এপ্রিল
২০২৪
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
রুদ্র ক্রমশই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। আজ ভীষণ দেরী করছে সাফারির গাড়িটা আসতে। বাবা-মা হোটেলের বারান্দায় বসে প্রথম কাপ চা শেষ করে দ্বিতীয় কাপটাও প্রায় শেষ করে ফেলেছে তাও গাড়ির দেখা নেই। এর আগে ডিসেম্বর মাসের রাজস্থানের প্রবল শীত অগ্রাহ্য করে ভোর পাঁচটায় উঠে ওরা তিনজন তৈরি হয়ে হোটেলের বারান্দায় জঙ্গল সাফারির গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল।
একে মঙ্গলবার তার উপর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি রাজস্থানের প্রচণ্ড শীত তাই বেশি টুরিস্ট নেই। অবশ্য শনি-রবিবার একটু বেশী ভিড় হয়। আজ আর একটি মাত্র বিদেশী টুরিস্ট পরিবার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। কয়েক মিনিট আগে ওদের গাড়ি এসে যাওয়ায় ওরাও চলে গেল। রুদ্রর হতাশা আরও বেড়ে গিয়েছিল, বাবা অমিতাভর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
- 'বাবা আমাদের গাড়ি আসবে তো?'
এবার অমিতাভেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। চায়ের কাপটা পাশে রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে গাড়ির ড্রাইভার এর সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
- 'আপনারা কোথায়? আলো ফুটে গেলে আজ আর সাইটিং হবে না! ড্রাইভার এর উত্তর শোনা গেল না।' তবে ফোন রেখে অমিতাভ বলল,
- 'আমাদের জঙ্গলে ঢোকার টিকিটে একটু গলদ ছিল ওরা সেটা মিটিয়ে আসছে। এখুনি হোটেলে এসে পড়বে।' কথা শেষ হবার আগেই কিছু দূরে একটি গাড়ির হেডলাইটও দেখা গেল।
এক বহুজাতিক তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার কর্তা অমিতাভর দুটো নেশা এক জঙ্গল ভ্রমণ, দ্বিতীয় ছবি তোলা। প্রথম প্রথম স্ত্রী কেকার, অমিতাভর সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে একদম ভালো লাগতো না। কিন্তু আস্তে আস্তে কেকারও জঙ্গল ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে। একমাত্র বার বছরের ছেলে রুদ্রনীল ওরফে রুদ্র্র একদম বাবার মত; অনেক জঙ্গলের বইও পড়ে ফেলছে।
অমিতাভের মতে প্রকৃতির আসল রূপ দেখতে হলে জঙ্গলে আসতে হবে। সৃষ্টিকর্তা প্রাণমন ঢেলে সাজিয়েছেন প্রতিটি জঙ্গল আর তার বসবাসকারী প্রতিটি প্রাণীকে। এই সৌন্দর্য অনির্বচনীয়, আর ক্যামেরাতে ধরে রাখার মতো তো বটেই। ব্যাঙ্গালোর থেকে ওরা প্লেনে রবিবার জয়পুর এসে। সেখান থেকে গাড়িতে সোমবার সকালে রনথম্ভুর এসে হাজির হয়েছিল। গতকাল বিকেলের সাফারিতে যদিও বাঘের দেখা পায়নি কিন্তু এক নম্বর জোনের সৌন্দর্য অমিতাভর যথেষ্ট ভালো লেগেছিল।
ভারতের সংরক্ষিত জঙ্গলের মধ্যে রনথম্ভুর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। প্রায় ১৩৩৪ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে প্রায় খান পঁচিশেক বাঘের বাসস্থান এই জঙ্গল। এই জঙ্গলের বেশিরভাগ গাছই বছরে একবার তাদের পাতা পাল্টায়। তাই এদের পর্ণমোচী বলা হয়। এই সময় সেই পাতাঝড়ার পর্ব চলছে। সারা জঙ্গলে পাতা পড়ে পড়ে একদম গালিচার মত চেহারা হয়েছে। রনথম্ভুর জঙ্গল অনেকখানি রুক্ষ আর পাথুরে। জায়গায় জায়গায় ঝোপঝাড়। ঘন জঙ্গল না হবার জন্য, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সাইটিং বা বাঘ দেখার জন্য এটা একটি লোভনীয় ব্যাপার। গতকাল অমিতাভরা প্রচুর সাম্বার হরিণ, আর পাল পাল চিতল হরিণও দেখেছে। এছাড়া দেখেছে নানা রকমের পাখি। তবে যে জঙ্গলে বাঘ থাকে সেখানে সবাই বাঘই দেখতে চায়। অর্থাৎ এই জঙ্গলে বাঘই প্রধান আকর্ষণ। সেটা দেখতে না পাওয়াতে অমিতাভের পরিবার কাল একটু হতাশই হয়েছিল।
যাই হোক আজ ঠিক সাতটায় ওদের গাড়ি জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এখনো দিনের আলো ভালো করে ফোটেনি। আর গাড়িটা বেশি জোরেই চলছিল জঙ্গলের এবরো-খেবড়ো রাস্তায়। মিনিট দশেকেই একপাল হরিণ আর সেই সঙ্গে একজোড়া নীলগাই দেখা দিল। সকালের নরম আলোয় আর আধা
অন্ধকারে ওদের দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিল। অমিতাভ ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে উদ্যোগী,
- সাব, এই সমস্ত জন্তু সারা জঙ্গলে আছে এবং পরেও আপনি প্রাণভরে ছবি তুলতে পারবেন। আগে আমরা বাঘের খোঁজ করে নেই।
ওদের কাছে খবর আছে। যে জঙ্গলের এই অংশে নুরী (টি-১০৫ নম্বর বাঘ) ছাড়াও আরেকটি পুরুষ-বাঘও এখন রয়েছে। ওরা এখন তারই খোঁজে চলেছে। একটু একটু করে সকাল হচ্ছে। তবে যেখানে ঘন জঙ্গল। সেখানে এখনো আলো-আঁধারি-ভাব রয়েছে। সেই রকম এক জায়গায় হঠাৎ মাথায় বিশাল পাগড়ী আর গায়ে কালো কম্বল জড়ানো একটি লোকের দেখা পাওয়া গেল। মনে হল লোকটি যেন হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে সামনে এসে হাজির হলো। রামচরন গাড়ির গতি কমিয়ে কিরকম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। লোকটা মৃদুস্বরে রাজস্থানি ভাষায় বলল।
- বাঘ দেখতে চাও তো লেকের পাশে পাথুরে জায়গায় যাও।
হতচকিত রামচরণ মৃদুস্বরে বলল আমরাই জায়গাটা ছেড়ে এসেছি, গাড়ি ঘোরাতে হবে।
অমিতাভর কানে ওর গলাটা একটু অস্বাভাবিক মনে হল। যাইহোক গাড়ি ঘুরিয়ে লেকের দিকে রওনা হল। তবে ওই কালো কম্বল জড়ানো লোকটাকে আর দেখা গেল না। সে যেমন মাটি ফুটে এসেছিল বোধহয় তেমনি উবে গেল। মিনিট দশের পর লেকের পাশে ওই পাথরের জায়গায় গিয়ে সবার অবাক হওয়ার পালা। এক বড়সড় পাথরের উপর সম্রাজ্ঞীর ভঙ্গিতে নুরী (টি-১০৫ নম্বর বাঘ) বসে আছে। সকালের মিষ্টি রোদ ওর গায়ে পড়ে হলুদ আর কালো ডোরা অপূর্ব লাগছিল। একটার পর একটা ছবি তুলেও অমিতাভর আশ মিটছিল না। একটু পরে নুরী পাথরের আসন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। সে হাঁটাও দেখার মত। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের ঝোপ থেকে দুটো ব্যাঘ্র শাবক বেরিয়ে এসে নুরীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এখন নুরী আর এই জঙ্গলের সম্রাজ্ঞী নয় এক মমতাময়ী মা।
অমিতাভ পরিবারের কারোরই আর চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছিল না। সবাই রাজ পরিবারের দর্শনে মুগ্ধ। কিছু পরে নুরী সপরিবারে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল।
আরও কিছুক্ষণ জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে পুরুষ বাঘের খোঁজ করেও দেখা পাওয়া গেল না। তবে অমিতাভরা খুব তৃপ্ত। অসাধারণ বাঘের দর্শন হয়েছে। এত ভালোভাবে খুব কম লোকই বাঘ এবং তার বাচ্চাদের দেখতে পায়।
হোটেলে ফিরে প্রাতরাশ বা ব্রেকফাস্ট এর জন্য অমিতাভরা রেস্টুরেন্টে হাজির হল। সেখানে পৌঁছতেই দর্শনের সঙ্গে দেখা। মাঝ বয়সি এই ছেলেটির মুখে এক গাল হাসি লেগে রয়েছে সব সময়। গতকাল থেকে দর্শন অমিতাভদের খুব যত্ন সহকারে খাওয়া-দাওয়া দেখাশোনা করছিল। নিজের হাতে বাড়ির লোকের মত পরিবেশন করছিল। আর রুদ্ররও বন্ধু হয়ে গেছিল, দর্শন। এখন এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করল।
- রুদ্রবাবুর কি আজ বাঘ দেখা হলো?
- আমরা আজ খুব ভালোভাবে নূরী আর তার দুই বাচ্চাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি।
রুদ্রর চোখে মুখে প্রচন্ড উত্তেজনার ছাপ। সে দর্শনকে সবিস্তারে সেই কম্বল জড়ানো লোকটার কথাও বলল। হঠাৎ দর্শনের মুখ কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়ে গেল।
- বাবু আপনাদের যে পথ দেখিয়েছে সে রক্তমাংসের মানুষ নয়। এখানকার লোকেরা বলে এক প্রেত আত্মা। জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে লোকটি বছর পাঁচেক হল। বোধহয় বাঘের শিকার হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে কেউ কেউ ওর দেখা পায়। তবে ও কারুর কোনো ক্ষতি করেনি আজ পর্যন্ত। অমিতাভর পরিবারের সবারই খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।
কবিতা
ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
দ্বিরাগমন
মনে পড়ে,
দ্বিরাগমনের দিনটির কথা?
জ্যোৎস্নার সেই পরশনের কথা?
প্রাক গোধূলিলগ্নে,
দুর্যোগ ভরা অবিশ্রান্ত বৃষ্টির খানিক বিরতিতে,
দোরগোড়া থেকে রিকশায় চড়ে গলি দিয়ে রাস্তার মোড়ে যাওয়ার পথে
বর্ষিত হয়েছিল প্রতিবেশীদের -
ছাদ থেকে,
বারান্দা থেকে,
উন্মুক্ত জানালা থেকে,
এবং অর্ধ উন্মুক্ত ঘোমটাবৃত সম্মুখ দরজা থেকে,
নানান উচ্চারণে,
নানান ভঙ্গীতে,
কত না কৌতূহলমিশ্রিত ভালোবাসা,
আর পাগল করা আশীর্বাদ!
সেইসময় -
বৈবাহিক কার্যাদি সমাপনান্তে
ছাদের কার্নিশ আর বারান্দার রেলিংএর কিছু স্থান হতে
তখনও চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের ফোঁটাগুলো
খুব ছোট থেকে ধীরে ধীরে প্রস্ফুরণ ঘটিয়ে বড় গোলাকৃতি ধারণ করে
ঝরে পড়বার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত
ছোট ছোট রামধনু সৃষ্টি করছিলোl
উঁকি দেওয়া অস্তগামী সূর্যের কোমল রশ্মি ও দ্রুতগতির মেঘের
লুকোচুরি খেলা আলো-আঁধারিতে
আর্দ্র স্যাঁতসেঁতে কিঞ্চিৎ ভারী সমীরণে দোদুল্যমান
অনতিদূরের সুবৃহৎ নারিকেল বৃক্ষের
এলোমেলো হতে থাকা আপাত: ফ্যাকাসে সবুজ পত্রাবলী হতে
নির্গত হওয়া
বৃষ্টিতে আশ্রয় নেওয়া
সদ্য বাসা ভাঙা কয়েকটি সাদা বক,
আর
গঙ্গাপাড়ের ইতিহাসসাক্ষী সুবৃহৎ বটবৃক্ষগুলো হতে
শিকারীর তাড়া খেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আর্তনাদ করতে করতে
শামুকখোল পাখিরা,
দক্ষিণ -পূর্বাকাশে ক্রমশ: পুঞ্জীভূত হতে থাকা কালো মেঘের নীচ দিয়ে
নিরাপদ উচ্চতায়
বিভ্রান্ত অবস্থায় এদিক সেদিক উড়ছিলোl
পরিস্থিতি অনুযায়ী
আপন আস্তানা হতে বহির্গমন নিমিত্ত তাৎক্ষণিক পরিবেশ কিঞ্চিৎ অনুকূল মনে হলেও,
সারমেয়কুল কিন্তু তখনও বৃষ্টিকালীন নিরাপদ আশ্রয় ছেড়েপথে নেমে স্ব এলাকা নিয়ে সদর্পে বিতন্ডা শুরু করেনি l
উপচে পড়া বাঁশপুকুর থেকে জলের তোড়ে ভেসে আসাছোট ছোট তেচোখো, তেলাপিয়া, এবং পুঁটির লাগি দোরগোড়ার সিঁড়ির নীচে,
কংক্রিটের আড়ালে, বৃষ্টিপ্লাবিত পয়:প্রণালীর খাঁজে আশ্রয় নেওয়া জলঢোড়া সার্পটি
প্রকাশ্যে আসেনিl
সুড়সুড়ি পিঁপড়েরা রিক্সাতে আচমকা উপস্থিত হয়ে নব দম্পতির সঞ্চারিত আবেগের ছন্দভঙ্গ করেনিl
মধুপেরা মধু সংগ্রহে বাহির হয়নি।
নব নব বিকশিত কিশলয় ভক্ষণ নিমিত্ত সদ্য আগত হনুমানেরা
সুবৃহৎ বৃক্ষগুলি হতে হাঁকডাক করা তো দূরের কথা,
এমনকি, লম্ফঝম্ফ করে শাবক বুকে নিয়েও
সামনে এসে দাঁড়ায়নি।
তবে ভুলি কেমনে,
পাশের বাড়ির সাদা -বাদামী ছোপওয়ালা বিড়াল ছানাগুলো
কি মিষ্টি ভঙ্গীতে পাঁচিলের উপরে
তাদের মায়ের পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে
কীট পতঙ্গ শিকারের লাগি তাকিয়ে থেকেছিলো!
আর,
সংকীর্ণ বর্ষণস্নাত: খানাখন্দ পথ ধরে
আমাদের রিকশা সন্তর্পণে এগুনোর সাথে সাথে
যেন পেখম মেলে
নৃত্যের ভঙ্গীতে
ডানপার্শ্বের বাড়ির ছাদের কার্নিশ দিয়ে
ক্রমান্বয়ে সম্মুখ আর পশ্চাদপানে মাথা নাড়াতে নাড়াতে
ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে
বকবকম করতে করতে
মদনবানে বিদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো
পোষা একজোড়া
সাদা ধবধবে গোলা পায়রা।
কর্মোদ্দেশ্যে ঘর ছাড়বার পূর্বাবধি
আজন্ম লালন পালনের মধ্যে কাটানো
আমার পাড়া ওটি।
সবাই ভালোবেসেছে আমাকে,
এবং
ওখানকার বাতাসে,
ধূলোকনায়,
মিশে রয়েছি আমি।
সেদিন ওরা সকলে বুঝিয়ে দিয়েছে যে
বধূ হিসাবে পাড়াতে স্বাগত তুমি,
গৃহীত তুমি সেথায়
আন্তরিকতা আর
সম্মানের সাথে।
এরপর রাস্তার মোড়ে পৌঁছে
রিকশা থেকে নেমে
মখমল আচ্ছাদিত নান্দনিক যন্ত্র বাহনে আসীন হয়ে
তব পিতৃ -মাতৃলয় উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময়
না জানি কত আশংকায় ছিলে তুমি -
'পাছে সেই ঘোর ভেঙে যায়!
বেপাড়া দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথে
পাছে কোথাও দেখতে হয়
চলন্ত গাড়ির উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত কোনো উষ্ণ চুম্বন,
কিংবা কোনো কুটিল চোখের ইশারা!'
হয়তো তাই চোখ বুজে ছিলে তুমি,
যাতে না দেখতে হয় অনাকাঙ্খিত ঐ সকল
রঙিন কাঁচের মধ্য দিয়ে।
খানিক পরে,
গোধূলি অন্তে,
বড় রাস্তার মায়াবী আলো আঁধারিতে দেখেছিলে
দুপাশ দিয়ে একের পর এক চলে যাওয়া
সান্ধ্যকালীন কুটিল ছায়াগুলো,
দন্তবিকশিত সব দানবগুলো;
যেন ওগুলো ছিল
চলে যেতে থাকা নানান প্রেতাত্মা!
যেতে যেতে সন্ধ্যা পার হলে,
অত:পর সুবৃহৎ বৃক্ষরাজি আর
দুই পার্শ্বের নবীন শস্যক্ষেত্রময়,
অন্ধকারময়,
জনবিহীন পথে পৌঁছে
একসময় অনুভব করেছিলে
কেউ যেন তোমার গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলোl
অনেক যত্নে পাগলা গোছের একটা মাকড়সা যেন
তোমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো।
তখন সলজ্জে মস্তক নুইয়ে
ক্ষীণস্বরে বলেছিলে
“ধরো ওটাকে”।
আঁধারে ব্যস্ত তখন
অনুসন্ধিৎসু মন।
খুঁজিতে সেই প্রাণীটিরে
থামিয়ে পথিপার্শ্বে যন্ত্রবাহন
রয়েছিলাম আমরা সেথায়
বেশ কিছুক্ষণ।
বাহনচালক তড়িঘড়ি চলে গিয়েছিলো নিরাপদ আড়ালে,
প্রকৃতির আজ্ঞায়।
ছিলাম আমরা তখন দুজনে
সেই নির্জনে
তার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়।
সেখানে তখন বর্ষার নতুন জলে
খুশিতে মাতোয়ারা কোলা ব্যাঙেরা।
ব্যাঙ ব্যাঙানির বিয়েতে ব্যাঙেদের ঘরে আনন্দের ধুম।
উজ্জ্বল হলুদ শাড়িপরিহিতা তাদের গানের আসরে
ঝিঁ ঝিঁ পোকারা তানপুরার সুর বেঁধেছিলো।
আকাশের তারাগুলো তো বহুদূরে,
জীবন স্পর্শ করতে পারে না;
তখন ওই থই থই অন্ধকারে দেখেছিলাম
ক্ষণে ক্ষণে
যেন তারা-দেরই মতন মিটমিট করে জ্বলে উঠে
ক্ষুদ্র বুকে প্রেমের আলোকে দীপ্তিমান হয়ে
কর্দমাক্ত আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ মেঠো পথে
থোকা থোকা জোনাকিরা
আরতির মতন নৃত্যের ছন্দে
মিছিল করে পথ দেখানো গ্রাম পরিক্রমা করেছিল।
বামপার্শ্বের এক শালবৃক্ষে
নিরাপদ -উচ্চ ডালে
একনাগাড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া বাসায়
শুকনো স্থানের সংকুলানে
তা দিয়ে ডিমগুলোকে গরম রাখতে
পাখিদের জায়গা পরিবর্তন করার সময়
মচ মচ শব্দ,
এবং ডানা ঝাপটানোর সময় বাতাসে ধাক্কা জনিত
ত্বরিত গতির ছন্দময় মসৃণ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে
ডানার পালকের সঙ্গে বাসার ঘর্ষণজনিত খর খর শব্দও ভেসে এসেছিলো।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে আপন কৃষিজমি পরিদর্শন শেষে কয়েকজন চাষী বগলদাবা করে
খানিক আগে বৃষ্টিতে ব্যবহার করা তালপাতার মাথাল,
আর
প্রজ্বলিত কেরোসিনের ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া কাঁচের লণ্ঠন হাতে,
উচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ঘরে ফিরছিলো।
সহসা ঐ পূর্ণিমার নিশীথে
উতল হাওয়ায় পুঞ্জীভূত মেঘ
কিছুক্ষণের জন্য উড়ে যাওয়ার পর,
পূর্বাকাশে নবীন চন্দ্রের স্নিগ্ধ -কোমল রূপ
সৌরভময় কদম, ছাতিম, আর হাসনাহানা পুষ্পশোভিত
বৃক্ষরাজির মধ্য দিয়ে
চিরুনির মত অগুনতি সংকীর্ণ পথে
রজতধারায় ঝরনার মতাে ঝরে
কুয়াশার মতন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে,
ক্রমশ:ই যেন অবগাহন করেছিলাম
এক গভীর উপলব্ধির অতলে।
আবেগমথিত সেই মায়াবী জ্যোৎস্নালোকে ভাসতে ভাসতে
দুজনে একাত্ম হয়ে
পাড়ি জমিয়েছিলাম এক স্বপ্নলোকে।
বাহনচালকের বিলম্বিত প্রত্যাগমনে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে
তোমাকে বলেছিলাম -
তাড়া কিসের
হোক না খানিক দূর,
এটা কি কম মধুর?
চলেছি আমি আবার
এ শহর, এ দেশ ছেড়ে
মানুষ হতে দূর থেকে দূরে।
ঘুমিয়ে আছে মানুষ
প্রাণহীন এ শহরে।
ঢাকা চারিধার শুধু
ইট-কাঠ আর পাথরে।
মরেছি আমি বহুবার
এ দেশে, এ শহরে।
নবজন্মের পর চলেছি আবার
কল্পনার রথে চড়ে।
গিয়েছি আমি বারে বারে
মানুষ হতে দূর থেকে দূরে সরে।
কবিতা
সঞ্জীব হালদার
কলকাতা
লেখক পরিচিতিঃ থাকেন কলকাতায়। শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতা “বসন্তের দুপুর” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে।
এই শহর এই দেশ
কতশত দেশে চলেছি আমি
কল্পনার রথে চড়ে।
গিয়েছি আমি বারে বারে সরে
মানুষ হতে দূরে।
দেখেছি আমি কোলাহল মাঝে
হিংসামত্ত আমার এ দেশ,
মৃত্যু মিছিলে আমার এ শহর।
না-এ আমার শহর নয়,
এ নগর আমার দেশ নয়।
কবিতা
মো:সাইদুর রহমান সাঈদ
পটুয়াখালি,বাংলাদেশ
যজ্ঞ-মন্ত্র
হে মহা-রুদ্র!
আমার চিত্তের তিক্ত-আত্মাকে
আবার জাগিয়ে তোলো!
কণ্ঠে ঢালো শূল-বাণী,
আবার করো আমায় ত্রিশূলপাণিনী!
বহাও রক্তাগ্নিস্রোত!!
মম ভালে জ্বেলে দাও পুনঃ রণনৃত্যের কাপালিক-টীকা!
চক্ষে চির-জ্বালাময়ী অগ্নি-বহ্নি-শিখা
ফিরিয়ে দাও!
জ্বালিয়ে দাও!
দুঃসহ-দাহনে আবার ভস্ম করি সব__সব!
দাও হে-ভীম ডম্বরু-রব,যাহা মম নীরব
ভেঙে যাক!টুটে যাক!
আমার গহীনের কৈলাশ হতে
জাগিয়ে তোলো বিনিদ্রিত শিবকে,
ভৈরব-শবখেলায় নেচে উঠি আমি আবার!
আনি কাল-প্রলয়ংকর-যামিনী!!
জাগাও!পিয়াও মোরে সে-ই নীল-হলাহল-পানি!
তাথিয়া-তাথিয়া নেচে উঠি আবার সে-ই ভৈরবী নাচ,
প্রলয়-ঝংকার বেজে উঠুক
তন্দ্রাচ্ছন্ন এই বাতাসে!
রুষে উঠুক ঘুম-যাওয়া অগ্নিগিরির অশান্ত রক্ত-নার!
গগন বিদারি উঠুক চির-ভৈরব-কোলাহলঃ
তিমির রাত্রি বিদারণ,
জাগে যাত্রী সংশয়-সংহার!
শংকর_শংকর!
ভীম-রুদ্র-ভয়ংকর!!
আল্লা--হু--আকবার!!!
কবিতা
রাহুল রাজ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
যেদিন তুমি চলে গেলে
যেদিন তুমি চলে গেলে-
সেদিন-
আকাশ ভরা বৃষ্টি ছিল,
বৃষ্টি ছিল দৃষ্টিতে।
বুকের ভিতর কষ্ট ছিল,
হাহাকারের সৃষ্টিতে।
চোখের ভিতর স্বপ্ন ছিল
মনে ভিতর কষ্ট।
সেদিন থেকে এই আমি
আমার থেকে নষ্ট।
কবিত্ব
চাঁদের গায়ে জোৎসনা ছিলো-
জোৎসনা ছিল তার রূপে,
কবির আজ বাঁধ ভেঙেছে
আগুন জ্বলে চুপে চুপে।
কবির মনে প্রেম জেগেছে-
প্রেম জেগেছে কবিতায়।
কবির আজ সাধ জেগেছে
ফুলের ভ্রমর হতে চায়
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে-
সে সম্প্রতি আবিষ্কার করেছে
কেন তার সাথে শুধু তাদেরই দেখা হয়?
লাল গোলাপের সাথে নীল চিঠি কেন আসে।
জানতে পেরেছে,
দুজনার দুজনে
এত কি আকর্ষণ!
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে
সে এখন বুঝতে শিখেছে লোকে খারাপ কাকে বলে।
পেটের গভীরে কালো শিশু জন্মানোর
জটিল রহস্য।
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে সে এখন
তুমি থেকে আপনি হয়
আবার আপনি থেকে তুমি
দেরিতে বাড়িতে এলে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলে।
অনেক কবির কবিতায় জোগায় আলপনা।
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে-
খুঁজতে শিখেছে নিজের জগতে কোথায় সে।
আয়নাতে কখন তাকে বেশি সুন্দর লাগে।
পুরুষের দৃষ্টি কেন স্থির নয়।
কিছুই হবে না পৃথিবীর
তোমার আমার মিলন না হলে কিছুই হবে না পৃথিবীর
দুঃখগুলো পুশে রেখে বুকে, দোষ দেব সব নিয়তির।
বুকের ভেতর স্মৃতিগুলো সব যত্নে রাখবো জমা
কিছুই হবে না এই সমাজের, যদি না করি ক্ষমা।
হাজার প্রেম রোজ ভেঙে, চাপা পড়ে ইতিহাসে
কত যুগলের মন ভারি হয় হতাশার নিঃশ্বাসে।
তোমার আমার মায়ার টান আবেগের সুতোয় বাঁধা
আমাদের প্রেম আমরা বুঝি, পৃথিবীর কাছে ধাঁধা।
প্রেম নদীর উল্টো স্রোতে দু’জনের দুই তীর-
তোমার আমার মিলন না হলে কিছুই হবে না পৃথিবীর।
মেয়েটি
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে
সে এখন চুপিচুপি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে
রাজ জেগে অন্তর্জালে স্বপ্ন আঁকে।
সে এখন বুঝতে শিখেছে ভালবাসার মানে।
জানতে পেরেছে ভালবাসার গোপন রহস্য!
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে-
সে এখন কায়দা করে সাজসজ্জা করে।
চলার পথে বাঁকা চোখে উৎসুখ চোখগুলো দেখে-
সে ইদানিং বুঝতে শিখেছে কারো জন্য
মায়া লাগার কারণ।
হরষিত চিত মনের সঙ্গোপনে
বাঁধে সবে যেন নিবিড় ঐকতানে
হৃদয়ের আজ সকল দুয়ার খোলা।
ক্ষণ এল ঐ ভক্তেরা মন্ডপে
ফুল বেলপাতা হাতে হাতে হয় বিলি,
দীপের আলোকে, ধূপের সুবাসে
ঘন চারিধার - যেন ঘোর লাগে;
দাঁড়াইনু নিয়ে করপুটে অঞ্জলি।
ভক্ত কণ্ঠে মন্ত্র ধ্বনিতে মুখরিত মণ্ডপ
পুলকিত চিতে কেন ঘোর লাগে শুনি কোন মহারব?
পদপুষ্পিত মাল্যভূষিত সম্মুখে মৃন্ময়
তথাপি মনের গহনেতে পূজা পায় নিজ চিন্ময়।
কবিতা
সোমদেব পাকড়াশী
পূজা
কাঠামোর খড়ে মাটির প্রলেপ পড়ে, সযতনে গড়ে অবয়ব এক তাঁর সজ্জা সাজের বাহারে অলংকারে
নিপুণ কুশলী শিল্পীর রেখাটানে
দেয় রূপ রং অনন্য এ প্রতিমার
সমবেত সবে অধীর ত্বরায়
আসিতেছে কত পূজা উপাচার;
আছে বাকি শুভ ক্ষণের বিচার
জানা না জানা কত লোকাচার শুভদিন ঐ সমাগত প্রায়।
মঙ্গলদিন ঊষার পরশে আসে
খুশীর উচ্ছ্বাস প্রাণমনে দেয় দোলা,
করা যেতেই পারে সংরক্ষণ মমির
করা যেতেই পারে সংরক্ষণ
মমির
অস্পষ্ট আলমগীরের
আলমারির চাবির
প্রক্রিয়া তিলধারণের
নাকছাবি সন্ধ্যার
উড়িয়ে দাও ক্রোধ
সুতোর সমস্ত দুর্গন্ধ
জ্বলেই চলেছে
দাউদাউ ধুলো
একাদিক্রমে
একাকী রজঃস্বলা।
কবিতা
পার্থ সরকার
তেইশ সালটা হাড়বজ্জাত
আগা গোড়াই ফাঁকি
বারোটা মাস চলেই গেল
সব টার্গেট বাকি!
ডিএ-এর খবর মামলা হয়ে
ঝুলছে এখন কোর্টে।
গভর্নমেন্টের মস্ত সাফাই
"মাইনেটা তো জোটে"।
প্রশ্ন করা, খাতা দেখা
মিড ডে মিলের তেল নুন-
মাস্টারি আজ মাল্টি ম্যাটার
সব্যসাচীর তিন গুন।
এরই মধ্যে টিউশনিটা
টুরের খরচ সামলায়।
কবিতা
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ
তেইশ সালের 'কু-নজরে'
'সে- উপরি' মামলায়।
ঐ-একটিই সহজ কাজ
রিটার্ন তবু জব্বর-
পুরানো-নোট্স্ জেরক্স গুনে
ঝকঝকে আর ভদ্দর।
নতুন বছর আর টিউশন
নিক্তির দুই পাল্লা-
ব্যাকডেট আর মান্ধাতাদের
ঢাকল আলখাল্লা।
নতুন বছর বলল হেসে
ঠিক বুঝেছ সোনা।
তেইশ সালের জেরক্স নিয়েই
চব্বিশ কল্পনা।
তুলনা নাই
এখন পাতাঝরার মরশুম -
শীতার্ত বাতাস বয় হাড় হিম করে,
যে পথে হাঁটা শুরু হয়েছিল অনেক কাল আগে -
তিনের দুই পেরিয়ে গেছি তার
আরো কিছু পথ চলা হয়তো বাকী এখন ও
ফুল শুকিয়ে গেলে মূল্য থাকে নাকি কখনও?
শুনি কারা যেন বলে সময় নেই
পাততাড়ি গুটোও
এবারকার মতো "বন্দরের কাল হলো শেষ" -
মন কিন্তু দেয় না সায় বলে না তো বেশ বেশ।
একটা কম বয়েসী মন উঁকি মারে
এই বলি রেখাঙ্কিত শরীরের ভেতর -
সে দেখে না পাঙ্গাস বরণ কিছু
সে দেখে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়ার হাসি,
সে হয় মাতাল মহুয়া ফুলের গন্ধে
মাঝে মাঝে তাই সে পড়ে বড্ড বেশী ধন্ধে।
বার্দ্ধক্যের খোলসে এখনও কেন
একটা সতেজ মন?
কবিতা
বনদেবী রায়
কলকাতা
সেই মন দৌড়ায়, পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে -
ঘুড়ে বেড়ায় দামোদরের চিক্চিকে বালির ওপর
সে কল্পনায় দেখতে পায়, সন্ধ্যেবেলায়
ছোটবেলার সুখী গৃহকোন
শোভে গ্রামোফোন
সে দেখতে পায় থোকায় জোনাক জ্বলে
মফঃস্বলী নিকষ কালো রাত
আর পাহাড়ের ওপরের দাবানল -
পলাশ গাছে ভরা "ভাদুরাণীর" দেশ,
তার সামনে পরীরা খেলা করে
দামোদরের সাদা বালুচরে।
তাদের মুকুটের হীরে করে ঝিক্ মিক্
আনন্দের হাসি তার মুখে করে চিক্ চিক্।
কিছু যায় আসে না বয়স আর বার্দ্ধক্যে ভরা দিন -
কল্পনার আলপনায় মন যদি থাকে রঙিন -
যাবার সময় যাবো নির্বিবাদে
মানবো না পাতা ঝরা মরশুমের
শীর্ণতা রিক্ততার গতি অবাধকে।
যাবার বেলা এই কথাটি বলবো বারবার
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা নেই তার।
অনুবাদ
বিশ বছর পর
নুপূর রায়চৌধুরী
ও হেনরীর 'আফটার টুয়েন্টি ইয়ার্স' গল্পের বাংলা অনুবাদ
পুলিশটা রাস্তার পাশে সরে গেল, ওকে দেখাচ্ছে শক্তিশালী এবং হোমরা-চোমরা। এইভাবেই সে সবসময় চলাফেরা করে। তাকে দেখতে কেমন লাগছে, তা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। তাকে দেখার লোকও রাস্তায় কম। রাত সবে দশটার কাছাকাছি, কিন্তু ঠান্ডা পড়েছে। এবং তার মধ্যে সামান্য বৃষ্টি সঙ্গে একটি বাতাস বইছিল। সে পথ চলতে চলতে দরজার সামনে থামছিল, নিশ্চিত করার চেষ্টা করছিল যে, প্রতিটি দরজা রাতের মতো বন্ধ করা হয়েছে। বার বার সে ঘুরে ঘুরে রাস্তার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে লক্ষ রাখছিল। সে একজন সুদর্শন পুলিশ, সতর্ক, শান্তিরক্ষাকারী। শহরের এই অংশের মানুষজন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। আপনি মাঝে মাঝে কোনো একটা দোকান বা একটা ছোট রেস্টুরেন্টের আলো দেখতে পারেন। তবে বেশিরভাগ দোকানপাটের দরজাই কয়েক ঘণ্টা আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পুলিশটা হঠাৎই তার হাঁটার গতি কমিয়ে দিল। একটা অন্ধকার দোকানের দরজার কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশটা তার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা দ্রুত কথা বলে উঠল।
"সব ঠিক আছে, অফিসার," লোকটা বলল।
"আমি একজন বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। বিশ বছর আগে আমরা আজ রাতে এখানে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম। এটা আপনার কাছে খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারি, যদি আপনি নিশ্চিত হতে চান যে সবকিছু ঠিক আছে। প্রায় বিশ বছর আগে এই দোকানে একটা রেস্তোরাঁ ছিল। 'বিগ জো' ব্র্যাডির রেস্তোরাঁ।"
"হ্যাঁ, পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত ওটা এখানে ছিল," পুলিশটা বলল।
দরজার কাছে দাঁড়ানো লোকটার মুখ বর্ণহীন, বর্গাকার, চোখদুটো জ্বলজ্বলে, আর তার ডান চোখের কাছে একটা সামান্য সাদা দাগ। তার গলার টাইটাতে একটা বড় রত্ন লাগানো রয়েছে।
"বিশ বছর আগের এক রাতে," লোকটা বলে চলল, "আমি এখানে জিমি ওয়েলসের সাথে ডিনার করেছি। সে আমার সেরা বন্ধু এবং সারা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে ভাল মানুষ। সে এবং আমি এখানে, নিউইয়র্কে দুই ভাইয়ের মতো একসাথে বড়ো হয়েছি। আমার বয়স তখন আঠারো আর জিমির বিশ। পরেরদিন সকাল। পশ্চিমের উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। আমি একটি কাজ খুঁজতে চলেছিলাম এবং তাতে দারুণ সফল হতে যাচ্ছিলাম। জিমিকে নিউইয়র্ক থেকে বের করে আনার সাধ্য কারুর ছিল না। সে মনে করত পৃথিবীতে এই একটামাত্র জায়গায়ই রয়েছে"।
“সেই রাতে আমরা একমত হয়েছিলাম যে বিশ বছর পর আমরা এখানে আবার দেখা করব। আমরা ভেবেছিলাম যে বিশ বছরের মধ্যে আমরা জানতে পারব কে কেমন ধরণের মানুষ হয়েছি এবং আমাদের জন্য কেমনতরো ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।”
"এটা আকর্ষণীয় শোনাচ্ছে," পুলিশটা বলল।
“সাক্ষাতের জন্য এটা এক দীর্ঘ সময়, আমার মনে হয়। আপনি পশ্চিমে যাওয়ার পর থেকে আপনার বন্ধুর কাছ থেকে কিছু শুনেছেন?”
"হ্যাঁ, কিছু সময়ের জন্য আমরা একে অপরকে লিখেছিলাম", লোকটা বলল। “কিন্তু এক বা দুই বছর পরে, আমরা ক্ষান্তি দিয়েছিলাম। পশ্চিম একটা বড় জায়গা। আমি সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি, এবং দ্রুত স্থান পরিবর্তন করেছি। তবে আমি জানি যে, যদি সম্ভব হয় তবে জিমি আমার সাথে এখানে দেখা করবেই। সে পৃথিবীর সত্যবাদী মানুষদের একজন। সে কখনো ভুলে যাবে না। আমি হাজার মাইল পার করে আজ রাতে এখানে অপেক্ষা করতে এসেছি। তবে আমি এতে খুশি হব, যদি আমার পুরনো বন্ধুও আসে।”
অপেক্ষমান লোকটা একটি সুদৃশ্য ঘড়ি বের করল, ছোট ছোট মণি দিয়ে সেটা আবৃত। "দশটা বাজতে তিন মিনিট বাকি আছে," সে বলল।
“সেই রাতে আমরা এখানে রেস্টুরেন্টের দরজায় যখন একে অপরকে বিদায় জানাই তখন ছিল দশটা।"
"আপনি পশ্চিমে বেশ সফল হয়েছিলেন, তাই না?" পুলিশটা জিজ্ঞাসা করল।
"হ্যাঁ, অবশ্যই! আমি আশা করি জিমি অন্তত তার অর্ধেক হাসিল করেছে। ও একটু ধীর গতির ছিল। আমার সাফল্যের জন্য আমাকে লড়াই করতে হয়েছে। নিউইয়র্কে একজন মানুষ খুব একটা বদলায় না। পশ্চিমে আপনি যা পান, তা আদায়ের জন্য আপনি লড়াই করতে শিখে যান।" পুলিশটা দু-এক কদম বাড়াল।
"আমাকে এবার যেতে হবে," সে বলল।
"আমি আশা করি আপনার বন্ধু ঠিকঠাক আছে, যদি সে এখানে দশটায় না আসে, আপনি কি তাহলে চলে যাবেন?"
"আমি যাচ্ছি না!" অন্যজন বলল।
"আমি অন্তত আধ ঘন্টা অপেক্ষা করব। জিমি যদি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, সে ততক্ষণে এখানে আসবেই। শুভ রাত্রি, অফিসার।"
"শুভ রাত্রি," পুলিশটা বলল, এবং সে চলে যেতে যেতে দরজাগুলো পরীক্ষা করতে থাকল ।
এখন ঠান্ডা বৃষ্টি পড়ছে আর বাতাস আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। যে অল্প কয়জন মানুষ সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তারা তাড়াহুড়ো করছিল, নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছিল। আর দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছিল সেই লোকটা, যে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে। এরকম একটা বৈঠক নিশ্চিত হতে পারে না। কিন্তু সে তবু অপেক্ষা করছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করেছে সে, তখন লম্বা কোট পরা একজন দীর্ঘদেহী লোক রাস্তা পার হয়ে দ্রুত চলে এল। লোকটা সরাসরি অপেক্ষমান ব্যক্তির কাছে আসল।
"তুমি, কি বব?" সে সন্দেহজনকভাবে জিজ্ঞাসা করল।
"তুমি, কি জিমি ওয়েলস?" দরজার কাছে থাকা লোকটা কেঁদে উঠল।
নতুন লোকটা অন্য লোকটার হাত নিজের হাতে নিল।
"তুমি বব! নিঃসন্দেহে তাই। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, তুমি বেঁচে থাকলে আমি তোমাকে এখানে খুঁজে পাবই। বিশ বছর অনেক লম্বা সময়। পুরানো রেস্টুরেন্টটা উঠে গেছে, বব, ইস, যদি ওটা এখানে থাকত, তাহলে আরও একবার আমরা এখানে ডিনার করতে পারতাম। পশ্চিম কি তোমার জন্য ভালো হয়েছে?"
"আমি যা চেয়েছিলাম, তার সবটাই ওই জায়গা আমাকে দিয়েছে। তুমি বদলে গেছো, জিমি। আমি কখনো ভাবিনি তুমি এতটা লম্বা।"
"ওহ, বিশ বছর বয়সের পরে আমি আর একটু লম্বা হয়েছি।"
"তুমি কি নিউইয়র্কে ভালো আছো, জিমি?"
