সূর্যাশীষ পাল
গল্প সমগ্র ২
প্রচ্ছদঃ সুরজিৎ সিনহা, হলদিয়া, পঃ বাংলা
আমার
দ্বৈত জীবন
সুব্রত মজুমদার
সুব্রত মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেক্নলোজি, থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। নানা ধরেনের ওয়েবজাইনে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি অগণিত পাঠকদের মনোরঞ্জন ও প্রশংসা অর্জন করেছে। লেখকের মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর ভ্রমন ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা।
সকালবেলায় আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। মেয়ের ডাকে খবরের কাগজের পাতা থেকে চোখটা তুলে তাকালাম ওর দিকে। দেখলাম মেয়ের হাতে একটা ময়লা ভাঙ্গাচোরা সুটকেস্। বড়বড় চোখদুটোকে ঘুরিয়ে সে তার হাত পা নেড়ে অনেক কথা আমাকে বলে গেল। এইটুকু বুঝলাম যে সে বলতে চাইছে যে সুটকেসটা পুরনো আর এখনো তার ভিতর থেকে মশলার গন্ধ বেরোচেছ। আরো জানতে পারলাম যে সুটকেসের ভিতরে শীলনোড়া আর কিছু বাসন ছিল সেগুলো সে নিচে বেস্মেন্টে রেখে দিয়েছে। আমরা কেন এত পুরনো জিনিস এতদিন ধরে ফেলে না দিয়ে রেখে দিয়েছি এই নিয়ে আমাকে বেশ ভালো রকমের একটা লেক্চার দিল। পরিষ্কার আমায় জানিয়ে দিল যে সে রিসাইকেল্ করার গাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবে সুটকেসটা আর এই ধরনের আরো অনেক জঞ্জাল। মেয়ে এখন বড় হয়েছে। এককালে আমি হুকুম করতাম ও শুনত এখন ও হুকুম করে আমি শুনি।
দেখতে দেখতে তিরিশটা বছর কেটে গেল আমেরিকায়। একদিন এই দেশেই থুড়ি এই বিদেশেই হয়ত আমার মৃত্যু হবে। যখন আমি দেশে ছিলাম তখন আমার একটাই পরিচয় ছিল। আমি ছিলাম ইন্ডিয়ান্। এই দেশে আসার পর আমার সেই পরিচয়ের সঙ্গে যোগ হল আর একটা পরিচয়। আমার নতুন পরিচয় হল-ইন্ডিয়ান আমেরিকান্। অনেকটা দাঁড়কাকের ময়ূর পুচেছর মত। গত তিরিশ বছর ধরে এই পরিচয়ের তাৎপর্য্য উপলব্দি করার চেষ্টা করে চলেছি। ফেলে আসা জগৎটাকে আঁকড়ে ধরে থাকার যেমন আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আবার নতুন জগৎটাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যা যা করার তারও কোন ত্রুটি রাখিনি। হেমন্ত মুখার্জীর গানের সাথে সাথে শুনেছি লাওনেল্ রিচির গাওয়া গান। প্রথম প্রথম আমার নিজেকে মনে হত সদ্য বিবাহিত কনে বৌয়ের মত। বাপের বাড়ি ফেলে এসে শশুরবাড়ির সবকিছুকে মানিয়ে নেওয়ার মত অনেকটা। সাটল্ককের মত দুটো জগতে ঘোরা ফেরা করতে করতে কেন জানিনা আমার মনে হয় দুটো জগৎকেই আমি বোধহয় ফাঁকি দিয়ে এলাম। গাছেরও পেলেম না আবার তলারও পেলেম না। ইংরেজও হতে পারলাম না আবার বাঙালীয়ানাটাও ভুলে গেলাম।
সদর দরজার সাথে আমার জীবনের একটা গভীর সম্বন্ধ আছে। সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যখন বাড়ির ভিতরে ঢুকি তখন বুঝতে পারিনা যে আমি আমেরিকায় আছি। বাড়ির ভিতরটাকে আমরা ফেলে আসা কলকাতার বাড়ির মত করে রাখি যাতে ঘুনাক্ষরেও যেন আমরা ভুলে না যাই আমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে। বাড়ির ভিতরে আমরা বা-লায় ছাড়া কথা বলিনা। মাছের ঝোল, মাংস, ডাল তরকারি হাত দিয়ে ভাতের সঙ্গে মেখে কব্জি ডুবিয়ে খাই। চাটনি বা অম্বল হলে আমরা আঙ্গুলেরও ব্যবহার করে থাকি। ঘুনাক্ষরেও কিন্তু আমরা আমাদের এই আচার ব্যবহার আমাদের আমেরিকান বন্ধুবান্ধবদের জানাই না, গোপন করে রাখি। প্রথম প্রথম ভয় হতো যদি ওরা জানতে পারে তাহলে হয়ত ওরা আমাদের দেশে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবে রিটার্ন ভিসা দিয়ে। অবশ্য আমরা যখন ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করি তখন কে বলবে আমাদের দেখে যে আমরা আমরা কাঁটা চামচ ছাড়া শুধু হাত দিয়ে সব কিছু সাবাড় করে দিতে পারি। তখন আমরা বনে যাই পাক্কা সাহেব। বা-ালীয়ানা তখন মনে হবে সঙ্কুচিত ভীত কৃতদাসের মত লুকাইয়েছে ছদ্মবেশে। যদিও মাছের ঝোল আর ভাত আমাদের সবথেকে প্রিয় তবে আমেরিকান খানাদানার ধারকাছ দিয়ে যে একেবারে যাইনা তা নয়। আমেরিকান স্যান্ডউইচ্ আমাদের খুবই প্রিয়। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও আমরা অবশ্য ওটার একটা ইন্ডয়ান ভার্সানও বানিয়ে ফেলেছি। দুটো রুটির ভিতরে আমরা লাগাই একটা পাতলা লেয়ার, কখনো সেটা হয় শসা টমেটো আর পেঁয়াজ, কখনো বা ঘুগনির আবার কখন বা পাওভাজির। বানানোর সুবিধা ছাড়াও আমার ধারণা হার্ডকোর এই আমেরিকান্ সোসাইটির সাথে, এই শেভ্রলে আর অ্যাপেল্পাইয়ের দেশে এই একটা স্যান্ডউইচ্ এর মধ্যে দিয়ে আমরা ওদের সঙ্গে ব্লেন্ড করে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। আমেরিকায় আসার আগে আমার গর্ব ছিল যে যেহেতু দেশে আমি ইংলিশ্ মিডিয়াম্ ঝর্ণা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি - সব কিছুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তার ক্যামেরার লেন্সের জাদুতে। কথা মতো পরের দিন ভোরবেলায় সবাই মিলে সায়নের কারে করে লোনাভালা খান্ডালার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। খান্ডালার রাজামাচি গার্ডেনে পৌঁছে সায়ন মেতে গেল তার নতুন ক্যানন এস. এল. আর ক্যামেরায় ফটো তুলতে। আগস্ট মাসের বর্ষায় বৃষ্টির ধারা সহ্যাদ্রি পর্বত বেয়ে নীচে নেমে সুন্দর জলপ্রপাতের আকার ধারণ করেছে। যেদিকেই চোখ যায় সেই দিকেই কেবল সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির জলে ভিজে গাছের পাতাগুলো সবুজ পান্নার মত চকচক করছে। এই রকম
অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রকৃতি প্রেমিক সায়ন আনন্দে আত্মহারা, তার খুশির সীমা নেই। মনের আনন্দে গাছপালা, ফুল, পাখি, অর্কিডের ছবি তুলতে লাগল সায়ন। এদিকে সায়ন যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন নিজের মনে গুনগুন করে গান জুড়ে দিল সাগরিকা। তার মিষ্টি গান শুনতে শুনতে প্রবালের কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সাগরিকার প্রতি প্রবালের দুর্বলতা সেই কলেজের দিন থেকেই, স্কুলে পড়াশোনা করেছি আমার জন্মগত ভাবে ইংরিজি ভাষাটার ওপর একটা দখল একটা অধিকার আছে। ভুলটা ভাঙ্গতে বেশী সময় লাগল না এদেশে আসার পরে। ধাক্কাটা খেলাম যখন দেখতাম কলেজ, অফিস আর দোকানের লোকেরা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি কিছু বলার পরে। ‘লেডি ফিংগার’ যে ‘ওকরা’, ব্রিন্জল্’ যে ‘এগ্প্ল্যান্ট’ আর ‘সিডিউল্’ যে ‘স্কেডুল্’ এই সব শিখতে সময় লেগেছিল। মনে আছে ভুলে বাবাকে চিঠিতে এইসব নতুন বানানে চিঠি লিখলে উনি পরের চিঠিতে সেই সব বানান কারেক্ট করে আমায় পাঠাতেন। বাবা নিশ্চই অবাক হয়ে ভাবতেন যে ছেলে বিদেশে গিয়ে কি করে এরকম বানান ভুল করছে। আমি বাবার চিঠিটা পড়ে মনে মনে হাসতাম, আর খুব মজা পেতাম। ইংরিজি ভাষাটাও যে অন্য সব ভাষার মতই খটমট এই ব্যাপারে বাবাকে একটা চিঠি দেব ভেবেছিলাম কিন্তু দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। যখন এই দেশে আসি তখন এদেশে অর্থাৎ আমেরিকায় দেশী মানে আমাদের ভারতবর্ষের কোন জিনিস বড় একটা পাওয়া যেত না। অতএব বলা বাহুল্য বৌয়ের শাড়ী থেকে শুরু করে, দেশের বড়ি, সরষের তেল, নানা রকমের মশলা, পাটালি গুড় এমন কি লেড়ো বিস্কুট আর ডালমুট্ হয়ে উঠেছিল অমুল্য। কালোবাজারীদের মত আমরা সেইসব জিনিসকে আঁকড়ে রাখতাম। তিল তিল করে খরচা করা হত তাদের, কারণ পরের বার দেশে যাওয়ার আগে ওসব জিনিস আর পাওয়া যাবে না। তখনই কিনেছিলাম ওই সুটকেসটা। ওত বড় সুটকেস সচারাচর চোখে পড়ে না। তাই চোখে পড়া মাত্র আমার আর আমার স্ত্রীর মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল।কিনে ফেললাম কোন দ্বিধা দ্বন্দ না করে। আমরা ওই সুটকেসটার মধ্যে পুরে কত শত জিনিস নিয়ে আসতাম আজ ভাবতে বসে অবাক লাগছে। আমার স্ত্রীর কাজ ছিল কেনা আমার কাজ ছিল সজত্নে সেগুলোকে ওই সুটকেসের মধ্যে ঢোকানো। শুধু ঢোকানো বললে বোধহয় ভুল বলা হবে। কাস্টমস্ এর চোখে ফাঁকি দিয়ে কি করে পাটালি গুড়, সর্ষের তেল আর মশলাপাতি নিয়ে আসা যায় এই নিয়ে বোধহয় একটা গবেষণা মুলক বইও লিখতে পারতাম। মনে আছে আমরা একবার একটা নারকেল কোরা যায় এমন একটা বঁটি আর একটা শীল নোঁড়াও এনেছিলাম ওই সুটকেসটার মধ্যে করে। ফুড্প্রসেসর আসার পরে ওগুলোর দিকে আমরা আর ফিরেও তাকাইনি বহু বছর। অতি বড় সাহসী হওয়া সত্তেও কোন রকম সবজি কখন আনতাম না। ওটা ছিল একেবারে নো নো কাস্টমস্ কাছে। মনে পড়ে একবার দেশ থেকে ফিরে সুটকেস্ খুলে দেখলাম কয়েকটা পটল এক কোনে উঁকিঝুঁকি মারছে। প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেলাম। তারপরেই বুঝলাম যে ঠাকুমা লুকিয়ে তার প্রিয় নাতির অতি প্রিয় পটল অজান্তে কখন ঢুকিয়ে দিয়েছে সুটকেসের মধ্যে। চোখের জল সেদিন চেপে রাখতে পারিনি। আজকাল সবকিছুই এদেশে পাওয়া যায়, দেশ থেকে আনার আর দরকার হয় না। তবু ফেলে আসা সেইদিনগুলোর কথা ভোলা যায় না।
সুটকেসটা একটানা দশ বছরের ওপর ধরে আমাদের কোলকাতা যাতায়াতের ধকল বয়েছে। বিগত বেশ কয়েক বছর আমরা কেউ আর ওর দিকে ফিরেও তাকাইনি। এক জায়গায় পড়ে থাকতে থাকতে আর ধুলো ময়লা লেগে লেগে ওর চেহেরার পরিবর্তন হয়েছে। আগের মত আর চক্চকে চেহারাটা নেই। ওকে আমরা ভুলে গেছি, ওর প্রয়োজন আমাদের কাছে ফুরিয়ে গেছে। ও আজ বাতিল। কিন্তু ওর সারা শরীরে এখনও মশলার গন্ধটা লেগে আছে। শীলনোড়া আর পুরনো বাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেক্ষন। ওরা আমায় স্মরণ করিয়ে দিল পিছনে ফেলে আসা অনেক স্মৃতি, অনেক স্নেহের স্পর্শ, অনেক আদর, অনেক ভালোবাসার কথা। তাদের অনেকেই আজ আর ইহলোকে নেই। আজ অনেকদিন পরে তাদের কত্থা ভেবে আমার দুটো চোখ জলে ভরে এল। আমি চিৎকার করে মেয়েকে ডাকলাম ‘‘ওরে সুটকেস্টা রিসাইকেল্ করার গাড়িতে নিয়ে যাস্ না। ওটাই যে এখন আমার সব। ওটা ছাড়া নিজের বলে আমার যে আর কিছুই নেই। ওটা জঞ্জাল নয়, ওটা আমার সবথেকে প্রিয়। ওটাকে আমি যক্ষের ধনের মত আগলে রাখব, যত্ন করে রাখব এবার থেকে আমার জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত। ’’
সাড়া পেলাম না মেয়ের, জানতে পারলাম সে রওনা দিয়েছে সুটকেসটাকে নিয়ে রিসাইকেল্ করার গাড়ির উদ্দেশে।
Comments
Top
বৃন্দাবন কুঠি
তাপসকিরণ রায়
জব্বল্পুর, মধ্যপ্রদেশ
রানাঘাট চুর্নী নদীর ধারে গোল গোল গম্বুজ আকারের বড় বড় পড়ো দুটো ঘর ছিল। আমরা ওগুলোকে গোলঘর বলেই জানতাম। ছোটবেলায় আমরা তা দেখেছি। পালচৌধুরী জমিদারের সময়কার সে সব পড়ো ঘর বাড়ি জানি না এখনো আছে কি না!
ওই গোলঘর ছাড়িয়ে সদর রাস্তা পেরিয়ে এক কোনায় ছিল পড়ো পুরনো জমিদার বাড়িরই এক অংশ। বাড়ির সামনে ছিল দু দুটো বিরাটাকার প্রবেশ দ্বার-- এক কালে নাকি তাতে বড় বড় লোহার দরজা ছিল। গেটের ওপরের দিকে রঙ চটা দেয়াল, ভাঙাচোরা, খসা প্লাস্টারের ভিতরেও ভালো ভাবে নজর করলে দেখা যাবে কোন এক কোণের দিকে লেখা আছে--বৃন্দাবন কুঠি। ওর সঙ্গে প্রায় লাগোয়া হাড় জিরজির কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল জমিদার বাড়িটা। ছোট বেলায় বন্ধুরা মিলে ভয়ে ভয়ে ঢুকেছি ওসব ঘরে। ভিতরের ঘরগুলি থাকত অন্ধকার। দিনের বেলাতেই তাতে আলো ছায়া খেলা করত, একটা গা ছমছম পরিবেশ ছিল-- প্রায় আধ কিলোমিটার জুড়ে পড়ে থাকা বাড়িটা লোক শূন্য খাঁ খাঁ করত!
আমি তখন ছোট ছিলাম-- ন দশ বছরের। ভূতপ্রেত দত্যি দানার গল্প শুনে মনে বড় ভয় ঢুকে গিয়ে ছিল। রাতের বেলা পথে একা চলতে পারতাম না। সঙ্গে বন্ধু বান্ধব থাকলে ঠিক আছে-- নতুবা ঘর থেকে বেরোবার প্রশ্নই ওঠে না।
সেদিন রাতের পড়া করছিলাম। জয়দেব এলো আমার কাছে। ও আমার স্কুলে পড়ে। এক ক্লাসেই পড়ি আমরা, বলল, তপন তোকে শীলাদি ডেকেছেন, বলেছেন, খুব দরকার, আজই একবার দেখা করতে। কথা কটা বলে ও নিজের ঘরে চলে গেলো।
শীলাদি আমার স্কুলের মেডাম, আমি ও জয়দেব তাঁর কাছে টিউশনিও পড়ি। স্কুলে তাঁকে আমরা,মেডাম আর স্কুলের বাইরে, দিদি ডাকি। গত দুদিন আমি স্কুলে যাই নি টিউশনিতেও যেতে পারি নি। কারণ শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না-- সর্দি কাশি, জ্বর-জ্বর ভাব চলছিল। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা সামনে ছিল। এ সময় স্কুল কামাই, টিউশনিতে অনুপস্থিতি এসব কারণেই বোধহয় শীলাদি ডেকে পাঠিয়েছেন। শীলাদির বাড়ী যাবো বলে তৈরি হলাম। পথে বের হবার আগে মনে হল,আরে একা যেতে পারবো তো!পথে ভয় পাবো না তো? আগে মনে হলে জয়দেবের সঙ্গেই চলে যেতে পারতাম। ভাবলাম রাস্তায় তো লাইট আছে। আর তা ছাড়া পথে লোকজনের যাতায়াত এখনো থাকবে। রাত বেশী হয় নি। সাহস জুটালাম মনে। পা বাড়ালাম রাস্তার দিকে। শীলাদির বাড়ি বেশী দূরে না-- যেতে পাঁচ সাত মিনিটের বেশী লাগে না। সোজা পথে হাঁটলাম দু মিনিট, এবার রাস্তা দুদিকে মোড় নিয়ে চলে গেছে। সামনেই পড়ে গম্বুজ আকারের গোলঘরগুলি। ও দিকে আলো নেই, অন্ধকারে গোলঘরগুলি ভূতের আস্তানার মত দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পাশ থেকেই আমায় যেতে হবে।
গোলঘর পার হয়ে সামান্য এগোলে ছোট একটা মাঠ, সেখানে প্রায় রোজই আমরা খেলতে আসতাম। না, দিনের বেলা, না ভয়, না ভুতের কোন কথা মনে পড়ত না, কিন্তু রাতের বেলা! ওগুলোর কথা ছাড়া আর অন্য কিছুই মনে পড়ে না! পড়বি তো পড়, ঠিক আমার চোখ গিয়ে পড়ল বৃন্দাবন কুঠির গেটের দিকে। গেটের দিকে চোখ পড়ায় আলাদা কিছু মনে পড়ছিল না, মনে পড়ল, সামনে আমার মস্ত বড় ভূতুড়ে রাজ প্রাসাদ-- যেন ঘুমিয়ে আছে।ভয়ের সময় দেখেছি-- এমনি ভয়ের কথাই সব মনে পড়ে! তবু কেন যেন আর একবার চোখ গিয়ে পড়ল বৃন্দাবন কুঠির দিকে! আর,আর একি! দেখলাম সুন্দর একটা মেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! আশ্চর্য অন্ধকারেও তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম! ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আর আমিও ওই দিকে তাকিয়ে আছি, চোখ সরাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না-- অদম্য ইচ্ছা নিয়ে কেবল তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম, পরমা সুন্দরী এক রমণী, যার শরীর ভরা আভরণ, চকমকে শাড়িতে যার দেহ মোড়া। আমায় ইশারাতে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল!
আমি চমকে উঠলাম, শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো-- দেহে কেমন যেন ঝিমঝিম অনুভব করতে লাগলাম! মনে করতে পারছিলাম না-- আমি কে? আমি যেন ঠিকানা বিহীন কেউ-- কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যাবো, সব, এক সময়, সব ভুলে গেলাম!
বৃন্দাবন কুঠির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি মা! হ্যাঁ, দেখি মা আমার হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। আমি তখন অন্য আমি! মনে হল ওই তো আমাদের বাড়ি-- বৃন্দাবন কুঠি
--আমি, হ্যাঁ, আমি বৃন্দাবন।
--বৃন্দাবন! বৃন্দাবন! -- মা আমায় ডেকে উঠলেন। মার কাছে এগিয়ে গেলাম।
--কোথায় গেছিলি বাবা, তোকে যে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি !
--নৌকা বিহারে মা! কেন তুমি জানো না মা! মামা আমায় সকালেই নৌকা বিহার করাবেন বলেছিলেন, বৃন্দাবন বলে উঠলো।
তখন ভোরের কাক ডাকা সকাল ছিল। কুঠির রোশনদানে তখন মোমের শেষ অংশটুকু জ্বলছিল।
--মামার সঙ্গে!
বৃন্দাবনের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন মা, তোকে বলেছিলাম না খোকা, তুই মামার সাথে কোথাও যাবি না!
--কেন,মা! মামা তো আমায় খুব ভালবাসেন। আমায় নতুন পরিচ্ছদ কিনে দেন, আমার জন্যে অনেক অনেক মিষ্টি কিনে আনেন। আমাদের বাড়ি যখন এলেন ঝুড়ি ঝুড়ি ফল মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন!
--না, ই বুঝিস না, মামার কাছে যাবি না। ও তোকে--
--কি মা-- আমাকে--
এমনি সময় বৃন্দাবন মামাকে দেখল দূরের নদীর পারের রাস্তা ধরে আসছেন। ধোপদুরস্ত হয়ে বৃন্দাবনের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। হাসলেন, বললেন, কেমন লাগলো, বৃন্দাবন? নৌকা বিহার ভালো লেগেছে?
--খুব ভালো, মামা! আরও কিছু বলতে চাইছিল বৃন্দাবন, বলতে চাইছিল, রোজ ভোরে এমনি নৌকো বিহার করবো, মামা! কিন্তু থেমে গেলো ও,মার কথা মনে হয়ে গেলো। একটু আগেই মা তার বলেছেন, মামার সঙ্গে কোথাও যাবে না। ও কিছুতেই বুঝতে পারলো না, কেন ওর মা বাবা এমনি বলেন! বৃন্দাবনের মামা, সংঘাত, বললেন, কি হল কি বলবে বল?
মামার দিকে তাকাল বৃন্দাবন, বলল, না, কিছু বলব না।
বৃন্দাবনের বাবা আদিত্য রায় চৌধুরী, জমিদার। বর্তমানে বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থ তিনি। শয্যাগত। দু বেলা ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছেন তাঁকে। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে আদিত্য পালচৌধুরীর দিন ফুরিয়ে আসছে! বুঝতে পারছেন তিনি, আর বেশী দিন তিনি বাঁচবেন না।
তাঁর এক মাত্র ছেলে বৃন্দাবন, তাঁর মৃত্যুর পর একমাত্র উত্তরাধিকারী ও। কিন্তু ও খুব ছোট--দশ বছর মাত্র ওর বয়স! ও কি করে বুঝে নেবে তাঁর বাবার সম্পত্তি? সে তো এসবের কিছুই বোঝে না! চিন্তায় চিন্তায় আরও ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন আদিত্য। চিন্তার ওপর দুশ্চিন্তা তাঁর মাথায় আরও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তাঁর একমাত্র শ্যালক! সংঘাত। ওর মতিগতি তাঁর ঠিক লাগে না। ওপরে ওপরে আদিত্যকে শ্রদ্ধা দেখাবার ভান করে। কিন্তু সেটা যে অতিরিক্ত-- শুধু মাত্র দেখানো— তা আদিত্য বুঝতে পারেন। সংঘাত ঘরভেদী বিভীষণ বললে ভুল হবে না। ও বহুদিন ধরে এখানেই আছে-- নিজের ঘর বাড়ি থাকলেও কোন দিন যাবার নাম করে না।
সংঘাত ঘরে ঢোকেন, কেমন আছেন এখন? ফল পথ্যি ওষুধপত্র খাচ্ছেন তো ঠিক মত? আদিত্যের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বললেন, সত্যি আপনার দিকে আর তাকাতে পারছি না! দিন দিন শরীরের গতি ভাঁটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
চুপ করে থাকেন আদিত্য।
--চিন্তা করবেন না জামাইবাবু, আমি আছি, সবকিছু আপনার মত করেই দেখে নিতে পারব।
--জানি কিন্তু মনে রেখো, বৃন্দাবন আছে-- আর--
--আরে সে চিন্তা আপনি করবেন না, ওকেই বুঝিয়ে শুনিয়ে দেবো আমি। আপনি নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করতে পারেন!
আদিত্য ভাবেন, বলে কি সংঘাত! সে যে তাকে এখনি চোখ বন্ধ করিয়ে দিতে চায়!
বৃন্দাবনকে কাছে ডাকেন মা, মায়াবতী--গলার স্বর নিচু করে বলেন, বৃন্দাবন,বাবা! তুমি ছোট, বোঝো না। তোমার মামা কিন্তু তোমার ভালো চান না। তাঁর কাছে কম যাবে। একা কখনো তাঁর সাথে কোথাও যেও না, বাবা!
--ঠিক আছে আর যাবো না, মা-- কিন্তু মা, মামা তো আমায় খুব ভালোবাসেন!
মায়াবতীর রাগ হয়, না, তোমায় বলেছি না, তুমি ওঁর সঙ্গে কোথাও যাবে না!
বৃন্দাবন বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, মামা তো তার কত ভালো, দেখা হলেই মিষ্টি হেসে কত কথা বলেন! খাবারের কথা,ঘুরতে যাবার কথা, শিকারে নিয়ে যাবার কথা বলেন, আর আজই তো নৌকা বিহারে নিয়ে গেলেন! তবু সে মাকে বলল, ঠিক আছে মা, তুমি বলছ,আমি আর কোথাও যাবো না-- মামার কথা শুনব না-- মামার সঙ্গে কথাও বলব না।
এমনি এক দিনের কথা, বেশ রাত তখন--বৃন্দাবন তখন তার মা, মায়াবতীর সঙ্গে ঘুমাচ্ছিল। মামা সংঘাত ওদের ঘরে ঢুকলেন, দেখলেন, বৃন্দাবন আর মায়াবতী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সংঘাত বৃন্দাবনকে ধাক্কা দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করলেন, কয়েকবার চেষ্টায় বৃন্দাবন জাগল না। সংঘাত পাঁজা কোলে করে ওকে বাইরের ঘরে নিয়ে এলেন। গেটে তখন দুই প্রহরী জাগ্রত। কিন্তু তাদের সংঘাত বশ করে নিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল বৃন্দাবনের। দেখল, এ কি! সে কি করে এ ঘরে এলো!
--তোমার সঙ্গে কথা আছে বৃন্দাবন! --সংঘাত হেসে বলে উঠলেন, তোমায় আমিই নিয়ে এলাম,আমি নৌকা বিহারে যাচ্ছি --মনে হল তুমিও যেতে পারো --নৌকা বিহার তোমার খুব ভালো লাগে।
বৃন্দাবনের মার কথা মনে পড়ে গেলো-- ও বলে উঠলো, কিন্তু মা--
--মাকে আমি বলেছি তো, তোমার মা বললেন, ঠিক আছে এবারটা ঘুরে আসুক বৃন্দাবন,আর কখনো যাবে না-- তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে?
বৃন্দাবনের মন নেচে উঠলো। মা তাকে যেতে বলেছেন। ঠিক আছে সে এবারের মত ঘুরে আসুক, আর না হয় যাবে না। ভোরের নৌকা বিহার খুব, খুব সুন্দর লাগে ওর-- নদীর বয়ে যাওয়া স্রোত, পারের দু ধারের গাছ পালা। বাড়ি ঘর ফসলের খেত, জেলেদের মাছ ধরা, আকাশের লালিম ছটা, সত্যি বৃন্দাবনের খুব ভালো লাগে!
বৃন্দাবন গিয়ে বজরাতে উঠে বসলো। সাজানো বড় নৌকো-- তাতে ঘর বানানো, তার জানালাতে রঙ্গিন পর্দা, ভেতরটায় দুটো ঘর তাতে ঝালর সাজানো!
--আমি ওপরে গিয়ে বসব, মামা? উচ্ছল বৃন্দাবন বলে উঠলো।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার জন্যে ওপরেই ব্যবস্থা আছে, বাঁকাভাবে ঈষৎ হেসে সংঘাত বলে উঠলো।
বজরা তখন মাঝ নদীতে, চুর্নী নদীর খরা স্রোত নিয়ে বয়ে যাচ্ছে অথই জল রাশি। মামা ডাকলেন, বৃন্দাবন দেখে যা, দেখে যা!
বৃন্দাবন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঘরের বাইরে, ছইয়ের বাইরে।
--দেখ,দেখ কত বড় মাছ! সংঘাত নৌকোর এক কিনারায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো। বৃন্দাবন পড়িমরি করে ছুটে গেলো মামার পাশে মাছ দেখতে।
--ওই, ওই দেখ কত বড় মাছ!
বড় মাছ দেখতে বৃন্দাবন ঝুঁকে পড়ল নদীর দিকে আর সেই মুহূর্তে সংঘাত আচমকা বৃন্দাবনের দুটো পা তুলে ধরে ঠেলে দিলো জলের দিকে।
--মামা! একটা মাত্র চীৎকার শোনা গেলো বৃন্দাবনের, ও গভীর জলের মধ্যে পড়ে গেলো। খরস্রোত জল তাকে আরও কিছুটা দূরে ঠেলে নিলো। ও জলের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল। আর একটিবার ওর মাথার কিছু অংশ মুহূর্তের জন্যে ভেসে উঠে নদীর অতল জলে তলিয়ে গেলো।
বৃন্দাবন প্রাণ ফাটা চীৎকার দিয়ে উঠলো... এবার যেন বৃন্দাবনের সত্ত্বা হারিয়ে যেতে লাগলো-- কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলো-- কোন গভীর অতলে! এ কি চারিদিক অন্ধকার কেন! আমি কোথায়, আর, এই কি সেই পোড়ো বাড়ী! সেই বাড়ী! তপন ভয় পেল। ধড়ফড় করে ও উঠে বসলো-- ছুটে বের হল সে ওই পড়ো বাড়ী থেকে। বৃন্দাবন কুঠিতে সে কি করে এলো! আর ও যা স্বপনের মত দেখল সেটা কি শুধুই স্বপ্ন ছিল!
Comments
Top
জন্মদিনের পায়েস
অয়ন দাস
দূরে কোথাও একটা ডাহুক পাখি ক্লান্ত স্বরে একটানা ডেকেই চলেছে। দূরের সীমানা কতটা হতে পারে, এটা ভাবতে ভাবতেই এক অদ্ভুত সমাপনে ঠিক এই সময়েই দোতলার কোনও ঘর থেকে রেডিওতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় "দূরে কোথায়, দূরে দূরে" গানটা মন্মথবাবুর কানে ভেসে এল। ধূপের গন্ধের মত সুরের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে মনের আনাচে কোনাচে। মন কেমন করা ভালো লাগা আর একই সাথে অচেনা এক নিরাসক্তির বৈপরীত্যের অনুভূতিতে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ক্লান্তিতে আনমনে চোখ বুজতে যেতেই টেবিলের উপর রাখা গত রাতের লেখা সদ্য কবিতাটায় চোখ পড়ল।
১৩ই আষাঢ়, ১৪২৫
সোমবার রাত,
|| ছেলেবেলা ||
আমার যা কিছু মূল্যবান, দূর্লভ, দুষ্প্রাপ্য
সবই সেই ছেলেবেলার;
যা কিছু প্রাচীন, গভীর, গোপন,--- সবকিছুই
প্রত্নতাত্ত্বিকের জমা ডাকটিকিটের মত
ছেলেবেলার পোস্টকার্ডে সেঁটে আছে।
ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড এর কাঁটা
স্থবির হয়ে
হঠাৎ থেমে গেছে;
জানলার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে আসা
ছোটবেলার এক-চিলতে রোদ্দুরের টাইমফ্রেমে।
আইসক্রিমের মত গলে গলে যায় সময়
টুপটাপ করে খসে পরে, ঝরে পরে মুহূর্ত
পল, অনুপল.....
ধাবমান সময়যানের দিকে
এগিয়ে আসা প্রতিটা দিন
আর আলোকিত নয়।
ছেলেবেলার চৌকাঠ পেরিয়ে
বড় হয়ে আমি
নতুন কিছুই শিখিনি, জানিনি;
ধার করা আলো, আর
প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়
যা কিছু চিনেছি, তা
অভ্যস্ত চোখ ও মনের
দ্রুত গাণিতিক সমীকরণ।
আমার আবিষ্কারের, সবকিছুই জমা হয়ে আছে
আবছা ফেলে আসা, ছোট্ট
ছেলেবেলার উঠোনে।
স্মৃতির কোটরে যা কিছু ছিল
সবই বদলে গেছে
ক্ষয়ে, নুয়ে, ভেঙ্গে গেছে;
রোদে জলে ধুয়ে গেছে, মুছে গেছে।
মনের কোনায়, ল্যাম্পপোস্টের খুটেতে
আজও ছেঁড়া ঘুড়ির মত
আটকে আছি হারিয়ে যাওয়া
ছেলেবেলার সেই ছোট্ট ‘আমি’।
টেবিলে রোজনামচা লেখার মোটা খাতাটা পরে আছে।
মন্মথবাবু তেমন ভাবে বিখ্যাত না হলেও, যৌবনে খুব একটা অপরিচিত ছিলেন না সাহিত্যের পরিমন্ডলে। বেশ কিছু উপন্যাস, কয়েকটি গল্প আর কবিতা বই-এর সুবাদে পাঠক-পাঠিকাদের মাঝে নামডাকও হয়েছিল। এখন সব কিছুই অতীত। সারাদিনই অবকাশ; অখন্ড অবসর নিয়ে লিখতে গেলেও শব্দ, অক্ষর ধরা দেয় না। সময়ের চোরাস্রোতে ভাটার টানে পিছিয়ে পড়েছেন। আধুনিক লেখার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না নিজেকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হীনমন্যতায় অপাংতেয় মনে হয় নিজেকে।
নামেই রোজনামচা, রোজ তো দূরের কথা, সপ্তাহান্তেও দু-পাতা লেখা হয় কি না সন্দেহ! মাঝে মাঝে হঠাৎ স্মৃতির
সরোবরে ঘাই মারে পুরোনো অতীত, ফেলে আসা নানা টুকরো ঘটনা। বেলাশেষে ছায়ারা দীর্ঘ হয়। বৃত্ত পরিক্রমায় জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে মন্মথবাবু অনুভব করেন, সময়ের গতিপথে, ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে যায়। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগের ঘটনাও আজকের প্রেক্ষাপটে অন্য রকম ভাবে ধরা দেয় মনের ক্যানভাসে। ছেঁড়া ছেঁড়া এই অনুভূতি গুলিই ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই খাতায় লিখে রাখেন মন্মথবাবু। শুধু লেখা নয়, এ যেন নিজের সাথে নিজের কথা বলা; আত্মকথন। মানুষের জীবনে কথা বলার লোকের বৃত্ত যখন ছোটো হয়ে আসে, নিজের সাথে নিজে কথা বলাই কি একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে?
১৪ই আষাঢ়, ১৪২৫
মঙ্গলবার সকাল, গতকাল সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। বেলা বাড়লেও দিনের আলো ম্লান। বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ। ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে দিন, একটু শীত শীত করছে। বারান্দায় এক-চিলতে রোদ সোনালী নরম মিঠে রোদ্দুর এসে পায়ের পাতায় লুটিয়ে পড়েছে। তেমন তেজ নেই, একটু বাদেই মিলিয়ে যাবে সুউচ্চ অট্টালিকার আড়ালে। মানুষ এখন পাশে বাড়তে পারে না, মাথায় বাড়ে। দু বছর আগেও সামনে একটু সবুজের ছোঁওয়া ছিল, প্রোমোটারদের দৌলতে সেটুকুও আর নেই। দুপুর বেলায় সূর্যের প্রখর তাপে নিজের ছায়া যখন ছোটো হয়ে আসে, তখন অনুভূত হয় এই ছায়ার মতই আমিও খুব দ্রুত ছোটো হয়ে ফুরিয়ে আসছি। জীবনের প্রয়োজনে জন্মের পর থেকে ছোটো থেকে বড় হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় থেকে ক্রমশ ছোটো হচ্ছি। জীবনের দীর্ঘ চলার পথে এখন শুধু অতীতের স্মৃতিটুকুই সম্বল। ভাবনা গুলো মাকড়সার জালের মত এলোমেলো হয়ে যায়, তার মাঝেই আচমকা হঠাৎ করে মনের কোন অতল গহ্বর থেকে ফেলে আসা নানা মূহুর্ত জলছবির মত ভেসে ওঠে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অনন্ত সময় নিয়ে বসে আছি। আমি কি স্বার্থপর? আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কেন দেখতে পাই না নিজের সন্তানদের মুখ! একি স্মৃতিভ্রষ্টতা? তাহলে কেন চোখ বন্ধ করলেই যা কিছু দেখি, সেই শৈশবের ঘটনা এসে পড়ে বারে বারে? কত পুরোনো, অথচ আজও স্পষ্ট! কিন্তু কই, ওরা যে এই এত বড় হল, বিদ্বান হয়ে স্কলারশিপ পেল বাইরে পড়তে যাবার সময়, সেই স্মৃতি কেন আবছা? দুই ছেলেমেয়ের দুজনেই বাইরে কর্মরত। চাকরি আর বিবাহসূত্রে
দুজনেই গ্রীন-কার্ড পেয়ে বিদেশেই থেকে যাবে বাকি জীবন। নতুন বছরের প্রথমে নিয়ম করে রঙিন পোষ্টকার্ডের মধ্যে দাদুভাই আর দিদুনের ছবি দেখতে পাই। আমারই মত অশক্ত সত্বেও দু-এক জন এখনও যারা পায়ে হেঁটে চলতে সক্ষম, তারা এলে বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখি তাদের দেখাবো বলে। তারা চলে গেলে মনে হয়, যাহ্, কিছুই তো বলা হল না! নিজেকেই প্রশ্ন করি, “কি হে জ্ঞানপাপী, সত্যিই কি ভুলে গেলে; না কি ইচ্ছাকৃত ভোলার অভিনয় করলে?” অবাক হয়ে ভাবি, স্বার্থপরতার সঙ্গে এও কি আমার আত্ম-প্রবঞ্চনা?
১৮ই আষাঢ়, ১৪২৫
শনিবার সকাল,
মানুষের ছায়া তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে বলে সে তাঁর নিজের ছায়ার স্বরূপ বুঝতে পারে না। ভুল বললাম; বুঝতে পারে তখন, যখন বেলাশেষে সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। নিজের ছায়া যতটা লম্বা হয়ে ওঠে, অতীতের প্রবল পরাক্রান্ত সেই মানুষটা সংকুচিত হয়ে ক্রমেই ততটা খাটো হতে থাকে।
সময়ের প্রবাহ স্রোতে ঘটমান অসংখ্য মুহূর্ত তৈরী হয়, আবার পরক্ষণে তা অতীতে পর্যবসিত হচ্ছে অতি দ্রুত। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটা ছোট্ট গ্রহ এই সবুজ পৃথিবী। তাঁর মধ্যেও কোটি কোটি প্রাণের সমষ্টিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটাণুকীট নগণ্য আমার এই অস্তিত্ব। মহাবিশ্বে অপরিমেয় অনন্তের মধ্যে আমার এই বিন্দুসম জীবনের তাৎপর্য কতটুকু?
প্রতি দিনের মত আজকের দিনটাও অতি সাধারণ। তবু একটু আলাদা বিশেষত্ব আছে বোধহয়। গত পাঁচ বছর আগে এই দিনটা আমার কখনই মনে থাকত না, অথচ যে মনে রাখত সবসময়, সে ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছে পুরোপুরি অনেক দূরের দেশে। দেওয়ালের গায়ে ছেঁড়া ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ দিয়ে রেখে অপেক্ষা করে এখন এই দিনটা শুধু মনে রাখি, সৌজন্যে এই ওল্ড-এজ হোমের আথিতেয়তা। যেদিন এই বুড়ো-বুড়িদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, সেদিন এখানের নিয়ম অনুযায়ী আমার ঠিকুজি কুষ্ঠি সব কিছু এরা নিয়ে রেখেছিল। প্রথম দিকে এক বছর ধরে মোটা লাল চালের ভাত আর ট্যালট্যালে নানা রকম সব তরকারির ঝোল খেতে খেতে যখন জিভের টেস্ট বাড্গুলি তাঁদের কাজকর্ম ভুলে গিয়েছিল, সেই সময় হঠাৎ একদিন এর অন্যথা ঘটল। যত্ন করে দুপরে খাবার পাতে রোজকার সু(!) খাদ্যের সঙ্গে ওই একটা আলাদা প্লেটে অল্প একটু দুধ গোলা ভাত, সঙ্গে কয়েকটা ভাঙ্গা চিনে বাদাম আর দু/চারটে কিশমিশ। সে-দিন না কি আমার পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই এই মহাভোজ! খাবার পর আমার হাতে ছয় ইঞ্চি মাপের একটা ক্যাডবেরি আর হ্যাপি বার্থ-ডে লেখা পোষ্টকার্ড সাইজের একটা সুদৃশ্য খাম আমার হাতে দেওয়া হল। কয়েকজন আমায় ঘিরে ধরে হ্যাপি বার্থ-ডে গানটা গাইলো কয়েক লাইন। আমায় হাসি হাসি মুখ দাঁড়াতে বলা হল, আর একজন এই অনুষ্ঠানের ফটো তুলে নিল ক্যামেরায়। বিদেশে আমার ছেলে– মেয়েকে পাঠাবে বলে।
ওহ্, বলা হয় নি আর একটা কথা; ফটো তুলে ওরা চলে যাবার সময় আমার দাঁত নেই বলে ক্যাডবেরিটাও নিয়ে গেল। আমারও বলিহারি। লজ্জার মাথা খেয়ে চাইতে গিয়ে আরো লজ্জা পেলাম। দোষের মধ্যে বলেছিলাম, দাঁত নেই তো কি হয়েছে! আমাকে দাও না; আমি চুষে চুষে খাবো!
হায় ভগবান! তারপর কত কথাই না শুনতে হল! চুষে খাবো বলাতে, সেটা অশ্লীলভাবে হাত নেড়ে কত ভাবেই না বোঝানো হল আমায়! আমি না কি বুড়ো ভাম, রসের নাগর! তিনকাল ঠেকে মরার সময় হল, এখনও রস কমলো না!
ছিঃ ছিঃ, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই! ধিক্!
ঘর ছেড়ে সবাই বেড়িয়ে গেলে, চৌকিতে শুয়ে চোখ বুঝে বিধাতার কাছে বললাম, কি প্রয়োজন ছিল এই নাটকের? আমার জন্মদিনটা কি ঘটা করে ওদের মনে করিয়ে দেবার এতটাই দরকার ছিল তোমার? তারপর থেকে আর ওদের কাছে কিছু চাই নি। পরের বছরেও আবার সেই পায়েসের প্লেট। তবে এবার আর আগের বারের মত ভুল করি নি। ওরা যা যা করতে বলেছিল, লক্ষী ছেলের মত শুনে তাই তাই করেছি। সেই দিনের পর থেকে ঐ পায়েস টুকুর স্বাদটা যেন জিভে লেগে থাকে সবসময়। বহুমুত্র রোগের প্রকোপে আক্রান্ত বহুদিন আগে থেকেই, মিষ্টি যে খুব ভালোবাসি তাও নয়; তবু ওই মিষ্টি পায়েসের স্বাদটা ভুলতে পারি না কেন?
লোকে বলে, বয়স বাড়লে না কি নোলা বাড়ে! সত্যি কি তাই? তবে কি শেষের দিন এগিয়ে এলো বলেই শুধু খাই খাই ভাব আমার?
পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত যে ছিল আমার সব সময়ের ছায়াবর্তিনী, সে আবার এসব শুনলেই মুখ-ঝাপটা দিত। একটু আগেই যেন সেই চেনা মিঠে গলায় শুনলাম,- “বুড়ো বয়সে ভীমরতি! বয়স হলে সুখী মানুষের না কি দুঃখবিলাসী ভাবনা দানা বাঁধে মনের মধ্যে। আজকের এই শুভ দিনে অনাছিষ্টি ভাবনা কেন? সুখে থাকতে কি ভুতে কিলোয়?”
প্রথমে বুঝতে পারি নি; চমকে গিয়েছিলাম। তারপর বুঝতে পেরে একগাল হেসে বললাম, “না গো, তা নয়। আমার এই নিস্তরঙ্গ জীবনে কি কোনো ঢেউ আছে? তোমায় কত ডাকি, তোমার তো আমার কাছে এসে আগের মত গল্প করার সময়ই হয় না। আমায় কি তুমি কখনও দুখী দেখেছো, বল? তোমায় বিয়ে করে ঘরে আনার পর থেকে সেই শেষের দিন অবধি তো দুজনের খুনসুটিতেই সংসারে এত বছর কাটিয়ে দিলাম! তুমি চলে যাবার পর আমার কথা বলার, শোনার লোক কই আর!”
- “ধ্যাত, তুমি ঠিকমত আমায় ডাকোই না, তাই তো আমি আসি না; আজ আমায় ভাবছিলে বলেই না এলাম!”
- “তুমি আর যাবে না তো আমার কাছ থেকে? “বল, থাকবে সব সময়?”
- “হ্যাঁ রে বাবা থাকবো, থাকবো, থাকবো। তিন সত্যি! এবার বিশ্বাস হল তো?”
- “হ্যাঁ, হল। তুমি তো মিছে কথা বল নি কখনও আমার সঙ্গে! তোমার কথা বিশ্বাস না করে উপায় আছে!”
- “ঠিক। এবার থেকে আর যাবো না তোমায় ছেড়ে কখনও। এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবো আমি।”
- “বাহঃ, খুব ভালো হবে তাহলে। তুমি যখন এসেই গিয়েছো, তখন একটা কাজ করবে?”
- “কি বল?”
- “আজ তো আমার জন্মদিন, তাই আজ ওরা খাবারের সঙ্গে আলাদা করে একটু পায়েস দেবে আমায়। আমি চাইলে ঠাট্টা করে, মস্করা করবে; তুমি ওদের বলে দেবে, আমায় যাতে আর একটু বেশি করে পায়েস দেয়?”
- “আচ্ছা, ঠিক আছে; বলে দেব। সকাল থেকে কত কথা বলে চলেছে! আজ তুমি খুব ক্লান্ত। আজকের দিনে মন খারাপ করতে নেই। তুমি চোখ বোজো এখন। এসো, আমি আগের মত তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই। ঘুম থেকে উঠে পায়েস খাবে।”
রান্নার মাসি সুরমা, খাবারের থালার সঙ্গে অতিরিক্ত পায়েসের প্লেটটা নিয়ে ২১ নম্বর ঘরে কাউকে না পেয়ে বারান্দায় এসে দেখে, দাদু হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। মাথাটা গাছের ছায়ার দিকে হেলে আছে, হাসি হাসি মুখ। বুড়ো বয়সের এই এক রোগ! গাল তোবড়ানো ফোকলা দাঁতে নিজের মনে কি যে বিড়বিড় করে কথা বলে, তা ভগবানই জানেন!
খাবারটা ঘরের টেবিলে রেখে, কাঁধ ধরে নাড়াতে গিয়েই কাঠের মত শক্ত দেহটা সশব্দে টুল থেকে দড়াম করে আছড়ে পড়লো নিচে শান বাঁধানো মেঝের উপর।
বিরক্তিভরা মুখে নিচের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে সুরমার অভিজ্ঞ চোখ বুঝলো, আজ আর তাড়াতাড়ি কাজে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে না।
...কাজের ফ্যাঁকড়া বাড়লো; কারণ, বুড়োটা মারা গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই!
Comments
Top
অন্যরকম
পুজো
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
অনেকক্ষণ থেকে অস্বস্তি হচ্ছিল ভুজঙ্গর। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিছানায় উঠে বসলেন। নিভাননীকে একটু ঠেলে বুঝে গেলেন ওঠবার নয়, ঘুমের ওষুধ সেঁধিয়ে গেছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। না খেলে ঘুম হয় না। নিভাননীর ঘুম না হলে তার ঘুমেরও দফা রফা। এটাই বেশ। রাতের ঘণ্টা ছয়েক নিশ্চিন্ত। বালিশের তলা হাতড়ে বুঝলেন টর্চটা নেই। মনে পড়ল সন্ধ্যেবেলা বাগানে গেছলেন বুলবুলি পাখির বাসা দেখতে, দুটো ডিম পেড়েছে। অন্য সময় দেখা পাওয়া যায় না মা-বাবা কারুরই। রাত্রে কিন্তু দুজনে এসে পাহারা দেয়। ছোট্ট বেদানা গাছের এমন জায়গায় বাসা বেঁধেছে যে বেড়াল, ভাম যে কোন সময় অঘটন ঘটাতে পারে। যেদিন থেকেই নজরে এসেছে সেদিন থেকেই সন্ধ্যেবেলা বার কয়েক গিয়ে দেখে আসেন। দু-একবার ছোট্ট করে আঙ্গুলের পেছন দিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, প্রথম প্রথম শিউরে উঠত, এখন আর করে না। চিনে গেছে, এ হাত আশ্রয়ের হাত। বসে থাকে নিশ্চিন্তে। আর তাতেই সমস্যায় পড়েছেন। নিবারণও মাঝে মাঝে লক্ষ্য রাখে। বেশী ভয় পাড়ার হুলো বেড়াল কয়েকটাকে নিয়ে। শেষমেষ উদ্বেগ ঢাকতে তার জাল দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন, বেড়ালগুলোর থেকে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। টর্চটা বসার ঘরেই থেকে গেছে। অন্ধকারে খানিক চোখ সওয়ালেন। তারপর ঠাওর করার চেষ্টা করলেন। মন বলছে ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। খানিক পরেই বুঝতে পারলেন তাঁর অনুমান অভ্রান্ত। মনের আস্বস্তি তিনি বুঝতে পারেন, এটা তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কোনদিন ফাঁকি দেয়নি। অনেক বিপদের আগাম আঁচ তিনি আগেও পেয়েছেন কয়েকবার। ভুজঙ্গবাবু দ্রুত বিশ্লেষণ করা শুরু করে দিলেন। রাতের আঁধারে ঘরের মধ্যে কোন সুহৃদ ঢোকেনি, এটা ভয়ানক রকমের সত্য। এবার বোঝার চেষ্টা করলেন বিপদের সম্ভাবনা কতটা। একটা ছায়া সিন্দুকের কাছে দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পেরেছে ঘরের একজন ঊঠে পড়েছে। কিন্তু সেটা মহিলা না পুরুষ বুঝতে পারছে না। আগন্তুকের থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা তাই বোঝার চেষ্টা করলেন। রাতের অন্ধকারে ঢুকেছে, ডাকাত নয়। দেখে মনে হয় না সঙ্গে এখানে আর কেউ আছে। বাইরে থাকলেও থাকতে পারে। অস্ত্র? তা থাকলেও থাকতে পারে। বন্দুক লাঠি নিয়ে আর যাই হোক চোর ঢুকবে না। তবে ছোরা-ছুরি থাকতে পারে।কিন্তু চোর কি ওসব নিয়ে আক্রমণ করেছে কোনদিন? মনে হয় না। কিন্তু ছুরি নিয়ে যদি লাফিয়েও পড়ে প্রথম ধাক্কা এ মশারি সামলে নেবে। যেমন তেমন মশারি এ নয়।
রীতিমত বিশেষ অর্ডার নিয়ে, যথেষ্ট সময় নিয়ে ভুবন দর্জির হাত থেকে বেরিয়েছে। দুপক্ষই চুপচাপ। একজন মশারির ভেতর, অন্যজন বাইরে। ধৈর্য্য পরীক্ষা। মনে মনে হাসলেন ভুজঙ্গ। জমিদার হোক আর নবাব হোক একদঙ্গল খুদের থেকে তাদের রেহাই নেই। মশা! তাঁর ভেঙ্গে পড়া বাড়ী, অযত্নের বাগান আর কেউ দখল করার কথা ভাবতেই পারে না। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মত দাপিয়ে বেড়ায় সারা দিন। নিবারণ মাঝে মধ্যে ধোঁয়া দেয় বটে তবে তা বেশীক্ষণ থাকে না। বড়জোর আটটা। আক্রমন শুরু হবার আগেই সবাই ঢুকে পড়ে মশারির ভেতর। রাতের খাওয়ায় বাহুল্য নেই। এই মশার জন্য এ বাড়ীতে কেঊ টেকে না। ভাবতে ভাবতেই চটাস করে শব্দ হল। হাসলেন ভুজঙ্গ। আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। একটু গলা খাঁকারি দিলেন।
- 'তা কি নাম হে তোমার?'
বেশ চুপচাপ কাটল কিছুটা। আবার একটা চটাস করে শব্দ। তারপর একটা বিরক্তিকর গলা – 'আমার নাম নিয়ে কি হবে। পুলিশ বাড়ীর লোক গ্রামের লোক যাকে ইচ্ছে হয় ডাকুন।'
বেশ মজা লাগল ভুজঙ্গর। কথাবার্তায় মার্জিত ভাব। বললেন – 'তবু, তুমি তোমার নাম বলবে না? বাবা মার দেওয়া একটা নাম তো আছে। ভালো নাম, ডাক নাম।'
- 'একটা নাম বললে সেটা আসল কিনা আপনি ধরতে পারবেন? যদি বলি আমার নাম ঘেঁটু, কিংবা ধরুন নাড়ু কিছু ফারাক ধরতে পারবেন? আমাকে কি আপনি চেনেন?'
- 'তা সত্যি কথা বলতে তোমাকে আমি চিনি না। আমার গ্রামের লোক বলে মনে হয় না। হলে কি আর এ বাড়ীতে ঢুকতে?'
- 'সে ঢুকেই টের পেয়েছি। ছ্যাঃ, ছ্যাঃ। জমিদার বাড়ী? ভুতুড়ে বাড়ীর হাল এর চেয়ে অনেক ভালো মশায়। একটা কুকুর বেড়ালেরও টিকি দেখতে পেলুম না।'
আঁতে ঘা লাগার কথা। একটু লাগলও। তবে সামলে নিলেন, ওসব গা সওয়া হয়ে গেছে এখন। সত্যি কথায় এখন আর দুঃখ পান না, পেতে নেই। নিচের এই গোটা তিনেক ঘর ছাড়া প্রায় সবটাই ভেঙ্গে পড়েছে। নিজেদের জন্য দুটো আর একটাতে সারাদিনের সারাক্ষণের সব কিছু সামলাবার লোক নিবারণ এবং রান্নার হরিঠাকুর। ছেলে মেয়েরা আর আসে না, এলে থাকার অসুবিধে হয় বড়। নিবারণ বাতে কাবু, হরিঠাকুর রাতকানা, যাওয়ার কোন ঠিকানা নেই, তাই থেকে গেছে। মাইনে নেয় না, দিতেও হয় না, দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। ভুজঙ্গ সোজা সাপটা বলে দিয়েছিলেন, - 'থাকলে থাকো না থাকলে যাও।' একে একে সবাই চলে গেছে। কি ছিল, কি হল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক জৌলুষ দেখে এসেছেন ভুজঙ্গ, আর দেখতে দেখতে তাঁরই জমানাতেই সব শেষ। আপনা থেকেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক কাঁপিয়ে, এমনই জোরে অন্ধকারের আগন্তুকও শুনতে পেল।
- 'দুঃখ পেলেন দেখছি। নানা আমি সে ভাবে বলতে চাইনি।' লোকটার গলায় সমবেদনার সুর। ভুজঙ্গর মনটা একটু হাল্কা হল। লোকটা চোর হতে পারে কিন্তু কিছুটা হলেও মন আছে। এবার একটা নাম না হলে কিন্তু বড্ড অসুবিধে হচ্ছে।কথাবার্তা জমছে না। ভুজঙ্গ গলায় একটু আন্তরিকতা ঢাললেন। কেন যেন লোকটাকে শুধুমাত্র চোর বলে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।
তখন থেকে আমার নামটা জানার জন্য বেশ চেষ্টা চালাচ্ছেন দেখছি। ওটি হচ্ছে না। নাম বলা বারণ। যেমন ইচ্ছে ধরে নিন একটা।
- 'সে আমি ধরেই রেখেছি। যেমন চোর, চোরা, চোরু, চোর চূড়ামনি। না না, চোরচূড়ামনি হল চোরেদের সেরা। তুমি
বাপু একেবারেই কাঁচা। নাহলে এভাবে হাতে নাতে ধরা পড়। তোমাকে বোকা চোর বলতে কোন আপত্তি নেই আমার।'
- 'আমার আছে। সে ভাবে দেখতে গেলে আমি চোর নই।'
- 'তুমি চোর নও? ভারী অবাক হলেন ভুজঙ্গ। তাহলে বাপু তুমি কে? কি জন্য এই মধ্য রাত্রে জমিদার বাড়ীতে ঢুকে বসে আছ?'
- 'জমিদার বাড়ী?' ফিক করে হালকা হাসির আওয়াজ হল। অন্ধকারেও ভুজঙ্গ ঠিক বুঝতে পারলেন। বুকের কোথাও লাগল একটু। অনেকেই এ নিয়ে মজা করে। কোবরেজ অন্নদাচরণ সবার সামনেই অনেকবার বলেছেন – 'ভুজঙ্গ, বলি কি কলকাতায় একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখ। আরশোলা, ব্যাং বিদেশে রপতানি হচ্ছে দেদার, মশা কেন হবে না? মশা কি ফেলনা? বিশেষ করে জমিদার বাড়ীর মশা, এদের শরীরেও জমিদার রক্ত বইছে কত পুরুষ ধরে,এখনো বয়ে নিয়ে চলেছে প্রতিদিন। না না, তুমি বাপু এবারে একটু ভবতে শুরু কর ... ঝাঁকে ঝাঁকে জমিদার মশা, একি আর কলকাতার নর্দমার জলের ডেঙ্গু মশা? আর তোমার অভয় পেয়ে যে ভাবে বাড়ছে এরা। তা বাড়ুক, তুমি যদি এর সদব্যবহার কর, কে তোমাকে থামাবে? বিদেশী মূদ্রার একটা পথ খুলে যাবে।'
গা জ্বালা করে, কিন্তু হজম করতে হয়। বড়ই দুরবস্থা চলছে। ছেলে মেয়ে দুজনেই রাজ্যের বাইরে। চাকুরি করে। দেওয়া নেওয়ার কোন বালাই নেই, কিন্তু সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হয়। জমির ধানে পেটে-ভাতে চলে যায় এই পর্যন্ত, অল্প বাড়তি ধান বিক্রীর টাকায় বেশী কিছু করা যায় না। এ বাড়ী সারিয়ে আগের জৌলুষ ফিরিয়ে আনা কি চাট্টিখানি কথা! আর ফিরিয়ে হবেই বা টা কি? থাকবে কে? বেশ চলছে গড়িয়ে গড়িয়ে যেমন, তেমনি চলুক। নতুন কিছু করা বা ভাবা কোনটাই তাঁর দ্বারা আর হবে না। চিন্তায় ছেদ পড়ল। পরিস্থিতি নিয়ে হুঁশ এল। ঘরের মধ্যে চোর, বৌ ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে অচেতন, কাজের লোক দুটোর কোন সাড়াশব্দ নেই, টেনে ঘুমুচ্ছে না হলে চোর সেঁধুল কি করে? তিনি একা কি আর সামলাতে পারবেন? কথায় কথায় ভোর পর্যন্ত টেনে দিতে পারলে।
- 'কি হোল চুপ করে গেলেন যে বড়? কিছু ফন্দি আঁটছেন, তাই তো? কি ভাবে আমাকে কব্জা করা যায়, তাই না?'
ধরা পড়ে একটু দমে গেলেন ভুজঙ্গ। দিনের আলো পর্যন্ত টানার কথাই ভাবছিলেন, তা হলে চাক্ষুস দেখা যাবে লোকটা কেমন। দমে গেলেও সামলে নিলেন। মিথ্যে কথা তাঁর ধাতে নেই, সে জমিদার হোন বা না হোন। বললেন -'তা বাপু কথাটা তুমি নেহাৎ ভুল বল নি। সেরকম যে একটা চিন্তা ভাবনা মাথায় খেলছিল না তাই বা বলি কি করে। নাঃ, একেবারে যতটা বোকা ভাবছিলাম ততোটা বোকা তুমি নও। তবে বোকার তকমাটা তোমার লেগেই থাকল, না হলে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে এ বাড়ীতে তুমি ঢুকতে যাবেই বা কেন। ঢোকার মত মেলা বাড়ি পাবে তুমি এ গ্রামে, নগদ টাকা, এট সেটা করে মন্দ হত না। তা না করে কোন বুদ্ধিতে তুমি এ বাড়ীতে ঢুকলে তাই আমার মাথায় ঢুকছে না। একটু ঝেড়ে কাশো না বাপু।'
চুপচাপ কাটল কিছুক্ষণ। তারপর চটাস চটাস বেশ কয়েকটা শব্দ।
- 'কি মশা পুষেছেন মশাই। রক্তখেকোর দল। জবজবে করে নিম তেলে মেখেছি, কিন্তু দিব্যি প্যাট প্যাট করে হুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে।' একরাশ বিরক্তি ঝরাল লোকটা।
- 'এ জমিদার বাড়ীর মশা বাপু, পোষ্য বলতেই পার। তবে খরচাপাতি নেই। জমিদারের রক্ত বইছে ওদের শরীরে সেই কত পুরুষ ধরে তার কি ঠিক আছে? নিম তেল ওদের কিস্যু করতে পারবে না। ভারী তৃপ্তি বোধ করলেন, একটু গর্বও। আর কিছু নিয়ে গর্ব করার নেই এখন।'
- 'রক্ত চোষার অভ্যেস জমিদারের রক্তে থাকবে এ আর নতুন কি। এমন কি মশাদেরও দিয়ে চোষাচ্ছেন। পোয়া খানেক টেনে নিয়েছে ইতিমধ্যে। ম্যালেরিয়া না হলেই হল।'
- 'মুখ সামলে হে ছোকরা।' চলাক করে খানিক রক্ত উঠে গেল মাথায় ভুজঙ্গর। এ তল্লাটে খোঁজ নিয়ে দেখ, এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। নেহাৎই সাদা মাঠা জমিদার ছিলেন আমাদের পূর্বপুরূষ। আমিও জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখিনি এমন কিছু হয়েছে এ বাড়ীতে। আমার ঠাকুর্দা, আমার বাবা আর এই আমি, অন্তত তিন পুরুষে এমন অপবাদ কেউ দেয়নি। রক্ত চুষতে জানলে আজ এটা জমিদার বাড়ীই থাকতো। তুমিই তো বলেছো ভুতের বাড়ী এর চেয়ে ভালো। কি বলনি?'
- 'তা বলেছি।' লোকটার গলায় একটু দুখী দুখী ভাব। 'সত্যি কি হাল হয়েছে বাড়ীটার। অথচ বাবার সঙ্গে যখন আসতুম ।'
- 'বাবার সঙ্গে আসতে?' কথাটা লুফে নিলেন ভুজঙ্গ। 'তার মানে অনেক দিন ধরে যাওয়া আসা আছে এ বাড়ীতে? সুলুক সন্ধান সব জান দেখছি। আমার তখনই বোঝা উচিৎ ছিল। হুট করে কোন আনকোরা চোরের এ ভাবে ঢুকে পড়াতো সম্ভব নয়। বাপের সঙ্গে থেকে থেকে হাত পাকিয়েছ, তাই না?'
- 'খবর্দার, আমার বাবা নিয়ে অমন কথা বলবেন না।' গর্জন করে উঠল লোকটা এমন ভাবে যে ভুজঙ্গ ভয়ানক চমকে উঠলেন। নিভাননী পাশ ফিরলেন। ঘুম জড়ানো গলায় কিছু বিড় বিড় করে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ভুজঙ্গর মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল। একটা চোরের মধে এমন প্রতিবাদী গলা তিনি ভাবতেই পারছেন না। তার মানে বাবাকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে লোকটা। তাঁর ছেলে-মেয়ের মতো নয়। চোখটা ভিজে এল। ধরা গলায় কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, 'বাবাকে খুব ভালোবাসো বুঝি?'
- 'এতে আবার নতুন কি আছে?' বাবার প্রসঙ্গে লোকটারও গলা নিচে নেমে এল। 'বাবা-মাকে ভালো না বেসে আপনার মতো লোকজনকে ভালোবাসতে আমার ভারী বয়েই গেছে।' আবেগ, অভিমান ঘরের ভেতরের হাওয়াটাকে বেশ ভারী করে তুলল। কিছুক্ষণ বেশ চুপচাপ। দুজনেই পেছনে তাকিয়ে দেখছে। কত স্মৃতি, কত ভালোলাগার ক্ষণ। চটাস চটাস শব্দও আর হচ্ছে না। মশারা বেশ টানছে। ভুজঙ্গই কথা শুরু করলেন আবার – 'তা বাবাকে যদি এত ভালোবাসো, তাহলে এ কাজে নামা কেন বাপু? জনগনের ধোলাই, পুলিশের মার এসব কি তোমার বাবার ভালো লাগবে? চুরি করাটা কি কোন ভালো কথা?'
- আমি তো চুরি করতে ঢুকিনি।' নির্বিকার গলায় বলল লোকটা।
- 'তো কি করতে ঢুকেছ বাপু তুমি এ বাড়ীতে? আমাকে দেখতে?' প্রায় ভেংচি কাটলেন ভুজঙ্গ।
- 'আপনার কি মনে হয় কিছু চুরি করার মত আছে এ বাড়ীতে?' ভুজঙ্গর কথা ভুজঙ্গকেই ফিরিয়ে দিল লোকটা। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যা দেখার দেখে নিয়েছি। দু-চারটে কাঁসার বাসন এখনো বেশ আছে, কিন্তু ওতে এখনকার চোরদেরও মন উঠবে না। ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে বিক্রি বাটা করে পোষাবে না।
- 'তা বাপু তোমাদের পোষানোর ক্ষমতা আমার নেই। অন্য বাড়ি দেখো। ভোর হয়ে আসছে, কেটে পড়। নিবারণ জেগে উঠবে, লোকজনও জেগে যাবে।'
- 'কিন্তু আমার কাজটা তো হল না। যার জন্য এত রক্ত দিলুম, এতক্ষণ আপনার সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করলুম, সেই কাজটাই তো বাকী থেকে গেল।'
- 'তখন থেকেই মনটা খচ খচ করছিল। একটা কিছু উদ্দেশ্য আছে। না হলে আমার ঘরে চোর? কি ব্যাপারটা খুলে বলো না বাপু। কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গালে, কি চাই তোমার?'
- 'একটা দলিল। আমার বাস্তুভিটের দলিল।'
- 'দলিল? ভুজঙ্গর মুখ হাঁ হয়ে গেল। মশারির বাইরে থাকলে নির্ঘাৎ ডজন খানেক মশা ঢুকে যেত। বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে জড়ানো গলায় বললেন - 'কার দলিল, কিসের
দলিল? আমার কাছে কেউ রেখেছিল?'
- 'না, আপনার বাবার কাছে রেখেছিলেন আমার ঠাকুর্দা। টাকা ধার নিয়েছিলেন কিনা।'
- 'ওঃ, তা কি নাম তোমার ঠাকুর্দার?'
- বললে কি আপনি চিনবেন? উষ্মা প্রকাশ পেল লোকটির গলায়। 'আমার বাবাকে আপনি চিনবেন।'
- 'কি নাম?'
- 'তারাপদ, চন্ডীপুরের। মাষ্টার মশায় হিসেবে লোকে চিনত ওনাকে।'
- 'তুমি তারার ছেলে?' গলা বুজে এল প্রায় ভুজঙ্গর। তারাপদ, তারাপদ! স্মৃতির ভারে প্রায় ডুবে গেলেন। স্কুলের কতগুলো বছর কেটেছে একসঙ্গে। জমিদার বাড়ীর রমরমা ছিল না, তাই তারাপদ বা অন্য ছেলেদের সঙ্গে মিশতে কোন সমস্যাই ছিল না। সেই তারাপদর ছেলে ঢুকেছে রাতের অন্ধকারে তাঁর ঘরে দলিল ফেরৎ পেতে? ভারী মন খারাপ হল ভুজঙ্গর।
মশারী তুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন ভুজঙ্গ। সলতে কমানো হ্যারিকেনটা উস্কে দিয়ে ডাকলেন - 'এদিকে এস।' অন্ধকার ঠেলে একজন এগিয়ে এল। কালো, লম্বা ছিপছিপে একটি ছেলে, সারা গায়ে তেল চকচক করছে। কাছে আসতেই নিম তেলের গন্ধ নাকে এসে লাগল। অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন ছেলেটিকে। তাঁর ছেলের চেয়ে একটু বয়সে ছোট হবে। স্কুলের পর ছাড়াছাড়ি, তারপর মাঝে মধ্যে এ বাড়ীর উৎসবে আসত তারাপদ ছেলের হাত ধরে। হঠাৎ করে সব যোগাযোগ আবার বন্ধ হয়ে গেল। ভুজঙ্গও আর খোঁজ নেননি। কেন নেননি এত দিন পরে তার আর কোন উত্তর পেলেন না নিজের থেকে।
- 'কি নাম তোমার? এবার নিশ্চয় নাম বলতে দ্বিধা নেই?'
- 'দ্বিজেন। বাবা মা দিজু বলেই ডাকতেন।'
- 'ডাকতেন? নেই আর?' গলা ভারী হল ভুজঙ্গর।
- 'বাবা মারা গেছেন ছ’বছর হল। মা মারা গেছেন গত মাঘে। একবছর হয়নি এখনো।'
- 'আমার কাছে দলিল আছে তোমাদের বাস্তুর কে বলেছে তোমাকে?'
- 'মা। বাবাই কোন সময় বলে থাকবেন মাকে। মা’র চিকিৎসায় বেশ কিছু ধার হয়ে গেছে। ঋণ রেখে মা বাবাকে দায়ী রেখে যেতে চাই না।'
- 'তা দিনের বেলায় আমাকে এসে বললে পারতে, রাতের বেলায় চুরি করার দুর্বুদ্ধিটা মেনে নেওয়া যায় না।'
- 'কত বছরের দেনা, কত টাকার দেনা কিছুই জানি না। আপনি আমাকে চেনেন না। এসে বাবার পরিচয় দিয়ে দলিল ফেরৎ চাইলে আপনি দিয়ে দিতেন?' একটু ঊষ্মা ঝরল গলায় দিজুর।
- 'হয়ত দিতাম না, কারণ আমি তোমাকে চিনি না। কিন্তু এই চুরির চেষ্টা তারাপদ মেনে নিতে পারত?'
- 'ভুল হয়েছে মানছি।' গাঢ় হল দিজুর গলা। 'কিন্তু এ ছাড়া আমার পথ কিছু কি ছিল?'
ভুজঙ্গ ভাবলেন খানিক। মেনে নেওয়া যায় না, আবার ফেলে দেওয়া যায় না। কোনটা ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছেন না। কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলেন – 'তা কি ভাবে দলিলটা নেবে ভেবেছিলে?'
- 'অত ভাবিনি।' নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল দিজু। তিনদিন আপনার এই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে গেছি। বড়সড় সিন্দুকটা দেখেছি, দলিলের মত দরকারী কাগজ ওর ভেতরেই থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
- 'তা ঠিক।' সায় দিলেন ভুজঙ্গ। 'দলিল কেমন দেখতে তুমি জান?'
মাথা নাড়ল দিজু। জীবনে দলিল দেখেনি। হাসলেন ভুজঙ্গ। সিন্দুকটা দেখিয়ে বললেন - 'যাও খুঁজে নাও।' হ্যারিকেন নিয়ে এগিয়ে গেল দিজু। বিশাল ভারী তালা ঝুলছে, হাত দিয়ে তুলতে গিয়ে বেগ পেতে হল। মিয়ানো গলায় বলল – 'এত সাংঘাতিক ভারী তালা!'
- 'কেন তুমি তৈরি হয়ে আসনি? তুমি কি ভেবেছিলে তালা খোলা থাকবে জমিদারবাড়ীর সিন্দুকে?'
- 'না তা ভাবিনি।' বলে কোমর থেকে একটা বাঁকান তার বের করে তালার ভতর ঢুকিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাতে থাকল। কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
ভুজঙ্গ দেখছিলেন একদৃষ্টিতে। বললেন -' বাস এই নিয়ে এসেছিলে জমিদার বাড়ীর সিন্দুক খুলতে?' দিজু জবাব দিল না। অসহায় ভাবে দৈত্যাকার লোহার তালাটিকে দেখছিল। ভুজঙ্গ উঠলেন। মশারি তুলে বালিশের তলা থেকে প্রায় একফুট লম্বা একটা চাবি বের করলেন। অবাক হয়ে দেখছিল দিজু। ভুজঙ্গ দুবার ঘুরিয়ে তালা খুললেন। বললেন - 'ঠিক আছে ধরে নাও,
সিন্দুক খোলা। এবার তোমার কাজ কর। আমরা সবাই কিন্তু ঘুমোচ্ছি। দিজু সিন্দুকের পাল্লা ধরে উপরে তুলল। বেজায় ভারী। তিন বারের চেষ্টায় উঠল কিন্তু যথেষ্ট শব্দ করে। ভুজঙ্গ বললেন - 'তোমার কি মনে হয় এই শব্দে কারোর ঘুম ভাঙতো না?'
- 'তা ভাঙতো।' মেনে নিল দিজু।
- 'মেনে নিলাম এই শব্দেও কারোর ঘুম ভাঙেনি। ধরে নাও আমরা ঘুমোচ্ছি। নাও এগোও।'
হ্যারিকেন নিয়ে ঝুঁকে সিন্দুকের ভেতর তাকাতেই মাথা ঘুরে গেল দিজুর। কাগজের পাহাড়। এর থেকে একটা দলিল খোঁজা তাও রাতের অন্ধকারে? ধপ করে বসে পড়ল দিজু। ভুজঙ্গ তাকিয়ে ছিলেন। বললেন - 'কি হল?'
- 'অ্যাত্ত কাগজ! এর থেকে খুঁজবো কি করে?' আর্তনাদ শোনাল দিজুর গলা।
- 'সে কি! জমিদার বাড়ী নিয়ে তো বেশ শ্লেষ করছিলে, তাই না? তা তুমি কি ভেবেছিলে শুধু তোমাদের দলিলটা পড়ে আছে, আসবে আর তুলে নেবে?' দিজু কোন উত্তর দিল না। কল্পনা আর বাস্তবে ভারী ফারাক। কেমন যেন মনে হয়েছিল, কাজটা হয়ে যাবে। কিন্তু কোনদিন ভাবেনি এ রকমও হতে পারে। ভুজঙ্গর দিকে তাকিয়ে বলল - 'আপনি বের করে দিতে পারেন?'
- 'আমি?' অবাক গলায় বললেন ভুজঙ্গ। 'আমি কোনদিন ওই সিন্দুক খুলেই দেখিনি। কতপুরুষ ধরে জমেছে কত দলিল, হিসেব, মামলার কাগজ তার কোন ইয়ত্তা আছে।'
- 'ওতে সব রকমের কাগজ আছে? এত বছরের জমিদারির?' হতাশ হয়ে দুহাতে কপাল টিপে ধরল দিজু। 'তাহলে কি হবে কাকাবাবু?'
কাকাবাবু! ভুজঙ্গ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন। কাকাবাবু! তারাপদর হাত ধরে যখন আসত তখন ওই নামেই ডাকত ছেলেটা। কত বছর হয়ে গেল। তারাপদর আগে এখন চন্দ্রবিন্দু, আর তিনি এখনও টিকে আছেন ভাঙ্গা জমিদারীর একমাত্র ওয়ারিশ হয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। কিছু একটা করতে হবে। দিজুর দিকে ফিরলেন, বললেন - 'এক কাজ কর। সিন্দুক থেকে সব কাগজ গুলো এক এক করে বের করে এই মেঝেতে রাখো। সাবধানে বের করবে কারন কোন কাগজের কি অবস্থা জানা নেই।'
- 'এই গোটা ঘরটাতো ভরে যাবে কাকাবাবু। হাঁটা চলা করতে পারবেন না কেউ।'
- 'তা যাবে। আর হাঁটা চলার লোক বলতে তো কয়েকজন। ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। নাও, শুরু কর। ভোর হয়ে আসছে।'
দিজু ঘরটাকে একবার ভালো করে পরখ করে নিল। জমিদার বাড়ী। এ ঘরে আগেও এসেছে, তখন ছোট ছিল। হাল্কা স্মৃতি। একদিকে বিছানা। নিভাননী তখনো ঘুমিয়ে। দ্রুত হাত ঘরটাকে গোছানো শুরু করল এমনভাবে যে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট বৃত্ত তৈরি হয়ে গেল। ভুজঙ্গ হ্যারিকেন তুলে ধরলেন, দিজু এক এক করে গোছা গোছা কাগজ সিন্দুক থেকে বের করে মেঝেতে সাজাতে লাগল। কাজ যখন শেষ হল তখন সূর্য উঠে গেছে। ঘরের মাঝখানে
কাগজের পাহাড়। ঘেমে গেছে দুজনে। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল, আংশিক সফলতার হাসি। এখনো অনেক কাজ বাকি। নিভাননী ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ ঘরের মধ্যে কাগজের পাহাড়ের পাশে ভুজঙ্গকে বসে থাকতে দেখে ভয়ানক অবাক হলেন। মশারির ভেতর থেকে বললেন, স্বপ্ন দেখলুম আমাদের ঘরে কার্তিক এসেছে। এতো দেখছি কাগজ। এত কাগজ কোত্থেকে এল গো রাতারাতি? ভুজঙ্গ হাসলেন। বললেন, - 'তোমার স্বপ্নের কার্তিক ওই যে বসে আছে।' হাত দিয়ে একপাশে বসা দিজুকে দেখিয়ে দিতেই নিভাননীর দুচোখ কপালে ওঠার যোগাড়। আর ওই কার্তিকই সিন্দুক থেকে সব কাগজ টেনে বের করেছে।
- 'কি হবে এ কাগজ দিয়ে?' নিভাননীর বিষ্ময় কাটে না। 'আর এই ছেলেটা কাদেরগো?'
অনেক আবর্জনা জমে ছিল সিন্দুকে। পরিষ্কার করতে হবে। তিনটে জমি ছাড়া আমাদের তো আর কিছু নেই। আর এদের একটা দলিল। বাকী সব পুড়িয়ে দেব। দিজুর দিকে ফিরলেন, বললেন - 'আজ বাড়ি যাও। খেয়েদেয়ে একটা টানা ঘুম দিয়ে কাল সকাল সকাল এস। কাল থেকে কাজশুরু। এক একটা করে পড়ে পড়ে দেখতে হবে। সময় লাগবে। এখানেই থাকবে কদিন, কাজ শেষ করে তোমার কাগজ নিয়ে বাড়ী যেও। নিভাননীর দিকে ফিরে বললেন, বলব সব বলব। চল দেখি, হরিঠাকুরের চা কতদুর। নিবারণ এল না এখনো।' বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন ভুজঙ্গ। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ। ঘোষ পাড়ায় ঢাকের বাজনা, প্রতিমায় মাটি পড়ছে। মা আসছেন। নিবারণ এক কাপ চা দিয়ে গেছে। দু’সপ্তাহ কি ভাবে কাটল টেরও পেলেন না। কি সাঙ্ঘাতিক উত্তেজনা। কত মামলার রায়, উকিলের চিঠি, সাক্ষ্য-প্রমানের খরচের হিসেব, ধার-দেনা-সুদ-বন্ধক, জমি কেনা-বেচার নানান খতিয়ান, জমিদারির আয়-ব্যয়। মাথা ঘুরে যাওয়ার দাখিল। ভুজঙ্গ জীবনে নিজে এত সব কোন কিছু করেননি আর হিসেবও রাখেননি, সিন্দুকের ভেতর এত তথ্য প্রমাণ আছে তা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেননি। কত বছর আগের সে সব মুহূর্তগুলো যেন সময়ের সীমা পেরিয়ে এসে চোখের সামনে ভাসছিল। দিজুতো নাওয়া খাওয়া ভুলে ডুবে ছিল কাগজে। অদ্ভুত নেশার মত পেয়ে বসেছিল, একটু সময় পেলেই বসে যেত। এ দু’সপ্তাহে এ বাড়ীরই একজন হয়ে গেল দিজু, নিভাননীর স্বপ্নে পাওয়া কার্তিক। ছেলে-মেয়ে দুরের, তাই দিজুই আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছিল সেই শুন্যস্থানে, অদ্ভূত মায়া। দিজুর দলিল পাওয়া গেছিল। ভিটে বিক্রী করে ধার-দেনা শোধ করে হাতে আরও প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ছিল। ভুজঙ্গর হাতে পুরোটা তুলে দিয়ে বলেছিল - 'কাকাবাবু, আমি কারোর দেনা রেখে যেতে চাই না। হিসেব কষলে অনেক টাকা হয়, অত টাকা পাবো কোথায়? যা আছে তাই নিয়ে আমাদের সবাইকে ঋণমুক্ত করুন। কম টাকা নয়। একসঙ্গে অত টাকা দেখেননি, যদিও জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী। অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ আছেন, কি দরকার নতুন করে জড়িয়ে পড়ার। তা ছাড়া টাকা তো আর তিনি ধার দেননি, নেওয়ার অধিকারও তাঁর উপর বর্তায় না। দিজুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন - 'কোথায় যাবে ঠিক করেছ? ভিটে তো বিক্রি করে দিলে।' উত্তরে একগাল হেসে ফেলেছিল দিজু। রবি ঠাকুরের কবিতা তুলে এনেছিল- 'তাই লিখে দিল বিশ্বনিখিল দু’বিঘার পরিবর্তে।' কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি দিজুর। নিবারণ এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিল টাকাটা। চার নম্বর ঘর সারাই হল। নিবারণ নিজে থেকে করাল। তারও বয়স হচ্ছে, একজন ছোকরা ওয়ারিশ থাকা অত্যন্ত জরুরি। নিভাননীও খুশি হয়েছিলেন। কার্তিক ওরফে দিজু পাকাপাকি ভাবে এ বাড়ীর চার নম্বর ঘরের পাঁচ নম্বর সদস্যপদ পেয়ে গেল। সিন্দুকের কাগজের পাহাড় থেকে একটা ছোট অতি সাধারণ দলিল পাওয়া গেছিল। উকিলের থেকে বুঝে এসেছিল দিজু। ভুজঙ্গর কোন উৎসাহ ছিল না, ছিল শুধু দিজুর, নিবারণের। দলিলটা মধ্য কলকাতার একটা মাঝারী বাড়ীর। কোন এক সাহেব টাকার অভাবে বিক্রি করে দিয়েছিল ভুজঙ্গর কোন এক ঊর্ধতন পুরুষকে। উকিলের থেকে দালাল, দালালের থেকে প্রোমোটার। দেড়কোটির একটু বেশী দাম পাওয়া গেল। অনেক টাকা। ভুজঙ্গ বিহ্বল হয়ে বললেন - 'এত টাকা নিয়ে আমি কি করব?' দিজু বলল - 'গ্রামের মানুষদের একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা তো করা যেতে পারে। এতটা জমি, এতগুলো টাকা, একটা কিছু কাজে লাগুক। কি বলেন কাকিমা?' নিভাননী মাথা নাড়লেন।
খবর রটে যেতে দেরী হল না। জমিদার বাড়ীতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র! গ্রামের মানুষের মুখে হাসি আর ধরে না। কোবরেজ অন্নদাচরণ সবার আগে। জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন - 'কাজের মত কাজ করলি ভুজঙ্গ।' জমিদারের রক্ত বলে কথা। তবে হুল ফোটাতে ছাড়লেন না। বললেন – 'আগে মশা দিয়ে রক্ত চোষাতিস, এখন সিরিঞ্জ দিয়ে। আগে ফোঁটা ফোঁটা, এখন বোতল বোতল।' বলে হো হো করে হাসলেন। ভুজঙ্গর আজ আর কোন খারাপ লাগল না। বললেন – 'তোকে দিয়েই শুরু করাব, দেখিস।'
তাকিয়ে ছিলেন ভুজঙ্গ। দিজুর দিন-রাত এক হয়ে গেছে। শুনশান ভুতুড়ে জমিদার বাড়ী লোকে লোকে ছয়লাপ। চিৎকার চেঁচামেচি মেশিনের ঘড়ঘড়, এ যেন কয়পুরুষ আগের জমিদার বাড়ী। বোধনের দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র উদ্বোধন হবে। কাজ চলছে পুরোদমে। খবর কাগজেও বেরিয়েছে। অনেক ডাক্তার যারা এ গ্রাম থেকে পাশ করে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে আছে, তারাও যোগাযোগ করেছে। আসবে তারা মাঝে মধ্যে, সবার রক্তেই লুকিয়ে থাকে কম বেশী মানুষকে ভালোবাসার ইচ্ছে। সবাই স্বার্থপর নয়, অর্থলোলুপ নয়। অবাক হচ্ছেন ভুজঙ্গ, চেনেন না এদের, দেখেননি কোনদিন। কিন্তু আজ সব এক ছাতার তলায় এসে জড় হয়েছে। অদ্ভুত ভালোলাগায় বুক ভরে যাচ্ছে ভুজঙ্গর, বুক ভরে গেছে নিভাননীরও। ছেলে-মেয়ে খবর পেয়েছে, আসবে জানিয়েছে। খুশি উপছে পড়ছে। পূজো আসছে, মা আসছেন। এবার অন্যভাবে, অন্যরূপে।
Comments
Top
নিত্যহরির
কথা
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
- কি পাব বলত ঠাকুর সোজা কথায়? ঘোলাটে চোখে তাকাল জগাই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। টলছে পা।
মৃদু হাসলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। আয়ত দৃষ্টি মেলে ধরলেন, মহাসাগরের গভীর নীল জলের সম্মোহনী টানে উদ্ধত দুর্বিনিত দুই মাতাল জগাই-মাধাই প্রায় ভেসে যায় আর কি! চোখ নামিয়ে নিল দুজনে। ও চোখে কি অত সহজে চোখ রাখা যায়? মাধাই ফিস ফিস করে জগাই কে বল্ল – সব্বোনেশে চোখ রে জগাই, তাকাস নে। যাদু করছে আমাদের। কাল কে তুই মেরে কপাল ফাটিয়ে দিলি, কি রক্ত, কি রক্ত ! আজ দ্যাখ সেই আমাদেরকেই আবার পথে আটকেছে!
জগাই ভারী বিরক্ত হল মাধাইর কথায়! যাদু না ছাই। সে ক্ষমতা থাকলে কালকে অমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খায়? মাধাইর দিকে তাকিয়ে বল্ল – ফিস ফাস আমার ভাল লাগে না মাধাই। গোটা নদীয়া আমাদেরকে চেনে। জগাই কাউকে ভয় পায় না, জগাইকেই সবাই সমঝে চলে।
জগাই দু’হাত আকাশে তুলে আস্ফালন করে। আমার কথার জবাব দিলে না তো ঠাকুর? কি পাব আমরা তোমার আখড়ায় যোগ দিলে?
স্মিত হাসলেল নিত্যানন্দ। দুই মাতালের কাঁধে হাত রাখলেন। শিউরে উঠল দুই মাতাল। জগাইর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন – কি পাবে?
জগাই একটু অস্থির হয়ে বল্ল – সেই কথাই তো জানতে চাইছি তখন থেকে। একটু খোলসা করে দাও না ঠাকুর।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত ছড়ালেন চির পরিচিত ভঙ্গিমায় –মদগুরু মৎসের ঝোল পাবে, চির যুবতীর কোল পাবে।
একটা হেঁচকি তুলল মাধাই। জগাইর হাতের মাটির ভাঁড়ে তখনো কিছু অবশিষ্ট কারণ বারি। সেদিকে একবার সতৃষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মাধাইর কাছ ঘেঁষে এল জগাই, আস্তে আস্তে বল্ল – আমি যা শুনলুম তুইও কি তাই শুনলি?
মাধাই দুর্বৃত্ত মাতাল হলেও জগাইর মত রগচটা নয়। এক আধটু বিচার বিবেচনা করে তবে কিছু বলে। ধূলো ঘামে ভেজা ঘন কালো চুলে হাত ঢুকিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে বল্ল – শুনতে আমরা কেউই ভুল করিনি। কিন্তু কোথাও একটা প্যাঁচ আছে, ধরতে পারছি না।
জগাইর চোখ বড় বড় হয়ে গেল – তাহলে ঠিকই শুনেছি বল। কিন্তু মদগুরু কথাটারমানে কি বলত মাধাই? তুই পিতাম্বর আচায্যির টোলে আমার চেয়ে দুবছর বেশী পড়েছিস।
শব্দটা কোনদিন পিতাম্বর আচায্যির টোলে পড়েছে বলে মনে পড়ল না, পড়লেও তা কি আর মনে থাকে? একবার ভাবল, এই ঠাকুরকে একবার জিজ্ঞেস করে। কিন্তু জগাইর কাছে মান থাকে না। বল্ল – খুব শক্ত শব্দরে জগাই। আমার সঙ্গে যারা পড়েছিল তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখিস কেউই বলতে পারবে না।
জগাইর চোখ বুজে এসেছিল, বল্ল – একটা সমস্যা থেকে আর একটা সমস্যা বাড়াসনে মাধাই। তুই না জানিস ঠাকুরকে জিজ্ঞেস কর।
মাধাইর শ্লাঘাতে ঘা পড়ল। আসহিষ্ণু গলায় বল্ল – আমি কি বলেছি, আমি জানি না। টোলের কথা তুললি বলেই বললাম। সব কিছু কি আর টোলে শেখায়?
নিত্যানন্দর মধ্যে ঈশ্বর আবেশ এসে গেছে। হরি নামের মাদকে চোখ ঢুলু ঢুলু, দুহাত আকাশের দিকে তুলে মন্দ্রস্বরে হরি নাম করে চলেছেন।
মাধাই সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে বল্ল –মদগুরু মানে মাগুর, সংস্কৃত শব্দ। তুই এসব বুঝবি না।
জগাই বিড় বিড় করে বল্ল – কি বলেছিল ঠাকুর পুরোটার মানে করে দেত।
মাধাই হাতের ভাঁড়টা মুখে উপুড় করে দিল, কিছু ছিল না। বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল – এই দ্যাখ, তোর ওই রসিকা মাগী কি ঠকান ঠকাল। কড়কড়ে টাকা দিলুম আর দু তিন চুমুকেই সব শেষ? কালকে এর একটা বিহিত করবই জগাই, তুই কিন্তু বাধা দিবি না। মাঝে মধ্যে ধার দেয় বলে কি মাধাইর মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?
জগাই নিজের ভাঁড়টা মাধাইর দিকে এগিয়ে দিল, বল্ল – নে, এখান থেকে দুচুমুক মেরে দে। আরা যে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম তার জবাবটা দে দিখি।
মাধাই মুখে একটা তাচ্ছিল্যর শব্দ করে বলল – থাক, থাক। আমাকে দিতে হবে না। তুই খা। একই টাকা দিলুম, একসঙ্গে খাওয়া শুরু করলুম, তোরটা থাকে কি করে?
জগাই,মাধাইর সঙ্গে তর্ক করে কোনদিন পারে না। আজকেও হাল ছেড়ে দিল। বল্ল – ঠিক আছে, কাল ও মাগীকে ধরব। তার আগে এই ঠাকুরের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করে নিই।
মাধাই বল্ল – স্রেফ ভুজুং ভাজুং দিচ্ছে জগাই। মাগুর মাছের ঝোল আর চিরযুবতীর কোল দেবে বললেই হল! একি রাস্তা ঘাটে গড়াগড়ি দিচ্ছে নাকি?
জগাইর চোখ খুলে গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল। বল্ল – বলিস কিরে মাধাই, চিরযুবতীর কোলে বসে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত? আহা রে!
টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল জগাইর জিভ দিয়ে নিচে পড়ল। খেতে বড় ভালবাসে। মাধাই মনে মনে গজরাল খানিক। একেবারে মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছে ঠাকুর। কিন্তু জানল কি করে?
জগাইর দিকে তাকাল মাধাই। ঢুলু ঢুলু চোখ। কি ভাবছে জগাই তা বেশ জলের মতই স্পষ্ট। তাকাল ঠাকুরের দিকে। তাঁর চোখও ঢুলু ঢুলু। দুজনে দু আবেশে বিভোর। কিন্তু বিপরীত মেরুর। বুঝতে পারল না মাধাই। জগাইকে একটা রাম চিমটি দিল মাধাই। অল্প চোখ খুলে হাসল জগাই। বল্ল – বেশ লাগছে রে মাধাই। তুই একবারটা ভাব দেখি, গরম গরম সাদা চালের ভাত, মাগুর মাছের ঝোল, আর খাচ্ছিস কোথায় বসে একবার ভেবে দ্যাখ – সুন্দরী যুবতীর কোলে বসে। অহো, কি কাথাই আজ তুমি শোনালে ঠাকুর!
তারপর নিজের ভাঁড়ের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। বল্ল – মাধাই, ঠাকুর তো এটা নিয়ে কিছু বলেনি। তাই না? এতো সোনায় সোহাগারে মাধাই। দিব্যি খেয়ে দেয়ে দু চুমুক টেনে আবার সুন্দরী যুবতীর কোলে শুয়ে পড়া। যুবতীদের দিয়ে কি আর ঠাকুর ফিরিয়ে নেবে? তুই কি বলিস মাধাই?
জগাইর চোখ আবার ঢুলু ঢুলু হয়ে গেল।
মাধাইর বিশ্বাস হচ্ছিল না। সতর্ক হয়ে চলে সে। কোথাও একটা ফাঁক আছে, এই ঠাকুর একটা মস্ত বড় চালিয়াত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সাবধান না হলে ডুববে সবাই, কিন্তু জগাই তো ডুবে বসে আছে। আবার একটা চিমটি কাটল মাধাই। জগাইর চোখ একটু ফাঁক হল। বল্ল – কিছু বলবি মাধাই?
মাধাই বলার জন্য উদ্গ্রীব। হিস হিস করে বল্ল – ঠাকুর বল্ল আর তুই বিশ্বাস করে নিলি। একটু খতিয়ে দেখবি না?
খতিয়ে দেখা জগাইর পোষায় না। বল্ল – কি দেখব আর মাধাই? ঠাকুর মানুষটা ভাল। আমাদের কি ভালো লাগে তা খোঁজ নিয়ে আমাদের বলেছে, যাতে করে আমরা আর কোনদিন ঠাকুরের উপর হামলা না করি। ঠাকুরের আখড়া দেখেছিস জগাই? মাধাই বোঝানোর চেষ্টা করে। সকাল হলেই হরিবোল হরিবোল করতে করতে
ঝোলা নিয়ে সব বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষায়। ভিক্ষাতে কি দেয়, জগাই? আর যাই দিক মাগুর মাছ কি দেয়?
জগাইর চোয়াল ঝুলে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে – ওদের কোন পুকুর টুকুর তো থাকতে পারে। কেউ হয়ত দান করেছে। কি পারে না?
তা পারে। মাধাই স্বীকার করে। সেখান থেকে প্রতিদিন আমাদের জন্য মাগুর মাছ ধরবে? কে ধরবে জগাই?
প্রতিদিন না হলেও মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলে ক্ষতি কি বল? সাফাই গায় জগাই। মাছ প্রতিদিন না পেলেও পেতে পারি। কিন্তু একবার একটি সুন্দরী যুবতী পেলে সেতো আর পালিয়ে যাবে না।
আখড়ার পাশ দিয়ে আমরা কত বার গেছি। মাধাইর ধন্দ কাটে না। একেবারে হা হা করে খোলা। আজ পর্যন্ত কোন মেয়েমানুষ আমার চোখে পড়েনি। তুই দেখেছিস জগাই?
জগাই স্বীকার করে সে দেখেনি। তা হলে? দুই মাতাল ঘোলা চোখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মাধাই ফিস ফিস করে – এই আমি বলে রাখলুম জগাই, এ মানুষটা সুবিধের নয়।
তা হলে কি মিছে কথা কইছে আমাদের? ফোঁস করে ওঠে জগাই, পুরনো মাতাল জেগে ওঠে। মারবো এই ভাঁড় ছুঁড়ে আবার?
মাধাই শিউরে ওঠে – না না আর মারিস নে। এখনো দ্যাখ কালকের কাটা দাগটা দ্গ দ্গ করছে। মিছে কথা হয়ত কইছেন না, কিন্তু কথার কিছু মারপ্যাঁচ থাকতে পারে।
চোখ খুললেন নিত্যানন্দ। নিখাদ ভালবাসা, করুণার টলটলে দিঘি দুচোখে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দুই মাতাল, ঘোলা চোখে ঘোর লাগে। এগিয়ে আসেন কাছে, আরো কাছে। প্রবল আকর্ষণে টেনে নেন দুই মাতালকে নিজের বুকে। বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কোথায়? বিশাল চেহারার দুই দুর্বিনীত মাতাল যেন নেহাত দুই শিশু। শান্ত স্বরে বলেন – যা বলেছি, তার সবই পাবে। কিচ্ছু বাদ যাবে না।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় কিন্তু ঠেলে ফেলতেও পারে না। মিন মিন করে জগাই। মিছে কথা কইছেন না তো?
হাসেন নিত্যানন্দ। আমাদের কি মিছে কথা বলা সাজে?
কিন্তু বড় ঠাকুর? মাধাইর দ্বিধা কাটে না। আপনার রক্ত দেখে তাঁর সেই তীব্র অগ্নি দৃষ্টির কথা ভাবলে আমি এখনও শিউরে উঠি। অভয় দিলেন নিত্যানন্দ – ওঃ, গৌ্রাঙ্গ ঠাকুরের কথা বলছ? তাঁর যে দয়ার শরীর। ও আমি সামলে নেব।
থামল নিত্যচরণ। ভাল গল্প বলে। রবিবারের দুপুর। সোফায় আধ শোওয়া হয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছিল হরিচরণ। প্রতি রবিবারের একই চিত্র। আজকেও অন্যথা নয়। দুই বন্ধু, কিন্তু নিত্যচরণ বিপত্নিক। রবিবার হলেই হানা দেয়। নিত্যচরণের একটু কিন্তু ছিল, কিন্তু হরিচরণের বউ রাধা রাজি করিয়েছে। সপ্তাহের ছ’টা দিন চাকরের হাতে রান্না খেয়ে কাটাক, একটা দিন না হয় একটু মুখ পালটানো। পাড়ায় গলায় গলায় দু বন্ধুকে কেউ কেউ বলে গৌর-নিতাই, কেউ কেউ বলে জগাই-মাধাই। মদ্যপ কেউ নয়, আবার ধর্মপ্রাণ কেউ নয়। তবু এটাই এদের ডাক নাম। একা থাকলে ঠিক নামে ডাকে, কিন্তু জুটি বাঁধলেই বিপদ।
আজ জগাই-মাধাইর গল্প শোনাচ্ছিল নিত্য। আর সোফায় শুয়ে শুয়ে শুনছিল হরি। নিত্য থামতেই বল্ল – ধাঁধা টা কিন্তু থেকেই গেল।
কোন ধাঁধা ? সবটাই তো জলবৎ। নিত্য আড় ভাঙ্গে।
মদগুরু মাছের ঝোল আর চিরযুবতীর কোল। আড়চোখে পর্দার দিকে তাকাতে ভুলে না হরি। শ্রীমতীর চরণ দুখানা না দেখা গেলেই মঙ্গল। রাধাকে হরি ওই নামেই ডাকে, শ্রীকৃষ্ণও ওই নামে ডাকতেন শ্রীরাধাকে।
নিত্য হাসে। বলে – মাধাই ঠিকই ধরেছিল। নিতাই ঠাকুরের কথার চাল ওটা। মদগুরু মানে শ্রীগুরু। শ্রীগুরুর বচনামৃতকেই মদগুরু মাছের ঝোল বলেছিলেন নিত্যানন্দ।আর চিরযুবতী? হরি উৎসুক। আহা কি সুন্দর টোপ।চিরযুবতীর কোল। কে না টলবে বল? এখনই শুনলে ভেতরটা কেমন গুড় গুড় করে। নিমিলিত চোখে কড়িকাঠের দিকে তাকায় হরি। কেমন যেন একটা ভাব আসা ভাব। ঠ্যাং নেচেই চলেছে তির তির করে।
তাই নাকি? একেবারে বিষ্ফোরণ ঠিক সময়ে। পর্দা ঠেলে ঢুকেছে রাধা। যুবতীর নাম শুনলে বুকের ভেতর গুড় গুড় করে তাই না?
তড়াক করে উঠে পড়েছে হরি। সব ভাব উধাও। দেখল খর চোখে তাকিয়ে আছে রাধা। সাফাই গাইতে চেষ্টা করল হরি – ওটা একটা উপমা আর কি। তুমি আছ, বুক কি আর গুড় গুড় করতে পারে? চা’টা তো নিয়েই আসবে, একটু ভাব আসছিল, গেল সব চটকে।
চোখ বুজে পড়ে ছিল নিত্য। রাধা-হরির মাঝে নাক গলায় না খুব একটা, তবে রাধার হার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে রাধার পক্ষ নিয়ে সওয়াল জবাব করে।
চোখ বুজেই একটা ছোট্ট ফোড়ন কেটে দিল – মিথ্যে কথা বলতে নেই হরি। বউদির মন রাখতে ওরকম মিথ্যে কথা নাই বা বললি।
মিথ্যে কথা? আকাশ থেকে পড়ে হরি। মিথ্যে কথার তুই কি দেখলি নিত্য? ঝাঁঝিয়ে ওঠে হরি।
দেখলাম বলেই তো বউদিকে সাবধান করে দিলাম। নিত্য নির্বিকার। বউদি তুমি নিশ্চয় শুনেছ হরির কথা – তোমাকে দেখে নাকি ওর ভাব চটকে গেল! ছি ছি, আমি ভাবতেও পারি না।সর্বনাশ করিসনি নিত্য, তোর ধর্মে সইবে না।
তোর বউ নেই বলে আমার বউর উপর নজর দিবি?
আহা কথার কি ছিরি দ্যাখ। তেতে ওঠে রাধা। নজর দেওয়া আবার কি? আমি কি আম তেঁতুল না মিষ্টি? বয়স তো হল, কথার লাগাম দাও।
নারদ, নারদ। দু’হাত উপরে তুলে নাচের ভঙ্গিতে শরীর দুলিয়ে দিল নিত্য। লাগিয়ে দে মা, লাগিয়ে দে। জয় তারা।
মেয়েদের সম্মান করতে শেখ হরি। বউদি ওকে ছেড় না।
বেরো, বেরো শালা আমার বাড়ী থেকে। রবিবারের দুপুরে হাজার টাকা কেজির পাঁঠা মাংসের ঝোল টেনে নারদের রোল নিয়েছিস? আমাদের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ককে তুই ভেঙ্গে দিতে চাইছিস? গজরায় হরি।
তুমি চেপে বসে থাকো ঠাকুরপো, একদম নড়বে না।
চেপে বসে আছিই বউদি। চা’টা খেয়ে নড়ব, তার আগে নয়। কিন্তু হরির ব্যাপারটা ফয়সালা করার দরকার।
কালসাপ, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছ শ্রীমতী। রাধার দিকে ঘুরে যায় হরি। একঘরে হয়ে যাচ্ছে। খাল কেটে কুমির এনে ঢুকিয়েছ। আমাদের সুখের সংসার ভেঙ্গে দিতে এসেছিস শালা? তোকে এ বাড়ী থেকে তাড়াব আমি।
কি করে তুমি ঠাকুরপোকে তাড়াও আমি দেখব। ঝাঁপায় রাধা। কাউকে এভাবে কেউ বলে?
