

ফেব্রুয়ারী
২০২৫

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ

প্রবন্ধ

কাউন্টি লাইব্রেরি থেকে সিডি-টা পেয়েছিলাম - ''The Venerable W.'' একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম। ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা বারবেট শ্রোডার ২০১৭ সালে এটা তৈরি করেন। চমকপ্রদ বিষয়বস্তু - উগ্র জাতীয়তাবাদী এক সন্ন্যাসী কীভাবে এক ঐতিহাসিক সহিংসতার বীজ ছড়িয়েছিলেন। কাহিনীর মূল চরিত্র গেরুয়া পরিহিত মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথু। ফিল্মটা দেখতে দেখতে হতভম্ব হয়ে গেলাম: ভরা সমাবেশে, হাজার হাজার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে উইরাথু দাবি করছেন, রোহিঙ্গারা "একটি সৌদি-সমর্থিত বাংলাদেশী বিদ্রোহী দল যাদের উদ্দেশ্য হলো মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করা, সেখানকার ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করা এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা।" বার্মিজ জনগণকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে, ঘৃণাপূর্ণ, সহিংস জাতিগত নির্মূল অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বুদ্ধের পূজারী এক ত্রিচীবর। আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাঁকে চরমপন্থী, ইসলামফোবিক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আল-কায়েদার প্রয়াত কুখ্যাত নেতার কথা মনে আছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওসামা বিন লাদেন? ঠিক ধরেছেন। লাদেনের সাথে নাম মিলিয়ে উইরাথুকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে "বৌদ্ধ বিন লাদেন"। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছেন গুজব? মোটেই তাই নয়। তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম বিরোধী লিফলেট বিতরণ, মুসলমানদের উচ্ছেদের বিষয়ে অগণিত ফ্যাসিবাদী ইন্ধনমূলক বক্তব্য প্রচার, আর ধর্মোপদেশের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ভুরিভুরি প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে: ২০১৩ সালে এক উপদেশ সভায় উইরাথু বলেছিলেন: ’আপনি দয়া, ভালোবাসায় পূর্ণ হতে পারেন, কিন্তু একটা পাগল কুকুরের পাশে আপনি ঘুমাতে পারবেন না। আমি তাদের (মুসলিমদের) সমস্যা সৃষ্টিকারী বলি কারণ তারা সমস্যা সৃষ্টিকারী। আমি একজন উগ্র বৌদ্ধ বলে গর্বিত। আমরা দুর্বল হলে আমাদের দেশ মুসলমানদের হয়ে যাবে।’’ আবার ধরুন গ্লোবাল পোস্ট পত্রিকায় দেওয়া উইরাথুর এই মন্তব্যটা: ’মুসলমানরা আফ্রিকান ক্যাটফিশের মতো; তারা অত্যন্ত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে, দারুণ হিংস্র এবং নিজেরাই নিজেদের খেয়ে ফেলে। যদিও তারা সংখ্যালঘু, তবুও তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, আর তাদের চাপের মুখে পড়ে আমরা শুধু ভুগেই চলেছি।’
আসুন এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিই উইরাথুর জীবনের সময়রেখার উপর। মায়ানমারের মান্দালে শহরে ১০ জুলাই, ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইরাথু। ১৪ বছর বয়সেই তিনি স্কুল ছেড়ে দেন এবং স্থানীয় একটি মঠে একজন কনিষ্ঠ সন্ন্যাসী হিসেবে ভর্তি হন। উইরাথু প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন ২০০১ সালে যখন তিনি ‘’নাইন সিক্স নাইন’’ (969) জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত হন। সেই সময় থেকেই উইরাথু বৌদ্ধ প্রধান দেশগুলোর মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করেন, সমস্ত মুসলিম দোকান বর্জন করার জন্য বৌদ্ধদের তিনি আহ্বান জানান। মায়ানমার জুড়ে শুরু হয় মুসলিম বিরোধী সভা সমাবেশ। সেই সব জমায়েতে লিফলেট বিতরণ এবং মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদের বিষয়ে হিংসাত্মক প্রচার চালান উইরাথু। এইসব দুষ্কৃতীর জন্য ২০০৩ সালে মায়ানমার সামরিক জান্তা উইরাথুকে ২৫ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাঁর কারাবাসের মাত্র সাত বছর পরেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেনের সরকার ২০১২ সালের জানুয়ারিতে, সাধারণ ক্ষমার আওতায় (general amnesty) তাঁকে মুক্তি দিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট থেইনের উদ্দেশ্যটা কী ছিল শুনবেন? রোহিঙ্গা মুসলমানদের অন্য দেশে পাঠানোর বিতর্কিত পরিকল্পনার প্রচারকার্যে রক্তলোভী শিকারী কুকুর হিসাবে উইরাথুকে স্রেফ লেলিয়ে দেওয়া। থেইন জানতেন, এর থেকে ভালো লোক আর তিনি পাবেন না। হ্যাঁ, সেটাই হলো, উইরাথু সোৎসাহে মিয়ানমার সফর শুরু করেন এবং প্রতি মাসে পরম নিষ্ঠাভরে, অন্ততপক্ষে ১৫টি করে’ ধর্মোপদেশ দিয়ে যান। কী ছিল সেই ধর্মোপদেশের বিষয়বস্তু? মুসলমানদের বিরুদ্ধে কেবল তাল তাল ঘৃণা ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। জুন মাসে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দাঙ্গাটা বেঁধে যায়। এরপর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে, মান্দালেতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটি সমাবেশের নেতৃত্ব দেন উইরাথু। উইরাথুর দলপতিত্বে ৯৬৯ আন্দোলনের নৃশংস সহিংসতা বহুগুণ বেড়ে যায়। সমাবেশের ঠিক পরের মাস অক্টোবরের ৩০ তারিখে, রাখাইন রাজ্যের ৯০% মুসলিম-অধ্যুষিত মংড়ুতে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের বাড়িঘর থেকে জন্তুর মতো তাড়া করে বের করে' দেওয়া হয়। ২০১২ সালের জুন এবং অক্টোবরে সহিংসতা, প্রতিশোধ এবং দাঙ্গার দুটি তরঙ্গ প্রধান বৌদ্ধ দেশটিতে শতাব্দী-প্রাচীন সংঘাতকে তীব্র করে তোলার পর, এক লক্ষেরও বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয় এবং শত শত নিহত হয়।
প্রসঙ্গত জেনে নিই যে, ৯৬৯ এই তিনটি সংখ্যা বুদ্ধ, বৌদ্ধ অনুশীলন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গুণাবলীর প্রতীক। ওদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা আল্লার উদ্দেশ্যে গুণগান করার জন্য "আল্লাহর নামে, পরম দয়াময়, পরম করুণাময়” এই শব্দবন্ধগুলো ব্যবহার করেন যার সংখ্যাসূচক মান যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৮৬। জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মিয়ানমারের সাধারণ জনগণকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উৎক্ষিপ্ত করার জন্যই তাঁদের আন্দোলনের নামটিকে ৯৬৯ সংখ্যাতত্ত্বের মোড়কে জড়িয়ে ধুয়ো তোলেন যে, মহাজাগতিক সাংখ্য বিচারের দিক দিয়ে এটা ৭৮৬ এর ঠিক বিপরীত। কেউ কেউ তো এও বিশ্বাস করতে থাকে যে, ২১ শতকে বিশ্ব আধিপত্য অর্জনের জন্য ৭৮৬ সংখ্যাটা রহস্যজনকভাবে এক মুসলিম ষড়যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করে, যেহেতু ৭+৮+৬ যোগ করলে ২১ হয়। কিন্তু এটা একটা ভুল ধারণা ছাড়া আর কিছুই না। প্রকৃতপক্ষে, বার্মার মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের হালাল রেস্তোরাঁ চিহ্নিত করার জন্য ৭৮৬ প্রতীকটি ব্যবহার করে আসছে।
২০১৩ সালে মধ্য ও পূর্ব মায়ানমার জুড়ে বিভিন্ন শহরে (মেইকটিলা, ওক্কান, লাশিও, কান্তবালু, থান্ডে) একটি ধারাবাহিক মুসলিম বিরোধী সংঘর্ষ জারি ছিল। যেদিকে তাকানো যায় শুধু অসহায় মানুষের লাশ, রক্ত আর আগুনের গন্ধে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। টাইম ম্যাগাজিন তাদের জুলাইয়ের কভার স্টোরিতে উইরাথুকে "বৌদ্ধ সন্ত্রাসের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি" হিসাবে বর্ণনা করে এবং সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্ম পরিচালনাকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘’সঙ্ঘ মহা নায়ক’’ ৯৬৯ আন্দোলনকে নিষিদ্ধ করে। এত কিছু ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট থেইন কিন্তু উইরাথুকে "বুদ্ধের পুত্র" এবং শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ "এক মহান পুরুষ" বলে' বর্ণনা করেছিলেন। উইরাথুর প্রতি থেইনের সমর্থনের বহর বুঝতে কারুরই অসুবিধা হয় না।
২০১৪ সালে, উইরাথু কলম্বো-ভিত্তিক সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘’বোদু বালা সেনা’’ (বৌদ্ধ শক্তির সেনাবাহিনী/বিবিএস) দ্বারা আয়োজিত একটি সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, ৯৬৯ আন্দোলনের কাজ তিনি অব্যাহত রাখতে চান। এর কিছুদিন পরেই, ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারী, ৯৬৯ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন যে জাতীয়তাবাদী সন্ন্যাসীরা তাঁরাই মায়ানমারের ‘’জাতি ও ধর্ম রক্ষা সমিতি’’ ওরফে ‘’মা বা থা’’ গঠন করেন। বলা বাহুল্য: এই গোষ্ঠীর মূল মাথা ছিলেন উইরাথু। বিশ্বব্যাপী কট্টরপন্থী উৎসাহীদের সমর্থন পায় এই সংঘটন, সদস্যসংখ্যাও রাতারাতি হুহু করে' বেড়ে যায়। বৌদ্ধ মহিলাদের আন্তঃধর্মীয় বিবাহ এবং ধর্মান্তরকরণের উপর নিষেধাজ্ঞ জারি করার জন্য একটি আইনের প্রস্তাব করে ‘’মা বা থা’’, আইনটি প্রণয়নের জন্য সরকারের উপর কড়া রাজনৈতিক চাপও সৃষ্টি করতে থাকে তারা। এরই মধ্যে, মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংহি লি তাঁর ১০ দিনের মিয়ানমার সফরে আসেন। মিয়ানমারে মুসলিম সংখ্যালঘুদের দুর্দশা, ও তাদের প্রতি পদ্ধতিগত বৈষম্যের কথা তিনি জনসমক্ষে তুলে ধরেন। ‘’মা বা থা’’-র প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটিরও তিনি সমালোচনা করেন। ব্যস, আর যায় কোথা! উইরাথু মিসেস লি-কে একজন "বেশ্যা" এবং ''কুত্তা'' বলে অভিহিত করেন। উইরাথুর ঘৃণ্য মানসিকতা ও নারী বিদ্বেষের আরেক অকাট্য প্রমাণ এই যৌনতাবাদী মন্তব্য। আশ্চর্য্যের ব্যাপার! ২০১৫তে মিয়ানমারে ওই জাতি এবং ধর্ম সুরক্ষা আইনটি কিন্তু দিব্যি পাসও হয়ে যায়।
‘’মা বা থা’’-র জঘন্য কীর্তিকলাপের এখানেই শেষ নয়। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের দ্বারা পরিচালিত গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল ‘’মা বা থা’’। ২০১২ সালে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দ্বারা কথিত রাখাইন বৌদ্ধ মহিলা মা থিদা হত্বেকে ধর্ষণ ও হত্যার একটা বাজে প্রচারণা, একটা মিথ্যা ছড়িয়ে দিয়ে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের বিভক্ত করেছিল ‘’মা বা থা’’; রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বার্মিজ জনগণকে তাতিয়ে তুলেছিল । হত্বেকে মোটেই ধর্ষণ করা হয়নি বরং তাকে কেবল হত্যা করা হয়েছিল। যে ডাক্তার তার দেহ পরীক্ষা করেছিলেন তিনি বলেছিলেন যে, তাকে মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণ হয়েছে বলে মিথ্যে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য এই নৃশংস সহিংসতার ঘৃণ্য কাজে সামরিক সংস্থার পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা ছিল। ধর্ষণের ঘটনাটি সরকারি এজেন্টরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং মায়ানমার জুড়ে রোহিঙ্গা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার তরঙ্গ শুরু করার জন্য এক লঞ্চিং প্যাড হিসাবে এটা ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৪ সালেও ঠিক একইভাবে, মান্দালেতে একজন বৌদ্ধ মহিলার ধর্ষণের অভিযোগে মুসলিম দোকানদারদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যার রিপোর্ট ‘’মা বা থা’’ সদস্যরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিল, ফলস্বরূপ শহরে তিন দিনের মারাত্মক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল।
এরপর ২০১৫ তে অং সান সু চি'র নেতৃত্বে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি/NLD) দেশের শাসন ক্ষমতায় আসে। ৯ অক্টোবর ২০১৬, সশস্ত্র ব্যক্তিরা রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়েকটি সীমান্ত পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় এবং নয়জন পুলিশ কর্মীকে হত্যা করে। অস্ত্র ও গোলাবারুদও লুট করা হয়। মূলত মংডু টাউনশিপে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা আগুনে ঘি ঢালার সমানই উত্তেজনা ছড়ায়। চরমপন্থী ভিক্ষু গোষ্ঠী তো রোহিঙ্গাদের সাথে জড়িত একটি বিদ্রোহের সম্ভাবনার কথা অনেক আগেই রটিয়ে দিয়েছেন, এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ফেসবুকে নিহত পুলিশের গ্রাফিক ছবি পোস্ট করতে থাকেন উইরাথু।‘ ’সঙ্ঘ মহা নায়ক’’ ২০১৭ সালের ২৩ মে ‘’মা বা থা''-কে নিষিদ্ধ করে, আর উইরাথুকে তো এর আগে মার্চ মাসেই এক বছরের জন্য ধর্ম প্রচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিল তারা। উইরাথু মুখে "এক্স" টেপ আটকে অনলাইনে নিজের ছবি পোস্ট করে এর প্রতিবাদ জানান। তিনি এও অভিযোগ করেন যে সুচির সরকার বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিকে মুসলমান আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে তুলছেন। ‘’মা বা থা’’ তড়িঘড়ি আবার তাদের নাম পরিবর্তন করে’ হয়ে যায় ''বুদ্ধ ধম্ম চ্যারিটি ফাউন্ডেশন'' এবং পুরানো কার্যক্রমই চালিয়ে যেতে থাকে। আর উইরাথুও ঠিক তেমনই সঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মুসলিম বিরোধী ধর্মোপদেশ প্রদানের জন্য তাঁর দেশ জোড়া ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন, এমনকি রাখাইনেও হাজির হয়ে যান, যেখানে এক বৃহৎ সংবেদনশীল মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বসবাস করছে।
২০১৭’র ২৫শে আগস্ট, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেই ভয়ঙ্করতম জাতিগত নির্মূল অভিযান (যখন প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক প্রতিবেশী বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল) শুরু হওয়ার পরপরই, রোহিঙ্গা বিরোধী সহিংসতার কেন্দ্রস্থল উত্তর রাখাইনে উইরাথুকে রাষ্ট্র-চালিত মিডিয়া সফরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক দমন-পীড়নের পুরোদস্তুর সমর্থন করতে দেখা যায়। এখানেই কি শেষ? ২০১৮ সালে, ইয়াঙ্গুন শহরে একটি সমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার সময়, উইরাথু বলেছিলেন, যে দিন মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের রোহিঙ্গা বিতাড়নের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সামনে আনা হবে, সেই দিনই তিনি নিজেই বন্দুক হাতে তুলে নেবেন। ভাবা যায়? শব্দগুলো নির্গত হচ্ছে একজন কথিত অহিংসার পূজারীর মুখ থেকে! এই ধরণের অগণিত ঘৃণাত্মক সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ফেসবুক তাঁর অ্যাকাউন্টটি মুছে দেয়।
আচ্ছা কী অজুহাত দিয়েছেন উইরাথু তাঁর এই চরমপন্থার, বৌদ্ধধর্মে যা গর্হিত? উইরাথু তাঁর কার্যকলাপের ন্যায্যতা দিয়েছেন এই বলে যে, চরম সময়ের জন্য চরম পদক্ষেপেরই প্রয়োজন।অতঃপর, ২০১৯ সালের এপ্রিলে উইরাথুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে প্রো-মিলিটারি সমাবেশে, তিনি মিয়ানমারের এনএলডি বেসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে ঘৃণা ও অবমাননা উস্কে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে থাই কর্তৃপক্ষ উইরাথুর দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এবং পরের মাসে মিয়ানমারের একটি আদালত তাঁর গ্রেপ্তারের জন্য একটি পরোয়ানাও জারি করেছিল যাতে উইরাথুর তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি এক বছরের জন্য আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
২০২১-এর ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানে সু চি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং জান্তা সরকার ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে উইরাথুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় ও উইরাথুকে মুক্তি দেয়, কিন্তু এর পিছনের কোনও কারণ কিন্তু তারা জানায়নি। শুধু বলেছে যে উইরাথু নাকি একটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি আছেন কিন্তু সেই চিকিৎসার অবস্থা কারুরই গোচর হয়নি। সকলের বোধ হয় চমকাবার আরও কিছু বাকি ছিল যখন জানা গেলো ২০২২ সালের নভেম্বরে, দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘’থিরি পিয়াঞ্চি’’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন ভিক্ষু উইরাথু।
সন্দেহ হয় এগুলো সবই কী কাকতালীয় ঘটনা! প্রথমে প্রেসিডেন্ট থেইন, পরে জান্তা সরকার-সকলেই কোনো এক রহস্যজনক কারণে বিতর্কিত উইরাথুকে রাজনৈতিক অনাক্রম্যতার সুরক্ষা প্রদান করেছেন। তাই, ঘৃণ্যতম অপরাধ করেও বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছেন উইরাথু বারবার। উইরাথুর বর্ণবাদী, ধর্মান্ধ এবং যৌনতাবাদী রটনা এবং অপরাধমূলক উসকানিকে যদিও অনেক মহলই নিন্দা করেছে, তবু অনেক বৌদ্ধদের কাছেই তিনি খুব জনপ্রিয়, এবং তা শুধু তাঁর জন্মভূমি মিয়ানমারে নয়, শ্রীলঙ্কার মতো জায়গাতেও লক্ষণীয়। মান্দালের বৌদ্ধ মঠ মাসোয়েইনে প্রায় ২,৫০০ ভিক্ষুর সভাপতি উইরাথুর ফেসবুক জুড়ে হাজার হাজার অনুসারী ছিল এবং তাঁর ইউটিউব ভিডিওগুলো কয়েক হাজার বার করে' দেখা হয়েছে।
দেখুন, বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বহু মানুষ বিশেষত পাশ্চাত্যবাসীদের মনের মধ্যে যে সাধারণ ছবিটা আঁকা রয়েছে তা হলো: এর অনুগামীরা এতটাই শান্তিপ্রিয়, এতটাই সহনশীল যে, তাঁরা একটা মাছিকেও আঘাত করেন না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক সক্রিয়তায় সন্ন্যাসীদের অংশগ্রহণের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মিয়ানমারের ২০০৭ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসজুড়ে যে ''স্যাফরন রেভোলিউশন'' শুরু হয়, তা এর এক আদর্শ উদাহরণ। তদানীন্তন জাতীয় সামরিক সরকারের জ্বালানির বিক্রয় মূল্যের উপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের কারণে এই বিক্ষোভ দানা বাঁধে। ক্রমে ক্রমে তা সমাজের বিভিন্ন স্তরে উল্কার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই নাগরিক প্রতিরোধের প্রচারণায় ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, নারী পুরুষ সকলেই সামিল হয়েছিলেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু এতে নেতৃত্ব দেন। এই প্রতিবাদটি অহিংস থাকলেও সাম্প্রতিককালে, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, এবং মিয়ানমারের মতো জায়গায় সন্ন্যাসীদের প্রতিরোধ অতি-জাতীয়তাবাদী এবং চরমপন্থী রূপ ধারণ করেছে। আসলে, বিশ্ব ধর্মের শিক্ষায় নিহিত নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ যাই হোক না কেন, ধর্মগুলো নির্ভরযোগ্যভাবে এই মূল্যবোধগুলিকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং ধর্ম অনুশীলনকারীরা মনুষ্য চরিত্রের বিচিত্রতায় ফিরে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। বৌদ্ধধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। বৌদ্ধ চরমপন্থীরা ইসলামকে একটি "বিপজ্জনক" বা "নৃশংস" ধর্ম হিসাবে গণ্য করে, এবং এই ধারণা পশ্চিমা দেশগুলো থেকেই সরাসরি ধার করা হয়েছে। বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের দ্বারা সংঘটিত চরম সহিংসতার নজিরের মুখে দাঁড়িয়ে পশ্চিমা সমাজ এখনও বৌদ্ধধর্মকে একটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ধর্ম হিসেবেই ধরে রেখেছে, অথচ, একই সাথে ইসলামের স্টেরিওটাইপগুলোকে একটি সহিংস ধর্ম হিসাবে মান্যতা দিয়ে চলেছে। মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দ্বন্দগুলোতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ব্যাপক অশান্তির সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে সংঘর্ষের ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। দক্ষিণ এশিয়াতেও যদি পশ্চিমা দেশগুলো নিয়মিত, ধারাবাহিক সামরিক অভিযানে সমানভাবে জড়িত থাকত, তাহলে তখন বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার সম্বন্ধে তাদের চোখ খুলে যেত। আরেকটা ব্যাপার হলো: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম অনুশীলন করে। বৌদ্ধধর্মের এই শাখাটি অহিংসা ও শান্তির বিষয়ে বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য রূপ থেকে আলাদা। এই অনুশীলনটি বৌদ্ধ ঐতিহ্যের প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে মেনে চলে এবং সাধারণত বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য (মহাযান এবং বজ্রযান) শাখার তুলনায় আরও কঠোরভাবে সন্ন্যাসবিধির পালনের উপর জোর দেয়; জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধ এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে সংযোগের সাথেও এটি আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। কিছু থেরবাদ সম্প্রদায় তো অ-বৌদ্ধদেরকে অবমানবিক বা দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসাবেই দেখে। বলে রাখা ভালো: প্রায় ৫৪ মিলিয়নের দেশ মিয়ানমারে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় নয় জন মানুষই বৌদ্ধ, এবং কার্যত তারা সক্কলেই থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে উইরাথু এবং তাঁর অপরাধী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দল বৌদ্ধ ধর্মকে অনৈতিকভাবে কব্জা করেছিলেন এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক আলোচনাকে বিষিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কেন? সন্ন্যাসীরা বলেছেন যে, তাদের ব্যাপক উদ্বেগ এবং ভয়ের কারণ এই যে, মিয়ানমারে একটা উগ্র ইসলামের পুনরুত্থান ঘটবে এবং বৌদ্ধ ধর্ম রসাতলে যাবে যেমনটি ঘটেছে শতাব্দী আগে আজকের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায়। এদিকে, মিয়ানমারের ২০১৪ সালের আদমশুমারির তথ্যের উপর নজর করলে দেখা যাবে যে, বার্মিজ জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধ (৮৯.৯%), মুসলমান ছিল মাত্র ৪.৩% ; ৫১৫ লক্ষ মানুষের এই দেশে বৌদ্ধরা যেখানে সংখ্যায় ছিল ৪৫১ লক্ষ মুসলিমরা ছিল সেখানে মাত্র ১২ লক্ষ। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের আনুমানিক ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম রাষ্ট্রহীন ছিল কারণ মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের আদমশুমারির অন্তর্ভুক্তই ছিল না। সুতরাং এমতবস্থায় কোনো সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী কীভাবে একটা প্রভাবশালী ধর্মের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেছিল, তার কোন ব্যাখ্যা নেই। আসলে বহু দিন ধরেই, মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত ও বর্ণগত গোষ্ঠীগুলিকে পরস্পরের প্রতি বিষিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা একে অপরকে ঘৃণা করে, হিংসা করে। শাসনকারী সামরিক বাহিনী যারা শক্তিশালী অস্ত্র কৌশল এবং চরমপন্থী নিয়মনীতি নিয়ে ভগ্ন দেশকে শাসন করছিল সেই সামরিক জান্তা কখনোই চায়নি যে, দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কোনো পরিবর্তন আসুক, এনএলডি সরকারের গণতন্ত্র কায়েম হোক। এনএলডি সরকারের সাথে সন্ন্যাসীদের যে বিরোধিতা ছিল, তার পূর্ণ সুবিধা নেওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরে সবসময় একটা জাতিগত বিভেদ বিভাজনের উত্তেজনাময় আবহাওয়া চালু রাখতে যার-পর-নাই ইচ্ছুক ছিল তাতমাদাও জান্তা। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিশেষ করে’, রোহিঙ্গা জনগণদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই সরকার উইরাথু এবং তাঁরই মতো বিদ্বেষপূর্ণ, জেনোফোবিক সন্ন্যাসীদেরকে ব্যবহার করেছিল, ‘’মা বা থা’’ গোষ্ঠীর মতো উগ্র বৌদ্ধদের সমর্থন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে “মা বা থা সেনাবাহিনী দ্বারাই বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। একজন বিশেষজ্ঞ তো একথাও জানিয়েছেন যে, সামরিক শাসকরা ‘’মা বা থা’’ সদস্যদের ওয়ার্ড প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করতে অবধি দ্বিধা করেনি। ২০১৫ তে সু চি এবং এনএলডি'র হাত ধরে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্টিত হলেও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী এবং সামরিক বাহিনীর রক্ষণশীল নেতৃত্ব এই দুই শ্রেণীর কাছেই উইরাথুর জনপ্রিয়তা ঠিকই বজায় ছিল। আর সেটাই সু চি'র সরকারকে একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেয় কারণ বার্মিজ জনসাধারণের বেশিরভাগই উইরাথুর মুসলিম-বিরোধী প্রোপাগান্ডায় আস্থা ও বিশ্বাস সঁপে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সমর্থন বজায় রাখা যায় কীভাবে? সারা মিয়ানমার জুড়ে ইসলামের প্রতি যে অসীম বিদ্বেষপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল উইরাথুর সমর্থকরা, তা প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেননি সু চি, চলতি হওয়ার মতোই তিনি তার সাথে সায় দিয়েছেন। এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ: ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময় এনএলডি প্রতিটি মুসলিম প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যদিও তাঁদের যোগ্যতার কিছুমাত্র কমতি ছিল না। যদিও ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে যে সামরিক দমন-পীড়ন হয়েছিল তার জন্য সু চি দায়ী ছিলেন না, কিন্তু সু চি’র মুখ থেকে সে সম্বন্ধে একটিও নিন্দা বাক্য নিঃসৃত হয়নি। বরং সু চি গলা ফুলিয়ে বলেছিলেন যে, সেনাবাহিনীর ওই সমস্ত পদক্ষেপগুলো আসলে রোহিঙ্গা মিলিশিয়া বিদ্রোহ দমনের একটা প্রতিক্রিয়ামাত্র ছিল। সু চির ধাষ্টামো এখানেই শেষ হয় নি, গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত জেনারেলদেরকে তিনি "বেশ মিষ্টি" বলেও বর্ণনা করেছেন। আসলে, রোহিঙ্গাদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতিও পোষণ করে না যে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যই "দ্য লেডি", ওরফে মিসেস সু চি ততদিনে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রতে পরিণত হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র:
1.The Politics of Numerology: Burma’s 969 vs. 786 and Malaysia’s 505. In SE Asia, some numbers are used for political and religious ends. Mong Palatino. The Diplomat. May 16, 2013.
2. Correcting The False Narratives of Ma Ba Tha – OpEd. Dr. Habib Siddiqui., Eurasia review. February 9, 2016.
3. Lion’s Roar. What’s the connection between Buddhism and ethnic cleansing in Myanmar? Randy Rosenthal. Sep 10, 2017.
4. Ashin Wirathu: The Buddhist bin Laden. Shehab Sumon. Arab News. July 30, 2019.
5. Wirathu: Myanmar military releases firebrand Buddhist monk. BBC. September 2021.
6. Aung San Suu Kyi: Myanmar democracy icon who fell from grace. BBC. December 6, 2021
7. Hate Speech and Incitement in Myanmar before and after the February 2021 Coup. In: Global Responsibility to Protect. Noel M. Morada. BRILL. Mar 03, 2023.
8. The Unholy Nexus Between the Monks and Military in Myanmar. Sauid Ahmed Khan. Australian Institute of International Affairs. Mar 22, 2023.
9. Buddhist Nationalism: Rising Religious Violence in South Asia. Eva Chappus. DU Undergraduate Research Journal Archive Vol. 4, Issue 2, Article 1. May 10, 2023.
কবিতা
ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
আলো
নিশীথে দীপ্যমান গগন জুড়ি এক আলোক,
যেন অমৃতময়;
ছড়ায় দীপ্তি অসীমের পথে,
আনে প্লাবন সাগর তরঙ্গে
অপরূপ বর্ণচ্ছটায়।
হে জ্যোতি,
উৎস কোথা তব,
ঠিকানা কোন অনন্তে?
আলোক তব, করে মায়াবর্ষণ
এই সাগরের জলে।
আবাহনে বুঝি ভাঙে আঁধার,
এই রজনীতে।
অনন্তের পথে যাত্রা এই স্নিগ্ধতা
করে রচনা সাগরে স্বপ্নময় রূপ।
দীপ্তির সারণীতে নক্ষত্রেরা গায় গান,
জ্যোতিতে হয় পরিমার্জিত
জগৎসংসারের প্রাণ।
হে দীপ,
হে প্রেরণা,
যোগাও শক্তি মোদের,
করিতে সমাপ্তি সকল বেদনা।
আপ্লুত নিখিল সংসার অব,
তব আগমনে।
রহে চরৈবতি চির অভিসার তব
সাগরের বুকে অনন্তকাল,
প্রণতি মোর ইহা,
তাহার চরণে।
নিঃসীম তব আলোকে
যায় বুঝি মিশিয়া মোর অস্তিত্ব
ধীরে ধীরে।
ফিরি আদিম শূন্যতায়-
সেই খোঁজে;
উদিত যেথা হতে এই রশ্মি,
উদিত যেথা হতে মোর এই আমি,
উৎক্ষিপ্ত যান মোর
মানস তীরে।
প্রশান্তি
দক্ষিণ চীন সাগরের এই নির্জন সৈকত যেন
প্রকৃতির এক অপ্রকাশিত কবিতা।
এখানে নীল সমুদ্রের বুকে তুষারশুভ্র পুঞ্জীভূত দুর্বার তরঙ্গে
নিদ্রাচ্ছন্ন ঝিনুকগুলোকে দেখলে মনে হয়,
বুঝি সময় গেছে থেমে,
অনেককাল।
ছন্দময় সমুদ্র যেন মালা গেঁথে
গুঞ্জনের সুরে আপন গল্প শোনায় পাহাড়কে;
সেই গল্পে থাকে অনন্ত তরঙ্গের ক্রন্দন,
রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার মুহূর্ত,
ভালোবাসার চিহ্ন,
আর, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি।
অনতিদূরে,
গভীর নীলাকাশে কয়েকটি পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অবিচল,
বহুকাল ধরে।
সূর্যাস্তের সময় তাদের গায়ে লেগে থাকা কুয়াশার চাদর যেন
সময়ের গাঢ় স্মৃতি।
সূর্যাস্তের বুননে দেখি,
পাহাড়ের ছায়ায়
এক জেলে তার ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সাগরের বুকে।
দু হাতে তার বৈঠার টান,
অনুভবি, শরীরের প্রতিটি রেখায় যেন ফুটে উঠেছে জীবনের লড়াই আর অনন্ত আশা।
তরঙ্গের শব্দে মিশে যায় তার গ্রাম্য গান,
যা হয়তো প্রাপ্ত তার পূর্বপুরুষদের কাছ হতে।
এখানে সূর্যাস্তের শুরুতে
আকাশ হতে ঝরে পড়া মৃদুসোনালি আলো দেখলে মনে হয়,
স্বর্ণালী কিরণ বুঝি দিনের উষ্ণ প্রকৃতিকে স্নান করাচ্ছে,
পরম যত্নে।
খানিক পর
সেই সোনালি রঙ ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে
তার কোমল ও উষ্ণ কমলা আভা
মেঘ ও আকাশে ছড়িয়ে দিলে মনে হয়,
কোনো শিল্পী বুঝি তুলির আঁচড়ে কমলা রঙের আলপনা এঁকে দিচ্ছেন,
আকাশ জুড়ে।
ক্রমশ: সূর্য দিগন্তের কাছে নামতে থাকলে,
কমলা রঙ হয় আরও গাঢ়, এবং
এক সময় তা রক্তিম লাল আভা হয়ে আকাশে মেঘের ক্যানভাসে মিশে গিয়ে
প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দিয়ে সৃষ্টি করে
এক মোহময় উষ্ণতা।
এরপর সূর্য যখন একেবারে দিগন্তে অস্ত যেতে থাকে,
তখন আকাশে দেখা দেয় গোলাপি ও হালকা বেগুনি রঙ।
এই সময়ের রঙে মিশে থাকে শান্ত ও কোমল এক আবেশ,
যা মনকে দেয় এক পরম প্রশান্তি।
অস্তগামী সূর্য তার অবর্ণনীয় বর্ণচ্ছটা পাহাড়ের গাত্রে ছড়িয়ে দিয়ে
দিনকে বিদায় জানায়।
সূর্য অস্ত গেলে
নেমে আসে নীলচে ধূসর রঙের ছায়া।
এই রঙের আবির্ভাব প্রকৃতিকে জানান দেয়
রাতের আগমনের।
ধীরে ধীরে নামতে থাকে আঁধার,
আর দিনের রঙিন চিত্রকলা মিলিয়ে যায়
গোধূলির নিস্তব্ধতায়।
গোধূলি বেলায়,
রুপালি বালুর বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকে
দিনের অন্তিম আলো।
পাথরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের পুঞ্জীভূত বাষ্প
মনকে করে সিক্ত,
পরিতৃপ্ত।
আঁধার নামলে,
কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে এক অব্যক্ত সৌন্দর্য
যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের জীবন হয় একাকার।
সৈকতের এই নিঃসঙ্গতা,
পাহাড়ের নিস্তব্ধতা, আর
জেলে ডিঙির অনন্ত যাত্রা -
সবই মিলে সৃষ্ট এক আশ্চর্য মায়াময় মুহূর্ত,
ফেলে যায় অদৃশ্য এক প্রশান্তির ছাপ
হৃদয় গভীরে।
বেশ ভালোই লাগে, প্রখর গ্রীষ্মে -
হঠাৎ বসন্তের মৃদু বাতাসের মতন।
ভুলের মায়ায় জাড়িত হয় দেহমন,
কাঁঠালচাঁপার পাপড়িতে প্রতিফলিত সূর্যকিরণ
কুয়াশা সরায় সর্পিল পাকদন্ডীর।
পৃথিবীর সব কঠোর নিষ্ঠূর ঠিক ও সত্যির ভিড়ে
ছোট ছোট ভুল সময়ের ঘড়িতে ঘন্টাধ্বনি করে,
নিস্তরঙ্গ মনসাগরে প্রানোচ্ছাসের ঢেউ তোলে -
তারপর সামান্য বুদ্বুদ তুলেই মিলিয়ে যায়।
তবু রেশ রেখে যায় মনের গভীরে, প্রাণের মাঝে,
ভালোবাসার তারে দোয়েল এসে বসে -
পূরবীর সুরে মূর্ছনা ওঠে অস্তাচলের প্রান্তে,
জীবন বয়ে চলে অন্য জীবনে
কপোতাক্ষের ছন্দে।
কবিতা
নিলয় দত্ত
কেষ্টপুর, কলকাতা
ভুলের পরে
ভুলের পরে এখনও কিছু ভুল হয়েই যায় -
বড় নয় তেমন, অকিঞ্চিৎকর সব ভুল -
ছোট বড় বৃত্তের জন্ম দেয় নিস্তরঙ্গ জীবনে।
বিত্তচূড়োয় বিদ্যমান কিছু অর্বাচীন বা
উন্নাসিকের কাছে -
এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভুলই হয়ত,
কখনও তাদের হৃদয় তাপিত করে
বা বাকরুদ্ধ হয়ে ওঠে দুঃসহ ভ্রান্তিতে -
ভুলের খাঁড়া নেমে আসে
কোনও এক জীবনের যূপকাষ্ঠে।
আবার অনেকেরই হয়তো এই সামান্য ভুলগুলো,