“হ্যাঁ যথেষ্টই। আমি শহরের জন্য কাজ করি। এসো, বব, আমরা আমার পরিচিত একটি জায়গায় যাব, এবং পুরোনো দিন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করব।" হাতে হাত রেখে রাস্তা ধরে চলা শুরু করল দুজন। পশ্চিমের লোকটা তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করল।
অন্যজন, তার কোটটা কান পর্যন্ত টেনে এনে, আগ্রহের সাথে শুনতে থাকল।
কোণের দিকে বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত একটি দোকান দাঁড়িয়ে আছে। সেটার কাছে এসেই ওরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। পশ্চিমের লোকটা হঠাৎ থেমে গেল এবং তার হাত সরিয়ে নিল।
"তুমি জিমি ওয়েলস নও," সে বলল।
"বিশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়, কিন্তু একটা মানুষের নাকের আকৃতি পাল্টে যাবার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ নয়।"
"তবে, এটা কখনও কখনও একজন ভাল মানুষকে খারাপ বানিয়ে দিতে পারে," দীর্ঘদেহী লোকটা বলল।
"আপনি দশ মিনিট যাবৎ ধরা পড়েছেন, বব। শিকাগো পুলিশ ভেবেছিল আপনি হয়তো নিউইয়র্কে আসছেন। তারা আমাদেরকে আপনার উপর নজর রাখতে বলে। আপনি কি চুপচাপ আমার সাথে আসবেন? সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু প্রথমে এখানে কিছু একটা আছে, যা আপনাকে দিতে বলা হয়েছে আমায়। আপনি এখানে জানালার কাছে এসে এটা পড়তে পারেন, ওয়েলস নামের একজন পুলিশ এটা দিয়েছে।"
পশ্চিমের লোকটা কাগজের ছোট্ট টুকরোটা খুলল। পড়তে পড়তে তার হাতটা একটু একটু কাঁপতে লাগল।
"বব: আমি সময়মতই সেই জায়গায় ছিলাম। আমি লোকটার মুখ দেখেছি, যাকে শিকাগো পুলিশ খুঁজছিল। আমি নিজের হাতে তোমাকে গ্রেফতার করতে চাইনি। তাই আমি ফেরত গিয়ে, আরেকজন পুলিশকে পাঠালাম কাজটা করার জন্য।
জিমি।"
বীথি পিসির
বাড়ি
সায়ন রায়
গল্প
হারু, পুরো নাম হরেন্দ্র পাল নিজের এক পিসির বাড়ি বেড়াতে যাবে ঠিক করে। দূর এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার পিসির বাড়ি, গ্রামের নাম ডালিপুতি। মায়ের মৃত্যুর পর এই সে প্রথম কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, মন খুব দূরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে! ভালোবাসার দুর্লভ তালিকায় মায়ের পরেই যে বীথি পিসির নাম আসে, তা সে সবসময়ই মেনে এসেছে, অতএব মা চলে যাওয়ার পর সে এই মনের টান যে আরো প্রবলভাবে অনুভব করছে, সেটা খুবই যুক্তিসঙ্গত ও মানবিক ব্যাপার! নির্ধারিত দিনে হরেন্দ্র দুপুরের ট্রেনে উঠে পড়লো, সঙ্গে নিলো দুটো গল্পের বই আর কয়েকটা আরামদায়ক সুতির জামা - গ্রামের খট-খটে রৌদ্র দুপুরে কাজে আসবে বলে।
বিকেল ছটায় হারু যখন ট্রেন থেকে নেমে ডালিপুতি গ্রামে প্রবেশ করলো, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সূর্যের শেষ লাল রশ্মিতে জঙ্গল, ক্ষেত, তৃণ-লতা ধিকি ধিকি করে জ্বলছে - দূরের কুঁড়েঘরগুলি সন্ধ্যা-রাতের সন্ধিক্ষণে হারালো প্রায়! ধানক্ষেতের মধ্যে চলে যাওয়া সরু আল-পথটি ধরে হারু এগিয়ে চললো - দুপাশে গাঢ় অন্ধকার অনন্ত কেশের ন্যায় মৃত্তিকা ব্রততির উপর প্লাবিত হচ্ছে, দুচোখ আঁধারে হারিয়ে হারিয়ে আবার নিজের সম্বিৎ ফিরে পায়! আরো কুড়ি মিনিট এভাবে চলার পর হারু একটু থামলো, তারপর সতেরো বছর আগের ছেঁড়া-ছেঁড়া স্মৃতির উপর ভর করে সে ডান দিকে বেঁকে পুকুর-পাড়ের নির্জন রাস্তাটি ধরলো।
রাস্তার পাশে সারি-সারি বটগাছগুলো সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে, জনমানবহীন কাঁচা-মাটির রাস্তা চাঁদের আলোয় স্বপ্নপুরীর খোয়া-গলির মতো দেখায় - স্মৃতি ও বর্তমান এক সাথে হাত ধরে পথ চলতে লাগে! কিছুটা যাওয়ার পর দুটো-একটা মাটির ঘর পাওয়া গেলো, কোনোটায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলছে, কোনোটা পুরোপুরি অন্ধকার। হারু কুটিরগুলোকে পাস কাটিয়ে রাস্তার একেবারে শেষে অবস্থিত বাড়িটার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। পথের এক কোণে পরে থাকা সেই কাঁচা-মাটির বাড়িটা আজও সেই একই ভাবে পথের শেষে পরে আছে- দেওয়ালের লাল হলুদের চিত্রকলা বোঝা যায় না আর! দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই হারানো শৈশবের প্রখর স্মৃতিবেদনা দমকা-হাওয়ার মতো হারুকে জাপ্টে ধরলো, মাঝ-উঠোনের সেই তুলসীতলা আজও কত নিখোঁজ স্মৃতির মরীচিকা আঁকড়ে বসে আছে!
কত যুগ, কত সময় কেটে গেছে কিন্তু সময় যেমনি প্রাণের অনুরাগে বন্দিত প্রানগুলিকে একই স্নেহ-বন্ধনে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বাহিত হয়, সেই একই স্নেহ-আবেগের বশে পড়ে হারু বীথি পিসির নাম জোরে ডেকে ফেললো!
আঁধার আবৃত ঠাকুর দালান থেকে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। ঘোলা চোখের গভীর দৃষ্টি দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটিকে অদ্দ-পান্তো অবেক্ষণ করলেন, তারপর আতশ কাঁচের চশমাটি পরে নিয়ে বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলো, ''কে রে হরেন্দ্র নাকি?''
"হা পিসি '' বলে বীথি পিসিকে নমস্কার করতেই বৃদ্ধাও তাকে স্নেহ ভরা হাতে জড়িয়ে ধরলেন। হারু বুঝতে পারলো চিঠিতে মা যে তার বর্ণনা পিসিকে দিয়ে থাকতো, সেটা পিসি ঠিক মনে রেখেছে। আর তা ছাড়া চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে গেলেও মনের চোখ তো যার ঝাপসা হয়ে যায় না, সেটা ঠিকই মনের মানুষের চিনে ফেলে -সেটা দিয়েই হয়তো বীথি পিসি তাকে চিনে ফেলেছে।
"এতো দিন পর তুই তাহলে এলি হারু?" কম্পিত কণ্ঠস্বরে বৃদ্ধা বলে উঠলো। "ভেবেছিলাম তুই হয়তো তোর বীথি পিসিকে একবারে ভুলে গেছিস, এই জন্মে আর হয়তো দেখা হলো না!"
সেই যে নয় বছর আগে হরেন্দ্রদের বাড়ির কালিপূজার সময় দেখা হয়েছিল, তারপর আবার আজ তাদের দেখা হলো, হারুর মন খুশিতে ভোরে গেলো।
"না না পিসি, তা কি কখনো হয়? মা আর ছেলের সম্পর্কতো জন্ম জন্মান্তরের, সে কি তাকে ভুলতে পারে কখনো! আমি তো তোমার ছেলের মতোই বলো?" হারু এই কথা বলতেই বীথি পিসির চোখ অশ্রুতে ভিজে গেল।
"ওরে হারু, তুই তো আমার ছেলেই হলি, কতদিন পর আজ আবার দেখতে পেলাম তোকে,"
হারু দেখলো খুড়ী পিসির বলি-ভরা মুখটায় আজও সেই মাতৃসুলভ হাসিটা বিদ্যমান, তুলসীতলার হলুদ প্রদীপের আলোয় তার সৌন্দর্য ও মাতৃত্ব আজও অখণ্ড।
'এখানে কিছু দিন থেকে যাবি কিন্তু হারু! আমি তোর কোনো অজুহাত শুনবো না, বলে দিচ্ছি!' পিসি আদর ভরা শাসনের সুরে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো।
'হা বীথি পিসি' উত্তর পেতে বৃদ্ধা ভারী খুশি হয়ে হারুর ললাটে একটা চুম্বন খেলো।
‘কতটা পথ হেঁটে এসেছিস, খিদে পেয়েছে নিশ্চই! যা গিয়ে পরিষ্কার হয়ে না, আমি যাই তোর জন্য বরং কিছু নিয়ে আসি’ বলে বৃদ্ধা চলে গেলো।
হারু লণ্ঠনটা হাতে তুলে নিলো, তারপর কলতলায় গিয়ে শীতল-স্বচ্ছ জলে ভালো করে হাত-পা ধুয়ে নিলো, মনে একটা ভাষণ প্রশান্তির অনুভূতি ‘তাহলে এতো বছর পর পিসির সাথে আবার দেখা হলো তার!’ কলতলা থেকে ফিরে আসতে সে দেখলো বীথি পিসি সন্ধ্যার খাবারের সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে। হারু পিসির পাশে গিয়ে বসলো, তারপর মুড়ি-বাতাসা খেতে খেতে মহানন্দে ফেলে আশা দিনের গল্পে করতে লাগল। হারু পিসির কাছে জানতে পারে আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো তার পিসিমশাই গিরিশচন্দ্র দাস পরলোক-গমন করেছেন, বীথি পিসির এক মাত্র পুত্র অতয়েব তার শীর্ষেন্দু দাদা বিবাহ করে অন্য গ্রামে চলে গেছে, তারপর সে আর কোনোদিন তার মায়ের কাছে আসেনি, একবার দুবার চিঠি লিখেছে মাত্র। কিন্তু নিয়তির লিখনকে মর্যাদা দিয়ে তার বুড়ো বিধবা পিসি এই ভিটেতে একাই রয়ে গেছে।
প্রাণভরা গল্প-গুজবে কখন যে সময়ে কেটে রাত দশটা বেজে গেলো, হারু বুঝতেই পারলো না। বীথি পিসি নড়বড় পায়ে রান্নাঘরে চলে যেতে হারু উঠোনে পরে থাকা উজ্জ্বল নীলাভ চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো। ঘন কালো আঁধার ভরা রাত্রি, গ্রামের কৃষ্ণবর্ণ গভীর-অন্ধকার তুঁতে আঠার মতো দুচোখের পাতা জুড়ে দেয়। রান্না শেষ হলে পরে পিসি তাকে ডাকতে আসে, তারপর পিসির মাতৃ ছায়ায় বশে হারু তার পছন্দের তরকারি দিয়ে ভাত খায়।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে বীথি পিসির পাশের ঘরটিতে শুতে যায়। ঘরে ঢুকতেই হারু বিছানায় উঠে জানালাটাকে হাট করে খুলে দেয় - গ্রীষ্মের রাতে খোলা হওয়ার প্রয়োজন যে কতটা! সেটা আর বলে দিতে হয় না! জানালা খুলতেই দিগ্-দিগন্তের অন্ধকারে অবগাঢ শস্যক্ষেত্রগুলিকে চাঁদের হালকা রোশনাইতে ভারী চমৎকার দেখালো, মৃদুমন্দ বাতাসের তালে-তালে মকাই শ্রেণীগুলো কখনো কখনো দুলে দুলে উঠছে! স্বপ্নস্মৃতির জালে টাঁকা এই দৈবদৃশ্য দেখতে দেখতে কখন হারু নিদ্রালোকে বিলীন হয়ে গেলো, বোঝা গেলো না।
রাত প্রায় আড়াইটে মতো বাজে, একটা খচ-খচ শব্দে হারুর ঘুম ভেঙে গেলো। 'খচ-খচ করে কি একটা কাটার শব্ধ যেন?" হারু চটপট বিছানায় উঠে বসে আওয়াজটির দিক ও উৎস নির্ণয় করতে লাগলো। কিছুক্ষন কান পেতে সোনার পর সে বুঝলো আওয়াজটা আসছে বাড়ির বাইরে থেকে। হারু জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে একবার বাইরে চাইলো, জঙ্গল ও ক্ষেত নিশাচর রাতের নিগূঢ় আঁধারে পুরোপুরি ডুবন্ত, খচ-খচ আওয়াজটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুকুর-পার থেকে!
হারু ঘুম-মাখা চোখে চাঁদের ভাষা-ভাষা আলোয় দেখলো কোনো এক বউ পানা-পুকুরের পাড়ে উপুড় হয়ে বসে কিছু সব কাটছে! মাথার উপর তার ঘোমটা টানা, ঝোপ-ঝাড়, কাঁটাগাছে ভরা পুকুর-পারে বসে সেই নারী অবিচলিত ভাবে কি সব পাতা কেটেই চলেছে! আরো দশ মিনিট ধরে জংলী লতা-পাতার গুচ্ছ কাটার পর সে বৌটি নড়া-চড়া বন্ধ করে একেবারে স্থির হয়ে গেলো। নির্জন পুকুর-পারে সেই ঘোমটা পড়া অবয়বকে একভাবে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে হারুর এবার একটু ভয় হলো! সে আস্তে করে জানালাটা বন্ধ করে দিতে গেলো কিন্তু পড়লো না! সেই বৌটিকে দেখতে দেখতে কি এক উটকো সম্মোহনের বশে পরে গেলো সে - তার দাঁত-মাড়ি, হাত-আঙ্গুল একসাথে জোড়া লেগে গেল, ভয়-ছায়ার কালো জগতে হারিয়ে কান-মাথা ঝিঁঝিঁ করতে লাগলো তার! সঙ্গে সঙ্গে এক বিবর্ণ স্মৃতির সাথে তার সংযোগ বাঁধতে শুরু হলো, যেন কেউ তাকে এক অতি পুরানো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? কে বেশ ছিল এখানে? প্রায় আধঘন্টা এক নিশ্চল অচল যন্ত্রণার মধ্যে কাটলো, হারু মনে করেও মনে করতে পারলো না । তারপর হঠাৎ বৌটি উঠে কোথায় চলে গেলো আর তার সাথে সাথেই হারুর ক্লেশপূর্ণ সংযোগটা বিচ্ছন্ন হয়ে গেলো - কষ্টকর শ্বাস প্রশ্বাস ও শক্ত হয়ে ওঠা শরীর আবার স্বাভাবিক স্থিতিতে ফিরে এলো!
হারুর সারা শরীর ও মাথাটা এবার ঝিম-ঝিম করতে শুরু লাগলো, সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছিলো? পুকুর-পাড়টা আবার ভালো করে দেখে নিলো সে, না কেউ তো নেই ওখানে! সে তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলো। দুঃস্বপ্নের ভয়গ্রস্ত অবস্থায় কি বেশ একটা কথা মনে পড়ছিলো তার? অনেক চেষ্টা করেও হারু মনে করতে পারলো না। অনেক চেষ্টাতেও কোনো কথা মনে না পড়লে, এক বিচিত্র রকমের কষ্টের সৃষ্টি হয়, চিন্তা পীড়ায় দগ্ধ হরেন্দ্র সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়লো - মনে তার কিছুই পড়লো না!
পরদিন সকালে হারু আবার পিসির সাথে নানা-প্রকের গল্পে রত হলো কিন্তু শেষ রাতের নিদারুন অভিজ্ঞতার কথা কিছুই জানালো না, পাছে পিসি তাকে এখনো ছেলেমানুষ ভেবে মজা করে!
ঠাকুরের চরণে ফুল দিতে দিতে বীথি পিসি তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে হারু কাল রাতে কেমন ঘুম হলো,’
হারু বললো, ‘খুব ভালো পিসি, কোনো অসুবিধা হয়নি’
‘কোনো অসুবিধা হলে আমায় ডাকবি হারু, আমার রাতে আর সেই আগের মতো ঘুম হয় না, আমি জেগেই থাকি’
‘নিশ্চই পিসি’
ছেলেবেলায় যে কতবার ভূতের স্বপ্ন দেখে সে পিসিকে মাঝরাতে জাগিয়ে দিয়েছে, সেটা হারুর ভালোই মনে আছে, ‘পিসি তাকে এখনো সেই ছেলেমানুষ ভাবে’ ভেবে হারু দিয়ালে মাথা ঠেকালো।
দুপুর হতে খাওয়া তাড়াতাড়ি সেড়ে ফেলে হরেন্দ্র বাড়ির বাইরেটা একটু ঘুরতে বেড়োলো।
বাড়ির পিছনের বাগানে হরেক রকমের পেয়ারা, ফুল, লঙ্কা গজিয়ে আছে, বেড়ার পাশে বড় একটা আম গাছ। দুপুরের খট-খটে রোদ্দুরে ক্ষেত, জমি-জমা খাঁ-খাঁ করছে, দূরে দূরে কোনো বট, অশ্বথ্বের ছায়া কালো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে! মাঠ-ঘাস, প্রকৃতি, সূর্যের আলো তাকে যেন তাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলো, সে যেন আছে - তারই সঙ্গে!
এবার তার চোখ সেই পুকুর-পাড়টার দিকে পড়লো, আগের রাতের কথা মনে পড়লো আবার। হারু একটা ঢোক গিলে এক পা এক পা করে সেদিকে এগিয়ে চললো। সেখানে পৌঁছে দেখলো অনেক বেগুনি ও সাদা ফুল ফুটে রয়েছে, আসে পাশে কাঁটা গাছ, ব্রততী ভোরে থাকলেও কি এক অজাগতিক শান্তির অস্তিত্ব বর্তমান সেখানে - ভারী মনোরম লাগলো জায়গাটা হারুর! ‘কাকে না কাকে দেখেছিলো সে, কোনো চোর টোর হবে, বা কোনো গ্রামের বৌ হয়তো ফুল নিতে এসেছিলো, সেটা দেখে নাকি সে ভয় পেয়ে গেছিলো, আবার হয়তো সে স্বপ্ন দেখছিলো তাও তো হতে পারে।’ হারুর এসব ভেবে হাসি পেলো, মনটা একটু হালকা হলো. একটা ফাঁকা জায়গায় দেখে সে বসে পড়লো সে, তারপর পুকুরের সবুজ কচুরিপানা, তার মাঝে ফুটে থাকা সাদা গোলাপি পদ্ম ফুলের সমারোহ দেখতে দেখতে গ্রামের নিশ্চুপ একলা দুপুরে হারিয়ে গেলো।
হয়তো একটু তন্দ্রা লেগে গেছিলো, যখন চোখ খুললো তখন সন্ধ্যার আঁধারে সে একলা বসে সেখানে, চারিপাশে কিট-পতঙ্গ, জোনাকির দল ডানা মেলে খেলে বেড়াচ্ছে! হারু তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে পড়লো, মশার কামড়ে আর বসতে পারলো না সে। তারপর চাঁদের আলোয় পথ তাহরে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ঢুকতেই দেখলো পিসি উঠোনে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে, জিজ্ঞেস করলো 'কি রে হারু? কোথায় চলে গেছিলিস? এতো সময় লাগলো যে তোর আসতে?’
‘অরে না না পিসি, আমি ওই পুকুর-পাড়ে গেছিলাম, ওখানেই বসে ছিলাম’
‘ওই জংলা পুকুর পাড়টায় কি করতে গেছিলিস শুনি? নোংরা জায়গা একখানা’ বৃদ্ধা বিরক্তির স্বরে বললো
‘কোথায় নোংরা? আমার তো বড় ভালোই লাগলো পরিবেশটা, কত ফুল ফুটে আছে ওখানে?’
‘ফুল ফুটেছে? ওখানে?’ বৃদ্ধা অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে চাইলো
‘হা গো বীথি পিসি!’
‘জানি না বাবা, হতে পারে, কত দিন যাওয়া হয়নি ওদিকে ’ বলে বৃদ্ধা হেঁশেলে চলে গেলেন।
সেদিন রাতে হারু দরজায় খিল আটকে সব জানালা আঁটো-সাঁটোভাবে বন্ধ করে দিলো। সব ঠিকঠাক ভাবে বন্ধ আছে কি না আবার করে দেখে সে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে হারু আবার সেই খচ-খচ আওয়াজটা পেলো কিন্তু স্বাভাবিক মনোভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলো। আরো কিছুক্ষণ আওয়াজটা চলতে থাকলে তার একটু অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো! গত রাতের তুলনায় আওয়াজটা যে আরো বেড়ে গেছে, সেটা হারু একেবারে বুঝে গেলো - যেন আওয়াজটা আসছে আরো কাছ থেকে, জোরে জোরে! ভয়ে সে জানালা খুললো না, চোখও খুললো না, পাথরের মতো বিছানায় পরে থাকলো। বিন্দু বিন্দু ঘামে তার কপাল ভোরে উঠলো, শরীরে আবার সেই আড়ষ্টতা ফিরে আসতে লাগলো কিন্তু হারু আত্মপ্রতিজ্ঞা করে নিলো যে বাইরে যেই হোক না কেন, সে জানালা খুলবে না, সে চোখও খুলবে না! বাইরের আওয়াজটা এবার থেমে গেলো কিন্তু তার ভয় কাটলো না, সে যেন চোখ বন্ধ করেও সেই বৌটিকে একভাবে পুকুরপাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখলো। আতঙ্কে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, সে বন্ধ চোখের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার ভাবে দেখলো সেই নারীটি ঘাস, ফুলের মাঝে নিশ্চল বস্তুর মতো পড়ে আছে, সে পিসিকে আওয়াজ দিতে গেলো কিন্তু পারলো না - তালাবন্ধ অন্ধকারে কারা যেন ফিস্ ফিস্ করে কথা বলতে লাগলো, ভয়ে হারুর রক্ত হিম হয়ে গেলো! সে দেখলো বৌটি এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তারই দিকে দৃষ্টিপাত করছে - চোখ খোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় সে ছটফট করতে লাগলো, কেউ যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বন্ধ চোখ দুটি টিপে ধরে রেখেছে!! সেই ঘোমটা পড়া বৌটি তারই দিকে চেয়ে রইলো, কারা যেন ফিশ-ফিশ করে কি সব বলে চলেছে তার কানে! তারপর হঠাৎ সেই বৌটি উঠে চলে যেতে তারও আতঙ্কের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ হলো! সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যেতে হারু চোখ খুললো কিন্তু প্রচন্ড ঘুমের রেশে সে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না, আত্মা শরীর নিদ্রা জগতে ফিরে গেলো।
পরদিন সকালে হারুর মাথা যন্ত্রণা করতে লাগলো, বাইরের অগ্নিবৎ রোদ্দুরে সে পা ফেলার দুঃসাহস করলো না - সারাদিন তাকে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে, বই পড়ে কাটাতে হলো। দুপুরে খেতে বসে সে বীথি পিসির সাথে অনেক গল্প করলো - গ্রামে কি কি উৎসব হয়, কোন ঋতুতে কি রোগ হয়, যাত্রা রাতে কে কি সাজে ইত্যাদি কিন্তু অন্য বিষয়টা নিয়ে কিছুই বললো না। হারু ভাবলো সে তো পরদিনই সেখান থেকে চলে যাবে, পিসিকে আর ওই সব কথা বলে বিব্রত করা ঠিক হবে না! যতই হোক তিনি বুড়ো মানুষ, তাকে এখানে, এই গ্রামে একাই থাকতে হবে, তার মনে কোনো রকমের ভয় ধরানো উচিত কাজ হবে না ।
এবার একটা ব্যাপার হলো, হারুর শেষ-দুপুর থেকে একটু সর্দির উপসর্গ দেখা দিলো। বীথি পিসি চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে হারু, সর্দি বাধিয়ে বসলি না কি?”
হারু জবাব দিলো ‘আমার নতুন জায়গায় মাঝে-মাঝেই এমনি হয়ে থাকে, আবার একটু পরেই ঠিক হয়ে যায়, তুমি চিন্তা করো না পিসি।’
‘জানি না বাবা! তা হলেই মঙ্গল' বলে বৃদ্ধা পিসি চাল বাছতে বসলো।
কিন্তু ক্রমশ ঘন ঘন হাঁচিতে ও কাশিতে হারুর প্রাণ অস্তগত হয়ে গেলো, সন্ধেবেলা ভন-ভন করতে থাকা মাথায় হাত দিয়ে সে বুঝলো তার জ্বর এসেছে। পিসিকে বলতে তিনি বিচলিত হয়ে নিজের ঘর থেকে একটা ওষুধের বাক্স নিয়ে এলো এবং করুণাভরা গলায় বললো, ‘জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে হারু! নে নে ওষুধটা শিগগিরি খেয়ে ফেল দেখি!!’
তারপর সে বালিশ থেকে একটু মাথা তুলতে বীথি পিসি তাকে যত্ন সহকারে ওষুধ খাইয়ে দিলো।
‘নে এবার একদম টান টান হয়ে বিশ্রাম কর দেখি! রাধা-মাধবের কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে,’ বলে পিসি ইষ্টনাম জপ করতে করতে চলে গেলো।
জ্বরে হারুর মাথা ঢিব-ঢিব করতে থাকলো, মস্তিস্ক গোলোকে সব কথা এলো-মেলো হয়ে যেতে ঘুমিয়ে পড়লো সে!
রাত আরো গভীর হলে হারু ধুম জ্বরের মধ্যে নানা স্বপ্ন দেখতে থাকলো ‘একটা আল পথ, সেটা দিয়ে কেউ যেন হেঁটে চলেছে, একটা অস্পষ্ট কুঁড়ে ঘর, কেউ যেন সেখানে বসে আছে? একটা ছায়া কি! না না ছায়া না পা অব্দি ঘোমটা টানা এক বৌ? সে যেন তাকে হাত নেড়ে ডাকছে, ডেকেই চলেছে !! ’ভয়ে-ঘামে তার নিঃশাস ফুলে উঠলো! এমনি বারেবারে হতে থাকলে সে পিসিকে ডাকতে উদ্যত হলো কিন্তু তার অবচেতন মন তাকে জানালো সে যা দেখছে, তা সত্যি নয়, মনের ভুল মাত্র! এই রাত কেটে যাবে, সে যেন ঘুমিয়ে থাকে।
বেশ অনেকক্ষণ পরে কি একটা আওয়াজে হারুর ঘুম ভেঙে গেলো! কোনোভাবে উঠে বসে সে জ্বর-মাখা চোখে দেখলো লণ্ঠনের আলোক বৃত্ত তার বিছানা অব্দিই সীমিত, বাকি ঘরটা কালো অন্ধকারে ঘুমিয়ে - খঁচ-খঁচ আওয়াজটা আসছে তারই ঘরের এক অন্ধকার কোন থেকে! হারু লণ্ঠনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিলো, দেখলো কে যেন ঘোমটা পরে বসে আছে সেখানে, হাতে কিছু একটা ধরা, সেটা দিয়ে সে স্তুপ করা কি সব পাতা এক মনে কেটে চলেছে! স্বপ্ন না সত্যি সেই দৃশ্য, হারু বুঝতে পারলো না !! এক রোমহর্ষক বিভিশিখায় হারুর সারা শরীর শিহরিত হয়ে গেলো - এবার সে নারী পাতা কাটা বন্ধ করে হাতে দুটো সবুজ পাতা তুলে নিলো, তারপর চোখের পলকে দু হাতের পাতা অদল-বদল করে কথা থেকে একটা মোমবাতি এনে ফেললো! ঘোমটার মধ্যে থেকে একটা ফুঁ দিলো সে আর সেই মোমবাতি জলে উঠলো - বাতির শিখায় চোখ পড়তেই হরেন্দ্রর নেত্রগোলক একেবারে স্থির হয়ে গেলো - হারুর মনে পরে গেলো, 'এ তো তার সাথে আগেও হয়েছে! ছোটবেলায়!! এইখানেই!! কত রাতে এই বৌটিকে সে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছে। 'পরমুহূর্তে সে দেখলো সেই নারী নিজের কালো পোড়া হাত তারই দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে - হারুর সর্ব ধমনী রক্ত শুন্য হয়ে গেলো! সে দেখলো প্রেতিনীর কুৎসিত হাত যত তার দিকে এগিয়ে আসছে, লণ্ঠনের আলো ততই দপ দপ করে উঠছে, তারপর সেটা নিভে গেলো, শুধু রয়ে গেলো জ্বলতে থাকা মোমের শিখা!! হারু অপলক দৃষ্টিতে নিজের হাতটা সেই বীভৎস দগ্ধ হাতটার দিকে বাড়িয়ে দিলো!!
ঠিক একই সময়ই কেউ হারুর নাম ধরে ডাকলো, হারু অবাক হয়ে দেখলো সে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে! চন্দ্রলোকের নীল সাদা আলোয় চারিপাশ ধু-ধু করছে!! সে পিছনে ঘুরে দেখলো বীথি পিসি দাঁড়িয়ে আছে, বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলো ‘তুই এখানে কি করছিস হারু?’
হারু বুঝলো তার জ্বরটা কেটে গেছে, দর দর করে ঘাম হচ্ছে তার । সে উত্তর দিলো, ‘জানি না গো পিসি!’
তারপর সে ও পিসি ঝোপ-ঝড়ের পথটি ধরে বাড়ি ফিরে এলো, সেখানে কেউ আর উপুড় হয়ে বসে ছিল না, কোনো ফুলও সেখানে ফুটে ছিল না! ঘরে ঢুকে হারু বীথি পিসিকে সব কথা খুলে বললো। সব শোনার পর বীথি পিসি কিছুক্ষণ কি সব ভাবলো, তারপর ঠাকুর-ঘর থেকে একটা মাদুলি এনে হারুকে পড়িয়ে দিলো। পরদিন সকালে পিসির আশীর্বাদ নিয়ে হরেন্দ্র সেখান থেকে চলে আসে।
গল্প
অভীককে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষতে হল। মেয়েটা একেবারে সামনে। ক্রসিং-এ লাল আলোয় গান বাজছে, 'যদি তারে নাই চিনিগো সেকি.. সেকি আমায় ...l আর মুহূর্তের মধ্যে নামলো মুষলধারে বৃষ্টিl ঘনঘটা চলছিল গত আধঘন্টা যাবৎ। সেই মুহূর্তে অধিক ভাবনা চিন্তার সময় ছিল না। গাড়ির দরজা খুলে, বৃষ্টির ঝাপটে বিপর্যস্ত তরুণীকে আহ্বান জানাল অভীক... 'উঠে আসুন শিগ্ গির উঠে আসুন।
একই সঙ্গে গাড়ির ব্রেক ও বৃষ্টির দাপটে মেয়েটিও reflex action – দিশেহারা হয়ে ঢুকে এলো গাড়ির ভেতর। ততক্ষণে গান পরের পঙক্তিতে পৌঁছিয়েছে, '...এই নব ফাল্গুনের দিনে.... জানি নে ...। গান থামলো।লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সবুজ আলো জ্বলতেই, অভীক গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে বললো, 'এমন হঠকারিতার কাজ করছিলেন কেন? এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? নিজে তো মরণ ঝাঁপ দিয়েছিলেনl এক্সিডেন্ট হয়ে গেলে, আমিও ফেঁসে যেতাম।' তরুণী কঠোর স্বরে উষ্মার সঙ্গে জবাব দিলো, 'হঠকারিতা তো আপনার তরফে। গান বাজছে, লাল আলো। সেসব দেখেই তো রাস্তা পার হচ্ছিলামl আপনার তো সিগনালে দাঁড়িয়ে পড়ার কথা।' এবার অপ্রস্তুত হওয়ার পালা অভীকের। তরুণী ঝকঝকে উজ্জ্বল স্মার্টl টাইট জিনস, ঢিলে টপ, পনিটেলে আটকানো টান-টান আশ্চর্য মসৃণ চকচকে চুল। ছোট্ট কপালে যেন তুলি দিয়ে আঁকা ভ্রূজোড়া। চিকচিকে সরু চেন মরালী গ্রীবায় সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। বাচ্চাদের হাতের বালার মাপে মস্ত মস্ত ইয়ারিং। মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গিনী, পাঁচ -পাঁচ তো হবেই। তন্বী সুঠাম দেহ সৌষ্ঠবে গরিয়সী। ওষ্ঠে লাল লিপলাইনার টানা, অধর চপচপে রাঙানো। রত্ন-খচিত হারের লকেট সুষ্ঠু বক্ষদ্বয়ের এদিক ওদিক দুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এক কথায় glamourousl. অভীকের মনে হল, 'দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে'।
খানিক প্রগলভ হওয়ার লোভ সামলাতে পারলো না, বলে উঠলো,' আসলে, ভরা বর্ষায় গান বাজছে, 'নব ফাল্গুনের দিনে'.. তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমি বাড়ি পৌঁছে যাবো। তারপর বৃষ্টি কমলে, চলে যাবেন।'
তরুণী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। খুব মৃদু হাল্কা পারফিউম – এর গন্ধ পাচ্ছে অভীক। গাড়িতে আরো আলাপ জমাতে সাহস করলো না সে। তার বাড়ি এসে গেলো। বৃষ্টির তোড় এতটুকু কমেনি। স্টার্ট বন্ধ করে নামা মাত্র, মেয়েটিও সাথে সাথে নেমে পড়েছে। দুজনে ভিজতে ভিজতে প্রায় একই সঙ্গে খোলা বারান্দার শেডে আশ্রয় নিলো। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে মোবাইল বেজে উঠতেই ফোন কানে নিলো তরুণী 'হাঁ, স্যার .. বৃষ্টিতে একটু আটকে গিয়েছি .... না, না, চিন্তার কোনো কারণ নেই। সাড়ে-ছটা বাজছে, আশা করি, সাড়ে আটটার মধ্যে অফিস পৌঁছে রিপোর্ট করতে পারবোl
'...ওকে ...বাই'। তটস্থ হল অভীক। এখনো মেয়েটির অফিসের কাজ শেষ হয় নি! রাত আটটায় অফিস যাওয়ার কথা ভাবছে।
চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে, আলো জ্বেলে ভেতরে ডাকলো মেয়েটিকেl মেয়েটি একটি সোফায় বসলে, অভীক ফ্যান ঘুরিয়ে, মুখোমুখি সোফায় বসলোl মেয়েটির আশ্চর্য সুন্দর কালো রেশমী চুলের একটি গুচ্ছ জলে ভিজে কপালে আটকে আছে। অভীক অবিবাহিত নব্য যুবক বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকেl পুজোর ঠিক আগে –
আগে দিদি মাকে নিজের কাছে নিয়ে গেছে দিল্লিতে মাস তিনেকের জন্যl বাড়িতে আপাততঃ সে একাl তার নিজের ব্যবসাl টিভি, হোম-থিয়েটার, মিউজিকে সিস্টসেম, এমনকি মোবাইল, ল্যাপটপ, আই -প্যাড ও বিক্রি করেl দুজন পুরুষ কর্মচারী আছেl কিন্তু দোকানের স্টেটাস বাড়াতে এক সুন্দরী স্মার্ট তরুণীর নিতান্ত প্রয়োজনl ব্যবসায়িক বিবেচনায়, মেয়েটিকে নিজের দোকানে কল্পনা করে ভারী তৃপ্তি পেলো সে। জিজ্ঞাসা করলো, 'আপনি এখন কোথায় যাবেন?'
'সেক্টর-ফাইভ, সল্টলেকl ওখানেই আমাদের মেন্ অফিস 'Cybernatica'l ওই বিল্ডিংয়ের লাগোয়া, ট্রেনীদের থাকার ব্যবস্থাl আমরা চারজন ট্রেনী থাকিl মেয়েটি তার ভিজিটিং কার্ড বার করে অভীককে দিল। Miss Robina, Rank No. 1 Computaplex Section, Sector - V। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে তো বাড়ছেইl এই এলাকাটা অল্প নীচুl তার বাড়ির দোরগোড়ায় গোড়ালি -ডোবা জল দাঁড়িয়ে গেছেl
আধুনিকা মেয়েদের পছন্দ আন্দাজ করে', অভীক মেয়েটিকে ব্ল্যাক কফি অফার করলl মেয়েটি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করল, 'না, আমার ওসব চলে নাl কী যে চলে, দ্বিতীয়বার আর্জি রাখতে কুন্ঠিত বোধ করল অভীকl এদিকে ঘড়িতে প্রায় আটটা বাজতে চললl মেয়েটির ফোন বেজে উঠতেই, মেয়েটি মোবাইল কানে নিল, 'হ্যাঁ স্যার, পাঠিয়ে দিন গাড়ি', তারপর অভীকের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আপনার বাড়ির ঠিকানা আর ডিরেক্শন, কাইন্ডলি ড্রাইভারকে বলে দিনl আমার গাড়ি আসছে'l
অভীক যন্ত্রের মতো ঠিকানা, ডিরেকশন আউড়িয়ে গেলl এবং, ধুক করে নিভে গেল বুক-ভরা আশাl এতক্ষণ সে দুরকম সম্ভাবনার কথা জল্পনা -কল্পনা করছিল, প্রথম: তুমুল বৃষ্টি নামলে, মেয়েটি যদি বাড়ি ফিরতে না পারে, দ্বিতীয়: বৃষ্টি থামলে বা কমলে, সেই মেয়েটিকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবেl কোনোটাই বাস্তবায়িত হল নাl
অগত্যা বাড়তি-পাওয়া সময়টুকুতে খানিক আলাপ জমানোর চেষ্টা করল' আপনি এই কোম্পানিতে কতদিন?
'ছয় মাসের ট্রেনিং, পাঁচ মাস হয়েই গেছেl'
'তারপর, কী করবেন?'
'জানি নাl তখনি ঠিক হবে, কী করা যাবে, সবটাই কোম্পানির ওপর নির্ভর করছে'
'আপনার কি কোনো সার্ভিস-বন্ড দেওয়া আছে?'
'ট্রেনিং শেষ হওয়ার পরেই ভবিষ্যৎ কর্মসূচী স্থির হবেl' তরুণী সংক্ষিপ্ত হলোl অভীক প্রসঙ্গান্তরে গেল, 'এখানে কোথায় এসেছিলেন?'
'যেখান থেকে আপনার গাড়িতে উঠলাম, তার কাছেই আমাদের ব্রাঞ্চ অফিসে এসেছিলাম সকালেl সল্টলেক থেকে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলl আমিই বলেছিলাম, একা ফিরে যেতে পারবl রাস্তা পার হয়ে, ট্যাক্সি ধরতে যাচ্ছিলাম, তখনি আপনার গাড়ির মুখেl'
'এরপর আবার কবে আসবেন?'
'রোজই আসবো এখনl এমাসটা তো এই ব্রাঞ্চ অফিসেই বসবো আমিl'
'তাই নাকি? তবে আসুন একদিনl কাছেই আমার শো রুমl দেখে যাবেনl'
'ঠিক আছেl কাল সন্ধ্যার দিকে আমার কাজ শেষ হলে, কল করব আপনাকেl আমাকে পিক আপ করে নেবেনl আপনার নম্বরটা দিনl'
'অবশ্যইl এই নিন আমার কার্ড' মেয়েটি কার্ড নিয়ে তার ভ্যানিটি বাগে ভরে ফেললl বাইরে গাড়ি হর্ন দিচ্ছেl দুজনে বেরিয়ে এলোl ঝকঝকে নতুন মার্সিডিজl ড্রাইভার নেমে এসে তরুণীর জন্য দরজা খুলে দিলোl তরুণী উঠে পড়েছে l কালো কাঁচ উঠে গেলl
অভীক গাড়ির অভ্যন্তরে কিছুই দেখতে পেল নাl গাড়ি সাঁ করে বেরিয়ে গেলl ঘরে ঢুকে প্রথমেই তরুণীর নম্বর মোবাইলে সেভ করে নিলোl রাত কাটল, সুখের রেশ নিয়েl সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে-মনে উচ্চারণ করল, 'রোবিনা' এবং আসন্ন সন্ধ্যার কথা ভেবে পুলকিত হলোl'
সন্ধ্যা ছ'টা বাজতে না বাজতেই অধীর প্রতীক্ষা শুরু হল অভীকেরl সাড়ে -ছটা বাজ্তেও ফোন নেইl মনে-মনে অস্থির হলেও, আগ বাড়িয়ে ফোন করে অগ্রহাতিশয্য দেখানো যুক্তিযুক্ত মনে হল না তারl পৌনে সাতটা নাগাদ রোবিনার ফোন বেজে উঠলl
'গুড ইভনিংl আসবো নাকি আপনাকে নিতে?'
'না, দরকার নেইl আমার ড্রাইভারকে আপনার অফিসের ডিরেক্শন দিনl আমি পৌঁছে যাচ্ছিl ড্রাইভারকে ডিরেক্শন দিয়ে দিলো অভীকl মিনিট তিনেক অপেক্ষা করে নিচে নেমে দাঁড়াল সেl প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেই মার্সিডিজ দাঁড়াল অভীকের অফিসের সামনেl
গাড়ি থেকে নামছে রোবিনাl আজ তার পরণে গোড়ালি পর্যন্ত হলুদ লেগিন্স ও ফ্রিল দেওয়া মেরুণ রঙের বাহারি টপl চোখাচোখি হতেই রোবিনা অল্প মুচকি হাসলোl ঠোঁটের বাঁ দিকে মিষ্টি একটি টোল পড়লোl তার আশ্চর্য সুন্দর মসৃণ কেশ আজ খোলাl স্টেপসে আকর্ষণীয় স্টাইলে কাটাl অভীক যতই দেখছে, মোহিত হয়ে পড়ছেl
একতলা দোতলা জুড়ে তার দর্শনীয় শোরুমl রোবিনা তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সব দেখলl অভীক ভেবেছিল, রোবিনা অভিভূত হয়ে নিজেই প্রশংসায় উদ্বেল হবেl
হল নাl তার মুখে কোনও ভাব বৈলক্ষণ্য দেখা গেল নাl অগত্যা অভীককেই লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হল,
'কেমন দেখলেন?' সংক্ষিপ্ত জবাব এলো 'বেশl
পরক্ষণেই কী মনে হতে, রোবিনা বলে উঠল, 'একটা প্রস্তাব দিচ্ছি, ভেবে দেখুনl আমাদের কোম্পানীর নিজস্ব প্রোডাক্ট আছে, টিভি, ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার, ইত্যাদিl আপনি ইচ্ছা করলে, উপযুক্ত কমিশনে আমাদের জিনিসও বিক্রি করতে পারেনl পাক্কা সেলস গার্লের ঢঙে বললো রোবিনাl
'আসুন একদিন আমাদের মেন্ অফিস সল্টলেকে'l
'বেশ তো যাবোl'
'আচ্ছা আপনি কি কলকাতার মেয়ে? নাকি কর্মসূত্রে এখানে আছেন?'
'কর্মসূত্রেই পাঁচ মাস যাবৎ আছিl আই লাভ কলকাতাl এখানেই আমার উন্মেষ, বিকাশ বলতে পারেন নবজন্মl নিজের স্বত্বাকে মেলে ধরাl'
'বাঃ! আপনি তো ভারী গুছিয়ে কথা বলেনl'
হাঃ হাঃ করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল রোবিনাl যাকে বলে loud laughter. ঝকঝকে নিখুঁত সাজানো দন্তরাশিl দাঁতের মাজনে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতনl তারপর বললো
'স্যার বলেন, আমাকে উনি ঠিকঠাক ট্রেনিং দিয়ে তৈরী করছেনl আমি সায়েন্স সেমিনার হোক বা পলিটিকাল জমায়েত হোক অথবা আমোদ-প্রমোদ–বিনোদনের উৎসব হোক, সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনা বা পরিচালনা করতে পারিl'
'কলকাতাকে যে ভালোবাসেন, কলকাতার দ্রষ্টব্য দেখেছেন কিছু?'
'হ্যাঁl সব ট্রেনীদের নিয়ে স্যার প্রথমে ইকোপার্কের কাছে ওয়াক্স মিউজিয়ামে নিয়ে গিয়েছিলেনl যে মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যাঁকে শ্রেষ্ঠ বাঙালী বলা হয়, তাঁরই মূর্তি নেই! আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিl' অভীক লক্ষ্য করল, মেয়েটির কথায় কথায় শুদ্ধভাষা ব্যবহার করার প্রবণতাl শুনতে অবশ্য মন্দ লাগছে নাl
জিজ্ঞাসা করল, 'আর কী কী দেখেছেন?'
'ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন অফ কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স ও বসু বিজ্ঞান মন্দিরl এই দুটো জায়গার সঙ্গেই আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জড়িতl'
কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স, সত্যই এখানে বিজ্ঞানের ফসল বোনা হয়l বিশ্ব বিশ্রুত রামন এফেক্ট তো এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছেl বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রবেশ পথে রয়েছে, শিল্পী নন্দলাল বসুর আঁকা নিবেদিতার বিখ্যাত চিত্র 'দি লেডি উইথ দি ল্যাম্পl' আচার্য জগদীশ বসুর প্রেরণাদাত্রী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লোকমাতা, স্বামী বিবেকানন্দের ভগিনী নিবেদিতাl প্রিয়তমা শিষ্যা মার্গারেটের সার্থক নাম দিয়েছিলেন নিবেদিতাl তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভারতের সেবায় নিজেকে নিবেদন করেছেনl সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছেন, বিবেকানন্দ কি বিবেকানন্দ হতেন 'যদি নিবেদিতাকে তাঁর পাশে না পেতেনl আমি বিবেকানন্দকে জেনেছি নিবেদিতার 'The master as I saw him' পড়েl আর ভারতবর্ষকে জেনেছি বিবেকানন্দ পড়েl সুদক্ষ কর্মযোগীর এমন সুযোগ্য শিষ্যার আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেইl'
এত খুঁটিনাটি অভীকের জানা ছিল নাl সে শুধু নির্বোধের মতন বলে উঠল, 'আপনার অনেক পড়াশুনাl'
'পড়তে হয়েছে স্যারের ইন্সট্রাকশনেl স্যার বলেন, আমার স্মৃতি শক্তি প্রখরl'
'আচ্ছা, বলুন তো বইয়ের একটা পাতা পড়তে আপনার কতটা সময় লাগে?'
