখিলেশ তার ঘরে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসেছিল। হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।
কে?
নিখু, আমি রে। একবার আসব?
ও মা, হ্যাঁ এসো। জিজ্ঞেস করার কি আছে। চলে এস। নিখিলেশের মেয়ে অ্যানা ঠাম্মাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরল। ঠাম্মাও নাতনির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
ব্যস্ত আছিস নিখু?
না না বল না।
কী বুঝছিস বলতো প্যালাকে দেখে? বুড়ো তো সেই কবে থেকে এসে প্যালার ঘাড়ে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত সম্পত্তি ভাগের ব্যাপারে টু শব্দটি করছে না।
একদিনই তো দেখলাম সবে ছেলেটাকে। আমাকে আরও স্টাডি করতে হবে। আচ্ছা, মা, সেদিন রাতে ঠিক কি ঘটনাটা হয়েছিল বলোতো?
কোন দিন?
যেদিন তোমরা প্ল্যানচেট করেছ সেদিন। আমাকে যদি আগে থাকতে একবার জানাতে….
আমি তোর বাবাকে পই পই করে বলেছিলাম যে ছেলেটাকে একবার জানাও। ওর তো এইসব নিয়েই পড়াশোনা। কিন্তু না সবার তখন ঐ সম্পত্তির ভুত চেপেছে মাথায়। হ্যাঁ রে, এই ভুত ঘাড় থেকে আবার নামবে তো?
দেখো মা, তোমাদের চোখে এরা ভুত। কিন্তু আমাদের স্টাডি বলছে এরা আসলে সেকেন্ড ডাইমেনশনের মানুষ যাদের জৈবিক দেহ নেই। পদার্থের যেমন তিনটে দশা হয়- কঠিন, তরল, গ্যাসীয়। ঠিক তেমনই মানবদেহেরও বিভিন্ন দশা আছে। প্রত্যেকটা দশায় তার রেন্ডমনেস চেঞ্জ হয়ে যায় সাথে সাথে দেহের অবস্থাও। কিন্তু মনটা একই থাকে আই মিন আত্মা। আর এইগুলোকেই আমরা বিভিন্ন ডাইমেনশনে বিচার করি। এনি ওয়ে বল কি হয়েছিল।
নিখিলেশের মা বিভাবরী ঘোষাল সেই রাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলেন। সব শুনে নিখিলেশ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। পাশে তার স্ত্রী মহুয়াও সব চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠলো,
-অ্যানা কই? বাকিদের খেয়াল হল সত্যিই অ্যানা তো ঘরে নেই। নিখিলেশ শান্ত ভাবে বলল,
- কোথাও আছে। দেখ গিয়ে। মহুয়া শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে বাইরে এল। চারিদিকে সন্ধ্যে নেমেছে। সামনে বাগানের ঈশান কোণে কাঁঠাল গাছটা হাওয়ায় দুলছে। সারাদিন গ্রীষ্মের চরা রোদের পর সন্ধ্যাবেলার এই হাওয়াটা প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আকাশে অগুন্তি তারা ফুটে আছে। মহুয়া মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে এল।
মেয়েটা গেল কোথায়?
ছাদের এইদিকের কোনটায় আসতেই দেখতে পেল, অ্যানা, কি করছ তুমি ওখানে? অ্যানা ছুট্টে চলে এল মায়ের কাছে।
কী করছ তুমি একা ছাদে?
একা কই মাম্মাম? আমি তো ঐ দাদুটার সাথে কথা বলছিলাম।
কে? কই? কোথাও কেউ নেই তো? ছিল তো। তুমি এলে বলে দাদুটা লুকিয়ে পড়ল।
মহুয়া মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে হাসল। অ্যানার এরকম মন গড়া কথা বলার অভ্যাস আছে। একা একা নিজের পুতুলের সাথেও সে কথা বলে।
তাই? কী বললেন সেই দাদু তোমাকে?
অনেক কিছু।
কিরকম?
বলল, এই বাড়িতে কেউ তাকে ভালোবাসে না। কেউ না।
মহুয়া হাসলেন, আচ্ছা। চল তুমি খেয়ে নেবে চল।
(৬)
ঘরটা বড্ড ছোট্ট, স্যাঁতস্যাঁতে। দেওয়ালের রং উঠে চুনের রেখা দাঁত বার করে আছে। একেকটা জায়গার সিমেন্ট কেমন ফেঁপে আছে, হাল্কা চাপ পড়তেই ঝড়ে পড়ছে। ঘরে একটা ছোটো চৌকি, তার ওপর মলিন একটা চাদর পাতা। কোণের দিকে জং ধরা একটা ট্যাংক, কোনো লক সিস্টেম নেই তাতে। নিখিলেশ ট্যাংকটা খুলে একবার উঁকি দিল। কতকগুলো ছেড়া জামা তার মধ্যে ঢোকানো। ট্যাংকের ওপরে বহু পুরনো একটা রেডিও। নিখিলেশ দেখেই চিনতে পারল এটা তার দাদু স্বর্গীয় উমাপতি ঘোষালের রেডিও। দাদুমশাই এই রেডিওটা হাতছাড়া করতেন না, মনে আছে তার। এই ঘরেই প্যালা থাকে। প্যালা বোধ হয় দাদুমশায়ের রেডিওটা রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। বাড়ির একেবারে নীচে তলায় এই ঘর। নীচে তলার ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল চাকর ঝিদের থাকবার জন্য। দশপতি ঘোষালের সময় নীচে তলায় যেন হাট বসত। নিখিলেশ সবটাই শুনেছে তার দাদু মশাইয়ের কাছে। সকালে প্যালাকে আর একবার স্টাডি করে সে আর জোন্স এসেছে তার ঘর দেখতে। যদিও এখন সে উমাপতি ঘোষালের ঘরেই থাকে কারণ সে তো এখন প্যালা নয়।
কি মনে হচ্ছে জোন্স? কেসটা কি?
কেসটা তো পরিষ্কার স্যার। সেকেন্ড ডাইমেনশনে পপুলেশন ডেনসিটি তার ক্রিটিক্যাল পয়েন্ট ক্রস করে গেছে আর তাই এই ডাইমেনশনে প্রবেশ করছে তারা। লা শ্যাতেলিয়ার প্রিন্সিপল অনুযায়ী রিয়াকশন ডাইরেকশন এখন রিভার্স দিকে, তাই প্যালার বডিটা ছাড়তে পারছেন না আপনার গ্র্যান্ড পা।
হুম। কী করা যায় বলোতো এখন?
ট্রান্সফরমেশন।
কিরকম?
দেখুন স্যার, কোনোভাবে প্যালার শরীরের যে এক্সটার্নাল এনার্জি প্রবেশ করেছে মানে আপনার দাদুর আত্মা, তাকে কোনোভাবে ম্যাটারে কনভার্ট করা যায় তাহলে একটা উপায় হতে পারে। আর নয়তো সেকেন্ড ডাইমেনশন থেকে কোনো সদস্য যদি আমাদের ডাইমেনশনে আসে, তাহলে ইনাকে ফেরত পাঠানো যাবে।
হ্যাঁ। কিন্তু সে তো ঝামেলা একই থেকে যাবে।
তাই তো বলছি স্যার প্রথম অপশনটাই বেস্ট।
কিন্তু সেটা করব কি ভাবে?
আই হ্যাভ আ প্ল্যান। আপনার দাদুর সবথেকে প্রিয় জিনিস কি?
এটা বলা একটু টাফ। দাদুমোশাই যত পুরনো জিনিসপত্র রেখে দিত। কোনোদিন ফেলতেন না। তার মধ্যে আমাদের ছোটবেলার বইপত্র, তার লাল হয়ে আসা পাতা। হ্যাঁ মনে পড়েছে জন্স, দাদুমশায় মাঝে মাঝেই দেখতাম ঐ বই খুলে পুরনো পাতার গন্ধ নিতেন।
ব্যাস তাহলে তো হয়েই গেল।
আর একটা ব্যাপার খেয়াল করতে হবে জোন্স। বাবা, জ্যেঠু যে কারণে দাদু মশাইকে এই ডাইমেনশনে নিয়ে এসেছেন সেটা যাতে পূরণ হয়, মানে সাইনটা যা হোক করে করাতে হবে।
নো প্রব্লেম স্যার। হয়ে যাবে। আমাদের যা হোক করে ঐ পুরনো বইগুলো জোগাড় করতে হবে।
সেদিনই সন্ধ্যেবেলা ঘোষাল বাড়ীর তিন ছেলে এবং তাদের ছেলেরা মিলে আলোচনায় বসলেন। উকিল বাবু কথা মতো সম্পত্তি ভাগের কাগজপত্র বানিয়ে দিয়েছেন। এখন তাতে সই কি ভাবে করানো হবে সেই নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। জোন্স সবাইকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
আপনাদের বাবামশাই কোনো নেশা করতেন? মানে যে নেশাতে তাঁর বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেত।
বাবামশায়ের হুঁকোর নেশা ছিল। কিন্তু তাতে সেরকম কিছু তো হত না। নারায়ণপতি বললেন।
একটু ভেবে দেখুন। এমন কিছু…..
সকলে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর রমাপতি বাবু লাফিয়ে উঠলেন।
হ্যাঁ মনে পড়েছে। আমি তখন খুব ছোটো। বাবা মশাইয়ের বন্ধুরা মিলে একবার বাড়ীর নারায়ণ পুজোর সময়ে সিদ্ধি খাইয়ে দিয়েছিল। সেদিন সারারাত তিনি ভুলভাল বকে ছিলেন। কোনো হুঁশ ছিল না। যে বাবামশায় কোনোদিন আমাদের মায়ের কথা শুনতেন না, সেই রাতে মা যা বলেছিলেন সব করেছিলেন। আমার এখনও মনে আছে মা পায়ে ব্যথা হচ্ছিল বলছিলেন। বাবা মশায় মায়ের পাও টিপেছিলেন। রমাপতি বাবু হেসে উঠলেন বলতে বলতে।এই ঘটনা কবে ঘটল? আমার মনে নেই তো।
কী রে মেজদা, তোর মনে আছে? গণেশপতি বললেন।
আহা! মনে থাকবে কি করে? তোরা তো তখন খুব ছোটো।
রমাপতিবাবু প্রত্যুত্তরে বললেন। বাহ্! তাহলে আমাদেরও এমনি কিছু করতে হবে। আপনাদের মায়ের পায়ের পরিবর্তে এখানে থাকবে আপনাদের সম্পত্তির কাগজপত্র। কিন্তু সাবধান। কোনোভাবে সন্দেহ যেন না করেন উনি।
(৭)
আজ পূর্ণিমা। ঘোষাল বাড়িতে কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে সত্য নারায়ণ পুজো চলছে। পাড়ার বেশ কিছু লোককে খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। নারায়ণপতি আর গণেশপতি ঘোষাল সেইদিকে তদারকিতে ব্যস্ত। প্যালার দেহে উমাপতি ঘোষাল খাদির ধুতি পাঞ্জাবি পরে তাঁর হাতে ধরা লাঠির মাথায় তাল দিচ্ছেন। পাড়ার লোকজন প্যালাকে কর্তামশায় জ্ঞানে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছে।
পুজো শেষ হলে খাওয়া দাওয়া করে একে একে সকলে বিদায় নিল। বাড়ির সকলের ও খাওয়া কমপ্লিট। এবার আসল কাজে নামতে হবে। রমাপতি ঘোষালের স্ত্রী উমাপতিবাবুর বড় বৌমা নির্মলা ঘোষাল সিদ্ধি মেশানো পানীয় নিয়ে গিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের সামনে ধরলেন।
বাবা মশায়, এটা খেয়ে নিন। আপনার প্রিয় ক্ষীর লস্যি বানিয়েছি।
ক্ষীর লস্যি? কই দাও দাও। বলে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন গ্লাসটা। বড় বৌমা চলে গেলেন। বাইরে থেকে উঁকি দিয়েছে সকলে ।
সিদ্ধির ডোজ ভালোই ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই উমাপতিবাবু টলমল পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফুটফুটে জ্যোৎস্না-আলো ছিটকে আসছে জানালা দিয়ে। গান ধরলেন তিনি। নাহ্! নেশাটা ভালোই ধরেছে। রমাপতি, গণেশপতি আর নারায়ণপতি সুড়সুড় করে ঘরে এসে ঢুকল।
বাবা মশায়, একটা কাজ ছিল।
কী কাজ? আমার এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
অবশ্যই। শুধু একটা সাইন করতে হবে।
সাইন? কোথায়? আমাকে বিরক্ত কোরো না তো। যাও এখন।
আমরা চলে যাব বাবা মশায়। শুধু এই কাজটুকু…. খুব দরকার। নারায়ণপতি অনুনয় করে বললেন।
করে দিলে তোমরা আর বিরক্ত করবে না তো? টলমল পায়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, গণেশপতি ধরে চেয়ারে বসালেন।
কই কি আছে দাও। মেলা বিরক্ত কোরো না আমায়।
রমাপতি পেন আর কাগজ এগিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কোথায় স্বাক্ষর করতে হবে। উমাপতিবাবু ঘোরের মধ্যেই সাইন করে এলিয়ে পড়লেন চেয়ারে। জোন্স এগিয়ে এল। এই কাজ সে একাই করে স্যারের চোখে নিজের সম্মান বাড়াতে চায়। ঝোলা থেকে কিছু পুরনো বই বার করে ছড়িয়ে দিল মেঝেতে। প্যালার গায়ে হাত দিয়ে কিছু একটা মন্ত্র পড়ল বির বির করে। সেকেন্ড ডাইমেনশন থেকে আগত এনার্জির রণ্ডমনেস বেড়ে গেল। জোন্স নিখিলেশের আবিষ্কৃত ম্যাগনেটিক অ্যানালাইজার নামক যন্ত্রটি বার করল। এই যন্ত্র এক্সটার্নাল ম্যাগনেটিক ফিল্ড অ্যাপ্লাই করে চার্জড এনার্জিকে মুভ করতে সাহায্য করে। প্যালার শরীরে থাকা এনার্জি বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এসে আছড়ে পড়ল পুরনো বইয়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সকলের চক্ষুস্থির। শুকনো, লাল হয়ে আসা পাতাগুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এনার্জি ম্যাটারে কনভার্ট হল।
পরের দিন সকালে আইনি কাগজপত্র নিয়ে তিন ভাই উকিলবাবুর বাড়ি গেলেন। মুখে তাদের খুশির ঝিলিক।
দেখে নিন উকিলবাবু সব ঠিক আছে কি না। উফফ যা ঝড় গেল। উকিলবাবু নাকের ডগায় চশমা নামিয়ে দেখতে লাগলেন,
এ কার সই এখানে?
কার আবার? বাবামশাইয়ের।
কিন্তু…. দেখুন একবার।
তিন ভাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সই দেখতে।
সেখানে নড়বড়ে হাতে লেখা আছে শ্রীমান প্যালা কুমার।
কবিতা
পার্থ সরকার
একাকী ভূতপূর্ব আখ্যান
ভিজে যাচ্ছে কথা
সরু বৃষ্টিধারায়
ক্রমেই জমাট বাধছে কুয়াশা পৃথিবীর ওপর
ক্রমেই জমে যাচ্ছে সমুদ্র
উঠোন জুড়ে জল
ঘরে বাইরের আদ্র পরিকল্পনায়
তাকিয়ে দেখে নৈঃশব্দ
ভয় মেশানো আনন্দে
সম্মুখে স্বাধীনতার মূর্তি
আর তার প্রশ্ন- ও কি কেবল মূর্তি?
আহার শেষে মরচে ধরা লোহা
কমে ক্রমে আসে মাটি
পায়ের তলায়
স্বাধীনতার।
কবিতা
রবীন্দ্র দাস
হৃদয়ের দিগন্ত
দূরে থাকা বসন্ত ছুঁয়ে যায়
অল্প কথার কিছু বার্তা,
তাতে ভরে রাখা একটু হাসি
হৃদয়ের অলিন্দে রক্ত শীতল হয়ে আসে।
তারপর একটু আবেগ...
স্নেহভাজনের পথটুকুও
সূর্য অস্তমিতের রক্তিম আভাটা
বুঝবে এপথ খুবই শক্ত,
তাই পাখি আজও ডানা মেলে ওড়ে আর সেই শূন্য মন দাঁড়িয়ে থাকে শেষ দিগন্তের
দিকে চেয়ে...
গল্প
গ্রামে যাত্রা
কল্যান সেনগুপ্ত
মুকুল ট্রেনে উঠেই বললে - 'শোন এবার পিসির পালা পড়েছে পুজো আর যাত্রার। তাই পিসেমশাই,ভাই শুভ দুজনেই নাটক করবে। ওদের নাটকটা কিন্তু দেখতেই হবে। রাতে হবে। খেয়েই শুয়ে পড়িস না আমার প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে। কলেজ ছুটি। লক্ষ্মী পুজো শেষ ,আমি আর সুনীল চলেছি মুকুলের পিসির বাড়ির গ্রামে। আমরা হচ্ছি বিশিষ্ট দর্শক। পিসির হয়ে দর্শক বাড়াতে চলেছি। মুকুল বলেছে ভালো খাওয়া দাওয়া হবে। লোভটা আসলে ওটাই, কিন্তু মুখে বলা যাবে না। ওদের নাটক দেখতে হবে, ভালো বলতে হবেই। আরেকটা লোভ তিন মহলা জমিদার বাড়ি দেখব। জমিদার বাড়ি সিনেমায় দেখেছি।'
স্টেশনে পৌঁছে মনটা দমে গেল। দেখি ঘোড়ার গাড়ি আসেনি। এসেছে একটা অ্যাম্বাসাডর। অনেকটা গ্রামের ভিতরে চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি ভরা রাস্তা পেরিয়ে সেই বাড়ি। সামনেই একটা পেল্লাই গেট, ওপরে সিংহর মূর্তি। দেখেই আমাদের উত্তেজনা তুঙ্গে। পাঁচিল ঘেরা জায়গা। লাল মোরাম বাঁধানো রাস্তা। ঢুকে সামনে অনেকটা ফাঁকা জমি দুদিকে ফুলের বাগান। একটু দূরে বিরাট গাড়ি বারান্দা দেওয়া প্রবেশ পথ। গাড়ি এসে দাঁড়ালে একজন কর্মচারী এসে আমার মুকুল আর সুনীলের ব্যাগগুলো নিয়ে চলে গেল ভিতরে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে শুভ। প্রথমেই বিরাট এক বসার ঘর, ইয়া উঁচু। বড় বড় অয়েল পেইন্টিং দেয়ালে। একতলা আমাদের এখানে দুতলা বাড়ির মত। একদিকে সোফা সেট অন্য দিকে বিরাট জলচৌকি ওপরে যেমন দেখেছি সিনেমায় তেমন সাদা চাদরে ঢাকা সঙ্গে কিছু বালিশ। এক দেয়ালে প্রচুর বই। প্রথম মহলটা একরকম অফিস, কাছারি, গুদাম। পরের মহলে অতিথিদের ঘর, নাটমন্দির, শেষে অংশে জমিদার বাড়ির লোকজনেরা থাকে। আমরা তিনজন গুটিগুটি সব পেরিয়ে শেষে পিসির পেল্লাই রান্নাঘরে হাজির। পিসি দেখে নি নিশ্চিন্ত, যাক বাপের বাড়ি থেকে কেউ তো এসেছে। শুভ আনন্দে আটখানা। বলে - "কি যে আনন্দ হচ্ছে কি বলব। কাউকে চিনি না। কালেভদ্রে আসা। কথা বলার কেউ নেই এই বিরাট বাড়িতে। তোরা এসেছিস এবার দারুন জমবে। চল, চল সব ঘুরে দেখাই"।
আমরা দুদিন থাকবো। প্রথম দিন গ্রামের লোকেদের যাত্রা, পরের দিন বাড়ির লোকেদের নাটক। দুপাশে দুটো বিরাট দীঘি। তার চারদিকে প্রচুর গাছ গাছালি। ছাদে গেলে বাড়িটার ব্যাপ্তি বোঝা যায়।কিন্তু শেষের মহল বড়ো খালি খালি। আমরা যে ঘরে থাকবো ঠিক হলো সেটা একটা বিরাট ঘর। অন্তত তিরিশ ফুট লম্বা আর পনেরো ফুট চওড়া। একদিকে অন্তত পাঁচজন শোয়া যায় এমন খাঠ, অন্য দিকে একটা পালিশ করা পুরনো কাঠের সোফা সেট, সঙ্গে কিছু সাইড টেবিল। একটা কাঠের আলমারি তাতে অনেক বই। আর আছে এক আরাম কেদারা, ভাঁজ করা হাতল, সেটা তে হাত রাখা যায় আবার বাড়িয়ে নিলে পা ও রাখা যায়। একদিকে ঘরের ইয়া চওড়া চকমেলানো বারান্দা আর দুটো জানালা। অন্যদিকে তিনটে মাটি থেকে আট দশ ফুট উঁচু জানলা। আমরা খুঁপরি খুঁপরি ঘরে থেকে অভ্যস্ত। জমিদার বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরই হলঘর। এখানে একা একা চলা ফেরা করা বেশ মুশকিল। কেমন একটা ভয় ভয় করে। ঘর দেখে মনে হল একটা স্বপ্নের দেশে চলে এসেছি। জানলা দিয়ে তাকালে সামনে দীঘি তারপর বড় বড় আম জাম কাঁঠাল গাছের সারি। পাঁচিল দেখা যায় না। বড়বড় গাছের জন্যে। ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বাথরুম। ঘরে দিনের বেলা বেশিক্ষণ থাকা হয় নি। গ্রাম দেখা, পাশের গ্রামের মন্দির দেখে, জব্বর খেয়ে কাটলো সেদিন।
দুপুরবেলা আমি সুনীল, মুকুল আর শুভ বের হলাম গ্রাম দেখতে। দুর্গা মন্ডপ, নদীর পাশে কালী মন্দির, বাজার, আর দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। আলের ওপর দিয়ে একটু হাঁটলাম। প্রচুর পাখির কলকাকলি বাড়ছে কারণ আলো কমে আসছে। সোঁদা গন্ধ পথে ঘাটে গাছতলায়। দুর্গা মন্ডপের পাশে যাত্রা, কীর্তনের জন্যে বাঁধানো চাতাল, সেখানে সেদিনের যাত্রার রিহার্সাল চলছে। কারুর খালি গা লুঙ্গি পড়া, কারুর পায়জামা বা হাফ প্যান্ট। হাতে তীর ধনুক। দেখে মনে হলো রামায়ণ বা মহাভারতের কোনো অংশ নিয়ে যাত্রা। গলার গমক দুর থেকে শোনা যাচ্ছে। গিয়ে দাড়িয়ে একটু দেখতেই যে নেতা সে এগিয়ে এলে, বললে একটু হেসে "বুঝলেন না শেষ মিনিট টাচ চলছে। আসবেন কিন্তু"। শুরু রাত নটা। প্রচুর হাঁটাহাঁটি করলাম আর সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম রাজবাড়ীতে। রাত্রিটা তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে গ্রামের লোকেদের যাত্রা দেখতে বসলাম আমি মুকুল, সুনীল আর শুভ। কিন্তু বসতে থাকে পারছি না।একদিকে প্রবল মশা। তার সঙ্গে গ্রামের লোকদের এত ভিড় যে লোকে প্রায় গায়ের ওপর উঠে আসছে। তারপর লুচি মাংস খেয়ে প্রবল ঘুমের আনাগোনা। চুপিচুপি আমি আর সুনীল গিয়ে অন্ধকারে দোতলায় উঠে ময়দানের মতো খাঠে শরীরটা ফেলেছি আর ঘুমের অতল সাগরে তলিয়ে গেছি।
পরদিন শুভ আর মুকুল এসে তুললে।
- কিরে তোরা কি ঘুমোতে এসেছিস? যাত্রার পর প্রাইজ দেবার সময় তোরা নেই।। সবাই ডাকাডাকি করছিল। শেষে মা বলল - সকাল বেলা ঘর থেকে বেড়িয়েছে তাই পারেনি ঘুমিয়ে পড়েছে"। "আজ কিন্তু থাকতেই হবে রাত্রে মনে আছে ত? আজ বাড়িতে হেভি ব্যাপার সবাই আস্তে যেতে পার্ট মুখস্ত করছে, ভুলে গেলে দৌড়ে গিয়ে খাতা দেখে আসছে। শুভ বললে সুনীল তুই ভালো প্রমোট করিস, বাবা বেশ নার্ভাস পার্ট নিয়ে। তুই আজ আপনাদের একদিকের প্রমোটে থাকিস। বাবা তোর কথা বলছিল। তোকে আগে কলকাতার পাড়ায় দেখেছে মনে হয়।
রাত্রে ঝপর ঝপর বাজনার পড়ে নাটক শুরু হলো। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের, চন্দ্রগুপ্ত। গিজগিজ করছে গ্রামের লোক। মুকুলকে আর আমাকে একটা সামনে বসার জায়গা দিয়েছে মাটিতে। কিন্তু এমন চাপ মহিলা, বাচ্চা, যুবকরা প্রায় গায়ের ওপর উঠে পড়ে আর কি। সুনীল একদিকে আর খাজাঞ্চি খানার একজন অন্যদিকে বই হাতে দাড়িয়ে উইংস এর পাশে। নাটক শুরু হল, একটু পর থেকেই মঞ্চে ছেলে বাবা থেমে থেমে উচ্চস্বরে কথা বলছে। মানে যেটুকু প্ৰমোট এ শোনা গেল ফের সেটা জোরে জোরে বললে তারপর সব চুপ। পার্ট বেমালুম ভুলে গুলিয়ে গেছে। স্টেজ এ সব পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে। বুঝলাম কিছুই মুখস্ত করেনি কেউ। প্রতি মুহূর্তে থমকে যাচ্ছে, কোনো সময় প্রমোটেরের কথাও না শুনতে পেয়ে উইং এর দিকে চাইছে। দর্শক প্রজা, বেশি কিছু বলতেও পারছে না। এর মধ্যে শুভ একবার স্টেজ এর মাঝখানে আর তখন প্রম্পট শুনতে পাচ্ছে না। অগত্যা সে কিছু একটা অছিলায় উইংসের দিকে গেছে আর তখনই সুনীলের হাত থেকে বইটা পড়ে গেছে মাটিতে। তাড়াতাড়ি করে তুলে আর খুঁজে পাচ্ছে না কোথা থেকে প্রম্পট করবে। আর স্টেজ এ শুভর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। শেষে ওটা খুঁজে পেতে আবার প্রম্পট শুরু করলে নাটক চলতে থাকে। সে একটা বিশ্রী ব্যাপার। হঠাৎ দেখলাম শুভর বাবা প্রম্পট না শুনতে পেয়ে, প্রথমে চোখ দিয়ে বার দুই পরের পার্টটুকু জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো উত্তর না পেয়ে উইং এর আড়ালে প্রমোটারের কাছে যেতে গিয়ে উইংস এর ভিতরে ঢুকে গেলেন। এদিকে তখন সুনীল হঠাৎ পেট কামড়াতে বই রেখে দৌড়েছে বাথরুম এ। এইবার দর্শক চিৎকার শুরু করেছে বেরিয়ে আসুন, বেরিয়ে আসুন কিছু শুনতে পারছি না। আর সুনীল সেখান থেকে কেটে পড়েছে। পিসেমশাই যখন সুনীলকে পেলেন না তখন নাটক থেমে গেল। পরিচালক শুভর এক কাকা বললেন প্রমোটার এর পেট কামড়েছে। তাই উনি থাকতে পারবেন না। আরেকজনকে জোগাড় করে শুরু হল। সুনীল একটু বাদে এসে বললে অন্ধকারে - চল চল ওপরে যাই। বেদম পেট কামড়াচ্ছিল তাই দৌড়েছিলাম বড় বাথরুম। মুকুল বললে - আমি যেতে পারব না, তোরা যা।
আমি বললাম - এটা কুকুরের পেট এত মাছ, ঘি এ ভাজা লুচি, পায়েস, মাংস সহ্য হয়?