কবিতা
সুকান্ত পাল
ফরাক্কা, পঃ বাংলা
কবিতা/গান
কে বলে ফাগুন মাসে ফোটে শুধু ফুল
দেখোনি কি ঝরে যেতে পলাশ শিমুল।
দেখেছো রঙের মেলা ফাগুন জুড়ে
কতটা হৃদয় কার গিয়েছে পুড়ে—
দেখতে যদি তুমি ভেঙে যেত ভুল
কে বলে ফাগুন মাসে ফোটে শুধু ফুল।
শুনেছো কোকিলের কুহু কুহু গান
বোঝো নি বুকেতে তার কত অভিমান।
কতটা বেদনা পেলে ধূলায় লুটায় বলো
বিরহী বকুল
কে বলে ফাগুন মাসে ফোটে শুধু ফুল।
ফাগুনের কি যে জ্বালা রাধাই জানে
কানুর পীরিতি গাঁথা ভাসে যমুনার গানে।
যে ফুল ফাগুনে ফুটে সুরভি হারায়—
বলো তার কি গো ছিল ভুল
কে বলে ফাগুন মাসে ফোটে শুধু ফুল।
নাগরিক গ্রাম
গ্রামগুলি আর নাই সেই গ্রাম বদলে গিয়েছে কতকিছু
নাই মেঠো পথ কুঁড়েঘরগুলি নিকানো উঠান যতকিছু।
গেছে একতারা গুবা ও খমক চোখের বালি পাতানো সই
বাঁক কাঁধে নিয়ে বেচে না কেউ আর ঘরে পাতা সেই সরের দই।
বুড়ো বটগাছ কেটে নিয়ে গেছে নামটুকু আছে বটতলা
গরু-মোষ-গাড়ি টাঙ্গা টমটম— বন্ধ তাদের পথ চলা।
হারিয়ে গিয়েছে প্রাণেশ বিজলী আদরের দীনু চুনীবালা
এসেছে বিট্টু বিকি রনি মাহী পুরানো নামেতে দিয়ে তালা।
এ বাড়ির ডাল ও বাড়ি যায় না —বন্ধ হয়েছে কড়ি খেলা
কাঁচের চুরি কেনে না কেউ আর জমে না আগের সে মেলা।
ঘুচে গেছে কবে শাস্ত্র রসনা টিভি মোবাইলে আটকে চোখ
কংক্রিট বুকে নাগরিক গ্রাম ইতিহাস মুখে লুকায় শোক।


একদিন ঝোড়ো ঝড় আছড়ে পড়ল
শণ্শণে বাতাস গাছের বৃত্তকে ফেলল ঘিরে;
হাওয়ার দমকা আঘাতে তার কাণ্ড
পড়ল ভেঙ্গে। আমাদের যাওয়ার পথে।
পরদিন উঠল রোদ। ভিজে চারপাশ
চক্চকে রোদের ফলায়। এল যন্ত্রমানব্।
তার শক্তিশালী করাত—বেগুনী মাথা
আলাদা করল ধড় থেকে।
অনেকদিন পর। সেই পথে যেতে দেখলাম।
তুমি নাই। শুকনো কাণ্ড থেকে মাথা তুলেছে
তোমার অন্ত্যজ। বেগুনী ভবিষ্যতের আশায়—
তাকিয়ে রইলাম শুধু।
বেগুনী ফুলের গাছ
সেইখানে একটা গাছ ছিল,
রঙীন বসন্তে হালকা বেগুনী ফুল মাথায় ভরে
দাঁড়িয়ে থাকত। আর ফুরফুরে হাওয়ায় মাথা ঝাঁকাত।
আড়াইফুটি ব্যাসার্ধের গোল জায়গা
ভরে থাকত বেগুনী ফুলে।
হাতে হাত ধরে পাশ দিয়ে যেতে যেতে—
বার বার ফিরে তাকাতাম।
তাকাতে তুমি কপট রাগে
বেগুনী আভা তোমার ভ্রূভঙ্গীতে।
কাঁপা হাওয়ায় ফুল ঝরিয়ে স্বীকৃতি দিত সে।
কবিতা
রথীন্দ্রনাথ বড়াল
ডঃ নগেন ঘোষ লেন, কলকাতা

কবিতা
এহিয়া আহমেদ
বরথল কছারী গাঁও, মৈরাবারী, মরিগাঁও, অসম
আমরা একটা পাথর
আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত,
লাঞ্চিত-বঞ্চিত এবং শোষিত
নিস্তব্ধ আমরা,
আমরা ধৈর্য্যশীল, কর্মশীল,
শত বছর পেরিয়েও রয়েছি চুপ, থেমেছি চুপচাপ,
কেউ ছুঁয়ে যায়, কেউ এড়িয়ে যায়,
কেউ ভাঙতে চায়, কেউ গড়তে চায়।
আমাদের বুকে লেগে থাকে সময়ের ধুলো,
আলোর উষ্ণতায় ছাপ রেখে যায় দিন।
মেঘের ফোঁটা, বৃষ্টির রেণু—
আমাদের শরীরের ওপরে রেখে যায় চিহ্ন।
আমরা জেগে থাকি পাহাড়ে, নদীর পাশে,
আমরা ভাঙি ধীরে, তবু টিকে থাকি,
আমরা পাথর—শতাব্দীর সাক্ষী,
আমরা স্থিরতার প্রতীক, এক অনন্ত আঁচল।
দুগগা মাইকি
আশ্বিনের এই শারদপ্রাতে
পড়াশোনা সব উঠল লাটে
মা দুর্গার আশীর্বাদে সবাই খুশি আজ
খিচুড়ি লাবড়া মিষ্টিমুখ, নেই কিছুই কাজ
পাঞ্জাবি ও ধুতিপরা ছেলেরা সব হিরো,
পাড়ার কর্তারা বলছে ডাঁটে--
যা-যা, আজকে তোরা জিরো।
শাড়িপরা মেয়েরা হাঁটে, যেন র্যাম্পের ধাঁচে,
বন্ধুর সাথে রাতভর আড্ডা, বাড়ি ফিরে হাঁচে
সন্ধ্যা-আলোর আলপনাতে, সবাই খুশি আজ
চপ-ফুচকার লম্বা লাইন, নেই তো ক'দিন কাজ
দেখতে দেখতে এল দশমী, সিঁদুর খেলায় মাতি
রাতদুপুরে দুগগা মাইকি-- দিনটা ফাটাফাটি!
দুর্গাপুজো এমনই তো, আনন্দে আত্মহারা
আবার অপেক্ষা, পরের বছর হবই পাগলপারা।
কবিতা
দেবার্ঘ্য মুখার্জী
উৎসব সব শেষ, তাই পড়ার বোঝা বেশ
উৎসবের সব দিনগুলো শেষ, খুশিতে মোড়া ক্ষণ,
দুর্গাপুজো, কালীপুজো একে একে সবই হলো নিস্প্রাণ।
প্যান্ডেল ঘোরা, আলোর ঝলক সবাই নিলো বিদায়,
এখন শুধু বইখাতা আর পড়ার বোঝা মাথায়।
দুর্গা গেলো কৈলাশেতে, মা কালী তার মন্দিরে,
তাই আমাদের জীবন আবার বইয়ের পাতার ভিড়ে।
সামনে আবার টেস্ট পরীক্ষা, শত চিন্তার জাল,
উৎসব শেষে পড়তে বসা! এতো কাঁচা মরিচের ঝাল!
কদিন আগেও চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ
এখন বইয়ের পাতা দেখে মনটা লাগে দম বন্ধ।
মা বলছেন, আর পড়বি কবে সময় এতো কম,"
আমার মাথায় ঘুরছে শুধু পুজোর গান আর ঢাকের দমাদম!
বন্ধুরাও সব হতাশ মুখে,
দিনগুলো সব, কাটবে দুখে।
উৎসব শেষ তাই পড়াই বাকি, সময়টা নিদারুণ,
সাদা পাতায় অঙ্ক কষ যোগ বিয়োগ আর গুণ

চল যাই ২০২৫-এ
সেখানে যেতে চাস কিনা বল
যেখানে টপ্পা খেয়াল করে ঠুকোঠুকি
স্নানঘরে গান করে মুখোমুখি
চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল
সেখানে যেতে চাস কিনা বল
যেখানে জলের সাথে জলের থাকাথাকি
জীবন ছুঁয়ে জীবন পাকাপাকি
চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল
সেখানে যেতে চাস কিনা বল
যেখানে ঝিম মেরে ঘুম আসে ভুল করে
সময়ের থেকে ঘোড়া ছোটে খুব জোরে
চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল
সেখানে যেতে চাস কিনা বল
যেখানে আকাশের গা থেকে আঁধার বিদায়
নিমেষেই ভালো কিছু পাশে এসে যায়
চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল
চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল
ইশতেহারে বৃষ্টি নামুক শান্তি অনর্গল

কবিতা
যশ চক্রবর্তী
শিকাগো, ইলিনয়

ছোট গল্প
চিত্তরঞ্জনে
চিৎকার
শ্রীকান্ত দাস

সালটা ২০১৭। নভেম্বরের মাঝামাঝি। দুদিনের জন্য রাঁচি বেড়িয়ে হঠাৎই রওনা দিলাম চিত্তরঞ্জন রাহুলের কোয়ার্টারে। রাহুল (বাপটু) আমার একমাত্র শালা। তিরির মাসির ছেলে। গত দু'বছর আগে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভে চাকরি পেয়েছে। রাহুল আমার থেকে বয়সে যথেষ্ট ছোট হলেও সময়ের ফেরে প্রায় বন্ধুর মতোই ওর সাথে সম্পর্ক আমাকে ভালোবেসে ‘জনি’ বলে ডাকে।বহুদিন ধরেই ওর অফিস কোয়াটারে আসার জন্য চেষ্টা করেও হয়নি। তবে এবার আমরা মন প্রাণ নিয়ে ভেবেই নিয়েছিলাম লং ড্রাইভে যখন বেরিয়েছি রাঁচি থেকে একদিনের ছুটিতে রাহুলের বাড়িতে কাটিয়েই আসব। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ জায়গাটা ভারী সুন্দর। অনেকটা নর্থ বেঙ্গলের ডুয়ার্সের মত। বয়ে যাওয়া অজয় নদী, ছোট্ট টিলা আর সাজানো-গোছানো রেলওয়ের পরিসর যথেষ্ট সুন্দর। সকালবেলায় রাঁচি থেকে বেরিয়ে পথে রাজারাপ্পাতে মা ছিন্নমস্তার পুজো দিয়ে বেলা আড়াইটে নাগাদ পৌঁছলাম চিত্তরঞ্জন। মাইথন যাওয়ার পথে মা কল্যানেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের পাশ থেকে চিত্তরঞ্জন এর রাস্তাটি যথেষ্ট সুন্দর।
- 'বাপটু…..'।মোবাইলে ফোন করলাম
- 'হ্যাঁ জনি বলো।'
- 'তোর বাড়ি আসছে কিন্তু।'
- 'বলো কি? সত্যি?'
- 'হ্যাঁ, এবার টা কিন্তু সত্যি।'
- 'ও মা; জনি আসছে। ফোনে শুনতে পেলাম। - 'সঙ্গে দিদি ও জেমো ও আসছে।'
- 'তোর ঠিকানাটা একটু বল বা গুগুলে লোকেশনটা শেয়ার কর।'
- 'তুমি সোজা লোকেশন অন করে সিএলডব্লিউর তিন নম্বর গেট লেখ। এসে একটা ফোন করো কিন্তু ….যদি কোয়াটার এর নম্বর জিজ্ঞেস করে তবে বলবে ২৫৬।'
- 'আমি যাব।' রাহুল বলল।
ছোট বড় জঙ্গলের মাঝখান থেকে গাড়ি চলল CLW তিন নম্বর গেটের দিকে। গেটের কাছে গিয়ে যখন আরপিএফ এর এনট্রি বুকে গাড়ির নাম্বার নথিভুক্ত করছি ততক্ষণে রাহুলের দিদি তিরি ফোন করে দিয়েছে তার ভাইকে। দূর থেকে দেখতে পেলাম বাইক নিয়ে রাহুল আসছে। নথিভুক্তকরণ করা পর সোজা চলে গেলাম রাহুলের কোয়ার্টারে। চিত্তরঞ্জনে ভিতরটাও খুব সুন্দর সোজা সোজা বেশকিছু রাস্তা। এবং তার পাশে সারিবদ্ধ হয়ে থাকা রেলের কোয়াটার। ২৪ নম্বর রাস্তার শেষে রাহুলের কোয়ার্টার। গাড়ি রেখে সোজা ঢুকে গেলাম কোয়াটারে। অনেকটা জার্নির পর শরীরটাও কেমন আরাম চাইছিল।
- 'মানি, দেখো এবার কিন্তু বলতে পারবে না এসেই গেলাম।'
- 'তুমি আর বোলো না কতবার ধরে প্ল্যান করেও তুমি আসতে পারলে না।'
- 'এবারটা তো আর মিস করলাম না কি বলো?'
তিরি ততক্ষণে তার মাসির সঙ্গে জমিয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলায় আমি আর রাহুল চিত্তরঞ্জন এর ভিতরটা একটু ঘুরতে গেলাম। হালকা ঠান্ডা লাগছিল।বার্কলে হাউস এর দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎই বেশ কিছু বুনো শুয়োর দেখতে পেলাম।
- 'আরে এ তো পুরো ওয়াইট লাইফ বাপটু।'
- 'চলো না অজয় নদীর তীরে শিয়ালও পাবে।'
- 'বলিস কি আমাদের ওদিকে তো এখন প্রায় লুপ্ত প্রাণী।'
- 'জনি ওই যে জঙ্গলটা দেখছো ওই জঙ্গলটার ভিতর পরশুদিন একটা সজারু দেখতে পেয়েছি।দাঁড়াও একটু পরে তোমায় ছবিতে দেখাচ্ছি মোবাইলে তোলা আছে।'
- 'বলিস কি? 'স স সজারু।....... এখানে।'
- 'জাস্ট এখানেই' - বাপটু উত্তর দিল।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। সবাই মিলে মেলায় যাওয়ার বিষয় আছে। এদিক-ওদিক দিয়ে ঘুরে প্রায় এক ঘন্টা পর যখন ফিরছি হঠাৎ ২৬৩ নম্বর কোয়াটার টার সামনে দিয়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হল আমার।
- 'আচ্ছা বাপ্টু এই কোয়াটারটা এভাবে পড়ে আছে কেন?'
- 'ও বাবা এটা তোমায় পরে বলছি। এর অনেক কীর্তি।'
- 'কেমন?'
- 'বলছি পরে।'
- 'এদিক দিয়ে বড়জোর ফিরি না আমি।' বাপটু বললো।
- 'সে আবার কি? কেন?' কৌতুহলী হয়েই বললাম।
তবে চলন্ত গাড়িতে যেন মনে হল আমারও পিছনে কেউ যেন বাইকে বসে আছে। একটা মানুষের অস্তিত্ব যেন অনুভব করলাম।
সন্ধ্যেবেলায় তিরি, জেমো, বাপটু, মানি সবাই মিলে গেলাম মেলায় ঘুরতে। মেলার ভিড়ে হঠাৎই দেখতে পেলাম স্কুলের বন্ধু মনোজিৎকে।
- 'আরে এই মনোজিৎ….. মনোজিৎ'
- 'যাঃ কোথায় চলে গেল। এখানেই তো দেখলাম।'
- 'জনি কাউকে খুঁজছো তুমি?' বাপটু জিজ্ঞাসা করল।
- 'আরে না আমার বাল্যবন্ধু এখানেই যেন দেখলাম'। বাপটু কিছুটা অট্টহাস্য করেই সবাইকে বলল,
- 'এই এই শোন জনি এখানেও বাল্যবন্ধুকে দেখছে, কি অবস্থা।'
তিরি তো বলেই উঠল - 'এই শোনো তুমি এখানে অন্তত তোমার বন্ধুত্ব আর আড্ডা পাতিও না।যেখানে সেখানে ছাত্র নয় বন্ধু এসব দেখা তুমি বন্ধ কর। আর উফ্ পারিনা তোমাকে নিয়ে।'
- 'আরে না গো, মনোজিৎকে দেখলাম মনে হল।'
বাপটু বলল - 'কাকে?' বাপ্টুর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। তখন আর কোন কথা না বলে রাতে রুটি নিতে যখন বাজারে এলাম তখন হঠাৎই বাপ্টু বলল,
- 'একটা হিসাব জনি কেমন মিলছে না যেন? যাক কালকে বলব অনেক কথা।'
বাপটুর কোয়াটারটা যথেষ্ট বড়। রাতে খাওয়ার পর বাইরের ঘরটায় টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম একাই। হঠাৎই রাত্রে কিসের একটা চিৎকার কানে ভেসে এলো। কারোর একটা কান্নার আওয়াজ। কিছুটা ইতস্তত হলাম। পাশের ঘরে সবাই তখন ঘুমোচ্ছে। ভাবলাম কিসের চিৎকার।
মোবাইলটা দেখলাম। সময় তখন রাত দেড়টা। বাইরের ঘরের দরজাটা খুলে বারান্দায় এলাম। আওয়াজটা বাইরে থেকেই আসছে।
হালকা ঠান্ডায় কুয়াশায় চারিদিক কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কিন্তু চিৎকারটা কিসের? কার?
কৌতুহলই হয়েই গেটটা খুললাম। গাড়ির পাশে দু চারটে কুকুর শুয়ে আছে। বাইরে আসতেই কোন আওয়াজ আর পেলাম না। এতটাই ভুল শুনলাম। ঢুকতে যাবো কি আবারো শুনতে পেলাম সেই চিৎকার এর আওয়াজটা। আওয়াজটা তো ওই ২৬৩ নম্বর কোয়াটারের দিক থেকেই আসছে। একটু ইতস্তত বোধ করলাম। এত রাতে…..বাপটু কে ডাকবো? না থাক! একবার দেখব কিসের চিৎকার?
মোবাইলের টর্চ জেলে আস্তে আস্তে ২৬৩ নম্বর কোয়াটারের দিকে এগোতে লাগলাম। আরে এই তো মনোজিৎ! এই মনোজিৎ, মনোজিৎ ……
- 'আরে বিপ্রতিপ যে।' মনোজিৎ বলল। প্রশ্ন করলাম
- 'ভাই তুই এখানে কি করছিস?'
- 'তুই কি করছিস বল। মনোজিৎ বলল।
- 'আমি তো শালার বাড়িতে এক রাত্রের ছুটিতে এসেছি।'
- 'মেলায় দেখলাম তোকে; ডাকলাম কতবার কোথায় চলে গেলি?'
- 'ও ছাড়'
- 'এখানে এত তুই কি করছিস?
- 'আর বিকেলে যখন এই কোয়াটার এর পাশ থেকে যাচ্ছিলাম কেমন অন্ধকার অবস্থা ছিল। এখানে কি তুই থাকিস। ও হ্যাঁ শেষ শেষবার যখন দেখা হয়েছিল রিউনিয়নের সময় তখন তো তুই বলেছিলি তুই রেলে চাকরি পেয়েছিস।'
- 'আচ্ছা গুরু, তুমি সিএল ডাব্লিউ তে চাকরি পেয়েছো'
- 'এই মনোজিৎ তুই একবারও বলিস নি তো তুই এখানে থাকিস।'
- 'জানলে কি করতিস?'
- 'না কিছু করতাম না। তাও….'
- 'এই যে ধর জানতাম না তুই এখানে আছিস! না দেখা করেই চলে যেতাম।'
- 'এবার অন্তত তোর ফোন নম্বরটা দিস।'
- 'সন্ধ্যেবেলা কি বাড়ি ছিলি না? আমি তো এই রাস্তা দিয়ে গেছি। বলব কি তোর বাড়িটা দেখে না আমার ঠিক একটা ভুতুড়ে বাড়ি মনে হয়েছিল।'
ওর কোয়াটার এর বারান্দার মুখে থেমে ইতস্ততভাবে ওকে বললাম,
- 'কিন্তু মনোজিৎ আমার যেটুকু মনে পড়ছে তুই বিয়ে তো করেছিলি না? শালা নেমন্তন্ন করিস নি কিন্তু।'
- 'আরে আয় আয় সেসব গল্প পরে বলছি।'
ঘরের মধ্যে ঢুকে আমার যেন কেমন একটা সেই পচা দুর্গন্ধ নাকে এলো একটা অস্বস্তি আমায় ঘিরে ধরছিল।
- 'তারপর কেমন আছিস বল?'
- 'মনোজিত উত্তর দিল ভালই আছি।'
- 'শেষবার যখন পিকনিক হয়েছিল তখন তো তোকে দেখিনি সবাই আমরা বন্ধুরা আলোচনা করেছিলাম।ব্যাটা বিয়ে করে আমাদের ভুলে গেছে কিন্তু রাত্রেবেলা এরকম ভুতুড়ে আওয়াজ এদিক থেকে কেন আসছিল রে? বলে মনোজিতের দিকে তাকাতেই দেখি মনোজিৎ নেই। মনোজিৎ এই মনোজিৎ …… আবার কোথায় গেলি?
পাশের ঘরের পর্দাটা দুলছে দেখে মনে হল। নিশ্চয়ই ও পাশের ঘরে গেছে। পাশের ঘর থেকে আওয়াজ এল।
- 'বোস আসছি। পাশের ঘর থেকে আবার সেই ভয়ানক চিৎকার যেন আমার কান মাথা সব ফাটিয়ে দিতে লাগলো।
- কে? কে ওই ঘরে?'
একটা হিমেল স্রোত আমার রক্তের মধ্যে দিয়ে যেন চলে গেল। এক পা দু পা করে এগিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখলাম ঘরটা এখন অন্ধকার একটা পচা গন্ধ আমার নাকে এলো। মোবাইলের টর্চটাও জ্বালাবো হঠাৎ মনে পড়ল মোবাইলটা তো ওর ঘরের বারান্দায় গ্রিলের কাছে রেখে এসেছি।
ভয় মিশ্রিতভাবে করে ডাকলাম,মো মো মনোজিৎ …..মনোজিৎ !
মাকড়সার জাল আমার মুখে গলায় যখন স্পর্শ করল বুঝলাম এই ঘরে বহুদিন ধরে কেউ থাকে না। বাইরের ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করলাম ঘন অন্ধকারে ঠিক বুঝতেও পারলাম না কোন দিকটা দিয়ে এসেছি।
চিৎকারের ঘনঘন আওয়াজ আমায় পাগল করে দিচ্ছিল। দৌড়ে বাইরের ঘরের দিকে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এরপর যা দেখলাম তা দেখে আমার চোখ যেন বিশ্বাসই করছিল না। একটু আগে যে ঘরটাই আমি বসে ছিলাম সেই ঘরটাতেই মনোজিতের পচা গলা দেহ ঝুলছিল ফ্যান থেকে। আমার হৃদপিণ্ডটা শরীর থেকে যেন বেরিয়ে আসছিল। দৌড়ে যখন ২৬৩ নম্বর থেকে ছুটে আসছিলাম। কেউ যেন বারবার আমার হাত পা ধরে টানার চেষ্টা করছিল বাকিটা আর আমার মনে নেই।
পরের দিন অচৈতন্য অবস্থা থেকে গাড়ির সামনে আমায় বাপটু ঘরে তুলে নিয়ে যায়। মনোজিতের সেই আর্তনাদ তখনও যেন বুকের মধ্যে বাজছে।
- 'এখন কেমন লাগছে' বাপটু একটু প্রশ্ন করে।
- 'আমি মানে এখানে…….' বাপটু বলল,
- 'কাল তুমি মেলায় যখন বললে না মনোজিৎ নামটা তখন আমার যেন কেমন অস্বাভাবিক লেগেছিল। কিন্তু পরে যখন দিদির কাছে শুনলাম মনোজিৎ বলে তোমার কোন বন্ধু ছিল, তাতে এটা বুঝেছিলাম ২৬৩ নম্বরে যে মনোজিৎবাবু যিনি আগের অগাস্ট মাসে সুইসাইড করেছিলেন তা আর কেউ না তোমারই বন্ধু। ওর স্ত্রীর সঙ্গে স্থানীয় এক ছেলের সম্পর্কের জেরে ওর স্ত্রী পালিয়ে যায়। প্রথমদিকে বেশ কিছুটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। একা বাড়িতে খুব চিৎকার করত। পরে একদিন সামনের ঘরটাতে ও সুইসাইড করে। প্রায় এক সপ্তাহ পরে ওর পচা গলা দেহ পুলিশ উদ্ধার করে।
তোমার বহুদিনের বন্ধু তো …… চিত্তরঞ্জনে এসে সেই বন্ধুই তোমায় তার অবস্থা দেখিয়ে দিল।'
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। আরো একটু রেস্ট নেওয়ার কথা মানি বাপটু সবাই বললেও কাজের তাড়াতে দুপুরে খাওয়ার পর কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ডান হাত নেড়ে টাটা- বাই করছে যখন তিরি ; জেমো……
গাড়ির বাঁদিকের মিররে আবছাভাবে ২৬৩ নম্বর কোয়াটারটি দেখলাম। খোঁজার চেষ্টা করলাম মনোজিত বোধ হয় হাত নাড়ছে আমাকে। হালকা স্পিডে গাড়ি এগিয়ে চলল কলকাতার উদ্দেশ্য। মনে রয়ে গেল হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর স্মৃতি। মনোজিৎ না ফেরার দেশে ভালো থাকিস ভাই।
ইগুয়াজু ফলস্ -
সপ্তম আশ্চর্যের এক
যশ চক্রবর্তী
শিকাগো, ইলিনয়
ভ্রমণ