ও নিয়ে তুমি মন খারাপ কর না বউদি। অভয় দেয় নিত্য। হরি বল্লেও থাকব, না বল্লেও থাকব। কিন্তু তোর ব্যাপারটা কি বলত হরি? নারী কি ভোগের জিনিষ? মনে পাপ রাখতে নেই। মন-মুখ এক কর।
কোনকালে ছিল না ঠাকুরপো, আর আজ এই বুড়ো বয়সে তার কি কন পরিবর্তন হয়? আমি আশাও করি নে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরির পাশে সোফায় বসে পড়ল রাধা।
আমি হাল ছাড়িনি বউদি। ফাগুন মাসের দিকে তোমাকে আর হরিকে নিয়ে একবার নবদ্বীপ যাব। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু আর নেই, কিন্তু অনেক আখড়া আছে। তার কোন একটাতে ভর্তি করে দেব হরিকে। আর তুই আমার বউকে নিয়ে সটকাবি। হরি-রাধার বদলে নিত্য-রাধা, তাই না? ছি ছি, কি কথা। কানে আঙ্গুল দেয় নিত্য হাসতে হাসতে। অবশ্য তোর idea টা খারাপ নয়। তোর এখন নিজেকে শুদ্ধ করার সময় এসেছে, আত্মা শুদ্ধি। মনে তোর বড় পাপ হরি। শ্রীহরির পায়ে নিজেকে সমর্পণ কর। তাহলে সব পাবি।
কি পাব নতুন করে? চোখ বুজে বিড় বিড় করে হরি।
“কি পাব” – নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কাছে জগাইর প্রশ্ন আবার উঠে আসে এত বছর পরে, এক রবিবারের দুপুরে এক সাধারন মানুষের কাছে আর এক সাধারন মানুষের প্রশ্ন হয়ে, নিত্যচরনের কাছে হরিচরনের প্রশ্ন। রাধাও তাকিয়ে থাকে নিত্যচরনের দিকে। পরিবেশটা কেমন যেন পালটে যায়। তিনজনে চুপচাপ।
হঠাৎ নিত্য উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত উপরে তোলে গৌ্র-নিতাইর সেই চিরায়ত ভঙ্গিমায় – কি পাবি হরি? চিরযুবতীর কোল পাবি। এই পৃথিবীতে কোন নারী চিরযুবতী থাকতে পারে? তুই কি বোকা রে হরি। এটা বুঝতে পারলি না? চিরযুবতী হল ধরিত্রী, শস্য শ্যামলা পৃথিবী, তার কোন জরা নেই, চিরসুন্দরী সে। মৃত্যুর আগেও তার কোলে, মৃত্যুর পরেও তার কোলে।
Comments
Top
স্মৃতিভ্রংশ
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
কিছুদিন হল সমস্যটা দেখা দিয়েছে। চট করে কোন কিছু মনে করতে পারেন না অবনী। বয়স ৭৩ হল। সব কিছু ঠিক আছে। খিদে হচ্ছে ঠিকঠাক, প্রতিদিন দু-কিলোমিটার পালা করে হাঁটছেন একটুও না হাঁপিয়ে, বাগানের মাটি কুপোনো থেকে শুরু করে আগাছা বাছা, জল দেওয়া, নিড়েন দেওয়া। ভুবন মালি আছে বটে, তবে কে মালি আর কে মালিক তা বোঝা যায় না। অবনীকে রীতিমত ধমক দিয়ে কাজ করায় ভুবন। খুরপি এদিক ওদিক চলে গেলে ভয়ানক ধমক খান অবনী।
- ‘কত্তাবাবা, পরশুও তুমি ঠিক এরকম করে চালিয়েছিলে খুরপি। গন্ধরাজ গাছটা এখনো সেরে ওঠেনি। কতটা দূর থেকে নিড়েন দেবে তা দেখিয়ে দিয়েছি। মনে থাকে না কেন বলো তো?
ধমক খেয়ে আমতা আমতা করেন অবনী। বলেন - বলেছিলি বুঝি? মনে পড়ছে না রে। আজকাল সব ভুলে যাচ্ছি কেন বলতো?
ধুতিলাল অনেক সময় এই মুহূর্তগুলোতে এসে পড়ে চা নিয়ে। ভুবনকে এই মারে কি সেই মারে। কোনকালে বিহারের ছাপড়ার বাসিন্দা ছিল মনে পড়ে না। ৩৬ বছরে সব মিলিয়ে বার চারেক গেছে। বৌ মারা যাবার পর আর যায়নি। এখন ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার ওখানে। ধুতিলালের কোন টান নেই। এখানেই বেশ থাকে। রেগে গেলে বাংলা বন্ধ, ভোজপুরী ছুটতে থাকে। ভুবন আবার উড়িষ্যার। রাগলে সেও কম যায় না। উড়িয়াতে চিল চিৎকার। বেশীরভাগ সময় ঝগড়াটা দশ-পনেরো মিনিটের বেশী স্থায়ী হয় না। ভুবনের একটু শ্বাসের টান আছে। কাশী শুরু হয়। কাশতে কাশতে বসে পড়ে। ঝগড়া থামিয়ে তখন ধুতিলাল দৌড়ায় জল আনতে। প্রতিপক্ষ এত অল্পে রণে ভঙ্গ দিলে ঝগড়া জমে কি করে? অবনী বা ভাগ্যলক্ষ্মী কেউ আজকাল আর ঝগড়ার মাঝখানে পড়ে থামানোর চেষ্টা করেন না, আগে করতেন। আজকেও তাই ঘটল। অবনীকে ভুবনের ধমকটা ঠিক হজম করতে পারেনি ধুতিলাল, তবে সেটা অবনীকে ভালোবেসে নয়। কত্তাবাবার কাছে ভুবন মান্যি গন্যি লোক হয়ে ঊঠছে আর সে যেই জায়গায় ছিল সেই জায়গায়। বয়সে ধুতিলাল বড় অবনী এবং ভুবনের চেয়ে। তাই স্বাভাবিক চোখে ধুতিলালের কতৃত্ব সবার উপরে থাকা উচিত। কিন্তু সে বিহারী, ভুবনের কথায় খোট্টা তায় আবার লেখাপড়ার পাঠ নেই। ভুবন সে তুলনায় সিক্স পাস। মুখে বলে, কিন্তু কত্তাবাবা কি আর তার সার্টিফিকেট চেয়ে পরখ করেছে কোনদিন? তবে কথাবার্তায় একটু পড়াশোনার ছাপ আছে। দুঃখ হয় ধুতিলালের, ইস কেন যে তার বাবা তাকে ফোর ক্লাসের পরে আর স্কুলে পাঠালো না। যেদিন ধুতিলাল তুলসীদাসের রামায়ন পড়া শুর করল তার পরদিন থেকেই স্কুল বন্ধ। আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। এটাই তাদের বংশের ধারা। ধুতিলালের মন সায় দেয়নি প্রথম প্রথম কিন্তু মেনে নিতে হয়েছিল। বাবার হাত ধরে কলকাতায়, তারপর কোলকাতা থেকে বর্ধমান, সেখান থেকে পুরুলিয়া আর তারপরে এই কত্তাবাবার বাড়ি। এখানেই কেটে গেল ৩৬টা বছর। ছেলে মেয়েরা তার চেয়ে বেশী পড়াশোনা করেছে, তবে সবাই যে চাকরি করছে তা নয়, যে যার মত করে সংসার গুছিয়ে নিতে পেরেছে। কত্তাবাবা অনেক টাকা দিয়েছেন তার পরিবারে, ধুতিলালের কল্পনার বাইরে। মানুষটা এত ভালো তাই আর ছেড়ে যাওয়া হয়নি, আরা যেতই বা কোথায়? বৌ মরে যাওয়ার পরে ছেলে মেয়ের সংসারে আর জড়াতে চায়নি ধুতিলাল। তর তর করে স্মৃতি এসে সামনে দাঁড়ায়, মান অভিমান সব গলে জল। সন্ধ্যে হলেই ছবি বদল। চান করে মালকোঁচা মেরে ধুতি পরে বসে পড়ে ধুতিলাল, ঘরের বিজলি আলো বন্ধ করে হ্যারিকেন জ্বালে। বিজলি চলে গেলে ছন্দপতন হতে পারে সেটা কারোরই পছন্দ নয়। ছোট্ট তেপায়ায় সিয়া-রাম-হনুমানের ছবির সামনে ধূপ জ্বলে, রেকাবিতে বাতাসা আর কলা। একটু পরে ভুবন এসে ঢোকে চান করে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে লুঙ্গির মত ধুতি পরে হাতে একটা ছোট্ট ঘটি। ধুতিলাল উঠে গিয়ে তিনটে পাথরে ছোট্ট গ্লাস নিয়ে আসে। ভুবন সাবধানে ঘটি থেকে ভাঙ্গের সরবত ঢালে তিনটে গ্লাসে সমান করে। যত্ন করে তিন নম্বর গ্লাসটা ঢাকা দিয়ে সরিয়ে রাখে যদি কত্তাবাবা এসে পড়েন। ভক্তিভরে ভাঙ্গের সরবত উৎসর্গ করে ধুতিলাল সিয়া-রাম-হনুমানজির কাছে। ভাঙ্গের গ্লাস কপালে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক চলে, কোন কথা হয় না। সরবত শেষ হলে শুরু হয় তুলসীদাসী রামায়ন, সুর করে থেমে থেমে পড়ে ধুতিলাল। প্রায় পুরোটাই মুখস্থ। ভাব-আবেগ টলটল করে দুজনের মধ্যে, সিয়ার দুঃখে টপ টপ করে জল পড়ে ধুতিলালের চোখ থেকে। ভুবনের চোখও ছাপিয়ে আসে যতটা না সিয়ার দুঃখে, তার চেয়েও নিজের অতীত ভেবে। সিয়া-রামের ভালোবাসার মতই গার্গী-ভুবনের ভালোবাসার জীবন শুরু হয়েছিল। পায়ে কাঁটা ফুটেছিল কবে ভুবন জানে না। গার্গীও বলেনি। পা ফুলে যন্ত্রনা একদিন। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার, সেখান থেকে মফস্বলের হাসপাতাল, সেখান থেকে কোলকাতা। ডাক্তার বলল টিটেনাস হয়ে গেছে। এক সকালে ভুবন দেখল হাসপাতালের বেডে তার দুহাতের মধ্যে হাসি হাসি মুখে অপলকে তাকিয়ে আছে গার্গী। নার্স এসে আস্তে করে শুইয়ে দিল গার্গীকে, চোখের পাতা দুটো বন্ধ করে দিয়ে একটা বেডশীট টেনে দিল। বলল ডাক্তার বাবু ডাকছেন কিছু কাগজ সই করতে হবে। কিসের সই জিগ্যেস করতে গিয়েও জিগ্যেস করা হয়নি, মুখ খুলতেই পারছিল না। তবে বুঝতে কষ্ট হয়নি। দেশে আর ফেরেনি ভুবন। অল্প জমি আছে, বাড়ীতে মা আর ভাই। বাবাও নেই। সে আর ভাগ বসাতে চায় না ওই জমিতে। তারপর এ ঘাট ও ঘাট। কতগুলো বছর। একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করত তখন ভুবন। বাজার ফেরত সাইকেল টায়ার পাংচার, ভুবনের হাতে ধুতিলালের সাইকেল। সেই প্রথম পরিচয়। একে অপরকে জানা। একদিন ভুবনকে জোর করে হাত ধরে নিয়ে এল কত্তাবাবা আর ভাগ্যলক্ষ্মীর কাছে। ভাগ্যলক্ষ্মী অবাক হয়ে বললেন – ও ধুতি, এ আবার কাকে ধরে আনলি? ধুতি গম্ভীর মুখে বলল – বয়স হচ্ছে কত্তামা। কত্তাবাবার বাগানের হালটা আর চোখে দেখা যায়না। আমার ঘরে আর একটা খাট ঢুকে যাবে। অনেক জায়গা আছে। অবনী হেসে বললেন – তোর একজন সঙ্গী চাই তুলসিদাসী রামায়ন শোনার জন্য তাই না? যুতসই এতদিন কাউকে খুঁজে পাসনি, এবার পেয়ে তাই টেনে এনেছিস, সেটাই বললে পারতিস। আমার বাগানের অজুহাত আর টানা কেন। এরও আর কোন পিছু টান নেই সে দেখেই বুঝেছি। এতগুলো ঘর খালি পড়ে আছে নীচে, তারই একটা খালি করে দে।
ব্যস, সাইকেল সারাই থেকে বাগানের পরিচর্যা। নিষ্প্রাণ যন্ত্রের সংগ থেকে বেরিয়ে এসে মিলে গেল সজীব সতেজ রংবাহারী বন্ধুদের। পালটে গেল ভুবন। এত আনন্দ এর আগে সে পায়নি। বাতাসের দোলা খেয়ে নরম সবুজ গাছের ডাল তার গাল ছুঁয়ে গেলে আনন্দের শিরশিরানী বয়ে যেত সারা শরীরে। হাসি ফুটল মুখে। সারা দিন কথা বলা শুরু হল নতুন বন্ধুদের সঙ্গে যদিও তারা সরাসরি জবাব দিত না। চুপ করে শুনত ভুবনের কথা। সেই শুরু। আজও চলে আসছে। গাছের ডাল পালা ছাটার সময় আস্তে আস্তে করে বোঝাত – বাবারা, এতে তোদের কোন কষ্ট হবে না দেখিস। আমরাওতো নখ চুল কাটি, কি কাটিনা বল? তাতে কি কষ্ট হয়? বরং হাল্কা লাগে। তোদেরও হাল্কা করে দিচ্ছি একটু।
অবনী শোনেন, আর অবাক হন। এত দরদ গাছেদের জন্য? বাগানের চেহারা গেছে পালটে। সবাই বাগানে আসে। অবনীর বন্ধু বান্ধবরাও আসেন। তারাও চিনে গেছে এই গাছ পাগল লোকটাকে। সমীহ করে চলে। একবার এক মহিলা এসে একটা হলুদ গোলাপ দেখে লোভ সামলাতে পারেননি। টুক করে তুলে নিয়ে খোঁপায় গুঁজে নিয়েছিলেন। আঁতকে উঠেছিলেন অবনী, এই না ভুবন দেখে ফেলে। এবং ভুবন দেখেও ফেলেছিল। কাছে এসে খুব শান্ত গলায় বলেছিল – মা ঠাকরুণ, কেঊ যদি এসে টকাস করে আপনার মাথা থেকে একটা চুল ছিঁড়ে নেয় কেমন লাগবে আপনার? মহিলা থতমত খেয়ে বললেন – মানে? চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় ভুবন বলল – ব্যথা লাগবে আপনার তাই না? মহিলা না বুঝেই মাথা নাড়লেন। ভুবন আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল – আমার ওই বন্ধুরও ব্যথা লেগেছে। আমাকে বললে আমি তুলে এনে দিতাম। ও খুশি হয়ে দিত। হন হন করে চলে গেল ভুবন। ভদ্রমহিলার স্বামী অবনীকে বললেন – তোমার এই মালীর মাথার গোলমাল আছে অবনী, এই আমি বলে দিলুম। ও পাগল। অবনী হেসে বলল – ওকে আমি তোমার চেয়েও বেশীদিন চিনি। হ্যাঁ ও পাগল, তবে গাছ পাগল। বড্ড ভালোবাসে ও গাছকে। আমিও কতবার ধমক খাই ওর কাছে। ভদ্রমহিলার অবাক হবার ঘোর কাটেনি তখনো। বললেন – তাহলে কি এটা সেই সেলফিস জায়েন্টের বাগান? এই বাগানে ফুল তোলা মানা।
অবনী বললেন – তা কেন? তিনটে ফ্লাওয়ার ভাসে রোজ ফুল সাজায় ভুবন, ঠাকুর ঘরে, বসার ঘরে আর আমাদের শোয়ার ঘরে। ওর বন্ধুদের কথায় ভুলিয়ে ফুল তুলে আনে। অবনী দেখছিলেন ভুবনকে। বিড় বিড় করতে করতে হলুদ পাতাগুলো খসিয়ে ফেলছে গাছ থেকে। অবনী জানেন ভুবন কি বলছে ওদের।
ভদ্রমহিলা বললেন – আপনাদের শোবার ঘরে ওই মালী ঢোকে? এ মা, কি লজ্জার কথা! আমার কত কিছু ফেমিনাইন জিনিষ ছড়িয়ে থাকে।বাইরের লোক সেখানে ঢুকে যাবে? না না , যতই বিশ্বস্ত হোক এটা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি লাগছে আমার। আপনাদের কথা অবশ্য আলাদা। অবনী কিছু জবাব দিলেন না।
ভাগ্যলক্ষ্মী কাছেই ছিলেন। এগিয়ে এসে বললেন – ও মা, ভুবন বাইরের হতে যাবে কেন? ভুবন আমার অপুর বয়সী। এক ছেলে আর এক মেয়ের বাপ। বাড়ী এলে দুপুরে সোজা আমার ঘরে ঢুকে পড়ে। বলে, মা সামনে কয়েকটা চুল পেকে গেছে। তুলে দাওতো। ভুবন কি দোষ করল?
ভদমহিলার খুঁতখুঁতুনি যায় না। বলেন – পেটের ছেলে আর এই মালী কি এক? আমি বুঝি না বাপু আপনাদের রকমসকম।
অবনী এতক্ষন চুপ করে শুনছিলেন। বললেন – আস্তে বলুন, ভুবন শুনলে কষ্ট পাবে। আজপর্যন্ত একদিনও যায়নি যেদিন ভুবন আর ধুতিলাল আমাদের দুজনকে প্রনাম করেনি।
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার ঘোর যেন আর কাটে না। ভদ্রলোক বললেন – এ চরিত্র যে তুমি রবিঠাকুর আর শরৎচন্দ্রের থেকে তুলে আনলে। বাস্তবে আবার এসব হয় নাকি, ধুস।
ভাগ্যলক্ষ্মী একটু অসন্তুষ্ট হলেন। শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলো কি কল্পনা? একেবারে বাস্তবের থেকে তুলে আনা, সবার তো আর কথাশিল্পীর চোখ নয়। এটা নিয়ে আর আলোচনা হোক তিনি চাইছিলেন না। তর্ক করে ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের কাছে কি আর প্রমাণ করবেন তিনি? ধুতিলাল আর ভুবন দুজনেই তো আর মিথ্যে নয়, আর মিথ্যে হয়েও যাবে না। কথা ঘোরালেন – যেতে দিন ওদের কথা।
স্মৃতিসমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছিল ভুবন। পড়া থামিয়ে মুখ তুলল ধুতিলাল। হনুমান আশোকবনে সিয়া’মার সঙ্গে দেখা করে রামের স্মারক অঙ্গুরীয় তুলে ধরেছেন। বাকরূদ্ধ সিয়া’মা। দু’চোখ ছাপিয়ে হু হু করে নেমে আসছে অলকানন্দা। টের পেল মহাসাগর। ধরিত্রী শুষে নেবে এই মহাপ্রবাহ? কোন অধিকারে? তার আগেই তুলে নিতে হবে এই মহাপবিত্র অশ্রুধারা। উচ্ছাসে উদ্বেল হয়ে ঊঠল মহাসাগর। মহাকল্লোল তুলে সহস্র সহস্র ফেনায়িত তরঙ্গ আছড়ে পড়তে লাগল তটভূমিতে। মহাপ্রলয় আসন্ন বুঝি। রুদ্ধবাক দশানন, বোঝার চেষ্টা করছেন হঠাৎ মহাসাগর ক্রুদ্ধ হোল কেন? ডুবে যাবে স্বর্ণলঙ্কা? উদ্বেগে প্রাসাদ শিখরে উঠে এলেন দশানন। প্রমাদ গুনলেন হনুমান। তাঁর উপস্থিতি এখনই দশাননের গোচরীভূত হোক তা কোনওমতেই কাম্য নয়। উপায়? রামভক্ত হনুমান অঞ্জলি পাতলেন। একি, অঞ্জলি যে ছাপিয়ে যায়। কি করবেন? প্রভুকে স্মরণ করে অঞ্জলির প্রবাহ ধারা নিজের বুকের দিকে বইয়ে দিয়ে বললেন – হে প্রবাহমানা অমৃতগঙ্গা,
তোমার উচ্ছাস স্তিমিত হোক, বিশ্বচরাচরের কল্যানে আজ তুমি পবননন্দনের বুকে সমাহিত হও। যেদিন প্রভু শ্রীরামচন্দ্র দুষ্ট দশাননকে বধ করে আমার সিয়া’মাকে সসম্মানে মুক্ত করবেন আমিও তোমাকে মুক্ত করে মহাসাগরের সঙ্গে মিলনের পথ উন্মুক্ত করে দেব। মন্দীভূত হল মহাপ্রবাহ। এক সময় তা থেমে গেল। বৃষ্টিভেজা পলাশের মত আয়ত চোখ দুটি অর্ধুন্মুক্ত হল। সামনে করজোড়ে পবননন্দন হনুমান। সিয়া’মা বললেন – কে তুমি পুত্র?
আঃ, কি স্বস্তি। কাল শুরু হবে এর পর থেকে। মাথায় ঠেকিয়ে বই বন্ধ করল ধুতিলাল। তাকাল ভুবনের দিকে। চোখ বন্ধ। ভুবন, এই ভুবন? সাড়া নেই ভুবনের। হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিল ধুতিলাল। দু’চোখ বুজে আছে ভুবন আর হূ হূ করে নামছে জলের ধারা। খুব আলতো করে নিজের ধুতির কোঁচা খুলে চোখ মুছিয়ে দিল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল ভুবন। লজ্জা পেয়ে বলল – কি কান্ড বলত ধুতিদাদা। তুমি ডাকছ আর আমি শুনতেই পাইনি।
পাবে কি করে? ভেংচি কাটল ধুতিলাল। যেবারেই এই অধ্যায়ে এসেছি, অমনি শুরু হয়েছে তোর অনাচ্ছিষ্টি কান্ড। পরের বারে তাহলে এই অধ্যায়টা বাদ দিয়ে দেব। ক্ষমা চেয়ে নেব সিয়ামা’র কাছে।
না না, সে কি কথা। ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভুবন। এ হলগে মহাগ্রন্থ। অসম্পূর্ণ করে পড়তে নেই।
তোর এই পাগলামি জেগে উঠলে এই পথটাই নিতে হবে। ধমক দেয় ধুতিলাল।
কি করব ধুতিদাদা? অসহায় শোনালো ভুবনের গলা - সিয়ামা’র চোখে জল দেখলে ভেতরের পাগলটাও জেগে ওঠে। মেরে ফেলার ক্ষমতাতো আমার নেই। ঘুম পাড়িয়ে রাখি, কিন্তু জেগে ওঠে মাঝে মধ্যে।
-আমারটা কেন জাগে না বলতো? দুজনে চমকে তাকিয়ে দেখে অবনী এসে দাঁড়িয়েছেন। কালেভদ্রে আসেন অবনী, এই যেমন আজ এসে পড়েছেন।
পাথরে গ্লাসটা এগিয়ে দেয় ভুবন, ধুতিলাল বিছিয়ে দেয় একটা আসন। ভুবন বলে – অমন কথা বলতেও নেই, ভাবতেও নেই। ও সব্বোনেশে জিনিষ মনে না আসাই ভাল কত্তাবাবা।
- আজ কি কি মনে করতে পারেননি কত্তাবাবা। উদ্বিগ্ন হল ধুতিলাল।
পাথরের গ্লাসে হালকা করে চুমুক দিয়ে বললেন – বেড়ে বানিয়েছিস তো ধুতি! বাঃ, বাঃ বেশ লাগছে খেতে। হ্যাঁ, কি বলছিলি যেন আজ কি মনে করতে পারিনি? সে বড্ড সব্বোনেশে দিনরে ধুতি। ও দিনটা কি কেউ ভোলে? করুণ শোনাল অবনীর গলা।
- কি দিন কত্তাবাবা? নিজের সমস্যা ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে ঊঠল ভুবন।
- সকালে নিয়ম করে যেভাবে হাঁটি সে ভাবে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। গিন্নি মুখ তুলে বলল, বেরুচ্ছ? খোকার ফোন আসবে কিন্তু। আমি বললুম, সে তো প্রতি সপ্তাহে রবিবার রবিবার আসে। আজ তো রবিবার নয়। আজ তা হলে ফোন কেন? বিশেষ কিছু আছে নাকি? গিন্নি দেখলুম কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বেরিয়ে গেল।
ভুবন, ধুতিলাল একসঙ্গে বলে উঠল - তারপর? এ যেন রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ।
পাথরের গ্লাস খালি করে ধুতির কোঁচায় মুখ মুছতে যাচ্ছিলেন, ধুতিলাল পরিস্কার নিপাট গামছা এগিয়ে দিল। সব মজুত করা থাকে। অবনী মুখ মুছলেন। বললেন – হেঁটে ফিরে দেখি খোকার ফোন, তোদের কত্তামার গলায় বিস্তর অভিযোগ।
আমি ঢুকতেই ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, খোকার ফোন, এই নাও, কথা বল। চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বললুম, হ্যাঁরে খোকা, আজ এই অসময়ে ফোন করলি যে বড্ড। সবাই ভালো আছিস তো? বৌমা, তিরি, তুতুন সবাই ভালো তো? ওদিক থেকে খোকার গলা ভেসে এল, একটু অন্যরকম। বলল, বাবা আজকাল তোমার ঘুম ঠিক-ঠাক হচ্ছে? আমি বললুম, হচ্ছে মানে, বেশ ভালোই হচ্ছে। যেমন হোত, তেমনই। তোর মার এই নিয়ে অভিযোগ, ঘুমোলে সাড় থাকে না, একি ঘুম রে বাবা! আচ্ছা বলতো খোকা, জেগে থাকলে সাড় থাকবে, আবার ঘুমোলেও সাড় থাকবে তাহলে এতো আধো নিদ্রা, আধো জাগরণ। সেটা কি ভালো? ওদিক থেকে খোকা বলল – সেটা ভালো নয় ঠিক, কিন্তু তুমি আমাকে বললে কেন আজ অসময়ে ফোন করেছি? আজ কি দিন বাবা? আমি বললুম, বুধবার। ভাদ্র মাস। পূজো আসছে। তিথি নক্ষত্র জানতে চাস? দাঁড়া পাঁজিটা দেখি। কিন্তু তোর কি হল বলতো, বাংলা মাসের তিথি নক্ষত্র জানতে চাইছিস ফোন করে? অ্যাই শুনছো, পাঁজিটা দাও খোকা তিথি নক্ষত্র জানতে চাইছে। খোকা বিরক্ত হল, অবাকও হোল, বলল – ড্যাড, ইঊ ফরগট হোয়াটস দি ডে টুডে? বিরক্ত হলে খোকার মুখে ইংরেজি চলে আসে।
অন্যসময় ঝরঝরে বাংলা, যদিও নাতি নাতনি ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ বেশী।
- ওটার মানে কি কত্তাবাবা? ধুতিলালের নিরীহ প্রশ্ন।
- খোকা বলছিল আজকের দিন কি দিন সেটা ভুলে গেছ বাবা?
- তুমি কি বললে কত্তাবাবা? ধুতিলাল উৎসুক। উৎসুক ভুবনও কিন্তু এই মুহূর্তে দুজন ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা তার কাম্য নয়।
অবনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন-এই প্রথম বার ভুলে গেলুম বুঝলি। আচ্ছা ধুতি, তোরও তো মনে থাকার কথা, কই তুইতো একবার উচ্চবাচ্য করলি না।
ধুতিলাল মাথা চুলকে বলল – কি ভুলে গেলুম বল তো কত্তাবাবা?
- তোদের কত্তামার জন্মদিনরে আজ। প্রতি বছর কালীঘাট যাই, এবছর মনেই পড়ল না। ভারী অবাক লাগছে রে। কেন এমন হল? নিজের জন্মদিন ভুলি তা ঠিক আছে, সেটা ভুলে যাওয়াই ভাল। কিন্তু তা বলে গিন্নীর জন্মদিন? না রে, খোকা সেটাই বোঝাচ্ছিল। কিছু একটা হয়েছে আমার।
- কি হয়েছে কত্তাবাবা? ব্যাকুল দুজনেই, ভুবন আর ধুতিলাল।
- অ্যলঝাইমার। অবনী ছাদের দিকে মুখ তুলে বললেন।
- কি মার কইলেন? তোতলাতে থাকে ধুতিলাল। যেন না শুনলেই ভাল।
- অ্যলঝাইমার। অবনী মুখ নামিয়ে বললেন। খোকা এটাই সন্দেহ করেছে।
- এটা নিশ্চয় কোন ব্যামো নয়? অনেক্ষন পরে মুখ খুলল ভুবন।
- ব্যামো নয় কিরে? ভারী কঠিন ব্যামো। রায় দিলেন অবনী। তোদের বোঝার কথা নয়। স্মৃতিভ্রংশ।
- কি হয় এতে কত্তা? ধুতিলাল ভারী চিন্তায় পড়েছে।
- সব আস্তে আস্তে মানুষ ভুলে যায়। কিচ্ছু মনে করতে পারে না। আজকে তোর কত্তামার জন্মদিন ভুলেছি, এর পরে তোদের নামও ভুলে যেতে পারি। মায় নিজের নামটাও। হাঁটতে গিয়ে দেখলি আমি ফিরছি না। বাড়ীর রাস্তা ভুলে গেছি। আস্তে আস্তে কাউকে চিনতে পারব না। নিজের গিন্নীকেও না।
- বালাই ষাট, বালাই ষাট। ওরকম অলুক্ষনে কথা বলবেন না কত্তাবাবা। ধমক দিল ধুতিলাল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেঁপেও উঠল। যদি সত্যি সেরকমটা হয়?
- ব্যাপারটা ফ্যালনা নয় রে ধুতি। অবনী যেন ভবিষ্যতটা দেখতে পাচ্ছেন।
- সে আর এমন বড় কথা কি? আস্বস্ত করল ভুবন। এই আমার কথাই ধরেন। ছোট বেলায় ডাঙ্গুলি খেলতে গিয়ে শ্রীপতি মাষ্টারের কপাল ফুলিয়েছিলুম নাকি হোলির আগুনে একটা খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে ছিলুম সে কি আর এখন মনে আছে? মনে না থাকলে কার কি যায় আসে কত্তা। যত ভোলা যায় ততই ভাল। আমি যেমন ভুলতে চাই কিন্তু পারছি না। গলা ধরে এল ভুবনের।
মনটা খারাপ হয়ে গেল অবনীর। সত্যি তো কত স্মৃতি বুকে করে বয়ে বেড়ানো বছরের পর বছর। এদের কেন অ্যলঝাইমার হয় না কেন কে জানে?
- কিন্তু কত্তা, ধুতিলালের ধন্দ যায় না, এটাতো খোকাবাবার কথা। ডাক্তারতো কিছু বলেনি।
- তা বলেনি। তবে খোকা বলল শহরে গিয়ে চেক করাতে। সে বড্ড হ্যাপা রে ধুতি। কিন্তু তোরা দুজন ভুলে গেলি কি করে আজ তোদের কত্তামার জন্মদিন?
ভুবন প্রতিবাদ করে উঠল। বলল – আমি তো ভুলিনি। এটা কি ভোলার মত কথা। কত্তামা হলুদ গোলাপ ভালোবাসেন। একটা ফুটেছিল। আলাদা করে দিয়ে এসেছি সকালে, প্রনামও করেছি। ভারী খুশি হয়েছিলেন। বললেন, তোর কত্তাবাবার আক্কেলটা দেখলি ভুবন। হন হন করে বেরিয়ে গেল। যাক তুই তবু মনে রেখেছিস। ধুতিও আজ আসেনি, তোর কত্তাবাবার মতই ভুলে মেরে দিয়েছে।
ধুতিলাল প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যায় আর কি। অপরাধী গলায় বলল – কত্তাবাবা, তোমার সঙ্গে আমাকেও নিয়ে চল। মাথার ব্যামো বলে কথা। কি করে ভুলে গেলুম কে জানে?
- আমার মনে হয় এটা এখনও গুরুতর হয়নি। আমার গ্রামে দিনু কোবরেজকে দেখেছি বুড়োদের মাথার মাঝখানটাতে কিছু একটা লেপে দিত কালো কালো বেড়ালের পায়খানার মত। বড্ড বিটকেলে গন্ধ। অতে নাকি মাথার ব্যামো ভালো হয়। ভুবন গম্ভীর গলায় নিদান বাতলায়। দিনু কোবরেজ এতদিনে ওপারে বুড়ো দেব-দেবীদের চিকিৎসা করছেন নিশ্চয়। সেখান থেকে ডেকে আনা যাবে না। তবে ধীরা কোবরেজকে একবার দেখাতে পারেন। বয়স হয়েছে, লোকে মান্যি গন্যি করে।
ধীরা কোবরেজের মনটা আজ ভালো নেই। না থাকারই কথা। কাল থেকে মনটা খচ খচ করছে। বিনয় ডাক্তারের আস্পর্ধা দেখে ভারী অবাক হয়েছেন। আর সেই সঙ্গে কালু চোরেরও। ধীরা ঠিক করেছেন ওকে কেলো বলবেন কারন আরও একটা কালু আছে। কিছুই জানতে পারতেন না যদি না কেলো চোর এসে গুহ্য কথাটা ফাঁস করে দিত। প্রতিদিনই রাত ৯ট ১০টা পর্যন্ত চেম্বারে আরাম করে বসে থাকেন, তবে চেয়ারে নয়। আরাম কেদারায়। ওই নাম মাত্র চেম্বার। তিনি বলেন ধন্নন্তরী আলয়। শুনতে সেকেলে, লোকে বিষেশ করে উঠতি বয়সী ও মাঝ বয়সীরা টিপ্পনী কাটে। বয়স্করা একটু সমীহ করে, অনেক সফলতার ইতিহাস লোকের মুখে মুখে ঘিরে যতট না তাঁকে নিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশী তাঁর স্বর্গীয় বাবাকে নিয়ে। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী ছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করে, অনেকে করে না। খুব একটা যায় আসে না তাঁর। বাবার থেকে জ্ঞান, কোলকাতায় বেশ কয়েক বছর আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশোনা করলেও তিনি জানেন বাবার সঙ্গে তাঁর তুলনা হয় না। শুধুমাত্র নাড়ী ধরে চোখ বুজে বসে থাকতেন অনেক্ষণ, রোগীও ধৈর্য হারায় হারায়, তারপরেই রোগ নির্ণয় করে দিতেন। ক্যানসারের মত মারণ রোগও তিনি ধরে ফেলতে পারতেন, তবে একজন ছাড়া কাউকে বাঁচাতে পারেননি। অদ্ভুত ক্ষমতা চিল তাঁর রোগ নির্ণয়ের। ধীরা আজও সেই রহস্যের চেষ্টায় মশগুল। রাত বাড়লে সব শুনশান হয়ে গেলে আরাম কেদারায় বসে নিজের নাড়ী ধরে বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু কিছু ধরতে পারেন তবে বাবার মত নয়। কালও এমনি বসে ছিলেন, খাওয়ার দেরী আছে দেখে নিজের নাড়ী ধরে নিলেন। হঠাৎ পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে কেউ একজন বসে পড়ল – প্রণাম কোবরেজ বাবা।
চমকালেন না, কোনওদিন চমকান না। কোবরেজদের ধীর স্থির হওয়া বড্ড জরুরী। হাল্কা গলায় বললেন – কে রে তুই? প্রনাম যখন করেছে তখন ছোট হবেই, তা ছাড়া রাতে তার কাছে কোন রুগী আসে না। হ্যারিকেনের হালকা আলোয় লোকটাকে দেখলেন। আলো বাড়ালেন না। কালো কুচকুচে, তেলকালী মাখা সারা মুখে। লোকটি বলল – আমি কালু, কোবরেজবাবা। ধীরা হাতড়ালেন – কোন কালু বলত? হাটতলায় তেঁতুল গাছের নীচে দলবল নিয়ে যে বসে থাকে?
লোকটা ভারী আহত হল মনে হল। অভিমানী গলায় বলল – মরে গেলেও যেন অমন না হই বাবা। আমিও তেমন কোন মহাপুরুষ নই, তবে ওরকম নই। ও হল কালাচাঁদ আর আমি হলুম কালীকিঙ্কর।
ধীরা হাসলেন। বললেন- মনে হচ্ছে তোমার বড্ড অপছন্দ, কিন্তু বাপু কালী আর কেষ্টতে ভারী মিলমিশ আছে।
-তা বলতে পারব না কোবরেজবাবা। তবে ওই হাটতলার কালু হওয়ার চেয়ে বাবলা গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লে পুণ্যি হবে। লোকটার গলায় আহত অভিমান।
-আচ্ছা, আচ্ছা সে না হয় হল। কথা ঘোরালেন ধীরা। তেল কালী মেখে রাতে বেরিয়েছ, তা আমার চেম্বারে কেন বাপু? সুবিধে হবে না আগে থেকে বলে রাখলুম। রান্নাঘরে গোটা কয়েক কাঁসার থালা, গ্লাস বাটী ছাড়া কিচ্ছু নেই। আলমারীও ঢুঁ ঢুঁ।
কালু তাচ্ছিল্যের একটা শব্দ করে বলল- সে কি আর আমি না দেখে এয়েছি? গিন্নীমা আটা মাখছেন, আর সরো দিদি ঠাকরুণ কিছু একটা ভাজছেন, মনে হল ওল ভাজা। থালা গেলাস গুলো জানলার ধারেই ছিল, টুক করে সব কটাই তুলে নিতে পারতুম, কিন্তু নিই নাই।
-তা আমাকে এত দয়া কেন কালু? ধীরা হঠাৎ উৎসাহ বোধ করতে শুরু করলেন।
-আপনি হলেন কোবরেজবাবা, সাক্ষাৎ ধ্বন্বন্তরী। মানুষের জীবন মরন আপনার হাতে। আপনার বাড়ী থেকে বাসন সরালে কি আমার ধম্মে সইবে বাবা?
-ও বাবা, তুমি আবার ধম্মকম্ম করো নাকি?
-করি কোবরেজবাবা। হাটতলার ওই কালু করে না। বেশীদিন টিকবে না ও। তা যেতে দ্যান। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়েছিলাম, আপনার রান্নঘরে আলো দেখে থমকে গেলুম। বুঝলুম, কাজে যাওয়ার সময় হয়নি এখনো। মধ্য রাত্তির থেকে আমার কাজ কিনা। মেঘলা ছিল একটু, তাই ঠাউর হয়নি। ভাবলুম দু দন্ড কাটিয়ে যাই আপনার সঙ্গে, পূন্যি হবে। সেই সঙ্গে একটা গুহ্য কথাও জানিয়ে যাই।
-গুহ্য কথা? ধীরা সোজা হয়ে বসলেন। কাকে নিয়ে?
-আজ্ঞে আপনার কাছে বলছি যখন, তাখন আপনাকে নিয়েই। বিনু ডাক্তার আজকাল আপনার বড্ড বদনাম করছে কোবরেজবাবা। বলে, যত্ত সব ভুজুং ভাজুং। তোরাও তাই বিশ্বাস করিস। বিশল্যাকরনী, ফুঃ। সে রামচন্দ্রের হনুমান ছিল তাই আনতে পেরেছিল। তোদের কোবরেজকে বল একটা চারপায়া পুষতে। তারপরে হিমালয় নিয়ে ভাবা যাবে। শুনলে গা জ্বলে যায় বাবা।
-বলেছে বিনু ডাক্তার এমন কথা? ধীরার যেন বিশ্বাস হয় না। উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু সামলে নিলেন। তিনি কোবরেজ। বললেন-তোমাকেও একটা গুহ্য কথা বলি শোন। রক্তে চিনি আর চাপ – দূটোই বেড়েই চলেছিল বিনু ডাক্তারের। শহরে নামি দামী ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছিল। কিছুদিন পরে চিঁ চিঁ করতে করতে আমার কাছে হাজির। বলল, তুই বাঁচা আমাকে ধীরা। নাড়ী দেখলুম, কিডনির এখন তখন অবস্থা।
-আপনিও গলে জল হয়ে গেলেন। শ্লেষ করতে ছাড়ল না কালু।
-কি করব বল, কোবরেজদের ধর্মই তো সেটা, না হলে পতিত হব যে। টানা তিন মাস ওষুধ খেয়েছে। তবেই না গলায় জোর এসেছে। সবার সামনে একদিন এই গুহ্য কথাটা ফাঁস করে দিও।
-সে আর বলতে কোবরেজবাবা। পুরো হাটের মাঝখানেই হাঁড়ি ভাঙ্গব। আজ চলি তাহলে বাবা। পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কালু।
কয়েকমিনিট পরেই রান্নাঘর থেকে গিন্নীর চিল চিৎকার – ওগো দৌড়ে এস, কি সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।
পড়িমরি করে দৌড়োলেন ধীরা। হাউমাউ করে কাঁদছে সরো।
-কি হয়েছে? ব্যস্ত হলেন ধীরা।
-কি হয়ে গেছে বুঝতে পারছ না? কবেই বা বুঝেছিলে? গিন্নীর চিৎকারে আরো ঘাবড়ে গেলেন ধীরা।
সরোকে বললেন, কি হয়েছে রে সরো? কাঁদতে কাঁদতে সরো বলল-সব্বোনাশ হয়ে গেছেগো দাদা। বৌদি রুটি
বেলে আমাকে দিচ্ছিল, আমি সেঁকছিলুম। তোমাকে খেতে ডাকব, থালা আনতে গিয়ে দেখি সব সাফ। ওই জানলার ধারে ছিলগো দাদা, আমরা দুটো জ্যান্ত মেয়েমানুষ বসে আছি, এই ভর সন্ধ্যেতে কি করে কে সরাল গো দাদা। বামুন বাড়ীর বিধবা আমি, নির্জলা একাদশী করি। এই আমি বলে রাখছি দাদা, তে রাত্তির কাটবে না ওর দেখে নিও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাঢ়ালেন ধীরা। খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। হাটতলায় ঝাঁটুর বাসনের দোকান এখনো খোলা আছে হয়ত।
সেই কথাই ভাবছিলেন বসে আজ ধীরা। কালু চোর আর বিনু ডাক্তার। কার কথা বিশ্বাস করবেন। এমন সময় দোর ঠেলে কেঊ একজন ভেতরে ঢুকল, পেছন পেছন আরো দুজন। একজন এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। বাকী দুজন ঢিপ ঢিপ করে প্রনাম ঠুকল ধীরার পায়ে। হ্যারিকেন টেনে আলোটা বাড়াতে যাচ্ছিলেন। বাধা পেলেন।অধো অন্ধকারে একটা হাত এগিয়ে এল – তোর তো দ্যাখা লাগে না, অনুভবের ব্যাপার। আমার নাড়ীটা একটু দ্যাখতো ধীরা। আমি অবনীরে।
-কোন অবনী? হাতড়াতে থাকেন ধীরা।
অবনীর গলায় একটু ঊষ্মা ঝরল – তুই কি ঠাট্টা করছিস? এ তল্লাটে অবনী মুখুজ্জে একটাই আছে।
আরও কিছুক্ষণ হাতড়ালেন ধীরা, কিন্তু ধরতে পারলেন না। লোকটা যেভাবে তুই তোকারী করে বলছে তার মানে খুব পরিচত বন্ধু স্থানীয়। কিন্তু কে অবনী মুখুজ্জে? তারপর দপ করে জ্বলে উঠল আলো মাথার কোষে কোষে। ওঃ, অবনী!
আধো অন্ধকারেই হাতটা ধরে ফেলল ধীরা। বলল – অবনী। কি কাণ্ড বলত। কিছুতেই মনে করতে পারছিলুম না। বয়স হচ্ছে, বুঝলি।
হাসিটা ছেড়েই দিলেন ধীরা, পেটের ভেতর থেকে, বুকের মাঝখান ছুঁয়ে আনাবিল আনন্দে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। অবনীও হেসে ফেললেন। দেখা দেখি ধুতিলাল আর ভুবনও।
হাসি থামিয়ে ধীরা বললেন- কি বলছিলি, তোর নাড়ী দেখতে? তোকে দেখেই তোর নাড়ী আমি টের পাই অবনী, ধরার দরকার হয় না। তবু যখন বলছিস তখন দে, আমার কোবরেজি বিদ্যেটা ঝালিয়ে নিই। এখন বেশীরভাগ সময় আমার উপরেই কাটাই। এ যুগে কে আর আমার সামনে হাত পেতে বসে থাকবে বল। প্যাটাপ্যাট ইনজেক্সান অথবা টপাটপ বড়ি এটাই এখন চলে।
সময় কেটে চলেছে। ধীরার হাতে অবনীর হাত। ধুক ধুক ধুক ধুক, এক একটা স্পন্দনকে যেন আলাদা করে আজ বুঝতে পারছেন ধীরা। মনে হচ্ছে এক একটা স্পন্দনও যেন তাঁর মাথায় পল আনুপলে বিশ্লেষিত হচ্ছে। প্রত্যেকটি আলাদা, কোনটি ধীর, কোনটি চঞ্চল। আশ্চর্য হচ্ছেন ধীরা। এ কেমন অনুভূতি? এমনটাতো আগে কোনদিন হয়নি।
- কিছু বুঝছিস ধীরা? আস্তে করে বলল অবনী। খোকা বলল অ্যলঝাইমার হতে পারে। সত্যি রে ধীরা আজকাল অনেক কিছু কেমন ভুলে যাচ্ছি।
- আবার মনেও পড়ছে অনেক কিছু, তাই না? এই যে সন্ধ্যেবেলা আধো অন্ধকারে তুই আমি হাত ধরাধরি করে বসে আছি, কিছু তোর মনে পড়ছে অবনী?
- মনে পড়বে না মানে? দপ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল স্মৃতির কোষে কোষে। পায়রা ছানা ধরতে গিয়ে বাবার একটা ভারী সখের ফুলদানী ভেঙ্গে গেছল। ভয়ে দুজনে চিলে কোঠার ঘরে ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল কাঠের আড়ালে হাত ধরা ধরি করে বসে ছিলুম অনেক রাত পর্যন্ত। শেষে টুনাই পিসি উদ্ধার করে, মার খাইনি কেউ। আমার বাড়ীতে সে রাত্তিরে থেকে গেছলি তুই, সেই প্রথম। তারপর অবশ্য অনেকবার থেকেছিস।
- এটা কি অ্যলঝাইমার অবনী? তোর নাড়ীতে একজন বয়স্ক সুস্থ মানুষের জীবন স্পন্দন। কিছু ভলবি, কিছু মনে পড়বে, কিছু হারাবি, কিছু ফিরে পাবি। এই হোল জীবন, ঠিক কিনা বল?
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন, হাসছেনদুজনে হা হা করে। অবাক হয়ে দেখছিল ভুবন আর ধুতিলাল।
ধুতিলাল মুখ খুলল, বলল-তা হলে কত্তাবাবার কিছু হয়নি, তাই না কোবরেজবাবা?
-কিস্যু হয়নি তোর কত্তাবাবার। হেসে আশ্বস্ত করলেন ধীরা।
-আর বাবা আমার? হাতটা বাড়িয়ে দিল ধুতিলাল। আমি কিন্তু কত্তাবাবার চেয়ে বড়।
বেশ কিছুক্ষন নাড়ি দেখলেন ধীরা। তারপর বললেন-পঞ্চভূতে মানে পাঁচ শক্তিতে চলছে এই পৃথিবী। আমাদের জীবনও তাই। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, বোম – মাটি, জল, সূর্য, বায়ু আর আকাশ – এই হল পঞ্চ শক্তি, আমাদের জীবনের উৎস। যখন মারা যাব, তখনও মিশে যাব আমরা এই পঞ্চভূতে। কিছু বুঝলি ধুতি, ভুবন? জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ধীরা।
-বুঝতে পারছি বাবা, দুজনেই বলে উঠল।
-তা হলে শোন। ধীরা খুব আস্তে আস্তে করে বলতে থাকলেন, কৃত্রিম জীবন থেকে বেরিয়ে এসে যারা এই পঞ্চশক্তির কাছাকাছি নিজের জীবন ধারা প্রবাহিত করে তারা অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থ জীবনের স্বাদ নিতে পারে। তোরাও তাই। অনেকদিন ভালো থাকবি দেখিস। আয়তো সবাই মিলে একটু ভালো করে হাসি!
Comments
Top
সদ্গতি
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
তোম্বা মুখ করে বসেছিলেন নবেন, হাতে মহানিমের সরবত। ধরণী কবরেজের দাওয়াই, একসপ্তাহের উপর ঘুম হচ্ছে না। ‘মহাবায়ু কুপিত, উর্ধমুখী’, রায় দিয়েছিলেন ধরণী হাতের নাড়ী ছেড়ে দিয়ে। বলেছিলেন,’এ তোমার নাকু কোম্পাউণ্ডারের ক্ষমতার বাইরে হে।‘ নাকু ডাক্তারের আসল নাম নরেন। তেঁতুল গাছে ঊঠে কাঠবেড়ালীর বাচ্চা চুরি করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটিয়েছিল ছেলেবেলায়। নাকটা অস্বাভাবিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কথা এখন সব নাকীসুরেই বেরোয়, সেই থেকে নরেন হয়ে গেল নাকু। স্কুলের বদমাইস ছেলেগুলো ওকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিত আর তার মধ্যে একটা হল অন্ধকারে বাঁশ বনে ওকে বসিয়ে রাখা। ভূত পেত্নী শাঁকচুন্নীদের তখন রমরমা। সন্ধ্যেবেলা বাজার ফেরৎ পাকা আমের ব্যাগ বা জিলিপির ঠোঙ্গা ফেলে কত বাচ্চা পালিয়েছে, কিছু বড়রাও বাদ যায় নি। বিয়ের দিন রাত্তিরে অন্ধকার ঘরে নাকু খাটের তলায় লুকনো শালীদের এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিল যে নাকুর বৌ একমাস নাকুর ঘরে ঢোকেনি। শেষমেষ শালীদের সঙ্গে ভারী রকমের জরিমানা দিয়ে বৌর মান ভাঙ্গিয়েছিল। নবেনের স্ত্রী প্রিয়বালা একটু কুণ্ঠিত গলায় বলেছিলেন,’আহা, এ তোমার ভারী অন্যায় দাদা। নাকু ডাক্তারকে নীচের দিকে ঠেলা কি ঠিক হচ্ছে? হতে পারে ও তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঠুকোঠুকি করে, কিন্তু ঘুষো ঘুষি তো করে না। আর তোমাকেও কোনদিন অশ্রদ্ধাও করেনি।‘ প্রিয়বালার একটু দুর্বলতা আছে নাকু ডাক্তারকে নিয়ে, মানুষটা খারাপ নয়। এই গ্রামে কোন পাশ করা ডাক্তার এসে বসবে? দু’সপ্তাহের উপর জ্বরে ভুগে বড় মেয়ে রাইকে নিয়ে নাকু ডাক্তারের কাছেই ছুটতে হয়েছিল ধরনীর কাছে আর ধন্না না দিয়ে। এক লহমায় দেখেই নাকু বলেছিল,’বৌদি, এটা কিন্তু টাইফয়েড। এতদিন মেয়েটাকে না ভোগালেই পারতে। ওষুধ দিচ্ছি, তবে একবার রক্ত পরীক্ষাটা করিয়ে নিও।‘ খবর নিশ্চয় পেয়েছিল নাকু, গায়ে পড়ে চিকিৎসা করানোর কথা তোলেনি। প্রসঙ্গটা তুললেন না প্রিয়বালা, অযথা খুঁচিয়ে লাভ কি? বয়স্ক মানুষ, নবেনের চেয়ে বড় কিন্তু বন্ধুর মত। নবেন নাম ধরেই ডাকে ধরণীকে, মাঝে মধ্যে দাবার আসর বসে। নাকে এক খাবলা নস্যি ঠেসে দিয়ে বেশ কয়েকবার রাম হাঁচি হাঁচলেন ধরণী। বোমা ফাটার মত আওয়াজ হয়, তাই রাই বলেছিল – রাম হাঁচি। ধরণীর সাফাই রেডি ছিল, বলেছিলেন,’দ্যাখ বালা, ডিগ্রি নাই তাই ডাক্তার নয়।‘ প্রিয়বালাকে বালা বলেই ডাকেন ধরনী অনেক দিন থেকেই। বললেন,’ ডাক্তারর সহকারী হয়ে কাজ করেছে, তাই কম্পাউণ্ডার। এই সত্যটা তো আর মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না। যতই নামের পাশে ডাক্তার লিখুক না কেন, আসলে নাকু কি তা ও নিজেই জানে। ইচ্ছে করলে ঠুকে দিতে পারি। নকল ডাক্তার নিয়ে আবহাওয়া বেশ গরম। ঠুকে দিলেই পুলিশ, জেল আর জরিমানা। নেহাত গ্রাম, তাই কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর তা ছাড়া আমি অতটা খারাপ নই বালা। ওর পরিবারটা পথে বসুক এটা আমি চাই না।‘
প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইলেন প্রিয়বালা। বললেন,’নাকুর কথা থাক, আপনার বন্ধুর ব্যাপারটা দেখুন। এক হপ্তার উপর হয়ে গেল, রোজ রোজ মাঝ রাত্তিরে চমকে জেগে উঠে বসে ভিকন বাঁশ কে গাল মন্দ করে। নাকু ডাক্তারের কাছে যাই নি দাদা, ঘুমের ওষুধে আমার বেশ আপত্তি।‘ ধরনী ভারী খুশি হয়ে আহ্লাদের গলায় বলেছিলেন,’এই একটা সিদ্ধান্ত তুমি এক্কেবারে ঠিক নিয়েছ। ঘুমের ওষুধ যেদিন খেলে সেদিন ঠিক, পরের দিন যেই কে সেই। আর খেতে খেতে কিছুদিন পরে ওটাও কাজ করবে না। এতে অবশ্য নাকুর কোন দোষ দেখিনে। ওর হাত পা বাঁধা। ওদের যে রোগের যা ফিরিস্তি দেওয়া আছে তার বাইরে যাওয়ার জো নেই। হুঁ হুঁ এ কি আর আয়ুর্বেদ যে রোগীর মত করে রোগ চিকিৎসা করবে?’
তারপর নাড়ী টিপে বসে রইলেন ধরণী, ওই রোগীর নাড়ীতেই রোগের নাড়ীনক্ষত্র টেনে বার করা। এ কি আর সবাই পারে? রোগের চিকিৎসা নয়, রোগীর। নবেন কিছুক্ষন পরে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন,’ওই জন্য তোর কাছে কেউ যায় না আজকাল। কার অত সময় আছে বলত। ঝিন ঝিন করছে হাত। অন্য ভাবে নিস না ধরণী, লোকে অন্য কথা বলে।‘
ধরণী রাগ করলেন না, কোবরেজদের রাগ করতে নাই, নাড়ীর ছোট্ট ছোট্ট বিট সারা শরীরের কথা জানান দেয়, একটাও মিস করা যায় না। চোখ বুজেই বললেন,’কে কি বলল তাতে আর আমার কি যায় আসে বল। তুই বোধ হয় ভাকু মিদ্দার তৃতীয় পক্ষের বৌর কথা বলছিস। নরম গোলগাল ফর্সা হাত ধরে আমি নাকি ঘণ্টার উপর বসেছিলাম নাড়ী দেখার নাম করে। তাই তো?’
নবেন কিছু বলতে যাচ্ছিলে, বলা হল না। প্রিয়বালা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন,’তোমার অত আজেবাজে কথা না বললে কি চলছে না? দাদার কাজটাতে বাগড়া দিচ্ছ কেন?’ ধমক খেয়ে নবেন কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। আরও মিনিট কুড়ি নাড়ী টিপে বসে থাকার পর হাত ছাড়লেন ধরণী। বললেন,’যা আশঙ্কা করেছিলুম, তাই। ঊর্ধমুখী মহাবায়ু।‘ ব্যশ তারপর থেকেই সকালের দার্জিলিং চা জায়গা বদল করেছে। মহানিমের সরবত ছাড়া মহাবায়ুকে প্রশমিত করবে কে? ধরণী নিয়ম করে সকালে আসছেন, নবেনের দার্জিলিং চা
ধরনীর হাতে আর নবেনের হাতে মহানিম। হাল ছেড়ে দিয়েছেন নবেন। বাটীতে ভেজানো সবুজ মুগ। তারই এক মুঠ মুখে ফেলে চায়ে চুমুক দিলেন ধরণী। গালাগাল মুখে উঠে আসছিল, একচুমুক মহনিমের জলে ফের পেটে ফেরত পাঠালেন নবেন।
‘কালকে ঘুম কেমন হল বল নবেন? ভিকন বাঁশ এসেছিল, না আসেনি?’
‘মনে হয় গত দু’দিন আসেনি দাদা’, জবাব দিলেন প্রিয়বালা। ‘আমি অন্তত ওকে জাগতে দেখিনি। আমার ঘুম বরাবর পাতলা।‘ নবেন চুপ করে রইলেন। প্রিয়বালা ভুল বলেনি, গত দু’দিন ভালোই ঘুমিয়েছেন। এটা কি মহানিমের মাহাত্ম্য কিনা কে জানে। ভয়ানক জ্বালাচ্ছিল বেশ কয়েকদিন। একই কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করা কানের কাছে। ভিকনের জমিটা কিনেছিলেন অনেকদিন হল, ন্যায্য দাম দিয়েছেলন বাজার দরে। তাঁর পুকুরের ধার ঘেঁষে জমিটা। নবেনের ইচ্ছে ছিল পুকুরটা বাড়ানো আর কিছু পছন্দ সই আম গাছ লাগানো। বছর খানেকের উপর হল ভিকন দেহ রেখেছে। পুকুর বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে, বাগড়া দিয়েছে একটা খেজুর গাছ। লম্বা সিড়িঙ্গে, এখন আর রস দেয় না কিন্তু খেজুর কুল হয়। কাঠ কুল, খেলে বিচিতে আঁশ থাকে না, এক কামড়েই বিচি আলাদা হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। ভালো মিষ্টি, কিন্তু আম বাগানের পক্ষে বেমানান। এমন জায়গায় গাছটা যে না কাটলেই নয়। সব কিছু ঠিকঠাক, যেদিন গাছ কাটা হবে তার আগের দিন রাত্তিরে ঘুমটা সবে এসেছে এমন সময় ভিকন হাজির। বলল,’ও নবেন ভাই, একটা কথা বলার ছিল।‘ নবেনের চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। বললেন,’তুমি কোত্থেকে?’ ভিকন ভারী মনমরা হয়ে বলল,’আমাদের কি আর থাকার কোন ঠিকানা আছে? দ্যাহটা গেছে, নামের আগে চন্দ্রবিন্দু এয়েছে এই পর্যন্ত। একটা কথা বলার ছিল বলেই আসা। জমির দাম তুমি ন্যায্য দিয়েছ, আমার কিছু আপত্তি নাই। বড় খোকাকে দু’হাজার টাকা দিয়ে গয়ায় পাঠিয়েছিলে পিন্ডি দিতে, কালীঘাটে গিয়ে মাথা ন্যাড়া হয়ে মরা গঙ্গার নর্দমার ধারে কিছু চাল ছড়িয়ে এয়েছে।‘ নবেন চমকে ঊঠে বলল,’গয়া যায় নি হতভাগা? আমাকে বলল যে সব কাজ ঠিক ঠাক করে এসেছে আর তুমিও নাকি স্বপ্নে ওকে আশীর্বাদ করেছ।‘‘বলেছে বুঝি?’ হতাশ হল ভিখন।‘টাকাটা ঘোড়ার রেসে লাগিয়ে খুইয়েছে। গুহ্য কথাটা তোমাকে বলে ফেললুম নবেন, ওকে জানিও না, পরের বছর শ্রাদ্ধটাও দেবে না।‘ নবেন তেতে ঊঠে বললেন,’কেন, পিণ্ড না পেলে খাওয়া হবে না? শরীর তো নেই, খাওয়ার নোলাটা
এবার তো ছাড়তে পার। খেয়ে খেয়েই তো মরলে, মরার পর আর নাই বা খেলে’। ভিখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অন্তত নবেনের তাই মনে হল। শরীর নেই তাই কোন আওয়াজ হল না। বলল,’কথা তোমার ফেলনা নয় নবেন ভাই। তবে পরকালের জন্য শ্রাদ্ধটা দরকার। ও তুমি বুঝবে না। বলি আত্মার সদগতি, ঊর্ধগতি বলে একটা ব্যাপার আছে সে তুমি মান আর নাই মান। নেবু পণ্ডিতকে মনে আছে নবেন?’
‘মনে থাকবে না মানে? কি কানমলা না খেয়েছি। ধাতুরূপ,শব্দরূপ,ব্যাসবাক্য,সমাস – ওঃ, জ্বালিয়ে দিয়েছিল।‘
‘আমিও কম কানমলা খাইনি। তবে আমার মেয়াদটা কম ছিল। ক্লাস এইটে ডুব দিলুম, আর উঠিনি। তোমরা টেন পর্যন্ত টেনেছিলে নেবু পণ্ডিতকে।‘
‘কিন্তু সে তো কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, বহুকাল হল’। নবেনের অবাক ভাব কাটে না। ‘দ্যাখা হল নাকি তার সঙ্গে?’
‘সেই কথাই তো বলছিলুম।‘ ভিকনের গলায় একটু উত্তেজনার আভাষ।‘তোমার বাতাবী লেবু গাছের নিচে হঠাত দেখা।‘
‘অ্যাঁ, বল কি হে,’ নবেন আঁতকে উঠলেন।‘আমার লেবু গাছে আস্তানা গেড়েছে নেবু পণ্ডিত? মতলবটা কি বলত?’
‘উঁহু, গেড়েছে না। গেড়েছিল। আমাকে দেখেই পাকড়াল। আরে, ভিকন না? পালাতে গিয়েও পারিনি।‘
‘শব্দরূপ, ধাতুরূপ ধরেছিল?’
‘নাহ, তা ধরেনি। কিন্তু ভারী কাজের কথা বলল। পরলোকের গুহ্য কথা। এতদিন শুধু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে, সদ্গতি হয়নি। দুঃখ করছিল। ছেলেরা সব হিল্লী দিল্লী করছে কিন্তু বাপের কথা একবারও ভেবে দেখেনি। ঘুমের মধ্যে দু দুটো ছেলেকে নড়া ধরে ভয় দেখিয়েছে, বুঝিয়েছে, কাকুতি মিনতি করেছে। কাজ হয় নি। ছেলেরা সাফ বলে দিয়েছিল ওসব গয়ায় পিণ্ডি দেওয়া শুধু পাজির পাঝাড়া পাণ্ডাদের আস্কারা দেওয়া। ও তারা করতে পারবে না। ছোট ছেলে এক কাঠি উপরে। বিরক্ত হয়ে বলেছিল সকালে তার কোথায় যাওয়ার আছে। ঘুমের ব্যাঘাত তার পছন্দ নয়। আরো একটা উপদেশও দিয়েছিল নেবু পন্ডিতকে।‘
নবেন ভারী অবাক হয়ে বললেন,’বলো কি হে। নেবু পন্ডিতকে উপদেশ?’
‘তাই নিয়ে দুঃখ করছিল পন্ডিত। বলল, হতভাগা ছোঁড়া আমকে বলল সোজা গয়া চলে যেতে, টিকিট লাগবে না, হাওয়াই জাহাজের চেয়েও জোরে ভেসে যেতে পারবে হাওয়ার সঙ্গে। গয়ায় সব পিণ্ড খেতে তো আর তেনার আসেন না। অনেক পড়ে থাকে। তারই একটা খেয়ে নিতে।‘
‘ভারী দুঃখ হচ্ছে নেবু পণ্ডিতের কথা ভেবে। ছেলেগুলো সব কুলাঙ্গার’। তেতে উঠেছিলেন নবেন।
‘খাঁটি কথা, নবেন ভাই। সেদিন সন্ধ্যেবেলা আমার জমির ওই খেজুর গাছটার নিচে বসে অনেক কিছুই ভাবছিলুম। হঠাৎ দেখি হুস করে নেবু পণ্ডিত আমার পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে কিছুদূর গেলুম পণ্ডিতের সঙ্গে। নেবু পণ্ডিতের মুখটা কেমন আলোয় আলো। বলল, ভিকন চললুম রে। এতদিনে সদগতি হল। নাতিটা শেষমেষ গয়ায় গিয়েছিল। রবিঠাকুর, বিদ্যাসাগর, রামঠাকুর, এদের সঙ্গে দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে। ভাবতেই কেমন আনন্দ হচ্ছে রে ভিকন। তবে তোর সদগতির কোন আশা দেখছিনে। তাই বলছিলুম নবেন ভাই, ওই শ্রাদ্ধটা বোধহয় দরকার। একটু একটু করে উপরে উঠব, অনেক কাল লেগে যাবে, সদগতি হলেও হতে পারে।‘
আরো কিছু বলবে বলে মুখ খুলেছিল ভিকন, কিন্তু হুস করে ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছিলেন নবেন। ঘেমে গেছেন। প্রিয়বালাও ঊঠে পড়েছিলেন। দু ঢোক জল খাইয়ে গামছা দিয়ে ঘাম মুছিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে জিগ্যেস করেছিলেন,’কি হোল বলত? শরীর খারাপ লাগছে?’
না। ভালো চায়ের লিকার বানিয়েছে প্রিয়বালা, গন্ধে ভুর ভুর করছে। নবেনের বিকেলের চায়ে কোন বাধা নেই, কয়েকটা কোবরেজি বড়ি যোগ হয়েছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে ধরণী বললেন,’তুই আর ভালো মানুষ হয়ে থাকিস না। ভিকনের সাহস বেড়েছে, এখন দিনে দুপুরে হানা দিচ্ছে। এরপরে খাওয়ার সময়ে হানা দেবে, চাই কি এই বিকেলের চায়ের সময়ও ভুশ করে ভেসে উঠে আবার ফুস করে মিলিয়ে যেতে পারে। না হে নবেন, ওকে দু’কথা শুনিয়ে দে। বড্ড বাড় বেড়েছে দেখছি। মরার আগেতো শুধু ভালো ভালো খাওয়া নিয়ে ভালো মানুষ হয়ে থাকত। আমি বারণ করেছিলুম, ওরে ভিকন এভাবে তেল মশলা গুরু পাচ্য খাবার তোর লিভারের বারোটা বাজিয়ে দেবে। সংযমী হ একটু। উলটে আমাকে দু’কথা শুনিয়ে দিত। বলত, শরীরতো যাবে একদিন ধরণীদাদা, রোখা যাবে না। যখন রোখাই যাবে না তখন ভালোটা ছাড়ব কেন? ভারী কষ্ট পেয়েছিল বেচারা শেষের দিকে। জন্ডিসে কাবু হয়ে পড়ল, খেতেই পারত না।‘ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ধরণী। ‘তা আজকে কিছু বলছিল ভিকন? পরকালের গুহ্য কথাগুলো জানলে বেশ মন্দ হোত না।‘
পরের দিনের সকালের মহানিমের কথা ভেবে নবেনের মন এমনিতেই তেতো ছিল। ভিকনের কথা আসতেই চিড়বিড় করে উঠলেন নবেন, ’তুমি কি করে ভাবলে কিছু বলিনি আমি? জোর ঝেড়েছি। বলেছি, তোর জন্যই আমার ঘুমের দফারফা, প্রেশার, সকালে আমার হাতে মহানিম। শুনে ফিচিক করে হাসল, বলল-আমিও যদি মহানিম রোজ সকালে খেতাম তা হলে জণ্ডিসটা হত না, আরো কিছুদিন ভালো খাওয়াটা টানা যেত। চালিয়ে যাও, আমার জন্যই তোমার এই মহা ওষুধ। স্বয়ং রবি ঠাকুরও খেতেন কিনা।‘
ধরণী খুশি হয়ে বললেন,’বাঃ, ভিকনের আক্কেল হয়েছে দেখছি। তা সে মরার পরে হলই বা। দেখলি নবেন, ধরণী কোবরেজের দাওয়াই নিয়ে ট্যাঁ ফুঁ করার জায়গা নেই। তা আসল কথা কিছু বলল, ইয়ে মানে ওই পরকালের কথা?‘
প্রিয়বালার ভালো লাগছিলনা, গা ছম ছম করে এসব কথা আলোচনা হলে, কিছু অশুভ আত্মার উপস্থিতি টের পায় যেন। বললেন,’থাক না এসব কথা। তোমরা বরং দাবা নিয়ে বসো, মাথার চিন্তাগুলো অন্যদিকে দাও’। প্রিয়বালা উঠে গেলেন। সন্ধ্যা দিতে হবে।
ধরণী ফিস ফিস করে বললেন,’জানিস নবেন, ভিকনের ব্যাপারটা কেমন যেন নেশার মত টানে আমাকে। ওপারে কি হচ্ছে কিচ্ছু জানা যায় না এপার থেকে, সবটাই আঁধার, কুয়াশায় মোড়া। আদৌ কিছু আছে কিনা? এখন মনে হয় আছে। না হলে ভিকনের মত বাকীরা আছে কোথায়? নেবু পণ্ডিত বা কোথায় গেল? না হে যত ভাবি তত রহস্য ঘনায়।‘
‘আমারও তোমার মত অবস্থা।‘ স্বীকার করলেন নবেন।‘ঘুমটা মাটি হচ্ছে ঠিকই, তবে রহস্যটা ধরার জন্য মুখিয়ে আছি। কিন্তু ভিকন ভাংছে না, কিংবা ভাঙ্গতে পারছে না। ঠিক সময়টাতে ফুস করে হাওয়া হয়ে যায়। আমার মনে হয় পরকালেরও একজন কর্তাব্যক্তি আছেন, যিনি চান না গুহ্য কথা ফাঁস হোক। তাই যতবার ভিকন বলতে চেয়েছে ততবারই ফুস করে দিয়েছেন।‘
‘আগে পিছু থেকে কিছু আন্দাজ করতে পারিস?’ জানতে চাইলেন ধরণী।
‘কিছুটা, পুরো নয়। আমার মনে হয় ভিকন সদ্গতির জন্য মরিয়া হয়ে ঊঠেছে।‘ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিলেন নবেন।‘নেবু পন্ডিতের চলে যাওয়াতে বড্ড একা লাগছে, মনে ভাবছে ওর বুঝি আর সদ্গতি হল না’।
‘কিন্তু ওরা থাকছে কোথায়? ভিকনদের মত মানুষেরা কিংবা নেবু পণ্ডিতের মত মানুষেরা।‘ স্বগোতোক্তি করলেন ধরণী।
কপাল টিপে বসে চিলেন নবেন। হঠাত সোজা হয়ে বসে বললেন,’আমার কি মনে হয় জান ধরণীদা, ওরা ওদের ভারী কোন পছন্দের জায়গায় আটকে থাকে। যতদিন টান থাকে ততদিন আটকে থাকে লাটাইর সুতোতে ঘুড়ির মত। টান ছিঁড়ে গেলেই ভোঁ কাট্টা। আমার বাতাবী লেবুর গাছে নাকি নেবু পণ্ডিত আটকে ছিল। ভিকনতো তাই বলল।‘
‘বলিস কিরে?‘ অবাক হলেন ধরণী। ‘এত দিন থানা গেড়ে বসেছিল তুই জানতেই পারিস নি। বালাকে বলিস না আবার, ভয়ে ওদিকে পা বাড়াবে না। কিন্তু ভিকনের আস্তানা কোথায়?’
দুজনে চুপচাপ বসে রইলেন, সামনে দাবার ঘুঁটি সাজানো, কিন্তু একটাও চাল চলেনি। দুজনে সেদিকে তাকিয়েই বসে, চিন্তা একটাই। ভিকন কোথায়?
***********************
সকালে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ধরনী হাজির হয়ে দেখেন নবেন মহানিমের সরবত শেষ করে ফেলেছেন। চোখে মুখে অনিদ্রার ছাপ নেই। বললেন,’কি হে, কাল ভিকন আসেনি? ভোঁ কাট্টা? কিন্তু কি করে? এর মধ্যে তো কেঊ গয়া যায়নি।‘
নবেন দাঁড়িয়ে পড়ল, উত্তেজনায় চোখ চক চক করছে। বললেন,’আমি জানি ওর আস্তানা, চল যাওয়া যাক, ফিরে এসে চা খেও।‘
ধরণী অবাক হয়ে বললেন,’বলিস কি রে? তোকে ভিকন বলেছে? আমাকে বলিসনি তো?’
‘উঁহু, বলেনি খোলসা করে। কিন্তু আমি ধরে ফেলেছি।‘ পা বাড়ালেন নবেন, পেছন পেছন ধরণী।
ভিকনের জমিতে কাজ হচ্ছে। পুকুর খোঁড়া হয়েছে, নবেনের পুরনো পুকুরের সঙ্গে জুড়ে দেবে বর্ষা এলেই। বেশ দিঘীর মত দাঁড়াবে। নতুন খোঁড়া পুকুরের মাটি দিয়ে বাঁধাই হচ্ছে পুকুরের পাড়, তৈরি হচ্ছে নতুন বাগানের জমি। নানান রকমের আম এসে বসবে। একটা লম্বা সিড়িঙ্গে খেজুর গাছ এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুর কাটা আর কিছুটা এগোলেই কাটা পড়বে গাছটা। দু’জনে এসে দাঁড়ালেন। ধরণী বললেন,’কি হল নবেন, ভিকনের আস্তানা দেখাবি বলেছিলি না?’ ‘এটাই ভিকনের আস্তানা ধরণীদা।‘ গাছটাকে জরিপ করতে করতে বললেন নবেন। অবাক হয়ে দেখছিলেন ধরনী। অবিশ্বাসের গলায় বললেন,’কি করে জানলি?’‘এখানেই নেবু পণ্ডি তের সঙ্গে ভিকনের শেষ দেখা।‘
ধরণী বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছেন, গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে। নবেনের কথা ফেলতেও পারছেন না, আবার নিতেও পারছেন না। ‘কি আছে এখানে যাতে ভিকন আটকে আছে এখানে?’ কথাটা স্বগতোক্তির মত করে বললেও শুনতে পেয়েছেন নবেন।
বললেন,’সেটাই তো আমি ভাবছি, ধরণীদা। কেন এখানে ভিকন আটকে আছে? কিছু কি আছে এখানে, সেটাই কি আমাকে বলার জন্য ওর আপ্রাণ প্রয়াস, কিন্তু বলতে পারেনি।‘
হঠাত লাফিয়ে উঠলেন নবেন। ‘মনে আছে তোমার, ভিকন গাছ বাওয়ায় কেমন ওস্তাদ ছিল। যে গাছ বাওয়ায় ওস্তাদ সে যদি কিছু রেখে থাকে তাহলে গাছের উপরেই আছে। মাটিতে পুঁতে রাখলে বৃষ্টিতে ধুয়ে ভেসে যেতে পারে, বা যায়গাটা পরে চেনা নাও যেতে পারে। কিন্তু গাছের উপরে রাখলে বিশেষ করে কাঁটাওয়ালা খেজুর গাছে তা হলে তা কোনদিন হারাবে না। গাছ বাড়বে আপন খেয়ালে, আর লুকনো জিনিষ আরও সুরক্ষিত হবে। অবশ্য এটা আমার ধারনা ধরণীদা, ঠিক নাও হতে পারে।‘ নবেনের কথা একেবারে ফেলে দিতে পারছেন না ধরণী। বললেন,’ডাক কাউকে, গাছে উঠুক’।
অনেক দিনের পুরনো খেজুর গাছ, নারকেল গাছের মত মসৃণ হয়ে আছে। দুশো টাকার রফায় কোদাল ফেলে নগেন উঠে এল, নারকেল গাছ বাইতে পারে ও। পায়ে দড়ি জড়িয়ে কোমরে কাটারি গুঁজে সড় সড় করে উঠে গেল নগেন। নবেন নীচ থেকে চেঁচিয়ে বললেন,’এক এক করে ডাল কাটতে থাক। থামতে বললে থামবি।‘
খচাখচ কাটারি চলছে আর ঝুপঝাপ ডাল পড়ছে। গাছ প্রায় ন্যাড়া হয়ে এল। ধরণী বললেন,’না রে নবেন, উপরে কিছু নেই। মিছি মিছি দুশো টাকা দিলি’।
নবেনেরও তাই মনে হচ্ছিল। হঠাত টুং করে শব্দ হল, একটা জং ধরা নস্যির কৌটো পড়েছে নীচে। নবেন হেঁকে বললেন,’এবার নীচে নেমে আয়। আর কাটতে হবে না।‘
কৌটো খুলতে বেগ পেতে হল বেশ। ছিপি জং ধরে আটকে গেছে। কোদালের বাঁট দিয়ে আস্তে আস্তে ভাঙ্গা হল। জীর্ণ ন্যাকড়ার ভেতর থেকে বেরুল একটা ছোট আংটি। নবেনের গলার কাছে এক দলা কান্না, কোনমতে বললেন,’আমার পৈতের আংটি ধরণীদা। হারিয়ে গেছিল, কি মার না খেয়েছিলাম বাবার হাতে।‘
****
‘নবেন ভাই, আমার লজ্জাটাকে আর সবাইকে জানিও না’।
ভিকন ভাসছে, চোখে মুখে আলো। ‘বড় খোকাকে বলো আর গয়া যেতে হবে না। আমি উপরের টান অনুভব করছি নবেন ভাই, একে আটকানো আমার ক্ষমতার বাইরে। ভেবেছিলুম আমার লজ্জা যেন কেউ টের না পায় কোনদিন। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলুম এর নিস্পত্তি না হলে আমার সদ্গতি হবে না। বলি বলি করেও তোমাকে বলতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাইটি’।
নবেনের মনে হল ভিকন কাঁদছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললেন,’ভিকন, আমার মনে কোন দুঃখ নেই, কোন অভিযোগ নেই। ভালো থেকো কি তোমাকে বলা যায়, জানি না।‘
ভিকন দূরে সরে যাচ্ছে। হাওয়ায় ভেসে এল কয়েকটা কথা, ’মহানিমের সরবতটা কিন্তু ছেড়ো না।‘
Comments
Top
সমুদ্রে
সুমাত্রা
মন্দিরা বসু
সেদিনের সেই ছোট্ট ফুটফুটে সুমি‚ আজ সুমাত্রা। সুমাত্রা বসু। স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে এবার ইতিহাসে ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট হয়েছে। উঃ‚ কি ভালো লাগছে সুমির। আমার সমস্ত পরিশ্রম আজ সার্থক। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গতেই ইন্টারনেটে নিজেই দেখেছে। কিন্তু কিভাবে বলা যায়? ডাকবে? নাঃ‚ তার আগে একটু বেরোতে হবে। ব্যাস নিঃশব্দে বাড়ী থেকে বেরিয়ে সোজা নিউমার্কেট। একটা বড় লালগোলাপের তোড়া কিনে একটা ট্যাক্সী করে বাড়ী ফিরল।তাড়াতাড়ি না ফিরলে বাপি আবার অফিসে বেরিয়ে যাবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একদম মায়ের মুখোমুখি।
- 'হ্যাঁ, রে সুমি‚ কাউকে কিছু না বলে‚ ফট করে কোথায় বেরিয়েছিলি‚ সক্কালবেলা?' মা বললো।
- 'আজ তোর রেজাল্ট আউট হয়েছে না? রোল নং টাও আমাকে দিস নি যে আমি নেট এ দেখবো। আমাদের তো দারুন টেনশন হচ্ছে।' পৌষালীর গলা পেয়েই সৌমদীপ তাড়াতাড়ি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এল।
সুমির মাকে উদ্দেশ্য করে বললো - ‘কি গো, সুমি ফিরেছে আমাকে ডাকনি কেন? নিজে একাই বকে চলেছ? আর সুমি তোর কি ব্যাপার বলতো? সক্কাল বেলাই নিখোঁজ?’
- ‘হা, হা, হা‚ সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ’ বলে দুজনের সামনে গোলাপের তোড়াটা তুলে ধরল।'
মা‚ বাপি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল - 'মানে কি সারপ্রাইজ? গোলাপ কেন‚ তোর রেজাল্ট কি হল?'
- ‘হুঁম‚ গেস করো‚ গেস করো ...... নাঃ পারলে না তো?’
- 'সুমাত্রা বসু ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট‚ কি বিশ্বাস হচ্ছে? বলেই বাপি আর মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল|
বাপি চেঁচিয়ে উঠল - ‘সাবাস‚ ওয়েলডান‚ ওয়েল ডান মাই সুইট বেবি।’ মা কাছে টেনে কপালে একটা চুমু খেল‚ সত্যি আজ এত আনন্দ হচ্ছে বলার নয়। বাপি সঙ্গে সঙ্গে - ‘আজ নো অফিস। আজ নো রান্নাবান্না। চলো সবাই মিলে আজ লংড্রাইভে যাবো। বাইরে খাবো। দ্যাটস ইট।’ ‘ও বাপি‚ দাঁড়াও‚ আমি আগে মার্কশিটটা নিয়ে আসি। কলেজে বন্ধুদের সঙ্গেও একটু সেলিব্রেট করে নি। লক্ষ্মী বাপি‚ তুমি আজ অফিস চলে যাও। কাল আমরা সকালেই বেরিয়ে পড়বো, প্রমিস।’ বাপি বলল ‘বলছিস? মা-ও বললো ‘সত্যিই তো ওকে বন্ধুদের সঙ্গে একটু আনন্দ করতে দাও।মার্কশিটটাও তো আনতে হবে।’ ‘রাইট‚ রাইট ইউ আর।তাহলে ঐ কথাই রইল। কাল সকাল সাতটায় আমরা বেরিয়ে পড়বো‚ ডান?’ সুমি উত্তর দিল ‘ডান।’
তারপর সুমি কলেজে যেতেই‚ সব্বাই হৈ হৈ করে এসে সুমিকে ঘিরে ধরলো। ট্রিট‚ ট্রিটচাই‚ কোন অজুহাত চলবে না। সুমাত্রা মোটামুটি রেডি হয়েই এসেছিল। বলল দাঁড়া‚ আগে মার্কশিটটা নিই‚ তারপর সবাই মিলে ক্যান্টিনে যাবো।তার আগে রুসা গিয়ে কানাইদাকে স্পেশাল কিছু তোদের যা ইচ্ছা অর্ডারটা দিয়ে আয়‚ বানাতেও তো সময় লাগবে।
রুমেলা বলল ‘আরে সেটা তোকে ভাবতে হবে না। আমরা অলরেডি অর্ডার দিয়ে দিয়েছি।’
‘না রে‚ তোর খুব বেশী খসাবো না। কোল্ডড্রিন্ক‚ এগডেভিল আর লাষ্টে জমিয়ে এককাপ করে কফি। কি রে অসুবিধা করলাম না তো?’ বললো তুহিন।
সুমি বলল ‘ধ্যাৎ ছাড়তো। আজ তোদের যা মনে হয়েছে তাই খাওয়াবো। রুমি‚ চল তো মার্কশিটটা নিয়ে আসি।’
মায়ের ফোন ‘এই সুমি আমি সবাইকে খবর দিয়ে দিয়েছি। সবাই প্রাণ ভরে তোকে আশীর্বাদ জানিয়েছে।’
সুমি ‘ওঃ মা এখন থাক না‚ প্লিজ। আমাকে একটু সেলিব্রেট করতে দাও। পরে বাড়ী গিয়ে কথা হবে‚ ওকে।’ ফোনটা কেটে দিল। এবার সারাদিন হৈহুল্লোড় করে ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যেবেলা বাড়ী ফিরল সুমি। বাপিও অফিস থেকে এসে গেছে কিছু খাবার দাবার কিনে নিয়ে। সুমি গিয়ে ধপ করে ওদের সামনে বসে পড়ল। ক্লান্তিতে শরীর আর বইছে না।তবু মা‚ বাপির সঙ্গে খানিক গল্প করে উঠে গেল ফ্রেশ হতে| টয়লেট থেকে বেরিয়ে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বাই করে শুতে চলে গেল। কাল আবার সকালে উঠতে হবে| সৌমরাও তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। অবশ্য পৌষালী সকালের জন্যে একটু গুছিয়ে রেখে তার পর শুতে গেল।
সকাল থেকেই সৌম্য হাঁক ডাক করে সবাইকে জাগিয়ে ঠিক সাতটাতেই বেরিয়ে পড়ল। তারপর সারাদিন যত হৈহৈ মজা করে ঘোরাঘুরি হল। রাস্তাতেই ব্রেকফাষ্ট সেরে নিয়েছিল। কোথায় যাওয়া হবে কোন উদ্দেশ্য নেই গাড়ী ছুটেই চলেছে। অবশেষে ডায়মন্ডহারবারে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লো। পুরো সাত ঘন্টা ড্রাইভ করে সৌম্য ওখুব ক্লান্ত। আর সুমিতো লাফ দিয়ে নামল। পেছনে ধীরে সুস্থে পৌষালী।
পৌশালী বলে ‘উঃ তোমার এখনো এতো এনার্জি? বাব্বা‚ সেই কোন সকালে বেরিয়েছ এখনও সুমি জেদ না করলে তুমি থামতে না।’
‘অফকোর্স। আমি আরো কিছুদুর গিয়ে তবে থামবো ঠিক করেছিলাম। ঐ সুমির জন্যেই বাধ্য হয়ে.......’
‘ওঃ বাপি আমি এতো ধকল আর সহ্য করতে পারছিলাম না। জানো তো কাল সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে হৈহৈ করেছি।রাতে কঘণ্টা রেষ্ট। আর পারা যায়?’
‘নাও চল পেটে তো ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। সামনেই সাগরিকা‚ সরকারী হোটেল ব্যবস্থাও ভালো শুনেছি। চল ওখানে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চটা সেরে নিই।’
‘আবার ফিরতে তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে’ বললো সৌম্য। বাপির কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি মায়ের হাত ধরে ঢুকে পড়েছে সাগরিকাতে। ওখানে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে বসে একটু রেষ্ট নিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা।তবে এবার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। বাড়ী ফিরে তিনজনেই এতো টায়ার্ড যে সবাই ফ্রেশ হয়ে একটু কফি খেয়ে একেবারে বিছানায়। তারপর আত্মীয়স্বজনের আসা যাওয়া, মামার বাড়ীতে যাওয়া এইসব করে কটা দিন বেশ কেটে গেল।এবার ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হওয়ার পালা। সুমির অবশ্য কোন চিন্তা নেই। ওর রেজাল্টই ওর বড় প্রমাণ| তাও নিয়ম মত সবই করতে হল। বাপি ছিল সঙ্গে ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়ে বাড়ী ফিরল।
নির্দিষ্ট দিনে এডমিশনও হয়ে গেল। ঐ দিন ওদের কলেজের তিনজনের সঙ্গে দেখাও হল। ওরাও চান্স পেয়েছে কলকাতা ইউনিভারসিটিতে। সুমি খুশিই হল। প্রথম থেকেই বন্ধু দু-একজন থাকলে সুবিধা হয়। ওদের সঙ্গে ঠিক করে নিল প্রথমদিন কটায় মিট করবে। তারপর রুটিন দেখে কোথায় ক্লাশ জেনে তবে সেই ঘরে যেতে হবে। ওদের বাই করে বাড়ী ফিরল সুমি। প্রথমদিন ইচ্ছে করেই সুমি মায়ের একটা শাড়ী পরে একটু সেজেগুজেই ইউনিভারসিটিতে গেল। ছেলেমেয়ে সবারই বেশ নজর পড়ছে সুমির দিকে।দেখতে তো ভালো রংটা অবশ্য একটু চাপা। তবে আজ হালকা গোলাপী শিফনটাতে দারুণ লাগছে ওকে। রুমেলা আর রুশার সঙ্গে রুটিন দেখে চলল তেরো নম্বর রুমে। ফার্ষ্ট পিরিয়ড প্রফেসর সমুদ্র সেনের। উনি খুবই গুণী মানুষ‚ গোল্ডমেডালিষ্ট। তাই শুধু নয় নিয়মিত ওনার লেখা আর্টিকেল পত্রপত্রিকাতে ছাপা হয়। তাই উনি স্বনামধন্য।সুমিও ওঁর লেখা কিছু কিছু পড়েছে ভালো লাগে ওনার লেখার ষ্টাইলটা। কিন্তু কোনদিন চাক্ষুষ দেখেনি শুধু ফটো দেখেছে। তাই মনে মনে একটু এক্সাইটেড ছিল। কারণ ছবিতেই ওনাকে দারুণ লেগেছে সুমির। স্যার ক্লাশে ঢুকতে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো। উনি সবাইকে বসতে বললেন। সুমি কিন্তু ওনার মুখের দিকে চেয়ে বসার কথা ভুলেই গেল। পাশ থেকে রুমেলা হাত ধরে টান দিল ‘কিরে বস‚ সবাই হাসাহাসি করছে তো’।এবার সুমির খেয়াল হতেই ধপ করে বসে পড়লো। কিন্তু চোখ ওনার দিকে। কি সুপুরুষ চেহারা। লম্বা‚ দোহারা চেহারা‚ বয়েসটা বোধহয় ফর্টির কাছাকাছি হবে। চুলে দু-একটা রুপালীরেখা উঁকি দিচ্ছে। সবচেয়ে আকর্ষক ওঁর চোখদুটি| চোখে সত্যিই সমুদ্রের গভীরতা। সুমি তো ওঁর চোখের থেকে আর চোখ সরাতেই পারছে না। এপাশ থেকে রুশা লক্ষ্য করে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল ‘এই সুমাত্রা কি করছিস? স্যার কি ভাববেন বলতো?’ সুমির সম্বিত ফেরে তাইতো, ছি ছি‚ কি করছেও। বাড়ী ফিরেও বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে সুমি। খালি সমুদ্র সেনের মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে আমার এমন হচ্ছে কেন? কি যেন একটা ভালোলাগা অনুভুতি। একেই কি বলে লাভ এট ফার্ষ্ট সাইট? ধ্যাৎ, আমি এসব কি ভাবছি? উনি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। হয়তো ওনার স্ত্রী‚ পুত্র আছে। না না আমার এরকম ভাবা উচিৎ নয়। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল‚ একটুও ঘুম এল না। নাঃ কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। ঐ টানাটানা চোখ দুটি যেন ওকে আকর্ষণ করে চলেছে। অসম্ভব আমি কিছুতেই ওঁকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবো না। সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই মায়ের মুখোমুখি| মায়ের নজরে পড়েছে চোখে মুখে অনিদ্রার ক্লান্তি|‘হ্যাঁ,রে সুমি, একি চেহারা তোর? সারা রাত ঘুমাসনি? আয়নায় চোখ মুখের অবস্থা দেখেছিস?’ শুরু হল মায়ের জেরা। ‘না না‚ মা কিছুই হয়নি তো। এমনি কাল ইউনিভারসিটির প্রথম দিন ছিল‚ তাই খুব এক্সাইটেড লাগছিল তো রাতেও গুলো ভেবেই ভালো ঘুম হয়নি’ বলে পাশ কাটিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেলাম| সমুদ্র সেনের ফার্ষ্ট পিরিওড কিছুতেই মিস করা চলবে না। তাই চট করে অল্প ব্রেকফাষ্ট করেই বেরিয়ে পড়ল সুমি। মনে সেই একজনের চিন্তাই ঘোরাফেরা করছে। ওনার পড়ানোর ভঙ্গিটাও খুব সুন্দর। আর কি দরাজ গলার পরিস্কার উচ্চারণ সত্যি সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে।ক্লাশে গিয়ে সুমি পড়া শুনবে কি শুধু ওনার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে কিছুই তার কানে ঢুকছে না। দু-একবার স্যারের নজর পড়ে যাচ্ছে ওর দিকে| স্যার নিজেই যেন অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছেন। নাঃ এভাবে হবে না। সুমি এবার সমুদ্র সেনের খবর নিতে শুরু করল। কোথায় বাড়ী‚ বাড়ীতে কে কে আছেন‚ সব জানা হয়ে গেল| নাঃ যা ভেবেছিল সেটা নয়। বাড়ীতে উনি বিধবা মাকে নিয়ে একাই থাকেন। নিউআলিপুরে নিজেদের দোতলাবাড়ী ওনার বাবাই করে গেছেন। এবার শুরু হল বাপির কাছে বায়না। বাপি‚ আমি সমুদ্র সেনের কাছে টিউশন নেব তুমি ব্যবস্থা করে দাও। অগত্যা বাপি গেলেন খোঁজ নিতে। কিন্তু বিধি বাম। উনি টিউশনি করেন না। সমুদ্র বললেন ‘দেখুন‚ আমি একটু লেখালেখি করি। এইসব নিয়েই ব্যাস্ত থাকি। সেইজন্য আমি কাউকে ঠিক সেভাবে পড়াতে পারি না। যার যা কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে‚ আমি ক্লাসেই বারবার বলে বুঝিয়ে দিয়ে থাকি। তাও সবাইকে বলি যদি কারো কোন অসুবিধা হয় ক্লাসেই সমাধান করে নিতে।’ কিন্তু বাপি তো নাছোড়বান্দা। জানে সুমি যখন বলেছে যে করেই হোক রাজী করাতেই হবে। নাহলে
সুমির মুখের দিকে তাকানো যাবে না‚ হয়তো খাওয়া বন্ধ করে দেবে। উঃ ভাবতে পারছি না।বারবার রিকোয়েষ্ট করতে শেষে উনি বললেন দেখুন ও একটা কাজ করতে পারে। ছুটির পরে আমার সঙ্গে চলে যেতে পারে আমার বাড়ীতে যেদিন ওর সম্ভব হবে। আমি ওকে ঘণ্টাখানেক সময় দিতে পারি। তবে সেটা রোজ নয়‚ আর এর জন্যে কোন পারিশ্রমিকও আমি নিতে পারবো না। সুমিতো শুনে আহ্লাদে আটখানা। পরদিনই শুরু করলো যাওয়া।ওখানেই স্যারের মায়ের হাতে বানানো জলখাবার দুজনে মিলে খেয়ে তারপর পড়তে বসা।বলেছিলেন এক ঘণ্টা কিন্তু বোঝাতে গিয়ে কোথা দিয়ে দুঘণ্টা কেটে যেত কেউই বুঝতে পারতো না। সুমি তো বরাবরই সিনসিয়ার ষ্টুডেন্ট তাই মন্ত্র মুগ্ধের মত ওনাকে ফলো করতো। সমুদ্রও ওর একাগ্রতা দেখে খুব খুশি। ওনার সব নোটস সব সুমিকে দিয়েছেন জেরক্স করে নিতে। কিন্তু সুমি যতক্ষণ সমুদ্রের সামনে থাকে ও যেন সমস্ত জগৎ সংসার ভুলে যায়। কেবল হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়া বোঝাতে গিয়ে সমুদ্রের ও মাঝে মাঝে ওর চোখে চোখ পড়ে যায়। সমুদ্রও বোধ হয় মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ছে সুমির প্রতি। কিন্তু নিজের আদর্শতাকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। ভাবে ও আমার ছাত্রী অল্প বয়েস এসব আমার ভাবাই ঠিক নয়। সমুদ্রের মা ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করেছেন। একদিন ছেলেকে বলেও ফেললেন ‘দেখ সমু‚ সুমাত্রা মেয়েটি কিন্তু বেশ। পড়াশুনায় তো ভালো বটেই ব্যবহারও বেশ নম্র। আর দেখতেও মোটামুটি সুন্দরীই বলা চলে‚ বল?’ ‘হ্যাঁ মা‚ কিন্তু তুমি এসব কথা বলছো কেন বলত?’ ‘না‚ এমনি বলছি| তুই যখন ফ্রেশ হতে যাস ও তখন রোজ আমার কাছে আসে। কি বানাচ্ছি‚ কেমন করে করছি আগ্রহ নিয়ে দেখে আমার সঙ্গে হাতও লাগায়। কদিনেই মেয়েটা বড় আপন করে নিয়েছে। ’এবার সমুদ্র উত্তর দেয় ‘দেখ মা‚ তুমি যে সম্পর্কের কথা ভাবছো মনে মনে সেটা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ওকে টের পেতে দিও না। মা তোমার ছেলের বয়েস হয়েছে আর সুমাত্রা সদ্য যুবতী। ’‘জানি রে সবই জানি। কিন্তু ওনিজেই তো হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে ও তোকে ভালোবেসে ফেলেছে সত্যি সত্যি। এক ফাঁকে টুক করে তোর ঘরে ঢুকে তোর ঘরটা একটু গুছিয়ে রেখে আসে। আমার চোখে কিছুই এড়ায় না।’ সমুদ্রও তো সত্যিই মনে মনে ওকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কিছুতেই প্রকাশ করতে পারে না। বয়েসটা ওর সামনে একটা ভারী পাথরের দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায়।এমন করেই কেটে গেল তিনটে বছর। পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন আর সমুদ্রের বাড়ী যাওয়ার কোন ছুতো খুঁজে না পেয়ে শেষে মায়ের কাছে টুকটাক রান্না শিখে সেটা স্যারকে দেওয়ার অছিলায় রোজই হাজির হয়ে যায় সমুদ্রের খাওয়ার সময়। নিজে বসে স্যারকে খাওয়ায় আবার মায়ের জন্য রেখেও আসে। দেখতে দেখতে রেজাল্ট আউটের সময় এসে গেল।রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল সুমাত্রা দারুণ রেজাল্ট করেছে। সব স্যারেরাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কিন্তু সুমি কারোর প্রশংসাকেই পাত্তা দেয় না ওর একজনের মুখের কথাটুকুই দরকার| বিকেলে কিছু খাবার আর একগোছা রজনীগন্ধা নিয়ে গেলো স্যারের বাড়ী। খাবার কিছুটা প্লেটে সাজিয়ে আর ফুলের গোছাটা হতে নিয়ে দাঁড়ালো সমুদ্রের সামনে। খাবারটা টেবলে রেখে ফুল হাতে নিয়ে নিচু হয়ে স্যারকে প্রণাম করতে যেতেই ‘এই কি করছো‚ ওঠ ওঠ’ বলে সুমির হাত ধরে দাঁড় করালো সমুদ্র। এবার একটা গিফ্ট প্যাক সুমির হাতে দিয়ে বললো ‘তোমার ভালো রেজাল্টের পুরস্কার।’ সুমি তাড়াতাড়ি খুলে দেখে একটা ডায়মণ্ডের নেকলেস। দারুণ খুশি। এবার আবদার নিজে হাতে পরিয়ে দিতে হবে।
সমুদ্র বলে ‘আমি তো এসব পরাতে হয় কিভাবে জানি না’।
‘ও সব জানি না পরিয়েই দিতে হবে‚ নইলে আমি নেব না। থাক তাহলে রেখেই দিন।’
‘উঃ‚ তুমি আমাকে মহাঝামেলায় ফেললে তো সুমি| আচ্ছা দেখি‚ এদিকে এস’ বলে অনেক চেষ্টা করে পরিয়ে দিল নেকলেসটা। এবার সুমি ঢিপ করে একটা প্রণাম করে দৌড়ে চলে গেল মায়ের কাছে। ‘কিরে‚ খুব খুশি লাগছে‚ কি ব্যাপার? রেজাল্ট তো ভালো হয়েছে জানি কিন্তু এটাতো অন্য খুশির খবর মনে হচ্ছে’ বলেন সমুদ্রের মা। সুমি কিছু বলার আগেই ঢিপ করে একটা প্রণাম করেই জড়িয়ে ধরে খুব আদর করতে লাগলো সমুদ্রের মাকে।
‘দেখ মেয়ের কাণ্ড। আরে কি ব্যাপার সেটাতো বলবি।’
‘এই দেখো মা তোমার ছেলে আমায় নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছে আমার ভালো রেজাল্টের পুরস্কার’‚বলে নেকলেসটা দেখায়।
মা বলে‚ ‘তাই? বাঃ ভারী সুন্দর মানিয়েছে তোকে।’
এবার খুব খুশিখুশি মুখে বাড়ী ফেরে সুমি।
‘কিরে সারাদিন কোথায় ছিলি? তোর বাপিও জানতে চাইছিল’ বলে পৌষালী।
কোথাও না মা‚ স্যারের বাড়ীতেই ছিলাম।
যদিও মেয়ে কিছুই শেয়ার করে না‚ তবু পৌষালীর মনে একটু খটকা লাগছে কিছুদিন ধরেই।
সব সময় স্যারের কথা‚ তার মায়ের কথা ছাড়া মেয়ের মুখে আজকাল আর কোন কথা নেই।বন্ধুদের কথাও কিছুই শোনা যায় না। মায়ের মন মেয়ের হাবেভাবে চলাফেরায় কিছুটা তো আন্দাজ করেই নিয়েছে। কিন্তু বয়সের ফারাকটা তো একটা বড় বাধা কি করে মেনে নেবে ভেবেই পায় না পৌষালী। এমনিতে তো সবই ঠিক আছে। অমন স্কলার ছেলে‚ বাড়ী‚ গাড়ী সবই আছে। বাড়ীতে শুধু মা ছাড়া কেউ নেই। সবদিক থেকেই ভালো। কিন্তু ওর বাপি কি মেনে নিতে পারবে? একমাত্র সন্তানকে ওরকম একজনের হাতে তুলে দিতে?
সুমি মাকে ধাক্কা দিয়ে বললো ‘হ্যালো কোথায় হারিয়ে গেছ তুমি? আমি সামনে দাঁড়িয়ে অথচ তুমি কোন অতলে তলিয়ে গেছ আমার দিকে নজরই নেই’। পৌষালীর উত্তরের অপেক্ষা না করে সুমি নিজেই বলল ‘তুমি বসো আমি চেঞ্জ করে আসছি।’ জামা পাল্টিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি বসলো সুমি।
এবার মায়ের চোখ পড়ল ‘হ্যাঁ রে, তোর গলায় ওকি? অমন সুন্দর ডায়মণ্ড নেকলেস কে দিলো তোকে?