জানি এখন আর কেউ কিছু বলবে না। নাটক শুরু হলো আবার আর আমরা একলাফে সিড়ি ভেঙে দোতলায় ঘরে ঢুকে বিছানায় লাফ।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল পেটে বেগ আসাতে। তখনও নাটক চলছে শুনতে পাচ্ছি। বাথরুম যাবার সময় ঘুম চোখে বুঝতে পারি নি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে পা দিয়ে মনে হল অন্য এক জগৎ। ঘরের অর্ধেক জোৎস্নার নীলচে আলোয় ভাসছে। ঘরের মধ্যে অর্ধেক আলো অন্ধকার। জানলার সামনে দাড়িয়ে মনে হল বাড়িতে নয় দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ যতদূর যায় দীঘির এদিক ওদিক পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হালকা বাতাস বইছে। কদিন বাদে পূর্ণিমা, দীঘির ওপর চাঁদের প্রতিবিম্ব তিরতির করে কাঁপছে। টিঃ, টি করে কোনো অজানা পাখির ডাক দুর থেকে ভেসে আসছে। দীঘির জল মাঝে মাঝেই ছোট ছোট ঢেউ তুলছে হঠাৎ হঠাৎ। দূরে ভূতের মতন আম, জাম, কাঁঠালের সারি পরপর দাঁড়িয়ে আছে। হালকা কীর্তনের খোলের শব্দ আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। আর কাছে কোথাও কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির সুর বাতাসে গুমরে গুমরে উঠছে। বেজেই চলেছে। ভীষণ করুণ সে সুর। সুর চরাচরকে বিদীর্ণ করছে। বুকের মধ্যে সেই সুরের মায়াজাল ছেয়ে ফেলছে, শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে ভেসে যাচ্ছি কোথাও। মুকুলকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হবে নাহলে আমি শহরের গলি রাস্তার ইঁট কাঠ ফেলে এই রাত্রির রূপ দেখবার সৌভাগ্য হয়? সৃষ্টি কর্তা কখন যে খুলে দেন তার রূপের ডালি, মেলে ধরেন নিজেকে জানি না। সুখ অসুখ আনন্দ বেদনার কোনো অনুভূতিই নয়, একটা দুঃখ বোধ, একটা ঘোর, ঢেকে ফেলছে মন প্রাণকে। অথচ তেমন দুঃখ বোধ এখন ত আমার নেই। এমন অপার্থিব, অসাধারণ, দৃশ্যতে স্নাত হতে হয়ে ভিজে গেছি। দাঁড়িয়েই আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সময় চলে যাচ্ছে। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। হঠাৎ সুনীল উঠে পড়ল। কোনদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে সোজা বাথরুমে। আমি বিছানায় এসে শুলাম। এমন দৃশ্য দেখব ভাবিনি। ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভাঙলো শুভ, আর মুকুলের কথাবার্তায়। - কিরে কেমন আছিস? তোকে আর সুনীলকে নিয়ে ত চিন্তায় পড়ে গেলাম। মুকুলের পিসি হজমের ওষুধ নিয়ে এলেন। মুকুল বললে - জানিস নাটকটা পরে খুব জমে গেছিল। পিসেমশাই পরের দিকে পার্ট মনে পড়ে যাওয়াতে স্টেজ এ নাকি ফাটিয়ে দিয়েছে। যিনি নাটকের প্রথমেই পার্ট মনে না পড়াতে প্রমোটরকে খুঁজতে উইংন্স এর আড়ালে চলে যেতে পারেন তিনি পরে কী করে ফাটালেন সেটা বড় প্রশ্ন। জানি করা যাবে না সুনীল শুধু আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলে। পিসেমশাই বেস্ট অ্যাক্টর হয়েছেন। মুকুলের পিসি খুব আফসোস করলেন আমরা বাকিটা দেখতে না পাওয়ার জন্যে। পিসি নাটকের কথা বলছেন আর আমি গতকাল যে অপার্থিব দৃশ্য দেখেছি তার কথাই ভাবছিলাম। আহা এই জীবনে এমন আর কি দেখতে পাবো? মনে হয় না। গ্রামের যাত্রায় যাত্রা না করলে এত কিছু দেখা হোত না। পিসিকে একটা মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার আসবো কথা দিয়ে, সিঙ্গী মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে, আমরা কলকাতার দিকে রওনা দিলাম।
গল্প
বলেন স্যার
শান্তনু ঘোষ
চতুর্থ পিরিয়ড চলাকালীন ক্লাস এইট বি সেকশনের ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যেতেই একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে হেডস্যার বুদ্ধদেব চৌধুরীবাবু তার ঘর ছেড়ে পড়িমড়ি করে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। হেডস্যারের ঘরের সামনের লম্বা বারান্দার ঠিক উল্টোদিকে স্কুল মাঠের পশ্চিম দিকে এইট বি সেকশনের ঘর। শোরগোলটা আসছে ঠিক সেখান থেকেই। উচ্চকণ্ঠে সংস্কৃতের মাস্টারমশাই যিনি পণ্ডিতমশাই নামেই স্কুলে পরিচিত - তার ভারী গলা আর সঙ্গে বেতের ছপ ছপ আওয়াজে সদা গম্ভীর হেডস্যারের ঘরের লাগোয়া টিচার্স রুমে থেকেও সবাই যেন শশব্যস্ত হয়ে বেড়িয়ে আসলেন।
হেডস্যার বুদ্ধদেব চৌধুরী চিন্তিত হয়ে বললেন, আজ আবার কি হলো, উফ! প্রত্যেকদিন এই অশান্তি আর ভালো লাগেনা। ধুর এসব দেখবো না অফিশিয়াল মেটার সামলাবো। সামনের সপ্তাহেই ডিআই ভিজিট। সঙ্গে অন্যান্য আধিকারিকরা আসবেন। কত কি হিসেব সামলাতে হবে? তার মধ্যে এই উটকো অশান্তি আর ভালো লাগে না ....ধুর।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলের দপ্তরি শ্যামল মুৎসুদ্দিকে বললেন, কতবার যে পন্ডিত মশাইকে বলেছি, আরে বাবা দিনকাল ভালো না, আপনি বদলান নিজেকে। কর্পোরাল পানিশমেন্ট এখন নিষিদ্ধ পুরোমাত্রায়। কে কার কথা শোনে? বয়স্ক মানুষ, কিছু বললেই প্রেস্টিজে নেবেন। আর এদিকে কিছু হলে ঠেলা সামলাব আমি। পারিনা বাপু।
ঠিক তখনই ক্লাস নাইন এর ঘর থেকে আসছিলেন স্কুলের তরুণতম শিক্ষক রণিত মজুমদার। যে ইতিহাস ক্লাসে কোনদিনও ছেলেমেয়েরা রস কস পেত না, রণিতের ছোঁয়ায় যেন এক লহমায় বদলে গেল তাদের মনস্তত্ত্ব। স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংক্রান্ত খুঁটিনাটি ছোটখাটো সমস্যা সমাধানে তাই রণিত স্যার হেডস্যারের অন্যতম সেনাপতি। হাতের কাছে রণিতকে পেয়ে হেডস্যার কাছে এসে বললেন, রণিত, তুমি এসব একটু থামাও না ভাই। কোথা থেকে গার্জেন এসে উটকো ঝুট-ঝামেলা করবে ......
আর ভালো লাগছে না ভাই। আমার অনেক কাজ আছে। এসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলবেনা। তুমি একটু এটাকে সামলাও না।
রণিত মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন হেডস্যার বুদ্ধবাবু। উনি জানেন রণিত গিয়ে ঠিক সামাল দেবে। গতবার সরস্বতী পুজোর রাতে স্কুলের পাশের শঙ্কর মন্ডল এর বাড়ির নারকেল লোপাট হওয়া নিয়ে যা কান্ড হয়েছিল তা সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল বুদ্ধবাবুকে। শেষে রণিতের বুদ্ধিতেই অবস্থা সামাল দেওয়া গিয়েছিল সে বারের মত।
হেডস্যারের কথা মত রণিতবাবু ও আরো জনা তিনেক তারই বয়সী মাস্টারমশাই ঝড়ের গতিতে রওনা হলো এইট বি এর উদ্দেশ্যে। ওই ঘরে তখন রীতিমত ঝড় বয়ে চলছে। বাইরে থেকে কর্কশ গলায় শোনা যাচ্ছে পন্ডিত স্যারের বকুনি আর বেতের ছপ ছপ আওয়াজ। রণিতরা বুঝতে পারল ব্যাপারটা মোটেই পড়াশোনা কেন্দ্রিক নয়।ঘরে ঢুকেই পন্ডিতমশাই কে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন, "এরা মানুষ হবে!!!!! অসভ্য কোথাকার। আমি স্কুলের সিনিয়র টিচার আমার সঙ্গে কিনা ফাজলামো"।
বেত্রাঘাত প্রাপক ছাত্রটি কিন্তু যথারীতি নির্বিকার। রণিত পন্ডিতমশাইয়ের কাছে গিয়ে ওনাকে শান্ত হয়ে বসতে বললেন, "মাস্টার মশাই, আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি দেখছি ব্যাপারটা"।
"দেখো, দেখো। তোমাদের আশকারায় আজ এই দশা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের। আরো মাথায় তোল।"
মাছ ধরতে যাও, খেলাধুলা কর ওদের সঙ্গে। আরে তোমাদের জন্যই তো আজকে এদের এত বড় সাহস" রীতিমতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন পন্ডিত মশাই।
রণিত বুঝল তার প্রতি এই স্যারের একটা ক্ষোভ ভেতরে রয়েছ। শুধু এই স্যারের কেন, সিনিয়রদের একাংশের তার ওপরে তা যথেষ্টই রয়েছে তা সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। আর থাকবে নাই বা কেন, চিরাচরিত মারধরের পদ্ধতি বাদ দিয়ে নতুনভাবে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও চালু করেছে তাতে ও অল্প সময়ের মধ্যেই যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সন্দেহ নেই। এনিয়ে টিচার্স রুমে ও ফিসফাস কম হয় না তাকে নিয়ে। রণিত এসবকে কোন পরোয়া না করেই তার জয়ফুল লার্নিং এর পদ্ধতি চালিয়ে যাচ্ছে। ফল ও পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে। ছাত্র-ছাত্রীরা ওদের সমস্যা অকপটে বলতে পারে রণিতদের, বিশেষ করে রণিতকে। তাই স্কুলে কোথায় কোন ছাত্র কার সঙ্গে মারামারি করছে, কি সমস্যা তৈরী হচ্ছে এ নিয়ে হেডস্যার এই জাতীয় সমস্যাগুলোকে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। মারধরের সাময়িক বিরতি হতেই রণিত ছাত্রটির কাছে এগিয়ে গেল। ওর মুখটা চেনা হলেও নামটা নয়। তবে রণিত বিলক্ষণ জানে ছেলেটি একটু ফচকে ধরনের। গতবার সরস্বতী পুজোর রাতে স্কুলের পাশের বাড়ির শঙ্কর মন্ডলের বাগানের নারকেলগুলো বেমালুম হাফিস হয়ে গেছিল। রণিত নিজস্ব নেটওয়ার্ক খাটিয়ে জানতে পেরেছিল ওই কেসে এই ছেলেটি প্রাইম সাসপেক্ট ছিল। সাক্ষী-প্রমাণ না থাকায় সে যাত্রায় ছেলেটি বেঁচে গিয়েছিল। তখন থেকেই ওকে চিনে রেখেছিল রণিত। তবে স্পোর্টসম্যান হিসেবে ছেলেটার বেশ নামডাক আছে। ভালো ফুটবল খেলে, সাঁতার কাটে, বর্ষা ছোঁড়ে। স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস এ অনেকগুলোই পুরস্কার পেয়েছিল গতবার। ছেলেটা ক্লাস এইটে পড়লেও গায়ে-গতরে যথেষ্টই শক্তপোক্ত; সিনিয়র ক্লাসের ছেলেদের মত লাগে। তখনকার মত নামটা জানা হলেও কিছুতেই এই মুহূর্তে মাথায় আসলো না রণিতের।
যাই হোক দাঁড়িয়ে থাকা আপাত শান্ত এই ছেলেটি যে পন্ডিতমশাই এর রাগের অন্যতম কারণ সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না।
ওর কাছে গিয়ে রণিত জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে রে?
স্যারকে কি বলেছিস? স্যার তোর ব্যবহারে এত রেগে গেলেন কেন? ছেলেটি যথারীতি নির্বাক থাকলেও চিৎকার করে পণ্ডিতমশায় বললেন, "ও কি বলবে? ওকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? আমি বলছি কি হয়েছে?"
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলেন রণিতের কাছে। সোজা চুলের মুঠি ধরলেন ছাত্রটির। বললেন, "হারামজাদাটাকে ওর নাম জিজ্ঞেস করছি বারবার। আর বলছে কিনা - 'বলেন স্যার'। ফাজলামি পেয়েছিস? একটা পাক্কা শয়তান। বারবার জিজ্ঞেস করছি, তোর নাম কি, তোর নাম কি, ঘুরে ফিরে একই কথা - বলেন স্যার, বলেন স্যার। আরে বলছি না তো কি করছি? গাধা কোথাকার ......স্টুপিড,,, ছাগল"।
ছাত্রটির উদ্দেশ্যে আরও বেশকিছু চোখা চোখা বিশেষণ ব্যবহার করে ক্লান্ত হয়ে শেষে চেয়ারে বসে পড়লেন পন্ডিতমশাই। ছাত্রটি কিন্তু নির্বিকার চিত্তে যথারীতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কিছুই জানে না।
ছাত্রটির চিবুকে হাত দিয়ে মাথা উঁচু করেই রণিত জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে রে? এত রেগে গেছেন কেন? নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস। তোদের জন্য আমার মাথা মাথা কাটা গেল।
কোন উত্তর নেই এবারও। পন্ডিতমশাই ওর দিকে তেড়ে গিয়ে বা কানটা ধরে জিজ্ঞেস করলেন, "তোর নাম কি?" ছেলেটি যথারীতি উত্তর দিল, 'বলেন স্যার।'
কান ছেড়ে এবার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পন্ডিত মশাই বললেন, "বলছি না তো কি চুপচাপ আছি? তখন থেকেই তো একটা কথাই বলে যাচ্ছি। বারবার জিজ্ঞেস করছি তোর নাম কি? তোর নাম কি? আর কোন উত্তর নেই। ব্যাটা শুধু বলে কিনা, বলেন স্যার, বলেন স্যার।"
আবার শুরু হলো পন্ডিত মশাই এর পিঠ পূজা। রণিত কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলল," আরে আরে মাস্টার মশাই, আপনি উত্তেজিত হবেন না, দেখছি দেখছি। আপনার শরীরটা কিন্তু ভালো নেই। ওটা খেয়াল রাখবেন, কিছু হলে তখন মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।"
সঙ্গে সঙ্গে ওনাকে টেনে নিয়ে গেলেন অন্যদিকে। কানের কাছে কিছু একটা বলতেই রণিতের দিকে অত্যন্ত রেগে গিয়ে তাকালেন পন্ডিত মশাই। তারপর গজ গজ করতে করতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। বাইরে থেকে তখনো গর্জন করেই যাচ্ছেন পন্ডিত মশাই, "যতই জিজ্ঞেস করি ব্যাটা বলে কিনা বলেন স্যার, বলেন স্যার ,,,,কত বড় আস্পর্ধা, সাহস বলিহারি এদের"।
রণিত গোটা ক্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখল ছাত্রছাত্রীরা মুখটিপে মিচকি মিচকি হাসছে। ব্যাপারটা বোধগম্য করবার জন্য ক্লাসের ফার্স্টবয় শুভম এর দিকে এগিয়ে গেল রণিত। বলল শুভম, সত্যি করে বলতো কি হয়েছে পণ্ডিতমশাই এত রেগে গেছেন কেন? কি বলেছে ছেলেটি? বল বল আমাকে। কোন ভয় নেই। আমাকে তুই নির্দ্বিধায় বলতে পারিস ।কেউ তোকে কিচ্ছু করবে না।
শুভম আস্তে আস্তে বলল স্যার, ওই ছেলেটির নাম বলেন সোরেন। পন্ডিত স্যার যখন ওর নাম জিজ্ঞেস করলেন তখন থেকেই সমস্যা। ও সেটাই বলেছিল, 'বলেন স্যার', আর পন্ডিত স্যার রেগে গিয়ে ভাবলেন তার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছে। ব্যস....
আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না স্যার, পাছে পন্ডিত স্যার আমাদের না মারেন। এটাই হল মূল ঘটনা।
এতক্ষণ পর সবকিছু পরিষ্কার হতেই হো হো হো হো করে হেসে উঠল রণিত সহ শুভঙ্কর,পীযূষ, কাজল ও অন্যান্য ক্লাস থেকে আসা উপস্থিত শিক্ষকরা। একযোগে এহেন হাসির আওয়াজে গোটা ক্লাসের শোরগোল বাইরে বেরিয়ে যেতেই প্রায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সটান হাজির প্রধান শিক্ষক। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কি হয়েছে? প্রথমে মারধর আর এখন হাসির আওয়াজ কি ব্যাপার বলতো। আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
হাসির আওয়াজ শুনে পণ্ডিতমশাই ও ঘরের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন। ঈষৎ বিরক্তি সহকারে রণিতকে বললেন, "এই রণিত তোমাদের কী হয়েছে বলতো? তোমরা সবাই দাঁত বার করে এমন হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসছো কেন? তুমিও কি ওদের ফচকেমিতে যোগ দিলে নাকি?
রণিত হাসতে হাসতেই বললো, মাস্টারমশাই আপনি শান্ত হোন। আপনি কিন্তু শুধু শুধুই ওকে এতক্ষণ ধরে মারধর করলেন। ওতো আপনার কথারই উত্তর দিয়েছে। আপনি যেমনটা জানতে চাইছিলেন ঠিক সেই উত্তরটাই দিচ্ছিল। আপনি বুঝতে পারেননি তাই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল।
দৃশ্যত হতবুদ্ধির মত পন্ডিতমশাই চশমাটাকে নাকের ডগায় ঠিকমতো বুঝে নিয়ে বললেন, মানে? কি বলতে চাইছো তুমি? আমি বুঝতে পারিনি। ঠিক আছে তুমি যখন সবটা বুঝেছো তাহলে এবার আমাকে বোঝাও তো বাপু।
হাসতে হাসতে রণিত বলল, মাস্টারমশাই ছেলেটির নাম বলেন সোরেন। আর এখান থেকে যত সমস্যার উৎপত্তি। যখন আপনি জিজ্ঞাসা করলেন তোর নাম কি? ও আপনাকে বলেছিল, বলেন স্যার। ও ঠিকই বলেছে। ও তো ওর নামটাই বলেছিল। কিন্তু আপনি তা বুঝতে পারেননি। তাই ভাবছিলেন আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছে, ফাজলামি করছে। আসলে তা নয়। আপনাকে ও বলতে চাইছিল, ওর নাম বলেন স্যার।
সবটা শুনেই হেডস্যার বুদ্ধদেব চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত হা হা, হাহা করে অট্টহাসি শুরু করলেন যা সহজে থামেন থামতে চাইল না। আর হাসির দমকা হাওয়ায় উপস্থিত সকলেই যোগদান করলো শুধু পণ্ডিতমশাই ছাড়া।
এরপর পরাজিত সৈনিকের মতো কোনমতে এক টিপ নস্যি নাকে গুঁজেই ক্লাসরুম থেকে অদৃশ্য হলেন পণ্ডিতমশাই ঝড়ের বেগে। পেছনে বাকি মাস্টারমশাইরা। টিফিন এর বেলের পাশাপাশি তখন পেছন শোনা যাচ্ছে ছাত্রদের সমবেত আওয়াজ ,,,,,,,,,, বলেন স্যার ,,,,,,, বলেন স্যার।
কবিতা
মিজানুর রহমান মিজান
সিলেট, বিশ্বনাথ, বাংলাদেশ
কথা কি সত্য নয়
আজ মরলে কাল দু’দিন হয়
মানুষ তোমার কিবা রয়।
অস্থায়িত্বের এ ভবে এসে দেখাও দেমাগ
ভাল কথায় ঝম্প মেরে দেখাও রাগ
কিন্তু অল্প রোগে ধরলে থাকে কাতরতার ভয়।
হাবভাবে তো মস্ত গুণের বাহার
দয়ার গুণে চল কর আহার বিহার
তা ভুলে যাও, স্মরণ কি না হয়।
সরলে গরল মিলিয়ে বল মন্দ কথা
শূন্য পুণ্য ভেদ ভুলে মিষ্টকে বানাও তিতা
চাপে পড়লে সোজা হতে হয়।
কেহ গরম পদ পদবীতে, কেহ পেশী শক্তিতে
কেহ গরম কথায় আবার কেহ টাকাতে
সম্বলের অভাবে সকলই হিম হয়।
অনেক সময় মহাবিপদেও কাটে না ঘোর
রাজার তেলে খুশবো ছড়াও অন্ত:পুর
সব হারাবে নিশ্চয় একদিন এ কথা কি সত্য নয়?
তারে ভুলে
দেখা পাবার অপেক্ষাতে কাটে সারাবেলা
দিনমান কাটাই থেকে একেলা, নিরালা।
মনের যতো দু:খ ব্যথা বলবো একান্তে
হতাশ হয়ে ফিরি নীড়ে দিনান্তে
লজ্জা শরম বিসর্জি আছি ধরে পালা।
আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু
যাক জীবন হই যদি বলির পশু
আশার আশে অবশেষে পরতে যদি পারি মালা।
বন্ধু বিনা কেবা আছে সদা রহমত যেজন যাচে
তারে ভুলে অন্যের কাছে দিন কাটাই হয়ে বেভুলা।
আমার আমি কই
চলছি সদায় বন্ধের দয়ায়
আমার আমি কই।
আমিতো আমি নয় অন্যের উপর নির্ভয়
বাহাদুরি কোথা রয় অযথা শুধু হইচই।
একদিনের রোগে পাইলে সর্বাঙ্গ অবশ হলে
পাই না মুক্তি কোনকালে, দয়ার দয়ায় শুধু রই।
এ ভব সংসারে, অতল গভীরে
পড়িয়া আধাঁরে, পথহারা ভিন্নতা কই।
হোক জয় বা পরাজয়, ভাবি না এ বিষয়
যখন যেথা ইচ্ছা হয়, তব নাম জপি কষ্ট হয় যতই।
কবিতা
এক ডজন ছোট্ট কবিতা
আশরাফ উল আলম শিকদার
ঢাকা, বাংলাদেশ
মৃত্যুকে ছুঁয়ে ফিরে আসা
হ্যাচ্চো! মৃত্যুকে ছুঁয়ে ফিরে আসা
করোনার পর
এই করোনার পর
শহর সব হচ্ছে সরব
ভিখারী মুখর
একটা ভালো খবর
জেগে উঠে বসে থাকি বিছানায়
একটা ভালো খবরের আশায়
শেষে ইমেল খুলি, সেই থোড়-বড়ি-খাড়া ...
ভগ্ন দূত
পয়সা অনেক আজ
এসেছে হাতে, অর্থাৎ
কাল অভাব আসছে।
শত্রু মিত্র বিচার
মিত্রের শত্রু কে
শত্রু জানে মিত্র কে
তারা একই জন
সংযোগ সংস্থাপন
সংযোগ সংস্থাপন
সম্পর্ক রক্ষণ-বেক্ষণ
আত্মীয় স্বজন
চাই স্বাধীনতা মোর
বিনিময়ে যাক
বা থাক প্রাণ বা গর্দান, চাই
স্বাধীনতা মোর।
মাকড়সা
সে বসে আছে
পোকামাকড়ের আশায়
খাবার অপেক্ষায়
চোখ
শিয়ালের দু চোখ
গভীর রাতে উকি দেয়
হাস-মুরগির বাসায়
ওয়ান ইসটু ফোর
আরশোলার পা
গরম চিকেন স্যূপে ─
ওয়ান ইসটু ফোর
সন্দেহ
প্রভুকে ডাকে
কুকুর চিৎকারে, চোর, চোর
সন্দেহে সব্বাই
তোমার ছোট্ট নাও
বড় মাছের লোভ
নেয় টেনে মাঝ সাগরে
তোমার ছোট্ট নাও
গল্প
অজানার টানে
পিন্টু মিত্র
অ্যাশ ভ্যালি, ইংল্যান্ড
লেখকের পরিচয়: আমি একজন অশীতিপর বৃদ্ধ কোভিড-১৯ এর জ্বালায় একান্ত বাস করছি। আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রাম বাংলায়, লেখাপড়া ও কাজে তাগিদায় বাকিটা কাল দেশে বিদেশে। পরে কি হবে জানি না।
রাতের শেষ ট্রেনটা যখন আমায় একা অন্ধকারে রেখে পিছনের জ্বলজ্বলে লাল আলোটা দেখিয়ে একেঁবেকেঁ মিলেয়ে গেল দূর-দূরান্তে তখনও অনুমান করেত পারিনি রাতের আঁধার বহুক্ষণ আগেই মিতালী পাতিয়েছে দুর্যোগের সাথে। একা জনমানব শূন্য ধুধু মাঠের মাঝে কোন ষ্টেশন ঘর নেই কারণ এটা একটা হল্ট ষ্টেশন। ভয়ডর বলে কোন কিছুই আমার কোন কালে ছিল না, তবে দুঃসাহসীও নই আমি। অবশ্য ভয় বুকে ভরে ভবঘুরে হওয়া যায় না।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হয়ে পড়েছিলাম দিশেহারা। কি করব, কোন দিকে যাব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় দেখি আমার পাসে এসে দাঁড়িয়েছে আরও একজন। গহন অন্ধকারের জন্য ওনার মুখটা দেখতে পাইনি। তবে পরনে খাটো ধুতি আর সাদা ধবধবে পৈতেটা জানান দেয় যে উনি ব্রাহ্মণ। তার মুখটা না দেখতে পাওয়ার আরও একটা কারণ, একমুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গল। উনি খুব মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ”এই অসময়ে গাড়ি থেকে নেমে কোথায় যাওয়া হবে বাবু-মশায়ের?”
গলার আওয়াজ আর ওই অন্ধকার নিরালা নিরিবিলি জায়গায় কেমন যেন গা ছমছম শিহরণ জাগায় দেহমনে। তবু সাহসে ভর করে বলি,
“যাব তো অনেক দুর। ভেবেছিলাম দুপুর নাগাদই এখানে থেকে পৌঁছে যাব পদ্মপুর। কিন্তু বিধি বাম গাড়িটা এমন বিগড়ে গেল যে দুপুরের গাড়ি এই রাতের আঁধারে নামিয়ে দিয়ে গেল তেপান্তরের মাঠে, বোঝা মুশকিল কোনদিকে গেলে কাছেপিঠের কোন গ্রামে যাবার রাস্তা পাব? কোন মানুষেরই দেখা নেই এখানে। আপনি কি এখানে থাকেন? তাহলে দয়া করে যদি একটা গাঁয়ে যাবার রাস্তা বাতলে দেন। সেখানে কারুর দোড়ে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে কাল ভোরেই রওনা দেব পদ্মপুর।“
উনি শুধালেন, “তা সেখানে কাদের ঘরে যাবে? যতদূর জানি লোকজন তো খুব বেশি থাকে না সেখানে।“
আমি বলি, “না কারুর ঘরে নয়, শুনেছি সেখানে নাকি এক বিশাল দিঘিতে সারা বছর পদ্মফুল ফোটে তারই কোলে যে একটিমাত্র বসতি আছে সেই গ্রামের নাম পদ্মপুর।“
আমায় থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তা সেখানে কার কাছে এমন কি দরকার পড়ল যে দুর্যোগকে সামনে দেখেও সেখানেই যেতে হবে?”
আমায় একটু গুছিয়ে বলতে হল, “ব্যাপারটা আপনাকে খুলেই বলি, শুনেছি ওখানে নাকি একটা আদিকালের ভগ্নপ্রায় মহামায়ার মন্দির আছে। সেখানে বহুদিন আগে একজন সাধক বসে সাধনা করেছিলেন। তার সাধনায় খুব প্রীত হয়ে মহামায়া ওনাকে দর্শন ও দিয়েছিলেন। এই সত্যটা এখনও লোক পরম্পরায় শুধু শোনাই যায় না, মানুষজন সেটা বিশ্বাস করে তাই দূরদূরান্তের পুণ্য কামিরা মাঝে মধ্যে চলে আসে এখানে। তবে সেই সাধকের কেউই আর দেখা পায়নি তার মহামায়ার দর্শন পাবার পরদিন থেকে। আর এখনও বিশেষ বিশেষ অন্ধকার রাতে ওই মন্দির থেকে ভেসে আসে গুরু গম্ভীর কন্ঠে ওঁকার ধ্বনি। বাতাসে ভেসে আসে সুগন্ধী ধুপধুনোর গন্ধ। দূরদূরান্ত থেকে কান পাতলে শোনা যায় মৃদু মন্দ জপের মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ। সেই সাধককে এখানকার লোকেরা পাগলা বাবা বলে ডাকতো। আজও সবাই সেই নামেই স্মরণ করে। শুনেছি খুব ভাগ্যবান হলে, তাঁর দর্শন না হলেও তাঁর সুমধুর স্বর শোনা যায়।“
এরপরই সামনে এসে পথ বন্ধ হয়ে যায়। পিছন থেকে আর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি তারে জিজ্ঞাসা করি, “এবার কোনদিকে যাব?”
এই সময় হঠাৎ কড়কড় করে মেঘ ডেকে বিদ্যুৎ চমকাল। তারই আলোতে দেখতে পাই অনেক দুরে ডানদিকের রাস্তায় কিছু মাটির ঘর দাঁড়িয়ে আছে, এই নিশুতি রাতের পথহারা পথিকের মত। এরই মধ্যে আবার শুরু হল বৃষ্টি। এবার খুব রাগ হল, এই বিজনে সেই অমঙ্গলে মানুষটা উপর। যাবার আগে রাস্তাটা একবার বলে দিয়ে গেলে কি ক্ষতিটা হত তার? জানিনা কতক্ষণ হেঁটেছিলাম এর মধ্যেই এসে পড়ি এক বাড়ির নাগালের মধ্যে। সব ঘর বন্ধ হয়ে থেকেও একটা ঘরের দাওয়ায় এক ধারে মনে হয় কেও একজন রান্নাপাতি চাপিয়েছেন কারণ বাইরে আগুনের আলোর নির্দেশন। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই সেই দিকে। ততক্ষণে ভিজে গিয়েছে সারা শরীর। যিনি রান্না করছিলেন তার পরনের কাপড় দেখে সহজেই অনুমান করা যায় তিনি একজন মহিলা। আমি কোন ভণিতা না করে বলি, “মা, হেমন্তের এই অসময়ের বৃষ্টিতে কাক ভেজা ভিজেছি। তোমার দোয়ারে একটু বসার ঠাঁই হবে মা? আমার বড্ড শীত করছে।“ এরপরেই মহিলা মুখ ফিরিয়ে আমাকে অবাক বিস্ময়ে দেখে বলে, “ওইখানে দাড়িয়ে আছ কেন বাবা, উঠে এস দাওয়াতে। ভিজে যে একবারে ঢোল হয়ে গেছ, উঠে এস, উঠে এস।“
এরপরেই যখন ওই মহিলার সামনে এসে দাঁড়াই, আমি স্তব্ধ বিস্ময় দেখি মা বলে ভাববার মতনই ওই মহিলা। একহারা চেহারার প্রৌড় সদ্য স্নাত, স্নিগ্ধময়ী দৃষ্টি, টিকোলো নাকের দুপাশে ফালা ফালা দুচোখের, দৃষ্টিতে একটা মায়াবী টান, যেন নিজের মাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ঈষৎ মাজা মাজা রং, পরণে কালাপাড় সাদা শাড়ি। আমি জবজবে ভিজে কাপড়ে মাটির দাওয়ায় উঠতে ইতস্ততঃ করছি দেখে মহিলা বললেন, “এখন আর ভাবার কিছু নেই বাবা। দেরি করলে অসুখ বাধাবে একটা।“ এরপর অবশ্য ধীরে সুস্থে আমার বোঁচকা থেকে শুকনো কাপড় বার করে পরে নিই আর দাওয়ার কোনে বেশ একটু শুকনো জায়গা দেখে আরাম করে বসি। জানিনা কতক্ষণ ওই ভাবে বসে থাকতে থাকতে ঘুমে ঢুলে পড়েছিলাম। এক সময় মহিলা ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। চোখ খুলে দেখি এক ঘটি জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দাওয়ার ধারে সেই মহিলা। আমাকে জাগতে দেখে বললেন, “নাও, হাত মুখ ধুয়ে এসে ভাতের পাতে বসে পর দেখি।“ আমি অম্লান বদনে বলি, “ইষ্টিশানে নেমে ওখানকার দোকান থেকে পেট ভরে মুড়ি আর আলুর দম খেয়েছি মা। আমার তো এখন আর খিদে নেই।"
“মা বলে যখন ডাকলে বাছা তখন একটা কথা বলি শোন। সন্তানের শুখনো মুখ দেখলেই মায়ের অন্তরটা টনটন করে উঠে। একমাত্র মা ই বুঝতে পারে সন্তানের জঠর জ্বালা। নাও আর দেরী কর না, হাত ধুয়ে বসে পর দেখি।
“সে যেন আচমকা নাড়া দিয়ে মা ডাকার সার্থকতার জানান দেয়।
আর কথা না বাড়িয়ে আমি একটা তালপাতার আসনে বসে দেখি কলাপাতায় উজাড় করে দেওয়া গরম ভাত আর সাথে দু-টুকরো করে কাটা একটা বেশ বড় মাপের কাঁচকলা সেদ্দ মাত্র। আজ দুদিন পেটে ভাত পড়েনি। পথের ধারের দোকানের কেনা মুড়ি, দুখানা বাতাসা আর ঢকঢক করে খাওয়া জল এই দিয়েই চলছিল। তাই খাবার সময় আর কোনদিকেই তাকাবার ফুরসত ছিল না। আমার ওই আগ্রাসী ক্ষুধা দেখেই মহিলা হাঁড়িতে তুলে রাখা কটা ভাত ও ঢেলে দিলেন আমার পাতে। খাওয়া শেষ করে ওঠার সময় আমার অত্যন্ত কুণ্ঠিত দেখে মহিলা বললেন, “বাবা, এর জন্য মনে কোন ক্ষোভ এনো না।"
নিজেকে অপরাধী ও মনে করবে না। জানবে পাগলা বাবাই তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন তোমার ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর করার জন্য। যাও বাবা দোরে চাটাই পাতা আছে রাতটুকু নিশ্চিন্ত মনে আরাম করে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দাও। কাল সকালের কথা কাল ভাবা যাবে। তবে আমি খুব সকাল সকাল কাজে যাই আর ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। তা বাবা তোমার কথা তো কিছু জানা হল না। তোমার আচার ব্যবহার দেখতে তো ভদ্দরঘরের ছেলে বলেই মনে হয়, তাহলে এমন বাউন্ডুলেপানা ব্যবহার কোন আক্কেলে? তবে যদি কোন বাধা থাকে তাহলে আমার শোনার কোন প্রয়োজন নেই।“
“না মা, বাধা নেই কিছুই। কিন্তু সব শুনে আমাকে যেন ভুল বুঝ না। ঘরে খাওয়া পড়ার কোন অভাব নেই কিছুই। বাবা মা ভাই বোন সবাই আছে ঘরে।
লেখাপড়াও বেশ কিছুদূর পর্যন্ত হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহে ঘর ছাড়লাম সকলের অজান্তে। তারপর থেকেই ভবঘুরে জীবনের আরম্ভ। মা, কেন জানিনা সব সময় মনে হয় এই তো নাগালের মধ্যে আছে সেই জন তবুও কেন তাকে দেখতে পাই না আর তাই হয়ত থেকে থেকে আসক্তিটা বাড়তে বাড়তে এখন নিদারুণ এক আবেগে পরিণত হয়েছে আর তাইত ছুটে বেড়াচ্ছি অন্ধের মত। জানিনা কবে সঠিক দিশা পাব। আর দেখা না পেলে অন্তত দেখার অনুভূতির পরিতৃপ্তি পাব।
“মহিলা কিছু কথা না বলে বেশ কিছুটা সময় নীরব থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে ঢোকার আগে বললেন, “বাবা তোমার জন্ম সার্থক। সার্থক হয়েছে তোমার ভবঘুরে জীবন। সন্ধ্যেরাতে যে তোমাকে ইষ্টিশান থেকে পদ্মপুকুরে যাবার হদিশ না দিয়ে বেশ কিছুটা পথ তোমায় সঙ্গ দেয় রাতের আশ্রয়স্থল পর্যন্ত, যার অদূরেই পদ্মপুকুর, সেই কত যুগ আগের পাগলা বাবা। শিশুর মত সরলতা, সাধকের মতন অহরহ চিন্তা আর ঐকান্তিক আতির্, তাঁকে বাধ্য করে আরাধ্যকের সান্নিধ্যে আসতে। আর কিছু বলার নেই বাবা। এবার ঘুমবার চেষ্টা কর।“ এরপর মহিলা চলে যান। ঘরের আগড় বন্ধ করার শব্দই জানিয়ে দেয় আর কোন কথা নয়।
মহিলার কথাশুনে মনটা তোলপাড় করে ওঠে। বহু দূর ওপার থেকে কেউ যেন নিঃশব্দে হাসছে মনে হয়। বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বেশ দেরী করে উঠে দেখি আমার শেয়রে ঠোঙ্গা ভর্তি মুড়ি আর কয়েকটা বাতাসা। চোখেমুখে জল দিয়ে মুড়ির ঠোঙ্গাটা বোঁচকায় ভরে জায়গাটা ছাড়ার আগে কোথাও মহিলার দেখা পেলাম না। অগত্য দাওয়ায় একটা প্রণাম করি ওই মহিলার উদ্দেশ্যে, মনে হয় বাংলার ঘরে ঘরে এমন মা আছে বলেই এখন এদেশে এত স্নিগ্ধতা ও কমলতা বিরাজ করছে। হঠাৎ বহু দিন পরে কেন জানিনা নিজের অজান্তে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে।
কবিতা
কনকজ্যোতি রায়
ফ্রেম
মন জুড়ে তারাহীন আকাশ
হৃদয়ে অলীক কল্পনার অনুরণন
চোখের পাতায় ভেসে যাওয়া টুকরো টুকরো মেঘ।
অনেকদিন বৃষ্টি হয় নি,
সিঞ্চনের আশায় পাতাগুলি হলুদ
শুষ্ক ধানের শিষে ফলে না মমতার ফসল,
ক্ষয়িষ্ণু শিকড় উৎপাটনের অপেক্ষায়,
ধূমকেতুর মতো হঠাৎ এসেই মিলিয়ে যায়
লাল নীল আর সবুজ স্বপ্নগুলো,
ভালবাসার মোড়কে নকল সোনা
বাজারদর তারই সবচেয়ে বেশী
অলিতে গলিতে হীরের টুকরোর ছড়াছড়ি।
প্রজাপতিটা আসেনি অনেকদিন
ওটা শুধুই রং ভুল করে
ধরতে পারলে বাঁধিয়ে রাখতাম
সুদৃশ্য ফ্রেমে,
নিরাভরণ নয়, মালা দিয়ে।
প্রবহমান
একদিন
চরাচরের নিস্তব্ধতায় মুখোমুখি
রুদ্ধগতি মহাকাল, বিপুলা বৈশাখী,
বনানীর মর্মর, হৃদয়ে কলতান
নীল স্বপ্ন চোখে, ভ্রমরের আহবান।
অতঃপর
ঢাকা পড়ল নক্ষত্র, ভেঙে গেল বাঁধ
আবিষ্কৃত হল বেঁচে থাকার আহ্লাদ,
ছায়া যেন কায়া, জগৎ তখন মায়া
বুকের মাঝে আগুন, দৃষ্টিতে আলেয়া,
সত্ত্বার ইতি, সংযমের বলিদান
দুমড়ানো পাঁপড়ি, তছনছ বাগান।
অবশেষে
থেমে গেল তুফান, ঝরে পড়ল পাতা
ঝর্না তখন নদী, বালুচরে শূন্যতা,
বসন্ত ইতিহাস, গ্রীষ্মের হাতছানি
অলক্ষ্যে বাজল প্রলয়ের পদধ্বনি
স্বপ্নবৃষ্টি
ঘাসের মত হলে পদানত হয়েই থাকতে হবে,
তার চেয়ে কাঁটাঝোপ হওয়া ভাল
অন্তত প্রতিবাদের অক্ষমতার আফসোস থাকে না।
মাটীর মত হলে জড়বৎ হয়েই থাকতে হবে,
তার চেয়ে নুড়িপাথর হওয়া ভাল
অন্তত পথিকের পায়ের সাথে কম্পিত হওয়া যায়।
ঢেউ এর মত হলে তীরে এসে ভেঙে পড়তেই হবে,
তার চেয়ে হিমশৈল হওয়া ভাল
অন্তত ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের দুঃখ থাকে না।
নক্ষত্রের মত হলে অবিরাম জ্বলতেই হবে,
তার চেয়ে চাঁদ হওয়া ভাল
অন্তত রাতের অন্ধকারে স্নিগ্ধ আলো বিতরণের গর্ব থাকে।
রাত্রির মত হলে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই মিলিয়ে যেতে হবে,
তার চেয়ে প্রত্যুষ হওয়া ভাল
অন্তত অল্প আলোর আভাসের মধ্যে উজ্জ্বলতার প্রকাশ থাকে।
মেঘের মত হলে পরনিয়ন্ত্রিত হয়েই উড়ে যেতে হবে,
তার চেয়ে আকাশ হওয়া ভাল
অন্তত অসীম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করা যায়।
বাতাসের মত হলে স্বেচ্ছাহীন বয়ে যেতেই হবে,
তার চেয়ে দখিণাবায়ু হওয়া ভাল
অন্তত শুষ্ক হৃদয়ে আনা যায় শীতলতার স্পর্শ।
কবিতা
মৌ চক্রবর্তী
কলকাতা
সুভাষিনী
দেখ দেশ ...