'মন দিয়ে পড়লে তিন-চার মিনিটl'
'আমি তিন চার সেকেন্ডে পড়ে ফেলবোl একবার চোখ বুলিয়েই আমি মনের মধ্যে ছবির মত স্ক্যান করে নিতে পারিl'
'আপনি অসামান্যা প্রতিভাময়ীl'
স্যার বলেন, আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতীl কমন ইন্টেলিজেন্স-এ তো বটেই, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স -ও আমি রপ্ত করেছিl তবে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স আমার কতটা আয়ত্তে এসেছে, সে সন্বন্ধে স্যার নিশ্চিত ননl
ইন্টেলিজেন্স -এর এত রকমফের আছে, অভীকের জানাই ছিল নাl অভীক দেখলো, মেয়েটি প্রতি কথায় স্যারকে টেনে আনবেই এত আনুগত্য কীসের?
সে বললো, 'সব তো ট্রেনিং এর অঙ্গ হিসাবে দেখেছেনl তাছাড়া, শুধু বেড়াবার জন্য, খুশি মতন আনন্দ করতে কোথাও যাননি?
'সে আবার কেমন? কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বিনা প্রয়োজনে? আমরা কি পাগল না ছন্নছাড়া? 'কেন? সবই কি চাহিদা অনুযায়ী হিসেব করে করতে হয়? মনের ইচ্ছে বলে কিছু নেই?
'অকারণ? ঘুরে বেড়াতে? উদ্দেশ্যহীন, যেমন 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থীl এমন চাওয়া?'
'বাঃ, এইতো বেশ বুঝছেনl আপনার এত বুদ্ধি আর এটুকু বুঝবেন না?'
'এই ধরুন, এখন তো সাতটাও বাজেনিl হাতে যথেষ্ট সময়l আপনি তো আটটার আগে সল্টলেকে ফেরেনওনাl সঙ্গে গাড়ি ও রয়েছেl
আমরা দুজন তো সাউথ সিটি মলে একটু হেঁটেও আসতে পারিl
'হ্যাঁ স্বচ্ছন্দে l আপনার যেতে ইচ্ছে?'
'কেন? আপনার ইচ্ছে করে না, কাজের বাইরে একটু আনন্দ করতে?'
'এভাবে তো ভাবিনি, কখনওl কাজ ছাড়া অন্য কিছু? শুধুমাত্র খুশি হলেই!'
'শুধু পড়াশুনো আর কাজ নিয়ে থাকতে থাকতে মনের খুশির হদিস পাচ্ছেন না কি যাবেন? বিনা কারণে ঘুরতে?'
'চলুন, যাওয়া যাকl'
রাস্তায় নেমে দুদিক থেকে দুজনে গাড়িতে উঠলোl রোবিনা বসেছে অভীকের ডানদিকেl তার বাঁ হাতখানি আলতো পড়ে আছে অভীকের ডান হাতের পাশেl হঠাৎ অভীক লক্ষ্য করলো মেয়েটির বাঁ হাতের অনামিকায় লাল পাথরের আংটি জ্বলজ্বল করছেl এনগেজমেন্ট রিং নয়তো? ভয়ে ভয়ে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, 'আপনার আংটির পাথর কি রুবি?'
'না-নাl fun jewelry. ব্রাইটনেস দেখে কে বলবে আসল রুবি নয়! স্যার বলেন, আজকাল রাস্তা ঘাট নিরাপদ নয় l সোনার গহনা পরিত্যাজ্যl কিন্তু মেয়েদের গায়ে গয়না না থাকলে না কি মানায় নাl তাই নকল গহনাl আংটিটা আমিই কিনেছি নিজে পছন্দ করেl এই সাউথ সিটি মল থেকেইl '
যাক তাহলে এনগেজমেন্ট রিং নয়l কিন্তু বাড়ির লোকের উপদেশ-নির্দেশ নয়, স্যার এর কথার গুরুত্ব অধিকl
আর থাকতে না পেরে অভীক জিজ্ঞাসা করে বসলো, 'স্যার' কে?
'আমাদের বস মিঃ অনুপম সান্যালl আসুন একদিন সল্টলেকের অফিসেl
আলাপ হবেl
অভীক মনে ভাবলো, যেতে তো হবেই বুঝে আসতে হবে তিনি নিজেই রোবিনার পাণিপ্রার্থী কী না l কারণ রোবিনা যে অনুপমা, সে সম্পর্কে কোনও সংশয়ই নেইl মাত্র ইঞ্চি কয়েকের ব্যবধানে রোবিনার বাঁ হাত পড়ে আছে অভীকের ডান হাতের পাশেl অথচ, সে ছুঁতে পারছে নাl কী
দূরতিক্রমণীও ওই তিন ইঞ্চির ব্যবধানl হঠাৎ রোবিনা তার বাঁ হাত বাড়িয়ে বলল, 'দেখুন কী রকম ঝকমক করছে?
প্রসারিত হাত প্রত্যাখ্যান করার মতন নির্বোধ অভীক নয়l সে রোবিনার আংটির পাথর পরখ করল , তার হাত হাতে নিয়েl বলল, 'সত্যিই খুবই সুন্দরl'
রোবিনা হাত সরিয়ে নেওয়ার কোনও চেষ্টাই করল নাl এদিকে অভীকের হাত ঘেমে উঠছে, তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুততরl
কিন্তু রোবিনার কোনও হেলদোল নেইl সে নিশ্চিন্তে তার হাত অভীকের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে l কিন্তু তার স্বেদস্পর্শে রোবিনার অসুবিধা হতে পারে ভেবে, সে নিজের হাত সরিয়ে নিতে, রোবিনা বলে উঠল, আংটিটা আপনার পছন্দ? তাহলে, ঠিক এমন আংটি আপনাকে আমি গিফট করতে পারিl'
'না-না' বিব্রতবোধ করল অভীক, 'আমার চাই না'
এই মলে অভীক প্রায়ই আসে, তার সুপরিচিতl দেখা যাচ্ছে, এখানে রোবিনারও যাতায়াত আছে রোবিনার নির্দেশ মতন ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করলো থার্ড লেভেলেl এরপর অভীকই রোবিনাকে নিয়ে এলো এক ক্যাফে কর্ণারেl
ছোট্ট গোল টেবিলের দুদিকে মুখোমুখি বসলো দুজনেl
অভীক লম্বা শ্বাস টেনে বলল 'দেখুন কেমন কোকোর সুঘ্রাণ আসছে নানান ধরণের চকলেটে বিস্কুট , প্যাস্ট্রি কেক তৈরী করে এরাl
'Yes. I can recognize the smell of coffee and cocoa.'
'তাহলে, আজ আর কফি খেতে আপত্তি নেই তো?'
রোবিনা ম্লান হেসে বিরস মুখে বললো 'সরি, ক্ষমা করবেনl আমি খেতে পারবো নাl'
অভীক আহত হলো, তবে কোল্ড ড্রিঙ্কস?
কেন অনর্থক জেদ করেন? বলছি তো কিছু খেতে পারবো নাl বেড়াতে এসেছিl
বেড়ানোর মজাটুকু উপভোগ করতে দিনl
'বেশ' অভীক গিয়ে নিজের জন্য এক কাপ ক্যাপিচুনো কফির অর্ডার দিলl আর নানা ধরণের চকলেটে বিস্কুট কিনে দুটো প্যাকে নিয়ে টেবিলে ফেরৎ এলোl
একটা প্যাক রোবিনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এটা আপনারl চকোলেটের সুবাস যখন আপনার পছন্দ, স্বাদও নিশ্চয় ভালোবাসেন আর তো 'না' বলতে পারবেন নাl
হতাশ স্বরে রোবিনা বলল, 'বেকার-বেকার এত সব করছেনl'
'কেন বেকার বলছেন? দারুণ বেকারী এদেরl অপূর্ব স্বাদl'
রোবিনা আগ্রহ না দেখিয়ে প্যাকেটটি হাতে নিলোl দুজনে কাফে কর্ণার থেকে বেরিয়ে এলোl পাশাপাশি হাঁটছে দুজনেl অনেকেই জোড়ায় জোড়ায় হাঁটছেl এমন একটি সুদর্শনাকে পাশে নিয়ে হাঁটবার সাধ তার বহুদিনেরl উল্টো দিক থেকে হাত ধরাধরি করে এক জোড়া তরুণ-তরুণী আসছে l
অভীক পাশ ফিরে রোবিনাকে চোখের ঈশারা করে, হাত বাড়ালে, সঙ্গে-সঙ্গে রোবিনা অভীকের হাত ধরে নিলোl উদ্দেশ্যহীন বেশ খানিকক্ষণ ঘুরলো দুজনেl রোবিনা বললো 'কাল তাহলে আমাদের গাড়ি লাঞ্চের পর আপনাকে পিক আপ করে নেবেl আমাদের স্যারের সঙ্গে আলাপ করে আসবেনl
‘আসবl কিন্তু তার আগে তোমার মতটা জেনে নেওয়া প্রয়োজনl' হঠাৎ মুখ দিয়ে তুমি সম্বোধন বেরিয়ে যেতে একই সঙ্গে লজ্জিত ও বিব্রতবোধ করলl
কিন্তু নিক্ষিপ্ত তীর ফেরৎ পাওয়া যায় নাl তবে তার সমস্ত শঙ্কার অবসান তখনই হয়ে গেলোl
রোবিনা বললো 'তুমি কী বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইছ?'
রোবিনা তার 'তুমি' সম্বোধনের উত্তর 'তুমি'তে দিয়েছেl বুকের ভেতর দিগ্বিজয়ের দামামা বেজে উঠলl পরম হৃষ্ট চিত্তে অভীক বলল,
'আমার একটা প্রস্তাব ছিলl তোমার ট্রেনিং তো সামনের মাসে শেষ হয়ে যাচ্ছেl' 'হ্যাঁ, আর তিন সপ্তাহ বাকিl
'তারপর তুমি কি আমার কোম্পানীতে জয়েন করতে পারো?'
'সবটাই নির্ভর করছে, আমার বসের ওপরl তুমি কাল এসl কথা বলো সামনা-সামনিl আমার সম্মতি আছেl
অভীকের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠলোl সে দুহাত দিয়ে রোবিনার দুহাত জড়িয়ে ধরলl রোবিনা বললো , কাল রেডি থাকবেl লাঞ্চের পর আমাদের গাড়ি তোমাকে অফিস থেকে উঠিয়ে নেবেl
গাড়িতে উঠে, দুজনে পাশাপাশি বসলl আর এবার অভীক নিঃসঙ্কোচে রোবিনার হাত ধরে বসলl হাতে একটু চাপ দিতে, রোবিনা মুচকি হাসলোl
অভীক বললো, 'গান-বাজনার শখ আছে?'
'আই লাভ মিউজিকl বিশেষ করে বাজনা, সেতার ও বেহালাl'
'গান গাইতে পারেন?'
প্রথাগতভাবে শেখা তো হয় নিl তবে যে কোনো গান শুনে, গলায় তুলে নিতে পারিl স্যার বলেন, গানে আমার সহজাতবোধ আছে, knack. . আবার স্যার! কবে যে স্যার রোবিনার পিছু ছাড়বে?
'তাহলে, তোমার গান তো শুনতে হয়l
'নিশ্চয় শোনাবোl তিনটে সপ্তাহ ধৈর্য্য ধরো, যদি স্যার তোমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান, তবে তোমার কোম্পানিতে জয়েন করতে পারলে, সবদিকেই সুবিধাl আর কোনও বাধ্যবাধকতা রইলো নাl কাল চলে আসবে, স্যারের সঙ্গে কথা বলতে.
পরদিন দুপুর দেড়টা নাগাদ সেই মার্সিডিস এসে দাঁড়ালো তার অফিসের সামনেl উৎফুল্ল মুখে গাড়িতে উঠে দেখলো, গাড়িতে রোবিনা নেইl ড্রাইভারকে রোবিনার কথা জিজ্ঞাসা করা শোভা পায় নাl ভাবল, তাহলে রোবিনা হয়তো অফিসেই তার জন্য অপেক্ষা করছেl গাড়ি পৌঁছে গেল সল্ট লেকের অফিসেl ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সিকিউরিটি গার্ডকে কিছু বলতে, সে ইশারায় একটি ছেলেকে ডাকলোl
সেই ছেলেটি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো অনুপম সান্যালের চেম্বারেl লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপারে ঘোরানো চেয়ারে বসে আছেl সুদর্শন যুবক, অভীকের কাছাকাছি বয়স হবেl উঠে দঁড়িয়ে অভীককে স্বাগত জানাল, 'আসুন, মিঃ বসাকl রোবিনা সব বলেছে আমাকেl আপনাকে বাড়তি ধন্যবাদ জানাই চমৎকার বিস্কুট পাঠিয়েছিলেন আমার জন্যl’
রাগে গা রি -রি করে উঠল অভীকেরl রোবিনাকে দেওয়া বিস্কুটের প্যাকেট, সে তার বসকে গিফট করেছে l কিন্তু পরক্ষণেই রোবিনার মিষ্টি মুখখানি স্মরণ করে ক্রোধ প্রশমিত হলl হয়তো বা রোবিনার চকোলেটে এলারজিl
এদিকে অনুপম বলে চলেছে, জানেন এবার আমরা দুর্গাপূজা করছিl পাঁচ দিন যাবৎ ধুমধাড়াক্কা নয়l বিদেশের মতন ছিমছাম, দুদিনl দূষণ-বর্জ্য-অপচয় নিরোধকl বুঝলেন না তো? ছোটবেলায় মেকানো নিয়ে খেলছেন?
'নানান পার্টস দিয়ে কত কিছু বানানো যেতl তেমনl
তফাতের মধ্যে আমাদের সব ইলেকট্রনিক্স পার্টসl পুজোর শেষে দুদিন পর সব পার্টস খুলে আবার গুছিয়ে উঠে যাবে পরের বছরের জন্যl আমি নিজে নন বিলিভারl পুজোতে বিশ্বাসী নইl মানব ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মে আস্থা রাখি নাl কিন্তু বাঙালীর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি - পুজো নিয়ে নস্টালজিয়া তো সহজে যাবার নয়l ভেবে রেখেছি, থিম হবে, সর্ব-ধর্ম-সমন্বয়l মন্দির-মসজিদ-গীর্জা -গুরুদ্বোয়ারা-বৌদ্ধ প্যাগোডা সব আকারের ছোট ছোট প্যান্ডেলের একেকটিতে মা দূর্গা ও তাঁর সন্তান -সন্ততিরা বিরাজ করবেনl '
শুনতে -শুনতে অভীক ধৈর্য্য হারিয়ে বললো, 'রোবিনা নেই?'
'না, তাকে অন্য একটা কাজে পাঠিয়েছিl বাই দি বাই, রোবিনা বলছিলো, আপনি ওকে আপনার কোম্পানীতে নিতে চান?
সলজ্জ স্বরে অভীক মাথা নেড়ে সায় জানাল, 'হ্যাঁ, যদি আপনার আপত্তি না থাকেl
'না, আমার কোনও আপত্তি নেইl ওর ট্রেনিং ও তো শিগগিরই শেষ হয়ে যাচ্ছে তা, আপনি ওর যমজ ভাই রোবিনকেও নিতে পারেন আপনার কোম্পানিতেl
'রোবিনার যমজ ভাই আছে নাকি? কই আমাকে তো কিছু বলেনিl
'ঐ তো নি জের থেকে কিছু বলবে না তোl তবে যা-যা জিজ্ঞাসা করবেন, ঠিকঠাক জবাব দেবেl' কলিং বেল বাজিয়ে বেয়ারা ডেকে মিঃ রোবিনকে পাঠিয়ে দিতে বললেন মিঃ সান্যালl মিনিট তিনেকের মধ্যে মিঃ রোবিন ঘরে ঢুকলেনl দারুণ হ্যান্ডসমl ত্বকের উজ্জ্বল জৌলুস ও মসৃণ চকচকে কালো চুল ছাড়া রোবিনার সঙ্গে আর কোনও সাদৃশ্য নেইl মিঃ সান্যাল পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'মিঃ রোবিন পুজোর ব্যবস্থার দায়িত্বে রয়েছেন,' তারপর রোবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
'আপনি মিঃ বসাককে নিমন্ত্রণ করুন পুজোয় আসতেl'
'হ্যাঁ -হ্যাঁ অবশ্য আসুন এবং criticএর চোখ দিয়ে বিচার করবেনl আমাদের পরিকল্পনা সত্যই কোনও পরিবর্তন আনতে পারবে কিনা, সে সম্পর্কে মতামত দেবেনl It is an anti-pollution,no-pollution, no recurring expense or labor, actually fantastic project.' আচ্ছা, আমি একটু ব্যস্ত রয়েছি, আপনি মিঃ সান্যাল -এর সঙ্গে কথা বলুনl আমি আসছি ...l '
চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লো রোবিনl
রোবিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, মিঃ সান্যাল চোখ টিপে বললেন, 'কেমন দেখলেন রোবিনকে? দারুণ এফিসিয়েন্টl আমার তো সময় - সময় মনে হয়, রোবিন রোবিনার চেয়েও কম্পিটেন্টl আচ্ছা আপনার রোবিনাকে কেমন লেগেছে?' আচমকা এহেন প্রশ্নে লজ্জা পেলো অভীকl আমতা আমতা করে বললো, 'বেশ-ভালোই-স্মার্ট -সপ্রতিভl' সুন্দরী শব্দটি উচ্চারণ করতে তার বাধলোl
'রোবিনা বলছিল, আপনি ওকে আপনার কোম্পানিতে কাজের অফার দিয়েছেনl তা আপনি রোবিনকেও নিতে পারেনl দুজনের যোগ্যতা একই l
'না, মানে আমি তো রোবিনার সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা বলেছিl আমার অফিস শোরুম সব ঘুরে দেখিয়েছি l এখন, আপনি-উনি যদি দুজনে রাজী থাকেন, তবে সামনের মাস থেকেই রোবিনা আমার কোম্পানিতে জয়েন করতে পারেl' 'আপনার কি রোবিনাকে বেশি পছন্দ?'
'পছন্দ' শব্দটিতে আবার লজ্জা পেল অভীকl তার ঘনিষ্ঠ তরুণী সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির মুখে ওই শব্দটির ব্যবহার সে অনুমোদন করল নাl
মিঃ সান্যাল বললেন, 'ঠিক আছে, এগ্রিমেন্টের কাগজপত্র আমি রেডি করে রাখবোl' 'আসছি তাহলেl' বিদায় নিলো অভীকl
গাড়ি অভীককে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিলোl ঘরে ঢুকেই ফোন করল রোবিনাকেl স্বরে অনুযোগ 'অভিযোগ-উষ্মা সব ফুটে উঠলো, 'তুমি তো বেশ! আমাকে যেতে বলে নিজে হাওয়া!' 'একটু আটকে গিয়েছিলাম'
'কাল কিন্তু তোমাকে আসতেই হবে, আমার বাড়িতেl'
'খুব কি প্রয়োজন?'
'হ্যাঁ, খু --ব খুবই প্রয়োজনl' পরদিন ঠিক সন্ধ্যায় ডোরবেল বাজলোl অভীক প্রায় লাফ দিয়ে দরজা খুলে দিলl সামনে লাস্যময়ী মোহময়ী রোবিনাl রূপ-লাবণ্য যেন রোবিনার শরীর বেয়ে পিছলিয়ে যায়l আজ তার পরণে অফিস ড্রেস নয়, নরম সিল্কের সুনীল সালোয়ার-কামিজ ও সাথে আকাশনীল ওড়নাl
মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রোবিনাl ব্যাগ থেকে একটা গোলাপী পাথরের আংটি বার করল, একেবারে রোবিনার আংটির সদৃশ, শুধু আকারে অল্প বড়োl অভীকের ডান হাত টেনে, ধ্যমায় আংটিটি পরিয়ে দিল সেl আংটি দেওয়ার মানে কি রোবিনার জানা নেই? অভীক আর নিজেকে সামলাতে পারল নাl সপাটে জড়িয়ে ধরল রোবিনাকেl তার ঠোঁটে রোবিনার নরম ঠোঁট নিষ্পেষিত হতে থাকলোl অভীকের বাহুর ঘেরে রোবিনার শরীর গলে যেতে চাইলোl অভীকের উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে রোবিনার রোবট-গালে-চিবুকেl অভীক ঘেমে উঠছে , রো'বিনার কোনও তাপ-উত্তাপ নেইl তার শ্বাস-প্রশ্বাসহীন নাসিকা নিথর, স্বেদহীন শরীর নিস্কম্প l মিনিট দুয়েক! ছিটকে সরে এল অভীক, আর্তস্বরে চীৎকার করে উঠলো.
'তুমি কে --- তুমি কে ..? '
'আমি রোবিনা-রোবোl' অভীকের উত্তরের অপেক্ষা না করে, ঝটতি দরজা খুলে বেরিয়ে গেল রোবিনা l
তিন সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর Cybernatica মেন্ অফিসে পৌঁছাল উদ্ভ্রান্ত অভীকl অনুপম সান্যালকে সরাসরি প্রস্তাব দিলো ,
'রোবিনাকে আমার চাইl'
'on rent? না, permanently?
'পার্মানেন্টলি'
'ক্যাশ ডাউন করবেন? নাকি ইনস্টলমেন্ট?'
'ক্যাশ ডাউন করবো, সঙ্গে এনেছিl
'বেশl তবে মেনটেনান্স কন্ট্রাক্ট করে নিনl তাতে আপনার সুবিধা হবে'
'ঠিক আছেl আপনি যেমন ভালো বোঝেনl
'আমি কিন্তু এখনই রোবিনাকে নিয়ে যাবোl
'স্বচ্ছন্দেl আমাদের দিক থেকে কোনও অসুবিধা নেইl রোবিনা পঞ্চম প্রজন্মের আধুনিকতম এন্ড্রয়েডl ওপরে তার মানবীর ত্বকl ভিতরে অস্থি-মেদ-মজ্জা-রক্ত কিছু নেই, আছে ইলেকট্রনিক সার্কিট l
রোবোটিক্স-র প্রাথমিক সূত্র মেনে কৃত্রিম মেধার উৎকর্ষে মানবীর গড়নে তৈরী এই এন্ড্রয়েডl রোবিনা নিজেকে এবং তার মালিককে রক্ষা করতে সমান পারদর্শিনীl কখনও আপনার কোনও ক্ষতি করবে না, নিজেরও ক্ষতি হতে দেবে নাl শ্রমে শ্রান্ত হবে না, কর্মে ক্লান্ত হবে নাl পরম নিষ্ঠাবতীl তঞ্চকতা কী, তার অজানাl চিরদিন আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেl তার খাদ্যের প্রয়োজন নেইl তার রোবোটিক সেন্সে, স্পর্শ-গন্ধ–শ্রবণ-ভাষণএগুলির প্রোগ্রামিং করা আছেl হিন্দী-ইংরাজী ও বাংলা এই তিনটি ভাষা তার শেখা আছেl' মিঃ সান্যাল রোবিনাকে ডেকে পাঠালেনl
রোবিনা সামনে এসে দাঁড়াল, পরণে হালকা বেগুনী বালুচরী শাড়ীl ম্যাচ করা লোকাট ব্লাউজl দুই ভ্রূর মাঝখানে ছোট্ট টিপ্l মানানসই ছিমছাম গহনাl মেয়েটি সাজতে জানেl নিজেকে স্নিগ্ধ –মোহময়ী করে তোলাও একটা আর্টl অভীক লক্ষ্য করলো, অনুপমের মুগ্ধ দৃষ্টি রোবিনাকে ছুঁয়ে -ছুঁয়ে যাচ্ছে l অনুপম আশ্চর্য হয়ে বললেন 'তুমি এই পোশাকে? 'সপ্রতিভ উত্তর দিলো রোবিনা' কেন? আমি তো আর আপনার অফিসে কাজ করছি নাl
নিতান্ত সহজে স্বচ্ছন্দে রোবিনা হাত বাড়িয়ে দিলো অভীকের দিকেl অভীক শক্ত করে তার হাত ধরলl অনুপম ভাবলেন, প্রেম অন্ধ হয়, তা' জানি কিন্তু মানুষ ও যন্ত্রে তফাৎ করে না! এমন তো কল্পনাও করতে পারি নাl
দুজনে হাত ধরাধরি করে এগোলোl দরজা দিয়ে ঠিক বেরোবার মুখে, হঠাৎ রোবিনা পিছন ফিরে, অনুপমর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকিয়ে হাসলোl তারপর প্রেমী-যুগল ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলোl
হতবাক অনুপম যেন স্পষ্ট দেখেছিলেন রোবিনার চোখ টেপায় আবেগ ছিলl মানুষ না হয় রোবটের প্রেমে পড়েছে! কিন্তু রোবট? রোবট কি প্রেমে পড়তে পারে? তবে কি অভীকের প্রেম রোবিনার মনেও ভালোবাসা জাগিয়েছে? রোবটের হৃদয়! এটা কি প্রযুক্তির নবতম অবদান, নাকি প্রেমের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া রোবটের মনে সঞ্চারিত হয়েছে! ধন্দে পড়ে গেলেন অনুপমl
গল্প
মুখচ্ছবি সাজানো ক্লারা
ছবিগুলি বড় ফ্রেমে দেখতে ছবির ওপর ক্লিক করুন।
ক্লারার পিঠে ভারতীয় মাহুত
ক্লারার পিঠে ঘড়ি। ষোড়শ শতাব্দী।
ভারতীয মাহুত আর গন্ডার
আমষ্টারডাম শহরের জাতীয় সংগ্রহশালাতে (Rijksmuseum) কিছুদিন আগে চীনেমাটির (Porceline) তৈরী এক গন্ডারের (Rhinoceros) প্রতিমূর্তির প্রদর্শনী হয়। ১৭৪১ সালে একটি মেয়ে গন্ডারকে ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে আনা হয়। ইউরোপে এর আগে কেউ কখনও গন্ডার দেখেনি। ওর নাম দেয়া হয় ক্লারা( Clara)।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর (East India Company) অধীনে ওকে অনেকবার বিক্রী করা হয, আর প্রায় সতেরো বছর ওকে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শিত হয়। সে সময়ে ইউরোপে কেউ কখনও গন্ডার দেখেনি। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে আসামের জঙ্গলে ওর একমাস বয়সেই ওকে ধরা হয়। ওর
মা এসময়ে এখানেই মারা যায়। কোম্পানীর ডাইরেক্টরকেই ওকে উপহার দেওয়া হয়। সে সময়, বাংলার সাথে যোগাযোগ, আর ব্যবসা-বানিজ্য করা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। বারুদের মসলা, আফিম, তুলা ইত্যাদি সংগ্রহ করা, আর লোকেদের দাস করে আয়ত্বে আনাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এ সময হুগলী ছিল একটা বড় ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্র। ক্লারা কম্পানীর ডাইরেক্টরের অধীনে আসে, আর, ওকে এত বিশেষ মনে করা হত, যে সান্ধ্যভোজনের সময ক্লারা অতিথিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। দুই বছর পরে এত বড় হয যে ক্লারা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ডাইরেক্টর ডাঔযে মন্টের (Douwe M’ont) কাছে হস্তান্তরিত হয। একজন ভারতীয় ওর দেখাশোনা করতো। এরপর ১৭৪৪ সালের শেযে ক্লারা জাহাজে নেদারল্যন্ডে আসে। ১৭৪৮ সালে ক্লারা আট ঘোরার টানা গাড়িতে ডাউএ মন্টের সাথে ভিয়েনা যায। ১৭৭০ ক্লারা এত বিখ্যাত হয যে ওর পোরসেলিনের অনেক মূর্তি তৈরী হয়। ইউরোপে অনেক জায়গা ক্লারা দেখেছে। এত বিশাল জন্তু ইউরোপে কেউ কখনও দেখেনি। একে নিয়ে অনেক কথা কাহিনীও লেখা হয়েছে। গন্ডারের শিং খুবই লোভনীয়, নানা কাজে দরকার, বিশেষ করে অসুখ-বিসুখে। ক্লারা কিন্তু ভিওসি অধীনে ছিল না, ও ছিল Douwe Mont এর বিশেষ আদরের। ১৭৫৮তে মৃত্যুর আগে পর্য্যন্ত ক্লারা ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক মডেল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেয থেকে আরও গন্ডারের আনাগোনা শুরু হল ইউরোপে। ক্লারার নাম হারিয়ে গেল। তবে অনেক দেশেই গন্ডারের শিং এর বিশেষ সমাদর আরও বৃদ্ধি পেল।
প্রবন্ধ
নদীজীবন ও
ডাগর বসন্ত
সুদীপ ঘোষাল
এক
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো। ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া। তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে। রোদের চাদরের মত উঠোনে শীতকালে বসে ওরা। নোটন নোটন পায়রার মত গল্প করে ঘন্টার পর ঘন্টা। কি এত গল্প ওদের। প্রতিবেশিরা হিংসে করে বলে, লোকদেখানি ঢলানি মাগি।আসলে ওরা নন্দনপুকুরের পাড়ে তেঁতুলগাছের নিচে ঘর বেঁধেছে পুতুলখেলার মত। কনকের স্বামী দাসপাড়ার মণি রূপচাঁদ। কিশোরির দল রূপকে দেখলেই গল্প করার ছলে একটু কাছে আসতে চায় একটু স্পর্শ চায় ভালবাসার। যদি বল কেন, কি কারণ। তা বলা মুস্কিল। এক একটা সুপুরুষ আসে, দেখে আর জয় করে মন। কারণ নাই বা কোন পাপ নাই। ফুলকে তো তোমার আমার সকলের ভাল লাগে কারণ ছাড়াই। রূপ বলে, ও আমার কনকচাঁপা।
কনক এর আসল নাম কিন্তু সবিতা। সবিতা দেবি বলেই সবাই জানতো কিন্তু স্বামী তাকে আদর করে ডাকে কনকচাঁপা বলে। কনকচাঁপা আবার সবিতাদেবী স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি শিক্ষিত কিন্তু তার শিক্ষার কোনো বড়াই নেই সে মনেপ্রাণে তার আচরণের মাধ্যমে তাকে দেখলেই বোঝা যায় কত বড় শিক্ষিতা তিনি। কনক বলে, তোমার কাজ করার দরকার নাই। আমি বাবুদের বাড়ি কাজ করি। খেয়ে পড়ে চলে যাবে আমাদের। রূপ বলে, তাই আবার হয় গো। লোকে নিন্দে করবে। বলবে, গতর বাগাইছে বৌকে পাঠায় পরের বাড়ি। তোমাকে কাজ করতে হবে না গো। আমি রোজগার করব গতর খাটিয়ে।
কনকের গায়ের রঙ চাঁপা ফুলকেই হার মানায়। মসৃণ পেলব তার মুখমণ্ডল। জোড়ায় যখন যায় বাবুপাড়ার লোকগুলো বলে, রূপ বটে দুজনার। না খেয়েও কি করে হয়?
কোন কোনদিন রূপের রোজগার ভাল না হলে উপোস যায়। ওদের জমি নাই। বাবুদের দুবিঘে জমি ওরা দুজনে দেখাশুনো করে আর খায়।আজ শ্রাবণমাসের সন্ধ্যাবেলা রাতের অন্ধকারে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। নিকষ অন্ধকারে কনক আর রূপ শুয়ে আছে মাটির মেঝেতে। ভীষণ এক মেঘগর্জনে বৃষ্টি দাপিয়ে বেড়াল কনকের শরীর জুড়ে। তারপর ফাগুন এল। ফুলে রঙে ভরে গেল প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে কনকের পেট। রূপ কনকের পেটে কান পেতে শোনে আগামীর ছটফটানি। জমির বাঁজা রূপে গ্রাম ছাড়ল রূপ। মুম্বাইয়ের এক হোটেলে কাজ পেল। কনক পোয়াতি হয়ে একা একা পাড়ার বুড়িমাসির কাছে থাকে। বুড়িমাসির ঘরদোর নাই। রূপ যাওয়ার আগে সুদে টাকা ধার করে ব্যবস্থা করে গিয়েছে দুজনের।
তারপর দেশজুড়ে প্লেগের প্রকোপে দিশেহারা হল মানুষ। স্বামীজীর ডাকে আমাদের ভারতবর্ষে এলেন ভগিনী নিবেদিতা তিনি রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে শুরু করলেন তার দেখাদেখি যুবকরা ও রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে শুরু করল। তবু প্লেগ এত বড় মহামারী যে হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নিল নিমেষে। দেশ কে দেশ গ্রাম থেকে গ্রাম আজার হয়ে গেল মুহূর্তে। কনকের চিন্তা বাড়ল। রূপ কেমন আছে। বেঁচে আছে তো।
বুড়িমাসি বলে, চিন্তা করবি না। যার কেউ নাই তার....
মহামারীর প্রকোপে গ্রামে গ্রামে মড়ক লাগলো। আজাড় হয়ে গেল পৃথিবীর ভান্ডার। কত লোক যে ছটফটিয়ে মরে গেল তার হিসেব রাখে কে?
কনকের কোলজুড়ে এল আলো। রূপচাঁদের ভালবাসার আলো। কনক এখন কাজে যায়। কনকের রূপ দেখে পঞ্চায়েতের পার্টির লোক বলল, আমাদের দলে নাম লিখা। তোকে এবার জেতাব পঞ্চায়েতের ভোটে। বুড়িমাসি বলল, তু যা। আমি তোর ছেলেকে মানুষ করব।
ভোটে জিতে কনক আজ মেম্বার হয়েছে পঞ্চায়েতে। তবে তারজন্যে রূপের সম্পত্তি বাঁধা দিয়েছে কনক। দলের মোড়ল একরাতে তার নরম মনের কোণে লুকিয়ে থাকা রূপকে চুরি করেছে। ছ্যাঁচড়া চোর আর লম্পট একই কথা,বলে বুড়িমাসি। তোকে রূপের এই আলো কে জ্বলিয়ে রাখতে হবে জীবনজুড়ে। রূপের মত যেন বাইরে খাটতে যেতে না হয়।
কনক বুড়িমাসির কথা শুনে বুঝেছিল এই বাঁজা জমিগোলাতে প্রাণ আনতে হবে। সে মাইকে এখন ভাষণ দেয়, জমিগোলা বাঁজা ফেলে না রেখে ফসল ফলাও আমার রূপসোনারা। বাবুদের জমিতে তোমরা চাষ কর। বাইরে যেও না। বাঙালি হয়ে থেকে যাও নিজের গ্রামে। আমরা বাংলার লোক পথ দেখালে এগিয়ে আসবে হাজার হাজার গ্রাম।
কনকের কথায় কাজ হয়েছিল। শয়ে শয়ে গ্রামের ছেলেরা চাষকাজে নেমে পড়েছে উৎসাহে। পঞ্চায়েত থেকে প্রধান হয়ে কনক চাষিদের লোনের ব্যবস্থা করে দিল সবাইকে। সবুজে সবুজে ভরে গেল বাঁজা মাঠ।
কনক আজও খুঁজে বেড়ায় রূপকে। মাসিবুড়ি বলে, "অতিবড় সুন্দরী না পায় বর... "
কনক সবুজ মাঠে যায়। ফাঁকা নীল আকাশে মাথা তুলে কনক বল, রূপ তুমি কোথায়। আমার কথা শুনছ। তুমি ফিরে এস বাংলার সবুজ বুকে।ধীরে ধীরে কাল কেড়ে নেয় রূপ হয়ত করোনা বা প্লেগের রূপে। কনক এখন মাঠে যায়। ছেলেকে চাষ করতে দে'খে মন ভরে যায় মায়ের। অতি সুক্ষ্ম তরঙ্গের স্পন্দন শোনার অপেক্ষায় মৌন হয়ে অপরূপ প্রকৃতির, কোলে আশ্রয় নিতে চায় কনক ।চাওয়া,পাওয়ার উর্ধ্ব জগতে ভাসতে ভাসতে ছাই হোক নশ্বর দেহের অহংকার। স্থূল পদার্থ নিয়ে পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না। অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত।তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তারা টানাটানি করতেন বেশি।
আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ, স্বার্থপরের মত খন্ড খন্ড করেছি। এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লীর, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখন্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই। আকাশ চিরদিন অখন্ডই থাকে।তাকে খন্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো। তবু কাঁটাতার হয়, সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভূত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল।
আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, 'অনন্ত নাদ' এর ভেরী। সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব, ভুলে যায় তার অবস্থান। এ অনুভূতি ঝর্ণার মত, কবিতার মত, ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না। সৃষ্টির সবাই ভয়ে কাজ করি। অস্তিত্ব বিনাশের ভয়ে। পৃথিবী ঘোরে ভয়ে, তা না হলে সে ধ্বংস হবে। সূর্য তাপ দেয় ভয়ে, তা না হলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সৃষ্টি মানুষের প্রশ্বাস, স্থিতি মানুষের ক্ষণিক ধারণ, প্রলয় মানুষের নিশ্বাস।
কনকের ছেলে শিক্ষিত। সে মাকে বলে, আলোর অনুসন্ধানীর ভয় নেই, তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই নেই। লোভ নেই, তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নেই। অকাল বার্ধক্য নেই। আছে শুধু আনন্দ, ছেলেমানুষি, বোকামি, সরলতা, সোজা পথে হাঁটার অখন্ডতার সোজা রাস্তা...