জল। আরও জল। যতদূর চোখ যায় শুধুই জলরাশি। জলরাশির পতন। জলোচ্ছ্বাস। শব্দগর্জন সমন্বিত। বিন্দু বিন্দু জলের ঘন বিম্বে চারিদিক জলকুয়াশায় আচ্ছন্ন। আচ্ছন্নতার আঁচ হালকা হাওয়ায় এসে মৃদু ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের মুখ, মাথার চুল, গোটানো জামার হাতার পর উন্মুক্ত বাহুদ্বয়। মাথা তুলে তাকালে - ওপর থেকে নেমে আসছে জলধারা। মাথা নামিয়ে তাকালে - ফুট ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে জলসম্ভার। হাঁটছি তো হাঁটছি। মনে হচ্ছে জলের দেশে আছি। জলের দেশে বাস।
হাঁটলাম দু'দিন। দু'দেশে। প্রথম দিন ব্রাজিলে। দ্বিতীয় দিন আর্জেন্টিনায়। মাঝে ইগুয়াজু নদী। ছুঁয়ে যাওয়া স্বল্প শীতের আমেজ, মিঠে রোদ্দুর, যত্র তত্র ছড়িয়ে থাকা রামধনু, ছিটকে আসা জলের দানায় আলতো ভিজে যাওয়া - গোটা ব্যাপারটার মধ্যে নৈসর্গিক এক সৌন্দর্য্যায়ন।
এই জলরাশির নাম ইগুয়াজু ফলস্। ইগুয়াজু জলপ্রপাত। সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। পৃথিবীর বৃহত্তম জলপ্রপাত। নায়াগ্রা ফলস্ এর থেকেও উঁচু, ভিক্টোরিয়া ফলস্ এর থেকেও চাওড়া।
হাঁটছি। ব্রাজিলের দিক থেকে দেখছি ইগুয়াজু ফলস্। মুগ্ধনয়নে। মাঝে মাঝে থামছি। থামতে বাধ্য হচ্ছি। এই সৌন্দর্য্য মিস্ করবো কী করে! চলে গেলেই তো হারিয়ে ফেলা। হয়তো জীবনে দ্বিতীয়বার এখানে ফিরে আসা হবে না। লুকাস ডাভিচিনো, আমাদের ট্যুর ম্যানেজার, ফাটা রেকর্ডের মতো বলেই চলেছে
- এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িও না। ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম হিয়ার। দিস আর নট গুড স্পটস্।
লুকাস পাশের দেশ আর্জেন্টিনার লোক। অসম্ভব মেসির ফ্যান। ব্রাজিলের ওপর নির্ঘাত জাতক্রোধ। তাই হয়তো বলেই চলেছে এই জায়গাগুলো বাজে, ফালতু। শেষে ওকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম
- কী সব ভিউ বস্। ছবিটবি তুলি। দাঁড়াতে বারণ করছো কেনো?
মুচকি হেসে লুকাস বললো
- বেটার স্পটস আর কামিং নেক্সট। ট্রাস্ট মি। তখন আমিই তোমাদের ছবি তুলে দেবো।


যাক, ব্যাপারটা তাহলে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার মধ্যে আর্চ রাইভালরি থেকে নয়। যতো এগোচ্ছি, লুকাসকে বিশ্বাস করতে আরও ভালো লাগছে। কতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাবলার মতো এমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছি যে ছবি তুলতেই ভুলে গেছি।
পরদিন ইগুয়াজু নদীর অন্য পাড়ে, আর্জেন্টিনার দিকে যখন হাঁটছি, ঠিকই করে নিয়েছিলাম লুকাসকে আর অমান্য নয়। করিও নি। একের পর এক নয়নাভিরাম সব দৃশ্য। ঘণ্টার পর ঘন্টা আটকে থাকা যায়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে, কিন্তু সময় এগোয় না।
বেসাল্ট পাথর ভেঙে দুই ধাপে বিভক্ত জলপ্রপাত। কোথাও উচ্চতা ২০০ ফুট, কোথাও ৩০০ ফুটের কাছাকাছি। একটা দুটো নয়, প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে সব মিলিয়ে ২৭৮ খানা জলপ্রপাত। বর্ষার সময় সেই সংখ্যা ৩০০ পেরিয়ে যায়। দৈর্ঘ্যও তখন চার কিলোমিটার পেরিয়ে যায়। ফুলে ফেঁপে ওঠে ইগুয়াজু। ছবি বা ভিডিও তুলে ইগুয়াজু ফলসের বিশালতাকে ধরা সম্ভব নয়।
নদীর দু'দিকে ইগুয়াজু ন্যাশনাল পার্ক। সাবট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট। ফওনা ও ফ্লোরার ঘন জঙ্গল। টিয়া, টুকান, ট্যানেজরের মতো নানা প্রজাতির পাখিদের এখানে উড়ে চলা এক গাছ থেকে আরেক গাছে। টেপার, হাওলার মাংকি, জায়ান্ট অ্যান্তিটার, হরিণ, কুমির, আরও অনেক জন্তু জানোয়ারদের সেখানে বসতি। শুনলাম (জায়গায় জায়গায় ছবিও দেখলাম) ভাগ্যে থাকলে লেপার্ড, জাগুয়ারদের দেখতে পাওয়া এখানে অস্বাভাবিক নয়। ভাগ্যিস, মুখোমুখি তাহাদের সাক্ষাৎ হয় নাই। জানিনা সেটা সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য, সাক্ষাৎ হলে ভাগ্যের কোনদিকে আমরা পড়তাম!
তবে সৌভাগ্যের দিকেই মনে হয় পড়েছিলাম। তার কারণ বহু। রেইনফরেস্ট ওই দুটো দিন ছিলো বৃষ্টিহীন। চড়াই উৎরাই, সিঁড়ি ভাঙা, লোহার ফুটব্রিজ বা পাথরের রাস্তায় হাঁটা, এতো কিছুর মধ্যে হাঁটু যুগল ঠিকঠাক ছিলো। শীত সেখানে সবে দরজায় কড়া নাড়া দিয়েছে, হিমিউডিটির কোনো বালাই নেই। এতো হাঁটাহাঁটি, তবু হাঁসফাঁস নেই - যাত্রাপথ গলদঘর্মহীন। লুকাসের সঙ্গে দু'দিন লম্বা সময় ধরে আর্জেন্টিনার স্কুল সিস্টেম, মুদ্রাস্ফীতি, বাচ্চাদের বড়ো হওয়া, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অবশ্যই ফুটবল নিয়ে আলোচনার সুবর্ন সুযোগ। এগুলো না হলে ইগুয়াজু ভ্রমণ হয়তো বেশ কঠিন হয়ে যেতো।
নতুন কোনো দেশে যাওয়া মানে সেখানে জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু সেলফি তুলে নেওয়া নয়, চেষ্টা করি যতোটা পারি সেখানকার ইতিহাস জানার, জীবনযাত্রা দেখার, গল্পগাঁথা, জনশ্রুতি শোনার, স্থানীয় সাধারণ মানুষদের সঙ্গে আড্ডায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার। এগুলোই সঞ্চয়। রোমাঞ্চকর।
ইগুয়াজু ফলসের সেই রোমাঞ্চে এবার সামিল হোলো নতুন সম্পর্কের বীজবপন। লুকাস, রাফায়েল, নিধি, ডঃ অ্যালিসিয়া, মিস্টার ও মিসেস হোয়াইট ... আড্ডায়, গল্পে, ব্রাজিলিয়ান কফির সুবাসে, আর্জেন্টিনীয় মাতে-র চুমুকে, একসঙ্গে পা মেলানোয় উষ্ণতর হয় সম্পর্কের বুনোট।
দেশ বিদেশ ভ্রমণে এগুলোই তো বাড়তি পাওনা। বাসু পিসেমশাই বলতেন - তাঁতি হ, তাঁতি। সেই চেষ্টাতেই আছি। তাঁতি হওয়ার। সম্পর্কের বুনোটকে শক্তপোক্ত করার। দীর্ঘ করার। ইগুয়াজু ফলসের মতো।

ছোট গল্প
বিধবা
এহিয়া আহমেদ
বরথল কছারী গাঁও, মরিগাঁও, আসাম

শীতকাল। চারপাশে কুয়াশার চাদরে ঢাকা গ্রাম। সকালে সূর্যের আলো কুয়াশার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। পুকুরের ধারে শাপলার পাশে বসে আছে রূপা। রূপা—চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ, বয়স ত্রিশের কোটায়। একসময় তার হাসি ছিল এলাকার আলো। এখন যেন সব হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে।
দুই বছর আগে তার স্বামী অভীক তাকে ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। অভীকের সঙ্গে তার বিয়েটা ছিল ভালোবাসার। ছোটবেলার বন্ধু, তারপর প্রেম, তারপর বিয়ে। কিন্তু হঠাৎ একদিন অভীক অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসার জন্য শহরে নেওয়া হলেও, শেষমেশ অভীকের জীবন বাঁচানো গেল না।
তখন থেকে রূপার জীবন একধরনের শূন্যতায় ভরা। গ্রামে অনেকেই বলেছে, "বিধবার জীবন এমনই। তাকে তো আর নতুন কিছু আশা করা মানায় না।" রূপার শাশুড়ি তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, "মেয়ে, তুই আবার নতুন জীবন শুরু কর। আমরা তোকে বেঁধে রাখব না।"
কিন্তু রূপার মনে হয়, সে যেন জীবনের এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি। গ্রামের মেয়েদের জীবন এমনিতেই কঠিন। তার ওপর বিধবা হওয়া যেন আরও বড় শাস্তি।
একদিন পুকুরপাড়ে বসে থাকতেই পাশের গ্রামের শিক্ষক রাজীব এসে বলল, "রূপা, আমি জানি, তোমার কষ্টের শেষ নেই। কিন্তু তুমি জানো কি? তোমার হাসিটা শুধু তোমার নয়, এই গ্রামটারও দরকার।"
রূপা মাথা তুলে তাকায়। রাজীবের চোখে-মুখে ছিল আন্তরিকতার ছাপ।
"তুমি যদি ইচ্ছা করো, আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। আমাদের স্কুলে একজন শিক্ষিকা দরকার। তুমি যদি পড়াতে চাও, তোমার জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে।"
রূপা প্রথমে দ্বিধায় ছিল। কিন্তু পরের দিন স্কুলে গিয়ে রাজীবের কথাগুলো মনে করে সাহস নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলল।
ধীরে ধীরে স্কুলে পড়ানোর কাজ, শিশুদের হাসি, আর নতুন দায়িত্ব রূপার জীবনের শূন্যতা ভরিয়ে দিতে থাকল। গ্রামের লোকজনও বদলাতে শুরু করল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
একদিন রূপা পুকুরপাড়ে বসে রাজীবকে বলল, "তোমার দেওয়া সাহসটা না থাকলে হয়তো আমার জীবন আজও থেমে থাকত।"
রাজীব মৃদু হেসে বলল, "জীবন থামে না, রূপা। আমরা শুধু সাহস খুঁজে পাই না। তোমার জীবনের গল্পটা এখন গ্রামের মেয়েদের জন্য এক উদাহরণ।"
রূপা আকাশের দিকে তাকায়। আজ সূর্য যেন আরও উজ্জ্বল। তার মনে হয়, বিধবা হওয়া মানেই সব শেষ নয়, বরং এটা এক নতুন জীবনের শুরু।
গল্পের বার্তা:
জীবনের প্রতিকূলতা আসবেই। কিন্তু সাহস, ভালোবাসা আর নিজের শক্তিতে ভর করে জীবনের নতুন পথ খুঁজে নেওয়াই হলো সাফল্যের আসল রূপ।
দীপাঞ্জনা
সঞ্জীব চক্রবর্তী
হিন্দুস্তান রোড, কলকাতা
গল্প

হঠাৎ দেখা
সবুজে ডুবে থাকা ছোট্ট পোড়া লাল রঙা বাড়িটা। মাধবী লতার ঝালর ঢাকা সাদা কাঠের ফটক। নাটকের গা ঘেঁসে নীলকণ্ঠ ফুলের সাজি নিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কালের পুরনো জ্যাকারান্ডা।
রাধাচূড়ার হলুদ ফুলের আলপনা আঁকা কালো পিচের সরু রাস্তাটা চলে গেছে কলা ভবনের দিকে। দূর থেকে প্রথম দেখেছিলাম - মাধবী লতার ঝালরে মোড়া ফটক পেরিয়ে পিচের রাস্তা ধরে মেরুন রঙা ছাতা মাথায় তুই চলেছিস সেই পথে। এ কি দেখলাম ---কলেজের মাস্টার মশাইদের অবোধ্য অনেক বিশ্লেষণের জীবন্ত উদাহরণ --
“তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্টী মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ”।
অগ্নি স্নাত উজ্জ্বল বৈশাখী রোদের ছাতা চোঁয়ানো লালের আভায় তোর উজ্জ্বল শ্যাম স্বেদাক্ত মুখে প্রতিফলিত হচ্ছিল অজন্তা গুহায় বৌদ্ধ চিত্রকরের স্বপন চারিণী কোন নশ্বর রাজরানীর অমর প্রস্তর চিত্রের প্রতিচ্ছবি। শ্রমণ চিত্রকরের স্বপ্ন জড়িয়ে গেল আমার চোখে।
পরে জেনে ছিলাম নতুন এসেছিস কলা ভবনে। আলাপের পরিস্থিতি খুঁজে ফিরতাম --তবে টের পেলাম ওই শান্ত সৌন্দর্য ঘিরে আছে অলঙ্ঘ্য অদৃশ্য বলয়। বহ্নি বিবিক্ষু পতঙ্গরা সেই অদৃশ্য বলয়ে বাধা পেয়ে মরে।
প্রথম আলাপ
স্নাতকোত্তর শেষ বছর। শান্তিনিকেতনের দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার পালা। বছর শেষে ঝাঁপ দিতে হবে জীবন জোয়ারে। ঠিক হয়েছিল কলা ভবনে কবিগুরুর জন্মদিনে শাপমোচন মঞ্চস্থ হবে। আয়োজনে ছিলাম আমি। পালা করে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হল রিহার্সাল। তোকে দেওয়া হল কমলিকার চরিত্র। সেই প্রথম আলাপ। আলাপের আদিতে নাম জানা খুবই জরুরী। নাম জানলাম – রঞ্জনা। জোর কদমে রিহার্সাল শুরু। একটি দায়িত্ব পেয়েছিলাম, রিহার্সালের পর ফেরার পথের নির্জন রাস্তাটা তোকে পার করে দেওয়া। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়, হরেক ফুলের মৃদু গন্ধ ছড়ান রাস্তায় সাইকেল ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে তোকে বাড়ি পৌঁছে নিজের পথ ধরতাম। মনে হয় তোর মনের আগল সেই সময় ভাঙতে শুরু করেছিল। সবাই চিন্তিত ছিলাম এই অল্প সময়ে মঞ্চ সাজানোর ফুল যোগাড়ের সমস্যায়। তখন জানিয়েছিলি তোদের বাগানের ফুলের খবর। ভয় দেখিয়ে ছিলিস বাঘের মত ওত পেতে বাগান পাহারায় থাকে তোর দাদু। তোর প্রশ্রিত হাসির ভরসায় এক বিকেলে তোদের বাড়িতে এলাম ফুলের আশায়। ভয় ভয়ে ভিতরে আসি। বারান্দায়, পাশের বাড়ির ছোট দুটো ছেলে মেয়ে সঙ্গে ইকিরমিকির চামচিকির খেলায় তুই তখন ভয়ানক ব্যস্ত। বাঘা দাদু বসেছিলেন বাগানের ধারের বারান্দায় এক আদ্যিকালের চেয়ারে। দাদুর সবই ছিল বিশাল। চেয়ার, শরীর, মাথার টাক, পাকা গোঁফ ও তীক্ষ্ণ ঘূর্ণায়মান আঁখি যুগল – বাঘই বটে। কার সাধ্য বাগানের ফুল চুরি করে। কিন্তু বাঘা দাদুর গাম্ভীর্যের খোলস সরে গিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা এক মানুষের। তাঁর ভরাট গলায় রবীন্দ্র কবিতা পাঠ, শান্তিনিকেতনের পুরনো মজাদার গল্প, কমলিকা চরিত্রে তোর মহড়ার বর্ণনা শুনে বাঘা দাদুর প্রাণ খোলা হাসি। সঙ্গে ছিল মাসিমার তৈরি ডিম ভাজা, মালপো। সেই সন্ধ্যা কখন রাত ছুঁয়েছিল জানতে পারি নি। তোর চোরা কটাক্ষের স্মৃতি আর দাদুর ফুলের আশ্বাস নিয়ে ফিরলাম।
তারপর?
“ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি ---”
বৈশাখে কোন একদিন শুরু হয়েছিল পথ চলা ----। চারিদিক তখন জীবন সমুদ্রের সুগন্ধি সফেন।আঁকাবাঁকা কোপাই এর মজা জলে পা ডুবিয়ে তোকে দেখেছি তপ্ত অপরাহ্ণে। জ্যৈষ্ঠের অস্তগামী সূর্যের গোধূলি আলোয় দেখেছিলাম তোর স্বপ্ন ভাসা চোখ। সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাসের বনে- বৃষ্টি ভেজা আষাঢ়ে বাতাসে পথ হারিয়েছি উঁচু নিচু ভুলভুলাইয়া খোয়াই এর প্রান্তরে। শ্রাবণের দামাল বৃষ্টি যখন মিলেছিল লাল মাটির বুকে, তোর মনের আগল গেল সম্পূর্ণ মুছে--- বৃষ্টি ভেজা শরীরী অধৈর্যতার মাঝে বলেছিলি – ‘দীপ দা-এতো দিন কোথায় ছিলে?’
শরতের বাতাস কাশের বনে নিয়ে এসেছিল আগমনীর সুর – আশ্বিনে সাঁওতাল পল্লীর ঢাক মাদলের বোলে নেচে উঠেছিল তোর শরীর – আমার মন।
এরপর? এরপর – বাতাস জানান দিল হেমন্তের। দিনের শেষে হিম ভেজা ছাতিম ফুলের গন্ধ মেখে শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যা নামে।
ডাক আসে মুম্বাই থেকে। বসতে হবে চাকরির পরীক্ষায়।
কলেজের পরীক্ষা মিটতেই ছুটি কোলকাতায় মুম্বাই মেল ধরতে। বোলপুরে ট্রেন ছাড়া অবধি দাঁড়িয়ে ছিলি। কথা ছিল চাকরির পাকা খবর এলেই যাব তোদের বাড়ি। তোর বাষ্পীয় চোখে কিছু কথা যেন বাকি রয়ে গেল। বলেছিলিস ইমেলে চোখ রেখ।
তোর না বলা কথায় মনে ধন্দ নিয়ে পাড়ি দিলাম পশ্চিম সাগর পারের অচেনা শহরে।
“হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায় ---”
ঝড়ের মত এক সপ্তাহ কেটে গেল মহার্ঘ চাকরির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায়। ফোন করা যায় নি কারণ মুঠো ফোনে ছিল বাঘা দাদুর চরম অনীহা। সু-খবর পেলাম – রাত তখন অনেক। চাকরির খবর আর ফেরার দিনক্ষণ জানাতে ইমেলে খুলে চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বোলপুর স্টেশনে তোর না বলা কথার ধন্দ ঘুচে গেল। বাঘা দাদু তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। পৃথিবীর রঙ সব মুছে গেল। থাকে শুধু আরব সাগরের অন্ধকার।
তোর দোষ নেই। মাঝ রাতে অনেকটা পথ পেরিয়ে চলে গেছিলাম জুহু সৈকতে। চারিদিকে তখন জীবন সমুদ্র ফেনিল গরল। রাত আর ভোরের সন্ধিক্ষণে জীবনের নতুন অধ্যায় মনে প্রশ্ন জেগেছিল কে আমি - ? পাই নি উত্তর। ফিরে এসেছিলাম স্বত্তাহীন নতুন জীবনে।
বহু দিন চলে গেল। সময় কাটাতে চলে যেতাম জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি। বেশি সময় পেলে – পাড়ি দিতাম ঔরঙ্গাবাদ হয়ে অজন্তার গুহায় গুহায় – খুঁজতাম হাজার বছর আগে শ্রমণ চিত্রকরের সৃষ্টি কোন রাজমহিষীর অবিনশ্বর গুহা চিত্র যার প্রতিফলন দেখেছিলাম তোর মুখে কোন এক বৈশাখী তপ্ত দুপুরে।
পাঁচ পাঁচটা বছর পার হয়ে গেল – আর ফেরা হয় নি শান্তিনিকেতনে।
আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয় .....
দিনটা ছিল শনিবার। পশ্চিমী শহরের দীর্ঘ অপরাহ্ণ। অলস পায়ে জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে ঘোরা ফেরার পর কাছের ক্যাফের এক কোনে না- ছোঁয়া কফির কাপ নিয়ে বসে ছিলাম। নিরুৎসুক দৃষ্টি ছিল ক্যাফের কাঁচের দরজায়। হঠাৎ সারা শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে– দু হাতে ঘন ঘন চোখ মুছি – পাঁচ বছর আগে শেষ দেখা সেই পরিচিত দেহ ভঙ্গী, তখন সে এসে বসেছে কাঁচের দরজার কাছে। রহস্যময়ী মনের কারসাজিতে বোধ হয় দৃষ্টি হয়েছিল অস্বচ্ছ। আবছা প্রতিবিম্ব ভাসে ক্যাফের দরজার কাঁচে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। এগিয়ে যাই দরজার দিকে। আড় চোখে দেখি কফির কাপে মাথা ঝুঁকিয়ে বসা মানুষটিকে-
“আরে দীপ দা?” তোর গলার স্বরে চোখের বিভ্রম মুছে গেল। তবে মনের ভিতর সযত্নে সাজানো ছবিটা চুর চুর হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছিল। একি চেহারা হয়েছে তোর ! সমুদ্রের তরঙ্গ দোলায় গা ভাসান প্রাণবন্ত নৌকা - এখন তার ভাঙা চোরা কঙ্কালসার দেহটা লোকচক্ষুর আড়ালে কাত হয়ে পড়ে আছে বালি চরে। নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে যায় ক্যাফের অভ্যন্তরের কলতান। অতীতের কবিতা হারিয়ে গেল।
কিছু সময় যায় অবান্তর কথায়। শেষে তোর মনের আগল খুলে গেল। গত পাঁচ’বছরের জমানো মনের কথা বাঁধ ভাঙা জলের মত বেরিয়ে আসে। শুনলাম বাঘা দাদুর জবরদস্তির কাছে হার মেনে
তাঁর ঠিক করা কুন্তলের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতে হয় তোকে। পরে বুঝতে পেরেছিলি বিশাল চাকরি করা কুন্তল মাদকাসক্ত। প্রথমে মানসিক পরে ক্রমবর্ধমান শারীরিক নির্যাতনে দিশাহারা হয়ে আইনি বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিস। এখন চাকরি হারা কুন্তল নেশা মুক্তি কেন্দ্রের পাকাপাকি বাসিন্দা। আরো জানলাম বাঘা দাদু আর নেই, তুই চলে যাবি মুম্বাই ছেড়ে।
স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিলাম। বুঝতে পারি তোর অসহায়তা। এই জগদ্দল পাথরের ভার লাঘব কি ভাবে সম্ভব বুঝে উঠতে পারি নি – সঙ্কোচ কাটিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এক সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যাক বাকি জীবন – কিন্তু তুই অদ্ভুত হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলি সেই প্রস্তাব। তবে বলেছিলি “সামনের সপ্তাহে চলে যাব - চল তোমার সেই বৌদ্ধ চিত্রকরের গুহা চিত্র দেখে আসি।” অস্বস্তি জড়ানো আনন্দিত মনে রাজি হয়েছিলাম। ছুটি নিয়ে দু’জনে পৌঁছে গেলাম অজন্তায় – দু’দিনের বাসা বাঁধালাম অশ্বখুরাকৃতি গুহা পাহাড়ের কাছে।
কিন্তু কোথায় পাব সেই নশ্বর নারীর অমর প্রাচীর চিত্র? পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম খাড়া পাহাড়ে পাথর খোদা গুহাগুলির উদ্দেশ্যে। তোর অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করি - যেন তুই ফিরে গেছিস সেই পাঁচ বছর আগের জীবনে। হাজারো প্রশ্নে আমি নাস্তানাবুদ। তোর মানসিক চাপে কালো হওয়া মুখে লেগেছিল রঙের ছোঁয়া। গুহা চিত্র দেখাটা নেহাতই ছিল তোর অজুহাত! না - ভোলা তোর সেই চোখের, প্রাণের কথাগুলো আবার যেন মূর্ত হয়ে উঠল। তুইও বোধ হয় এই স্বল্প কিছু পাওয়া সময়ের সম্পূর্ণ নির্যাস নিংড়ে বার করে নিতে চেয়েছিলি। গিরি প্রাকারের মাথায় মাথায় ছড়ানো সবুজের গায়ের আলো ম্লান হয়ে আসে। তোর ফেরায় মন ছিল না। চলে গেছিলাম কাছের ভিউ পয়েন্টে। বসে ছিলাম রুক্ষ পাথরের পাঁচিলে। নিচের গিরি খাতে ওয়াঘার নদীর প্রায় শুকনো খাত অন্ধকারময়। পাথর চুঁইয়ে পড়া ঝোরার ক্ষীণ শব্দ। তুই একেবারে নিশ্চুপ, গভীর চিন্তায় মগ্ন। স্বপ্নাচ্ছন্ন রাত গভীর হয় .....। বেশ রাতে ফিরে এলাম আস্তানায়। কাল থেকেই আবার চিরতরের বিচ্ছেদ। ফিরেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেছিলি। তোর কাছে যাওয়ার স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে। অস্বস্তির বোঝা ভারি হয়ে ওঠে। দাঁড়ালাম সামনের লম্বা বারান্দায়। অশ্বখুরাকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন পাহাড়ে ঝরে পড়ে একটা দুটো উল্কা। ঘরে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আধো ঘুম ভাঙে দরজায় টোকার শব্দে। দরজা খুলতে দেখি প্রায়ান্ধকার গিরি পর্বতের পটভূমিতে তোর সিলুয়েট। আমার বুকের মাঝে ঝাঁপিয়ে, গভীর আবেগে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লি।
তারপর? ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। উঠে তোকে পাশে দেখতে পাই নি তবে শয্যায় ছড়িয়ে ছিল তোর চিহ্ন -। সন্দেহ কেটে গেল। বোধ হয় গত রাতটা ছিল অসম্ভব এক স্বপ্নের। – তোর ঘরে যাই - দেখি খালি ঘর। চলে যাই লজের রিসেপশনে। শুনলাম রাতেই গাড়ি ঠিক করে ছিলিস ভোরে এয়ারপোর্ট পৌঁছনোর জন্য। ঘরের টেবিলে আমার নাম লেখা একটি খাম চোখে পড়ে। মাথার ঠিক ছিল না। খামটা পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
সূর্য তখন মধ্য গগনে। দু ধারে গিরি প্রাচীর। শেষ প্রান্তের প্রাচীরের গায়ে একটি পর্যটক শূন্য ভাঙা চোরা গুহা। অন্ধকার গুহায় কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সামান্য কিছু গুহা চিত্রের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুহার সামনেই গিরি শ্রেণীর মাঝে অতলস্পর্শী খাদ। অনেক নিচে দেখা যায় ছোট বড় পাথর ছড়ান নদী খাত।
গত তিন দিন অনুভব করেছি আমার ভিতরে যেন বিপ্লব ঘটে গেছে। এই বিপ্লব আমার শিরায় শিরায় উঠিয়ে ছিল বিষের স্রোত। সেই তীব্র বহতা বিষাক্ত অন্ত: স্রোত একান্তই আমার- রঞ্জনার কোন সম্পর্ক নেই। মধ্য দিনের তাপ, রুক্ষ পাথরে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কাল রাতে হঠাৎ মনের গহনে চাপা অগ্নুৎপাতের বিষাক্ত লাভা লেপে দিয়েছিল এক অপাপ বিদ্ধ শরীরে। মনের এই পাপ কি লুকিয়ে ছিল সেই “প্রথম দেখা”র দিন থেকে?
আর সহ্য করতে পারলাম না। দু পা এগিয়ে দাঁড়ালাম খাদের ধারে। তাকিয়ে থাকি বহু নিচের নদী খাতে। তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি গভীরতার। সম্মোহিত অবস্থায় টের পাই পকেটের আমার নাম লেখা সাদা খামের অস্তিত্ব। কৌতূহলী মনের টানে ফিরি প্রায়ান্ধকার গুহায়।
থর থর আঙুলে খামের ভেতরের কাগজে দেখি সন্মোধনহীন কিছু লেখা .......৷
“সে দিন বলেছিলে – চল জীবনটা আবার আরম্ভ করি এক সাথে। শরীর মন কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু নিজের দুর্বলতা চাপা দিতে হেসে উঠেছিলাম। একটা ব্যর্থ জীবন তোমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে চরম অন্যায়। সেই তো এক গুচ্ছ মন্ত্রের মৌখিক শপথ। জীবন দিয়ে টের পেয়েছি তার অসারতা। সেই সময় মনের ভিতর আনাগোনা করেছিল - দুটো আলাদা স্বত্তা এক হয়ে আর একটি পবিত্র তৃতীয় স্বত্তার যদি সৃষ্টি হয় – ক্ষতি কি?
তোমাকে আমার সাথে চির জীবনের মত জড়িয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। বাকি জীবনটা তুমি সাথে না থেকেও, আমার জীবনসঙ্গী হবে। চাক্ষুষ দেখা আর নাই বা হল।”
পরিত্যক্ত গুহার পাষাণ প্রাচীরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দিনের আলো নিভে আসে। ফিরে গেলাম মুম্বাই শহরে।
“সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার তুমি ”
দু দশক পেরিয়ে গেল। নিঃসঙ্গ জীবনে ক্লান্তির ছায়া পড়ে। দেহ মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে রঞ্জনার স্মৃতি – অজন্তার সেই দুটো দিনের কথা। কোথায় সে আছে জানার সুযোগ পাই নি। মন বলে – অনেক তো হল! এবার ফিরে যাই আমাদের শান্তিনিকেতনে।
চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলাম। আমাদের সব হতে আপন, পুরনো শান্তিনিকেতন খুঁজে পেলাম না। শেষে ডেরা বাঁধালাম শহরের উপকণ্ঠে। আমার ছোট্ট বাড়ির প্রবেশ পথের দেওয়ালে লেখা থাকল -- তৈত্তিরীয় উপনিষদের একটি ছত্র:
“”সত্যাত্ম প্ৰাণাৰামং মন আনন্দং””
২৫শে বৈশাখ এসে গেল। কাগজ বিলি করা ছেলেটি বলে কলা ভবনে মঞ্চস্থ হবে ‘শাপ মোচন’ নৃত্য নাট্য।
এক ঝাঁক পুরনো স্মৃতি নিয়ে সেই দিন বিকেলে হাজির হলাম কলা ভবনে।
মুগ্ধ চোখে দেখছি কত বছর আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। বেশি আকর্ষিত করে কমলিকা চরিত্রে নৃত্যরতা মেয়েটি। অবাক চোখে বিভ্রম জাগে – হুবহু মিল খুঁজে পাই কত বছর আগের কমলিকা চরিত্রের সাথে। ভিড় সরিয়ে এগিয়ে যাই মঞ্চের সামনে। বিস্মিত হই – মনে হল মেয়েটি আমার পরিচিতা! ভেবে উঠতে পারি না – এত মিল কি ভাবে সম্ভব! ভবনের বাইরে এসে ঠিক করি অনুষ্ঠানের শেষে –আলাপ করব। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে – দূর থেকে দেখি মেয়েটি আসছে সঙ্গে এক বয়স্কা মহিলা। একটু আলো অন্ধকারে কাছে আসতে চমকে উঠি মহিলা কে দেখে – আরে .... ! বয়সের ছাপ পড়ে কত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে থাকা কমলিকা চরিত্রের মেয়েটি কে? তার চলা ফেরার ভঙ্গিমা, মুখ আমার অতি পরিচিত। দ্রুত পা’য়ে এগিয়ে যাই। থমকে দাঁড়ায় রঞ্জনা – এক লহমায় খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে তার চোখ মুখ – কবে এলে? কেমন আছ? উত্তর দিয়ে মেয়েটিকে দেখে, ফিরে তাকাই রঞ্জনার দিকে। আমার চোখের প্রশ্ন বুঝে স্মিত হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে “আমার মেয়ে দীপাঞ্জনা”-- কয়েকটি পা এগিয়ে আর একবার ফিরে তাকিয়ে - রঞ্জনা হারিয়ে গেল মঞ্চ থেকে ফেরা জনতার ভিড়ে।
ফিরে আসি আমার গাছ গাছালি ঘেরা ছোট আস্তানায়।
বারান্দায় বসে চেয়ে থাকি আকাশের দিকে। দূর আকাশে এখনো দেখা যায় বিশাখা নক্ষত্র। রাত হয়ে উঠেছে গভীর। রহস্যময়ী মন অকারণে হয়ে উঠেছে প্রফুল্ল। মনের মাঝে ভেসে ওঠ ----
‘আমার প্রাণের আরাম- মনের আনন্দ- আত্মার শান্তি।’
গল্প
লেক গার্ডেন্স, কলকাতা