জোছনার ভারে নুয়ে গেছে নারকেল পাতা
আরেকটু হাঁটলেই সূর্য পৌঁছে যাবে
আরেকটু বাঁ আরেকটু ডানে তুলসির গায়ে
জবার কেশরে গোলাপের বৃন্তে ফিঁকে গল্পের সরণি
ধানের শীষে ধান মিশে দিনের মতন শিশির জুতো পায়ে
নন্দিনী ... একমুঠো মুড়ি হাতে বৃষ্টির আঁচল বেঁধে কোমরে
দেশ __ ছাতিমতলায় পাতার কোলে নদী জ্যোৎস্নার স্বরলিপি
মন সুর মন আনচান দিনের কাছে ফড়িং জীবন
লিখবে মৃত্যু কাহিনী ...
কবিতা
তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য
কবি পরিচিতি: তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য, জন্ম কলকাতা উনিশশো ঊনআশি সালের ছয়ই জুন। পড়াশোনা কলকাতায়। বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় এবং তারপরে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। তারপর ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর এবং পেশায় প্রবেশ। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস পারিবারিক উৎসাহে। পরিবারে হাতে লেখা পত্রিকার চল ছিল বহু বছর যাবৎ। ছোটবেলায় সন্দেশ পত্রিকায় রচনা প্রকাশ। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালিখি। বহুজাতিক সংস্থায় বর্তমানে কর্মরত এবং নিজস্ব ব্যবসার সাথে যুক্ত এবং অধ্যাপনার কাজেও জড়িত। কর্মসূত্রে বহু মানুষের সাথে আলাপ ও পরিচয় যা বারবার রচনায় বিভিন্নভাবে ধরা পড়েছে। যদিও ভ্রমণপিপাসু কিন্তু সে পিপাসা সময়াভাবে চরিতার্থ হয় না। সাহিত্যানুরাগী এবং বাঙলা সাহিত্য সহ তার ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
মানসজননী
আদিগন্ত সমুদ্রের সম্মুখে
ওড়াচ্ছি একা আমি বিজয়কেতন,
ঔদ্ধত্য নয়, নম্রতার সাথে।
আশে পাশে কেউ কোথা নেই, কোনো রব নেই
আমি আছি জেগে তাঁর তরে-
আমার মানসজননী।
বীরত্বের সাথে আমি করব আহ্বান
রণসাজে সজ্জিত হব তাঁর আপন হস্তে
উন্মত্ত মলয়ে আসে ভেসে সেই
মৃদু আকাশবাণী
সমুদ্রের গর্জনে বাজে আমার রণবাদ্য।
রত্নাকরের রত্নে খচিত হোক সেই আশীর্বাদ
আমি নতশিরে স্বীকার করব।
সমুদ্রের বক্ষের অন্তরালে যে অন্তরাত্মা
আন্দোলন করে আপন খেয়ালে,
তপঃসাধনে তুষ্ট হয়ে পূর্ণ করে দিক
জোয়ার ভাঁটা আর জ্যোৎস্নার মণি মাণিক্য
এই ভিক্ষুকের রিক্ত বিবরে।
উৎসুক ধ্যানমগ্ন নয়ন তবু জেগে রয়
সন্ধানে সন্ধানে মাতে বিহ্বল সে চেতনা
সে চেতনা আমার
মিশে রয় এই ব্যাপক মগ্নতার সাথে
আমার মানসজননী।
প্রবন্ধ
স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে উত্তরপাড়া হিতকরী সভা
সুখময় ঘোষ
শ্রীরামপুর, হুগলী
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে শাসনভার গ্রহণ করলেও ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারে তাদের কোন সহানুভূতি ছিল না। বাণিজ্য বিস্তার করে মুনাফালাভ করাই ছিলে তাঁদের উদ্দেশ্য। পরে ইউরোপীয় মিশনারীরা এদেশে খ্রীস্টধর্ম প্রচারে এসে জনগণকেও শিক্ষিত করতে উদ্যোগী হয়। শ্রীরামপুরের মিশনারীরা এই বিষয়ে প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন। তাঁদের হাত ধরেই এই বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারও শুরু হয়। শ্রীরামপুরের নামজাদা পাদ্রী জোশুয়া মার্শম্যানের স্ত্রী হানা মার্শম্যানের চেষ্টায় ১৮০০ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরামপুরে বঙ্গদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তৎকালীন সরকার বাহাদুর নারীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের কোন আগ্রহই দেখাইনি। সেইসময় ১৮৪৯ খ্রীস্টাব্দের ৭ই মে ডিঙ্কওয়াটার বিটন কোলকাতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে জোরদার আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। তিনি মনে করতেন দেশের উন্নতির জন্য নারীদের শিক্ষিত করা একান্তই জরুরী। সৌভাগ্যক্রমে বিটন সাহেবের সাথে পরিচয়সূত্রে বিদ্যাসাগরের মহাশয় ঐ ‘বিটন নারী বিদ্যালয়ের’ সম্পাদকরূপে নিযুক্ত হন। তিনি বালিকা বিদ্যালয়ের গাড়ীর দুপাশে দেশের মানুষকে সচেতন করার জন্য মনুসংহিতার এই শ্লোকটি খোদাই করে দিয়েছিলেন – ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ’। যার অর্থ ‘পুত্রের ন্যায় কন্যাকেও যত্নের সহিত পালন করতে ও শিক্ষা দিতে হবে’।
বিলেত ও ভারতবর্ষে যখন এদেশের নারী শিক্ষার স্বপক্ষে জনমত জোরদার হচ্ছে তখন ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দে বিলেতের কর্তৃপক্ষ ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং সেখানকার পার্লামেন্টে এইদেশে বহুল সংখ্যায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কর্তৃপক্ষের এই দৃষ্টিভঙ্গির পর দক্ষিণবঙ্গের তৎকালীন বিদ্যালয় পরিদর্শক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য বহু গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র পেয়েছিলেন। গড়ে ওঠে বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে সাহায্যের জন্য কয়েকটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘উত্তরপাড়া হিতকরী সভা’। বিদ্যাসাগরের এই স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের ৫ই এপ্রিল সমাজ সংস্কারক হরিহর চট্টোপাধ্যায় এই সভা প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সভাপতি হন। উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এবং রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই সভা প্রতিষ্ঠায় তাঁদের আন্তরিক সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। শিক্ষাবিস্তার বিশেষত: স্ত্রী শিক্ষার প্রচেষ্টায় তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর নারীমুক্তি আন্দোলন সংঘটিত করতে ব্যাপকতর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তরপাড়া হিতকরী সভা। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার ছাড়াও সমাজ সংস্কারেও এই সভা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল – দরিদ্র ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা, দুর্গতদের অন্নসংস্থান, দরিদ্র রোগীদের ঔষধ-পথ্য প্রদান, বিধবা এবং পিতৃমাতৃহীন শিশুদের ভরণপোষণ। ‘বঙ্গীয় সুরাপান নিবারণী’ সভার সহায়তায় উত্তরপাড়া ও সন্নিহিত অঞ্চলে সুরাপান বিরোধী প্রচারেও এই সভা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। প্রথমদিকে এইসব বৃহত্তর প্রচেষ্টার দিকে নজর দিলেও পরবর্তী সময়ে অর্থাভাবে শুধু স্ত্রীশিক্ষা প্রসারেই মনোযোগ দেওয়া হয়।
১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে এই সভা বালিকাদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ গড়ে তুলতে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রীদের জন্য তিনটি বৃত্তি ও পারিতোষিক প্রদানের ব্যবস্থা করেছিল। তৎকালীন সরকারী শিক্ষাবিভাগের বার্ষিক রির্পোটগুলিতে উত্তরপাড়া হিতকরী সভার কার্যকলাপের সপ্রশংস উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৬৪-৬৫ সালের শিক্ষা দপ্তরের রিপোর্টে এই মর্মে লিখিত আছে যে, ‘হিতকরী সভা প্রতিষ্ঠার এক বৎসরের মধ্যেই হাওড়া ও হুগলীর বালিকা বিদ্যালয়সমূহের ছাত্রীদের ১৮৬৫-র ফ্রেবুয়ারী মাসে পরীক্ষা গ্রহণ এবং উৎকৃষ্ট ছাত্রীদের মাসে দুই টাকা করিয়া এক বৎসরের জন্য আটটি বৃত্তি দিবার মনস্থ করে’। কবি কামিনী রায় হুগলী স্কুল থেকে ভালো ফল দেখিয়ে হিতকরী সভার বৃত্তি লাভ করেছিলেন। ১৮৬৬-৬৭ সনের সরকারী শিক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বর্ধমান বিভাগে উত্তরপাড়া হিতকারী সভাই স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে কর্মরত প্রধান প্রতিষ্ঠান’। সভা কর্তৃপক্ষ নিজেদের তত্ত্বাবধানে উত্তরপাড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করেছিলেন যা সেইসময়ে ‘ফিমেল ইউনিভার্সিটি’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করতে আসেন। কোলকাতায় ফিরে আসার সময় পথে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গাড়ীর বগি উল্টে যায় এবং তিনি যকৃতে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন। এই যকৃতসংক্রান্ত ব্যাধিতেই পরবর্তীকালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উৎসাহদানে প্রথমে হাওড়া ও হুগলীতে, পরে সমস্ত বর্ধমান বিভাগে হিতকরী সভা প্রাথমিক স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী
হয়েছিল। হিতকরী সভার অনুকরণে ফরিদপুরে সুহৃদ সভা এবং বাখরগঞ্জে হিতৈষনী সভা গড়ে উঠেছিল। ১৮৬৫ সালে উত্তরপাড়ার এই সভা বয়স্ক মহিলাদের জন্যও শিক্ষার ব্যবস্থা করে। এই উদ্যোগ ছাড়াও বাংলায় প্রথম কৃষিবিদ্যালয় গৌরব এই সভারই প্রাপ্য। এই সভা ১৮৬৩ সালেই বৃত্তিগত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ‘মাখলা পেজান্ট বয়েজ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। উত্তরপাড়া হিতকরী সভার সদস্যদের কেউ কেউ উইলিয়াম কেরী ও জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের কৃষি-বিজ্ঞানমনস্কতায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষিশিক্ষা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছিলেন। অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বয়ং জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। তারই ফলশ্রুতি ছিল এই মাখলা কৃষিবিদ্যালয়। যদিও জনসাধারণ বিশেষ করে ঐ এলাকার কৃষি পরিবারগুলি এই বিদ্যালয় সম্পর্কে উৎসাহ না দেখানোয় ঐ কৃষিবিদ্যালয় অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। তবুও বৃত্তি শিক্ষার জন্য ঐ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সেইসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুঃসাহসিক বলা যেতে পারে। হিতকরী সভার একটি সাহিত্যশাখা ছিল। সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সমাজের উন্নতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, প্রবন্ধপাঠ বা বক্তৃতার মাধ্যমে উত্তরপাড়া ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের মানুষদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং সমাজ সংস্কারের গুরুত্ব বোঝান হত। এই সভা হতে ‘উত্তরপাড়া হিতকরী সভা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ হত। যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজচেতনা ও শিক্ষার আদর্শকে যুবসমাজের সামনে তুলে ধরা। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় শিক্ষায় ও সমাজ ভাবনায় যে বিপ্লব দেখা গিয়েছিল সেখানে হিতকরী সভার অবদান অনস্বীকার্য। বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়াও এই সভা বয়স্ক নারীদের শিক্ষার জন্য ‘অন্তঃপুর স্ত্রী-শিক্ষার’ আয়োজন করেছিল। ‘অন্তঃপুর স্ত্রীশিক্ষার’ পরীক্ষাকে তখন ‘অন্তঃপুরিকা’ পরীক্ষা বলা হত। তবে ‘অন্তঃপুরিকা’ পরীক্ষা বিশেষ সাড়া জাগাতে সফল হয় নি। কেননা তখনকার সমাজব্যবস্থায় স্ত্রী-শিক্ষা সম্পর্কে সকলের নেতিবাচক মনোভাব মূলত এর জন্য দায়ী। তা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে ‘উত্তরপাড়া হিতকরী সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় কর্মকান্ড হল স্ত্রী শিক্ষার প্রসার যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে বাংলার পণ্ডিত ব্যক্তিরা ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
উত্তরপাড়ার প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পত্তি হিতকরী সভাকে দান করে যান। তিনি বহু বৎসর হিতকরী সভার সম্পাদক ছিলেন। হিতকরী সভায় বহু বিখ্যাত ব্যক্তি এসে বক্তৃতা করেছেন। অধিকাংশ বক্তৃতা দেওয়া হত ইংরাজিতে। এমনকি বার্ষিক-বিবরণীগুলিও লেখা হত ইংরাজিতে। আসলে ইংরাজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তরেই প্রাধান্য ছিল এই সভাতে। বোধহয় এই কারণে সভার রাজনৈতিক মতাদর্শ জাতীয় চেতনার সঙ্গে মানানসই ছিল না। বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে হিতকরী সভা সমর্থন করেনি। ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনেই তাঁদের মত ছিল। বাংলার নব্যসংস্কৃতিতে উত্তরপাড়া হিতকরী সভা ছিল একটা চেতনা। তৎকালীন বাংলার শিক্ষা অধিকর্তা, বিদ্যালয়–পরিদর্শক এবং মেরি কার্পেনটারের মত শিক্ষাবিদ ও বিদগ্ধ মানুষেরা এই সভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে প্রশংসা করেছেন। সেইসময় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারবার্ট জন রেনল্ড স্বয়ং তাঁর সমাবর্তন ভাষণে এই হিতকরী সভার গৌরবজনক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। ওম্যালি সাহেব ও মনোমহন চক্রবর্তী হুগলী ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারে এই সভা সম্বন্ধে লিখেছিলেন –
“....its chief objects being to educate the poor, to distribute medicines to the indigent seek, to support poor widows and orphan, to encourage female education by the award of scholarships to girls and to ameliorate the social, moral, and intellectual condition of the inhabitants of Uttarpara and neighbouring places............It holds annual examination for girls in the Burdwan Division, issuing certificates to the successful candidates, and awarding prizes and scholarships.
সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে উনবিংশ শতাব্দীতে ‘উত্তরপাড়া হিতকরী সভা’ নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
তথ্যসূত্র –
১। বাংলার নব্যসংস্কৃতি – যোগেশ চন্দ্র বাগল
২। হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ – সুধীরকুমার মিত্র
গল্প
ক্রিকেট
এবং মানিক
সায়ন দাস
আজকে বেজায় দেরী হয়ে গেল খেলার মাঠে পৌঁছতে। ছেলেগুলো সব এতক্ষণে ওয়ার্ম আপ শুরু করে দিয়েছে নিশ্চয়ই। বাইক রেখে যখন মাঠে প্রবেশ করলাম তখন ৮টা বেজে গেছে। ছেলেরা প্রাকটিস শুরু করে দিয়েছে সব। আজকেও সেই ছেলেটা দেখি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। প্রায় প্রত্যেকদিন আসে সে। একমনে খেলা দেখে, মাঝে মাঝে বল ওর দিকে গেলে দৌড়ে এসে আমারদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আজকে আমি ওকে আমার কাছে ডাকলাম প্রাকটিস শেষ হয়ে যাবার পর। জিজ্ঞেস করলাম – নাম কি তোমার? বলল মানিক দত্ত। আজকেও মানিক আসেনি কেন কেউ জানিস? জিজ্ঞেস করলাম আমি। না, স্যার সব ছেলেরা একসাথে বলে উঠল। কি ব্যাপার! যেই ছেলেটা ক্রিকেট মানে প্রাণ, সে কামাই করছে কেন! শরীর খারাপ করল নাকি। আজান্তেই আমার মন একমাস আগে চলে গেল। ছেলেটার নাম মানিক দত্ত। পছন্দের খেলোয়াড় গৌতম গম্ভীর। ১৬ কি ১৭ বছর বয়স হবে মানিকের, তিন ভাই বোনের মধ্যে ওই সবচেয়ে বড়। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। বাবা আগে ইঁট ভাটাতে আগে কাজ করতো, এখন শ্বাসকষ্টের সমস্যার জন্য বাড়িতে থাকে, কাজ করতে পারে না। মানিক মাধ্যমিকটা দিয়ে দিলে ওকেও কাজ করতে হবে, নাহলে সংসার চলবে না। কিন্তু ছেলেটার ক্রিকেট খেলার বড় শখ। ভারতের হয়ে খেলতে চায় একদিন। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা সরঞ্জাম কেনারও সামর্থ্য নেই ওর। আমি বললাম- সরঞ্জাম কিনতে লাগবে না, এখানে অনেক এক্সট্রা ব্যাট বল থাকে, তুই তাই দিয়ে করিস। মানিক বলল - "স্যার আপনার ফী ত দিতে পারব না আমি।" আমি বললাম - "ফী এর দরকার নেই, ভাল করে খেলা শেখ, তারপর সেসব দেখা যাবেখন।" পরের দিন থেকেই চলে আসল মানিক, বেশ ভালই খেলে ছেলেটা, আরেকটু উন্নতি করলেই ও অন্যদের মতন হয়ে যাবে। প্রায় ১৫-২০ দিন মতন এসেছে, অথচ এখন আসছে না কেন। কোন শরীর তরীর খারাপ করল নাকি? বাড়ির কারোর কিছু হল? না, আজকে যেতেই হবে একবার ওর বাড়ি। অন্য ছেলেরা দেখছি কেউ খুব একটা উদাসীন না মানিককে নিয়ে, এই কদিনেই যা ভাল খেলতে শুরু করেছে ছেলেটা। বাড়ি ফেরার পথে, মানিক এর বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে আসব। ওর বাড়িটা গড়িয়া থেকে বড়ালের দিকে, অনেকটাই ভেতরে। একটা বস্তিতে এক কামরার ঘরে মানিকের ৫ জনের সংসার। মানিক ছিল না বাড়িতে, ওর
মা আর বাবা ছিল। ওর মা আমাকে চেনে না, আমার পরিচয় পেয়ে খুব যে আনন্দিত হয়েছে এটা মনে হল না। বললাম - "ছেলে যাচ্ছে না কেন খেলতে?"