‘সমুদ্র দিয়েছে মা। ও নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছে। ও‚ দাঁড়াও’ বলে উঠে গিয়ে মাকে একটা প্রণাম করল।
‘জানো মা ওর মাকেও প্রণাম করেছি| তারপর নেকলেসটা হাত দিয়ে ধরে বলে ‘ওর দেওয়া আমার জীবনের প্রথম গিফ্ট। এ যে আমার কাছে অমুল্য মা, তাইতো তোমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তোমাদের স্বীকৃতি চেয়ে নিচ্ছি। মা তো হাঁ করে কথাগুলো শুনছে আর ভয়ে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। ওর বাপি শুনে কি বলবে? কিন্তু আর তো দেরী করা চলে না। আজই সব বলতে হবে ওর বাপিকে।
সুমি মায়ের মনের অবস্থা আন্দাজ করে বললো ‘মা‚ তুমি বাপিকে ভয় পাচ্ছো? তুমি কিছু চিন্তা করো না আমি আজই খাওয়ার সময় বাপিকে সব বুঝিয়ে বলবো।’
‘দেখো বাপি কিন্তু আপত্তি করবে না। বয়েস একটু বেশী তো কি হয়েছে মা। আগের দিনে তো এরকম বয়েসের ফারাকেই বিয়ে হত। আর সমুদ্রকে দেখলে মোটেই বোঝা যায় না ওর বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে। মায়ের মনের দ্বিধা তবু কাটতেই চায় না| রাতে খাওয়ার সময় ঠিক বাপির নজর পড়েছে নেকলেসটার দিকে। ‘বাঃ ওয়াণ্ডারফুল! এটাকে চয়েস করেছে রে? আমার মামনি না তোর মা? ’‘না বাপি‚ আমরা কেউই নই। আমার এমএর রেজাল্টের জন্যে সমুদ্র আমাকে গিফ্ট করেছে। নিজেই চয়েস করে এনেছে। ’‘তাই? বাঃ, পছন্দ আছে তো ছেলেটার। তোকে মানিয়েছেও খুব সুন্দর। ‘হুম ‚ তাহলে........ এবার আমাদের বাড়ীতে ডাক একদিন ওকে। ভালো করে আলাপ করি। ’‘বাপি শুধু ওকে বললে তো হবে না ওর মাকেও বলতে হবে। ’‘ও হ্যাঁ নিশ্চয় নিশ্চয়। এসব ক্ষেত্রে মা-বাবাদের তো প্রয়োজন হয়ই। ‘তুই এক কাজ কর মা। নেক্স্ট সানডেতে লাঞ্চে ওদের বলে দে। না না থাক এটা আমারই কর্তব্য। আমি নিজে ওদের বাড়ীতে গিয়ে বলে আসবো‚ আর ওর মায়ের সাথেও আলাপ করে আসব।’ সুমির তো আনন্দ আর ধরে না। বাপিকে কিছুই বলতে হল না। বাপি সবটা বুঝেও নিয়েছে একসেপ্টও করেছে। মা চুপ করে দুজনের কথা কেবল শুনেই গেল। কোন উত্তর করেনি। এবার ঘরে গিয়ে সৌম্যকে চেপে ধরল। তোমার কি ব্যাপার বলতো? তুমি যেন আগে থেকেই সব জানতে মনে হচ্ছে। আর সব কিছু বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে ও নিলে।একটা অতবয়স্ক ছেলে আর আমাদের সুমির কিই বা বয়েস?‘ দেখ চোখ কান খোলা রাখলেই সব বোঝা যায়। তুমি প্রথম থেকেই ধর না। সুমির জেদ ধরা সমুদ্রের কাছে পড়বেই সে।তারপর অমন সুপুরুষ চেহারা‚ অতো কোয়ালিফায়েড। নির্ঝঞ্ঝাট ফেমিলি। যদি বয়েসের বাধা নিয়ে তুমি আপত্তি কর‚ তাহলে আমাদের একমাত্র আদরের সন্তানকে হারাতে হবে জেনে রেখ। ‘তার চেয়ে মেয়ে যা চাইছে সেটা মেনে নাও। এতে সুমি আর আমরাও সুখে থাকবো। ’পরের রবিবার সমুদ্র তার মাকে সঙ্গে নিয়ে এল। মায়ের হাতে একটা বড় মিষ্টির প্যাকেট। সৌম্য বললো ‘এটার কি কোন দরকার ছিল দিদি? ’‘অবশ্যই ছিল। শুভ কাজের কথা বলতে গেলে মিষ্টি তো মাষ্ট। ’সবাই হো হো করে হেসে পরিবেশটা হালকা করে ফেলল।একেবারে সবাই মিলে খাওয়ার টেবলেই বসা হল| প্রচুর আয়োজন। খেতে খেতেই সৌম্য কথাটা পাড়লেন। সমুদ্রের মায়ের তো হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। সুমি লাল শাড়ীতে আর লজ্জায় আরো লাল। আর সমুদ্র জানি বারণে ঈষৎ নত বদন। খাওয়া মিটলে একেবারে পঞ্জিকা দেখে সবচেয়ে কাছের দিনটাই ঠিক করা হল। ওরা চলে যাওয়ার পরে সুমি বাপির গলা জড়িয়ে ধরে আমার সুইট বাপি বলে খুব আদর করল। কারণ সুমি এতোটা আশাই করেনি একেবারে বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক। ‘ওরে ছাড় ছাড় এখন কত কাজ আমার’ বলে বাপি বেরিয়ে গেল। বিয়ের জন্য বাড়ী বন্দোবস্ত করেই দুটো সুইজারল্যাণ্ডের টিকিট বুক করে তবে ফিরলেন সৌম্য। কিন্তু টিকিটের ব্যাপারটা গোপনই রইলো। মাত্র পনের দিনের মধ্যে দুই বাড়ীতেই জোগাড় যন্ত্র সব সারা। অবশ্যও বাড়ীতেও বেশীর ভাগ দায়িত্বই সৌম্য কাঁধে তুলে নিয়েছিল। নির্বিঘ্নে বিয়ে বৌভাত সব মিটে গেল। সুমিতো খুশিতে ঝলমল করছে।ওদিকে সমুদ্র আর তার মাও খুব খুশি। আর পৌষালীর মনে এখনো একটু দ্বন্দ তাই পুরোপুরি সবার তালে তাল দিতে পারছে না। বৌভাতের দিন ফিরে আসার ঠিক আগে সৌম্য আড়ালে সমুদ্রকে ডেকে বললো ‘এই নাও তোমাদের সারপ্রাইজ গিফ্ট। জানি তোমার ছুটি বেশী নেই তাই সাতদিনের সুইজারল্যাণ্ডের ছোট্ট টুর কাম হানিমুন। এটা কিন্তু আমার মামনিও জানে না। ’পরদিন সকালে দুবাড়ীর সবাই এয়ারপোর্টে। ওদের চেক ইন হয়ে গেছে। ভিতর থেকে এসে একবার দেখা করে বাই করে হাত ধরাধরি করে চলে গেল। সৌম্যরা আর সমুদ্রের মা সবাই আনন্দাশ্রু মুছতে মুছতে গাড়ীতে উঠে বাড়ীর দিকে রওনা দিল।
Comments
Top
কবি সম্মান
আইভি চট্টোপাধ্যায়
এক দেশে এক রাজা ছিলেন। উঁহু, রাজা নয়, রাজা নয়। এখন আবার রাজা কোথায়! এখন মন্ত্রীরাই রাজা। এক দেশে এক মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী খুব কবিতা ভালোবাসেন। রাজদরবারে নিত্য নতুন কবির আগমন। কবিকে সম্মান-প্রদর্শন,বিশেষ দক্ষিণা সহযোগে আপ্যায়ণ, নানা উত্সবে আমন্ত্রণ .. এমন সব রাজকীয় নিয়ম আছে। রাজকার্যে মন্ত্রী দেশে বিদেশে গেলে জনা দু’ তিন কবি, একজন আবৃত্তিকার, জনা দুই গাইয়ে সঙ্গে থাকেন।
মন্ত্রী নিজেও কবিতা লেখেন। দুর্জনেরা অবশ্য সেগুলোকে কবিতা বলতে নারাজ। নেহাত বাল্যখিল্য ছড়া। তবে ছড়া বলে কি আর কবিতা নয়! কে না জানে, ছন্দে লিখলেই কবিতা।মন্ত্রীর ছড়ার বই থুড়ি কবিতার বই দেশজুড়ে পাঠ্যপুস্তক হয়েছে। দুলে দুলে শিশুরা সে সব কবিতা মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসে। মন্ত্রী নিজে সর্বক্ষণ ছড়া কেটে কেটে ছন্দে কথা বলতে ভালোবাসেন। স্বভাবকবি মন্ত্রী রোজই নতুন নতুন কবিতা থুড়ি ছড়া তৈরী করেন। সেসব কবিতা মন্ত্রীর সভাসদদের মুখে মুখে আরো প্রচার হয়। নিজের কবিতা ছাড়াও মহাকবিদের কবিতার লাইন মন্ত্রীর ঠোঁটস্থ। কবি জাতটার ওপর তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। দ্যাখ না দ্যাখ, কেমন টপাটপ কবিতা লিখে ফেলেন তাঁরা। রাজকার্যের বিপুল চাপ, রাজকর্মের নানা পরিকল্পনা, দেশের নানা সমস্যা। কম টেনশন! মন্ত্রী সে থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কবিতা পড়েন। কবিতা তাঁকে সব টেনশন, সব সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। নানা দপ্তরের কাজের জন্যে অনেকগুলো কমিটি তৈরী করেছেন মন্ত্রী। প্রতি কমিটিতে একজন কবি থাকবেনই। বিশেষ সম্মান-দক্ষিণায় তাঁরা বিশেষভাবে নিয়োজিত। কর্ম-সংক্রান্ত মিটিং-এর শুরুতেই একটি কবিতাপাঠের ব্যবস্থা আছে। যাতে কাজ শুরুর আগে দপ্তরের সব কর্মীর মাথা টেনশন-মুক্ত হয়।
তবু মন্ত্রীর মনে সুখ নেই। নিত্য রাজসভায়, জনতার সভায় কবিতা উদ্ধৃতি দিতে গেলে নিত্যসঙ্গী একজন কবি চাই। তিনি মন্ত্রীর বক্তৃতা লিখে দেবেন, রাজসভায় কবিতা পাঠ করে সবার মাথা ঠান্ডা রাখবেন। তাছাড়া রাজদরবারে একজন সভাকবি না হলে চলে? এখন মুশকিল এই যে, মন্ত্রীর প্রিয় কবিরা সবাই এক এক দপ্তরের উপদেষ্টা পদে আছেন। কোনো একজনকে সভাকবির পদ দেওয়া যায় না। ইতিমধ্যেই মন্ত্রী একটা কবিতা অ্যাকাডেমি তৈরি করেছেন। বছরে একবার কবি-অ্যাকাডেমি-অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। আর কী করা যায়!ভেবেচিন্তে মন্ত্রী এক কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজনের আদেশ দিলেন। প্রথম পুরস্কার পাওয়া কবিকে হাজার স্বর্ণমুদ্রা দক্ষিণার সঙ্গে ‘কবিকিঙ্কণ’ উপাধি দিয়ে সভাকবি পদে অভিষেক করা হবে। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। অনেককাল দেশে এমন সংস্কৃতিমনস্ক রাজা, থুড়ি মন্ত্রী পাওয়া যায় নি। মানুষের উন্মাদনার সীমা নেই।
সেই দেশে থাকে এক ভোলারাম। চাষবাসই হোক, আর সংসারে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠই হোক, ভোলারামের নিষ্ঠার অভাব নেই। তবু ভোলারামের কপালে কেবল নিন্দেমন্দ জোটে। সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছনা বউয়ের কাছে। ভোলারামের বউ সর্বদাই নিজের ভাইদের সঙ্গে তুলনা করে ভোলারামকে নিষ্কর্মা অকর্মণ্য বলে বলে গঞ্জনা দেয়। বেচারা কিছুতেই আর বউ এবং শ্যালকদের খুশি করতে পারে না।
পুকুরঘাটের পড়শিনীদের জটলা থেকে খবর পেল বউ, একহাজার স্বর্ণমুদ্রার খবর। ব্যস, একবার সভাকবি হতে পারলেই হল। ‘খেটে রোজগার করার মুরোদ নেই, এবার ঘরে বসে রোজগারের সুযোগ এসেছে। আর কোনো অজুহাত শুনব না। একখান মাত্র কবিতা। তা পারবে না?’
শ্যালকরা বলল,‘এই একটা কাজ করে দেখাও তো বুঝি। আমাদের বোনটার কথা তো ভাবতে হবে তোমায়। একবার ভাবো দেখি, হাজার স্বর্ণমুদ্রা। আর তোমায় ক্ষেতের কাজে, ঘরের কাজে খাটাতে পারবে না কেউ। পায়ের ওপর পা তুলে জমিদারি করবে কেবল ।‘
বৌও বোঝালো,‘তা নয়ত কি? প্রথমেই তো কয়েক বিঘে জমি কিনে ফেলব। একটা মাত্র কবিতা লিখেই জমিদারি। এমন সুযোগ আর আসবে?’
শুনতে শুনতে ভোলারামের মনেও ঘোর লেগে গেল। জেগে জেগেও সভাকবি হবার স্বপ্ন। আহ, তাহলে আর বউয়ের গঞ্জনা শুনতে হবে না। আসতে যেতে শ্যালকরা কুর্নিশ করবে। সারা দেশে নাম ছড়িয়ে পড়বে। আহা, সত্যি সত্যি যদি এমনটা হয়!
তিনটে খাতার তিন দিস্তে কাগজ শেষ হয়ে গেল। কবিতা হল না। এক ডজন কলম খারাপ হয়ে গেল। দেখেশুনে বউ এক বাক্স পেনসিল এনে দিল। আর একখানা মোটা খাতা। লেখা পছন্দ না হলে মুছে মুছে লিখবে। খাতার ওপর ‘ওম সরস্বত্যই নম:’ লিখে মন্দির থেকে ফুল বেলপাতা এনে পুজো করে নিল ভোলারামও।
কিছুতেই কিছু হয় না। কবিতা লিখতে গেলে রচনা হয়ে যায়। কিংবা তাল দিয়ে দিয়ে গান। এমন কবিতা চলবে না। বেশ অন্যরকম লিখতে হবে, যা একবার শুনলেই সবার তাক লেগে যাবে। হাজার স্বর্ণমুদ্রা তো আর এমনি এমনি দেবে না।গ্রামের স্কুলের মাষ্টারমশাই কবিতার ক্লাস খুলেছেন। উপসর্গ হল মাথায় টনটনে ব্যথা। দাঁতে কনকনে যন্ত্রণা। কবিতার অ আ ক খ, কবিতার ব্যাকরণ, ছন্দ লয় মাত্রা সব শিখছে ছেলেরা। বউ ভোলারামকে কবিতা-ইশকুলে ভর্তি করে দিল।
কবিতার ক্লাসে গিয়ে কিন্তু ভোলারাম কিছুতেই জুত করতে পারে না। কবিতার ব্যাকরণ শুনতে গিয়ে ঘুম এসে যায়। ঘুমিয়ে পড়লে তো চলবে না। রাত জেগে জেগে নতুন নতুন শব্দ মুখস্থ করতে হয়। নতুন এদিকে বোসপাড়ার দুলো, নবীনগরের তুলো, মৌহাটির কুলো সব্বাই টপাটপ কবিতা নামিয়ে ফেলছে রোজ। মাষ্টারমশাই বলে দিয়েছেন, অন্তত একশ’টা কবিতা লিখে ফেলতে হবে। তার মধ্যে থেকে সেরা কবিতাখানা বেছে দেবেন তিনি।
পুকুরপাড়ে গিয়ে বউ সব খবরই পায়। এত কবিতা লিখে ফেলছে সবাই, অথচ নতুন মোটা খাতার পাতায় একটা পেন্সিলের আঁচড় কাটা হয় নি ভোলারামের। বউ বাড়িতে তুলকালাম করছে রোজ। কোনোদিন খাওয়া বন্ধ, কোনোদিন ঘুমোনো বন্ধ, কোনোদিন কথা বন্ধের শাস্তি চলছে।
একদিন মাষ্টারমশাইয়ের কাছে বেশ কান্নাকাটি করে ফেলল ভোলারাম। মাষ্টারমশাই বোঝালেন,‘শোনো বাবা ভোলারাম, কবিতা লেখা কিন্তু যার তার কম্মো নয়। শুধু গুটিকয় শব্দ সাজিয়ে দিলেই হবে না। প্রথমে শব্দটা মাথায় খেলাতে হবে। শব্দের এক একটা অক্ষর বেশ গভীরে প্রবেশ করবে, কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হবে, শিরশির করবে সারা শরীর, সেই হল সৃষ্টির বিশেষ ক্ষণ। পাত পেড়ে বসে পড়লাম আর হাপুসহুপুস ভাত খেয়ে ফেললাম, তেমন তো নয়। কবিতা ছাড়া জীবন পানসে, এমন একটা গভীর অনুভুতি চাই। সাধনা চাই। অন্তরের প্রেরণা চাই। প্রেরণা বলতে কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ নয়। অন্য একটা কিছু। গভীর একটা বোধ। সব সময় যা জাগিয়ে রাখবে। চেতনাকে জাগ্রত রাখা, ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকা, অত সহজ নয়।‘ ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে ভোলারাম, আর যা-ই হোক, কবিতা হবে না। বুকের মধ্যে টনটনে কষ্ট, মাথার মধ্যেটা ভার। একলা একলা হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এসে পৌঁছল। ‘কবিতাই হল না, আমার আর বেঁচে থেকে কি লাভ, এ জীবন লইয়া কি করিব’ নদীর জলে ঝাঁপ দিল ভোলারাম। শীতের বিকেল। কনকনে ঠান্ডা জল। সারা শরীর শিরশির করে উঠল। চমকে উঠল ভোলারাম। এই তো সেই অপার্থিব অনুভুতি! সারা শরীর শিরশিরিয়ে উঠে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হওয়া একেই বলে নাকি! ঠিকই তো। কবিতা ছাড়া জীবন পানসে, এ অনুভুতিটা বেশ চিনতে পারছে। আর একটা কি যেন বলছিলেন মাষ্টারমশাই? ওহো, চেতনাকে জাগ্রত রাখা। চোখ খোলা রাখো হে ভোলারাম, জেগে থাকো। ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত শরীর ডুবিয়ে রেখে কাঁপতে কাঁপতে চারপাশে তাকাল।
কই, কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে জনমনিষ্যি নেই। নদীর ধারের দিক থেকে গাছের একটা লম্বা ডাল এঁকেবেঁকে এসে পড়েছে জলের মধ্যে। সেই ডালে বসে একটা কাক অলস ভঙ্গীতে এক একবার জলে ঠোঁট ডুবোচ্ছে, আবার মাথা তুলে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। ফের ঠোঁট ডুবোনো, ফের মুখ তুলে চারদিকে চাওয়া। নিরাসক্ত দার্শনিক ভঙ্গী। একহাত দূরে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা জলজ্যান্ত মানুষ ঠকঠকিয়ে কাঁপছে, সেদিকেও দৃষ্টি নেই কাকের।
হঠাত্ সত্যিই নাভিমূল পর্যন্ত শিউরে উঠল ভোলারামের। ‘রক্তমাংসের মানুষ হলে হবে না, প্রেরণা চাই’। তবে কি এই কাকই সেই ঈশ্বরপ্রেরিত প্রেরণা? তাহলে এখনই কবিতা আসবে? হে ভগবান, হে মা সরস্বতী, দাও দাও কবিতা দাও! দয়া করো ভগবান! আশীর্বাদ করো!
আচ্ছা, কাকের ভালো নামটা কি যেন! বায়স। বাহ, সারসের সঙ্গে মিল হয় বেশ। শ্বেত শুভ্র সারস, আর কালো কাক। না না কালো নয়, কালো নয়। কৃষ্ণ। ‘হে কালো কাক’ না বলে ‘অহো কৃষ্ণ বায়স’ বলা বেশি ভালো।
কাকটা ঠোঁট ডুবিয়ে একখানা জ্যান্ত মাছ তুলে আনল এ সময়। আপাদমস্তক শিউরে উঠল ভোলারাম। কৃষ্ণ বায়স। তীক্ষ্ণ ঠোঁট। ঠোঁটের ভালো প্রতিশব্দটা কি যেন! মনে পড়ল না। যাকগে, শব্দ মনে করতে গিয়ে কবিতাটা ছেড়ে গেলে মুশকিল। কৃষ্ণ বায়স কেমন হাঁ করে মাছ ধরছে দ্যাখো! ছটফটে মাছটাকে গপ করে গিলে নিল কাক! কৃষ্ণ বায়সের হাঁ মুখ। হাঁ নয়, হাঁ নয়। ভালো একটা শব্দ চাই। মুখের ভেতর। গহ্বর। ভাবতে ভাবতেই মাথায় কবিতার লাইন:
জলের মধ্যে ডুবিয়ে দাও
ডুবিয়ে দাও জলের গভীরে
তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর
হে কৃষ্ণগহ্বর
চঞ্চলা চপলকে গ্রাস করো
হে স্থিতধী কৃষ্ণ
আমি যে তোমার মন পড়তে পারি
নাচতে নাচতে বাড়ি এল ভোলারাম। মগ্ন ভাব, উদ্দীপ্ত দৃষ্টি।রকম সকম দেখে বৌও আর ঘাঁটাতে ভরসা পায় না। এমন মেজাজ না হলে কবিকে মানায়! মনে গভীর পুলক, বউ চিড়ে-মুড়ি বেঁধে পুঁটুলিতে খাতা-কলম ঢুকিয়ে দিল, রাজসভায় যাবে ভোলারাম।
‘ওসব খাতা ফাতা লাগবে না’, জোরে জোরে হাত নাড়ে কবি ভোলারাম, ‘কবিতা আমার মাথায় আছে।‘ বউ তো বটেই, শ্যালকদেরও সপ্রশংস দৃষ্টি। আহা, সরস্বতীর বরপুত্র বুঝি এমনই হয়! রাজসভার দৃশ্য টিভিতে লাইভ দেখানো হবে আজ। মন্ত্রীর শ্বেতশুভ্র বসন, মঞ্চের চারদিকে সাদা চাদর। সঞ্চালক বিগলিত হাস্য, মন্ত্রীর সিংহাসনের পাশেই বসার অধিকার যে আজ। পারিষদরা গম্ভীর মুখে সচেতনভাবে টিভি ক্যামেরার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আছেন। সামনে সারি সারি টেবিলে সারি সারি মাইক্রোফোন। সারি দিয়ে বসে আছেন দেশের নামী দামী কবিরা, তাঁরা সকলেই আজ বিচারক।
বিশাল হলঘরের পেছনে একদিকে নীল রঙের অর্ধবৃত্তাকৃতি চাঁদোয়া। এক এক চাঁদোয়ার নিচে অন্তত তিনশ কবির বসার ব্যবস্থা। আরেকদিকে ফুল ফুল সিল্কের ছাউনির নিচে দর্শকের আসন। মঞ্চ, হলঘর, বসার সব জায়গা সাজানো হয়েছে সাদা রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা আর নীল অপরাজিতায়। দরজার পাশে পাশে মঙ্গলঘটে ঘন সবুজ আম্রপল্লব। মঞ্চ জুড়ে সাদা আল্পনা, দেশের নামী চিত্রকর এঁকেছেন। মঞ্চের পেছনের দেয়াল জুড়ে চিত্রকররা ছবি এঁকেছেন। সবুজ মাঠ, লাল সূর্য, সোনালী তোরণ, নীল পতাকা।নামী অনামী সব কাগজ থেকে, পত্রিকা থেকে সাংবাদিক সমালোচক এসেছেন, একবাক্যে ঘাড় নাড়লেন। হ্যাঁ, জম্পেশ ব্যবস্থা হয়েছে বটে।
দেখেশুনে ভোলারামের মুখ শুকিয়ে গেল। কত কবি। কত দূর দূর থেকে এসেছে। শীর্ণমুখো, চশমাচোখো, হুঁকোমুখো। কেউ লম্বা দাড়ি, কেউ খোঁচা দাড়ি। কারো কাঁধে ঝোলা, কারো পরনে জোব্বা। কেউ লিখেই চলেছে। কেউ ল্যাপটপ নিয়ে একমনে টাইপ করে চলেছে। কেউ ফিসফিস করে কবিতা বলছে। কেউ বক্তৃতার মত একনাগাড়ে আবৃত্তি করে চলেছে। কোথাও বা পাঁচ সাতজনের এক একটি দল, তারা আবার বুড়ো কবি দেখলেই নাক কুঁচকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। দশ বারোজন কবির একটা দল জোরে জোরে কবিতার আধুনিক ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করছে। লম্বা সাদা দাড়ি, কাঁধে ঝোলা এক কবি মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে জোরে জোরে কবিতা আন্দোলনের ইতিহাস শোনাচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে কবিতা-বিপ্লবীদের একটা বড় দল। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন বাউল-কবি। মাঝে মাঝে খোলা গলায় গানের সুরে কবিতা বলে উঠছেন। দর্শক আসন থেকে মুহূর্মুহু হাততালি। টিভির ক্যামেরা নিয়ে ছেলেমেয়েরা এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এত মজা, কাকে ছেড়ে কাকে ধরি ভাব। হাজার হাজার কবি। লক্ষ লক্ষ কবিতা। লম্বা কাগজে, মোটা খাতায়, ছবির মতো
পোস্টারে, পতাকার মত নিশানে। দেখেশুনে ভোলারামের গলা শুকিয়ে এল। তার তো কুল্লে সাড়ে পাঁচখানা লাইন। শোনাতে পারবে তো মন্ত্রীমশাইকে?
মন্ত্রীর ডানদিকে লম্বা টেবিলে দশজন বিশিষ্ট কবি। নানা দেশ থেকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। তাঁরা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না। কেবলই ঘাড় নাড়েন, আর কাগজে কি সব লেখালেখি করেন। কারো কবিতা শুনে গম্ভীর মুখে এ ওর দিকে তাকান। সভার দর্শক জনতা হয়ত হাসতে হাসতে হাততালি দেওয়া শুরু করেছিল, কবিদের মুখ দেখে তাড়াতাড়ি শোকস্তব্ধ নীরবতা পালন করে। মন্ত্রীর বাঁ দিকে লম্বা লম্বা পাঁচখানা টেবিল।
পাঁচখানা টেবিল রাখার জন্যে এদিকটা সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে। এক এক সিঁড়িতে এক একখানা টেবিল। যাতে সবাইকে বেশ দেখা যায়। এঁরা বিশেষ অতিথি। মন্ত্রীমশাইয়ের যে
কোনো সভার আয়োজনে এঁরা উপস্থিত থাকেন। দর্শকদের বিশেষ চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই ব্যবস্থা। সিনেমা - অভিনেতা, নাট্য - অভিনেতা থেকে শুরু করে আবৃত্তিকার সঙ্গীতশিল্পী গাইয়ে বাজিয়ে গীতিকার চলচ্চিত্র -পরিচালক টিভি সিরিয়াল - পরিচালক প্রযোজকদের মস্ত দল। আছেন বিশিষ্ট খেলোয়াড়, ফুটবল ক্রিকেট টেনিস ব্যাডমিন্টন থেকে দাবা সাপলুডো খেলোয়াড়রাও। টিভিতে রিয়েলিটি শো করে উঠে আসা নতুন মুখের পাশাপাশি বিগত যুগের অভিনেতা সাহিত্যিক কবি গায়ক। সেকালের রাজাদের নবরত্ন - সভার কথা মাথায় রেখে মন্ত্রীর এই বিশেষ রত্নসভা। অন্তত নব্বই রত্ন। দর্শকের মূল আকর্ষণ।বিচারক কবিরা কবিতা শুনে গম্ভীর হয়ে পড়লে এই রত্নসভা মাথা নিচু করেন। কবিরা মুচকি হাসলে হাততালি দিয়ে হাসেন। কোন কবিতায় বিচারক কবিরা দন্ত - বিকশিত করে হাসেন। তখন রত্নসভার কেউ কেউ মুখের মধ্যে হাত দিয়ে বিশেষ আওয়াজ করেন। ভোলারাম আজ জেনেছে,এই বিশেষ মুদ্রাকে ‘সিটি মারা’বলে। এই মুদ্রাটি ব্যবহার হলে দর্শক আসন থেকে লোকজন উঠে নৃত্য প্রদর্শন করেন। রত্নসভাও তাতে যোগ দেন। মন্ত্রী হাততালি দিয়ে ঘাড় নাড়েন। নামী রঙ্গকৌতুক শিল্পী এ সভায় বিদূষকের পদে আছেন। তিনি তখন একটি শিঙা বাজিয়ে কবিকে সম্মান প্রদর্শন করেন।
এক একবার বিচারক কবিদের মধ্যে কবিতার ব্যকরণ ছন্দ মাত্রা বৃত্ত নিয়ে তর্ক লাগে। দর্শক শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে জ্ঞানগর্ভ সেসব তথ্য শোনে। একসঙ্গে এতজন তত্ত্বজ্ঞানী সর্বজ্ঞানী কবির দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা। আবেগপ্রবণ কেউ কেউ জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে ফেলে। নবীন কবিরা ডায়েরির পাতায় নোট নিতে ব্যস্ত। প্রবীণ কবির দল গম্ভীর মুখে কখনো মাথা দুলিয়ে সায় দেন, কখনো রাগ করে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। মন্ত্রীমশাই কবিতা শোনেন এক মনে। মাঝে মাঝে হাই তোলেন, তখন পাঠরত কবিকে সভা থেকে বার করে দেওয়া হয়। কবিতা শুনে মন্ত্রী মুচকি হাসলে কবিকে রৌপ্যমুদ্রা পুরষ্কার দেওয়া হয়। মন্ত্রীমশাইয়ের দন্তবিকশিত হলে স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার। তারিফ করে মন্ত্রী ডানদিকে ঘাড় দোলান, তখনই কবিকে একটি কমিটিতে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। মন্ত্রীর ঘাড় যদি বাঁ দিকে দোলে, তখন কবিকে আগামী পূর্ণিমায় কবিসভার জন্যে আগাম দক্ষিণা দিয়ে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়।
কবিতা শুনতে শুনতে মন্ত্রী পেছনপানে চাইলে রত্নসভার সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন। একজন বা দুজন বিশিষ্ট রত্ন পাঠরত কবিকে নিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করেন। মন্ত্রী যদি সামনের দিকে ঝুঁকে চক্ষু মুদিত কারেন, কবিকে উজ্জ্বল তাম্রপাত্রে বিশেষ উপঢৌকন দেওয়া হয়। দেশের নামী অনামী ছোট বড় হাজার খানেক অ্যাড-এজেন্সি এই উপঢৌকন দেওয়ার জন্যে উন্মুখ অপেক্ষায় রাজসভার বাইরে সারি দিয়ে বিপণী খুলে রেখেছেন।
প্রথম তিন দিন ভোলারাম বসার জায়গাই পায় নি। দাক্ষিণাত্যের কবিরা বিদায় নেবার পর চারদিনের অপরাহ্নে সভায় বসার জায়গা পেল। কবিতা পড়ার ডাক পেল আরো তিনদিন পরে। খালি হাত, কাগজ কলম নেই। কবিকে দেখে সভা অবাক।
ভুল লোক মঞ্চে উঠে পড়েছে ভেবে টিভি ক্যামেরাগুলো রত্নসভার ছবি দেখাতে লাগল। জীর্ণ পোষাক, গলায় একটা উড়নি পর্যন্ত নেই, রুক্ষ চুল, শীর্ণ মুখ, খালি পা। অজানা শঙ্কায় পা দুটো কাঁপছে। মন্ত্রী বিগলিত হলেন। গরীব গুরবো মানুষ দেখলেই তাঁর চোখে জল আসে। উত্তরীয় তুলে চোখের জল মুছে অভয়মুদ্রায় হাত তুললেন,‘ মাটির গন্ধ বয়ে আনা কবি, আপনি কবিতা পড়ুন।‘ টিভি ক্যামেরা তাড়াতাড়ি সে ছবি তুলে নিল।
আলোর জোয়ারে ভোলারামের পায়ের কাঁপুনি শরীর জুড়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় আবৃত্তি করল,
জলের মধ্যে ডুবিয়ে দাও
ডুবিয়ে দাও জলের গভীরে
তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর
হে কৃষ্ণগহ্বর
চঞ্চলা চপলকে গ্রাস করো
হে স্থিতধী কৃষ্ণ
আমি যে তোমার মন পড়তে পারি
জনতা নিশ্চুপ। সভা নি:শব্দ। আগামী লাইনগুলো কি হবে সেই ভাবনায় উত্কণ্ঠ। উদগ্রীব। ভোলারাম সবিনয়ে জানালো, তার পাঠ শেষ হয়েছে। জনতা অট্টহাস্য করে উঠল। বিচারক কবিরা বঙ্কিমহাস্যে একে অন্যের দিকে চাইলেন। রত্নসভা থেকে জোরে হুল্লোড় আর হাসির শব্দ ভেসে এল। প্রতিষ্ঠিত কবিরত্নরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে হাসলেন। আরো একজন কবির উত্থানের ফাঁড়া কাটল।
কবিতা-বিপ্লবের সংগ্রামী কবিরা ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। দীর্ঘদিনের কবিতা আন্দোলনের পর এ কি অনাসৃষ্টি! নবীন কবিরা তর্ক তুলল, কবিতাপাঠের আসরে কবির মিনিমাম একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিত কিনা।
পারিষদের দল ধমকে উঠলেন,‘ওহে ছোকরা, এখানে রসিকতা করতে এসেছে? একে কবিতা বলে?’
মন্ত্রীমশাই চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর অন্যরকম মনে হচ্ছে। এ তো কবিতা নয় শুধু, এ যেন এক গভীর অর্থবাহী সঙ্কেত। সম্প্রতি পশ্চিম সীমান্তের গুপ্তচর সংবাদ এনেছে, একদল বিদ্রোহী প্রজা আন্দোলনে নেমেছে। উত্তর সীমান্তের বন্ধুরাষ্ট্রের গুপ্ত সমাচার, প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে তাঁর। এ কবিতা কি তারই সঙ্কেত? এ কবি কি প্রাণঘাতী গুপ্তচর, নাকি প্রাণদায়ী দেবদূত? এ কবিতা বুঝতে হলে বিশেষ রাজনৈতিক জ্ঞান চাই, নাকি এ সঙ্কেত বোঝার জন্যে বিশেষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান?
কবিতাবোদ্ধা হিসেবে দেশ তথা বিশ্বের সাংস্কৃতিক মহলে ইদানিং বেশ সুনাম হয়েছে তাঁর। সাম্প্রতিক অতীতে একদল বিদেশী বণিক তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রচ্ছন্ন একটু অহঙ্কারও আছে তাঁর। তিনি বুঝবেন না, এমন কবিতাও হয় নাকি!
গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবি, এ কবিতা বোঝাতে পারবে তুমি?
’বিচারক আসনের দিকে ফিরলেন, ‘আপনারা কেউ বোঝাতে পারবেন?’
পারিষদের দল নড়েচড়ে বসলেন। রত্নসভা গম্ভীরমুখে সমর্থনের ভঙ্গিমায় মাথা দোলাতে লাগলেন। বিচারক প্রবীণ কবিরা মন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে ঘাড় ঝাঁকাতে লাগলেন। তার অর্থ ‘আমি বুঝেছি’ নাকি ‘আমি বুঝি নি’ তা বোধগম্য হল না। প্রবল উত্কণ্ঠায় কবিরা সবাই মঞ্চের দিকে চেয়ে রইলেন।
ভোলারাম কেবল মিটিমিটি হাসে।
মন্ত্রী নিশ্চিত হলেন। এ কবিতা যে সে কবিতা নয়। এর গূঢ় অর্থটা জানতেই হবে। কবিতা - সভার নিয়ম ভেঙে মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ‘এ কবিতার অর্থ যে ঠিক ঠিক বোঝাতে পারবে, তাকে পুরষ্কার হিসেবে সহ-সভাকবি পদ দেওয়া হবে।‘ এ পদটি আগে ছিল না। কবিসভা উল্লসিত। দর্শক উজ্জীবিত। মন্ত্রীর এহেন কর্মসূচীর জন্যে রাজসভা গর্বিত। রত্নসভার সদস্যরা টিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, মন্ত্রীমশাইয়ের এমন বিপ্লবী চিন্তার জন্যে অতি শীঘ্রই তাঁকে ‘অনলস সংগ্রামী কাণ্ডারী’ আখ্যা দিয়ে একটি সম্বর্ধনা দেওয়া হবে।
এবার অর্থ বোঝার পালা। নবীন কবিরা স্পষ্টত দুই দলে বিভক্ত।
একদল বলে, ‘তীক্ষ্ণ’ আঘাত। জেহাদের ডাক এ কবিতায়। তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। ডু অর ডাই। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। জেহাদ চাই।
আরেক দল বলে, না না। এ আসলে প্রেমের কবিতা।
ওই যে ‘মন পড়তে পারি’ এর মধ্যেই এ কবিতার গভীর ভাব।
কবিতা - আন্দোলনের কবিরা বললেন, আসল কথাটা হল ওই ‘কৃষ্ণগহ্বর’। ব্ল্যাক হোল। পৃথিবীর ধ্বংসের বার্তা এ কবিতায়। জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে ডুবিয়ে বিদায় করার অপূর্ব দর্শন।
অধ্যাত্মবাদী কবিরা বলেন, উঁহু।
‘হে স্থিতধী কৃষ্ণ’.. এটিই কবিতার মূল। মুলাধার চক্রের মত গভীর চিন্তা।
ভোলারামের হয়েছে মুশকিল। সকাল সন্ধ্যা তাকে পালা করে নানা দলের কবিদের সঙ্গে সিটিং দিতে হয়। একদল কবি ভোলারামকে সভাপতি করে একটি ‘কবিতা ওয়ার্কশপ’ শুরু করেছেন। সেখানে রোজ শব্দ ছন্দ মাত্রা তাল অক্ষরবৃত্ত নিয়ে ক্লাস হয়।
বসে বসে ঢুলুনি এসে গেলেও সেখানে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ভোলারামকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান, তাতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে। ইন্টারনেটে ‘বাক - বিপ্লব’ নামে একটি ওয়েবসাইট হয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে ডাক পড়ছে।
দীর্ঘ আলোচনা। সুদীর্ঘ বিশ্লেষণ। দীর্ঘতর ব্যাখ্যা।
দিনের শেষে রোজই দেখা যাচ্ছে, অবন্তী মথুরা কন্যাকুব্জ দাক্ষিণাত্য উত্তরাঞ্চল কামরূপ তিব্বত যত জায়গা থেকে আসা কবিই হোক না কেন, সব কবি এবং সব কবিতা -বিশেষজ্ঞ দাবি করছেন যে তাঁদের মতের সঙ্গেই একমত হয়েছেন বিশিষ্ট কবি ভোলারাম।
ভোলারামকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ভীরু চোখে তাকিয়ে থাকেন।শরীর আরো শীর্ণ হয়েছে, অনিদ্রাজনিত কারণে চোখের কোণে কালি। রোজ দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে থেকে কোমরে ব্যথা, ঘাড়ে স্পণ্ডিলাইটিস। কবি ভোলারাম কেন আর হাসেন না, এ নিয়ে খবরের কাগজে কাগজে দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। কেন এখনো কেউ কবিতার মর্মোদ্ধার করে খুশি করতে পারে নি তাঁকে, সে নিয়ে ইন্টারনেটের ব্লগে ব্লগে বিস্তর লেখালেখি চলছে।
এমনই সিটিং চলছে একদিন। টিভিতে লাইভ দেখানো হচ্ছে। ইন্টারনেটে এবং মোবাইলে দেশ বিদেশ থেকে মতামত আসছে। ‘ডুবিয়ে দাও জলের গভীরে’ নিয়ে তর্ক জমেছে। প্রবীণ কবি বললেন, ‘এখানে জলমানে জল নয়। জল মানে আত্ম - অনুসন্ধান।‘
কবিতা আন্দোলনের পথিকৃত বিশিষ্ট কবি, সম্প্রতি কবি-অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন, দীর্ঘ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আত্ম নয়, আত্ম নয়। আত্মা। সেই বিশেষ আত্মা,
যা কেবল মানুষ নয়, বৃক্ষ এবং লতাগুল্মে বাস করে। পশু পাখি পাহাড় নদী সর্বত্র বিরাজ করে।‘
নবীন কবি বললেন, ‘একেবারেই না। এখানে জল হল একটা সিস্টেম। জটাজুটধারী গভীর শিকড় সে সিস্টেমের। গভীর অনুপ্রবেশ চাই, তবেই চঞ্চলা চপলকে গ্রাস করা সম্ভব।‘
বিশিষ্ট গবেষক কবি, মন্ত্রীর সবগুলো কমিটির মাথায় আছেন, বললেন, ‘জলের গভীরে, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর, বিশেষ ব্যঞ্জনা এখানেই। গভীর অর্থ। তীক্ষ্ণতর শব্দটি এখানে বিশেষ অনুধাবন করা দরকার।‘
সম্মানিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সম্প্রতি রাজ দরবারে বিশেষ সম্মানে প্রধান পরামর্শদাতা পদ পেয়েছেন, বললেন, ‘না হে না। এখানে জল হল দেশ। দ্রাঘিমা আর বিষুবরেখার আলিম্পনে দেশ - মার্তৃকার আরাধনার কথা বলা হয়েছে।‘
হঠাত্ জানলার গরাদে একটি কাক এসে বসল। কৃষ্ণ বায়স। মাথাটা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে কাক কি যেন দেখতে লাগল ঘরের মধ্যে। একবার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে নিল গরাদের গায়ে। গম্ভীর গলায় ডেকে উঠল, ‘ক্ব: .. ক্ব:’। তারপর উড়ে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে হঠাত্ হেসে ফেললেন কবি ভোলারাম। হাততালি দিয়ে উঠলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘর হাততালিতে ভরে উঠল। ঠিক কোন ব্যাখ্যায় কবি প্রসন্ন হয়েছেন তা না বুঝলেও এটুকু বোঝা গেল যে, আজকের সিটিং ফলদায়ী হয়েছে। সম্ভবত সব শেষের অর্থবাহী ব্যাখ্যাটি কবির মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
মন্ত্রীমশাই খুশি হয়ে হাসিমুখে টিভি ক্যামেরার সামনে হাত নাড়তে লাগলেন।
রাজ্যসুদ্ধ লোক, পুরুষেরা পথেঘাটে অফিস - কাছারিতে হাটেবাজারে কফিহাউসের আড্ডায়, মেয়েরা পুকুরঘাটে শপিংমলে অফিসে বিউটি পার্লারে, নব্য যুবক যুবতীরা টুইটার ফেসবুকে, ছেলেমেয়েরা কলসেন্টারে নাইটক্লাবে ডিস্কে, বিদ্যালয়ে কিশোর ছাত্রছাত্রীরা, পাড়ার চায়ের দোকানে অলস যুবকরা, মর্নিং ওয়াকের বৃদ্ধ বৃদ্ধারা সবাই একযোগে বলতে লাগল, এমন কবি আগে হয় নি। কাব্যপ্রতিভার সঙ্গে সুগভীর দেশপ্রেম, অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে দর্শনের মেলবন্ধন, জেহাদ এবং শৃঙ্খলার সহাবস্থান এমনটি এই দিকপাল কাব্যের বিশেষ দিক।
অতিথিশালা থেকে রাজকীয় মর্যাদায় ডেকে এনে মন্ত্রীমশাই কবি ভোলারামকে যথোচিত সম্মান সহকারে রাজ - সভাকবির পদে অভিষেক করলেন।
আজ থেকে তিনি আর কেবল কবি নন,‘কবিকিঙ্কণ ভোলারাম’।
ভোলারামের বউ অবশ্য শব্দটা উচ্চারণ না করতে পেরে ‘কবিকিঙ্কর’ বলে ফেলছে। দুর্মুখ কিছু দুর্জন সে নিয়ে হাসাহাসিও করছে। তাতে কি? কবিকিঙ্কণ এখন সাধারণের ধরাছোঁয়ার অনেক দূরে। হাজার স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও পুরষ্কার এবং সম্মান হিসেবে মন্ত্রী একটি বড় মহল দিয়েছেন। নোবেল পুরষ্কারের জন্যে নাম পাঠানো হয়েছে। কবিকিঙ্কণ ভোলারামের আপ্তসহায়ক হিসেবে নবীন কবিদের একটি দল নিযুক্ত হয়েছে। কবির হয়ে রাজস্তুতি-স্তোত্র ও রাজসভা-গীতি লিখে দেওয়া তাঁদের কাজ। রাজসভায় নিত্য হাজিরা দেওয়া ছাড়া কবিকিঙ্কণের আর বিশেষ কাজ নেই।
কবিতাবোদ্ধা রাজনীতিক বিজ্ঞ সজ্জনকে সহ-সভাকবি পদ দেওয়া হয়েছে। তাঁর নামটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের জন্যে পাঠানো হয়েছে।
অবশেষে মন্ত্রীমশাইও পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেছেন।
Comments
Top
শেষ ইচ্ছে
চান্দ্রেয়ী ভট্টাচার্য্য
বড় রাস্তার থেকে লাল ধুলোয় ভরা মোরামের রাস্তা ধরে প্রায় মাইল সাতেক দূরে আম-জাম-কাঁঠালে-ঘেরা গ্রাম মৌবনি। গ্রামের বেশির ভাগ ঘরের লোকই চাষবাস করে থাকে। কয়েক ঘর ছোটো - খাটো দোকান দানিও করে। একদিন সকালে অপ্রত্যাশিত ভাবে এক ভদ্রমহিলা বুড়ো বাঁড়ুজ্জে দাদুদের বাড়িতে আসে। সেই মহিলা নিজের পরিচয় দেয়, সে নাকি বাঁড়ুজ্জে দাদুর সেজ মেয়ের শ্বশুর বাড়ির কোন আত্মীয়া।
বাঁড়ুজ্জে দাদুদের বাড়ির বাইরের ঘরের একপাশে একটি ছোট্ট মুদী-দোকান। অনেক বছর আগে তিনি কোলকাতার কাছে কোথাও কোন-এক চটকলে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছিলেন দাদু। চার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর যে কয়েক বিঘা জমি ছিল সেগুলি তিনি দেখাশুনা করেন, সেই গ্রামেরই একজন কে দিয়ে চাষবাস করাতেন।
সুখেদুঃ খে জীবন একরকম কেটে যায়। কথায়-বার্তায় তিনি কিন্তু মৌবনি গ্রামের লোকজনের থেকে বেশ আলাদা, সেটা দশ মিনিট যে কেও তাঁর সাথে কথা বললেই তা সহজেই বুঝে যায়।
সেই ভদ্রমহিলা যখন বাঁড়ুজ্জে দাদুদের বাড়িতে আসে, সেসময় দাদুর দোকানে দু চার জন খদ্দের দাঁড়িয়ে। সেই মহিলা তার পরিচয় টুকু দেওয়ার পরই, দাদুকে টুক করে একটি প্রণাম করে। ভদ্রমহিলা তার নাম বলেছিল রমা। খদ্দেরদের জিনিসপত্র দিয়ে বাঁড়ুজ্জে দাদু দোকানের ভেতরের দরজা দিয়ে ঘরের উঠোনে আসে আর দাদুর সাথে সাথেই ভেতরে আসে সেই রমাও। দাদুর বৌ অর্থাৎ দিদিমা, আর তাদের এক নাতনি, বাঁড়ুজ্জে দাদুর বড় মেয়ের ছোট-মেয়েটি, এই তিন জনাই সেসময় বাড়িতে। বাঁড়ুজ্জে দাদু দের এক ছেলে আর চার মেয়ের সংসার, মেয়ে গুলির বিয়ে হয়ে গেছিল অনেক দিন আগেই। ছেলেটি মিলিটারির কর্মসূত্রে বাইরে বাইরেই থাকতো। এই রমা কথায় কথায় বাড়ির সকলকে জানিয়ে দেয় যে তারা সবাই তার খুবই পরিচিত, সে সবাইকেই জানতো, এমন কি দাদুর কোন মেয়ের কোথায় বিয়ে হয়েছে, সেখানের সব আত্মীয়-স্বজন দের নামও তার জানা। সরল মানুষ দাদু দিদার মনে সন্দেহের কোন অবকাশই রইল না। দাদুর নাতনিটি যার নাম রত্না সে স্কুলে পড়ত। কয়েক দিনের ছুটিতে সে এসেছিল মামাবাড়ি। তার মাথায় এই ভদ্রমহিলার হুট করে কাওকে কিছু না বলে আসাটা একটু কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।
প্রথম থেকেই রত্নার কিন্তু এব্যাপারে সন্দেহ একটু একটু করে ভাল মতই হয়। যাই হোক, সেই রমা, বাড়ির মেয়ের মতই দু দুটি দিন বাঁড়ুজ্জেদের বাড়িতে কাটিয়ে দেয় বহাল তবিয়তেই। শুধু একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর তা ছাড়া তেমন বিশেষ কিছুই ছিল না সেই গ্রামে। সব থেকে কাছের পাকা রাস্তায় বাস ধরতে যাওয়ার জন্যেও গরুর গাড়িতে করে যেতে হোতো গ্রামের লাল ধুলো ভরা রাস্তা ধরে।
তৃতীয় দিন সকাল বেলা দিদার তো খেয়ালই নেই, তিনি যথারীতি ভোর ভোর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছেন আর তার নিজের কাজের মধ্যে ব্যস্ত। রত্না সেসময় কোঠার উপরের ঘরে শুয়ে, সে রাত জেগে কিছুক্ষণ পড়াশুনা করে, ভোরের দিকে একটু বেশীই জমিয়ে ঘুমটা ধরে যায়। প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে তখন। দাদু যথারীতি, প্রাতঃকৃত্য সেরে, মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে, পান মুখে দিয়ে, দোকান খুলে বসে ছিলেন তার নিজের জায়গায়। ইতিমধ্যেই দু একজন খদ্দেরও এসে গেছে তখন। সুতরাং দাদু তার নিজের কাজেই বেশ ব্যস্ত। ঘুম থেকে উঠেই রত্না লক্ষ্য করে তাদের গোয়ালের দিকে যাওয়ার দরজার পাল্লা দুটো ঠেসান, মানে
দরজা খোলা। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় টনক নড়ে, সে তাড়াতাড়ি ঘরের সব জায়গা গুলোকে একবার খুঁজে নেয়। ব্যাস, যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সেই অপরিচিতা মহিলা, যার নাম রমা, তাকে সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।
সে তার দাদুকে জিজ্ঞাসা করে, 'গোয়ালের দিকের দরজাটা কি কাল রাত্রে বন্ধ করা হয় নি?' তার দাদু দোকানের ভিতর থেকেই সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় যে সে নিজে সেই দরজাটা বন্ধ করেছিল শুতে যাওয়ার আগে। 'তাহলে এই দরজাটা এখন খোলা কেন?' নাতনি জানতে চায়। উত্তরে দাদু বলে, 'দেখ হয়তো তোর দিদা ভোর বেলাতেই খুলে দিয়েছে ওই দরজা।' একটু পরেই তারা তিন জনাই বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে যে ভোর হওয়ার অনেক আগে রমাই ওই দরজা খুলেছিল। রত্না এরপর দৌড়ে-দৌড়ে আশেপাশের সব বাড়িতেই খোঁজ নিয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে গ্রামের অন্যান্য লোকজনও জানতে পারে যে রমা নামের সেই মহিলাকে সেসময় গ্রামের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশেপাশের বাড়ির অনেকেই তখন তাদের প্রথম থেকেই সেই মহিলার বিষয়ে সন্দেহ হওয়ার কথা দিদা আর দাদুকে জানায় বার বার করে। 'মানুষ একটু সুযোগ পেলেই কেমন কথার ফুলঝুরি ছাড়তে থাকে!' রত্না মনে মনে ভাবে। দিদা বাড়ির সব জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক আছে কি নেই তা দেখতে শুরু করে দেয়। দাদু বা দিদার থেকে রত্নাই অবিশ্যি বাড়ির সব কিছু কোথায় কি থাকে তার খেয়াল রাখত বেশী। সেও তাই সব কিছু ভাল করে দেখতে শুরু করে দেয় । বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বোঝা গেল যে সেই অনাহুত মহিলা এক জোড়া কানের দুল আর কিছু টাকা পয়সা নিয়ে চম্পট দিয়েছিল।
বাঁড়ুজ্জে দাদু সব শোনার পর একটা বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠেন, 'যাক খুব কমের উপর দিয়েই গেছে।'
রত্না প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়, তাই সে তার মামার শোবার ঘরের দরজায় দুটো তালা দিয়ে চাবি গুলো লুকিয়ে রাখে। দাদু আর দিদা খুব প্রশংসা করে, এতটুকু মেয়ের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে। দিদা বলে উঠে, 'হ্যাঁ গো সে মেয়ে তো সবার ঠিকানা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল, এখান থেকে বেরিয়ে আবার সেখানের কোথাও গেল না তো?'বুড়ো বুড়ি তখন আলোচনা শুরু করে দেয়, 'ছোট জামাই পুলিশ অফিসার, সেখানে মনে হচ্ছে যাওয়ার সাহস হবেনা তার', দিদার অনুমান। দাদু এবং রত্না দুজনেও তাই মনে করে। '
তুমি বরঞ্চ সেজ মেয়ের শ্বশুর বাড়িতেই একটা খবর নাও, সে তো নিজেই বলেছে সে নাকি তাদের বাড়ীরই কোন আত্মীয়।' দিদার পরামর্শ। সুতরাং তাই ঠিক হল। দাদু তাদের দোকানে যে ছেলেটি কাজ করতো তাকে বাড়িতে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করে, সংগে সংগেই রওনা হয়ে যান সেজ মেয়ের শ্বশুর বাড়ি আসানসোল যাওয়ার জন্য।
সেখানে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন যে, তাদের সেজ মেয়ের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন দের মধ্যে রমা নামের যে, সে তো তখন হাসপাতালে ভর্তি এবং মৌবনিতে আসা
যে রমার বর্ণনা তাদেরকে তিনি দেন তার সাথে তাদের বাড়ীর রমার কোন মিলই নেই। দাদুর মাথায় তখন বার বার একটি কথাই আসে যে এরপর সেই মেয়েটি কোথায় যেতে পারে। দাদু সেখানে শুধু একটি মিষ্টি আর এক গ্লাস জল খেয়েই বেরিয়ে পড়েন তার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য। বাঁড়ুজ্জে দাদুর মেজ মেয়ের শ্বশুর বাড়িটি বেশ দূরে আর ছোট মেয়ের বিয়ে হয় সবে কিছুদিন আগেই, তার উপর জামাই সে তো পুলিশ অফিসার। দাদুর তখন সোজা সেখান থেকে বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথাটাই মাথায় আসে। ভগবানের নাম নিয়ে তিনি সেটাই ঠিক করেন।
সন্ধ্যে উত্তীর্ণ, দাদু বাস স্ট্যান্ড থেকে নেমে খুব জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করেন। মন খুবই অস্থির। শ্বাস জোরে জোরে নিতে হচ্ছে, পা যেন ঠিক-ঠাক ভাবে পড়ছে না, এক রিকশাওয়ালা দাদুকে দেখেই চিনতে পারে। দাদুকে সে আগেও দেখেছিল তাঁর বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে, সে তার রিক্সায় দাদুকে বসিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাইরের দরজাটা তখন খোলাই ছিল। দাদু প্রায় চিৎকার কোরে বড় মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকেন। মেয়ে রান্না ঘর থেকেই শুনতে পায় বাবার গলা। সে সোজা ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাঁড়ুজ্জে দাদু তাঁর মেয়ের বাড়ির সবার খবরাখবর নেওয়ার আগেই সেই রমা নামের মহিলার হুট কোরে তাদের গ্রামের বাড়ি মৌবনিতে আসা আর ঠিক তেমনই অপ্রত্যাশিত ভাবে চলে যাওয়ার সমস্ত কথার বর্ণনা দিতে শুরু করে দেন। তখন তাঁর মন এতো দিশেহারা, শরীর এতো ক্লান্ত, যে তিনি সাজিয়ে সব কিছু ঠিক মত করে, বলতেও পারছেন না। আর তিনি তাঁর মেয়েকেও কিছু বলতে দেওয়ার সুযোগই দিচ্ছেন না।
এরমধ্যে বাঁড়ুজ্জে দাদু যতটুকু ততক্ষণে বলেছিলেন, তা শুনেই, মেয়ে বলে উঠে, 'দাঁড়াও দাঁড়াও বাবা, এই ‘রমা’ বলে তুমি যার কথা বলছ, সে তো এখানে এসেছে, আজই এসেছে। দুপুরে সে এখানে ভাতও খেয়েছে' ... এবং দাদু আরও জানতে পারেন, তারপর সে, মানে ‘রমা’, বাজারে গেছিল দাদুর বড়-নাতনি স্বপ্নার সাথে; টুকিটাকি কেনাকাটাও করেছে; আর তারপর, মানে কিছুক্ষণ আগেই তো, সেই অজানা ‘কুটুম’কে রেল-স্টেশনে পৌঁছে দিতে গেছে দাদুর বড়-নাতি রঞ্জন। দাদু এটুকু শোনার পর শান্ত হয়ে সোফা-কাম-বেড টাতে বসে একটা লম্বা স্বস্তির-নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, 'যাক, রাত তো কাটায় নি সে এখানে...' মেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠে, 'না না বাবা, তারা তো বেশ কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে, এতক্ষণ বোধহয় স্টেশনে পোঁছেও গেছে।'
এরপর দাদু বাইরের ঘরে রাখা সোফা-কাম-বেড-টার উপর বসে আরও একটি ছোট্ট স্বস্তির-নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে বলেছিলেন, 'শোন তবে বলি, আমি কেন এত দৌড়ে এলাম, তবে বলি সেই কথা...' তিন দিন পর দাদু যথারীতি মৌবনিতে ফিরে আসেন। জীবন আবার চলতে থাকে ঠিক আগের মতই।
বিবিধ জানা অজানা সব পাখিদের কিচিরমিচির দিয়ে শুরু হয় মৌবনির সকাল-বেলা। দিদা ভোর হওয়ার অনেক আগেই উঠে শুরু করে দেন নিজের কাজ। কখনোবা গোয়ালের দিকের দরজাটা ভোর বেলাতেই খুলে দেন, খেয়ালই থাকে না বুড়ীর। কখনো আবার নিজেই গোয়াল পরিষ্কার করতে থাকেন, দোকানে কাজ করে যে ছেলেটা সে হয়ত কোন কোন দিন একটু দেরিতে আসে, 'আহা, ছোট ছেলে, বোধহয় কালকের খাটুনিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, ...' দিদা নিজের মনে মনেই কত কথাই যে বলতে থাকেন। কখনো বা কাল-রঙের গরুটা আর তার সদ্যজাত লালচে - রঙের বাছুর টাকে নিয়েই কথা বলতে থাকেন। দোকানে বসে পান চিবোতে চিবোতে দাদু সেসব কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসেন।
বেশ কিছু দিন পর, আচমকা আবার এক সকালে, অপ্রত্যাশিতভাবে একটি ছেলে আসে মৌবনির বাঁড়ুজ্জে দাদুদের বাড়িতে। সেদিনও দাদুর দোকানে দু চার জন খদ্দের দাঁড়িয়ে, ছেলেটি দোকানে ঢুকে দাদুরই নামটি বলে জিজ্ঞাসা করে বাঁড়ুজ্জে দাদুর বাড়িটি কোথায়।
দাদু মুচকি হেসে বলে, 'যার বাড়ি তুমি খুঁজছ সেই আমি,' এবার সেই বাইশ-চব্বিশের ছেলেটি দাদুকে টুক করে একটি প্রণাম করে, এবং বলে, 'আমি কি এখানে একটু বসতে পারি, আপনার সাথে অনেক কথা আছে।' দাদু তাকে ইশারায় পাসে রাখা কাঠের তক্তার উপর বসতে বলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা খদ্দেরদের জিনিসপত্র দিয়ে বিদায় করে, দাদু ছেলেটির সাথে কথা বলা শুরু করেন। 'দেখ বাবা এমনি করেই একদিন একটি মেয়ে হটাত করে আসে আমাদের বাড়িতে...' কথা বলতে বলতেই দাদু লক্ষ্য করেন ছেলেটি কাপড়ে বাঁধা একটি ছোট্ট পুঁটুলি খুলতে খুলতে দাদুর দিকে তাকিয়ে যেন সে কিছু বলতে চায় । দাদু বলেন, 'কি আছে বাবা ওর মধ্যে?' ... 'আগে এগুলি ভাল করে দেখে নিন এই সবই আপনাদেরই জিনিস, সব কিছু ঠিক ঠাক আছে তো? আমি আসছি আসানসোল থেকে আমাকে আজই ফিরে যেতে হবে,' ... জিনিস গুলির দিকে নজর পড়তেই দাদু ঠিক চিনতে পারেন কানের দুল জোড়াটিকে । মাথাটি তুলে দাদু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলেটির দিকে, কি বলবেন, কোন কথাটা আগে বলবেন, চিৎকার করে গ্রামের লোক ডাকবেন, কি করবেন ... ঠিক তখন ছেলেটি বলে উঠে, 'জানি আপনি খুব অবাক হয়েছেন, কি ভাবছেন আমি জানি না, তবে এগুলি দেওয়ার সাথে-সাথে আমাকে একটি খারাপ খবরও দিতে হবে আপনাদের...'
চমকে উঠে দাদু বলেন, 'আবার কি খারাপ খবর বাবা?” আমাদের আত্মীয়া যে রমা হাসপাতালে ভর্তি ছিল, আপনি শুনে এসেছিলেন, সে... সে... আর নেই...' দাদু সাথে সাথে বলে উঠেন, 'আর নেই...'
...রমারই ইচ্ছেতে রমারই এক বন্ধু, যার নাম প্রীতি, খুব ডানপিটে মেয়ে সে, সেই প্রীতি নামের মেয়েটিই আপনাদের বাড়িতে আসে, আর তারই সাথে রমার কথা হয়েছিল, এমন কিছু একটা কাজ, রমার পরিচয় দিয়ে, প্রীতি করে আসবে, যা নিয়ে বহু দিন অনেক আত্মীয়স্বজন রমার নামটা অন্তত করবে। ছোটর থেকেই রমার শরীর প্রায়ই খারাপ থাকত, তাই রমা অন্য সব মেয়েদের মত দুষ্টুমি কিম্বা মজা করার কোন সুযোগ কখনই তেমন ভাবে জীবনে সে পায়নি, তাই এটাই হয়তো ছিল তার... একরকম মজা করার ‘শেষ ইচ্ছে’ ...
দাদু অবাক চোখে তাকিয়েই থাকেন ছেলেটির দিকে।
:: এই ঘটনা যে সময়ের তখনকার দিনে ‘মোবাইল-ফোন’ নামক বস্তুটি ছিল না, থাকলে হয়ত এ-ঘটনা ঘটতো না ।
Comments
Top
অপত্যস্নেহ
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
দাওয়ায় বসা রমেন আরে... আরে... আরে... শব্দটা করতে করতে ধরতে চেয়েছিল চিত্রাকে কিন্তু তার আগেই চিত্রা পপাত-ধরণীতলে। ধপাস শব্দটার আগে অবশ্য মাগো... বলে চিৎকার করে উঠেছিল চিত্রা।
একটু আগে গজগজ করতে করতে মেঝেটা মুছছিল নিজেই। কদিন হল কাজের মেয়েটা ডুব দিয়েছে। রাগে তালকানা হয়ে হয়তো একটু বেশিই জল ঢেলে ফেলেছিল মেঝেতে। চোখের সামনে বিড়ালটা পাটিসাপ্টাগুলো সাঁটাচ্ছে দেখে মাথা গরম হয়ে যায় তার। অথচ পিঠেগুলো ঢাকা দেওয়াই ছিল। বিড়ালটাকে তাড়াতে গিয়েই বিপত্তি। সিমেন্টের মেঝেতে প্রথম পড়ে পেছনটা। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হাত দুটো চলে যায় পেছনে। শরীরের সমস্ত ভারটা স্বাভাবিক ভাবে চলে আসে হাতের উপর আর তাতেই কোনও রকমে বেঁচেছে মাথাটা। রমেন চিত্রাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে শুইয়েছে বিছানায়। কোমরে বেশ লেগেছে চিত্রার। সমানে আহা, উহু করছে সে। অপরাধীর মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রমেনের মা আশালতাদেবী।
আজকে ঘটনাটা যে প্রথম ঘটল তা নয়। এর আগে অনেকবার এমন ঘটেছে, চিত্রা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কখনও সামলে নিয়েছে নিজেকে আবার কখনও শ্বাশুড়ি বৌমা কথা কাটিকাটি হয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য পাশের গ্রামে বাপের বাড়ি চলে গেছে চিত্রা।
রমেন মাকে বুঝিয়েও কিছু করে উঠতে পারে নি। আসলে মায়েদের মনটা বোধহয় এমনই হয়। সন্তানের ভালো করতে গিয়ে নিজের অজান্তে কত রকমের যে সমস্যা তৈরি হয়ে যায় তা কি আর মাতৃস্নেহ বুঝতে চায়!
বছর তিন আগে, সেদিন ছিল রমেনের জন্মদিন। দিনটা ঘরোয়া ভাবেই পালন করবে বলে প্রস্তুতি নিয়েছিল চিত্রা। গেষ্ট বলতে রমেনের শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, শালা আর শালভাজ। বাজার থেকে অসময়ের ইলিশ এনেছিল রমেন। রমেনের শালা আর শালাভাজ যত্ন করে সাজিয়েছিল ড্রয়িংরুমটা। রঙিন আলোয় বেশ একটা উৎসব উৎসব আমেজ। চিত্রার কিনে আনা দামী পাঞ্জাবিটা রমেনের বয়স এক ধাক্কায় কমিয়ে দিয়েছিল বছর দশ। পাশে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে চিত্রা। শালা বাবু ক্যামেরার লেন্সটা ঠিক করছিল।
এমন সময় আশালতাদেবী ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে গৃহদেবতার পা-ছোঁয়ানো ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে।আর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল উৎসব আবহ। ধান-দূর্বায় লেগে থাকা ঠাকুরের পায়ের সিঁদুর ছড়িয়ে পড়ল সারা পাঞ্জাবিতে। হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন আশালতা। পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য নতুন পাঞ্জাবি পাল্টে বিয়েরটা পরেছিল রমেন। পুরানো স্মৃতি উসকে দিয়ে
যদি বৌকে ক্ষান্ত করা যায়। চিত্রা সেদিন একটা কথাও বলেনি শ্বশুড়িরসঙ্গে। আশালতা গায়ে পড়া হয়েও বৌমাকে ঠাণ্ডা করতে পারে নি। পরের দিন সাবান-জলে ছেলের পাঞ্জাবি থেকে মাতৃস্নেহের দাগ তুলে ফেলতে পারলেন না আশালতা। সে ঘটনার জের থেকে গিয়েছিল আরও দিন চার। আড়ালে ডেকে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল রমেন। মাও বুঝেছিলেন। বলেছিলেন - 'দেখিস আর এমন ভুল হবেই না, তুই বৌমাকে বুঝিয়ে বলিস, আমি খুব কষ্ট পেয়েছি রে খোকা।'
কথাগুলো শুনে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল রমেন। মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আরও বেশি কষ্ট হচ্ছিল চিত্রার জন্য। সে যে মাতৃস্নেহটাকেই বুঝতে চাইল না।রমেনদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকীতেও জল ঢেলে দিয়েছিলেন আশালতা। সকাল বেলা ছেলের মঙ্গলের জন্য তিনি পায়ে হেঁটে দু'কিমি দূরের নারায়ণ মন্দির থেকে নিয়ে এসেছিলেন চরণামৃত। মায়ের এতো কষ্ট করে আনা প্রসাদ সন্তান কি না নিয়ে পারে। সোফায় বসে ড্যাবডেবিয়ে মা-ছেলের আদিখ্যেতা সহ্য করতে না পেরে উঠে চলে গিয়ে ছিল চিত্রা।আর সেই চরণামৃতেই বিকেল থেকে রমেন বাথরুমের বাইরে বেরাতেই পারে নি। শেষকালে
নার্সিংহোম পর্যন্ত করতে হয়েছিল। বিবাহ বার্ষিকীর বিরিয়ানি ফেলে নার্সিংহোমে স্যালাইন নিয়ে শুয়েছিল রমেন।
বাড়ি ভর্তি অতিথিদের কাছে চিত্রার মুখরক্ষাই হয়ে উঠেছিল কঠিন। অত খাওয়ার-দাওয়ার, আলো-আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল সে রাতে।
সারারাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে নার্সিংহোমের ওয়েটিংরুমে কেটেছিল আশালতার।
আশালতার মাতৃস্নেহ প্রায়ই নানান ঝামেলা ঘটিয়ে ফেলত সংসারে। আসলে সাদা মনে আশালতা যাই করতে চান তাই কেমন পাল্টে যেত অশান্তিতে। আর সে অশান্তির চূড়ান্ত হয়েছিল রমেনের প্রমোশন নিয়ে। মায়ের জন্য যে দিন রমেনের প্রমোশনটা আটকে গেল সেদিনই শনির দশা কটাতে সংসার আলাদা করে নিয়েছিল চিত্রা। প্রমোশনটা বাঁধা ছিল রমেনের। কিন্তু বাদ সাধল মায়ের দেওয়া তাবিজটা। খুব ছোটবেলায় পিরের দরগা থেকে
রূপোর তাবিজ বানিয়ে ছেলের বাঁ হাতে কালো কারে পরিয়ে দিয়েছিলেন আশালতা। তখন রমেনের বয়স বছর তেরো। রাতে ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে কেঁদে উঠত রমেন, আর ভয় পেয়ে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরত মাকে।পাশের বাড়ির বড় বৌ হদিশ দিয়েছিল দরগার। ওর ভাইয়েরও নাকি ঐ ব্যারাম ছিল, বলেছিল - 'খরচ একটু আছে, রূপোর তাবিজ তো, তবে একবার হাতে ঠলে সারা জীবনে কোনও বিপদ ছুঁতে পারবে নি।'
তা সেই বিপদহরা তাবিজের মধ্য এতকাল ধরে এতবড় বিপদ ওৎ পেতে আছে তা কি করে জানবে রমেন!
কোম্পানির পার্সোনাল ম্যানেজার মিঃ সাক্সসেনা ছিলেন ঘোর নাস্তিক। তিনি তাবিজ, মাদুলি, মন্দির, দরগা এসব শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন। ইন্টারভিউর সময় সাক্সসেনার নজর গিয়ে পড়ে রমেনের বাঁ হাতে। হাফ হাতা শাটের বাইরে তখন পেন্ডুলামের মতো ঝুলে পড়েছে রূপোলী রং-এর তাবিজটা। মিঃ সাক্সসেনা চশমাটাকে নাকের ডগায় নামিয়ে কপালে চোখ তুলে বলেছিলেন -
'দেখেন মিঃ রোমেন বাবু আপনি আপনার ভোবিষ্যোতের লিয়ে যদি তাবিজ - ফাবিজ লাগান, তোবে আপনি কোম্পানির ভোবিষ্যোত কি ভাবে দেখবে।'
এক তাবিজে মোটা মাইনে হাতছাড়া হয়েছিল রমেনের। আশালতার মুখের উপর তাবিজটা ছুঁড়ে মেরেছিল চিত্রা।
রমেনের অবস্থা না কুল না শ্যাম। সে মাকে না পারছে ফেলতে আর চিত্রাকে না পারছে বোঝাতে।
আজ যেমন কত সামান্য ঘটনায় এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতি হয়ে গেল। সকাল বেলা চিত্রা একটা বাটিতে পাটিসাপ্টা পিঠে দিয়েছিল রমেনকে। পিঠেগুলো এসেছে রমেনের শ্বশুর বাড়ি থেকে। স্থানগুণে বস্তুর মূল্য বাড়ে। একে পিঠে, তার উপর তা বৌ-এর বাপের ঘরের, স্বাভাবিক ভাবেই খাদ্যটি ফাইভস্টার না হোক থ্রিস্টারের মর্যাদা পাবে।রমেন দাড়ি সেভ করছিল দেখে, চিত্রা আর একটা বাটি দিয়ে ঢাকা দিয়ে দেয় পিঠেগুলোকে। এর মধ্যে আশালতা এসে হাজির, তাঁর দু'হাত ভরা কালোজাম। পেকে একেবারে টসটস করছে। ছেলের জন্য যত্ন করে গাছের তলায় পড়ে থাকা জামগুলো তুলে এনেছেন তিনি। গাছটা লাগিয়ে ছিলো রমেনের বাপ। মানুষটা নেই কিন্তু ঘর-বাড়ি, গাছ-গাছালি সবকিছুতেই তিনি না থেকেও আছেন। ছেলের জন্য আনা জামে পাছে মেঝের নোংরা লেগে যায় তাই পিঠেতে ঢাকনা দেওয়া বাটিটা নিয়ে তার মধ্যে জামগুলো রেখে দেন আশালতা।
কত দিন ছেলের দিকে ভালো করে তাকায় নি আশালতা। রমেনের মাথার চুলে পাক ধরেছে, গোঁফটা তো কবেই সাদা। কাজের চাপে খুব রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা। আশালতা রমেনের পাশটিতে বসেন। স্নেহের হাত বোলাতে থাকেন মাথায়। পাছে ব্লেড বসে যায় তাই থেমে যায় রমেন। কতদিন পর সে মায়ের আদর পাচ্ছে! এতো বড় বয়সে তো আর মায়ের কোলে শুয়ে পড়া যায় না। যদি তার ছেলে রাতুল দেখে ফেলে কি হাস্যকর ব্যাপার হবে! একটা ঘোর কাজ করছিল রমেনের মধ্য। সে কখন যেন পৌঁছে গেছে তার শৈশবে।
আর এই সুযোগে বিড়ালটা মুখে তুলে নিয়েছিল খান-দুয়েক পাটিসাপ্টা। বেড়াল তাড়াতে গিয়েই আছাড়। বাটিটা ঢাকা থাকলে এমনটা হতো না। আর তার ফলেই সব রাগ গিয়ে পড়েছে আশালতার উপর।
ডাক্তার বাবু এসেছিলেন, সব দেখেশুনে বললেন 'তেমন কিছু হয় নি, কোমরে একটু ব্যথা লেগেছে।' দুটো ঔষধ দিয়েছেন একটা খাওয়ার অন্যটা মালিশের। ব্যথাটায় একটু গরম সেঁক আর সপ্তাহ দুই বেডরেষ্টের কথা বলেছেন।
যন্ত্রণায় বিছানাটাকে একেবারে এলোমেলো করে ফেলেছে চিত্রা। বিছানার পাশে রাখা টুলটাতে বড় বাতিতে জ্বলছে একটা হারিকেন। সেঁক দেওয়ার জন্য হারিকেনটার মাথায় একটা কাপড়ের টুকরো চাপানো। টিউবটার পেছন দিকটা বাম হাত দিয়ে টিপে ডান হাতের আঙুলে মলমটা নিলেন আশালতা। ডাক্তার বাবু যেমনটি বলেছেন তেমন ভাবেই ম্যাসেজ করতে থাকলেন চিত্রার কোমরে। আবেশে দু'চোখের পাতা জুড়ে এল চিত্রার। নিরাময়ের অমোঘ মন্ত্র নিয়ে ব্যথাটার উপর খেলা করে যাচ্ছে আশালতার আঙুলগুলো।
একটু একটু করে কমতে থাকল ব্যথাটা! মায়েদের হাতে কি ম্যাজিক থাকে! হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তটা মনে পড়ে গেল চিত্রার। পড়ে যাওয়ার আগে শেষবার সে মা বলেই চিৎকার করে উঠেছিল। ঠোঁটে জিভে অন্য কোনও শব্দ তো এসে বসে নি। ম্যাসেজটা হতেই সারা কোমরে ছড়িয়ে পড়েছে শীতলতা। চিত্রা তার গালটাতেও ভেজা ভেজা ভাব টের পেল। ততক্ষণে দু'চোখের জলে বালিশটাকে যে ভিজিয়ে ফেলেছে সে।
Comments
Top
থাপ্পড়
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
এই বয়সে ছেলে, বৌমা, নাতি, পাড়া প্রতিবেশী,কাজের মেয়ে সব্বার সামনে এমনি নেংটো হতে সংকোচ বোধ হয়। আজ একুশে আগষ্ট, বাহাত্তরে পা দিলাম। এর মাঝে একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে। রোগের নামটি বড় গাল ভরা মডারেট এল ভি সিসটোলিক ডিফাংশান। নিয়মিত রেমিপ্রিল, কাডিভাস আর ইকোস্পিন এই তিনটি ঔষধ সকাল ও সন্ধ্যা। হজম শক্তি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। একটু বেশি অনিয়মে সাড়া দিয়ে দেয় শরীর। সরকারি চাকরি থেকে অবসর হয়েছে নয় নয় করে বছর দশ। কাগজে কলমে আমার স্কুল মাস্টার বাবা বয়স কমিয়ে রেখেছিল বছর দুই। এটা না হলে লাস্ট পে-কমিশনটা, ওভার ব্রিজ বেয়ে নামতে নামতে ট্রেন মিশ হওয়ার মতো, হুস করে হাতছাড়া হয়ে যেত। কথায় আছে বাপ কা বেটা, কি ভাবে টুকটুক করে উচ্চাশার সিঁড়ি গুলো পার হতে হয় বাবার থেকে জীবনের সে পাঠ নিয়েছি নির্ভুল। অবসরের বছর চার আগে লোকাল নেতার দৌলতে ছেলের একটা হিল্লে হয়েছে। বৌমা প্রাইমারি শিক্ষিকা, একমাত্র নাতি সৌরীনের পরের বছর কলেজ হবে। চাকরি জীবনে দুহাতে সৎ অসৎ দুই রোজগারে কোন ছুঁতমার্গ ছিল না আমার। তমলুক শহর লাগোয়া তিনতলা বাড়ি, গাড়ি আধুনিক জীবনের কোনো স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই সংসারে।
আজ সারা ঘরময় রঙিন বেলুন,রোলেক্স ঝাড়, বার্থ-ডে রিং,ঝুলে পড়া গালে খুচরো অভ্রে বার্থ-ডে কেকের চটচটে আস্তরণ। রাতের রান্নার কাজ একপ্রস্থ এগিয়ে রেখেছে বৌমা সুলতা,কাজের মেয়ে মিনু বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক, আজ তার ছুটি। আমার অর্ধাঙ্গিনী বীনা নিজের হাতে পায়েস বানিয়েছে আমার জন্য, পায়েসের সুঘ্রাণ গেঁথে রয়েছে কিচেন লাগোয়া ড্রয়িং রুমে। একটু আগেই বার্থ-ডে মোমবাতি গুলো বেশ কষ্ট করে নিভাতে হয়েছে। এ বয়সে বুকের হাপরে যেটুকু বাতাস সংকুলান হয় তাতে না আগুন জ্বলে আর না নেভে। নরম কেকে ছুরি বসানোর সাথে সাথে সুর করে শাখা-প্রশাখায় বেজে ওঠেছে হ্যাপী বার্থ ডে টু ইউ...
সৌরীন 'বর্ণময়-বাহাত্তর' নামে একটা ডকু তৈরী করেছে আমাকে নিয়ে। দেওয়াল ভরা এল ই ডি তে সবার চোখ আটকে। এল ই ডি জুড়ে বছর চারেকের শৈশব, লাল রঙের একটা প্লস্টিকের গামলায় স্নান করছে আমার শৈশব, সামাল দিতে হিমসিম আমার মা। গামলার জলে কিলবিল করছে আমার দুরন্তপনা। ঘোলাটে অস্পষ্ট ছবি থেকে চলকে আসতে চাইছে জল। শৈশবের দম কুলিয়ে উঠছে না মাথা ভেঙে নেমে আসা জলে। মাথা ঝাঁকিয়ে, দুহাতে চোখ, মুখের জল সরিয়ে আকুলি বিকুলি অবস্থা আমার। আর তা দেখে ঠোঁট টেপা হাসি উসখুস করছে ড্রয়িং রুমে।
বুড়ো বয়সে অনেক কিছুই ছেলেবেলার মতো হয়ে যায়। চার বছরের নেংটো শৈশব দেখে ঘোলাটে চোখ আর কুঞ্চিত মুখে শৈশবের লজ্জা। আজ আমি বৃদ্ধ শাহজাহান, সম্রাটের পদতলে সারা পরিবার জো হুজুর জাহাঁপনা। মহম্মদের হাত ধরে বৃদ্ধ আজ অতীত বিহারী, পেরিয়ে আসা জীবন অলিন্দে অলিন্দে আনন্দিত পরিব্রাজন।
পেছন পথে যে এত দ্রুত হাঁটা যায় আগে জানতাম না। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবন,কখনো দৃশ্য অনুরাগে বয়সটাকে থামিয়ে স্থির-চিত্রে চক্ষু-স্থির।
একত্রিশে আগষ্ট দুহাজার ছয়, এল ই ডি জুড়ে আমার আপিসের লোকজন। চশমাটা সামান্য কপালে তুলে বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী দিয়ে চোখের কোন উপচানো জল মুছছে কেউ কেউ। ঐ দিন ছিল আমার অবসর। শুধু আমার নয় বিপ্লবেরও।
বিপ্লব আমার অতি নিকট জন। চাকরি জীবনের শুরুতে হাতধরে শিখিয়েছে সব।
অথচ কর্মজীবনের শেষ দিকটায় তার সঙ্গেই কিনা! কি জানি কেমন আছে সে। এতদিনেও সে কি পারবে আমাকে ক্ষমা করতে!
এল ই ডি তে বিপ্লবের হাতে মানপত্রসহ স্মারক তুলে দিচ্ছেন লাহিড়ী স্যার। স্মারকের ঝলকানি চোখটা পুড়িয়ে দিল যেন। মুহূর্তে ঘাড়টা ছিটকে গেল ডান থেকে বামে,স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বাম হাত আলতো স্পর্শ রাখলো ডান গালে। স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা শক্ত চড়ের শব্দ। সারা শরীর যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট। এল ই ডি থেকে চোখ ছুটে গেল কেরানীতলার আপিসে।
লোহার বাঁকানো সিঁড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠছি আমি। এই প্রথম বাড়ির বাইরে একা একা পা রাখা। মাকড়সার ফাঁদ ঘিরে নিয়েছে দেয়ালের কোন, উত্তরের দেওয়ালে নিচের দিকটায় কালচে লাল পান পিক, পুরানো কাঠের চেয়ারের
কচকচ, টাইপরাইটার এর খটা-খট , খটা-খট, মাথার উপর প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে ঘুরতে থাকা ফ্যানটার ক্যাঁচর ক্যাঁচর -এসব নিয়ে সারা আপিসের কোথাও কৌলীন্যের "ক" টুকু নেই। তবে লাহিড়ী স্যারের কাঁচ ঘেরা হিমশীতল চেম্বারে আভিজাত্যের অভাব নেই। জয়েন করার পর লাহিড়ী স্যার সকলের সঙ্গে পরিচয় করে দিচ্ছিলেন আমার। সবার সঙ্গে পরিচয় হলেও পূর্ব দিকের কোনে বসা রোগা ফর্সা মতো যে লোকটি কম্পিউটারে টাইপ করছিলেন তার সঙ্গে পরিচয় হলো না। আসলে লাহিড়ী স্যারই নিয়ে গেলেন না ওনার কাছে। আপিস শেষে বাস স্টপে আবার মুখোমুখি হয়ে গেলাম লোকটার। লোকটার চোখে মুখে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আছে, এড়িয়ে থাকা যায় না। নিজেই এগিয়ে এলেন আমার দিকে -
'নমস্কার, আমি বিপ্লব, বিপ্লব মিত্র, এ্যাকাউন্টস দেখি।'
পাল্টা নমস্কার জানিয়ে, আমার নাম জানিয়েছিলাম আমি ।
কয়েক দিনের মধ্যেই বিপ্লবের সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতা হয়ে গেল। এবং এটুকু বুঝতে সময় লাগল না কেন সেদিন লাহিড়ী বিপ্লবকে এড়িয়ে ছিল।
এখানে এসে থেকে দেখছি চেয়ারের খোশামোদ খিদে একটু বেশি। আসলে এটাই হয়তো নিয়ম, যখন কোনো মানুষ উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন নিচের মানুষজনকে আরো বেশি করে ছোট দেখে। মন প্রস্তুত থাকে না কোনো কিছুতে না শোনার জন্য। আগ্রাসী ক্ষুধায় সব কিছু মুঠোবন্দী করে নিতে চায় - এমন কি নারীকেও। আমাদের মতো একদল, বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে লাহিড়ীদের আরো অতি ঈশ্বর করে তোলে।
বিপ্লবের কাছে প্রথম শুনেছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর 'একটি উজ্জ্বল ষাঁড়'- যারা প্রতিনিয়ত মনে করে 'ভূ-মধ্যসাগর এসে পায়ে পড়ে হবে পুষ্করিণী।' আর আমরা নাকি বিশ্বস্ত বাদুড়ের দল লেজের চামরে আরতি করে যাই।
কাজের ব্যাপারে বিপ্লব বড় পরিপাটি, বড় সৎ - তার বাম হাত পূতোদক ধৌত। অহেতুক সুবিধের নেশা কখনো পেয়ে বসেনি তাকে।
বাদুড় দলে ঐ এক বিপ্লব অসহ্য হয়ে উঠছিল লাহিড়ীর কাছে। ক্ষমতার ধরনটাই এমন সে চায় বাকি সব ইঁদুরের গর্তে ঢুকে যাক।মুষ্টি যত শক্তিশালী হোক যারা সৎ তাদের মুষ্টিবদ্ধ করা যায় না, আঙুলের ফাঁক গলে তারা ঠিক বেরিয়ে যায়, সে তুমি যত কৌশলই নাও না কেন। আর এটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল লাহিড়ীর জেদ।
কথায় কথায় ইগনোর করা শুরু হয়েছিল বিপ্লবকে,যে কারণে আমি জয়েন করার দিন ইচ্ছাকৃত ভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি বিপ্লবের সঙ্গে।
আমি আপিসে বরাবর মধ্যপন্থা নিয়েছি, না ছিলাম বাদুড় দলে আর না নিয়েছিলাম বিপ্লবের পক্ষ। সকলকে দিয়ে বিপ্লব হয় না। তবে বড় বোঝাপড়া ছিলো দুজনের। সেটা হয়েছিল বোধহয় দুজনের রিটায়ারমেন্ট এক দিনে বলেই হয়তো।
চাকরি জীবনে বিপ্লবকে নানা ভাবে হেনস্তা হতে দেখেছি। আমারা কেউ কিছুই করে উঠতে পারি নি। প্রতিবাদের জন্য একটা মুষ্টিবদ্ধ হাতের দরকার পড়ে। হাত আমার ছিল বটে তাতে আঙুল ছিল না একটাও।
কর্মচারী ইউনিয়ন একটা ছিল যদিও, সেটা হয়ে উঠেছিল দালালের জরায়ু। সেবার বিপ্লবের কম্পিউটারটা বেশ গড়বড় করছিল।লাহিড়ীস্যারের কাছে বারবার নতুন একটা কম্পিউটার কেনার দরবার করে বিফল বিপ্লব ভেতরে ভেতরে বেশ তেতে ছিল। শেষ পর্যন্ত পুরানো কম্পিউটার মেরামতির ব্যবস্থা হয়েছিল। এপর্যন্ত সব ঠিক ছিল কিন্তু দিন দুই পর লাহিড়ী গ্রুপ ডি কে দিয়ে একটা বিল পাঠালো বিপ্লবের কাছে। বিলটা দেখা মাত্র একটা হাঁফ ওঠা পুরানো কম্পিউটারে তার নিজের গলদঘর্ম ছবিটা ভেসে উঠল। রোগা পাতলা শরীরে কুলিয়ে উঠল না উত্তেজনা।
বিলটা নিয়ে বিপ্লব সোজা উঠে যায় লাহিড়ীর চেম্বারে। কাঁচের দেওয়াল ভেঙে দুজনের চিৎকার ছড়িয়ে পড়েছিল সারা আপিসে। বিলটা লাহিড়ীর সামনে ফেলে দিয়ে রীতিমতো টেবিল চাপড়ে বিপ্লব বলছে - 'এটা কত নম্বর ফ্রডজারি, মেরামত করে বিল তৈরী হচ্ছে - নিউ কম্পিউটার এন্ড ইনস্টলেশন কস্ট...'
এহেন অপমানে লাহিড়ীর মুখ ঝুলে গেছিল নিচের দিকে। দু-একজন স্টাফের কৌতূহলী চোখ গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো বাড়িয়ে তুলছে অপমানের মাত্রা।
লাহিড়ীরা সব সময়ই সঞ্চয়ী। তারা তাদের সকল অপমান, অসম্মান এমনি কি তাদের প্রতি ছোটো খাটো অসচেতন অবজ্ঞার খুঁটিনাটিগুলিও সযত্নে ধরে রাখেন, পুষে রাখেন।
কোন ঘটনা কালের স্রোতে ভেসে যায় না, যায় না ক্ষয়ে। বরং ঘটনা গুলোকে দৃশ্যপটে সাজিয়ে প্রতিমুহুর্তে চলে কাপালিকের সাধনা - প্রতিশোধের সাধনা। কামার যেমন আগুনে নিয়ত ইন্ধন জোগায়,জাগিয়ে রাখে আগুন আর সময় মতো শক্ত, সোজা লোহাকে বাঁকানোর জন্য আঘাতের পর আঘাত করে পাশবিক। লাহিড়ীও ছিল সুযোগের অপেক্ষায়।
ইয়ার এন্ডিং - এর পরের দিন, বেলা দুটো নাগাদ আমি বসে বিপ্লবের পাশের টেবিলে, বাকিরা দুপুরের টিফিন নিতে গেছে ক্যান্টিনে। গত কয়েক দিন ইয়ার এন্ডিং এর কাজ সেরে বেশ রাত করেই ফিরেছে বিপ্লব। কাজের চাপ,টানা কম্পিউটার স্কিনের আলোয় চোখ রাখা, রাত্রি জাগরণ এসবের জন্য হয়তো চোখের পাতা দুটো লেগে আসছিল তার।
লাহিড়ী স্যার পান চিবাতে চিবাতে এগিয়ে যান উত্তরে, পুচ করে পিকটা ফেলেন দেওয়ালে, জলের মগ থেকে জল নেন মুখে। মুখের পেশী আর জিভ দিয়ে জলটা ঠেলে দেন বাঁ দিকে, পরে ডান দিকে - কুলিকুচি করেন। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দেন মুখের জল।
তারপর সোজা এগিয়ে যান পূর্বে। মগের মুখটা খুলে মগটা উপোড় করে দেন বিপ্লবের মাথায়। টেবিলে ঠক করে মগটা নামিয়ে বলেন -
'এটা আপিস, কাল থেকে একটা বালিশ নিয়ে আসবেন। শরীর না টানলে অবসর নিয়ে নিন।'
আমার চোখ কপালে, মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
বিপ্লবের জামা কাপড় ভিজে সপসপ করছে, মাথার পাতলা চুল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল নেমে আসছে ফোঁটা ফোঁটা এসিড এর জ্বালা নিয়ে। চেয়ারে মুখ নিচু করে বসে আছে সে, থরথর করে শরীরটা কাঁপছে অপমানের যন্ত্রনায়। এরমধ্যে ফিরে এসেছে বাকিরা। ঘিরে আছে বিপ্লবকে। বিপ্লবের গলা বেয়ে উঠে আসছে কান্না, অপমানের কালো জল আর কান্না একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার, তাদের আর আলাদা করা যাচ্ছে না।
পরেরদিন লাহিড়ীর চেম্বারে সালিশি সভা বসেছিল। ইউনিয়নের লোকজন সহ স্থানীয় এক নেতা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ডাক পড়ল আমার। সমস্ত বিচার ব্যবস্থা আমার দিকে তাকিয়ে। এই বাদুড়ের দলে বিপ্লবের সাহসের সবটুকুই আমি। দীর্ঘদিনের সহকর্মীর কাছে এ তো খুব সামান্য চাওয়া। কতদিন ছেলে অসুস্থ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেছি একা হাতে দুজনের কাজ সামলে দিয়েছে বিপ্লব। সৌরীন যেদিন জন্মালো এক কথায় কুড়ি হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়েছিল বিপ্লব বিনা সুদে। বিধাতা এই জীবনেই মানুষকে তার ঋণ পরিশোধের একটা সুযোগ করে দেয়। সুযোগ আমার সামনেও।
প্রত্যয়ী বিপ্লবকে পথে বসিয়ে আমি বলেছিলাম জল খেতে গিয়ে মগের আলগা মুখ খসে পড়ে, তাতেই ভিজে যায় বিপ্লব। সেদিন আর একটু বেশি রোজগার, আর একটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে আমার প্রতি বিপ্লবের বিশ্বাস, ভরসা, আস্থাকে কোন পিছুটান ছাড়া ভাসিয়ে ছিলাম স্রোতে।
প্রতিশ্রুতি রেখেছিল লাহিড়ী। অবসরের দু বছর আগে প্রমোশন জুটেছিল আমার। তারপর থেকে বিপ্লবের সঙ্গে আর কথা হয় নি, আসলে বলতে পারি নি। বিপ্লবের থেকে একধাপ বেশি উপরে উঠেও বন্ধুত্বের মুখ তুলে দাঁড়াতে পারি নি কোনোদিন।
একত্রিশে আগষ্ট দুহাজার ছয়, সারা আপিস গুম মেরে ছিল। লোক দেখানো কিনা জানি না, সকলের চোখে মুখে যেন অঙ্গ-হানি যন্ত্রণা। লাহিড়ী স্যার নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন একটা বিদায় সভার। পাশাপাশি বসেছিলাম দুজন তবুও যেন কত দূরে। তাকে ছোঁয়া যায় না। তার চোখে চোখ রাখা যায় না।
বিপ্লব যে এতো ভালো বলতে পারে তা আগে কখনো শুনি নি। যখন তাকে দুকথা বলতে বলা হল, ধীর গলায় একটা গল্প বলেছিল বিপ্লব, উপনিষদের গল্প -
'আরুনি তার পুত্র শ্বেতকেতুকে একটা বড় বট গাছ দেখিয়ে বলল, ঐ বিশাল বট গাছের একটা বীজ নিয়ে এসো। বীজ নিয়ে এল শ্বেতকেতু। আরুনি বলল - ঐ বড় গাছটি এই সামান্য বীজটা থেকে উৎপন্ন। অর্থাৎ এই ছোট্ট বীজটার কি অসীম ক্ষমতা, তার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ঐ অসীম। তাই পুত্র শ্বেতকেতু বড় নয় শ্রদ্ধাবান হও।'
অনুষ্ঠান শেষে বিষণ্ণ মনে হাঁটছিলাম লাহিড়ী স্যারের চেম্বারের দিকে। দরজায় থমকে দাঁড়ালাম। ভেতর থেকে বিপ্লবের কথাগুলো দরজার ফাঁক গলে চুঁইয়ে আসছিল -
'এ উপহারগুলো আমি বইতে পারব না। এগুলো রাখুন। সবার সামনে আপনার সম্মানার্থে সানন্দে নিয়েছি। এ স্মারক, এ উৎকোচ আমাকে আমার কর্মজীবনের প্রতিটি অপমান প্রতিমুহুর্তে মনে করাবে। তাই এগুলো রইলো। ভালো থাকুন।'
কথা কটা শেষ করে ঘুরে পড়েছিল বিপ্লব কিন্তু সৌখিন টুলের উপর থাকা জলের মগটা দেখে ফের ঘুরে পড়ল সে।কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সপাটে একটা চড় কসালো লাহিড়ীর গালে। হয়তো এই চড়টা এতো দিন ধরে শক্তি সঞ্চয় করছিল। আজ যে তার কোন পিছুটান নেই, আজ সে ক্ষমতার আস্ফালনের সীমারেখার বাইরে, পদমর্যাদার কাছে, নেই সামান্যতম সৌজন্যের অবকাশ। লাহিড়ী মহুর্তে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। বিপ্লব আমার সামনে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে।স্মারক, উপহার এগুলো কেমন যেন পাথরের চেয়ে ভারী ঠেকছিল হাতে, ভারে নুয়ে যাচ্ছিল মেরুদণ্ড। নিজের গালটাও যেন গুলগুল করে উঠল।
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম তার চলে যাওয়ার দিকে। আর মনে মনে ভাবলাম এ চড়টা কি কেবল লাহিড়ীকেই বাজল। এ চড়কি আমাদের মতো মেরুদণ্ডহীন সমস্ত বাদুড়কে দিয়ে গেল না বিপ্লব। কতক্ষণ আগে ডকুমেন্টারিটা শেষ হয়েছে ঠাওর করতে পারি নি। সবাই সৌরীনের কাজে খুব খুশি। ততক্ষণে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে সৌরীন। সুলতা পাশ থেকে ছেলেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে - 'আশীর্বাদ চেয়ে নে, যেন দাদুর মতো বড় হতে পারিস।'
সৌরীনের মাথায় হাত রেখে, মনে মনে বললাম - 'বিপ্লব দাদুর মতো বড় হও বাবা। শ্রদ্ধাবান হও।'
Comments
Top
অনিকেত
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
সকাল থেকে পাঁচুবাবু গোবিন্দের চা দোকানে বসে আইঢাই করছে। বাঁশের খুঁটিটায় ঠেস দিয়ে বসেছে বুড়ো আর ঘাড়টা বাঁকিয়ে বারবার বাইরের পথটা দেখছে। তিন নম্বর চা টেবিলে রেখে গোবিন্দ বলল---- ছ্যার আজ বোধহয় আর উকিল বাবু এলেন না।পাঁচু বাবুর এতোক্ষনে টনক নড়ল তাকে তিন নম্বর চা দেওয়া হয়েছে। লেড়ো বিস্কুটা সাবধানে দাঁতের তলায় রাখল পাঁচু বাবু। মাথা ভাঙা দাঁত কটা প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ভিতের মতো জেগে আছে। অনেক দিন ধরে পাঁচু বাবু আর নৃপেন্দ্র নারায়ন গোবিন্দর ধরা কাস্টমার। তাই তাদের আলাদা গ্লাস। গোবিন্দ আগে কাপেই চা দিত কিন্তু দুই বুড়োর পোষালো না।
চা'টাকে বড্ড কম কম মনে হতো। তাই গ্লাসের বন্দোবস্ত। পাঁচু বাবু বছর দুই হলো রিটায়ার্ড করেছেন বিধুবিনোদ স্কুল থেকে। আদি বাড়ি চাকদহে। তবে সে এখন গঙ্গায় তলিয়ে গেছে। এখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে ইঙ্গিত করে বলতে হয়, ঐ, ঐতো বাড়িটা।ভাঙনের শক্তি এতোটাই বেশি, তার ধ্বংস লীলা এতো অনিবার্য,যে তিন পুরুষের স্মৃতিটাও কল্পনায় একে নিতে হয়। প্রথম যেদিন সাপের মতো ফণা তুলে ঢেউটা তিন পুরুষের ভিতে ছোবল বসিয়েছিল সেদিন রাতে পাঁচুগোপাল নস্কর দু'চোখের পাতা এক করতে পারে নি।
একটার পর একটা ঢেউ ভাঙনের হুঙ্কার নিয়ে আছড়ে পড়ছিল পশ্চিমের দেওয়ালে। দেওয়ালে কান পেতে থেকে থেকে শিউরে উঠছিলেন পাঁচু বাবু। তিনটি নাবালক সন্তানকে নিয়ে পাঁচু বাবু আর তার বৌ সারাটা রাত কাটিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। দিন তিনেকের মধ্যে সংসারের সব বাঁধাছাঁদা করে উঠে এসেছিল ভাড়ার ঘরে। পাঁচুগোপালের চোখের সামনেই টুপ করে গঙ্গার গভীর জলে খসে গিয়েছিল বাড়িটা। সেদিন থেকে নিজের একটা বাড়ির বড় সাধ পাঁচু বাবুর। ফুলিয়ায় স্কুলের কাছাকাছি চার কাঠা জায়গা কিনেছিলেন তিনি। ফুলিয়ায় উঠে আসার পর নৃপেন্দ্র নারায়নের সঙ্গে আলাপ গড়ে ওঠে তাঁর। নৃপেন্দ্র নারায়ন হালদার অকৃতদার। পেশায় উকিল। পাঁচু বাবুর জীবনের কম বেশি সব সিদ্ধান্তে নৃপেন্দ্র নারায়নই শেষ কথা। বন্ধু শব্দটাকে নৃপেন্দ্রকে দিয়েই সঠিক ভাবে বুঝেছে পাঁচু বাবু। অবশ্য এই অনুভুতিটা একতরফা নয়। পাঁচু বাবু ও তার পরিবার নৃপেন্দ্রকে তাদের বাড়ির একজন বলে মনে করে। অবসরের পর গ্রাচ্যুইটি, প্রভিডেন্ড ফান্ড, আর চাকরি জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে তিন ছেলের জন্য দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন পাঁচুবাবু। বিপত্তি হয়েছে কে কোন তলায় থাকবে তা নিয়ে। এক তলায় সবার নজর। সিঁড়ি ভাঙার ধকল, গরমকালে ছাদের তাপ এসবের জন্য দোতলায় কেউ যেতে চাইছে না। বড় ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে গ্রাউন্ডফ্লোরের জন্য রাজি করানো গেলেও, বড়বৌমা ঘাড় পাতছে না। তাইপাঁচুবাবু সকাল থেকে তীর্থের কাকের মতো চা দোকানে বসে কখন মুশকিল আসান নৃপেন্দ্র নারায়ন হাজির হয়। নৃপেন্দ্রর প্রতি তাঁর ভরসা অগাধ। বিয়ে থা না করলেও উকিলি বিদ্যা দিয়ে কত বার সংসারের সুরাহা করে দিয়েছে সে। তিন নম্বর চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিতে না দিতে নৃপেন্দ্র নারায়ন পেছন ঠেকিয়ে দিল গোবিন্দর বেঞ্চে।
গোবিন্দও ঠকাস করে গরম চায়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে দুটো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট এগিয়ে দিল উকিল বাবুর দিক। গুম হয়ে আছে পাঁচু বাবু,দেরির কারন সবিস্তারে বলে যাচ্ছে নৃপেন্দ্র নারায়ন। হাতে ধরা চায়ের গ্লাস ঠান্ডা হতে না হতে পাঁচু বাবুর রাগ গলে জল।
চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা, গোবিন্দকে আড়াল করে চাপা গলায় পরিস্থিতিটা নাগাড়ে বলে গেল পাঁচু বাবু। বাধ্য ছাত্রের মতো সবটুকু শুনল নৃপেন্দ্র। একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়ায় সাদা বলয় তৈরী করে ভাসিয়ে দিল বাতাসে। বলয় গুলো সেকেন্ড কয়েক পরে ভেঙে একটা রেখা হয়ে সাপের মতো বাতাসে ভেসে রইল।
নৃপেন্দ্র দোল খাচ্ছে হ্যাঁ ও না এর ভিতর। তার মাথায় দোলা দিচ্ছে নানা সিদ্ধান্তের বিকল্প।
হঠাৎ নৃপেন্দ্র বলে উঠল--
--- লটারি। তিনটি কাগজ -শূন্য, এক,দুই।
ফ্ল্যাট বাড়ি কেনার মতো লটারি করে ফেল। লটারিতে যে , যে কাগজটা তুলবে সে পাবে সেটাই। পক্ষপাতিত্বের কোনো প্রশ্নই নেই।
নৃপেন্দ্র নারায়নের কথা শুনে পাঁচু বাবুর মুখে চকচক করে উঠল হাসি। ঘাড় ঘুরিয়ে গোবিন্দকে বলল--
--- একটু আাদা দিয়ে, দুটো স্পেশাল চা বানা কড়া করে।
চায়ের গ্লাস দু'টো ভর্তি করে চা দিল গোবিন্দ। এতক্ষণ সব কথা সে কান পেতে শুনেছে। দোকানে কাস্টমারও নেই। সে পাঁচু বাবুর গা ঘেঁসে বসল। একটু আমতা আমতা করে পাঁচু বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল---
--- ছ্যার একটা কথা বলব?
--- একটা কেন রে গোবিন্দ, দশটা বল।
--- না ছ্যার আমার ঐ একটা কথাই ছিল।
--- বলে ফেল।
--- বলছিলাম কি, উঠা-নামার সেই যন্ত্রটাকি ঘরে লাগাইছেন?
--- উঠা-নামার যন্ত্র! ওহঃ লিফট্। না তো।
---লাগিয়ে ফেলেন তাড়াতাড়ি।
---- কেন রে!