বেশ কয়েকটা ফুচকা সাঁটিয়ে বুজুর তখন বেশ ফুরফুরে ভাব। আরো গোটা দুই শাল পাতার ঠোঙায় নেবার আগে সবে তেঁতুলের বাকী জলটা সুরুৎ করে গালে দেবে - হঠাৎ চিনি দিদির এক হ্যাঁচকা টানে সুখস্বপ্নটা গেল কেঁচে। খুব বিরক্ত হয়ে সে কিছু বলার আগেই চিনি দিদি ফিস্ ফিস্ করে বলল,'বড় গলিতে ছবি দাঁড়িয়ে, তোকে ডাকছে। আজ পাশের পাড়ার সঙ্গে তোদের খেলা নাকি - তার টিমটা ফাইনাল করবে।’ বুজু তাড়াহুড়ো করে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে চোখমুখ না ধুয়েই চুপিসাড়ে পিছনের গলিতে হাজির হল। হাজির তো হতেই হবে - ছবি ওর ক্লাস ফোর এর বেস্ট ফ্রেন্ড। আর মাঠেও ওকে ছাড়া বুজুর চলে না। বুজুদের বাড়ির উঁচু আর তিনদিক খোলা টানা বারান্দাওয়ালা বাড়ীর একদম শেষের দিকে ছোট্ট একটুকু গলির একপাশে পরপর রান্নাঘর, চানের ঘর আর এককোনে গোয়াল ঘর। রান্নাঘরের শেষ ধরে টানা দুমানুষ সমান উঁচু দেওয়াল। আরো কিছুটা এগিয়ে দেওয়ালটা সামনের ছোট বাগানের শেষ কোনা ধরে ঘুরে গিয়েছে। দেওয়ালের খালি অংশটা প্রায় সারা বছর ধরে ঘুঁটে দেওয়ার কাজে কাজে লাগে। রান্নাঘরটা পেরোলেই দেওয়ালটায় একমানুষ সমান উঁচুতে একটা ছোটমতো খোঁদল আছে। তাতে বুজুর মতো ছোটরা ইচ্ছে হলে আরামসে গলে যেতে পারে। খুব দরকারে বুজু বাড়ির বাইরে যাবার এই শর্টকাট ব্যবহার করে - তবে চুপি চুপি। আজও তাই পিছনের বড় গলিতে চোখের নিমেষে হাজির হতে তার কোন অসুবিধা হল না। খোঁদলটা গলে দিল একটা ছোট্ট লাফ। গলিতে নামার পর খেয়াল হল তাড়াহুড়োয় চপ্পলটা পড়া হয়নি। তবে টিম করার জন্য কাগজ পেন্সিল সবই নিয়ে আসবে ছবি, খুব গোছালো আর করিৎকর্মা ছেলে ও।
দুই বন্ধুই খেলাধুলাতে বেশ ভাল। বিশেষ করে নানা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার জন্য ওরা হামেশা ডাক পায়।
সেবার পাল পাড়ার নেতাজী সংঘ হঠাৎ চার দশ হাইট এর টুর্নামেন্ট এ তাকে ডেকে নিল। কিন্তু বাইরে মাপিয়ে দেখা গেল তার উচ্চতা আধ ইঞ্চি মত বেশী।
করিৎকর্মা ছবি এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করে ফেলল। ও চটকরে একটা বেল্ট বুজুর প্যান্টের ভেতর দিক দিয়ে একটা বিশেষ কায়দায় পরিয়ে রাম টাইট করে বেঁধে দিল। কি হলো ঠিক বোঝা গেল না - হাইট মাপার জায়গায় দেখা গেল মাপ পাক্কা চার দশ, মানে চার ফুট দশ ইঞ্চি। ‘বড়ো গলি”টা বেশ লম্বা চওড়া। হয়তো সে কারণেই এই নাম হয়েছে। গলি ধরে এগিয়ে গেলে একদিকে একটা বড় মাঠ। অপর দিকে বড় পিচ রাস্তা - বাস রাস্তায় পড়তে দু তিন মিনিট হাঁটা পথ । গলির পথ ধরে সেদিকে যেতে যেতে ছবি বলল, 'শোন, আজ আর বেশী সময় হাতে নেই, আটটায় ম্যাচ। টিম মোটামুটি তৈরি আছে।… আর শোন, আজ কিন্তু ফুটবল ম্যাচটা হবে না, আজ মিলন সংঘের সাথে হকি ম্যাচ নিয়েছি। তুই চট করে বাড়ী থেকে খেলার ড্রেসটা পরে মিলন সংঘের মাঠে আয়। ওখানেই হকি স্টিক পাবি। তবে তোর দাদার হকি স্টিকটা নিয়ে আসতে পারলে আরো ভাল। আমি ব্যাকে আছি, তুই সেন্টার ফরোয়ার্ড। ভাবিস না, জিতব আমরাই’।
বাড়ী ফিরতে বুজুর হঠাৎ মনে পড়লো হরিণঘাটার দুধ আনা বাকি। সেটা সেরেই তাকে আটটার মধ্যে মাঠে যেতে হবে। সকালের জলখাবার সেরে ‘বড় গলি’টা ধরে অল্প এগিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে এসে বাঁদিকে ঘুরতেই ছোট্ট, নামকরা ‘পলা’র ঘুগনীর দোকানটা পেরোল ও। এরপর সামান্য হাঁটলে ডান হাতে গাড়িবারান্দাওয়ালা বিশাল দালান বাড়ি বাস রাস্তার দিকে মুখ করে। এর একতলায় ছড়িয়ে বহু পুরানো আর বড় বাজার। দালানের বাইরের দিকে নানান দোকান। একটা ঘরে হরিণঘাটার দুধের বুথ।
কার্ডে সবই লেখা আছে, তবু রোজের অভ্যাস মত খালি বোতল দুটো আর কার্ডটা দিতে দিতে বুজু বেশ ভারিক্কিচালে বলল, 'একটা কাউ মিল্ক আর একটা বাফেলো মিল্ক, দুটোই হাফ লিটার।‘ আসলে বাংলার সাথে দুটো একটা ইংরেজি শব্দ থাকলে তার কথা বলতে বেশ মজা লাগে। একজন শুভ্রকেশ ভদ্রলোক বুথেই কার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। শ্যামলা, গোলগাল, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলের বুজুকে তার ভারী ভাল লেগে গেল। কিছুটা যেন খাতির জমাতেই বললেন,
'বলতো দাদাভাই বাফেলো মানে কী?’ মুহূর্তে জবাব এল,
'বাফেলো মানে মহিষ'।
'বাফেলো বানান তুমি জান?’
'হাঁ, এইতো', বুজু খুব একটা গর্বের সঙ্গে বলল,
'ঐ তো ,…. বি-ইউ-এফ-এফ-এ-এল-ও।‘ বয়স্ক লোকটি উৎসুকভাবে তার দিকে তাকাতে বুজু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যোগ করল,
'হাঁ ,হাঁ - , একদম শেষে একটা ডাবলু আছে'।
‘হাঁ বাবা, এতবড় বাফেলো - শেষে একটা ডাবলু থাকাই ভাল - কি বল?
'তা, তুমি কোন ক্লাসে পড়?' বুজুকে প্রশ্ন করায় মুহূর্তে জবাব এলো
'ক্লাস ফোর।‘
'খুব ভাল --- ঘরে গিয়ে একবার বইতে বানানটা দেখে নিও কিন্তু' – শুভ্রকেশী মৃদু হেসে নিষ্ক্রান্ত হলেন।
দুধ নিয়ে আসার পথে ক্লাসের সমীরের সাথে দেখা। জ্ঞানবাবু স্যারের ছেলে। ‘কিরে বুজু,’, সমীর বলল,
‘খবর জানিস তো?’
‘কী রে ?’ ‘আজ তো স্কুল ছুটি।‘
‘কীসের ছুটি,কাল স্কুলে কিছু বলল নাতো ?’
'আরে, নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দিয়েছে তো। তুই তো দেখলাম ড্রিল স্যারের ক্লাসটা শেষ হতেই ফুটবল নিয়ে মাঠে। গত পরশু স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছিলেন তো - তাই আজ ছুটি দিয়েছে।‘ - সমীরের এই খুশ খবরে বুজুও বেশ উদ্বেল।
কাল রথের ছুটি, পরশু রবিবার - দুধের বোতল দুটো একছুট্টে ঘরে রেখেই হকি মাঠে পৌঁছনো আশু প্রয়োজন,ভাবছিল বুজু। এতগুলো পরপর ছুটিতে কখন কি মজা করা যায় সেসব শলা করতে ছবিকে তার দরকার সবার আগে। আনমনে ঘরে ফেরার পথে একটা খটকা তার মনে মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে আসছিল ---- তবে কি বাফেলো বানানে কোনও ভুল হল? ----- ভাবতে ভাবতে চলার পথে হঠাৎ বাঁ হাত থেকে দুধের বোতলটা গেল পড়ে।
বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো আজ কপালে কি আছে কে জানে। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে সেটা তুলতেই বোঝা গেল বোতলটা অক্ষত। দেখল, একটা ছোট্ট বালির ঢিপির মত জায়গায় পরে বোতলের সিলটা পর্যন্ত খোলেনি।……আজ সকাল থেকে কেন যেন সবকিছু ভাল ভালই যাচ্ছে,
বারান্দার কোনে রাখা হকি শ্যু টা পরে, দাদার হকি স্টিকটা নিয়ে বুজু বেরোবে এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই ও দেখল একজন মাঝবয়সী লোক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। হাতে চ্যাপ্টা পিচবোর্ডের বাক্স, বেঙ্গিকে খুঁজছেন। কিন্তু মা’র ডাকনাম এ লোকটা জানল কী করে। মাকে ডাকতে যেতেই বুজুকে তিনি থামালেন - বুজুর হাতে ওই বাক্সটি আর একটি ছোট্ট খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোমার মায়ের হাতে এই চিঠি আর লাড্ডূর বাক্সটা দেবে, বলবে - সামু কাকু এসে পরে দেখা করে যাবে। আজ আমার হাতে সময় বড় কম। ঘরে গিয়ে মাকে সব দিতে চিঠিটা পড়তে পড়তে মা বলল, 'বুজু, একটু দাঁড়িয়ে যা, তোর মেজকা দিল্লী থেকে লাড্ডু পাঠিয়েছেন- সামুর হাত দিয়ে। একটা খেয়ে যাবি নাকি?’
'’বাক্সর উপর ও গুলো কী লেখা মা?', ইতিমধ্যে বাক্সটার গায়ে হিন্দিতে লেখাগুলোর দিকে নজর পড়েছে বুজুর।
'ও কিছু না, লিখেছে - দিল্লীর লাড্ডু খেলেও পস্তাবি না খেলেও পস্তাবি’, হাসতে হাসতে মা বুজুর হাতে একটা লড্ডু দিল।
'হাঁ, এই চিঠিতে বুজুর জন্য একটা দারুণ খবর আছে। তোর জন্য একটা দুচাকার সাইকেল কিনতে কাকীমা টাকা দিয়েছে সামুকে। ও দিন কয়েকের মধ্যে সাইকেলটা দিয়ে যাবে।' এ খবরে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বুজু দৌড় দিল মাঠের দিকে। গলি দিয়ে বেরোতে যাবে, জ্যাঠাতো ভাই শিবুর সাথে দেখা। সে সমবয়সী, ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাওয়ার পথে ওর কাঁধে হঠাৎ মৃদু চাপড় পড়ল। ফিরে দেখে রবিদা। ওর বড় পিসির ছেলে।
'বুজুবাবু, মাঠ থেকে ফিরবে কখন?’
‘এইতো, ঘন্টা খানেক বাদেই। কেন রবিদা?’
‘চিড়িয়াখানায় যাবি তো বল, শিবুও যাচ্ছে ‘
‘আজ?’, বিশাল উত্তেজনা চেপে বুজুর প্রশ্ন।
‘হাঁ,আজই তো।‘
'চল চল, বড়মামীকে বলে এসেছি আমি। ওখানেই খেয়ে নিবি দুপুরে।‘- রবিদার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। বুজুকে যে এতটা স্নেহ করেন রবিদা, এ তার জানা ছিল না। সে খুব খুশি আর অবাক হয়ে একদৌড়ে মিলন সংঘের মাঠে হাজির হল।
বড়দিদি বারবার করে বলে রাখা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে দেরীই হয়ে গেল বুজুর - সন্ধ্যা পার হয়ে গেল।
রবিদার সাথে চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দেখা ছাড়াও খাওয়া দাওয়া, হরেক মজার পর ফেরার পথে আবার ছবির সাথে পাড়ায় দেখা। সে একদম টেনে নিয়ে গেল রথের মেলায়। ম্যাজিক এর দোকান থেকে ম্যাজিক বাক্স আর কৃষ্ণনগর এর ঘাড় - নাড়া বুড়ো কেনার ইচ্ছে গত বছরই তার ছিল। কিন্তু
আগেই এটা সেটা কিনে, নাগর দোলায় চড়ে আর নানা রকম খাবার সাঁটিয়ে প্রায় ফতুর হয়ে গেছিল সেবার। আর এবার তো দুটো পকেটই ফাঁকা। সেকথা ছবিকে বলতেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি আজ যেন কল্পতরু, 'শোন, আজ মেলায় তোর পছন্দের ভাল ভাল যা যা কেনার দুটো করে কিনব - একটা তোর আর একটা আমার। বাবা আজ অনেকগুলো টাকা আমাকে পাব্বুনী দিয়েছে। বুজুর মনে হল ছবির এই উদারতার কারণ হয়ত আজ হকি ম্যাচ জেতায় তার করা দুখানা গোল।
রথের মেলায় পছন্দের কেনা কাটা, নানান মজা, খাওয়া দাওয়া এসব সারতেই বিকেল প্রায় গড়িয়ে গেল...... সন্ধ্যার মুখে মুখেই ‘একটা লোকের দুটো মাথা' দেখানর তাঁবুটা থেকে একটা ভয়ার্ত কাতর গোঙানোর আওয়াজ শুরু হতে - দুই বন্ধু ভয়ে ভয়ে সে এলাকা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। …….
এরপর আবার দু’খানা ‘আধতেল’ ঘুড়ির লোভে পাড়ার দীপুদার প্রতিশ্রুতি মত তার বাড়ি যাওয়া - সেখানে মাসিমার সাথে দু – একটা কথার পরে সান্ধ্য পূজার প্রসাদ খাওয়া শেষ হতে দীপুদার লোটা ঘুড়ি দুটো পুরানো আলমারীর মাথায়, বেশ কিছুটা মাঞ্জা দেওয়া সুতোর সঙ্গে পাওয়া - এ সমস্ত মিলিয়ে আরো বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে।
কিন্তু দিদিকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে যে - কয়েকটা ফার্স্ট আর সেকেণ্ড প্রাইজ নেবার আছে তার। অনেক দেরী হয়ে গেল। এর মধ্যে যদি প্রাইজ দেওয়া হয়ে যায়? … বুজু হন হন করে বাড়ীর দিকে এগুতে লাগল।
বাইরের দরজার কড়া নেড়ে ঢোকার আগেই পিছন থেকে দিদির ডাক।
‘কিরে? এত দেরী করলি - কখন স্কুলে যাবি আজ?'
‘চল না, এখুনি যাব। এইতো চিড়িয়াখানা দেখে ফিরলাম। বিশুও তো সঙ্গে ছিল।‘ - বুজু সভয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল।
'সে সব ঘরে গিয়ে ভাল করে শুনব।' দিদি থামিয়ে দিয়ে বলল।
'এখন ব্যাগে কী কী এনেছি দেখ'- দরজা খোলার আগেই, দিদি কাঁধে ঝোলান সাইড ব্যাগ থেকে রঙিন ফিতে বাঁধা বড় একটা কাগজের প্যাকেট বার করে দেখাল। ‘বল তো, কী আছে এতে?’ ‘কি জানি।‘ ‘এতে আছে আজ স্কুলে বুজু বাবুর পাওয়া সব কটা প্রাইজ। গত তিন বছরের জন্য দিয়েছে ছ ছটা সুন্দর বই। এছাড়া দুবছর পর পর প্রথম হওয়ার জন্য আবার বিশেষ পুরস্কার - একটা খুব ভাল ফাউন্টেন পেন। সাথে একটা নতুন রকম ড্রয়িংবক্স।‘- দিদি এক নিঃশ্বাসে সব বলে গেল। চমক আর আনন্দে তাল না রাখতে পেরে বুজু একটানে দিদির হাত থেকে সেই প্যাকেটটা কেড়ে নিতে গেলে বুজুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিদি আদরের কণ্ঠে বলল,
'আগে ঘরে চল, সবাই মিলে একসাথে তোর প্রাইজগুলো দেখব। তোরই তো সব। আমি তোর দেরী দেখে হেডস্যারের সাথে কথা বলে প্রাইজগুলো তোর হয়ে নিয়ে এলাম। স্যার কত প্রশংসা করলেন তোর।“
ঘরে ঢুকে মুগ্ধ বিস্ময়ে পুরস্কার পাওয়া বইগুলোর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বুজু।
‘ওরেব্বাস, …. এতো সব সুন্দর বই’, তার স্বগতোক্তি,‘
’নেতাজী, …. বিবেকানন্দ ,…. আর এটা - মাদাম কুরীর জীবনী। …..আবার সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু, হযবরল, ….. আর এটা .. এটা কার লেখা?------
ও এটা তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আম আঁটির ভেঁপু।‘
---- বুজুর এই প্রাপ্তি বহু প্রতীক্ষিত, নতুন আনন্দে আজ তাই সে উচ্ছল, প্রায় আত্মহারা।
---- তার এত আনন্দ হচ্ছে ----- মনে হচ্ছে যেন সে আজ সব পেয়ে গেছে।
---- গোটা দিনটাই যেন সে সব পেয়েছির দেশে ভেসে ভেসে চলেছে। ….. কিন্তু মা কোথায়?
বুজু আনন্দে দুটো ডিগবাজি খেয়ে, মাকে এসব কথা তক্ষুনি জানাতে ডাক দিল,
'মা .......। ও..ও মা।'
আরে, ঐ তো রান্না ঘরে পিছন ফিরে মা।
'মা .......। ও মা।' …. কিন্তু মা সারা দিচ্ছে না কেন? ‘....... ও ..ও মা..আ' এবার আরো একটু জোরে মা কে ডাকল সে। অস্ফুট কিছু শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল বিজনবাবুর। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি ভাল করে। কিন্তু 'মা' --- 'মা বলে কে ডাকছে শুনলেন যেন তিনি। নিজেই কি ডাকছিলেন ঘুমের ঘোরে? মা কে ডাকছিলেন? কিন্তু ---- মা আর এখন কোথায়? মা তো কবেই ---। পাশে তার স্ত্রী মণিমা গভীর ঘুমে। তাকেই কি খুঁজছিলেন?
ইতিমধ্যে ভোরের নরম আলো জানালা পথে এসে ঘরকে রঙ্গীন করে তুলেছে। ওদিকে বাইরের গাছগাছালি থেকে পাখীর কাকলির টুকরো টাকরা ঘরে ভেসে আসছে। আলোর পরশে সুপ্তির আবেশ থেকে বোধের উত্তরণে ধীরে ধীরে ভরে উঠল বুজু অর্থাৎ বিজন বিহারী রায়ের মন। কিন্তু, বিজনবাবুর আজ আর কোনো কিছুতেই তাড়া নেই। তিনি চোখ মেলে তাকালেন না ... ... আজ ধীরে ধীরে কেন যেন নানা কথা এই সময় মনে পড়ছে তার। কত পুরানো কথা মনে ভীড় করে আসছে একে একে..........
বিজনবাবুর মনে পড়লো, …… সেদিন হকি ম্যাচে দুটো গোল করে একটাও পাওয়া যায়নি। রেফারি সঠিক ফল্ট আর ‘ডি এর নিয়ম ভাঙার অজুহাতে দুটো গোলই নাকচ করে - যদিও একদম জেনুইন ছিল গোল দুটো। ---- এ ছাড়া, এতো বাড়ির সবাই জানে, যেদিন সকালে দিল্লী থেকে কাকিমার পাঠান লাড্ডু ওদের ঘরে আসার কথা, মা অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় কী ভাবে যেন তা লাগোয়া পাশের ঘরের আত্মীয় বৌদির হস্তগত হয়। ফলে একটিও বুজুদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। ‘দিল্লি কা লাড্ডু না খেয়েই এইভাবে পস্তাতে হয়েছিল সেবার।
…… আর, দু চাকার সাইকেল! ………… অনেকদিনের শখ ছিল তার - অনেকদিনের - একটা নতুনা দু চাকার সাইকেলের। বড় কাকীমা সেবার দিল্লী থেকে এসে স্কুলে বুজুর পর পর দুবার ফার্স্ট হওয়াতে খুব খুশী হয়ে তাকে একটা দু চাকার সাইকেল দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে যাওয়ার পর সে বেশ ক’বছর শুধু অধীর অপেক্ষায় থেকেছে তা নয়, দেয়ালের ওই ছোট গর্ত পেরিয়ে লাফ দিয়ে নেমে এক দৌড়ে সামনের চিঠি ফেলার বাক্সে চুপি চুপি কত যে চিঠি পাঠিয়েছে কাকীমাকে তার ইয়ত্তা নেই। ….. অবশ্য অতি দীর্ঘ ও বৃথা অপেক্ষার পর তার কলেজ জীবনে কেনা হয়েছিল সেটি। নিজের স্কলারশিপের টাকায়।
কেন দীপুদার প্রতিশ্রুত সেই ‘আধতেল’ ঘুড়ি ----? দীপুদার কথা মত তার বাড়িতে বসার ঘরের টেবিলে, উপরে, নীচে,আনাচে কানাচে কোথাও কোনো ঘুড়ি পাওয়া যায়নি সেদিন। বোকা বোনে গিয়ে বিমর্ষ মুখে ফেরার পথে অবশ্য মাসিমা সান্ধ্য পুজোর প্রসাদী একটা প্যাঁড়া বুজুকে দিয়েছিলেন।
--- আর, সেই রথের মেলার কেনা 'ঘাড়নাড়া বুড়ো', 'ম্যাজিক বাক্স', লটারিতে 'চকোলেট আইসক্রিম? ... কোথায় কী! সেদিন বাড়িথেকে পাওয়া সামান্য কিছুর সঙ্গে জমানো টিফিনের পয়সা থেকে অল্প কিছু , আর বড়দের এর তার থেকে চেয়েচিন্তে যৎসামান্য পাব্বুনী জোগাড় করা গেলেও ছবির সঙ্গে সারা মেলা ঘুরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে তেলেভাজা, ঘুগনি, জিলিপি, পাঁপড়ভাজা এসব উদরস্থ করার পর ওসব কেনার পয়সাই বা আর ছিল কোথায়?
সেদিন শিবুদার চিড়িয়াখানা দেখানোর কথা মনে পড়লে এখনো বিজনবাবুর বেশ অস্বস্তিকর লাগে। সেদিনের বালক বুজু বাড়িতে প্রায় একটা পর্যন্ত রবিদার জন্য অপেক্ষা করে করে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে শিবু আর রবিদা চিড়িয়াখানায় ঠিক সময়েই রওনা হয়েছে - বিশাল লম্বা ভীড় থাকাতে লাইনে দাঁড়ান একজনকে দুটোর বেশী টিকেট না দেওয়ায় নাকি বুজুর জন্য অনেক চেষ্টাতেও টিকেট জোগাড় করা যায়নি।
বিজনবাবুর অল্পস্বল্প মনে পড়ল সে সময় পূজার মরশুমে পাড়ার বিভিন্ন প্যান্ডেলে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার কথা। মনে পড়লো, বেশ কয়েকবার, সে সময়, বুজু প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছিল। কিন্তু হলে কি হবে প্রতিশ্রুত মেডেলগুলি তাকে দাওয়া হয়নি কখনই। পরে বুঝেছিল ওটাই তখনকার মোটামুটি দস্তুর। মনে লাগেনি। ------কিন্তু, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় পর পর প্রথম, দ্বিতীয় হবার পুরস্কারগুলো!
এখনো পরিষ্কার মনে আছে ------
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও সেদিন পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে তার নাম শোনা গেল না। মঞ্চের পিছনদিকে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যারকে কিছু বলার জন্য ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতেই তিনি ওকে প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, 'এই এদিকে একদম ঘোরাঘুরি করবি না। যা, ওই সামনে গিয়ে বস।‘ ….. বুজুর সাধ্য ছিল না এব্যাপরে আর কিছু বলার। কিন্তু কে জানে কেন, তার নাম আর ডাকাই হ’ল না।
অবশ্য এই কাক ভোরে মণিমাকে ডেকে তোলা কি ঠিক হবে? নাঃ, থাক এখন -----। সবপেয়েছির দেশে ঘুরে আসার, ইচ্ছা পূরণের এই সদ্য পাওয়া অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তি, প্রাপ্তির অসামান্য এ সম্পদ মনের ছোট্ট মনিকোঠায় পরম আদরে পুরে ফেললেন তিনি। এটি আর হাতছাড়া করা চলবে না। কেবল মাত্র দুজনে, তিনি আর বুজু, এ সম্পদ বারেবারে উপভোগ করবেন। যখন ইচ্ছা, আজীবন।
অঘ্রান প্রায় শেষের দিকে। সুপ্তির পূর্ব মুহূর্তে স্মিত আস্যে পাতলা চাদরখানা গায়ে ভাল করে টেনে নিলেন বিজনবাবু।
গল্প