মা বললেন – "গেলে আমরা খাব কি স্যার? ও এখন একটা চালের দোকানে কাজ নিয়েছে। ওর বাবা কাজ করতে পারে না, আমি একা কদিন সামলাব, তাই ওকে কাজে দিয়ে দিয়েছি। খেলা শিখলে তো আর পয়সা রোজগার করতে পারবে না।"
এরপর আর কিছু বলা চলে না। আমি বাড়ি ফিরে আসলাম, মনটা খারাপ হয়ে গেল প্রচণ্ড, একটা প্রতিভা শুধুমাত্র পয়সার অভাবে নষ্ট হয়ে গেল। সেইদিন রাতে বাজারে গেলাম একটু সবজি কিনতে। হঠাৎ দেখলাম, একটা চালের দোকানে মানিক ২৫ কিলোর একটা বস্তা মাথায়ে করে একটা ভ্যানে তুলছে। ওইতুকু ছেলে অত ওজনের চাপে একেবারে নুইয়ে পড়েছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, একসময় মনে হল পকেটে ২টো ৫০০ টাকার নোট আছে, ছেলেটাকে দিয়ে আসি গিয়ে, কিন্তু তারপরেই মনে হল, ওকে সেটা অপমান করা হবে। এইসব ভাবছিলাম এমন সময় দেখি, মানিক আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমাকে দেখে বলল – "স্যার, বাজারে এসেছেন বুঝি? আমি ওই চালের দোকানে কাজ নিয়েছি এখন।" আমি কিছু বলতে পারলাম না। মানিক নিজেই বলতে লাগল - "স্যার আমার আর ক্রিকেট শেখা হবে না, আমার পরিবারকে কষ্ট দিয়ে আমি খেলতে পারব না, নাহলে আমাদের আধপেটা থাকতে হবে।" দোকানের মালিক এই সময় চেঁচিয়ে উঠল - "এই মানিক এইদিকে আয়ে, ওনাকে, ১ কিলো গবিন্দভোগ চাল দেয়।" আমার পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে মানিক চলে গেল।
পরের দিন খেলার মাঠে, গিয়ে দেখি সবাই ওয়ার্ম আপ শুরু করে দিয়েছে। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই, রোহিত বলে একটি ছেলে এগিয়ে এল আমার কাছে। বলল - "স্যার দেখুন এই ব্যাটটা কিনেছি আমি, ইংলিশ উইলো, ৩০০০০ হাজার টাকা নিয়েছে স্যার, কেমন হয়েছে?" আমার বিরক্ত লাগছিল। আমি বললাম - "হ্যাঁ, ভাল হয়েছে, যাও তাড়াতাড়ি ওয়ার্ম আপ শেষ করে নেও।" আমি মনে মনে ভাবলাম মানিক এর স্বপ্ন আর সত্যি হবে, আরেকটা গৌতম গম্ভীর হয়ত আমাদের দেশ পেল না। কিন্তু আসল খেলোয়াড় মানিক দত্তই থাকবে আমার কাছে, চিরদিনের জন্য।
গল্প
বাসায়
মৃত্যুর ঘর
অর্ক চক্রবর্তী
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বর্ষা। পশ্চিমের ঝুপ ঝুপ ভেজা গাছগুলো ঝিমিয়ে আছে স্যাঁতস্যাঁতে আকাশ ছুঁয়ে। বিকেল শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর অন্ধকার ঝোপে, গাছে, কেঁপে ওঠা প্রদীপ জ্বলা ঘরের কোণায় আসন পেতে বসল। আজ কেউ আসে না এমন ঘরে। উঠোনের উত্তর-পূর্বে আম গাছে অনেক পাখি ভিড় করেছে। তাদের তারস্বরে আনন্দ ভয় মিশিয়ে চিৎকার হঠাৎ থেমে যায়। দু'একটা কালপেঁচা কর্কশ গলায় আতঙ্কের ঝাপটা দিয়ে যায় আম গাছের বাসিন্দাদের। বৃষ্টি থেমেছে কিছু আগে। অবাধ্য চিন্তার গোছা আজ বেশ আলগা হয়েছে ঘাসমাটি মাখা শীতল হাওয়ায়। এমন দিনে প্রতিবেশীহীন অন্ধকার একটু ঘন হয়ে পাতলা সুতির চাদরের ফাঁকে জমে। মানুষের মুখের ভাষা ভাগ করে নেওয়ার কেউ নেই। সে কেবল ঘরের চোখেমুখে। বাইরের আওতায় একটু বেরোলেই আবেগ, শব্দ, অজানা কালোজলের ভেতরে বাইরে থাকা অগুনতি ভাষায় বোঝায়, সবাই আছে, থাকবে। সরসর করে অল্প দূরে ঠান্ডা সাপ শিকার খুঁজে ফেরে।
চোখ খুললে সব ঝাপসা দেখায়। দেওয়াল ঘেঁষা খাটের মাথায় খোলা জানালা। আকাশে একটুকরো ইস্পাতের উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ ফলার মত চাঁদের গায়ে ছেঁড়া মেঘ ভাসছে। ভেজা গাছের পাতায়, লকলকে ঘাসের ডগায়, বুনো ঝোপের ঝুপসি আঁধারের মাথায় ঝকঝকে রূপালী আলো। ক্যাঁ ক্যাঁ চিৎকার আর ঝটপট ডানা ঝাপটানোর শব্দে নিষাদের ঘোর কাটে। মনে পড়ে আমগাছে কয়েকটা বাসায় ডিম ছিল, দু'চারটে ফুটে কিছু ন্যাড়া ছানাপোনাও বের হয়। উল্টোদিকের গাছের বড় প্যাঁচাটা নিশ্চয়ই আমগাছে খাবার জোগাড় করেছে। একপক্ষের সন্তান অন্যপক্ষের বেঁচে থাকার খাদ্য। ভারসাম্য ঠিক থাকল। একই ভাবে জরা রোগ দুর্ঘটনা মহামারী অতিমারী মানুষ শিকার
করে। প্রকৃতির কাছে সবাই সন্তান, সবাই খাদ্য। আবার আসে আবার যায়। হঠাৎ ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসে। খুব যেন জ্বর কিন্তু তাপ নেই। এই নিয়মের মাঝেই নিষাদ। মৃত্যুকে ভয় করার মত কোনো কারণ দেখে না। কিন্তু ভয় ছেয়ে আসে আষাঢ়ের মেঘের মত। সজাগ মন সূক্ষ্মে যায় অভ্যাস বসে। এই আতঙ্ক মৃত্যুর নয়। তার পৃথিবীর আসন্ন ধ্বংসের অজানা আভাস। এত বছর ধরে যা কিছুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। তার বাড়ি, এই ঝাউগাছের ভিড়, পূর্বের ক্ষীণ উজ্জ্বল আভার ঊষা, ধ্যানী শিবময় ভোর, সোনা গলা পশ্চিমের বৈরাগী বিকাল, সব নিমেষে মুছে যাবে যেমন স্লেটে খড়ির ছবি ধুয়ে দেয় জল। অনিত্যম্ ক্ষণভঙ্গুরম্। তার পৃথিবী থাকবে না কারণ তার মন থাকবে না যার সঙ্গে এই সবকিছু আত্মিক ছিল। কিন্তু গভীর ঘুমের অন্ধকার যে নিঃশব্দে দেখে যায়, সে ছিন্নবন্ধন। এই ভয় মন হারানোর, মনে জুড়ে রাখা নিষাদ কে হারানোর। যদি এই বোধ থেকে বেরিয়ে আসে যে সে নিষাদ, যদি প্রাণ বিশ্বপ্রাণে মিলে যায়, যদি সেই বিরাট পুরুষে নিজের স্বত্ব মেশে, তবে আমিত্ব থাক আর যাক, ভয় নাই।
নিষাদ ভালো করে চারিদিকের জ্যোৎস্না মাখা জীবন দেখে নেয়,
প্রার্থনা করে,
যতো ইন্দ্র ভয়ামহে ততো নো অভয়়ং কৃধি।
মঘবং ছগ্ধি তব ত্বং ন ঊতিভিঃ বি দ্বিষো বি মৃধো জহি।। (অথর্ববেদ, ১৯.১৫.১)
মন্ত্রার্থঃ হে ইন্দ্র, যা কিছুকে আমরা ভয় পাই তার ভয় থেকে আমাদের মুক্ত করুন। হে মঘবন্, আপনার শক্তি দিয়ে অসৎ ও শত্রুদের ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের রক্ষা করুন।
কবিতা
দেবাশিস পট্টনায়েক
জন্ম ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলার (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর) তমলুক মহকুমায়। চাকরি সূত্রে দিল্লী নিবাসী, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত। কবিতা লেখা শখ।
ফল্গুধারা
মেঘ, তুই একেবারেই পাগল !
এমন করে দিন নেই, রাত নেই যখন তখন
চিৎকার করে অঝোর ধারায়
কেউ কি কাঁদে?
এমন করে ব্যথার আগুন
হৃদয় খুলে কেউ কি দেখায়?
এমন করে ক্ষ্যপার মতো
কান্না ক্লান্ত অবুঝ মন নিয়ে
হাওয়ার তানে মাতোয়ারা হয়ে
কেন ঘুরে বেড়াস পেছন পেছন,
দিগন্তিকার আড়ালে যে লুকিয়ে আছে?
মেঘ তুই পাগল, একেবারেই পাগল !
তোর মতো আমিও কাঁদি অঝোরে,
আমারও বুকে আগুন জ্বলে।
শুধু পারি না তোর মতো
জাগাতে হৃদয়বীণায় সুরের ঝংকার
কান্নার আকুল আবেগে।
পারি না তোর মতো
চোখের আয়নায় আঁকতে
ভালোবাসার আগুনের ছটা।
আমার মনের নীরব কান্না
মুছতে পারে না
মুখের আবছা অকারণ হাসি,
পাছে সে আমায় পাগল বলে !
নিজেকে ঢেকে রাখি,
যদি সে ভয় পায়
দুলতে ব্যথার ছন্দে
হৃদয় আকাশে চকিত অনল দেখে!
তাইতো স্বপ্ন দেখি
অজানা অচেনা গন্ধহীন জংলী ফুল হওয়ার -
নাই বা তাকাল আমার দিকে,
নাই বা দিল স্থান খোঁপায়;
উপেক্ষা নীরবে সয়ে
তার আসা যাওয়ার পথে
বুকের আগুন মেলে ধরব
গাড় লাল কোরকের মোড়কে,
নিবেদন করব প্রেম অঞ্জলি
নীরবে ঝরে পড়ে পায়ের কাছে।
আরাধনা
একেলা অলস ক্ষণ,
উতলা এ পাগল মন
আঁকে কোন অস্ফুট জলছবি
হয়ে না বলা বাণীর কবি।
স্বর্ণালী গোধূলি বেলা মনের আকাশে মেঘের মেলা,
কাজল ছায়া, ধূসর ডানা, গোপন ব্যথার নীরবে হানা।
অপরিচিতা তাহার কারণ
আজি হৃদয় উচাটন,
অলক্ষ্য অলীক চাওয়ার, ইন্দ্রপুরীর, কোন অমরার,
চপলা হরিণী, স্বপনচারিনী, কুহকী কামিনী, মনো বিহারীনি,
নিঠুর দরদী নয়নে হারা,
দাওগো ধরা হয়ে মুক্তধারা।
নিবিড় গহীন মনপথে
উচ্ছল নব নব ছন্দে,
মরমী গানের সুরভি কলি,
প্রেমের অঞ্জলি পদাবলী।
‘রঞ্জনী শারদ’
শিউলি সুবাস বাতাসে,
মায়ের আগমন লাগি
প্রমুদিত মন দিন-রাতি;
পুলকিত চাঁদ
শিশির আয়নায়
নিজেরে ভাতি।
হাওয়ার তালে দোলে
সাদা মেঘের ভেলা,
নীলের নীচে কাশের গুচ্ছ;
সবুজ ধানের শীষে
পাখনা মেলা গঙ্গা ফড়িং
নাচিয়ে আঁখি পুঞ্জ;
জল থৈ থৈ
কাজলা দীঘিতে
পাঁপড়ি মেলা শাপলা ফুল;
আর দোলে
ঘোমটা ঢাকা ভীরু নয়ন তলে
টলমল একবিন্দু জল।
পথ পানে চাহি
কাহারে স্মরি
তৃষিত আকুল হৃদয়
দীঘির জলে
সাঁঝের বেলা
আশার প্রদীপ ভাষায়।
রঙের বাহার
ঘাটের উপর বিছানো
হিজল ফুলে,
বধূর আলতা পায়ে,
সিঁদুর টিপে,
পরবাস প্রিয় আসবে বলে।
কলস ছলকে জল,
ছলকে আগমনীর সুর
হৃদয়কুঞ্জ মাঝে,
খুশির রঙে
মনের আয়নায়
প্রকৃতি সাজে।
‘ব্যর্থ পূজা’
সে আমি নই,
লিখি না কোন কবিতা,
বাজে না মনবীণায়
প্রেমের ব্যকুল বারতা।
সীমার মাঝে অসীমকে
খোঁজার নেই আকুলতা,
পারিনা ছড়াতে সুরে
প্রকৃতির সুবাসভরা রম্য গাথা;
অগম্য মনের কোনে
নিঝুম গহীন অন্ধকার,
কান্না নীরব ব্যথার
আমার কথা দলিত পাতার।
আকুল প্রাণের আর্তি নিয়ে
খুঁজে ফিরি তারে,
লুকিয়ে আছে যে
ওই দিগ্বলয়ের পারে।
এক আঁধার রাতে
শ্রাবণ ধারায় নেয়ে,
শীর্ণ কায়া রিক্ত করে
আপন রক্ত ধূলায় বেয়ে,
জ্বালিয়ে ছিল আলো
ঘুম ভাঙা নয়ন পরে,
পরিয়ে ছিল স্নেহের বলয়
উলঙ্গ শরীর ঘিরে,
শিখিয়ে ছিল আঙ্গুল ধরে
হাঁটতে ওই মেঠো পথে,
যদি পড়ে যাই লাথি মারতে
ধুলো ঝেড়ে আপন হাতে।
যার মুখের অরূপ হাসি
অক্ষর হয়ে 'বর্ণ পরিচয়ের'
ফুটেছিল সন্ধ্যাবেলা
টিম টিম আলোয় হ্যারিকেনের।
বাসন মাজা সকালবেলা
সদর পুকুর ঘাটে,
পৌষের হিমেল হাওয়ায়
সারাদিন ধানের মাঠে,
বাজার-হাটে সাথে সাথে
হেঁটে হেঁটে পথ চলিতে
অমৃতবাণী ঝরত সদাই
নবীন চোখের ক্ষুধা ভরাতে।
কপট রাগ আর কাঁদার ছলে
যে সরল মন ভুলায়ে
শূন্য করে নিজের থালা
পরম তৃপ্তি ভরে দিত সব খাইয়ে।
একদিন কোন খেলার ছলে
দিয়ে ফাঁকি আমায়
ভিতরখানায় বাঁশের বনে
ওই যে ওই হোথায়,
শুকনো কাঠ আর
শুকনো ডালের আড়ে
লুকিয়ে গেছে, দেয় না সাড়া
কি জানি কি অভিমান ভরে !
পাতার ফাঁকে অপলক
ঝাঁকে উদাস সন্ধ্যাতারা,
খুঁজে বেড়াই সকাল সাঁঝে
শোকাতুর আমি নিন্দ্রাহারা।
চেনা অচেনা পথে,
ঝরা পাতার মর্মরে,
যদি ভাসে আওয়াজ
তার রাতুল পায়ের !
নীরব ব্যথা, দমিত আশা,
ভাঙা স্বপনের কূল?
পূজার থালা সাজাব
দিয়ে তাদের হাসির ফুল।
সাজিয়ে তরী দিলেম পাড়ি
অতল অকূল বারি সাগর,
যদি পাই মুক্তামনি
তবেই হবে পূজার উপাচার।
কালো মেঘ তুফান ভারি
হায়রে আমার ডুবল তরী,
হারিয়ে গেল গোপন স্বপন,
কুড়াই এখন পাথর নুড়ি।
ঢলে গেল চঞ্চল বেলা,
এ যে শুধুই মিছে খেলা,
হারিয়ে গেছে সকল আশা,
শূন্য আমার পূজার থালা।
জানিনা কখন ঘুমের দেশে
ডুববে শশী কোন মোহনায়,
তাইতো জোছনা পড়ে ঝরে
ব্যথার বাদল হয়ে হাওয়ায় পাতায়।
পাগল বাউল গান সেধেছে
একতারায় সেই রিমঝিম সুরে,
হয়তো সে সুর দিয়েছে দোলা
তোমাদের করুন প্রাণের পরে।
গল্প
সংশোধনাগার
গীতাঞ্জলী ঘোষ
(১)
“ঐ ঐ ওঠ। শালা কত ঘুমাবি। ওঠ” —দ্বিতীয় বার বলা ওঠাটা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছিল। ঘুমটা অবশ্য ভেঙেছিল পেটে সজোরে এক লাথির তাড়নায়। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েছিলাম। শরীরটা নোংরা মেঝে থেকে উঠে পড়লেও চোখদুটো খুলে রাখতে পারছিলাম না। মাকড়সার জালের মতো দুই চোখ ঘুমে জড়িয়েছিল, অনেক চেষ্টাতেও সেই জাল ছাড়াতে পারছিলাম না।
-- ”ওদিকে দেখ ওদিকে দেখ”— এইরকম আওয়াজের এক কোলাহলে ঘুমটা হঠাৎ করেই চোখের পাতা ছেড়ে বেরিয়ে এল। এই ঘরটায় একটাই মাত্র ঘুলঘুলি, কোনো জানালা নেই। সেই ঘুলঘুলি দিয়ে দিনের প্রথম আলো এসে ঘরটায় এক মায়াময় বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। ঘর বলা ভুল হবে। জেলখানা। দান্ডেলিয়া সংশোধনাগার এর তেরো নম্বর সেলটাই আমার বিগত দুদিন যাবৎ ঘরে পরিণত হয়েছে। তবে এখনও কয়েদির পোশাক পরানো হয়নি, যথারীতি কয়েদি নম্বরটাও জোটেনি। কেন সেটা এখনও জানি না। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। আমার নাম মাকস্যাম সেইজ, ম্যাক্স নামেই বেশি পরিচিত। আমি পেশায় ডাক্তার, মনের ডাক্তার। যাকে কিতাবি ভাষায় বলে সাইকোলজিস্ট। না না কাউকে খুন, চুরি, ডাকাতি করে জেলে আসিনি আমি। বরং খুন করব না এই মনোভাব পোষণ করেছিলাম বলে আজ আমি জেলে। খারাপ কাজ কে না বলতে নেই, এতদিনের এই ধ্রুব ধারণার সংশোধনের জন্যই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। এই তেরো নম্বর সেল এ আমি ছাড়া আরও আট জন আছে। তাদের নাম, পেশা নিয়ে আমি কোনো আগ্রহ দেখাইনি। তবে তারা যে আমারই সমসাময়িক এই জেলে, সেটা তাদের মুখ চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। সাইকিয়াট্রিস্ট বলে কথা। যাই হোক, বাকি সদস্য দের শেল এর গেটের একটা কোনে ভিড় করতে দেখে ব্যাপারটা কি দেখার জন্য উঠে এগিয়ে গেলাম।
-- “এগো বাঞ্চোত। পা নড়ছে না নাকি। এগো”, এই বলে খাকি পোশাক পরা পুলিশটা গায়ের যত জোর দিয়ে হয় লাঠির এক বাড়ি মারল রুগ্ন, শীর্ণ লোকটার পায়ে।
--” ও মা গো”, ককিয়ে উঠলো সে। হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়েছিল। অত্যন্ত কষ্টে উঠে দাঁড়াল। লোকটার কয়েদি পোশাকে ৩২ মার্ক করা ছিল।
দেখলাম থানার বাইরে লম্বা একটা লাইন। কয়েদির পোশাকে ঢাকা লোকগুলোর শারীরিক অবস্থা কম বেশি একই — রোগা, ঝুঁকে পড়া, দুর্বল। তাদেরকে একে একে তোলা হচ্ছে কালো রঙের পুলিশি ভ্যানটায়।
-- ”এদেরকে পাঠানো হচ্ছে গ্যাস চেম্বার এ”। আমার কলিগদের মধ্যে কেউ বলে উঠল (কলিগ বলছি কারণ আমরা এই নয় জন একই কাজ উদ্দেশে এসেছি, নিজেদের সংশোধন করতে)
-- গ্যাস চেম্বার!!!! সেটা কোথায়। মানে কেন নিয়ে যাচ্ছে”।
-- গ্যাস চেম্বার হল এদের সেন্ট্রাল ক্যাম্প। সেখানে অনেক ক্রেমেটরিয়াম আছে। যে সব কয়েদিরা দুর্বল হয়ে পড়ে, যাদের খাটার আর কোনো ক্ষমতা থাকে না, তাদেরকে ওই ক্যাম্প এ পাঠানো হয়। ওখানে জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড আছে সেখানে একে একে সকলকে পুড়িয়ে মারা হয়। অনেক সময় মজা দেখার জন্য যে কোনো একজনের গায়ে আগুন লাগিয়ে খোলা মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বাকিদের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়। আগুনে জ্বলতে থাকা মানুষটা চারিদিকে ছুটে বেড়ায়, সে ভাবে ঐ আগুন অন্যের গায়ে লাগিয়ে দিতে পারলে তার বোধহয় জ্বলন কিছুটা কমবে। এই ভাবে আস্তে আস্তে সবাই আগুনে জ্যান্ত জ্বলে পুড়ে মরে।
শুনে একজন ধপ করে বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “মানে আমরা কোনোদিন এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারব না। আমার বউ, বাচ্চা। ওদের আমি তার মানে আর কোনোদিন দেখতে পাব না! আরেকজন বলে উঠল, “আমার মনে হয় ওরা আমাদেরও জ্বলন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলবে, তাইতো এখনও কয়েদীর পোশাক পড়তে দেয়নি।“
ওরা সেটা করবে না। বললাম না এটা একমাত্র যারা শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, যাদেরকে ওরা বোঝে যে আর কোনো কাজে লাগানো যাবে না। তাদের সাথেই একমাত্র ওরকম করে।