কনকের ছেলে আলো। সে বাবার খোঁজে মায়ের কথা না শুনে বেরিয়ে গেল গ্রাম ছেড়ে। কেরালা সে একটা চাকরি পেল এবার সে চাকরি করে মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে লাগল আর খোঁজ করতে লাগল বাবার কিন্তু কোথায় পাবে তার হদিশ তো কেউ জানে না তবু কোন সূত্র ধরে সে বাবাকে খুজবে সেই বুঝে উঠতে পারল না ধীরে ধীরে বয়স বাড়তে লাগলো আলো আজ 40 বছরের হল।
এদিকে গ্রামে মা অনেক বয়স হয়ে গেছে আর তার খাট বা ক্ষমতা নেই তার বুড়িমা কবে জানো মরে গেছে আর একা একা মা গ্রামে থাকে তার মন খারাপ করে কিন্তু উপায় নেই আর তো বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না সেভাবে এবার গ্রামে ফিরে যাব।
দুই
বিরাজুল মানুষ হয়েছে তার চেনা জগতে। ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই আম্মির মুখ দেখে শুরু হতো তার দিন। সারাদিন স্কুলে কাটতো ছেলেবেলার জগত।
মনে পরে স্কুল থেকে এসেই ব্যাট হাতে বেরিয়ে পরতো ক্ষেত্রপালতলার মাঠে। জাহাঙ্গীর, মতিউল্লাহ, সিরাজ, ইজাজুর, সামিম, সুদীপ্ত, বাবু, ভম্বল, বিশ্বরূপ, মিলু, অধির সব বন্ধুরা জড়ো হতো ক্রিকেট খেলবে বলে। খেলার শেষে বসে গল্প করতো। প্যান্ট না পরে লুঙ্গি পরে মাঠে এলে তার মাথায় তুলে দিতো লুঙ্গি বন্ধুর দল। লুঙ্গি পরে খেলার অসুবিধা। বলতো, বিরাজুল। হোলে, বল লেগে একবার অজ্ঞান হয়ে গেছিলো এক বন্ধু। ধীরে ধীরে সকলের প্যান্ট পরে আসার অভ্যাস হয়ে গেলো। ম্যাচ খেলতে যেতাম অনেক জায়গায়। একবার বিল্বেশ্বর গ্রামের টিমকে হারিয়ে জিতেছিলাম এক হাঁড়ি রসগোল্লা। সুধীনবাবু ধরিয়ে দিলেন বিরাজুলের হাতে ক্যাপটেন হিসেবে। সবাই ভাগ করে খেলো। পুরস্কারের এই অভিনবত্বে অধুনা কানাডাবাসী মিলুদা খুব খুশি হয়েছিলেন।
বিরাজুল আজ রূপাকে বলছে তার ছাত্র জীবনের কথা, তখন ১৯৮০ সাল। আমরা দশজন বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। একটা রেকর্ড রেজাল্টে সবাই খুশি হয়েছিলেন সেবার। তারপর জীবন যুদ্ধে সবাই আলাদা হয়ে গেলো। কে যে কোথায় পড়তে গেলো কোনো খবর পেলাম না। কিন্তু পুরোনো অনেক ক্লাসমেটের সঙ্গে যখন দেখা হয়, মনে পরে যায় পুরোনো দিনের কথাগুলো।
বিরাজুল বলে চলেছে, একবার স্কুল থেকে ছাত্রদের নিয়ে বেড়াতে গেছিলেন স্কুলের শিক্ষক মহিমবাবু। ঘুরে এসে অজয় নদীর ধারে যখন এলাম, তখন রাত্রি দশটা বেজে গেছে। নদীতে বর্ষার উদ্দাম গতি। কানায় কানায় ভর্তি জল। মহিমবাবু চিন্তায় পরে গেছেন, কি করে চল্লিশটা ছেলে নদী পার হবে। হঠাৎ আমরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম পাঁচজন সাহসী ছেলে হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে লাফিয়ে পড়লো জলে। আমরা সবাই হায় হায় করে উঠলাম ভয়ে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছিলাম এই বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো নিজের প্রাণের বিনিময়ে ওই লালমুখো বাঁদরদের কাছ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, দুটো নৌকো নিয়ে তারা ছেলেদের নদী পার করছে। মহিমবাবু বললেন, মাঝিরা এলো না? শ্যাম বললো, স্যার চিন্তা করবেন না। ওদের ঘুমের ব্যাঘাত না করে আমরা নৌকো নিয়ে এসেছি। ওরাও জানে শ্যাম থাকলে কোনো ভয় নেই।
মহিমবাবুর চোখে জল এসে গিয়েছিলো। দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন দামাল পাঁচ ছাত্রকে।
আর ছোটোবেলা থেকে মুসলিম পাড়ার ছেলে মেয়ের সঙ্গে খেলতো রূপা। রূপে, গুণে অতুলনীয়া। সে বিরাজুলের সঙ্গে খেলতো বেশি। বিরাজুলকে না দেখলে ভালো লাগতো না রূপার। কেন ভালো লাগতো না, সেকথা বুঝেছিলো অনেক পরে। বালিকা বয়সের ভালো লাগা, ভালোবাসায় পরিণত হয়েছিলো।
ধীরে ধীরে স্বর্ণলতার মতো বেড়ে উঠলো শরীর ও মন। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কে কোথায় ছিটকে গেলো কে জানে? শুধু বিরাজুল আর রূপা কাকতালীয়ভাবে একই কলেজে রয়ে গেলো। দুজনেই সুরেন্দ্রনাথ ল কলেজে পড়ে। সল্টলেকে একটা কোয়ার্টারে তারা ভাড়া থাকে। ল পাশ করে তারা দুজনেই যাবে বিলাত। হায়ার স্টাডির জন্য।
হিন্দুর মেয়ে মুসলিম ছেলের সঙ্গে থাকে, শোয়, খায় একথা প্রচার হতে বেশি সময় লাগলো না। রূপা বললো, জীবনটা আমাদের। কে কি বললো যায় আসে না। বিরাজুল ও রূপার রেজেষ্ট্রী ম্যারেজ হয়ে গেলো। দুজনে এখন শোয় একসাথে। কন্ডম ব্যবহার করে। ছেলেপুলে এখন নেবে না। বিরাজুল বলে, প্রথমে দুজনে ভালো আয় করবো। তারপর ছেলেপুলে নেবো।
গ্রামে একটা রসের আলোচনা এই দুজনকে নিয়ে। ওরা জাত দেখে, মানুষ দেখে না। ওরা পোশাক দেখে হৃদয় দেখে না, বলে বিরাজুল। বিরাজুলও আর বাড়ি যায় না। ওদের বাড়ির অনেকেই এই বিয়ে মন থেকে মানতে পারে নি।
রূপাও বিরাজুল একদিন বিদেশে পাড়ি দিলো। কানাডার টরেন্টো শহরে বাসা নিলো। দুজনেই কাজ পেয়ে গেলো। মাইনে মোটামুটি। তার সঙ্গে পড়াশোনা। রূপা দেখেছে, শরীর বেশিদিন ভালো লাগে না। ও বিরাজুলের মন দেখেছে। একটা সুরের সাধককে দেখেছে ওর মধ্যে, যে সুরের সাধনা না করেও মানুষের মনসুরের সন্ধানে ব্যস্ত। ওদের দুজনেরই এখন দেশের কথা মনে পরে।
বিরাজুল ভাবে, আব্বা তাদের নবাবের মতো মানুষ করেছে। তাকে দেখেই শিখেছে, মানুষের হৃদয়ধন খোঁজা। আব্বা বলতেন, মন বড় রাকবি। মন বড়ো থাকলেই দেকবি মানুষের হৃদয়ে আল্লার অধিষ্ঠান। হৃদয় হলো মসজিদ আর মানুষ হলো আল্লার দূত। কোনো মানুষই ছোটো নয়। যদি একটা মানুষের মনে জায়গা করতে পারিস, তাহলেই তোর জীবন ধন্য হয়ে যাবে।
আম্মির আদরে বিরাজুল মানুষ হয়েছিলো। সেই আম্মিকে ছেড়ে তার মন খারাপ করে। কিন্তু জীবনে সাধনার জন্য অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকলে পৃথিবীটা অচেনা হয়ে যাবে।
রূপা বাবার খুব আদরের একমাত্র মেয়ে। মা, বাবাকে রাজী করিয়ে সে বিরাজুলের সঙ্গে ঘর ছেড়েছে। মা, বাবাকে সে বলেছে, চিন্তা কোরো না, আমি ওর সঙ্গে সুখে থাকবো। আর ওর সঙ্গেই আমার সাধনার সুতো জড়িয়ে আছে।
যে বিষয়ে রূপার অসুবিধা হতো পড়ার সময়, বিরাজুল সেই অসুবিধাগুলো সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতো রূপাকে। ফলে রূপাকে পড়ার সময় ঝামেলায় পড়তে হতো না। দুজনের সুন্দর এক বোঝাপড়া ছিলো।
রূপার মনে পড়ছে পিউ তার বান্ধবী, আর সে ন্যাশানাল পাড়ায় একটা বাড়িতে ভূত দেখেছিলো।
পিউ স্কুটি চালিয়ে বাজারে গেছিলো। বাবাকে বাজার করতে দেয় না। বাবা পুজো নিয়ে ব্যসত থাকেন। আজ পিউ এর পায়ে একটা পাথর লেগেছে। ব্যাথা হচ্ছে। রাস্তার ঢালাই এর পাথরগুলো রাক্ষসের মতো দাঁত বের করে আছে। নামেই ঢালাই। আর হবে না কেন। যারা চেয়ার দখল করে বসে আছে তারা ঘুষ খাবে। তবে অনুমোদন দেবে রাস্তা তৈরি করার। তারপর যে তৈরি করবে সে খাবে। তারপর তলানি। এতে আর কি হবে।
ভিতরে ঢুকতেই পিউ এর বাবা বললো, কি হলো পায়ে। পিউ বললো, ও কিছু না, একটু লেগেছে। মা বললো, যা করবি একটু দেখে শুনে করবি।
পিউ ব্যাগ রেখে তার প্রিয় বান্ধবী রূপাকে ফোন করলো। ছোটোবেলা থেকে ওর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একবার ওরা ভূত দেখেছিলো।
একবার ন্যাশানাল পাড়ার একটা বাড়িতে ভূত দেখেছিলো দুজনে। একটি বাচ্চা মেয়ে সামনে এসে বললো, একবার এসো আমাদের বাড়ি। আমার মা ডাকছে। রীতা বললো,তোর মা কে তো চিনি না।
মেয়েটি বললো, একবার এসো না।
ওরা ভিতরে গিয়েছিলো। তারপর দেখলো মেয়েটা আর ওর মা হাত বাড়িয়ে নারকোল গাছ থেকে নারকোল পেড়ে আনলো। তারপর এক কিল মারলো। নারকোল ভেঙ্গে গেলো। তারপর রক্ত হাতে বললো, খা, খা।
ভয়ে ওরা ছুটে বাইরে এলো। রীতা ও পিউ মামুদপুরের মেসোকে বলেছিলো ঘটনাটা। তিনিও ভয়ে পালিয়েছিলেন। মেশো তার আত্মীয় অমলকে ঘটনাটা বলেছিলো। অমল বন্ধুদের বলেছিলো। পিউ এর মনে আছে অমল ও তার বন্ধুরা সবাই আড্ডা মারছে। এমন সময় অমল বলে উঠলো, জানিস ন্যাশানাল পাড়ার বনের ধারে যে তিনতলা লাল বাড়িটা আছে সেখানে নাকি ভূত দেখা গেছে।
মিহির বললো, তাহলে তো একদিন সবাই মিলে গিয়ে দেখে আসতে হবে।
পিউ আর রূপা দোকান গেছিলো। সে বললো, টোটোনদা সত্যি আমরা দেখেছি ভূত নিজের চোখে। যা করবে সাবধানে কোরো আর পারলে ঘনাদাকে সঙ্গে নিও। ওর সাহস আছে।
টোটোন বলে উঠলো, তোরা খুব আজগুবি কথা বলিস। আরে টোটোন থাকতে ভূতের বাপও বাড়ি ছেড়ে পালাবে। চল তাহলে একদিন দেখাই যাক। আমরা সামনের অমাবস্যায় ওই বাড়িতে যাবো। ফিষ্ট করবো। মাংস আর লাল জল। বুঝলি কিনা। জমবে ভালো।
অমল বললো, শোন আসল কথাটা বলি। আমার মামুদপুরের মেসো একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। বিকালে ওই বাড়ির দিকে বেড়াতে গেছিলো। একট বাচ্চা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মেশোকে বললো, আমার খিদে পেয়েছে। মামা জিলাপি কিনে ছেলেটাকে বললো, যাও খেয়ে নাও।ছেলেটি নাছোড়বান্দা। বললো, আমার বাবাকে দেখবে এসো। কতদিন খেতে পায়নি। এসো দেখে যাও।
মেসো সরল লোক। মায়া হলো। ভিতরে গিয়ে দেখলো বাবা নয়। এক ভয়ংকর স্কন্ধকাটা ভূত। বললো, আমার গলা কেটে সবাইকে মেরে আমার সংসার শেষ করেছে তোর মতো একটা পাষন্ড। আমি কাউকে ছড়বো না। কাটা মুন্ডুটা হাতে। সেই মুন্ডুই কথা বলছে।
মেসো ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। এবার ভবলীলা সাঙ্গ ভাবছে মেসো। এমন সময় ছেলে্টি সামনে এসে বললো, বাবা এই লোকটি ভালো। জিলাপি কিনে দিয়েছে। এই বলে ছেলেটি উড়তে উড়তে জিলাপি খেতে লাগলো। উড়ন্ত অবস্থায় ছেলেটির মা বললো, এঁকে ছেঁড়ে দাঁও। যাঁও যাঁও। জিঁলাপি খাঁও।
তখন সুযোগ বুঝে মেসো পালিয়ে এসে বাঁচে।
টোটোন ভয় লুকিয়ে বাতেলা দিলো অনেক। বললো, ঠিক আছে আমরা কুড়িজন একসাথে যাবো ওই বাড়িতে। দেখা যাবে। কত ধানে কত চাল। তবে ঘনাকে সঙ্গে নিস বাবা।
চালাক টোটোন। তাই দল বাড়াচ্ছে। ঠিক হলো কুড়িজন বন্ধু একসাথে যাবে। অনেক ছেলের মাঝে নিশ্চয় ভূত আসবে না।
মাঝের কয়েকদিন যে যার কাজ নিয়ে থাকলো। তারপর এসে গেলো সেই অপেক্ষার অমাবস্যা। দিনের বেলায় সবকিছু কেনাকাটা সেরে সবাই দুরুদুরু বুকে রাতের প্রতিক্ষায়। কিন্তু কেউ ভয় প্রকাশ করছে না। বাড়িতে কেউ বলে নি। সবাই বলেছে, আজ একজন বন্ধুর জন্মদিন। রাতে বাড়ি আসবো না। ওখানেই সব ব্যবস্থা।
রাতের বেলা ন্যাশানাল সিনেমা হলের কাছে সবাই একত্র হলো। সবাই চললো এবার সেই অভিশপ্ত বাড়িতে। টোটন চুপ। কোনো কথা নেই। অমল বললো, কি রে টোটোন, চুপ মেরে গেলি কেন? কথা বল।
টোটোন বললো, এই দেখ আমার অস্ত্র। একটা মস্ত নেপালা বের করে দেখালো। তারপর বললো, ভূতের দফা রফা করবো আজই।
কথায় কথায় বাড়িটা চলে এসেছে কাছে। অমল বললো, চল ভিতরে ঢুকি। ঘনা বললো, তোরা যা, আমার কাজ আছে। তবে অই বাড়িতে ভূত আছে। পিউ আর রীতা আমাকে বলেছে। যাস না বাড়ি যা। ঘনাকে কেউ রাজী করাতে পারলো না। ঘনাকে পিউ আড়চোখে দেখলো। মনে মনে ভাবলো, কি সুন্দর চেহারা ছেলেটার।
দুজন লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। বললো, মরতে যেচো কেনে ওই বাড়িতে? খবরদার ওই দিকে মাড়িয়ো না। গেলেই মজা টের পাবে।
এখন আর ফেরার কোনো ব্যাপার নেই। হুড়মুড় করে সবাই ঢুকে পড়লো বাড়ির ভিতরে। তারপর মাকড়সার জাল, ধুলো পরিষ্কার করে রান্না শুরু করলো। এখনও অবধি কোনো ভৌতিক কান্ড ঘটে নি। ভয়টা সকলের কমে গেছে।
টেটোন বললো, অমল তোর মেশোর গাঁজার অভ্যাস আছে নাকি?
সকলের সামনে অমল একটু লজ্জা পেলো। তারপর ভাবলো, বন্ধুরা একটু ইয়ারকি মারে। ওতে ইজ্জত যায় না।
টোটোন এক পিস কষা মাংস নিয়ে লাল জলে মন দিয়েছে। সে এই দলের নেতা। সবাই অলিখিত ভাবে তাকে মেনে নিয়েছে নেতা হিসাবে। নেতা কষা মাংসতে কামড় মারার সঙ্গে সঙ্গে কষ বেয়ে লাল রক্ত। বোতলে রক্ত ভরতি। সবাই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু নেতা দেখতে পাচ্ছে না। নেতাকে রক্ত মাংস খাওয়া ভূতের মতো লাগছে।
অমল কায়দা করে তাকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। নেতা নিজের রূপ দেখে ভয়ে বু বু করতে লাগলো। সবার প্রশ্ন এত রক্ত কোথা থেকে এলো? নেতা অজ্ঞান হয়ে গেলো।
তাকে জল দিয়ে জোরে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলো বন্ধুরা। তারপর জ্ঞান ফেরার পরে আবার ভয়ের পালা। রাত তখন দশটা। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। আর চার দেওয়ালের গা বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা। এত রক্ত যে মেঝে দিয়ে গড়িয়ে সকলের পা ভিজে যাচ্ছে। নেতা এবার জোড় হাত করে বলছে, আমাদের ছেড়ে দাও, এই কান মুলছি, নাক মুলছি আর কোনোদিন এই বাড়িতে ঢুকবো না। দয়া করো আমাদের দয়া করো।
তখন আড়াল থেকে কথা শোনা গেলো, তুই তো নেপালা এনেছিস। সবাই দেখলো নেপালা নিজে থেকেই শূণ্যে ভাসছে। তারপর ভূত হাজির। নেপালা একবার ভূতের মাথা কাটছে আর জোড়া লেগে যাচ্ছে। বলছে, আমাকে কাটবি। মাথা কাটবি। তোর মাথা কাটি। নেতা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে।তখন অমল বললো, আমরা তোমার সাহায্য করবো। কে তোমাকে মেরেছে বলো। আমরা পুলিশকে জানাবো। সে শাস্তি পেলে নিশ্চয় তোমার আত্মার শান্তি পাবে। কথায় কাজ হলো সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। রক্ত মুছে গেলো। আর একটা ছবি হাওয়ায় উড়ে এলো।
টোটোন ছবি দেখে বললো, একে আমি চিনি। নিশ্চয় একে পুলিশে দেবো। আমরা কুড়িজন সাক্ষী দেবো। তারপরে পুলিশ সব দায়িত্ব পালন করেছিলো। সেই বাড়ি এখন পুলিশ থানা। চাকরি পেয়েছে কুড়িজন সাহসী ছেলে। যাদের চেষ্টায় খুনী ধরা গেছে। আর অতৃপ্ত তিনটি আত্মা মুক্তি পেয়েছে।
ঘনা ভূতে বিশ্বাস করে। ও সহজ সরল ছেলে। ঝামেলার মধ্যে ও নেই। আর ওর বাড়ি অনেক দূরে। সেদিন ঢোল সারাতে এসে ওদের সঙ্গে দেখা।
ঘনার সাথে এই গ্রামের ছেলেমেয়েদের ছোটোবেলায় দু একবার কথা হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি নয়। তারপর পরিচয় হওয়ার পর জানতে পেরেছে দুজনেই। প্রায় দশ বছর পরে ওদের দেখা। প্রথম দর্শনে কেউ বুঝতে পারে নি। পিউ হঠাৎ করে ঘনাকে ভালোবাসে নি। ভালোবাসার সুপ্ত বীজ পিউ এর অন্তরে গেঁথে গেছিলো ছোটোবেলা থেকেই। সে ঘনাকে চিনতে না পারার ভান করেছিলো।
ঘনা ভাবে চিনতে না পারাই ভালো। ওরা ধনী। তারপর আবার উঁচু জাত। ভালোবাসলে সমানে সমানেই ভালো। সমাজের নিয়ম আগে।
মাঝে মাঝে ঘনা জাল নিয়ে অজয় নদীতে মাছ ধরতে যায়।
আবার বিরাজুল ভাবে, দেশের বন্ধুদের কথা, তার আত্মীয় স্বজনের কথা।
এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পড়েনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো সে। সারা বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্ত কিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের শালার। গঙ্গার ধারে গ্রামটি। ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া। কারও বাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। সন্ধ্যা নেমে এলো জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো মন ভাবসাগরে।
কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায় কালের প্রবাহে। বন্ধু অমিত বললো। তবু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে অন্তত বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করা ভালো।
অতনুর মনে পড়ে, বিরাজুল, রাজু আর তার দশজন বন্ধু পুজো বাড়ির শ্যাওলা পড়া দেয়াল ঘেঁষে বসতো। পুরোনো কারুকার্যের মুগ্ধতা ছাড়িয়ে ভালোবাসার গান বিরাট বাড়িতে প্রতিধ্বনি শোনাতো। বন্ধুদের মধ্যে চারজন মেয়ে ছিলো। দেবীকা বলতো, বন্ধু শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ করিস না। ভালো শোনায় না। কোনোদিন রাজু বা বিরাজুল তাদের মেয়ে মনে করেনি। বন্ধু তো বন্ধুই। তার আবার ছেলে আর মেয়ে কি? বলতো রাজু। একই কাপে তারা কফি খেতো পুজো বাড়ির পাশের কফি হাউসে। ভাগে কম হলে রূপসী বলে বন্ধুটা রাস্তায় লোকের মাঝে দীনেশকে ফেলে মারতো খুব। তাদের বন্ধুদল বিপদে, আপদে কাজ করতো গ্রামে। তাই তাদের অনেকেই সম্মান দিতো। আর আদরের এই মার খেতেই দুষ্টুমি করে তার ভাগেরটা কম রাখতো। অভিভাবকরা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের মেলামেশায় বাধা দিতেন না।
দরজা ঘাটের বাঁধানো ঘাটে পানকৌড়ি আর মাছরাঙার কলা কৌশল দেখে পার হয়ে যেতো অবাধ্য সময়। অন্ধকারে ফুটে উঠতো কালীতলার সার দেওয়া প্রদীপ। ঘরে ঘরে বেজে উঠতো শঙ্খধ্বনি। হাতগুলো অজান্তে চলে যেতো কপালে। তারপর হাত পা ধুয়ে ভাইবোন একসাথে বসে সরব পাঠের প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেতো। কে কত জোরে পড়তে পারে। একবার বুলু কাকা বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন অতনু পড়ছে, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়। ঘরে ঢুকে কাকা বললেন, ন্যাটিওনাল নয় ওটা ন্যাশনাল। ঠিক করে পড়। অতনু জোরে পড়ছে বলে উচ্চারণটা ঠিক হলো। তারপর পড়া হয়ে গেলে একান্নবর্তী পরিবারের সবাই উঠোনে খেতে বসতো। আলাদা করে কোনো শিশুকে খাওয়া শিখতে হতো না, জোর করতে হতো না। সবার খাওয়া দেখে ধীরে শিখে যেতো নিজে খাওয়ার কায়দা।
শোওয়ার পালা আরও মজাদার। বড় লেপে তিন ভাইয়ের ঢাকা। কেউ একটু বেশি টানলেই খেলা শুরু হয়ে যেতো রাতে। কোনো কোনো দিন ভোরে। বড়দা আরও ভোরে উঠে নিয়ে রাখতেন জিরেন কাঠের খেজুর রস। সকালে উঠেই খেজুর রস। সেই দিনগুলো আর কি ফিরবে? বড় মন খারাপ হয় বড়ো হয়ে যাওয়া অতনুর।
তারা একসাথে ঘুরতো। খেলতো নানারকমের খেলা। চু কিত,কিত, কবাডি, সাতগুটি, ঘুরি ওড়ানো, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও আরও কত কি। বন্ধুরা জড়ো হলে, এলাটিং, বেলাটিয়ং সই লো, যদু মাষ্টার কইলো..., তারপর আইশ, বাইশ কত কি। হাততালি দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খেলতাম, কাটুরিস, চায়না প্লিজ, মেম সাব, মেইন আপ... । তারপরের কথা, খেলা ডুব দিয়েছে কোন অতলে জানিনা, অতনু বলতো, সব কথা পুরো মনে পড়ে না। ছেঁড়া, ছেঁড়া স্মৃতিগুলো হৃদয়ের পদ্মপুকুরে ভেসে উঠেই ডুব দেয়, আর হারিয়ে যায় ব্যস্ত সময় সংসারে। সেখানে আবেগ মানে ছেলেখেলা পাগলামি। তবু তার মনে হয়, এরকম পাগলের সংখ্যা আরও বাড়ুক। বাড়লে পাওনাটা মন্দ হয় না।
রূপার মনে পরে কাকীমা, মা, জেঠিমার হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা। তাদের বাড়িতে, সব জা, একত্রে মিলিত হতো ননদ বা দেওরের বিয়েতে। একবার বাসু দেওরের বিয়েতে পুণ্যলক্ষী বৌদি ছেলে সেজেছিলো। প্যান্ট, জামা পরে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটা লাঠি নিয়ে অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলে বিয়ে বাড়িতে। সব জা রা প্যান্ট পরা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে যখন ভাশুরদের সামনে দাঁড়ালো, মাথা লজ্জায় নিচু করেছিলো পুরুষদল। তখনকার দিনে এটা একটা ভীষণ সাহসের ব্যাপার ছিলো। অভিনয়ের শেষে যখন জানতে পারলো প্রকৃত ঘটনা তখন সকলে হাসাহাসি আর চিৎকার শুরু করলো। নতুন বৌ বুঝতে পারতো একান্নবর্তী পরিবারের আনন্দ। বিয়ের শেষে যে যার চাকরীর জায়গায় চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা লাগতো। নতুন বৌ এর ভালো লাগতো না। স্বামী চলে যেতো চাকরীর জায়গায়। বাড়িতে মা, বাবা আর বেকার দেওরের দল। তারপর জলের ধর্মে যে কোনো পাত্রের আকার ধারণ করতো নতুন বৌ। বাবা, মায়ের সেবা, দেওরের খাওয়া, রান্নাবান্না সব নজরে রাখতে হতো নতুন বৌকে। প্রাণমন ছটফট করতো বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে রাজী করে শর্ত মেনে যেতে হতো বাবার বাড়ি। তখন পুরোনো মাটির গন্ধে নতুন বৌ ভুলে যেতো সব না পাওয়ার দুঃখ। রূপার মনে পড়ে তার মায়ের কথা। কতবার বিরাজুলকে বলেছে, আমার মা সাধনায় ছিলেন রামপ্রসাদ। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন রামপ্রসাদি। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন জীবনানন্দ ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পড়েনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে।
একবার বৈশাখী ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন, তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন, চলে গেলো, ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বারবার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা, পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন, পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসিন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত, উপবাস। বলবে, কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।
বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।
বিদেশে থেকেও তাদের দুজনেরই দেশের কথা, বাড়ির কথা মনে পড়ে। বিদেশে সব যান্ত্রিক। আবেগ তাদের কাছে ছেলেখেলা। শরীর সর্বস্য ভাবনা তাদের। ভালো গুণ অবশ্য অনেক আছে। রূপা ভাবে, এরা পরিশ্রমী। কাজ যখন করে তখন তার মধ্যেই ডুব দেয়। নিজের কাজ নিজে করতে ভালোবাসে। কুড়ি কিলো ওজনের ব্যাগ বিদেশের মেয়েরা সহজেই পিঠে নিয়ে বহন করে। তবু তাদের নগ্ন সভ্যতার রূপের মাঝে, তারা দুজনে বেশ মানাতে পারলো না। বিদেশের অনেক নিয়মনীতি তাদের ভালো লাগলো না। তাই তারা হঠাৎ করেই কলকাতা চলে এলো। তারপর সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি। মাটিতে পা দিয়ে তাদের উল্লাস বেড়ে গেলো। মুঠো মুঠো মাটি তারা গায়ে, মাথায় মেখে তার ঘ্রাণে শুয়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো বনে। তারপর তেঁতুলতলার বন, ওদের পছন্দ হলো। টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। গ্রাম ছাড়িয়ে তেঁতুলতলার বনে ওরা গড়ে তুললো এন, জি, ও। ওরা শুরু করলো সেবাকেন্দ্র।
বিরাজুল ও রূপা মানুষের সেবায় নেমে পড়লো। তারা গড়ে তুললো হাসপাতাল, নর সেবা কেন্দ্র প্রভৃতি। গরীব মানুষেরা এখানে এলেই বিনা পয়সায় খাবার পায়, স্বাস্থ্য পরিষেবা পায়। এই হলো তাদের সংসার, আনন্দের জায়গা।
আশেপাশের গ্রামের মানুষরা হলো তাদের মন-মসজিদ আর মন্দিরের দেবতা...
বিরাজুল আর রুপা ভারতবর্ষ ছাড়াও দেশে দেশে বেড়াতে ভালবাসে এবার তারা ঠিক করল তারা বেড়াতে যাবে তারপরে মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল একদিন। মুম্বাইয়ের অনেক ঘোরাঘুরি করল প্রায় দিন পনেরো তারপরে সেই একটা ঘর ভাড়া করে তারা ছিল। তারপর ঘুরলো কেরালার দর্শনীয় স্থানে। এই বার ফিরবার পালা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালো এক মহামারী। চলে এলো দেশজুড়ে করোনা রোগ। করোনার কারণে রোগে মানুষ ছটপট করে মরে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বিরাজিল বলল এখন তো যাওয়া যাবে না দেশে ফেরা যাবে না কি করা যাবে তখন রুপা বলল তাহলে আমরা কিছুদিন অপেক্ষা করি কিন্তু অপেক্ষা করব কতদিন, একুশ দিনের ঘটনা করেছেন তার পরে আবার যদি বাড়িয়ে দেয় কবে ফিরবো আমরা দেশে যা হোক দেখা যাবে পরে।
তিন
এদিকে আলো কেরালা এসে বিয়ে করেছে এক বাঙালি মেয়েকে তার নাম মিনতি। মায়ের কাছে যাবে বলে আলো সব গোছগাছ করেও যেতে পারল না কারণ কর্ণাটকে দেশজুড়ে এখন লকডাউন চলছে তারা যেতে পারল না তারা যাওয়া মনস্থ করে ও বলল লকডাউন নিতে গেলে তখন মায়ের কাছে যাব। ভালো শিক্ষিত ছেলে এবং মিনতি অশিক্ষিত সে তারা দুজনেই খবরের কাগজ পড়ে সংবাদমাধ্যমে সব খবর শুনে আর প্রতিদিন তাদের ডায়রিতে সেই অভিজ্ঞতা লিখে রাখে। আজকে আলো লিখছে তার প্রথম অভিজ্ঞতা সে লিখছে, করোনা আতঙ্কে ২০২০ সালের ২২ শে মার্চ রবিবার প্রথম লক ডাউন ঘোষণা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর কিছু সময় কেনাকাটি, বাজার করার পরে টানা একত্রিশে মার্চ অবধি টানা লকডাউন শুরু হয়ে গেল। বেশিরভাগ মানুষ সচেতন কিন্তু অনেকেই বাহাদুরি করে বাইরে যাচ্ছেন। চীনদেশ, ইতালি এরাও প্রথমে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে করোনা ভাইরাস কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। পুলিশ, প্রশাসন কড়া হয়েছেন। কিছু পাবলিক লাথখোড়। তার কিছুতেই নিয়ম মানতে চাইছে না। মুরগির মাংস কিনতে, মাছ কিনতে, মদ খেতে, জুয়া খেলতে বেরিয়ে পড়ছে বাড়ির বাইরে।
মিনতি বলল, সোম, মঙ্গল,বুধ পেরিয়ে গেল। এখনও লকডাউন চলছে। কতদিন চলবে কেউ জানে না। আজ একটা খবরের কাগজে পড়লাম বর্তমান পরিস্থিতি বাংলার।কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আলাদা করে তৈরি করা হচ্ছে ‘করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র’। ৩ হাজার শয্যার করা হতে পারে এই চিকিৎসা কেন্দ্র। নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা আলাদা জায়গায় নয়, একই হাসপাতালে চিকিৎসা করা হবে। করোনা মোকাবিলায় নতুন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে রাজ্য সরকার। এখন সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, গোটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকেই করোনার চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে বিশেষভাবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে এদিন বিকেল পর্যন্ত লিখিত কোনও নির্দেশিকা আসেনি। নির্দেশিকা দ্রুত জারি হবে বলে স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর। সম্পূর্ণ একটি হাসপাতাল যদি শুধুমাত্র করোনা চিকিৎসার জন্য করার ভাবনা–চিন্তা সত্যিই হয় তাহলে রাজ্যে এটি নজিরবিহীন হবে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। সূত্রের খবর, সোমবার দুপুর থেকেই নতুন করে রোগী ভর্তি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল। এখন ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা কেন্দ্র।
আজও আলো লিখে চলেছে তার ডায়েরি করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে। সে লিখছে, হাসপাতালের ৯ তলার যে সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লক রয়েছে সেখানে দুটি তলা রাখা হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য। বাকি ৭টি তলায় করোনা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা করা হবে। নতুন হস্টেলও বর্তমানে ফাঁকা রয়েছে। এদিন মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে জরুরি বিভাগ ডাকা হয়। এই সপ্তাহেই সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে এই পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে বলে জানা গেছে। করোনা সংক্রান্ত সব ধরনের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কলকাতা মেডিক্যালের উপাধ্যক্ষ ডাঃ ইন্দ্রনীল বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘করোনা–আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন রোগীর সংখ্যা বাড়লে আমাদের চিকিৎসা দিতে হবে। তাই নতুন রোগী ভর্তি নেওয়া কমাতে হবে। না হলে করোনা–আক্রান্ত রোগীদের জায়গা দেওয়া মুশকিল হবে। আপাতত ৩০০ শয্যার সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। তবে শুধুমাত্র করোনা রোগীর চিকিৎসা হবে বলে গোটা হাসপাতাল খালি করতে হবে এরকম কোনও লিখিত নির্দেশনামা আমাদের কাছে এখনও আসেনি। যদি নির্দেশ আসে তখন সেইভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’ এখন ২,২০০টি শয্যা রয়েছে মেডিক্যালে। সেটি বাড়িয়ে ৩,০০০ করার পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী সব হাসপাতালেই পেডিয়াট্রিক, চেস্ট, কমিউনিটি ও জেনারেল মেডিসিন, ইএনটি এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্টদের নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড করতে হবে। সেই অনুযায়ী এখানেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রয়েছেন। তবে এখন অন্য অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন যাঁদের চিকিৎসা চলছে এখানে। শয্যা খালি করার জন্য সেই চিকিৎসাধীন রোগীদের দ্রুত অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজও অনেকে বাইরে বেরিয়েছে। কোন বিজ্ঞানসম্মত বারণ মানতে চাইছে না। যদি কাউকে মানা করা হচ্ছে সে তার উত্তরে খিল্লি করছে, হাসছে পাগলের মত। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়িতে বসে যতটা পারছি ফেসবুকে সাবধানতার পোষ্ট দিচ্ছি। কবিতা, গল্প পোষ্ট করছি। শীর্ষেন্দুবাবুর গল্পের লিঙ্ক পেয়েছি। গল্প পড়ছি। এখন পড়ছি, মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি, গল্পটা। ছেলেটা মোবাইলে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বলছে, ভয়ঙ্কর অবস্থা, কি হবে বাবা? পাড়ার এক মা ছেলেকে বকছেন, টেনশন করবি না। সাবধানে থাকবি। হাত, মুখ সাবান দিয়ে ধুবি। চান করবে। তাহলে কিছুই হবে না। বাড়িতে বসে বসে পড়। বাইরে একদম বেরোবে না।ছেলে খুব সচেতন। সে মা কে বলে, মা তুমি কিন্তু হাত কম ধুচ্ছ। রান্না করার আগে হাত ধোও সাবান জলে।আমি জানি, আমাদের এইটুকুই জ্ঞান। আর বেশি কিছু জানি না। তবে বাবা বলতেন, সাবধানের মার নেই। ছেলেটির বাবা ও বাইরে কাজ করে তিনিও ফিরতে পারেননি এখন ওরা পাশেই আমাদের পাশেই আছে ছেলে আর মা তারা অনেক দিনের পরিচিত তাদের কথাবার্তা আমরা জানালা দিয়ে শুনতে পাচ্ছি।
আলো দেখলো পাশের বাড়িতে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া চলছে এক চাষীর।
সে লিখছে, চাষী তার গরু উঠিয়ে আল ভেঙ্গে দেয়। আমি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থামতে বললাম,বেঁচে থাকলে অনেক বাড়ি হতে পারে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়।একজন আমাকে মেসেঞ্জার বক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। আমার কথা বলা হয়নি তার সঙ্গে। তাই সে রেগে আমাকে ব্লক করে দিল। সব ঝগড়ার সূত্র সেই ভুল বোঝাবুঝি।যাইহোক মেসেঞ্জার কয়েকদিনের জন্য আনইন্সটল করে দিলাম। এখন একটাই চিন্তা পৃথিবীর এই কঠিন রোগ। ভাইরাস আ্যাটাকে সারা বিশ্ব রোগগ্রস্ত। এখন দূরে দূরে থাকার সময়। দূরে থাকলে বাঁচব আর একত্রে সমাবেশ করলে মরব। ভাইরাস মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে চেনের মত। এই চেনকে ভাঙ্গার জন্য লকডাউন।
প্রকৃতি শুদ্ধ হচ্ছে। লকডাউন করার ফলে দূষণ কমছে ব্যাপকহারে।এবার প্রধানমন্ত্রী একুশ দিনের লক ডাউন ঘোষণা করলেন। সচেতনতা প্রয়োজন মানুষের। গ্রামেগঞ্জে কেরালা,মুম্বাই থেকে কাজ করে ফেরা লোকগুলো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে সংক্রমণ ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। আমলা থেকে সাধারণ মানুষের ছেলেপুলে সব একই অবস্থা। রাস্তায় বেরিয়ে সেলফি তুলছে। প্রশাসন কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষের চেতনা জাগ্রত না হলে ধ্বংস হবে সভ্যতা। এখন বাংলায় বসন্তকাল চলছে। পাখি ডাকছে, ফুল ফুটছে। পাখিরা পশুরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে আর মানুষ ঘরবন্দি। মানুষ শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু প্রকৃতির বিচার নিরপেক্ষ। তাই আজ উল্টোচিত্র। প্রকৃতি কি হাসছে। জানি না তবু এটুকু বলতে পারি, ভাবার সময় এসেছে। কল কারখানা, ধোঁয়া আবর্জনায় পৃথিবী কলুষিত। তাই আজ এই প্রতিশোধ।চারিদিক নিস্তব্ধ। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ নেই। বাজার করা, মাছ কেনা, স্কুল যাওয়া সব বন্ধ। একটা কোকিল গান শুনিয়ে চলেছে। ফিঙেটা ইলেকট্রিক তারে বসে ডাকছে। ওরা মানুষের মত স্বার্থপর নয়। তাই হয়ত গান শুনিয়ে চলেছে এই দুর্দিনে। আজকের খবরে শুনলাম, করোনাভাইরাসের জেরে ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। লকডাউনের জেরে উৎপাদন বন্ধ হয়েছে ছোট থেকে বড় সংস্থায়। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসে তহবিল ঘোষণা করল দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)। এসবিআই সূত্রে খবর, চলতি ২০১৯–২০ আর্থিক বছরে মুনাফার ০.২৫ শতাংশ কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে করোনা প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি বৃহত্তম সংস্থাকে নিজেদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাত থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যয় করার পরামর্শ দেয় কিছুদিন আগে। এবার তা পালন করতে চলল এসবিআই।এসবিআইয়ের চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার জানান, ‘এই তহবিলটি মূলত স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে জড়িত। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সংক্রান্ত খাতে ব্যবহার করা হবে। এসবিআই ভারতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই তহবিলটি মূলত সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষকে স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে।’তিনি অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থার কাছেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে টুইটারে লিখেছেন, গোটা দেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্যে যাচ্ছে। মানুষের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন। সতর্কতামূলক এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীকে উদারভাবে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাই।ভরসা পেলাম। খাবারের জোগানও অব্যাহত থাকবে। রাজ্যসরকার থেকে দিন আনা দিন খাওয়া লোকেদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকার সবদিক ভাবছেন। মানুষই একমাত্র মানুষকে বাঁচাতে পারে। ডাক্তার, নার্স, আয়া, পুলিশ সকলে জীবনকে বাজি রেখে মানুষ তথা পৃথিবীকে বাঁচানোর কাজে লেগে পড়েছেন। এ এক আশার কথা। ভালো লাগছে এই কথা ভেবে যে সকলে রাজনৈতিক জীবনের উর্ধে উঠে মনেপ্রাণে এক হয়ে কাজ করছে। এই অপূর্ব মিলনের বার্তা একমাত্র ভারতবর্ষ দিতে পারে। সকলে তাকিয়ে আছে আমাদের দেশের দিকে। সারা পৃথিবী মিলিত হোক মানবতার মহান জগতে। পৃথিবী ভাল থেক। পৃথবী নিরোগ হও।আজ একটা সংবাদপত্রে পড়লাম, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এবার সরাসরি চীনের দিকে আঙুল তুলল আমেরিকা। আর এই আঙুল তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগাম বিপদ সম্পর্কে চীন সতর্ক করলে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। বেজিংকে সরাসরি এই ভাষাতেই বিঁধলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকী তিনি এই বিষয়ে সামান্য বিরক্ত বলেও মন্তব্য করেছেন। আমেরিকার চিকিৎসকদের সেখানে পরিদর্শনে যেতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প।এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন দেশের যে তিনটি জায়গাকে সংক্রমণের আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে, সেগুলো হল নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওয়াশিংটন। তালিকার প্রথমেই আছে নিউ ইয়র্ক। সেখানে ১৫ হাজার নিশ্চিত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৫৪১৮টি সংক্রমণ ঘটেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। এখনও পর্যন্ত ১১৪ জন মারা গিয়েছেন। একদিনেই প্রাণ গেছে ৫৮ জনের। গোটা আমেরিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। মারা গিয়েছেন সাড়ে চারশো।আমি ভাবি দেশের কথা, পৃথিবীর কথা।এখন দোষারোপের কথা বাদ দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচাই। সকলের সমবেত চেষ্টায় রোগমুক্তি ঘটুক পৃথিবীর। কারাবাসে যেমন বন্দি থাকা হয় এই গৃহাবাস কিন্তু ততটা বিরক্তিকর নয়। সংসারের মাঝে থেকে একটু একা একা থাকা। একটু রামকৃষ্ণ পড়ি, একটু রবীন্দ্রনাথ পড়ি, একটু জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ পড়ি। সময় কেটে যাবে আরামসে। দেরাজে রাখা বইগুলো একটু পরিষ্কার করে রাখি। রান্নায় সাহায্য করি স্ত্রীকে। দূরে থেকে সকলকে বাঁচিয়ে চলতে পারলেই জীবনের খোঁজ পাওয়া যাবে।"অসদো মা সদগময়, ত্বমসো মা জ্যোতির্গময়" এই মন্ত্রে এগিয়ে চলি নিশ্চিন্তে।আবার খবরের কাগজে দেখলাম কি মারাত্মক পরিস্থিতি সারা বিশ্বের। নাকানিচোবানি খাচ্ছে গোটা দুনিয়া। প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। মারণ ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে মৃত ১৭,২৩৫ জন। এ–পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৩,৯৫,৮১২। ইতালি এখন মৃত্যুভূমি। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৬০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতালিতে এখনও পর্যন্ত মৃত ৬,০৭৮। আক্রান্ত ৬৩, ৯২৭। ইতালির লম্বার্ডির অবস্থা ভয়াবহ। ইতালির মোট মৃতের প্রায় অর্ধেক লম্বার্ডির বাসিন্দা। সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৩,৭৭৬ জনের, আক্রান্ত ২৮,৭৬১। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে দেরির কারণেই ইতালির এই অবস্থা। শুধু প্রবীণদেরই নয়, ইতালিতে ৩০–৪০ বছরের কোঠায় যঁাদের বয়স, তঁাদেরও কাবু করছে করোনা। নাজেহাল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন— সব দেশেই।স্পেনের অবস্থা এখন ভয়াবহ। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে মারা গেছেন ৫১৪ জন। মোট মৃত ২,৬৯৬। আক্রান্ত ৩৯,৬৩৭। মৃতদেহ রাখার জায়গা অমিল। অনেক জায়গায় বাড়িতেই পড়ে আছে মরদেহ। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, মৃতদেহ হিমঘরে রাখা যায়, কিন্তু করোনায় মৃত্যু শুনলে কেউ মৃতদেহ স্পর্শ করছে না। অন্ত্যেষ্টির কাজে নিযুক্ত কর্মীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অবস্থা মোকাবিলায় নেমেছে সেনাবাহিনী। ওদিকে ফ্রান্সও নাজেহাল। সেখানে মৃত ৮৬০, আক্রান্ত ১৯,৮৫৬। রাজধানী প্যারিসের রাস্তা এখন খাঁখাঁ করছে। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ। কাফে, রেস্তোরার ঝাঁপ বন্ধ। লোকজনের দেখা নেই। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়। কে জানে কখন ভাইরাস ঢুকে পড়ে শরীরে! আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দি। ব্রিটেনেও ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। সেখানে মৃত ৩৩৫। আক্রান্ত ৬,৬৫০। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দেশে তিন সপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা করেছেন। দেশবাসীকে ঘরবন্দি থাকতে বলেছেন। দু’জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ। আমোদপ্রমোদের জন্য সপ্তাহ শেষে কেউ পার্ক বা অন্য কোথাও জড়ো হলে নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা। ওষুধ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকান খোলা। বাকি সব বন্ধ। বিয়ে আর ব্যাপটাইজেশনও বন্ধ থাকবে।