--- তিন তলা তিন জনকে দিয়ে ফেল্লে আপনার তো আর ঘর নেই। মাসে দশ দিন অন্তর উপর নিচ করতে পারবেন? বয়স তো কম হল না।
স্পেশাল চায়ের গ্লাস হাতেই ধরা রইল দুজনের। পাঁচু বাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন গোবিন্দের মুখের দিকে। গোবিন্দ কিছুটা লজ্জায় কিছুটা ভয়ে তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সরিয়ে নিল।
পাঁচু বাবু, চাকদহে তিন পুরুষের দেওয়ালে আছড়ে পড়া ঢেউ এর শব্দ শুনতে পেলেন।
Comments
Top
উত্তরাধিকার
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
সবেমাত্র প্রভাতফেরি শেষ হল। পাতলা পাঞ্জাবিটা ঘামে লেপটে গেছে শরীরের সঙ্গে। ছোট ছোট ছেলেদের কেক আর একটা করে লাড্ডু দেওয়া হচ্ছে। টিফিনটা হাতে পেয়ে মুখগুলো থেকে মুহুর্তে উধাও ক্লান্তি। লাইনটাকে ম্যানেজ করতে হিমশিম খাচ্ছে কল্যাণ। শহিদবেদীতে জাতীয় পতাকার পাশে পতপত করে উড়ছে প্রতিষ্ঠানের পতাকা। পতাকার নকশাটা করেছিলেন কল্যাণের বাবা। পঁচিশ বছর আগে তাস খেলার আড্ডাটাকে কল্যাণের বাবা আর তার বন্ধুরা চাঁচ দিয়ে ঘিরে মাথায় একটা ত্রিপল চাপিয়ে শুরু করেছিল প্রগতি সংঘ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ইঁটের দেওয়াল আর মাথায় এ্যাজবেসটার পেয়ে গেল প্রগতি সংঘ। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কলোনির এই মানুষগুলোর একটা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের দরকার হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে আসা মানুষগুলোকে আঁটসাঁট বাঁধনে বেঁধেছিল প্রগতি সংঘ।
শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত পাক্কা, সংঘের বাইরে জুতোর সঙ্গে খুলে আসতে হবে রাজনৈতিক সত্তা। পঁচিশ বছরের জীবনে দু'এক বার হয়তো সাময়িক সমস্যা তৈরি হয়েছ কিন্তু তা স্থায়ী হয় নি।
জন্ম থেকেই ফি-বছর প্রতিষ্ঠা দিবসের সকালে প্রভাতফেরি, তখন ছোট ছোট ছেলেদের মুড়ি, বাতাসা আর বাদাম দেওয়া হত। স্থানীয় হাসপাতালে রোগীদের ফল বিতরণ আর সারাদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বছর তিন চার হল অনুষ্ঠানের চাকচিক্য বেড়েছে। ভাড়া করা শিল্পী আসছে। কোথায় যেন সেই আন্তরিকতাটা নেই। অথচ আগে নিজেরাই বাঁশ-বাটামে মঞ্চ বেঁধেছে অপটু হাতে। কলোনীর ছেলে মেয়েরা রং মেখে নাটক করেছে, সুরে-বেসুরে গান গেয়েছে। দর্শক বলতে কলোনীর লোকজন,যারা গাইছে, নাচছে, অভিনয় করছে তাদের মা-বাবা, পাড়া প্রতিবেশী। হঠাৎ করে কলোনীর কালচারে ঢুকে পড়ল বাইরের হাওয়া। শুরু হল পয়সা খরচ করে কলকাতার বক্স আর্টিস্ট দিয়ে ফাংশন।
এবার যে রজতজয়ন্তী তাই আরও বড়ো শিল্পী এসেছেন।
মাস তিনেক হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেছে সদস্যরা। রজতজয়ন্তী বলে কথা, কালেকশন, সুভেনিয়রের বিজ্ঞাপন, লেখাপত্তর সব কিছুই এক হাতে সামলেছে কল্যাণ। নিজেরা চাঁদা করে ক্লাবের ছাতটাকে স্থায়ী করার ঝুঁকিও নিয়েছে। দিন কুড়ি হলো ঢালাই ছাত হয়েছে, হয়েছে ছোট্ট একটা বাথরুম। সকাল থেকে কল্যাণের বছর বারোর ছেলে, নয়ন বার চারেক জল ভরে ফেলল বাথরুমে।
কলকাতা থেকে বিকর্ণ রায়তালুকদার এসেছেন গান গাইতে। ভদ্রলোক এখনকার প্রথম শ্রেণীর শিল্পী। রবীন্দ্র সংগীতের লোক হলেও সব রকমের গান গাইতে পারেন। বিকর্ণবাবু চলে এসেছেন গত কাল রাত্রে। সেই থেকে নয়ন পোষা কুকুর ছানার মতো বিকর্ণবাবুর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাত সকালে রেওয়াজ সেরে এক গ্লাস ত্রিফলার জল, তারপর লিকার চা, বাথরুমের জল, শহরে তো পাওয়া যায় না তাই দাঁতে দেওয়ার নিমকাঠি, জলখাবার ফাই-ফরমাশের বিরতি নেই। নয়নের খুব পছন্দের গায়ক
বিকর্ণবাবু। যার গান এতো দিন রেডিও, রেকর্ডে শুনে এসেছে নয়ন, আজ তাকে সামনে পেয়ে সে আনন্দে আত্মহারা। কত দিন এ গলা সে তন্ময় হয়ে শুনেছে আর কল্পনায় ছবি এঁকেছে তার প্রিয় শিল্পীর।এতদিন যে ছবি সে এঁকেছে তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর বিকর্ণবাবু।
নয়নও গান গায়,তার গানের গলা মন্দ নয়। প্রিয় শিল্পীকে পেয়ে তার যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি কোথাও যেন ছোট্ট একটা কাঁটার খচখচও জেগে আছে। তাদের কলোনীর কালচারটা হঠাৎ করে পাল্টে না গেলে আজ সেও হয়তো মঞ্চে গাইতে পারত। তার গানও তো শুনত কলোনীর মানুষজন, হাততালি পড়ত। অনুষ্ঠান শেষে গ্রীনরুমে খোঁজ নিতে আসত কেউ কেউ।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকর্ণবাবুর সঙ্গে ভাব জমে উঠেছে নয়নের। তিনি একদিন আগে এসেছেন গ্রাম দেখবেন বলে। নয়ন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গ্রামের পথে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসেছেন চন্ডীতলায়। কথায় কথায় বিকর্ণবাবু এও জেনে নিয়েছেন নয়ন গান গায়। অনেক জেদাজেদির পর নয়ন খালি গলায় গান শুনিয়েছে তার স্বপ্নের গায়ককে। গান শেষ করে লজ্জায় মুখ তুলতে পারে নি নয়ন, এ যেন সমুদ্রের সামনে গোষ্পদের আস্ফালন। গান শেষের পর সারা চন্ডীতলায় শ্মশানের নীরবতা। তখনও নয়নের মুখ নিচের দিকে নামানো। মুখটা লজ্জায় লাল, যেন শরীরের সব রক্ত এসে জমা হয়েছে মুখে। বিকর্ণবাবুই জড়িয়ে ধরলেন নয়নকে। নয়নের দু'চোখ জলে থৈ, থৈ।বিকেল থেকে মন্টু দখল নিয়েছে মাইকের। বারবার মাইকে ঘোষণা হচ্ছে অনুষ্ঠানের কথা, ফলাও করে বলা হচ্ছে বিকর্ণ বাবুর নাম। আজ সারাদিন প্রগতি সংঘে যে কি কি ঘটে গেল তার কিছুই জানে না নয়ন। সে তো সারাদিন লেগেপড়ে আছে তার স্বপ্নের সাথে। সন্ধ্যের দিকে নয়ন চা নিয়ে বিকর্ণবাবুর দরজায় দাঁড়াল। নয়নকে দেখা মাত্র কিছু একটা লুকিয়ে ফেলতে চাইল বিকর্ণবাবু। তারপর কোন কথা না বলে হাতের ইশারায় নয়নকে চলে যেতে বলল। যে মানুষটার সঙ্গে সারাটা দিন সে লেগে পড়ে রয়েছে, তাঁর এই অবজ্ঞায় নয়ন খুব ব্যথা পেল মনে। সবচেয়ে বড় কথা যে মানুষটা কথা বলতে পারে সে যখন হাতের ইশারায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চলে যেতে বলে তখন খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। কৌতূহলকে শিকল পরাতে পারল না নয়ন, জানালার ফুটোতে চোখ রাখল সে। ভেতরে যা দেখতে পেল তাতে সে নিজের চোখটাকে বিশ্বাস করতে পারল না। দু'হাতে চোখ দুটো কচলে ফের চোখ বসাল গুপ্ত পথে। দেবতা যখন রক্ত মাংসের সাধারণ মানুষে নেমে আসে যখন সাধারণ জীবন
যাপনের ক্লেদ ছুঁয়ে ফেলে তাকে তখন পূজার ফুল কাঁটা হয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় হৃদয়।
জরুরি ভিত্তিতে কোর কমিটির মিটিং ডাকা হয়েছে। কল্যাণ, অনিন্দ্য, রূপম সহ আর জনা ছয়েক রয়েছে। সিনিয়র হিসেবে রয়েছেন কল্যাণের বাবা আর রাধারমণ বাবু। পুরো পরিস্থিতি সকলের সামনে সংক্ষেপে বলল কল্যাণ।
'আমি কিন্তু বারবার তোমাদের এই রেনটেড আর্টিস্ট আনার বিরোধীতা করেছি। কতবার বলেছি এ প্রবণতা ভাল নয়, তখন তোমরা আমল দাওনি।' পান চিবাতে চিবাতে বেশ শ্লেষ মিশিয়ে কথাগুলো বললেন রামবাবু।
মাথাটা যেন ধরে আছে। দু'হাতে রগ দু'টোকে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে কল্যাণ। কি ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় তার কোনও সূত্রই খুঁজে পাচ্ছে না সে। তার উপর শুরু হল পুরানো কাসুন্দি চটকানো। কল্যাণের কাজটাকে সহজ করে দিল রূপম -
- 'দেখুন কাকাবাবু, আমরা আপনার মতামতকে এরপর অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে ভাবব কিন্তু এখন তো আগে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাক।'
- 'হ্যাঁ, রে কল্যাণ ভদ্রলোককে কি কোনও ভাবেই মঞ্চে আনা যাবে না?'
- 'না বাবা, লোকটা গলা অবধি মদ গিলে একেবারে বেহুশ। নয়নকে গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছে, কপাল ভাল নয়নের লাগে নি। অনিন্দ্যকে যাতা খিস্তি করেছে।'
নয়নের নামটা আসতেই রূপমের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। কল্যাণের হাতটাকে শক্ত করে ধরে বলল -
- 'উপায় একটা আছে কল্যানদা, নয়ন। নয়নই পারে এ যাত্রায় বাঁচাতে।'
- 'দর্শককে কি করে বোঝাবি!'
- 'বলতে হবে বিকর্ণ বাবু সিরিয়াস অসুস্থ।'
অনিন্দ্য বলল -
- 'রূপমের সঙ্গে আমি একমত। বাকিরা কি বলেন?'
সভা এক কথায় সহমত হয়ে গেল।
মন্টু দুঃখ দুঃখ গলায় ঘোষণা করতে থাকল -
'অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমাদের প্রিয় শিল্পী বিকর্ণ বাবু গতকাল থেকে আমাদের মধ্যে আছেন কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। তাই তাঁর পক্ষে......'
কানাঘুষো সত্যটা ততক্ষণে চাউর হয়ে গেছে।
দর্শক আসনে শুরু হয়েছে রসালো আলোচনা। যারা শালীনতা শব্দকে বিশেষ রকম পাত্তা ফাত্তা দেন না তাঁরা কেউ কেউ খিস্তি-খেউরও করছেন। মঞ্চে হারমোনিয়াম রাখা হয়েছে। বুকের ভিতর চাপা কষ্ট নিয়ে মঞ্চে এল নয়ন। নাগাড়ে গোটা ছয় সাত গান গেয়ে গেল সে। এরপর আর লোকে নয়নকে নিতে চাইছে না। আশাহত হয়ে দর্শকরা আসন ছাড়তে শুরু করেছে। কেউ কেউ নয়নকে নেমে যেতে বলছে চিৎকার করে।
এবার কি হবে! কি ভাবে সামাল দেওয়া যাবে এই অগণিত জনতার আক্রোশ। মঞ্চের পিছনে লম্বা লম্বা পা ফেলে পায়চারি করছে কল্যাণ।
এমন সময় দর্শক আসন থেকে চিৎকার আরও তীব্র হল। চড়তে থাকল গালি-গালাজ। কল্যাণ উঁকি মেরে দেখে টলতে টলতে মঞ্চে উঠছে বিকর্ণ বাবু।
শরীরের এতোটাই ভারসাম্য হীন অবস্থা যে যে কোন মুহুর্তেই মঞ্চে আছাড় খেয়ে পড়তে পারেন তিনি।
দর্শকরা এটুকু বুঝে গেছে বিকর্ণবাবুর পক্ষে পারফর্ম করা সম্ভব নয়। মঞ্চের সামন থেকে আওয়াজ উঠছে গো ব্যাক, গো ব্যাক।
বিকর্ণবাবু স্থির ভাবে দাঁড়িয়েছেন মাইকের সামনে। তার উদাত্ত কণ্ঠ ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে -
'নমস্কার, মদ আমি যে পান করি না তা নয়। তবে মাতাল হয়েছি খুব কম বারই। বিশ্বাস করুন আজ আমি মদ ছুঁই নি।'
দর্শক আসনের বিশৃঙ্খলা এই কটা কথাতেই উধাও। মাইকের শব্দ যতদূর যায় ততদূর ছড়িয়ে গেল বিকর্ণবাবুর পরের কথাগুলো - 'সারাটা দিন নয়নের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি আমার শৈশবটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম নয়নের মধ্যে। সে সময় আমারও তো ইচ্ছে হতো আমাকেও একটা মঞ্চ দেওয়া হোক। আমার গান শুনেও লোকে হাততালি দিক। তখন সুযোগ দেবে কে! সবাই তো প্রতিষ্ঠিতের পেছনে ছুটছে। ভাবলাম আমার শৈশবের অতৃপ্তিটা অনন্ত আজকের দিনের জন্য নয়নকে যেন না ছোঁয়। তার জন্যই মাতলামি।'
দর্শক আসনে তখন পিন পড়ার নীরবতা।
মঞ্চের সমস্ত আলো এসে পড়েছে বিকর্ণবাবু উপর। হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন -
'তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী'
আসন ছেড়ে চলে যাওয়া দর্শকেরা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে।
কল্যাণ, অনিন্দ্য, রূপমরা পাথরের মতো নিশ্চল। এতক্ষণে মনে হয়েছে আজ পয়লা এপ্রিল তো শুধু প্রগতি সংঘের জন্মদিনই নয়, আরও একটা বিশেষ দিন যে।
নয়ন মঞ্চের বাঁ দিকের উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে। পরম মুগ্ধতা নিয়ে সে অপলক তাকিয়ে তার স্বপ্নের গায়কের দিকে।
ডান দিকের ফলোটার আলোক রশ্মি ছিটকে পড়েছে তার মুখে। তার দু'চোখ থৈ, থৈ করছে আনন্দ আর অনুতাপের অশ্রুতে।
Comments
Top
চাপরাশি
জয়নগরের মোয়া
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
চাপরাশি
এক পশলা বৃষ্টি পিছিয়ে দিল পাক্কা এক ঘন্টা। বৃষ্টির জন্য বেরাতে পারলাম না। ফলে যে গাড়িটায় ফিরব ভেবেছিলাম সেটাতে ফেরা হল না। পরের গাড়ি এক ঘন্টা পর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দুপুরের বাস স্ট্যান্ড, তাই লোকজন খুব একটা নেই বললেই চলে। টাইম মাস্টার চেয়ারে গা এলিয়ে খুচরো একটা ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছে। বট গাছের নিচে পান-বিড়ি দোকানটা অবাধ-বন্ধ, ছোকরাটাকে একটা সিগারেট চাইতে মুখের উপর না করে দিল। মাথাটা নিচু করে দেখি, ঘুপচি দোকানেই দুপুরের ভাত তরকারি সাজিয়ে বসেছে সে। বট গাছের ছায়াটা দখল করে তেলচিটে শরীর, মাথা ভর্তি রুক্ষ বাদামী চুল আর শত ছিন্ন অবাধ-ময়লা জামা কাপড়ে একটা পা নিয়ে যে ছেলেটা রোজদিন ভিক্ষা করে তাকে তো আজ দেখতে পাচ্ছি না। বৃষ্টির জন্য বোধহয় বেচারা বাড়ি ফিরে গেছে।ছেলেটার কথা মনে আসতেই একটা বিষণ্ণতা ঘিরে ধরল আমাকে। একটা পা না থাকা জীবন বয়ে বেড়ানো বড্ড কষ্টের।আবার ঐ না থাকা পা'টাই ওর বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার। ওটাই যতটুকু অনুকম্পা এনে দেয় তাতে শুধু ওর নয় হয়তো ওর পরিবারেও দু'বেলা দু'মুঠো জোটে। রোজদিন কত গুলোইবা টাকা পায় বেচারা। আজ তেমন ভাবে কিছুই পেল না, কি খাবে আজ! প্রতিদিন যাতায়াতের পথে দেখি কিন্তু ওর সম্পর্কে তেমন করে জানাই হয় নি কোনো দিন। এ যুগের ধর্ম এটাই, প্রযুক্তির হাত ধরে সারা পৃথিবী যখন ঢুকে পড়ছে আমাদের বাড়ির উঠোনে তখন আমরা নিজেদের লক্ষ্মণরেখাকে আরো সংকীর্ণ করে নিচ্ছি। এ গতির যুগে অন্যের পানে ফিরে তাকাবার সময় কোথায়!এর মধ্যে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, পথ শ্রমের ক্লান্তি, তাই মিনিট দশেক ঝিমিয়ে ছাড়বে। খাঁ খাঁ করছে গাড়িটা। হাতে গোনা জনা পনেরো সিট দখল করে বাপ বাপান্ত করছে ড্রাইভার, কনডাক্টটরের। বাস কর্মচারীদের জীবনটাই অদ্ভুত, এরা বাড়ি থেকে বেরানোর সময় চোখ-কান খুলে রেখে আসে। হাজার কথায় এরা রা কাড়ে না। গাড়িতে উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে বট গাছের দিকটা নজরে আসতে দেখি একটা ঝাঁ চকচকে গাড়ি সেই খোঁড়া ছেলেটাকে বট তলায় সামনে নামাচ্ছে। এক পায়ে মাটি ঘঁষটে ঘঁষটে শরীরটা এগিয়ে যাচ্ছে গাছ তলার দিকে। শরীরের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে অক্ষমতার বাধাটাকে অতিক্রম করার এক প্রাণান্তকর চেষ্টা। হাত দুটো দিয়ে প্রবল প্রতাপে ছুঁড়ে দিচ্ছে শরীরের নিচের অংশ।ঈশ্বর যাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত করেন, নিজের থেকেই তাদের সংগ্রামের শক্তি দেন অনেক।কাচের আড়ালে বসে থাকা লোকটি সুদর্শন, পোশাক পরিচ্ছদে পরিপাটি। ভাবতে ভালো লাগে এ ধরণের মানুষজনের জন্য পৃথিবীটা আজও সুন্দর। কে চায় এমন নোংরা ময়লা মাখা মানুষকে গাড়িতে লিফট্ দিতে।খোঁড়া শরীরটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসেছে গাছের ছায়ায়।গাড়ির ভিতর থেকে তার কোলের উপর এসে পড়ল একটা ভিক্ষা পাত্র। তারপর গাড়িটা অতি দ্রুত গতিতে হারিয়ে গেল।পিছনের সিট থেকে শুনতে পেলাম--" শালা, হারামির বাচ্চা অনাথ আশ্রমের নামে খোঁড়ার কামাইয়ে চার-চাকার ফুটুনি!"চমক লাগল কথাটা কানে আসতে। সত্যি আত্মসুখের লক্ষ্মণরেখার বাইরে বেরোবার সময়টুকুই আজ বাড়ন্ত। পৃথিবীতে দু'হাত বা দু'পাওয়ালা কত শত খোঁড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কতটুকুই বা জানি!
বাস কর্মচারীদের জীবনটাই অদ্ভুত, এরা বাড়ি থেকে বেরানোর সময় চোখ-কান খুলে রেখে আসে। হাজার কথায় এরা রা কাড়ে না। গাড়িতে উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে বট গাছের দিকটা নজরে আসতে দেখি একটা ঝাঁ চকচকে গাড়ি সেই খোঁড়া ছেলেটাকে বট তলায় সামনে নামাচ্ছে। এক পায়ে মাটি ঘঁষটে ঘঁষটে শরীরটা এগিয়ে যাচ্ছে গাছ তলার দিকে। শরীরের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে অক্ষমতার বাধাটাকে অতিক্রম করার এক প্রাণান্তকর চেষ্টা। হাত দুটো দিয়ে প্রবল প্রতাপে ছুঁড়ে দিচ্ছে শরীরের নিচের অংশ।ঈশ্বর যাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত করেন, নিজের থেকেই তাদের সংগ্রামের শক্তি দেন অনেক।কাচের আড়ালে বসে থাকা লোকটি সুদর্শন, পোশাক পরিচ্ছদে পরিপাটি। ভাবতে ভালো লাগে এ ধরণের মানুষজনের জন্য পৃথিবীটা আজও সুন্দর। কে চায় এমন নোংরা ময়লা মাখা মানুষকে গাড়িতে লিফট্ দিতে।খোঁড়া শরীরটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসেছে গাছের ছায়ায়।গাড়ির ভিতর থেকে তার কোলের উপর এসে পড়ল একটা ভিক্ষা পাত্র। তারপর গাড়িটা অতি দ্রুত গতিতে হারিয়ে গেল।পিছনের সিট থেকে শুনতে পেলাম--" শালা, হারামির বাচ্চা অনাথ আশ্রমের নামে খোঁড়ার কামাইয়ে চার-চাকার ফুটুনি!" চমক লাগল কথাটা কানে আসতে। সত্যি আত্মসুখের লক্ষ্মণরেখার বাইরে বেরোবার সময়টুকুই আজ বাড়ন্ত। পৃথিবীতে দু'হাত বা দু'পাওয়ালা কত শত খোঁড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কতটুকুই
বা জানি!সেক্রেটারি বা ক্যাশিয়ার হওয়ার মধ্যে একটা কেতা ছিল। সেক্রেটারি হলে নিজেকে একটা কেউকেটা কেউকেটা বলে মনে হত। ফাংশানে সুযোগ পাওয়ার জন্য পড়ার মামনিরা তেল দিত, যে কাকুটা বরাবর নিন্দামন্দ করে বেড়িয়েছে সে পর্যন্ত মঞ্চে মাউথ অর্গান বাজানোর জন্য, লোক দেখানো প্রশংসা করত ---"তুমি বলে পার বাপু, তুমি না দায়িত্ব নিলে, 'জলসা' একেবারে জলসা হয়ে যেত। আমি হলফ করে বলে দিতে পারি..... "
অবশ্য ক্যাশিয়ার হলে কটাদিন নিজেকে বেশ জমিদার জমিদার মনে হত। এর বাইরে বাকি সব কাজগুলোতে আত্মসন্তুুষ্টি ছাড়া আর বিশেষ কোন প্রাপ্তিযোগ ঘটে নি কখনো। বরং বদনাম জুটেছে বেদম।
জয়নগরের মোয়া
স্বেচ্ছায় রক্ত দান। আবডালে লোকে বলে বেড়িয়েছে-
--- " ও তো কসাই, চড়া দামে রক্ত বিক্রি করে।" ---- " আরে না না, এক বোতল হরলিক্সের লোভে রক্ত দেয়।" শবদাহ করতে যাওয়া নাকি লোক দেখানো 'সুভাষ খুড়ো' সাজা আসল আকর্ষণ 'বিপিন বাবুর কারনসুধা'।
পাশের বাড়ির মেয়েটাকে শহরের কলেজ চিনিয়ে দেওয়ার মধ্যে, শরীরের গন্ধ খুঁজে পায় কেউ কেউ। অচেনা লোকটা সুস্থ হয়ে, ট্যাক্সিতে উঠে টা টা করতে করতে চলে যায়। দু-রাত জেগে বাসে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ফিরে আসতে হয় গাঁটের কড়ি খরচ করে। কথায় আছে কাজ ফুরালে ছাপড়ায় লাথি। বেকার জীবনে এই সব কাজের অর্থনৈতিক মূল্য কোনদিন নিরূপিত হয় নি। সামাজিক মূল্য নির্ধারণের প্রশ্নই ওঠে না কারণ বেকার জীবন সমাজের বাইরের অংশ আমি তখনও চাকরি-বাকরি পাই নি। ঐ রকম একটা অকাজের দুপুরে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরতে মা বলল--
-- বাড়িতে তো বলে যাবি, যে মোয়ার টাকা দিয়ে রেখেছিস। একটা লোক এসেছিল জয়নগরের মোয়া দিয়ে গেছে। আমরা খেয়েছি দারুণ।
ফ্রিজে রাখা আছে খেয়ে নিস্। দামের কথা বলতে, বলল তুই দিয়ে রেখেছিস।
-- আ... আ... আমি!
--- তাই তো বলল।
কথা কটা বলে মা রান্না ঘরে চলে গেলেন।
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রিজ খুলতে যতটা সময় লাগে তার মধ্যে লোকটাকে মনে করতে পারলাম না। মিষ্টিতে আমার খুব লোভ। আর দেরি না করে একটা মোয়া তুলে নিয়ে দিলাম মুখে।
বাঃ অসাধারণ। কি তুলতুলে! মুখে দিতেই মিলিয়ে যাচ্ছে, কি স্বাদ!
আবার একটা তুলে নিলাম।
খুব আয়েশ করে খাচ্ছি। সত্যি এতো ভালো মোয়া আগে কোন দিন খাই নি।
হঠাৎ মনে হল সেই মোয়া ফেরিওয়ালাকে।
সপ্তাহ দুই আগে যে ফেরি করতে করতে দুপুরের চড়া রোদ সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমরা তাস খেলছিলাম ক্লাবে।
ধরাধরি করে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তাকে নিয়ে, টপাটপ গোটা দুই ইনজেকশন গেঁথে দিলেন। সাময়িক অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করতে হল। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা না হলে লোকটার স্ট্রোক হয়ে যেতে পারত। সারা দুপুর পড়ে রইল লোকটা। আমরা না খেয়ে বসে রইলাম।
পরিশ্রমী লোক তাই খুব তাড়াতাড়ি ধকলটা কাটিয়ে উঠল।
ফোন করে খবর দিতে বাড়ির লোক চলে এলো বেলার দিকে।
বিকেলে সুস্থ হতে ওকে ডায়মন্ডহারবার লঞ্চে তুলে দিয়েছিলাম আমি।
সেদিন লোকটার ব্যবসা মার খেয়েছিল।
ঝাঁকায় মোয়ার বেশ কয়েকটা প্যাকেট পড়ে ছিল।
আমি কিনতে চাইতে লোকটা বলেছিল-
-- তুমি এতো করলে বাবু, এ মোয়া তত ভালো নয়। তোমাকে একদিন জয়নগরের আসল মোয়া খাওয়াবো।
এখন একটা স্কুলে পড়াই। বেকারত্ব ঘুচেছে, হাতে একটু টাকা পয়সাও এসেছে। কিন্তু বেকার জীবনের সেই মোয়ার স্বাদ, আর কোন দিন পাই নি।
Comments
Top
আলোর পথ যাত্রী
বড় হ বুঝবি
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
আলোর পথ যাত্রী
আকাশে আলোর বিন্দুটুকুও নেই। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। গাছের পাতা তো দুরঅস্ত, শরীরের রোম গুলো নড়ে চড়ে তেমন বাতাস টুকুও নেই। চারপাশ থমথমে। হয়তো শেষবারের মতো শক্তি সঞ্চয়। হয়তো কিছু সময় পর প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়বে সে। এবারে মান রেখেছে কালবৈশাখী। এখনো বার আট দশেক দেখা মিলেছে তার। দ্রুত পা না চালালে এ যাত্রায় সমূহ বিপদ। বাসটাতে যখন উঠলাম বাসটা পুরো ফাঁকা, যথারীতি জানালা লাগোয়া একটা সিটও পেয়ে গেলাম। এখন মনে মনে এটাই চাওয়া যেন বসন্ত বিলাপের চিন্ময় রায় সাইজের একটি সহযাত্রী পাশে এসে বসে। আমার আশি ছুঁই ছুঁই ওজনের সঙ্গে সংগতি রেখে সেটিই হবে আদর্শ সহযাত্রী সমন্বয়। সারা রাজ্য জুড়ে যজ্ঞ ছিল আজ। বেকারত্বমেধ যজ্ঞ। লক্ষহীন চব্বিশ লক্ষ বেকার তারাই যজ্ঞের হব্য। অজানা পরীক্ষাকেন্দ্র তাদের গন্তব্য, চাকুরীপ্রার্থী ও সঙ্গে লোক লস্কর সব মিলিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ লোকের একশ কোটি পা, পাল তোলা জাহাজ হয়ে নেমেছে পথে। মনে হয় একটা লোকাল একটু আগে প্লাটফর্মে উগরে দিয়েছে কয়েক শ যাত্রী। তারাই কাঁকড়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিকে। কাঁকড়ার মতো একে অপরকে টেনে ধরে একজন অন্যজনের বাসরোহনকে করছে বিপর্যস্ত।বাড়ি এমন এক গন্তব্য, ব্যর্থ-সফল সকলেই দিনশেষে ফিরতে চায় সেখানে।
একটি রোগা পাতলা সুন্দরী বাসের সামনের দরজা ভেঙে উঠল। তার চোখ জোড়া একটা যুতসই জায়গা খুঁজছে যাতে পথ-স্বস্তি মেলে। আমি তাকিয়ে আছি তার কৃপা প্রত্যাশায়। পাশে বসলে রোগা হওয়ায় গুঁতোগুঁতি কম হয় সর্বোপরি সহযাত্রী মহিলা হলে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ সুখে পথ-শ্রম বিস্মৃত হওয়া সুযোগ থাকে। মহিলাটি তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। একজন পুরুষ যত সহজে এইসব পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন, একজন মহিলা পারেন না। একটা ব্যাগ উড়ে এসে পড়ল আমার পাশের জায়গাটিতে। পেছন ফিরে দেখি আমার থেকে কিঞ্চিত বেশি ওজনের একটি লোক ব্যাগটি ছুঁড়ে আমার পাশের জায়গাটিতে তার দখল নিশ্চিত করে ফেলেছে।একটু একটু করে ভরে গেল বাসটা।বাসে আর লোক নেওয়ার মতো স্থান নেই তবুও নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা। এখনো মিনিট দশেক পর বাসটা ছাড়বে।কনডাক্টর বাসের ভিতর যাত্রী সাজাচ্ছে যত্ন করে। আগুপিছু করে, বাম ডান ফিরিয়ে, লোক ঢোকাচ্ছে, যেন এতটুকুও ফাঁক না রয়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে এক রসিক যাত্রী বলে উঠল "যে ভাবে লোক নিচ্ছেন এবার তো দুজনের ফাঁকে বরফ দিতে হয়। না হলে তো পচে গন্ধ বেরোবে।"এধরন কথাগুলো এমন কষ্টকর সময়গুলোতে চিত্তের প্রশান্তি সাধন করে। ঘড়ি ঘুরতে চাইছে না। আমার সামনের সিটে জানলা লাগোয়া যে ছেলেটি বসে তার এক মাথা সোনালী চুল। মাথার উপর বাসের বাতিটার অনুজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে চুলগুলো। বাম হাতে একটা রবার ব্যান্ড, ডান হাতে ঝুলে রয়েছে ছোট ছোট রুদ্রাক্ষের মালা। বাসে উঠা থেকে দেখছি ছেলেটি হাতে কুলিয়ে উঠছে না এত্তো বড় একটা মোবাইল নিয়ে সমানে ঘষা মাজা করছে। বারবার আড় চোখে দেখছে মেয়েটিকে। চশমার পাওয়ার এতোটাই বেশি যেন মনে হয় চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইছে ছিটকে। ছেলেটির পাশে হেলিপ্যাডের মতো মস্ত টাক নিয়ে মধ্য চল্লিশের এক অফিস যাত্রী। এ পথে প্রায় প্রতিদিন দেখা মেলে তার। মিনিট কুড়ির নিশ্চিন্ত ঘুম সেরে পাঁচ নম্বর স্টপেজ তার অবতরণ। ছিপছিপে সেই সুন্দরী আপাতত তীর্থের কাক হয়ে ঐ সিটটির প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে। কমলা রঙের গেঞ্জি তার শরীরে লেপটে বসেছে। কাঁধ থেকে বারবার নেমে আসছে ব্যাগ। সেই ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে দুধসাদা অন্তর্বাস, জিনসের প্যান্টটা হাঁটুর কাছে ছেঁড়া। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি ওটা ফ্যাশন। কয়েক জোড়া চোখ ঘুরঘুর করছে মেয়েটার কাঁধে। মেয়েটিও তার জায়গায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে নিমগ্ন। এই মোবাইলে বাঙালীর মেনিয়া এখন অনেকটা পেচ্ছাবের মতো হয়েছে। একজন খুললেই অন্যজন খুলে বসে, এ যেন অনেকটা প্রদর্শন প্রভাব। যারা মোবাইলে নেই কেবল তাদেরই পোড়াচ্ছে এই অস্বস্তিকর গরম। মাথা থেকে গড়িয়ে পড়া ঘাম শিরদাঁড়ার নালা পথ বেয়ে, শরীরের অস্থান কুস্থান পেরিয়ে মিশছে পায়ে। যেন ওটাই মোহনা। কষ্ট মানে যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা, এ যে কত বড় সত্য তা যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের থেকে আর কেউ বেশি বুঝবে না। বারবার ওরাই উগরে দিচ্ছে বিরক্তি। যারা মোবাইলে রয়েছেন তারা এ জগতে নেই ফলে এই প্যাচপ্যাচে গরম তাদের কাছে কোন অস্বস্তির কারণই নয়। মেয়েটির কপাল গড়িয়ে এক ফোঁটা ঘাম নেমে আসছে নাকে এই বুঝি ভিজিয়ে দিল মোবাইলের স্কীন। ডান হাতের মুঠোয় রাখা রুমালে মেয়েটি কাপলটা মুছল, সেই কারণে হাত বদল হল মোবাইল। ঘামের ফোঁটা সোজা গিয়ে পড়ল হেলিপ্যাডে। হঠাৎ করে টাকে এক বিন্দু জল পড়লে মনে হয় কে যেন পেরেক ঠুকল। শিউরে উঠল লোকটি। জলের উৎস সন্ধানে ঘুমঘুম চোখে তাকাল উপরের দিকে। কিন্তু উৎস সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে আবার চোখ বুজল।ততক্ষণে বাস ছাড়ার সময় হয়েছে। বছর আশির এক বুড়ো কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়েছে বাসের পা দানিতে। হেলপার লোকটাকে ঠেলেঠুলে চালান করে দিল ভেতরে। বাসের অস্পষ্ট আলোয় দেখি বুড়োটা একেবারে সুবোধ কাকুর মতো দেখতে।সুবোধ কাকু আমাদের পাড়ায় থাকত। নিজে বেশি লেখাপড়া না জানলেও একমাত্র ছেলেকে পড়িয়েছিল ইংরাজী অনার্স। অনেক জমি জমা ছিল কাকুর। সে সব সরকার নিয়ে নিল কারখানা হবে বলে। অনেক টাকা পেয়েছিল কাকু,সে টাকা হাতিয়ে নিল একমাত্র ছেলে। দুবেলা খেতে দিত না ছেলে। সেবার পরপর তিন দিন সুবোধ কাকুর খাওয়ার জোটে নি। সন্ধ্যে বেলা দাওয়ায় বসে ছিল কাকু। হঠাৎ অন্ধকারে কাকে যেন সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে উঠে যেতে দেখল। তার হাতে দুলছিল একটা প্যাকেট। তার চলে যাওয়ার পরও বাতাসে পাক খেতে লাগল মাংসের সুঘ্রাণ। চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল সুবোধ কাকু। শরীরের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে ধাক্কা মারল দরজায়। ঘরের মধ্যে ছেলে বসেছে মদ আর মাংস নিয়ে। লাথি মেরে ফেলে দিল সবকিছু।একটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলের উপর। ছেলে থানা পুলিশ করতে পারে নি লজ্জায়। তবে তার পর থেকে এলাকায় আর দেখা যায় নি সুবোধ কাকু কে। ভাল করে না দেখলে যে কেউ লোকটাকে সুবোধ কাকু মনে করে ভুল করবে।বুড়ো কে দাঁড়াতে দেখে সামনের সিটের ছেলেটি তার সিটটা ছেড়ে দিতে চাইল। বুড়ো বলল-" না না বাবা তুমি পরীক্ষা দিয়ে ফিরছ। সারা দিন কতো ধকল গেলো, তুমি বসো বাবা। আমি এটুকু দাঁড়াতে পারব।"ছেলেটি একপ্রকার জোর করে বসিয়ে দিলো বয়স্ক মানুষটাকে নিজের সিটে। নিজে দাঁড়াল ভিড়ে মিশে গিয়ে।বাসটার অনুজ্জ্বল আলোতেও এত বেশি চকচক করছিল তার মুখ খানি যে ভিড়ের মধ্যে আলাদা করা যাচ্ছিল তাকে। বাসটা গতি বাড়িয়ে এগোচ্ছিল সামনের দিকে। জানালা গলে আসা ঠান্ডা বাতাস ধুয়ে দিচ্ছিল পথ-শ্রম।
বড় হ বুঝবি
গরমের ছুটিতে তেমন করে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ে উঠল না। বাইরে সূর্যের দাপট প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। রবিবারের আড্ডায় হাজির হওয়া বেশ কঠিন এটা বুঝে সময় কাটানোর জন্য বিছানায় এলোমেলো কতক গুলো বই-পত্তর নিয়ে বসলাম। সব গুলোই কম বেশি একাধিক বার পড়া। তাই একাধিক নিয়ে বসা, কোনটা মনোযোগকে প্রভাবিত করতে পারবে তার আগাম খবর নেই যে।
একটু আগে গিন্নি বিছানাটা গোছগাছ করে দিয়ে গেছে।
তার মধ্যে বিছানার এই হাল দেখা মাত্র বাইরের তাপ ছড়িয়ে গেল গোটা ঘরে।
খসে যাওয়া আঁচলটাকে কোমরে গুঁজতে গুঁজতে গিন্নি বলে উঠল--
--- তোমাকে শোধরানো গেলো না!
বই-এর পাতায় মুখ ডুবিয়ে গিন্নিকে বললাম---
---- সে কম্ম তোমার নয়, তুমি ডাল সাঁতলাও গিয়ে।
হলুদ মাখা হাতে গিন্নিকে টেবিলে ছড়ানো বই গুলোর দিকে
আগুয়ান হতে দেখে, জোড়হাত করে বললাম ---
--- দেখ বাপু তোমার যেমন ঠাকুর দেবতা আছে, ঐ পুথি-পত্তর গুলোই আমার ঠাকুর দেবতা। দোহাই তোমাকে, আমিষ হাতে আমার দেবতার দেবত্ব নষ্ট করে দিও না।
আমি জানি এই ব্রহ্মাস্ত্রে গিন্নি কুপোকাত হবেই। ঠাকুর দেবতা নিয়ে কথা উঠলে গিন্নি রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য। হলও তাই গিন্নি গজগজ করতে করতে হেঁশেলের পথ ধরল।
আমি আমার খসে যাওয়া মনোযোগ উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করলাম।
মাথার উপর পাখাটা যে ঘুরছে তা তার বাতাসে নয়, শব্দে বুঝে নিতে হয়। গরমের সময় সব পরিবারের ইলেকট্রিক কনজামশান চরচর করে বেড়ে যায়, তার ফলে ভোল্টেজের ভন্ডুল দশা।
এই বয়সে ছেঁদা দিয়ে একবার মনোযোগ হড়কে গেলে তার পুনরুদ্ধার বড় কঠিন। তাই শেষ পর্যন্ত এই সাব্যস্ত হল বই পড়ায় বিরাম চিহ্ন দিয়ে রবিবাসরীয় সকালটা পুথি-পত্তর গোছগাছে বরাদ্দ হোক।
আলমারি ভর্তি বই। কোনো নিদিষ্ট নিয়মে সাজানো নেই। যখন যেমন পড়েছি সে ভাবেই তুলে রেখেছি তাকে। কোথাও আবার ডাই করে রাখা। অগোছালো বই-পত্তর গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি আর দৃষ্টি সরে গেছে সেই কোন শৈশবে।
হাঁটছি বাবার হাত ধরে। পথে যেতে যেতে বাবা গাছ চেনাচ্ছেন,পাখি চেনাচ্ছেন, চেনাচ্ছেন ফুল। বাবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি ছোটো ছোটো পায়ে গঙ্গা ফড়িং এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছি।
বাবা মাঝেমধ্যে অশেষ জেঠুর বাড়ি যেতেন। অশেষ জেঠু বাবার খুব বন্ধু, যেমন অশেষ জেঠুর ছেলে কিশলয় আমার। অশেষ জেঠু, লম্বা, ফর্সা,মাথা ভর্তি জট পাকানো চুল, চোখে মোটা কাচের চশমা, কলেজে ইকনমিকস্ পড়াতেন। নানা বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য। বাবা যেতেন জেটুর সঙ্গে আড্ডা দিতে।
তবে সে আড্ডাকে আমার চা দোকানের আড্ডা বলা চলে না।
বাবা বেরোলেই আমি ছুট্টে এসে ধরে নিতাম বাবার আঙুল।
আমিও যে আড্ডা দিতাম কিশলয়ের সঙ্গে।
কিশলয়ের খেলনা দেখতাম, সেই যে দম দেওয়া পুতুল। পুতুলের পেছনের দিকে চাবি ঘুরিয়ে দম দিলে খত্তাল বাজাত ঝাই-চিকি- চাই, ঝাই-চিকি-চাই। কিশলয়ের অনেক বই ছিল, চাঁদমামা, আবোলতাবোল,পঞ্চতন্ত্র। আমি কিশলয়ের 'ঠাকুমার ঝুলি'- তে হাত বোলাতাম। 'ছোটোদের মহাভারত'- এর পৃষ্ঠা উল্টে ছবি দেখতাম।
জেঠুদের বাড়িটা ছিমছাম। খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো,ছবির মতন।
জেঠিমা নকশা করা কাচের প্লেটে করে নারকোল নাড়ু দিতেন।
এলাচের গন্ধ থাকত সেই নারকোল নাড়ুতে।
এক সময় আড্ডা দিতে বিরক্তি আসত। মন কেমন করত বাড়ি ফেরার জন্য।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেতাম বাবা আর জেঠুর আড্ডার দিকে। জেঠুর বসার ঘরে তখন কুয়াশার মতো সিগারেটের ধোঁয়া। আমাকে দেখা মাত্র বাবা আর জেঠু সিগারেট গেঁথে দিত এ্যাসট্রেতে।
জেঠুর ঘরে আলমারি ভর্তি অগোছালো বই, ছড়ানো ছিটানো খবরের কাগজ, টেবিলের উপর খোলা বইটার পাতা গুলো যেন প্রজাপতির ডানা ঝটপট।
একদিন ফেরার সময় বাবাকে বলেছিলাম---
---- জেঠুটা বড্ড নোংরা, বই-পত্তরগুলো কেমন এলোমেলো করে রাখা! একটু সাজিয়ে রাখা যায় না?
বাবা আঙুল দিয়ে আমার মাথার চুল গুলো ঘেঁটে দিয়ে বলেছিল---
--- বড়'হ, বুঝবি।
বড় হয়ে আমি বাবার মতো মাস্টার হতে পারি নি, একটা অফিসে হিসাবের কাজ করি। কিশলয় কিন্তু জেঠুর মতোই কলেজে ইকনমিকস পড়ায়। বাবা জেঠু দুজনেই নেই। আমার আর কিশলয়ের শৈশবের সেই সখ্যতা আজও আছে। আড্ডাও হয় মাঝে মাঝে।
একবার কিশলয়ের বাড়ি গিয়েছি।
কিশলয় কলেজ থেকে ফিরে ল্যাপটপে শেয়ার ট্রেডিং করছে। কিশলয়ের বউ ফ্রিজ খুলে প্লেট ভর্তি মিষ্টি দিয়ে গেল।
সেদিন অনেক সময় ধরে আড্ডা হল, গল্প হল, সংসারের টুকিটাকি কথাও হল।
ওঠার সময় একবার মনে হল জেঠুর বসার ঘরটা ঘুরে যাই।
একটা চেয়ারে সাদা তোয়ালের উপর রাখা জেঠুর ছবিটা আগের মতোই বুদ্ধিদীপ্ত। শুকনো মালার ফুল গুলো গেছে ঝরে। আলমারি ভর্তি নানান বই, ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো।
কত দিন বইগুলোতে কেউ হাত দেয় নি, কত কাল কেউ ছুঁয়ে দেখেনি বইগুলোকে।
আচমকা কেউ যেন মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিল। স্পষ্ট শুনতে পেলাম--
" বড়'হ বুঝবি।" হাতে ধরা বইটা ধপ করে পড়ল টেবিলের উপর।
গিন্নি আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল---
--- ঢের হয়েছে, আর গুছিয়ে লাভ নেই, স্নানে যাও। দু'দিন পরই তো আবার টেনে বার করবে সব।
Comments
Top
আঁশ
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
দই আর আম আনতে না আনতে পাত খালি। সুলতা খাওয়ার টেবিলে টক দই আর দু-ফালি হিমসাগর নামিয়ে উগরে দিল বিরক্তিটা। " পার বটে, মাছটাও খেলে বিড়ালের মতো। কাঁটা-টাঁটা বেছে খেলে তো? কত সময় নিয়ে, যত্ন করে রান্না-বান্না করি। খাওয়াটা অন্তত ধীরে হোক! এটা কি কোন কম্পিটিশন" সুলতার মুখের কথা টেনে নিয়ে বললাম- " আজকের সমাজে প্রতিটি সেকেন্ডই তো কম্পিটিশন সুলু। তাছাড়া দ্রুত খাওয়ার কম্পিটিশন হলে, সে প্রতিযোগিতায় তোমার বরের পুরস্কারটা বাঁধা ছিলো বুঝলে।"
কিছু দিন আগে পর্যন্ত আম খাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হতো, এতোটাই বেশি সুগার ছিলো। তার উপর কোলোস্টরেল। কোলোস্টরেলের আবার গুড, ব্যাড আছে।আমার গুডটা ব্যাড,মানে পরিমানে কম, আর ব্যাডটা গুড। বছর দুই সুলতা পাক্কা ডায়েটেশিয়ানের মতো চোখে চোখে রেখে, সামলে দিয়েছে অনেকটা। হিমসাগরে দাঁত ডুবিয়ে বললাম- " জানো সুলু,কোনো কোনো নিমন্ত্রন বাড়িতে আমার উল্টো দিকের খাওয়ার টেবিলের লোকজন খায় যতটা সময় তার থেকে বেশি সময় আমার খাওয়ায় তাকিয়ে থাকে। এতো তাড়াতাড়ি পাত খালি হয়! জানি না অন্য সব চাকুরেদের সঙ্গে এমনটা হয় কিনা! লোকজন ভাবে শালা কত দিন যেন খায় নি! তুমি তো জানো, স্কুল বেরানোর আগে হাতে এতো কম সময় থাকে,আর তার ফলেই এ রাক্ষুসে অভ্যাস তৈরী হয়ে গেছে।"
হিমসাগরে আমার বরাবরের লোভ। সেটা সুলতার অজানা নয়। তাই শেষ হওয়ার আগে আরো এক টুকরো বাড়তি আম দিয়ে গেলো সুলতা। এটা ঠিক বাড়তি নয়। বরাদ্দের। একসঙ্গে তিনটি দিলে পরে আবার একটি দিতে হত। তাই আগে থেকে বরাদ্দের একটি কায়দা করে সরিয়ে রাখা। সত্যি নিয়মিত হাঁটাহাঁটি,হাল্কা শরীর চর্চা,একটু ঘাম ঝরনো আর সুলতার লীস্ট অনুযায়ী সংযমী খাদ্যাভ্যাসে চরচর করে নেমেছে সুগার লেভেল,মধ্য-প্রদেশ কমানোর ক্ষেত্রে বেল্টে দু-গাঁট উন্নতি হয়েছে। জামাটা প্যান্টের উপর ফেলে পড়ি তাই বাঁচোয়া নাহলে সব প্যান্ট বাতিল হয়ে যেত। তাড়াহুড়ো করে স্কুল বেরাচ্ছি, সুলতা মৌরীর কৌটা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে। বেল্টটাকে কষে বাঁধছি, কোমরে টান লাগছে।
ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমের মধ্যে লুঙ্গি আলগা হয়ে বুক অবধি উঠে এসে ছিল। সুলতা লুঙ্গিটা কষে বাঁধছে, আমার উপর ঝুঁকে। সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছে সুলতা,তার ভেজা চুল নেমে এসেছে আমার মুখে, চোখে-মুখে সদ্য স্নানের সতেজতা, শরীরে লেপ্টে রয়েছে সাবানের সুগন্ধ, অর্ন্তবাস ছাড়া তরল বুক দুটোর দোলুনী আমার নেতিয়ে পড়া মধ্য বয়সী পৌরুষকে প্রকটিত করতে চাইছে। দুহাতের দুষ্টু আদরে বুকের উপর টেনে নিলাম সুলতাকে।
প্রশ্রয় কন্ঠে সুলতা বলল-
" এ্যাই কি হচ্ছে কি! ছাড়ো,ছাড়ো বলছি। এ্যাই এ.. এ. এ্যাই দুষ্টুমি করো না, লক্ষ্মীটি, কটা বাজে দেখো, এক্ষুনি কাজের মেয়েটা ঘর মুছতে এসে পড়বে।"
অগত্যা কি আর করা যায়। যদিও আজ রবিবার,সাতটা বাজে। আমাকে বাজার বেরাতে হবে। আজকাল অনেক রাত পর্যন্ত এর ওর দেওয়াল ধরে হাঁটা হাঁটি তে ঘুমাতে দেরি হয়ে যায়। তার ফলে সুলতার দিন শুরুর পাক্কা ঘন্টা খানেক পর আমার সকাল আসে। ঠিক আসে না সুলতাই জোর জবস্তি আনে।
বিছানা ছেড়ে নামার আগে আমার স্ফীত মধ্য-প্রদেশেটা হাত দিয়ে দুলিয়ে, সুলতা বলল-
টেবিলে করলার সরবত রাখা আছে মনে করে খেয়ে নিও।
নাক টিপে, চোখ কুঁচকে, খানিক ওয়াক ওয়াক করে গ্লাসটা খালি করলাম। এ শালা শুয়ার সুগারকে ব্লকই করতে পারছি না।
সাতটা পনেরো, কোনো রকমে দাঁতে দু পাক দিয়েই বাজার ছুটতে হবে,নইলে ভাল মাছ পাওয়া যাবে না। বড় কাতলা তো নয়ই।
মাছের দোকান থেকেই মাছ ড্রেসিং করে দেয়। আঁশ তুলে কেটে কুটে একেবারে ফিট। শুধু কড়াই এ তোলার অপেক্ষা। সুলতা বড় খুঁতখুঁতে, নিজে একবার থেকে যাওয়া আঁশ গুলো খুঁজে খুঁজে বের করে। একটা আঁশও যেন না থাকে।
অদ্ভুৎ বিষয় যতদিন মাছটা বেঁচে ছিল ততদিন রূপোলী আঁশের বিন্যাস তার সৌন্দর্য হয়ে ছিল,শুধু সৌন্দর্য নয় সে আঁশ ছিল তার বর্ম। তার বেঁচে থাকার কবচ। আঁশের উপর পিচ্ছিল লালায় মানুষের হাত হোড়কে, ছড়ানো জাল ফসকে্ পালিয়ে বাঁচা। আশ্চর্যজনকভাবে আজ যখন সেই মাছ পন্য, তখন তার আঁশ উদ্বৃত্ত, অপ্রয়োজনীয়। নিখুত হাতে সে আঁশ সরিয়ে ফেলা। সেই উদ্বৃত্ত,অপ্রয়োজনীয় পড়ে থাকা আঁশের সীমাহীন দুর্গন্ধ মাছ বাজারের বাতাসকেও এনে দেয় ভিন্নতা।আগে বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তে পারতাম। তখনো স্কুলে চাকরি পাই নি। সকাল থেকে দুটো ব্যাচ পড়ানো। পড়ানো মানে আহামরি গোছের কিছু নয়। বাপ-দাদার কাছে হাত পাতার লজ্জা থেকে মুক্তি, নিজের থেকে নিজের পকেট খরচ চালানো। যেহেতু পড়াই, কিছু লোকজন মাস্টার, মাস্টার করে আর তার বদান্যতায় সামাজিক অবস্থা আঁশের থেকে এক সুতো ভালো। বেকার জীবন মনে পড়লেই বিফল এর মুখটা ভাসে, মুহুর্তে মুখটা ছোটো-বড়ো, সোনালী-রূপালী আঁশে মাখামাখি হয়ে মাছবাজারের চেনা গন্ধ হয়ে যায়।
তখন রাগ হয়, সে রাগের তীব্রতা ছড়িয়ে যায় সাংসারিক পরিমন্ডলে। পচ্ছন্দের কাতলার টুকরো দাঁতে শিরশিরানি আনে, জিভ বেঁকে গিয়ে ছোট হয়ে যায়, স্বাদ কোরক গুলো হাত গুটিয়ে নেয়, যতটুকু যা উদরস্থ করেছিলাম সেগুলো তালগোল পাকাতে থাকে পেটের ভিতর, উঠে আসতে চায় গলা পথ বেয়ে।
বিফল আমার থেকে বছর তিনের ছোটো। আমার প্রথম অনার্স ব্যাচ। ব্যাচ বলতে ও একাই। খুব সহজ সরল আর লেলাক্ষ্যাপা টাইপের ছিল। আমি মাছ খেতে ভালবাসি বলে একবার ঝড়-জল মেখে কতক গুলো কৈ মাছ নিয়ে হাজির। সেগুলো নাকি নিজের হাতে ধরেছে ও। পরের দিন পড়ানোর সময় দেখি হাত দুটো কৈ-এর কাঁটায় চেরা চেরা। কলম ধরতেও কষ্ট হচ্ছিল যেন।
বয়সের ব্যবধান কম বলেই হয়তো বন্ধু হয়ে উঠেছিল বিফল, যদিও সে আমাকে দাদা, দাদাই করত। কতদিন একসঙ্গে বিড়ি ভাগ করে খেয়েছি দুজন, কত অলস দুপুর গল্প গাছায় গড়িয়েছে সন্ধ্যায় বুঝতেই পারিনি।
হিসাবটা আমার মতো কাঁচা মাস্টারের থেকে বেশ কম সময়ে শিখে নিয়েছিল বিফল।
প্রফিট এন্ড লস এ্যাকাউন্ট, ব্যালেন্স শীট সব সবই।
জীবনটা তো আর মেলানো অতো সহজ কাজ নয়। হওয়া না হওয়া, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব করতে গিয়ে জীবনের ব্যালেন্স শীটে মস্ত অঙ্কের সাসপেন্স। জন্ম থেকেই বোধহয় বিফলের ভবিতব্য স্থির হয়ে ছিল।
ব্যর্থতার বাতি কেউ বোধহয় জ্বেলে দিয়েছিল অজান্তে,না হলে কেনই বা নাম হবে বিফল বাগ।
মাছবাজার ঢোকার মুখে দু- ডগ কচি পুঁই শাক ভরে নিয়েছি থলে তে। এখন একখানা সাইজের কাতলা পেলেই চলে। মাথা দিয়ে ঘন্ট, জমে যাবে রবিবারের মধ্যাহ্ন ভোজ।
আমাদের মাছ বাজারে নদীর মাছ পাওয়া যায় কিন্তু সে সব খেয়ে খেয়ে জিভ অসাড়।
খুব কি দেরি হয়ে গেল! বাজার পুরো ফরসা। কারো পাতাতেই ভালো মাছ নেই। যার থেকে নিয়মিত মাছ নেই তার পাতায় রবারের মতো থলথলে নিহাড়া মাছ জেগে আছে যা দেখে মাছ খাওয়ার ইচ্ছেটুকু শুকিয়ে যায়।
শুধু পশ্চিমের কোনে নীলা মাসির পাতায় তখনো একটা কেজি দেড়েকের কাতলা হাঁফ টানছে। শেষ বারের মতো বাঁচার চেষ্টা। লেজ ঝাপটে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেগে দিচ্ছে ক্ষোভ। সে বিদ্রোহও সাময়িক, সেও এক বিফল-বিদ্রোহ। ঐ ক্ষোভ একসময় হতবল,হতোদ্যম হয়ে যাবে।
মাছটা চড়বে পাল্লায়, রূপালী চকচকে শরীর চালান হয়ে যাবে মাসির পিছন দিকটায়। কিছু বাদে ফিরে আসবে আঁশহীন পন্য হয়ে।
নীলা মাসি ধারালো চকচকে বটিতে টুকরো টুকরো করে কাটবে মাছটাকে, গড়িয়ে পড়া রক্ত মাখিয়ে দেবে পড়ে থাকা অন্য টুকরো গুলোতে যাতে সেগুলোকে বেশি করে তরতাজা দেখায়। যত বেশী তরতাজা তত দামি পন্য।
আমি নীলা মাসির কাছে কোনো দিন মাছ কিনি নি। এ কথা সবাই জানে। নীলা মাসিও।
তাই আর পাঁচ জন দোকানির মতো আমাকে কোনো দিন মাছ কেনার আহ্বান জানায় নি মাসি। হয়তো সে সেটুকুর পিছনে ছিল পিছনের অন্ধকার সালটে থাকা আঁশটে দুর্গন্ধের অনুনয়।
আজ ফাঁকা মাছবাজারে আমার অসহায়তা, মাসির পাতায় ছটকাতে থাকা কাতলার প্রতি আমার লোলুপ তাকিয়ে থাকা, থলে থেকে বেরিয়ে পড়া লকলকে পুঁই পরিবেশটাকে দিল পাল্টে। মাসি হাত বিছিয়ে ডাকল আমাকে। মাসির আহ্বানে জেগে উঠল স্বপ্ন দৃশ্য।
আমার রবিবারের পাতে হলুদ রঙা ঘন্টে কালচে সবুজ পুঁই দেখতে পেলাম, গন্ধ পেলাম নিরিহ জিরা ঝোলের, ঝোলের মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠল রোগা পাতলা পেপের টুকরো, লেতিয়ে পড়া বেগুন, আর সব কিছু ছাপিয়ে ঘাড় উচুঁ করা কাতলামাছের দশাসই পেটিটা।আমি পশ্চিমে এগানোর জন্য বাঁ পা তুললাম, আর মুহুর্তে আমার অনার্স পড়ানোর প্রথম ব্যাচটার মুখ ভেসে উঠল- ছোটো-বড়, সোনালী-রূপালী আঁশ মাখা মাছবাজারের চেনা গন্ধ হয়ে।
সরিয়ে নিলাম বাঁ পা। বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম।
একটা রবিবার খুব সাদামাটা কাটবে!
কাটুক।
প্রিয় কাতলা মাছ ছাড়া কাটবে!
হোকনা।
আঁশের মতো মূল্যহীন কাটবে সেও স্বস্তিকর।
মাসির থেকে মাছ নেওয়া যাবে না।
মাসির পেছনের অন্ধকারটা সহ্য করা যাবে না।
ঐ অন্ধকারে মাছের আঁশগুলো নিখুত হাতে সরিয়ে, মাছ গুলোকে পন্য বানিয়ে তুলছে লেলাক্ষ্যাপা বিফল। নীলা মাসির দোকানের দীর্ঘ দিনের ডেলি লেবার সে।কি জানি! হয়তো অনার্স পাস আঁশ হয়েই বেঁচে থাকার ভবিতব্য নিয়েই জন্মেছিল বিফল।
Comments
Top
অসুখ
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
বাড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সুতনুকা। না বাড়িটা সুতনুকাদের নিজস্ব বাড়ি নয় ভাড়ার বাড়ি। এখন বিকেল চারটা বাজে, প্রতিদিন এই সময়টায় সুতনুকা বাড়ির সামনের রাস্তাটার উপর এসে দাঁড়ায়। গাড়িটা এসে থামে। বিথি গাড়ি থেকে নেমে, বন্ধুদের হাত নেড়ে টাটা করে দেয়, ততক্ষনে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সুতনুকা। মেয়ের কাঁধ থেকে ভারি স্কুল ব্যাগটা নিয়ে নেয় সে। বিথি একটা চঞ্চল প্রজাপতির মতো নাচতে নাচতে চলতে থাকে মায়ের সাথে। আজ গাড়িটা লেট করছে। গাড়িটার অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয়। দু'দিন ছাড়া যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। এমনও হতে পারে মাঝ পথে টায়ার পাংচার হয়ে ফেঁসে গেছে। ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়ল সুতনুকা। মেয়েটার শরীরটা ক'দিন ধরেই বিশেষ ভাল নয়। কেমন যেন মনমরা। প্রায় সময় গুম মেরে বসে থাকে। গেল সপ্তাহে নাচের ক্লাসেও গেল না মেয়েটা। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়িটা যে কখন তার সামনে থেকে চলে গেল প্রথমটায় টের পায় নি সুতনুকা। গাড়িটা খানিকটা এগিয়ে যেতে তার খেয়াল হল আজ বিথিকে নামাতে ভুলে গেছে হেল্পপার। একটু এগিয়ে বাকিদের নামিয়ে মিনিট দশ পরে এপথেই ফিরবে গাড়িটা। ততক্ষন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফেরার পথে বিথিকে নামিয়ে হেল্পপার তার ভুলের জন্য এমন ভাবেই আকুতি মিনতি করবে যে আর রাগ পুষে রাখা যাবে না। এর আগে বার কতক ঘটেছে এমন। আসলে বেসরকারি স্কুলগুলো চলে অভিভাবকেদের টাকায় তাই তাদের মতমতকে বেশ গুরুত্ব দেয় স্কুলগুলো। দেবেই না বা কেন আজকের এই তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে কনজিউমার স্যাটিসফ্যাকশানই হল টিকে থাকার মুলমন্ত্র। একটা অভিযোগেই বেচারার চাকরি ঘচাং। ফিরতি পথে গাড়িটা আরো বেশি গতিতে সুতনুকাকে অতিক্রম করল। গাড়িটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুতনুকার ভাবনাটা মুহুর্তে বদলে গেল এক গভীর দুশ্চিন্তায়। অনেকগুলো যদি কিন্তু নিয়ে মনের ভিতর ডালপালা মেলে দিল দুশ্চিন্তাটা।
" তাহলে কি গাড়িটা বিথিকে না নিয়েই চলে এসেছে!"
সুতনুকার মাথার মধ্যে তাপ ছড়াচ্ছে।
" যদি তাই হয়, তবে কিভাবে ফিরবে মেয়েটা! নাহঃ এমন ইরেসপনসিবল্ স্কুল থেকে মেয়েকে তুলে নেওয়াই ভাল।"
মনের এ এক বিচিত্র খেয়াল একটা আশঙ্কার সঙ্গে সে অন্য আর এক ভরসার আশ্বাস জুগিয়ে দেয় নিপুন হাতে।
" এমনও তো হতে পারে বিথি গাড়িতে উঠেছিল, পথে কোনো বন্ধুর সঙ্গে নেমে গেছে। যদি তাই হয় তাও মঙ্গল কিন্তু যদি গাড়িতেই না উঠে!"
আশঙ্কাটা অস্থির করে তুলল সুতনুকাকে।পায়েরতলা থেকে ঝুর ঝুর করে সরতে লাগল মাটি, বুকের ভিতর ভুমিকম্পের দুলুনি টের পেল সে। এখুনি স্কুলে একটা কল করা দরকার। রাস্তা থেকে বাড়ি, ছুটে এল না উড়ে এল তা বুঝে উঠতে পারল না সুতনুকা। বাড়ি ফিরে, ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল পাঁচটা মিসড কল। স্কুল থেকেই। আরো চাপ বাড়িয়ে দিল মিসড কলগুলো
ঘুরিয়ে কল করল সুতনুকা।
ফোনের অন্য প্রান্তে মহিলা কন্ঠ-
--হ্যালো...
--হ্যাঁ আমি ক্লাস সিক্স-এর বিথিকা সেনের মা বলছি...
-- ওঃ মিসেস সেন। আমরা কল করেছিলাম আপনাকে...
-- বিথিকা আজ স্কুল থেকে...
-- ওই বিষয়েই আমরা ফোন করে ছিলাম। গাড়িটা চলে যাওয়ার পর আমরা জানতে পারি ওকে ছাড়াই চলে গেছে গাড়িটা। দুশ্চিন্তা করবেন না, একটা মোটর সাইকেলে ওকে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিনিট পনের আগে ওরা স্টাট করেছে। হয়তো এতোক্ষনে পৌঁছে গেছে। কাইন্ডলি একটু বেরিয়ে এসে রাস্তা থেকে পিক-আপ করে করে নিন।
-- বাঁচালেন,ওহঃ যা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। থ্যাঙ্কস্ মেনি মেনি থ্যাঙ্কস্।
-- এখানে থ্যাঙ্কস্-এর কি আছে, ওঃ আর একটা কথা ছিল,মিস্টার সেনকে কাল একটিবার সময় করে স্কুলে আসতে বলবেন।
-- ঠিক আছে ম্যাডাম, কাল যাবেন উনি।ওকে, রাখছি তাহলে।
কথাগুলো বলতে বলতেই বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে সুতনুকা। একটা মোটর সাইকেল এসে থামল তার কাছে। বিথিকে নামিয়ে মোটর সাইকেলটা যে পথে এসেছিল ফিরে গেল সেই পথে। বিথির মুখটা শুকিয়ে গেছে, কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে চোখ দুটো। মেয়েকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরেছে সুতনুকা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বিথি। অজানা আশঙ্কার দোলাচল শেষে আবেগে ভেসে যাচ্ছে সুতনুকা। তার যে এখন রাস্তায় তা ভুলে গিয়েছে সে। দু'হাতে বিথির মুখটা ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে অশ্রুভেজা গাল দু'টো। চোখের একেবারে সামনে গ্লাসটা নিয়ে এসে পেগটা মাপার চেষ্টা করছে সিতেশ। মুখে ব্যাসন মেখে বসে আছে সুতনুকা। পাশের ঘর থেকে বিথির পড়ার শব্দ চুইয়ে চুইয়ে আসছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতলটা দিতে বলল সিতেশ। সুতনুকা মুখে শব্দ না করে হাত দিয়ে সরিয়ে দিল সিতেশের ফরমাশটা। অগত্যা নিজেই ফ্রিজ খুলে বোতল বের করল সিতেশ। গ্লাসে জলটা ঢেলে আর একবার অনুপাতটা বোঝার চেষ্টা করল সে। অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন রাতে দু'পেগ মদ নেয় সিতেশ। তার ফলে তার ফিতে মাপা হাত। মদ আর জলের নির্ভুল অনুপাত কষে নিতে পারে সে। গলা দিয়ে নেমে গেল পরপর দু'পেগ। মুখটা সামন্য একটু বাঁকল এই যা। সুতনুকার ব্যাসন মাখা মুখ এতক্ষনে ছুটি পেয়েছে। মুখটা ধুয়ে নরম কাপড়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলল---- কি হল কিছু বললে না যে?-- কিসের কি বলব!-- বিথির বিষয়ে। কাল একবার স্কুলে দেখাতো করতে যাবে নাকি?-- আমি!-- হ্যাঁ তুমি, তুমি নয়তো কি আমি?-- ইমপসিবল্। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।-- তা নয়টা কেন শুনি?-- ঘর-বাইর, দু'টো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।-- স্কুলটা কিন্তু বাইরেই পড়ে সিতেশ।-- মা-বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছাড়ার সময় আমি কিন্তু পইপই করে বলেছিলাম "বাড়ি ছাড়তে চাইছো ছাড়ো বাবা-মা যে দায়িত্বগুলো নেন তা কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে।"
-- সামলাচ্ছিতো, কিন্তু স্কুলে অভিভাবক তুমি।
-- হাসালে তুমি, আমি অভিভাবক!
-- হু, তাছাড়া এখানে হাসির কি আছে!
-- আছে, আছে। আমি মানছি, আমি বিথির অভিভাবক কিন্তু আমার অভিভাবকতো তুমি। বিয়ের পর থেকে কোন জায়গাটায় আমাকে আমার মতো করে ভাবতে দিয়েছ!
-- তা আমার ভাবনাটা যদি ভুল না হয় তবে কষ্ট করে না ভেবে আমারটাই না হয় নিলে।
-- তোমার ভাবনায় চলতে গিয়ে তো বুড়ো বাপ-মাকেও ছেড়ে এলাম।
-- এটা কিন্তু এক তরফা হয়ে গেল। ওদের যে প্রথম থেকেই আমাকে অপচ্ছন্দ ছিল তা কি করে অস্বীকার করো! তাছাড়া বিথির স্কুলিংটা ওখানে থাকলে হতো?
-- বেশ হতো। আমার হয় নি?
-- সে জন্যই তো তোমায় যেতে বলছি। কত বিচক্ষন তুমি।
সুযোগ পেলে খোঁচা দিতে ভুল করে না সুতনুকা।
পাশের ঘরে বিথির পড়ার শব্দ অনেক সময় বন্ধ হয়েছে। সে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা-বাবার কথা শুনছিল। মা-বাবার এই ঝগড়া-ঝাঁটি তার একদম ভাল লাগে না। বাবা-মায়ের ঘর থেকে আর কোনো কথা কানে আসছে না। তার মানে মা হয়তো এখুনি এসে পড়বে। তাই
মা-বাবার কথা বন্ধ হতে বিথি তাড়াতাড়ি নিজেকে সরিয়ে নিল পড়ার টেবিলে।
এইমাত্র রিসেস-এর ঘন্টা বাজল। ছেলে-মেয়েরা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বই-পত্তরের বাঁধন আলগা হতেই দল বেঁধে সব ছোটাছুটি করছে ছোট্ট পার্কটাতে। খাঁচা ছাড়া পাখি যেভাবে ছড়িয়ে পড়তে চায় আকাশে ঠিক তেমনই প্রাণহীন শৈশবগুলো দাপিয়ে বেড়াছে সবুজ মাঠ।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে কঁচি-কাঁচাদের ভিড়ে বিথিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সুতনুকা। মিনিট কুড়ি হল এখানে এসেছে সে। সিতেশ বলেছে সে সরাসরি অফিস থেকে চলে আসবে। বাম হাত উল্টে সময় দেখল সুতনুকা। হয়তো আর মিনিট দশেকের মধ্যে এসে পড়বে সিতেশ।
স্কুল যে কেন ডেকে পাঠাল কাল থেকে অনুমানের অলিগলি ঘুরেও কারণটা অনুসন্ধান করে উঠতে পারে নি সুতনুকা। বিথির বাড়ি ফেরার বিষয় হলে ফল্টটাতো ওদের, তার জন্য নিশ্চিত ডাকবে না। তবে আর কি কারণ থাকতে পারে!
" কতক্ষন এসেছ?"
সিতেশের জিজ্ঞাসায় ছেদ পড়ল ভাবনায়।
"মিনিট তিরিশ।"
" চলো প্রিন্সিপ্যালের চেম্বারে যাওয়া যাক।"
এই প্রথম সিতেশের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল সিতনুকা।
রিনা রায় এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল। ছোটদের সঙ্গে বেশ বন্ধুর মতো মিশে যান কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে বেশ কড়া ধাতের। মাথার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে।
রং-এর গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেন নি চুলগুলোকে। চুলটা বব করে সাজানো। মাথার ভেতর ও বাইর দু'টো দিকই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রবল ভাবে মানান সই। মহিলা বেশ শৌখিন। চেম্বারটা সুন্দর করে সাজানো। চেম্বারের কোথাও ফাইল-পত্তর এলোমেলো ভাবে পড়ে নেই। দরজা ঠেলে ঢুকলেই দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথ। দেওয়াল জুড়ে নানান মনীষীর ছবি। বাঁ দিকের আলমারিতে ছোটদের খেলনা। তারই পাশে টুলের উপর রাখা আছে চকলেট ভর্তি কাঁচের বয়াম।
রিনা রায়ের উল্টো দিকের চেয়ারে বসেছে সিতেশ ও সুতনুকা। পাশের চেয়ারে গাড়ির হেল্পার। সিতেশরা সবে মাত্র চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়েছে। সামনে রাখা খাতা থেকে মুখ তুলে রিনা ম্যাডাম প্রশ্নটা সরাসরি ছুঁড়ে দিলেন সিতেশের দিকে-
-- বলুন কি জেনেছেন?
-- কি ব্যাপারে ম্যাডাম?
-- ঐ যে বিথিকার..
রিনা ম্যাডামের মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে সুতনুকা বলল-
-- ও তো খুব চাপা ম্যাডাম সহজে বলতে চায় না। অনেক চাপাচাপিতে বলল- ছুটির পর ও বাথরুমে গিয়েছিল ফিরে এসে দেখে গাড়িটা নেই।
-- মিথ্যা কথা বলেছে আপনার মেয়ে।
কথাকটা কেটে কেটে বলল রিনা ম্যাডাম। তারপর ঘাড়টা সামান্য কাত করে পালান বাবুকে বললেন -- বলুন তো কি হয়েছিল কালকে।
পালান বাবুর বেশ বয়স হয়েছে। নিজে ভালমতোই জানেন দোষ তার নয় তবুও দু'কথা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন। গলায় জড়িয়ে থাকা কফ নিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় শুরু করলেন পালান বাবু--
-- ম্যাডাম গত কাল ছেলে-মেয়েরা যখন গাড়িতে ওঠে তখন ঐ মেয়েটিকে গাড়িতে দেখেছি তারপর...-- তারপর--- তারপর আসলে আ... আ...--- আ... আ... না করে বাকিটা বলুন।কথাগুলো বেশ ভারি করে বললেন রিনা ম্যাডাম।-- গত কাল আমি গাড়ির সামনের গ্লাসটা মুছতে ভুলে গিয়েছিলাম ম্যাডাম, তাই ড্রাইভার আমার উপর চড়াও হয়। আমাকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দেয় গাড়ি থেকে। আমি গ্লাসটা পরিস্কার করার সময় খেয়াল করিনি কখন মেয়েটি নেমে গেছে। -- আগে থেকে কাজগুলো সেরে রাখেন নি কেন? তাছাড়া একটি মেয়ে কখন নেমে গেল তার খেয়াল থাকবে না। যদি আমাদের নজরে না আসত। যদি দরজা লাগিয়ে চলে যেত সবাই। তখন কি হত! মিডিয়া ছিঁড়ে খেত। এমনিতেই স্কুলের উপর গর্ভনম্যান্টের চাপ বাড়ছে। কি যে সব করেন আপনারা! ঠিক আছে আপনি এখন আসুন।পালান বাবু চলে যাওয়ার পর রিনা ম্যাডাম চশমাটাকে আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন---- এরপর আমরা দিদিমনিরা যখন স্কুল ছাড়ছি দেখি বিথিকা সিঁড়ির কোনে দাঁড়িয়ে। ভয়ে ও থরথর করে কাঁপছিল, কাঁদছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।-- বিশ্বাস করুন ম্যাডাম বিথি আমাদের এতো সব কিছু বলে নি।-- দেখুন মিস্টার সেন আপনারা বোধহয় বিষয়টার গভীরে যেতে পারছেন না। বেশ কয়েক মাস ধরে ও কেমন যেন মনমরা। রিসেসে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা করে না। বাগানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। বুড়ো মালির সঙ্গে কথা বলে। বেশ কিছুদিন ওয়াচ করার পর মালির কাছে জানতে চেয়েছিলাম ওর সঙ্গে কি কথা বলে বিথিকা।
মালি বলেছিল
" সে কত কথা ম্যাডাম, জানতে চায় গাছ-পালার নাম, আমার বাড়িতে আর কে কে আছে, আমি কেন গাছ লাগাই, কি লাভ গাছ লাগিয়ে, আমি বলি সে তুমি বুঝবে না। কত পাখি এসে বাসা বাঁধে, কত রকমের ফুল-ফল ধরে। তা শুনে মেয়েটি বলেছিল তুমি পরের জন্য এসব করো তাহলে, তুমি বড্ড বোকা লোক।"
দেখুন মিস্টার সেন আপনারা ওর বাবা-মা, আপনারা আরো ভালো বুঝবেন। আমি বলতে চাইছি যে বয়সটা হাসি-খুশির বয়স সেই বয়সে এতো বিষন্নতা এতোটা ফ্রাসট্রেশন আমার কিন্তু ভাল লাগছে না।
একটা ভালো কোথাও গিয়ে কাউনসিলিং করান। এভাবে চলতে থাকলে পুরো বিষয়টা কিন্তু একসময় হাতের বাইরে চলে যাবে।
কিছু মনে করবেন না প্লিজ। অনেক দিন ছেলেপুলে নিয়ে আছি তো, তাই কেমন যেন ভয় হয়। এখন তাহলে আসুন আপনারা। আর চাইলে কিন্তু আপনারা ওর সঙ্গে দেখা করে যেতে পারেন। বাগানের আসেপাশে কোথাও থাকবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাল সিতেশরা। প্রতিনমস্কার জানালেন রিনা ম্যাডামও।
স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেওয়াল জুড়ে রবি ঠাকুরের একটা লেখার কাছে থমকে দাঁড়াল সিতেশ...
" শিশু প্রকৃতির সৃজন। কিন্তু বয়স্ক মানুষ বহুলপরিমাণে মানুষের নিজকৃত রচনা।"
লেখাটা পড়তে পড়তে তার চোখ দু'টো ভারি হয়ে এল।
রাস্তাঘাটের যা অবস্থা তাই হাতে অনেকটা সময় নিয়ে বেরিয়েছে সিতেশরা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিথির জন্য ডাঃ সেনগুপ্তের একটা অ্যাপয়েন্টম্যান্ট পেয়েছে সিতেশ।একটা ফিটার না নিয়ে ছাড়বে না গাড়িটা। তাই বসে বসে ঘামে ভেজা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
থ্রি-টু সিট হওয়ায় বাসটাতে দাঁড়ানোর জায়গাটা কম। সিতেশরা একটা থ্রি-সিটে বসেছে, বিথি মা-বাবার মাঝে। ফিটারটা ঢোকা মাত্র ভরে গেল বাসটা। একটা যুবক একজন বৃদ্ধকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে দখল নিল ফাঁকা সিটের। ধাক্কাটাকে কোনো প্রকারে সামলে নিলেও হাতের লাঠি পড়ে গেল বৃদ্ধের। তিনি লাঠিটা তুলে নিয়ে, যুবকের সামনে মুখটা ঝুলিয়ে বললেন--
" তুমি কি করলে তুমি তা জান না। যেদিন আমার মতো বয়স হবে তোমার আর তোমার সঙ্গে এমনটাই ঘটবে, সেদিন বুঝবে আজকে কি করলে।"
সিতেশদের সামনেই ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে সিতেশের কি করা উচিত তা সে বুঝে উঠতে পারল না। বিথি কিন্তু পুরো ঘটনা ওয়াচ করেছে। বড় অস্থির লাগছে তার। গা গোলাচ্ছে। উত্তেজনায় বমি করে ফেলল বিথি।
ডাঃ সেনগুপ্তের চেম্বার যেন আস্ত একটা পাগলা গারদ। একবার এখানে এলে জীবন সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে যেতে বাধ্য। ষন্ডা মার্কা দু'টো লোক গেটের কাছে বসে। কোনো মানসিকরুগি ডাক্তার বাবুর কাছে না এসে পালিয়ে যেতে চাইলে এরা জোরজবরদস্তি ধরে আনে বোধহয়। মানসিক ডাক্তাররা যে পাগলদের চিকিৎসা করে সেটা বোঝার মতো বয়স এখনো বিথির হয় নি, আর সেটাই বাঁচোয়া।
ডাক পড়তে তিনজন ঢুকে পড়ল চেম্বারে। ডাক্তার বাবু মন দিয়ে সমস্ত ঘটনা শুনলেন। বিথিকে খেলনা দেখাবেন বলে নিয়ে গেলেন পাশের রুমে। ডাক্তার বাবু মিথ্যা বলেন নি,
সত্যি সত্যি পাশের ঘরে নানা রকমের খেলনা দেখে বেশ আনন্দ পেল বিথি। ডাক্তার সেনগুপ্ত বিথির সঙ্গে শিশুর মতো মেতে উঠলেন খেলায়। ডাক্তার বাবুর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল বিথির। খেলার ছলে কথা শুরু করলেন ডাক্তার সেনগুপ্ত--
-- আচ্ছা বিথি তোমার কতগুলো খেলনা আছে?
-- আমার? আমার... অনেক... অনেকগুলো।
--- দেবে আমায় একটা?
--- সে তুমি নিতেই পারো কিন্তু তোমারও তো অনেক আছে!
--- তা আছে। আচ্ছা খেলনা গুলো কে দিলো তোমায়?
-- বাবা,মা,দাদুও দিয়েছে।
-- কে তোমায় সবচেয়ে বেশি ভালবাসে?
-- সব্বাই। তুমিও।
-- সে তো বাসে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কে?
-- সবচেয়ে বেশি... এ্যা.. সবচেয়ে বেশি.. দাদু।
-- তবে দাদু এলো না কেন?
-- বারে দাদু আসবে কেমন করে! সে তো আমাদের সঙ্গে থাকেই না।
-- কেন থাকে না?
-- থাকবে কেমন করে! মা যে সব সময় ঝগড়া করে।
ডাক্তার সেনগুপ্ত লক্ষ্য করলেন দাদু-ঝগড়াঝাঁটি এসব প্রসঙ্গ আসতেই বিথি কেমন যেন বদলে গেল। বেশ ঘাম দিচ্ছে তাকে। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। অসুখটা যে কোথায় তা বুঝতে বাকি রইল না ডাঃ সেনগুপ্তের। যেহেতু সে দাদুকে খুব পচ্ছন্দ করে তাই দাদুর সঙ্গে মায়ের ঝগড়ার প্যানিকটা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সেকারণে ঝগড়াঝাঁটি দেখলেই ভয় পেয়ে যায় সে। পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য ডাঃ সেনগুপ্ত আরো একটা নতুন খেলনা দিলেন বিথির হাতে। বললেন তুমি একটু খেল আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি।
ডাক্তার বাবু চেম্বারে ফিরে পরিস্থিতিটা বোঝালেন বিথির মা-বাবাকে। কাগজে কতকগুলো ঔষধ-পত্তর লিখে দিয়ে বললেন
"ব্যাপারটা বুঝি পুরানো ভাবধারার সঙ্গে সংঘাত,ছেলে-মেয়ের স্কুলিং, ফাস্ট লাইফ, নগরজীবনের সুখ-সুবিধা এসবের জন্য পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। ঔষধ-পত্তর লিখে দিলাম। দেখুন কতটা কি হয়। তবে সবচেয়ে ভাল হয় ও যা চায়... বুঝতে পারছি সমস্যা আছে। তবে আর একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সেন্ট পার্সেন্ট গ্যারেন্টি দিলাম অসুখটা সারবেই।
একটু আগে সুতনুকা রাতের ঔষধটা দিয়ে গেছে বিথিকে। কিন্তু জল দিতে ভুলে গেছে সে। ঔষধটা খাওয়ার জন্য জল নিতে গিয়ে দরজায় থমকে গেল বিথি। পাশের ঘরে বাবা মাকে বোঝাচ্ছে--
--শুনলে তো ডাক্তার বাবুর কথা। চল আমরা ফিরে যাই।
-- মেয়ের লেখাপড়ার কথাটা একবারও ভাববে না!
-- কিছুদিন পরে তো লেখাপড়ার পরিস্থিতিই থাকবে না।
-- সময় সবসময় এক রকম যায় না সিতেশ। হয়তো পরে পরে ও ঠিক হয়ে গেল, তাছাড়া ঔষধগুলো নিয়মিত খেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। সিতেশ আর কথা বাড়াতে চাইল না। কারন এর পর কথা চালালে সেটা আর আলাপ আলোচনার মধ্যে থাকবে না। আর এই ঝগড়াঝাঁটিটাই মানসিক ভাবে বড় বেশি চাপে ফেলে দিচ্ছে বিথিকে।
মা-বাবার কথাগুলো শোনার পর জল না নিয়েই দরজা থেকে ফিরে এল বিথি। বাড়ির পিছনের জানালা দিয়ে অন্ধকারে ফেলে দিল ঔষধটা।
অসুখটা থাকলে তবেই তো সে ফিরে পাবে দাদু-ঠাকুরমাকে।
Comments
Top
তাহাদের কথা
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
অনেকক্ষণ একভাবে বসেছিলাম, নিধু কাকাকে বসিয়ে দোকান ছেড়ে বাইরে এলাম। নিধু কাকা আমাদের দোকানের সর্বক্ষণের সঙ্গী (কর্মী নন) বাবার সময় থেকে। একটু আড়াল খুঁজে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম, আজ কাল সিগারেট খেলে একটুতেই হাঁপ ধরে। হাতের সিগারেট একটু একটু করে হাতে পুড়ছে। দেখতে দেখতে মাথার উপর কালো মেঘটা ভারি হয়ে এল। দুপুর বারোটা, চারপাশে অকাল আঁধার। অস্থায়ী দোকানগুলো আজকের মতো ব্যবসা গোটাতে তৎপর, স্থায়ী দোকানগুলো বর্ধিত বিপণীতে বৃষ্টি নিরোধক পলিথিন চাপাচ্ছে।
'অম্লান দত্তের লেখা বিকল্প সমাজের সন্ধানে, আনন্দ পাবলিশার্স, আউট অফ প্রিন্ট, বইটার কোনো কপি আছে আপনাদের কাছে?'
কাঁপা-কাঁপা কন্ঠের কথা কটি কানে আসা মাত্র শিথিল হয়ে গেল আঙুল দুটো, আপনা আপনি খসে পড়ল সিগারেট।
মাথা ভরা পাকা চুল,বয়সের ভারে ঈষৎ ঝুঁকে পড়া চেহারা, কাঁধে ঝোলা, চোখে মোটা কাঁচের চশমা, মোটা সুতোর ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এ কাকে দেখছি আমার দোকানের সামনে! আমাদের ইকনমিক্স এর স্যার বিপ্রবাবু না? হ্যাঁ, একদম তাই বিপ্রবাবুই তো।
বিপ্রপদ পাত্র, আমাদের স্কুলে ইকনমিক্স পড়াতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মনের বাগান কর্ষণই ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা। আর সেই সাধনায় তিনি সতত আত্মনিষ্ঠ। আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে শিক্ষকতাকে জীবন যাপনের আনুপূর্বিক আরাধনা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন স্যার।
সমাজ-সংস্কৃতির সব দিকে তাঁর অবারিত অনুরাগ। তাই পুঁথির সঙ্গে সমাজ-সভ্যতা, ভুত-ভবিষ্যৎকে মিলিয়ে ফেলার এক অদ্ভুত রসায়ন জানতেন তিনি। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। মাঝে মাঝে আমাদেরই বুঝতে অসুবিধা হত আসলে তিনি কি পড়াচ্ছেন- অর্থবিদ্যা, সমাজবিদ্যা নাকি মনুষ্যত্বের আণবিক গঠন।
একবার ভারতের ভারী শিল্প নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন - ''শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, খ্রিষ্টের জন্মের ১৫০০ বৎসর আগে যখন কিনা আজকের সাহেবরা, ইউরোপিয়ানরা পশুর ছাল পরছে তখন ভারতীয়রা পোশাকের ব্যবহার জানত। কিংবা এ আমার কথা নয়, কোনো এক পর্তুগীজ লেখকের কথা, Cape of good hope to chaina was clothed from head to foot in Indian maid garment. আমাদের শিল্প এতোটাই পুরানো। "
''কুতুব মিনারের যে লোহার স্তম্ভ গুলো আছে প্রায় আটশো বছরের রোদে জলে মরিচা আজও থাবা বসাতে পারেনি - এমনই উন্নত শিল্পের উত্তরাধিকার আমাদের।''
গ্রন্থলোকের মহাবিশ্বে তাঁর ক্লান্তিহীন পদচারণা, স্মৃতির সরণি সতত সুস্পষ্ট - তাই তিনি পড়াচ্ছেন ভারতের শিল্প, তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনার গুণে অবলীলায় এসে পড়ছে মধ্য যুগের ইতিহাস, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য।
বিষয়ের গভীরতা, শব্দ চয়ন ও প্রক্ষেপণ, নাটকীয়তা এমন এক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করত যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকতাম চিত্রার্পিত।
আসলে স্যারের বিদ্যাদান যেন এক সমুদ্রযাত্রা। নিদিষ্ট পথ নেই আছে স্থির লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে অনাবিল আনন্দে পথ চলা। কখনো ঢেউ তো কখনো বাতাসকে সঙ্গী করে চলা। কখনো পাল আবার কখনো দাঁড়ের সাহচর্য।
বৈচিত্র্য আর বিভিন্নতার বৈভবে বিদ্যার বিপুল বিকিরণ।
স্যার খুব সহজেই আমাদের মনটা পড়ে নিতে পারতেন। আমাদের বলার আগেই আমাদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-যন্ত্রণা সব সব বুঝে নিতেন তিনি। একবার দেখেছি মিনহাজের কপালে অমৃতাঞ্জন ঘষে দিচ্ছেন।
অপেক্ষাকৃত অমনোযোগী যারা তাদের বোঝাতেন অর্থবিদ্যার পরিভাষায় -
''প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ ভোগের নৈবেদ্য সাজিয়ে রেখেছে। ভোগ তৃপ্তিকর তাই ভোগে আমাদের আগ্রহ বেশি। তাইতো পড়াশোনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, ফাঁকি দেওয়া। পড়াশোনা হল ভোগ বিরতি, ভোগ বিরতি হল সঞ্চয় যা ভবিষ্যতকে দৃঢ় করে সুন্দর করে। এখন নিজেকে তৈরীর সময়, এখন ভোগের নেশা পেয়ে বসলে সঞ্চয়ের ঘরে শূন্য, তার ফলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, অন্ধকারময়। দেখবে তখন জীবনের সব মুহূর্ত গুলো পিছলে যাছে শক্ত করে ধরার আগেই।''
আত্মদর্শী আচার্যের অনুপম অনুসঙ্গ আজও আমোদিত করে আমাদের।
পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম স্যারকে। সাল, ক্লাস, মিনহাজ, মনতোষ টুকরো টাকরা নানান সুতোর সূত্র ধরে স্যার খুব সহজেই আবিষ্কার করে ফেললেন আমাকে। গায়ে মাথায় স্নেহের হাত বোলাতে লাগলেন। সারা কলেজ স্ট্রিট হাঁ করে দেখছে আমাদের দুজনকে। স্যার তখন পিছিয়ে গেছেন অনেক কটা বছর - স্কুলের প্রশস্ত দালান, ক্ষয়াটে বিকেলের নরম আলো আর ফাঁকা ক্লাস রুমে আমরা কজন আর স্যার। আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম স্যারের চোখে মুখে ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
খুব সহজেই জিজ্ঞাসা করে বসলাম-
'এখনো পড়াচ্ছেন?'
স্যার ঘষা কাঁচের দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন -''আমার মননের আদ্যকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই, আমি কেবল শরীরটা বয়ে বেড়াচ্ছি। জানো পড়ানো আমি ছেড়ে দিয়েছি।''
কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন গলাটা বুজে আসছিল কান্নায়।
তারপর হঠাৎই স্যারের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল অভিমানের এক অনন্ত আগুন। ''জানো আজকাল ছেলেমেয়েরা সীমাবদ্ধতার সীমানার বাইরে জানতে চায় না, তাদের চাই নোটস্ চাই সাজেশনস্। একটা ছক বাঁধা, ছাঁচে ঢালা শিক্ষা। অনেকটা যেন ট্রেন জার্নি - প্রয়োজনের বাঁধা পথে অসংলগ্ন উপাগম।''
আমার হাতের মধ্যে স্যারের হাত দুটো ধরা ছিলো, আমি খুব বুঝতে পারছিলাম স্যার থরথর করে কাঁপছেন।
''অনেক সময় অশিষ্ট কিছু অভিভাবক নির্দেশ দেন, কি পড়াতে হবে, কতটা এমনকি কিভাবে। ভাবটা এমন - গরু যে একটা প্রাণী সে না জানলেও চলে, গরু যে দুধ দেয় এ অতিরিক্ত তথ্যের বদহজম, শুধু ক্ষীরটুকুই চাই। তাই রাগে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছি।''
তাঁর রাগ অভিমান দলা পাকিয়ে চারপাশের আকাশ বাতাসকে আরো একটু ভারি করে তুলল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আর স্যার বৃষ্টি মাখতে মাখতে মিলিয়ে গেলেন বইয়ের ভিড়ে, অসংখ্য বই অনুরাগী মানুষের মধ্যে।
তাহাদের কথা- ২
স্কুল ফেরত বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক বাসের অপেক্ষায় বলা যাবে না আবার না বলারও কোনো কারণ নেই। দাঁড়িয়ে আছি আর একটার পর একটা বাসের চলে যাওয়া দেখছি। ঠিক চলে যাওয়া দেখছি না, দেখছি বাসের গায়ে, পেছনে লেখাগুলো। ঐ লেখাগুলো বেশ লাগে। যেমন - হিংসা করো না চেষ্টা করো কিংবা জন্ম থেকেই জ্বলছি অথবা দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি আবার কেউ লিখেছে, বললে হবে সতীন নিয়ে ঘর করছি নয়তো মদন বাড়ি ফিরবেই অন্য দিকে রবিঠাকুরের - আমার পথ চলাতেই (আসলে চাওয়াতেই) আনন্দ, বা পদাতিক কবির, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ আনন্দ (বসন্ত নয়) অথবা পথে হল দেরী, রাস্তা কারো বাবার নয় নানা ধরনের লেখা। বেশ মজা লাগে। কদিন হল মনটা বিশেষ ভাল নয়, কিন্তু কাউকেই তার হদিশ পেতে দিই নি এমন কি গিন্নিকেও নয়। আজ স্কুলে শিক্ষারত্ন নিয়ে বেশ বললাম -
'ওভাবে কেউ নিজেকে রত্ন হিসাবে দাবী করে? একি সরকারি ব্যবস্থা! আবেদন করে জানাতে হবে, আমাকে রত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হোক।'
অথচ নিজে আগে ভাগেই আবেদন জমা করেছিলাম। সিল.এল নিয়ে ছোটা - ছুটিও করছিলাম, ও প্রান্ত থেকে আশ্বাসও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিকা ছিঁড়ল না। মন খারাপের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একটা লুলে যাওয়া, গলে যাওয়া বুড়ি এসে হাত পাতল। বাঁ হাত নিজের কপালে ছুঁইয়ে, আমার কাছে যে কিছু জুটবে না তা জানিয়ে দিলাম। ব্যাগের মধ্যে শিক্ষক দিবসের প্যাকেট ছিল, যদিও ভাল আইটেমগুলো আগেই সাবাড় করে রেখেছি। একবার ভেবে ছিলাম দেই, পরে মনে হল বাড়িতে নিয়ে গেলে কাজের মেয়েটা পাবে, খুশি হবে। অন্তত আজকের জন্য বাড়তি পরিসেবা জুটবে, এমনিতে কাজের ক্ষেত্রে ওরা একেবারে মাপা হাত। বুড়িটা আমাকে মাপতে মাপতে চলে গেল। আমি তেমনি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের লাইনের গাড়ি গুলোর ডেনসিটি একটু কম তাছাড়া আমার তো তেমন কোনো তাড়া নেই। আগে যদিও পড়ানোর হোম ডেলিভারি ছিল, এখন আর যাই না। না শরীরে কুলোয় নি তা নয়, কেমন যেন একটা আত্মসম্মানে বাঁধল। একদিন এক বাড়িতে পড়াচ্ছি। ছাত্রের মা ফোনে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছে-
"আর বোলো না দিদি খরচের কি শেষ আছে - মাছ, মাংস, সবজি, ডাল, চাল, তেল, ডাক্তার, ইলেট্রিক, ফোন, কুকুর, মাস্টার।"
ঝটকা লাগল। আমরা মাস্টাররা কুকুরেরও পরে! ব্যস সেদিন থেকেই পড়ানোর হোম ডেলিভারি বন্ধ।
এখন দুএকটা পড়াই নাম মাত্র পয়সায় বা বিনা পয়সায়। ওগুলো আমার ভাল মানুষীর বিজ্ঞাপন। দেখতে দেখতে আমার বাস এসে গেল। জানলার ধার ঘেঁষে বসার একটা সিটও জুটে গেল কপালে। বাস ছুটছে। বাইরের পৃথিবীটা উল্টো মুখে ছুটছে। দ্রুত অতি দ্রুত সরে যাচ্ছে বাইরের গাছ-পালা, ঘর- বাড়ি, মানুষ-জন। এই ছুটে চলাটাই জীবন। নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়, হারিয়ে যেতে হয়। অন্যকে ছাড়িয়ে, অন্যকে মাড়িয়ে এগিয়ে চলার নামই জীবন।বাইরের ঠান্ডা বাতাসে একটু তন্দ্রা মতো আসছিল, হঠাৎ সজোর ব্রেকে জেগে উঠলাম। জানালা দিয়ে যেটুকু বুঝলাম, একটা মানুষ গাড়ির ধাক্কায় দলা পাকিয়ে গেছে, রক্তাক্ত শরীরটা ছিটকে গেছে পথের প্রান্তে। লোকটা কাতরাচ্ছে মৃত্যু যন্ত্রণায়। লোকটা আমার চেনা তবুও আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম পাছে জড়িয়ে পড়ি অবাঞ্ছিত ঝামেলায়। গাড়ি ছুটছে, আরো, আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে নিশ্চিন্ত নিরাপদের আশায়।
আমার স্টপেজ এ নেমে পড়লাম। আমাকে ছেড়ে গাড়িটা বাতাসের বেগে ছুটে গেল সামনের দিকে। আর আমি চকিতে লক্ষ্য করলাম বাসটার পেছনে লেখা - বিশ্বাসের মা মারা গেছে। আমার শরীরটা একটু টাল খেল। বুকের ভেতরটা যেন খালি হয়ে গেছে। আমি হাঁটছি আমার পা দুটো জড়িয়ে যাচ্ছে, আমার গতি শ্লথ হয়ে আসছে। আমার মস্তিষ্কে দাপাদাপি করছে সেই বুড়ি মানুষটা, শিক্ষারত্ন, রক্তাক্ত দলাপাকনো পরিচিত মুখটা। কোথা থেকে ভেসে আসছে সেই চেনা সুর... আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। কি অসহ্য সেই সুর, যেন কেউ আমার কানে গরম সিসা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি যতই আমার বাড়ির কাছাকাছি হচ্ছি সে সুর হয়ে উঠছে তত তীব্র।
বাড়ি পৌঁছে দেখি সে সুর ছড়াছে আমারই বাড়ি থেকে। দেখি আমারই দরজায় আমার বিনা পয়সার ছাত্ররা, আমার ভাল মানুষীর বিজ্ঞাপন, আমার জন্য ফুল, মালা, আর চন্দনের বরণ ডালায় সাজিয়ে রেখেছে শিক্ষক দিবসের অর্ঘ।
ওদেরই একজন বলল-
"আজ বড় আনন্দের দিন, স্যার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিন।"
আমি সাওয়ারের তলায় বিবস্ত্র দাঁড়িয়ে আছি। গলা বেয়ে কান্না উঠে আসছে, আজ যে এক কলসি গঙ্গা জলের বড় প্রয়োজন।
Comments
Top
অর্ধ-বৃত্ত
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
মিতালিপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে ঘড়ি দেখল শ্যামল। ঘড়িটা দেখতে গিয়ে বগল থেকে সরে গেল ক্র্যাচটা। ক্র্যাচটা সরে যেতে শরীরটা সামান্য টাল খেল। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল শ্যামল। ক্র্যাচটা তুলতে গিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে অনেক গুলো হোডিং চলে এলো শ্যামলের চোখে। তার মধ্যে "একটু ভালবাসা"-এর হোডিংটা নজরে পড়ার মতোই। পথ-নির্দেশিকা অনুযায়ী "একটু ভালবাসা" এখান থেকে সাত কিমি পথ। হিসাব মতো সহেলীর এখনো ঘন্টা দুই লাগবে। অথাৎ আরো ঘন্টা দুই এখানেই অপেক্ষা করতে হবে তাকে। সকাল থেকে ভারি কিছু খাওয়া হয় নি। এবয়সে বাইরের খাওয়ার আজকাল আর সহজে হজম হয় না। তবুও রাস্তা পার হয়ে উল্টো পিঠের রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল শ্যামল।
খাওয়া শেষে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের উপরে লাগানো আয়নায় একটা মুখ দেখে চমকে উঠল সে। রেস্টুরেন্টের মাঝে মোটা থাম লাগোয়া টেবিলটার তিনটি চেয়ার ফাঁকা কিন্তু চতুর্থটিতে ও কে বসে! এক মাথা পাকা চুল আর চশমাটা খসিয়ে নিলে একদম হিয়া না!
হ্যাঁ, কোনো ভুল নেই, হিয়াই তো।
শ্যামলের বুকের ভেতর কো যেন ধামসা-মাদল পেটাচ্ছে। শ্যামল অনেক যদি কিন্তু মাড়িয়ে এগিয়ে গেল টেবিলটার কাছে--
- কিছু মনে করবেন না, আ.. আ.. আপনি কি হিয়া বিশ্বাস ?
ভদ্রমহিলা মুখ তুলে তাকালেন শ্যামলের দিকে। আঙুল দিয়ে ঠিক করে নিলেন নেমে আসা চশমাটাকে। কপালে তৈরি হওয়া ভাজগুলোকে মাথার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন -
- হি... হিয়া বিশ্বাস! না না আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি হিয়া বিশ্বাস নই।
- আসলে হয়েছে কি আমার এক বান্ধবীর নাম হিয়া, বিশ্বাস করুন আপনাকে একদম তারই মতো দেখতে। এমনকি এই যে আপনি কথা বলছেন, কন্ঠস্বরটাও যেন..
- এক সুরে বাঁধা তাইতো? না মশাই আমি তো হিয়াই নই আর সে অর্থে আমার কোনো যমজ বোনও নেই, যার নাম হিয়া।
- স্যারি ম্যাডাম। খুব স্যারি। বছর পঁচিশ আগের দেখাতো। হিয়া আমার ভীষন বন্ধু ছিলো।
- ভেরি ইন্টারেস্টিং! পঁচিশ বছর আগে শেষ দেখা। তার মানে তখন...আরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন! বসুন না। তখন আপনি কত আর..
- না ঠিক আছে, আমি ত-খ-ন বছর তেইশ, আর হিয়াও...ঠিক তাই। আমরা এক ক্লাস ছিলাম যে।
- এই একমাথা সাদা চুল, নড়বড়ে দাঁত, ঘোলাটে চোখে ভারি চশমা, সব মিলিয়ে আমাকে দেখে তো মশাই কখনই ষাটের কম মনে হয় না।
- সে তো আমিও কম বুড়ো হই নি ম্যাডাম।
- হুম.. বুঝলাম। তা মশাই স্পেশ্যাল কেউ ছিল নাকি?