আজ সকাল থেকেই রজতশুভ্রবাবু বাড়িতে একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। গিন্নিকে ব্যতিব্যস্ত করে দিচ্ছেন, এমন কী মেয়েকেও ছাড়ছেন না। বারোটা পঞ্চান্নর কাটোয়া লোকালটা তাঁকে ধরতেই হবে। বারোটা পঞ্চান্নয় হাওড়া থেকে ট্রেন ধরা মানে তাঁকে অন্ততঃ সোয়া একঘন্টা আগে বেরোতে হবে। চিল্কা, তাঁর মেয়ে একবার বলেছিল, “আজ রোববার বাবা, আজকে তো আর অন্যদিনের মতো জ্যাম হবে না, পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে বেরোলেই চলবে। তাছাড়া চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ওলা বা উবের বুক করে দেবো...সাঁ সাঁ করে হাওড়া পৌঁছে যাবে”। মেয়ের কথাটা মনঃপূত হয়নি রজতশুভ্রবাবুর, দাড়ি কামাতে কামাতে বললেন, “তোমাদের মতো - আমি শিরে সংক্রান্তি করতে পারবো না, বাপু। আমি একটু ধীরস্থির, হাতে সময় নিয়েই বেরোতে চাই। তোর মাকে বল, পঞ্চব্যঞ্জন কিচ্ছু রান্না করতে হবে না, দুটো ভাতে-ভাত ডিমসেদ্ধ করে দিক, আমি সোয়া এগারোটা নাগাদ খেতে বসবো”। অন্যদিন রজতশুভ্রবাবু একবার সোজা আর একবার উল্টো রেজারে শেভ করেন, আজ তিনবার করলেন, সোজা দুই, উল্টো এক। গালে মাছি বসলে, নির্ঘাৎ পা পিছলে যাবে!
মেয়ের মুখে বাবার লাঞ্চের অর্ডার শুনে, খুন্তি হাতেই শুক্লা, রজতশুভ্রবাবুর গিন্নি, বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে, বললেন, “তোমার কী মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? যাচ্ছো একটা শুভ কাজে, তার আগে অলক্ষুণে ওই জিনিষটার নাম না বললেই চলছিল না?” রজতশুভ্রবাবু অবাক হয়ে গিন্নি এবং মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, অলক্ষুণে বস্তুটা কী সেটাই বুঝতে পারছিলেন না। গিন্নির পেছনে দাঁড়ানো মেয়ে ঠোঁট নেড়ে ফিসফিস করে বলল, “পাখিরা যে বস্তুটি তাদের বাসায় পাড়ে, সেটি গোল তাই অলক্ষুণে”। ভ্রূকুটি করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে গিন্নি আবার বললেন, “ভাত-মুগের ডাল, ঘি, পটলভাজা আর চারাপোনা ভাজা। শুভ কাজে মৎস্যমুখ করে যাওয়াটাই দস্তুর...”! রজতশুভ্রবাবু আর কথা বাড়ালেন না, সুবোধ বালকের মতো শ্বাস ফেলে বললেন, “বেশ, তা না হয় হল, কিন্তু সোয়া এগারোটা মানে এগারোটা পনের”।
গিন্নি তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ঢুকতেই, রজতশুভ্রবাবু কাবার্ড থেকে জামা প্যান্ট গেঞ্জি রুমাল বের করতে লাগলেন। তাঁর পেছন পেছন মেয়েও এসে দাঁড়াল। বলল, “বাবা, আজকের দিনে রোজ অফিসে পরে যাওয়া একঘেয়ে জামা-প্যান্টগুলো পরো না, প্লিজ। ধুতি-পাঞ্জাবি না পরো, অন্ততঃ পাজামা-পাঞ্জাবি পরো”। কথাটা রজতশুভ্রবাবুর মাথাতেও এসেছিল, কিন্তু একটু লজ্জা-লজ্জা করছিল বলে, ও পথে হাঁটেননি। তিনি মেয়ের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “ধুস্, এ কি বিয়েবাড়ি যাচ্ছি নাকি? অত সাজগোজ দেখলে লোকে বলবে কী?”
“কী আবার বলবে? যাঁরা তোমাকে ডেকেছেন, তাঁরা কী তোমাকে অফিসের কাজের জন্যে ডেকেছেন?”
“তা না... ইয়ে... তা অবিশ্যি ঠিক। তবে...ওসব পরে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে”!
“কিচ্ছু হবে না। আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো, তুমি এখন চান করতে যাও, ততক্ষণে আমি সব বের করে রাখছি। আজকে চুলে একটু শ্যাম্পু দিও, বাবা। শ্যাম্পু করে আবার মাথায় গুচ্ছের তেল দিও না যেন, তোমার যা মাথা ঠাণ্ডার বাতিক...জুলপি দিয়ে তেল গড়ালেই হয়েছে আর কী!”
মেয়ের ভালোবাসা ও আদরে রজতশুভ্রবাবুর মনটা বেশ একটু মাখোমাখো হয়ে উঠল, খুব দুর্বল স্বরে তিনি প্রতিবাদ করে উঠলেন, “তোরা আমাকে কী পেয়েছিস বল তো? মা আর মেয়ে, যা নয় তাই বলে চলেছিস তখন থেকে। বলি, আমি কী তোদের হাতের পুতুল, যেমন সাজাবি, তেমন সাজতে হবে”! ফিক করে হেসে মেয়ে বলল, “তা নয় তো কী! যাও, যাও চানটা সেরে এস দেখি, ওদিকে পৌনে এগারোটা বাজতে চলল, সে খেয়াল আছে?” রজতশুভ্রবাবু কিছুটা চমকে উঠে বললেন, “ওঃ তাই তো! তোদের পাল্লায় পড়ে আমার যাওয়াটাই না ভেস্তে যায়। বললে তো আর শুনবি না, যা পারিস কর, আমি চানে চললাম”।
চান করে বেরিয়েই গামছাপরা রজতশুভ্রবাবু মেয়েকে ডাক দিলেন, “কই রে, টিকলু, কোথায় রাখলি তোর সব সঙের সাজ?” রজতশুভ্রবাবু মেয়েকে আদর করে টিকলু ডাকেন। টিকলু বাক্স থেকে বাবার স্যাণ্ডেলজোড়া বের করেছে। অনেকদিন ব্যবহার না হওয়াতে উড়ো ধুলো পড়েছিল, সাদা কাপড়ে সে দুটো মুছে চকচকে করতে করতে বলল, “তুমি আগে খেতে বস, বাবা। খেয়ে উঠে পাজামা-পাঞ্জাবি পরবে! বলা যায় না, ডালভাত পড়লে, পাঞ্জাবিতে দাগ ধরে যেতে পারে!”
রজতশুভ্রবাবু এবার একটু বিরক্তই হলেন, বললেন, “তার মানে? আমাকে কী বাচ্চা ছেলে পেয়েছিস? ভাত খেতে বসে থ্যাপথ্যাপ করে ভাত-ডাল গায়ে মাখব”? রান্নাঘর থেকে গিন্নি ভাতের থালা সাজিয়ে খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিতে দিতে বললেন, “বাচ্চা ছেলেরও অধম! মেয়ে বাপকে ঠিকই চিনেছে! বসে পড়ো, সোয়া এগারোটা বলেছিলে, এখন মোটে এগারোটা পাঁচ। খেয়ে উঠেই দৌড়বে নাকি? একটু জিরিয়ে তারপর বেরোবে!” কিচ্ছু করার নেই, গামছা ছেড়ে ঘরে পড়ার পাজামাটা পরেই খেতে বসলেন রজতশুভ্রবাবু। গরমভাত, গাওয়াঘি। মুগেরডাল, বেগুনভাজা, পটলভাজা আর চারাপোনার সরষেঝাল। বেশ তৃপ্তি করেই খেলেন এবং আঁচাতে গিয়ে বুঝলেন, অন্যদিনের তুলনায় খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে!
সোফায় আরাম করে বসে মেয়েকে বললেন, “তোর মায়ের না কাণ্ডজ্ঞান নেই! এক থালা ভাত খাইয়ে দিল। এইভাবে এখন যাওয়া যায়?” মুচকি হেসে টিকলু বলল, “ভালোই তো, ভাতটা কিছুক্ষণ পেটে থাকবে। সেখানে গিয়ে কী জলখাবার দেবে, কখন দেবে – তার কোন ঠিকানা আছে? আরামসে একটু গড়িয়ে নাও না, তোমার হাতে এখনও মিনিট পনের সময় তো আছে!” রাগরাগ মুখ করে রজতশুভ্রবাবু মেয়েকে বললেন, “দে একটু মৌরিভাজা দে, যেমন মা তার তেমনি মেয়ে...হুঃ!”
হাওড়ায় পৌঁছে টিকিট কেটেও হাতে আধঘন্টার মতো সময় রয়ে গেল। চিল্কা ঠিকই বলেছিল, আরো মিনিট পনের পরে বের হলেই চলত, কারণ আজ রোববার, কলকাতার রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা। তবে হাওড়া স্টেশন চত্বরে ভিড় গিসগিস করছে, কোত্থাও বসার জায়গা খালি নেই। এক-একটা পরিবার প্রচুর লটবহর সমেত এক-একটা বেঞ্চ দখল করে বসে আছে। তাঁর সঙ্গে অবিশ্যি লটবহর বলতে কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ। তার মধ্যে তাঁর লেখা সদ্য প্রকাশিত খানচারেক বই। চশমার খাপ। আর মৌরিভাজা-জোয়ানের ছোট্ট একটা কৌটো। এই ব্যাগটাও চিল্কা দিয়েছে, বাবার এই সাহিত্য সম্মানের কথা শুনে, কদিন আগে দক্ষিণাপণ থেকে কিনে এনেছিল। আগে বলেনি মেয়েটা, আজ একেবারে তাঁর হাতে তুলে দিল। রজতশুভ্রবাবু একটু লাজুক হেসে বলেছিলেন, এসবের আবার কী দরকার ছিল, আমার পুরোনো হাতব্যাগটাতো ছিলই! বাবার বই-টইগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে চিল্কা বলল, “আজ তুমি সাধারণ অফিসযাত্রী নও বাবা, তুমি সম্বর্ধনা নিতে যাওয়া সম্মানের সাহিত্যিক!” হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড়িয়ে, মেয়ের কথাগুলো মনে করে, বড়ো তৃপ্তি পেলেন, রজতশুভ্রবাবু। “পাগলি, বড়ো হয়ে গেল কত। এই সেদিনের পুঁচকে মেয়েটা, এত কিছু বুঝতে শিখল কবে?” মনে মনে ভাবলেন তিনি।
২
সব মিলিয়ে মিনিট পনের লেট করলেও নির্বিঘ্নেই স্টেশনে পৌঁছলেন রজতশুভ্রবাবু। এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে দু বার ফোনে যোগাযোগ হয়েছে সমিতির কর্তার। তাঁরা স্টেশনে আসছেন রজতশুভ্রবাবুকে রিসিভ করতে। রজতশুভ্রবাবু কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে তখনো দাঁড়ায়নি, থামার আগে গড়িয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। সব স্টেশনের কংক্রিটের প্ল্যাটফর্ম, মাথার ছাউনি, ওভারব্রিজ – প্রায় একই রকম হয়। তবুও রজতশুভ্রবাবু প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য অনুভব করেন। আর সেই বৈশিষ্ট্যটি বানিয়ে তোলে, সেখানকার ফেরিওয়ালারা, অপেক্ষারত যাত্রীরা, এমনকি প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা ভিখিরিরাও! কলকাতা থেকে কিছুটা দূরের অচেনা এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে, সেই বৈশিষ্ট্যটিই লক্ষ্য করছিলেন তিনি।
“এই তো...অ্যাই বিপিন, এই দিকে, এই দিকে...স্যার এই কামরাতে রয়েছেন”। বলতে বলতে এক ভদ্রলোক ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল রেখে প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে হাত তুলে নমস্কার করে জিগ্যেস করলেন, “আপনিই রজতশুভ্ভোবাবু তো”।
“হ্যাঁ”। ভদ্রলোক নিজের কৃতিত্বে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, “তবে? কোনদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই, তবু কেমন চিনে নিয়েছি বলুন স্যার? আমি গণপতি দলুই, আমাদের সমিতির সেক্কেটারি, আমিই আপনার সঙ্গে ফোনে কথাবাত্তা বলছিলাম...আসুন স্যার, আসুন, সাবধানে নেমে আসুন”। ট্রেন দাঁড়িয়ে যেতে রজতশুভ্রবাবুকে গণপতিবাবু সাদরে আহ্বান জানালেন, আর তাঁর পাশে এই মাত্র উপস্থিত হলেন আরেকজন। প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াতেই, তিনি একগাল হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, “আমি বিপিন হাজরা, স্যার। সমিতির কোষাধ্যক্ষ। হে হে হে হে, আপনার মতো মানুষের পায়ের ধুলোতে আমাদের শহর ধন্য হয়ে গেল, স্যার। বাইরে গাড়ি রাখা আছে। এই গরিবের বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম আর জলযোগ সেরে নেবেন, তারপর সাড়ে ছটা নাগাদ আপনাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবো, স্যার”।
রাস্তা দেখিয়ে গণপতিবাবু ও বিপিনবাবু আগে আগে হাঁটতে লাগলেন। ওভারব্রিজ পার হয়ে, একনম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বাইরের রাস্তায় পা দিলেন তাঁরা। সামনেই অজস্র রিকশার জটলা, একটু দূরে কিছু টোটোও রয়েছে।
“বিপিনকাকা, এই যে এদিকে...চলে আসুন...” টোটোগুলোর কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ছোকরা হাত তুলে তাঁদেরই ডাকল। বিপিনবাবুও দাঁতের শোকেস সাজিয়ে বললেন, “ওই তো, বিষ্টু...হে হে হে হে হে...ওই আমাদের সারথি স্যার...চলুন, ওদিকে যাই। রেল কোম্পানি এই পর্যন্ত আসতে ওদের অ্যালাউ করে না। এটুকু স্যার, হাঁটতেই হবে”।
রজতশুভ্রবাবু বললেন, “এ আর এমনকি? কিন্তু সাড়ে ছটায় অনুষ্ঠান শুরু হলে কতক্ষণে শেষ হবে গণপতিবাবু? আমার আবার ফেরাটা...”
“ও নিয়ে আপনি একদম টেনশন করবেন না, স্যার। আটটা পঁচিশের হাওড়া লোকাল আপনাকে ধরিয়ে দেব। তারপরেও সেই সাড়ে দশটা পর্যন্ত আরও চারখানা ট্রেন তো আছেই! কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, স্যার!”
রজতশুভ্রবাবু একটু আতঙ্কিত স্বরে বললেন, “আটটা পঁচিশ হলে তাও ঠিক আছে, এগারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে পারব! কিন্তু তার থেকে দেরি হলে, বিপদে পড়ে যাবো যে, ভাই...”।
গণপতিবাবু এবং বিপিনবাবু একই সঙ্গে হৈ হৈ করে বললেন, “আটটা পঁচিশের ট্রেন আপনাকে না নিয়ে যাবে না, স্যার”। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা টোটোর সামনে এসে গিয়েছিলেন, গণপতিবাবু বললেন, “উঠে পড়ুন, স্যার। আপনাকে আতান্তরে ফেলবো না, স্যার, আপনাকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও তো আমাদের, না কী বলেন, স্যার!”
কোন কথা না বলে রজতশুভ্রবাবু মাথা নিচু করে টোটোয় চড়ে বসলেন, তাঁর পাশে বসলেন, গণপতিবাবু। আর ড্রাইভার বিষ্টুর পাশে বসলেন বিপিনবাবু। সবাই উঠে পড়তেই বিষ্টু গাড়িতে স্টার্ট দিল, বিপিনবাবু বললেন, “প্রথমে আমার বাড়িতে চল, বিষ্টু, ওখানে স্যার একটু ফ্রেস-ট্রেস হয়ে রেস্ট নেবেন। তারপর তুই সোয়া ছটা নাগাদ চলে আসবি, স্যারকে নিয়ে আমি ফাংশনে যাবো”।
গণপতিবাবু বললেন, “আমাকে কাছারিপাড়ার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে, তোমরা বেরিয়ে যাও, বিপিন। আমি বরং ওদিকে যোগাড়-যন্ত্র কেমন হচ্ছে দেখে নিই, বুজেছো? যে দিকে না দেখবে, সেদিকেই ব্যাটারা তোমায় ডোবাবে...”।
বিপিনবাবু বললেন, “তুমি বড্ডো টেনশন করো গণাদা। ওখানে নিতাই আছে, হাবলা আছে। এমন অনুষ্ঠান ওরা কম করেছে! ঠিক সামলে নেবে। জানেন স্যার, আমাদের এই দিকটাতে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে খুব আগ্রহ”। শেষ কথাগুলো বিপিনবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে রজতশুভ্রকে বললেন, তিনি আরো বললেন, “এই অঞ্চলে আমাদের এই সমিতি, “সরস্বতী কলা ও শিল্প মণ্ডলী”, বহুদিনের প্রাচীন। সেই আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের আমল থেকে আমাদের সমিতি, বছরে দুটো সাংস্কৃতিক ফাংশন করে। পঁচিশে বোশেখ আর সরস্বতী পুজোয়। তাছাড়া সারা বছর কিছু না কিছু হুজুগ তো লেগেই আছে...। স্বাধীনতা দিবস, বিজয়া সম্মিলনী... কী বলো, গণাদা? আমাদের এখানে কম গুণীলোকের পা পড়েছে, বলো?” গণপতিবাবু বললেন।
“সে আর বলতে? কত লোকের নাম বলবো, মিলন মুখুজ্জ্যে, দিগীন সান্যাল, অনুভব চৌধুরি...”
রজতশুভ্রবাবু ওঁদের কথা শুনছিলেন, আর রাস্তার দুধারের শহর দেখছিলেন। প্রাচীন শহর। পুরোনো পুরোনো আদ্যিকালের ভাঙাচোরা বাড়ি, তার মধ্যে আধুনিক ঝাঁ চকচকে বাড়িও রয়েছে। চাঁদসীর ক্ষত চিকিৎসালয়ের ঝুপসি ঘর, তার পাশেই ঝলমলে সিটি মার্কেট। টিমটিমে লক্ষ্মী জুয়েলার্সের পাশেই কলকাতার ঝলমলে গয়নার দোকানের শাখা। গলায় ফিঁতে ঝোলানো বিষণ্ণ দরজির দোকানের পাশেই, নামী ব্র্যাণ্ডের শোরুম...।
বিপিনবাবু বললেন, “হ্যাঁ, তারপরে তোমার ধরো, পীযুষ বটব্যাল, তনুময় হালদার, শেখর বিশ্বাস...তারপর ওই যে গো, খুব নাম করা, হাসির গল্প লিখতেন...মনে পড়েছে বিনয় দত্ত... কতজনের নাম আর বলবো, স্যার। আমাদের অনুষ্ঠান দেখলেই বুঝবেন, আমাদের এখানে শিল্প-সংস্কৃতির খুব চর্চা...”
কাছারিপাড়ার মোড়ে গণপতিবাবু নেমে গেলেন, তারপরেও প্রায় মিনিট দশেক বিপিনবাবুর কথা শুনতে শুনতে, গাড়ি এসে দাঁড়াল, বিশাল তিনতলা এক বাড়ির সামনে। বেগুনি আর হলুদ রংয়ে উজ্জ্বল বর্ণময়।
টোটো থেকে নেমে বিপিনবাবু আরেকবার বিষ্টুকে সোয়া ছটায় আসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, “আসুন স্যার। এই হচ্ছে গরিবের কুটির...কই রে, বুল্টি, হারু, তোদের মাকে ডাক, কে এসেছেন দেখ...” বিপিনবাবুর ডাকে বাড়ির ভেতর থেকে এক কিশোরী আর একটি বালক দৌড়ে বেরিয়ে এল... “হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ এইটি আমার কন্যা বুল্টি আর পুত্র হারু, প্রণাম করো মা, প্রণাম করো জ্যেঠুকে...লজ্জা কী...কতো বড়ো সাহিত্যিক জানো...”। বাড়ির দরজায় বিপিনবাবুর গৃহিণী এসে দাঁড়ালেন। রজতশুভ্রবাবুর মনে হল, একটু অগোছালো ভাবে পরা, কিন্তু তাঁর পরনের শাড়িটা খুবই দামী এবং তাঁর দুই বাহু এবং গলা ভর্তি সোনার গয়না। জোড়হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, “কী ভাগ্যি আমাদের, আপনার মতো মানুষ আমাদের বাড়ি এলেন, আসুন আসুন, ভেতরে আসুন...বুল্টি ওঁনাকে ভেতরে নিয়ে বসার ঘরে বসা...কতদূর থেকে এসেচেন”!
বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসতেই, চঞ্চলা কিশোরী বলে উঠল, “আমি কিন্তু আপনার সব লেখা পড়ি”।
রজতশুভ্রবাবু ভীষণ আশ্চর্য হলেন। এই মফস্বল শহরের বিপিনবাবুর মতো ধনী ও বিষয়ী ভদ্রলোকের কন্যা, তাঁর সব বই পড়ে? তিনি অবাক স্বরে বললেন, “তাই নাকি? তা কী কী বই পড়েছো?”“বই? বই কী করে পড়বো? বাবা গল্পের বই কিনতেই দেয় না। বলে, ও সব না পড়ে পড়ার বই পড়, তাতে আখেরে কাজ হবে। আমি আপনার লেখা মোবাইলে পড়ি, ওয়েব ম্যাগাজিনে! আপনার লেখা ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, হাসির গল্প - সব পড়ি। রিসেন্ট যে ভূতের গল্পটা লিখেছেন, ওই যে ভূতেরা বাঁশবনের ভেতর নিজেদের মুণ্ডু খুলে নিয়ে ভলিবল খেলছিল, আর মিহির গিয়ে সেটাকে লুফে নিল...দারুণ মজার হয়েছে, জানেন!”স্মিতমুখে রজতশুভ্রবাবু বললেন, “বাঃ। তোমার মতো ছোট্ট এক ভক্ত পেয়ে আমার খুব আনন্দ হল, বুল্টি। কোন ক্লাসে পড়ো। টেন না ইলেভেন?” দু হাতে কান ঢেকে বুল্টি বলে উঠল, “ও মা আপনি আমাকে বাচ্চা ভেবেছেন বুঝি? আমি রীতিমতো কলেজে পড়ি, সেকেণ্ড ইয়ার, হিস্ট্রিতে অনার্স”।
কিছুটা অপ্রস্তুত রজতশুভ্রবাবু হেসে বললেন, “সত্যি তোমাকে দেখে বুঝতেই পারিনি, তুমি এত বড়ো। তোমার ভাল নাম কী, বুল্টি?”“ভালো নামটা বিচ্ছিরি, চন্দ্রাবলি। আপনি আমাকে বুল্টি বলেই ডাকবেন। ওই নামেই আমার
বন্ধুরাও ডাকে। আপনি ফেসবুক করেন? আপনাকে আমি ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবো, অ্যাক্সেপ্ট করবেন, প্লিজ। আরেকটা কথা বলবো, আংক্ল্? রাগ করবেন না, বলুন?”
বুল্টির সহজ সরল আচরণ খুবই ভাল লাগছিল রজতশুভ্রবাবুর, এই প্রথম তিনি বুল্টিকে একটু লজ্জা পেতে দেখলেন, অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “কী বলবে, বল না! রাগ করব কেন?”
“আপনার সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নেবো, প্লিজ। মা এখনি আপনার জন্যে জলখাবার নিয়ে আসবে, তার আগেই...”।
“বেশ তো, নাও না! তোমার মতো ভক্ত পাঠিকার সঙ্গে সেলফি নিতে রাগ করব কেন? আমাকে কিন্তু মনে করে, পাঠিয়ে দেবে...”। এরপর আর কিছু বলতে হল না, বুল্টি রজতশুভ্রবাবুর পাশে বসে এবং দাঁড়িয়ে চটপট বেশ কয়েকটা সেলফি তুলে নিয়ে বলল, “আপনার হোয়াটস্ অ্যাপ নাম্বারটা বলুন, আমি সেভ করে নিয়ে, এখনি শেয়ার করছি...”।
“৯২...”
এই সময়েই ঘরে এলেন বিপিনবাবুর স্ত্রী এবং তাঁর পিছনে স্বয়ং বিপিনবাবু। সামনের টেবিলের ওপর প্লেট সাজাতে সাজাতে বিপিনবাবুর স্ত্রী বললেন, “দোকানের ছাইপাঁশ নয়, এসব কিন্তু আমার নিজের হাতে বানানো, না বললে চলবে না, দাদা। অনেকদূর থেকে এসেছেন, নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে। নিন শুরু করুন। বুল্টির পাল্লায় পড়েছেন তো, দাদা। ও মেয়ে দিনরাত ফোনে মগ্ন ... হয় ফেসবুক নয় হোয়াট্স্ অ্যাপ। আসতে না আসতেই আপনার ফোন নাম্বারটাও নিয়ে নিল, দেখবেন খুব জ্বালাবে...”।
টেবিলের ওপর সাজানো গরম গরম লুচি, বেগুনভাজা এবং ঘুগনির বাটি দেখে রজতশুভ্রবাবু সত্যি সত্যি খিদেটা অনুভব করলেন। বললেন, “না, না জ্বালাবে কেন? খুব ভালো মেয়ে। ইয়ে, মানে হাতটা একটু ধুলে হত...”।
এতক্ষণ বিপিনবাবু হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ ছাড়া অন্য কথা বলেননি, এখন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “সে কী, বুল্টি মা? জেঠুকে বাথরুমটা দেখাওনি? তোমাকে বলে গেলাম যে...! আমার সঙ্গে আসুন দাদা, মুখহাতটা ধুয়ে নেবেন...”।
হাতমুখ ধুয়ে খেতে শুরু করার আগে রজতশুভ্রবাবু ব্যাগ থেকে নিজের একটি বই আর কলম বের করলেন। প্রচ্ছদের দুটো পৃষ্ঠা পরে লিখলেন, “স্নেহের বুল্টি ও হারুকে”, নিচেয় সই করলেন। তারপর বইটি বুল্টির হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, “বিপিনবাবু, আপনাদের বাড়িতে এমন আপ্যায়ন পাবো, ভাবতেই পারিনি। আপনাদের আপ্যায়নের কৃতজ্ঞতায় আমার এই সামান্য উপহার। বইটি পড়ে আপনার পুত্রকন্যার মুখে যদি হাসি ফোটে, ভীষণ আনন্দ পাবো”।
বুল্টি আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল, বলল, “ওয়াও, আমাকে দিলেন? উইথ অটোগ্রাফ! থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ সোওওও মাচ, আংক্ল্!”
বিপিনবাবু বললেন, “ঠিক আছে, মা, ঠিক আছে। জ্যেঠুকে প্রণাম করো। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ...”
৩
বিষ্টু কথার খেলাপ করেনি। সোয়া ছটাতেই এসেছিল এবং বিপিনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনুষ্ঠানের মাঠে আসতে মিনিট দশেকও লাগল না। খুব কিছু বাহুল্য নেই। ছোট্ট মণ্ডপ, ছোট্ট মঞ্চ। ফুলটুল দিয়ে পরিচ্ছন্ন সাজানো। মঞ্চের পেছনে টানটান করে ফেস্টুন টাঙানো, “গুণীজন সম্বর্ধনা ২০১৯ – সরস্বতী কলা ও শিল্প মণ্ডলী, মোহনপুর, হুগলি”। দর্শক বা শ্রোতাও মন্দ হয়নি। বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ, অনেকগুলি কলেজে পড়া ছেলেমেয়ে, বুল্টিদের সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবই হবে। আরও রয়েছে, বাচ্চা বাচ্চা স্কুলের ছেলেমেয়েরা, তারা মঞ্চের নিচে শতরঞ্চিতে বসে খুব কলবল করছে।
তিনি মাঠে ঢুকতেই মাইকে ঘোষণা চলতে লাগল, “আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বনামধন্য সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত রজতশুভ্র মাড়িক উপস্থিত হয়েছেন। তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্যেই আমাদের আজকের এই অনুষ্ঠান। বন্ধুগণ, এই অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। আপনারা দলে দলে এসে যোগ দিয়ে এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলুন”। একই ঘোষণা চলতে লাগল, বারবার, লাগাতার। রজতশুভ্রবাবুর মনে হল, টিকলুটা আজ সঙ্গে এলে, পুরো ব্যাপারটা খুব এনজয় করত!
স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় ও নমস্কার পর্ব শেষ করে, রজতশুভ্রবাবুকে নিয়ে গণপতিবাবু মঞ্চে উঠলেন। মঞ্চের ওপর পাঁচটি চেয়ার। মাঝখানের চেয়ারটি ছেড়ে রেখে সকলেই বসলেন। রজতশুভ্রবাবুকে পাশে নিয়ে বসলেন গণপতিবাবু। সকলেই প্রস্তুত কিন্তু সকলেই সভাপতির প্রতীক্ষা করতে লাগলেন, যিনি মাঝের ওই চেয়ারটিকে অলংকৃত করবেন।
মাইকে বার বার ঘোষণা হচ্ছে, তাঁর নাম এবং পল্লিবাসীবৃন্দদের দলে দলে যোগ দিয়ে এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার আহ্বান। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে... কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে রজতশুভ্রবাবুর ঘড়ির কাঁটা যেন দৌড়তে লাগল, সাড়ে ছয়, পৌনে সাত...সাত...সাতটা দশ...।
রজতশুভ্রবাবু নিচু হয়ে পাশে বসা গণপতিবাবুকে বললেন, “গণপতিবাবু, এখনও শুরু হল না, শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যাবে যে...আমার ফেরার ট্রেন...”
গণপতিবাবু একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “তাই তো, কি করা যায় বলুন তো। সভাপতিমশাই গত একঘন্টা ধরে বলছেন, পাঁচমিনিটের মধ্যে আসছি...তাঁকে ছাড়া অনুষ্ঠান শুরুও করা যায় না...”।
“তাহলে বরং আমাকেই ছেড়ে দিন। নটা সাড়ে নটা হয়ে গেলে, খুব মুশকিলে পড়ে যাবো...”।
“কী বলছেন, স্যার? আপনাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছি, আর আপনি চলে যাবেন...এ যে মোহনপুরের লজ্জা। ছি ছি ও কথা মুখেও আনবেন না, স্যার। কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব স্যার”। গণপতিবাবু বিপিনবাবু এবং আরো কয়েকজন ভলান্টিয়ারকে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “কী খবর হে?” কাঁচুমাচু হয়ে সকলেই বলল, “শুনেছি অন রোড, রওনা হয়েছেন। বারবার ফোন করলে, দাদা খুব বিরক্ত হন, স্যার”।
রজতশুভ্রবাবু দুশ্চিন্তার শেষ সীমায়, সাড়েসাতটা নাগাদ সভাপতি মশাইয়ের গাড়ি এসে দাঁড়াল, মাঠের গেটে। অনেকেই হৈচৈ করে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্যে এগিয়ে গেল। গণপতিবাবুর সঙ্গে রজতশুভ্রবাবুও উঠে গিয়ে মঞ্চের ধারে দাঁড়ালেন। সভাপতিমশাই আসছেন। তাঁকে ঘিরে আসছে, অন্ততঃ জনা ত্রিশেক ছোকরা। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে বারবার, “সভাপতিমশাই চলে এসেছেন, আমাদের অনুষ্ঠান এখনই শুরু হবে। সকল পল্লিবাসীদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তাঁরা যেন অবিলম্বে এখানে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন”।
ভিড়ের মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু মঞ্চে ওঠার সিঁড়িতে বোঝা গেল গোলগাল আকারের সভাপতিমশাই কিছুটা তরল অবস্থায় রয়েছেন। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে মঞ্চে উঠে সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। সকলেই প্রচুর পরিমাণে হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ বললেন, কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না, শুধু শুনলেন। আর ভিখারিকে ভিক্ষে না দেওয়ার সময় লোকে যেমন কপালে হাত তোলে, সেভাবে হাত তুলতে লাগলেন। শেষে রজতশুভ্রবাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। মঞ্চের ওপর নিজের চেয়ারে আরাম করে বসতে না বসতেই, কেউ একজন একটা মাইক ভাঁজ করে তাঁর মুখের কাছাকাছি ফিট করে দিয়ে গেল।
রাজকীয় আসনে আড় হয়ে বসে, সভাপতিমশাই মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ড়জতসুভ্ভোবাবু, আপনি কী করেন?” মাইক একটু দূরে হলেও, উপস্থিত শ্রোতারা সে কথা স্পষ্টই শুনতে পেল।
রজতশুভ্রবাবু সবিনয়ে বললেন, “আমি? ওই একটু আধটু লিখিটিখি আর কী”!
“ধূর মশাই, কী লেকেন সেটাই তো জানতে চাইছি”।
“ইয়ে..মানে গল্প-সল্প, ছোটোদের জন্যে, বড়দের জন্যে...”।
“গল্প লেকেন? কই আপনার নাম তো শুনিনি কোনদিন। রবিঠাকুর বলুন, শরৎ, বঙ্কিম বলুন, সবার নাম শুনেছি, কিন্তু আপনার নাম, নাঃ কক্খনো শুনিনি। ও গণপতিদা, এ সব কাকে ধরে আনচো মাইরি, সম্বদ্ধনা দেবে বলে? আমাদের ক্লাবের একটা পেস্টিজ নেই? আমাদের এই পল্লির একটা সুনাম নেই?”
মঞ্চে এবং সামনের শ্রোতা ও দর্শকদের সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। সভাপতিমশাইয়ের গলা এখন চড়ছে, মাইকে সে কণ্ঠ সকলেই শুনছে। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে সভাপতিমশাই বললেন, “আমাকে এই সভার সভাপতি করেচো। আর আমিই জানিনা উটকো কাকে না কাকে সম্বদ্ধনা দিচ্চো। আমাকে একবার জিগ্যেস করতে পারতে! আমাদের হারাধন রয়েচে, দেঁতো নারাণ রয়েছে, ওরাও তো লেকে। দেয়াল লেকে, ফেস্টুন লেকে...আমাদের পোচারের বক্তব্য লেকে। ঘরের ছেলেদের ছেড়ে দিয়ে, উটকো বহিরাগত কেন?”
রজতশুভ্রবাবু সবিনয়ে বললেন, “আপনাদের সকলকে খুবই বিড়ম্বনায় ফেললাম। তাহলে আমি এখন আসি?” এখন আটটা বাজতে দশ, এখনও বেরোলে তিনি অনায়াসে আটটা পঁচিশ পেয়ে যাবেন। এসময়ে হঠাৎই তাঁর মনে হলে, টিকলুটা ভাগ্যিস আসেনি, এলে কী ঝকমারিই না হত!
“আসি নয়, কেটে পড়ুন। ছাতারমাথা কী লিকছেন, আমরা কেউ জানতেই পারলাম না, আর আপনি চলে এলেন সম্বদ্ধনা নিতে...ও গণপতিদা, এসব আপদ বিদেয় করে অনুষ্ঠান শুরু করুন তো!”
ওদিকে মাঠের গেটের কাছে তখন জোর হট্টগোল শুরু হয়েছে, একদল উত্তেজিত ছেলেমেয়ে দৌড়ে আসছে মঞ্চের দিকে। তাদের বক্তব্য আমন্ত্রিত একজন গুণীব্যক্তিকে এভাবে অপমান করার অধিকার সভাপতিমশাইকে কে দিয়েছে? মঞ্চে ওঠার আগেই তাদের বাধা দিল সভাপতিমশাইয়ের সঙ্গীসাথিরা। সেখানে ভীষণ উত্তেজনা, মারামারি শুরু হবার উপক্রম। রজতশুভ্রবাবুর কানেও ওদের উত্তেজিত কথাবার্তা কানে আসছিল। তিনি অসহায় বোধ করতে লাগলেন, তাঁকে নিয়ে এমন হাঙ্গামা শুরু হবে, তিনি কল্পনাও করেননি। মঞ্চের ওপরেও শুরু হয়ে গেল বিশ্রী বিশৃঙ্খলা। রজতশুভ্রবাবু আতঙ্কে পিছিয়ে গেলেন মঞ্চের একদম পিছনদিকে। সামনে তখন তাণ্ডব চলছে মঞ্চের ওপর।
হঠাৎ মণ্ডপের পিছনের কাপড় সরিয়ে মঞ্চে উঠে এল বুল্টি আর বিষ্টু। বুল্টি রজতশুভ্রবাবুর হাত ধরে বলল, “আংক্ল্, তাড়াতাড়ি চলে এসো আমার সঙ্গে, এসব নোংরা ঝামেলার মধ্যে তুমি জড়িও না”। রজতশুভ্রবাবু মঞ্চের দিকে একবার দেখলেন, তারপর ওদের সঙ্গে লাফ দিয়ে নেমে এলেন মাটিতে। তিনজনে দৌড়ে গেটের বাইরে এসে, চেপে পড়লেন বিষ্টুর টোটোতে। বুল্টি আর রজতশুভ্রবাবু পিছনে বসতেই, বিষ্টু টোটোতে স্টার্ট দিল।
৪
স্টেশনে পৌঁছে জানা গেল ট্রেন মিনিট পঁচিশ লেট। টিকিট কাটার তাড়া নেই, রজতশুভ্রবাবু আসার সময়েই রিটার্ন টিকিট কেটেছিলেন। হাতে প্রায় মিনিট কুড়ি সময় রয়েছে।
বিষ্টু বলল, “একটু চা খাবেন, স্যার? আপনি টোটোতেই বসুন, আমি নিয়ে আসছি, বুল্টি চা খাবি তো?” বুল্টি কোন উত্তর দিল না, বিষ্টুর চোখে চোখ রেখে সম্মতি জানাল।
বিষ্টু চা আনতে যাওয়ার পর, বুল্টি বলল, “আপনার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে, তাই না, আংক্ল্”? এ কথার উত্তর আর কী দেবেন, রজতশুভ্রবাবু? তিনি চুপ করে, বুল্টির দিকে তাকালেন। রজতশুভ্রবাবুর চোখে চোখ রেখে বুল্টি বলল, “আমাদের শহরের লোক কিন্তু এমন না, আংক্ল্, তারা ভীষণ ভালো। দু-একজন লোকের জন্যেই এমন বদনাম হয় আমাদের। আপনার এই অপমান আমরাও সহ্য করব না, আংক্ল্। এরপর আপনাকে আমাদের কলেজে ডাকব, তখন দেখবেন আমরা কত ভাল!”
রজতশুভ্রবাবু হাসলেন, বললেন, “তোমাদের বাড়ির সকলকে এবং তোমার মতো মিষ্টি একটি মেয়েকে না দেখলে, হয়তো খারাপ ধারণা নিয়েই বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু তোমাদের তো কোন দোষ নেই...”।
বিষ্টু এই সময়েই চা নিয়ে এল, ছোট একটা প্লেটে বসানো, কাগজের কাপে তিন-কাপ। রজতশুভ্রবাবু এবং বিল্টুকে চা দিয়ে, নিজের কাপ নিয়ে বসল, সামনের সিটে।
বিষ্টু চায়ে হাল্কা চুমুক দিয়ে বলল, “আমরা জানতাম স্যার, এরকম কিছু একটা হবে”!
রজতশুভ্রবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, “তোমরা জানতে?”
বুল্টি বলল, “হ্যাঁ স্যার। ওই সভাপতির মতো বাজে লোক এই শহরে আর একজনও নেই। ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, মনে করে, ও যা খুশি করতে পারে। বড়োরা ওকে আর ওর দলকে ভয় পায়। আমরা পাই না”।
রজতশুভ্রবাবু বললেন, “তোমরা মানে?”
বুল্টি বলল, “আমরা মানে, আমাদের কলেজের ছেলেমেয়েরা। বিষ্টুদার মতো মানুষরা। টোটো চালায় বলে, বিষ্টুদাকে কম ভাববেন না, আংক্ল্। আমাদের কলেজ থেকেই ভালোভাবে পাশ করা গ্র্যাজুয়েট ও। ইংরজিতে অনার্স। কিন্তু চাকরির বাজার তো জানেন, স্যার, চাকরি কোথায়?”
রজতশুভ্রবাবু বললেন, “তাই নাকি? বাঃ, এ তো খুব ভালো কথা।”
বিষ্টু একটু হতাশ গলায় বলল, “আমরা বুল্টিদের পাড়াতেই থাকি, কাকু, ওদের কয়েকটা বাড়ি পরেই আমাদের বাড়ি। আমার বাবা বীণাপাণি স্কুলে পড়াতেন। তাঁর ছেলে এখন টোটো চালায়!”
বুল্টি ঝংকার তুলে বলল, “বাজে বকিস না, বিষ্টুদা, টোটো চালানো খারাপ, আংক্ল্ আপনি বলুন তো?”
রজতশুভ্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “মোটেই না, এ তো ব্যবসা। আগে আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা এসব লাইনে যেত না, আজকাল যাচ্ছে। খারাপ কেন হবে? তা ছাড়া হাত গুটিয়ে ঘরে বসে না থেকে যে কোন একটা কাজ নিয়ে থাকা ভাল।”
বিষ্টু বলল, “তাও যদি নিজের টাকায় টোটোটা কিনতে পারতাম, বিয়ের আগেই শ্বশুরের দেওয়া টোটো...”।
বুল্টি এবার রণমূর্তি ধারণ করল, বলল “তুই কী রকম অকৃতজ্ঞ রে বিষ্টুদা। বাবা তোকে দান করেছে, নাকি ভিক্ষে দিয়েছে? তোকে লোন দিয়েছে, আর সে তুই মাসে মাসে শোধও করছিস। লোকে তো ব্যাংক থেকেও লোন নেয়। আমার বাবা যে তোকে এত বিশ্বাস করে, সেটার মূল্য দিতে শেখ, বিষ্টুদা...”।
এতক্ষণ বিষ্টু আর বিল্টুর কেমিস্ট্রিটা বুঝেও না বোঝার ভান করছিলেন, এখন রজতশুভ্রবাবুর কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হল। বিষ্টু তার মানে বিপিনবাবুর হবু জামাই। রজতশুভ্রবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। তাঁর এই উচ্ছ্বসিত হাসি দেখে বুল্টি এবং বিষ্টু দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে রজতশুভ্রবাবু বললেন, “তোমাদের সমিতির সম্বর্ধনার কথা কিছুদিনের মধ্যে ভুলে যাবো। কিন্তু তোমাদের এমন রাজযোটকের মিঠে সম্বর্ধনা কিন্তু কোনদিন ভুলব না, মা বুল্টি! আমার মেয়েও তোরই বয়সি, তাকে আজ সঙ্গে নিয়ে এলে বেশ হত, তোর মতো মিষ্টি মেয়ের সঙ্গে তার বেশ আলাপ হত”!
বুল্টি আচমকা লজ্জা পেয়ে গেল খুব, মুখ নিচু করে বলল, “তাহলে একটা কথা দিন কাকু”।
রজতশুভ্রবাবু বুল্টির মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী কথা বল তো”?
“আমাদের বিয়ের সময় আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে”।
রজতশুভ্রবাবু একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন, একটা হাত বিষ্টুর কাঁধে আর অন্য হাত বুল্টির মাথায় রেখে বললেন, “এখানে আসার সময় এমন সম্বর্ধনার কথা কল্পনাও করিনি, নিশ্চয়ই আসব, খবর দিস”।
স্টেশনের মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে, ডাউনে হাওড়া যাওয়ার গাড়ি এক নম্বরে আসছে, এই ট্রেন গ্যালপিং সব স্টেশন ধরবে না।
প্রবন্ধ
বাংলার
পূর্ব-পশ্চিম
রথীন্দ্রনাথ বড়াল
ডঃ নগেন ঘোষ লেন, কলকাতা