এদিকে কানাডায় করোনায় মৃত ২০। আক্রান্ত ১,৪৭৪। সংক্রমণ মোকাবিলায় ৩৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে কানাডা সরকার। সংক্রমণ এড়াতে সকলকেই ঘরবন্দী থাকতে বলছেন। কিন্তু কেউ কেউ আইসোলেশনের তোয়াক্কা করছেন না। তাতেই চটেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বলেন, ‘অনলাইনে আমরা অনেক লোকজনের ছবি দেখছি। তাঁরা ভাবছেন তাঁদের কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। ভাল, তবে আপনাদের দেখা যাচ্ছে। যথেষ্ট হয়েছে। বাড়িতে যান, ঘরেই থাকুন। আমরা নিয়ম মানতে বাধ্য করব। তা লোকজনকে সচেতন করেই হোক বা জোর করেই হোক।’
আমেরিকায় উদ্বেগ তুঙ্গে। মৃত ৫৮২ জন। এ অবস্থায় লক ডাউনে থেকে করোনার চেন ভাঙ্গতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। গ্রাম থেকে শহরের প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতন হতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে করোনা মোকাবিলায় কলকাতা পৌরসভার উদ্যোগে জোর কদমে চলছে শহর স্যানিটাইজ করার কাজ। কিভাবে গাড়ি করে সকলের বাড়ির সামনে এসে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে সুন্দর। বাড়িতে যথেষ্ট খাবার মজুত নেই। ছাড় দেওয়া আছে মুদিখানা, সব্জিবাজারকে। একজন করে পরিবার পিছু ভিড় না করে বাজার করা নিয়ম। কিন্তু এটা একশ চল্লিশ কোটির দেশ। ভিড় হয়ে যাচ্ছে যেখানে সেখানে। পুলিশের টহল চলছে। আমার স্ত্রী পাড়ার দোকান থেকে চাল, ডাল কিনে আনলেন। আমরা তিনজন। গ্রামের বাড়িতে অন্যান্য সদস্যরা আছেন। তাদের খবর রাখছি মোবাইল ফোনে, হোয়াটস আ্যপে। তাছাড়া উপায় নেই। এক একজন
ধনীলোক প্রচুর খাবার মজুত করছেন বাড়িতে। এর ফলে খাবারের অভাব হতে পারে। এক সব্জীব্যবসায়ী বললেন, যার দরকার আড়াইশ আদা তিনি নিয়ে নিচ্ছেন আড়াই কেজি। চড়া দাম দিতে তারা প্রস্তুত। এ এক অদ্ভূত মানসিকতা। তারা বলছেন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম থাকবে। তবু সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। জীবনের চরম মুহূর্তের কথা তারা ভুলে যায়। কত রাজার ধনে মরচে পরেছে ইয়ত্তা নেই। শিক্ষা নিতে হয় অতীতের কাছে। আমার পাশের বাড়ির সকলেই কিছু খাবার কিনলেন। একুশ দিন যাওয়ার মত। কম খেতে হবে। প্রকৃতি তার হারানো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে জেনে আনন্দ হল। পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীর জলবায়ু যেমন ছিলো সেরকম হতে চলেছে পৃথিবী। প্রকৃতি সব দিক দিয়ে মারেন না। একদিক ভাঙ্গলে আর একদিক গড়ে দেয়। আশার অনেক কিছু আছে। "আশায় বাঁচে চাষা।"
আমার স্ত্রী বাজারে গেছিলেন আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা। পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী।
আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম। এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই। খবরের কাগজ পেলাম। হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর দুর্যোগ মোকাবেলায় কমিউনিস্টশাসিত কিউবা প্রায়ই তাদের ‘সাদা পোশাকের বাহিনী’ পাঠিয়ে আসছে। এর আগে হাইতিতে কলেরা এবং পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও দেশটির চিকিৎসকরা সামনের কাতারে ছিলেন। এবারই প্রথম কিউবা বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ইতালিতে ৫২ সদস্যের শক্তিশালী একটি দল পাঠাচ্ছে; যার মাধ্যমে দেশটি তাদের ‘চিকিৎসা কূটনীতির’ বড় ধরনের নজিরও স্থাপন করতে যাচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এ নিয়ে কিউবার ষষ্ঠ মেডিকেল ব্রিগেড অন্য কোনো দেশের উদ্দেশে রওনা হলো। দেশটি এর আগে তাদের সমাজতান্ত্রিক মিত্র ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়ার পাশাপাশি জ্যামাইকা, সুরিনাম ও গ্রেনাদাতেও চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে। শনিবার ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে চিকিৎসকদলের সদস্য ৬৮ বছর বয়সী লিওনার্দো ফার্নান্দেজ বলেন, ‘আমরা সবাই বেশ ভীত, কিন্তু আমাদের বিপ্লবী দায়িত্ব আছে, তাই আমরা আমাদের ভয়কে একপাশে সরিয়ে রেখেছি।
চার
বিরাজুল ও খবরের কাগজে পড়ছে, এদিকে চিনের অবস্থাও ভাল নয়। আমার কাটোয়া শহরে করোনা আক্রান্ত রোগী এখনও অবধি একটাও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তৎপর আছে। বাইরে বেরোলেই পিটুনি খাচ্ছে আনাড়ির দল। ঘরে বসে ছেলেটা বই পড়ছে। আরণ্যক।আমিও মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছি। শীতের পোশাকগুলো গুছিয়ে রাখলাম। বসন্ত কেমন ম্লান হয়ে রয়েছে। একটা সবুজ ছোট্ট পাখি শিউলি গাছে বসে আছে। স্ত্রী রুটি বেলছে। জলখাবারের জন্য। এতদিন তো ঘরে বসে থাকার সুযোগ পাই না। বেশ লাগছে সপরিবারে একসঙ্গে থেকে। দোকানপাট যা করার লকডাউনের আগেই করা হয়েছে। সরকার থেকে খাবার বিতরণের কাজ শুরু হবে। ভবঘুরের দল ব্লক অফিস আর স্কুলগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। দুদিনের ঘর। তারপর তাদের ঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে হবে।
মিনতি বলছে, প্রতি বছর রথ যাত্রার ঠিক আগে ভগবান জগন্নাথ স্বয়ং অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জ্বর এবং সর্দি কাশি হয়; অসুস্থতার এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে Quarantine করা হয় যেটাকে মন্দিরের ভাষায় অনাসর বলে। ভগবানকে ১৪ দিন পর্যন্ত একা বাস মানে isolation এ রাখা হয়। হ্যাঁ, ঠিক ১৪ দিন। এই সময় ভগবানের দর্শন বন্ধ থাকে এবং ভগবানকে জড়িবুটি আর জল খাবার দেওয়া হয় মানে Patients Diet, আর এই পরম্পরা হাজারাে বছর থেকে চলে আসছে।আর এখন ২০ শতাব্দীতেও বলা হলো isolation & Quarantine এর সময় ১৪ দিন! আগের সেই বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন কৌশল যা আজও বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে!..১৪ দিন জগতের প্রভু জগন্নাথ যদি মানেন Isolation / Quarantine / light diet আমাদের কেন তা মানায় অসুবিধা? ভগবানকে মেনে, চাহিদা কমিয়ে এই ক'দিন আমরা তাঁর দেখানো পথে একটু চলিইনা! কিন্তু কিছু লোক আড়ালে মশারি টাঙিয়ে তাস খেলছে। জুয়ো খেলছে। কোন আইন মানতে চাইছে না। একজন মহাপুরুষ বলেছিলেন, আমাদের দেশে কম করে দুবছর মিলিটারি শাসনের প্রয়োজন আছে। তার কথাই ঠিক। তবে যদি এরা কিছু নিয়ম শেখে তাহলে দেশের দশের উপকার। রাজ্যে করোনাভাইরাসের (Coronavirus) পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, রাজ্যে মোট আক্রান্তের মধ্যে ৫৫ জন এসেছেন মাত্র সাতটি পরিবার থেকে। ফলে ভাইরাস যে একটা সীমাবদ্ধই রয়েছে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন যে ই রাজ্যে ৯৯ শতাংশ করোনা রোগীর সঙ্গে বিদেশি-যোগ রয়েছে।
বিরাজুল বলছে, লকডাউনের বাজারে দিন হোক কি রাত বাঙালি মজে আছে নীল ছবিতে। আর তার জেরেই হু হু করে রাজ্যে বেড়েছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। দেশের অনান্য রাজ্যেও নেট ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু বাংলায় কার্যত তার তিন-চার গুণ বেড়েছে। দিল্লি বা মহারাষ্ট্রে যেটা ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেড়েছে, বাংলায় সেটাই বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এই তথ্য চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। দেশের মানুষ এখন দিনের একটা বড় সময়ই কাটান মোবাইলের সঙ্গে। দক্ষিণ ভারতের মানুষ খুবই সিনেমাপ্রেমী। কিন্তু তাঁরা সেই সিনেমা মোবাইলে দেখতে পছন্দ করেন না। দলবেঁধে তাঁরা তা দেখতে যান হল বা মাল্টিপ্লেক্সে। তাই দক্ষিণভারতে মোবাইলে সিনেমার দেখার চাহিদা নেই বললেই চলে। আবার সেখানে নেট ওয়েব সিরিজের চাহিদাও সেভাবে নেই। যে টুকু আছে তা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই দক্ষিণ ভারতে নেটের চাহিদা অফিস কাজ, বাড়িতে বসে পড়াশোনার কাজ আর নীল সিনেমা দেখার জন্য। তুলনামূলক ভাবে বাংলায় শিক্ষিতের হার বেশি বলে বাড়িতে নেটের চাহিদাও বেশি। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও নেটের চাহিদা বাড়ছে বাংলায়। বাংলাতে অফিসে নেটের চাহিদা যেমন আছে তেমনি আছে বাড়িতে নেটের চাহিদা। আবার মোবাইলে সিনেমা দেখার পাশাপাশি, অয়েব সিরিজ দেখা বা নীল ছবি দেখার প্রবণতাও রয়েছে। বাংলার যে সব শ্রমিক, বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা ভিন রাজ্যে কাজ করেন তাঁরা লক ডাউনের এই বাজারে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই গ্রাম হোক কি শহর মোবাইলে নেটের চাহিদা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। আবার তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের অনেকেই এখন বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করছেন। সব থেকে বড় কথা বাংলায় হিন্দি, ইংরাজি ও বাংলা ভাষার সিনেমা, ওয়েব সিরিজ দেখার চাহিদাটা খুব বেড়ে গিয়েছে। হইচই, আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, এলটি বালাজি, উল্লু, ভুট প্রভৃতি অনলাইন স্ট্রিমার সংস্থাগুলি এই লকন ডাউনের বাজারেও নিত্য নতুন শো বা সিনেমা হাজির করছে দর্শকদের কাছে। আর সব থেকে বেশি বেড়েছে নীল ছবি দেখার চাহিদা। তাতেই কার্যত বাজিমাত করেছে বাংলা।
মিনতি বলছে, আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষ ত্যাগের দেশ। আজ খবরে জানলাম, শিক্ষকরা যে যেমন পারছেন দান করছেন। এক শিখ মহাজন কয়েকলক্ষ টাকা দান করেছেন পাঞ্জাবের পিড়িতদের জন্যে। বাংলায় এক গ্রামের ধনী কয়েকলক্ষ টাকা দান করলেন পিড়িতদের কল্যাণে। খবরে প্রকাশ, রাজ্যে আক্রান্ত বেড়ে ১০। কলকাতার নয়াবাদের এক প্রৌঢ়ের শরীরে মিলল করোনার নমুনা। আশঙ্কা, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের। বিরাজুল মিনতিকে শুনিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে একটিও করোনা আক্রান্তের সংবাদ না আসায় একটু স্বস্তিতে ছিল বাংলার মানুষ। কিন্তু বুধবার রাতেই সেই স্বস্তিতে জল পড়ল। ৬৬ বছরের ওই বৃদ্ধ সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হন। বুধবার রাতে রিপোর্ট মেলে। তাঁর বিদেশ ভ্রমণের কোনও খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাঁর পরিবারের কেউ সম্প্রতি দেশরে বাইরে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়নি। রাজ্যে আশঙ্কা বাড়ল। এটি তৃতীয় পর্যায়ের শুরু কিনা ভেবে। এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদ চলবে বলে সূত্রের খবর।একের পর এক বাড়তেই থাকবে নাকি রোগীর সংখ্যা। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি ঘরে থেকে।আমি কাটোয়া পৌরসভার কুড়ি নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।পৌরসভা থেকে বারবার মাইকিং করা হচ্ছে।সবরকম সাহায্য করার পাশাপাশি সচেতনাতামূলক প্রচারও চলছে।কাটোয়া পৌরসভা, কাটোয়া হাসপাতাল, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে করোনা মহামারী রুখে দেওয়া যায়।মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, কাটোয়ার সর্বস্তরের জনসাধারন আমাদের যে ভাবে সাহায্য করছেন তাতে আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এতো দিন গৃহবন্দী থাকা যথেষ্ট কষ্টকর এটা আমরা বুঝি। কিন্তু এই মারনব্যাধি থেকে মানবসভ্যতা কে রক্ষা করার এটাই এক ও একমাত্র উপায়।আপনাদের প্রতি আমাদের বিনীত আবেদন - বাজার করা অথবা মুদি / রেশন / ওষুধের দোকানে কিছু কিনতে যাবার সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে অন্তত ৬ (ছয়) ফুট দুরত্ব বজায় রাখুন। খুব প্রয়োজন না থাকলে বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। অন্যথায়, অন্যের থেকে সংক্রমন আপনার তথা আপনার প্রিয়জনের মধ্যে ছড়াতে বেশি সময় নেবে না। রাস্তায় একসাথে জড়ো হবেন না। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না। সর্বোপরি, নিজে সুস্থ থাকুন, নিজের পরিবারকে ভালো রাখুন তাহলেই সমাজ ব্যাপকার্থে মানব সভ্যতা রক্ষা পাবে। কেউ শুনছে কেউবা শুনছে না। মাছ, মাংস খাওয়ার লোভে অনেকে বেরিয়ে পড়ছেন বাইরে। এটা সংযমের সময়। সংযত হয়ে চলার সময়। এটা ভাবতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়।আজ খবরে পড়লাম আবার একই বিষয়ে। করোনা। করোনা। করোনা। খবরের কাগজ আর ফেসবুকের খবর ছাড়া বাইরে বেরিয়ে খবর নেওয়া উচিত নয়। তাহলে এত পরিশ্রম বৃথা যাবে। আজকের খবরে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই করোনা আতঙ্কে জেরবার দেশের মানুষ। করোনা আতঙ্ককে সাথে নিয়ে দেশের পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। সারা দেশবাসীর কাছে এখন একটাই লক্ষ্য, কিভাবে করোনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবেন তাঁরা? দেশের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা একযোগে করোনার সংক্রমণকে মহামারী হওয়া থেকে আটকাতে শুরু করেছে লকডাউন। সরকারিভাবে নোটিশ জারি করা হয়েছে এই মুহূর্তে দেশের কেউ যেন কোন রকম জমায়েতে শামিল না হন। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল চীন থেকে। সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। যার মধ্যে ভারত অন্যতম। অন্যদিকে, এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা আশার কথা শোনাচ্ছেন ভারতকে নিয়ে। এই মুহূর্তে একদিক দিয়ে যেমন ভারতে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, সেরকম অন্যদিক দিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু জন। যদিও সে সংখ্যা আক্রান্তের তুলনায় অত্যন্ত কম। কিন্তু তা সত্বেও সুস্থ হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে খুশির বলেই মনে করা হচ্ছে।এখনো পর্যন্ত ভারতে 37 জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে স্বাস্থ্যমহল সূত্রে জানা গেছে। ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন 492 জন। তার মধ্যে মারা গেছেন এখনো পর্যন্ত ন জন। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া 37 জনের মধ্যে 11 জন ইতালীয় পর্যটক রয়েছেন। যাঁদের সুস্থ হওয়ার পর ইতালীয় দূতাবাসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, চীনের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বলে খবর। তবে সাংবাদিক সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ এর মধ্য দিয়ে চিনে আসিম্পটোমেটিক রোগী ধরা পড়ছে। নাও ঠেলা। এক রোগে নিস্তার নেই আবার শঙ্করাকে ডাকে। অন্য আর একটি রোগ যেটি ইঁদুরবাহিত ক্রমশ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে জানালো চিন সরকার। আজকে একটা ভাল খবর শুনলাম, নবান্নে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, শহরের একাকী থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে খেয়াল আমাদেরকেই রাখতে হবে। কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খেতে পারছে না বা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে না জানতে পারলে সেই হাউসিং কম্প্লেক্সকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জেলাশাসক মহকুমা শাসক বা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার আবেদন জানান। প্রশাসন প্রয়োজনীয় চাল ডাল থেকে শুরু করে ওষুধ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেবেন। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিতে সকলকে মানবিক থাকার অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, “কারোর জ্বর হলে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করবেন না। প্রয়োজনে স্থানীয় থানায় খবর দিন পুলিশ অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে”অন্যদিকে ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে নাইট শেল্টারে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন তারা যেন কর্পোরেশনের স্কুল এবং কমিউনিটি হল গুলোতে যেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে থাকেন। খাবারের ব্যবস্থা পুলিশ এবং কর্পোরেশগুলি, করে দেবে। শুনে মনটা একটু হাল্কা হল। কত অসহায় ভবঘুরে পাগল মানুষ থাকে রাস্তায়। তারাও ভাল থাকুক। ভাল থাকুক ভালবাসা। রাস্তায় যখন যেতাম এই রোগ আসার আগে। তখন দেখতাম কত গোসাপ, সাপ, শেয়াল, কুকুর চাপা পড়ে মরে আছে মানুষের দাপাদাপিতে। এখন আর তারা চাপা পড়বে না একুশ দিন। শান্তিতে ঘুরতে পারবে। আমরা ভুলে যাই তারাও এ পৃথিবীর অংশিদার। তাদের ঠকিয়েছি আমরা। তার মাশুল গুণছে মানুষ। ক্রিকেটার সৌরভ থেকে আমজনতার অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করছেন অভুক্ত মানুষের কথা ভেবে। সব স্তরের মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। জ্বালা যন্ত্রণা অত্যাচার বেড়ে গেলে ফিরে ফিরে আসে সমোচ্চশীলতার ধর্ম। সে যে রূপেই হোক। কখন রোগ মহামারী বা প্রলয়। তার বিচারের কাছে গরীব ধনী নেই। তার বিচারের কাছে শিক্ষিত অশিক্ষিত নেই। সব সমান করে নবরূপে তৈরি করেন প্রকৃতির প্রতিমা। আজকে একটা খবর পড়লাম, করোনা ভাইরাসের কারনে পৃথিবীর প্রায় ৭৫% ছোট বড় ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ হয়েছে। আকাশ পথে বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০% যানবহন চলাচল বন্ধ হয়েছে।ভারী অস্ত্রের মহড়া বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীজুড়ে লকডাউন আইনের কারনে মানব সৃষ্ট দূষণ বন্ধ হয়েছে।হাঁচি, কাশি ঠান্ডাজনিত রোগ থেকে দুরে থাকতে সবাই এয়ার কন্ডিশন চালানো বন্ধ রেখেছে। করোনা থেকে বাচঁতে নিজের শরীর থেকে শুরু করে বাড়ির আশে পাশের আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখছে। যত্রতত্র বিশেষ করে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে এসেছে।এ সব কিছুর ফলে নাসার দেয়া তথ্যমতে পৃথিবীজুড়ে নাইট্রোজেন গ্যাস ও কার্বন এমিশনের মাত্রা ২৫% কমে এসেছে।ফলে প্রকৃতি তার নতুনরূপে সাজতে বসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমে এসেছে। গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায় গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করেছে।যেখানে নিজের ঘরের মানুষকে আটকিয়ে রাখা যায় না। সেখানে ৭০০ কোটি মানুষকে কিভাবে সম্ভব? হয়তো সৃষ্টিকর্তা করোনার অছিলায় ৭০০ কোটি মানুষকে আবদ্ধ করে প্রকৃতি মেরামত করে দিচ্ছেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবী কে একটু একটু করে ধ্বংস করে যাচ্ছিলো।করোনায় সৃষ্ট মহামারীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরবে বিশ্ব অর্থনীতিতে। কিছু কিছু দেশে দুর্ভিক্ষের ন্যায় আঘাত হানবে। আজ আমাদের প্রতিটি সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সময়। তারা আমাদের ভাল চাইছেন। বিশ্ববাসি প্রত্যের মঙ্গলের জন্য ঘরবন্দি থাকাটা কোন ব্যাপার নয়। এই ফাঁকে যে যার শখের কাজগুলি মন দিয়ে করতে পারবেন। ভাঙ্গা মচকা কুচটপড়া সম্পর্কগুলো মেরামত করে নিতে পারবেন। বিপদের বন্ধু প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়ে 'অমলের' মত জানালা দিয়ে পাখি আর গাছের সঙ্গে মিত্রতা করলে দেখবেন কখন অজান্তে সময় উধাও হয়ে গেছে আনন্দে। এখন আর কান্নার সময় নয়। মন মিলিয়ে দূরত্বে থাকার সময়। মনের মিল থাক ফোনে, হোয়াটস আ্যপে আর মেসেঞ্জারে। দেহের দূরত্ব বজায় থাক। মশা মাছি থেকে নিজেকে বাঁচান। আর কত দিন বলে হা হুতাশ না করে ভাল থাকুন। রাজ্যে লকডাউনের তৃতীয় দিন এবং দেশে প্রথম দিনে পরিস্থিতি কলকাতাসহ গোটা রাজ্যে একইরকম। তবে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এবং লাগোয়া জেলাতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু মানুষ লকডাউনের নিয়ম ভেঙেছেন। পুলিশ কঠোর হাতে তা দমন করেছে। অনেক জায়গাতেই বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরির জন্য পুলিশ তাড়া করেছে। এখনও পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১৩০২ জনকে। এর মধ্যে ৬৪০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে মাতলামোর জন্য। এবং লকডাউন ভাঙার জন্য ৬৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলকাতার নগরপাল অনুজ শর্মা জানিয়েছেন, প্রত্যেককে অনুরোধ করা হচ্ছে বাড়িতে থাকুন। এবং প্রশাসনকে সাহায্য করুন।
কলকাতায় শৃঙ্খলার চিত্রও দেখা গেছে। বেলেঘাটা, উল্টোডাঙা, গুরুদাশ দত্ত গার্ডেন লেনে বহু মানুষ রাস্তায় এঁকে দেওয়া বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। সহনাগরিকের থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওষুধপত্র, বাজারহাট সবই করেছেন। ওষুধের দোকানগুলিতে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। বেশি টাকার ওষুধ কিনলে যে ছাড় পাওয়া যেত, এখন তা দেওয়া হচ্ছে না। অড়েক জায়গায় চাহিদামতো ওষুধও নেই। হাওড়া ব্রিজে এদিন অন্য চিত্র দেখা গেল। ব্রিজের একটা দিক দিয়েই গাড়ি যাতায়াত করবে। বাকি অংশ আটকে রাখা হয়েছে। ব্রিজের দুপারেই পুলিশ মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে। গাড়ি নিয়ে কেউ গেলেই, থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিটের ছবিও একইরকম। সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোর মূল ফটকে তালা। নিয়মশৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য কয়েক জায়গায় র্যাফ টহল দিচ্ছে। ধর্মতলা জনহীন। শিয়ালদা স্টেশনের ছবিও এক। তবে কয়েক জায়গায় দেখা গেল দু’একটি সরকারি বাস চলছে। সাইকেল চালিয়ে কাজে যোগ দিতে চলেছেন অনেকে। টিভি আর মোবাইলে চিত্রগুলি দেখতে পাচ্ছি। বাইরে না বেরিয়ে বাইরের খবর জানতে পারা এক সুন্দর ব্যাপার। বেশ লাগছে। অনেকে ফোন করে খবর নিচ্ছেন। এক দাদা বললেন, মানুষ এত পাপ করছে যে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ,খুন বেড়েই চলেছে। অথচ এই কয়েকদিনের গৃহবন্দি অবস্থায় সব পাপ কমে গেছে। পুলিশ, প্রশাসন রাস্তায় মাস্ক পড়ে টহল দেওয়ার সুফল মিলছে। এর ভাল দিক আছে অনেক।
মিনতি বলল,অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহাভারতে আঠারোদিন যুুুদ্ধ চলেছিল আজ করোনা রোগের বিরুদ্ধে একুশ দিনের যুদ্ধ চলবে। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে একুশ দিন কেন একুশ মাস হলেেও প্রয়োজনে ঘরে থাকবে। তা না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। অনেকেই চাল-ডাল মালমশলা সবজিতেে ঘর ভরে নিচ্ছেন কিন্তু এতটা স্টক করা একজনের পক্ষে ঠিক না। সবাইকে বাঁচতে হবে সকলের জন্য চিন্তা করতে হবে তবেই" ধন্য রাজার পূণ্য দেশ" ।
নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, অর্থনীতিকে এর মাসুল গুনতে হতে পারে। আর ব্রিটিশ ব্রোকারেজ সংস্থা বার্কলেজ় সমীক্ষায় জানাল, সম্ভাব্য সেই ক্ষতির অঙ্ক প্রায় বারো লক্ষ কোটি টাকা।
গরীব ভ্যানচালক, রিক্সাচালক সকলের কথা চিন্তা করছেন সরকার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন সরকার বাহাদুর। এ এমন এক সময় যখন সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। শুধু নজর রাখা আর অনুশাসন মান্য করাই ভারতবাসী তথা দেশবাসীর কর্তব্য। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-ভারতে আজ দুপুর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩। তাঁদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। দিল্লিতে সংক্রমিত ৬ জন, হরিয়ানায় ১৪ জন (প্রত্যেকেই বিদেশি নাগরিক), কেরলে ১৭ জন, রাজস্থানে ৩ জন (একজন ভারতীয় নাগরিক এবং দু’জন বিদেশি নাগরিক), তেলেঙ্গানায় আক্রান্ত একজন, উত্তর প্রদেশে ১১ জন (১০ জন ভারতীয় নাগরিক এবং একজন বিদেশি নাগরিক), কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে আক্রান্ত ৩ জন, তামিলনাড়ুতে একজন, জম্মু ও কাশ্মীরে একজন সংক্রমিত, পাঞ্জাবে আক্রান্ত একজন এবং কর্ণাটকে করোনায় সংক্রমিত ৪ জন। এইভাবে বাড়তে থাকলে তৃতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণহারে বাড়তে থাকবে রোগীর সংখ্যা। অনেকে এটাকে আমল না দেওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইতালির কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সকলের। ওরাও প্রথমে বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ করেনি।
সবথেকে আনন্দের খবর পশুপাখিরা আনন্দে বিচরণ করছে। দূষণের পরিমাণ কমে গিয়ে অনেক রকম পাখির আনাগোনা বেড়ে গেছে আশ্চর্যভাবে। আমরা যদি মাসে একদিন লকডাউন করে যাই নিয়মিত তাহলে হয়ত পৃথিবীর পরমায়ু বেড়ে যাবে। এ এক আশার বার্তা।
পাঁচ
আলোর এখন অফুরন্ত সময়। পড়ছি, পড়া আর শোনা ছাড়া কোন কাজ নেই। ঘরবন্দী হয়ে শুনছি ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছি জনসচেতনতামূলক। খবরের কাগজ আছে। আমি আর কতটুকু জানি। তবু জানার ইচ্ছে, পিঠে কুঁজ নিয়ে চিত হয়ে শোওয়ার বাসনা। করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। ভারতেও তা মহামারির আকার নিচ্ছে। রাজ্যে যাতে করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ না করতে পারে, তার জন্য জনগণকে প্রতিদিন সতর্ক করে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাজ্য সরকার করোনা ঠেকাতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে অনেকদিন। করোনা মোকাবিলায় জরুরী ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, প্যারাটিচার, পার্টটাইম টিচার সহ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ত্রাণ তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য আবেদন করলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যা পরিস্থিতি তাতে আগামীদিনে আর্থিক অভাব ঘটবে। আমাদের এই আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা একজোট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াব।’ পাশাপাশি তিনি দলের বিধায়কদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের যতটুকু সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী এই ত্রাণ তহবিলে সাহায্য করুন। বিধানসভা থেকে যে ভাতা পান, তার কিয়দংশ অনুদান ত্রাণ তহবিলে দিন। আপনারা যা ভাল বুঝবেন, তাই করুন। যেভাবেই হোক করোনার সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। মমতার পাশে দাঁড়ান।’ পাশাপাশি তৃণমূলের শিক্ষা সেল ও গণ সংগঠন এবং বামপন্থীদের কাছেও পার্থ চ্যাটার্জি সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছেন।
সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় পৃথিবীর এই গভীরতম অসুখ সেরে যাবে একদিন।
"একদিন ঝড় থেমে যাবে আবার পৃথিবী শান্ত হবে"। লকডাউনের সময় প্রকৃতি সেজে উঠছে টাটকা জলে রঙীন ফুলে আর আকাশের নানা রঙের ক্যাভাসে। সুপার মুনের কথা অনেকেই শুনেছেন, দেখেছেন কী? তবে সেই অভাব এবার পূরণ হতে চলেছে। আগামী ৮ এপ্রিল দেখা যাবে সুপার পিঙ্ক মুন বা বৃহত্তম গোলাপি চাঁদ। এতে নাকি করোনা ভাইরাসের নিধন ঘটবে বলে অনেকে মনে করছেন। যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যবর্তী গড় দূরত্ব ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। চাঁদের গোলাপি আভা দেখা যাবে পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৯০৭ কিলোমিটার দূর থেকে। অর্থাৎ ওইদিন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কমে যাবে ২৭ হাজার ৪৯৩ কিলোমিটার এবং দেখা যাবে এই নান্দনিক দৃশ্য।
মিনতি বলে, এখন প্রশ্ন হল এই সুপার মুন বৃহত্তম গোলাপি চাঁদ কী? জানা গিয়েছে, অন্যান্য দিনের তুলনায় এইদিন চাঁদের আকার ৩০ শতাংশ বড় হয়ে যায়। সুপার মুনের কক্ষপথ পৃথিবীর নিকটতম হয়। গ্রহ থেকে এই নিকটতম দূরত্বের কারণেই চাঁদকে অনেক বড় এবং উজ্জ্বল দেখায়। তবে পূর্ণিমা হলেই যে সুপার মুন হবে তা কিন্তু নয়। কারণ চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে। পৃথিবী থেকে আরও অনেক দূরে থাকলেও পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ দেখা যেতে পারে।একে গোলাপি চাঁদ বলার কারণ হল–পূর্ণিমা'র চাঁদের নামকরণের বিষয়টি সাধারণত আমেরিকান অঞ্চল এবং ঋতুগুলির ওপর নির্ভর করে। ‘গোলাপি চাঁদ’ নামটি গোলাপি ফুলের নামের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া। এই ফুল উত্তর আমেরিকার পূর্ব দিকে বসন্তকালে ফোটে এবং এটি মোটেও চাঁদের রঙ নয়। পুরো গোলাকার চাঁদকে স্প্রাউটিং গ্রাস মুন, এগ মুন এবং ফিশ মুন নামেও ডাকা হয়। তবে, লকডাউন পুরোপুরি তোলার ক্ষেত্রে কোভিড–১৯ সংক্রমণ কী অবস্থায় রয়েছে, সেটাই যে নির্ণায়ক হবে তা স্পষ্ট হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর গড়া টাস্ক ফোর্সের সদস্য রামন আর গঙ্গাখেড়করের কথায়। তিনি জানান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সংক্রমণের শৃঙ্খলকে ছিন্ন করা। তাৎপর্যপূর্ণভাবে তিনি জানিয়েছেন, এখন টেস্ট কিট ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের বিপুল ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি রয়েছে ভেন্টিলেটরেরও। এপ্রিলের শেষে অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটগুলো তৈরি হয়ে যাবে। এই কিটে পরীক্ষা শেষ হবে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে। ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকার ৫০ লক্ষ অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের বরাত দিয়েছে। অ্যান্টিবডি টেস্টেই সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাই দ্রুত পরীক্ষা হলে সংক্রমণের মাত্রাও তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে।
আলো রেডিও শুনছে। খবরে পড়ছেন, আইসিএমআরএর সংক্রামক রোগ ও মহামারী বিভাগের প্রধান গঙ্গাখেড়কর বলেন, কত দিনে সংক্রামিতদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে, তার হার দেখেই বোঝা যাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না। তঁার মতে, পরবর্তী তিন সপ্তাহে কতজন কোভিড–১৯ পজিটিভ রোগীর খেঁাজ মিলছে, তার ওপরেই লকডাউন প্রত্যাহারের বিষয়টি নির্ভর করবে। লকডাউন কতটা শিথিল হবে, সেই সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে সংক্রমণের হটস্পটগুলি। গঙ্গাখেড়কর বলেন, গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্যায়ে এখনও পৌঁছোয়নি ভারত। তবলিগি জমায়েতের প্রভাব ২০০ জেলায় পড়লেও একে গোষ্ঠী সংক্রমণ বলা যাবে না। এর আগে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। তারপর পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব অবনীশ অবস্থি এদিন বলেছেন, ‘লকডাউন তখনই পুরোপুরি খোলা হবে যখন রাজ্যে আর করোনার রোগী থাকবেন না। যতক্ষণ একজনও করোনা পজিটিভ মানুষ থেকে যাবেন, ততক্ষণ লকডাউন তোলা কঠিন। কাজেই এর জন্য সময় লাগতে পারে।’ এ সবের পাশাপাশি এখনকার মতো লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এর গেরোয় আটকে পড়েছেন অসংখ্য দরিদ্র মানুষ। কাজ হারিয়ে দু’বেলা অন্নের সংস্থান নিয়ে চিন্তায় বহু মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা, সার্বিক লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতি গভীর থেকে গভীরতর সঙ্কটে চলে যাবে।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী এদিন বিজেপি–র ৪০তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সামনে দীর্ঘ লড়াই। এজন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে জয় না–আসা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ আরও বলেছেন, ‘এবার এমন এক সময়ে দলের প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হচ্ছে যখন শুধু ভারতই নয়, সমগ্র বিশ্ব এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে। মানবতার এই সঙ্কটের সময় একনিষ্ঠভাবে দেশের সেবা করে যেতে হবে।’ করোনার সংক্রমণের জেরে ২৪শে মার্চ দেশ জুড়ে একুশ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবনপণ করে যাঁরা কাজ করে চলেছেন, সেই চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষকে ধন্যবাদপত্র পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের প্রসিদ্ধ মিষ্টির একটা অংশ হাতে গড়া হয়। যখন সাধারণ নাগরিককে দিনে দশ বার রগড়ে রগড়ে সাবান, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে বলার উপদেশ দেওয়া হল, তখন স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে কোনরকম পরিদর্শন ছাড়া স্বাস্থ্যকর বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাত স্যানিটিজেড কিনা জানা-নেই, বানানো-মিষ্টি বাঙালিদের খেতে দেওয়ার রাস্তা উন্মুক্ত করা প্রশাসনিক অর্বাচীনতার নামই বটে। আসলে Covid -১৯ শুধু একটা সাদামাটা, প্লেইন-ভ্যানিলা বায়োলজিক্যাল ভাইরাস-ই নয়, এটা মানব সভ্যতার বড়াই করা আর্থ-সামাজিক-চিকিৎসা-প্রশাসনিক উৎকৃষ্টতার লিটমাস টেস্ট আর অ্যাসিড টেস্ট, যেখানে আমরা অনুত্তীর্ণ। সেখানে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করা উচিত যাতে নিরীহ আইনানুগ সর্বসাধারণের জনস্বাস্থ্যের কোনও ঝুঁকি না তৈরি হয় কারো ব্যক্তিগত অবিবেচকতার জন্য। সেখানে কিছু জনগণকে খুশি করার চেষ্টা বুমেরাং হয়ে, সর্বনাশী করাল ছোবল আনতে পারে অজ্ঞতার সামান্য ভুলে প্রথমে এক দিনের জনতা কার্ফু, তারপরে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তিন দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা এবং সেটি চলাকালীনই দেশজুড়ে লকডাউন। তার ফলে বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়েছেন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা। এই কারণে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়াতেও আটকে পড়েন বিহারের ভাগলপুর থেকে আসা অন্তত ১৫০ জন শ্রমিক। প্রতি বছরই এই সময় বিহারের ভাগলপুর থেকে মহিলা ও শিশু সহ প্রায় ১৫০ জনের একটি দল পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমার লক্ষ্মীপুর গ্রামে চাষের কাজ করতে আসেন। এবছরও তাঁরা এসেছিলেন সেই কাজেই। তবে তাঁরা আসার পরেই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় লকডাউন। তার ফলে তাঁরা কাটোয়ায় আটকে পড়েন। কাটোয়া মহকুমা প্রশাসন ও কাটোয়া পুরসভার তরফ থেকে স্থানীয় আরএমসি মার্কেটে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। শুধু থাকার ব্যবস্থা করাই নয় সেই সঙ্গে তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করে স্থানীয় প্রশাসন। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ওই শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক দিন এভাবে কাটার পরে ওই শ্রমিকরা কাটোয়া থানায় যোগাযোগ করে তাঁদের পোশাকের সমস্যার কথা জানান। তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে একই জামাকাপড় পরে আছেন বলে জানান। এর ফলে তাঁদের যে সমস্যা হচ্ছে সেকথাও গোপন করেননি। এই সমস্যার কথা জানার পরে কাটোয়া থানার পক্ষ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের জন্য জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়। কাটোয়া থানার আইসি বিকাশ দত্ত বলেন, “শ্রমিকরা একই জামাকাপড় দীর্ঘদিন ধরে পরে আছেন একথা জেনে কাটোয়া থানার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দলে কত জন স্ত্রী, পুরুষ ও বাচ্চা আছে তা জেনে নেওয়া হয়। তারপরে মহিলাদের জন্য শাড়ি, সায়া ও ব্লাউজ, বাচ্চাদের জন্য জামা ও প্যান্ট, কম বয়সী মেয়েদের জন্য চুড়িদার এবং পুরুষদের জন্য লুঙ্গি ও বারমুডার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের হাতে ইতিমধ্যেই সেই পোশাক তুলে দেওয়া হয়েছে।” করোনা ভাইরাস দূরে রাখতে যে সব উপায়ের কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে একটি হল পরিচ্ছন্ন থাকা। এই শ্রমিকদের পক্ষে নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন ঠিকই তবে প্রশাসনের উদ্যোগে এখন তাঁরা অনেকটাই পরিচ্ছন্ন ভাবে থাকতে পারবেন। নিয়মিতভাবে পোশাক বদলও করতে পারবেন। লকডাউন উঠলে তাঁরা কাজ পেয়ে যাবেন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী অজিত কুমার কুন্ডু, সভাপতি কালাচাঁন কুন্ডু, সাধারন সম্পাদক যুগল দেবনাথ এবং সনাতন যুব সেবা সংঘের সভাপতি শ্রী বিবেকানন্দ দেবনাথ এর উদ্যোগে হিন্দু মুসলিম জাত ধর্ম নির্বিশেষে মন্দিরের নিজস্ব তহবিল ও স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী তরুন যুবকদের নিজ নিজ ব্যক্তি দানের টাকায় এই ত্রানসামগ্রী বিতরণ করা হয়৷ এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন রিয়াদ৷ মন্দির কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী অজিত কুমার কুন্ডু বলেন, “মানবসেবার চেয়ে বড় ধর্ম অার কিছুই হয় না৷ আমাদের সনাতন ধর্মে মানবসেবা ও দানের কথা বলা আছে।” প্রায় তিনদিনের খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ছিলো ৩ কেজি চাল, ২ কেজি অালু, ১ কেজি ডাল, হাফ লিটার তেল, ১ কেজি লবণ এবং ১টি সাবান। উল্লেখ্য যে, এই উদ্যোমী তরুনরা নিজ এলাকায় সবসময় মানবসেবায় অতুলনীয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। কিছুই বড় নয় জীবনের থেকে। তাই বন্ধুত্বকে পাশে সরিয়ে রেখে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা গেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা নরেন্দ্র মোদির বিশেষ বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ভারত যদি অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ মার্কিন মুলুকে রপ্তানির অনুরোধ নাকচ করে, তাহলে তার ফল ভুগতে হবে ভারতকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অনুরোধ করেন যাতে হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইনের রপ্তানির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক। হোয়াইট হাউসে ব্রিফিংয়ের সময়ে ট্রাম্প জানান, ‘আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব ভাল। আমি বলেছি, আপনি যদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, তাহলে খুবই ভাল হবে। যদি তিনি একান্তই এদেশে ওই ওষুধ আসতে না দেন, তাহলেও আমি অবাক হব। আমার কিছু বলার থাকবে না। তবে তার ফল ভুগতে হতে পারে ভারতকে। সূত্রের খবর, হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইনের অর্ডার মার্চ মাসে দিয়েছিল আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি বার্তায় বলেন, ‘বহু বছর ধরে ভারত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার সুবিধে নিয়েছে। তাই এখন যদি ভারত পিছিয়ে যায় আমি অবাকই হব। তবে যাই সিদ্ধান্ত হোক না কেন প্রধানমন্ত্রীকে আমায় তা জানাতে হবে।’ ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারির পর নয়াদিল্লি থেকে কোনও জবাব এখনও দেওয়া হয় নি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে রবিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।ডাউনিং স্ট্রিটের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বলা হয় যে, বরিস জনসনের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে, কিছু পরীক্ষার জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। বরিস জনসন ছাড়াও তাঁর অফিসের স্বাস্থ্যসচিব ম্যাট হ্যানকক এবং জুনিয়র স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাদিন ডরিসও করোনায় আক্রান্ত। গত ২৬ মার্চ বরিস জনসন করোনায় আক্রান্ত হন। এরপরই আইসোলেশনে চলে যান তিনি। আগের থেকে তিনি অনেক সুস্থ রয়েছেন বলেও জানান তিনি। বিগত দিনগুলিতে ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবন থেকেই অফিসের কাজকর্ম করছিলেন বরিস জনসন। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই সারা দেশে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হোক৷ কেন্দ্রর কাছে এমনই আর্জি রেখেছে বিভিন্ন রাজ্য৷ দেশজুড়ে করোনা মোকাবিলার এর থেকে আর ভাল পথ নেই বলেই মনে করছে রাজ্যগুলি৷ সেই কারণেই এমন আর্জি করা হচ্ছে বল সূত্রের খবর৷ যদিও এই নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী৷ লকডাউন ওঠার ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টা আগেই পরবর্তী পরিস্থিতির কথা স্থির করবেন তিনি৷ মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অনেকের পক্ষ থেকেই দাবি করা হয় যে লকডাউন চললে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে অনেকটা সুবিধা মিলবে৷ যদিও বিভিন্ন করোনা স্পর্শকাতর জোনগুলিকে চিহ্নিত করে সেই জায়গায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে, এমনই ভাবনা চিন্তা চলছিল কেন্দ্রীয় স্তরে৷ কিন্তু রাজ্যগুলির আর্জির পর সেই ভাবনার বদল হতে পারে বলে সূত্রের খবর৷ তাই মনে করা হচ্ছে ২১ দিনের পর আবার লকডাউনের সয়মসীমা বাড়তে পারে৷ যদিও এই চিন্তা নিয়ে দুরকম মত উঠে আসছে৷ কারণ অনেকেই মনে করছেন যে লকডাউন না উঠলে রুটিরুজির টান পড়বে অনেকের৷ অন্যদিকে লকডাউন না থাকলে করোনার সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে৷ এখন প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ৷