- হু... একটু স্পেশ্যালতো ছিলই।
- আচ্ছা। আসুন না, ভুল করে যখন এসেই পড়েছেন, তখন আজকের দিনের জন্য আমিই না হয় আপনার হিয়া হলাম।
- না ম্যাডাম, তা হয় না। এই তঞ্চকতাটা এ বুড়ো হৃদয় সইতে পারবে না। নমস্কার। ভাল থাকবেন।
শ্যামল রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল রাস্তায়। অনেক দিনের সেই না মেলা অঙ্কটা আজ বড় অস্থির করে তুলল তাকে। চিনচিন করে ব্যথাটা বাড়ছে। ব্যথারাও ঘুমিয়ে যায় কিম্বা ঘাপটি মেরে থাকে অবচেতনে। একটু নাড়া পেলেই জেগে ওঠে। আর তখন সব কিছুকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়।
একসময় যে চাওয়াটা ছিল অনিবার্য আজ সেই না-পাওয়ার সামনে স্বেচ্ছাকৃত সব নির্মান যেন হয়ে যায় মিথ্যে। অসীম শূন্যতা অনতিক্রম্য হয়ে ওঠে। মৃত্যুকেও বড় তুচ্ছ বলে মনে হয়।
ভদ্রমহিলাকে দেখার পর থেকে শ্যামলের বুকের ভিতর উন্মত্ত দাপাদাপি শুরু হয়ছে।
ক্র্যাচটার উপর শরীরটাকে টানতে টানতে সে এসে পড়েছে বাসস্টপে।
"একটু ভালবাসা" সব ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল। নিজে থেকেই না করেছে শ্যামল। অবশ্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলেই না করেছে। মেয়ে ফ্লাইট থেকে নেমে সোজা চলে আসবে এখানে। তারপর বাপ-বেটি দু'জন রওনা দেবে।
- শ্যাম...
চমকে উঠল শ্যামল। বুকের ভিতরটাকে কে যেন শক্ত হাতে নিঙড়াচ্ছে। শুকিয়ে গেছে মনের আনাচ-কানাচ। শুধু দূর থেকে শুকনো পাতা উড়িয়ে শনশন বেগে ছুটে আসছে এক উন্মত্ত ঝড়।
- ওভাবে বলিস না। শেষ পর্যন্ত তুইতো আর কোনো যোগাযোগ রাখতে চাস নি।
- এখনও ট্রেনের ধাতব শব্দটা শুনলে ভয়ে থেকে থেকে খাঁমচে ধরি বাঁ পা'টাকে।
তোর মনে আছে কিনা জানি না, সেদিন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন।
- আমি হোষ্টেল থেকে ফিরছিলাম বেডিং পত্তর নিয়ে..
- বোঝাটা বইবার জন্য পথে একটা ভ্যান রিক্সাও তুই পেলি না..
- লাইনন দড়ি বাঁধা বোঝাটা তুই নিজের থেকেই নিলি হাতে ঝুলিয়ে - হু, খুব কষ্ট হচ্ছিল বোঝাটা বইতে। কিন্তু তখন কষ্ট করার নেশাটা পেয়ে বসেছিল আমাকে। এরপর তো তোর সব বোঝা আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে।স্টেশন পৌচ্ছে দেখি দড়িটা কেটে বসে গেছে আমার হাতে । হাতটা ভীষন জ্বালা করছিল।
তার মধ্যে তোর নজর পড়তে তুই কাঁদতে কাঁদতে স্থান কাল ভুলে চুমু খেতে থাকলি দু'হাতে। তোর চোখের নোনা জলে জ্বালাটা আরো বেড়ে যাচ্ছিল।
- এর মধ্যে ট্রেন এসে ঢুকে পড়ল প্লাটফর্মে..
- তোকে ট্রেনে তুলে আমি চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেনটা ছাড়ল, গতি বাড়তে থাকল। আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন ভারি হতে থাকল। শূন্যতারও যে কি ভীষন ওজন থাকতে পারে সেই প্রথম টের পেলাম। ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে থাকলাম তোর জানালাটা ধরে। তারপর হঠাৎ ইচ্ছে হল তোর সঙ্গে যাওয়ার। ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল গতি। হঠাৎ পা'টা গেল ফসকে্ আমার শরীরটা তখন প্লাটফর্মে ঘষটাচ্ছে। সারা প্লাটফর্ম জুড়ে তখন একটাই শব্দ গেল গেল গেল...
তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই।
- দু'দিন পর তোর সেন্স ফিরেছিল। টানা দেড় মাস পড়েছিলি হসপিটালে। হসপিটাল থেকে ফেরার পর তুই কেমন যেন পাল্টে গেলি।
- হসপিটাল থেকে যখন একটা পা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম তখন আমার জগৎটাই কেমন যেন বদলে গেল। দাদা-বউদির সংসারে একটা বাড়তি বোঝা হয়ে উঠলাম। তখন আমার সম্বল বলতে তুই। বাকি জীবনটা কেবল তোর ভরসায় বাঁচা।
- আমিও তো তাই চেয়ে ছিলাম, পাশে থেকে সাহস দিতে।
- বাঁধ সাধল তোর বাবা।
- বাবা!
- হ্যাঁ। একদিন উনি এলেন আমাদের বাড়ি।বললেন যেন কোন ভাবেই এই পঙ্গু জীবনটা না চাপিয়ে দেই তোর জীবনে।
- ওঃ তাই তুই আমাকে অস্বীকার করে গেলি বারবার।
- এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না যে আমার। তবে বিশ্বাস কর আমার এই পঙ্গু জীবনটা বেশ বয়ে বেড়াচ্ছে আমার স্ত্রী ও মেয়ে।
- তাহলে আমাকে না পেয়ে ভালো হয়েছে বল।
- সেটা বলতে পারব না।
- এখন কোথায় যাবি?
- এই তো সামনের দু'টো স্টপেজ পেরিয়েই আমার বাড়ি।
- আমার কাজের বেশ দেরি আছে চলনা তোর বাড়িটা ঘুরে আসি। আলাপ হবে তোর বউ মেয়ের সঙ্গে।
- আসলে আমার বউটা বেশ সন্দেহ বাতিক। তোকে দেখলে আবার না অন্য কিছু ভেবে বসে।
- ওঃ তাই নাকি!
এমন সময় রাস্তায় একটা ছোট গাড়ি এসে থামল। গাড়ির জানালায় সহেলী। মেয়েকে কিছু মাত্র বুঝতে না দিয়ে গাড়িতে চেপে বসল শ্যামল। হিয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল সে এক ছুট্টে উঠে পড়ে শ্যামলদের গাড়িতে কিন্তু তার সে জোর যে আজ আর নেই। মঞ্চটা সুন্দর করে সাজানো। মঞ্চে বসে রয়েছেন অতিথিরা। সামনের সারিতে কঁচি-কাঁচারা বসে। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যায় চলছে। "একটু ভালবাসা" এ বছরও বিগত বছরের মতো সম্মান জানাচ্ছে সেরা বাবাকে , আর সেই সঙ্গে এবারে সম্মানিত হচ্ছেন সেরা মা। ঘোষক বিষয়টা ঘোষনা করা মাত্র পুরো অডিটোরিয়াম ভেঙে পড়ল করতালিতে। করতালির শব্দে ঘোষক তার কথা আপাতত বন্ধ রেখেছেন। দর্শকাসন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসে ঘোষক আবার শুরু করলেন।
"এবছরের সেরা বাবা ও সেরা মা হলেন শ্রী শ্যামল সেনগুপ্ত ও শ্রীমতি হিয়া বিশ্বাস।
আজ এঁদের দু'জনের সন্তানই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। বিগত বছরগুলোর সঙ্গে এবারের উৎসবের তাৎপর্যপূর্ণ তফাৎ এতোটুকুই- এঁদের দু'জনের জীবনে, এঁদের সন্তান ছাড়া আর কোনো বাঁধন নেই। অনেক বিবাহিত দম্পতি আমাদের এই অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়েছেন। তাঁদের সেই সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে বলছি, মিস্টার সেনগুপ্ত ও মিস বিশ্বাস কোনো এক অজ্ঞাত কারনে জীবনে দ্বিতীয় জনকে গ্রহন করেন নি। তবুও তবুও তাঁরাই আজকের সেরা বাবা ও সেরা মা।
একাই যে একটা সংসার নির্মান করা যায় তা এঁরা একক ভাবে করে দেখিয়েছেন।
এঁদের এই নিঃসঙ্গ জীবনের সার্থকতা এখানেই, এই জীবন পূর্ণ করেছে আর এক রিক্ত জীবনকে। একটু ভালবাসায়, না-হয়ে ওঠা জীবনকে বর্ণময় করেছেন এঁরা।
মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি এবছরের
"একটু ভালবাসা- সেরা বাবা ও মা'কে"
আজ কোনো অতিথি নন আজ তাঁরা সম্মানিত করবেন একে অপরকে।
মঞ্চের সমস্ত আলোর তলায় এসে দাঁড়িয়েছেন শ্যামল আর হিয়া। একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাঁসছে মিটমিট করে।
একটু আগে শান বাঁধানো গাছটার তলায় নিজেদের তৈরি করা মিথ্যে সংসারটা ভেঙে ধুয়ে যাচ্ছে "একটু ভালবাসা"- এর মঞ্চে।
এই প্রথম শ্যামলের মনে হল সে ক্র্যাচ ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে আর হিয়াও যেন এতোদিনে খুঁজে পেয়েছে সোনার হরিণ। দর্শক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন সবাই। করতালিতে ভেঙে পড়ছে পুরো অডিটোরিয়াম। মঞ্চের মাঝে দু'টি আলোকিত অর্ধবৃত্ত।
Comments
Top
সংস্কার
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
হাসপাতালের কিরকম যেন একটা গন্ধ আছে। গন্ধটা নাকে এলে বুকটা শুকিয়ে যায়। একটা শুকনো খসখসে বাতাস পাক খেতে খেতে হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা বায়ু শূন্য করে দেয়। তখন জোরে জোরে শ্বাস হাতড়াতে হয়। কি যেন এক অজানা আশঙ্কায় বুকের সব ঘুলঘুলি গুলো বন্ধ হয়ে গিয়ে অদ্ভুত এক দমবন্ধ অবস্থা তৈরী করে।
পাশ থেকে চলে যাওয়া স্ট্রেচারের ঘরঘর আওয়াজ বহু দূর পর্যন্ত বুকে হাতুড়ি পিটতে থাকে। তখন নিজেকে সরিয়ে নিতে ইচ্ছে জাগে। মনে হয় পায়ে পায়ে আলগা একটু সময় কাটিয়ে আসা যাক।
কদিনের আনাগোনায় মুখ চেনা হয়ে গেছি দোকানির। চকলেটের বয়ামের উপর পাঁচ টাকার কয়েন রাখতেই, হাতে ধরিয়ে দেয় দশটা বিড়ি। কলাপাতা ভাঙা হাওয়ায় বিড়ি ধরিয়ে নিই দু-হাতের আড়াল তৈরী করে। গাল চুপসে লম্বা টান লাগাই, মুখ ভর্তি ধোঁয়ায় চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে বিড়ির কটু গন্ধ।
এখানে মানুষের স্বার্থ চক্র ভিন্ন পথে চলে। আমি চাইছি মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুক, হাসপাতাল বা ঔষধ দোকানগুলোর চাওয়া ঠিক এর বিপরীত। তেল চিটে চেহারা, কোটরে ঢুকে থাকা চোখ, মাথা ভর্তি ঝোড়ো চুল, ময়লা জিনস পরে শব-বাহী গাড়িটায় হেলান দিয়ে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে, সে হয়তো সকালে স্নান সেরে যমের ফটোতে প্রণাম করে বেরিয়েছে রোজদিনের মতো।
এ এমন এক পরিস্থিতি এখানে অর্থবান, শক্তিমান সকলেই অসহায় হয়ে চেয়ে থাকে ঈশ্বরের পানে। আর আমার ভরসা ঠিক সেই খানটিতে, মা-আমার, ব্রত ও উপাসনায় খরচ করেছে জীবনের বেশির ভাগ সময়। তার সেই উন্মুখ উপাসনা বিফলে যাওয়ার নয়। ঈশ্বর তাঁর এতো বড়ো সেবাইতের এতো বড় অনিষ্ট করবেন না। আর তাই যদি হয় তবে সে হবে ঘোর অনাচার।
চারটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি, একটু একটু করে ভিড় ঘন হতে শুরু করেছে। চারটা থেকে পাঁচটা ভিজিটিং আওয়ার্স, সে সময় মনে হয় কোথাও যেন আমরা একা নই, আমাদের চরাচর যাপনে জড়িয়ে আছে কত আপনজন, কত আশা-আকাঙ্ক্ষা,কত শুভেচ্ছা।
ঘন্টা খানেক আগে আমার দাদু, মায়ের বাবা এসেছেন মেয়ের খোঁজে। যদিও বয়সের ভারে তিনি প্রায় চলচ্ছক্তিহীন, তবুও সন্তানের শুভকামনা- সঙ্গে নিয়ে এসেছেন গৃহ দেবতার প্রসাদি ফুল-বেলপাতা। কোন ছোটবেলা থেকে ঐ গৃহদেবতার সান্নিধ্যেই মায়ের বড় হয়ে ওঠা।
দাদু ছিলেন পন্ডিত ব্রাহ্মণ, আশেপাশের পাঁচ গ্রাম তার যজমান। খুব ছোটবেলা থেকে মা সংস্কার মনস্ক। পূজা-পার্বণ, ছোঁয়াছুঁয়ি, জাত-পাত এসব খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে এসেছেন আজীবন।
তখন আমার ক্লাস সেভেন কি এইট, মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি যাচ্ছি। আনন্দ একটা রঙিন প্রজাপতি হয়ে অস্থির করে তুলেছে যাত্রাপথ। প্রথমে বাস তারপর বেশ খানিক হাঁটা পথ। বাসের মন্থর গতিতে চুকচুক শব্দ এসে পড়ছে জিভে-ঠোঁটে। বাস থেকে যখন নামলাম তখন রোদ চাঁটি বসাচ্ছে মাথায়। এরপর প্রায় মাইল খানেক গ্রামের পথ ধরে হাঁটা। সারা পথের সবটাই মনোহর প্রাকৃতিক শোভা, পুরোটাই গাছ-গাছালির ছায়া পথ।
পুকুরের স্থির জলে আম, জাম, খয়ের, অশ্বত্থের ঘনছায়া, হাত ধরে দাঁড়ানো সার বাঁধা সুপুরি গাছে বাতাসের শনশন। গুটিকয় বক পুকুরের উপর ঝুঁকে পড়া কলাগাছে ভাঙা পাতায় চুপটি করে বসে শিকারের অপেক্ষায়। দূরে বাঁশ বনে শুকনো বাঁশ পাতা পাক খায় নিজের খেয়ালে। মাটির পথ খানি কোথাও বা ক্ষীণ হয়ে গেছে মানুষের মলে। ছেলে বুড়ো লজ্জাকে সিন্দুকে ভরে ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রাতঃক্রিয়া সেরে নেয় পথের দুধারে।
ঝুলে থাকা শাড়িটাকে সামান্য তুলে সাবধানী মা হাঁটছেন তার স্বভাব জাত শুচিগ্রস্ততা বাঁচিয়ে, আর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যাতে আমি নোংরা মাড়িয়ে না ফেলি।
মামা বাড়ি ঢোকার মুখেই শীতলার মন্দির, সামনে নাটমন্দির,পাশে পুকুর। ঐ পুকুরটি ছিল সদর পুকুর।
মা বাড়ি ঢোকার আগেই পুকুরে স্নান করে নিতেন, যাত্রা-পথের নোংরায় মা যে তখন অশুচি। স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে শীতলার প্রণাম সেরে তবেই বাড়ি ঢুকতেন। সেবার মামা বাড়ি সবেমাত্র ঢুকেছি। দাদু বেরচ্ছেন যজমান বাড়ি, শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে। আমাকে সঙ্গে নিলেন।
বাড়ি ফিরে মার সঙ্গে তর্ক করেছিলাম খুব। বলেছিলাম- "যে পথ মাড়িয়ে তুমি স্নান করো, সেই পথ হেঁটে দাদু যজমান বাড়ি গেলে ওরা পিতলের থালায় দাদুর পা রেখে,পা ধোয়া জল খায়! ছিঃ।" পরে আরো বড় হয়ে মাকে বলেছিলাম- "ধরো তুমি অসুস্থ হলে, রক্ত চাই। হিজবুল তোমাকে রক্ত দিলো। সে রক্তে কি তুমি বাঁচবে না মা?"
মা হাসতে হাসতে বলেছিল- "আমি যেদিন মরবো সেদিন তুই চিকিৎসার সুযোগই পাবি না। টুক করে গড়িয়ে পড়বো যমের কোলে।"
ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়েছে অনেক ক্ষণ, একে একে সবাই গেছে চলে। ডাক্তার বাবু বলেছেন কাল মাকে রক্ত দিতে হবে,পরশু অপারেশন। তারপর আর দিন পাঁচ রেখে মাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। মায়ের রক্ত আর হিজবুলের রক্তের গ্রুপ এক। হিজবুলকে কাল সকাল সকাল আসতে বলেছি।
দিন কয়েকের টানা ধকলে শরীর আর পেরে উঠছে না। ওয়েটিং রুমের চেয়ার গুলো প্রায় ফাঁকা। গোটা তিনেক
চেয়ার নিয়ে একটু গা এলিয়ে দিলাম। মুহূর্তে ক্লান্তিতে বুজে এল চোখ। হঠাৎ বেজে উঠল ফোনটা। এক দৌড়ে মায়ের কেবিন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে,কাচের দেওয়ালের ওপারে ডাক্তার,নার্স সবাই খুব ব্যস্ত। ডাক্তার বাবুর চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল হল্টার মনিটরে। প্রেসার ক্রমশ নিচের দিকে নামছে, আশি-একশকুড়ি থেকে সত্তর-নব্বই। অক্সিজেন সেচুরেশন কমে আঠাত্তর পার্সেন্ট। মাকে অক্সিজেন দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।
অপারেশনের পর আজ দিন তিন হয়ে গেল মায়ের কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই,বরং আরে অবনতি হচ্ছে যেন। ডাক্তার বাবুর কথা মতো দু বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছে, যা যা ঔষধ প্রয়োজন সবটাই। ডাক্তার বাবু বলেছিলেন অপারেশন সাকসেসফুল। হয়েছিলও তাই, অপারেশনের পরের দিন মা আমাদের সঙ্গে কথা বলল, নিজের হাতে ঔষধ নিল নার্সের থেকে। আর সেই পেসেন্ট কিনা আজ হল্টার মনিটরিং- এ।
তাহলে কি অপারেশনে কোনো ত্রুটি থেকে গেল! এ-কদিন ডাক্তার বাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে একটু যেন গা-ছাড়া ভাব। আই সি ইউ এর বাইরে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছি। অজান্তে মায়ের ফ্যাকাসে দৃষ্টি চলে এলো চোখে।
তবে কি হিজবুলের রক্তটা!
হিজবুল যেদিন রক্ত দেয় ও চেয়েছিল মার সঙ্গে দেখা করতে। আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু কি ভাবে বলি। শেষ পর্যন্ত মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হিজবুল বলেছিল-
" চিন্তা করবেন না আমরা সবাই আছি, ছোট্ট একটা অপারেশন, ঠিক সুস্থ হয়ে ওঠবেন।"
মা কেমন যেন একটা ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে।
আমি মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারি নি। একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিল ভেতরে ভেতরে। ফোন ধরার ভান করে বেরিয়ে এসেছিলাম চেম্বার থেকে।
কদিন যাবৎ এই চিন্তাটা আমাকে অস্থির করে তুলছে।
মায়ের পালস্ ফ্লাকচুয়েট করছে। ডাক্তার বাবু আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠছেন। কি একটা ইনজেকশন গেঁথে দিলেন। হল্টার মনিটরের সংখ্যাগুলো পাল্টে যাচ্ছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।
ডাক্তার বাবু মায়ের হাতটা নিয়ে কি যেন একটা বোঝার চেষ্টা করলেন। সেই খোঁজার চেষ্টাটা আরো বেশি করে মনযোগী হয়ে উঠল। তারপর নিজের নিচের ঠোঁটকে উপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে, ঘাড়টাকে বার দুই দোলালেন। কাচের দেওয়াল ভেদ করে ডাক্তার বাবুর দীর্ঘশ্বাস ফুটল আমার বুকে। অপ্রার্থিত পরাজয়ের গ্লানিতে তাঁর মুখখানি কালো দেখালো বোধহয়। মায়ের শরীরের উপরে রাখা সাদা কাপড়টাকে ডাক্তার বাবু টেনে দিলেন মার মুখ পর্যন্ত। আমি টাল খেয়ে বসে পড়লাম মেঝেতে।
বাইরে আমার বন্ধুরা এসে জটলা পাকাচ্ছে একটা কিছু গন্ডগোল হবেই। যা হয় হোক আমার আর কিছু ভাল লাগছে না। মায়ের মাথার কাছে বসে আছি। এখনো বাবাকে এ খবর দেওয়া হয় নি। এসময় মনটাকে শক্ত করতে হবে। ছোট বোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মায়ের মাথাটা গড়িয়ে গেছে বালিশের নিচে। মাথাটা বালিশের উপর রাখলাম। হাতে কি সব যেন লাগল। মায়ের বালিশের তলায় দেখি এক গাদা ঔষধ। তার মানে মা একটাও ঔষধ খায় নি অপারেশনের পর। নিজেকেই নিজের শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। এ তো মায়ের ইচ্ছা-মৃত্যু,আর এ মৃত্যুতো কেবল আমার জন্য। আমি যদি হিজবুলের রক্তটা!
ততক্ষণে বাইরের জটলাটা বেশ জটিল আকার নিয়েছে। ঝনাৎ করে একটা কাঁচ ভাঙল।
কাচ ভাঙার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। ধড়পড়িয়ে উঠে বসলাম। অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে চলছে হৃৎপিন্ড। কপালে ছড়িয়ে রয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রুমাল বের করে মুছে নিলাম ঘাম। ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। দারোয়ানের নজর এড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম মায়ের কেবিনের দিকে। উঁকি দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। মা বেডে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। নার্সটা মোবাইলে হাবিজাবি বকে চলেছে সমান তালে।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে হিজবুলের নাম্বারটা সার্চ করলাম। গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলাম ওয়েটিং রুমে।
হিজবুলকে বললাম মা ভাল আছে, রক্ত লাগবে না। ফোনটা রেখে পা বাড়ালাম ব্লাড ব্যাঙ্কের দিকে।
Comments
Top
লিপইয়ার
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
সকালবেলা রোজকার দিনের মতো স্নান সেরে শুদ্ধ চিত্তে গুরুদেবের চরণে ফুল দিয়ে প্রণাম সারল নিকুঞ্জ। গুরুদেব নিশ্চলানন্দের কাচ বন্দী মুখটা হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে নিকুঞ্জর দিকে। তার সিদ্ধান্তে যেন গুরুদেবও সুপ্রসন্ন। নিকুঞ্জ দাস বড় আশায় ছেলের নাম রেখেছিল ঋতব্রত দাস। আশা ছিল তার নিজের জীবন যেমন সত্যের চরণে নিবেদিত তার সন্তানও তেমনটাই হবে। হয় নি ঋতব্রত নামটাই হয়েছে ব্যর্থ। তাই নিকুঞ্জ যে ভাবে আজকের নিকুঞ্জ হয়েছে সেভাবেই সে তার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আর সেই কারণে বিজ্ঞাপন।
নিকুঞ্জ বিজ্ঞাপনের রিপ্লাইগুলো বিছানায় ছড়িয়ে বসেছে। সব গুলোই যে কাজের হবে এমন নয়। এধরনের বিজ্ঞাপনে অনেকে খিস্তি করেও রিপ্লাই করবে, সেগুলোকে সবার আগে সরিয়ে ফেলা চাই। বাকিদের মধ্যে থেকে খুঁজে নিতে হবে সঠিক সন্ধান। সামনা সামনি দেখা সাক্ষাৎ, বংশ- পরিচয়, কথোপকথন সে এক দীর্ঘ পথ।
একটা দলা পাকানো কাগজ নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল ঋতব্রত। খুব ভাল করে না দেখলেও বোঝা যায় আকণ্ঠ নেশায় সে আচ্ছন্ন। পা-দুটো ঠিকঠাক ফেলতেও পারছে না। দরজায় একটা ধাক্কা খেয়ে, বাঁ-দিকে টাল খেয়ে দু-হাত এগিয়ে, আলনার জামা-কাপড় গুলো ধরে কোন রকমে স্থিত হল সে। নিকুঞ্জ চোখ তুলে একবার দেখল ছেলেকে। অবাক লাগল এটা ভেবে এতো তাড়াতাড়ি তো ঋতের ফেরার কথা নয়। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার সময় দেখল, তারপর আবার নিজের কাজে ডুবে গেল।
এখন ঘরটা থমথমে। হয়তো একটু পরেই এখানে সংসারের অতি নিবিড় সম্পর্ক পিতা-পুত্রের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে চলেছে, সেটা বর্তমান পরিস্থিতি দেখে আন্দাজ করা মুশকিল। এটাই হয়, প্রলয়ের আগে চরাচরে নেমে আসে চরম শান্তি। থমথমে আর গুমরে থাক ছাই চাপা আগুনেই গর্ভস্থ থাকে চরম বিপর্যয়ের ভ্রূণ।
হাতের দলাপাকা কাগজটাকে ঋতব্রত ছুঁড়ে মারল বাবা নিকুঞ্জর দিক। নেশায় তা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল। কাগজটা তুলে নিয়ে ঋতব্রত ফের ছুঁড়ল নিকুঞ্জের দিকে। এবার কাগজটা গিয়ে লাগল নিকুঞ্জের মুখে। কাগজটা মুখে লাগার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল চোখ-মুখ।
সরাসরি ঋতের দিকে প্রশ্ন করল নিকুঞ্জ-
-- কি চাই?
-- কাগজটা খুলে দেখ্
এটা নতুন কিছু ঘটনা নয়, এর আগে বহুবার নিকুঞ্জকে তুই তোকারি করেছে ঋত। দলা পাকানো কাগজটায় তেলের ছপছপ দাগ। কাগজটা খুলে নিকুঞ্জ বুঝতে পারল কেন একটু আগে চোখ-মুখ জ্বালা করছিল। কাগজটায় ঝাল-মটরের লঙ্কা গুঁড়ো লেগে রয়েছে। সম্ভবত এই কাগজটাতে ঝাল-মটর রেখে মদ্য পান হচ্ছিল সাগরেদদের সঙ্গে।
কাগজটার ভেতরে নিকুঞ্জর দেওয়া সেই বিজ্ঞাপন। এতক্ষণে ঋতের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কারণটা বুঝতে পারল নিকুঞ্জ। কাগজটা সরিয়ে নিজের কাজে ফের ফিরে গেল সে।
বাবাকে নিরুত্তাপ দেখে ঋত ঝাঁঝিয়ে উঠল-
- কি হল? ওটা কি?
- তুমি ঠিকই ধরেছ, এটা একটা বিজ্ঞাপন।
- বিজ্ঞাপন! না আমার সুইসাইড নোট? এর চেয়ে জন্ম দিয়েই কেন আমাকে মেরে ফেলা হয় নি?
- কোন বাবা-মা তাদের সন্তান কে মেরে ফেলতে চায়? তুমি তো জানো তোমাকে জন্ম দিতে গিয়েই তোমার মা মারা গিয়েছিলেন।
- আমাকে! আমি যতটুকু জানি সে তো চিররুগ্না।
- বাঃ। সাবাস। আমি অবাক হচ্ছি..
- আমি অবাক হচ্ছি,তার কথা আসছেই বা কেন! দাঁত দাঁত চেপে কথা কটা বলল ঋত, অভিযোগ করল --
- জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যে মা ছেলেকে অনাথ করে! মাতৃস্নেহ যে কি, সে তো আমি বুঝলামই না।
মদের নেশায় ঋতব্রতের কথা গুলো স্পষ্ট হচ্ছিল না। তবে নিকুঞ্জের বুঝে নিতে খুব একটা কষ্টও হচ্ছিল না। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সে বলল--- - আমি একটুও অবাক হচ্ছি না, একথা তোমার পক্ষেই বলা সম্ভব। আমি মানছি তোমার
মা ছিলেন না কিন্তু আমি তো আমার সবটুকু দিয়ে তোমার মা-বাবা দুই হওয়ার চেষ্টা করে গেছি।
- হুঁঃ, চেষ্টা করে গেছ, ঐ পর্যন্ত।
- হ্যাঁ চেষ্টা, চেষ্টাটাই শেষ কথা ঋত। তুমি তো কোনোদিন সেটুকুও করলে না। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছ কোনোদিন! মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। এই যে তোমার নাম ঋতব্রত, অর্থাৎ সত্য বলাই যার ব্রত। ঐ নামটি একদিনে হয়ে ওঠা যায় না। ওটাও একটা চেষ্টা। এমনকি সন্তান হয়ে ওঠাও একটা চেষ্টা।
--- যেমন বাবা হয়ে ওঠাও একটা চেষ্টা। হুঁঃ আর সে চেষ্টায় তুমি "কলম্বাসের কলকে"। যখন তুমি তোমার সম্পত্তি আমাকে দিতে চাইছ না তখন কিসের বাবা,কিসের চেষ্টা!
--- তুমি ভুল করছ ঋত, এ সম্পত্তি আমার নয়। আমার গুরুদেবের। তিনি বুঝেছিলেন তার সারা জীবনের সঞ্চয়কে সঠিক ভাবে মানুষের জন্য ব্যবহার করতে পারব আমি। তাই তিনি সেই গুরুদায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছেন। তিনি যে পথে আমাকে দিয়ে গেছেন আমি সেই পথে আর একজন সৎ মানুষের সন্ধান করেছি মাত্র।
--- তা সেই পথটি কি?
--- সে তোমার জেনে লাভ কি!
---তুমি তো লাভ লোকসানের কারবারি নয় বাবা। না কি আদপে পথ-টথ সব ঢপের চপ।
--- গুরুদেব বলেছিলেন লিপ ইয়ারের ঊনত্রিশে ফেব্রুয়ারি, রাত তিনটে পনের মিনিট একুশ সেকেন্ডে যে জন্মগ্রহণ করে সে সত্যবাদী হয়, পরকল্যানকামী হয়। কারণ ঐ লগ্নে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান হেতু এক অমৃতযোগ সৃষ্টি হয়। তার প্রভাবে জাতক অন্যদের থেকে অনন্য হয়। তার হঠাৎ করে প্রভূত সম্পদ প্রাপ্তি ঘটে এবং তার জন্মগত গুন দিয়ে সে সেই সম্পদকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করে। তাই বিজ্ঞাপনে ঐ লগ্নের জাতকের খোঁজই একমাত্র পথ।
--- আমি গ্রহ-নক্ষত্র, লগ্ন-তিথি এসব বুঝি না।আমি একটি সহজ সত্য বুঝি পিতার সম্পদে পুত্রের অবারিত অধিকার। তা তুমি কি তোমার ঐ গুরুদেবের অবাঞ্ছিত সন্তান? আমার ঠাকুমার শয্যায় কোন লগ্নে তার আগমন?
--- ঋতব্রত আমি তোমাকে অনেক সহ্য করেছি, আমার মা বা গুরুদেব সম্পর্কে আর একটি কথা বললে..
--- ঠিক আছে তোমার যখন আপত্তি আমি ঠোঁটে আঙুল দিলাম। তা পিতৃদেব বিজ্ঞাপনের নামে আমার কত নম্বর ভাই এর খোঁজ চলছে এটা। মানে তোমার কত নম্বর অবৈধ সন্তানের?
--- ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তুমি এতো নিচে নামতে পারলে! তোমার জন্মের পর যখন তোমার মা মারা গেলেন তখন আমার পূর্ণ যৌবন,স্বচ্ছন্দে অন্য কাউকে জীবনে গ্রহণ করতে পারতাম। করি নি তোমার কথা ভেবে। পরিবার পরিজনের সব অনুরোধ সরিয়ে রেখেছিলাম এই ভেবে যে আসবে সে যদি তোমাকে সহজ ভাবে না নেয়। আমারও শরীর ছিল,তারও চাহিদা ছিল। আমি সবকিছু ত্যাগ করেছিলাম সে কি শুধু এ জন্য!
--- ওসব ভারি ভারি কথা তোলা থাক বাবা। তুমি ঐ সব রিপ্লাইয়ের কাগজ গুলো আমাকে দাও। আমি তোমার একমাত্র সন্তান এটাই একমাত্র কথা, তোমার সব সম্পত্তি আমার এটাই শেষ কথা। দাও কাগজ গুলো দাও। ঋতব্রত কাগজগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হামলে পড়ল নিকুঞ্জের উপর। নিকুঞ্জ অতি দ্রুত নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলতে চাইল কাগজপত্তর গুলোকে। বাপ বেটার চোর পুলিশ খেলা দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চলানন্দের ছবিটা। মদের নেশায় শরীর অশক্ত ও অবশ তবুও সাধ্য মতো চেষ্টা করছে ঋত। হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে পড়ল ধপাস্ করে। নিকুঞ্জ চেয়ে দেখে সে মশারি ভেঙে সোজা পড়েছে মেঝেতে। মাটির মেঝে তাই বিশেষ আঘাত লাগে নি। হাত লেগে কাল সকালের জন্য রাখা পান্তা ভাত ছড়িয়ে গেছে চারপাশে। বৌ-টা ঘুমিয়ে আছে বেঘোরে। হারিকেনের বাতিটাকে একটু বাড়াল নিকুঞ্জ। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা বলছে এখন রাত তিনটা বেজে পনের মিনিট হয়ে একুশ সেকেন্ড। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কোমরে হাল্কা ব্যথা পেল নিকুঞ্জ। ব্যথাটা সামলে কোন রকমে তক্তপোশর নিচ থেকে বের করল বিয়েতে পাওয়া ট্রাংকটাকে। বাপের তৈরি কোষ্ঠীটা আজ পর্যন্ত ভালো করে কোন দিন দেখা হয় নি। শুনেছিল তার লিপ ইয়ারে ঊনত্রিশে ফেব্রুয়ারি তবে জন্ম লগ্নটা জানা নেই।
Comments
Top
উৎসর্গ
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
আজ সিধু বাউরির ছুটি। নিদিষ্ট কোন ছুটি নয় হঠাৎ করে পাওয়া ছুটি। আজ সে রোদে রোদে ফেরি নিয়ে বার হবে না। সিধুর ঝাঁকায় সব পাবেন, একটা সংসারের টুকিটাকি যা যা দরকার চামচ, চাটু, হাতা, হাঁড়ি, বাটি, ঘটি, বটি, ছানতা, ছুরি, চুলের ক্লিপ, মাথার চিরুনি, মশলার ডিবে, সাবান কৌটো সব সবই।
অদ্ভুত একটা সুরে হাঁক পেড়ে গাঁ-গঞ্জে ফেরি করে বেড়ায় সিধু।
সেই ফেরিতে মাথায় অভ্যস্ত পাগড়ি, রোদে পুড়ে-আমা ইঁটের মতো কালচে লাল গায়ের রং, পায়ের জুতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে গোড়ালি ছুঁয়ে যায় মাটি।
গাছের ছায়ায় ঝাঁকা নামিয়ে এক মুহূর্তের বিশ্রাম।
তারপর আবার সেই সুর দিয়ে হাঁক-
"সংসারের সোব জিনিস ছেলো, ভালো ভালো জিনিস ছেলো, হাতা ছেলো, মাথায় দেওয়া ফিতে ছেলো,মেয়ে মানসের আলতা ছেলো...।"
আজ একটু বিশ্রামের আশা জেগেছে সিধুর মনে। তার বারবার মনে হচ্ছে এবার একটু বিশ্রাম মিলবে, মিলবেই।
কমলা, সিধুর বউ। রগ উঠা, হাড়সার শরীরে একটা কাপড় জড়ানো অবয়ব। রোজ সকালে হাটপাড়ায় যায় ব্যাঙ্ক বাবুদের রান্না করতে।
আজ সিধু বাউরির ছুটি। নিদিষ্ট কোন ছুটি নয় হঠাৎ করে পাওয়া ছুটি। আজ সে রোদে রোদে ফেরি নিয়ে বার হবে না। সিধুর ঝাঁকায় সব পাবেন, একটা সংসারের টুকিটাকি যা যা দরকার চামচ, চাটু, হাতা, হাঁড়ি, বাটি, ঘটি, বটি, ছানতা, ছুরি, চুলের ক্লিপ, মাথার চিরুনি, মশলার ডিবে,সাবান কৌটো সব সবই।
অদ্ভুত একটা সুরে হাঁক পেড়ে গাঁ-গঞ্জে ফেরি করে বেড়ায় সিধু।
সেই ফেরিতে মাথায় অভ্যস্ত পাগড়ি, রোদে পুড়ে-আমা ইঁটের মতো কালচে লাল গায়ের রং, পায়ের জুতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে গোড়ালি ছুঁয়ে যায় মাটি।
গাছের ছায়ায় ঝাঁকা নামিয়ে এক মুহূর্তের বিশ্রাম।
তারপর আবার সেই সুর দিয়ে হাঁক-
"সংসারের সোব জিনিস ছেলো, ভালো ভালো জিনিস ছেলো, হাতা ছেলো, মাথায় দেওয়া ফিতে ছেলো,মেয়ে মানসের আলতা ছেলো...।"
আজ একটু বিশ্রামের আশা জেগেছে সিধুর মনে। তার বারবার মনে হচ্ছে এবার একটু বিশ্রাম মিলবে, মিলবেই।
কমলা, সিধুর বউ। রগ উঠা, হাড়সার শরীরে একটা কাপড় জড়ানো অবয়ব। রোজ সকালে হাটপাড়ায় যায় ব্যাঙ্ক বাবুদের রান্না করতে।আর একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। মা-বাবা বাড়ির সবাই মঞ্চে গিয়ে বসবে শুধু দিদিটাই যা থাকল না- কথাটা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল বুধনের।
অবশ্য উজ্জ্বলা বলেছে,রান্না সেরে যত তাড়াতাড়ি ফেরা যায় তার চেষ্টা সে করবে।র
মাঠ ভর্তি লোকজন। সারা বাউরি পাড়াতো বটেই, পাশের দু দশটা গ্রাম থেকে মেয়ে মদ্দ এসে হাজির হয়েছে পলাশচক সত্যসরণ হাইস্কুলের মাঠে।
মঞ্চে গণ্যমান্য অতিথিদের মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে বুধনের মা-বাপ।
বুধনের জীবন সংগ্রামকে ভাবে-আবেগে কাব্যময় করে তুলছেন মাস্টার মশাইরা। সে সব কথা বুধনের কানে এসে পৌঁছচ্ছে না। তার চোখ দুটো মাঠের ভিড়ে হারিয়ে গেছে।
সাংবাদিকরা বুধনকে প্রশ্ন করল-
- কেমন লাগছে এই সাফল্যে?
- ভালো।
- তোমার লক্ষ্য কি?
- দিদির একটা সুন্দর বিয়ে।
- না মানে,বড় হয়ে কি হতে চাও?
- সেটা তো ভাবা হয় নি।
- এই সাফল্যের পেছনে কারা?
- সব্বাই। বাবা-মা-দিদি, মাস্টার মশাই, দিদিমণি সব্বাই।
- সবচেয়ে বেশি অবদান কার?
আশুবাবুর মুখ চকচক করছে, চেয়ারে বসা নেতাটি বুধনের মায়ের রান্নার কাজ ঠিক করে দিয়েছিল, সে ও আশায় বুক বেঁধেছে। হেডমাস্টার মশাই সারা বছর ফি নেন নি, তিনি আশায় আছেন। বুধন তার নাম বলুক। তা হলে আগামী বছরে শিক্ষারত্ন বাঁধা।
বুধনের চোখ দুটো মাঠের ভিড়টাকে হাতড়াচ্ছে। চোয়ালটা ধীরে ধীরে শক্ত হচ্ছে। হঠাৎই কি যেন একটা খুঁজে পাওয়ার আনন্দে তার মুখটা খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল। হাতটা লম্বা করে তুলে ভিড়ে মিশে যাওয়া একটা মুখকে নির্দেশ করল বুধন। তার তর্জনীর নির্দেশে সেই মুখ, যে মুখ- দিদি হয়েও মায়ের, আত্মত্যাগের আবার অনুপ্রেরণার, সাধারণ হয়েও অনন্য, কিম্বা শুধুই উৎসর্গের।
ততক্ষণে বুধনের হাতে মাইক দেওয়া হয়েছে, সে বলছে-
- এই সাফল্য আমার নয় আমার দিদির। আমি যখন খুব ছোটো তখন দেখেছি লন্ঠনের আলোয় আমার দিদি লেখাপড়া করত। তখন তো নিষ্ঠা বুঝিনি, অভাব বোঝার বয়স হয় নি তাই সংগ্রামও বুঝিনি।
আসলে সে ছিল আমার দিদির এক নীরব সংগ্রাম। আজ আপনারা আমাকে সংগ্রামের সৈনিক বলছেন, সংগ্রামের প্রথম পাঠ আমি ওর থেকেই নিয়েছি, আমার দিদিই বুঝিয়েছে নিষ্ঠা কি।
অভাবের সংসারে দিদির আর আমার লেখাপড়ার খরচ বাবা আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। শরীরের সবটুকু পরিশ্রম সে সামর্থ্য জোগাড়ে হয়েছিল ব্যর্থ।
দিদি বাবাকে বলেছিল-
-" আমি লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছি বাবা। তুমি বুধনকে পড়াও। ওর মাথাটা বড্ড ভাল। দেখো একদিন ও পলাশচকের নাম উজ্জ্বল করবে।"
একজন সৈনিক যুদ্ধ করতে করতে নিশ্চিত জয় জেনেও যখন যুদ্ধ বিরতি মেনে নেন, তার যে মানসিক কষ্ট সেই কষ্টই আমি সেদিন দেখেছিলাম আমার দিদির চোখে-মুখে।
সেদিন আমার দিদি তার লেখাপড়াকে বলি না দিলে আমি এখানে আসতেই পারতাম না।
বুধনের শেষকথা গুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল কান্নায়।
উজ্জ্বলার এতোবড় একটা উৎসর্গ,এই মহান ত্যাগ, আকাশের মতো বিশাল মনটার খোঁজ পেয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে ভিড়টা। জয়ধ্বনি দিচ্ছে সবাই সমস্বরে। হাতে হাতে সে উঠে এসেছে ভিড়ের মাথায়,শোভা পাচ্ছে মুকুটের মতো। লজ্জা আর অহংকার দুই মিলেমিশে অনন্য করে তুলেছে তার মুখখানি।
যে মুখখানি ভিড়ের মধ্যে আলাদা করা যায় না। সাধারণের থেকেও সাধারণ। শুধু চিনে নিতে হয়, খুঁজে নিতে হয়।
Comments
Top
আব
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
চট, ত্রিপল,বাঁশ, বাটাম, দড়ি-দড়া আলগোছে পড়ে। ফুলওয়ালা ছাদনা তলা সাজাচ্ছে। একটা হলদেটে রঙের পলিথিন পেপারে ডাই করে রাখা রজনীগন্ধা। গোলাপ ফুলগুলো কাঁটা জাগিয়ে পলিথিনের একটা কোনে নির্লিপ্ত পড়ে। মোবাইলের হেডফোন কানে গুঁজে কাজ করতে করতে ফুলগুলোর উপর জলের হালকা ঝাপটা মারল ফুলওয়ালা ছোকরাটা। একটা ধোগড়া ছু্ঁচে পরপর ফুল গুলোকে গাঁথছে ছোকরা।
বাঁশের মাচার উপর বসে বিড়ি ফুঁকছে বাবলু।
ধীমান চোখ থেকে চশমা নামিয়ে, চশমাটা কাপড়ের খুঁটে মুছছে। এরই ফাঁকে চোখ জোড়া পায়চারি করে এল চারদিক। দায়িত্ব নেয়াটাই শেষ কথা নয়, কাজটাকে চোখে চোখে রাখা সবচেয়ে বড় কথা।
ধীমান শ্রীতমার বড় কাকা। সপ্তাহ খানেক তার ব্যস্ততার শেষ নেই। আর হবেই না বা কেন, তিন ভাইয়ের ঘরে একমাত্র মেয়ে শ্রীতমা।
কত দেখা দেখি, পছন্দ অপছন্দের বেড়া টপকে পাত্র পাওয়া গেছে। পাল্টি ঘর, ওরাও খুঁজছিল বনেদী পরিবার। হিজলপুরের পাশের ব্লক নেতাইচকে পাত্রের আদি বাড়ি। সুবিমল বাবুর জলপাইগুড়িতে চা বাগান আছে। রীতেশ সুবিমল বাবুর একমাত্র ছেলে। তিন বারের চেষ্টায় বি.এ পাশ দিতে পারে নি বটে। তবে তাতে কি যায় আসে, মস্ত বড় বড়লোক রীতেশরা। রীতেশের সঙ্গে শ্রীতমার ঠিকুজির মিলও হয়েছে রাজযোটক। হাতের কাছে এমন সুযোগ কোনো পক্ষই হাতছাড়া করতে চায় নি। তাই চটজলদি বিয়ের বন্দোবস্ত।
- 'বাবলু বাবা একটু তাড়াতাড়ি কর, এভাবে এগোলে বউ ভাতের পরের দিনেও কাজ শেষ হবে না।'
চশমাটাকে নাকের আগায় রেখে, ভ্রু-জোড়া কপালে তুলে কথাগুলো বলল ধীমান। বিড়িতে একটা লম্বা টান দিল বাবলু, ধোঁয়াটা গোল গোল করে ভাসিয়ে দিল বাতাসে।
বাঁশের মাচা থেকে ঝুপ করে নামল ধীমানের গায়ের কাছে। নিজেকে একটু সরিয়ে নিল ধীমান। বাবলুর পা দুটো নরম মাটিতে সামান্য বসে গেল।
সে দিকে ইঙ্গিত করে বাবলু বলল-
- 'কাকা দেখছো তো অবস্থা- পা বসে যাচ্ছে, সকালে ঐ বৃষ্টিটা না হলে এতক্ষণে কাজ কমপ্লিট হয়ে যেতো।'
বাবলুর গলায় গামছাটা শৌখিন ভাবে জড়ানো। নয় নয় করে বছর সাত হয়ে গেল এই লাইনে। এখন ডেকোরেশন এর পাশাপাশি রান্নার সাজ সরঞ্জামও ভাড়া দেয় কাত্যায়নী ডেকোরেটার্স। মায়ের নামে নাম রেখেছে বাবলু। নেই নেই করে আরো পাঁচ-ছয়টা বাড়ির হাড়ির দায় কাত্যায়নী ডেকোরেটার্স এর ঘাড়ে। হারুন, মন্টা, ঝড়ু, নান্টু এরা বাবলুর পারমান্যান্ট এমপ্লয়ি। কাজ নিয়ে আজ পর্যন্ত কারো কাছে কথা শুনতে হয় নি বাবলুকে। সময়ের আগে কাজ শেষ করে দড়ি-দড়া গুছিয়ে পাটিকে নিশ্চিন্ত করেছে বরাবর।শুধু তার নিজের গ্রাম হিজলপুর নয় পাঁচ গ্রামে তার কাজের সুনাম আছে। নিজে মালিক হলেও হেড মিস্ত্রি সে। কোথায় ভাল কাপড় লাগাতে হবে, কোন জায়গাটা খুব একটা লোক জনের নজরে আসবে না অথাৎ পুরানো, রং চটা কাপড়ে ম্যানেজ হয়ে যাবে মেশিনের মতো নির্ভুল কষে নিতে পারে বাবলু। ধীমানদের বড় পুকুরের ডান পাড়ে মাটির বাড়ি ছিল বাবলুর বাপের। ধীমানের ঠাকুরদা বাবলুর ঠাকুরদার বাপকে পুকুর পাড়ে বসিয়েছিল কোর্ফা প্রজা হিসাবে। বছর পাঁচ হল মাটির বাড়ি ফেলে পাকা বাড়ি বানিয়েছে বাবলু।
ধীমানরা তিন ভাই। বড় ধীরেশ-শ্রীতমার বাবা, মেজ ধীমান আর ছোট ধৃতেশ।
এককালে হিজলপুরের জমিদার ছিল ধীরেশদের ঠাকুরদা। সেই জমিদারির ভাগ বাটোয়ারায় ধীরেশদের বাপও পেয়েছিল বিঘা সত্তর। বামফ্রন্টের ভূমি সংস্কার কেড়ে নিল সব জমি জমা।
এখন নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবে না অবস্থা। পুরানো দালান গুলো বিপদজনক ভাবে ঝুর ঝুর করে ঝরছে। অবস্থার ফের, শরিকি ঝামেলায় জেরবার অবস্থা।
ধীমান বিয়ে থা করে নি। একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। তিন ভাইয়ের জোড়া সংসার,তবে সংসারের সব দায় এক প্রকার ধীমানের। শ্রীতমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে ধীমান, লেখাপড়া আদর আবদার সবই পূরণ করেছে সে। সে দিক থেকে ধীমানই কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা বললে কম বলা হবে।
এর মধ্যে ছেলের বাড়ি থেকে হলুদ নিয়ে ছেলের বাড়ির লোক এসে হাজির।
হাতের কাজ ধরা রইল হাতে, বাবলু লোক গুলোকে দেখতে থাকল উল্টে পাল্টে।
- 'আসুন, আসুন। পথ চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?'
ধীমান আদুরে গলায় কথা গুলো বলতে বলতে ওদের নিয়ে সোজা চলে গেল অন্দরমহলে। বাবলুর নির্লজ্জ চোখ দুটো জানালা-দরজা টপকে সোজা চলে গেছে শ্রীতমাদের ভিতর বাইরে। এ বাড়ির প্রতিটা ইঁটের খবর সে জানে।গায়ে হলুদ ব্যাপারটাই কেমন যেন অসভ্য অসভ্য। এবার তুমি অন্যের শয্যা সঙ্গিনী হবে তার জন্য শরীরের আনাচ কানাচের ময়লা, গন্ধগুলো সরিয়ে ফেলো। তাও নিজে সরালে কথা ছিল না। শ্রীতমার শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পাঁচ জনের দশটা হাত। লালপাড় শাড়িটা হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। কাঁচা হলুদে পায়ের গোছ দুটো হয়ে উঠেছে আরো আকর্ষণীয়। ফর্সা চওড়া পিঠে লেপ্টে গেছে হলুদ, ঘাড়ের কাছের চুলগুলোতেও হলুদের ছোপ। যতবার ঘাড়ের কাছে হলুদ মাখা হাত যায় ততবারই শিহরণে শ্রীতমার ঘাড় বেঁকে যাচ্ছে বারে বারে। নিজের অজান্তে গামছার তলা দিয়ে হাত চলে গেছে ঘাড়ে। সরে গেছে গামছা। হাতটা উঁচু বির মতো আবটার উপরে যেতে সম্বিৎ ফিরে পায় বাবলু। ঘাড়ের কাছে কুমড়োর মতো ঝুলে থাকা আবটা সবসময় গামছার আড়ালে লুকিয়ে রাখে
বাবলু। জন্মের সময় থেকে বাপ দুটো জিনিস দিয়ে গেছে তাকে অনটন আর ঘাড়ের উপর জন্ম বোঝা ঐ আবটা। শৈশব থেকে দুটোই বাড়তে শুরু করে। বড় হয়ে নিজের চেষ্টায় অনটনকে বাগে আনতে পারলেও আবটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি বাবলু। শরীরবৃত্তীয় এসব জিনিস কতটাই বা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব খাদ্যগুণ বোধহয় একাই শুষে নিয়েছে আবটা। একটু একটু করে বড় হয়েছে আর তাকে করে তুলেছে বিকৃত দর্শন। এই আবটাতে তার তো কোনো হাত ছিল না অথচ আবটার জন্য ছোটবেলা থেকে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ পিছু ছাড়ে নি তার। কতবার বন্ধু বান্ধবের কাছে খোরাক হয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছে বাবলু। মা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছে-- 'সবাই তো আর রাজপুত্তুর হয়ে জন্মায় না বাবা। ভগবান গনেশকেও তো হাতির মতো দেখতে। তবুও তো সবাই তাঁকে পুজো করে। দেখবি একদিন তোকেও সবাই ভালবাসবে।'
সে সব সময় মায়ের কথায় বাঁচবার শক্তি পেয়েছে বাবলু। আজ অবস্থা ফিরেছে। পাকা ঘর, কিছু জমি জমাও হয়েছে কিন্তু ভালবাসার মানুষটি জোটে নি। মাঝেমাঝে বাবলুর মনে হয়, কি লাভ এতো খাটা-খাটুনি করে? এতো টাকা পয়সা কার জন্য, কিসের জন্য রোজগার করা! কত বিয়ের মণ্ডপ সাজিয়ে ফেলল সে। অথচ তার বিয়েটাই হলো না। শুধু মাত্র বিকৃত আবটার জন্য তাকে কেউ পছন্দ করে নি আজ পর্যন্ত। এমনকি তার ছোটবেলার খেলার সঙ্গীও কদিন আগে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আতঙ্কে। ছোটবেলা বাবলুর খেলার সঙ্গী ছিল শ্রীতমা। কাত্যায়নীদেবী যখন জমিদার বাড়ি মুড়ি ভাজতে যেত তখন বাবলুর বয়স ছয় বা সাত। অতো ছোটো বাচ্চাকে তো আর ঘরে ফেলে আসা যায় না। সঙ্গে নিয়ে যেত কাত্যায়নী। মা যত সময় মুড়ি ভাজত তত সময় বাবলুই ছিল শ্রীতমার খেলার সঙ্গী। শৈশব তো আর রাজা-প্রজা বোঝে না, সুন্দর-অসুন্দর দেখে না। শৈশব ছেলেখেলার সময়। মন যাকে ধরে তার কাছে সব সময় থাকতে চায়। কখনও কখনও জমিদার কন্যা চলে আসত বাবলুদের মাটির ঘরে। বাবলু ও শ্রীতমার ভালবাসা শৈশব পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কৈশোরে। বাবলুর লেখাপড়া না হলেও শ্রীতমার স্কুল গেটে রোজদিন সাইকেল নিয়ে হাজির হয়ে যেত সে।সে দিন সন্ধ্যা গাঢ় হয়েছে, ধীমান ইষ্ট দেবতাকে ঠাকুর শীতল দিতে যাচ্ছিল। নাটমন্দিরের অন্ধকার ভেঙে কার যেন গলা শুনতে পেল ধীমান। এগিয়ে গিয়ে প্রদীপের নরম আলোয় যা দেখেছিল তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করত না ধীমান। তার স্নেহ ভালবাসাকে নোংরা করছে তাদেরই আশ্রিত কোর্ফা প্রজা। সেদিন রাতে বাপ মরা বাবলুকে ধীমানরা তিন ভাই মেরেছিল বেদম। ঘরের খড়ের চালে আগুন লাগিয়ে বেঘর করতে চেয়েছিল ওদের। কাত্যায়নীদেবী হাতে পায়ে ধরে শেষ রক্ষা করেন। তবে ধীমান বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা আজও জমিদার আর ওরা কোর্ফা প্রজা। তারপর থেকে আর কোনো দিন বাবলু জমিদার বাড়ির আনাচ কানাচ দেখেনি। পথে ঘাটে আর পাঁচ জনকে এড়িয়ে খুব সতর্কতায় কখনো সখনো দেখে নিয়েছে শ্রীতমাকে। রাজা, প্রজা এই শব্দগুলো ডিঙিয়ে তার মন থেকে থেকে ভেসে বেড়িয়েছে তার ফেলে আসা শৈশবে। সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে- ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল তাদের উঠোনে, ছোট্ট একটা ঘোমটা শরীর শাঁখ বাজাচ্ছে তুলসীতলায়। প্রদীপের আলোয় সেই ঘোমটা ভেঙে বারবার ফুটে উঠেছে শ্রীতমার মুখ।আবটা যতই একটু একটু করে বড় হয়েছে আর ততই স্বপ্নদৃশ্যগুলো অস্থির করেছে বাবলুকে।একদিন বাবলু স্নান করছিল বড় পুকুরে, শ্রীতমা যাচ্ছিল স্কুল। অসাবধানতায় গামছা সরে যায় আবের উপর থেকে আর তা দেখে আঁতকে উঠেছিল শ্রীতমা। তারপর থেকে শ্রীতমা যত সুন্দরী হয়েছে ততই গামছার আড়ালে আবটাকে ঢাকতে তৎপর হয়েছে বাবলু।আজ সেই শ্রীতমার বিয়ের প্যান্ডেল সাজাতে হচ্ছে তাকে। অনিচ্ছায় আচ্ছন্ন সে, হাত চলছে না তবুও একপ্রকার জোর করেই করতে হচ্ছে। ঝলমল করছে সন্ধ্যা। অতিথি অভ্যাগতরা আসতে শুরু করেছে। মাচায় বসে সানাই বাজাচ্ছে জন তিনেক লোক। জমিদারের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আলোকিত প্যান্ডেল ফুটে উঠেছে বড় পুকুরের জলে। পুকুরের ডান পাড়ে দাওয়ায় বসে আছে বাবলু।তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন-পান দিয়ে ঢাকা শ্রীতমার মুখ। বেনারসী, গা ভরা গহনা, ফুলের সাজ, রঙীন আলো অপরূপা করে তুলেছে তাকে। তসরের ফিনফিনে পাঞ্জাবির উপর থেকে স্পষ্ট প্রতীয় মান আবটা। শ্রীতমার পরিয়ে দেওয়া রজনীগন্ধার মালায় ঢাকা পড়ে গেছে বাবলুর আবটা। হোমের আগুনকে প্রদক্ষিন করছে বাবলু ও শ্রীতমা। আশীর্বাদী ধান দূর্বা ছুড়েছে ধীমান, ধীরেশ আর ধৃতেশ। একটা বিড়ি বের করল বাবলু। বিড়িটাকে ধরানোর আগে দু- আঙুলে হাল্কা দোলে নিল বাবলু। নেমে এল দাওয়া থেকে। বিড়িটা ধরিয়ে আগুনটা গুজে দিল প্যান্ডেলের কাপড়ে। আর দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিল দাওয়ায়। দাউদাউ করে জ্বলছে প্যান্ডেল। বড় পুকুরের জলে ধরা পড়া আলোকিত ছবিটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। বালতি, কলশি, গামলা যে যেভাবে পারে জল ছুড়ে দিচ্ছে আগুনে। দানবের মতো দাউদাউ করে জ্বলছে প্যান্ডেলের সিন্থেটিক কাপড়, কাঠ -কাঠামো। উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে ধীমান। শ্রীতমার চন্দন সাজ ধুয়ে গেছে চোখের জলে। রক্ষণশীল পাত্র পক্ষ এই অশুভ ঘটনাকে আরো বড় কিছু দুর্ঘটনার পূর্বাভাস ধরে নিয়ে ফেরার তোড়জোড় শুরু করছে। সুবিমলবাবুর হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করছে ধীরেশ। পুকুরের ডান পাড়ে দাওয়ায় বসে আছে বাবলু। উল্টো দিকের জ্বলতে থাকা প্যান্ডেলের আগুনে তার ছায়া ফুটে উঠেছে দেওয়াল জুড়ে। সে ছায়ামূর্তি তে আবটাকে আরো বড়ো দেখাচ্ছে। আগুনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বাবলুর মুখ। বিড়ির আগুনে সে মুখ জ্বলছে নিভছে আশার দোলাচলে। শ্রীতমাকে লগ্ন ভ্রষ্টার অপবাদ থেকে মুক্তি দিতে একটু পরেই যে বর সাজে সাজতে হবে তাকে।
Comments
Top
এক্সচেঞ্জ
অফার
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
ভীড়টা এড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল ঊর্মী। এখন শুধু জোড়হাত করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সময়ের অপেক্ষা।
এই মন্দিরের পুরোহিত মোহিত মুখুজ্জে ঊর্মীর বাবার বন্ধু।
একবার চোখাচোখি হলেই আগে পূজো দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে ঊর্মী।
এভাবে সুযোগ নিতে চায় নি সে, মনের ভেতরে একটা আশঙ্কা প্রশ্রয় পাচ্ছিল থেকে থেকে।
কৃচ্ছ সাধন ছাড়া কি তিনি তুষ্ট হবেন! নাটমন্দিরে থকথকে ভিড়টা দেখে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল ঊর্মীর।
এমনিতেই সকাল থেকে নির্জলা।
সোজাপথে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে কমপক্ষে আরো ঘন্টা চার লাগবে।
অতটা সময় সে এঁটে উঠতে পারবে কি!
তাছাড়া গতবার কি এমন কষ্ট করেছিল সে। তবুওতো কোলকেনাথ তার প্রার্থনা পূরণ করেছিলেন।
সুযোগ যখন তার সামনে নিজে থেকে হাজির তাকে অবহেলা করা উচিত হবে না।
এইসব যুক্তি নির্মান করতে করতে ঊর্মী আপাতত কোলকেনাথের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কোলকেনাথ এ অঞ্চলের জাগ্রত দেবতা। শুদ্ধচিত্তে শিবচতুর্দশীতে যে বাবার মন্দিরে কোলকে চড়ায় বাবা তাকে নিরাশ করেন না। বাবা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী তাই বাবার চাহিদাও সামান্য। একছিলিম গাঁজা, কোলকে, বেলপাতা আর কাঁচা দুধ এই সামান্য নৈবেদ্যতেই তুষ্ট কোলকেনাথ।মাঝে বছর তিনেকের ইন্টারভ্যাল,
এই তিন বছর বাবার কাছে আসে নি ঊর্মী।
আসার প্রয়োজন হয় নি।
অভাব বোধ প্রবল হয় নি।
তার আগে পরপর চার বছর বাবার মন্দিরে হোত্যে দিয়েছে সে।বাবাও খালি হাতে ফেরায় নি তাকে। আজ সেই ভরসায় বুক বেঁধে আবার হাজির ঊর্মী।
বাবার কাছে মেয়ে আসবে এ আবার নতুন কি কথা।
প্রথম বার ঊর্মী যখন বাবার কাছে এসেছিল তখন সে ক্লাস এইটে পড়ে।
পরপর চারটে শিবরাত্রির কোলকে নিয়ে শীতলের সঙ্গে ঊর্মীকে ফিট করে দিয়েছিলেন কলকেবাবা।
পাত্র হিসেবে সে বাজারে শীতল চক্কত্তি হেলাফেলা করার মতো ছিল না।
সেবারও ভিড় এড়িয়ে মায়ের হাত ধরে মোহিত জেঠুর তদবিরে অনেকের আগে পূজো দিয়েছিল ঊর্মীরা। হয়তো ঐ সাত জনের আগে।
নাহলে হয়তো হাত থেকে জল গলে যাওয়ার মতো, ঊর্মীর সব বাঁধন ফস্কে বেরিয়ে যেত শীতল।
ঊর্মী যখন ক্লাস এইট, শীতলদার তখন ক্লাস নাইন। সব ক্লাসেই বরাবর ফাস্ট শীতল।
ভালো আঁকে, গানের গলাও মন্দ নয়।
গ্রামের ক্ষিরোদ মোহন স্কুলের জুয়েল ইন ক্রাউন।
এমন ছেলেকে বর হিসেবে কে না চায়।
তার উপর শীতলরাও ঊর্মীদের মতো কুলীন বামুন।
পরপর চার বছর কোলকে চড়ানো হয়ে গেছে ঊর্মীর কিন্তু কোনো ফল নেই!
এদিকে একটা কিছু ব্যবস্থা না হলে শীতল বেহাত হতে বাধ্য।
তখন শীতলের টুয়েল্ভ চলছে।
মাস দু- একের মধ্যে পাখি গিয়ে বাসা বাঁধবে কলেজে। সে অভয়ারন্যে নাকি হরিন-সিংহরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়!এক অজানা আশঙ্কায় বুক ভেঙে যাচ্ছিল ঊর্মীর।সেদিন ছিল ক্লাস টুয়েল্ভের বিদায় সভা। বারো ক্লাসের ছাত্র- ছাত্রীরা যতটা কষ্টে ছিল তার থেকে অনেক বেশী ছিল ঊর্মীর কষ্ট। এযেন দেশভাগের যন্ত্রনা। 'একই ক্ষিরোদ মোহনে বেড়ে ওঠা শীতলদার দেশটাই পাল্টে যাচ্ছে!'
বিদায় সভা শেষে বিষন্ন মনে স্কুলের লম্বা বারান্দা ধরে হাঁটছিল শীতল।
নাছোড় জেদ নিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায় ঊর্মী। চারপাশটায় ভালো করে চোখ বোলায় সে।
না কেউ নেই।
সেদিন শীতলের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে মনের কথাটা এক নিশ্বাষে বলেছিল ঊর্মী।
না বোঝা অঙ্কের বিষ্ময় নিয়ে শীতল তাকিয়ে ছিল ঊর্মীর মুখে।
ঊর্মীর চোখের পলক পড়ছিল না। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছিল রক্ত চলাচল। মুখটা সামান্য হাঁ করা, তিরতির করে কাঁপছিল ঊর্মীর ঠোঁট।
আকস্মিকতা কাটিয়ে শীতল ঐ ঘটনার দিন দুই পরে দেখা করে ঊর্মীর সঙ্গে।
একে অপরকে একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা শুরু হয়।
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে ঊর্মী বুঝেতে পারল, ভুল নামে কোলকে চড়িয়ে ফেলেছে সে।
প্রথম প্রথম ঊর্মী ভেবেছিল শীতলকে সে তার নিজের ছাঁচে ফেলে নিজের মতো করে গড়ে নেবে। চেষ্টাও যে করে নি তা নয়। কিন্তু শীতল ছিল অন্য ধাঁচার মানুষ।
মোটা দাগের হিন্দি সিনেমা একদম না পচ্ছন্দ ছিল শীতলের।
কখনো কখনো জোর খাটিয়ে হলে নিয়ে গেছে ঊর্মী।
নায়ক নায়িকা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পর্দায়।
ঊর্মী ভেবেছে সেনেমা হলের আলো-ছায়ায় এই বুঝি তার হাতে হাত রাখল শীতল। বারবারই ঊর্মীকে হতাশ করে নাক ডাকিয়ে হলে বসে ঘুমিয়েছে শীতল।
সেদিন গঙ্গার পাড়ে বসে হাওয়া খাচ্ছিল ঊর্মীরা। বাদামের ঠোঙাটা ছিল ঊর্মীর হাতে। খবরের কাগজে তৈরী ঠোঙাটার দিকে অপলক তাকিয়ে শীতল।
আসলে ঠোঙার ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল অমর্ত সেনের একটা আর্টিকেলস্।
সব চেষ্টাই বিফল হয়েছিল ঊর্মীর।
সে যাত্রায় ঊর্মীর জীবনটা যেন শিব গড়তে বাঁদর অবস্থা।
আজ আবার সে বাবার শরণাগত। সুযোগ বুঝে বাবার কাছে চেয়ে নিতে হবে বর। বাবাকে নিজের অসহায়তা বোঝাতে ভরসা সেই কোলকে। আজ শিবচতুর্দশী, আজও নির্জলা ঊর্মী।
বাবার কাছে আজ তার অনুনয়, সেদিনের সাত কোলকের কোন এক কোলকের প্রার্থনা বাবা পূর্ণ করুন আজ। সেদিনের প্রতিযোগীদের হারিয়ে, হেসেছিল ঊর্মী। আজ তাদেরই একজনকে নিজের থেকে
জয়ী করিয়ে আর একবার হাসতে চায় সে।এ বোঝা সে আর বইতে পারছে না। এক্সচেঞ্জ অফারে তার এমন এক বর জুটুক যে বাদামের ঠোঙায় ঊর্মীর হাত থাকলেও নিজের হাতটা ঠোঙায় ডোবাবে যাতে ঊর্মীর আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে যায়, সেনেমা হলের আলতো আলোয় ঊর্মীর নায়ক হয়ে উঠবে, জ্বর তপ্ত কপালে রাখবে প্রশান্তির হাত।
কোলকেবাবা তাকে নিরাশ করবেন না এতোটাই আশাবাদী ঊর্মী। কারন সব বাবাই চায় তার মেয়ে মনের মতো বর পাক।
Comments
Top
মাইনাস
শুকদেব চট্টোপাধ্যায়
রহড়া, হুগলী
কয়েকমাস হল অজয় এই ব্র্যাঞ্চে এসেছে। আগে যে সব ব্র্যাঞ্চে ছিল এটা তার থেকে অনেকটা আলাদা। আলাদা অফিসের কাজের নিরিখে নয়। ব্যাঙ্কের কাজ তো সব যায়গায় একই রকম। তফাতটা গ্রাহকদের ক্ষেত্রে। এখানে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের সিংহভাগই সিনিয়র সিটিজেন। বয়স্ক লোককে সামলান বেশ কঠিন কাজ। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, পারিবারিক, নানারকম সমস্যার কারণে এঁদের মন মেজাজ অনেক সময়েই ভাল থাকে না। পরিষেবায় এঁদের তুষ্ট করতে গেলে একটু বেশি সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। অজয়ের এই গুণটি আছে।
অজয় ক্যাশে বসে। একদিন কাউন্টারে বসে টাকা গুনছে এমন সময় কানে এল—
আরে আপনি এখানে!
তাকিয়ে দেখে আগের ব্র্যাঞ্চের এক কাস্টোমার। নাম কেশব সেন। কোলকাতা বন্দরে ডেক অফিসার ছিলেন। একবার অজয়কে ওনার জাহাজে নিয়ে গিয়ে অনেক আপ্যায়ন করেছিলেন। সেই প্রথম ও কোন জাহাজের ইঞ্জিন রুমে ঢুকেছিল।
-- এই কয়েক মাস হল এখানে এসেছি।
-- ভালই হল, নিজের লোক একজন পেলাম।
কেশব বাবুর গলায় কলার দেখে অজয় জিজ্ঞেস করল-- স্পন্ডিলাইটিস হয়েছে?
ম্লান হেসে বললেন-- ওটা তো এটা সেটা করে বাগে আনা যায়। আমার রোগটা বড় বেয়াড়া, বাগ মানে না।
কলারটা খুলে দেখালেন। গলায় একটা ফুটো করা। ক্যানসার, কেমো চলছে। যাওয়ার আগে কেশব বাবু করমদর্নের জন্য হাত বাড়াতে নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে অজয় বলল—ভাল থাকবেন।
ভদ্রলোকের গলা বসে গেছে। ক্ষীণ স্বরে বললেন— ভাল তো সকলেই থাকতে চায় ভাই।অজয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর এক দিন এক বৃদ্ধ কাউন্টারে হাত ঢুকিয়ে বললেন--- এই নাও।
অজয় জিজ্ঞেস করল— কি?
- প্রশ্ন নয়, দিচ্ছি খেয়ে নাও।
হাতে পড়ল কয়েকটা শুকনো আমলকী। এক একজন কত সহজে অপরিচিতকে আপন করতে পারে।
এক সহকর্মী পাশ থেকে বলল- ওনার বয়স প্রায় পঁচাশি।
ভদ্রলোক বেশ ধমকের সুরে বললেন— কি যা তা বলছ, পঁচাশি কবে পার হয়ে গেছে।
সুন্দর ছিপছিপে হাসিখুশি চেহারা।
-- আপনাদের দেখলেও ভাল লাগে। আসবেন মাঝে মাঝে।
-- আসব বৈকি। ভালবাসি, তাইতো আসি, বয়স যদিও অষ্টআশি।
অজয়ের মনটা খুশিতে ভরে গেল। এমন মানুষকে জোরের সঙ্গেই বলা যায় —
‘ভাল থাকবেন’।
কিছু কথা কাউন্টারে বসলে গতানুগতিকভাবে সকলকেই বলা হয়। যেমন ‘কি নোট দেব’ বা ‘টাকাটা গুনে নেবেন’ ইত্যাদি। একদিন, একজন বয়স্ক মানুষকে পেমেন্ট দেওয়ার পর, অজয় ‘টাকাটা গুনে নেবেন’ বলাতে উত্তর এল -- আমি গুনিনা ভাই। হিসেব নিকেশ করা অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। হিসেব মেলে না। এই কটা টকায় আর কত মাইনাস হবে! আমার সারা জীবনটাই মাইনাসে ভরা। এখন ফাইনাল মাইনাসের জন্য দিন গুনছি।
কথাগুলো বলে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। একটা ছোট্ট কথার কি প্রতিক্রিয়া। একে ‘ভালো থাকবেন’ বলা অর্থহীন। কারণ, মানুষটার ভাল থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেছে। মুখটা ভোলেনি। পরের মাসে টাকা দেওয়ার সময় আবার কি শুনতে হবে এই ভয়ে অজয় ওনার সাথে কোন কথা বলেনি।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন-- ভাল আছেন তো?
অজয় কেবল মাথা নেড়েই উত্তর দিয়েছিল। অজয় খুব ভাল শ্রোতা। এজন্য বৃদ্ধরা ওকে খুব পছন্দ করে। সংসারে যাদের কথা শোনার লোক কম, তারা অমন আগ্রহী শ্রোতা পেলে তার কাছে দুটো সুখ দুঃখের কথা বলে মনের ভার কিছুটা লাঘব করবে এটাই স্বাভাবিক। প্রথম দিন ওইরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলেও ওই মানুষটার সাথেও বার কয়েক দেখা সাক্ষাতের পর ধীরে ধীরে অজয়ের বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠল। ব্যাঙ্কে এলে কাজের বাইরেও একটু আধটু কথা বা গল্প গুজব হয়। কথা বাতার্তেও আগের মত অতটা হতাশা থাকে না।
এক শনিবার ব্যাঙ্কে নিজের কাজ মেটার পর ভদ্রলোক অজয়কে বললেন
-- আজ অফিসের পরে তুমি ফ্রি আছ ভাই?
-- তেমন কোন কাজ নেই। কেন বলুন তো?
---আমার বাড়িতে যাবে? বাড়ি বেশি দূরে নয়। আর তোমাকে বেশিক্ষণ আটকাব না।
বুড়ো মানুষ অমন করে বললে মুখের ওপর না বলা মুশকিল।
-- ঠিক আছে, আপনি একটু বসুন আমি কাজ শেষ করে আসছি।
অজয় মানুষটার মুখে একটা খুশির ভাব লক্ষ্য করল।
ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে রিক্সয় চেপে ভদ্রলোকের বাড়ি পৌঁছাতে মিনিট সাতেক লাগল। দোতলায় দু কামরার একটা ফ্ল্যাট। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন।
-- বস, আমি একটু কফি করে আনি।
-- না না থাক না।
-- তোমার অস্বস্তির কোন কারণ নেই। রান্না বান্নায় আমি বহুদিন থেকেই অভ্যস্ত। এতো সামান্য কফি। বস, আমি এখনি আসছি।
অজয় সোফায় বসে ঘরের চারধারটায় একবার চোখ বোলাল। আসবাবপত্রগুলো বেশ রুচিসম্মত। আলমারি আর র্যাকেতে প্রচুর বই। দেওয়ালে কয়েকটা ছবি টাঙান। একটাতে দুটি শিশু গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটা ছবিতে যৌবনকালে ভদ্রলোক এবং পাশে মনে হয় ওঁর স্ত্রী, আর দুজনের কোলে দুটি বাচ্চা। আর ওই মহিলারই একটা বড় ছবি পিছন দিকের দেওয়ালে রয়েছে। বেশ সুন্দরী। আর দরজার ঠিক মাথায় মাঝবয়সী এক ভদ্রলোকের ছবি।
একটু বাদে দু কাপ কফি আর একটা প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন।
-- এখানে আপনি একাই থাকেন ?
-- হ্যাঁ ভাই, সাথে তো আর কাউকে রাখতে পারলাম না।
-- আপনি কি অবিবাহিত ?
-- আমার জীবনটা বড় বিচিত্র ভায়া।
-- কি রকম ?
-- বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই তো ?
-- সেরকম কিছু নেই। সন্ধ্যের দিকে গেলেই হবে।
-- জানি না কেন এই প্রথম কারো কাছে আমার জীবনের ঘটনা বা দুর্ঘটনাগুলো জানাতে মন চাইছে। তুমি তো একটু আধটু লেখালিখি কর, দেখ হয়ত গল্পের কিছু রসদ পেলেও পেতে পার। এরপর বৃদ্ধ তাঁর অতীতের পাতাগুলো আস্তে আস্তে ওলটাতে শুরু করলেন।
বাবা-মা আহ্লাদ করে নাম রেখেছিল আনন্দময়। আনন্দময় দাস। ঈশ্বর অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। জীবনে কোন আনন্দই তার দীঘর্স্থায়ী হয়নি। বরং দাস পদবীটা অনেক মানানসই। জীবনের অনেকটাই কেটেছে লোকের দাসত্ব করে আর গালমন্দ শুনে। বাবা ছোট একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করত। সংসারটা কোনরকমে চলত। সঞ্চয় কিছুই ছিল না। তাই অকালে বাবা মারা যেতে পাঁচ বছরের শিশু মায়ের সাথে দাদুর বাড়িতে গিয়ে উঠতে বাধ্য হয়।
দাদু তখন রিটায়ার করেছে। তাঁর তিন মেয়ে আর এক ছেলে। আনন্দর মা সবার বড়। ছেলে ছোটখাট একটা চাকরি করে। মাইনে সেরকম কিছু নয়। ছোট মেয়ের তখনও বিয়ে হয়নি। সংসারের আথির্ক অবস্থা এমনিতেই সঙ্গিন তার ওপর আরো দুটো গলগ্রহ বাড়ল। বাবা তো, তাই কষ্ট হলেও ফেলতে পারেনি। বাড়িতে ঘর মাত্র দুটো। তার মধ্যে একটা বেশ ছোট। ছোট ঘরটাতে ছেলে থাকে, আর অপেক্ষাকৃত বড় ঘরটায় বিপত্নীক বৃদ্ধ আর তার ছোট মেয়ে থাকে। মেজো মেয়ে জামাই এলে আবার ছোট ঘরটা ওদের ছেড়ে দিতে হয়। আনন্দ আর ওর মার ঠাঁই হল সামনের বারান্দার একটা কোণে। ওটাই তখন ওদের কাছে অনেক। মাথার ওপর একটা ছাদ আছে আর দু বেলা দু মুঠো খাবার তো জুটছে।
আনন্দর মা অনুভার একটা সেলাই মেশিন ছিল। আর সেলাইটাও ভাল পারত। সংসারের কাজের ফাঁকে পাড়া প্রতিবেশীদের জামা কাপড় সেলাই করে দিত। সামান্য হলেও কিছু আয় হত। বছর খানেক এভাবে কাটল।
-- অভাবে আর কষ্টে বড় হওয়ার ফলে আমার কখনও কোন চাহিদা বা প্রত্যাশা ছিল না। যখন যতটুকু পেয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছি। কিন্তু ওই সামান্য পাওয়াটাও বোধহয় বিধাতার পছন্দ হয়নি।
বেল বাজল। আনন্দ গিয়ে দরজা খুলে পিওনের হাত থেকে একটা খাম নিয়ে ঘরে ঢুকে ওটা না খুলেই টেবিলে রেখে দিল।
-- ছেলের চিঠি।
-- পড়ে নিন না, পরে কথা হবে।
-- না না, তেমন দরকারি কিছু নয়। না খুলেই বলতে পারি ভেতরে কি লেখা আছে। পরে পড়ব।
অজয় বুঝল যে চিঠিটা পড়ার সামান্যতম আগ্রহও বুড়োর নেই।
-- হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আমার কোন সুখই জীবনে বেশিদিন টেকেনি।
আবার শুরু হল এক দুঃখী মানুষের আত্মকথা। এক এক করে বেরিয়ে আসতে লাগল অন্তরে বহুদিন জমে থাকা হতাশা, বেদনা, বঞ্চনা আর ক্ষণিকের সুখের মুহূর্তগুলো।
মামার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার বছরখানেক বাদে আনন্দর দাদু মারা যায়। আর তখন অনুভা বুঝতে পারে যে মাথার ওপর কংক্রিটের ঢালাই নয়, তার বাবাই ছিল সংসারের আসল ছাদ। কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির চাপে ছেলেকে নিয়ে ও বাড়ি ছাড়তে হল। এক প্রতিবেশীর দয়ায় ঠাঁই পেল মেয়েদের একটা আশ্রমে। সারাদিন আশ্রমের নানান কাজ করতে হত আর বিনিময়ে জুটত দুজনের দু মুঠো অন্ন। কাজের প্রয়োজনে আর ব্যবহারের গুনে অল্পদিনেই অনুভা আশ্রমের সকলের প্রিয় হয়ে উঠল। ছেলেকে একটা স্কুলে ভর্তি করল। আনন্দর লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল। এত অভাব অনটনের মধ্যেও ভাল নম্বর পেয়েই পরীক্ষা গুলোয় পাশ করত।
আনন্দ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে মা বিছানায় শুয়ে আছে। অনুভা অসময়ে শোওয়ার মানুষ নয়। শরীরটা তার কদিন থেকে ভাল যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে কাশি হচ্ছে। আর কাশি একবার শুরু হলে তা চট করে থামে না। আনন্দ বুঝতে পারল মার শরীরটা খুবই খারাপ হয়েছে। কাছে গিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল
-- মা তোমার কি হয়েছে ?
অনুভা ছেলের হাতটা টেনে নিয়ে বলল-
--সেরকম কিছু না। শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছিল তাই শুয়ে আছি। তুই আমার কাছে একটু বোস তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
--- , তোমার শরীর এত খারাপ, একবার আশ্রমের মাসিদের ডাক্তার ডাকতে বলি না।
অনুভা ছেলেকে বাধা দিয়ে বলল---তুই এত ব্যস্ত হোস না বাবা। ডাক্তার ডাকার মত আমার কিছু হয়নি।
রাতে কাশির সাথে বেরোতে লাগল রক্ত। ডাক্তারকে ডাকতেই হল। কিছু পরীক্ষা করাবার পর ডাক্তার জানালেন যে অনুভার টিবি হয়েছে। যে আশ্রমে অনুভা এত প্রিয় ছিল, রাতারাতি সেখানে অচ্ছুৎ হয়ে গেল। লোক ধরে তাড়াতাড়ি একটা সরকারি টিবি হাসপাতালে পাচার করা হল। মা আশ্রম ছাড়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আনন্দ বুঝতে পারল যে আশ্রমে তার আর কোন জায়গা নেই। স্কুল যাওয়া শিকেয় উঠল। একটা ব্যাগে কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে এল রাস্তায়, খোলা আকাশের নিচে। দু একদিন কখনও রেল স্টেশনে কখনও ফুটপাতে কাটাল। সঙ্গে আনা চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে কোনরকমে পেটের জ্বালা মেটাল। এর মধ্যে মাকেও দেখতে যায়। মায়ের দিকে তাকান যায় না। এমনিতেই রোগা চেহারা, কয়েকদিনে যেন আরো শুকিয়ে গেছে। ছেলেকে দেখলে শীর্ণ অবসন্ন হাত দুখানি দিয়ে জড়িয়ে বুকে টেনে নিত। সে এক অদ্ভুত মুহূর্ত। রোগের জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে অনুভার মুখে ফুটে উঠত এক অসীম প্রশান্তি। আর মায়ের বুকে মাথা রেখে আনন্দও খুঁজত এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে আনন্দ রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে গিয়ে বসল। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। সঙ্গে না আছে খাবার না কিছু কিনে খাওয়ার মত পয়সা। ওর থেকে রাস্তার ভিখারিদের অবস্থা অনেক ভাল। ওরা যখন তখন যার তার কাছে হাত পাততে পারে। কখনও কিছু পায় কখনও বা পায় না। কিন্তু আনন্দর যত কষ্টই হোক ভিক্ষে করার মত মনটা এখনও তৈরি করতে পারেনি। আনন্দ যেখানে বসেছিল তার সামনেই একটা রেস্টোরেন্ট। খাবারের গন্ধে খিদে আরো বেড়ে গেল। সামনে কাউন্টারে মাঝ বয়সী একটা লোক বসে রয়েছে। লোকের কাছ থেকে খাবারের দাম বুঝে নিচ্ছে আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে কর্মচারীদের এটা ওটা বলছে। আনন্দের দিকে ভদ্রলোক কয়েকবার তাকাল। কিছু পরে ইশারায় ওকে কাছে ডাকল। ওকেই ডাকছে কিনা বুঝতে না পেরে ও এদিক ওদিক দেখছিল।
-- তোকেই ডাকছি। এদিকে আয়।
আনন্দ কাছে যেতে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল-- ওখানে বসে আছিস কেন ?
-- এমনি।
-- বাড়ি কোথায় ?
আনন্দ লোকটাকে তার প্রকৃত অবস্থা জানাল।
-- সকাল থেকে খাওয়া হয়নি তো! যা, হাতে মুখে জল দিয়ে এসে খেয়ে নে।
আনন্দর বিশ্বাস হচ্ছিল না।
-- দাঁড়িয়ে রইলি কেন, যা।
আনন্দ টেবিলে গিয়ে বসতেই একটা ছেলে ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ সব সাজিয়ে রেখে গেল। কতদিন বাদে একটু ভাল খেতে পাচ্ছে। তৃপ্তি করে খেয়ে ওঠার পর লোকটা আবার ডাকল।
-- আমার কাছে এখানে থাকবি? পড়াশুনোও করবি আর দোকানের কাজে আমাকে টুকটাক সাহায্য করবি।
নিজের কানকে আনন্দর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল।
আবার মাথার ওপর ছাদ জুটল। শুরু হল নতুন জীবন।
দোকানের মালিকের নাম কানাই সরকার। বিয়ে থা করেনি। আত্মীয়স্বজন সেরকম বলার মত কেউ নেই। যা দু একটা আছে, তাদের সাথে কোনরকম যোগাযোগ নেই। কানাই এর ওই অঞ্চলে বহুদিনের বাস। পুরোনো দিনের দোতলা বাড়ি। অত বড় বাড়িতে থাকার লোক বলতে কানাই ছাড়া নিচের একটা ঘরে দোকানের দুজন কমর্চারী। কানাই যখন খুব ছোট তখন ওর বাবা এই বাড়িটা কেনে। শৈশবেই কানাই মাকে হারায়। এক বিধবা নিঃসন্তান পিসি ওদের কাছে থাকতেন। উনিই বেশ কিছুদিন সংসারটা সামলেছিলেন। লেখাপড়ায় কানাইএর তেমন মাথা ছিল না। অনেক চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর লেখাপড়ায় ইতি টেনে বাবার সাথে দোকানে বসতে শুরু করে। লেখাপড়ায় মাথা না থাকলেও দোকানদারিতে কানাই অল্পদিনেই পোক্ত হয়ে উঠল। ছিল মুদির দোকান। টিম টিম করে চলত। আশে পাশে কয়েকটা ছোট কারখানা ছিল। ওগুলোতে অনেক লোক কাজ করত। কিন্তু ধারে কাছে কোন খাবারের দোকান ছিল না। এটা মাথায় রেখেই কানাই বেশ কিছুদিন ধরে তালে ছিল একটা রেস্টোরেন্ট খোলার। বাবা প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু শেষে খানিকটা জোর করেই মুদির দোকানের পাশে একতলার বাকি ফাঁকা জায়গাটায় একটা খাবারের দোকান খুলল।
নিজের মায়ের নামে নাম রাখল ‘করুণাময়ী রেস্টোরেন্ট’। নামে রেস্টোরেন্ট হলেও মূলত কারখানার লোকগুলোর জন্য দুপুরে আর রাতে ভাত আর রুটির থালি থাকত। প্রথম কিছুদিন সেরকম না চললেও লোকমুখে ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর দুবেলা ভালই ভিড় হতে শুরু হল। একে এলাকায় আর কোন খাবারের দোকান নেই তার ওপর দামও কম। ভিড় তো হবেই। আস্তে আস্তে ভাত রুটি ছাড়াও কানাই মুখোরোচক নানারকম ভাজাভুজিও রাখতে শুরু করল। দোকান থেকে রোজগারও ক্রমশঃ বাড়তে থাকল।
আনন্দ বাড়িতে আসার দু একদিন বাদে কানাই ওর সাথে ওর মাকে দেখতে গেল। হাসপাতালে ঢুকতেই ডাক্তাররা জানালেন যে মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ঐ অবস্থাতেও ছেলের মুখে সব শুনে অনুভা একবার কানাইএর দিকে তাকাল। চোখে জল, তবু ঐ চাউনিতে ছিল পরম স্বস্তি। আনন্দ কাছে গিয়ে বসতে মায়ের শীর্ণ হাত দুখানি রোজের মত ওকে বুকে টানার চেষ্টা করল। কিন্তু একটু কেঁপেই তা স্থির হয়ে গেল। ছেলেকে দেখার জন্যই বোধহয় প্রাণটা আটকে ছিল। কিশোর আনন্দ কাঁদতে কাঁদতে মায়ের নিথর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ বসে রইল।
কানাই আনন্দকে সান্ত্বনা দিয়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে অনুভার শেষ কৃত্যের সব ব্যবস্থা করল।
প্রথম দিন থেকে আনন্দর ওপর কানাইএর বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল। একটা রাস্তার ছেলের ওপর কেন যে এত টান এল তা বলা মুশকিল। হয়ত তার জীবনের একাকীত্বই এই অপত্য স্নেহের একটা বড় কারণ।
-- এই কটা দিন তুই আমার সাথে এক ঘরেই থাক। মায়ের কাজ মিটে গেলে যে ঘরটা ভাল লাগে সেটাতে থাকিস।
শ্মশান থেকে ফিরে পরম স্নেহে কানাই আনন্দকে কথাগুলো বলল পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম মিটে গেলে পূব দিকের বাড়ির সেরা ঘরটাতে কানাই আনন্দর থাকার ব্যবস্থা করল। আবার আনন্দ স্কুলে ভর্তি হল। বই, খাতা, কলম, কোন কিছুর অভাব রইল না। অচিরেই দুজন অপরিচিত মানুষের মধ্যে গড়ে উঠল পিতা পুত্রের মত এক আত্মিক বন্ধন। পড়াশোনায় আনন্দর বরাবরই আগ্রহ ছিল। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে উত্তরোত্তর রেজাল্ট ভাল হতে লাগল।
প্রথম দিকে কানাইকে আনন্দ কাকু বলেই ডাকত।
একদিন কানাই কিন্তু কিন্তু করে বলল-- বাবা তোকে একটা কথা বলব?
-- বল না।
-- তুই আমাকে বাবা বলে ডাকতে পারবি না!
আনন্দ সেই মুহূর্তে কোন উত্তর দেয়নি। পরদিন সকালে আনন্দর মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনে কানাই ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল।
কানাইকে সাহায্য করতে আনন্দ মাঝে মাঝে দোকানে গিয়ে বসত। লোকের সাথে ওর ব্যবহার খুব ভাল। ও দোকানে থাকলে খদ্দেররাও খুশি হয়। অনেকে তো ওকে দেখতে না পেলে কানাইকে জিজ্ঞেস করে-- কিগো, তোমার ছেলেকে দেখছি না যে! ‘ছেলে’ কথাটা শুনে কানাইএর মনটা ভরে যায়।
গম্ভীর হয়ে বলে-- উচু ক্লাসে উঠেছে, পড়াশোনার চাপ বেড়েছে, রোজ কখনও আসতে পারে!
বেশ ভাল নম্বর পেয়েই আনন্দ হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করল। কানাই তো আনন্দে আত্মহারা। দোকানে সব খরিদ্দারকে মিস্টি খাওয়াল। আনন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে একটা ভাল সাইকেল কিনে দিল।
সঙ্গে সাবধান বানী-- কখনও জোরে চালাবি না, আর বড় রাস্তায় যাবি না। আনন্দ খুব বাধ্য ছেলে। নিষেধ অমান্য করেনি।
কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হল। নম্বর ভাল থাকায় অনেক ভাল কলেজে সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাড়ির থেকে দূরে হওয়ায় কানাই রাজি হয়নি। বাড়ির কাছেই একটা কলেজে ভর্তি হল।
এর মধ্যে একদিন কানাই আনন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ওর নামে ব্যাঙ্কে একটা খাতা খুলে তাতে বেশ কিছু টাকা রেখে দিল।
-- মাঝে মাঝে ব্যাঙ্কে গিয়ে প্রয়োজন মত টাকা তুলবি, আবার মাসের প্রথমে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে জমা দিয়ে দিবি। কিরে, বুঝলি কিছু ?
আনন্দ মাথা নেড়েছিল। ওর কোন চাহিদা নেই। যা পায় তাতেই খুশি। এইজন্য কানাইএর ওকে এত ভাল লাগে।
কলেজেও মেধাবী ছাত্র হিসেবে আনন্দ নাম করল। দেখতে দেখতে বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। আনন্দ অনেক রাত পযর্ন্ত পড়াশোনা করে। কানাইও জেগে পাশে বসে থাকে। কখনও মশা তাড়ায়, কখনও আনন্দর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আনন্দ শুতে যেতে বললে বলে-- তুই বাচ্চা ছেলে রাত জেগে পড়ছিস আর আমি বাপ হয়ে কখনও শুতে পারি!
ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হল। সবকটা পেপারই খুব ভাল হয়েছে। আর একটা বাকি। পরীক্ষার আগের দিন আনন্দ রাত জেগে পড়ছে আর কানাই যথারীতি গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কানাইএর হাতটা আনন্দর একটু গরম ঠেকল।
-- তোমার কি জ্বর হয়েছে ?
-- কই না তো।
-- তাহলে তোমার হাতটা অত গরম লাগল কেন ? এদিকে এস তো দেখি। কানাইএর গায়ে হাত দিয়ে আনন্দর মনে হল বেশ জ্বর।
-- গা বেশ গরম, এখনি শুয়ে পড়। কাল ডাক্তার দেখাতে হবে।
-- ও ঠাণ্ডা গরমে একটু হয়েছে হয়ত। শরীর আমার ঠিকই আছে। যা হোক ছেলের কথায় ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
শেষ পেপারটাও মনোমতই হল। বাপ ব্যাটা দুজনেই খুব খুশি। দুদিনের জন্য দুজনে পুরী বেড়াতে গেল। আনন্দর জীবনে এই প্রথম কোথাও বেড়াতে যাওয়া। সমুদ্র দেখে মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। দুজনে প্রাণ ভরে সমুদ্রে স্নান করল। কানাইএর আরো কদিন থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ি ফাঁকা আর দোকানটাও তো বেশিদিন বন্ধ রাখা যাবে না, তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে হল।
এই বাড়িতে আসার পর থেকে আনন্দর জীবন সত্যিই আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। কানাইএর স্নেহ ভালবাসা ভুলিয়ে দিয়েছিল তার অতীতের সব দুঃখ, বেদনা। আর কানাইএর শূন্য, একাকী, উদ্দেশ্যহীন জীবনে আনন্দ ছিল এক চরম প্রাপ্তি। ও আসার পর থেকে কানাইএর জীবনটা আমূল পাল্টে গিয়েছিল। সংসারে যে এত সুখের ভান্ডার আছে তা সে আগে কখনও বুঝতে পারেনি। পরস্পরকে অবলম্বন করে উভয়ে পেয়েছিল এক নতুন জীবনের সন্ধান। কানাই আনন্দকে এতটাই ভালবেসে ফেলেছিল যে একদিন ওকে ডেকে বলল-- শোন, এখন তুই বড় হয়েছিস। এবার সময় করে একটা ভাল দিন দেখে বাড়ি আর দোকানটা তোর নামে করে দেব।
আনন্দ বাধা দিয়ে বলল-- কেন, নাম পাল্টাবার কি দরকার?
-- বাঃ তোকে এবার আস্তে আস্তে সব বুঝে নিতে হবে না। আমি মরে গেলে সব দেখবে কে ?
আনন্দ কানাইএর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল-- অমন কথা আর বলবে না। আমার ভাল লাগে না।
কানাই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল। পুরী থেকে ফিরে আসার পর থেকেই কানাইএর শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝেই শরীর ম্যাজম্যাজ করে জ্বর হয়। প্রথমদিকে আনন্দ বার বার বলা সত্ত্বেও একেবারেই গা করেনি। ধীরে ধীরে শরীর আরো কাহিল হয়ে পড়ল। অর্ধেক দিন দোকানে বসতে পারে না। আনন্দ গিয়ে সামাল দেয়। পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভ হল না। আনন্দর এক সহপাঠীর বাবা বড় ডাক্তার। একদিন কানাইকে নিয়ে তার কাছে গেল। তিনি ভালভাবে দেখার পর রক্তের কিছু পরীক্ষা করাতে দিলেন। রিপোর্ট আসার পর জানা গেল ব্লাড ক্যানসার। অনেক চেষ্টা করেও আনন্দ খবরটা কানাইএর কাছ থেকে লুকোতে পারেনি। মনে মনে ভেঙ্গে পড়লেও আনন্দকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল-- ওরকম গুম মেরে থাকিস কেন? একটু আধটু শরীর খারাপ হবে না! কয়েক মাস ওষুধ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার অত সহজে কিছু হবে না।
মুখে যাই বলুক, সময় যে তার ঘনিয়ে এসেছে তা কানাই বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল। তাই আবার বাড়ি হস্তান্তরের প্রসঙ্গটা তুলল।
-- উকিলের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি ভাল দিন আছে, রেজিস্ট্রিটা করিয়ে নেব।
কিন্তু সময় যে হাতে এত কম তা কানাই বুঝতে পারেনি। ঘোরাঘুরি করা আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে বিছানায় উঠে বসার শক্তিটাও চলে গেল। আর তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল কোমায়। আনন্দ সারাক্ষণ কানাইএর মাথার কাছে বসে থাকে। অসম্ভব জেনেও আশায় থাকে যদি কানাই আবার ভাল হয়ে যায়। না ভাল সে আর হয়নি। দুদিন বাদেই মারা গেল। শেষ বেলায় বোধহয় একটু জ্ঞান এসেছিল। চোখ চেয়ে বিড়বিড় করে আনন্দকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিল। নিজের বাবাকে মনে নেই। খুব অল্প বয়সে হারিয়েছে। কানাই প্রকৃত অর্থে তার বাবার জায়গাটা নিয়েছিল। আনন্দর দ্বিতীয়বার পিতৃ বিয়োগ হল।
মারা যাওয়ার খবরটা জানাজানি হতেই শকুনের মত বেশ কিছু আত্মীয় পরিজন এসে হাজির হল। এতদিন আনন্দ এই বাড়িতে আছে কিন্তু এই মানুষগুলোকে সে কখনও দেখেনি বা কানাইএর কাছেও এদের কথা কখনও শোনেনি। বাড়িতে ঢুকে একটু চোখের জল ফেলে নিয়ে যে যার মত খবরদারি করতে শুরু করে দিল। আনন্দ যে এ বাড়িতে আশ্রিত ছাড়া আর কিছু নয় তা ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ওকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিল। আনন্দ চিরকালই একটু নম্র প্রকৃতির। তাছাড়া অভাব অনটনের মধ্যে বড় হওয়ায় কোন ব্যাপারে প্রতিবাদ করার মত মনের জোরও তার ছিল না। তবে একটা ব্যাপার বেশ জোরের সঙ্গে সকলকে জানিয়ে দিল।
-- বাবার মুখাগ্নি ও পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সব আমিই করব।
দু একটা টিপ্পনী ভেসে এল। ‘আশ্রিতের আবার বাবা। রঙ্গ দেখে আর পারি না, বাব্বা।‘ তবে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ যাই হোক শ্রাদ্ধশান্তিতে খরচ আছে বলে এ কাজে কেউ এগোয়নি। আর শকুনদের নজর তো কানাইএর সম্পত্তিতে। ওটা বেহাত না হলেই হল। শ্মশান থেকে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতে কানাইএর ঘরের মেঝেতে কম্বল পেতে আনন্দ শুল। ঘুম আর আসে না। খালি বিছানার দিকে তাকিয়ে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
-- সারাদিন এত ধকল গেল, রাত জাগিস না বাবা, শুয়ে পড়।
চমকে উঠে আনন্দ ঘরের চারদিকটা দেখল। খাটের ওপর থেকে কানাই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কানাইএর কিনে দেওয়া ক্যামেরায় আনন্দই কয়েক মাস আগে ছবিটা তুলেছিল। এতদিনের স্মৃতি, কথা, সব যেন চারদিক থেকে ভেসে আসছে। নিজের সমস্ত ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে তার জীবনটা ভরিয়ে দিয়েছিল ঐ মানুষটা।
-- যেন ভায়া, সুখ এক একজনের কপালে থাকে না। অমন মানুষটাকে হারাবার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে ও বাড়িতে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়। শ্রাদ্ধের কাজকর্ম মিটে যেতেই সবাই নিজেদের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকলেই সকলের প্রতিপক্ষ। তবে নিজেদের মধ্যে যতই মারামারি করুক, আমার বিরুদ্ধে কিন্তু সকলে একজোট। কারণ, আমাকে রাস্তা থেকে সরাতে না পারলে কাজ হাসিল করা সহজ হবে না। রুখে দাঁড়াবার মত মনের জোর বা ইচ্ছে কোনটাই আমার ছিল না। আমার এক বন্ধু অমলের সাহায্যে কয়েক দিনের মধ্যেই আমার জিনিসপত্র নিয়ে ও বাড়ি ছেড়ে কলেজ স্ট্রিটের এক মেসে গিয়ে উঠলাম। জিনিসপত্রের সঙ্গে এনেছিলাম আমার তোলা কানাই সরকারের ছবিটা। দরজার ওপরে যে ছবিটা টাঙান রয়েছে, ওইটাই সেই ছবি। আমার নিজের বাবা বা মা কারোরই ছবি নেই। মায়ের মুখ অস্পষ্ট হলেও মনে আছে, বাবার তাও নেই। জ্ঞানত উনিই আমার বাবা, আমার গুরুজন, আমার সবকিছু।
-- আর ঐ ছবি দুটো কাদের ?
-- একটা আমার স্ত্রীর আর অন্যটা আমার ছেলে মেয়ের সাথে আমি ও আমার স্ত্রী।
-- আপনার স্ত্রী তো বেশ সুন্দরী!
আনন্দ কোন উত্তর করল না।
--অনেকক্ষণ তো হল। আর এক রাউন্ড চা করে আনি, কি বল? আবার বেল বাজল। দরজা খুলতেই একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে আনন্দকে জড়িয়ে ধরল।
-- দাদু আজ বেড়াতে নিয়ে গেলে না?