আমেরিকায় পৌঁছে অবাক হয়েছিলাম বাসে চেপে। গাড়ীর স্টিয়ারিং উল্টোদিকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের ডানদিকের বদলে বাঁদিকে। আপ-ডাউন রাস্তার চলনও উল্টো। থাকার ঘরে ঢুকে দেখলাম—আলো-পাখা জ্বালানোর সুইচ্ উল্টো। মানে আমাদের দেশে – নীচে নামালে আলো জ্বলে – ওদেশে ওপরে ওপরে তুললে আলো জ্বলবে। আজ আমেরিকার আর ভারতের বৈপরিত্যের কথা বলতে বসিনি। বলতে চেয়েছি—পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিদিনের ব্যবহারিক বৈপরিত্য।
মামাবাড়ি গেলে দেখা হল বেবেদিদিদের সাথে। খেলাধূলা-খাওয়াদাওয়া চলতে থাকত। আমরা ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করে কিছু মুখে দিতাম না। কিন্তু বেবিদিদি ও আরো ওই বাড়ির দাদাদিদিদের দেখতাম—দিব্যি, ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃরাশ সারতে। তাদের দাঁতমাজা স্নানের আগে। জানিনা এই ব্যবস্থা পূর্ববঙ্গের সব জায়গায় চালু কিনা। মুখ ধোওয়ার পর স্নান। আমরা স্নান করতাম খাওয়ার মানে মধ্যাহ্নভোজের আগে। কোনোদিন বাদ পড়লে—সেদিন আর স্নান করা হত না। কিন্তু অপরপক্ষে দেখতাম খাওয়ার আগে স্নানের বাধ্যবাধকতা না থাকা। আগে করলেও চলে পরে করলেও চলে। স্নানের আগে সারা অঙ্গে সরিষার তেল আর মাথায় নারকেল তেল মাখা অবশ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গের দাদা-দিদি-বন্ধুদের মধ্যে এই বাধ্যবাধকতা ছিল বলে মনে হয়নি বরং স্নানের পর তেল মাখার প্রচলন ছিল কিংবা আছে বলেই মনে হয়। আর একটি বিষয়—গামছার ব্যবহার। গামছা ঘটিদের জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। বাবা-কাকা-দাদুদের স্নানের আগে পরে গামছা পরে কাটাতে দেখেছি। আর আমদাদুতো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন গামছা পরেই। শখ করে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো গামছা আনানো অনেক ঘটি বাবুদের অভ্যাস ছিল। বিশেষতঃ বাঁকুড়ার গামছা কিংবা উড়িষ্যার গেরুয়া গামছা। এই গামছা প্রীতি ওপার বাংলার মানুষের বোধহয় কম। গামছার পরিবর্তে অন্য প্রথা নিশ্চয়ই প্রচলিত ছিল।
স্নানের পরই আসে খাওয়ার কথা। এর বৈচিত্র্যের কথাতো বলে শেষ করা যায় না। কিছু কথা উল্লেখ করি—যেগুলো চোখে পড়েছে। ভুল কিছু বললে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। প্রথমে বলি, পান্তা খাওয়ার কথা। আমরা ঘটিরা তো ভুলেও পান্তা খাব না। অরন্ধনের একদিনই এই পান্তাভাত অল্প করে খাওয়া হত। অথচ ওপার বাংলার মানুষের মধ্যে পান্তা খাওয়ার মধ্যে বিপুল ভালবাসা দেখেছি। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের মাছ আর শাকপাতা খাওয়ার অভ্যাসও—পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেকটা আলাদা।
নানারকম শাক, মান, কচু, ওল ইত্যাদির ব্যবহার এপার বাংলার মানুষের জানা ছিল না। কিন্তু ওপার বাংলার মামীমা, দিদাদের হাতের এইসব নিরামিষ পদ আমায় বার বার মোহিত করেছে। মাছের বৈচিত্র্য সত্যিই বাংলাদেশকে মানে পূর্ব-পশ্চিম দুই বাংলাকেই সমৃদ্ধ করেছে। রুই, কাতলা, ইলিশ, চিংড়ির জনপ্রিয়তা দুই বাংলায় থাকলেও— দুই বাংলার জন্য দুটো আলাদা তালিকা অবশ্যই আমি তৈরী করে দিতে পারি। পশ্চিমবাংলা—পারশে, ট্যাংরা, তপশে, ভাঙ্গ, গুরজারি, নেদশ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর পূর্ব বাংলার—আর, বোয়াল, চিতল পাবদা। এই চারটি মাছ আমরা ছোটবেলায় খাওয়ার সুযোগ পায়নি। পশ্চিমবাংলার তালিকার মাছ পূর্ববঙ্গের ভাইবোনেরা কতটা খেয়েছে ঠিক জানা না থাকলেও—ব্যবহারের প্রকট বৈপরিত্য অবশ্যই ছিল আছে। বেলে, গুলেও পশ্চিমবাংলার প্রিয় মাছ। ভেটকি, পমফ্রেট দুই বাংলারই প্রিয়। আর শুঁটকি মাছের নানা পদ—একান্তই পূর্ববঙ্গের। এই বঙ্গের কাউকে আমি শুঁটকি চাখতে দেখিনি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে মূল পার্থক্য বোধহয়—পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর মানসিকতায় সেক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ আমাদের পশ্চিমবঙ্গকে কম করে ৫ গোল দিয়েছে। পশ্চিমবাংলার বাঙালীদের মধ্যে এক বড় অংশকে দেখেছি—কোন উদ্যোগ ছাড়া পৈতৃক বিষয় সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে জীবন কাটাতে। কেউ কেউ পৈতৃক ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেনি। বরং সংকুচিত হতে হতে সেই সব ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। আমার মামাবাড়ীর ঐতিহ্যশালী সুপ্রাচীন বটতলার বইয়ের ব্যবসার কথা মনে আসে। অন্যত্র সে আলোচনা করব। মা-মাসী-কাকীদের কোনোরকম চাকরীক্ষেত্রে যোগদানের উৎসাহ দেখিনি কিংবা সামাজিক পরিস্থিতি সেকাজে বিরত করেছে। অপরপক্ষে পূর্ববাংলার মানুষদের কঠোর পরিশ্রমে ও কৃচ্ছ্বসাধনে এই বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী পদে তাদের যোগদান উল্লেখযোগ্য। ওপার বাংলার মা-মাসীরাও স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন কিংবা ক্ষুদ্র সংগঠন/ব্যবসায় মনোনিয়োগ করেছেন। অলসতা সর্বক্ষেত্রে এবাংলাকে পিছিয়ে দিয়েছে। অপরপক্ষে উদ্যম ওপার বাংলার মানুষকে এগিয়ে দিয়েছে একটু একটু করে। এপার বাংলার মানুষ তাদের পাঁচমহল বাসস্থান রক্ষা করতে পারেনি। ভাড়া দিতে দিতে এক এক মহল হাতছাড়া হয়েছে। তারপর পুরোটাই প্রোমোটরদের দখলে। ওপার বাংলার কাকুরা, জ্যেঠুরা নিঃস্ব অবস্থায় এসে এক কামরা ঘরে অবর্ণনীয় কষ্ট করে—আজ তারা সুস্থ পরিচ্ছন্ন বাসস্থানের অধিকারী হয়েছেন। অপরপক্ষে, এ পারের অট্টালিকায় বট-অশ্বত্থের ঝুড়ি প্রায়শই দেখা যায়—যেগুলির সংস্কার করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। তাই ধ্বংস ক্রমশই ত্বরান্বিত হচ্ছে।
গল্প/প্রবন্ধ


চাই নিশ্ছিদ্র বুন্ধতা
আমাদের স্কুলে প্রার্থনা লাইনে রোজদিন একটা করে বানী পাঠ করা হয়। এটা আমাদের বর্তমান হেডস্যারের ভাবনা। এই বানী পাঠের দৌলতে কত নতুন নতুন বানী, ভাব-ভাবনা ঝুলিতে ভরতে পারি,আর তার ভালোলাগায় সকালটা শুরু হয় চমৎকার।
গত সোমবার সকালের বানী ছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান প্রয়াত এপিজে আবদুল কালাম মহাশয়ের।
বানীটার নিখুঁত উদ্ধৃতি করতে পারলাম না-- সামগ্রিক ভাবে বিষয়টা ছিল বন্ধুত্বের উপর---
★বৃষ্টি হলে ছাদের ফুটো জানা যায়
বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়।★
মনে ধরল কথাগুলো। যদিও বন্ধুত্ব নিয়ে মহামতি চানক্যের শ্লোক সকলের জানা। ছেলেবেলায় সংস্কৃত পাঠ্যে পড়েছি--
উৎসবে ব্যসনে চৈব
দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ
যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।
ছেলেবেলায় বারবারই মনে হয়েছে -- এমন একজন বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি-- এমন বন্ধু হয়ে ওঠা শুধু কঠিনই নয় অন্তত আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। ছেলেবেলার ধূলোখেলার বন্ধু থেকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কম কিছু বন্ধুতো জোটে নি।
আজ বলতে দ্বিধা নেই তাদের সত্যিকার বন্ধু হয়ে ওঠা দূরস্থ ক'জনের ভাল বন্ধু হতে পেরেছি!
তারাও বা ক'জন পেরেছে! শ্লোকটার মাপকাঠিতে বন্ধু হয়ে ওঠা সে আমার কম্ম ছিল না। এমন মহৎ বন্ধু আমি কোন কালেই হতে পারি নি, পারবও না। তা বলে বন্ধু হিসাবে সুযোগ সুবিধামতো পাশে থাকি নি এমনটা নয় আবার পাশে পাইনি সেটাও বললে মিথ্যে বলা হয়।
সে হিসাবে বন্ধুত্ব একটা পারস্পরিক দায়বদ্ধতা। এখনও পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হলে নস্টালজিক হয়ে পড়ি। পুরোনো দিনের আলাপচারিতা ওঠে আসে।
আবার একই দিন-রাত্রে আবর্তিত হয়ে কোন এক সময়ের খুব অতি বন্ধু আমাকে পশ্চিম গোলার্ধের লোক ভেবে বসে, আমি তাকে পূর্বের। বুঝতে পারি একটা সময়, সেই সময়ের প্রয়োজন ধরে রেখেছিল আমাদের দু'জনকে। আজকের সময় ইথার বন্ধুতার সময়। অজানা, অচেনা অসমবয়সী বন্ধুত্বের বিশ্বলোক আমাদের আঙুলে আঙুলে।
এই বন্ধুত্বের কোন দায় নেই-- পরস্পরের প্রয়োজন নেই, বন্ধুত্ব বাঁচানোর পরিশ্রম নেই। এমন কি কখন শুরু হল কখন শেষ হল বা হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। চানক্য শ্লোক মাফিক বায়বীয় এই বন্ধুত্বের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। তার মধ্যেও যে আকর্ষণ কাজ করে তা কেবল অদেখার অদৃশ্য মোহ।
যতদূর জানি আবদুল কালাম মহাশয় সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। চানক্য শ্লোক নিশ্চিতভাবেই ছিল তাঁর কন্ঠস্থ। তবুও বন্ধুত্বের ওইরূপ একটা প্রমাণ মান থেকেও কেন তিনি নতুন করে বন্ধুত্বের উপর এমন দু'কলম লিখলেন!
এটা অনেকাংশেই ঠিক বিপদে আমরা ক্রমশ নির্বান্ধব হয়ে পড়ছি। বিপদে বন্ধু পাশে থাকবে এটা যেমন চাইব তেমনই বন্ধুর বিপদে পাশে থাকার নিশ্চয়তা থাক। ঐ যে "ফুটো" ওটাই আসল কথা।
ফুটোটার দায় কার! ফুটোটা না থাকলে জল পড়বে কোথা থেকে। তাই বন্ধুত্ব নিশ্ছিদ্র হোক।
কোথাও বন্ধুত্বকে নিজেই ছেঁদা করে ফেলে-- বিপদে অবাঞ্ছিত প্রত্যাশা করে বসছি না তো আমরা!
২
চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে বুক সেল্ফ থেকে মোটা বইটা টেন নিল নৈঋতদা। সূচিপত্র বরাবর আঙুলটা দ্রুত নামতে নামতে স্থির হল "সেভিয়ার দম্পতি ও অদ্বৈতসাধনা" - টপিকটার ফেভিকলে। চশমা ও ভ্রুঁ জোড়ার ভিতর থেকে সরু দৃষ্টি ছু়্ঁড়ে দিয়ে নৈঋতদা বলল,
- কুমায়ুন ফেরত দু-পর্বের যে লেখাটা পোষ্টালি, সেটার মেটেরিয়াল এখান থেকে ঝেপেছিস?
লজ্জা মিশিয়ে বললাম-- 'খানিকটা।'
পুরোটা ঝেপেও মিথ্যে বললাম কারন নৈঋতদার এতবড়ো টপিকটা পড়ার সময় কোখায়!
- 'দেখ, কটা লেখা একেবারে মৌলিক হয় বলতো, তাছাড়া এধরনের লেখা মৌলিক হবেই বা কেমন করে! তবে তথ্য ঋণ স্বীকার করা উচিত ছিল।' কথাগুলো শেষ হতে না হতেই নৈঋতদা বলল,
- 'তবে পুরো বিষয়টাকে প্রেজেন্ট করেছিস বেশ। তোর এটা ভাল আসেও।'
নৈঋতদার মুখের কথা টেনে নিয়ে বললাম-- 'আর ছবিগুলো?'
- 'না, ছবির দিকটায় তোকে আরো খাটতে হবে।'
কথাটা শেষ করে চা'য়ে শেষ চুমুক রাখল নৈঋতদা। আমার লেখালেখির বেশিটাই যে ঝাপা এটা বুঝলেও বইটা যে নৈঋতদার, মানে সেটাও যে ঝাপা। তা বুঝে ফেলার আগে বইটা তড়িঘড়ি নৈঋতদার হাত থেকে নিয়ে সেল্ফে তুলে রাখলাম।
খানিকটা কলার উচুঁ করার ভঙ্গিতে বললাম,
- 'লেখাটা নিজের দেওয়াল ছাড়া তিনটে গ্রুপে টাঙিয়েছিলাম।'
নৈঋতদা চা'য়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে বলল,
দেখেছি, একটা গ্রুপে তো লেখাটায় তিন'শ সাঁইত্রিশটা কমেন্ট বাহান্নটা শেয়ার দেখলাম।
- 'বাহান্ন নয় দাদা বিরাশি' আর বেশি বাড়িয়ে বলতে সাহস হল না।
লোকটা সেয়ানা গ্রুপটায় গিয়ে পথে বসাতে পারে।
- 'অথচ দেখ নিজের দেওয়ালে.....'
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই নৈঋতদা মাস্টারমশাইয়ের মতো বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল-
- নিজের দেওয়ালে লাইক বা কমেন্ট জোটেনি বলে ভাবিস না,যে তোর বন্ধু বান্ধব প্ততিবেশি কাকা পিসিরা পড়ে নি। সবসময় লাইক কমেন্ট এগুলো পাঠ প্রতিক্রিয়া হবে এমন সরল ভাবনা করতে নেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম-- 'তবে!' নৈঋতদা আরো স্থিতধী হয়ে বলল,
- না পড়েও তো লাইক দেওয়া যায়,
- যায় না কি?
আমি সম্মতির ঘাড় দোলালাম।
- কমেন্ট পড়েও কমেন্ট করা যায়। কি রে-- হয় না কি! প্রতিবেশির পাঠ প্রতিক্রিয়া কেমন জানিস?
কাপালে হাজার রেখার আঁকিবুকি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে নৈঋতদা। আমি একেবারে চুপ। নৈঋতদা ফের শুরু করল,
- তোর আবাল্য বন্ধুর তোর প্রতি ঈর্ষা তোর প্রতিবেশি দাদা বা খুঁড়োর তোকে এড়িয়ে চলা অহেতু সমালোচনা, আড়ালে আবডালে গালমন্দ -- এগুলোই আসল পাঠ প্রতিক্রিয়া। কথাগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে নৈঋতদা সেল্ফ থেকে বইটা ফের নামিয়ে নিল। বইটার উপর আলতো আদুরে হাত বুলিয়ে বলল, - আটান্নটা শেয়ারের জন্য একদিন বিরিয়ানি খাইয়ে দিস।
৩
তোমরা তো আগেই জেনেছ--
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই
কিন্তু পাহাড়টাকে --
সে কোন দিনই ভুলতে পারল না।
মেঘ লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি পাঠাত পাহাড়কে।
বৃষ্টি দিয়ে লেখা সে চিঠি--
কান্না হয়ে ভিজিয়ে দিত পাহাড়টাকে
বজ্রকে লুকিয়ে--
মেঘ চুপটি বসে থাকত।
বসে থাকত পাহাড়ের গা'ঘেসে
বসে থাকত কালো শাড়িতে।
পাহাড়ের পিঠে পিঠ রেখে বলত----
কষ্ট কথা.....
লাল শাড়ি আর পরে নি মেঘ।
শোকের রং নাকি কালো।
একদিন মেঘ পাহাড়কে বলেছিল--
'বলতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সেতুর নাম কি?'
উদাস গলায় পাহাড় বলেছিল--
'বিরহ'।
ম্লান হাসি হেসেছিল মেঘ।
পাহাড় প্রশ্ন করেছিল--
'পৃথিবীর কুৎসিত ভাষা কি বলতো?'
মেঘ মূহুর্ত সময় না নিয়ে জানিয়েছিল --
'ব্রজের চিৎকার'।
তারপর তারা ডুবে গিয়েছিল--
একে অপরের আলিঙ্গনে।
আর ঠিক তখনই--
রক্তচক্ষু বজ্র এসে হাজির।
রগ ফুলিয়ে--
দিগবিদিক কাঁপিয়ে দিল চিৎকারে---
আশ্চর্য!
মেঘ বা পাহাড় কেউ ভয় পায় নি।
বরং আরো দৃঢ় হয়েছিল তাদের আলিঙ্গন।
আর বজ্র!
চিৎকার করতে করতে--
নিজেই হয়ে গিয়েছিল বধির।
পরদিন মেঘ পরে ছিল ধপধপে সাদা শাড়ি।
পাহাড় মুচকি হেসে বলেছিল--
'আজ বুঝি আর শোক নেই!'
'এ আমার বৈধব্য উল্লাস-- বজ্রের চোখ রাঙানিকে
উদ্ধত চিৎকারকে গলা টিপে মেরে ফেলার বৈধব্য।'---
আঁচলটা হাওয়ায় উড়িয়ে জানিয়েছিল মেঘ।
৪
সৃষ্টির আদি আলো দিয়েছিল সূর্য
শুধু আলো নয় বেঁচে থাকার উত্তাপও।
সূর্য আর চাঁদ দু'জনা
ভাগাভাগি করে নিয়েছিল দিন-রাত।
দিনের বেলা সূর্যের আলো...
আর রাতে চাঁদের চলকে আসা জ্যোৎস্না।
সূর্যেরও তো ক্লান্তি আসে.....
সারাদিনের খাটাখাটুনির পর রাতে ঘুমুতে ইচ্ছে যায়।
বিশ্রামের জন্যই তো....
ঈশ্বর রচনা করেছেন রাত্রি।
রাতের আলোর অভাব ঘুঁচিয়েছিল পাহাড়।
কিভাবে?
পাথর ভেঙেই বেরিয়েছিল প্রথম আলো।
যেদিন মানুষ প্রথম আলো জ্বেলেছিল
হয়তো সেদিনের কোন ধনতেরাসে....
সন্ধ্যা সবিতা...
পাহাড়টাকে দিয়েছিল একটা সাতনরী হার।
দিয়েছিল ভালোবেসে....
তারপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় পাহাড়টা...
সূর্যাস্তের আলোয় স্নান সেরে...
সাতনরী হারে সাজে....
অভিসারে যায়....
আজব রোগী
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
প্রবন্ধ