মিনতি বলল, জানুয়ারি থেকে করোনা ভাইরাসে জর্জরিত চিন (China)। দিনের পর দিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে হুহু করে। কিন্তু মঙ্গলবার ছবিটা পুরোপুরি বদলে গেল। কারণ এই প্রথম কোভিড ১৯-এ (Covid 19) আক্রান্ত হয়ে নতুন করে কারও মৃত্যু হল না সেই দেশে।চিনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন মঙ্গলবার জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি চিনে। এমনিতে মার্চের শুরু থেকেই চিনে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে হুহু করে। কিন্তু তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ এখন বাড়াচ্ছে বিদেশ থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিনে আসা।প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মার্চের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত বাইরের দেশ থেকে আসা অন্তত হাজার জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের (Coronavirus) উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে। ফলে এখনও চিন্তামুক্ত হয়নি প্রশাসন। বরং তাঁদের আশঙ্কা করোনাভাইরাসের এই দ্বিতীয় ভাগে বেজিংয়ে প্রভাব পড়তে পারে, কারণ বিদেশ থেকে বেশি মানুষ বেজিংয়েই আসছেন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ আটকাতে গোটা বিশ্ব এখন লকডাউনের (Lockdown) পথে হাঁটছে। এই বুদ্ধিটা প্রথম চিনই দিয়েছিল। হুবেই (Hubei) প্রদেশের উহান শহরে মাত্রাছাড়া ভাবে বাড়ছিল আক্রান্তের সংখ্যা। তখনই গোটা শহরকে লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।
আজ টিভির খবর শুনছে আলো।খবরে বলছে, লক ডাউন উঠবে ১৪ এপ্রিল মধ্যরাতে। ১৫ এপ্রিল সকাল থেকেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারে দেশের জনজীবন। বাংলার ক্ষেত্রে সেই লক ডাউন উঠবে ১৫ এপ্রিল মধ্যরাত্রে। পরেরদিন থেকে স্বাভাবিক হওয়ার কথা বাংলার। কিন্তু সত্যিই কী সব কিছু আগের মতই স্বাভাবিক হয়ে যাবে? এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলা জুড়ে। তবে রাজ্যের অভিজ্ঞ মহলের ধারনা লক ডাউন উঠলেও কিছু বাধা নিষেধ থেকেই যাবে। চট করে স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, সিনেমা হল, মল-মাল্টিপ্লেক্স, ফার্স্ট ফুডের দোকান, জামা কাপড়ের দোকান, ইলেকট্রনিক্সের দোকান, হার্ডওয়্যারের দোকান, সেলুন, স্পা, খুলবে না। গণপরিবহণও খুব একটা সচল হবে না। তার মধ্যে থাকবে রেলও। আর এখানেই ঝুলছে গাদা গুচ্ছের প্রশ্ন। আদৌ কি রেল চলবে? রেলমন্ত্রক সুত্রে জানা গিয়েছে, ১৫ এপ্রিল থেকে রেল চালাবার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে সংশ্লীষ্ট মন্ত্রক। কিন্তু কোনও রাজ্যে লক ডাউন চললে সেখানে রেলের পরিষেবা চালু হবে না। আবার যে এলাকায় সংক্রমণ বেশি ছড়িয়েছে সেখানেও রেল পরিষেবা দেবে না। তবে চেষ্টা করা হবে দেশের নানা প্রান্তে আটকে পড়া মানুষদের আগে নিজের নিজের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজ গুরুত্ব দিয়েই করা হবে।সেই সঙ্গে বাধ্যতামূলক করা হতে পারে মাস্ক পড়া। ট্রেনে ওঠার আগে যাত্রীদের ভালো করে শারীরিক পরীক্ষাও করা হবে। তবে সব ট্রেনই এক সঙ্গে চালু করে দেওয়া হবে না। শহরতলির ট্রেন যেখানে খুব ভিড় হয় সেই লাইনে আপাতত ট্রেন চালু করা হবে না। তবে এই সব কিছুর আগে কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ছাড়পত্র আসা। বাংলায় কি হবে? রাজ্য সরকার লক ডাউন দীর্ঘায়িত করতে চায় না। আবার সব কিছু বিধি নিষেধ একদম উঠে যাবে এমনও নয়। নোয়াপাড়া থেকে কবি সুভাষ মেট্রো রেল চালু না হলেও ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো রেল চালু হতে পারে। আবার দমদম স্টেশন থেকে মাঝেরহাট পর্যন্ত চক্ররেল চললেও চলতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কৃষ্ণনগর বা বনগাঁ থেকে সরাসরি লোকাল ট্রেন দমদম হয়ে মাঝেরহাট চলে আসবে। শিয়ালদা মেইন ও দক্ষিণ শাখায় এখনই কোনও লোকাল ট্রেন চালু হবে না। কারণ দিনে এই সব শাখায় যদি দুটি করেও ট্রেন চলে তাহলেও ভিড় হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। একই ছবি হাওড়া স্টেশনের ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য। সেখানেও পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব রেলের শহরতলির ট্রেন চট করে চালু হবে না। তবে শিয়ালদা ও হাওড়া দুই স্টেশন থেকেই ধাপে ধাপে দূরপাল্লার ট্রেন চালু করা হলেও হতে পারে। জোর দেওয়া হবে আন্তঃরাজ্য এক্সপ্রেস ট্রেনগুলি চালু করার বিষয়ে। তবে এই সব কিছু এখনও পর্যন্ত ভাবনাচিন্তার স্তরেই রয়ে গিয়েছে। বাস্তবটা ১৫ এপ্রিলের পরেই বোঝা যাবে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, সর্বত্র লকডাউন না-তুলে সংক্রমণ ও হটস্পটের (Hotspot) নিরিখে গোটা দেশকে তিন বা তার বেশি জোনে ভাগ করা হোক। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রতিটি জোনের অবস্থা খতিয়ে দেখে লকডাউন তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক আলাদা আলাদা করে। গত বছরই অ্যামাজন অরণ্যে আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। কয়েক মাস পর ভয়াবহ দাবানলের গ্রাসে চলে যায় অস্ট্রেলিয়া। শুশুনিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনই বেদনাদায়ক ছবি সামনে এল। করোনারি আতঙ্কের পরিবেশের লকডাউন এর আতঙ্কের পরিবেশে পুলিশ, ডাক্তার ও নার্সদের প্রশংসা না করে উপায় নেই। দিনরাত তাদের সেবার মাধ্যমে জনগণ সুস্থ হয়ে উঠছে ।এক ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছেন জনগণকে। ফুটপাতে অসংখ্য না খেতে পাওয়া মানুষকে খাওয়াচ্ছেন বৃদ্ধদের বাজার করে দিচ্ছেন কোন অসহায় মহিলাকে সাহায্য করছেন। একমাত্র কারো ক্ষতি করার জন্য বাহুবলের প্রয়োজন, তা না হলে ভালোবাসা যথেষ্ট। বাঁকুড়া জেলার ছাতনা থানার অন্তর্গত শুশুনিয়া পাহাড়ের ঢালে বিস্তৃত জঙ্গলে গতকাল দুপুরের পর আগুন লাগে। গোটা পাহাড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গিয়েছে। অসৎ উদ্দেশে শুকনো পাতায় আগুন লাগানোর ফলেই এই বিপত্তি বলে ধারণা এলাকাবাসীর। বিকেলে দমকল বাহিনী সেখানে গেলেও বিপুল এলাকার কারণে, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। রাতে তা ভয়াবহ আকার নেয়। আজ সকাল থেকে দমকল ও বনকর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে রেঞ্জার জানিয়েছেন। সারা রাত ধরে চলা দাবানলে পাহাড়ের জীব বৈচিত্র্য অত্যন্ত সঙ্কটের মুখে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে সবার প্রথম সাফল্য পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। কারণ তারা বিপুল পরিমাণে পরীক্ষা করে সাধারণ সুস্থ মানুষকে রোগীদের থেকে আলাদা করতে পেরেছিল। তারা সেই সংক্রমণে রাশ টানতে পেরেছিল। ফলে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে মডেল হয়ে যায়।
ছয়
আজ বিরাজুল সকালে উঠেই টিভির সামনে বসল। তার মন ছটফট করছে গ্রামে ফেরার জন্য। সে শুনছে, এবার একই মডেল গ্রহণ করে নজির স্থাপন করল কেরল। ফলে বোঝা গেল বাংলার পর দেশের বাকি রাজ্যের থেকে তারা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ধাঁচে কেরলে তৈরি হল করোনা কিয়স্ক। এখানেই করোনা সন্দেহভাজনদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। চারটি হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে এই কিয়স্কগুলি তৈরি করা হয়েছে। কিয়স্কগুলিতে আছে আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং সোয়াব পরীক্ষার ল্যাব। এই কিয়স্কগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়াক ইন স্যাম্পল কিয়স্ক’ বা উইস্ক। বেসরকারি জাতীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, কাঁচ দিয়ে ঘেরা কিয়স্কগুলিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের নমুনা সংগ্রহ করার একটি করে আলাদা স্থানও রয়েছে। করোনা আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের নমুনা সংগ্রহের সময় স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে সরাসরি সংস্পর্শে না আসেন সেই ব্যবস্থাও রয়েছে কিয়স্কে। লালার নমুনা সংগ্রহের পর স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতের দস্তানা কিয়স্কের বাইরে স্যানিটাইজ করিয়ে আনা হচ্ছে।কেরলের জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক এস সুধাস জানান, এই পদ্ধতিতে গণ স্ক্রিনিং–এর ব্যবস্থা থাকবে। ফলে দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে করোনা আক্রান্তকে। এই ব্যবস্থার জেরে কমবে পিপিই কিটের চাহিদা। এভাবে অল্প সময়েই অনেক পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। প্রতিটি উইস্ক তৈরি করতে সরকারের ৪০ হাজার টাকা খরচ পড়ছে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ কোরিয়ায় এই ধরনের কিয়স্ক তৈরি করা হয় করোনায় গণসংক্রমণ পরীক্ষার জন্য। ফলে দেশে সংক্রমিতদের দ্রুত চিহ্নিত করার কাজে সফল হয়েছিল তারা। আমেরিকায় আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনা। গত ২৪ ঘণ্টায় কেবল নিউইয়র্কেই মৃত্যু হয়েছে ৭৩১ জনের। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে, একদিনে কোনও একটি শহরে এতজনের মৃত্যু হয়নি। মঙ্গলবার এমনটাই জানিয়েছেন নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো। সবমিলিয়ে নিউইয়র্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪৮৯ জন। যা কিনা গোটা দেশের অর্ধেক। এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ মৃতের সংখ্যা ছিল ৬৩০ জন। গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো জানিয়েছেন, নিউইয়র্ক প্রদেশে মৃতের সংখ্যা একদিনে বাড়লেও নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাই এতে আতঙ্কের কিছু নেই। তিনি আরও দাবি করেছেন, এতে করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য গৃহীত সরকারি পদক্ষেপগুলি সফল হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, তাতেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না শহরবাসী। শেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৩ লক্ষ ৮৬ হাজারের কাছাকাছি এবং মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ হাজারবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী চীন ঘেঁষা? আসলে এমন অভিযোগ করেছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই অভিযোগ তুলে এবার ট্রাম্পের হুমকির মুখে পড়ল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। আসলে করোনা ভাইরাসে কাবু আমেরিকা। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রোজ মাত্রা ছাড়িয়েছে। তারই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুললেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর অভিযোগ, চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে হু। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই হুমকির পর আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছে। এদিন হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুমকি দিয়ে বলেন, ‘হু–কে পাঠানো ফান্ড বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ এই মন্তব্যে শোরগোল পড়তেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কখনও বলিনি ফান্ড বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমি বলেছি আমরা এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে দেখব।’ এই পরিস্থিতিতে অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, চীন থেকেই গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এই মারণ রোগ। হু আগে থেকে ভাইরাস প্রতিরোধের কোনও পরামর্শও দেয়নি বলে অভিযোগ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অন্যান্য দেশকে করোনা নিয়ে হু ঠিক তথ্য দেয়নি। করোনা ভাইরাসের আগে বিশ্ববাসী যে স্বাভাবিক জীবনে ছিল সেটা ফিরে নাও পেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শীর্ষ মার্কিন বিজ্ঞানী ডা. অ্যান্থনি ফাউসি।মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজের প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে এক বিবৃতিতে ফাউসি বলেন, করোনা ভাইরাস সহজে বিলুপ্ত না হয়ে মৌসুমি ফ্লুর প্রকৃতি ধারণ করে বার বার ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্ব মহামারি করোনা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব অঞ্চল ও দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে চলছে লকডাউন। তিনশ’ কোটির বেশি মানুষ ঘরবন্দী। অর্থনীতি ধসে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা। তবে সংক্রমণ ও মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কোভিড-১৯ রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশটির ডাক্তার-নার্সরা। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের হিসেবে মতে, আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা ৮১ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে করোনাবিষয়ক বিজ্ঞানী ফাউসি বলেন, দেশে দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। সেখান থেকে সমাজের প্রতি স্তরে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা হয়তো করোনাভাইরাসের আগের জীবন ফিরে পাব না। ডা. ফাউসি আরো বলেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে আমাদেরকে করোনা ভাইরাস মুক্ত হতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব কিনা জানি না। তবে একমাত্র ভ্যাকসিনই সেই সমাধান দিতে পারে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ১৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৭৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৮২ হাজার ৯৬ জনের। দেশজুড়ে ২১ দিনের লকডাউনে বিপর্যস্ত স্বাভাবিক জীবন। করোনাকে দূরে রাখতে গৃহবন্দি দশাই এখন একমাত্র উপায়। এমন পরিস্থিতিতে কারও মৃত্যু হলেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বাড়ির লোকেদের। ঠিক যেমন বিপাকে পড়তে হল ইন্দোরের এক পরিবারকে। করোনা আতঙ্কে কেউই মৃতদেহ সৎকারে যেতে চাইছে না। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আবার অমিল গাড়ি। এমন অবস্থায় হিন্দু মহিলার সৎকারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রতিবেশী মুসলিম যুবকরা।
বিরাজুলের পাড়াতে সোমবার মৃত্যু হয় ৬৫ বছরের প্রৌঢ়ার। দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগছিলেন তিনি। রেখে গেলেন দুই ছেলেকে। লকডাউনের জেরে মায়ের কাছে পৌঁছতেই অনেকটা সময় লেগে যায় তাঁদের। যাও বা পৌঁছলেন, গাড়ির অভাবে শ্মশান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াই মুশকিল। অসহায় পরিবারকে দেখে এগিয়ে আসেন আশপাশের মুসলিম যুবকরা। মৃতাকে কাঁধে নিয়েই প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেন তাঁরা। মৃতার দুই ছেলের সুবিধার্থে সৎকারের সমস্ত ব্যবস্থাও করলেন। সে রাজ্যের কংগ্রেসের মুখপাত্র নরেন্দ্র সালুজা খবরটি নিশ্চিত করে যুবাদের প্রশংসা করেছেন। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথও সম্প্রীতির ছবি দেখে মুগ্ধ। টুইটারে লেখেন, ‘মৃতাকে কাঁধে তুলে সৎকারের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন মুসলিম যুবকরা। সঙ্গে মৃতার দুই ছেলে। সত্যিই তাঁরা সমাজের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এটাই আমাদের সম্প্রীতির ছবি। বিরাজুলও সঙ্গেই ছিল। যুবকরা জানিয়েছেন, ওই প্রৌঢ়াকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন তাঁরা। তাঁর চোখের সামনেই বড় হয়েছেন। তাই এমন সঙ্কটের দিনে মৃতার ছেলেদের পাশে দাঁড়ানো নিজেদের দায়িত্ব ভেবেছেন।
দিন কয়েক আগে অনেকটা এমন ছবিই দেখা গিয়েছিল বুলন্দশহরে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হয় প্রৌঢ় রবিশঙ্করের। প্রতিবেশীরা মনে করেছিলেন করোনা সংক্রমণের জেরেই হয়তো মৃত্যু হয়েছে তাঁর। তাই শেষ দেখাটুকুও কেউ দেখতে আসেননি। শেষমেশ পাড়ার পাশের মুসলিম অধুষ্যিত এলাকার যুবকরাই সমস্যা মেটান। আজ জলপাইগুড়ির এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ৭০০ দুঃস্থ পরিবারের হাতে খাদ্য সামগ্রী তুলে দিলেন ওই সংস্থার সদস্যরা। প্রতিটি পরিবারের হাতে তাঁরা ৩ কেজি চাল, ডাল ৫০০ গ্রাম, আলু, ১ কেজি, পেঁয়াজ ৫০০ গ্রাম এবং সাবান ১টি দেন। সব জায়গায় মানুুষের পাশে মানুষই আছে। করোনা মোকাবিলায় সারা বিশ্বের ভরসা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল। মানিকতলা বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর দিকে তাকিয়ে এবার ভারত তথা গোটা বিশ্ব। এই মুহূর্তে শুধু ভারত কেন আমেরিকার মত দেশ ও প্রাচীন এই ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানের দিকেই তাকিয়ে। কারণ একটাই করোনা প্রতিরোধের আংশিক ওষুধ হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইন তৈরি হয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের হাতে গড়া বেঙ্গল কেমিক্যালে। এই ওষুধের কার্যকারিতা জানা মাত্রই বিদেশে রফতানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতি এই ওষুধের দাবি জানায় ভারতের কাছে।
মিনতি পড়ছে কাগজে, বিশ্বকে যতই করোনা ভাইরাস গিলে ফেলছে, ততই অভিযোগের আঙুল উঠছে চিনের বিরুদ্ধে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র দিকেও উঠেছে আঙুল। দাবি, তারা নাকি চিনের দোষ ঢাকছে। এবার এই বিষয়েই সরব হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের দাবি, করোনা ভাইরাস ছড়ানোর পরেও চিনের একাধিক তথ্য গোপন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এমনই আক্রমণ শানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এমনকী হু-কে অর্থ সাহায্য বন্ধ করারও হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এদিকে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় হুয়ের প্রশংসা করেছে রাষ্ট্রসংঘ।করোনা সংক্রমণ আমেরিকায় মারাত্মক আকার নিয়েছে। মৃতের সংখ্যা ১১,০০০ ছড়িয়ে গিয়েছে আমেরিকায়। এই পরিস্থিতির জন্য চিনকই দায়ী করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও চিনের পক্ষ নিয়ে তথ্য গোপন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। চিনকে আড়াল করার সবরকম চেষ্টা করেছে হু। এমনই অভিযোগ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমেরিকার থেকে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেডকোয়ার্টারে বিপুল পরিমান আর্থিক সাহায্য যায় আমেরিকার পক্ষ থেকে। এই আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে চাপ বাড়বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপর।
বিরাজুল বলল, করোনা ভাইরাসে আমেরিকায় ১১,০০০ মৃত্যু হয়েছে। সেই মৃত্যু আরও বাড়ছে। সংক্রামিত আরও কয়েক হাজার। মড়কের অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২৪ ঘণ্টা ১৫০০ জনেরও মৃত্যু হয়েছে আমেরিকায়। প্রবল সংকট তৈরি হয়েছে গোটা দেশে। ভারতের কাছে ম্যালেরিয়ার ওষুধ চেয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে ট্রাম্প। দিশেহারা অবস্থা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের। এদিকে, মঙ্গলবারই করোনা সংক্রান্ত তথ্য স্বীকার করেছে চিন। মঙ্গলবার চিনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে ডিসেম্বরের শেষে উহান শহরে ধরা পড়েছিল এই ভাইরাস।
গল্প/প্রবন্ধ
এক
কোনো ভাবেই মনে হয় নি লোকটা মাস্টার মশাই। পোশাক আশাকে লোকটা একদম কর্পোরেট-- কিন্তু খোঁটকা ছিল মাফলারে। না, ঠিক মাফলারটায় নয়। কান মাথা মুখ ঢাকা মাফলারটা এক্সট্রাঅর্ডিনারিই ছিল। আসলে মাফলারটা যেভাবে জড়ানো ছিল তার সঙ্গে কর্পোরেট প্রেজেন্স ঠিকঠাক যায় না।
লোকটা বাসের জানলা লাগোয়া সিটটা আমার থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিল। বাসের জানলা লাগোয়া সিট আমার খুব পচ্ছন্দের। লোকটা বসা মাত্র জানালার সাটার আরো আঁটোসাটো করে নিয়েছিল যাতে ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে না পারে। নভেম্বর শেষ হতে চলল, শীতের দেখা সাক্ষাৎ নেই।
তাও --কেউ কেউ এমনতর শীত কাতুরে হয়! লোকটা মাফলারটা আরো শক্ত করেছিল বোধহয়।
তারপর আমার চোখাচোখি হয়েই হাসল মাফলার ঢাকা মুখটা। ঠিক তখনই ভুল ভাঙল আমার--
"লোকটা কর্পোরেট নন।" কর্পোরেট লোকজন অপ্রয়োজনীয় হাসি হাসেন না।
"কোথায় যাবেন?"
আবার ধন্দে পড়লাম-- লোকটা ঘাড় কাত করে, ভ্রু জোড়া কপালে তুলে চোখ দুটো সরু করে এমনভাবে প্রশ্নটা করল-- মনে হল লোকটা বড়সড় কোন চেয়ার সামলেছেন দাপটের সঙ্গে।
আমি খুব অযত্নে -- " হলদিয়া" উচ্চারণ করে মোবাইলে ফিরলাম।
"স্কুলে পড়ান?"
"লোকটা জ্যোতিষি নাকি!" - চমকে যাওয়াটা লুকিয়ে, তিন দিনের বাসি দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে --
"হুম" -- বললাম।
"না,না আমি জ্যোতিষ টোতিষ নই-- ঐ যে একটু আগে আপনি ফোনে বলছিলেন -- কর্পোরেট সোশাল রেসপনসেবলিটি।" -- লোকটা আবার হাসল।
"ঠিক তো, একটু আগে শিরিন ফোন করেছিল, জানতে চেয়েছিল সিএসআর কি।"
শিরিন মাধ্যমিকে নাইনট্টি টু পারসেন্ট পেয়েও কমার্স নিয়েছে। ছোকরা সায়েন্স নিয়ে মস্ত কেরিয়ার বানাতে পারত, সেসব নয় ভুত চাপল কমার্সের। পৃথিবীটা নাকি কর্পোরেটদের দখলে। কর্পোরেটরা যা দেখায় তাই দেখতে হয়, যা গেলায় তাই গিলতে হয়।
"কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি" জানালার দিকে মুখ করে শব্দগুলো কেটে কেটে বলল লোকটা।
রেসপন্সিবিলিটি কথাটায় এতোটাই শ্লেষ ছিল -- আমি লোকটার গায়ে পড়া হলাম।
"তা, আপনি কোথায় যাবেন?"
"কুন্দনপুর হাইস্কুলে আমিও কমার্স পড়াতাম।" এই তো জ্বালামুখ উঁকি দিয়েছে -- এইবার গলগল বেরিয়ে আসবে রহস্য লাভা সব সবই।
"কত সালে ঢুকেছিলেন স্কুলে?" গাড়ি ছুটছে--- বিপ্রদেব বাবু নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন-- কন্টাই কলেজ - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি -এম কম-
"কোন সালে আপনার জয়েন?"
"শুরুতে অনেক ছাত্র পড়ত কুন্দনপুরে, তখন মফস্বলেও কমার্সের ছাত্র ছিল।"
"সেটা কত সাল ছিল?"
"আমি রিটায়ার করলাম দু'হাজার আটের সেপ্টেম্বরে -- ছয়,সাত, আট এই তিন বছর আমার কোন ক্লাস ছিল না। অনুপস্থিত শিক্ষকদের ক্লাস নিতাম। কমার্সের ছাত্রই ছিল না।"
এরপর বিপ্রদেববাবুর সঙ্গে কোন কথা বলতেই পারি নি। চুপ করে গিয়েছিলাম। হঠাৎ টাই শুট কোট পরা এক যুবককে দেখে ছেলেমানুষ হয়ে উঠলেন বিপ্রদেব বাবু--
"এই এই অরণ্য.... অরণ্য এই অরণ্য..."
ছোকরা আমাদের সিট পেরিয়ে পেছনের দিকে চলে যাচ্ছিল, এমন সময় বিপ্রদেববাবু অরণ্য অরণ্য বলে ছোকরার হাতে হ্যাঁচকা টানে আমার পাশের খালি সিটে বসিয়ে দিল। ছোকরা প্রায় আমার কোলে বসে পড়ে!
"তুই কোথায় যাচ্ছিস অরণ্য?" বিপ্রদেব বাবুর কথায় যেন আকাশ থেকে পড়ল ছোকরা। মুখ থেকে মাফলার সরিয়ে হাসল বিপ্রদেববাবু। আশ্চর্য হলাম এতো সুন্দর হাসিটা এতক্ষণ মাফলারের আড়ালে ছিল!
"আমায় চিনতে পারছিস না! আ আ আমি তোদের কমার্সের মাস্টার মশাই বিপ্রদেববাবু। সেই যে কুন্দনপুর... কুন্দনপুর ভবতারণ বিদ্যালয়, কিরে মনে পড়ছে না? সেই -সেবার একটা ফাইনাল এ্যাকাউন্ট কিছুতেই মিলে না, শেষ পর্যন্ত তুই মিলিয়ে দিলি। মনে পড়ছে? "
ছোকরা মোটা কাঁচের চশমা নিয়ে তাকিয়ে রইল বিপ্রদেববাবুর দিকে। বিপ্রদেববাবু শিশুর মতো হাসতে হাসতে বললেন--
"চিনতে তো একটু অসুবিধেই হবেই... ইন দ্যা ইয়ার নাইন্টিন নাইন্টি নাইন.... তা কি করছিস এখন? কোথায় পড়াচ্ছিস? তা কোন কলেজ তোর?" ছোকরার চোয়াল শক্ত হল, সে দৃঢ় ভাবে বলল--
"আপনার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে... আ আ আমি আমি অরণ্য নই।"
"তু.. তুমি... আ... আপনি অরণ্য নন!"
নিজের অবাক হওয়াটা কোন রকম সামলে আবার মাফলারে মুখ ঢাকলেন মানুষটা। তারপর অনেক সময় আমাদের সিটটা থম মেরেছিল। না, মানে ছোকরা কথা বলছিল, কথা বলছিল ফোনে টার্নওভার কমিশন ওর্ডার সাইজ এইসব নানান ব্যবসায়িক কথা।
কন্টাই- এম কম - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি - অরণ্য আর বাসের দুলুনিতে চোখ বুজে এসেছিল- কিছু সময় পর চোখ খুলে দেখি -- বিপ্রদেববাবুর বাস থেকে নামার তোড়জোড় চলছে ।
"আসছি তাহলে" --মাফলারের ফাঁক থেকে আশ্চর্য সুন্দর হাসিটা হাসলেন বিপ্রদেববাবু। ভিড় ভেঙে এগিয়ে চলছেন মানুষটা। এগিয়ে চলছেন সামনের দরজার দিকে। হঠাৎ খেয়াল হল-- আমার পাশের ছোকরা হুড়মুড়িয়ে ভাঙছে-- তার চশমার ভারি কা়ঁচে ছড়িয়েছে কুয়াশা। ঢিল ছুড়লাম আন্দাজে---
"আশ্চর্য! পরিচয় লুকালে! মানুষটাকে মিথ্যে বললে!" ছোকরা কান্না জড়ানো গলায় বলল--
"স্যারকে কিভাবে বলি... স্যারের যে অনেক প্রত্যাশা ছিল। অনেক আশা ছিল আমাদের নিয়ে, আমাকে নিয়ে। আমি যে কিছুই হয়ে উঠতে পারি নি। আমি কিভাবে স্যারকে বলব, আমি একটা কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার যে কোম্পানি গুটখা প্রোডাকশন করে! এ.. এটা...এটাই আমার সোশাল রেসপন্সিবিলিটি!"
আমি চোখ কোঁচলে ভাল করে বোঝার চেষ্টা করলাম-- "ভিড় ভেঙে আমি যাচ্ছি না তো! ছোকরা শিরিন নয়তো!"
দুই
আপনাদের পুজো পাঁচ দিনের। আমাদের এক দিনের। সারা বছর আপনারা অপেক্ষা করে থাকেন ঐ পাঁচটা দিনের জন্য। আমাদের অপেক্ষা এক দিনের। আপনাদের পুজো আসে বলেই আমাদের পুজো আসে।
বোধন থেকে আপনারা মেতে ওঠেন। হয়তো মেতে ওঠেন তারও অনেক আগে থেকেই। মহালয়ার ভোরেই আপনাদের অন্তরে বেজে ওঠে 'আলোর বেনু'। উৎসবের এক একটা দিন এক ভিন্নতর বৈচিত্র নিয়ে আসে জীবন। এমন কি পাঁচটা দিনে ঢাকের সুর-তালটাও বদলে বদলে যায়। আনন্দিত সে সুর নবমীর ছোঁয়ায় বড় বেদনাময় হয়ে ওঠে। আমাদের জীবনে ঢাকের সুর-তাল একটাই। সে সুর, সে তাল, আশার সুর-ভরসার সুর। ঢাকের সেই তালের সঙ্গে আমরা যেন এক যুদ্ধ যাত্রার দামামা শুনতে পাই।
নবমী নিশি এলেই আপনারা বিষন্ন, বুকের ভিতর মন খারাপ করা মেঘেদের আনাগোনা। নবমী নিশি এলেই আমাদের বুকের ভিতর শত সহস্র জল তরঙ্গের উন্মাদনা। পুজো এলেই আমরা প্রহর গুনতে থাকি নবমী নিশির। আপনাদের কাছে 'মা' সালংকারা, সুশোভিতা। আমাদের কাছে ' মা' নিরাভরন।
আর কোন দিন পেট ভরে খাওয়ার জুটুক আর না জুটুক, দশমীর দুপুরে পেট ভরে খাওয়া চাইই চাই। তা না হলে শক্তি আসবে কিভাবে! আমাদের জীবনটাই যে স্রোতের বিরুদ্ধে। নদী স্রোতের প্রতিটি ওঠা-নামা হাতের তালুর মতো করে জানি আমরা। ভাসান ঘাট ও তার চারপাশের জলরাশির গঠন আমাদের নখ তর্পনে। উপরের স্রোতটা তলায় কোথায় কিভাবে আঘাত খেয়ে বিপদজনক ফেরান স্রোতে বইবে,এ খুব ভাল জানি আমরা। না জানলে চলে!
চরাচর অন্ধকার, ধূ ধূ করছে জল-প্রান্তর, স্রোতের উপর চাঁদের আবছা আলোর আভাস, নদীর কুলকুল আর আপনাদের হা-হুতাশ মিলে মিশে এক গা ছমছমে আবহ। নদীতে মা-কে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে একটু বেশি রকম দুলে উঠে নদী। আর ঠিক তখনই ঝপাং করে ঝাপাতে হয় নদীতে।নদী তখন জল আর অন্ধকারে মিলেমিশে একাকার। একটু বেচাল হলেই ভেসে যেতে হবে বহু দূর- একবার সে দেশ পাড়ি দিলে সেখান থেকে ফেরা আর সম্ভব নয়। সেদেশে গেলে শরীর হয়ে যায় শব।
পুজো কদিন আপনারা যখন আনন্দে ভাসছেন- তখন আমরা ভাসছি নদীতে। প্রখর অনুশীলনে নিয়ন্ত্রন করছি স্রোতকে। নিজেদের নিখুঁত নির্মাণ করছি ঢেউ এর আঘাতে আঘাতে। মহড়া দিচ্ছি এক অদম্য লড়াই-এর। অদ্ভুত ভাবে আমাদের সেই লড়াই-এর ক্ষুধাটা আসে, ক্ষুধা থেকে। আসলে আমাদের সব্বার লড়াই তো শেষপর্যন্ত ক্ষুধা জয় করার অভ্যাস। যদিও আপনাদের ক্ষুধা অনেক রকমের। পায়ুপথ বন্ধ হলে আমাদের ক্ষুধার আর কোন অর্থ রয় না। কিভাবে শক্তি সঞ্চয় করে নদীর স্রোতে ভেসে থাকতে হয়। আবার প্রয়োজনে কিভাবেই বা সেই শক্তি কে উজাড় করে
দিতে হয়- এই লড়াইটা আমি শিখেছিলাম বাবার কাছে। অন্ধকারে, প্রবল প্রতিকূল স্রোতে প্রতিমার কাঠ-কাঠামো বাবা অনায়াসে আনতে পারতেন ডাঙায়। পাঁচ বছর আগে রাতের অন্ধকারকে যখন একটু একটু করে মুছে দিচ্ছে ভোরের আলো....ক্ষয়ে যাওয়া মাতৃ মূর্তির সঙ্গে ভেসে উঠেছিল বাবার দেহ। ময়না তদন্তে বাবার পাকস্থলীতে মিলেছিল মদ। অথচ আমার বাবার কোনো নেশা ছিল না কোন দিন। হয়তো সেদিন ভাসান পার্টিরা খাইয়ে দিয়েছিল বাবাকে। ঐ একটি বিজয়ার কষ্টে আজও বুক ভারি হয়ে উঠে। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। বিজয়া আপনাদের কাছে অপ্রত্যাশিত হলেও আমাদের বড় আপন। আপনাদের এতো বিনিয়োগ, এতো সব আয়োজন ভেসে যাবে জলে-আর আমাদের ভেসে যাওয়া সংসারটা মাতৃ মূর্তির কাঠ-কাঠামোগুলো বেচে, বেঁচে যাবে আর কিছু কাল- চালে, ডালে। আমাদের এই অনাহার-অর্ধাহারের জীবনে বিজয়ার অন্য একটা মানে আছে।বিজয়া মানে ক্ষুধা বিজয়ের উল্লাস। তাই তো বিজয়া আমাদের জন্য বিশেষ ভাবে শুভ।...... শুভ বিজয়া।
তিন
আমরা যারা ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে লেখাপড়া করেছি -- তাপস, ভ্রমর, সন্দীপ, হাবলু, রাজা, দিলীপ, সন্তু, মোহন, শ্রীমন্ত, দেবাশীসবাবু -- আমারা একে অপরের সঙ্গে লেখাপড়া শেষে একই সঙ্গে থেকে গিয়েছি।
থেকে গিয়েছি কারণ আমরা সবাই ঠিকানা লিখতে গিয়ে গ্রাম-আনারনগর, পোষ্ট -কুকড়াহাটী লিখি। লেখাপড়া শেষে নিজের নিজের মতো কর্মজীবন জুটিয়ে সন্ধ্যেটা কাটে একই ক্লাবে ক্যারম বা তাস খেলে। ছুটির দিনে একই চা দোকানে আড্ডা হয়, হয় রাজনৈতিক তর্কবিতর্কও। আত্মসুখে ঐ একটা ঠিকানায় আমরা বাঁধা রইলুম আজীবন। খুব কম বয়সে সন্তু আমাদের ছেড়ে চলে গেল পরলোকে। আর তারও ঢের আগে, মাধ্যমিকের পরপর শ্রীমন্ত ও হাবলু -- ঐ ঠিকানাটাকে শূণ্য আকাশে উড়িয়ে --
'সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।' এই মন্ত্রে ঘর ছাড়ল। বেড়াতে বেরিয়ে তীর্থস্থানে তীর্থস্থানে সময় সুযোগ মতো ওদের সন্ধান না করলেও সর্তক থেকেছি যদি দেখা মেলে-- কেমন হয়েছে এখন শ্রীমন্ত বা হাবলু! আধ্যাত্মিক জগত কতটা বদলে দিয়েছে ওদের! দেখা হলে চিনতে পারবে তো!
মনে পড়বে স্কুলবেলার দিনগুলো! শ্রীমন্ত ও হাবলু এরা দুজনেই ছিল বেশ শান্ত স্বভাবের, অনেকটা মুখচোরা। সাধু সন্ত ভাব দেখিনি কখনও। বরং শ্রীমন্তটা ছিল মিচকে শয়তান,একবার ক্লাস সেভেনে মঘবানবাবুর হাতে মার খাইয়েছিল ক্লাস সুদ্ধ সক্কলকে। ছেলেবেলায় আমারই মনে হয়েছিল উপনয়নের পরপর ভোরের আলোআঁধারি সামলে ঘর ছাড়ব সকলকে কাঁদিয়ে।
মস্ত সন্ন্যাসী হব, জ্যোতি ছড়াবে চোখ মুখ থেকে। কে যে কখন ঘর ছাড়ে! মস্তিষ্ক অনেকটা পরিণত হলে মানুষের অন্তর্জগতে তার প্রস্তুতি চলতে থাকে একটু একটু করে সমস্ত বন্ধন হতে থাকে শিথিল। মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করতে থাকে---
" ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।"
পুণঃগমনায়চ শব্দটাকে মুছে শেষ বারের মতো নিভৃতে নিঃশব্দে ঘরের চৌকাঠ ডিঙোয় পা।আশ্রমের ডায়নিং হলের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি বৌ-বাচ্চা নিয়ে। খলবল করছে মানুষজন। হিমালয় এখন কেবল বেড়ানো- তীর্থ যাত্রার পবিত্রতা একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে ক্রমশ।
লাইনটার অনেকে কেদার থেকে ফিরেছে কেউ বদ্রীনারায়ণ, কেউবা যাত্রার করবে- চলছে তারই উৎচকিত আলাপ। কে কত দামি গাড়ি ভাড়া নিয়েছে, কতটা ড্রাই ফ্রুটস চকলেট স্টক করেছে, কতটা শীতের পোশাক-- কনকনে ঠান্ডার রাত, গল্পগাছায় লাইনটা এগোচ্ছে সাপের মতো। দরজায় আলোছায়ায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘদেহী মহারাজ, নিয়ন্ত্রণ করছেন লাইনটা। কাছাকাছি হতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে।
ডাইনিং হলের আলোর উল্টো পিঠে দাঁড়ানো আশিষ মহারাজকে মিথ্যে করে আমার স্মৃতিতে উঠে এল আমাদের স্কুলবেলার দিনগুলো, ফিরে এল সামান্য তোতলামি আর অনেকটা গোঁয়ার হাবলু-
আরো একটু কাছাকাছি হয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম কিন্তু ক্ষীণ আলোয় তা সম্ভব হল না। উপায় হিসাবে কাছাকাছি গিয়ে বললাম--
"মহারাজ আমরা কুকড়াহাটী থেকে এসেছি।" কথাটা শেষ করে স্থির চেয়ে রইলাম মহারাজের মুখে।
দেখি কুকড়াহাটী শব্দে কোন অস্থিরতা দেখা দেয় কিনা, চোখ দুটো চকচক করে কিনা। মহারাজ রইলেন স্থিতধী-- চোখে মুখে অদ্ভুত নির্লিপ্ততা। দপ করে নিভে গেল হাবলু, আমার স্কুলবেলার বন্ধু। খাওয়ার কুপনগুলো যখন মহারাজের হাতে দেব তখন, মহারাজ কেটে কেটে বললেন--
"কুকড়াহাটীর কোথায় বাড়ি?" আমি নিশ্চিত হলাম এ আমাদের হাবলুই।
"শীতলা মন্দিরের উল্টো দিকে, আমি সনোজ।" এতক্ষণে মহারাজ আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন--
"তুমি তো অনেক বদলে গেছ!"
আমার মুখ উঠে এসেছিল-- " তুইও তো অনেক পাল্টে গেছিস রে হাবলু!" নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললাম-- "আপনিও অনেক বদলে গেছেন মহারাজ।" আমি আমার বৌ-বাচ্চার সঙ্গে পরিচয় করালাম। বাবদা প্রণাম করতে মাথায় হাত রাখলেন আশিষ মহারাজ-ক্ষণিকের জন্য শিশু হয়ে উঠলেন তিনি। সন্তু আর বাপ্পার মুত্যু খবর শুনে একটা দীর্ষশ্বাস পড়ল কি!
আমি গায়ে পড়া হয়ে আরো কিছু বলতে চাইলে আমাকে উপেক্ষা করে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন লাইন সামলাতে। বুঝলাম এ তার বানানো ব্যস্ততা, আসলে আমার কাছে, স্কুলবেলার কাছে, জন্মভিটের কাছে, হাবুলের কাছে ধরা দিতে চাইছেন না আশিষ মহারাজ। তাই তার ব্যস্ত হয়ে ওঠা।
সন্ন্যাসীদের যে পূর্বাশ্রমে ফিরতে নেই এমন কি স্মৃতিতেও নয়।
চার
স্টেশনে ঢোকার আগে ছোকরা উঠে গিয়ে দাঁড়াল ট্রেনের দরজায়। ফোনেই ওর্ডার করে রেখেছিল।
ট্রেনের দরজায় 'পিপার বার্বিকিউ চিকেন পিজার' প্যাকেটটা ডেলিভারি দিয়ে ডেলিভারি বয় ছুটল বি থ্রির দিকে। এই স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে সাত মিনিট। নামে সুপার ফাস্ট হলেও ট্রেনটা ঝোলাচ্ছে শুরু থেকেই।
পিজার প্যাকেটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিল ছোকরা। ছোকরা সদ্য বিয়ে করেছে হয়তো, স্বামী-স্ত্রী চলছে মুসৌরীতে। সুধাময় আর অনিমা চলছে হরিদ্বার। সুধাময় আর অনিমার মুখোমুখি বসেছে ছোকরারা। সুধাময়দের একটা লোয়ার আর অন্যটা আপার। অনিমার হাঁটুর ব্যারাম আর সুধাময় বরাবরের বেতো। ছোকরাদের অনুরোধ করতেই সুধাময়দের নিজেদের লোয়ারটা ছেড়ে দিয়েছিল ছোকরা। দুই লাভ বার্ড এখন একেবারে উপরের সিটে মুখোমুখি। বার্থগুলো এখনো এ্যারেজ করে নি কেউই।
দুপুরের খাওয়ার খেয়ে হয়তো এ্যারেঞ্জ হবে ঘুমাবার জন্য। সুধাময়দের যেহেতু দু'টোই লোয়ার সিট তাই এ্যারেঞ্জম্যান্টের কোন ঝোঁক্কি নেই। অনিমার কোন সাধই পুরণ করতে পারে নি সুধাময়। সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে, নিজেদের সব সাধ আহ্লাদ ভুলে দীর্ঘ হয়েছে যাত্রাপথ। এখন সংসার সুখের মুখ দেখেছে, সুধাময়ের ছেলে তপব্রত গত বছর সরকারি চাকরি জয়েন করেছে। ব্যাঙ্কের চাকরি - পোষ্টিং হরিদ্বারে।
তপব্রতই বাবা মায়ের জন্য টিকিট করেছে--ছেলের কাছে থেকে দিন কুড়ি তীর্থ করবে সুধাময় আর অনিমা। কোন ট্রেন, কত নম্বর প্লাটফ্রম, কোন কোন সিট-তপব্রত ফোনে পই পই করে বুঝিয়ে দিয়েছে সবটা। এখন হরিদ্বারে নামিয়ে নিতে পারলেই, নো টেনশন।
জীবনে প্রথম এমন চকচকে ট্রেনে চড়ল সুধাময়- তপব্রত পাখি পড়াম মতো করে সবটা শেখালেও, সুধাময়রা অন্যদের দেখে রপ্ত করছে প্রতিনিয়ত। জীবনে কত কিছু শেখা হয় নি সুধাময়দের!বার্থে বার্থে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থাপনা চলছে।
সুধাময়রাও খাওয়ার এনেছে বাড়ি থেকে-অনিমা ভোর রাত থেকে বানিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে রেখেছে সব। তপব্রত বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে ট্রেনের খাওয়ার এড়িয়ে যেতে। দুপুর একটা, বার্থে বার্থে খাওয়ারের সুঘ্রাণ পাক খাচ্ছে। ছোকরারা উত্তরের লোয়ার বার্থে পিজার প্যাকেটা খোলা মাত্র গন্ধটা ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। সুধাময় এমন খাওয়ার আগে দেখেনি। খিদেতো ছিলই, খাওয়ারের মিষ্টি গন্ধ নাকে আসা মাত্র তেজ বাড়াল তার।
অস্থির হল সুধাময়। অনিমাকে খাওয়ার রেডি করতে বলে হাত ধুতে গেল সে। হাত মুখ ধুয়ে এসে হতাশ হল সুধাময়-- কাঁচ বাঁধা জানালায় অপলক তাকিয়ে অনিমা। কোন খাওয়ার দাওয়ার রেডি হয় নি তখনও!