-- কাল যাব দিদিভাই। আজ কাকুটার সাথে একটু কথা বলছি তো।
উত্তরটা শিশুটির একেবারেই মনঃপুত হল না। এ ঘর ও ঘর খানিক ঘোরাঘুরি করে চলে গেল।
-- আমার নাতনি। স্কুল থেকে ফিরে এলে রোজ বিকেলে একবার বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। আর ছুটির দিনে কতবার যে আসে তার ঠিক নেই।
-- বাঃ, আপনার একজন দারুন সঙ্গী বলুন।
-- তা বটে।
অজয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছটা বেজে গেছে। শনিবারের সন্ধ্যায় ক্লাবের আড্ডাটা বেশ জমে। আজ আর যাওয়া হল না। এমন এক কাহিনীর মাঝপথে ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না।
কিচেনের দিকে যেতে যেতে আনন্দ জিজ্ঞেস করল-- ভাই, বোর হচ্ছ না তো? আর হলেও এই বুড়োটার কথা ভেবে আর একটু না হয় থাক। কতদিন বাদে মনটা বড় ভাল লাগছে।এবার চায়ের সাথে এল অমলেট। খিদেও পেয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে প্লেট খালি হয়ে গেল।
টি ব্রেকের পর আবার শুরু হল আনন্দর বিচিত্র জীবনকথা।
প্রথম জীবনটা খুবই কষ্টের ছিল। কিন্তু মাঝে এতগুলো বছর সুখে, স্বাচ্ছন্দে কাটার ফলে কলেজ স্ট্রিটের মেসের ছোট পলেস্তারা খসে যাওয়া ঘরে প্রথম কদিন বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। আনন্দর বন্ধু অমলও একই মেসে থাকত। অমলদের বাড়ি বদ্ধর্মান জেলার দাইহাটে। বয়সে আনন্দর থেকে একটু বড়। ও বি.কম. পাশ করে চাটারড পড়ছে। অমল আনন্দর খুব ভাল বন্ধু। আনন্দর বাড়িতে মাঝে মাঝেই যেত। আর ছুটি ছাটাতে গিয়ে থেকেওছে। কানাইও অমলকে পছন্দ করত। ও সঙ্গে থাকায় নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া আনন্দর পক্ষে অনেক সহজ হল। মাস খানেক পর বি.এস.সির রেজাল্ট বেরল। হাই ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে আনন্দ পাশ করেছে। এই খবর শুনে যে মানুষটা সব থেকে খুশি হত সেই আজ নেই। ঘরে ফিরে মাকর্শিটটা কানাইএর ছবির সামনে রেখে বাচ্চা ছেলের মত কেঁদেছিল।
এম.এস.সি তে চান্স পেতে কোন অসুবিধে হল না। বাড়ি আর দোকান রেজিস্ট্রি করে যেতে না পারলেও, কানাই নিজের জমানো টাকার প্রায় সবটাই আনন্দর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়েছিল। ঐ টাকার পরিমাণটা যথেষ্ট ছিল বলে খরচ খরচা নিয়ে আনন্দকে চিন্তা করতে হয়নি। এম.এস.সি পাশ করার পর আনন্দ বেশ কটা সরকারী, আধা সরকারী চাকরির সুযোগ পেল। কিন্তু পড়াশোনা ভালবাসত বলে ওগুলোতে না ঢুকে কাছাকাছি একটা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। কয়েক মাস কাটার পর মেস ছেড়ে পাশেই দু কামরার একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ও আর অমল চলে আসে। অমলের বাবা-মা কোলকাতায় এলে ওদের ভাড়া বাড়িতে এক আধ দিন থেকে যেতেন। কেবল ছেলের বন্ধু বলেই নয়, ধীর, শান্ত স্বভাবের জন্য ওঁরা আনন্দকে খুব পছন্দ করতেন। সংসারে একা বলে ওর প্রতি একটা সহানুভূতিও ছিল। আনন্দকে অনেকবারই ওঁরা দাইহাটে যাওয়ার জন্য বলেছেন কিন্ত নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেবার গরমের ছুটিতে অমল প্রায় জোর করেই ওকে নিজের দেশের বাড়িতে নিয়ে গেল। বদ্ধির্ষ্ণু গ্রাম। স্টেশনের পাশেই বড় খেলার মাঠ। মাঠের ধারেই স্কুল। অমলের বাবা ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্কুলের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। রিকসায় মিনিট দশেক লাগল অমলদের বাড়ি পৌঁছতে। পুরনো ধরনের বড় বাড়ি। সামনে অনেকটা বাগান।
বাইরে থেকেই অমল চিৎকার পাড়ল-- ও মা আ আ আ। কাকে এনেছি দেখ।
অমলের মা সামনের বারান্দায় এসে ছেলের সাথে আনন্দকে দেখে খুব খুশি হলেন।
-- এস বাবা ভেতরে এস। তুমি এসেছ খুব ভাল লাগছে। খোকা আনন্দকে তোর ঘরে নিয়ে যা। আর হ্যাঁ, সাড়ে বারোটা বাজে। একটু জিরিয়ে নিয়ে চান করে ভাত খেয়ে নে। সেই কখন বেরিয়েছিস, নিশ্চই খুব খিদে পেয়ে গেছে।
অমল বাবা মার একমাত্র সন্তান, তার ওপর বাইরে থাকে, ফলে বাড়িতে ওর আদর আবদারটা স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি। বন্ধু হিসেবে এই স্নেহ ভালবাসার অংশীদার হয়ে আনন্দরও খুব ভাল লাগছিল। পাশেই লাগোয়া অমলের কাকার বাড়ি। দুই ভাইয়ে সম্পর্ক খুব ভাল। বহুদিন একসাথে সবাই এ বাড়িতেই ছিল। কয়েক বছর আগে পাশের ফাঁকা জমিতে কাকারা বাড়ি করে চলে গেছে। এখনও ভাল মন্দ কিছু রান্না হলে এবাড়ি ওবাড়ি চালান হয়। কাকার নিজস্ব ব্যবসা আছে।
ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টে দুজনে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, এমন সময় বছর পনেরর একটা ছেলে ঘরে ঢুকল।
-- দাদা, কখন এলি রে ?
-- এইতো খানিকক্ষণ হল। তুই আজ স্কুলে যাসনি?
-- টেস্ট হয়ে গেছে, স্কুল তো ছুটি।
-- ও, তাইতো। আমার একদম খেয়াল ছিল না।
তারপর গুরুজন সুলভ গম্ভীর স্বরে ব্লল-- পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো?
বোঝা গেল প্রসঙ্গটা তার একেবারেই পছন্দের নয়।
সংক্ষিপ্ত উত্তর এল-- হ্যাঁ।
-- এ আমার বন্ধু আনন্দ। তোর আর একটা দাদা। আর আনন্দ, ও আমার ছোট ভাই অয়ন।
পায়ে হাত দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা বুঝতে না পেরে অয়ন আনন্দের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বয়সে অনেকটা তফাৎ থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই আনন্দর সাথে অয়নের সম্পকর্টা বেশ জমে গেল। যে কয়দিন আনন্দ ওখানে ছিল, অয়ন সারাক্ষণই ওর সাথে ঘুরেছে।
নিচে থেকে অমলের মার গলা পাওয়া গেল-- কিরে তোদের স্নান হল? আর বেলা করিস না, খেতে আয়। খেয়ে দেয়ে যত পারিস গল্প কর।
খাওয়ার ঘরটা বেশ বড়। মাঝে টেবিল পাতা। আটজন একসাথে খেতে বসতে পারে। ঘরে কিছু অপরিচিত মুখ। অমল একে একে পরিচয় করাল।
-- আমার কাকা, কাকিমা আর আমাদের একমাত্র আদরের বোন তনিমা।
কাকা-কাকিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আর তনিমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আনন্দ খেতে বসল। অমলের মা রান্নাঘরে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন, কাকিমা আর তনিমা পরিবেশন করছে। এলাহি আয়োজন। মনে হয় আনন্দর আসার খবরটা এঁরা জানতেন।
কাকিমা বললেন-- নিজের বাড়ি মনে করে চেয়ে নেবে, একদম লজ্জা করবে না।
এত সুস্বাদু রান্না এত আন্তরিকতার সঙ্গে আনন্দকে কেউ কোনদিন খাওয়ায়নি। মনটা ভরে গেল, সঙ্গে পেটটাও। তনিমা অয়নের থেকে বছর তিনেকের বড়। উনিশ কুড়ি মত বয়স। স্থানীয় কলেজে পড়ে। এদের ভাই বোন সবকটিকেই দেখতে ভাল। খাওয়া দাওয়ার পর আনন্দ দুপুরে গুছিয়ে একটা ঘুম দিল।
-- উঠুন, চা এনেছি। মিস্টি সুরেলা কন্ঠে ঘুম ভাঙল। তনিমা চায়ের কাপ হাতে সামনে দাঁড়িয়ে।
-- আমায় ডাকলেই তো হত, কষ্ট করে আনতে গেলে কেন ?
মুচকি হেসে তনিমা বলল-- কষ্ট করে এনে যখন ফেলেছি তখন একটু কষ্ট করে খেয়ে নিন।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল-- চা খাওয়া হলে নিচে আসবেন। দাদা অপেক্ষা করছে, আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।
বিকেলে অমলের সাথে অনেক ঘোরা হল। বেশ ভাল লাগছিল। সন্ধ্যাবেলায় কাকার বাড়িতে জোর আড্ডা বসল। অয়নের সামনে পরীক্ষা, তাই ইচ্ছে থাকলেও বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি পায়নি। গল্প, ঠাট্টা, মস্করার মধ্যে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল।
-- এবার ওঠ, সকলে খেতে চল। অমলের মা তাড়া লাগালেন।
রাতের খাওয়া কাকার বাড়িতে। কাকার বাড়িটা অমলদের থেকে একটু ছোট হলেও অনেক ঝাঁ চকচকে। রাতেও ভুরিভোজ।
আনন্দ খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল-- কাকিমা, আমি এত খেতে পারব না।
অমলের কাকা মিস্টি ধমকে বললেন-- বাচ্চা ছেলে, খেতে বসার আগেই ওরকম না না করবে না। তোমাদের বয়সে আমরা... লোহা খেয়ে হজম করতাম---তনিমা বাক্যটা সম্পূর্ণ করে দিল। তবে রে মেয়ে— জেঠি বকা লাগাল।
অমল তো ভাল বন্ধু ছিলই, এখানে আসার পর ওর পরিবারের সকলকেই খুব ভাল লাগল। এদের আতিথেয়তা, আন্তরিকতা, ভোলার নয়। হয়ত নিজের বলতে কেউ নেই বলেই এদের পরিবারের স্নেহের বাঁধনটা ওকে এতটা অভিভূত করেছিল। ফিরে আসার সময় অমলের মা আর কাকিমা বাদে গোটা পরিবার ওদের স্টেশনে ছাড়তে এসেছিল।
-- আবার আসবেন।
ট্রেন ছাড়ার মুখে তনিমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। আসবে বৈকি। এত ভালবাসাকে কি কখনও উপেক্ষা করা যায়!
কিছুদিন পর স্কুল ছেড়ে আনন্দ কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেয়। মাইনেও কিছুটা বাড়ে।অমল চাটারড পাশ করে বড় একটা ফার্মে চাকরি করছে। এখনও ওরা একসাথেই থাকে তবে বাড়ি পাল্টেছে। এ বাড়িটা আগের থেকে অনেক বড় আর ভাল।
এক রবিবার দুপুরে গল্প করতে করতে অমল বলল-- আনন্দ, এবার বিয়ে করে সংসারী হ।
-- তা আমায় পরামর্শ না দিয়ে তুই নিজে করছিস না কেন?
-- আমার বাড়িতে তো দেখাশুনো জোর কদমে শুরু করে দিয়েছে।
-- ঠিক আছে, আগে তোর বিয়েতে মজা করি, তারপর না হয় আমারটা নিয়ে ভাবব।
-- আনন্দ একটা কথা বলব ?
-- তুই আবার কবে থেকে আমার সাথে কথা বলার আগে পারমিশান নেওয়া শুরু করলি?
-- তনিমাকে তোর পছন্দ ?
আনন্দ একটু চুপ করে রইল। ভাবতেই পারছে না যে ওর মত চালচুলোহীন মানুষের সাথে তনিমার মত ভাল বংশের এক সুন্দরী মেয়ের সম্বন্ধ আসতে পারে।
-- কিরে, চুপ করে রইলি যে !
-- আমার তো তুই সবই জানিস। তোর বাড়ির অন্যদের কি এতে মত আছে?
-- বাড়িতে না জিজ্ঞেস করে কি আর তোকে বলছি ।
প্রথম দেখার পর থেকেই তনিমার প্রতি আনন্দর একটা দুবর্লতা জন্মেছিল। তবে সাহস করে সে কথা তনিমাকে তো নয়ই এমনকি যে অমলের সাথে সে সব কথা শেয়ার করে তাকেও সংকোচে কিছু বলতে পারেনি।
-- তনিমাকে জিজ্ঞেস করেছিস, ও রাজি আছে তো?
হেসে অমল বলল-- তনিমার মনের খবর বাড়ির মধ্যে সবথেকে ভাল আমিই রাখি।
--ঠিক আছে। তবে আমাকে তৈরি হওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হবে।
প্রায় বছর খানেক বাদে তনিমা আনন্দর ঘরে এল। বাড়িতে আনন্দ একাই থাকে। অমল চাকরি সূত্রে তখন পাটনাতে। সমস্ত ঝক্কি সামলে আনন্দর বিয়েটা অমল একাই উৎরে দিয়েছিল।
তনিমা খুব গোছানো মেয়ে। কয়েকদিনের মধ্যে ঘরদোরের চেহারাটাই পাল্টে দিল। আনন্দর শ্রীহীন জীবনে তনিমা এল পূণির্মার জ্যোৎস্না হয়ে। যার স্নিগ্ধ আলোয় সে খুঁজে পেয়েছিল জীবনের অনেক সুখের সম্ভার। তখন হানিমুনের সেরকম চল না থাকলেও সুযোগ পেলেই আনন্দ সস্ত্রীক বেড়াতে চলে যেত। ওই কয়েকটা বছর ছিল তার জীবনের সেরা সময়। বিয়ের বছর ঘুরতেই তনিমার কোলে এল ‘আশা’। দুজনেই চেয়েছিল মেয়ে হোক। মেয়েকে প্রথম দেখার পর আনন্দর সেকি আহ্লাদ। বাচ্চা হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে তনিমা বাপের বাড়িতে ছিল। মেয়ে দু তিন মাসের হতেই ওদের নিয়ে আনন্দ কোলকাতায় চলে আসে। এখানে অতটুকু বাচ্চা নিয়ে একা থাকতে হবে বলে বাড়ির লোকেরা আপত্তি করলেও আনন্দ
খানিকটা জোর করেই তনিমাকে নিয়ে আসে। ওদের ছেড়ে ও আর একা থাকতে পারছিল না। তনিমার মা মেয়েকে ঐ অবস্থায় একা ছাড়তে ভরসা পাননি তাই সঙ্গে এসে কোলকাতায় কিছুদিন রইলেন। আনন্দর জীবনের ধারাটাই বদলে গেছে। সে এখন আর এই সংসার সমুদ্রে সহায়সম্বল, আত্মীয় পরিজনহীন এক দিগ্ ভ্রষ্ট নাবিক নয়। আনন্দময় দাস ছাড়াও তার আরো পরিচয় আছে। সে একাধারে স্বামী, বাবা, শিক্ষক ও পরিবারের দায়িত্ববান একজন কর্তা।
-- জানো ভায়া, বিয়ের পর কয়েক বছর আমাদের একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। সে এক অদ্ভুত ভাললাগা। যার আবেশে ছকে বাঁধা দৈনন্দিন জীবনের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তবে আশাকে কোলে নিয়ে যে অনুভূতি, যে শিহরন, যে ভাললাগা অন্তরে উপলব্ধি করতাম তার সাথে অন্য কোন জাগতিক সুখই তুলনীয় নয়। আমার রক্ত, আমার সৃষ্টি, আমার সন্তান- সে এক স্বগীর্য় তৃপ্তি।
একদিন গল্প করতে করতে তনিমা আবদার করে বলল-- হ্যাঁগো, আমাদের নিজেদের ছোটখাট একটা বাড়ি করার কথা একটু ভাব না। এখনি বলছি না। একটু টাকা পয়সা জমিয়ে তারপর।
আনন্দরও একটা বাড়ি করার কথা কিছুদিন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
বলল— হ্যাঁ, আমারও মাথায় আছে। দু একজনকে বলেওছি ভাল জায়গায় দু এক কাঠা জমির সন্ধান পেলে খবর দিতে।
কিছুদিন বাদে ভবানীপুরে আদি গঙ্গার দিকে দুকাঠার মত পছন্দসই একটা জমি পাওয়া গেল। কলেজের মাইনে ছাড়াও টিউশনি করে আনন্দ ভালই রোজগার করত। সংসারে যথেষ্ট খরচ করার পরেও উদ্বৃত্ত থাকত। এ ছাড়া কানাই এর দেওয়া টাকাটার অনেকটাই তখনও ছিল। ফলে জমি কিনে ছোট একটা বাড়ি করতে কোন অসুবিধে হয়নি। পুজো দিয়ে নিজের বাড়িতে যখন ঢুকল তখন আশার বয়স আড়াই বছর। নতুন বাড়িতে এসে সেও বেশ মজা পেয়েছিল। ‘আমার বালি’ আমার বালি’ বলে ধেই ধেই করে খানিক নেচে নিল।
বাড়িটা ছোট হলেও সুন্দর প্ল্যান করে করা। দুটো বেড রুম, দুটো টয়লেট, একটা কিচেন, একটা ছোট ড্রইং রুম আর একটা স্টাডি। সামনে কিছুটা ফাঁকা জমি। তনিমা ধীরে ধীরে নিজের পছন্দমত জিনিসপত্রে ঘরদোর সাজিয়ে ফেলল। দোতলায় সিঁড়ির পাশে ফাঁকা জায়গাটায় ঠাকুরঘর। সামনের ফাঁকা জমিটাও আর ফাঁকা নেই। নানারকম ফুলের গাছ লাগিয়েছে। তনিমা খুব খুশি।
অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বলেছিল— আমার আনন্দের ঘরে এসে জীবন আমার আনন্দে ভরে গেছে। আচ্ছা, আমাদের বাড়ির একটা নাম থাকবে না ?
---কিছু ভেবেছ ?
---‘সোনার সংসার’ নামটা কেমন ?
---তুমি যখন চাইছ তখন ঐ নামই হবে।
কয়েক দিনের মধ্যেই পাথরে খোদাই করে বাড়ির নাম গেটের সামনে লাগান হল। কলেজের সহকর্মী থেকে আত্মীয় পরিজন যারাই বাড়িতে আসে তারা সকলেই একবাক্যে বাড়ির আর এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার জন্য তনিমার প্রশংসা করে।
বিজয় তো একদিন বলেই ফেলল— আনন্দদা, বৌদি ছিল বলে তরে গেলে। রান্নাবান্না করে, এতটুকু বাচ্চা সামলে, সারা বাড়িটা কি সুন্দর চকচকে রেখেছে বলতো !
আনন্দ অকপটে স্বীকার করল-- সে আর বলতে ভাই।
বিজয় ঐ পাড়াতেই কিছুটা দূরে ভাড়া থাকে। একাই থাকে। বাবা মা অনেক কাল অগে মারা গেছে। পৈতৃক বাড়ি ডায়মন্ড হারবারের কাছে কোন এক গ্রামে। সরকারি কোন একটা অফিসে কাজ করে। ভাড়াটে হলেও এ পাড়ায় অনেকদিন আছে। জমি দেখতে আসার সময় রাস্তাতেই আনন্দর সাথে আলাপ হয়। পাড়াতে বেশ পপুলার। পরোপকারী ছেলে। সকলের প্রয়োজনে পাশে থাকে। আনন্দর সাথে তো মাত্র কদিনের আলাপ, তাতেও নতুন বাড়িতে মালপত্র নিয়ে আসার সময় সারাক্ষণ সাথে থেকেছে।
বলেও রেখেছে-- আনন্দদা নতুন পাড়া, কোন সমস্যা হলে ছোট ভাইকে ডাকতে সংকোচ কোর না।
আনন্দ তখন প্রকৃত অর্থেই সুখী। ভাল চাকরি, মনের মত বাড়ি, ঘরে অমন ভাল বৌ, ফুটফুটে মেয়ে, আর এত ভাল পাড়া প্রতিবেশি। আর কি চাই ? সুখের পাত্র অবশ্য তখনও ভরেনি। পাওয়া আরো বাকি ছিল। বছর খানেক বাদে ঘরে এল ‘আলোক’। ছেলে মেয়েদের নাম সব তনিমার দেওয়া। ভাইকে দেখে সাড়ে তিন বছরের দিদির সে কি আনন্দ। নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন কেবল ভাইএর কাছে বসে থাকে। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পর নিজের ভরা সংসার দেখে আনন্দর মন জুড়িয়ে যায়। সেরকম আড্ডাবাগীশ না হলেও আগে পাড়ার ‘আমরা কজন’ ক্লাবে গিয়ে মাঝে মাঝে গল্প গুজব করত। বিজয়ই সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এখন কলেজ আর বাজার করা ছাড়া সারাক্ষণ বাড়িতেই কাটায়। শিশুদের কলকাকলি, স্ত্রীর সোহাগ, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। যদিও বাড়িতে সর্বক্ষণের জন্য একটা কাজের মেয়ে আছে তবু তনিমাকে একটু হাতে হাতে সাহায্য করার চেষ্টা করে। ভাল লাগে। তনিমা উদ্যোগি হয়ে মেয়েকে পাড়াতেই একটা ভাল গার্লস স্কুলে ভর্তি করল। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে মেয়ের সে কি কান্না। তারপর ধীরে
ধীরে অভ্যাস হয়ে গেল। সাদা জামা আর লাল টুকটুকে ফ্রক পরে পিঠে বইখাতার ব্যাগ নিয়ে ওইটুকু মেয়ে মাকে আর ভাইকে টা টা করতে করতে বাবার সাথে স্কুলে যেত। অন্য সময়ে বাবার কোলে চড়ে ঘুরলেও স্কুলে কিন্তু হেঁটেই যেত। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে পাকা গিন্নি হয়ে উঠল। কোনদিন আনন্দ কলেজ থেকে একটু দেরী করে বাড়ি ফিরলে বকুনি খেত-- কি ব্যাপার, এত দেরী কেন ? এতক্ষণ কি করা হচ্ছিল ?
আনন্দ হাত বাড়ালেই লাফিয়ে বাবার কোলে উঠে অনেক আদর করত।
তনিমা ভেঙিয়ে বলত-- ওরে আমার বাপ সোহাগী মেয়ে রে ।
আলো হামা দিয়ে কাছে এলে ওকেও কোলে তুলে নিত। একদিন ছেলে মেয়ে দুজনেই বাবার কোলে, এমন সময় বিজয় বাড়িতে ঢুকল।
-- আরে ব্বাস। এমন সুন্দর দৃশ্য, দাঁড়াও দাঁড়াও একটা ছবি তুলি।
বিজয়ের হাতে ক্যামেরা। ওর ছবি তোলার খুব শখ।
-- বৌদি, তুমি দূরে কেন? দাদার পাশে দাঁড়াও...একটু গা ঘেঁসে..আর একটু..আর একটু.. হ্যাঁ, পারফেক্ট। যা একখানা ছবি হবে না। ছবি তুলে দিলাম, এবার কড়া করে একটু চা কর তো বৌদি।
-- তোমরা গল্প কর আমি চা বসাচ্ছি।
তনিমা আর আনন্দের ব্যবহারের গুনে পাড়া প্রতিবেশী অনেকের সাথেই বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। বাড়িতেও যাতায়াত হয়। তবু তার মধ্যে পাশের বাড়ির তপন ব্যানাজীর্দের পরিবার আর বিজয়, এরা একরকম ঘরের লোক হয়ে গেছে। ছুটি ছাটার দিনে মাঝে মাঝেই একসাথে খাওয়া দাওয়া হৈ হুল্লোড় হয়।
দেখতে দেখতে আলোর বয়স চার বছর হল। ওর স্কুলটা একটু দূরে। আনন্দ ছেলে মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে আর বাড়ি আনে তনিমা। দুজনেরই পড়াশোনায় আগ্রহ আছে। আনন্দ ওদের জন্য একজন মাষ্টার রাখার কথা বলতে তনিমা আপত্তি করে বলেছিল—এইটুকু বাচ্চাদের আবার মাষ্টার কিসের? আমি তো রোজই ওদের পড়াই।
-- না আসলে তোমার একার ওপর বড্ড চাপ পড়ে যাচ্ছে তাই।
-- আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। আর তুমি নিজেও তো একটু পড়াতে পার।
-- ঠিক আছে, কাল থেকেই শুরু করছি। এই আশা, এই আলো, কাল সন্ধ্যে বেলা থেকে তোমাদের নতুন মাষ্টার মশাই পড়াবেন।
-- কে বাবা, কে বাবা ?
-- আমি ই ই ই।
-ছেলেমেয়ে তো হেসেই খুন।
তনিমা কপট রাগ দেখিয়ে বলল—অমন ফাজলামো করলে ওরা আর তোমার কাছে পড়েছে। নির্মল আনন্দে সময়টা ভালই কাটছিল। কিন্তু কোন সুখই আনন্দর কপালে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ছেলে মেয়ে দুটো তখন একটু বড় হয়েছে। মেয়ে ক্লাস সিক্স আর ছেলে থ্রীতে পড়ে। কয়েক মাস হল তনিমার আচরণে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। অমন হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মেয়ে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবে। অল্পেতেই রেগে যায়। ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর আনন্দ নানাভাবে বহুবার তনিমাকে জিজ্ঞেস করেও কারণটা কি তা জানতে পারেনি। কিন্তু সমস্যাটা ক্রমশ বাড়তে থাকায় আনন্দ একদিন তনিমাকে বলল—তোমার শরীরটা নিশ্চয় ভেতরে ভেতরে খারাপ হয়েছে। চলো একটা ভাল ডাক্তারকে দেখাই। উত্তর না দিয়ে তনিমা চুপ করে রইল। কিন্তু আনন্দ ডাক্তার দেখাবার জন্য পীড়াপীড়ি করাতে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে তনিমা বলল— আমি ঠিক আছি। আর আমাকে নিয়ে তোমার অত না ভাবলেও চলবে।
এই তনিমা আনন্দর একেবারে অচেনা। এতদিন যে মানুষটার সাথে ঘর করেছে এ যেন সে নয়। আনন্দ চুপ করে গেল। আগে কখনও মনমালিন্য হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তনিমা তা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করত। সে চেষ্টা দূরে থাক, আনন্দর সাথে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছে। ছেলে মেয়েদের সাথে একটু আধটু যা কথা বলে। তাও যে ছেলে মেয়ে ওর প্রাণ তাদেরও কারণে অকারণে বকাবকি করে। বাড়ির কাজকর্ম, বাগান, কোনকিছুতেই আর মন নেই। আচরণে মানসিক বিকারের লক্ষণ স্পষ্ট। আনন্দ খুব চিন্তায় পড়ে গেল। বাড়িতে কোন গোলমাল বা অশান্তি হয়নি। কেন এমনটা হল তার কোন কারণই মাথায় আসছে না। ডাক্তারের কাছেও যেতে চাইছে না। কি করবে বুঝতে না পেরে পাশে তপনদের বাড়িতে গিয়ে সব কিছু খুলে বলল।
-- বিজয় আর তোমরা আমার অত্যন্ত কাছের লোক। বিজয়ের তো আজকাল দেখাই পাওয়া যায় না। তোমরা একটু চেষ্টা করে দেখ, যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে তনিমাকে কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পার।
-- ব্যাপারটা আমাদেরও চোখে পড়েছে। আগে আপনারা অফিস চলে গেলে আমি আর বৌদি কত গল্প গুজব করতাম। ইদানীং বৌদি তো আসেইনা আর আমি আপনাদের বাড়ি গেলেও দায়সারা ভাবে দু একটা কথা বলে। ফলে আমিও আর যাওয়ার আগ্রহ পাই না।
আনন্দকে আস্বস্ত করে অনিতা বলল— আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করব। তপন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবে আর বৌদিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ভার আমার। আপনি অত চিন্তা করবেন না, আমরা পাশে আছি।
আনন্দ খানিকটা নিশিন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরল। এই অদ্ভুত আচরণ শুরু হওয়ার পর থেকে তনিমা আনন্দের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আনন্দও আর ঘাটায় না। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে যতটা পারে সময় কাটায়।
তপন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছে। সামনের রবিবার সন্ধ্যায় সময় দিয়েছে। এখনও তনিমার কানে যায়নি, গেলেই একটা অশান্তি বাধাবে।
সেদিন কলেজে ক্লাস কম ছিল। শরীরটাও ভাল লাগছিল না, তাই লাইব্রেরি বা অন্য কোথাও না গিয়ে আনন্দ সোজা বাড়ি ফিরে এল। বাড়িতে ঢোকার সময় দেখে তপন সামনের বারান্দায় পায়চারি করছে। ডাক্তার দেখাবার ব্যাপারে তনিমাকে রাজি করাতে এসেছে বোধহয়। ইশারায় তপনকে জিজ্ঞেস করলে ও আনন্দকে বাড়ির ভেতরে যেতে বলল। শোওয়ার ঘরের খাটের ওপর অনিতার কোলে মাথা রেখে দুই ছেলে মেয়ে অঝোরে কাঁদছে। আনন্দ কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। বাবাকে দেখতে পেয়ে বাচ্চা দুটো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল— বাবা, মা নেই।
-- সেকি, কোথায় গেল ?
অনিতা চুপ করে বসে আছে।
অনিতা তুমি কিছু জান ?
অনিতা তখনও চুপ।
চুপ করে থেক না, তনিমার কি হয়েছে বল।
অনিতা আমতা আমতা করে বলল— আপনি ওর সাথে কথা বলুন।
আনন্দ ছুটে গিয়ে তপনকে জিজ্ঞেস করল— আমাকে খুলে বল কি হয়েছে।
তপন ছেলেমেয়েদের থেকে একটু আড়ালে সরে গিয়ে কোনরকম রাকঢাক না করে জানাল— তনিমা তোমার ঘর ছেড়ে বিজয়ের সাথে চলে গেছে।
আনন্দ স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ এতরকম দুশ্চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেলেও এটা একবারের জন্যও ভাবতে পারেনি। তপন টেবিল থেকে একটা খাম এনে আনন্দকে দিল। ভেতরে তনিমার লেখা একটা চিঠি।
‘জানি যা করছি সমাজের চোখে তা চরম পাপ। নিজের মনের সাথে এই ক মাস অনেক যুদ্ধ করেছি। কিন্তু কি করব, অনেক চেষ্টা করেও বিজয়ের আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারলাম না। ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য কষ্ট হচ্ছে। ওদের নিয়ে যেতাম। কিন্তু ওরা তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমার এ কাজ ক্ষমার অযোগ্য তাই ক্ষমা চাইছি না। ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখ। ওরা তোমার কাছে ভাল থাকবে। আমাকে ভুলে যেও। ভাল থেক।-- তনিমা’
চিঠিটা পড়ে আনন্দর চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মনটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হায় রে সংসার। নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা সোনার সংসারকে কত সহজে ছারখার করে দিয়ে চলে গেল। সে নিজের কথা না হয় বাদই দিল, কিন্তু তনিমা তো একজন মা। কি করে পারল ছেলেমেয়েদের ওপর এতটা নিষ্ঠুর হতে। আর যে ছেলেটাকে সে নিজের ভাইএর মত দেখত, বিশ্বাস করত, তার কাছেই পেল এমন চরম আঘাত। মানুষকে ভালবাসা আর বিশ্বাস করার কি নির্মম পরিণতি। আনন্দ অবাক হয়ে ভাবে যে সংসারে সম্পর্কগুলো এত ঠুনকো হলে সমাজটা এখনও টিকে আছে কি করে ! মনের ভেতরের দুঃখ কষ্টটা আস্তে আস্তে চরম রাগ আর ঘৃণায় পরিণত হল। নিজের মনকে বোঝাল যে ভেঙে পড়লে চলবে না। বাচ্চা দুটোর জন্য ওকে শক্ত হতে হবে। ওদের যে ও ছাড়া আর কেউ নেই। খবরটা শ্বশুর বাড়িতেও পৌছল।
-- প্রাথমিক সংকোচ কাটিয়ে শ্বশুর শাশুড়ি বাড়িতে এসে আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে নিজেদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। আমার মাথার ঠিক ছিল না। ওদের সকলের মধ্যেই তখন আমি তনিমাকে দেখতে পাচ্ছি। ওদের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় করে দিই। এমনকি এক সময়ের আমার প্রানের বন্ধু অমল সান্ত্বনা দিতে এলে ওকেও দূর দূর করে তাড়াই।
-- কিন্তু একা দুটো বাচ্চাকে সামলাতেন কি করে? যখন কলেজে যেতেন তখন তো ওরা একেবারে একা থাকত।
-- ওটাই তখন আমার সবথেকে বড় চিন্তা ছিল অজয়। প্রথমে বেশ কিছুদিন কলেজে যেতে পারিনি। তারপর সারাক্ষণের জন্য একজন মাঝবয়সী মহিলাকে রেখেছিলাম। ওই বাচ্চাদের দেখত। এছাড়া তপন আর ওর স্ত্রী ওই দুঃসময়ে সারাক্ষণ পাশে ছিল। বাচ্চা দুটোকে যতটা সম্ভব আগলেছে। সমস্যা আরো ছিল। ততদিনে খবরটা চারিদিকে বেশ চাউর হয়ে গেছে। পাড়ায়, কলেজে, বাজারে, সর্বত্র একই প্রশ্ন। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ পরামর্শ দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ শুধু মজা লুটছে। আমার তখন উন্মাদের অবস্থা। পরিচিত মানুষ দেখলেই আতঙ্ক হচ্ছে। কেউ কিছু বলতে এলেই, তা ভাল মন্দ যাই হোক, রাগ হচ্ছে।
ফোন বাজল। আনন্দ গিয়ে খানিকক্ষণ কথা বলে আবার এসে বসল।
রাত তখন প্রায় নটা। অজয় আগেই বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে ফিরতে একটু দেরী হবে। কিন্তু সেই একটুটা যে এতক্ষণ হয়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি। এখন পুরোটা না শুনে উঠতেও মন চাইছে না। দুজনেরই তখন নেশা ধরেছে। একজনের শোনাবার নেশা আর অপরজনের শোনবার নেশা।
লোকলজ্জার যন্ত্রণায় আনন্দ ভবানিপুরের ‘সোনার সংসার’ ছেড়ে অনেক দূরে দমদমে একটা ভাড়া বাড়িতে এসে উঠল। এখানে সকলেই তার অপরিচিত। সারাক্ষণ অন্ততঃ তনিমাকে নিয়ে নানা কুরুচিকর প্রশ্নের উত্তর তো দিতে হবে না। মা চলে যাওয়ার পরে আশা কয়েকদিন ভাইএর সাথে খুব কান্নাকাটি করেছিল। তারপরে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে ওইটুকু মেয়ে বাড়ির সকলকে সামলেছে। ভাইকে সারাক্ষণ সামলানোর সাথে সাথে বাবাকেও নানাভাবে ভুলিয়ে রেখেছে। ছোট্ট আশা মানসিক ভাবে অনেক বড় হয়ে গেছে। মায়ের জাত তো। মেয়েরা বোধহয় এমনই হয়। তনিমা কি তবে ব্যতিক্রম! হয়ত।
শুধু বাড়ি পাল্টেই সমস্যা মেটেনি। একই কারণে চাকুরিস্থলও পাল্টাতে হল। শহরের ভাল কলেজ ছেড়ে মফস্বলের একটা কলেজে চাকরি নিল। রেজাল্ট ভাল, অধ্যাপক ভাল, ফলে কলেজ পাল্টাতে অসুবিধে হয়নি।
জীবনে তনিমার মধুর স্মৃতি আর তার কাছে পাওয়া চরম আঘাত, কোনটাই আনন্দর পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। তবু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই স্বাভাবিক হয়ে এল। তনিমা এখন এই সংসারে অতীত। স্ত্রী অথবা মা, কোনরূপেই সে আর এখন এই সংসারকে কাঁদাতে পারবে না। ছেলেমেয়েদের মনে এখন মার জন্য আছে কেবল ঘৃণা আর আক্রোশ। আনন্দর মনে তাও নেই। তনিমার প্রতি ভালবাসা, ঘৃণা, ক্রোধ, কোনটাই সে অনুভব করে না।
দেখতে দেখতে আশা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হল। লেখাপড়ায় ছেলেমেয়ে দুজনেই ভাল। আনন্দই ওদের গাইড করে। শুধু পড়াশোনা কেন, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে বাবাই ওদের পরামর্শদাতা, বন্ধু, সবকিছু।
আনন্দর শ্বাশুড়ি তখন খুব অসুস্থ। নাতি নাতনিকে একবার দেখার জন্য অনেক কান্নাকাটি, অনুনয় করে চিঠি লিখে ছেলেকে আনন্দর কাছে পাঠালেন। সেবার আনন্দ আর কোন বাধা দেয়নি। ছেলেমেয়েরা যাবে না বলে বেঁকে বসলেও আনন্দই ওদের বুঝিয়ে রাজি করায়। মা চলে যাওয়ার পর এই প্রথম ওদের মামার বাড়িতে যাওয়া। আশার তবু কিছু মনে আছে। আলোকের কাছে জায়গা, মানুষজন সবই নতুন। আদর ভালবাসা সব পেলেও ওরা একবারের জন্যও ভুলতে পারছিলনা যে এরা সকলেই মায়ের লোকজন। কোনক্রমে একদিন থেকে জোর করেই দুজনে বাড়ি ফিরে আসে।
-- স্যার, এবারের বড়দিনের ছুটিতে কিন্তু আমার দেশের বাড়িতে যেতেই হবে।
-- ঠিক আছে যাব।
-- প্রত্যেক বারেই যাব যাব বলেন কিন্তু যান না।
-- নারে বিশু, এবার ঠিক যাব।
-- মনে থাকে যেন স্যার।
বিশু মানে বিশ্বনাথ টুডু, আনন্দর কলেজের পিওন। পুরুলিয়ার একটা গ্রামেতে ওর বাড়ি। আনন্দকে খুব ভালবাসে। আনন্দকে একবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ওর অনেক দিনের ইচ্ছে । প্রায়ই বলে কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
--আমি দু তিন দিনের জন্য পুরুলিয়ায় বিশুর বাড়িতে যাব ভাবছি। এমন ভাবে ধরেছে। তোরা কদিন একা থাকতে পারবি?
-- কেন পারব না । আমরা কি এখনও বাচ্চা আছি নাকি ? বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে আশা জানাল।
ঠিকই তো। ওইটুকু দুটো বাচ্চা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। আশা মাস্টার্স করছে আর আলো কলেজে পড়ে। আশা অনেকটা বাবার মতন। কোন চাহিদা নেই। বাবা যা দেয় তাতেই খুশি। আলোর ধরণটা একেবারে আলাদা। আবদার লেগেই আছে। আর কখনও অভিমান করে, কখনও বা বাবার গলা জড়িয়ে আদর করে কাঙ্ক্ষিত জিনিস সে আদায় করেই ছাড়বে। আনন্দও ছেলেমেয়েদের কোন দিক থেকে কোন অভাব রাখেনি। সব সময় নানাভাবে চেষ্টা করেছে যাতে সন্তানেরা মায়ের অভাব বুঝতে না পারে।
আলো এমন সুযোগ হাতছাড়া করল না। রসিকতা করে বলল—যাওয়ার পারমিশান দিচ্ছি, কিন্তু বাবা একটা শর্ত আছে।
-- এতে আবার শর্ত কিরে ?
-- আছে, আছে। একটা ভাল রেস্টোরেন্টে দুজনের খাওয়ার পয়সা দিয়ে যেতে হবে।
-- কি হচ্ছে ভাই ? আশা ধমক দিল।
-- কিছু না দিদি। সোজা হিসেব। বাবা বেড়াতে যাবে আর আমরা খেতে যাব।
আনন্দ ছেলের গাল টিপে প্রস্তাবে সম্মতি দিল।
ডিসেম্বর প্রায় শেষ। ঠান্ডা ভালই আছে। আর কোলকাতা থেকে গ্রামের দিকে ঠান্ডা অনেক বেশি হবে। দুদিনের মত জামা, প্যান্ট, টুকটাক জিনিস আর একটা শাল ছোট একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগে পুরে সকালে একটা ট্রেন ধরে আনন্দ পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল। বিশুর বাড়ি যে স্টেশনে সেখানে কয়েকটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়া আর কিছুই দাঁড়ায় না।
তাই পুরুলিয়ায় নেমে ট্রেন পাল্টাতে হবে। পুরুলিয়ায় নেমে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা লোকাল ট্রেনে উঠল। বিকেল চারটে নাগাত পৌঁছল বিশুর স্টেশন বাগালিয়া হল্টে। একেবারেই ছোট স্টেশন। যাত্রীও হাতে গোনা কয়েকজন। গাড়ি এক মিনিট দাঁড়াবে। বিশুই মালপত্র নামিয়ে আনন্দকে নিয়ে একটা রিকশায় চেপে বসল। স্টেশনের পাশে দু একটা দোকানপাট ঘরবাড়ি রয়েছে। একটু এগোতেই চারিদিক সব ফাঁকা হয়ে গেল। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে কয়েকটা বাড়ি
আর বাকি ধু ধু প্রান্তর। কোথাও কোথাও কিছু চাষবাস হচ্ছে। এত রুক্ষ লাল মাটিতে চাষও সেরকম ভাল হওয়ার কথা নয়। স্টেশনের কিছুটা পর থেকে রাস্তাও কাঁচা আর এবড়ো খেবড়ো।
একটা মাটির বাড়ি দেখিয়ে বিশু বলল— ওটা স্যার একটা ছোটদের স্কুল। লেখাপড়া ছাড়াও ওখানে একটু আধটু হাতের কাজও শেখান হয়। কালকে আপনাকে এখানে নিয়ে আসব স্যার। আপনার মত মাস্টারমশাইয়ের পদধূলি পড়লে আমাদের ছেলেমেয়েগুলো ধন্য হয়ে যাবে।
-- বাজে বোকো নাতো। তোমার বাড়ির বাচ্চারা কি এই স্কুলেই পড়ে ?
-- হ্যাঁ স্যার, শুধু আমার বাড়ি কেন, আমাদের মহল্লার প্রায় সব বাড়ির ছেলেমেয়েরাই এখানে পড়তে আসে।
বাড়ির বাইরে দু একটা বাচ্চা দৌড়াদৌড়ি করছে। গেটের সামনে স্কুলের নাম বড় বড় করে লেখা “আশালোক বুনিয়াদী বিদ্যালয়”।
বেশ নতুন ধরণের সুন্দর নাম।
আর একটু যেতেই বিশু বলল— স্যার এসে গেছি।
সামনে অনেক ঘরবাড়ি। অধিকাংশই মাটির। কিছু পাকা বাড়িও রয়েছে। একটু এগিয়ে বাঁ ধারে একটা পাকা বাড়ি দেখিয়ে বিশু জানাল—স্যার ওটা আমার বাড়ি।
রিকশাওয়ালা জিনিসগুলো ঘরে পৌঁছে দিল। আনন্দ ভাড়া দিতে গেলে কিছুতেই নিল না। বিশু নিশ্চয় মানা করেছে। রিকশাওয়ালার বাড়িও ওই পাড়াতেই। এর মধ্যে ওদের দেখতে লোক জমে গেছে। দু একজন আনন্দর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে গেল। ব্যাপার স্যাপার দেখে মনে হল বিশু এ পাড়ার একজন কেউকেটা। আর সেটাই স্বাভাবিক। কোলকাতায় চাকরি করে, একটা পাশ দিয়েছে, তার ওপর তুলনামূলক ভাবে অবস্থাও ভাল। একটা ঘর আনন্দর জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। এদের আতিথেয়তা আর আন্তরিকতায় আনন্দ অভিভূত হয়ে গেল।
খানিক বাদে বিশু আনন্দকে নিয়ে বের হল। ঘোরা বা দেখার সেরকম কিছু নেই। আদিবাসী পাড়াটা পার হলে চাষের জমি আর ফাঁকা মাঠ। অনেক আদিবাসী এলাকা আনন্দর ঘোরা। এদের নিয়ে ওর গবেষণা মূলক কিছু লেখা বিভিন্ন সময়ে নানান পত্রিকায় বেরিয়েছে। অনান্য জায়গাগুলোর মত বিশুদের পাড়ায় অভাব অনটন সেরকম চোখে পড়েনি। প্রত্যেক বাড়িতেই বড়রা কিছু না কিছু উপার্জন করে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানর একটা আগ্রহও আছে। আর সর্বোপরি পাড়ার লোকেদের মধ্যে বেশ সদ্ভাব আছে। দেখে আনন্দর খুব ভাল লাগল। পাশেই রয়েছে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র। একটু এগোতেই একটা শিব মন্দির দেখিয়ে বিশু বলল— স্যার, বাবা খুব জাগ্রত। বাবার কাছে মন থেকে কিছু চাইলে ঠিক পাওয়া যায়।
তুমি কি কি পেয়েছ?
-- আমার ছেলে, মেয়ে, বৌ, চাকরি, বাড়ি সবই বাবার দয়ায়।
আনন্দ একটু হেসে বলল— তাহলে তোমার চেষ্টায় কিছুই হয়নি বলছ।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বিশু একটু লজ্জা পেল। ঝাঁ চকচকে মন্দির। বিশুর কাছে জানতে পারল যে বছর কয়েক আগে একটা ট্রাস্ট পুরোনো মন্দিরটাকে সংস্কার করে এখনকার অবস্থায় এনেছে। আনন্দ নাস্তিক না হলেও জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হতে তার ঈশ্বরে বিশ্বাসটা ফিকে হয়ে গেছে। এখনও সে ঠাকুর দেবতাকে প্রণাম করে ঠিকই, তবে তার অধিকাংশটাই এতকালের অভ্যাসের ফলে, বিশ্বাসে নয়। চটি খুলে দুজনে মন্দিরে ঢুকল। এখানে শিব হিসেবে যা পুজো করা হয় তা কোন শিবলিঙ্গ নয়। একটা গোল মত কালো পাথর শ্বেত পাথরের সিংহাসনে বসান আছে। বিশু হাত জোড় করে বিড় বিড় করে কিছু বলতে শুরু করল। বোধহয় শিব ঠাকুরের কাছে নতুন কোন চাহিদা জানাচ্ছে।
মন্দিরে ঢুকে আনন্দরও বেশ ভাল লাগছে। অভ্যাসবসে ছেলে-মেয়ে দুটোর ভাল চেয়ে চোখ বন্ধ করতেই মনের জানালা দিয়ে তৃতীয় একজন কখন যেন ঢুকে পড়ল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে আলাদা করে সরান গেল না। অতবড় আঘাত সত্ত্বেও এতকাল পরেও আনন্দর অবচেতন মনে তনিমা এখনও রয়ে গেছে। সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে ওরা ফিরে এল।
-- স্যার কাল আমাদের রাতে গাড়ি। সকালবেলা স্কুলে যাব।
-- তোমার জায়গায় এসেছি, যেখানে নিয়ে যাবে যেতে হবে।
-- গিয়ে দেখবেন ভাল লাগবে।
রাতে বিছানায় শুয়ে কেবলই তনিমার কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। এতদিন বেশ ভুলে ছিল। ওই শিব মন্দিরে গিয়ে সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
সকালবেলা স্কুল দেখতে যাওয়ার আগে আনন্দ বাচ্চাদের জন্য কিছু লজেন্স আর বিস্কুট কিনে নিল। বিশুও চান টান করে রেডি।
-- তোমাদের স্কুলে কোন ক্লাস পর্যন্ত আছে ?
-- ক্লাস ফাইভ অব্দি স্যার। ঘর খুব কম। পলিথিন, টিন, এসব দিয়ে ঢেকে কোনরকমে ম্যানেজ হচ্ছে। বর্ষাকালে খুব অসুবিধে হয়। আসলে স্যার পয়সার বড় অভাব। এবার আমাদের এম.এল.এ. কথা দিয়েছেন স্কুলটার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।
-- রাজনীতির কারবারিদের প্রতিশ্রুতি কর্পূরের থেকেও তাড়াতাড়ি উবে যায় এটা জান তো।
-- তা ঠিক। তবে অনেককেই ধরেছি, এবার একটা কিছু ব্যবস্থা করেই ছাড়ব।
সমাজকল্যাণ মূলক কাজে বিশুর এই উৎসাহ আনন্দর খুব ভাল লাগল।
বেরোবার সময় সাথে চেক বইটা নিয়ে নিল। সঙ্গে তেমন টাকা নেই, যদি কিছু ডোনেট করতে ইচ্ছে হয় চেক কেটে দেবে। স্কুলটা বিশুর বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ। তখনও স্কুল শুরু হয়নি। বাচ্চারা সব একে একে আসছে। বিশুর মহল্লার বাচ্চারা সংখ্যায় বেশি হলেও আশে পাশের গ্রাম থেকেও ছেলে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে। স্কুলে আসার কথাটা বোধহয় বিশু আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েকজন সার দিয়ে আনন্দকে অভ্যর্থনার জন্য স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশু এক এক করে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে আনন্দকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
-- স্যার একটু বসুন, বড় দিদিমণি এখনই আসছেন।
বসার সাথে সাথেই একজন চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। তারপর শুরু হল পেন্নামের পালা। মাস্টার, পড়ুয়া, কেউ বাদ যাচ্ছে না। অল্প সময়ের মধ্যেই বড় দিদিমণি ঘরে ঢুকলেন। আনন্দকে তখন দেখা যাচ্ছে না। কৌতূহলী ছাত্র শিক্ষক সব ওকে ঘিরে রয়েছে। কেউ ওর পা ছুঁয়ে কেউ একটু কথা বলে ধন্য হচ্ছে। আর আনন্দ তখন সঙ্গে আনা লজেন্স বিস্কুটগুলো বাচ্চাদের মধ্যে বিলোচ্ছে।
-- নমস্কার স্যার। একটু দেরী হয়ে গেল, মার্জনা করবেন। বাচ্চারা, স্যারকে আর বিরক্ত কোরো না। তোমরা এবার ক্লাসে যাও।
-- গলাটা শুনেই আনন্দ চমকে উঠল। প্রতি নমস্কারের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে সামনের মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তনিমা। একটা হাল্কা আকাশি রঙের শাড়ী পরা। এতগুলো বছর পরেও চেহারাটা প্রায় একই আছে।
বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর অস্ফুট স্বরে আনন্দ জিজ্ঞেস করল— তোমরা এখানে থাক?
-- আমি একাই থাকি।
শিক্ষক ছাত্র সবাই ক্লাসে চলে গেছে। ঘরে তখন শুধু ওরা দুজন। আনন্দর মনের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কত কিছু বলতে আর জানতে ইচ্ছে করছে। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করল।
-- কাল বিশুর কাছে নাম আর পেশায় অধ্যাপক শুনে মনে হয়েছিল যে মানুষটা তুমিই হবে। তবে এক নামে তো একাধিক মানুষ থাকে তাই নিশ্চিত হতে পারিনি।
আনন্দ নিজের আবেগকে লাগাম দিয়ে চুপ করে রইল।
-- ছেলে মেয়ে দুটো কত বড় হয়ে গেছে। ওদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ওরা এখন কি করছে?
আনন্দ সংক্ষেপে জানাল।
-- এতদিন বাদে দেখা হল, আমায় ভাল মন্দ কিছুতো বল।
-- সব সম্পর্কেই তো বহুকাল আগে ইতি টেনে দিয়েছ তনিমা। এতদিন বাদে আর কি বা বলার থাকতে পারে !
কথার মাঝে বিশু আর একজনের সাথে এক প্লেট জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল।
-- খেয়ে নিন স্যার।
-- তুমি কি পাগল, এত কে খাবে বলত ?
কিছু খেতেই হল।
আনন্দকে থামিয়ে অজয় জিজ্ঞেস করল— এতকাল পরে দেখা, ওভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকলেন কি করে? ভাল কথা যদি নাও বলা যায়, মনের ভেতর জমে থাকা রাগ দুঃখটা তো প্রকাশ করতে পারতেন।
-- ওর প্রতি তখন আমার মনে রাগ, দুঃখ বা ঘৃণা কিছুই নেই। ওটা আমার জীবনে ঘটা অনেক দুর্ঘটনার মধ্যে একটা বলে মনে করি। আর সেদিন কম কথা বলেছি কারণ তা না হলে নিজেকে সামলাতে পারতাম না।
চলে আসার আগে আনন্দ চেক বইটা খুলে এক লাখ টাকার একটা বেয়ারার চেক তনিমাকে দিয়ে বলেছিল— টাকাটা বিরাট কিছু নয়, তবু এতে যদি কোন উপকার হয় ভাল লাগবে।
তনিমা না করেনি।
উপকারটা কার তনিমার না স্কুলের তা উহ্য ছিল। তাই চেকে পে র জায়গাটাও ফাঁকাই রাখা ছিল।
ফিরে আসার সময় তনিমা খুব আস্তে বলেছিল— সকলে ভাল থেক।
অনেক চেষ্টা করেও সে আনন্দের কাছ থেকে চোখের জল লুকোতে পারেনি।
-- চেকটা তাহলে আপনি স্কুল নয়, তনিমাকেই দিয়েছিলেন।
-- বলতে পার। আমাকে এক সময় স্বামী রূপে অস্বীকার করলেও আমার সন্তানের মা হিসেবে তো আমি ওকে অস্বীকার করতে পারি না।
তনিমার সামনে সব আবেগ, কৌতূহল, চেপে রাখলেও স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে বিশুকে আনন্দ জিজ্ঞেস করল— তোমাদের দিদিমণি কি বরাবরই এখানে থাকেন ?
-- না স্যার। বেশ কয়েক বছর আগে কয়েকজন লোক কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে আমাদের এখানে লেখাপড়া আর চিকিৎসার উন্নতির জন্য কাজ করতে এসেছিল। দিদিমণিও ওই দলে ছিল। ওনাদের চেষ্টাতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর এই স্কুলটা হয়েছে। বছর দুয়েক বাদে অন্যরা চলে গেলেও দিদিমণি এখানেই থেকে গেলেন। আসলে আমাদের ভালবেসে ফেলেছেন। স্কুলেরই একটা মাটির ঘরে থাকেন আর সারাদিন বাচ্চাগুলোকে নিয়েই মেতে থাকেন। মানুষটা খুব ভাল স্যার। এখানে সবাই ওনাকে খুব ভালবাসে আর মান্য করে।
-- দিদিমণির ঘরবাড়ি, পরিবার পরিজন, কেউ নেই ?
-- সেও একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার। বললেন “চলতে চলতে একদিন হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। আর তখনই না আমার জীবনের সব থেকে দামী জিনিসগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল”। উনি কি যে বললেন স্যার কিছুই বুঝলাম না। তবে আর ওই নিয়ে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
-- স্কুলের নামটা দিদিমণি রেখেছে তাই না ?
-- স্কুলের সব কিছুই ওনার মতে হয়েছে স্যার।
সন্তানদের নামেই স্কুলের নামটা রেখেছে। বাড়ি ফিরে এসে তনিমার ব্যাপারটা ছেলে মেয়েদের জানাবে কিনা তাই নিয়ে আনন্দ একটু দোটানায় ছিল। কিছুদিন বাদে দুজনকেই সব কিছু জানায়। কিন্তু ছেলে বা মেয়ে কেউই মায়ের ব্যাপারে সামান্যতম আগ্রহও দেখায়নি। আশা এম.এ. পাশ করে অল্প সময়ের মধ্যেই একটা ভাল চাকরি পেয়ে গেল। প্রথম মাইনের টাকায় বাবা আর ভাইএর জন্য কতকিছু এনেছিল। সেই কোন ছোটবেলায় মা চলে যাওয়ার পর থেকে বিয়ের আগে পর্যন্ত আশা বাড়িটাকে সব দিক থেকে আগলে রেখেছিল।
কমল ওর স্ব নির্বাচিত। সম্পর্কটা জানার পর আনন্দ একদিন ছেলেটিকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল। ছেলেটার কথাবার্তা ভাল। দেখতে শুনতেও খারাপ নয়। বয়স আশারই গায়ে গায়ে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বাড়িতে মা আর ছেলে থাকে। বাবা বছর কয়েক আগে মারা গেছেন। আনন্দ কোন আপত্তি করেনি। আপত্তি করার কথাও নয়। আশা চলে যেতে বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আলোর একটা আলাদা পরিমণ্ডল, আলাদা জগৎ তৈরি হতে শুরু হয়। সেটা আস্বাভাবিক কিছু নয়। ছেলেপুলে বড় হলে তার নিজস্ব একটা স্পেস তো থাকবেই। আশারও ছিল। কিন্তু একসাথে বসে খাওয়াদাওয়া, অবসর সময়ে সকলে মিলে গল্প গুজব ইত্যাদি করার মধ্যে দিয়ে ও বাড়ির সম্পর্কের বাঁধনটাকে কখনও আলগা হতে দেয়নি। ওর নিজস্ব সম্পকর্গুলো কখনই পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়নি।
কিন্তু আলোর নতুন সম্পকর্গুলো ওকে ধীরে ধীরে আনন্দের থেকে দূরে আরো দূরে নিয়ে যেতে থাকে। বাবার সাথে ছাড়া যে কোনদিন খেতে বসত না সেই ছেলের কাছে এখন বাড়ির এইসব ছোটখাট সেন্টিমেন্টের কোন মূল্য নেই। কতদিন আনন্দ রাতে একসাথে খাবে বলে ছেলের অপেক্ষায় বসে থেকেছে। অনেক রাতে ছেলে যখন মাতাল হয়ে ঘরে ফিরেছে তখন তার আর খাওয়ার অবস্থা ছিল না। একদিন পাকাপাকিভাবে ব্যাপারটায় ইতি টেনে বলে দিয়েছে—বাবা তুমি রোজ আমার জন্য বসে থেক না। তুমি তোমার মত খেয়ে নিও। আমি আমার সুবিধে মত খাব।
কিছু বলার নেই। বড় হয়েছে। ছেলেবেলার অভ্যাসগুলো তো পাল্টাবেই। আনন্দ খবর নিয়ে জেনেছে যে ছেলে অসৎ সঙ্গে পড়েছে। কয়েকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। যৌবনের উদ্দাম স্রোতে নৌকো তখন বাঁধন ছিঁড়ে ভাসতে ভাসতে ঘাটের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটা সময়ের পরে একই বাড়িতে থাকলেও, বাবা আর ছেলের মধ্যে মানসিক যোগাযোগটা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অথচ এমনটা হওয়ার কোন কারণ ছিল না। আনন্দ সব সময় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে তার দুই সন্তানকে আগলে রেখেছিল। ওদের কোনদিন কোনকিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি।
-- বুঝলে অজয়, এরপর মাঝে মাঝেই একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে আসতে শুরু করল। থাকতে না পেরে একদিন মেয়েটি কে তা জানতে চাইলাম। বেশ উত্তেজিত হয়ে জানিয়েছিল যে ওটি ওর গার্ল ফ্রেন্ড। আমারও সহ্যের সীমা তখন পার হয়ে গেছে। বলেছিলাম যে আমার বাড়িতে এসব চলবে না। এর কয়েকদিন বাদে আলো বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে গিয়েছিল ‘তুমি কি ভেবেছ তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না’!
এরপর বাবার সাথে অনেকদিন কোন যোগাযোগ রাখেনি। আনন্দ ছেলের খবর কিছু কিছু রাখত। লেখাপড়ার পাঠ আগেই সাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। কোথায় একটা ছোটখাট কাজ করত। রোজগার সামান্যই, তাই বস্তি এলাকায় একটা ঘর ভাড়া করে ছিল। এরমধ্যে বিয়েটাও সেরে ফেলেছে। নিজের ছেলের বিয়েতে আনন্দ একজন সাধারণ নিমন্ত্রিত ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর নিমন্ত্রণটাও হয়েছিল অত্যন্ত দায়সারাভাবে। আত্মসম্মানবোধ আছে এমন মানুষ নিজের ছেলের বিয়েতে এভাবে যেতে পারে না। আনন্দও যায়নি। দুঃখ, কষ্ট, আঘাত, আনন্দর জীবনে নিত্য সঙ্গী। তবু ছেলের কাছে পাওয়া আঘাত বোধহয় সবকিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছে।
মেয়ের ইচ্ছেয় আর চেষ্টায় মেয়ের ফ্ল্যাটের সামনা সামনি এই ফ্ল্যাটটা কিনে বহুদিন কাটান দমদমের ভাড়া বাড়িটা ছেড়ে একসময় এখানে চলে আসে। এখানে মেয়েরও বাবাকে দেখাশুনার একটু সুবিধে হয় আর আনন্দরও নাতি নাতনির সাথে সময়টা ভালই কাটে। আলোর বউ অনেকবার এই ফ্ল্যাটে এসেছে। কয়েকবার আলোও সঙ্গে ছিল। মেয়েটি খারাপ নয়।
স্বামীর আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়ে আবার বাপ ছেলের সম্পকর্টা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এমনকি আলোকে দিয়েও তার কৃতকর্মের জন্য বাবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করিয়েছে।
আনন্দ যেমন জীবনে কখনও কোন কিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি, তেমনই আঘাত জর্জরিত জীবনে সব আঘাত
সামলে অচিরেই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ওর মধ্যে ছিল। কিন্তু আলোর আচরণের এই কুৎসিত পরিবর্তনের পর থেকে ওকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতেও ঘৃণা বোধ করে। তাই বৌমার শত চেষ্টাতেও বাবা ছেলের সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। তা ছাড়া আনন্দর মনে হত আলো বা তার বউএর তার ফ্ল্যাটে আসাটার পিছনে একটা অভিসন্ধি ছিল। তা হল অর্থ।
-- ছেলের চিঠি না পড়ে কেন রেখে দিয়েছি জানো অজয় ? কারণ খামের ভেতর কি লেখা আছে তা আমার জানা। নয় নিজে নয় বউমাকে দিয়ে টাকা চেয়েছে। চাকরি তো সেরকম কিছু করে না। ভাঁড়ারে টান পড়লেই বাপকে স্মরণ করে।
-- চাইলেই টাকা দিয়ে দেন?
-- অধিকাংশ সময়েই দিই। কি করব ছেলে ত। যত বদই হোক পয়সার অভাবে খেতে পাবে না বাপ হয়ে তা কি দেখতে পারি!
-- তা সামনা সামনি না এসে চিঠি লিখে চায় কেন?
-- সামনে এসে চাইবার তো আর মুখ নেই। আর তাছাড়া এখন এখানে নেই। বিহারে কোথায় যেন কাজ করে। অবশ্য কাজ সেরকমই করে, না হলে ফি মাসে হাত পাততে হয় !
যাক ওসব কথা ছাড়। সব ঘটনা তো শুনলে। এবার বল, আমার মত জীবনে এত বিয়োগ, এত হারানো, এত কষ্ট, আর কখনও শুনেছ ? কেবলই মাইনাস।
-- বাবা কখন খাবে ? কত রাত হল বল তো! আজকাল একদম কথা শুনছ না। আর তুমি না খেলে বাচ্চা দুটোও খাবে না।
কথাগুলো বলার পর মহিলা ঘরে অজয়কে দেখতে পেয়ে লজ্জা পেয়ে যায়।
-- তুই খাবার বাড় আমি এখনই আসছি।
ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর আনন্দ অজয়ের দিকে চেয়ে বলল— আমার মেয়ে।
-- আন্দাজ করেছি। এর পরেও বলবেন আপনার পাওয়ার ঘরে কিছুই নেই। কানাইএর মত একজন অপরিচিত মানুষের নিজেকে উজাড় করে দেওয়া ভালবাসা, সান্নিধ্য ও অসীম নির্ভরতা পাওয়া কজন মানুষের কপালে জোটে। আর আপনার মেয়ে আশা। বিয়ের আগের কথা বাদই দিলাম, বিয়ের এতকাল পরেও বাবার জন্য এত ভাবে, এটা কি কম বড় পাওয়া। সন্তানের এই ভালবাসা আর উৎকণ্ঠায় ভরা শাসন, নাতি নাতনির সঙ্গ, আজকের এই বৃদ্ধাশ্রমের যুগে এক বৃদ্ধের কাছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি থাকতে পারে ! জীবনে আপনি যতবার সমস্যায় পড়েছেন তা থেকে বেরিয়ে আসার পথও কিন্তু কোন না কোন ভাবে পেয়ে গেছেন। জীবনের অঙ্কটা বড় জটিল। কোথায় কি চিহ্ন বসাচ্ছেন তার ওপর নির্ভর করবে এর উত্তর।
কিছু সময় চুপ করে থাকার পর বৃদ্ধ বললেন— তোমার মত করে অবশ্য কোনদিন ভাবিনি। দেখি তোমার প্রসেসে অন্য কোন উত্তর পাই কি না।
এতদিনের জমে থাকা ব্যাথা বেদনাকে উগরে দিতে পেরে মানসিকভাবে মানুষটাকে অনেকটাই ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। এখন একে ভরসা করে বলাই যায় “ভাল থাকবেন”।
অজয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারটা। আর নয়, এবার উঠতে হবে।
Comments
Top
প্রেম পত্র
সুব্রত মজুমদার
কারওয়ান বাজার, ঢাকা, বাংলাদেশ
সুব্রত মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেক্নলোজি, থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। নানা ধরেনের ওয়েবজাইনে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি অগণিত পাঠকদের মনোরঞ্জন ও প্রশংসা অর্জন করেছে। লেখকের মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর ভ্রমন ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা।
মনে আছে মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম যখন আমি কলেজের ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়তে ঢুকেছিলাম। কোলকাতার আশেপাশের কোন একটা ছোট জায়গা থেকে এসেছিল। মনে আছে এই কারণে নয় যে মেয়েটি ডাকসাঁইটে সুন্দরী বা অসাধারন ভালো পড়াশুনায় ছিল বলে। বরঞ্চ উল্টোটাই বলা যেতে পারে। মেয়েটির চেহেরার মধ্যে ছেলেদের আকর্ষণ করার মত বা মেয়েদের হিংসে করার মত কিছু ছিল না। সাধারন সাজ পোষাক পরে সাধারন চেহেরাটাকে আরও সাধারন করে রাখত। মাথার চুলকে টেনে বেঁধে একটা বড় খোঁপা আর সাদা পোষাকেই সবসময়ে দেখতাম তাকে। আমাদের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা ছিল এগারো, ওই মেয়েটি আসার পর হল বারো। আমরা ছেলেরা আড়ালে বলতাম দ্যা ডার্টি ডজন। আমরা লক্ষ্য করলাম যে মেয়েটি কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না, নিজের মনে চুপচাপ বসে থাকে উদাস হয়ে। জোর করে প্রশ্ন করলে শুধু হাঁ বা না বলে উত্তর দায়। কথা বাড়াবার কোনরকম চেষ্টা করেনা। ওকে আমরা হাসতেও কখন দেখিনি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেচে আলাপ করতে গিয়েছিল কিন্তু মেয়েটির ঠান্ডা বরফের মত স্বভাবের জন্য বেশি দুর এগোতে পারেনি। অবশেষে সবাই একসময়ে আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মেয়েরা বলত ওর নাকি ভীষণ দেমাক, আমরা ছেলেরা সেকথা মানতাম না। মেয়েটির নাম জেনেছিলাম আশা। আমরা অনেক রকম নাম দিয়েছিলাম মেয়েটির। কেউ বলত যোগিণী, কেউ বলত সরস্বতী ঠাকুর আবার কেউ কেউ ডাকত মাস্টারনী বলে। মেয়েটির ডানদিকের গালের ঠিক মাঝখানে ছিল একটা ছোট্ট কলো রংয়ের তিল। আমি মেয়েটির নাম দিয়েছিলাম তিলোত্তমা।
খবরটা প্রথম এনেছিল অনন্যা। ওর এক আত্মীয়ের সঙ্গে নাকি আশার বাড়ির লোকেদের চেনাশোনা আছে। ওনারা আশাকে ছোট থেকে বড় হতে থেকে দেখেছেন। ছোটবেলার থেকে আশা নাকি খুব হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। চেহেরাতেও একটা লালিত্য ছিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল আশার জীবনে। জেনেছিলাম আশার বয়স উনিশ। বিয়ে হয়েছিল গ্রামাঞ্চলের এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। বরের বয়স ছিল আশার থেকে অনেকটা বেশি। উপায় ছিল না। একে অভাবের সংসার, তারপর দেখতে ভালো না, রং ময়লা, বিয়ে হচ্ছিল না। বাবা আর মা অনেক ধার দেনা, অনেক পনের বিনিময়ে জামাইকে কিনেছিলেন। কিন্তু সুখ আশার কপালে লেখা ছিল না। বিয়ের প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই আশার বর মারা যায় মোটর সাইকেল একসিডেন্টে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আশাকে দোষ দেয় তাদের ছেলের মৃত্যুর জন্য। অপয়া আর রাক্ষুসী বলে তাকে অপবাদ দেয়। অনেক কান্নাকাটি অনেক হাতেপায়ে ধরাধরি করেছিল আশা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোন কাজ হল না। অবশেষে একদিন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আশাকে তার বাপের বাড়ি তুলে দিয়ে গেল। অসহায় বাবা মা আর কি করবে, মেয়েকে তো আর ফেলে দিতে পারে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আশাকে তাঁরা আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। জীবনের ওপর বিতৃষ-ায় আশা একবার আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সময়মত ধরা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়। অবশেষে এক কাকিমার প্রশয়ে আশা ঠিক করে ও পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কাকিমাই সব খরচা বহন করার ব্যবস্থা করেন। সব শোনার পর আশার ওপর আমাদের মন দুঃখ আর সহানুভুতিতে ভরে উঠেছিল। আমার সব বন্ধুরাই কোন না কোন ভাবে আশাকে তার অজান্েত সাহায্য করার চেষ্টা করত। কেন জানিনা আমি আশাকে কোন সাহায্য করিনি, উলঠে আমি তার সঙ্গে ভয়ানক এক খেলায় মেতে উঠেছিলাম কাউকে না জানিয়ে। আমি আশাকে প্রেমপত্র লিখতে শুরু করলাম। না খামের ভিতরে পোরা, সুন্দর রঙ্গিন কাগজে লেখা স্ট্যাম্প আটকানো চিঠি নয়। খাতার পাতা থেকে ছেঁড়া ছোট চিরকুটে লেখা প্রেমপত্র। আমি শুধু তিনটে কথা লিখতাম চিরকুটে - ‘‘আমি তোমায় ভালবাসি’’। তক্কে তক্কে থাকতাম এবং সুযোগ পেলেই সবার অজান্েত আমার লেখা চিরকুটটা আশার বইয়ের দুটো পাতার মাঝখানে গুঁজে দিতাম। তারপর অনামি এক লেখকের চিরকুটে লেখা ওই তিনটি কথা পড়ে আশার কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আদি অনন্ত কাল ধরে চলে আসা পৃথিবী বিখ্যাত এই তিনটি কথায় ঘায়ল হয়নি এমন মানুষ দুনিয়ায় কোথাও আছে কি না আমার জানা ছিল না। প্রথম চিঠিটা লেখার পর প্রায় তিনদিন উদগ্রিব হয়ে অপেক্ষা করার পরেও আশার মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য রলাম না। ধরে নিলাম যে তার মানে হয় আশা বইটার ভিতরে রাখা চিরকুটটা দেখার সুযোগ পায়নি অথবা আশা মানুষ নয়। আমিও হেরে গিয়ে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। একদিন সুযোগ বুঝে আবার একটা চিরকুট রেখে দিলাম দুটো পাতার মাঝখানে। প্রফেসর ক্লাসে আসার আগে আমরা ছেলেরা আর মেয়েরা নানারকম হাসি আর ঠাট্টায় মসগুল হয়ে থাকতাম। আর উনি ক্লাসে প্রবেশ করার সাথে সাথে সব বন্ধ হয়ে যেত। আশা কোনদিন আমাদের এই হাসিঠাট্টায় যোগ দিত না। একটা বইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকত। আজ আমি শুধু আশাকে লক্ষ্য করছিলাম। আজ যেন আশাকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। মনের ভুল কিনা জানিনা, একটা পরিবর্তনও আশার মধ্যে মনে হল লক্ষ্য করলাম। সবসময়ে প্রথম সারির বেঞ্চে বসা আশাকে এর আগে কখন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের সারিতে বসা ছেলেদের দিকে তাকাতে দেখিনি। আজ দুবার দেখলাম আশা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকাল। একবার তো প্রায় আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। আমার বুকের ভিতরটা ধক্ করে উঠেছিল। ধরা পড়ে গেলাম নাকি? না দেখলাম ঘাড়টা ঘুরিয়ে আশা আবার সামনের দিকে ফিরে মাথা নিচু করে বসে পড়ল।
আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কোন ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে প্রফেসরকে প্রশ্ন করলে আশা আজকাল মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আশা যেন একটা কিছু খুঁজছে ওর চোখ দেখে আমি বুঝতে পারতাম।
আমার খেলা চলতে লাগল। আমার চিরকুটে লেখা কথার সংখ্যা ধিরে ধিরে বাড়তে লাগল আর সেই সঙ্গে পরিবর্তন হতে সুরু করল আশার ব্যবহারের। আশা আজকাল অন্যদের সঙ্গে কথা বলে, পিছন ফিরে ছেলেদের দিকে তাকায়। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায় না, ঠাট্টা ইয়ার্কিতেও যোগদান করে। আমার কেন যেন মনে হত আশার চোখদুটো সবসময় কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়। আমি যত আশার ব্যবহারের পরিবর্তন দেখতাম ততো মনে মনে খুশি হতাম। একবার একটা পরিক্ষা করার ইচ্ছে হল। চিরকুটে লিখলাম তোমায় হালকা নীল রং এর
শাড়ী আর খোলা এলো চুলে দেখতে চাই। পরের দিন ক্লাসে ঢুকে আশাকে দেখলাম না। লাস্ট বেঞ্চে বসে আগের দিনের হোমওয়ার্কটা তন্ময় হয়ে চেক্ করছিলাম শেষ বারের মত, জমা দেওয়ার আগে। অর্ণবের কনুইয়ের ধাক্কায় চমক ভাঙ্গল। অর্ণব আঙ্গুল দিয়ে সামনের দিকে তাকাতে বলল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এক অদ্ভুত ব্যাপার। যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ক্লাসের সব ছেলেরা আর মেয়েরা অবাক হয়ে তাদের সামনে দাঁড়ানো আশার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে বলে আশার সারা মুখে একটা লজ্জা মেশানো সুন্দর হাসি। সব থেকে অবাক হলাম আমি। আশার পরনে আজ হালকা নীল রঙ্গের শাড়ী আর চুলটা খোলা। আশাকে আজ সত্যি সুন্দর লাগছে দেখতে। মেয়েটা এত সুন্দর দেখতে আগে কখনো লক্ষ্য করিনি তো।
ভাগ্যের চক্র কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানে না। আমার সুযোগ এলো এক নামকরা কলেজে এনজিনীয়ারিং পড়তে যাওয়ার। একদিন সবাইকার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি আমার নতুন কলেজ জীবনের জন্য যাত্রা শুরু করলাম। আশার কাছ থেকেও বিদায় নিয়েছিলাম অন্যদের মতই। অল্পদিনের আলাপে আলাদা করে আমাকে মনে রাখার কথা নয় আশার। আমাকে বিদায় জানিয়েছিল অন্যদের মতই। তাতে আন্তরিকতা হয়ত ছিল, ছিল না কোনরকম ঘনিষ্ঠতা। আমি শুধু মনে মনে বলেছিলাম তুমি ভালো থেকো, তোমার ভালো হোক। তারপর অনেক যুগ কেটে গেছে। আমার জীবনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আমি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেছি। এখানে সাজানো অথচ একটি ছোট্ট নির্জন শহরে আমার বসবাস। এখানে আমার নিজের বলে কেউ নেই। একাকি নিঃসঙ্গতায় আমার জীবন কাটে। মাঝে মাঝে মনে হয় সম্পর্কের নিস্তব্ধপুরে কোন উদ্দাম নাস্তিকের পদচারনা বুঝি বা জীবনেরই অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। প্রায় দুটো যুগ কেটে গেছে দেশ ছেড়ে এসেছি। ফেলে আসা দেশের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। স্পঞ্জের মত দেশে গিয়ে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে নিয়ে আসি যতটা পারি দেশের সব কিছুকে নিজের দেহে আর মনে। একবার দেশে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো যখন আমন্ত্রন পেলাম আমার এক নিকট আত্মীয়ের বড় মেয়ের বিয়েতে আসার জন্য। অনেক দিন দেশের কোন বিয়ে বাড়ি আমার যাওয়া হয়নি, তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না।
দেখলাম বিয়ের ব্যাপারে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে আবার অনেক কিছু একই রকম আছে। আমার ওপর ভার পড়েছিল ছেলের বাড়ির লোকেদের আদর আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না হয় তার খোঁজখবর রাখার জন্য। দেখলাম ছেলের বাড়ির লোকজন খুবই ভদ্র, তাঁরা অল্পেই খুশী, তাই আমার কাজ অনেক কম মনে হচ্ছিল। হঠাৎ ছেলের বাড়ির একজন আমাকে দেখে এগিয়ে এল। আমার নাম ধরে ডাকল। আমি চিনতে পারলাম। আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু অর্ণব। দুই বন্ধু ফিরে গেলাম অনেক বছর আগের সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। এক ভদ্রমহিলা একসময়ে অর্ণবের কাছে এসে দাঁড়াল। অর্ণব আলাপ করিয়ে দিল। চিনতে পারলাম অনন্যাকে। আমরা তিনজনে মিলে গল্প জুড়ে দিলাম। আমাদের সব বন্ধুদের কথা শুনছিলাম অনন্যার কাছে। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল আশার কথা জানার জন্য। কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন আমায় বাধা দিচ্ছিল। হঠাৎ অনন্যাই আশার কথা ওঠাল। জানতে পারলাম যে আশা ডক্টোরেট করেছে মাইক্রোবায়োলজিতে। নামকরা বিলিতি কম্পানিতে উচ্চপদে কাজ করে আশা। বিয়ে করেছে, দুটি সন্তান, একটি ছেলে একটি মেয়ে। খুব সুখের সংসার আশার। তাছাড়া নানারকম সমাজ কল্যান প্রতিষ্টানের সঙ্গেও নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এত হাসিখুশি আর এত পপুলার যে আমি নাকি দেখলে চিনতেই পারব না যে এই আমাদের সেই আশা।
একটু বাদে ওরা দুজনেই আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে গেল। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম একটা ফাঁকা জায়গা দেখে। মনে মনে খুশি হলাম আমার তিলোত্তমা ভাল আছে জেনে। আজ এতদিন বাদে এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় আশাকে লেখা আমার সেই প্রেমপত্রের কথা। সেই চিরকুটে লেখা খেলার কথা। অনেক ছোট ছোট ঘটনা সিনেমার ফ্ল্যাসব্যাকের মত ফিরে এল আমার মনের আয়নায়। একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে ভিড় করে এল। আচ্ছা ওই খেলাটা কি আমার ছোটবেলাকার ছেলেমানুষি ছিল? নাকি আমি কি জেনেশুনে আশার সঙ্গে ওই খেলা খেলেছিলাম? আমি কি আশাকে ভালোবাসতাম? নাকি আমার আরো গূঢ় কোন উদ্দেশ্য ছিল?
Comments
Top
রাশিফল
রূপা মন্ডল
নিত্যগোপাল ঘোষাল রোড, কলকাতা
বহুদিন থেকেই আমার অভ্যেস খবরের কাগজটা প্রথমে খুলেই রাশিফলটা দেখে নেওয়া।আজকেও সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ পেয়েই বুঝলাম খবরের কাগজ দিতে এসেছে।বন্ধ দরজার ওপারে কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলাম, কলিং বেলটা খারাপ। দরজা খুলে দেখলাম কাগজটা কড়ার সাথে আটকে দিয়ে গেছে। কাগজটা নিয়ে ভিতরে ঢুকেই আগে রাশিফলের পাতাটা খুললাম। দেখলাম কন্যারাশিতে লিখেছে -
"বুদ্ধির ভুলে কর্মের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত আসতে পারে। সঙ্গীতচর্চায় অগ্রগতির সুযোগ আসতে পারে। দিনের শেষভাগে প্রতিকূল অবস্থা কাটবে। আজ ব্যবসায় কর্মচারীর জন্য অবনতির যোগ দেখা যাচ্ছে। শ্বশুরকুল থেকে সম্পত্তি পাওয়ার একটা আশা রাখতে পারেন। পরিবারে কারও সঙ্গে অশান্তি বাঁধতে পারে। সন্তানদের কর্মের সুযোগ আসতে পারে। আজ রাস্তায় যানবাহনের যোগাযোগের জন্য ভোগান্তি হতে পারে। কর্মে অন্যরকম বদল দেখতে পারেন।"
আমি দেখেছি আমার রাশিফল মোটামুটি মিলে যায়। তাই রোজ রাশিফল না দেখে আমি বাড়ি থেকে বেরোই না। কাগজের খবরে মোটামুটি চোখটা বুলিয়ে নিয়ে স্নান করতে যাবো ভাবছি, এমন সময় আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো, "হ্যাল্লো" বলতেই ওপাশ থেকে আমাদের "যুগের ঢেউ" ক্লাবের ন্যাপ্লা ওরফে নেপাল চন্দ্র বলে উঠলো, "নাড়ুদা, আমাদের বিজয়া দশমীর ফাংশানে এবারে তোমাকে গান গাইতেই হবে। কোনো কথা শুনছি না ! তুমি গাইবে কিন্তু!" আমি কিঞ্চিৎ অবাকই হ'লাম - গত দু'বছর আমি পাড়ার ফাংশানে গান গাই নি! বছর তিনেক আগে গলাটা একটু ধরা ছিল বলে অনেকে কটূক্তি করেছিল ! হুঁ হুঁ বাবা, আজ আমার রাশিফলে লেখা আছে- "সঙ্গীতচর্চায় অগ্রগতির সুযোগ আসতে পারে।" হতেই হবে !
আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটাও রিক্সা পাচ্ছিলাম না।অনেক্ষণ বাদে একটা রিক্সা পেলাম।যাত্রী নামিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। ভাড়াও একটু বেশিই নিলো।তা নিক, অফিস টাইম। কিছু করার নেই! উঠতেই হবে। পাওয়া গেছে এই ঢের! রিক্সা থেকে নেমে স্ট্যান্ডে অনেক্ষণ দাঁড়াবার পর বাস এলো। ওখানেও দেরি হলো খানিকটা!
শ্যাম বাজার মেট্রো স্টেশন-এ গিয়ে দেখলাম বেজায় ভিড়! অনেক্ষণ ট্রেন আসছে না! বেলগাছিয়া স্টেশনে নাকি সুইসাইড হয়েছে! কপালের ভোগান্তি আর কি! মেট্রো স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে একটা ওলা ভাড়া করলাম।শেয়ার ওলা! এদিক-সেদিক যাত্রী নামিয়ে সব শেষে আমাকে ড্রপ করলো। অফিস পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেলো! আজ তো আমার রাশিফলে লেখাই ছিল - "আজ রাস্তায় যানবাহনের যোগাযোগের জন্য ভোগান্তি হতে পারে।"
আজ একজন ক্লায়েন্টের সাথে মিট করতে যাওয়ার কথা ছিল ঠিক দুপুর তিনটের সময়।তাকে অনেক কষ্টে একটা মিউচুয়াল ফান্ড করবো বলে রাজি করিয়েছি। হঠাৎ আমার শ্যালক ফোন করলো, "দাদা, আমাদের ওই জমিটা কালকেই রেজিস্ট্রি হবে, একবার আসুন না ডালহৌসিতে, আমাদের ল'ইয়ারের অফিসে! কাগজপত্রগুলো একটু দেখে নিলে ভালো হতো!"
শ্বশুরমশাই অনেকদিন ধরেই একটা জমি বিক্রি করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ভাইয়েদের বিরোধিতায় পেরে উঠছিলেন না। এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবে! আমারও ওদিক থেকে কিঞ্চিৎ প্রাপ্তিযোগ হতে পারে! হুঁ হুঁ মনে পড়ছে, রাশিফলে লেখা ছিল - "শ্বশুরকুল থেকে সম্পত্তি পাওয়ার একটা আশা রাখতে পারেন।" তাই তখনি "ক্লায়েন্ট ভিজিট করতে যাচ্ছি"
বলে বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে।ঠিক দুটো দশে পৌঁছে গেলাম এটর্নি অফিসে। কিন্তু হায়! তিনি তখন কোর্টে কেস করতে বেরিয়ে গেছেন - ফিরবেন সাড়ে চারটে নাগাদ! অতএব বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই! এদিকে আমার তিনটের সময় ক্লায়েন্ট ভিজিট - ডালহৌসি থেকে নিউ আলিপুরে যেতে হবে। একটা ট্যাক্সি নিলাম।কিছুদূর গিয়ে ট্যাক্সি খারাপ হয়ে গেলো! নেমে গিয়ে ওলা ভাড়া করে যখন নিউ আলিপুরে পৌঁছলাম তখন বাজছে তিনটে পঞ্চান্ন! আমার ক্লায়েন্ট কোনো জরুরি ফোন পেয়ে বেরিয়ে গেছেন! ফোনে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পেলাম না! মনে পড়ছে, আমার রাশিফলে লেখা ছিল -"বুদ্ধির ভুলে কর্মের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত আসতে পারে।"
পৌনে পাঁচটার সময়ে এটর্নি অফিসে ফিরে এসে দেখলাম আমার শ্যালক একটু বেজার মুখে বসে থাকতে দেখলাম, আমাকে দেখেই বললো, "আর এখন এসে কি হবে? উকিলবাবু এই একটু আগে এসে কাগজটা নিয়ে চলে গেলেন! বললেন, কালকেই রেজিস্ট্রি হবে, ঠিক দশটার সময়ে রেজিস্ট্রি অফিসে পৌঁছে যাবেন!"
অফিসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই গিন্নির ফোন, "তোমাকে কি একটা দরকারে পাওয়া যায় না! আমার ভাই তোমাকে বলেছিলো, বাবার জমির কাগজপত্রগুলো একটু দেখে নিতে, তা না করে তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? এখন ওতে কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে কি হবে? তুমি কি একটাও কাজ করতে পারো না? অপদার্থ একটা!" বলেই ফোন কেটে দিলো! বুঝলাম, দিদির কাছে কমপ্লেন করেছে আমার শ্যালক! ভয়ঙ্কর রাগ হচ্ছিলো বৌয়ের দাঁতখিঁচুনি খেয়ে! কিন্তু সামলে নিলাম, এখন মাথা গরম করলে চলবে না! আজ আমার রাশিফলে লেখাই ছিল - "দিনের শেষভাগে প্রতিকূল অবস্থা কাটবে। পরিবারে কারও সঙ্গে অশান্তি বাঁধতে পারে।"
অফিসে ঢুকতেই ব্যানার্জি বললো, "তোমাকে বস খুঁজছিলো!" কে জানে কি আবার বলবে! বোধহয় ওই মিউচুয়াল ফান্ডটা করাতে পেরেছি কি না তাই জিজ্ঞাসা করবে! এদিকে ক্লায়েন্ট ফোন ওঠাচ্ছে না! এক জ্বালা হয়েছে! বসের চেম্বারের সামনে গিয়ে একটু কপালে হাত ঠেকিয়ে নিলাম,
- আসব স্যার?
- আসুন!
একটা কগজ দেখছিলেন, মুখ তুলে বললেন,
- কি খবর মিত্রবাবু? আপনার ক্লায়েন্ট কি রাজি হচ্ছে না? আপনি তো আজ দেড়টার সময়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? কিন্তু আপনার ক্লায়েন্ট বললো, আপনি না কি চারটের সময়ে ওনার বাড়িতে গিয়েছিলেন? এতক্ষণ লাগলো? কিসে করে গিয়েছিলেন? হেঁটে?
- না স্যার! মানে! একটা অসুবিধা হয়ে গিয়েছিলো, তাই!
- দেখুন, আমাদের বিজনেসে সময়ের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে! আপনার খেয়াল খুশি মতো ক্লায়েন্ট ভিজিট করলে চলবে না! এখন যদি তিনি অন্য কারোকে দিয়ে মিউচুয়াল ফান্ড খুলে নেন, তাহলে কিন্তু আপনার খুব মুশকিল হয়ে যাবে, বলে দিলাম!
- স্যার, শুনুন, মানে আমি ওনাকে অনেকদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু উনি....
- উনি কি? ক্লায়েন্টরা এরকমই হবে! আপনাকে তাদের লাইনে আনতে হবে! আর সেটা যদি না পারেন....তাহলে আমাদের ভাবতে হবে আপনাকে ঠিক কি ধরণের কাজ দিলে আপনি করতে পারবেন! এখন আপনি যান!
হা ঈশ্বর! এটাও মিলে গেলো, "কর্মে অন্যরকম বদল দেখতে পারেন।" নাঃ, কাল থেকে ভাবছি রাশিফল দেখা ছেড়েই দেব !
Comments
Comments
Top
Top
শব্দহীন
বিবেকের কঙ্কাল
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর এ দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি যেমন অবদান রেখে চলেছেন তেমনি সৃষ্টিশীল লেখার ক্ষেত্রেও তাঁর পদচারণা। তিনি মনে করেন বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অন্যের পরিপূরক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার, নাট্যকার, সমাজ সংস্কারক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনে বিশ্বাসী এই মানুষটির ছোটবেলা থেকেই লেখায় হাতেখড়ি। কৈশোর ও তারুণ্যে তিনি বাংলা একাডেমি, খেলাঘর, কঁচিকাচার মেলা সহ বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেছেন। এই সময় তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যায়নের সময় তিনি প্রগতিশীল কর্মী হিসেবে কাজ করে সহিত চর্চা করে গেছেন। এ সময় তাঁর লেখাগুলো বিশ্ববিদালয়ের ম্যাগাজিনে এখনও সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও অনেকদিন ধরেই তিনি দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই সাহিত্যেই তাঁর সমান দক্ষতা রয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, পরিবর্তন, সম্ভাবনা ও মানুষ তাঁর লেখার মূল উপজীব্য বিষয়। তিনি একজন ভাল বক্তা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক্ শো সহ বিভিন্ন সৃজনশীল অনুষ্ঠানে তাকে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। ভারতরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী অজিত কুমার পাঁজা কলকাতা দূরদর্শনের একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রেরিত প্রবন্ধে মোহিত হয়ে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সে সময় সম্প্রচারিত হয়। এই খবরটি আজকাল, সংবাদ, বাংলাবাজার সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ফিলিপিন্স, চীন, বি-টিভি সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন পুরুস্কারে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের একজন কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করে চলেছেন।
সময়টা ঠিক মনে নেই। বাংলার এক অখ্যাত জনপদ। বিরূপ প্রকৃতির মুখোমুখি হল সে ভূখন্ডের বাসিন্দারা। পালাবদলের বিচিত্র ধারায় সবল জনপদটিতে নেমে এল দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত। পথে ঘাটে অনাদরে পড়ে থাকত অস্থিমজ্জা সমৃদ্ধ বুভুক্ষু মাংসহীন লাশ- এ যেন দুমড়ে মুচড়ে পড়া আদম সন্তানদের লাশ। আর সেই লাশগুলোর উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত শকুন, কুকুর, শিয়াল আর কাকেরা। কাড়াকাড়ির এই নগ্ন লড়াইয়ে শরীরের শক্ত চামড়াটা বিদীর্ণ হয়ে ভিতরের কংকালটা বেরিয়ে আসত। কী বীভৎস ছিল সেই দৃশ্য! ডাষ্টবিনে পচন ধরা খাবার নিয়ে চলত বিবেকবান মানুষ আর বিবেকহীন পশুদের ভারসাম্যহীন সংগ্রাম। বুঝা যেতনা কোনটা মানুষ আর কোনটা পশু। মানুষের জীবনটা হয়ে উঠেছিলো কাচের আয়নার প্রতিচ্ছবির মতো। কাচের আয়নাটা ভেঙ্গে গেলে জীবনের প্রতিচ্ছবিটা মিলিয়ে যেত- দেহ থেকে মুক্ত হতো ক্ষুধার্ত আত্মারা। আগ্নেয়গিরির অসহিষ্ণু লাভায় ভোরের সুন্দর শিশিরবিন্দু যতটা তীব্র দহনে দগ্ধ হতে পারে ততখানি জীবন যন্ত্রণায় দগ্ধ হত মানুষের জীবন। উত্তর দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে চলত আর্তনাদ, আহাজারী আর চাপা দীর্ঘশ্বাসের দুঃসহ জীবনযুদ্ধ। জীবনের ঘাতক সত্যগুলো যে কত ভয়ংকর; যারা ভুক্তভোগী কেবল তারাই বুঝতে পারে। যেমন বুঝেছিল সেই জনপদের মানুষ।
ছেলে বউ নিয়ে রহিম শেখের ছিল সুখের সংসার। দু’কিশোর ছেলে ছিল তার এই সুখের সাম্রাজ্যের প্রাণ। এদের মধ্যে একজনের মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়াটা তাদের দু:খ দিত কিন্তু সুখের প্রবল ঝড়ে তা হয়ে উঠত বিলুপ্ত প্রায়। রহিম শেখ তার বাড়ীর সামনের বাজারটায় কসাইয়ের কাজ করত। তবে দুর্ভিক্ষের সর্বগ্রাসী পাষন্ড দানবের ক্ষুধার্ত থাবার নিচে পড়ে তাকে হতে হলকর্মচ্যূত। মালিক কিছু টাকা গুজে দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন। কড়কড়ে টাকার শব্দে রহিম শেখ যেন পেল মৃত্যুর প্রতিধ্বনি। একদিন যে মানুষ ছিল বাজারের কসাই; নিজেকে বাঁচাবার অন্ধ আকুলতা নিয়ে বাস্তব জীবনে তার কসাই চরিত্রের খোলসটা বেরিয়ে এল। রহিম শেখ তার নিষ্পাপ-প্রতিবন্ধী ছেলেটার দিকে আঙ্গুলী নির্দেশ করে বলল,‘ওরে খ্যাওন দ্যাওনের দরকার নাই; ঐ আপদ খান দূর হইলে আমরা বাঁচুম; ও মইরা গেলে অন্তত: একখান বেকার খানেওয়ালা তো কমবো।’ তারপর মোটা একটা রশি দিয়ে তার হাত-পা গুলো ঘরের শক্ত খুঁটিটার সাথে আটকে দিল। যেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে তাকে শৃঙ্খলিত করল। একটা আহত অবুঝ পাখি শিকারীর ফাঁদ থেকে মুক্তির নেশায় যেমন ছটফট করে; তেমনি করুণ আর্তনাদে বাকশক্তিহীন ছেলেটির বেদনা যেন নীরব বিস্ফোরণে পৃথিবীতে এক অন্যরকমের নিস্তব্ধতা নিয়ে এল।রহিম শেখের বউ পাথরের মতোনির্বাক হয়ে অনুভব করল সেই বেদনার অন্তহীন চাপা কান্নার সুর। কেননা সে যে মমতাময়ী মা। নিজেকে সে স্থির রাখতে পারল না। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার সন্তানকে বন্ধন মুক্ত করতে চাইল। আসলে তার মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানটি মানুষের পৃথিবীতে মূল্যহীন হতে পারে; কিন্তু মাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে সে ছিল মহামূল্যবান। মানুষ পথের কুকুর-বিড়ালকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখে- আর এতো ছিল জলজ্যান্ত রক্ত মাংসের মানব সন্তান। মাতৃত্বের গভীরতা রহিম শেখের বোধশক্তিকে জাগাতে ব্যর্থ হল। আর ব্যর্থ তো হবেই কারণ রহিম শেখকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে গিয়ে তার মাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল পৃথিবীর চরমতম সত্য নির্মম মৃত্যুকে। ফলে শৈশবে মাতৃহীন রহিম শেখ পরিমাপ করতে পারলনা বেদনা হত মায়ের মন। রহিম শেখের বউ উন্মাদের মতো ছুটে গেল খুঁটিটার কাছে। রহিম শেখ এতে বাধ সাধল। জ্ঞানশূন্য রহিম শেখ রাগে থরথর করে কেঁপে উঠল।ঠিঁকরে যেন বের হয়ে আসতে চাইল তার রক্তবর্ণ চোখ দুটি। বিদ্রোহী হয়ে উঠা মায়ের অস্ত্রহীন বাহুর আবেগময় বিপ্লবকে আপন বাহুর জোরে ম্লান করে দিল রহিম শেখ। ঘরের অন্য একটা খুঁটির সাথে তার বউকে আটকে রাখল।রহিম শেখের অন্য ছেলেটি তার বাবাকে যেন আবিষ্কার করল নুতন করে- অবিশ্বাসীর কৃত্রিম চোখে। একদিন যে বাবাকে দেখে তারা জীবনের কথা ভাবত; আজ সেই চোখে সে দেখছে এক বুভুক্ষু শকুনিকে। ডারউইনের বিবর্তন বাদে চেহারা পরিবর্তনের সাথে সাথে আচরণ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দিন বদলের পালায় মানুষের চেহারায় যতটা না পরিবর্তন ঘটে তার চেয়েও বেশী রূপান্তর ঘটে তার আচরণে। কঠিন বাস্তবতার যাঁতাকলে মানুষের মুখোশটা খুলে পড়ে যায়; যা থাকে তা শুধু মাংসহীন কংকালের নিরেট অবয়ব। ফলে আতঙ্কের বন্ধুর পথে চলৎশক্তি হারিয়ে রহিম শেখের অন্য ছেলেটিও শয্যা নিল। রহিম শেখ তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পৈত্রিক ভিটাটুকু বন্ধক রাখল। কড়া সুদে মহাজনের কাছে ধার নিলসিন্দুক থেকে সদ্য মুক্ত উৎকট গন্ধের কিছু টাকা। সেই সিন্দুকে মরচে ধরা টাকায় মরচে ধরা রহিম শেখ অন্ন এনে দিত তার শয্যাশায়ী সন্তান আর বউকে। নিজের আকন্ঠউদর পূর্তি করে সে যেন একটা স্বার্থপর আত্মতৃপ্তি লাভ করত। বঞ্চিত হত তার প্রতিবন্ধী সন্তানটি। রহিম শেখের বউ ক্ষুধার্ত সন্তানের শোকে বোবা কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ত। তাকে দেখে মনে হত ঝড়ের রাতে উত্তাল সমুদ্রে হাল বিহীন এক নায়ের মাঝি-যে নায়ের যাত্রী ছিল তার প্রতিবন্ধী সন্তানটি। সন্তানের নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেড়ে সে নিজেকেও খাদ্য থেকে বঞ্চিত করল। সেও মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়ে হতে চাইত তার সন্তানটির সহযাত্রী। মা ও সন্তানটির দেহ থেকে একদিন আত্মারা বেরিয়ে গেল। রাতের আঁধার কেটে প্রতিদিনের মতো আরও একটা আলোকিত ভোর এল। তবে শষ্যাশায়ী ছেলেটির জন্য সেই ভোর আলো নিয়ে এল না, নিয়ে এল অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া তার মা ও ভাইয়ে বীভৎস লাশের বাস্তবতা। ছেলেটির জন্য সেই দিনটি ছিল সবচেয়ে বেদনার দিন। আর রহিম শেখ সেদিন কি অদ্ভুত অমানুষের হাসি হেসেছিল! চীৎকার করে বলছিল,‘আমার আরও দু’জন খানে ওয়ালা পটল তুলল; অহন আমি পেট পুইড়া খামু; আমি আর মরুম না! বহুত মজা হইব।’ লাশগুলোর দাফন-কাফন আর হলনা। দাফন-কাফন করতে গেলে অর্থের অপব্যয়- রহিম শেখের উর্বর মস্তিষ্কে এই বিকৃত চিন্তার অভ্যুদয় ঘটল। মানব থেকে সে হয়ে গেল যেন হিং¯্র দানব। দানবীয় শক্তির উৎশৃঙ্খল উৎসবের অসংলগ্ন মাতমে মেতে উঠে লাশ দুটোকে
টানতে টানতে নিক্ষেপ করল রাস্তার পাশের ডাষ্টবিনটাতে। আর সঙ্গে সঙ্গে তীর্থের কাকের মতো রাস্তার শিয়াল কুকুর আর শুকুনীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাংস বিহীন ঐ পচা গন্ধের লাশগুলোর উপর। কিন্তু তারা বেশীক্ষণ ওগুলোর উপর তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে পারল না। তারা অনুভব করল তাদের মতোই দুটিমাংস বিহীন দেহ। পার্থক্য শুধু এটুকু তাদের দেহে এখনও প্রাণ আছে কিন্তু ওদের দেহে তা নেই। সন্ধ্যায় আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলার সময় শয্যাশায়ী ছেলেটা পেল ডাষ্টবিন থেকে উঠে আসা পঁচা লাশের গন্ধ; তবে তার কাছে সেই গন্ধটা মনে হল অমৃতের মতো; সেই গন্ধে অবগাহন করল তার চেতনা আর অস্তিত্ব। সেই গন্ধের সাথে সে তার জীবন্ত শরীরের গন্ধকে পৃথক করতে পারলনা বরং তার মধ্যে নিজেকে সে দেখতে পেল। টাকা ফেরত পেতে মহাজনের চাপ বাড়ে রহিম শেখের উপর। রহিম শেখ তার শয্যাশায়ী ছেলেটাকে নিয়ে ব্যবসার ফন্দি আটে। তার টাকা চাই আরও টাকা; তাকে বাঁচতে হবে; মূল্য যাই দিতে হোক না তাকে। ছেলেটাকে সে বিক্রি করে দেয় এক ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে। সেদিন টাকা পেয়ে রহিম শেখ অতিরিক্ত খায়। তার উদর ছিল অস্বাভাবিক ভাবে পূর্ণ। কিন্তু সব হারিয়ে সে নিজের অস্তিত্বের অভাব অনুভব করে। সে দৌড় দিয়ে রাস্তার ওপারে যেতে চায়; তার বিকৃত বিবেকে সপ্রতিভ বিবেকেরা যেন আঘাত হানে; তার মনে হয় ওপারে গিয়ে সে খুঁজে পাবে তার হারানো জীবনকে; কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনা। একটা দ্রুতগামী ট্রাক এসে মধ্যরাস্তায় তার ঐ বিকৃত দেহটা খন্ড-বিখন্ড করে দেয়। তার মস্তক থেকে বিকৃত মগজটা বেরিয়ে আসে; অক্ষি কোটর থেকে বিচ্যুত হয় তার বিশ্বাস ঘাতক চোখ; তার দুষিত রক্ত ঝাঁঝালো রোদের উষ্ণতায় রাস্তাটাকে আঁকড়ে ধরে। অনেকে এটাকে দূর্ঘটনা বলে; অনেকে বলে আত্মহত্যা। আর আমি বলি এটাকে কর্মফল।
কথাটা বলে কঠিন নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় আকাশ।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,‘মানুষ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে এতটাই স্বার্থপর হয়ে যায় তখন রক্তের বন্ধনগুলোও তার কাছে শিথিল হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্যের জন্য মৃত্যুখাদ খনন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিজেই সেই খাদে পড়ে যায়। পতঙ্গেরা জ্বলন্ত প্রদীপের আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে যেমন সেই আগুনে ঝাপদেয়; রহিম শেখও তেমনি আগুনে ঝাপ দিয়েছিল। ওটা আলো ছিল না, ছিল আলেয়া। আর এটাই চরম বাস্তবতা।’
সামনে বসা পুলিশ কমিশনার মনসুর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল গল্পটা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসে যেন দোল খেল তার কোমল মন। বিস্ময়ে বিহ্বলতায় তার স্বরথলিতে আটকে থাকা কথা মুখ দিয়ে যেন বেরুবার পথ পাচ্ছিল না। তবুও অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এটা কি গল্প?’