চেম্বারে তরুণ ডাক্তারবাবু বসে আছেন, এক বৃদ্ধা পা টেনে টেনে ঢুকলেন। সঙ্গে এক ছেলে।
“আসুন দিদা। বসুন। নাম কী বলুন।“ বৃদ্ধা নাম বললেন। ডাক্তারের আবার প্রশ্ন, “বয়স কত?”
এবার সেই রোগী ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দেখুন না কত লেখা আছে।“
এই সময়ে ছেলে একতাড়া পুরনো কাগজ এগিয়ে দিল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার বললেন,
“আপনার বয়স কত আপনি জানেন না?”
“না বাবা। ওই কাগজে যেটা লেখা আছে, সেটাই।“
“তাও আন্দাজে বলুন। কত হবে? ষাট?”
“হ্যাঁ। হতে পারে।“
“নাকি সত্তর?”
“সেটাও হতে পারে।“
ছেলে এইসময়ে বলল, “এইসব কাগজে দেখুন লেখা আছে কিনা। কত দেওয়া আছে মনে নেই।“
ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের আন্দাজ মত একটা বয়স লিখে বললেন,
“কী সমস্যা বলুন।“
“প্রচণ্ড গ্যাস। কিচ্ছু হজম হয় না। আর বুক পেট সবসময়ে এক হয়ে থাকে।“
“আর?”
“এটাই তো। গ্যাসের জন্য মাথায় ব্যথা। গ্যাসের জন্য পিঠে শিরদাঁড়া জুড়ে ব্যথা। আর পায়ের তলায় কেমন নিটপিট করে।“
“কাউকে দেখিয়েছেন?”
“কত্ত ডাক্তার দেখালাম। সেই যাদবপুরের ভুবনকে চেন? খুব বড় ডাক্তার। তাঁকে তো কতবার দেখালাম। সব বড় বড় ডাক্তার ফেল মেরে গেছে। কত টাকার ওষুধ আমার ছেলেরা কিনে দিল। কিচ্ছু হয় না। দেখ না, কত ওষুধ এখানে।“
এই বলে সেই রোগী একটা কালো পুঁটুলি বার করে ডাক্তারের টেবিলে ঢেলে দিলেন। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে পড়ল নানা সময়ের অজস্র ওষুধের স্ট্রিপ। তার কোনটা তিনটে খেয়ে তারপর বাকিটা পড়ে আছে, আর কোনটা পুরো ভর্তি, কিন্তু এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে। ডাক্তার আর্তনাদ করে উঠলেন, “এগুলো কী? এত পুরনো ওষুধ নিয়ে কী করছেন?”
“এই তো সব ওষুধ। “
ছেলে তখন বলল, “স্যার। মার যখন গ্যাস হয়, তখন এই ব্যাগ থেকে ওষুধ বার করে খায়।“
“এই ব্যাগ থেকে বার করে? এখানে তো দেখছি ভিটামিন, ব্যাথার ওষুধ সবরকম আছে। কোনটা খায় তাহলে?”
“জানি না স্যার।“
“এই তো দেখছি একটা ঘুমের ওষুধও আছে। এটাও খায় নাকি? কে দিয়েছে এটা?”
“ওই তো ভুবন দিয়েছে।“
“কবে?”
কেউ কোনও উত্তর দিল না।
ডাক্তার আবার বললেন, “তাহলে এগুলোই আপনার সমস্যা তাই তো?”
“হ্যাঁ বাবা।“
ডাক্তার প্রেসক্রিপশান লিখে নিলেন। তারপর বললেন, “এবার বুঝে নিন। এই কটা ওষুধ আছে। এই দুটো খাওয়ার আগে আর এই শেষেরটা খাওয়ার পরে। আর এই যে লেখা আছে, সেই টেস্ট করিয়ে
আসবেন।“
ছেলে প্রেসক্রিপশানটা তুলে নিল। তারপর দেখে বলল, “ডাক্তারবাবু এইটা খাওয়ার আগে?”
“হ্যাঁ, দেখুন লেখা আছে।“
“খাওয়ার আগে মানে কি পাঁচ মিনিট আগে না জাস্ট খেতে বসার আগে?”
“ওটা যেভাবে খুশি খাওয়া যায়।“
“আচ্ছা ডাক্তারবাবু, এটা খেলেই কমবে তো?”
“হ্যাঁ কমবে। একটু সময় লাগবে।“
“মানে আজকে রাত্রে কী একটু রিলিফ পাবে?”
“আজকে রাত্রে হবে কিনা জানি না। কিন্তু আস্তে আস্তে হবে।“
“জানেন না ডাক্তারবাবু, সারা রাত পেটে গ্যাস বলে জেগে থাকে। কাউকে শুতে দেয় না। সেই পুজোর পর থেকেই চলছে।“
“সে তো প্রায় দুমাস হয়ে গেছে। এতদিন দেখান নি কেন?”
“প্রথমে আমরা হোমিওপ্যাথি করলাম। তারপর আগের যে ওষুধ ছিল, সেটা দোকানে বলে কিনে এনে দিলাম। এত কিছু করলাম। কিছুতেই কমছে না।“
“আচ্ছা, কমবে। যেভাবে বলেছি খাওয়ান।“
এবার সেই রোগী উঠে দাঁড়ালেন। চেয়ার ঠেলে সরিয়ে বেরোনোর জন্য দরজা অবধি চলে গেলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “মেয়ে বলেছে একবার প্রেশারটা দেখতে।“
ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনার সমস্যা তো গ্যাস। তাহলে প্রেশার দেখে কী হবে?”
ছেলে বলল, “হ্যাঁ, একটু দেখে দিন। আসলে আগে মায়ের প্রেশার ছিল। সেরে গেছে বলে বন্ধ করে দিয়েছি আমরা।“
“এটা তো এতক্ষণ বলেননি! আর প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করেছেন কেন?”
“আসলে বুঝলেন এক ওষুধ বেশিদিন খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। সেই জন্য।“
“এটা কে বলল?”
“আমাদের পাশের বাড়ির একজন বলল। সে বলল,
----মাসিমা আপনি এতদিন এক ওষুধ খাবেন না। সেইজন্য বন্ধ করেছি।“
“কী ওষুধ খাচ্ছিলেন? সেই কাগজ আছে?”
“প্রেশারের ওষুধ বাবা। ওই যে সাদা সাদা ছোট বড়ি। এক পাতার দাম চল্লিশ টাকা। সেইটা।“
ডাক্তার হাল ছেড়ে প্রেশার চেক করলেন। “ঠিক আছে এখন।“
ছেলে বলল, “ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, বললাম তো।“
“মানে ওষুধ লাগবে না?”
“এখন না।“
“পরে লাগতে পারে?”
“বেড়ে গেলে লাগবে।“
রোগী আর তার ছেলে প্রায় চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার ছেলে ফিরে এসে বলল, “ডাক্তারবাবু, একটা কথা বলা হয়নি। আমার মায়ের কিন্তু লিভার খারাপ। প্রায় দশ বছর থেকে পিজিতে চিকিৎসা চলছে।“
ডাক্তারবাবু এবার চীৎকার করে বললেন, “আসল অসুখের কথা না বলে আপনি পুরো সময় ধরে গ্যাসের গল্প শুনিয়ে গেলেন? আবার নাম লেখান কালকে। আজকে আর হবে না।“
ফেস্টিভ্যাল
অফার
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
গল্প


শ্রেয়সীদি খুব উত্তেজিত। একটা অনলাইন শপিং ওয়েবসাইটে বছর শেষের বিশেষ ডিসকাউন্ট সেল দিচ্ছে। ৩১শে ডিসেম্বর বিকেল সাতটা থেকে নটা ---শুধু এই সময়ের জন্যই এই অফার খোলা থাকবে। তার আগেও নয়, পরেও নয়। আর কম নয়, পঞ্চাশ থেকে আশি শতাংশ অবধি ছাড়। পাগল ছাড়া কেউ এই সুযোগ ছাড়ে?
শ্রেয়সীদি সবাইকে বলে রেখেছে, ওই সময়ে যেন কেউ ফোন না করে। ফোন নয়, ভিডিও কল নয়। বাড়িতে সায়নদা আছে, শ্রেয়সীদির বর। তাকেও শাসিয়ে রেখেছে, “তুমি ওই সময়ে নেটফ্লিক্স দেখবে না। ওটা দেখলে ওয়াইফাই স্লো হয়ে যাবে। আমি সবকিছু বুকিং করতে পারব না। বাম্পার অফার হাতছাড়া হয়ে যাবে!”। সায়নদা প্রথমে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, “ওইদিন একটা নতুন ফ্যান্টাসি সিরিজের নতুন সিজনের প্রিমিয়ার আছে। আমি এর আগের সিজনটা দেখেছি। প্রায় ক্লিফহ্যাঙ্গারে শেষ হয়েছিল। এই সিজনে কী হল…” কথা শেষ করার আগেই শ্রেয়সীদি চীৎকার করে উঠেছে, “আমি ওইসব জানি না। নেটফ্লিক্সে পরেও দেখতে পারবে। নটার পরে যত খুশি দেখো। কিন্তু নটার আগে যদি নেটফ্লিক্স চালিয়ে ওয়াইফাই স্লো করে দাও, তাহলে আমি নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দেব। আর কোনদিন দেখতে পারবে না!” সায়নদা আর কথা বাড়ায়নি। তাও আর একবার আস্তে করে বলেছিল, “একবার প্রিমিয়ার হয়ে গেলে ফেসবুকে আমাদের গ্রুপে সবাই স্পয়লার দিয়ে দেবে। তখন আর দেখে কী হবে?” শ্রেয়সীদি আবার চেঁচিয়ে উঠেছে, “তাহলে ওই দুই ঘণ্টা ফেসবুকের বাইরে থাক! তাহলেই আর স্পয়লার চোখে পড়বে না। জানো গতবার এরকম সেল থেকে মিসেস রাউত কী দারুণ একটা এক্সারসাইজ বাইক কিনেছিলেন।" সায়নদা হেসে বলে, “সেই বাইক? তুমি একবার কিনবে বলে ঠিক করেছিলে না? ওসব দিয়ে কী হয়? আমি দেখেছি সব বাঙালি বাড়িতেই এই বাইক কিছুদিন পরেই হয়ে যায় জামাকাপড় মেলার স্ট্যান্ড!”
“একদম বাজে কথা বলবে না। নিজে কুঁড়ের বাদশা, তাই সবাইকে ভাবো নিজের মতন। আমি যদি কোনদিন কিনি, তাহলে দেখবে রেগুলার কাজে লাগাবো”।
সায়নদা আর কী করবে? অনেকদিন পরে টিভি খুলে বসল। একটা বাংলা নিউজ চ্যানেল। সন্ধ্যে সাতটার সময়ে খুলেই দেখে, ও মা! এত চীৎকার কিসের? একটা স্টুডিয়োতে পাঁচ ছয় জন লোক বসে আছে আর সবাই সবার ওপর চীৎকার করে চলেছে। সায়নদা গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ গো, এখন সাতটায় খবর হয় না?” শ্রেয়সীদি তখন সবে সাইট খুলেছে। অলরেডি হোয়াটসঅ্যাপে এক বন্ধু আপডেট দিয়েছে যে সত্তর পারসেন্ট ডিস্কাউন্টে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লীনার বুক করে ফেলেছে। শ্রেয়সীদির প্রচণ্ড চাপ লাগছে। এরকম কিছু একটা বুক না করতে পারলে পরদিন বন্ধুদের চ্যাটের সময়ে লজ্জায় পড়ে যেতে হবে। তখন সায়নদার প্রশ্ন শুনে প্রথমে অন্যমনস্কভাবে বলল, “খবর তো আমার হয়ে গেছে। জানো, মিসেস মাধবন অলরেডি একটা দারুণ ডিল পেয়ে গেছেন”। সায়নদা বুঝল এখন আর শ্রেয়সীদি এই জগতে নেই। উনি এখন ঢুকে গেছেন অফার আর ডিস্কাউন্টের মধ্যে। সায়নদা চুপচাপ টিভি দেখতে শুরু করল। কিন্তু এ কী প্রোগ্রাম? পাঁচ-ছজন লোক বসে আছেন। কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কে জানে? শুধু দেখা যাচ্ছে একসাথে সবার মাইক অন করা আর সবাই একসাথে কথা বলছে। আবার প্রোগ্রামের নাম দিয়েছে, “দিনের শেষের আড্ডা”! এর নাম আড্ডা? কিন্তু অন্য কোন চ্যানেলে যাবেন? আজকাল অনলাইনে সিনেমা, সিরিয়াল ইত্যাদি সব দেখে দেখে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে টিভি দেখতে ভালোই লাগে না। অগত্যা ভলিউম একটু কমিয়ে এটাই দেখতে শুরু করলেন। একবার ফেসবুকের গ্রুপে ঢুকেছিলেন। যেই দেখলেন যে অনেক মেম্বার সেই সিজন প্রিমিয়ারের সম্পর্কে আপডেট দিচ্ছে, অমনি বন্ধ করে দিলেন।
এদিকে শ্রেয়সীদির তো তখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। প্রথমেই জামা কাপড়ের লিঙ্কে ক্লিক করেছেন। পর পর অফার আসছে। একটা হলুদ কুর্তি বেশ পছন্দ হল। সায়নদাকে ডেকে একবার বললেন, “এই দেখে যাও তো”। সায়নদা তখন সেই ঝগড়ার মধ্যে ঢুকে গেছেন। একজন কলেজের প্রফেসর অন্য একজন প্রোফেসরকে মুখের ওপর “অশিক্ষিত” বলে দিয়েছেন। এবার ক্যামেরা ঘুরে গেছে সেই আক্রান্তের দিকে। স্টুডিয়োতে সবাই চুপ। কী হয় কী হয় ভাব। সায়নদার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ। কী হবে? সেই প্রোফেসর কী চীৎকার করবেন, না স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে যাবেন? নাকি বেশ লঙ্কাবাটার মত উত্তর দেবেন? এই সময়ে শ্রেয়সীদি ডেকে পাঠাল, “দেখে যাও তো!” সায়নদা টিভির দিকে চোখ রেখেই বলল, “কেন?” “আরে দেখ না। এই কুর্তিটা বুক করে দেব? আর মাত্র সাতাশ মিনিট ডিলটা খোলা থাকবে। আর বলছে মাত্র দু পিস আছে। এখনই না নিলে কিন্তু হাওয়া হয়ে যাবে”।
“আরে তোমার ভালো লাগলে নিয়ে নাও”।
“একবার দেখবে না?”
“একটু পরে আসব”। আসলে তখন সেই প্রোফেসর বেশ যুতসই একটা জবাব দিচ্ছেন। অন্যজনের পুরনো ইতিহাস টেনে এনে, তার পরিবারের ইতিহাস টেনে এনে মোটামুটি হাটে হাড়ি ভাঙছেন। ক্যামেরা একবার দেখাছে বক্তাকে, আর একবার দেখাচ্ছে তার টার্গেটকে। এই সময়ে ওঠা যায়?
শ্রেয়সীদি আবার চিল্লিয়ে ওঠে, “এলে না তো? তাহলে বুক করে দিলাম কিন্তু…”
“দাও না। ডিস্কাউন্ট তো। কত আর দাম হবে?”
“ঠিক আছে। এর পরে কিন্তু কিছু বলবে না”।
“দাও দাও”।
শ্রেয়সীদি তো বুক করে তার স্ক্রীনশট নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করে দিয়েছেন। পাঁচ মিনিট পরেই চীৎকার। “এ বাবা, তুমি একটু বলতে পারলে না?”
তখন বিজ্ঞাপনের বিরতি চলছে। সায়নদা সবে জল খেয়ে পরের রাউন্ডের জন্য রেডি হচ্ছেন। এই সময়ে এই চীৎকার। বিরতির ঠিক আগে একজন নতুন বক্তা এসে একটা জব্বর গালাগালি দিয়েছেন। সায়নদা সবে ভাবছিল যে এরকম গালাগালি প্রাইমটাইম টিভিতে বিপ না করে প্রচার করল কী করে? সায়নদার চিন্তার রেশ কেটে গেল। উঠে এসে বলল, “কী হয়েছে?”
“দেখ না, এই যে কুর্তি বুক করলাম, সাইজে ছোট!” “কত ছোট?”
“আমার থার্টি টু লাগে। এটা থার্টি”।
“আগে দেখো নি?”
“দেখলে কী আর তোমাকে ডাকি? তখন তো ডিল পাবো বলে ক্লিক করে দিলাম। সাইজ দেখার সময় ছিল না।”
“তাহলে ক্যান্সেল করে দাও”।
“আমি হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দিয়েছি। সবাই লাইক করেছে আর ক্ল্যাপ ইমোজি দিয়ে দিয়েছে। এখন ক্যান্সেল করলে লোকে কী বলবে?”
“লোকে কী বলবে সেই জন্য তুমি ছোট জামা কিনবে? টাকা নষ্ট করবে?”
“সেটা তুমি বুঝবে না। আগের বার এইরকম হলুদ জামা কিনে তানিয়া ফেসবুকে কয়েকশো ছবি দিয়েছিল। প্রচুর লাইক পড়েছিল। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছি যে ওইরকম জামা কিনে সেটা পরে কালকে নিউ ইয়ারস ডে তে ছবি দেব। আর যদি এখন সেটা কিনে ক্যান্সেল করি, তাহলে সবাই কী বলবে?”
“অন্য জামা দেখো। তাহলেই হবে!”
সায়নদা আবার এসে টিভির সামনে বসে পরে। বিরতি শেষ। সেই গালাগালি নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ওটা কাকে দেওয়া হয়েছে? বক্তার দাবি তিনি কোন ব্যাক্তিকে নয়, সিস্টেমকে গালাগালি দিয়েছেন। অন্য একজন বক্তা মানহানির মামলার ভয় দেখাচ্ছেন। সায়নদার মন অনলাইন সেল থেকে সরে গেছে।
শ্রেয়সীদি কিছুক্ষণ পরে বলল, “বুঝলে ক্যান্সেল আর করলাম না। কালকে ওটাই টেনেটুনে পরে ছবি তুলে নেব। তারপর আমি তো ওয়েট লুজ করছিই, কিছুদিন পরেই ওটা ফিট করে যাবে”।টিভিতে তখন চীৎকার চলছে, “আপনি এই সময়ের পক্ষে মিসফিট! আপনি পঞ্চাশের দশকে ফিরে যান…” সায়নদা সেই শুনতে শুনতে বলে দিল,
“ঠিক আছে। ফিট করে যাবে। নিয়ে নাও”।
“আর এমনকি বেশি দাম। মাত্র চার হাজার”।
“অ্যাঁ!” সায়নদা মাথা ঘোরায়, “তুমি যে বললে ডিসকাউন্ট? এত দাম কেন?”
শ্রেয়সীদি বলে, “আরে ডিসকাউন্ট দিয়েই এই দাম। নইলে কী আর কিনি? এমনি সময়ে, দেখে যাও না, দাম প্রায় আট হাজার”।
সায়নদা উঠে দেখতে যাচ্ছিলেন। এই সময়ে প্রোগ্রামের সঞ্চালক বলে উঠলেন, “এই ভুল প্ল্যানিং এর ফলেই কিন্তু গত বছর প্রায় এগারশো কোটি টাকা জলে গেছে”।
ব্যাস, সায়নদা আবার জমে গেলেন। একটু আগেই একজন নেতা সেই প্ল্যানিং এর প্রশংসা করছিলেন। এবার ক্যামেরা তার মুখের দিকে। চার হাজার টাকায় সাইজে ছোট জামা কেনার প্রসঙ্গ ওখানেই চাপা পড়ল।
মাঝে মাঝেই শ্রেয়সীদি টুকটাক কথা ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন। “এই জানো, এই কফি টেবিলের জন্য একটা সেরামিকের ভাস কিনলাম”, “আমাদের রান্নাঘরের জন্য একটা স্ট্যান্ড কিনে নিলাম” বা “তোমার নেকটাইটা পুরনো হয়ে গেছে। একটা লাল রঙের কিনলাম” ইত্যাদি। কিন্তু সায়নদার তখন সেসব মাথায় নেই। এক ঘণ্টা হয়েছে। ঝগড়ার তখন মধ্যগগন। কিছুদিন আগের একটা বক্তৃতার ক্লিপ দেখাচ্ছে। এর পরেই শুরু হবে সেটার চুলচেরা বিচার। এখন আর কফি টেবিলের ভাস নিয়ে ভাবার সময় আছে?
একটু পরে শ্রেয়সীদি বলল, “তোমার জিপে একাউন্ট এর পাসওয়ার্ডটা বল তো”।
“কেন?” সায়নদা একটু চমকে ওঠে।
“আমার জিপে একাউন্টে সব শেষ”।
“সব শেষ? মানে? কী কিনেছ?”
“কিছুই না। এই দেখ না আমার কার্ট!”
সায়নদা উঠে আসে। চেয়ে দেখে সেই কার্টের লিস্ট। “এতগুলো দেয়ালে ঝোলানোর ছবি কিনেছ কেন? কোথায় রাখবে? আমাদের বাড়িতে কী আর জায়গা আছে?”
“কিনে নিলাম। আমাদের কিছু কিছু বেশ পুরনো হয়ে গেছে। ভাবছিলাম চেঞ্জ করব। এই দেখ, প্রায় ৫০ পারসেন্ট কমে পেয়েছি। এই ছবি যদি তুমি গড়িয়াহাটের দোকানে কিনতে যাও, গলা কেটে নেবে!”
সায়নদা ছবিটা দেখলেন। এমন কিছু সুন্দর লাগল না। একটা বিখ্যাত আমেরিকান পেন্টারের ছবির প্রিন্ট। কিন্তু শ্রেয়সীদি এমন হাসিমুখে ছবিটা দেখালেন যে সায়নদা আর কিছু বললেন না। আর সাহস করে সেই ছবির দামের দিকে তাকালেনও না।
টিভি থেকে ভেসে আসছে এক বিখ্যাত লেখকের গলার শব্দ। এবার প্রোগ্রামে ওনাকে জুম কলে নিয়েছে। এটা না দেখলে হবেই না। সায়নদা গুটি গুটি পায়ে আবার সোফার দিকে পা বাড়ালেন। তাও পাসওয়ার্ডটা দেওয়ার সময়ে একবার বললেন, “এই তো সেদিন দেওয়ালি সেলের সময়ে গুচ্ছের জিনিস কিনলে। বেশিরভাগ প্যাকেজ অবধি খোলা হয় নি। আবার কিনে কী হবে?”
“তুমি যাও তো। বললাম এসে আমাকে সাপোর্ট কর। আমাকে ঠিকঠাক জিনিস চিনিয়ে দাও। সেসবের নাম নেই। একদিন ছুটিতে বাড়ি আছ। সেটাও টিভির সামনে বসেই কাটিয়ে দিলে”।
সায়নদার মুখে অনেকগুলো কথা এসে গিয়েছিলঃ টিভির সামনে বসতে চাই নি। তুমি নেটফ্লিক্স দেখতে দিলে না তাই বসেছি। তুমি নিজে কী করছ? কার কথা শুনে অনলাইন সেল হবে, সেই আনন্দে সব কাজ ছেড়ে রাবিশ সব বুক করছ। তার বেলা? কিন্তু এসব বললে টিভির এই জমাটি প্রোগ্রাম মাথায় উঠবে, লাভ কী? তাছাড়া যা কেনার সে তো কেনা হয়েই গেছে। দেখা যাক না, কীরকম হয়। সেই মনে আছে গত দেওয়ালিতে একটা ড্রিমক্যাচার কিনেছিল। সে তো দুদিন পরেই দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেল। কিন্তু এখন বেশ ধুলো ঝাড়তে কাজে লাগে।
কিন্তু এসব কথা বলা যায় না। আর তখন সায়নদার ফেভারিট টপিক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের উদার অর্থনীতি এনে লাভ হয়েছে না ক্ষতি? সেই সময়ে ঝগড়া শুরু হলে মুশকিল। তাই সায়নদা চুপ করে গেলেন। নটার সময়ে প্রোগ্রাম শেষ। তখন দেখা যাবে।
ইতিমধ্যে প্রায় পনেরো মিনিট শ্রেয়সীদির মুখে কথা নেই। একবার দুবার নিচু গলায় কীসব মন্তব্য করেছিল, সায়নদা শোনার চেষ্টা করেনি। যা কিনছে কিনুক। এর আগেও হয়েছে। কিছু জিনিস পেয়েছে বাড়ির রান্নার মাসি, কিছু পেয়েছে বাড়ির কেয়ারটেকারের বউ। এবারও তাই হবে। একবার দুবার সায়নদার মোবাইলে একাউন্ট ডেবিট হওয়ার মেসেজ এসেছে। তার মানে অনলাইন বুকিং চলছে। তা চলুক।
একবার শ্রেয়সীদি বলল, “অনেকদিন ধরে শখ ছিল। এরকম অফার পেলে ছাড়া যায়? কিনে নিই, কী বল?” সায়নদা তখন মগ্ন দেশের কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে। যখন প্রোগ্রামের আর পাঁচ মিনিট বাকি, তখন শ্রেয়সীদি একবার ডাকল। “দেখে যাও। এটাই ফাইনাল করলাম”। তখন কী আর টিভির সামনে থেকে ওঠা যায়? একজন বক্তা প্রায় টেবিলের ওপর উঠে সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখছেন। অন্যরা মুখ খুলে তীর্থের কাকের মত বসে আছে। কিন্তু সেই বক্তার গলার জোর এতটাই যে লাগসই উত্তর দিয়ে উঠতে পারছে না। টিভি স্ক্রীনের একদিকে গ্রাফ ভেসে উঠছে। শেষ তিন বছরের সালতামামি। একদিকে সেই বক্তৃতা আর অন্যদিকে সেই গ্রাফের নীচে লেখা দেখানো হচ্ছে যে বক্তা ভুল বলছেন। সায়নদা বলল, “এখন দাড়াও। একটু পরে আসছি”। শ্রেয়সীদি তাও কীসব বলছিল। “তোমার আমার দুজনেরই কাজে লাগবে”, “আর বাইরে যেতে হবে না”। “দারুণ কমে পাচ্ছি” ইত্যাদি। সায়নদা খুব একটা মন দিয়ে শোনেনি। শেষে শ্রেয়সীদি চীৎকার করল,
“আরে সেল তো আর পাঁচ মিনিটেই শেষ। যদি এখন ক্লিক না করি তাহলে কিন্তু হাত ফস্কে যাবে”।
“তাহলে করে দাও”।
“ ঠিক তো?”
“আরে করে দাও না”।
“এটা কিন্তু তোমার আমার দুজনেরই কাজে লাগবে। ওই যে জামাটা কিনলাম, সেটাও পরতে পারব”।
“ঠিক আছে। করে দাও”।
নটা বাজল। টিভির প্রোগ্রামও শেষ। অনলাইন সেলও শেষ। শ্রেয়সীদি বিজয়গর্বে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল। “এই শেষ অফারটা যে পাব ভাবতে পারিনি।” সায়নদার তখন মাথা ঘুরছে। টানা দু ঘণ্টা চীৎকার আর টেবিল বাজানো শুনে শুনে তিনি ক্লান্ত। “বা!” উনি না দেখেই বললেন, “ ভালোই বাজার হল তাহলে।”
শ্রেয়সীদির তখন সময় নেই। হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করছেন যে কত কম দামে কী কী জিনিস পেয়ে গেছেন। একবার মুখ তুলে বললেন, “তাহলে ওটা এলেই তোমার সোফার পাশে দিয়ে দেব।”
এতক্ষণে সায়নদার টনক নড়ল। “কী দিয়ে দেবে? সেই স্ট্যান্ড? সে তো রান্নাঘরে বললে…”
“আরে নানা। সে তো রান্নাঘরেই থাকবে। আমি বলছি সেই বাইকের কথা!”
“বাইক মানে?”
“কেন, এতক্ষণ ধরে যা যা বললাম, কিছুই শোনোনি? কী বললাম তোমায়? লাস্ট মোমেন্টে দেখি সেই ইনডোর এক্সারসাইজ বাইক সিক্সটি পারসেন্ট কমে দিচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল আর দুটো বেড কভার কিনব। কিন্তু এটা দেখে সব ছেড়ে এটাই নিয়ে নিলাম।”
ততক্ষণে হোয়াটসঅ্যাপের পোস্ট দেখে ফোন আসতে শুরু করেছে। সায়নদা শুনতে পেলেন, “আরে তানিয়া। দারুণ ব্যাপার বল। আমি ভাবতেই পারিনি এত কমে এটা পেয়ে যাব।”
সায়নদা একটু হাঁপ ছাড়লেন। যাক, কমেই পেয়েছে। হঠাৎ ওনার মনে পড়ল সেই নেটফ্লিক্সের সিরিজের কথা। তাড়াতাড়ি মোবাইলে খুলতে গিয়ে দেখলেন অনেকগুলো মেসেজ এসেছে। সব একাউন্ট ডেবিট হওয়ার মেসেজ। শেষেরটা খুলেই সায়নদার চোখ কপালে। এ কী? এর নাম সিক্সটি পারসেন্ট? এ তো গালে থাপ্পড় মেরে টাকা নেওয়া!
ওদিকে শুনতে পেলেন শ্রেয়সীদি কাকে ফোনে বলছে, “হ্যাঁ রে, আমিও ভাবিনি। মাত্র পয়তাল্লিশ হাজারে এরকম বাইক পেয়ে যাব। নেক্সট উইকেই ডেলিভারি দেবে। তখন তোকে ডাকব। এসে দেখে যাস।”
সায়নদার আর নেটফ্লিক্সের সিরিজ দেখার ইচ্ছে রইল না।
বাগান করার ঝকমারি
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা

প্রবন্ধ

আমাদের পাড়ার অভিষেকদার খুব বাগানের শখ। বাড়ির সামনে কোন জায়গা নেই। কিন্তু তাতে কী? বাড়ির প্রত্যেক জানলা, বারান্দা, আর বাড়ির ছাদে তাঁর গাছ-গাছালির জগৎ। আর ঘরের ভেতরেও রয়েছে হরেক রকম ইনডোর প্ল্যান্ট। অভিষেকদার বউ, মানে আমাদের গার্গীবৌদির প্রাণ ওষ্ঠাগত। যত অভিষেকদার গাছের সংখ্যা বাড়ছে, ততই বৌদির ব্লাড প্রেশার বাড়ছে। আমাকে দেখতে পেলেই বলে,
“বুঝলি সায়ন, মনে হয় এবার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে”।
“এবারে আমি কিন্তু খুনোখুনি করে ফেলব সায়ন!”
কিছুক্ষণ পরে দাদা দরজা খুলে প্রথমে আমার পেছনে আর কেউ আছে কিনা দেখে, তারপর আমাকে ছাদে ঢুকতে দিল। “কী ব্যাপার?” আমি প্রশ্ন করি, “ফেসবুকে ক্রিপ্টিক মেসেজ, বাড়িতে
নিজের ঘরে দরজা বন্ধ। কী করছ?”
“আস্তে আস্তে বলছি দাঁড়া”।
দাদা আমাকে টেনে নিয়ে গেল ছাদের এক কোণে। এদিকটা একটা লোহার খাঁচা মত বানানো।
“এই দেখ—"
একটা টবে দেখলাম একটা ছোট গাছ। ঘন সবুজ পাতা। “কী এটা দাদা?”
“বলছি। কিন্তু প্রমিস কর যে কাউকে বলবি না?”
“আরে নিশ্চয়ই। কোনদিন বলেছি?”
“বউদিকেও না?”
“তুমি না বললে বলব না!”
“ঠিক আছে। এটা কী গাছ জানিস?”
“না। চেনা লাগছে না!”
“এটা হল ইস্তানবুলের প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার!”
“সে আবার কী?”
“তুর্কির এক অখ্যাত গ্রামে এই ফুল ফোটে। বছরে মাত্র পাঁচ দিন। এটা সেই গাছ!”
“সে কী! তুমি পেলে কী করে?”
“সে এক গল্প। আমার ফেসবুক পেজের এক ফ্যান আমাকে সেদিন মেসেঞ্জারে বলল”।
“তুমি কিনলে?”
“আরে এসব ফুলের কী দাম হয়? সেই ফ্যানের বাবার প্রিয় গাছ ছিল এটা। তিনি মারা গেছেন সম্প্রতি। সেই লোকটি অন্য শহরে চলে যাচ্ছে বাড়ি বিক্রি করে। সে আমাকে দিয়ে দিল”।
“কিন্তু,” আমার সন্দেহ যায় না,“ এরকম রেয়ার গাছ কলকাতায় আছে আমরা কেউ জানি না! আমাদের কথা ছাড়, তুমি এত দেশ বিদেশের গাছ লাগাও, তুমিও জানতে না যে কলকাতায় কারুর কাছে এরকম গাছ আছে?”
“আরে ও বলেছে যে ওর বাবা সব সময়ে প্রচার এড়িয়ে চলতে চাইতেন। তাই এই গাছের কথা উনি কাউকে বলেন নি”।
“প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার?” আমার সন্দেহ যেন যায় না। “তুমি দেখেছ সেই ফুলের ছবি?”
“এই দেখ, আমাকে হোয়াটসআপে পাঠিয়েছে”।
চেয়ে দেখলাম। সত্যিই সুন্দর ফুল। হালকা গোলাপি রঙের বড় বড় পাপড়ি, মাঝখানটা লাল। পাপড়ি এক সারিতে নয়, প্রায় চার-পাঁচ সারি পাপড়ি মেলে আছে ফুলটা। এত সুন্দর ফুল সত্যিই আমরা কেউ দেখিনি।
“বাহ!” আমার মুখ দিয়ে আপনিই বেরিয়ে গেল। “এই ফুল হবে ওই গাছে?”
“হবে মানে? আর তিন দিন!”
“সে কী! আমি বলে উঠি। কুঁড়ি এসে গেছে এরই মধ্যে?”
“আরে কুঁড়ি ছিলই। আমাকে যখন বিক্রি করেছে, তখনই কুঁড়ি ছিল। ওই দেখ না!”
সত্যিই দেখলাম একটা ডালে ছোট ছোট কুঁড়ি। আগে চোখে পড়েনি।
“কিন্তু এত ছোট কুঁড়ি?” আমি একটু ক্ষুণ্ণ হলাম, “ছবির ফুলগুলো তো বেশ বড় বড় গো”।
“আরে এতেই হবে। এই ফুল একবার ফুটলে দুসপ্তাহ থাকে। আস্তে আস্তে বড় হবে”।
দাদাকে কংগ্র্যাটস জানিয়ে চলে আসছি, দাদা একটু ডাকল, “এই সায়ন, আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিতে পারবি?”
“সে কী? কেন?”
“আসলে এই গাছটার দাম নিয়েছে সাড়ে ছয়। এখন আমার হাতে এই ফোনের ই এম আই দেওয়ার টাকাও নেই”।
“সাড়ে ছয়?” আমার মুখ আপনি থেকেই হাঁ হয়ে গেল, “তবে যে বললে এমনিই দিয়ে দিয়েছে!”
“ধুর, এমনি কী হয়? উনি আমাকে ক্যাটালগ দেখালেন বিদেশে এর চারার দাম প্রায় পাঁচশ ডলার। নেহাত উনি চলে যাবেন তাই কম দামে আমাকে দিয়ে দিলেন”।
এরপর কেটে গেল দিন তিনের। আমার নিজের অফিসের কাজে এই কথাটা ভুলেই গিয়েছি। হঠাৎ একদিন মা আমাকে ডেকে বলল, “কী ব্যাপার রে? অভিষেকরা বাড়ি বন্ধ করে কোথায় গেছে?”
“বাড়ি বন্ধ করে?” আমি অবাক হলাম।“ কই জানি না তো!”
পরের দিন গিয়ে দেখি সত্যিই বাড়ি বন্ধ। অভিষেকদাকে ফোন করলাম। ফোন আউট অফ রিচ। বৌদির ফোনেও লাগলো না। অবশেষে বিকালে ফোনে বৌদিকে পেলাম।
“কী হয়েছে বৌদি? তোমরা কোথায়?”
বৌদি প্রায় কান্নাভেজা গলায় বললেন, “কেন? জানো না?”
“না তো? কী হয়েছে?”
অবশেষে জানা গেল সেই ঘটনার কথা। দাদা টানা দুদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে ছাদের সেই গাছের পাশে বসে ছিলেন। অবশেষে তিন দিনের মাথায় ভোরবেলা ফুটল সেই ফুল। বেশ ছোট ফুল। কিন্তু তাও, ইস্তানবুলের প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার বলে কথা। দাদা ভোর পাঁচটাতেই ফেসবুক লাইভ করে সেই গাছ দেখিয়েছেন সবাইকে। তারপর কিছুক্ষণের জন্য ফোন বন্ধ করে ঘুমোতে গেছেন।
আটটার সময়ে উঠে ফেসবুক খুলেই বজ্রপাত। দাদার পেজে ব্যাঙ্গ আর রসিকতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আজকের ছেলে মেয়েরা যখন ফেসবুকে ট্রোল করে, তখন কিন্তু ভদ্রতা-সভ্যতার ধার ধারেনা। “জালিয়াত”, “জোচ্চোর” “নতুন সুদীপ্ত সেন” ইত্যাদি বাছা বাছা বিশেষণে দাদাকে ভূষিত করা হয়েছে। কী হল কেসটা?
দাদা স্ক্রোল করতে করতে অবশেষে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। ফেসবুকে ছবি দেখার পরেই চারিদিকের বাগানপ্রেমীরা রে রে করে উঠেছেন। এটা প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার? চালাকির জায়গা পাওনি? এটা হল ঘেঁটু ফুল। গ্রামের মাঠেঘাটে হয়ে থাকে। সেই ফুলের গাছ দাদাকে বিক্রি করে গেছে প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার নামে। অন্য কোন ফুলের ছবি দিয়েছে দাদার মোবাইলে। আর দাদাও ফেসবুকে চমক দেওয়ার লোভে আর কিছু না দেখেই সেই গাছের ছবি দিয়ে দিয়েছেন। ঘেঁটু ফুলের অন্য নাম ভাঁট ফুল। তাই দাদার পেজে কমেন্ট এসেছে, “ভাঁট ফুলের ছবি দিয়ে ভাঁট বকছেন?”
এখন দাদা-বৌদি লুকিয়ে আছেন ভাটপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দাদার ফেসবুক পেজ ডিলিট করে দিয়েছেন। বৌদি শেষে বললেন,
“তাও ভালো যে বিনা পয়সায় গাছটা পেয়েছিলেন। এই জংলি গাছ যদি টাকা দিয়ে কিনতেন তাহলে আরও লজ্জার শেষ থাকতো না”।
আমি আর সাহস করে বৌদিকে গাছের দামটা বলতে পারলাম না।
প্রবন্ধ
শ্রীময়ী
সোমা বান্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যক্ষ
নরসিংহ দত্ত কলেজ, হাওড়া

অনেকদিন কাছেপিঠে কোথাও যাওয়া হয়নি। বেরিয়ে পড়া হয়নি টুক করে কোথাও। বর্ষা এবার এক লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। অঙ্কের ঘাটতি পুরণ হয়েছে কিনা জানিনা কিন্তু চাষীর মন সে ভরাতে পারেনি এখনও। আমার সবুজ বাংলা নির্মল হয়ে উঠেছে বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে। সমস্ত প্রকৃতি তারুণ্যের তেজে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই ডাকে সাড়া দিতে বেরিয়ে পড়লাম দলবেঁধে। আমাদের গন্তব্য একটুকরো সুন্দরবন। মাতলা নদীর বাঁধের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর এক গ্রাম বনঘেরি। জল আর জঙ্গলে ঘেরা এই গ্রাম সম্বৎসর তাল মিলিয়ে চলে মাতলার প্রলয়নাচনের সঙ্গে।
শহর থেকে চলতে শুরু করে গগনচুম্বী অট্টালিকার জঙ্গল পার হয়ে চলে এসেছি সবুজের দেশে। ঠিক কখন যে প্রকৃতিটা ধূসর থেকে সবুজ হয়ে গেল, খেয়াল করতে পারিনি। প্রচন্ড গুমোট গরম। ধানক্ষেতে জমে থাকা জলে ভেসে উঠেছে নীল আকাশ আর একরাশ সাদা মেঘের জলছবি। সে ছবিতে ঠোক্কর মারছে দুধ সাদা বক, শামুকখোলের দল। বাড়ন্ত ঘনসবুজ ধানগাছ সমস্ত ছবিটাতে লাগিয়ে দিয়েছে জীবনের রঙ।
কৃষ্ণমোহন, জয়নগর, ধপধপি ছাড়িয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি কৈখালী যাওয়ার রাস্তায়। কাছারিবাজার ছাড়িয়ে গাছের আড়ালে ঢালে নেমে যাওয়া রাস্তাটা আমরা খেয়াল করিনি। খানিকটা এগিয়ে আবার যখন ফিরে এলাম, রাস্তাটা দেখে প্রথম প্রশ্ন মনে এলো- গাড়ি ঢুকবে তো? রাস্তার পাশের দোকানে বসে থাকা এক ছোকরা মাতব্বরের ভঙ্গিতে বলে- গাড়ি এখানে রেখে টোটো নিয়ে চলে যান। তা কি করে সম্ভব? বনঘেরি গ্রামে আমাদের দুটো রাত কাটানোর পরিকল্পনা। গাড়ি রাস্তায় ফেলে রেখে গেলে কি করে চলবে? কোনওরকমে ঢুকে পড়া হলো ঢালে নেমে যাওয়া ঢালাই রাস্তায়। সাপের মত এঁকে বেঁকে ক্রমশ: গ্রামের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়া রাস্তাটা গাড়ি চালানোর পক্ষে যথেষ্ট বিপজ্জনক। খাড়া ঢালাই রাস্তার দুধারে মাটির বাঁধ নেই। গাড়ির চাকা পড়লেই সবশুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে উলটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কোনওরকমে হরিনাম জপতে জপতে পৌঁছে গেলাম ‘বাবাহরি হোমস্টে’ তে। জানা গেল রাস্তার ধারে বসে থাকা একদল মাতব্বর এভাবেই পর্যটকদের বিভ্রান্ত করে এবং রাস্তায় গাড়ি রাখার জন্য একটা মোটা টাকা আদায় করে। তোলাবাজির সূক্ষ্ম নিদর্শন।
বাবাহরি হোমস্টে এখনও ঠিক বাণিজ্যিক অতিথি আবাস হয়ে ওঠেনি। সূর্য্য নস্করের বসতবাড়ির মধ্যেই কয়েকটা ঘর পর্যটকদের চাহিদামতো সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। হোমস্টের আসল স্বাদ পাওয়া গেল এখানে। বাড়িতে ঢুকতেই দৌড়ে এলো গোলগাল শামলাবরণ ছোট্ট একটি মেয়ে। একগাল হাসি সঙ্গে করে। অচেনা লোকজন দেখে নাচতে লাগল ধেই ধেই করে। আদর করে জিগ্যেস করলাম- ‘কি নাম তোর!’
‘চিময়ি’।
‘চিন্ময়ী’?
না। ‘চিময়ি’
বেগতিক দেখে ছোটখাটো চেহারার এক প্রৌঢ়া বললেন - ওর নাম শ্রীময়ী।
সূর্য্য আর চন্দনার সাজানো সংসার এই হোমস্টে। সঙ্গে আছেন সূর্য্য নস্করের মা আর তাদের চার কন্যা - মমতা, সুজাতা, তাপসী আর শ্রীময়ী। মমতা আর সুজাতা কৈখালী রামকৃষ্ণ আশ্রমের ইংরাজি মাধ্যম কো-এডুকেশন স্কুলের দ্বাদশ এবং নবম শ্রেণীতে। তাপসী বনঘেরি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীতে, শ্রীময়ী তৈরী হচ্ছে স্কুলে যাওয়ার জন্য। শহুরে মানুষরা যাকে প্রিস্কুল এডুকেশন বলি ওরা বলে ‘টিউশুনি’। প্রিস্কুলে পড়া অনেক বাচ্ছার থেকে বোধহয় একটু বেশিই শিখেছে শ্রীময়ী। শ্রীময়ীর সবথেকে বড় সম্পদ ওর সারল্য আর মিষ্টি গ্রামীন ভাষা। আমরা কিন্তু শ্রীময়ীর অতিথি নই। কেউ দাদু, কেউ কাকু, কেউ কাকী, কেউ আবার ঠাম্মা। মিনিট পাঁচেক সময়ও নেয়নি ও এই সম্পর্কগুলো তৈরি করে ফেলতে। চন্দনা দু একবার চোখ পাকালেও তার কোনও তোয়াক্কাই করেনা শ্রীময়ী। আমাদের খাবার টেবিলের মাঝখানে বসেই চালিয়ে যায় তার দস্যিপনা।
কথায় কথায় কখন ওদের পরিবারটার সঙ্গে মিলে গেলাম আমরা। হয়ে গেলাম এমন কেউ যাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় সুখ দু:খের কিছু কথা। বড় অদ্ভুত এদের জীবনযাত্রা। মাতলা নদী থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এদের বাস। মাছকে ঘিরেই বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার লড়াই যে কি অসম্ভব কঠিন হতে পারে তার হদিস মিলল এই নস্কর পরিবারের রোজনামচা থেকে।
এই হোমস্টের খাবার মেনুতে মাছের জয়জয়কার। ভাতের পাতে ছোট ছোট আমোদী, পারসে মাছ ভাজা, নদীর টাটকা রুই মাছের ঝাল। কি অপূর্ব যে তার স্বাদ। কিন্তু সে মাছ ধরার কাহিনী শুনলে শিহরন জাগে। দুপুরে এক রাউণ্ড ঘুমিয়ে বিকেলে আমরা নদীর পাড়ে বেড়াতে গেলাম। তখন ভাটা চলছে। নদীর পাড় অনেক উঁচু করে ইট দিয়ে বাঁধানো। বাঁধের নীচে এক কোমর কাদা। সে কাদায় হাঁটা যে কি পরিশ্রমসাধ্য তা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বাঁধের উপর একদল মানুষ বসিয়েছে তাসের আড্ডা। আর একদল ছেলেমেয়ে কাঁচের গুলি নিয়ে পিল খেলছে হৈ হৈ করে। সামনে বিস্তীর্ণ নদী মেলে ধরেছে তার সৌন্দর্য। কেমন যেন কেঁপে ওঠে বুকটা। সন্ধ্যায় মুড়ি আর বেগুনি নিয়ে আমরা গল্প জুড়লাম সূর্য্যর সঙ্গে। সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটায় সূর্য্য যাবে নদীতে জাল ফেলতে। তখন ভরা জোয়ার। বাঁধের পাশে একবুক জলে দাঁড়িয়ে খোঁটায় বেঁধে রেখে আসবে তার জালখানা। বুকসমান জলের উথাল পাথাল স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে জাল খাটাবে একদল সূর্য্য নস্কর। কখনো এক কোমর জলে হেঁটে, কখনও এক বুক জলে সাঁতার কেটে জাল খাটাতে কেটে যাবে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা। পেটানো লোহার মত আঁটোসাটো ক্লান্ত সূর্য্য যখন বাড়ি ফিরল
তখন আমরা খাবার টেবিলে ঝড় তুলেছি। সামনে মুরগির ঝোল আর নরম রুটি। সূর্য্য অতিথি আপ্যায়নে এতটুকু কার্পণ্য করে না। বাঙালির আলোচনা দু’পা এগোলেই রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে পড়ে। আমরাও ব্যতিক্রম নই। আমাদের এক বন্ধু রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে জানতে একটু বেশীই উৎসুক। কথায় কথায় এসে পড়ে ভোটের কথা, বিভিন্ন সরকারি পরিষেবার কথা, প্রকল্পের কথা। সমস্ত প্রশ্নের গুছিয়ে উত্তর দেয় সূর্য্য। দু:খ করে বলে বহুদিন ধরে জব কার্ড তার আছে, কিন্তু তা কোনও কাজে লাগে না। ভোটের নামে দাদাগিরি আর ভোটের দিনের আতঙ্কের কথা বলতে গলা কাঁপে না সূর্য্যর। মনে হয় কাউকে বলতে পেরে গায়ের জ্বালা বোধহয় কিছুটা মিটছে। মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতের মুখে অনেকবার পড়েছে সূর্য্য। বুক চিতিয়ে চালিয়ে যাওয়া সে লড়াইয়ের গল্পও শোনায় আমাদের। সে গল্পের ছত্রে ছত্রে রয়েছে মাছুয়াদের এককাট্টা লড়াইয়ের কাহিনী। সূর্য্যর গলায় আক্ষেপ শোনা যায়। সেই ডাকাবুকো মাছুয়ারা আজ সরকারি ভাতার দিকে তাকিয়ে থাকে জুলজুল করে। খেটে খাওয়ার সুখ আর কেউ চেটেপুটে অনুভব করেনা।
‘মাছের কাজে বিস্তর কষ্ট গো দিদি। তাও যেদি ঠিকমতো দাম পাওয়া যেত। সক্কালসক্কাল বাজার ধরতি না পারলি সব কষ্ট বেগার। ওই জন্যিই সব মাছের কাজ ছেড়ি দে অন্য ধান্দায় নামতিছে নয়তো ভাতা নে বাড়ি বসি আছে’
কথা প্রসঙ্গে জানা যায় মাছধরা সূর্য্য নস্করের কয়েক পুরুষের পেশা হলেও বনঘেরি গ্রামে তাদের বসত খুব বেশিদিনের নয়। সূর্য্যর ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার লেক গার্ডেন্সে। বিঘের পর বিঘেক
জুড়ে ছিল মাছের ভেড়ি। সেই ভেড়িতেই সূর্য্যর জাল টানার হাতেখড়ি। বাবা লেক গার্ডেন্স এলাকায় রিক্সা চালাতেন। সেই সঞ্চয় বুকে করেই সমস্ত সংসার নিয়ে চলে আসেন মাতলার ধারে। কিছুটা জমি আর বসত বাড়ি নিয়ে গড়ে তোলেন সাজানো সংসার। ধীরে ধীরে গতরে খেটে সূর্য্য তৈরী করেছে বেশ বড় একটা বাড়ি, বাড়ির পিছনে পুকুর, চারিদিকে বাগান। হোমস্টেটাকে বেশ বড় করে বানানোর পরিকল্পনা আছে ওর। কিন্তু ‘নদীর ধারে বাস ভাবনা বারোমাস’ তাই একটু করে এগোয় আর প্রকৃতির ক্ষণিক তান্ডবে পিছিয়ে পড়ে কয়েক যোজন। কিন্তু আয়েসে পাওয়া ভাতার কাছে বিক্রি করেনি দুচোখের স্বপ্নটুকু।
সন্ধ্যেবেলা আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। হাসির রোল উঠছে দেদার। হঠাৎ নি:শব্দে আমাদের সকলের মাঝে এসে গ্যাঁট হয়ে বসল শ্রীময়ী। ‘ঠাম্মা বিস্কুট দাও’। অনাবিল সরলতায় মাখা শ্রীময়ী আমাদের অবাক করে দেয়। এভাবেও পরকে আপন করা যায়? আমাদের পরিবারের বাচ্চারা কি পারে? এমন করে চাইলে আমাদের বাচ্চাদের তো আমরা চোখ রাঙাই। সহবতের অভাব মনে করি। আর এই ছোট্ট শ্রীময়ী কেমন অবলীলায় আমাদের নাতনি হয়ে ওঠে। গোটা খাটে ডিগবাজি খেয়ে, নেচে, খেলে আমাদের আড্ডার দফারফা করে সকলের হৃদয় জিতে নিল শ্রীময়ী। আমার বন্ধু বলে - ‘চল তোকে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যাই’। শ্রীময়ীর দৃপ্ত উত্তর - ‘না। কি জন্যি যাবো?
মাছের কাজে যতই কষ্ট হোক সূর্য্য নস্কর সব সয়ে নিয়েছে। ছেলে নেই বলে এতটুকু দু:খ নেই ওর মনে। প্রত্যয়ী সূর্য্য স্বপ্ন দেখে মেয়েরা ওর মানুষের মত মানুষ হবে। অনেকদূর লেখাপড়া করবে। দশ জনের একজন হবে। শ্রীময়ীর দস্যিপনায় একটু ছেদ টানতে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি।
‘এই তুই ইস্কুলে যাবি না?’
‘যাবো তো। আগের বছর। বাবা বলি দ্যাছে’
‘ইস্কুলে কি পড়বি’
‘বাংলা, অঙ্ক, ছড়া কবিতা সব’
‘বড় হয়ে কি হবি তুই?’
‘ডাক্তার’
‘তাহলে তো কলকাতা যেতে হবে’
‘না যাবো না। কি জন্যি যাবো?’
সত্যিই রে মা! কি জন্যি যাবি! এ শহর সরলতার সম্মান দেয় না। এই একরত্তি মেয়েটা কেমন করে যেন বুঝে ফেলেছে কলকাতার গোপন কথা। ডাক্তারই হোক আর শ্রীময়ীই হোক, পরিবারের বাইরে কেউ নিরাপদ নয়! পরিবারের মধ্যে? তাতেও সন্দেহ আছে। এতটুকু বুক, রুদ্ররূপী মাতলার সামনে চিতিয়ে দাঁড়ায়। শহরের চোরাকুঠুরীতে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতা নেই। কি জন্যি শহরে যাবে? ধুলোমাখা পা আর আদুল গায়ের এই মেয়ে যেন একখন্ড হীরে। আঁচড়ে কামড়ে খুবলে খাবে শহরের ওই নরপিশাচগুলো। কি জন্যি শহরে যাবি! এ শহরে ডাক্তারের চোখ ফেটে রক্ত ঝরে। ছাল ছাড়ানো কচি পাঁঠার মত টেনে চিরে ফেলে ডাক্তারের দুখানা পা। কি জন্যি শহরে যাবি! আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ডাক্তার যখন আর্তনাদ করে মা কে ডাকে, এ শহর বার্তা দেয়- আসুন আমরা উৎসবে ফিরি। অনুদানের ফোয়ারা আর মাতব্বরের হুমকি নেচে বেড়ায় শ্মশানকালীর বেশে। লকলকে তার জিব। খুঁটি পুজো আর কার্ণিভালের আলোর ঝলকানিতে চাপা পড়ে যায় সেই অন্ধকার রাত। মাটির প্রতিমার রূপে আপ্লুত হাজার হাজার চোখের আড়ালে হারিয়ে যায় সেদিন জ্বলে ওঠা এক দল হায়নার দৃষ্টি। এ শহরে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি হায়নার দল যাদের সামনে কেউ আয়না ধরে না। বলে না দেখো কি কদর্য দেখাচ্ছে তোমায়। তারিখের পর তারিখ, তারপর আবার তারিখ - আদালতের প্রহসনে হারিয়ে যায় আসল তারিখটা। শূণ্য যদি কিছু হয় তা শুধু ওই পোড়াকপালি মার বুকটা। বেশ তো আছিস এমন প্রকৃতির কোলে, মায়ের বুকটা জুড়ে। এমন হায়নার চিড়িয়াখানায় তুই কি জন্যি যাবি??
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.