সুধাময় ফের একবার মনে করাল অনিমাকে। অনিমা শুকনো শুকনো মুখে জবাব দিল- খাওয়ারের ব্যাগটাই নিতে ভুলেছে সে। অনেকটা যেন অপরাধী অপরাধী মুখে বসে অনিমা।
সুধাময় অনিমার হাতটা আলতো চেপে ধরল-- আদর মিশিয়ে বলল--
"মন খারাপ করো না, এমনটাতো হতেই পারে। তাছাড়া উপোস দেওয়াটা তো আমাদের অভ্যাস, আজকের দিনটাই তো।"
দু একটা বার্থ ছাড়া সারা বি-টু কুপটা অসাড়ে ভাত ঘুম দিচ্ছে। অনিমা আলতো ঠেলা দিল সুধাময়কে,খিদের ঘুম হালকা ছোঁয়ায় গেল ভেঙে। অনিমা এক থালা ভাত, শাক চচ্চড়ি আর আলু সেদ্দ মেখে হাসি হাসি মুখে বসে। সুধাময় বলল--
"এই যে বল্লে আনতে ভুলে গেছ!" অনিমা ভাতের থালা গোছ করতে করতে বলল--
"ঐ সব দামি দামি খাওয়ারের পাশে, আমাদের এই শাক চচ্চড়ি মানাত? তাছাড়া তোমার ছেলে যে মস্ত অফিসার তার বদনাম হত না।"
শাক চচ্চড়ির সুঘ্রাণ নিতে লম্বা শ্বাস টানল সুধাময়।
প্রবন্ধ
কোমর, হাঁটু, অস্থি সন্ধিতে, বাতের ব্যথার টোটকা চিকিৎসা
. মেথি গুঁড়া ১০০ গ্রাম, শুঁঠ(শুকনো আদা) গুঁড়ো ১০০ গ্রাম,হলুদ গুঁড়ো ১০০ গ্রাম সমপরিমাণে মিশিয়ে সেই মিশ্রণকে এক চামচ করে সকালে এবং রাত্রিতে খালি পেটে গরম জলের সঙ্গে অথবা গরম দুধের সঙ্গে খেতে হবে। দুধের সঙ্গে খাওয়া বেশি উপকারী। এটি অব্যর্থ ওষুধ।
. শিউলী পাতা ৫ টা তুলে নিয়ে ভালো করে শীলে থেঁতো করে ২ গ্লাস জলে মিশিয়ে সেদ্ধ করুন।জল যখন অর্ধেক হয়ে যাবে সেই সময় গ্যাস ওভেন বন্ধ করে সেটাকে নামিয়ে নিন। জল ১ গ্লাস হয়ে গেলে সেই জলকে ঠান্ডা করে ছেঁকে নিন এবং প্রতিদিন এভাবে ১ মাস পান করুন সকাল বেলায় খালি পেটে। প্রচুর উপকার পাবেন।
. দু টুকরো ছোট ছোট শুঁঠ (শুকনো আদা) নিয়ে তাকে কেটে ছোট ছোট করে নিন। এরপর গিলোয় এর ৩ ইঞ্চি কাণ্ডের একটি টুকরো নিয়ে তাকে ছোট ছোট করে কেটে এই শুকনো আদা এবং গিলোয় টুকরো গুলোকে ২ কাপ জলে ফুটিয়ে সেদ্ধ করে নিন। যদি গিলোয় টুকরো না পান অথবা শুঁঠ না পান তাহলে গিলোয় চূর্ণ ১ চামচ এবং শুঁঠ(শুকনো আদা) চূর্ণ ১/৪ চামচ নিয়ে ২ কাপ জলে ফুটিয়ে সেদ্ধ করুন।জল যখন ফুটে ৪ ভাগের ১ ভাগ হয়ে যাবে তখন সেটাকে নামিয়ে ছেঁকে নিন। এরপর ওই ক্বাথ টিতে গরম অবস্থায় ১ চামচ রেড়ীর তেল মিশিয়ে নিন। কিন্তু মনে রাখবেন ক্বাথ টিকে ফোটানোর সময় রেড়ীর তেল মেশাবেন না। ছেঁকে নিয়ে গরম অবস্থায় রেড়ীর তেল মেশাবেন।তারপর তেলকে ক্বাথ এর সঙ্গে ভালো করে চামচ দিয়ে মেশাবেন। রেড়ীর তেল বাত এবং অস্থিসন্ধির ব্যথার সবথেকে ভালো ওষুধ। এবার এটিকে সকালে খালি পেটে ৭-৮ দিন খান।তারপর আবারও ৫ দিন অন্তর একই ভাবে খেতে পারেন। যাদের পাতলা পায়খানা হয় তারা রেড়ীর তেল ব্যবহার করবেন না। রেড়ীর তেল ব্যবহার না করলে এই ক্বাথ টিকে ১০-১৫ দিন খেতে পারেন। পরে আবার ৫ দিন অন্তর ফের ব্যাবহার শুরু করতে পারেন। এই ক্বাথ টিকে সবসময় টাটকা তাজা এবং ফ্রেশ করে বানাতে হবে প্রতিদিন। আগে বানিয়ে রেখে দিলে চলবে না ।এই ক্বাথ প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে হবে।দেখবেন এতে অনেক উপকার পাবেন।
. দই এর সঙ্গে এক চিমটে খাওয়ার চুন মিশিয়ে প্রত্যেকদিন খান।
. ব্যথার স্থানে তিল এর তেল অথবা খুব পুরোনো ঘী দিয়ে মালিশ করুন।
. ৩০০ মি.লি দেশী গাই এর দুধকে গরম করে তার মধ্যে ১ চামচ কাঁচা হলুদ বাটা এবং এক চামচ দেশী ঘি কে মিশিয়ে দুটি গ্লাসে প্রায় ৫ মিনিট ধরে মিশিয়ে বা নাড়িয়ে সেই মিশ্রণকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আস্তে আস্তে করে খেতে হবে। মাঝে মাঝে মিশ্রণকে নাড়াতে হবে যাতে হলুদ গ্লাসের নিচে পড়ে না থাকে।এটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হবে বসে খেলে হবে না। আর সবসময় জল বসে বসে মুখের লালার সঙ্গে মিশিয়ে আস্তে আস্তে খেতে হবে।খুব উপকার পাবেন।
ডায়াবেটিস বা সুগার রোগের টোটকা চিকিৎসা
▪️ জাম বীজ, মেথি বীজ/মেথি দানা, নিমের ছাল গুঁড়ো করে সমান করে একসঙ্গে মিশিয়ে, প্রতিদিন ২ চামচ করে রোজ সকালে ও বিকালে খালি পেটে খেতে হবে।
▪️ সাদা নয়নতারা পাতা ২ টি, কাঁচা হলুদ ১ টুকরো, কাঁচা আমলকী ১ টি, নিমপাতা বেটে প্রতিদিন সকাল বেলায় খালি পেটে খেতে হবে।
▪️ এক গ্লাস জলে এক টুকরো পিয়াশাল কাঠের খন্ড রেখে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে জল হালকা লাল হয়ে গেলে সেটা খালি পেটে খান। সুগার কন্ট্রোলে থাকবে।
সর্দি কাশি, কফ ও সর্দিজ্বর এর টোটকা চিকিৎসা
▪️ বাসক পাতার রস বা তুলসী পাতার রস ৪-৫ চামচ নিয়ে অল্প গরম করে সামান্য মধু দিয়ে ৫-৭ দিন খেতে হবে।
▪️ বাসক পাতা ৬ টি ও তুলসী মঞ্জরী ৫ টি ২ গ্লাস জলে ফুটিয়ে নিতে হবে। জল ফুটে ১ গ্লাসে নামলে সেই ক্বাথ টিকে ছেঁকে নিয়ে ৪ চামচ মধু মিশিয়ে দিনে ২ বার করে ৫ দিন খেলে সর্দিকাশি কমে যাবে। এটি খুবই ভালো কাজ করে।
▪️ কাশীর জন্য বাসক পাতার রস অথবা ৬ টি বাসক পাতা সেদ্ধ জল মিছরি ও এক চিমটে গোলমরিচ গুঁড়ো এর সঙ্গে পান করলে সব ধরনের কাশি ভালো হয়।এটি অব্যর্থ ওষুধ।
▪️ তেজপাতা ৪ টি, ১ টুকরো আদা, আধ চামচ হলুদ গুঁড়ো, একটি ছোট দারুচিনি টুকরো, ৪ টি লঙ এগুলোকে ৪ কাপ জলে ফুটিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। জল যখন অর্ধেক হয়ে যাবে তখন সেটাকে নামিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এবার সেটা থেকে ৪ চামচ ক্বাথ তুলে নিয়ে একটি কাপে রেখে তার সঙ্গে(৪ চামচ ক্বাথ এর সঙ্গে) এর সঙ্গে আধ কাপ গরম জল মিশিয়ে তিন চামচ মধু মিশিয়ে খেতে হবে। বাকি ক্বাথ টিকে রেখে দিয়ে পরবর্তীকালে আরো ৪ চামচ নিয়ে আবারও আধ কাপ গরম জল মিশিয়ে ৩ চামচ মধু মিশিয়ে খেতে হবে ৩-৫ দিন ধরে। বাচ্চাদের জন্য ২ চামচ ক্বাথ নিলেই হবে। এটা করলে খুব উপকার পাবেন।
▪️ যদি কাশতে কাশতে মুখ লাল হয়ে যায় এবং কাশি থামার নাম না করে তখন এক টুকরো আদা কে আগুনের আঁচে উত্তপ্ত করে হালকা পুড়িয়ে সেই আদা খন্ডকে হলুদ গুঁড়ো এর প্রলেপ দিলে হলুদ গুঁড়ো ওই হালকা পুড়ানো আদা টুকরোর সঙ্গে চিটে যাবে। এরপর হলুদ গুঁড়ো লাগা আদা টুকরো টিকে মুখের ভিতরে নিয়ে একটু একটু করে জিভ দিয়ে চেটে ও চুষে খেতে হবে। চিবিয়ে খাওয়া চলবে না। এরকম ভাবে চুষতে থাকল ৫ মিনিটের মধ্যে প্রচন্ড কাশিও থেমে যাবে।
▪️ আদার রস,তুলসী পাতার রস এবং মধু মিলিয়ে এক চামচ সকালে, দুপুরে ও রাত্রে এই তিন বার ৫ দিন ধরে খেলে সর্দি কাশি কমে যাবে।
▪️ টনসিলাইটিস হলে আধ চামচ হলুদ এক গ্লাস দুধে গরম করে ফুটিয়ে অর্ধেক করে খেতে হবে সকাল ও রাত্রিতে।
▪️ শিউলী পাতার রস ২-৩ চা চামচ মাত্রায় অল্প গরম করে মধুর সঙ্গে বা আদার রসের সঙ্গে সকালে ও বিকেলে ৫-৬ দিন খাওয়াতে হবে। তাহলে সর্দিজ্বর ভালো হবে।
▪️ সর্দিজ্বর হলে বাসক পাতা ও ছাল পিষে জলে সেদ্ধ করে ক্বাথ করে দিনে ৩ বার করে খেলে জ্বর সেরে যায়।
▪️ যদি কোনো দীর্ঘস্থায়ী জ্বর কারো হয় যা কোনো ওষুধেই ঠিক হচ্ছে না তাহলে গিলয় বা গুলঞ্চ এর ৩ ইঞ্চির একটি কাণ্ড কে ছোট ছোট টুকরো করে থেঁতো করে ২ গ্লাস জলে ফুটিয়ে সেদ্ধ করে জল যখন ফুটে অর্ধেক হয়ে যাবে তখন সেটাকে ছেঁকে ঠান্ডা করে খেতে হবে দুবার করে ২-৩ দিন ধরে।অবশ্যই উপকার পাবেন। এটি একটি অব্যর্থ ওষুধ।
▪️ তুলসী পাতা ১৫-২০ টি শিলে পিষে তার সঙ্গে ৪ টি গোলমরিচ দিয়ে এক গ্লাস জলকে সেদ্ধ করে জল অর্ধেক হয়ে গেলে ক্বাথ কে ছেঁকে ঠান্ডা করে দিনে ২ বার ৩ দিন ধরে খাওয়ালে জ্বরে উপকার পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্রঃ - স্বদেশী চিকিৎসা - রাজীব দীক্ষিত।
নতুন দিনের
হায়দ্রাবাদ
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
ভ্রমণ
বিকেলে আলোর সাজে চারমিনার
ছবিগুলি বড় ফ্রেমে দেখতে ছবির ওপর ক্লিক করুন।
দুর্গম চেরুভুর ওপরে সেই কেবল ব্রিজ
স্ট্যাচু অফ ইকোয়ালিটি
হায়দ্রাবাদে হয়ত আপনাদের মধ্যে বেশিরভাগ পাঠকই একাধিকবার ঘুরে এসেছেন। সেই গোলকোন্ডা দুর্গ, সালার জং জাদুঘর, চারমিনার ইত্যাদির নাম আপনারা সবাই জানেন। যদি নাও গিয়ে থাকেন, বাংলার অজস্র ভ্রমণ পত্রিকায় এসবের নাম আপনারা সবাই শুনেছেন। কিন্তু এতেই তো আর হায়দ্রাবাদের পরিচয় শেষ হয় না। এটি হল ভারতের অন্যতম দ্রুতগতিতে উন্নতি করা শহর। ফলে সেই দুশো-পাঁচশো বছর আগের স্থাপত্য নিয়ে হায়দ্রাবাদ বসে নেই। এর চারপাশে গড়ে উঠছে নতুন দিনের ঝকঝকে মেট্রোপলিস। প্রায় বেঙ্গালুরুর সমান বা কিছু ক্ষেত্রে তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আই টি হাব হয়ে উঠেছে হায়দ্রাবাদ এবং তার হাইটেক সিটি। এসেছে অজস্র বিদেশি ব্র্যান্ড। আসুন দেখে নেওয়া যাক যে, আজকের দিনে হায়দ্রাবাদ গেলে আপনারা নতুন আর কি কি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন। সেই চারমিনার এবং তার চারপাশের প্রচণ্ড ঘিঞ্জি বাজার তো আছেই। কিন্তু শুধু ফিউডাল যুগে পড়ে থেকে লাভ কী? নতুন পৃথিবীর কথাও তো জানতে হবে। তাই না?
হায়দ্রাবাদ গেলে প্রথম যে জায়গাটি মন টানবে, সেটি হল এর বিমানবন্দর। ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বিমানবন্দর এখন হায়দ্রাবাদে। রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দেশি-বিদেশি নানা বিমানসংস্থার যাতায়াতে সবসময় ভিড়ে উপচে পড়ছে এই এয়ারপোর্ট। এর শপিং এরিয়াতে ঘুরে বেড়ালে মোটামুটি ভারতের সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডের দেখা পেয়ে যাবেন। বিদেশি তো আছেই। সুতরাং যদি আপনি কিছুক্ষণ এই বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেন, আপনার মনোরঞ্জনের অনেক উপকরণ রয়েছে এখানে। খাবারের দোকানের বৈচিত্র্য নজর কাড়ার মত। এবার আসুন, এয়ারপোর্ট ছেড়ে নতুন দিনের হায়দ্রাবাদে পা রাখা যাক। এখন যারা আধুনিক পর্যটক বা পেশাদার, তাদের কিন্তু ওই পুরনো একটা হাভেলি বা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখলে শুধু চলে না। তার সাথে চাই একটা এক্সপেরিএন্স। হায়দ্রাবাদ আপনাদের সেই নতুন এক্সপেরিএন্সের চাহিদা অনেকটাই পূরণ করতে পারবে।
হায়দ্রাবাদে প্রচুর নতুন শপিং মল হয়েছে। সময় কাটানোর জন্য এগুলি একদম আদর্শ। যেমন ইনঅরবিট মল বা জি ভি কে মল। নানা বিপণি তো রয়েছেই, তার সাথে রয়েছে দারুণ ফুড কোর্ট এবং সিনেমা হল। সুতরাং বিকেলটা ফ্রী থাকলে সময় কাটবে ভালোই। তবে দুটি বিশেষ মলের কথা এখানে বলা উচিত। এক নম্বর হল, আইকিয়া (Ikea)। পাঠকদের মধ্যে আপনারা যারা প্রবাসী বা প্রায়ই বিদেশ যান, তারা এই সুইডিশ ব্র্যান্ডের নাম জানেন। কিন্তু এদের শপিং মলে ঢোকা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ঘরের প্রয়োজনের যাবতীয় দ্রব্য এখানে আছে। আসবাবপত্র তো বটেই। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। সেরকম তো অনেক মলেই থাকে। কিন্তু এদের শপিং মলে ঢোকা মানে একটা অন্য জগতে চলে যাওয়া। প্রায় তিরিশটি সেকশান রয়েছে এদের মলে। এবং এত সুন্দর করে সাজানো সব দ্রব্য যে মনে হবে কিনি বা না কিনি, এখানে থাকলেও সেই হাই লাইফ-এর নির্যাস উপভোগ করতে পারব! এই মলে ঢোকার সময়ে লকারে নিজের হাতের ব্যাগ রেখে ঢুকতে হয়। সেই লকার আপনি নিজে পাসকোড দিয়ে লক করবেন আবার বেরোনোর সময়ে নিজেই জিনিস বার করে নেবেন। সুতরাং অনেক বেশি নিরাপদ। এছাড়া এই মলের দোতলায় রয়েছে একটি বিশাল রেস্তোরাঁ। সেখানে সুইডিশ খাবার, যেমন মিটবল (Meatball)পাওয়া যায়। সেটাও চেখে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয় যে শপিং মলের নাম জানা উচিত, সেটা হল লুলু (Lulu) মল। দুবাইয়ের এক ব্যবসায়ী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই মলের চেইন গড়ে তুলছেন। এই মলে এত রকম খাবার পাওয়া যায় যে সেই সেকশানে বাজার করাই একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। আপনারা যারা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রকম কারি পাউডার পছন্দ করেন রান্নায়, তারা এখানে সেইসব মশলা পাবেন। এছাড়া বিভিন্ন রকম শুকনো ফল, সেই সব ফলের লজেন্স, চীজ, আচার ইত্যাদি তো রয়েছেই। আছে রকমারি জ্যাম, যেমন প্যাশন ফলের জ্যাম, ক্র্যানবেরি জ্যাম ইত্যাদি। আরেকটি নতুন সেকশান হল আরবীয় মিষ্টি। এদের বলা হয় ব্যাক্লাভা মিষ্টি। দাম একটু বেশি বটেই। কিন্তু আপনি তো নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেই গেছেন। একবার ট্রাই করেই দেখুন।
এরপর হায়দ্রাবাদে যে খাবারের দোকানে আপনার যাওয়া উচিত, সেটা হল করাচি বেকারি। একটি ছোট দোকান থেকে শুরু করে এই বিস্কিটের দোকান এখন মহীরুহ। হায়দ্রাবাদ এবং তার বাইরেও অন্যান্য শহরে রয়েছে অনেক আউটলেট। আপনার যাতায়াতের পথে যেটা কাছে পড়বে, সেটাতেই ঢুঁ মারুন। আপনার চোখ টেনে নেবে নানারকম ফল দিয়ে তৈরি বিস্কিট বা কুকি। নানা রকম আকারের বাক্সে পাওয়া যায় এইসব অপূর্ব খাদ্য। এদের কয়েকটি বিখ্যাত প্রোডাক্ট হলঃ ওসমানিয়া বিস্কিট, চাঁদ বিস্কিট, ফিগ রোল ইত্যাদি। এছাড়া খেজুর দিয়ে বা পেস্তা দিয়ে তৈরি বিস্কিট তো রয়েছেই। এদের নিজেদের তৈরি কিছু বিশেষ চকলেটও এইসব দোকানে পাওয়া যায়। সুতরাং নিজের পকেট বুঝে আর স্বাদ বুঝে কেনাকাটা করুন।
হায়দ্রাবাদের রাস্তায় রাস্তায় আরও যে সব খাবারের দোকান রয়েছে, সেখানে মিষ্টির মধ্যে দুটি নতুন জিনিস ট্রাই করতে পারেনঃ তেলেঙ্গানার পিঠেঃ পুথরেকু আর পাউরুটি দিয়ে বানানো ডাবল কা মিঠা। ডাবল কা মিঠা মানে কলকাতার কিছু দোকানে যেটাকে বলা হয় শাহি টুকরা। পাউরুটি, ক্রীম ইত্যাদি দিয়ে তৈরি একটি স্বর্গীয় খাদ্য। এই খাবার প্লেটে পড়লে কিন্তু আপনি কিছুক্ষণের জন্য ক্যালোরির কথা ভুলেই যাবেন। এক হাতা খেলেই সেই বিকেলের মত পেট ভর্তি। পুথরেকু চালের পিঠে। সঙ্গের ছবি দেখলে বুঝতে পারবেন যে কিভাবে এটি বানানো হয়। একটি মাটির হাঁড়ি উপুড় করে, তার পেটের ভেতরে কাঠের আগুন জ্বেলে, হাঁড়ির ওপরে চাল-গোলা দিয়ে এই পিঠে তৈরি হয়। ভেতরে থাকে ঘি, বাদাম এবং ড্রাই ফলের গুঁড়ো।
কিন্তু হায়দ্রাবাদের খাবারের বর্ণনা এখনও শেষ হয়নি। আজকাল অনেক পর্যটক আছেন যারা ফুড ট্রেইলে যাওয়া পছন্দ করেন। অর্থাৎ, কোথাও বেড়াতে গিয়ে সেখানকার নানা খাবার টেস্ট করাতেই এদের আনন্দ। যদি আপনাদের পাঠকদের মধ্যে সেরকম কেউ থাকেন, তাহলে হায়দ্রাবাদের খাদ্য ভুবনের আরেকটি দিক তো দেখতেই হবে। না, আমি বিরিয়ানির কথা বলছি না। হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানি যে ভালো, সেটা সবাই জানেন। আর আপনি যদি কলকাতার লোক হন, তাহলে হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানির মধ্যে আপনি স্পেশাল কিছু খুঁজে পাবেন না। ওরকম বিরিয়ানি কলকাতাতেও অনেক আছে। কিন্তু নতুন হায়দ্রাবাদে বিরিয়ানি ছাড়াও একটি নতুন ক্রেজ এসেছেঃ আরবীয় খাবার! অনেক রেস্তোরাঁ হয়েছে যেখানে দারুণ সব আরবীয় খাবার সার্ভ করা হয়। একটা শহরে ঘুরতে গিয়ে সেই শহরের বিশেষ খাবার না খেলে আর লাভ কী? ট্রাই করুন আরবীয় মান্ডি। এই খাবারটি হল খেজুর, বাদাম ইত্যাদি দিয়ে রান্না করা ভাত, সাথে চিকেন বা মটন রোস্ট। এছাড়া সালান তো আছেই। ঠিক যেমন মান্ডি, সেরকম হায়দ্রাবাদের অনেক মিষ্টির দোকানে এখন পাওয়া যায় আরবীয় মিঠাইঃ বাক্লাভা। এর কথা আগেই বললাম। আরেকটি নতুন খাবার, যেটি হায়দ্রাবাদে গেলে উপভোগ করতে পারেন, সেটি হল পোলার বেয়ার আইসক্রিম। এই ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বিক্রি হয় মূলত সান্ডে (Sundae) হিসাবে। এদের ডেথ বাই চকলেট, টেন্ডার কোকোনাট, ম্যাঙ্গো বেরি ইত্যাদি ফ্লেভার ট্রাই করে দেখুন। হায়দ্রাবাদের অনেক আউটলেট রয়েছে। অনলাইনে দেখে নিলেই হবে।
এতক্ষণ পড়ে অনেক পাঠকই সন্দেহ করবেন যে, এই লেখক অত্যন্ত পেটুক। একটা ঝকঝকে আধুনিক শহরে গিয়ে খাবার ছাড়া আর কিছুই চোখে দেখতে পায়না। সুতরাং এবার হায়দ্রাবাদের নতুন দু-একটি আকর্ষণের কথা বলে শেষ করি। তেলেগু ভাষায় চেরুভু মানে সরোবর। সেরকম হাইটেক সিটির কাছে একটি সরোবর হল দুর্গম চেরুভু। তার ওপর এখন তৈরি হয়েছে একটা অপূর্ব কেবল ব্রীজ। অনেকেই হয়ত এই ব্রীজের ছবি নানা জায়গায় দেখেছেন। রাতের বেলা এই ব্রীজ আলো দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়। প্রচুর সিনেমার শুটিং হয় এখানে। সিনেমার শুটিং বলতে মনে পড়ে গেল, হায়দ্রাবাদ এলে রামোজি ফিল্ম সিটি একবার দেখে নেবেন। ফেসবুকে সেলফি দেওয়ার আদর্শ স্থান এই ফিল্ম সিটি।
দুর্গম চেরুভু ব্রীজের পাশেই রয়েছে ফ্লোটিং রেস্তোরাঁ, রয়েছে বোটিং, মিউজিক্যাল ঝর্ণা। সময় ভালোই কাটবে।
সম্প্রতি হায়দ্রাবাদে থাকা ওড়িয়া সমাজের চেষ্টায় শহরে স্থাপিত হয়েছে একটি অপূর্ব জগন্নাথ মন্দির। ২০২৩ সালে এই লেখক যখন গিয়েছিলেন, তখনও কিন্তু মন্দিরের কিছু অংশের কাজ চলছে। সুন্দর পাথরের কাজ দেখে ভালো লাগবে। ওড়িশা থেকে আনা লাল পাথর দিয়ে এই মন্দির নির্মাণ চলছে। বাঞ্জারা হিলসএর কাছেই এই মন্দির। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে রামায়ণ মহাভারতের নানা দৃশ্য রিলিফের কাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে একটি অপূর্ব পার্ক কাম অভয়ারণ্য। কে বি আর ন্যাশানাল পার্ক। যদি সময় পান, তাহলে এই পাহাড়ি জঙ্গলে একবার ঢুঁ মারতেই পারেন। ময়ূর সহ নানা বিরল পাখির দেখা পাবেন এখানে। যারা বার্ড ফটোগ্রাফি করেন, তাদের জন্য তো স্বর্গ এই পার্ক।
তবে মন্দিরের কথাই যখন উঠল, তখন শুধু জগন্নাথ মন্দির কেন, দেখে আসুন স্ট্যাচু অফ ইকোয়ালিটি। রামানুজ স্বামীর বিশাল মূর্তিঃ উচ্চতা ২১৬ ফুট। আর সেই মূর্তি ঘিরে ১০৮টি ছোট মন্দির। ২০২২ সালে এই কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করা হয়েছে; নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা!। এছাড়া বিশাল সেই মূর্তির নীচেই রয়েছে ১০০ কেজির বেশি সোনা দিয়ে তৈরি রামানুজ স্বামীর আরেকটি মূর্তি। মন্দির কমপ্লেক্স খুবই সুন্দর। মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি জমা রেখে ঢুকতে হয়। এই ১০৮টি মন্দিরে ঘুরতে ঘুরতে আপনি দেখতে পাবেন কোথাও পুজো হচ্ছে, তো কোথাও সংস্কৃত পাঠ চলছে। এই মন্দিরে রয়েছে ডিজিটাল বৈদিক লাইব্রেরি। মূল মন্দির কমপ্লেক্সের বাইরের দেওয়ালে খুব সুন্দর কিছু ভাস্কর্য রয়েছে। যেমন রথ, গজহস্তী, গরুড় ইত্যাদি। মন্দির থেকে বেরোনোর মুখে নানা খাবারের এবং হস্তশিল্পের দোকান রয়েছে। এখানে এই লেখক একটি বিশেষ খাবার দেখেছেনঃ মিলেট (Millet) আইসক্রিম। আপনারাও একবার চেখে দেখতে পারেন।
সবশেষে এটা বলাই যায় যে আজকের তরুণ পর্যটক যেরকম অভিজ্ঞতা চান, তার অনেক কিছুই নতুন দিনের হায়দ্রাবাদে রয়েছে। গুগল ম্যাপ সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন এখনই।
আরবীয় মান্ডি
তৈরি হচ্ছে পুথরেকু
জগন্নাথ মন্দিরের ভাস্কর্য
অনুগল্প
অপর্ণা চক্রবর্তী
টালিগঞ্জ, কলকাতা
প্রবন্ধ
চৌপাহাড়ি_ইতুন_আসড়া (একটি সাঁওতালি ভাষার পাঠশালা)
বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে সাঁওতালি শিশুদের পাঠশালা "ইতুন আসড়া"। কয়েকজন কাছের বন্ধু পাশে থেকেছে বলেই, "ইতুন আসড়া"-র পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হল নতুন সোয়েটার।
ইতুন আসড়া-র শুভানুধ্যায়ী বন্ধু অর্পিতা সেনের বিশেষ উদ্যোগে এবং সোনালী চক্রবর্তী, সোনালী সাহা, দেবলীনা সরকার, রুমেলী রায় এবং পার্থপ্রতীম সেনের বিশেষ সহযোগিতায় কাজটি সফল করা সম্ভব হয়েছে। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। চৌপাহাড়ি জঙ্গলের শীত বাতাসে কাঁপতে থাকা বাচ্চাদের জন্য, তোমাদের বাড়িয়ে দেওয়া উষ্ণ সহানুভূতি - আগামীদিনেও আমাদের চলার পথ মসৃণ করবে এই আশা রাখি।
ভালোবাসা বড় ছোঁয়াচে জিনিস। সহানুভূতিশীল হতে সেই ছোঁয়াচে উষ্ণতা-টুকুই যথেষ্ট। একটা ছোট্ট আবেদনের মধ্যে যে আবেগের উষ্ণতা ছিল, আমার কাছের বন্ধুরা নিশ্চয়ই তার আঁচ পেয়েছিল বলেই গত সপ্তাহে ৭ই জানুয়ারি '২৪ রবিবার, আমাদের পাঠশালার উঠোনে একসঙ্গে এত গুলো ফুলের হাঁসি মুখ দেখার সুযোগ পেয়েছি।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বন্ধুদের কাছে একটা ছোট্ট অনুরোধ করেছিলাম-- "আমাদের পাঠশালার কচিকাঁচা গুলোর জন্য তোরা একটা করে নতুন জামা দিবি... তোদের দেওয়া জামা পরে ওরা ওদের পরবের দিনটা আনন্দে কাটাক।" -- ব্যাস এটুকুই বলেছিলাম।
এরপর থেকে আর তেমন ভাবে কারও কাছে অনুরোধ করেছি, আবেদন জানিয়েছি এমন নয়। কিন্তু, অর্পিতা, পায়েল, সোনালী দি, সৌম্য দা, অভিজিৎ দা, দেবলীনা, অনুতোষ, রঞ্জিতা, রুমেলী দি, নীলাঞ্জনা দি, দীপান্বিতা, গৌতম, পার্থ, সৌমিত, জাতবেদা দি, প্রসেনজিৎ দা, সোনালী দত্ত, সোনালী পাল, তরুন, নীপা, ঋতব্রত, আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা, সবাই সব্বাই পাশে ছিলি/ছিলে বলেই আমাদের সাঁওতালি ভাষার পাঠশালা "ইতুন আসড়া"র বাচ্চা গুলো কে নিয়ে একটা আনন্দের দিন কাটলো।
সেদিন যারা এসেছিলে আর যারা আসতে পারলে না সবাইকে আবার আমন্ত্রণ জানালাম আমাদের পাঠশালায়।
অনুষ্ঠানের কিছু ছবি রইল। ছবি দেখে কিন্তু আনন্দের মাপকাঠি আন্দাজ করা সম্ভব নয়!
সবাইকে আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠানে আসতে হবে; আমাদের পাশে থাকতে হবে এভাবেই। সবার ভালোবাসায় এবং মিলিত উদ্যোগে আমাদের পাঠশালা একদিন ঠিক তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে...
#বাঁদনা_পরব_উদযাপন : প্রথম বর্ষ 'ভারতীয় সংস্কৃতি পরিষদ' - র একটি উদ্যোগ আমখই // চৌপাহাড়ি জঙ্গল // বীরভূম
------------------------
"ভালোবাসতে না জানলে
জীবনের ষোল আনাই ফাঁকি..."
অভাবের সংসারে রান্নার একটা আলাদা স্বাদ থাকে। অ্যালুমিনিয়ামের কানা উঁচু থালায় ভাই বোনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া সেই সব দিনের স্বাদ- ভবিষ্যত জীবনের পাথেয় বললে, আমার ক্ষেত্রে অন্তত কম কিছু বলা হয় না।
সামান্য কাঁচা কলা সেদ্ধ, বেগুন সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ- ভাজা শুকনো লঙ্কা দিয়ে চটকে চটকে মাখত আমার বাবা। গরম ভাতের পাশে সেই সব দলা পাকানো স্বাদ ছিল অমৃত সমান। কাঁচা কলার খোসা-টাও বাদ যেত না। মাছের ডিম পাওয়া গেলে অনেকটা পিঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা কুঁচি দিয়ে মেখে, পরিমাণ বাড়ানোর জন্য তাতে আরও কিছুটা বেসন বা আটা মিশিয়ে নেওয়া হতো। তারপর বড়া বানিয়ে আলু দিয়ে ঝোল হতো। নামানোর আগে ওপরে একটু শিলে বাটা গরম মশলার আদর মিশিয়ে দিত মা। ফুটন্ত ঝোলের গন্ধ নাকে এলেই, কানা উঁচু থালাটা আমাকে হাতছানি দিত। হাতল ভাঙা মগ, কলাই করা থালা, ঠাম্মির দেওয়া কাঁসি, পুরীর কলসি, টোল খাওয়া বড় বাটি- বাসনকোসনের অপ্রতুলতার কারণে কোনোটাই ফেলা হয়নি কোনোদিন। দুএকটা ভালোর সঙ্গে, ওরাও সবাই ঠোকাঠুকি করে সংসারে থেকে গেছে ভাঙাচোরা নাম নিয়ে।
মামার বাড়িতে দিদার রান্নার জায়গাটা ছিল বারান্দার এক কোণে। কালো হয়ে যাওয়া কাঁঠাল কাঠের তাকে দু একটা ভালো থালা বাসনের পাশে রাখা থাকতো ছোটো ছোটো কয়েকটা স্টিলের বাটি। বড়মামা রোজ স্নানের আগে সেই ছোট বাটিতে গরম তরকারি খাওয়ার আব্দার করতো দিদার কাছে। একটু ঝোল, একটুকরো আলু খাওয়ার জন্য মামাকে তার মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরতে দেখেছি। অভাবের সংসারে সেই ঝোলের স্বাদ ছিল একদম অন্যরকম। এতজনের খাবারের ভাগ থেকে আলাদা করে সন্তানের আব্দার মেটাতে পারলে মায়ের পরিতৃপ্তি বোধহয় অন্যরকমই হয়। ছোটবেলায় দেখা আমার দিদার চোখে মুখে সেই পরিতৃপ্তি আজও আমার কাছে অবিস্মরণীয়। বুড়ি রাগে গজগজ করতো। অথচ হাতায় করে সন্তানের বাড়িয়ে দেওয়া বাটিতে ঝোল তুলে দেওয়ার সময়, মূহুর্তে তার রাগ ভ্যানিশ হয়ে যেতে দেখেছি।
আমার বুড়ি দিদারও অভিযোগহীন একটা অভাবের সংসার ছিল। একদম ছোট্ট বেলায় সেই সংসারটাই ছিল আমার প্রথম শিক্ষার জায়গা। ওই বাড়িতে খাবারের থালায় অনেক কিছুর প্রাচুর্য না থাকলেও থালার পাশ ঘেঁষে সাজানো থাকতো আদর, প্রেম, যত্ন আর মায়া।
আমার ছোড়দির বাড়িতে ছিল পুরনো চীনামাটির ভারী ভারী প্লেট। অভাবের সংসারে অতিথি আপ্যায়নের জন্য তুলে রাখা ছোড়দির সম্পদ। ওই বাড়ির প্লেট গুলোর ওপর আমার আলাদাই আকর্ষণ ছিল। কোনোটা শিয়ালদহ মার্কেট থেকে, কোনোটা পুরনো নিউমার্কেট থেকে কেনা। ওখানে বেড়াতে গেলে আমি অতিথি না হয়েও, ঠিক অতিথির মতোই অনুভূতি পেয়ে এসেছি সব সময়। ভাঙা সানমাইকা ওঠা রঙচটা টেবিলে চিনামাটির প্লেটে কি খাচ্ছি- সেটার থেকেও বড় কথা হল চামচে ঠুংঠাং শব্দ তুলে খাচ্ছি। উত্তর কলকাতার কোন এক সরু গলি পেরিয়ে, অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠতে পারলেই ছোড়দির সংসার। সেই সংসারটাও আমার কাছে ম্যাজিক বাক্সর মতো ছিল। যখনই যেতাম কোনো না কোনো যাদুমন্ত্র সঙ্গে নিয়ে ফিরতাম। সেই হিংটিংছট গুলোই আমাকে সব রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে।
তখন সদ্য চাকরি পেয়েছি। খুবই কম মাইনে। প্রথম মাসের মাইনে পাইনি হাতে। সকালে একটা টিউশনির টাকায় পথ খরচ চলছে। মায়ের হাতে তৈরি রাতের খাবার, পুরনো পুরনো গন্ধ লেগে থাকা শিমুল তুলোর বালিশ, দিদার দেওয়া একটা রেডিও, বিছানার পাশে রাতের খোলা জানলার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরা। পেটে ছুঁচোর চিলচিৎকার উপেক্ষা করে, কলকাতার রাস্তায় একলা হেঁটে হেঁটে বাসস্টপ। বাসস্টপের পাশে এক চিলতে জায়গায় উনুন ধরিয়ে বুতরুর মা গুলাবী আঁচের ওপর লিট্টি সেঁকে। পাঁচ টাকায় দুটো। সঙ্গে রসুন ধনে পাতার চাটনি ফ্রী। একদিন পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিতে দুটোর জায়গায় তিনটে লিট্টি আর চাটনি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল - "বহুত দেরসে কুছু খায়া নেহি না? খাইলিও বিটিয়া..."
সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এই সব মমতাময়ীদের খপ্পরে পড়েছিলাম বলেই হয়তো, এ মায়া প্রপঞ্চ থেকে আমার আর নিস্তার পাওয়া হল না। ভালোবাসতে না পারলে, আমি ভালো থাকি কই!!
----------------------------------------------------
ছবিতে পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনো সেই চীনামাটির বাসনপত্র এখন আমার সম্পত্তি।
ইন্দ্রাশীষ আচার্য পরিচালিত "নীহারিকা" দেখলাম। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের "ভয়" উপন্যাস অবলম্বনে মূলত একটি মেয়ের গল্প যার শৈশব জীবন অত্যন্ত অ্যাবিউসিভ এবং অন্ধকারে কেটেছে। তবুও জীবনে সব কিছু হারিয়ে, সব শেষে সে বাঁচতে চেয়েছে ভালোবাসায়। এর বেশী বললে স্পয়লার হতে পারে, তাই এটুকুই থাক।
এডিটিং ভালো। তবে ছবির দৈর্ঘ্য কমাতে কিছু দৃশ্য বাদ দেওয়া হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে, সেই দৃশ্য পরিপ্রেক্ষিতে যেটুকু রাখা হয়েছে, ওটুকু অনাবশ্যক এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। ওটুকুও মূল ছবি থেকে বাদ দেওয়া যেত।
ধীরগতিতে চলা একটা ছবি, অনেকক্ষণ লংশট ধরে রাখার জন্য- শিমুলতলা-মধুপুর-দেওঘরের খুব সুন্দর চিত্রায়ণ দেখলাম, যা আমার ভালো লেগেছে।
সিনেমা শেষকরা বা শুরু করার কোনো তাড়াহুড়ো নেই ডিরেক্টরের। সমস্ত ছবির একটাই গতি এবং সেটা ধীর। একটি মেয়ে সব হারিয়েও প্রকৃতির সাথে, বৃষ্টির সাথে একাকার হয়ে ভালোবাসায় বেঁচে আছে।
শিলাজিৎ দা আমার ভীষণ প্রিয় একজন কাছের মানুষ। পর্দায় ওকে দেখতেই গিয়েছিলাম। শান্ত হয়ে ফিরেছি।
গোপনীয়েষু - ৭
=====================
"আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।"
=====================
হ্যালো, হ্যাঁ বেরিয়েছি।
••••••••
নানা, সাতসকালে অনেক গুলো কাজ সেরে, তারপর বেরোতে হল। দুপুরে বাইরে কিছু খেয়ে নেব, চিন্তা কোরো না।
••••••••
উফ্, এত বাজে বকতেও পারো তুমি, সত্যি!
নিজে খেয়ে বেরিয়েছো তো?
••••••••
হুঁ, আচ্ছা। হ্যাঁ, আসব তো। পরশু বিকেলে দেখা হচ্ছে।
••••••••
মনে আছে মশাই, মনে আছে।
••••••••
হুঁ, ওটাই পরে আসব।
••••••••
আচ্ছা তুমি কি বলোতো! নিজের জন্মদিনে আমাকে নতুন শাড়ি পরতে বলছো!
••••••••
আচ্ছা আচ্ছা, বুঝলাম। অফিসে বসে, লোকজন জানিয়ে আর প্রেমিক সাজতে হবে না। কাজ করো। রাখছি আমি। বিকেলে কথা হবে।
বেশ কিছুক্ষণ কথপোকথনের পর, ফোন রেখে আনমনে চেয়ে থাকি কাঁচের বাইরে শীত-রোদের দিকে। ট্যাক্সি গোলপার্ক ছাড়িয়ে ছুটছে। রিয়ার-ভিউ-মিরর থেকে মাঝেমধ্যেই আমার দিকে ঠিকরে আসছে ড্রাইভারের সন্দিগ্ধ নজর। আড়চোখে আমাকে লক্ষ্য করছে। পড়ে ফেলতে চেষ্টা করছে একজন প্রেমিকার মুখ, তার চোখের ভাষা। ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকে, ঠিক এইটাই আমি চাইছিলাম। চাইছিলাম - অচেনা ড্রাইভার আমাকে দেখুক। আমার কথা গুলো কান পেতে শুনুক।
আমি একজনকে অষ্টপ্রহর বুকের ভেতর আগলে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছি- অথচ পৃথিবীতে কেউ সেকথা জানতে পারছে না। এ যে কী ভীষণ দমবন্ধ করা আদর! আমি প্রতি মুহূর্তে পুড়ে যাচ্ছি তার আঁচে। একটা সময় আসে, যখন পুড়তে পুড়তে - আমি চিৎকার করতে চাই, জানাতে চাই আপনার কথা। আমি বোঝাতে চাই আপনার অস্তিত্ব। আপনি আছেন, সবসময় আছেন আমার সাথে। কেউ তো জানুক!!
অপরিচিত ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে আমার নিজেরই বানানো খেলায় আমি জিতে যেতে থাকি। তাকে বোঝাতে থাকি, কেউ আছে, আমার ফোনের ওপাশে কেউ একজন আছে...
কথোপকথন কখনও কখনও আরও দীর্ঘায়িত হয়। এক তরফা,একটানা,একা একাই। না, ফোনের ওপাশে কেউ নেই কবি। কেউ কখনও সঙ্গে থাকে না। কারণ- কথা শুরু করার আগেই মোবাইল এয়ারপ্লেন মোডে রেখে সব নেটওয়ার্ক - সমস্ত যোগাযোগ আমি বন্ধ করে দিই। তারপর একটা প্রাইভেট ট্যাক্সিতে উঠে, আপনার সাথে অলীক কথপোকথনে সওয়ার হয়ে, ভাসতে থাকি
কোলকাতায়। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে - আপনার সাথে আমার এমন কাল্পনিক ফোনালাপ। সাক্ষী থাকে অচেনা ট্যাক্সি ড্রাইভার। অদ্ভুত একটা খেলা না! অদ্ভুতই বটে! এমন অদ্ভুত কিছুই চেয়েছি আজীবন। গোলপার্ক, বালিগঞ্জ, কসবা, তিলজলা, বিধাননগর, বেলেঘাটা পার করে, ট্যাক্সি ঘুরে যায় ডানদিকে। সল্টলেকের কোনো একটা রাস্তায়। শান্ত নিরিবিলি পাড়ায়। দুএকটা প্রাইভেট অফিস, গাছপালা ঝুঁকে পড়া ছায়া ছায়া রাস্তা। এখানে ট্যাক্সি ছেড়ে দিই আমি। হাঁটতে থাকি নিজের ছায়ার পাশে। হাঁটতে থাকি একা। হাঁটতে থাকি এলোমেলো, সামনের দিকে। ইয়ারফোনে একটানা বাজতে থাকে আমার পছন্দের অদ্ভুত প্লে-লিস্ট-
"সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভক্ষণ হঠাৎ এলে তখনই পাব দেখা।"
দেখা পাব কিনা জানিনা। কাকে দেখতে চাই, তাও এখন আর বুঝতে পারি না। শুধু জানি 'পথ চাওয়াতেই আনন্দ'। হাঁটতে হাঁটতে- গান বদলে যায়।
"I walk a lonely road
The only one that I have ever known
Don't know where it goes
But it's only me, and I walk alone"
রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্ট আমার মতোই একা দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। ঠিক উল্টো দিকে একটা কাঠ বাদাম গাছ, বাদামী রঙের পাতায় আলতো আড়াল করে রেখেছে - সুন্দর বাড়িটার ঝুল বারান্দা-কে। ল্যাম্পপোস্টের সাথে বারান্দার সম্পর্কের কথা, শুধুমাত্র একজন প্রেমিক জানে। হয়তো সেই প্রেমিক এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচ একা এসে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। তারপর আঘাত লগ্নে ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের সাথে পা মিলিয়ে, হেঁটে যায় এই সরনী ধরে। ফাঁকা বারান্দা তখন আড়ালে চোখ মোছে ওই প্রেমিকের গায়ে ঠিকরে পড়া ল্যামপোস্টের আলোর জন্য।
আমার ইয়ারফোনে তখনও বাজছে -
"I walk this empty street
On the Boulevard of Broken Dreams
Where the city sleeps
And I'm the only one, and I walk alone"
আমাকেও হেঁটে যেতে হবে আরও কিছুটা। আরও কিছুটা এলোমেলো হাঁটা বাকি আমার। গানটা এক্ষুনি শেষ হবে। আমি জানি আমার এই অদ্ভুত প্লে-লিস্টে এরপর কি গান বাজবে। সেই গানটা শুরু হবার আগে আমাকে পৌঁছে যেতে হবে খানিকটা দূরে, ওই করঞ্জা গাছের আলোছায়ার নীচে।
স্মৃতির শাল গায়ে, মুহূর্তের মাফলার জড়িয়ে, বেদনার বলিরেখা নিয়ে- ওখানেই বসে আছে শীতকাল। বিষন্ন, একা, পাতা ঝরা- একটা শীতকাল। অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার একার আস্ত একটা শীতকাল পেয়ে যাব ওখানে পৌঁছলেই। ঠিক ওই করঞ্জা গাছটার নীচে।
ইয়ারফোনে পরের গানটা শুরু হওয়ার আগে আমাকে পৌঁছে যেতে হবে ওর কাছে। তারপর, ওর পাশে বসে শুনবো - অমোঘ অত্যাশ্চর্য কটা লাইন---
"না চাহিতে মোরে যা করেছ দান-
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহা দানেরই যোগ্য ক'রে"
ভাগ্যিস আমি বঞ্চিত। সেই জন্যই এই ব্যথার অনুরণনটুকু সম্বল করে হাঁটতে শিখেছি-- বিষন্ন শীতকালের দিকে। ওকে পেয়ে গেলেই, আপনার কথা বলার জন্য প্রতিবার আর কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভারের প্রয়োজন হবে না।
শীতের একটা নিজস্ব বিষাদ থাকে, অথবা বিষাদের একটা একান্ত শীতকাল।
আপনি বুঝতে পারেন তো কবি?