‘গল্প! না এটা গল্প নয়-নির্ভেজাল সত্য ঘটনা’। বলল আকাশ। মনসুর ততক্ষণে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। নির্মম সত্যের যে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসটা তার দিকে ধেয়ে আসছিল তা সাময়িক ভাবে থামিয়ে খুঁজে ফিরছিল সে উত্তরণের পথ। অন্তহীন তৃষ্ণার্ত মন নিয়ে সে বলল, ‘আচ্ছা ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি হওয়া ছেলেটার কি হয়েছিল।’
হাঃ হাঃ করে বিদ্রূপের অট্টহাসিতে ফেটে পড়লে আকাশ। ওটা ওর স্বভাবের আওতায় পড়ে না। এ ধরণের অস্বাভাবিক আচরণের সম্মুখীন হয়ে মনসুর কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ল। আকাশের কাছে এ ধরণের আচরণ ছিল তার চিন্তার বাইরে।
আকাশ দ্রুত স্বাভাবিকতা এনে বলল, ‘আমি সেই ছেলে।’ ইংরেজ ভদ্রলোক তাকে পুত্রস্নেহে মানুষ করেছে; বিজ্ঞানে সে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছে ঐ মানুষটির দৌলতে, তার সামনে মানুষটা খুলে দিয়েছে বিজ্ঞানের অন্তহীন জিজ্ঞাসার অনুসন্ধিৎসু জগত; তারপর মানুষটার মৃত্যুর পর তিনি প্রত্যাবর্তন করেছেন দেশের মাটিতে- এসব কথাও অবলীলায় বলে গেল আকাশ। মুনসুর জানতে চাইল আজকের পরিণতআকাশের কাছে তার বাবার প্রতি তার অনুভূতির কথা। আকাশ উত্তরে বলল,‘তার প্রতি আমার করুণা হয়; শ্রদ্ধা জাগে না। করুণা হয় এ কারণে তিনি ছিলেন কাপুরুষ; জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক মানুষ। তিনি ছিলেন আমাদের সংসারের সেনাপতি আর আমরা ছিলাম তার সৈন্য। তিনি নিজেই নিজের সৈন্যদের মেরেছিলেন কিন্তু তারও শেষ রক্ষা হয়নি।’
‘আর আপনার মায়ের প্রতি’- জিজ্ঞাসা করল মনসুর।
মৃদু হেসে আকাশ বলল,‘তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা হয়, সেখানে করুণা ধারার ঝরেনা সিক্ত বর্ষণ। আমার মা-তো বীর ছিলেন। নিজের সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারেননি বলে তিনি নিজেও অন্ন তুলে নেননি। মরে গিয়েও তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি সৈন্য ছিলেন কিন্তু তার আচরণ ছিল সেনাপতির মতো।’
‘আপনার ভাইয়ের ………..’
মনসুরের অসমাপ্ত কথাটা কেড়ে নিয়ে আকাশের মুখ থেকে নি:সৃত হল,‘ঐ যে আপনি বলেছিলেন না সত্যের পিছনে আরেক সত্য থাকতে পারে না। আর যে কারণে আপনাকে গল্পটা বলা, জীবনের নির্মম সত্য গল্পটা। আসলে কি জানেন আমার অক্ষম ভাইটিই ছিল সত্যের নির্মম প্রকাশ। সে মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল এটা যেমন সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য সে তার অক্ষমতা দিয়ে আমার বাবার অক্ষমতার জ্বলজ্বলে সত্য গুলো সামনে এনেছিল। আমার জীবনে সে ছিল অসাধারণ মানুষ। একফালি নি:শ্বাস ফেলে ও বলল আবার, ‘বাবা হারম্যানের উপহার দেয়া কম্পাস যন্ত্র যেমন বোকা আইনষ্টাইনের জীবনে এনেছিল অনুসন্ধানী চেতনা; আমার ভাইটি ছিল যেন সেই কম্পাসযন্ত্র-যা আমাকে সত্য-সন্ধানী করেছে। আর সেই সূত্রেই তো আপনাদের সাথে আমার যোগাযোগ।’ তারপর বিড়বিড় করে আবৃত্তি করল-
‘চলছে আজও অস্থিমজ্জা-মাংসহীন সত্যের অসত্য লড়াই
সত্যের নির্মম কংকালটায় জীবন্ত মাংসপিন্ড চড়াই
মেঘলা আকাশ ছিঁড়ে অসহিষ্ণু সূর্যের জ্বলন্ত আলো চাই
তবেই লেখা হবে সত্যের সুতীব্র অধ্যায়।’
Comments
Top
কৃতিত্ব
শুকদেব চট্টোপাধ্যায়
রহড়া, পশ্চিমবাংলা
বেশ কিছুকাল আগের কথা। হাওড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম “পাতিহাল”। গ্রামে কিছু যায়গায় বিদ্যুৎ এলেও অনেকটাই তখনও লণ্ঠনের কবলে। রাস্তাঘাট প্রায় সবই কাঁচা। মণ্ডলদের মত কিছু ভূস্বামী বাদ দিলে বাকিরা অধিকাংশই গরিব চাষি। শহরের বিভিন্ন অফিসে কাজ করেন এমন মানুষও কিছু আছেন। পাতিহালের ক্ষেত্রে তাঁরা একপ্রকার অনাবাসী। শহরের মেসে থাকেন আর সপ্তাহান্তে একবার পরিবার দশর্নে আসেন। মারটিন রেল উঠে গেছে। কোলকাতা যাতায়াত করার জন্য কেবলমাত্র কিছু বাসই ভরসা। এখনকার মত এত বাসও তখন ছিল না। তাই রোজ যাতায়াত করা একপ্রকার অসম্ভব ছিল।
অমূল্য এই গ্রামেরই বাসিন্দা। বছর চব্বিশ পঁচিশ বয়স, রং ফরসা, সুপুরুষ। উপরোক্ত কোন পেশাই তার নয়। সে পাশের গ্রামে একটা স্কুলে মাস্টারি করে। কিছু জমি জমাও আছে। স্কুলে যা পায় আর চাষের আয় মিলিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়। ছোট সংসার। তারা স্বামী-স্ত্রী আর মা-বাবা। তার এক বোন আছে। বিয়ে হয়েছে মেদিনীপুরের এক গ্রামে। যাতায়াত কষ্টকর হলেও বাড়ির টানে মাঝে মাঝে আসে।
কিছু উচ্চবিত্ত পরিবার ছাড়া তখন গ্রামের বউ বা জামাই সাধারণত: আর একটা গ্রাম থেকেই আসত। আসলে অপেক্ষাকৃত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করা শহুরে মানুষেরা সচরাচর গ্রামেতে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিতেন না। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। অমূল্যর স্ত্রী বিমালাই এমন এক ব্যতিক্রম। অমূল্যর পিসেমশাই রমাকান্ত আর বিমলার বাবা ব্রজেন কোলকাতায় একই অফিসে চাকরি করতেন। দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে ব্রজেন বারকয়েক পাতিহালে এসেছেন। কিন্তু একা, পরিবার নিয়ে নয়। পিসিমার অনুরোধে একবার শীতকালে স্ত্রী আর তিন মেয়েকে নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে এলেন। রমাকান্তর বাড়ির পাশেই একটা বড় বাগান ছিল। ওই বাগানে সেদিন পারিবারিক চড়ুইভাতির আয়োজন করা হয়েছিল। অমূল্যরাও ওখানে নিমন্ত্রিত ছিল। পিসিমার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, পাশের গ্রামেই।
বিরাট বাগান। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল গাছের ফাঁকে বেশ খানিকটা জায়গা রান্না আর খাওয়ার জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে। পাশেই বড় পুকুর। এগুলো সব রমাকান্তর নিজের। এছাড়া শরিকি জমিজমাও কিছু আছে। জেলেরা পুকুর থেকে ধরে দুটো বড় কাৎলা মাছ দিয়ে গেছে। কয়েক কাঁদি ডাবও গাছ থেকে পাড়িয়ে মাথা কেটে রাখা আছে। যার যত ইচ্ছে খাও। নামে চড়ুইভাতি হলেও রান্নার জন্য লোক রাখা হয়েছে। কারণ, রান্নায় সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আড্ডাটা জমবে না। বাড়ির মেয়েরা ঠাকুরকে টুকটাক সাহায্য করবে। বিমলাদের সকলকে নিয়ে পিসিমারা সকালবেলাই বাগানে চলে এসেছেন। অমূল্যর পিসিমার একটাই মেয়ে। বছর চোদ্দ পনের বয়স। বিমলার মেজো বোনের বয়সী। কোলকাতায় অল্প যায়গায় থেকে অভ্যাস তাই এখানে এত ফাঁকা জায়গা, পুকুর, বাগান পেয়ে বিমলার বোনেরা আনন্দে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে পিসিমার মেয়ে। বিমলা আঠেরোয় পা দিয়েছে। ফ্রক ছেড়ে অনেকদিনই শাড়ি পরছে। মনে ইচ্ছে থাকলেও বাচ্চাদের সাথে হুড়োহুড়ি তার সাজেনা, তাই মায়েদের পাশে বসে গল্প করতে করতে রান্নায় টুকটাক সাহায্য করছে। রমাকান্ত চড়ুইভাতির সব যোগাড় যন্তর সেরে বন্ধু ব্রজেনের সাথে বসে গুছিয়ে আড্ডা মারছেন আর মাঝে মাঝে গিন্নিদের উদ্দেশ্যে রঙ্গ করে টিপ্পুনি কাটছেন। প্রত্যুত্তরে ওপাশ থেকেও ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ ভেসে আসছে।
সকাল নটা নাগাৎ অমূল্যরা বাগানে পৌঁছল। জলখাবারের আলুরদম তৈরি। লুচি ভাজা হচ্ছে। শালপাতার থালায় করে গরম লুচি তরকারি বিমলা এক এক করে সকলের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। তারই মধ্যে মায়ের ইশারায় এক ফাঁকে অমূল্যর বাবা-মাকে নমস্কার করে গেল। বাচ্চারাও খেলায় একটু বিরতি দিয়ে মা-কাকিদের পাশে বসে আয়েশ করে জলখাবার খাচ্ছে। আসলে ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন পাচকের হাতে তৈরি একই পদ অনেক সুস্বাদু লাগে। অমূল্যর মা মলিনা মহিলা মহলে খোশ গল্পে মত্ত। আর তার বাবা সত্যেনও জলখাবার খেয়ে রমাকান্ত আর ব্রজেনের সাথে আড্ডায় যোগ দিলেন। অমূল্য পড়ে গেল একা। সে খুবই শান্ত আর লাজুক স্বভাবের। অপরিচিত লোকজনের সামনে পড়ে আরো গুটিয়ে গেল। পিসিমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওকে ডেকে এনে সকলের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে একটু স্বাভাবিক করে দিলেন। লাজুক হলেও এর মধ্যেই আড়চোখে বেশ কয়েকবার বিমলাকে তার মাপা হয়ে গেছে। কাছ থেকে আবার দেখল। ডানাকাটা পরী না হলেও বিমলা বেশ সুশ্রী। বারে বারেই চোখ চলে যাচ্ছে। গুরুজনদের দৃষ্টি বাঁচিয়ে বিমলাও কয়েকবার সদ্য পরিচিত ছেলেটাকে দেখেছে। ভাল যে লাগেনি তা নয়। উভয়ের অগোচরে আরো কয়েক জোড়া চোখ তাদের লক্ষ্য করেছে।
পিসিমাই প্রথম কথাটা পাড়লেন— বৌদি, আমাদের অমূল্যর সাথে বিমলাকে বেশ মানাবে। পালটি ঘর। মেয়ে লেখাপড়াও জানে, ম্যাট্রিক পাশ।
অমূল্যর মায়েরও বিমলাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। ননদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে বিমলার মাকে দেখিয়ে বললেন— আগে ওনাদের মতটা জান।
গ্রামেতে মেয়ের বিয়ে দিতে ব্রজেনের মনটা খুঁত খুঁত করছিল। কিন্তু তার রোজগার তেমন কিছু নয়। তিন তিনটে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। ছেলেটা স্বভাব চরিত্রে আর দেখতে শুনতে ভালই। আর সব থেকে বড় কথা কোন দাবি দাওয়া নেই। ফলে এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করলেন না।
বিমলাকে ভাল লাগলেও একটা ব্যাপার সেদিন অমূল্যর চোখে পড়েছিল। তা হল কারণে অকারণে নিজের ছোট বোনেদের শাসন করা। এমনকি একবার কি একটা কথায় মাকেও ইশারায় ধমক দিল। তার শান্ত সুন্দর চেহারার সাথে যা একেবারেই বেমানান। এইসব ছোটখাট ব্যাপার অন্যদের চোখ এড়ালেও অমূল্যর এড়ায়নি কারণ, ওর নজর যে ঘুরে ফিরে বিমলার দিকেই ছিল।
এর কয়েক মাস বাদেই কোলকাতার মেয়ে বিমলা অমূল্যর বউ হয়ে পাতিহাল গ্রামে এল। বিমলার সান্নিধ্যে এসে অমূল্যর মনে হল তার জীবনে বোধহয় আর কিছু পাওয়া বাকি নেই। তার বাবা-মাও বৌমার সেবা যত্নে তৃপ্ত। আত্মীয় পরিজনেরাও নতুন বৌ এর নম্র মধুর ব্যবহারে খুশি। রেখা তো বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েও বৌদির পিড়াপীড়িতে আরো কদিন থেকে গেল। সত্যি, এই কদিনেই বৌদি বাড়ির সকলকে বড় আপন করে নিয়েছে। শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় রেখা বাবা-মার থেকে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে বেশি কাঁদল। নতুন বৌ, অমূল্যর তো ভাল লাগবেই, কিন্তু পাঁচ জনের প্রশংসা শুনে তার বুকটা ভরে গেল।
স্কুলে না গেলেই নয় তাই যেতে হয়। কোনরকমে ক্লাসগুলো নিয়েই অমূল্য বাড়ি পালিয়ে আসে। টিউশনিতেও প্রায়ই ফাঁকি পড়ছে।
মলিনা থাকতে না পেরে একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন— হ্যাঁ, রে, আজকাল আর টিউশনি করিস না ?
কোনরকমে হুঁ হাঁ করে অমূল্য পাশ কাটিয়েছিল। মাকে কি করে বোঝাবে যে বিমলার সান্নিধ্যের চেয়ে তার কাছে আর কোন কিছুই বড় নয়। শরীর খারাপের অছিলায় দু এক দিন স্কুলও কামাই করল।
বিমলা কপট ধমকের সুরে একদিন বলল— যা শুরু করেছ তাতে এবার লোকে তোমায় বৌ পাগলা বলবে।
আদর করতে করতে অমূল্য বলেছিল—বলুগ গে।
একটা জিনিস অমূল্যকে মাঝে মাঝে হজম করতে হয়। তা হল বিমলার শাসন। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে ওঠার
উপায় নেই। তারপর সারাদিন কত যে এটা কোরো না ওটা কোরো না শুনতে হয় তার শেষ নেই। মাস্টারি তার নয় বিমলারই করা উচিৎ ছিল। বিমলার এই মাতব্বরি অবশ্য সে উপভোগই করে কারণ, তাতে থাকে অনুরাগের ছোঁয়া। সে দেখেছে বিমলা তাকে অযৌক্তিক কিছু বলে না। তা ছাড়া স্বামীর ওপর জোর খাটাবেনাতো খাটাবে কোথায়! বেশ কটা দিন ঘোরের মধ্যে কাটল।
প্রথম ছন্দ পতন হল অমূল্য যেদিন স্কুলের মাইনে নিয়ে ঘরে এল। মার কাছে সংসার খরচের টাকাটা দিয়ে ঘরে এসে সোহাগ করে বউএর হাতে একশ টাকা দিয়ে বলল—এটা তোমার হাত খরচের জন্য। ইচ্ছেমত খরচ কোরো।
তখনকার বাজারে বিশাল কিছু না হলেও একশ টাকা একেবারে ফেলনা ছিল না। বিশেষতঃ অমূল্যর মাইনের অনুপাতে ওটা অনেক। বউকে ওই হাতখরচ দেওয়ার ফলে তাকে কিছুটা খরচ কমাতে হবে অথবা আরো এক আধটা টিউশনি যোগাড় করতে হবে। তবু আদরের বিমলার খুশির জন্য এটুকু কৃচ্ছসাধন এমন কিছু নয়। বিমলার মুখে যে খুশির ঝলক দেখতে পাবে তাতেই তার মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। এইটুকু সময়েই অমূল্য বিমলাকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছিল।
টাকা হাতেই বিমলা জিজ্ঞেস করল—মাইনের বাকি টাকাটা কি করলে ?
যা আশা করেছিল তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখে অমূল্য একটু থতমত খেয়ে গেল।
একটু সামলে নিয়ে বলল—সংসার খরচের টাকাটা মার কাছে দিয়ে বাকি অল্প কিছু আমার হাত খরচের জন্য রেখেছি। তুমি কি খুশি হওনি ?
উত্তরে বিমলা শুধু বলল—বিয়ের আগে সংসার খরচের টাকা বাবা আমার কাছে দিতেন। তাতে আমাদের সংসার কিন্তু কোনদিন খারাপ চলেনি।
অমূল্য একেবারে চুপ করে গেল।
কথাটা বলেই বিমলা বুঝতে পারে যে ভুল হয়ে গেছে। বাপের বাড়ির মত স্বামীর সংসারও নিজের মত করে চালানোর বাসনাটা ওভাবে প্রকাশ করা উচিত হয়নি। তাও এত তাড়াতাড়ি।
অমূল্যর গলা জড়িয়ে দুঃখপ্রকাশ করে বলল—আসলে সংসার চালানোটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই অভ্যাসের বসেই কথাগুলো বলে ফেলেছি। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
বিমলা আরো বলল—সংসারের টাকা মার কাছেই থাক। আমাদের রোজগার তো বেশি নয় তাই মাকে বোলো একটু হিসেব করে খরচ খরচা করতে।
কথাগুলো শুনে অমূল্যর মনটা ঠাণ্ডা হল। সে একেবারেই সংসারী নয়। সংসারের ভালমন্দর ব্যাপারে তার জ্ঞান খুবই কম। তাই বিমলাকে কাছে টেনে আদর করে বলল--- ও সব যা বলার তুমিই বোলো।
ওই বলা থেকেই শুরু হল যাবতীয় বিপত্তি।
অমূল্যর বাবা অমূল্যর মতই শান্ত প্রকৃতির মানুষ। মলিনাই এতদিন ছিলেন এই পরিবারের নিয়ন্তা। দৈনন্দিন সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিতেন। এইখানেই সংঘাতের শুরু। কোন বিশেষ একটা ঘটনা হয়ত তেমন কিছু বড় নয়। কিন্তু বিমলার সাথে ছোট খাট মতপাথর্ক্য গুলো দিনে দিনে বাড়তে লাগল আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগল অশান্তি।
শাশুড়ি চাইতেন বৌমা রান্নার যোগাড় যন্তর করুক কিন্তু রান্নাটা তিনিই করবেন। প্রথম প্রথম তাই হচ্ছিল। কিন্তু বিমলা এক আধটা করে পদ রাঁধতে শুরু করল আর রান্নার প্রশংসাও পেল, বিশেষ করে শ্বশুরের। আর পায় কে। ধীরে ধীরে রান্নাঘরের পুরো দখলটাই নিয়ে নিল। এতে পরিশ্রম বাড়লেও পরোয়া নেই। মহানন্দে নিত্য নতুন রান্না করে সবাইকে খাওয়ায়। সংসার খরচের ব্যাপারেও মাঝে মাঝেই বিমলা নাক গলায়। মলিনার যেটা একেবারেই পছন্দ নয়। একবার তো খরচ কমাবার জন্য বাড়ির কাজের লোককেও ছাড়িয়ে দেবার কথা বলেছিল কিন্তু বিমলার কষ্ট হবে বলে সত্যেন রাজি হয়নি। সংসারের অন্যান্য দায়িত্বের সাথে সাথে শ্বশুরকে ভোরের চা থেকে আরম্ভ করে রাতের খাবার দেওয়া পযর্ন্ত সমস্ত কিছু বিমলা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে করে। এখন টুকটাক কিছু কাজ ছাড়া মলিনাকে প্রায় কিছু করতেই হয় না। সবই বৌমা করে। কাজের ভার কমলে খারাপ লাগার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা তো অন্য যায়গায়। সারা জীবন এই সংসার একা চালিয়েছেন। যা উচিৎ মনে করছেন তাই হয়েছে। সেই সংসারেই কাজ কমার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে কতৃর্ত্ব। এখন তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাই শেষ কথা নয়, বৌমার মতটাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আর সব থেকে
রক্তির ব্যাপার হল যে, এতে সত্যেনের প্রচ্ছন্ন আশকারা আছে।শাশুড়ি বউএর মনমালিন্য নতুন কিছু নয়। হয় না এমন বাড়ি খুব কমই আছে। কিন্তু এই তরজার কিছু নিয়ম আছে। শ্বশুরের জীবিতাবস্থায় শাশুড়ি যতদিন কমর্ক্ষম থাকে ততদিন এই দ্বৈরথে বিজয় তিলক তাঁর কপালেই থাকে। তারপর ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবতর্ন হয়। কিন্তু এ তো সময় দিল না। আসার কিছুদিনের মধ্যেই মলিনাকে নক্ -আউট করে দিল। বৌমা চিৎকার চেঁচামেচি করে না। যা করবে ঠিক করে তা করে ছাড়ে। যেটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। তাই চেঁচামেচি তাঁকেই করতে হয়। প্রথম দিকে অল্প ছিল কিন্তু বৌমার দখলদারি বাড়ার সাথে সাথে অশান্তিও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। সেবা যত্ন করে শ্বশুরকেও হাত করে নিয়েছে। সেবা তাঁকেও যে করেনা তা নয়। কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক নয় তা হল বৌমার মাতব্বরি। স্বামীকে বলে লাভ নেই, তাই ছেলের কাছেই বিমলার নামে বেশ কয়েকবার নালিশ করেছে। অমূল্য বউকে অল্প স্বল্প বকেওছে। কিন্তু মলিনার ধারণা ওটা লোকদেখানো কারণ, বিমলার আচরণ এতটুকু পাল্টায়নি। এভাবে নরমে গরমে কয়েকমাস কাটল।
একদিন ‘জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে এই টাকায় আর সংসার চালান যাচ্ছে না’ —মলিনার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিমলা অত্যন্ত শান্ত ভাবে বলল—মা, জিনিসপত্রের দাম আমরা কমাতে পারব না আর আয়ও আমাদের বাঁধা। তাই সবাই মিলে চেষ্টা করে সংসার খরচটা একটু কমাতে হবে।
ব্যাস, আগুনে ঘি পড়ল। সংসার খরচের টাকা মলিনার কাছে থাকে, তাই এ আক্রমণ সরাসরি তাঁকেই।
ছেলে বাড়ি ফিরতেই তার কাছে কেঁদে পড়লেন—তোর বউএর কাছে আর কত অপমান সহ্য করতে হবে রে ? আমি তো এখন তোদের বাড়ির কাজের লোকের থেকেও অধম হয়ে গেছি রে।
রোজ অভিযোগ শুনতে শুনতে সে বিরক্ত। ক্লান্ত হয়ে সবে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ঢোকার সাথে সাথেই অভিযোগ শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল। মাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বলে পুরো ঘটনাটা না শুনেই চেঁচিয়ে সকলের সামনে বিমলাকে বলল—এ বাড়িতে থাকতে হলে এখানকার মত করে থাকতে হবে। না পারলে থাকার দরকার নেই। যেখান থেকে এসেছ সেখানে গিয়ে থাক।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেই অমূল্য বুঝতে পারে যে রাগের মাথায় সে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। বিমলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুচোখ বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা।
নিজের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত অমূল্য রাতে বিমলার কাছে বারে বারে দুঃখপ্রকাশ করে। বিমলা কোন উত্তর দেয়নি। বালিশে মুখ গুঁজে চুপ করে শুয়ে ছিল। পরের দিন সকালে বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম সেরে অমূল্য স্কুলে চলে যাওয়ার পর শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে বিমলা কোলকাতায় তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইল। মলিনা মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে রইলেন। সত্যেন প্রথমে
বৌমাকে খানিক বোঝালেন। তারপর কদিন বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে মনটা ঠাণ্ডা হবে এই ভেবে এক ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীকে ডেকে বিমলাকে কোলকাতায় পোঁছে দিয়ে আসতে বললেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বিমলাকে দেখতে না পেয়ে অমূল্য মাকে জিজ্ঞেস করল। মলিনা প্রথমে পাশ কাটিয়ে গেলেও পরে আসল ঘটনাটা জানাতেই হল। এতটা অমূল্য ভাবেনি। মেয়েটা খুবই কষ্ট পেয়েছে। মনের দুঃখে ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। হঠাৎ চেয়ারের ওপর কয়েকটা চাবি আর একটা খাম চোখে পড়ল। খামটা খুলে দেখে বিমলার লেখা কয়েক লাইনের একটা চিঠি—
আমি এই বাড়িকে নিজের বাড়ির মতই ভাবি। বাপের বাড়ির লোকেদের থেকে তোমাদের কক্ষনো আলাদা চোখে দেখিনি। তাই সংসারের মঙ্গলের জন্য যা উচিৎ মনে হয়েছে তা করার পুরনো অভ্যাসটাও ছাড়তে পারিনি। পারলে ক্ষমা কোরো।“--- বিমলা।
চিঠিতে কাউকে সম্বোধন করা না থাকলেও বোঝাই যাচ্ছে এ চিঠি তাকেই লেখা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এ সবের জন্য সেই দায়ি। সামনে পূজো। এ সময় লোকে বাড়ির কুকুর বেড়ালকেও তাড়ায়না আর সে কিনা নিজের বউকেই তাড়িয়ে দিল। কেন যে মার কথায় মাথাটা গরম করল। এই কয়েক মাসে বিমলাকে সে বড্ড ভালবেসে ফেলেছিল। স্বাবলম্বী সে কখনই ছিল না, কিন্তু বিয়ের পর থেকে তার জীবনটা পুরপুরি বৌ নির্ভর হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে একটু শাসন করে এই যা। তা তার মত আনাড়ির ওটা দরকার।
রাতে মায়ের শত অনুরোধ সত্ত্বেও অমূল্য কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ল। সত্যেনও খেতে বসে প্রায় কিছুই না খেয়ে উঠে গেলেন। স্বামী, সন্তান যখন অভুক্ত তখন মলিনাই বা খান কি করে। রাতে শোয়ার পরেও দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না। সারাদিনের ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ছেলের কাছে বৌমার হেনস্থায় তিনি খুশি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বিমলা যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে তা ভাবতে পারেননি। যাওয়ার সময় যখন কাছে এল তখন রাগের মাথায় কথা না বলাটা ঠিক হয়নি। মেয়েটাকে আটকান উচিৎ ছিল।
সকালে উঠেও গতকালের ঘটনা অমূল্যর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। স্কুলে যেতে ভাল লাগছে না। টেবিলের ওপর আলমারির চাবিগুলো পড়ে রয়েছে। কতদিন সে নিজে আলমারি খোলেনি। দরকারই পড়ত না। সব বিমলাই হাতে হাতে যোগান দিত। ধীরে ধীরে উঠে আলমারিটা খুলল। জামাকাপড় সব পরিপাটি করে সাজান রয়েছে। শাড়ী গুলোয় হাত বুলিয়ে বিমলাকে অনুভব করার চেষ্টা করল। হঠাৎ চোখে পড়ল কয়েকটা খাম। এক একটা খামে এক এক জনের নাম লেখা আর তার পাশে লেখা “পূজোর জন্যে।“ প্রত্যেকটার ভেতরে অল্প কিছু টাকা রাখা আছে। এই কয়েক মাসের হাত খরচের টাকা থেকে তিল তিল করে জমিয়ে বাড়ির প্রত্যেকের পূজোর কেনাকাটার জন্য আলাদা করে রাখা। কেবল নিজের জন্য কিছু নেই। পূজোর সময় স্বামীর কষ্ট যাতে কিছুটা লাঘব হয় তার জন্যই এই সঞ্চয়। অমূল্য নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে চোখের জলে ভেজা খামগুলো মায়ের সামনে রেখে বলল—মা, বিমলা কি খুবই খারাপ ছিল ?
বিমলা চলে যাওয়ার পর সংসার আবার মলিনার একার হাতে ফিরে এসেছে। এখন তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাই শেষ কথা। প্রশ্ন করার কেউ নেই। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই মলিনা বুঝতে পারলেন যে তাঁর সাধের সংসারের স্বাভাবিক ছন্দটাই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাড়িতে তিনটে মানুষ, কিন্তু কেউ কাউকে যেন চেনে না। সারাদিন সংসারের জন্য পরিশ্রম করেও কারো মন পান না। ছেলে শুধু বাড়িতে খেতে আর শুতে আসে। তাও অধের্ক দিন শরীর খারাপের অছিলায় রাতে খায় না। দিনের যতটা সময় পারে বাইরে কাটায়। স্বামী এমনিতেই কম কথার মানুষ, এখন একেবারেই কথা বলেন না। যে সংসার একদিন তাঁকে ছাড়া অচল ছিল এখন সেখানে নিজেকেই অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। বয়স অনুপাতে তাঁর শরীর স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভাল। তাই বাড়ির কাজ করতে তাঁর কোনদিন কষ্ট হত না। কিন্তু মেয়েটা আসার পর থেকে সব কাজ নিজে করতে শুরু করে মলিনার কাজ করার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিয়েছে। এখন সামান্য কাজ করতেও আর শরীর চলে না।
এই কদিনে আর একটা উপলব্ধি মলিনার হয়েছে। যেখান থেকে যাবতীয় বিবাদের সূত্রপাত, সেই সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিমলার নজরদারিতে আখেরে লাভই হয়েছে। খরচ এখন বেশ কম হয়। আগে মাসের শেষে প্রায়ই ছেলের কাছে টাকা চাইতে হত। এখন দু পাঁচ টাকা বরং বেঁচে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে স্বীকার করা সম্ভব না হলেও এটাই বাস্তব।
দুপুরবেলা একা বসে বিমলা ভাবেন... মেয়েটা বাড়ির সকলকে সেবা যত্ন করত। কোন কাজে কক্ষনো না করেনি। একমাত্র সমস্যা, সংসারে কোথাও কোন কিছু ঠিক হচ্ছে না মনে হলেই বলত বা নিজেই তা শুধরোবার চেষ্টা করত। ওইটুকু মেয়ে তাঁর মত গিন্নিকে সংসার চালানোয় জ্ঞান দিলে রাগ হবে না ? তবে তিনি যতই চেঁচামেচি করুন না কেন বৌমা কিন্তু কক্ষনো ঝগড়া করেনি।
কিছুটা অনুতাপ আর কিছুটা বিমলা চলে যাওয়ার পর বাড়ির অস্বস্তিকর পরিবেশ, এই দুটো কারণে মলিনা মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
দিন দশেক বাদে এক রবিবার বিমলার বাবা পূজোর তত্ত্ব নিয়ে পাতিহাল এলেন। ব্রজেনকে দেখেই সত্যেন আর মলিনা খুবই লজ্জিত হয়ে পড়লেন।
প্রথমেই ব্রজেন মেয়ের জন্য বেয়াই বেয়ানের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন—আমাদের জন্য মন কেমন করছে বলে বিমলা মার অমন করে হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা উচিৎ হয়নি। আপনারা খুব ভাল বলে ওকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আমি আজই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম কিন্তু ও আর কটা দিন থাকতে চাইল।
যারা চরম অপমান করে তাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করল, নিজের বাবার কাছে সে কিন্তু তাদের ছোট হতে দেয়নি। কত ভালবাসা থাকলে তবেই এটা সম্ভব। মলিনার এখন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।
সত্যেন বললেন—বৌমার যে কদিন মন চায় আপনাদের কাছে থাকুক। শুধু বলবেন যে এই বুড়টার মায়ের জন্য বড্ড মন কেমন করছে।
মলিনা ততক্ষনে বেয়াইয়ের জন্য চা, জলখাবার নিয়ে এসেছেন। অনেক আদর আপ্পায়ন হল। নানা অছিলায় ব্রজেন রাতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ কোনোরকমে কাটালেন। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আসা। এদের যত্ন আর আন্তরিকতায় ব্রজেন আপ্লুত। অনেক ভাগ্য করে এমন ঘর পাওয়া যায়। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। জামাই এসে বাসে তুলে দিয়ে গেল। বাড়ি পোঁছতে রাত দশটা বাজল। বাড়ির সকলে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ব্রজেনের অপেক্ষায় বসে ছিল। বিমলার উদ্বেগ ছিল সবথেকে বেশি। বাবার ফিরতে দেরী হচ্ছে মানে এখানে করা তার সব নাটকের ওপর যবনিকা পড়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে তার নিজের সংসার ঘিরে গড়ে তোলা সব সোনালী স্বপ্ন।
ব্রজেনকে দেখতে পেয়েই বিমলা দৌড়ে বেরিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল—বাবা এত দেরী হল ?
-- ভেতরে চল সব বলছি।
বিমলার উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল। ঘরে বসে বিমলার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে স্ত্রীকে বললেন—অনেক ভাগ্য করে অমন বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছ। যা আপ্যায়ন করল ভাবা যায় না। কিছুতেই ছাড়ছিল না। অনেক কষ্টে রাতে থাকাটা এড়িয়েছি।
বেয়াই বিমলার অভাবে কতটা কাতর তাও জানালেন।
যে বাড়ি থেকে সে একপ্রকার বিতাড়িত, সেই বাড়ির প্রশংসা নিজের বাবার মুখে শুনে বিমলার খুব আনন্দ হল। তার এখানে চলে আসার আসল কারণটা অন্তত বাড়ির সকলের কাছে গোপন রইল। না হলে বাবা,মা খুবই কষ্ট পেতেন। তা ছাড়া শ্বশুর বাড়িকে সে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছিল। তবু তখনও সে দ্বিধাগ্রস্ত। কি করবে না করবে এইসব নিয়ে যখন তার মন তোলপাড় হচ্ছে তখনই ব্রজেন পকেট থেকে একটা ছোট খাম বার করে মেয়েকে দিয়ে বললেন—ভুলেই গিয়েছিলাম, এটা বেয়ান তোকে দিয়েছেন।
আবার আতঙ্ক। বিমলা জানে না ওর ভেতর কিসের পরোয়ানা আছে। কোন রকমে খাম খুলে চিঠিটা বার করল। ছোট্ট দু লাইনের চিঠি। --- মা বিমলা, ফিরে এসে নিজের সংসারের হাল ধরো। এই বুড়ি যে আর সামলাতে পারছে না মা।
চিঠিটা পড়ে বিমলার অন্তর জুড়িয়ে গেল। মনে আর কোন দ্বন্দ নেই।
--- মা, আমি কাল সকালে পাতিহাল যাব।
ব্রজেন বললেন—সে কিরে, এই যে বললি আরো কটা দিন থাকবি! আমি সেইমত তোর শ্বশুরবাড়িতে বলে তাঁদের মত নিয়ে এলাম।
বিমলা বলল—না বাবা, আমাকে যেতেই হবে।
মা ভাবলেন বরের জন্য মেয়ের মন কেমন করছে। মেয়েকে আদর করে বললেন—পাগলী ।
বিমলার থেকে সুখী এ সংসারে এই মুহুর্তে আর কেউ নেই। শাশুড়ির দু লাইনের চিঠিতে সে পেয়ে গেছে তার ইপ্সিত স্বীকৃতি। তাই আর বিলম্ব করা সম্ভব নয়।
Comments
Top
ক্যানভাস
মিঠুন মন্ডল
সন্দীপ রায় মন দিয়ে পেপার পড়ছে। না, কোন রাজনীতির বা খেলার খবর নয়। শেয়ার মার্কেটে বেশ কয়েকশো সূচক পড়েছে, সেটাই মন দিয়ে পড়ছে। দুতিনটে বড়ো কোম্পানির শেয়ার পড়ায় সন্দীপ একটু চিন্তিত। রাইমা চায়ের গ্ল্যাসটা টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াট হ্যাপেনড? এনি থিং রং?’ রাইমা কনভেন্টে পড়া মেয়ে। কথায় কথায় ইংরাজী বলে ফেলে। তবে নিজেকে জাহির করতে নয়, নিতান্তই অভ্যাস বশত বলে ফেলে। না, কিছু হয়নি বলে সন্দীপ চায়ের গ্লাসে চুমুক দিল। ‘বাটার টোস্ট, ডিম সেদ্ধ কিছুই তো খেলে না? কাল অনেক রাত্রে খেয়েছি তো, মনে হয় অ্যাসিড হয়ে গেছে। রাইমা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কি মনে করে কিছু বলল না হয়তো উত্তরটা জানা। অফিসে পার্টি ছিল কিংবা কোন বন্ধুর বাড়ী থেকে খেয়ে এসেছে। সন্দীপ একটা অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। গত বছর একটা ফেয়ারনেস ক্রিমের অ্যাড বানিয়ে এওয়ার্ড পেয়েছিল। সন্দীপ আনমনে কিছু ভাবছিল। রাইমা টাই পরাতে থাকে। সন্দীপের ফোনটা বেজে উঠল। সন্দীপ হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো, ‘ শুনেছেন মুখার্জী আবার মুম্বাই থেকে ব্যাক করছে। আমি কালকেই শুনেছিলাম আপনাকে বলা হয়নি’। ‘ও তাই ! ভালো তো! ‘মুম্বাই এ যে বেশিদিন টিকবে না সেটা আমি আগেই জানতাম। বাঙালী ছেলেদের মাছ ভাত- মাংস ভাত না হলে চলে’। ‘আপনি বলতে চাইছেন মুম্বাই এ মাছ, মাংস পাওয়া যায় না’? সন্দীপ একটু গম্ভীর ভাবে বলল। ‘না, না সেটা বলছি না, আসলে কলকাতায় থাকার যে মজা সেটা কি অন্য কোথাও পাওয়া যায়’? ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বেড়চ্ছি বাকি কথা অফিসে হবে। সন্দীপ রায় মোবাইলটা পকেটে পুড়লে, রাইমা বলে, বুবলাইয়ের জন্মদিন ওর জন্য কি একটা ড্রয়িং সেট কিনে নেবো? ‘কোন বুবলাই’? ‘বুবলাইকে ভুলে গেলে? রঞ্জুদার ছেলে? তোমার তো কিছুই মনে থাকে না দেখছি’? ‘ও আচ্ছা, মনে পড়েছে। ওকে একটা খেলনা কিনে দাও। ‘কেন ড্রয়িং সেট কিনে দিলে কি হবে? ‘কিছু হবে না, বুবলাইতো পাবলো পিকাসো হবে না’? রাইমা সন্দীপের মুখের দিকে চেয়ে আছে। সন্দীপ কি কিছু মিন করতে চাইছে? রাইমা কে অন্যমনস্ক দেখে, সন্দীপ বলে, তোমার যা ইচ্ছে তাই কিনে নিয়ে যেও, আমি চললুম দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সন্দীপ অফিস চলে গেলে, রাইমা টবে লাগানো গাছ গুলোতে জল দিল। হঠাৎ করেই মনে পড়ল, চিলে কোঠার ঘরটা অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। দরজা খুলেই একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ অনুভব করল রাইমা। একটা সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সন্দীপ এই ঘরে থাকত। প্রায় ৫ বছর হয়েগেল সন্দীপ এই ঘরে আর ঢোকে না। চারিদিকে সন্দীপের আঁকা পোট্রে। কোনটা শুধু পেনসিল দিয়ে স্কেচ করা কোনটা জল রং। বছর আটেক আগে গগনেন্দ্র ভবনে এই রকমই এক পেনসিল দিয়ে স্কেচ করা পোট্রে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল রাইমা। অনেকটা গায়েপরেই আলাপ করেছিল রাইমা। একটা ডাইরি বার করে অটোগ্রাফ চাইলে সন্দীপ বলে, ‘অটোগ্রাফ চাইছেন, দিচ্ছি কিন্তু আমি কোন বড় শিল্পী নই, মনের খেয়ালেই ছবি আঁকি। আপনি সারাজীবন মনের খেয়ালেই ছবি এঁকে যান সন্দীপদা, আপনার ছবি আন্তর্জাতিক মানের। এরপর সন্দীপের প্রায় প্রত্যেকটা প্রদর্শনীতেই রাইমা থাকত। সন্দীপের বাবা অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন। মায়ের পেনশন আর নিচের তলার ঘর ভাড়ার টাকায় সংসার চলত। রাইমার সাথে যখন বন্ধুত্ব এক বছর গড়িয়েছে হঠাৎ করেই সন্দীপের মা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।সন্দীপ আরও বেশি করে রাইমার উপর নির্ভরশীল হতে থাকে। সন্দীপের মা মারা যাবার তিন মাস পর একদিন সন্ধ্যাবেলায় রাইমা সন্দীপের বাড়ী আসে। হাতে একটা বড়ো ব্যাগ। সন্দীপ কিছু বুঝে উঠার আগেই রাইমা বলে, ‘আমি আজ থেকে এখানেই থাকব’। ‘মানে কি? তোমার বাড়ির লোক জানে? ওরাতো এক্ষুনি পুলিশে খবর দেবে’। ‘না দেবে না, আমি বাড়িতে বলে এসেছি’ রাইমা ধীর গলায় উত্তর দেয়। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি তেমন কিছু করিনা, কি করে...। উফ! তোমাকে কিছু করতে হবে না, আমি একটা জব পেয়েছি, যা মাইনে পাবো আমাদের চলে যাবে।
দেওয়ালের এককোণে রাইমার একটা পোট্রে ঝুলছে। পাহাড়ী মেয়েদের মতো সেঁজে বসে আছে। বিয়ের একমাস পরই দার্জিলিং গিয়েছিল। ঠিক হানিমুন বলা যায় না। সন্দীপ কার্শিয়ং এ একটা স্কুলে ওয়ার্কশপ করাতে গিয়েছিল। একদিন ওয়ার্কশপ থেকে সন্দীপ ফিরলে রাইমা বলে, ‘যদি একসঙ্গে সময়ই না কাটানো যায় তাহলে আর মধুচন্দ্রিমার মানে কি’? সন্দীপ কিছুক্ষণ চুপ চাপ থাকে তারপর বলে, ‘তুমি এক জায়গায় ১ ঘণ্টা বসে থাকতে পারবে? ‘কেন? তুমি কি টাইটেনিকের মতো ছবি আঁকবে’? রাইমা চোখ দুটো বড় করে জিজ্ঞেস করে। হ্যাঁ। তবে উইথ কস্টিউম। তোমাকে আমি আজ পাহাড়ি মেয়ে সাজাবো। প্রথম ১০ মিনিট বসে থাকতে কোন অসুবিধা হয়নি রাইমার। একটু নড়লেই সন্দীপ বলে উঠে, ‘এই একদম নয়, চুপচাপ লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকো’। এর পর রাইমা আর কোনদিন পোট্রে করার কথা বলেনি। মডেলদের অসীম ধর্য্যের জন্য অবাক হয়েছে। একবার সন্দীপকে জিজ্ঞেস ও করে ছিল, ‘তোমার মডেলরা ২-৩ ঘণ্টা বসে থাকে কি করে? এটা ওদের professionalism এবং dedication দুটোর সংমিশ্রণ। ওয়ার্কশপের শেষ দিনে ম্যালে বেড়াতে গিয়েছিল। জানো রাইমা এই বাজারটার পাশে একটা বুদ্ধ মন্দির আছে, তুমি যাবে? তুমি কি করে জানলে? রাইমা বিস্ময় প্রকাশ করল। আর্ট কলেজে পড়ার সময় একবার এসেছিলাম। তাই! তোমারা মন্দির দেখতে এসেছিলে নাকি? তা নয়। আমরা দার্জিলিং বেড়াতেই এসেছিলাম। আমার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে এসেছিল। কেন? আমাদের এক ক্লাসমেটকে ওর ভালো লাগতো কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছিল না। শেষে আমার দায়িত্ব পড়ল তাকে জানানোর। তুমি পিয়নের কাজে সফল হয়ে ছিলে? রাইমার মুখে একটা হাসি মাখানো বিস্ময়। মেঘনার সাথে আমার আগে থেকে আলাপ ছিল। আমি ওকে একটা চিরকুট দিলে, সে এক পলক দেখেই সেখানে ফেলে দেয়। তারপর? আমার কি দূরবস্থা! সবার সামনে চিরকুট দেওয়াটা মনে হয় ঠিক হয়নি। সেই সময় মনে হচ্ছিল ধরিত্রী তুমি দ্বিধা হও আমি ঢুকে যায়। এটা বেশি বাড়াবাড়ি! সত্যি বলছি লোকের জন্য এতোটা লজ্জায় কখনও পড়িনি। তোমার চিঠি দেওয়ার সঙ্গে মন্দিরের কি সম্পর্ক? বলছি, একটু সবুর করুন। এই ঘটনার পর আমি বন্ধুকে বললাম ভাই তুই মেঘনাকে ভুলে যা, ওর কাঁদতে বাকী, কোথা থেকে শুনেছিল আমি জানি না, আমাকে টানতে টানতে এই বুদ্ধ মন্দিরে নিয়ে এসেছিল। কিছু দিন পর বন্ধুটা আর্ট কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল। আমার সাথে অনেকদিন কোন কন্ট্যাক্ট ছিল না। মাস তিনেক আগে সল্টলেকে একবার দেখা হয়েছিল। একথা সেকথা পর জিজ্ঞেস করলাম কি রে মেঘনাকে ভুলতে পেরেছিস? ও বলল সেটা মনে হয় আর সম্ভব নয়, এক সাথে ঘর করছি তো! আমি না এক মিনিট কোন কথা বলতে পারিনি। বন্ধুটা আমার মনের অবস্থা দেখে বলল, ‘আমরা বুদ্ধ মন্দিরে গিয়েছিলাম তারই ফল পেয়েছি, আমাদের একটা দুবছরের বাচ্চা আছে, নাম
আয়ুস। আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম বা! কনগ্রাচুলেশনস! কিন্তু কি করে হল। ও তো... । আজ ব্যস্ত আছি একদিন বাড়িতে আয় সব বলব। সন্দীপ ম্যালের বাজার থেকে একটা স্কার্ফ কিনে দেয় রাইমাকে। রাইমা ঘর সাজানোর কয়েকটা জিনিস কেনে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের কাছে এসে পড়ে। কলকাতার মতো ফল ফুল দিয়ে পুজো করার রেওয়াজ নেই। মন্দিরের ভিতরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রাইমা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল। ভগবানের কাছ থেকে কি চাইলে? বলব কেন? সন্দীপ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাইমার দিকে চেয়ে আছে। রাইমা হেসে বলল, ‘পতি দেবতা যেন আর বেশি সময় দেয় আরও অনেক বেশি ভালবাসে’। তোমাকে একটু কম ভালবাসছি বলছ? রাইমা মুখে হাসি রেখেই ঘাড় নাড়ালো। কেন তোমার এই রকম মনে হচ্ছে? সন্দীপ একটু গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল। এই ধরো আমি তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই তোমার ঘরে এসেছি, তুমি হয়তো কিছুটা বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছ। সন্দীপ কয়েক মুহূর্ত রাইমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘মানুষের কিছু আবেগ কে অনুভব করতে হয়, মুখে বললে মাধুর্য্য নষ্ট হয়ে যায়’।
রাইমা জানলাটা খুললে সূর্যের আলো ঘরের এক কোনে রাখা পোট্রের উপর পড়ে। পোট্রের নিচে ছোটো করে তারিখ লেখা ২৪ শে সেপ্টেম্বর ২০১০। সেই দিন সকাল ৯ টার সময় রাইমা অফিসের জন্য বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায় ঘরের ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে এবং কিছু সবজি নিয়ে আসতে। সন্দীপ একটা পোট্রে আঁকছে মন দিয়ে, কানে কোন কথা ঢুকেছে কিনা বোঝা গেল না।সন্ধ্যে ৭ টার সময় ফিরে এসে রাইমা দেখে ইলেকট্রিক বিলের কাগজ যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই পড়ে রয়েছে। ডাইনিং টেবিলের উপর মুড়ির প্যাকেট, থালা, চায়ের গ্লাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রাইমা কাঁধের ব্যাগটা খাটের উপর রেখে চিলে কোঠার ঘরে যায়।সন্দীপ তন্ময় হয়ে ছবি আঁকছে, ঘরের ভিতরে একজন এসেছে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘরের মেঝেতে রং, তুলি কাগজ ছড়ানো। এই নিয়ে পাঁচ বার চেষ্টা করেও সন্দীপ ঠিক যেমনটা চাইছে ঠিক তেমন ভাবে পোট্রে টাকে ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। তিন বছরের এক সাঁওতালি বাচ্চা তার মাকে অর্ধেক বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। সন্দীপ চাইছে মায়ের মুখটাতে হাসি এবং একই সঙ্গে ভিতরের একটা কান্না ফুটিয়ে তুলতে। হাসিটা তো ঠিক আছে কান্নাটা আসছে না! ঘরের ছিটকানি টা লাগাওনি কেন? রাইমা জিজ্ঞেস করে। রঞ্জু আর শ্যামল এসেছিল, তারপর আর লাগানো হয়নি। সন্দীপ ক্যানভাস থেকে মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিল। ‘ইলেকট্রিক বিল জমা দাওনি কেন’? ‘একবার ভেবেছিলাম যাবো, কিন্তু আর হয়ে উঠল না, থাক আগামীকাল দিয়ে দেব’। ‘আজকে এই মাসে বিল জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল, কাল জমা দিতে গেলে ফাইন দিতে হবে। রাইমা কথাগুলো চিৎকার করে বলল। সন্দীপ চুপ করে থাকে। ঘরটার কি অবস্থা করে রেখেছ, দেখেছ? এখানে কোন মানুষ থাকে? সন্দীপ পরিবেশটা একটু হালকা করার জন্য বলল, ‘আমার মনে হয় ভূত থাকে! আমি ভূত আর তুমি পেত্নী, কথাটা বলেই সন্দীপ হাসার চেষ্টা করল। রাইমা একই রকম গম্ভীর হয়ে আছে। চানাচুরের প্যাকেট শেষ হয়ে গেছে বলনি তো? সন্দীপ বলল। রাইমা আর নিজের নার্ভ কে ধরে রাখতে পারল না। সে চিৎকার করে বলল, ‘সাট আপ! জাস্ট আই কান্ট টলারেট ইউ। দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছ সন্দীপ। তোমাকে সবজি আনতে বলেছিলাম, এনেছ? সন্দীপ জানলার দিকে চেয়ে আছে। রাইমা মেঝের উপর বসে পড়ল। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সন্দীপ কি করবে বুঝতে পারছে না। নিজের আঁকা পোট্রের দিকে একবার চাইল। এতক্ষণ যেটা দেখে কিছুই হচ্ছে না মনে হচ্ছিল এখন সেটাই এক অসাধারণ ছবি মনে হচ্ছে। রাইমার চোখের জল যেন ছবিটার মধ্যে ফুটে উঠেছে। দিন সাতেক হয়ে গেল সন্দীপ একটা পোট্রে বানাচ্ছে। এই বছর প্যারিসে আন্তর্জাতিক পোট্রেট প্রতিযোগিতা শুরু হবে ২২শে ফেব্রুয়ারী। সন্দীপ অংশ গ্রহণ করতে চায়। এন্ট্রি ফ্রি যাতায়াত নিয়ে প্রায় ১৫০০০০ টাকা খরচ। ব্যাঙ্কে লাখ খানেক টাকা আছে। এদিক ওদিক থেকে হাজার দশেক হয়ে যাবে। বাকি ৪০০০০ টাকা কোথায় পাবে? সন্দীপ চিন্তা করছে রাইমাকে বললে কি দেবে? গত বছর মানালি গিয়েছিল প্রতিলিপি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু প্রথম
দ্বিতীয় বা তৃতীয় কিছুই হতে পারেনি। শুধু পাবলিক চয়েস অ্যায়ার্ড পেয়েছিল একটা মোমেন্টো। এদেশে এতো পলিটিক্স আর লবি চলে যে নতুন কিছু করাই খুব মুশকিল। সেবার রাইমাকে বড়ো মুখ করে বলেছিল, ‘দেখবে প্রথম পুরষ্কার এক লক্ষ টাকা আমিই পাবো। তোমাকে একটা ডাইমন্ডের রিং দেবো’। রাইমা মাঝে মাঝে তার পুরানো রিং টা দেখিয়ে বলে, ‘দেখেছ সন্দীপ আমার ডাইমন্ডের রিংটা কেমন চক্ চক্ করছে। এখন যদি ৪০০০০ টাকা চাই রাইমা কি দেবে? দেখা যাক! রাইমাকে বলার সাথে সাথেই নাকচ করে দিল। কোথা থেকে দেব? তুমি দিয়ে রেখেছ? রাইমা বেশ জোর গলায় জিজ্ঞেস করল। সন্দীপ আস্তে আস্তে বলল, ‘না মানে তোমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট আছে না, সেটা যদি ভাঙাতে। আমি ১০০% কনফিডেন্ট এবার...’ থাক্ থাক্ তোমার আত্মবিশ্বাস তোমার কাছেই থাক। গত বছর ডাইমন্ডের রিং দিয়েছিলে না? এবছর না হয় থাক। রাইমা একটু ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল। ‘রাইমা তুমিই তো চাইতে আমি একজন আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী হই, এখন যখন সুযোগ এসেছে, অল্প কয়েকটা টাকার জন্য পিছিয়ে যাবো। পিছিয়ে যেতে বলছি না তো? তুমি আর একটু তৈরি হও। সল্টলেকে একটা অ্যাড এজেন্সিতে পোস্ট ভ্যাকান্সি আছে, আমার এক রিলেটিভ আছে, আমি তোমার কথা বলেছি। আরে এই প্রতিযোগিতায় একবার ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে গেলে আর চাকরী করতে হবে না। মকবুল ফিদা হুসেন তো... । উফ্ থাক, তোমার মতো কুঁড়ে লোক আর দেখিনি, তুমি তাহলে চাকরী করবে না? তুমি জানো একজন বিখ্যাত লোক কি বলেছিলেন, ‘শিল্পীদের কখনও ১০-৫ টা বা ৯ টা ৬ টার টাইম লাইনে বেঁধে রাখা উচিৎ নয়’। বিখ্যাত লোকটার নাম কি সন্দীপ রায়? রাইমা জিজ্ঞেস করল। সন্দীপ কোন কথা না বলে দাঁত বার করে হাসতে লাগল। তোমার এই হাসিটা আমার অসহ্য লাগে। কথাটা বলেই রাইমা বেড়িয়ে গেল। সন্দীপ ঘর থেকেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, ‘টাকা তাহলে দিচ্ছ না’? বার থেকে উত্তর এল ‘না’।
দিন দুয়েক বহু চেষ্টা করে, বন্ধুদের কাছে ধার করে ২০০০০ টাকা জোগাড় করেছে সন্দীপ। সময় তখন ১০ টা ১১ টা হবে, রাইমা অফিসে গিয়েছে। সন্দীপ একবার আলমারির ভিতরের লকারটা খুলল। একটা হার, দুটো বালা, তিনটে নাকের নথ আর হাজার দুয়েক টাকা রয়েছে। সন্দীপ ভাবতে থাকে কি করবে? দিন কুড়ির মধ্যে কি রাইমার হার টা লাগবে? কোথাও তো যাবার প্লান নেই। একবার কম্পিটেশনে জিতে গেলে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। তখন এই রকম দু-তিনটে হার কিনে দেবে রাইমা কে। সন্দীপ হারটা বন্ধক দিকে টাকা জোগাড় করে। ঠিক দিন সাতেক পরে রাইমা হারটা খোঁজ করতে শুরু করে। অফিসের এক কলিগের ছেলের জন্মদিনে নেমন্তন্ন। প্রথমে আলমারি, বিছানার তলা তারপর নিজের দুতিনটে ব্যাগ প্রায় সব জায়গা খুঁজল। কোথাও পেল না। রাত্রে ফিরে এসে সন্দীপকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার হারটা দেখেছ? তোমার হার! না তো? হারটা আমার দাদু দিয়েছিল, ক্লাস টেন থেকে আমি হারটা আমি পড়ছি। ও ছাড়! পরে আমি বানিয়ে দেবো। রাইমা কোন কথা বলে না, সন্দীপের মুখের দিকে চেয়ে আছে। সন্দীপ একটু অস্বস্তি বোধ করছে। সন্দীপ বলে, ‘কি হবে জিনিসের জন্য মায়া করে’? রাইমা একটু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি আমার হারটা বেঁচে দিয়েছ না’? আমি না তো। কথা টার মধ্যে কোন জোর ছিল না। রাইমা বুঝতে পারে সন্দীপ কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। রাইমা সন্দীপের কাছে এসে বলে, ‘আমাকে ছুঁয়ে বলো, তুমি হারটা বেঁচো নি’। সন্দীপ একটু দূরে সরে গিয়ে বলে, ছেলে মানুষী করছ কেন, বলছি তো নিই নি। এবারেও কথার মধ্যে কোন জোর খুঁজে পেল না রাইমা। রাইমা আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। বিছানায় শুয়ে পরে মুখ গুঁজে। বালিশ ভিজতে থাকে। সন্দীপ হারটা বেঁচেছে বলে যত টা না কষ্ট হচ্ছে, সন্দীপ ওর বিশ্বাসে আঘাত করেছে বলে বেশি কষ্ট হচ্ছে। মা-বাবার সাথে ঝগড়া করে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। প্রায় দুবছর হয়ে গেল, একদিনও বাপের বাড়ী যায়নি। যে লোকটাকে বিশ্বাস করে বেড়িয়ে এসেছে সেই যদি বিশ্বাসের মূল্য না দেয়, ভালোবাসার গুরুত্ব না বোঝে তাহলে কার জন্য লড়াই করা। রাইমার আর বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না। রাত্রি ২ টোর সময় একবার ওয়াস রুমে গেল। হঠাৎ করেই যেন মাথায় ভূত চেপে গেল। বাথরুমে রাখা ফিনাইলের বেশ কিছুটা অংশ খেয়ে ফেলে। ভিতরের সব কিছু যেন জ্বালা করতে থাকে। বমি পাচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর সন্দীপ বাথরুমে যায়। দেখে রাইমা ওয়াক ওয়াক করছে, ফিনাইলের বোতলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! রাইমার মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। ছুটে নিচের তলার মাসিমাদের ডাকল। ভোর ৪টের সময় রাইমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। রাইমা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে রাইমাকে একটু বমি করানোর চেষ্টা করা হল। সকাল ৯ টার সময় পুলিশ এলো। রাইমা জানালো কেউ তাকে বাধ্য করেনি ফিনাইল খেতে। দিন তিনেক পরে রাইমাকে ছেড়ে দিল। তবে সলিড খাবার খেতে মানা করেছে। ডাক্তার আরও বলল, ‘পাকস্থলীর বেশ কিছুটা অংশ পুড়ে গেছে। সেটা রিকভারী করতে সময় লাগবে। মাস খানেক পরে একটা ছোটো অপারেশন করতে হতে পারে’। রাইমার বাবা-মা রাইমাকে বাড়ী নিয়ে যায়। সন্দীপ দিন সাতেক পরে দেখতে গেল রাইমাকে। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে করছে সন্দীপ। রাইমার হাত ধরে কাঁদতে থাকে। ‘বিশ্বাস করো আমি বুঝতে পারিনি তুমি এই রকম বোকার মতো কাজ করবে’ সন্দীপ ভাঙা গলায় বলে। রাইমা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চোখ দিয়ে জল গাল বেয়ে বালিশে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর রাইমা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কবে যাচ্ছ’? আমি যাচ্ছি না, টিকিট ক্যান্সেল করে দিয়েছি। রাইমা বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সন্দীপ আরও বলে, ‘সল্টলেকের অ্যাড এজেন্সি কোম্পানিতে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি।যাওয়ার আগে রাইমার হারটা বালিশের পাশে রেখে যায়।
সন্দীপ অফিস থেকে ফিরেই ভাবছে রাইমাকে কিভাবে বলবে কথাটা। হাতে খুব বেশি সময় নেই। দিন পনেরোর মধ্যেই কলকাতা ছাড়তে হবে। অফিস থেকে ফিরেই এক কাপ চা বা কফি খায়। রোজ রাইমায় বানায়। এখনও মিনিট ৩০ লাগবে রাইমার ফিরতে। সন্দীপ নিজেই চা বসাল। রান্নার ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি দেখে মায়ের কথা মনে পড়ল। তখন সবে মাত্র ছবি আঁকা শিখছে। দেওয়ালে মায়ের ছবি আঁকতে গিয়ে দুর্গা মায়ের ছবি এঁকে দেয়। পরে ঘর রং করার সময় সন্দীপের মা আর ঐ জায়গা টা রং করতে দেয় নি। সন্দীপের বাবা চাইত না, সন্দীপ সারাক্ষণ ছবি আঁকা নিয়ে পরে থাকুক। টার কাছে ছবি আঁকাটা বিলাসিতা। মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতেই সন্দীপের আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া। ক্লাস ট্রেনে পড়ার সময় দিল্লীতে এক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় নিজের কয়েকটা ড্রয়িং পাঠায়। নির্দিষ্ট মূল্যের ডাক টিকিট না দেওয়ায় বেয়ারিং হয়ে খামটা ঘরে চলে আসে। সন্দীপের বাবাকে প্রায় ১০০ টাকা দিয়ে খামটা নিতে হয়। এই নিয়ে দু চার কথা শুনতে হয়েছিল সন্দীপের মাকে। ছেলেকে বোলো পিকাসো হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছেড়ে ভালো করে পড়াশুনা করতে, নাহলে একটা পিয়নের চাকরীও জুটবে না। এখনও সময় আছে, ছেলেকে সাবধান করে দিও। ‘তোমারও তো ছেলে, তুমিই বলে দিও। ‘আমার কথা শনে কই! আমার কোন জমিদারি নেই, চাকরী জোটাতে না পারলে গড়িয়াহাটে ছবি ফেরি করতে হবে। আ! কি কথার ছিরি! আমার ছেলে অনেক বড় শিল্পী হবে।‘ ওই স্বপ্নই দেখো’। দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরল। ঘরের ভিতর ঢুকেই রাইমা বলল, ‘জানো ড্রয়িং সেটটা পেয়ে বুবলাই খুব খুশি হয়েছে’। ‘এবার তোমাকে একটা খবর দিই, আমি চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি’। মানে? তুমি এখন কি করবে? রাইমা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল। ‘দেখি কি করা যায়’। সন্দীপ গাম্ভীর্য্য বজায় রেখে সকালের পেপার পড়তে লাগল। মিনিট খানেক নিস্তব্ধতা। ‘কেন ছাড়লে চাকরি টা? ‘এমনি ভালো লাগছিল না’। সন্দীপ কথাটা বলেই আড়চোখে রাইমার মুখের দিকে তাকাল। রাইমার মুখে যেন কালো মেঘের ছায়া, মনের ভিতর যেন ঝড় উঠেছে। ‘এখন কি করবে’? ‘জানি না’। সন্দীপ একই রকম উদাস গলায় উত্তর দিল। এবার রাইমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, জোর গলায় চিৎকার করে বলল, চাকরি ছাড়বে আগে থেকে বলবে না, আমাকে তো একটা চাকরী জোটাতে হবে! দিন দিন তুমি কেমন একটা হয়ে যাচ্ছ। তোমার সাথে ... রাইমা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, সন্দীপ মুচকিয়ে হাসছে দেখে থেমে গেল। সন্দীপের ইচ্ছে হচ্ছিল আরও একটু রাইমাকে রাগাতে কিন্তু ভরসা পেল না। রাগের মাথায় রাইমা যা করেছিল, ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। সন্দীপ বলল, ‘ব্যাগ গোছাও দিন ১৫ এর মধ্যে আমরা ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি। রাইমা হাতে ধরে রাখা টাওয়েলটা সন্দীপের মুখে ছুড়ে বলল, ‘এতক্ষণ বলনি কেন? কোন কোম্পানিতে জয়েন করছ? কি পোষ্ট? কতো হাইক দিচ্ছে’? ‘কুল ম্যাম! কুল! আগে কিছু খাদ্যবস্তু দাও পেটটা ঠাণ্ডা করি, তারপর সব বলব’। রাইমা ফ্রিজে রাখা খাবার গুলো মাইক্রোওভেনে ওভেনে গরম করতে দিল।
সকাল সাড়ে ৮ টা বাজছে। অন্যদিন সন্দীপের এই সময় স্নান হয়ে যায়। ইতিমধ্যে রাইমা দুবার ডেকে গেছে। রাইমা স্নান সেরে হিয়ার ডায়ারে চুল শুকোতে শুকোতে জিজ্ঞেস করে, ‘কি গো আজ অফিস যাবে না’? অফিস! সেটা আবার কি? ধ্যাত! ভালো লাগে না, অফিস যদি না যাও বলো, ভাত বসাবো। এতো তাড়াতাড়ি? আরে সব কিছু গোছাতে হবে তো। একদিনে কি সব কিছু হবে? ও! আজ কি স্পেশাল মেনু হবে শুনি? কেন? রাইমা ডায়ারের সুইচটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল। না ভালো কিছু রান্না হলে, আজ অফিস যাবো না। রাইমা ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘তেল কই কিংবা সরষে ইলিশ’। বাহ! তাহলে আজ অফিস গিয়ে কাজ নেই! তাড়াতাড়ি উঠে মুখ হাত ধুয়ে বাজারে যাও। থাক! ডাল, আলু সেদ্ধ ভাত করে দাও বলে, সন্দীপ গায়ে চাদর নিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। রাইমার বকুনি খেয়ে সকাল ১০ টা নাগাদ সন্দীপ বাজার করে আনল। জলখাবার খেয়ে তিন তলার চিলেকোঠার ঘরটাতে ঢুকল। একটা সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছে । গত পাঁচ বছরে আর আসেনি। জানলার পাশে রাখা ক্যানভাসটার দিকে চেয়ে আছে সন্দীপ। একটা অসম্পূর্ণ ছবি। পেনসিলে করে স্কেচ করা আছে। দিগন্তরেখা বরাবর সূর্য উঠছে, একটা ছেলে ছুটে যাচ্ছে। সূর্যের রক্তিম আভাটা করা হয়েছিল। রাইমা সন্দীপের পিঠে হাত রাখে। ও তুমি? ডাকও নি তো। সন্দীপ চমকে উঠে বলে। ‘তুমি তন্ময় হয়ে কি ভাবছিলে’? তেমন কিছু না, ছেলেটাও ছুটছে, আমরাও ছুটছি, কোথায় যাবো জানি না। নাম, যশ, টাকার পিছনে ছুটছি। রাইমা সন্দীপের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, আর ইউ হ্যাপি সন্দীপ? ‘নো ম্যান ইজ হ্যাপি ইন হিস ওন স্টেট’। সন্দীপ বলে। রাইমা আবার জিজ্ঞেস করে ‘ আমি অন্য কারো কথা বলছি না, তুমি সুখী হয়েছে’? হয়তো! হয়তো বা না! রাইমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানলার দিকে চেয়ে থাকে। সন্দীপ এবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি সুখী হয়েছে? রাইমা ঘাড় নারে, তারপর বলে, ‘যদি তুমি চাকরীর পাশাপাশি ছবি আঁকাও চালিয়ে যেতে আরও বেশি খুশি হতাম। সন্দীপ আরাম কেদারায় বসে বলে ওঠে, ‘জানো রাইমা আমাদের জীবনটা আমার ওই অসম্পূর্ণ ছবিটার মতো, কিছুটা অংশ কল্পনার রং দিয়ে দেখতে হবে তাহলেই দেখবে আর কোন আক্ষেপ নেই।
Comments
Top
লস্ট এন্ড
ফাউন্ড
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
সকাল বেলার প্রথম আলো ইতিমধ্যে রোদ্দুরে পরিণত হয়েছে। মাস্টারদা সূর্য্য সেন মেট্রো স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল সাঁটাচ্ছিল ভেতো। ভেতোর আসল নাম সুনীল চ্যাটার্জী। তবে এই নামে আর কেউ ডাকে না তাকে। রোজকার ঝালমুড়ি খেয়ে খেয়ে তার মুখ পঁচে গেছে। স্বাদের বদল দরকার, তাই এই রাস্তার পাশের লুচির দোকানের আশ্রয় নিয়েছে সে। মোটামোটি খাওয়া শেষ করে, হাত ধুয়ে, সিগারেটের অভবাবে বিড়ি ধরাল সে। সকালের এই শান্ত শান্ত মুহূর্তগুলো খুব ভালোবাসতো সে। এখুনি ছুটতে হবে মেট্রো রেল ধরতে। আজকাল ধান্দা খুব একটা ভালো চলছে না। লোকজন আজকাল পার্সে, ওয়ালেটে বেশি টাকা রাখে না। এই ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড আর নেট ব্যাংকিংয়ের জন্য ভেতোর মতো পকেটমারের হেব্বি লোকসান হয়ে যায়। খাটনির মূল্য পাওয়া যায়না ঠিকঠাকভিড়ের মধ্যে ভেতো দেখতে পেল একটি পাঁচ বছরের বাঁচাকে তার মা বাবা হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট শিশুটির গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে। সুনীলের সেই দিনের কথা মনে পড়ে। চন্দননগরে সেদিন প্রচুর ভিড়। জগদ্ধাত্রী পুজো। লোকে, লোকারণ্য। হঠাৎ ভিড়ের মাঝখানে হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিলো। অদূরে সে মায়ের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল। লোকজনের স্কাইস্ক্রেপারদের মাঝখানে সে মাকে ঠিক দেখতে পারেনি। ছোট ছোট পায়ে সে ভিড়ের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। অন্ধকার গলি, হঠাৎ নাকের ওপর একটা রুমাল। তারপর আর কিছু মনে নেই । মায়ের নামটা এখনো মনে আছে তার, সোমা। চিবুকের ওপর কালো তিল। এই স্মৃতিটুকুই বাকি ছিল তার কাছে। সুনীল কিছুদিনের মধ্যেই ভেতো হয়েউঠলো। পার্ক সার্কাসের গাঙ্গের দক্ষ পকেটমার। অবশ্য চুরি, ছিনতাই কিছুই বাকি রাখেনি সে। তবে সে কোনদিন মেয়ে মানুষের ওপর হাত তোলেনি। ওই সব সাতে পাঁচে সে নেই। সর্দারের কাছে ট্রেনিং নিয়েছে। মোবাইল লোপাট, ওয়ালেট লোপাট এসবে সে এক্সপার্ট ছেলে, ছোকরাদের ট্রেনিং দেয় মাঝে। যাকগে, পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ
করে তো আর লাভ নেই। কর্মই ধর্ম। মেট্রো স্টেশন এ ঢুকে গেল। তার টিকেট কাটতে হয় না, এই সব কাজের লাইনে পুলিশ কনস্টেবলেদের হাতে রাখলে এই লাভ। একটু দক্ষিনা দিয়ে দিলেই আর ধরা পড়বার ভয় থাকেনা। এই গাড়ি আসবে লোকজন যখন তাড়াহুড়ো করে উঠবে, তখন ভেতো ছোবল মারবে। যা পাবে তা দিয়ে দুপুরের খাবার হবে অন্তত বেশি পেয়েগেলে নিজের ভাগ রেখে সর্দারকে চালান করে দেবে। ট্রেন আসল। ট্রেনের ভিড়ে একজন মাঝবয়েসী মহিলাকে লক্ষ করল। তার হাতে একটা বড় ব্যাগ, সম্ভবত কাপড় চোপড় রাখার জন্য। এর মধ্যে থেকে যখের ধন পার্সটা খুঁজে পেলেই কেল্লা ফতে। ভেতোর জন্যে এসব বাঁ হাতের খেল। কখন যে ভেতো ব্যাগের চেনের সমান্তরালে এক সুক্ষ ছিদ্র বানিয়ে, পার্সটা বের করে নিল ভদ্রমহিলা জানতেই পারলেন না। পরের স্টেশনে নেমে গিয়েছে ভেতো। একটি সিগারেটের দোকানের পাশে চা নিয়ে বসেছে সে। এক হাতে চা, অন্য হাতে সিগারেট। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কলকাতা শহরটা আস্তে আস্তে ভিজে যাচ্ছে। গরম পৃথিবীটা অনেক দিনের অপেক্ষার পর আজ যেন ঠান্ডা হবে। ভেতোর সামনে দু একটা রাস্তার ছেলে ছুটে চলে গেলো। ওদিকে সারি সারি স্কুল বাস ছুটছে। ইতিমধ্যে চা শেষ করে উঠল। টাকা দিতে হবে। কিন্তু তার কাছে তো খুচরো বিশেষ নেই, খালি দুটো পাঁচশো টাকার নোট। পাঁচশো টাকার নোট দোকানদারকে দেয়াও যাবে না। মহিলার পার্স তা খুলে নিল সে, যদি টাকা পাওয়া যায়। খুলে দেখল যে পার্স খালি। শুধু একটা ডেবিট কার্ড, একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স। আর একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স জাতীয় কিছু। পুরো দিনের খাটুনিটা মাঠেই মারা গেল। ভগবান কে খিস্তি দিতে দিতে, সে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ওপর চোখ রাখে, নাম সোমা চ্যাটার্জী, প্রৌঢ় মুখের চিবুকে তিল, বাড়ির ঠিকানাটা আবছা হয়ে গেছে। চায়ের দোকানদারকে পাঁচশো টাকা দিয়ে আর খুচরো ফেরত চাইনি। সেই প্রথমবার সে "লস্ট এন্ড ফাউন্ড" সেক্শনে গিয়েছিল। অনেক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে কার যেন হাতছানি সে দেখতে পেল।
Comments
Top
দেহের
কামনা
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
প্রথম অধ্যায়ঃ
কানকাটা বিশুর লাইফে বিশাল চাপ। চারদিন হয়ে গেল ডেলিভারি দিতে পারেনি। আজকাল মর্গে প্রচুর সিকিউরিটি। একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছে। আগের বারের খদ্দেরটা তবুও একটু বিন্দাস ছিল। লাশ পাচার করতে একটু সময় লাগলেও কিছু বলতো না। এবারের মালটা ঢ্যামনা, সময়ে মালনা পেলে হেব্বি দেমাগ দেখায়, দ্বিগুন পয়সা দেয় বলে তাই। কানকাটা বিশুকে হাওড়া থেকে বাঁশদ্রোণী, হুগলী থেকে খিদিরপুর সবাই একডাকে চেনে এবং ভয় পায়।
রোডের সাইডে বিহারি ভাইয়ার দোকানে একটা নোনতা বিস্কুটের, একটা গজা এবং চায়ের সাথে বিকেলে চা পর্ব শেষ করছে। আজ পনেরো দিন পেরিয়ে গেলো, কোন লাশ ডেলিভার হয়নি। ফোনের পর ফোন আসছে দ্বিজেন বাবুর কাছ থেকে। দ্বিজেন বাবু দেখতে সাধাসিধে, মাথায় সাদা চুল। উনি যে লাশের অঙ্গ কালো বাজারে বিক্রি করেন, কে বলবে? অবশ্য বিশু জানেনা উনি লাশগুলো কি ভাবে বেচেন, কেমন করে এবং কার কাছে বেচেন। ওর কাজ লাশ ডেলিভার করা, ও করে দেয়। প্রত্যেক ১৫ দিনেকুড়ি হাজার টাকা। গান্ধীজির বন্যা বইছে জীবনে। আর এমনিতেও এতে সমাজ কল্যাণ হয়, লাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকোনো অন্য মানুষের কাজে লাগে। কত বেওয়ারিশ লাশতো আসে মর্গে, ওদের দিয়ে যদি কারুর প্রাণ বাঁচে, এতে কার আপত্তি থাকতে পারে। অথচ কর্তৃপক্ষের যত চুলকানি, এখন রাতেও কড়া পাহারা। লাশ বাঁচিয়ে কি হবে, এই পাহারা যদি রাস্তা ঘাটে দেয়া হতো তাহলে কি এতো ধর্ষণ হতো? মিছিমিছি গরিবের পেটে লাথি মারা ছাড়া আর কিছু নয়। আজ আবার দ্বিজেন মালটা দেখে পাঠিয়েছে। কে জানি কি বলবে। রাস্তার ওপর চেয়ে দেখলো, পুরো রাস্তাতে পায়রা পায়খানা করার দাগ সাদা সাদা। মাঝখানে কোথাও পড়ে যাওয়া পাতা এলোমেলো। চায়ের কাপটা রেখে বেরিয়ে এলো। বিহারি ভাইয়া বললো, "আপকা কালকা বাকি থা" "এখন কেচিওনা মামা, কাল এক সঙ্গে দিয়ে দেব। অভি হামকো জানা পড়েগা, রাশবিহারী জানা পড়েগা।"
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ
দ্বিজেন বাবুর বাড়িটা বেশ বড়। দেখেই মনে হয় বিশাল সম্পত্তির মালিক। নইলে কলকাতার এই এলাকায় এরকম পেল্লাই বাড়ি তাও আবার তিনতলা। আসে পাশে বাগান। একলা মানুষ, তবে তিনটে তালাই সুসজ্জিত। কাওকে ভাড়া দেন নি। বিশু ভেবেছিলো যে মালটা খোঁচে বোম হয়ে থাকবে। কিন্তু বেশ অমায়িক ভদ্রলোক। তাকে সোফায় বসতে বলে কি সব আয়োজন করতে গেছেন। তার ফাঁকে বিশু পেইন্টিংসগুলো দেখছে। কিছুই বুজছে না। কিন্তু বাড়ি তে কি একটা চাপা গন্ধ, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। রাত্রি তিনটে বাজার
ঘন্টা পড়লো। সকালে তো এসব কাজ হয় না, তাই ভদ্রলোকের সঙ্গে রাত্রিতেই দেখা করতে হয়। ইতিমধ্যে, দ্বিজেন বাবু একটু কুচো নিমকি আর ভদকার গ্লাস নিয়ে চলে এসেছে।"আরে এসবের কি দরকার ছিল?",
বিশু বললো "আছে, আছে, দরকার আছে", দ্বিজেনবাবু এলিয়ে বসলেন।"আচ্ছা এ বাড়িতে কোনো চাকর বাকর নেই?"
"আমি একলা মানুষ নিজের কাজ নিজেই করি। চাকর বাকর আজকাল পাওয়া মুশকিল"।
ভদকার গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন দ্বিজেনবাবু।
"বলছেন যখন", বিশু বলে একেবারে খেয়ে নিল। গলাটা কেমন জ্বালা জ্বালা করল তার। আসলে এই লেভেলের মাল তো কোনোদিন খায়নি তাই কিরকম জ্বালা করে কে জানে ।ও তো খালি বাংলা টেনেছে, বিলেতির স্বাদ কি ও জানবে।
"আছা, স্যার কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করব?"
"কর কর"
ইতিমধ্যে আরেক পেগ বানিয়ে দিয়েছেন দ্বিজেনবাবু। কি ভদ্দরলক মাইরি নিজে না খেয়ে আতিথিকে প্রথমে দিচ্ছেন ।
"আছা আপনি লাশগুলোর কি করেন এই পাড়ায় থেকে তো আঙ্গ পাচার করা সহজ বেপার নয়।" বিশুর মাথা এবার ঝিম ঝিম করছে।
"লাশের যে আঙ্গ বেচতেই হবে তার কোন মানে আছে?"
"মানে আপ, আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনি কি করেন এই লাশগুলোকে নিয়ে" এবার কথাগুলো জড়িয়ে আসছে।
"সময় এলে সব বুঝবে"
"অরে ধুর মশাই, খুলে বলেন" মাথার ঝিমুনিতে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল বিশু।"
ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে "নেক্রোফিলিয়া", মানে বোঝো?"
এবার মাথার ব্যাথা অনেক বেড়ে গেছে। সোফার নিচে ঢোলে পড়ে, রাগে বিরক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে বললে উঠলো, "ধুর শালা, জ্ঞান আওড়াচ্ছে, গদা বাংলায় বল না"
"লাশের সঙ্গে যৌন... " তারপর কি একটা যে বললেন দ্বিজেনবাবু কিছুই বুঝতে পারলো না বিশু। মাটিতে লুটিয়ে মুখের থেকে ফেনা বেরিয়ে আসছে বিশুর।
শেষ অধ্যায়ঃ
মর্গে নতুন বেওয়ারিশ লাশ এসেছে। গলায় লাল রঙের মাদুলি ছাড়া সম্পূর্ণ নগ্ন। মর্গের নতুন কর্মী সুমন, যৌনাঙ্গে ক্ষত চিহ্ন দেখেও গ্রাহ্য করল না। তার হাতে সময় নেই, লাশ ডেলিভার করতে হবে তো।
অভিমন্যু
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
প্রথম অধ্যায়ঃ
আর কোনো উপায় ছিল না অভিমন্যুর কাছে। অভিমন্যু মানে অভিমন্যু হালদার। কলকাতার নামকরা মনোচিকিৎসক। মানুষ কতটা বিকৃত হতে পারে সেটা তিনি জানেন।তএব কাওকে সহজে বিশ্বাস তিনি করেন না। তাই বোধ হয় বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-সজ্জন নেই বললেই চলে। বিয়ে করেছেন। ছেলে মেয়ে হয়নি। মিথ্যে সংখ্যাবৃদ্ধি করে কোন লাভ নেই, ছেলে পুলে হলে টাকা পয়সার শ্রাদ্ধ হবে। এতো আগেকার জামানা নয়। এখন ছেলে মেয়েরা বাপের পয়সায় ফুর্তি করে। আর বাপ্ বুড়ো হলে লাথি মারে। বিয়েটাও তিনি অনেক লেট করেছেন। ছোকরা বয়েসে বান্ধবী টান্ধবী ছিল। কিন্তু চল্লিশের ঘরে যখনি পা দিলেন, তখনি বুঝলেন যে সে সব আর কপালে জুটবে না। হঠাৎ এক দিন তার ইন্টার্ন সৌমিলির প্রেমে পড়বার ভান করলেন । সৌমিলিও ভান করলো। দিয়ে বিয়ে করে নিলেন। কিছুদিন একাকিত্ব কাটল। সৌমিলি কিন্তু মিডলাইফ ক্রাইসিসের মোক্ষম ওষুধ। রাত্রি অনেক ঘনিয়ে এসেছে। অভিমন্যু সাধারণত এই সময় ঘুমিয়ে যায়। শীতের মৌসুমে লেপের মুড়ি তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু আজ তার মন ছুটে যাচ্ছে সেই দিনে। বছর তিনেক আগে অধীরথি সরকার ঢুকেছিলো তার হাসপাতালে। গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, চোখে মুখে একটা বুদ্ধির ছাপ। সৌমিলির সাথে বন্ধুত্বও পাতিয়ে ফেললো ছেলেটি। আসলে সৌমিলি একদম সেকেলে নয় , অভিমন্যুর জীবনে অসংখ্য মেয়ে এসেছে গেছে। সৌমিলি এই অবাধ আনাগোনার হিসেব রাখেনি। তা ছাড়া অধীরথি আর সৌমিলির মধ্যে বন্ধুত্বের বিস্তার কতদূর ছড়িয়েছে সে তো নিজেও জানেনা। তাই এব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জল ঘোলা করা যায়না |কিন্তু ঈর্ষার আগুন যে জ্বলে উঠেছে। সেই ঈর্ষার আগুনে ঘি ঢালছে সন্দেহ। অধীরথির গৌরবর্ণ চেহারা, দীর্ঘকায় দেহ সব যেন হিংসের ইন্ধন। নাহ, বেপারটা তাকে জানতেই হবে। ডিটেক্টিভ, টিকটিকি, খোঁচরের এ কাজ নয়। মিছিমিছি অর্থ ব্যয়, এবং লোক জানাজানি। তাকেই কিছু করতে হবে| ঠিক তখনি মনে পড়েছিল ফ্রান্সের স্ট্রাসবোর্গ শহরের সেই ওয়ার্কশপের কথা। তখন অভিমন্যু ফ্রান্সেই তার পোস্ট গ্রাডুয়েশন কমপ্লিট করছিল, মনোচিকিৎসক অভিমন্যু হালদারের জন্ম হয়নি। সাইকোটিক হিপ্নোটিজমের ওপর ওয়ার্কশপ, কলেজেই হচ্ছিলো বলে এটেন্ড করেছিল। সাইকোটিক হিপ্নোটিজমের মূল সিদ্ধান্ত হলো ট্রান্সফার অফ কোন্সসিয়াসনেস। যিনি হিপ্নোসিস করেন, তিনি নিজের কোন্সসিয়াসনেস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেন। যিনি হিপ্নোসিস করেন তার শরীর থেকে চেতনা লোপ পায় কিন্তু অবচেতন মনে রয়ে যায়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যেন তিনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন, কিন্তু আসলে তার চেতন মন কোন অন্য ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করেছে। তার শরীর সব অনুভূতিই এই নতুন চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
সাইকোটিক হিপ্নোসিসের পদ্ধতি খুব একটা কঠিন নয়। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে সব থেকে দুর্বল। তার চেতন মন তখন নিষ্ক্রিয়, কিন্তু তার অবচেতন মন সব কিছুশুনতে পারে, বুঝতে পারে। সেই সময় মানুষের কানে ফিসফিস করে হিপনোটিক আফিরমেশন বলতে থাকলে তার চেতন মনে প্রবেশ করা যায়। নিজের শরীর তখন আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাজ শেষ হয়ে গেলে নিজের শরীর মধ্যে একই রকম ভাবে ফিরে যাওয়া যায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ
অসংখ্য বার, অসংখ্য রোগীর সাথে এই হিপ্নোটিজমের খেলা খেলেছিলেন। রোগীর জীবনের অজানা তথ্য, কালো সত্য না জানলে কি আর প্রপার ট্রিটমেন্ট হয়। কিন্তু সেদিন বেপারটা অন্যরকম ছিল, মানুষের সম্মতি ছাড়া হিপ্নোসিস করা উনএথিক্যাল। ডাক্তারি পেশার সাথে বেয়াদবি। কিন্তু তাকে যে ইটা জানতেই হবে। তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে তার একবার হার্ট স্ট্রোক হয়েছে। সৌমিলির বেপারে সব কিছু না জানলে যে তিনি মারা যাবেন।
সেদিন শনিবার। সৌমিলির ছুটি, রাত্রে বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে বেরোবে। এই অজুহাত দিয়ে বেরোয়, তার পর চলে যায় সে অধীরথির কাছে। পুরোটা অনুমান, কিন্তু কিছু অনুমানের প্রমাণ লাগে না। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যু কিছুক্ষণ। বিছানায় ঘুমিয়ে, শান্ত চেহারা । এটাই কারেক্ট টাইমিং, যা ভাবা তাই করা। পারফেক্ট এক্সেকিউশন।
আজ দু দিন হল অভিমন্যু সৌমিলির শরীরে। না কিছুই সন্দেহ জনক লাগেনি। ইতিমধ্যে তিনবার দেখা হয়েছে অধীরথির সাথে। কিন্তু সে অভিমন্যুর অনুপস্থিতে প্রেম নিবেদন রাখেনি। সে তো বলেছে জয়িতার কথা। জয়িতার সঙ্গে তার খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। জয়ীতা মেডিকেলটা পাশ করলেই তারা বিয়ে করবে। শুধু শুধু সন্দেহ করেছিল অভিমন্যু তার ভাবতেও লজ্জা করে। না এবার ফিরে যেতে হবে নিজের দেহে।
নিজের দেহটি সোফায় পড়ে আছে। ঠিক যেমন ছেড়ে এসেছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায়, কানে কানে ফিসফিস করে কিছু আফিরমেশন দিলেই জেগে উঠবে। নিজের দেহের কানের কাছে হাটু গেড়ে বসলো সৌমিলির দেহে অধিষ্টিত অভিমন্যু। আফিরমেশন ফিসফিস করতে লাগলো। সময় একটু বেশি লাগছে, সে লাগতেই পারে। কিন্তু অভিমন্যুর দেহ বিন্দুমাত্র রেস্পন্ড করছে না। অভিমন্যু দেহটার হাতটা ধরল। হাতটা এতো ঠান্ডা কেন। অভিমন্যু নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। না এ হতে পারে না। আরেকবার ভালো করে দেখে নিল, না এবার আশঙ্কা নেই। অভিমন্যুর দেহের মৃত্যু ঘটেছে। সে আর কোনোদিন ফিরে যেতে পারবে না। সৌমিলির নারী শরীর সেদিন যেন চক্রব্যূহ।
Comments
Top
সত্য ঘটনা
অবলম্বনে
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
ব্যাপারটা সৌমিককে তাক লাগিয়ে গেছে। এরকম কি হয়। টিভির দিকে অনোমনস্ক হয়ে তাকিয়ে সে এই কথাটাই ভাবছে। সৌমিক পেশায় ডাক্তার হলেও ডাক্তারির ফাক ফোকরে গল্প লিখে থাকে। আগের সপ্তাহে যেমন একটা ডিটেক্টিভ থ্রিলার লিখে ফেলেছে। গল্পের নায়ক তার বৌ এবং চার বছরের বাচ্চা কে খুন করে উধাও হয়ে যায়। রান্না ঘরে কড়াইশুঁটি কচুরি ভাজছে রিনা। এই গন্ধটা পেলে, অন্য দিনে সে পাগল হয়ে যেত সৌমিক। কোথায় বলে, "the way to man's heart is through his stomach"। এই প্রবাদটা বোধ হয় সৌমিককে মনে করেই লেখা হয়েছে। অন্যদিন হলে কড়াইশুঁটির কচুরির আগে বৌয়ের ঠোঁটের চুমু দিয়ে ভোজন শুরু করত সৌমিক।কিন্তু আজ দিনটা একটু আলাদা। গরমের সাথে বৃষ্টির কম্বিনেশন মিলিয়ে বিশ্রী একটা আবহাওয়া। সৌমিক এখনো হতবাক। আসলে সব সময় যে নতুন চিন্তা মানুষের মাথায় আসে না, আর গল্পের লেখকরা মানুষ বই ভগবান নয়। তাই সৌমিক তার চারিপাশে, পাড়ায়, ট্রামে, বাসে, হসপিটালে যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তার ওপরেই কিছুটা রং চড়িয়ে, কিছুটা কল্পনার রং ঢেলে উপন্যাস লিখত। কখনো বা এই সত্য, কল্পনার খিচুড়ি দিয়ে কবিতা লেখা হত। এর দুটো বিশেষ লাভ ছিল, এক সত্যকে যদি গল্পের রূপ দেওয়া তখন গল্প হয়ে উঠে আরো বিশ্বাস যোগ্য। দ্বিতীয়, এতে প্লাগিয়ারিজমের দোষ ও চাপে না।রিনা হন্ত দন্ত করে এসে টেবিলে কচুরির থালাটা নিয়ে এসে ডাক দিলো, "খেয়ে নেবে এসো, তোমার হাসপাতালে দেরি হয়ে যাবে"। "আহা আসছি তো" সামনে ছোলার ডাল আর কড়াইশুঁটির কচুরি। একটা পাশে নামনাজানা মিষ্টি। সৌমিক খেতে খেতে ভাবতে থাকল। সমস্যাটা দেখা গেছিলো আগের মাসে। তার ড্রাইভার হীরালাল, তাকে শিয়ালদহে হাসপাতাল পৌঁছে দেয়। লোকটি বেশ ইন্টারেষ্টিং ক্যারেক্টার। গায়ের রং তামাটে, বেশি লম্বা হবে না, পেটে হালকা ভুড়ি থাকলেও বেশ তাগড়া শরীর। হাসি ঠাট্টাই রোজদিন অফিসের সফরটাকে ইন্টারেষ্টিং করে তোলে। সৌমিক ভেবেছিলো যে হীরালালকে নিয়ে একটা গল্প লেখাই যায়। লিখেও ফেললো, গল্পে হীরালাল ট্যাক্সি চালায়, রং তামাটে, বেশি লম্বা হবে না, পেটে হালকা ভুড়ি। সে রোজ রাত্রে মদ খেয়ে বৌকে পেটায়। আসলে বৌকে পেটানোর ব্যাপারটা পুরোটাই কল্পনা। সৌমিক যতদূর জানতো হীরালাল সৎ চরিত্রের ভালো মানুষ। কিন্তু এরকম সৎ চরিত্রের মানুষের গল্প
পাবলিক খাবে না। তাই একটু কল্পনার রং দিয়ে হোলি খেলা। গল্প প্রকাশিত হল লিটিল ম্যাগাজিনে, ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে।
সেদিন রবিবার। হাসপাতাল ছুটি। চায়ের কাপে আর ব্রেড টেস্টের দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারছে সৌমিক। রিনা কিন্তু একদণ্ড স্থির হয়ে এদিক ওদিক করে যাচ্ছে। চিন্তিত এবং কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা সৌমিক বলল
"তোমার কি হয়েছে বল? সারাদিন এধার ওধার করলে কোন সমস্যার সমাধান হবে না"।
"আর কি বলবো বল দেখিনি, মালতির বর হীরালাল কালকে রাতে মদ খেয়ে মারধর করেছে। দু তিন দিন কাজে আসবে না। আশ্চর্য বেপার লোকটা এক মাস আগে পর্যন্ত মদ মাংস কিছুই খেত না। হঠাৎ মাতাল হয়ে বৌ কেলাচ্ছে।"
সৌমিক কি একটা জিজ্ঞাসা করবে করবে করেও, করল না।
খাওয়া শেষ হয়েছে। এগারোটা বাজছে এবার বেরোতে হবে । একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগল। কমপ্লেটেলি কোইন্সিডেন্সও হতে পারে তো। তাছাড়া হয়তো লোকটা গোপনে মদ খেত, মাতলামি করত, কেও জানতে পারত না । ইবার জিনিসটা প্রকাশ্যে এল। এরকম একটা বাজে কোররিলেশনের ওপর মাথা ঘামানোর কোন মানে হয় না।
তবুও ফালতু রিস্ক নেওয়ার কোন মানে নেই। পরের গল্পটা প্রকাশিত হওয়ার আগে, মিলিয়ে দেখে নিতে হবে যে কোন চেনা জানা লোকের নাম, বিবরণ যেন না ব্যবহার করা হয় ।গলিতে কিছু লোকের জমায়েত, হৈ হট্টগোল দেখা যাচ্ছে বারান্দার জানলা দিয়ে।
সৌমিক রিনাকে ডেকে বললো,"আচ্ছা আমার নতুন গল্পের মানুস্ক্রিপ্ট কোথায় রেখেছো গো? আর এই নিচে ইটা কি হচ্ছে?"
"তুমি জানো না? নিচের তলার সমাদ্দারবাবু বৌ এবং চার বছরের বাচ্চাকে খুন করে উধাও হয়ে গেছে। লোকটা নিপাট ভদ্রলোক, হঠাৎ কি যে ব্যামো হল। যাকগে, তোমার মানুস্ক্রিপ্ট আমি সুধীনদাকে দিয়ে দিয়েছিলাম আগের শনিবার। যখন তুমি ছিলে না, তখন উনি এসে ছিলেন। বলছিলেন এই সংখ্যায় প্রকাশ করবার মতো ছোট গল্প নেই, তার কাছে। আমিও তখন .............."
সৌমিকের দেহ হীম হয়ে গেল। তার নায়কের পদবীটা কি ছিল যেন বেশ?
Comments
Top
চেনা সুর
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
প্রথম অধ্যায়ঃ
সেদিন রেকর্ডিং এ মন লাগছিলো না সন্দীপনের। সে রুপেনদাকে বললো, "দাদা আজ আর ঠিক হচ্ছে না। আমি বরং কাল চেষ্টা করে দেখবো।"
রুপেনদা একটু গম্ভীর স্বরে বললেন "হ্যাঁ , একটাও নোট তো ধরতে পারছ না দেখছি। ডেডলাইন কিন্তু সামনে আসছে, পুজোতে রিলিজ করতে হলে পরের সপ্তাহের মধ্যে এগুলো সেরে ফেলতে হবে। আমি তোমায় চাপ দিচ্ছি না ... "।
এই হলো রূপেনদার স্বভাব। চাপ দিয়ে বলবেন, "আমি তোমাকে চাপ দিচ্ছি না .."। যাকগে এবার বেরোতে হবে, কাঁচের জানলা থেকে কলকাতার আবহাওয়ার অবস্থা জরিপ করে নিল সে। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। না এবার বেরোতে হবে, যে কোনো সময় বৃষ্টি আস্তে হবে। রতন কে একটা ফোন করতে হবে।
রতনকে ফোন করার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি নিয়ে চলে এলো রতন। গাড়ির মধ্যে বসে সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত। অসহ্য লাগছে।
"আঃ থামাও না, গানটা বন্ধ করো। এতো ট্রাফিকের মধ্যে এসব ভালো লাগে না", সন্দীপন চেঁচিয়ে উঠলো।
"লেকিন আপ তো হামেশা যেহি গানা শুনতে থে সাহেব।", রতন বললো।
"জ্যাঠামি করো না। জো বোলা হয় বহ করো।", সন্দীপনের গলায় হুকুম করার সুর। বেচারা রতনের ওপর সে রুক্ষ হতে চাইনি। কিন্তু কি করবে সে আসল কথা বললে কি আর ও বুঝবে। বুঝবে না, উল্টে পাগল ভেবে বসবে। অবশ্য ওকেও দোষ দেয়া যায় না। যে কোন মানুষকে বোঝানোই কষ্টকর, তার সাইকাট্রিস্ট মানে ডক্টর রায় বেপার্টাকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এতক্ষণ এ রুবি ক্রস করে গাড়ি ছুটেছে। ডক্টর রায় এই পসিবিলিটিটাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সন্দীপন নিজে তো এই পসিবিলিটিটাকে উড়িয়ে দিতে পারছে না। হাজার হোক, কান্ডগুলো হচ্ছে তো তার সামনে তার সঙ্গে। প্রথমে সন্দীপনের মনে হতো যেন কেউ তার সঙ্গে রসিকতা করছে। একটা প্রাকটিক্যাল জোক, একটা জঘন্য, কদর্য প্রাকটিক্যাল জোক কিন্তু না, এটা জোক নয়। সে নিজেই বোঝে সে কি বিপদেই পড়েছে। আসলে প্রত্যেক মানুষই শুধু নিজেরটা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। তারা অপরের কষ্ট বুঝবার ভান করে মাত্র। যে ভোগে, সেই বোঝে।
গাড়িটা থামলো তার বাড়ির গেটের সামনে। নাম্বার আগে রতনের পকেটে একটা পাঁচশো টাকার নোট ঢুকিয়ে দিলো সে। বেচারার সঙ্গে রুক্ষ ভাবে কথা বলা উচিত হয়নি।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ
দুতলার ড্রয়িংরুমে বসে আছে সন্দীপন। ধিরুদা যেন আজকাল ভীষণ স্লো হয়ে গেছে, একটা কফি বানাতে কত সময় লাগে। সোফায় একটু এলিয়ে বসল সে। মাথাটা যেন টিপটিপ করছে। কালকে আবার ডাক্তার রায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা। ভদ্রলোককে সব খোলাখুলি বলেছিল সন্দীপন। বস্তুত, সন্দীপন নৈহাটির ছেলে। তার বাবা দোকানে কাজ করতেন। সন্দীপন যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ উঠল। তখন সে বুঝল যে ইতিহাসের স্নাতক হয়ে সে তেমন কিছুই করতে পারবে না। বাড়ির দেনা পাওনা সব একি রকম থেকে যাবে। বাবার শরীর খারাপ, বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হয় মাঝে মাঝে। দোকানে গিয়ে কাজ তিনি আর বেশি দিন পারবেন না। প্রাইভেট টিউশন করে যে কটা টাকা রোজগার করে তাতে সংসার চলার মত অবস্থা হয় না। আবশ্য এতে তার কলেজর ফিস আর হাত খরচ চলে যায়। সৌমিলির সাথে দেখাও এই সময়ে হয়েছিল। কলেজর প্রথম বছরের ফ্রেশারস পার্টিতে গান গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছিল, সেকেন্ড ইয়ারের সন্দীপন। আনেক মেয়ে বান্ধবীর প্রস্তাব জোটে। কিন্তু পকেট খালি থাকলে প্রস্তাব গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকে না। সউমিলি কিন্তু এদের দলে ছিল না, একটু চাপা স্বভাবের, অন্তর্মুখী প্রকৃতির মেয়ে সৌমিলি। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের রাগ্গিং নেয়ার সময় যখন সৌমিলি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিল তখনই সন্দীপন বুঝেছিলো যে সৌমিলির কি অসীম প্রতিভা। তারপর মাঝে মধ্যেই ক্যান্টিনে, সুলেখা ম্যাডামের নোটস দিতে দেখা হতো তাদের। সন্দীপন অনেকদিন ধরে বলবো বলবো করে একদিন বলেই দিয়েছিলো তার মনের কথা। সৌমিলি অবশ্য কিছুটা সময় নিয়েছিল। তারপর কত রিহার্সাল, কত শো করলো এক সাথে। স্টেজ এ উঠতে সৌমিলিকে সন্দীপন শিখিয়েছিলো।
সেদিন বৃষ্টি পড়ছে ঝম ঝমিয়ে। সন্দীপন রবীন্দ্র সদন পৌঁছে গেছে, কিন্তু সৌমিলির ফোন পাওয়া যাচ্ছে না। এই আদিকালের ফোনে অর্ধেক সময় টাওয়ার ধরে না। শেষে সৌমিলিকে ফোন পেলো।
"হ্যালো, আমি আজ আস্তে পারবো না আজ। জল জমে বাস আটকে গেছে"।, সৌমিলির গলার আওয়াজ।
"ঠিকাছে। সাবধানে থাকিস। ভালোবাসি কিন্তু।", বলে ফোনটা রেখে দিল সন্দীপন। সৌমিলি আসবে না তাই একলাই পারফর্ম করতে হয়েছিল। "ভালোবেসে সখি" গানটায় হাততালির কলরবে অডিটোরিয়ামের ছাদ যেন ভেঙে যায়। ইতিমধ্যে কফি চলে এসেছে। সঙ্গে কুচো নিমকি।
তৃতীয় অধ্যায়ঃ
কফির স্বাদটাও কেমন অতিরিক্ত তেতো তেতো লাগছে। বারবার সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়, সেদিন রবীন্দ্র সদনের পারফরম্যান্সের কত ফোন কালে অভিনন্দন পেয়েছিল। কিন্তু শুধু অভিনন্দন পেয়েছিল তা নয়, একটি প্রস্তাব ও পেয়েছিল সে। সোনার তরী অডিও কোম্পানির মালিক শশিভূষণ পাকড়াশী তার গান রেকর্ড করতে চায়। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গেলো সন্দীপন, প্রথমে সৌমিলিকে তারপর মা বাবাকে ফোন করলো। পরের দিন মা কালীর পায়ে পুজো দিয়ে টালিগঞ্জ ছুটেছিল সে। পর পর কিছুদিন ফাটিয়ে গান করেছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলো যে শুধু গান গাইলেই হবে না, শশিভূষণবাবুর মেয়ে মন্দাকিনী প্রায় তার সঙ্গে কথা বলে। সুযোগ পেলেই কাছে ঘেঁষতে চায়, শশিভূষণবাবু দেখেও যেন দেখেননা। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে গডফাদার না থাকলে এ ইন্ডাস্ট্রিতে খুব চাপ। বাবার অসুখ, মা ও বুড়ি হচ্ছে, সংসারের বোঝা পুরোটাই তার ঘাড়ে। এই সময়ে সন্দীপন যা করেছিল, যে কোনো প্রাকটিক্যাল মানুষ তাই করতো।
সৌমিলি কখনো ফোন করেনি আর। ফোন করলো সে তাকে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করতো তার জীবনের কঠিন বাস্তবের কথা। বাড়িতে একবেলা খেয়ে থাকার যন্ত্রণার কথা। হয়তো ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারতো না। কালের স্রোতে ভেসে গেলো কত প্রতিশ্রুতি। সাথে গান
গাওয়ার সাথে জীবন কাটানোর অঙ্গীকার। মন্দাকিনীর সাথে বিয়ে করেছিল সে। পরের পর অনেক রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বের করেছিল। বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে মিশিয়ে অনেক ছবিতেই গান করেছিল। নৈহাটির দোকানের কর্মচারীর ছেলে সন্দীপন কবে যে স্যান্ডই হয়ে উঠলো সে নিজেও জানে না
গাড়ি হলো। বাড়ি হলো। হলো প্রেয়সী, বান্ধবী। সুখ সাচ্ছন্দে কিছুই বাকি ছিল না সন্দীপনের। বাবার সার্জারি। মায়ের তীর্থদর্শন কিছুই বাকি থাকলো না। জীবিকা খুঁজে পেলেও, জীবন কিন্তু সহজ হলো না সন্দীপনের। প্রেমের আঠা না থাকলে বিয়ে টেকে না, মন্দাকিনীর সাথেও টেকে নি। স্বেচ্ছায় ডিভোর্স দিয়ে এখন সম্পূর্ণ একলা একলা একটা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে কারাগারের মতো বন্দি হয়ে রয়েছে। সঙ্গী বলতে ওই ধীরুদা, মাঝে মাঝে আশা কিচ্ছু ভাড়াটে মেয়ে। কিছু মিথ্যে বন্ধুবান্দব ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।
চতুর্থ অধ্যায়ঃ
ফোনটা তুলে দেখলো যে ডাক্তার রায়ের ফোন। "হ্যালো, ডক্টর রায় বলুন?", সন্দীপন বললো "কেমন আছো সন্দীপন? আপনি কি কালকে ফ্রি?", ডক্টর রায় বললেন।" আসলে পরশু বৌকে নিয়ে একটু বেরোবো। আপনি কালকে এসে গেলে ভালো হয়।"
"হ্যাঁ, কোন অসুবিধা আমি ষ্টুডিও থেকে ছুটি নিয়েছি এই জন্যেই। তাহলে কাল দেখা হবে।", সন্দীপন বলতে বলতে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলো।
"থ্যাংক ইউ সো মাচ সন্দীপন, রাখছি" বলে ফোনটা কেটে দিলেন ডাক্তার রায়।
ডাক্তার রায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অভিকের সূত্রে। জীবনে অনেক সত্যি মিথ্যে বন্ধু দেখেছে সন্দীপন কিন্তু অভিকের মতো বন্ধু দেখেনি। তাকে সব কথা খুলে বলা যায় নিজের সব থেকে দুর্বল মুহূর্তে পাশে পেয়েছিল সে অভিককে। যখন এই ব্যাপারটা হওয়া শুরু করলো তখনও কিন্তু অভিককেই খুজেছিলো সে।
ব্যাপারটা প্রথমে সে গ্রাহ্য করেনি। যখনি সে একলা গান গাইতে যায়, তখনই মনে হয় একটি মহিলা কণ্ঠস্বর ভেসে উঠছে। হয়তো মনের ভুল। এটি চেনা পরিচিত গানের সুর, মেয়েলি গলার কণ্ঠস্বর। তার সঙ্গে প্রত্যেক গানে তাল মিলিয়ে গান গাইছে। ডুয়েট গান একলা গাইলে, ফিমেল পার্টটা গেয়ে দিচ্ছে ওই একই কণ্ঠস্বরে। প্রথমে মনে হয়েছিল কেউ যেন তার সঙ্গে হেয়ালি করছে। হয়তো সে যখন গান গায়, তখন তখন এই মেয়েটি গান গেয়ে তাকে বোকা বানাবার চেষ্টাতে আছে। কোন রিয়ালিটি শো হতে পারে। কিন্তু নিজের বাড়ির সাউন্ডপ্রুফ রেকর্ডিং রুমে যখন এই বেপারটা হলো, তখন মনে খটকা লাগলো। তারপর মনে হতে লাগলো এ যেন মনের ভুল। কেও নেই আসে পাশে, তবুও গানের সুর। একই কখনো বাস্তবে হয়না । দিনের পর দিন আওয়াজটা শুনতে পেয়েছে সে। আওয়াজটা হয়ে উঠেছে আরো সুস্পষ্ট।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে এটা সৌমিলির গলার কণ্ঠস্বর। সৌমিলির সাথে সন্দীপনের কোন যোগাযোগ নেই আর। কিন্তু এবার তাকে সৌমিলিকে খুঁজে বার করতে হবে। সৌমিলি অনাথ তার তিন কূলে কেও ছিল না। অনাথ আশ্রম থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। এবার সন্দীপন সৌমিলি কে খুঁজে বের করবে। তারপর তার সঙ্গে গান গাইবে। অ্যালবাম বের করবে। তার ফেলে আশা ঋণ না শোধ করতে পারলে তো তার রেহাই নেই।
পঞ্চম অধ্যায়ঃ
তারপর সে কত চেষ্টাই করেছিল। অনাথ আশ্রমে ফোনের জবাব পায়নি সে। তারা বলেছিলো সৌমিলি কোথায় আছে তারা জানে না। ফেসবুকেও নেই সৌমিলি। টিভিতে, নিউসপেপার এ বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দেওয়া হলো। আমলা বন্ধুদের দ্বারা পুলিশ দ্বারা তল্লাশি চালিয়েছে, কিন্তু সৌমিলি কে পাওয়া যায়নি।
তাহলে কি সৌমিলি মারা গেছে। একদিন শীতের সন্ধ্যায় পার্ক এ চুমুর ঠিক পরমুহূর্তে বলেছিলো সে, "তুমি ছেড়ে গেলে কি আমি আত্মহত্যা করবো। "অনাথাশ্রমেও থাকা কালীনও সে এই চূড়ান্ত চেষ্টাটি করেছিল। তার পক্ষে এটা করা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে কি তার প্রেতাত্মা সন্দীপনের সঙ্গে সঙ্গে সুর মেলায়।
ডাক্তার রায় এসব কিছু মানতেই চাননি। বলেছিলেন এটা মনের ভুল। মানুষ কি দিনের পর দিন একই মনের ভুল করতে পারে? ডাক্তার রায় বলেছিলেন যে তার গিল্ট কংসাইন্স তাকে এসব শোনাচ্ছে। সে জীবনে আগে বেড়ে গেলেও, তার অবচেতন মন ওখানেই থেকে আছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ
গায়কদের গান গাওয়াটা স্বভাবের মধ্যে তারা জানতে অজান্তে গেয়ে ওঠেন। এই যেমন এই বারে সন্দীপন গেয়ে উঠলো, "যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে ....।, গেয়েই শুনতে থাকলো।
কিছুক্ষন একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো, " তবে একলা চলো রে .."