বলছ ভাই। বলছ? তার মানে আমরা বাঁচব বল। যত হাড় খাটুনি খাটাক আমার কোনো অসুবিধা নেই কিন্তু যেন বাঁচিয়ে রাখে। আমি শেষে আমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চাই।
এইভাবে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ যারা নিজেরাও জানি না কে কোন অপরাধে এসেছি, একে অন্যের সহমর্মী হয়ে উঠলাম। কথায় বলে না, সুখের থেকেও দুঃখ মানুষের হৃদয়কে বেশি বিচলিত করে। আর যখন সকলের দুঃখ এর কারণ একই হয় তখন খুব তাড়াতাড়ি সেটা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। সেই দুঃখ ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়ে ছাই চাপা আগুন হয়ে জ্বলতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই শব্দহীন এক প্রতিজ্ঞা আমাদের মনে গেঁথে গেল, যে ভাবেই হোক যে পরিস্থিতিতেই হোক নিজেদের পরিবারের জন্য আর একে অপরের জন্য আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। যদিও কয়েদি ইউনিফর্ম না পাওয়ার কারণটা আমরা পরদিন এই বুঝে গেলাম। এখানে আমাদের রাখা হবে না, পাঠানো হবে অন্য এক ক্যাম্পে। তবে সেটা গ্যাস চেম্বার নয় জেনে সবাই স্বস্তি বোধ করল। তবে সেটা কোথায় তা আমাদের জানানো হল না। আমার সিকস্থ সেন্স এটাই বলছে সেটা আরও ভয়াবহ কিছু হতে চলেছে।।
(২)
পরেরদিন অবশ্য আর গোত্তা খেয়ে উঠতে হয়নি। আগেরদিন সন্ধ্যেবেলাতেই আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল যে ব্যভেরিয়া ক্যাম্পে ট্রান্সফার করা হবে আমাদের। সেখানে কিরকম ব্যাপার কি হবে এই সব ভেবেই রাতে আমরা বেশিরভাগ ঘুমোতে পারিনি। লাইন দিয়ে বেরোনোর সময় আমাদের যে জিনিসপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছিল সব একে একে ফেরত দেওয়া হল। আমি নিজের লেখা অর্ধ সমাপ্ত ম্যানুস্ক্রীপ্টটা ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি হলাম। নিজের অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করার সুযোগ সকলে পায় না। আমার মুখে খুশির উজ্জ্বলতা দেখে গার্ড বলল,
ইতনা খুশ কা হে হো রহে হো বে। সব কুছ ফির্সে ওয়াপাস লে লিয়া জায়েগা।
শুনে আমার হাজার ওয়াট এর বালবের ফিউজ উরে গেল এক মুহুর্তে। একে একে উঠে গেলাম পুলিশি ভ্যানে। স্টেশন এ নিয়ে গিয়ে এক মালগাড়ি তে ওঠানো হল আমাদের। যে কামরাতে উঠলাম সেটা একটা বদ্ধ নোংরা কামরা। মেঝেতে ভেজা খড়, স্যাঁতস্যাতে আর আম্যোনিয়ার উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধ। বুঝলাম এখানে মল মূত্র ত্যাগ হয়েছে অদূর অতীতে।
ওয়াক ওয়াক। আমার সহযাত্রীদের একজন বমি করে ফেলল। সেটা আর পরিষ্কার করা হল না। তার ওপরই কিছুক্ষণের মধ্যে মাছি ভন্ভন্ করতে আরম্ভ করল, সেই নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হল অজানা উদ্দেশ্যে।
এইরকম ভাবে দু ঘণ্টা কাটল। হঠাৎ দাড়িভর্তি মুখওয়ালা একটা লোক এসে আমাকে কলার ধরে টেনে তুলল। চোখদুটো কেমন কোটরাগত।
পকেটে যা মাল আছে বের করে দে। কুইক। যা কিছু আছে সাথে বার কর বার কর জলদি।
আমার কাছে নিজের লেখা ম্যানু স্ক্রিপ্ট ছাড়া কিছুই ছিল না। টাকা পয়সা থাকলে আমি নিমেষেই দিয়ে দিতাম, কিন্তু এটা দেওয়া যাবে না। কোনোভাবেই না। আমি ম্যাণু স্ক্রিপ্টটা জামার ভেতরে চেপে ধরে থাকলাম যাতে বুঝতে না পারে। আর একজন (যতদূর সম্ভব এর সঙ্গী) এসে আমার পাশে বসে থাকা একজনকে টেনে তুলল। সে বেচারা প্রচণ্ড ভীতু, কেঁদে ফেলল।
তোর কাছে কি আছে। বার কর। ফালতু মটকা গরম করাস না।
(কেঁদে) আমার কাছে কিচ্ছু নেই, বিশ্বাস করুন। এই দেখুন দেখুন একটা করিও নেই। ছেড়ে দিন প্লিজ….. বলে সে পকেটে এর কাপড় টেনে দেখাল।
কাঁদছিস কেন। কাঁদছিস কি জন্য। যেখানে যাচ্ছিস সেখানে এরকম নেকা কাঁদলে না জিন্দা ফাঁসি দিয়ে দেবে, চুলের মুঠিটা ধরে ঝাঁকালো।
বাগি, এই মালগুলো যাচ্ছে এবার। এদের ধুতে হেব্বি মজা আসবে বে। সব এই মায়ের পেট থেকে বেরিয়েছে। বলে দুজনেই কেমন খ্যাক্ খ্যাক্ করে হেসে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাগি ঘুরে এসে আচমকা সপাটে এক চর কষালো আমার গালে। এক লক্ষ্য বিদ্যুতের তারের একসাথে ফুল ভোল্টেজ ঝটকা লাগল মাথায়, গালের উষ্ণতা বেড়ে ১২১ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
বেশি চালাকি করো না বস……তোদের আচ্ছা করে ক্লাস নিতে হবে। বলে আমার গলাটা টিপে ধরল।
বাগগী, ছাড় বে। যা আছে হয়ে যাবে আজ। ছাড় ছাড়। এ মংরু ছোরওয়া উস্কো। এক মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো।
কিয়া করে আর্লি, তুঝে পাতা তো হ্যা ইসকা এক dope না জায়ে তো দিমাগ হিল জাতা হ্যা। বাগি আমাকে ছাড়ছে না দেখে আর্লি এসে বাঁচাল আমাকে।
যা না। এ মঙ্গরু লিয়ে যা একে। মোংরু আর বাগি চলে গেলে আর্লি একটা সাইডে হেলান দিয়ে ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। আমার পাশের জন তখনও হালকা সুরে কেদেই যাচ্ছে।
আব্বে ইসকো চুপ করানা ইয়ার। রতুলা। দেন আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
কাহাসে আয়া রে।
অস্কটিচ।
কি করিস।
ডক্টর। সাইকিয়াট্রিস্ট।
বাব্বা দীমাগ কা ডক্টর। তোদের তো শুনছিলাম ভিসা দিয়ে আমেরিকা পাঠিয়ে দিচ্ছে, যাসনি কেন তুই। আমি চুপ করে ছিলাম।
কথা বলতে ভুলে গেছিস নাকি।
না মানে আমার বাবা, মা সবাই এখানে……ওদের কে যেতে দেবে না নাজি সরকার, তাই। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
পিতৃ মাতৃ ভক্ত। তো সেনাবাহিনী তে চলে যেতে পার তি। হিটলারের বাহিনীর মন জুগিয়ে চললে বহুত ইজ্জত পেতিস। গেলি না কেন।
আমি চুপ করে রইলাম। আর্লি বলল,
ভয় পেলি কি!! চল তোকে এমন ট্রিটমেন্ট দেব, বাইরে বেরিয়ে তুই সেনাবাহিনীতে ঢোকার জন্য তৈয়ার হয়ে যাবি। বলে সিগারেটটা ফেলে উঠে দাঁড়াল আর্লি।
আমার পাশের জন এবার মুখ খুলল।
একটা পাওয়া যাবে, অত্যন্ত ভয়ে ইশারা করে বলল।
তোরা তো ঝাঁঝু মাল আছিস। একটার শালা মুখ দিয়ে কথা সরে না আর একটা সামনে ভেউ ভেউ করে কাঁদে আর পেছনে এই। বলে আর্লি চলে যেতে যেতে একটা সিগারেট বার করে ছুড়লো।
এই টাই ফার্স্ট আর লাস্ট। এরপরে……..না থাক পরে বলব। চলে গেল আর্লি।
পেচ্ছাপের ঝাঁঝালো গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগল আমার। আমি খেয়াল করলাম, যতক্ষণ এই আর্লি, বাগি আর মঙ্গেরু ছিল আমি গন্ধটা পাইনি। তার মানে নিজের মন অন্য দিকে রাখলে আমি অনেক গন্ধ থেকেই নিস্তার পাব। নিজেকে বাঁচানোর এক রাস্তা আবিষ্কার করতে পারায় মনে মনে বেশ রোমাঞ্চ বোধ করলাম।।
(৩)
ব্যভেরিয়ার লেবার ক্যাম্পে আসতেই আবার এক লাইনে দাঁড়াতে হল। গার্ড বলল, জামা প্যান্ট খোল। কুইক।
আমরা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার মন পড়েছিল ম্যানইউ স্ক্রিপ্ট এর দিকে, ওটা হারানো যাবে না।
কি রে খোল। বলে এক লাঠির বারি মারল যথারীতি আমার পাশের সেই কেঁদে ফেলা মানুষটাকে।
দশ গোনার সাথে সাথে খুলে ফেলবি সব। নাহলে….
বাকিটা আর বলতে হল না। পাঁচ গোনার সাথে সাথে আমরা বুঝলাম, এই নগ্ন শরীরটা ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের আর হারানোর কিছুই নেই। আমার আগের জনের সব চেকিং হয়ে যাওয়ার পর যখন সে কয়েদির পোশাক পরল, তার পকেটে গিয়ে মানুস্ক্রিপটটা গুজে দিলাম। পোশাকের নম্বরটা দেখে নিলাম ৭১৩। আমার পালা এল।
তুই ডক্টর আছিস? আইডি কার্ড দেখে গোঁফ ওয়ালা গার্ড জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
এ ইসকো ৭৫২ ওয়্যালা দে তো। আউর ও কাগজ দে। শোন এই কাগজটা ঠিক করে রাখবি। সকালে ব্রেড আর রাতে সুপ পাবি। আর হ্যাঁ তোর কাজ মাটি কাটা। সব লেখা আছে কাগজটা য়। নে কুড়ি গোনার সাথে সাথে পড়ে নে জামাটা। এক…..দুই…
এখানে আমাদের একটাই পরিচয় কয়েদি ইউনিফর্ম এ লেখা নম্বর। আমি ৭৫২, আমার পাশের ভীতু ৭৮৯ মাঝের সংখ্যাগুলো বোধ হয় অন্য কয়েদিদের। ২৫ নম্বর সেল। যাওয়ার সময় আর্লিকে দেখলাম মহিলাদের লাইন এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ২৫ নম্বর এ গিয়ে দেখলাম বারো জন আমি নিয়ে। সে তুলনায় ঘরটা ছোট। একটাই ল্যাট্রিন, ঘরের মাঝখানে। সবারই দেখলাম ঐ এক কাগজ। একজন কে দেখলাম একটু খোড়া, হাল্কা পা টেনে চলছে। নাম্বার ৭৫৩। আমার পরেই।
৭৫৩ : রেগুলার বডি চেক আপ হয়। বডি সিধা করে দাঁড়াবে আর রেগুলার সেভিং করবে। এরা এসব ব্যাপারে খুব লক্ষ্য রাখে। দেখো আমি এই খোঁড়া পা নিয়েও উতরে যাচ্ছি। মন্যাল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তার জন্য আমাকে বেঁচে ফিরতেই হবে।
৭৫২ : মোনাল কে? আর শেভিং এর জিনিস কিনব কি করে?
৭৫৩ : মণাল আমার স্ত্রী। ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেকদিন। কিন্তু আজ আমি বুঝতে পেরেছি ওকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। ফিরে গিয়ে আমি ক্ষমা চাইব ওর কাছে। বেঁচে আমাকে ফিরতেই হবে। শেভিং এর জিনিস ওদের কাছেই থাকে, পুরনো। এত শয়তান এরা যে এগুলোর জন্য টাকা নেয়। ঐ কাজের জন্যে প্রত্যেকদিন পঞ্চাশ টাকা করে দেয়। পঞ্চাশ টাকা ছয়টা সিগারেট এর দামেই শেষ। কিন্তু তার থেকেই ব্রেড কিনতে হবে। আর হ্যাঁ এখানে সিগারেট একমাত্র ক্যাপো রা খায়। কোনো কমরেড এর হাতে সিগারেট দেখলেই বুঝে যাবে সে এমন কোনো বড়ো কাজ করেছে, সাংঘাতিক কিছু। গার্ডরা তাদেরও সমীহ করে চলে।
৭৫২ : কি রকম কাজ করতে হয় ক্যাপো হওয়ার জন্যে? আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ৭৫৩ বোধ হয় আমার মনের গোপন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিল। সে মুচকি হেসে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করল,
ওইদিকে আছে একটা কুয়ো। মানুষের বডি, নোংরা জিনিস, এমনকি মলমূত্র ওখানে ফেলা হয়। তারপর শাস্তি হিসেবে কোনো জ্যান্ত মানুষকে ওখানে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ঐ পচা গলা গন্ধের মধ্যে থাকতে থাকতে সেও মরে যায়। বাগি আর মনরু এখন মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়। ফিউচার ক্যাপো। বলে হাসল।
(৪)
পরেরদিন সকালে সবাই একটা করে বালতি নিয়ে কল পারে স্নান করতে বসলাম। তখনও সূর্য ওঠেনি, চারিদিকে এক আলো আঁধারের ছাপ। হঠাৎ, ওগো তোমরা আমাকে কেউ নাও গো কেউ নাও বলে অদ্ভুত ভাবে কান ফাটানো চিৎকার করতে করতে একটা খেপি মতো মেয়ে ছুটে এলো আমাদের সামনে। একটা লেডি গার্ড তাকে মারতে মারতে নিয়ে গেল। চোখে প্রশ্ন চিহ্ণ নিয়ে তাকালাম ৭৫৩ এর দিকে।
নাজি সরকার রিসেন্ট ধর্ষিত মহিলাদের জন্য মাসিক ভাতা ঘোষণা করেছে। ওর এখনও রেপ হয়নি, বাড়িতে একটা ছোটো বোবা বোন আছে। ঐ অনুদানে সে বোনকে ভালো রাখতে চায়। কিন্তু কি করে জানি খেপিটার সিফিলিস হয়ে গেছে। তাই কোনো পুরুষ ওর ধার মারায় না।
বলে ৭৫৩ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে গেল বালতি নিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, ভাবছি কোন অমোঘ টানে মানুষ নিজের সম্মান বিক্রি করে দিয়ে বোনকে ভালো রাখতে চায়-- কিসের জন্য!
ব্যভারিয়া ক্যাম্পে এসে দিন সাত হয়ে গেল। এই প্রথম বুঝলাম, আমার ডাক্তারি বইগুলোতে সব মিথ্যা লেখা আছে, ভুল সব। বুঝলাম সাত ঘণ্টা ঘুম আর পর্যাপ্ত পুষ্টি ছাড়াও মানুষ বেঁচে থাকে। হাড় আর চামড়ার আড়ালে বেঁচে থাকে। বুঝলাম মানুষ এমন এক জীব যে সব অবস্থাতেই এডজাস্ট করে নেয়। গাড়ি, বাড়ি, টাকা, জামা কিচ্ছু না শুধু প্রাণে বেঁচে থাকাটাই কারাগার জীবনে সবথেকে সুখের আর কিচ্ছু না। বড্ড আজব এই জীবন। এখানে একটা দিন কাটতে চায় না কিন্তু একটা সপ্তাহ এক নিমেষে কেটে যায়। ৭৫৩ আমার বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেছে কদিনে। ৭৮৯ ক্যাপো হওয়ার লোভে দেখছি বাগিদের পা চাটা শুরু করেছে। একদিন আমরা লাইন দিয়ে ব্রেড নিচ্ছি। কিছুজনকে দেওয়ার পর হঠাৎ ঘোষণা হল,
আর দুটো ব্রেড আছে।
মানুষ প্রায় কুড়িজন। দুটো ব্রেড এর কথা শুনেই কুকুরের মতো ঘিরে ধরল সকলে। ভাগ্য ভালো ছিল আমি পেয়েছিলাম। দুটো ব্রেড শুনে যারা পেয়েছিল সবাই টপাটপ খেয়ে নিল যাতে ভাগ দিতে না হয়। আমি আমার টা ৭৫৩ এর দিকে এগিয়ে দিলাম। এদিকে ৭৮৯ এর পকেটে দেখলাম চারটে ব্রেড গোঁজা। সেই দেখে ৭১৩ তেড়ে এল। দুজনের মধ্যে হাতাহাতি চলল কিছুক্ষণ। কিন্তু ক্যাপোর হাত জার মাথায় থাকে শেই তো বাজিগর। তাই কিছুই হল না ৭৮৯ এর। এরপর শুরু হল আসল সংগ্রাম—অন্তঃ প্রজাতি সংগ্রাম। দুটো ব্রেড এর ওপর প্রায় কুড়িটা একই জাতির প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্রেড এর টুকরো একবার এর হাতে যাচ্ছে তো একবার ওর হাতে। একজন কোমর থেকে ছোঁড়া বার করে ভুসিয়ে দিল আরেক জনের পেটে। কয়েদি সাদা ইউনিফর্ম রাঙা হয়ে উঠল। শেষ অব্দি কে পেল সেটা দেখার কোনো উৎসাহ ছিল না আমার। এর মধ্যে একদিন কাজ থেকে ফেরার সময় আর্লির সাথে দেখা হল। এ কথা ও কথায় সে বলল,
এখানে মেন্টাল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম মানুষ খুব উৎসাহী থাকে। ভাবে সে নিস্তার পাবে, পরিবারের সাথে দেখা করতে পারবে। বহুত তেল থাকে তখন তার। নোংরা জামা পরব না, একই জায়গায় মুতবো না হাগব না। নৌট্যাঙ্কি সব। দেন এক টাইম আতা হ্যা জাব সব ফিউজ। এমন ভেতর থেকে পচে যায় কি ডান্ডা দিয়ে মেরে মেরেও শালাদের কাজে নিয়ে যাওয়া যায় না। মনটা মরে পচে গলে যায়। খিদে যাতে না পায় ড্রাগ নেয়। ড্রাগের নেশায় খিদে, তেষ্টা সব ভুলে যায়।
এই সব ভাবছি হঠাৎ ৭৫৩ আমার হাত ধরে টানল,
এই দেখো আমার মোনাল। বড়ো ভালোবাসি আমি একে।
ফটোর থেকেও আমি ৭৫৩ এর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। শৃঙ্খলে আবদ্ধ পাখির ওড়ার স্বপ্নে ভরা চোখ দুটো দেখছিলাম। ডক্টর নয় নিজেকে পেশেন্ট এর জায়গায় দেখতে বড্ড অন্যরকম লাগছিল।।
(৫)
“ ক্যা বে। খাড়া কিউ হ্যা। খুদাই হো গই?” মোনরু চেঁচালো।
“ চলছে”, বলে আমি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসতে গেলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছিল। পায়ের গোড়ালিতে তিব্র যন্ত্রণা। নিজের মনটা অন্যদিকে করার চেষ্টা করছি, এটাই ব্যথা কমানোর একমাত্র বেস্ট সাইকোলজিকাল উপায়। গাছ এর গুড়িতে ঠেস দিয়েছি হঠাৎ মাথায় কিছু একটা এসে ঠেকল। দেখি দুটো পা। কোনোমতে ভয়ার্তো চোখে মাথা ওঠালাম। একটা লোক গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে। ঢোক গিলতে গিয়ে আটকে গেল। ভয়ে পেছোতে থাকলাম এক পা এক পা করে। পায়ে শক্ত ইঁট লেগে হোচট ক্ষেয়ে পড়তে যাচ্ছি কি ৭৫৩ হাতটা এসে ধরল।
সাবধানে। কি কান্ড।
দেখি আমার পেছনে মস্ত কুয়া, বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে তার থেকে।
এইটাই ঐ কুয়ো। তুমি এখানে কি করছ?
আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলাম।
ও এই দেখে ভয় পেয়েছো। ও এখানে হামেশাই হয়। কাজ না করে ড্রাগ নিয়ে পড়ে থাকলেই জ্যান্ত ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়। বেচারা জানতেও পারে না কখন মরে গেছে।
কি হল বুঝলাম না। আমি আচমকা ৭৫৩কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার পিঠে হাত রেখে আস্তে করে বলল
ম্যাক্স, ডোন্ট ক্রাই। হি হু হ্যাস এ হোয়াই টু লিভ ক্যান বিয়ার উইথ অলমোস্ট এনি হাউ।
এই প্রথম অনেকদিন পর নিজের নামটা (অপরিচিত যাকে কোনোদিন নিজের নাম বলিনি) তার মুখ থেকে শুনে বুকে কোথাও একটা হালকা মৃদু ব্যথা অনুভব করলাম। আর একবার জড়িয়ে ধরলাম ৭৫৩ অর্থাৎ আলেক্সকে।
এইভাবে পাঁচ মাস কেটে গেল। ক্যাম্পে স্ক্রাব টাইফাস দেখা দিল ভয়ঙ্কর রূপে। ডাক্তারি ডিগ্রী থাকায় ডাক পড়ল পাশের ক্যাম্পে। দিনরাত এক করে হাড় খাটানো খাটুনি। যত ট্রিটমেন্ট করে রোগ টাকে বাগে আনার চেষ্টা করি ততই পিছলে যায়। আয়নায় নিজেকে নগ্ন অবস্থায় দেখলাম একদিন। পুষ্টি হীনতায় ক্ষীণ হয়ে আসা শরীর। চামড়া হারের ওপর লেপ্টে আছে। হাত দিয়ে দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম কোথাও কি এক টুকরো মাংস বেঁচে নেই! স্ক্রাব টেইফাস এ মারা গেল অসংখ্য মানুষ —দ্যা হলোকস্ট। কি করে জানি না আমি বেঁচে ফিরলাম ক্যাম্পে। আমার কলিগ দের চিনতে পারলাম না। তাদেরও শরীর ভয়ংকর, কাজ করার ক্ষমতা নেই। চারপাশের অবস্থা দেখে আমার সেই প্রথম দিনের গ্যাস চেম্বার এর কথা মনে পড়ছিল, সময় বুঝি আমাদেরও হয়ে এল। বাগি এসে বলল, পরশু একটা কম্পিটিশন হবে যার মাধ্যমে সবল আর দুর্বলদের বেছে নেওয়া হবে। আসলে সবল দুর্বল কারা এরা সেটা ভালোই জানে। যারা নতুন আসে ইচ্ছা করে তাদের সাথে পুরনো (যাদের শরীর ভেঙে গেছে) তাদেরকে লড়তে দেয়। এইভাবে মেরে জনসংখ্যা কমানোটাই মূল উদ্দেশ্য। পরেরদিন একটা বড়ো লিস্ট এল কারা কারা যাবে। তাতে আমার নাম রইল না। কিন্তু ৭৫৩ ছিল। আমার বুক কেপে উঠল। একেই পা খোঁড়া তার ওপর শরীর ভেঙে গেছে, ৭৫৩ পারবে না। আমি বুঝে গেলাম। মুখে একটা লম্বা হাসি টেনে ৭৫৩ বলল,
এই ফটোটা তুমি রাখো। যদি কোনোদিন মোনালের সাথে দেখা হয় ওকে বোলো আমি ওর কথা খুব মনে করতাম। পারলে যেন ও আমাকে ক্ষমা করে……কথা শেষ হল না। আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।
উপস্থিত হল সেই দিন। ফাঁসিতে ঝোলার আগেও মানুষ আশা দেখে হয়তো কোনোভাবে সে নিস্তার পেয়ে যাবে। এটা একটা সাইকোলজিকাল এফেক্ট। আমার মনের মধ্যেও সেটা কাজ করছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কিছু একটা হবে । কিছু একটা করে ৭৫৩ ফিরে আসবেই। সত্যি এসেছিল ৭৫৩। কম্পিটিশন শুরুর এক ঘন্টা আগে এসে বলল,
শুনলাম যাদের কম্পিটিশন এ নেওয়া হচ্ছে না তাদেরকে মেরে ফেলার জন্যে এই ক্যাম্প এ আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে। শোনো আমি বাগিকে রাজি করেছি ওদের ভ্যানে তোমাকে তুলে নেবে।
আর তুমি? ৭৫৩ হাসল।
না তুমি না গেলে আমি যাব না। কিছুতেই না। দরকার হলে জ্বলে মরবো তাও ভালো।
বোকার মতো কথা বোলো না। এই সমাজের দরকার তোমাকে। আর আমার যা শরীরের অবস্থা, এই খোঁড়া পা নিয়ে আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। শোনো তুমি আধ ঘন্টা পর ঐ কুয়োর কাছে চলে যেও। ৭৫৩ চলে গেল। শুরু হয়ে গেল ওদের মারণ লড়াই। আমি যাইনি দেখতে। ঠিক করে নিয়েছিলাম ৭৫৩ যাই বলুক আমি নড়ব না এখান থেকে। রাত বাড়ল। ৭৫৩ এর কথামত ক্যাম্প এর একদিকে আগুন জ্বলে উঠল। আমি ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা আমার গায়ে এসে ঝাপটা মারল। আর ঠিক তখন আমাকে পাঁজা কোলা করে কেউ তুলে দিল ভ্যানে। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম, হাত জোড় করে প্রার্থনা করলাম, ছেড়ে দাও। আমি মরতে চাই আমার বন্ধুর সাথে। কিন্তু ঐ “যা কিছু চাই সব তো পাওয়া যায় না”।
ভ্যানে উঠে দেখলাম চারিদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ভ্যান চলতে শুরু করল, ভেতরে আর্লি, মনরূ, বাগি, ৭৮৯। আমি শুধু ঝাপসা চোখে দেখলাম আমার বন্ধুত্ত্ব এর পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। না সে ফিরল না। আমি ফিরে পেলাম না ৭৫৩কে। দূর থেকে দেখলাম ধুম্রমান কুণ্ডলি রূপে সমগ্র আকাশ ছেয়ে ফেলল-- আমার প্রাণের আলেক্স।
গল্প
অনুগল্প
সনোজ চক্রবর্তী
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
অন্য এক রোব্বার
"কি হল সাতসকালে পায়জামা পাঞ্জাবি?" সুলতার প্রশ্নে একটু হলেও ঘাবড়ে যায় তপন, কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করে।
"না, মা..মা...মানে... ক্যা..কেমন দেখাচ্ছে?"
ব্রাশের উপর টুথপেষ্টটা পূর্ণচ্ছেদের মতো লম্বা টেনে, ঘাড় ঘোরায় সুলতা--
"উু.... মন্দ নয় কিন্তু এতো সকালে!"
ততক্ষণে তপন বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়েছে।
"যেভাবে মেঘ ধরছে, খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নামবে তাছাড়া বাজার ফেরত সেই তো আজকাল স্নান করতে হয় তাই সকাল সকাল বাজার সেরেই না হয় কলতলায় যাব।"
পেষ্ট লাগানো ব্রাশটা ড্রেসিংটেবিলে রাখে সুলতা। বাজারের ব্যাগটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়। শক্ত হাতে পাঞ্জাবীর কলার ধরে নিজের কাছে টেনে নেয় তপনকে। হকচকিয়ে যায় তপন।
ঘটনাক্রম ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারে না। হিন্দি সিনেমায় সে দেখেছে, ভিলেনরা ভয়ঙ্কর কিছু করার আগে এমন ভালোমানুষি করে। তার গলা শুকিয়ে আসে, সে মনে করতে চেষ্টা করে, গতকাল কিছু কি ভুল হয়েছে তার! অনেক চেষ্টাতেও সে কিছুই খুঁজে পায় না-- এমনিতে স্বাভাবিক অবস্থায় কত কিছু ভুলে যায় তপন!
"আজ তোমাকে কিছুই করতে হবে না।" -- কথাগুলোয় আদর মেশায় সুলতা।
"আমার কি কিছু ভুল হয়েছে সুলু?" --কাতর জিজ্ঞাসা করে তপন।
"ভাইকে বলছি, সে আজ বাজার থেকে শাক-সবজি আনবে, কলতলায় এঁটো বাসনে আমি মাকে হেল্প কর..." সুলতাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তপন অস্থির হয়--
"না, না তা কি করে হয়!"
"আজ তোমার রবিবার" -- সুলতা হেসে বলে।
আকাশ থেকে পড়ে তপন -- "রবিবার?
আজ তো...."
সুলতা তপনের মুখের কথা কেড়ে নেয়-- "জানি, আজ বুধবার কিন্তু আজ কি বলতো?"
সুলতার মুখে তাকিয়ে বোকাবোকা হাসে তপন। "আ...আ.….আজ!"
মনে করার ভয়ংকর চেষ্টা করে সে কিন্তু সবজীবাজার, কলতলা, রাতের রুটি বেলা, শাশুড়ীমার ঔষধ,শ্যালকের জামাকাপড় ইস্ত্রী এসবের বাইরে কোনো কিছুরই নাগাল পায় না সে!
"বুদ্ধু আমার.... আজ জামাইষষ্ঠী। আজ সারাদিন তোমার রবিবার। "
দু'আঙুলে, আলতো তপনের নাক টিপে আদর করে সুলতা।
২
বারবার ঘড়ি দেখছিল জন্মেজয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। নইলে রক্ষে নেই। পৌঁছতে না পারলে, যেখানে ভোরের আলো সেখানেই আপাত অস্থায়ী আস্তানা বসাতে হবে রবিউলদের। লোকালয় ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি খুঁজে নিতে হবে একটু ঘন সবুজ জলা-জঙ্গল।সঙ্গের লটবহর কম নয়।
নিজেদের ব্যাগ ব্যাগেজ ছাড়াও সত্তরটির উপর কাঠ বাক্স। দড়িদড়া খুলে, বাক্সের ঢাকনাটা সরিয়ে নিলেই সকালের আলো মেখে ওরা দলে দলে ছড়িয়ে পড়বে ইতিউতি। দিনশেষে সন্ধ্যে নামার আগেই একটু একটু করে যখন কমে আসবে আলো তখন আবার ওরা ফিরে পড়বে ওদের ঘরে।ঘর বলতে কাঠ-বাক্সের আস্তানা। কথা হচ্ছিল বসিরহাটের রবিউল ও জন্মেজয়ের সঙ্গে। দুইজনই লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারে নি। কিছুদিন আর পাঁচজন বেকারের মতো এটা ওটা চেষ্টা চরিত্র করে শেষমেশ সরকারি ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে বছর দশেক আগে শুরু করে এপিক্যালচার।মৌমাছিদের এই বিশেষ চরিত্র জানা ছিল না।
দিনের আলোয় নাকি ওদের আটকে রাখা যায় না, ছেড়ে দিতে হয়, পরে দিন ফুরালে নিজেরাই ফিরে আসে। রবিউলরা বছরভোর বাংলার নানা জেলায় ঘুরে বেড়ায় মৌমাছি ভরা বাক্সগুলি নিয়ে।শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি। ঐ সময় সরষে চাষ হয় পশ্চিম মেদিনীপুর ও হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সরষে ফুলের মধু সংগ্রহ করতে জন্মেঞ্জয়রা ঘাঁটি গাড়ে পশ্চিম মেদিনীপুর বা হুগলির সরষে ক্ষেতের আশেপাশে। সরসে ফুলের মধু সংগ্রহ চলে অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাসের শুরুর দিকটায়। বেশি ঠান্ডা, কুয়াশা, বৃষ্টি পছন্দ করে না মৌমাছিরা তাই অত্যধীক কুয়াশা,অতিরিক্ত ঠান্ডায় মধু সংগ্রহ বাধা পায়। যতদিন মাঠ হলুদ থাকে অর্থাৎ সরষে ফুল সরষেতে পরিণত না হচ্ছে ততদিন মধু সংগ্রহ চলতে থাকে।
এরপর রবিউলরা চলে যায় পাশের জেলা বাঁকুড়ায়। পৌষের মাঝামাঝি থেকে ইউক্যালিপটাস ফুল ফুটতে শুরু করে। ইউক্যালিপটাসের মধু পাওয়া যায় মাঘের প্রায় মাঝামঝি পর্যন্ত। এরপরের গন্তব্য মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদে প্রচুর ধনে (ধনিয়া) চাষ হয়।মুর্শিদাবাদে মাঘ-ফাল্গুনের কাজ। ওখান থেকে লিচু ফুলের মধু সংগ্রহ করতে জন্মেজয়রা ছোটে মালদায়। ফাল্গুন-চৈত্রে লিচু ফুলের মধু পাওয়া যায়। তিলের মধু সংগ্রহ করতে ফের ওরা ফিরে আসে পশ্চিম মেদিনীপুর ও হুগলীতে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তিল ফুলে সাদা হয়ে থাকে এই দুই জেলার বিস্তৃত প্রান্তর। অগ্রহায়ণ থেকে জ্যৈষ্ঠ, প্রায় ছ'মাস এপিক্যাচারের কার্যকরি সময়।
এসময় সরষে, ইউক্যালিপটাস, ধনে, লিচু, তিল কোনো না কোনো ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে পোষা মৌমাছির দল। বছরের বাকি ছ'মাস? ঐ ছ'মাস রবিউলরা মৌমাছিগুলোকে নিজেরাই পালন করে। প্রায় ছ'মাস চিনি জল খাইয়ে আদর যত্নে বাঁচিয়ে রাখতে হয় মৌমাছিদের। বুঝলাম সব কারবারেই একটা প্রাইমারি বিনিয়োগ থাকে। নইলে লাভের মধুটি আসবে কোত্থেকে?
পুনশ্চঃ
রবিউলদের থেকে শুধু এতো সব জানলাম তা নয়। মধু নিলাম। সরষে ফুলের মধু। বাজারে ওই মধুই নাকি প্যাকেটবন্দী করে পাঁচ'শ টাকা কেজিতে বিকোয়। রবিউল হাসতে হাসতে বলেছিল --"আপনার জন্য তিনশ'টাকা কেজি।"
সে মধুর রং সাদা দেখে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে-- 'সরষে ফুলের মধু তো সাদা হয় না!' নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কি করে! চোখের সমানে খাঁটি মধু দিলো। আমল দেইনি কাউকেই। দিন সাতেক পর দেখি বয়ামে মোমের মতো বসে গেছে সবটা। পরদিন হাঁটতে হাঁটতে রবিউলদের আস্থানায়। ততদিনে মৌমাছি সহ উড়ে গেছে ওরা। খবরটা কানাকানি হতেই, আশেপাশের অনেকেই বাড়ি গিয়ে দেখে সকলেরই আমার মতোই দশা ঠকে গেলাম! মানুষ এভাবে ঠকাতে পারে! ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে পা ভারী হয়ে আসছিল, কষ্ট হচ্ছিল খুব। না, কষ্টটা হাঁটতে নয় বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ায়। চার মাস পরে দেখি সাদা মোমের মতো বসে যাওয়া মধু সরষের তেলের মতো দেখাচ্ছে। সত্যি কত কম বুঝে আমরা সন্দেহ করে ফেলি মানুষকে!
৩
আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের বেশি কিছু আগের ঘটনা। নেপাল আর উত্তর বিহারের মধ্যবর্তী একটি স্থান। দুটি রাজ্যের সীমানা হিসাবে বয়ে চলেছে একটি নদী-নদীর নাম রোহিনী। তারই দুই তীরে দুটি রাজ্য। একটিতে কোল আর অন্যটিতে শাক্য জাতির বাস। কোল রাজ্যের রাজধানী দেবদহ। রাজা অঞ্জন বা সুপ্রবুদ্ধ। জ্যোতিষীরা বলেছেন সুপ্রবুদ্ধের কনিষ্ঠা কন্য মহাপ্রজাপতি গৌতমীর গর্ভে যে সন্তান জন্ম নেবে সে হবে রাজ চক্রবর্তী। শাক্যরাজ বিবাহ করতে চাইলেন কনিষ্ঠাকে। রাজা সুপ্রবুদ্ধ জ্যেষ্ঠার বর্তমানে কনিষ্ঠার বিবাহ প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। শাক্যরাজ জ্যেষ্ঠা মহামায়া ও কনিষ্ঠা গৌতমী দুজনকেই বিবাহ করলেন। জ্যেষ্ঠজায়ার গর্ভে সন্তান এলো দীর্ঘ অপেক্ষার পর। যেদিন সন্তান জন্মগ্রহণ করছেন সে সংবাদে শাক্য বংশের কুলপুরোহিত ঋষি কালদেবল প্রাসাদে এসে উপস্থিত।
ঋষি কালবলদেব ভবিষ্যৎবাণী করলেন--
নবজাতের মধ্যে সুলক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে এ শিশু সংসার ত্যাগ করে সর্বজ্ঞ সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রূপে পূজিত হবেন।
নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে আটজন দৈবজ্ঞের মধ্যে সাতজন বলেছিলেন--
এ-শিশু সংসারে থাকলে রাজচক্রবর্তী হবেন আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলে হবেন সর্বজ্ঞ।
অষ্টমজন, নাম কোণ্ডণ্য বললেন---
সংসার নয়, সংসার নয়। সন্ন্যাস। সন্ন্যাস নেবেন কুমার।
হবেন আসক্তিশুন্য বুদ্ধ।
৪
জানালায় মুখটা দেখা মাত্র দাউদাউ জ্বলে উঠেছিল মাথা। মূর্তিমানকে দেখে নিজেকেই স্থির রাখাটা ছিল কঠিন। শক্ত হয়েছিল চোয়াল। রাগে রাগে তাকাচ্ছিলাম সামনে বসা ছাত্রদের দিকে। গলাটা যদ্দুর সম্ভব খাদে এনে বলেছিলাম-
"এই কিনা নতুন ছাত্র, তোদের গুজুং ফ্রেন্ড!"
"চেনেন নাকি?"
"চিনি মানে হাড়েহাড়ে চিনি।"
ততক্ষণে মূর্তিমান জানালা থেকে হাওয়া। আসলে ছেলেটিও জানত না আমিই মাস্টার। সেটা ছিল ২০০২ বা ২০০৩ সাল, ১৯৯৭-এ রপ্ত নেশা তখন সপ্তমে -- তখন আমি রীতিমতো চেনস্ স্মোকার।
২০০০ সালে সেকেন্ড আরএলএসটি-র রিটিন কোয়ালিফাই করেও মাস্টার না হতে পারাটাই অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল নেশাটা। অদ্ভুত একটা অবসাদ ছেয়ে গিয়েছিল যাপনে।সেসময় পুরানো কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মাঝেমধ্যেই হাজির হয়ে যেতাম কলেজ ক্যান্টিনে। চা আর ধোঁয়ার আড্ডা ভেঙে বাড়ি ফিরে অবেলায় স্নান, ততক্ষণে ভাত-তরকারি বরফ ঠান্ডা।
আমি হয়তো একটু বেশিই যেতাম।
কলেজের ক্লাস শুরুর দিনগুলোতে, যেতাম ছাত্রের সন্ধা নে। তেমনি এক দুপুরে এক কাপ চা নিয়ে বসেছিলাম ক্যান্টিনে, পাঁচ নম্বর সিগারেটটা শেষ করে উঠব উঠব করছি এমন সময় -
মাথা ভর্তি চুল, চোঙা প্যান্ট, রোগারোগা একটা ছেলে এসে বলল- "দাদা আগুনটা হবে?"
মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে দেশলাইটা দিয়েছিলাম তাকে। শেষ পর্যন্ত দেশলাই ফেরত এসেছিল ক্যান্টিনের মালিক পন্ডাদার হাত থেকে কারণ ততক্ষণে ছোকরা জেনে গেছে আমি তার মতো ছেলেদের পড়াচ্ছি বেশ কয়েক বছর ধরে। সেই মূর্তিমান থার্ড ইয়ার শেষ হতে মাস ছয়- সাত হাতে নিয়ে আমার কাছেই হাজির হবে এ শুধু আমারই নয়, বোধহয় তারও কল্পনার চৌহুদ্দিতে ছিল না। সপ্তাহ ভোর ওর বন্ধুদের জোড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত অনুমোদন জুটিয়েছিল সে ছোকরা।
পরীক্ষার মাস খানেক আগে শ'পাঁচেক টাকার বই আর শেষ মাসের দক্ষিণা সহ উধাও হয় সে। পরীক্ষার পর অন্যরা পরীক্ষার ভাল মন্দ জানিয়ে গেলেও তার কোন খবর ছিল না। তবে বইগুলো ফেরত এসেছিল অন্য ছাত্রের হাতে। বুঝে নিয়েছিলাম শেষ মাসের দক্ষিণার আশাটা একটু বেশিই কষ্টের হবে।
তারও মাস দুই পর একদিন সে ছোকরা আমার বাড়িতে হাজির। একথা ওকথার পর সে নিজেই তুলেছিল শেষ মাসের বেতনের কথা।
"এটা আমার রেকর্ড স্যার, আমি আজ পর্যন্ত কোনো টিউশন মাস্টারকে শেষ মাসের টাকা দিই নি। ভাবলাম আপনারটাও মেরে দেই। দু'মাস অনেক যুদ্ধ করলাম। মনের দিক থেকে সায় পেলাম না। টাকাটা নিন স্যার।"
ছাত্রটির পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম -
"ঠিক আছে বজায় থাক তোর রেকর্ড।"
"না স্যার, মন বলছে এ লোকটার টাকা মারিস না।" এই বলে সে একরকম জোর করেই টাকা কটা গুঁজে দিয়েছিল পকেটে।
ভাইরাল
মাথা গুনতি বাইরে দাঁড়ানো লোকজনের আন্দাজে ভাতের পরিমাণটা বুঝে ঠোঁট মুড়ল দুর্লভ। চালের জন্য আবার একবার বাড়ি ছুটতে হবে তাকে। অবশ্য সমস্যার কিছু নেই বড় কড়াইয়ে জল ফুঁটছে, চাল ফেললেই আধ-ঘন্টায় ভাত রেডি। প্রাইমারি স্কুলের দাওয়ায় পাত পেড়ে বানভাসি লোকদের দুবেলা খাওয়াচ্ছে দুর্লভ মিদ্যা।
সবটা দুর্লভ মিদ্যার নয়, তিন মাইল দূরের বাজার থেকে মশলা সব্জী কিনে আনছে অতনু, নন্দন, বিমল, ফারহান -- নবসূর্য ক্লাবের ছেলেরা, চালটা কেবল দুর্লভের। সেও তো আর কম নয়, দিনে দেড় মনের ধাক্কা। বাপের কাজে খুশি হয়ে ছেলে, শহর থেকে ঔষধ আর ব্লিচিং পাঠিয়েছে পরশু। শুরুতেই বাঁধ দিতে না পারলে বানভাসি এলাকায় পেটের ব্যামো তাড়াতাড়ি ছড়ায়।
শুরুর দিকে সপ্তাহ খানেক বিভিন্ন এনজিও, সরকার এমন কি ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগ থাকলেও-- এখন দুর্লভরাই ভরসা। জল নামলেও, পাক আর পলিতে গেঁথে আছে ঘর-গেরস্থ। ধান-চাল সবই গেছে। আবহাওয়ার দফতরের সতর্কতা ছিল কিন্তু দুর্ভোগ যে এমনটা হতে পারে ভাবতে পারেনি হিম্মতপুরের লোকজন। দুর্লভের বাষট্টি বছরের জীবনকালে এমন দুর্ভোগে পড়েনি হিম্মতপুর। ফুলে ফেঁপে ওঠা নদী মুহুর্তে ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। আসলে নদী নিয়ে ঘর করা হিম্মতপুর সতর্কতাকে বিশেষ একটা আমল দেয় নি। তা না হলে এভাবে চাল ধান নষ্ট হয়! ডাঙা যত জাগছে ততই দুর্গন্ধে ভরে যাচ্ছে এলাকা। পেটে খিদে নিয়েও পচা চাল ধান রাস্তায় টেনে দিচ্ছে লোকজন। দুর্লভের মতো যাদের ভিটা একটু উঁচুতে সামলে নিয়েছে তারাই।
তাদের অনেকেই আবার সুযোগ বুঝে দাম চড়িয়েছে চালের। দুর্লভেরও সে সুযোগ ছিল। সুদখোর হাড়কিপটে দুর্লভকে পাল্টে দিয়েছে একটা ছবি। ফারহানদের বাড়িতে মা-বোনের মাথা গোঁজার জায়গা না হলে মুশকিলে পড়ত বিমল। বিমল আর ফারহান বছর চার আগে কলেজ পাশ করেছে। বন্যায় বিমলদের সবই গেছে, শুধু বুকে বয়ে আগলে রাখতে পেরেছে কলেজের সার্টিফিকেটগুলো। ওগুলোই তো আগামীর ভরসা। বন্যার পর থেকে অমল, নন্দন, বিমল, ফারহানদের রাতদিনের তফাৎ নেই। রাতের দিকে এর ওর থেকে কিছু কালেকশন, সাতসকালে বাজার তারপর রান্না, ডিস্ট্রিবিউশন, ধোয়া-মোছা জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সবটাই সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে 'বখাটে' ছেলেছোকরারা।
খালি ভাতের বালতিটা নামিয়ে, হাঁক পাড়ল বিমল--- "কা.. কা... আ আ আ..."