তবুও যদি শিক্ষা হয়
আমার মতো আপনিও কি প্রথম আলাপেই সবাইকে বন্ধু ভেবে নেন? মানুষকে চট্ করে বিশ্বাস করার বদ অভ্যাস আছে, তাইনা? সবার সঙ্গেই অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করেন এবং ভেবে নেন আপনিও একই ব্যবহার ফেরত পাবেন।
আপনিও নিশ্চই ধরতেই পারেন না আপনাকে নিয়ে কখন খেলা করা হলো অথবা অন্যের স্বার্থে ঠিক কখন ব্যবহৃত হলেন? আঘাত পাওয়ার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারলেন না - ওটা চক্রান্ত ছিল। আঘাত পেয়েও প্রত্যাঘাত করতে পারেন না, তাইতো?
কোনো কাজের ক্ষেত্রে- 'না' বলতে কি খুবই অসুবিধা হয় আপনার? খারাপ ব্যবহার বুঝতে পারছেন, বুকের ভেতর প্রতিবাদের ঝড় চলছে, অথচ- নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গেলেই, সবকিছু গুলিয়ে গিয়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছে আপনার?
নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া খারাপ ইতিহাস, আপনার প্রিয় জনের সঙ্গে যাতে না ঘটে- সে দিকে যথেষ্ট সচেতন থাকেন নিশ্চই? সবার সব সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনেন, তাইতো? সমাধান করার চেষ্টাও করেন।
কিন্তু, নিজেরটা!?! আপনার নিজের কথা- বাথরুমের দেওয়াল ছাড়া কেউ আর জানেই না বোধহয়। একলা কাঁদেন। একলাই বোঝান নিজেকে। একসময় একলাই শান্ত হয়ে যান। নিজের বোকামি বুঝতে পেরে দোষারোপও করেন নিজেকেই, তাইতো?
যে মানুষ কখনও আপনার জন্য এগিয়ে আসবে না, তাকেই তীব্র ভাবে ভালোবেসেছেন কি? থামতে পারেননি। ভালো বাসতে বাসতে মরে যাচ্ছেন, তবুও অপেক্ষা করছেন, আর বিশ্বাস রাখছেন- 'একদিন সে বুঝবেই'...
কি তাইতো? ঠিক বলছি? মিলে যাচ্ছে নাকি অনেকটাই?
তাহলে শুনুন - "সবাই একদিন বুঝবে" এই কনসেপ্ট-টাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
কারণ - অপেক্ষা মোমবাতির সলতের মতো। মোমের সঙ্গে জ্বলতে জ্বলতে, সম্পূর্ণ ফুরিয়ে যাওয়া ছাড়া যেমন- সলতের কাছে আর কোন উপায় থাকে না; আপনার আত্মার সঙ্গে আপনার অপেক্ষাও ক্ষয়ে ক্ষয়ে এক সময় সম্পূর্ণ ফুরিয়ে যাবে, তবুও -"সবাই একদিন বুঝবে" - আপনার এই স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে না।
তার থেকে নিজেকে এতটাই স্বাবলম্বী করে তুলুন, যাতে- শাবাশী-র জন্য আপনাকে অন্যের অপেক্ষা না করতে হয়। কারণ আপনার অতিরিক্ত সহানুভূতিশীল মন, ভালো মানুষি, মানবিকতা বোধ, অন্যের কাছে আপনার মূর্খামির পরিচয়।
নিজেকে সহজলভ্য করার আগে সামলে নিন। গুছিয়ে রাখুন, আগলে রাখুন সমস্ত মূল্যবান আবেগ। একলা নিজের পাশে বসে বলতে শিখুন- "ও জীবন তোমার সাথে, কাটাব রূপকথা-তে"
নিজের হাতটাকে নিজেরই পিঠ চাপড়ানো জন্য যথেষ্ট লম্বা ভাবতে ক্ষতি কী!
------------------------
শেষ কবে এত অলিগলি ঘুরেছি, এতটা রাস্তা হেঁটেছি মনে পড়ছে না। বিশেষ কাজে শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল - বোধহয় অনেক দিন থেকে আমার শহর আমারই অপেক্ষায় ছিল। কতদিন পর দেখা হল দুজনের। বুড়ো হতে চলেছি, অথচ এখনও ভালো করে চিনিনা সব রাস্তাঘাট! তবুও যেন মনে হয় - এই শহরের অলিগলি পাকস্থলী যতই জটিল হোক আমি এখানে হারিয়ে যাব না কখনও। আমি না চিনলেও, কলকাতার সব রাস্তাই আমাকে চেনে।
কলকাতা আমার চোখে কখনও চনমনে, কখনও দৃপ্ত, কখনও মেজাজি, কখনও শেষ হয়ে আসা বিকেলের মতো- বিষন্ন। যে সব পুরনো বাড়ি গুলো এখনও বেঁচে আছে - আমার কলকাতা সেইখানে থাকে। প্রিন্টেড পুরনো চাদর কেটে জানলার পর্দা বানায়, জাফরী বসানো ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে হেমন্তের রোদ পোহায়। এখনও যে সব বাড়িতে সবুজ খড়খড়ি দেওয়া জানলা আছে, কলকাতা বুঝিবা সেই জানলা গুলো প্রতিদিন বন্ধ করে, খোলে- আবার বন্ধ করে...
মাঝে মাঝে ভাবি, এভাবে জাপটে ধরার মতো একটা শহরে আছি বলেই- দারুন ভাবে বেঁচে আছি।
--------------------
চরম ফ্যান্টাসি থেকে ঘোর বাস্তবের দিকে যাওয়ার মাঝখানে একটা গ্র্যাডিয়েন্ট থাকে। সেই ফেড-আউট হয়ে যাওয়া স্বপ্ন আর ফেড-ইন্ হয়ে স্বল্প ধীরে চোখের সামনে উন্মোচিত বাস্তবের মাঝখানে পড়ে থাকা সময়টাকে- হেমন্ত ঋতুর মতো, আমরা অনুভব করতে ভুলে যাই।
শরতের উৎসব আড়ম্বর শেষ করে, শীতের ঘরে প্রবেশের সদর দরজার নাম হেমন্ত। আউশ-আমনের গন্ধে মাতাল হেমন্ত। নবান্নের আয়োজনে মুখরিত হেমন্ত। শালবনে পাতা ঝরার শব্দের নাম হেমন্ত। ভোরের শিশিরে হীরের ঝলকের নাম হেমন্ত।
অথচ, ঋতু-টা কখন আসে, কখন যায় কিছুই বুঝি না। কিছু মানুষও বোধহয় হেমন্তের মতো হয়। বুঝতে পারার আগেই মিলিয়ে যায়। ধরতে চাওয়ার আগেই হুঁশিয়ার হয়ে যায়, ধরা দেয় না।
সেই সব অধরা মানুষকে কেন্দ্র করে, অপূর্ণ হেমন্ত ঋতুর মতোই , স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে আমরাও ফেলে আসি আমাদের কিছু ইচ্ছে-গুঁড়ো।
হয়তো নতুন করে কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হবার ইচ্ছে, অথবা- সব ছেড়ে আগলহীন বেড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে। কারো জন্য ভাতের থালা আগলে বসে থাকার ইচ্ছে, কারও উঠোনে ভেজা পায়ের ছাপ ফেলার ইচ্ছে, অথবা- নিজের মতো করে আরেকবার বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছে। অচেনা স্টেশনে নেমে পড়ার ইচ্ছে বা প্রকৃতির সঙ্গে বিলীন হওয়ার ইচ্ছে।
কিন্তু, মেঘ রোদ্দুর নিয়ে চু-কিতকিত খেলতে খেলতেই ফুরিয়ে আসে জীবন। আর জীবন ফুরিয়ে আসার আগেই একটু একটু করে ফুরিয়ে যেতে থাকি আমরাও। তখন সবকটা ইচ্ছে-গুঁড়ো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কখন যে সময় আর অসময়ে মধ্যে মিলিয়ে যায়, হিসেবই রাখা হয় না।
জীবনের যে দৃশ্যগুলোর উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, কেবলমাত্র দূরে দাঁড়িয়ে থেকে অনুভব করা যায়, শুধু সেগুলো পর পর সাজিয়ে নিলেই আমাদের প্রত্যেকের জীবন নিয়ে এক একটা অন্য মাত্রার সিনেমা বানিয়ে ফেলা যায় বোধহয়। কিন্তু, আমাদের ক্রয়সর্বস্ব নাগরিক জীবনে - গভীর আবেগ, অনুভূতি হেমন্তের মতোই অধরা থেকে যায়।
তবে, জীবনের কাছে প্রার্থনা- যে স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেল, তার জন্য দীর্ঘশ্বাস আমাদের যেন ব্যাকুল না করে। যারা হারাবার ভয় করে না কোন কিছুতেই, একমাত্র তারাই ভালোবেসে সব হারাতে জানে। আমরা যেন কখনও সব হারিয়ে ফেলার মতো ভালবাসতে ভুলে না যাই।
কোনো কোনো জ্বর ভালো
জ্বর এলে যত আদ্যিকালের স্মৃতি চোখের পাতায় জড়ো হয়। আজ ভীষণ চোখ জ্বালা করছে। ঘোরের মধ্যে চাদরের নীচে ঠান্ডা পায়ের পাতায় কখনও বাবা কখনও মায়ের স্পর্শের স্মৃতি গাঢ় হচ্ছে। মাথা তোলার শক্তি আজ নেই। শুকিয়ে যাওয়া গলার ভিতর তেতো স্বাদের জল কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে। অনর্থক একগাদা দুঃখের কথা মনে পড়ে, কান্না পাচ্ছে অকারণে। ঠিক তখনই, একটা স্যাঁতস্যাঁতে জল জল হাত আমার গা ছুঁয়ে দেয়। কপাল, পিঠ, হাতের তালু, পায়ের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মায়া বুলিয়ে দিতে থাকে। আমার আপত্তি শোনে না।
আমি বলি - "থামো দিদি, আমি ঠিক আছি"।
কথা শোনার লোক সে নয়। আমাকে ধমকে বলে - "শুয়ে থাকার লোক তুমি নয়। ভালো আছ তো শুয়ে আছ কেন? গরম জল করেছি গা ধোবে চলো।"
গা সে নিজেই মুছিয়ে দিল। কোনো আপত্তি শুনলো না। তারপর গরম রুটি, ঝালঝাল আলুভাজা। ঠিক যেমন আমি খেতে ভালোবাসি, তেমনটা সামনে এনে রাখল।
মা-বাবার যত্ন অনেক পেয়েছি। এখন তাঁদের যত্ন করে রাখার সময় এসেছে। কিন্তু, আমার শরীর খারাপ হলে একটা স্পর্শ দরকার হয় আজও। স্নেহের, যত্নের, মমতার স্পর্শ।
বিয়ের পর পর আমার গলস্টোন অপারেশন হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে , শ্বাশুড়ি মা সেলাইয়ের জায়গায় প্লাস্টিক জড়িয়ে ঠান্ডা জলে সারা গা জলজল করে মুছিয়ে, মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। তীব্র গরমে সেদিন সেই আরামের স্পর্শ আমি ভুলতে পারি না এখনও।
আর ভুলতে পারিনি আনমনে বুড়ির বিড়বিড় করে বলা দুচারটে কথা - "পরের মেয়ে - অযত্ন না হয়, গুরুদেব..." পরবর্তী সময়ে সংসারের শত সমস্যা, বাকবিতন্ডা সত্ত্বেও তাঁর আপন মনে উচ্চারণ করা ওই শব্দ গুলোর জন্য, আমি তাঁর ওপর কোনো ক্ষোভ রাখতে পারিনি।
যারা দুঃসময়ে এভাবে পরের মেয়েদের যত্ন করতে জানে, তাদের মায়ার স্পর্শ পেয়েছি বলেই হয়তো - কাছের দূরের কারও প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই।
প্রবন্ধ
শান্তিনিকেতনে
হট্টগোল
সঞ্জীব চক্রবর্ত্তী
কোলকাতা
প্রথম দিন
বাচ্চু মাসির ঘন ঘন তাগাদা – 'ওরে সন্তু খুব তালেবর হয়েছিস না? এই নিয়ে দু’দিন ফোন করলাম জয়ন্তীকে। তোরা নাকি ওদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিস? কিন্তু শুনলাম আজও ওকে কিছু জানাস নি!'
আরো গালাগাল থেকে বাঁচতে সোমবার অফিস থেকে ফিরে তানিয়ার সঙ্গে কথা বলেই ফোন করলাম বাচ্চু মাসির বন্ধু দক্ষিণ কোলকাতার জয়ন্তীদিকে। যথারীতি ফোন বেজে যেতে – ধরলাম জয়’দাকে। শুনলাম দিদি সোমবার সন্ধ্যেবেলা গানের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে, মুঠো ফোন কোথায় পড়ে আছে খেয়াল নেই। জয়’দা আমাদের প্ল্যানের ব্যাপারে অন্ধকারে ছিল – বললো –
“আরে - চলে এস, চলে এস – এই সুযোগে আমিও তোমাদের সঙ্গে ঘুরে আসব।“
পরের শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা আমরা হাজির হলাম জয়ন্তীদির ফ্ল্যাটে - শান্তিনিকেতন যাত্রার প্ল্যান ফাইনালাইজড করতে। ফিস ফ্রাই সহযোগে কথাবার্তা শুরু হতে না হতেই দেবনাথদা ওরফে দেব’দার ফোন।
“শুনলাম এই ভরসন্ধ্যায় সাউথ কোলকাতার দিকে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ ব্রাদার? নতুন প্রেমিকা টেমিকা জুটিয়ে ফেলেছ নাকি হে? তানিয়াকে বলে দেব না কি?” কি ভাবে খবর পেল – কে জানে বাবা!
“কি আজেবাজে বলছেন! তানিয়া এখানেই আছে।” অপর দিকে দেব’দার খিক খিক হাসি শুনে গা জ্বলে গেল। তানিয়া বলে –
“নিশ্চয় দেব’দাটা আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে। ফোনটা স্পিকারে রাখ তো।“
“কয়েকটা দিন অফিস ডুব দাও না ব্রাদার – একটু বোলপুর ঘুরে আসা যাবে – আমার শালির ভাসুরের নাতনীর বিয়ে – তোমাদের ফুলু বউদি বায়না ধরেছে শান্তিনিকেতনের কাঁথা স্টিচ শাড়ি চাই। হাঁটুর ব্যথায় যেতে পারছে না। তোমার তো বউ টউ এর বালাই নেই, তানিয়াকেও ঝুলিয়ে রেখেছ – হেঁ হেঁ হেঁ .... আমার ঝামেলা কি করে বুঝবে ব্রাদার।“
“দেখুন মশাই – বকবকানি থামান তো – এখন প্ল্যান করছি জয়ন্তীদির শান্তিনিকেতনের বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসার। আপনিও আমাদের সঙ্গে ঝুলে পড়ুন ---“ জয়ন্তীদি তখন ফোনটা কেড়ে নিয়ে দেব’দাকে তাঁর বাড়িতে সাদর আমন্ত্রণ আর ভালো কাঁথা স্টিচ শাড়ি যোগাড়ের আশ্বাস দিতে, দেবদা – থ্যাঙ্কিউ ম্যাডাম, থ্যাঙ্কিউ ম্যাডাম বলতে বলতে ফোন ছাড়লেন।
এখানে চুপি চুপি বলে রাখি দেব’দা কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের বড় দরের অফিসার। কোথায় যে কখন থাকেন বোঝা ভার। দিল্লিতেই থাকেন কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যান। ভদ্রলোকের অদ্ভুত ধরনের কথা ও হাবেভাবে বোঝা যায় না উনি কি ভাবছেন। কিন্তু সাধারণ চেহারার মানুষটির কথায় ও চোখে মাঝে মাঝে যখন ঝলকে ওঠে বুদ্ধির দীপ্তি, তখন আপনা থেকে মনে সম্ভ্রম জাগায় - তবে কাজের স্বার্থে আম জনতার মাঝে তিনি সাধারণ ভাবে মিশে থাকা পছন্দ করেন।
দ্বিতীয় দিন
যাওয়ার দিন সকালে আকাশের মুখ ভার – বৃষ্টির সংকেত। জয়’দা গাড়ি চালাচ্ছে পাশে দেব’দা – বেশ আলাপ জমে গেছে। মাঝের সিটে আমরা। পিছনে গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে জয়ন্তীদির কেনা রাজ্যের বাজারের ফাঁকে ড্রাইভার ভজহরি জড়োসড়ো হয়ে বসে।
ঝিরি ঝিরি ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি - ডানকুনি পেরিয়ে হু হু করে হাওয়া গাড়ি ছুটছে বাতাসের বেগে – দেব’দার রাজ্যের কৌতূহলের নিরসন করছে জয়’দা। আমাদের পীড়াপীড়িতে গান ধরল জয়ন্তীদি – দেব’দা প্রবল বেগে মাথা নেড়ে – হুঁ হুঁ আর বেতালা তালির সঙ্গতে বিরক্ত তানিয়ার কয়েকবার দাবড়ানির পরোয়া না করে – মুচকি হাসিতে জবাব দিলেন –
“সন্তুর সাথে মিশে মিশে -- তোমারও রস জ্ঞান গ্যাছে না কি সিস্টার?” কনুইয়ের গুঁতোয় তানিয়াকে চুপ করাই।
শক্তিগড় এলে জয়’দা বললো – “কচুরি চলবে তো?” দেব’দা খুশিতে ডগমগ –
“খুব চলবে, খুব চলবে। কচুরি আর ছোলার ডাল – আহা হা- পরে ল্যাংচা!”
অজয় নদের ব্রিজ পেরবার সময় হঠাৎ দেব’দার প্রশ্ন – “আচ্ছা জয়’দা কাগজে পড়লাম কয়েকদিন আগে অজয়ের চরে একটা লাশ পাওয়া গেছে – কোন পরিচয়পত্র নেই, কোথাকার লোক পুলিশ খোঁজ পায় নি – এরকম কিছু শুনেছেন না কি দাদা?” ধমকে উঠলাম –
“আপনার এত মাথা ব্যথা কিসের বলুন তো? পুলিশ নিশ্চয় ধরবে।”
“বারে! এমন ফস ফস করে এখানে খুন হয়ে যাচ্ছে আর ওই দেখুন নদীর চরে মানুষ ঘুরছে, কোন হেলদোল নেই! সাহস আছে বটে।“ জয়’দার একটু ভ্যাবাচাকা উত্তর –
“হতে পারে – আমার কানে তো আসে নি।”
ইলামবাজার ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে দু’পাশের শাল বনের মাঝ দিয়ে শান্তিনিকেতনের দিকে। দেব’দা নিজের মনে গুন গুন করে চলেছেন। মাঝে উইলস ফ্লেক সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান দিতে দিতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
হঠাৎ রাস্তার বাঁ দিকে ধুধু মাঠের দিকে চোখ পড়তেই আবেগ ভরা হেঁড়ে গলায় আরম্ভ করলেন –
‘ ধু ধু করে যে দিকে পানে চাই
কোনখানে জনমানব নাই
আমি চলেছি পাল্কিতে মা চড়ে ---
এমন সময় হারে রে রে ----’
আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না - খিঁচিয়ে উঠি –
“যেটা জানেন না – তবু সেটা বলতেই হবে?'
“কেন! রবি ঠাকুরের কবিতা বলেছি – এই ধু ধু তেপান্তরের মাঠটা দেখেই বোধহয় লিখেছিলেন – তাই না তানিয়া?”
তানিয়ার গলায় হতাশার সুর – “আরে পালকিতে ছিলেন মা– খোকা নয়।”
“ওই একটু ভুল হয়ে গেছে সিস্টার। এই জন্য তো আপনাদের সঙ্গে থাকি। সেই যে কে বলেছিলেন না – ‘জ্ঞানী গুণীদের ছোঁয়ায় সাধারণ লোকও কত কিছু শিখে ফেলতে পারে।”
“বা বা! একবার চিন্তা করুন - সন্তু ভাই খোলা তলোয়ার হাতে সাদা ঘোড়ায় চড়ে পালকির পাশে পাশে চলেছে– আঁধার ঘনিয়ে এসেছে – এমন সময় মশাল হাতে দস্যুর দল সন্তু ব্রাদারকে তাড়া করেছে – উরি বাবা! উফ: কি রোমাঞ্চ – দেখুন, ভেবেই হাতের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে।” হো হো করে হেসে ওঠে সবাই। তানিয়াকে ও হাসতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না --
“ন্যাকামো দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়, সব জানে – ইচ্ছে করে উল্টোপাল্টা বলবে। আর খোকা রাঙা ঘোড়ায় ছিল। আমাকে খোঁচা মারছেন তো! ঠিক আছে – পরেরবার আমার ফ্ল্যাটে এসে ডিমের ডালনা ফরমাশ করলে – দেখিয়ে দেব।” রেগে যাই আমি।
“কি যে বলো ব্রাদার – আমায় এত ভালোবাসো – এক দিকে তোমার হাতের ডিমের ডালনা আর অন্য দিকে ভীমনাগের চম্চম্ – আমি তোমার হাতের ডিমের ডালনাটাই বেছে নেব সন্তু ভাই।” দেব’ দা আমায় সান্ত্বনা দেন।
শনিবারের হাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জয়ন্তীদি বলে –
“কাল তোমাদের এখানে নিয়ে আসবো- এখন শুধু শনিবার নয় সারা সপ্তা হাট বসে। আপনাকে পিঠে, পাটি সাপ্টা খাওয়াব দেবনাথবাবু।”
“উরি বা বা! পাটি সাপ্টা? সেই দিদিমা চলে যাওয়ার পর খাওয়া হয় নি।“ গলাটা যেন ধরে আসে দেব’ দার।
এবার পৌঁছে গেলাম জয়ন্তীদির প্রান্তিকের ছোট্ট বাড়িটায়। পোড়া লাল রঙা টালির চালের দো’তলা বন বাংলোটা চারপাশের ঘন সবুজের মাঝে যেন ভাসছে। দেব’দা বলে ওঠেন – “আরে এত একটা ‘চ্যালেট’! আমার ফোড়ন –
‘চ্যালেট নয় দেব’ দা‘ ফ্রান্সে এই ধাঁচের কটেজ কে বলে ‘শ্যাঁলে’।“
“কি বললেন‘ শেঁয়াল?”
“উফ! এই লোকটা কে নিয়ে পারা গেল না।“
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কেয়ার টেকার – রবি আর জবা। চটজলদি গাড়ি থেকে সব মাল নামিয়ে গুছিয়ে তুলে দিল বাড়িতে। জবা জানিয়ে দিল আজ দুপুরের খাওয়ার ফর্দ – ভাত, ডাল, ডিমের ডালনা আর আলু-সানা। জয়ন্তীদি জানাল জবা দুপুরে খাওয়া তৈরি রেখেছে, রাতেরটা তিনি করবেন।
দেব’দা সোজা বাড়ির লনে চলে গিয়ে সাঁতারের ভঙ্গিমায় এক পাক ঘুরে বলেন – “ওই আলু সানাটা কি বস্তু?” জয়ন্তীদি জানালো -
"আলু ভাতে কে সাঁওতালরা বলে আলু-সানা।”
খাওয়ার টেবিলে সমানে চললো দেব’ দার বকবকানি – থামাতে পারি না, আবার হেঁ হেঁ হেসে বলেন – “ফুলু বলে আমি নাকি ভীষণ বকবক করি – আপনারা স্যার বোর হলে থামিয়ে দেবেন।” এর মধ্যে ওনার ফোন বেজে ওঠাতে, লাফিয়ে উঠে, ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেন –
“এই রে ফুলুর ফোন – হ্যালো হ্যালো – ফুলু? একটু জোরে বল – এখন আছি কাঁথা স্টিচের দোকানে – তোমার জন্য শাড়ি পছন্দ করছি, হ্যাঁ হ্যাঁ– ঠিকভাবে পৌঁছেছি? এনারা এত যত্ন করছেন, কি বলবো – এ্যাঁ – শাড়ি দুটো নিতে হবে- আর রঙ? অ! ঠিক আছে – আমার পেটের অবস্থা? আরে বাবা – তোমার জেঠুর হোমিও ওষুধের দুটো গুলি খেয়ে নিয়েছি – এখন লোহা চিবলেও হজম- কি বললে? এ্যাঁ – এ্যাঁ - কি বলছ? আরে এখানে নেট ওয়ার্ক ঠিক নেই, শুনতে পাচ্ছি না, পরে ফোন করব।“
চিড়বিড়িয়ে উঠি – “ডাঁহা গুল মেরে গেলেন?”
“কি যে বল ব্রাদার – একে বারে গোঁফে কাঁঠাল গাছে তেল। বিয়ে করুন বুঝবেন।”
“কথাটার মানে কি হল ? প্রবচন ও ঠিক ঠাক বলতে পারেন না।“
মুচকি হেঁসে বলেন “ওই হলো আর কি? তা এবার সব শিখে নেব ব্রাদার”
লাঞ্চের পর আবার আড্ডা চললো –
দেব’ দা একটা উইলস ফ্লেক ধরিয়ে ভস ভসিয়ে টানতে লাগলেন। মুখ চোখের চেহারা যেন পাল্টে গেল – মনে হল গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছেন। হঠাৎই হালকা চালে বলেন
“জয়’দা? দেখুন কি সুন্দর মেঘলা আকাশ – ব্যাং ট্যাং এর ডাক শুনছি না, আপনাদের এখানে ব্যাং নেই?”
জয়ন্তীদি, জয়’দা হেসে কুল পাচ্ছে না। হঠাৎ সিগারেট মেজেতে ফেলে –
“তিনটে বেজে গেল, আপনারা রেস্ট নিন, আমি ঝপ করে একটু ঘুরে আসি – এখানে টোটো পাওয়া যাবে স্যার?” আমি উঠে পোড়া সিগারেটটা তুলে পাশে রাখা এ্যাস্ট্রেতে রাখলাম।
“আরে আপনি তো এখানকার রাস্তা ঘাট চেনেন না!” জয়দার চিন্তিত স্বর।
“না না চিন্তা নেই – একবার ইউনিভার্সিটিতে একজনের সঙ্গে দেখা করে চলে আসব। সন্তু ব্রাদারের এক পেট খেয়ে ঘুমনো অভ্যাস। তাই একাই একটু ঘুরে আসি? চিন্তা করবেন না স্যার।”
“তা হলে – আপনি রবির টোটো করে যান – ও ঠিকঠাক দেখিয়ে নিয়ে যাবে।“ জয়দা রবিকে ডেকে – বুঝিয়ে দিলেন।
থ্যাঙ্কউ স্যার, থ্যাঙ্কউ স্যার বলতে বলতে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দেব’দা বেরিয়ে পড়লেন।
“শুনলি কি বলল? আমি না কি এক পেট খেয়ে ঘুমই! মহা ঘুঘু - আমি ১০০ পার্শেন্ট নিশ্চিত এখানে কোনো কাজে নিয়ে এসেছে – ওই শাড়িটাড়ি সব গুল ধাপ্পা –” তানিয়া বলে
“চিন্তা হচ্ছে এই অজানা জায়গায় একা একা কোন বিপদে না পড়ে।“
মেঘলা আকাশ – সন্ধ্যে নেমেছে। আমাদের তখন লনের ধারের ছোট বারান্দায় বসেছে চা’এর আসর। জয়ন্তীদির অনুরোধে তানিয়া গান শোনাল। বারান্দার হলুদ আলো চলকে পড়েছে লনের মখমলি সবুজে। দেব’দা ফিরল প্রায় সন্ধে সাত’টা পার করে। এসেই বললেন –
“ফুলু পই পই করে বলে দিয়েছে – ভদ্রলোকদের বাড়ি যাচ্ছ , দু’বেলা ভালো করে চান্ করবে মনে করে, তোমার গা দিয়ে যা বোটকা গন্ধ বেরোয়!– যাই বাথরুমটা ঘুরে আসি স্যার।” জয়’দা জিজ্ঞেস করাতে রবি বলে কাকু শান্তিনিকেতন থানায় গেছিলেন। জয়’দা একটু আশ্চর্য হয়ে রবিকে প্রান্তিক স্টেশনের কাছের দোকান থেকে সিঙ্গাড়া নিয়ে আসতে বলে দিলেন। আমি বিরক্তির স্বরে তানিয়া কে বলি – “দেখলি ঠিক বলে ছিলাম কি না! ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে।”
দেব’দা প্রায় এক ঘন্টা পার করে আড্ডায় যোগ দিতে এসে প্লেট ভরা সিঙ্গাড়া দেখে লাফিয়ে উঠলেন – “উফ সিঙ্গাড়া! তানিয়া দেখ, সিঙ্গাড়ার সাইজটা দেখ!” বলেই দু’হাতে দুটো তুলে নিয়ে – “সন্তু ব্রাদার একটু পেটরোগা মানুষ, একটার বেশি খেতে পারবে না – দিদি কাঁচা লঙ্কা হবে, জমবে ভালো।”– আমি এবার খেপে উঠি –
“সকাল থেকে গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়ে একঘন্টা বাথরুমে তো কাটিয়ে এলেন।” – জয়’দা হো হো করে হেসে ওঠেন। দেব’দা তখন ভ্রুক্ষেপ না করে চোখ বন্ধ করে সিঙ্গাড়া চিবচ্ছেন।
এরপর জয়ন্তীদি রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন – ভেতর থেকে হাঁক দিলেন – “তোমারা ভেতরে চলে এস নইলে আড্ডাটা মিস করবো।” জবা কাপের পর কাপ চা সরবরাহ করে চলেছে।
“হঠাৎ থানায় গেলেন কেন?” জয়’দার কৌতূহলী প্রশ্ন। সিঙ্গাড়া চিবনো একটু থামিয়ে দেব’দা বলেন “আর বলবেন না স্যার, রবি তখন ওই উপাসনা ঘরটা দেখাচ্ছিল। হঠাৎ শুনি কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে – দেখি এ যে আমাদের সুদর্শন, এক পাড়ার ছেলে, ওকে ক্রিকেট খেলা শেখাতাম – এখানকার থানার বড়বাবু এখন। এতদিন পর দেখা স্যার - জোর করে থানায় নিয়ে গেল চা খাওয়াতে।”
“শুধু চা না ‘টা’ও ছিল?” আমার বক্রোক্তি।
“তুমি তো আর বাঙ্গালীর আতিথেয়তা জান না, চা এর জন্য ডাকলে ‘টা’ ও সঙ্গে থাকে। তাই না বৌদি ?” গলার স্বরে ঝরে পড়ছে অভিমান। জয়ন্তীদির মন্তব্য –
“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই – কেউ শুধু চা খাওয়া নাকি!”
“এখানকার বিখ্যাত ইউসুফের কাঁচের গাড়ির চপও ছিল। বুঝলে তো! একেই বলে বাঙালী বনেদীয়ানা।”
আমার টিপ্পনী – “বোঝ!”
রাতে মাংস পরোটা খেতে খেতে, দেব’দার হাজারটা বায়নাক্কা – একটা লঙ্কা হবে? আর একটু পেঁয়াজ – একটু বিট নুন – তানিয়া একটু নাও- ঝপাঝপ হজম হয়ে যাবে – ইত্যাদি।
খাওয়া শেষে দেব’দা একেবারে চুপ – টেবিলে টরেটক্কা বাজিয়ে সিগারেট ফুঁকছেন। লনের পাশে রাধাচূড়ার ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকির ঝাঁক। হঠাৎ আমাকে বললেন – “কাল একটা সারপ্রাইজ দেব – কিন্তু এখন বলব না।“ মুচকি হেসে শুতে চলে গেলেন।
তৃতীয় দিন
সকালে উঠে দেখি রবি ও জবা টেবিলে ব্রেকফাষ্ট সাজিয়ে রেখেছে। দেব’দা লনে ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজের চেষ্টা করছেন।
তানিয়া ও জয়ন্তীদি বারান্দায় বসে গল্প করছে। তখন একটা কালো মারুতি গাড়ি এসে গেটের সামনে থামাতে – রবি দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে ফিরে আসে – “কাকু পুলিশ এসেছে।“ জয়’দা একটু আশ্চর্য হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে – দেব’দাও তাড়াহুড়ো করে সঙ্গে চললেন।
বারান্দা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি গাড়ি থেকে নামছেন মাঝ বয়সী ভারিক্কি চেহারার একজন সঙ্গে পুলিশি পোষাকে লম্বা চওড়া আর একজন – দেব’দা তাঁদের পথ দেখিয়ে আনছেন।
– “আসুন রাও সাহেব – আপনি আসছেন শুনে সন্তুর তর সইছে না। সকাল থেকে উঠে বসে আছে – আপনাকে কবিতা শোনানোর জন্য।” রাগে গা জ্বলে গেল। এই রাও সাহেব কোলকাতা পুলিশের একজন হর্তা কর্তা। দেব’দার দিল্লির বাড়িতে সেবার কিছু দিন থাকার সময় ওনার সঙ্গে আলাপ। উনি রবি ঠাকুরের খুব ভক্ত। আমাকে দেখলেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা শেখানোর বায়না ধরেন। ভদ্রলোকটির থেকে আমি একটু দূরে থাকার চেষ্টা করি। দেব’দার দিকে কটমট করে চাইলে দেখি - মুখে ফিচেল হাসি। জয়দা ও জয়ন্তীদির সঙ্গে রাও সাহেবের আলাপ করিয়ে বললাম –
“রাও সাহেব দিল্লি পুলিশের বড় কর্তা আবার রবীন্দ্র সাহিত্যের সমজদার।“ দেব’দা এবার পুলিশি পোষাকের ভদ্রলোকের পরিচয় দেন –
“এই হল আমাদের সুদর্শন – এখানকার পুলিশের বড় কর্তা – হুঁ হুঁ।”
জয়ন্তীদির ব্রেকফাস্ট অফারে – রাও সাহেব শুধু চা নেবেন শুনে – জবা চা’য়ের যোগাড়ে গেল।
রাও সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বললেন – “না সন্তু দিল্লি নয় – খবর রাখো না, এখন আমি বিশেষ কাজের জন্য কিছুদিন কোলকাতায়। দেবনাথ শান্তিনিকেতনে এসেছে আমাদের একটা ব্যাপারে একটু হেল্প করতে। বার বার থানায় যাতায়াত না করে আলাদা তদন্ত করবে। ওহ! আপনাদের বলে রাখি দেবনাথ কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্টালেজেন্সে আছে – ধুরন্ধর অফিসার।” জয়’দা শুনে বেশ ইমপ্রেশড হলেন, আর হইহই করে জয়ন্তীদি বলে–
“বা! দেবনাথবাবু আমাদের রোজ কিন্তু তদন্তর ডিটেলস বলতে হবে” দেব’দা বিগলিত হয়ে – “নিশ্চয়ই ম্যাডাম, নিশ্চয়ই ম্যাডাম – তবে আমি তদন্তের কি আর জানি, রাও সাহেব আমাকে খুব ভালবাসেন – তাই একটু বাড়িয়ে বলছেন।” আরো কিছুক্ষণ নানান কথার পর রাও সাহেবদের গাড়িতে ওঠার আগে আমাকে বললেন – “দু চার দিন এখানকার গেষ্ট হাউসে থাকব। সময় করে তোমাকে কবি গুরুর “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে” কবিতাটা একটু শিখিয়ে দিতে হবে কিন্তু।” সেই সঙ্গে দেব’দার “নিশ্চয় স্যার নিশ্চয় স্যার – সে আর বলতে!” – এবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তানিয়ার হাসি চাপতে গিয়ে বিষম খাওয়ার আওয়াজে – মাথা গরম হয়ে ওঠে।
দেব’দা ফিরে এলে জয়’দার কমপ্লেন – “আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! এতক্ষণ পুরো ব্যাপারটা চেপে রেখেছিলেন?”
“কি যে বলেন স্যার – আসলে পড়া শোনায় কিছুই করতে পারলাম না দেখে বাবা পুলিশের পরীক্ষায় বসিয়ে দিল। ব্যাস এখন ঘস্টে মরছি।”
আমি জয়’দাকে দেব’দার অতীতের কিছু কীর্তিকলাপ সবিস্তারে জানাতে উনি বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।
ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজলো। দেব’দা হঠাৎ বলে – “সন্তু ভাই – চল, তোমায় শান্তিনিকেতন ঘুরিয়ে আনি।” তানিয়াও জেদ ধরে সঙ্গে যাওয়ার। জয়ন্তীদি নোটিশ দিল –
“দেড়টার মধ্যে ফিরবেন কিন্তু – ইলিশের ঝাল রেডি থাকবে।“
“ওফ ইলিশ!” তুড়ি দিয়ে এক পাক ঘুরে দেব’দা হঠাৎ দিদির সামনে নিল ডাউন হয়ে – নাটকীয় ঢঙে –
“উফ! দিদি আপনার জবাব নেই – ম্যাডাম আমার মনের ইচ্ছেটা ঠিক ধরেছেন - আপনি একেবারে সাক্ষাৎ মা করুণাময়ী – হেঁ হেঁ –” এবার চোখ বুঁজে দু’হাত ছড়িয়ে – বেশ আবেগের সাথে শুরু করলেন -
‘ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছেটা, দিলো মনে উঁকি।
ইলিশ ডিমের বড়ার জন্য,নিতে পারি শত ঝুঁকি।‘
ইলিশের ডিম ভাজা পাওয়া যাবে ম্যাডাম? জয়ন্তীদি হাসি মুখে সায় জানালেন।
“বাবা:! ইলিশের নাম শুনে কবিতা বেরিয়ে গেল যে?” আমার টিপ্পনী।
“সেই ছোটবেলায় মা’র কাছে শুনেছিলাম ব্রাদার।”
এবার তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম – এনার পাল্লায় পড়ে কপালে কি আছে কে জানে!
“একবার থানায় ঘুরে চল রবি ভাই।”
“থানায়! থানায় কেন যাব? আমাকে বিশ্ব ভারতীতে নামিয়ে যেখানে খুশি যান।” রেগে যাই আমি। দেব’দা অনেক বুঝিয়ে রাজি করালেন।
সুদর্শনবাবু আজ পুলিশের বেশে নেই। দেব’দাকে দেখে
“আসুন আসুন – ইলাম বাজারের ফাইলটা রেডি রেখেছি। রসুলপুরের কাছে অজয়ের চরে আজ যে বডিটা পাওয়া গেছে – স্পটটা দেখতে যাবেন না কি?” এবার একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন “এতে ইলামবাজারের অজয়ের চরে পাওয়া বডির ডিটেলস আছে।–” বুঝলাম থানায় আসাটা আগেই ঠিক ছিল। টেবিলে চা বিস্কুট এসে গেল। দেব’দা বিস্কুট চিবোতে চিবোতে মোটা ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছেন - হঠাৎ ওনার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। টেবিলে রাখা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস নিয়ে কিছু দেখলেন। এবার আমাদের ফাইলটা দিয়ে –
“ছবিগুলো একটু দেখ তো ব্রাদার।” দেখি নানান এ্যাঙ্গেলে তোলা একটি ডেডবডির রঙিন ফটো। ছবিগুলো একটি রোগাসোগা যুবকের। মুখের ধাঁচ মোঙ্গলিয়, পরনে ছেঁড়া ছেঁড়া নীল জিনস্, কানে মাকড়ি, কাদামাটি মাখা জট পাকানো লালচে চুল। কিছু বুঝলাম না।
দেব’দার ইঙ্গিতে, সুদর্শন বাবু একজন সাধারণ পোষাকের কনেষ্টবলকে বললেন –
“সাহেবদের রসুলপুরের স্পটটা দেখিয়ে নিয়ে আয়।“ রবির টোটোতে আমরা সেই কনেষ্টবলের মোটর বাইকের পিছু নিলাম।
“হাতের উল্কিটা দেখেছ ব্রাদার?” আমি ঠিক দেখি নি কিন্তু তানিয়া উত্তেজিত হয় –
“ঠিক বলেছেন – উল্কি দেখেছি – মনে হল দুটো অক্ষর ‘WP’ আর পাশেরটা বোধহয় কিছু একটা ফুলের।“
“কি চোখ তোমার তানিয়া দিদি! ওই জন্যই তো তোমাদের পাশে পাশে থাকি।“ দেব’দার মুখে ফিচেল হাসি।
“এটা কি ফুল বলুন তো ম্যাডাম? জয়ন্তীদি একটু ভেবে বলেন
“কল্কে ফুল, শ্রাবণে শিব পূজোয় লাগে – এটা পকেটে নিয়ে ঘুরছেন কেন?”
“কি আবার! গাঁজা খোরদের মনে পড়ে – আবার শিবের ভক্তরা এতে টান মেরে জয় ভোলেনাথ বলে চিল্লায় আর কি।“
“ওটা হিট অন দা নেল’ হবে দাদা।“ দেব’দা ফিক করে হেসে চুপ মেরে গেলেন।
“শেষ করা কি ভালো – তেল ফুরবার আগেই যদি দিই নিবিয়ে আলো’ – হেঁ হেঁ!– আর ঘটনাটা যে কি আমিই জানি না স্যার - এ সব আমার দ্বারা কি হয়? – খটকা রয়ে গেছে তবে সবুরে কাঁঠাল পাকে।“ কথা শেষ করে ঘরে চলে গেলেন। জয়’দা অবাক হয়ে ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বিকেলে সবাই মিলে শনিবারের হাটে যাওয়া হল। সেখানে পুলি-পিঠে, পাটিসাপ্টা খাওয়া পর বাউলদের গানের সঙ্গে দেব’দার হাত পা ছুঁড়ে বেতালা নাচ – আমাদের তো বটেই, ভিড় জমানো দর্শকদের মধ্যেও সাড়া ফেলে দিল। তখন ঠিক হল রাতে খাওয়া সারা হবে বাড়ির কাছেই ‘ক্রিক’ রেঁস্তোরায়। বাড়ি ফিরে জয়’দা ফোনে পাঁচ জনের জন্য টেবিল বুক করলেন। রাতে গাড়িতে যাওয়া হল ‘ ক্রিক’ রেঁস্তোরায়। বিশাল এক গেট পেরিয়ে লম্বা ড্রাইভওয়ের শেষে রেঁস্তোরা। আদব কায়দায় বড় শহরের রেঁস্তোরা হার মানবে। সার্ভ করতে মিনিট দশেক লাগবে শুনে দাদার সিগারেটের বায়না মেটাতে বড় গেটের বাইরের রাস্তায় যেতে হল। গেটের বাইরে কিছু গাড়ি আর টোটো দাঁড়িয়ে। রাস্তার আবছা আলোয় নজর পড়ল একটা গাছের নিচে কয়েকটা মোটরবাইক ঘিরে গল্পে মত্ত কিছু ছেলে। একজনের মুখে কোন চলন্ত গাড়ির হেড লাইটের চকিত আলো পড়ায় চমকে উঠি – “আরে আজ সকালে অজয়ের ব্রিজে একেই তো দেখেছি আমাদের ওপর নজর রাখতে!” দেবদা ফিস ফিস করে বলেন –
“ওফ! চিলি প্রনটার জবাব নেই। বলদেওর ডান কবজির উল্কিটা দেখেছেন?” না বলাতে একটু হতাশ হলেন –
“‘কল্কে ফুল’ – বোম বোম ভোলেনাথ-।” তানিয়ার মন্তব্য –
“পাঁচ ছয় জোড়া পেলাম – কিন্তু এগুলো নিয়ে কি করবেন?” দেব’দার এবার এক গাল হাসি –
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন বলুন তো? সে বারের মত আমাদের ফ্যাসাদে ফেলবেন না তো?”
“ঝুট মাত বোলো।“ লোকটা এবার ডান্ডা উঁচিয়ে মারে আর কি। দেব’দা এবার ছদ্ম ভয়ার্ত স্বরে বলেন –
“তানিয়া খুব লেগেছে বোধহয়?” বলতেই তানিয়া রুমালে মুখ হাতের কাদা মুছতে মুছতে প্রায় খেঁকিয়ে ওঠে-
“কি বলতেসেন – হামি কিডন্যাপ করিয়েছি! ছি: ছি: ছি : এই সোমেন – সাব মেমসাব কে খাতির করে আনছিস তো?”
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.