"কে তুমি কাছে এস? সামনে এস? সামনে এস বলছি?", পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে সন্দীপন।
কোন সাড়া পাওয়া যায়না। ধীরুদা বেরিয়ে গেছে। বাড়ি ফাঁকা। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। দেরাজের কোনে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা হাতে নিয়ে চিৎকার করলো -
"কে তুমি? সামনে এস?" একটা ব্লাইন্ড শট ফায়ার করলো কোন সাড়া শব্দ নেই, যেন সৌমিলির প্রেতাত্মা তার সঙ্গে বিদ্রুপ করছে।
না এরকম বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। তার জীবনের দ্বিতীয় সৌমিলি যদি তার প্রথম ভালোবাসা গানকে কেড়ে নিতে চায়, তাহলে কি করে বাঁচবে সে। এ সে কখনোই হতে দেবে না। পিস্তলের একটি গুলি চালালো সে নিজের ওপর মাথার ওপর। রক্তাত্ব দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
সপ্তম অধ্যায়:
কানাডার দুপুর। বর অফিস গেছে। বছর চারেক আগে একটি গানের শোতে দেখা হয়েছিল অরিন্দমের সাথে। তারপর তার সাথেই বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি। একটিমাত্র বাংলা চ্যানেল ধরে এখানে, দেশের সাথে এই একটি যোগাযোগ রাস্তা। নিউস চ্যানেলের হেডলাইন সেদিন, "বিখ্যাত সংগীত শিল্পী সন্দীপন প্রয়াত। "হঠাৎ শীতের রাতে পার্কে দেওয়া একটি হুমকির কথা মনে পড়ে গেলো সৌমিলির।
Comments
Top
শিকার
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
খুলনা জেলায় জঙ্গলে বাঘ, ভালুক মেরে বেশ নাম করেছিলাম। কিন্তু আমার নাম যে একেবারে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে গেছে সে কথা কোনোদিন অনুমান পর্যন্ত করিনি। সিপাহী বিদ্রোহের দরুন মীরাট, কানপুর, হাজারীবাগ সব জায়গায় ঘুরে এসেছি। তবে শিকার করিনি তবে কি করে জানতে পারলেন মহারাজাধিরাজ রাজেশ্বর হোলকার সিন্ধিয়া? কে জানে। সিপাহী বিদ্রোহে আমি লড়েছিলাম ভারতের সৈনিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আসলে সিপাহী বিদ্রোহে শুধু সিপাহীরা নয়, ভারতবর্ষের জন সাধারণ হিন্দু ,মুসলমান, ব্রাহ্মণ, কুমোর, তাঁতি সবাই একসাথে লড়েছিলাম। কত মুসলমান কুমারীই তো আমার সামনে বেওয়া হয়ে যায়, কিন্তু একটা হিন্দু পুরুষ তাদের ওপর খারাপ নজর দিয়ে দেখেনি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন ভারতের কিছু রাজা রাজড়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদ্রোহটাকে থামিয়ে দিলে। সেই রাজা রাজড়াদের মধ্যে একজন মহারাজাধিরাজ রাজেশ্বর হোলকার সিন্ধিয়া।অবশ্য রাজেশ্বর সাইন্ডিয়ার তাতে লাভ হয়েছিল প্রচুর।আসলে যুবরাজ রাজেশ্বর সিন্ধিয়ার অবস্থা তখন খুব নড়বড়ে। তার চার ভাই, চারজনই বয়েসে বড় এবং জনপ্রিয়। মসনদে বসার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের আগুন দমিয়ে তিনি হয়ে গেলেন ব্রিটিশ সরকারের খাসম খাস। ব্যাস প্রথমে রাজা, তারপর রাজাধিরাজ এবং শেষে মহারাজাধিরাজ হয়ে বসলেন।
আর এদিকে আমি শশীভূষণ দত্ত। খুলনা জেলায় বাবার মুদির দোকান ছিল। লেখাপড়া পাঠশালায় চুকিয়ে দিয়ে, কেরানির চাকরিতে ঢুকেছিলাম খুলনা সদর দফতরে। কিন্তু মন তো ছুটে যেত বনে বাদাড়ে, জঙ্গলে জঙ্গলে। সুন্দরী গাছের গাছের মাঝখানে মাঝখানে।মোহনার জলে, পাখির ডাকে। খোলা আকাশের পাখি কে কি খাঁচায় পুরে রাখলে প্রাণ তার ওষ্ঠাগত হয়। ফতরের চাকরিতেও আমার সেরকম অবস্থা।
তবে দফতরের বড় বাবু হালদার মশায় ভীষণ ভালোবাসতেন । তবে সেটা শুধুই ভালোবাসা না ছটি কন্যার দায়গ্রস্ত পিতার চাতুরী সেটা বুঝতাম না। যাই হোক, একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন। গরম ভাত, দল, আলু পোস্ত আর মৌরলা মাছ দিয়ে খাওয়া শেষ করেছি। এ সময় পান চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "শোনো শশী, তোমায় একটা জিনিস দেব। যত্ন সহকারে রাখবে কেমন' এই বলে হাতে তুলে দিলেন কি একটা। হাতের দিকে তাকিয়ে চক্ষু ছানাবড়া। লোহার ভারী কালো পিস্তল।
"এর মধ্যে গুলি নেই, তবে ওপাড়ার ভানু সরকারি অস্ত্রাগারে কাজ করে। ওকে দু পাঁচ আনা দিয়ে দিলে .." , বলতে বলতে পানটা আরেকবার চিবিয়ে নিলেন" কিন্তু এদিয়ে আমি কি করবো? " আমি বললাম।
"মানুষ মেরো না। বাকি সব কিছু করতে পারো।", উনি বললেন।
এইভাবেই আমার শিকারে হাতে খড়ি হয়। প্রথমে পাখি, ছাগল ইত্যাদি দিয়ে শুরু পরে শেয়াল ও মেরেছিলাম। কিন্তু বড় কিছু করবার সুযোগ তখনও পায়নি। পেতে বেশি দেরি হলো না।
দ্বিতীয় অধ্যায়
বটিয়াঘাটা গ্রাম থেকে খবর এলো, যে ওখানকার জন্তু হঠাৎ উধাও হয়ে যাচ্ছে। কখনোবা তাদের রক্তাত্ব লাশ পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে একজন বাঁচাকেও তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু এসব হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। গ্রামে হাহাকার।সদর দফতরের থেকে পাঁচ দিনের ছুটি পাওনা ছিল, তড়িঘড়ি দরখাস্ত করে। বেরিয়ে গেলাম বটিয়াঘাটা গ্রামে।লালমাটির রাস্তা, ধারে ধানের খেত। গ্রীষ্মকালে গুরুর গাড়িতে চললাম, ওখানে মনোহর বাঁড়ুজ্জের ভিটেতে থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন হালদার মশাই।
মনোহর বাঁড়ুজ্জের বাড়িতে পৌঁছে অতিথি আপ্যায়ন বেশ ভালোই হলো। মনোহর বাঁড়ুজ্জে গ্রামের মোড়ল। বিয়ে থা করেননি। তবে বাসায় ভৃত্য আছে। তার রান্নার হাত খুবই উঁচু মানের। খেয়েদেয়ে দুপুরের ঘুমটা জমিয়ে হলো। বিকেলে বাঁড়ুজ্জে মশাই গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। সে সময় লক্ষ্য করলাম যে জঙ্গলের পাশে একটা জায়গায় ঘাস দুমড়ে গেছে।কাদামাটিতে থাবার চাপ দেখে বুঝলাম না ভুল হয়নি , যা আন্দাজ করেছিলাম তাই ঠিক।
আসলে ব্রিটিশ সরকার আর রাজা রাজড়ারা মিলে দেশের জঙ্গলের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। বন্য পশু প্রাণীদের আস্তানা ধ্বংস তারা বেরিয়ে আসছে গ্রামাঞ্চলে।বাঘ ও এদের মধ্যেই একজন। সাধারণত বাঘ মানুষের ওপর শিকার করে না। মানুষের মাংস তার বিশেষ পছন্দ নয়।কিন্তু বাঘ যখন বুড়ো হয় তখন সে আর অন্য শিকার করতে পারে না। তখন মানুষ হয় তার জন্য সব থেকে সহজ শিকার।
থাবার আকৃতি দেখে বুঝলাম যে এ জন্তু বাঘ ছাড়া আর কিছু নয়। বাঘ শিকার একদিনের বেপার নয়। বাঘ সাধারণত সপ্তাহে একবার কিম্বা দুবার খায়। অতএব মাচা বেঁধে বসে থাকতে হবে। বস্তুত বাঘ মানুষকে খুব ভয় করে , তাই বাঘের কানে যদি গুলির শব্দ একবার যায়, তাহলে সে আর কোনদিন গ্রামের মুখ দেখবেনা। রক্তব্যয় ছাড়াই কাজ হাসিল।
সেই রাতটা আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা। তখন মাঝরাত ঘুম ভেঙে গেলো এক ভয়ঙ্কর গর্জন শুনে। সে গাছটির ওপর মাচা বেঁধেছিলাম সেটি কাঁপছে। নিচে তাকিয়ে দেখলাম, জ্বলন্ত দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে গেছে।ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেলাম গাছটিকে একটি প্রকান্ড বাঘ আক্রমণ করেছে। সে বারবার গাছটিকে ধাক্কা মারছে।গাছটির ডাল গুলো ধাক্কার জ্বরে নড়চড়ে উঠছে। তার সঙ্গে ম্যাচটাও দোলানি খাচ্ছে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়লাম। আমার সামনে হলুদ রঙের জ্বলন্ত দুটি চোখ, ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আমার অজান্তেই পিস্তলের গুলি গগনভেদী হুঙ্কার ভোরে বাঘের পাঁজরাই গিয়ে লাগলো।বাঘটি শেষবারের মতো গর্জন করে,মা টিতে লুটিয়ে পড়লো।পরেরদিন গ্রামে হৈহৈ কান্ড। নোহবৎ বাজছে, ভোজ রান্না হচ্ছে। আমি যেন গ্রামের নায়ক। কত উপহার দেওয়া হচ্ছে , কত মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে। তবে আমি মনে মনে জানতাম যে প্রাণে বাঁচাটাই আমার সব থেকে বড় প্রাপ্য।
তৃতীয় অধ্যায়
আমার নাম শশীভূষণ দত্ত থেকে "বাঘমারা শশী" হয়ে যায়। ডুমুরিয়া, দিঘলিয়া, খালিশপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বাঘ, ভালুক, সিংহ, নেকড়ে ঢুকে পড়লেই আমার ডাক পড়তো।অভিজ্ঞ হাত না থাকলে এসব শিকার অত্যন্ত নির্মম মৃত্যুর রূপ নিতে পারে। এবার ডাক পড়েছে সুদূর বিদেশে গয়ালিওরে।মহারাজাধিরাজ রাজেশ্বর হোলকার সিন্ধিয়া
ডেকে পাঠিয়েছেন। মানুষ পেটের দায়ে আর টাকার লোভে সব কিছু করতে পারে। আমিও মেনে গেলাম যেতে। নাহলে আমার মতো সিপাহী বিদ্রোহের যোদ্ধাকে এই কদর্য, বেইমান, ইংরেজের চাম্পচার স্মরণে যাওয়া শোভা দেয়না।চিঠির সঙ্গে একটা থার্ড ক্লাস রেলের টিকিট ও পাঠিয়েছেন।সে নিয়েই বিদায় জানালাম প্রাণের বঙ্গভূমিকে।
রেল যাত্রা এই প্রথম। প্রকান্ড দৈত্যাকার রেল ট্রেন। তার থার্ড ক্লাসের কামরায় ব্রাহ্মণ, বনিয়া, মুসলমান গরু মোষের মতো ঠেলা। তবু অন্য পথের তুলনায় জলদি পৌঁছে গেলাম| ঢাকা হতে গবলিৰ যেতে লাগলো মাত্র ৬ দিন। স্টেশন থেকে মহারাজার নিজের লোক আমায় নিয়ে গেলো রাজপ্রাসাদে। পেল্লাই বাড়ি। রাজা এবং তার পাটরানীদের জন্য খান পঞ্চাশেক কামরা। বাবুর্চি, পরিচারক সব আছে।আমাকে রাখা হলো অতিথি নিবাসে। সকাল বিকেলে লোকজন শরবত, দুধ, দই এনে দেয়। বিকেলে রাজপ্রাসাদ, খামান দুর্গ ইত্যাদি ঘুরে আসি। এরকম করেই কেটে গেলো দুদিন। কিন্তু রাজামশাই আমায় ডেকে কেন পাঠালেন, সেটা চিঠিতেও স্পষ্ট বলেননি। এখানেও জানতে পারলাম না। শুধু বলেছেন একটা জরুরি কাজে আমাকে নিযুক্ত করবার জন্য মাসিক বেতন দুটাকা বেতন দিয়ে আমায় রাখতে চান।আট আন্নার চাকরি সদর দফতরে। দুটাকা বেতন পাবো কোনদিন জীবনে ভাবতেও পারিনি।তাই চলে এসেছি।
তবে রাজার যে শিকারের শক আছে সেটা আমি আগেই শুনেছি। তাই ভেবেছিলাম শিকার জাতীয় কিছুই নিশ্চয়ই করাবেন। কিন্তু আসল অভিপ্রায়টি সন্দেহের ঘেরাটোপে থেকে গেলো।
চতুর্থ অধ্যায়
সকালে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে রাম সিংহ বললো, "সাহেব, অপক মহারাজাধিরাজ বুলা রেহে হায়।" সকালে স্নান টান সেরে। চলে গেলাম মহারাজাধিরাজ মহারাজাধিরাজ রাজেশ্বর হোলকার সিন্ধিয়ার বেঠক খানায়। সাহেবি আমলে সাজানো। দেওয়ালে দেওয়ালে পেইন্টিং।
"অরে আসুন আসুন সাশি সাহেব", রাজা সাহেব বলে উঠলেন। মাঝবয়েসী লোক। পেটে মেদ। পাগড়ির ওপর সোনা জহরত। হালকা হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় কথা বলেন আমার সঙ্গে।
"আপনার ব্যাপারে হুম খুব শুনেছি? আপনি নাকি বাঘ, ভালুক প্রায়ই মেরে থাকেন?", ঠোঁটের কোন মৃদু হাসি নিয়ে বললেন। লোকটা মুখে মিষ্টি স্বরে কথা বললেও ওর চোখ ছিল লাল, নৃশংসতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় ওই দুটি চোখে ।
"ওই আর কি। গ্রামে মাঝে মাঝে বাঘ, ভালুক ঢুকে গেলে ....", বিনম্র ভাবে উত্তর দিলাম।
"যাকগে , হুম আপনাকে এক চীজ দেখাবো। আমার সঙ্গে আসুন।", উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমিও পিছু নিলাম। দরদালান পেরিয়ে একটা কামরায় ঢুকে গেলেন। আমিও সঙ্গে ঢুকলাম।
ঘরে জন্তু জানোয়ারের ফটোগ্রাফ বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে।আসলে জন্তু নয় লাশ। লাশের পাশে মহারাজাধিরাজ মহারাজাধিরাজ রাজেশ্বর হোলকার সিন্ধিয়া বাহাদুর, কখনো রিভলভার হাতে, কখনোবা পিস্তল, কখনোবা রাইফেল।
"এসব আমার শিকারের ছবি", রাজাজি বলে উঠলেন।
"এই জন্তুটিকে তো চিনতে পারলাম না?", আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"এটার নাম পান্ডা। এটা দক্ষিণ চীনে পাওয়া যায়। আমি ওখানে যখন বেড়াতে যাই। তখন চীনের যুবরাজ তও যেন লাই এর সঙ্গে শিকার করি", উনি বলে উঠলেন।
"বেশ বেশ। আপনি তো দেখছি জাত শিকারী", মিথ্যে প্রশংসা জুড়ে দিলাম আমি।
"তবে একটা জানভারের শিকারী হুম এখনো করেনি", উনি বললেন।
"কোনটা রাজা সাহেব। আপনি বলুন আমি সেটাকে ধরে বেঁধে পেশ করবো আপনার সামনে", আমি বললাম। "হা হা হা। ওসবের দরকার নেই। ওতে শিকারের মজা নেই।শিকারের মজা জঙ্গলে হয়। যখন শিকার জানে যে সে পালতে পারে। সে প্রাণের ভয়ে পালায়, তার চোখে দেখা যায় মৃত্যুর ভয়। তার মুখে মৃত্যুর আর্তনাদ। এরকম সময় এ শিকারী করলে শিকারের আসল মজা পাওয়া যায়। আর সেই শিকার যদি নিজেই দক্ষ শিকারী হয় তাহলে তো কথাই নেই", রাজা সাহেব বললেন।
"কিন্তু আপনি কোন জানোয়ার কে মারতে চান?" , আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"বলবো বলবো। সে এক অতি হিংস্র জানোয়ার। তুমি বরং কালকে একলা গিয়ে পাশের শিবপুরির জঙ্গলটা ভালো করে জরিপ করে নাও। আমি কালকে একটু বেরোবো ভোপালের দিকে, তাই আমি থাকতে পারবো না।"
পঞ্চম অধ্যায়
রাজার আদেশ অমান্য করার জো নেই। পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে গেলাম শিবপুরির জঙ্গলের দিকে। বেশি দূরে নয়, ৩০ মিনিটের হাটা পথ। জঙ্গল ঠিক বলা যায়না তৃণভূমির মাঝখানে মাঝখানে লম্বা লম্বা গাছ। ঘাসের উচ্চতা এতো যে একটা মানুষ ঢেকে যেতে পারে। শিকার করবার উপযুক্ত জায়গা। পশুর সামনে ঘাপটি মেরে বসে থাকলেও বুঝবার জো নেই। হঠাৎ দূরে লতাপাতাগুলো একটু নেড়ে চেড়ে। যেন কোন পশু ওর মধ্যে লুকিয়ে আছে। আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতে লাগলাম। কিন্তু সেই সময়েই এক গগনভেদী আওয়াজ আমি শুনতে পেলাম। আমার পায়ের পাশ দিয়ে কি একটা জিনিস দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলো।আমি কিছু ভাবার আগেই আবার সেই আওয়াজ এবার আমার কানের পাশদিয়ে গেলো। বুলেটের শব্দ আমি চিনতে ভুল করিনা। ভাববার অবসর নেই। ছুটতে হবে। আতঙ্কে, ত্রাসে আমি ধাবা দি। পেছনে ঘুরে দেখতে পাই সেই পাগড়ি, তার মধ্যে জহরত গাঁথা। দুটি লাল নৃশংস চোখ আস্তে আস্তে বটিয়াঘাটার বাঘের চোখের মতো হলদে হলদে হয়ে আসছে । তবে কি মহারাজ মানুষ শিকার করতে চেয়েছিলেন। হঠাৎ আরেক গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবার মহারাজা লক্ষ্য ভেদ করলেন। আসে পাশের লতাপাতায় রক্তের দাগ ছড়িয়ে গেল।
ষষ্ঠ অধ্যায়
মহারাজ শিকার ফটোগ্রাফের কালেকশন একটি নতুন ফোটো যোগ হলো। আমি এখন ওখানেই থাকি, শিবপুরির তৃণভূমির মাঝখানে, হালদার মশাইয়ের পিস্তল নিয়ে, ঘাপটি মেরে। শুনেছি মহারাজ আবার শিকারে আসছেন, সঙ্গে ষোলো বছরের যুবরাজও থাকবেন।
Comments
Top
কালো কাক
ভূতের ভ্যাকেসন
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
কালো কাক
গাড়ি চলেছে লালমাটির রাস্তায়, রতনের মন কিন্তু অন্য দিকে। আজকাল কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগে রতনের। যাদবপুরের ফেস্ট এ যে রিয়ার সাথে দেখা হয়েছিল প্রথমবার, যার সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল সে, সেই রিয়া কোথায় হারিয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসেস এর পরীক্ষা পাস করবার পরেই বিয়ে করেছিল তারা। রিয়া নিজের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ক্যারিয়ার ছেড়ে ফুল টাইম রাইটার হবার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরুলিয়ার ব্যারান্টি অঞ্চল এ প্রথম পোস্টিং। লালমাটির রাস্তা, সারিসারি সাল গাছের বন, দূর থেকে ভেসে আসা ছৌ সংগীত, ঝি ঝি পোকার মাদক আওয়াজ। তার মাঝখানে ফরেস্ট বাংলো।
কতবছর কাটিয়ে দিয়েছে এই জঙ্গল বাংলোয়। বন্য পরিবেশে রিয়া বেশ নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ভ্রমণ কাহিনী লিখে যথেষ্ট নাম করেছে। রতনের ফরেস্ট বাংলো এখন ওয়ার্ডে সারিসারি। রতন প্রমোশন পেয়ে এখন এরিয়া ম্যানেজার।
কিন্তু তারপর শুরু হল রিয়ার সমস্ত আজগুবি অন্ধবিশ্বাস। সেদিন হারুর মা কাজ করতে এসে বলেছিলো, "জানেন কালো কুচ কুচা কাকটা সালেম চাচার বাড়িতে এসে বসেছিল। তখনই বুঝেছিলাম যে রাতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে"।
আসলে এখানকার এক অন্ধবিশ্বাস যে কালো কাক হল দুঃসংবাদের বাহক। যে কালো কাককে দেখে তার আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে কেও একজন মারা যান। তার কিছুদিন পর রিয়া উঠোনের ওপর কালো কাক দেখে, পরের দিন তার একমাত্র কাকার মৃত্যু হয়। বস্তুত তার কাকা অনেকদিন ধরেই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত তার মারা যাওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কালো কাকের বিষয়টা নেহাত কাকতালীয়। কিন্তু রিয়াকে এসব কি আর বোঝানো যায়। ওঝা ডেকে ফরেস্ট বাংলো ঝাড় করিয়েছে। এখন ফরেস্ট বাংলোর আনাচে কানাচে ঝোলে লেবু আর লঙ্কা।
এ নিয়ে কত তর্ক বিতর্কই তো হল। কিন্তু রিয়াকে বোঝানো গেলো না। আজ প্রমাণ হাতে পেয়েছে রতন। দফতরে মধ্যে একটা কদর্য কুঁচকুঁচে কালো কাক তার ডেস্ক এসে বসে। সজোরে ক্যাঁক ক্যাঁক করে উঠলো। রতন কিন্তু কাক তাড়াবার কোন চেষ্টাই করলো না। ফোনটা তুলে একটা ছবি তুলে নিল। আজ সে ঘরে ফিরে রিয়াকে এই ফটো দেখাবে। ভুল ভাঙবে তার। রাতের গভীরে টর্চের আলোকপাত। ইতিমধ্যে গাড়ি থেমেছে। গাড়ি থেকে নেমে "রিয়া, রিয়া করে চিৎকার করতে করতে দোতালায় উঠে গেলো রতন"। রিয়ার কোনো সাড়া শব্দ নেই। বেডরুম এ ঢুকে দেখে রিয়া ঘুমিয়ে পড়ে আছে। নিদ্রায় মগ্ন, চোখে মুখে শান্ত আভা। রতন গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কিন্তু একি রিয়ার দেহ তো হিমের মতো শীতল। রতন রিয়াকে নাড়া চাড়া করলেও অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। সেদিন গাছে বসে থাকা কাকগুলো শুনতে পেল, ফরেস্ট বাংলো থেকে আসা একটি মানুষের গগনভেদি আর্তনাদ।
ভূতের ভ্যাকেশন
প্রথম অধ্যায়
আজ সকালেই উঠে এলাম কবর থেকে। কতদিন আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে থাকবো বলুন। সেই ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে মারা গেছিলাম সিপাহী বিদ্রোহে। সে এক অপূর্ব গাঁথা, রাজা কুঁয়ার সিংহের নেতৃত্বে ইংরেজে শাসকদের সাথে লড়াই করে যাচ্ছি। মুসলিম, হিন্দু সবাই এক সাথে মিলে সংগ্রাম করছি গোরাদের বিরুদ্ধে। গোরাদের কাছে আছে অঢেল টাকা, অস্ত্র, শস্ত্র। আমাদের কাছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকজন আর ঢাল তরোয়াল। মৃত্যু অনিবার্য। তবুও লড়ে যাচ্ছিলাম।তখন আমি বিহারের আররাহ অঞ্চলে যুদ্ধ করছি। মধ্যে গ্রীষ্মের দুপুর। হঠাৎ আমি গুলিবিদ্ধ হলাম। ও সে কি কষ্ট।হাঁকিয়ে উঠলাম। আমার গগনভেদী আর্তনাদকেও শুনল না। মৃত্যুর কোলে শান্তি পেলাম। অনেক নাম না জানা শহীদদের মতোই আমায় লোকজন ভুলে গেছে। তবু একটা কবর দেওয়া হয়েছিল। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান, আমার কত সহকর্মীদের তাও জোটেনি কপালে। তাদের দেহ চিলে, শেয়ালে খেয়েছিলো।
দ্বিতীয় অধ্যায়
সময় অনেক এগিয়ে গিয়াছে। কুঁয়ার সিংহ যুদ্ধ হেরেছে।ইংরেজ শাসক কড়া হাতে দমন করেছে সিপাহী বিদ্রোহ।আরো শতবছর শাসন করেছে তারা। ভারতকে কাঙাল করে ছেড়ে গেছে। তারপর ভারত স্বাধীন হয়েছে।এখন আমাদের দেশ একটি সফল গণতন্ত্র। এখন গরু গাড়ির জায়গা নিয়েছে মোটর গাড়ি। সবই শোনা কথা।আমার পাশের কবরের আলম যখন আগের বছর ভ্যাকেশন নিয়ে গেছিলো তখনই বলেছিলো। আমারো কত ইচ্ছে যে আমার প্রাণের দেশে একটু ঘুরে আসবো। ভূত হবার অনেক অ্যাডভান্টেজ। আপনি সবাই কে দেখতে পাবেন, কেউ আপনাকে দেখতে পাবেন না। এক মুহূর্তের মধ্যে কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী যাওয়া যায়। কোথাও ঢুকতে পারমিশন লাগে না। মন্দির, মসজিদ, চার্চ সব জায়গায় যাওয়া যায়। তাই ভাবলাম একবার ঘুরেই আসি না।
তৃতীয় অধ্যায়
উঠলাম কবর থেকে। ভাবলাম ভারত দর্শন কলকাতা থেকেই শুরু করবো। আমাদের কালের রাজধানী। শুনেছি নাকি উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। যাকগে , এই সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, আমাদের সময় এসব ছিল না। দেখলাম সামনের মাঠের ওপর কত ছেলে মেয়ে বসে প্রেম করছে। আমাদের সময় কি এসব সম্ভব ছিল।আমারও ছোটবেলায় এরকম একজনকে ভালো লেগে গেছিলো। তার চোদ্দ বছরে বিয়ে হয়ে যায়, আশি বছরের এক বামুনের সাথে। যাকগে পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। এবার বেরোলাম দিল্লির দিকে। আমাদের সময় বাহাদুর শাহ জাফরের এবং মুঘল রাজ্যের কেন্দ্র ছিল এই দিল্লি।এখন স্বতন্ত্র ভারতের রাজধানী। ঝাঁ চকচকে রাস্তা, শপিং সেন্টার, দ্রুত বেগে ছুটছে মেট্রো আহা এতো স্বর্গ।বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিমানবন্দর, এই ভারতের জন্যই তো প্রাণ দিয়েছিলাম আমরা। গর্বে বুক ভোরে গেলো।ভাবলাম একবার পার্লামেন্ট ঘুরে আসবো। আমাদের সময়ও সভা হতো, রাজা তার মন্ত্রীদের পরামর্শে দেশকে শাসন করতেন। আজকাল আবার গণতন্ত্র এসেছে। এসব আমাদের সময় ভাবাই যেত না। ভাবলাম, একবার দেখেই আসি না আজকালকার ছেলে ছোকরারা কিরকম ভাবে দেশ শাসন করে। ঢুকে গেলাম লোক সভাতে। ভূত হওয়ার কারণে কেউ আটকাতে পারলে না। ও মা এ কিরকম সভা। সভার মাঝখানে এক মহিলা বসে আছেন। তিনি ক্রমাগত বাদবাকিদের শান্ত থাকতে বলেছেন। কিন্তু বাকিরা কেউ তার কথা শুনছে না। সমানে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগালি। পিছনে ফিরে দেখি একজন লোক এই কোলাহলের মধ্যেই দিব্বি ঘুমোচ্ছে। আরেকজন আবার বেমালুম ফোনে কি সব দেখছে। নাহ, এবার উঠি নইলে কানের বারোটা বেজে যাবে।
শেষ অধ্যায়
বেরিয়ে পড়লাম কাশ্মীরের দিকে। এই জায়গাটি নাকি পৃথিবীর জান্নাত বলে মনে করা হয়। জীবিত কালে কোনোদিন দেখা হয়নি, মরণের পর জান্নাত ও নাসিবে হলো না। তাই ভাবলাম যখন বেরিয়েছি তখন কাশ্মীর দেখে আসতেই হবে। আমি ভূত। গায়ে ঠান্ডা গরম কিছু লাগেনা। সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছি। কাশ্মীরের বরফে, গাছের মাঝখানে। মরণের পর মনে হচ্ছে, এই না হলে জীবন। হাঁটতে হাঁটতে পথ গুলিয়ে কোথায় চলে এসেছি, শ্রীনগরের থেকে অনেক দূর কাঠুয়া গ্রামে। কিভাবে, যে ফিরে যাবো জানি না। যাকগে দুপুর হয়েছে, একটা আস্তানা পেলেই হলো। সামনেই একটা মন্দির আছে ভাবছি দুপুরটা একটু জিরিয়ে নিয়ে, বিকেলে বেরোবো। মন্দিরেই কিছু ভোগ প্রসাদ পেলে মন্দ হয় না।উনি দেবতা হলে আমি অপদেবতা। যথাযত সম্মানতো পাওয়া উচিত। মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম মন্দিরের সিংহদ্বার রুধ। এই দরজা বন্ধ করে, মানুষকে বাইরে রাখা যায় কিন্তু ভগবান এবং ভূতকে রাখা যায় না। ঢুকে গেলাম ভেতরে।শুনতে পেলাম একটি শিশুর আর্তনাদ। মন্দিরের এক কোন থেকে আসছে। অচিরেই সেখানে পৌঁছলাম আমি। দেখলাম একি, চার পাঁচটি নগ্ন পুরুষ, তার মধ্যে একজন বোধ হয় মন্দিরের পূজারী আর একটি ছোট বালিকা। পেছন থেকে জয় শ্রীরামের জয়ধ্বনি। না থাক বাকিটা আর বললাম না।কবরে ফিরতে হবে।
Comments
Top
বিজয়
ম্যাগাজিন
সূর্যাশীষ পাল
নয়ডা, উঃ প্রদেশ
বিজয়
হঠাৎ, ফোনটা বেজে উঠলো।
"স্যার , পাঠিয়ে দেব? "
"হ্যাঁ, মিনিট ১৫ পরে, পাঠিয়ে দিন।"
ফোনটা রেখে, বিন বাগে এলিয়ে বসে, জানালার দিকে তাকাল আর কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
তখন সে গ্রাম থেকে প্রথম কলকাতায় এসেছে। ক্লাসের মধ্যে অনেক মেয়ের মধ্যেই রিয়া একজন। চোখ কেড়ে নেওয়া সৌন্দর্য্য নেই তার মধ্যে, অত্যন্ত সাধারণ দেখতে। তবে বিজয় গ্রামের ছেলে, ড্রেসিং সেন্স বলতে কিছুই নেই। সাদামাটা দেখতে, একটু কুৎসিত বলা যেতে পারে। পড়াশোনায় মাঝারি। ঠিক বাংলা উচ্চারণ করতে পারে না। নজর কাড়ার মতো কিছুই নেই।
তবুও ক্লাসের মাঝখানে, টিফিনে কেমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠল রিয়ার সাথে। সস্তা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, সিনেমা দেখা। মাঝে মাঝে হাত ধরে রাস্তা পার হওয়া। ক্রমশ কলেজের গন্ডি পেরিয়ে গেল দুজনে। দুজনেই তখন কাঠ বেকার, বিজয় তখন টিউশন পড়িয়ে নিজের হাত খরচ চালায়। কিছু টাকা গ্রামেও পাঠায়।
কলকাতায় তখন বিশ্বায়নের জোয়ার। অলিতে গলিতে শপিং সেন্টার, ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্ট। সস্তার রেস্টুরেন্টগুলো যেন হারিয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। পরের সিগারেট ধরিয়ে বিজয়ের জীবনের প্রথম সিগারেটের কথা মনে পড়ে গেল।
প্রথম টিউশন শেষ করে, দ্বিতীয় টুইশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিজয়। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, টি-শার্ট ভিজে গায়ে চিটে গেছে। এসপ্ল্যানেডের রাস্তা, পথের ধারে সারি সারি দোকান। পাশেই একটা কোল্ড ড্রিংক, সিগারেটের ঠেক। আজ মাইনে পেয়েছে সে, একটা কোল্ড ড্রিংক মারাই যেতে পারে।
কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকানে গিয়ে দেখল, রিয়াকে। একটা ছেলের সাথে। রিয়া তাকে চিনেও না চিনবার ভান করল। দোকানদারের কাছে সিগারেট চেয়ে প্রথম সিগারেট ধরিয়েছিল বিজয়।পরে জানতে পেরেছিল, যে রিয়া অনেককেই এরকম স্বপ্ন ফেরি করে বেড়িয়েছিল। তার মধ্যে একজনের সাথে তার বন্ধুত্ব অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে প্রেমে পরিণত হয়। সে পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিজয়ের খারাপ লেগেছিল বটে, কিন্তু সে রিয়ার মুখোমুখি হয়নি কোনোদিন। কান্নাকাটিও করেনি। তিন মাসের একটা ইন্টার্নশীপ জোগাড় করেছিল। দিয়ে সেখানেই পার্মানেন্ট হয়ে যায়। কর্পোরেট লাইফ এ ওভারটাইম খেটে একের পর এক প্রমোশন পেয়ে এখন ম্যানেজার এন্ড চিফ রিক্রুটের। বিয়ে করেনি। তবে জীবনে অগুনতি নারীর আসা যাওয়া লেগে আছে। ইতিমধ্যেই দুয়েক জায়গায় তার কবিতা ছাপিয়ে সুনাম করেছে। রিয়া এর মধ্যে কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল, আজ যেন আবার ভেসে উঠেছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
রিয়া কেবিনের দরজাটা ঠেলে বললো, "আসতে পারি স্যার?"
মুচকি হেসে বিজয় বললো "হ্যাঁ আসুন।"
মানুষ আসলে গিরগিটি। কখন সে কাউকে প্রেমিক বানায়, কখন স্যার বলে সম্মান দেয়, কখনো বা এমন ভাব করে যে চিনতেই পারেনি। সুবিধের জন্য যেটা শ্রেষ্ঠ, সেটাই মানুষের ধর্ম।
কথোপকথন শুরু হল। রিয়ার গলায় মিনতির স্বর, তার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বর চাকরি হারিয়েছে।
কথাটা শুনে বিজয় কেমন যেন একটু খুশিই হল, কিন্তু পরের মুহূর্তের মধ্যে সে নিজের ওপর ঘৃণা করল। সে কথা ঘোড়াবার জন্য কিছু কাজ জড়িত কিছু প্রশ্ন করল। রিয়া আমতা আমতা করে মিনিয়ে মিনিয়ে কি যে জবাব দিল শুধু অন্তর্যামীই জানলেন।
ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার আগে রিয়া বললো, "আপনার কবিতাগুলো পড়েছি স্যার দারুন হয়েছে।" শেষ চেষ্টা করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রিয়া।
বিজয় মনে মনে মুচকি হাসল। পার্সোনাল লাইফ আর ওয়ার্ক লাইফ বিজয় মেলায় না। আজ কিন্তু সে দুটোকে আলাদা রাখতে অসমর্থ হল। এক্সেল শীটে রিয়ার নামের আগে "সিলেক্টেড" লিখল। বিজয় কি তার পুরোনো প্রেম ফিরে পেয়েছিল? না সে জিতে যাওয়ার স্বাদের আমেজ নিতে চেয়েছিল আরেকবার, কে জানে?
ম্যাগাজিন
প্রথম আধ্যায়
মিস্টার পাকড়াশীর কাছ থেকে লাস্ট কনফার্মেশন পেয়ে গেল মিস্টার সরকার। এবার সে ফ্রি। আরাম কেদারায় শুয়ে আপন মনে কি একটা ভাবছে। রিনা কিচেন চা বানাচ্ছে। সন্ধ্যে বেলায় চা খাবার পুরোনো অভ্যেস এখনো ছাড়তে পারেনি মিস্টার সরকার।
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, হোস্টেলের সেইদিনটির কথা। মনে পড়ে গেল যখন সে প্রথম সেই ম্যাগাজিন পেয়েছিল। তখন প্লেসমেন্টের বাজার। একের পরেক কোম্পানি আসছে আর চলে যাচ্ছে। কিন্তু ভুবনেশের প্লেসমেন্ট আর হচ্ছে না। মা বাবার সঙ্গে রোজ ফোনে কথা হয়, সব কথা বললেও ভুবনেশ তার চাকরির কথা এড়িয়ে যায়। সারাদিন বই পাল্টানো আর সিগারেটের টান। জুনিয়রদের মুখ দেখতে চাই না সে। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে ভুবনেশ
সরকার। প্লেসমেন্ট এ চাকরি না পেলে চাপের শেষ থাকে না। হঠাৎ এক দুপুরে, হোস্টেলের রুমের দরজার তলায় এই ম্যাগাজিন পায় সে। সাধারণ ম্যাগাজিন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ম্যাগাজিনের কোনো শীর্ষক নেই, কোন নাম নেই। শুধু একটা তারিখ আছে, তৃতীয় অক্টোবর ২০১৩। আশ্চর্য আজ তো সবে মাত্র কুড়ি জুলাই ২০১৩। ম্যাগাজিনটা বেশ ইন্টারেষ্টিং লাগল ভুবনেশের। পড়ার মাঝে মাঝে প্রত্যেকটা আর্টিকেল পড়ে নিল সে। পড়ে তাকে আরো আশ্চর্য হতে হয়। ম্যাগাজিনের একটা কোনে তার কলেজের প্লেসমেন্ট আপডেট বের হয়েছে। তার মধ্যে সফল ছাত্রছাত্রীদের তালিকা দেওয়া। তারা কে কোন কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে তাও দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ভুবনেশের নাম। ভুবনেশ বুঝলো কেউ বুঝি ওর সঙ্গে রসিকতা করেছে। কে করেছিল এই রসিকতা তা জানবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছ ছিল না ভুবনেশের। কিন্তু পরের মাসে সত্যি সত্যিই ভুবনেশ চাকরি পেল এবং সেই কোম্পানিতেই পেল যা ম্যাগাজিনে লেখা আছে। সন্দীপনকে যখন সে এই ম্যাগাজিনের কথা বললো, তখন সন্দীপন বললো যে সে ঢপ মারছে। কিন্তু ভুবনেশের মনে হল ব্যাপারটা ঢপ না হলেও নেহাত কাকতালীয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়
ইতিমধ্যে একটা সিগারেট জ্বালিয়েছে মিস্টার সরকার। কলেজের দিনগুলির কথা জীবনের অপরাহ্নে যখন মনে পড়ে, তখন সিগারেটের দু একটা টান না লাগালে মনটা যেন শান্তি পায় না। রিনার ভীষণ সময় লাগছে চা বানাতে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রিনাকে। তবে হুট্ করে ভালোবেসে নয়। তখন ভুবনেশ ময়সুরের এক কোম্পানিতে পোস্টেড্। সদ্য একটা রুমের ফ্লাট নিয়েছে। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে যে তার ফ্ল্যাটের দরজার নিচে একটা ম্যাগাজিন। হুবহু, অবিকল সেই কলেজের ম্যাগাজিনের মতো। সেই ডিসাইন, নাম নেই, তারিক আছে । তখন ডিসেম্বর ২০১৪, ম্যাগাজিনের ডেট মার্চ ২০১৫।কোথাও কোন কন্টাক্ট ইনফরমেশন নেই, আছে শুধু আর্টিকেল আর ছবি। একটি ছবি তাকে আকৃষ্ট করল। "শহরের বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ে রিনা মহাপাত্রের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে ভুবনেশ সরকারের।" ছবিতে ভুবনেশ দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা মায়াবী সুন্দরীর সাথে। এবার যেন ভুবনেশের ম্যাগাজিনের ওপর বিশ্বাস জন্মাতে শুরু হল। সে ফেসবুকে গিয়ে সে রিনা মহাপাত্রকে সার্চ করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল। সাধারণত মেয়েরা অচেনা ছেলেদের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে না। কিন্তু এ যেন গল্পের মতো সব হয়ে গেল। কখন যে সে রিনার প্রেমিক এবং স্বামী হয়ে উঠলো সে নিজেও জানতে পারলো না।
তৃতীয় অধ্যায়
এরপর থেকে এই ম্যাগাজিন প্রায়ই আসতে লাগল। শেয়ার বাজারের ইনফরমেশন আগে হতেই পেয়ে যেত ভুবনেশ। সঠিক জায়গায় শশুরের টাকা ইনভেস্ট করে, ভুবনেশ। অচিরেই শহরের সবচেয়ে বড় উদ্যোগপতি হয়ে দাড়িয়েছে জীবনে যা চেয়েছে, যখন চেয়েছে তাই পেয়েছে। লোকজন তাকে ফিনান্সিয়াল জেনিয়াস বললেও, ভুবনেশ জানত যে ম্যাগাজিন ছাড়া সে পঙ্গু।
পুরো জীবনটা যেন ধুয়ার শিখায় ভেসে উঠতে শুরু করল তার সামনে। কিন্তু সব পেলেও একটা জিনিস পাইনি ভুবনেশ। রিনা কোনদিন মা হয়নি। এ নিয়ে কত ঝগড়া কত জন্ঝাট। ডাক্তার, বদ্যি কিছুই বাকি রাখেনি ভুবনেশ। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। শুধু রিনা দূরে সরে গেছিল কয়েক যোজন।
শেষ অধ্যায়
পরশু যে ম্যাগাজিনটা পেয়েছিল, তার তৃতীয় পৃষ্ঠাটি পড়ে মিস্টার সরকার আশ্চর্য হলেও ভীত হয় নি। জীবনের যা পাওয়া ছিল, সবই মোটামুটি পেয়েছেন। এখন মারা গেলেও তেমন একটা দুঃখের কোন কারণ নেই।
চা এসে গেছে। রিনা এসে বসেছে, সোফায়। দুজনেই নির্বাক। চায়ের প্লেটটা হাতে নিয়ে মনে মনে ম্যাগাজিনের শিরোনামটা আরেকবার মনে করে নিল মিস্টার সরকার, "শহরের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট মারা গেছেন, মৃত্যুর কারণ ঠিক জানা যায়নি।" তারিক ২১শে জুলাই ২০১৮। অবশ্য, মিস্টার সরকারের একবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। আরেকবার স্ট্রোক হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এলিয়ে বসল। আজকেই উকিল মিস্টার পাকড়াশী বলে সব সম্পত্তি রিয়ার নামে করিয়ে দিয়েছে সে। অহা বেচারি কি কষ্টই না পেয়েছে। এক সময় কত কদর্য, কুৎসিত, অশ্রাব্য ভাষায় তিরস্কার করেছিল সে, আজ রিনার ওপর সব চেয়ে বেশি মায়া লাগে। রিনা এতো বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ে হয়েও তার সঙ্গে মানিয়ে চলেছে। আছে ছেলেমেয়ে না হওয়া কি কোন মহিলার চারিত্রিক দোষ? ভেবেও নিজে কি রকমের পাষাণের মতো সমবেদনাহীন মনে হয় মিস্টার সরকারের।
গলাটা কিরকম জ্বালা করতে লাগল মিস্টার সরকারের। ক্রমশ বুক জ্বালা করতে লাগল। হাতের কাপটা হাত থেকে পড়ে গেল। ধীরে ধীরে যেন সব মিলিয়ে যাচ্ছে, চোখের কোন দিয়ে মিস্টার সরকার দেখতে পেলেন যে রিনা মুচকি হাসছে মিস্টার সরকার লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
পরেরদিন খবরের কাগজে বেরোলো,"শহরের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট মারা গেছেন, মৃত্যুর কারণ ঠিক জানা যায়নি" ।
Comments
Top
ঘটনা
কুমার সোম
ঘটনাটা ঘটেছিল অনেকদিন আগে ব্রিটিশ আমলে। তখন পার্টিসন হয়নি। আমরা দুদেশে বিভক্ত হইনি। তা আমি সবে ডাক্তারি পাস করে আসামের একটা চা বাগানে কাজ করবো বলে রেডি হচ্ছি, তখন আমার মা জানালো তারা একজন মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে আমার জন্যে। তখন আমার আর বয়স কত, পঁচিশ হবে। বিয়ের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। মা জোর করাতে গেলুম মেয়ে দেখতে নিউ আলিপুরে। বাইরের ঘরে বসে আছি, মেয়েটি চা নিয়ে এল। কি বলবো যেমন রূপ, তেমন গায়ের রং আর তেমন আদব কায়দা, মানুষের মন ভুলিয়ে দেবার মত। এখানেই বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল।
মেয়ের বাড়ী থেকে আমার ডাক এলো। আমি আসাম যাবার আগে মেয়েটি আমার সাথে দেখা বলতে চায়। আমি মাকে বললুম, ‘মা আমি এখন কি বলি? কি করে বলি যে কেন এখনই বিয়ে করব না?’ মা বললো ‘যা, না দুটি কথা বলতে চায়, বলে আয়। আমার মনে হয় তোকে ওর ভাল লেগেছে, তোকে কথা দিয়ে আসতে হবে কবে বিয়ে করবি।‘
ওরা বেশ বনেদি ঘর, নিউ আলিপুরে বিরাট বাড়ী। কথায় কথায় মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আমার তাকে ভালো লেগেছে কিনা। আমি বললাম ভালো লেগেছে। বাড়ীর সবাই বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, চা নিয়ে বসে রইলাম আমি আর ঐ মেয়েটি। নানারকম কথা হল। সে জানালো তার বয়স পঁচিশ, বিয়ে সে করতে চায়, আর তার এই একাকী জীবন ভালো লাগে না। সে একটা অফিসে ক্লার্কের কাজ করে, ডালহাউসিতে। বাইরে বেরুলে অনেক পুরুষ মানুষ পেছু নেয়। অফিসের লোকেরা তাকে খুব বিরক্ত করে। আমি বললাম যে আমি আসামে সেটল করে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাব। মেয়েটি তার হাতের ওপর হাত রেখে আমাকে কথা দিতে বললো। সেদিন রাজী হয়েছিলাম তাকেই বিয়ে করব। তারপর আমি পাড়ি দিলাম আসামের ঘন জংগলে একটা বিরাট চা বাগানের রেসিডেন্ট ডাক্তার হিসেবে কাজ করতে। বছর ঘুরে এল, পাপিয়া প্রায়ই আমাকে চিঠি দিত। অনেক কথা লিখত, তার বাড়ীর অনেক খবর দিত। তার মা বাবা ভাইবোনের খবর, আমি কবেই বা আসবো, কবেই বা বিয়ে হবে আমাদের, ইত্যাদি। আসামের চা বাগানে কাজটা একঘেয়ে লাগতো আমার। চা বাগানের মজুরদের কঠোর জীবন। সকালে উঠে তারা হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খাটতো, অসুখ বিসুখ তাদের হত না খুব একটা। তবে হিল ডায়েরিয়া বা ওই ধরনের ছোটো খাটো অসুখ লাগেই থাকতো। বড় অসুখ টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া যে হত না তা নয়। তবে বড় অসুখ করলে আমাদের আসামের উপত্যকা থেকে মাইল চল্লিশ দূরে ডিব্রুগড়ের হাসপাতালে পাঠানো হত তাদের। আমার বাংলো থেকে আমাদের চা বাগানটা দেখা যেত অনেক দূর পর্যন্ত। আমি রাত্তিরবেলা বাংলোতে ফিরে আমার শখের কলকাতার বইমেলা থেকে কেনা বইগুলো নিয়ে পড়তাম।
অনেক বড় বড় ফিলসফারদের জীবনের মানে নিয়ে লেখা। অনেক সাধুপুরুষদের কথা। তারা নতুন নতুন ভাবে জীবনের ওপর তাদের মতামত জানিয়ে আলোকপাত করে গেছেন। ভাবতাম আমাদের এই ছোট্ট জীবনের অর্থটাই বা কি? আমরা এই পৃথিবীতে এসে দুদিনের জন্য সুখ, দুঃখ, ভালবাসা, বিয়ে, সন্তানদের নিয়ে তাদের ভবিষ্যতের পুরোটা না দেখে আবার কোথায় যেন মিলিয়ে যাই। আমার বাড়ীতে ঝিমলি বলে একটি পাহাড়ি মেয়ে এসে আমার ঘর দোর পরিষ্কার করতো, ভাল মন্দ রান্না করে দিয়ে যেত রাত সাতটার আগেই। ও আমাদেরই চা বাগানের মজুর। ওকে দেখে মায়া হত। বয়স কত আর হবে উনিশ কি কুড়ি। খুব হাসি খুশী ছিল ঝিমলি। ওর হাসিটা আমার মনে অনেকদিন দাগ কেটে রেখেছিল। আমাকে দেখলেই ও খিল খিল করে হাসতো আর বলতো ‘বাবু তু শাদি করবি না?’ বলেই পালিয়ে যেত আমার থেকে অনেক দূরে নীচের চা বাগানের দিকে। আমার মনের কোনে ও অনেক আলোড়ন তুলে যেত। এত সুন্দর একটা মানুষের সংস্পর্শে আমি কোনদিন আসিনি। আমি ঝিমলির আসার অপেক্ষায় থাকতাম। এরকম করে বাগানে কাজ করতে করতে বছর দুই কেটে গেল। আমি ভাবলাম এবার আমার বিয়ের ইচ্ছেটা একটু বেড়েছে, এবার কলকাতা গিয়ে বিয়ে করবো। সেদিন কলকাতা যাব বলে বাক্স গুছোচ্ছি, দেখলাম ঝিমলি আমার জন্যে অনেকক্ষণ সে বললো পাপিয়াকে একটু মেডিকাল কলেজে ভর্তি করা দরকার। আমি আর ডাক্তার বন্ধু প্রবীর পাপিয়াকে মেডিকাল কলেজে ভর্তি করলাম। প্রবীর তার পুরনো চেনা এক হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে পাপিয়াকে তার ওয়ার্ডে রাখলো। প্রায় মাসখানেকের মধ্যে পাপিয়া সুস্থ হয়ে উঠলো। আমি আমার চা বাগানে তার করে আমার ছুটি আরো দিন পনেরো বাড়িয়ে নিলাম। পাপিয়া ভালো হয়ে যাবার পর মাকে বললাম ঘটা করে বিয়ে দেবার সময় আর নেই, আমরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করবো। বিয়ে করে আমি আর পাপিয়া আসামের চা বাগানে পাড়ি দিলাম। পাপিয়াকে নিয়ে আসামের জংগলে আমার ছোট্ট বাংলোতে নতুন বিবাহিত জীবন শুরু করলাম। চারিদিকে আসামের ঘন জংগলে আমাদের ভালো কাটছিল। আমি পাপিয়ার শরীরের খুব যত্ন নিতাম। আমাদের জীবন ভালো কাটতে লাগলো। আমি পাপিয়াকে একজন খুব বড় ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার বললো, তার আগে যে কঠিন অসুখ করেছিল তার জন্যে তার সন্তান হবার সম্ভাবনা খুব কম।
আমার আর পাপিয়ার চা বাগানে চা বাগানে গোটা দু বছর সুন্দর কেটে গেল। বাগানের কাজ করে ফিরে এসে আমরা হাঁটতে বেরুতাম, ঘন জংগলে চা বাগানের ভেতর দিয়ে। কত রং বেরং এর পাখী উড়ে বেড়াতো। সেদিন আমি আর পাপিয়া হাঁটছি, হঠাৎ দেখলাম ঝিমলি কোলে একটা সুন্দর মেয়ে নিয়ে, চা পাতা তুলছে। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বললো ‘বাবু তুমি শাদি করিছ, তোমার বৌমা ভারী সুন্দর দেখতে‘। বলেই সে বৌমাকে জড়িয়ে ধরে বললো ‘মাজি কাল সামকো হামার বাড়ীতে আসেন না? আমি আপনাকে এসে লিয়ে যাব, হামি আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো‘। ঠিক পরের দিন ঝিমলি আমাদের তাদের ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গেল, তার মার বাড়ীতে। তার মা আমাদের চা বাগানে মজুরের কাজ করে। আমার ফটোগ্রাফির পুরনো শখ। আমি ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ঝিমলির মিষ্টি হাসি আর তার কোলে তার সুন্দর মেয়ের ছবি তুললাম, আমার বাইরের ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখবো বলে। কথা বলতে বলতে আমি ঝিমলিকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এই ঝিমলি, কিরে তোর বরের কাছে কবে যাবি রে, না এখানেই মার সাথে থেকে যাবি?’ দেখলাম তার বেয়ে জল পড়লো। বুঝলাম তার বিয়েটাতে কোনো গন্ডগোল আছে। আমি বললাম ‘থাক থাক চোখ মোছতো, আমরা তোর সাথে আনন্দ করতে এসেছি যে ‘। তারপর ঝিমলির কান্না আর থামে না। ওর দুঃখের জীবনী বলতে আরম্ভ করে দিল।
যা বুঝলাম কথা শুনে, যে ওর বর খুব দারু খায়। দারু খেয়ে ওকে খুব মারধোর করে। সে অনেকদিন বাড়ীতেই থাকে না রাত্তিরে, অন্য মেয়ে মানুষের সাথে রাত কাটায়। আমাদের ওকে দেখে মায়া হল। আমার বৌ পাপিয়া আমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো ‘চলো না আমরা ঝিমলিকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে রাখি, আমাদের কোনো সন্তান হয়নি, আমি ওর মেয়েটাকে দেখবো, ওকে স্কুলে পড়াব‘। আমি ঝিমলির মাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই কথা বললাম। ওর মা রাজি হলো।
তারপর আমাদের ঝিমলিকে নিয়ে জীবনটা বেশ ভালোই কেটে গেল তিন বছর। আমাদের ভয় ছিল ঝিমলির জরু এসে আমাদের ওপর হামলা না করে। আমি ডিব্রুগড়ে আসামের বড় হাসপাতালে রেসিডেন্টের কাজ পেয়ে চলে গেলাম ঝিমলিকে সাথে নিয়ে তার জরুর থেকে অনেক দূরে।
বেশ কিছুদিন পর আমাকে ঝিমলি বললো সে তার মেয়েটাকে নিয়ে তার মার সাথে দেখা করতে যাবে। আমরা রাজী হলাম। সে তার মার সাথে দেখা করতে গেল। প্রায় পনেরো দিন কেটে গেল ঝিমলি আর আসে না। আমি গাড়ী চালিয়ে শনিবার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, গেলাম তার মার বাড়ী। গিয়ে যা দেখলাম তা কল্পনা করা যায় না। ঝিমলির বর তাকে ভীষণ মারধোর করেছে যেহেতু সে তার কাছে ফিরে যায়নি। আমি ঝিমলি আর তার মেয়েকে আবার আমার কাছে নিয়ে এসে তার শরীরের সমস্ত ঘাগুলো সারিয়ে তুললাম। তার কিছুদিন পর ঝিমলির মার একটা চিঠি এলো। চিঠিতে মা লিখেছে ঝিমলির জরু খুব বেশী মদ খেয়ে মারা গেছে। সেদিন রাত্তিরে ঠাকুরের সামনে ঝিমলি খুব কেঁদেছিল, কাঁদতে কাঁদতে সে প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। আমার বৌ খুব সেবা শুশ্রূষা করেছিল তার। সেদিন বুঝেছিলাম ঝিমলি তার বরকে কতটা ভালোবাসতো। কেন যে ওর বর ওকে ছেড়ে অন্য মেয়েমানুষের কাছে যেত ও মদ খেতো তার কোনো উওর পাইনি খুঁজে। মনে হয়েছিল বড় বড় মনীষীদের কথা ‘এই জীবনের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না, এরই নাম জীবন ‘।
বাড়ীর বাইরে বসে আছে। আমি বললাম ‘কি রে ঝিমলি কি হয়েছে, আমার জন্যে বসে আছিস কেন রে, কিছু বলবি? ‘ ঝিমলি কাঁদো কাঁদো মুখে বললো ‘আমার বাড়ীর লোক আমাকে একটা লোকের সঙ্গে বিহা করতি বলতিছে, লোকটা খুব দারু খায়, হামি ওকে বিহা করুম না, বাবু ওই লোকটা ভাল লয়’ বলে আমার পা ধরে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। ‘বল বল বাবু আমি কি করি, আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব অনেক দূরে। আপনি আমাকে কিছু টাকা দিয়ে আপনার জীপ গাড়ীতে করিয়া ছাড়িয়া আসুন।‘ অনেক বুঝিয়ে ওর চোখের জল আমার রুমাল দিয়ে মুছে দিলুম সেদিন।
শুনলাম ঝিমলির ইচ্ছা না থাকলেও ওর মা ওকে সেই লোকটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সে তার জরুর সাথে তিরিশ মাইল দূরে আরেকটা চা বাগানে আছে। তারপর আমার কলকাতা থেকে মায়ের চিঠি এল। পাপিয়ার খুব অসুখ, ডাক্তাররা ঠিক ধরতে পারছে না। প্রায় দুবছর পর আমি একমাসের জন্যে আসামের জোরহাট স্টেশন থেকে ট্রেনে করে কলকাতা রওনা হলাম পুজোর ছুটিতে।
কলকাতায় বাড়ি পৌঁছে বাক্স প্যাঁটরা রেখে গেলাম পাপিয়ার বাড়ি, মার সাথে। নিউ আলিপুরে ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখি পাপিয়া শয্যাগত, চেহারা তার ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। ভগবান তার মুখের সুন্দর হাসিটা কেড়ে নিয়েছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম তার গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। আমি মাকে বাড়িতে নামিয়ে আমার খুব পরিচিত ডাক্তার বন্ধুর বাড়ী গেলাম, ট্যাক্সি করে। তাকে নিয়ে পরের দিন পাপিয়ার বাড়ী এলাম।
Comments
Top
যাপিত জীবন
রোমন্থনে রমণী
পদ্মনাভ অধিকারী
পীরের বাড়ী। কিন্তু' সেখানে কোনো ঘরবাড়ী নেই। লোকালয় থেকে বেশ দূরে- ঘন গাছপালা ঘেরা একটা জায়গা। শীত গ্রীষ্ম সব আবহাওয়ায় জায়গাটা উপভোগ্য। দাবন পীরের সুসন্তান। অদ্ভুত ব্যাপার, কোনো কালেও এখানে কোনো রকম ঘরবাড়ী ছিল কিনা তেমন নিশানাও মেলে না। অথচ বছর বছর এখানে মাঘমাসের শেষে লাখো মানুষের ঢল নামে। ভক্তেরা গানে গানে আর বিবিধ পানীয় পানে মাতোয়ারা হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হল পীর বংশের সদস্য যারা আছে, তারা পর্যায়ক্রমে খাদেম ও পীরের স'সন্তান জুড়ে থাকে। গভীর রাত অবধি চলে কেবল ভক্তদেরই মেলা। যারা ভক্ত নয়- তাদের মাঝ রাতের আগেই ফিরে যেতে হয়। এই দাবন পীরের ভক্ত রমেন ঋষি। তার অঞ্চলে সে পীরের খাদেম। তার বাড়ীতেও ভক্তরা যায়। সেখানেও উৎসব চলে সাতদিন। তবে এ স'স্থানে আগেই হয়। সে এসে হাজির হয়েছে দু’দিন আগে। রাত পোহালেই মেলা শুরু করে। মাঝ রাতে রমেন- লক্ষ্য করে একজন রমণী সারি সারি গাছের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসছে। তার হাতে একটা হ্যারিক্যান। পরণে বকের পালকের মত সাদা বসন। রমেন অবাক বিস্ময়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে খোলা জায়গায় ঘাসের উপর। তার মতো অসীম সাহসী মানুষ আজ কেন কুঁচকে যাচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে রমণী কাছে আসে। রমেন সহসা সরে গিয়ে একটা প্রকাণ্ড বটগাছের গায়ে সেটে দাঁড়ায় আর লক্ষ্য করে। রমণী এসে ঘাসের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে, উঠছে না বহুক্ষণ! রমেন দেখতে থাকে। এক সময় রমণী বাতাসে ভর করে উপরে উঠতে থাকে। ঠিক যেভাবে শুয়ে ছিল- সেভাবেই ক্রমাগত পরে উঠতে থাকে। রমেন এবার নিজেকে সামাল দিতে পারে না। সে ভাবে- - একি কাণ্ড। এ রমণী কোন স-রের সাধিকা। নিশ্চয়ই পীরের সান্নিধ্য পেয়েছে সে। রমেন ধীর পায়ে কাছা কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দপ করে হ্যারিকেন নিভে যায়। শিহরে ওঠে রমেন। সে ভাবে কি ব্যাপার! আলো নিভে গ্যালো ক্যানো? তবে কি রমণীটা কোন জেন- পরী হবে। হতেও পারে- পীরের ভক্তের মাঝে বহু জীন-পরী থাকার কথা সে শুনেছে। ভাবনার ভেতর হঠাৎ- বাঘের গর্জন শুনতে পেয়ে ঘাবড়ে যায় সে। সরে পড়ে।
ভয় ঠেকানে সাথে রাখা গ্যাস লাইটটা জ্বালায়। সে কি! রমণীটা গেল কোথায়। তার সামনেই তো ছিল। কিন্তু' গোল কোথায়। আচমকা রমেন তার কাঁধে নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করে। সে বলে ওঠে- কে?
হ্যারিটা জ্বলে ওঠে। সামনে দাঁড়ানো অপরূপ রমণী মুখে হাসিভরা। সে বলে
- কি রমেন দা- ভাল আছ তো, অবাক হচ্ছো কাণ্ড দেখে? রমেন সাহসের সাথে বলে-
- না-না, ঘাবড়ানোর কি আছে। তুমিতো ভালই রফতো করেছ। কিন্তু' কিভাবে করলে?
- আমাকে চিনতে পেরেছ রমেন দা?
- হ্যাঁ, পেরেছি, তুমি নবিছন না?
- হ্যাঁ।
স্বামীর ঘরে ফিরে যাওনি তাহলে?
- না। - ছেলেটা?
- ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করে- এখন মস- বড় অফিসার।
- তোমার খোঁজ খবর নেয় তো?
- পত্র মারফৎ।
- তা হবে ক্যানো, নিজে আসে না?
- দাদা-চাচাদের বাধ্য কিনা।
- ও বুঝেছি। তা তুমি কি এ পথেই আছ?
- হ্যাঁ- আছি।
- কিন্তু' কিভাবে বল- ?
- প্রথমে দ্যাখা শোনা, তারপর আলাপ পরিচয়, তারপর দেহদান- দিদার- সবশেষে অর্জন।
- কি বলছো তুমি, এ যে আজগুবি কথাবার্তা! না-না- তুমি ধাপ্পা দিচ্ছো। তুমি যা বল্লে- তা কি করে সম্ভব।
- অবশ্যই সম্ভব। তুমি তো পীরের ভাবানুসারি মাত্র।
- হ্যাঁ, সেভাবেই তো সব ভক্তেরা আছে ও থাকবে।
- দিদার না হলে মিনারে চড়বে কি করে? মিনারে না উঠলে বেহেশতের পথ দেখবে কি করে? পীরের সাথে মিলন না ঘটলে- তুমি কার সাথে সাথী হয়ে সেখানে পৌঁছাবে?
- কর্মের মাধ্যমে।
- পীরের সাথে দৈহিক মিলনের ফলে যে বন্ধন সৃষ্টি হবে- সেই বন্ধনের মাধ্যমেই মহাজাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে দোহে মিলে একাকার হয়ে- ঐ একই স'স্থানে গিয়ে উপস্থিত'ত হওয়া যায়।
- তা কি করে হবে, গুরুজি তো তেমন কথা বলেনি কোনদিন?
- ক্যানো? পীরের গান আছে না। দাবন গেয়েছে-
প্রেমের রসে হয়ে মাতাল
গুরু পদে দেরে পাতাল
পাতাল ছুঁয়ে দিলে গুরু
তোর হবেরে সবই সামাল ॥
ও সে চাম আটুলির মত
থাকবি সাথে তুই অবিরত
ফেলতে তোরে পারবে না সে
থমকে রবে এই মহাকাল।
গুরুপদে ভক্তি মতি
তারই সাথে রতিপ্রীতি
আবার, তারই সাথে ঘর-বসতি
তবেই মেলে নূর-মহাল ॥
রমেন বলে- কি শোনালে তুমি নবিছন!! তুমি কি সত্যিসত্যিই পীর পরবর্তী খাদেমের খাদ্য হয়েছ?
- হ্যাঁ, তবেই তো- আমার মত কতশত সেবিকা শেষ রাতে এখানেই আসবে বলে আমিও এলাম। অবাক হলে বুঝি?
- না- মানে- তোমার পক্ষে যা সম্ভব হয়েছে, সে কাজটা পুরুষ ভক্তদের পক্ষে কি করে সম্ভব। তা করতে গেলে তো- ভোগ বাসনা বাড়বে। সেটা বাড়লে-
নবিছন বলে- বোকার মত কথা বোলো না রমেনদা। যাকে ধরে চলবে তাকে বাদ দিলেও মরবে। জগতে সব নাগরের নগরী পরিক্রমার বাসনা ছিল। এ কাজটা বিপরীতে সম্ভব। সম মেরুতে তা হয় না।
রমেন বলে- তা হলে- গুরু পরম্পরা একাজটা চলে আসছে, কই এ কথা আমরা তো জানতে পারিনি! ভোর হতে থাকে, বাড়তে থাকে বনানীর ভিতর ভক্তদের ভীড়। বাজতে থাকে বাদ্যযন্ত্র। রমেন মাথা নিচু করে পীরের দরবার ছাড়ে। পিছ থেকে ডাকতে থাকে নবিছন। দাদা- দাদা যেও না।
Comments
Top
সজিবাবু
প্রদীপ চক্রবর্তী
এত বড় লেজওয়ালা পাখি ইদানীং বেশি চোখে পড়ে না। পাখিটির নাম সাহেব। এই পাখির অন্য কোন নাম আছে কিনা তা তরাব আলীর জানা নেই। মাঠের কোনের ঘন বন থেকে ধরেছে সে। আগ্রহ নিয়ে দেখতে আসছে অনেক লোক। পাখিটিকে রাখা হয়েছে খাঁচায়। আর ঠেলে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে নানা রকমের খাবার। ভালো একটা দামও হাঁকিয়েছেন তরাব আলী। কিন্তু' দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়-য়া সুজন এই পাখিটাকে কোথাও বিক্রি হতে দিতে চায় না। যত দামই হোক সে আনতে চায় নিজের বাড়িতে। এক্ষেত্রে তাকে একমাত্র সহযোগিতা করতে পারে তার থেকে আট বছরের বড় একমাত্র বোন সজিনা। যাকে ছাড়া সে দুনিয়ার কিছু চিন্তাও করতে পারে না। ঠিক যেন গাছ কে গাছ আর গরু কে গরু বলতে শিখিয়েছে তার সজিনাবু। সজিনাবু সুজনের আবদারের কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। যেকোন কিছুর বিনিময়ে তার ভাইয়ের আবদার পূরণ করতে চান। কিন্তু' পরের জমিতে রাত-দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে সংসার চালানো বাবা খলিল মিয়ার কাছে এ আবদার করা বেশ বিলাসিতা হবে। মাও এটা মেনে নেবেন না। তাই সজিনাবু তার হাতের রূপার বালাটা পাশের বাড়ির পাচুবিবির কাছে গোপনে বন্ধক রাখলেন। আর তার বিনিময়ে খাঁচা সহ পাখিটা আসলো সুজনদের বাড়িতে। সুজনের যেন আনন্দের সীমা রইলো না। মা ঠিকই বুঝেছিলেন যে কিসের বিনিময়ে তার এই শখ মিটলো। তবে কিছুই বললেন না। এমনি ভাবে সুজনের সব শখ কিম্বা ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ করতে থাকে সজিনাবু। বাবা-মা আর সজিনাবুকে নিয়ে সুজনদের দিন কাটতো অভাব-অনটনে। তবে হাঁড়িতে ভাত না থাকলেও সুজনের থালায় কখনো ভাতের কমতি পড়তো না।
হঠাৎ কেন জানি বাবা সজিনাবুর বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সজিনাবুর জন্য সুন্দর একটা বর খোঁজা হচ্ছিলো। সজিনাবু সবাইকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না।
এগিয়ে আসতে লাগলো মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষা। আর এদিকে সুজনের দুষ্টুমি বেড়েই চললও। দত্ত পুকুর থেকে বার বার গিয়ে নানা রকম অজুহাতে তুলে আনলেও হঠাৎ জ্বর বাঁধিয়ে বসলো। জ্বর সারতেই আবার সাঁতরাতে শুরু করলো দত্ত পুকুরে। একদিন সজিনাবু জোর করে তুলে আনতেই সুজন রেগে গিয়ে বলল, তোর বিয়ে হলে আমি বাঁচি। তখন দেখবো কে আমায় ঠেকায়। সকালে নামবো আর রাতে উঠবো। সজিনাবু আঁচল দিয়ে সুজনের মাথা মুছাতে মুছাতে খিল খিল শব্দে হেসে উঠলেন। মুহূর্তে তা আবার মিলিয়েও গেল।
সজিনাবুর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হলো। বিয়ের দিন ঠিক হলো। বিয়ের দিন এগিয়ে আসতেই সজিনাবু সুজনকে আদর করতে করতে বললেন, আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এখন আর তোকে কেউ দত্ত পুকুরে নামতে বাঁধা দেবে না। কি ভালো! না? সুজন সজিনাবুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
ঠিকই বিয়ে হয়ে গেল সজিনাবুর। কিন্তু' জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল যেন। বিয়ের পর পরই তার মুদি দোকানদার স্বামী মতিন সময়ে অসময়ে টাকার দাবি করতে থাকে। কৃষক বাবার পক্ষে মতিনের সব দাবি মেটানো সম্ভব হয় না। সজিনাবুকে তার স্বামী খুব মারতো। মতিনের উপর ওর খুব রাগ হতো সুজনের। একবার সজিনাবু যখন বাড়িতে আসলো তখন কানের দুল, নাকের নোলক এগুলো না দেখতে পেয়ে মা বললেন, তোর রাক্ষস স্বামী কি ওগুলো খেয়ে ফেলেছে। সজিনাবু কেঁদে উঠে বলেন, আবার টাকা চেয়েছে। বিক্রি করে দিয়েছে তার দোকানটা। সজিনাবু বাড়ি ফিরে এলেই কেমন জানি নিস্তব্ধতা নামে বাড়িটাতে। এখন প্রকাশ্যেই কাঁদতে দেখা যায় তাকে। সুজন ভাবে যেভাবেই হোক সে সজিনাবুর মুখে হাসি ফুটাবে। দের বাড়ির পিছনের ছোট্ট জায়গাটাতে ঠেলে গুঁজে অনেকগুলো গাছ লাগালো।
যত্ন করে আর সজিনাবুকে বলে,বুবু দেখ! মার গাছগুলো কত তাড়াতাড়ি বাড়ছে। আর কখনো কেঁদো না বুবু। দেখো, আমি দুলাভাইকে অনেক টাকা দেব। তোমার কানের দুল, নোলক সব কিনে দেব। সজিনাবু সুজনকে জড়িয়ে ধরে। সজিনাবুর চোখে একটা আলোক ঝলকানি দেখা যায় যেন, তা আবার মিলিয়েও যায়।
সুজনের ছোট গাছগুলো বড় হতে থাকে। বাড়তে থাকে সুজনের স্বপ্ন। কিন্তু' সজিনাবুর বাড়িতে আসা আর শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যাওয়া পূর্বের মতোই চলতে থাকে। সুজন একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে, উঠোনের এককোণে মানুষের ভীড়। কান্নার শব্দ আর চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ঘুরপাক খেতে খেতে ছড়িয়ে যাচ্ছে বহুদূর। সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল সজিনাবু। তাদের ছোট্ট উঠোন পুরো গ্রামের আংশিক মানুষকেও আশ্রয় দিতে পারছিলো না। তাই সারি ধরে সবাই আসছিলো। তাদেরকে কেউ অন্য সময় খোঁজ না নিলেও এখন অবশ্য সব শ্রেণীর মানুষকেই দেখা যাচ্ছে। সজিনাবুর গলায় দড়ির দাগটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। সুজন বুঝতে পারলো তার বুবু চলে গেছে না ফেরার দেশে। তার গগনবিদারী চিৎকার সবার চোখে পানি আনলো কিন্তু' বুবু কোন সাড়া দিলেন না।
আজ এতবছর পর বুবুর মুখটা মনে পড়তেই চোখ ভিজে উঠলো সুজনের। তার ছোট গাছগুলো এখন অনেক বড় যা কাটতে পাশের বাড়ির দবির শেখ বাবার সাথে অনবরত তর্ক করে চলেছেন। দবির শেখ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, এ গাছ গুলো আমার। বাবা করুন স্বরে বললেন, এ গাছগুলো আমার সুজন লাগিয়েছিল। দবির শেখ বললেন, তুমি একটা মুরব্বি মানুষ হয়ে মিথ্যা কথা বলো কি ভাবে? এ গাছগুলো এমনিতে হয়েছে। আমি কামলা খাটিয়ে, যত্ন আদ্দি করে এত বড় করেছি। তাছাড়া এটাতো আমার জমির ভেতর পড়েছে।
বাবা আবার বললেন, না! এটা আমার জমির ভেতর।
দবির শেখ একটু উপহাসের ভঙ্গিতে বললেন, আরে ভাই, যদি মাপো, তবে দেখবা সব গাছ আমার জমির ভেতর পড়েছে। তাছাড়া আমি তো আর সব গাছগুলো কেটে নিচ্ছি না। দশটার ভেতর দুইটা তোমার জন্য রেখে দিচ্ছি।
সুজন এখন আইন নিয়ে শহরে পড়াশোনা করে। আর কিছুদিন গেলেই তার পড়াশোনা শেষ হবে। সুজন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল দবির শেখের কান্ড। হঠাৎ অসুস্থ মা পাশের ঘর থেকে কাতর স্বরে বললেন, সুজন... বাপ তোর গাছ সব কেটে নিয়ে যাচ্ছে। থামা বাপ থামা।
সুজন বাইরে বেরিয়ে আসতেই দবির শেখ আর বাবা চুপ করে গেলেন। এরপর বাবার হাত ধরে বাড়ির ভেতর আনতেই বাবা বললেন, না এটা চরম অন্যায়। তোর লাগানো গাছ ওরা নিজেদের দাবি করছে। সুজন বলল, থাক বাবা। যার জন্য আমার এই স্বপ্নের গাছ সে-ই যখন নেই তখন মিছে তর্ক কেন? আমার বোনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি, ধরে রাখতে পারিনি তার হাসি মুখ। আর কয়েকটা দিন গেলেই ঠিক চিনে নেব সীমানা, অধিকার। এমন হাজার বোনের স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকবো বাবা। বাবার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সুজন।
দত্ত পুকুরের পাড় দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। দেখলো, বিস্তর পুকুরের হাঁটু সমান পানিতে একটা শিশু সাঁতার কাটছে। আর তার বোন দত্ত পুকুরের এপার ওপাড় দৌড়াচ্ছে, অনুরোধ করছে উপরে উঠে আসার জন্য। সুজন সজিনাবুকে দেখতে পেল যেন। অবচেতন মনে ডেকে উঠলো, বুবু...
মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চমকে শুরু হলো বৃষ্টি। চোখের জল আর বৃষ্টি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। আবার দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললও সুজন। শহরে যাবার শেষ গাড়িটা তাকে যে ধরতেই হবে।
Comments
Top
ট্রেনের
সেই লোকটা
সুমন চক্রবর্তী
"দাদা আপনার কাছে পাঁচ মিনিট সময় হবে?", আমি লোকটার দিকে অবাক হয়ে হতচকিত দৃষ্টিতে তাকালাম। এই তো কিছুক্ষণ আগে তার সাথে আলাপ হয়েছে। তাও আলাপ বলতে সেরকম কিছু নয়। সন্ধ্যে শেষ হয়ে রাতের দিকের ট্রেন, সেরকম একটা ভিড় কিছু না, তবে কিছু লোকজন তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক আমি যেখানে বসে আছি ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমায় হঠাৎ একবার জিগ্যেস করলেন, "আচ্ছা আপনি কি কাছাকাছি নামবেন?" আমি কর্কশ গলায় 'না' বলায় বললেন, "কিছু মনে করবেন না। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পা দুটো বড্ড ব্যথা, তাই জানতে চাইলাম আর কি।" আমি লোকটির আত্মপক্ষ সমর্থনে তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। যাইহোক আমার ডানদিকে বসা লোকটা দেবদূতের মত, "আমি সামনেই নামবো।", বলায় লোকটি আমার সামনে থেকে সরে ঐ লোকটির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ বাদে আমার পাশে বসা লোকটি উঠে যেতেই একগাল হাসি মুখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পাশে এসে বসলেন। আমিও ভদ্রতার খাতিরে তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ব্যাস তার সঙ্গে আমার এইটুকুই আলাপ। এই আলাপের সূত্র ধরে যখন কেউ, "আপনার কাছে পাঁচ মিনিট সময় হবে?", কিনা জানতে চায় তখন কিছুটা হলেও অবাক এবং বিরক্ত লাগে। প্রথমতঃ আমি বরাবরের কম মিশুকে। তাই অপরিচিত কারুর সাথে যেচে আলাপ করা বা কেউ করতে চাইলেও প্রশ্রয় দেওয়া আমার ধাতে নেই। এবং আমার ধারণা যারা কথার শুরুতেই অল্প মাত্রার একটা সময় নির্দিষ্ট করে, তারা আদতে বেশি কথা বলে। আমি কিছু উত্তর না দিয়ে, শুনেও না শোনার ভান করে, পিঠটা সিটে সেঁটে দিয়ে দুচোখ বন্ধ করলাম। সাধারণতঃ আমার এরকম ব্যবহারে লোকটি নিজের উত্তর পেয়ে যাবেন ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম উনি বরং উল্টো বুঝলেন। বা হয়তো আমার উত্তরের সেরকম তোয়াক্কা করলেন না। একটু আগে কেনা বাদামের প্যাকেট থেকে কয়েকটা বাদাম মুখে ঢেলে লোকটি বললেন, "আপনি বোধহয় খুব বিরক্ত হচ্ছেন আমার কথায়। নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষ গায়ে পরে যেচে কথা বললে বিরক্ত লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যাটা কি বলুন তো এখন আমার মন চাইছে কিছু কথা বলতে। মনে যা আসছে সেগুলো বলতে ইচ্ছে করছে। ট্রেনে লোক বলতে আপনার সাথেই আলাপ। তাই আর কি।" আমি খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম, "বলুন কি বলবেন।" মনে মনে ভাবলাম - 'আজ কি কুক্ষণে যে আগের ট্রেনটা হাতছাড়া হয়ে গেল।' সাধারনতঃ আমি এর আগের ট্রেনেই রোজ ফিরি। আজও সেটাই ধরতে আসছিলাম কিন্তু ট্র্যাফিক জ্যামে সব ভেস্তে গেল। ভদ্রলোক বাদাম চিবোতে চিবোতে বলতে শুরু করলেন, "আসলে আমার আপনার কাছে একটা পরামর্শ নেওয়ার ছিল।" মনে যতই বিরক্তি থাকুক, কেউ নিজে যেচে আমার কাছে পরামর্শ নিতে চাইছে শুনে বেশ ভালো লাগলো। মনে মনে ভাবলাম - 'তাহলে হয়তো আমায় দেখে লোকটির বেশ পরিণত মনে হয়েছে, তাই পরামর্শ চাইছে'। লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। দেখতে বেশ সুন্দর। মাথার চুলগুলোতে অল্প পাঁক ধরেছে। চোখে চশমা। পরনে সাদা সুতির জামা আর খয়েরি রঙের প্যান্ট। লোকটি বলতে শুরু করলেন, "আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নের স্নাতক। তারপর পড়াশোনা শেষ হলে একটা ছোট কোম্পানিতে কেমিস্টের চাকরিতে ঢুকি। খুব বিশাল কিছু মাইনে না হলেও খুব খারাপও ছিলো না। বছর কয়েক বাদে বিয়েও করলাম। বাড়িতে তখন আমরা চারজন। আমি বাবা মা আর আমার বউ। কয়েক বছর বাদে আমার একটা ছেলে হলো। সে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে।" পরামর্শ দেবার আশায় শুনতে বসে লোকটির আত্মজীবনী আর সালতামামি শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম, "তা এখানে অসুবিধেটা কি আছে? পরামর্শই বা কি নেবেন?" লোকটি বোধহয় বুঝতে পারলেন যে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। বললেন, "সে কথায়ই আসছি। রাগ করবেন না। আমি পাঁচ মিনিটের বেশি নেব না আপনার।" লোকটি চোখ থেকে চশমাটা খুলে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছতে মুছতে আবার বলতে শুরু করলেন, "কয়েক বছর পর বাবা মারা গেলেন। মা ও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো। সময়ের সাথে সাথে বুঝলাম আমার স্ত্রীয়ের একটু মানসিকরোগ আছে। ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করেও ফল হলো না। আমার মায়ের সাথে তার নিত্য ঝামেলা। আসলে আমার মাকে দেখাশোনা করা তার পছন্দ নয়। আদপে আমার বউটি অত্যন্ত একাসারে এবং সন্দেহপ্রবণ। আমার মেয়ে-বন্ধু এবং সহকর্মীদের সাথে কথা বলা নিয়েও সে আমার উপর সন্দেহ করতে শুরু করলো। বাড়িতে রোজ অশান্তি লেগেই থাকতো। ক্রমশঃ মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লো। আমার বন্ধুমহল বলেও বিশেষ কিছু রইলো । বছর কয়েক আগে, আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আমার বউ মোটেই মিতব্যয়ী নয়। ফলে কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় সব জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল। সবশেষে পেটের দায়ে হকারি শুরু করলাম। যদিও বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি।"
লোকটির কথা শুনে এবার আমার বেশ করুণা হলো। বললাম, "তা আপনি কি আমার কাছে চাকরি-বাকরির ব্যাপারে পরামর্শ চান?" লোকটি বললো "না। ঠিক তা নয়।" আমি বললাম, "তাহলে?" লোকটি বললো, "মায়ের অসুখ, বউয়ের মাথার দোষ, ছেলের পড়াশোনা, অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমার তো সে ক্ষমতা নেই। তাহলে কি আমার আত্মহত্যা করাউচিত?" লোকটির কথা শুনে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। যেন একটা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল শরীরের ভিতর। বললাম, "ছি ছি। কি বলছেন? আত্মহত্যা মহাপাপ। আপনি তো এতদিন লড়াই করে এসেছেন। এবারও পারবেন। হাল ছাড়বেন না। আর ওসব কথা কখনও মাথায় আনবেন না।" আমার কথা শুনে লোকটাকে যেন সামান্য হলেও ফুরফুরে লাগলো। লোকটি বললো, "অনেক ধন্যবাদ। আমি এই পরামর্শটাই চাইছিলাম। আমার ষ্টেশন এসে গেছে। ভালো থাকবেন।" বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ট্রেন তখন অনেকটা ধীরগতিতে স্টেশনে এসে ঢুকছে। ট্রেন দাঁড়াতেই লোকটি নেমে গেল। নামার আগে একবার হাসিমুখে আমার দিকে তাকালো। লোকটি নেমে যাবার পর প্রথমে লোকটার উপর যেরকম রাগ হচ্ছিলো, এবার বেশ মায়া হল, লোকটির পরিস্থিতির কথা ভেবে। প্রায় মাসখানেক পর, সেদিনও আমি আমার রোজকার ট্রেনটা পাইনি। পরের ট্রেন ধরেছি। ট্রেনে আজ তুলনামূলক বেশি ভিড়। আমি তাই ভিতরে না ঢুকে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছি। ট্রেনে উঠতেই অদ্ভুতভাবে কেন জানিনা লোকটার কথা একবার মাথায় এলো। যদিও চারপাশে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেলাম না। ট্রেন ছাড়বার কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ করে একটা গলা কানে এলো। "আপনার কাছে পাঁচ মিনিট সময় হবে?", কণ্ঠস্বরটা খুব চেনা। পিছনে ফিরে দেখি ঐ লোকটা। আসলে আমি আগে খেয়াল করিনি, লোকটি আমার ঠিক পিছন দিকে বসে ছিলো। যদিও আমি মুখ না ফেরালে উনি আমায় দেখতে পারবেন না। যাইহোক কিছুক্ষণ ধরে কান পেতে রইলাম লোকটি আর তার পাশে বসা লোকটির কথোপকথনে। তারপর যা শুনলাম সব কিছুই একদম একভাবে উনি অনর্গল বলে গেলেন। এবং সবশেষে আবার আজকের লোকটিও আমার মতো ওনাকে আত্মহত্যা না করবার পরামর্শ দিলেন। আমার খুব অদ্ভুত লাগলো। মনে মনে ভাবলাম লোকটা কি পাগল? রোজ এক কথা সবাইকে কেন জিগ্যেস করে বেড়ায়। অদ্ভুত রকম একটা রাগ হলো। এরপর বেশ কয়েকদিন ধরে আমি রাতে ঐ ট্রেনেই ফেরা শুরু করলাম। খেয়াল করে দেখলাম লোকটি কোনো নির্দিষ্ট কামরায় ওঠেন না। তবে রোজ একজন করে নতুন লোকের কাছে পরামর্শ অবশ্যই চান। এবং রোজই সবাই তাকে সেই একই পরামর্শ দেয় যা আমি তাকে দিয়েছিলাম। খুব সাধারণ ব্যাপার, কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে যেকোনো সুস্থ মানুষই তাকে মানা করবে। কিন্তু এরকম করবার কারণ কি? আমার কৌতূহল হলো। কেন লোকটি এরকম রোজ করেন। একদিন ঠিক করলাম ওনাকে জিগ্যেস করবো। সেরকম ভেবে ট্রেনে উঠে কিছুক্ষণ ওনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটি হয়তো আমায় চিনতে পারলেন না, বা চিনেও না চেনার ভান করলেন। স্টেশন আসতেই লোকটি নেমে গেলেন। আমিও তার পিছু নিলাম। অন্ধকার স্টেশনে লোকটিকে "দাদা শুনছেন!" বলে ডাকতেই পিছন ফিরে তাকালেন। আমি বললাম, "চিনতে পারছেন? সেদিন ট্রেনে আলাপ হলো। আপনি আপনার পরিস্থিতি আমায় বললেন। আমি আপনাকে আত্মহত্যা না করার পরামর্শ দিলাম।" লোকটির ফ্যালফ্যাল করা চাহনি বলে দিলো যে উনি আমায় চিনতে পারেননি। তবে খানিকটা ভদ্রতা রক্ষার খাতিরেই বললেন, "হ্যাঁ পারছি। বলুন কেমন আছেন?" আমি কোনো রাখঢাক না করেই বললাম, "আমি লক্ষ্য করেছি আপনি রোজই ফেরবার সময় আপনার পরিস্থিতির কথা কাউকে না কাউকে শোনান এবং কি করা উচিত তার পরামর্শ চান। তা আপনি এটা কেন করেন। কি পান? এটা কি আপনার খুচরো বিনোদন?" লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি আপনাকে যে যে কথাগুলো বলেছি প্রতিটাই সত্যি। আসলে রোজই বাড়ি ফেরার আগে, নিজের পরিস্থিতির কথা মাথায় আসলে, মনে হয় আজ আর ফিরবো না, রেল লাইনে গলা দিই। আপনাদের মত কাউকে মনের কথা বলে বেশ হাল্কা লাগে। তারপর আপনাদের দেওয়া পরামর্শতে মনে জোর পাই। এভাবেই একটা একটা দিন নিজেকে শক্ত করি, বেঁচে থেকে লড়াই করি। আপনারা না থাকলে কবেই হয়তো মরে যেতাম? আর কি জানেন তো - ব্যক্তিগত সমস্যা চেনা লোকের থেকে অচেনা লোককে বলা অনেক সহজ। তাতে কোনো দ্বিধাবোধ হয় না। আচ্ছা আমি আসছি। আমার ছেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।"লোকটি চলে যাওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। প্রথমে ওনার দিকে তারপর অন্ধকারের দিকে। এরপর মাঝে মাঝেই আমি ঐ ট্রেনে ফিরতাম। খুঁজে বার করতাম লোকটিকে, শুনতাম তার গল্প। কি পেতাম জানিনা, কিন্তু শুনতে ভালো লাগতো। লোকটির নাম না জানলেও, ওনার কথা শুনে আমিও যেন মনের জোর পেতাম। ট্রেনের সেই লোকটার গল্পটা শুনে......।
প্রেমের দহন
শ্রীরণেশ চন্দ্র মজুমদার
Top
Comments
নায়িকার নাম প্রথমে ভেবেছিলাম শঙ্খমালা। কিন্তু তার ঘন, ভ্রমর কালো, যুগল ভুরু। বিশাল চোখ দুখানা। কৌতুকে, বুদ্ধিতে, জীবনানন্দে সদা ঝিলমিল। স্বচ্ছসলিলা অতল হ্রদের হাল্কা ঢেউয়ের উপর যেন সূর্যের কিরণ। এই চোখ দুখানার জন্য নায়িকার নাম দিয়েছি সুলোচনা। কিন্তু আপনি তো ওর সুলোচন যুগল দেখেননি। কাজেই আপনি ইচ্ছামত অন্য যে কোনো নাম দিতে পারেন। আপনার মনের পরম মমতার ঘরটিতে যেসব আহ্লাদি, দুলালী, রাঙা মাথায় চিরুনি রাজকন্যাদের স্থায়ী বসত, তাদেরই যে কোনো একজনের নাম। শহরের আদিম ঘিঞ্জি এলাকায় আজন্ম বাস। ঘোষনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যায় প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে প্রথম ক্যাম্পাস দর্শনেই মোহিত। এ তো কল্প লোক! দিগন্ত বিস্তীর্ণ ক্যম্পাস। ঘাসের কার্পেট। বিশাল গম্ভীর ছায়াঘন প্রাচীন সব গাছ বেয়ে উঠেছে হাতির কানের মত পাতাওয়ালা মানিপ্লান্ট। আরো কত ধরণের লতা! আবার জায়গায় জায়গায় ফুল্লকুসুমিত বাগানের হিন্দোল। কত রং বাহার! কাঠবিড়াল আর হরেক পাখির ফুড়ুক-ফাড়ুক। স্বচ্ছ জলের ঝিল। মাছরাঙা। পানকৌড়ি। হাঁসগুলো নিশ্চয় বুনো । সুনীল আকাশ। উড়ন্ত চিল গুলোর ডানায় যেন সোনালী রোদের গন্ধ। ছেলেরা মেয়েরা ঘুরছে ফিরছে হাসছে বকবক করছে। হাত ধরাধরি। কোমর, গলা জড়াজড়ি। ঝিল ধারের কুঞ্জ ছায়ায়, ফাঁকা ক্লাস রুমে, সিঁড়িতে আশ্লিষ্ট যুগল। অজ্ঞাত যৌবনা সুলোচনা সহসা সুপ্তোত্থিতা। মানবীবিদ্যা বিভাগে করিডোরে দেওয়াল ভর্তি ছবি আর ছবি। সবথেকে নজরকাড়া বিশাল ছবিটির ফোরগ্রাউন্ডে রাজা রামমোহন। চোখে জল টলটল। ব্যাকগ্রাউন্ডে, তলার লেয়ারে, পুরোহিত, বাজনদার, উৎসাহী দর্শক বৃন্দের মাঝখানে একটা গনগনে চিতার দিকে এক মানবীকে ঠেলে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কম্প্যুটার গ্রাফিক শিল্পীর কুশলতায় সব জীবন্ত। মানবীটির আর্তনাদ দর্শকের যেন কানে বাজে। সুলোচনা প্রথম ক’দিন ঐ ছবির সামনে দিয়ে চলতে শিউরে উঠতো। নির্ধারিত দিনে মানবাধিকারীর তত্ত্বাবধানে, নবাগতা মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করার অধিকার নিলাম হলো। সুলোচনার সঙ্গে প্রেম করার অধিকার নিলামে পেয়েই, কাগজ পত্র নিয়ে, তার অভিসারক, দয়িতাকে ভোগদখল করার জন্য খুঁজে পেতে করিডোরে পেয়ে প্রেমের প্রস্তাবটি দিল। তার চোখে তাকাতেই সুলোচনার মনের চোখে চিতা লেলিহান। সে কোন কথা না বলে, ধীর পায়ে সরে গেল। কিন্তু পিরীতি কাঁঠালের আঠা। এবং দস্তুর মত নিলামে পাওয়া। অভিসারক লেগে থাকলো। করিডোরে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে, অটো স্ট্যান্ডে, সর্বত্র, বিভিন্ন আঙ্গিকে, নানা ঘরানায় প্রেমের প্রস্তাব পেশ করেই চল্লো। হস্টেলের ঘরে, এমনকি পুরী নিয়ে যেতে চাইল। দয়িতার
বাড়িতেও ধাওয়া করলো। প্রেমিক আরকি করতে পারে? ওর পাগল পাগল ভাব। অথচ, সুলোচনা কদাপি, ওর সঙ্গে একটা কথাও বলে না। ক্যাম্পাসে গবেষণা: মেয়েটা তো লেসবিয়ানদের রামধনু রাঙা ব্যাজ পরে না। স্ট্রেট। তবে বেচারা অভিসারককে এত ল্যাজে খেলাচ্ছে কেন? নিলামের মর্যাদা ধুলোয়! ঐকমত – মহা ঠ্যাঁটা। ছেছড়ি। অভিসারকের উপর সমস্ত ক্যাম্পাসের পরিপূর্ণ সহানুভূতি। একদিন ক্যাম্পাস জানলো সুলোচনা মাইগ্রেশান নিয়ে চলে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস অধীর আগ্রহে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের প্রতীক্ষায়। শেষের আগের দিন। এক বান্ধবীর আমন্ত্রণে সুলোচনা ক্যান্টিনে বিদায়ী ভোজ খেতে গেল। আজ অস্বাভাবিক ভিড়। ও পৌছতেই ভিড় দুভাগ হয়ে ওকে রাস্তা করে দিল। ওরই জন্য একটা খালি চেয়ার। ও বসতেই উলু। শাঁখ। বিয়ের গান। গাল বাদ্য। এসবের মাঝে ক্যান্টিন পরিচালক স্বয়ং মুচকি হাসি মুখে, বিশাল একটা কাঁসার থালায় অনেক ক’টা বাটি সাজিয়ে সামনে নামিয়ে দিল। সুলোচনা দেখে: সুক্তো, ডাল, আলু ভাজা, গলদা, পাকা মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস, পোলাও। অবিশ্রান্ত উলু, শাঁখ, গানের মাঝে বিমূঢ়া, স্থানু সুলোচনার বান্ধবী আর ক’টা মেয়ে সমস্বরে কলকলিয়ে বল্লো: “আজ তোর আইবুড়ো ভাত। খেয়ে নে”।সুলোচনা ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ দেখে টেবিলের ওপারে তার দিকে তাকিয়ে অভিসারক। অজানা তীব্র ত্রাসে সুলোচনার মুখ কড়ির মত সাদা, হাত পা হিম। না খেয়ে উঠে যাচ্ছিল। সবার চিৎকারে বাধ্য হয়ে একগ্রাস মুখের কাছে আনতেই নিমতলা শ্মশানের মানুষ পোড়ানোর উৎকট গন্ধে প্রবল বিবমিষা। ওয়াক করতেই, “পেট ”আর “মাস” নিয়ে ইতি উতি ছোঁড়াছোঁড়ি হওয়া রসিক মন্তব্যগুলো তো আন্দাজ করতেই পারছেন। সুলোচনা কোনোমতে চেয়ার ছেড়ে টলমল করতে করতে, চুপচাপ উঠে গেল।পরদিন সুলোচনা মাইগ্রেশান নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দলবল আর ব্যান্ড পার্টিনিয়ে অভিসারক গেটে আটকালো। “এতদিন নাচালি! আজ তোর গায়ে হলুদ দিয়ে তবে যেতে দেবো”। সুলোচনা ওর চোখে নিজের সর্বনাশ দেখে প্রবল কম্পমানা। উৎসুক দর্শক গিজগিজ। ব্যান্ড, শাঁখ, উলু। সুলোচনাকে পিছমোড়া করে অভিসারক গেটের সঙ্গে বাঁধলো। হাঁটুর উপরে সর্বাঙ্গ নির্বসনা করে নতুন গামছা জড়িয়ে দিলো। তারপর অভিসারক, সুলোচনার মাথা থেকে জঘন্য অ্যাসিড-ধৌত করলো। ব্যান্ডে বাজছিল: পরান যায় জ্বলিয়া রে। সুলোচনার দুটো সুলোচনই গলে গেলো। মুখমন্ডল থেকে জঘন—জ্বলে, গলে, দলা দলা পাকিয়ে গেলো। অনেক হাড় বেরিয়ে গেলো। মিনিট দুই/তিনের মধ্যেই সব মিটে গেল। বাজারী কাগজের রিপোর্টের শিরোনামা দিল: প্রেমের দহন।
Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.