ডাকটা স্কুল বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। চিল চিৎকারেও স্কুল বিল্ডিং- এর ধারে কাছে দেখা মিলল না দুর্লভ মিদ্যার। টিম লিডার অতনু ফিসফিস করে বলল
"দেওয়ার সময় ভাতটা একটু টেনে রাখ।"
নন্দন বলল--
"কত সময়! দেড় মন হয়ে গেছে, কাকার কোটা শেষ, আজ আর চাল মিলবে না।"
বাইরে তখনও জনা সাতাশ ক্ষুধার্ত মানুষ। "ফারহান, ভাইটি আমার, বাড়ি থেকে কি কিছু ব্যবস্থা করা যায় না?"
অনুনয়ের সঙ্গে বলে অতনু। ফারহান সাইকেল নিয়ে স্কুল ছাড়বে এমন সময় দেখতে পায়--
কাঁধে চালের বস্তা, বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আসছে দুর্লভ চাচা। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।
ফারহান মোবাইলে ছবি তুলতে যেতেই তেড়ে আসে দুর্লভ--
"না, না একদম নয়... ছবি তুলবি না ফারহান। গতবার এক ছবিতেই সব শেষ হয়ে গেছে আমার!"
দুর্লভের কথা শেষ না হতেই অতনু, বিমল, ফারহানরা সবাই মিলে হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে। শুরুতে যখন ত্রাণ দেওয়া হচ্ছিল তখন ত্রাণের লাইনের ভিড়ে মিশে গিয়েছিল দুর্লভ।
দুর্লভের মতো মানুষের বরাবরই ঐরকম-- মুফতে কিছু পাওয়া গেলে সে সুযোগ নষ্ট করে না। দোষটা অভ্যাসের। দোষটা নিজেকে বদলে নিতে না পারার। এই বয়সেও নিজের হাতে চাষ করে দুর্লভ। খালি গা সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। ছেলে একটা জামা এনে দিয়েছিল শহর থেকে- একবার গায়ে তুলে সেই যে বাক্সবন্দী হল আর বের হয় নি। মান-সম্মানের তাগিদে ছেলেও আজকাল বাপের কাছে আসে না। সেদিন দুর্লভের ত্রাণ নেওয়ার ছবি দুষ্টুমি করে ভাইরাল করে দেয়েছিল ফারহান। পাঁচ গ্রামের দশজনে ছিঃ ছিঃ করেছিল দুর্লভকে-- ছেলে ডাক্তার, চারটে পুকুর, সাত বিঘা দোফসলি জমি এরপরও মানুষের অভাবের থাকে!
এই ঘটনার পর দিন দশেক বাড়ি থেকে বের হয় নি দুর্লভ। ছেলে এমনিতেই নয়ে-ছয়ে গ্রামের বাড়ি আসত- হুশিয়ারি দেয়, সে আর ফিরবে না। দুর্লভের সেই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল অতনু, বলেছিল--
"নিজের জন্য তো অনেক হল, মানুষের জন্য কিছু কর কাকা, দেখবে সব বদনাম ধুয়ে মুছে গেছে।" একটা ছবির জন্য ছ'কুইন্ট্যাল চাল চলে গেছে তার।আর নয়। বিড়ি ফেলে, গামছায় মুখ ঢেকে ফেলে দুর্লভ। রহান চিৎকার করে বলে--
"চাচা ছবিতে অসুবিধে কোথায়! তুমি তো নিচ্ছ না, দিচ্ছ।"
"তোমার কোনো কথায় আমি ভুলছি না। দেওয়া-নেওয়া এক মস্ত গোলকধাঁধা, পরণের পোশাক ছাড়া কে নেয় আর কে দেয় ছবি দেখে কিচ্ছুটি বোঝা যায় না ভাইপো। কিভাবে কে যে কখন ভাইরাল হয় তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।"
নতুন বউয়ের মতো মুখ লুকায় দুর্লভ।
ফটো
"নাতিটা ছোট, খিচুড়ি স্কুলে যায়, নাতনি কি যেন একটা বড় পাশ দেবে সামনের বছর। এখন তো করোনা, কলেজ টলেজ নেই সারাদিন মোবাইল নিয়েই থাকে। মুখ বাঁকিয়ে ছবি তোলে থেকে থেকে। অনেক বার বলেছি-- দিদিভাই আমার একটা ফটো নে, নিতেই চায় না।"
অনেকটা রাগ নিয়ে কথাটা শেষ করল বুড়ো। আমার চায়ের গ্লাস শেষ হতে বাকি থাকলেও বুড়োর গ্লাস শেষ। চো চো করে মুহুর্তে গরম চা ফিনিশ। মুখ বন্ধ, অদ্ভুত একটা শব্দ করে জিভ দিয়ে ভাঙা দাঁতের ফাঁক থেকে জড়ানো বিস্কুট বের করছে বু্ড়ো। চোখাচোখি হতে লজ্জা পেয়ে বলল--
"চুরাশি চলছে,দাঁত কি আর থাকে!" হাঁ মুখে ভেতরটা দেখালো বুড়ো।
মুখের ভেতরটা কি বিভৎস দেখাচ্ছে-কালো কালো ক্ষয়াটে কয়েকটা দাঁত কোনো রকম লেগে আছে মাড়িতে। এ পথে বুড়োকে দেখেছি মাঝে মধ্যে। জমির আল ধরে টলমলিয়ে হাঁটছে, কখনও আলের উপর বসে বিড়ি টানতে টানতে বুঝে নিচ্ছে চাষের কাজ।
বুড়োর বাপ ছিল সর্দার। কুঠীবাজারের ইংরেজ সাহেবের মস্তবড় গোডাউনের রাতরক্ষী। তাগড়াই শরীর ছিল বুড়োর বাপের। কেবল লাঠি দিয়েই একা রগড়ে দিত পারত জনা দশেক। বারো টাকা মাস মাইনের রাতরক্ষীর চাকরি বেশি দিন টেকে নি তার। ঝমঝমে এক বর্ষার ভোরে ঝুমির চরে পাওয়া গিয়েছিল বুড়োর বাপের দেহ। এই গল্প বলতে বলতে বুড়োর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বুড়ো বলে -
"এসব কথা ঠাকুরমার কাছে শোনা, আমি তখন তিন বছরের বাচ্চা। জন্ম দিতে গিয়ে চলে গিয়েছিল মা। বাপের রেখে যাওয়া পিতল-কাঁসা বাসন আর সোনা, রূপা বিক্রি-বন্ধক রেখে আমাকে বড় করেছিল টেঁপিরানী।"
"টেঁপিরানী?"
"আমার ঠাকুরমা, সে আমার মতো হতকুৎসিত ছিল না বাবু, প্রতিমার মতো রং ছিল তার।"
বুড়ো ঝকঝকে মুখে বিনয়ের সঙ্গে বলে--
"ঠাকুরমা আর ঝুমি না থাকলে কবেই ফুরিয়ে যেতাম!"
ঝুমির জলে এখানের মাঠ সব সবুজে-হলুদে একাকার। পাম্প হাউস থেকে জল ছড়িয়ে পড়ছে জমি-জিরেতে। ছবি তুলতে তুলতে -- হাঁটতে হাঁটতে, এ পর্যন্ত এসে টুঙির ঘাট লাগোয়া চা'দোকানে একটু জিরিয়ে নেই। নেই নেই করে সাত কিমি পথ হাঁটা হয়ে যায় ততক্ষণ। ঘাম ভেজা শরীর, ঝুমির বাতাসে অদ্ভুুত আবেশ লাগে। চা দোকানের বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে চা'য়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প জুড়ে দেই পাঁচঘরা-- বলরামপুরের সহজ সরল মানুষগুলোর সঙ্গে। ওরা ঝুমির কথা বলে- ঝুমিই ওদের মা। ঝুমি না থাকলে চাষবাসই হত না এ-এলাকায়। আবার বন্যায় ঝুমি যে কত বেপরওয়া হয়ে ওদের কষ্ট দেয় সেসব কথাও শোনা এই চা' দোকানেই।
"নাতনি ছবি নেয় না!" বুড়োর মুখে আঁধার ঘনায়। থমথমে মুখ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
"সবাই কি সুন্দর হয় বাবু? বুড়ো হয়েছি গায়ের রং কালো, চার বছর বয়স থেকেই মুখের বাঁ'দিকটা ঝলসে আছে!"
অভিমানী কথাগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় বুড়ো। সতর্ক হয়ে বুড়োর বাঁ'গালটা দেখি,
ছেলেবেলার পোড়াটা এ বয়সেও--নদী চরের মতো জেগে আছে।
"গায়ের রং, রূপ এসবে কি নিজের হাত থাকে বাবু? এই যে আপনার গৌর পানা রং-- এতো উপরওয়ালারই দেওয়া। কালো বলে ঠাকুরমা নাম দিয়েছিলো কেশব-- কেশব হলেই তো আর কেষ্টঠাকুর হয় না!"
বুড়োকে তখন ঘোর লেগেছে, সে এক আশ্চর্য সুষুপ্তি, যেন ভাব সমাধি। সংসারে একজন হয়েও সংসার থেকে পালিয়ে বেড়ানো। আগাগোড়া সাকার পৃথিবীতে থেকেও নিরাকার স্বপ্নকল্পে ভেসে যাওয়া। এরই মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে লঘু চালে বুড়ো বলে--
"কালো হলে কি হবে, যৌবনে শরীর ছিল টানটান। জমি-জিরেতে হাড়ভাঙা খাটুনি, দিনে প্রায় এক'পোয়া চালের ভাত, রাতে খান ছয় রুটি।" ফোকলা দাঁতে হাসল বুড়ো।
"তুমি তো আদাড়বাদাড়ে ফটো তুলে বেড়াও, আমার একটা ফটো নিবে বাবু? চুরাশি বছরের জীবনে আমার ঐ একটাই আপশোস, আমার কোনো ছবি নেই!"
শেষ কথাটায় এতোটাই মনখারাপ ছিল যে আমি আর সত্যিটা বলতেই পারলাম না। ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করে দাবিয়ে দিলাম সাটার। চা দোকান ছাড়ার আগে বুড়ো বলল
"কাল তাহলে এমন সময়...." কথাটা শুনে ভয় হল---
"বুড়ো ফটোর কপি চাচ্ছে কি?" বুড়োর দিকে তাকিয়ে সত্য মিথ্যা মিশিয়ে হাসলাম। কটা বাজে কে জানে, ভুলে মোবাইলটা সঙ্গে নেওয়া হয় নি। ফিরে ছেলেকে আবার পড়াতে হবে। ফেরার পথে টোটোতে চেপে বসলাম। দিন পনেরো পর একদিন রাতে মনে পড়ল বুড়োকে। ঝুমির কালো জল, অসম্ভব দুলতে থাকা বাঁশের সাঁকো আর ধবধবে সাদা কাগজে আলতা ছাপে দু'পায়ের পাতা স্পষ্ট দেখতে পেলাম স্বপ্নে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভোররাতে ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম ঝুমির পথে। টুঙির ঘাটে কুয়াশা মেখে শুয়ে আছে বাঁশের সাঁকোটা। বাঁশের ভারা ভেঙে সাঁকোর নিচে বয়ে যাচ্ছে ঝুমি।
সাঁকো পেরিয়ে এপারের লোক মিলিয়ে যাচ্ছে ওপারের ঘন কুয়াশায়।
ক্যামেরা বের করে সকালটাকে ধরে নিলাম চটপট-- সময়, একটা ছবি একবার মাত্র এঁকে মুহুর্তেই মুছে ফেলে সেটা।
সেই মহেন্দ্রক্ষণে মুহুর্তটা ধরে নিতে না পারলে আফশোস ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
কুয়াশা চুঁইয়ে আলো ঢুকছে একটু একটু করে। শীতের অলসতা ডিঙিয়ে ব্যস্ত হচ্ছে টুঙির ঘাট। ঝকঝকে আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে পথ-প্রান্তর, দেখে বোঝা মুশকিল কিছু সময় আগেও অতল এক অস্পষ্টতায় ডুবে ছিল চরাচর।
চায়ের দোকানে আজ আর পাঁচঘরা-- বলরামপুরের আড্ডায় মন নেই। মনযোগের সবটুকু নিয়ে চোখ জোড়া মাঠে মাঠে খুঁজচ্ছে বুড়োকে। আগের দিন বুড়োর ছবি তোলা হয় নি। আসলে ক্যামেরায় চার্জই ছিল না। বুড়োকে সান্ত্বনা দিতে মিথ্যে করে সাটার দাবিয়ে ছিলাম।
মনে হয়েছিল, সত্যিটা বললে বুড়ো ভাবত এড়িয়ে গেলাম। মনে করত, সত্যি সত্যিই হয়তো অসুন্দর আর পোড়া মুখের ছবি হয় না। এখন অপেক্ষা-বুড়োর পথ চেয়ে বসে থাকা। পরপর তিন গ্লাস চা শেষে, চতুর্থতে চুমুক।
কবিতা
অনিশা দত্ত
প্রজাতন্ত্র দিবস
সাধারণ তন্ত্র, জপিতেছে মন্ত্র
চিত্ত উদ্ভ্রান্ত, কোন দলের হবে জয়?
ধরমেতে যুদ্ধের হাওয়া,
করমেতে খাওয়া-শোয়া,
হেঁটে -মুণ্ড বেপরোয়া, নাহি ভয়।
ফিকির-ফন্দি, নোট-বন্দী
অর্থনীতির নেইকো মাত্রা
স্বাধীন মতামত।
মারদাঙ্গা - বিপদ সংকুল জীবনযাত্রা
ক্রাইম-পেট্রল, সাবধান ইন্ডিয়া
ছাপোষা পরিবার উর্ধনেত্রা
তবু স্বচ্ছ ভারত হোক অক্ষয়l
মূল্যবৃদ্ধি -গুণমান হ্রাস
জনগণ সবে করে হাঁস -ফাঁস
উঠলো বুঝি নাভিশ্বাস
শরীরের নাম মহাশয়l
নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখো, মহা যুযুধান
দেখিয়া ভারতে নানা দলের উত্থান
জনগণ মানিবে বিস্ময়l
প্রতিদিন খুনোখুনি, গণ ধর্ষণ
দুর্দিন, দুর্নীতি, পুলিশী শাসন
দীন হীন উদাসীন জনসাধারণ
গণতন্ত্রের নাহি পরাজয়।
গল্প
কয়েক টুকরো ছোটোবেলা
পিয়ালী দত্ত চক্রবর্তী
আমি বোধহয় সত্যিই নস্টালজিয়ায় ভুগছি। কেন জানিনা আজকাল সারাক্ষণ ছোটোবেলার কথা খুব মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করলেই ছোটোবেলার দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আমাদের পুরোনো বাড়ির কথা.. মানে আমার ঠাকুরদার তৈরী হাওড়ার বাড়ির কথা। বড়ো গেটের মাথায় পাঁচিল জুড়ে মাধবীলতা গাছটা আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। আসলে গাছটার পাতাই চোখে পড়তো না, শুধু থোকা থোকা ফুলে ভরে থাকতো। আর তার পাশে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেই প্রথম সবচেয়ে কাছের জন ছিল অনেক পুরোনো শিউলি গাছটা। বাবা বলে ওটা নাকি বাবা জন্ম থেকে দেখছে। হয়তো ঠাকুরদা বসিয়েছিলেন। সে যাই হোক, বছরের একটা বিশেষ সময়ে শিউলির গন্ধে সারা বাড়িটা ভরে থাকতো। আমার মনে পড়ে কোজাগরী লক্ষী পুজোর দিন সাজি ভরে ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার একটা অদ্ভুত আনন্দ ছিল। মা সকাল থেকে পুজোর জোগাড় করতে ব্যস্ত থাকতো, সারা বাড়িতে আলপনা দিতো। কত আয়োজন আর আনন্দ ছিল পুজো কে ঘিরে!
আর পাঁচটা বাচ্চার মতো আমারও ছোটোবেলার বেশিটাই জুড়ে ছিলো আমার মা। মায়ের গায়ের গন্ধ না পেলে আমার ঘুম আসতো না। এখনো ঘুমোতে যাবার সময় একবার অন্তত গন্ধটা পেতে ইচ্ছে করে। হয়তো practically সেটা সম্ভব হয় না। কিন্তু longterm memory তে আজও সেটা এমন ভাবেই জড়িয়ে রয়েছে যে মনে করতে চাইলেই এখনো সে গন্ধ পাই।
ছোটোবেলায় আমার ঘুমোনোর সময় মা পাশে শুয়ে গান গাইতো। আমার মায়ের গানের গলা খুব সুন্দর। মা বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেও মাঝে মধ্যে কিছু অন্য গানও থাকতো। একটা গান খুব মনে পড়ে, যেটা আজও রাতে অন্ধকার ঘরে ঘুমোনোর ঠিক আগে মনে পড়লে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে! একটা অচেনা ভয় চেপে ধরে! ঠিক ছোটোবেলার মতোই অদ্ভুত একটা চাপা কষ্ট অনুভব করি.. "ও তোতা পাখি রে.. শিকল খুলে উড়িয়ে দেবো আমার মাকে যদি এনে দাও..!" হঠাৎ 'মা' বলে চিৎকার করতে উঠতে ইচ্ছে করে! ছোটোবেলায় মাকে জাপটে ধরতাম। এখন বেশিরভাগ সময়েই সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা তুলে মাকে dial করি। ওদিক থেকে "হ্যালো.. কী রে? এতো রাতে? কী হলো?" এই শব্দগুলোই আমার সে রাতের ঘুমের রসদ। "বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই".. এই গান টাও মায়ের কাছেই শোনা। আজও গান টা শুনলে বুকের ভেতরটা চিন্ চিন্ করে ওঠে।
পড়াশোনা ছাড়াও গানবাজনা, আঁকা সব কিছু নিয়েই মায়ের কঠিন অনুশাসন ছিল। রোজ ভোরবেলায় উঠে আগে গলা সেধে তবে পড়তে বসা ছিল আমাদের রুটিন। স্কুল থেকে ফিরে একটু জলখাবার খেয়েই খেলতে চলে যেতাম। সন্ধের মধ্যে খেলা সেরে একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে পড়তে বসতে হবেই হবে। মা পড়া ধরতে আসবে ঘন্টাখানেক পরে
সাংসারিক কাজ সেরে। পড়া ধরতে বসে মায়ের রাম ঠ্যাঙানি মনে পড়লে আজ এই বয়সেও মন স্থির করে পড়াশোনা করে নিতে পারি! অবশ্য কোনো কোনো দিন পড়াশোনা ঠিক মতো করে রাখলে চকলেটও পাওয়া যেতো। আমাদের আঁকার ক্লাস থাকতো রবিবার সকালে। তার আগে সারা সপ্তাহে যেভাবে হোক সময় করে আমাদের আঁকা practice কিন্তু করতেই হতো। তখন অনেক সময়েই খুব রাগ হয়েছে! কেন আঁকতে বসবো? এখন তো আমার আঁকতে ভালোই লাগছে না! কিন্তু মায়ের কথা অমান্য করার স্পর্ধা ছিল না। পরে ঠেকে শিখে অনুভব করেছি সব জিনিসের একটা নিয়মানুবর্তিতা থাকা সেসময়ে খুব দরকার ছিল। অনেকসময় ভালো না লাগলেও কাজটা করতেই হবে।
রবি ঠাকুরের সেই অমোঘ সৃষ্টি আবৃত্তি করতে শিখেছিলাম মায়ের কাছেই "মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মা কে নিয়ে যাচ্ছি অনেকদূরে, তুমি যাচ্ছো পালকিতে মা চড়ে, দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে, আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে.." ওই লাইনগুলো আবৃত্তি করতে করতে খুব confidence পেতাম, নিজেকে সত্যি সত্যিই বীরাঙ্গনা ভাবতাম! শিশুমনে কতো কিছুই মনে হতো.. কিন্তু এটা বলতে বাধা নেই যে নিজের মধ্যে অসম্ভব দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়েছিল।
প্রথম দিকে মাকে বেশ ভয় পেলেও কখন জানিনা মা-ই আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। ছোটোখাটো কোনো ঘটনা মাকে না বলে থাকতে পারি না আজও।
স্কুল জীবনের শেষের দিকেই মায়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ব্যাপারটা অনেক বেশি দৃঢ় হয়েছিলো। আমার co-education college এর সমস্ত বন্ধুদের মা খুব সুন্দর ভাবে accept করতো without any gender biasness, ওদের সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশতে পারতো মা। আমার বেশ অবাকই লাগতো! কী করে আমার এতো রাগী মা আমার সব বন্ধুদের এতো সহজভাবে গ্রহণ করছে! পরে বুঝেছি এটা parenting এর আরেকটা স্তর যেটা মা খুব সহজ সাবলীলভাবে আত্মস্থ করেছিলো।
একটা কঠিন অনুশাসনে মা সবসময় সংসারটাকে বেঁধে রেখেছে.. আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তাই অফিসে আসার আগে ছেলেকে ওর দিদাই এর কাছে রেখে আমি সবচেয়ে নিশ্চিত থাকি। তবে নাতির ওপর আমার মায়ের সেই প্রতাপ আর নেই। বা হয়তো খাটায় না। ওই যে কথায় আছে না 'আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি!'
আমাদের মা বাবাদের কাছে এই positive patenting টা ভীষণভাবে শিক্ষনীয়। কিন্তু জানিনা আদৌ আমরা এগুলোর কতোটা নিতে পেরেছি, আর আমাদের আগামী প্রজন্মকে ঠিক কতটুকু দিতে পারবো যে তারাও পরে ছেলেবেলার দিনগুলো এইভাবে মনে রাখবে।
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.